৭১ এর রোজনামচা – আহসান হাবীব
’৭১ এর রোজনামচা – আহসান হাবীব
প্রথম প্রকাশ একুশে গ্রন্থমেলা ২০১২
আহসান হাবীব। জন্ম সিলেট, ১৯৫৭ সাল। ৫ই নভেম্বর। পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। থেকে ভূগোলে মাস্টার্স। ব্যাংকার হিসেবে। জীবন শুরু করে পেশা বদল কার্টুনিস্ট হিসেবে। বর্তমানে উন্মাদ ও ট্রাভেল এন্ড ফ্যাশনের সম্পাদক। পাশাপাশি রম্য লেখক। ব্যক্তিগত। জীবনে স্ত্রী আফরোজা আমিন ও কন্যা এষাকে। নিয়ে পল্লবীতে বসবাস করছেন।
উৎসর্গ : মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের।
ভূমিকা
একাত্তরে আমি ক্লাশ সিক্সের ছাত্র। আমাদের পরিবারটা তখন নানা ভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এই সময় আমি ডায়েরী লিখতাম একটা। সাদা খাতায়। যা যা দেখতাম বা শুনতাম লিখে ফেলতাম। স্বাধীনতার পরও খাতাটা ছিল। তারপর আর একসময় পেলাম না। এখন আফসোস হয় খাতাটা থাকলে অনেক ঘটনা জানা যেত। কিছু কিছু ঘটনা আমার এখনো মনে আছে। ভাবলাম, আচ্ছা লিখে রাখলে কেমন হয়? এক সময়তো এগুলিও হারিয়ে যাবে। তরুণ প্রজন্ম বরং জানুক আমরা কী সময় পার হয়ে এসেছি। সেই সময়কার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে এই একাত্তরের রোজনামচা… কিছু কিছু ঘটনা আবার ইদানিংকালে শোনা। এগুলোর বেশীর ভাগই অনিক খানের তবুওতে ছাপা হয়েছিল।
*
গভীর রাতে এক হিন্দু প্রধান গ্রামে হামলা করল পাক আর্মী। গুলি আর আগুন দিয়ে তছনছ করে দিল গ্রামটাকে। সবাই পালাচ্ছে। পাশেই বিশাল নদী। যদি নৌকা দিয়ে কোন মতে পার হওয়া যায় নদীটা তবেই জানে বাঁচা যেতে পারে। রাতের অন্ধকারে সবাই ছুটছে নদীর দিকে। রমাকান্ত তার স্ত্রী আর ছোট দুই পুত্র-কন্যা নিয়ে ছুটছেন। মেয়েটি কোলে ছেলেটার হাত ধরে রেখেছেন মা। হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়লেন মা।
–কি হল? রমাকান্ত হতভম্ব।
‘আমার গুলি লেগেছে’ কোনমতে বললেন স্ত্রী সুধা। বুকের কাপড় থিক থিক করছে রক্তে।
‘তুমি ওদের নিয়ে পালাও’ কোনমতে বললেন স্ত্রী।
রমাকান্ত দেরী করলেন না, ছেলে মেয়ের হাত ধরে ছুটছেন। নদীর ঘাটে নৌকা বেশী ছিল না। সবাই হুড়োহুড়ি করে উঠছে। একটায় কোনমতে উঠলেন রমাকান্ত। শক্ত করে ধরে রেখেছেন ছেলে আর মেয়েকে। নদীটা পার হতে পারলে হয়। নৌকা চলতে শুরু করল। মাঝ নদীতে হঠাৎ মর্টারের শেল আঘাত হানল নৌকায়, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল নৌকাটা। রমাকান্ত ছেলে আর মেয়ে নিয়ে ডুবে গেলেন উত্তাল নদীতে। দু’হাতে দু’জনকে ধরে রেখে কোনমতে ভেসে থাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি পারছেন না। যে কোন একজনকে ছেড়ে দিলে হয়ত বেঁচে যেতে পারেন। কিন্তু কাকে ছাড়বেন? ছেলেকে না মেয়েকে? দ্রুত চিন্তা চলছে তার মাথায়। তিনি অন্ধকার রাতে নদী আর চোখের পানি এক করে মেয়েটাকেই ছেড়ে দিলেন। তিনি কী ভেবে ছেড়েছিলেন মেয়েটিকে? হয়ত ভেবেছেন মেয়েতো একসময় পরের ঘরে চলেই যাবে বরং ছেলেটাই থাক শেষ বয়সে বাবাকে দেখবে… এমনটা? মেয়েটি ভেসে গেল। তিনি এক হাতে ছেলেটিকে ধরে উত্তাল নদী সাঁতরে কোন মতে অন্য পাড়ে উঠে এলেন। আর আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলেন তিনি ডান হাতে ধরে আছেন তার মেয়েটিকে। তিনি রাতের অন্ধকারে ছেলেটিকেই ছেড়ে দিয়েছিলেন, বুঝতে পারেন নি!
*
তরুণ ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। বাবার মন সায় দেয় না। তার চুপচাপ ঘরোয়া ছেলেটি কি পারবে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করতে? কিন্তু বাবা জানেন না। ছেলে গোপনে ঢাকায় গেরিলাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একের পর এক অপারেশন করে চলেছে। ছেলে যে গভীর রাতে ফিরে স্টেনগান লুকিয়ে রাখে তার ঘরে সেটাও তিনি জানেন না। বাবা কেন তাদের বাসার কেউই জানেন না তাদের বড় ছেলে গোপনে এক ভয়ঙ্কর মুক্তিযোদ্ধা। চলছিলো ভালোই। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছেলের দুই বন্ধু এলো তার খোঁজে। মা চেনেন তাদের। খুশিও হলেন তাদের দেখে- কতদিন পর এলো তারা। তাদের দুপুরে খেতেও দিলেন। খেয়ে দেয়ে তারা ফিরেও গেলো হাসিমুখে। বলে গেলো, “খালাম্মা পারভেজকে বলার দরকার নেই আমরা এসেছিলাম, আমরা আবার আসব।” সহজ সরল মা বুঝতেই পারলেন না তারা আলবদর।
সে রাতেই আবার তারা এলো। এবার তাদের হাতে অস্ত্র, ভাবভঙ্গিও অন্যরকম। বাইরে অপেক্ষা করছে সাদা মাইক্রোবাস। কোন কথা নেই, পারভেজকে জোর করে ধরে তুলল সাদা মাইক্রোবাসে… ছোট ভাই ফিরোজ ছুটে গেলো, ভাইয়াকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ওরা হ্যাঁচকা টানে ছোটভাই ফিরোজকেও তুলে নিলো। দিনটা ছিলো ১৪ই ডিসেম্বর। তার দুদিন পরে ১৬ই ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো! রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলায় ফিরে এলো না শুধু তারা দুই ভাই…।
*
পাকিস্তানী বাহিনী বাবাকে হত্যা করতে নিয়ে গেলো। বাবার চোখ বাঁধা। বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মুক্তিযযাদ্ধাদের সহযোগীতা করেছেন। রাজাকাররাই তাকে ধরে এনেছে। বাবাকে দাঁড় করানো হলো গুলি করার জন্য। হঠাৎ কোত্থেকে খবর পেয়ে ছুটে এলো তার কিশোর পুত্র। দুহাতে জরিয়ে ধরল বাবাকে, চিৎকার করে বলল, “আমার বাবাকে মেরো না, আমার বাবাকে মেরো না।” মিলিটারীর নির্দেশে কিশোর ছেলেটিকে টেনে হিঁচড়ে সরানো হলো। ছেলেটি আবার ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো- “আমার বাবাকে মেরো না, আমার বাবাকে মেরো না।” এবারও তাকে টেনে-হিঁচড়ে সরানো হলো। আবারও একই ঘটনা ঘটলো। এবার মিলিটারীরা নির্দেশ দিলো গুলি করার। গর্জে উঠলো কয়েকটা রাইফেল। ছিটকে পড়লো বাবা আর ছেলে এক সঙ্গে। সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখলো কিশোর ছেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে থাকলে… আর ভয়ঙ্কর মৃত্যু তাদের গ্রাস করলো একসঙ্গে।
*
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নানা রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা আমাদের কানে আসতো। তার একটা ছিলো এরকম–পাকবাহিনীরা বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের নাকি বাঘের খাঁচায় ছুঁড়ে দিয়েও হত্যা করতো। স্বাধীনতার পরেও সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা আমাদের কানে এসেছে। সেইরকম একটি ঘটনা যেখানে একজন দুর্ধর্ষ। মুক্তিযোদ্ধা বাঘের খাঁচা থেকে জীবিত অবস্থায় বের হয়ে এসেছিলেন।
তার নাম শফিকুল আলম চৌধুরী। পঞ্চগড়ের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। একবার এক পাকসেনা ভুল করে তার এলাকার বাজারে চলে এলে তিনি নিরস্ত্র অবস্থায় একাই পাক আর্মির অস্ত্র ছিনিয়ে নেন। সেই শুরু, তারপর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বহু সফল অপারেশন করেছেন। ঐ অস্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনায় পাক বাহিনীর একটা ক্ষোভ ছিলো তার ওপর। এবং স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় একদিন তাকে ধরেও ফেললো সে। তারপর শুরু হলো ভয়ানক নির্যাতন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন একটা খাঁচার ভেতর। খাঁচাটা বাঘের, চারটা বাঘ সেই খাঁচায়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, বাঘ তাকে ছুঁয়েও দেখলো না। উল্টো একটা বাঘ তার গায়ে হেলান দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়লো। এই ঘটনা দেখে রাজাকার আর মিলিটারীরা ভীষণ অবাক হলো। তবে খাঁচা থেকে তাকে বের করলো না। এই ভাবে টানা তিন মাস তিনি বাঘের খাঁচায় রইলেন। বাঘ তাকে স্পর্শও করলো না। তার সামনে প্রায়ই অন্যদের ধরে এনে বাঘের খাঁচায় দেয়া হতো, বাঘ মুহূর্তেই তাদের ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলতো। বাঘের আক্রমনে যারা গুরুতর আহত হতো কিন্তু মারা যেত না, তাদের আবার বাইরে এনে গুলি করে মেরে ফেলা হতো।
পরে তাকে ঠাকুরগাঁও জেল-হাজতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে এক পরিচিতের মাধ্যমে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এখনো তিনি শরীরে অজস্র ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন।
আর আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় এখনো তার কোন নাম নেই!
*
১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগের সময় পাঞ্জাবী আল্লারাখা খান কি মনে করে পাবনা শহরে চলে এসেছিলেন তা আজ আর কারও মনে নেই। তিনি পাবনা শহরেই এক বাঙ্গালী রমনীকে বিয়ে করে স্থায়ী হয়ে যান। তিনি ছিলেন পুলিশের লোক। অস্ত্র চালনা ভালই জানতেন। তার এক ছেলে ছিল শরীফ খান।
তারপর একদিন দেখতে দেখতে চলে এল ১৯৭১ সাল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
সেই সময় পঞ্চাশ জন পাক সেনার একটা দল হটাৎ পাবনার শহরে পুলিশ লাইনে হামলা চালাল। পাবনার পুলিশ বাহিনী জনতাকে সাথে নিয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ করে ঘিরে ফেলল। শুরু হল যুদ্ধ। আশ্চর্যের ব্যাপার প্রায় ৩৫ জন পাক সেনাকে মেরে ফেলল স্বাধীনতা কামী জনতা আর পুলিশ মিলে। বাকি ১৫ জন পাক সেনা গিয়ে আশ্রয় নিল পাশের টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। ওদিকে খবর পেয়ে পাক বাহিনীর দু’তিনটা কনভয় ছুটে আসছিল পাবনার দিকে। এ খবর কিভাবে পেয়ে গেলেন আল্লারাখা খান, তিনি তার তরুন ছেলে শরীফ খান আর তৃতীয় একজনকে নিয়ে মাত্র তিনটি রাইফেল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন, সার্কিট হাউজের পাশের একটা টয়লেটের জানালা দিয়ে তিনি গুলি শুরু করলেন। তার সঙ্গের লোকটি নাকি রাইফেল চালাতেই জানতো না। তিনি ছেলে কে গুলি করতে দিয়ে সঙ্গের লোকটিকে তখন তখনই শিখিয়ে দিয়ে গুলি করতে বলেন। ধুন্ধুমার গুলি চালিয়ে যেতে লাগলেন তারা তিনজন। তাদের এই অতর্কিত আক্রমনে বেশ কয়েকজন পাক সেনা মারাও গেল। সে যাত্রা তাদের ঠেকিয়েই দিলেন আল্লারাখা খান আর তার ছোট্ট দলটি। এই গোপন প্রতিরোধ খুব বেশী মানুষ জানল না। কিন্তু পাক বাহিনী ঠিকই মনে রাখল।
মাস খানেক পরে প্রতিরোধ ভেঙে পাক বাহিনী পাবনা শহরে ঢুকলো। তখন তরুনরা সব ছুটছে মুক্তিযযাদ্ধার ট্রেনিং নিতে ভারতে, সেই দলের সঙ্গে আল্লারাখা খানও রওনা দিলেন। কিন্তু তাকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। উর্দুভাষি বলে তাকে পাকিস্তানী চর’ সন্দেহে তাকে নেয়াতো হলই না উল্টো মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হল। তবে পরিচিত কয়েকজনের হস্ত ক্ষেপে সন্দেহ দূর হলেও তিনি সেই দলের সঙ্গে ভারত যেতে পারলেন না। ফিরে এলেন পাবনায়… এবং ধরা পরলেন পাক বাহিনীর হাতে। তার ছেলে এবং আরও কয়েকজন ধরা পড়ল তার সাথে। পাক বাহিনী সেই প্রতিরোধের সূত্র ধরেই তাকে ধরেছে।
তখন আল্লারাখা খান পাক বাহিনীর কাছে সব স্বীকার করলেন যে তিনিই সেই পাঞ্জাবী ( তাদের ভাষায় গাদ্দার ) সেই দিন একক ভাবে তাদের ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি পাক বাহিনীকে বললেন মাত্র তিনটি রাইফেল নিয়ে তিনি একাই সুবিধা জনক স্থান থেকে তাদের প্রতিহত করেছিলেন। তার সঙ্গে আর কেউ ছিল না। পাকবাহিনী তাদের স্বজাতী বলেই হয়ত তাকে বিশ্বাস করল এবং তার ছেলে আর সঙ্গের কয়েকজন কে ছেড়ে দিয়ে আল্লারাখা খানকে আরো অন্য সাত জনের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করল। না আল্লারাখা খান কোন পদক পান নি। তাকে আমরা মনেও রাখিনি। হয়তো বাংলার মাটি তাকে মনে রেখেছে।
*
দুধর্ষ মুক্তি যোদ্ধা হাফিজুর রহমান খানের ঘটনা। তার কাছেই শোনা। তখন তিনি চুয়াডাঙ্গা পিলখানায়। কয়েকদিন ধরেই ইপিআরের বাঙালী অবাঙালী অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বাঙালী অফিসাররা সবাইকে (সৈনিকসহ) অস্ত্র হাতে রাখার গোপন নির্দেশ দিয়েছিলো, তিনিও সসস্ত্র ছিলেন তখন। তার রুমমেট ছিলো একজন পাকিস্তানী। ঘটনার দিন দুইজন একসাথে রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে অনেক রাত পর্যন্ত কার্ড খেলে-টেলে ঘুমিয়ে গেলেন। গভীর রাতে হঠাৎ প্রচন্ড গুলীর শব্দে ঘুম থেকে উঠে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই পিস্তল দিয়ে পাকিস্তানী রুমমেটকে গুলী করে বসেন তিনি। পরে আলো জ্বেলে দেখেন তার রুমমেটের হাতেও পিস্তল। তার গুলী মিস হলে তাকেই মরতে হতো। পরে রুম থেকে বের হয়ে বাঙালী অফিসার ও সৈনিকদের সাথে নিয়ে বিহারী সৈনিক ও অফিসারদের গ্রেপ্তার করেন তিনি এবং যশো, মেহেরপুর হয়ে ইন্ডিয়াতে সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দেন। তাদের নিয়েই ‘ফার্স্ট বেঙল রেজিমেন্ট’ গঠন করা হয়।
*
মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান খানের রনাঙ্গনের জীবনের আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা। তারা তখন ছোট্ট একটা দল নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। উদ্দেশ্য পাক বাহনীর উপর আক্রমন করা। পথে একটা পরিত্যাক্ত বাড়িতে রাত্রি যাপনের জন্য আশ্রয় নিলেন। অন্ধকার সাত সাতে বাড়ি! ঘরের ভিতর কোন আসবাব পত্র নেই শুধু শত শত টিন গাদা করা। তারই উপরেই ক্লান্ত শ্রান্ত মুক্তি যোদ্ধারা শুয়ে পড়লেন। এবং শোয়া মাত্র ঘুম … হটাৎ গভীর রাতে ফোঁস ফোঁস শব্দ! তিনি সহ কয়েকজন লাফিয়ে উঠলেন। দেখেন গোখরো সাপ, টিনের নিচ থেকে বেরুচ্ছে একের পর এক…। সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে পড়লেন। পরে দেখা গেল প্রতিটা টিনের নিচে চারটা পাঁচটা করে বিশাল বিশাল সব গোখরো সাপ ঘাপটি মেরে আছে। তারা সঙ্গে সঙ্গে বুট পরে যতগুলোকে পাড়া গেল পাড়িয়ে মারলেন। মোট ৯৮টা গোখরো সাপ মেরেছিলেন তারা। আর পালিয়ে গিয়েছিল কত গুলো তার কোন হিসেব নেই।
*
এই ঘটনাটা এক মুক্তি যোদ্ধার কাছে শুনেছিলাম, হাসতে হাসতেই ঘটনাটা বলেছিলেন তিনি। একবার তাদের এক শক্ত ঘাটিতে পাক বাহিনী গভীর রাতে এ্যাটাক করে বসল। সারা রাত যুদ্ধ হল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার পাক বাহিনীর একটা গুলি বা শেলও এসে তাদের ঘাটিতে পরল না। পর দিন সকালে পাক বাহিনী সুবিধা করতে না পেরে সরে গেলে পরে… মুক্তি বাহিনীর দল বিষয়টা সরেজমিনে তদারক করতে গিয়ে অবাক হলেন হাসিও পেল তাদের। পাক বাহিনী একটা বড় পুকুরের পারে পজিশন নিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে তারা টের পায় নি, পুকুরের অন্যপারটা ছিল অনেকটা উঁচু ফলে তাদের সমস্ত শেল বা গুলি সব এসে পড়েছে পুকুরের অন্য পারে। পুকুরের অন্যপার বিধ্বস্ত বাংলার মটিই তাদের প্রতিরোধ করেছে তারা টের পায় নি। পাক বাহিনী নাকি পৃথিবীর সেরা বাহিনীর একটি!!
*
দুই ভাই শহরে চাকরী করে। বিপদ বুঝে পরিবার পরিজন নিয়ে চলে এসেছে গ্রামে। গ্রাম থেকেই দুই ভাই প্রতিদিন অফিস করে। দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন কথা বলে না। খুব সকালে দুই ভাই বাসে করে অফিস চলে যায় সন্ধ্যার পরে ফিরে আসে। এই চলছিল। একবার ফেরার পথে আর্মীরা তাদের বাস থামাল। সবার ব্যাগ চেক করা হবে। দুই ভাই পাশাপাশি বসে। বসা অবস্থায় চেকিং চলছে। বাসে খুব বেশী যাত্রীও নেই। বড় ভাইয়ের ব্যাগ চেক করল এবার ছোট ভাই, ছোট ভাই নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকলো। তার ব্যাগে পাওয়া গেল ছটা তাজা গ্রেনেড। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে নিয়ে গেল আর্মীরা ছোট ভাই ফিরেও তাকাল না হতভম্ব হয়ে বসে থাকা বড় ভাইয়ের দিকে, যেন চিনেই না। চিনলেই বিপদ তাই চিনেনি সে। তারপর একদিন দেশ স্বাধীন হল। বীরের মত ফিরে এল কত নাম নাজানা সব মুক্তিযোদ্ধা… শুধু ছোট ভাই ফিরে এল না। কি করে ফিরবে? দেশ মাতৃকার জন্য কাউকে কাউকেতো ফিরে আসলে চলে না!
*
১৯৭১ সেপ্টেম্বর মাস। এক মুক্তিযোদ্ধা গোপনে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এল গভীর রাতে। রাজাকাররা টের পেয়ে বাড়ি ঘিরে ফেলল। বাড়ির সবাই পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে সাহায্য করল তাদের যোদ্ধা ছেলেকে। রাজাকাররা তাকে না পেয়ে ধরে নিয়ে গেল অন্য দুই ভাইকে। পরদিন আর্মী ক্যাম্পে আত্মসমর্পন করল যোদ্ধা ভাই, ছোট দুই ভাইয়ের মুক্তির বিনিময়ে। তারপরের ইতিহাস নির্মম। নির্মম ভাবে বেয়নেটে খুচিয়ে হত্যা করা হল তাকে। টর্চার সেলের শক্ত কংক্রিটের উপর গড়িয়ে গেল তার গাঢ় রক্তের ধারাবাংলার সবুজ ঘাসের দিকে!
*
বড় বোন তেমন সুন্দরী নয়। শ্যামলা গড়ন ছোট খাট। কিন্তু ছোট বোনটা অপরূপ সুন্দরী। নজর পড়ল রাজাকারদের তার উপর। বড় বোন আর ঝুঁকি নিল না। তার প্রেমিককে রাজী করাল তার ছোট বোনকে বিয়ে করতে। একটি প্রগাঢ় প্রেমের সমাধী হল। রাজাকারদের হাত থেকে বেঁচে গেল ছোট বোন। বড় বোন আর বাকি জীবন বিয়েই করল না।
*
লোহাগড়া গ্রামের ঘটনা। আর্মী ঢুকেছে গ্রামে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলিয়ে দিচ্ছে। সবাই পালাচ্ছে। এক মা তার শিশু কণ্যাকে কাথায় জড়িয়ে পালাল। নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে কথা খুলে দেখে সে ভুল করে কোলবালিশ প্যাচানো কাথা নিয়ে চলে এসেছে। পাগলের মত ছুটে গলে তার বাড়িতে। বাড়ি তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে! পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার তিন মাসের শিশু কন্যা। হায় মায়ের হাহাকারে…. কেঁপে উঠল অগ্নি দগ্ধ গ্রাম।
*
১৯৭১ এর ছাব্বিশে মার্চ। শহর ছেড়ে সবাই পাগলের মত পালাচ্ছে। কিন্তু কিভাবে পালাবে? কোন যানবাহন নেই। এই সময় দেখা গেল একটা পুরোনো বেডফোর্ড গাড়ি নিয়ে এসে হাজির এক বৃদ্ধ। সবাই উঠে গেল সেই বাসে বিশেষ করে নারী আর শিশুরা। বাস ছুটলো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। পৌঁছে দিল সেই বৃদ্ধ। কিন্তু ঐ এলাকার লোকজন চিনে ফেলল সেই বৃদ্ধ ড্রাইভারকে ‘আরে এতো নান্টু বিহারী!’ তাকে মেরে ফেলা হোক। কিন্তু না নারী আর শিশুরা তাকে রক্ষা করল। সেই বৃদ্ধ নান্টু বিহারী এরপরও কয়েক ট্রিপ বাঙালী নারী শিশুকে পৌঁছে দিয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে!
*
আড়পাড়া গ্রামের রাস্তার মোড়ে বসে থাকতেন দু’জন তরুণ। রাস্তাটি যশোর শহর থেকে ঢাকা পর্যন্ত গেছে। যারাই ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন তাদেরকে এক গ্লাস পানি আর মুড়ি কিংবা ভিজানো ছোলা খেতে দিতেন তারা। শিশুদের জন্য জোগাড় করে আনতেন দুধ। তাদের বাবা মা অনুমতি দেননি মুক্তিযুদ্ধে যেতে কিন্তু স্বাধীনতার দিন পর্যন্ত তারা দুজন এভাবেই সেবা করেছেন সাধারণ মানুষকে। এরা দু’জন কি কোন একজন অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধার চাইতে কম?
*
ঢাকা শহরের নভেম্বর মাস। শান্তিবাহিনী, রাজাকার আলবদররা এস সৃষ্টি করেছে। বাবা মা শিশু কন্যাকে নিয়ে পালাতে পারেননি। সারাদিন রাত এমন নিঃশব্দে থাকতেন যেন মনে হয় বাড়িতে কেউ নেই। শিশুটি সারাদিন চুপচাপ থাকলেও রাত্রে কাঁদতো। তাদের চিৎকার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পাশে শিশু কন্যাটি কেঁদে ওঠে আর রাজাকাররা টের পায় তাই মা বাচ্চাকে দুধের সাথে মিশিয়ে ঘুমের অষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন। অষুধের ডোজ বেশী হয়ে গিয়েছিলো মেয়েটির ঘুম আর ভাঙ্গেনি।
*
বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে এক গ্রামীণ নববধূ আর তার সদ্য বিবাহিত স্বামী। স্বামীর হাতে রংচংয়ে টিনের ট্রাঙ্ক। তারা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। হয়ত বাসে করে তারা যাবে দূরে কোথাও… তাদের নতুন সংসারে। স্বামী শক্ত করে একহাতে ধরে রেখেছে প্রিয়তমা স্ত্রীর হাত। দুজনের চোখেই আগামী দিনের স্বপ্ন!
কিন্তু বাস এলো না, এল একটা মিলিটারী কনভয়। সেখান থেকে লাফিয়ে নামলো কিছু মিলিটারী। নতুন স্বামী স্ত্রী দেখে কিছুক্ষণ তারা তাদের ভাষায় মোটা দাগে ঠাট্টা তামাশা করল। তার কিছুই বুঝলো না গ্রাম্য সহজ সরল স্বামী-স্ত্রী।
তারপর ঘটল সবচে ভয়ংকর ঘটনা। নেমে আসা মিলিটারীরা নববধূকে টেনে নিয়ে তুলে ফেলল কনভয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব স্বামী দাঁড়িয়ে রইল রংচংয়ে ট্রাঙ্ক হাতে… মূর্তির মত। একটা মিলিটারি তখনও কনভয়ে উঠতে পারেনি। হঠাৎ যেন খেপে গেল স্বামিটি। একটা থান ইট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই মিলিটারিটির উপর। মুহূর্তে পাক আমীর হেলমেট পড়া মাথাটা হেলমেট সহই ছেচে ফেলল সে, তারপর সেই থান ইট হাতে কনভয়ে উঠতে গেল… যেন সবগুলোকে সে ঐ ভাবে হত্যা করবে, তার আগেই কনভয় থেকে গুলি… ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল তরুন স্বামীটি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার নব বধূ স্ত্রী… কি ভেবেছিল সে তখন…? না সেই নববধূকেও আমরা আর ফিরে পাইনি এই স্বাধীন দেশে। দেশমাতৃকার জন্য একটা ছোট্ট স্বপ্ন কি ভংয়কর প্রতিশোধের দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল কেউ জানলো পেল না।
*
এই গল্পটিও আমি লেখক সাঈদ হাসান দারার কাছে শুনেছি। এটাও পাবনার ঘটনা। অদ্ভুত এক মানবিক ঘটনা। পাবনার পাঁচ ভাই। পাঁচ ভাই-ই ভয়ানক মুক্তিযোদ্ধা। সবার বড়ভাই পাক আর্মীদের কলজে কাঁপানো কমান্ডার। যুদ্ধ তখন প্রায় শেষের দিকে। ক্রমে ক্রমে দেশ স্বাধীন হচ্ছে। পাক আর্মীরা পালাচ্ছে। এই সময় তাদের সবচেয়ে ছোট ভাই বাবুল শহীদ হয়ে গেল। তারা তখন পলাতক এক আর্মী দলকে ধাওয়া করে এক পাকিস্ত নী ক্যাপ্টেনকে ধরে ফেললেন। তাকে জীবিত অবস্থায় মায়ের কাছে নিয়ে এল চার ভাই। উদ্দেশ্য মায়ের সামনে তাকে জবাই করে ছোট ভাই বাবুলের হত্যার প্রতিশোধ নেবে, তাতে যদি মায়ের কষ্ট একটু লাঘব হয়।
বাড়ির উঠানে সেই ক্যাপ্টেনকে শোয়ানো হল জবাই করা হবে, মাকেও ডাকা হল। বড় ভাইয়ের হাতে ধারালো গরু জবাইয়ের ছুরি। এই সময় মা ছুটে এসে সবাইকে হতবাক করে পাক ক্যাপ্টেনকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন “আজ থেকে এই আমার বাবুল।” সবাই হতভম্ব! সেই পাক আর্মী হাউ মাউ করে করে কেঁদে ফেলল। এক আশ্চর্য মানবিক নাটক যেন সেই বাড়ির উঠোনে ঘটলো। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা মায়ের এই আবেগকে মেনে নিল। ক্ষমা করল পাক ক্যাপ্টেনকে। মেনে নিল ছোট ভাই বাবুল হিসেবে।
এরপরের গল্প আরো নাটকীয়। সেই পাক ক্যাপ্টেন সেই গ্রামেই সেই মায়ের আশ্রয়েই থেকে গেল। সেই গ্রামেই বিয়ে করল। সংসার পাতল। পরবর্তীতে সে বিরাট শিল্পপতি হয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আন্দোলনে ভুমিকা রেখেছে। এখনো সে নাকি পাবনাতেই আছে।
*
বরিশালের ঘটনা। একটা পরিবার একটু গোড়া পরিবারই বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অত মাথা ব্যাথা নেই তাদের। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে কিন্তু তাদের বড় ছেলে নিখোঁজ। এনিয়েও তাদের বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই, তাদের বড় ছেলে একটু পাগলাটে আছে তবে ছেলে আর যেখানেই যাক মুক্তিযুদ্ধে যে যাবে না এতে তারা মোটামোটি নিশ্চিত। কিন্তু বাবা-মার ভাবনায় একটু গলদ ছিল বড় ছেলে তখন রীতিমত মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। এ খবর স্থানীয় রাজাকাররা পর্যন্ত জানে কিন্তু বাবা-মার দৃঢ় বিশ্বাস তার ছেলে ‘ঐ রকম নয়। ছেলে একটু পাগলাটে বটে হুটহাট করে এদিক ওদিক চলে যায় এর বেশি কিছু নয়। তারপর হঠাৎ এক গভীর রাতে ছেলে এসে হাজির। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
–কিরে তুই কই ছিলি?
–একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। তাও ভাল বাবা মা নিশ্চিত। ছেলে রাতে ঘুমাল। দিনে ঘরে বসে নাস্তা করল। দুপুরে বলল
–মা গোসল করব কর
–না মানে পুকুর থেকে এক বালতি পানি এনে দাও ঘরে
–কেন, পুকুর থেকে পানি আনতে হবে কেন? তুই বাইরে পুকুরে যেয়ে গোসল করতে পারিস না?
ছেলে কেমন যেন বাইরে পুকুরে যেতে চায় না। মা একরকম ঠেলে ইলেই পাঠালেন বাইরের পুকুরে। ব্যাস। রাজাকাররা নজর রেখেছিল তক্কে তক্কে ছিল। বাড়ির ভিতরের কেউ জানল না পুকুর ঘাট থেকে নিঃশব্দে ধরে নিয়ে গেল তাকে। আর ফিরে এল না সেই তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধা। পরে মা সব জানতে পেরে হাউ মাউ করে কাঁদলেন আর চেঁচাতে লাগলেন ‘আমিই খুনি… আমিই খুনি, বলে…’
*
এই গল্পটা এক প্রবাসীর কাছে শোনা। তিনি বহুদিন ধরে আমেরিকায় আছেন। আর দেশে ফিরে আসবেন বলে মনে হয় না, তার সাথে পরিচয় হয়েছিল ফেরিঘাটে। চা সিগারেট খেতে খেতে পরিচয় তারপর অনেক গল্প হল তার সাথে। এই গল্পটা সেই সময় তার কাছেই শোনা। তো ঘটনাটা হচ্ছে…
তিনি একদিন ভাড়া করা ট্যাক্সিতে করে যাচ্ছিলেন দূরে কোথাও। তার ট্যাক্সি ড্রাইভার বৃদ্ধ এক পাকিস্তানী। তার কি হল তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলা শুরু করলেন। পাকিস্তানী ড্রাইভার নীরবে শুনে যাচ্ছে। তিনি বললেন ঐ যুদ্ধে তার দুই ভাই শহীদ হয়েছেন মাতৃভূমির জন্য…
হঠাৎ পাকিস্তানী ড্রাইভার হাইওয়েতে এক পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল। তিনি একটু অবাক হলেন। কি হল ড্রাইভারের। তিনিও কি ভেবে নেমে এলেন। নেমে দেখেন পাক ড্রাইভার উপুড় হয়ে বসে হাউ মাউ করে কাঁদছে। তাকে দেখে ছুটে এসে পা চেপে ধরলো পাক ড্রাইভার। উর্দুতে বলল–
“আমাকে ক্ষমা কর। ঐ সময় আমি একজন পাকিস্তানী সোলজার ছিলাম।… আমাকে ক্ষমা কর… আমাকে ক্ষমা কর… এখন বুঝি আমরা একটা ভুল করেছিলাম…।”
ভদ্রলোক অবশ্য তাকে নাকি বলেছিলেন “তুমি একা ক্ষমা চাইলেতো হবে না। পুরো জাতিকে ক্ষমা চাইতে হবে।”
*
‘ডক ইয়ার্ডের উপর ওরা আমার বাবা মাকে হত্যা করে… আমার সামনেই… আরো লোকজন ছিল…’ এইভাবেই তিনি বর্ণনাটা করেছিলেন আমাকে খুব স্বাভাবিক গলায়। বাবাকে দেখলাম বুকে হাত দিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন। মা আমার দিকে চেয়ে ছিলেন হাত দিয়ে আমাকে কি একটা ইশারা করছিলেন… পেটে গুলি খেয়ে যখন তিনি আস্তে আস্তে বসে পড়ছিলেন তখনও হাত দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছিলেন মা। আমি তখন বুঝতে পারিনি তিনি ঠিক কি ইশারা করেছেন। একটু পরে পাকিস্তানী আর্মীটা যখন ঘুরে দাঁড়াল আমাদের দিকে (তখনও তার অস্ত্রের নল দিয়ে ধুয়া বেরুচ্ছিল) সেও দেখি ঠিক আমার মায়ের মত হাত দিয়ে ঐ ইশারাটাই করছে… তখন বুঝতে পারলাম আমাদের চলে যেতে বলছে। মা ঠিক ঐ ইশারাটাই করেছিল। আজও চোখ বুজলে মায়ের ইশারাটা দেখি… স্পষ্ট। (এক শহীদের ছেলের কাছে শোনা)
*
আমার পরিচিত এক লোকের খালার ঘটনা। তার মুখেই শুনি..
ঘটনাটা আমার খালার, নোয়াখালি এলাকার ঘটনা। আর্মী এক গৃহস্থ বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আমার খালা তখন বটিতে মাছ কুটছিলেন। তার কি হল হঠাৎ ঘরের ভিতর পুরুষ মানুষ দেখে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারেন নি যে এরা পাকিস্তানী আর্মী। তিনি মাছ কাটার বটি নিয়ে তেড়ে উঠেন। আর্মীও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে পড়ে।
একটু পড়ে ফের আসে গুলি করতে করতে। তখন খালা চালের ডুলির পিছনে লুকিয়ে পড়েন। পাকিস্তানী আর্মীরা যখন ঘরে ঢুকলো… হয়ত খালাকে খুঁজছে তখন কোত্থেকে এক বিশাল বাস্তু সাপ বেরিয়ে আসে! ভয় পেয়ে আর্মীরা সরে পড়ে। পরে খালা খালু অবাক হন ঘরের ভিতর বাস্তু সাপ এল কোত্থেকে। ঘরে কার্বলিক এসিড দেয়া থাকে সাপ আসার কথা নয়। তবে আশেপাশের প্রতিবেশীদের ধারণা জ্বীন নাকি সাপের বেশ ধরে খালাকে রক্ষা করেছে!
খালা অবশ্য এসব বিশ্বাস করেননি। হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন।
*
আমাদের পরিবারের পরিচিত একজন। একাত্তর সালে তিনি ছিলেন তরুণ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর থেকে তিনি নিখোঁজ। নিখোঁজ মানে সবাই ধরে নিয়েছিল তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। খুবই বিপ্লবী ধরনের মানুষ ছিলেন তিনি। বছরের মাঝামাঝিতে তাকে হঠাৎ দেখা গেল ফকিরাপুলে প্রকাশ্যে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে। দাড়িমোচ গজিয়ে গেছে, উষ্ণুখু চুল। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে প্রায় রাস্তার মাঝে আইল্যান্ডের পাশে দাঁড়ানো। হঠাৎ তাকে দেখে একজন ছুটে এল।
‘আরে মন্টু ভাই আপনি? এতদিন কোথায় ছিলেন? এখানে দাঁড়িয়ে কেন?
মন্টু ভাই ফিসফিস করে বললেন, ‘আমার সাথে কথা বল না। এখনি সরে পড়।’
ছুটে আসা তরুণ অবাক হয়ে বলল, ‘কেন কি হয়েছে?’
‘বললাম না কথা বল না এখান থেকে পালাও…’ ছুটে আসা তরুণটি কিছু না বুঝে সরে পড়তে গেল ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। সিভিল পোষাকে দুজন পাক আর্মী এসে ধরে ফেলল তরুণকে। বিষয়টি আর কিছু নয়। মন্টু ভাই একজন গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। ধরা পড়েছেন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে। পাক বাহিনীর একটা কৌশল, তাকে প্রকাশ্যে দাঁড় করিয়ে তার সাথে যারা যারা কথা বলতে এসেছে তাদের ধরেছে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে। বলাই বাহুল্য, তারা কেউই জীবিত ফিরে আসেন নি রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলায়!
*
এ গল্পটি শুনেছি পাবনার সাঈদ হাসান দারার কাছে। সাঈদ হাসান দারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসাধারণ কিছু উপন্যাস লিখেছেন। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। ঘটনাটা পাবনার। শহরের বড় একটি হোটেলের মালিকের সুন্দরী দুই মেয়েকে ধরে নিয়ে গেল পাক আর্মীরা তাদের ক্যাম্পে। স্তব্ধ হয়ে গেছেন সেই হিন্দু হোটেল মালিক। কি করবেন তিনি এখন?
মাসখানেক পর তার কাছে এল পাক আর্মীরা এক প্রস্তাব নিয়ে। প্রস্ত বিটা হচ্ছে তার দুই মেয়েকে তারা ছেড়ে দিবে (ইতোমধ্যে আরো অনেক নতুন মেয়েদের ঢুকানো হয়েছে ক্যাম্পে কাজেই যারা পুরানো হয়ে গেছে তাদের ছেড়ে দিয়ে কিছু সুবিধা যদি পাওয়া যায় মন্দ কি!)। বিনিময়ে আমী ক্যাম্পে প্রতিদিন খাওয়া দাওয়া সাপ্লাই করতে হবে। হিন্দু মালিক দৃঢ় স্বরে বললেন ‘না’! অবাক হয়ে গেল আর্মীরা। নিজের মেয়েকে ফিরিয়ে দিবে তারপরও কোন বাবা তাদের কথা শুনবে না! তখন তখনই তাকে প্রকাশ্যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হল। না, এই বীর বাবাকে কোন পদক দেই নি আমরা, যিনি তার দুই মেয়েকে আর নিজেকে উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার জন্য। বাংলার মাটি শুধু তার রক্ত শুষে নিয়েছে নীরবে।
*
একাত্তর পাবলিক বাস যাচ্ছিল। হঠাৎ পাকিস্তানী আর্মী চেকপোস্টে থামানো হলো বাসটি। যাত্রীদের সবাইকে নামালো। অবশ্য তখন যাত্রীও খুব বেশী ছিল না। সবাইকে রাস্তার অন্যপাশে পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হল। এক লোকের কোলে ছিল একটা দুধের বাচ্চা। বাচ্চাটি একটু পর পর না বুঝে দাঁতহীন মারি বের করে হাসছিল। পাক আমীর এক অফিসার সোলজারকে ডেকে কি বলল। সোলজারটি বাচ্চা কোলে লোকটিকে সরিয়ে দিল। তারপর কি আশ্চর্য সারি বদ্ধ লোকগুলো অবাক হওয়ারও সময় পেল না। গুলি শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তে সবাই শেষ। বাচ্চা কোলের লোকটি ভাবল সে কি তবে তার বাচ্চার মিষ্টি হাসির কারনে বেঁচে গেল?
না, ঘটনা আরও বাকি ছিল। এর পর লোকটির কোল থেকে বাচ্চাটিকে কেড়ে নিয়ে নেয়া হল। লোকটিকে মারা হল বেয়নেট চার্জ করে আর বাচ্চাটিকে? … না এটা লেখার ভাষা আমার নেই। শুধু একটা ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সেগুন বাগিচা মুক্তিযুদ্ধ যাদু ঘরে একটা ছোট বাচ্চার পোশাক আছে (আমি যে বাচ্চাটির কথা লিখেছি সেই বাচ্চার পোষাক এটি নয়) সেই ছোট্ট শিশুটিকে পাক আর্মীরা কিভাবে হত্যা করেছিল তার বর্ণনা সেখানে আছে…!
*
এ ঘটনাটি শুনেছি দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা কচি ভাইয়ের কাছে। গত বছর (২০০৯ইং) তিনি মারা গেছেন। খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন। তিনি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা তা কখনওই বড় গলা করে বলতেন না। আশ্চর্য এক মানুষ। তার কাছেই শুনেছি ঘটনাটি। তবুও’র পাঠকের সাথে শেয়ার করি…
সম্মুখ যুদ্ধে হঠাৎ একজন মুক্তিযোদ্ধা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। পাক আর্মীরাও তার দিকে তেড়ে এল দল বেঁধে। মুক্তিযোদ্ধা কোন উপায় করতে না পেরে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। পাক আর্মীরা ঘিরে ফেলল সেই বাড়িটি। এখন উপায় কি? বাড়ির মালিক এক বৃদ্ধ মা আর তার বোবা অসুস্থ্য পুত্র। মা যে কাজটি করলেন তা শুধু বাংলাদেশের একজন দেশপ্রেমিক সাহসী মায়ের পক্ষেই সম্ভব। তিনি মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে অস্ত্রটি কেড়ে নিয়ে তার বোবা ছেলের হাতে ধরিয়ে ঠেলে বের করে দিলেন বাসা থেকে। পাক আর্মীরা তার বোবা ছেলেকে অস্তহাতে দেখে মুক্তিযোদ্ধা ভেবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে মারে। শুধুমাত্র একটি ভুখন্ডের, একজন অচেনা অজানা মুক্তিযোদ্ধার জন্য, একজন মায়ের কি অসাধারণ আত্মত্যাগ।
*
আমার বড় ভাই হুমায়ুন আহমেদ-কে পাকিস্তানী মিলিটারীরা ধরে নিয়ে গিয়ে ভয়াবহ টর্চার করেছিলো। সেটা ছিলো ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস। পারিবারিক আড্ডায় আমরা ভাইবোনরা নানারকম গল্প করি কিন্তু সে এই ব্যাপারটা মোটেই বলতে চায়না। একবার অবশ্য সে এটা নিয়ে তার কোন একটা লেখায় একটু লিখেছিলো সেটাও খুব বিস্তারিত নয়। অনেক পরে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় (শাহাদাৎ চৌধুরী সম্পাদিত) আমার বন্ধু সাংবাদিক মোস্তাক হোসেন পাক বাহিনীর বন্দি শিবিরে’ নামে একটা কভার স্টোরী করে। সেটা সে সময় খুব আলোড়ন তোলে। সেখানে অনেক বিখ্যাত লোকের পাক বাহিনীর বন্দি শিবিরের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী ছিলো (তবে হুমায়ুন আহমেদেরটা ছিলো না)। তখন আমার নিজের একটা প্রকাশনী ছিলো, নাম ছিলো দিনরাত্রি প্রকাশনী। আমি মোস্তাকের ঐ বইটার একটা পেপারব্যাক সংকলন বের করি আমার প্রকাশনী থেকে। সেই বইয়ে মোস্তাক হুমায়ুন আহমেদের অভিজ্ঞতাটা অন্তর্ভূক্ত করে। সেটা ১৯৮৯ সালের কথা। সেই বই এখন আর নেই। হঠাৎ করে পুরনো বই ঘাটতে ঘাটতে সেই বইটা পেয়ে গেলাম। মাসুক হেলালের প্রচ্ছদ আঁকা বইটা উল্টে-পাল্টে মনে হলো তবুও’র পাঠকদের সাথে বড় ভাইয়ের এই ঘটনাটা তবুও’র এই সংখ্যায় শেয়ার করা যাক। দাদাভাইয়ের (আমরা তাকে দাদাভাই ডাকি) নিজের মুখের এই কাহিনীটা এরকম…
আমার বাবা পাক মিলিটারীর হাতে মৃত্যুবরণ করলেন ৫ মে, ১৯৭১। তখন আমি মা ও ভাইবোনকে নিয়ে বরিশালের গ্রামে পালিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে অনেক কষ্টে নানার বাড়ি ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে উপস্থিত হলাম। জুলাই মাসের দিকে সেখানে থাকাও বিপজ্জনক হয়ে উঠলো। মিলিটারীরা তখন যুবক ছেলেপুলেদের খুঁজছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গ্রামে লুকিয়ে আছে মানেই অন্যকিছু। কাজেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আমি আমার ছোটভাই জাফর ইকবালকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। সে উঠলো যাত্রাবাড়িতে এক আত্মীয়ের বাসায়, আমি মহসিন হলে। হলগুলি তখন নিরাপদ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত। মিলিটারীরা তখন দেখাতে চেষ্টা করছে সব স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা, হল খোলা। তখন রোজার মাস। এক দুপুরে মিলিটারী হল ঘেরাও করলো। হল থেকে আমাকে এবং আমার সঙ্গে আমার আরও দুজন ছাত্র ও একজন দারোয়ানকে ধরে নিয়ে গেলো। ইতিহাসের শিক্ষক গিয়াসুদ্দিন সাহেবও (আমার হাউস টিউটর) ধরা পড়েন। পরে তিনি আলবদরদের হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। মনে হয় হলের ভেতর থেকেই পাক বাহিনীর কোন চর আমাদের ধরিয়ে দিয়েছিলো, কারণ মহসিন হলে সে সময় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জনের মতো ছাত্র ছিলো। ছাত্রদের সবাইকে একটা দরজা জানালা বন্ধ গাড়ির চারপাশে ঘুরানো হচ্ছিলো। গাড়ির ভেতর থেকে কেউ আমাদের চিহ্নিত করে। আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু তার কথা শুনতে পারছিলাম। আমি যখন গাড়ির চারদিকে ঘুরছি তখন ভেতর থেকে বলা হলো- “এই সে।” আমার ধারণা সে হলেরই কেউ, তবে ধারণা ভুলও হতে পারে। আমাদের ধরে নিয়ে প্রাথমিক ইন্টারোগেশন হয় আনবিক শক্তি কমিশনের একতলায়। সেখানে আমাদের দোষী সাব্যস্ত করে দরজা জানালা বন্ধ একটা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের কোন একটা থানায় বা পুলিশ ব্যারাকে। তবে জায়গাটার নাম সঠিক মনে করতে পারছি না। আমাদের রাখা হয়েছিলো। লম্বা একটা ঘরে। বেশীর ভাগ বন্দি ঘরে শুয়ে বা বসে থাকতেন। ঘরে গোটা ছয়েক দড়ির চারপাই এবং কয়েকটা চৌকি ছিলো। প্রতিটিতে বেশ কয়েকজন বন্দি ছিলেন। কেউ কেউ জড়াজড়ি করে বসে ছিলেন। আমরা ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম অনেকেই সেখানে অনেকদিন ধরে আছেন। ভোর বেলা কাউকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়, তারা আর ফিরে আসেনা। আমাদের মধ্যে একজন মৌলানা ছিলেন। তিনি সারাক্ষণই উচ্চস্বরে কোরান পড়তেন। বন্দি শিবিরে নামাজের ইমামতি করতেন। দু’জন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত চেহারার হিন্দু বৃদ্ধও ছিলেন। এই দু’জন খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এদের দু’জনকে কিছুই খেতে দেখিনি। এরা অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছেন। এদের কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। জানি না তারা বেঁচে আছেন কিনা। মিলিটারীদের মুখের ওপর ‘আমরা তোমাদের অন্নজল গ্রহণ করবো না’ বলা সহজ কথা না। বন্দি শিবিরে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। জীবনের এই অংশটা আমি ভুলে থাকতে চাই। আমাদের বন্দি শিবিরে নির্যাতনের দায়িত্বে ছিলো তিনজন। এদের একজন শ্বেতী রোগগ্রস্থ। সে মানুষ নয়, দোজখ থেকে উঠে আসা কোন শয়তান। আমি এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে ঐ লোকটাকে দেখি। নির্যাতনের বর্ণনা আমি দিচ্ছি না, তবে একটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। এ থেকে নির্যাতন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হবে। আমার একজন সঙ্গী ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোহাম্মদ হোসেন। মিলিটারীর হাত থেকে মুক্তি পাবার পর সে সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। রাতে ঘুমুতে পারতো না। বিকট চিৎকার করতো। কয়েকজন মিলে তাকে ধরে রাখতে হতো। আমার অন্য সঙ্গী কবি রফিক কায়সারের জীবনেও এই নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া নানানভাবে তীব্রভাব ফেলে বলে আমার ধারণা। আমি আগেই বলেছি মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে আমি শ্বেতরোগগ্রস্থ ঐ লোকটাকে দেখি। ঘুম ভেঙে যাবার পর বাকি রাত আমার ঘুম হয় না। আমি এই সব কথা মনে করতে চাই না- ভুলে যেতে চাই।
*
এবার আমার নিজের জীবনের কিছু ঘটনা বলি। আমার বয়স এখন ৫২ (২০১০ইং) চলছে। হঠাৎ মরে টরে গেলে এই গল্পগুলো হয়ত কারো জানা হবে না। বরং তরুন পাঠকদের সঙ্গে একটু শেয়ার করি।
এই কিছুদিন আগে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখে চমকে উঠলাম। এতো আমার জীবনের ঘটনা। অ্যাডটা ছিল এরকম… পাক আৰ্মী আক্রমন করেছে সবাই পালাচ্ছে। নদী পার হতে হবে। নৌকায় জায়গা হচ্ছে না বলে ছোটভাইকে রেখে বড়রা সবাই নদী পার হচ্ছে। আর্মীরা আসলে ছোটজনকে নিশ্চয়ই মারবে না… এইরকম একটা ঘটনা নিয়ে কোন একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির অ্যাড!
এবার আমার জীবনের ঘটনাটা বলি। ১৯৭১ সালে আমি সিক্সে পড়ি। জায়গাটা ময়মনসিংহের কোন এক জায়গায়। মামা আর আরও কয়েকজনের সঙ্গে যাচ্ছিলাম ভারতের মহেষখালি ক্যাম্পে। হঠাৎ ওই অ্যাডের মত পাক আর্মী গুলি করতে করতে ছুটে আসছিলো। আমরা সবাই ছুটছিলাম। পিছনে গুলির শব্দ আর আমরা সরু একটা পথ ধরে ছুটছি। হঠাৎ সামনে পড়ল একটা বড়সড় খাল। ওটা পার হতে হবে। কোন নৌকা নেই। কি করা? সবাই ভয়ে অস্থির। আমিও প্রচন্ড ভয় পেয়েছি। কি করব আমরা এখন? এদিকে গুলির শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হঠাৎ আমাদের দলের একজন কোত্থেকে ছোট কলাগাছের একটা ভেলা নিয়ে এল। মুশকিল হচ্ছে ওই ভেলায় তিনজনের বেশী ওঠা যায় না। একজন ভেলা বেয়ে নিয়ে যাবে তারপর ফিরে আসবে আবার দুজনকে নিয়ে যাবে। এই করে পার হতে হবে একে একে। আমি ভয়ের চোটে ভেলায় উঠে পড়লাম সবার আগে। আমাকে নামিয়ে দেয়া হলো। বলা হল “তুমি সবার পড়ে আস তুমি ছোট তোমাকে মারবে না আর্মীরা”। (ওই অ্যাডের মতই!) আমি রইলাম। তিনজন রওনা হয়ে গেল। সময় যেন আর যায় না। তিনবারে তিন গ্রুপ পার হল। ওদিকে গুলির শব্দ আর মানুষের আর্তচিৎকার ক্রমে ক্রমেই এগিয়ে আসছে। জীবনে এত ভয় আর কখনো পাইনি। সবার শেষে এল আমার পালা কোনমতে পার হলাম। তারপর দে ছুট…। পরে শুনেছিলাম আমাদের পিছনের গ্রামে ম্যাসাকার করেছিল ওরা। খাল পর্যন্তও এসেছিল কিন্তু খালটা আর পার হয়নি তারা।
*
হুলার হাট থেকে একটা দোতলা লঞ্চে করে আসছিলাম। ঠিক কোথায় যাচ্ছিলাম এখন আর মনে নেই তবে সম্ভবত ঢাকার দিকেই। সঙ্গে ছিল আমার পিঠাপিঠি বড়বোন শিখু আর এক মামা আর মামী। আমরা তখন পিরোজপুর থেকে ভাগে ভাগে পালাচ্ছিলাম। পিরোজপুরে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে তখন হুলিয়া ছিল। আমার বাবাকে পাক আর্মীরা ইতিমধ্যে হত্যা করেছে, আমরা অবশ্য জানতাম না। আমাদের ধারনা ছিল তাকে পাক আমীরা ধরে নিয়ে গেছে। আসলে তাকে ৫মে হত্যা করা হয়। আমাদের গন্তব্য তখন, ময়মনসিংহ নানার বাড়ি। তখন বেশীরভাগ রুটই বন্ধ লঞ্চে করে ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহ যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই।
একটা ঘাটে লঞ্চে কিছু আর্মী উঠল। লঞ্চ চলছে। তারা লঞ্চে টহল দিচ্ছে। সবার হাতে অস্ত্র। লঞ্চের বেশীরভাগ মেয়েরাই বোরখা পরা। আমার বোনের তখন কিশোরী বয়স। সে অবশ্য বোরখা পড়া ছিল না। মামী বোরখা পড়া ছিলেন। আমরা ছিলাম দোতলার ডেকে।
হঠাৎ শুনতে পেলাম নিচতলায় হৈচৈ। তারপর ঝপাৎ পানিতে কিছু পড়ার শব্দ। তার পর গুলির শব্দ… আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। একটু পরে সব জানতে পারলাম…।
নিচে পাক আর্মী টহল দিচ্ছিল। তখন এক বোরখা পরা তরুণীকে উঠতে বলল তারা। তরুণী উঠে দাঁড়ালে তাকে বলল আর্মীদের সাথে তাকে কেবিনে যেতে হবে। তরুণীর বাবা বিপদ বুঝতে পারলেন। প্রথমে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলেন তারপর যা করলেন তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। তিনি হঠাৎ আর্মীদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে তাদের অবাক করে দিয়ে মেয়েকে জাপটে ধরে পানিতে লাফিয়ে পড়লেন। সেই শব্দই আমরা পেয়েছিলাম। আর্মীরা তখন এলোপাথারী গুলি করল পানিতে কিন্তু লাভ হয়নি। সে যাত্রা তারা বেচে গেলেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
অন্ততঃ যারা ওখানে ছিল তারা পরে বলল তারা দেখেছে মেয়ে আর বাবা ভাসতে ভাসতে দূরে সরে গেছেন। লঞ্চ খুব দ্রুত চলছিল বলে রক্ষা। তবে আর্মীরা লঞ্চ থামিয়েছিল, তবুও লাভ হয়নি কিছুই। বাকি রাস্তা আমরা জান হতে নিয়ে চললাম ঢাকার দিকে।
সাহসী সেই বাবা আর মেয়েকে; আজ এত বছর পর গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
*
আমাদের এক আত্মীয়া। লেখালেখি করেন। তার বেশ কিছু বইও আছে। ভাল লিখেন। তিনি অবশ্য মারা গেছেন। ১৯৭০ সালে তারা ছিলেন পাকিস্তানে, তার স্বামী ছিলেন পাকিস্তান পর্যটনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (পরে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পর্যটনের প্রধান হয়েছিলেন)। তারা তখন ঢাকায় বদলি হয়েছেন। তারা ঠিক করলেন দেশে ফিরবেন জাহাজে। একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে। তারপর এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে তারা জাহাজে করে রওনা দিলেন। বিশাল পাকিস্তানি জাহাজ। মধ্য সমুদ্রে সেই জাহাজ হঠাৎ ঝড়ে পড়ল। প্রচন্ড ঝড়। জাহাজ এই ডুবে তো ওই ডুবে। জাহাজে তখন এক পাকিস্তানী কর্ণেল ছিল সিভিল ড্রেসে। সে সোজা গিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে হুকুম করল- “যে কোন ভাবেই হোক জাহাজকে আশেপাশের কোন এক দেশের পোর্টে ভিরাও, কারন জাহাজ ভর্তি আর্মস অ্যামুনেশন আছে।” জাহাজের ক্যাপ্টেন হতভম্ব! “কি বলছেন? এটাতো যাত্রীবাহি জাহাজ, এখানে অস্ত্র গোলাবারুদ থাকবে কেন?”
পরে জানা গেল জাহাজের প্রায় সব যাত্রীই ছিল সিভিল ড্রেসে পাকিস্তানী আর্মী। যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। ষড়যন্ত্রের শুরু…!
*
এই গল্পটাও এক মুক্তিযোদ্ধার কাছে শুনেছিলাম। তিনি তখন মাত্র ইন্টার পাশ করেছেন। চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। অনেক সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। একবার এক যুদ্ধে তারা জীবিত অবস্থায় চারজন পাকআর্মী ধরে ফেললেন। ঠিক করা হলো এদের সবাইকে জবাই করে মারা হবে। কারণ গুলি নষ্ট করে লাভ নেই, এমনিতেই গোলাবারুদ কম। এক জঙ্গলের ভেতর ওদের লাইন করে দাঁড় করানো হলো। একজন একজন করে ডাকা হলো। প্রথম তিনজন বেশ সাহসীকতার সাথে এগিয়ে এসে গলা পেতে দিল, তাদের জবাই করা হল। কিন্তু চতুর্থজন যথেষ্ট তরুণ এবং প্রচন্ড ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একটু থমকে গেলেন তার কান্নাকাটিতে। তিনি তখন এক অদ্ভুত প্রস্তাব করলেন- “ঠিক আছে যাও, দশ পর্যন্ত গুনব এর মধ্যে তুমি দৌড়ে যদি আমাদের গুলির রেঞ্জ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারো তাহলে বেঁচে যাবে।”
তিনি বললেন–“এক…”। তরুণ পাক আর্মী ছুটতে লাগল… মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আর দুই বললেন না। তাকে পালাতে দিলেন।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে প্রচন্ড যুদ্ধের মধ্যেও মাঝে মাঝে মানবিক আচরন এটা তার জ্বলন্ত উদাহরন।
*
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কথা আমরা সবাই জানি। মাত্র সতেরো বছরের এই তরুণ (কিশোরই বলা উচিৎ) দেশ মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। নিজ হাতে দুটি গ্রেনেড ছুঁড়ে দিয়ে পাকিস্তানীদের দুটি মেশিনগান পয়েন্ট উড়িয়ে দিয়ে সেই মেশিনগানের গুলিতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন নিজে। বলা হয়ে থাকে তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে কম বয়সী সবচেয়ে বড় পদক পাওয়া দেশের জন্য আত্মউৎসর্গীকৃত প্রাণ। তার একটি ঘটনা আমরা অনেকেই জানিনা। যেটা আমি জানতে পেরেছিলাম তার উপর মুক্তিযুদ্ধের কমিকস করতে গিয়ে লেঃ কর্ণেল (অবঃ) বীর প্রতিক সাজ্জাদ জহীরের কাছ থেকে। যে ঘটনাটি হামিদুরকে দেশ মাতৃকার জন্য উজ্জীবিত করেছিলো প্রথম।
হামিদুর তখন চট্টগ্রামে বিডিআরের ট্রেনিং ক্যাম্পে (ইবিআরসি) ছিলেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানীদের হামলায় তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তখন তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিলোনা। ঘুমিয়ে ছিলেন সবাই। সেই সময় হামলা করে বর্বর পাক আর্মি। হামিদুরও অন্য কয়েকজনের সঙ্গে পালাচ্ছিলেন। তখন ভোর হয়ে আসছিলো। হঠাৎ দেখেন পাঁচিলের ধারে একটা ড্রেনে তাদেরই একজন (তিনি চিনতে পারেননি) একটা স্টেনগান হাতে লুকিয়ে আছে। এই সময় একদল পাক আর্মি এগিয়ে আসছিলো। আর কি আশ্চর্য সেই নাম না জানা তরুণ হঠাৎ স্টেনগান হাতে ড্রেন থেকে লাফিয়ে উঠে ওদের লক্ষ্য করে গুলি করতে লাগলেন। হামিদুর দেখলেন ততক্ষনাৎ ছয়জন পাক আর্মি মাটিতে পড়ে গেলো। আর বাকিরা উপায় না দেখে ছুটে আসতে লাগলো সেই বিক্ষুব্ধ রাগী তরুণের দিকে। তরুণের স্টেনগানের গুলি তখন শেষ। তারা ঘিরে ফেরলো তাকে। এরপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারলো হামিদুরের চোখের সামনে। হামিদুর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন সেই তরুণের মুখটি, একবিন্দু ভয় সেখানে ছিলো না। এই ঘটনাটিই সেই মুহূর্তে তার ভিতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়… তিনি ছুটে যান রণক্ষেত্রে… দেশ মাতৃকার জন্য প্রাণ দিতে।
*
২০১১ এর বইমেলায় চা কর্নারে দাঁড়িয়ে বিকেলের দিকে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি একটু দূরে মিতিল আপা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন একা একা। আমার সঙ্গে এই প্রজন্মের কয়েকজন তরুণ-তরুণী ছিলেন, তাদের বললাম “উনাকে চেন?”
— কাকে?
— ঐ যে নীল শাড়ি পরা মহিলা চা খাচ্ছেন?
— না উনি কে?
— উনাকে দেখে কি মনে হয়?
— আর দশটা সাধারণ বাঙালী মহিলা যেমন হয়, তাই… হয়তো বই কিনতে এসেছেন…
আমি খেয়াল করলাম তরুণদের গলায় তেমন কোনো আগ্রহ নেই ঐ দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক সামান্য নারীর জন্য। আমি তখন বোম ফাটালাম। বললাম- “উনি সামান্য কোন নারী নন। অসাধারণ এক মহিয়সী নারী। ১৯৭১ এ ছেলেদের মতো করে চুল কেটে ছেলেদের ড্রেস পরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, কেউ বুঝতেই পারেনি।”
— ‘বলেন কি?’ আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে সবগুলো তরুণ তখনই ছুটে গেলো তার কাছে অটোগ্রাফ নিতে। আমি দূর থেকে লক্ষ্য করলাম মিতিল আপা বিব্রত ভঙ্গিতে কঁপা হাতে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তার কেমন লাগছিলো জানিনা। আমার ভালো লাগছিলো তরুণদের এই তাৎক্ষনিক আবেগটা। তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা একজন অসাধারণ মুক্তিযযাদ্ধাকে পেল তাইবা ক’জন পায়! (মিতিল আপার ছোট বোন সুচী আপা আমার বোনের বান্ধবী সেই সূত্রে তাকে চিনি)
*
দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযযাদ্ধারা ফিরে আসছে নিজ নিজ এলাকায়। এক মুক্তিযোদ্ধা দলছুট হয়ে নিজের গ্রামের পথ ধরেছে। বাড়ির কাছে চলে এসেছে প্রায়। কতদিন পর বাড়ি ফেরা বাড়ির কাছে ছিলো ছোট একটা খাল। কি মনে করে কাঁধের স্টেনগানটা নামিয়ে রেখে নেমে গেলো খালে। হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে মুখ ধুলো। হয়তো খুব ভালো লাগছিলো, ছেলেবেলায় কত না সাঁতরেছিলো এই খালে। কিছুক্ষণ বাদে উঠে এলো। কিন্তু একি… তার অস্ত্র কোথায়? যেখানে স্টেনগানটা রেখেছিলো সেখানে সেটা নেই। তাকিয়ে দেখে তার অস্ত্র তার দিকেই তাক করে আছে এক লোক। সে চিনতে পারলো এই এলাকার রাজাকার…।
না, সেই রাজাকারও পরে পার পায়নি। শহীদের সহযোদ্ধারা ধরে ফেলে তাকে তারপর ছিন্নভিন্ন করে সেই স্টেনগানের গুলিতেই।
*
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের পরিবারটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা যেন একেক জন একেক দিকে ছড়িয়ে পড়ি। আমি আমার মা আর তিন বোন কোন রকমে নানার বাড়ি মোহগঞ্জে চলে আসি। তাও দু তিন বারে। বড় দুই বাই তখনো নিখোঁজ। এর মধ্যে বড় ভাইকে আর্মী ধরে নিয়ে গেল। সব মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা। ছোট ছিলাম বলে ঘটনার ভয়াবহতাটা অতটা ধরতে পারিনি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি আর আমার ছোট মামা মাহাবুবুন্নবী শেখ (আমারই বয়সি) মোটমোটি বাউণ্ডুলে হয়ে গেলাম যেন। পড়াশুনা নেই। শুধু ঘুরে বেড়ানো। আশপাশের শূন্য হিন্দু বাড়িগুলো ঘুরতাম। বেশীর ভাগ হিন্দুরাই তখন পালিয়ে গেছে ভারতে। এর মধ্যে আমার এক শিক্ষক মামা প্রস্তাব করলেন আমার আর ছোট মামার স্কুলে যাওয়া দরকার। ছোট মামা আগে থেকেই ঐ স্কুলে পড়ে আর আমাকে ভর্তি করানো হবে। আমি তখন আরেক মামার সঙ্গে লবিং করলাম যে এখন স্কুলে যাওয়া মানেতো রাজাকার হওয়া। আমার কি স্কুলে যাওয়া ঠিক হবে মামা? মামা আমার সঙ্গে একমত পোষণ করলেন। তিনি আমার পক্ষ নিয়ে ফাইট দিলেন। আমাকে আর স্কুলে যেতে হল না।
তবে অন্যরকম এক স্কুলে যে শিক্ষা নিতে শুরু করলাম দুই মামা ভাগ্নে। একদিনের ঘটনা মনে আছে; দুজন এক জঙ্গলা পুকুর পারের বিশাল জাম গাছে উঠেছি। জাম গাছ ভর্তি পাকা টসটসে জাম ঝুলছে (তখন সব গাছেই প্রচুর ফল-ফলারী হয়েছিলো খাওয়ার লোক ছিল না) তো আমরা দুজন মগ ডালে উঠে জাম খাচ্ছি হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। মুক্তিবাহিনী থানা এ্যটাক করেছে। তখন প্রায়ই এ্যাটাক হত। নিচে তাকিয়ে দেখি পিল পিল করে আর্মী ছুটছে তখন তারা যদি একবার উপরের দিকে তাকাত তাহলে নির্ঘাত গুলি করে ফেলে দিতো আমাদের। একসময় গোলাগুলি চরম আকার দারণ করল বাতাসে শীষ কেটে গুলি ছুটছে আমরা দুজন জাম গাছে আঠার মত সেটে রয়েছি। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। একসময় দেখি আর্মী পিছু হটছে। মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসছে। গাছ থেকে বসে আমরা দুজন পুরো একটু যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করলাম যেন। পরে যুদ্ধ থামলে বাসায় ফিরে এসে এই ঘটনা কাউকে বলিনি।
*
আরেকটা ঘটনা বলা যেতে পারে। এটাও রোমাঞ্চকর। নানার বাড়ির সামনেই ছিল একটা খাল। সেই খালে নানাদের একটা ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা ছিল। সেই নৌকা করে আমি আর ছোট মামা প্রায়ই এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়তাম। একদিন দুজনে বেড়িয়েছি। বহুদূর চলে গেছি কোথাও কেউ নেই। নিরিবিলি নিশ্চুপ প্রকৃতি… হঠাৎ কানের কাছে গম গম করে উঠল মেশিন গানের শব্দ। খুবই কাছে আমাদের ধারণা হল মুক্তি বাহিনী আবার থানা এ্যাটাক করেছে। থানায় তখন আর্মীদের ঘাটি। আমরা দ্রুত নৌকা ঘুরিয়ে বাইতে লাগলাম। তখন আবার জোয়ার শুরু হয়েছে, উল্টো দিকে যেতে হচ্ছে আমাদের। জান দিয়ে বৈঠা মারছি কিন্তু নৌকাতে আগায় না। আর কি কারণে হুর হুর করে পানি উঠছে নৌকায়। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। মামা বলল, ‘পানিতে লাফ দাও’। দুজনেই লফিয়ে পড়লাম পানিতে, নৌকা উল্টে গেল। সাঁতরে কোন মতে পাড়ে এসে প্রায় ক্রলিং করে (কারণ উপর দিয়ে তখন ক্রস ফায়ার শুরু হয়ে গেছে। নিরাপদ জায়গায় সরে আসলাম। পরে যুদ্ধ থামলে উল্টানো নৌকা উদ্ধার করা হল।
এইতো কিছুদিন আগে আমরা কয়েক ভাইবোন গিয়েছিলাম মোহনগঞ্জে নানাবাড়িতে বেড়াতে। গিয়ে দেখি সেই বিশাল খালটি চুপশে ছোট হয়ে গেছে। আমি লাফ দিয়ে পার হলাম খালটা অথচ কি আশ্চর্য ১৯৭১ সালে এই খাল দিয়ে আমি আর ছোট মামা নৌকা করে এ্যাডভেঞ্চার করে আসছিলাম…মুক্তি বাহিনী আক্রমণ করলে নৌকা ডুবে গেল, সাঁতরে পারে এলাম; সেই খালের এই অবস্থা। কি অদ্ভুত!
*
এই ফাঁকে একটা প্রায় ভৌতিক অভিজ্ঞতার বলা কথা বলা যেতে পারে। আমি আর ছোট মামা যখন পরিত্যক্ত শূন্য হিন্দু বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বৈড়াতাম তখন একটা ভয়াবহ ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। মামা আর আমি লটকন গাছে চড়ে মিষ্টি পাকা লটকন খেয়ে একটা হিন্দু বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছি। সময়টা দুপুরের কিছু পরে তবে মেঘলা দিন বলে সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। আশে পাশে কেউ নেই। মামা আগে আগে হাটছে আমি বেশ খানিকটা পিছে, হঠাৎ একটা খস খস শব্দ চেয়ে দেখি… আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম মানে পা যেন আটকে গেল মাটিতে। দেখি দু পায়ে একটা কুকুর হেঁটে আসছে আমার দিকে তার শরীরের পিছনের অর্ধেকটা নেই। সামনের পা দুটি দিয়ে হেঁটে আসছে অনেকটা মানুষের মত… আমি মামা বলে চিৎকার করলাম। গলা গিয়ে আওয়াজ বেরুল না। মামা কি বুঝলো ছুটে এল, ‘কি হয়েছে?’
কি হয়েছে আমি আর বলতে পারি না। মামা তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরে ছুটল বাড়ির দিকে। আর কি আশ্চর্য ফেরার পথে তখন আর কুকুর টুকুর কিছু দেখলাম না।
পরে অবশ্য রহস্য ভেদ হয়েছিল। ঐ কুকুরটা থানায় ঢুকে পড়লে মিলিটারীরা গুলি করে তার পিছনের অংশ ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। এ অবস্থায় সে অনেকদিন বেঁচে ছিল। সামনের পা দিয়ে হাঁটতো।
তারপর এক মহেন্দ্রক্ষণে প্রিয় দেশ একদিন স্বাধীন হল। স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলে। ক্লাশ সেভেনে। কেন জানিনা স্কুলটাকে ভাল লাগাতে পারি নি কিছুতেই। আসলে একটা মানসিক চাপ কাজ করেছে, নানার বাড়িতে তখন আমরা অনেকটা আশ্রিত। যদিও আমাদের মামারা সবাই খুবই ভাল মানুষ। তবে ঐ স্কুলে একজন ভাল বন্ধু পেয়েছিলাম। সে হচ্ছে কামরুল সেও তার এক আত্মীয়য়ের বাসায় আশ্রিত ছিল। তবে খুব বেশীদিন আমাকে ঐ স্কুলে পড়তে হয় নি। পারিবারিক সিদ্ধান্তে আমরা স্বাধীনতার পরের বছরই ঢাকায় চলে আসি।
*
মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলে আমার যতনা স্মৃতি তার চেয়ে বেশী স্মৃতি এই স্কুলের বাইরে, ছোট মামাকে নিয়ে। এ স্কুলের পড়ার সময় আমার ক্লাশের বন্ধু কামরুলের পর সবচে ঘনিষ্ঠ ছিল এক ক্লাশ উপরে পড়া আমার ছোট মামা মাহবুবুন্নবী শেখ। স্কুলে এক সঙ্গে যেতাম আসতাম। এই মামার সঙ্গেই ১৯৭১ সালে একবার আর্মীর হাতে পড়ি। কোন কারণ ছাড়াই। ছোট মামা ছিল আমার চেয়ে লম্বা চওড়া আর সুদর্শন। আমরা যাচ্ছিলাম বাজারে। হঠাৎ একদল মিলিশিয়া আমাদের থামতে বলল। দুজনেই থামলাম। মামাকে আলাদা করে দাঁড় করালো, আমাকেও! ভয়ও পেলাম। মেরে ফেলবে নাকি। হঠাৎ একজন আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে হাসতে শুরু করল। আমি অপ্রস্তুত! কি হল! এ সময় আরেকটা বয়স্ক মিলিশিয়া হাসতে থাকা তরুণ মিলিশিয়াকে থমক দিয়ে আমাদের চলে যেতে বলল। আমরা দ্রুত পা চালালাম। পিছনে শুনলাম তরুন মিলিশিয়া বলছে, ‘উসকা দোনো কান বহুত বাড়া হ্যায়!’
অর্থাৎ আমার দুই কান অনেক বড়। কথাটা মিথ্যে নয় অবশ্য। কান দুটো আমায় একটু বড়ই!
*
যশোহরের এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে শহরের কিছু কিশোরী, তরুনী তারা ছয়জন সবাই এক বাড়ির নয়। আলাদা আলাদা পরিবার ঘটনা চক্রে তারা এক সাথেই আছে পাশাপাশি বাড়িতে। সবাই আতঙ্কে আছে কখন এই এলাকায় হামলা চালায়। বাড়ীয় গুরুজনরা ঠিক করলো মেলেটারী এই এলাকায় এলে তরুনীরা সব বাড়ির পিছন দিয়ে ছুটে একটু দূরে বিলের ধান ক্ষেতে আশ্রয় নেবে। গার্জেনরা তাদের রাস্তাটা চিনিয়েও দিল। কিভাবে বিলের ধান ক্ষেতে যেতে হবে। তখন অগ্রাহায়ন মাস বিলে পানি নেই। ধান ক্ষেত গজিয়ে উঠেছে। প্রচুর ধান। তখন ফসল হয়েছিল প্রচুর।
তারপর হঠাৎ একদিন খবর এল মেলেটারী এসেছে। ছয় তরুনী ছুটলো তাদের চিনিয়ে দেয়া পথে। ছুটতে ছুটতে এক সময় গিয়ে আশ্রয় নিল সেই ধান ক্ষেতে। মিলিটারী গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এদিক ওদিক আগুন ধরিয়ে চলে গেল। তারা কেন এল কেন গেল ঠিক বোঝা গেল না। তবে প্রচুর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে গেল। বিপদ যখন কেটে গেছে তখন বাড়ির গার্জেনরা একট নির্দিষ্ট আওয়াজ করল যেটা শুনে তরুনীরা বুঝবে আর বিপদ নেই, ফিরে আসা যায়। তারা ফিরে আসবে। আওয়াজ শুনে তারা ফিরেও এল। আবার সব স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ তারা আবিষ্কার করল তারা ফিরে এসেছে পাঁচ জন। একজন মিসিং! বয়সে সবচে ছোট যে কিশোরী সে নেই, সে ধান ক্ষেত থেকে ফিরে আসেনি! সবাই ছুটলো তার খোঁজে। কোথাও সে নেই! সবাই পাগলের মতো তাকে খুঁজছে, নেইতো নেই। শেষ পর্যন্ত পাওয়াই গেল না তাকে। তারপরও সবাই হারিকেন টর্চ দিয়ে খুঁজছে। রাত তিনটার দিকে পাওয়া গেল তাকে অন্য একটা ধান ক্ষেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সে আসলে আতঙ্কে ভয়ে দল ছুট হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। আহা বেচারী।
তার কিছু দিন পরই ঐ এলাকায় মিলিটারী এসে সব তছনছ করে দেয়। তবে তরুণীরা রক্ষা পায়। পরে তাদের মধ্যে একজন লেখিকা হিসেবে বেশ নাম করে।
*
এক তরুন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। হঠাৎ শখ হল এক ফাঁকে বাবা-মা ভাই-বোনদেরকে দেখে এলে কেমন হয়? কমান্ডার ছুটি দিলেন। কিছুদিন আগে একটা বড় অপারেশন করে এসেছে সে এখন তাকে ছুটি দেয়া যায়। ছুটি মঞ্জুর হল চারদিনের জন্য।
তরুন যোদ্ধা গভীর রাতে ফিরে এল। সবার আগে টের পেল তার প্রিয় পালা কুকুর ‘জিমি’। জিমি প্রভুর হঠাৎ আগমনে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করল। সেটাই হল সর্বনাশের কারণ। আশে পাশের রাজাকররা তক্কে তক্কে ছিল তারা জানে এই বাড়ির এক ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। তারা চোখ রেখেছিল বাড়ির উপর। কুকুরের চিৎকারে কিছু একটা টের পেল যেন।
পরদিন সকালে বাড়ি ঘিরে ফেলল আর্মী। ধরা পড়ল তরুন মুক্তিযোদ্ধা। হতবাক বাব-মা, ভাই- বোনকে ফেলে তাকে উঠতে হল একটা খোলা পিক আপে। পিক আপে দুজন রাজাকার চারজন আর্মি বসা সেখানে হাত পিছমোড় করে বেধে তাকে ভোলা হল। গাড়ি ছেড়ে দিল। কিন্তু জিমি যেন ক্ষেপে গেল। বিকট চিৎকার করে ছুটতে লাগল পিক আপের পিছনে পিছনে তরুন মুক্তিযোদ্ধা তাকিয়ে দেখছে ছুটে আসা জিমিকে। আর তখন এক রাজাকার তার হাতের থ্রি নট থ্রি রাইফেল তাক করল ছুটে আসা জিমির দিকে গুলি করবে। ট্রিগার চাপ দিতে যাবে তখনই তরুন মুক্তিযোদ্ধা দুপায়ে লাথি হাকাল রাজাকারের দিকে। প্রচন্ড শব্দে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাগলো পিক আপের কোনায় বসা মেলিটারীর গায়ে, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। জিমি ছুটতে ছুটতে অবাক হয়ে দেখল তার প্রভুর সেই শেষ যুদ্ধ, তার জন্য।
স্বাধীনতার পর সেই তরুন মুক্তিযোদ্ধা আর ফিরে আসেনি। তাকে তখন তখনি হত্যা করা হয়েছিল কিন্তু জিমিকে কে বোঝাবে? সে নাকি মাঝে মাঝেই সেই রাস্তায় ধারের হিজল তলায় গিয়ে দাঁড়াতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতো বাঁক নেয়া রাস্তায় দিকে যেখানে ঘটনাটি ঘটেছিল… তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠতো ঘেউ ঘেউ করে… কে জানে সে কি বলতে চায়…!!
*
ঘটনা বরিশালের। পাক আর্মীদের ডাব খাওয়ার শখ হল। তিনজন পাক আর্মী এক তরুনকে পাকড়াও করলো তাকে নারকেল গাছে উঠে ডাব পেড়ে দিতে হবে। সেই তরুন সাহস করে বলল তার গায়ে জ্বর। কে শোনে কার কথা বন্দুকের বাট দিয়ে বাড়ি দিল পাক আর্মী। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল তরুনের, কিন্তু কি আর করে তর তর কের গাছে উঠে গেল। বরিশালের গ্রাম গঞ্জের সবাই নারকেল গাছে উঠতে এক্সপার্ট। গাছে উঠে তার মনে হল সে দা ছাড়াই উঠেছে এখন ডাব পাড়বে কি ভাবে? আর তখনই তার নজরে পড়ল বিশাল এক বল্লার চাকের উপর! চট করে তার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এল। সে খুব সাবধানে বল্লার চাকটা ভাঙ্গলো, তারপর ছুঁড়ে মারল তিন পাক আর্মির উপর আর নিজে লাফ দিল নারকেল গাছটার পাশের পুকুরটায়। তারপর আরকি পুকুর থেকে ভুস করে ভেসে উঠে সাতরে পাগারপার। পিছনে তিন পাক আৰ্মী তখন ‘মারডালে’ ‘মারডালে’ বলে চেঁচাচ্ছিল বল্লার ভয়াবহ কামড়ে!
পরে নাকি ঐ গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাক আর্মীরা। ঐ তরুনকেও অনেক খুঁজেছে তাকে কি আর পায়।
তরুণকে কি আর পায়? সে তখন সীমান্তের ঐ পারে ট্রেনিং নিতে ব্যস্ত। ফিরে এসে বল্লা দিয়ে নয় সত্যি কারের বুলেটে ওদের দেশ ছাড়া করতে হবে যে!
*
কুকুর নিয়ে আরেকটি ঘটনা আছে। আমি আর ছোট মামা (এই মামা এখন মোহগঞ্জের মেয়র) তখন প্রায়ই ঘুরে বেড়াতাম হিন্দু পাড়ায়। হিন্দুরা তখন বাড়ি ঘর ছেড়ে চলে গেছে। তাদের খা খা শূন্য ঘরে আমরা দুজন ঘুরে বেড়াতাম, কিছু করার নেই। স্কুল নেই পড়াশুনা নেই ঘুরে বেড়ানোটাই তখন এক মাত্র কাজ। একদিন একটা বাড়িতে দেখি একটা কাঠের সিন্দুক পড়ে আছে খুলে দেখি তাতে কিছু নেই তবে একটা বই পড়ে আছে। আমি নেমে বইটা উদ্ধার করলাম। বইটার সামনে পিছনে কোন পাতা নেই। তবে উল্টে পাল্টে যা বুঝলাম বইটা ভূতের। আমি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলাম রাতে বইটা পড়া যাবে। তখন পড়ার মতো বই-টই তেমন ছিলো না। কাজেই এই বইটা পেয়ে আমি খুবই উত্তেজিত। মামা তখন তাড়া দিল চল চল বাড়ি ফেরা যাক। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তখনই একটা ঘটনা ঘটল হঠাৎ দেখি আমার সামনে একটা কুকুর বেশ বড় আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে! ধূসর রঙের কুকুরটা চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে… আমি প্রচন্ড ভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম চিৎকার করে মামাকে ডাকলাম কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না আমার ধারনা ছিল মামা আমার সামনে কিন্তু মামা ছিল পিছনে। হঠাৎ পিছন থেকে মামা এসে বলল ‘কি হল?’
আমি বলি ‘কুকুর’
–কই কুকুর?
তাকিয়ে দেখি সামনে কোন কুকুর নেই। আশ্চর্য! বিষয়টা তখন আমরা দুজন আলোচনা করছিলাম। সেখানে একটু দেরীও হল আমাদের পরে যখন পথ ধরে এগুলাম একটু আগে ভয়ঙ্কর মিলিশিয়ার একটা দল সামনের রাস্তা দিয়ে পার হয়েছে তারই চিহ্ন চারদিকে! এই রকম নিরিবিলতে হঠাৎ আমাদের দেখলে নির্ঘাৎ মেরেই ফেলত এই কারণেই সেই প্রেত কুকুর আমাদের বাঁচিয়ে দিল? কে জানে!
পশু-পাখির কারণে মানুষ পাক আর্মীর কারণে বেঁচে গেছে এরকম অনেক ঘটনা কানে এসেছিল সেই সময়। তারাও আমাদের পাশে ছিল।
*
এক তরুণ ভালবাসে এক তরুণীকে। গভীর প্রেম। হঠাৎ কি হল সামান্য ঘটনায় তরুণী বেঁকে বসল! ফিরিয়ে দিল তরুণকে। প্রচণ্ড কষ্ট পেল তরুণ। ঠিক করল আত্মহত্যাই করব তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বন্ধুরা বোঝাল, ‘গাধা একজন মেয়ের জন্য আত্মহত্যা করবি? এরচে আমাদের সাথে চল দেশ জননীর জন্য প্রান দিবি।’ তাই হল তরুণটি বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধে চলে গেল।
ওদিকে ঐ তরুণীর বিয়ে হয়ে গেছে। (তখন সুন্দরী মেয়েদের ঘরে রাখাই মুশকিল ছিল) বাসর রাতে মেয়েটি বউ সেজে বসে আছে। বর ঢুকলো, বর ঢুকেই বলল।
–খবর শুনেছ?
–কি খবর?
–তোমাদের পাড়ার বিখ্যাত কমাণ্ডার আজ একটা অপারেশনে শহীদ হয়েছেন।
— কোন কমাণ্ডার?
বর নাম বল্লেন। হায় এতো তার সেই অভিমানী প্রেমিকের নাম। স্তব্ধ হয়ে বসের রইল সেই বধু। চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুর ধারা! …শহীদের এক ফোঁটা রক্তের কাছে প্রেমিকার হাজার অশ্রু আজ যেন মূল্যহীন…
*
এই রকমই আরেকটি ঘটনা। এক্ষেত্রে প্রেমিক প্রেমিকার বিচ্ছেদ ঘটেনি। প্রেমিক প্রেমিকার কাছে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছে। খুব নামও করেছে কমাণ্ডার হিসেবে।
একদিন কি মনে করে সেই প্রেমিকা রেডিও অন করল… আর কি আশ্চর্য শুনে স্বাধীন বাংলায় রেডিওতে তার প্রেমিকের নাম বলছে! নাম শোনা যায় না ভাল করে নব ঘুরিয়ে যা শুনলো… তা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল প্রেমিকা, তার বীর প্রেমিক শহীদ হয়েছে এক সম্মুখ যুদ্ধে।
যে বীর
তোমাকে ছেড়ে গেছে,
সে আসলে যায়নি!
সে ছিল শুধু তোমার হৃদয়ে
এখন, সবার…
*
পাক আর্মীরা এক বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। খালি বাড়িতে তরুনী মা তার এক মাত্র কোলের সন্তানকে নিয়ে আলমারির পিছনে লুকালেন। দম বন্ধ করে আছেন। আর্মীরা ঐ ঘরেই ঢুকেছে, এই সময় কোলের বাচ্চা ফুঁপিয়ে উঠে কাঁদতে যাবে তিনি মুখ চেপে ধরলেন বাচ্চার যেন শব্দ বের না হয়। বাচ্চা ছটফট করছে… ওদিকে আর্মীরা ঘরে এটা সেটা ঘটছে। এক সময় চলেও গেল। মা সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার মুখ থেকে হাত সরালেন কিন্তু হায় বাচ্চা মৃত। দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে তার আদরের সন্তান।
মা আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলেন! তার আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হল যে সমগ্র বাংলায়!
*
এক সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হল। বেশির ভাগ পাকিস্তানী সৈন্য মারা গেল। বাকিরা এদিক ওদিক পালাল। এক পাকিস্ত নী তাড়া খেয়ে আশ্রয় নিল এক মহিলার ঘরে। ঘটনাচক্রে মহিলাটি ছিল বিহারী। বিহারী বলেই সে পাকিস্তানী সৈনিকটিকে হয়ত আশ্রয় দিল। মহিলাটি পাকিস্তানী সৈনিকটিকে তার চকির নিচে ঢুকিয়ে লুকিয়ে ফেলল। মুক্তিযোদ্ধারা ঐ পলাতক পাকিস্তানী সৈনিকটিকে খুঁজতে খুঁজতে ঐ মহিলার বাড়িতেও ঢুকলো। মহিলা দরজা খুলে বলল তার এখানে কেউ নেই। মুক্তিযোদ্ধারা তার কথা বিশ্বাস করে ফিরে গেল।
তারপর ঘটল ভয়ঙ্কর ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধারা চলে গেলে পাকিস্তানী সৈনিকটি বের হয়ে তারআশ্রয় দাতা মেয়েটিকে ধর্ষন করে। তবে শেষ রক্ষা হয় নি ঐ বিহারী মেয়েটিই পরে পাকিস্তানী সৈনিকটিকে ধরিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।
*
দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। সেই অপরাধে বৃদ্ধ বাবাকে ধরে নিয়ে গেল রজাকাররা আর্মী ক্যাম্পে। বলা হল ছেলেরা কোথায় আছে বলতে হবে নইলে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। বৃদ্ধ বাবা বললেন ঠিক আছে মেরে ফেল। পাকিস্তানী আর্মী ক্যাপ্টেন একটু অবাক হল বাবার এরকম সরাসরি প্রতি উত্তরে। নির্দেশ দিল রাজাকারদের বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে মেরে ফেলতে। রাজাকাররা তাকে নিয়ে চলল নদীর ধারে। নদীর ধারে দাঁড় করানো হল বাবাকে গুলি করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে রাজকাররা রাইফেল কক করছে এ সময় বৃদ্ধ বাবা হাত তুললেন
— কিছু বলবেন চাচা? রাজাকাররা জানতে চায়
— হ্যাঁ বলব।
— বলেন কি বলবেন
— আমি আমার দুই ছেলেকে ধরিয়ে দিচ্ছি আমাকে মের না।
— সত্যি?
— সত্যি
— বেশ তাহলে এখনি চলেন তারা কোথায়
— তোমরা আমার সঙ্গে আস। বলে বৃদ্ধ বাবা তাদেরকে নিয়ে চললেন। চারজন রাজাকার বৃদ্ধ বাবার পিছনে পিছনে চলল।
অনেকদূর হাটার পর একটা জঙ্গলের মত জায়গায় ঢুকলো বাবা। রাজাকাররা রাইফেল হাতে সতর্ক বুড়া আবার কোন ফন্দি করছে নাতো?– কি চাচা আর কত দূর
এইতো আইসা গেছি। বলে বৃদ্ধ মুখে আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে চুপ করতে বলল ফিস ফিস করে একটা অন্ধকার ঝুপড়ি বাড়ি দেখিয়ে বলল ‘এই বাড়িতে আছে আমি ঢুকে ওদের ডেকে আনি। তোমরা বাইরে প্রস্তুত থাক!’ বলে রাজাকারদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঢুকে গেলেন অন্ধকার ঘরে। রাজাকাররা বাইরে থেকে রাইফেল হাতে প্রস্তুত। ভিতরের ছাপড়া ঘরে মেচ জ্বললো যেন তারপর একটু পর সেই বৃদ্ধ হটাৎ বেরিয়ে এল একটা ধারালো রাম দা নিয়ে.. এবং রাজাকাররা কিছু বোঝার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের উপর অসুরের শক্তি নিয়ে…একজন স্পট ডেড, দুজন গুরুতর আহত চতুৰ্তৰ্জন অবশ্য গুলি করে দিল বৃদ্ধকে। তিনি শহীদ হলেন তবে সঙ্গে নিয়ে গেলেন তিন বিশ্বাস ঘাতক রাজাকারকে, গুরুতর আহত দুই রাজাকারও পরে বাঁচে নি।
*
ধরা যাক তার নাম গাফফার। খুবই গরীব এক তরুন। তখন শুরু হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধ। শান্তিবাহিনীর তত্ত্বা বধানে তৈরী হয়েছে রাজাকার বাহিনী গাফফার রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিল। জীবনের প্রথম চাকরী বেতন আছে ড্রেসও আছে ক্ষমতাও আছে। তার বেশ ভালই লাগছে, ডিউটি থানায়… আর্মী ক্যাম্পে। রাইফেল হাতে পাহাড়া দিতে হয়। মাস শেষে বেতন। ভালই কাটছিল গাফফারের জীবন। কিন্তু হটাৎ তার খটকা লাগল যেদিন অন্য রাজাকারররা কিছু মেয়ে ধরে আনল ক্যাম্পে। তার ঠিক পছন্দ হল না, বিষয়টা তার কমান্ডারকে জানালে কমান্ডার দিল ধমক।
— তোমার কাজ তুমি কর। চোখ কান বন্ধ কইরা ডিউটি করবা
— জি স্যার।
গাফফার ডিউটি করে কিন্তু মন খচ খচ করে। আজ আরো কয়েকটা নতুন মেয়েকে আনা হয়েছে। তারপরও চোখ কান বুজে ডিউটি করে। চাকরী বলে কথা জীবনের প্রথম চাকরী টাকা পয়সার মুখ দেখছে। বাড়িতে বাবা খুশী এদ্দিনে ছেলের একটা গতি হয়েছে। কিন্তু মা নাখোশ। ছেলে মুক্তি না হয়ে রাজাকার কেন হল? এই বিষয়টা অবশ্য সহজ সরল গাফফারের মাথায় খেলে না। সে যা বুঝেছে মুক্তি হলে ( মানে মুক্তি বাহিনী) কোন লাভ নাই বেতন ভাতা নাই ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিতে হবে, খালি যুদ্ধ করতে হবে। দেশের জন্য মরতে হবে। কি দরকার বাবা এইতো সে ভাল আছে নিজের গ্রামে, দেশও আছে …চাকরীও আছে। বেতন পাচ্ছে। রাজাকার কমান্ডার বলেছে ঠিকমত ডিউটি করলে বেতন নাকি আরো বাড়বে।
গাফফার তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তার পাশের বাড়ির মেয়েটিকে তার ভাল লাগে। আগে বলতে সাহস হয় নি। এবার বলা যায় চাকরী বাকরী আছে ক্ষমতাও আছে।
কিন্তু হঠাৎ একদিন অঘটন ঘটলো। ডিউটি করছিল গাফফার। দেখে অন্য রাজাকাররা তিনটা মেয়ে কে ধরে আনছে তার মধ্যে তার পাশের বাড়ির মেয়েটিও আছে। তার মাথা কাজ করে না। সে ছুটে যায় কমান্ডারের কাছে।
— স্যার … এইডা কি করলেন?
কমান্ডার কি বুঝে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় গাফফারকে। গাফফারের মাথার ভিতর যেন একটা বিস্ফোরন ঘটে। সে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে বসে রাজাকার কমান্ডারকে তারপর পাগলের মত এলো পাথারি গুলি করতে থাকে। ঐ মেয়ে তিনটা বেঁচে যায়, তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় কিন্তু রাজাকার গাফফারকে গুলি করে মারে আর্মীরা তবে তার এলাপাথারী গুলিতে দুজন রাজাকার তিনজন পাকিস্তানী আর্মী মারা যায়।
গাফফারের দরিদ্র বাবা হতাশ হয়েছিল ছেলের এই বোকামীতে কিন্তু মা নাকি এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলেন নি। গর্বে তার বুকটা ভরে গিয়েছিল। তার বোকা সহজ সরল ছেলেটা মরে গেছে বটে তবে … বীরের মতই একটা কাজ করে মরেছে।
*
চাকরী-বাকরীর মায়া ছেড়ে শহর থেকে পালিয়ে গহীন গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি, সীমান্ত নিতটবর্তী একটা গ্রামে। তিনি যে ঘরে থাকতেন সে ঘর থেকেও বেরুতেন না। প্রচন্ড মৃত্যু ভয়ে সবসময় কাতর থাকতেন। এই মিলিটারী এল… মিলিটারী এল এমন একটা আতঙ্কে থাকতেন তিনি। বিয়ে করেন নি। একা মানুষ … তারপরও তার আতঙ্ক! কোনও কথাও বলতেন না। অন্যরা তার এই ভিতু ভাব নিয়ে হাসাহাসিও করত।
একদিন তাকে সবাই মিলে ধরল—’চল বাজারে চল কিসের এত ভয় তোর?’ এই গ্ৰামতো দূরে… এই গ্রামের আশেপাশের কোন গ্রামে মিলিটারী আসার সম্ভব না নেই। এত ইন্টেরিওর গ্রাম। সবার অনুরোধে একদিন সে গেল বাজারে অন্যদের সঙ্গে। সময়টা ছিল শীতকাল। একটা সবুজ ভারী পুলওভার টাইপের কিছু পড়ে গিয়েছিল সে।
বাজারে গিয়ে মানুষ জন স্বাভাবিক ভাবে চলা ফেরা করছে দেখে তার মত্য ভয়টা একটু কাটলো। বাজারের দোকানে বসে চা খেল সিগারেট খেল। অনেকদিন পর সবার সাথে আড়াই মারল।
হঠাৎ শো শো শব্দ সঙ্গে সঙ্গে বোম্বিং এর বিকট শব্দ! কি ব্যাপার? ঐ বাজারের লোকজন হতচকিত হয়ে আবিস্কার করল তাদের ওখানেই সরাসরি একটা চায়ের দোকানের উপর বোম্বিং হয়েছে হটাৎ করে। পাক বিমান থেকে হটাৎ কোন কারণ ছারা বোম্বিং… তিনজন গুরুতর আহত, মারা গেছে সবুজ পুলওভার পরা সেই লোকটি যে সবসময় মৃত্যু ভয়ে কাতর থাকত ঘর থেকে বেরুতে চাইতো …এই বাজারেও আসতে চায় নি।
ধ্বংস স্তূপ থেকে যখন তাকে উদ্ধার করা হল। দেখা গেল ঝলসে গিয়ে তার সবুজ পুলওভারটা গায়ের চামড়ার সাথে সুন্দর ভাবে সেটে আছে। যেন সবুজ চামড়ার একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে সবুজ বাংলায়!
*
‘কোন স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না’ কথাটি বলেছিলেন ভারতের মাটিতে ১৯৭১ সালে গেরিলা ট্রেনিং দেয়ার সময় মেজর খালেদ মোশররফ।
স্বাধীনতার পর অনেক গেরিলাই ফিরে এসেছিলেন কিন্তু কেউ কেউ আর ফিরে আসেন নি। তাদেরই একজন তার কোন ছবি নেই। শখ করে একটি মাত্র ছবি স্টুডিওতে তোলা গালে হাত দিয়ে। কিন্তু ছবিটি তিনি ডেলিভারী নেন নি পয়সার অভাবে। পরে তার এক আত্মীয় (যিনি ঘটনাটি বলেছিলেন) সেই ছবিটি উদ্ধার করেন। আশ্চর্যজনক হচ্ছে কবি সুকান্তের সঙ্গে কি মিল ছবি তোলায় ব্যাপারটির কবি সুকান্তও এরকম গালে হাত দিয়ে ছবি তুলেছিলেন একটি মাত্র ছবি তার, আমরা দেখি এখন। তিনি পয়সার অভাবে নিজের ছবিটি ডেলিভারী নিতে পারেন নি।
সুকান্তর ছবিটি আছে কিন্তু সেই নাম না জানা গেরিলার ছবিটিও আজ আর নেই! না থাক তার আত্মত্যাগ লেখা আছে বাংলাদেশের রক্তিম পতাকায় তিনি সুকান্তের ভাষায় যেন বলে গেছেন।
…বাংলার মাটি
দুর্জয় ঘাটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত!
*
আমাদের এক আত্মীয় ভয়ঙ্কর মুক্তিযোদ্ধা তিনি গেলেন এক অপারেশনে। এক রাজাকারকে মারতে হবে। এই রাজাকারও নাকি ভয়ঙ্কর। তার বিশাল একটা ভয়ঙ্কর দর্শন কুকুর আছে সব সময় সেই কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। জায়গাটা সম্ভবত আট পাড়ার কোন এলাকা।
তো এক রাতে তিনি তার দল নিয়ে হাজির হলেন সেই রাজাকারের বাড়িতে গিয়ে দেখেন দোতলা এক দূর্গ কোন দরজা জানালা নেই। এক্সপ্লোসিভ দিয়ে দেয়াল উড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় গেলেন। তারা খবর পেয়েছেন সে দোতলায় থাকে।
কিন্তু গিয়ে অবাক কেউ নেই শুধু তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। বিশাল এক কুকুর। কুকুরটা উনাদের দেখেও এক চুল পরিমান নড়লো না। তারা ভয়ঙ্কর কুকুরটাকে মেরে চলে এলেন কিন্তু তারা জানতেন না ঐ কুকুরের নিচেই লুকিয়ে ছিল সেই রাজাকার। প্রভুভক্ত কুকুর জীবন দিয়ে তার রাজাকার প্রভুকে রক্ষা করল।
সেই দুঃসময়ে কিন্তু আর্মীদের বোকামী নিয়ে অনেক জোকসও আমাদের কানে আসত তখন। স্মৃতি থেকে ধার করে তারই কিছু এখানে পরিবেশন করা যাক …
*
আর্মীরা তখন আইডি কার্ড চেক করতো। এক লোককে থামাল
— আইডি কার্ড নিকালো।
ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন রেশন তুলতে। তার কাছে রেশন কার্ড ছিল। আইডি কার্ড ছিল না। তিনি কি ভেবে রেশন কার্ড বের করেই দেখালেন। মুখ পাক আর্মী ভাবল বাপরে এত বড় আইডি কার্ড নিশ্চই হোমড়া চোমরা কেউ ঠকাস করে সেলুট মারল। ভদ্রলোক সে যাত্রা রক্ষা পেলেন।
*
পাক আর্মীরা খুলনায় হিন্দু এলাকায় ঘাটি গেড়েছে। একের পর এক গরু মেরে খাচ্ছে হিন্দুদের। তখন স্থানীয় মুসলমানরা চটের উপর ‘ইহা মুসলমানের গরু খাইবেন না’ লিখে নিজেদের গরুর উপর ফেলে রাখত পোষাকের মতো। এত দুঃখেও এই ঘটনা হাসির উদ্রেক করেছিল সেই সময়।
*
এটা জোক না সত্যি ঘটনা। এটাও জোকের পর্যায়েই পরে বলে লিখছি।
আমাদের নানা বাড়িতে এক লোক ছিল। তার নাম আমান উল্লাহ। সে ছিল পেশায় কুলি। অসম্ভব শক্তি শালি একজন মানুষ। আমার সাথে খুব খাতির ছিল। সে আর্মীদের প্রচন্ড ঘৃনা করত কিন্তু রহস্যময় কারনে আবার তাদের সাথে সাথেই ঘুরতো। আমি তাকে বলতাম।
— তুমি ওদের ঘৃনা কর তো বাজারে ওদের পিছে পিছে ঘুরো কেন? সে এর উত্তর দিত না মুচকি মুচকি হাসত। একদিন এক ঘটনা ঘটল।
তিনজন আর্মী বাজারে এল। আমানউল্লাহ তাদের পিছে পিছে ঘুরছে। তাদের ফাঁই ফর্মাশ খাটছে। হটাৎ কিছু একটা নিয়ে দুই আর্মীর সাথে এক আর্মীর লেগে গেল। তখন এক আর্মী আমানউল্লাহকে নির্দেশ দিল ‘উসকো বানাও’ মানে ওকে মার। আমানউল্লাহ আর দেরী করলো না। ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই তৃতীয় আমীর উপর। মারতে মারতে তাকে শুইয়ে ফেলল। পরে অন্য দুই আর্মীই তাকে ঠেকাল। এর মূল্য অবশ্য পরে আমান উল্লাহকে দিতে হয়ে ছিল। সে রাজাকারদেও পিটিয়েছিল একাধিকবার।
স্বাধীনতার পর সে বেচারা ঢাকায় শ্যামলীতে বোড এ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। তার লাশ আমি আর আমার ছোট মামা মর্গ থেকে খুঁজে বের করি, সে এক মর্মান্তিক ঘটনা। বেচারার শেষ জীবনটা গেছে ভিষন কষ্টে।
*
এটাও ঠিক জোক না সত্যি ঘটনা। এক বাবা পাকিস্তানী মাইন্ডের। তার ছেলেরা এ কারণে বাবাকে পছন্দ করে না। বাবা আবার বাজারে গিয়ে পাকিস্তানের খুব গুনগান গায় পাকিস্তানীরা যে ইসলাম রক্ষায় নেমেছে এজন্য তাদের ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ ইত্যাদী ইত্যাদী। তো একদিন বাজারে বিরাট হই চই, কি ব্যাপার? এক ছিঁচকে রাজাকারকে পেটানো হচ্ছে। ঐ বাবার ছেলে বাজারেই ছিল সেও গিয়ে ধুপ ধাপ দুই তিন লাথি মেরে টান দিয়ে রাজাকারের পকেট ছিঁড়ে নিয়ে এল। বাড়ি এসে সেই ছেঁড়া পকেট সবাইকে দেখাল বলল আজ এক রাজাকারকে পিটিয়ে তার পকেট ছিঁড়ে নিয়ে এসেছি। এই নিয়ে বাড়িতে খুব হাসাহাসিও হল। একটু পরেই খবর এল। তার বাবা হাসপাতালে কে বা করা মেরেছে। সবাই ছুটলো হাসপাতালে দেখে রক্তাক্ত অবস্থায় বাবা শয্যাশায়ী। গায়ের কাপড় চোপড় ছিড়া শার্টের একটা পকেট নেই। এই ঘটনার পর আর তাকে পাকিস্তানীদের পক্ষে কিছু বলতে শোনা যায় নি।
*
বিহারী লাল নামে এক হিন্দুকে পাকরাও করল হানাদার পাক আর্মী।
— তোমহারা নাম কিয়া?
হিন্দু ভদ্রলোক ভাবলেন। এমনেও মরছি ওমনেও মরছি। মরার আগ আর মিথ্যা নাম বলব না। আসল নামই বলব
দৃঢ় স্বরে বললেন–
–মেরা নাম বিহারী লাল হ্যায়
–ওহ তোম বিহারী হ্যায়…যাও যাও…
মূর্খ পাক আৰ্মী ছেড়ে দিল বিহারী লালকে। বেঁচে গেলেন সে যাত্রায় বিহারী লাল।
NIRJASH
SUNDOR
RANA ZAMADER
I Mourn to read this book. I want to thank you for sharing it with us.
পর্দা করা ফরজ
শেষের কয়েকটা খুবই মজার।
Cherry blossom
It is really difficult to believe that people back in those days had that degree of unconditional love for their motherland. We really should be ashamed of our narcissist behaviour these days.. living in a fake existence revolving around the ‘VIP me.’ Nothing but enjoyment and entertainment matters. How did we let ourselves be deteriorated to this level?