গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

ইন্দ্রতূলক

ইন্দ্রতূলক

ইতিহাসের পণ্ডিত বলিলেন, ‘গল্প শোনো। কাল রাত্রে প্রাচীন ইতিহাসের এক পুঁথি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম—’

খুবই স্বাভাবিক। ইতিহাসের পুঁথি পড়িতে পড়িতে ঘুমাইয়া পড়ে না এমন মানুষ আমি দেখি নাই।

পণ্ডিত বলিতে লাগিলেন, ‘ঘুমিয়ে এক স্বপ্ন দেখলুম। আশ্চর্য স্বপ্ন। আমি যেন ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ, শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি, আর আমার চোখের সামনে যুগের পর যুগ কেটে যাচ্ছে। আট হাজার বছরের পুরানো ইতিহাস চোখের সামনে দেখতে পেলুম।’

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কাল রাত্রে কি খেয়েছিলেন?’

পণ্ডিত বলিলেন, ‘মনে নেই। গিন্নি বলতে পারেন।’

গৃহিণী বলিলেন, ‘কাঁকড়ার ঝোল আর ভাত।’

বলিলাম, ‘বুঝেছি, ইংরেজিতে যাকে বলে নাইট্‌ মেয়ার আপনি তাই দেখেছেন। আমি এবার উঠি।’

পণ্ডিত বলিলেন, ‘আরে বোসো, চা খেয়ে যাও। — ভূগোল পড়েছ?’

বলিলাম, ‘ভূগোল? ইতিহাসের স্বপ্ন দেখলেন, তার মধ্যে ভূগোল। ইস্কুলে পড়েছিলুম বটে।’

পণ্ডিত বলিলেন, ‘বেশ, এখন একটা দেশ মনে মনে কল্পনা কর, বেলুচিস্থান থেকে ইরানের দক্ষিণভাগ পর্যন্ত। কল্পনায় দেখতে পাও?’

মনের মধ্যে ম্যাপ আঁকিবার চেষ্টা করিলাম; পূর্বদিকে সিন্ধু নদ, পশ্চিমে পারস্য উপসাগরের মুখ, দক্ষিণে সমুদ্র, মাঝখানে পাহাড় ও মরুভূমিতে ভরা একটা দেশ।

পণ্ডিত বলিলেন, ‘আট হাজার বছর আগে সিন্ধু নদ ছিল না। বর্তমানে যে দেশটা পাঞ্জাব নামে পরিচিত সেটা ছিল ধূ ধূ মরুভূমি। আর কাশ্মীর ছিল প্রকাণ্ড একটা মিঠে জলের হ্রদ। এখন কল্পনা কর, পূর্বদিকে দুস্তর মরুভূমি, উত্তরে দুর্ভেদ্য পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র— মাঝখানে সরু এক ফালি দেশ। কোনও দিক দিয়েই বেরুবার রাস্তা নেই। আট হাজার বছর আগে এই দেশে একটা জাতি বাস করত।

‘বর্বর জাতি; কিন্তু গায়ের চামড়া কটা, চোখের মণি নীল, চুল সোনালী। পরবর্তী কালে যারা আর্য বলে পরিচিত হয়েছিল এরা তারাই। এই দেশই তাদের আদিম বাসভূমি। পাহাড় এবং মরুভূমির পরপারে কালো মেটে পাঁশুটে নানা রঙের মানুষ বাস করত বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গে এই আর্যদের মেলামেশার কোনও উপায় ছিল না। সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গভাবে এই জাতি বহুকাল বাস করেছিল। নিঃসঙ্গতার মধ্যেই তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি পরিপুষ্ট হয়েছিল।

‘শুকনো দেশ, তার ওপর ওরা তখন চাষবাস করতেও জানত না। গরু, ছাগল পুষতে শিখেছিল, কিন্তু ঘোড়া কি জন্তু তা কখনও চোখে দেখেনি। দেশের পূর্বসীমায় বেলুচিস্থানের পাহাড়ে একরকম ঘাস জন্মাত, তার বীজ তারা গুঁড়ো করে খেত। এই পাহাড়ী ঘাসের বীজ আধুনিক গমের পূর্বপুরুষ। কিন্তু তাতে তাদের পেট ভরত না; এই জাতির প্রধান জীবিকা ছিল সমুদ্রে মাছ ধরা।

‘ছোট ছোট নৌকায় চড়ে তারা সমুদ্রের কিনারে কিনারে মাছ ধরে বেড়াত। মাছ তাদের জীবনের প্রধান অবলম্বন, তাই মাছকেই তারা দেবতা মনে করত। মৎস্য ছিল তাদের অবতার।

‘তাদের অবশ্য একজন রাজা ছিল। রাজার নাম মনু। তখনকার বর্বরতার যুগে সকল জাতিরই একটা totem থাকত; এই জাতির totem ছিল সূর্য। মনু দাবি করতেন সাক্ষাৎ বিবস্বান তাঁর আদি পুরুষ।

‘সমুদ্রে পুরুষানুক্রমে মাছ ধরার ফলে এই জাতি নৌ-বিদ্যা বেশ আয়ত্ত করেছিল। মনুর কয়েকটা বড় বড় নৌকা ছিল, তিনি তাইতে চড়ে মাছ ধরে বেড়াতেন। তিনি ভারি বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, সমুদ্রের জল-বাতাস লক্ষ্য করে আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বুঝতে পারতেন।

‘একদিন মনু সমুদ্রে মাছ ধরছেন, তাঁর জালে এক অদ্ভুত চেহারার মাছ উঠিল। মাছের নাকের কাছে এক শিং। মনু পঞ্চাশ বছর এই সমুদ্রে মাছ ধরছেন, কিন্তু এমন মাছ কখনও চোখে দেখেননি। মাছটা ধড়ফড় করল না, নির্জীব হয়ে পড়ে রইল। মনু বুঝলেন, এ মাছ অজানা কোনও সমুদ্র থেকে এসেছে। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন, মনে হল আকাশ বাতাস যেন এক মহা দুর্যোগের প্রতীক্ষায় থমথম করছে।

‘মনু তাড়াতাড়ি তীরে ফিরে এলেন, প্রজাদের জড়ো করে বললেন, “আমি জানতে পেরেছি এক মহাপ্লাবন আসছে, পৃথিবী ডুবে যাবে। তোমরা যদি বাঁচতে চাও যে-যার নৌকায় ওঠো।”

‘মনুর কথায় অনেকেই নৌকায় গিয়ে উঠল। মনু তাঁর স্ত্রী-পুত্র আত্মীয়-পরিজন গরু ছাগল নিয়ে নিজের বড় বড় নৌকা ভরতি করলেন। যারা মনুর কথা বিশ্বাস করল না কিংবা যাদের নৌকা ছিল না তারা মাটিতেই রইল।

‘সন্ধ্যাবেলা সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে, সমুদ্র থেকে হুহুঙ্কার শব্দ শোনা গেল। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে তালগাছের মতো উঁচু ঢেউ ছুটে আসছে, তার সঙ্গে ঝড়-তুফান। দেখতে দেখতে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

‘পরদিন সকালবেলা দেখা গেল চারিদিক জলে জলময়, কোথাও মাটির চিহ্নমাত্র নেই। ছোট নৌকাগুলো ঢেউয়ের ঝাপটে সব ডুবে গেছে, কেবল মনুর কয়েকটা বড় নৌকা প্রলয়পয়োধি জলে বটপত্রের মতো ভাসছে।’

পণ্ডিতকে বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এরকম একটা রসাতল কাণ্ড কেন হল আপনি জানতে পেরেছিলেন?’

‘পেরেছিলাম। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করতে পারবে?’

‘বলুন, চেষ্টা করে দেখি।’

‘পারস্য উপসাগর তখন হ্রদ ছিল, সমুদ্রের সঙ্গে যোগ ছিল না। ম্যাপ দেখলে তার কতকটা আন্দাজ পাবে। হ্রদের উত্তর দিকে দুটো বড় বড় নদী— টাইগ্রিস আর য়ুফ্রেটিস— ক্রমাগত হ্রদের মধ্যে জল ঢালছিল, হ্রদের জল বেড়ে বেড়ে তীর ছাপিয়ে যেতে লাগল। তারপর একদিন জলের চাপে সমুদ্রের দিকের বাঁধ ভেঙ্গে গেল, হ্রদ সমুদ্রে মিশল। হু হু শব্দে জল বেরিয়ে সমুদ্র তোলপাড় করে ছুটতে লাগল। সেই তোড়ে আশপাশের তীরভূমি ডুবে গেল। এই হচ্ছে মহাপ্লাবনের কারণ। মহাপ্লাবনের যত প্রাচীন গল্প আছে সব ঐ পারস্য উপসাগরকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটা ঐখানেই ঘটেছিল কি না।’

আমি গুম হইয়া গেলাম। কিন্তু তর্ক করা বৃথা, স্বপ্নের বিরুদ্ধে তর্ক নিষ্ফল। বলিলাম, ‘বুঝেছি। তারপর মনুর কথা বলুন।’

পণ্ডিত বলিলেন, ‘সাত দিন সাত রাত মনু নৌকায় ভাসতে লাগলেন। রাজ্যের উত্তর সীমানা ঘিরে যে পাহাড় ছিল তার নাম সুমেরু, মনুর নৌকা ঢেউয়ের ধাক্কা খেয়ে সেইদিকে ভেসে চল্‌ল।

‘সাত দিন পরে জল নামতে আরম্ভ করল; বানের জল যেমন জোরে আসে তেমনি জোরে নেমে যায়। মনু তখন সুমেরুর গায়ে গিয়ে ঠেকেছেন, একটা চূড়ায় নৌকা বেঁধে ফেললেন।

‘ক্রমে সমুদ্রের জল সমুদ্রে ফিরে গেল, আবার ডাঙ্গা জেগে উঠল। দেশ যেমন ছিল প্রায় তেমনি আছে, কিন্তু মানুষ সব শেষ হয়ে গেছে। বেঁচে আছেন শুধু মনু আর তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠী। আর কয়েকটি ছাগল গরু।

‘মনু তাই নিয়ে আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করলেন— যাকে বলে কেঁচে গণ্ডূষ।’

এই সময় চা আসিয়া পড়িল। পণ্ডিত পেয়ালা তুলিয়া লইয়া চুমুক দিলেন।

বলিলাম, ‘আপনার স্বপ্ন এইখানেই শেষ তো?’

পণ্ডিত বলিলেন, ‘আরে রামঃ, আরো অনেক আছে। তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছ, সংক্ষেপে বলছি। মনুর পর আন্দাজ পাঁচশ’ বছর কেটে গেল। মনু দেহরক্ষা করলেন, কিন্তু তাঁর বংশধরেরা আবার দলে ভারী হয়ে উঠল।’

প্রশ্ন করিলাম, ‘পাঁচশ’ বছর কেটে গেল বলছেন, তার মানে সাড়ে সাত হাজার বছর আগেকার কথা?’

পণ্ডিত বলিলেন, ‘মোটামুটি। তখন আকাশে ধ্রুবতারা ছিল না। ধ্রুবতারা এসেছিল আরও দু’হাজার বছর পরে। কিন্তু সে অন্য ধ্রুবতারা, জ্যোতিষে তার নাম Alpha Draconis। বেদে তার উল্লেখ আছে। আজকাল যাকে আমরা ধ্রুবতারা বলি সে অন্য তারা।’

‘সর্বনাশ! ধ্রুবতারা আবার ক’টা আছে?’

‘অনেক। কিন্তু জ্যোতিষের জটিল তত্ত্ব তুমি বুঝবে না, সে যাক। মহাপ্লাবনের পর দেশের আবহাওয়া কিছু বদলেছিল, মাটির ওপর পলি পড়েছিল। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের দু’-একটা রাস্তাও খুলে গিয়েছিল।

‘মহাপ্লাবনের পর আর্যদের নতুন দেবতা হলেন— বরুণ। তিনি জলের দেবতা, রাখলে রাখতে পারেন, মারলে মারতে পারেন, সুতরাং তাঁকে তুষ্ট করা আগে দরকার। এই বরুণকে কেন্দ্র করে আর্যদের আদিম দেবতা-গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। আর্যদের ভাষা তখন বেশ দানা বেঁধেছে কিন্তু তারা লিখতে জানে না। সবই কানে শোনা কথা— শ্রুতি।

‘আর্যরা সংখ্যায় বেশ বেড়ে উঠল। তাদের মধ্যে তুক-তাক মারণ উচাটন প্রভৃতি দৈবক্রিয়ার উদ্ভব হল : তারা রোজা হয়ে ভূত ঝাড়ে, ওঝা হয়ে সাপের বিষ নামায়। এটা অথর্ববেদের প্রথম যুগ। অথর্ববেদ নামেও অথর্ব কাজেও অথর্ব, সবচেয়ে পুরোনো; আর্যদের প্রাচীনতম শ্রুতি ওতে ধরা আছে।

‘সে যাক। বাইরে যাবার রাস্তা খোলা পেয়ে দু’চার জন উৎসাহী লোক দেশের বাইরে যেতে আরম্ভ করেছিল। বেশির ভাগই যেত উত্তরদিকে, কারণ পূর্বদিকে পাঞ্জাবের মরুভূমি তখনও শত যোজন জুড়ে পড়ে আছে, তাকে অতিক্রম করা অসাধ্য। যা হোক, বহির্জগতের সঙ্গে আর্যদের অল্প-স্বল্প মেলামেশা আরম্ভ হল; সুমেরু পর্বতের ওপারে কৃষ্ণচক্ষু কৃষ্ণকেশ একজাতীয় মানবের সঙ্গে আলাপ হল।

‘এইভাবে আরও কয়েক শতাব্দী কেটে গেল। ইতিমধ্যে আর্যরা কৃষিকার্য শিখে ফেলেছিল, বুনো গমের বীজ বুনে শস্য ফলাতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু তবু দেশে খাদ্যের অনুপাতে মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, খাদ্যের অনটন দেখা দিল। মৎস্য এবং গোধূম পর্যাপ্ত নয়।

‘কিন্তু পুরুষানুক্রমে মৎস্যভোজনের ফলে আর্যদের বুদ্ধি খুব ধারালো হয়েছিল; তারা দলে দলে খাদ্য অন্বেষণে বিদেশে যেতে লাগল। কিন্তু বিদেশে যাবার দু’টি মাত্র পথ; এক সমুদ্র, দ্বিতীয় উত্তর দিক। আর্যদের মধ্যে যারা মৎস্যজীবী, তারা নৌকা নিয়ে সমুদ্রে বেরিয়ে পড়ল। এরাই পরে পাণি বা ফিনিশিয়ান নামে পরিচিত হয়েছিল, দক্ষিণে লঙ্কা এবং উত্তরে ইংলন্ড পর্যন্ত উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।

‘দ্বিতীয় দল গেল সুমেরুর গিরিসঙ্কট পার হয়ে মাটির পথে। আর্যদের উত্তরাভিযান আরম্ভ হল। এই অভিযান তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে পারস্য গ্রীস রাশিয়া পার হয়ে স্কান্ডিনেভিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছিল।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এ আপনি স্বপ্নের বৃত্তান্ত বলছেন, না ইতিহাস বলছেন?’

পণ্ডিত বলিলেন, ‘ইতিহাসে অন্য কথা আছে, আমি যা স্বপ্ন দেখেছি তাই বলছি। কিন্তু সাহেবের লেখা ইতিহাসই সত্য আর আমার স্বপ্ন মিথ্যা, তার প্রমাণ কি?’

পণ্ডিতকে ঘাঁটাইয়া লাভ নাই, বলিলাম, ‘কোনও প্রমাণ নেই। তারপর বলুন।’

‘তারপর আমার স্বপ্নের ক্লাইম্যাক্স।’

‘যাক, স্বপ্ন তাহলে শেষ হয়ে আসছে? কিন্তু কই, আর্যরা ভারতবর্ষে তো এল না?’

‘এইবার আসছে। সেইখানেই ক্লাইম্যাক্স।’

পণ্ডিত আবার আরম্ভ করিলেন, ‘উত্তরদিকে যারা অভিযান করল তার অধিকাংশই ফিরে এল না, দু’চার জন ফিরে এল। যারা ফিরে এল তাদের মধ্যে একজনের নাম— ইন্দ্র।

‘ইন্দ্র গোড়ায় মানুষ ছিলেন; সাধারণ মানুষ, একজন যোদ্ধা। কিন্তু অসাধারণ তাঁর বুদ্ধি, দুর্দম সাহস। যুগে যুগে যে-সব মানুষ জাতিকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে, ইন্দ্র তাদেরই একজন। যুগাবতার বলতে পার। ইন্দ্র দলবল নিয়ে উত্তরদিকে গিয়েছিলেন, অনেক বছর পরে যখন ফিরে এলেন তখন তাঁর সঙ্গে একপাল ঘোড়া! দেশের লোক আগে কখনও ঘোড়া দেখেনি, ঘোড়া দেখে চমৎকৃত হয়ে গেল। উচ্চৈঃশ্রবার নাম শুনেছি বোধ হয়। দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্রের কেবল ঘোড়া ছিল আর কারুর ছিল না।

‘ইন্দ্র ঘোড়া নিয়ে দেশে ফিরে এলেন, কিন্তু বেশি দিন চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না। চুপ করে বসে থাকার লোক তিনি নন। আবার সদলবলে অভিযানে বেরুলেন। এবার পূর্বদিকে। ইন্দ্র স্থির করলেন, কতদূর যাওয়া যায় তিনি পরীক্ষা করে দেখবেন। মরুভূমির পরপারে কী আছে? মরুভূমি কি পার হওয়া যায় না?

‘ইন্দ্রের অশ্বারোহীর দল পূর্বদিকে চলল। বেলুচিস্থানের পূর্ব সীমানা থেকে মরুভূমি আরম্ভ হয়েছে। ইন্দ্র বারবার মরুভূমি উত্তীর্ণ হবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। মরুভূমি তো নয়, জ্বলন্ত দাবানল। ব্যর্থ হয়ে ইন্দ্র মরুভূমির কিনারা ধরে উত্তর মুখে চললেন। হয়তো উত্তরে মরু পার হবার পথ আছে।

‘কুটিল কর্কশ পথ; জলের বড় কষ্ট। তবু ইন্দ্র নিরস্ত হলেন না। মাসের পর মাস কেটে গেল, বছর কেটে গেল, ইন্দ্র পাহাড়-মরুর সন্ধিরেখা ভেদ করে চলেছেন। ঘোড়া ছিল বলেই পেরেছিলেন, পদব্রজে পারতেন না।

‘কিন্তু পথ যত দুর্গমই হোক, কোথাও তার শেষ আছে। একদিন ইন্দ্র কাশ্মীর প্রান্তে গিয়ে পৌঁছুলেন। কাশ্মীর তখন ভূস্বর্গ নয়, প্রকাণ্ড একটি হ্রদ। ইন্দ্র দেখলেন হ্রদের জল কানায় কানায় টলমল করছে, তাকে সাপের মতো বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে কৃষ্ণবর্ণ পাহাড়ের শ্রেণী। ইন্দ্র অঞ্জলি ভরে জল পান করলেন; দেখলেন মিষ্টি জল।

‘হ্রদের দিকে চেয়ে চেয়ে ইন্দ্রের মস্তিষ্কে একটা প্রচণ্ড আইডিয়া খেলে গেল। আজকালকার দিনেও কোনও আমেরিকান বা রুশ ইঞ্জিনিয়ারের মাথায় এতবড় দুঃসাহসিক আইডিয়া সহজে আসে না। ইন্দ্র ভাবলেন, সিন্ধুকে অর্থাৎ সমুদ্রকে যদি কোনও মতে পর্বতরূপী বৃত্রাসুরের নাগপাশ থেকে মুক্তি দিতে পারি, তাহলে এই সিন্ধু নিম্নাভিমুখে মরুভূমির উপর দিয়ে ধাবিত হবে, যা এখন ঊষর মরুভূমি আছে তা জলসিক্ত হয়ে শ্যামল ভূমি হবে, মরুর উপর পথ তৈরি হবে…

‘ইন্দ্র শুধু ভাবুক নয়, কর্মীপুরুষ! তিনি তাঁর ভাবনাকে কার্যে পরিণত করবার জন্যে মহা উদ্যমে লেগে গেলেন।

‘কাজটি কিন্তু সহজ নয়, অনেক দিন লাগল। হ্রদের কিনারে কিনারে বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর ইন্দ্র একটা জায়গা পেলেন যেখানে পাহাড়ের বাঁধ কিছু দুর্বল, দু’-চারটি বড় বড় পাথরের চাঁই সরাতে পারলেই জল নিকাশের একটা রাস্তা হয়। একবার একটা রাস্তা পেলে জল নিজের জোরেই রাস্তা প্রশস্ত করে নেয়, তখন আর তাকে ঠেকাবে কে?

‘ইন্দ্র ঐ পাথরগুলো সরাবার উদ্যোগ করলেন।

‘কিন্তু মানুষের দৈহিক শক্তিতে ও পাথর সরানো সম্ভব নয়। ইন্দ্র ঘোড়া লাগালেন; চর্মরজ্জু দিয়ে পাথর বেঁধে ঘোড়ারা টানতে লাগল। প্রথমে পাথর কিছুতেই নড়ে না, তারপর অনেক টানাটানির পর হঠাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল।

‘সঙ্গে সঙ্গে প্রবল তোড়ে জল বেরুতে লাগল। এত তোড়ে ইন্দ্রও আশা করেননি, রন্ধ্র পথে জলের উত্তাল ধারা সগর্জনে ছুটল। অন্য ঘোড়াগুলো রক্ষা পেল বটে কিন্তু ইন্দ্রের নিজস্ব ঘোড়াটা এই দুর্বার স্রোতের আঘাতে চূর্ণ হয়ে ভেসে গেল। ইন্দ্রের ঘোড়ার নাম ছিল— দধীচি।’

পণ্ডিত চুপ করিলেন। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া বলিলাম, ‘তারপর?’

পণ্ডিত বলিলেন, ‘এইখানেই আমার স্বপ্ন শেষ। কিন্তু মন থেকে আরও কিছু জুড়ে দিতে পারি। সিন্ধুকে প্রবাহিত করার ফলে একদিকে যেমন পাঞ্জাব থেকে সিন্ধু পর্যন্ত সঞ্জীবিত হয়ে উঠল, অন্যদিকে তেমনি কাশ্মীর জলের তলা থেকে উঠে এল। ভারতবর্ষের পশ্চিত প্রান্তে যে অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক ব্যবধান ছিল তা ভেঙে পড়ল। স্থলপথে বহির্জগতের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ স্থাপিত হল। ইন্দ্র এই কীর্তির কতা; তাই ইন্দ্র দেবরাজ।’

আমি বলিলাম, ‘একটা কথা। আপনার হিসেবে এই ব্যাপার ঘটেছিল আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে। কিন্তু ইন্দ্র কি অত পুরোনো দেবতা?’

পণ্ডিত বলিলেন, ‘ইন্দ্র মানুষটা সাত হাজার বছরের পুরোনো বটে কিন্তু দেবত্ব লাভ করতে তাঁর আরও দু’হাজার বছর লেগেছিল। আজকাল মানুষের দেবত্ব লাভ যত সহজ, তখন তত সহজ ছিল না। সিন্ধু নদ এবং আরও অনেকগুলি নদী বেরিয়ে পাঞ্জাবকে শস্যশ্যামল করে তোলবার পর আর্যরা অনেকে এসে সপ্তসিন্ধুর তীরে উপনিবেশ স্থাপন করলেন। নূতন দেশের সতেজ জল-হাওয়ায় আর্যদের এক নূতন সংস্কৃতি জন্মলাভ করল। পাঞ্জাবের এই নূতন আর্যরাই বরুণ দেবতাকে সরিয়ে ইন্দ্রকে প্রধান দেবতার পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। ইন্দ্রপূজার প্রথম দেশ হল সেই দেশ, যাকে ইন্দ্র মরুভূমির বুক থেকে টেনে তুলেছিলেন।

‘দেশটা ইন্দ্রের দেশ বলে পরিচিত হল; প্রাচীন দেশ অবশ্য বরুণের দেশই রইল। ইন্দ্রের দেশে যারা বাস করতে লাগল, তাদের নাম হল ইন্দ্র। কালক্রমে ইন্দ্র অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়াল হিন্দু। এখনও সেই নাম চলে আসছে। আমরা হিন্দু, অর্থাৎ ইন্দ্রপূজক।’

‘তারপর?’

‘তারপর ইতিহাস পড়। সূর্যবংশে সগর নামে এক রাজা ছিলেন শুনেছ বোধ হয়। কিন্তু তিনি ভারতবর্ষের লোক নন, সুমেরু দেশের রাজা প্রথম সারগণ, খ্রীস্টপূর্ব তিন হাজার অব্দের কথা। আর্যরা তখন সুমেরু পর্বতের উত্তরে অনেক রাজ্য স্থাপন করেছেন, আবার ভারতবর্ষেও তাঁদের উপনিবেশ পূর্বদিকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। সারগণ বা সগর রাজার এক পুত্র ষাট হাজার প্রজা নিয়ে কোনও কারণে আদিম জন্মভূমি ছেড়ে ভারতবর্ষে অভিযান করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা অযোধ্যায় এসে রাজ্য স্থাপন করেছিল।

‘সেই থেকে সূর্যবংশের একটা শাখা ভারতবর্ষেই আছে। রামচন্দ্র হলেন সগর রাজার অধস্তন নবম পুরুষ; তিনি ভারতবর্ষেই জন্মেছিলেন। এসব নেহাত হালের কথা।’

পণ্ডিত বোধ করি আরও কিছুক্ষণ তাঁহার স্বপ্নাদ্য ইতিহাস শুনাইতেন, কিন্তু এই সময় পণ্ডিতগৃহিণী আসিয়া বলিলেন, ‘রবিবার বলে কি আজ নাওয়া খাওয়ারও ছুটি? যাও, স্নান করগে।’

পণ্ডিত স্নান করিতে চলিয়া গেলেন। আমি পণ্ডিতগৃহিণীকে বলিলাম, ‘বৌদি, আপনার কর্তার পেট গরম হয়েছে। ওঁকে আর কাঁকড়া খাওয়াবেন না। বরং রাত্রে শোবার সময় একটু ত্রিফলার জল দেবেন।’

১৮ আষাঢ় ১৩৫৫

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ October 21, 2022 at 12:22 am

পড়লাম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *