অন্তর্যামী – ২৬

ছাব্বিশ

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা বিরাজ করল। এরপর রানাকে লক্ষ্য করে ভেরোনিকা বলল, ‘কিছু কিছু ব্যাপার আছে, যেগুলো এ-মুহূর্তে আমরা খুলে বলতে পারছি না। অ্যালি সহ্য করতে পারবে না। না, শুধু ওর ভিন্নতার কথা বলছি না, আর বেশ কিছু বিষয় আছে। ওর মায়ের পরিণতি… বন্দিদশা থেকে আমাদের পালানো… টিফানি ক্যানট্রেল…’

‘তার মানে এ-ই নয় যে, আমরা ওসব চাপা দিতে চাইছি,’ বলল এলিনা। ‘সবই খুলে বলব তোমাদেরকে, কিন্তু তার আগে অ্যালি ওর স্মৃতি ফিরে পেলে ভাল হয়। নইলে আমাদের কথা বিশ্বাস করতে পারবে না ও। বিশ্বাস করতে চাইবে না।’ অ্যালির দিকে তাকাল সে। ‘তুমি নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছ, অ্যালি, ওসবের একটাও সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।’

‘ডায়েরি লেখার অভ্যেস আছে তোমার,’ অ্যালিকে বলল ভেরোনিকা। ‘গত কয়েক বছর থেকেই লিখছ। কিন্তু সে- ডায়েরি তোমাকে দেখাব কি না, এ-নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছি আমি আর এলিনা। ওভাবে হয়তো শর্টকাটে সব জানতে পারবে তুমি, কিন্তু হজম করতে পারবে না। তারচেয়ে স্মৃতিগুলো স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসা ভাল। বাড়তি কোনও চাপ পড়বে না তোমার ওপর। বিশ্বাস করো, তোমার মঙ্গলের কথা ভেবেই এ-সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’

‘টিফানি ক্যানট্রেল কোথায় থাকেন, তা লিয়ারি জানে, ‘ থমথমে গলায় বলল অ্যালি। ‘তিনি যদি বিপদের মধ্যে থাকেন, তা হলে এভাবে অপেক্ষা করাটা কি ঠিক হবে আমাদের?’

‘সত্যিই বিপদে আছে টিফানি,’ স্বীকার করল এলিনা। ‘বড় ধরনের বিপদ। কিন্তু খুব শীঘ্রি কিছু ঘটবে না তার কপালে। জানি, কথাটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে… তবে নিশ্চিত থাকতে পারো, অন্তত আগামী এক সপ্তাহের ভেতর কেউ ফুলের টোকাও দেবে না তার গায়ে।’

‘তোমরা সেটা কীভাবে জানো?’

‘যেভাবেই হোক, জানি,’ সংক্ষেপে বলল এলিনা। ব্যাখ্যা দিতে গেল না। ‘আমার ওপর বিশ্বাস রাখো।’

হতাশা দেখা দিয়েছে অ্যালির চেহারায়। তাকে দোষ দিতে পারল না রানা। ওর নিজের ভেতরেও উঁকি দিচ্ছে হতাশা। এরা কিছু বলতে চাইছে না কেন?

‘লিয়ারি আমার নাগাল পেল কী করে?’ জিজ্ঞেস করল অ্যালি। ‘দু’মাস আগে আমাকে কীভাবে খুঁজে পেল সে?’

‘সেটাও পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত, ‘ বলল ভেরোনিকা। ‘আসলে… পুরোটাই একটা লম্বা কাহিনী। এখন সেটা তোমার না শোনাই ভাল।’

আসলেই কি ভাল? মনে মনে ভাবল রানা। নাকি অন্য কোনও মতলবে ওদেরকে অন্ধকারে রাখতে চাইছে এরা?

ভাবনাটা শেষ হতে না হতেই ভেরোনিকার ওপর চোখ পড়ল ওর—একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে। চিন্তাটা পড়তে পেরেছে নিঃসন্দেহে। বিব্রত হলো রানা। বলল, ‘সরি।’

‘সরি বলার কিছু নেই,’ একটু হাসল ভেরোনিকা। ‘এমন পরিস্থিতিতে মনের ভেতর সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের কোনও কুমতলব নেই। বিশ্বাস করো!’

‘তা হলে মরুভূমির মাঝখানের ওই সেল টাওয়ারটার কথা বলো,’ বলল রানা। ‘কেন ওটাকে ভয় পাচ্ছে লিয়ারি ও তার লোকেরা?’

‘টাওয়ারটাকে ভয় পাচ্ছে না… ওটাকে এ-মুহূর্তে যে- কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটাও ওদের ভয়ের কারণ নয়। এর পেছনে আরও বড় একটা রহস্য রয়েছে।’ পালা করে রানা আর অ্যালির দিকে তাকাল ভেরোনিকা। ‘সব প্রশ্নের জবাব খুব শীঘ্রিই পাবে তোমরা, নিশ্চিন্ত থাকো। তার আগ পর্যন্ত দয়া করে ধৈর্য ধরো। আমি শুধু এটুকুই বলব, পুরোটা জানার পর তোমাদের মনে হবে, ওসব না জানলেই ভাল হতো।’

.

সান্তা মনিকা উপসাগরের বুকে আঁধার নেমে এসেছে। ডাঙার এক মাইল ভেতরে, পাঁচশো ফুট উঁচুতে, নিজের বাড়ির প্যাটিয়ো থেকে আনমনে সেদিকে তাকিয়ে আছে লিয়ারি। চাঁদের আলোয় পশ্চিমে আবছাভাবে ফুটে উঠেছে পয়েন্ট ডিউমের সাগরসৈকত। আর পুবে, বিশ মাইল দূরে ঝিকমিক করছে লস অ্যাঞ্জেলেস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের আলো। এয়ারপোর্টের পেছনে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত মহানগরীর কৃত্রিম আভা।

সুইমিং পুলের পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে বাতির আলো, চোখের সামনে তুলে ধরল একটা বাঁধাই করা ফোল্ডার। প্রথমবার ওটায় চোখ বোলানোর পর থেকে ফোল্ডারটার শিরোনাম তার জন্যে একটা চিরন্তন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইউ.এস. আর্মি বায়ো-ওয়ারফেয়ার রিসার্চ ইন্সটিটিউট
(ইউ.এস.এ.বি.আর.আই.)
লিভিং ওয়েপন্স ইনিশিয়েটিভ—কোর্ট ২৩.৩
অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট
‘স্ন্যাপড্রাগন’

চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ মুদল লিয়ারি। আর তখুনি পকেটে রাখা সেলফোনটা বেজে উঠল। রিংটোনটা হুপারের। চোখ না খুলেই ফোনটা বের করল সে, কানে ঠেকাল।

‘শিকাগো অপশন চালু করা হয়েছে, স্যর,’ জানাল হুপার।

‘খুব ভাল,’ বলে লাইন কেটে দিল লিয়ারি। ফোনটা নামিয়ে রাখল পাশে।

দু’মাস আগে, অ্যালি ধরা পড়ার পর ওর চামড়া আর চুলের পলিউট্যান্ট প্রোফাইল বের করা হয়েছিল। ওটা আসলে এক ধরনের কেমিক্যাল অ্যানালিসিস—দীর্ঘ সময় কোথাও বাস করলে সেখানকার পরিবেশ দূষণের প্রভাবে মানুষের শরীরে অদৃশ্য একটা রাসায়নিক প্রলেপ পড়ে। সেই প্রলেপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বোঝা যায়, মানুষটা কোথাকার অধিবাসী। অ্যালির বেলায় শিকাগোর প্রোফাইল পাওয়া গিয়েছিল। যদিও তাকে শিকাগো থেকে ধরেনি লিয়ারির লোকজন, তারপরেও ওই প্রোফাইল দেখে বোঝা যাচ্ছিল, মেয়েটা বেশ কিছুদিন শিকাগোতে থেকেছে। ওখানে নিশ্চয়ই কোনও আশ্রয়স্থল আছে ওর।

অবশ্য এত দ্রুত শিকাগোর ঠিকানা মনে করতে পারার কথা নয় অ্যালির, তাও কোনও ঝুঁকি নিচ্ছে না লিয়ারি। চালু করে দিয়েছে শিকাগো অপশন—মেয়েটাকে খুঁজে পাবার জন্যে। এক ধরনের মরিয়া পদক্ষেপও বলা যায় ওটাকে। নইলে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছে লিয়ারি। যত সময় যাচ্ছে, ততই চোরাবালিতে ডুবে যাবার মত একটা অনুভূতি হচ্ছে তার।

.

‘তুমি তা হলে লিভিং রুমে ঘুমাবে?’ বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল অ্যালি। পরনে ঘুমানোর পোশাক, বুকের কাছে কাছে জাপটে ধরে রেখেছে ডায়নোসরের পুতুলটা—এখন ওকে সত্যিকার একটা বাচ্চা মেয়ের মত দেখাচ্ছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল রানা। বলল, ‘অ্যাপার্টমেন্টের দরজার যতটা সম্ভব কাছে থাকতে চাই। বিপদ এলে ওদিক থেকে আসবে। তিরাশি তলায় ঢোকার পথ ওই একটাই।’

‘এখন বোধহয় অতটা সতর্ক না থাকলেও চলে,’ বলল অ্যালি। ‘এখানে আমরা নিরাপদ। তুমি আমার পাশের কামরায় থাকতে পারো না? তুমি কাছে থাকলে আমি সাহস পাই।’

‘পাশের রুমটাও যথেষ্ট দূরে,’ হালকা গলায় বলল রানা। ‘বড় বাড়িতে থাকার এই এক অসুবিধে।’

জোর করে একটু হাসল অ্যালি। লাঞ্চের পর থেকে আবার মনমরা হয়ে গেছে ও। মাথা নিচু করে বলল, ‘আমার খুব ভয় করছে, জানো? পুরনো স্মৃতি মনে করার জন্যে খুব চেষ্টা করেছি গত ক’দিন, কিন্তু আজ ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, কোনোকিছু মনে না পড়াই হয়তো ভাল। খুব খারাপ কিছু লুকিয়ে আছে ওর ভেতর, তাই না? আমি তার সঙ্গে জড়িত।’

‘ওটা তোমার অনুমান। সত্যি না-ও হতে পারে।’

‘না, সত্যি। আমি সেটা অনুভব করছি, রানা। নিশ্চয়ই কোনও মন্দ কাজ করেছি আমি, সেটা জানতে চাই না। অথচ… না জেনেও তো উপায় নেই। আমার স্মৃতি ফিরবেই। এখুনি তার আভাস পেতে শুরু করেছি।’

‘খামোকা দুশ্চিন্তা করছ, অ্যালি। ব্যাপারটা তেমন কিছু না-ও হতে পারে।’

‘আর যদি হয়?’

কী জবাব দেবে, ভেবে পেল না রানা। ওকে আর কিছু বলল না অ্যালি। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল, তারপর শুভরাত্রি জানিয়ে বন্ধ করে দিল রুমের দরজা।

অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টটা উল্টে চলেছে লিয়ারি। এই প্রথম নয়, আগেও বহুবার পড়েছে ওটা। তারপরেও মাঝে মাঝে রিভাইস দেয়। মাথায় গেঁথে নেবার চেষ্টা করে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য।

বরাবরের মত রিপোর্টের শেষদিকে একটা সেকশনে পৌঁছে থামল। ওপরে বড় করে শিরোনাম লেখা রয়েছে: অ্যালিসন মিচেল। পাতাটার ওপর হাত বোলাল লিয়ারি, কিন্তু সযত্নে এড়িয়ে গেল শিরোনামের শব্দদুটো। যেন ওগুলোকে স্পর্শ করলেই আঙুল কেটে যাবে তার।

.

লিভিং রুমে রানার ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ভেরোনিকা, এরপর পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল নিজের কামরা থেকে। হাজির হলো এলিনার কামরায়। ভেজিয়ে দিল দরজা। এলিনা তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। লেক মিশিগানের পিয়ার, থেকে ভেসে আসা আভায় নিশ্চল মূর্তির মত লাগছে ওকে।

পাশে গিয়ে দাঁড়াল ভেরোনিকা। বলল, ‘ওকে এভাবে অন্ধকারে রাখতে ভাল লাগছে না আমার।’

‘এভাবে বেশিদিন ও থাকবেও না,’ এলিনা বলল। ‘ধৈর্য ধরো।’

‘কী ঘটবে বলে মনে হয় তোমার? যখন সবকিছু মনে পড়বে ওর… সব ফিরে পাবে?’

নিঃশ্বাসের সঙ্গে চাপা হাসির মত একটা আওয়াজ করল এলিনা—কঠিন, শীতল হাসি। তবে একেবারে রসকষহীন নয়।

‘আর কিছু না হোক, দেখার মত একটা ব্যাপার হবে!’ বলল সে।

.

মনোযোগ দিয়ে অ্যালিকে নিয়ে লেখা সেকশনটা পড়ছে লিয়ারি। সংক্ষিপ্ত জীবনে মেয়েটা যা যা করেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ আছে ওতে। বেশ কিছু রঙিন ছবিও আছে রিপোর্টের সঙ্গে। যথেষ্ট শক্ত ধাতের মানুষ লিয়ারি, কিন্তু তারপরেও ছবিগুলো তার স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে। অস্বস্তি চাপা দিয়ে ছবিগুলোয় চোখ বোলাচ্ছে সে। নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, ব্যাপারটা কতখানি গুরুতর।

খানিক পর রিপোর্ট পড়া শেষ হলো লিয়ারির। ফোল্ডারটা চেয়ারের পাশে নামিয়ে রাখল। টের পেল, বরাবরের মত কাঁপছে তার হাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *