কবি – ১২

কবি – ১২

একদিন, দুইদিন, তিনদিন।.
পর পর তিনদিন ঠাকুরঝি আসিল না। চতুর্থ দিনে উৎকণ্ঠিত হইয়া নিতাই স্থির করিল, আজ ঠাকুরঝি না আসিলে ঠাকুরঝির গ্রামে গিয়া খোঁজ করিয়া আসিবে।
বারোটার ট্রেন চলিয়া গেল, সেদিনও ঠাকুরঝি আসিল না। অন্যান্ত মেয়েরা যাহারা দুধ দিতে আসে, তাহারা আসিয়া ফিরিয়া গেল। নিতাইয়ের বার বার ইচ্ছা হইল—উহাদের কাছে সংবাদ লয়, কিন্তু তাহাও সে কিছুতেই পারিল না। কেমন সঙ্কোচ বোধ করিল। নিজেই সে আশ্চর্য হইয়া গেল—বার বার মনে হইল, কেন সঙ্কোচ, কিসের সঙ্কোচ? কিন্তু তবু সে-সঙ্কোচ নিতাই কাটাইয়া উঠিতে পারিল না। চুপ করিয়া সে আপনার বাসায় আসিয়া ভাবিতে বসিল। কোন অজুহাতে ঠাকুরঝির শ্বশুরগ্রামে যাইলে হয় না? ভাবিয়া চিন্তিয়া সে ঠিক করিল—হাঁস, মুরগী অথবা ডিম কিনিবার অছিলায় যাইবে। ঠাকুরঝির শ্বশুরের হাঁস মুরগী আছে সে জানে। সংসারের তুচ্ছতম সংবাদটি পর্যন্ত ঠাকুরঝি তাহাকে বলিয়াছে। দেওয়ালে কোথায় একটি সুচ গাথা আছে, নিতাই সেটি গিয়া স্বচ্ছন্দে–চোখ বন্ধ করিয়া লইয়৷ আসিতে পারে।
—ওস্তাদ রয়েছ নাকি? রাজার কণ্ঠস্বর। নিতাই আশ্চর্য হইয়া গেল, রাজা বাংলায় বাত বলিতেছে! বিস্মিত হইয়া সে হিন্দীতে উত্তর দিল—রাজন, আও মহারাজ, কেয়া খবর?
রাজা আসিয়া খবর দিল—বিষন্নভাবে বাংলাতেই বলিল—খারাপ খবর ওস্তাদ, ঠাকুরঝিকে নিয়ে তো ভারি মুশকিল হয়েছে ভাই।
নিতাইয়ের বুকের ভিতরটা ধড়াস করিয়া উঠিল। সে কোন প্রশ্ন করিতে পারিল না, উৎকণ্ঠিত স্তব্ধমুখে রাজার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
–আজ দিন তিনেক হ’ল, কি হয়েছে ভাই, ওই ভাল মেয়ে-লক্ষ্মী মেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ী, ননদ-মরদ সবারই সঙ্গে ঝগড়া-বাটি করছে—মাথামুড় খুড়ছে। কাল রাত থেকে আবার মূর্ছা যাচ্ছে৷ দাঁত লাগছে, হাত-পা কাঠির মত করছে।
অপরিসীম উদ্বেগে নিতাইয়ের বুকের ভিতরটা অস্থির হইয়া উঠিল। রাজার হাত দুইখানা চাপিয়া ধরিয়া বলিল—তুমি দেখতে যাবে না রাজন?
রাজা বলিল—বউ গেল দেখতে, ফিরে আসুক। আমি ও-বেলায় যাব।
—আমিও যাব। নিতাইয়ের চোখে জল আসিয়া গেল, মাথা নীচু করিয়া সে তাহা গোপন করিল।
রাজা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল—বড় ভাল মেয়ে ওস্তাদ। আবার কিছুক্ষণ পর রাজা বলিল—ওঃ, ঠাকুরঝির মরদটি যা কাঁদছে! হাউ হাউ করে কাঁদছে। ছেলেমানুষ তো, সবে ভাব-সাবটি হয়েছে ঠাকুরঝির সঙ্গে। বেচারা! রাজা একটু স্নান হাসি হাসিল।
টপ টপ করিয়া দুই ফোঁটা জল নিতাইয়ের চোখ হইতে এবার ঝরিয়া পড়িল। সে তাড়াতাড়ি খেলাচ্ছলে আঙুল দিয়া জলের চিহ্ন দুইটা বিলুপ্ত করিয়া দিল। কিছুক্ষণ পরে একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সে ডাকিল—রাজন!
—ওস্তাদ!
—ডাক্তার-বদ্যি কিছু দেখানো হয়েছে? হতাশায় ঠোঁট দুইটা দুইপাশে টানিয়া রাজা বলিল—এতে আর ডাক্তার-বদ্যি কি করবে ওস্তাদ! এ তোমার নির্ঘাত অপদেবতা, না হয় ডান ডাকিনী, কি কোন দুষ্ট লোকের কাজ!
কথাটা নিতাইয়ের মনে ধরল। চকিতে মনে হইল, তবে কি ওই ক্ষুরধার মেয়েটার কাজ! ঝুমুর দলের স্বৈরিণী—উহাদের তো অনেক বিদ্যা জানা আছে, বশীকরণে উহারা তো সিদ্ধহস্ত।
রাজা বলিল—মা কালীর থানে ভরনে দাঁড় করাবে আজ ঠাকুরঝিকে। কি ব্যাপার বিত্তান্ত আজই জানা যাবে।
আরও কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া রাজা উঠিয়া দাঁড়াইল এবং নিতাইয়ের হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল—আও ভেইরা, থোড়াসে চা পিয়েগা।
এতক্ষণে সে হিন্দী বলিল, অনেকক্ষণ পর রাজা যেন সহজ হইয়া উঠিয়াছে।

米 米 米

রাজার বাড়ীতেই নিতাই বসিয়া ছিল। রাজার স্ত্রী ঠাকুরঝির শ্বশুরবাড়ীতে গিয়াছে। এখনও ফেরে নাই। ভরন শেষ হইলেই সংবাদ লইয়া ফিরিয়া আসিবে—সেই সংবাদের প্রত্যাশায় উৎকণ্ঠিত ও ব্যগ্র হইয়া নিতাই বসিয়া রহিল। রাজা দুঃখ কষ্ট শোক সন্তাপের মধ্যেও রাজা। সে প্রচুর মুড়ি, বেগুনি, আলুর চপু, কাঁচালঙ্ক, পেয়াজ, তাহার সঙ্গে কিছু সন্দেশ আনিয়া হাজির করিল।
নিতাই বলিল— এ সব কি হবে? এ সমারোহ তাহার ভাল লাগিতেছিল না।
—খানে তো হোগা ভেইয়া; পেট তো নেহি মানেগা জী! লাগাও থান। তারপর সে চীৎকার আরম্ভ করিল—এ বাচ্চা! এ বেটা!
ডাকিতেছিল সে ছেলেটাকে। রাজার ছেলের ধরণটা অনেকটা সে আমলের যুবরাজের মতই বটে, দিনরাত্রিই সে মৃগয়ায় ব্যস্ত, একটা গুলতি হাতে মাঠে মাঠে ঘুরিয়া বেড়ায়। শালিক, চড়ুই, কোকিল, কাক—যাহা পায় তাহাই হত্যা করে। হত্যার উদ্দেশ্বে হত্যা। খাওয়ার লোভ নাই। কখনও কখনও পাখীর বাচ্চা ধরিয়া পোষে এবং তাহার জন্য ফড়িং শিকার করিয়া বেড়ায়। যুবরাজ বোধ হয় আজ দূরে কোথাও গিয়া পড়িয়াছিল, সাড়া পাওয়া গেল না। রাজা চটিয়া চীৎকার করিয়া হাঁক দিল—এ শূয়ার কি বাচ্চা, হারামজাদোয়া–
তবুও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। রাজা নিতাইকে বলিল—কিধর গিয়া ওস্তাদ। তারপর হাসিয়া বলিল—উ বাতঠো—কেয়া বোলতা তুম ওস্তাদ? কেয়া?—তেপান্তরকে মাঠকে উধার—কেয়? মায়াবিনী, না কেয়া?
এমন ধারার চীৎকারে সাড়া না পাইলে নিতাই বলে—যুবরাজ বোধ হয় তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে মায়াবিনী ফড়িং কি পক্ষিণীর পেছনে ছুটেছে রাজন।
আজ কিন্তু নিতাইয়ের ও-কথাও ভাল লাগিল না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলির সে একটু স্নান হাসি হাসিল, সে কেবল রাজার মনরক্ষার জন্য!
রাজাও আর ছেলের খোঁজ করিল না, দুইটা পাত্র বাহির করিয়া আহার্য ভাগ করিয়া একটা নিতাইকে দিয়া, অপরটা নিজে টানিয়া লইয়া বিনা বাক্যব্যয়ে খাইতে আরম্ভ করিয়া দিল। বলিল—যানে দেও ভেইয়া শূয়ার-কি বাচ্চাকো। নসীবমে ভগবান উস্‌কো নেহি দিয়া, হাম কেয়া করেগা?
নিতাই স্তব্ধ হইয়া রহিল। সে ভাবিতেছিল ঠাকুরঝির কথা। চোখের সম্মুখে হেমস্তের মাঠে প্রান্তরে ফসলে ঘাসে পীতাভ রং ধরিয়াছে, তাহার প্রতিচ্ছটায় রৌদ্রেও পীতবর্ণের আমেজ। আকাশ হইতে মাটি পর্যন্ত পীতাভ রৌদ্র ঝলমল করিতেছে। চারিপাশে দূরান্তরের শূন্যলোক যেন মৃদ্ধ কম্পনে কাঁপিতেছে বলিয়া মনে হইল। তাহারই মধ্যে চারিদিকেই নিতাই দেখিতে পাইল স্বর্ণবিলুীর্ষ কাশফুল। এদিকে, ওদিকে, সেদিকে—সব দিকেই। .কোনদিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিলেই মনে হইল কম্পমান দূর দিগন্তের মধ্যে একটি স্বর্ণবিদুশীৰ্ষ কাশফুল দুলিতেছে, কাঁপিতেছে।
ক্ষুধার্তগ্রাসে রাজা খাওয়া শেষ করিয়া বলিল—খা লেও ভাই ওস্তাদ।
স্নান হাসিয়া নিতাই বলিল—ন।
—দূর, দূর; খা লেও। পেটমে যানেসে গুণ করেগা। তবিয়ৎ ঠিক হে যায়েগা।
— তবিয়ৎ ভালই আছে রাজন, কিন্তু মুখে রুটবে না।
—কাহে? মুখমে কেয়া হয়৷ ভাই?
রাজার হাত দুইটি চাপিয়া ধরিয়া নিতাই যেন অকস্মাৎ বলিল—রাজন সেদিন তুমি আমাকে শুধিয়েছিলে আমার মনের মানুষের কথা।
—হাঁ। রাজা কথাটা বুঝিতে পারিল না, সে ওস্তাদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
—আমার মনের মানুষ, রাজন, ওই ঠাকুরঝিই। ঠাকুরঝি আমার মনের মানুষ। বলিতে বলিতে ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
রাজার খাওয়া বন্ধ হইয়া গেল, বিস্ময়বিস্ফারিত চোখে কবিয়ালের দিকে সে চাহিয়া রহিল। সে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিল না। অন্য সময় হইলে সে হয়তো বিকট হাস্যে কথাটা এই মুহূর্তে পৃথিবীময় প্রচার করিয়া দিত, কিন্তু ঠাকুরঝির জন্য তাহার বেদনাভারক্রান্ত মন আজ তাহা পারিল না। স্তব্ধ হইয়া দুজনেই বসিয়া রহিল।
কতক্ষণ পরে কে জানে চীৎকার করিতে করিতে প্রবেশ করিল রাজার স্ত্রী। ব্যগ্র উৎকণ্ঠিত নিতাই প্রশ্ন করিতে গিয়া তাহার মনের মধ্যে গুঞ্জিত শত প্রশ্নের মধ্য হইতে কম্পিত কণ্ঠে কোনমতে উচ্চারণ করিল, কেবল একটি কথা—কি হ’ল?
রাজার স্ত্রী যেন অগ্নিস্পৃষ্ট বিস্ফোরকের মত ফাটিয়া পড়িল—ডাইন, ডাকিন, রাক্ষস—
তারপর সে অশ্লীল কদর্য অশ্রাব্য বিশেষণে নিতাইকে বিপর্যস্ত করিয়া দিল। এবং নিতাইয়ের মুখের উপর আঙুল দেখাইয়া বলিল—তুই, তুই, তুই! তোর নজরেই কচি মেয়েটার আজ এই অবস্থা! এত লোভ তোর? তোর মনে এত পাপ?

অজস্র ক্রুদ্ধ অভিসম্পাত ও অশ্রাব্য গালিগালাজের মধ্য হইতে বিবরণটা জানা গেল। আজ ঠাকুরঝিকে কালী মায়ের ভরনে দাঁড় করানো হইয়াছিল। সকাল হইতে উপবাসী রাখিয়া দ্বিপ্রহরের রৌদ্রে তাহাকে একখানা মন্ত্রপূত পিডির উপর দাঁড় করাইয়া সম্মুখে প্রচুর ধূপ-ধুনা দিয়া কালী মায়ের দেবাশী একগাছ কাটা হাতে তাহার সামনে দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিয়াছিল—কালী, করালী, নরমুণ্ডমালী। ভূত, পেরেত, ডাকিনী, যোগিনী, হাকিনী, রাক্ষস, পিচাশ, যে মন করেছে যা তাকে তুমি নিয়ে এস ধরে। তার রক্ত তুমি খাও মা।
ঠাকুরঝি থরথর করিয়া কাঁপিয়াছিল।
—বল বল? কে তোকে এমন করলে বল? দোহাই মা কালীর!
ঠাকুরঝি তবুও কোন কথা বলে নাই, কেবল উন্মাদের মত দৃষ্টিতে চাহিয়া যেমন কাঁপিতেছিল তেমনি কাঁদিয়াছিল। এবার বজ্রনাদে দুর্বোধ্য অনুম্বার-বহুল মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া দেবাংশী সপাসপ্‌ মন্ত্রপূত ঝাঁটা দিয়া তাহাকে প্রহার করিয়াছিল। তখন অস্থির অধীর ঠাকুরঝি বলিয়াছিল—বলছি বলছি, আমি বলছি।
সে নাম করিয়াছে নিতাইয়ের; বলিয়াছে—ওস্তাদ, কবিয়াল। আমাকে লালফুল দিলে। তারপর সে উদ্‌ভ্রান্ত মৃদুস্বরে গান আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল—,
“কাল চুলে রাঙা কোলম হেরেছ কি নয়নে?”
রাজার স্ত্রীর মনে পড়িয়াছিল—নিতাইয়ের বাসার জানাল দিয়া দেখা ছবি—নিতাই ঠাকুরঝির চুলে ফুল গুঁজিয়া দিতেছিল। সে কথাটা সমর্থন করিয়া সচীৎকারে সমস্ত প্রকাশ করিয়া দিয়াছে।
বাকীটা ঠাকুরঝিকে আর বলিতে হয় নাই। রাজার স্ত্রী চীৎকার করিয়াই সমস্ত প্রকাশ করিয়া দিয়াছে। অবশেষে এখানে আসিয়া নিতাইকে গালিগালাজে—শরবিদ্ধ ভীষ্মের মত জর্জরিত করিয়া তুলিল।
অন্যদিন হইলে রাজা স্ত্রীর চুলের মুঠা ধরিয়া কঞ্চির প্রহারে মুখ বন্ধ করিত। আজ কিন্তু সেও যেন পঙ্গু হইয়া গেল। নিতাই মাথা হেঁট করিয়া যেমন বসিয়া ছিল তেমনি ভাবেই বসিয়া রহিল। গালিগালাজ অভিসম্পাত বিশেষ করিয়া ঠাকুরঝি যাহা বলিয়াছে সেই কথা শুনিয়া—সে যেন পাথর হইয়া গিয়াছে।
কতক্ষণ পর ট্রেনের ঘণ্টার শব্দে রাজা সচেতন হইয়া উঠিল। তাহাকেও সচেতন করিয়া দিল। ট্রেনের ঘণ্টা পড়িয়াছে। তিনটার ট্রেন। রাজা স্টেশনে যাইবে, সে নিতাইকে ডাকিল। উঠে ভাই ওস্তাদ, কি করবে বল? হম ইস্টিশনমে যাতা হ্যায়! নিতাই উঠিয়া আসিয়া বসিল কৃষ্ণচুড়া গাছের তলায়। উদাসীন স্তব্ধ নিতাই ভাবিতেছিল, পথের কথা। কোন্‌ পথে গেলে সে এ লজ্জার হাত হইতে পরিত্রাণ পাইবে, কোন্‌ পথে গেলে জীবনে শান্তি পাইবে সে?
ঠিক এই মুহূর্তেই একটি লোক আসিয়া দাঁড়াইল তাহার সম্মুখে—এই যে ওস্তাদ!
নিতাই নিতান্ত উদাসীনের মতই তাহার দিকে চাহিল। মুহূর্তে তাহার মুখ উজ্জল হইয়া উঠিল—তুমি?
লোকটি বলিল—হ্যাঁ আমি। তোমার কাছেই এসেছি।
—আমার কাছে?
—হ্যাঁ। বড় দায়ে পড়ে এসেছি ভাই। বসন পাঠালে।
—বসন?
—সেই ঝুমুর দলের বসন।
লোকটি সেই ঝুমুর দলের বেহালদার।

আরও ঘণ্টা কয়েক পর। হেমন্তের ধূসর সন্ধ্যা; সন্ধ্যার মান রক্তাভ আলোর সঙ্গে পল্লীর ধোঁয়া ও ধূলার ধূসরতায় চারিদিক যেন একটা আচ্ছন্নতায় ঢাকা পড়িয়াছে। ওদিকে সন্ধ্যার ট্রেনথানা আসিতেছে। পশ্চিমদিক হইতে পূর্বমুখে। যাইবে কাটোয়। সিগন্যাল ডাউন করির রাজা লাইনের পয়েণ্টে নীল বাতি হাতে দাঁড়াইয়া আছে। অন্ধকারের মধ্যে নিঃশব্দে আসিয়া দাঁড়াইল নিতাই।
—রাজন!
রাজা ফিরিয়া দেখিল—নিতাই। তাহার পায়ে ক্যাম্বিসের জুতা, গায়ে জামা, গলার চাদর, বগলে একটি পুঁটলি। রাজা বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল—কাহা যায়েগা ওস্তাদ? পাঁচটা টাকা তাহার হাতে দিয়া নিতাই বলিল—দুধের দাম, ঠাকুরঝিকে দিও। রাজা ফিস্‌ ফিস্ করিয়া অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে বলিল—ঠাকুরঝিকা জাত মে জাত দেগা ওস্তাদ? নিতাই বিস্মিত হইয়া রাজার দিকে চাহিল।
—ঠাকুরঝিকে সাদী হাম বাতিল কর দেগা। তুমারা সাথ ফিন সাদী দেগা। ‘সাগাই’ দে দেগা।
নিতাই মাথা নীচু করিয়া কিছুক্ষণ মাটির দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর মুখ তুলিয়া হাসিয়া কেবল একটি কথা বলিল—ছি!
—ছি কাহে?
—মামুষের ঘর কি ভেঙে দিতে আছে রাজন? ছি!
রাজা একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস করিয়া চুপ করিয়াই রহিল।
নিতাই বলিল—তুমি বিশ্বাস কর রাজন, আমি কবিগান করি, কিন্তু মন্ততন্ত কিছু জানি না, কিছু করি নাই। তবে হ্যাঁ, টান—একটা ভালবাসা হয়েছিল। তা বলে ঠাকুরঝিকে নষ্টও আমি করি নাই।
সন্ধ্যার অন্ধকার চিরিয়া বাঁকের মুথে ট্রেনের সার্চ-লাইট জ্বলিয়া উঠিল। ট্রেনটা ওদিক হইতে স্টেশনে ঢুকিতেছে। নিতাই ক্রতপদে স্টেশনের দিকে চলিল। এতক্ষণে এই সার্চলাইটের আলোতে নিতাইয়ের বেশভূষা ও বগলের পুঁটলি যেন রাজার চোখে খোঁচা দিয়া বুঝাইয়া দিল নিতাই কোখাও চলিয়াছে। এতক্ষণ কথাটা তাহার মনে হয় নাই। এবার সে হাঁকিয়া প্রশ্ন করিল–কাঁহা যায়েগা ওস্তাদ?
ওদিকে ট্রেনটা সশব্দে কাছে আসিয়া পড়িয়াছিল, সেই শব্দের প্রচণ্ডতায় নিতাই কিছু বলিল কিন রাজা বুঝিতে পারিল না। ট্রেনথান স্টেশনে প্রবেশ করিলে পয়েণ্ট ছাড়িয়া রাজা ছুটয়া প্লাটফর্মে আসিল।
—ওস্তাদ —ওস্তাদ!
তখন নিতাই গাড়ীতে উঠিয়া বসিয়ছে। গাড়ীর কামরা হইতে মুখ বাড়াইয়া নিতাই উত্তর দিল—রাজন!
উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে রাজন প্রশ্ন করিল—কাঁহা যায়েগা ভাই?
স্বভাবসিদ্ধ হাসি হাসিয়া নিতাই বলিল—বায়ন এসেছে ভাই। আলেপুরের মেলায়।
আলেপুরে মহাসমারোহে নূতন মেলা হইতেছে। কিন্তু বায়না কখন আসিল? রাজার মনে চকিতে একটা সন্দেহ জাগিয়া উঠিল। ঠাকুরঝির দুধের দাম পাঁচ টাকা মিটাইয়া দিয়া সে বায়না লইয়া কবিগান করিতে চলিয়াছে! মিথ্যা কথা। সে বলিল—ফুট বাত।
—না রাজন। এই দেখ, লোক। রাজা দেখিল, সেই ঝুমুর দলের বেহালাদার। দলনেত্রী প্রৌঢ়া মেলায় গিয়াছে, সেখান হইতে নিতাইয়ের কাছে লোক পাঠাইয়াছে। তাহাদের দলের কবিয়াল পলাইয়া গিয়াছে। বসন ঝগড়া করিয়া তাহাকে লাথি মারিয়াছে।
নিতাই বলিল—আলেপুর, আলেপুর থেকে কান্দর, কানারা থেকে কাটোয়, কাটোয়৷ থেকে অগ্রদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ থেকে—
ট্রেনের বাঁশী তাহার কথাটাকে ঢাকিয়া দিল।
বাঁশী থামিল, ট্রন চলিতে আরম্ভ করিল। রাজা ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে চুটিতে ছুটিতে প্রশ্ন করিল—অগ্রদ্বীপসে কাঁহা? দুনিয়া ভোর কি তুমারা বায়্না আয়া হ্যায়? উতার আও ওস্তাদ, উতার আও। —রাজার কষ্ট্রের আর্তমিনতি মুহূর্তের জন্য নিতাইকে বিচলিত করিয়া তুলিল। পরক্ষণেই সে আত্মসম্বরণ করির হাসিল। মনে মনেই বলিল—হ্যাঁ, দুনিয়া ভোর বায়না আয়া হ্যায় রাজন।
ইতিমধ্যেই কিন্তু ট্রেন প্লাটফর্ম পার হইয়া দ্রুতগতিতে বাহির হইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *