ড্রাগন ভয়ংকর
সাইমুম ৬১ – ড্রাগন ভয়ংকর – আবুল আসাদ
প্রথম প্রকাশ – মে ২০১৯
.
[এই বইয়ের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত অথবা মৃত কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে এর কোন প্রকার সম্পর্ক নেই। লেখক]
১
ছুটছে আহমদ মুসার নতুন হাইল্যান্ডার জীপ। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তার হাইল্যান্ডারটি।
কিছুক্ষণ আগেই শূন্য ট্যাংকিতে তেল ভরতে হয়েছে গাড়িটাকে সক্ষম। ও সচল রাখার জন্যে।
কিন্তু আহমদ মুসার কোনো ক্লান্তি নেই। ইচ্ছা করলে সে জিবেরা থেকে সোজা পথে তিয়ানজিনে আসতে পারতো এবং সেই পথ দিয়ে ঢুকতে পারতো হুবেই প্রদেশে। কিন্তু আহমদ মুসা হাইওয়ে বাদ দিয়ে লোকাল পথ ব্যবহার করতে চায়নি। এ কারণেই তাকে অনেক কিলোমিটার পথ বেশি পাড়ি দিতে হয়েছে জিনান হয়ে ঘুরে আসার জন্যে। হুবেই-এর উডাং যাবার আগে তিয়ানজিন ও বেইজিং থেকে আরও তথ্য তার প্রয়োজনে।
বন্দরনগরী তিয়ানজিন সামনেই। তিয়ানজিন চীনের চতুর্থ বৃহত্তম শহর এবং পৃথিবীর অষ্টম ব্যস্ততম বন্দরনগরী।
আহমদ মুসার পরিকল্পনা অনুসারে তার প্রথম হল্টেজ এই। তিয়ানজিনে।
তিয়ানজিন চীনের একটা অনন্য বন্দরনগরী। এই বন্দরনগরীতে এক সময় চীন পশ্চিমা দেশগুলোর বণিকদের বাণিজ্যের জন্যে বাড়ি, শিল্প কারখানা করার সুযোগ দিয়েছিল। তিয়ানজিনের পাঁচটি প্রধান সড়কে এখনও পশ্চিমা ধাঁচের বাড়ি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, গির্জা ইত্যাদি ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
আহমদ মুসা শহরের এই ওয়েস্টার্ন অংশ এড়িয়ে ট্যুরিস্ট গাইড দেখে শহরের চীনা অংশে পাঁচতারা হোটেলের একটা কক্ষ বুক করেছিল। আহমদ মুসার দুএকদিন সময় দরকার উডাং ছাড়াও ইয়েলো অববাহিকার প্রাচীন। হুয়াজিয়া সম্প্রদায় এবং তাদের রাজনীতি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কিছু জানার জন্যে। বড় এই চীনা হোটেলটা আহমদ মুসা পছন্দ করেছে এই কারণে যে, তাদের সম্পর্কে চীনাদের কাছ থেকেই ভালো সাহায্য পাওয়া যাবে। হোটেলে সিট পেতে কষ্ট হয়েছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ বলেছিল তাদের হোটেলের পাশেই তিয়ানজিন অপেরা হলে অল চায়না ছাত্র ফেডারেশন এবং চীনা যুব কমুনিস্ট পার্টির তিন দিনের সম্মেলন হচ্ছে। তারা হোটেলের রুমগুলো আগে থেকেই রিজার্ভ করে রেখেছে। রুম খালি নেই। অবশেষে আহমদ মুসার বিশেষ অনুরোধে তার জন্যে একটি রুমের ব্যবস্থা করেছে তারা।
চীনা যুব কম্যুনিস্ট পার্টির সম্মেলন হচ্ছে তা আহমদ মুসা আগেই পত্রিকায় দেখেছে। সম্মেলনটি আহমদ মুসার দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে বিশেষ একটি কারণে। আর তা হচ্ছে, গতকাল সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অল চায়না ছাত্র ফেডারেশনের সমাপ্তি অধিবেশনে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদিকা লিয়েন হুয়া ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা পদে মনোনীত হয়েছেন মা ঝু সুলতান দায়িত্ব গ্রহণ করা পর্যন্ত। সংবাদটি আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে আরও একটি কারণে, চীনা সরকার নিশ্চয় মনে করছে মা ঝু সুলতানের আশু উদ্ধার সম্ভব নয়। আরও একটা কথা তার মনের কোণে উঁকি দিয়েছে। সেটা হলো, মা ঝু সুলতান মুসলমান বলেই কি একটা সুযোগ পেয়ে তাকে সরিয়ে দেয়া হলো? আবার তার মনে হয়েছে, দায়িত্ব গ্রহণকালে লিয়েন হুয়ার কান্না এবং মা ঝু’র কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়া ইত্যাদি তো বিপরীত কথাই প্রমাণ করে।
নগরীর প্রশস্ত রাজপথ ধরে চলছে আহমদ মুসার গাড়ি। সামনেই একটা বড় মোড়। তখনও বেশ দূরে। আহমদ মুসার চোখ দুটি ছিল সামনে প্রসারিত। তার মনে নানা চিন্তা।
হঠাৎ গোলাগুলি, অনেকগুলো গাড়ির শব্দ। চিৎকার-আর্তনাদ কিছু কণ্ঠের।
আহমদ মুসা দ্রুত চোখ তুলে তাকাল সেদিকে। দেখল, মোড়টির উত্তর পাশের মুখে উত্তর দিক থেকে আসা দুটি গাড়ির উপর গুলি বর্ষণ করছে একটা মাইক্রো থেকে নেমে আসা কয়েকজন লোক।
আহমদ মুসার গাড়ি থেকে মোড়টি তখনও খুব কাছে নয়। তার উপর সামনে আরও দুটো গাড়ি রয়েছে। গুলির আওয়াজ শুনে গাড়ি দুটি দাঁড়িয়ে। পড়েছে। মোড়ের আগে এ রাস্তায় ধনুকের মতো একটা বাঁক থাকায় মোড়ের সবকিছু দেখতে পাচ্ছে আহমদ মুসা।
সামনের গাড়ি দুটো দাঁড়িয়ে পড়লে আহমদ মুসার গাড়ি সামনের গাড়ি দুটোকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলল সামনে।
ঘেরাও হওয়া গাড়ি দুটো থেকে কয়েকজন নেমে এসেছিল। তাদের হাতেও ছিল স্টেনগান, কিন্তু গুলিবৃষ্টির মুখে পড়ে তারা কিছু করতে পারেনি।
গুলিবৃষ্টি করতে করতেই এগিয়ে গেল আক্রমণকারীরা গাড়ি দুটোর দিকে দুপাশ থেকে।
আহমদ মুসার গাড়ি মোড়টির দক্ষিণ পাশে পৌঁছে গেছে।
আক্রান্ত গাড়ি দুটির অপর পাশে আক্রমণকারীদের মাইক্রো দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসার মনে হলো মাইক্রোতে কারা যেন উঠল। সে দেখল, এ পাশের আক্রমণকারীরা উত্তর দিকে ছুটছে, লক্ষ্য মনে হলো মাইক্রো। মাইক্রোটারই লোক ওরা।
গাড়ি দুটির পাশে মুমূর্ষ একজন যুবক কাতরাচ্ছিল এবং চিৎকার করছিল, ম্যাডামকে শয়তানরা নিয়ে গেল। তার পাশেই তিনজন পুলিশের লাশ।
আহমদ মুসা তার গাড়ি মুমূর্ষ যুবকটির পাশে দাঁড় করিয়ে লাফ দিয়ে। গাড়ি থেকে নামল। ছুটে গেল যুবকটির কাছে। বলল, আপনাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার। কাকে ওরা ধরে নিয়ে গেল?
যুবকটি ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, শয়তানা লিয়েন হুয়াকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে বাঁচান। আমার কথা ভাববেন না। আমার সময় শেষ। যুবকটির ক্ষীণ কণ্ঠ ক্ষীণতর হয়ে শ্রবণের বাইরে চলে গেল। তার গায়ের ইউনিফরম পুলিশ থেকে আলাদা। ইউনিফরমের বুকে ইনসিগনিয়া। তাতে লিখা: ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্স। আহমদ মুসা বুঝল, ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সের লোকটি নিশ্চয় লিয়েন হুয়ার পার্সোনাল সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিল।
আহমদ মুসা তাকাল মাইক্রোর দিকে। ওটা আক্রমণকারীদের গাড়ি।
মাইক্রোটি তখন ছুটতে শুরু করেছে। পশ্চিমের হাইওয়েতে মাইক্রোটি উঠে গেছে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি সিকিউরিটি লোকটির পাশে পড়ে থাকা কারবাইন ও গুলির বেল্ট হাতে তুলে নিল। উঠে দাঁড়াল। কারবাইনটি লেটেস্ট মডেলের এবং খুবই কার্যকর। নিরাপত্তা ও সশস্ত্র বিভাগের এলিটরাই এ অস্ত্র ব্যবহার করে। স্টেনগান থেকে এর গুলির রেঞ্জ, ফ্রিকুয়েন্সী ও কার্যকারিতা সবই বেশি।
লিয়েন হুয়া নামটা শুনেই আহমদ মুসা বুঝতে পেরেছে এ সেই লিয়েন হুয়াই হবে। অল চায়না ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও যুব কম্যুনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা মা ঝু অনুপস্থিত থাকাকালে এই লিয়েন হুয়া তার নিজের দায়িত্বসহ এই দায়িত্বও পালন করবেন। তাহলে যারা মা ঝুঁকে কিডন্যাপ করেছে, তারাই কি কিডন্যাপ করল লিয়েন হুয়াকে? লু ঝিদের কিডন্যাপকারীরাও তাহলে তো তারাই।
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটল মাইক্রোর পেছনে। কিন্তু গজ কয়েক এগোতেই ব্রাশ ফায়ারের মুখে পড়ে গেল আহমদ মুসার গাড়ি।
উত্তর দিক থেকে একটা জীপ ছুটে এসেছে। সে জীপ থেকেই ফায়ার করা হয়েছে। আহমদ মুসার মনে হলো, কিডন্যাকারীদের লোক এরা। কিডন্যাপকারীদের পেছন দিক নিরাপদ করার জন্যেই এদের মোতায়েন রাখা হয়েছিল।
ব্রাশ ফায়ারে আহমদ মুসার গাড়ির ডান ও পেছন দিকের কাঁচ গুঁড়ো হয়ে গেছে। আহমদ মুসা মাথা নিচু করায় বেঁচে গেছে। কিন্তু কাঁচের গুড়োয় তার গা ভর্তি হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল, তার গাড়ির চাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বেশ একটু দূর থেকে গুলি করায় গাড়ির চাকা টার্গেট করা। কঠিন ছিল।
ব্রাশ ফায়ারের মধ্যেও আহমদ মুসা গাড়ি থামায়নি। আহমদ মুসা ভাবল, এদের সাথে এখন লড়াইয়ে নামলে কিডন্যাপকারীদের গাড়ি হারিয়ে যাবে। আর পেছনের আক্রমণকারীরা এটাই চায়।
পেছন থেকে ফায়ার করার সময় জীপের আরোহী দুজন গাড়ি থেকে নেমেছিল। কিন্তু তাদের দুটি স্টেনগানের ফায়ারের মধ্যেই আহমদ মুসার গাড়িকে যখন তারা ছুটতে দেখল, তখন তারা গুলি করা বন্ধ করে গাড়িতে উঠল। গাড়ি ছুটল আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে।
আহমদ মুসার গাড়ির বডি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যান্ত্রিক কোনো ক্ষতি হয়নি। এ ধরনের হাইওয়েতে যতটা স্পিড় দেয়া সম্ভব, তার চেয়েও বেশি স্পিডে চলছে আহমদ মুসার গাড়ি।
কিডন্যাপারদের মাইক্রোটি সিলভার কালারের।
মাইক্রোটি এখনও আহমদ মুসার চোখের আওতায় আসেনি। কিডন্যাপারদের পেছনের গাড়িটা তার পেছনে পেছনে ছুটে আসছে, সেটা আহমদ মুসা আগেই দেখেছে। রিয়ারভিউতে গাড়িটাকে সে এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। গাড়িটা একই গতিতে ছুটে আসছে তার গাড়ির পেছনে। গাড়িটার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া নেই। যেন আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে থাকাটাই তার একমাত্র কাজ।
সামনের কিডন্যাপারদের গাড়ি দেখতে না পাওয়ায় আহমদ মুসার উদ্বেগ বাড়ল। সামনে আরও কিছুটা এগোলেই এই হাইওয়েটি দুই ভাগ হয়ে একটি বেইজিং-এর দিকে গেছে, অন্যটি বেইজিং-এর দক্ষিণ পাশ দিয়ে আরও পশ্চিমে এগিয়ে গেছে। কিন্তু বেইজিং অঞ্চলে গিয়ে এই হাইওয়ে নানামুখী রাস্তা, ফ্লাইওভার, আন্ডার টানেলের মুখোমুখি হয়েছে।
সে অঞ্চলে পৌঁছার আগেই যদি কিডন্যাপারদের গাড়িকে চোখের আওতায়। না আনা যায়, তাহলে ওদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।
আহমদ মুসা স্পিডোমিটারের দিকে তাকিয়ে দেখল, স্পিড় আরও কিছুটা বাড়াবার সুযোগ আছে।
স্পিড বাড়িয়ে দিল আহমদ মুসা।
তিয়ানজিন থেকে বেইজিং-এর অর্ধেক পথ তখন পেরিয়ে এসেছে। সামনে এখনও ষাট-পঁয়ষট্টি কিলোমিটার বাকি। যাকে বেইজিং-এর উপকণ্ঠ বলে তা শুরু হতে যাচ্ছে বলা যায়।
আহমদ মুসার দুই চোখ অস্থিরভাবে ছুটে বেড়াতে লাগল সামনে। হঠাৎ একটা চড়াই-এর মাথায় একটা বাসের সামনে ভেসে উঠল মাইক্রোটি। মাইক্রোটির পেছনের স্ক্রিনে লাগানো লাল স্টিকারটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খুশি হলো আহমদ মুসা। সেই সাথে বিস্মিতও হলো, কারণ তার। হিসাব মতে মাইক্রোটা তো আরও কিছুটা দূরত্বে থাকার কথা। তাহলে নিশ্চয় স্পিড কমিয়ে দিয়েছে মাইক্রোটি? কেন? কারণ যাই যোক খুশি হলো আহমদ মুসা।
রিয়ারভিউতে তাকাল আহমদ মুসা। পেছনের গাড়িটাকে দেখতে পেল। না। বুঝল, রাস্তার চড়াই-উতরাই ও বাঁকের কারণেই গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। আরও কিছুটা এগোলো সামনে।
সামনের গাড়িটা হঠাৎ শেষ মুহূর্তেই বাম দিকে টার্ন নিল। মনে হলো, শেষ মুহূর্তে সে তার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে।
আহমদ মুসা মনে মনে একবার এই এলাকার রোড নেটওয়ার্কের চিত্রটা সামনে নিয়ে এলো। যে রোডে গাড়িটা প্রবেশ করল সে রোডটি বেইজিং এলাকা পাশ কাটিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে।
আহমদ মুসার বিস্ময় বাড়তে লাগল। সামনের গাড়িটার মধ্যে উদ্বেগ অস্থিরতার সামান্য চিহ্নমাত্র নেই। আহমদ মুসা গাড়ির গতি বাড়ালো না। যে গতিতে চলছিল সেই গতিতেই গাড়িটা চলছে।
আহমদ মুসার গাড়ি এবং সামনের ও পেছনের দুই গাড়ি বেইজিং-এর সন্নিহিত এলাকা থেকে তখন অনেকখানি দূরে সরে এসেছে। চড়াই-উত্রাই নেই বললেই চলে। অঞ্চলটা মালভূমি ধরনের উষর।
কিন্তু একটা বিস্ময়ের যন্ত্রণা এসে তার মনে জেঁকে বসেছে। সামনের ও পেছনের গাড়ি দুটো অমন নির্লিপ্ত কেন? সামনের গাড়িটা বলা যায় সমান দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে। পেছনের গাড়িটাও তাই। ও দুটো গাড়ির মধ্যে নিশ্চয় যোগাযোগ হয়েছে। নিশ্চয় তারা কোনো পরিকল্পনা এঁটেছে। সেটা কী?
আরও কিছুটা পথ চলার পর সামনের গাড়িটা আবার টার্ন নিয়ে দক্ষিণের একটা এক্সিট রোডে প্রবেশ করল। তার মানে ওরা রাজধানী বেইজিং থেকে আরও দক্ষিণে চলে গেল, ভাবল আহমদ মুসা।
ল্যান্ডস্কেপ ধীরে ধীরে পাহাড়ি ধরনের এবড়ো-থেবড়ো হয়ে উঠল। দিগন্তে চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়ে দেখল, হাতের ডানে, মানে পশ্চিম দিকে কয়েকটা সবুজ পাহাড় ও শৃংগের গুচ্ছ দেখা যাচ্ছে।
আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পিড় সত্তর কিলোমিটারে নামিয়ে এনেছে। সড়ক এবড়ো-থেবড়ো হয়ে উঠার কারণে। দেখতে পেল আহমদ মুসা সামনের ও পেছনের গাড়ি দুটিও স্পিড় কমিয়ে দিয়েছে।
মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। গাড়ি দুটো যেন খেলছে আহমদ মুসাকে নিয়ে। পানিতে বঁড়শিতে গাঁথা মাছকে খেলানোর মতোই যেন। মাছকে খেলিয়ে ক্লান্ত করার মতো তাকে সামনে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে ঠান্ডা মাথায় ধীরে-সুস্থে।
এই অবস্থায় আহমদ মুসার কিছু করণীয় নেই। তাঁর একটাই লক্ষ্য সামনের গাড়িতে আটক মেয়েটাকে উদ্ধার করা। কিন্তু তার জন্যে সমস্যা। হয়েছে পেছনে, শত্রু রেখে সামনের শত্রুকে তাড়া করা। আবার পেছনের শত্রুকে আগে সামাল দিতে গেলে সামনের গাড়িটা পালাবে এবং এটাই ওরা চায়। ওদের চাওয়াকে মোকাবিলা করতে হলে সামনের গাড়িকে তাড়া করা ছাড়া বিকল্প তার কাছে কিছু নেই। কিন্তু ওরা আলটিমেটলি কোনো পরিকল্পনার পেছনে ছুটছে!
সামনের গাড়ি আবার পশ্চিম দিকে টার্ন নিল। একই গতিতে চলছে। সামনের গাড়ি।
মিনিট বিশেক চলার পর সামনের পাহাড়গুচ্ছ একেবারে সামনে এসে গেল। সামনের গাড়িটা ঢুকে গেল পাহাড়গুচ্ছের মধ্যে।
দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বেশ প্রশস্ত পাকা রাস্তা। ঢুকে গেল আহমদ মুসার গাড়ি।
দশ মিনিটের মতো গাড়ি চলার পর বড় একটা উপত্যকায় প্রবেশ করল। উপত্যকার চারদিকেই পাহাড়। সব পাহাড়েই কিছু কিছু বাড়ি নজরে পড়ছে।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন প্রায় উপত্যকার মাঝামাঝি। হঠাৎ সামনের দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেল সামনের গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেছে। আহমদ মুসার গোটা দেহে বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা শিহরণ খেলে গেল। দ্রুত চোখ ফেলল চারদিকে। ঠিক যা ভেবেছে তাই। পেছনের গাড়ি তো আছেই, তাছাড়া দুই পাশ থেকে আরও দুটো মাইক্রো ছুটে আসছে তার দিকে।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন চারদিক থেকে আসা রাস্তার মিলন গ্রন্থিতে। চারটি গাড়িই আহমদ মুসার গাড়ি থেকে সমদূরত্বে। এখানে এমন একটা বিঘুঁটে জায়গায় ফাঁদে আটকাবার জন্যেই আহমদ মুসার গাড়িকে এভাবে সামনে টেনে এনেছে ওরা।
ফাঁদে পড়ার ব্যাপারটা চোখে পড়ার পরও আহমদ মুসা গাড়ির গতি স্লো করেনি। ডান বাম দুদিকের রাস্তা দেখে নিয়ে অঙ্ক কষে ফেলেছে। আহমদ মুসা মুহূর্তেই।
ডান ও বামের রাস্তা সমান সমভূমির উপর দিয়ে। রাস্তার দুধারে কোনো ব্যারিয়ার নেই। কিন্তু সামনের মানে পশ্চিম দিকের রাস্তাটার দুই পাশ বরাবর খাড়া-মাথার ঢিবির মতো সারি সারি পাথরের এবড়ো-থেবড়ো স্থপ!
আহমদ মুসা ঢুকে গেল সামনের রাস্তায়। কিডন্যাপকারী মাইক্রোর ৩০ ফুটের মতো দূরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। পেছনের তিনটি গাড়ির কোনোটিই রাস্তা ছেড়ে তাকে লক্ষ্য করে কোনাকুনি এদিকে আসতে পারবে না। আসতে চাইলে রাস্তা ঘুরে তার পেছন দিক দিয়ে আসতে হবে।
সামনের গাড়িটি স্থিরভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। যেমন নিশ্চিতে চলছিল, তেমনভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটির মাথা সামনে।
আহমদ মুসা তার গাড়ি দাঁড় করিয়েই সামনের গাড়ির লোকদের নতুন। কিছু ভাবা এবং পেছনের তিনটি গাড়ি আরও কাছে আসার আগেই সামনের গাড়ির বিষয়টা হেস্তনেস্ত করতে চাইল। সামনে ও পেছনে দুই দিকের শত্রুর সাথে একই সাথে লড়াই করা কঠিন হবে।
গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা দরজা একটু ফাঁক করে। রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল গাড়ি থেকে। দ্রুত গড়িয়ে চলল সামনের গাড়ির দিকে আহমদ মুসা সামনের গাড়ির দরজা খোলার শব্দ পেল।
আরও দ্রুত আহমদ মুসা এগোলো সামনের মাইক্রোটির পেছনে আড়াল নেবার জন্যে। আহমদ মুসা শরীরের পেছন দিকটা দক্ষ অ্যাক্রোব্যাটের মতো বিদ্যুৎ গতিতে সামনে ছুঁড়ে দিল। এভাবে দুবার শরীরকে চরকির মতো ঘুরিয়ে নিয়ে একেবারে মাইক্রোর পেছনে গিয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে সামনে থেকে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলো।
একটুও সময় নষ্ট করল না আহমদ মুসা। পেছনের তিন দিকের তিনটি গাড়ি কিংবা আরোহীরা কাছাকাছি আসার আগেই তাকে এখানকার আক্রমণ শেষ করতে হবে।
দেহটা মাটিতে পড়ে স্থির হবার আগেই গড়িয়ে গাড়ির ডান প্রান্ত অর্থাৎ যে দিক ব্রাশ ফায়ার হচ্ছিল, সেই প্রান্তে গিয়ে স্থির হলো।
ওদিকের ব্রাশ ফায়ার হঠাৎ কমে গিয়েছিল। সম্ভবত আহমদ মুসাকে দেখতে না পেয়ে নতুন আক্রমণের পথ খুঁজতে গিয়েই ওদের গুলিবর্ষণ কমে গিয়েছিল।
এরই সুযোগ গ্রহণ করল আহমদ মুসা। ওদের স্টেনগানগুলো টার্গেটে নেই এটাই ধরে নিল সে। এখন ওদের কিছুটা অপ্রস্তুত পাওয়া যাবে।
আহমদ মুসা মাইক্রোটির ডান প্রান্তে পৌঁছেই কারবাইনের ট্রিগারে আঙুল রেখে ম্প্রং-এর মতো উঠে দাঁড়াল এবং তার সাথে ট্রিগারে চেপে বসল তার তর্জনি।
সত্যিই মাইক্রোর চারজনকে মাইক্রোর ডান পাশে পাওয়া গেল। ওদের পছনের জন স্টেনগান বাগিয়ে বসেছিল। অবশিষ্ট তিনজন দ্রুত ক্রলিং করে গাড়ির এ প্রান্তের দিকে আসছিল।
আহমদ মুসাকে যখন ওরা দেখল, তখন ওদের করার কিছু ছিল না। আহমদ মুসার কারবাইন অগ্নিবৃষ্টি শুরু করে দিয়েছে।
বেঘোরে প্রাণ দিল ওরা চারজন।
গুলি করার পর মুহূর্তও দেরি করল না আহমদ মুসা। ওদের কয়েকটা স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে অনেকটা হামাগুড়ি দেয়ার মতো দ্রুত এগোলো মাইক্রোটির দরজার দিকে।
পেছনের গাড়িগুলো থেকে তখন গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে।
মাইক্রোর দরজায় এসে আহমদ মুসা দরজার সাথে সেটে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে পেছনে তাকাল। আহমদ মুসা তার গাড়ির পাশ দিয়ে দেখতে পেল, পেছনের তিনটি গাড়িই চৌরাস্তার ঐছি পেরিয়েছে। একটি গাড়ি আহমদ মুসার গাড়ির কয়েক গজ পেছনে এনে দাঁড়িয়ে গেছে। অন্য দুটি দ্রুত এগিয়ে আসছে, কিন্তু পশ্চিম দিকের রাস্তায় প্রবেশ করেনি। তার আগে সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে।
তিন গাড়ি থেকে ওরা নেমেছে সাতজন।
ওরাই গুলি ছুঁড়ছে। আহমদ মুসার মাথায় একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল।
কুড়িয়ে নিয়ে আসা একটি স্টেনগান তুলে ওদের দিকে লক্ষ্য করে গুলিবৃষ্টি করল। গোটা ম্যাগজিন শেষ করল আহমদ মুসা।
দ্রুত উঠল মাইক্রোতে। দেখল, লিয়েন হুয়াকে পিছমোড়া করে বেঁধে মুখে টেপ লাগিয়ে সিটে ফেলে রাখা হয়েছে।
আহমদ মুসা আস্তে মেয়েটির মুখের টেপ খুলে দিল। কেটে দিল হাতের বাঁধন।
মেয়েটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। চোখে তার কৃতজ্ঞতার স্ফুরণ।
আপনি নিশ্চয় লিয়েন হুয়া। আপনি স্টেনগান চালাতে জানেন?
মেয়েটি কিছু বলতে গিয়েছিল। কিন্তু থেমে গিয়ে বলল, জানি।
একটা স্টেনগান তার হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখুন।
কথা বলার সময় চোখ দুটি আহমদ মুসার মাইক্রোর পেছনের দিকেই ছিল। নতুন ভাবনার ছায়া আহমদ মুসার মুখে।
আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে পৌঁছল মাইক্রোর পেছনের স্ক্রিনের কাছে। পকেট থেকে একটা কাটার বের করে স্ক্রিনের একটা অংশ কেটে নামিয়ে নিল।
পেছন থেকে তখনও গুলি আসছিল। তবে আগের চেয়ে কম। ভাবল আহমদ মুসা, নিশ্চয় ওদের কয়েকজন গুলির আড়াল নিয়ে মাইক্রো, পর্যন্ত পৌঁছার চেষ্টা করবে। আহমদ মুসা তাদের এই আসাটাই কিছুক্ষণের জন্যে থামিয়ে দিতে চায়।
দ্রুত পেছনের দিকটা একবার দেখে নিয়ে নতুন উইনডো পথে আহমদ মুসা তার কারবাইনের নল সেট করে আবার উঁকি দিল বাইরে। মাইক্রোর এই উইনডো অপেক্ষাকৃত উঁচু বলে দেখতে পেল নিজের এবং ওদের গাড়িগুলো ভালোভাবেই। দেখতে পেল ওদের কয়েকজন গাড়িগুলোর দক্ষিণ পাশ দিয়ে ক্রলিং করে এগিয়ে আসছে। তাদের সকলের হাতেই উদ্যত স্টেনগান। ওদের লক্ষ্য, মাইক্রোর দক্ষিণ দিক দিয়ে এগিয়ে লিয়েন হুয়াকেসহ মাইক্রোটা দখল করে নেয়া। ওদের সকলের অবস্থানই মোটামুটি আহমদ মুসার নজরের আওতায়।
আহমদ মুসা ওদের টার্গেট করে তার স্টেনগানের ট্রিগারে তর্জনি চেপে ধরুল। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে গেল ওদের দিকে।
আহমদ মুসা তার স্টেনগানের ব্যারেল ঘুরিয়ে নিল ওদের গাড়িগুলোর দিকে। স্টেনগানের গোটা ম্যাগজিন খালি করল গাড়িগুলোর উপর।
আসলে আহমদ মুসার টার্গেট ওদের সবাইকে মারা নয়, বরং যতটা পারা যায় ওদের গাড়ির ক্ষতি করা। যাতে আহমদ মুসাকে অনুসরণের অবস্থায় না থাকে ওরা। আহমদ মুসা ফিরে এলো গাড়ির পেছন থেকে সামনে। বলল মেয়েটিকে লক্ষ্য করে, এদের গুলিতে আমার গাড়ির ক্ষতি হয়েছে। আমাদের এখন সরে পড়ার জন্যে এই মাইক্রোই নিতে হবে।
মেয়েটার হাতে স্টেনগান তখনও ধরা। অনেক বিস্ময় ও প্রশ্ন নিয়ে মেয়েটা আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আছে।
ও, এবার আমার কথা বলি। তিয়ানজিনের মোড়টায় যখন সংঘর্ষ চলছিল, তখন আমি ঐ রাস্তা দিয়ে তিয়ানজিনের একটা হোটেলে যাচ্ছিলাম। যখন আমি মোড়ে পৌঁছি, তখন দেখি এরা আপনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আপনাকে উদ্ধারের জন্যেই আমি ওদের পিছু নিয়েছিলাম। ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসতে বসতে বলল আহমদ মুসা।
মেয়েটার মুখ কিছুটা সহজ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার চোখের একরাশ প্রশ্ন তখনও যায়নি। বলল মেয়েটা, ধন্যবাদ। আপনার কথা বুঝলাম, তবে আপনার পরিচয় কিন্তু এতে পাওয়া গেল না।
আহমদ মুসা জানালা দিয়ে একবার পেছনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, আমি আপনার মিত্র। আমাকে মা ঝু সুলতানের একজন ভাই বলতে পারেন।
মেয়েটার স্বাভাবিক হয়ে উঠা মুখে একটা রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল। তারপরেই বেদনায় ঢেকে গেল তার মুখ। বলল, আপনি আমাকে চিনেন?
আপনার নাম আমি জানতাম। আজকের কাগজ পড়ে আপনার নতুন দায়িত্বের কথাও জেনেছি। আপনার দায়িত্বের কারণেই কি ওরা আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল? বলল আহমদ মুসা।
হতে পারে। মা ঝুকে ওরা নিশ্চয় তার দায়িত্বের কারণেই কিডন্যাপ করেছে। বলল মেয়েটি।
গাড়িটি তখন তীরবেগে চলতে শুরু করেছে। উপত্যকাটা পার হয়ে পাহাড়ি রাস্তায় ঢুকে গেছে গাড়ি। রাস্তার দুপাশ বরাবর ছোট-বড় সবুজ পাহাড়ের সারি।
মেয়েটা বসেছে আহমদ মুসার পেছনের সিটের মাঝামাঝি। সামনের দুই সিটের মাঝখান দিয়ে সামনে ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছে সে আহমদ
মুসাকে।
আমার মনে হয় ওরা আরেকটা কারণেও কিডন্যাপ করতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
সেটা কি? জিজ্ঞাসা মেয়েটার। তার চোখে মুখে প্রচণ্ড কৌতূহল।
আপনি লিয়েন হুয়া প্রেসিডেন্ট লিউ জোয়ান ঝেং-এর ভাগনী, এটা একটা বড় কারণ হতে পারে। ওরা এমন সব লোকদের কিডন্যাপ করছে, যাতে সবার মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়। এই সাথে ওরা কিছু লোককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বিশেষ বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে। বলল আহমদ মুসা।
ভীতি সৃষ্টি করার ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য কি? লিয়েন হুয়া বলল।
আমিও পুরো ব্যাপারটা বুঝিনি। কিন্তু দুজন অস্ত্রবিজ্ঞানী এবং দুজন প্রত্নবিজ্ঞানীর কিডন্যাপ হওয়া থেকে আমার মনে হচ্ছে সন্ত্রাসী ঐ পক্ষটি অর্থ ও অস্ত্রবলেও বলীয়ান হতে চায়। বলল আহমদ মুসা।
লিয়েন হুয়া চোখ কপালে তুলল। শুধু বিস্ময় নয়, মনে মনে সে। চমকেও উঠল। সরকারসহ সবারই ধারণা ওরা কোনো এক সন্ত্রাসী গ্রুপ। টাকারও হয়তো সন্ধান করতে পারে। কিন্তু তারা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক। পারটিকলস দিয়ে কী করবে। নিশ্চয় বিজ্ঞানী ফা জি ঝাওকে মা ঝু’র বোন। হিসাবে সাম্প্রদায়িক কারণে কিডন্যাপ করতে পারে। বলল সে আহমদ, মুসার দিকে তাকিয়ে, ফা ঝি ঝাও-এর কিডন্যাপ হওয়া মা ঝু’র বোন হিসাবে, এটাই কি বেশি যুক্তিযুক্ত নয়? দুজন প্রায় একই সময়ে কিডন্যাপ হয়েছে।
হ্যাঁ মিস লিয়েন হুয়া, এটাও হতে পারে। তবে সন্ত্রাসীদের পরিচয় স্পষ্ট না হলে শুধু যুক্তি দিয়ে সবকিছু বোঝা যাবে না। বলল আহমদ মুসা।
আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনি…।
লিয়েন হুয়া কথা শেষ করতে পারলো না। তার কথার মাঝখানেই বলে উঠল আহমদ মুসা, মিস লিয়েন সামনেই আরেকটা চার রাস্তার মোড়।
আপনি কোথায় যেতে চান, বেইজিং-এ?
আহমদ মুসার গাড়ি ঘন পাহাড় এলাকা থেকে তখন বেরিয়ে এসেছে। যে এলাকায় এখন গাড়ি, সেটাও অনেকটা এবড়ো-থেবড়ো মাঠ। কিন্তু সবদিকে সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
হ্যাঁ, আমি বেইজিং-এ ফিরবো। বাড়িতে নিশ্চয় এতক্ষণ উদ্বেগ-আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। আপনি দয়া করে যাবেন বেইজিং-এ। লিয়েন হুয়া বলল।
এ এলাকায় যথেষ্ট ট্যাক্সি পাওয়া যায়, ডাকাও যায়। আপনি কী ট্যাক্সিকে নিরাপদ মনে করবেন? বলল আহমদ মুসা।
আপনাকে কষ্ট না দেবার এটা একটা পথ। কিন্তু আমি একা যেতে পারবো না। লিয়েন হুয়া বলল।
তাহলে বেইজিং যাওয়ার জন্যে ডাইনে না বাঁয়ে টার্ন নেয়া ভালো হবে? বলল আহমদ মুসা।
ডান দিক দিয়ে। লিয়েন হুয়া বলল।
এ সময় সামনে থেকে সাইরেনের একটা শব্দ পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে বলল, পুলিশের গাড়ির সাইরেন। এদিকেই আসছে।
লিয়েন হুয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আহমদ মুসার গাড়ি যখন চৌরাস্তায় পৌঁছল, তখন পুলিশের গাড়িও চৌরাস্তার মুখে। আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড় করাল।
পুলিশের গাড়িও ছুটে এসে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে গেল আহমদ মুসার গাড়ির গতিরোধ করে।
আহমদ মুসার মন শুরু থেকেই খুঁতখুঁত করছিল। পুলিশ এত তাড়াতাড়ি জানতে পারল কি করে? কে জানাল তাদের? আর এভাবে গাড়ির সামনে গতিরোধ করার মতো আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে যাওয়াকেও আহমদ মুসা ভালো চোখে দেখল না।
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে দ্রুত লিয়েনকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের অবস্থান এবং আপনার খবর কি আপনি বাড়িতে বা পুলিশকে জানিয়েছেন। এর মধ্যে?
আমার কাছে মোবাইল নেই। শুরুতেই ওরা কেড়ে নিয়েছে। লিয়েন হুয়া বলল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। কিছু বলল না আহমদ মুসা লিয়েন হুয়াকে।
পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তেই পুলিশরা ছুটে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। তাদের সকলের হাতে স্টেনগান বাগিয়ে ধরা।
পুলিশের কয়জন প্রথমেই ছুটে এসেছিল লিয়েন হুয়ার বাম জানালায়। লিয়েন হুয়া জানালা খুলে দিয়েছিল।
পুলিশের অফিসার গোছের একজন জানালার সামনে এসে লিয়েন। হুয়াকে খুবই ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, আপনিই তো লিয়েন হুয়া?
জিজ্ঞেস করে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, আমরা নির্দেশ পেয়েছি, আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
আহমদ মুসা বাম পাশের দরজায় এসে গিয়েছিল।
পুলিশ অফিসারটি কথা শেষ করেই লিয়েন হুয়ার দরজা খোলার জন্যে। দরজার হাতলে হাত দিল।
লিয়েন হুয়া তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা দ্রুত তার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো।
আহমদ মুসা বেরোবার সাথে সাথে দুতিনটি স্টেনগানের ব্যারেল তার দিকে ঘুরে এলো। আহমদ মুসার সবচেয়ে কাছে লিয়েন হুয়ার দরজায় দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারটি। তাঁর কাঁধে একটা স্টেনগান। রিভলবারও তার কোমরে ঝুলছে। রিভলবারের বাটের হাল্কা চকলেট বটম তলটি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার চোখে। ভীষণ চমকে উঠল আহমদ মুসা রিভলবারের বাটের সেই বটমে চীনের বিলুপ্ত ভাষা হানজুর। প্রথম বর্ণ কালো অক্ষরে উত্তীর্ণ দেখে। তাহলে তো এরা সবাই সন্ত্রাসী দলের সদস্য। তারা এবার পুলিশের বেশে এসেছে হারানো শিকার লিয়েন হুয়াকে ধরে নিয়ে যেতে। এত দ্রুত ওদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ওদের ভয়ঙ্কর কৌশল দেখে আঁতকে উঠল আহমদ মুসা। ওদের দিকে আরেকবার চোখ বুলাতে গিয়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা। ওদের সবার বুট এক রকমের নয়। চারজনের বুট কালো, কিন্তু তিনজনের বুট ডীপ। চকলেট রঙের।
তিনজনের স্টেনগান তখনও আহমদ মুসার দিকে তাক করা।
আপনারা লিয়েন হুয়াকে নিয়ে যেতে এসেছেন, কিন্তু আমার দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছেন কেন? যার বা যাদের নির্দেশে আপনারা এসেছেন, তারা আপনাদের কি ব্রীফ করেছে? আমাকে শত্রু ভাবলেন কোন। যুক্তিতে? বলল আহমদ মুসা।
লিয়েন হুয়ার পাশের দরজা খুলে গেছে। আহমদ মুসাকে গাড়ির দরজা। খুলে বেরোতে দেখে লিয়েন হুয়াও তার দরজা খুলে দিয়েছিল।
আহমদ মুসার কথা শুনে লিয়েন হুয়ার দরজায় দাঁড়ানো অফিসারটি কিছুটা সরে এলো। বলল, আমরা লিয়েন হুয়াকে চিনি, আপনাকে নয়। আপনি মিত্র তা প্রমাণও হয়নি। প্রমাণ হয়েছে উল্টোটাই। আমাদের প্রেসিডেন্টের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কোথায়, কেমন আছে এখনও পুলিশকে জানাননি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, প্রেসিডেন্টের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য লিয়েন হুয়া এখন এই রাস্তার এখানে, এটা আপনাদের কে জানিয়েছে? পুলিশ কীভাবে জানতে পেরেছে? আপনারা কোত্থেকে, কোন পুলিশ ফাড়ি বা কোন পুলিশ স্টেশন থেকে…?
জ্বলে উঠল অফিসার লোকটি। আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে দিল না। চোখের পলকে রিভলবার তুলে নিয়ে ট্রিগার টিপল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসা অফিসার লোকটির চোখে চোখ রেখেই কথা বলছিল। অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে সে হোল্ডার থেকে রিভলবার তুলে নিয়ে আহমদ মুসাকে গুলি করছিল। কিন্তু তা. আহমদ মুসার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। নিমেষে আহমদ মুসা মাথা ও বাম হাত পেছনে নিয়ে দেহটাকে মাটিতে ছুঁড়ে দিয়েছিল। তার মাথা মাটি স্পর্শ করার আগেই কাঁধে ঝুলানো, মিনি ব্যারেলের কারবাইনের ট্রিগার চেপে ধরেছিল ডান হাত দিয়ে অফিসারটিকে লক্ষ্য করে এবং সেটা ডানদিকে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরিয়ে নিল।
আহমদ মুসা পেছন দিকে জাম্প করায় অফিসার লোকটির গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। দ্বিতীয় গুলি করার আর তার সুযোগ হলো না। আহমদ মুসার কারবাইনের গুলির অসহায় শিকারে পরিণত হলো সে। স্টেনগান বাগিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো তার অন্য সাথীরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কিছু করার আগেই তারাও আহমদ মুসার গুলিবৃষ্টির গ্রাসে পরিণত হলো।
গুলিবৃষ্টি করেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা। তাকিয়েছিল পেছন দিকে। দেখল, আড়াআড়িভাবে দাঁড়ানো ওদের মাইক্রোর দরজায় একজনের স্টেনগানের নল আহমদ মুসার দিকে উঠে আসছে।
আহমদ মুসা নিজেকে পাশে ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল, মিস লিয়েন, আপনি গাড়ির মেঝেতে শুয়ে পড়ন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুলির ঝাঁক ছুটে এলো মাটির তিন ফুট উঁচু বরাবর। আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে থাকলে তার কোমরের উপরের দিকটা ঝাঁঝরা হয়ে যেত। কিছু গুলি লিয়েন হুয়ার। মাইক্রোর দরজা এবং দরজার ভেতরের সিটে আঘাত করেছে। আহমদ মুসার নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গেই লিয়েন হুয়া গাড়ির মেঝেতে শুয়ে পড়তে পেরেছিল।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই ঐ মাইক্রোর দরজায় দাঁড়ানো লোকটির লক্ষ্যে কারবাইনের ট্রিগার টিপে ধরল। লোকটি তার স্টেনগানের ব্যারেল নতুন টার্গেটে ঘুরিয়ে নেবার আগেই আহমদ মুসার গুলির শিকার হলো।
আর কোনো দিক থেকে গুলি এলো না। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। মাইক্রোর দরজার দিকে এগিয়ে গেল আহমদ মুসা। লিয়েন হুয়া তখনও গাড়ির মেঝেতে শুয়ে আছে।
মিস লিয়েন হুয়া, আপনি ঠিক আছেন তো? উঠুন এখন। ওদের আর কেউ বেঁচে আছে বলে মনে হয় না। বলল আহমদ মুসা।
বাম বাহু চেপে ধরে উঠে দাঁড়াল লিয়েন হুয়া।
আপনি আহত? বাম বাহুতে গুলি লেগেছে আপনার? দ্রুত ও উদ্বিগ্ন কণ্ঠ আহমদ মুসার।
ধন্যবাদ স্যার। বাহুতে গুলি লেগেছে। কিন্তু আপনি শুয়ে পড়তে না বললে, আর সময় মতো সরতে না পারলে গুলি বুকে লাগত। দেখুন…।
লিয়েন হুয়ার কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, গুলিবিদ্ধ স্থান থেকে আপনার প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আপনি সিটে বসুন। আমি দেখছি গাড়িতে ফাস্ট এইডের কিছু আছে কিনা।
থাক স্যার। এখান থেকে এখনই সরে পড়া দরকার। আবার কোন বিপদ আসে কে জানে? লিয়েন হুয়া বলল।
আপনার কথা ঠিক। কিন্তু এভাবে রক্তপাত হতে থাকলে বিপদ হবে। কখন কোথায় হাসপাতাল পাওয়া যাবে কে জানে! বলল আহমদ মুসা।
এখানে বেশি দেরি করলে আরও বিপদে পড়তে হতে পারে। এতগুলো পুলিশ মারা গেছে। বলে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে। তারা আপনাকে প্রথম গুলি করেছে। এগুলো এখন আর কেউ দেখবে না। এতগুলো পুলিশ মারা গেছে, এটাই বড় হয়ে উঠবে।
আহমদ মুসা হাসল।
আপনি হাসছেন যে! লিয়েন হুয়ার দুই চোখভরা বিস্ময়।
এ মাইক্রোতে ফাস্ট এইডের কিছু দেখছি না। আমার কাছে যে ব্যান্ডেজ আছে তাতেই কাজ চলবে। গুলির ক্ষতস্থানটা একটু দেখব। গুলি ভেতরে না থাকলে ছোটখাটো একটা ব্যান্ডেজ দিলেই রক্ত কমতে পারে। বলে আহমদ মুসা এগোলো লিয়েন হুয়ার বাম হাতের দিকে।
লিয়েন হুয়া বাম বাহুটা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ভীষণ তো লাগবে স্যার।
আপনি মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিন। বলে আহমদ মুসা লিয়েন হুয়ার বাম হাতের ফুল শার্টের হাতা ছিঁড়ে ফেলল। দেখল গুলিটা বাম বাহুর বাইরের প্রান্তে লেগেছে। ক্ষতটা বেশ গভীর।
আহমদ মুসা ক্ষতস্থানের প্রকৃতিটা দেখে বলল, চিন্তার কিছু নেই মিস। লিয়েন, গুলিটা বেরিয়ে গেছে।
বলে আহমদ মুসা তার পিঠে আটকানো ব্যাগ থেকে ব্যান্ডেজের একটা ছোট রোল বের করল।
ক্ষতস্থানের রক্ত পরিষ্কারের শুরুতেই কেঁপে উঠল লিয়েন হুয়া। বলল, স্যার, পরিষ্কার না করে কিছু একটু বেঁধে দিন।
ঠিক আছে, আর লাগবে না। খুব আস্তে করে রক্তটা একটু মুছে দেব। বলল আহমদ মুসা।
খুব আলতোভাবে ক্ষতস্থানের রক্ত মুছে একটু শক্ত করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল আহমদ মুসা। বলল, আর অসুবিধা নেই। মেডিকেটেড স্পঞ্জ ব্যান্ডেজটি শুধু রক্তপড়া বন্ধ নয়, ব্যথারও কিছু উপশম ঘটাবে।
ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু স্যার আর লাগবে না বললেন, কিন্তু খুব লেগেছে।
বলে মুখ এদিকে ঘুরিয়ে ব্যান্ডেজটা দেখে বলল, খুব সুন্দর হয়েছে স্যার। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ব্যান্ডেজও আপনি ভালো বাঁধেন দেখছি।
লিয়েন হুয়ার কথা যেন আহমদ মুসার কানেই যায়নি, এমনভাবে বলে উঠল, মিস লিয়েন হুয়া, আপনি একটু বসুন। আমি এই লোকগুলোকে এবং তাদের গাড়ি সার্চ করে আসছি।
এ লিয়েন হুয়া তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে কিছুটা বিস্ময়। বলল, পুলিশকে এবং তাদের গাড়িকে সার্চ করা আপনার দরকার কেন?
পরে বলব, আমি আসি। বলে আহমদ মুসা দ্রুত লোকগুলোর দিকে এগোলো।
আহমদ মুসা লোকগুলোর সবগুলো পকেট, জ্যাকেট-জামার হাতা, কলার ব্যান্ড, বাহু-কাঁধ, মানিব্যাগ সব পরীক্ষা করল। ম্যানিব্যাগ দেখে তা তাদের পকেটেই রেখে দিল।
লিয়েন হুয়া আহমদ মুসার কাজ অপলক চোখে দেখছিল আর ভাবছিল।
প্রায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আহমদ মুসা ফিরে এলো। গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। সার্চ করে কিছু পেলেন? কি সার্চ করছিলেন? লিয়েন হুয়া বলল।
ওদের পরিচয় সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
ওদের পরিচয়ের কি প্রয়োজন? ওরা তো পুলিশ। লিয়েন হুয়া বলল।
ওরা পুলিশ নয় মিস লিয়েন। পুলিশের পোশাক পরে ওরা এসেছিল। আপনাকে নিয়ে যেতে। বলল আহমদ মুসা।
কি বলছেন আপনি! আর্তনাদ করে উঠল লিয়েন হুয়ার কণ্ঠ। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় তার মুখ পাংশু হয়ে উঠেছে।
কিছুক্ষণ সে কথা বলতে পারলো না। কাঁপছে তার ঠোঁট। দুচোখ জুড়ে তার নেমে এসেছে রাজ্যের ভয়। ভেতরটা কাঁপছে তার। এক বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে আহমদ মুসার দিকে।
অনেকক্ষণ পর সে বলল, ওরা কারা স্যার? কম্পিত কণ্ঠ তার।
আপনাকে যারা কিডন্যাপ করেছিল এবং মা ঝু, ফা জি ঝাও ও অন্যদের যারা কিডন্যাপ করেছে, এরা তারাই। বলল আহমদ মুসা।
কেঁপে উঠল লিয়েন হুয়া। বলল, আগের কিডন্যাপকারীদেরই লোক এরা? গলা কাঁপছে লিয়েন হুয়ার।
হ্যাঁ, মিস লিয়েন। বলল আহমদ মুসা।
আবার নীরব হয়ে গেল লিয়েন হুয়া। রাজ্যের ভয় তাকে পেয়ে বসেছে। সে তো পুলিশদের সাথে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছিল। এই লোকটি ওদের চিনতে না পারলে কি ঘটত! ভয়ে তার কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হতে চাইল। দুর্বল ও রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলল, স্যার, আপনি আমাকে দ্বিতীয়বার জীবন দিলেন। কিন্তু ওদের চিনতে পারলেন কি করে? আমি তো ওদের সাথে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছিলাম।
গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে। আহমদ মুসার দুই হাত স্টিয়ারিং হুইলে। দৃষ্টি সামনে। বলল, পুলিশ কি করে খবর পেল যে, আপনি মুক্ত হয়েছেন, আপনি এই গাড়িতে এই পথে আসছেন, এটা ছিল আমার প্রথম সন্দেহের বিষয়। তারপর গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ অফিসারের রিভলবারের বাটের বটমে একটা বিশেষ বর্ণ উত্তীর্ণ দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম ওরা
পুলিশ নয়, সন্ত্রাসী দলের অংশ। তাছাড়া ওদের জুতার রং ছিল দুই রকমের, কালো এবং উপ চললেট। পুলিশের ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে না।
দুচোখে বিস্ময় ঝরে পড়ল লিয়েন হুয়ার।
অপার বিস্ময় নিয়ে সে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বুকে তার অনেক কথার তোলপাড়। তিন-তিনটা উদ্যত স্টেনগানের মুখে দাঁড়িয়ে এত কিছু তার চোখে পড়ল কি করে? জুতার কালার দেখে তো আমার মনে কোনো প্রশ্নই দাঁড়াতো না। আর একটা বর্ণ উৎকীর্ণ দেখে কেন বুঝলেন তিনি যে ওঁরা পুলিশ নয়, সন্ত্রাসী!
লিয়েন হুয়া বলল, অবিশ্বাস্য আপনার সূক্ষ্ম দৃষ্টি, অপূর্ব আপনার নার্ভের শক্তি। কিন্তু বর্ণটি কি? সে বর্ণের সাথে এদের সন্ত্রাসী হওয়ার সম্পর্ক আছে?
চীনে যাকে গোল্ডেন এজ বলা হয়, সেই গোল্ডেন এজ-এর প্রথম সম্রাটের (ইয়েলো সম্রাট) জাতি, মানে শাসক জাতির নাম হুয়াজিয়া।
হুয়াজিয়াদের ভাষার নাম হানজু। হানজু ভাষা অবলুপ্ত হলেও এই ভাষা থেকেই চীনা ভাষার উদ্ভব। হানজু ভাষাকে খুবই পবিত্র মনে করা হয়। এই ভাষার প্রথম বর্ণকেই সন্ত্রাসীরা তাদের পরিচয়ের সিম্বল বানিয়েছে। পুলিশ পরিচয়দানকারী অফিসারের রিভলবারের বাটের বটমে এই বর্ণকেই উল্কীর্ণ দেখেছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
লিয়েন হুয়ার চোখে-মুখে বিস্ময় যেন উপচে পড়ছে। সে ভেবে পেলো, একজন লোক চীনা নয়, চীনের বাসিন্দাও সম্ভবত নয়, সে, এরই মধ্যে গোপন সন্ত্রাসীদের এতটা চিনে ফেলেছে! অথচ চীনা পুলিশ, গোয়েন্দা সন্ত্রাসীদের নাম, পরিচয়, উদ্দেশ্যের কিছুই জানতে পারেনি। এমনকি ওদের মুখোমুখিও হতে পারেনি এখনও। অদ্ভুত একজন লোক চীনে এসে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কীভাবে একাই লড়াই করেছে, সে সম্পর্কে কিছু শুনেছিলাম। ইনিই কি তিনি? নিজে যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য। বিদেশি ও অপরিচিতা এক মেয়েকে রক্ষার জন্যে আগে-পিছে শত্রু নিয়ে একা একজন এভাবে ছুটে এলো। চারদিক থেকে চারটি গাড়ি দ্বারা ঘেরাও হবার পরেও তাদের পরাজিত করে লিয়েন হুয়াকে সে উদ্ধার করল। পুলিশবেশী সন্ত্রাসীদের হত্যা করে সে লিয়েন হুয়াকে দ্বিতীয়বারের মতো বাঁচাল। কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধায় নুয়ে গেল লিয়েন হুয়ার হৃদয়।
চিন্তার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল লিয়েন হুয়া। তার মনে ভেসে উঠা প্রশ্নটিও চাপা পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু এরই মধ্যে সংবিৎ ফিরে পেয়েই প্রশ্নটি করল লিয়েন হুয়া। বলল, স্যার, মনে হচ্ছে আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। প্লেনের হাইজ্যাক প্রচেষ্টা বানচাল করে যিনি আমাদের প্রত্নতত্ত্ব পণ্ডিতের কিডন্যাপ ঠেকিয়েছিলেন। তারপর সন্ত্রাসীদের সাথে যার কয়েকটা বড় সংঘাত হয়েছে, আপনি তো সেই লোক। কিন্তু স্যার, এই সেদিন আপনি চীনে প্রবেশ করলেন। এর মধ্যে সন্ত্রাসীদের সিম্বল আপনার কাছে ধরা পড়ে গেল কি করে? আর সিম্বলটা যে কোনো বর্ণ তা আপনি বুঝলেন কি করে? অবলুপ্ত এই আদি চীনা বর্ণকে আপনি কিভাবে চিনলেন?
আমি লু ঝি’র মামার সাহায্য নিয়েছি। লু ঝি’র মামা ভাষাবিজ্ঞানী প্রফেসর হুয়াং ফুর কাছেই জেনেছি হানজু বর্ণমালা সম্পর্কে। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু এই বর্ণটা যে একটা সন্ত্রাসী গ্রুপের সিম্বল, সেটা কি করে বুঝলেন? লিয়েন হুয়া বলল।
এই গ্রুপের আড়াই থেকে তিন ডজনের মতো লাশ আমি পরীক্ষা করেছি। সব লাশের কলার ব্যান্ড, বাহু বা অন্য কোথাও এই বর্ণটিকে উত্তীর্ণ থাকতে দেখেছি। বড় বড় গ্যাং…।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই লিয়েন হুয়া বলল, স্যার, আমরা বেইজিং-এ প্রবেশ করছি। সামনের গেটটাই বেইজিং-এ প্রবেশের প্রথম চেকপোস্ট।
হ্যাঁ, রাস্তার দুধারেই অনেক পুলিশ দেখছি। নিশ্চয় ওখানে বড় দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার থাকবেন। আপনাকে ওদের দায়িত্বে দিয়ে তো আমি চলে যেতে পারি? বলল আহমদ মুসা।
না স্যার, আমি কোনো পুলিশের আশ্রয়ে যাব না। ওই ঘটনার পর এখনও আমার বুক কাঁপছে। আমার বাড়িতে আপনাকে যেতে হবে। লিয়েন হুয়া বলল।
যেতে পারি এক শর্তে। আমি গাড়ি থেকে নামবো না। বলল আহমদ মুসা।
তা কি করে হয় স্যার? আমার পরিবার ছাড়বেন কেন আপনাকে? লিয়েন হুয়া বলল।
আমি তো পরিবার পর্যন্ত যাচ্ছি না। যাচ্ছি প্রেসিডেন্ট প্যালেসের গেট পর্যন্ত। সেখানে আপনার পরিবারের লোকরা থাকে না। বলল আহমদ। মুসা।
ঠিক আছে স্যার।
একটু থেমেই আবার বলল লিয়েন হুয়া, আপনার খুব তাড়া আছে? কোথাও কি কোনো প্রোগ্রাম আছে স্যার?
না, কোনো প্রোগ্রাম নেই। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে তাড়া কেন? যাবেন কোথায়? লিয়েন হুয়া বলল।
আহমদ মুসা তাকাল লিয়েন হুয়ার দিকে। একটু ভাবল। তারপর বলল, আমি আপনাকে বলেছিলাম, আমি মা ঝু সুলতানের, একজন ভাই। আমি মনে করি মা ঝুকে যারা কিডন্যাপ করেছে, তারাই লু ঝিকে কিডন্যাপ করেছে এবং অন্যদেরকেও- এটাও আপনাকে বলেছি। আমি খুঁজতে চাচ্ছি তাদের কারা কোথায় আটকে রেখেছে। আমি তাদের উদ্ধার করতে চাই।
লিয়েন হুয়ার চোখে-মুখে ফুটে উঠল রাজ্যের বিস্ময়। ভাবল সে, এই লোক বিস্ময়কর বুদ্ধি, সাহস ও যোগ্যতার অধিকারী। কিন্তু একা এক মানুষ কীভাবে এই কথা বলতে পারে! আমাদের রাষ্ট্রের গোটা ব্যবস্থা যেখানে তাদের সন্ধান করতে গিয়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে, সেখানে উনি একা এ কাজ করতে যাচ্ছেন? কে ইনি? উনি তো মা ঝু’র ভাই নন, লু ঝি’র কেউ নন। আমাকে বাঁচাতে এসেছিলেন নিজের জীবন বিপন্ন করে, আমাকে তো। উনি চিনেন না। কে ইনি?
স্যার, এ পর্যন্ত আপনাকে যতটুকু চিনেছি, আপনি এই কথা বলতেই পারেন। কিন্তু এককভাবে এমন অভিযান কি সম্ভব, না উচিত? স্যার…।
লিয়েন হুয়ার কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, মিস লিয়েন হুয়া, সম্ভব-অসম্ভবের কথা আপনি বলতে পারেন, ঔচিত্য নিয়ে প্রশ্ন নিশ্চয় তুলতে পারেন না। কিন্তু বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্যের প্রশ্ন যখন সামনে আসে, তখন এত কিছু ভাবার সময় থাকে না। আমিও তা ভাবিনি। আর। এই অনুসন্ধানে আমি একা কই? সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও তো এই অনুসন্ধান ও তাদের উদ্ধারের কাজ নানাভাবে করছেন।
আমার জিজ্ঞাসার জবাব এটা হলো না স্যার। আপনার বিষয়টা একক, আর সরকারের ব্যাপারটা রাষ্ট্রশক্তির পরিচালনায় টিমওয়ার্ক। থাক এ প্রসঙ্গ স্যার। আমার বিস্ময় হলো, সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার লোক আছে, অন্যায় কাজে বাধা দেবার লোকও আছে। কিন্তু অপরিচিত জনদের পক্ষে নিজের জীবন বিপন্ন করে অব্যাহত লড়াই করার লোক দুনিয়াতে খুব কম আছে।
কথা শেষ করেই লিয়েন হুয়া বলে উঠল, আমরা এসে গেছি স্যার। ঐ তো সামনের গেট দিয়ে ভেতরের ফ্যামিলি এনক্লোজারে দেখা যাচ্ছে আমার মামী লি চুন হুয়া এবং আমার মামাতো বোন ফেন ফ্যাংকে।
প্রেসিডেন্টের প্যালেস এরিয়ায় আসার পর বেশ কয়েকটি সিকিউরিটি চেক পার হয়েছে তারা। মূল গেটের প্রায় দশ গজ দূরে সর্বশেষ সিকিউরিটি বক্স। উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন সিকিউরিটি অফিসার দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসাকে গাড়ি দাঁড় করাতে হলো।
অফিসাররা এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে।
একজন অফিসার বিনীত কণ্ঠে লিয়েন হুয়াকে বলল, ম্যাডাম, এই গাড়ি আর সামনে এগোতে পারবে না। ড্রাইভ করছেন যিনি, তিনিও আর সামনে যেতে পারবেন না। ম্যাডাম, আপনার জন্যে গাড়ি প্রস্তুত। আপনি আসুন।
সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা বলে উঠল লিয়েন হুয়াকে উদ্দেশ্য করে, ঠিক আছে ম্যাডাম, ওঁরা প্রোটোকলের কথা বলেছেন, যা সবাইকে মানতে হবে। আমি আপনার কাছে বিদায় চাচ্ছি।
লিয়েন হুয়া কোনো উত্তর না দিয়ে বলল অফিসারটিকে, অফিসার, আমাদের এই মেহমান এবং তার গাড়ি আমাদের ফ্যামিলি গাড়ি বারান্দায়। যাবে। আমি আসছি।
বলে গাড়ি থেকে নেমে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে লিয়েন হুয়া দুই হাত জোড় করে বলল, ক্ষমা করুন স্যার। একটু অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।
ছুটল লিয়েন হুয়া গেটের দিকে।
একজন বড় অফিসার আহমদ মুসার গাড়ির জানালায় এসে বলল, স্যার, মাফ করুন। আইনের শৃঙ্খলে আমরা বাধা। প্লিজ আপনি কি গাড়িটা রাস্তার এই পাশটায় একটু সরিয়ে নেবেন?
অফকোর্স অফিসার।
বলে আহমদ মুসা তার গাড়ি রাস্তার পাশে সরিয়ে নিল। গাড়িটা কিছুটা। সামনে এগিয়ে গেটের সিকিউরিটি বক্সের প্রায় গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে গেল। মাঝখানে দেড় দুই ফুটের মতো ফুটপাত।
গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হতেই আঞ্চলিক চীনা ভাষার কথা আহমদ মুসার কানে এলো সিকিউরিটি বক্সের দিক থেকে। চাপা কণ্ঠ থেকে কথাগুলো বের হচ্ছে। কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট
কাউকে বলা হচ্ছে: …হ্যাঁ, সাথে একজন লোক। …বলছি, গাড়ির নাম্বারটা হলো : OOPG011-3399…। ঠিক আছে, ও যখন ফিরবে জানাব।….হ্যাঁ, লোকটা এশিয়ান। ওকে বাই।
কথা বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসার কপাল কুঞ্চিত। চোখে-মুখে ভাবনার গভীর ছায়া। আমার গাড়ির নাম্বারটা সিকিউরিটির লোকটা কাকে দিল? লিয়েন হুয়া ফেরার কথা বাইরে থেকে লোকটাকে কে জিজ্ঞেস করল? আমি কখন ফিরব, আমার পরিচয় কে জানতে চাইলো, কেন জানতে চাইলো? ভাবল আহমদ মুসা, প্রশ্নগুলোর জবাব একটাই হতে পারে, এরা লিয়েন হুয়ার কিডন্যাপার গ্রুপ। যদি তাই হয়, তাহলে এটা নিশ্চিত যে, প্রেসিডেন্ট হাউজের সিকিউরিটি টিমে তাদের লোক আছে।
মনের এই চিন্তা নিয়েই সে তাকিয়ে ছিল সিকিউরিটি বক্সের দিকে। আহমদ মুসা দেখল, সিকিউরিটি বক্সের ভেতরের কথা শেষ হবার মিনিট খানেক পরেই সিকিউরিটি বক্স থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই কিছুটা সামনে রাস্তার ধার বরাবর দাঁড়ানো একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ম্যাডাম কি বলে গেলেন?
স্যারকে ওয়েট করতে বলে গেছেন। মনে হয় ফিরবেন।
সিকিউরিটি বক্স থেকে বেরিয়ে আসা লোকটি এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে। মাত্র দুই গজের ব্যবধান।
আহমদ মুসার চোখ নিবদ্ধ হয়েছে তার বুকের নেমপ্লেটের দিকে। নাম সু লীন।
সু লীনের নেমপ্লেটের দিকে চাইতে গিয়েই নেমপ্লেটের নিচের বোতামের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। বোতামটার ঠিক মাঝখানে একটা স্বচ্ছ বিন্দু নজরে পড়ল। হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার মুখে। এ বিন্দুর সাথে সে পরিচিত। এটা অত্যন্ত শক্তিশালী ক্যামেরার চোখ, সেই সাথে বিরাট শক্তির ট্রান্সমিটারও
এর বিশেষ একটা গুণ হলো, কোনো স্পাই ট্যাগ ডিটেক্টরেই এটা ধরা পড়ে না। আহমদ মুসা নিশ্চিত তার ছবি পাঠানো হলো তার শত্রু সন্ত্রাসীদের কাছে।
স্যরি স্যার, আপনাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্যে। স্যারের…।
কথা শেষ করতে পারল না সিকিউরিটি অফিসারটি।
অয়্যারলেসে কথা বলতে বলতে একজন ঊর্ধ্বতন অফিসার ছুটে এলো আহমদ মুসার কাছে।
ওদিকে লিয়েন হুয়াকে গেটের দিক থেকে ছুটে আসতে দেখা গেল।
ঊর্ধ্বতন অফিসারটি বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ওয়েলকাম স্যার। গাড়িসহ আপনার যাবার অনুমতি হয়েছে। আপনার কষ্ট হওয়ার জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত স্যার।
লিয়েন হুয়াও এসে আহমদ মুসার পাশের সিটে উঠল। বসেই বলল, স্যরি স্যার। একটু অসুবিধা হলো।
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, যা ঘটেছে, তা খুবই স্বাভাবিক।
গাড়ি পৌঁছল প্রেসিডেন্ট হাউজের ফ্যামিলি গাড়ি বারান্দায়।
লাফ দিয়ে নামল লিয়েন হুয়া গাড়ি থেকে।
ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল, ওয়েলকাম স্যার, আসুন।
গাড়ি বারান্দার প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল লিয়েন হুয়ার মামী, প্রেসিডেন্ট-পত্নী লি চুন হুয়া এবং ফেন ফ্যাং।
লিয়েন হুয়া আহমদ মুসাকে নিয়ে এগিয়ে যেতেই প্রেসিডেন্ট-পত্নী, লিয়েন হুয়ার মামী স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে।
লিয়েন হুয়া আহমদ মুসাকে পরিচয় করিয়ে দিল তার মামীর সাথে। বলল, মামাকে হয়তো দেখতে পাবেন না। প্রেসিডেন্ট পদের অনেক = ঝামেলা।
না লিয়েন, ফেন ফ্যাং-এর বাবা ফ্যামিলি ড্রয়িং রুমে এসেছেন। তিনি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। তোমার আহত হবার খবরও উনি জেনেছে। উদ্বিগ্ন উনি। চল ওখানে গিয়েই পরিচয় হবে। বলল লিয়েন। হুয়ার মামী, প্রেসিডেন্টের স্ত্রী এবং ফেন ফ্যাং-এর মা।
বলেই লি চুন হুয়া, প্রেসিডেন্টের পত্নী, আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, আসুন প্লীজ।
হাঁটতে শুরু করল লি চুন হুয়া। তার সাথে সকলেই চলতে শুরু করল। লিয়েন হুয়া আহমদ মুসার পাশাপাশি হাঁটছিল।
স্যার, মামা প্রেসিডেন্ট হলেও পরিবারে তিনি অত্যন্ত স্নেহশীল একজন পরিবারকর্তা। বলল লিয়েন হুয়া আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
ফেন ফ্যাং একটু পিছিয়ে এসে লিয়েন হুয়ার পাশে হাঁটতে লাগল।
লিয়েন হুয়া তার হাতটা ফেন ফ্যাং-এর কাঁধে রাখল। বলল, ভালো। আছিস?
ফেন ফ্যাং লিয়েন হুয়ার আহত হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, কি সাংঘাতিক, গুলি লেগেছে তোমার হাতে। খুব কষ্ট হয়েছে না, খুব কষ্ট হচ্ছে না? ফেন ফ্যাং-এর কণ্ঠ কান্না ভেজা।
একটা ঢোক গিলে সে আবার বলে উঠল, জান তোমার কিডন্যাপ হওয়ার পর থেকে বাবার বলতে গেলে নাওয়া-খাওয়া নেই। অয়্যারলেস হাতে নিয়ে বসে আছেন। কোনো খবর যোগাড় করতেও ব্যর্থ হওয়ায় ভীষণ বিরক্ত তিনি গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশের উপর। বাবাকে এভাবে মুষড়ে পড়তে কেউ নাকি কোনো দিন দেখেনি।
ফ্যামিলি ড্রয়িং রুমের দরজায় পৌঁছে গেল তারা সকলেই।
স্বয়ং প্রেসিডেন্ট লিউ জিয়াং ঝেং ড্রয়িং রুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট-পত্নী লি চুন হুয়া প্রেসিডেন্টের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, লিয়েনের পাশে যে ছেলেটি, সেই লিয়েনের উদ্ধারকারী।
প্রেসিডেন্ট দুহাত বাড়াল লিয়েনের দিকে। লিয়েন ছুটে এলো তার মামার কাছে।
প্রেসিডেন্ট তাকে জড়িয়ে নিল বুকে। বলল, ইশ্বরকে ধন্যবাদ মা, তুই ফিরেছিস।
স্যরি মামা, তোমাকে টেনশনে ফেলেছিলাম। লিয়েন হুয়া বলল।
আমার মা ফেন ফ্যাং আমার হৃদপিণ্ডের একটা অংশ, আরেকটা অংশ তুই মা। বলল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট-পত্নী লি চিন হুয়া বলল, চলুন মি. প্রেসিডেন্ট, বসা যাক। লিয়েন আহত, ওকে ছাড়তে হবে চিকিৎসার জন্যে।
হ্যাঁ, সব ঠিক আছে, ওটিতে তার জন্যে সবাই অপেক্ষা করছে। তাহলে ফেন লিয়েন হুয়া মাকে নিয়ে যাক। বলল প্রেসিডেন্ট।
প্লিজ মামা, স্যারকে বিদায় দিয়েই আমি যাব। লিয়েন হুয়া বলল।
স্যার মানে যে তোমাকে বাঁচিয়েছেন? ঠিক আছে মা। তাই হবে। বলল প্রেসিডেন্ট।
বলে প্রেসিডেন্ট তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, কাম অন ইয়ংম্যান। এস আমরা বসি।
সবাই বসল।
প্রেসিডেন্ট একটা সোফায় বসেছে। তার পাশের সোফায় প্রেসিডেন্ট পত্নী লি চিন হুয়া। তার দুপাশে ফেন ফ্যাং ও লিয়েন হুয়া।
আহমদ মুসা বসেছে তাদের সামনের এক সোফায়।
বসেই উঠে দাঁড়াল লিয়েন হুয়া। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, স্যার, মি. প্রেসিডেন্ট ও ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট মানে আমার মামা-মামীকে আপনি নিশ্চয় চিনেছেন। আর মামা-মামী, আমি যাকে স্যার বলছি তিনি তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে আমাকে উদ্ধার করেছেন, আমাকে দুবার বাঁচিয়েছেন।
– ইয়ংম্যান তুমি যা করেছ, কোনো প্রশংসাই তার জন্যে যথেষ্ট নয়। শুধু তুমি লিয়েন হুয়াকে নয়, আমাদের গোটা পরিবারকে নতুন জীবন দিয়েছ। আমরা খুশি। আমরা কৃতজ্ঞ ইয়ংম্যান তোমার প্রতি। আমার পুলিশ গোয়েন্দারা ব্যর্থ হয়েছে যা করতে, আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে লিয়েন। হুয়াকে তুমি কিভাবে উদ্ধাব করলে? বলল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট থামতেই ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট লিয়েন হুয়ার মামী লি চিন হুয়া। বলে উঠল, বাছা, লিয়েন তোমাকে স্যার বলছে। কিন্তু স্যার হওয়ার মতো। বয়স তো তোমার মনে হচ্ছে না। এ বিষয়টা আমাদের বিস্মিত করছে, মারামারি, গোলাগুলি করে কিভাবে তুমি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে আমাদের লিয়েনকে উদ্ধার করলে? কিডন্যাপ হওয়ার ভিডিওটা আমরা দেখেছি। বলত বাছা তারপর কীভাবে কী ঘটল?
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট ও সম্মানিত ম্যাডাম, সন্ত্রাসী কিডন্যাপারদের হাত থেকে উদ্ধার করতে গেলে যা ঘটে, এক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। আমি যা করেছি, সেই অবস্থায় যে কেউ সেটাই করতো। তিয়ানজিনের একটা হোটেলে আমার একটা সিট বুক করা ছিল। সেখানেই যাচ্ছিলাম। শহরের সেই মোড়টিতে পৌঁছার আগেই গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমি দ্রুত সেদিকে যাই। মোড়ে পৌঁছে একটা গাড়ির পাশে কয়েকটা লাশ পড়ে থাকতে দেখতে পাই। একজন আহত মুমূর্ষ লোকও পড়ে ছিল। আমি তাকে হাসপাতালে নিতে চেষ্টা করি। সে বলে, আমি মরে। গেছি, আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করবেন না। ওরা ম্যাডামকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে বাঁচান। আমি এর আগে দেখতে পেয়েছি কয়েকজন অস্ত্রধারী কাউকে ধরে মাইক্রোতে তুলল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। মাইক্রোটি পাগলের মতো বেপরোয়া গতিতে চলতে শুরু করেছে মোড় থেকে পশ্চিমের হাইওয়ে ধরে। আমি পড়ে থাকা কারবাইন তুলে নিয়ে আমার গাড়িতে উঠে ছুটলাম ঐ মাইক্রোর পেছনে। কিছুদূর চলার পর আমার পেছনে আরেকটা গাড়ি আসতে দেখলাম। বুঝলাম পেছনের গাড়িটিও সন্ত্রাসীদের।
একটু থামল। তারপর সংক্ষেপে উদ্ধার কাহিনীটা বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা কথা শেষ করল।
সকলের চোখ আহমদ মুসার প্রতি নিবদ্ধ। চোখ ভরা তাদের বিস্ময় ও আনন্দ। কারো মুখেই কোনো কথা নেই।
প্রেসিডেন্টের বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর।
প্রথম মুখ খুলল প্রেসিডেন্ট-পত্নী লি চুন হুয়া। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, বাছা, আসল বিষয়টাই তো জানা হলো না। পাহাড়ঘেরা একটা উপত্যকায় চারদিক থেকে চারটি গাড়ি দ্বারা ঘেরাও হবার পর কীভাবে তুমি। লিয়েনকে উদ্ধার করে বেরিয়ে এলে, সেটা তোমার কথায় আসেনি। আবার নকল পুলিশ দলকে কীভাবে চিনলে, কীভাবে তাদের হাত থেকে তোমরা বাঁচলে, সে সম্পর্কে কিছুই বলনি বাছা।
আহমদ মুসা বলল, সম্মানিত ম্যাডাম, কী ঘটেছিল, সেটা আমি সংক্ষেপে বলেছি। দুঃখিত আমি বিস্তারিত বলতে পারিনি। আমি এখনি উঠতে চাই, আপনারা দয়া করে অনুমতি দিলে খুশি হবো। অজানা অনেক পথ আমাকে পাড়ি দিতে হবে। ম্যাডাম লিয়েন হুয়া সবকিছু দেখেছেন, জানেন, তিনি অবশ্যই আপনাদের ব্রিফ করবেন। প্লিজ আমাকে অনুমতি দিন, আমি উঠতে চাই।
না, তা হয় না বাছা। তুমি কিছু মুখে না দিলে আমরা কষ্ট পাব।
বলেই প্রেসিডেন্ট-পত্নী লি চুন হুয়া তাকাল দূরে দাঁড়ানো তার পিএর। দিকে।
পিএ তরুণীটি একটা বাউ করে সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে গেল।
ইয়ংম্যান, তুমি কোথায় যাবে? আমরা অন্যভাবে সেখানে পৌঁছেও দিতে পারি। বলল প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। ওভাবে যাওয়া আমার জন্যে অসুবিধাজনক হবে। আমি অনেকেরই চোখে পড়ে যাব। আমি সে জায়গায় পৌঁছতে চাই নীরবে, সবার অলক্ষ্যে। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের কপাল কুঞ্চিত হলো। একটু ভাবল। বলল, খুব অসুবিধা না হলে বলতে পার ইয়ংম্যান তুমি কোনো বড় কাজে যদি থেকে থাক এবং আমাদের যদি কিছু করার থাকে।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আপনার এই অভয়, আমার প্রতি আপনার এই সদিচ্ছা আমাকে খুবই আনন্দিত করেছে, আশান্বিত করেছে। আজ নয়, তবে প্রয়োজন হলে আমি আপনার সাহায্য চাইতে পারি। বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ আবেগে ভারি হয়ে উঠেছিল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিল।
প্রেসিডেন্ট সঙ্গে সঙ্গে কথা বললেন না। তার স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখের উপর নিবদ্ধ। বলল একটু সময় নিয়ে, অফকোর্স। আমি নিশ্চিত ইয়ংম্যান তুমি যা চাইবে, যা করবে তা সকলের কল্যাণের জন্যেই হবে। লিয়েন এখনি তোমাকে একটা নাম্বার দেবে। ওটা আমাদের ফ্যামিলি হটলাইন। আমার পরিবারের বিশেষ চারজন, আমি, আমার পত্নী, লিয়েন হুয়া ও ফেন ফ্যাং ছাড়া অন্য কারও কাছে এ লাইন যাবে না। আমাদের মধ্যে যার লাইন ক্লিয়ার থাকবে, তার কাছেই হটলাইনটা ওপেন হবে।
এক্সিলেন্সি, এটা আমার জন্যে এক অকল্পনীয় পাওয়া। আমার প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে, আমার প্রতি আপনার আস্থার মর্যাদা যেন আমি রাখতে পারি। বলল আহমদ মুসা। তাঁর কণ্ঠ আবেগাপ্লুত।
নাস্তা এলো। নাস্তা পরিবেশিত হলো সবার জন্যে।
নাস্তা খাওয়া হয়ে গেলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, রেসপেকটেড ম্যাডাম, আপনারা অনুমতি দিলে আমি উঠতে
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল লিয়েন হুয়া, প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্ট-পত্নী কিছু বলার আগেই। বলল, মামা, স্যারের নামটা এখনও জানা হয়নি। আর…।
তুমি জান না? বলল প্রেসিডেন্ট লিয়েন হুয়ার কথার মাঝখানেই।
আমারও জিজ্ঞেস করার সময় হয়নি মামা। লিয়েন হুয়া বলল।
প্রেসিডেন্ট তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, স্যরি এক্সিলেন্সি, লিয়েন হুয়াকে নামটা তখন আমি বলিনি। এখানে পরিচয়ের সময়েই আমার নাম বলা উচিত ছিল। কিন্তু বলতে পারিনি। এক্সিলেন্সি সবার কাছে নয়, কিন্তু কিছু লোকের কাছে কিছু সময় পর্যন্ত আমার নাম গোপন রাখতে চাই। এক্সিলেন্সি…।
প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে বিস্ময়, কিছুটা বিরক্তিও। বলল, নাম বলতে পারনি কেন? সন্দেহ…।
স্যরি এক্সিলেন্সি, সন্দেহ নয়, একটা আশঙ্কা। বলল আহমদ মুসা।
কি আশঙ্কা? বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সকিউজ মি এক্সিলেন্সি, আপনার গেটের সিকিউরিটিদের কেউ কি আল্টা পাওয়ারফুল স্পাই ক্যামেরা কাম ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে? বিনীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে কিছুটা বিস্ময় ফুটে উঠল। বলল, আমি জানি যে, গেটের সিকিউরিটিদের এমন স্পাই উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ নেই। তবু আমি চেক করে দেখছি।
এক্সনিউজ মি এক্সিলেন্সি। আমার অনুরোধ, আপনি চেক করতে যাওয়ার আগেই সিকিউরিটি ঐ অফিসারকে নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থা করুন। তা না হলে স্পাইবাগ হারিয়ে যেতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের বিস্মিত দৃষ্টি ফিরল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ধন্যবাদ ইয়ংম্যান। তুমি জান, তার নাম কি? এবং স্পাইবাগটা কোথায় আছে?
অফিসারটির নাম সু লীন। তার ডান বুকে নেমপ্লেটের নিচের বোতামটির ঠিক মধ্যখানে। সে আমার সামনে এলে তার সেই বোতামে স্পাইবাগ আমি দেখেছি।
প্রেসিডেন্ট অয়্যারলেস হাতে তুলে নিয়ে মুখের কাছে এনে বলল, চ্যাং শুন, সু লীন কোথায়?
সিকিউরিটি বক্সে।
তার বুকের নেমপ্লেটের নিচের বোতামসহ তাকে গ্রেফতার কর। এখনি। ওভার। প্রেসিডেন্টের মুখে কঠোর নির্দেশ।
কথা শেষ করে অয়্যারলেসেই আরেকটা নির্দেশ দিল। বলল, মি. ক্যাং, এখনি তুমি আমাদের ফ্যামিলি গেটে এস। সু লীনকে আটক করা হয়েছে। তার ডান বুক পকেটের বোতামটি চেক করে এখনি আমার কাছে। রিপোর্ট কর।
ক্যাং প্রেসিডেন্ট হাউজের সম্মিলিত গোয়েন্দা টীমের প্রধান।
প্রেসিডেন্টের ফ্যামিলি ড্রয়িং রুমে পিনপতন নীরবতা। সকলের চোখে মুখেই বিস্ময় ও অস্বস্তি। আর আহমদ মুসা ভাবছে, তার যাওয়াটা একটু বিলম্বিত হলো। সু লীনের বিষয়টা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সেও যাওয়ার কথা বলতে পারছে না।
প্রেসিডেন্ট অয়্যারলেস নামিয়ে নিয়েই আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ধন্যবাদ ইয়ংম্যান।
তাকাল প্রেসিডেন্ট লিয়েন হুয়ার দিকে। বলল, তুমি কথা শেষ করনি লিয়েন।
থ্যাংক ইউ মামা, আমি বলতে চাচ্ছিলাম আমার স্যার সম্পর্কে তো আপনারা ইতিমধ্যেই জেনেছেন। বিমান…।
তার সম্পর্কে আমরা জানি, জেনেছি? সেটা কি? বলল প্রেসিডেন্ট।
বিমান হাইজ্যাক বানচাল করে প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ডাকে কিডন্যাপ হওয়া থেকে ইনিই বাঁচিয়েছিলেন, বিমান বন্দরেও ড. ডার কিডন্যাপ প্রচেষ্টাকে ইনিই বাধা দিয়েছিলেন। আবার কিডন্যাপারদের অনুসরণ করে জিবেরা শহর পর্যন্ত তিনি এসেছিলেন। শুনা গেছে সেখানেও কয়েকটা সংঘর্ষ হয়েছিল এবং অনেকগুলো লোক মারাও যায়। কিডন্যাপকে কেন্দ্র করে স্যারের সাথেই এ সংঘর্ষগুলো হয়।
প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। যেন চোখে তার নতুন দৃষ্টি। আহমদ মুসার উপর চোখ রেখেই বলল, হ্যাঁ লিয়েন, ঘটনাগুলো আমাদের সরকার নিবিড়ভাবে ফলো করছে। বিদেশি একজন যে এসব ঘটিয়েছে, সেটা আমরা জানি। আমরা তার প্রশংসা করেছি এবং তাকে খোঁজার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তার সাহায্য আমাদের সরকার পায়।
প্রেসিডেন্ট একটু থামল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, ধন্যবাদ ইয়ংম্যান, সত্যি তুমি আমাদের বিস্মিত করেছ। সেই থেকেই…।
কিছু বলতে যাচ্ছিল প্রেসিডেন্ট। কিন্তু পিএকে, তার দিকে আসতে দেখে থেমে গেল।
পিএ একটা দূরত্ব পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে গেল। বলল, এক্সিলেন্সি, উ ক্যাং বাইরে দাঁড়িয়ে।
তাকে নিয়ে এস। বলল প্রেসিডেন্ট।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা প্রবেশ করল।
উ ক্যাং বস। কি খবর এনেছ বল।
বসেই আবার উঠে দাঁড়াল উ ক্যাং। বলল, এক্সিলেন্সি, চ্যাং আপনার নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গেই সু লীনকে গ্রেফতার করেছে। বোতামটিও পাওয়া গেছে। গ্রেফতারের আর কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে বোতামটি পাওয়া যেত না স্যার। বোতাম…।
উ ক্যাং-এর কথার মাঝখানেই প্রেসিডেন্ট বলল, কেন, বোম সে সরিয়ে ফেলছিল?
বোতামটি সে গিলে ফেলছিল। মুখে পুরেছিল সে বোতামটি। চ্যাং তার মুখ থেকে বোতামটি বের করে নেয়। এক্সিলেন্সি, বোতামটি সর্বাধুনিক ক্যামেরা, সর্বাধুনিক একটা ট্রান্সমিটারও। ক্যামেরাটি ৬০ বর্গফুট পর্যন্ত একটা আলপিনের ছবিও নিখুঁতভাবে তুলে আনতে পারে এবং ২০০ বর্গফুট এলাকার একটা ক্ষুদ্র মার্বেল পতনের শব্দও সুস্পষ্টভাবে মনিটর করে। উ ক্যাং বলল।
বিস্ময় ফুটে উঠল প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে। নির্বাক হয়ে পড়েছিল প্রেসিডেন্ট কিছু সময়ের জন্যে।
অনেকটা স্বপ্লেখিতের মতো দ্রুত চোখ ফিরাল প্রেসিডেন্ট এবং বলল, উ ক্যাং, এ রকম সু লীন আর কতজন আছে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে?
উ ক্যাং মাথা নিচু করল।
যাও ক্যাং, অবিলম্বে গোয়েন্দা প্রধান ডাই ডিং জিয়াং, সেনা গোয়েন্দা প্রধান চাও চেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াংকে খবরটা পৌঁছাবার ব্যবস্থা কর। বলল প্রেসিডেন্ট।
উ ক্যাং দাঁড়িয়েছিল। প্রেসিডেন্টকে বাউ করে সে বেরিয়ে গেল।
প্রেসিডেন্ট তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ইয়ংম্যান, তোমাকে কি ভাষায় ধন্যবাদ দিলে, সেটা উপযুক্ত হবে তা ভেবে পাচ্ছি না। তুমি সত্যই এক মিরাকল। তুমি চীনে প্রবেশের পর থেকে গত কয়েকদিনে যা করেছ তা কোনোটাই তোমার জন্যে নয়, চীনের জন্যে। লিয়েনকে উদ্ধার করেছ, বিশ্বাসঘাতক সু লীনকে ধরিয়ে দিয়েছ, এটাও আমাদের মহান। চীনের জন্যে। মিরাকল ইয়ংম্যান এবার কি জানতে পারি তোমার নাম?
এক্সিলেন্সি প্লিজ নামটা আমি ম্যাডাম লিয়েন হুয়াকে লিখে দিয়ে যাব। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট হাসল। বলল, বুঝেছি ইয়ংম্যান। ঠিক আছে লিয়েন আমাকে জানাবে। তোমাকে আমার আরও দুটি প্রশ্ন। সেটা হলো, সু লীনরা যাদের পক্ষে কাজ করছে সে কিডন্যাপার সন্ত্রাসীরা কারা? দ্বিতীয় বিষয়টা আমার, আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, তুমি সাধারণ কেউ নও। নিশ্চয় চীনে আসার পেছনে তোমার একটা মিশন আছে। সেটা কী?
এক্সিলেন্সি, সন্ত্রাসীরা কারা সে ব্যাপারে জানা আমার এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। যেটুকু জেনেছি, সবটাই আমি বলেছি ম্যাডাম লিয়েনের জিজ্ঞাসার জবাবে। সে আপনাকে এ বিষয়টা জানাতে পারবে। আর দ্বিতীয় জিজ্ঞাসার ব্যাপারে আমার কথা হলো, আহমদ ইয়াং নামে উইঘুরের আমার এক স্নেহভাজন যুবককে কিডন্যাপ করেছে সন্ত্রাসীরা। বলা যায় তার সন্ধানেই আমি এখানে এসেছি এক্সিলেন্সি। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ ইয়াং কে? তার পরিচয় কী? জিজ্ঞেস করল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেসি, আহমদ ইয়াং হুই নেতা শেখ ওয়াং চিং চাই-এর ছেলে। সে তার পরিবার নিয়ে উরুমুচিতে বাস করত। উইঘুরের একজন যুব নেতা সে। আহমদ মুসা বলল।
ঐতিহাসিক হুই নেতা মা পেন চাই-এর উত্তরপুরুষ শেখ ওয়াং চিং চাই। তাহলে তাঁরই ছেলে সে এবং সে সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নর লিউ ইউয়ান-এর জামাতা। তাই তো? বলল প্রেসিডেন্ট।
হ্যাঁ, এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা বলল।
আমি জানি সিংকিংয়াং অঞ্চলে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। সেখানে ধর পাকড়সহ রাজনৈতিক সন্ত্রাস দমনমূলক নানা তৎপরতা চলছে। কিন্তু পুলিশ আহমদ ইয়াংকে গ্রেফতার করেছে বলে অে জানি না। তাহলে কে বা কারা তাকে কিডন্যাপ করল? বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি, আমি মনে করি, মা ঝু, ড. ডাদের যারা কিডন্যাপ করেছে, আহমদ ইয়াংকে কিডন্যাপ করেছে তারাই।বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। আহমদ ইয়াং এবং ড. ডা ও মা ঝুরা এক হলো কি করে। ভাবছিল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি, আমি উঠতে চাই। অনুমতি দিন। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে ইয়ংম্যান। বলে উঠে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট। তার সাথে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসাও।
প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্ট-পত্নী আহমদ মুসাকে বিদায় দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বাড়ির ভেতরে যাবার জন্যে। আর লিয়েন হুয়া ও ফেন ফ্যাং আহমদ মুসাকে সঙ্গ দিল গাড়িবারান্দা পর্যন্ত।
আহমদ মুসা গাড়িবারান্দায় তার নিয়ে আসা গাড়ি দেখল না। তার জায়গায় রয়েছে দামি একটা হাইল্যান্ডার জীপ।
আমার গাড়ি তো দেখছি না লিয়েন? বলল আহমদ মুসা।
হাসল লিয়েন। বলল, ও গাড়ি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এ গাড়িটাই আপনার।
কেন? বলল আহমদ মুসা।
ও গাড়ির নাম্বার শত্রুর কাছে চলে গেছে, তাই এ ব্যবস্থা। এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্টের নির্দেশে এটা করা হয়েছে স্যার। লিয়েন হুয়া বলল।
আহমদ মুসা তার ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে এগোলো গাড়ির দিকে।
গাড়ির দরজা খুলে সিটে বসল। তাকাল আবার হাতঘড়ির দিকে আহমদ মুসা। দেখল হাতঘড়ির ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ডিটেক্টরের সিগন্যাল অস্থির হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা নেমে এলো গাড়ি থেকে।
তাকাল আহমদ মুসা লিয়েন হুয়া ও ফেন ফ্যাং দুজনের দিকে। বলল, তোমাদের দুজনের কাছে অনুরোধ, আমি গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছি, তবে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে পশ্চিমমুখী রাস্তার পাশে আমি এটা রেখে যাব। তোমরা প্রেসিডেন্ট হাউসের ফ্যামিলি পুল বা ট্রান্সপোর্ট পুলকে বলে গাড়িটা আনিয়ে নেবে।
কেন, গাড়ি নেবেন না কেন? গাড়ি রেখে যাবেন কেন? বলল তারা। দুজন একই সঙ্গে। বিস্ময় তাদের চোখে-মুখে।
গাড়িটা নিশ্চয় ট্রান্সপোর্ট পুল থেকে এখানে পাঠিয়েছিল। পাঠানোর কোনো একপর্যায়ে গাড়িতে ইলেক্ট্রনিক ট্রান্সমিশন ডিভাইস সেট করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শত্রুরা সব সময় আমার অবস্থান লোকেট করতে পারবে। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়-উদ্বেগে দুজনের চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল। বলল ফেন। ফ্যাং, বাবাকে এ গুরুতর কথাটা এখনি জানানো দরকার। আমি যাচ্ছি।
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে যাচ্ছিল ফেন ফ্যাং।
প্লিজ ফেন ফ্যাং, বিষয়টা তোমার আব্বাকে এখন বলো না। আমি চলে যাবার পরে বল। আমি চাই, আমার যাওয়াটা বিলম্বিত না হোক। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে। তাহলে এক কাজ করুন। এ গাড়িটা এখানেই থাক। আমাদের গোয়েন্দারা একে পরীক্ষা করবে। আর আমি আমাদের ফ্যামিলি পুল থেকে একটা গাড়ি আপনাকে দিচ্ছি।
কথা শেষ করেই লিয়েন হুয়া তাকাল ফেন ফ্যাং-এর দিকে।
হ্যাঁ আপা, আমি টেলিফোন করে দিচ্ছি, এখনি এসে যাবে গাড়ি। ফেন ফ্যাং বলল।
ঠিক আছে গাড়ি নিলাম, ফেরত দেব কি করে? পুলের গাড়ি তো তোমরা এককালীন কাউকে দিতে পার না।
গাড়িগুলো আমাদের পরিবারের নিজস্ব, সরকারি নয়। সুতরাং কারও অনুমতির দরকার নেই, তেমনি ফেরত দেবারও প্রশ্ন নেই। লিয়েন হুয়া বলল।
তবু বাবাকে বিষয়টা অবশ্যই জানাব। ওই গাড়িতে স্পাই ডিভাইস সেটের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট অবশ্যই জানবেন। বলল লিয়েন হুয়া।
ফ্যামিলি পুলের গাড়ি এসে গেল।
লিয়েন হুয়া, ফেন ফ্যাংকে ধন্যবাদ জানিয়ে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে ফিরতে যাচ্ছিল। লিয়েন হুয়া ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বলল, আমাদের ফ্যামিলি হটলাইন।
ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসা চিরকুটটি নিয়ে বলল, স্যরি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
বলে পকেট থেকে একটা স্লিপ বের করে লিয়েন হুয়াকে দিল। বলল, এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট আমার নাম জানতে চেয়েছিলেন।
আহমদ মুসা গিয়ে গাড়িতে উঠল।
লিয়েন হুয়া ছুটে গেল গাড়ির জানালায়। তার সাথে ফেন ফ্যাংও।
স্যার, আপনি যদি মা ঝু’র দেখা পান, তাহলে বলবেন আমি ভালো নেই। সে যেন নিজের খেয়াল রাখে।
বলল লিয়েন হুয়া। বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল।
ফেন ফ্যাং লিয়েন হুয়ার আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে তার একটা হাত রাখল লিয়েন হুয়ার পিঠে।
আহমদ মুসার গাড়ি চলতে শুরু করেছে। দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে তখন আহমদ মুসার গাড়ি। লিয়েন হুয়ারা ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। তারা দেখতে পেল স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আসছেন গাড়িবারান্দার দিকে। দাঁড়িয়ে গেল লিয়েন হুয়ারা।
কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে ফেন ফ্যাং বলল, বাবা তুমি এ সময় এদিকে!
প্রেসিডেন্ট আশেপাশে সামনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল, মেহমান কি চলে গেছেন ফেন?
হ্যাঁ, বাবা এই তো কয়েক মিনিট। বলল ফেন ফ্যাং।
দেখা পেলে ভালো হতো। আরেকবার ধন্যবাদ জানাতাম। বলল প্রেসিডেন্ট।
কেন মামা, কি হয়েছে? আরও কিছু জেনেছেন? লিয়েন হুয়া বলল।
হ্যাঁ, সে জন্যেই তো এলাম। কিন্তু পাখি উড়ে গেছে। আমাদের গোয়েন্দারা সর্বশেষ অনুসন্ধান থেকে বলছে, এই লোকটিই আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট লিয়েনকে বলল, মা লিয়েন ওর নাম কি তোমাকে দিয়েছে?
হ্যাঁ মামা দিয়েছেন। বলে একটা কাগজের টুকরো মেলে ধরল প্রেসিডেন্টের দিকে।
দেখো তো মা ওর নাম আহমদ মুসা কিনা? বলল প্রেসিডেন্ট।
দ্রুত কাগজখণ্ডের উপর চোখ বুলিয়ে লিয়েন বলল, হ্যাঁ মামা, আহমদ মুসা।
লিয়েন হুয়ার চোখে-মুখে তখন অপার বিস্ময়। ফেন ফ্যাং আহমদ মুসার নাম শোনার পর থেকেই নির্বাক।
ব্যাপারটা শুধু বিস্ময়ের নয়, একেবারেই অবিশ্বাস্য। আহমদ মুসা। চীনের প্রেসিডেন্টের ভাগ্নীকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করে প্রেসিডেন্টের ঘর পর্যন্ত পৌঁছেছেন, এটা অবিশ্বাস্যই বটে।
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট বলল, কি ব্যাপার গাড়ি দেখছি, গাড়িটা আহমদ মুসা নেয়নি?
বাবা, পুলের এই গাড়িতে স্পাইবাগ পাতা আছে, তাই তিনি এ গাড়ি নেননি। বলল ফেন ফ্যাং।
স্পাইবাগ? এটা তো পুলের অনেক গাড়ির একটি। এতে স্পাইবাগ পাতবে কে? বলল প্রেসিডেন্ট।
উনি বলেছেন, পুল থেকে আমাদের বাসা, এর মধ্যেই স্পাইবাগ পাতা হয়েছে। লিয়েন হুয়া বলল।
প্রেসিডেন্টের দ্রু-কুঞ্চিত হলো। বলল, ওদের ষড়যন্ত্র এত বিস্তৃত, এত গভীর! স্বগতঃ কণ্ঠে প্রেসিডেন্টের।
দ্রুত বলল সে লিয়েন হুয়ার দিকে চেয়ে, লিয়েন হুয়া মা, যাও ডাক্তাররা তোমার অপেক্ষায় আছে। তোমাকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তৈরি। হতে হবে। নিরাপত্তা কমিটি বৈঠকে বসছে, সেখানে তোমাকে ডাকা হয়েছে।
ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে থেমে গেল প্রেসিডেন্ট। বলল, গাড়ি আহমদ মুসা নেয়নি, তাহলে গেছে কীভাবে লিয়েন?
আমাদের ফ্যামিলি পুল থেকে একটা গাড়ি তাকে দেয়া হয়েছে মামা। বিকল্প আর কিছু পাইনি আমরা ঐ সময়। লিয়েন হুয়া বলল।
প্রেসিডেন্টের মুখ হঠাৎ প্রসন্ন হয়ে উঠল। বলল, তোমাদের ধন্যবাদ লিয়েন। তোমরা ভালো কাজ করেছ। তার সাথে সংযোগ একটা আমাদের থাকল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এস তোমরা।
ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট চলতে শুরু করল।
২
পাথুরে রক্তাক্ত উঠানটা নে নুয়া কয়েক লাফে পার হলো। ভীত, বিপর্যস্ত সে। চিৎকার করে সে ডাকছে মা, বাবা, ভাইয়া।
কোথাও কারো সাড়া নেই। ছুটছে নে নুয়া তার পিতার কক্ষের দিকে।
কক্ষের সামনে পৌঁছতেই একটা বুকফাটা চিৎকার বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠ থেকে। বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে তার চোখ। ঘরের দরজা ভাঙা। তার মা ও ভাই উ চাও-এর লাশ রক্তে ভাসছে। ঘরের জিনিসপত্র উলট-পালট।
নে নুয়া চিৎকার করে ছুটে গিয়ে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল মা ও ভাইয়ের লাশ।
নে নুয়া ২০ বছরের সুত্রী ও প্রতিভাদীপ্ত এক তরুণী। সে বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব লেজেন্ডারি হেরিটেজ-এর ছাত্রী। পাহাড়ি অনাঘ্রাত ফুল সে। যতটাই সে কোমল, ততটাই কঠিন। কুংফু কারাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন সে। তার মনে একটা গর্বও আছে, সে শুনেছে তার পরিবার চীনের আদি পরিবার। তার কুংফু স্কুলের শতাধিক বয়সের বৃদ্ধ গুরু তাকে চামড়ার কাগজে লেখা একটা দলিল দেখিয়ে বলেছিল তোমরা বাহুতে যে উল্কি পর, তা চীনের প্রথম সম্রাজ্ঞীর সিলমোহর, যদিও বলা হয় লেজেন্ডারি। ঐ দলিলে চীনা দুই বর্ণের চিহ্নটি তিনি দেখিয়েও দিলেন। নে নুয়া তার গুরুর এ কথাটি তার বাবা জে ঝি সেংগকে বলেছিল। কিন্তু তার বাবা বিষয়টিকে এড়িয়ে যান।
ধীরে ধীরে নে নুয়া তার মা ও ভাইকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বাইরের দিকে একবার তাকিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে। চিৎকার করে ডাকল, কে কোথায় তোমরা? কেউ আছ?
কাজের লোক ও পরিচারিকারা বেরিয়ে এলো। তারা সবাই ভয়ে আড়ষ্ট। চোখে-মুখে আতঙ্ক। চারদিকে তাকাচ্ছে। তখনও কাঁপছে তারা।
বাড়িতে কি ঘটেছে? কে ঘটাল এসব? বাবা কি আসেননি? বলল আর্তস্বরে নে নুয়া।
বাড়িতে প্রবেশ করল তাদের মন্দিরের সেবায়েত। ছুটে এসে নে নুয়াকে বলল, ছোট মাজি, ভয়ানক সন্ত্রাসীরা হামলা করেছিল। তারা আপনাকে ও বড় কর্তাজীকেও খুঁজছিল।
বাবা কোথায়? আসেননি? বলল নে নুয়া।
বড় কর্তাজীও কিছুক্ষণ আগে এসেছেন। উনি মন্দিরে গেছেন। সেবায়েত ছেলেটা বলল।
শুনেই নে নুয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটল মন্দিরের দিকে।
মন্দিরে নে নুয়ার পিতা জে ঝি সেংগ দুই হাটু মুড়ে মাথা নিচু করে বসে। আছে। ধ্যানস্থ ঠিক নয়, বলা যায় আত্মস্থ।
নে নুয়া গিয়ে পিতার পাশে বসল।
সামনে মন্দিরের বিরাট উন্মুক্ত স্পেস। কোনো মূর্তি, বিগ্রহ নেই। আছে নিরন্তর শূন্যতা। সে শূন্যতা উপরে মন্দির-শীর্ষের দিকে উঠে অন্ধকারের সাথে মিশে অন্তহীন হয়ে উঠেছে। এই অন্তহীনতার আবেশ অভিভূত করে ভক্তদের। এই মন্দিরে অন্তহীন নিরাকার এক শক্তির পূজা
নে নুয়া মন্দির-শীর্ষের অন্ধকার অন্তহীনতার দিকে একবার তাকিয়ে জোড়হাতে মাথা নুইয়ে পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল, বাবা, বাড়িতে কী ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে, কেন ঘটিয়েছে? ওরা তোমাকে এবং আমাকেও খোঁজ করেছে।
নে নুয়ার পিতা জে ঝি সেংগ মুখ ফেরাল নে নুয়ার দিকে। তাকাল। চারদিকে।
উঠে দাঁড়াল সে। বলল, নেয়া এস।
মন্দিরের পাশ দিয়ে পাহাড়ে উঠে গেল বাপ-মেয়ে দুজন।
মন্দিরের বিপরীত দিকে পাহাড়ের সুন্দর একটা প্লেটে গিয়ে বসল জে ঝি সেংগ, নে নুয়ার বাবা।
নে নুয়া তার বাবার পাশে আরেকটা পাথরে বসতে বসতে বলল, এতদূর উঠলে বাবা, ওদিকে বাড়িতে এখন অনেক কিছু করার আছে।
হ্যাঁ মা জানি। কিন্তু তোমাকে কিছু কথা এখনই বলা দরকার। পরে যদি সুযোগ না হয়। কখন জানি না, কিন্তু ওরা আবার ফিরে আসবে। বোধ হয় আমাদের রক্ষা নেই। বলল জে ঝি সেংগ।
ওরা কারা বাবা? নে নুয়া বলল।
চিনি না ওদের। ওরা কথা বলেছে টেলিফোনে। একবারই সামনে এসেছিল, তাও মুখোশ পরে। বলল নে নুয়ার বাবা।
ওদের সাথে তাহলে আমাদের কি শত্রুতা? কেন হত্যা করল আমার মা, ভাইকে? নে নুয়া বলল।
আমাদের ওদের সাথে কোনো শত্রুতা নেই। তবুও আমরা ওদের শত্রু। বলল জে ঝি সেংগ।
আমাদের শত্রু ভাবছে কেন ওরা? নে নুয়া বলল। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল জে ঝি সেংগ। কিন্তু ব্রাশ ফায়ারের শব্দে তার কথা বন্ধ হয়ে গেল। চমকে উঠে জে ঝি সেংগ এবং নে নুয়া দুজনেই তাকাল শব্দের দিকে।
তাদের পাহাড়ের গোড়া থেকেই উন্মুক্ত প্রান্তর। পাহাড়ের সামনেই রাস্তার একটা তেমাথা। পাহাড়ের পূর্ব প্রান্তের সমান্তরালে একটা রাস্তা উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত। আরেকটা পুব দিক থেকে এসে মিসেছে এ রাস্তার সাথে এবং সৃষ্টি হয়েছে তেমাথাটি।
তিনদিক থেকে ৫টা গাড়ি এসে ঘিরে ধরেছে একটা গাড়িকে। আক্রান্ত গাড়িটা রাস্তা থেকে নেমে পাহাড়ের দেয়ালকে পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে গেছে। গাড়ির আরোহী গাড়ির পেছনে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তার হাতে একটা রিভলবার।
আরোহীটা চীনা নয়, বিদেশি। আক্রমণকারী সবাই চীনা।
রিভলবারধারী আরোহীকে লক্ষ্য করেই আসছিল ওদের সকলের স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার। আর লোকটি গাড়ির পেছনে বসে আত্মরক্ষা। করছিল এবং মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে গাড়ির দুপাশেই নজর রাখছিল।
গাড়িটার দুপাশ এবং গাড়ির উপর সবদিক থেকেই অবিরাম গুলীবর্ষণ চলছিল এবং গাড়ির দুপাশ দিয়েই ওরা এগিয়ে আসছিল। গাড়িটা অক্ষত। নিশ্চয় বুলেট প্রুফ হবে।
গাড়িটার এক পাশে ছিল একটা ছোট টিলা। টিলাটির গা ঘেঁষে লোকটি তার গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল।
আক্রান্ত গাড়ির আরোহী লোকটির তরফ থেকে কোনো প্রতিরোধ না পেয়ে আক্রমণকারীরা গুলীবর্ষণের সাথে সাথে দ্রুত এগিয়ে আসছিল তার গাড়ির দিকে। আক্রমণকারীরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল তাদের টার্গেট লোকটি তার গাড়ির পেছনে আশ্রয় নিয়েছে। তারা দ্রুত আগানোর সাথে সাথে পাশের দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল টার্গেট গাড়ির পেছনের দিকটা গুলির রেঞ্জের মধ্যে নিয়ে আসার জন্যে। বিশেষ করে ডানদিকের লোকরা টিলা। ঘুরে এগিয়ে আসছিল আক্রান্ত গাড়ির পেছনটাকে টার্গেট করার জন্যে।
বাবা, লোকটা সত্যি বিপদে পড়তে যাচ্ছে। ওরা টিলা ঘুরলেই কিন্তু গাড়ির পেছনটার প্রায় সবটাই ওদের নজরে এসে যাবে। বলল নে নুয়া।
নে নুয়ার কথা শেষ হবার আগেই তারা দেখতে পেল, আক্রান্ত লোকটি মাটির উপর ফুটবলের মতো দ্রুত গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে টিলার শেষ প্রান্তের দিকে। তারা বিস্মিত হলো, লোকটি অদ্ভুত দক্ষতার সাথে তার দেহটা ফুটবলের মতো করে ফেলেছে। তারা দেখল, লোকটি টিলার শেষ প্রান্তের একটা পাথরের আড়ালে বসল নেকড়ের মতো শরীরটাকে গুটিয়ে নিয়ে। তার অবস্থা ঠিক যেন নেকড়ের শিকার ধরার পূর্ব অবস্থার মতোই।
ওদিকে টিলার ওপাশের লোকরা ক্রলিং করে দ্রুত এগিয়ে আসছিল।
নুয়া মা, দেখ আক্রমণকারীদের খুব প্রফেশনাল মনে হচ্ছে। ওরা স্টেনগানের ট্রিগারে আঙুল চেপে স্টেনগান বাগিয়ে ধরে দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে কেমন দ্রুত এগিয়ে আসছে দেখ। বেচারা এই লোক একা একটা রিভলবার দিয়ে কি করবে। বলল জে ঝি সেংগ, নে নুয়ার বাবা।
উনি তো গাড়ির পেছনেই অপেক্ষাকৃত ভালো ছিলেন। একেবারে উন্মুক্ত স্থানে ওদের বন্দুকের মুখে গেলেন কেন? নে নুয়া বলল।
বুঝছি না মা। বলল নে নুয়ার বাবা জে ঝি সেংগ।
জে ঝি সেংগ-এর কথা তখনও বাতাসে মেলায়নি। তারা দেখতে পেল, একটা স্টেনগানধারী চোখ ঘুরে এলো পাথরের আড়ালে লুকানো লোকটির লক্ষ্যে। কিন্তু তার চেয়ে দ্রুত লোকটির হাত নিচ থেকে ছুটে গেল। স্টেনগানের ব্যারেলের দিকে
ব্যারেলের মাথা উপরে উঠে গেল এবং ব্রাশ ফায়ারও শূন্যকেই বিদ্ধ করল। পরক্ষণেই দেখা গেল স্টেনগানটি পাথরের। আড়ালে লুকানো লোকটির হাতে। স্টেনগান হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটি। তার স্টেনগান থেকে গুলির আঁক ছুটে গেল অবশিষ্ট চারজনের দিকে। তারা ব্যাপারটা বুঝে উঠার আগেই তাদের দেহ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল।
চোখের পলকৈ ঘটে গেল ঘটনা। বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে নে নুয়ার মুখ।
জে ঝি সেংগ বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলল, দেখলে তো মা নুয়া, ছেলেটা কি কাণ্ড ঘটাল? চোখকে বিশ্বাস করানো যায় না।
দেখ বাবা, লোকটা দুটো স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে কি দ্রুত গড়িয়ে গাড়ির পেছনে আবার এসে গেছে! নে নুয়া বলল।
হ্যাঁ মা নুয়া। বুঝা গেল, সে পালানো নয়, ওদের মোকাবিলার কৌশল। হিসেবেই ওদিকে গিয়েছিল। সে এপাশে ওদের আক্রমণ শুধু বানচালই করে দিল না। দুটো স্টেনগাওঁ সে যোগাড় করেছে, যা তার…।
তার পিতার কথার মাঝখানেই নয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, দেখ বাবা।
তারা দেখল, গাড়ির পেছন থেকে হঠাৎ লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে কতকটা হপ স্টেপ এন্ড জাম্পের মতো করে গাড়ির উত্তর পাশে ওদের সামনে গিয়ে। পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গেই তার স্টেনগান গর্জে উঠল। তার স্টেনগানের ব্যারেল ঘুরে এলো আক্রমণকারীদের উপর দিয়ে।
আক্রমণকারীদের সবার স্টেনগানের ব্যারেল তাক করা ছিল গাড়ির দিকে। তারা তাদের স্টেনগানের ব্যারেল লোকটার দিকে ঘুরিয়ে নেবার
আগেই তারা লোকটার ব্রাশ ফায়ারের শিকার হয়ে গেল।
নে নুয়া ও তার বাবা জে ঝি সেংগ সম্মোহিতের মতো দেখছিল দৃশ্যটা।
হঠাৎ নে নুয়া দেখতে পেল, তেমাথার উত্তর পাশে দাঁড়ানো দুইটি গাড়ির একটি থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসেছে। তার হাতে রিভলবার। তাক করেছে সে এই লোকটিকে। লোকটি তখন ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তার গাড়ির দিকে।
নে নুয়ার কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, বাম দিকে গুলি।
চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি তার মাথা ও স্টেনগানের ব্যারেল বামদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটির উপর। রিভলবারের একটা গুলির শব্দ শোনা গেল এ সময়। প্রায় তার সাথে সাথেই গর্জন করে উঠেছিলো লোকটির স্টেনগান। লোকটি তার দেহকে মাটির দিকে ছুঁড়ে দেয়ার সাথে সাথেই তার স্টেনগানের ট্রিগার চেপে ধরেছিল।
গাড়ি লক্ষ্যে লোকটির স্টেনগানের গুলির অধিকাংশই গাড়ির উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু কিছু গুলি গাড়ির পাশ বিদ্ধ করেছিল। তারই একটি গুলি গাড়ির পাশের রিভলবারধারীর মাথা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
নে নুয়া ও তার বাবার চোখ নিবদ্ধ ছিল লোকটি যেখানে পড়ে গিয়েছিল, সেদিকে। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ। তাদের আশঙ্কা গাড়ির দিক থেকে আসা একমাত্র গুলিটি লোকটির ক্ষতি করেনি তো? রিভলবারের গুলি স্টেনগানের ফায়ারের কিঞ্চিৎ আগেই শোনা গিয়েছিল।
তাদের অপেক্ষার অবসান হলো।
লোকটি উঠে দাঁড়াল। তার বামদিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার হাতে তখনও স্টেনগান।
বাবা, লোকটি সাংঘাতিক আহত। বাবা তুমি বস। আমি একটু দেখি।
কী দেখবে মা। আমরাই তো বিপদে। বলল নে নুয়ার বাবা জে ঝি সেংগ।
বাবা, আমরা নিজেকে যে সাহায্য করতে পারিনি, সেই সাহায্য আমরা অন্যকে তো করতে পারি বাবা। বলে নে নুয়া উঠে দাঁড়াল।
তাদের সামনে পাহাড় খাড়া হলেও একটু ডানদিকে পাহাড়ের গা ঢালু। ছোট গাছ-গাছড়ার মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে নেমে গেছে পাহাড়ের গা।
পাহাড়ের এ গা বেয়েই নে নুয়া ছুটে নেমে এলো নিচে।
লোকটি তার গাড়ির দিকে এগোচ্ছিল।
.
লোকটি আহমদ মুসা। আসছিল বেইজিং থেকে। যাওয়ার কথা ছিল দক্ষিণে উডাং-এর দিকে। কিন্তু পেছনে আসা শত্রুদের তাড়ায় পথ ছেড়ে বিপথে আসতে হয়েছে।
পাহাড়ের গোড়ায় নেমেই নে নুয়া আহমদ মুসাকে কাছ থেকে দেখল। লোকটিকে তার খারাপ প্রকৃতির মৃনে হলো না। একজন ভদ্র নাগরিকের মতোই তাকে মনে হলো।
নে নুয়া আহমদ মুসার সামনে গিয়ে বলল, স্যার, আমি কি কোনো সাহায্য করতে পারি?
আহমদ মুসা আগেই তাকিয়েছিল নে নুয়ার দিকে। বলল, তুমিই কি আমাকে বামদিকে গুলির কথা বলে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলে? হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম। কিন্তু কাজে লাগেনি। নে নুয়া বলল।
উপকার একটু হয়েছে। নিহত না হয়ে আহত হয়েছি। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথার ঢং-এ হেসে উঠল নে নুয়া। বলল, জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারটা এত সহজ আপনার কাছে?
সহজ নয়, তোমার কথা আমাকে কতখানি সাহায্য করেছে সেটাই আমি সহজ ভাষায় বললাম। বলল আহমদ মুসা।
নে নুয়া খুশি হলো। লোকটির কথা ও চোখ যেমন স্বচ্ছ, তেমনি লোকটিও স্বচ্ছ হবে নিশ্চয়।
ধন্যবাদ। স্যার, সামনের এ গাড়িটা তো আপনার। বলল নে নুয়া।
হ্যাঁ। তুমি জান কি করে? আহমদ মুসা বলল।
পাহাড়ের উপর থেকে সব আমরা দেখেছি। বলল নে নুয়া।
আমরা মানে কারা? প্রশ্ন আহমদ মুসার।
আমি ও আমার বাবা। বলল নে নুয়া।
কথা শেষ করে নে নুয়া সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, পাহাড়ের উপরে আমাদের বাড়ি। চলুন।
রাস্তার বিপদ ঘরে নিয়ে যাবে? আমার বিপদ তো দেখেছ। বলল আহমদ মুসা।
আমরাও বিপদে আছি স্যার। বলল নে নুয়া।
তাহলে বিপদ আরও বাড়াবে কেন? আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে নে নুয়া কিছু বলল না। তাকাল একবার আহমদ মুসার দিকে, মাথা নিচু করল। বলল, পুণ্য হবে তাই। পুণ্যে নাকি বিপদ কাটে।
তোমরা কোন্ ধর্ম মান? বলল লোকটি।
নে নুয়া একটু ভাবল। বলল কতকটা দ্বিধাগ্রস্তভাবে, আমরা প্রচলিত কোনো ধর্ম মানি না। আমরা বংশীয় ধর্ম অনুসরণ করি, যাকে অনেকে বলে প্যাগান ধর্ম।
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল নুয়া, চলুন স্যার, আবার কোন্ বিপদ কখন এসে পড়ে। অনেক গুলিগোলা হয়েছে। পুলিশের কানে নিশ্চয় পৌঁছবে।
আচ্ছা চল। বলে আহমদ মুসা হাঁটতে লাগল তার গাড়ির দিকে।
গাড়ি ঠিক আছে স্যার? পাহাড়ের এ পাশটা ঘুরলেই আমাদের বাড়ি। বলল নে নুয়া।
বুলেটপ্রুফ গাড়ি। কোনো ক্ষতি তো আমার নজরে পড়ছে না। গাড়ির সামনে তারা পৌঁছে গেছে।
গাড়ির দিকে ভালো করে তাকাতে গিয়ে ফ্রন্ট টপের মাথায় একটা মনোগ্রাম দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল নে নুয়া।
গাড়ির ফ্রন্ট টপের মাথায় একটা মনোগ্রাম। চীনা প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রধান গেটের কাঠামোর মধ্যে প্রেসিডেন্সিয়াল ইনসিগনিয়া। প্রেসিডেন্টের পারিবারিক গাড়িসহ পরিবারের সবকিছুতেই এই মনোগ্রাম থাকে।
আহমদ মুসার গাড়িতে তাদের প্রেসিডেন্টের ফ্যামিলি মনোগ্রাম দেখে। বিস্মিত চোখে তাকাল নে নুয়া আহমদ মুসার দিকে। বলল, স্যার, এ গাড়িটা তো দেখছি আমাদের প্রেসিডেন্টের পরিবারের!
আহমদ মুসার চোখে-মুখেও বিস্ময় ফুটে উঠল। বলল, কি করে বুঝলে?
নে নুয়া মনোগ্রামটি দেখিয়ে বলল, এটা আমাদের প্রেসিডেন্টের ফ্যামিলি মনোগ্রাম। তাঁদের গাড়ি ও জিনিসপত্রে এ মনোগ্রাম থাকে।
ঠিক বলেছ। কিন্তু আমি এটা খেয়াল করিনি। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু গাড়িটা আপনার কাছে এলো কি করে? নিশ্চয় আপনি আমাদের প্রেসিডেন্টের পরিবারের সদস্য নন! নে নুয়া বলল।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, সে অনেক কথা। তবে জেনে রাখ, গাড়িটা আমি চুরি করিনি।
নে নুয়া আর কিছু বলল না। সে আহমদ মুসার আহত কাঁধের দিকে তাকিয়ে বলল, উঠুন গাড়িতে।
বলে নে নুয়া ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল।
আহমদ মুসা গিয়ে পাশের সিটে বসল।
.
অনেক কথা হলো। আপনাদের প্রেসিডেন্টের পরিবারের সাথে সম্পর্কের কথা আমি বললাম। প্রেসিডেন্টের ভাগ্নীকে আমি যাদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলাম, তাদের আমি বড় শত্রু। তারাই আমার পিছু। নিয়েছিল। এবার বলুন, আপনাদের মতো শান্তিপ্রিয় লোকদের এই অবস্থা কেন? এই পরিবার রক্তাক্ত কেন? এমন মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড কারা ঘটাল? বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার পরিচয় এখনও নে নুয়াদের দেয়নি। সেদিন নে নুয়ার সাথে তাদের বাড়িতে তার মা ও ভাইয়ের রক্তাক্ত লাশ দেখেছে। আহমদ মুসা। দেখেছে তাদের চোখে-মুখে সার্বক্ষণিক আতঙ্ক। তাদের এ বিপদের মধ্যেও তারা আন্তরিকভাবে আহমদ মুসার সেবা-যত্ন করেছে। আহমদ মুসা পরদিনই চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা কিছুতেই ছাড়েনি। একটা বিপদগ্রস্ত পরিবারকে ছেড়ে আসতে মনও চায়নি আহমদ মুসার।
আমাদের কথা খুব বড় নয়। তা বলতে হবে আমাকে। কিন্তু আপনার। কথা তো শেষ হয়নি। বলল নুয়ার বাবা জে ঝি সেংগ।
বলে সে পকেট থেকে কাগজের একটা কাটিং বের করল। কাগজের কাটিংটি সে আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল। বলল, আপনি একটা চীনা এয়ারলাইন্সের বিমানকে এবং চীনের শীর্ষ প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ডাকে কিডন্যাপ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলেন। কিডন্যাপাররা সবাই আপনার হাতে মারা গিয়েছিল। বিমানবন্দরে আরও চারজন কিডন্যাপার আপনার হাতে মারা যায়, যদিও তারা ড. ডাকে কিডন্যাপ করতে সক্ষম হয়। সুতরাং আপনার কথা আপনি সম্পূর্ণ বলেননি। আপনার পরিচয় শুধুই আহমদ আবদুল্লাহ নয়।
আহমদ মুসা কাগজের কাটিংটি জে ঝি সেংগ-এর হাতে ফেরত দিয়ে বলল, আমার আহমদ আবদুল্লাহ পরিচয় মেনে নিয়ে কি আপনার কথা আমাকে বলতে পারেন না।
অবশ্যই বলতে পারি। আমি আমার একটা কৌতূহলের কথা বলছিলাম মাত্র।
বলে একটু থামল জে ঝি সেংগ। তাকাল মেয়ে নে নুয়ার দিকে। বলল, বলতে ভুলে গেছি মা। তোমার ওয়াং আলী চাচারা তোমার স্যারের সাথে দেখা করতে আসবেন। হয়তো দুপুরের মধ্যেই ওরা আসবেন। গেটে বলে। এস মা।
যাচ্ছি বাবা। বলে নে নুয়া ছুটল গেটের দিকে।
ওয়াং আলী কে জনাব? বলল আহমদ মুসা।
ওয়াং আলী আমাদের হেংশান পাহাড়ে আসা উদ্বাস্তুদের একজন, তিনি উইঘুর একজন নেতা। জে ঝি সেংগ বলল।
উদ্বাস্তু মানে? কি হয়েছে তাদের? কোথায় ছিল? বলল আহমদ মুসা।
মাস তিনেক আগে পাশের শানশি প্রদেশ থেকে অনেক উইঘুর পরিবার এসেছে আমাদের হেংশান পাহাড়ে আশ্রয় নিতে। এই ছোট্ট উইঘুর ক্যুনিটির নেতা ওয়াং আলী। সেদিন বাজারে তার সাথে আমার কথা, হয়েছিল। আমি তাকে আপনার কথা বলেছিলাম। আপনাকে খাওয়ানোর মতো হালাল গোশত এখানে পাচ্ছি না, তাও আমি তাকে বলেছিলাম। তখনই সে আজ এখানে আসবেন বলেছিলেন।
তার সাথে দেখা হলে খুশি হবো। কিন্তু তারা উদ্বাস্তু হলো কী করে? বলল আহমদ মুসা।
বিস্তারিত কিছু জানি না। তবে তাঁর কাছে শুনেছি শিক্ষা ও সংশোধনের জন্যে তাদের ছেলেমেয়েদের তারা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিল সেগুলো ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। তাদের ধর্ম ও সমাজ ধ্বংসেরই নাকি ওটা একটা পরিকল্পনা। এর বিরোধিতা তারা করে। এর প্রতিশোধ হিসেবেই তাদের গ্রাম আক্রান্ত হয়। অনেকে পুড়ে মরে, অনেকেই পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। গ্রামে আর তারা থাকতে পারেনি। তাদের একটা গ্রুপ তাদের হেংশান পাহাড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
নে নুয়াও এসে পড়েছে।
কথা শেষ করে জে ঝি সেংগ আবার বলে উঠল, সবাই তো আছে। গেটে নুয়া মা? বলে এসেছ তো?
হ্যাঁ বাবা। সব ঠিক আছে। স্যারের প্রশ্নের জবাব তুমি দিয়েছ বাবা? নুয়া বলল।
উত্তরের জন্যে দেখছি তোমার স্যারের চেয়ে তোমার আগ্রহ বেশি? বলল জে ঝি সেংগ।
নিশ্চয় বাবা, এ বিষয়ে আমরাও কিছু জানি না। কিছুই বলনি কোনো দিন। নে নুয়া বলল।
জে ঝি সেংগ তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, হ্যাঁ মি. আহমদ আবদুল্লাহ বাড়ির কাউকেই বিষয়টা আমি জানতে দিইনি তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়বে এই ভয়ে।
আতঙ্কটা কিসের? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আতঙ্ক একটা হুমকি নিয়ে। বলল জে ঝি সেংগ।
হুমকি কিসের? আহমদ মুসা বলল।
আমাদের গোটা পরিবারকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। না গেলে পরিবারের সবাইকে দুনিয়া থেকেই বিদায় দেয়া হবে। থামল জে ঝি সেংগ।
তারপর? বলল আহমদ মুসা।
চীনের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসগুলোর একটা সম্মেলন হয়েছিল হুবেই প্রদেশের উডাং পাহাড়ের একটা প্রাচীন প্যালেসে। আমি সেখানে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে সভাপতিত্ব করার জন্যে আমি মনোনীত হয়েছিলাম। দুদিনের সম্মেলন শেষে ফেরার পথে, কয়েকজন মুখোশধারী আমাকে কিডন্যাপ করেছিল। একটা অন্ধকার ঘরে আমাকে ৪৮ ঘণ্টা বন্দি করে রাখা। হয়। পানি ছাড়া আর কিছুই খেতে দেয়া হয়নি। আমি যখন দুর্বল হয়ে পড়েছি, যখন উদ্বিগ্ন আমি ব্যাকুলভাবে মুক্তির পথ খুঁজছি, তখন অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ একজন মুখোশধারী দরজা খুলে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল ঐ কথা, যে কথা আমি বলেছি। লোকটির কণ্ঠ ভারি, দৃঢ় ও ভীতিকর। কথা বলেই লোকটি আমার কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার বলে, আমরা যা বলি তাই করি এবং যা আমরা চাই তা আদায় করি। বলেই লোকটি চলে যায়। তার পরেই আমি মুক্তি পাই।
থামল নে নুয়ার বাবা জে ঝি সেংগ।
আপনি কি মনে করেন, আপনাদের বাড়িতে সেদিনের হত্যাকাণ্ড তারাই ঘটিয়েছে? আহমদ মুসা বলল।
জে ঝি সেংগ একটু চিন্তা করে বলল, একমাত্র তাদের হুমকিতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটাবার ইংগিত আছে। এ ছাড়া অন্য কিছু আমি চিন্তা করতে পারছি না।
আপনার পরিবার নিয়ে সম্প্রতি আর কোনো কিছুই ঘটেনি? আহমদ মুসা বলল।
কথা বলল না জে ঝি সেংগ।
কোনো হারানো জিনিস পাওয়ার মতো চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে নে নুয়া বলে উঠল, কেন বাবা, একটা বড় ঘটনা ঘটেছে তো? •
কোন্ ঘটনার কথা বলছ? বলল জে ঝি সেংগ।
কেন ইউনেস্কোর স্বীকৃতি। নে নুয়া বলল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। ধন্যবাদ।
বলে চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, দুঃখিত, ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের পরিবার নিয়ে বড় একটা ঘটনা ঘটেছে। ইউনেস্কো আমার পরিবারকে প্রাচীনতম পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, মন্দির, বাড়ি সংরক্ষণে আমরা ইউনেস্কোর কাছ থেকে বড় অনুদান পাব। তাছাড়া আমাদের পরিবার দেশের পরিবার নাম্বার ওয়ান ঘোষণা হতে পারে। বলল জে ঝি সেংগ।
ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি আপনাদের পরিবার কবে পেয়েছে? উডাং পাহাড়ের প্রাচীন ধর্মসম্মেলনের আগে, না পরে? বলল আহমদ মুসা।
কয়েক দিন আগে। জে ঝি সেংগ বলল।
এক্ষেত্রে কোনো পরিবার কি আপনার পরিবারের প্রতিযোগী ছিল? বলল আহমদ মুসা।
না, এমন পরিবার তো দেখি না। জে ঝি সেংগ বলল।
তাহলে ওরা কারা? কোন্ কারণে তারা আপনাদের দেশ থেকেই তাড়াতে চায়? আহমদ মুসা বলল।
আমি জানতে পারিনি, বুঝতেও পারিনি। বলল জে ঝি সেংগ।
আচ্ছা আপনি উডাং পাহাড়ের যেখানে বন্দি ছিলেন, সেটা আপনাদের প্রাচীন ধর্মসম্মেলনের আশেপাশেই কোথাও কি? বলল আহমদ মুসা।
সেখান থেকে অল্প কিছুটা আসার পরেই কিডন্যাপ হই। জে ঝি। সেংগ বলল।
ধর্মসম্মেলন হয়েছিল কোন্ প্রাসাদে? বলল আহমদ মুসা।
নানিয়ান প্রাসাদে। জে ঝি সেংগ বলল।
সে প্রাসাদ থেকে অল্প দক্ষিণেই তো ড্রাগন কেভ। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, ঠিক, ঐ রকম জায়গাতেই। জে ঝি সেংগ বলল।
আচ্ছা, আপনি যে বাড়িতে বন্দি ছিলেন, সেখানে ঢোকার পথে, আসার পথে, বন্দিখানা, আপনার দেখা জিনিসপত্রে এমন কিছু দেখেননি, যা দেখে আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে? বলল আহমদ মুসা।
ভাবনার ছাপ ফুটে উঠল জে ঝি সেংগ-এর চোখে-মুখে। চোখ দুটি বন্ধ হয়ে গেল, মুখ নিচু হলো তার।
অনেকটা সময় পর সে মুখ তুলল। বলল, অনেক কিছুই দেখেছি। পাথরের, কাঠের অপরিচিত ধরনের জিনিসপত্র দেখেছি। সেসব নিয়ে মনে কোনো প্রশ্ন জাগেনি। কিন্তু দুজন প্রহরীর বাহুর উল্কি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। উল্কির সাথে আমি পরিচিত। উল্কিগুলো মজার। উল্কি হলো খুব প্রাচীন চীনা অ্যালফাবেট। আমি…।
জে ঝি সেংগ-এর কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা দ্রুত চীনা অ্যালফাবেট এঁকে বলল, উল্কির অ্যালফাবেট কি এই রকম?
আহমদ মুসার আঁকা অ্যালফাবেটের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে চোখ। ছানাবড়া হয়ে উঠল জে ঝি সেংগ-এর। বলল, হ্যাঁ, ঠিক এ অ্যালফাবেটই, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?
আহমদ মুসা মুখ তুলল। তাকাল জে ঝি সেংগ-এর দিকে। গম্ভীর আহমদ মুসার মুখ। বলল, ঐ উল্কির সাথে আমি পরিচিত জনাব। আমার শক্ররা দেখছি আপনার পরিবারেরও শত্রু।
অপার বিস্ময় ফুটে উঠল জে ঝি সেংগ এবং নে নুয়ার চোখে-মুখে। দ্রুত কণ্ঠে দুজনেই বলে উঠল, আপনি ওদের জানেন? ওরা আপনারও শত্রু?
পুরো জানি না। কিছু জানি শত্রু হিসেবে। জানার চেষ্টা করছি। বলল আহমদ মুসা।
সেদিন যাদের দ্বারা আপনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারাই কি আপনার এই শত্রু? নে নুয়া বলল।
ঠিক বলেছ, এরাই তারা। বলল আহমদ মুসা।
কারা ওরা? জে ঝি সেংগ বলল।
ওরা কারা তা আমি এখনো জানি না। ওদের জানি আমি সন্ত্রাসী হিসেবে। সেই বিমান হাইজ্যাক থেকে শুরু করে ওদের হাইজ্যাকার, কিডন্যাপার হিসেবে দেখছি। বলেছি, ওরা প্রেসিডেন্টের ভাগ্নীকে কিডন্যাপ করেছিল। কিডন্যাপ করেছে ড. ডা ও তার কলিগকে, আরও অনেক ভিআইপিকে। বলল আহমদ মুসা।
ওরা দেখছি ভয়ংকর সন্ত্রাসী দল। ওরা আমাদের পেছনে লাগল কেন? আমরা তো আর ভিআইপিদের মতো নই। জে ঝি সেংগ বলল।
ভিআইপি নন, কিন্তু ভিআইপির চেয়ে বড় কিছু? আপনারা সবচেয়ে প্রাচীন পরিবারের উত্তরসূরি। বলল আহমদ মুসা।
আপনি কি মনে করেন আমাদের উপর বিপদটা এই কারণে? নে নুয়া বলল।
আমি তা জানি না। কিন্তু এ ছাড়া কোনো কারণও তো দেখছি না। আচ্ছা আপনারা বলুন তো, আপনাদের মতো প্রাচীন পরিবার দেশে আর। আছে কি? বলল আহমদ মুসা।
দেশের সব খবর আমার কাছে নেই। একটা উল্লেখযোগ্য তথ্য আমার কাছে আছে। প্রাচীন চীনের ঐতিহাসিক শাসন সময়ের শুরুতে, ২৬৯৯ থেকে ২৫৮৮ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে, চীন শাসনকারী সম্রাট হুয়াংফির বংশধর পূর্ব চীনের পীত নদী বিধৌত সাংডন প্রদেশের জিববা শহরে বাস করে। সম্রাট হুয়াংফিকে ইয়েলো সম্রাট বলেও অভিহিত করা হয়। তার আরও নামের মধ্যে একটা নাম ছিল কিন শিং হুয়া। জিবো শহরের সেই পরিবারটির কর্তা ব্যক্তির নাম কিন শিং হুয়া। তারা চীনের একটি প্রাচীন পরিবার। তবে তাদের পরিবার ইতিহাসের আওতার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের পরিবারের সময়কাল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। বলা হয়, আমাদের পরিবারের প্রধান ব্যক্তি সম্রাজ্ঞী নুয়া ছিলেন একাধারে শাসক, অন্যদিকে দিব্যক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ দেবতা। তাদের ধর্মশালায় কোনো প্রতিমা, মূর্তি ছিল না। অদৃশ্য দেবতার পূজা হতো।
ধন্যবাদ জে ঝি সেংগ। আপনি জিবো শহরের যে পরিবারের কথা। বললেন, তার কর্তা কিন শিং হুয়া কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং পার্টির প্রাচীন ইতিহাস বিভাগের প্রধান পরিচালক। তাই তো? বলল আহমদ মুসা।
ঠিক, আপনি ঠিক চিনেছেন। জে ঝি সেংগ বলল।
আহমদ মুসা যখন কথা বলছিল, তখনও তার মনে অন্য কথার ঝড়। তাহলে লু ঝি’র বাবাই দেখছি জে ঝি সেংগ পরিবারের শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর দ্বিতীয় প্রাচীন পরিবার হওয়া এবং তাদের ও আমার শত্রুর উল্কি প্রতীক এক হওয়া প্রমাণ করছে লু ঝি’র বাবা কিন শিং হুয়াই তাহলে সব কিডন্যাপের জন্যে দায়ী। আর তারা জে ঝি সেংগ পরিবারের শত্রু নিশ্চয়
এজন্য হতে পারে যে, প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে এক নম্বর পরিবার যদি না থাকে, তাহলে কিন শিং হুয়াই-এর দুই নম্বর পরিবার তখন এক নম্বর পরিবারের সম্মানে অধিষ্ঠিত হবে। এই হিংসারই তাহলে শিকার এই পরিবার!
বলল আহমদ মুসা, আমি বোধ হয় আপনার শত্রুকেও পুরোপুরি চিনে ফেলেছি। তবে…।
গেটের কলিং বেল বেজে উঠল।
থেমে গেল আহমদ মুসা। নে নুয়া উঠে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
গেটম্যান ভেতরে ঢুকল। বলল, জনাব ওয়াং আলীর কাছ থেকে একজন লোক এসেছে।
নিয়ে এস।
বলেই স্বগত কণ্ঠে জে ঝি সেংগ বলল, ওয়াং আলী আসার কথা। তিনি লোক পাঠালেন কেন?
গেটম্যান প্রবেশ করল লোকটিকে নিয়ে।
জে ঝি সেংগ লোকটিকে বসতে দিয়ে বলল, কী খবর চৌ?
চৌ লোকটি একটা চিঠি জে ঝি সেংগ-এর দিকে তুলে ধরে বলল, ওয়াং আলীরা খুব বিপদে। এই চিঠি দিয়েছেন তিনি।
একটু থেমেই তাড়াতাড়ি বলল, আমি যেতে পারি গুরুজী?
জে ঝি সেংগকে এলাকার লোকরা একজন ধর্মগুরু হিসাবে মান্য করে। তিনি শুধু প্রাচীনতম বংশের কর্তা ব্যক্তি নন, তিনি প্রাচীনতম মন্দিরের পুরোহিতও।
চিঠির ভাঁজ খুলতে খুলতে জে ঝি সেংগ বলল, যাও, ধন্যবাদ।
চৌ চলে গেল।
চিঠিটা পড়ছি জনাব। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল জে ঝি সেংগ।
ওয়াং আলীর বিপদের কথা শুনে আহমদ মুসাও উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল কি ঘটেছে তা জানার জন্যে। বলল, প্লিজ পড়ন।
পড়তে শুরু করল জে ঝি সেংগ।
মান্যবর গুরুজী,
আকস্মিক এক বিপদে পড়ে আমি আপনার ওখানে যেতে পারলাম না। আমি দুঃখিত। খুব বিপদ আমাদের সামনে। আমরা যাদের ভয়ে শানশি, এলাকা থেকে পালিয়ে এসেছিলাম, তারা এ এলাকার মিত্রদের সাথে মিশে আমাদের উপর চড়াও হতে আসছে। শুনলাম, তারা গোপনে তাদের মিত্রদের এখানে এসে জমায়েত হয়েছে। যেকোনো সময় আক্রমণ হতে পারে। আমি কি করব, সেই চিন্তায় আমরা এখন অস্থির। ঈশ্বরের কাছে। প্রার্থনা করবেন, তিনি যেন আমাদের সাহায্য করেন। কথা রাখতে না পারায় আবারও দুঃখ প্রকাশ করছি।
-ওয়াং আলী।
চিঠি পড়া শেষ হলো। কেউ কোনো কথা বলল না।
জে ঝি সেংগ-এর চোখে-মুখে উদ্বেগ ও দুঃখের প্রকাশ। আহমদ মুসার মুখ গম্ভীর। ভাবনার ছায়া তার চোখে-মুখে।
অল্পক্ষণ পরেই আহমদ মুসা চোখ তুলল জে ঝি সেংগের দিকে। বলল, ওয়াং আলীরা এখান থেকে কত দূরে, কোথায় থাকেন?
আমাদের মাউন্ট হেংশানের এই শাখাটা দক্ষিণে এক মাইল দূরে হু উপত্যকা পর্যন্ত গেছে। এই হু উপত্যকার উত্তরে এই পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে ওয়াং আলীরা আশ্রয় নিয়েছে। বলল জে ঝি সেংগ।
ওখানে কাদের বাস? আহমদ মুসা বলল।
উপত্যকায় প্রধানত হারা বাস করে, কিন্তু পাহাড় এলাকায় উইঘুর এবং হুইদের বাস। বলল জে ঝি সেংগ।
উদ্বাস্তু হুইরা সুদূর উত্তর শানশি থেকে শাংশি প্রদেশের এই জায়গাটাকে বসতির জন্যে পছন্দ করার কারণ? আহমদ মুসা বলল।
এই এলাকায় কোনো জাতিগত বিরোধ নেই। হান, উইঘুর, হুই- সবাই মিলেমিশে বাস করে। হুই-উইঘুরদের কোনো মেয়ে হানদের ঘরে যায়নি বটে, কিন্তু হানদের প্রচুর মেয়ে উইঘুর, হুই বিশেষ করে হুইদের ঘরে এসেছে। এই এলাকার রাজনীতিতেও জাতি-বিভেদ নেই। গণপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও হান, হুই, উইঘুর সবাই সুযোগ পায়। বলল জে ঝি সেংগ।
উইঘুর উদ্বাস্তুরা যদি কোনো বৈরিতা ও আক্রমণের শিকার হন, তাহলে সবাই মিলে তাদের সাহায্য করবে না? আহমদ মুসা বলল।
এটা নির্ভর করছে এখানকার সরকারি অফিস ও পুলিশের ভূমিকার উপর। পুলিশ যদি উইঘুরদের সক্রিয় সমর্থন দেয়, তাহলে তারা সবার। সমর্থন পাবে। কিন্তু যদি পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে, সাহায্যে এগিয়ে না আসে, তাহলে এলাকার লোকরা উদ্বাস্তু উইঘুরদের সমর্থন করবে, কিন্তু সক্রিয় সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। বলল জে ঝি সেংগ।
কিন্তু যদি উদ্বাস্তু উইঘুররা আত্মরক্ষা করতে, আক্রমণ ঠেকাতে পারে, তাহলে অন্যান্য বাসিন্দা ও পুলিশের প্রতিক্রিয়া কি হবে? আহমদ মুসা বলল।
স্থানীয় বাসিন্দারা খুশি হবে, পুলিশও প্রকাশ্যে কিছু বলবে বলে মনে হয় না। কিন্তু ওয়াং তার চিঠিতে আক্রমণকারীদের সাথে স্থানীয় কারো। কারো যোগ-সাজসের কথা বলেছে। যদি তা হয় তাহলে এটা একটা সমস্যা হতে পারে। তবে উইঘুর উদ্বাস্তুরা যদি আত্মরক্ষা করতে পারে, তাহলে ওরা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে হয় না। বলল জে ঝি সেংগ।
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কথা বলল না। ভাবছিল সে। এক সময় সে বলল, মি. জে ঝি সেংগ, আমি হু উপত্যকার ওখানে যেতে চাই।
আপনি যাবেন? কেন? বলল জে ঝি সেংগ।
ওয়াং আলীর বিপদটাকে সরেজমিনে জানা। আহমদ মুসা বলল।
একটু চিন্তা করল জে ঝি সেংগ! বলল, আপনি গেলে তো আমাকেও যেতে হবে। আপনাকে একা ছাড়তে পারি না।
থামল একটু। আবার বলল, ঠিক আছে আমরা খাওয়া-দাওয়া করে নেই। একটু কাজ আছে আমার, তারপরই আমরা যাব।
বাবা আমি যেতে পারি না। কালকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। বলল নে নুয়া।
মা, ওখানে আমরা একটা বড় ঝামেলার আশঙ্কা করছি। আমরা তাড়াতাড়ি চলে আসব। তোমার গিয়ে কাজ নেই। জে ঝি সেংগ বলল।
বাবা, ওয়াং আলী আংকলের মেয়ে ফা জিয়া হাদিদ আমার ভালো বন্ধু। ওঁদের যদি বড় ঝামেলা হয়ে থাকে, তাহলে কি আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াব না। আমাদের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলার পর কয়েক দিন সে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। বলল নে নুয়া।
জে ঝি সেংগ একটু চিন্তা করে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, আপনি কি বলেন জনাব। ওখানে যাবার প্রস্তাব তো আপনার।
নে নুয়ার দাবিটা সামাজিক। ঠিক আছে, সে যাক। আহমদ মুসা বলল।
তিনজনই যাত্রা করল হু উপত্যকায়। গাড়ি ড্রাইভ করছিল নে নুয়া। পেছনের সিটে আহমদ মুসা এবং জে ঝি সেংগ। ছুটে চলল গাড়ি।
.
ওয়াং আলী তার দীর্ঘ কথা শেষ করতে গিয়ে বলল, ওগুলো শিক্ষা শিবির নয়, আসলে ওগুলো আমাদের জাতি ধ্বংসের একটা ভয়ংকর কর্মসূচি। ওখানে আমাদের কিশোর, যুবক-যুবতীরা তাদের ঈমান-আকিদা থেকে সরে আসে। যারা ঈমান-আকিদার উপর অনড় থাকে, তাদের এক এক করে গুম করে ফেলা হয়।
এ বৈঠকে উপস্থিত আহমদ মুসা, জে ঝি সেংগসহ উদ্বাস্তু উইঘুরদের যুবক, তরুণ ও প্রবীণ বয়সের নেতৃবৃন্দ।
।কথা হচ্ছিল ওয়াং আলীর বাড়ির ভেতরের বৈঠকখানায়।
পর্দার আড়ালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মহিলা নেত্রীও এসেছেন।
এর আগে আহমদ মুসা হু উপত্যকার পাহাড়ে উদ্বাস্তু উইঘুর বসতিতে পৌঁছলে ওয়াং আলী আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়েছিল। আহমদ মুসার নাম না জানতে পারলেও আহমদ মুসার সাহস ও সংগ্রামের বিস্ময়কর কাহিনী ওয়াং আলী শুনেছিল জে ঝি সেংগ-এর কাছে। খুশি হয়েছিল আহমদ মুসাকে পেয়ে। ওয়াং আলীর স্বাগত জানানোর জবাবে আহমদ মুসা বলেছিল, জনাব আমি আপনাদের বিপদের কথা শুনেছি, কিন্তু সব কথা জানি না। তাছাড়া আপনাদের উদ্বাস্তু হওয়ার কাহিনীও জানতে আমার আগ্রহ।
ওয়াং আলী বলেছিল, আমাদের কথা যারা শোনার কথা, তারা কেউ শোনেনি। প্রতিকারও পাইনি। আপনি শুনলে খুশি হবো।
আহমদ মুসার সাথে কথা বলার আগে ওয়াং আলী তার লোকদের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয়দের ডেকে নিয়েছিল। বিপদের প্রেক্ষিতে সবাই আশেপাশেই ছিল।
ওয়াং আলীর কথা শেষ হলে আহমদ মুসা বলল, আপনাদেরকে ঐ শিক্ষা-শিবিরে জোর করে নেয়ার ব্যাপারে আপনারা পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেননি?
হ্যাঁ, ঐ কথা বলতে ভুলে গেছি। আমরা পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। এলাকার পুলিশ অফিসের কর্তাব্যক্তি বিষয়টাকে কোনো গুরুত্বই দেননি। বলেছিলেন, এটা নতুন কি। অন্যান্য অনেক জায়গায় এ ধরনের শিক্ষা শিবির হচ্ছে। তোমরা বাধা দিচ্ছ কেন? ওরা যা বলে তাই কর।
আমাদের আর কোনো কথাই পুলিশ শুনতে চায়নি।
আমরা ফেরার পথে পুলিশ অফিসের বাইরে ছোট ব্যাংকের একজন পুলিশ অফিসার আমাদের বলেছিলেন, আপনারা প্রশাসনে গিয়ে অভিযোগ করুন। এ পুলিশ অফিসে কোনো বিচার পাবেন না।
আচ্ছা বলুন তো, এই শিক্ষা-শিবির কর্মসূচি কি সরকারের? সরকারি হলে তো সরকারি কর্মচারীরা যাবেন। কিন্তু যারা যান তাদের তো সরকারি কর্মচারী বলে মনে হয় না। বলেছিলাম আমি পুলিশকে।
তিনি বলেছিলেন, না না এটা সরকারি কর্মসূচি নয়। একটা অপরিচিত সংস্থা এটা করছে বলে আমরা জানি। সরকারের প্রশাসন ও পুলিশের কিছু লোক ওদের সহযোগিতা করে। ওরা যা করে সরকার সবকিছু জানে বলে মনে হয় না।
বলে একটু থেমেই ওয়াং আলী আবার শুরু করল, এখানকার পুলিশ অফিসের অবস্থাও কতকটা এই রকমই। পুলিশ অফিসের প্রধানকে গিয়ে জানালাম, আপনাদের বিশেষ করে আপনার সহযোগিতায় আমরা বসতি গড়েছি। আমরা খবর পেয়েছি একটা গ্রুপ আমাদের বসতি ধ্বংস করতে আসছে। আমরা আপনার সাহায্য চাই।
কারা আসছে জানেন? বলেছিলেন পুলিশ অফিসের পুলিশ প্রধান।
ইয়েলো নদীর ওপারের শানসি এলাকা থেকে তারা এসেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। বলেছিলাম আমি।
পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, শুধু ইয়েলো নদীর ওপার থেকে নয়, এপারের লোকও শামিল আছে।
তাহলে তো নিজেই সবকিছু জানেন স্যার। প্লিজ আমাদের সাহায্য করেন। বলেছিলাম আমি।
কখন কি ঘটবে আমরা জানি না। সার্বক্ষণিকভাবে কয়েকজন। পুলিশকে যদি রাখি তারা ভালো কিছু করবে, কিংবা করতে পারবে সে আস্থা আমার নেই। আপনাদের নিরাপত্তার মতো আমারও নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। সুতরাং চাইলেই আমি কিছু করতে পারবো না। বলেছিলেন পুলিশ। অফিসার।
আমি অনুরোধ করেছিলাম, প্লিজ আপনি সরকারকে জানিয়ে আমাদের সহযোগিতা করুন। তিনি বলেছিলেন, সরকারকে মানে উপরের পুলিশকে জানানো তো? রোগ কিছু কিছু সেখানেও সংক্রমিত হয়েছে। লোভের বশীভূত অনেকেই হয়, সন্ত্রাসকে সবাই ভয় করে। আর বাস্তুহারাদের বসতিতে কেউ কেউ অবৈধ বলে কিছু করে বসে, তাহলে আমাদের কি করার আছে!
শেষে আমি বলেছিলাম, আমরা তাহলে কি করব? তিনি বলেছিলেন, আমরা ওদিকে নজর দেব না, যা ইচ্ছা তাই কর। পরে আমরা সরকারকে জানাব। ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্তৃপক্ষই এর বিহিত করতে পারেন। আমি হতাশ হয়েই সেখান থেকে ফিরে এসেছি।
কিন্তু আশার কথাও তিনি কিছু বলেছেন। বলল আহমদ মুসা।
তিনি কি আশার কথা বলেছেন? ওয়াং আলী বলল।
প্রথমেই বলা যায়, তিনি আক্রমণকারীদের সন্ত্রাসী দল মনে করেছেন। আর দ্বিতীয়ত, বলেছেন, আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন, তারা দিকে নজর দেবেন না। আরও একটা কথা বলেছেন তিনি। ঘটনা যখন তিনি জানবেন এর বিহিত করার জন্যে ঊর্ধ্বতন সরকারকে অবহিত করবেন। তাতে নিশ্চয় আক্রমণকারীরাই আসামী হবেন। বলল আহমদ সা।
তাহলে আমাদের করণীয় কি জনাব? সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমরা কি করে লড়াই করব? আমাদের আত্মরক্ষার অস্ত্র যা ছিল, পুলিশ তো নিয়ে। গেছে। আমরা তো খালি হাতে এখানে এসেছি। আর সন্ত্রাসীদের হাতে আমরা যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই। পরে পুলিশ কোনো প্রতিকার করলে, আমাদের তাতে কি লাভ! ওয়াং আলী বলল।
ঠিক বলেছেন জনাব। কিন্তু কি করা যায়, এ ব্যাপারে আপনার মন কি বলছে? বলল আহমদ মুসা।
ওদেরকে আমরা আমাদের বসতি আক্রমণ করতে দিতে চাই না। শক্তি থাকলে ওদেরকে আমরাই আক্রমণ করতাম। ওয়াং আলী ভাবল।
শক্তি নেই বলছেন, এখন কি করবেন মনে করছেন? বলল আহমদ মুসা।
কিছুই ভাবতে পারছি না। আগে ভেবে ছিলাম মাটি কামড়ে নিজ বসতিতেই পড়ে থাকব। কিন্তু এখন ভাবছি, জীবন দিয়ে কেন আমরা শত্রুদের ষড়যন্ত্রকে বিজয়ী করব? তার চেয়ে বসতি ত্যাগ করাই আমাদের জন্যে ভালো। ওয়াং আলী বলল।
কিন্তু সময় তার জন্যে আপনারা পাবেন না। বরং পলায়নপর বিশৃঙ্খল ও অবিন্যস্ত অবস্থায় তারা যদি আপনাদের পেয়ে যায়, ক্ষয়ক্ষতি আপনাদের তখন বেশি হবে।
উদ্বেগ ফুটে উঠল ওয়াং আলীর চোখে-মুখে। বলল, তাহলে শেষ হয়ে যাওয়াই কি আমাদের ভবিতব্য?
ওয়াং আলীর কথা শেষ হতেই ভেতর থেকে একটা তরুণী কণ্ঠ চিৎকার। করে উঠল, না, এভাবে ধ্বংস আমাদের ভবিতব্য নয়। আমরা মানি না। আমরা এবার মোকাবিলা করব। ওরা প্রস্তুত হয়ে আসার আগেই ওদের আমরা আক্রমণ করব। আমরা যুব-তরুণরা সম্মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আহমদ মুসা ভেসে আসা কণ্ঠস্বরের দিকে তাকিয়েছে। তার চোখে মুখে বিস্ময়, আনন্দ।
ওয়াং আলী আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, জনাব তরুণীটি আমার মেয়ে উম্মে খাওলা হুইফেং। শানশির একটি মহিলা মাদরাসায় পড়ে। বসতিতে ওদের একটা সংগঠন আছে।
আহমদ মুসা ওয়াং আলীকে ধন্যবাদ দিয়ে ভেতরে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ তোমাদের সাহস ও সিদ্ধান্তের জন্যে। তোমাদের সিদ্ধান্ত যদি এটাই হয়, তাহলে আমি তোমাদের সাথে আছি। তবে তোমরা যা চাচ্ছ সেটা হবে না। তোমাদেরকে কোনোভাবেই আক্রমণকারী হওয়া চলবে না।
কেন। তরুণীটি বলল।
উইঘুর মুসলমানদের গায়ে এমনিতেই সন্ত্রাসের লেবেল আছে। এই অভিযোগ তাহলে আরও বাড়বে। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে? তরুণীটি বলল ভেতর থেকে।
তাহলে ওরাই আগে আক্রমণকারী হোক। বলল আহমদ মুসা।
ওরা তো আক্রমণকারীই। ওরাই তো আমাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে। এবারও এসেছে আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে। তরুণীটি বলল।
কেউ কাউকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে না, আল্লাহ না চাইলে এবং তোমরাও যদি চাও নিজেদের রক্ষা করতে আল্লাহর দেয়া শক্তি ও যোগ্যতা ব্যবহার করে। তাহলে আল্লাহর সাহায্য তোমরা পাকে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ওয়াং আলী বলল, আমরা খুশি হবো, এই বিপদে আপনি আমাদের সাথে থাকলে।
আপনাদের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে আমি বসতে চাই, সম্ভব হলে এখনি। বলল আহমদ মুসা।
ওয়াং আলীর ভেতরের বসার ঘরে বৈঠক বসেছে। ওয়াং আলীসহ চারজন সরদার বসেছে সরদারের আসনে। তাদের চারজনের মাঝখানে বসানো হয়েছে আহমদ মুসাকে। তাদের সামনে বসেছে হেংশান পাহাড়ের ধর্মনেতা জে ঝি সেংগ এবং তার মেয়ে নে নুয়া। সবার সামনে অর্ধ চন্দ্রাকারে বসেছে ওয়াং আলীর মেয়ে উম্মে খাওলা হুইফেংসহ দুজন যুব। নেত্রী এবং দুজন যুব নেতা। মেয়ে দুজনের মাথাসহ সর্বাঙ্গ কালো চাদরে ঢাকা।
কথা শুরু করেছিল ওয়াং আলী। ওয়াং আলীর কথা শেষ না হতেই বাইরে থেকে দুইজন ছুটে এলো। চিৎকার করে বলল, ওরা আমাদের আক্রমণ করতে ছুটে আসছে। এখনি এসে পড়বে।
আতঙ্কের গুঞ্জন উঠল বৈঠকে।
আহমদ মুসা হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল ছুটে আসা লোক দুজনকে, শত্রুরা আসছে কোন্ দিক থেকে, পাহাড়, না উপত্যকার পথে? উপত্যকার দিক থেকে তারা উঠে আসছে। বলল দুজনের একজন।
কতদূর পর্যন্ত এসেছে ওরা? আহমদ মুসা বলল।
পাহাড়ের গোড়ায়। বলল আগের লোকটিই।
কতদূর থেকে ওদের দেখেছ? আহমদ মুসা বলল।
দুগজ দূর থেকে হবে স্যার। দুজনের দ্বিতীয়জন বলল।
কতজন হবে ওরা? আহমদ মুসা বলল।
তিরিশ-পঁয়ত্রিশজন হবে। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এগিয়ে আসছে। একজন ঘোড় সওয়ারের নেতৃত্বে পনেরো-বিশজনের একটা দল সামনে। বেশ একটু পেছনে অবশিষ্টরা। তারা পাহাড়ের গোড়ায় এসে সিংগল লাইনে ছড়িয়ে পড়ছে বসতির দক্ষিণ পাশে। বলল শেষোক্ত লোকটিই।
আহমদ মুসা কিছু বলল না। মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল। চোখ খুলেই আবার তাকাল ওয়াং আলী ও সরদারদের দিকে। বলল, বুঝা যাচ্ছে ঘোড় সওয়ার ওদের সরদার বা নেতার নেতৃত্বে ওদের সামনের দলটি আপনাদের বসতির সম্মুখভাগ আক্রমণ করবে। আর পেছনের দলটি আপনাদের ঘিরে ফেলছে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে। সামনে থেকে তাদের আক্রমণ হবার পর ওরা পাশ থেকে আক্রমণ করবে বসতির কেউ যাতে পালাতে না পারে। ওদের সামনের আক্রমণ যদি ব্যর্থ করে দেয়া যায়, তাহলে তাদের পাশের আক্রমণ দুর্বল হয়ে পড়বে। আমার প্রথম পরামর্শ হলো, জীবনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াবার জন্যে বসতির সামনেসহ সবদিকের প্রান্ত বরাবর কয়েকটি করে বাড়ি খালি করুন। বয়স্ক ও নারী-শিশুদেরকে বসতির মাঝ বরাবর এক জায়গায় রাখুন। সক্ষম নারী-পুরুষরা যা আছে তাই নিয়ে বসতির প্রান্ত বরাবর দাঁড়িয়ে যাবে, সম্মুখযুদ্ধের জন্যে নয়, গেরিলা আক্রমণের লক্ষ্যে। আর বসতির সম্মুখভাগের ভার আমার হাতে থাকবে। দুই. সম্মুখভাগের সব আলো জ্বালিয়ে রাখুন। তিন, ভিডিও ক্যামেরা থাকলে সেটা অন করে বসতির সামনের চত্বরের কোথাও লুকিয়ে রাখুন এবং চার, সবদিক নিরাপদ হলে আমি রিভলবারের তিনটা ফাঁকা গুলি করব, এরপর সবাই বেরিয়ে আসবেন।
আহমদ মুসা থামলে উম্মে খাওলা হুইফেং কিছু বলার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল। আর কোনো কথা নয়। ওরা এসে পড়বে। যে কাজগুলোর কথা বলা হয়েছে, তা করুন এবং সবাই তার স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করুন। বলল আহমদ মুসা।
ওয়াং আলী উঠে দাঁড়াল। বলল, জনাব যা বললেন, তা সবই এখনি করতে হবে। কিন্তু বুঝতে পারছি না, এসব দিয়ে কি হবে! কীভাবে ওদের। ঠেকানো যাবে?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ঠেকাবার শক্তি শুধু আল্লাহরই আছে। আমরা তার উপরই ভরসা করছি। প্লিজ আপনি…।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না।
একজন লোক পাহাড়ের ঢালের দিক থেকে ছুটে এলো। চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, সবাইকে পালাতে হবে। ওরা আক্রমণ করতে ছুটে আসছে। সবার হাতে স্টেনগান, রিভলবার। আরও কত কি কে জানে?
ওরা এখন কত দূর? বলল আহমদ মুসা।
ঢালের অনেকখানি উঠে এসেছে। পথে বিক্ষিপ্তভাবে যে বাড়িগুলো পেয়েছে তা ভাংচুর করেছে। লোকরা পালিয়ে বসতির এদিকে চলে এসেছে। লোকটি বলল।
আহমদ মুসা তাকাল ওয়াং আলীর দিকে। বলল, কতটা সময় লাগবে ওদের আসতে?
দশ মিনিট। ওয়াং আলী বলল।
সামনের এই বাড়িগুলো খালি করে দিন অবিলম্বে। আর সামনের চত্বরে আলোর ব্যবস্থা তো হচ্ছেই। বসতির সামনে শুধু আমিই থাকব। বলল আহমদ মুসা।
আপনার পেছনে দুএকজন থাকলে ভালো হয় না জনাব। ওয়াং আলী বলল।
একজন ক্যামেরাম্যান তো আমি রাখছি। আরও দুএকজন থাকতে, পারে। তবে তারা আমার নির্দেশ ছাড়া কিছুই করবে না। বলল আহমদ মুসা।
একটু সামনেই হৈচৈ শোনা গেল। একজন ছুটে এলো আহমদ মুসাদের দিকে।
এই বসতিরই লোক। বলল, ওরা এসে পড়েছে। জ্বালিয়ে দেবে আমাদের বসতি, মেরে ফেলবে সবাইকে।
দ্রুত আহমদ মুসা তাকাল ওয়াং আলীর দিকে। বলল, আমি যেভাবে বলেছি, সেভাবেই হবে সবকিছু।
উপস্থিত সবাইকে নিয়ে দৌড়ে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আপনি কোথায় থাকবেন? কি করবেন?
আমার কথা ভাববেন না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। বলল। আহমদ মুসা।
ওরা এসে গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত একটা আড়ালে সরে গিয়েছিল। অগ্রবাহিনীর বিশজনের একটা দল মারমুখি উন্মত্ততা নিয়ে এসে দাঁড়াল বসতির সামনে। একজন চিৎকার করে বলল, কে কোথায় আছ, বেরিয়ে এস। জেহাদ কর আমাদের সাথে। কাপুরুষের মতো লুকিয়ে কেন?
কোনো উত্তর পেল না কোথাও থেকে।
একজন বলল, কেউ বেরোবে না। ওরা নিশ্চয় চোরাগোপ্তা আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত হয়ে ওঁৎপেতে বসে আছে। চল আমরা ঘরবাড়িতে আগুন লাগাই। তখন সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে আমাদের বন্দুকের খোরাক হবার জন্যে।
নেতা গোছের লোকটি, যে প্রথম কথা বলেছিল, বলল, ঠিক বলেছ।
বলেই সে একটা আগুন বোমা ছুড়ল সামনের বাড়ির বৈঠকখানা লক্ষে)। তার দেখাদেখি আরও অনেকগুলো আগুনের বোমা ছুটে গেল সামনের বাড়িগুলো লক্ষ্যে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বসতির সামনের বাড়িগুলো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
আহমদ মুসা চত্বরের লাইটপোস্টে স্থাপিত ভিডিও ক্যামেরার দিকে একবার তাকিয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুই। হাত উপরে তুলে এগোতে লাগল আক্রমণকারী সন্ত্রাসীদের দিকে। বলল, আপনারা প্লিজ থামুন। বসতির উপর আক্রমণ দয়া করে বন্ধ করুন। তারা তো আপনাদের কোনো ক্ষতি করেনি। আপনারা তাদের উচ্ছেদ করেছেন। তাদের বসতি থেকে। তারা মেনে নিয়েই পালিয়ে এসে এখানে বসতি গড়েছে। আপনারা তাদের এ আশ্রয়টুকু ধ্বংস করবেন না। আপনারা প্লিজ…।
আহমদ মুসার কথার মধ্যেই নেতা গোছের লোকটি চিৎকার করে বলে উঠল, কে তুমি? তোমাকে তো চীনা মনে হচ্ছে না? সরে যাও আমাদের সামনে থেকে। আমরা এই বসতিকে তার বাসিন্দা সমেত মাটির সাথে মিশিয়ে দেব।
ওদের অপরাধ কী? বলল আহমদ মুসা।
আমরা কোনো কৈফিয়ত দিতে রাজি নই। সরে দাঁড়াও, না হলে তোমাকেই আগে শেষ করব। চিৎকার করে বলল সেই লোকটিই।
আমি সরব না। তোমাদের আইন ভাঙতে দেব না। সন্ত্রাস করতে তোমাদের দেব না। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই সেই নেতা লোকটির স্টেনগান উপরে উঠল আহমদ মুসার লক্ষ্যে। ছুটে এলো এক ঝাঁক গুলি, তার সাথে অব্যাহত অট্টহাসি।
লোকটির স্টেনগানের ট্রিগার শব্দ করার সাথে সাথে আহমদ মুসার। দেহ ছিটকে পড়েছিল মাটির উপর, যেন গুলি খেয়ে সে ঢলে পড়েছিল মাটিতে।
ওদের গুলিতে একটু ছেদ নেমেছিল। ওদের স্টেনগান ধরা হাতও কিছুটা শিথিল হয়ে পড়েছিল।
পড়ে গিয়ে আহমদ মুসা মৃতের মতোই নিশ্চলভাবে শুয়ে ছিল।
স্টেনগানধারীদের সর্দার গোছের লোকটি চিৎকার করে বলল, কেউ একজন গিয়ে নিশ্চিত কর যে শয়তানটা মরেছে কিনা। লোকটিকে মনে হয় ওরা হায়ার করে এনেছিল। কথা-বার্তায় তাকে উইঘুর কিংবা চীনা মনে হলো না।
একজন ছুটে গেল।
আহমদ মুসা উপুড় হয়ে পড়েছিল। ছুটে যাওয়া স্টেনগানধারী লোকটি তার স্টেনগান দুহাতে ধরে ঠেলে আহমদ মুসাকে চিৎ করল।
আহমদ মুসা এক ঝলক চেয়ে দেখল লোকটির দুই হাত স্টেনগানের ট্রিগার থেকে খানিকটা দূরে। আহমদ মুসা তার স্টেনগান দুহাত দিয়ে কেড়ে নিয়ে চোখের পলকে প্রথমে গুলি করল তাকে। স্টেনগানের সেই ব্যারেলটি নিমেষেই ঘুরিয়ে নিল অন্য স্টেনগানধারীদের দিকে। তারপর ওদের ওপর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত কয়েকবার ঘুরিয়ে নিল স্টেনগানের ব্যারেল।
ওদের কয়েকটা স্টেনগান গর্জন করে উঠেছিল বটে, কিন্তু ওদের গুলি আহমদ মুসার মাথার অনেক উপর দিয়ে চলে গেছে। আর অধিকাংশই তাদের হাতের স্টেনগান তোলার সুযোগ পায়নি। বুঝে উঠে স্টেনগান। তোলার আগেই ওরা শেষ হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা শুয়েই আরেকটু অপেক্ষা করল। কোনো গুলি এলো না। কোনো দিক থেকে। উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ছুটে গেল স্টেনগানধারীদের দিকে। দেখল, ওদের কেউ বেঁচে নেই।
আহমদ মুসা অভ্যেস অনুযায়ী সবাইকে সার্চ করতে চাইল। কিন্তু সে সময় নেই। আহমদ মুসা এগোলো সরদার লোকটির দিকে। ঠিক করেছে তাকেই শুধু সার্চ করবে। প্রথমে সে সরদারের স্টেনগান সার্চ করল। তাতে বাঞ্ছিত সে মনোগ্রাম পেল না। দুই বাহু সার্চ করল। কিন্তু সেখানেও উল্কি নেই। সবশেষে তার শার্টের কলার ব্যান্ডে পেল বাঞ্ছিত সেই চিহ্ন, লুপ্ত। প্রাচীন চীনা বর্ণমালার প্রথম বর্ণ। পাশেই তার মাথার ক্যাপ পড়েছিল চিৎ হয়ে। ওদিকে চোখ পড়তেই ক্যাপের ভেতরের টপে একটা মনোগ্রাম দেখতে পেল। ক্যাপ হাতে নিয়ে দেখল, কালো ক্যাপে পেস্টকরা ডিপ কালো গোলাকার প্লাস্টিক খণ্ডে কিছু লিখা আছে। কালোর উপর ভায়োলেট রঙে প্রায় অদৃশ্য লিখাঁটি পড়ল, জোয়ান উ আর্মি। জোয়ান উ এই শব্দ দুটো পড়তেই তার মনে পড়ে গেল উডাং পর্বতের কোনো এক প্যালেস বা মন্দিরের কাহিনীতে এই নাম সে পেয়েছিল। সে চীনের এক লেজেন্ডারি হিরো। সে পেয়েছিল এক ঐশী তরবারি ও আশীর্বাদ। ঐ তরবারি দিয়ে সব যুদ্ধেই বিজয়ী হয়েছে সে। তরবারিটা নানিয়ান মন্দির বা উঝেন মন্দিরে সংরক্ষিত আছে। এই সন্ত্রাসী দলটি তার নামেই বাহিনী গঠন করেছে, না কি এই সন্ত্রাসী দলের নেতা এই নাম গ্রহণ করেছে? তাহলে দেখা যাচ্ছে। কিডন্যাপকারী বাহিনীসহ সকলেরই নাম জোয়ান উ আর্মি।
তাহলে সেই একই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এরা, ভাবল আহমদ মুসা।
এই সময় ভিডিও ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করা উচাও এবং নে নুয়া ও উম্মে খাওলা হুইফেং বেরিয়ে এলো।
আহমদ মুসা ওদের দিকে এগোলো। বলল, সকলকে ধন্যবাদ যে, আগুনের বিস্তার রোধ করা গেছে।
আহমদ মুসা একটু থেমেই বলল, তোমরা এখানে অপেক্ষা কর। লাশ, তাদের অস্ত্র যা যেখানে যেভাবে আছে সেখানেই থাকবে। কোনো কিছুতেই হাত দেয়া যাবে না। আমি দক্ষিণ দিক দিয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছি। কয়েকটা গুলির শব্দ পেয়েছি। দেখি ওদিকে যাওয়া সন্ত্রাসীরা কি করছে। অবশ্য তোমাদের কেউ আমার সাথে আসতে পার, উ চাও তুমি এস। জায়গাগুলো আমি চিনি না।
আহমদ মুসা একনাগাড়ে বলে গেল কথাগুলো। উ চাও, নে নুয়া ও হুইফেংদের চোখ তখন ছানাবড়া। অনেক প্রশ্ন, অনেক বিস্ময় তাদের চোখে-মুখে। আড়াল থেকে সবটাই তারা দেখেছে। দেড় ডজন স্টেনগানধারীর আক্রমণের মুখে একক যুদ্ধ জয়ের একক নেতা আহমদ মুসাকে বোবা বিস্ময় নিয়ে তারা দেখছে। এক ঘোরের মধ্যে আহমদ মুসার নির্দেশ তারা শুনছে।
আহমদ মুসা একটু থামতেই বসতির ভেতর থেকে ছুটে এলো ওয়াহ আলী। চিৎকার দিয়ে বলল, জনাব এদিকের খবর কি? দক্ষিণ ও পশ্চিমের ওঁদের সবাই কি খবর পেয়ে এদিকে ছুটে এসেছে, আমাদের ইনফরমাররা এ খবর দিল।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসাসহ সবাই তাকাল দক্ষিণ দিকে। বসতির দক্ষিণ কোনায় পুড়ে যাওয়া বাড়ির পাশে ছুটে আসা লোকদের স্টেনগান বন্দুক উঠে আসছে আহমদ মুসার লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার স্টেনগান তখনও তার হাতে ঝুলছে।
আহমদ মুসা ওদের দেখার সঙ্গে সঙ্গেই হাতের স্টেনগান ফেলে দিয়ে নিজকে ছুঁড়ে দিল দক্ষিণ দিকে, মাটিতে।
গুলিবর্ষণ তখন শুরু হয়ে গেছে।
আহমদ মুসার দেহ ফুটবলের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ছুটল দক্ষিণে, স্টেনগানধারীদের দিকে।
ওদের স্টেনগান, বন্দুক টার্গেট শিফট করছিল, কিন্তু তা আহমদ মুসার ছুটন্ত দেহের মতো ক্ষীপ্র নয়।
আহমদ মুসার তীরের মতো ছুটন্ত দেহ সারবেঁধে দাঁড়ানো গুলিবর্ষণরত আক্রমণকারীদের মাঝখানে গিয়ে আঘাত করল। ওরা তিনজন পড়ে গেল উপুড় হয়ে।
আহমদ মুসার দেহ ওদের পেছনে চলে গেল।
আহমদ মুসা পড়ে যাওয়া একজনের স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে উঠে। দাঁড়াল এবং গুলিবর্ষণ শুরু করল।
দাঁড়ানো লোকরা তখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। যারা পড়ে গিয়েছিল, তারাও উঠছিল। সবাই আহমদ মুসার স্টেনগানের শিকারে পরিণত হলো।
কয়েক মিনিট নয়, কয়েক মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল সব। প্রায় পনেরো জনের মতো মানুষ বলা যায় চোখের পলকে লাশে পরিণত হলো। এর। আগে লাশ হয়ে গেছে আরও বিশজন।
বসতির ভেতর থেকে আরও উৎসুক মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে।
ঠিক এ সময় পুলিশের একটা হাইল্যান্ডার জীপ এলো বসতির চত্ত্বরে। এসে দাঁড়াল লাশগুলোর পাশে।
হাইল্যান্ডার জীপের পেছনে আরও দুটি জীপ।
গাড়ি তিনটি দাঁড়াতেই পেছনের দুটি গাড়ি থেকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের একজন অফিসারসহ দশ বারজন পুলিশ নামল। তারা এসে সামনের গাড়িটির চারদিকে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।
সামনের গাড়ি থেকে একজন পুলিশ অফিসার নামল। বুঝা গেল বড় পুলিশ অফিসার সে।
অফিসার নামার পর গাড়ির পেছন থেকে নামল চারজন পুলিশ। তাদের হাতে উদ্যত স্টেনগান। এরা পুলিশ অফিসারটির বডিগার্ড বলে মনে হলো।
সামনের জীপ থেকে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা নামার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পুলিশ অফিসের অফিসারটি তাকে স্যালুট দিয়ে একটু দূরে দাঁড়ানো ওয়াং আলীকে দেখিয়ে বলল, ইনি নতুন এই অবৈধ বসতির প্রধান।
হ্যাঁ, তাকে ডাক। আর তোমার পুলিশকে বল চারদিকটা ঘিরে ফেলতে যাতে কেউ পালাতে না পারে।
ওয়াং আলীকে ডাকল পুলিশ অফিসারটি। ওয়াং আলী এলো।
এসে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই উধর্বতন পুলিশ অফিসার বলল, এতগুলো খুন কীভাবে হলো? কে খুন করলো, পঁয়ত্রিশ জনের মতো মানুষকে? এ তো গণহত্যা!
এরা আমাদের বসতিতে আগুন দিয়েছে। বসতির লোকদের হত্যার জন্যে এত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এতগুলো লোক এসেছে। তাদেরকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করলে একযোগে তারা ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। তখন আত্মরক্ষার্থেই এই পাল্টা আক্রমণ করতে হয়। ওয়াং আলী বলল।
একসাথে এত লোক হত্যা? বলল সেই অফিসারটিই।
এরা এত লোক না মরলে, আমরা বসতির সকলেই মরতাম। ওরা আমাদের মেরে শেষ করার জন্যেই এত অস্ত্র, এত লোক নিয়ে এসেছিল। ওয়াং আলী বলল।
এদের কে হত্যা করল? আর অস্ত্র পেল কোথা থেকে? বলল ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার।
এদের অস্ত্র নিয়েই এদের প্রতিরোধ করা হয়েছে। তাছাড়া আমাদের জীবন বাঁচানোর আর কোনো পথ ছিল না। বলল ওয়াং খুব জোরের সাথে।
এ হত্যাকাণ্ড হলো কার হাতে? বলল পুলিশ অফিসারটি।
আমি এই ক্যুনিটির প্রধান। আমার হাতেই হয়েছে এই হত্যাকাণ্ড। ওয়াং আলী বলল।
এই অত্যাধুনিক স্টেনগান আপনি ধরতে পারেন? না, পরিকল্পনা করে লোক মারার জন্যে সন্ত্রাসী হায়ার করেছিলেন? বলল পুলিশ অফিসারটি। তার কণ্ঠে কঠোরতা।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো।
দাঁড়াল পুলিশ অফিসারের সামনে। বলল, অফিসার, আমার হাতের এই স্টেনগান দিয়েই এ সন্ত্রাসীদের হত্যা করেছি আমি এবং এই স্টেনগানটা আমি এদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছি।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই স্থানীয় পুলিশ অফিসের অফিসারটি বলে উঠল, স্যার, এই লোকটিই ঐ গাড়ি নিয়ে আসা লোক।
ও আপনি! প্রেসিডেন্টের পারিবারিক গাড়ি কোথায় পেলেন? গাড়িটা আমি জে ঝি সেংগ-এর বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছি। এখন একজন পুলিশের পাহারায় রেখে এসেছি। গাড়িটা কোত্থেকে চুরি করেছেন?
মামলা যদি হয়ে থাকে, তাহলে তারাই তো সব বলেছে। আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন? বলল আহমদ মুসা।
মামলা হয়নি, হবে। আমি এখনি টেলিফোন করছি প্রেসিডেন্ট হাউজে। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের গোয়েন্দা প্রধান উ ক্যাংগ আমার বস ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে কেসটা আমি নিয়ে নিচ্ছি। এরপরেই আপনাকে নেব শ্রীঘরে। গাড়ি চুরি তো আছেই, তার সাথে আছে তিরিশ পঁয়ত্রিশ জন। লোককে হত্যার অপরাধ। ভয়াবহ অপরাধ। বলল পুলিশ অফিসারটি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ঠিক বলেছেন অফিসার। এই তিরিশ পঁয়ত্রিশজন অস্ত্রধারী যদি উইঘুরদের এই বসতিটা জ্বালিয়ে দিতে পারতো, যদি পারতো তির কয়েক হাজার উইঘুরকে হত্যা করতে এবং দোষটা যদি কোনোক্রমে চাপানো যেত হুই অথবা হানদের ঘাড়ে, তাহলে কতই না ভালো হতো। তাই না অফিসার?
বলেই আহমদ মুসা তাকাল স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, আপনি থানার অ্যাসাইনমেন্টে এখানে এসেছেন?
কেন? বলল স্থানীয় পুলিশ অফিসারটি। তার চোখে-মুখে কিঞ্চিৎ বিব্রত ভাব।
পুলিশ স্টেশন থেকে এনে থাকলে জনাব ওয়াং আলীদের মামলা আপনাকে রেকর্ড করতে হবে, তা না হলে এদেরকে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে মামলা দায়েরের জন্যে। এই সন্ত্রাসীরা যা করেছে তার পুরো ভিডিও রেকর্ড আমাদের কাছে আছে। বলল আহমদ মুসা স্বাভাবিক কণ্ঠে।, পুলিশ অফিসারটি তাকাল ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের দিকে।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারটি আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, খুব তো আপনার সাহস। আসামী হয়ে বাদীর মতো কথা বলছেন?
কে আসামী, কে বাদী তা কোর্টে প্রমাণ হবে। সন্ত্রাসীরা যা করেছে। তার সব প্রমাণ আমাদের হাতে আছে, সেটা তো বললাম। বলল আহমদ মুসা শান্ত কণ্ঠে।
জ্বলে উঠল ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের দুই চোখ। বলল, কোর্ট অনেক দূর। কালকের ভোর দেখতে পাবেন কিনা সেটা ভাবুন।
বলেই পকেট থেকে অয়্যারলেস বের করতে করতে বলল, কথা বলে নেই প্রেসিডেন্ট হাউজে, তার পর দেখাচ্ছি মজা…।
কল করল পুলিশ অফিসারটি।
ওপারের সাথে কানেকশন হতেই বলল, স্যার, শানসি থেকে আমি ডিআইজি গাও ইয়াং বলছি স্যার।
আমরা ভালো আছি স্যার। একটা জরুরি ব্যাপারে টেলিফোন করেছি স্যার। আমি এখন হেংশান এলাকায়। মাননীয় প্রেসিডেন্টের পারিবারিক পুলের একটা গাড়ি ধরেছি স্যার। নিশ্চয় চুরি হয়েছিল। চোরকে সৰ্মেত ধরেছি স্যার।
ওকে স্যার। গাড়ির নাম্বারটা এখনি দিচ্ছি স্যার।
বলে ঊর্ধ্বর্তন সেই পুলিশ অফিসার ডিআইজি গাও ইয়াং নাম্বারটি নোটবই থেকে তাকে দিল। ডিআইজি গাও ইয়াং-এর মুখে তখন হাসি ধরছিল না।
ওকে স্যার। আমি হোল্ড করছি।
বলেই অয়্যারলেসটা মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে স্থানীয় পুলিশ অফিসারটির দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, উ ক্যাংগ স্যার প্রেসিডেন্টের কক্ষে ঢুকছেন। প্রেসিডেন্ট তাকে ডেকেছেন।
বলেই অয়্যারলেস আবার মুখের কাছে তুলে নিল। পার হলো কিছু সময়।
জি স্যার। আমি অয়্যারলেসে আছি।
ডিআইজি গাও ইয়াং-এর মুখটা হঠাৎ কিছুটা মলিন হয়ে উঠল এবং তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, না তেমন কিছু নয় স্যার। একটু কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, ভয় দেখিয়েছি।
হ্যাঁ স্যার, লোকটা চীনা নয়।
আবার নীরবতা।
একটু পরেই ডিআইজি গাও ইয়াং মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি। স্যরি। আর স্যার, গাড়ির ব্যাপারটা ছাড়াও হেংশানে তিরিশ-পঁয়ত্রিশজন মারা গেছে ওঁর গুলিতে, এজন্যেও মাথাটা গরম হয়ে। গিয়েছিল। আমি দুঃখিত স্যার। আগে সব জেনে নেয়া আমার উচিত ছিল।
বলেই ডিআইজি অয়্যারলেস মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে তার দিকে এগোতে এগোতে নিচু কণ্ঠে বলল, স্যার, আমাকে মাফ করবেন স্যার। আমি বুঝতে পারিনি স্যার। প্রেসিডেন্টের। পরিবার গাড়িটা যে আপনাকে দিয়েছে তাও আপনি বলেননি। স্যার, অয়্যারলেসটা নিন, মাননীয় প্রেসিডেন্ট আপনার সাথে কথা বলবেন।
আহমদ মুসা অয়্যারলেসটা নিল। অয়্যারলেস মুখের কাছে নিয়েই সালাম দিল।
সালাম ইয়ংম্যান। আমি সাংঘাতিকভাবে তোমাকে খোঁজ করছি। তুমি ভালো আছ তো? গাড়ি নিয়ে বোধ হয় কিছু বিপত্তি ঘটেছে। আমি দুঃখিত ইয়ংম্যান। বলল প্রেসিডেন্ট।
আমি ভালো আছি এক্সিলেন্সি। আমাকে কেন খোঁজ করছেন। এক্সিলেন্সি?
খুব জরুরি দরকার। সেদিন তাড়াহুড়ার মধ্যে বিষয়টা আমার মনে। আসেনি। আর তোমার পরিচয়টাও পরে জানলাম লিয়েন হুয়ার হাতে দেয়া চিরকুটে। খুব অসুবিধা না হলে তুমি এখনি এস, আমার এটা অনুরোধ। বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেলি, এখনি? আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ, ইয়ংম্যান। যদি কোনো প্রোগ্রাম থাকে দুদিন পিছিয়ে দাও। আর তুমি হেংশান অঞ্চলে কেন, ইত্যাদি সব আসলেই শুনব। ঠিক আছে ইয়ংম্যান? বলল প্রেসিডেন্ট।
ঠিক আছে এক্সিলেন্সি আমি আসছি। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ ইয়ংম্যান। দুএক কথায় বলতে হেংশানে। কি ঘটেছে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন নাকি তোমার গুলিতে মারা গেছে? বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি, হেংশান পাহাড়ের দক্ষিণ অংশে উত্তর কানশু এলাকা থেকে পালিয়ে আসা তিন হাজার উইঘুরদের একটা বসতি আছে। এই বসতিও পুড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র হয়। আজ রাতের অন্ধকারে ওরা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। উইঘুর বসতির লোকরা পুলিশকে জানিয়ে তাদের সাহায্য চায়। পুলিশ অপারগতা জানায়। আমি হেংশান পাহাড়ের উত্তরাংশে জে ঝি সেংগ পরিবারের অতিথি ছিলাম। খবর পেয়ে এই পরিবারের কয়েকজন উইঘুর বসতির প্রধান ওয়াং আলীর বাড়িতে আসে সব জানার জন্যে। আমিও তাদের সাথে আসি। আমরা ওখানে থাকতেই পঁয়ত্রিশ জনের একটা বাহিনী স্টেনগান, বোমা সজ্জিত হয়ে বসতিতে আক্রমণ করে, আগুন লাগাতে শুরু করে বাড়ি-ঘরে। আমি এগিয়ে গিয়ে ওদের অনুরোধ করি হাজার হাজার মানুষের সর্বনাশ না করতে। আমাকে মেরে ফেলার জন্যে ওদের স্টেনগান থেকে গুলি করা হয়। আমি আত্মরক্ষা করতে গেলে এই হত্যার ঘটনা ঘটে। বলল আহমদ মুসা।
স্যরি ইয়ংম্যান, একটা গোপন সন্ত্রাসী চক্র দেশের ঐক্য-সংহতি নষ্ট করার জন্যে আন্তঃসম্প্রদায় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। মনে করা হচ্ছে বড় বড় কিডন্যাপগুলোও এই সন্ত্রাসেরই অংশ। এর বিহিত দ্রুত আমরা করতে চাই। তুমি এস।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আসছি। আহমদ মুসা বলল।
অয়্যারলেসটা পুলিশ অফিসারকে দাও। বিষয়টা নিয়ে উ ক্যাং তাকে কিছু বলবে। ধন্যবাদ ইয়ংম্যান। সালাম।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে অয়্যারলেসটা পুলিশ অফিসারকে দিয়ে বলল, প্রেসিডেন্ট বললেন মি, উ ক্যাং আপনার সাথে কথা বলবেন।
ধন্যবাদ স্যার! বলে টেলিফোন হাতে নিল পুলিশ অফিসার।
অয়্যারলেস নিয়ে ডিআইজি গাও ইয়াং প্রায় তিন মিনিট ধরে শুধু স্যার, স্যার করে চলল।
কথা শেষ করেই ডিআইজি গাও ইয়াং আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, মাননীয় প্রেসিডেন্ট আপনাকে ডেকেছেন। আমার উপর নির্দেশ হয়েছে হেলিকপ্টার পর্যন্ত আপনাকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে। আমি রেডি স্যার।
বলেই তাকাল স্থানীয় পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, তোমাদের স্টেশন ইনচার্জ কোথায়?
বাইরে ছিলেন। এতক্ষণ এসে গেছেন। বলল পুলিশ অফিসারটি।
শোন, সব লাশ এখনি পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাও। খুব তাড়াতাড়ি এদের পরিচয়, ঠিকানা সব যোগাড় কর। বসতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণের দ্রুত ব্যবস্থা পুলিশ স্টেশনকে গ্রহণ করতে হবে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশকেই মামলা দায়ের করতে হবে। সাক্ষী হবেন বসতির
লোকরা। আর বসতির নিরাপত্তা বিধানের সব দায়িত্ব পুলিশ স্টেশনের উপর। শানসি ও কানশুর পুলিশের যৌথ তদন্ত দল উইঘুরদের উচ্ছেদ ঘটনার তদন্ত করবে। বলল ডিআইজি গাও ইয়াং।
পুলিশ অফিসারের কথা শেষ হতেই বসতির উপস্থিত লোকরা আনন্দ ধ্বনি করে উঠল। জিন্দাবাদ ধ্বনি দিল সম্মানিত মেহমানের উদ্দেশ্যে।
মানুষের জিন্দাবাদ ধ্বনি থামলে পুলিশ অফিসার ওয়াং আলীর দিকে তাকিয়ে তাকে বলল, আপনার আর কোনো চিন্তা নেই। আপনাদের নিরাপত্তার দিকটা পুলিশই এখন থেকে দেখবে। আর আপনাদের উপর যে অবিচার হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ এবং আপনাদের নিজ ভূমিতে আপনাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকার নিয়েছেন।
থেমে একটু দম নিয়েই বলল, আমি না জেনে আপনাদের উপর যে অন্যায় করেছি, তার জন্যে আমি দুঃখিত।
ওয়াং আলীর সাথে কথা শেষ করে ডিআইজি গাও ইয়াং আহমদ মুসাকে বলল, স্যার, আমরা কখন স্টার্ট করছি?
অফিসার এদের সাথে একটু কথা বলে আমি জে ঝি সেংগদের বাড়িতে ফিরব। আমি সেখান থেকেই যাব। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে স্যার, আপনি আসুন। জে ঝি সেংগের বাড়ির সামনে। মেইন রোডে আমরা অপেক্ষা করছি। বলল গাও ইয়াং।
ধন্যবাদ। বলল আহমদ মুসা।
ওয়াং আলী এবং জে ঝি সেংগ এলো আহমদ মুসার কাছে। বলল, পু লিশ তাদের কাজ করুক। চলুন একটু ভেতরে।
আহমদ মুসাসহ সবাই হাঁটতে লাগল ভেতরে যাওয়ার জন্যে।
ভেতরে বসতির মানুষের ঢল নেমেছে। সবার চোখে আনন্দের অশ্রু। আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকতেই ওয়াং আলীর মেয়ে উম্মে খাওলা উঠে দাঁড়াল। একটা টেবিলের উপর। চিৎকার করে অরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, আমরা হাজারো যুদ্ধ জয়ের কাহিনী পড়েছি, অজস্র মিরাকলের কথা শুনেছি, কিন্তু আজ যা ঘটল তার কোনো তুলনা হয় না। আজ শুধু কয়েক মিনিটে যুদ্ধ জয়। শুধু নয়, আমাদের হারানো সবকিছুই আমরা ফেরত পাচ্ছি। এটা আমাদের প্রতি আল্লাহর সীমাহীন দয়া। কিন্তু আল্লাহ এ কাজ যাকে দিয়ে করিয়েছেন তিনি আমাদের মেহমান। অনেক শিক্ষা তিনি দিয়ে গেলেন আমাদের। তিনি ৩৫ জন আক্রমণকারীকে শেষ করেছেন তাদেরই অস্ত্র দিয়ে। আল্লাহর উপর ভরসা করে একা ও নিরস্ত্র একজনও নির্ভয়ে এগিয়ে গেলে সে জয় ছিনিয়ে আনতে পারে, সেটা তিনি দেখিয়ে গেলেন। তিনি এখনই চলে যাচ্ছেন বসতির মানুষদেরকে কিছু বলারও সুযোগ না দিয়ে। এই আবেগ প্রকাশ ছাড়া আমরা খুশি তার চলে যাওয়ায়। প্রেসিডেন্টকে বলে তিনি চীনা মুসলমানদের উপর চেপে বসা কালরাতের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নিলে সেটাই হবে আমাদের বড় পাওয়া। তাঁর সম্পর্কে কিছুই আমরা জানি না, তিনি আমাদের সব জানেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আমরা এবং সব মানুষ তাদের দুঃসময়ে এভাবেই যেন তাকে কাছে পায়।
কথা শেষ করল উম্মে খাওলা।
আহমদ মুসা বলল, আমি মনে করি, সবার কথাই বলে ফেলেছে উম্মে খাওলা। আল্লাহ কবুল করুন উইঘুর বসতির সবাইকে। উইঘুর সবাই উম্মে। খাওলা এবং হামজা, খালেদ, তারিক হোক। সবাই আমার জন্যে দোয়া করুন। সালাম সবাইকে।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল জে ঝি সেং-এর দিকে। বলল, চলুন ওখানে গিয়ে আমাকে তৈরি হতে হবে।
অশ্রু ঝরছে ওয়াং আলীর দুই চোখ দিয়ে। কাঁদছিল সবাই।
৩
বেইজিং। প্রেসিডেন্ট হাউজের ফরেন ভিআইপি গেস্ট রুম। সকাল ৮টা। আহমদ মুসা কোরআন শরিফ পড়া শেষে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিল।
একটা সামরিক হেলিকপ্টারে রাত ১টায় সে বেইজিং পৌঁছেছে। গোয়েন্দা চীফ উ ক্যাংগ এবং চীফ অব প্রোটোকল মাদাম হুইজং তাকে। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে স্বাগত জানায়।
ফ্রেশ হয়ে তার কক্ষে এসে বসার পর আহমদ মুসা একটা ইনভেলাপ পেল। তাতে প্রেসিডেন্টের একটা চিঠি 1 প্রেসিডেন্ট তাকে স্বাগত জানিয়ে সকাল সাড়ে ৮টায় নাস্তার দাওয়াত দিয়েছেন তার পারিবারিক টেবিলে এবং সকাল ৯টায় একটা ক্লোজ গেট টুগেদারে অংশ নেবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
আহমদ মুসা সাড়ে ৮টার প্রোগ্রামের জন্যে প্রস্তুত হয়েই রেস্ট নিচ্ছেন। দরজায় নক হলো।
দরজার এ-পিঠে সেট করা স্ক্রিনে দরজার ওপ্রান্তে লিয়েন ও প্রেসিডেন্টের মেয়ে ফেন ফ্যাংকে দেখতে পেল।
এস তোমরা। শোয়া থেকে উঠে বলল আহমদ মুসা।
ওরা ঘরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকেই ওরা সালাম স্যার বলে হেসে উঠল।
সালামের সাথে তো হাসির সম্পর্ক নেই। হাসছ যে তোমরা? উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল আহমদ মুসা।
স্যার, পুরো সালামটা মুখস্থ করেছিলাম। কিন্তু দরজায় এসে ভুলে গেছি। আমাদের বিদ্যার দৌড় দেখে আমরা হাসছিলাম। বলল লিয়েন হুয়া।
চেষ্টা করার জন্যে ধন্যবাদ। এখন চল ওপাশে বসি। সবাই এসে ড্রয়িং রুমে বসল।
স্যার, আপনি রাত একটায় এসেছেন। ছিলাম আরও দেরি হবে। আসতে। তাই শুয়ে পড়তে হয়েছিল। স্যরি স্যার, আমরা আপনাকে স্বাগত জানাতে পারিনি। বলল লিয়েন হুয়া।
রাত একটার পরিবর্তে তোমাদের সালাম দিয়ে আমার দিন শুরু হলো, এটাই ভালো হলো না? আহমদ মুসা বলল।
যুক্তিতেও সব সময় আপনিই জিতবেন; আমরা জানি। বলে একটু থেমেই লিয়েন হুয়া বলল, স্যার, আপনি কেমন ছিলেন?
ভালো ছিলাম। আল-হামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অনুগ্রহ সব সময় আমার সাথে ছিল। বলল আহমদ মুসা।
একটু গম্ভীর হলো লিয়েন হুয়া। বলল, স্যার, মা ঝুদের ব্যাপারে আপনি কতটা এগিয়েছেন স্যার? পুলিশ এখনও পাজড অবস্থায়।
সবকিছুই আমার কাছে এখন পরিষ্কার। এখানে না এলে আজই উদ্ধার অভিযানে যাওয়ার কথা ছিল। এটা আমার এখনকার একমাত্র কাজ। চিন্তা করো না। কোথায় যেতে হবে, কোথায় যাব, এ বিষয়টাও আমার কাছে এখন অস্পষ্ট নয়। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ স্যার। স্যার, ওরা কি ভালো আছে, আপনি কি মনে করেন? বলল লিয়েন হুয়া। ভেজা কণ্ঠ তার।
আহমদ মুসা একবার তাকাল তার দিকে। বলল, আমি মনে করি ভালো আছে। তাদের কোনো অপরাধে তারা বন্দি হয়নি। তাদের বন্দি করা হয়েছে কোনো না কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। অতএব তারা খুব মন্দ থাকার কথা নয়।
ঈশ্বর মঙ্গল করুন, আপনার কথা ঠিক হোক। বলল লিয়েন হুয়া।
স্যার আমি শুনেছি, আপনি গল্পের মহাকাব্য। আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় গল্প কোনটা স্যার? বলল ফেন ফ্যাং।
কার কাছে শুনলে আমি গল্পের মহাকাব্য? আমি তো স্টোরি টেলার নই। আহমদ মুসা বলল।
আপনি স্টোরি টেলার হবেন কেন? আপনি নিজেই স্টোরি। আমি সেই গল্প শুনতে চাচ্ছি।
সে তো আমার জীবনের মতোই লম্বা। বলব কি করে? আহমদ মুসা বলল।
একটা দৃশ্য বলুন, যা আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে। বলল ফেন।
ফেন আমার মাথায়, এখন অন্য জিনিস কিলবিল করছে। আজ নয়, সুযোগ পেলে বলব। আহমদ মুসা বলল।
কাল বলবেন, ওয়াদা করুন। বলল ফেন।
কাল পর্যন্ত কি আমি থাকব? ওনারা কি জন্যে ডেকেছেন শুনে আজকেই চলে যাবো। অনেক কাজ আছে। আহমদ মুসা বলল।
আজই যাবেন? বলল লিয়েন হুয়া।
দোয়া কর, ওঁদের কাজ যেন আজ শেষ হয়। আহমদ মুসা বলল।
ফেন ফ্যাং হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, এখনি উঠতে হবে। বাবা হয়তো নাস্তার টেবিলে এসে গেছেন। তাহলে এজেন্ডা কি হবে স্যার, আজ যদি আপনি যান। বলল ফেন ফ্যাং।
বিবেচনায় থাকল। ভেবো না। আহমদ মুসা বলল।
স্যার, আসুন আমরা উঠি। ফেন ঠিকই বলেছে, মামা এসে যেতে পারেন। উঠে দাঁড়াল লিয়েন হুয়া।
আমি বিবেচনায় থাকলাম। লিয়েন আপা কিন্তু ছাড়তো না। বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল ফেন ফ্যাং।
লিয়েনের চেয়ে তুমি ভালো। চল। বলে আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে নাস্তা শুরু হলো। টুকিটাকি কথার মধ্য দিয়ে নাস্তা চলল।
এক সময় ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট লি চুন হুয়া, জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসাকে, বাবা তোমার বাড়ি নাকি কানশুতে?
জি আমি কানশুর ছেলে। বলল আহমদ মুসা।
আমি শুনে খুব খুশি হয়েছি, আমাদের ছেলে তুমি জগৎজোড়া নাম করেছ। এখন কেউ কি নেই কানশুতে তোমার? ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট বলল।
মা পেছনের কথা আমি স্মরণ করি না। কেউ কানশুতে আছে কিনা জানি না। জানার কোনো সুযোগ পাইনি। কান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আমরা কিং হাই হয়ে তিব্বতের দিকে যাবার সময় বাবা, মা, ভাই বোন সবাইকে হারিয়ে ফেলি। তারপর এমন কেউ আমার ছিল না, যার কাছে বিষয়টা আমি জানতে পারি। বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার কণ্ঠ ভারি। আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল তার কণ্ঠ।
ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট এবং সবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবার চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। সবাই বিস্মিত, বিব্রত। বেদনায় ভারি হয়ে, উঠেছে ম্যাডাম প্রেসিডেন্টের চোখ-মুখ।
স্যরি বেটা বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট। বলল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে এক মহাদুঃসময় চীনের উপর দিয়ে গেছে। আজও তার ছিটেফোঁটা নানা রকম সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। আজকের চীন চেষ্টা করছে অতীতের বিভেদ-বৈষম্য বিপর্যয়ের ধ্বংসস্তূপের। উপর ঐক্য-সংহতি-সমঝোতার উপর এক শক্তিশালী চীনকে গড়ে তুলতে।
বলে আবার একটু থামল ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট। মুহূর্তকাল পরেই আবার। বলল, ধন্যবাদ বেটা। তুমি অতীতকে স্মরণে রাখনি ঠিকই, কিন্তু চীনকে তো ভুলে যাওনি।
ভুলে যাইনি মা। জন্মভূমি চীনকে আমি ভালোবাসি। তাই তো আমি বার বার আসি। মা, আপনার মতো আমিও চাই, এখানকার জাতিসত্তাগুলো জাতিগত, আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেই সমঝোতা-সমন্বয় সংহতির এক মহান চীন গড়ে তুলুক। বলল আহমদ মুসা। আবেগ জড়ানো তার কণ্ঠ।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। অতীতের শত কাহিনী আমারও জানা আছে। তোমার পরিবারের ঘটনা আমাকে অভিভূত করেছে। মানুষ যেমন ভুল করে, তেমনি জাতীয় নেতাদেরও ভুল হয়। ভুল শোধরানোর ক্ষমতাও মহান চীনের আছে। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, আরও এগোতে চাই। চাই আমরা, তুমি যেমনটা বলেছ, তেমনি একটা চীনকে গড়ে তুলতে। এই পথে প্রবল শুক্র অতীতে যেমন ছিল, এখনও তেমনি আছে। প্রেসিডেন্ট একটু থামল।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে বলল, লি চুন ঠিকই বলেছে, তুমি চীনের ছেলে, তোমাকে নিয়ে আমরা গর্বিত।
বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল ঘড়ির দিকে। ঘড়ি থেকে মুখ তুলেই বলল, সময় বেশি নেই। ওরা বোধ হয় বাইরে অপেক্ষা করছে। উ ক্যাংগ। তোমাকে মিটিং-এ নিয়ে যাবে আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট উঠতে যাচ্ছিল।
ফেন ফ্যাং বলে উঠল, বাবা, মা তোমরা আমাদের বলনি কখনও যে, স্যার চীনের ছেলে, কানশুর ছেলে। তাহলে তো জগৎবিখ্যাত. আহমদ মুসা এখন আমাদের। আমরা এর একটা সেলিব্রেশন করব বাবা।
সেটা আমাকে নয়, আহমদ মুসাকে বল। বলে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটতে লাগল প্রেসিডেন্ট নিজের ঘরের দিকে।
মা, আমি উঠছি। বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
বলল আহমদ মুসা লিয়েন হুয়াদের দিকে তাকিয়ে, তোমরা আমাকে। নিয়ে চল উ ক্যাংগ-এর কাছে।
তার আগে বলুন কবে সেলিব্রেশন। বাবা তো বলে গেলেন আপনাকে বলার জন্যে। বলল ফেন ফ্যাং।
দেখ ফেন, তুমি প্রেসিডেন্টের মেয়ে। ড. ডা, বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও, জনপ্রিয় যুবনেতা মা ঝুদের কিডন্যাপারদের হাতে বন্দি রেখে সেলিব্রেশন কি খুব সুন্দর হবে? তুমিই বল।
ধন্যবাদ, পাশ কাটাবার মোক্ষম যুক্তি পেয়ে গেছেন স্যার। লিয়েন আপার স্বার্থে এটা মানলাম। বলল ফেন ফ্যাং মুখ টিপে হেসে।
আড় চোখে মামির দিকে একটু তাকিয়ে ফেনের দিকে চোখ পাকিয়ে লিয়েন হুয়া বলল, চল স্যারকে দিয়ে আসি।
.
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের একটি সভাকক্ষ। প্রেসিডেন্ট তখনও আসেননি।
প্রেসিডেন্টের স্ট্যান্ডিং নিরাপত্তা কমিটির জরুরি বৈঠক। ঘড়িতে নয়টা বাজল।
প্রেসিডেন্ট এসে ঢুকলো সভাকক্ষে।
একটা ওভাল মতো টেবিলের প্রেসিডেন্সিয়াল চেয়ারে এসে বসল। প্রেসিডেন্ট।
সবাই উঠে প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাল। প্রেসিডেন্ট চাইলেন সকলের দিকে। অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো চেয়ারে বসেছে সবাই।
ডানদিক থেকে প্রথম চেয়ারে বসেছে পিপলস কংগ্রেসের প্রধান হোয়াং হুয়া। দ্বিতীয় চেয়ার থেকে বসেছে সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান চি চেং, সেনাপ্রধান হং হু, সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান চাও চেন, চীনা কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান ডাই ডিং জিয়াং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরের শেষ চেয়ারটিতে বসেছে আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট কথা শুরু করল। বলল, ভদ্র মহোদয়গণ, মি. আহমদ নামে যে সম্মানিত যুবকটির সন্ধান আমরা করছিলাম, তাকে আমরা পেয়ে গেছি। তিনি আমাদের মিটিং-এ হাজির। প্রথমে তার সাথে সবার পরিচয় হওয়া উচিত। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সবাইকে আহমদ মুসার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আহমদ। মুসার পরিচয় দিল মি. আহমদ হিসাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং থামতেই প্রেসিডেন্ট বলল, মি, আহমদের আরও কিছু পরিচয় আছে। এটা তাঁর ছদ্মনাম। বিভিন্ন অসুবিধা এড়ানো এবং কাজের সুবিধার জন্যে নিজের পরিচয় আড়ালে রেখেছেন। সেটা তিনি। আমাদের জানিয়েছেন এবং অনুরোধ করেছেন তার পরিচয় আমাদের কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে। এ প্রেসিডেন্ট একটু থামল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, জনাব পরিচয় কি আপনি বলবেন, না আমি বলব।
এক্সকিউজ মি এক্সিলেন্সি, আমি আমাকে এমন কেউ মনে করি না যে, এক্সিলেন্সি আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন।
বলে থামল একটু আহমদ মুসা। মুহূর্তকাল পরেই আবার বলল, আমি আহমদ মুসা। একটা কাজে আমি চীনে এসেছি। আমার আসা নিয়ে সমস্যা এড়ানোর জন্যেই আমি ছদ্মনাম নিয়েছি।
নাম শুনেই চমকে উঠল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স চীফ ডাই ডিং জিয়াং এবং সেনা গোয়েন্দা প্রধান চাও চেন। তারা বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকাল। আহমদ মুসার দিকে। তাদের মুখে কোনো কথা নেই।
কোন্ আহমদ মুসা? সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গোপন অস্ত্র নিয়ে যে সংকট হয়েছিল তাতে ভূমিকা পালন করেছিলেন যিনি, সেই আহমদ মুসা? বলল সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান চি চেং।
হ্যাঁ, দুনিয়া কাঁপানো ঐ ঘটনা, তার সাথে একজন আহমদ মুসার বিষয় আমি গোয়েন্দা রিপোর্টে পড়েছি, শুনেছি। পিপলস কংগ্রেসের সভাপতি হুয়াং হুয়া বলল।
হ্যাঁ, ইনিই তিনি। তার নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ফাইল ফটোতে দেখা চেহারা আমার চোখে ভেসে উঠেছে। এক্সিলেন্সি জনাব আহমদ মুসা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অস্ত্রসংকটে নয়, এর আগেও জায়নিস্টদের বিরাট ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেন। বলল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স চীফ ডাই ডিং জিয়াং।
জিয়াং থামতেই কথা বলে উঠল সেনা গোয়েন্দা প্রধান চাও চেন। বলল, আমরা অনেকেই জানি রাশিয়ায় সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিনকে আহমদ মুসাই ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং সম্রাজ্ঞী হিসাবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
চাও চেন-এর পরেই কথা বলল সেনাপ্রধান হংহু। সে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, পৃথিবীর দেশ-মহাদেশ জুড়ে আপনার যে কাজ তার হিসাব বোধ হয় আপনি জানেন না জনাব আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার, আমি চেষ্টা করি সব সময় সামনে তাকাতে। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার বলে উঠল সে, এক্সিলেন্সিজ, আমি যতটুকুই যা করেছি, তা আমার পরিকল্পনার ফল নয়। আল্লাহই করিয়েছেন আমাকে দিয়ে। যেমন- চীনে আসার পথে প্লেন কিডন্যাপকে কেন্দ্র করে কিছু ঘটনার সাথে আমি জড়িয়ে পড়েছি।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। প্লেন কিডন্যাপের। ঘটনার সাথে মি. আহমদ মুসা জড়িয়ে পড়ায় আমাদের উপকার হয়েছে। এখন আপনার পরিচয় পেয়ে আমি মহাখুশি। আমার মনে হচ্ছে, আমরা যে সংকটে পড়েছি, যে সংকট আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সংকটের মধ্যে ঈশ্বরই আপনাকে নিয়ে এসেছেন। বলল চীনের সামরিক কমিশনের প্রধান প্রবীণ রাজনীতিক গোয়াং জেন।
প্রেসিডেন্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, আহমদ মুসার আর একটি পরিচয় আছে সে আমাদের চীনের সন্তান। কানশুতে সে জন্মগ্রহণ করে। অতীতের এক দুঃখজনক ঘটনায় অন্য অনেকের মতো তার পরিবারকেও দেশ ছাড়তে হয় আহমদ মুসার বালক অবস্থায়। কিন্তু সে জন্মভূমি চীনকে ভুলেনি। এর আগে সে দুইবার সিংকিয়াং অঞ্চলে এসেছে। দুইবারই সে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সিংকিয়াং-এর মুসলিম নেতৃবৃন্দের সমঝোতা, প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। থামল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হবার সাথে সাথে টেবিলের ওপাশের সাতজনের সকলেই ধীরলয়ে হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল এবং স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সিজ, চীনের মানুষ হিসাবে আমি গর্বিত। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা।
বলে প্রেসিডেন্ট সবার দিকে তাকিয়ে বলল, মিটিং-এর কাজ আমরা শুরু করতে পারি।
ইয়েস, এক্সিলেন্সি। বলে উঠল সবাই।
শুধু একটা প্রশ্ন, আহমদ মুসা বলেছেন, ছদ্মনাম নিয়ে একটা কাজে তিনি চীনে এসেছেন। সে কাজটা কি? বলল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। উইঘুরের একটি ছেলে আহমদ ইয়াং আমার স্নেহভাজন ছোট ভাইয়ের মত। সে কিছুদিন আগে কিডন্যাপ হয়েছে। পুলিশি সাহায্য নিয়েও তার পরিবার তার হদিস করতে পারেনি। তারা বিষয়টা আমাকেও জানায়। আমি টোকিওতে একটা সম্মেলনে এসেছিলাম। সেখান থেকেই আমি এসেছি আহমদ ইয়াং ও তার পরিবারের খোঁজ খবর নিতে। আহমদ মুসা বলল।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আপনি কিডন্যাপের খোঁজখবর নিতে এসে একেবারে কিডন্যাপের মধ্যে পড়ে গেছেন। তবে আমরা খুশি। আপনার সাহায্য পাওয়া সহজ হয়েছে। বলল গোয়াং জেন।
ধন্যবাদ জননেতা গোয়াং জেন। আপনি ঠিকই বলেছেন। জনাব আহমদ মুসার কাজ ও আমাদের কাজ একই ধরনের, হতে পারে একই কাজ। অতএব বিষয়টা আমাদের জন্যে আনন্দের।
বলে প্রেসিডেন্ট একটু থেমেই তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং-এর দিকে। বলল, মি. লিয়াং শুরু করুন।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। সবাই আপনারা জানেন, আমরা আহমদ মুসাকে খুঁজছিলাম। কারণ, সাম্প্রতিক কিছু কিডন্যাপের বিষয় আমাদের জন্যে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই কিডন্যাপকারীদের সাথে জনাব আহমদ মুসার সংঘর্ষ হয়েছে একাধিকবার, বেশ কিছু কিডন্যাপকারী মারাও পড়েছে তার হাতে। সুতরাং কিডন্যাপকারীদের জানা এবং তাদের ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতা আহমদ মুসার হয়েছে। এই বিষয়ে আমরা তাঁর কাছে জানতে চাই এবং এই সন্ত্রাসের মোকাবিলায় আমরা তার সাহায্যও চাই। এই উদ্দেশ্যে আমরা জনাব আহমদ মুসাকে অনুরোধ করেছি আসার জন্যে। তিনি অনুগ্রহ করে এসেছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
একটু থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গেই আবার শুরু করল, এ পর্যন্ত ছয় জন মর্যাদাবান নাগরিক ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে কিডন্যাপূড় হয়েছেন। বুঝতে পারা যাচ্ছে, তারা সংঘবদ্ধ শক্তিশালী কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ। কিন্তু আমরা তাদের উদ্দেশ্য, পরিচয়-পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি। এ ব্যাপারে আমরা জনাব আহমদ মুসার সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
আহমদ মুসা নিবিষ্ট মনে কথা শুনছিল। একটু সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, আমি যে তাদের ব্যাপারে খুব বেশি জানি তা নয়। তবে কিছু জেনেছি।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, এক্সিলেন্সিজ, প্রথমে তাদের পরিচয়ের কথা বলি। ঐ দল বা গ্রুপের প্রতিটি সদস্য তাদের পরিচয়। জ্ঞাপক একটা প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করে। বর্তমান চীনা ভাষার পূর্বসূরি, যা এখন অবলুপ্ত, হানজু ভাষার প্রথম বর্ণ তাদের সেই প্রতীক চিহ্ন। ইয়েলো নদীর লোয়ার অববাহিকায় একসময় বসবাসকারী হুয়াজিয়া সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল এটা। সন্ত্রাসী গ্রুপটি রিভলবার বা স্টেনগানের বাট বা ব্যারেলে, তাদের জামা বা জ্যাকেটের ভেতরের কলার ব্যান্ডে, তাদের হাতের আংটিতে তারা এই চিহ্ন ব্যবহার করে।
উপস্থিত সকলেই একে-অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান ডাই ডিং জিয়াং বলেই উঠল, যারা এ পর্যন্ত সংঘর্ষে মারা গেছে, তাদের সবার সাথে কি এই প্রতীক চিহ্ন ছিল?
বিমানে, কিংদাও বিমানবন্দরে এবং জিবেরা শহরের দুতলা বাড়ির চত্বরে যারা মারা গেছে, তাদের লাশ পরীক্ষার সুযোগ আমার হয়নি, কিন্তু জিবেরা শহরের একটা ডুপ্লেক্সে যে সন্ত্রাসীরা মারা যায় এবং ম্যাডাম লিয়েন হুয়াকে কিডন্যাপ করার চেষ্টাকারী লোকরা ও পুলিশের পরিচয়ে যারা এসেছিল তাঁকে কিডন্যাপ করতে তারাসহ গতকাল সন্ধ্যায় হেংশান। পাহাড়ের উইঘুরদের উদ্বাস্তু বসতিতে যারা মারা গেছে, তাদের শার্টের কলার, স্টেনগানে আমি এই প্রতীক চিহ্ন দেখেছি। আর…।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে উঠল, হেংশানের উইঘুর বসতিতে ঐ কিডন্যাপকারী সন্ত্রাসী গ্রুপের লোকরাই কি আক্রমণ করেছিল?
হ্যাঁ। আমি সেটাই দেখেছি। বলল আহমদ মুসা।
মি. আহমদ মুসা, এদের সংগঠন সম্পর্কে কিছু জানা গেছে কিনা? বলল সশস্ত্র বাহিনী প্রধান হংহু।
সংগঠনের পরিচয় বলতে সংগঠন কাঠামো, এর প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, রিক্রুট ইত্যাদি বুঝায়। এ ব্যাপারে আমি খুব বেশি এগোতে পারিনি। কিছু জানতে ও বুঝতে পেরেছি। সংগঠনটি প্রাচীন চীনের কাহিনী বা কল্পকাহিনী ব্যবহার করে আলট্রা জাতীয়তাবাদী হিসাবে গড়ে উঠতে চাচ্ছে। এক্সিলেন্সি, গতকাল রাতে হেংশান পাহাড়ে উইঘুর বসতি আক্রমণ করতে এসে যারা নিহত হয়েছে, তাদের যিনি কমান্ডার ছিলেন তার মাথার ক্যাপে। একটা মনোগ্রাম পাওয়া গেছে। তাতে জিয়ান উ আর্মি নাম পাওয়া গেছে। এটাই যদি তাদের পরিচয় হয়, তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায় চীনের লিজেন্ডারি হিরোর নাম তারা ব্যবহার করছে। জোয়ান উ সম্পর্কে আপনারা সকলেই জানেন। তার একটা ঐশী তরবারি ছিল যা কোনো যুদ্ধে পরাজিত হয়নি। বলা যায়, জোয়ান উর সর্বজয়ী একটা মিথ ব্যবহার করে এই সন্ত্রাসীরা চীনা জনগণের সস্তা আবেগকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে প্রাচীন চীনের একটা মৃত ভাষার প্রথম বর্ণকে প্রতীক হিসাবে গ্রহণ এর আরও একটা প্রমাণ হতে পারে। মৃত হানজু ভাষাটি যে জাতির সেই হুয়াজিয়া সম্প্রদায়ের একজন নেতা হোয়াং জি, যাকে ইয়েলো এমপারার বলা হয়। ২৭০০ খ্রিস্টপূর্ব অব্দের ইয়েলো সম্রাটের শাসনকালকে গোল্ডেন এজও বলা হয়। এই কালকে সামনে নিয়ে এর সাথে আরও কিছু মিথ বা লোককথা উপকথাকে যোগ করে এক সস্তা আবেগকে ভিত্তি হিসাবে এরা দাঁড় করাতে পারে। আর এটা যদি ঠিক হয়, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। আর…।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না।
কি বলছেন আহমদ মুসা! বলে প্রায় চিৎকার করে উঠল প্রেসিডেন্ট। বলল আর্ত-আবেগের সাথে, আহমদ মুসা অত্যন্ত উদ্বেগের খবর দিয়েছেন। যা বলছেন, আসলেই তা কি সত্য? ওরা কি এই ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন?
অন্য সবারই মুখ বিস্ময়-উদ্বেগ তাড়িত। তারা যেন বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অনেকটাই নির্বাকের মতো তাকিয়ে তারা আহমদ মুসার দিকে।
স্যরি এক্সিলেন্সি। আমি আগেই বলেছি, আমি সব বিষয় জানি না। কিন্তু যতটুকু জানি তার ভিত্তিতেই আমি আমার মত দাঁড় করিয়েছি। এক্ষেত্রে আমি কতকগুলো বিষয় বিবেচনা করেছি। যেমন- প্রত্নতত্ত্ববিদ মি. ডা-কে প্রথম কিডন্যাপের চেষ্টা করা হয় উডাং পাহাড়ে। পরিকল্পনা করেই তাকে সেখানকার একটা ধর্মসম্মেলনে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্মেলনেরই একজন কৌশলে তাকে সেখান থেকে বের করে এনে বাঁচিয়ে দেন। এই গ্রুপই হেংশান পাহাড়ের চীনের প্রাচীনতম পরিবারের বর্তমান প্রধানকে আটক করে রেখেছিল উডাং পাহাড়ে। আটক জে ঝি সেংগও সেই বন্দিখানায় দুজন প্রহরীর হাতে যে উল্কি দেখেন, সেখানেও ছিল হানজু বর্ণমালার প্রথম বর্ণ। তার সাথে আলোচনা করে জেনেছি, তাকে পরিবার। সমেত চীনের বাইরে চলে যেতে বলা হয়েছে, না গেলে তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করবে। ইতিমধ্যেই মি, জে ঝি সেংগ-এর স্ত্রী ও ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। এই পরিবার ধ্বংস হলে বা চীনের বাইরে চলে গেলে সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতার পরিবার চীনের নাম্বার ওয়ান প্রাচীনতম পরিবার হতে পারে। মি. সেংগ-এর পরিবারের ধ্বংসকারী এই নেতা, যাকে আমি সন্ত্রাসী গ্রুপের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসেবে মনে করি, তার খুব প্রিয় জায়গা উডাং। পাহাড়ের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রগুলো। অন্যদিকে…।
প্লিজ আহমদ মুসা! বলে উঠল প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার কথার মধ্যেই। বলল, আপনার কথাগুলো আমাদের একটু হজম করতে দিন। ড. ডা আগে আরও একবার কিডন্যাপ প্রচেষ্টায় শিকার হয়েছিলেন জানলেন কি করে আপনি?
ড. ডা-ই আমাকে বলেছেন। আগে একবার নয়, দুবার তাকে কিডন্যাপের চেষ্টা করা হয়েছিল। আরেকবার বেইজিং উপকণ্ঠে একটা সেমিনারে যাওয়ার পথে পাহাড়ি এলাকায় তাকে কিডন্যাপের চেষ্টা করা হয়। পুলিশের দুটি পেট্রোল কার হঠাৎ এসে পড়ায় তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। আহমদ মুসা বলল।
কিডন্যাপ প্রচেষ্টার এই দুটি ঘটনা আমরা কিংবা কেউ জানে বলে মনে হয় না। তিনি কাউকে বলেননি বলেই মনে হয়? বলল প্রেসিডেন্ট।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ড. ডা নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন। অনেকভাবে অনেক প্রশ্ন করে আমি এই ঘটনা তার থেকে বের করে আনি।
মি, আহমদ মুসা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। ঐ ভয়ানক গ্রুপটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসাবে একজনকে সন্দেহ করেছেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিষয় এটা। কে সেই ব্যক্তিত্ব? বলল সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান।
এক্সিলেন্সি, এটা আমার প্রাথমিক সন্দেহ। তথ্য-প্রমাণসহ আমি আরও নিশ্চিত না হলে তার নাম বলতে চাই না। তিনি অত্যন্ত সম্মানী ব্যক্তিত্ব। আহমদ মুসা বলল।
তিনি অত্যন্ত সম্মানী ব্যক্তিত্ব? আমাকে আরও মহাউদ্বেগে ফেললেন আহমদ মুসা। আপনার নিশ্চিত হতে আর কতটা সময় লাগবে? বলল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান এবং দেশের সবচেয়ে প্রবীণ রাজনীতিক মি. গোয়াং জেন।
খুব বেশি সময় নাও লাগতে পারে। যারা কিডন্যাপ হয়েছেন, তাদের দুএকজন উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু সেটা তো অনিশ্চিত। তাদের উদ্ধারই তে মূল। উদ্ধার হবার আগে তাদের অনেক কিছুই জানতে হবে। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আমি অনুসন্ধানের জন্যে কিছু স্থানকে চিহ্নিত করেছি। আমার বিশ্বাস আমি হতাশ হবো না। আহমদ মুসা বলল।
আরেকটা কথা মি. আহমদ মুসা, হেংশান পাহাড়ের জে ঝি সেংগ পরিবারকে ধ্বংস করে যিনি নাম্বার ওয়ান প্রাচীনতম পরিবার হতে চাচ্ছেন, সেই ব্যক্তি এবং আমরা কিডন্যাপকারী সন্ত্রাসী গ্রুপের যে নেতাকে খুঁজছি, তারা তাহলে কি একই লোক? বলল সেনা গোয়েন্দা প্রধান।
আমি তাই মনে করি এক্সিলেন্সি। কারণ এদেরও প্রতীক চিহ্ন হানজু বর্ণমালার সেই প্রথম বর্ণ। এ ছাড়া আরও কিছু বিষয়কে প্রমাণ হিসাবে। ধরে নেয়া যায়। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে আপনার কথা ঠিক মি. আহমদ মুসা। এই সন্ত্রাসী গ্রুপ ও গ্রুপের নেতা অসম্ভব উচ্চাভিলাষী এবং এ ধরনের উচ্চাভিলাষের বড় রাজনৈতিক অ্যামবিশন থাকে। বলল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি অনেক দূর এগিয়েছেন। আপনি সন্ত্রাসী ঐ ভয়াবহ গ্রুপকে অনেকখানিই জানার মধ্যে নিয়ে এসেছেন। এটা আমাদের দেশ ও জাতির জন্যে বড় একটা সুখবর। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আপনি কাজ করছেন। কৃতজ্ঞ আমরা আপনার প্রতি। কিন্তু আহমদ মুসা গ্রুপটা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, এ ব্যাপারে আপনি আর কোন কোন বিষয়কে বিবেচনা করছেন? বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠ উদ্বেগে জড়িত।
হ্যাঁ, এ বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় একই সাথে বলে উঠল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন এবং পিপলস কংগ্রেসের সভাপতি হোয়াং হুয়া।
এক্সিলেন্সিজ, গ্রুপটি তিনটি ফ্রন্টে কাজ করছে। তার একটি হলো, দেশের মধ্যে তাদের সাপোর্ট বেজ প্রসারিত করা এবং তাদের আট্রা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিরোধী হতে পারে তাদের নির্মূল বা দুর্বল করা। আমার মনে হচ্ছে গ্রুপটি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে। হেংশান পাহাড় ও জিবেরা শহরে গ্রুপটির তৎপরতাকে পুলিশ সহযোগিতা কিংবা প্রশ্রয় দিয়েছে। কিং দাও বিমানবন্দরে ড. ডাকে কিডন্যাপ করার কাজকে নিরাপদ করার জন্যে সেখানে উপস্থিত সেনা অফিসাররা কিছু সেনা অফিসার গ্রুপটিকে সহযোগিতা করেছে। আমি যখন ড. ডার কিডন্যাপকারী গাড়িকে অনুসরণ করে বেরিয়ে আসি, তখন সে গাড়ির সাথে আমার গাড়ির দূরত্ব বেশি ছিল না। আমি কিডন্যাপকারীদের ধরে ফেলার আশা করছিলাম। কিন্তু বিমানবন্দরের সেনা ইউনিট আমার গাড়ি আটকে দেয়। আমি তাদের জরুরি অবস্থার কথা বলি। তারা বলে ও-গাড়িতে ড. ডা নেই। এই সময় একজন ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসার এলেন। তিনিও একই কথা বললেন। আমি বললাম, আপনারা গাড়ির সিলিং-এর দিকে তাকিয়েছিলেন কিনা। তারা জবাব দেয়নি। অবশেষে আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি বলি যে, এখন আমি কি করব। গাড়িটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। তখন তারা বলে যে, আমরা গাড়িটাকে মনিটর করছি। গাড়িটা সোজা জিবেরার দিকে এগোচ্ছে। গাড়িটা যদি গুরুত্বপূর্ণ না হয়, তাহলে তারা মনিটর করছিল কেন। গাড়িটাকে? দ্বিতীয় বিষয় হলো, তারা অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলার চেষ্টায়। আছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ডা, নিষিদ্ধ নগরী খননের বিস্তারিত মানচিত্র নির্মাতা চাও জিয়াংকে কিডন্যাপ করা হয়েছে কুবলাইখান ও পরবর্তী সম্রাটের গোপন ধনভাণ্ডার উদ্ধারের লোভেই। ধনভাণ্ডারগুলো উদ্ধারের সংকেত তাদের কাছে পাওয়া যাবে, এ আশাতেই তাদের অপহরণ করা হয়েছে। তৃতীয় বিবেচনার বিষয়টি হলো, বিজ্ঞানী ফা জি ঝাওকে অপহরণ। তিনি যুগান্তকারী এক অস্ত্রের আবিষ্কার করতে যাচ্ছেন, যা আণবিক বোমা থেকে শুরু করে সব অস্ত্রকে জড়পিণ্ডে পরিণত করতে পারে। আবার চাইলে ঐ এক অস্ত্রের মাধ্যমেই সব অস্ত্রের পরমাণুকে ডিসইন্টিগ্রেট করতে পারে। যার ফলে অস্ত্র আর অস্ত্র থাকে না। তাকে কিডন্যাপ করার একটাই অর্থ যে, তারা অজেয় হওয়ার মতো শক্তি অর্জন করতে চায়। থামল আহমদ মুসা।
সবাই নীরব। সবার মুখ বিস্ময় ও উদ্বেগে পীড়িত।
নীরবতা ভাঙল প্রেসিডেন্ট। বলল, ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আমরা যা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে বেশি আপনি অগ্রসর হয়েছেন। সত্যিই গ্রুপটির অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলা, অজেয় হওয়ার মতো শক্তি অর্জন করা এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার লক্ষ্যেই কাজ করছে। মা ঝু সুলতান এবং ইরকিন আহমেদ ওয়াংদের অপহরণ করা হয়েছে ধর্মীয় জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ তীব্রতর করার জন্যে। হান ও হান পুলিশদের দিয়ে উইঘুরদের উপর নানা রকম অত্যাচার নিপীড়ন করা হচ্ছে, সেটাও ঐ গ্রুপটিরই ষড়যন্ত্র। এই তো কয়েকদিন আগে কানশুর ডান হোয়াং-এ যে ঘটনা ঘটল, তা একজন পুলিশ অফিসারের কীর্তি। এখন মনে হচ্ছে এই পুলিশ অফিসারের সাথে ঐ গোপন গ্রুপের সম্পর্ক ছিল। পুলিশ অফিসারকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু হাজতেই তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। নিশ্চয় পুলিশ অফিসারটির কাছ থেকে ঐ গ্রুপটির গোপন তথ্য ফাঁস রোধ করার জন্যেই এটা করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট একটু থামল। সবার দিকে তাকাল। বলল, ভদ্র মহোদয়গণ, সব আপনারা শুনেছেন। গোপন গ্রুপটি যে এক জঘন্য ষড়যন্ত্র নিয়ে সামনে এগোচ্ছে তা পরিষ্কার হয়েছে। এখন বলুন আহমদ মুসাকে আমাদের আর কি বলার আছে?
এক্সিলেন্সি, আহমদ মুসা নিজের থেকে যে কাজ করছেন, সেটা আমাদেরই কাজ। আমরা তাকে ধন্যবাদ দিচিছ। আমরা কৃতজ্ঞ তার প্রতি। আমরা তার সামনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই। আমরা একসাথে কাজ করতে পারি কিনা, এসব ব্যাপারেও আমরা তার কাছ থেকে জানতে চাই। বলল সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান চি চেং।
সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন বলে উঠল, এটা আমাদেরও কথা। সন্ত্রাসী গ্রুপটির বিরুদ্ধে একসাথে কাজ করা যায় কিনা কিংবা সমম্বয়ের মাধ্যমে এগোনো যায় কিনা, সেটা দেখা দরকার।
এক্সিলেন্সি, যারা কিডন্যাপ হয়েছেন, তাদের উদ্ধারের কাজ আমি শুরু করতে চাই। এই কাজ গোপনে এবং এককভাবে করাই সুবিধাজনক। সবকিছু সরকার জানতে পেরেছে, এটা ওরা জানতে পারলে যারা কিডন্যাপ হয়েছেন, তাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। সুতরাং সরকার যতটুকু এগোবেন, সেটাও গোপনে হতে হবে। সরকার ওদের সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি, এমন ভাব বজায় রাখতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা। ঠিক বলেছেন। তবে গোপন ও একক অভিযান হলেও উভয় পক্ষের কাজের একটা সমম্বয় সহযোগিতার প্রয়োজন আছে কিনা। সেনা গোয়েন্দা প্রধান বলল।
কাজের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা অবশ্যই থাকতে হবে। প্রয়োজন হলে পুলিশ ও অন্যদের সহযোগিতা পাব এ ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রয়োজনে কোথায় কি করতে হবে, এ বিষয়টা সরকারের কাকে আমি বলব এ ব্যবস্থাও থাকতে হবে। মাঝে মাঝে মতবিনিময়ের জন্যে আমরা বসতে পারি, তারও ব্যবস্থা থাকা উচিত। বলল আহমদ মুসা।
জনাব আহমদ মুসা একটা প্রস্তাব রেখেছেন। এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বলুন আপনাদের মত। প্রেসিডেন্ট বলল।
জনাব আহমদ মুসা ভালো কথা বলেছেন, এভাবে কাজ শুরু হতে পারে। আমার মনে হয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনা গোয়েন্দা প্রধান ও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স প্রধান- এই তিনজনকে নিয়ে একটা কমিটি হতে পারে। প্রয়োজন হলে আহমদ মুসা কমিটির সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করবেন এবং বসার দরকার হলে বসবেন। বলল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন।
হ্যাঁ, এটা হতে পারে এক্সিলেন্সি। তাছাড়া আহমদ মুসা যাতে প্রয়োজনে পুলিশ, সেনা, সরকারি কর্মচারীদের সহযোগিতা পান এজন্যে উপযুক্ত একটা আইডি আহমদ মুসার কাছে থাকতে পারে। বলল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স প্রধান।
আহমদ মুসা এবার বলুন। প্রেসিডেন্ট বলল।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। ধন্যবাদ সকলকে। এটুকু সাহায্য হলেই আমার আপাতত চলবে। আমার অনুরোধ সকল পর্যায়ে আমার নামটা গোপন থাকবে। আল্লাহ করুন, কিডন্যাপড হওয়া সকলকে উদ্ধার যদি করতে পারি। সে ক্ষেত্রেও আমার নামটা গোপনই থাকবে। বলল আহমদ মুসা।
আলোচনা বোধ হয় আমরা শেষ করতে যাচ্ছি। আমার আরেকটা কথা, ষড়যন্ত্রকরীরা হান-উইঘুর-হুঁইদের মধ্যে বিরোধ-সংঘাত বাঁধাতে চাচ্ছে। এটা যাতে না পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্যে আমাদের পুলিশ ও সেনা কর্তৃপক্ষ সকলকেই সতর্ক হতে হবে। কোনো জাতিসত্তার অন্যায়, সংহতি বিরোধী দাবি ও তাদের অবিচারমূলক কাজ যেমন আমরা সহ্য করবো না, তেমনি তাদের প্রতি আমরা কোনো প্রকার অবিচারও করবো না। অবিচার যদি কিছু হয়ে থাকে, তাহলে তার ক্ষতিপূরণ আমাদের করতে হবে। বলল সামরিক কমিশনের প্রধান।
ধন্যবাদ মি. গোয়াং জেন। আপনি যা বললেন, সেটাই আমাদের পলিসি। কোথাও পলিসির ভায়োলেশন হয়তো হয়েছে, আবার কোনো কোনো ধর্মীয় সত্তার কিছু বাড়াবাড়িও আছে। উভয় ক্ষেত্রে যদি সচেতনতা ও সমঝোতা ফিরে আসে এবং আইন ও সুবিচারকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সংকট দূর হবে। এ ব্যাপারে আমরা আহমদ মুসারও সহযোগিতা চাই। আরও দুবার সিংকিয়াং-এ এসে এই কাজই তিনি করেছেন। বলল প্রেসিডেন্ট।
একটু থেমেই প্রেসিডেন্ট আবার বলে উঠল, আমার মনে হয় আজ আলোচনা এখানেই শেষ করতে পারি। সকলকে ধন্যবাদ।
বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল সকলেই।
কানে কানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ মুসাকে বলল, জনাব আহমদ মুসা, সব কন্ট্রাক্ট নাম্বার এখনি আপনি পেয়ে যাচ্ছেন। আইডিটাও আজই একটু পরে পাবেন।
ধন্যবাদ। আহমদ মুসা বলল।
প্রেসিডেন্ট চলে গেছে। সবাই বেরিয়ে এলো মিটিং রুম থেকে।
আচ্ছা চেং ঝি বল তো, এমন জেলখানা কোথাও দেখেছ? বলল লু ঝি।
কি বকম জেলখানা? চেং ঝি বলল। চেং ঝি লু ঝি’র সেক্রেটারি। তাকে লুঝি’র সাথে ধরে আনা হয়েছে।
এই যে আমরা যেখানে আছি। সেটা একটা সুন্দর বাড়ি। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। আলমারি ভর্তি কাপড়চোপড়। দামি কসমেটিকস। চার বেলা খাবার পাচ্ছি আমরা মানসম্মত। এমন তো কোনো জেলখানা হয় না, কিংবা শত্রুকে আটক রাখার কেন্দ্রও তো এমন হয় না? বলল লু ঝি।
আপনি কার মেয়ে দেখতে হবে তো? আপনাকে খারাপ জায়গায় রাখার সাহস ওরা করতে পারে? চেং ঝি বলল।
কেন, আমাকে ধরে আনার সময় আমি কার মেয়ে সেটা তো ভাবেনি। তারা?
ধরে আনতে তারা বাধ্য হয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে তুমি তো খুব ছোট অপরাধ করনি? ধরে আনলেও তোমার স্ট্যাটাস যেমন, তেমন অবস্থায় তোমাকে রেখেছে। চেং ঝি বলল।
আচ্ছা, আমার সাথে তোমাকে ধরে আল কেন? তুমি তো দোষ করনি? বলল লু ঝি।
আমাকে ধরে আনার মাধ্যমে আমার মুখ বন্ধ করতে পেরেছে। না ধরে আনলে, আমাকে মেরে ফেলতে হতো। চেং ঝি বলল।
ওরা মুখোশ পরা ছিল। ওদের কাউকেই তুমি চেননি। তাহলে তোমাকে তারা ভয় করবে কেন? বলল লু ঝি।
না চিনলেও আমি চেঁচামেচি করতাম। তার ফলে নিরাপদে পালানো অসুবিধাজনক হতো।
ওদের আসা আমাদের গেটম্যানদের অবশ্যই নজরে পড়েছে। ফিরে আসার সময়ও তারা কেউ বের হয়নি। অতএব চেঁচামেচিতে কি খারাপটা তাদের হতো?
বলে একটু থেমেই লু ঝি বলল, আসলে তোমাকে ধরে এনেছে। আমাকে সঙ্গ দেবার জন্যে। একাকী একটা বাড়িতে একটা মেয়েকে রাখা খুবই খারাপ। এটা ওরা চায়নি। কেন চায়নি? বরং এমনটা ওরা তো চাওয়ারই কথা ছিল। এর উত্তর কি বল?
হ্যাঁ, ম্যাডাম এটা একটা বড় প্রশ্ন। চেং ঝি বলল।
আরো একা মজার জিনিস দেখ। ওদের দেয়া খাবার জিনিসগুলোর ব্যাপারে খেয়াল করেছ? আমি সব সময় যা পছন্দ করে এসেছি এবং এখনও যা আমি পছন্দ করি, নাস্তা, লাঞ্চ, ডিনারে সেসব জিনিসই দেয়া হচ্ছে। আমার টেস্ট সম্পর্কে, আমার পছন্দ সম্পর্কে ওরা জানল কি করে? বলল লু ঝি।
ভাবছে চেং ঝি। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন। বলল, হ্যাঁ, তাই তো ম্যাডাম। এর তাহলে অর্থ কি? আপনার বাবা কি ওদের সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করেছে?
বাবা ওদের সাথে যোগাযোগ করে এই সুন্দর ব্যবস্থা করলে আমাকে উদ্ধার করছে না কেন? বলল, লু ঝি। তার কণ্ঠ ভারি।
চেং ঝি তাকাল লু ঝি’র দিকে। বলল, অযথা মনকে কষ্ট দেবেন না। স্যার অনেক বড়, অনেক সম্মানী মানুষ। তিনি কোনো ব্যাপারে ক্রিমিনালদের কাছে নতি স্বীকার করতে পারেন না। তিনি নিশ্চয় উদ্ধারের চেষ্টা করছেন? পুলিশকে তো এই জায়গাটা খুঁজে পেতে হবে।
ক্রিং করে একটা বেল বেজে উঠল। খাবার দিতে এসেছে মুখোশধারীরা।
খাবার নিয়ে এসে মুখোশধারী একজন বেল বাজায়। সঙ্গে সঙ্গে খাবার আনতে যেতে হয়। বাইরের দেয়ালে গোল একটা ঘুলঘুলি খুলে যায়। কয়েকটা কোল্ড ও হটপটে করে খাবার ঐ ঘুলঘুলি দিয়ে নিতে হয়। খাবার। চেং ঝিই সব সময় নিয়ে থাকে।
আজ ক্রিং শব্দ হওয়ার সাথে সাথে লু ঝি উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল সেই ঘুলঘুলির দিকে। তার পেছনে পেছনে চেং ঝিও।
ঘুলঘুলি তখন খুলে গেছে।
ঘুলঘুলি দিয়ে দেখা যাচ্ছে খাবার পটগুলো নিয়ে একজন মুখোশধারী দাঁড়িয়ে আছে।
দৌড়ে গিয়ে লু ঝি ঘুলঘুলিতে মুখ লাগিয়ে বলল, তোমরা খাবার নিয়ে যাও। আমরা আজ থেকে কোনো কিছুই আর খাব না। আমাদের ছেড়ে না। দেয়া পর্যন্ত আমরা কোনো খাদ্যে হাত দেব না। মুক্তি অথবা মৃত্যু- এ দুয়ের একটা আমরা চাই। এটাই আমাদের শেষ কথা।
বলে চেং ঝি’র হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে এলো লু ঝি।
একি করলেন ম্যাডাম? এটা ঠিক হলো না। আমরা বিপদে পড়েছি। এ সময় মন-এর সাথে শরীরকেও সবল রাখতে হবে। বলল চেং ঝি।
আমি আমার শেষ কথা বলে দিয়েছি চেং ঝি
আমি খাব না। বাবা যদি কোনোভাবে আমাদের ভালো থাকা ও ভালো খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে, তাহলে তিনিও জানুন, আমরা তার ভালো খাওয়া খাচ্ছি না। বলল লু ঝি।
কিছু বলতে পারল না চেং ঝি। তার মনেও নানা প্রশ্ন। বন্দিখানা এটা, কিন্তু কোনো কিছুই বন্দিখানার মতো নয়। তোক যারা খাবার দিয়ে যায়, যারা মাইক্রোফোনে পাশে কোথাও থেকে কথা বলে, তারা সম্মানের সাথে কথা বলে। মেয়ে ছেলে বা মেয়ে প্রহরী ছাড়া কেউ ভেতরে আসে না। এটা তাকে বিস্মিত করেছে। এরা যদি শক্র হয়, তাহলে এই সম্মান, মর্যাদা দেয়ার কথা নয়! ওরা ধরে নিয়ে আসার সময়ই মান-মর্যাদা হারাবার শঙ্কাই তার মনে প্রথম জেগেছিল। লু ঝি ম্যাডাম ঠিকই বলেছেন, আমাকে নিয়ে। আসা হয়েছে তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যেই। কোনো ক্রিমিনাল বা শত্রুদের তো এই বিবেচনা থাকার কথা নয়। তারা লু ঝিকে একাই চাইবার কথা। লু ঝি ম্যাডাম বারবার তার বাবার কথা আনছে কেন? কি করবেন তিনি। চেষ্টা তিনি নিশ্চয়ই করছেন। কিন্তু তিনিই যদি তাদের খাওয়া-থাকার এই স্পেশাল ব্যবস্থা করে দিয়ে থাকেন, তাহলে তো তিনি এদের জানেন। তাদের মুক্তির ব্যবস্থা তিনি করেননি, করছেন না কেন? এই বিষয়টা নিশ্চয় লু কি ম্যাডামের মনকে পীড়া দিচ্ছে বেশি। এই মানসিক অবস্থার কারণেই কি তিনি খাবার ছেড়ে দেয়ার কথা বললেন? এরপর কি হবে? লু ঝি ম্যাডাম
যে জেদী মেয়ে। কি ঘটছে সামনে? শঙ্কায় ভরে গেল চেং ঝি’র মন।
চেং ঝি বল তো, এ জায়গাটা কোথায়? বলল লু ঝি।
চেং ঝি’র চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। সংবিৎ ফিরে পেয়ে তাকাল লু ঝি’র দিকে। একটু ভেবে নিয়ে বলল, জতা বলা মুশকিল ম্যাডাম। জানালা দিয়ে দূরে কিছুই দেখা যায় না। চারদিকেই দেখা যায় গাছপালা। গাছপালার ফাঁক দিয়েও কিছু দেখা যায় না। কোনো দিক থেকেই কোনো কথা শোনা যায় না। এসব কিছু থেকে জায়গার নাম অনুমান করা মুশকিল।
ছাদটাও উঁচু দেয়াল ঘেরা। সেদিন পানির ট্যাংকিতে চড়ে দূরে কোনো বাড়ির ছাদের উপর বা পিলারের উপর একটা বিজ্ঞাপন দেখছি। বিজ্ঞাপনটির বটমে একটা টেলিফোন নাম্বার দেখছি। নাম্বারটি পাহাড় এলাকার, আমি নিশ্চিত। বলল লু ঝি।
তার মানে আপনি মনে করছেন আমরা কোনো পাহাড়ি এলাকার কোথাও বন্দি। চেং ঝি বলল।
আমি তাই মনে করছি। বলল লু ঝি। বাইরের গেট খোলার শব্দ হলো এ সময়। উৎকর্ণ হলো লু ঝি এবং চেং ঝি।
তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাল গেটের দিকে। ঢুকল কয়েকজন। সামনেই রয়েছে বাড়িটার সর্বময় শাসক, বিশাল বপু একজন মেয়ে। মুখে তার। মুখোশ। কাঁধে ঝুলানো স্টেনগান। হাতে একটা ব্যাটন। দেড় ফুট লম্বা ও বেশ মোটা। কাঠের তৈরি, কিন্তু লোহার মতো দেখতে।
তার পেছনে দুজন স্টেনগানধারী মহিলা। তাদেরও মুখে মুখোশ। স্টেনগান উদ্যত লু ঝিদের দিকে। তাদের একজনের হাতে বড় হটপট ক্যারিয়ার।
তাদের পেছনে চারজন পুরুষ, মাশলম্যান। পরনে প্যান্ট, গায়ে গেঞ্জি। মুখোশ এদের মুখেও।
ওরা সোজা এসে দাঁড়াল লু ঝি’র সামনে।
বিশাল বপু শাসক মেয়েটি লু ঝি’র দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, খাবার নিসনি কেন?
চেং ঝি অবাক হলো ওদের কথার ধরনে। আপনি থেকে একদম নেমে তুইতে কণ্ঠও জঘন্য ধরনের কর্কশ।
আমি খাব না, বলেছি তো। বলল লু ঝি।
লু ঝি’র কথার সাথে সাথেই বিশাল বপু মেয়েটির ব্যাটন বিদ্যুৎ গতিতে। উপরে উঠল। তীব্র গতিতে গিয়ে পড়ল লু ঝি’র পিঠে।
লু ঝি এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না।
আকস্মিক আঘাতে আ বলে চিৎকার করে উঠল লু ঝি।
ব্যাটন চালাবার সাথে সাথে চিৎকার করে বলে উঠল বিশাল বপু মেয়েটি, এটা তোর বাড়ি নয়। এখানকার যে আইন, যে হুকুম তা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে।
চেং ঝি ছুটে এসে ধরেছিল লু ঝিকে। বলল, খাবার সময় তো হয়নি। কথার কথা বলেছে। এজন্যে আপনারা তার গায়ে হাত তুললেন?
চেং ঝি থামতেই লু ঝি চিৎকার করে বলে উঠল, আমি বলেছি আমি খাব না, আমাকে ওরা মেরে ফেলুক।
আবার ব্যাটন তুলেছিল বিশাল বপু মেয়েটি।
চেং ঝি হাত তুলে বাধা দিয়ে লু ঝিকে আড়াল করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
আঘাতাটা এলো। লু ঝি’র বদলে তা আঘাত করলে চেং ঝিকে। ব্যাটনটি লাগল গিয়ে চেং ঝি’র মাথায়। মাথা থেতলে গিয়ে ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এলো মাথা থেকে।
সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে বিশাল বপু মহিলাটি বলল পেছনে তাকিয়ে, শিং চিয়া, হটপট ক্যারিয়ার ওদের সামনে রাখ।
স্টেনগান ঘাড়ে ঝুলিয়ে হটপট ক্যারিয়ারটি লু ঝিদের সামনে রাখল।
লু ঝি তখন তার রুমাল দিয়ে চেং ঝি’র মাথার আহত জায়গাটা চেপে ধরেছিল। বলল সে বিশাল বপু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, তোমরা মেরে ফেলতে পার। মেরে ফেল, সেটাই চাই। নিয়ে যাও খাবার।
মরতে চাও? মরা সহজ। মরতে দেব না তোর দেহকে, মারব তোর মনকে, তোর মর্যাদা, সম্মানকে, যা নিয়ে এত অহঙ্কার। সময় দিলাম এক ঘণ্টা। এক ঘণ্টা পরে আমি ফিরব। যদি দেখি খাবার খাসনি। তাহলে তোর খাটে শুইয়ে তোক বাঁধব, তারপর এই চারজন পশুকে তোর ঘরে ঢুকিয়ে দেব। না খাওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন তোর এ শাস্তি চলবে।
বলেই ঘুরে দাঁড়াল বিশাল বপু মেয়েটি। বাড়ি থেকে ওরা সবাই বেরিয়ে গেল।
কান্নায় লুটিয়ে পড়ল চেং ঝি। বলল, ম্যাডাম এরা অমানুষ, পাষণ্ড। এরা করতে পারে না এমন কাজ নেই।
লু ঝি’র চোখে কান্না নেই। কান্না শুকিয়ে গেছে। সে ফার্স্ট এইড বক্স এনে চেং ঝি’র মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। কোনো কথা বলল না।
চেং ঝি দুই হাত দিয়ে লু ঝি’র হাত চেপে ধরে কান্নার সুরে বলল, ম্যাডাম এদের সাথে গণ্ডগোল করে লাভ নেই। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
চেং ঝি আমি যা বলেছি, সেখান থেকে আমি নড়ব না। আমি দেখতে চাই এরা কতদূর যেতে পারে। কারও পায়ের তলায় মাথা দিয়ে যে বাঁচা, সে বাঁচা আমি বাঁচতে চাই না। আহমদ মুসার কাছ থেকে বাঁচার অর্থ আমি বুঝেছি। বলল লু ঝি।
কিন্তু তুমি যা চাইছ, আহমদ মুসা তা চাইতেন না। মেয়েদের একটা সীমাবদ্ধতা আছে, শত্রুর হাতে পড়লে তাকে ধৈর্যশীল ও কৌশলী হতে হয় নিজেকে রক্ষা করার জন্যে। আহমদ মুসা নিশ্চয় এটা পছন্দ করতেন। চেং ঝি বলল।
তুমি যা বলতে চাচ্ছ, আমি তা বুঝেছি চেং ঝি। আমাকে ওরা মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু আমার গায়ে ওরা হাত দিতে পারে না। শয়তানদের হুকুমের দাস না হয়ে আমি শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই। আমি মুসলিম হইনি বটে, কিন্তু আহমদ মুসার আল্লাহ কি আমাকে দেখবেন না? আমি তো আহমদ মুসার আল্লাহর উপর খুব বিশ্বাস রাখি। বলল লু ঝি। তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
বাড়িটার মাঝখানে একটা ফাঁকা চত্বর। লাউঞ্জ হিসাবেও ব্যবহার হয়। বাড়ির সকলের গেট টুগেদারেরও জায়গা এটা হতে পারে। লাউঞ্জটার চারদিকেই নানা রকমের ঘর। এই লাউঞ্জ থেকে দুতলায় উঠারও সিঁড়ি।
লাউঞ্জে বসেই গল্প করছিল লু ঝি এবং চেং ঝি।
চেং ঝি কাঁদছিল।
কেঁদো না চেং ঝি। আহমদ মুসা বলে দুনিয়াটা পরীক্ষা দেয়ার জায়গা। কে ভালো কাজ করে, ভালো পথে চলে, এটাই আল্লাহ দেখতে চান। এ কারণে নীতি ও আদর্শের উপর থাকাটাই আসল কাজ। কিন্তু আহমদ মুসার নীতি আদর্শ তো আমি জানি না। তবে আমি যেটা ভালো বুঝেছি, সেই ভালো কাজটাই করার জন্য আমি চেষ্টা করছি। আজও ওদের অন্যায় ও ভয় দেখানোর কাছে নতি স্বীকার করবো না। বলল লু ঝি।
কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেও মানুষ কৌশল হিসাবে পিছু হটে। সময় ক্ষেপণের। জন্যে কৌশলের আশ্রয় নিতে আমরা পারি না? চেং ঝি বলল।
এটা করা যায় না, তা নয়। কিন্তু আমি দেখতে চাই বাবা কতদূর যেতে পারেন? বলল লু ঝি।
এর মধ্যে আপনার বাবাকে টেনে নিয়ে আসছেন কেন? তিনি নিশ্চয় বসে নেই। কিছু করছেন। চেং ঝি বলল।
তুমি জান না চেং ঝি। বাবা এদেরকে চেনেন, জানেন। কিন্তু এরপরও…।
কথা শেষ করতে পারল না লু ঝি। কান্নায় ভেঙে পড়ল। আবার দরজা খোলার সেই শব্দ। ভেতরে এলো আগের সেই টিম।
সামনে সেই বিশাল বপু মহিলা। তার হাতে হ্যান্ড মেশিনগান। তার পেছনের দুই মহিলা গার্ডের হাতে স্টেনগান। পেছনে সেই চারজন। মাসলম্যান যুবক। তাদের কোমরে ঝুলানো রিভলবার।
লু ঝি’র সামনে এসে দাঁড়াল সেই বিশাল বপু মহিলা।
লু ঝি’র মুখটা অশ্রু ধোঁয়া। কিন্তু দুই চোখে আগুন। বলল, ম্যাডাম, আপনি তো দেখছি যুদ্ধসাজ নিয়ে এসেছেন। কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন? আমি একা, তাও আবার নিরস্ত্র। চেং ঝি আমার সেক্রেটারি। সে আমাদের বিরোধের মধ্যে নেই।
বলেই লু ঝি তাকাল চেং ঝি’র দিকে। বলল, চেং ঝি, তুমি উপরে তোমার রুমে যাও।
না, আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। বলে কেঁদে উঠল চেং ঝি।
তোমাদের এ নাটক শুনতে আমি আসিনি।
বলেই লু ঝি’র দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিশাল বপু মহিলা বলল, দেখা যাচ্ছে খাবার যে জায়গায় ছিল, সেখানেই পড়ে আছে। তার মানে তুমি খাওনি, খাবে না?
সে তো আগেই বলেছি। বলল লু ঝি।
বিশাল বপু মহিলাটি তার হাতের হ্যান্ড মেশিনগানের ব্যারেল উপরে তুলে এক পশলা গুলিবৃষ্টি করল। তারপর হ্যান্ড মেশিনগান লু ঝি’র দিকে তাক করে পেছনের দুজন মহিলাকে বলল, তোমরা দুজনে লু ঝিকে উপরে ওর রুমে নিয়ে চল। আর গুণ্ডা-ষণ্ডারা চারজন এস।
পেছনের দুজন স্টেনগানধারী মহিলা লু ঝি’র দুপাশে এসে দাঁড়াল। বলল, উঠে দাঁড়ান ম্যাডাম, চলুন।
লু ঝি উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কোমর পর্যন্ত দেহটা সোজা করেই দুই হাত সামনে প্রসারিত করে বিশাল বপু মেয়েটার দুই হাঁটুর নিচটায় আঘাত করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বিশাল বপু নিয়ে মেয়েটা উপুড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল লু ঝি’র গায়ের উপর। পড়ে গিয়েই লু ঝি মেয়েটাকে উল্টে দিয়ে তার হ্যান্ড মেশিনগানটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই একটা জাম্প দিয়ে দেহটা শূন্যে তুলে দুপায়ের জোড়া আঘাত ছুঁড়ে দিল মেয়েটার কণ্ঠনালির উপর এবং শরীরটা সোজা হবার আগেই পর পর দুই পায়ের হাতুড়ির মতো দুই আঘাত ছুঁড়ে দিল তাকে ধরতে আসা দুই মেয়ের মাথায়।
বিশাল বপু মহিলাসহ তিনজনই মাটিতে পড়েছে। লু ঝি হ্যান্ড মেশিনগান এবার ওদের দিকে তাক করে এক পশলা গুলিবৃষ্টি করে বলল, তোদের মতো জঘন্য মানুষের বাঁচার অধিকার নেই পৃথিবীতে।
এদিকে চার মাসলম্যান ততক্ষণে ঘিরে ফেলেছে লু ঝিকে। তাদের সকলের হাতেই উদ্যত রিভলবার। একজন চিৎকার করে বলল, আমাদের চারজনকে এক সাথে মারতে পারবে না। হ্যান্ড মেশিনগানের ট্রিগারে হাত দিলেই হয় মরতে হবে, নয় তো আহত হয়ে ধরা দিতে হবে।
আমাকে মারতে পার, আমাকে ধরতে পারবে না। বলেই লু ঝি তুলল তার হ্যান্ড মেশিনগান।
.
কক্ষে নীল ডিমলাইট। ভৌতিক পরিবেশ।
এই ভৌতিক পরিবেশে বিশাল টেবিল সামনে নিয়ে সিংহাসনাকৃতির। কালো চেয়ারে বসে আছে কালো এক ছায়ামূর্তি। আপাদমস্তক কালো পোশাক। মুখে সাদা মুখোশ। দেখলে মনে হবে কমিকের কিং অথবা ভয়ংকর এক দৈত্য।
তার বা পাশে সাইড টেবিলে ইন্টারকম কথা বলে উঠল, এক্সিলেন্সি বিজ্ঞানী ড. শিনহুয়াকে নিয়ে এসেছেন আমাদের চীফ কমান্ডার হুই দাই।
আমি অপেক্ষা করছি। বলল সাদা মুখোশের কালো মূর্তি।
এই সাদা মুখোশের কালো মূর্তিটিই জোয়ান উ, চীনের লিজেন্ডারি হিরোর ডামি। সম্প্রতি উদয় হয়েছেন চীনে তিনি উডাং পাহাড়ে পরিত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে। উডাং শৃংগের ২০০০ মন্দির ও প্রাসাদে সজ্জিত ৭০ কিলোমিটার বিস্তৃত পবিত্র উডাং সাম্রাজ্য হবে চীনের হৃদয়। পবিত্র হৃদয় তার দেহকে মুক্ত করবে অপবিত্র লোকদের স্পর্শ থেকে। এই পবিত্র। সাম্রাজ্যের জোয়ান উর রয়েছে একটা গোপন সংগঠন জোয়ান উ উডাং। আর্মি সংক্ষেপে জুয়া- JUUA। চীনের বিশেষ ঐতিহ্য মার্শাল আর্টে সজ্জিত এই বাহিনী। প্রাচীন চীনের হারানো হানজু ভাষার পবিত্র প্রথম বর্ণ হলো তাদের প্রতীক চিহ্ন। গোপন এই সংগঠন জোয়ান উ উডাং আর্মি পরিচালনা করে দেশ জুড়ে ছড়ানো জোয়ান উ আর্মি (JUA)-কে। চীনের বিভিন্ন বাহিনীর উৎসর্গিত সদস্যদের নিয়ে তৈরি এই বাহিনী। দুই বাহিনীরই চীফ কমান্ডার হুই দাই।
বিজ্ঞানী ড. শিন হুয়াকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল হুই দাই।
দুজনেই দীর্ঘ বাও করল জোয়ান উকে। বাউ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল দুজন।
বসুন। বলল জোয়ান উ মুখ না তুলেই। বসল সঙ্গে সঙ্গেই ওরা দুজন।
হুই দাই তুমি কি ড, শিন হুয়াকে বলেছ আমরা কি জন্যে তাঁকে ঢেকেছি? জোয়ান উ বলল রোবটিক ভাষায়। কথার মধ্যে রস-কষ। আন্তরিকতা ইত্যাদি কিছুই নেই। মেঘ ডাকের মতোই পতিত হওয়া কথার টুকরা যেন।
সব বলেছি, মাই লর্ড। বলল হুই দাই নরম ও নিয়ন্ত্রিত কণ্ঠে।
তাকে নিয়ে এসেছ কতক্ষণ আগে হুই দাই? বলল জোয়ান উ।
দুই ঘন্টা আগে মাই লর্ড। হুই দাই বলল।
ফাইল ইনি পড়েছেন কত ঘণ্টা? বলল জোয়ান উ।
পৌনে দুই ঘণ্টা মাই লর্ড। হুই দাই বলল।
পাঠাগারের কোনো বইপত্র তিনি দেখেছেন? প্রশ্ন জোয়ান উর।
ইয়েস মাই লর্ড। বেশ কতকগুলো বই তিনি কনসাল্ট করেছেন। কিছু ম্যাগজিনও তিনি দেখেছেন। হুই দাই বলল।
ধন্যবাদ ডক্টর শিন হুয়া। আমি খুব খুশি যে আপনি ফাইলটার ভেতরে ঢুকেছেন। এখন বলুন ডক্টর ফাইলটা কিসের? বলল জোয়ান উ।
স্যার, ওটা একটা সমাপ্ত প্রজেক্টের ব্রিফিং। ড. শিনহুয়া বলল।
প্রজেক্টটা কি? বলল জোয়ান উ।
স্যার ওটা পোস্ট ম্যাটার ম্যাগনেটিক উইপন্স প্রকল্প। ড. শিন হুয়া বলল।
পোস্ট ম্যাটার ম্যাগনেটিক উইপনস টেট-এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কি বলা হয়েছে? বলল জোয়ান উ।
এখানে দুটি উইপন্স পাশাপাশি দেখানো হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দুই অস্ত্রের। একটি অস্ত্র পরমাণুর বিস্ময়কর সংকোচনের মাধ্যমে অস্ত্রগুলোকে জমাট পিণ্ডে পরিণত করে। তখন অস্ত্রগুলো তার সকল কার্যকারিতা হারায়। অন্য অস্ত্রটি পরমাণুর পারটিকলসগুলোকে বহির্মুখী ফিউশনের মাধ্যমে মারণাস্ত্রকে চোখের পলকে অস্তিত্বহীন করে দেয়।
বলে একটু থেমেই ড. শিনহুয়া বলল, আমি আগেও মি. হুই দাইকে বলেছি, এমন অস্ত্রের বিষয় দুনিয়ার কারও কল্পনার মধ্যেও নেই। এই অবস্থায় অস্ত্র দুটির এই ব্রিফিং এলো কোত্থেকে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি নাস্যার।
ডক্টর যে প্রশ্ন করব, তার বাইরে কোনো কথা বলবেন না। কথা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। বলল জোয়ান উ।
ড. শিন হুয়া সরি বলে মাথা নিচু করল।
ধন্যবাদ ডক্টর, বলুন তো ফর্মুলা পাওয়া গেলে এই দুই অস্ত্র তৈরিতে আর কোনো সমস্যা আছে কিনা? বলল জোয়ান উ।
একটু ভাবল ড. শিনহুয়া। বলল, ফমূলা দেখার পর বিষয়টা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে। তবে আমি অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সার্বিকভাবে পোস্ট ম্যাটার ম্যাগনেটিক সায়েন্স যতদূর পর্যন্ত এগিয়েছে, তাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ধন্যবাদ। ফর্মূলা পাওয়ার পর আর কিছু জানার প্রয়োজন আছে। কিনা? বলল জোয়ান উ।
ফর্মুলার সাথে অনেক সময় আলাদাভাবে ব্যাখ্যামূলক বা মন্তব্যধর্মী পরিশিষ্ট থাকতে পারে। সেটাও প্রয়োজনীয় একটা দলিল। ড. শিন হুয়া। বলল।
আপনি বললেন, এ ধরনের অসম্ভব অস্ত্রের পরিকল্পনা দুনিয়ার কারও মাথায় নেই। যদি তাই হয়, তাহলে ফর্মুলা দেখলেই বিষয়টা কিভাবে তাদের মাথায় আসবে? বলল জোয়ান উ।
স্যার, বিজ্ঞানে জানা ও অজানার মাঝের দেয়াল খুবই পুরু, আবার খুবই পাতলা। একটা আবিষ্কার দাঁড়িয়ে থাকে একটা কনসেপ্টের উপর। কনসেপ্টেরই আরেকটু বিস্তারিত রূপ ফর্মুলা। সুতরাং কনসেপ্ট বা ফমূলা পেয়ে গেলে সবই পরিষ্কার হয়ে যায়। ড. শিন হোয়া বলল।
ধন্যবাদ ডক্টর।
বলে জোয়ান উ তাকাল হুই দাই-এর দিকে। বলল, ডক্টর সাহেবকে নিয়ে যাও। তাকে বিশ্রামে রাখ।
উঠে দাঁড়াল জোয়ান উ। ডক্টর শিন হুয়া ও হুই দাইও উঠে দাঁড়াল।
ওরা বেরিয়ে যেতেই ঘড়ির দিকে তাকাল জোয়ান উ। আর সেই সাথেই তার ইন্টারকম কথা বলে উঠল।
মাই লর্ড জি পিং লাইনে। বলল জোয়ান উর সেক্রেটারি।
আমি তার অপেক্ষা করছি। বলল জোয়ান উ।
ওপার থেকে মাই লর্ড বলে শুরু করতেই জোয়ান উ বলে উঠল, তোমাদের ওখানে সব রেডি?
ইয়েস মাই লর্ড। বলল ওপার থেকে জি পিং।
আর কথা নয়, আমি আসছি। বলল জোয়ান উ।
ঘুরে বসেই জোয়ান উ তার টেবিলের অদৃশ্য প্রায় একটা বাটনে তর্জনি চাপল। সঙ্গে সঙ্গেই তার চেয়ারটি চোখের পলকে নিচে নেমে গেল।
এক জায়গায় এসে চেয়ারটি স্থির হতেই তার সামনে লিফটের একটা দরজা খুলে গেল। লিফটের দরজার পরেই দাঁড়ানো গাড়ি। জোয়ান উ, গিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিল।
গাড়ির ফ্লোর থেকে উঠে এলো একটা স্ক্রিন। তাতে ভেসে উঠল একটা রাস্তার দৃশ্য। দেখছে সে রাস্তায় ছুটছে তার গাড়ি। আগে-পিছে এবং ডান বায়ের সব দৃশ্য তার চোখের সামনে। স্ক্রিনের এক কোনায় ইনসেটে দেখতে পাচ্ছে তার ডেস্টিনেশন ড্রাগন কেভ এবং তার চার পাশের লাইভ। দৃশ্য।
.
ড্রাগন কেভ-এর বন্দি ব্যারাক।
ঘুম থেকে চোখ মেলেই ফা জি ঝাও তাড়াতাড়ি ঘড়ির দিকে তাকাল। সকাল দশটা।
বই পড়তে পড়তে ফা জি ঝাও ঘুমিয়ে পড়েছিল।
নাস্তার সময় পার হয়ে গেছে। এ বন্দিখানায় নাস্তা দেয় সকাল নয়টায়।
ফা জি ঝাও অপহৃত হবার পর থেকেই সে এই কক্ষেই রয়েছে।
কক্ষটি জেলখানার বড় সেলের মতোই। প্রথম শ্রেণির বন্দিরা যে সুবিধা পায়, সে সুবিধা এখানেও। জেলখানার মতোই এখানে সারিবদ্ধ সেল। একটা চতুর ঘিরে সেলগুলোর সারি। সেলগুলোর বাসিন্দারা একে অপরকে দেখতে পায়, কিন্তু কথা বলতে পারে না। সিসি ক্যামেরায় সব সময় মনিটর করে বন্দিদের গতিবিধি।
ফা ঝি ঝাও উঠে বসল।
তার চোখ গেল পাশের সেঁলে। অনেকটা ভূত দেখার মতোই চমকে উঠল সে। পাশের সেলে তার ছোট ভাই মা ঝু সুলতান তার দিকে তাকিয়ে সেলের শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ফা জি ঝাও উঠল এবং ছুটে গেল। গিয়ে দাঁড়াল সেলের শিক ধরে।
দুজনের পাশাপাশি সেলের মাঝখান দিয়ে ছয় সাত ফুটের মতো একটা প্যাসেজ, প্রহরীদের যাতায়াতের জন্যে।
শিক ধরে দাঁড়িয়ে ফা জি ঝাও বলল, সুলতান তোমাকে ওরা ধরে নিয়ে এসেছে? কবে? কিভাবে? কেন?
সেলের বন্দিদের যে কথা বলা নিষেধ তা ভুলে গেল ফা জি ঝাও।
আপা, তোমাকে যখন অপহরণ করা হয়, সেই রাতেই আমাকে ধরে নিয়ে আসে আমার হলের রুম থেকে। মা ঝু সুলতান বলল।
তোমাকে কেন ধরেছে, আমাকে কেন ধরেছে জান কিছু তুমি? বলল ফা ঝি ঝাও।
না আপা কিছুই জানতে পারিনি, তবে এরা বড় কোনো গ্রুপ। কোনো বড় লক্ষ্যে কাজ করছে। মা ঝু সুলতান বলল।
এ সময় উপর থেকে একটা বড় কণ্ঠ ধ্বনিত হলো, মা ঝু সুলতান, ফা জি ঝাও আপনারা সেলের বন্দি। বন্দিদের পারস্পরিক কথা বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের মহান লর্ড আপনাদের দুই ভাই বোনের জন্যে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছেন।
কথা কয়টি বলেই থেমে গেল কণ্ঠ।
এই মহান লর্ড কে মা ঝু সুলতান, জান? বলল ফা জি ঝাও।
না জানি না আপা। এরা যেমন কথা বলতেও দেয় না, তেমনি বলেও। মাত্র গতকাল সেল চেক করতে আসা এক ঊর্ধ্বতন কেউ একটা মারাত্মক খবর দিল। বলল, লিয়েন হুয়া আমাদের হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। তা না হলে পাশের সেলেই তাকে দেখতে পেতে। শয়তান আহমদ মুসা আমাদের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করেছে। আমাদের অনেক লোককে হত্যা করেছে এই শয়তান। বলল মা ঝু সুলতান।
হ্যাঁ, তোমার কাছে নাম শুনেছি লিয়েন হুয়ার। সে তো প্রেসিডেন্টের ভাগ্নী এবং একজন ছাত্র যুবনেত্রী। তাকে কিডন্যাপ করল কেন? বলল ফা জি ঝাও। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
আবার উপর থেকে যান্ত্রিক কণ্ঠ ভেসে এলো, বিস্ময় শেষ করে ফেলবেন না ম্যাডাম, সামনে আরও বড় বড় বিস্ময় ও বেদনা আছে। ড. ডা, এবং সহকারী চাও জিয়াংকেও তুলে এনেছি। চেয়ে দেখুন সেলে অনেকেই আছেন। থামল কণ্ঠটি।
ফা জি ঝাও এবং মা ঝু সুলতান দুজনেরই চোখে-মুখে বিস্ময়। মুখ চুপসে গেছে তাদের। ড. ডাকে তারা চেনে। দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। নিভেজাল, নির্বিরোধ এক মানুষ। তাকে অপহরণ করা হয়েছে কেন?
তোমাকে এ কয়দিন কোথায় রেখেছিল? জিজ্ঞেস করল ফা জি ঝাও মা ঝু সুলতানকে।
ওপাশে আরও সেল আছে, সেখানে আরও বন্দি আছে। সেখানে। ছিলাম। মা ঝু বলল।
তোমাকে আবার এখানে আনল কেন? ভালোই হলো কথা বলা তো যাবে। বলল ফা জি ঝাও।
ম্যাডাম, এখানে বন্দিদের প্রয়োজনে কিছু করা হয় না, যা করা হয় মহান লর্ডের প্রয়োজনে। খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়, সেটাও আমাদের প্রয়োজনে। মা ঝু সুলতানকে তার বোনের পাশে আনা হয়েছে, সেটা মহান। লর্ডের প্রয়োজনেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মহান লর্ড আসবেন। উপর থেকে সেই যান্ত্রিক কণ্ঠ আবার বলে উঠল।
ফা জি ঝাও এবং মা ঝু সুলতান দুজনের চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া নেমে এলো।
শুকনো কণ্ঠে মা ঝু সুলতান বলল, আপা ড. ডা দেখছি তোমাদের এখানেই বন্দি আছেন। উইঘুরদের বিখ্যাত নেতা ইরকিন আহমদ ওয়াংকেও দেখছি এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
হ্যাঁ মা ঝু সুলতান, নেতার মতোই তোমার দৃষ্টি। তুমি সবার কথাই ভাবছ। এখন ভাবছ, পরে আরও জানবে। আমরা লুকোচুরি করে কিছু করি না। যা করি প্রকাশ্যে করি, প্রকাশ্যে বলি। কি জন্যে ওদের আনা হয়েছে, সবই জানতে পারবে।
থামল উপর থেকে আসা আকাশ বাণীর মতো যান্ত্রিক কণ্ঠটি।
একটু পরেই কণ্ঠটি আবার বলে উঠল, ম্যাডাম ফা জি ঝাও, আপনি নাস্তা করেননি, তাড়াতাড়ি করে নিন। থামল কণ্ঠটি।
নাস্তা করনি আপা? যাও, খেয়ে নাও। বলল মা ঝু সুলতান।
আচ্ছা বল তো, তুমি ছাত্র, আমি শিক্ষক, ড. ডা একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, আমরা কেন এখানে? আমি…
ফা জি ঝাও-এর কথায় বাধা দিয়ে মা ঝু সুলতান বলল, থাক এসব। কথা আপা। বলে কোনো লাভ নেই। দেখা যাক। আল্লাহ ভরসা। যাও খেয়ে নাও।
ফা জি ঝাও নীরবে ঘুরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল বেড়-এর দিকে।
বেডের ওপারে ছোট্ট একটা টেবিল। ওখানেই খাবার ঢাকা দেয়া আছে।
ঢাকনা তুলল খাবারের ট্রে থেকে। মন কিছুটা খুশি হয়ে উঠল। আজ ব্রেড-বাটারের সাথে ডিম আছে, ফল আছে। এ কদিন থেকে নাস্তায় খাচ্ছে। শুধুই ব্রেড-বাটার।
আজ নাস্তায় এই উন্নতি কেন? সবাই কী এ রকম পেয়েছে?
ড. ডা এবং ইরকিন আহমদ ওয়াং-এর কথা মনে পড়ল। খারাপ হয়ে গেল মন। ড. ডা সম্পর্কে সে বেশি কিছু জানে না। কিন্তু সে দেশের বড় গুণী লোক, এটা সে জানে। আর ইরকিন ওয়াং-এর কথা বাবার কাছে সে। অনেক শুনেছে। উইঘুরদের সম্মানী ও শীর্ষ নেতা।
বসল ফা জি ঝাও চেয়ারে। টেনে নিল নাস্তার ট্রেটা।
৪
বিচারকের মতো এক বিশাল চেয়ারে জোয়ান উ। তার সামনে হাতাছাড়া এক ছোট্ট চেয়ারে আসামীর মতো বসে আছে ফা জি ঝাও।
পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মা ঝু সুলতান। বোনের দিকে তার দৃষ্টি। মুখ শুকনো।
অন্যান্য সেলের সবার দৃষ্টি আছড়ে পড়েছে ফা জি ঝাওদের সেলের দিকে। সকলে উৎসুক এবং উদ্বিগ্নও। ইনিই মহান লর্ড, এর কথাই ঘোষণা করেছে উপর থেকে আকাশ বাণীর মতো সেই কণ্ঠ।
সেই মহান লর্ড আপাদমস্তক লাল পোশাকে আবৃত। মুখে সোনালি মুখোশ। তার ডাইনে, বামে ও পেছনে তিনজন স্টেনগানধারী দাঁড়িয়ে।
মহান লর্ড এসে আসন নেবার আগেই ঘোষণা করা হয়েছে, মহান লর্ড! জোয়ান উ আবির্ভূত হয়েছেন এক মহান মিশন নিয়ে। এ মিশনকে লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্যে তিনি সকলের সহযোগিতা চান। সহযোগিতার বিপরীত শব্দ হলো অসহযোগিতা। আর মহান লর্ড-এর কাছে অসহযোগিতার অর্থ হলো শত্রুতা। তিনি শত্রুদের বাঁচিয়ে রাখেন না।
আরও ঘোষণা করা হয় যে, মহান লর্ড তার এই আগমনে দুজন। সৌভাগ্যবানের সাথে কথা বলবেন। তাদের একজন হলেন বিজ্ঞানী ফাজি ঝাও, আরেকজন হলেন সম্মানিত বিজ্ঞ প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ডার সঙ্গে। আর এ সময় মা ঝু সুলতান ও ইরকিন আহমদ এই দুজনের সাথেও কথা বলার ইচ্ছা আছে, যদি সময় হয়।
মহান লর্ড প্রথমে বসেছে ফা জি ঝাও-এর সাথে। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়ে গেছে।
মহান লর্ড জোয়ান উ কথা বলছে তার মুখের সাথে সেট করা স্পীকারের মাধ্যমে।
বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও আপনি কি ঘোষণা শুনেছেন? জোয়ান উর যান্ত্রিক কণ্ঠ বলল।
শুনেছি। বলল ফা জি ঝাও।
আপনি তো দুটি ম্যাগনেটিক অস্ত্র তৈরি করেছেন? বলল জোয়ান উর যান্ত্রিক কণ্ঠ।
ফা জি ঝাও চমকে উঠে তাকাল মুখোশধারী মহান লর্ড-এর দিকে। কোনো উত্তর দিল না।
নীরবতার মধ্যে পাঁচ সেকেন্ড পার হয়ে গেল।
জোয়ান উর ডান হাতের অর্জনিটা একটু নড়ে উঠল এবং চেপে বসল হাতলের অদৃশ্য প্রায় একটা কালো সুইচে। সঙ্গে সঙ্গে মোটা ধরনের সুচের মতো একটা বুলেট ফা জি ঝাও-এর ডান কানের মাঝ বরাবর ফুটো করে বেরিয়ে গেল।
চিৎকার করে উঠে ডান হাত দিয়ে কান চেপে ধরল ফা জি ঝাও।
স্যরি মিস ঝাও, কিছুক্ষণ তীব্র যন্ত্রণা হবে, তারপর ঠিক হয়ে যাবে। বুলেটটির মাথায় যন্ত্রণাদায়ক কেমিকেল লাগানো ছিল। বলল জোয়ান উ।
একটু থেমেই আবার বলল জোয়ান উ, আপনি না বললেও আমরা জানি, আপনি দুই ধরনের ম্যাগনেটিক অস্ত্র আবিষ্কার করেছেন। একটি হলো সংকোচনের মাধ্যমে পারমাণবিকসহ সকল অস্ত্রকে অকেজো করে দেয়া, অন্যটা বিভাজনের মাধ্যমে সব অস্ত্রকে অস্তিত্বহীন করে ফেলা। তাই তো ম্যাডাম? প্রশ্ন করলাম বটে, কিন্তু এরও উত্তর চাই না, নিশ্চিতকরণও নয়।
কথায় আবার একটু বিরতি দিল। বলল কিছু সময় নিয়ে, মিস ঝাও, অস্ত্র ও ফর্মূলা দুটি করে তৈরি করেছিলেন। তার একটি করে কপি। অফিসিয়াল ব্যবহারে লেগেছে। অস্ত্রও তৈরি হয়ে গেছে। দ্বিতীয় কপি দুটি আপনার কাছে রেখেছেন। সেটা কোথায়? প্রশ্ন করল জোয়ান উ।
ফা জি ঝাও চোখ তুলে তাকাল মুখোশধারীর দিকে। বলল, সেটা তাপনার জানার বিষয় নয়।
সেটা আমাকে জানতে হবে। কারণ, ওটা আমি চাই। জোয়ান উ বলল।
ওটা চীনা জনগণ ও চীন সরকারের সম্পদ, ওটা কোনো ব্যক্তি কিংবা গ্রুপ চাইতে পারে না। ফা জি ঝাও বলল।
হ্যাঁ, ওটা চীনা জনগণের অবশ্যই। কিন্তু আজকের চীনা সরকারের নয়। আর মুসলমানদের কাছে তো ওটা থাকতেই পারে না। হুই, উইঘুর, সালার, ডং জিয়াংগ এসব কোনো গ্রুপের মুসলমানকেই আমরা চীনের নাগরিক বলে মানি না। চীনা জনগণের পক্ষে আমরাই ঐ ফর্মুলার দাবিদার। আমরা এ ফর্মূলা অবিলম্বে চাই। বলল জোয়ান উ।
চাইতে পারেন, আমি দিতে পারবো না। বলল ফা জি ঝাও।
জতাহলে আমাদের সহযোগিতা করছেন না আপনি? অসহযোগিতার অর্থ আমাদের কাছে কি- তা ঘোষণায় বলা হয়েছে। জোয়ান উ বলল।
স্যরি, সহযোগিতার অর্থ যদি হয় ফর্মূলা টি আপনাদের দিয়ে দেয়া, তাহলে সহযোগিতা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ফা জি ঝাও এর কথা শেষ হতেই জোয়ান উ মুখ উপরে তুলে বলল, হুই দাই।
জোয়ান উর পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার নাম হুই দাই। জোয়ান উ এর গোপন জোয়ান উ উডাং বাহিনীর চীফ কমান্ডার।
জোয়ান উর কণ্ঠে তার নাম উচ্চারণ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে ঘুরে দাঁড়াল মা ঝু’র দিকে। তার হ্যান্ড মেশিনগানটি বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে তুলে নিয়েছে রিভলবার। গুলি করল সে মা ঝুকে।
মা ঝুঁকে ফা জি ঝাও-এর ঘরে আনা হয়েছিল। দাঁড়িয়েছিল সে ঘরের এক পাশে।
হুই দাই-এর গুলি গিয়ে আঘাত করল মা ঝু’র বাম ঘাড়ে।
আর্তনাদ করে ঘাড় চেপে ধরে বসে পড়ল মা ঝু সুলতান।
মা ঝুকে আজ মারা হলো না। আমরা কি করব তার একটা নমুনা দেখালাম। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম ফা জি ঝাও আপনাকে। কাল এই সময়ে আসব। ফর্মুলা পাওয়ার সব ব্যবস্থা কাল না হলে মা ঝুঁকে হত্যা করা হবে। তারপর বীভৎস ঘটনা ঘটবে এই সেলে। ফা জি ঝাওকে আমরা বাঁচিয়ে রাখব, কিন্তু বেঁচে থাকার অর্থ হারাবেন তিনি। বলল জোয়ান উ।
মা ঝুঁকে গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই ফা জি ঝাও ছুটে গিয়েছিল মা ঝু’র। কাছে। গায়ের চাদরের একাংশ ছিঁড়ে নিয়ে আহত জায়গাটা চেপে ধরেছিল।
এসব কোনো কিছুর দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে জোয়ান উ তাকাল হুই দাই-এর দিকে।
মাই লর্ড ড. ডাকে নিয়ে আসব এখানে?
এখানেই নিয়ে এস। সবকিছু এখানেই হয়ে যাক। ডক্টর ডাকে নিয়ে এলো তার সেল থেকে।
ড. ডার মুখ গম্ভীর ও বেদনার্ত। ওপাশের সেল থেকে তারা সবকিছু শুনেছে এবং দেখেছে।
ড. ডার জন্যে বাচ্চারা বসার মতো একটা চেয়ার আনা হয়েছে। বসল ড. ডা।
ড. ডা, আমার হাতে সময় বেশি নেই। আপনার মতো বয়স্ক ও সর্বজনমান্য লোকের সাথে কোনো রক্তারক্তিও আমি চাই না। আপনিও নিশ্চয় ঘোষণা শুনেছেন।
বলে মুহূর্তকাল থামল জোয়ান উ। শুরু করল আবার, আরেকটা কথা মি. ডা, আমার কাজের স্টাইল একটু আলাদা। আমি কোথাও আপনাকে সরিয়ে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু আমি চাই, সবার সামনে আপনার সাথে কথা হোক। কেউ শুনলে জানলে আমার কোনো ক্ষতি নেই। কারণ, আমার জেলখানায় যারা আসে, তারা আর বের হয় না, দুনিয়ার আলো বাতাস আর দেখতে পায় না। আপনারও কথা বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়। সত্য কথা বলবেন, কোনো সমস্যা হবে না। আমরা যা জানতে চাই, তা না পেলে কি হয় তার কিঞ্চিৎ নমুনা আপনি ফা জি ঝাও-এর ক্ষেত্রে দেখেছেন।
বলে আবার একটু থামল জোয়ান উ। শুরু করল আবার সে, ড. ডা জানেন আপনার একটা ফাইল চুরি গেছে। এ ফাইলে আছে বেইজিং-এর ফরবিডেন সিটি খননকাল সময়ের আপনার নোট এবং সরকারের কাছে আপনার ফাইন্ডিংস-এর যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তার পূর্ণাঙ্গ কপি। কিন্তু তার, সাথে নেই রিপোর্টের ব্যাখ্যামূলক পরিশিষ্ট। থাকলে এই কষ্ট আপনাকে দিতাম না।
থেমে গেল জোয়ান উ। তাকাল হুই দাই-এর দিকে। বলল, তুমি মা ঝুকে নিয়ে তার আহত বাহুসন্ধি ড্রেসিং করে নিয়ে এস। মা ঝু এবং ইরকিন ওয়াংকে নিয়ে আমার আলোচনা আছে।
কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াল আবার জোয়ান উ। বলল, ড. ডা, পরিশিষ্টটা আমাদের দরকার। কীভাবে পেতে পারি ডক্টর?
কি জন্যে? কুবলাই খানের গুপ্ত ধন উদ্ধারের জন্যে? বলল ড. ডা।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন ড. ডা। আমরা সাত রাজার ধন নয়, সাত সম্রাটের ধন উদ্ধার করতে চাই। আমি শুনেছি কুবলাই খানের সমতুল্য ধনভাণ্ডার দুনিয়ায় আর ছিল না, এখনও নেই। খননের সময় ধনভাণ্ডারের সংকেত আপনি খুঁজে খুঁজে বের করেছেন এবং ধাঁধা ও সংকেতের ব্যাখ্যামূলক পরি শিষ্ট আপনি তৈরি করেছেন। তার এক কপি সরকারকে দিয়েছেন, আর এক কপি আপনার কাছে আছে। কিন্তু তা ফাইলে ছিল না।
হ্যাঁ, আপনি ঠিক শুনেছেন, পরিশিষ্ট আমি তৈরি করেছি এবং সরকারকে দিয়েছি। কিন্তু তাতে ধাঁধার সমাধান নেই, সংকেতের কোনো অর্থও করা হয়নি। কারণ আমি নিজেই জানি না। বলল ড. ডা।
মিথ্যা বলছেন ডক্টর। আপনি না জানলে সেটা আর কে জানবে? আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না। জোয়ান উ বলল।
হাসল ড. ডা। বলল, আপনি বিশ্বাস না করলে আমি কি করব। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলছি, আমার মনে হয়েছে ধাঁধাগুলো অনর্থক কিংবা ওগুলোর অর্থ বের করার সাধ্য আমাদের মতো লোকদের নেই। সরকারও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ধাঁধা ও সংকেতগুলো পরীক্ষা করিয়েছেন। কিন্তু তারা বলেছেন ওগুলোর কোনো অর্থ হয় না। তারা আরও বলেছেন, রহস্য সৃষ্টি করা সম্রাটদের এক প্রকারের শখ ছিল। ওগুলো সে রকমেরই একটা। ব্যাপার।
ধন্যবাদ ডক্টর, আপনার কথা বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিছুই করলাম না। আমরা পরিশিষ্টগুলো চাই। জোয়ান উ বলল।
স্যরি। আমি জানি ওগুলো কোনো কাজে আসবে না। আমার কাছে খুব মূল্যবানও নয়। কিন্তু সরকারের ডকুমেন্ট। সরকারের অনুমতি ছাড়া এগুলো কাউকে আমি দিতে পারি না। বলল ড. ডা।
আমি জানি না, সেগুলো কোনো কাজে আসবে কিনা। তবু আমরা সেটা চাই। ওটা হলেই আমাদের ফাইলটা পূর্ণ হয়। ড. ডা আমি নিশ্চিত, আপনারা যা পারেননি, সেটা আমরা পারব। পরিশিষ্টটা বলুন আমরা কখন কীভাবে পাচ্ছি। জোয়ান উ বলল।
কিন্তু আমি বলেছি, আমি ওটা দিতে পারবো না। আমি অপারগ। বলল ড. ডা।
দুই চোখ জ্বলে উঠল জোয়ান উর। মুহূর্তেই তার হাতে উঠে এলো একটা সোনালি রিভলবার। কিন্তু পর মুহূর্তেই তা নামিয়ে নিয়ে বলল, আমি আপনাকে আর একটু সময় দিতে চাই। আগামীকাল ফা জি ঝাও-এর বিষয়টা শেষ হওয়ার পর আপনার বিষয়টা দেখবো।
কথা শেষ করেই তাকাল হুই দাই-এর দিকে।
সঙ্গে সঙ্গেই হুই দাই লম্বা একটা বাও করে বলল, মা ঝু এখনি এসে পড়বে মাই লর্ড।।
ইরকিন ওয়াংকে নিয়ে এস। বলল জোয়ান উ।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটল হুই দাই। মা ঝু এবং ইরকিন ওয়াং দুজনকেই নিয়ে আসা হয়েছে।
জোয়ান উর সিংহাসনাকৃতির চেয়ারের সামনে পাশাপাশি দুপায়ের। উপর ভর দিয়ে বসেছে মা ঝু সুলতান ও ইরকিন ওয়াং।
জোয়ান উ তাকাল মা ঝু’র দিকে। বলল, তোমাকে তুলে আনা হয়েছে। কেন বল তো?।
আমি জানি না। মা ঝু বলল।
দুই কারণে, ছাত্র নেতা ও যুবনেতা হয়ে তুমি আকাশে উঠেছ, সেটা তোমার অপরাধ, হুই মুসলিমদের শীর্ষ পরিবারের সন্তান তুমি, সেটাও তোমার অপরাধ। দ্বিতীয়ত, তোমার কাছে কিছু জানার এবং তোমাকে কিছু জানানোর আছে।বলল জোয়ান উ।
জোয়ান উ তাকাল ইরকিন আহমদ ওয়াং-এর দিকে। বলল, আপনাকে নিয়ে আসা হয়েছে কেন বলুন তো?
আপনাকে আমি চিনি না। চিনলে আপনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে পারতাম। এ পর্যন্ত আমি মনে করেছি সরকারি কোনো পক্ষের লোক আপনি। বলল ইরকিন ওয়াং।
আমার পরিচয় জানার দরকার নেই, উদ্দেশ্য আমি জানাতে পারি, বিশেষ করে আপনাদের। কারণ আপনারা পরে জানার জন্যে বেঁচে থাকবেন না। একটু থামল জোয়ান উ।
একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। বলল, চীনের আদি জনগোষ্ঠী হুয়াজিয়াদের ঈশ্বর যিনি, আমি তার চাবুক। আমি এসেছি চীন থেকে অপবিত্রদের বিনাশ করতে। প্রথম বিনাশের তালিকায় হুই ও উইঘুররা। বিনাশের কাজ শুরু করছি। এখানে-সেখানে কিছু ট্রায়াল দিচ্ছি। মা ঝু তোমাদের কানশুর ডান হুয়াং শহরে উইঘুর স্কুলটায় যা ঘটেছে, তা খুবই ছোট ঘটনা, তবে বড় ঘটনার বিগিনিং। উইঘুরদের আটক শিবিরে নেয়া হচ্ছে, উচ্ছেদ করা হচ্ছে, এগুলো ঘটনার আইসবার্গ মাত্র। উইঘুরদের ল্যান্ড দখল শেষ হবার পর আমাদের হাত যাবে হুইদের দিকে। হুই, উইঘুর এ দুয়ের মধ্যে হুইরা বড় শয়তান। তারা চীনের স্থানীয় ভাষা সংস্কৃতি, রাজনীতি গ্রহণ করে ইসলাম ছড়িয়ে দিচ্ছে চীনা হান জনগোষ্ঠীর মধ্যে। তাদের মসজিদ, ইসলামিক স্কুল দ্রুত বাড়ছে। সরকারি চাকরি, সেনা ও পুলিশে তাদের প্রবেশ অবিশ্বাস্যভাবে। বাড়াচ্ছে। উইঘুরদের সাথে গোপন যোগসাজসেই তারা এটা করছে। উইঘুররা বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার ধ্বজা উড়িয়ে মুসলমানদের অধিকার ও দাবির পরিধি বাড়াবার জন্যে অবিরাম চাপ সৃষ্টি করছে। চীন সরকার সেই চাপে মুসলমানদের অধিকার বাড়িয়ে দেবার নামে হুইদের আকাশে তুলছে। আর এর সুযোগ গ্রহণ করছে উইঘুররাও। গোপনে বা ছদ্ম। পরিচয়ে হুইদের পাওয়া অধিকার তারাও ভোগ করছে। হুই ইসলামিক স্কুলের নামে উইঘুরদের ইসলামিক স্কুলের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। হুইদের নামে উইঘুররা চাকরি পাচ্ছে। সুতরাং শয়তানীর দিক দিয়ে হুইরা বেশি বিপজ্জনক। মা ঝু তোমার ভাই হুফেং জেনারেল না? সে তো এখন জিনজিয়াং-এ। উইঘুরদের বিশৃঙ্খলা দমনের জন্যে পাঠান হয়েছে হুই জেনারেলকে। এর রহস্য কি আমরা বুঝি না? যাক মা ঝু, ইরকিন ওয়াং আমার কথা শুনালাম, এখন তোমাদের কথা শুনতে চাই। থামল জোয়ান উ।
সবই তো আপনি বলবেন, এখন আমাদের বলার জায়গা কোথায়? বললে বিশ্বাসই বা করবেন কি করে? বলল ইরকিন ওয়াং। এ আমি এসব কথা শুনতে চাই না। শুনতে চাই আপনাদের নতুন ষড়যন্ত্রের কথা। জোয়ান উ বলল।
কী ষড়যন্ত্র? জিজ্ঞাসা ইরকিন ওয়াং-এর।
আপনারা বাইরে থেকে সন্ত্রাসী, কিলার হায়ার করছেন। অলরেডি সে বা তারা চীনে এসে পৌঁছেছে। ড. ডাকে কিডন্যাপ করার আমাদের প্রথম উদ্যোগ সে বানচাল করে দিতে বিমান হাইজ্যাক ঠেকিয়ে আমাদের চারজন লোককে সে হত্যা করেছে। বিমানবন্দর থেকে ড. ডাকে কিডন্যাপ করার দ্বিতীয় উদ্যোগও সে প্রায় ব্যর্থই করে দিয়েছিল আমাদের চারজনকে হত্যা করে। তার হাতে এ পর্যন্ত আমাদের প্রায় ষাটের বেশি লোক মারা গেছে। সবশেষে হেংশান পাহাড়ে উইঘুরদের বিশাল উদ্বাস্তু বসতিতে আমাদের সুপরিকল্পিত নির্মূল অভিযানকে সে ঠেকিয়েছে। আমাদের অপারেশন টিমের পঁয়ত্রিশজনকেই সে হত্যা করেছে। তাকে আটকাবার, ধরার এ পর্যন্ত চারটি অভিযান, সে ব্যর্থ করে দিয়েছে। তোমাদের কে বা কারা তাকে নিয়ে এসেছ? জোয়ান উ বলল।
আপনার কথা শুনেও বুঝতে পারছি না সে কে? যেসব ঘটনার কথা বললেন, সেগুলোর কিছুই জানি না, একমাত্র বিমান হাইজ্যাক চেষ্টা ও ড. ডার কিডন্যাপের ঘটনা ছাড়া। বলল মা ঝু। ইরকিন ওয়াং মা ঝু’র কথা সমর্থন করল।
তাহলে আপনারা তাকে জানেন না? জোয়ান উ বলল।
না, আমরা চিনি না, জানিও না। বলল মা ঝু ও ইরকিন ওয়াং দুজনেই।
তাহলে আপনারা দুজনসহ ফা জি ঝাও ও ড. ডা এই চারজনের একটা ভিড়িও বক্তব্য নিতে চাই।
বলেই জোয়ান ডাকল, হুই দাই।
স্ক্রিপ্ট রেডি, আনছি মাই লর্ড। বলে ছুটল হুই দাই সেলের বাইরে।
দুমিনিটের মধ্যেই স্ক্রিপ্ট ও ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে এলো হুই দাই।
হুই দাই স্ক্রিপ্টটা ড. ডার হাতে দাও। ওঁর বক্তব্য প্রথম রেকর্ড হবে, তারপর ফা জি ঝাও, ইরকিন ও সবশেষে মা ঝু। জোয়ান উ বলল।
ড. ডা ও ফা জি ঝাও প্রথমেই বসার জন্যে যে চেয়ার পেয়েছিল, সে চেয়ারেই তারা বসে আছে উদ্বেগ-উল্কণ্ঠা নিয়ে। তারা শুনছিল জোয়ান উর সাথে মা ঝু এবং ইরকিন ওয়াং-এর কথাগুলো। ড. ডার মনে চিন্তার। ঝড়। এই সন্ত্রাসী নেতা যে লোকটির কথা বলছে, সে লোকটিই কি তার চেনা সেই মি. আহমদ? সেই কি এদের এত লোক হত্যা করেছে? তাই হবে। বিমান ও বিমানবন্দরেই তো এদের আটজন মারা গিয়েছিল তার। হাতে! তাহলে কি মি, আহমদ এদের পিছু ছাড়েনি? ড. ডাদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছে সে? উদ্ধার পাওয়ার একটা ক্ষীণ আশা জাগল তার মনে। কিন্তু সে তো একা? পারবে কি সে?
স্ক্রিপটি হাতে নিল ড. ডা। চোখ বুলাল স্ক্রিপটার উপর। স্ক্রিপ্টের সারাংশ হলো, আগামীকাল রাত নয়টার মধ্যে মি. আহমদ আত্মসমর্পণ না করলে বা সরকার তাকে আলটিমেটাম প্রদানকারীদের হাতে তুলে না দিলে আহমদ ইয়াং, ড. ডা, মা ঝু, ফা জি ঝাও, চাও জিয়াং এবং ইরকিন। ওয়াংসহ সকল বন্দিকে হত্যা করা হবে।
ড. ডা তার মনে বড় এক ধাক্কা খেল। নিজের মুক্তির বিনিময়ে সে লোকটিকে এদের হাতে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করবে? এই কথা সে তার মুখ দিয়ে বলবে কি করে? হঠাৎ তার মনে হলো, ড. ডারা মি. আহমদের কেউ নয়, এমন লোকদের বাঁচানোর জন্যে সে আত্মসমর্পণ করতে পারে না, এই যুক্তি দিয়ে ঐ বক্তব্য প্রচার থেকে রেহাই পেতে পারে কিনা!
এই চিন্তা করেই ড. ডা বলল, আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যে লোকটি আপনাদের কাছে আত্মসমর্পণ না করলে আপনি আমাদের মতো বন্দি সবাইকে হত্যা করবেন, এই কথা আমরা বললেই কি সে আত্মসমর্পণ, করবে? সে আমার রক্তের কেউ নয়। কোনো প্রকার আত্মীয়-স্বজনই সে নয়, এমনকি আমরা যারা বন্দি আছি তাদের মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া কাউকে তিনি চিনেন না, জানেন না, এমনকি দেখেননি পর্যন্ত।
ড. ডা আপনি তাকে চিনেন না। এ পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি, জেনেছি, প্রত্যেক বিপদগ্রস্ত মানুষই তার স্বজন। এই তো কদিন আগের ঘটনা। প্রেসিডেন্টের ভাগ্নীকে আমরা এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্য দিয়ে কিডন্যাপ করেছিলাম। মি. আহমদ লোকটি আমাদের সব লোক হত্যা করে তাকে উদ্ধার করে। পুলিশের গাড়ি, পুলিশের ছদ্মবেশ নিয়ে আবার তাকে আমরা কিডন্যাপের চেষ্টা করি, লোকটি পুলিশবেশী আমাদের সব লোককে হত্যা করে কিডন্যাপ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। সে একা ছিল, যেকোনোভাবে তার জীবন যেতে পারতো। কিন্তু জীবনের তোয়াক্কা সে করেনি। সুতরাং আপনাদের সাতজনের হত্যার কথা শুনলে সে পাগলের মতো ছুটে আসবে আত্মসমর্পণের জন্যে। আমরা জানতে পেরেছি, ইতিমধ্যেই এদিকে সে এসেছে আপনাদের উদ্ধারের উদ্দেশ্য নিয়ে। আহমদ ইয়াং এখানে থাকলে আরও ভালো হতো। কারণ সে তার ছোট ভাইয়ের মতো। বলল জোয়ান উ।
কোন্ আহমদ ইয়াং? ইরকিন ওয়াং বলল।
কেন উরুমুচির আহমদ ইয়াং, জিনজিয়াং-এর সাবেক গভর্নরের জামাতা। জোয়ান উ বলল।
সে আপনাদের হাতে বন্দি এখনও? আমরা আশঙ্কা করছিলাম সে মারা গেছে। ইরকিন ওয়াং বলল।
সে মারা যাবে, এখনও যায়নি। সে আমাদের একজন ভিআইপি বন্দি। তাকে টোপ বানিয়ে তার শশুরকে আমরা ধরব। সে জিনজিয়াং ও মুসলমানদের স্বাধীনতা চেষ্টার একজন ছদ্মবেশী গুরু। বাইরে তার একটা পরিচিতিও আছে। তাকে আমরা হাতে পেতে চাই। বলল জোয়ান উ।
বলেই উঠে দাঁড়াল জোয়ান উ। বলল, হুই দাই তুমি রেকর্ডগুলো করে নিয়ে তাড়াতাড়ি ওখানে এস। জরুরি কিছু কাজ আছে।
কথা শেষ করেই জোয়ান উ পা বাড়াল যাওয়ার জন্যে। কিন্তু পা। বাড়িয়েই আবার থমকে গেল। বলল, কেউ ভিডিও বক্তব্য দিতে গড়িমসি করলে সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করে মাথা গুঁড়িয়ে দেবে হুই দাই, কোনো কথা, কোনো চিল্কারেরও যেন সুযোগ না পায়।
চলতে শুরু করল জোয়ান উ।
খাস ইউরোপিয়ান চেহারা, ইউরোপিয়ান ট্যুরিস্টের পোশাকে আহমদ, মুসা এসে নামল উডাং রেলওয়ে স্টেশনে।
উডাং রেলওয়ে স্টেশন উডাং-এর যোগাযোগ গ্রন্থি।
উডাং পর্বতের পাদদেশ দিয়ে চলে যাওয়া, শিয়ান-জিয়াং-ফ্যান, রেলওয়ে, চীনের ২০৯ নাম্বার হাইওয়ে এবং উডাং পর্বতের ভেতরে ঢোকার প্রধান সড়ক ও মিনি রেলপথ সম্মিলিতভাবে উডাং রেলওয়ে স্টেশনকে ক্রস করেছে।
আহমদ মুসার পিঠে একটা ব্যাগ, হাতে আজকের পিপলস ডেইলি পত্রিকা।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকতেই ভাড়া গাড়ির ড্রাইভারের ইউনিফরম পরা একজন সুগঠিত শরীরের যুবক অন্যদের মতোই ছুটে এলো। বলল, স্যার, আমার গাড়ি বড় এবং নতুন। পাহাড়ের জন্যে খুবই ভালো।
কথাটা শুনেই আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল, তাকে যে ব্রিফ করেছে। চীনের গোয়েন্দা প্রধান ভাই ডিং জিয়াং যাদের ব্যাপারে তার মধ্যে উডাং পাহাড়ে ভাড়ায় গাড়ি চালানো গোয়েন্দা কর্মীরাও রয়েছে। প্যাসেঞ্জারকে ডাকার তাদের কোড কল হলো, স্যার আমার গাড়ি বড় ও নতুন, পাহাড়ের জন্যে খুবই ভালো। এই কল তারা সবাইকে দেয় না। যার ব্যাপারে তাদের ব্রীফ করা হয়, তাকেই মাত্র এই কল দেয়।
এই চিন্তা তার মনে আসার সাথে সাথে সে তাকাল যুবকটির শার্টের কলার ব্যান্ডের দিকে। সব গোয়েন্দারই গলার দুপাশে কলার ব্যান্ডের বাইরের অংশে কৌণিক শেষ প্রান্তটায় ক্ষুদ্র লাল কাপড় জড়ানো থাকবে এবং সেটা শার্ট তৈরি করার সময়ই সেলাই করা, বাড়তি কোনো জিনিস নয়।
যুবকটির কলার ব্যান্ডে সেই লাল প্রতীক চিহ্নটি আহমদ মুসা দেখল না। মুহূর্তের জন্যে ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। তাহলে শত্রুরা তার আসা টের পেয়ে গেছে এবং এও জেনে গেছে যে, পরিবহন ক্ষেত্রের গোয়েন্দারা আমাকে রিসিভ করবে। আর আমাকে সে ঠিক ঠিক আইডেন্টিফাই করেছে।
মুহূর্তেই আহমদ মুসা তার করণীয় ঠিক করে নিল। এই যুবকটির গাড়ি নেয়াই সে ঠিক করল। যেহেতু আমাকে আইডেন্টিফাই করেছে, তখন এর গাড়ি না নিলেও সে তাকে ফলো করবে। এর চেয়ে ভালো তার গাড়িই নিয়ে নেয়া। দেখা যাক ঘটনা কোনদিকে গড়ায়।
আরো যারা এসেছে যাত্রী নিতে এবং তাকেও আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, তাদের সকলের দিকে তাকাচ্ছিল আর এসব চিন্তা করছিল আহমদ মুসা।
তাদের সবার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা তাকাল যুবকটির দিকে। বলল, তুমিই আমাকে প্রথম বলেছ, অতএব তোমারই অগ্রাধিকার। চল। তোমার গাড়ি কোথায়?
যুবকটি খুশি হয়ে বলল, চলুন স্যার সামনেই আমার গাড়ি। যুবকটির মুখে বিজয়ের আনন্দ, কিন্তু তার মধ্যেও একটা কালো দাগ রয়েছে।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠল।
ল্যান্ড ক্রুজার ধরনের বড় জীপ।
ড্রাইভারও উঠে বসেছে। বলল, কোথায় যাব স্যার?
উডাং রেসিডেন্সিয়াল এলাকায় ভালো হোটেল তো আছে। কোন্ হোটেল ভালো বল তো? বলল আহমদ মুসা।
অনেক ভালো হোটেল আছে স্যার। ইন্টারন্যাশনাল চেইনের কয়েকটা হোটেল সম্প্রতি হয়েছে। আবার চীনা ভালো হোটেলও আছে। বলল ড্রাইভার।
চীনা হোটেল কোটা ভালো? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
অনেক ভালো হোটেল আছে স্যার। তার একটা উডাং রেসিডেন্সিয়াল এলাকার ও-প্রান্তে একেবারে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। নিরিবিলি হোটেল খুব ভালো। পর্যটকও ওখানে যায় বেশি।
নাম কি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হোটেল গংসুন। বলল ড্রাইভার।
হোটেলের নাম শুনে আবার ভ্রু কুচকে গেল আহমদ মুসার। চীনের ইয়েলো সম্রাটের অন্য আরেক নাম গংসুন (Gongsun)। হানদের পূর্বসূরি হুয়াজিয়া জাতির সম্রাট সে। হোটেলটা এ নাম নিল কেন? তাহলে কি এদের জোয়ান উর সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে যোগসাজশ আছে? খুশিই হলো আহমদ মুসা। বলল, হ্যাঁ ড্রাইভার, ঐ হোটেলেই চল।
চলতে শুরু করল গাড়ি।
গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা বিশ্রামের জন্য।
সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের বেগে তার মাথায় এলো একটা চিন্তা। সন্ত্রাসী বাহিনীটির পরিকল্পনা কী? তারা ড্রাইভার কেন পাঠিয়েছে? আমার লোকেশনটা জানার জন্যে? হ্যাঁ, এটাই হবে। লোকেশন জানার পর তাদের কাজ শুরু হবে। নিশ্চয় প্রথমেই তারা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ অথবা মেরে ফেলার চেষ্টা করবে। স্যুট অন সাইট-এ নির্দেশ তো তাদের উপর আছেই। সুতরাং আহমদ মুসাকে সাবধান হতে হবে। হোটেলে বসে এ নিয়ে ভাবা যাবে।
এখনকার মতো এই চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা সিটে আবার গা এলিয়ে দিল।
স্যার, রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ায় এখন বেশ জ্যাম। আমি একটু ঘুরা পথে যেতে চাই। তাতে আমরা বেশ আগে পৌঁছতে পারব হোটেলে। আর এ পথে প্রাকৃতিক দৃশ্যও আপনার ভালো লাগবে স্যার। বলল ড্রাইভার।
ঠিক আছে ড্রাইভার। বলে আহমদ মুসা আর একটু নড়ে-চড়ে বসল।
পাহাড়ের পথে চলছে গাড়ি। দুপাশে ঝোঁপঝাড়, ছোট-বড় টিলা। পথ একটু উঁচু-নিচু, কিন্তু পথটা ভালো। গাড়ি বেশ বেগে যেতে পারছে।
হঠাৎ একটা শব্দ হলো, তারপরই টায়ারের বিস্ফোরণ। অল্প কিছুটা এঁকেবেঁকে গিয়ে থেমে গেল গাড়ি। গাড়ির একটা পাশ একটা বেশ উঁচু টিলার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেছে।
চমকে উঠে সোজা হয়ে বসেছে আহমদ মুসা।
প্রথম শব্দটা যে সাইলেন্সার লাগানো কোনো রিভলবারের তা বুঝতে আহমদ মুসার মুহূর্ত দেরি হয়নি। জ্যাকেটের পকেটে মেশিন রিভলবারে হাত দিয়েছিল আহমদ মুসা।
চারদিকে সে তাকাল। রাস্তা ছাড়া সবটাই ঝোঁপঝাড়ে ঘেরা। টিলার দিকের প্রান্ত দিয়ে গাড়ি থেকে দরজা খুলে বেরোনো সম্ভব নয়, ঢোকাও সম্ভব নয়। বিপরীত প্রান্তের দিকে এগোলো আহমদ মুসা। দেখতে পেল জনা পাঁচেক লোর্ক ছুটে আসছে গাড়ির এ-প্রান্তের দিকে।
আহমদ মুসা ওদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যে পেছনে সরে আসতে গিয়ে পেছনে তাকাল। দেখতে পেল সিটের উপর কাত হয়ে পড়ে থাকা ড্রাইভার উঠে বসেছে। তার হাতে রিভলবার। উঠে এসেছে আহমদ মুসার লক্ষ্যে। আঙুল তার ট্রিগারের উপর উঠেছে।
আহমদ মুসার ডান হাত তার মেশিন রিভলবারের বাট ধরেই ছিল। চোখের পলকে তা বেরিয়ে এলো, গুলি করল ড্রাইভারকে। গুলিটা। ড্রাইভারের রিভলবার ধরা হাত ছুঁয়ে তার বুকে গিয়ে বিদ্ধ হলো।
গুলি করেই আহমদ মুসা ফিরতে যাচ্ছিল। কিন্তু পেছন থেকে তখন। গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। ওরা গাড়ি থেকে বেশ একটু দূরে।
ফিরতে পারল না আহমদ মুসা। একটি গুলি এসে আঘাত করল তার কাঁধে। সে ছিটকে সরে গেল পেছনের বন্ধ দরজার দিকে। দরজা খোলা যাবে না। জানালা খোলাই ছিল। আহমদ মুসা দ্রুত জানালা দিয়ে বেরিয়ে ওপারের টিলায় গিয়ে পড়ল। সে নিজেকে একটু সামলে নিয়েই হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত এগোলো গাড়ির পেছন দিকে। ওদেরকে গাড়ির বাইরেই পেতে হবে। আহমদ মুসা গাড়িতে নেই দেখলেই ওরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এক সাথে ওদের পাওয়া কঠিন হবে।
আহমদ মুসা গাড়ির পেছনে পৌঁছেই ওপাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল গাড়ির জানালার বাইরে ওদের জটলা। টের পেয়ে গেছে ওরা, আহমদ মুসা গাড়ির সিটে নেই। কেউ ভেতরটা ভালো করে দেখছে, তাকাচ্ছে কেউ গাড়িটির দুই পাশের দিকে। একজুন বলল ওদিকের জানালা দিয়ে সে পালাল নাকি?
গাড়ির ভেতরটা যে দেখছিল, সে বেরিয়ে এলো ও চিৎকার করে বলল, তোমরা চারদিকে দেখ, সে যেন পালাতে না পারে।
আহমদ মুসার তর্জনি মোশন রিভলবারের ট্রিগারে। সে ঝট করে উঠে। দাঁড়িয়ে বলল, সবাই অস্ত্র ফেলে দাও, না হলে সবাই মারা পড়বে।
সবাই ওরা দেখে ফেলেছিল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসার কথা। ওদের কানে গেল বলে মনে হলো না। ওদের পাঁচটি রিভলবারই বেপরোয়া গতিতে ছুটে এলো আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগার চেপে ধরল। গুলির ঝাঁক বেরিয়ে গেল ওদের দিকে।
ওরা পাঁচজনই মারা পড়ল।
আহমদ মুসা এলো তাদের কাছে। ওদের কয়েকজনের শার্টের কলার ব্যান্ড উল্টিয়ে দেখল। সবার কলার ব্যান্ডে প্রাচীন ও মৃত হানজু বর্ণমালার সেই আদ্যাক্ষর।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। চারদিকে তাকাল। ঝোঁপঝাড়, ছোট-বড় টিলা চতুর্দিকে। একটু দূরে উঁচু উঁচু শৃংগও দেখতে পেল। ঝোঁপঝাড়, টিলার আড়ালে বাড়িঘরও নিশ্চয় আছে, দেখতে পাচ্ছে না।
আহমদ মুসা নিজের আহত কাঁধের দিকে তাকাল। গুলি বেরিয়েও। যেতে পারে, কিন্তু ক্ষতটা গম্ভীর হয়েছে। বেশ ব্লিডিং হচ্ছে।
গুলির অনেকগুলো শব্দ হয়েছে। পুলিশ শীঘ্রই এসে পড়বে। তার আগেই তাকে এখান থেকে সরে পড়তে হবে।
আহমদ মুসা মেশিন রিভলবার পকেটে রেখে ডান হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে রাস্তা বাদ দিয়ে যে দিকে ঝোঁপঝাড় ও টিলা বেশি সেদিকে এগোতে লাগল। তার ইচ্ছা ভালোমত একটা আড়ালে বসে কাঁধের ব্যন্ডেজটা কোনো রকমে সেরে নেবে যাতে রক্ত বন্ধ হয়।
কয়েক গজ এগোতেই ডান দিক থেকে শব্দ পেয়ে চমকে উঠে ফিরে। তাকাল। দেখল, এক বৃদ্ধা ও একজন তরুণ একটা টিলার মাথা থেকে নেমে আসছে।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে গেল।
বৃদ্ধার বয়স নব্বই-এর বেশি হতে পারে। মুখের চামড়ায় তার বয়সের গভীর বলিরেখা। কিন্তু বয়স যতটা, তার বয়সের ভার শরীরে ততটা নেই। বেশ শক্ত সমর্থ। বেশ স্বচ্ছন্দে সে টিলা থেকে নেমে আসছে।
তারা এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে।
বৃদ্ধার সন্ধানী দৃষ্টি আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, তুমি তো পর্যটক দেখছি বাছা। আর গাড়িটা ভাড়ার ট্যাক্সি। তুমি এখন কোথায় যেতে চাও। মারাত্মক আহত তো তুমি।
কিছুক্ষণ আগে ট্রেন থেকে নেমেছি। যাচ্ছিলাম হোটেলে উঠব বলে। রাস্তার জ্যাম এড়াবার জন্যে ড্রাইভার আমাকে এদিক নিয়ে যাচ্ছিল হোটেল গংসুনে। এর মধ্যে পথেই এ ঘটনা ঘটে গেল। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে তো তোমার উঠবার কোনো জায়গা নেই। এভাবে তুমি হোটেলেও যেতে পারবে না। তুমি কি হাসপাতালে যাবে, হাসপাতালে নেব তোমাকে? বলল বৃদ্ধা মহিলা।
না দাদীমা, হাসপাতালে যাব না আমি। অনেক ঝামেলায় পড়তে হবে। আহমদ মুসা বলল।
আমরা সব দেখেছি টিলায় দাঁড়িয়ে, তোমার তো কোনো দোষ নেই। ও সন্ত্রাসীরাই আক্রমণ করেছিল তোমাকে কিডন্যাপ করা বা মেরে ফেলার জন্যে। ড্রাইভারও সন্ত্রাসীদের লোক বলেই মনে হয়েছে। সুতরাং ওদের মারায় তোমার কোনো দোষ হয়নি। তোমার রিভলবারের নিশ্চয় লাইসেন্স আছে? বলল বৃদ্ধা মহিলা।
হ্যাঁ, আমার রিভলবারের লাইসেন্স আছে দাদীমা। আহমদ মুসা বলল।
তুমি হাসপাতালে যাবে না, তাহলে চিকিৎসা হবে কীভাবে? বলল বৃদ্ধা মহিলা।
একটু আড়ালে গিয়ে জামা খুলে নিজেই ব্যান্ডেজটা কোনো রকমে করব, যাতে রক্ত বন্ধ হয়। তারপর…।
থাক থাক হয়েছে বাছা। আর বলল না। বিদেশে এসেছ বলেই কি পানিতে পড়ে গেছ। চল আমার বাসায়। হোটেলের মতো সুন্দর হবে না বটে, তবে আমরা তো বাস করি। তুমিও একটু কষ্ট করলে। আর আমাদের পরিচিত ডাক্তার আছে, ডাকতেও পারব।
বলেই বৃদ্ধা তরুণটির দিকে তাকিয়ে বলল, এ আমার নাতি মা জিয়াও জিন।
নাম শুনে আহমদ মুসা তার দিকে একবার তাকাল। কিছু বলল না।
একটু থেমেছিল বৃদ্ধা মহিলা। বলল আবার মা জিয়াও-এর দিকে তাকিয়ে, তুমি বাছার পিঠের ব্যাগটা হাতে নাও। আর এক হাত দিয়ে বাছাকে ধরে নিয়ে চল। বেশি দূর তো নয়। আমাদের গাড়ি আছে। সামনেই।
আমাকে ধরতে হবে না দাদীমা। আমি বেশ হাঁটতে পারব। চলুন। বলল আহমদ মুসা।
চলল তারা।
ওদের গাড়িটা ঘোড়ায় টানা। একটু লম্বা ভ্যান ধরনের গাড়ি। তার পেছনের অর্ধেকটা কাভারড। সামনের অংশটা খোলা। এ গাড়িতে মানুষ, মাল সবই বহন করা যায়। গাড়ির কাভারড বা কম্পার্টমেন্ট অংশে ভেতরে বিছানা পাতা। এখানে শুয়ে বসে থাকা যায়।
আহমদ মুসাকে গাড়ির কম্পার্টমেন্ট অংশে বসাল যুক্তির অনেক টাগ অব ওয়ারের পর। বৃদ্ধা মহিলার যুক্তি হলো, রক্তাক্ত অবস্থায় বাইরের লোকেরা আহমদ মুসাকে দেখা ঠিক নয়। মানুষের মনে নানা রকম প্রশ্ন উঠতে পারে, আবার শত্রুরাও দেখে ফেলতে পারে। আহমদ মুসা বুড়ি দাদীমার যুক্তি মেনে নিয়েছে।
বৃদ্ধা মহিলা বসেছে সামনের উন্মুক্ত স্থানে। আর তার নাতি মা জিয়াও বসেছে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে।
চলতে শুরু করল ঘোড়ার গাড়ি।
এসব গাড়ি পাহাড়ের লেন-বাইলেনগুলোতে চলে থাকে। শহরের ও বাইরের প্রধান সড়কগুলোতে এসব গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ।
বৃদ্ধা মহিলার বাড়িতে শুয়ে বসেই কেটে গেল তিন দিন আহমদ মুসার। অধিকাংশ সময়ই আহমদ মুসা বৃদ্ধা মহিলার গল্প শুনে কাটিয়েছে। গল্পগুলো কখনও আহমদ মুসাকে বুকফাটা বেদনা দিয়েছে, কখনও আবার আনন্দিত করেছে।
প্রথম দিনেই আহমদ মুসাকে নামায পড়তে দেখে বৃদ্ধা কেঁদে ফেলেছে। এসে বসেছে আহমদ মুসার পাশে। বলেছে, বাছা তুমি, মুসলমান। আমি খুব খুশি হয়েছি বাছা। অরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিল বৃদ্ধা।
দাদীমা আপনারা কি মুসলমান? আমার সন্দেহ হয়েছিল মা জিয়াও জিন-এর নাম শুনে। চীনে বিশেষ করে হুইদের মধ্যে এ নামের প্রচলন আছে। নামের আগে মা অর্থ মোহাম্মদ। সে অর্থে আপনার নাতির নাম মোহাম্মদ জিয়াও জিন। বলেছিল আহমদ মুসা।
বৃদ্ধা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, আমি যে কি আমি জানি না বাছা। তবে আমার এই নাতি হান বাপ-মায়ের ছেলে, তাই হান বলেই পরিচিত। কিন্তু তার নামের আগে মা বসিয়ে তার নামে মুসলমানের চিহ্ন রেখেছিলাম আমি। তেমনি আমি ছোটবেলা থেকে তাকে শুনিয়েছি, মুসলিম রক্ত তার দেহে আছে! বলেছি, আমারই সন্তান তার বাবা। তার দাদা হান হলেও আমি হুই মুসলিম। মুসলিম এই কারণে যে, আমি হানদের ধর্ম বৌদ্ধ অথবা তাও বা কনফুসীয় কোনোটাই গ্রহণ করিনি। আবার পুরো মুসলমান থাকতেও পারিনি হান পরিবারে এসে। কিন্তু মনের সবটা জুড়েই আমি মুসলমান। আমার নাতি মা জিয়াও আমার মতোই হয়েছে। বাইরে সে হান, কিন্তু ভেতরে সে মুসলমান। তাই না রে মা জিয়াও?
বৃদ্ধার নাতি তার দাদীর পাশেই বসেছিল।
সে বৃদ্ধার প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলল না। তার চোখেও পানি।
তোর চোখে পানি কেন রে? নাতিকে প্রশ্ন করল তার দাদী।
এটা কান্না নয় দাদী, আনন্দ। স্যারকে দেখে প্রথমবার আমার মনে হয়েছে মুসলমান হওয়াও গর্বের হতে পারে। স্যার সেদিন একাই ছয়জন সন্ত্রাসীকে মেরেছেন। মুসলমানদের সাহস, শক্তি অন্যদের চেয়ে বেশি হতে পারে, তারা শুধুই মানুষের মার খায় না, হাত পেতে বেড়ায় না, এটা আমি প্রথম বুঝলাম দাদীমা স্যারকে দেখে। সেই সাথে তোমার স্থান, তোমার কাছ থেকে শোনা শক্তি সাহসের গল্পগুলো আমার কাছে খুব উঁচু হয়ে উঠেছে। সেই আনন্দের অশ্রু আমার চোখে দাদীমা। মা জিয়াও জিন বলল।
কিন্তু দাদীমা আপনি হান ঘরে এলেন কেন, কি করে? বলল আহমদ মুসা।
গম্ভীর হয়ে উঠল দাদীমা। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস নেমে এলো তার বুক থেকে। মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল সে। বলল, সে এক বেদনার কথা বাছা। এই উডাং পর্বতের একটু পশ্চিমে শানসির একটা গ্রামে আমরা দুশ ঘরের মতো মুসলমান বাস করতাম। উডাং পর্বতের এই পশ্চিম ঢালে সমৃদ্ধ। একটা হান বসতি ছিল। এখানে প্রতি বছরই বড় মেলা বসত। আর উডাং পর্বতের গোড়ায় ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। মেলা উপলক্ষে এবং উডাং-এর কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া উপলক্ষে এখানে ব্যাপক যাতায়াত আমাদের দুই পল্লীর মুসলমানদের। আমার বয়স যখন আঠার উনিশ, সেই সময় একটা বড় ঘটনা ঘটল। উডাং থেকে বলা হলো, কোনো মুসলমান পড়াশুনা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, ভ্রমণ কোনো উদ্দেশ্যেই উডাং পর্বত ও সন্নিহিত অঞ্চলে আসতে পারবে না। এই নিষেধাজ্ঞায় সাংঘাতিক বিপদে পড়ে গেল আমাদের অঞ্চল। আমাদের এলাকা থেকে শানসির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়-বাণিজ্যের কেন্দ্র অনেক দূরে। ফলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও উডাং-এ গোপনে ছদ্মনামে মুসলমানদের লেখাপড়া চলতেই থাকল। এই সময় একটা হান মেয়ে পালিয়ে আসে আমাদের হুই পল্লীতে। বেইজিং-এ পড়ার সময় আমাদের এক হুই মুসলিম ছেলের সাথে তার প্রেম হয়। বেইজিংয়েই তাদের বিয়ে হয়। এভাবেই উডাং-এর হান পরিবারের মেয়েটি আমাদের হুই পল্লীতে আসে। আমাদের দুই পল্লীর নেতারা বিষয়টির মীমাংসা ২রার চেষ্টা করে। কিন্তু হানরা কিছুই মানতে রাজি হয়নি। একদিন রাতে শত শত হান সব রকম অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের পল্লীতে। গোটা বসতিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুড়ে মরে বহু মানুষ। যারা আমরা আগুন। থেকে বেরোতে পারি, তারা চারদিকে ঘিরে থাকা হানদের আক্রমণের শিকার হই। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, বয়স্ক নারীদের হত্যা করা হয়। তরুণী যুবতী নারীদের হানরা ধরে আনে। আমাকেও একজন হান যুবক ধরে আনে। সে যুবকই আমাকে বিয়ে করে। এ যুবকই আমার নাতি মা জিয়াও এর দাদা। আমার মতো বহু মুসলিম মেয়েকে উডাং-এর এই হান বসতিতে হানদের ঘর করতে হয়েছে। আমার পরিবারের মতো এখানকার বহু হান পরিবারে মুসলিম রক্ত রয়েছে।
কথা শেষ করে দাদীমা। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস নামে তার বুক থেকে।
তিনদিনের খণ্ড স্মৃতি নিয়ে আহমদ মুসা যখন মশগুল, তখন দাদীমা এসে ড্রয়িং রুমে ঢুকল।
আহমদ মুসা ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো। সোজা হয়ে বসল। আহমদ মুসা।
দাদীমা বসতে যাবে এ সময় দরজায় নক হলো।
বৈঠকখানা ঘরে বসেই আহমদ মুসা বিশ্রাম নিচ্ছিল। নক হলো বৈঠকখানার দরজাতেই।
দাদী না বসে গিয়ে খুলে দিল দরজা।
দরজায় দাঁড়িয়ে এক সুন্দরী তরুণী। চেহারায় হান ভাব মুখ্য, কিন্তু মুখের আদল ও চোখ হানদের নয়।
দাদী তাকে ভেতরে ডাকল।
সোফায় বসিয়ে আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, উনি আমাদের সম্মানিত মেহমান। সালাম দাও।
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সালাম দিল।
আহমদ মুসা সালাম নিয়ে বলল, দাদীমা সালাম দিতে বললেন, একি আপনার আত্মীয় কেউ?
আত্মীয় নয়, কিন্তু আত্মীয় হবে। অল্প দূরেই এদের বাড়ি। আমার নাতির মতোই এর বাবা, মা, দাদা হান, কিন্তু দাদী ছিল হুই মুসলমান। বলল দাদীমা।
তোমার নাম কি বোন? বলল আহমদ মুসা।
ফা জোয়ান জিয়ান। তরুণীটি উত্তর দিল।
আহমদ মুসা দাদীমার দিকে তাকিয়ে বলল, সুন্দর নাম। সব ভালো তো একসঙ্গে করা হয়েছে।
দাদীমা উত্তরে বলেছিল, নামটা সে ওর দাদীর কাছ থেকে পেয়েছে।
বলেই দাদীমা তাকাল ফা জোয়ানের দিকে। বলল, কি বোন কি খবর। নিয়ে এসেছ? তুমি কারণ ছাড়া তো আসই না।
বাবা আপনার কাছে আসতে চান, কখন আসবেন সেটা জানতে চেয়েছেন। আর একটা কথা দাদীমা, মেহমানের নাম কি, কোন দেশের জানতে চেয়েছেন বাবা। বলল ফা জোয়ান।
তাকে আজ বা কাল সন্ধ্যায় আসতে বলো।
একটু থেমেই আবার বলল দাদীমা, তোমার বাবা কীভাবে জানলেন আমাদের বাসায় মেহমান আছেন?
জিয়াও-এর কাছ থেকে শুনেছে। বলল ফা জোয়ান।
হ্যাঁ, দাদীমা ওঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল গতকাল। আমি বলেছি মেহমানের কথা। আমাদের বাড়িতে কোনো আত্মীয় এসেছেন কিনা উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। বলল মা জিয়াও।
ফা জিয়াও কথা বলার সময়ই মা জিয়াও ঘরে ঢোকে।
মা জিয়াও থামতেই ফা জোয়ান বলল, ঠিক আছে দাদীমা বাবাকে জানাবো। তিনি কনফার্ম করলে আমি আপনাকে জানিয়ে দেব।
মা জিয়াও ফা জোয়ানকে ভেতরে নিয়ে যাও। নাস্তা দিতে বল। বোনকে। দাদীমা বলল।
সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল ফা জোয়ান। বলল, এখন নয় দাদীমা। আমি গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি। এখনই যেতে হবে। একটু বাজারে যাব।
একটু থেমেই বলল, আসি দাদীমা, আসি জিয়াও। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, আসি স্যার।
বেরিয়ে গেল ফা জোয়ান।
মা জিয়াও ফা জোয়ানকে এগিয়ে দিয়ে ফিরে এলো।
মা জিয়াও তুমি ফা জোয়ানের বাবাকে আমার সম্পর্কে কি কি বলেছ? বলল আহমদ মুসা মা জিয়াওকে লক্ষ্য করে।
সেদিন যা ঘটেছিল, সেটাই বলেছি স্যার। বলেছি, পর্যটক একা, নতুন। উডাং-এ তার কেউ নেই। তার শুশ্রুসার জন্যে আমরা নিয়ে এসেছিলাম। বলল মা জিয়াও।
আহমদ মুসা মনে মনে হিসাব কষল। গতকাল দেখা হয়েছিল, কিন্তু আজ এ প্রশ্ন করল কেন? এই চিন্তা মনে আসতেই আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল, মা জিয়াও তোমার হবু শ্বশুর কোথায় কি চাকরি করেন?
মা জিয়াও-এর মুখ লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠেছিল। বলল মাথা নিচু করে, আগে তিনি তার পশুপাল দেখা-শুনা করতেন, তার সাথে একটা ব্যবসাও করতেন। কিন্তু দুমাস হলো উনি চাকরি পেয়েছেন। চাকরি পেয়েছেন মানে। চাকরি দিয়েছেন নানিয়ান টেম্পলের গুরু। বলল মা জিয়াও।
ফা জোয়ানের বাবার কাজ কি নানিয়ান টেম্পলে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
কাজ এক জায়গায় নয় স্যার। নানিয়ান প্যালেস-টেম্পল, একটু দূরের ড্রাগন কেভ এবং তার পাশের পারপল টেম্পলে কাজ করতে হয়, যখন যেখানে আদেশ হয়। বলল মা জিয়াও।
কি কাজ করতে হয়? কখন থেকে কখন? আহমদ মুসা বলল।
ওখানে যান খুব ভোরে। বাজার-ঘাটের কাজ করতে হয়। আসেন। দুপুরের পরে। খুব রাখ-ঢাক ওখানকার কাজে। ওখানকার কোনো কথা, এমনকি ওখানে চাকরি করে, এ কথাও বাইরে বলা নিষেধ।
একটু থামল মা জিয়াও। বুলল, আবার, তবে তিনি ওখানে বেশি দিন। চাকরি করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
কেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
সেটা তিনি পরিষ্কারভাবে বলেননি। কথায় কথায় বলেছিলেন, ওরা লোক ভালো নয়। লোকদের ওখানে এনে আটকে রাখে। ড্রাগন কেভে নাকি কারও কাছে এরকম কথা শুনেছেন। বলল মা জিয়াও।
মনে মনে আল্লাহর হাজারো শুকরিয়া আদায় করল। অমূল্য কিছু ইনফরমেশন সে একেবারে মূল্যহীন পথে পেয়ে গেল। সেই সাথে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা চলছে না। যেকোনো মুহূর্তে এখানে আক্রমণ হতে পারে। মা জিয়াও-এর হবু শ্বশুরের খবরের। অপেক্ষা তারা করবে না।
হাতঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল বিকেল সাড়ে চারটা।
বাছা, তুমি এত কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? তোমাকে যেন একটু অস্থির। মনে হচ্ছে? বলল দাদীমা।
দাদীমা এখানে একটা বড় ঘটনার আশঙ্কা করছি। মনে হচ্ছে আপনার বাড়ি, মানে আমি আক্রান্ত হবো। আহমদ মুসা বলল।
কি বলছ তুমি বাছা। কে আক্রমণ করবে, কেন করবে? বলল। দাদীমা। তার চোখে-মুখে বিস্ময়!
সেদিন যারা আক্রমণ করেছিল, তারাই আসছে। আহমদ মুসা বলল।
কেমন করে বলছ? তারা জানবে কেমন করে? তুমি তো বের হওনি। কোথাও? বলল দাদীমা।
জেনেছে দাদীমা, ওরা যেকোনো সময় এসে পড়বে। পরে আপনাকে সব বলব? এখনি আমাকে যেতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
দাদীমার মুখে আশঙ্কা-আতঙ্কের ছায়া। বলল, তুমি এখন কোথায় যাবে?
সেটা পরে ঠিক করব। আহমদ মুসা বলল।
দাদীমা একটু চিন্তা করল। বলল, শোন বাছা, নিচে উডাং-এর মূল আবাসিক এলাকায় একটা টিলার গোড়ায় রাস্তার ধারে আমাদের একটা ছোট বাড়িসহ একটা দোকান আছে। আমার স্বামীর আমলে ওখানে। আমাদের জমজমাট ব্যবসাও ছিল। কিন্তু আমার ছেলে লেখাপড়া শিখে ভালো চাকরিতে ঢুকায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ভাড়া দেয়া হয়নি ওটা। কিছুদিন আগে আমি ধুয়ে-মুছে বাড়ি ও দোকান ঠিক করেছি ভাড়া দেব বলে। কিন্তু আমার নাতি বলছে, তার লেখাপড়া শেষ হয়েছে, এখন সে দাদার মতো ব্যবসা করবে। কিন্তু পুঁজির অভাবে ব্যবসা শুরু করা যায়নি। ফা জোয়ান-এর সাথে বিয়েও বন্ধ আছে এ কারণে। ফা জোয়ানের বাবা চায় মা জিয়াও আগে ব্যবসায়ী হোক, আয়-উপার্জন করতে শিখুক। তুমি ঐ বাড়িতে গিয়ে উঠ বাছা।
একটু থামল দাদীমা। তাকাল মা জিয়াও-এর দিকে। বলল, যাও মা জিয়াও, বাছাকে সেখানে তুলে দিয়ে এস।
না দাদী আমি একাই চিনে নেব। আপনি ঠিকানা দিন। সন্ত্রাসীরা এসে মা জিয়াওকে যদি না দেখে, তাহলে ভাববে নিশ্চয় সে আমাকে পালিয়ে নিয়ে গেছে। আপনার ফ্যামিলি বিপদে পড়বে।
আহমদ মুসা সোফার উপর থেকে ব্যাগ তুলে নিল। সন্ত্রাসীরা এলে বলবেন, আমি সুস্থ হবার পর চলে গেছি। কোথায় যাচ্ছি বলে যাইনি।
বলে আহমদ মুসা মা জিয়াও-এর দিকে ফিরল। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, তুমি খুব ভালো ছেলে।
মা জিয়াও কেঁদে ফেলল। বলল, স্যার, তিন দিনেই আমার অভিভাবক হয়ে গিয়েছিলেন। আমি এক নতুন জীবনও লাভ করেছি। দেখা হবে না স্যার আপনার সাথে আর?
দেখা হবে না কেন, তোমাদের ছোট বাড়িটা তো হবে আমার স্টেশন। তবে আগামী দুই তিনদিন ওখানে তুমি যেও না। সন্ত্রাসীরা তোমাকে ফলো করে আমাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
থেমেই ঘুরল আহমদ মুসা, দাদীর দিকে। পকেট থেকে ডলারের একটা বান্ডিল বের করে দাদীর হাতে দিয়ে বলল, দাদীমা মা জিয়াও-এর বিয়েতে আমার উপহার এবং তার ব্যবসায়ের মূলধন।
একি করছ বাছা। এ টাকা তোমার কাছ থেকে নেব কেমন করে? বলল দাদী।
কেন? ভাবুন যে আপনার এক বড় নাতি এই টাকা দিয়েছে। দিতে পারে না? আহমদ মুসা বলল।
যাওয়ার সময় এভাবে কাঁদিয়ে যাবে তুমি? বড় নাতি হলে তাহলে চলে যাবে কেন? বলল দাদীমা।
চলে যাচ্ছি কই? একটু সরে যাচ্ছি। এই তো তোমাদের আর এক বাড়ির চাবি ও ঠিকানা পেলাম। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে আর এভাবে টাকা দেয়া কেন দরকার? তুমি তো থাকছই। বলল দাদীমা।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না আহমদ মুসা। একটু-গম্ভীর হয়ে উঠল তার। মুখ। বলল, দাদীমা বড় একটা কাজ নিয়ে আমি এসেছি উডাং পর্বতে। এজন্যে নানা কাজে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
শত্রুরা কী তোমার পেছনে এই কারণেই লেগেছে? দাদীমা বলল।
হ্যাঁ, শত্রুরা খুবই পাওয়ারফুল। সরকারকেও ওরা তোয়াক্কা করে না। বলল আহমদ মুসা।
দাদীমার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, তুমি একা। এত বড় শত্রুর বিরুদ্ধে তোমার কি কাজ বাছা?
আপনাকে বলা যায় দাদীমা, ওরা বড় বড় কিছু লোককে অপহরণ করে এনে আটকে রেখেছে। আমি তাদের উদ্ধারে এসেছি।
দাদীমার দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। বলল চাপা কণ্ঠে, সর্বনাশ। এত বড় কাজ তুমি একা কীভাবে করবে। তার উপর তুমি নতুন এখানে। জানও তো না যে তারা কোথায়।
না, দাদীমা। এজন্যেই তো ব্যস্ত থাকতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
আমার নাতি মা জিয়াও উডাং-এর সবকিছু চেনে। সব জায়গায় গিয়েছে। কিছুদিন সে গাইডেরও কাজ করেছে। তুমি তাকে নিতে পার বাছা। বলল দাদীমা।
দাদীমা থামতেই জিয়াও উৎসাহের সাথে বলে উঠল, উডাং-এর টেম্পল প্যালেসের নাড়িনক্ষত্র আমি জানি। আমাকে যা বলবেন সেই কাজ করতে পারব, শুধু গুলি চালনা ছাড়া।
না দাদীমা, এই শত্রুরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। তোমাদের বাড়ির উপর সামান্য সন্দেহ হলে, এ বাড়ির মানুষ তো বটেই, গোটা বাড়িই নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তোমাদেরকে এসবের মধ্যে জড়াব না। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু তুমি তো এই নিষ্ঠুর শত্রুর মুখোমুখি হচ্ছ বাছা! দাদীমা বলল।
আমি একা। এখানে তো আমার বাড়িঘর নেই। আত্মীয়-স্বজন নেই। আমার ওরা কি ক্ষতি করবে। খুব বেশি হলে আমার জীবনটাই তারা নিতে…।
দাদীমা কথা শেষ করতে দিল না আহমদ মুসাকে। হাত দিয়ে আহমদ মুসার মুখ চেপে ধরে বলল, বালাই ষাট, এসব কথা বলতে আছে, বিশেষ করে গুরুজনদের কাছে? তুমি খুব ভালো ছেলে। আল্লাহ তোমাকে আমার চেয়ে বেশি হায়াত দিক।
ঠিক আছে দাদীমা, বললাম না।
বলেই তাকাল মা জিয়াও-এর দিকে। বলল, মা জিয়াও, তুমি নানিয়ান প্যালেস বা মন্দির, পারপল প্যালেস বা মন্দির এবং ড্রাগন কেভে কখনও ঢুকেছ?
স্যার, এ তিনটিসহ এ ধরনের প্যালেস-মন্দিরের দুইটা অংশ থাকে। একটা পাবলিক, অন্য অংশ প্রাইভেট। প্রাইভেট অংশ ধর্মগুরু ও তাদের লোক ছাড়া সকলের জন্যে নিষিদ্ধ। বলল মা জিয়াও।
ড্রাগন কেভটা কত বড়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
অরিজিনাল ড্রাগন কেভ বড় নয়। কিন্তু ড্রাগন কেভ-এর উপর যে স্থাপনা তৈরি হয়েছে, সেটা বিশাল। কেভ-এর মতোই অনেকগুলো ব্যারাকে বিভক্ত কেভের স্থাপনাটি। অরিজিনাল গুহাটি মানুষকে দেখানো হয়, কিন্তু ব্যারাক-কেভগুলো নিষিদ্ধ বাইরের লোকদের জন্যে। বলল মা জিয়াও।
নিষিদ্ধ এলাকা রক্ষার জন্যে ওদের অনেক প্রহরী আছে, তাই না? আহমদ মুসা বলল।
না স্যার, প্রহরী দেখাই যায় না। কিন্তু কেউ নিষিদ্ধ এলাকায় পা বাড়ালেই যমদূতের মতো আবির্ভূত হয় খড়গধারী লোকরা। তাদের সংখ্যা কখনই দেখা যায় না, গোনাও যায় না। বলল মা জিয়াও।
ধন্যবাদ মা জিয়াও, আমি চলি।
তারপর তাকাল দাদীর দিকে। বলল, আসি দাদীমা।
ব্যাগটা পিঠে তুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
রাস্তায় নেমে দ্রুত হাটছে আহমদ মুসা।
এ পথে চলার প্রধান মাধ্যম পায়ে হাঁটা। যানবাহনের মধ্যে একমাত্র ঘোড়ার গাড়িই চলে এ পথে।
দুপাশেই মাঝে মাঝে ঝোঁপঝাড় এবং ছোট বড় টিলা।
পথটা এঁকেবেঁকে নেমে গেছে উপত্যকার উডাং রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ায়।
আহমদ মুসার টার্গেট এই রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া।
আহমদ মুসা সামনে চোখ রেখে হাঁটছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, অল্প দূরে একটা ঝোঁপের পেছনটা নড়ে উঠল। সে দেখতে পেল একজন লোক ঝোঁপটা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে সামনে চলে গেল।
সঙ্গে সঙ্গেই একটা চিন্তা আহমদ মুসার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। লোকটি শত্রুপক্ষের ইনফরমার নিশ্চয়। সে চোখ রাখছিল বাড়িটা এবং রাস্তার উপর। সামনেই কোথাও শত্রুপক্ষের লোকরা ওঁৎ পেতে আছে। আহমদ মুসার খবর তাদেরকে দিয়ে লোকটা পালিয়ে গেল। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে প্রশ্ন জাগলো, লোকটা একদম সামনে থেকে সামনের দিকে পালালো কেন? সামনের দিকে আমার নজর আকৃষ্ট করা এবং সামনে শত্রু আছে এই ধারণা আমার মধ্যে সৃষ্টি করার জন্যে নয়তো?
এই ভাবনার সাথে সাথেই আহমদ মুসা তার ডান হাতটা শোল্ডার হোলস্টারের দিকে চালিয়ে দিয়ে নিজের দেহকে রাস্তার বাম পাশের দিকে ছুঁড়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝাঁক গুলি যেখানে আহমদ মুসা দাঁড়িয়েছিল, তার উপর দিয়ে ঝড়ের মতো চলে গেল।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই গড়িয়ে রাস্তার পাশে একটা পাথরের আড়ালে চলে গেল এবং সেই সঙ্গে মাথা সে যেদিক থেকে গুলি এসেছে সেদিকে মানে পেছন দিকে ঘুরিয়ে নিল। পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দিল পেছন দিকে। দেখল স্টেনগান বাগিয়ে ওরা পাঁচজন ছুটে আসছে এদিকে। তাদের চোখগুলো রাস্তার বাম পাশে খুঁজছে আহমদ মুসাকে। তারা পাথরটা ও পাশের ঝোঁপকে সন্দেহ করেছে। সন্দেহকে সুনির্দিষ্ট করতে পারলেই কিংবা আরও একটু সামনে এসে তাদের কৌণিক অবস্থানের অসুবিধাকে দূর করতে পারলেই তারা আবার আক্রমণে আসবে। ওরা আক্রমণে এলে এই পাথরের আড়ালে বেশিক্ষণ সে টিকে থাকতে পারবে না। অন্যদিকে ঝোঁপ পর্যন্ত যাওয়াও নিরাপদ হবে না। তাকেই আগে আক্রমণে যেতে হবে। আর ওরা যখন ভাবছে আমি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে ব্যস্ত, তখনই আক্রমণের উপযুক্ত সময়।
যে চিন্তা সেই কাজ। ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে স্পিং-এর মতো উঠে দাঁড়ালো আহমদ মুসা। তর্জনি তার ট্রিগারে চেপে বসল। গুলির ঝাঁক বেরিয়ে গেল তার মেশিন রিভলবার থেকে।
আহমদ মুসা এমন বেপরোয়া আক্রমণে আসবে ওরা ভাবতে পারেনি। আহমদ মুসাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও স্টেনগান তুলেছিল। কিন্তু আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার তার আগেই গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। তারা শুয়ে পড়ারও সুযোগ পেল না। পাঁচটি লাশ রাস্তার উপর এক লাইনে ঝরে পড়ল।
ট্রিগারে হাত রেখেই আহমদ মুসা ছুটল ওদের দিকে। ওদের একজনের. জ্যাকেটের কলার ব্যান্ড উল্টিয়ে দেখল সেখানে হানজু বর্ণমালার সেই আদ্যাক্ষর। উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
তাকাল দাদীমার বাড়ির দিকে। বাড়িটা বেশ দূরে, কিন্তু দৃষ্টিসীমার বাইরে নয়। দেখতে পেল, দাদীমা মা জিয়াওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ মুসাকে তাকাতে দেখেই মা জিয়াও হাত তুলেছে। আহমদ মুসা ওদের দিকে একবার হাত নেড়ে ঘুরে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল আবার সামনের দিকে।
রাস্তার একটা বাঁক ঘুরে আরও কিছুটা এগিয়ে সামনে পেছনে একবার তাকিয়ে নিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। যোগাযোগ করল উডাং এর গোয়েন্দা অফিসের সাথে।
ওপার থেকে ফোন ধরেই শুভেচ্ছা জানিয়ে বলল, স্যার, আপনার মোবাইল নাম্বার চিনতে পেরেছি। আমরা আপনাকে আশা করছিলাম। স্যার, আপনার আসার দিন একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। শত্রুরা আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার কর্মীকে কিডন্যাপ করে তার গাড়ি নিয়েই আপনাকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছিল। আমরা…।
গোয়েন্দা অফিসারটির কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, সে গাড়ি তো পেয়েছেন?
শুধু সে গাড়ি পাইনি স্যার, ছয়টি লাশও আমরা পেয়েছি। তার মধ্যে আমাদের লোককে কিডন্যাপকারী ও গাড়ি হাইজ্যাককারী লোকটির লাশও ছিল। আপনাকে ধন্যবাদ স্যার। বলল গোয়েন্দা অফিসারটি ও-প্রান্ত থেকে।
এখন আরও পাঁচটি লাশ আপনারা নিয়ে যান। আহমদ মুসা বলল।
কোথায় স্যার? বলল গোয়েন্দা অফিসারটি।
সেদিন যেখানে, লাশ পেয়েছিলেন, সেখান থেকে আরও পশ্চিমে আরেকটা রাস্তা হাইওয়ের দিকে নেমে গেছে, তার নাম জানি না, সেই রাস্তায় পাবেন। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ স্যার, আমরা মুভ করছি। আরেকটা কথা স্যার। বেইজিং থেকে আমাদের বা কয়েকবার টেলিফোন করেছিলেন। আবার টেলিফোন করলে কি বলব তাকে? বলল গোয়েন্দা অফিসারটি।
আমি আহত হয়েছিলাম। সেরে গেছে। আমি ভালো আছি। আমি অনেক দূর এগিয়েছি। বড় ঘটনার আগে আমি ইনফরম করতে চেষ্টা করবো। এ কথাগুলোই জানাবেন। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ স্যার। সেদিন স্টেশনের ঘটনার জন্যে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলল গোয়েন্দা অফিসারটি।
ঐ ঘটনায় আপনাদের কোনো দোষ নেই। ওরা উডাং-এর এই স্পেসিফিক খবর নিশ্চয় বেইজিং থেকে পেয়েছে। আহমদ মুসা বলল।
অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমি শুনেছি, আপনি খুব বিবেচক ও ভালো মানুষ স্যার।
আপনারা সবাই ভালো মানুষ অফিসার। ধন্যবাদ। এখন রাখছি। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ স্যার। আমরা আপনার কলের অপেক্ষা করব। বলল গোয়েন্দা অফিসারটি।
৫
আহমদ মুসার রিমোট চেঞ্জিং মনিটরে গুলির শব্দ ভেসে এলো। আশেপাশে ঘুরে সবে এসে শুয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। একদিন আগে দাদীমার এ ছোট বাড়িটায় এসে উঠেছে সে।
বাড়িটা ছোট হলেও খুব সুন্দর। দুইটা বেড, একটা লিভিং রুম, একটা স্টোর, দুইটি বাথ ও একটা ছোট্ট লাউঞ্জের মতো চত্বর নিয়ে বাড়িটা। বিছানাপত্র পাতাই ছিল, শুধু ঝেড়ে নিতে হয়েছে। তার কোনই অসুবিধা হচ্ছে না বাড়িতে। মোবাইলে দাদীমাকে সে ধন্যবাদ দিয়েছে। দাদীমা ও মা জিয়াও খুব উদ্বিগ্ন ছিল সেদিন রাস্তার ঘটনার পর থেকে। আহমদ মুসার। ফোন পেয়ে খুব খুশি হয়েছে দাদীমা। বলেছে, আমার ছোট বাড়িটা তোমাকে পেয়ে ধন্য হয়েছে বাছা। দাদী আরও জানিয়েছে, মা জিয়াও নাকি দূর থেকে তাকে দেখে গেছে। আহমদ মুসার নিষেধ সত্ত্বেও দাদীর জেদেই নাকি সে আসে। শুনে আহমদ মুসাও খুব খুশি হয়েছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছে। আত্মীয় না হওয়া সত্ত্বেও এমন আত্মীয় পেয়ে তার দুচোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে। এ সবই আল্লাহর সাহায্য।
মনিটরে গুলির শব্দ পেয়েই আহমদ মুসা উঠে বসল।
উঠে গিয়ে জ্যাকেটটা গায়ে দিল। দেখে নিল মেশিন রিভলবারটা একবার। মনিটর নিয়েই বাইরে বেরিয়ে এলো।
যে টিলার গোড়ায় বা পাশে আহমদ মুসার বাড়িটা, সে টিলার উপর দিকে ইঙ্গিত করছে মনিটারের ইন্ডিকেটর।
উপরের বাড়িটার দিকে তাকাল আহমদ মুসা।
বাড়িটাকে দিনের বেলাতেও দেখেছে আহমদ মুসা। বিরাট বাড়ি। চারদিক থেকে বাগান ঘেরা।
মনিটরে আবার গুলির শব্দ পেল আহমদ মুসা। মনিটর ছাড়া গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হয় বাড়িটা সাউন্ড প্রটেকটেড অথবা গানগুলোতে সাইলেন্সর লাগানো।
মনিটরে একটা মেয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো। পরে একজন ছেলের কণ্ঠও শুনতে পেল। বুঝল, একজন মেয়েকে মেরে ফেলা বা ধরার চেষ্টা করা। হচ্ছে।
আহমদ মুসা দ্রুত টিলায় উঠে গেল।
টিলার নিচ থেকে একটা রাস্তা উঠে গেছে বাড়ির বাইরের গেট পর্যন্ত। বাড়ির চারদিকে বাগানের বাইরে দিয়ে প্রাচীর। বাইরের গেট এই প্রাচীরেই। প্রাচীরের গেট ঠেলা দিতেই খুলে গেল।
আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকে গেট খোলা রেখেই সামনে এগোলো। বাগানের ভেতর দিয়ে লাল পাথরের সুন্দর রাস্তা। রাস্তা গিয়ে উঠেছে। গাড়িবারান্দায়।
গাড়িবারান্দার পরেই বেশ উঁচু একটা বারান্দা। এই বারান্দাতেই ভেতরে ঢোকার প্রধান গেট।
বারান্দার ডান-বাম দুপাশেই তাকাল আহমদ মুসা। দেখল দুপাশেই। বারান্দা সামনে এগিয়ে গেছে। হতে পারে বাড়ির চারদিকে ঘিরেই রয়েছে বারান্দাটা। এ ধরনের বারান্দা থাকলে ভেতরে ঢোকার আরও গেট আছে ধরে নেয়া যায়।
আহমদ মুসা বারান্দায় উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা দরজা স্পর্শ করার জন্যে হাত বাড়াতে যাচ্ছে। পেছন থেকে একটা শব্দ ভেসে এলো, যেন দুই ধাতব বস্তুর ঘর্ষণ। খাপ থেকে ছুরি খোলা। কথাটা ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার মাথায়। চিন্তাটা যত দ্রুত মাথায় এসেছিল, বলা যায় তার চেয়ে দ্রুত আহমদ মুসার দেহটা দেয়ালের পাশে ছিটকে পড়ল। আর তার সাথে সাথেই একটা ভয়ংকর ছুরি, আহমদ মুসা দরজার যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই বরাবর গিয়ে, দরজায় বিদ্ধ হলো। আহমদ মুসা ওখানে থাকলে তার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যেত।
দেহটা মাটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা পাশ ফিরল। তার হাতে রিভলবার। দেখল বারান্দায় একজন লোক। তার হাতে আবার উঠে এসেছে একটা সুইচ দুধারী চাকু।
কিন্তু দ্বিতীয়বার চাকু ছোঁড়ার সুযোগ সে পেল না। আহমদ মুসার রিভলবার আগেই উঠে এসেছে লোকটির লক্ষ্যে। ট্রিগারও সে চেপেছে। সাইলেন্সর লাগানো রিভলবারের নিঃশব্দ গুলিটা বিদ্ধ করেছে লোকটির বুক। লোকটি আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল।
গুলি করেই উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
আবার দাঁড়াল বাড়ির মূল দরজার সামনে।
দরজাটি কোনো ঘরের সাথে না প্যাসেজে, বুঝতে পারল না আহমদ মুসা। তবে ঘরের সাথের দরজা এতটা বড় ও হেভি হয় না। অনেক পুরু কাঠের দরজা।
দরজায় ইন্টারলক সিস্টেম। চাপ দিল আহমদ মুসা দরজায়। দরজা বন্ধ।
ডান হাতের মেশিন রিভলবারটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে রিভলবার তুলে নিল। রিভলবারেও সাইলেন্সর লাগানো রয়েছে।
কী-হোলে রিভলবারের নল সেট করে গুলি করল আহমদ মুসা। রিভলবারের গুলির শব্দ না হলেও লক ভাঙ্গার শব্দ ঠেকাতে পারল না। আহমদ মুসা।
শব্দের সাথেই আহমদ মুসা রিভলবার পকেটে ফেলে মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনি চেপে লাথি দিয়ে দরজা খুলে ফেলল।
পায়ের লাথি এবং ট্রিগারে রাখা তর্জনি একসাথেই কাজ করল। দরজা খুলে গেল।
তার সাথে ভেতরে ছুটে গেল এক পশলা গুলি। ভেতরে রিভলবার বাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুখোশধারী একজন ঝাঁঝরা হয়ে উল্টে পড়ে গেছে প্যাসেজের উপর।
আহমদ মুসা দেখল, প্রশস্ত প্যাসেজের দুই পাশ দিয়ে দেয়াল পনেরো। বিশ ফিট এগিয়ে গেছে।
দরজা খোলা রেখেই আহমদ মুসা ঢুকে গেল ভেতরে।
প্যাসেজের পরেই দেখা যাচ্ছে আলোকিত একটা চতুর। প্যাসেজের ডান দিকের দেয়াল বরাবর সামনে চত্বরের ডানপাশে ঘর দেখা যাচ্ছে। তার মানে চত্বরটা বাম দিকে বিস্তৃত।
আহমদ মুসা প্যাসেজের বাম দেয়াল ঘেঁষে মেশিন রিভলবার বাগিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল।
কি রে তেন জিং, কি হলো? বাইরে কে ছিল?
চত্বরের বাম দিক থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো।
কণ্ঠটি থামতেই আরেকটি কণ্ঠ বলে উঠল, ডেং তুমি দেখ সে বাইরে চলে গেল নাকি। আমরা দুজন দুদিক থেকে ম্যাডামকে সামলাচ্ছি। তুমি যাও।
আহমদ মুসা দ্রুত সামনে এগিয়ে দেয়ালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। তার মেশিন রিভলবারের ব্যারেল চত্বরের দিকে। উদ্যত।
বাম দিকে চত্বর থেকে রিভলবার বাগিয়ে একজন ছুটে এলো।
লোকটি আগেই আহমদ মুসার দৃষ্টিতে পড়ে গেল। লোকটিও আহমদ মুসাকে দেখতে পেল।
আহমদ মুসা ও মেশিন রিভলবারের সামনে পড়ে সে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল মুহূর্তের জন্যে। তার পরেই বেপরোয়া গতিতে তার রিভলবারের নল ঘুরে এলো আহমদ মুসার দিকে।
কিন্তু আহমদ মুসার তর্জনি স্টেনগানের ট্রিগার তখন চেপে বসেছে। বেরিয়ে গেছে গুলির একটা ঝাঁক।
লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ল সেখানেই গুলিতে ঝাঁঝরা দেহ নিয়ে।
আহমদ মুসা দেখল চত্বরের বাম দিকে আরও দুজন সন্ত্রাসী অবশিষ্ট আছে, যারা আটকে রেখেছে দুটি মেয়েকে।
দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে আহমদ মুসা। বাম হাতেও পকেট থেকে তুলে নিয়েছে রিভলবার।
দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসা চত্বরের দৃশ্যটা। লু ঝি এবং চেং ঝিকেও। দেখতে পেয়েছে।
দেয়ালের আড়াল থেকে আহমদ মুসা চত্বরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই লু ঝি’র দিকে স্টেনগান বাগিয়ে থাকা দুজনের এদিকের জন ঝট করে ঘুরিয়ে নিল তার স্টেনগান আহমদ মুসার দিকে।
কিন্তু টার্গেটে উঠতে সময় পেল না লোকটির স্টেনগান। আহমদ মুসার রিভলবারের গুলি গুঁড়িয়ে দিল লোকটির মাথা।
ওদিকে অবশিষ্ট স্টেনগানধারীর স্টেনগান ঘুরে এসেছিল আহমদ মুসার দিকে। লু ঝি এই সুযোগ গ্রহণ করলো। তার হাতের কারবাইন ব্রাশ ফায়ার করল লোকটির উদ্দেশ্যে।
গুলি করে রেজাল্ট না দেখেই পাগলের মতো ছুটে এসে লু ঝি আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার পায়ের উপর। বলল, জানতাম আমার স্যার আসবেন। বাঁধভাঙা কান্নায় ডুবে গেল তার কণ্ঠ।
চেং ঝিও ছুটে এসে দাঁড়িয়েছে আহমদ মুসার সামনে। তার চোখেও। অশ্রুর বন্যা।
দুহাতের রিভলবার জ্যাকেটের পকেটে রেখে আহমদ মুসা দুহাত দিয়ে ধরে লু ঝিকে টেনে তুলল পায়ের উপর থেকে।
উঠে দাঁড়িয়েই আবার বসে পড়ল লু ঝি। অঞরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, শেষ মুহূর্তেই বুঝি আল্লাহ মানুষকে বাঁচান! আমার জীবনের শেষ রাত ছিল আজ।
লু ঝি, পেছনের কথা ভাবতে নেই। উঠ, এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। বলল আহমদ মুসা।
চেং ঝি এগিয়ে এলো।
ম্যাডাম উঠুন। স্যার এসেছেন, বিপদ তো শেষ। বলে চেং ঝি টেনে। তুলল লু ঝিকে।
উঠে দাঁড়াল লু ঝি।
কয়েক খণ্ড টিস্যু এগিয়ে দিল চেং ঝি লু ঝি’র দিকে। লু ঝি চোখ মুছল।
তুমি আমাকে সাহায্য কর লু ঝি। এ বাড়ি সার্চ করলে কি কিছু পাওয়া যাবে?
লু ঝি চোখ মুছে টিস্যু চেং ঝি’র হাতে দিয়ে বলল, স্যরি স্যার।
একটু থামল লু ঝি। তাকাল লু ঝি আহমদ মুসার দিকে। বলল, যে জন্যে সার্চ করার কথা, সে জন্যে সার্চের প্রয়োজন নেই স্যার। এ বাড়ির উপর ও নিচ তলায় আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না।
তাহলে চল আমরা যাই। এ খবর ওদের কাছে ছড়াবার আগে নিরাপদ স্থানে আমাদের যেতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে স্যার আসছি। লু ঝি বলল।
দুতিন মিনিটের মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো লু ঝি ও চেং ঝি।
ইতিমধ্যে আহমদ মুসা বিশাল বপু মহিলাসহ তিন মহিলার পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিয়েছে।
লু ঝি এলে আহমদ মুসা বলল, এ তিনজন মহিলা নিশ্চয় তোমার গুলিতে মরেছে। বড় মেয়েটি কে?
স্যার এই বড় মেয়েটাই ছিল আমাদের কেয়ারটেকার, মালিক। এদের সবার মধ্যে এর পদই সবচেয়ে উঁচু। বলল লু ঝি।
আহমদ মুসা তার মোবাইলটি তার পকেটে রাখল এবং অন্য মোবাইলগুলো লু ঝিকে দিয়ে বলল, তুমি এগুলো পরীক্ষা করো।
আহমদ মুসারা বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।
আহমদ মুসার পেছনেই হাঁটছিল লু ঝি।
স্যার আমরা কোথায় যাব? বলল লু ঝি।
সেটাই ভাবছি। তুমি কি মনে কর তোমার বাড়ি তোমার জন্যে নিরাপদ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
অবশ্যই নয়। বলল লু ঝি। বলতে গিয়ে অবরুদ্ধ আবেগে তার কণ্ঠ ভেঙে পড়ল।
আহমদ মুসা তাকাল তার দিকে। কিছু বলল না।
একটু সময় নিয়ে আহমদ মুসা অনেকটাই স্বগত কণ্ঠে বলল, উডাং এর হোটেলগুলোও নিরাপদ নয়। কারণ এখানে ওদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি।
আহমদ মুসা স্বগত কণ্ঠে বললেও শুনতে পেয়েছে সকলেই।
ঠিক বলেছেন স্যার। এটা যদি উডাং হয়, তাহলে হোটেল-রেস্তোরাঁ, রেস্টহাউস কোনোটাই নিরাপদ নয়। বলল লু ঝি।
চলছে তিনজন।
আহমদ মুসা দাদীমার বাড়ির কথা ভাবল। কিন্তু শত্রুরা এ বাড়ি চিনে ফেলেছে, দেখেছে। সুতরাং ও-বাড়িতে লু ঝিকে রাখা যাবে না।
আহমদ মুসা হাঁটা দ্রুত করল। আহমদ মুসা স্থির করেছে, দাদীমার ছোট বাড়িতেই লু ঝিদের তুলবে।
আহমদ মুসা বাড়িটার সামনে দিয়ে এগোলো যেন বাড়িটা চেনেই না। সামনে দুটি পাহাড় পার হয়ে একটা পায়ে হাঁটা রাস্তায় প্রবেশ করল। সে। পায়ে হাঁটা রাস্তা এঁকেবেঁকে তাদেরকে একটা ছোট পাহাড়ের ঢালে নিয়ে এলো। সেখানে রাস্তার চিহ্ন ছিল না। ঢাল বেয়ে তারা নেমে এলো দাদীমার সেই ছোট বাড়ির কাছে। যে বাড়িটায় থাকে আহমদ মুসা তার পেছনে।
পেছনের একটা গোপন দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। গোপন দরজাটা দেয়াল রঙের, স্টিলের। খুব ভালো করে দেখলে দেয়ালের একটা কী-হোল পাওয়া যায়। ভেতর ও বাহির দুদিক দিয়েই দরজাটা চাবি দিয়ে খোলা যায়। ভেতরের জন্যে বাড়তি হুড়কো আছে। ভেতরে হুড়কো। লাগানো থাকলে বাইরে থেকে চাবি দিয়ে খোলা যায় না।
ড্রয়িং রুমে এসে বসল সবাই। সবাই ক্লান্ত। অনেকখানি পাহাড়ি পথ তারা হেঁটেছে।
রাতের রাস্তা আমি ঠাওর করতে পারিনি স্যার। আমরা কোথায় এলাম? বলল লু ঝি।
তোমরা যে পাহাড়ের টপে বন্দি ছিলে, সেই পাহাড়ের গোড়ায়, দক্ষিণ পাশেই এ বাড়িটা। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু আমরা তো অনেক পথ হেঁটেছি, মনে হয় দেড়-দুই মাইল হবে। বলল লু ঝি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, এক ধাপ দূরে যাওয়ার জন্যে আমরা একশ ধাপ হেঁটেছি। বাড়ির সম্মুখ দরজা দিয়ে আমরা ঢুকিনি। কারো চোখে পড়ার ঝুঁকি এড়াবার জন্যে আমরা অনেক ঘুরে পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছি। আমি দিনে দুএকবার সম্মুখ দরজা ব্যবহার করি, অধিকাংশ সময়ই আমি এই পেছনের পথ দিয়ে আসি।
আপনি এ বাড়িতে থাকেন? বলল লু ঝি।
হ্যাঁ, দিন কয়েক থেকে আছি। আহমদ মুসা বলল।
কার বাড়ি এটা? বলল লু ঝি।
আমার এক পাহাড়ি দাদীমার। আহমদ মুসা বলল।
পাহাড়ে মাপনি দাদী পেলেন কোত্থেকে? বলল লু ঝি।
আহমদ মুসা গোটা কাহিনীটা বলল।
আপনি উডাং-এ এসে প্রথম দিনেই এভাবে আহত হন? কারা ওরা? বলল লু ঝি।
জিবোতে যারা বারবার আক্রমণ করেছে, এরা তারাই। বলল আহমদ মুসা।
এ পর্যন্ত ওরা এসেছে? লু ঝি বলল।
এখানে তো ওরা আছেই। তোমাকে ওরাই তো ধরে নিয়ে এসেছে। মনে হয় উডাং-এ ওদের হেড কোয়ার্টার। বলল আহমদ মুসা।
তাই হবে। না হলে আমাকে ধরে এখানে নিয়ে এসেছে কেন? লু ঝি। বলল।
একটু থেমেই লু ঝি বলল, দাদীমারা এখানে আসেন?
আমি নিষেধ করেছি আসতে, ঐ ক্রুয়েল লোকদের সন্দেহ থেকে পরিবারটাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। আহমদ মুসা বলল।
আপনি জিবেরা থেকে এখানে কেন এলেন? কীভাবে এলেন? জিজ্ঞাসা লু ঝি’র।
সে অনেক কাহিনী, এক মহাকাব্য লিখা যাবে। অবশেষে আমি নিশ্চিত হলাম, তুমিসহ এ পর্যন্ত যারা কিডন্যাপ হয়েছে, তারা সবাই এই উডাং-এ বন্দি আছে। আলহামদুলিল্লাহ, তোমাদের উদ্ধার দিয়ে আমার উদ্ধার কাজ শুরু হলো। আহমদ মুসা বলল।
আমরা ওখানে বন্দি আছি জানলেন কি করে? লু ঝি জিজ্ঞেস করল।
এই ঘর থেকে ডিস্ট্যান্ট সাউন্ড মনিটরের মাধ্যমে আমি গুলি গোলার শব্দ পাই। ছেলে ও মেয়েদের কথা শুনতে পাই। বুঝতে পারি মেয়েদের বন্দি করে রাখা হয়েছে।
কথা শেষ করে আহমদ মুসাই বলল, অনেক রাত হয়েছে। আর কথা নয়। ওদিকে তোমাদের শোবার ঘরটা দেখে ঠিক করে নাও, আমি আমার ঘরে যাচ্ছি।
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তারাও উঠে দাঁড়াল।
.
রাত তখন দুইটা।
আহমদ মুসার ঘুম ভেঙে গেল। তার দরজায় নক হচ্ছে। একটু শুনেই বুঝল, নক করছে চেং ঝি, লু ঝি’র সেক্রেটারি। উঠল আহমদ মুসা। দরজা খুলে দাঁড়াল।
স্যার, আমাদের ঐ পাহাড়ে অনেক লোক এসেছে। আমরা জানালা দিয়ে দেখলাম। কেউ কেউ পাহাড়ের গোড়া পর্যন্ত নেমে এসেছে। পুলিশ এসেছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না। বলল চেং ঝি।
দেখতে পেল আহমদ মুসা লু ঝিও এসে ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝল আহমদ মুসা, এরা ভয় পেয়েছে। বন্দি সময়ের আতঙ্ক এদের। কাটেনি।
চল চেং ঝি ড্রয়িং রুমে বসি। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই লু ঝি বলল, স্যরি স্যার, আপনাকে ঘুম থেকে তোলা হলো। আমাদের ভয় করছে স্যার, তাই…। লু ঝি কথা অসমাপ্ত রেখেই থেমে গেল।
ভয় পাবার কিছু নেই। ওরা সম্ভবত বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে পুলিশের ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্যে। এ বাড়িকে ওরা সন্দেহ করলে শুরুতেই এ বাড়িতে হানা দিত। যখন তা করেনি, তখন আর ভয় নেই। বলল আহমদ, মুসা।
স্যরি স্যার, শুধুই আপনাকে কষ্ট দেয়া হলো। লু ঝি বলল শুকনো কণ্ঠে, মাথা নিচু রেখে।
দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই লু ঝি। আল্লাহর ইচ্ছাতেই এটা হয়েছে। কিছু কথা তোমাদের বলা দরকার। কালকের দিনটা আমার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি ও চেং ঝি দুজনেই তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বলল, রাতে শোবার আগে তোমাদের ঐ বিশাল বপু মহিলার মোবাইল চেক করেছি। আজ রাত নয়টায় তার মোবাইলে এক গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ এসেছে। মেসেজটা আমি পড়ছি শোন–
সব বিবেচনা থেকে আমরা নিশ্চিত, সরকার আহমদ মুসাকে আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। আমাদের অবর্ণনীয় ক্ষতি করেছে সরকার। পাল্টা ব্যবস্থা না নিয়ে আমাদের উপায় নেই। আমাদের হাতে এখন বন্দি আছে ড. ডা, ফা জি ঝাও, মা ঝু সুলতান, চাও জিয়াং, আহমদ ইয়াং ও ইরকিন আহমেদ ওয়াং। আজ রাত নয়টার মধ্যে আহমদ মুসা যদি আমাদের হাতে আত্মসমর্পণ না করে কিংবা সরকার যদি তাকে আমাদের হাতে তুলে না দেয়, তাহলে রাত ৯টায় তাদের সবাইকে হত্যা করা হবে। এই ঘোষণা চূড়ান্ত।
— JUA-এর পক্ষে জোয়ান উ
আহমদ মুসা পড়া শেষ করল।
লু ঝি ও চেং ঝি অপলক চোখে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। চোখে-মুখে তাদের সীমাহীন উদ্বেগ-আতঙ্ক। তাদের মুখে কোনো কথা ঝরছে না, বোবা হয়ে গেছে যেন তারা।
পড়া শেষ করে আহমদ মুসা সোফায় হেলান দিয়ে বসে একটু হাসল। কিছু বলতে যাচ্ছিল।
তার আগেই লু ঝি বলে উঠল আর্ত কণ্ঠে, আপনি হাসছেন স্যার? সর্বোচ্চ পাহাড় হিমালয়ের চেয়েও বড় গুরুভার আপনার মাথায়। অরুদ্ধ কণ্ঠ লু ঝি’র।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
বেজে উঠল আহমদ মুসার অয়্যারলেস। হাতে তুলে নিল অয়্যারলেসটি।
তাকাল স্ক্রিনের দিকে। স্ক্রিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং-এর কল।
অয়্যারলেস মুখের কাছাকাছি নিয়ে বলল, স্যার, আমি আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট আমাদের নিয়ে মিটিং এ বসেছেন। তার নির্দেশেই আপনাকে এই টেলিফোন করছি। আমরা…।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলল, আপনারা জোয়ান। উর কাছ থেকে একটা চরমপত্র পেয়েছেন তো?
আপনি কি করে জানলেন? বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আজ রাতে ওদের কয়েকজন লোক মারা পড়েছে, তাদের নেতার মোবাইলে এই আলটিমেটাম আমি পেয়েছি। বলল আহমদ মুসা।
মি. আহমদ মুসা, এক্সিলেন্সি আপনার সাথে কথা বলবেন। অয়্যারলেস তাকে দিচ্ছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং বলল।
ওপার থেকে প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ পেতেই আহমদ মুসা কথা বলে উঠল, সালাম এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, আমি আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা, আপনাকে এভাবে পেয়ে আমরা খুব খুশি হয়েছি। খুবই উদ্বেগে ছিলাম আপনাকে কোথায় পাওয়া যাবে। অয়্যারলেসটা হয়তো আপনার কাছে সব সময় থাকবে না! শুনলাম আপনিও পড়েছেন আলটিমেটামটি। আচ্ছা এই জোয়ান উ কে?
বিশাল এই সন্ত্রাসী গ্রুপের যে নেতা, সেই এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেছে। চীনা জনগণের লেজেন্ডারি হিরোর নাম গ্রহণ করে চীনা জনগণের মনে জোয়ান উর আসন পেতে যাচ্ছে। বলল আহমদ মুসা।
কি জঘন্য কৌশল! আচ্ছা আহমদ মুসা, JUA-এর পক্ষে জোয়ান উর নাম এসেছে। এই জুয়া কে বা কি? এ নিয়ে আপনি চিন্তা করেছন? প্রেসিডেন্ট বলল।
এক্সিলেন্সি, JUA হলো জোয়ান উ আর্মি। অর্থাৎ কথিত জোয়ান উর সন্ত্রাসী দলের নাম জোয়ান উ আর্মি। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। ওদের বাহিনীর নাম অবশেষে পাওয়া গেল।
প্রেসিডেন্ট মুহূর্তের জন্যে থেমে আবার বলে উঠল, এখন ওদের আল্টিমেটামের ব্যাপারে কি করা যায় বলুন। আমরা বসেছি, কিন্তু আমরা। কোনো ওয়েআউট বের করতে পারিনি।
এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই এক্সিলেন্সি। একটা রিটার্ন মেসেজ ওদের দিয়ে দিন যে, আহমদ মুসা রাত নয়টায় আত্মসমর্পণ করবে। বলল আহমদ মুসা।
কি বলছেন মি. আহমদ মুসা! এটা কি হতে পারে? আর আমরা এটা হতে দিতে পারি?
থামল একটু প্রেসিডেন্ট। আবার বলে উঠল, মি. আহমদ মুসা একটু হোল্ড করুন। আমি একটু কথা বলে নেই।
মিনিট খানেকের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট আবার অয়্যারলেসে ফিরে এলো। বলল, মি. আহমদ মুসা, এখানকার কেউই এটা গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। একজনকে ওদের হাতে তুলে দিয়ে, অন্য কয়েকজনকে আমরা বাঁচাব, একটা রাষ্ট্র এত নিচে নামতে পারে না, বিশেষ করে একটা সন্ত্রাসী দলের কাছে। আমি মনে করি রাষ্ট্রের জন্যে এটাই যুক্তিসংগত।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, আলটিমেটাম ওদের একটা কৌশল। আমাদেরকেও কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
কি কৌশল মি, আহমদ মুসা? প্রেসিডেন্ট বলল।
রাত নয়টা পর্যন্ত ওদের নিশ্চিন্ত রাখা যে আহমদ মুসা আত্মসমর্পণ করছে। ওদের এভাবে গুড হিউমারে রেখে আমাদের লোকদের উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু উদ্ধার যদি না করা যায়, তাহলে? বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট সব হিসাব আগে করা যায় না এবং তা না। করাই ভালো। আহমদ মুসা বলল।
মি. আহমদ মুসা, একটু হোল্ড করুন। বলল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট অয়্যারলেসে ফিরে এলো মিনিট দুয়েক পর। বলল, মি. আহমদ মুসা, কৌশল হিসাবে আপনার প্রস্তাব সবাই গ্রহণ করেছে। আপনার কি করণীয়, আমাদের কি করার আছে, এসব ব্যাপার নিয়ে আপনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. নিকোলাসের সাথে কথা বলুন। ধন্যবাদ আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে কথা বলল।
কথা শেষ করে অয়্যারলেস রাখতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। আবার তার মোবাইল বেজে উঠল।
স্ক্রিনে দেখল লিয়েন হুয়ার টেলিফোন।
মোবাইল ধরতেই লিয়েন হুয়া অঞরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, আপনি নিশ্চয় সব শুনেছেন, জেনেছেন স্যার। এখন কি হবে?
কেঁদো না বোন আল্লাহ আছেন। ইচ্ছা করলেই কেউ কাউকে মারতে পারে না। চিন্তা করো না। আমি রাত ৯টায় আত্মসমর্পণ করব জানিয়ে দিয়েছি। দেখা…।
না বলে আর্তনাদ করে উঠল লিয়েন হুয়ার কণ্ঠ। বলল, এটা হতে পারে না স্যার। স্যার, মা ঝুঁকে আমি ভালোবাসি। মা ঝুঁকে আমি সমগ্র
অন্তর দিয়ে চাই। কিন্তু তার জীবন আপনার জীবনের বিনিময়ে নয়। আমি এটা চাই না, আমার মা ঝুও এটা চাইবে না। লিয়েন হুয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল।
শোন লিয়েন হুয়া, ওরা ছয়জনকে মেরে ফেলবে, এটা যেমন ভবিষ্যতের কথা, তেমনি আমার আত্মসমর্পণ এটাও ভবিষ্যতের কথা। দুটোই কৌশলের খেলা। এ খেলায় আমরা হারব, এটা আমরা ধরে নিচ্ছি না। আল্লাহ আমাদের সহায় আছেন।
স্যার, আমাদের ছোট হৃদয়, ছোট জীবন, ছোট পৃথিবী। এই ভার আমি বুকে ধারণ করতে পারছি না। আপনার আল্লাহকে তো আমি চিনি না।
চিনেই তাঁর উপর আমি ভরসা করছি স্যার। তিনি আপনাকে নিশ্চয় বিজয়ী করবেন। লিয়েন হুয়া বলল।
আলহামদুলিল্লাহ। এ ভরসাই মানুষের সম্বল লিয়েন হুয়া। তাহলে রাখছি বোন। সালাম।
বলে আহমদ মুসা রাখল মোবাইলটা।
মোবাইল রেখে আহমদ মুসা তাকাল লু ঝিদের দিকে। দেখল, লু ঝি’র দুই গণ্ড দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে।
তুমিও দেখছি কাঁদছ লু ঝি! বলল আহমদ মুসা।
আমি কেন, সবারই আপনার জন্যে কাঁদা উচিত। চীনের ছয়জন লোককে বাঁচাবার জন্যে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন! এটা আপনি কি করে পারলেন? কেন করলেন? লু ঝি বলল। কান্নায় জড়ানো তার কথা। তার দুগণ্ডে অশ্রর ধারা আরও বেড়ে গেছে।
তোমার প্রশ্নের জবাব আমি লিয়েন হুয়ার সাথে কথা বলার সময় দিয়েছি। এটাকে একটা কৌশলের খেলা হিসাবে দেখ। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, এটা জীবন দেয়া-নেয়ার কৌশলী খেলা, এটাই সত্য। লু ঝি বলল।
মানুষের জীবনে বিভিন্ন কাজে, বিভিন্ন পর্যায়ে জীবনের ঝুঁকি নেয়ার ব্যাপারটা একটা নিরেট বাস্তবতা। বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি কোনো কথা বলল না। তার শূন্য দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ।
বলবে কিছু নিশ্চয় লু ঝি? বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি মুখ নিচু করলো। বলল, স্যার, জিজ্ঞেস করলেন না, আমরা বন্দিখানায় কেমন ছিলাম।
জবাব আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গেই দিল না।
আহমদ মুসাও মুখ নিচু করেছে। মুখ নিচু রেখেই বলল আহমদ মুসা, জিজ্ঞেস করিনি কারণ, তুমি যা বলবে, আমি তা শুনতে চাই না।
পিতা মেয়েকে বন্দি করার কাহিনী আপনি শুনবেন না কেন স্যার? কেন শুনবেন না স্যার, মেয়েকে নিজের পক্ষে আনতে বাধ্য করার জন্যে মেয়েকে গণধর্ষণের হুমকি দেয়ার কাহিনী!
বলে বাঁধভাঙা কান্নায় লুটিয়ে পড়ল লু ঝি সোফার উপর।
চেং ঝি সরে এসে লু ঝিকে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে লু ঝিকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।
ধীরে ধীরে মুখ তুলল আহমদ মুসা।
অশ্রু ভেজা তার দুই চোখ। বলল নরম, কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে, নিজেকে শক্ত কর লু ঝি। পিতাকে পিতার জায়গায় রাখ, তোমার বিবেচনা দিয়ে পিতাকে দেখো না, তাহলে কষ্ট কমবে তোমার।
কান্না আরও বেড়ে গেল লু ঝি’র।
কি কষ্টে কাঁদছে লু ঝি, তা আহমদ মুসা বুঝে। গোটা হৃদয় জুড়ে স্নেহময় পিতার যে স্থান, তাকে কেটে তুলে ফেলার অর্থ নিজেকেই তো কেটে ফেলা। সেটা অসহনীয় এক কষ্টের।
হঠাৎ উঠে বসল লু ঝি।
চোখ মুছল। বলল, স্যার, আমি আজ সর্বস্বান্ত, কিছু নেই আমার আজ। আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
বল লু ঝি। বলল আহমদ মুসা নরম কণ্ঠে।
আপনার এই অভিযানে দয়া করে কি আমাকে সাথে নেবেন? লু ঝি। বলল অরুদ্ধ কণ্ঠে।
আহমদ মুসা তাকাল লু ঝি’র দিকে। বলল মমতা মাখানো কণ্ঠে, নিজেকে এই কঠিন অবস্থান তুমি নিও না লু ঝি। শোন, বিপদ, দুঃখ যত বড় হয়, আবেগ, অভিমান, ক্রোধের উপর তার বেশি লাগাম পরাতে হয়। ভেঙে পড়ো না তুমি। সামনের পথটা সময়ই তোমাকে দেখিয়ে দেবে।
আমি জানি আপনি এ কথাই বলবেন স্যার। আরও জানি, আপনি আমাকে সাথে নেবেন না। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। বলল লুঝি। লু ঝি’র কণ্ঠ ভারি, শক্ত। সজল চোখ। পানি ভরা মেঘের মতো মুখ।
কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ? বলল আহমদ মুসা। তার চেহারায় উদ্বেগ।
আমি আপনাকে ফলো করব স্যার। লু ঝি বলল।
ফলো করবে কিভাবে? অল্প কিছুদূর যেয়ে গাড়ির ভিড়ে বা গাড়ির আড়ালে আমাকে হারিয়ে ফেলবে। বলল আহমদ মুসা।
হারালে আমি খুঁজে নেব। আমি নিশ্চিত, পারপল প্যালেস থেকে নানিয়ান প্যালেস পর্যন্ত এবং মাঝের ড্রাগন কেভসহ গোটা এলাকার কোথাও না কোথাও আমাকে যেতে হবে। আমি নিজেই আপনাকে খুঁজে নেব। লু ঝি বলল।
মনে মনে ভীষণ চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার লোকেশনের কথা লু ঝি ঠিক ঠিক বলল কি করে? সে তো তাহলে নিশ্চয় যাবে।
লু ঝি এসব জায়গা তো চেন, জান। কিন্তু ওখানে বা ওখানকার কোথাও আমার ডেস্টিনেশন তুমি জানলে কেমন করে? বলল আহমদ মুসা।
ওগুলোর কোথায় আপনার ডেস্টিনেশন তা আমি জানি না। এ কয়েক দিনের বন্দি জীবনে সেই বিশাল বপু মহিলাকে বিভিন্ন সময়ে মোবাইলে কথা বলতে শুনেছি, তাতে ঐসব জায়গার নাম শুনেছি। আমি নিশ্চিত হয়েছি, ঐ স্থানগুলোর কোনো একটা বা সবগুলোই তাদের তৎপরতার কেন্দ্র। লু ঝি বলল।
ধন্যবাদ লু ঝি। ঠিক ধরেছ। কিন্তু বল তো এই অভিযানে যেতে চাচ্ছ কেন? বলল আহমদ মুসা।
কেন যেতে চাচ্ছি আমি জানি না স্যার। কিন্তু যেতে হবে এটা আমার মন চাচ্ছে এবং আমি যাবই। লু ঝি বলল।
হ্যাঁ, আমি তোমাকে বাধা দিতে পারি না, তোমার স্বাধীন ইচ্ছাকে আমি বাঁধতে পারবো না। তুমি যদি যেতেই চাও, তাহলে তোমাকে একা যেতে দিতে পারি না। একা তোমাকে সাথেও নিতে পারি না। চেং ঝি কি তোমার সাথে যাবে? বলল আহমদ মুসা।
আমি চেং ঝিকে জিজ্ঞেস করিনি। তবে আমি প্রেফার করব সে সাথে থাক। লু ঝি বলল।
এককভাবে অভিযানে যাবার কথা বলার প্রয়োজন নেই। ম্যাডাম যতদিন না বাড়ি ফিরছেন, ততদিন আমি তার সাথে আছি। চেং ঝি বলল।
ধন্যবাদ চেং ঝি। লু ঝি’র এখন তোমাকে খুব দরকার।
বলেই তাকাল আহমদ মুসা লু ঝি’র দিকে। বলল, তোমাকে এক শর্তে আমি সাথে নিচ্ছি। সে শর্তটা হলো, আমার আদেশ বা অনুরোধের অন্যথা করা যাবে না।
ভালো করে চোখ মুছল লু ঝি। বলল, ধন্যবাদ স্যার। আপনার শর্ত দেবার প্রয়োজন নেই। আপনার ছোট একটা অনুরোধ, আমার কাছে অমোঘ আদেশ। অনেক ধন্যবাদ স্যার। শেষের কথাগুলো লু ঝি’র কণ্ঠে ভারি হয়ে উঠেছে।
তোমরা গিয়ে শুয়ে পড়। ড্রাগন কেভ এলাকায় যাওয়ার আগে তোমাদের সামান্য একটু ছদ্মবেশ নিতে হবে। তোমাদের চাইনিজ চেহারাকে মঙ্গোলীয় ধরনের করতে হবে। তোমরা হবে মঙ্গোলীয় ট্যুরিস্ট। আমি হবো এক চাইনিজ ট্যুরিস্ট গাইড কাম ড্রাইভার। আমি সকালেই টুরিস্ট গাইডের আইডি পেয়ে যাবো। তোমরাও সকাল দশটার মধ্যে মঙ্গোলীয় পাসপোর্টে চাইনিজ ভিসা পেয়ে যাবে। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু চীনে এ কাজটা তো খুব কঠিন। দশটার মধ্যে হবে কি করে?
অফিসই দশটায় খুলবে। লু ঝি বলল।
তোমাদের ছবি নিয়ে সকালেই পাঠিয়ে দেবো। দশটাতেই পেয়ে যাবে। আমরা এগারোটার দিকে যাত্রা করব। বলল আহমদ মুসা।
বলেই উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। উঠে দাঁড়াল লু ঝিরা দুজন।
.
নানিয়ান মন্দির প্রাসাদের ডায়মন্ড হলের গ্রিন রুম পেরিয়ে মন্দির প্রাসাদের একদম পূর্ব-উত্তর প্রান্ত।
প্রান্ত ঘেঁষে একটা বড় সুসজ্জিত কক্ষ।
কক্ষটির বাইরের প্রান্তের দেয়ালে একটা সুন্দর দরজা। দরজাটি বাইরের ঝুলন্ত বিরাট ব্যালকনির প্রবেশপথ।
ব্যালকনিটি যেন দৃষ্টিনন্দন এক সৌন্দর্য-রাজ্যের উপরে ভাসমান এক আকাশ-দ্বীপ। ব্যালকনি থেকে নিচে তাকালে দেখা যায় অতল, প্রলম্বিত এক গিরিখাদ, ডানে বামে সামনে তাকালে দেখা যায় অনেক নিচে দিগন্ত প্রসারিত বনরাজি আর অনেক সবুজ পাহাড় শীর্ষ শোভিত ল্যান্ড ক্যানভাস। মনে হয় এই ব্যালকনি, এই বাড়িই সরব দুনিয়ার এন্ডপয়েন্ট, এর পর আর কিছু নেই।
অপরূপ এই সৌন্দর্যের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল জোয়ান উ। কিন্তু মনটা ধরে রাখতে পারছিল না জোয়ান উ সৌন্দর্যের সবুজ বাঁধনে। মনটা অস্থির তার। বারবার সে তাকাচ্ছিল পাশের চায়ের টেবিলে রাখা তার অয়্যারলেসের স্ক্রিনের দিকে।
এক সময় অয়্যারলেস স্ক্রিনে ছবি ভেসে উঠল হুই দাই-এর।
সেদিকে তাকিয়ে জোয়ান উর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হুই দাই এসে গেছে কক্ষের দরজায়।
তার হাতের রিমোটের একটা বোতাম চেপে ধরল। মিনিট খানেকের মধ্যেই হুই দাই এসে দাঁড়াল ব্যালকনির দরজায়।
এস হুই দাই। বলল জোয়ান উ।
হুই দাই ব্যালকনিতে ঢুকে জড়সড় হয়ে দাঁড়াল জোয়ান উর সামনে জোয়ান উ একটা দোলনায় বসেছিল। সামনে একটা ছোট চেয়ার দেখিয়ে বলল, বস হুই দাই। হুই দাই বসতেই জোয়ান উ বলল, লু ঝিদের কোনো খবর পেলে?
দুঃখিত মাই লর্ড। কোনো খবর পাওয়া যায়নি। শুধু এটুকু জানা গেছে। যে, তাদেরকে নিয়ে একজন বাড়ি থেকে বের হয়। রাস্তায় তারা বেরিয়ে আসে। রাস্তায় তখন কোনো গাড়ি ছিল না। এরপর মাইলখানেক দক্ষিণে একটা পাহাড়ের গোড়া দিয়ে পায়ে হাঁটা পথে সামনে এগোতে দেখা গেছে। এরপর তাদের কোন ট্রেস পাওয়া যায়নি। থামল হুই দাই।
লোকটি আহমদ মুসাই তো! বলল জোয়ান উ।
ভিডিওতে ছবি পাওয়া গেছে, কণ্ঠ পাওয়া যায়নি। ছবিটা ছদ্মবেশের হতে পারে। ছবিতে যাকে পাওয়া গেছে, সে আহমদ মুসা এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। উডাং-এর বাইরে ওরা যায়নি, এটা নিশ্চিত মাই লর্ড।
লোকটা বাড়ি খুঁজে পেল কেমন করে, এটাই বুঝতে পারছি না আমি। বলল জোয়ান উ।
উপত্যকার রাস্তা থেকে বাড়ির চতুর্দিকের গত কয়েকদিনের সব ভিডিও চিত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে, বাড়ি এলাকার কোথাও বাইরের কোনো লোককে দেখা যায়নি। সুতরাং লোকটি হঠাৎ করে কোত্থেকে এলো তা বুঝা যাচ্ছে না মাই লর্ড। বাড়িতে রাখা ঐ কয়জন ছাড়া আমাদের লোকদেরও ঐ বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। ওখানে কাকে রাখা হয়েছে, এটাও কাউকে জানতে দেয়া হয়নি। বলল হুই দাই।
জোয়ান উ সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না। তার চোখে-মুখে একটা বিব্রত ভাব।
হুই দাই, কে বা কারা তাদেরকে ওখানে বন্দি করে রাখে, এটা তো লু ঝিরা কোনোভাবেই জানতে পারার কথা নয়। বলল জোয়ান উ অনেকটা স্বগত কণ্ঠে।
ঠিক মাই লর্ড। আমাদের লোকরা তাদের সাথে কথা বলত না। আর। বাড়িটা আমাদের নতুন কেনা, তাই ওখানে আমাদের কোনো প্রকার নাম, চিহ্ন ছিল না। সুতরাং কোনোভাবেই তাদের জানার কোনো উপায় ছিল না। হুই দাই বলল।
আচ্ছা হুই দাই, সরকার আহমদ মুসাকে আত্মসমর্পণ করাতে এত তাড়াতাড়ি রাজি হলো কেন? বলল জোয়ান উ।
ছয়জন বন্দির ভিডিও বক্তব্য খুব কাজ দিয়েছে। একজন বিদেশির জন্যে দেশের অতি মূল্যবান কয়েকজন মানুষ বন্দি আছে এবং ঐ একজন বিদেশির জন্যে তাদের জীবন দিতে হবে, এটা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করবে, আমার মনে হয় এই ভয় তাদের বাধ্য করেছে সঙ্গে সঙ্গে তাদের রাজি হয়ে যেতে। হুই দাই বলল।
ঠিক তাই হুই দাই। আমাকে তারা ভয় করেছে। কিন্তু সামনে এই ভয় তো তাদের বাড়বে। আহমদ মুসাকে হাতে পাওয়ার পর আমরা ছয় বন্দিকে যখন ছাড়ব না এবং দাবি করব যে, গত ৫০ বছরে বিদেশি হুই-উইঘুররা যেসব বসতি করেছে, সেসব খালি করে হানদের হাতে তুলে দিতে হবে এবং যেসব চাকরি হুই-উইঘুররা দখল করেছে, সেখান থেকে তাদের সরিয়ে বেকার হানদের দিতে হবে, তখন সরকারের অবস্থা কি দাঁড়াবে ভাবতে পারছ হুই দাই? বলল জোয়ান উ।
মাই লর্ড, সরকার পাগল হয়ে যাবে। হুই দাই বলল।
আমরা তো সেটাই চাই। আজই এ আগুন তাদের ঘরে লাগাব। আহমদ মুসা আত্মসমর্পণ করতে আসছে রাত নয়টায়। ঠিক রাত সাড়ে আটটার পর সরকারের কাছে আমাদের মেসেজ যাবে নতুন দাবিনামা নিয়ে। আমাদের লোকদের বলে দেবে তারা যেন সরকারের প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের জানায়। বলল জোয়ান উ।
ইয়েস মাই লর্ড। আমি ব্যবস্থা করছি। হুই দাই বলল।
ড্রাগন কেভের আয়োজন কতদূর হুই দাই? বলল জোয়ান উ।
আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছে মাই লর্ড। সেই নাম্বার ওয়ান কেভ-এর চারদিকের ব্যারাকের মাঝের যে চত্বর সেখানেই আজকের বিচার মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। আর আসামীরা থাকবে ফা জি ঝাও-এর বড় সেলটায়। ড. ডা এবং ফা জি ঝাও-এর কাছে যা চাওয়া হয়েছে তা যদি না দেয়, তাহলে ঐখানেই ড. ডার শারীরিক মৃত্যু ও ফা জি ঝাও-এর প্রথম মানসিক মৃত্যুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ড. ডা, মা ঝু, চাও জিয়াং এবং ইরকিন ওয়াংদের। বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। শুধু ফা জি ঝাওকে মানসিকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তার কাছ থেকে ফর্মূলা না পাওয়া পর্যন্ত। হুই দাই বলল।
গুড। সব ঠিক আছে।
বলেই একটু থামল জোয়ান উ। কথা বলল আবার, আহমদ মুসার আত্মসমর্পণের স্থান, প্রতিক্রিয়ার ডিটেইল বিষয় সরকারকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা নিয়েছে, এ বিষয়টা তারা কনফার্মও করেছে। এখন আমাদের প্রস্তুতির কতদূর হুই দাই?
মাই লভ সে পরিকল্পনাও আমাদের সম্পন্ন হয়েছে। জিনজিয়াও হোটেলের পার্কিং এলাকার দক্ষিণে এবং নানিয়ান প্যালেসের পশ্চিম থেকে উত্তরে পাহাড় এলাকার সাদা পতাকাওয়ালা পাহাড় শৃংগ যেখানে আত্মসমর্পণের জন্যে তাকে বলা হয়েছে, সে গোটা এলাকা আমাদের লোকদের দখলে থাকবে। সে পার্কিং এলাকা ও নানিয়ান প্যালেসের মাঝখানের এলাকায় কাউকে থাকতে দেয়া হবে না। গোটা এলাকা জুড়ে আমাদের লোকই শুধু থাকবে। পারপল মন্দির প্রাসাদ, নানিয়ান, মন্দির প্রাসাদ এবং ড্রাগন কেভে মিনিমাম লোক রেখে সবাইকে এখানেই মোতায়েন করা হবে। যাতে তারা কোনো ষড়যন্ত্র করলে তা আমরা ব্যর্থ করে দিতে পারি। হুই দাই বলল।
হ্যাঁ, কোনো ষড়যন্ত্র তারা করতে পারে। তার জন্যে অবশ্যই আমাদের প্রস্তুত থাকা দরকার। তবে আমি মনে করি আমাদের দ্বিতীয় মেসেজ পাওয়ার পর আহমদ মুসাকে রক্ষার জন্যে তেমন আর মাথা ঘামাবে না তারা। দ্বিতীয় আলটিমেটাম কীভাবে শামাল দেবে, সেটাই বড় হয়ে উঠবে। বলল জোয়ান উ।
অবশ্যই মাই লর্ড। হুই দাই বলল।
সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বলল না জোয়ান উ। তার চোখ অলক্ষ্যেই যেন চলে গেছে ব্যালকনির বাইরে। অতি শান্ত, নিঃশব্দ ও নিকষ অন্ধকারে যেন হারিয়ে গেছে তার দুই চোখের দৃষ্টি।
সময় বয়ে চলল পল পল করে।
কি করবে, কি করবে না এই চিন্তায় বিব্রত হুই দাই। সে বুঝতে পারছে সবই। তার অতি বাস্তববাদী প্রভুকে এমন আপনহারা অবস্থায় কখনও সে দেখেনি। এভাবে মায়া, মমতা ও আবেগের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ তার প্রভুর জন্যে অবিশ্বাস্য।
এক সময় চোখ দুটি বাইরে রেখেই জোয়ান উ বলল অনেকটা স্বগত কণ্ঠে, লু ঝি উডাং-এ আছে, তাহলে বাড়িতে এলো না কেন! সে তো উডাং-এর বাড়ি খুব পছন্দ করে। তার কণ্ঠ নরম, শুকনো।
হুই দাই তার প্রভুর এ স্বগত কণ্ঠের কথার কোনো জবাব দিল না। কোনো জবাব তার কাছেও নেই।
কথা শেষ করে ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে নিল ব্যালকনিতে। তাকাল হুই দাই-এর দিকে। বলল, তোমরা লু ঝি’র সন্ধান ছেড়ে দিও না। লু ঝি’র সাথে আছে চেং ঝি, তার সেক্রেটারি। লু ঝি যেখানেই যাক, যেখানেই থাক ওরা দুজন অবশ্যই একসাথে থাকবে। সন্ধানের সময় এটা তোমরা খেয়াল
একটু থামল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, আচ্ছা হুই দাই। সব, কাজ যাতে ঠিকভাবে হয় দেখ। চারদিকে চোখ রেখ। এখন এস।
হুই দাই উঠে বেরিয়ে গেল। ঝুলন্ত সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজল জোয়ান উ।
৬
উডাং ন্যাশনাল পার্কের এন্ট্রি গেট দিয়ে আহমদ মুসা প্রবেশ করল উডাং পর্বতের দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার আঞ্চলিক সড়কে।
এই এন্ট্রি গেটটা উডাং-এর দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশের একটা গ্রন্থি বা জংশনের মতো। উডাং-এর দক্ষিণাঞ্চলীয় হাইওয়েতে এখান থেকে প্রবেশ করা যায়। আবার আঞ্চলিক সড়কেও যাত্রা শুরু করা যায় এখান থেকেই। আর উডাং-এর দক্ষিণাঞ্চলের দুপাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে। বাম পাশের নদীর তীর ধরে রেলওয়ে উডাং এলাকার মাঝামাঝি পর্যন্ত পৌঁছেছে।
আহমদ মুসা হাইওয়ে অ্যাভয়েড করেছে, আঞ্চলিক সড়কে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আঞ্চলিক সড়কে চলার গতি হাইওয়ে থেকে কম, তবু আহমদ মুসা এটাই পছন্দ করেছে।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে। তার গায়ে চীনা ড্রাইভারের পোশাক। আর লু ঝি এবং চেং ঝি দুজনেই মঙ্গোলীয় পর্যটক।
চেং ঝি মঙ্গোলীয়। মঙ্গোলীয় ভাষা তার মাতৃভাষা। লু ঝিও মঙ্গোলীয় ভাষা ভালো জানে। ছদ্মবেশ লু ঝি ও চেং ঝি দুজনের বয়স একটু বাড়িয়েছে। তারা দুজন গাড়ির পেছনের সিটে।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তারা পড়েনি। গেটের পুলিশরা তাদের দিকে একবার তাকিয়েই ছেড়ে দিয়েছে। তবে গেট থেকে বেরিয়ে আসার পর দুজন লোক দুপাশ থেকে গাড়ির জানালায় এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা দুজনেই তাকিয়ে ছিল লু ঝিদের দিকে। আহমদ মুসাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, তারা কোথায় যাবে। গোল্ডেন হল পর্যন্ত। বলেছিল আহমদ মুসা।
তাহলে এ পথে কেন? গোল্ডেন হলে যাবার জন্যে পর্যটকরা তো পশ্চিম পাশের রাস্তা ব্যবহার করে। বলল তাদের একজন।
পূর্ব পাশে দর্শনীয় স্থান বেশি আছে, এজন্যে ম্যাডামরা এই পথে। যাচ্ছেন। বলেছিল আহমদ মুসা।
লোক দুজন আর কিছু না বলে চলে যায়।
ওরা কারা ছিল স্যার? জিজ্ঞেস করেছিল লু ঝি। তার কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ।
হ্যাঁ লু ঝি, ওরা কিডন্যাপার দলেরই লোক। ওরা তোমাকে খুঁজছে। বলল আহমদ মুসা।
গোটা রাস্তায় কি ওরা এভাবে ঝামেলা করবে? লু ঝি বলল।
কেন, ওদের কাজ ওদের করতে দেবে না? আহমদ মুসা বলল।
আমার তো ভয় করছে। লু ঝি বলল।
ভয় ঝেড়ে ফেলে দাও। তুমি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। মাঝে মাঝে রিভলবারে হাত দাও। তাহলে মনে থাকবে, তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে। বলল আহমদ মুসা।
স্যার আমি যুদ্ধক্ষেত্রে, এটা মনে হলেই তো ভয় বাড়ছে। লু ঝি বলল।
তাহলে মনে কর তুমি গোল্ডেন হল পরিদর্শনে যাচ্ছ। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, এটা হতে পারে স্যার। ধন্যবাদ। লু ঝি বলল।
একটু থেমেই লু ঝি আবার বলে উঠল, আপনার এ গাড়িটা তো স্যার বুলেটপ্রুফ। আগে-পেছনে অটো ফায়ারের প্রভিশন আছে। এ তো সাংঘাতিক দামি গাড়ি। গাড়িতে উঠার সময় দেখলাম গাড়িতে প্রেসিডেন্সিয়াল ফ্যামিলি পুল-এর মনোগ্রাম। আমি বুঝতে পারছি না স্যার।
গাড়ি আমার নয়, আমি ব্যবহার করছি। এটা প্রেসিডেন্সিয়াল ফ্যামিলি পুলের গাড়ি। বলল আহমদ মুসা।
তা আমি বুঝেছি। কিন্তু আপনার হাতে এলো কি করে? লু ঝি বলল।
তুমি কিডন্যাপ হবার পর আমি উডাং-এর দিকে আসার পথে অনেক ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে এটা একটা।
বলে আহমদ মুসা সংক্ষেপে লিয়েন হুয়াকে উদ্ধার ও প্রেসিডেন্ট হাউজে যাওয়ার কাহিনীটা বলল।
স্যার, সত্যি আপনি পরশ পাথর। আপনি প্রেসিডেন্ট হাউজে গেলেন, আর জয় করে ফেললেন প্রেসিডেন্ট হাউজকে। লিয়েন হুয়াকে আমি জানি। সে আমার ভালো বন্ধু। সব ব্যাপারেই সে খুব কনজারভেটিভ। সাধারণ একটা গাড়ি নিয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। এ গাড়ি তাকেও আমি ব্যবহার করতে দেখিনি। সে গাড়িটা দিয়ে দিল আপনাকে? লু ঝি বলল।
আমি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ লু ঝি। সবাই আমাকে সাহায্য না করলে এভাবে এগোতে পারতাম না। দেখ তোমার গাড়িটা নিয়ে পৌঁছেছিলাম লিয়েন হুয়াকে উদ্ধারের ঘটনা পর্যন্ত। তারপর পেলাম লিয়েন হুয়ার গাড়ি। এভাবেই আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেন। বলল আহমদ মুসা।
হিংসা হয় স্যার, আল্লাহকে আপনি যেভাবে পেয়েছেন, সেভাবে আমরা যদি পেতাম, তাহলে বোধ হয় এতটা দুর্ভাগা আমি হতাম না। লু ঝি বলল। তার কণ্ঠ ভারি।
ঠিক বললে না লু ঝি। কোনটা দুর্ভাগ্য, আর কোনটা সৌভাগ্য তা মানুষ ঠিক করতে পারে না। মানুষ যাকে মনে করে দুর্ভাগ্য, সেটা তার সৌভাগ্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর যাকে সৌভাগ্য মনে করে তা তার জন্যে দুর্ভাগ্য ডেকে আনতে পারে। সব অবস্থায় আল্লাহর উপর আমাদের নির্ভর করা উচিত। বলল আহমদ মুসা।
স্যরি স্যার। আপনার আল্লাহর প্রতি আমার ভরসা আছে বলেই আমি বেঁচে আছি, দাঁড়াতে পেরেছি। লু ঝি বলল।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, আমার আল্লাহর উপর ভরসা করবে কেন? তোমার আল্লাহর উপর ভরসা করো। আল্লাহ তো সবার। বলল আহমদ মুসা।
আল্লাহকে আমি কি আমার বুকে ধারণ করতে পারব? আমি অত ভালো মানুষ হতে পারব? আমি তার গুণবাচক নামগুলো পড়েছি রিলিজিয়াস এনসাইক্লোপেডিয়ায়। সেগুলোকে আমি কি করে ধারণ করবো আমার বুকে? লু ঝি বলল।
তুমি যখন আল্লাহকে স্রষ্টা, রক্ষাকর্তা, পালনকর্তা, দয়ালু, বারবার ক্ষমাকারী, শেষ প্রত্যাবর্তনস্থল ইত্যাদি হিসাবে মেনে নেবে, তখন গুণগুলো আপনাতেই তোমার মধ্যে এসে যাবে। প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ এভাবে অপার সম্ভাবনাময় করে তৈরি করেছেন। কেউ ছোট নয়, কারও বুক ছোট নয়। দেখবে একে আকাশের মতো সীমাহীন।
ধন্যবাদ স্যার আপনাকে। অনেক ধন্যবাদ আল্লাহকে তার দয়াতেই নিশ্চয় আপনার দেখা পেয়েছি। আলোর পরশেই তো অন্ধকার দূরে সরে যায়। আপনি সেই আলোর পরশ। আল্লাহকে মনে হচ্ছে আমার বুকে পেয়েছি। কোনো ভয় যেন আমার মধ্যে নেই। মনে হচ্ছে হাজারো কামান। বন্দুকের সামনে দাঁড়াতে বুক আর কাঁপবে না।
আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু বলা হলো না। দেখল ঠিক রাস্তার মাঝখানে দুজন লোক এসে হাত তুলে দাঁড়াল। আহমদ মুসা গাড়ি থামাল প্রায় তাদের গা ঘেঁষে। ওদের জ্যাকেটের পকেটের ওজন দেখে বুঝল, রিভলবার আছে পকেটে।
গাড়ি থামতেই গাড়ির সামনের দুজনের একজন ছুটে এলো আহমদ মুসার গাড়ির জানালায়। তাকাল সে গাড়ির পেছনে বসা লু ঝিদের দিকে।
দেখেই হাত তুলে চিৎকার করে উঠল দ্বিতীয় লোকটির দিকে তাকিয়ে, হ্যাঁ, পাওয়া গেছে দুজন মঙ্গোলীয় মেয়ে।
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়জন পেছনে তাকিয়ে ডাকল, ম্যাডাম মেংগ, ম্যাডাম তেং আপনারা আসুন।
মন্দির থেকে বেরিয়ে এলো দুই মহিলা। তাদের দুজনার হাতেই পিস্তল।
আহমদ মুসার গাড়ি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার দশ গজ সামনেই একটা মন্দির। মন্দিরের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ির রাস্তাটা ডানদিকে বাঁক নিয়ে মন্দিরের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ- তিন পাশ ঘুরে দক্ষিণে এগিয়ে গেছে।
মহিলা দুজন এসে লু ঝি’র পাশের জানালায় দাঁড়াল। আর পুরুষ দুজন আগের মতোই দাঁড়াল গাড়ির সামনে।
মহিলা দুজনের একজন জানালা দিয়ে লু ঝিকে বলল, স্যরি ম্যাডাম, সামান্য একটু চেকিং আছে, আসুন।
আপানারা কে, কি চেক করবেন? বলল লু ঝি সেই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে।
মহিলা দুজনেরই মেদহীন ঋজু শরীর। দেখেই বুঝা যায়, কুংফু কারাতের দেহ ওদের।
আমরা উডাং সিকিউরিটি সমিতির লোক। আজকাল পাহাড়ে নানা ঘটনা ঘটছে। এর প্রেক্ষিতেই আজ থেকে পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র বহন ও ছদ্মবেশ ধারণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বলল মহিলাটি।
শুধু যে ওদের বললেন, আমার চেকিং হবে না? আহমদ মুসা বলল।
আপনাকে ছেলেরা ডাকবে। আচ্ছা আপনিও আসুন। বলল। মহিলাটি।
ঠিক আছে চেকিং যখন হবেই, তখন তাড়াতাড়ি হোক। বলে আহমদ। মুসা বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে।
লু ঝিরাও বের হলো গাড়ি থেকে।
লু ঝিরা আগে চলল। তার পেছনে দুই মহিলা। দুই মহিলার পেছনে সেই দুজন লোক। সবার পেছনে আহমদ মুসা।
কোথায় চেকিং হবে? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসার সামনের দুই লোককে।
মন্দিরের দুটি কক্ষ বরাদ্দ হয়েছে, এজন্যে। বলল দুজন লোকের একজন।
পাহাড়ে তো গণ্ডগোলের কথা শুনিনি। কিছু ঘটেছে কি? বলল আহমদ মুসা।
ঘটেছে, ঘটবে। এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। বলল আগের সেই লোকটি।
মন্দিরের একদম পশ্চিম প্রান্তের একটা দরজা দিয়ে তারা ঢুকল।
ঢুকেই আহমদ মুসা পকেট থেকে তার স্পেগানটি বের করল। দরজাটি বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধের শব্দ পেয়েই বোধ হয় তোক দুজন ফিরে তাকিয়েছিল।
ওরা একদম আহমদ মুসার সামনে দুগজের মধ্যে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ওরা স্থির হবার আগেই আহমদ মুসা তাদের দিকে উদ্যত স্পেগান থেকে দুবার দুবার চারবার ফায়ার করল।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ওরা সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল।
স্পেগানের কোনো শব্দ হয়নি। কিন্তু তাদের দেহ মাটিতে আছড়ে পড়ার শব্দ হলো।
বোঁ করে দুজন মহিলা ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়িয়েছিল লু ঝিরাও।
বুঝতে পারল সঙ্গে সঙ্গেই। আর প্রায় তার হাতের সীমার মধ্যেই দাঁড়িয়ে দুজন মহিলা।। লু ঝি মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না। পেছন থেকে তার দুহাতের দুই কারাত চালাল দুই মহিলার ঘাড়ের পাশটায়।
মহিলা দুজনের দেহ টলে উঠে আছড়ে পড়ল পেছন দিকে।
ধন্যবাদ লু ঝি, তোমরা একদম ওদের লাগোয়া ছিলে বলে ক্লোরোফরম স্প্রে করতে পারছিলাম না ওদিকে। তোমরা সরে এস। বলল আহমদ মুসা।
ওরা সরে এলো।
ওদের দেহ সংজ্ঞাহীন হলেও এদের নাকে, আহমদ মুসা বিশেষ ক্লোরোফরম স্প্রে করল। বলল, ওদের তিরিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে রাখতে হবে। যাতে ঘটনাটা কাউকে জানাবার সুযোগ তারা না পায়।
আহমদ মুসা ঘরের পাশেই একটা টয়লেট খুঁজে পেল। ওদের সবাইকে সেখানে ঢুকিয়ে দরজা লক করে দিল।
ওরা বেরিয়ে এলো মন্দির থেকে। উঠল তারা গাড়িতে।
আল্লাহকে ধন্যবাদ স্যার। আমরা দুই চেকিং পার হলাম। বলল লু ঝি।
আলহামদুলিল্লাহ। নিশ্চয় আল্লাহর দয়া আমাদের সাথে আছে।
আবার যাত্রা শুরু হলো তাদের।
রেনওয়েল মন্দিরের ঘটনার পর ফাইভ ড্রাগন মন্দির পার হয়ে এলো তারা। ফাইভ ড্রাগন মন্দির বিশাল। এর ভেতর দিয়ে স্থানীয় সড়কটি। আহমদ মুসা আশঙ্কা করেছিল এখানে শত্রুরা বড় বাধা দাঁড় করাতে পারে। কিন্তু ভালোই ভালোই তারা পার হয়ে এসেছে ফাইভ ড্রাগন টেম্পল।
গুরুত্বপূর্ণ হুয়াং রক পার হবার পর আঞ্চলিক সড়কটি উঁচু পর্বত ও পার্বত্য এলাকার মুখোমুখি হয়েছে। পাহাড়ের এই বাধা এড়াবার জন্যে সড়কটি লেফট টার্ন নিয়ে পূর্ব দিকের উপত্যকা ধরে এগিয়ে গেছে। বেশ কিছুটা এগোবার পর সড়কটি শার্প রাইট টার্ন নিয়ে ফুমা ব্রিজ দিয়ে একটা পাহাড়ি নদী ও পাহাড়ের বড় একটা খাদ পার হয়ে যেতে হবে।
আহমদ মুসারা তখন চলছিল পূর্বের উপত্যকা পথে। উপত্যকাটা সবুজ গাছ-গাছালিতে পূর্ণ।
আহমদ মুসার গাড়ি খুব দ্রুতই চলছিল সামনে। উপত্যকার পথ তখনও শেষ হয়নি।
আহমদ মুসার সতর্ক দৃষ্টি চারদিকে।
সে দেখল, তার গাড়ির পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় মাইক্রো।
সড়কটি সিংগল লেনের। আসা-যাওয়ার একই রাস্তা। মাইক্রোটি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ঠিক মধ্যখানে। দুপাশেই রাস্তার কিছু করে জায়গা ফাঁকা।
মাইক্রোর দরজা খোলা। বাইরে কেউ নেই, ভেতরে আছে কি? মতলব কি মাইক্রোর।
আহমদ মুসার গাড়ি একই গতিতে এগোচ্ছে।
আরও কিছু এগোলো আহমদ মুসা। মাইক্রোটি অনড়। মাইক্রোর দুই পাশে রাস্তায় যে স্পেস, তা দিয়ে গাড়ি যাবে না।
তাহলে?
মাইক্রোটি কি খালি?
মাইক্রোর জানালাগুলোতে কালো শেড দেয়া গ্লাস। কিন্তু খোলা দরজা দিয়ে গাড়িতে কেউ থাকার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ড্রাইভিং সিট, পাশের সিটেও কেউ নেই। মাইক্রোর লোক এবং আরও লোক মিলে কি বাইরে ওঁৎ পেতে বসে আছে। গাড়ি থেকে আহমদ মুসাদের নামাতে চায় ওরা?
আহমদ মুসা রাস্তার দুপাশে তাকাল। দেখেই বুঝল, রাস্তার খুব ভালো একটা জায়গা তারা বেছে নিয়েছে তাদের আটকানোর জন্যে। এখানে রাস্তাটি সামনে পেছনের তুলনায় বেশি সংকীর্ণ। আর রাস্তার দুধারের ভূমিটা বেশ খানিকটা খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে। সুতরাং রাস্তা থেকে অল্প কিছুটাও নামিয়ে গাড়ি ওপাশে নেবার উপায় নেই। অন্যদিকে দুপাশটা পজিশন নেবার মতো উপযুক্ত জায়গা। ওখান থেকে রাস্তার যে কাউকে টার্গেট বানানো সহজ, কিন্তু রাস্তা থেকে ওখানে টার্গেট বানানো সহজ নয়। তাছাড়া ওদের জন্যে আছে ঝোঁপঝাড় ও গাছপালার আড়াল।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। মনে মনে বলল, আল্লাহ কখনই কারও সামনে চলার পথ একেবারে বন্ধ করে দেন না।
আহমদ মুসার গাড়ি মাইক্রোর কাছাকাছি এসে গেছে।
আহমদ মুসা একটা অর্ধ টার্ন নিয়ে তার গাড়ি মাইক্রোর প্যারালালে তার গায়ের সাথে সেঁটে দাঁড় করাল। মাইক্রোর খোলা দরজা এবং আহমদ মুসার গাড়ির দরজা এক বরাবরে এসে গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এসে নিজের গাড়ির দরজা খুলে মাইক্রোর খোলা দরজা দিয়ে মাইক্রোতে প্রবেশ করতে গেল।
লু ঝি ও চেং ঝি উদ্বেগ নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল এবং দেখছিল আহমদ মুসার কাজ। লু ঝি বলল, স্যার, আপনি মাইক্রোতে ঢুকছেন না কেন?
আমি দেখব গাড়িতে বোমা বা কোনো ধরনের বিস্ফোরক পাতা আছে কিনা। তুমি এস, এ গাড়ি তোমাকে ড্রাইভ করতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
দেখল আহমদ মুসা, বিস্ফোরক ইন্ডিকেটরে কোনো রেড সিগন্যাল
লু ঝিও এসে প্রবেশ করল মাইক্রোতে।
লু ঝি তোমাকে দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে সড়ক ধরে সামনে এগোতে হবে। দ্রুত গাড়ি ঘুরাতে হবে এ কারণে যে, ওরা যেন এই পজিশনে মাইক্রোকে
অকেজো করে দিতে না পারে। বলল আহমদ মুসা।
আমরা এ মাইক্রো নিচ্ছি কেন? লু ঝি বলল।
আমরা মাইক্রো নিচ্ছি না, রাস্তা থেকে সরাচ্ছি। বলল আহমদ মুসা।
হাসন লু ঝি। বলল, এটা অনেকটা চোরের উপর বাটপাড়ি স্যার।
হ্যাঁ, কিছুটা। বলল আহমদ মুসা। তার মুখেও হাসি।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, গাড়ি স্টার্ট দিয়েই চাকা ঠিক আছে কিনা দেখে নিও। আমি ওই গাড়িতে যাচ্ছি। আমি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বামে ঘুরে মাইক্রোর দিকে অ্যাবাউট টার্ন করার আগেই মাইক্রো স্টার্ট দেবে। আমার গাড়ি বামে টার্ন নিতেই আমি পালিয়ে যেতে পেছনে ফিরছি। মনে করে আমার গাড়ি লক্ষ্যে ওরা গুলি শুরু করতে পারে। ওদের বন্দুকগুলো আমার গাড়ির দিকে ঘুরানো থাকবে, এই সুযোগ নিয়ে তুমি গাড়ি ঘুরিয়ে সামনে ছুটবে। বলল আহমদ মুসা।
বুঝেছি স্যার। আমরা ওদের বোকা বানাচ্ছি। বলল লু ঝি। তার মুখে। হাসি।
আহমদ মুসা যা বলেছিল তাই ঘটল। আহমদ মুসা গাড়ি বামদিকে ঘুরিয়ে পেছনমুখো হতেই দুদিক থেকে ১২টির মতো স্টেনগান গর্জন করে উঠল।
লু বি মাইক্রো ঘুরিয়ে ছুটতে শুরু করলে তারা মাইক্রো লক্ষ্যেও ব্রাশ ফায়ার শুরু হলো। লু ঝি’র মাইক্রো তখন তাদের গুলির রেঞ্জের বাইরে।
আহমদ মুসার গাড়ি আবার অ্যাবাউট টার্ন করে লু ঝি’র মাইক্রোর পেছনে ছুটতে শুরু করেছে।
রাস্তার দুপাশ থেকে স্টেনগানধারী, বারো চৌদ্দজন ওরা তখন রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। চোখ তাদের ছুটে চলা দুই গাড়ির দিকে। বোকা বনার দৃষ্টি তাদের চোখে-মুখে।
আর এদিকে আহমদ মুসা সোজা ব্রিজ পার হয়ে গাড়ি দাঁড় করাল।
লু ঝি গাড়ি থেকে নামলে আহমদ মুসা মাইক্রোটার চারটি চাকাই গুলি করে ফুটো করে দিল।
লু ঝি গাড়িতে উঠলে আবার চলতে শুরু করল আহমদ মুসার গাড়ি।
স্যার আপনার কৌশল ওদের এমন বিপদে ফেলল যে, টেলিফোন করে গাড়ি না আনা পর্যন্ত ওরা নড়তে পারবে না। কারণ, ফাইভ ড্রাগন টেম্পল থেকে হোটেল জিনজিয়াও পর্যন্ত রাস্তায় কোনো ভাড়া গাড়ি পাওয়া যায় না। এই মধ্যপথে কোনো প্যাসেঞ্জার পাওয়া যায় না। তাই যারা এ রাস্তায় নামে প্যাসেঞ্জার নিয়েই নামে। বলল লু ঝি।
কেন এত বড় এলাকায় কোনো মন্দির, বাজার ইত্যাদি নেই? আহমদ মুসা বলল।
এখন আমাদের ড্রাগন কেভ পাওয়ার আগে মাত্র তিনটা মন্দির আছে। কিন্তু এগুলো খুব ছোট, ঐতিহাসিক কোনো মূল্য এগুলোর নেই।
অধিকাংশই এসব মন্দির দেখতে নামে না। বলল লু ঝি।
যাক, আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন। ওরা আমাদের ফলো করতে পারলে অসুবিধাই হতো।
একটু থামল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলল, আমাদের গাড়ির নাম্বার পাল্টাতে হবে। ছোটোখাটো পরিবর্তন এনে গাড়িটাকে যাতে সহজেই চিহ্নিত করতে না পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। কোথায় দাঁড়ানো যায় লু ঝি?
স্যার রাস্তার দুপাশে এমন প্যাসেজ ও ঝোঁপঝাড় পাওয়া যাবে।
বলে সামনেই রাস্তা থেকে নেমে যাওয়া একটা প্যাসেজ দেখিয়ে বলল, দেখুন স্যার, ওই প্যাসেজটা দুই ছোট টিলার মাঝ দিয়ে ভেতরে ঝোঁপের। দিকে ঢুকে গেছে। বলল লু ঝি।
ধন্যবাদ লু ঝি।
বলে প্যাসেজ বরাবর পৌঁছে ওদিকে ভালো করে একবার তাকিয়ে নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে প্যাসেজে ঢুকে গেল।
মিনিট পনেরো পরে আহমদ মুসার গাড়ি বেরিয়ে এলো প্যাসেজ দিয়ে। উঠে এলো রাস্তায়।
গাড়ির আগে পিছের নেমপ্লেট বদলে গেছে। গাড়ির দুই পাশের বডিতে মাঝ বরাবর লম্বালম্বি লম্বা একটি স্টিকার ছিল। তাতে ছিল তিনটি রাইজিং সান-এর প্রতিকৃতি। সেই রকম স্টিকারেই এখন লিখা দেখা যাচ্ছে FORTUNE লিখা এই স্টিকার গাড়ির স্টোরেই ছিল।
এবার কোনো ঝামেলা ছাড়াই আহমদ মুসারা পৌঁছে গেল জিনজিয়াও হোটেলে।
এখানেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চীনা গোয়েন্দা বাহিনীর পক্ষ থেকে দশ তলায় দুই বেডের স্যুট রিজার্ভ করা হয়েছে লু ঝি এবং চেং ঝি’র জন্যে। আর আহমদ মুসার জন্যে রুম রিজার্ভ করা হয়েছে একতলার ড্রাইভারস ব্যারাকে।
আহমদ মুসার ইচ্ছা অনুসারে চীনা গোয়েন্দা বিভাগ থেকেই হোটেল সিকিউরিটির পোশাকে কয়েকজন গোয়েন্দাকে লু ঝিদের কক্ষকে সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখা হয়েছে।
হোটেলে পৌঁছে ফ্রেশ হবার পর ব্যাগ থেকে জুসের কেন বের করে জুসটা খেয়ে সবে বিছানায় গা এলিয়েছিল আহমদ মুসা।
তখনই তার অয়্যারলেস বেজে উঠল।
এ অয়্যারলেসটি দিয়েছে তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং নিরাপদ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে।
অয়্যারলেস তুলে নিল আহমদ মুসা।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল, আপনি হোটেলে, খবর। পেয়েছি জনাব আহমদ মুসা। পথে যে গণ্ডগোলগুলো হয়েছে তারও রিপোর্ট পেয়েছি। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি আমাদের সবাইকে চমৎকৃত করেছেন। ঈশ্বর সত্যি আপনাকে তার করুণা একেবারে ঢেলে দিয়েছেন। আর…।
স্যার অন্য সব বিষয়ের খবর কি স্যার। আমি শোনার জন্যে উদগ্রীব। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ আহমদ মুসা, ওদিকের সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার ও পর্যটকের ছদ্মবেশে সেনাবাহিনীর ৫০ জন কমান্ডো ওখানে পৌঁছে গেছে। সন্ধ্যা থেকে ওরা ড্রাগন কেভ এলাকায় অবস্থান নেবে। কিছু থাকবে পারপল মন্দির-প্যালেস এবং নানিয়ান মন্দি-প্যালেস এলাকায়, যাতে ওখান থেকে ড্রাগন কেভ এলাকার দিকে মুভ করতে না পারে। এ ছাড়া ড্রাগন কেভ এলাকার নিচে পাহাড়ের গোড়ায় দুটি সামরিক হেলিকপ্টার অপেক্ষা করবে। এর বাইরে ঐ এলাকা জুড়ে আমাদের গোয়েন্দারা তো থাকবেই। কমান্ডো ইউনিটের অধিনায়কসহ গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধানের নাম্বার তিনটি আপনাকে দেয়া হয়েছে।
ধন্যবাদ স্যার। আহমদ মুসা বলল।
ওয়েলকাম। তাহলে এখন রাখছি জনাব। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
ঠিক আছে জনাব। বাই।
বলে আহমদ মুসা অয়্যারলেস রেখে দিল।
আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা।
দশ মিনিটও পার হয়নি।
এবার দরজায় নক হলো।
আগেই বুঝতে পেরেছিল বেশ কয়েকটি পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। তার দরজায় এসে পাগুলো স্থির হয়েছিল, তাও বুঝতে পেরেছিল আহমদ মুসা।
দরজায় দ্বিতীয়বার নক হতেই আহমদ মুসা উঠে দরজা খুলে দিল।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তিন চারজন যুবক বয়সের ছেলে।
আহমদ মুসা মুখ খোলার আগেই সবার সামনে দাঁড়িয়েছিল যে ছেলেটি সে বলল, আমরা আপনার আশপাশের রুমেই থাকি…।
তার কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা কানশু এলাকার চীনা উচ্চারণে বলল, ওয়েলকাম, আপনারা ভেতরে আসুন।
দরজা থেকে সরে এসে আহমদ মুসা সোফার দিকে ইংগিত করে বলল, বসুন সকলে প্লিজ।
আহমদ মুসার এ সৌজন্যে সবাই খুশি হলো। বসল সবাই।
আহমদ মুসাও বসল গিয়ে সোফায়। বলল, আমি এই কিছুক্ষণ আগে এলাম। খুশি হলাম আপনাদের পেয়ে।
ধন্যবাদ। আমরা চারজনই উডাং-এর। আমাদের স্যাররা কয়েকদিন এখানে আছেন। হোটেলের হলে কি একটা ওয়ার্কশপ চলছে। আগামীকাল শেষ হবে। আগামীকাল পর্যন্ত আমরাও আছি। যে ছেলেটি প্রথমে কথা শুরু করেছিল, সেই বলল।
খুশি হলাম। তাহলে তো উডাং সম্পর্কে আপনারা খুব অভিজ্ঞ। বলল আহমদ মুসা।
কেন উডাং-এ আসেননি এর আগে। কোথায় বাড়ি? বলল চারজনের
অন্য একজন।
দুএকবার এসেছি, এতদূর আসিনি। বলল আহমদ মুসা।
আপনি ফ্যামিলি গাড়ি ড্রাইভ করেন? বলল ওদের একজন আহমদ। মুসাকে।
হ্যাঁ। আমি আমার স্যারদের মঙ্গোলীয় মেহমানকে উডাং নিয়ে এসেছি। আহমদ মুসা বলল।
তাই তো দেখলাম গাড়িটা অন্যরকম। বেশ দামি গাড়িটা। বলল তাদের একজন।
আমার গাড়ি দেখেছেন? চিনলেন কি করে? আহমদ মুসা বলল।
সেটাই তো কথা। আমরা পার্কিং-এ ছিলাম। দেখলাম কয়েকজন লোক একটা গাড়ি খোঁজ করছে। তারা বলল, অল্প কিছুক্ষণ হবে এসেছে প্রাইভেট কার। খুব দামি। পার্কিং লটের ইনচার্জ আপনার গাড়ি দেখিয়ে বলল, এই গাড়ি কিছুক্ষণ আগে এসেছে। এ ছাড়া তিন চার ঘণ্টার মধ্যে আর কোনো প্রাইভেট গাড়ি পার্কিং লটে আসেনি। এই গাড়ির ড্রাইভার ব্যারাকে ১১ নং কক্ষে আছে। লোকগুলো গাড়িটা দেখেই বলল, হ্যাঁ, এই গাড়িটাই আমরা খুঁজছি। তারপর পকেট থেকে কাগজ বের করে গাড়ির নাম্বার, গাড়ির বডির স্টিকার ইত্যাদি মিলিয়ে বলল, হ্যাঁ, এই গাড়িটাই, কিন্তু মিলছে না। আমরা বললাম, এক ব্রান্ড, এক কালারের বহু গাড়ি আছে। আসল হলো নাম্বার ও অন্যান্য স্পেসিফিকেশন। লোকরা বলল, হতে পারে গাড়িটা কোনো প্রাইভেট পার্কিং-এ গেছে। বলে তারা গাড়ির নাম্বার ও ছবি পার্কিং লট ইনচার্জকে দিয়ে বলল, এ গাড়িটা পার্কিং লটে এলে কাগজে লিখা নাম্বারে আমাদের জানাবেন। গাড়িটা খুব বিপজ্জনক। গাড়িটা আমাদের খুব দরকার। গাড়ি খোঁজ করতে আসা ঐ লোকগুলোকে খুব ভালো লোক বলে মনে হয়নি। পকেটে ওদের রিভলবার টিভলবার আছে বলে মনে হয়েছিল।
বলে একটু থামল লোকটি। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলল, তাই ঘটনাটা আপনাকে বলতে এলাম। আপনারা বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন।
মুখে একটু ভীতির ভাব এনে বলল আহমদ মুসা, ধন্যবাদ আপনাদের এমন খবর দেয়ার জন্যে। এখানে কি লোকরা রিভলবার নিয়ে ঘুরাঘুরি করে? আহমদ মুসার কণ্ঠে ভয়ের প্রকাশ।
ওদের মধ্যকার সেই প্রথম লোকটি বলল, না, এমন নয় ব্যাপারটা। উডাং-এর মানুষ শান্তিপ্রিয়। অস্ত্র-টস্ত্র থেকে মানে অশান্তি থেকে তারা সব সময় দূরেই থাকে। বড় বড় মন্দিরে মার্শাল আর্টের কিছু গ্রুপ আছে, তাছাড়াও আরও কিছু ধরনের গ্রুপ আছে তারা কখনও কখনও ভয়ংকর হয়ে উঠে শোনা যায়। কিন্তু সেটা মন্দিরকেন্দ্রিক। বাইরে কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তু আমার ম্যাডামরা তো মন্দির দেখতেই এসেছেন। কোনো অসুবিধা নেই তো?
না, কোনো সমস্যা নেই, চিন্তা করবেন না। বলে তিনজন উঠে দাঁড়াল।
আমরা একটু আসি, কাজ আছে। বলে ওরা চলে গেল।
যে প্রথম কথা বলেছিল, সে ছেলেটি সোফায় একটু গা এলিয়ে বলল, পাশের রুমেই আমি থাকি।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে মিনি ফ্রিজ থেকে কিছু চকলেট নিয়ে একটা প্লেটে তুলে ছেলেটির সামনে টিপয়ে রেখে বলল, এখানে দেখছি চা-টা পেতে ঝামেলা। কি করব তাই চকলেট দিয়েই মেহমানদারী।
এ ধরনের রুমে মেহমানদারীর যা কিছু সুবিধা আছে, আমাদের কক্ষে তার কিছুই নেই। একটা চকলেট বার হাতে তুলে নিতে নিতে বলল ছেলেটি।
কেন ড্রাইভার ব্যারাকের সব রুম এক রকমের নয়? বলল আহমদ মুসা।
না, এক রকম নয়। আপনার এ কক্ষকে ড্রাইভার ব্যারাকের মধ্যে ভিআইপি রুম বলে। স্যাররা, ম্যাডামরা তাদের ড্রাইভারদের জন্যে যে ধরনের রুম চান, সে ধরনের রুম দেয়া হয়। ছেলেটি বলল।
এ ধরনের বৈষম্য ঠিক নয়, খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। বলল আহমদ মুসা।
ওসব থাক! আপনি কি ম্যাডামদের নিয়ে বেরোবেন? ছেলেটি বলল।
বেরোব সন্ধ্যার দিকে। ম্যাডামরা এখন রেস্ট নিচ্ছেন। কিন্তু ভাবছি, কোথায় কোথায় গেলে ভালো হয়, কোথায় কি নিয়ম, এসব আমি কিছুই জানি না। বলল আহমদ মুসা।
এই হোটেলের চারদিকে তিনটা বড় জিনিস আছে দেখার। পারপল মন্দির-প্যালেস, নানিয়ান মন্দির-প্যালেস এবং ড্রাগন কেভ। ড্রাগন কেভ এর সামনে আরেকটা মন্দির আছে। মন্দিরটা ছোট, তেমন কিছু নেই দেখার বা জানার।
ড্রাগন কেভ-এর অনেক নাম শোনা যায়। ওখানে কি আছে? প্রথমেই ওখানে যেতে হতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
আজ আপনারা যেতে পারবেন বলে মনে হয় না। ড্রাগন, কেভ-এর ক্রয় বিভাগে আমার এক আত্মীয় কাজ করে। আমি আজ তার সাথে দেখা। করতে গিয়েছিলাম। আমাকে ভেতরে যেতে দেয়া হয়নি। আত্মীয়টা পরে বাইরে এসে আমার সাথে দেখা করে। সে জানায়, আজ সকাল থেকে সাক্ষাতপ্রার্থী কাউকেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। বিকেল থেকে পর্যটকদেরও ঢুকতে দেয়া হবে না। বিদেশি পর্যটক হলে শুধুমাত্র কে-এ ঢুকতে দেয়া হবে। বিধি-নিষেধ শুধু নাকি আজকের দিনের জন্যে।
ছেলেটি থামলে আহমদ মুসা বলল, একদিনের জন্যে এই বিধি-নিষেধ কেন?
হ্যাঁ, সেটাও সে বলেছিল। সন্ধ্যার পর ড্রাগন কেভ-এর বেশির ভাগ লোক নাকি কোথাও যাবে। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর ড্রাগন কেভে নাকি বন্দিদের কি একটা বিচার বসবে। এজন্যে লোকজনের ঝামেলা থেকে ড্রাগন কেভকে তারা মুক্ত রাখতে চায়।
কেভ কি খুব বড় জায়গা? সেখানে বন্দি, বিচার, এসব কি করে হয়? বলল আহমদ মুসা।
কে খুব বড় নয়, কিন্তু তার উপর যে স্থাপনা তা বেশ বড়। দেখতে দুতলা মনে হবে। কিন্তু আসলে তিন তলা। তিন তলায় মন্দিরের গুরু ও দ্বিতীয় তলায় শীর্ষ স্টাফ ও মেহমানদের থাকার জায়গা। নিচের তলায় কেভ-এর তিন পাশে নিচ্ছিদ্র দেয়াল ঘেরা। তিন পাশে কি আছে কেউ জানে না। বলল ছেলেটি।
পর্যটক কিংবা মন্দিরের কেউ কি ওখানে যেতে পারে না? আহমদ মুসা বলল।
শুনেছি কেভের সম্মুখ দিকে তিন পাশের দেয়াল ঘেরা এলাকায় প্রবেশের কোনো পথ নেই। প্রবেশপথ নাকি পেছন দিকের কোথাও। তাই কেউ ওদিকে যাবার কোনো সুযোগই পায় না। বলল ছেলেটি।
মনে মনে ভীষণ খুশি হলো আহমদ মুসা। অত্যন্ত মূল্যবান খবর পাওয়া গেল ড্রাইভার ছেলেটির কাছে। সম্মুখ দিয়েই কেভে ঢুকার পথ থাকার কথা। এদিক দিয়েই পথ খুঁজে সে বন্দিখানায় যাবার চেষ্টা করতো। আল্লাহ। তাকে বিরাট সাহায্য করেছেন অকল্পনীয় এক পথে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল সে।
তাকাল ড্রাইভার ছেলেটির দিকে। বলল, আমার ম্যাডাম মঙ্গোলিয়ার। মঙ্গোলিয়ার পাসপোর্ট তারা শো করতে পারবে। দেখা যাক ঢুকতে পারা যায়। কিনা। ধন্যবাদ, আপনার কাছে অনেক কিছু জানলাম। বলল আহমদ মুসা।
ড্রাইভার ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। বলল, আসি ভাই, পরিচয় হলো। খুশি। হলাম। সুস্বাদু চকলেটের জন্যে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ভাই, দেখা হবে। বলল আহমদ মুসা। চলে গেল ড্রাইভার ছেলেটি।
আহমদ মুসা তার মোবাইল তুলে নিল। কল করল লু ঝিকে।
কল ধরেই লু ঝি বলল, স্যার, আপনাকে ড্রাইভার ব্যারাকে রেখে এই ভিআইপি রুমটা আমাদের কাছে কাঁটার মতো মনে হচ্ছে।
ওসব চিন্তার প্রয়োজন নেই। আমিও ড্রাইভারদের ভিআইপি রুমে আছি। থাক, এসব কথা। আমি বেরোচ্ছি। তোমরা রেস্ট নাও। মাগরিবের নামাজের পর আমরা বেরোব। আহমদ মুসা বলল।
মাগরিবের নামাজ কয়টায়? বলল লু ঝি।
ও স্যরি, তুমি মাগরিব নামাজের সময় জানবে না। আহমদ মুসা বলল।
স্যরি, আমি জেনে নেব। আপনি সময় বলবেন না। দেখবেন আমি তৈরি হতে পারি কিনা। বলল লু ঝি।
ধন্যবাদ, আমার কথা শেষ। রাখি। তোমরা সাবধানে থেকো। আহমদ মুসা বলল।
আল্লাহ হাফেজ স্যার। বলল লু ঝি।
সুন্দর বলেছ, আল্লাহ হাফেজ। আহমদ মুসা বলল।
৭
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা।
আহমদ মুসার গাড়ি ড্রাগন কেভ-এর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা আরও দক্ষিণে পারপল প্রাসাদের দিকে চলে গেছে, সে রাস্তা ধরে এগোচ্ছে।
ড্রাগন কেভ পেরিয়ে অল্প কিছুদূর যাবার পর টার্ন নিয়ে বামদিকের একটা অস্পষ্ট রাস্তার চিহ্ন ধরে কিছুটা পুবে এগোবার পর দক্ষিণ দিকে টার্ন নিয়ে ড্রাগন কেভ-এর পঞ্চাশ গজের মতো উত্তরে ঝোঁপের আড়ালে গাড়ি দাঁড় করাল। নামল আহমদ মুসা গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসার সর্বাঙ্গ কাল কাপড়ে মোড়া।
লু ঝিও গাড়ি থেকে নামল।
তারও আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা।
ড্রাগন কেভের উত্তর দিকে গোটা এলাকাটাই ছোট গাছ-গাছড়া, ঝোঁপ ঝাড়ে ভরা। তাই অন্ধকারটা বেশ গভীর। এদিকের দেয়ালের পাশে দুইটি আলোর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আজ জ্বলছে না কেন! হতে পারে তারাই কোনো কারণে বন্ধ রেখেছে। ড্রাগন কেভের এদিকের দেয়ালে সিসি টিভি ক্যামেরা আছে, কিন্তু প্রহরীও থাকার কথা, আজ নেই। সিসি ক্যামেরায় নাইটভিশন যুক্ত থাকলেও দেয়ালের গোড়ায় দুই ফুট এলাকায় এ ক্যামেরা কাজ করে না।
আহমদ মুসা বলল, লু ঝি, চেং ঝি যেসব বিষয় আলোচনা হয়েছে, সেই মোতাবেক কাজ হবে।
বলেই আহমদ মুসা নিজেকে মাটিতে ছুঁড়ে দিয়ে গড়াতে শুরু করল। লু ঝিও আহমদ মুসার পেছনে গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটতে শুরু করল। দেয়াল পাওয়ার পর আহমদ মুসা উঠে বসেছে।
লু ঝিও উঠে আহমদ মুসার পাশে বসতে গিয়ে জিব কেটে গজ খানেক দূরে গিয়ে বসল।
বসেই আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল, বিস্ফোরক ইনডিকেটর সবুজ। তার মানে বাইরে পঁচিশ গজের মধ্যে কোনো প্রকার বোমা বা বিস্ফোরক নেই। দেয়ালের ওপারে থাকলে তা ইনডিকেটর শো। করবে না। বডি ইনডিকেটরের কাটাও সবুজের উপর স্থির। বিল্ডিং-এর বাইরে এদিকে কোনো পাহারা তাহলে নেই।
আহমদ মুসা দেয়াল ঘেঁষে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা দেয়ালের যেখানে দাঁড়িয়ে, সে জায়গাটা বিল্ডিং-এর মাঝামাঝি জায়গা থেকে একটু পশ্চিমে।
দেয়ালের গা ঘেঁষে আহমদ মুসা হাঁটতে লাগল দেয়ালের মাঝামাঝি স্থানের দিকে।
ড্রাগন কেভের এ উত্তর পাশটা দেখার জন্যে হমদ মুসা বিকালে এখানে এসেছিল রাখালের ছদ্মবেশে। দেয়ালের কাছাকাছি দিয়ে সে একবার হেঁটে গিয়েছিল। দেখেছিল সে, দেয়ালের মাঝ বরাবর জায়গার ঘাস বেশ কিছুটা দলিত মথিত। এর পাশের দেয়ালে কোনো দরজা থাকবে এটা সে ধরে নিয়েছিল। এরপর অল্প দূরের একটা ঝোঁপের মধ্যে বসে আহমদ মুসা। বিশেষ ধরনের মিনি দূরবীক্ষণ দিয়ে গোটা দেয়াল বিশেষ করে মাঝ এলাকার দেয়াল সে পরীক্ষা করেছিল। কিছুই পায়নি। তবে দেয়ালের মাঝ এলাকায় বটম থেকে সাত ফিট উঁচু এবং পাঁচ ফিট প্রস্থ এলাকার দেয়াল অন্য অংশ থেকে একটু আলাদা- সেটা তার কাছে পরিষ্কার হয়েছিল। কিন্তু খুঁটে খুঁটে দেখেও ডিজিটাল কোনো লক পয়েন্ট বা কী-বোর্ড কিংবা ইংগিতমূলক কিছুই পায়নি।
এই অনিশ্চিত অবস্থার মাঝে আহমদ মুসা এগোচ্ছে দেয়ালের মাঝখানের ঐ জায়গার দিকে। আহমদ মুসা ঠিক করেছে যদি দরজা খোলার কোনো ব্যবস্থা বাইরে না পাওয়া যায়, তাহলে ইভা নারিনের কাছ থেকে পাওয়া যে বিস্ফোরক মাইক্রো চিপস তার কাছে আছে, সেটাই আজ সে ব্যবহার করবে। যেকোনো কংক্রিট বা মেটালে এক বর্গগজ গবাক্ষ সৃষ্টি করা যায় নিঃশব্দে এই বিস্ফোরক মাইক্রো চিপস ব্যবহার করে।
দেয়ালের সেই জায়গাটা তখনও গজ দুয়েকের মতো দূরে।
একটা ভারি ও অব্যাহত শব্দ ভেসে এলো আহমদ মুসার সাউন্ড মনিটর থেকে। সাউন্ড মনিটরের দিকে তাকিয়েই আহমদ মুসা পেছনে মুখ নিয়ে বলল অন্তত তিনটা গাড়ি এদিকে আসছে। যতটা পার পিছিয়ে দেয়ালের পাশে শুয়ে পড় লু ঝি। আহমদ মুসাও পিছিয়ে শুয়ে পড়ল দেয়াল সেঁটে।
এক মিনিটও গেল না।
তিনটি গাড়ি প্রায় নিঃশব্দে জমাট অন্ধকারের মতো এগিয়ে এসে দাঁড়াল দেয়ালের মাঝ বরাবর স্থানে।
গাড়ির লাইট নিভানো। বুঝল আহমদ মুসা, গোপন দরজা দিয়ে ওরাও গোপনে প্রবেশ করে।
তিন গাড়ির মাঝের গাড়িটা দাঁড়াল দেয়ালের সেই মাঝের স্থান বরাবর।
গাড়ি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই আগে-পিছের দুই গাড়ি থেকে ডজন খানেক লোক নামল। তারা মাঝের গাড়ি থেকে দেয়াল পর্যন্ত দুই সারি হয়ে দাঁড়াল।
মাঝের গাড়ির দরজা খোলার শব্দ হলো।
আহমদ মুসা বুঝল নিশ্চয় কোনো শীর্ষ নেতা এসেছে। তাকে নিরাপদ করার জন্যেই দুই সারি মানব ঢাল তৈরি করা হয়েছে। একবার তার মনে হলো, এই মানব ঢালের দুই সারি উড়িয়ে দিয়ে শীর্ষ নেতাকেও শেষ করা সম্ভব। কিন্তু তা করা যায় না। বন্দিদের অবস্থা না দেখা পর্যন্ত যতটা পারা। যায় তার অভিযান গোপন রাখতে হবে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল দেয়াল ঘেঁষে। লোকটির যাওয়া ও দরজা খোলা কিছুই দেখতে পেল না আহমদ মুসা।
ওদিক থেকে একটা অনুচ্চ কণ্ঠ ভেসে এলো, শুধু আমার গাড়িটাই এখানে থাকবে। তোমরা দুই গাড়ি নিয়ে সকলে এখনি চলে যাও হোটেলের দক্ষিণ দিকে হোটেল ও নানিয়ান প্যালেসের মাঝের এলাকায়। খবর পাওয়া গেছে লোকদের আনাগোনা হোটেল এলাকায় অনেক বেড়েছে। আহমদ মুসার আত্মসমর্পণ শেষে তাকে সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত অন্যদের নিয়ে। তোমরা ওখানে থাকবে। কোনো বাধা বা আক্রমণ হলে নির্দয়ভাবে তার। মোকাবিলা করবে।
কথা বন্ধ হয়ে গেল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুই সারি লোক আগে ও পেছনের দুই গাড়িতে উঠে গেল।
চলে গেল দুটি গাড়ি আহমদ মুসাদের পাশ দিয়েই। গাড়ি মুভ করার সময় আহমদ মুসা শুয়ে পড়েছিল। গাড়ি চলে যেতেই উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। লু ঝিও উঠে দাঁড়িয়েছে।
লু ঝি আমি গাড়িটা চেক করব। তুমি দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গাড়িটা বরাবর দেয়ালের স্থান পর্যন্ত এগোও।। কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ক্রলিং করে গাড়িটার দিকে এগোতে লাগল।
আহমদ মুসা গাড়ির সামনের পাশে না গিয়ে উল্টো পাশের দিকে অগ্রসর হলো।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে আহমদ মুসা জানালা দিয়ে উঁকি দিল। ভেতরে আরও বিকট অন্ধকার। চেষ্টা করতেই ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে গেল।
পেন্সিল টর্চ জ্বেলে সিট ও ড্যাশ বোর্ডের কেবিন পরীক্ষা করল। কোনো কিছুই পেল না।
আহমদ মুসা পেছনের সিটের দিকে সরে এলো।
হাতল ধরে টানল। দরজা খুলে গেল। লক করা নেই গাড়ি। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, এদের কনফিডেন্স এত বেশি! আর আহমদ মুসা আত্মসমর্পণ করছে, এ নিয়ে তারা সম্ভবত আজ খুব বেশি আত্মহারা হয়ে পড়েছে। দশ বারোজন প্রহরী সম্ভবত এখানে থাকার কথা। তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে আহমদ মুসাকে হাতে পাওয়া নিশ্চিত করার জন্যে। বুঝা। যাচ্ছে, জোয়ান উ উডাং আর্মির সমস্ত মনোযোগ আজ আহমদ মুসার আত্মসমর্পণের ঘটনার দিকে। আর এখানে বিচারের জন্যে তো বেশি লোক দরকার নেই।
আহমদ মুসা দরজা খুলে গাড়ির পেছনের সিটে প্রবেশ করল। জালাল পেন্সিল টর্চ। ঘুরিয়ে নিল সিটের উপর দিয়ে। কিছু নেই। মেঝেতে কোনো ব্যাগ-ট্যাগ নেই তো? পেন্সিল টর্চের মুখ ঘুরাল নিচে, মেঝের দিকে।
টর্চের ফোকাস প্রথমেই গিয়ে পড়ল মোবাইল ধরনের কিছুর উপর। বিস্ময় নিয়ে তুলে নিল জিনিসটা।
তুলতে গিয়েই বুঝল, এটা মোবাইল নয়, রিমোট কনট্রোল।
রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আহমদ মুসা তাকিয়ে রিমোট কনট্রোলের দিকে। রিমোটটা কি গাড়ির জন্যে?
রিমোটের কমান্ডগুলো পরীক্ষা করল আহমদ মুসা। না, গাড়ির কোনো কমান্ড এতে নেই। তাহলে?
রিমোট কি তাহলে ড্রাগন কেভের?
আবার নজর বুলাল আহমদ মুসা রিমোটের কমান্ড কীগুলোর উপর। কমান্ড কী বেশ অনেকগুলো। এগুলোর মধ্যে নিশ্চয় এই দরজা খোলার কমান্ড থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
ভালো করে দেখতে গিয়ে বুঝল আহমদ মুসা, কমান্ড অ্যালফাবেট-এ ক্যামোফ্লেজ করা হয়েছে। যেমন- POD, LCD, পর পর সাজানো এই একজোড়া বর্ণগুলোর দুই D-এর অর্থ করল ডোর। D থেকে পড়লে প্রথম তিন বর্ণের অর্থ দাঁড়ায় Door opeil, দ্বিতীয় তিন বর্ণের তাহলে অর্থ দাঁড়াচ্ছে। Door close, পরের দুই জোড়া বর্ণের অর্থ নিয়ে সমস্যায় পড়ল আহমদ মুসা। DNO এবং DNC এই দুই জোড়া বর্ণের অর্থ আগের দুই জোড়া বর্ণের অভিজ্ঞতা অনুসারে দুই জোড়ার D-এর অর্থ Door এবং 0, C-এর অর্থ open ও close কিন্তু দুই জোড়ার কমন বর্ণ N-এর অর্থ কি? চিন্তা করে অর্থ খুঁজে পেল না। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো N-এর অর্থ ব্যাখ্যামূলক বা গুণবাচক হতে পারে। কিসের ব্যাখ্যা কিংবা তার বিশেষণ? দুইজোড়া বর্ণমালায় তিনটি শব্দ আছে। একটি Door, অন্যটি open এবং শেষ শব্দটি close। তিন শব্দের মধ্যে বিশেষ পদ একটিই। সেটা হলো D। তাহলে বিশেষণটা Door শব্দেরই হতে পারে। আগের দুই Door শব্দের বিশেষণ নেই, এখানে বিশেষণ কেন? হঠাই আহমদ মুসার মনে কথাটা এলো যে, আমাদের সামনের এ ডোরটা তো North Door, মূল ফ্রন্ট ডোরের বিপরীত দিকে। মন আনন্দে নেচে উঠল আহমদ মুসার।
N-এর অর্থ তাহলে North, এটাই উত্তর। আলহামদুলিল্লাহ, প্রধান দরজা খোলার কোড নাম্বার তাহলে আমরা পেয়ে গেলাম। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
রিমোট হাতে নিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। মাথা নিচু করে এক দৌড়ে আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়াল দেয়ালের পাশে। লু ঝিও দাঁড়িয়েছিল।
লু ঝি, আমরা সম্ভবত এ দরজা খোলার রিমোট কমান্ড পেয়ে গেছি। বলল আহমদ মুসা।
আলহামদুলিল্লাহ, গাড়িতে পেলেন? লু ঝি বলল।
হ্যাঁ লু ঝি। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, লু ঝি দেখে নাও তোমার রিভলবার। ফুল লোডেড কিনা, সাইলেন্সার ঠিক আছে কিনা।
আপনাকে আসতে দেখেই পরীক্ষা করে নিয়েছি স্যার। লু ঝি বলল।
লু ঝি’র কথা শেষ হতেই দেয়ালে একটা হিস-স-স শব্দ উঠল। আর চোখের পলকে দেয়ালের একটা অংশ সরে গেল।
সরার সুযোগ পেল না আহমদ মুসা। খোলা দরজার একেবারে মধ্যখানে সে।
সরে যাওয়া দেয়াল তখনও তার শেষ প্রান্তে পৌঁছেনি, আহমদ মুসা। শোল্ডার হোলস্টারের দিকে হাত চালিয়ে গাছ থেকে পাকা ফল পড়ার মতো ঝুপ করে বসে পড়ল।
এক ঝাঁক গুলি আহমদ মুসার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
আহমদ মুসার বসে পড়তে যে সময় লেগেছে, তার মধ্যেই তার ডান হাত বেরিয়ে এসেছে মেশিন রিভলবার নিয়ে এবং গুলিবৃষ্টি শুরু করেছে। গোটা দরজা কভার করে কিছু না দেখেই।
নিঃশব্দ গুলিবৃষ্টি।
ওদের গুলির শব্দ হয়নি। গুলি করতে করতেই আহমদ মুসা শুয়ে পড়েছিল।
লু ঝি’র অবস্থানটা ছিল দেয়ালের আড়ালেই। তারও হাতে রিভলবার উঠে এসেছিল। কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। কি করবে বুঝতেও পারছিল না।
দরজা খুলে গেলেও কোনো আলো কিন্তু বাইরে আসেনি। সোবহে। সাদেক শুরু হওয়ার মতো একটা স্বচ্ছতা মাত্র দরজার উপর।
ওদিক থেকে আর গুলি আসতে না দেখে আহমদ মুসা গড়িয়ে এগোলো দরজার দিকে।
লু ঝিও এগিয়ে এলো হামাগুড়ি দিয়ে।
স্যার, দরজার উপর ও পেছনে মিলে তিনটি লাশ পড়ে আছে স্যার। ফিসফিসে কণ্ঠে বলল লু ঝি।
আহমদ মুসা উঠে বসল। হাতঘড়ির দিকে তাকাল হিউম্যান বডি ইনডিকেটরের দিকে। দেখল, আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। সবচেয়ে কাছে যে, সেও দশ ফুট দূরে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
লু ঝি সাইলেন্সার লাগানো ওদের একটা কারবাইন তুলে নাও। বলল আহমদ মুসা। নিজেও একটা তুলে নিয়ে কাঁধে ঝুলালো।
দরজার পরেই একটা ঘর।
ঘরটির সিলিং-এ একটা মাত্র সাদা শেডে ঢাকা আলো। ঘরে স্বচ্ছ অন্ধকার।
আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করল। তার পাশে লু ঝি। ঘরে একটা মাত্র দরজা, বাইরের দরজার বিপরীত দিকে।
রেডি লু ঝি। বলে আহমদ মুসাও ডান হাতে মেশিন রিভলবার বাগিয়ে বাম হাত দিয়ে দরজার নব ঘুরালো।
খুলে ফেলল দরজা। বাইরেটা আলোয় প্লাবিত।
সে আলোর প্লাবন এ ঘরেও প্রবেশ করল। বাইরে একটা করিডোর। আহমদ মুসা ও লু ঝি বেরিয়ে এলো করিডোরে।
হিউম্যান ইনডিকেটরের দিকে আবার তাকাল আহমদ মুসা। সেই দশ গজ দূরের লোকটি এখন মাত্র তিন গজ দূরে। তার সাথে জুটেছে আরেকজন।
করিডোরটা দেখা যাচ্ছে পশ্চিম দিকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। আর পুবে ফুট তিনেক এগিয়ে দক্ষিণ দিকে টার্ন নিয়েছে। তিন গজ দূরের ঐ দুজন লোক উত্তরমুখী করিডোরটির এ মাথার দিকেই কোথাও আছে।
আহমদ মুসা দক্ষিণের করিডোর ধরেই এগোবার সিদ্ধান্ত নিল। হিউম্যান বডির ডটগুলো সব ঐ দিকেই দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে এক জায়গায় গুচ্ছাকারে বেশ কিছু ডট দেখা যাচ্ছে।
বুকে ঝুলন্ত সাউন্ড মনিটর আহমদ মুসা তুলে নিয়ে একটা কানে সেট করল।
সাউন্ড মনিটরে কয়েকটা কণ্ঠ ভেসে এলো।
পঁচিশ গজ দূর পর্যন্ত একটা চামচ মাটিতে পড়ার শব্দও মনিটরিং-এ ধরা পড়ে।
সবচেয়ে কাছ থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো, স্যার, আমি বো চেং। জি সেংগ আমার সাথে।
উত্তরে একটু দূরের একটা কণ্ঠ ভেসে এলো, আমার বডি গার্ড তিনজনকে পাঠিয়েছিলাম। তাদের একজন গাড়ি থেকে রিমোটটা নিয়ে আসবে। আর দুজন পেছনের দিকে চোখ রাখবে। একটু দেখ, এখনও ফিরছে না কেন রিমোট নিয়ে। ওদিকে ডি ঝিকে বলে দিয়েছি। ওরাও যাচ্ছে। আজ লোক কম। সবাইকে এলার্ট থাকতে হবে, এটা মাই লর্ডের নির্দেশ। কোনো গাফিলতি যেন না হয়।
ইয়েস স্যার। আমরা যাচ্ছি। বলল কাছের কণ্ঠ, বো চেং।
আহমদ মুসা মেশিন রিভলবার বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে তুলে নিল। ক্লোরোফরম-গান।
লু ঝি তুমি পেছনে চোখ রাখবে।
বলে আহমদ মুসা করিডোর ধরে পুব দিকে হাঁটা শুরু করল।
লু ঝি আহমদ মুসার পেছনে। সে পেছন দিকে চোখ রেখে উল্টো হাঁটছে।
হঠাৎ পেছন থেকে লু ঝি’র চাপা কণ্ঠ, স্যার…।
স্যার শব্দ শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা দুই হাত সামনে ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে। অন্যদিকে লুঝিও তার কারবাইনের ট্রিগার চেপে ধরে বসে পড়েছে। শুয়ে পড়েও শুনল লু ঝি’র কারবাইন গুলি বন্ধ করেনি।
আহমদ মুসা পেছনটা দেখতে যাচ্ছিল। কিন্তু দক্ষিণমুখী করিডোর থেকে একাধিকজনের দৌড়ানোর শব্দ কানে এলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই দুজন দৌড়ে এসে উঠল এ করিডোরে।
ওদের হাতে উদ্যত কারবাইন। কিন্তু কারবাইনের ব্যারেল উত্তরমুখী তখনও।
ওরা আহমদ মুসাদের দেখতে পেয়েছে। দ্রুত ব্যারেল ঘুরিয়ে নিচ্ছে ওরা কারবাইনের।
আহমদ মুসার দুই হাতই সামনে প্রসারিত ছিল। ওদের দৌড়ানোর শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মেশিন রিভলবারের ব্যারেল উঁচু করেছে ওদিক থেকে আসা করিডোরের মুখ লক্ষ্যে।
ওদের কারবাইনের ব্যারেল টার্গেটে আসার আগেই গুলির ঝাকের মধ্যে তারা ডুবে গেল।
পেছনে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল করিডোরের পশ্চিম মাথার দিকে তিনজনের লাশ পড়ে আছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ধন্যবাদ লু ঝি।
ধন্যবাদের কিছু নেই স্যার। পেছনটা তো আপনিই দেখতে বলেছিলেন। আর ভাগ্য ভালো যে, গুলিটা আগে করতে পেরেছিলাম।
সেজন্যেই ধন্যবাদ তোমাকে। আজকের যুদ্ধ গতির প্রতিযোগিতা। কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, এস।
দ্রুত হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসা দক্ষিণমুখী করিডোরের দিকে। বলল, আমাদের দ্রুত হতে হবে লু ঝি। বন্দিদের নাকি আজ বিচার করছে। ওরা। মূল্যবান জীবনগুলোর ক্ষতি হবার আগে আমাদের সেখানে পৌঁছতে হবে।
পেছনে চোখ রেখেই ডবল মার্চ করে লু ঝি আহমদ মুসার পেছনে চলছে।
আহমদ মুসাকে গাইড করছে তার সাউন্ড মনিটর। সে শুনতে পেল একটা মহিলা কণ্ঠ, তোমরা আমাকে মারতে পার, কিন্তু ফর্মূলা তোমরা পাবে না।
আমরা তোমাকে মারার জন্যে এখানে আনিনি। তুমি মৃত্যু চাইবে কিন্তু পাবে না, তোমার এই হাল আমরা করব। আমরা ফমূলা না পাওয়া পর্যন্ত এটা চলবে।।
বলে পুরুষ কণ্ঠটি একটু থেমেই আবার বলে উঠল, শেষবারের মতো বলছি ফমূলা তুমি আমাদের দেবে।
আমার কথা আমি বলেছি। বলল মহিলা কণ্ঠ।
পুরুষ কণ্ঠটি চিৎকার করে উঠল, জং ডিং তুমি এবার এস। ফা জি ঝাও এখন তোমার।
একটা তরুণ পুরুষ কণ্ঠ চিৎকার করে কেঁদে উঠল, আপা দিয়ে দাও। ফমূলা। কিছুই করতে পারবে না ওরা ওটা দিয়ে। আল্লাহর কসম, দিয়ে দাও ফর্মূলা।
চোখ বন্ধ করো মা ঝু। দেখ না পৃথিবীকে। অন্যায়ের পক্ষে আল্লাহর কসম হয় না। আমেরিকার গোটা শক্তি নিউরো বিজ্ঞানী ড. আফিয়ার মনকে মারতে পারেনি, আমারও পারবে না। আমার আল্লাহ সর্বশক্তিমান। চিৎকার করে বলল ফা জি ঝাও।।
মনটা থর থর কেঁপে উঠল আহমদ মুসার। দুই পা তখন অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটতে শুরু করেছে।
.
ফা জি ঝাও-এর কথা শেষ হতেই জোয়ান উ আর্মির পেশাদার কিলার ছোট বেলমাথার বিশাল বপু জং ডিং এক লাফে ফা জি ঝাও-এর সামনে গিয়ে হিংস্র বাঘের মতো দুই হাত দিয়ে তার মাথার হেডড্রেস খুলে নিল। টেনে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলল গায়ের ওড়না।
ড. ডাসহ সবাইকে এনে সারিবদ্ধভাবে এই সেলে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। দুহাত পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছিল মা ঝু সুলতান এবং ইরকিন আহমেদ ওয়াং-এর। অপমান লাঞ্ছনা থেকে বাঁচানোর জন্যে তারা নিজেদের ও ফা জি ঝাও-এর কিছু করে না বসে, এজন্যেই এই সতর্কতা। অন্যদের শাসিয়ে দেয়া হয়েছে, কেউ মাথা নিচু করতে পারবে না, কেউ চোখ বন্ধ করতে পারবে না।
পশু জং ডিং যখন ফা জি ঝাও-এর ওড়না টেনে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলল, তখন ড. ডা. সেলের পাশ থেকে লাফ দিয়ে জং ডং-এর সামনে গিয়ে পড়ল। ফা, জিঝাও এর সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বলল, দেশের একজন সম্মানিত বিজ্ঞানী, সম্মানিত মহিলা ইনি, এর গায়ে হাত দিতে পারবে না।
জং ডং একবার তাকাল ড. ডার দিকে। শিকার পাগল বাঘের মতো তার বেপরোয়া হিংস্র দৃষ্টি। সে দুহাত দিয়ে ড. ডার দুকাধ ধরে ছুঁড়ে দিল। দেয়ালের দিকে।
ড. ডার দেহ গিয়ে, লোহার বারে ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পড়ল মেঝের উপর।
সাবাস জং ডং। তোমার পুরষ্কার ডবল করব। বলল হুই দাই, জোয়ান উ বাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ।
উৎসাহিত হয়ে জং ডং আবার হাত বাড়িয়ে এগোলো ফা জি ঝাও-এর। দিকে।
পাথরের মতো স্থির, মৌন ফা জি ঝাও মাটির উপর আছড়ে পড়ল এবং সেজদায় পড়ে গেল।
জং ডং একটু ঝুঁকে পড়ে ফা জি ঝাও-এর পিঠে হাত দিয়ে, তার জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলল।
ফা জি ঝাও সিজদা থেকে একটুও নড়ল না। জং ডং এবার ফা জি ঝাও-এর নগ্ন পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। থাম বজ্রের মতো ধ্বনিত হলো একটা কণ্ঠ।
একটু মাথা তুলেছিল জং ডং পেছনে তাকাবার জন্যে। আগুন জ্বলে উঠেছিল তার দুচোখে। কিন্তু তার আগুন দৃষ্টি আর পেছনে গেল না।
পরপর দুটি গুলি ঢুকে গেল তার ছোট বেল মাথায়।
তার বিশাল দেহটা একবার দুলে উঠে পেছনে আছড়ে পড়ল।
হুই দাই বিশাল চেয়ারে বসে জং ডং-এর কাজের মজা উপভোগ করছিল।
থাম শব্দের বাজ পড়ার পর জং ডং-এর মতো সেও পেছনে ঘুরাচ্ছিল তার মাথা। গুলির শব্দ কানে যাবার পর সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। হাতের কারবাইন সে ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। কারবাইন ঘুরাতে পারলেও টার্গেটে তুলে আনতে সময় পেল না। পরপর দুটি গুলি এসে তার মাথাও গুড়ো করে। দিল।
ওদিকে চারজন স্টেনগানধারী সেলের বাইরে ছিল। তারা ঘটনার আকস্মিকতা, জং ডং ও হুই দাই গুলিবিদ্ধ হওয়ায় কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল।
সংবিৎ ফিরে পেতে তাদের দেরি হয়নি।
বেপরোয়া গতিতে তাদের স্টেনগান উঠে আসছিল আহমদ মুসা ও লু ঝি’র লক্ষ্যে।
কিন্তু লু ঝি শুরু থেকেই ওদের পাহারায় ছিল।
ওদের স্টেনগান তুলতে দেখে চিৎকার করে বলল লু ঝি, তোমাদের গান ফেলে দাও, না হলে সবাই মারা পড়বে।
কিন্তু লু ঝি’র কথা ওদের কানেই যেন গেল না। লু ঝি ট্রিগার চাপল তার কারবাইনের। গুলির আঁক বেরিয়ে গেল তার কারবাইন থেকে। চারজন লাশ হয়ে পড়ে গেল।
লু ঝি তুমি ব্যারাকের প্রবেশপথটা সামলাও। আমি সেলের ভেতরটা দেখি।
সেলের ভেতরের লোকদের আতঙ্ক, বিমূঢ়তা ধীরে ধীরে কাটছে।
আহমদ মুসা সেলে প্রবেশ করেই তার জ্যাকেটের উপর আরও যে। একটা কালো জ্যাকেট পরেছিল, সেটা দিয়ে ফা জি বাও-এর গা ডেকে দিল।
ফা জি ঝাও তখনও সিজদায় পড়ে ছিল।
বোন ফা জি ঝাও উঠ, আল্লাহ আমাদের কথা শুনেছেন।
বলেই আহমদ মুসা ছুটল ড. ডার কাছে। সে তখন উঠে দাঁড়াচ্ছিল। তার কপাল ফেটে গেছে। রক্ত ঝরছিল।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে তাকে ধরল। বলল, স্যার, আপনি ঠিক আছেন? আর কোথাও আঘাত লাগেনি তো?
ঠিক ছিলাম না বেটা, তুমি ঠিক করে দিয়েছ। এখন শরীরে যে এনার্জি এসেছে, তাতে আমি একশ মিটারের রেস দিতে পারব। বলল ড. ডা।
আলহামদুলিল্লাহ। বলে আহমদ মুসা তাকে একটা ছোট চেয়ার পেয়ে। তাতেই বসাল।
তারপর আহমদ মুসা ছুটল মা ঝুদের দিকে।
মা ঝু সুলতান, ইরকিন ওয়াং, চাও জিয়াংদের অপলক বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। এই হলো তাদের অনেক শোনা গল্পের নায়ক আহমদ মুসা! ড. ডা ঠিকই বলেছিল আল্লাহর সৈনিক আহমদ মুসা নিশ্চয় আসবে। আমাদের উদ্ধার করতে। সত্যিই আহমদ মুসা এসেছে একেবারে ঠিক মুহূর্তে। আর তাকে মনে হচ্ছে না অচেনা লোক। বহুকালের চেনা যেন সে। ফা জি ঝাওকে, সে বোন ডাকল। সে ডাক যেন শুধু ডাক নয়, হৃদয়ের অফুরান আবেগ, আন্তরিকতা জড়িত একান্ত আপন এক সম্বোধন।
এসবই ভাবছিল মা ঝু সুলতান এবং ইরকিন আহমেদ ওয়াংরা।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে প্রথমে ইরকিন আহমেদ ওয়াং-এর বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, জনাব, শরীর আপনার ভালো আছে তো? আপনার নাম
আমি শুনেছি আহমদ ইয়াং-এর কাছে।
আমি আপনার নাম অনেক শুনেছি। গতবার আপনি যখন সিংকিয়াং এ আসেন। তখন আমি বেইজিং-এ ছিলাম।
ইরকিন ওয়াং একটু থামল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, অনেক ধন্যবাদ, অনেক কৃতজ্ঞতা আপনাকে।
ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা সব আল্লাহর জন্যে। আর আমাকে দয়া করে। আপনি নয়, তুমি বলবেন। বয়স, স্ট্যাটাস সব দিক থেকেই আপনি আমার গুরুজন। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা এজন্যেই তুমি এত বড়, আল্লাহর এত দান, এত দয়া তোমার উপর। আমরা গর্বিত তোমার জন্যে। ইরকিন ওয়াং বলল অরুদ্ধ কণ্ঠে। তার দুচোখ দিয়ে গড়াচ্ছে অশ্রু।
আহমদ মুসা এগোলো মা ঝু সুলতানের দিকে। তার হাতের বাঁধন খুলে দিল। জড়িয়ে ধরল আস্তে যাতে তার আহত কাঁধে আঘাত না লাগে সেভাবে।
মা ঝুও জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
জড়িয়ে ধরে রেখেই আহমদ মুসা বলল, তোমার জন্যে একটা মেসেজ আছে, লিয়েন হুয়ার মেসেজ। তোমার দেখা পেলে সে বলতে বলেছে যে, সে ভালো নেই।
মা ঝু’র দুই চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছিল।
আহমদ মুসার দেয়া মেসেজটি শুনে সে মুখ নিচু করল।
আহমদ মুসা তার মুখ উঁচু করে তুলে ধরে চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে বলল, নেতার চোখে অশ্রু থাকতে নেই। আর মুখ নিচু করবে কেন? আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে মাথা নত করবে না।
আমি কবে নেতা হলাম। আমাদের নেতা তো আপনি। এতদিন স্বপ্নে দেখেছি। আজ জাগরণে দেখলাম। বলল মা ঝু।
মা ঝু তুমি ফা জি বাওকে দেখ। জ্যাকেটটা পরতে বলল। হেড ড্রেসটা তাকে দাও। দেখি লু ঝি’র কাছে ওড়না জাতীয় কিছু আছে কিনা।
আহমদ মুসা এগোলো ড. ডার সহকর্মী চাও জিয়াং-এর দিকে এগিয়ে। তার সাথে হ্যান্ডশেক করল। বলল, কোনো অসুবিধা নেই তো স্যার আপনার?
চাও জিয়াং জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ড. ডার কাছে। আপনার কথা এত শুনেছি যে, আপনি আমাদের একেবারেই আপন হয়ে গেছেন। যেন অনেক…।
চাও জিয়াং-এর কথার মাঝখানেই ড. ডা একটু কণ্ঠ চড়িয়ে বলল, আমি আহমদ মুসা সম্পর্কে এক বর্ণও যে বানিয়ে বলিনি, তা এখানে প্রমাণ হয়ে গেল। শক্তি-মনুষ্যত্ব-মমতার এমন বিস্ময়কর প্রতিমূর্তি আমি কোথাও দেখিনি, আপনারাও কোথাও দেখবেন না।
একটা ছোট আপত্তি স্যার। আপনি যে গুণের কথা বললেন এর কোনটার মালিক আমি নই। যা কিছু আমার সবই আমার আল্লাহর এবং আমি তা আমার ধর্মের মাধ্যমে পেয়েছি। পশুর অধম হওয়া থেকে বাঁচিয়ে আহসানে তাকবীম হওয়ার পথে চলার সুযোগ আল্লাহই দয়া করে আমাকে দিয়েছেন। বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ আবেগে ভরা।
লু ঝি এদিকে একটু এগিয়ে এসেছে। বলল, এক্সকিউজ মি স্যার, কোথাও আপনি জরুরি কল করতে চেয়েছিলেন। লু ঝি বলল।
ধন্যবাদ লু ঝি।
বলেই আহমদ মুসা মোবাইল বের করে দ্রুত একটা কল তৈরি করল।
ওপারে সাড়া পেয়েই শুভেচ্ছা জানিয়ে আহমদ মুসা বলল, কর্নেল আপনার ফোর্স তো এখন এ বাড়ির চারদিকে, তাই না?
ইয়েস স্যার। বলল কর্নেল।
ধন্যবাদ। বাইরে থেকে কেউ যেন এ বাড়িতে ঢুকতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করে আপনারা বাড়ির ভেতরে আসুন। যারা বন্দি ছিলেন, তারা সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। জোয়ান উ আর্মির প্রধান কমান্ডারসহ ওদের চৌদ্দজন মারা গেছে। আর ওদিকের অবস্থা কি? জোয়ান উ আর্মির এখানকার জনশক্তির অধিকাংশই অবস্থান নিয়েছিল আত্মসমর্পণের এলাকায়।
সাদা পোশাকে আমাদের স্পেশাল ফোর্স ও পুলিশ গোটা এলাকা ঘিরে ফেলেছিল। সংঘর্ষে আমাদের একজন আর্মি অফিসার ও একজন পুলিশ কর্মী মারা গেছে। ওদের দশজন মারা গেছে। বাকি সবাই ধরা পড়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন এবং এ ঘাঁটির দায়িত্ব নিন। জোয়ান উ আর্মির মূল যে নেতা, আশেপাশেই কোনো ঘাঁটিতে থাকার কথা। আমি তার সন্ধান করতে চাই। আপাতত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ যারা মুক্ত হয়েছেন, তারা হোটেলের প্রটেক্টেড একটা অংশে উঠার কথা। ওদিকে কি অবস্থা? বলল আহমদ মুসা।
আপনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই কাজ হয়েছে। সব রেডি স্যার। ওখানে একজন মেজরের নেতৃত্বে একটা সেনা ইউনিট দায়িত্ব পালন। করবে। কর্নেল বলল।
তাহলে একটা সেনা ইউনিটের পাহারায় এদের এখনি হোটেলে শিফট করতে হবে। এদের বিশ্রাম প্রয়োজন। বলল আহমদ মুসা।
ব্যবস্থা করছি স্যার। কর্নেল বলল।
ধন্যবাদ অফিসার। বলে আহমদ মুসা মোবাইল রাখল। মোবাইল রাখতেই অয়্যারলেস বিপ বিপ করে উঠল আহমদ মুসার। অয়্যারলেস হাতে নিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কল।
অয়্যারলেস ওপেন করতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে উঠল, ধন্যবাদ আহমদ মুসা। অনেক কৃতজ্ঞতা আমাদের। প্রেসিডেন্ট আপনাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। আপনি একটু সুস্থির হলেই তার সাথে কথা বলতে তিনি অনুরোধ করেছেন। আমরা সবাই আনন্দিত, আপনার পরিকল্পনা পুরোপুরি সফল। এখন বলুন আপনার কাছে কিছু শুনতে চাই।
আহমদ মুসা গোটা বিষয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ব্রিফ করে বলল, আসল লোক, যিনি সর্বময় নেতা, ড্রাগন কেভে ছিলেন না। যে দুজনকে বন্দি করা গেছে, তাদের কাছে আসল নেতার অবস্থান ব্যাপারে একটা কু পেয়েছি। তার সন্ধানে আমি সেখানে যেতে চাই।
এখনি আহমদ মুসা? বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বেশি সময় পেলে অন্য কোথাও চলে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। হবে। আমি তাকে সময় দিতে চাই না স্যার। বলল আহমদ মুসা।
তোমার কথা ঠিক আহমদ মুসা। তুমি একা যাবে? জিজ্ঞাসা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।
লু ঝিকে সাথে নেব। এই অভিযানেও সে এবং তার পিএস আমার সাথে ছিল। বলল আহমদ মুসা।
তোমার আর কিছু প্রামর্শ? বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
যে বাড়িতে এখন যাব তার সন্ধানে, আমি চাচ্ছি সেখানে সাদা পোশাকে একটা আর্মি ইউনিট থাক। কিন্তু তারা মোতায়েন হবে আমি সেই বাড়িতে ঢোকার পর। বলল আহমদ মুসা।
ওখানকার কর্নেলকে আমি বলে দিচ্ছি। সে আপনার নির্দেশ। মোতাবেক কাজ করবে। আর একজন জেনারেলকে সেখানে আমরা পাঠাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও ওখানে আসছি। খুব বড় ঘটনা তুমি ঘটিয়েছ আহমদ মুসা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
আপনারা এলে খুব খুশি হবো। আর একটা কথা স্যার, বন্দিত্ব থেকে যারা মুক্ত হলেন, তারা এখন কোথায় যাবেন? বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ওরা সবাই প্রেসিডেন্টের মেহমান। সবাই ওরা বেইজিং আসবেন। তারপর নিরাপত্তার বিষয়টা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
ধন্যবাদ স্যার। ঠিক সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট নিয়েছেন। বলল আহমদ মুসা।
আর কিছু কথা আছে আহমদ মুসা? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
না নেই। ধন্যবাদ স্যার। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। ঈশ্বর আপনাকে ভালো রাখুন। বাই।
অয়্যারলেস রাখতেই মা ঝু বলে উঠল, আপনি কি এখনি আরেক অভিযানে বেরোবেন? মা ঝু বলল।
হ্যাঁ মা ঝু। আসল যে নেতা, সর্বময় নেতা যিনি, তিনি ধরা পড়েননি। আমি তার সন্ধানে বেরোব। তাছাড়া আহমদ ইয়াংকে এখানে পাওয়া গেল না। যে দুজন বন্দি হয়েছে, তাদের কাছে শুনেছি, আরেকজন বন্দিকে আশেপাশেই কোথাও রাখা আছে। অতএব আমাকে বেশ কয়েক জায়গায় যাওয়া লাগতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
কেন আর্মি, পুলিশ হাজির আছে, তারাই তো এটা পারে। ড. ডা বলল।
স্যার, এসব অভিযান নীরবে, এককভাবে হতে হয়। আর্মি, পুলিশ যে হৈচৈ বাঁধায়, তাতে ভালোও হয়, খারাপও হয়। যেমন ধরুন, এই যে কমান্ডার মারা গেছে, সে যদি দুএক মিনিট আগেও জানতে পারত, সে আক্রান্ত হচ্ছে। বন্দিদের মুক্ত করতে কেউ আসছে, তাহলে আপনাদের সবাইকে এভাবে আমরা নাও পেতে পারতাম। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ব্যাপারটা আমার কাছে মিরাকল মনে হচ্ছে। দেখছি, গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে তুমি তোমার পেছনে নিয়ে এসেছ। কি করে সম্ভব হলো এটা? ইরকিন ওয়াং বলল।
কারণ আমি নিজের জন্যে কিছু করছি না। চীনের কিছু সম্মানিত মানুষ এবং চীনের জনগণের জন্যে কাজ করছি। সরকারও এটাই চেয়েছে করতে। ফলে আমরা পরস্পরের সহযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছি। বলল আহমদ মুসা।
ইরকিন ওয়াং-এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল।
এ সময় কর্নেল তার টিম নিয়ে সেলের সামনে এসে আহমদ মুসাকে স্যালুট দিয়ে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।
কর্নেল ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি কি ওদিকে লাশ ও দুজন বন্দি পেয়েছেন? বলল আহমদ মুসা।
স্যার ওদিকে আটটি লাশ ও দুজন বন্দিকে পেয়েছি। এখানে দেখছি ছয়টি লাশ। মোট ১৪টি লাশ ও দুজন বন্দি পাওয়া গেল। এই তো স্যার? কর্নেল বলল।
এ ছাড়া ওদের আর কোনো লোক আছে বলে মনে হয় না। আপনার লোকরা দোতলা, তিনতলায় গেছেন? বলল আহমদ মুসা।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে উপরে কাউকেই পাওয়া যায়নি। কর্নেল বলল।
ওরা যাদের বন্দি করে রেখেছিল, তাদের মধ্যে মুক্ত পাঁচজন এখানে রয়েছেন।
বলে আহমদ মুসা তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, প্লিজ কর্নেল, এখনি এঁদের হোটেলে শিফট করার ব্যবস্থা করুন।
গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে স্যার। আপনি অনুমতি দিলে তাদের…।
হ্যাঁ কর্নেল, সবাইকে গাড়িতে তুলে দিচ্ছি, চলুন।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল লু ঝি’র দিকে। বলল, লু ঝি, তোমার সেক্রেটারি চেং ঝি কি গেটে এসেছে?
জি স্যার, ঠিক সময়েই সে এখানে এসেছে। আমার সাথে কথা হয়েছে। লু ঝি বলল।
ধন্যবাদ লু ঝি, তুমি ফা জি ঝাও এবং মা ঝু সুলতানকে তোমার। গাড়িতে নাও। তুমিও সাথে যাবে।
বলেই আহমদ মুসা তাকাল কর্নেলের দিকে। বলল, তাহলে আর একটা গাড়ি লাগছে, তাতে উঠবেন ড. ডা, জনাব ইরকিন ওয়াং এবং চাও। জিয়াং। সাথে আপনাদের গাড়ি তো থাকছে কর্নেল।
ইয়েস স্যার, দুই গাড়ির আগে পেছনে আমাদের দুইটি গাড়ি থাকবে।
ধন্যবাদ কর্নেল চলুন। বলল আহমদ মুসা।
ফা জি ঝাওকে ধরে নিয়ে চলল লু ঝি। তাদের পেছনে মা ঝু সুলতান। আহমদ মুসা ড. ডা এবং ইরকিন ওয়াংকে সাথে নিয়ে এগোলো।
ইরকিন ওয়াং আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি তো হোটেলে যাচ্ছ না?
হ্যাঁ, এখন যাচ্ছি না। তবে আপনারা যাওয়ার আগে আমি হোটেলে পৌঁছব আশা করি, যদি অভিযানের কাজটা তার আগে শেষ হয়। আর দেখা করতে না পারলে বেইজিং-এ তো দেখা হবেই জনাব। বলল আহমদ মুসা।
তোমার সাথে অনেক কথা আছে আহমদ মুসা। তুমি আমার, মা ঝুদের জীবন বাঁচালে। সংকট কিন্তু মাথায় চেপে বসে আছে। ইরকিন ওয়াং বলল।
আমি জানি জনাব। সব সংকট আল্লাহ দূর করে দেবেন। বলল আহম
আলহামদুলিল্লাহ। আমি এখন আশাবাদী আহমদ মুসা। মা ঝু সুলতানের সাথেও অনেক কথা হয়েছে। ইরকিন ওয়াং বলল।
ধন্যবাদ জনাব। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। বলল আহমদ মুসা।
সবাই গেটে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল।
ড. ডা এবং ইরকিন ওয়াংকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আহমদ মুসা লু ঝিদের গাড়ির কাছে গেল।
মা ঝুরা সবাই গাড়িতে উঠে বসেছে।
ফা ঝি ঝাওকে নিয়ে লু ঝি বসেছে পেছনের সিটে। ড্রাইভিং-এ বসেছে। চেং ঝি। তার পাশের সিটে মা ঝু।
লু ঝি সব ঠিকঠাক আছে? অসুবিধা নেই তো? গাড়ির জানালা দিয়ে বলল আহমদ মুসা লু ঝিকে লক্ষ্য করে।
সব ঠিকঠাক স্যার। ফা জি ঝাও ম্যাডাম ভালো আছেন। লু ঝি বলল।
আলহামদুলিল্লাহ।
বলে আহমদ মুসা মা ঝু’র জানালায় গেল। মা ঝু সুলতান দরজা খুলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে বলল, দরকার নেই। মা ঝু তুমি কি বাড়িতে কিংবা কোথাও যোগাযোগ করেছ?
না, স্যার। বলল মা ঝু।
আবার স্যার মুখে এলো কি করে? বড় ভাই বলবে। জেনারেল সাহেব এক নম্বর বড় ভাই। আমি দুই নম্বর। বলল আহমদ মুসা।
আপনি এত বড়, এত বিস্ময়কর, এত সরল, এত স্বচ্ছ, এত আপন। আপনি মানুষের? বলতে বলতে কেঁদে ফেলল মা ঝু।
চোখ মোছ মা ঝু। একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, জান এ গাড়িটা কার?
মা ঝু তাকাল আহমদ মুসার দিকে চোখ মুছতে মুছতে।
এটা লিয়েন হুয়ার গাড়ি, প্রেসিডেন্টের পারিবারিক গাড়ি বহরের একটি। আমার গাড়িটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলে লিয়েন হুয়া আমাকে দিয়েছিল এটা।
মা ঝু তার মুখটা সেই আগের মতোই আবার নিচু করেছিল।
আহমদ মুসা কথা শেষ করেই চেং ঝি’র দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বা লু ঝি তোমাদের মোবাইল মা ঝুঁকে দাও বাইরে যোগাযোগের জন্যে এখনি।
এখনি দিচ্ছি স্যার। বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করল চেং ঝি।
আচ্ছা আসি, সালাম। বলে জানালা থেকে সরে এলো আহমদ মুসা। চলে গেল চারটি গাড়ির বহর। গাড়ি বিদায় করে দিয়ে কর্নেল এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে।
আচ্ছা কর্নেল, এই এলাকায় মানুষ বাইরে থেকে আসা এবং এখান থেকে লোক বাইরে যাওয়া কি বন্ধ করা হয়েছে? বলল আহমদ মুসা।
ইয়েস স্যার, বন্ধ করা হয়েছে। ঘোষণা দেয়া হয়নি, কিন্তু রাত আটটায় এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
ধন্যবাদ কর্নেল। অনেক ধন্যবাদ! এটার খুব প্রয়োজন ছিল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, এস কর্নেল, আমরা ভেতরে আর একটু দেখি।
বলে ভেতরে ঢুকে গেল আহমদ মুসারা।
.
পোশাক পরা হয়ে গেছে আহমদ মুসার।
আজও সেই কালো পোশাক। কালো প্যান্ট, কালো জ্যাকেট, মাথায় কালো ক্যাপ।
ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে আহমদ মুসা। রাত ১২টা বাজতে ১০ মিনিট। দরজায় নক হলো। ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। এই সময় কে আসতে পারে? তবে শত্রু নয়, যিনি বা যারাই হোক বন্ধু। আহমদ মুসা দরজা খুলে দিল। আহমদ মুসাকে বিস্মিত করে ঘরে ঢুকল মা ঝু সুলতান, ফা জি ঝাও। আগে ঢুকেছিল ফা জি ঝাও। সেই সালাম দিয়েছে আহমদ মুসাকে।
কানশুর ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেছে ফা জি ঝাও। মাথায় হিজাব। উৎসব-আয়োজনে কানশুর মেয়েরা এ পোশাক পরে।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই ফা জি ঝাও বলল, শুধুই সালাম দিতে এসেছি। তখন গোটা সময় যে অবস্থায় ছিলাম আপনাকে সালাম দিতে পারিনি। সালাম তো দোয়াই। আপনি অভিযানে বেরোচ্ছেন, দোয়া না করে মন আমার মানছিল না। কমিনিট আগে লু ঝি আমাকে জানাল, আপনি ১২টায় বেরোবেন। তাই সুযোগটা নিলাম। মাফ করবেন বিব্রত করার জন্যে।
আলহামদুলিল্লাহ। বিজ্ঞান চর্চাকে আল্লাহ খুব বড় মর্যাদা দিয়েছেন।
বিজ্ঞান চর্চাকারীকে আল্লাহ শহীদের চেয়ে বড় সম্মান দান করেছেন। তার
দোয়া আমার জন্যে খুবই কাম্য বিষয়। ধন্যবাদ এজন্যে।
ফা জি বাও কিছু বলার জন্যে মুখ তুলেছিল।
এ সময় আহমদ মুসার অয়্যারলেস বেজে উঠল। তার পরেই যে কণ্ঠ ভেসে এলো সেটা প্রেসিডেন্টের।
সালাম এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট। বলল আহমদ মুসা।
সলাম আহমদ মুসা। তুমি তো ১২টায় বেরোচ্ছ? প্রেসিডেন্ট বলল।
ইয়েস এক্সিলেন্সি। বলল আহমদ মুসা।
অন্য কোনো কথা বলার জন্যে আমি তোমাকে টেলিফোন করিনি। শুধু এটুকু তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তুমি নিজের উপর অবিচার করছ। চীনে আসার পর একের পর এক তুমি আহত হয়েছ। তোমার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। তুমি কোনো সময়ই রেস্ট নাওনি। আমি লু ঝি, লিয়েন হুয়া এবং নে নুয়ার কাছে সব শুনেছি। এত বড় অভিযান কিছু আগে শেষ করেছ, এ অভিযানেই কাঁধে গুলিবিদ্ধ হয়েছ। এখনি বের হচ্ছ আরেক অভিযানে। তুমি নিজের প্রতি ততটা আন্তরিক নও, যতটা আন্তরিক অন্যের ব্যাপারে আমার অনুরোধ, তুমি নিজের প্রতি খেয়াল রেখ। আগে তোমার নিরাপত্তা, পরে সব। বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে পিতার মতো উপদেশ।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আপনার উপদেশ তমি মনে রাখব।
মা ঝু সুলতান ও ফা জি ঝাও সামনের সোফায় বসেছিল। অয়্যারলেসের সব কথাই তারা শুনতে পাচ্ছিল। প্রেসিডেন্টের টেলিফোন, তার কথা বিস্মিত ও অভিভূত করেছে দুজনকেই।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ওপার থেকে প্রেসিডেন্ট বলল, বাই দি বাই আহমদ মুসা, জোয়ান উ আর্মির শীর্ষ নেতা, যিনি জোয়ান উ নাম নিয়েছে, তার পরিচয়ের ব্যাপারে তুমি কি এখনও নিশ্চিত হওনি?
এক্সিলেন্সি! যদি বলি, তার পরিচয় আমার কাছে পরিষ্কার নয়, তাহলে মিথ্যা বলা হবে। আবার যদি বলি, তার পরিচয় সম্পর্কে আমি নিশ্চিত, তাহলে কোন নিশ্চিত প্রমাণের ভিত্তিতে আমি নিশ্চিত হলাম, সে প্রমাণ আমি দিতে পারবো না। এজন্যেই বিষয়টাকে আমি গোপন রাখছি এক্সিলেন্সি। তবে এক্সিলেন্সি, লু ঝিকে উদ্ধারের পর কেন তাকে আমি সাথে রাখছি, কেন আজ সঙ্গে নিচ্ছি, সে বিষয়টা চিন্তা করলে আপনি আঁচ করতে পারবেন যে, আমি কাকে সন্দেহ করছি। বলল আহমদ মুসা।
কি বলছ আহমদ মুসা! এ যে অবিশ্বাস্য, কল্পনাতীত! তুমি আগাগোড়া ভুল করছ না তো! অয়্যারলেসে প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠল।
ওমনটা চিন্তা করতে ভালো লাগে না এক্সিলেন্সি। খুব কষ্ট লাগে মনে। তাই বিষয়টা সবার কাছেই গোপন রেখেছি। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা, লু ঝি কি কিছু জানে না? সে তো খুব শার্প ও সচেতন মেয়ে। প্রেসিডেন্ট বলল।
সে সন্দেহ করে কিন্তু তার পিতাই যে শীর্ষ নেতা সেটা কতটা জানে। আমি জানি না। তাকে উদ্ধারের পর যখন তাকে আমি তাদের বাড়িতে যেতে বলি সে রাজি হয়নি। সে সময় তার চোখে-মুখে জমাট বেদনা এবং ভেঙে পড়ার মতো মন দেখেছি। তার পিতাই তাকে বন্দি করিয়েছে বা করেছে, সেটা লু ঝি আমাকে পরিষ্কার বলেছে। এ বিষয়ে কোনো কথা আর তুলিনি আমি। বলল আহমদ মুসা।
স্যরি আহমদ মুসা। এসব কথা না শুনলেই ভালো ছিল। যাক, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, সফল হও। সত্য যত তিক্ত হোক, সত্যের জয় হতে হবে। তোমাকে ধন্যবাদ আহমদ মুসা। রাখছি। বাই।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। বলে অয়্যারলেস অফ করে দিল আহমদ মুসা।
স্যার মানে বড় ভাই, প্রেসিডেন্ট আপনাকে এত ভালোবাসেন! আপনি এই সেদিন চীনে এসে সব তো জয় করে নিয়েছেন। বলল মা ঝু।
মা ঝু যিনি আল্লাহকে জয় করেন কিংবা আল্লাহ দয়া করে যাকে জয়। করান, গোটা পৃথিবী তার হয়ে যায়। আহমদ মুসা বলল।
আল্লাহর অসীম করুণা আরো বেশি বেশি আপনি পান। ধন্যবাদ জনাব, সালাম দিতে এসেছিলাম। আমরা এখন উঠছি।
বলে ফা জি ঝাও তাকাল মা ঝু’র দিকে। মা ঝু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, স্যার উঠছি।
উঠছ, কিন্তু মেহমানদারী কিছু হলো না। বিশেষ করে সবার শ্রদ্ধা, গৌরবের পাত্র আজকের বিশ্বের একজন শীর্ষ বিজ্ঞানী ফা জি ঝাওকে খালি মুখে বিদায় দিতে হলো। বলল আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে।
ভুলে গিয়েছিলাম জনাব, বাবা আপনাকে দাওয়াত করেছেন এবং বলেছেন, চীনের সংকট দূর না করে আপনি যেতে পারবেন না। আমরা সবাই দারুণ খুশি যে, আপনি আমাদের কানশুর মানুষ। ফা জি ঝাও বলল। তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল।
হ্যাঁ, আমি কানশুর ছেলে। সেদিনের পর আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি কানশুতে। বালক আমি তখন, বয়সে কৈশোর তখনও আসেনি। সেদিন যখন আমরা কানশু ছাড়ি, তখন আমরা এতই কেঁদেছিলাম যে, পরে কান্নায় আর অশ্রু আসেনি। বলল আহমদ মুসা। কণ্ঠ ভারি আহমদ মুসার।
মা ঝু’র অপলক দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। ফা জি ঝাও চোখ তুলে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে।
অশ্রুর কিন্তু শেষ হয়নি জনাব। সে অশ্রু ঝরছে এখনও। আপনাদের অশ্রু কেউ মোছায়নি। কিন্তু আপনাকে আজ মুছাতে হবে কোটি মানুষের। অশ্রু। বাবা খুব ক্রুড ভাষায় সে কথাই বলেছেন জনাব। ফা জি ঝাও বলল। তার কণ্ঠও ভারি।
আমাকে ডাকতে হয় না বোন, অশ্রুই আমাকে টেনে নিয়ে যায়।
একটু থেমেই আহমদ মুসা বলল, মা ঝু’র চীনা রাজনীতির মেইন। স্ট্রিমে আসাকে আমি অভিনন্দিত করেছি। আমি এই চেতনাকে উৎসাহিত করতে চাই।
মা ঝু উঠে ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসল। বলল, এভাবে কেউ কখনও বলেনি আমাকে বলতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলল মা ঝু।
আহমদ মুসা তাকে তুলে পাশে সোফায় বসিয়ে বলল, নেতার চোখে অশ্রু শোভা পায় না। মুসলমানরা অনেক কেঁদেছে, কাঁদছে। নেতারা। কাঁদলে তাদের অশ্রু মুছাবে কে?
ফা জি ঝাও-এর চোখে অশ্রু, মুখে হাসি। বলল, জনাব মা ঝু এই প্রথম একজন নেতা দেখল। এখন এই অঞই তাকে অশ্রু মুছাতে শিখাবে। দোয়া করুন জনাব।
বলেই উঠে দাঁড়াল ফা জি ঝাও। বলল, অনুমতি দিন জনাব।
উঠে দাঁড়াল মা ঝু সুলতান।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসাও।
সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা।
আহমদ মুসা বিছানা থেকে ব্যাগ তুলে নিল। আটকে রাখল পিঠে।
১২টা পনেরো মিনিট।
আহমদ মুসার গাড়ি বেরিয়ে এলো হোটেল পার্কিং থেকে।
পেছনের সিটে বসেছে লু ঝি এবং তার সেক্রেটারি চেং ঝি।
ড্রাইভিং সিটে আহমদ মুসা।
ছুটে চলল আহমদ মুসার গাড়ি।
লক্ষ্য নানিয়ান মন্দির-প্রাসাদ।
শেষ খবর অনুসারে ওখানেই আশ্রয় নিয়েছে জোয়ান উ আর্মির প্রধান ও চীনের আন্দ্রা হিংস্র জাতীয়তাবাদের নেতা জোয়ান উ। কল্পকথার জোয়ান উর মতো সে চীনের ঈশ্বরের আসনে বসতে চায়। আর সে জন্যে অপবিত্রদের রক্তস্রোত দিয়ে তার আসন এবং তার সাম্রাজ্যকে পবিত্র করতে চায়।
[এই সিরিজের পরবর্তী বই আবার আফ্রিকার অন্ধকারে]
Leave a Reply