আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৫.১০

দশ

কাউন্ট ভ্রন্‌স্কি আর গোলেনিশ্যেভের কার্ড যখন নিয়ে আসা হয় বরাবরের মত শিল্পী শিখাইলোভ তখন কাজে বসেছিলেন। বড় একটা ছবি নিয়ে সকালে তিনি কাজ করেছিলেন স্টুডিওতে। বাড়ি এসে তিনি স্ত্রীর ওপর চটে ওঠেন কারণ বাড়িউলী টাকা চাইতে এসেছিল কিন্তু স্ত্রী তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।

‘বিশ বার তোমাকে বলেছি যে কৈফিয়ৎ দিতে যাবে না কখনো। এমনিতেই তুমি হাঁদা, আর ইতালিয়ান ভাষায় বোঝাতে শুরু করলে হাঁদা হয়ে পড়ো তিনগুণ’, দীর্ঘ কলহের পর স্ত্রীকে বলেছিলেন মিখাইলোভ।

‘ভাড়া ফেলে রেখো না তাহলে, দোষ তো আমার নয়। আমার টাকা থাকলে…’

‘দোহাই, শান্তিতে থাকতে দাও আমাকে!’ অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে মিখাইলোভ চেঁচিয়ে উঠেছিলেন এবং কানে আঙুল দিয়ে পার্টিশনের ওপাশে তাঁর কাজের ঘরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। মনে মনে বলেন, ‘নির্বোধ!’ তারপর টেবিলের সামনে বসে ফাইল খুলে শুরু করা কাজটার পেছনে লাগেন রোখের মাথায়।

অবস্থা যখন খারাপ এবং বিশেষ করে যখন ঝগড়া হয় স্ত্রীর সাথে, তখন ছাড়া এত রোখ আর সার্থকতায় তিনি কাজ করেননি কখনো। কাজ চালাতে চালাতে তিনি ভাবলেন, ‘আহ্! কোথাও উধাও হয়ে যেতে পারলে বাঁচতাম! ‘ রোষকশায়িত একটি মানুষের মূর্তি আঁকছিলেন তিনি। আঁকাটা আগেই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সন্তুষ্ট হতে তিনি পারছিলেন না। ‘না, ওটা ছিল বরং ভালো…কোথায় সেটা?’ চোখ-মুখ কুঁচকে তিনি গেলেন স্ত্রীর কাছে কিন্তু তাঁর দিকে না তাকিয়ে বড় মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন যে কাগজটা তিনি তাদের দিয়েছিলেন, সেটা কোথায়। স্কেচ আঁকা পরিত্যক্ত কাগজটা পাওয়া গেল, কিন্তু ময়লা, তাতে স্টিয়ারিনের দাগ লেগে আছে। তাহলেও নিলেন ছবিটা, নিজের ঘরে গিয়ে টেবিলের ওপর সেটা রেখে খানিক পিছিয়ে এসে চোখ কুঁচকে দেখতে থাকলেন। হঠাৎ হেসে উঠে হাত দোলালেন তিনি।

‘বটে, বটে!’ এই বলে তখনই দ্রুত আঁকতে লেগে গেলেন পেনসিল নিয়ে। স্টিয়ারিনের দাগটায় মানুষটার একটা নতুন ভঙ্গি ফুটেছিল।

এই নতুন ভঙ্গিটা আঁকতে আঁকতে হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল প্রকাণ্ড থুতনি-ওয়ালা দোকানদারের সতেজ মুখখানার কথা, যার কাছ থেকে তিনি চুরুট কিনেছিলেন। সেই মুখ, সেই তুখনি তিনি আঁকলেন মনুষ্যমূর্তিটায়। আনন্দে হাসলেন তিনি। নিষ্প্রাণ কল্পনা থেকে মূর্তিটা হঠাৎ হয়ে উঠল জীবন্ত এবং এমন যে তা আর বদলানো যায় না। সে মূর্তি সজীব, সুস্পষ্ট এবং নিঃসন্দেহে সুনির্দিষ্ট। এ মূর্তির দাবির সাথে মিল রেখে তাতে কিছু অদলবদল করা চলে, পা দুটো রাখা যায় এবং উচিত অন্যভাবে, একেবারে বদলে দিতে হবে বাঁ হাতের অবস্থান, চুল পেছনে ঠেলে দিতে হবে। কিন্তু এই সংশোধনগুলো করতে গিয়ে তিনি বদলাচ্ছিলেন না মূর্তিটাকে, শুধু মূর্তিটা যাতে ঢাকা পড়ছিল সেগুলো ফেলে দিচ্ছিলেন। যেন মূর্তিটার পুরোটা যাতে দেখা যাচ্ছিল না, সে আবরণ খুলে ফেলছিলেন তিনি; স্টিয়ারিনের দাগ পড়ায় হঠাৎ যে বলিষ্ঠতায় মূর্তিটা দেখা দিয়েছিল প্রতিটি নতুন আঁচড়ে তা পুরো ফুটে উঠছিল। যখন তিনি ছবিটা সযত্নে শেষ করছেন, কার্ড দুটো আনা হল তাঁর কাছে।

‘এখনই, এখনই আসছি!’

স্ত্রীর কাছে গেলেন তিনি।

‘নাও হয়েছে, রাগ করো না’ সাশা’, তিনি বললেন ভীরু ভীরু গলায়, নরম হেসে, ‘তোমারও দোষ। আমারও দোষ। আমি সব ঠিকঠাক করে নেব’, এবং স্ত্রীর সাথে মিটমাট করে নিয়ে মখমলের কলার দেওয়া জলপাই রঙের ওভারকোট আর টুপিটা পরে তিনি গেলেন স্টুডিওতে। উৎরে যাওয়া মূর্তিটার কথা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। হোমরা- চোমরা এই রুশীরা যে গাড়ি করে তাঁর স্টুডিওতে এসেছেন, তাতে তিনি আনন্দ আর উত্তেজনা বোধ করছিলেন।

নিজের যে ছবিটা এখন তাঁর ইজেলে, সেটা সম্পর্কে তাঁর মনের গভীরে ছিল একটা ধারণাই—এমন ছবি কেউ কখনো আঁকেনি। এ কথা তিনি ভাবতেন না যে ছবিটা রাফায়েলের সমস্ত ছবির চেয়ে সেরা, কিন্তু তিনি জানতেন যে ছবিটায় তিনি যা দেখাতে চেয়েছিলেন এবং দেখিয়েছেন, তা কেউ দেখায়নি কখনো। এটা তাঁর সুনিশ্চিত জানা ছিল এবং জানা আছে অনেকদিন ধরেই, ছবিটা আঁকতে শুরু করার সময় থেকে; তাহলেও লোকের মতামত, সেগুলো যাই হোক, তাঁর কাছে ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং আমূল আলোড়িত করে তুলত তাঁকে। সব কিছু মন্তব্য, এমন কি যা নেহাৎ অকিঞ্চিৎকর, যাতে বোঝা যেত যে ছবিটায় তিনি যা দেখেছেন, বিচারক দেখছে তার মাত্র সামান্য একটু অংশই, তাও আমূল আলোড়িত করত তাঁকে। তাঁর নিজের যে বোধ ছিল, তার চেয়ে সব সময়ই বেশি প্রগাঢ় একটা বোধ তাঁর বিচারকদের আছে বলে তিনি ধরে নিতেন এবং সব সময় তাদের কাছে থেকে এমন একটা কিছু আশা করতেন যা তিনি নিজে দেখতে পাননি তাঁর চিত্রে। আর দর্শকদের মন্তব্যে সেটা তিনি পেলেন বলে তাঁর মনে হত প্রায়ই।

দ্রুত পায়ে তিনি গেলেন তাঁর স্টুডিওর দরজার কাছে এবং নিজের উত্তেজনা সত্ত্বেও তিনি অভিভূত হলেন মৃদু আভাটায় আন্নার মূর্তিতে। আন্না দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রবেশমুখের ছায়ায় এবং গোলেনিশ্যেভ উত্তপ্ত কণ্ঠ তাঁকে যা বোঝাচ্ছিলেন তা শুনছিলেন, তবে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে আগতপ্রায় শিল্পীকে দেখতে তিনি উৎসুক। শিল্পী খেয়াল করেননি যে আন্না যে ছাপটা ফেলেছিলেন সেটা তিনি লুফে নিয়েছেন আর গলাধঃকরণ করেছেন যেমন করেছিলেন চুরুট বিক্রেতার থুতনির বেলায়, কোথায় যেন তা লুকিয়ে ফেলেছেন, সেখান থেকে তা বার করে নেবেন দরকার পড়লে। গোলেনিশ্যেভের কথায় দর্শকদের মোহ আগেই কেটে গিয়েছিল, এখন আরও বেশি কাটল শিল্পীর চেহারা দেখে। বাদামি টুপি, জলপাই-রঙা ওভারকোট আর আঁটো প্যান্টালুন পরা (যেখানে অনেক দিন থেকেই ঢিলা ট্রাউজারের চল হয়েছে), মাঝারি লম্বা, গাঁট্টা-গোট্টা মিখাইলোভ তাঁর ছটফটে চলনে, বিশেষ করে তাঁর চওড়া মুখের মামুলিয়ানায়, ভীরুতার একটা ভাবের সাথে সাথে নিজের মর্যাদা জাহির করার বাসনায় যে ছাপটা ফেললেন সেটা উপাদেয় নয়।

‘আসুন দয়া করে’, একটা নির্বিকার ভাব ফোটাবার চেষ্টা করে বললেন তিনি, প্রবেশমুখে গিয়ে পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খুললেন।

এগারো

স্টুডিওয় ঢুকে শিল্পী মিখাইলোভ আরও একবার অতিথিদের দিকে চাইলেন এবং ভ্রন্‌স্কির মুখভাব, বিশেষ করে তাঁর গণ্ডাস্থির ছবিটা ধরে রাখলেন কল্পনায়। তাঁর শিল্পীসুলভ অনুভব মালমশলা সংগ্রহ করে অবিরাম কাজ করে যেতে থাকলেও এবং তাঁর কাজের ওপর মতামত দেবার মুহূর্তটা কাছিয়ে আসার দরুন ক্রমাগত বেশি করে অস্থিরতা বোধ করলেও অলক্ষ্য সব লক্ষণ থেকে এই তিন ব্যক্তি সম্পর্কে দ্রুত ও সূক্ষ্ম একটা ধারণা করে নিলেন। ওটি (গোলেনিশ্যেভ) হলেন স্তানীয় রুশী। ওঁর উপাধি কি, কোথায় ওঁর সাথে দেখা হয়, কি কথাবার্তা তাঁরা কয়েছিলেন মিখাইলোভের মনে ছিল না। শুধু তাঁর মুখটা মনে ছিল, কাউকে কখনো দেখলে তার মুখ যেমন মনে থেকে যায় তাঁর। এও তাঁর মনে ছিল, মিত্যে গুরুত্বধারী কিন্তু অভিব্যক্তিতে দীন যে মুখগুলোকে তিনি তাঁর বিশাল প্রকোষ্ঠে সরিয়ে রাখতেন, এটা তাদেরই একটা। বড় বড় চুল আর অতি উন্মুক্ত কপালে বাহ্যিক একটা গুরুত্ব এসেছে মুখে, যেখানে ছেলেমানুষের মত ছোট্ট একটা অস্থিরতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে সংকীর্ণ নাসাদণ্ডে। মিখাইলোভের অনুমান অনুসারে অঙ্কি আর কারেনিনা বড় ঘরের ধনী রুশী হওয়ার কথা, সমস্ত ধনী রুশীর মত যারা শিল্পের কিছুই বোঝেন না, কিন্তু ভাব করেন যেন শিল্পানুরাগী ও সমঝদার। মনে মনে ভাবলেন, ‘নিশ্চয়ই প্রাচীন দ্রষ্টব্যগুলো সব দেখা হয়ে গেছে, এখন ঘুরে ফিরছেন নতুনদের স্টুডিওতে—বুজরুক জার্মান আর নির্বোধ প্রাক্-রাফায়েলী ইংরেজটার স্টুডিও ঘুরে আমার কাছে এসেছে কেবল পর্যবেক্ষণ সম্পূর্ণ করার জন্য।’ পল্লবগ্রাহীদের (যতই তারা মেধাবী হয় ততই খারাপ) হালচাল তাঁর বেশ ভালোই জানা আছে, এরা আধুনিক শিল্পীদের স্টুডিও দেখতে যায় কেবল এই কথা বলার অধিকার অর্জনের জন্য যে শিল্পর অধঃপতন ঘটেছে, নতুনদের যত বেশি দেখা যায় ততই বোঝা যায় কি অননুকরণীয় রয়ে গেছেন অর্থীতের মহান শিল্পাচার্যরা। এই রকমটাই তিনি আশা করছিলেন, এ সবই দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁদের মুখে আঁকা, যে নিস্পৃহ অবহেলায় তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন, দেখছিলেন ডামি আর আবক্ষ মূর্তিগুলোকে, শিল্পী কখন চিত্রের আবরণ উন্মোচন করবেন তার প্রতীক্ষায় অবাধে পায়চারি করছিলেন, দেখতে পাচ্ছিলেন তা থেকে। তা সত্ত্বেও যখন তিনি তাঁর স্কেচগুলো বিছচ্ছিলেন, জানালার খড়খড়ি, ক্যানভাস-ঢাকা কাপড়টা খুলে নিলেন, তখন বড় ঘরের সমস্ত ধনী রুশীদের যে মূর্খ ও গর্দভ হওয়ার কথা, তাঁর এই অভিমত সত্ত্বেও তিনি প্রচণ্ড একটা অস্থিরতা বোধ না করে পারলেন না, বিশেষ করে এই জন্য যে ভ্রন্‌স্কি এবং আরো বেশি আন্নাকে তাঁর ভালো লেগেছিল।

ছটফটে চলনে দূরে সরে গিয়ে ছবিটা দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘আজ্ঞা হোক। এটা পিলাতের ধিক্কার। মথি লিখিত সুসমাচার, ২৭ অধ্যায়।’ টের পাচ্ছিলেন উত্তেজনায় ঠোঁট তাঁর কাঁপতে শুরু করেছে। সরে গিয়ে তিনি দাঁড়ালেন ওঁদের পেছনে।

দর্শনার্থীরা যে কয়েক সেকেন্ড ছবিটা দেখছিলেন নীরবে, মিখাইলোভও তা দেখলেন এবং দেখলেন বাইরের লোকের উদাসীন দৃষ্টিতে। এই কয়েক সেকেন্ড ধরে তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল যে সর্বোচ্চ ন্যায্য রায় দেবেন এঁরা, ঠিক এই লোকগুলিই, এক মিনিট আগে যাঁদের তিনি ঘৃণা করেছিলেন। নিজের ছবি সম্পর্কে আগে, যে তিন বছর ছবিটা তিনি এঁকেছিলেন তখন কি ভেবেছিলেন তা সব ভুলে গেলেন তিনি; তার যে কৃতিত্ব তাঁর কাছে ছিল সন্দেহাতীত, তা ভুলে গেলেন—ছবিটা তিনি দেখলেন বাইরের লোকের নির্বিকার নতুন একটা দৃষ্টিতে এবং ভালো কিছু পেলেন না তাতে। তাঁর সামনে মুখ্য স্থানে পিলাতের বিরক্ত আর খ্রিস্টের শান্ত মুখ, পিছনে পিলাতের অনুচরদের মূর্তি আর জনের মুখ, কি ঘটছে তা দেখছে সে। প্রতিটি মুখ যা এত অন্বেষণ, ভুলচুক, সংশোধনের ভেতর দিয়ে তাঁর মানসপটে বেড়ে উঠেছিল তাদের বিশিষ্ট চরিত্র নিয়ে, প্রতিটি মুখ যা তাঁকে অত কষ্ট আর আনন্দ দিয়েছে, একটা সাধারণ রূপ ফোটাবার জন্য কতবার জায়গা অদল-বদল করা এসব মুখ, অত কষ্টে অর্জিত বর্ণবিন্যাস ও বর্ণভঙ্গির সমস্ত মাত্রা— ওঁদের চোখ দিয়ে দেখে এখন এ সবই মনে হল মামুলী, হাজার বার যা পুনরাবৃত্ত হয়ে গেছে।

তাঁর কাছে যে মুখখানা সবচেয়ে প্রিয়, খ্রিস্টের মুখ, ছবির কেন্দ্রবিন্দু, যা আবিষ্কার করে তিনি অত উল্লসিত হয়েছিলেন, সেটা ওঁদের চোখ দিয়ে দেখে তাঁর কাছে মনে হল ওটা একেবারে মূল্যহীন। সুন্দর করে আঁকা চবিটায় (এমন কি সুন্দরও নয়—একরাশ ত্রুটি এখন পরিষ্কার চোখে পড়ছিল তাঁর) তিনি দেখলেন টিশিয়ান, রাফায়েল, রুবেন্সের অসংখ্য খ্রিস্ট আর ওই একই যোদ্ধাদের ও পিলাতের পুনরাবৃত্তি। এ সবই মামুলী, নিঃস্ব, পুরানো, এমন কি আঁকাটাও খারাপ–রঙবেরঙ, দুর্বল। শিল্পীর উপস্থিতিতে কপট কিছু প্রশংসা করে আড়ালে তাঁকে নিয়ে করুণা আর হাসাহাসি করলে ওঁরা ঠিকই করবেন।

এই নীরবতাটা বড় বেশি দুঃসহ হয়ে উঠল তাঁর কাছে (যদিও সেটা মিনিটখানেকের বেশি নয়)। সে নীরবতা ভঙ্গ করা এবং তিনি যে উিেদ্বগ বোধ করছেন না তা দেখাবার জন্য তিনি গোলেনিশ্যেভকে বললেন, ‘মনে হচ্ছে আপনার সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।’ বললেন অস্থির হয়ে কখনো আন্না কখনো ভ্রন্‌স্কির দিকে তাকাতে তাকাতে যাতে তাঁদের মুখভাবের একটা দিকও দৃষ্টিচ্যুত না হয়।

‘বটেই তো! আমাদের দেখা হয় রসিতে, সেই যে সন্ধ্যায় মনে আছে ওই যে ইতালীয়ান ভদ্রকন্যাটি আবৃত্তি করে—নতুন রাশেল’, ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে এতটুকু আফশোস বোধ না করে শিল্পীর দিকে চাইতে অনায়াসে বলরেন গোলেনিশ্যেভ।

কিন্তু মিখাইলোভ ছবিটা সম্পর্কে মতামতের অপেক্ষা করছেন লক্ষ করে বললেন, ‘আমি শেষ বার ছবিটা যা দেখেছিলাম তার চেয়ে ওটা অনেক ভালো হয়ে উঠেছে এখন। যেমন তখন, তেমনি এখনো আমাকে অসাধারণ অভিভূত করেছে পিলাতের মূর্তি। বেশ বোঝা যায় মানুষটাকে—সদাশয়, চমৎকার লোক, কিন্তু অস্থিমজ্জায় এক আমলা, যে দেখতে পাচ্ছে না কি সে করছে। তবে আমার মনে হয়…’

মিখাইলোভের চঞ্চল মুখখানা হঠাৎ একেবারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, জ্বলজ্বল করে উঠল চোখ। কিছু-একটা বলতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ব্যাকুলতাবশে পারলেন না, ভান করলেন যে কাশছেন। গোলেনিশ্যেভের শিল্প বোঝার ক্ষমতাকে আগে তিনি যত তুচ্ছই জ্ঞান করে থাকুন, আমলা হিসেবে পিলাতের মুখভাবের যথার্থও সম্পর্কে সঠিক ওই মন্তব্যটা যত তুচ্ছই হোক, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলো সম্পর্কে কিছু না বলে প্রথম ওই ধরনের তুচ্ছ মন্তব্য তাঁর কাছে যত অপমানকর লাগতে পারত তা সত্ত্বেও মিখাইলোভ উল্লসিত হয়ে উঠলেন কথাটায়। পিলাতের মূর্তি সম্পর্কে গোলেনিশ্যেভ যা বলেছেন, তিনিও তাই ভাবতেন। লক্ষ লক্ষ অন্যান্য যে মতও সঠিক হত বলে মিখাইলোভের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এটা তারই একটা হলেও গোলেনিশ্যেভের মন্তব্যের গুরুত্ব হ্রাস পেল না তাঁর কাছে। এ মন্তব্যের জন্য গোলিশ্যেভের ভালো লেগে গেল তাঁর এবং বিষাদ থেকে হঠাৎ উল্লাসে পৌঁছে গেলেন। সমস্ত জীবিতের অনির্বচনীয় জটিলতা নিয়ে গোটা ছবিটা তৎক্ষণাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল তাঁর সামনে। পিলাতকে যে তিনি ওইভাবেই বুঝেছিলেন সেটা আবার বলবার চেষ্টা কররেন মিখাইলোভ; কিন্তু ঠোঁট তাঁর অবাধ্য হয়ে কাঁপতে থাকল, বলতে পারলেন না তিনি। ভ্রন্‌স্কি আর আন্নাও কি যেন বলাবলি করছিলেন চাপা গলায়, প্রদর্শনীতে যেভাবে লোকে বলে থাকে খানিকটা শিল্পীকে আঘাত না দেবার জন্য আর শিল্প সম্পর্কে বলতে গিয়ে নির্বোধ যে উক্তি করে বসা খুবই সহজ, সেটা উচ্চকণ্ঠে না বলার জন্য খানিকটা। মিখাইলোভের মনে হল ছবিটা ওঁদের ওপরও ছাপ ফেলেছে। কাছে গেলেন তিনি।

‘কি আশ্চর্য খ্রিস্টের মুখভাব!’ আন্না বললেন, যা কিছু তিনি দেখেছিলেন তা সবের মধ্যে এই মুখভাবটাই তাঁর ভালো লেগেছিল এবং টের পাচ্ছিলেন যে এটাই ছবিটার মধ্যবিন্দু হওয়ায় তার প্রশংসা শিল্পীকে খুশি করবে। ‘বেশ দেখা যাচ্ছে যে পিলাতের জন্য করুণা হচ্ছে তাঁর।’

তাঁর ছবি এবং খ্রিস্টের মূর্তি সম্পর্কে লক্ষ লক্ষ সঠিক যেসব মন্তব্য হতে পারত, এটাও তারই একটা। আন্না বলেছেন যে পিলাতের জন্য খ্রিস্টের করুণা হচ্ছে। খ্রিস্টের মুখে করুণার ভাবও থাকার কথা বৈকি, কেননা তাঁর মধ্যে রয়েছে প্রেম, অপার্থিব প্রশান্তি, মৃত্যু বরণের আর বাক্যব্যয়ের নিষ্ফলতা সম্পর্কে চেতনার ভাব। বলাই বাহুল্য, পিলাতের মধ্যে আমলা আর খ্রিস্টের মধ্যে করুণা তো থাকবেই, কেননা একজন রক্তমাংসের জীবন অন্যজন আত্মিক জীবনের প্রতিমূর্তি। এসব এবং আরও অনেক কিছু চিন্তা ঝলক দিয়ে গেল মিখাইলোভের মনে এবং আবার তিনি উল্লসিত বোধ করলেন।

‘আর কিভাবে আঁকা হয়েছে মূর্তিটা, কত হাওয়া। প্রদক্ষিণ করা যায়’, গোলেনিশ্যেভ বললেন, স্পষ্টতই এতে করে তিনি দেখাতে চাইছিলেন যে মূর্তিটার বিষয়বস্তু ও সারার্থে তাঁর অনুমোদন নেই।

‘হ্যাঁ, আশ্চর্য ওস্তাদি!’ বললেন ভ্রন্‌স্কি, ‘পেছনদিককার এই লোকগুলোকে কিভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে! একেই বলে টেকনিক!’ কথাটা বললেন তিনি গোলেনিশ্যেভের উদ্দেশে, এই টেকনিক আয়ত্ত করতে ভ্রন্‌স্কি নিজের হতাশা জানিয়ে ওঁর সাথে যেসব কথাবার্তা বলেছিলেন তার ইঙ্গিত করে।

‘সত্যি আশ্চর্য!’ পুনরাবৃত্তি করলেন গোলেনিশ্যেভ আর আন্না। মিখাইলোভ তখন একটা তুরীয় অবস্থায় থাকলেও টেকনিক নিয়ে মন্তব্যটা তাঁকে বড় মর্মাহত করল, ভ্রন্‌স্কির দিকে একটা ক্রদ্ধ দৃষ্টিপাত করে হঠাৎ চুপসে গেলেন। এই টেকনিক কথাটা প্রায়ই শুনেছেন তিনি, কিন্তু তাতে কি বোঝায় সেটা একেবারেই বোধগম্য হত না তাঁর। তিনি জানতেন যে কথাটায় ছবির মর্মবস্তুর মোটেই অপেক্ষা না করে তা আঁকতে পারার যান্ত্রিক নৈপুণ্য বোঝাচ্ছে। বর্তমান এই প্রশংসাটার মত প্রায়ই তিনি লক্ষ করেছেন যে টেকনিককে রাখা হয় ভেতরকার পরাকাষ্ঠার বিপরীতে, যেন যে জিনিসটা ভালো নয় তাকেও আঁকা যায় ভালো করে। তিনি জানতেন যে আসল সৃষ্টিটার ক্ষতি না করে তার আবরণগুলো মোচনে, সমস্ত আবরণ মোচনে অনেক মনোযোগ ও সতর্কতা প্রয়োজন; কিন্তু সেটা শিল্পরচনা নয়, টেকনিকও নয়। তিনি যা দেখছেন তা যদি দেখা দেয় কোন একজন শিশু বা তাঁর রাঁধুনির কাছে, তাহলে তারাও তিনি যা দেখেছেন তার খোসা ছাড়িয়ে দেবে। অথচ অতি অভিজ্ঞ ও নিপুণ চিত্রকর-টেকনিশিয়ান শুধুই যান্ত্রিক দক্ষতায় কিছুই আঁকতে পারবেন না যদি আগে মর্ম বস্তুর রূপরেখা তিনি আবিষ্কার করতে না পারেন। তা ছাড়া তিনি দেখেছেন যে টেকনিকের কথাই যদি ওঠে, তাহলে তার জন্য তাঁকে বাহবা দেবার কিছু নেই। যা কিছু তিনি এঁকেছেন আর আঁকছেন তার সবেতেই তিনি চোখ-জ্বালানো এমন ত্রুটি দেখছেন যা ঘটেছে আবরণ মোচনের অসতর্কতা থেকে, কিন্তু গোটা সৃষ্টিকর্মটাকে নষ্ট না করে তখন তা আর শোধরানো যায় না। আর পায় প্রতিটি মূর্তি আর মুখাবয়বে তিনি দেখতে পেতেন পুরোপুরি মোচন না করা আবরণের অবশেষ যা মাটি করে দিচ্ছে ছবিটাকে

‘আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে একটা কথা বলতে পারি…’ গোলেনিশ্যেভ বললেন।

‘ওহ্, অত্যন্ত খুশি হব, বলুন-না’, মিখাইলোভ বললেন কপট হেসে।

‘সে কথাটা এই যে আপনার খ্রিস্ট হয়েছে মনুষ্য-দেব, দেব-মনুষ্য নয়। তবে আমি জানি যে আপনি তাই আঁকতে চেয়েছিলেন।’

‘যে খ্রিস্ট আমার প্রাণের মধ্যে নেই, তাঁকে তো আর আঁকতে পারি না আমি’, বিমর্ষ মুখে বললেন মিখাইলোভ।

‘তা ঠিক, কিন্তু সেক্ষেত্রে, যদি আমার ভাবনাটা আমাকে বলতে দেন… ছবিটা আপনার এত সুন্দর যে আমার মন্তব্যে ওর কোন ক্ষতি হবে না, তা ছাড়া এটা আমার ব্যক্তিগত মত। আপনার মত ভিন্ন। আপনার বক্তব্যটাই অন্যরকম। কিন্তু ধরা যাক শিল্পী ইভানভ। আমি মনে করি খ্রিস্টকে যদি একটা ঐতিহাসিক ব্যক্তিতে পর্যবসিত করা হয়, তাহলে ইভানভের উচিত হত অন্য ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু নেওয়া যা আরও তাজা, আরও চিত্তাকর্ষক।’

‘কিন্তু শিল্পের কাছে এটাই যদি হয় একটা মহত্তম প্রসঙ্গ?’

‘খুঁজলে অন্য প্রসঙ্গও পাওয়া যাবে। কিন্তু আসলে যুক্তি-তর্ক মানে না শিল্প। ইভানভের চিত্রের সামনে আস্তিক বা নাস্তিক দু’য়ের কাছেই প্রশ্ন উঠবে : এটা কি সৃষ্টিকর্তা নাকি নয়? এতে ভেঙে পড়ছে সাধারণ একটা আবেশ।‘

‘কেন? আমার ধারণা’, বললেন মিখাইলোভ, ‘শিক্ষিত লোকের কাছে এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে না।’

গোলেনিশ্যেভ তা মানলেন না, তাঁর প্রথম মত ধরে থেকে আবেশের যে ঐক্য শিল্পের পক্ষে প্রয়োজন, সেটা দিয়ে মিখাইলোভকে ভেঙেছেন।

মিখাইলোভ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু নিজের কথাটা প্রমাণের মত কিছু বলতে পারলেন না।

বারো

বন্ধুর বুদ্ধিমন্ত মুখরতায় বিব্রত হয়ে আন্না আর ভ্রন্‌স্কি অনেকক্ষণ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলেন, শেষ পর্যন্ত গৃহস্বামীর অপেক্ষা না করে ভ্রন্‌স্কি গেলেন আরেকটা অনতিবৃহৎ ছবির কাছে।

‘আরে, কি সুন্দর, কি যে সুন্দর! আশ্চর্য! কি সুন্দর!’ সমস্বরে বলে উঠলেন তাঁরা।

‘ওটায় কি ওঁদের অত ভালো লাগল?’ ভাবলেন মিখাইলোভ! তিন বছর আগে আঁকা এই ছবিটার কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। কয়েক মাস ধরে দিনরাত ওটা নিয়ে খাটার সময় যে যন্ত্রণা ভুগেছেন, যে কষ্ট হয়েছিল, ভুলে গিয়েছিলেন তার কথা, যেমন সব সময় তিনি ভুলে যান পরিসমাপ্ত ছবিগুলোকে। এমন কি ওটার দিকে তাকাতেও তাঁর ভালো লাগত না, টাঙিয়ে রেখেছেন শুধু ওটা কিনতে ইচ্ছুক জনৈক ইংরেজের আগমনের আশায়।

বললেন, ওটা এমনি একটা স্কেচ, অনেকদিন আগেকার।’

‘কি সুন্দর!’ স্পষ্টত সত্যি করেই ছবিটার সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে বললেন গোলেনিশ্যেভও।

উইলো গাছের ছায়ায় বসে দুটো ছোট ছেলে মাছ ধরছে। বড় ছেলেটি সবেমাত্র ছিপ ফেলেছে, আপ্রাণ চেষ্টা করছে একটা ঝোপ থেকে তার ফাতনাটাকে বার করার, এই কাজেই সে একেবারে মগ্ন; যেটি ছোট, সে শুয়ে আছে ঘাসের ওপর, এলোমেলো শণরঙা মাথাটা ভর দিয়ে আছে তার হাতে, নীল ভাবাকুল চোখে তাকিয়ে আছে পানির দিকে। কি সে ভাবছে?

ছবিটার প্রশংসায় মিখাইলোভের মনে তাঁর অতীতের দোলা জেগে উঠেছিল, কিন্তু তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, অতীত নিয়ে এই অলস ভাবাবেগ তাঁর ভালো লাগত না, তাই প্রশংসাগুলো তাঁকে আনন্দ দিলেও তিনি দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইলেন তৃতীয় একটি ছবিতে।

কিন্তু ভ্রন্‌স্কি বললেন ছবিটা বিক্রি হতে পারে কিনা। দর্শকদের আগমনের ভাবনায় আন্দোলিত মিখাইলোভের কাছে এখন টাকাকড়ির ব্যাপারটা খুবই বিছছিরি ঠেকল।

বিমর্ষ কুঞ্চিত মুখে তিনি বলরেন, ‘ওটা টাঙানো হয়েছে বিক্রির জন্যই।’

অতিথিরা চলে গেলে মিখাইলোভ বসলেন পিলাত আর খ্রিস্টের সামনে, যা যা বলা হয়েছিল, এমন কি বলা না হলেও অতিথিরা যা ভেবেছেন তাও আওড়াতে লাগলেন মনে মনে। আর আশ্চর্য : ওঁরা যখন এখানে ছিলেন এবং মনে মনে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তখন তাঁর কাছে যা অত গুরুত্ব ধরেছিল, তা সবই অর্থহীন হয়ে গেল। শিল্পীর আদ্যন্ত দৃষ্টিতে তিনি নিজের ছবিটা দেখতে লাগলেন এবং পরিপূর্ণতা আর সেহেতু নিজের ছবির তাৎপর্যের একটা নিশ্চয়তায় তিনি পৌঁছলেন যা অন্য সব কিছু ভাবনা বর্জন করে যে একান্ত অভিনিবেশেই কেবল তিনি কাজ করতে পারতেন তার জন্য প্রয়োজন ছিল।

পরিপ্রেক্ষিতে দেখানো খ্রিস্টের পা ঠিক তেমনই হয়নি। রঙের পাত্র নিয়ে আঁকতে লালেন তিনি। পা শোধরাতে শোধরাতেই তিনি অনবরত চাইছিলেন গৌণস্থানে রাখা জনের মূর্তির দিকে। দর্শকেরা এটি লক্ষ করেননি, কিন্তু তিনি জানতেন এ মূর্তি পূর্ণতার পরাকাষ্ঠা। পা-টা শেষ করে তিনি জনের মূর্তি নিয়ে লাগবেন ভাবছিলেন, কিন্তু তার পক্ষে বড় বেশি উত্তেজিত বলে নিজেকে বোধ হল তাঁর। যখন তিনি নিরুত্তাপ আর যখন তিনি বড় বেশি ভাবাকুল, সব কিছু বড় বেশি দেখতে পাচ্ছেন, এর কোন অবস্থাতেই তিনি কাজ করতে পারতেন না। শীতলতা থেকে উদ্দীপনার মাঝখানে কেবল একটা ধাপেই কাজ করা সম্ভব হত তাঁর পক্ষে। কিন্তু এখন তিনি বড় বেশি উদ্বেল। ভাবছিলেন ছবিটা ঢেকে ফেলবেন, কিন্তু থেমে গেলেন, আচ্ছাদনের চাদরটা হাতে ধরে পরমানন্দের হাসি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখতে লাগলেন জনের মূর্তিটা। অবশেষে যেন বিষণ্ন হয়ে চোখ ফেরালেন, চাদরটা টাঙিয়ে ক্লান্ত কিন্তু প্রসন্ন চিত্তে ফিরে গেলেন বাড়ি।

খুব চাঙা হয়ে, ফুর্তি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ভ্রন্‌স্কি, আন্না আর গোলেনিশ্যেভ। মিখাইলোভ আর তাঁর ছবিগুলো নিয়ে তাঁরা কথা বলছিলেন। আলাপে বার বার করে উঠছিল প্রতিভা শব্দটা। তাতে তাঁরা বোঝাচ্ছিলেন মন ও হৃদয় নির্বিশেষে সহজাত, প্রায় দৈহিক একটা সামর্থ্যের কথা, যা দিয়ে তাঁরা শিল্পীর সব কিছু অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করতে চাইছিলেন। শব্দ তাঁদের দরকার পড়েছিল, কারণ যা নিয়ে তাঁরা কথা বলছিলেন সে সম্পর্কে তাঁদের কোন ধারণা ছিল না, অথচ ইচ্ছে হচ্ছিল কথা বলার আর তার একটা নামকরণ দরকার। তাঁরা বলছিলেন যে ওঁর প্রতিভা আছে সেটা অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু শিক্ষার অভাবে সেটা বিকশিত হতে পারে না—যেটা আমাদের রুশী শিল্পীদের সাধারণ দুর্ভাগ্য। তবে ছেলে দুটোর ছবিটা ওঁদের স্মৃতিতে গেঁথে গিয়েছিল এবং থেকে থেকেই উঠছিল তার কথা।

‘কি অপরূপ! কি করে ওটা উনি করতে পারলেন আর কি সহজে! ছবিটা যে কি সুন্দর তা নিজেই জানেন না। না, ছাড়া চলবে না, কিনব ওটাকে’, ভ্রন্‌স্কি বললেন।

তেরো

ভ্রন্‌স্কিকে ছবি বিক্রি করলেন মিখাইলোভ, আন্নার পোর্ট্রেট আঁকতেও রাজি হলেন। নির্ধারিত দিনে এসে কাজ শুরু করলেন তিনি।

পঞ্চম দিন থেকে চবিটা সবাইকে, বিশেষ করে ভ্রন্‌স্কিকে চমৎকৃত করে দিলে শুধু আন্নার সাথে তার সাদৃশ্যেই নয়, অসাধারণ সৌন্দর্যেও। আন্নার ওই বিশেষ সৌন্দর্যটা মিখাইলোভ কেমন করে যে ধরতে পারলেন আশ্চর্য। ‘তার অন্তরের এই সুমধুর অভিব্যক্তিটা ধরতে হলে আন্নাকে জানা ও বালোবাসা প্রয়োজন, আমি যেমন করে ভালোবেসেছি’, ভ্রন্‌স্কি ভাবলেন, যদিও আন্নার অন্তরের সুমধুর অভিব্যক্তিটা এত সত্য যে ভ্রন্‌স্কির এবং অন্যান্যদের মনে হল ওটা অনেকদিন থেকেই তাঁদের জানা।

তাঁর নিজের আঁকা পোর্ট্রেটটা সম্বন্ধে ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘আমি কত দিন থেকে মাথা ঠুকছি, কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারিনি, আর উনি তাকিয়ে দেখেই এঁকে ফেললেন। এই হল টেকনিকের মানে।’

‘যথাসময়ে তা দেখা দেবে’, বললেন গোলেনিশ্যেভ, তাঁর ধারণায় ভ্রন্‌স্কির প্রতিভাও আছে এবং বড় কথা শিক্ষাও আছে যাতে শিল্প সম্পর্কে একটা সমুন্নত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে তাঁর পক্ষে। ভ্রন্‌স্কির প্রতিভা বিষয়ে গোলেনিশ্যেভের প্রত্যয় পুষ্ট হয়েছে আরও এই জন্য যে তাঁর দরকার ছিল যে ভ্রন্‌স্কি তাঁর প্রবন্ধগুলি আর ভাবধারণায় দরদ দেখান, প্রশংসা করুন এবং তিনি অনুভব করতেন যে প্রশংসা ও সমর্থন হওয়া উচিত পারস্পরিক।

পরের বাড়িতে, বিশেষত ভ্রন্‌স্কির পালাৎসোতে মিখাইলোভকে মোটেই সে মানুষ মনে হত না যা তিনি ছিলেন নিজের স্টুডিওতে। তিনি থাকতেন নিজের সম্ভ্রম নিয়ে বিরূপ, যেন যাদের তিনি সম্বোধন করতেন হুজুর বলে আর আন্না ও ভ্রন্‌স্কি আমন্ত্রণ করা সত্ত্বেও ডিনারের জন্য থেকে যেতেন না এবং সিটিঙের জন্য ছাড়া আসতেন না এখানে। অন্য যে কোন লোকের চেয়ে ওঁর সাথেই আন্না মিষ্টি ব্যবহার করতেন বেশি এবং কৃতজ্ঞ ছিলেন নিজের পোর্ট্রেটটার জন্য। তাঁর প্রতি ভ্রন্‌স্কির মনোভাব ছিল শ্রদ্ধারও অধিক এবং স্পষ্টই বোঝা যেত নিজের ছবিটা সম্পর্কে ওঁর মতামত জানতে তিনি ছিলেন আগ্রহী। শিল্পের আসল একটা বোধ সম্পর্কে মিখাইলোভকে জ্ঞান দান করার সুযোগ কখনো চাড়তেন না গোলেনিশ্যেভ। কিকন্তু সবার প্রতিই মিখাইলোভ রইলেন সমান নিরুত্তাপ। ওঁর দৃষ্টি থেকে আন্না টের পেতেন যে তাঁকে চেয়ে দেখতে তাঁর ভালো লাগে; কিন্তু আন্নার সাথে কথোপকথন এড়িয়ে যেতেন তিনি। তাঁর চিত্রকলা নিয়ে ভ্রন্‌স্কির কথা-বার্তায় গোঁ ধরে চুপ করে থাকতেন তিনি, আর ভ্রন্‌স্কির ছবিটা তাঁকে দেখান হলে সমান গোঁ ধরে চুপ করে রইলেন। গোলেনিশ্যেভের আলাপ তাঁর কাছে কষ্টকর লাগত কিন্তু তাঁর কথায় আপত্তি করতেন না কখনো।

মোটের ওপর ওঁর যখন মিখাইলোভকে আরও ভালো করে জানতে পারলেন তখন তাঁর চাপা, বিরূপ, যেন-বা শত্রুতামূলকই মনোভাবে ওঁদের সকলেরই ভারি অপছন্দ হয়েছিল তাঁকে। সিটিঙগুলো যখন শেষ হল, হাতে ওঁদের রয়ে গেল অপূর্ব পোর্ট্রেটটা এবং মিখাইলোভ আসা বন্ধ করলেন, খুশি হয়েছিলেন তাঁরা।

গোলেনিশ্যেভই সবার মনের কথাটা বললেন, যথা—ভ্রন্‌স্কিকে স্রেফ ঈর্ষা করতেন মিখাইলোভ।

‘ধরা যাক ঈর্ষা করতেন না, কেননা প্রতিভা আছে ওঁর, কিন্তু এই জন্য ওঁর রাগ হত যে উঁচু মহলের ধনী একটি লোক, তদুপরি কাউন্ট (সবাই ওরা যে এটা ঘৃণা করে) বিশেষ প্রয়াস ছাড়াই ওঁর চেয়ে এমন কি ভালো হলেও একইরকম আঁকছেন, যে ক্ষেত্রে উনি এর পেছনে দিয়েছেন গোটা জীবন। প্রধান কথা হল শিক্ষা, যেটা ওঁর নেই।’

ভ্রন্‌স্কি মিখাইলোভের পক্ষ নিলেন, কিন্তু মনের গভীরে বিশ্বাস করতেন কথাটা, কেননা তাঁর ধারণা ছিল যে নিঃস্ব অন্য একটা জগতের লোক ঈর্ষা করবেই।

জীবন থেকে মিখাইলোভ আর ভ্রন্‌স্কি আন্নার যে একই পোর্ট্রেট এঁকেছেন, তা থেকে তাঁদের ভেতর প্রভেদটা কি সেটা ভ্রন্‌স্কির চোখে পড়া উচিত ছিল, কিন্তু পড়ল না। মিখাইলোভের পরে তিনি শুধু আন্নার যে পোর্ট্রেটটা আঁকছিলেন তা বন্ধ করলেন, মনে করলেন ওটা এখন নিষ্প্রয়োজন। মধ্যযুগীয় জীবন নিয়ে তাঁর ছবি কিন্তু এঁকে চললেন তিনি এবং তিনি নিজে, গোলেনিশ্যেভ, বিশেষ করে আন্না, সবার কাছেই ছবিটা মনে হল অতি চমৎকার, কেননা নামকরা ছবিগুলির সাথে তাঁর ছবির মিল মিখাইলোভের চেয়ে বেশি।

ওদিকে মিখাইলোভ কিন্তু আন্নার পোর্ট্রেটে খুব ডুবে গেলেও সিটিঙগুলো যখন শেষ হল, শিল্প নিয়ে গোলেনিশ্যেভের মতামত শোনার প্রয়োজন রইল না, ভুলে যেতে পারেন ভ্রন্‌স্কির ছবিটাকে, তখন তিনি বেশি খুশি হলেন ওঁদের চেয়েও। তিনি জানতেন যে চিত্রকলা নিয়ে ভ্রন্‌স্কির ছেলেখেলা নিষিদ্ধ করা চলে না; ওঁর এবং সমস্ত অপেশাদারদেরই যা খুশি আঁকার পূর্ণ অধিকার আছে, কিন্তু বিছছিরি লেগেছিল তাঁর। মোম দিয়ে বড় একটা পুতুল বানিয়ে লোকে যদি সেটাকে চুমু খায় তা বারণ করা যায় না। কিন্তু যে প্রেমে পড়েছে, লোকটা যদি তার পুতুল নিয়ে যায় তার কাছে, এবং প্রেমিক যাকে ভালোবাসে তাকে সে যেভাবে আদর করে সেভাবে লোকটা আদর করতে থাকে তার পুতুলকে, তাহলে প্রেমিকের খারাপ লাগবে। ভ্রন্‌স্কির ছবি দেখে সেইরকম একটা বিশ্রী অনুভূতি হয়েছিল তাঁর : তাঁর একাধারে হাসি পেয়েছিল, রাগ হয়েছিল, করুণা বোধ করেছিলেন তিনি, নিজেকে মনে হয়েছিল অপমানিত।

চিত্রকলা আর মধ্য যুগ নিয়ে ভ্রুনস্কির নেশা বেশি দিন টিকল না। শিল্পরুচি তাঁর এতখানি ছিল যে নিজের ছবি তিনি শেষ করতে আর পারলেন না। আঁকা থেমে গেল। ঝাপসাভাবে তিনি টের পাচ্ছিলেন কি ত্রুটি ছবিটার, প্রথমটায় সামান্য লক্ষণীয় হলেও আঁকা চালিয়ে গেলে সেগুলো হয়ে উঠবে মারাত্মক। তাঁর ক্ষেত্রে যা ঘটল সেটা ঘটেছে গোলেনিশ্যেভের ক্ষেত্রে, যিনি অনুভব করছিলেন যে তাঁর বলার কিছু নেই এবং ক্রমাগত এই বলে আত্মপ্রতারণা করছিলেন যে তাঁর ভাবনাটা এখনো পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি, তিনি খাটছেন সেটা নিয়ে আর মালমশলা সংগ্রহ করে চলেছেন। কিন্তু গোলেনিশ্যেভকে এটা তিক্ত করে তুলছিল, যন্ত্রণা দিচ্ছিল, ভ্রন্‌স্কি ওদিকে আত্মপ্রতারণা করতে ও নিজেকে কষ্ট দিতে পারেন না, বিশেষ করে পারেন না তিক্ত হয়ে উঠতে। নিজের স্বভাবসিদ্ধ দৃঢ়তায় তিনি কিছু না বলে, কোন কৈফিয়ৎ না দিয়ে শিল্পচর্চা বন্ধ করলেন।

আন্না বিস্মিত হন তাঁর মোহভঙ্গে। অথচ ঐ চর্চাটা ছাড়া ইতালীয় শহরে তাঁর ও আন্নার জীবন তাঁর কাছে এত একঘেয়ে লাগল, পালাৎসো হঠাৎ হয়ে উঠল স্পষ্টত এত জীর্ণ আর নোংরা, কার্নিসের ভাঙা পলেস্তারা, পর্দায় দাগ এবং মেঝেতে ফুটো এত বিশ্রী দেখাতো, সেই একই গোলেনিশ্যেভ, ইতালীয় প্রফেসার আর জার্মান পর্যটকের সেই একই সাহচর্য এত বিরক্তিকর দাঁড়াল যে দরকার পড়ল জীবনটা বদলে নেবার। তাঁরা স্থির করলেন যাবেন রাশিয়ায়, গ্রামে। ভ্রন্‌স্কি ঠিক করলেন পিটার্সবুর্গে ভাইয়ের সাথে সম্পত্তি ভাগ করে নেবেন আর আন্নার ইচ্ছা ছেলেকে দেখার। গ্রীষ্মটা তাঁরা কাটাবেন ভাবলেন ভ্রন্‌স্কির পৈত্রিক মহালে।

চৌদ্দ

লেভিনের বিয়ের পর তৃতীয় মাস চলছে। সুখী তিনি, তবে যা আশা করেছিলেন মোটেই সে ধরনে নয়। প্রতি পদে তাঁর চোখে পড়ত আগের স্বপ্নগুলোয় মোহভঙ্গ আর অপ্রত্যাশিত নতুন মোহ। লেভিন সুখী, কিন্তু সংসার পেতে তিনি প্রতি পদে দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি যা কল্পনা করেছিলেন সেটা সেই লোকের দশার মত যে মুগ্ধ হয়ে হ্রদে মসৃণ, নিশ্চিন্ত নৌকা বাওয়া দেখার পর নিজেই উঠেছে সে নৌকায়। সে দেখতে পাচ্ছে টলমল না করে স্থির হয়ে বসে থাকা দরকার তাই শুধু নয়, মাথাও খিলাতে হবে, মুহূর্তের জন্যও ভোলা চলবে না কোথায় যাওয়া দরকার, পায়ের নিচে পানি, দাঁড় বাইতে হবে, অনভ্যস্ত হাত ব্যথা করছে, নৌকা বাওয়া দেখতেই শুধু সহজ, বাইতে যাওয়া অতি আনন্দের হলেও অতিশয় কঠিন।

যখন অবিবাহিত ছিলেন, অন্যদের দাম্পত্য জীবন, ছোটখাটো ঝামেলা, ঝগড়া-ঝাঁটি, ঈর্ষা দেখে তিনি শুধু অবজ্ঞাভরে হেসেছেন মনে মনে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তাঁর ভবিষ্যৎ দাম্পত্য জীবনে এ সব শুধু হবে না তাই নয়, মনে হত তার বাইরের চেহারাটাও হবে একেবারেই অন্যদের জীবনের মত নয়। হঠাৎ তার বদলে স্ত্রীর সাথে তাঁর জীবনটা বিশেষ রকমের কিছু-একটা হয়ে উঠল না শুধু তাই নয়, গড়ে উঠল ঠিক সেই সব তুচ্ছ খুঁটিনাটি নিয়েই যাকে তিনি আগে অত অবজ্ঞা করেছেন কিন্তু যা তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এখন একটা অসাধারণ ও অকাট্য গুরুত্ব লাভ করেছে। এবং লেভিন দেখলেন যে এসব তুচ্ছ জিনিসগুলোর সুব্যবস্থা করা মোটেই তেমন সহজ নয়, যা তাঁর মনে হয়েছিল আগে। পারিবারিক জীবনের একটা যথাযথ ধারণা তাঁর আছে বলে ধরে নিলেও অন্য সমস্ত পুরুষের মতই তিনিও শুধু প্রেমের পরিতৃপ্তিকেই পারিবারিক জীবন বলে কল্পনা করতেন যাতে কোন কিছুতেই ব্যাঘাত ঘটতে দেওয়া চলে না, ছোটখাট ঝামেলায় তা থেকে বিচ্যুত হওয়া অনুচিত। তাঁর ধারণায়, তিনি নিজের কাজ করে যাবেন আর কাজ থেকে বিশ্রাম নেবেন ভালোবাসার সুখাবেশে। কিটিকে হতে হবে শুধুই প্রিয়তমা। কিন্তু সমস্ত পুরুষের মত উনিও ভুলে গিয়েছিলেন যে কিটিরও কাজ করা প্রয়োজন। আর তাঁর দেখে অবাক লাগল যে কাব্যময়ী অপরূপা কিটি কিভাবে পারিবারিক জীবনের প্রথম কয়েক সপ্তাহেই শুধু নয়, প্রথম কয়েকটা দিনেই টেবিল-ক্লথ, আসবাব, অতিথিদের জন্য শয্যা, ট্রে, বাবুর্চি, ডিনার ইত্যাদির কথা ভাবতে, মনে করতে, তা নিয়ে ব্যস্ত হতে পারল। সেই পাণিপ্রার্থী থাকার সময়েই যে দৃঢ়তায় কিটি বিদেশে যেতে আপত্তি জানিয়েছিল এবং স্থির করেছিল যে গ্রামে যাবে, যেন কি দরকার তেমন কিছু-একটা তার জানাই আছে, নিজের ভালোবাসা ছাড়াও বাইরের জিনিস নিয়ে সে ভাবতে পারছে, তাতে অভিভূত হয়েছিলেন লেভিন। তখন সেটা ক্ষুণ্ন করেছিল তাঁকে আর এখন বার কয়েক তাঁকে ক্ষুণ্ণ করেছে ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তার ব্যস্ততা আর দুর্ভাবনা। কিন্তু উনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে ওটা কিটির দরকার। আর এই ঝামেলাগুলো কেন সেটা না বুঝলেও, তাতে তাঁর হাসি পেলেও কিটিকে ভালোবাসতেন বলে এতে মুগ্ধ না হয়ে পারতেন না। মস্কো থেকে আনা আসবাবগুলো কিটি যেভাবে সাজিয়েছে, নিজের এবং তাঁর ঘর যেভাবে নতুন করে গোছগাছ করেছে, পর্দা টাঙিয়েছে, যেভাবে ভবিষ্যৎ অতিথিদের এবং ডল্লির জন্য ঘর ঠিক করে ফেলেছে, যেভাবে নিজের নতুন দাসীর জন্য জায়গা বরাদ্দ করেছে, যেভাবে ডিনারের বরাত করত সে, আগাফিয়া মিখাইলোভনার সাথে তর্ক বাধিয়ে খাদ্যভাণ্ডারের ভার থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয়, তাতে হাসতেন লেভিন। বৃদ্ধ পাচক মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখত, হাসত, শুনত তার আনাড়ী ও অসম্ভব হুকুমগুলো; দেখতে পেতেন যে ভাঁড়ারে তরুণী বধূর নতুন নির্দেশগুলোয় আগাফিয়া মিখাইলোভনা চিন্তিতভাবে সস্নেহে মাথা নাড়ছেন; কিটিকে লেভিনের অসাধারণ মিষ্টি লাগত যখন আধো কেঁদে আধো হেসে তাঁর কাছে এসে সে অনুযোগ করত যে দাসী মাশা তাকে বাবুবাড়ির অকর্মা মেয়ে বলে মনে করে, তাই কেউ তার কথা শোনে না। এটা তাঁর মিষ্টি লাগলেও অদ্ভুত মনে হত এবং তিনি ভাবতেন ওটা বাদ দিতে পারলেই বরং ভালো।

পিতৃগৃহে কিটির মাঝে মাঝে ইচ্ছা হত ভাস বা বাঁধাকপি, কি চকোলেট খাবে কিন্তু কোনটাই জুটত না, আর এখন সে যা ইচ্ছা ফরমাশ দিতে পারে, কিনতে পারে স্তূপাকৃতি চকোলেট, যত খুশি টাকা খরচ করা যায়, ইচ্ছামত বরাত করা সম্ভব মিষ্টি কেকের, এই যে পরিবর্তনটা কিটি অনুভব করতে, সেটা বুঝতেন না লেভিন

কিটি এখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে ডল্লির আসার সানন্দ স্বপ্নে বিভোর, কেননা শিশুগুলির যার যা পেয়ারের কেক তার হুকুম দিতে পারবে সে, আর ডল্লি কদর করবেন তার ব্যবস্থা-বন্দোবস্তের। কিটি নিজেই জানতো না কেন এবং কিসের জন্য, কিন্তু গৃহস্থালী তাকে অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে টানতো। স্বতঃবোধে বসন্ত আসন্ন অনুভব করায় এবং এটা জানা থাকায় যে দুর্যোগের দিনও আসবে, সে তার নীড়টি বাঁধছিল যেমন পারে, তাড়াতাড়ি করছিল একই সাথে বাসা বাঁধতে আর কি করে তা বাঁধতে হয় শিখে নিতে

বিবাহোত্তর সমুন্নত সুখ সম্পর্কে লেভিনের যা আদর্শ, তার অতি বিরোধী এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কিটির এই দুশ্চিন্তা ছিল একটা মোহভঙ্গ; আর এই মধুর যে ব্যস্ততাগুলোর অর্থ তিনি বুঝতেন না, আবার ভালো না বেসেও পারতেন না, তা হল নতুন মুগ্ধতাগুলির একটা।

দ্বিতীয় মোহভঙ্গ ও মুগ্ধতা হল কলহ। লেভিন কদাচ কল্পনা করতে পারেননি তাঁর ও স্ত্রীর মধ্যে কোমলতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু সম্ভব; আর হঠাৎ কিনা প্রথম দিনগুলোয় ঝগড়া বাধল আর কিট ওঁকে বলে দিলে যে উনি ওকে ভালোবাসেন না, ভালোবাসেন কেবল নিজেকে, কাঁদলে, হাত ঝটকালে।

প্রথম ঝগড়াটা হয়েছিল কারণ লেভিন নতুন একটা খামার বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং ফেরেন আধ ঘণ্টা দেরি করে, কেননা তাড়াতাড়ি একটা রাস্তা ধরতে গিয়ে পথ হারান। বাড়ি তিনি আসেন কেবল কিটির কথা, তার ভালোবাসা, নিজের সুখের কথা ভাবতে ভাবতে আর যতই কাছিয়ে আসছিলেন ততই বেশি করে তাঁর মধ্যে প্রেমের আগুন জ্বলে উঠছিল। ঘরে তিনি ঢুকলেন ছুটতে ছুটতে এবং একই হৃদয়াবেগ নিয়ে, শ্যেরবাৎস্কিদের ওখানে গিয়ে তিনি যখন পাণিপ্রার্থনা করেন এটা তার চেয়েও প্রবল। হঠাৎ তিনি দেখলেন কিটির গোমড়া মুখ যা আগে কখনো দেখেননি। চুমু খেতে চেয়েছিলেন লেভিন, কিন্তু কিটি ঠেলে সরিয়ে দিলে তাঁকে।

‘কি হল?’

‘তোমার তো ফুর্তি লাগছে দেখছি…’ কিটি শুরু করলে শান্তভাবে একটা বিষাক্ত সুর ফোটাবার চেষ্টা করে। কিন্তু যেই সে মুখ খুলল, অমনি অর্থহীন ঈর্ষায় ভর্ৎসনার কথাগুলো, এই আধ ঘণ্টা জানালার কাছে নিশ্চল হয়ে বসে থাকার সময় যা কিছু তাকে পীড়িত করেছে তা সব অনর্গল বেরিয়ে এল। বিবাহের পর গির্জা থেকে কিটিকে নিয়ে আসার সময় লেভিন যা বোঝেননি, সেটা স্পষ্ট বুঝলেন কেবল এই প্রথম। তিনি বুঝলেন যে কিটি শুধু তার

আপনজন নয়, তিনি জানেনই না কোতায় কিটির শেষ আর তাঁর শুরু। সেটা তিনি বুঝলেন সেই মুহূর্তে দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ার যে যন্ত্রণাকর অনুভূতি তাঁর হচ্ছিল তা থেকে। প্রথম মিনিটটায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু সেই মুহূর্তেই তিনি টের পেলেন যে কিটি তাঁকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে না, কেননা নিজেই তিনি কিটি। প্রথম মুহূর্তটায় তাঁর যে মনোভাব হয়েছিল তা সেই লোকের মত যে পেছন থেকে হঠাৎ প্রচণ্ড একটা গুঁতো খেয়ে রাগে আর প্রতিশোধস্পৃহায় ঘুরে দাঁড়িয়ে দোষীকে খুঁজে খুঁজে দেখে যে দোষ তারই, এবং নিঃসন্দেহ হয়ে ওঠে যে নিজেই সে গুঁতো মেরেছে নিজেকে, কারো ওপর রাগ করার নেই, ব্যথাটা মেনে নিয়ে সয়ে যেতে হবে।

এর পরে আর কখনো তিনি এটা এত তীব্রভাবে অনুভব করেননি, কিন্তু সেই প্রথম বার অনেকক্ষণ সুস্থির হতে পারেননি তিনি। স্বাভাবিক একটা প্রবৃত্তিতে কৈফিয়ৎ দাবি করতে যাচ্ছিলেন তিনি, কিটির দোষটা তাকে দেখিয়ে দিতে চাইছিলেন; কিন্তু দোষ দেখিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে তাকে আরো চটিয়ে দেওয়া, যে ফাটলটা সমস্ত বিপত্তির কারণ তাকে বাড়িয়ে তোলা। অভ্যস্ত একটা প্রবণতা ছিল দোষটা নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে কিটির ওপর চাপানো; কিন্তু প্রবলতর আরেকটা প্রবণতা তাঁকে টানছিল তাড়াতাড়ি, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফাটলটাকে বাড়তে না দিয়ে মিটিয়ে ফেলা। এমন অন্যায় একটা অভিযোগ মেনে নিয়ে থাকা কষ্টকর, কিন্তু নিজেকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করা, ওদে দগ্ধানো হবে আরো খারাপ। আধঘুমন্ত লোকের যন্ত্রণা হলে যেমন হয়, তার মত তিনি চাইছিলেন রুগ্‌ণ অঙ্গটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে, কিন্তু চৈতন্যোদয় হতে টের পেলেন যে রুগ্‌ণ অঙ্গটা তিনি নিজে। সে অঙ্গটা যাতে সহিষ্ণু হয়, তাতে সাহায্য করার চেষ্টা করা উচিত এবং সে চেষ্টা তিনি করলেন।

মিটমাট হয়ে গেল ওঁদের। নিজের দোষ সম্পর্কে সচেতন হয়ে কিন্তু লেভিনকে তা না বলে কিটি ওঁর প্রতি আরো কোমল হয়ে উঠল, ভালোবাসার দ্বিগুণ একটা নতুন সুখ বোধ করলেন তাঁরা। কিন্তু সংঘাতের পুনরাবৃত্তি হতে এমন কি ঘন ঘনই এবং খুবই অপ্রত্যাশিত ও তুচ্ছ কারণে, কোন বাধা হল না এতে। সংঘাতগুলো হচ্ছিল ঘন ঘন, কারণ তখনো তাঁরা জানতেন না পরস্পরের কাছে কি গুরুত্বপূর্ণ, এবং এ কারণেও বটে যে এই প্রথম দিকটায় উভয়েরই মেজাজ প্রায়ই থাকত বিগড়ে। একজনের মেজাজ যখন ভালো থাকত আর অন্যজনের খারাপ তখন শান্তিভঙ্গ হত না, কিন্তু যখন দুজনেরই মেজাজ খারাপ থাকত, তখন সংঘাত বাধতো এবং দুর্বোধ্য তুচ্ছ কারণে যে পরে মনে করতে, পারতেন না তাঁরা ঝগড়াটা বেধেছিল কি নিয়ে। এ কথা ঠিক যে দুজনেরই মন ভালো থাকলে জীবনের আনন্দ হয়ে উঠত দ্বিগুণ। তাহলেও এই প্রথম দিকটায় দুঃখের একটা সময় গিয়েছিল তাঁদের।

প্রথম দিককার গোটা এই সময়টায় বিশেষ তীব্রভাবে অনুভব হত, যে শেকলটায় তাঁরা বাঁধা, যেন তার দু’দিকেই চলছে এক একটা হেঁচকা টানাটানি। মোটের ওপর মধুচন্দ্রিকা, অর্থাৎ বিয়ের পরেকার মাসটা, লোকপ্রথা অনুসারে যা থেকে অনেককিছু আশা করছিলেন লেভিন, তা মধুময় তো হলই না, বরং দুজনের মনেই তা তাঁদের জীবনের একটা দুর্বিষহ ও হীনতাসূচক সময়ের স্মৃতি রেখে গেল। এই যে অসুস্থ সময়টায় দুজনেই স্বাভাবিক থাকতেন কদাচিৎ, স্বপ্রকৃতিস্থ থাকতেন কদাচিৎ, তার সমস্ত কদর্য, লজ্জাকর ঘটনাগুলো তাঁরা দুজনেই পরবর্তী জীবনে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছেন সমানভাবে।

মস্কোয় তাঁরা গিয়েছিলেন এক মাসের জন্য। সেখান থেকে ফেরার পর দাম্পত্য জীবনের কেবল তৃতীয় মাসেই তাঁদের জীবন হয়ে উঠল মসৃণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *