হুই উইঘুরের হৃদয়ে
সাইমুম ৬০ – হুই উইঘুরের হৃদয়ে – আবুল আসাদ
প্রথম প্রকাশ – এপ্রিল ২০১৮
[এই বইয়ের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত অথবা মৃত কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে এর কোন প্রকার সম্পর্ক নেই। লেখক]
১
ডেভিড বেঞ্জামিন কোহেন (ডিবিসি) একটু ঝুঁকে পড়ে টেবিলের উপর রাখা একটা মানচিত্রের উপর গভীরভাবে চোখ বুলাচ্ছিল।
ডেভিড বেঞ্জামিন কোহেন এক মানুষ এক পৃথিবী সংগঠনটির ইউরোপ ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের নতুন প্রধান। রত্নদ্বীপে ব্ল্যাক সিন্ডিকেট-এর বিপর্যয়ের পর এক মানুষ এক পৃথিবীর পক্ষে সে এসেছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে।
মানচিত্রটি রত্নদ্বীপের।
রত্নদ্বীপের পাহাড়ের উচ্চতা ও লোকেশন, রাজধানী, নিরাপত্তা ঘাঁটিসহ প্রধান জনপদগুলোর অবস্থান, রাস্তার প্রধান জংশনগুলো, উপকূল থেকে এসবের স্কাই-রুট দূরত্ব ইত্যাদি নিখুঁতভাবে দেখানো আছে মানচিত্রে। রত্নদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণের দুই প্রবেশপথের আরও বিস্তারিত নকশা আছে। মানচিত্রটিতে রত্নদ্বীপের চারদিকে অনেকগুলো রেড ডট। ডটগুলো থেকে রত্নদ্বীপের ভেতরের নানা লোকেশনের দূরত্ব দেখছে ডেভিড বেঞ্জামিন কোহেন।
তার বামপাশ থেকে বিপ বিপ শব্দ উঠল।
শব্দটা উঠল ডেভিড বেঞ্জামিন কোহেনের বামপাশের দেয়ালে সেট করা বড় স্ক্রিনের ডান টপের এক ফ্লাশিং নীল আলো থেকে। বিপ বিপ থেমে গেল কয়েক সেকেন্ডেই, আলোর ফ্লাশও। সেখানে ইনসেট একটা বক্সে ভেসে উঠল একটা ছবি।
ডেভিড বেঞ্জামিন কোহেন ছবির দিকে একবার তাকিয়েই মুখ সামনে। ঘুরিয়ে নিল। পা দুটি এগিয়ে গেল পা-দানির উপর প্রান্তের দিকে।
সামনের দরজাটা খুলে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। ঘরে প্রবেশ করল এক মানুষ এক পৃথিবীর গোয়েন্দা প্রধান দানিয়েল ডিটমার।
দরজার দিকে তাকায়নি বেঞ্জামিন কোহেন। তার স্থির দৃষ্টি টেবিলের উপর নিবদ্ধ। মুখ গম্ভীর। কিন্তু তাতে খুব চিন্তার ছাপ নেই।
টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল দানিয়েল ডিটমার।
মাথা না তুলে দানিয়েল ডিটমারের দিকে না তাকিয়েই বলল, বস ডিটমার।
বসল দানিয়েল ডিটমার।
এবার বেঞ্জামিন কোহেন তাকাল দানিয়েল ডিটমারের দিকে। কিন্তু কিছু বলল না।
রত্নদ্বীপের পরবর্তী খবর নিয়েছি এক্সিলেন্সি। বলল দানিয়েল ডিটমার।
বলে যাও ডিটমার। বেঞ্জামিন কোহেন বলল।
ব্ল্যাক সিন্ডিকেট ওদের হাতে ধ্বংস হবার পর ওরা মহা আনন্দে…।
দানিয়েল ডিটমারের কথায় বাধা দিয়ে বেঞ্জামিন কোহেন বলে উঠল, ওদের আনন্দের কথা আমি জানতে চাইনি ডিটমার।
স্যরি এক্সিলেন্সি, আমি বলতে চাচ্ছিলাম ওরা এতটাই আনন্দে আছে। যে, ভবিষৎ নিয়ে ওরা কেউ ভাবছে না। বলল দানিয়েল ডিটমার।
আহমদ মুসা চলে যাচ্ছে এমন কিছু জানা গেছে? জিজ্ঞাসা বেঞ্জামিন কোহেনের।
এমন কিছু জানা যায়নি। বলল দানিয়েল ডিটমার।
তাহলে কেমন করে বলছ ভবিষ্যৎ নিয়ে ওদের কোনো ভাবনা নেই? জান, অপ্রয়োজনে আহমদ মুসা একদিন কোথাও থাকে না? রেনেটা দুর্গ অপারেশন ও ব্ল্যাক সিন্ডিকেট ধ্বংস হবার দুদিন পরেও সে রত্নদ্বীপে থাকার অর্থ সেখানে তার মিশন শেষ হয়নি। বেঞ্জামিন কোহেন বলল। নিরস, শক্ত তার কণ্ঠস্বর।
এক্সিলেন্সি, রত্নদ্বীপের কমপক্ষে তিনটি ধনভাণ্ডার এখনও উদ্ধার হয়নি। বলল দানিয়েল ডিটমার।
ধনভাণ্ডার উদ্ধারের জন্য আহমদ মুসা রত্নদ্বীপে দুই দিন অপেক্ষা করবে, তা হতে পারে না। ও রকম হাজার হাজার ধনভাণ্ডারও আহমদ মুসার কাছে কিছু নয়। অর্থের পেছনে সে ছোটে না। আর ঐ তিনটা ধনভাণ্ডার উদ্ধার করা তার কয়েক ঘন্টার কাজ। এজন্যে সে দুইদিন সময় রত্নদ্বীপে নষ্ট করবে এমনটা অসম্ভব। বেঞ্জামিন কোহেন বলল।
ঠিক এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা দুর্বোধ্যও। আমাদের এজেন্ট রত্নদ্বীপ নিরাপত্তা বাহিনীর একজন বড় অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেছিল আহমদ মুসা কি তাড়াতাড়ি চলে যাবে? উত্তরে অফিসারটি বলেছিল এক ঘন্টা আগেও জানা যায় না আহমদ মুসা পরবর্তী ঘন্টায় কি করবেন। বলল দানিয়েল ডিটমার।
আহমদ মুসা দুর্বোধ্য নয়। কারও কাজের নির্ঘন্ট জানা না গেলেই সে দুর্বোধ্য হয় না। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে রত্নদ্বীপে আহমদ মুসার মিশন শেষ হয়নি। তার মিশনের কি অবশিষ্ট আছে, সেটাই জানা যাচ্ছে না। আমাদের মিশনটা কি সে জানতে পেরেছে? বেঞ্জামিন কোহেন বলল।
তা মনে হয় না এক্সিলেন্সি। ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের শীর্ষস্থানীয় কেউই ধরা পড়েনি। আর তাদের শীর্ষ পর্যায়ের চার পাঁচজন ছাড়া কেউই বিষয়টা জানতো না। সুতরাং আহমদ মুসা তা জানার কথা নয়। বলল দানিয়েল ডিটমার।
এটাই আশার কথা। কিন্তু আহমদ মুসা এখনও রত্নদ্বীপে তাহলে কেন? বেঞ্জামিন কোহেন বলল। তার চোখে-মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।
আহমদ মুসা জানে না বলেই মনে করি। কিন্তু এক্সিলেন্সি, সে যদি জানতোই তাহলে কি বড় কোনো অসুবিধা হতো আমাদের? বলল দানিয়েল ডিটমার।
বেঞ্জামিন কোহেন মুখ তুলেছিল কিছু বলার জন্যে। তার পাশেই কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে বিপ বিপ শব্দ উঠল। সেই সাথে কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠল ওয়ান ওয়ার্ল্ড (এক মানুষ এক পৃথিবী)-এর ভূমধ্যসাগরীয় অপারেশন কমান্ডার জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন।
ঠিক আছে, ইয়াসার আসুক। সে গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে আসার কথা। প্রশ্নটার জবাব সে দিলেই ভালো হবে। বলল বেঞ্জামিন কোহেন।
খুলে গেল ঘরের দরজা।
জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন ঘরে ঢুকে বড় একটা বাউ করে এগিয়ে এল।
বেঞ্জামিন কোহেন তার টেবিলের একটা ম্যাপের দিকে তাকিয়েছিল। মাথা না তুলেই বলল বস।
বসল জেনারেল ইয়ামিন। বলল, ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।
মুখ তুলল বেঞ্জামিন কোহেন। স্বাগত জানানোর মতো কিঞ্চিত মাথা তার ঝুঁকল। চোখে তার প্রশ্ন।
জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন পকেট থেকে এক খণ্ড কাগজ বের করে বলল, এক্সিলেন্সি, আপনি অনুমতি দিলে এই প্ল্যান আপনার সামনে রাখতে পারি।
আবার নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিল বেঞ্জামিন কোহেন।
জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন কাগজ খণ্ডটি খুলে বেঞ্জামিন কোহেনের সামনে রাখল। বলল, এক্সিলেন্সি, আজ রাত এগারোটার মধ্যে রত্নদ্বীপের চারদিকে আমাদের লংরেঞ্জ গানবোট এবং কামান ও ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধ জাহাজের অফেনসিভ সেটিং কমপ্লিট হয়ে যাবে।
তার সামনে রাখা প্ল্যানের নকশাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল বেঞ্জামিন কোহেন।
সবাই নীরব।
পলপল করে সময় বয়ে যাচ্ছিল।
এক সময় মাথা তুলল বেঞ্জামিন কোহেন। বলল, ধন্যবাদ জেনারেল ইয়াসার। অভেনসিভ সেটিং অনন্ত ২৪ ঘন্টা এগিয়ে আনতে পেরেছ। এটাই হবে আমাদের ট্রাম কার্ড। কারও সাহায্য ওরা চেয়ে থাকলেও সেটা তাদের ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু ২৪ ঘন্টা এগিয়ে আনতে গিয়ে শক্তির কিছু কাটছাট করতে হয়নি তো?
না এক্সিলেন্সি, আগের প্লানের বিন্দুমাত্র এদিক-সেদিক হয়নি। শুধু সময়টা এগিয়ে এসেছে। বলল জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন।
গুড। ওদের সকলের আন্তরিক সহযোগিতা পাওয়া গেছে, এটাই বড় কথা। বেঞ্জামিন কোহেন বলল।
এক্সিলেন্সি, আমরা পয়সা দিয়ে সহযোগিতা কিনেছি। কিন্তু তাদের আন্তরিকতা আমরা ফ্রি পেয়েছি। কয়েকটি ক্ষেত্রে স্বত:স্ফূর্তভাবে কিছু স্বেচ্ছাসেবক আমাদের অভিযানে যোগ দিয়েছে। আমাদের মতো তারাও চায় একক রাষ্ট্রের অধীনে আন্ত:ধর্ম সহাবস্থানের ঐ মডেলটা ধ্বংস হোক। এই শান্তি ও সহাবস্থানের অর্থ ইসলাম ধর্মকে এগিয়ে দেয়া। এটা হতে দেয়া যাবে না। বলল জেনারেল ইয়াসার।
ব্রাভো! এই সেন্টিমেন্টেরই তো আমরা উজ্জীবন চাই। আচ্ছা যাক, এখন বল, এখন করণীয় কি? বেঞ্জামিন কোহেন বলল।
এক্সিলেন্সি, রাত ১১টার মধ্যে রত্নদ্বীপের চারদিকে আমাদের অস্ত্র মোতায়েন কমপ্লিট হবে। রাত ১২টা থেকে অভিযানের জন্যে আমরা প্রস্তুত থাকব। আমরা আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি। বলল জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন।
আচ্ছা তোমরা টার্গেট করেছ রাজধানীকে, নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থানগুলোকে, বাজার ও লোকালয়গুলোকে। কিন্তু এগুলো কি তোমাদের কামান ও ক্ষেপশন্ত্রের আওতায় আনতে পেরেছ? বেঞ্জামিন কোহেন বলল।
এক্সিলেন্সি, আমরা আগেই ক্ষেপণান্ত্র মোতায়েনের স্থান থেকে প্রত্যেকটি টার্গেটের ডিস্ট্যান্স মেপে নিয়েছি। কোন্ লোকেশান কোন্ ডিস্ট্যান্স কভার করবে, আগেই তার ডিটেইল চার্ট তৈরি করা হয়। সেই অনুসারেই আজ আমাদের গানবোট ও জাহাজগুলো মোতায়েন করা হয়েছে। সুতরাং কোনো টার্গেটই আমাদের আওতার বাইরে নেই। বলল জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন।
এখন বল, আহমদ মুসা কি করছে রত্নদ্বীপে? আমাদের পরিকল্পনা তার কাছে ধরা পড়ে যায়নি তো? বেঞ্জামিন কোহেন বলল।
সে রকম মনে হয় না এক্সিলেন্সি। রত্নদ্বীপের সর্বত্র এখন আনন্দ ও গা-ছাড়া। ভাব। রত্নদ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যেও বিশেষ নড়াচড়া নেই। তারা বিষয়টা জানলে তাদের মধ্যে আনন্দের বদলে আতঙ্ক থাকতো। হতে পারে। এক্সিলেন্সি, দ্বীপের সরকার আহমদ মুসাকে এখনও রেখেছে সম্ভবত এই কারণে যে, দ্বীপরাষ্ট্র শক্তিশালী করার জন্যে আহমদ মুসার কাছ থেকে তারা নানা পরিকল্পনা, প্রকল্প নিচ্ছে। বলল জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন।
জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন ঠিক বলেছেন। আহমদ মুসার কাছে পরামর্শ তারা চাইতে পারে। যা ঘটেছে, তার প্রেক্ষিতে তাদের নীতি-পলিসির সংশোধন উন্নয়ন হতে পারে। আর এক্ষেত্রে আহমদ মুসার চেয়ে বড় পরামর্শদাতা আর কেউ হতে পারে না। গোয়েন্দা প্রধান দানিয়েল ডিটমার বলল।
ধন্যবাদ। এ রকমটা ঘটতে পারে। এরপরও বলি যদি কোনো পর্যায়ে তারা জানতে পারে আমাদের অভিযানের কথা? বলল বেঞ্জামিন কোহেন।
জানতে পারলেও তারা আমাদের আক্রমণ ঠেকাতে পারবে না। সময় কোথায় তার? এক্সিলেন্সি আদেশ দিলে আজই রাত ১২টা থেকে যেকোনো সময় আমরা অপারেশনে যেতে পারি। বলল জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন।
তারা আমাদের আক্রমণ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু কিছু তো করতে পারে। সেটা কি? তোমরা কি তা ভেবেছ? বেঞ্জামিন কোহেন ববল।
এক্সিলেন্সি, চার দিন আগে আমরা ৬জন গোয়েন্দা পাঠিয়েছি রত্নদ্বীপে, বিশেষ করে আহমদ মুসার গতিবিধি মনিটর করার জন্যে। ওরা সবাই আলজিরিয়ার ইহুদি পরিবারের লোক। ওরা সব সময় আমাদের আপডেট করছে। জানিয়েছে ওরা, পূর্ব থেকেই রত্নদ্বীপের চারটি গানবোট ছিল। কয়েকদিন আগে নতুন দশটি যোগ হয়েছে। মোট ১৪টি। এদের দুটিকে গানবোট হিসেবে ধরার মতো। এ দুটি গানবোটে ৪টি করে টর্পেডো টিউব এবং ৪টি করে দশমাইল রেঞ্জের ক্ষেপণাস্ত্র সেল রয়েছে। বহুমুখী এই গানবোট দুটি আহমদ মুসা যোগাড় করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তার বন্ধুদের কাছ থেকে ৭ দিন আগে। বলল জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন।
হাসল বেঞ্জামিন কোহেন। বলল, আমরা আর উপকূলে নামতে যাচ্ছি।। ঐ গানবোটগুলো দিয়ে কি হবে ওদের! পানিতে তো আর যুদ্ধ হচ্ছে না, যুদ্ধ হচ্ছে আকাশ পথে। একসাথে শত কামান, শত ক্ষেপণাস্ত্র গর্জে উঠবে। খুব বেশি লাগলে সময় লাগে তিরিশ মিনিট। এর মধ্যেই রত্নদ্বীপের রাজধানীসহ ওদের জনপদগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আপনি যা বলেছেন সেটাই, ঠিক সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। আপনি আদেশ দিন এক্সিলেন্সি। আমি আপনার আদেশ নেবার। জন্যে এসেছি এক্সিলেন্সি। বলল জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন।
অপরেশন শুরুর আগে কি আমাদের গোয়েন্দা ছয়জন ফিরে আসছে? গোয়েন্দা প্রধান দানিয়েল ডিটমার বলল।
স্যার, আপনি যা চান, সেটাই হবে। বলল জেনারেল ইয়াসার।
আগে আমি ভেবেছিলাম ফিরিয়ে আনব। আমাদের ছয়জন লোকের দাম অনেক। কিন্তু এখন ভাবছি, নোম্যানস ল্যান্ডের কোথাও আশ্রয় নিয়ে ওদের আত্মরক্ষা করতে বলব। ওরা দ্বীপে থাকা দরকার। ধ্বংসের প্রাইমারি রিপোের্ট তাদের কাছ থেকেই আমরা চাই। আরেকটি কথা, ওদের উপর নির্দেশ আছে, অপারেশন শুরুর আগ মুহূর্তে আহমদ মুসাকে হত্যা করার। সুযোগ নেয়ার ধ্বংস থেকে আহমদ মুসা যদি কোনো রকমে বেঁচে যায়, সেটা হবে আমাদের জন্যে বিপজ্জনক। দানিয়েল ডিটমার বলল।
ধন্যবাদ দানিয়েল ডিটমার, তুমি ঠিক চিন্তা করেছ। আহমদ মুসা কোনোওভাবে যাতে বেঁচে না যায়, সেটা আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। তুমি আবার আমাদের গোয়েন্দাদের সাথে কথা বল। আহমদ মুসাকে হত্যা করা ওদের এখনকার নাম্বার ওয়ান প্রাইওরিটি। বলল বেঞ্জামিন কোহেন।
কথা শেষ হতেই বেঞ্জামিন কোহেনের অয়্যারলেস বিপ বিপ শব্দ করে উঠল। তুলে নিলেন তিনি তার অয়্যারলেস। অয়্যারলেস কানের কাছে নিয়ে নীরবে তিনি ওপারের কথা শুনলেন। সবশেষে বললেন, আপনি ঠিক শুনেছেন। এটাই এখনও কনফার্ম আছে। জিহোভার কাছে প্রার্থনা করবেন প্লিজ আমাদের জন্যে। টেলিফোন করে খোঁজ নেয়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
অয়্যারলেস অফ করে দ্রুতকণ্ঠে বলল, সর্বনাশ আমাদের এই অপারেশনের খবর বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ জানতে পারল কি। করে? কে জানাল? ইসরাইলি গোয়েন্দা বিভাগ? হ্যাঁ, তা হতে পারে। ইসরাইলের গোয়েন্দাদের মধ্যে বৃটিশদের প্রতি সিমপ্যাথাইজার অনেক আছে। তাদের কাজ এটা হতে পারে। স্যরি, আমাদের অভিযানকে অল প্রফ করতে পারিনি।
বুঝতে পারছি না এক্সিলেন্সি, আমরা কেন তাদের এই রিপোর্ট কনফার্ম করলাম! বিনয়জড়িত কণ্ঠে বলল জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন।
হাসল বেঞ্জামিন কোহেন। বলল, কোনো ক্ষতি হয়নি এতে আমাদের, কিন্তু মহালাভ হয়েছে। আমরা জানতে পারলাম আমাদের অতি সিক্রেট তথ্যটা বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পৌঁছেছে। তবে আমার মনে হয় তাদের কাছে আমাদের আগের সিদ্ধান্তটা পৌঁছেছে। পরের সিদ্ধান্ত তারা। জানতে পারেনি। আমি কনফার্ম করলাম এই কারণে যে, তারা এবং আমাদের প্রতিপক্ষ ভুল তথ্যের উপর থাকুক। আমি নিশ্চিত বৃটিশ গোয়েন্দারা জানতে পারলে সেটা সিআইএ, এফবিআই পর্যন্ত অবশ্যই। পৌঁছেছে। আর সিআইএ, এফবিআই জানার অর্থ আহমদ মুসাও জেনেছে। আহমদ মুসা কিছু করলে, তার জন্যে আরও ২৪ ঘন্টা সময় নেবে।
মুহূর্তের জন্যে একটু থামল বেঞ্জামিন কোহেন। বলল, জেনারেল ইয়াসার, তুমি যে সিদ্ধান্ত চাচ্ছ তার জন্যে সময় এখনও হয়নি। তুমি ও দানিয়েল ডিটমার আজ রাত ৯টায় এসো। সিদ্ধান্ত তখন নেব। ইতিমধ্যে রত্নদ্বীপে আমাদের ছয় গোয়েন্দাকে নির্দেশ দাও, এই মুহূর্ত থেকে তারা যেন আহমদ মুসাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত। আর জেনারেল, আবার খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হও যে আজ রাত ১১টার মধ্যে রত্নদ্বীপের চারদিকে আমাদের নৌবহরের অফেনসিভ মোতায়েন সম্পন্ন হচ্ছে।
বলেই উঠে দাঁড়াল বেঞ্জামিন কোহেন।
উঠল দানিয়েল ডিটমার ও জেনারেল ইয়াসার ইয়ামিন। বলল, গুড বাই স্যার, আমরা আসছি।
.
সময় রাত সাড়ে ৯টা।
আহমদ মুসার গাড়ি ফিরছিল রত্নদ্বীপের উত্তর গেট-বন্দর থেকে। রাস্তায়। খুব একটা ভিড় নেই। গাড়ি দ্রুত চলছিল রাজধানীর উদ্দেশ্যে।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে আহমদ মুসা। পেছনের সিটে সিকুরিটির দুজন লোক।
আহমদ মুসা বেরিয়েছিল বোটে করে রত্নদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের উপকূল দেখতে। তার ভাবনা, পাওয়া খবর সত্য হলে আগামী কালের রাতটা হবে রত্নদ্বীপের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক। বন্ধু দেশগুলোর সাহায্য যথাসময়ে পৌঁছবে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরেও রাতটা বিপজ্জনক। ওর অন্ধকার শরীরে কি আছে, তা আল্লাহই মাত্র জানেন। তাই রত্নদ্বীপের চারদিকের উপকূলটা আরও একবার ভালো করে দেখতে চেয়েছিল আহমদ মুসা। এভাবে দেখার সময় আহমদ মুসা রত্নদ্বীপের চারদিকের পাহাড়ের কোনটার কি উচ্চতা তা মেপে নিয়েছে এবং একটা গ্রাফও তৈরি করেছে। গ্রাফের প্রতিটি ভাজে উচ্চতা লেখা হয়েছে। ব্যাপারটা করতে পেরে মনটা আনন্দে তার ভরে গিয়েছিল।
গাড়ির সামনে চোখ থাকলেও এসব ভাবনা আহমদ মুসাকে আনমনা করে ফেলেছিল।
সামনেই রাস্তার একটা জংশন। ডান ও বাম দুই দিক থেকে দুই রাস্তা এসে এই প্রধান হাইওয়ের সাথে মিশেছে।
আহমদ মুসা দেখতে পেল দুই দিকের রাস্তা দিয়ে ছুটে আসা চারটি হেডলাইট। হাইওয়ে থেকে অল্প দূরত্বে ছুটে আসা চারটি হেডলাইট দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ করেই। হাইওয়ে থেকে গাড়ি দুটির অবস্থান প্রায় সমদূরত্বে। আপনাতেই আহমদ মুসার কুঞ্চিত হয়ে উঠলেও গাড়ির চলায় কোনো ব্যত্যয় ঘটল না। হাইওয়ে বরাবর বেশ দূরে লাল-নীল আলোর জিগজ্যাগ ফ্লাশ দেখতে পেল। বুঝল আহমদ মুসা, ওটা পুলিশের গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন হাইওয়ের জাংশন থেকে ২০ গজের মতো দূরে। দুপাশে দাঁড়ানো দুটি গাড়িও হাইওয়ে জাংশন থেকে এ ধরনেরই দূরত্বে।
ফাঁকা রাস্তা। প্রায় ৮০ কিলোমিটার বেগে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি।
হঠাৎ দুটি গুলি এবং বিকট শব্দে টায়ার ফাটার দুটি শব্দ কানে এল। কিছু ভাবার আগেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি এবং ওলটপালট শুরু হলো। প্রবল বেগে আহমদ মুসা জড়িয়ে ধরেছিল স্টিয়ারিং হুইল। বুদ্ধি তার যেন ভোতা হয়ে গিয়েছিল। দেহটা কয়েকবার ওলটপালট খেল। শেষ পর্যন্ত আহমদ মুসা স্টিয়ারিং হুইল ধরে রাখতে পারেনি। আহমদ মুসার দেহটা সবশেষে ছিটকে পড়েছিল গিয়ে গাড়ির দরজার উপর। দরজায় ধাক্কা খেয়ে তার দেহটা গিয়ে পড়েছিল দরজা ও স্টিয়ারিং হুইলের মাঝখানে। তার পায়ের অংশটা ছিল সিটের উপর, আর মাথার দিকটা পড়েছিল সিটের নিচে স্টিয়ারিং হুইলৈর। পাশে।
আহমদ মুসা জ্ঞান হারায়নি, এক ধরনের অবচেতন ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। তার মধ্যে। তাই কি ঘটছে তা সে ফলো করতে পারেনি। কিন্তু তার দেহটা যখন স্থির হলো, চোখ খুলে সে দেখতে পেল স্টিয়ারিং হুইলের গোড়ায় তার মাথা। তার কপাল, তার মুখমণ্ডল ভিজা। একটা গরম স্রোত নেমে যাচ্ছে ডান কানের পাশ দিয়ে। অনুভব করল ডান চোখের উপরে কপালে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। বুঝল কপাল ফেটে গেছে। তারই রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে মুখমণ্ডল, কানের পাশ দিয়ে। সে অনুভব করল শরীরের নানা স্থানে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে। তার স্মরণে এল, সে গুলির শব্দ শুনেছিল আর দুটি টায়ার ফাটার শব্দও পেয়েছিল। তারপরেই ওলট-পালট। কথাগুলো মনে হতেই আহমদ মুসার হাত চলে গেল জ্যাকেটের পকেটে। রিভলবারটা পকেট থেকে পড়ে যায়নি।
গাড়ির জানালা প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ার আওয়াজে ওদিকে ফিরে তাকাল আহমদ মুসা। তার সাথে হাতের রিভলবারটাও তুলল।
তাকিয়ে আহমদ মুসা দেখতে পেল ভেঙে যাওয়া জানালার পেছনে তিনটি মুখ। তাদের চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখল আহমদ মুসা। ছুটে আসছিল দুটি রিভলবারের নল জানালা দিয়ে।
আহমদ মুসা আগেই তার রিভলবার বের করে নিয়েছিল। সুতরাং এমন কিছুর জন্যে প্রস্তুত ছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার রিভলবার দ্রুত টার্গেটে উঠে এসেছিল।
রিভলবারটা একেবারেই স্বয়ংক্রিয়। ট্রিগার চেপে রাখলেই ছটি গুলি। বিরতিহীনভাবে বেরিয়ে যায়।
ওদের আগেই আহমদ মুসার রিভলবার গুলি বৃষ্টি শুরু করেছিল। জানালার তিনটি মুখই ঝরে পড়ে গেল জানালার বাইরে।
ঠিক এ সময় গাড়ির ওপাশের দিক থেকে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলো। সেই সাথে গাড়ির ডান জানালায় আর্তনাদ।
আহমদ মুসা তাকাল ডান জানালার দিকে। দেখতে পেল একাধিক লোক জানালার ওপাশে পড়ে গেল। ব্রাশ ফায়ার কে বা কারা করল? পুলিশের ঐ গাড়িটা কি এসে পৌঁছেছে? বুঝতে পারল আহমদ মুসা, দুপাশের রাস্তার দুই গাড়ি ছিল শত্রুদের। দুই গাড়ি থেকে গুলি করে তার গাড়ির দুই টায়ার ফাটিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওরাই দুদিক থেকে ছুটে এসেছিল তার গাড়ির দুই জানালায়।
গাড়ির বাম জানালার দিকে আবার শব্দ হলো।
আহমদ মুসার রিভলবার দ্রুত উঠে এল জানালা লক্ষ্যে।
জানালার দিক থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, স্যার, আমি মেজর পাওয়েল পাভেল। আপনি কেমন আছেন স্যার? আমরা উদ্বিগ্ন।
কথার সাথে সাথে মেজর পাওয়েল পাভেল ও কর্নেল জেনারেল রিদা জানালার সামনে এসে দাঁড়াল।
দাঁড়িয়েই চিৎকার করে উঠল, কর্নেল জেনারেল রিদা স্যার, আমাদের আহমদ মুসা স্যার মারাত্মক আহত।
বলেই মেজর পাওয়েল পাভেল গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগল।
দরজা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। খোলা সম্ভব হলো না।
আহমদ মুসা টলতে টলতে তার শোয়া অবস্থা থেকে উঠল।
মেজর পাভেল ততক্ষণে গুলি করে দরজার লক উড়িয়ে দিয়েছে এবং তার সাথীদের নিয়ে টেনে দরজা খসিয়ে ফেলেছে।
আহমদ মুসাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে মেজর পাভেলরা ছুটে এল।
আহমদ মুসার মুখ ও সামনের দিকটা রক্তাক্ত।
মেজর পাভেল, আমি ঠিক আছি। গাড়ির পেছনের সিটে দুজন। সিকুরিটির লোক ছিল। তাড়াতাড়ি দেখ তাদের কি অবস্থা। তাড়াতাড়ি কর। গাড়ির ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া উঠছে। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
দেখছি স্যার। বলেই মেজর পাভেল পেছনে তাকিয়ে নির্দেশ দিল, তোমাদের দুজন লোক এদিক দিয়ে গাড়িতে ঢোকাও আর কয়েকজন গাড়ির দরজা খোল, না হয় ভেঙে ফেল। যেকোনো দিক দিয়ে তাদের দ্রুত বের কর।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।
মেজর পাভেল তাকে তার গাড়ির দিকে নিতে নিতে বলল, স্যার, আপনি সংজ্ঞাহীন থাকলে বিপদ হতো। ওদের টার্গেট ছিল আপনাকে হত্যা করা। সংজ্ঞায় বা সংজ্ঞাহীন যে অবস্থায় থাকুন, গুলি করে ওরা আপনার দেহকে ঝাঁঝরা করে দিত। গাড়ির কাছে আসা লোকদের এই নির্দেশই দিচ্ছিল পেছনের একজন।
আল্লাহ সহায় মেজর পাভেল। কথায় আছে, ম্যান প্রোপোজেস, গড় ডিসপোজেজ।
বলে আহমদ মুসা পেছন দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা হলো না। গাড়িটা জ্বলে উঠেছে। বিস্ফোরণ ঘটেছে গাড়ির ইঞ্জিনে।
আল হামদুলিল্লাহ। সিকিউরিটির দুজনকে ওরা ঠিক সময়ে বের করতে পেরেছে। মনে হচ্ছে ওরা সংজ্ঞাহীন। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আপনি মারাত্মক আহত। ওদের নিয়ে এত ভাবছেন স্যার? মেজর পাভেল বলল।
আমি বুঝতে পারছি আমি ভালো আছি। ওদের নিয়েই তো চিন্তা হবার কথা। ওদের অবস্থা জানি না। বলল আহমদ মুসা। ( কথা শেষ করেই আহমদ মুসা এগোলো গাড়ির দিকে। বসল গাড়িতে নিজে নিজেই। মেজর পাভেলও তার সাথে সাথে এসেছিল।
গাড়িতে বসেই আহমদ মুসা সিটে হেলান দিয়ে বলল, মেজর পাভেল, আক্রমণকারীরা কয়জন ছিল?
ছয়জন স্যার। মেজর পাভেল বলল।
ওদের তো সার্চ করা হয়নি। তুমি যাও, ওদের ছয়জনের পকেটে কাগজ জাতীয় কিছু পাওয়া গেলে সেগুলো এবং ওদের প্রত্যেকের মোবাইল নিয়ে এসো। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন। কমপক্ষে এখনি ফাস্ট এইড প্রয়োজন। কর্নেল জেনারেল স্যার আসছেন। এক্সিলন্সি প্রেসিডেন্ট এখনি আপনাকে হাসপাতালে নিতে বলেছেন। তারা সেখানে অপেক্ষা করছেন। মেজর পাভেল বলল।
তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ওরা কারা, কি ওদের মিশন? সেটা জানা। তুমি যাও। আমি ওদিক দেখব। বলল আহমদ মুসা।
মেজর পাভেল আর কিছু না বলে নিহত ঐ ছয়জন লোকের সার্চ করার জন্যে চলে গেল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই রত্নদ্বীপ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদা এসে পৌঁছল। তার সাথে এসেছে একটা অ্যাম্বুলেন্স। সার্চ শেষে মেজর পাভেলও এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে।
আসুন। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে স্যার। বলল কর্নেল জেনারেল রিদা।
একটু সময় দিন জেনারেল রিদা। বলে আহমদ মুসা তাকাল মেজর পাভেলের দিকে। বলল, সার্চ করে কিছু পেলে?
মোবাইল ছাড়া নেবার মতো আর কিছুই ছিল না স্যার। হাতের মোবাইলগুলো দেখিয়ে বলল মেজর পাভেল।
আহমদ মুসা একটু ভেবে বলল, খুবই সাম্প্রতিক ধরনের, ধরো আজকের বা গতকালকের কোনো কল বা মেসেজ আছে কি না তাড়াতাড়ি চেক করো।
একটা মোবাইলে কাজ শুরু করল মেজর পাভেল।
দুএকটা মোবাইল আমাকে দাও মেজর পাভেল, তোমাকে একটু সাহায্য করি। কর্নেল জেনারেল রিদা বলল।
ধন্যবাদ স্যার! বলে দুএকটা মোবাইল তুলে দিল জেনারেল রিদার হাতে।
প্রথম মোবাইলের মেসেজ চেক করতে গিয়েই মেজর পাভেল বলে উঠল, একটা মেসেজ পাওয়া গেছে স্যার। মাত্র আধা ঘণ্টা আগে এসেছে।
আধা ঘণ্টা আগে? পড় তো পাভেল? বলল আহমদ মুসা।
বিফোর জিরো আওয়ার টি এন মুভ টু নোম্যানস জোন। পাভেল পড়ল।
শুনেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। একবার বাক্যটা মুখে উচ্চারণ করেই। দ্রুত কণ্ঠে জেনারেল রিদাকে বলল, জেনারেল রিদা, আপনি হোম মিনিস্টারকে টেলিফোন করে প্রেসিডেন্টকে বলতে বলুন যাতে সর্বোচ্চ ইমারজেন্সি দিয়ে এখনি মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকতে পারেন। আরও বলুন, দ্বীপের সবগুলো কেন্দ্রকে নির্দেশ দিতে যে, সব রকমের গাড়ি যেন সবাই প্রস্তুত রাখে এই মুহূর্তের পর থেকেই। আহমদ মুসা কথা শেষ করল। তার সব সময়ের শান্ত কণ্ঠেও উদ্বেগের আভাস।
মুখ চুপসে গেছে কর্নেল জেনারেল রিদা এবং মেজর পাভেলের।
মেসেজে কিছু কি আছে স্যার? আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। মোবাইল হাতে নিয়ে কল তৈরি করতে করতে বলল কর্নেল জেনারেল রিদা।
গুরুতর মেসেজ জেনারেল। ওরা আজ রাত ১২টায় রত্নদ্বীপ আক্রমণ। করছে। বলল আহমদ মুসা।
আজ রাত ১২টায়! আর্তনাদ করে উঠল জেনারেল রিদা ও মেজর পাভেল দুজনের কণ্ঠই।
মুখে আর্তনাদ করলেও আহমদ মুসার মুখে কথাটা শোনার সাথে সাথেই তারা দুজনেই অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।
যদি তাই হয় তাহলে দ্বীপকে রক্ষার জন্যে আমরা মৃত্যুর জন্যেও প্রস্তুত স্যার। কর্নেল জেনারেল রিদা বলল।
ধন্যবাদ জেনারেল রিদা। মৃত্যুকে ভয় না করলে বাঁচাটা সহজ হয়ে যায়। বলল আহমদ মুসা। ||||||||
|| হোম মিনিস্টারের টেলিফোন এল। তার সাথে কথা বলছিল জেনারেল রিদা।
এক সময় সে মোবাইলটা মুখের কাছ থেকে সরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, স্যার, হোম মিনিস্টার স্যার আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন।
জেনারেল রিদা মোবাইল আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা মোবাইল ধরতেই ওপ্রান্ত থেকে হোম মিনিস্টার ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল, স্যার আমরা উদ্বিগ্ন, আপনি কেমন আছেন? আমরা সবাই হাসপাতালে। আরেকটা বড় উদ্বেগের খবর আপনি দিলেন জেনারেল রিদার মাধ্যমে। আমি কিছুই বুঝছি না।
বিষয়টা টপ ইমারজেন্সি। আজ রাত ১২টার পরে রত্নদ্বীপ আক্রান্ত হতে যাচ্ছে বলে আমি মনে করি। বলল আহমদ মুসা।
কিছুক্ষণ ওপার থেকে কোনো কথা এল না। মুহূর্ত কয়েক পরে কথা বলে উঠল ক্রিস কনস্টানটিনোস-এর কণ্ঠ। কণ্ঠ তার কাঁপা, উদ্বেগ-উত্তেজনায় ভাঙা। বলল, ও গড! এখনি আমি প্রেসিডেন্টকে বিষয়টা জানাচ্ছি। প্রেসিডেন্টসহ অনেকেই আমরা হাসপাতালে। এখানেই যদি আমরা বসি?
ভালো হবে। সময় বাঁচবে। আমরা আসছি। বৈঠকটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়া দরকার। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। রাখি তাহলে? ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
ওকে, রাখছি স্যার। বাই। বলে আহমদ মুসা মোবাইল কল ক্লোজ করল।
আহমদ মুসার সামনেই দাঁড়িয়েছিল জেনারেল রিদা। আগেই রেডি ছিল। অ্যাম্বুলেন্স। ২ স্যার অ্যাম্বুলেন্সে উঠুন। ওখানেই আপনার প্রাথমিক চিকিৎসটা হয়ে
যাবে। জেনারেল রিদা বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, আমি আহত মনে করিয়ে আমাকে দুর্বল করবেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিককেও যুদ্ধ করতে হয়। মনে হচ্ছে রত্নদ্বীপ এখন একটা মহাযুদ্ধক্ষেত্র।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে একটা জীপের ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। জেনারেল রিদা উজ্জ্বল চোখে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে নীরবে তার। পাশের সিটে গিয়ে বসল।
স্টার্ট নিল গাড়ি।
সামনে আহমদ মুসার গাড়ি।
তার পেছনে মেজর পাভেল।
সবার পেছনে অ্যাম্বুলেন্স।
গাড়ির সারির এই ক্ৰম আহমদ মুসাই সাজিয়েছিল।
আহমদ মুসা ধরেই নিয়েছিল, যারা তাকে হত্যার জন্যে তিন দিক থেকে আক্রমণ করেছিল, তারা আবারও আক্রমণ করতে পারে। তারা ধরেই নেবে। আহমদ মুসাকে অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হবে। সুতরাং কাজ হলো তাদের বিপথে। ডাইভার্ট করা। আহমদ মুসারা এরই সুযোগ গ্রহণ করবে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে। এই মুহূর্তে তাদের কাউকে হাতে পাওয়া খুবই প্রয়োজনীয়।
কিন্তু পথে কোনো আক্রমণ এলো না।
তাহলে কি তাদের কোনো লোক নেই এদিকে? ভাবল আহমদ মুসা। হাসপাতালে পৌঁছে গেল আহমদ মুসার গাড়ি।
সিকিউরিটির লোকজন গিজগিজ করছে হাসপাতালের চারদিকে। মুহূর্তে ওরা আহমদ মুসার গাড়ির দুধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল।
আহমদ মুসার গাড়ি এসে ঢুকল হাসপাতালের গাড়ি বারান্দায়। গাড়িবারান্দার উপরে হাসপাতালে ঢোকার মুখে লবির মতো জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিল প্রেসিডেন্ট। তার একপাশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ মন্ত্রীসভার কয়েজন সদস্য। প্রেসিডেন্টের অন্যপাশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কনস্ট্যানটিনোস-এর মেয়ে জোনা ডেসপিনা এবং জাইনেব জাহরা।
জোনা ডেসপিনা ও শাহজাদী জাইনেব জাহরার গায়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহি নীর ইউনিফরম। প্রেসিডেন্টের পেছনে তার বড় ছেলে হামযা আনাস আমিন। তারও গায়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ইউনিফরম। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়েছে আহমদ মুসার নির্দেশে ছাত্র-অছাত্র, কর্মী, চাকুরেসহ যুবশক্তির সবাইকে নিয়ে।
গাড়িবারান্দা পার হয়ে আহমদ মুসার গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল লবির গা ঘেঁষে।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিট থেকে নেমেই তরতর করে উঠে গেল সিঁড়ি দিয়ে। সে যে মারাত্মক আহত তার কোনো চিহ্ন নেই তার নড়াচড়ায়।
আহমদ মুসার পেছনে উঠছিল কর্নেল জেনারেল রিদা এবং মেজর পাভেল।
আহমদ মুসা লবিতে উঠে আসতেই প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল, আল্লাহর হাজার শোকর যে, আপনার আর কোনো ক্ষতি হয়নি।
বলেই প্রেসিডেন্ট একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তারকে বলল, ডাক্তার, তুমি ভাই আহমদ মুসার ট্রিটমেন্টটা তাড়াতাড়ি করে দাও। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ডাক্তার দ্রুত এগিয়ে এল। সালাম দিল আহমদ মুসাকে।
অন্য সবাই আহমদ মুসার কাছে এগিয়ে এসেছে।
ডাক্তার কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা মুখ প্রেসিডেন্টের দিকে ঘুরিয়ে বলল, প্লিজ এক্সিলেন্সি, খুবই জরুরি আলোচনা রয়েছে। আমার কথা আগে শুনুন। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত অবস্থাতেও প্রয়োজনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। এক্সিলেন্সি সত্যিই আমরা। এখন যুদ্ধক্ষেত্রে।
গম্ভীর হয়ে উঠল প্রেসিডেন্টের মুখ।
মুখ খুলেছিল প্রেসিডেন্ট কিছু বলার জন্যে। তার আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের মেয়ে জোনা ডেসপিনা বলল, যুদ্ধক্ষেত্রে সুযোগ থাকে না, এখানে সুযোগ আছে স্যার।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ঠিক ডেসপিনা, সুযোগ আছে। কিন্তু সময় নেই।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকালো প্রেসিডেন্টের দিকে।
হ্যাঁ ভাই আহমদ মুসা। বৈঠকের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। চলুন। বলল প্রেসিডেন্ট।
বলে চলতে শুরু করেই আবার দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, মন্ত্রীসভার বাইরে কি কেউ থাকতে পারে মিটিং-এ?
এটা আপনার সিদ্ধান্ত এক্সিলেন্সি। তবে আমার মতে নিরাপত্তা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্বশীলরা এ বৈঠকে থাকতে পারেন। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। আমিও এটাই চাচ্ছিলাম। প্রেসিডেন্ট বলল।
প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল। তাদের পেছনে সবাই চলল মিটিং-এর জন্যে নির্ধারিত কক্ষের দিকে।
.
আহমদ মুসা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং দিয়ে কথা শেষ করল।
বেশ বড় মিটিংরুমটি। লোকে ভর্তি। উপস্থিত দায়িত্বশীল সকলকেই মিটিং-এ ডাকা হয়েছে। ঘরে পিনপতন নীরবতা।
উদ্বেগে আচ্ছন্ন সকলের মুখ।
প্রেসিডেন্টের গম্ভীর মুখের স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, তথ্যের সূত্র সম্পর্কে ভাই আহমদ মুসা নিশ্চয় নিশ্চিত?
গম্ভীর মুখ আহমদ মুসার। তাকাল সে প্রেসিডেন্টের দিকে। বলল, আমি নিশ্চিত এক্সিলেন্সি।
আহমদ মুসার কণ্ঠ থেকে কথাটি বের হওয়ার সাথে সাথে চাপা একটা আর্ত গুঞ্জন উঠল বিশাল ঘরটি জুড়ে।
প্রেসিডেন্টের স্থির দৃষ্টি তখনও আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। বলল প্রেসিডেন্ট শান্ত-স্থির কণ্ঠে, ওরা তাহলে সময় এগিয়ে এনেছে! আমাদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি তো তাহলে পিছিয়ে পড়ল! প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ বেশ শুকনো।
ঠিক এক্সিলেন্সি। কোনোভাবে আমাদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির কিছু খবর ওরা পেয়ে থাকতে পারে। সেজন্যেই সময় ওরা যথেষ্ট এগিয়ে এনেছে। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে উঠল, হাতে আছে মাত্র দুঘন্টা সময়। এ সময়ে আমাদের কি করার আছে! তার মানে আমরা, আমাদের। রত্নদ্বীপ…!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর কিছু বলতে পারলো না। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।
ভাই আহমদ মুসা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস যে কথাটা বলতে পারলেন না, আমার মনে হয় এখানকার সবারই মনের কথা এটা। কিন্তু কিছু করার নেই, আমি তা মনে করি না। আহমদ মুসা ভাই এখন আপনি বলুন, আমরা এখন কি করতে পারি?
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। কি করতে পারি, সেটা আলোচনার জন্যেই এই বৈঠকের ব্যবস্থা। ওরা আমাদের অবরোধ করলে ওদের অবরুদ্ধ করে তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেবার যে প্রোগ্রাম হয়েছিল, সেটা এখন আর সম্ভব নয়। শেষ বিকল্প যেটা ছিল, সেটা হলো কোনো বন্ধু দেশের বিমান। বাহিনীর সাহায্য নেয়া। সে চেষ্টা আমি করেছি। কিন্তু সমস্যা দাঁড়িয়েছে এত বড় সিদ্ধান্ত এত অল্প সময়ে নেয়া এবং তা গোপন রাখা! প্রকাশ হয়ে পড়াকে তারা ভয় করছে। অবশেষে সৌদি আরব ও তুরস্ক তাদের সার্ভিস অফার করেছে। অল্প সময়ের মধ্যে দুটি করে চারটি বোমারু বিমান যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু তাদেরকে ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি দিতে হবে আশেপাশের অন্য কোনো দেশে আলেকজান্দ্রিয়া সৌদি আরবকে এবং ত্রিপলি তুরস্কের বোমারু বিমানকে ল্যান্ডিং ও রিলোড ফ্যাসিলিটি দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু তাদের বিমানগুলো সাড়ে বারোটার আগে অ্যাকশনে আসতে পারবে না। থামল আহমদ মুসা।
কিন্তু রাত ১২টা থেকে আক্রমণ শুরু হবে। আধা ঘন্টায় আমাদের ছোট্ট দ্বীপ তো ধ্বংস হয়ে যাবে। বলল অর্থমন্ত্রী ইহুদি নেতা বেন নাহান আরমিনো।
ধ্বংস তো কিছু হবেই, কিন্তু দেশের জনগণকে রক্ষা করতে হবে। সে ব্যবস্থা করাই এখন আমাদের প্রধান কাজ। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু কীভাবে? এ দেশের মানুষই তাদের প্রধান টার্গেট। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
ওদের আক্রমণ হবে শহর, গ্রাম, লোকালয়, বাজার জনবহুল এমন অবস্থানগুলোকে টার্গেট করে। আগামী দুঘন্টার মধ্যে সব মানুষকে এসব স্থান থেকে সরিয়ে নিতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
এত মানুষকে কোথায় নেয়া হবে? প্রেসিডেন্ট বলল।
ওদের আক্রমণের যে পরিকল্পনা, তাতে দ্বীপের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হলো পূর্ব ও পশ্চিমের পাহাড়ের মধ্যবর্তী সবচেয়ে উঁচু অংশের পাদদেশ এলাকা। আমি হিসেব করে দেখেছি, চারদিকের গোলাবর্ষণ থেকে এই দুই স্থান নিরাপদ থাকবে। এছাড়া অবশিষ্ট লোকদের পাহাড় এলাকায় সরিয়ে নিতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
নীরব মিটিং কক্ষটি। আহমদ মুসা থামলেও সঙ্গে সঙ্গে কেউ কথা বলল না। সকলের চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
নীরবতা ভেঙে কথা বলল প্রেসিডেন্ট। বলল, ভাই আহমদ মুসা, আপনি। যা বলছেন, এটাই নিশ্চয় শেষ অপশন। তারপর কি? ওরা গোলাবর্ষণের পর নিশ্চয় দ্বীপে প্রবেশ করবে। তারা তো তখন পেয়ে যাবে আমাদের। বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে হতাশার প্রাধান্য।
এক্সিলেন্সি এই দুঃসময়ে আল্লাহর উপরই আমাদের নির্ভর করতে হবে। এবং যতটুকু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব সেটা আমাদের করতে হবে। প্রথমত, যতটা সম্ভব আমাদের লোকদের বাঁচাতে হবে। ওরা দ্বীপে প্রবেশ করার সুযোগ ইনশাআল্লাহ পাবে না। যে চারটি জংগী বিমান আসছে, তারা আটটা বোমা বহন করা ছাড়াও ওগুলো মেশিনগান সজ্জিত। সুতরাং আমরা খুব শীঘ্রই আক্রমণে যেতে পারব। আমাদের পাল্টা আক্রমণে ওদের আক্রমণ চলতে পারবে বলে মনে হয় না। বলল আহমদ মুসা। তার শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠ।
ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। আমিসহ আমাদের জন্যে এই ধরনের ভয়াবহ সংকট এই প্রথম। তাই হঠাৎ করেই আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। ভাই আহমদ মুসার কথা আবার আমাদের মধ্যে সাহস ফিরিয়ে এনেছে। আল্লাহ ভরসা।
প্রেসিডেন্ট মুহূর্তকাল থেমে সবার উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ভাই আহমদ মুসা লোক সরিয়ে নেবার ব্যাপারে যা বলেছেন, তা সবাই বুঝেছেন?
হ্যাঁ আমরা বুঝেছি। সমস্বরে বলে উঠল সবাই।
আমি নির্দেশ দিচ্ছি এই মুহূর্ত থেকে লোক সরানোর কাজ শুরু করার জন্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিন সিনিয়র মন্ত্রী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ- এই চারজন লোকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার সব কাজের নির্দেশনা দেবেন ও সমন্বয় করবেন। আর ভাই আহমদ মুসা বাইরের সাহায্যের দিকটা দেখবেন। বলল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, এক্সিলেন্সি, জেনারেল রিদাকে কমিটির বাইরে রাখলে ভালো হয়। অন্যত্র তার প্রয়োজন আছে। আমি মনে করছি জেনারেল রিদা দ্বীপের দক্ষিণ এন্ট্রিপয়েন্টের দায়িত্বে থাকলে ভালো হবে, আমি থাকব উত্তর এন্ট্রিপয়েন্টে। আমাদের কামান সজ্জিত দুটি বড় পেট্রোল বোট রয়েছে। এ দুটির একটি থাকবে দক্ষিণের প্রবেশপথে, দ্বিতীয়টি থাকবে উত্তরের প্রবেশপথে। শত্রুরা যদি দ্বীপে আসে বা আকস্মিক ল্যান্ডিং করতে চায়, তাহলে ওদের বাধা দিতে হবে।
ধন্যবাদ, ভাই আহমদ মুসা ঠিক বলেছেন। এ বিষয়টা তো আমাদের মাথায় আসেনি। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। দ্বীপের গোটা জনশক্তি ভাই আহমদ মুসা এখন আপনার অধীনে। যাকে, যেভাবে, যেখানে ব্যবহার করবেন তা আপনার দায়িত্বে।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। নিরাপত্তা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর লোকরা মানুষকে সরিয়ে নেবার কাজ করবে এবং মানুষের সাথেই থাকবে। আর। নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু লোককে জেনারেল রিদা সিলেকশন করবেন উত্তর ও দক্ষিণ প্রবেশপথের জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
তাই হবে ভাই আহমদ মুসা।
বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জেনারেল রিদার দিকে। বলল, এবার আপনরা প্লিজ কাজে লেগে যান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জেনারেল রিদাসহ মন্ত্রীরা আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল।
মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ভাই আহমদ মুসা তোক সবানোর যে পরিকল্পনা। দিয়েছেন, সে অনুসারেই কাজ হবে। আমাদের জন্যে দোয়া করুন মহামান্য প্রেসিডেন্ট। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিশ কনস্টানটিনোস।
আসুন মি. কনস্টানটিনোস। ফি আমানিল্লাহ। প্রেসিডেন্ট বলল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যরা পা বাড়ালেন বেরুবার জন্যে। কর্নেল জেনারেল রিদা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, স্যার মেজর পাওয়েল পাভেল আমার পক্ষ থেকে আপনার কমিটিকে সহায়তা করবে। আর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হামযা আনাস আমিনও আপনাদের সহযোগিতায় থাকবে।
ধন্যবাদ! বলে বেরিয়ে গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার সাথীরা।
জেনারেল রিদা মুখোমুখি হলো আহমদ মুসার। বলল, স্যার, আমি মনে করছি জোনা ডেসপিনা ও ক্যাপ্টেন আলিয়ার নেতৃত্বে নিরাপত্তা সদস্যদের একটা টিম সর্বক্ষণ প্রেসিডেন্টকে অ্যাটেন্ড করবে। আর স্যার, আপনার সাথে মেজর যোবায়ের খালেদের নেতৃত্বে একটা নিরাপত্তা টিম থাকবে কামানবাহী পেট্রোল বোটে।
ধন্যবাদ জেনারেল, আপনার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। একটা জরুরি কথা জেনারেল রিদা। আমার মনে হয় ওরা দ্বীপে গোলাবর্ষণ শুরু করার পর অথবা সঙ্গে সঙ্গেই ওরা দ্বীপের দুটি প্রবেশপথ দখলে নেয়ার চেষ্টা করবে। আর তা দুই কারণে, এক. দ্বীপের কাউকে পালাতে না দেয়া, দুই. দ্বীপের অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট করা, যাতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ সম্ভব হয়। তিন দিক পুরোপুরি পর্যবেক্ষণে রাখার সুবিধার জন্যে আপনার কামানবাহী পেট্রোলশীপকে প্রবেশপথের মুখে ডান বা বাম দিকে মোতায়েন করতে।
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে একটা বিশেষ ধরনের গগলস বের করে জেনারেল রিদার হাতে দিয়ে বলল, এটা লেটেস্ট নাইটভিশন গগলস। অন্ধকারে আধা মাইল দূর পর্যন্ত দেখতে এটা আপনাকে সাহায্য করবে। বর্তমান অবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চেষ্টা করবেন শত্রু যেন দ্বীপের প্রবেশপথের উপর আগে আক্রমণের সুযোগ না পায়। থামল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। আপনার প্রতিটা আদেশ-নির্দেশ সব শক্তি দিয়ে কার্যকর করার চেষ্টা করব। আসছি স্যার, দোয়া করুন।
বলে জেনারেল প্রেসিডেন্টের কাছে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ভাই আহমদ মুসা, আপনি শত্রুকে প্রথম আক্রমণের সুযোগ না দেয়ার কথা বললেন। কিন্তু রাত ১২টায় ওরাই তো আগে আক্রমণে আসছে। বলল প্রেসিডেন্ট।
দ্বীপের চারদিকের ঐ আক্রমণ ঠেকাবার এবং পাল্টা আক্রমণ চালানোর মতো উপায়-উপকরণ আমাদের নেই। আমি সে আক্রমণের কথা বলিনি। দ্বীপে প্রবেশের সময় ওদের আক্রমণের উপর পাল্টা আক্রমণ চালানোর কথা আমি বলেছি এক্সিলেন্সি এবং এটা সম্ভব। ওরা বাইরে থেকে কামান দাগুক, ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ুক, কিন্তু ওরা যেন ওদের অপবিত্র পা এই দ্বীপের মাটিতে না রাখতে পারে। আহমদ মুসা বলল। আবেগে তার কণ্ঠ, ভারি।
আহমদ মুসার এই আবেগ সেখানে উপস্থিত প্রেসিডেন্ট, জোনা। ডেসপিনা, জাইনেব জাহরা, ক্যান্টেন আলিয়াসহ সবাইকে স্পর্শ করেছে।
প্রেসিডেন্টের চোখ-মুখ ভারি হয়ে উঠেছে। বলল, ভাই আহমদ মুসা, রত্নদ্বীপ আপনার জন্মভূমি নয়, আবাসভূমিও নয়। এরপরও এ অসহায় ছোট এই দ্বীপদেশকে এত ভালোবাসেন আপনি?
এক্সিলেন্সি, আল্লাহর বান্দার কাছে আল্লাহর গোটা দুনিয়া আবাসভূমি, জন্মভূমি। গোটা দুনিয়াকে সে ভালোবাসে, সব দেশকে তাই সে ভালোবাসবেই। বলল আহমদ মুসা।
আমরা কয়জন এটা জানি, কয়জন এটা মানি! প্রেসিডেন্ট বলল।
আল্লাহর রাসুল (স:)-এর সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীনরা সকলেই এটা যেমন জানতেন, তেমনি মানতেনও। গোটা দুনিয়াকে তারা তাদের ঘর বানিয়েছিলেন। তাই সেই সময়ের গোটা দুনিয়ায় তাদের কবর ছড়িয়ে। ছিটিয়ে আছে, তাদের নিজস্ব বাড়ি ঘরের স্বাভাবিকভাবেই কোনো ঠিকানা নেই। বলল আহমদ মুসা।
সে মহান ভাইয়েরা তো ছিলেন মহান মিশনারী। মানুষের শান্তি ও মুক্তির বাণী নিয়ে তারা গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আমরা তো তা নই। প্রেসিডেন্ট বলল।
আমরা তা নই বলে নীতি তো পাল্টে যায়নি। আল্লাহর বান্দাহদের একটা জন্মভূমি থাকে, একটা আবাসভূমি থাকে, কিন্তু গোটা দুনিয়াকে, সব দেশকে তারা নিজের জন্মভূমি, আবাসভূমির মতোই ভালোবাসে।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল জোনা ডেসপিনা ও ক্যাপ্টেন আলিয়ার দিকে। বলল, মহামান্য প্রেসিডেন্টের সব দায়িত্ব তোমাদের উপর দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা তোমরা জান। সেভাবেই দায়িত্ব পালন করবে।
প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, এক্সিলেন্সি, আমি আসছি। দোয়া করুন, দ্বীপ এবং দ্বীপের মানুষ যেন রক্ষা পায়।
হ্যাঁ ভাই আহমদ মুসা, আপনার উপর বিরাট দায়িত্ব। আপনাকে যেতেই হবে। আমার অনুমান মিথ্যা না হলে দ্বীপের উত্তরের প্রবেশপথটাই আক্রান্ত। হবে, যদি তারা দ্বীপে নামতে চায়। কারণ, দক্ষিণের প্রবেশপথের সামনের। পানি অগভীর, ডুবো পাহাড়-টিলায় ভরা। এ পথে চলাচলে অভ্যস্ত ও সতর্ক কেউ না হলে জেটি পাওয়ার আগেই আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। থাক এদিকের কথা। আপনার কাছে একটা কথা আমার খুবই জানতে ইচ্ছা করছে। সেটা হলো, পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কি ভাবছেন? বাস্তবে কি ঘটতে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে আপনার নিজস্ব অনুমান কি?
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসা। বলল, আমরা যেসব দিক বিবেচনায় রেখে কথা বলি, তার উপরে রয়েছে আল্লাহর সিদ্ধান্ত। আমি আশা করি, আল্লাহ রত্নদ্বীপের নিরপরাধ মানুষকে রক্ষা করবেন। আল্লাহ যে সুযোগ দিয়েছেন, তা সাধ্যমত ব্যবহারের আমরা চেষ্টা করেছি। আমার যে হিসাব। তাতে, শত্রুরা খুব বেশি হলে আধা ঘন্টা একতরফা গোলাবর্ষণের সুযোগ পাবে দ্বীপের উপর। আধা ঘন্টার মধ্যেই ওদের উপর চারটা বিমানের আক্রমণ শুরু হবে। এরপর শত্রুরা দ্বীপের উপর আক্রমণের সুযোগ আর পাবে না। আল্লাহ সহায় হলে, যারা দ্বীপ ধ্বংস করতে আসছে, তারাই ধ্বংস। হয়ে যাবে।
আমিন! বলে উঠল উপস্থিত সবাই।
আমি আসছি এক্সিলেন্সি। বলে আহমদ সালাম দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ঘর থেকে বেরুবার জন্যে।
জোনা ডেসপিনা, জাইনেব জাহরা ছুটে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন আলিয়াও এল তাদের পেছনে পেছনে। জোনা ডেসপিনা বলল, আমরা দশ মিনিট সময় চাই আপনার কাছে। ভেতরে চলুন। ডাক্তার-নার্সরা অপেক্ষা করছেন।
আহমদ মুসা ওদের দিকে না তাকিয়েই নির্বিকার কণ্ঠে বলল, চল। এদিকের কাজ শেষ। এখন থেকে ১২টা পর্যন্ত সময় আমার নিজস্ব। এখন সময় দিতে আমার আপত্তি নেই।
কিছুটা দূরে ডাক্তার-নার্সরা দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা হাঁটতে লাগল তাদের দিকে। পেছনে জোনা ডেসপিনা ও অন্যরা।
স্যার, একটা প্রশ্ন করতে পারি? বিনীত কণ্ঠে বলল জোনা ডেসপিনা।
অনুমতির প্রয়োজন নেই। সামনে তাকানো আহমদ মুসা হাঁটতে হাঁটতেই বলল।
ধন্যবাদ স্যার। আমরা সবাই উদ্বিগ্ন, চিন্তিত, আতঙ্কিত। কিন্তু আপনার মধ্যে এর কিছুই দেখছি না কেন? বলল ডেসপিনা।
দেখ, আমি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাধ্যের মধ্যে যা আছে, তা করেছি এবং সাধ্যমতো চেষ্টা করবো সামনের অবশিষ্ট সময়েও। এর পরের কাজ আল্লাহর। সুতরাং আমার উদ্বিগ্ন হওয়ার কি আছে। আহমদ মুসা বলল।
পরের কাজ মানে ফলাফলের কথা বলছেন? তাহলে আপনি এবং আমাদের চিন্তা-ভাবনা, প্রচেষ্টা, সংগ্রাম সবই তো ফল লাভ করার জন্যে। বলল ডেসপিনা।
হ্যাঁ, ফল লাভ আমার লক্ষ্য। ফল-এর জন্যেই আমার কাজ-প্রচেষ্টা। কিন্তু ফল আনা আমার দায়িত্ব নয়। ফল দেয়া আল্লাহর এখতিয়ার। ফল আনার দায়িত্ব আমরা হাতে নিলে যেকোনো মূল্যে ফল নিয়ে আসার জন্যে আমরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে যেতাম। একেই বলে চরমপন্থা বা এক্সট্রিমিজম। এটা সুস্পষ্টভাবে সীমালংঘন। এটা আল্লাহ তার বান্দার জন্যে পছন্দ করেন না। আহমদ মুসা বলল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল জাইনেব জাহরা।
তার আগেই দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে বলল, স্যার সব রেডি, এদিকে আসুন।
ইমারজেন্সি সেকশনের দরজা পেরিয়ে ডাক্তার সিকিউরিটি জোন চিহ্নিত পাশের ঘরগুলোর দিকে এগোলো। একটা কক্ষের সামনে গিয়ে দরজা খুলে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল।
আহমদ মুসা প্রবেশ করল কক্ষে। পেছনে পেছনে নার্সরা। জোনা ডেসপিনারা ফেরত গেল প্রেসিডেন্টের কাছে।
ক্যাপ্টেন আলিয়া প্রেসিডেন্টের সামনে গিয়ে ছোট্ট একটা বাউ করে বলল, এক্সিলেন্সি বাইরে প্রটোকল রেডি। আমাদের যেতে হয় এক্সিলেন্সি।
প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। বলল, চলো ক্যাপ্টেন। কিন্ত আমার চিন্তা হচ্ছে আহমদ মুসার জন্যে। এতটা আহত, এই অবস্থায় রত্নদ্বীপের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ উত্তরের প্রবেশপথ রক্ষার দায়িত্ব তিনি নিলেন? অনেকটা স্বগতকণ্ঠে কথাগুলো বলে প্রেসিডেন্ট পা বাড়াল বাইরে বেরুবার জন্যে।
২
কৃষ্ণপক্ষের নিকষ কালো রাত।
ভূমধ্যসাগরের কাক-কালো পানির কালো-বিচ্ছুরণ অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে চারদিক।
সময় তখন ঠিক ১২টা ৫ মিনিট।
অন্ধকারের কালো পর্দা ঠেলে কামান ও ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ এসে দাঁড়াল রত্নদ্বীপের উত্তর-প্রবেশপথ থেকে এক কিলোমিটার সামনে।
জাহাজটি বড় ধরনের একটা যুদ্ধজাহাজ। রত্নদ্বীপ অভিযানের জন্যে জাহাজটি বেমানান, ঠিক যেন মশা মারতে কামান দাগার মতো। জাহাজে কোনো পতাকা নেই, জাহাজের কোথাও তার নাম লেখা নেই। নামের জায়গায় লেখা আছে কমান্ডশীপ অপারেশন ডার্ক ডায়মন্ড।
জাহাজের কমান্ড কেবিন। কমান্ড আসনে বসে আছে রিটায়ার্ড অ্যাডমিরাল বিভেন বেনগুরিয়ান।
অ্যাডমিরাল বিভেন বেনগুরিয়ান রাশিয়ান নৌবাহিনীর নামকরা কমান্ডার। রিটায়ারমেন্টের আগে সে ছিল ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগর নৌ বহরের কমান্ডার। রিটায়ারমেন্টের পরে সে এক মানুষ এক পৃথিবী নামের ইহুদিবাদী সংগঠনে যোগ দেয়। তাকেই সংগঠনটি রত্নদ্বীপ ধ্বংসের দায়িত্ব দিয়েছে।
অ্যাডমিরাল বিভেন বেনগুরিয়ান কথা বলছিল তার কমান্ড অয়্যারলেসে। বলছিল সে, আজ আমাদের অপারেশন ডাক-ডায়মন্ড-এর সর্বশেষ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে দুটি। এক. রত্নদ্বীপের মানুষকে ধ্বংস করা এবং দুই. এই দ্বীপের একজনকেও পালাতে না দেয়। আমরা চাই না, আজকের রত্নদ্বীপের ধ্বংসলীলার ঘটনার একবিন্দুও বাইরে প্রকাশিত হোক। এজন্যেই আমি আছি কমান্ড জাহাজ নিয়ে উত্তরের প্রবেশপথে এবং দক্ষিণের প্রবেশপথে রয়েছেন কমান্ডার বেঞ্জামিন। ওভার।
অডিও মেসেজটি শেষ করার পর চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে একটু ভাবল অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান। আবার হাতে তুলে নিল অয়্যারলেস। অয়্যারলেস হাতে নিতেই বিপ বিপ সংকেত দিয়ে উঠল রিসিভার বাটন অন করতেই কথা বলে উঠল অয়্যারলেস।
– অনেকটাই যান্ত্রিক কণ্ঠে বলা হলো, রত্নদ্বীপের চারদিকে আমাদের অফেন্সলাইনের পেছনে ২০০ মাইল রেডিয়াসের মধ্যে কোনো জাহাজ, বোট কিছুই নেই। আমাদের কেনা স্যাটেলাইটের ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এ থেকে প্রমাণ হয় রত্নদ্বীপ রক্ষার কোনো ব্যবস্থাই আহমদ মুসা করতে পারেনি।
অয়্যারলেসের কথা বন্ধ হয়ে গেল।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ানের।
অয়্যারলেস আবার তুলে নিল মুখের কাছে। বলল, নির্দেশ প্রতিটি ইনডিভিজুয়াল ইউনিটের জন্যে। অল-ক্লিয়ার। ঠিক ১২টা ১৫ মিনিটে গোলা বর্ষণ শুরু হবে। পরবর্তী প্রতিটি গোলা সামনে-পেছনে, ডাইনে-বামে আগের লোকেশন থেকে ১০ মিটার দূরত্বে পড়বে। আমরা রত্নদ্বীপের সব জনপদকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে চাই। গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকবে। কোনো নতুন। নির্দেশ থাকলে কমান্ডশীপ থেকে জানানো হবে। সব জাহাজ ও বোটের সব রকম আলো নিভানো থাকবে। ওভার।
অয়্যারলেসটা ছোট টেবিলটার উপরে রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান।
ঠিক ১২টা ১৫ মিনিটে একসাথে ডজন ডজন কামান গর্জে উঠল। চারদিক থেকে আঁক বেঁধে ছুটল কামানের গোলা রত্নদ্বীপের দিকে। কমান্ড রুমের কক্ষে তার দৃশ্য ফুটে উঠল। অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান দেখছে সে নয়ন মুগ্ধকর দৃশ্য।
তাকিয়ে থাকতে গিয়ে আনমনা হয়ে পড়েছিল অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান। মন চলে গিয়েছিল তার ঘটনার পেছনের ঘটনায়। রত্নদ্বীপের ধ্বংস তারা চায় আদর্শিক কারণে। সব ধর্মের সহাবস্থান সফল হোক, কার্যকর হোক, সম্প্রীতি-সহযোগিতার এক সমাজ গড়ে উঠুক তা তারা চায় না। তারা চায় সংঘাত। সংঘাতের মধ্য দিয়েই তাদের ধর্ম ছাড়া অন্য সব ধর্ম হয়ে পড়বে দুর্বল অথবা বিলুপ্তি ঘটবে। সেই শূন্যতায় তাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠবে এক মানুষ এক পৃথিবীর।
বাইরে তখন রত্নদ্বীপের চারদিক থেকে কামানের গোলা বর্ষণের ঝড় বইছে। কিন্তু এই ঝড়ও অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ানের তন্ময়তা ভাঙতে পারেনি। তার শূন্য দৃষ্টি সিসি টিভির স্ক্রিনে নিবদ্ধ। স্ক্রিনে কমান্ডশীপের চারদিকের একটা আবছা দৃশ্য ফুটে উঠেছে। জাহাজের চারদিকের নাইটভিশন ক্যামেরাগুলো চারদিকের দৃশ্যকে এতটা স্বচ্ছ করেছে যে, সমুদ্রের ছোট ঢেউকেও দৃশ্যমান হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ানের শূন্য দৃষ্টিতেও একটা দৃশ্য এসে আঘাত করল। প্রায় ১০০ ফিটের মতো দূরে ছোট কালো বলের আকারের একটা কিছু সাগরের ওপর উঠেই যেন আবার ডুবে গেল। কালো বস্তুটি একটু পরেই আবার ভেসে উঠার কথা, কিন্তু উঠল না।
চমকে উঠল অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান। তন্ময়তা ভেঙে গেল তার। সিসি টিভির স্ক্রিনের উপর তীক্ষ্ণ হলো তার চোখ। একশ ফুটের মতো দূরে সেই কালো বস্তুটি আবার ভেসে উঠে সঙ্গে সঙ্গেই তা আবার ডুবে গেল। ততক্ষণে অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান দৃশ্যটির একটা স্ক্রিন শট নিয়ে নিয়েছে।
দৃশ্যটিকে অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান কম্পিউটারে স্ক্রিনে নিয়ে এসে কালো বস্তুটিকে এক্সপান্ড করে চমকে উঠল। দেখল সে, কালো বস্তুটি একটি মানুষের মাথা। আরও তীক্ষ্ণ হলো অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ানের চোখ। মাথাটাকে রোটেট করে মুখ সামনের দিকে ঘুরিয়ে নিল সে। মুখের উপর নজর পড়তেই দ্বিতীয়বারের মতো চমকে উঠল অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান। একি সেই? তোলপাড় করে উঠল প্রশ্নটি অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ানের মনে। তাড়াতাড়ি সে মোস্ট ওয়ান্টেডদের অ্যালবাম বের করল। অ্যালবামে বাঞ্ছিত। ছবির উপর একবার নজর ফেলেই আঁতকে উঠল অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান, এ যে সত্যিই আহমদ মুসা!
শব্দ কয়টি মুখ থেকে বের হবার পর অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ আহমদ মুসার ছবির দিকে। তার পরেই ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল সে। মুখ ফেটে বেরিয়ে এল। কথা, কিজন্যে আহমদ মুসা এসেছিল জাহাজের দিকে!
কথাটা বলেই অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান কেঁপে উঠল। মুখে বলল, আমরা কি তাহলে অন্তর্ঘাতের মুখে?
বলেই অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান একটু বাম দিকে ঝুঁকে পড়ে ইন্টারকমে নির্দেশ দিল, ম্যাশন ময়নিহান এখনি জাহাজের দুপাশে কয়েকটা বোট নামাও, ডুবুরী নামাও। দ্রুত খুঁজে দেখ জাহাজের গায়ে এক বা একাধিক বিস্ফোরক পাতা হয়েছে। কুইক। ওভার।
কথা শেষ করেই অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান ইন্টারকমে আরেকটা চ্যানেলে নির্দেশ দিল, দানিয়েল সাগর সারফেসের সমান্তরালে সামনে হেডলাইটের ফোকাস দাও।
সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলে উঠল হেডলাইটের আলো।
আলোর সাথে সাথে ছুটল অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ানের চোখ সামনের দিকে। আলোর মাথায় দেখতে পেল একটা অবয়ব, একটা বোটের অবয়ব।
তাহলে আহমদ মুসা অপেক্ষমাণ বোটে উঠেছে? পালাচ্ছে? এই ভাবনার সাথে সাথেই অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান নির্দেশ দিল, বেঞ্জামিন ফায়ার, কামান দাগ। ধ্বংস কর ঐ বোটটাকে।
কমান্ডশীপ-এর আলো বোটটির উপর পড়ার মুহূর্তকাল। সে স্থানটা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ছেয়ে গেল।
ধোঁয়ার কুণ্ডলী, গাঢ় অন্ধকারের মতো শুধু দেয়ালই সৃষ্টি করল না, কমান্ডশীপের শক্তিশালী আলোর ফোকাসকেও অন্ধ করে দিল এবং আশ্চর্যজনকভাবে আলোর ফোকাসকে বিভক্ত ও বিস্তৃত করে দিল। কামানের। গোলাবর্ষণ অন্ধের মতো লক্ষ্যহীনভাবে অগ্রসর হলো।
বিস্ময়ে আচ্ছন্ন অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ানের মুখ। সে ধোঁয়ার কালো কুণ্ডলী দেখেই বুঝতে পেরেছে, ওটা সর্বাধুনিক বিশেষ ধরনের গ্যাসীয় বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণের গ্যাসীয় কুণ্ডলী নির্দিষ্ট একটা স্পেসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এর মধ্যে মেটালিক কিছু পড়লে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় মুহূর্তেই তা গলে যায়। তার মানে তাদের কামানের গোলাগুলো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ঢোকার পরে বিস্ফোরণ ঘটে নষ্ট হয়ে গেছে।
বেঞ্জামিন, কামান দাগা বন্ধ করে দাও। আলোও নিভিয়ে দিতে বল।
বেঞ্জামিনকে এ নির্দেশ দিয়েই অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান ইন্টারকমের চ্যানেল ঘুরিয়ে কমান্ডশীপের অপারেশন কক্ষের ইয়াসারকে বলল, জাহাজ স্টার্ট দাও, দ্বীপের প্রবেশপথটার আরও কাছে এগিয়ে চল। প্রবেশপথে সম্ভবত ওরা একটা ঘাঁটি গেড়েছে। পালানোরও সুযোগ নিতে পারে। ওদের এ প্ল্যান ধ্বংস করতে হবে।
স্যার, যারা নিচে নেমেছে অনুসন্ধানের জন্যে, তারা ফেরেনি এখনও। বলল ইয়াসার।
তাহলে ওদের সাথে যোগাযোগ করতে বল। ওদের কাজ কত দূর দেখ। অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান বলল।
ইয়েস স্যার। এখনি দৈখছি এদিকটা। এই সাথে ইঞ্জিন চালু করে দেই। স্যার? বলল ইয়াসার।
কথা বলার জন্যে অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ইন্টারকমের দিকে। কেঁপে উঠল জাহাজ। তার পরেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। চেয়ার থেকে ছিটকে পড়লো অ্যাডমিরাল বেনগুরিয়ান। প্রথম প্রচণ্ড। বিস্ফোরণের পর একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটে চলল। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। গোটা জাহাজটা অগ্নিগোলায় পরিণত হলো। রত্নদ্বীপের উত্তর প্রবেশপথ বরাবর সামনে সাগরের এক বিরাট অংশ আলোকিত হয়ে উঠল।
বিষয়টা নজরে পড়ল রত্নদ্বীপের উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম পাশে মোতায়েন করা যুদ্ধ জাহাজ ও সামরিক বোটগুলোর।
রত্নদ্বীপের চারদিকে কমান্ডশীপসহ চারটি কামান ও ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ মোতায়েন রয়েছে। তার সাথে কয়েক ডজন কামানবাহী বোট।
পূর্ব ও পশ্চিম পাশের যুদ্ধজাহাজ দুটিই কমান্ডশীপের বিস্ফোরণ দেখতে পেয়েছে। পশ্চিম পাশের যুদ্ধজাহাজের কমান্ডার প্রথমে দেখতে পেয়েছে কমান্ডশীপের ঘটনা। সে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছে কমান্ডশীপের সাথে। কিন্তু পারেনি। কোনো রেসপন্স পায়নি। তারপরেই সে যোগাযোগ করল অবশিষ্ট দুই জাহাজের সাথে। দুই কমান্ডারের সাথে আলোচনা করল। তারা একমত হলো, নিশ্চয় রত্নদ্বীপ থেকে কমান্ডশীপ সাবটাজের শিকার হয়েছে। কিন্তু রত্নদ্বীপের পক্ষে এটা সম্ভব হলো কি করে! সেখানে তো এমন। স্পেশালাইজড ট্রেনিংপ্রাপ্ত কেউ নেই। তারা একমত হয়েছে, এই কাজ নিশ্চয় আহমদ মুসার। তাহলে তো তিনি শুধু এই একটা কাজই নয়, নিশ্চয় আরও কিছু পরিকল্পনা তিনি করেছেন।
একজন কমান্ডারের এই কথা চলার সময় একটা নয় কয়েকটা জেট বিমানের ভয়ংকর গর্জন চারদিকের নীরবতাকে ভেঙে খান খান করে দিল।
এক কমান্ডার অয়্যারলেসে চিৎকার করে উঠল, তোমরা শুনতে পেয়েছ। জেট বিমানের গর্জন?
অন্য কমান্ডার চিৎকার করে বলল, শুধুই জেট বিমান নয়, এগুলো। বোমারু বিমান। একটা বোমা আমাদের জাহাজকে আঘাত করেছে।
আরেক কমান্ডারের কণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠল, আমাদের জাহাজেও বোমা পড়েছে। আগুন ধরে গেছে জাহাজে।
অয়্যারলেসে আর কোনো কমান্ডারের কোনো কথা শোনা গেল না।
খুব অল্প সময়েই রত্নদ্বীপের চারদিকটা একের পর এক বিস্ফোরণ ও আগুনের লেলিহান শিখায় ছেয়ে গেল এবং ভারি বোমারু বিমানের আকাশ ফাটা গর্জনে যেন থর থর করে কেঁপে উঠল চারদিকটা। মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যেই বোমারু বিমানের গর্জন থেমে গেল।
বিস্ফোরণের কারণে ধ্বংসযজ্ঞ চলল সারা রাত ধরে। পরদিন সকালেও কোথাও কোথাও আগুনের শিখা দেখা গেল। তারপর সাগর ঘিরে নামল নীরবতা। শুধু কিছু সন্ধানী বোটের চাপা গর্জন এবং একের পর এক ঢেউ ভেঙে পড়ার সুরেলা শব্দ চারদিকের অখণ্ড নীরবতার মাঝে স্পন্দন তুলছিল। আহমদ মুসার নেতৃত্বে বোটগুলো আহত এবং বাঁচার জন্যে আকুলিবিকুলি করা অসহায় মানুষদের সন্ধান করছিল এবং বোটে তুলে নিচ্ছিল।
রত্নদ্বীপ আক্রমণ করতে আসা চারটি যুদ্ধজাহাজই ধ্বংস হয়ে গেছে। বেশ কিছু বোট ডুবে গেছে। আর কিছু পালিয়ে বেঁচেছে।
.
সেদিন রত্নদ্বীপ আক্রমণের সময় কমান্ডশীপ ধবংসের অভিযানে গিয়ে আহত আহমদ মুসা আবারও মারাত্মকভাবে জখম হয়।
মেজর যোবায়ের ও গোটা নিরাপত্তা টিমের নিষেধ ও অনুরোধ সত্ত্বেও আহমদ মুসা অপারেশন কমান্ডশীপের দায়িত্ব নেয় নিজে।
তার আগে রাত ঠিক সাড়ে এগারোটায় আহমদ মুসা তার নিরাপত্তা টিম নিয়ে দ্বীপের উত্তর প্রবেশপথে গিয়ে পৌঁছে। প্রবেশপথটাকে একবার দেখে পাহারায় থাকা প্রহরীদের বলে, এই দ্বীপের লোক বলে মনে হবে না, এমন অপরিচিত লোক দেখলেই তাকে গ্রেফতার করবে।
কামানবাহী বড় পেট্রোল বোটটা নোঙর করা ঘাটের জেটিতে। নিরাপত্তা টিম নিয়ে আহমদ মুসা ওঠে পেট্রোল বোটটিতে।
সবাইকে করণীয় সম্পর্কে লম্বা একটা ব্রিফ করে বলে, শত্রু আজ বড়, আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। সুতরাং যখন যেটুকু সুযোগ পাব আমরা অফেনসিভে যাব। আমাদের আগাম অ্যাকশন যেমন তাদের ইন্যাকটিভ করতে পারে, তেমনি ভীত ও বিভ্রান্তও করতে পারে। আমাদের মতো ছোট শক্তির জন্য এটাই হবে যুদ্ধ কৌশল।
আহমদ মুসা এসে বসে আপার ডেকের পর্যবেক্ষণ আসনগুলোর সামনেরটিতে। পাশেই পর্যবেক্ষণ স্ক্রিন। স্ক্রিন অন্ধকার, কারণ পেট্রোল। বোটের ঘুরন্ত চারটি সার্চ লাইটই নিভানো। সার্চ লাইট জ্বালানোও যাবে না।
আহমদ মুসা পকেট থেকে নাইটভিশন দুরবীণ বের করে। এ দুরবীণটি সদ্য আবিষ্কৃত। এখনও বাজারে যায়নি। গতকাল এটা আহমদ মুসা পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই চীফ আব্রাহাম জনসনের কাছ থেকে। ইয়ার কুরিয়ারে গতকাল আহমদ মুসা এটা পেয়েছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করাসহ মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয় জর্জ আব্রাহাম জনসনকে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি মূল্যবান আর কিছু নেই আহমদ মুসার কাছে।
নাইটভিশন এই দুরবীণটি দিয়ে রাতের অন্ধকারে দুমাইল দূরের একটা টেনিস বলকেও নিখুঁতভাবে দেখা যায়।
বোটে উঠেই আহমদ মুসা সমুদ্রের দিকটা একবার দেখে নেয়। কিছুই দেখা যায়নি, শূন্য সাগরের বুক ছাড়া।
হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে উঠে আহমদ মুসা দূর থেকে ভেসে আসা একটা চাপা। অব্যাহত শব্দে।
ঘড়ির দিকে তাকায় আহমদ মুসা। রাত ১২টা বেজে তিন মিনিট। হঠাৎ শব্দটা থেমে যায়।
নাইটভিশন দুরবীণটা চোখে তুলে নেয় আহমদ মুসা। দুরবীণের ফোকাস অর্ধ চন্দ্রাকারে ঘুরিয়ে নেয় আহমদ মুসা সাগরবক্ষের উপর।
হঠাৎ বড় একটি যুদ্ধ জাহাজের উপর আটকে যায় দুরবীণের চোখ।
আহমদ মুসার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ হয় জাহাজটির উপর। দুরবীণের ফোকাস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেয় জাহাজটি উপরে-নিচে, দুপাশে-সবখানে। জাহাজটি থেকে একসাথে চারদিকে ১২টি গোলা নিক্ষেপ করা যায়। কামানের নলগুলো ইচ্ছামতো ঘুরানো যায়। কামান ছাড়াও দেখা যাচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার এক ঝাঁক টিউব। টপ ডেকের উপর সাজানো বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র।
ওরা একটা রেগুলার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। ভাবে আহমদ মুসা। আরও চিন্তা মাথায় আসে, এ রকম কয়টা জাহাজ নিয়ে এসেছে ওরা। রত্নদ্বীপের চারদিকের জন্যে ডজনখানেক না হলেও হাফ ডজন তো বটেই। তার সাথে অবশ্যই রয়েছে কামানবাহী অনেক পেট্রোল বোট। একদম একটা রেগুলার যুদ্ধের প্রস্তুতি!
আহমদ মুসার নাইটভিশন দুরবীণের ফোকাস হঠাৎ এসে পড়ে জাহাজের সম্মুখ প্রান্তের ছোট ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডের পতাকার উপর। নীল বর্ডার দেয়া আয়তাকার সাদা কাপড়ের বুকে গ্লোবের বিশাল রেখাচিত্র। তার মাঝে বড় করে লেখা কমান্ডশীপ।
কমান্ডশীপ লেখাটা নজরে পড়তেই কপাল কুঞ্চিত হয় আহমদ মুসার।
তার পরেই তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
আহমদ মুসা পেছনে দাঁড়ানো মেজর যোবায়েরকে পাশে ডেকে তার হাতে দুরবীণটি দিয়ে বলে, সামনে দেখ।
মেজর যোবায়ের দুরবীণ নিয়ে দেখে যুদ্ধজাহাজটিকে। একটু সময় নিয়েই দেখে। চোখ থেকে দুরবীণ সরিয়েই দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলে।
স্যার, বিরাট যুদ্ধজাহাজ। ওরা রীতিমতো বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে, কিন্তু আমাদের নৌবাহিনীই তো নেই।
একটু থেমেই সে আবার বলে, রত্নদ্বীপের চারদিকেই তারা এ ধরনের জাহাজ মোতায়েন করেছে এবং এই জাহাজ ওদের কমান্ডশীপ! অনেকটা স্বগতকণ্ঠ মেজর যোবায়েরের।
ভাবছিল আহমদ মুসা। মেজর যোবায়েরের কণ্ঠও তার কানে গিয়েছিল। বলে, হ্যাঁ মেজর যোবায়ের এটা কমান্ডশীপ। তার অর্থ এই জাহাজটাই গোটা অপারেশন নিয়ন্ত্রণ করবে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, যারা বা যে সংগঠন এই অপারেশনের আয়োজন করেছে, তাদের সাথে এই যুদ্ধজাহাজেরই যোগাযোগ থাকবে। অতএব এই জাহাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আক্রমণকে কাউন্টার করার আমরা ব্যবস্থা করেছি, তার সাফল্যের জন্য এই জাহাজটি গুরুত্বপূর্ণ।
থামল একটু আহমদ মুসা।
এই সুযোগেই মেজর যোবায়ের বলে ওঠে, আমাদের পরিকল্পনার সাফল্যের জন্যে ঐ যুদ্ধজাহাজটি গুরুত্বপূর্ণ কেন?
রত্নদ্বীপের পক্ষে বোমারু বিমান আসছে, এ কথা যদি ওরা বাইরে থেকে জানতে পারে, তাহলে এদেরকে সতর্ক করার জন্যে তারা কমান্ডশীপের সাথেই যোগাযোগ করবে। এতে এখানে অভিযানে আসা জাহাজগুলো সতর্ক ও আত্মরক্ষার কৌশল গ্রহণসহ প্রতিরোধে যাবার সুযোগ পাবে। আর তাতে আমাদের পরিকল্পনা ব্যর্থও হতে পারে। কারণ আমাদের সাহায্যে আসা বিমানগুলো সীমিত সংখ্যক কিছু বোমা ও সীমিত সময় নিয়ে আসবে। বলে। আহমদ মুসা।
তাহলে কি হবে স্যার? রত্নদ্বীপের শেষ অবলম্বন কি এভাবে বঞ্চিত করবে রত্নদ্বীপকে? হতাশ কণ্ঠে বলে মেজর যোবায়ের।
প্রথম এবং শেষ সব অবলম্বনই আমাদের একমাত্র আল্লাহ। অতএব চিন্তা করার কিছু নেই, শুধু এখন কিছু কাজ করতে হবে আমাদের। আমরা আমাদের কাজ করলে সাফল্য আল্লাহ আমাদের দেবেন। বলে আহমদ মুসা।
কি কাজ স্যার? মেজর যোবায়ের বলে।
কমান্ডশীপ অকেজো করে দিতে হবে যাতে বাইরে থেকে কেউ যোগাযোগ করতে না পারে এবং এখানকার ওদের অভিযান পরিচালনাও যাতে বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে। বলে আহমদ মুসা।
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে মেজর যোবায়েরের। কিন্তু পরক্ষণেই বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায় তার মুখ। বলে উঠে, জাহাজ অকেজো হবে কীভাবে!
আমাদের তো সেই যুদ্ধ-সামর্থ্য নেই।
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, আমাদের সামর্থ্য নেই, কিন্তু আল্লাহর আছে। তিনিই আমাদের সাহায্য করবেন যদি আমরা আমাদের যা আছে তা নিয়ে কাজে নামি। বলে আহমদ মুসা।
আমাদের কি করণীয়, কি করব, বলুন স্যার। মেজর যোবারের বলে।
তোমার এখন দায়িত্ব কামানবাহী এ পেট্রোল বোট নিয়ে এই নিরাপত্তা টিমকে নেতৃত্ব দেয়া এবং এই প্রবেশপথকে অনুপ্রবেশ থেকে রক্ষা করা। বলে আহমদ মুসা।
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে মেজর যোবায়েরের মুখ। বলে, আমি নেতৃত্ব দেব? কেন আপনি কোথাও যাচ্ছেন?
হ্যাঁ, আমি একটা বোট নিয়ে ঐ কমান্ডশীপে যাচ্ছি। ওদের পরিকল্পনা বানচাল করে আমাদের আয়োজন সফল করার ব্যবস্থা করতে হবে। বলে আহমদ মুসা।
দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠে মেজর যোবায়েরের। বলে, এক সাংঘাতিক অভিযানের কথা বলছেন। এ ধরনের অভিযানের জন্যে আমাদের। কি আছে? আর আপনি নিজে এই ঝুঁকি নেবেন, এটা কেউ মানবে না স্যার।
মেজর যোবায়ের, কয়েক লাখ মানুষ এবং তাদের রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যেখানে বিপন্ন, সেখানে কোনো ঝুঁকি নেয়াই বড় নয়। এমন অভিযানের জন্যে যা
দরকার তা আমাদের নেই এ কথা সত্য, কিন্তু যা আছে তাতেই আল্লাহ বরকত দেবেন। এই বোটে আমাদের হাতে এখন দুই ধরনের দুটি বিস্ফোরক ডিভাইস আছে। এগুলো আমরা গতকাল সরবরাহ পেয়েছি। বলে আহমদ মুসা।
মাফ করবেন স্যার, এ ধরনের যুদ্ধজাহাজ অকেজো বা ধ্বংস করার। জন্যে ঐ দুটি বিস্ফোরক কি যথেষ্ট হবে? মেজর যোবায়ের বলে।
যথেষ্ট হবে কিনা বলা কঠিন। তবে সর্বাধুনিক বিস্ফোরক দুটি খুবই কার্যকর। যেমনটা চেয়েছিলাম, তেমনই পাঠানো হয়েছে। একটা বিস্ফোরক যেকোনো মেটাল বডি জাহাজে ছয় বর্গইঞ্চি হোল সৃষ্টি করতে পারে। অন্যটি লেসার টিপড হওয়ায় যেকোনো জাহাজের অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়ে ভেতরে। বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। জাহাজ যদি ফায়ার প্রুফ, ওয়াটার প্রুফ কম্পার্টমেন্ট সিস্টেমের হয়, তাহলে সেখানে এই ছোট ধরনের বিস্ফোরক কার্যকর নাও হতে পারে। যাক, এসব আমাদের ভাবনার বিষয় নয়, যে সুযোগটুকু আছে তা কাজে লাগানোই আমাদের এখনকার দায়িত্ব।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ায়।
স্যার, আমার একটা অনুরোধ, আপনি দয়া করে লেফটেন্যান্ট ডেভিড কোহেনকে সাথে নিন। সে সাহসী সমুদ্রচারী এবং ভালো শুটার। সে আপনার বোট ড্রাইভ করবে। বলে মেজর যোবায়ের।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়াল। হেসে বলে, ধন্যবাদ মেজর, আমার উপকারই হবে। একজন বোটের দায়িত্বে থাকলে আমার কাজের সুবিধাই হবে। তবে ব্যাপারটা কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ। ডেভিড কোহেনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছ না তো?
ডেভিড কোহেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, স্যার আপনার সাথে থাকার বিনিময়ে আমি আগুনে ঝাঁপ দিতে পারবো।
বেশি আবেগপ্রবণ হবে না। পরিবারের কথা সব সময় ভাবনায় রাখবে। আহমদ মুসা বলে।
আমার বাবা মা আমার চেয়েও আবেগপ্রবণ। আমি আপনার টিমে থাকার সুযোগ পেয়ে বাসায় টেলিফোন করেছিলাম। বাবা কি বললেন জানেন? বললেন, তুমি ভাগ্যবান। তুমি এমন মানুষের সংগ পেয়েছ, যিনি সোনার মানুষ। তিনি সবার জন্যে করেন, পারলে তার জন্যে কিছু করবে। বলে লেফটেন্যান্ট ডেভিড কোহেন।
কিন্তু কোহেন ইহুদিরা তো আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না। আহমদ মুসা বলে।
না স্যার। আপনি যাদের কথা বলছেন, তারা ইহুদি নয়, জায়নিস্ট ইহুদিবাদী। ইহুদিরা আপনাকে ভালোবাসে। বলে ডেভিড কোহেন।
ধন্যবাদ কোহেন। এবার বোটে উঠ। সময় খুব মূল্যবান।
আহমদ মুসা ও লেফটেন্যান্ট কোহেন বোটে উঠে। তীরবেগে চলতে শুরু করে বোট সামনে নোঙর করা জাহাজ লক্ষ্যে। নোঙর করা যুদ্ধজাহাজে বিস্ফোরক পেতে নিরাপদেই আহমদ মুসারা ফিরে আসছিল। কিছুদূর আসার পরই ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটে। জাহাজের সার্চ লাইটে তাদের বোট ধরা পড়ে যায়। ফায়ার ম্যাগনেটিক স্মোকম্ব ছুঁড়েই আহমদ মুসা লেফটেন্যান্ট কোহেনকে বোট রাইটে নিয়ে সামনে এগোতে বলে।
চলতে শুরু করে বোট নতুন রুটে।
জাহাজ থেকে ছোঁড়া গোলা ফায়ার ম্যাগনেটের আওতায় এসে বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিগোলায় পরিণত হয়ে ঝরে পড়ছিল।
হঠাৎ লেফটেন্যান্ট কোহেন দেখতে পায় একটা বিস্ফোরিত অগ্নিপিণ্ড বোটের দিকে ছুটে আসছে।
লেফটেন্যান্ট ডেভিড কোহেন ছুটে গিয়ে বোটের সামনে দাঁড়ানো। আহমদ মুসাকে প্রবল ধাক্কায় সাগরের পানিতে ছুঁড়ে দেয়। পরক্ষণেই একটা আগুনের গোলা এসে তাকে গ্রাস করে ফেলে। জ্বলন্ত কয়েকটা টুকরো ছুটে যায় আহমদ মুসার দিকে। তার মাথা, তার কাধ, তার পাজরে গিয়ে আঘাত করে তিনটি খণ্ড। মারাত্মক আহত হয় আহমদ মুসা।
ধাক্কা খেয়ে পানিতে ছিটকে পড়েই পেছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করতেই তিনটি আঘাত এসে আহমদ মুসার চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছিল। দেহটাকে অনেকটা অবশ করে দেয় আকস্মিক আঘাতের তীব্রতা।
মুহূর্তের জন্যে ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসার দেহ। আকুয়ালাংগ আঘাতে ফুটো হওয়ায় তা কাজ করেনি। কিন্তু বুকের সাথে বাধা ৬ ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি মাপের ইমারজেন্সি র্যাফট আহমদ মুসাকে জাগিয়ে তুলেছিল।
পানির উপর মাথা উঠতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল তার বোট গোটাটাই অগ্নিগোলকে পরিণত হয়েছে। আহমদ মুসার হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠল। লেফটেন্যান্ট কোহেন আহমদ মুসাকে বাঁচিয়ে দিয়ে কুরবানী দিল নিজের জীবনকে। তার বাবার কথার কথাকে এভাবেই বাস্তবে রূপ দিল!
প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে আহমদ মুসার।
অবসন্ন হয়ে পড়ছে তার শরীর। কিন্তু তাকে কূলে পৌঁছতেই হবে। এক হাত এবং দুই পা কিছুটা নড়াতে পারছে সে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল আহমদ মুসা বুকের নিচের র্যাফটের উপর ভর। করে। দুঃসাধ্য এক চেষ্টা এটা।
ওদিকে রত্নদ্বীপের উত্তর-প্রবেশপথে মেজর যোবায়েরের উৎকণ্ঠা তখন চরমে। কমান্ডশীপ ধ্বংস হওয়ার পর আধা-ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছিল। রত্নদ্বীপের উপর আক্রমণ চালানো চারদিকের জাহাজগুলোর উপর বিমান থেকে বোমা ও গোলাবর্ষণ চলছিল। অনেক আগেই আহমদ মুসাদের ফিরে আসার কথা। এ খবর পেয়ে প্রেসিডেন্ট অস্থির হয়ে উঠেছেন। মুহূর্তে মুহূর্তে টেলিফোন করছেন। দক্ষিণ প্রবেশপথ থেকে এই উত্তর-ঘাটে ছুটে আসছেন কর্নেল জেনারেল রিদা। প্রেসিডেন্টের নির্দেশ এসেছে এ প্রান্তের সব বোট সাগরে নামিয়ে দিতে, আলো জ্বেলে আহমদ মুসাকে সার্চ করতে।
কর্নেল জেনারেল রিদা এসে পৌঁছেছেন উত্তরের প্রবেশপথে। তিনি এবং মেজর যোবায়েরের নেতৃত্বে ডজনখানেক পেট্রোল বোট নিয়ে সাগরে নেমে যায়। দুই ঘন্টার চেষ্টায় ভাসমান আহমদ মুসাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
.
সাতদিন পর আহমদ মুসা আজ প্রথম হাসপাতালের বেডে উঠে বসতে পেরেছে।
আহমদ মুসার অ্যাটেনডেন্ট নিরাপত্তা অফিসার মেজর পাভেল পিঠের পেছনে দুটো বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসতে সাহায্য করল তাকে। বলল, স্যার, লেফটেন্যান্ট ডেভিড কোহেনের বাবা মা এসেছিলেন। এক গুচ্ছ ফুল ও একটা চিঠি রেখে গেছেন আপনার জন্যে।
বলে পাশের টেবিল থেকে একগুচ্ছ ফুল ও চিঠি এনে আহমদ মুসার হাতে দিল।
আমাকে জাগিয়ে দাওনি কেন? ওঁদের সাথে দেখা করার ইচ্ছা আমার ছিল। বলল আহমদ মুসা।
আমি আপনাকে জাগাতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু উনারা কিছুতেই তা করতে দেননি। মেজর পাভেল বলে।
আহমদ মুসা ফুলের গুচ্ছ পাশে রেখে চিঠিটা খুলল। পড়ল :
স্যার,
পরম প্রভু জিহোভা আপনার মঙ্গল করুন। আমরা আমাদের ছোট ছেলেকে নিরাপত্তা বাহিনীতে ভর্তি করতে এসেছিলাম। এই সুযোগে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। দেখার ইচ্ছা জিহোভা পূর্ণ করেছেন। এতেই আমরা সন্তুষ্ট।
আমাদের ছেলে ডেভিড কোহেনের জন্যে আমরা কেঁদেছি। কিন্তু দুঃখের চেয়ে গৌরব বোধ করেছি বেশি। আমার ছেলে পরার্থে যার জীবন এমন মহান ব্যক্তির জন্যে জীবন দিতে পেরেছে, সে গৌরব গাঁথা শুধু আমরা নই, আমাদের বংশ যুগ যুগ ধরে স্মরণ করে যাবে। তার রক্ত আমাদের মতো ইহুদিদের আলোর পথ দেখাক। আপনি আমাদের জন্যে দোয়া করবেন। রত্নদ্বীপের জন্যেও আপনি আল্লাহর প্রেরিত সাহায্য। প্রশংসা করে আপনাকে খাটো করব না। আপনি প্রশংসা লাভের জন্যে কিছু করেন না।
শহীদ ডেভিড কোহেনের বাবা-মা।
চিঠি পড়ে আহমদ মুসা ভাঁজ করে পাশে রেখে বলল, মেজর পাভেল তোমাদের রত্নদ্বীপে সুদিন আসছে। আমার আশা, রত্নদ্বীপের সবাই লেফটেন্যান্ট কোহেনের বাবা মার মতো হবে।
তারা সোনার স্পর্শ পেয়েছে, সোনা হতে না পারলেও, অন্তত শক্ত লোহা তো হতে পারবে। বলল মেজর পাভেল।
ঘরে ঢুকল ক্যাপ্টেন আয়লা আলিয়া। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, স্যার, এক্সলেন্সি প্রেসিডেন্ট আসছেন। তার সাথে আরও অনেকে।
ও, বুঝলাম। আমার বেডের তিন পাশে এত সোফার আয়োজন এ কারণেই?
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল ক্যাপ্টেন আলিয়াকে লক্ষ্য করে, তাহলে প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি টিমে তুমি এখনো আছ?
আপনি যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা বদলায় কার সাধ্য। বলল ক্যাপ্টেন আলিয়া।
ক্যাপ্টেন আলিয়ার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই দরজায় নক হলো। পরক্ষণেই ঘরে ঢুকল প্রেসিডেন্ট এবং তার মন্ত্রীসভা। তার সাথে সিকিউরিটির কয়েকজন দায়িত্বশীল।
প্রেসিডেন্ট এসে আহমদ মুসার একটা হাত তুলে চুমু খেয়ে বলল, আল্লাহর অশেষ প্রশংসা আপনি উঠে বসেছেন। আমরা যে কত আনন্দিত বলে বুঝাতে পারবো না। আমি সৌদি আরবের মহামান্য বাদশাহ এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ দিয়েছি। তারা সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম না পাঠালে আমরা মহাবিপদে পড়তাম।
আমিও আজ সকালে তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি তাদের সাহায্য ও শুভেচ্ছার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
ভাই আহমদ মুসা তাদের রোমারু বিমানের সাহায্যও খুব বেশি ক্ষতি হওয়ার আগেই আমরা পেয়েছি। কিন্তু তারা আপনাকে নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিল। বেশি। সত্যি মানুষ আপনাকে কত ভালোবাসে তা আপনি জানেন না। প্রেসিডেন্ট বলল।
আহমদ মুসা এসব কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে আপনাদের মূল্যায়ন কি শেষ হয়েছে এক্সিলেন্সি?
ওদের উপর বিমান আক্রমণের আগে আমাদের উপর পঁচিশ তিরিশ মিনিটের মতো গোলাবর্ষণ হয়েছে। আল্লাহর রহমতে ওদের অর্ধেক গোলাই কোনো কাজে আসেনি। এরপরও আমাদের বিরাট ক্ষতি তারা করেছে। চতুর্মুখি গোলায় আমাদের রাজধানীর ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কোনো অক্ষত বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হাতে গোনা যে কয়টি বাড়ি রক্ষা। পেয়েছে, তার মধ্যে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ একটা। রাজধানীর বাইরে দুহাজারের মতো বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাইওয়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে মানুষের কোনো ক্ষতি হয়নি। আপনার পরিকল্পনাকে ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। আল হামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, গোপন ধনভাণ্ডারের খবর কি এক্সিলেন্সি?
হ্যাঁ, সে বিষয়ে আলোচনাই আমার আজকের বড় এজেন্ডা।
বলে সোফায় একটু নড়ে-চড়ে বসেই আবার শুরু করল, ভাই আহমদ মুসা, খায়ের উদ্দিন বার্বারোসা, নাইটস অব সেন্ট জন এবং স্যার হেনরি-এই তিনের ধনভাণ্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। আপনি ধনভাণ্ডারের স্কেচ ও সংকেতগুলোকে যেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা অনুসরণ করেই ধনভাণ্ডারগুলো উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। আপনি ঠিকই বলেছিলেন, খায়ের উদ্দিন বার্বারোসার ধনভাণ্ডার তার ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদ সংলগ্ন পাহাড়ের তলা থেকে পাওয়া গেছে। সেখানে পাথর কেটে অনেকগুলো গোডাউন জাতীয় ঘর তৈরি হয়েছিল। সেগুলো বোঝাই ছিল স্বর্ণ ও স্বর্ণমুদ্রায়। আর নাইটস অব সেন্ট জন গোপন ধনভাণ্ডার পাওয়া গেছে দক্ষিণের ওবাদিয়া অঞ্চলে। ওবাদিয়া পাহাড় অঞ্চলে ঢোকার মুখে একটা পাহাড়ের তলদেশ থেকে তা পাওয়া গেছে। সেখানে পাওয়া গেছে অলংকর ও স্বর্ণমুদ্রাই বেশি। সামান্য কিছু স্বর্ণ পাওয়া গেছে, তাও প্রসেস করা। এখানে স্বর্ণালংকারের বেশির ভাগের গায়ে, লকেটে আরবি বর্ণমালা এবং কাবা ও মসজিদে নববীর খোদাই করা চিত্র দেখা গেছে। সবচেয়ে বড়, প্রায় জেন জানজ-এর ধনভাণ্ডারের সমান ধনভাণ্ডার পাওয়া গেছে স্যার হেনরির গুপ্ত ভাণ্ডার থেকে। সব মিলিয়ে দুইশ টনের মতো সোনা ও মণি-মুক্তা পাওয়া গেছে। ৫০ টনের মতো পাওয়া গেছে স্বর্ণমুদ্রা। এখন এগুলো আমরা কি করব সে নির্দেশনা আপনি দেবেন। এ নির্দেশনার জন্যেই আমি গোটা মন্ত্রীসভা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। বলল, ধনভাণ্ডার তিনটি তিন রকমের। ওগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্তও ভিন্ন রকমের হওয়া উচিত। খায়ের উদ্দিন বার্বারোসা তুর্কি নৌবাহিনীর ভূমধ্যসাগরীয় একজন অ্যাডমিরাল ছিলেন, যদিও তুর্কি নৌবাহিনীর রেগুলার সদস্য সে ছিল না। তার ধনভাণ্ডারে যুদ্ধলব্ধ ও লুণ্ঠনলব্ধ দুই ধরনেরই সম্পদ রয়েছে। আমি যতদূর জানি তার। কোনো বৈধ উত্তরাধিকারী নেই। তার উপর এই গুপ্তধন রত্নদ্বীপ রাষ্ট্রের মালিকানায় পাওয়া গেছে। তাই এর মালিক রত্নদ্বীপ রাষ্ট্রই। নাইট অব সেন্ট জনের গোপন ধনভাণ্ডার থেকে যে স্বর্ণ-রত্নালংকার ও স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। তা বলা যায় সবই স্পেন থেকে উচ্ছেদ করা মুসলমানদের। এগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো রক্তঝরা বেদনাদায়ক কাহিনী। নাইট অব সেন্ট জন ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক এবং চরম মুসলিম বিদ্বেষী। তার জলদস্যু বাহি নীর হাতে মুসলিম উদ্বাস্তুদের শত শত নৌকা ও জাহাজ লুষ্ঠিত ও নিমজ্জিত। হয়েছে। আমার মতে এই সম্পদের সবটাই স্পেনীয় মুসলমান ও স্পেনীয় মুসলমানদের বংশধরদের কল্যাণে ব্যয় হওয়া উচিত। এই সম্পদের একাংশ দিয়ে সেই সময়ের বিস্তারিত তথ্য ও ইতিহাস উঘাটনের কাজ করা হবে। অন্য অংশ খরচ হবে স্পেনে মুসলিম ইমিগ্র্যান্টদের জন্যে। বিশাল যে ধনভাণ্ডার পাওয়া গেছে স্যার হেনরির লুকানো ধনাগার থেকে, গোটাটাই তার অবৈধভাবে অর্জিত। তার লুণ্ঠনের ক্ষেত্র ছিল ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্ব ও উত্তর আটলান্টিক। বাণিজ্য জাহাজসহ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নিয়ে। আসা স্বর্ণ বোঝাই ডজন ডজন জাহাজ সে লুণ্ঠন করেছে। এ সম্পদের যারা বৈধ মালিক, তাদের কেউ এখন নেই। তাদের মাত্র জাতিগত উত্তরসূরি হয়েছে। জলদস্যু জেন জানজ ধনভাণ্ডারের ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, এক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত। স্যার হেনরির সম্পদের এক-চতুর্থাংশ ইউনেস্কোর তহবিলে দেয়া যায়, যা দক্ষিণ আমেরিকার ইনকা, মায়া সভ্যতার শিক্ষা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় এবং উত্তর আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের ঐতিহ্য সভ্যতার উন্নয়নে খরচ হবে। অবশিষ্ট সম্পদ পাবে রত্নদ্বীপ, যার মালিকানাধীন ল্যান্ড থেকে ধনভাণ্ডার উদ্ধার হয়েছে।
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল আহমদ মুসা।
উপস্থিত মন্ত্রীসভার সদস্য সকলের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
প্রেসিডেন্ট সবার উপর চোখ বুলিয়ে নিল। বলল, ভাই আহমদ মুসার সব কথা শুনেছেন আপনারা। আপনাদের কোনো কথা থাকলে বলুন।
মন্ত্রীরা সমস্বরে বলে উঠল, ভাই আহমদ মুসা যা বলেছেন, তার সাথে আমরা একমত।
ধন্যবাদ। আমি একটা কথা ভেবেছিলাম, সেটা কিন্তু হলো না। বলল প্রেসিডেন্ট।
কি কথা এক্সিলেন্সি? আহমদ মুসা বলল।
আমরা সবাই পেলাম। স্পেনীয় ও মায়া-ইনকা-রেড ইন্ডিয়ানরাও পেল, কিন্তু বঞ্চিত হলেন আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা যাকে আমরা বলছি নতুন রত্নদ্বীপের স্থপতি। বলল প্রেসিডেন্ট।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, আমি বঞ্চিত হলাম কোথায় এক্সিলেন্সি? রত্নদ্বীপের মানুষ, স্পেনীয় মুসলিম, ইনকা-মায়া-রেডইন্ডিয়ান সকলের। স্বার্থের মধ্যে আমারও স্বার্থ আছে।
ভাই আহমদ মুসা, আপনি কথারও রাজা। আপনার কথার পাল্টা আমি কিছুই বলতে পারব না। আমরা চেয়েছিলাম, একটা অংক আপনাকেও দিতে চাই, যা আপনি মানুষের জন্যেই খরচ করবেন। বলল প্রেসিডেন্ট নরম কণ্ঠে, বিনয়ের সাথে। প্রেসিডেন্ট থামার সাথে সাথে সব মন্ত্রী একসাথে বলে উঠল, মহামান্য প্রেসিডেন্ট যা বলেছেন, সেটা আমাদেরও কথা। আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা হতাশ করবেন না প্লিজ।
আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। ভাবল। বলল, ঠিক আছে এক্সিলেন্সি আপনাদের চাওয়াকে মর্যাদা দেয়ার জন্যেই বলছি, আপনারা যা দিতে চান, সেটা পবিত্র মক্কা মোকাররমা ভিত্তিক রাবেতায়ে আলম আল ইসলামীর বিশেষ তহবিলে দান করুন। রাবেতা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষের মর্যাদা ও অধিকার আপ-হোল্ড করা, বিভিন্ন দেশে মুসলিম মাইনরিটিসহ সব ধরনের জাতিগত ও ধর্মীয় মাইনরিটিদের জাতীয় ও ধর্মীয়
অধিকার রক্ষা ও সমুন্নত করা এবং সব ধর্ম ও জাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য যে বিরাট কাজ করছে, তাতে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। এই মহান কাজে সবার সহযোগী হওয়া দরকার।
ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। আপনার ইচ্ছা সবার আগে বাস্তবায়িত করা হবে। রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামীর এই কাজ আমাদেরও কাজ। আমরা। খুবই খুশি হবো এই টাকা সেখানে কাজে লাগলে। বলল প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আরেকটা জরুরি কথা এক্সিলেন্সি, সৌদি আরব ও তুরস্ক সামরিক বিশেষজ্ঞ ও ট্রেনার পাঠানোর কথা ছিল, সেটা কতদূর?
স্যরি, বলতে ভুলে গেছি ভাই আহমদ মুসা। তুরস্ক ও সৌদি আরব থেকে সামরিক বিশেষজ্ঞ ও ট্রেনাররা আজ সকালেই এসেছে। আপনার নামে। দুটি চিঠিও এসেছে।
বলে প্রেসিডেন্ট পকেট থেকে দুটি ইনভেলাপ বের করে আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা চিঠি দুটির উপর চোখ বুলাল। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আহমদ মুসার মুখ। বলল, একটা বড় খুশির খবর আছে এক্সিলেন্সি। বিশ্বের প্রধান দেশগুলোর, বিশেষ করে এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোর দূতাবাস যাতে রত্নদ্বীপে খোলা হয়, সে চেষ্টা তারা করছেন। খুবই শীঘ্রই জাতিসংঘের একটা অফিস রত্নদ্বীপে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। ওআইসির মাধ্যমে তাদের এই চেষ্টা সফল হয়েছে।
আহমদ মুসার এই কথা শোনার সাথে সাথে ঘরের সকলে আনন্দ ধ্বনি করে উঠে দাঁড়াল। জড়িয়ে ধরল একে অপরকে।
ভাই আহমদ মুসা এই উদ্যোগও আপনিই নিয়েছিলেন। আল্লাহর হাজার শোকর সে উদ্যোগ সফল হয়েছে। বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে আনন্দের উচ্ছ্বাস।
এক্সিলেন্সি ওরা লিখেছে, রত্নদ্বীপের আত্মরক্ষামূলক একটা নৌবাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছে তুরস্ক এবং আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে দেবে সৌদি আরব। এই কাজে যারা এসেছেন, তারা খুবই অ ও যোগ্যতা সম্পন্ন। তারা কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নিয়ে আসেনি। তবে তারা। কোনো অহেতুক সময় কাটাতে চায় না। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। আমাদের জন্যে এটা খুব বড় স্বস্তির খবর। কিন্তু ওদের সাথে আলোচনা করে সবকিছুর ব্লুপ্রিন্ট আপনাকেই করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা খুব সাহায্য করতে পারবো না। বলল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা মোবাইল তুলে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, এক্সকিউজ মি এক্সিলেন্সি, আমি টেলিফোন ধরতে চাই।
আমরা কি উঠব? বলল প্রেসিডেন্ট।
না এক্সিলেন্সি। অসুবিধা নেই। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা কল ওপেন করে ওপ্রান্তের উদ্দেশ্যে বলল, আস্সালামু আলাইকুম।
ওপ্রান্তের সালাম নিয়ে আহমদ মুসা বলল, আমি মাননীয় প্রেসিডেন্টের সাথে একটা বৈঠকে আছি। বলুন জোসেফাইন।
ওপার থেকে জোসেফাইন বলল, আমি পরে টেলিফোন করি?
না অসুবিধা নেই। বল। বলল আহমদ মুসা।
গতকাল বললে তুমি আসছ। কবে আসছ? তুমি কি ট্রাভেল করার উপযুক্ত এখন?
আল হামদুলিল্লাহ, আমি একদম সুস্থ। কিন্তু ডাক্তারদের বিধি-নিষেধে আমি যথেষ্ট অসুস্থ এখনও। বলল আহমদ মুসা।
ডাক্তারের কথাই ঠিক। সেটাই মেনে চলা উচিত। জোসেফাইন বলল।
তাহলে তো ফ্লাই করতে দেরি হবে। সেটা ভেবেছ? বলল আহমদ মুসা।
ভেবেছি। সময়ের চেয়ে তোমার সুস্থতা বড়। জোসেফাইন বলল।
ধন্যবাদ। তুমিসহ সবাই তোমরা কেমন আছ? বলল আহমদ মুসা।
যাক, আমার কথা মনে আছে। ধন্যবাদ। তুমি ফিরলে আমরা কোথাও যেতে পারি না? সবাই মিলে বেড়িয়ে আসা যাবে। জোসেফাইন বলল।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না আহমদ মুসা। একটু সময় নিয়ে বলল, ঠিক আছে। ভালো প্রস্তাব। বলল আহমদ মুসা।
ভালো প্রস্তাবের উত্তর দিতে এত দেরি হওয়ার কথা ছিল না। আসল ব্যাপার কি বলত। জোসেফাইন বলল।
আমি কয়েকদিন মদিনায় কাটিয়ে ওমরা করতে যাব মক্কা মোকাররমায়। সেখান থেকে মদিনায় ফিরে সুযোগমতো আমাকে যেতে হবে জাপানে। সেখানে একটা সম্মেলন শেষে আমি যাব চীনের সীমান্ত সংলগ্ন রাশিয়ার একটা শহরে।
আহমদ মুসা একটু থামতেই ওপ্রান্ত থেকে জোসেফাইন বলে উঠল, ঐ শহরেই কি নেইজেন-এর বাবা সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নর বাস করছেন?
হ্যাঁ জোসেফাইন, চীন থেকে সরে গিয়ে তিনি ওখানেই বাস করছেন। আর আহমদ ইয়াংকে উত্তর-পূর্ব চীনের বেজিং-এর আশেপাশে কোথাও কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছে। ওখানকার অবস্থা ভালো নয়। সরকারের সাথে উইঘুরদের যে সমঝোতা হয়েছিল, তা ভেঙে পড়েছে। একটা স্থায়ী সমঝোতা খুবই জরুরি। বলল আহমদ মুসা।
বুঝেছি, চীনে তোমার নতুন মিশন শুরু হচ্ছে। সারাকে তুমি নিশ্চয় জানাওনি ব্যাপারটা। জোসেফাইন বলল।
গিয়েই বলব। বলল আহমদ মুসা।
কোনো ভারী খবর একবারে তাকে জানানো ঠিক নয়। কোনো বড় মানসিক চাপ তার ক্ষতি করবে। জোসেফাইন বলল।
এই খবরকে তুমি বড় মানসিক চাপ মনে করছ? বলল আহমদ মুসা।
এমন কথা বলবে না। মাত্র কয়েকদিন আগে কি সাংঘাতিক দুর্ঘটনা থেকে তুমি সারভাইভ করেছ, সেটা ভাববে না তুমি। সারা সত্যিই খুব মুষড়ে পড়েছিল। জোসেফাইন বলল।
ওকি আছে? ওকে টেলিফোন দাও। বলল আহমদ মুসা।
ও ঘুমাচ্ছে। ঠিক আছে কিছুটা ইংগিত আমিই তাকে দেব। জোসেফাইন বলল।
ধন্যবাদ জোসেফাইন। আমি আসছি। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক কবে? জোসেফাইন বলল।
ইনশাআল্লাহ কাল সকালে। বলল আহমদ মুসা।
আল হামদুলিল্লাহ। আল্লাহ কবুল করুন। জোসেফাইন বলল।
সালাম দিয়ে আহমদ মুসা মোবাইলের লাইন অফ করে দিল।
কল অফ করতেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ভাই আহমদ মুসা, কি শুনলাম আমি! কাল সকালেই আপনি যাচ্ছেন? প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে বিস্ময় বেদনার চিহ্ন।
হ্যাঁ এক্সিলেন্সি, আগামীকাল সকালেই আমাকে যেতে হচ্ছে। বলল আহমদ মুসা।
কালকেই? আপনি তো সবে আজ উঠে বসেছেন! প্রেসিডেন্ট বলল।
এক্সিলেন্সি ফ্লাই করার মতো আমি যথেষ্ট সুস্থ। বাইরে একটা কাজ পড়েছে। আমার মোবাইলের কথা থেকে কিছু বুঝেছেন নিশ্চয়। আর এদিকে আমার কাজ শেষ। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না।
একটা নিচ্ছিদ্র নীরবতা নামল কক্ষটিতে। নীরবতা ভাঙল অর্থমন্ত্রী ইহুদি নেতা বেন নাহান আরমিনো। বলল, মহামান্য ভাই আহমদ মুসা, এভাবে এত তাড়াতাড়ি আপনাকে আমরা ছাড়তে পারবো না। আপনি এক নতুন রত্নদ্বীপের নির্মাতা। মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি সবার বন্ধু আপনি। শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ গড়ার আরও কিছু বাকি…। কথা শেষ করতে পারলো না। বেন নাহান। তার আগেই তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।
জনাব, আমি যাচ্ছি ঠিকই তবে রত্নদ্বীপের সাথে আমার যোগাযোগ থাকছে না তা নয়। আপনাদের প্রয়োজনে যেকোনো ডাকেই আমি সাড়া দেব ইনশাআল্লাহ।
একটু থামল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, আরেকটা কথা, বিধ্বস্ত বাড়ি-ঘর, রাজধানী পুনঃনির্মাণের জন্যে আপনারা কি করছেন। যাদের বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত তারা কীভাবে আছে?
পুনঃনির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে ভাই আহমদ মুসা। গৃহহীন লোকরা। কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। অবশিষ্টরা রয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে। কোনো অসুবিধা কারও নেই। বলল প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা বলল।
প্রেসিডেন্টের পিএস ঘরে ঢুকল। বলল প্রেসিডেন্টের কাছে এসে নিচু কণ্ঠে, এক্সিলেন্সি মেহমান স্যারের ওষুধ খাওয়া ও তাকে চেক করার সময় হয়েছে। ডাক্তার বাইরে অপেক্ষা করছেন।
সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। বলল, আমরা আসছি ভাই আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।
.
ছোট্ট রত্নদ্বীপের ছোট্ট বিমানবন্দর।
বিমানবন্দরের সামনে হাজার হাজার মানুষ।
সবার হাতে রত্নদ্বীপের পতাকা। তার সাথে একটি করে প্লাকার্ড। প্লকার্ডে বিভিন্ন ধরনের লেখা। কোনোটিতে উই লাভ আহমদ মুসা। কোনোটাতে লং লিভ আহমদ মুসা। অধিকাংশ প্লাকার্ডে লেখা আছে, নতুন রত্নদ্বীপের নির্মাতা আহমদ মুসা।
জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। প্লাকার্ডগুলোও দেখল।
বিমানবন্দরগামী রাস্তার দুধারে বিশাল জনতা শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে।
আহমদ মুসা গাড়ির পাশে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল। বলল, কি ব্যাপার এক্সিলেলি, এই মানুষ এখানে?
হাসল প্রেসিডেন্ট। বলল, এত মানুষ দেখে আপনার মতো আমিও বিস্মিত হয়েছি। আপনি চলে যাবার খবর চারদিকে ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আমি রাতেই জানতে পেরেছি। কিন্তু দ্বীপের মানুষ সবাই এভাবে বিমানবন্দরে ছুটে আসবে আমি তা কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। মাত্র কদিনেই আপনি দ্বীপের মানুষের মন কেড়ে নিয়েছেন। আপনি তাদের ভালোবেসেছেন, তারাও আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
আহমদ মুসা ও প্রেসিডেন্টকে বহনকারী গাড়ি যখন জনতার মধ্য দিয়ে চলছে, তখন চারদিকে মুহূর্মুহূ স্লোগান। স্লোগান আহমদ মুসাকে নিয়ে। বিব্রত বোধ করল আহমদ মুসা।
সরল ও সুন্দর মনের মানুষদের এই ভালোবাসার কি মূল্য দেবে সে? অস্বস্তিতে ভরে গেল তার মন। শত্রুতার চাপকে সে সানন্দে মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু ভালোবাসা তাকে দুর্বল করে দেয়।
বিমানবন্দরের গেটের পাশেই উঁচু একটা মঞ্চ। গেটে ঢোকার জন্যে। মঞ্চের পাশ দিয়ে গাড়ি চলছিল আহমদ মুসাদের। গাড়ির পাশে ছুটে এল অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিননা। দাঁড়াল প্রেসিডেন্টের পাশের জানালায়। বলল প্রেসিডেন্টকে, এক্সিলেন্সি, সবাই ভাই আহমদ মুসাকে দেখতে চায়, দুএকটা কথা বললে তারা খুশি হবে।
প্রেসিডেন্ট তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
ঠিক আছে এক্সিলেন্সি। না বলা শোভন হবে না। আমি যাচ্ছি। আপনিও আসুন প্লিজ। বলল আহমদ মুসা।
চলুন। প্রেসিডেন্ট বলল।
আহমদ মুসা এবং প্রেসিডেন্ট উঠল মঞ্চে। তাদের সাথে উঠল অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিনো।
আরমিনো মাইকের সামনে দাঁড়াল। বলল জনতাকে উদ্দেশ্য করে, রত্নদ্বীপের সম্মানিত নাগরিক ভাইয়েরা, মহামান্য প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে সাথে নিয়ে মঞ্চে এসেছেন। আমি আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসাকে মাইক দিচ্ছি।
আহমদ মুসা মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রেসিডেন্ট গিয়ে দাঁড়াল। তার ডান পাশে।
লাখো কণ্ঠে স্লোগান উঠল, আহমদ মুসা জিন্দাবাদ, রত্নদ্বীপের সেভিয়ার আহমদ মুসা জিন্দাবাদ, নতুন রত্নদ্বীপের নির্মাতা আহমদ মুসা জিন্দাবাদ ইত্যাদি।
চলতেই থাকল স্লোগান।
আহমদ মুসা দুহাত তুলে সকলকে থামতে ইশারা করল।
সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল জনতা।
কদম পিনপতন নীরবতা।
মাইকে আহমদ মুসার কণ্ঠ ধ্বনিত হলো, রত্নদ্বীপের সবাই আপনারা আমার ভাই। আমাকে আপনারা খুব বেশি ভালোবাসেন বলেই আমার সম্পর্কে বেশি বলে ফেলেছেন। রত্নদ্বীপের সেভিয়ার আমি নই, সেভিয়ার সর্বশক্তিমান আল্লাহ। আর আমি নতুন রত্নদ্বীপের নির্মাতা নই। আমার ডানে। দাঁড়িয়ে আছেন আপনাদের মহামান্য প্রেসিডেন্ট। তিনি, তাঁর সরকার এবং মুসলিম-খ্রিস্টান-ইহুদি মিলে আপনারা সবাই এক রত্নদ্বীপ নির্মাণ করেছেন। এখানে সব মানুষের স্বাধীনতা আছে, সব ধর্মের স্বাধীনতা আছে, সব মতের স্বাধীনতা আছে, যেকোনো মত গ্রহণ ও বর্জনের স্বাধীনতা আছে। তিন ধর্মের আপনারা মহান মানুষরা মিলে এমন এক সংবিধান তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে সবার ন্যায্য অংশগ্রহণমূলক সরকার আপনারা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাকে মুগ্ধ করেছে, আপনাদের এই ব্যবস্থা। আমি রত্নদ্বীপের জন্যে যা একটু কিছু করেছি, তা আপনাদের কাজেরই একটা ধারাবাহিকতা, নতুন কিছু নয়। আল্লাহ রাব্দুল আলামিন চিরদিন রত্নদ্বীপকে নিরাপদ রাখুন, আপনাদের সরকারকে নিরাপদ রাখুন, আপনাদেরকে নিরাপদ রাখুন। সবাইকে ধন্যবাদ। আসোলামু আলাইকুম।
মাইক থেকে সরে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
মানুষ নীরব, নিস্তব্ধ।
এমনকি কোনো গুঞ্জনও নেই কোথাও।
সব মানুষের চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। সে চোখগুলোর কোনোটাতে বিস্ময়, কেনোটাতে বেদনা, কোনোটাতে নীরব অশ্রু।
প্রেসিডেন্ট গিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়াল। বলল জনতাকে উদেশ্য করে, প্রিয় দেশবাসী, আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা সাধ্য অনুসারে সবার জন্যে কাজ করেন, কারও কাছ থেকে কোনো বিনিময় প্রত্যাশাও করেন না, নেনও না, এমনকি প্রশংসাও নয়। তাঁর কাজ ফি সাবিলিল্লাহর এক অনুপম দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের কাছ থেকে এটাই চান। এটাই আল্লাহর পথে জিহাদ। আপনারা প্রার্থনা করুন আল্লাহর কাছে, সর্বশক্তিমান ও দয়াময় আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ রাখেন, দীর্ঘজীবী করেন এবং অসহায় মানুষের কল্যাণে কাজ করার আরও তৌফিক তাকে দান করেন।
আহমদ মুসা, প্রেসিডেন্ট এবং বেন নাহান আরমিনো নেমে এল মঞ্চ থেকে।
পেছনের জনসমুদ্রে তখন আহমদ মুসা জিন্দাবাদ স্লোগান চারদিকে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আহমদ মুসারা প্রবেশ করল বিমানবন্দর লাউঞ্জে। সামনে তাকিয়ে বিস্মিত হলো আহমদ। সামনে যেন বর-কনের মিছিল।
দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসা।
প্রথমেই তাকে বর-কনে বেশে এসে সালাম করল প্রেসিডেন্টের বড় ছেলে হামযা আনাস আমিন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্ট্যানটিনোস-এর মেয়ে। জোনা ডেসপিনা। আহমদ মুসা তাদের দোয়া করার পরেই জোনা ডেসপিনা বলল, ভাইয়া আমি এখন আয়েশা আনাস আমিন। দ্বিতীয় বর-কনে প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় ছেলে মেজর যোবারের খালেদ এবং শাহজাদী জাইনের জাহরা। তৃতীয় জুটি হিসেবে এল মেজর পাওয়েল পাভেল এবং ক্যাপ্টেন আলিয়া। সালাম করেই ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল, স্যার, আমি এখন ফাতিমা জহুরা এবং সে তারিক তাহের।
আহমদ মুসা ওদের দোয়া করে বলল, তোমাদের পরিবর্তনটা। কোনোভাবে চাপিয়ে দেয়া তো নয়?
না স্যার। আমাদের অনেক দিনের অনেক চিন্তার ফল এটা।
ধন্যবাদ।
বলেই আহমদ মুসা সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের না আজ আনন্দের দিন। তোমাদের চোখে অশ্রু কেন? বিষণ্ণ কেন তোমরা এতটা?
আপনার বিদায়ের দিন এটা। বলল সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাপ্টেন ফাতিমা জহুরা ওরফে ক্যাপ্টেন আলিয়া।
আমরা মানতে পারছি না আপনার সাথে এটাই আমাদের শেষ দেখা! বলল তারা সমস্বরে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ভবিষ্যৎ আল্লাহই শুধু জানেন। তাঁর এখতিয়ারে হাত দিও না।
কিছু বলতে যাচ্ছিল মেজর খালেদ।
তার আগেই আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, বোর্ডিং-এর সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে, উপস্থিত মন্ত্রীদের দিকে, নিরাপত্তা অফিসারদের দিকে। সবার চোখে অশ্রু।
এক্সিলেন্সি আমাকে অনুমতি দিন। বলল আহমদ মুসা প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে।
প্রেসিডেন্ট এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, আপনাকে ছাড়ব কি করে! ভাবলেই মনে হচ্ছে মাথার উপর থেকে আশ্রয়ের একটা ছাতা সরে যাচ্ছে।
এক্সিলেন্সি সব আশ্রয় ক্ষণস্থায়ী, আল্লাহর আশ্রয়ই একমাত্র স্থায়ী। বলল আহমদ মুসা।
অনেক কান্না, অনেক অশ্রু মাড়িয়ে আহমদ মুসা বিদায় নিয়ে এগোলো বিমানের দিকে।
আহমদ মুসার একপাশে প্রেসিডেন্ট, অন্যপাশে বিমানের ক্যাপ্টেন। বিমানের দরজায় আহমদ মুসাকে বিদায় জানাল প্রেসিডেন্ট। শেষ মুহূর্তে আহমদ মুসার হাত ছেড়ে দেবার আগে প্রেসিডেন্ট বলল, রত্নদ্বীপ কি আর আপনাকে দেখতে পাবে?
মানুষ তো অনেক কিছু চায় এক্সিলেন্সি। কিন্তু আল্লাহ রাব্বল আলামিন যা চান সেটাই হয়।
আহমদ মুসা ঢুকে গেল বিমানের ভেতরে। বিমানের দরজাও বন্ধ হয়ে গেল। প্রেসিডেন্ট সম্মোহিতের মতো গ্যাংওয়ের মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন।
এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্টের পেছন থেকে ডাকল একটা কণ্ঠ।
ধীরে ধীরে প্রেসিডেন্ট ফিরে তাকাল। দেখল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কনস্ট্যান্টিনোস এবং অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিননা দাঁড়িয়ে।
চলুন। প্রেসিডেন্ট বলল প্রায় অস্ফুট কণ্ঠে।
সবাই চলতে শুরু করল।
৩
পুলিশের একটা জীপ ও একটা বড় মাইক্রো এসে থামল মা সাই। নামের একটা বড় বাড়ির সামনে।
এটা বাড়ি ঠিক নয়। একটা শিক্ষালয় এটা। দুই দিক ঘেরা বাচ্চাদের জন্য তৈরি একতলা একটা বিল্ডিং। অবশিষ্ট দুই দিক প্রাচীরঘেরা। পূর্ব দিকের প্রাচীরে বড় একটা গেট।
গেটটার সামনে পুলিশের গাড়ি দুটি এসে থামল। জীপ ও মাইক্রো থেকে নামল ডজনখানেক পুলিশ।
এলাকাটা চীনের কানশু প্রদেশের পশ্চিম-দক্ষিণ প্রান্তের ডান হুয়াং শহর। ডান হুয়াং শহরটি কানশু প্রদেশের মতোই হুই মুসলিম অধ্যুষিত। তবে শহরের দক্ষিণ প্রান্তের একটা বড় এলাকায় কয়েক হাজার উইঘুর মুসলিম পরিবারের বাস।
মা সাই নামের এই স্কুলটা উইঘুর মুসলিম লোকালয়ের প্রায় মাঝখানে। স্কুলটি একটা বেসরকারি ইসলামী স্কুল। স্কুলে তখন গার্লস শিফটের ক্লাস চলছিল। গার্লসদের শিফট সকাল ৭টা থেকে ১০টা, বয়েজদের সময় সকাল ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত।
স্কুলের গেট খোলা ছিল।
জীপ থেকে নামা অফিসারটির নেতৃত্বে পুলিশরা ঝড়ের মতো স্কুলের ভেতরে ঢুকে গেল।
গেটের পর একটা বড় প্রাঙ্গণ।
প্রাঙ্গণ পেরিয়ে পুলিশরা ছড়িয়ে পড়ল স্কুল ঘরগুলোর সামনে।
একজন পুলিশ চিৎকার করে বলল, সবাই বেরিয়ে যাও স্কুলের ঘর থেকে।
বলেই পুলিশরা ছুটে ঘরে ঢুকে গেল এবং বই, খাতা, ব্যাগ সবকিছু ছুঁড়ে ফেলতে লাগল বাইরে।
স্কুলের মেয়েরা এবং শিক্ষিকারা ভীত-সন্ত্রস্ত। ঘটনা এতই দ্রুত ঘটতে লাগল যে প্রতিবাদ, বাধা দেয়ার সুযোগই তারা পেল না।
শিক্ষিকাদের মধ্য থেকে একজন তরুণী ছুটে এল। যে পুলিশ প্রধান শিক্ষিকার টেবিল থেকে সবকিছু ছুঁড়ে ফেলছিল, সে দিকে ছুটে গেল।
সে সময় একজন তরুণ ছুটে এসে ঘরে ঢুকল। সে পুলিশটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এসব কি হচ্ছে অফিসার?
পুলিশটি তাকাল তরুণটির দিকে। বলল, কেন, যা হবার তাই হচ্ছে।
তাই হচ্ছে? আপনারা কেন স্কুলে ভাঙচুর চালাচ্ছেন। কেন স্কুলে তালা লাগাবার ঘোষণা দিয়েছেন। এসব কি? বলল তরুণটি।
এই ইসলামিক স্কুল বেআইনি। স্কুল আমরা বন্ধ করতে এসেছি। পুলিশ অফিসারটি বলল।
ডান হুয়াং শহরে অনেক ইসলামিক স্কুল আছে। এটা বেআইনি হবে। কেন? বলল তরুণটি।
ওগুলো হুই মুসলিমদের। হুই মুসলিমদের ইসলামিক স্কুল বেআইনি নয়। ডান হুয়াং শহরের উইঘুর এলাকায় যতগুলো ইসলামিক স্কুল আছে সব বন্ধ করে দেব। পুলিশ অফিসারটি বলল।
কেন উইঘুরদের এই এলাকায় বহুদিন ধরেই তো এই স্কুল চলছে। আগে চলতে পারলে এখন চলতে পারবে না কেন? বলল তরুণটি।
আগের প্রশাসন কেন স্কুলগুলো চলতে দিয়েছেন তা আমি জানি না। কিন্তু আমি চলতে দেব না।
কথা শেষ করেই পুলিশ অফিসারটি হেড মিস্ট্রেসের পাশের র্যাক থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিল।
তরুণটি লাফ দিয়ে গিয়ে কোরআন শরিফটি কেড়ে নিল।
জ্বলে উঠল পুলিশ অফিসারটির দুই চোখ। মুহূর্তে সে কোমরে ঝুলানো রিভলবার তুলে নিয়ে গুলি করল তরুণটিকে। শিক্ষিকাদের মধ্য থেকে ছুটে আসা এক তরুণী চোখের পলকে এসে আড়াল করে দাঁড়াল তরুণটিকে।
বুকে গুলিবিদ্ধ হলো তরুণীটি।
ঠিক এই সময় কক্ষটিতে ঝড়ের মতো প্রবেশ করল পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার।
সে ঘরে প্রবেশ করেই পকেট থেকে রুমাল বের করে রুমালে জড়িয়ে নিল পুলিশ অফিসারের রিভলবারটি। বলল পুলিশ অফিসারটিকে লক্ষ্য করে, শহরের এই এলাকার উইঘুর ইসলামিক স্কুল বন্ধে তোমার অতি আগ্রহ দেখে তোমাদের পাঠানো হয়েছিল স্কুলের সবকিছু দেখে তারপরে তা বন্ধ করার নোটিশ দিতে। ভাঙচুর করতে তো বলা হয়নি। হত্যার অনুমতি দেয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না।
কথা শেষ করেই সাথে আসা একজন পুলিশ অফিসারকে বলল, হত্যাকারী এই পুলিশ অফিসারকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাও গাড়িতে।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এবার তাকাল তরুণটির দিকে। তারপর পুলিশ অফিসারটিকে লক্ষ্য করে বলল, যে তরুণটিকে গুলি করে মারতে গিয়েছিল তাকে চেন? চেন না। সে অল চায়না ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি মা ঝু সুলতান। হুই ও উইঘুর ছাত্রদের মধ্যেও অসম্ভব জনপ্রিয় সে। সে নিহত হলে আগুন জ্বলত। আর হ্য তরুণীকে তুমি গুলি করেছ সে লু হু আয়েশা। উইঘুরদের জনপ্রিয় ছাত্রী নেত্রী। সে মা ঝুর সাথে বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন ছুটি। ছুটিতে তারা দুজন এসেছিল ইসলামিক স্কুলে ফ্রি সার্ভিস দিতে।
কথা শেষ করে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলল মা ঝুঁকে, স্যরি মি, মা ঝু, আপনার টেলিফোন পেয়েই ছুটে এসেছি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
গুলিবিদ্ধ তরুণীটি তখন মা ঝুর কোলে। মা ঝু সুলতান তখন তরুণীটিকে দুহাতে তুলে নিতে চেষ্টা করছিল।
তরুণীট বাধা দিয়ে বলছিল ক্ষীণ কণ্ঠে, হাসপাতালে আমাকে নিও না। আমার সে সময় নেই।
উধর্বতন পুলিশ কর্মকর্তার কথা শুনে মুখ তুলে তার দিকে চেয়ে মা ঝু বলল, ধন্যবাদ স্যার। আপনি আরও অনেক কিছু ঘটা থেকে আমাদেরকে বাঁচিয়েছেন। মা ঝুর কণ্ঠ নরম, কান্না ভেজা।
পুলিশ অফিসারকে কথাটা বলেই মা ঝু তাকাল তরুণী লু হু আয়েশার দিকে। তার মাথাটা দুহাতের উপর রেখে বলল, তুমি এই কাজটা করতে গেলে কেন?
কি করতাম! চেয়ে চেয়ে দেখতাম, তুমি গুলি খেয়ে মরে যাচ্ছ! তোমার মৃত্যু ক্ষতি করবে চীনের, বেশি ক্ষতি করবে চীনের মুসলমানদের, হুই উইঘুর সম্পর্কের। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। খুব বেশি আর কি হতাম, তুমি রাজি হলে তোমার বউ হতাম। এর কোনো মূল্য নেই। আল্লাহর হাজার শোকর তিনি তোমাকে বাঁচিয়েছেন। লু হু আয়েশার কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এল। নিস্তেজ হয়ে পড়ল তার দেহ। তার চোখ দুটি বুজে গেল। এলিয়ে পড়ল তার মুখটা একপাশে। যেন সে এক গভীর প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল।
একটু যেন কেঁপে উঠল মা ঝু সুলতান। তার মুখ জুড়ে নামল বেদনার একটা কালো ছায়া। সে অসহায়ভাবে একবার তাকাল পুলিশ অফিসারের দিকে।
পুলিশ অফিসার মাথা থেকে হ্যাট খুলে ছোট একটা বাউ করল লু হু আয়েশার দিকে। বলল, স্যরি, মি. মা ঝু। আমরা খুবই দুঃখিত। এটা একেবারেই হৃদয়বিদারক!
মা ঝু সুলতান চোখ নামিয়ে তাকাল লু হু আয়েশার দিকে। একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, লু হু একাই তো সব বলে গেলে। আমাকে কিছুই বলার সুযোগ দিলে না। আমার কাজ নিয়ে তুমি ভেবেছ, আমাকে নিয়ে তুমি ভাবনি। ভাবলে এমন সহজ ও নিশ্চিন্ত বিদায় তুমি নিতে পারতে না। শেষ কথাগুলো মা ঝুর কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল।
বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। কক্ষে প্রবেশ করল লু হু আয়েশার খালা ও তার পরিবারের লোকজন। লু হুর খালা লি হুয়া হামিদা লু হুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কক্ষে এক বিষাদ পরিবেশের সৃষ্টি হলো।
লম্বা ভ্যাকেশনে এই খালার বাড়িতে এসেই লু হু আয়েশী উইঘুর কম্যুনিটির এই ইসলামিক স্কুলে ফ্রি সার্ভিস দিচ্ছিল। মা ঝুও এই লম্বা ভ্যাকেশনে বাড়ি এসেছিল। কানশুতেই তার বাড়ি। কানশুর রাজধানী লানঝুর একটা পুরানো ও সম্মানিত হুই পরিবারের সন্তান সে। বিশ্ব বিদ্যালয়ের লম্বা ভ্যাকেশনে চীনের কোনো না কোনো এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজে সে জড়িত হয়। এই ভ্যাকেশনে সে এসেছে নিজ প্রদেশ কানতে কাজ করতে। সেই লু হুকে অনুরোধ করেছে কানশুতে ভ্যাকেশন কাটাতে। লু হু আয়েশা মা ঝুর ডাকেই কানশুতে এসেছিল। স্কুলে সময় দেয়া ছাড়াও উইঘুর কমুনিটির মধ্যে কিছু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব-সচেতনতা বিষয়ে কাজ করছিল সে।
লু হুর খালা লি হুয়া হামিদা উঠে লু হুর মাথা কোলে তুলে নিয়ে বসেছে। লু হুর মুখে সাদরে হাত বুলিয়ে বলল, মা তোর মাকে, আমার বড় আপাকে, আমি কী জবাব দেব? অরুদ্ধ কণ্ঠ তার।
বলেই সে মা ঝুর দিকে তাকাল। অঞরুদ্ধ কণ্ঠেই বলল, মা ঝু সুলতান বাবা, লু হুমা আমার খুবই চাপা স্বভাবের ছিল। কোনো দিন কিছু জানতে দেয়নি। একদিন আমি একান্তে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে হেসে বলেছিল, খালা আমি জানি এবং আমি চাই, মা ঝুকে অনেক পথ চলতে হবে, অনেক উঁচুতে উঠতে হবে। আমাকে তাঁর পথে দাঁড় করাতে চেও না। আল্লাহর ইচ্ছার উপর সব ছেড়ে দাও। আল্লাহর ইচ্ছাই কি আজ সে পূরণ করে গেল?
বলেই ডুকরে কেঁদে উঠল লি হুয়া হামিদা।
অশ্রু গড়াচ্ছিল মা ঝুর দুচোখ থেকেও। বলল সে, লু হু আমার সামনে কি পথ দেখাতে চেয়েছিল, কোন্ উঁচুতে ওঠার কথা সে বলেছিল, তার তো আমি কিছুই জানি না। ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন আলোচনা কখনই সে করেনি। তার ভাবনা-চিন্তার হয়তো অনেক কিছুই আমাকে জানতে দেয়নি। অথচ অদৃশ্য এক দায়ে এভাবে সে বেঁধে গেল আমাকে। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল তার কণ্ঠ।
বাইরে পুলিশের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ পাওয়া গেল। কয়েক মুহূর্তে বারান্দায় উঠে এল কয়েকজন পুলিশ।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারটি মা ঝুর দিকে চেয়ে বলল, মি, মা ঝু, পুলিশ এসেছে লাশ নিতে। প্লিজ সহযোগিতা করুন।
মা ঝু তাকাল লু হুর খালা লি হুয়া হামিদার দিকে। বলল, খালা আম্মা, লু হুকে ছাড়তে হয়।
অবশ্যই। কিন্তু লাশ আমরা কখন পাব বাবা। ওর মরদেহ তো উরুমুচি পৌঁছাতে হবে আমাদের খুব তাড়াতাড়ি। মরদেহের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আমরা চাই না। লি হুয়া হামিদা বলল।
মা ঝু কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার বলল, ম্যাডাম আমরা সময় নেব না। পুলিশের মহিলা ইউনিট তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে। মহিলা ডাক্তাররাই তাঁকে পরীক্ষা করবেন। শুধু দেখা হবে পুলিশ অফিসারটির বুলেটের আঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছে কি না। এর পরেই লাশ আপনাদের হাতে তুলে দেব আমরা।
মা ঝু তাকাল লু হুর খালার দিকে। বলল, খালাম্মা, এটুকু সময় তাদের দেয়া যায়।
ঠিক আছে মা ঝু। আমরা অপেক্ষা করব। প্লিজ, তুমি ওদের সাথে থাক। আমাদের জানিও কখন কি করতে হবে। লি হুয়া বলল।
ধন্যবাদ খালাম্মা। আমি আছি ওদের সাথে। বলল মা ঝু। ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল।
মা ঝু বলল, মি. অফিসার, আরেকটা কথা। এই স্কুলের এখন কি হবে? আইন বলে উইঘুরদের ইসলামিক স্কুল থাকতে পারবে না। কিন্তু এ স্কুল বহু দিন থেকে চলছে, যেমন আইনসঙ্গতভাবে চলছে হুই মুসলিমদের ইসলামিক স্কুল।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার ঘুরে দাঁড়িয়েছে মা ঝুর দিকে। বলল, আদেশ বা নিষেধ কিছুই আমি করব না। আজ পর্যন্ত যেমনটা ছিল, সবটা তেমনই চলবে। চলি। বাই মা ঝু।
ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল পুলিশ অফিসারটি। কয়েকজন মহিলা পুলিশ ঘরে ঢুকল লু হু আয়েশার লাশ নেবার জন্যে।
লাশ নিয়ে ওরা বেরিয়ে গেল। মা ঝু ঘুরে দাঁড়াল।
বাবা মা ঝু, কি আশ্চর্য দেখ, দুজন পুলিশ অফিসারই হান, অথচ তাদের মধ্যে কত পার্থক্য! লি হুয়া হামিদা বলল।
হ্যাঁ খালাম্মা। সত্যিই অনেক পার্থক্য। জুনিয়র পুলিশ অফিসারটি মাত্র দুদিন হলো বদলি হয়ে এখানে এসেছে। জানতে পেরেছি এখানে আসার আগে সে ছিল হারবিনে। সেখানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, যেসব পুলিশ স্বভাবগতভাবে নিষ্ঠুর নয়, তাদের দেখতে পারত না এই পুলিশ অফিসার। বিনা কারণেই তারা নাজেহাল হতো। তাছাড়া চেইন অব কমান্ড। ব্রেক করে সে নানা অত্যাচার-নিপীড়ন করত মানুষের উপর। বিশেষ করে মুসলমানদের উপর।
লি হুয়া হামিদা ভাবছিল। মা ঝু সুলতানের কথা শেষ হলে বলল, মা ঝু, আমাদের এই অবস্থা কতদিন চলবে? উইঘুর মুসলিমরা এ দেশের নাগরিক হয়েও কতদিন এই অসহনীয় বৈষম্যের শিকার হবে তারা? আমার মা লু হু একা তো নয়, এমন লাশ তো আমাদের অব্যাহতভাবে দেখতে হচ্ছে। কবে শেষ হবে অবিরাম এই হৃদয় ভাঙার ঘটনা!
মা ঝু তাকিয়েছিল লি হুয়া হামিদার দিকে।
কোনো উত্তর দিল না। চোখে তার অতলান্ত এক শূন্য দৃষ্টি। ধীরে ধীরে ভিজে উঠল তার দুই চোখ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি বলব খালাম্মা। আপনার জিজ্ঞাসার কোনো জবাব আমার কাছে নেই। আমি এ নিয়ে অনেক ভেবেছি, এখনও ভাবি। বলতে পারেন খালাম্মা এটাই আমার প্রধান ভাবনা। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সমাধান আমি পাইনি। উইঘুররা যা বলে তার সবটাই ঠিক বলে আমি মনে করি। হুই মুসলিমরা যে মত পোষণ করে, সেটাও আমার কাছে সবদিক থেকে ঠিক বলে মনে হয়। আবার সরকার, হানরা উইঘুরদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলে আসছে, সেটাও যৌক্তিক আমার কাছে। অথচ সত্য একটাই। হুই ও চীনা সরকার সত্য হলে উইঘুররা মিথ্যা হয়ে যায়। আবার উইঘুররা সত্য হলে হুই ও চীনা সরকার মিথ্যে হয়ে যায়। কিন্তু সত্য মিথ্যার এ রায়টা কে দেবে, কে তা শুনবে। এই ভাবনার কোনো কূল কিনারা নেই খালাম্মা।
মা ঝু, তুমি প্রভাবশালী ছাত্র নেতা হিসেবে এবং যুব কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা হিসাবে এবং ক্ষমতার ভারকেন্দ্রের একজন বিশ্বস্ত খুঁটি হিসেবে রাজনীতির মূল স্রোতে আছ। তুমি সমস্যার যে কূল কিনারার কথা বললে, তা করা রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র থেকেই সম্ভব, উইঘুরা তা পারবে না। অতএব এই দিক থেকে তোমার এই ধরনের হতাশা অর্থহীন। বলল লি হুয়া হামিদা, লু হু আয়েশার খালা।
হ্যাঁ খালাম্মা, আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক সমস্যার কিনারা বিচারকদের রায় ঘোষণার মতো হয় না। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সমঝোতার পথেই আসতে হয়। এই সমঝোতার কোনো পথ আমি দেখি না। আমার হতাশা এখানেই। মা ঝু সুলতান বলল।
তোমার এই হতাশা তোমাকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে আমি জানি না, কিন্তু উইঘুরদের আরও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে। বলল লি হুয়া হামিদা।
আমি তা চাই না, কেউ তা চায় না। একটা সমাধান, সমঝোতা সবার কাম্য। কিন্তু এই কঠিন দায়িত্ব নেবার মতো কাউকে আমি দেখি না। অন্যদিকে হিংসা, বিদ্বেষ, বিভেদ ও সংঘাত বৃদ্ধির চেষ্টা অব্যাহতভাবে। চলছে। আজকে নতুন পুলিশ অফিসারটির কাজ তারই একটা অংশ। কম্যুনিস্ট পার্টি এটা জানে, সরকারও জানে না তা নয়। কিন্তু বিভেদের শক্তি এতই প্রবল, এতই সর্বব্যাপী যে সবকিছু তারা গ্রাস করে আছে। কিছুই করার যেন নেই। মা ঝু বলল।
মা ঝু, আমি চেয়েছিলাম তুমি আমার মনে আশার সৃষ্টি করবে, আশাবাদী করবে। কিন্তু তুমি তো আমাকে আরও গাঢ় হতাশার অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলে বাবা। বলল লি হুয়া।
আমি ক্যুনিস্ট পার্টি করি খালাম্মা। সেটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়। কিন্তু আল্লাহতে বিশ্বাস করি আমি। আমি হুই মুসলিম। আমি নিশ্চিত, চীনে মুসলমানদের দুর্যোগ কখনোই খুব স্থায়ী হয়নি। এবারও হবে না। কিন্তু সেটা কীভাবে আমি জানি না খালাম্মা। মা ঝু বলল।
আল হামদুলিল্লাহ। তোমার কথা সত্য হোক মা ঝু।
বলে উঠে দাঁড়াল লি হুয়া।
তাহলে আমি চলি খালাম্মা। পুলিশরা এতক্ষণে পৌঁছে গেছে। মা ঝু। বলল।
ঠিক আছে। তোমার ওখানে ঠিক সময়ে থাকা খুব জরুরি। তুমি যাও। বলল লি হুয়া।
মা ঝু সুলতান ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান এলাকার উইঘুর নেতা মাহমুদ ওয়াং এবং স্কুলের হেড মিস্ট্রেস ফাতিমা ওয়াং, মাহমুদ ওয়াং-এর মেয়ে।
মা ঝু বেরিয়ে আসতেই ফাতিমা ওয়াং বলল, মি. মা ঝু, আমাদের স্কুলের কি হবে। ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার স্পষ্ট তো কিছু বললেন না।
মা ঝু সালাম দিয়েছে মাহমুদ ওয়াংকে। বলল, স্কুল যেমন চলছিল, তেমনি চলবে। তাঁর কথার অর্থ এটাই।
আল হামদুলিল্লাহ।
স্বগত কণ্ঠে কথাটা শেষ করেই ফাতিমা ওয়াং মা ঝুঁকে লক্ষ্য করে বলল, ধন্যবাদ আপনাকে মি. মা ঝু। আপনি ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারকে না। জানালে এখানে আরও কি যে ঘটত! একটু আগে তার আসা সম্ভব হলে বোন আয়েশাকে হয়তো না-ফেরার দেশে চলে যেতে হতো না। কান্না রুদ্ধ কণ্ঠ ফাতিমা ওয়াং-এর।
পুলিশ অফিসারটি যে এত বেপরোয়া হবে আমি বুঝতে পারিনি। উইঘুরদের নিয়ে সমস্যা চলছে। কিন্তু এমন ঘটনা পুলিশের হাতে সাম্প্রতিককালে ঘটেনি। পুলিশ অফিসারটি বিশেষ একশ্রেণির উগ্রবাদীদের মতো আচরণ করেছে। বলল মা ঝু সুলতান।
সাবধানে থাকবেন আপনি। আয়েশার কাছে আমি শুনেছি, আপনি হুই হলেও প্রতিবাদী। প্রতিবাদীদের বিপদ আছে পদে পদে। ফাতিমা ওয়াং বলল।
আমি প্রতিবাদ করি, কিন্তু আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। বলল মা ঝু সুলতান।
হুই মুসলিমরা কিন্তু তা করে না। ফাতিমা ওয়াং বলল।
গম্ভীর হলো মা ঝু।
ভাবল একটু। বলল, আপনার কথার জবাবে অনেক কথা বলতে হয়। আজ তা বলব না। শুধু এটুকুই বলব, হুই ও উইঘুরদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি দূর হতে হবে। উইঘুররা যা মনে করে, যা বলে তার মধ্যে যুক্তি নেই তা নয়। অন্যদিকে হুইদের যে অবস্থান তার বাস্তবতাও মানতে হবে। হুইরা প্রতিবাদ করে না। কারণ, প্রতিবাদের কিছু তাদের ক্ষেত্রে নেই।
জটিল প্রশ্নের সরল জবাব এটাই।
কিন্তু আপনি তো প্রতিবাদ করেন। আপনি শুধু তো একজন হুই মুসলিম নন, বলা যায় হুইদের সবচেয়ে পুরনো ও বনেদি পরিবারের সন্তান আপনি। ফাতিমা ওয়াং বলল।
মা ঝু সুলতান একটু হাসল। বলল, আমি এই প্রতিবাদ হুই মুসলিম হিসেবে করি না। চীনের যুব কমুনিস্ট পার্টির একজন নেতা হিসেবে এবং চীনের দেশজ ও লোকজ ইতিহাস-ঐতিহ্যের একজন উত্তরাধিকারী হিসেবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ আমি করি।
মাফ করবেন, ক্যুনিস্ট হয়ে কতখানি মুসলিম থাকা যায়? ফাতিমা ওয়াং বলল।
মা ঝু তাকাল ফাতিমা ওয়াং-এর দিকে। বলল, আপনি পুরনো একটা প্রশ্ন তুললেন। সেই কম্যুনিস্ট বা কম্যুনিজম এখন নেই। আজকের কম্যুনিজম একটা অর্থনৈতিক কর্মসূচি। ব্যক্তিপূজি ও জাতীয় পুঁজির মধ্যে অনেক গ্রহণ-বর্জন ঘটে গেছে। এর ফলে অর্থনীতির ইসলামী দর্শনের অনেক কাছাকাছি এসে গেছে সেকালের কম্যুনিস্ট অর্থনীতি। সুতরাং এখন কম্যুনিজম আর ইসলামের সাথে সংঘর্ষে আসে না।
কথা শেষ করেই মা ঝু বলল, তাহলে এখন আসি মি. মাহমুদ ওয়াং, মিস ফাতিমা ওয়াং। ওদিকে আবার দেরি হয়ে যাবে। চলি।
বলে সালাম দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল মা ঝু সুলতান। নেমে এল স্কুলের বারান্দা থেকে। এগোলো গাড়ির দিকে।
.
টেলিফোন রেখেই চিৎকার করে সাই মা চুং ইং ডাকল, হু ফেং, ফা জি ঝাও, খা লিয়াং কোথায় তোমরা।
সাই মা চুং ইং চীনের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী সাই সো ফে পরিবারের বর্তমান প্রধান।
সাই সো ফে পরিবারের ইতিহাস বেশ লম্বা। চীনের কিংবদন্তী দুই আরব পরিবারের দুই স্রোত এসে মিশেছে এই পরিবারে। চীনের হুই মুসলমানদের রেকর্ড অনুসারে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় ৬১৬ বা ৬১৭ সালের কোনো এক সময় দুই সাহাবী সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস ও জাফর ইবনে আবি তালিবের নেতৃত্বে একটি মুসলিম প্রতিনিধিদল আবিসিনিয়া থেকে চট্টগ্রাম কামরূপ-মনিপুর হয়ে চীনের গোয়াংঝুতে (ক্যান্টনে) আসেন। দূতদের এই মিশন পরবর্তীকালে আরও আসে। খলিফা হযরত ওসমান (রা.) চীনের সম্রাট গাওঝংগ-এর দরবারে এক প্রতিনিধিদল পাঠান। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি (৭৫৮ খ্রি:) সময়ে গোয়াংঝুতে বিশাল আরব মুসলমানদের বসতি গড়ে ওঠে। গোয়াংঝুতে চীনের প্রথম মসজিদ হোয়াইশেংগ এবং সাহাবী পরিবার নতুন মুসলিম বসতির কেন্দ্রবিন্দু। এই সাহাবী পরিবারের একজন আরব দুহিতা ফাতিমা জোহরার সাথে কানশুর লা ঝু শহরের সাই সো ফে পরিবারের পূর্বপুরুষ যোবায়ের আওয়ামের বিয়ে হয়। এই সাই সো ফে পরিবারও একটা আরব চাইনিজ পরিবার। একাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে (১০৭০ খ্রিস্টাব্দ) সুংগ ডাইনেস্টির সম্রাট শেন জুংগ মধ্যএশিয়া থেকে। ৫৩০০ আরব মুসলমানকে চীনে বসতি স্থাপনের জন্যে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন প্রিন্স আমির সাইয়েদ। প্রিন্স আমির সাইয়েদকে চীনা মুসলমানদের পিতা বলা হয়। তার নেতৃত্বে ইসলাম চীনে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার আগে চীনে ইসলাম স্বনামে পরিচিত ছিল না। ইসলামকে বলা হতো দা-শি ফা- অর্থ আরবদের আইন। দা শি বা তা-শি আরবি তা-জি শব্দের অপভ্রংশ। তা-জির অর্থ আরব। প্রিন্স সাইয়েদ ইসলামের নামকরণ করলেন হুই হুই জিয়াও অর্থাৎ হুই হুইদের ধর্ম। এই প্রিন্স আমির সৈয়দ সাই সো ফে পরিবারের পূর্বসূরি। সাই সো ফে আসলে প্রিন্স আমির সৈয়দের চাইনিজ নাম। তার এই নামেই পরিবারের নামকরণ করা হয়েছে। এই পরিবারের যোবায়ের আওয়ামের। সাথেই বিয়ে হয় গোয়াং ঝুর সাহাবী পরিবারের মেয়ে ফাতিমা জোহরার। চীনের ঐতিহ্যবাহী দুই মুসলিম পরিবারের মিলনগ্রন্থি এই সাই সো ফে পরিবার। তাই সমগ্র চীনে এই পরিবারকে সম্মানের চোখে দেখা হয়। সাই মা চু ইং এই পরিবারের বর্তমান প্রধান।
দাঁড়িয়েই ডাকাডাকি করছিল সাই মা চু ইং। হু ফেং তার বড় ছেলে। ফা জি জাও একমাত্র মেয়ে এবং খা লিয়াং স্ত্রী। হু ফেং চীনা সেনাবাহিনীর একজন নামকরা জেনারেল। দেশপ্রেমিক নিরেট প্রফেশনাল হিসেবে চীনা সেনাবাহিনীতে তার নাম-ডাক আছে। জাতীয় স্বার্থের কঠিন মিশনগুলোতে তাকে পাঠানো হয়। কাশ্মীর সীমান্তের আকসাই চীন থেকে পূর্ব প্রান্তের অরুনাচল পর্যন্ত সাই ফেং ফ্রন্টিয়ার কমান্ডের অধিনায়ক ছিল সে অনেক দিন। একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ইস্ট ও সাউথ চায়না সী কোস্ট কমান্ডের নেতৃত্বেও সে ছিল। সম্প্রতি সে জিনজিয়াং ও তারিম বেসিন কমান্ডের দায়িত্ব পেয়েছে। কয়েক দিনের ছুটিতে সে বাড়ি এসেছে। ছুটি থেকে গিয়েই সে জিনজিয়াং ও তারিম বেসিন কমান্ডের দায়িত্ব নেবে। মা চু ইং-এর একমাত্র মেয়ে ফা জি ঝাও বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক। সে চীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন বিজ্ঞানী। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পার্টিকল সাইন্সের এক গোপন বিষয়ে তার গবেষণা। মনে করা হয় তার আবিষ্কার চীনের সীমান্তকে অভেদ্য করে দেবে।
বাবার ডাক শুনে জেনারেল হু ফেং, ফা জি ঝাও ছুটে এল বাবার ঘরে। এল স্ত্রী খা লিয়াং।
সবাইকে বসতে বলল সাই মা চু ইং। নিজেও বসল।
তাকাল হু ফেং-এর দিকে। বলল, মা ঝু সুলতান তোমাকে কি জানিয়েছিল?
ডান হুয়াং-এর উইঘুর ইসলামিক স্কুলে যা ঘটেছে, সেটা বলেছে। আর দিয়েছিল পুলিশের গুলিতে লু হু আয়েশার নিহত হবার খবর। বলল জেনারেল হু ফেং।
কিন্তু আসল খবর সে চেপে গেছে হু ফেং। পুলিশ মা ঝু সুলতানকে লক্ষ্য করেই গুলি করেছিল। লু হু আয়েশা ছুটে এসে মা ঝু সুলতানকে আড়াল করে দাঁড়ায়। ফলে যে গুলি মা ঝু সুলতানের বক্ষ ভেদ করতো, সেই গুলি লু হু আয়েশার বুক এফোড়-ওফোড় করে দেয়। সাই মা চুং ইং বলল।
সাই মা চুং ইং-এর কথা শেষ হলো।
ঘরের কারো মুখে কোনো কথা নেই। তাদের সবার চোখে-মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন। কানশুর একজন ছোট পুলিশ অফিসার মা ঝু সুলতানকে। হত্যার জন্যে গুলি ছুঁড়ে ছিল! একজন পুলিশ অফিসার কি করে এটা করতে পারে! মা ঝু একজন হুই মুসলিম ছাত্র শুধু নয়। সে যুব কম্যুনিস্ট পার্টির একজন অত্যন্ত সুপরিচিত জাতীয় নেতা। অল চায়না ছাত্র ফেডারেশনের অত্যন্ত জনপ্রিয় দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা। তাকে একজন পুলিশ অফিসার গুলি করতে সাহস পায় কি করে! কেমন করে এ ঘটনা ঘটতে পারল!
এই ভাবনা জেনারেল হু ফেং এবং ফ জি জাও দুজনের মনকেই অবাক বিস্ময়ে ভরে দিয়েছিল।
বাবা, মা ঝু কিন্তু এসব কোনো কথাই আমাকে বলেনি। আপনাকে কে বলল বাবা? বলল জেনারেল হু ফেং।
ডান হুয়াং-এর মেয়র আমাকে জানাল। তাকে খুব চিন্তিত মনে হলো। মা ঝুঁকে কোনো পুলিশ অফিসার গুলি করতে পারে এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। সাই মা চুং ইং বলল।
আমিও সেটাই ভাবছি বাবা। এটা ছোট ঘটনা মনে হচ্ছে না। অবশ্য সে পুলিশ অফিসারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সব জানা যাবে। বলল। জেনারেল হু ফেং।
মনে পড়ছে ভাইয়া। আমার কলিগদের একটা আলোচনা আমি ওভারহিয়ার করেছিলাম। তাদের একজন বলছিল, দেশে একটা বড় শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপ রয়েছে। তারা উইঘুর-হুঁই, উইঘুর-হান, হান-হুঁই। জাতি গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘাত বাধাবার চেষ্টা করছে। তারা কেন এটা। করছে, তা জনি না। কিন্তু গ্রুপটা খুবই বিপজ্জনক। আমার সন্দেহ হচ্ছে, মা ঝুর ঘটনা ঐ ধরনের কারও হীন মানসিকতার ফল কিনা। ফা জি ঝাও বলল।
জেনারেল হু ফেং মনোযোগ দিয়ে বোন ফা জি ঝাও-এর কথা শুনছিল। কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলল, ধন্যবাদ ফা, তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ। পুলিশ অফিসারটি সম্পর্কে বিশেষ অনুসন্ধান দরকার।
অনুসন্ধান কর। কিন্তু তুমি যাচ্ছ জিনজিয়াং-এ একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে, এ কথাগুলো তোমার মনে রাখা দরকার হু ফেং। সাই মা চুং ইং বলল।
ধন্যবাদ বাবা। কিন্তু পরিস্থিতি খুবই জটিল। আমাদের উইঘুর ভাইরা চীনের নাগরিক হওয়ার মতো আচরণ করছেন না। এই মূল, বিষয়টার সমাধান না হলে কোনো সমস্যারই সমাধান করা যাবে না। বলল জেনারেল হু ফেং।
তোমার কথা বেঠিক নয় হু ফেং। কিন্তু উইঘুর মুসলমানদের কথাও তোমাকে ভাবতে হবে। ইসলাম গ্রহণের আগে এক সময় মানি চিয়ান উইঘুর সাম্রাজ্য ওদের ছিল। উইঘুরিস্তান নামে বৌদ্ধ সাম্রাজ্যও তাদের ছিল। দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি তাদের শাসক বখরাখান প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তার নাম হয় সুলতান সাটুক কারা খান। বলা হয় তার পথ অনুসরণ করে ৯৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে উইঘুরের এক লাখ ও তাঁবুর লাখ লাখ উইঘুর ইসলাম গ্রহণ করে। কাশগড়, তারিম অববাহিকা ও উইঘুর এলাকা মুসলিম শাসনকে নিজের করে নেয়। সুতরাং তারা রাজনৈতিক জাতি এবং রাজনীতির আসনে দাঁড়িয়েই তারা ইসলাম গ্রহণ করে। তাই রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তা তাদের মজ্জাগত। তাদের স্বাতন্ত্রের সংগ্রামকে তাই উদারভাবে দেখার মধ্যেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। সাই মা। চু ইং বলল।
বাবা যা বললেন, সেটা ইতিহাস। ইতিহাস নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ইতিহাস তার জায়গায় থাকে, মানচিত্র পাল্টায়। এটা বাস্তবতা। উইঘুর মুসলিমরা এই বাস্তবতা মানছেন না। সমস্যার এখান থেকেই সৃষ্টি। সুতরাং এর সমাধান ওরা বাস্তবতা মেনে নেয়ার উপর নির্ভর করছে। বলল জেনারেল হু ফেং।
তুমি তোমার সামরিক অংকে কথা বলছ। কিন্তু সব সমস্যার সামরিক সমাধান হয় না, হওয়া উচিতও নয়। এটা এই ধরনেরই একটা সমস্যা। মা চুং ইং বলল।
ঠিক বলেছেন বাবা। কিন্তু সে বিকল্প সমাধানও মানচিত্র মেনে নেয়ার পরেই হতে পারে। তাদের মধ্যে এমন চিন্তা নিয়ে এগোবার কোনো লোক দেখা যাচ্ছে না বাবা। বলল জেনারেল হু ফেং।
তাদের মধ্যে এমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না ঠিক, কিন্তু হান, হুই, সরকার- এদের মধ্য থেকেও তো কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। মা চুং ইং বলল।
ওদের সাথে আলোচনা অনেক হয়েছে বাবা। কিন্তু ফল হয়নি। বলল জেনারেল হু ফেং।
ফল হয়নি, না হতে দেয়া হয়নি এমন কিছু কখনও কি ভেবেছ? মা চুং ইং বলল।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না হু ফেং। একটু ভাবল। একটু পরেই বলল, হ্যাঁ বাবা, ডান হুয়াং শহরের ঘটনা আমাকে ভাবাচ্ছে। উইঘুরদের উস্কে দেয়ার জন্যে এমন ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে।
জেনারেল হু ফেং-এর পকেটের অয়্যারলেস বিপ বিপ করে উঠল।
তাড়াতাড়ি পকেট থেকে অয়্যারলেস তুলে নিল হু ফেং। হাই লাইট স্ক্রিনের উপর নজর দিয়েই মনে মনে বলল জেনারেল হু ফেং, হঠাৎ সেনা গোয়েন্দা সংস্থার মেসেজ কেন?
সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ কোডে মেসেজটি পাঠানো হয়েছে। পড়ল মেসেজটি :
ম্যাডাম ফা জি ঝাও যেন ট্রেনে আসার বর্তমান প্রোগ্রাম বাতিল করেন। গোয়েন্দাদের একটা বিশেষ টিম পাঠানো হচ্ছে। তারা ম্যাডামকে নিয়ে আসবে। জানতে পারা গেছে, অপরিচিত কেউ বা কারা ম্যাডামের সফর প্রোগ্রাম চুরি করেছে। তারা গোপনে আরেকজন বিজ্ঞানীরও খোঁজ-খবর নিচ্ছে। আমরা কিছু আশঙ্কা করছি। তাই এই সাবধানতা।
ঘরের সবাই তার দিকে আগ্রহভরে তাকিয়েছিল। ঘরের সবাই নীরব।
মেসেজ পড়া শেষ করেই হু ফেং তাকাল ছোট বোন ফা জি ঝাও-এর দিকে। বলল, আজ রাতে ট্রেনে তুমি বেজিং ফিরছ?
হ্যাঁ, কেন? বলল ফা জি ঝাও।
তুমি যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল কর। আজ এই ট্রেনে তোমার যাওয়া হচ্ছে না।
ফা জি ঝাওসহ সবার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠল। বিস্ময় তাদের চোখে-মুখে।
প্রোগ্রাম বাতিল করব কেন? মেসেজে কি আছে? খারাপ কিছু? মা চুং ইং, হু ফেং-এর পিতা বলল।
মেসেজটা সেনা গোয়েন্দা বিভাগের বাবা। তারা জি ঝাও-এর এভাবে ট্রেন সফরকে নিরাপদ মনে করছে না। তারা একটা গোয়েন্দা টিমকে পাঠাচ্ছে। তারা এসকর্ট দিয়ে জি ঝাওকে নিয়ে যাবে। বলল জেনারেল হু ফেং।
কেন নিরাপদ মনে করছে না? ঘটেছে কিছু? হু ফেং-এর পিতা মা চু ইং বলল। জ কে বা কারা জি ঝাও-এর সফর প্রোগ্রাম চুরি করেছে। তারা নাকি আরও একজন বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত তথ্য জোগাড় করেছে। বলল জেনারেল হু ফেং।
ভ্রূ-কুঞ্চিত হলো মা চুং ইং-এর। তাকাল জি ঝাও-এর দিকে। বলল, মা এ রকম কোনো আশঙ্কার কথা কি তুমি জান?
ফা জি ঝাও-এর চিন্তিত মুখ। বলল, এ ধরনের সন্দেহজনক কোনো কিছুই আমার চোখে পড়েনি। আর তাছাড়া কারও সাথে শত্রুতা, ঝগড়া ঝটি দূরে থাক- বাইরের, এমনকি সহকর্মী বিজ্ঞানীদেরও অনেকের সাথে আমার কোনো উঠা-বসা নেই। আমার পিছু নেবে কে, কেন?
মা চুং ইং-এর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। জবাবে কিছু বলল না সে।
কথা বলল হু ফেং। বলল, তোমার সফর প্রোগ্রাম কেউ বা কারা যদি চুরি করে থাকে, তাহলে সেনা-গোয়েন্দা বিভাগের আশঙ্কা অমূলক নয়। এটুকুই আমাদের জন্যে যথেষ্ট। ওরা কারা তা বের করার চেষ্টা চলছে। তার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ঠিক আছে ভাইয়া, প্রোগ্রাম আমি বাতিল করছি। বলে ফা জি ঝাও বেরিয়ে গেল। হু ফেং-দের পিতা মা চুং ইং-এর চোখে শূন্য দৃষ্টি। ভাবছিল সে।
এক সময় সে হু ফেং-এর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবো না, কিন্তু ডান হুয়াং-এ মা ঝু সুলতানকে গুলি এবং বেজিং-এ জি ঝাও-এর পেছনে লাগা- এই দুই ঘটনাকে আমি বিচ্ছিন্ন করে দেখতে পারছি না হু ফেং।
জেনারেল হু ফেং সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। তার চোখে-মুখেও চিন্তার ছায়া।
বলল সে একটু সময় নিয়ে, দুই ঘটনা বিচ্ছিন্ন হতে পারে, আবার নাও, হতে পারে। দুই ঘটনা নিয়েই তদন্ত চলছে বাবা। সব জানা যাবে।
ঠিক আছে। কিন্তু মা ঝু সুলতান ও জি ঝাও দুজনকেই সাবধান করে দাও। তারা যেন দেখে-শুনে চলাফেরা করে। আপাতত কোনো কিছুতে জড়িয়ে পড়াকে তারা যেন এড়িয়ে চলে। আর তুমি নিয়মিত ওদের খোঁজ খবর রাখবে বাবা। আর একটা কথা দাও হু ফেং। তুমি জিন জিয়াং-এ যাচ্ছ। তুমি হুই ও সরকারের সাথে উইঘুরদের দূরত্ব বাড়ানো নয়, কমানোর চেষ্টা করবে। মা চুং ইং বলল।
কথা আমি দিতে পারি বাবা, কিন্তু রাখা বড় কঠিন হবে। আমার যে দায়িত্ব, সে দায়িত্বে থেকে এই কাজ করার সুযোগ বেশি নেই। এজন্যে প্রয়োজন সামাজিক, জাতীয় পর্যায়ে সাহসী উদ্যোগ। সে উদ্যোগ আমি দেখছি না। বলল হু ফেং।
তুমি ঠিক বলেছ। সমস্যা এখানেই। সমঝোতার শক্তি সামনে নেই। বিভেদের শক্তি খুবই সক্রিয়। তার পরও আমি মনে করি, প্রশাসনের বিশেষ করে সেনা-প্রশাসনের অনেক দায়িত্ব আছে। পরিস্থিতি শান্ত রাখা, শান্তি ও আইনের শাসনের প্রতি নাগরিকদের অস্থাশীল করার ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা পালন করতে পারে। মা চুং ইং বলল।
দোয়া করো বাবা। সরকারি নীতির মধ্যে থেকে যতটা পারি অবশ্যই করবো। তবে আইন যদি কেউ ভাঙে, দেশের অখণ্ডতাকে যদি কেউ চ্যালেঞ্জ, করে, তাহলে আমার কিছু করার থাকবে না। বলল জেনারেল হু ফেং।
সেটা আমি জানি হু ফেং। তবে দেখ, আইন ভাঙার পেছনে আইন ভাঙার জন্যে উস্কানি, প্ররোচনামূলক কিছু থাকলে, সেটাও কিন্তু বড় অপরাধ।
দ্রু কুঞ্চিত হলো জেনারেল হু ফেং-এর। মনে মনে বলল, বাবা নিরেট এক সত্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। মুখে বলল, বাবা, ও বিষয়টা দেখাও। আমার দায়িত্বের আওতাভুক্ত। আসি বাবা। হু ফেং সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল। ফা জি ঝাঁও ও খা লিয়াং আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল। মা চুং ইং গিয়ে তার ছোট্ট রাইটিং টেবিলে বসল। টেনে নিল অয়্যারলেস টেলিফোন। জিন জিয়াং-এর উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেত ওয়াংকে ডায়াল করল। ওপ্রান্ত থেকে আওয়াজ ভেসে এল, ইরকিন আহমেত ওয়াং বলছি।
সালাম আলাইকুম। আমি লা ঝুর সাই মা চুং ইং। বলল মা চুং ইং।
ওয়া আলাইকুম সালাম। সাই সো ফে পরিবারের সাই মা চুং ইং? বলল উরুমুচি শহরের উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেত ওয়াং।
হ্যাঁ, জনাব। বলল মা চুং ইং।
হঠাৎ সৌভাগ্যবানের টেলিফোন এই গরিবকে? ইরকিন আহমেত ওয়াং বলল।
ভাই ওয়াং কে সৌভাগ্যবান, আর কে সৌভাগ্যবান নন, তা ঠিক করার মালিক আল্লাহ, আপনি আমি নই। বলল মা চুং ইং।
ওটা গোটা সৃষ্টজগতের মালিক আল্লাহর কথা। কিন্তু দেশের মালিকরা দেশে দেশে তার জায়গায় বসে গেছে। ভাগ্যবান, ভাগ্যহীন তারাই বানায়। এটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। ইরকিন আহমেত ওয়াং বলল।
খোঁচা আপনি দিতেই পারেন। কিন্তু জেনে রাখুন, চীনের নাগরিকরা যতটুক সৌভাগ্য ভোগ করছে, তার চেয়ে বেশি কিছু হুইদের নেই। বলল মা চুং ইং।
উইঘুরদের তা নেই জনাব মা চুং ইং। ইরকিন আহমেত ওয়াং বলল।
হুইদের কেন আছে, উইঘুরদের কেন নেই, এটা আপনি খুব ভালো করে। জানেন জনাব ইরকিন আহমেত ওয়াং। বলল মা চুং ইং।
থাক এ প্রসঙ্গ। আমি তর্ক বাড়াতে চাই না। আপনাদের চিন্তা, আমাদের চিন্তা ভিন্ন। ফলও ভিন্ন হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন বলুন, আপনি কেন টেলিফোন করেছেন? ইরকিন আহমেত ওয়াং বলল।
আমার ছেলে জেনারেল হু ফেং জিন জিয়াং-এ যাচ্ছে। শান্তি, সমঝোতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সে যাতে সফল হয়, সেই সাহায্য আমি চাচ্ছি। বলল মা চুং ইং।
আসছেন, এটা আমরা জানতে পেরেছি। হান জেনারেল ছিলেন, এখন হুই জেনারেল আসছেন। মানুষ পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু নীতির পরিবর্তন নেই। আমাদের সাহায্য করার কি আছে? ইরকিন আহমেত ওয়াং বলল।
নীতি এক থাকলেও, মানুষভেদে নীতির বাস্তবায়ন ভিন্ন হতে পারে, ভিন্ন হয়ে থাকে। আমি চাই এর সুযোগ নিয়ে শান্তি ও সমঝোতার একটা পরিবেশ। সৃষ্টি হোক। বলল মা চুং ইং।
আপনার শুভেচ্ছাকে আমি সম্মান করি। কিন্তু শান্তি ও সমঝোতার নামে নীতি ও স্বকীয়তা প্রশ্নে আমরা কোনো লেনদেন করবো না।
ভাই ইরকিন আহমেত, এই আলোচনা টেলিফোনে সম্ভব নয়। তবে ছোট একটা কথা বলব, নীতি, স্বাতন্ত্র, স্বকীয়তা রক্ষা প্রশ্নে ইসলামী শরিয়ত দেশ, সময়, অবস্থাভেদে যে ব্যবস্থা দিয়েছে তা খুবই ব্যাপক ও বিস্তৃত। তা সবার সামনেই আছে। আমি এদিকে না গিয়ে অনুরোধ করছি, সংঘাতের ঘটনা কমিয়ে আনা যায় কিনা দেখুন। উভয় পক্ষের সদিচ্ছা থাকলে তা সম্ভব। বলল মা চুং ইং।
মজলুমরা শান্তি ও স্বস্তিই চায়। কিন্তু জালেমরা অশান্তি বৃদ্ধির মধ্যেই তাদের স্বার্থ দেখে। আমাদের ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে। ইরকিন আহমেত ওয়াং বলল।
জালেম ও মজলুম হিসেবে না দেখে দেশের নাগরিক ও সরকারের মধ্যকার সমস্যা হিসেবে দেখা যায় না ভাই ইরকিন? বলল মা চুং ইং।
সমস্যাটা এতটা সরল নয় জনাব মা চুং ইং। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন মানুষদেরকেও সংশ্লিষ্ট সেই দেশের নাগরিক বলা হয়। সুতরাং নাগরিক শব্দ সব ক্ষেত্রে এক অর্থ বহন করে না। সুতরাং সমস্যার ধরনও এক নয়। আমাদের জাতিগত ও মানবিক স্বাধীনতা স্বীকৃত হলে তবেই বর্তমান সমস্যার সমাধান হবে। ইরকিন আহমেত ওয়াং বলল।
আমি জানি এটা আপনাদের দাবি। দাবিটা একটা পক্ষের। এর বাইরে আরও কথা, আরও যুক্তি থাকতে পারে, এটা আপনাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। বলল মা চুং ইং।
আমরাও সেসব জানি। জনাব এ সবের বাইরে নিশ্চয় আপনার আর। কোনো কথা নেই। বলল ইরকিন আহমেত ওয়াং।
ঠিক আছে রাখছি জনাব ইরকিন আহমেত ওয়াং। স্যরি, আপনার অনেক সময় নিয়েছি। সালাম আলাইকুম। বলল মা চুং ইং।
ওয়া আলাইকুম সালাম। ইরকিন আহমেত ওয়াং বলল নির্বিকার কণ্ঠে।
কল অফ করে মা চুং ইং অয়্যারলেস টেবিলে রেখে ইজি চেয়ারটায় গিয়ে বসল। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটি বন্ধ করল। তার মুখে হতাশার অন্ধকার।
হতাশার পথে অনেক চিন্তা মা চুং ইং-এর মনে এসে জেঁকে বসল। প্রথমেই একটা আত্মজিজ্ঞাসা জেগে উঠল তার মনে। আমরা মানে হুইরা ঠিক আছি, ঠিক পথে চলছি? আমাদের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে ইসলামের শরিয়তকে যতটুকু বুঝেছি, আমরা সেভাবেই কাজ করছি! উইঘুররাও এই কথাই বলছে, তারা ঠিক আছে। তারা ইসলামী শরিয়তের নির্দেশই পালন করছে। কিন্তু সত্য তো দুটি হতে পারে না। হয় আমরা সত্যের উপর, নয়তো ওরা? কারা সত্যের উপর?
প্রশ্নগুলো তোলপাড় করতে লাগল মা চুং ইং-এর হৃদয়ে। কোনো সমাধান সে খুঁজে পেল না। দুঃখ-বেদনা পীড়িত চিন্তা তাড়িত তার হৃদয়। থেকে একটা প্রার্থনা বেরিয়ে এল রাব্বল আলামীন মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে: হে আল্লাহ, আমাদের জন্মভূমিকে মুসলমানদের সংঘাত থেকে বাঁচাও মুসলিম হিসেবে বাঁচবার তৌফিক দাও। হুই, উইঘুর কারা সহি পথে আছে। তা বুঝবার আমাদের তৌফিক দাও। বিজ্ঞ যোগ্য কাউকে আমাদের মধ্যে পাঠাও, আমাদের যে সাহায্য প্রয়োজন তা তার মাধ্যমে আমাদের দাও প্রভু। ভাবতে ভাবতে আহত মন নিয়ে মা চুং ইং কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল।
.
মোবাইলের রিং-এর শব্দে ঘুম ভাঙল মা ঝু সুলতানের। মা ঝু রাত ৯টায় বাইরে থেকে এসে রেস্ট নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
উঠে বসে টেবিল থেকে মোবাইল তুলে নিল মা ঝু। স্ক্রিনের দিকে একবার তাকিয়েই দ্রুত কথা বলল, হ্যাঁ আপা, বল।
ভাইয়াকে পেলাম না। শোন মা ঝু, আমি ট্রেনে, বেজিং আসছি। আমার কক্ষের বাইরে কিছু গোলাগুলি হচ্ছে। আমার কক্ষের দরজা ভাঙার জন্য ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছে। ওরা কারা জানি না। তবে সেনা গোয়েন্দারা এই আশঙ্কা করেছিল। তুমি…।
আর কথা বলতে পারল না ফা জি ঝাও, জেনারেল হু ফেং এবং মা ঝুর বোন।
টেলিফোনেই দরজা ভেঙে পড়ার শব্দ পেল মা ঝু। সঙ্গে সঙ্গেই পেল। গুলির একটা শব্দ।
ফা জি ঝাও-এর মোবাইল বন্ধ হয়ে গেল।
আপা…। বলে চিৎকার করে উঠল মা ঝু।
মা ঝু নিজেকে সামলে নেবার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠল। দ্রুত সে টেলিফোন ধরল। দেখল লিয়েন হুয়ার টেলিফোন।
লিয়েন হুয়া মা ঝু সুলতানের সহপাঠী এবং সহকর্মী। ছাত্র ও কম্যুনিস্ট যুব আন্দোলনের একজন শীর্ষ নেত্রীও লিয়েন হুয়া। তার আরেকটা বড় পরিচয় হলো, দেশের প্রেসিডেন্ট ও চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি চীনের নাম্বার ওয়ান ব্যক্তিত্ব লিউ জোয়ান ঝেং-এর আদরের ভাগনী।
মা ঝু টেলিফোন ধরতেই ওপ্রান্ত থেকে লিয়েন হুয়া বলল, কেমন আছ। মা ঝু?
এখনই একটা টেলিফোন পেলাম জি ঝাও-এর কাছ থেকে। ট্রেনে সে বেজিং আসছিল। তার কম্পার্টমেন্টের দরজা ভাঙার শব্দ পেলাম, তার সাথে গুলির শব্দও। গুলির সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল বন্ধ হয়ে গেল। আপার নিশ্চয় মারাত্মক কিছু ঘটেছে। এখন আমি কি করব বুঝতে পারছি না। বলল মা ঝু। উদ্বেগে ভরা তার কণ্ঠস্বর।
মা ঝু তার সাথে, তার পাহারায় কেন্দ্রীয় একটা গোয়েন্দা টিম ছিল। লিয়েন হুয়া বলল।
ছিল? কেন? বলল মা ঝু।
বিভিন্ন তথ্য থেকে গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছিল। তাই জি ঝাও-এর একাকি সফর বন্ধ করে তাকে গোয়েন্দাদের পাহারায় বেজিং আনার ব্যবস্থা হয়। লিয়েন হুয়া বলল।
গোয়েন্দারা কি তাকে রক্ষা করতে পারবে? বলল মা ঝু।
সেটাও ধরে নেয়া কঠিন। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে মা ঝু। ইতিমধ্যে বিষয়টা তুমিও উপরে জানাও, আমি জানাচ্ছি।
কথা শেষ করেই লিয়েন হুয়া বলল, তোমাকে একটা কথা জানাবার জন্যে এই টেলিফোন করেছি। কিন্তু তার আগে তোমাকে আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে মা ঝু।
বল। বলল মা ঝু।
লু হু আয়েশার মৃত্যুতে আমি খুশি হয়েছি, এটা কি তুমি মনে কর? লিয়েন হুয়া বলল।
কথাগুলো মা ঝুর কানে ভারি শোনাল।
তা কেন? তা আমি মনে করব কেন? বলল মা ঝু। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না লিয়েন হুয়া।
একটু সময় নিয়ে বলল, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি বা ভালোবাসতাম। লিয়েন হুয়ার কণ্ঠ ভারি এবং কাঁপা।
মা ঝু তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল না।
মা ঝু ও লিয়েন হুয়ার মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক অনেক দিনের। সেটা। এক নীরব ভালোবাসা। দুজনের কেউ কাউকে জানায়নি তাদের মনের কথা। এর মধ্যে লু হু আয়েশা ঝড়ের মতো আসে ঝুর জীবনে। লিয়েন। হুয়ার হৃদয় ভেঙে গেলেও সে নীরব হয়ে যায়। কিন্তু লিয়েন হুয়ার এক বান্ধবী বিষয়টা মা ঝুকে জানিয়ে দেয়। মা ঝুর হৃদয়ের চাপাপড়া গোপন। ভালোবাসাটা এই আঘাতে জেগে উঠে। কষ্ট পায় মা ঝুও। ঠিক এই সময় লু হু আয়েশার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
লিয়েন হুয়া, আমার কোনো কথা বা কাজে তুমি বুঝেছ যে, লু হু আয়েশার মৃত্যুতে তুমি খুশি হয়েছ আমি এটা মনে করেছি? বলল মা ঝু।
তাহলে তুমি কেন বলনি লু হু আয়েশার মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা। লিয়েন হুয়া বলল। তার কণ্ঠে অবরুদ্ধ কান্না।
ও এই কথা? লু হুর মৃত্যুতে তুমি খুশি হবে এটা কি আমি মনে করতে পারি? আমি তোমাকে চিনি না! লু হু যখন আমার জীবনে হঠাৎ এল, তুমি আমাকে কিছু বলনি, তাকেও কিছু জানতে দাওনি। নীরবে সরে দাঁড়িয়েছিলে। আমার মনে হয়েছিল লু হু তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল, আমি তোমাকে কিছু বলতে পারিনি বটে, কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তুমি আমার কাছে আরও বড়, আরও মহৎ হয়ে উঠেছিলে। সেই তুমি লু হু আয়েশার মৃত্যুতে খুশি হবে, এটা আমি ভাবতে পারি? বলল মা ঝু। তার কণ্ঠও আবেগে ভারি হয়ে উঠেছিল।
আমার মনের ব্যাপারটা তুমি জানলে কি করে? অনুমান করেছিলে? লিয়েন হুয়া বলল।
না। তোমার বান্ধবী জিয়েন আমাকে বলেছিল। বলল মা ঝু।
জিয়েন? তাই তো সে একদিন আমাকে খুব বকাবকি করেছিল। বলেছিল, কেন আমরা মনকে চেপে রেখে দুজনেরই অপূরণীয় ক্ষতি করেছি। তার কথা শুনে আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, মনে হচ্ছে তুমি মা ঝুর মনের কথা জান! ব্যাপার কি? সে এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এটা সেটা বলে এড়িয়ে গিয়েছিল। লিয়েন হুয়া বলল।
জিয়েন ঠিকই বলেছিল। আমরা নিজেদের প্রতি এবং একে অপরের প্রতি সুবিচার করিনি। যদি অন্যায়, অযৌক্তিক ও অনৈতিক না হয়, তাহলে মনের কথা এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়। আমরা সেটা করেছিলাম লিয়েন হুয়া। বলল মা ঝু।
দোষটা তোমার। তুমি বলনি, আমাকে বলার সুযোগও দাওনি। যখনই আমার কথা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়েছি, তুমি তড়িঘড়ি সরে গেছ। তখন আমি কিন্তু লজ্জিত, কিছুটা ক্ষুব্ধ হতাম। নারী হিসেবে অপমানও বোধ করতাম। এসবকিছু কোনোই ফল দেয়নি। আমার মুখের দিকেই তুমি তাকাওনি। লিয়েন হুয়া বলল। কণ্ঠ তার ভারি হয়েছে।
লিয়েন, আমার কথাটাও একটু ভাব। প্রাপ্তিটা যদি হঠাৎ বড় হয়ে যায়, বিশ্বাস করতে সময় লাগে। বুঝতেও একটা সময় দরকার হয়। তুমি তো আর কেউ নয়, বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট লেডি। আমার মনটা আমি জানতাম। কিন্তু তোমার মনটা সত্যি আমি বুঝে উঠতে পারিনি। বলল মা ঝু।
বললাম তো বুঝাতে দাওনি তুমি। শুরুতেই আমি বুঝেছি, তুমি অতি ঘনিষ্ঠতা, ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার একদমই পছন্দ কর না। আর এ ব্যাপারটাই আমাকে তোমার কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আমার সবকিছু বোঝার বয়সের পর থেকে এমন একজনকেই কামনা করতাম, যে হবে সবার চেয়ে আলাদা, অনন্য। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র তোমাকেই এমন পেয়েছিলাম। তাই মুসলিম হলেও আমি তোমার দিকেই ছুটে গিয়েছিলাম। বলল লিয়েন হুয়া।
কথা শেষ করেই সঙ্গে সঙ্গে আবার বলে উঠল লিয়েন হুয়া, যাক টেলিফোনে বলেই এত কথা তোমাকে বলতে পারলাম। মুখোমুখি হলে কোনো না কোনো অজুহাত তুলে কথা বন্ধ করে দিতে। এখন শোন, যে কথা বলার জন্যে তোমাকে আমি টেলিফোন…।
মা ঝু লিয়েন হুয়ার কথার মাঝখানেই বলে উঠল, শুনছি। নিল তার আগে শোন, তুমি একতরফা আমার উপর দোষ চাপাচ্ছ। অ তো তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আড্ডাতে দেখি না। কথা-বার্তা মেলামেশায় তুমিও সব সময় একটা সীমারেখা বজায় রেখে চল। তাই ছেলেমেয়েরা তোমাকে কিছুটা ভয় বা সমীহ করে থাকে। আমার মধ্যেও তো এর কিছু থাকতে পারে?
কথা ঘুরিয়ো না। আমি কাছে গেলে…।
লিয়েন হুয়ার কথার মাঝখানেই মা ঝু বলে উঠলো, ঠিক আছে এ নিয়ে আর কথা নয়। আমি আপোস করছি। আমি তোমাকে বুঝেছি।
কি বুঝেছ? লিয়েন হুয়া বলল।
তুমি যা তাই। বলল মা ঝু।
আমি কি? লিয়েন হুয়া বলল।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না মা ঝু। একটু হাসল। বলল, তুমি লোটাস মানে পদ্মফুল।
সে তো আমার নাম। লিয়েন হুয়া বলল।
শুধু নাম নয়, তুমি লাল অপরূপ পদ্মফুল। বলল মা ঝু।
তারপর? লিয়েন হুয়া বলল। তার মুখ গম্ভীর হলেও ঠোঁটে মিষ্টি হাসির ছোঁয়া।
ভারতবর্ষে একটা ধর্ম আছে, সে ধর্মে দেবতাকে সন্তুষ্ট করার একটা শ্রেষ্ঠ উপকরণ পদ্মফুল। এ ফুল দেবতার পায়ে অঞ্জলি দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করা হয়। বলল মা ঝু।
ওটা পদ্মফুলের সৌভাগ্য। কিন্তু আমার দেবতা কি তার পায়ে মানুষ পদ্মফুলের অঞ্জলি চাইবেন? লিয়েন হুয়া বলল।
না মানুষ পদ্মফুলের অঞ্জলি পায়ে হয় না, হৃদয়ে হয়। আর সে অঞ্জলি হাত দিয়ে হয় না, হৃদয় থেকে হৃদয়ে হয়। বলল মা ঝু।
কিন্তু দেবতা তো দরকার। লিয়েন হুয়া বলল।
সে তো বিরাট সমস্যা! আমি তো দেবতা নই, মানুষ! বলল মা ঝু।
এই অজুহাতে পালাবার পথ দেব না। পদ্মফুলের অঞ্জলির জন্যে দেবতা দরকার। কিন্তু লিয়েন হুয়া মানে মানুষ-পদ্মফুলের জন্যে মানুষ-দেবতাই দরকার।
সুতরাং আর কোনো সমস্যা থাকল না। এবার বল তোমার সেই কথা। বলল মা ঝু।
সমস্যা থাকলো না মানে? আমার মানুষ-দেবতা অঞ্জলি নিলেন কিনা কিছুই বললেন না। লিয়েন হুয়া বলল।
ওটা বলার জিনিস নয়, বুঝে নেবার বিষয়। মনকে জিজ্ঞেস করলেই তা পাওয়া যায়, বুঝা যায়। বলল মা জু।
একবার ঠকেছি। মনকে জিজ্ঞাসা করতে ভয় হয়। কি উত্তর পাব কে জানে। লিয়েন হুয়া বলল।
জিজ্ঞাসার আর দরকার নেই। তোমার এই ভয়টাই প্রেম, মন থেকে। আসা মেসেজ। এটাই ঠিক আছে।
হাসল লিয়েন হুয়া। বলল, ঠিক নেই। বাস্তবটা দেখব তারপর।
সেটাই ভালো। ফল দেখেই পরিচয়। এবার তোমার কথা বল। বলল মা ঝু।
দেখ, ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তোমার
কাছে সে রকম মনে নাও হতে পারে।
বলে একটু থামল লিয়েন হুয়া। শুরু করল আবার, দুদিন আগে বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসেছিলাম। আমার পেছনেই একটা ছোট্ট ঝোঁপ। ঝোঁপের ওপারে আরেকটা বেঞ্চ। আমি আসার সময়ই দেখেছিলাম বেঞ্চিতে তিনজন লোক বসেছিল। দুজন যুবক। একজন মাঝ বয়সী। ওরা কথা বলছিল, হাসছিল। তাদের কথায় তোমার ও তোমার বড় বোনের নাম শুনে আমার মনোযোগ ওদিকে আকৃষ্ট হলো। একজন বলছিল, আমি বুঝতে পারছি না জনাব হু জিন, মা ঝু সুলতান তো সরকারের কোনো খুঁটি নয়, তাহলে তার ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্ত কেন?
সরকারের খুঁটি নয় বটে সে, কিন্তু গোটা ছাত্র ও যুবকদের কাছে অসম্ভব, জনপ্রিয় সে। কম্যুনিস্ট পার্টি এবং সরকারের আশীর্বাদ আছে তার উপর।
কিন্তু তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে অন্য কারণে, যেটা আমি শুনেছি। সে কারণ হলো, মা ঝু যেমন পপুলার, তার পরিবারও তেমনি হুই-উইঘুর সব মুসলমানের মধ্যে পপুলার। এই পরিবারে চীনা সেনাবাহিনীর একজন। জেনারেল আছে। তাকে পাঠানো হয়েছে জিনজিয়াং-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে। হুই ও উইঘুরদের সমঝোতার একটা উদ্যোগ হতে পারে এটা। তা যদি হয় তাহলে সরকারের সাথেও সমঝোতা হতে পারে, যা দেশে আনতে পারে শান্তি ও ঐক্য। এটা আমরা চাই না, শুধু তাই নয়বানচালও করে দিতে চাই। এজন্যেই মা ঝু আমাদের টার্গেট, তার পরিবারও আমাদের টার্গেট। মা ঝুর বড় বোন বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও তো এখন আমাদের জালের মধ্যে। যেকোনো সময় তাকে তুলে নেয়া হবে। বলল হু জিন নামের লোকটি।
বিজ্ঞানীকে কি হবে জনাব হু জিন? ওরা তো নিরীহ মানুষ, ওরা সকলের। তৃতীয় জন বলল।
আমাদের কাজ একটা নয়, বহু। বহুজনকে বহু কাজে দরকার। বলল হু জিন।
বহু কাজ কি? তৃতীয়জনই বলল।
যা বলেছ, আর বলো না। এসব নিয়ে কথা বলা আমাদের জন্যে নিষিদ্ধ। উপরে, উপরের উপরে, তার উপরে যারা আছেন, এটা তাদের কাজ। তাদের কাজ নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। তাহলে মাথা থাকবে না।
তাদের কথা আর শোনার সাহস আমার হয়নি। তারা যদি আমাকে দেখতে পায় অথবা তারা যদি মনে করে আমি তাদের কথা শুনেছি, তাহলে আমি কোনো বড় ঝামেলায় পড়ে যেতে পারি। এই ভয়ে চলে আসি আমি। তারপর এ কথাগুলো যত ভেবেছি, ততই আতঙ্ক বোধ করেছি। কথাগুলো তোমাকে জানাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। জানাতে পেরে ভালো লাগছে।
কথা বলতে যাচ্ছিল মা ঝু।
হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কায় তার ঘরের দরজা খুলে গেল।
রিভলবার হাতে চারজন তার দরজায়। চার রিভলবারের নলই তার দিকে তাক করা।
মা ঝু উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, লিয়েন আমার ঘরে চারজন রিভলবারধারী প্রবেশ করেছে। তাদের মুখে মুখোশ। নিষ্কম্প কণ্ঠে কথাগুলো বলল ঝু।
কথা শেষ হবার সাথে সাথেই একজন রিভলবারধারীর বুলেট এসে বিদ্ধ করল মা ঝুর বাম হাতকে। তার হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল।
মা ঝু চিৎকার করল না। শান্ত কণ্ঠে বলল, তোমরা কে জানি না। জানি তোমরা আমাকে কিডন্যাপ করতে এসেছ। কিন্তু তোমরাও জান না, আমাকে কেন কিডন্যাপ করতে এসেছ।
মা ঝুর কথা শুনতে পেয়ছে লিয়েন হুয়া। ফ্লোরে পড়ে যাওয়া মোবাইলে লিয়েন হুয়ার কণ্ঠে তখন চিৎকার চলছে, মা ঝু…মা ঝু…।
মা ঝুর শেষ কথাগুলোও সে শুনতে পেয়েছিল।
৪
চায়না এয়ার লাইন্সের একটা বিমান আকাশে উড়ল জাপানের নাগাসাকি বিমান বন্দর থেকে।
ছুটছে বিমান চীনের উদ্দেশ্যে।
মাঝারি সাইজের বিমান।
লোকে ভর্তি।
প্রথম শ্রেণির পাশাপাশি তিন সিটের ডান প্রান্তের সিটে বসেছে আহমদ মুসা। মাঝের সিটে ষাটোর্ধ্ব বয়সের একজন ভদ্রলোক। তার একটা চুলও কাঁচা নেই। কিন্তু তার দেহের গাঁথুনি দেখে মনে হয় লোকটি নিশ্চিতই একজন যুবক। বাম প্রান্তের সিটে বসা লোকটি স্টিলবডি রোবটের মতো। সব সময় সামনে দৃষ্টি। মুখ ভাবলেশহীন। লোকটি সিটে বসার পর মাঝের লোকটিকে বার কয়েক দেখেছে। একবার তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকেও।
সিটে আসন নেয়ার পর দুজনের উপর একবার চোখ বুলিয়েছিল আহমদ মুসা। মাঝের লোকটিকে দেখে খুশি হয়েছিল সে। তার অন্তরটা কাঁচের মতো স্বচ্ছ। সেখানে লোভ, হিংসা ইত্যাদি লুকিয়ে রাখার কোনো জায়গা। নেই। আর বাম প্রান্তের লোকটিকে দেখে চমকে উঠেছিল আহমদ মুসা। তার মুখ দেখে আহমদ মুসার মনে হলো, সে যেন কারও উপর ঝাঁপিয়ে। পড়ার জন্যে মুখিয়ে আছে।
মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। আল্লাহ সব মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। একজন মানুষ হিসেবে। সেই মানুষের এখন কত রূপ!
মাঝের লোকটি ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে হাতে নিয়েছিল। হঠাৎ বইটি তার হাত থেকে পড়ে গেল। পড়ে গেল আহমদ মুসার পায়ের কাছে।
আহমদ মুসা বইটি তুলে ভদ্রলোকটির হাতে দিল।
ইতিমধ্যে বইটির নাম পড়া হয়ে গেল আহমদ মুসার। চমৎকার নাম।
পাস্ট ইজ রাবল।
লোকটি বই হাতে নিয়ে ধন্যবাদ দিল আহমদ মুসাকে।
ওয়েলকাম। বলে আহমদ মুসা তাকে জিজ্ঞেস করল, স্যার, সুন্দর বইটা কি প্রত্নতত্ত্বের উপর?
লোকটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখে তার মুগ্ধ দৃষ্টি। বলল,
বইটি প্রত্নতত্ত্বের উপর এই সন্দেহ আপনার হল কীভাবে?
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, নিছকই অনুমান স্যার। অতীতকে ধ্বংসস্তূপ বলা হয়েছে। আসলেই অতীত সময়টা দৃশ্যত মৃত, সেহেতু ধ্বংসভূমি। আর ধ্বংস শব্দকে বলা হয় প্রত্ন শব্দের একটা প্রতিরূপ। এ জন্যেই নাম দেখে মনে হয়েছে বইটি প্রত্নতত্ত্বের উপর।
হাসিমাখা মুখে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল লোকটি আহমদ মুসার দিকে। বলল, তিল থেকে আপনি তাল আবিষ্কার করেছেন। অসাধারণ আপনার দৃষ্টি। অসাধারণ ইকুয়েশন। জিজ্ঞেস করতে পারি, আপনার প্রফেশন কি?
মাঝে মাঝে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো। বলল আহমদ মুসা।
এটা কোনো প্রফেশন হলো? বলল লোকটি।
মনে করলেই হলো স্যার। নন প্রফিটেবল কাজগুলোও তো কাজ।
হ্যাঁ, নন প্রফিটেবল কাজগুলোও কাজ এবং এটা প্রফেশনও হতে পারে। ধন্যবাদ তোমাকে। বলল লোকটি।
সঙ্গে সঙ্গে লোকটি আবার বলে উঠল, আপনাকে তুমি বলে ফেললাম। স্যরি।
ওয়েলকাম স্যার। আমাকে তুমিই বলবেন। খুশি হবো।
একটু থেমে সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলল আহমদ মুসা, স্যার কি প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষক?
কেন? বলল লোকটি।
ছোট সবাইকে তুমি বলা শিক্ষকদের অভ্যেস। আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ, ইয়ংম্যান আমি শিক্ষক। প্রত্নতত্ত্বের। বলল লোকটি।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
হঠাৎ প্লেনের কেবিন লাইট নিভে গেল। ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
আলো নিভে যাবার মিনিট খানেকের মাথায় ককপিটের দিক থেকে গুলির শব্দ হলো।
শিরদাঁড়া সোজা হলো আহমদ মুসার। উৎকর্ণ হলো সে।
পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় ককপিটের দিক থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠ ধ্বনিত হলো: সবাই যে যার সিটে বসে থাকুন। সামান্য সন্দেহজনক আচরণ করলে। গুলি করে মারা হবে। এমনকি প্রয়োজন হলে প্লেন ধ্বংস করে দেব।
প্লেনে পিনপতন নীরবতা। ভয় আতঙ্কে সবাই চুপসে গেছে।
আহমদ মুসা স্থির, শান্ত, সতর্ক। এরা কারা, কি উদ্দেশ্যে প্লেন হাইজ্যাক করছে। ওদের টার্গেট কি, কোনো দাবি, টাকা, না কোনো মানুষ! এসব নানা প্রশ্ন জট পাকাচ্ছে আহমদ মুসার মনে।
আরও কয়েক সেকেন্ড পরে কেবিন লাইট আবার জ্বলে উঠল। আহমদ মুসা দেখল প্লেনের সিকুরিটি, স্টুয়ার্ড, এয়ার হোস্টেস সবাইকে বেঁধে ফেলা হয়েছে।
আলো জ্বলে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই একজন রিভলবারধারী আহমদ মুসার পাশে এসে প্রত্নতত্ত্ববিদ লোকটির দিকে রিভলবার তাক করে দাঁড়াল এবং প্রত্নতত্ত্ববিদের ওপাশের সেই স্টিলবডি লোকটিকে নির্দেশ দিল, লিউ, আমাদের স্বর্ণমৃগকে সংজ্ঞাহীন করে বেঁধে ফেল এবং নিয়ে গিয়ে প্যাক করো। ওয়াটার প্রুফ ব্যাগটা সেখানেই আছে।
স্টিলবডি লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে ফিরল প্রত্নতত্ত্ববিদ লোকটির দিকে। তার হাতে একটা রুমাল।
কি ব্যাপার তোমরা আমার উপর চড়াও হচ্ছ কেন? কে তোমরা? কি চাও? বলল প্রত্নতত্ত্ববিদ লোকটি। তার কণ্ঠে প্রবল শঙ্কা।
তাদের দুজনের কেউ কোনো উত্তর দিল না। রুমাল ধরা হাত সামনে বাড়াল সেই স্টিলবডি লোকটি। রিভলবারধারীর উদ্যত রিভলবার তথন আহমদ মুসার আসনের হাতল বরাবর উপরে তার নাকের সমান্তরালে।
আহমদ মুসা দেখে নিয়েছে এখানে এ দুজন ছাড়া ককপিটে যাওয়ার করিডোরের মাথায় আর একজন দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। প্রস্তুত সে।
লিউ নামের স্টিলবডি লোকটি ডান হাত দিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ লোকটিকে সিটের সাথে চেপে ধরে তার হাতের রুমালটি লোকটির নাকে চেপে ধরতে যাচ্ছে।
আহমদ মুসার হাত চোখের পলকে উপরে উঠে এল। কেড়ে নিল তার পাশে দাঁড়ানো লোকটির রিভলবার এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনটি গুলি করল তিন দিকে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সাথে।
আহমদ মুসার পাশে দাঁড়ানো লোকটি, স্টিলবড়ি সেই লোক এবং ককপিটের করিডোরে দাঁড়ানো লোকটিসহ তিনজনই লাশ হয়ে পড়ে গেছে।
গুলি করেই আহমদ মুসা ককপিটের দিকে ছুটল।
এক ঝটকায় খুলে ফেলল ককপিটের দরজা। দেখল একজন রিভলবার। বাগিয়ে দরজার দিকে আসছে। তার বাঁ হাতে বলের মতো গোলাকার কিছু। ওটা একটা মারাত্মক বোমা, বুঝল আহমদ মুসা। লোকটি আহমদ মুসাকে এভাবে সামনে দেখে মুহূর্তের জন্যে হকচকিয়ে গিয়েছিল।
লোকটির উপর চোখ পড়ার পর আহমদ মুসা কিন্তু মুহূর্তও দেরি করল না। গুলি করল তার কপাল বরাবর। দেহটি তার একবার টলে উঠে আছড়ে পড়ল ককপিটের দরজায়।
আহমদ মুসা এবার চোখ ফিরাল ককপিটে। দেখল, সহকারী পাইলটের লাশ পড়ে আছে সিটের নিচেই।
পাইলটের বিস্ফারিত চোখ আহমদ মুসার দিকে।
ওদের বোধ হয় চারজন লোক ছিল। চারজনই মারা গেছে। প্লেন এখন নিরাপদ। পাইলটকে উদ্দেশ্য করে বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় জড়িত সৌজন্যে মুখ ভরে গেল পাইলটের। বলল, ধন্যবাদ। স্যার, অনেক ধন্যবাদ।
ওয়েল কাম বলে আহমদ দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসাকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে দেখে প্লেনের যাত্রী সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারা ককপিটে গুলির আওয়াজ পেয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল এজন্য যে, প্রতিরোধকারী লোকটির কিছু হয়ে গেল কিনা।
আহমদ মুসা সকলের দিকে চেয়ে বলল, আল হামদুলিল্লাহ, প্লেন এখন বিপদমুক্ত।
যাত্রীরা উল্লাস ধ্বনি করে উঠল।
প্রথম শ্রেণীর আসন থেকে একটি মেয়ে ছুটে এসে প্লেনের বিমান বালা ও ক্রুদের বাধন খুলে দিতে লাগল।
একহারা মেয়েটি। চীনা মেয়ে। তবে হলুদ, সোনালি ও সাদার অপরূপ এক মিশ্রণ মেয়েটার গায়ের রঙে। দক্ষ হাতে মেয়েটি দ্রুত ও সহজেই সবার বাঁধন খুলে দিল।
বাঁধনমুক্ত হয়েই বিমানের ক্রু ও বিমানবালারা কৃতজ্ঞতা জানাল আহমদ মুসাকে।
মেয়েটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল আহমদ মুসাকে। সবার শেষে সে এল। আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ধন্যবাদ স্যার। এমন শার্প শুটার সিনেমায় দেখেছি, বাস্তবে দেখিনি। কোনো প্রফেশনাল নয় নিশ্চয়?
মেয়েটা আহমদ মুসার চোখে চোখ রেখে কথা বলছিল।
আহমদ মুসা চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ঠিক ধরেছেন আপনি। কীভাবে ধরলেন?
প্রফেশনালরা আরও একটু বিবেচক হয়, আপনার মতো এমন বেপরোয়া হয় না। বলল মেয়েটি।
বেপরোয়াকে কিন্তু মানুষের একটা খারাপ বৈশিষ্ট্য মনে করা হয়। আহমদ মুসা বলল।
সব ক্ষেত্রে নয়। এই দেখুন, আপনি বেপরোয়া না হলে আজকের প্লেনটা বাচতো না। বলল মেয়েটি।
বাচতো না কেমন? ওদের উদ্দেশ্য পূরণ হলে ওরা প্লেন ও যাত্রীদের নিশ্চয় ছেড়ে দিত। আহমদ মুসা বলল।
এটা সাধারণ নিয়ম। এর ব্যতিক্রমও তো হতে পারে। অনেকে তাদের কাজের কোনো সাক্ষী রাখা পছন্দ করে না। বলল মেয়েটি,
সাংঘাতিক কথা বলেছেন। এরা কি তেমন কেউ? আহমদ মুসা কথাটি বলল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আহমদ মুসার।
মেয়েটি সেদিকে তাকিয়ে যাবার জন্যে পা তুলে বলল, আমি একটা। সম্ভাবনার কথা বলেছি, সুনির্দিষ্ট কিছু নয়।
বলে মেয়েটি আহমদ মুসাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার সিটের দিকে চলে গেল।
আহমদ মুসা আর কথা বাড়াল। সে বিস্মিতও হলো কিছুটা। আহমদ মুসাও ঘুরে দাঁড়াল সিটে ফেরার জন্যে। মাইক্রোফোনে প্লেনের ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ ভেসে এল।
বলা হলো: ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আনন্দের সাথে ঘোষণা করছি, প্লেন এখন নিরাপদ। ডেস্টিনেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আপনারা দেখেছেন, একজন ভদ্রলোকের অসীম সাহসিকতায় প্লেনসহ আমরা এখন নিরাপদ। সবার পক্ষ থেকে তার প্রতি আমাদের অন্তহীন কৃতজ্ঞতা। আমরা আমাদের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তাকে স্বাগত জানাবার জন্যে তারা অপেক্ষা করছেন। আপনাদের যাত্রা শুভ হোক। ধন্যবাদ সকলকে।
আহমদ মুসা তার সিটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সেই প্রত্নতত্ত্ববিদ ভদ্রলোক সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, বাবা তুমি আমার জীবন-মান সব বাঁচিয়েছ। কান্নায় ভেঙে পড়ল ভদ্রলোকের কণ্ঠ।
আহমদ মুসা আস্তে আস্তে তাকে সিটে বসিয়ে নিজে বসে বলল, স্যার, এই বাঁচাবার এখতিয়ার আল্লাহর মানে ঈশ্বরের। অপাত্রে প্রশংসা যাওয়া ঠিক নয় স্যার। আহমদ মুসা বলল।
সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজেছিল প্রত্নতত্ত্ববিদ ভদ্রলোক। কয়েক মুহূর্ত পর চোখ খুলল। বলল, তুমি যা বলছ, তা খুব বড় মনের, বড় মানের লোকেরাই বলতে পারে এ কথা। তুমি কে জানতে পারি কি?
আহমদ মুসা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। পরে ধীরে ধীরে বলল, স্যার, অনেক পরিচয় আছে, যা কোনো এক নামে প্রকাশ করা যায় না।
প্রত্নতত্ত্ববিদের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, তোমার নামের ক্ষেত্রে নিশ্চয় সে রকম কোনো কারণ নেই? বলল প্রত্নতত্ত্ববিদ ভদ্রলোক।
স্যার, আমি আহমদ। আহমদ মুসা বলল।
মুসলিম। হ্যাঁ, আমিও এটাই অনুমান করেছি। ভদ্রলোক বলল।
কীভাবে? বলল আহমদ মুসা।
তুমি প্লেনের সিটে বসার সময় কয়েকটা আরবি শব্দ উচ্চারণ করেছিলে। ভদ্রলোক বলল।
আপনি আরবি ভাষা জানেন? বলল আহমদ মুসা।
অনেক ভাষার সাথেই প্রত্নতত্ত্ববিদদের পরিচয় থাকতে হয়। তার উপর আরবি মানব সভ্যতার কেন্দ্রস্থলের ভাষা। আরবি ভাষার সাথে পরিচয় থাকা আমাকে প্রোহিবিটেড সিটি মানে নিষিদ্ধ নগরীর দ্বিতীয় খনন কর্মসূচিতে, এর রহস্য অনুসন্ধানে আমাকে অভাবনীয় সাহায্য করেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ ভদ্রলোক বলল।
প্রোহিবিটেড সিটির রহস্য অনুসন্ধানে আপনি কীভাবে আরবির সম্পর্ক; পেলেন? বলল আহমদ মুসা।
কুবলাই খানের নাম শুনেছ? ভদ্রলোক বলল।
হ্যাঁ, কুবলাই খানের নাম শুধু নয়, তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। এ কথাও জানি যে, নিষিদ্ধ নগরী ম্রাট কুবলাই খানের প্রাসাদ ও রাজধানীর উপর গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেখানকার রহস্যের সাথে আরবির সম্পর্ক কি? রহস্যই বা কি?
বলেই আহমদ মুসা হঠাৎ মূল্যবান কিছু খুঁজে পাওয়ার মতো বিস্ময় দৃষ্টিতে প্রত্নতত্ত্ববিদ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি তাহলে নিষিদ্ধ নগরীর খনন কাজে ছিলেন! প্লিজ স্যার, আপনার নাম কি বলবেন?
হ্যাঁ, আমি ডা. ডোমিংগো। প্রত্নতত্ত্ববিদ ভদ্রলোক বলল।
ডা. ডোমিংগো মানে ড. ডা, যিনি নিষিদ্ধ নগরীর খনন কাজের প্রধান এবং প্রত্নতত্ত্বের কিংবদন্তী? বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। কারো নামের সাথে এমন সস্তা বিশেষণ তোমার মুখে মানায় না। ড. ডা বলল।
কিছু বিশেষণ সস্তা শোনালেও তা আসলে মানুষের পরিচয় জ্ঞাপক। এর প্রয়োজন আছে স্যার। যাক, আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি স্যার, আপনার সাক্ষাৎ পেয়ে। আপনার কথা অনেক শুনেছি। আমার একটা প্রশ্ন স্যার, আপনার মতো লোকের শক্ত থাকার কথা নয়। কিন্তু কারা এই শত্রু, যারা আপনাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল? বলল আহমদ মুসা।
এই প্রশ্ন আমারও আহমদ। কারা ওরা? কেন ওরা আমাকে টার্গেট করেছে? ড. ডা বলল।
সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা কোনো উত্তর দিল না। ভাবনার চিহ্ন আহমদ মুসার চোখে-মুখে।
কি ভাবছ আহমদ? ড. ডা বলল।
স্যার, এ ধরনের সন্দেহজনক কোনো ঘটনা কি এর আগে কখনও ঘটেছে? বলল আহমদ মুসা।
সেরকম কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে না। তবে আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া, আমার সাথে সাক্ষাত, ইত্যাদি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ড. ডা বলল।
এই বাড়াটা কখন থেকে স্যার? বলল আহমদ মুসা।
ড. ডা একটু চিন্তা করে বলল, বছরখানেক থেকে মনে হয় এই পরিবর্তন ঘটেছে।
তার মানে নিষিদ্ধ নগরীর দ্বিতীয় খননের ঘটনার পর থেকে! বলল আহমদ মুসা। স্বগত কণ্ঠ তার।
হ্যাঁ আহমদ, সময়ের হিসাবে তাই হয়। ড. ডা বলল।
কিন্তু বলুন তো নিষিদ্ধ নগরীর দ্বিতীয় খননের পর আপনি মূল্যবান হয়ে উঠলেন কেন? বলল আহমদ মুসা।
বিষয়টাকে এভাবে কখনও আমি ভাবিনি। ড. ডা বলল।
স্যার আবার একটু ভাবুন তো, গত এক বছর সন্দেহজনক কিছু ঘটেছে। কিনা কিংবা কোনো কিছুকে আপনার সন্দেহজনক মনে হয়েছে কিনা? বলল আহমদ মুসা।
ড. ডা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ভাবনা তার চোখে মুখে। বলল, তুমি সন্দেহজনক কিছু খুঁজছ কেন?
খুঁজছি কারণ আজ আপনাকে প্লেন হাইজাক করে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এটা শুধু খুব বড় ঘটনা নয়, চূড়ান্ত ধরনের ঘটনা একটা। এমন বড় ঘটনার আগে আরও ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। বলল আহমদ মুসা।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে ড. ডা’র।
কথা বলল না সঙ্গে সঙ্গে। ভাবছে সে। বলল, ধন্যবাদ আহমদ, ঠিকই বলেছ।
বলে আবার চুপ করল ড. ডা। আবার তার চোখে-মুখে সেই ভাবনা। মুখটা তার নিচু হয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ মুখ তুলল। তার চোখে-মুখে উজ্জ্বল দৃষ্টি। তার যেন ভালো কিছু মনে পড়ে গেছে। বলল সে, একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। গত জুনে উডাং পাহাড়ের ইউঝেন প্যালেসের বার্ষিক তাও অনুষ্ঠানের এক আলোচনায় দাওয়াত পেয়েছিলাম। খুশি হয়ে দারুণ আগ্রহ নিয়ে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলাম। আলোচনার এক পর্যায়ে একজন সন্ন্যাসী আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় আমাকে একটা চিরকুট দেন। তাতে লেখা। ছিল, আমি আপনাকে চিনি। আপনি প্লিজ আমাকে ফলো করুন। আমি আপনার এক শুভাকাক্ষী। চিরকুট পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মন বলল, তার কথা আমার শোনা উচিত। টয়লেটের কথা বলে আমি হলরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি বেরিয়ে এলাম হলের লবিতে। দেখলাম সন্ন্যাসিটি লবী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমিও তাকে অনুসরণ করলাম। তিনি আমাকে দুর্গম এক পাহাড়ি পথে নিচে নিয়ে এলেন। তিনিই আমাকে পৌঁছে দিলেন বেইজিং-এ। পাহাড় থেকে নেমে তিনি আমাকে বলেছিলেন, স্যার আপনাকে কিডন্যাপ করার জন্যেই এখানে আনা হয়েছিল। পাহাড়ে উঠার আগেই আপনাকে কিডন্যাপ করার কথা ছিল, কিন্তু একটা অসুবিধার জন্যে তা পারেনি। ফেরার সময় পাহাড় থেকে বেরুবার পথে আপনাকে কিডন্যাপ করা হতো। সন্ন্যাসীটি তার কোনো পরিচয় আমাকে দেয়নি।
এত বড় ঘটনা আপনি ভুলে গিয়েছিলেন কীভাবে? বলল আহমদ মুসা।
তার চিরকুটকে আমি বিশ্বাস করতে পারলেও তার সব কথা আমার, বিশ্বাস হয়নি। আমাকে কেউ কিডন্যাপ করবে কোন্ কারণে? ড. ডা বলল।
যারা দাওয়াত দিয়েছিল, তারা জিজ্ঞেস করেনি আপনাকে কেন আপনি চলে এসেছিলেন? বলল আহমদ মুসা।
আমিই টেলিফোন করেছিলাম বাড়ি ফেরার পর পরই। বলেছিলাম। হঠাৎ খুব অসুস্থ বোধ করায় আমি চলে আসি। বলে আসতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম। ড. ডা বলল।
এ ধরনের আর কোনো ঘটনার কথা আপনার মনে পড়ে ড. ডা? বলল আহমদ মুসা।
আরেকটা ছোট ঘটনা আছে। আমি বেইজিং-এর পাশেই একটা প্রোগ্রামে যাচ্ছিলাম। পাহাড়ের টানেল এলাকা পার হবার সময় হঠাৎ আমার গাড়ি বিকল হয়ে যায়। কি হয়েছে দেখার জন্যে ড্রাইভার নেমে যায়। সে নেমে যাবার সাথে সাথেই দুটি গাড়ি এসে আমার গাড়ির দুপাশে দাঁড়িয়ে যায়। দুপাশের গাড়ি থেকে দুজন হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসে। দুদিক থেকে তারা ছুটে আসে আমার গাড়ির দিকে। এই সময় পুলিশের একটা পেট্রোল টিমের গাড়ি এসে দাঁড়ায় আমার গাড়ির পেছনে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসা। লোক দুটি দ্রুত ফিরে গিয়ে গাড়িতে উঠে এবং গাড়ি দুটি দ্রুত চলে যায়। পরে পুলিশ জানায়, আমার গাড়ির ফুয়েল টিউবে অত্যাধুনিক টাইমার সেট করা হয়েছিল, যাতে নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করার পর জ্বালানি সাপ্লাই বন্ধ হওয়ায় গাড়ি থেমে যায়। তারা আরও জানায়, ওদের মতলব ছিল আমাকে কিডন্যাপ করা। ড. ডা বলল।
আপনি এ ঘটনাকে ছোট বলছেন কীভাবে? বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ তাদের আশঙ্কার কথা বলেছে, আমি শুনেছি। কিন্তু আমার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। আমার কোনো শত্রু আছে বলে মনে করি না। তাই বিষয়টা আমার মনে থাকেনি। ড. ডা বলল।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, একজন আত্মভোলা গবেষকের কাছে এ ছাড়া আর কিই বা আশা করা যায়।
ড. ডা’র চেহারায় গাম্ভীর্য নেমে এল। বেদনার বিষাদ ছড়িয়ে পড়ল তার চোখে-মুখে। বলল, আমি দুঃখিত। আমি বুঝতে পারছি, আমি ভুল। করেছিলাম বুঝতে। আরও বুঝতে পারছি আহমদ, আজকের দুনিয়ায় বাঁচার জন্যে আমাদের মতো লোকরা সত্যিই অনুপযুক্ত। ভেজা কণ্ঠস্বর ড. ডা’র।
দুঃখিত স্যার, আপনি বিশ্বাসী থেকে একেবারে অবিশ্বাসী হয়ে গেলেন। নির্বিচারে সবাইকে বিশ্বাস করা আপনার আগের সেই বিশ্বাস যেমন ঠিক ছিল না, তেমনি আজকের দুনিয়ার জন্যে আপনি অনুপযুক্ত, এটাও ঠিক নয়। আপনি যা, সেটা হলো, প্রত্ন-জগতের পরিমণ্ডলে নিজেকে আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। অন্য কোনো চিন্তা-বিবেচনা আপনার কাছে গুরুত্ব পায় না। বলল আহমদ মুসা।
হতে পারে। তবে এটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নয়, মানব প্রবণতার বাইরে নয়। ড. ডা বলল।
একটু থামল ড. ডা। বলল পরক্ষণেই, কিন্তু আহমদ আমি বুঝতে পারছি না, আমার বিরুদ্ধে ওদের এই শত্রুতা কেন?
আমি বিত্তশালী কেউ নই, কোনো প্রকার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী আমি নই, আমি কখনও কারও কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে কেন, কোন্ কারণে আমি তাদের কিডন্যাপের মতো ঘটনার টার্গেট হলাম!
স্যার, আপনি আপনার শক্র না থাকার পক্ষে তিনটি যুক্তি দিয়েছেন। আমি মনে করি আর একটা দিক বাদ পড়ে গেছে। সে কারণেও আপনার শত্রু সৃষ্টি হতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
সেদিকটা কি? ড. ডা বলল। তার চোখে মুখে কৌতূহল।
আপনার কাছে কিছু পাওয়ার স্বার্থও তো কারো থাকতে পারে। বলল। আহমদ মুসা।
আমার কাছে পাওয়ার স্বার্থ? আমার কাছে পাওয়ার এমন কি আছে? ড. ডা বলল।
আমি জানি না স্যার। আপনাকে আপনার নিজের দিকে তাকাতে হবে।
বলল আহমদ মুসা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো ড. ডা’র।
হঠাৎ ড. ডা স্বপ্লেখিতের মতো সোজা হয়ে বসল। বলল, হ্যাঁ আহমদ, আমাকে যেমন ওরা কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছে, সে রকমভাবে আমার অফিসে আমার পার্সোনাল ফাইল থেকে একটা ফাইল ওরা চুরি করেছে।
কি ফাইল? ফাইলে কি ছিল? বলল আহমদ মুসা।
নিষিদ্ধ নগরী খননের উপর কিছু জরুরি নোট। এগুলোর ভিত্তিতেই খনন সংক্রান্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে ও প্রত্নতত্ত্ব আর্কাইভে পাঠিয়েছিলাম। ড. ডা বলল।
ভাবছিল আহমদ মুসা। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, নিষিদ্ধ নগরী আসলে রহস্যের নগরী। এমন কিছু রহস্য কি আপনি পেয়েছিলেন, যা সীমাহীন লোভ জাগাতে পারে কারো মনে?
হাসল ড. ডা। বলল, প্রতাপশালী সম্রাট কুবলাই খানের রাজধানী ও প্রাসাদের উপর তৈরি নিষিদ্ধ নগরী পাঁচ শবছর চীনের রাজধানী ছিল, ২৮জন ম্রাট এখানে রাজত্ব করেছেন। এখানে সীমাহীন লোভ জাগানোর মতো অনেক কিছুই আছে।
ধন্যবাদ স্যার। সে লোভনীয় বিষয় কারও টার্গেট হতে পারে। কিন্তু আপনি টার্গেট হলেন কেন? বলল আহমদ মুসা। চোখে তার অনুসন্ধিৎসু
আমি জানি না। ড. ডা বলল।
স্যার আমি পড়েছি, নিষিদ্ধ নগরীর রহস্য ও গোপন সবকিছু নানা রকমের সংকেত ধাঁধায় বাঁধা। আপনি নিশ্চয় এ ব্যাপারে অনেক ভালো জানেন। বলল আহমদ মুসা।
অনেক ভালো জানি, তা ঠিক নয়। তবে কিছু জানি। ওখানকার। ধাঁধাগুলো এতটাই জটিল ও প্রাকৃতিক যে ওগুলোকে ধাঁধাই বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কুবলাই খানের রাজপ্রাসাদ ও রাজধানীর ডিজাইনার ছিলেন ইগদার ওরফে ইখতিয়ার আলদীন। কুবলাই খান তার রাজধানীর নির্মাণে মুসলিম স্থপতি ও কারিগরদের নিয়োগ করেন। মুসলিম ডিজাইনার, কারিগর ও স্থপতিরা তাদের নির্মিত প্রাসাদ-রাজধানীতে যে ধরনের ধাঁধার ব্যবহার করেন, সেই জটিল ও প্রাকৃতিক ধাঁধার অনেক নিষিদ্ধ নগরীর রহস্য ও গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যবহার করা হয়। ড. ডা বলল।
আহমদ মুসা তাকিয়েছিল ড. ডা’র দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল আহমদ মুসা। এ সময় কেবিন মাইক্রোফোনে ধ্বনিত হলো ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ, লেডিজ এন্ড জেন্টলম্যান, আমাদের বিমান চীনের শানদং প্রদেশের উপকূলীয় বিমানবন্দর কিংদাও-এ অল্পক্ষণের মধ্যে ল্যান্ড করছে। সম্মানিত যাত্রীদের প্রতি অনুরোধ, চীনের প্রত্নতত্ত্ব-বিজ্ঞানী চীনের মহান নগরিক ড. ডা ডোমিংগ এবং আমাদের এই বিমান যে অসম সাহসী ও বিস্ময়কর ব্যক্তির তৎপরতায় রক্ষা পেয়েছে, সেই মহান ব্যক্তিত্ব মি. আহমদ আগে নেমে যাবার পর আপনারা দয়া করে নামবেন।
ঘোষণাটি শুনেই আহমদ মুসা তাকাল ড. ডা’র দিকে। বলল, স্যার এদের আপনি বলুন, আমাকে নিয়ে কোনো ধরনের প্রচার না করার জন্য। আমি এসব পছন্দ করি না। আর বিমানবন্দরে অপেক্ষা করার মতো সময়ও আমার নেই।
একজন এয়ার হোস্টেস পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে আহমদ মুসার কথা শুনে থমকে দাঁড়াল। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, এক্সকিউজ মি স্যার, প্রচার ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। শানদং প্রদেশসহ চীনের প্রধান টিভি চ্যানেলে আপনার ফটো এবং গোটা কাহিনী ইতিমধ্যে প্রচার হয়ে গেছে।
বিষণ্ণতা নেমে এল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। তবুও মুখে কিছু বলল।
আহমদ তুমি অবাক লোক। সবাই প্রচার চায়, আর তুমি প্রচার হয়েছে। জেনে মন খারাপ করলে। বলল ড. ডা।
ল্যান্ড করল বিমান। তিনটি চাকার উপর ভর করে বিমান ছুটছে ল্যান্ডিং গ্যাংওয়ের দিকে।
.
পাহাড়ের মাথায় চারদিকে লেকঘেরা বিশাল, সুন্দর পুরাকীর্তির মতো একটা প্রাসাদ। বিশাল হলঘর। অন্ধকার। কালো কাপড়ে আবৃত কালোর চেয়ে কালো ছায়ামূৰ্তিরা হাঁটু মুড়ে ফ্লোরের কারপেটের উপর বসে। হলের শুরুর প্রান্তে একটা বেদির উপর শূন্যে ঝুলছে একটা সবুজ ড্রাগন আকৃতির তলোয়ার। গোটা হলের পিনপতন নীরবতা ভেঙে একটা ঘোষণা ধ্বনিত হলো, হুশিয়ার, মহান জোয়ান উ আবির্ভূত হচ্ছেন।
ঘোষণার সাথে সাথে উপরের অন্ধকার থেকে বেদির উপর নেমে এল সিংহাসনাকৃতির চেয়ারে বসা লাল কাপড়ে আবৃত একজন মানুষ। হলুদাভ মুখ। একটু বেশি পোলিশড, ফরমাল। জোয়ান উ-এর কাল্পনিক ছবির সাথে যথেষ্ট মিল আছে।
জোয়ান উ চীনের কিংবদন্তীর যোদ্ধা, মিস্ট্রিয়াস ওয়ারিয়র। তার হাতের তলোয়ার, যা তিনি পেয়েছিলেন এক দৈব পুরুষের কাছ থেকে, একেবারেই অজেয়। যেকোনো যুদ্ধে জয় ছিনিয়ে আনতে পারে এই তলোয়ার।
জোয়ান উর চেয়ার বেদির উপর স্থির হবার সঙ্গে সঙ্গে ঝুলন্ত তলোয়ার তার হাতে চলে এলো।
ঠোঁট নড়ে উঠল জোয়ান উর। মাইক্রোফোনের মতো যান্ত্রিক গলায় ধ্বনিত, হলো, আমি জোয়ান উ। সাতাশ শৃঙ্গের ৭০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ২০০০ মন্দির ও প্রাসাদের মহাপবিত্র উড্যাংগ আমার, চীনের পবিত্র-আত্মা মানুষের। আবার চীনের ভূমি উড্যাংগের। আমার আবির্ভাব উড্যাংগের ৩২১ বর্গমাইল এলাকায় পবিত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে। এটা হবে চীনের হৃদয় এবং এ হৃদয় হবে এক পবিত্র সাম্রাজ্য। অর্থবিত্তের মহাকেন্দ্র হবে। উড্যাংগের এই পবিত্র সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য পরিণত হবে চীনের মহাসাম্রাজ্যে। অপবিত্র আত্মারা চীন ছাড়বে। তাদের জন্যে চীন নয়। তাই উড্যাংগ চায় অঢেল বিত্ত সম্পদ। এ বিত্তের সন্ধান আমি পেয়েছি নিষিদ্ধ নগরীর মাটির তলে। তা উদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সোনার ডিমপাড়া রাজহাঁস এখনও আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তার মগজেই আছে নিষিদ্ধ। নগরীর মাটির তলার কুবলাই খানদের সীমাহীন সম্পদের চাবিকাঠি। সোনার হাঁসটি তৃতীয়বারের মতো হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। নিষিদ্ধ নগরী থেকে কুবলাই খানের ধনভাণ্ডার উদ্ধারের দায়িত্ব যাদের দিয়েছিলাম, তারা ব্যর্থ। হয়েছে। তাই তোমাদের ডাকা। তোমরা উড্যাংগের প্রাণ সাধক ও সংগ্রামী কুংফু বাহিনীর নেতা। নির্দেশ দিচ্ছি সকল বাধা ধ্বংস করে সোনার হাঁস ড. ডা’কে ছিনিয়ে নিতে, তাকে জীবিত আমি চাই। এই দায়িত্বও তোমাদের আমি দিচ্ছি। তার কথা শেষ হতেই অন্ধকারে হাঁটু মুড়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা কালো কাপড়ে আবৃত লোকগুলো ঝুঁকে পড়ে মাথা মাটি পর্যন্ত নিয়ে বাও করল।
জোয়ান উ যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই আবার অন্তর্হিত হয়ে গেল।
অন্ধকার হল থেকে সবাই এক এক করে বেরিয়ে গেল। হলটি পাহাড়ের শীর্ষদেশে।
হলের তিনদিকে শত শত ফিট গভীর গিরিখাদ। একদিকে সিঁড়ি। দীর্ঘ সিঁড়ি। শত ধাপের সিঁড়ি। সিঁড়ির গোড়ায় প্রশস্ত ল্যান্ডিং-এ এসে দাঁড়াল হল থেকে নেমে আসা কালো কাপড়ে মোড়া লোকগুলো। তাদের মধ্যে একজন ল্যান্ডিং-এর এক প্রান্তে একটা বেদির উপর দাঁড়িয়ে বলল, জোয়ান উ কুংফু বাহিনীর সম্মানিত নেতৃবৃন্দ, আমাদের লর্ডের কি নির্দেশ তা আপনারা জেনেছেন। এখন কে প্রথম এগিয়ে আসবেন এ নির্দেশ পালনের জন্যে?
জোয়ান উ কুংফু বাহিনীর উড্যাংগ পাহাড়ের একটা গোপন বাহিনী, যারা লর্ড জোয়ান উর কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে নিয়োজিত। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বাহিনী। হলের সভায় যারা এসেছিল তারা সামরিক গ্রুপেরই নেতৃবৃন্দ। আর যে বেদিতে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে কথা বলল সে উড্যাংগ ডায়মন্ড হলের শীর্ষ কুংফু গুরু হুই দাই। সে এই সামরিক গ্রুপের কমান্ডারও।
হুই দাই-এর কথা শেষ হতেই সবাই প্রায় একসঙ্গে হাত তুলল। বলল, আমি প্রস্তুত।
ধন্যবাদ সকলকে। আপনারা লর্ড জিয়ান উর উপযুক্ত সৈনিকের কাজ করেছেন।
বলে হুই দাই একজনের দিকে ইংগিত করে বলল, ডা চুন তোমাকেই দায়িত্ব দেয়া হলো। লর্ড কথিত সোনার ডিমপাড়া হাঁসকে প্লেনে যে বা যারা বাঁচিয়েছে এবং আমাদের চারজনকে হত্যা করেছে, তাদের ব্যাপারে লর্ড যা বলেছেন সেই কাজ করতে হবে অনতিবিলম্বে। প্লেনে আমাদের উড্যাংগ গোয়েন্দা বিভাগের একজন লোক ছিল। সে ড. ডাসহ হন্তা লোকটিকে ফলো করছে। বিমানবন্দরেই সে নির্দেশের অপেক্ষা করছে। তুমি তোমার লোকদের এখনি নির্দেশ দাও। লর্ড আমাদের সকলের প্রতি খুশি হোন। ধন্যবাদ সকলকে।
কথা শেষ করেই হুই দাই আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল।
ডা চুন নামতে লাগল নিচে। তার হাতে উঠে এসেছে মোবাইল। কথা বলছে মোবাইলে।
কিংদাও বিমানবন্দর।
ভিভিআইপি লাউঞ্জের এক্সিট দরজার দিকে চোখ রেখে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে বিমানবন্দরের একজন নিরাপত্তাকর্মী। নাম গুয়েটিন। তার হাতের মোবাইলটা বেজে উঠল। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ।
মোবাইলটা তুলে নিয়ে ওপারের কথা শুনল গুয়েটিন। ইয়েস, ইয়েস করে সব কথা শুনল। সবশেষে বলল, সব বুঝেছি স্যার। লর্ডের ইচ্ছা, আমরা অবশ্যই সফল হবো।
লর্ড সহায় হোন। ওপারের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো।
ওপার থেকে কেটে গেল লাইন।
মোবাইলের কল অফ করে গুয়েটিন ভিভিআইপি লাউঞ্জের দরজার দিকে চোখ রেখেই একটু আড়ালে সরে গেল। একটা কল করল সে। বলল, নতুন .) মিশন। হাই প্রোফাইল। তোমরা আটজন পার্কিং প্লেসে চলে এসো এবং আমার নির্দেশের অপেক্ষা কর।
মিনিট দশেক পর সিকিউরিটির লোকদের পরিবেষ্টিত হয়ে বের হয়ে এল ড. ডা। তার পাশে আহমদ মুসা। এয়ারলাইন্সের বড় বড় কর্মকর্তারা রয়েছে তাদের সাথে।
তারা নিচে নামল। এগোলো কারপার্কিং-এর দিকে। শুয়েটিন ভিভিআইপি লাউঞ্জের নিরাপত্তা প্রহরী এবং সে জোয়ান উর কুংফু সশস্ত্র বাহিনীর একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।
সবার সাথে ড. ডা ও আহমদ মুসা কারপার্কিং-এ নেমে গেলে গুয়েটিন। ছুটল কারপার্কিং-এর উপরের কাঁচের দেয়ালটার দিকে। এখান থেকে কারপার্কিং-এর গোটা আন্ডারগ্রাউন্ড এলাকা চোখে পড়ে। সে দেখল, তাদের লোক আটজনই এসে গেছে। বিমানবন্দর নিরাপত্তাকর্মীর ছদ্মবেশে তারা পজিশনও নিয়েছে। দেখতে পেল, সিকিউরিটি পরিবেষ্টিত হয়ে ড. ডা ও সেই খতরনাক লোক আহমদ প্রবেশ করছে পার্কিং এরিয়ায়। এগিয়ে নেয়া হচ্ছে দুজনকে দুই গাড়ির দিকে।
গুয়েটিন মুখের কাছে তুলে নিল তার অয়্যারলেস পলপল করে বয়ে গেল কয়েকটা মুহূর্ত।
ড. ডা ও আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়ানো সিকিউরিটির লোকদের পেছন থেকে অগ্নিবৃষ্টি করল চারটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সাইলেন্সার লাগানো অস্ত্রে কোনো শব্দ হলো না। সিকিউরিটির চারজন লোকই গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। গুলিগুলো পয়েন্টেড ছিল। ড. ডা’র সিকিউরিটি চারজন হত্যাকারীদের গুলি থামলো না। হত্যাকারী চারজন নিহত হবার পরও গুলি চলল। আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়তে না পারলে তার সিকিউরিটিদের মতোই তার দশা হতো।
আহমদ মুসা বেঁচে যাওয়ায় দৃশ্যপট পাল্টে গেল! সিকিউরিটির লোকদের হাত থেকে পড়ে যাওয়া একটা রিভলবার তুলে নিয়েছিল আহমদ মুসা। শুয়ে পড়া আহমদ মুসাকে ওরা টার্গেট করার আগেই আহমদ মুসার রিভলবার অবিশ্বাস্য দ্রুততায় চারটি গুলি করেছে। অব্যর্থ লক্ষ্য। চারজনই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিঃশব্দে ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে।
স্বভাবসুলভ সতর্কতায় আহমদ মুসা গুলি করেই পেছনে তাকিয়ে ছিল। দেখল চারটি রিভলবার তাকে লক্ষ্য করে উঠে এসেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়ে ছুটল গাড়ির আড়াল নেয়ার জন্যে। গুলি বৃষ্টিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। আহমদ মুসার দেহটা আগের জায়গায় থাকলে চারটি গুলির অসহায় শিকার হতো।
আহমদ মুসা গাড়ির আড়াল পাওয়ার পর দ্রুত ক্রল করে গাড়ির পেছনে চলে গেল।
ওদের অব্যাহতভাবে হতে থাকা গুলি হঠাৎ থেমে গেল। আহমদ মুসার নতুন লোকেশন ওরা নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করছিল।
আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়ে আবার স্থান পরিবর্তণ করে পাশের গাড়ির আড়ালে চলে গেল।
ওদিকে গুয়েটিন তাদের চারজন লোককে নিহত হতে দেখে এবং অবশিষ্ট চারজন ও আহমদ নামের লোকটি সাপ-নেউলে খেলায় ব্যস্ত হতে দেখে দ্রুত নিচে নেমে কারপার্কিং-এ চলে এল।
ড. ডা বিমূঢ়ভাবে তার নির্দিষ্ট গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছিল।
গুয়েটিন বিড়ালের মতো নিঃশব্দে ছুটে এসে বিমূঢ় ড. ডা’কে বলল, স্যার, আপনি নিরাপদ নন, তাড়াতাড়ি আসুন। এবং সেই সাথে তাকে টেনে নিয়ে পাশের একটা গাড়িতে তুলল। পাশের সিটে তাকে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল গুয়েটিন।
গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দে আহমদ মুসা চমকে উঠে চোখ ফেরাল। দেখল একটা গাড়ি চলতে শুরু করেছে। যে গাড়ির পাশে ড. ডা দাঁড়িয়েছিল, সেখানে তাকে দেখতে পেল না। চলন্ত গাড়ির দিকে তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না, গাড়িতে শেডওয়ালা কাঁচ। গাড়ির নাম্বার প্লেটের উপর নজর পড়ল, গাড়ি সরকারি নয়। তাহলে? মি. ডা কি হাইজ্যাক হলেন? উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। এবার গোটা কারপার্কিং তার নজরে এল। দেখল, ও প্রান্তে দাঁড়িয়ে যারা তাকে গুলি করছিল তারা গাড়ির পেছনে ছুটে বেরিয়ে গেল। বাইরে গিয়ে ওরাও গাড়িতে উঠবে।
উপর থেকে একদল সিকিউরিটি ছুটে এসে কারপার্কিং-এ প্রবেশ করল।
ড. ডা কিডন্যাপ হয়েছেন। ছুটে আসা সিকিউরিটিদের উদ্দেশ্যে একথা বলেই আহমদ মুসা পাশের ল্যান্ড ক্রুজার জীপে উঠে বসল।
আহমদ মুসার গাড়ি কারপার্কিং হলের দরজা পর্যন্ত পৌঁছলে বাইরে ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ পেল। হাসল আহমদ মুসা। নষ্ট হলো গুলিগুলো। নিশ্চয় হাইজ্যাকার গাড়ি এতক্ষণে গুলির রেঞ্জের বাইরে চলে গেছে।
এদের গুলি করতে দেরি হলো কেন? নিশ্চয় বুঝতে ওদের দেরি হয়েছিল। কেন?
আহমদ মুসার গাড়ি কারপার্কিং থেকে বেরিয়ে এসেছে। বেপরোয়া তার গাড়ির। গাড়ির ইমারজেন্সি এলার্ম বাজিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা। পুলিশ সিকিউরিটির লোকরা রাস্তা থেকে সরে দাঁড়িয়ে পথ করে দিচ্ছে। শেষ এক্সিটে এসে দাঁড়াতে হলো তার গাড়িকে। এই শেষ এক্সিটটার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনা অফিসাররা। তারা আহমদ মুসার গাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামতে বলল।
নামল আহমদ মুসা।
স্টেনগান বাগিয়ে আহমদ মুসাকে ঘিরে ফেলল সেনা অফিসাররা। বলল, সব আইন-কানুন ভেঙে এভাবে ছুটছেন কেন? কে আপনি?
আগের গাড়িটা ফলো করছি। ড. ডা’কে কিডন্যাপ করা হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক নয়। আগের গাড়িটা একজন সিকিউরিটি কর্মকর্তার। গাড়িতে চারজন যারা ছিল তারাও সিকিউরিটির লোক। তবু গাড়িটা আমরা সার্চ করেছি। ভুল করে সে গাড়ি লক্ষ্যে গুলি চালানো হয়েছিল। একজন সেনা অফিসার বলল।
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল ভেবে বলল, আপনারা কি গাড়ির ইনার রুফ দেখেছিলেন?
সেনা অফিসাররা কথা বলল না। পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এই সময় একজন ঊর্ধ্বতন অফিসার ছুটে এল। বলল সেনা অফিসারদের সরে দাঁড়াতে। বলল, ইনি মি. আহমদ। আমাদের মহান চীনের একটা প্লেন ও ড. ডা’কে বাঁচিয়েছেন।
আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, এভাবে আপনি কোথায় যাচ্ছেন স্যার?
আহমদ মুসা ড. ডা কিডন্যাপ হওয়ার কথা বলল। ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসার হাসল। বলল, উনি কিডন্যাপ হননি। ওখানেই কোথাও লুকিয়েছেন। খোঁজা হচ্ছে। তবু আপনি চাইলে এগিয়ে দেখতে পারেন।
কি দেখব? অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি। বলল আহমদ মুসা।
ভাববেন না, সে যাচ্ছে একটা জরুরি কাজ নিয়ে। তার গাড়ি আমাদের স্যাটেলাইট ট্রাকিং-এ রেখেছে। গাড়িটা কিংদাও জিবো হাইওয়ে ধরে জিবোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারটি বলল।
জিবেরা মানে সুন্দর সুন্দর পাহাড়ী ভিলা, বন-বাগান আর তাও-মন্দিরের শহর জিবেরা? বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন স্যার। সেনা অফিসার বলল।
ধন্যবাদ অফিসার।
ঊর্ধ্বর্তন অফিসারটির উদ্দেশ্যে এই ধন্যবাদ শব্দ উচ্চারণ করলেও তার ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছিল। চোখে-মুখে নেমেছিল চিন্তার ছায়া। যদি ঐ গাড়িতে ড. ডা নাই থাকেন। তাহলে তো তাদের আমাকে বাধা দেবার কথা? কিন্তু তা না করে আমাকে গাড়িটার পেছনে ঠেলে দিলেন কেন? আর গাড়িটাকে ট্রাকিং-ই বা করা হচ্ছে কেন? সেনা অফিসারটি কি ঠিক আছেন?
এসব চিন্তার মধ্যেই আহমদ মুসা গাড়ি আবার স্টার্ট দিল। চলতে লাগল গাড়ি।
রিয়ার ভিউতে আহমদ মুসা দেখল, ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারটি একটা ছোট্ট অয়্যারলেস মুখের কাছে তুলে নিয়েছে। তার মুখে বিজয়ের মতো খুশির হাসি।
আহমদ মুসার চোখ-মুখের বিস্ময়ের ছায়াটা আরও গম্ভীর হলো।
এয়ার পোর্টের বাইরে বেরিয়ে এল আহমদ মুসার গাড়ি।
মন থেকে সকল চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আহমদ মুসা সামনের দিকে মনোযোগ দিল। ল্যান্ড ক্রুজার জীপটি নতুন। পাওয়ারফুল তার ইঞ্জিন। হাইওয়েতেও তেমন গাড়ি নেই। ঝড় তুলে এগিয়ে চলল গাড়ি।
প্রায় এক ঘন্টা। সমান গতিতে এগিয়ে চলছে গাড়ি। সামনের গাড়ির দেখা নেই। নিশ্চয় এই গতিতে সামনের গাড়িটা চলছে না।
সামনের গাড়ি ও আহমদ মুসার গাড়ির মধ্যে চলা শুরু করার দূরত্বটা সব মিলিয়ে পনেরো মিনিটের বেশি নয়। এই দূরত্বটা ইতিমধ্যে কভার হবার কথা। তাহলে কি সামনের গাড়িটা ডান-বামের অন্য কোনো ডেস্টিনেশনে যেতে পারে? সেটা হয়নি। ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারটি যা বলেছেন সেটাই ঠিক। দেখা যাক।
আহমদ মুসার গাড়ি ছুটে চলছেই। আরও কিছুটা পথ এগোলো।
আহমদ মুসার সন্ধানী দৃষ্টির সামনে পশ্চিমের দিগন্তে একটা গাড়ির অবয়ব ভেসে উঠল। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো। হ্যাঁ, এটা সেই গাড়িই। খুশি হলো আহমদ মুসা।
আবার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল গাড়িটা। সামনের এলাকাটা উঁচু-নিচু। রাস্তা ও টিলার আড়ালে গাড়িটা হারিয়ে গেল। যতই সামনে এগোলো, উঁচু নিচু অবস্থা, টিলার উচ্চতা বাড়তে লাগল।
জিবেরা শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেল আহমদ মুসার গাড়ি। পাহাড় ঘেরা শহর জিবেরা।
স্যাটেলাইট ছবিতে কতকটা আনমনে জিবেরা শহরের ভেতরের দৃশ্য দেখেছে। শহরটাও উঁচু-নিচু, নানা রকম টিলায় ভরা। শহরের বাড়িগুলো টিলায় অথবা সমতলে তৈরি। বলা যায়, প্রত্যেক বাড়ির চারদিকেই বাগান অথবা উন্মুক্ত স্পেস। অধিকাংশ বাড়িই প্রাচীর ঘেরা।
শহরে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ি। শহরে ঢুকতে গিয়ে রিয়ার ভিউতে নজর পড়তেই দেখতে পেল একটা গাড়ি আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে। শহরের উপকণ্ঠ থেকেই গাড়িটাকে দেখছে আহমদ মুসা তার। পেছনে। এই একই দূরত্বে গাড়িটা আহমদ মুসার পেছনে আসছে।
গাড়ির ইঞ্জিন দেখার ভান করে আহমদ মুসা মিনিট পাঁচেক সময় নষ্ট করল। দেখল আহমদ মুসা পেছনের গাড়িটাও গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিলে, সে গাড়িটাও স্টার্ট নিয়ে আহমদ মুসার পেছনে আসতে লাগল।
খুশি হলো আহমদ মুসা। গাড়িটা তাকে ফলো করছে, এ সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ নেই। খুশি হলো, কারণ আগের টার্গেট গাড়িটাকে সে হারিয়ে ফেলেছিল। পেছনের ফলো করে আসা গাড়িটা যেহেতু ওদের তাই টার্গেটকৃত গাড়িওয়ালাদের কাছে পৌঁছার একটা মাধ্যম পেয়ে গেল সে।
লক্ষ্যহীনভাবে এগোচ্ছিল আহমদ মুসার গাড়ি।
সামনের গাড়ি সে হারিয়ে ফেলেছে। এভাবে গাড়ি খোঁজা নিরর্থক। এখন ভরসা পেছনের গাড়িটা। গাড়িটাকে অনুসরণ করার কৌশলই তাকে নিতে হবে।
আহমদ মুসা একটু খোঁজাখুঁজি করে স্থানীয় ধরনের একটা আবাসিক হোটেলের কাছে তার গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ি থেকে নেমে আহমদ মুসা হোটেলের ভেতরে ঢুকে গেল। একটা রুম রিজার্ভ করে লিফটে উপরে উঠে গেল সে। উঠেই আবার অন্য সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে লাউঞ্জের এক প্রান্তে বসল।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ছিপছিপে গড়নের স্টিলবডি একজন যুবক দ্রুত কাউন্টারে এল। কি যেন বলল। কাউন্টারের লোকটি দ্রুত কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে শশব্যস্তে কি কি বলল।
যুবকটি খুশি হয়ে কাউন্টারের লোকটিকে বেশ কিছু কথা বলল। কিছু যেন বুঝিয়ে দিল তাকে। ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল কাউন্টারের লোকটির চোখে-মুখে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
যুবকটি গোটা লাউঞ্জের উপর একবার চোখ বুলিয়ে হোটেল থেকে বেরুবার দরজার দিকে এগোলো।
বেরিয়ে গেল যুবকটি হোটেল থেকে। আহমদ মুসাও স্বাভাবিকভাবে হেঁটে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল।
সে পেছনে তাকালে দেখতে পেত আহমদ মুসা হোটেল থেকে বেরুবার সাথে সাথে কাউন্টারের সেই লোকটি তার মোবাইল তুলে নিল মুখের কাছে। তার চোখে-মুখে শশব্যাস্ত ও ভীতির চিহ্ন।
আহমদ মুসা বেরিয়ে আসা যুবকটিকে গাড়িতে উঠতে দেখল। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, এতক্ষণ তো তার গাড়ি চলতে শুরু করার কথা। দেরি। করল কেন? মনের এক কোণে সন্দেহের একটা মেঘ মাথা তুলল।
সেই যুবকটির গাড়ি তখন চলা শুরু করেছে। আহমদ মুসার গাড়িও চলতে শুরু করল। একই গতিতে চলছিল যুবকটির গাড়ি, বলা যায় অলস গতি। যেন হাওয়া খেতে বেরিয়েছে।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। যুবকটি সম্পর্কে যা সে মনে করছে, তা কি ঠিক নয়?
শহরটি সুন্দর। ব্লকে ব্লকে বাড়ি। রাস্তাগুলো ঢেউ খেলানো। একবার ভেসে উঠা, আবার ডুবে যাওয়া।
শহরের রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, ফুটপাতে মানুষ যথেষ্ট। যুবকটির গাড়ি ফলো করে যাওয়া যথেষ্ট কষ্টকর। গাড়িটাকে নজরে রাখতে সমস্যা হচ্ছে আহমদ। মুসার।
আহমদ মুসাদের গাড়ি শহরের উত্তরের উঁচু অংশে চলে এল। এ অংশে বাড়িঘর আরও কম। বলা যায় প্রত্যেক বাড়িই সুপরিসর ও বাগান ঘেরা অথবা উন্মুক্ত চত্বর ঘেরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাচীর ঘেরা নয়। কোথাও কোথাও বাগান-চত্বর দেড়-দুই ফুট সুদৃশ্য বেড়া দিয়ে ঘেরা। এখানে সেখানে প্রাকৃতিক বনও আছে। বনের মধ্যে রয়েছে বাড়ি-ঘর।
এ রকম একটা বনের মধ্য দিয়ে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি সেই যুবকটির গাড়িটাকে অনুসরণ করে। তার বামপাশে একটা দুতলা বাড়ি, আর ডান পাশে একটা তিনতলা বাড়ি।
দুপাশের উপর নজর বুলাতে গিয়ে তার গাড়িটা একটু স্লো হয়ে পড়েছিল।
সামনে তাকাল আহমদ মুসা। বিস্মিত হলো সে, সামনের গাড়িটা দেখা যাচ্ছে না। দ্রুত সামনে এগোলো, কিন্তু সামনে কেউ নেই। সামনে বহু দূর দেখা যায়, কিন্তু গাড়িটা নেই। ভালো করে চারদিকটা দেখতে গিয়ে ছোট বড় কয়েকটি এন্ট্রান্স দেখতে পেল। তাহলে সে কি ঢুকে গেছে কোনো একটা বাড়িতে?
গাড়ি ব্যাক করছিল আহমদ মুসা।
দুতলা সেই বাড়িটার সামনে তার টার্গেট সেই গাড়িটাকে দেখতে পেল।
খুশি হলো আহমদ মুসা। ভাবল তাহলে ঐ যুবকটি এ বাড়িতেই প্রবেশ করেছে। আর এ বাড়িতেই নিশ্চয় ড. ডা’কে পাওয়া যাবে।
বাড়িটার দিকে আবার ফিরে তাকাল আহমদ মুসা,। বাড়িটা দুতলা, কিন্তু অনেকটাই দুর্গের মতো। বাড়িটার সামনেসহ তিনদিকে বাগান-বন থাকলেও পেছনটা উন্মুক্ত চত্বর। চত্বরটার পর গাছ-গাছড়ায় ঘেরা টিলার উপর একটা প্রাসাদের মতো বাড়ি।
গাড়িটা দুতলা বাড়ির পেছনের চত্বরেই থাকার কথা, কারণ। আত্মগোপনের এটাই ছিল ভালো জায়গা। তাহলে সামনে কেন? তাহলে তাকে ফলো করা হয়েছিল যে কারণে, যে কারণে তাকে ফলো করা গাড়ির যুবকটি হোটেল পর্যন্ত পৌঁছেছিল এবং চেয়েছিল আমি তাকে ফলো করি, সেই কারণেই কি গাড়িটা চোখে পড়ার মতো স্থানে রাখা হয়েছে? তবে আহমদ মুসার কাছে শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে উঠল ড. ডা.-কে উদ্ধার এবং কিডন্যাপারদের ঠিকানায় পৌঁছার আনন্দ।
আবার তাকাল আহমদ মুসা গাড়ির দিকে। দেখল, গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। বাড়ির উত্তর দিক ঘুরে গাড়িটা চলল পশ্চিমের চত্বরের দিকে।
আহমদ মুসা আর দেরি করল না।
গাড়িটা রাস্তার পাশে একটা ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামল। দ্রুত এগিয়ে আইরন ওয়্যারের বেড়া পার হয়ে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। বাড়িটার আড়াল নিয়ে সে চত্বরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
চত্বরটার প্রান্তে গিয়ে আড়াল থেকে উঁকি দিল চত্বরের দিকে। দেখল, একজন গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। লোকটি আগের দেখা সেই যুবকটির মতোই। মেদহীন ঋজু শরীর। ইস্পাতের মতো পেটা।
এক ঝটকায় আহমদ মুসা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে লোকটির সামনে দাঁড়াল।
লোকটির হাত থেকে কাগজটি পড়ে গেল। সে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে বিস্ময় কিংবা চাঞ্চল্য নেই।
কাগজটি তার হাত থেকে পড়ে যাবার সাথে সাথেই তার হাত বিদ্যুৎ বেগে হাতুড়ির মতো ছুটে এল আহমদ মুসার মুখ লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা তার চেয়ে দ্রুতগতিতে মাথা নিচে নামিয়ে রক্ষা পেল। আহমদ মুসা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না রাখলে মাথাটা সে বাঁচাতে পারতো না।
বেঁচে গিয়েই আহমদ মুসা মাথা তুলল। সেই সাথে তার খোলা ডান হাত কুড়োলের মতো ছুটে গিয়ে লোকটির মাথার বাম পাশটায় আঘাত করল তার। বাম কানের ঠিক নিচে।
লোকটি প্রথম আঘাত ব্যর্থ হবার পর হাত টেনে নিয়েছিল দ্রুত দ্বিতীয় আঘাত করার জন্যে। কিন্তু সেই সুযোগ সে পেল না। তার হিসাবের বাইরে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল।
মুহূর্তেই লোকটির দেহ একবার টলে উঠেই খসে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা লোকটির দিকে একবার তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বাড়িতে প্রবেশের জন্যে। ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল কয়েকজন লোক ছুটে এসে তাকে ঘিরে ফেলেছে।
সংখ্যায় ওরা পাঁচজন। পাঁচজন একই রকমের। একই ধরনের শরীরের গঠন তাদের। আহমদ মুসা বুঝল চীনের বিখ্যাত সব মার্শাল আর্টের কোনো একটার এরা সদস্য।
আহমদ মুসা সতর্ক হলো। বুঝল অতীতের চেয়ে মোকাবিলার এক নতুন। জগতে সে আজ। ভাবল চীনের মার্শাল আর্টের শত শত বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের কথা।
ওরা বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলেছিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসার ভাবনা শেষ হতে পারলো না।
বৃত্ত থেকে একজন প্রায় উড়ে এসে আহমদ মুসার সামনে পড়ল। মাটিতে পড়ার আগে তার ডান পা আহমদ মুসার কণ্ঠনালি লক্ষ্যে হাতুড়ির মতো ছুটে এল।
আহমদ মুসার দেহের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্র ছিল হাই এলার্টে।
আহমদ মুসা তার কোমর পর্যন্ত অংশকে লম্বের মতো ঋজু রেখে দেহের উপরের অংশকে চোখের পলকে ডান দিকে বাঁকিয়ে নিল।
লোকটি আহমদ মুসাকে আঘাত করতে ব্যর্থ হওয়ায় তার পিঠটা মাটিতে গিয়ে আছড়ে পড়ল।
পরক্ষণেই দ্বিতীয় আঘাত এল আহমদ মুসার উপর।
বৃত্ত থেকে আরেকজন তার দেহটাকে চক্রাকারে ঘুরিয়ে দুই পা সাঁড়াশির মতো ছুঁড়ে দিল আহমদ মুসার কণ্ঠনালি লক্ষ্যে। দুই পায়ের এই বিপজ্জনক সাঁড়াশি আঘাত এক মোচড়ে ভেঙে দিতে পারে যেকোনো শক্তিমানের কণ্ঠদেশকে মুহূর্তেই।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই এই বিপদের সম্মুখীন হলো। চিন্তার সময় পেল না আহমদ মুসা। স্বয়ংক্রিয় এক নির্দেশে মনে হলো মটকানোর হাত থেকে ঘাড় বাঁচাতে হবে।
বাঁচাবার জন্যেই আহমদ মুসা আবার কোমর পর্যন্ত দেহের নিচের অংশটা স্থির রেখে মাটির সমান্তরালে দেহটা রুকুর মতো বাঁকিয়ে নিল। তার পর মুহূর্তেই উড়ে আসা দেহটির একটা অংশ আহমদ মুসার বাঁকানো দেহের উপর আছড়ে পড়ল। তার সাঁড়াশি হয়ে আসা দুই পা টার্গেট না পাওয়ায়। দেহ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল।
আহমদ মুসার উপর এসে পড়া দেহের অংশটা গা থেকে গড়িয়ে পড়লে আহমদ মুসা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। নতুন কিছু ভাববার আগেই আহমদ মুসা দেখতে পেল বাঁ দিক থেকে দুজন ছুটে আসছে তার দিকে। দুজনের। হাতেই ভয়ংকর দুটি চাইনিজ ড্যাগার।
দুজন একসাথে ছুটে আসছিল সমান্তরালে। তাদের মধ্যে দূরত্ব এক ফুটের বেশি নয়।
আহমদ মুসা প্রস্তুত। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে। পায়ের পাঁচ আঙুলের। উপর ভর দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা। ওরা ফুট পাঁচেক দূরে তখন। আহমদ মুসার মাথা নিচের দিকে ছুটে গেল। তার দেহটা ওদের সমান্তরালে তীরের মতো তীব্র গতিতে এসে ছুটে আসা লোক দুজনের পা চারটিতে আঘাত করল। পাগুলো মাটি থেকে ছিটকে গেল। মাটিতে আছড়ে পড়ল ওদের দেহ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াবার আগেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বৃত্তের শেষ লোকটি। তার বাঁকানো দুপায়ের জোড়া গোড়ালি সূঁচালো হ্যাঁমারের মতো বিরাট ওজন নিয়ে ছুটে এলো আহমদ মুসার বুক লক্ষ্যে।
শেষ ব্যবস্থা হিসেবে আহমদ মুসা দুই হাত জোড় করে লোকটির জোড়া গোড়ালিকে সর্বশক্তি দিয়ে উপরের দিকে পুশ করল। আকস্মিক এই প্রবল বাধায় লোকটির দেহ প্রিং মতো করে আহমদ মুসার পেছনে পড়ে গেল। তার পা দুটি আহমদ মুসার পায়ের উপর পড়ল।
অন্য লোকেরা তখন উঠে দাঁড়িয়ে আবার ঘিরে ফেলতে শুরু করেছে তাকে।
আহমদ মুসা প্রিং-এর মতো উঠে দাঁড়িয়ে লোকটির দুই পা ধরে। ঘুরানো শুরু করল প্রচণ্ড বেগে।
লোকগুলো, যারা আহমদ মুসাকে ঘিরে ফেলছিল, তারা বেকায়দায় পড়ে গেল।
কিন্তু দেখা গেল, শীঘ্রই তারা একসাথে হয়ে জোটবেঁধে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা তিল পরিমাণ সময়ও নষ্ট করল না। ঘূর্ণায়মান লোকটির দেহকে তীব্র বেগে ছুঁড়ে দিল জোট বেঁধে দাঁড়ানো ওদের উপর।
ওদের পাঁচটি দেহই পড়ে গেল মাটিতে।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চিৎকার করে। বলল, কেউ মাটি থেকে ওঠার চেষ্টা করবে না। এতক্ষণে জেনেছ নিশ্চয়, আমি যা করতে পারি না, তা বলি না।
আহমদ মুসা দেখতে পায়নি যখন সে ঘূর্ণায়মান দেহটাকে জোটবদ্ধ লোকদের দিকে ছুঁড়ে মারছিল, তখন বাড়ি থেকে একজন লোক বেরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে আসছিল আহমদ মুসার দিকে। তার হাতে লোহার সলিড একটা বার। আহমদ মুসা যখন লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, সেই লোকটি তখন বিড়ালের মতো নিঃশব্দে এসে আহমদ মুসার পেছনে গিয়ে পৌঁছল। লোকটি ডান হাতের আয়রন বার দুই হাতে চেপে ধরল এবং আঘাত করল আহমদ মুসার মাথা লক্ষ্যে।
শেষ মুহূর্তে আহমদ মুসা টের পেয়েছিল।
সে তার মাথা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুরো সফল হলো না। তার মাথার ডান পাজরে প্রচণ্ড আঘাত করল আয়রন বারটি। মাথার ডান পাঁজর ধ্বসিয়ে ডান কান থেঁতলে দিয়ে আঘাতটা গিয়ে পড়ল ডান কাঁধে।
টলে উঠল আহমদ মুসার দেহ। এরপরেই সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল তার দেহ মাটিতে।
এরপর অন্য লোকরা মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল।
তারা পেছন থেকে আঘাতকারী লোকটিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, ঠিক কাজ করেছ চ্যাং। লোকটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাকে ঠিক এভাবে শিক্ষা দেবার প্রয়োজন ছিল। না মেরে ফেলে ভালো করেছ। একে লর্ডের কাছে হাজির করলে তিনি খুব খুশি হবেন। এর পরিচয় জানার পর এর জীবনের সমাপ্তি আসবে।
তার কথা শেষ হতেই বাড়ির পশ্চিম সীমানার দিক থেকে একজন এসে লাফিয়ে পড়ল। তার উড়ন্ত দেহ এসে পড়ল ঐ লোকদের মধ্যে। স্পোর্টস ড্রেস পরা তার মুখ ঢাকা ছিল মুখোশে। চিৎকার করে বলল সে, তোমরা। উড্যাং-এর মার্শাল আর্টের পবিত্র নীতি লংঘন করেছ। শাস্তি তোমাদের প্রাপ্য। বলেই সে চরকির মতো ঘুরে নির্মমভাবে দুই হাত, দুই পা চালাল লোকদের উপর। তার দুই হাতে দেড় দুই ফুট লম্বা দুটি লোহার চেন। মুহূর্তের মধ্যে যেন প্রবল এক ঝড় বয়ে গেল। লোকদের রক্তাক্ত দেহ। মাটিতে লুটোপুটি খেল।
উড়ে আসা সে ছিল একজন মেয়ে, তার মেয়েলী কণ্ঠ থেকে এটা বুঝা গেল। মেয়েটি এগোলো পড়ে থাকা সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসার দিকে। পাঁজাকোলা করে তুলে নিল আহমদ মুসাকে। এগিয়ে গেল কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির দিকে।
গাড়িতে আহমদ মুসাকে তুলল। নিজে গিয়ে বসল ড্রাইভিং সীটে। গাড়ি স্টার্ট নিল। গাড়িটি চলল বাড়ি থেকে বেরোবার জন্যে গেটের দিকে।
মুখোশ পরা মেয়েটির চলাফেরা, অ্যাকশন সবই একজন চৌকস সৈনিকের মতো। শক্তি ও শৌর্য যেন ঠিকরে পড়ছে তার দেহ থেকে।
গেট থেকে বের হয়ে টার্ন নেবার সময় মুখোশধারী মেয়েটি পেছন ফিরে আহমদ মুসাকে দেখল। তার মুখটি মুখোশে ঢাকা ছিল বলে তার মুখের ভাব দেখা গেল না।
.
দুই হাতে ঠেস দিয়ে বিছানায় উঠে বসতে চেষ্টা করল আহমদ মুসা। পারল না। মাথাটা দারুণ ভারি।
আঘাতটার কথা মনে পড়ল আহমদ মুসার। মনে হয়েছিল মাথায় পাঁজরটা যেন ধ্বসে গেল। মাথাটা ঐটুকু সরিয়ে নিতে না পারলে চৌচির হয়ে যেত তার মাথা। আঘাতের পর কি ঘটেছে সে জানে না।
যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সে এই বিছানায়।
দুগ্ধ সফেন শয্যা, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ঘর। আহমদ মুসার মনে হয়েছিল কোনো ভালো হাসপাতালের কক্ষ এটা। পরে তার এ ভুল ভেঙে যায়।
সংজ্ঞা ফিরে পাবার পর এদিক-ওদিক চাইতে গিয়ে দেখতে পেল তার বেডের পাশে চেয়ারে বসে বেডে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে একটা মেয়ে। তার হাতে ধরা তখনও একটা বই। পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়। সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসার অ্যাটেনডেন্টের দায়িত্ব পালন করছে কি মেয়েটা? মনে প্রশ্ন জাগে আহমদ মুসার।।
মেয়েটার হাতের বইটা দেখে অনেকটা অবাক হল। একজন সংজ্ঞাহীনের পাশে বসে মানুষের ইতিহাস পড়ছে মেয়েটা! একটা অস্থির সময়ে তো এমন ভারি বই মানুষ পড়ে না!
মেয়েটা বেকায়দা অবস্থায় ঘুমে ঢলে পড়েছিল বিছানায়। বিছানায় উপুড় হয়ে পড়লেও মুখটা ডান পাশে ঘুরানো অবস্থায় ছিল।
ঘুমন্ত অবস্থায় তার মুখ বাম পাশে ফেরাল মেয়েটি।
মুখ দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। এতো বিমানে দেখা সেই মেয়ে। কথাও হয়েছিল তার সাথে। অনেকের মধ্যে তাকে স্বতন্ত্র মনে হয়েছিল। সে এখানে? সে তাকে পেল কি করে? পেছন থেকে মারাত্মক আঘাত পাওয়ার পর সে ওখানেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। সে তো ওদের হাতে মানে শত্রুর কবলে থাকার কথা। মেয়েটা কী শত্রুপক্ষের? না, তা হবে কি করে? বিমানে তাকে তো উল্টো পরিচয়েই সে দেখেছে। তাছাড়া সে শত্রুপক্ষের হলে এমন। সুন্দর অবস্থায়, এত সুন্দর পরিবেশে তার থাকার কথা নয়।
ডান কাত হয়ে আবার ঠিকঠাকভাবে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। ক্লান্তিতে চোখ বুজল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল যে তিনি তাকে শত্রুর হাত দিয়ে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে তা ঘটল?
এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল আহমদ মুসা।
কোনো বৌদ্ধ প্যাগোড়া থেকে রাত্রি চতুর্থ প্রহরের ঘন্টা বাজল, অনেকটাই যেন ক্লান্ত সুরে। রাতের নিঃসীম নীরবতার মধ্যে সে ক্লান্ত সুরটাই জেগে উঠা জীবনের গানের মতো শোনাল।
ঘুম থেকে জেগে উঠল মেয়েটি।
চোখ মেলে চেয়েই ধড়মড় করে উঠে পড়ল মেয়েটি। একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে, আবার তাকাল মনিটরের স্কীনের দিকে। মনিটরে আহমদ মুসার ব্লাড প্রেসার, হার্টবিট ইত্যাদির সার্বক্ষণিক ডিসপ্লে উঠছে।
ডিসপ্লের উপর নজর পড়তেই মেয়েটির মুখে বিস্ময় ও আনন্দের আলো ফুটে উঠল। আহমদ মুসার ব্লাড প্রেসার ও হার্টবিট স্বাভাবিক এবং তার সেন্স-লেভেল বিস্ময়করভাবে পজিটিভ।
মেয়েটি আবার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। সেন্স-লেভেল পজিটিভ হলো কি করে? ডাক্তার ম্যাডাম গতকাল থেকেই বলছেন, আঘাতটা মারাত্মক। কমপক্ষে ৭২ ঘন্টা না গেলে তার সংজ্ঞা ফেরা সম্পর্কে কিছুই বলা যাবে না। তাহলে ২৪ ঘন্টার আগেই সেন্স-লেভেল পজিটিভ হয় কি করে! তাছাড়া সেন্স-লেভেল পজিটিভ হলে তার জ্ঞান ফিরে আসেনি কেন?
মেয়েটি তাড়াতাড়ি পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল করল ডাক্তারকে। ডাক্তার ম্যাডাম মিং হুয়া।
মেয়েটি জানাল আহমদ মুসার অবস্থার কথা।
আমি এখনই আসছি ম্যাডাম লুঝি। ওপার থেকে বলল ডাক্তার মিং হুয়া।
প্লিজ, আসুন তাড়াতাড়ি। আমার ভয় করছে। প্লিজ আসুন। বলল লু ঝি।
ভয় নেই। দরকার হলে তাকে হাসপাতালে শিফট করব আজই। ডা, মিং হুয়া বলল।
না ড. ম্যাডাম, ওঁকে হাসপাতালে নিতে চাই না। আবার সে আক্রান্ত হতে পারে। বলল লু ঝি।
কি বলছেন ম্যাডাম লু ঝি? আপনি না কিন শিং হুয়াং-এর মেয়ে? তার উপর আপনি চীনের চারটি মার্শাল আর্টের চারটি ব্ল্যাকবেল্টধারী। আপনাকেই তো সবাই ভয় পাবার কথা। আপনি কাকে ভয় করবেন?
কিন শিং হুয়াং চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। চীনা ইতিহাস বিশেষ করে প্রাচীন চীনা ইতিহাস বিভাগের তিনি প্রধান। মনে করা হয়, তিনি চীনের প্রথম লেজেন্ডারি ডেমিগড অধিপতি কিন শিং হুয়াং-এর বংশধর। তাঁর নামেই তার নাম। ইনিই লু ঝি’র পিতা। জিবেরা শহরের এই বাড়িটা কিন শিং হুয়াং পরিবারের আদি বাড়ি। খামার বাড়ি হিসাবে বাড়িটা এখন ব্যবহৃত হয়। শীতকালের বেশির ভাগ সময় হুয়াং পরিবার এখানেই কাটান। মি. হুয়াং এই শান্ডং প্রদেশেরই একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি।
সমস্যা আছে ডাক্তার ম্যাডাম। রাস্তায় তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। এঁকে মেরে ফেলাই তাদের টার্গেট ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। আবার তিনি আক্রান্ত হতে পারেন। বলল লু ঝি নামের মেয়েটি।
ইচ্ছা করেই কিছু কথা চেপে যায় লু ঝি। আহমদ মুসা, বিমান হাইজ্যাক ঠেকিয়েছিলেন, ড. ডা’কে রক্ষা করেছিলেন- এসব কথা লু ঝি ডাক্তার মিং হুয়াকে বলল না।
ঠিক আছে আমি আসছি ম্যাডাম লুঝি। চিন্তা নেই, আপনি যে খবর দিলেন, তাতে হাসপাতালে নেবার প্রয়োজন নাও হতে পারে। ডা. মিং হুয়া বলল।
ধন্যবাদ, আসুন ম্যাডাম। বলল লু ঝি। মিনিট দশেকের মধ্যেই ডাক্তার এসে পৌঁছল লু ঝি’র বাড়িতে।
বিশাল বাড়ি। একমাত্র লু ঝি ও তার সেক্রেটারি চাও ঝিং ছাড়া বাড়ির সদস্যদের কেউ এখন নেই বাড়িতে। গৃহকর্মীরাই বাড়ির তত্ত্বাবধান করে সব সময়।
তার বিশাল বাড়ির এক প্রান্তের একটা অংশ এককভাবে লু ঝি’র। তার পিতা, মাতা ও লু ঝি’র প্রাইভেট স্টাফ ছাড়া এ অংশে প্রবেশের কারও অনুমতি নেই। সবার চোখের আড়ালে লু ঝি আহমদ মুসাকে-এখানেই নিয়ে এসেছে। লু ঝি জাপান থেকে বেইজিং ফিরেছে গতকাল। যাবার কথা ছিল। বেজিং-এ। কিন্তু জিবেরায় যুব কম্যুনিস্ট আন্দোলনের একটি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে কয়েকদিনের মধ্যে জিবেরাতে থেকে গেছে লু ঝি।
লু ঝি নিয়ে এল ডাক্তারকে আহমদ মুসার কাছে। ডাক্তার মিং হুয়া লু ঝিকে ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসাকে পরীক্ষা করতে লেগে গেল।
লু ঝি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ডাকল প্রাইভেট সেক্রেটারি চাও, ঝিংকে। বলল, ওষুধ আনতে একটু বেশিই যেন দেরি হলো চাও ঝিং?
হ্যাঁ ম্যাডাম। দোকানের সেলস সেকশনটা ব্যস্ত ছিল। কয়েকজন দোকানে গিয়েছিল। তারা সেলস রেকর্ড দেখছিল। তাই একটু অপেক্ষা করছিলাম। চাও ঝিং বলল।
কয়েকজন মানে বাইরের কেউ দোকানের রেকর্ড দেখছিল? কেন? বলল লু ঝি।
ওরা চলে গেলে আমি ওষুধটা নিয়েছিলাম। দোকানিরাই বলছিল যে, ব্যান্ডেজ ম্যাটেরিয়াল কেউ এখান থেকে কিনেছে কিনা, এটা দিয়ে ওরা কি করবে বুঝলাম না। চাও ঝিং বলল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো লু ঝি’র। মনে মনে বলল, সর্বনাশ আহমদ নামের এই লোকটিকেই ওরা নিশ্চয় খোঁজ করছে! সাংঘাতিক লোক তো ওরা! মি. আহমদকে ধরার জন্য ওরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।
উদ্বেগ ফুটে উঠল লু ঝি’র চোখে-মুখে। বলল, ব্যান্ডেস ম্যাটেরিয়ালস, ওষুধ তো তুমি ওখান থেকেই কিনেছিলে। ওরা সে রেকর্ড দেখেছে নিশ্চয়?
না ম্যাডাম, তাড়াহুড়া করে সেসব নিয়ে এসেছিলাম, তখন ওরা মেমো দেয়নি, লিখতে পারেনি। তাই ওসবের কোনো রেকর্ড ওদের কাছে ছিল না। চাও ঝিং বলল।
ওকে ঝিং।
বলে ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে লু ঝি বলল, দেখি ওদিকে ডাক্তারের কাজ কতটা হলো।
লু ঝি গিয়ে দাঁড়াল ডাক্তার মিং হুয়ার পাশে।
আহমদ মুসাকে পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষার যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
লু ঝি পাশে এসে দাঁড়ালে ডা. মিং হুয়া তার দিকে ফিরে বলল, সুখবর ম্যাডাম লু ঝি। আপনার অতিথি জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন। তিনি ঘুমিয়ে আছেন। এখন।
জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন! থ্যাংকস গড। বলল লু ঝি।
আমি অবাক হয়েছি ম্যাডাম লু ঝি। কোনো প্যাশেন্টের অবস্থা নিয়ে এমন অবাক কখনও হইনি। আমি…।
ডাক্তার মিং হুয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়ে লু ঝি বলে উঠল, কি ঘটেছে এমন ডাক্তার ম্যাডাম?
আমি বলেছিলাম না, ৭২ ঘন্টা পর বলা যাবে আপনার অতিথির জ্ঞান। কখন ফিরবে। তার মাথার আঘাত এতটাই মারাত্মক ছিল যে বড় ধরনের অপারেশন ছাড়া তার জ্ঞান ফেরা অসম্ভব। সেই কারণেই তাকে হাসপাতালে নেয়ার কথা বলেছিলাম। মনে করেছিলাম, এখন দেখার পর করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেব। কিন্তু আশ্চর্য, বিস্ময়করভাবে সে রিকভার করেছে। তার সংজ্ঞা ফিরে এসেছে। ডা. মিং হুয়া বলল।
লু ঝি’র চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, এমন কি সম্ভব? কীভাবে সম্ভব হলো?
ম্যাডাম লু ঝি, আপনার অতিথির ব্লাড প্রেশার, পালস থেকে শুরু করে তার সমগ্র স্নায়ু সিস্টেমের রেসপন্স একদম সুস্থ, এত বড় আঘাতের কোনো। চিহ্ন এ সবের কোথাও নেই। এর অর্থ তার মন একেবারে স্থির, একেবারে শান্ত। আঘাতজনিত কোনো টেনশন তার মনে নেই। মনের এই বিস্ময়কর শক্তিই আমি মনে করি তার আঘাতের অসুস্থতাকে দ্রুত নিরাময় করেছে। ডা. মিং হুয়া বলল।
এমন আঘাতের পর কারও এই স্থিরতা, টেনশনহীনতা কি সম্ভব, বিশেষ করে অবচেতন অবস্থায়? বলল লু ঝি। তার চোখে মুখে বিস্ময়।
সাধারণভাবে এটা সম্ভব নয়। সর্ব অবস্থায় কিন্তু অবচেতন মন। ক্রিয়াশীল। চেতন মন অবচেতন মনের উপর ক্রিয়া করে, আবার অবচেতন মন চেতন মনকে প্রভাবিত করে। কিছু মানুষ আছে, যাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে। মনের উপর, তাদের চেতন মনের মতো তাদের অবচেতন মনও ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। ডা. মিং হুয়া বলল।
কীভাবে এটা সম্ভব? বলল লু ঝি।
এই বিষয়টা আমি জানি না ম্যাডাম লু ঝি। আমি ডাক্তার, এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা দার্শনিকদের কাজ। ডা. মিং হুয়া বলল।
ডা. মিং হুয়া, একটু সরে গিয়ে সোফায় বসে যন্ত্রপাতি ব্যাগে তুলতে লাগল। আর লু ঝি সরে গেল আহমদ মুসার কাছে। বলল ড. মিং হুয়াকে লক্ষ্য করে, তাহলে ম্যাডাম স্বীকার করতে হবে, আমার এই অতিথি সাধারণ। মানুষের মধ্যে পড়েন না।
তাই তো মনে হচ্ছে। আরেকটা কথা ম্যাডাম লু ঝি। আমি আপনার অতিথিকে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি তার শরীরভর্তি, বলা যায় সারা শরীরেই আঘাতের চিহ্ন। অধিকাংশই গুলি লাগার দাগ। এমনটাও খুব বিরল। ডা. মিং হুয়া বলল।
বিস্ময় নামল লু ঝি’র চোখে-মুখে। বলল, একজন বড় যোদ্ধা, কিংবা দুর্ধর্ষ কোনো গোয়েন্দা বা একজন ক্রিমিনালের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক, তাই না ডা. ম্যাডাম? বলল লু ঝি।
বড় যোদ্ধা, দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা কি না জানি না, তবে ক্রিমিনাল নয়। মেডিকেল সায়েন্সে এ নিয়ে কথা আছে, সে থেকেই আমি এ কথাটা বললাম। লু ঝি খুশি হলো ডা. মিং হুয়ার কথায়। তারও মন এমনটাই চাচ্ছে। বিমান হাইজ্যাক ব্যর্থ করে দেবার ঘটনায় লু ঝি তার প্রতি মুগ্ধ। তার মাতৃভূমি চীন মার্শাল আর্টের দেশ, ফাইটারদের ও বীরদের দেশ চার হাজার বছর থেকে। ক্ষিপ্রতা, দুর্ধর্ষতার অনেক ঘটনা সে দেখেছে, জেনেছে। কিন্তু হাইজ্যাকারদের বন্দুক দিয়ে ওদেরই চারজনকে চোখের পলকে হত্যা করার মতো ফিল্মি ঘটনা বাস্তবে সে কখনও দেখেনি। এমন ঘটনার জন্যে অসীম সাহসী, লক্ষ্য অর্জনে বেপরোয়া, নিপুণ লক্ষ্যভেদি ও মৃত্যু ভয়হীন হওয়া এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে মানুষের স্বার্থে সব ধরনের ঝুঁকি নেয়ার মতো বিরল গুণ থাকা প্রয়োজন। এমন গুণ তার অতিথি আহমদ-এর আছে। আহত হওয়ার এত দাগ তার শরীরে? তার মতো স্বচ্ছ, সুন্দর, একহারা গোবেচারা ভদ্রলোকের সাথে এ বিষয়টা ফিট করে না! কে উনি আসলে?
ডা. মিং হুয়ার কথার আর কোনো জবাব না দিয়ে তোলপাড় করা মন নিয়ে লু ঝি আর একটু সরে গিয়ে আহমদ মুসার কোমর পর্যন্ত নেমে আসা কম্বল টেনে বুক পর্যন্ত তুলে দিল।
আহমদ মুসা নড়ে উঠল। পাশ ফিরতে গিয়ে আ করে উঠল যন্ত্রণায়। চোখ খুলে গেল তার। চোখ গিয়ে পড়ল লু ঝি’র উপর। ভ্রু কুঁচকে গেল আহমদ মুসার। ঠিকই তো প্লেনে দেখা সেই মেয়েটিই তো এ! এই মেয়েটিই কি তাকে উদ্ধার করেছে ঐ হিংস্র কিডন্যাপারদের হাত থেকে! কীভাবে? আঘাতের পর সেতো সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল। তাকে ওরাই তো নিয়ে যাবার কথা!
একি মিস আপনি…?
কথা সম্পূর্ণ না করেই থেমে গেল আহমদ মুসা।
লু ঝি। আমি লু ঝি। বলল লু ঝি।
লু চি! লু চি তো চীনের খুব ট্রেডিশনাল নাম। আহমদ মুসা, বলল।
কীভাবে ট্রেডিশনাল হলো? বলল লু ঝি।
কেন, চীনের হান সম্রাট হুই দাই-এর স্ত্রী লু হুর জন্মকালীন নাম এটা। আহমদ মুসা বলল।
আপনি চীনের এতটুকু অতীতকে জানবেন, তাতে আমি বিস্মিত হচ্ছি না। কারণ এ পর্যন্ত দুই ঘটনায় আপনাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে চীনের ইতিহাসের এতটুকু বিষয় আপনি অবশ্যই জানবেন। ধন্যবাদ। আপনি এখন কেমন আছেন? বলল লু ঝি।
আল হামদুলিল্লাহ! ভালো আছি। ধন্যবাদ আপনাদের। আহমদ মুসা বলল।
একটু দূরেই সোফায় বসেছিল ডা. মিং হুয়া।
আহমদ মুসাকে জেগে উঠতে দেখে সেও উঠে এসে আহমদ মুসার পাশে। দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা থামতেই ডা. মিং হুয়া বলল, আপনি মুসলিম? ঈশ্বরের প্রশংসার জন্যে তারা এই আরবি শব্দগুলো উচ্চারণ করে।
আমি ভুল না বুঝলে, মনে হচ্ছে নিশ্চয় আপনি আমার ডাক্তার। ধন্যবাদ আপনাকে। বিস্মিত হচ্ছি, আপনি কি করে আরবি শব্দগুলো জানেন! বলল আহমদ মুসা।
জানব না কেন? ইসলাম তো চীনের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্ম। মুসলমানদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।
ম্লান হাসল আহমদ মুসা। বলল, সবাই কিন্তু এমনটা ভাবে না। অনেকে। তার ভাবনাটা বোধ হয় প্রকাশও করতে চায় না।
হ্যাঁ, তবে সেটা আলোচনার ভিন্ন চ্যাপ্টার। আপনাকে ধন্যবাদ আপনার বিস্ময়কর রিকভারির জন্যে। বলল ডা. মিং হুয়া।
ধন্যবাদ আপনাদের দেবার কথা ম্যাডাম। আহমদ মুসা বলল।
কেউ যদি এক মাসের সুস্থতা একদিনেই পেয়ে যায়, তাহলে তার মধ্যে ডাক্তারের কৃতিত্ব থাকে না। বলতে হবে, সেক্ষেত্রে প্যাশেন্টের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ শক্তিই প্রশংসার পাত্র। বলল ডা. মিং হুয়া।
একটু থেমেই ডা. মিং হুয়া আবার বলল, আপনার মাথায় ভারি ও ভোতা কোনো কিছুর আঘাত পড়েছিল। এসব আঘাত মারাত্মক হয় আশপাশটাকেও আহত করার কারণে। আপনাকে বেশ সময় রেস্টে থাকতে হবে। কিসের আঘাত পেয়েছিলেন আপনি?
মনে হয়েছিল ভারি আয়রন রড জাতীয় কিছু একটার। বলল আহমদ মুসা।
ইস, কি যে অবস্থায় আমরা পড়লাম! আজকের কাগজে দেখলাম, পাশেই একটা বাড়ি থেকে ক্ষত-বিক্ষত সাতটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা ওরা সবাই কোনো মার্শাল আর্ট গ্রুপের সদস্য। ডা. মিং হুয়া বলল।
আজকের কাগজের খবর? আজকের কাগজই তো আমার দেখা হয়নি! বলল লু ঝি।
বলেই ঘর থেকে দ্রুত বাইরে গিয়ে সেক্রেটারি চাও ঝিং-কে আজকের খবরের কাগজ দিতে বলল।
লু ঝি আবার ঘরে প্রবেশ করল।
ডাক্তার মিং উঠে দাঁড়াল। বলল, ম্যাডাম লু ঝি কিছু ওষুধ আমি লিখে দিয়েছি। ওগুলোও খাওয়াতে শুরু করুন। আগের কিছু ওষুধ বাদ দিয়েছি। আমি চলছি।
ধন্যবাদ ম্যাডাম ডক্টর। আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব। লু ঝি বলল।
ডাক্তার মিং হুয়া চলতে শুরু করেছে। লু ঝি হঠাৎ কিছু মনে পড়ার মতো ব্যস্ত হয়ে বলল, ডা, ম্যাডাম, একটা বিষয়।
ডাক্তার মিং হুয়া থমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কি ম্যাডাম লু ঝি? তার চোখে কৌতূহল।
একটা কথা ডাক্তার ম্যাডাম। কিছু লোক এমনকি ওষুধের দোকানে গিয়ে একজন আহত লোকের খোঁজ করছে। আপনার ক্লিনিকে কি তেমন কেউ গিয়েছিল?
ডাক্তার মিং হুয়ার চোখে-মুখে মুহূর্তের জন্যে একটা বিব্রত ভাব দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গেই তার কাছ থেকে উত্তর এল না।
আমাকে বিপদে ফেললেন ম্যাডাম লু ঝি। বিপদ হলো আমি মিথ্যা কথা বলি না।
একটু থামল ডাক্তার মিং হুয়া। থেমেই আবার বলে উঠল, হ্যাঁ, এরকম কয়েকজন আমার ক্লিনিকে এসেছিল। আপনাকে এ কথাটা জানালাম একটা শর্তে।
কি শর্ত? জিজ্ঞাসা লু ঝি’র।
এ কথাটা আর কাউকে বলবেন না। কারণ তারা বলতে কড়া নিষেধ। করে গেছে। ডা. মিং হুয়া বলল।
বলব না ডাক্তার ম্যাডাম, কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন। ওদের কেউ কি আপনার চেনা কিংবা ওরা কি পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা বিভাগের লোক? বলল লু ঝি।
চেনা নয়। ওরা পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা বিভাগের কেউ বলে মনে হয় না। তবে…
তবে বলে থেমে গেল ডাক্তার মিং হুয়া।
তবে কি ডাক্তার ম্যাডাম? বলল লু ঝি।
ওরা ওখানে থাকতেই ওদের কাছে একটা টেলিফোন আসে। টেলিফোনে তাদের একজন বলে, কালো পোশাকে আবৃত মুখোশ পরা মাত্র একজনই এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। পরে ওরা আমাকে বলেছিল, পুলিশরা পর্যন্ত ভীষণ উদ্বিগ্ন। জিবেরার পুলিশ প্রধান নিজে এই টেলিফোন করেছিল। এ ঘটনা থেকেই আমি বুঝেছি ওরা পুলিশের লোক নয়। ডাক্তার মিং হুয়া বলল।
ধন্যবাদ ডাক্তার ম্যাডাম। অনেক ধন্যবাদ। বলল লু ঝি।
ওয়েলকাম বলে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও আবার থমকে দাঁড়াল। বলল, প্রয়োজন নেই তবু বলি ম্যাডাম লু ঝি। আপনার আহত মেহমান নিয়ে আপনার সাবধান হওয়া দরকার। আপনার চেষ্টায় উনি বেঁচে গেছেন। ওকে নিরাপদ রাখাও আপনার দায়িত্ব।
অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার ম্যাডাম। আপনি ঠিক বলেছেন। বলল লু ঝি।
ওয়েলকাম। আসছি আমি। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ডাক্তার মিং হুয়া।
লু ঝি ডাক্তার মিং হুয়ার সাথে বাইরে গেল। একটু পরেই ফিরে এল। লু ঝি ও ডাক্তার মিং হুয়ার মধ্যকার কথা শুনছিল আহমদ মুসা। সংবাদ পত্রে প্রকাশিত সাতজন নিহত হবার খবর ডাক্তার মিং হুয়ার মুখ থেকে শোনার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসার মনে হয়েছিল, ঐ সাতজন অবশ্যই কিডন্যাপার দলের এবং ওরাই তাকে কিডন্যাপ বা হত্যা করতে চেয়েছিল। ওদেরই একজনের আঘাতে সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঐ সাতজনকে হত্যা করে কে বা কারা তাকে উদ্ধার করেছিল? ডাক্তার মিং-এর কথায় আরও জানা গেল কালো পোশাক ও মুখোশে আবৃত মাত্র একজন সাতজনকে হত্যা করে তাকে উদ্ধার করেছে। কে সে? লু ঝি হতে পারে কি? আর পুলিশ প্রধান। কিডন্যাপারদের পক্ষে ওদের হত্যাকারীর সন্ধানে তৎপর হয়েছে কেন? হতে পারে, পুলিশ কিডন্যাপারদের পরিচয় জানে না।
লু ঝি ঘরে ঢুকে আহমদ মুসার দিকে এগোলো।
আহমদ মুসা মাথাটা একটু ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করে বলল, ম্যাডাম লু ঝি, আপনিই তো মৃত্যু অথবা বন্দী হওয়া থেকে উদ্ধার করেছেন আমাকে।
আহমদ মুসার হঠাৎ এই প্রশ্নে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল লু ঝি। একটু পরেই হেসে উঠল। বলল, আপনার মতো লোক এটা ধরে নেবেন তা আমি জানি। কিন্তু বলুন তো আপনি এখানে এই গুন্ডাদের হাতে পড়লেন কি করে?
এরা গুণ্ডা নয়, এরা বড় মাপের কোনো গোপন দল। এরাই তো প্লেন হাইজ্যাক করেছিল এবং ড. ডা-কে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো লু ঝি’র। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ওরাই কি আপনাকে তাড়া করে এখানে এনেছিল? ওদের সাথে কোথায় দেখা হলো আপনার? আপনি তো বিমানবন্দরে ড. ডা’র সাথে পুলিশ ও বিমান কর্তৃপক্ষের মেহমান হয়েছিলেন?
অনেক কথা। তার আগে শুনুন, ড. ডা বিমানবন্দর থেকে আবার কিডন্যাপ হয়েছেন। আমি কিডন্যাপারদের গাড়ির পিছু নিয়ে এখানে এসেছিলাম এবং ওদের ফাঁদে পড়েছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়ার মতো হয়ে গেল লু ঝি’র। সে অনেকটা যন্ত্রের মতো আহমদ মুসার বেডের এক প্রান্তে গিয়ে বসল। বলল, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এই অবিশ্বাস্য ব্যাপার কীভাবে ঘটল? উনি বিমানবন্দর থেকে আবার কিডন্যাপ হতে পারেন কি করে?
আহমদ মুসা ড. ডা’র সাথে নিরাপত্তারক্ষীর পাহারায় পার্কিং লটে এসে গাড়িতে উঠার আগে কীভাবে সে নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা চারজন সন্ত্রাসীকে হত্যা করে, গুলি চলার সময় কীভাবে নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা কয়েকজন ড. ডা’কে ওদের গাড়িতে তুলে নিয়ে পালায়, কীভাবে আহমদ মুসা ওদের পিছু নেয়, কীভাবে বিমানবন্দরে থাকা সেনা অফিসারের পোশাক পরা বড় অফিসার ফাঁদে ফেলার জন্যে আহমদ মুসাকে কিডন্যাপারদের পেছনে জিবেরা শহরের দিকে ঠেলে দেয়- সব কথা সংক্ষেপে জানিয়ে বলল, আমার মনে হয় এরা খুবই শক্তিশালী বিশাল একটা দল, যাদের লোক পুলিশ ও সেনাবাহিনীতেও আছে।
লু ঝি’র চোখ-মুখের বিস্ময় উদ্বেগে পরিণত হয়েছিল। শুকিয়ে গিয়েছিল তার মুখ। বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে মি. আহমদ। আমি বুঝতে পারছি না, নিরীহ একজন প্রত্নতাত্ত্বিক ওদের এত বড় শত্রুতে পরিণত হলো কেন? যে বাড়িতে ওরা আপনার উপর চড়াও হয়েছিল, সে বাড়িতেই কি ড. ডা তখন ছিলেন?
আমি তাই মনে করে ঢুকেছিলাম। তবে এখন আমার মনে হচ্ছে উনি ওখানে ছিলেন না, কারণ ফাঁদের জায়গায় অত বড় শিকারকে রাখা স্বাভাবিক নয়। ফাঁদ পাতা তো সব সময় সফল হয় না। বলল আহমদ মুসা।
ফাঁদ তো আপনি কেটেই ফেলেছিলেন। পেছন থেকে আঘাতের মতো অন্যায় কাজ লোকটি না করলে আপনাকে হারানো ওদের আর সাধ্য ছিল না। লু ঝি বলল।
আপনি এসব কি করে জানলেন? আপনি কি শুরু থেকে ঘটনাটা দেখছিলেন? বলল আহমদ মুসা। তার চোখে বিস্ময়।
হ্যাঁ, আমি বাড়ির ছাদ থেকে সব দেখছিলাম। যখন দেখলাম ওরা যুদ্ধের নিয়ম সম্পূর্ণ ভংগ করে আপনাকে আঘাত করেছে, তখন আমি প্রতিশোধ নিতে গিয়েছিলাম।
মারি অরি পারি যে কৌশল, এটা যুদ্ধের একটা নিয়ম। ওদের অন্যায় কি দেখলেন আপনি? বলল আহমদ মুসা।
ওরা সবাই ছিল চীনা। ওরা নিখুঁত মার্শাল আর্টেই লড়াই করছিল। হেরে গিয়ে ওরা মার্শাল আর্টের নীতি ভংগ করে আপনাকে পেছন থেকে আঘাত করে। চীনা মার্শাল আর্টই বলে এর প্রতিশোধ নিতে। লু ঝি বলল।
আপনি কি মার্শাল আর্টের ছাত্র? অবশ্য আপনার দেহের গঠন তাই বলে। বিমানে আপনাকে দেখেও আমার এটাই মনে হয়েছিল। বলল আহমদ মুসা।
আপনিও তো মার্শাল আর্টের ছাত্র। দেখলাম, নিখুঁত মার্শাল আর্টে আপনি ওদের সাথে লড়াই করেছিলেন। লু ঝি বলল।
আহমদ মুসা বলল, না, মার্শাল আর্টের ছাত্র আমি নই। পড়াশোনা করে মার্শাল আর্ট সম্পর্কে আমি জেনেছি।
তাহলে তো আপনি আরও সাংঘাতিক! মার্শাল আর্টের ছাত্র আপনি নন, মার্শাল আর্টের মাস্টার আপনি। ছয়জনের আক্রমণ আপনি একা ঠেকিয়ে গেছেন ধীরস্থিরভাবে। যেটুকু আপনি মেরেছেন, সেটা আত্মরক্ষার জন্যে। এতেই ওরা কুপোকাত। আপনার লড়াইটা এখনও আমার কাছে বিস্ময়! মার্শাল আর্টের চারটি ধারা থেকেই আমি ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছি। কিন্তু আপনি যা করেছেন, তা আমার কাছে বিস্ময়! পাল্টা আক্রমণে না গিয়ে ঐ অবস্থায় নিজেকে রক্ষার কথা আমি কল্পনাই করতে পারি না।
একটু থামল লু ঝি। থেমেই আবার বলে উঠল, প্লিজ, আপনি বলবেন। কি- কোন ধারায় আপনি যুদ্ধটা করেছেন?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, কোনো ধারার, কোনো ধরনের ট্রেনিং আমার নেই। তবে আমার মনে হয়েছিল, ওরা লড়াই করছিল মাস্টার ডং উদ্ভাবিত বাংগুয়া ঝ্যাংগ-এর আট ডায়াগ্রাম পাম স্টাইলে এবং ওয়াং ফি হ্যাংগা-এর টাইট মুভমেন্ট ও বেপরোয়া আক্রমণ স্টাইলে। আর আমি আত্মরক্ষা করছিলাম তাও চির বিটিং অ্যাকশন বাই ইন্যাকশন স্টাইলে এবং সুযোগ মতো জিংগী কুয়ান-এর স্ট্রেট ফরওয়ার্ড কুইক অ্যাটাক স্টাইলের মাধ্যমে। তবে শাওলিন মার্শাল আর্টের ফিজিক্যাল অ্যাকশন এবং মেন্টাল অ্যাকশনের সম্পর্কই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক শক্তিই শারীরিক শক্তির উৎস ও পরিচালক- এটাই মূল কথা বলে আমি মনে করি।
স্তম্ভিত লু ঝি পলকহীন চোখে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। ধীরে ধীরে তার পলকহীন চোখ মুগ্ধতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, চমৎকার মি. আহমদ। আপনি চীনের চার হাজার বছরের মার্শাল আর্টকে বলা যায় চারটি বাক্যে সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন। আপনি বলেছেন, মার্শাল আর্টের ট্রেনিং আপনি কারও কাছে নেননি। নেয়ার প্রয়োজন কি? যিনি মার্শাল আর্টের অন্তরাত্মায় পৌঁছে গেছেন, তার তো হাত-পায়ের ট্রেনিং নেয়ার দরকার নেই। কিন্তু স্যার, আমি বুঝতে পারছি না, আপনি শাওলিন ধারায় মন ও দেহের শক্তির মিলন কীভাবে ঘটালেন! মানে আমি বলতে চাচ্ছি। মনসমীক্ষণের মাধ্যমে মনের শক্তিকে দেহের কোনো অংগের উপর কেন্দ্রীভূত করার জটিল কাজ কীভারে আপনি নিজে নিজে রপ্ত করলেন?
আমি মুসলিম। দৈনিক পাঁচবার নামাজ বা প্রার্থনার মাধ্যমে মনঃসমীক্ষণ বা মনের একাগ্রতার ট্রেনিং আমাদের হয়েছে। আমাদের স্রষ্টা, প্রতিপালক এবং প্রত্যাবর্তনস্থল আল্লাহর প্রতি একাগ্র হতে হয় আমাদের নামাজের সময়। দৃশ্যমানের চেয়ে অদৃশ্যমানের প্রতি মনঃসমীক্ষণ করতে হলে এর জন্যে অনেক বেশি মানসিক ও একাগ্রতার প্রয়োজন হয়। এই কঠিন কাজ আমাদের নিয়মিত করতে হয় বলে দৃশ্যমান আমাদের কোন্ অংগের উপর মনের শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করা আমাদের জন্যে অনেক সহজ। বলল আহমদ।
সব ধর্মের প্রার্থনায় মনঃসমীক্ষণ আছে। আমিও তো প্রর্থনা করি। কিন্তু এই ফল তো পাইনি? বলল লু ঝি। তার মুখ জুড়ে উচ্ছ্বাস ও ঔজ্জ্বল্যের প্রস্রবণ।
মনঃসমীক্ষণের সাথে অনেক বিষয় জড়িত। আপনাদের তাও কনফুসীয় কোনো ধর্মই সুস্পষ্ট একত্ববাদী ধর্ম নয়। মনঃসমীক্ষণের জন্যে মনের এককেন্দ্রিকতা ও লক্ষ্যের এককেন্দ্রিকতা দুইই জরুরি। বলল আহমদ মুসা।
এই জটিল বিষয়ের ভেতরে প্রবেশ আমার কাজ নয়। আরেকটা কৌতূহল আমার। মেডিকেল ক্যালকুলেশন মিথ্যা করে দিয়ে বারো ঘন্টারও কম সময়ে আপনি সংজ্ঞা ফিরে পেয়েছেন। ডাক্তার ম্যাডাম বললেন, আপনার মানসিক শক্তির বলেই এই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে পেরেছে। আমারও তাই মনে হচ্ছে। এ সম্পর্কে আপনি একটু বলুন। লু ঝি বলল। তার মুখে স্বচ্ছ এক টুকরো হাসি।
ডাক্তার ম্যাডাম যা বলেছেন তা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষা, কিন্তু আমি এ বিষয়ে বলতে পারব না। তবে এটা জানি, মানসিক শক্তি, সাহস, নিশ্চিন্ত শরীরকে সুস্থ রাখে, সুস্থও করে তুলতে পারে মানুষকে। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, এটা অনেকেই বলেন। আমিও কিছুটা জানি। কাজটা সহজ নয়। আশঙ্কা, অস্বস্তি, অস্থিরতা মনকে যেভাবে চারদিক থেকে চেপে ধরে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। কোনো আদেশ, উপদেশও কাজ করে না। মনের শক্তি, সাহস তো স্বয়ংক্রিয় নয়! লু ঝি বলল।
স্বয়ংক্রিয় নয়, কিন্তু সক্রিয় করা ও সক্রিয় রাখার পথ আছে। বলল আহমদ মুসা।
কীভাবে? উপদেশ, আদেশ, অনুরোধ কিছুই তো কাজ করে না। লু ঝি বলল।
কারও আদেশ, উপদেশ, অনুরোধ নয়, আল্লাহ মানে স্রষ্টার উপর নিখাদ নির্ভরতা মনকে নিশ্চিন্ত, নির্ভার, পরিতৃপ্ত করে, যা দেহের প্রতিটি কোষ, অণু-পরমাণুকে পূর্ণ সুস্থ, সজীব, সবল করে তুলে। দেহের কোষ, অণু পরমাণু যখন সুস্থ, সজীব, সরব হয়, তখন রোগ আর থাকার আশ্রয় পায় না। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্রষ্টার উপর নির্ভরতাই মন ও শরীরকে সুস্থ করে তোলে এবং রোগ থেকে নিরাময় লাভ হয়। তাহলে তো…
আহমদ মুসা লু ঝি’র কথার মাঝখানেই বলে উঠল, শর্ত একটাই, যদি আল্লাহ মানে স্রষ্টার অন্য কোনো ইচ্ছা না থাকে এবং যদি মানুষ আল্লাহর দেয়া সুযোগকে অবহেলা না করে।
লু ঝি’র ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, শর্ত কিন্তু দুইটা হলো।
__ লো, কিন্তু একবাক্যে বলেছি। বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি এবার সশব্দে হেসে উঠল। বলল, দেখছি আপনি কথারও রাজা। যাক, একবাক্যে বলা দুই শর্তের কোনোটাই আমি বুঝিনি। স্রষ্টার অন্য কোনো ইচ্ছা কি? আল্লাহর দেয়া সুযোগ অবহেলা বলতে কি বুঝাচ্ছেন?
দেখুন, আল্লাহ শুধু স্রষ্টা নন, তিনি প্রতিপালকও। যাদের তিনি প্রতিপালন করেন, তাদের কল্যাণ কিসে, অকল্যাণ কিসে, তা জানেন এবং সেই অনুসারে তিনি প্রগ্রামও করেন। মানুষের রোগ-শোক মানুষের কোনো বৃহত্তর কল্যাণের জন্যেও হতে পারে, আবার তার দেহের কোনো। প্রয়োজনকে জানান দেবার জন্যেও হতে পারে। যেমন…।
ধন্যবাদ স্যার। বুঝেছি। যেমন, রোগ দেহের ঘাটতিগুলোকে সামনে। নিয়ে আসে যাতে তা পূরণের ব্যবস্থা হয়। এখন দ্বিতীয় শর্তটা বলুন। বলল লু ঝি। তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল।
আল্লাহ দুনিয়াতে শুধু রোগ দেননি, তার ওষুধও দিয়েছেন। তিনি চান মানুষ তার সন্ধান করুক এবং গ্রহণ করুক। আল্লাহর দেয়া এ সুযোগকে অবহেলা করা যাবে না। আহমদ মুসা বলল।
আবার হেসে উঠল লু ঝি। বলল, তাহলে রোগ নিরাময়ের কৃতিত্বটা কাকে দেবো, স্রষ্টাকে, না ওষুধকে?
ওষুধ আল্লাহরই দেয়া। বলল আহমদ মুসা।
বুঝলাম। প্রশ্ন কিন্তু তবু থেকে যাচ্ছে। স্রষ্টার দেয়া ওষুধে রোগ সারবে, তাহলে মনের শক্তির ভূমিকা রইল কোথায়? লু ঝি বলল। এবার তার মুখ গম্ভীর।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ভূমিকা যে আছে, আপনারাই তো তার সাক্ষী ছিলেন। ওষুধে সংজ্ঞা ফেরাত ৭২ ঘন্টার পরে বা কিছু আগে, কিন্তু মনের শক্তি যোগ হওয়ায় সংজ্ঞা ফিরেছে ১২ ঘন্টারও কম সময়ে। মনের। শক্তি দেহকে সুস্থ থাকতে, সুস্থ হতে, আর ওষুধকে নিরাময় করতে সাহায্য করেছে।
ধন্যবাদ। একটা নতুন চিন্তার খোরাক আপনি দিলেন। যদিও আমাদের মার্শাল আর্ট মনের শক্তিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়, তবু এ নিয়ে গভীরভাবে ভাববার কোনো অবলম্বন আমার ছিল না।
কথা শেষ করেই লু ঝি আবার বলল, আপনার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। এটা বলেই সে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে আহমদ মুসার মাথা বালিশের সাথে সেট করে দিয়ে বলল, আপনাকে বালিশে হেলান দিয়ে আর একটু উঁচু হতে হবে।
বলে আহমদ মুসার দুই ঘাড়ের নিচ দিয়ে দুটি হাত ঢুকাতে যাচ্ছিল।
আমি নিজেই আর একটু উঁচু হয়ে হেলান দিতে পারবো। বলে উঠল আহমদ মুসা।
না, তা হবে না। আপনি দুই হাতে ভর দিয়ে মাথাসহ সামনের দিকটা উঁচু করতে গেলে মাথায় চোট লাগবে। ডাক্তার যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই কাজ করতে হবে।
বলে আহমদ মুসার আপত্তি না শুনে তার ঘাড়ের নিচ দিয়ে দুই হাত কোমর পর্যন্ত নামিয়ে আহমদ মুসার মাথার ভারটা দুই বাহুর উপর নিয়ে বালিশের উপর উঁচু করে শুইয়ে দিল।
এরপর অর্ধশোয়া আহমদ মুসাকে ওষুধ খাইয়ে দিল লু ঝি। অনেকক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকার পর আরাম পেল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ ম্যাডাম লু ঝি। আপনাকে বিরাট কষ্টের মধ্যে ফেলেছি। বলল আহমদ মুসা।
যদি বলি জীবনে যে আনন্দ পাইনি, সেই আনন্দ আমি পেয়েছি। আপনি যদি এমন সুযোগ পেতেন, তাহলে বুঝতেন আমার আনন্দ সম্পর্কে। লু ঝি বলল। তার কণ্ঠ শান্ত, গম্ভীর।
সেদিনের ঘটনা আমাকে কিছু বলেননি। আপনি তো একা ছিলেন। ওদের সাতজন মরল কীভাবে? বলল আহমদ মুসা।
ওরা দুর্ধর্ষ, বেপরোয়া। ওদের একজন বেঁচে থাকলেও আপনাকে আনতে পারতাম না। তাছাড়া ওদের কেউ বেঁচে গেলে আমার বিপদ হতো। লু ঝি বলল।
তাহলে ওরা আপনাকে চিনেছিল? বলল আহমদ মুসা।
আমার মুখ ওরা দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি এই বাড়ি থেকে গিয়েছি, এটা তারা হয়তো দেখেছে। না দেখলেও আন্দাজ করে নিতে পারে। আর আমার কণ্ঠও ওরা শুনেছিল। লু ঝি বলল।
ওরা কে বা কারা আপনি কি তা বুঝতে পারছেন? বলল আহমদ মুসা।
আপনি যেটুকু বলেছেন, তার বেশি নয়। পত্রিকাও তেমন কিছু লেখেনি। লু ঝি বলল।
ড. ডা’কে ওরা কোথায় যে রাখল! এ শহরে এখনও কি উনি থাকতে পারেন? বলল আহমদ মুসা।
বলা মুশকিল। তবে ওদের এই নিহত হওয়ার ঘটনার পর তাঁকে জিবেরাতে রাখবে বলে মনে হয় না। লু ঝি বলল।
আমি নিশ্চয় দুতিন দিনের মধ্যে উঠে দাঁড়াতে পারব? বলল আহমদ মুসা।
দুতিন দিন! কি বলেন! ডাক্তার বলেছেন, কমপক্ষে আটদিনের আগে আপনাকে উঠে দাঁড়াতে দেয়া যাবে না। আর চলাফেরা করতে পনের দিন লাগবে। আপনি বলেই পনের দিন। অন্য লোকের ক্ষেত্রে এক মাসের আগে এটা ভাবাই যেত না। লু ঝি বলল।
সিদ্ধান্তটা ভবিষ্যতের জন্যে ভোলা থাক। দেখা যাক শরীর কি বলে।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, আচ্ছা ম্যাডাম লু ঝি, ড. ডা সম্পর্কে পত্রিকাগুলো কি লিখেছে?
কিছুই লেখেনি মি. আহমদ। বলল লু ঝি।
তার মানে কিডন্যাপ হওয়ার কথা লেখেনি? দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
কিছুই লেখেনি। সম্ভবত সরকারের নির্দেশে পত্রিকা ও অন্যান্য মিডিয়া
এ ঘটনা চেপে গেছে। লু ঝি বলল।
কেন সরকার এ ঘটনা চেপে যাবে, বলতে পারেন? বলল আহমদ মুসা।
আমার মনে হয় পাবলিক প্রতিক্রিয়া এড়াবার জন্যে। লু ঝি বলল। আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। অল্প দূরে সেন্টার টেবিলে রাখা লু ঝি’র মোবাইল বেজে উঠল।
মাফ করবেন। বলে দ্রুত গিয়ে মোবাইল তুলে নিল।
মোবাইলের স্ক্রিন দেখে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল লু ঝি’র। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বাবা।
গুডমর্নিং বাবা।
বাবা তুমি কেমন আছ, কোথায় তুমি এখন?
বেইজিং-এ? পার্টি মিটিং চলছে?
এরপর দীর্ঘক্ষণ লু ঝি ওপ্রান্ত থেকে বলা তার বাবার কথা শুনল।
ধীরে ধীরে লু ঝি’র মুখ বিষণ্ণ হয়ে গেল। এক সময় সে বলে উঠল, বাবা, এদের সম্পর্কে জানি না। হয়তো তুমি জান, ড. ডা কিডন্যাপ হয়েছেন। আমি দেখেছি একটা গ্যাং প্লেন হাইজ্যাক করে ড. ডা’কে কিডন্যাপ করতে চেষ্টা করেছিল। মনে হয় ওরাই ড. ডা’কে আবার কিডন্যাপ করেছে।
ওপার থেকে বলা বাবার কথা শুনে আবার লু ঝি বলল, ঠিক আছে বাবা, বিষয়টা আমি দেখছি। তবে একটা কথা শোন, কিডন্যাপারদের রুট যারা মনিটর করেছে, তাদের একজন সেনা অফিসার বলেছেন কিডন্যাপার রা ড. ডা’কে নিয়ে জিবোর দিকে যাচ্ছে। তার পরেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে জিবোতে। সুতরাং দুই ঘটনা জড়িয়ে পড়েছে কি না?
আবার শুনল তার বাবার কথা। ধীরে ধীরে তার মুখ উদ্বেগে ছেয়ে গেল। বলল, আমি সতর্ক আছি। আমি দেখছি বাবা।
লু ঝি মুখের কাছ থেকে মোবাইল সরিয়ে নিল।
কথা শেষ হলেও মোবাইলটা হাতে নিয়ে মুখ নিচু করে বসেছিল। তার চোখে মুখে উদ্বিগ্ন-বিব্রত ভাব।
আহমদ মুসা ইচ্ছা করে না শুনলেও লু ঝি’র সব কথাই তার কানে গিয়েছিল। জিবোর সাত হত্যার ঘটনা এবং ড. ডা-কে নিয়েই যে কথা
হচ্ছিল তা আহমদ মুসা বুঝেছে। এসব বিষয় নিয়ে মেয়ে-বাবার মধ্যে মতানৈক্য ঘটেছে এবং লু ঝি যে তার বাবার কথা পছন্দ করেনি, তাও স্পষ্ট হয়েছে আহমদ মুসার কাছে। আহমদ মুসা কিছু বলল না।
লু ঝি এক সময় মুখ তুলল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। উঠে দাঁড়াল সে।
আহমদ মুসার বেডের এক প্রান্তে এসে বসল লু ঝি। বলল, মি. আহমদ, আমার বাবা গতকালকের সাত হত্যার সব ঘটনা জেনেছেন। মনে হয় জিবো থেকেও তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে।
একটু থামল লু ঝি।
এই সুযোগে আহমদ মুসা লু ঝিকে প্রশ্ন করল, ম্যাডাম লু ঝি, আপনার বাবা সম্পর্কে কিন্তু আমাকে কিছু বলেননি।
হ্যাঁ ঠিক তাই, বলিনি। কিন্তু এখন বলছি।
একটু দম নিল সে। রুমাল দিয়ে চোখ মুখ মুছল। চাইল একবার আহমদ মুসার দিকে। শুরু করল, আমার বাবা কিন শি হুয়াং। তিনি রাজনীতিক। শ্যানডং প্রদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির সিনিয়র নেতা। কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিনি। চীনের প্রাচীন ইতিহাস বিভাগের পরিচালনা তার দায়িত্ব। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমার বাবা চীনের প্রথম লেজেন্ডারি ডেমিগড, সবকিছুর অধিকর্তা, কিন শি হুয়াং-এর বংশধর বলে বিশ্বাস করা হয়। বাবার নামকরণ তার নাম অনুসারেই করা হয়েছে। আজ তিনি বেজিং-এ পার্টির একটা মিটিংয়ে আছেন।
খুশি হলাম ম্যাডাম লু ঝি। আপনার বাবা তো সব দিক দিয়েই চীনের একজন সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। কিন্তু বাবা এখন যা বললেন, তা ধন্যবাদ পাবার মতো নয়। আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন। লু ঝি বলল।
উদ্বেগ কোনো ফল দেবে না, ক্ষতিই করবে। আমি কি জানতে পারি উনি কি বলেছেন? বলল আহমদ মুসা।
বাবা সেই সাতজনের হত্যাকারী ও আহত লোকটি যাতে ধরা পড়ে, সেজন্যে তিনি ঐ পক্ষকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়ার কথা বলেছেন। আমার কোনো যুক্তিই তিনি শোনেননি।
একটু থেমেই বলল আবার লু ঝি, আমি বিস্মিত হচ্ছি এজন্য যে, বাবা এই ধরনের আদেশ ও কঠোর স্বরে আমার সাথে কখনও কথা বলেননি। লু ঝি বলল।
ভাবছিল আহমদ মুসা।
উত্তর দিতে একটু সময় নিল। বলল, আপনাকে তিনি কিছু প্রশ্ন করেছিলেন কি?
আমাদের বাড়ির পাশেই যে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে আমি জানি কি না? প্রথমেই এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে আমি বাবাকে অন্য। প্রশ্ন করেছি। লু ঝি বলল।
আপনার বাবা আর কি বলেছেন? বলল আহমদ মুসা।
আহত ব্যক্তি এবং সাতজনের হত্যাকারী এই শহরেই আছে। সব ধরনের অনুসন্ধানে নাকি প্রমাণ হয়েছে, তারা শহরের বাইরে যায়নি। বিশেষ করে এই এলাকাতেই আছে বলে তাদের ধারণা। তিনি বলেছেন, সাতজনের হত্যাকারী হয়তো তাৎক্ষণিক অবস্থায় পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে ঐ কাজ করেছে, কিন্তু আহত লোকটি খুবই বিপজ্জনক। তাকে পেতেই হবে। যে সাহায্যই তারা চায় আমাকে দিতে বলেছেন। লু ঝি বলল। কণ্ঠ শুকনো। কাঁপছে তার গলা।
আপনার সাহায্যকে উনি জরুরি মনে করছেন কেন? পুলিশকে বললেই তো তারা সব কাজ করে দিতে পারে। আপনার বাবা তো সরকারি লোক। বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ পুলিশের মতো কাজ করছে। আর এরা নিজেদের মতো করে কাজ করতে চায়, বাবা বলেছেন। লু ঝি বলল।
নিশ্চয় কিডন্যাপার পক্ষ কারও মাধ্যমে আপনার বাবাকে বুঝিয়েছে। রাজনীতিকদেরকে তো অনেকের কথা শুনতে হয়, মানতে হয়। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু বাবা এমনভাবে কথা বলেছেন যেন এটা তাঁর কাজ, তারই সমস্যা। তিনি অন্য কারও প্রয়োজনে আমাকে নির্দেশ দেবেন, এটা অবিশ্বাস্য। লু ঝি বলল।
ঘটনার কতটা আপনার বাবা জানতে পেরেছেন, এটা একটা বড় বিষয়। আচ্ছা ম্যাডাম লু ঝি, আমাকে উদ্ধার করে কীভাবে এখানে আনলেন? বলল আহমদ মুসা।
ওখানে দাঁড়ানো ওদের গাড়িতে তুলে সোজাপথে না এসে এপথ সেপথ। ঘুরে আমাদের বাড়িতে এনেছি। লু ঝি বলল।
তখন তো দিন ছিল। আপনার বাড়ির সবাই তো দেখেছে। বলল আহমদ মুসা।
আমাদের বাড়িতে আমার জন্যে এই অংশটা আলাদা। গেট দিয়ে ঢোকার পর আমার অংশে আমার জন্যে ভিন্ন পথ ও ভিন্ন গাড়িবারান্দা আছে। গেট দিয়ে ঢোকার সময় দুজন গেটম্যানই শুধু আমাকে-আপনাকে দেখেছে। বাড়ির অন্য কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাকে-আপনাকে দেখেনি। লু ঝি বলল।
আপনার বাড়িতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা কোথায় কোথায় আছে?
চমকে উঠে মুখ তুলল লু ঝি। তার চোখে বিব্রত দৃষ্টি। বলল, সর্বত্র রয়েছে। তবে প্রাইভেট ঘরগুলোর সিসিটিভি ঘর যার বা যাদের তাদের হাতে থাকে। তারা বন্ধও রাখতে পারে, চালু রাখতে পারে। লু ঝি বলল।
আপনার বাবা কি গতকালের ঘটনার পর বাড়ির সিসিটিভির রেকর্ড দেখেছেন? বলল আহমদ মুসা।
গতকাল থেকেই তিনি বাড়িতে নেই। গতকাল সকালে কি কাজে এসেই চলে গেছেন বেইজিং-এর বাড়িতে। তবে না থাকলেও তিনি সিসিটিভির রেকর্ড চাইতে পারেন। সে ব্যবস্থা আছে। লু ঝি বলল।
চিন্তার ছায়া নামল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল আহমদ মুসা।
লু ঝিই কথা বলল, আপনি কি ভাবছেন বাবা সিসিটিভির কপি নিয়েছেন? আমাকে না বলে বাবা এত দূর যাবেন বলে মনে হয় না।
সিসিটিভির রেকর্ড অন্য কেউ তো নিতে পারেন। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে লু ঝি’র চোখ ছানাবড়ার মতো হয়ে উঠল।
আমি এদিকটা তো ভেবে দেখিনি! কিন্তু আমাদের বাড়ির লোকরা বা অন্য কোনো লোক এই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে?
পারে বলছি না। কিন্তু কিছু একটা তো ঘটেছে। বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল মুখের কাছে তুলে ধরল লু ঝি।
গুড মর্নিং ডাক্তার ম্যাডাম। উল্লসিত কণ্ঠে বলল লু ঝি।
কথা বলল লু ঝি ডাক্তার ম্যাডামের সাথে। দুএকটা হা, না ছাড়া কোনো কথা বলল না লু ঝি। শুধু শুনলই। শুনতে শুনতে উদ্বেগে যেন কাঠ হয়ে উঠল লু ঝি’র মুখ।
অবশেষে আপনার শুভেচ্ছার জন্যে ধন্যবাদ ডক্টর ম্যাডাম বলে মোবাইলের কল অফ করে দিল।
আহমদ মুসা লু ঝি’র মুখ দেখেই বুঝল বড় কিছু দুঃসংবাদ সে পেয়েছে।
আহমদ মুসা উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল শোনার জন্যে।
মোবাইলের কল অফ করেই মোবাইলটা বিছানার উপর ফেলে দিয়ে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে, এখনি এ বাড়ি আমাদের ছাড়তে হবে মি. আহমদ।
কি হয়েছে বলুন। শান্ত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ওরা এ বাড়িতে আসছে। সার্চ করবে এ বাড়ি।
ডাক্তার মিং হুয়া এটা জানলেন কি করে? বলল আহমদ মুসা।
ডাক্তার মিং এখানে গতকাল থেকে কয়েকবার এসেছেন, এটাও ধরা পড়েছে। ওঁর বাড়ির কর্মচারীর মাধ্যমেই এটা লিক হয়েছে। লু ঝি বলল।
বুঝেছি। আপনার আব্বাও ওদের গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছেন এবং আপনাকেও সহযোগিতা করতে বলেছেন। আপনার কথা ঠিক। এখনি আমাদের এ বাড়ি ছাড়তে হবে।
আহমদ মুসা একটু থামল। শুরু করল আবার, ম্যাডাম লু ঝি, আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আহমদ মুসার কণ্ঠে শান্ত সুর এবং মুখে হাসি।
বিস্ময় লু ঝি’র চোখে-মুখে। বলল, আপনি হাসছেন! সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, কীভাবে?
আহমদ মুসা উঠে বসল।
লু ঝি ছুটে এল। বলল, উঠবেন, উঠবেন না। ব্লিডিং শুরু হয়ে যাবে। ডাক্তার নিষেধ করেছেন অন্তত তিন দিন একা না উঠতে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ডাক্তারের কথা, শান্তির সময়ের জন্যে। এখন সে সময় নয়। আমি এখনই বেরুব মাথায় দেয়ার মতো একটা ক্যাপ চাই, যা দিয়ে ব্যান্ডেজ ঢাকা যাবে। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে লু ঝি।
ছুটে এসে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, সর্বনাশ! আপনি কি করছেন! বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে আপনার!
না দাঁড়ালে আরও বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি ধরা পড়লে ক্ষতি নেই। কিন্তু আপনি ধরা পড়লে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। বলল আহমদ মুসা।
আমি জানি। আমি সে কথাই ভাবছি। আপনাকে নিয়েই আমি বেরুবো। সে চিন্তা আমি করে ফেলেছি। লু ঝি বলল।
না, ম্যাডাম আপনার যাওয়া হবে না। আপনি বাড়িতে না থাকলে সবকিছুই ওদের কাছে ধরা পড়ে যাবে। ওরা, এমনকি আপনার বাবাও নিশ্চিত হবেন আপনি ঘটনার সাথে জড়িত এবং আমাকে আপনি সরিয়ে নিয়ে গেছেন। আপনার বাবা তাদের সহযোগিতা করতে বলেছেন। এই অবস্থায় এই সময়ে আপনি বাড়ি ছাড়তে পারেন না। বলল আহমদ মুসা।
যদি এখন আপনাকে চলেই যেতে হয়, তাহলে আমাকে আপনার সাথে। যেতে হবে। আমি আপনাকে একা কিছুতেই ছাড়ব না। লু ঝি বলল।
একজন অতিথির প্রতি আপনার দায়িত্বের কথা বলছেন। কিন্তু পিতার প্রতি, পিতার সম্মানের প্রতি, পরিবারের প্রতি এবং অবশ্যই আপনার নিজের প্রতি দায়িত্বের কথা ভাবছেন না। আমি এটা হতে দিতে পারি না। আপনার যদি এটাই শেষ কথা হয়, তাহলে আমারও শেষ কথা শুনুন। আমিও এখান। থেকে চলে যাচ্ছি না। বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি তাকাল পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে।
পলপল করে সময় বয়ে চলল। লু ঝি’র পলকহীন চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। ধীরে ধীরে তার চোখ দুটি ভারি হয়ে উঠল। তার দুচোখের কোণায় এসে জমা হলো অশ্রু। বলল, মি. আহমদ, আপনার জীবন বিপন্ন। আপনি ভালো করেই জানেন, প্লেন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যা ঘটেছে, তাতে আপনাকে দেখা মাত্র তারা হত্যা করতে পারে। এই সময় আমার বাবা, আমার পরিবার, আমার নিরাপত্তা এবং আমাদের সম্পর্কের কথা ভাবছেন আপনি! লু ঝি’র গলা ভারি হয়ে উঠেছে।
আমার জীবন ওদের হাতে নয়, আমার স্রষ্টার হাতে। সুতরাং মৃত্যুর ভয় আমি করি না। এই মুহূর্তে সবার জন্যে যা ভালো, আমি সেটাই বলেছি ম্যাডাম লু ঝি।
লু ঝি ভাবছিল। বলল, আমি আপনার কথা মেনে নিলাম স্যার। তবে এরপর আমি যা বলব সেটাই হবে।
লু ঝি একটু থেমেই আবার বলল, আমাদের বাড়ি থেকে বেরোবার একটা গোপন পথ আছে। সে পথে আমার সেক্রেটারি চাও ঝিং আপনাকে নিয়ে যাবে। এখান থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের উপর আমার নিজস্ব একটা ডুপ্লেক্স আছে। এর খবর আমি ও আমার সেক্রেটারি ছাড়া আর কেউ জানে না। আর ওখানেই আপনি থাকবেন।
ধন্যবাদ ম্যাডাম লু ঝি। আপনার কথাও আমি মেনে নিলাম। বলল, আহমদ মুসা।
আমার আরও একটা কথা আপনাকে মানতে হবে। সেটা হলো, আমাকে ম্যাডাম এবং আপনি কোনোটাই বলা যাবে না।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডাকল তার সেক্রেটারি চাও ঝিংকে।
চাও ঝিং প্রবেশ করল ঘরে।
চাও ঝিংকে দেখিয়ে লু ঝি আহমদ মুসাকে বলল, আমার প্রিয় সেক্রেটারি চাও ঝিং। মঙ্গোলিয়ার মেয়ে।
চাও ঝিং-এর দিকে তাকিয়ে লু ঝি বলল, আমার এই অতিথিকে তুমি জান। তুমি এঁকে পাহাড়ে আমার ডুপ্লেক্সে নিয়ে যাবে। আমি না যাওয়া পর্যন্ত তুমি থাকবে সেখানে। আমার অতিথির সব নিরাপত্তার দায়িত্ব। তোমার।
চাও ঝিং মেয়েটি মাথা নেড়ে লু ঝি’র কথায় সায় দিল।
লু ঝি বলল আবার, চাও ঝিং তৈরি হয়ে নাও। এখনি বেরুতে হবে।
লু ঝি চলে গেল।
লু ঝি পাশের ঘরে গিয়ে একটা সাইড ব্যাগ নিয়ে আলমারির দিকে এগোলো।
আহমদ মুসা ওয়াশরুম থেকে এসে সোফায় বসে দুরাকাত নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে সালাম ফিরিয়ে দেখল, একটা ব্যাগ হাতে লু ঝি দাঁড়িয়ে। তার মুখ ভারি। চোখ নিচু।
ঘরে প্রবেশ করল চাও ঝিং। বলল, আমি প্রস্তুত ম্যাডাম।
লু ঝি ব্যাগটা নিয়ে এগোলো চাও ঝিং-এর দিকে। ব্যাগটা চাও ঝিং এর হাতে তুলে দিয়ে বলল, এতে ওঁর কাপড় ও ওষুধ আছে। তাকে সময়। মতো ওষুধ খাওয়াবে। আর কিছু বিষয় লিখে দিয়েছি, সে অনুসারে কাজ করবে।
চাও ঝিংকে নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসার সামনে গিয়ে দাঁড়াল লু ঝি। পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল। বলল, জানি আপনার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। এ রকম একটা অস্ত্র আপনার কাছে থাকা দরকার। ভাববেন না, এটা আমার লাইসেন্স করা অস্ত্র, অন্য নামে। আমার অনুরোধ, ঔষধ ঠিকমতো খাবেন। ডাক্তারের সব পরামর্শ মেনে চলবেন।
ধন্যবাদ ম্যাডাম লু…।
আহমদ মুসাকে তার কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে লু ঝি বলল, প্লিজ ম্যাডাম না, শুধুই লু ঝি বলবেন। বলল লু ঝি।
আচ্ছা লু ঝি, তুমি তো আমার জন্য অনেক করেছ। বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি কোনো কথায় কান না দিয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গিয়ে বলল, আসুন দেখি আপনি কতটা হাঁটতে পারেন!
আহমদ মুসা হাঁটতে লাগল, একদম স্বাভাবিক অবস্থার মতো।
ধন্যবাদ স্যার। আপনি সত্যি একজন ভিন্ন মানুষ।
একটু থেমেই হাঁটতে শুরু করে লু ঝি। আবার বলল, আসুন আপনাদের গোপন পথটা পার করে দিয়ে আসি।
হাঁটতে লাগল তিনজন। সামনে লু ঝি, মাঝখানে আহমদ মুসা এবং শেষে চাও ঝিং।
৫
দরজায় নক না করেই, কোনো অনুমতি না নিয়েই ঝড়ের মতো ঢুকল। ফেন ফ্যাংগ লিয়েন হুয়ার ঘরে।
ফেন ফ্যাংগ চীনা প্রেসিডেন্ট ও ক্যুনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি লিউ। জোয়ান ঝেং-এর মেয়ে এবং লিয়েন হুয়ার মামাতো বোন।
পড়ার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াল লিয়েন হুয়া বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে। বলল, কি হয়েছে ফ্যাংগ? ব্যস্ত এত?
আপা, বাবা তোমাকে ডেকেছেন, এখনি। মুখ শুকিয়ে গেল লিয়েন হুয়ার। ভয়ের চিহ্নও ফুটে উঠল মনে। তার মামা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পাবার পর এভাবে তাকে ডাকেন না, অন্তত তার মনে পড়ে না এমন ঘটনা। মামা বাড়িতে থাকলে খাবার টেবিলে তার সাথে দেখা হয়। দরকার হলে। খাবার টেবিলেই কথা বলেন তিনি।
মামা ডাকছেন? এখনি? কেন? তুমি জান কিছু ফ্যাংগ? বলল লিয়েন হুয়া।
না আপা। আমি কিছু জানি না। বাবা কি একটা মিটিং-এ যাবেন। তার আগে একটু রেস্টে আছেন বাবা। ফেন ফ্যাংগ বলল।
তাহলে এ সময় আমাকে ডাকা কেন? মামাই কি ডেকেছেন? বলল। লিয়েন হুয়া।
অবশ্যই বাবা ডেকেছেন। বললেন, যাও লিয়েনকে আসতে বল। ফ্যাংগ বলল। কেমন দেখলে, উনি রেগে নেই তো? কিংবা গম্ভীরভাবে বসে নেই তো? বলল লিয়েন হুয়া।
হেসে উঠল ফ্যাংগ। বলল, আমি অত কিছু জানি না। আমি চললাম। বলে চলে যেতে উপক্রম করল ফ্যাংগ। ফেন ফ্যাংগ তার বাবা-মার একমাত্র সন্তান। খুব আদুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
লিয়েন হুয়া তাকে বাধা দিয়ে বলল, সত্যি ফ্যাংগ আমার ভয় করছে। মামা এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার আগে আমাকে তো ডাকেন না! বকবেন না তো আমাকে?
ফ্যাংগ উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
লিয়েন হুয়ার দুহাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসল। মুখের কাছে মুখ। নিয়ে বলল, বাবা তোমাকে বকবে! জান, তোমার প্রশংসা বাবা সব সময় করে। আর আমার বিপদ বাড়ে। বাবা সব সময় বলেন, তোমাকে লিয়েনের মতো হতে হবে। লিয়েন যেমন ভালো ছাত্র, তেমনি ভালো সংগঠক। গোটা দেশে দেখ কেমন পপুলার সে। বাবা-মা তোমাকে বকতে পারেন না।
বলে উঠে দাঁড়াল ফ্যাংগ। বলল, আমি চললাম। চীনের প্রেসিডেন্ট ও ক্যুনিস্ট পার্টির ফাস্ট সেক্রেটারি লিউ জোয়ান ঝেং-এর স্টাডিতে ইজি চেয়ারে শরীরকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছে।
লিয়েন হুয়া স্টাডিতে প্রবেশ করল। পায়ের সামান্য শব্দেই চোখ খুলল। লিউ জোয়ান ঝেং, চীনের প্রেসিডেন্ট এবং লিয়েন হুয়ার মামা।
মা এসো, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। বলল প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং।
সামনে এগোলো লিয়েন হুয়া।
বস সোফাটায়। বলল প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং। লিয়েন হুয়া সংকোচের সাথে বলল, আমি শুনছি মামা বলুন।
সংকোচ কেন মা। আমি তোমার মামা। বলল প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং।
লিয়েন হুয়া সোফার এক প্রান্তে জড়সড় হয়ে বসল।
তুমি তো জান মা, প্রতিভাবান বিজ্ঞানী মা ঝু সুলতান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র এবং খুবই জনপ্রিয় যুবনেতা। মা ঝু সুলতান কিডন্যাপ হওয়ায় উচ্চপর্যায়ে তদন্ত চলছে। দেখলাম, তোমার একটা স্টেটমেন্ট তারা নিয়েছে। সেটা আমি পড়েছি। কিন্তু তোমার কথা তোমার ল্যাংগুয়েজে কোট না হওয়ায় আমার মনে হয়েছে কিছু কথা উহ্য থেকে গেছে। আর তুমি সর্বশেষ কথা বলেছ মা ঝুর সাথে কিডন্যাপ হওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। সুতরাং তোমার প্রতিটি কথা খুবই মূল্যবান। এজন্যে তোমার মুখ থেকে কথাগুলো শোনার জন্যে তোমাকে ডেকেছি মা। বলল প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং।
হ্যাঁ মামা বলব। সব কথা আমার মনে জীবন্ত হয়ে আছে। লিয়েন হুয়া বলল।
সেদিন সে ঘটনা যেভাবে ঘটেছিল, হুবহু আমাকে বল।
লিয়েন হুয়া একটু চিন্তা করল। তারপর বলতে শুরু করল। মা ঝুর সাথে তার টেলিফোনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা ঘটেছিল, তা ঠিক ঠিক বলে গেল। শেষে বলল, মা ঝুর বোন বিজ্ঞানী ফা ঝি ঝাওকে যেভাবে কিডন্যাপ করা হয়েছিল, সেভাবেই কিডন্যাপ করা হয় মা ঝুঁকে। আমার স্থির বিশ্বাস একই গ্রুপ এই কাজ করেছে। কি উদ্দেশ্যে করেছে, সেটা আমি জানি না। তবে আমি মনে করি, দুজনকে কিডন্যাপের কারণ এক নয়। লিয়েন হুয়া বলল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং-এর। বলল, কারণ দুটি কি মা?
আমার মনে হয় মা ঝুর জনপ্রিয়তা এবং ফা জি ঝাও-এর বিজ্ঞান প্রতিভা, বিশেষ করে তার গবেষণার বিষয়।
বিশ্বখ্যাত আমাদের প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ডাও কিডন্যাপড় হয়েছেন। ভাবছিল প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং। বলল, তোমার কথা গুরুত্বপূর্ণ মা কিন্তু জনপ্রিয় ও প্রতিভাবানদের গ্রেফতারের উদ্দেশ্য কি?
এ বিষয়টা আন্দাজও করতে পারছি না। কিডন্যাপগুলো যদি একই গ্রুপের কাজ হয়, তাহলে আমার মনে হয় একটা গ্রুপ বিরাট কোনো উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ফ্রন্টে কাজ করছে। সব মিলিয়ে উদ্দেশ্য তাদের একটাই। লিয়েন বলল।
গভীর ভাবনা প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং-এর চোখে-মুখে। ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে তোমার কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু পরিষ্কার হচ্ছে না উদ্দেশ্যটা কি? বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও কিডন্যাপ হওয়ার আগেই তার বিপদের কথা জানতে পারে। কিন্তু কারা ষড়যন্ত্র করছে এবং কেন, তা গোয়েন্দারাও আন্দাজ করতে পারছে না। আচ্ছা মা, ফা জি ঝাও ও মা ঝুর শেষ কথাগুলো। আমাকে আবার শোনাও তো।
মামা বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও টেলিফোনে মা ঝুঁকে বলেছিল, আমার কক্ষের। বাইরে কিছু গুলি-গোলা হচ্ছে। আমার কক্ষের দরজা ভাঙার জন্য ধাক্কা ধাক্কি শুরু হয়েছে। ওরা কারা জানি না। তবে সেনা গোয়েন্দারা এই আশঙ্কা করেছিল। আর আমার টেলিফোনে মা ঝুর শেষ কথা ছিল, লিয়েন, দরজা ভেঙে আমার ঘরে চারজন রিভলবারধারী প্রবেশ করেছে। তাদের মুখে মুখোশ। এর পরেই মাঝু কিডন্যাপারদের লক্ষ্য করে বলে, তোমরা কে জানি না। জানি তোমরা আমাকে কিডন্যাপ করতে এসেছ। কিন্তু তোমরাও জান না, আমাকে কেন কিডন্যাপ করতে এসেছ।
থামল লিয়েন হুয়া।
প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং কোনো কথা বলল না। চোখ বন্ধ করে ভাবছিল
অল্প কয়েক মুহূর্ত পর প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং ইজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল, ধন্যবাদ লিয়েন। লিয়েন একটা জিজ্ঞাসা কিডন্যাপারদের একটা গ্রুপের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পার্কে তুমি যে কথা শুনেছিলে তাতে তিনটি বিষয় জানা গেল, এক, তারা হুই-উইঘুর এবং হুই-উইঘুর-হানদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ লাগিয়ে রাখতে চায়, দুই. তারা দেশের মধ্যে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়। তৃতীয় আর একটা বিষয়ও ওদের কাছ থেকে শোনা তোমার কথায় জানা গেল, ওদের কাজের ক্ষেত্র অনেক। বিভিন্ন ধরনের লোক তারা কিডন্যাপ করছে তাদের কাজের ক্ষেত্রগুলো সামনে রেখেই। সবকিছুর মূলে একটা লক্ষ্যেই তারা কাজ করছে। সেটা কি? কারা ওরা? তোমরা কখনও কি এসব নিয়ে ভেবেছ?
না মামা। স্যরি। আমি মনে করি কারা এই গ্রুপে কাজ করছে, তা জানতে পারলেই তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জানা যেত। তবে এরা খুবই বেপরোয়া। কিছু মিডিয়াতে বলা হচ্ছে, যে লোক প্লেন ও ড. ডা’কে কিডন্যাপ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল, সে লোকটিকে কিডন্যাপ করতে ওরা উঠে-পড়ে লেগেছে। বলল লিয়েন হুয়া।
হ্যাঁ লিয়েন, আমার কাছেও রিপোর্ট এসেছে। লোকটি নাকি সাংঘাতিক চৌকস। প্লেনে ওদের দলের চারজন, বিমানবন্দরে চারজন এবং জিবেরাতে তাকে কিডন্যাপ করতে যাওয়া সাতজনকে হত্যা করে সে পালিয়েছে।
লিয়েন হুয়া কথা বলল না।
প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং কথা বলতে বলতে একটু চোখ বুজেছিল।
লিয়েন হুয়া তার মামা চোখ খোলার অপেক্ষা করল।
চোখ খুলে উঠে বসল প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং। বলল, মা লিয়েন, আমি তোমাকে এত কথা বললাম, কারণ প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা- দেশের রাজনীতি ও দেশ গড়ার কাজে আমি আশা করি। যা ঘটছে তা উইঘুর বা আমাদের জন্যে প্রবল মাথাব্যথা। আমার মনে। হচ্ছে মাথাব্যথার কারণ আরও সৃষ্টি হচ্ছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না দেশে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও বিভেদ চায়- এমন চীনা নাগরিক কারা?
থামল প্রেসিডেন্ট লিউ ঝি।
মামা, হুইদের মতো উইঘুররাও কি দেশপ্রেমিক নাগরিক হতে পারে না? লিয়েন হুয়া বলল।
মা, শুধু উইঘুররা সমস্যা নয়। উইঘুররা ঐতিহ্যগতভাবে স্বাধীনচেতা। তাদের মানসিকতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে জিনজিয়াংকে স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল হিসাবে রাখা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, পশ্চিমের আমাদের কিছু শত্রু দেশ। উইঘুরদের শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। শত্রুরা তাদেরকে একটা অসম্ভব স্বপ্ন দেখিয়ে অশান্তি ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা তো সবার প্রিয় বাসস্থান চীনের সংহতি রক্ষার জন্যে সবকিছুই করব, এটা চীনের সম্মানিত নাগরিক উইঘুররাও জানে মা, কিন্তু তারা মানছে না, এটাই সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে মা। তোমার আর কোনো কথা নেই তো?
ধন্যবাদ মামা! বলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি মা ঝুর জন্যে খুবই উদ্বিগ্ন মামা। একটু ভারি হয়ে উঠেছিল লু ঝি’র কণ্ঠস্বর।
প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং তাকাল লিয়েন হুয়ার মুখের দিকে। কিন্তু তার চোখের ভাষা বোঝা গেল না। মুখে বলল, আমরাও উদ্বিগ্ন। খুব সম্ভাবনাময় ছেলে সে। নির্বিকার কণ্ঠ প্রেসিডেন্টের।
ধন্যবাদ মামা আমি আসছি।
বলে লিয়েন হুয়া ঘর থেকে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে এল।
প্রেসিডেন্টের স্টাডি ডেস্কের একটা গোপন বোর্ডে একটা সবুজ সংকেত জ্বলে উঠল, তার সাথে বিপ বিপ শব্দ।
প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং পকেট থেকে ছোট্ট একটা কী বোর্ড বের করল। তাতে নানা রঙের বোতাম। একটা বোতামে চাপ দিয়ে কী বোর্ডটি পকেটে রেখে স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে এল। পিএস এসেছে। বাইরে সিকিউরিটি টীম অপেক্ষা করছে। মিটিং-এর জন্যে তৈরি হতে হবে তাকে।
.
কথা বলছিল ডাই ডিং জিয়াং, সমস্যা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার পর। প্রাথমিক মন্তব্য হিসেবে আমি কয়েকটা কথা এখন বলব। বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও, জনপ্রিয় যুবনেতা মা ঝু সুলতান এবং প্রত্ন ও পুরাতত্ত্ব বিজ্ঞানী ড. ডা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া দেশের ভেতর ও বাইরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। নিখোঁজ হওয়া তিনজনই তাদের জায়গায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বিজ্ঞানী। ফা জি ঝাও ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক পারটিকল-এর স্পর্শকাতর ব্যবহার বিষয়ে গবেষণা সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন। এই অবস্থায় তার কিডন্যাপ হওয়া গুরুতর কিছুর এলার্ম দিচ্ছে কি না, এ প্রশ্ন উঠেছে। যারা কিডন্যাপ করেছে তাকে, তাদের পরিচয় নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। অনুরূপভাবে ড. ডা একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দেশের শীর্ষ প্রত্ন ও পুরাতাত্ত্বিক তিনি। চীনের ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিষিদ্ধ নগরী খনন প্রজেক্টের তিনি প্রধান ছিলেন। অনেক গোপন ও সেন্সেটিভ তথ্য তিনি জানেন, যার সাথে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পর্ক আছে। তাকে কিডন্যাপ কোন্ স্বার্থে, এটা চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মা ঝু সুলতান কম্যুনিস্ট যুব আন্দোলনের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। তার উপর সে হুই সম্প্রদায়ের লোক। দুর্ভাগ্যক্রমে ফা জি ঝাও ঐ একই সমপ্রদায়ের লোক এবং মা ঝুর বড় বোন। তারা দুজন এভাবে কিডন্যাপ হওয়ায় বড় ধরনের ভুল বুঝাবুঝি ও রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশ একটা জাতীয় সংকটের মুখোমুখি। থামল ডাই ডিং জিয়াং।
ডাই ডিং জিয়াং কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর প্রধান।
প্রেসিডেন্টের নির্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটিকে চলমান সংকট সম্পর্কে ব্রিফ করল সে।
জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি দেশের নিরাপত্তা বিষয়ক শীর্ষ কমিটি। প্রেসিডেন্ট স্বয়ং এ কমিটির প্রধান। প্রেসিডেন্ট ছাড়াও দশজন সদস্য রয়েছে কমিটিতে। পিপলস কংগ্রেস, পিপলস আর্মি, সামরিক কমিশন, গোয়েন্দা এজেন্সিসমূহের শীর্ষ পদের অধিকারীরা এই কমিটির সদস্য। নিরাপত্তা সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই কমিটিই নিয়ে থাকে।
প্রেসিডেন্টের আহবানেই আজকের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ডাই ডিং জিয়াং-এর কথা শেষ হবার পর প্রেডিডেন্ট তাকাল সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাপ্রধানের দিকে। বলল, জেনারেল চাও চেন এবার আপনি বলুন। মি. ডাই ডিং জিয়াং কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট ও প্রতিক্রিয়া আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। আমরা চাই যা ঘটছে এবং যা ঘটেছে সব। বিষয় আমাদের সামনে আসুক।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি! শুরু করল জেনারেল চাও চেন, এক্সিলেন্সি, সম্মানিত ডাই ডিং জিয়াং কিডন্যাপের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সংক্ষেপে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে আমার কথাও এরকমই। আমাদের কাছে এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে কিডন্যাপারদের পরিচয় ও উদ্দেশ্যের বিষয়টি। এ সম্পর্কে এখনও সুস্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। তবে তাদের কিডন্যাপের ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছে, ওরা বড় ধরনের কোনো সংস্থা হতে পারে, যাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাযুক্তিক কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। সে উদ্দেশ্য কি এ বিষয়ে আমরা একেবারেই অন্ধকারে। এ পর্যন্ত ওদের আটটি লাশ পাওয়া গেছে। কিন্তু লাশে এমন কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি, যা থেকে ওদের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। ড. ডা কিডন্যাপ। হওয়ার দিনই আরেকটি বড় ঘটনা ঘটেছে। জিবেরা শহরের একটা বাড়ির পেছনের উঠানে সাতটি লাশ পাওয়া গেছে, এদেরও কোনো পরিচয় উদ্ধার হয়নি। এদের লাশ থেকে কোনো ধরনের কু মেলেনি। সম্মানিত ডাই ডিং জিয়াং-এর কাছ থেকে আমরা শুনেছি, এদিন আরেকটি কিডন্যাপের ঘটনা। ঘটে। আহমদ নামের যে যুবকটি চারজন কিডন্যাপারকে হত্যা করে ড. ডা ও প্লেনকে নিরাপদ করেছিলেন, সেই যুবকটিই কিংদাও বিমানবন্দরে। কিডন্যাপারদের চারজনকে হত্যা করে ড. ডা’কে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। এবং তিনি ড. ডা’কে উদ্ধারের জন্যে কিডন্যাপারদের পিছু নিয়েছিলেন। তাকেও কিডন্যাপ বা হত্যা করা হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবশ্য জিবেরাতে সাতজন নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। কিংদাও বিমানবন্দর থেকে যে গাড়িটা নিয়ে কিডন্যাপারদের তিনি পিছু নিয়েছিলেন, সে গাড়িটাকে সাতজন হত্যার ঘটনাস্থলের কিছু দূরে পাওয়া গেছে। সম্মানিত ডাই ডিং জিয়াং জানিয়েছেন সেই গাড়ির রক্তের সাথে নিহত হওয়া পনেরোজনের কারো ডিএনএ টেস্ট মেলেনি। এর অর্থ তিনি আহত অবস্থায় কিডন্যাপড় হয়েছেন। ডাই ডিং জিয়াং যে সন্দেহ করেছেন আমরাও তাই মনে করছি, জিবেরাতে সাতজন হত্যার সাথে যুবকটির সম্পর্ক আছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে ঐ সাতজনও কিডন্যাপারদের অংশ। সাত হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর বিশ্লেষণ থেকে জানা যাচ্ছে, ঘটনাটির সাথে নিহত হওয়া সাতজন ও যুবকটি ছাড়াও তৃতীয় আরেকজনের সংশ্লিষ্টতা। ছিল। এই তৃতীয়জনকে চিহ্নিত করার জন্যে অনুসন্ধান চলছে। এক্সিলেন্সি, এসব হত্যাকাণ্ডের তথ্য পাওয়ার আগে বাইরের ঘটনা অনুসন্ধানে আমরা সামনে অগ্রসর হতে পারি। থামল জেনারেল চাও চেন।
ধন্যবাদ জেনারেল চাও চেন, ধন্যবাদ ডাই ডিং জিয়াংগ প্রাথমিকভাবে। সবকিছু উপস্থাপনের জন্যে।
বলেই প্রেসিডেন্ট দৃষ্টি ফেরাল সকলের দিকে। বলল, সমস্যা নিয়ে মুক্ত আলোচনা হবে। আমি আপনাদের একটা কথা পরিষ্কার জানাতে চাই, আপনারা সমস্যার আইসবার্গ, দেখছেন। সমস্যার পাহাড় কিন্তু এখনও রয়েছে অদৃশ্য। সেটা কি তা আমাদের জানতে হবে। থামল প্রেসিডেন্ট।
সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন বলল, মি. প্রেসিডেন্ট, ধন্যবাদ আপনাকে। সমস্যার গুরুত্বকে আপনি ঠিক তুলে ধরেছেন। চিন্তার বিষয়। আমাদের মহান চীনে কালো পর্দার আড়ালের এই কালো মানুষরা কারা? আমার মনে হয় এখানে উপস্থিত কারও সামনে ওরা দিনের আলোতে নেই। কিন্তু এটা তো চলতে পারে না।
সেনাবাহিনী প্রধান হং হু বলল, ঠিক এক্সিলেন্সি, এটা চলতে পারে না। কিন্তু আমরা এই ব্যাপারে নিকশ এক অন্ধকারে। যদি ওদের চেনা যেত, ওদের উদ্দেশ্য বের করে নেয়া যেত। আবার ওদের উদ্দেশ্য জানা গেলে ওদেরকেও চিনে নেয়া যেত। সমস্যা হলো, আমরা এ দুয়ের কোনো অবস্থাতেই নেই।
সশস্ত্র বাহিনী প্রধান হং হু থামল। কিন্তু কেউ কথা বলল না। সবাই যেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের শেষ কথার জবাব খুঁজছে। শুধু প্রেসিডেন্ট লিউ ঝেং স্থির, শান্ত।
নীরবতা ভাঙল প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। বলল, ওরা মহান চীনের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করতে চায়। বহুমুখী সংঘাত বাধাতে চায় ওরা। এর লক্ষ্য হলো, সরকারকে দুর্বল ও অকার্যকর করে ফেলা। এই লক্ষ্যের পিছনে কি আছে সেটা স্পষ্ট নয়। আমাদের মহান চীন আজ যে ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে বিশ্বে বিকল্প নেতৃত্ব উপহার দিতে যাচ্ছে, সে ব্যবস্থাই ধ্বংস করতে ওরা চায় কি না, সেটা অনুসন্ধানের বিষয়। বিভিন্ন ফ্রন্টে তাদের কাজ করা দেখে এই সন্দেহ কিন্তু আমার মনে জাগছে। শক্তি, অর্থ ও প্রযুক্তি এই তিনের সম্মেলন বড় পরিবর্তনের নিয়ামক হতে পারে। মনে হচ্ছে এই তিনের সম্মেলন ঘটাবার পথেই তারা হাঁটছে। থামল একটু প্রেসিডেন্ট।
পিনপতন নীরবতা তখন বৈঠকে। সবার চোখে-মুখে চিন্তার কালো ছায়া। মনে তাদের একই চিন্তা, আমাদের সুশৃঙ্খল ও শক্তিমান মহান চীনে এমন কে বা কারা আছে, যারা অসম্ভব একটা লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগোবার। সাহস করতে পারে?
প্রেসিডেন্ট আবার কথা বলতে শুরু করল, লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাদের কৌশলটা কি, তাও কিছুটা জানা গেছে। তারা চায় উইঘুরদের সাথে হুইদের, উইঘুরদের সাথে হানদের এবং সবার সাথে সরকারের ভুল বুঝাবুঝি ও সংঘাত বাঁধাতে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা সবার মধ্যে বা সব সেক্টরে এজেন্টদের ঢুকিয়ে দিয়েছে কিংবা ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। থামল প্রেসিডেন্ট।
আবার সেই পিনপতন নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন। বলল, আমাদের মহান চীনে এরকম চিন্তার গ্রুপ বা পক্ষ আছে এবং তারা সক্রিয়, একথা আমরা আরো আগে জানতে পারিনি কেন?
এক্সিলেন্সি, বিমান হাইজ্যাক থেকে শুরু করে কয়েকটি কিডন্যাপের ঘটনার মধ্য দিয়ে গ্রুপটার তৎপরতা সারফেসে এসেছে। তারা আমাদের নজরে এসেছে এর পরেই। বলল ডাই ডিং জিয়াং।
সম্মানিত প্রেসিডেন্ট যে, তথ্য দিলেন, সেটা আমাদের গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো দিতে পারলো না কেন? সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন বলল। তার কণ্ঠে ক্ষোভ।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি জানতে পেরেছি এখানে আসার আগ মুহূর্তে। একে ঈশ্বরের সাহায্যই বলতে হবে। যাক, আসুন ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করি। এমন গ্রুপের বা সংগঠনের অস্তিত্ব যদি সত্য হয়, তাহলে এদের খুঁজে বের করা প্রথম কাজ। বলল প্রেসিডেন্ট।
সম্মানিত প্রেসিডেন্ট, আরেকটা বিষয়। ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপের নিহত পনেরোজনের মধ্যে আটজনকেই একজন বিদেশি হত্যা করেছে। অবশিষ্ট সাতজনের হত্যাকাণ্ডের সাথে তারই সংশ্লিষ্টতা আছে। এই ঘটনার সাথে তার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার যোগ আছে। যেভাবে, যে কারণেই হোক সে আমাদের পক্ষে কাজ করেছে। তার কি হলো জানা, তাকে উদ্ধার করার দায়িত্বও আমাদের নেয়া উচিত। বলল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। এই মূল্যবান পরামর্শ আমরা গ্রহণ করলাম। আর সাত হত্যার রহস্য আমরা বিশেষ তদন্তের আওতায় নিয়ে এসেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং বলল।
তার কথার মাঝখানেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং-এর অয়্যারলেস বেজে উঠেছিল।
কথা শেষ করেই কলটাকে অ্যাটেন্ড করার অনুমতি নিয়ে ঘরের এক প্রান্তে সরে গেল।
দুমিনিট পরেই ফিরে এল তার চেয়ারে। প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিয়ে বলল, এক্সিলেন্সি, এইমাত্র একটা তথ্য পাওয়া গেল। জিবেরা শহরে যেদিন সাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, সেই রাত থেকেই কিছু লোক জিবেরা শহরের প্রতিটি হাসপাতাল, ক্লিনিকে একজন আহত লোকের খোঁজ করছে। এমনকি প্রতিটি ডাক্তার ও ওষুধের দোকানেও তারা গেছে। বড় ধরনের আহতের জন্যে ওষুধ, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি কেউ বিক্রি করেছে কি না, কোথায় বিক্রি করেছে, এসব কথা জিজ্ঞাসা করে বেড়িয়েছে পাগলের মতো। মনে করা হচ্ছে নিহত সাতজনের পক্ষের লোক ওরা, তারা কিডন্যাপারদের দলেরই লোক। আর…
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং-এর কথার মাঝখানেই বলে উঠল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন, কি বলছেন নিকোলাস লিয়াং! ওরা এতটা বেপরোয়া! আপনার পুলিশরা তাহলে কি করেছে?
পুলিশ ঘটনাটা জানতে, বুঝতে সময় লেগেছিল। আর ওরা অনেক লোক লাগিয়ে রাত ও সকালের মধ্যে তাদের অনুসন্ধানের কাজ শেষ করে। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং।
সাতজন নিহত হবার পরও ওদের এত লোক ছিল এক জিবেরা শহরে। অবাক ব্যাপার। সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন বলল।
ঘটনা এটাই এক্সিলেন্সি।
বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থামল। একটু সময় নিয়ে বলল, একটা ঘটনার কথা এই সুযোগে বলতে চাই। কানশুর রাজধানী ডান হুয়াং শহরের উইঘুরদের একটা ইসলামিক স্কুলের একটা ঘটনায় লোকাল পুলিশ ইনচার্জ মা ঝু সুলতানকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল এবং তাকে বাঁচাতে গিয়ে বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী একজন উইঘুর মেয়ে সেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল, একথা আপনারা জানেন। পরে পুলিশ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছিল, পুলিশ অফিসারটি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে গুলি করেছিল মা ঝুঁকে। গোটা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ও সরকারি অস্ত্রধারীদের এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আরও ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডের টার্গেট ছিল। রাজনৈতিক, সামাজিক ও যুব নেতৃত্ব, যা আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও সংঘাত সৃষ্টির নিমিত্তে হয়েছে। মনে হয়েছে ঘটনাগুলো যেন একই সূত্রে গাঁথা। পেছনের রহস্য জানার জন্যে পুলিশ অফিসারটির জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। হঠাৎ মারা যায় পুলিশ অফিসারটি। ময়না তদন্ত থেকে জানা গেছে, তার মৃত্যুর এক ঘন্টা আগে তাকে একটি ওষুধ খাওয়ানো হয় যার প্রতিক্রিয়ায় তার মৃত্যু ঘটে। তার মানে তাকে সরিয়ে দেয়া হলো। হয়তো তার কাছে এমন কিছু কথা ছিল, যা প্রকাশিত হওয়া বন্ধ করার জন্যেই তাকে হত্যা করা হয়। কীভাবে…
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং-এর কথার মাঝখানে সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন বলল, আপনার কথার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের মধ্যে ওদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে!
সশস্ত্র বাহিনী প্রধান চি চুং বলে উঠল, এক্সিলেন্সি, পুলিশ বাহিনীতে ওদের অনুপ্রবেশ যদি সত্যি হয়, তাহলে যে প্রয়োজনে ওরা পুলিশ বাহিনীতে অনুপ্রেবেশ করেছে, সেই প্রয়োজনেই ওরা আমলাতন্ত্র, এমনকি সেনাবাহি নীতেও অনুপ্রবেশ করতে পারে। থামল চি চুং, সশস্ত্রবাহিনী প্রধান।
কেউ কথা বলল না তৎক্ষণাৎ। ভাবছে সবাই। সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের শেষ কথা কয়টি আশঙ্কার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে সবার মনে। আজকের মহান চীনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা কোনোভাবেই বিশ্বাস করার মতো। নয়। কি ঘটল চীনে? কে ঘটাল? প্লেন হাইজ্যাক করে সামাল দেয়া, ড. ডা এবং মা ঝুকে কিডন্যাপ করতে সাহস করা ছোট ঘটনা নয়। এই চিন্তা সবার মনকেই দারুণভাবে পীড়া দিচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট লিউ জোয়ান ঝেং শিরদাঁড়া সোজা করে মাথা খাড়া রেখে অবিচলভাবে তার চেয়ারে বসে আছে। নিঃশঙ্কতা তার চেহারায়।
নীরবতা ভাঙল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান গোয়াং জেন। বলল, মি. চি চুং অবস্থা এতটা খারাপ হয়নি বলে আমি মনে করি। তবে খারাপ করার আয়োজন চলছে। এই আয়োজন যদি ধ্বংস করতে হয়, তাহলে অবিলম্বে মা ঝু এবং ড. ডা’কে উদ্ধার করতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে, জানতে হবে ওদের পরিচয়। এ বিষয়টিই এখন আলোচনায় আসা উচিত।
এক্সিলেন্সি এই কাজ দেশের বাহিনীগুলো শুরু করে দিয়েছে। শীঘ্রই আমরা ভালো ফল আশা করছি। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং।
জিবেরা শহরে এত বড় ঘটনা ঘটল, কোনো একজন গ্রেফতার সেখানে এখনও হয়নি। অথচ কিডন্যাপাররা দল বেঁধে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। তাদের টার্গেট আহত লোকটিকে ধরার জন্যে। খুবই দুঃখ লাগছে, একজন বিদেশি আহমদ এ পর্যন্ত ওদের বিরুদ্ধে যা করেছে। ওদের বিরুদ্ধে করার সেটাই একমাত্র কাজ। অথচ এখনও পর্যন্ত আমরা ওদের কিছুই করতে পারিনি। বলল সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অয়্যারলেস আবার বেজে উঠল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুমতি নিয়ে অয়্যারলেস অ্যাটেন্ড করার জন্যে আবার উঠে গেল।
ফিরে এল দুই আড়াই মিনিট পরেই। বসল তার চেয়ারে।
মুখটি তার বিমর্ষ। কথা বন্ধ করে সবাই তাকিয়ে ছিল তার দিকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে। বলল, দুটি বড় খবর আছে এক্সিলেন্সি। শুকনো কণ্ঠ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
কি খবর বলুন। বলল প্রেসিডেন্ট। নির্বিকার কণ্ঠ তার।
কয়েক মিনিট আগে খবর এসেছে, নিষিদ্ধ নগরী খননের পর নতুন পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রের নির্মাতা ইঞ্জিনিয়ার চাও জিয়াং এবং উইঘুরের শীর্ষ মুসলিম নেতা ইরকিন আহমেত ওয়াং এক ঘন্টা আগে প্রায় একই সময়ে কিডন্যাপড় হয়েছেন। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
ও গড! বলল সামরিক কমিশনের প্রধান গোয়াং জেন।
মিটিং-এ উপস্থিত সবাই নির্বাক। অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে।
প্রেসিডেন্ট স্থির বসে।
নির্বিকার তার চেহারা। শুধু তার দুই চোখের চঞ্চল দৃষ্টি একবার ছুটে গিয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং-এর দিকে।
পিনপতন নীরবতার মধ্যে শোনা গেল পিপলস কংগ্রেসের নেতা হোয়াং হুয়া-এর কণ্ঠ। বলল সে, কোথা থেকে কীভাবে তারা কিডন্যাপড় হয়েছেন?
চাও জিয়াংকে অপহরণ করা হয়েছে তার বাড়ির গেট থেকে। তাকে নিয়ে তার গাড়ি বের হচ্ছিল অফিসে যাওয়ার জন্যে। ঠিক সেই সময় চারটি গাড়ি এসে তার গাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে গাড়ি থেকে বের করে একটি গাড়িতে তুলে তাকে নিয়ে যায়। আর ইরকিন আহমেত ওয়াং কিডন্যাপড় হয়েছেন তার অফিস থেকে। দুপুরে লাঞ্চের পর তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তার বিশ্রামকক্ষে। সেখান থেকে তিনি হাওয়া হয়ে যান। পরে দেখা যায় অফিসের পেছন দরজা দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বিশ্রামের বিছানা দেখে বোঝা যায় ঘরে ধস্তাধস্তি হয়েছিল। বিশ্রামকক্ষের বাতাসে আট্রা ক্লোরোফরমের চিহ্ন পাওয়া গেছে। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং।
আশ্চর্য বেপরোয়া ওরা! দুজনকেই দিনের বেলা প্রকাশ্যে কিডন্যাপড় করা হয়েছে। ওদের শক্তির উপর ওদের অপরিসীম আস্থার প্রমাণ এটা। হতে পারে, আশেপাশে আরও লোক মোতায়েন করেই তারা এ কাজ করেছে। বলল পিপলস কংগ্রেসের প্রধান হোয়াং হুয়া।
কিডন্যাপগুলোর বৈশিষ্ট্য সব একই। এই কিডন্যাপ দুটোও আগের সেই পক্ষই করেছে। বলল সেনাবাহিনীর প্রধান হং হু।
কিডন্যাপ যারাই করুক, এখন প্রচার হবে যে সরকারি লোকরা বিরোধী পক্ষের একজন বড় নেতাকে অপহরণ করেছে। পিপলস কংগ্রেসের প্রধান হোয়াং হুয়া বলল।
হুই মুসলমানদেরকেও নিশ্চয় এর সাথে জড়ানো হবে। একটা ঘটনাও ঘটেছে। জেনারেল হু ফেং জিন জিয়াং প্রদেশের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগের দিন কানসুর হুই নেতা মা চু ইং উইঘুরের শীর্ষ নেতা আহমেদ ওয়াং-এর সাথে সংঘাত-বিরোধ নিয়ে কথা বলেছেন। আলোচনার শেষটা ভালো হয়নি। আর হুই মুসলিম নেতা মা চু ইং-এর ছেলে জেনারেল হু ফেং। মা চু ইং-এর আলোচনার বিষয় জিনজিয়াং-এর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এখন ইরকিন আহমদ ওয়াং-এর কিডন্যাপের সাথে হুইদের যোগসাজস আবিষ্কার করা হবে। বলল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান ডাই ডিং জিয়াং।
এমন প্রতিক্রিয়া হতেই পারে। আর এ দুটি কিডন্যাপই শেষ নয়। বরং শেষের এ দুটি ভালোভাবেই জানান দিচ্ছে যে, এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। শত্রুদের এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা তাদের পাকড়াও করার। মাধ্যমেই মাত্র করা যেতে পারে। বলল পিপলস কংগ্রেসের নেতা হোয়াং হুয়া।
হোয়াং হুয়া কথা শেষ করলেও তৎক্ষণাৎ কেউ কথা বলল না।
আবার নীরবতা মিটিং ঘিরে।
অপরাধীরা তাদের অপরাধের কোনো না কোনো চিহ্ন রেখে যায়। কিন্তু আমাদের পুলিশ-গোয়েন্দারা বলছে কোনো লিংক তারা খুঁজে পায়নি। আমার মনে হচ্ছে, ঐ বিদেশি ছেলেটা আহমদ যতখানি ওদের নিকটে যেতে পেরেছে, আমাদের কেউ তা পারেনি। সে কিছু জানতে পারে। কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে কোথায়! অবিলম্বে তাকে পাওয়ার চেষ্টাও করা দরকার। নীরবতা ভেঙে বলল পিপলস কংগ্রেসের প্রধান গোয়াং জেন।
এক্সিলেন্সি, আমরা সে চেষ্টাও করছি। আমরা এখনও মনে করছি, যে আহত অবস্থায় জিবেরাতেই কোথাও লুকিয়ে আছে সে। বলল কাউন্টার। ইন্টেলিজেন্সের প্রধান ডাই ডিং জিয়াং।
সকলকে ধন্যবাদ। নড়ে-চড়ে বসে বলতে শুরু করল প্রেসিডেন্ট, একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনারা সকলেই মূল্যবান আলোচনা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা সামনের অন্ধকারে কোনো পথ খুঁজে পেলাম না। আমি আলোচনার শুরুতেই বলেছি, ঘটনার যা আমরা দেখছি, ষড়যন্ত্রকারীদের যতটুকু আমরা জানি, তা আইসবার্গের একটা চূড়া মাত্র। সমস্যার মূল অবয়ব অন্ধকারের আড়ালে। গোটাটা আমাদের চোখের সামনে। আসার পর আমাদের আশু করণীয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তার আগে এখন। আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে অন্ধকার থেকে ওদের দিনের আলোতে আনার জন্যে। অনেকেই বিদেশি আহমদ-এর কথা বলেছেন। আমরা তাকে চিনি না, জানি না। একথা ঠিক সে অত্যন্ত চৌকস লোক। বিমানে ও বিমানবন্দরে যা ঘটেছে তার পুরো ভিডিও আমি দেখেছি। সে। অসাধারণ ক্ষিপ্র, অসাধারণ ভালো শুটার। সবচেয়ে বড় কথা, অস্বাভাবিক শক্তিশালী তার নার্ভ। জীবন দেয়া-নেয়ার সংকটময় মুহূর্তেও তাকে একেবারেই স্বাভাবিক থাকতে দেখা গেছে। এ ধরনের অসাধারণরা বড় কেউ হয়ে থাকে, বড় মিশনও এরা নিয়ে বেড়ায়। তার ব্যাপারে পুরোটা জানার আগে, তাকে ভালোভাবে পরখ করার আগে তার ব্যাপারে আমাদের। আশাবাদী হওয়া ঠিক নয়। তবে পারলে আমরা তাকে সাহায্য করতে পারি। কোনো বিপদগ্রস্তকে সাহায্য আমাদের করতেই হবে।
একটু থামল প্রেসিডেন্ট। একটু ভাবল যেন। তারপর আবার বলল, আমাদের অদৃশ্য শত্রু যেই হোক, তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যটা খুব বড়। যাদের বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য থাকে, তাদের সাংস্কৃতিক লক্ষ্যও থাকতে হয় তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যের স্থায়িত্বের জন্যে। তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য আমাদের কাছে পরিষ্কার, কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক লক্ষ্যটা কি? এই শেষ প্রশ্নটার উত্তর জানতে পারলে তারা আসলে কি এবং কে তা জানা যাবে। আমাদের অনুসন্ধানে এই বিষয়টার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
থামল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট থামার সাথে সাথেই পিপলস কংগ্রেসের প্রধান হোয়াং হুয়া বলল, প্লিজ মি, প্রেসিডেন্ট, ওদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পরিষ্কার, কিন্তু অর্থনৈতিক লক্ষ্যের ব্যাপারটা কি করে জানা গেল, আমি বুঝতে পারছি না।
নিষিদ্ধ নগরী খননের সাথে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দুজনকে অপহরণ করা থেকে এটা বুঝা যাচ্ছে। এই দুজন অরাজনৈতিক ও নিরেট পেশাজীবী ব্যক্তিত্ব অপহরণের পেছনে অর্থনৈতিক ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য থাকতেই পারে না। গোটা চীনে একটা লোককথা প্রচলিত আছে, নিষিদ্ধ নগরীর কুবলাই খানসহ মিং ও কিং ডাইনেস্টির ২৫ সম্রাটের হীরা-জহরত, মণি মুক্তা এবং টন টন স্বর্ণমুদ্রা লুকানো আছে। কঠিন কঠিন সব কোড, আর গোলকধাঁধায় সেসব সুরক্ষিত। এখন আরও মনে করা হচ্ছে, খনন কাজের মাধ্যমে কুবলাই খানের প্রাসাদসহ অতীতে অনেক কিছুই মাটির তলা থেকে বের করা হয়েছে, কিন্তু ধনভাণ্ডারসমুহের আশেপাশেও কেউ যেতে পারেনি। তবে পথের গোলক ধাঁধা ও সংকেত খননকারীদের চোখে পড়েছে এবং তার মানচিত্রও তারা তৈরি করেছে। এর বেশি তারা এগোতে পারেনি। এই ধনভাণ্ডারগুলো উদ্ধারের জন্যে খননের মানচিত্র এবং আরও কিছু তথ্য হাত করার জন্যেই খনন কাজের সাথে জড়িত দুই শীর্ষ ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়েছে। থামল প্রেসিডেন্ট।
মি. প্রেসিডেন্ট, ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি যা বলেছেন সেটাই ঘটনা। আমরাও ছোটবেলা থেকে এই অঢেল ধনভাণ্ডারের কথা শুনছি। আসলে সত্যিটা কি এক্সিলেন্সি?
লোককথা লোককথাই। খননও এটা প্রমাণ করেছে। জানার বাইরে সেখানে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। বলল প্রেসিডেন্ট।
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং-এর দিকে। বলল, মি. নিকোলাস, কিডন্যাপারদের যে পনেরোজন নিহত হয়েছে, তাদের শরীরের সার্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট এবং জীবনপঞ্জি কি তৈরি হয়েছে?
এক্সিলেন্সি কাজ শেষ হয়নি। গোষ্ঠীগত পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে। তারা সকলেই পিওর হান। জানা গেছে তাদের অধিকাংশই ইয়েলো। নদীর অববাহিকা শ্যানডং অঞ্চলের বাসিন্দা। ওদের জীবনপঞ্জি থেকে কিছু পাওয়া যায় কি না তা দেখা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই এক্সিলেন্সি পেয়ে যাবেন। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
ধন্যবাদ মি. নিকোলাস লিয়াং। আপনারা কি খুঁজে পাবেন জানি না। আমাদের দৃষ্টিকে আরও তীক্ষ্ণ, আরও সুদূরপ্রসারী করতে হবে। এত বড় সব ঘটনা ঘটছে, অপরাধীরা কোনো কু রেখে যাচ্ছে না, একথা স্বাভাবিক নয়। আমরা কু খুঁজে পাচ্ছি না, সেটা আমাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। প্রেসিডেন্ট লিউ জোয়ান ঝেং বলল।
ইয়েস এক্সিলেন্সি। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাস লিয়াং।
প্রেসিডেন্ট মুখ তুলে তাকাল সবার দিকে। বলল, সবাইকে ধন্যবাদ মূল্যবান আলোচনার জন্যে। মহান চীনের উপর বড় বড় বিপদ এসেছে, চলেও গেছে। মহান চীন ক্রমাগত সমৃদ্ধির পথেই এগিয়েছে। এগোতেই থাকবে। চীনা জনগণের বিরুদ্ধে আজ যারা কালো হাত বাড়িয়েছে, সমূলে ওদের উৎখাত করা হবে। জনগণ আমাদের সহযোগিতা করবে। আজকের মতো আমরা উঠছি।
উঠে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট। উঠে দাঁড়াল তার সাথে সকলেই।
৬
আহমদ মুসা অসাধারণ ডুপ্লেক্সের সুন্দর একটি ড্রইংরুমে এসে বসল। লু ঝি’র সেক্রেটারি চাও ঝিং ল্যাগেজের ব্যাগটা নিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকেই বলল, স্যার, এখানে এখন বসা নয়। অনেক পথ হেঁটেছেন। বেডরুমে চলুন। কিছুটা বিশ্রাম নেবেন, তারপর অন্য কথা।
ধন্যবাদ! বলে উঠল আহমদ মুসা। সত্যি আহমদ মুসা ক্লান্ত।
অনেকটা পাহাড়ী পথ হেঁটে আসতে হয়েছে। রাস্তা আছে, কিন্তু গাড়ি ছিল না আহমদ মুসাদের। নিজেদের গাড়ি লু ঝি ব্যবহার করতে পারেনি। গাড়ি ভাড়া পাবারও সুযোগ ছিল না। বেশ উঁচু টিলায় লাল রঙের সুন্দর ডুপ্লেক্সটি মুগ্ধ করেছে আহমদ মুসাকে। এ পাহাড়ী এলাকার বাড়ি-ঘরগুলো বেশ ব্যবধান নিয়ে তৈরি।
প্রতিটি পাহাড়-টিলা ঘিরে রয়েছে ছোট-বড় গাছের সবুজ দেয়াল। যেন নয়নাভিরাম এক অমূল্য স্বাস্থকেন্দ্র। বেডরুমটা বেশ বড়। সুন্দরভাবে কেউ যেন এইমাত্র তা সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছে।
মিস চাও ঝিং, কেউ কি এ বাড়িতে থাকে? মনে হচ্ছে বেডরুমটা কেউ যেন এইমাত্র ঠিকঠাক করেছে। ড্রইংরুমটাকেও এমনই দেখলাম। বলল। আহমদ মুসা।
স্যার, এ বাড়িতে কেউ থাকে না। এ ডুপ্লেক্সের নিচের তলার একটা অংশ ম্যাডাম বিনা পয়সায় ভাড়া দিয়েছেন তার এক বান্ধবীর বাবার। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। ডুপ্লেক্সটা এমনভাবে তৈরি যাতে সবদিককেই এর ফ্রন্ট বলা যাবে। নিচ তলার তিনটি কক্ষ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের রেজিস্টার্ড অফিস। ওরাও কেউ এ বাড়িতে থাকেন না। অফিস সময়টাই তারা অফিসে থাকেন। ম্যাডাম তাদেরকেই মাসিক একটা অ্যামাউন্ট দেন। বাড়িটাকে পরিচ্ছন্ন ও সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার জন্যে। বাড়িটাকে দেখাশুনার এই কাজটা করেন ম্যাডামেরই আস্থাভাজন একজন মহিলা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্টাফ হিসেবে। চাও ঝিং বলল।
চমৎকার ক্যামোফ্লেজ। বাড়ির মালিক সবার কাছেই অজানা থেকে। যাবে। মনে করবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটিই বাড়ির মালিক। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি কি কাজ করে? ওরা তো বিশ্বস্ত? বলল আহমদ মুসা।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি অসহায় বৃদ্ধা-বৃদ্ধ, সহায়-সম্বলহীন অসুস্থদের মনিটর করে এবং তাদের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে দেন দরবার করে তাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে। দীর্ঘকালীন বেকারদের সমস্যাও তারা দেখা শুরু করছে। তারা খুবই আস্থাভাজন স্যার। বিশেষ করে ম্যাডাম ওদের কাজকে খুবই পছন্দ করেন। চাও ঝিং বলল।
একটু থামল চাও ঝিং। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলল, স্যার, আপনি একটু রেস্ট নিন। পরে ফ্রেশ হবেন। আমি আপনার জন্যে গরম দুধের ব্যবস্থা করছি। আসছি আমি।
শুনুন, সাধারণত এ সময় আমি কফি বা চা খাই। বলল আহমদ মুসা।
থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে চাও ঝিং বলল, আমার উপর ম্যাডামের হুকুম শুধু সকালে নাশতার পর আপনি কফি বা চা পাবেন। অবশিষ্ট সময়ে লাঞ্চ ও ডিনারের বাইরে আপনাকে দুধ পরিবেশনের নির্দেশ। বলেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে চলা শুরু করল চাও ঝিং।
আহমদ মুসা সোফায় বসেছিল। উঠল ফ্রেশ হবার জন্যে। পাশেই জানালা।
জানালা দিয়ে বাইরে দৃশ্য দেখার লোভ সামলাতে পারল না আহমদ মুসা।
জানালায় দাঁড়াল আহমদ মুসা। বাইরে দৃষ্টি পড়তেই একটা দৃশ্যের উপর চোখ আটকে গেল আহমদ মুসার। কেউ যেন ক্রল করে উঠে আসছে টিলার উপরে। তীক্ষ্ণ হলো আহমদ মুসার চোখ। জানালার আরও ঘনিষ্ঠ হলো আহমদ মুসা।
এবার টিলার গায়ের দৃশ্যটা আরও পরিষ্কার হলো। হ্যাঁ, লোকটির ঘাড়ে ঝুলছে স্টেনগান। হাতে একটা রিভলবার। আশেপাশেও চোখ বুলাল। হ্যাঁ, আর একজন উঠছে ঐভাবে ক্রল করে। তার কাছেও স্টেনগান, রিভলবার। তারও পিঠে ঝুলছে একটা ব্যাগ। আহমদ মুসার মনে হলো ওতে আরও অস্ত্র কিংবা অ্যামুনিশন আছে! আহমদ মুসা দেখল, ক্রল করা প্রথম লোকটি হঠাৎ থামল। তাকাল উপর দিকে। মত প্রকাশের মতো একটা ইশারা করল উপরের দিকে কাউকে।
তার মানে ওদের আরও লোক কি উপরে ওঠে এসেছে? এটা ভাবার সাথে সাথে গোটা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। লাফ দিয়ে সরে এল জানালা থেকে। পকেট থেকে বের করে নিল রিভলবার।
ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ওদেরকে প্রবেশ পথেই আটকাতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ল আহমদ মুসার, এই ডুপ্লেক্সের চারদিকেই ফ্রন্ট। মানে, চারদিকেই ভেতরে প্রবেশের জন্যে গেটও আছে। তাহলে?
আহমদ মুসা টিলার চারদিকের চিত্র সামনে আনার চেষ্টা করল।
টিলার পূর্ব ও উত্তর দিক দিয়ে রাস্তা। রাস্তার ওপাশেও বাড়ি আছে এবং এই দুই দিকে গাছ-গাছড়াও কম। এই রাস্তা দিয়েও গাড়ি-ঘোড়া চলে। অন্য দুই পাশে প্রচুর গাছ-গাছড়া, ঝোঁপ-ঝাড়ও আছে। কেউ যদি সবার চোখ এড়িয়ে উপরে উঠতে চায়, তাহলে এই দুই দিকই তার জন্যে উপযুক্ত। এর মধ্যে টিলার দক্ষিণ পাশ দিয়ে দুজনকে উঠতে দেখেছে আহমদ মুসা। অন্যরাও হয়তো এদিক দিয়েই উঠছে। সুতরাং দক্ষিণ দিকের গেট দিয়েই ওরা ঢুকতে পারে।
আহমদ মুসা ছুটল ড্রইংরুমের দিকে। সে দেখেছে, ড্রইংরুম থেকেই চারদিকে সিঁড়ি নেমে গেছে।
ট্রেতে করে কফি নিয়ে আসছিল চাও ঝিং অর্থাৎ লু ঝি’র সেক্রেটারি।
অল্পের জন্যে ধাক্কা থেকে বেঁচে গেল চাও ঝিং, বেঁচে গেল তার কফির ট্রেও।
স্যরি মিস চাও ঝিং, আপনি ঘরে যান। ঘরের ভেতরেই থাকবেন। আমি বড় কিছু সন্দেহ করছি। আমি দেখছি ওদিকে। বলে আহমদ মুসা এগোলো ড্রইংরুমের দিকে।
স্যার কি হয়েছে? কোথায় যাচ্ছেন? আপনি তো অসুস্থ? চিৎকার করে বলল চাও ঝিং।
পেছনে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল দ্রুত কণ্ঠে, প্লিজ মিস চাও ঝিং, আমি যা বলেছি তা শুনুন।
আবার ছুটল আহমদ মুসা ড্রইংরুমের দিকে। ড্রইংরুমে ঢোকার আগে করিডোরের মুখে আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়েছিল। দেখতে পেল, কয়েকজন উঠে আসছে ড্রইংরুমে।
করিডোর মুখে দাঁড়ানোর আগেই আহমদ মুসা লু ঝি’র দেয়া রিভলবার পকেট থেকে তুলে নিয়েছিল।
তার হাতে রিভলবার ছিল উদ্যত।
ড্রইংরুমে উঠে আসা অস্ত্রধারীদের দেখতে পেয়েছিল আহমদ মুসা। ওরাও দেখতে পেয়েছিল আহমদ মুসাকে। ওরা তাদের অস্ত্র ঘুরিয়ে নিচ্ছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসার রিভলবার থেকে চারটি গুলি বেরিয়ে গেল।
গুলি করেই আহমদ মুসা নিজেকে ড্রইংরুমের মেঝেতে ছুঁড়ে দিল। ওদিক থেকে গুলি আসার কোনো শব্দ পেল না আহমদ মুসা! ভাবল, যাদের লক্ষ্য করে সে গুলি করেছে তারা তাহলে বেঁচে নেই। কেউ বেঁচে থাকলে নিশ্চয় নিচের দিকে সরে গেছে গুলি থেকে বাঁচার জন্যে।
আহমদ মুসার দেহটা ফুটবলের মতো গড়াচ্ছিল। তার লক্ষ্য সিঁড়ির মুখ।
ওরা নতুন করে এগিয়ে আসার আগেই তাকে পৌঁছতে হবে সিঁড়ির মুখে।
সিঁড়ির মুখে গিয়ে স্থির হলো আহমদ মুসার দেহ। সিঁড়ির দিকে হাতের রিভলবার বাড়িয়ে ধরে দুই কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথা একটু উপরে তুলল। দেখল দুটি লাশ ড্রইংরুমের প্রান্ত ঘেঁষে এবং অন্য দুটি লাশ সিঁড়ির মুখে পড়ে আছে।
আহমদ মুসা পাশেই পড়ে থাকা একটা স্টেনগান হাতে তুলে নিল।
আহমদ মুসা ড্রইংরুমের অন্য তিন সিঁড়িমুখের দিকে চকিৎ তাকিয়ে দেখল। ওদিক থেকেও ওরা আসতে পারে আহমদ মুসাকে ঘিরে ফেলার জন্যে। কাউকে দেখতে পেল না।
এবার লাশের ফাঁক দিয়ে পাশের সিঁড়ির নিচের দিকে তাকাল। দেখতে। পেল, উপরের দিকে স্টেনগান বাগিয়ে কয়েকজন সিঁড়িতে হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। উপর দিকে এগোবার চিন্তা তাদের মধ্যে দেখা গেল না। তাদের মধ্যে কি একটা অপেক্ষার ভাব। তারা কি আহমদ মুসা আক্রমণে আসার অপেক্ষা করছে? না, অন্যদিক…
মনের জিজ্ঞাসাটা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা মাথাটা নামিয়ে তাকাল পূর্ব দিক থেকে উঠে আসা সিঁড়ি-মুখের দিকে।
তাকানোর সাথে সাথে গুলির শব্দ। গুলিটা এল ঐ সিঁড়িমুখ থেকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা একজন উঠে দাঁড়াচ্ছিল সিঁড়িমুখে। তার রিভলবার থেকেই গুলিটা এসেছে।
আহমদ মুসা যদি ঘুরে তাকাবার সময় মাথাটা না নামাত, তাহলে। বুলেটের আঘাতে গুড়ো হয়ে যেত আহমদ মুসার মাথা। তার গুলিটা ব্যর্থ হয়েছে বুঝতে পেরেছিল লোকটা। দ্বিতীয় গুলি আসছিল তার রিভলবার থেকে। কিন্তু সুযোগ সে পেল না। লোকটির প্রথম গুলির পরেই তার দিকে। গুলি ছুটে গিয়েছিল আহমদ মুসার রিভলবার থেকে। গুলিটা লোকটির বুক বিদ্ধ করেছিল।
বুক চেপে ধরে লোকটি আছড়ে পড়ল সিঁড়িমুখের উপর। আহমদ মুসা মুখ তুলল না। চুপ করে পড়ে রইল।
আহমদ মুসার হিসাবমতো ওদিক কিংবা এদিকের সিঁড়ি থেকে কেউ উঠে আসার কথা।
আহমদ মুসার অনুমান মিথ্যা হলো না।
ওদিক থেকে এবং আহমদ মুসার দিক থেকে গুলি চলার সময়ই এ সিঁড়ির দুজন লাফ দিয়ে উঠে এসেছিল সিঁড়ির মাথায়। তারা শুয়ে পড়েছিল লাশের আড়ালে।
আহমদ মুসাও ছিল লাশের আড়ালে। দুদিকের ব্যাপারেই সে সতর্ক।
সিঁড়ির নিচ থেকে উঠে আসা দুজন লাশের আড়ালে নিজেদের গোপন করেছে বটে, কিন্তু আহমদ মুসাকে টার্গেট করতে পারছে না। তাকে গুলির আওতায় আনতে হলে উঠে বসা ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই তারা তাদের শত্রু কখন আক্রমণে আসে বা উঠে দাঁড়ায় তার জন্যে অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শত্রুর কৌশল সম্পর্কে আহমদ মুসা এটাই অনুমান করল। তার মাথায় একটা চিন্তা এল। ঠিক সিঁড়িমুখের ল্যান্ডিং-এর উপর দুটি লাশ পড়ে আছে। তাদের দেহের একটা অংশ নিচের ধাপে গড়িয়ে পড়েছে। আহমদ মুসা তার সামনের দুটো লাশের পাশ কাটিয়ে ক্রল করে এগিয়ে সিঁড়িমুখের লাশ দুটিকে নিচের দিকে গড়িয়ে দিয়ে আক্রমণে যেতে পারে। কিন্তু লাশকে এভাবে ব্যবহার করে মানুষের লাশের অসম্মান করা অন্যায় মনে করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা অমানবিক চিন্তা পরিত্যাগ করে সতর্ক ও নিঃশব্দে ক্রল করে সিঁড়িমুখের লাশের দিকে এগোলো। স্টেনগান আহমদ মুসার ডান হাতে এবং ট্রিগারে তার ডান তর্জনী। বাম হাত দিয়ে স্টেনগানের ব্যারেল ধরে আছে। সে ক্রল করছে দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে।
লাশের গা ঘেঁষে সিঁড়িমুখে পৌঁছল আহমদ মুসা। সিঁড়িমুখ, সিঁড়ির। উপরের ল্যান্ডিং থেকে সিঁড়িতে অবস্থানকারী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা অপেক্ষাকৃত সহজ।
সিঁড়িমুখের লাশের ফাঁক দিয়ে স্টেনগানের ব্যারেল সিঁড়ির সমান্তরালে সেট করতে গিয়ে একটা শব্দ করে ফেলল।
সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির নিচের দিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হলো।
আহমদ মুসার তর্জনীও চেপে বসল ট্রিগারে। গুলির ঝাক বেরিয়ে গেল স্টেনগান থেকে।
আহমদ মুসার মাথা সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর আড়ালে ছিল। নিচ থেকে আসা শত্রুর সব গুলি মাথার অনেকখানি উপর দিয়ে ড্রইংরুমের ছাদের দিকে চলে গেল।
আহমদ মুসার গুলিবর্ষণ শুরু হবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওদিক থেকে আসা গুলি বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসার স্টেনগানও থেমে গেল। কিন্তু আহমদ মুসা তার জায়গায় স্থির থাকল। মাথাও তুলল না। ওদিকের প্রতিক্রিয়া দেখতে চায় আহমদ মুসা। পলপল করে সময় বয়ে গেল। মিনিট তিন চার অপেক্ষার পর মাথা তুলল আহমদ মুসা। না, কোনো দিক থেকে গুলি এলো না।
স্টেনগানের ট্রিগারে তর্জনী রেখে উঠে বসল আহমদ মুসা। সিঁড়ির নিচের দিকটা দেখল সে। কয়েকটা রক্তাক্ত লাশ সিঁড়ির উপর বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে।
চারদিকে দৃষ্টি ফেরাল। দেখল চাও ঝিং ড্রইংরুমের করিডোর থেকে উঁকি দিচ্ছে। তার মুখ ভয়-আতঙ্কে পাণ্ডুর। আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়ে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা দুই আঙুলের ভি দেখিয়ে চাও ঝিংকে আশ্বস্ত করতে চাইল।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। সিঁড়ি যদিও কার্পেটে মোড়া, তবুও সিঁড়ি দিয়ে কেউ দ্রুত উপরে উঠার ভারি শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।
পুবের সিঁড়ি থেকে এই শব্দটা আসছে। আহমদ মুসা স্টেনগান বাগিয়ে। দাঁড়াল সিঁড়িমুখে।
সিঁড়ি দিয়ে পাগলের মতো ছুটে আসছে লু ঝি। আহমদ মুসা স্টেনগানের ব্যারেল নামিয়ে নিল।
লু ঝি ছুটে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। হাপাচ্ছে সে। বলল, ভালো আছেন আপনি? আপনার মাথায় আবারও আঘাত লেগেছে? গুলি…।
কথা শেষ করতে পারলো না লু ঝি। গলায় আটকে গেল তার কথা।
না, আমার মাথায় কিছু হয়নি লু ঝি। বলল আহমদ মুসা।
হয়েছে, মাথায় অনেক রক্ত দেখা যাচ্ছে। গড়িয়ে পড়ছে মাথা থেকে রক্ত।
বলেই লু ঝি কোমরে বেল্টের মতো জড়ানো কালো কাপড়টা খুলে নিয়ে আহমদ মুসার গলায় জড়িয়ে দিল। বলল, চলুন ভেতরে।
চাও ঝিংও ছুটে এসে ধরল আহমদ মুসাকে।
চাও ঝিং তুমি এঁকে নিয়ে যাও ভেতরে। আমি আসছি।
বলে লু ঝি ড্রইংরুমের ওপ্রান্তের দিকে ছুটল।
ড্রইংরুম ও সিঁড়ির লাশগুলোকে দেখল লু ঝি। নয়টি লাশ। শিউরে উঠল। লু ঝি। নয় স্টেনগানধারী এসেছিল এক আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করা বা মেরে ফেলার জন্যে? কি করে মারাত্মক অসুস্থ আহমদ মুসা ভারি এ অস্ত্রধারীদের মোকাবিলা করল? কীভাবে নয়জনকেই মেরে নিজেকে রক্ষা করল!
চারদিকটা একবার ভালো করে দেখে ছুটল লু ঝি ভেতরে। আহমদ মুসা ঘরে সোফায় গিয়ে বসেছিল। চাও ঝিং কি করবে বুঝতে পারছিল না। দরজার দিকে চোখ যেতেই সে বলল, স্যার, ম্যাডাম আসছেন।
লু ঝি ঘরে ঢুকল। বলল, সোফায় নয় বেডে শুয়ে পড়ুন। বলে বিছানায় হাত বুলিয়ে ঠিক করে দিল সে।
লু ঝি এটা শোবার সময় নয়। ওদিকের কি করলে? বলল আহমদ মুসা।
পুলিশকে জানিয়েছি, তারা আসছেন। ডাক্তার ম্যাডামও আসছেন। বলল লু ঝি।
কথাগুলো আহমদ মুসার জন্যে, বিস্ময়ের এক বড় ধাক্কা। বলল, লু ঝি পুলিশকে খবর দিয়েছ? আমি তো…।
আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে লু ঝি বলল, আপনি ক্রিমিনাল নন। আপনি মহান চীনের জন্যে জীবনবাজি রেখে কাজগুলো করছেন। আপনি ক্রিমিনালদের ফলো করেছেন ড. ডা’কে উদ্ধারের জন্যে। পুলিশকে তো আমাদের সাহায্য করতে হবে।
পুলিশ জানা মানে আপনার বাবারও জানা। তাকে কি বলবে? বলল আহমদ মুসা।
বাবাকে আমিই জানিয়েছি, আমি তার সাথে ঝগড়াও করেছি। লু ঝি বলল।
বিস্ময়ে দুই চোখ আহমদ মুসার কপালে উঠার দশা। বলল, কি জানিয়েছ, কি বলেছ তোমার বাবাকে?
আমার এখানেও সন্ত্রাসীরা আপনার উপর হামলা করেছে, এই খবর পেয়ে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। বাবার অনুমতিতেই ওরা আমাদের বাড়ি সার্চ করেছে এবং এই বাড়িতেও আক্রমণ করবার তারা সাহস করেছে। আমি বাবাকে এই কথাই বলেছি, কেন তিনি সন্ত্রাসীদের আমাদের বাড়ি সার্চ করার অনুমতি দিলেন? এই কারণেই তারা আমার বান্ধবীর বাড়িতে আপনার উপর আক্রমণ করার সাহস পেয়েছে। আমি…
আহমদ মুসা লু ঝি’র কথার মাঝখানেই বলে উঠল, আমার কথা তাকে
কি বলেছ? বিস্ময় আহমদ মুসার কণ্ঠে।
আপনি যা তাই বলেছি। সন্ত্রাসীরা আপনাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আপনাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। বলল লু ঝি।
কিন্তু তোমার বাবার কাছে আগে তো এটা গোপন করেছিলে। আহমদ মুসা বলল।
সেটাও বাবাকে বলেছি। উনি যেহেতু সন্ত্রাসীদের পক্ষে কথা বলেছিলেন, তাই বিষয়টা গোপন করতে বাধ্য হয়েছিলাম দেশের স্বার্থেই এবং এই কারণেই আপনাকে আমার বান্ধবীর বাড়িতে শিফট করেছিলাম। বলল লু ঝি।
উনি সব মেনে নিলেন? আহমদ মুসা বলল।
মেনে নেবেন না কেন? আমি তো অপরাধ করিনি! শুধু তাই নয়, বাবা তার কাজের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বলেছেন যে, তারা রাজনীতি করেন, জনগণকে নিয়ে তাদের কাজ। তাই অনেক সময় অনেকের কথা অনিচ্ছাতেও শুনতে হয়। বলল লু ঝি।
পুলিশকে খবর দেয়ার কথা তাঁকে জানিয়েছ? আহমদ মুসা বলল।
জানিয়েছি। উনিও পুলিশকে বলবেন বলেছেন। বলল লু ঝি।
উনি কোনো পরামর্শ দিয়েছেন? আহমদ মুসা বলল।
উনি বলেছেন, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আপনি আমাদের বাসায় থাকবেন। তবে তিনি বলেছেন, আপনি চলে যেতে চাইলে সেটা আমি যেন তাঁকে জানাই। আপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে কিছু করবেন বা বলবেন হয়তো।
আহমদ মুসার অবচেতন মনের কোথায় যেন খোঁচা লাগল। একটু আনমনা হলো আহমদ মুসা।
কথা শেষ করার পর লু ঝিই আবার বলল, আর বসে থাকা নয়। আপনি শুয়ে পড়ুন। একটু রেস্ট নিতে হবে। ডাক্তার আসছেন।
প্লিজ লুঝি, রেস্ট পরে নেব, পুলিশ আসার আগে লাশগুলো আমি একটু দেখতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
প্লিজ, আপনার মাথার পুরানো আহত জায়গা থেকে ব্লিডিং এখনও বন্ধ হয়নি। এ সময় আপনাকে নড়াচড়া করার অনুমতি দেয়া যাবে না। লু ঝি বলল। তার কণ্ঠ শক্ত।
কিন্তু লাশগুলো আমাকে দেখতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
কেন? পুলিশ তো আসছেই। লু ঝি বলল।
ড. ডা’র উদ্ধার-প্রচেষ্টার সাথে এই লাশ দেখার সম্পর্ক আছে। বলল আহমদ মুসা।
তাঁকে উদ্ধার করা এখন পুলিশের দায়িত্ব। এই মুহূর্তে এই কষ্ট আপনি করতে যাবেন না। দরকার নেই। লু ঝি বলল।
পুলিশের কাজ পুলিশ করবে। আমার কাজ তো আমার। বলল আহমদ মুসা।
এই ঘটনা নিয়ে কি আপনি আরও এগোতে চান? লু ঝি বলল।
ড. ডা আমার কাছে আমার গুরুজনদের মতো। আমার সামনে থেকেই তিনি কিডন্যাপড হয়েছেন। আমি তার জন্যে কিছু করাকে আমার দায়িত্ব মনে করছি। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে, তাহলে উঠুন। আমি আপনার পাশে আছি। আপনাকে আস্তে আস্তে বসতে-উঠতে হবে। লু ঝি বলল।
ধন্যবাদ। বলে আহমদ মুসা উঠল। দুজন হাঁটতে শুরু করলো।
হাঁটতে হাঁটতে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে লু ঝি বলল, স্যার, আমার মনে হয় ড. ডা’র ব্যাপারে এককভাবে কারো কিছু করার সুযোগ খুবই কম। মিলবে। আমার বিশ্বাস ড. ডা’র কিডন্যাপের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সাম্প্রতিককালে মহান চীনে বড় বড় কিছু কিডন্যাপের ঘটনা ঘটেছে।…
এ পর্যন্ত শুনেই দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসা। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে প্রবল জিজ্ঞাসা।
লু ঝিও কথা বন্ধ করে দাঁড়াল।
যেমন?… জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ছাত্র, যুব কম্যুনিস্ট আন্দোলনের শীর্ষ নেতা এবং হুই মুসলিমদের সবচেয়ে সম্মানিত নেতা মা চুইং-এর ছোট ছেলে মা ঝু সুলতান, মা ঝু সুলতানের বড় বোন দেশের অন্যতম শীর্ষ বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও, উইঘুর মুসলমানদের অন্যতম শীর্ষ নেতা উরুমুচির বাসিন্দা ইরকিন আহমেত ওয়াং, চীনের নিষিদ্ধ নগরীর খনন কাজের এবং খনন-পরবর্তী ম্যাপ তৈরি কাজের প্রধান ইঞ্জিনিয়ারের কিডন্যাপ হওয়ার কাহিনী বলে হতাশ কণ্ঠে জানাল, এসব কিডন্যাপের বিষয়ে কিছুই হদিস করতে পারেনি পুলিশ এখনও।
আহমদ মুসার চোখে নেমে এসেছে বিস্ময়। গোগ্রাসে যেন গিলছিল লু ঝি’র কথাগুলো। লু ঝি’র কথার পরও ভাবনা শেষ হলো না আহমদ মুসার। এক সময় সে নির্বিকার কণ্ঠে বলল।
কিডন্যাপের ঘটনা আরও আছে লু ঝি। জিনজিয়াং-এর সাবেক গভর্নরের জামাতা এবং উইঘুর মুসলমানদের উদীয়মান নেতা আহমদ ইয়াং নিখোঁজ হয়েছেন কয়েক মাস হলো। সবাই জানেন তাঁকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।
আবার হাঁটতে শুরু করেছে আহমদ মুসা ও লু ঝি দুজনেই।
আহমদ মুসার কথা শুনে লু ঝি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখে। কিছুটা বিস্ময়। বলল, হ্যাঁ, আমি সে কথা শুনেছি, কিন্তু আপনি তাকে এতটা চেনেন?
জানার সুযোগ হয়েছিল লু ঝি। বলল আহমদ মুসা। লু ঝি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে কিছুটা কৌতূহল। ড্রইংরুমের ওপ্রান্তে লাশের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল আহমদ মুসারা।
যে চারটি লাশ ড্রইংরুম ও সিঁড়িমুখে পড়েছিল, সে লাশগুলো দেখা শুরু করল আহমদ মুসা।
লাশগুলোর পকেট হাতড়িয়ে টাকা ও মানিব্যাগ ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। বড় ক্রিমিনাল দল বা লোকদের এমনটাই দেখে আসছে, আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা লাশগুলোর বাহু, বুক, পিঠ ও শার্ট-জ্যাকেটের কলার, হাতা পরীক্ষা করল। তেমন কিছুই দেখল না। তবে জামা ও জ্যাকেটের হাতার উল্টো পিঠে চীনা একটা অ্যালফাবেট দেখল। ঠিক এখনকার চীনা অ্যালফাবেট নয়, বর্তমান চীনা অ্যালফাবেট-এর আদি রূপ। চীনের ল্যাংগুয়েজ মিউজিয়ামে আহমদ মুসা চীনা অ্যালফাবেট-এর আদি ীপ্টটা দেখেছিল।
লাশগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে আহমদ মুসা সবার জামা-জ্যাকেটের হাতার উল্টো পিঠে এই অক্ষরটা পেল। অ্যালফাবেটটা কি, তার অর্থ কি, এসবকিছুই বুঝতে পারল না আহমদ মুসা। তবে বুঝতে পারল এ সংকেতের একটা অর্থ আছে। উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। যেন এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটা মৌলিক আবিষ্কার। বিষয়টা পরিষ্কার হওয়ার আগে লু ঝিকে এটা সে জানাবে না, সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা।
আশ্চর্য রকম চালাক এই লোকগুলো। এদের সম্পর্কে জানবার, চিনবার, অনুসন্ধান করবার মতো কোনো কিছুই এদের সাথে নেই। তবে এরা বড় কোনো গ্যাং হবে। বলল আহমদ মুসা।
সেই সাথে উঠে দাঁড়াল সে।
এসব থাক। পুলিশ এসে দেখবে। চলুন আমরা যাই। ডাক্তার ম্যাডাম এখনি এসে পৌঁছবেন। লু ঝি বলল।
হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসা। সাথে লু ঝিও।
ঘরে ঢুকে লু ঝি বলল আহমদ মুসাকে, প্লিজ আপনি একটু বিশ্রাম নিন। ডাক্তার এলে তো তাকে আবার সময় দিতে হবে।
ধন্যবাদ! বলে আহমদ মুসা শুয়ে পড়ল।
আমি পাশের ঘরেই আছি স্যার। ডাক্তার এলেই তাকে নিয়ে আসব।
.
ডাক্তার দেখে যাবার পরই আহমদ মুসাকে লু ঝি তার বাসায় নিয়ে এসেছে।
নতুন আঘাত পুরানো আঘাতের গুরুতর ক্ষতি করেছে। ডাক্তারের পরামর্শ ছিল, এ অবস্থায় বাসায় রাখা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। যখন সেটা সম্ভব নয়, তখন খুব সাবধানে থাকতে হবে। আঘাতের উপর কিছুতেই কোনো বাড়তি চাপ আনা যাবে না। অন্তত সাতদিন কমপ্লিট রেস্টে থাকতে হবে।
.
পরদিন সকাল।
আহমদ মুসার নাশতা খাওয়া শেষ। চাও ঝিং বাসন-পত্র নিয়ে গেল।
গতকাল থেকেই লু ঝি’র সেক্রেটারি চাও ঝিং লু ঝি’র সাথে এ বাড়িতে আছে। চাও ঝিং আহমদ মুসার সাংঘাতিক ফ্যান হয়ে উঠেছে। আহমদ। মুসাকে সে মিরাকল ম্যান বলে মনে করে। গতকাল সে যা দেখেছে তা ফিল্ম ছাড়া আর কোথাও ঘটেছে বলে সে মনে করে না। তার সমস্ত সম্মান। ও শ্রদ্ধা এখন আহমদ মুসার প্রতি। স্বেচ্ছায় বাড়তি সার্ভিস দেয়ার জন্য সে তার মনিব লু ঝিকে অফার করেছে।
আহমদ মুসার সাথে লু ঝিও নাশতা করেছে।
বেড়েই বালিশে হেলান দিয়ে আহমদ মুসা কফি খাচ্ছিল। লু ঝি পাশেই সোফায় বসেছিল।
লু ঝি, তোমাদের জিরোতে ভাষাবিজ্ঞানী নিশ্চয় আছেন? বলল আহমদ মুসা।
ভাষাবিজ্ঞানী? ভাষাবিজ্ঞানী দিয়ে কি করবেন? লু ঝি বলল।
মানুষের পরেই গুরুত্বপূর্ণ তার ভাষা। চীনা ভাষাটার মূলটা নিশ্চয় ইন্টারেস্টিং হবে। অসুস্থতার এই সময়টাকে আমি একটু কাজে লাগাতে চাই।
চমৎকার। আমি আপনাকে যতই দেখছি, ততই বিস্ময়ের পরিধি বাড়ছে।
বলে একটু গম্ভীর হলো লু ঝি। বলল, স্যার, আমার একটা বড় কৌতূহল।
কি কৌতূহল? বলল আহমদ মুসা।
আপনার সম্পর্কে কিন্তু আমি কিছুই জানি না। জিজ্ঞাসাও করা হয়নি, আপনিও বলেননি। লু ঝি বলল।
হ্যাঁ, পরিচয় জানা একটা অধিকার। কিন্তু পরিচয় সব সময় পাওয়া যায়। বলল আহমদ মুসা।
পরিচয় পাওয়া না গেলে বলার কিছু নেই। পরিচয় না দেওয়াও একটা দায়িত্ব। বলল লু ঝি।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, আমার নাম তো আপনি জেনেছেন।
নাম নয়, নামের একটা অংশ জেনেছি। আর নাম পরিচয়ের মাত্র একটা অংশ।
গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। একটু ভাবল সে। তারপর হেসে উঠে বলল, তুমি বুদ্ধিমতি, গোটা দুনিয়া সম্পর্কে সচেতন। আমি নিশ্চিত তুমি আমার পরিচয় বের করে ফেলবে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে চাই।
হাসল লু ঝি। বলল, আপনি চমৎকারভাবে নিজের পরিচয় আড়াল করার ব্যবস্থা করলেন। ধন্যবাদ। কিন্তু তবু একটা পরিচয় পেয়েই গেলাম যে, আপনি কোনো না কোনো দিক দিয়ে একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি হলে তবেই চেষ্টা করলে যে কেউ তার পরিচয় বের করতে পারে।
ঠিকই বলেছ লু ঝি। তবে আমি এই অর্থে কথাটা বলিনি। স্যরি। আল্লাহ প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষ যেকোনো অহংকার প্রকাশ থেকে আমাকে হেফাজত করুন। বলল আহমদ মুসা। গম্ভীর কণ্ঠ আহমদ মুসার।
স্যরি স্যার। আমি এদিকটা চিন্তা করে কথাটা বলিনি। স্যার, যে মানুষ অন্যের স্বার্থে মৃত্যুমুখে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তিনি সেটা করেন মানুষকে ভালোবেসে, মানবিক দায়িত্ব বোধের তাকিদে। তার মনে কোনো অহংকারের স্থান হতে পারে না।
থামল একটু লু ঝি। বলল আবার, আপনার সাথে অল্প কয়েক দিনের আমার পরিচয়। তাতেই আমার মনে হয়েছে, আপনার জীবনটা যেন মানুষের জন্যেই। এমন মানুষ তো পৃথিবীতে খুব বেশি দেখা যায় না। তাই তো আমার এত আগ্রহ ছিল জানার জন্যে যে, কে আপনি? আবেগে ভারি হয়ে উঠা কণ্ঠস্বর তার।
লু ঝি, তুমি যেটা বলছ সেটাই স্বাভাবিক। এটা আমার তোমার সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আহমদ মুসা একটু থেমেই বলে উঠল, এসো আমরা পুরনো কথায় ফিরে যাই। আমি একজন ভাষাবিজ্ঞানীর কথা বলছিলাম। তোমার জানা শোনার মধ্যে এমন কেউ আছেন?
আছেন অবশ্যই। আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় একজন চীনা ভাষার ইতিহাসের উপর ডক্টরেট। তিনি বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ডীন ছিলেন। এখন রিটায়ার করেছেন। এই জিবেরা শহরেই তার বাড়ি। তিনি এখন এখানেই থাকেন। লু ঝি বলল।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ধন্যবাদ লু ঝি। তিনিই উপযুক্ত ব্যক্তি হবেন। আমি আজকালের মধ্যে তার কাছে একটু যেতে চাই।
কিন্তু ডাক্তারের তো নিষেধ আছে। এ ধরনের চলাফেরা এখন কিছুতেই করা যাবে না। অন্তত সাত দিন অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে। লু ঝি বলল।
স্যরি লু ঝি, এটা সম্ভব নয়। আমি আসলেই ভালো আছি। তুমি ব্যবস্থা করলে আমি গাড়িতে যেতে পারব। কোনো অসুবিধাই হবে না। বলল আহমদ মুসা।
আমি বুঝতে পারছি না, বিষয়টা এত জরুরি হলো কেন? লু ঝি বলল। দৃষ্টি তার আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
লু ঝি আমি ড. ডা’র কিডন্যাপারদের পরিচয় উদ্ধারের চেষ্টা করছি। এই চেষ্টার অংশ হিসেবেই আমি তাঁর কাছ থেকে কিছু জানতে চাই।
বিস্ময় নেমে এল লু ঝি’র চোখে-মুখে। অনেক প্রশ্ন ছুটে এল তার মনে। ইনি এমন অসুস্থ অবস্থাতেও কিডন্যাপারদের পরিচয় উদ্ধারে তদন্তে নেমেছেন? পুলিশ তো একাজ করছে! আর ড. ডা তো সরকারের লোক। তাদেরই দায়িত্ব তাঁকে উদ্ধার করা। ইনি এ বিষয়টাকে এত বড় অগ্রাধিকার দিচ্ছেন কেন? আর ভাষাবিজ্ঞানীর কাছে এ ব্যাপারে কি-ই বা পাবেন?
তাদের পরিচয় অনুসন্ধানের জন্য ভাষাবিজ্ঞানীর কাছে? আমি বুঝতে পারছি না স্যার? লু ঝি বলল।
আমার একটা সন্দেহ নিরসন হবে এতে। কোনো কাজের একাধিক অপশন থাকতে পারে। সেরকম একটা অপশন নিয়ে আমি ভাবছি। কিছুই। নাও পেতে পারি। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে তাড়াহুড়া করা কেন? লু ঝি বলল।
কিডন্যাপারদের পরিচয় যত তাড়াতাড়ি জানা যাবে, ড. ডাদের উদ্ধার ততই সহজ হবে। বলল আহমদ মুসা।
আবার বিস্ময় নেমে এল লু ঝি’র চোখে-মুখে। তার পলকহীন দুটি চোখ আহমদ মুসার মুখের উপর আটকে আছে। সেই সব প্রশ্ন আবার তার মনে। তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছে, অপহৃতদের উদ্ধার করার দায়িত্ব তাঁর। কেন তিনি এমন কথা বলছেন? আসলে ইনি কে? আবার এই প্রশ্নটাই তার কাছে। বড় হয়ে উঠল। কিন্তু কোনো প্রশ্ন আর সে করল না। বলল, আমি বুঝেছি স্যার। আজ সন্ধ্যার পর আমরা যাব আমার মামা ড. হুয়াং ফুর কাছে। একটু আগেই আমরা যাব। আমি মামাকে বলে রাখছি।
.
সন্ধ্যার পর লু ঝি’র গাড়ি বারান্দা থেকে একটা গাড়ি বেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে বাড়ির সামনের বড় রাস্তায় উঠল। ছুটে চলল প্রশস্ত রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে।
ড্রাইভিং সিটে লু ঝি।
পাশের সিটে বসেছে আহমদ মুসা। তার মাথায় হ্যাট। হ্যাটটা তার মাথার ব্যান্ডেজ ঢেকে দিয়েছে।
জনাব হুয়াং ফুঁ কোথায় থাকেন? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
জিবেরা শহরের একদম পশ্চিম মাথায়। প্রায় বিশ কিলোমিটার হবে এখান থেকে।
কথা শেষ করেই লু ঝি আবার বলল, এই সময় এই এলাকায় গাড়ি ঘোড়া কম থাকে। আমাদের যেতে সময় বেশি লাগবে না।
আমরা এমন আলোচনা নিয়ে যাচ্ছি উনি কি বিরক্ত হবেন? বলল আহমদ মুসা।
হাসল লু ঝি। বলল, দেখবেন আপনি উঠতে পারবেন না ওখান থেকে। কথা বলার জন্যে কাউকে পেলে বড় মামা তাকে ছাড়েন না। আপনাকে পেলে তো কথাই নেই।
এরকম টুকিটাকি গল্পের মধ্য দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছিল লু ঝি। ছুটে চলছিল গাড়ি প্রায় ফাঁকা সোজা রাস্তা ধরে।
অভ্যাস বশতই আহমদ মুসার চোখ গাড়ির রিয়ার ভিউ-এর উপর গিয়ে পড়ছিল। অনেকক্ষণ ধরেই একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা যাচ্ছিল একই গতিতে তাদের পেছনে পেছনে আসতে। হঠাৎ গাড়িটার গতিবেগ বেড়ে গেল। ব্যাপারটা আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। হঠাৎ এমন গতিবেগ বাড়া স্বাভাবিক নয়। কোনো খবর পেয়েই হঠাৎ যেন গাড়িটা লাফ দিয়ে উঠেছে।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
গাড়ির রিয়ার ভিউ থেকে আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনের দিকে ছুটে গেল। সামনে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠল আহমদ মুসা। দেখল সামনের দিক থেকে চারটি হেডলাইট ছুটে আসছে রং সাইড নিয়ে। লু ঝি আহমদ মুসার মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পেয়েছিল। সেও দেখতে পেয়েছিল বাম সাইড দিয়ে আসা চারটি হেডলাইট। রং সাইড দিয়ে এভাবে ছুটে আসতে দেখে সেও আঁতকে উঠেছিল।
চারটি হেডলাইটের ধেয়ে আসার দিকে চোখ পড়তেই আহমদ মুসা একটু ঘুরে ডান হাত দিয়ে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে সিটের সামনের দিকে নিজেকে একটু সরিয়ে নিয়ে বলল, লু ঝি তাড়াতাড়ি এই সিটে সরে এসো। কুইক।
সামনের দিকে চোখ পড়ার পরই লু ঝি পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছিল। সুতরাং লু ঝি আহমদ মুসা বলার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের দেহটাকে সিটের দেয়ালের দিকে গুটিয়ে নিয়ে এগিয়ে এল পাশের সিটে। সাথে সাথেই আহমদ মুসা বসল তার জায়গায়।
রিয়ার ভিউ-এর দিকে তাকিয়ে পেছনের গাড়িটার দূরত্ব পরিমাপ করে নিল আহমদ মুসা।
সামনের চারটা হেডলাইটের পারস্পরিক দূরত্ব ও উচ্চতা দেখে গাড়ি দুটির আকৃতি এবং তা রাস্তার কতটা জুড়ে আসছে, তার পরিমাপ করে নিল।
আহমদ মুসা তার গাড়িটাকে সামনের দুই গাড়ির মাঝ বরাবর নিয়ে এল।
আহমদ মুসা তার গাড়ির গতি একটুও পরিবর্তন করল না। সে বুঝতে দিতে চায় না যে, তাদের ষড়যন্ত্র-পরিকল্পনা আহমদ মুসারা বুঝতে পেরেছে।
লু ঝি’র চোখে-মুখে আতঙ্কের ছায়া।
সে একবার দেখছে সামনের গাড়ি দুটোকে, আবার তাকাচ্ছে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার মুখ পাথরের মতো স্থির, নির্বিকার। তার দুই চোখ। সামনের দুই গাড়ির উপর আঠার মতো লেগে আছে।
লু ঝি তুমি রিয়ার ভিউতে পেছনের গাড়ির গতি এবং এগোবার লাইনটা দেখ।
পেছন থেকেও গাড়ি তাড়া করেছে! এটা শুনে আঁতকে উঠল লু ঝি। তাকাল রিয়ার ভিউ-এর দিকে।
কয়েক সেকেন্ড দেখে বলল, গাড়িটা মনে হয় তার সর্বোচ্চ গতিবেগ নিয়ে এগিয়ে আসছে। আর গাড়িটা ঠিক আমাদের গাড়ির লাইনে আছে। বলল লু ঝি। উদ্বেগে তার কণ্ঠ রুদ্ধ প্রায়।
একটু থেমেই সঙ্গে সঙ্গে আবার বলে উঠল, ওরা আমাদের সামনে পেছনে দুই দিক থেকে আঘাত করবে। আমাদের পালাবারও তত পথ নেই। কেঁপে কেঁপে কথাগুলো বেরিয়ে এল লু ঝি’র কণ্ঠ থেকে। শুকনো তার কণ্ঠ।
আহমদ মুসার পলকহীন দৃষ্টি সামনের গাড়ির উপর নিবদ্ধ। চোখ না, সরিয়েই বলল, লু ঝি, আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে। শান্ত-স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর আহমদ মুসার।
লু ঝি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখে মুখে তার সেই ঔজ্জ্বল্য। শুধু তাতে লড়াই করার মতো শপথদীপ্ত ছাপ।
দুদিক থেকেই তখন গাড়ির শব্দ তীব্র হয়ে উঠেছে। যমদূতের মতো ছুটে আসছে সামনের ও পেছনের গাড়ি দুটো।
আহমদ মুসা গাড়ির লাইন সামান্যও চেঞ্জ করেনি। দুই গাড়ির মাঝ বরাবর যে স্পেস আছে, ঠিক তার বরাবর গাড়ি ছুটে চলেছে আহমদ মুসার।
সামনের গাড়ি দুটিও তাদের লাইন তেমন একটা চেঞ্জ করেনি। শুধু পরস্পর একটু ক্লোজ হয়েছে। মাঝের ফাঁকা জায়গা দিয়ে আহমদ মুসার গাড়ি যাতে স্লিপ করতে না পারে, তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। খুশি হলো। আহমদ মুসা। তার কৌশল কাজ দিয়েছে। গাড়ি ক্লোজ হওয়ায় বামদিকের। গাড়িটা ও ফুটপাতের মধ্যকার স্পেস আর একটু বেড়েছে।
সামনের গাড়ি দুটো পঞ্চাশ মিটার দূরে। পেছনের গাড়িটাও তাই হবে।
আহমদ মুসা স্টিয়ারিং হুইলে রাখা হাত দুটোকে আরও মজবুত করল। চেপে ধরল অ্যাকসেলেটর বিসমিল্লাহ বলে। আর সেই সাথে ধ্বনিত হলো শক্ত কণ্ঠ আহমদ মুসার, লু ঝি শুয়ে পড় সিটে, আঁকড়ে ধর সিট।
আহমদ মুসার গাড়ি লাফ দিয়ে উঠে চলতে শুরু করেছে তীব্র গতিতে।
দ্রুত কমছে দূরত্বের আয়ু। দশ মিটার বিশ মিটার হারিয়ে গেল দূরত্ব। থেকে চোখের পলকে। ডিস্ট্যান্ট মিটারের লাল কাঁটা তিরিশ মিটারে পৌঁছতেই আহমদ মুসা বামদিকে এল আকারে এক ভয়ানক টার্ন নিল। গাড়ির চাকা চিৎকার করে উঠল, কিন্তু গাড়ি উল্টে গেল না। গতি একটুও কমায়নি আহমদ মুসা।
শক্ত, স্থির আহমদ মুসার মুখ।
তার দুই বাহু শক্ত করে ধরে স্টিয়ারিং হুইল। প্রথম টার্ন নেবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরেকটা এল টার্ন নিল আহমদ মুসা। আরও কয়েক সেকেন্ড পর গাড়ির হার্ড ব্রেক কসল সে। তার সাথে সাথেই প্রচণ্ড সংঘর্ষের শব্দ। আরও কয়েকটা মুহূর্ত, কয়েকটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ।
আহমদ মুসার ভ্রূক্ষেপ সেদিকে নেই। দুই হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখেই। সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে সে। চোখ দুটি বোজা তার। আর আল্লাহর শোকর আদায়ে হৃদয় তার ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। করুণাময় আল্লাহ তার অপার করুণা দিয়ে বারবার তাকে সাহায্য করেন। এই সেদিন আর্মেনিয়ায় সে ঠিক আজকের মতোই গাড়ির ফাঁদে পড়ে স্যান্ডউইচ হওয়ার হাত থেকে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছেন।
ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের ঘোর তখনও কাটেনি লু ঝি’র। গাড়ির ভয়ংকর টার্নের সময় সে আঁকড়ে ধরেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। তার দেহের পেছনের অংশ সিটকে পড়েছিল সিটের নিচে। মনে হয়েছে গাড়ির সংঘর্ষ ও বিস্ফোরণের শব্দ যেন তাদেরই উপর হয়েছে। তারা কোথায়, কি অবস্থায়, কি ঘটেছে, ভাবতেও ভয় করছে তার। চোখ খুলতে পারছে না আতঙ্কে।
এক সময় তার মনে হলো, তার ডান হাত নরম কিছু যেন জাপটে ধরে আছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখল, তার ডান হাত আহমদ মুসার উরু জাপটে ধরে আছে। সিটকে পড়া থেকে বাঁচতে গিয়ে খুঁজে হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই আঁকড়ে ধরেছে সে।
লু ঝি তাড়াতাড়ি হাত টেনে নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসাকে নীরব, নিস্পন্দ, চোখ বোজা এবং সিটের উপর এলিয়ে পড়া দেখে ভয় পেয়ে গেল লু ঝি। লু ঝি তাড়াতাড়ি উঠে আহমদ মুসার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে আর্তকণ্ঠে বলল, স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো? আপনার চোখ বন্ধ, কেন?
আহমদ মুসা চোখ খুলল। সোজা হয়ে বসল।
চোখ খোলার সাথে সাথে দুচোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার দুই গণ্ড বেয়ে।
স্যার; আমরা বেঁচে গেছি। ঈশ্বর আমাদের বাঁচিয়েছেন। আপনার চোখে অশ্রু কেন? বলল লু ঝি।
এ অশ্রু কান্নার নয়, আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয়ার। সব অসম্ভবকে তিনিই সম্ভব করতে পারেন। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু আমরা বাঁচলাম কি করে? আপনার আদেশ শোনার পর বুঝেছিলাম দুদিকের পেষণে পিষ্ট হয়ে মরার প্রস্তুতি ওটা। লু ঝি বলল। তার কণ্ঠ কান্নায় অবরুদ্ধ।
কি করে বাঁচলাম চল দেখে আসি। বলে আহমদ মুসা নামল গাড়ি থেকে।
লু ঝিও নেমে এল ওপাশের দরজা দিয়ে। তারা দেখল, মুখোমুখি ধাক্কা খেয়ে দুই গাড়ি এবং একটি গাড়ি আইল্যান্ডের সাথে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত ও বিস্ফোরিত হয়েছে। প্রবল গতিবেগের কারণেই গাড়ি তিনটির এই মর্মান্তিক দশা হয়েছে। ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হয়ে গাড়িতে আগুন লেগে যাওয়ায় কারও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম।
সব দেখে লু ঝি তাকাল আহমদ মুসার দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে। বলল, স্যার, যা ঘটেছে, যা ঘটালেন তা অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য…। আবেগরুদ্ধ তার কণ্ঠ। বিস্ময়পীড়িত তার চেহারা। বিমুগ্ধ তার দৃষ্টি।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখন দুদিক থেকে পুলিশের গাড়ি আসতে দেখা গেল।
চল লু ঝি গাড়িতে। পুলিশের জন্যে অপেক্ষা করার আমাদের প্রয়োজন। নেই। পুলিশ সহজেই বুঝবে, হাইল্যান্ডার জীপকে টার্গেট করে রং সাইড, নিয়ে গাড়ি আসছিল। অবশ্যম্ভাবী সংঘর্ষে এই মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে।
আহমদ মুসা চলতে শুরু করল। তার সাথে লু ঝিও। আহমদ মুসার নির্দেশে লু ঝি আবার ড্রাইভিং সিটে বসেছে।
গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, কোথায় যাব আমরা? আমরা কি এখন ফিরে যাব না বাড়িতে?
বাড়ি ফেরার মতো কিছু ঘটেনি লু ঝি। তুমি অন্যরকম না ভাবলে আমরা যেখানে যাচ্ছিলাম, সেখানেই যেতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ, আপনি যা বলছেন, সেটাই আমার মত। আমি ভেবেছিলাম, আপনার উপর এত বড় প্রাণঘাতী আক্রমণ হলো এবং যখন শত্রুর নজরে পড়েই গেছি, তখন আর আমরা সামনে অগ্রসর হবো কি না। বলল লু ঝি।
ফিরে গেলেই যে বিপদ বাড়বে না, তা নয়। শত্রু তার কাজ করুক, চল। আমরা আমাদের কাজ করি। বলল আহমদ মুসা।
আবার লু ঝি’র বিস্ময় দৃষ্টি গিয়ে নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার মুখে। বলল। লু ঝি, আপনাকে প্রশংসা করার মতো কোনো শব্দ, কোনো বিশেষণ আমার। জানা নেই। এত বড় ঘটনা…।
আহমদ মুসা লু ঝি’র কথার মাঝখানেই বলে উঠল, বিশেষণ বা বিশেষণ বাচক বিশেষ্য-এর ব্যবহার মানুষের ক্ষেত্রে কোনো সময়ই যথার্থ হয় না লু ঝি। হয় বেশি হয়, না হয় কম হয়। তবে অতিরঞ্জনটাই বেশি হয়। তাই লু ঝি কোনো বিশেষণ খুঁজো না। আসলে সব প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, স্রষ্টার জন্যে।
ধন্যবাদ। একটা প্রবল কৌতূহল আমার, সামনে ও পেছন থেকে ট্রাকের মতো ভারি গাড়ি আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মুখে শেষ বিশ মিটারের সংকীর্ণ স্পেসে আপনি গাড়ি ঘুরিয়ে গাড়িকে ঐরকম নিরাপদ জায়গায় নিতে পারবেন, এমন নিখুঁত অংক আপনি কীভাবে কষলেন! আর এমন ভয়াবহ ঝুঁকি নিতে আপনার বুক কাঁপেনি? ভেবে আমি কুল-কিনারা পাচ্ছি না, দূরত্ব। হিসাব করে আপনি প্রথম টার্ন নিয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র সাত-আট ফুট পরে। ফুটপাত থেকে বাঁচার জন্যে দ্বিতীয় টার্ন আপনি ঠিক সময়ে কেমন করে নিলেন?
মানুষের সামনে যখন সব পথ বন্ধ হয়ে যায়, আল্লাহ তখন নতুন পথ খুলে দেন। মাথায়-মনে বুদ্ধি পরিকল্পনাও তিনিই এনে দেন, কঠিনকে তিনি সহজ করে দেন। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাদের গাড়ি টার্ন নিয়ে ডান দিকের একটা রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করল। বলল লু ঝি, তবে স্যার, স্রষ্টা পথ খুলে দেন তাদেরকেই যারা যোগ্য, কিন্তু সবাই সে পথ পায় না বা সে পথে চলতে পারে না। আপনি যা করেছেন তা আমার জন্যে অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। কয়েক সেকেন্ডে কি ঘটেছিল, তা ভাবতেই আমার বুক কাঁপছে।
সেটা আমি পাশে আছি এবং ছিলাম বলে। যদি তুমি একা থাকতে, তাহলে তুমিও তা করতে, আমি যা করেছি। বলল আহমদ মুসা।
আমি আর কথা বলব না আপনার সাথে। প্রশংসা এড়াবার জন্যে, আপনার অনন্যতাকে চাপা দেয়ার জন্যে সবাইকেই আপনার সমকক্ষ বানাতে ছাড়বেন না। লু ঝি বলল। তার কণ্ঠে অভিমানের সুর।
দেখ আমি তো শুধু কথায় কাজ সারছি, তোমার মুখে ধুলা দিতে যাইনি। বলল আহমদ মুসা।
বুঝলাম না স্যার। লু ঝি বলল। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
এই যে কথা বলবে না বললে? বলল আহমদ মুসা।
আমি কথা বলছি না, মুখে ধুলা দেয়ার অর্থটা বুঝতে পারিনি তাই বললাম।
একটু থেমেই আবার বলে উঠল লু ঝি, আমার মামার বাসায় আমরা এসে গেছি।
আহমদ মুসা বলল, আমাদের ধর্মে সামনে প্রশংসাকারীর মুখে ধুলা নিক্ষেপের কথা এসেছে।
আহমদ মুসাদের গাড়ি আবার একটা টার্ন নিল। প্রাইভেট ধরনের একটা রাস্তা ধরে অল্প কিছুটা এগিয়ে একটা টিলায় উঠে। এল আহমদ মুসাদের গাড়ি।
টিলাটা বেশ বড়। তার মাথায় বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে বিশাল একটা বাড়ি।
বাড়িটা দেখিয়ে বলল লু ঝি, ঐ বাড়িতেই আমরা যাচ্ছি। মামাদের বাড়ি ওটা।
[*সামনে প্রশংসাকারীর মুখে ধুলা নিক্ষেপের কথা হাদীসে এসেছে।]
.
কফি খেতে খেতে লু ঝি’র মামা আবার অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। পরিচয়ের সময়ও লু ঝি’র মামা অধ্যাপক হুয়াং আহমদ মুসার। দিকে এই দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।
লু ঝি আহমদ মুসা সম্পর্কে সব কথা মামাকে বলে রেখেছিল। পরিচয় পর্বে সে শুধু জানায়, মামা ইনি ড. ডা’র উদ্ধারের ব্যাপারে কাজ করতে চান। এ ব্যাপারেই তিনি চান আপনার কাছে কিছু একটা বিষয় জানতে।
লু ঝি’র মামার মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। তাতে পড়েছিল বেদনার ছায়াও। বলেছিল অধ্যাপক হুয়াং, ড. ডা আমার বন্ধু। তার মতো একজন নির্বিরোধ গুণী মানুষ কিডন্যাপড় হওয়ায় আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি, তার সাথে বড় আঘাতও পেয়েছি।
একটু থেমেছিল অধ্যাপক হুয়াং। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। বলেছিল, খবরের কাগজেই আমি পড়েছি ড. ডা’র জন্যে তুমি কি করেছ। পুলিশদের যা করার ছিল, তুমিই সেটা করেছ। তাকে উদ্ধার করতে ছুটে এসে তুমি ভয়ানক বিপদে জড়িয়েছ। তোমাকে না দেখেই আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। তুমি আবার তার অনুসন্ধানে নামতে চাও। আমি তোমার মানবতায় মুগ্ধ।
অধ্যাপক হুয়াং লু ঝি’র মামা-খালাদের মধ্যে সবার বড়। অনেক বয়স। হয়েছে তার। তার মাথার চুল, দাড়ি, এমনকি চোখের ভ্রুও একেবারে শুভ্র। প্রথমেই আহমদ মুসাকে সে তুমি বলে সম্বোধন করেছিল।
অধ্যাপক হুয়াং আহমদ মুসার দিক থেকে অর্থপূর্ণ, সেই সাথে বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি সরিয়ে কফির মগটা টেবিলে রেখে আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ইয়ং ম্যান, তুমি তোমার পরিচয় লু ঝিকে দাওনি, আমাকেও দাওনি। আমি কি ঠিক বলছি?
আহমদ মুসা তাকাল অধ্যাপক হুয়াং-এর দিকে।
জি, ঠিক বলেছেন স্যার। বলল আহমদ মুসা।
প্রথম দেখাতেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত।
মুহূর্তের জন্য একটু থামল অধ্যাপক হুয়াং। বলল আবার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, আপনার পরিচয় গোপন করার যৌক্তিকতা আছে। আপনার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। আমি সত্যি বিস্মিত, অভিভূত আপনাকে দেখে। আমার এখনও মনে হচ্ছে চোখ কি আমার ঠিক দেখছে!
স্যার, শুরুতেই আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছেন। আমি এই সম্বোধনেই খুশি। প্লিজ আমাকে আপনি বলে বিব্রত করবেন না। বলল আহমদ মুসা।
একটু থামল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই আবার কথা বলার জন্যে মুখ। খুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই লু ঝি বলল, বড় মামা, আপনি এঁকে চিনতে পেরেছেন। এখন ওঁর পরিচয় গোপন রাখাকে সম্মান দেখান ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার আগ্রহ তো শতগুণ বেড়ে গেল ওঁর পরিচয় জানার জন্যে, তার কি হবে এখন?
হাসল অধ্যাপক হুয়াং, লু ঝি’র মামা।
আমি এই বিষয়েই কথা বলতে যাচ্ছিলাম। আমার কৌতূহল, প্রথম। দেখাতেই আপনি চিনেছেন। তার মানে আপনি আমাকে ভালোভাবে চিনেন। কিন্তু কীভাবে চিনেন? আমি চীনের এ অঞ্চলে কখনই আসিনি। বলল আহমদ মুসা।
গম্ভীর হয়ে উঠল অধ্যাপক হুয়াং-এর মুখ। বলল, তোমার পরিচয়ের জন্য খুব অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই।
তোমার পরিচয় দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। ইন্টারনেট তোমাকে প্রতি পদে পদে ফলো করছে। আপডেট দিচ্ছে তোমার ব্যাপারে। ইন্টারনেটের সবটা হয়তো ঠিক হয় না। তবে মোটামুটি একটা স্টোরি পাওয়া যায় তোমার ব্যাপারে। তোমাকে জানা আমার শুরু হয় তুমি যখন প্রথমবার সোভিয়েট ইউনিয়নে আস তখন থেকে। দ্বিতীয়বার তুমি সিংকিয়াং এসেছিলে তখন বেজিং-এ সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নরের সাথে আমার দেখা হয়। তার কাছ থেকে প্রথমবার তোমার সম্পর্কে সরাসরি জানার সৌভাগ্য আমার হয়। আধুনিক যুগে যারা দুনিয়ায় পরিবর্তন এনেছেন, তাদের বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন কারণে আমি শ্রদ্ধা করি। তোমাকে আমি শ্রদ্ধা করি, তোমাকে শ্রেষ্ঠ আসন দেই এই কারণে যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনার কাজে তুমি তোমার আদর্শবাদ, নৈতিকতা, মানবিকতার সম্মিলন ঘটিয়েছ। অন্য অনেকের চাইতে তোমার বড় পার্থক্য হলো, অবৈধকে তুমি সব সময় অবৈধ বলেছ, অন্যায়কে সর্বাবস্থায় তুমি অন্যায় বলেছ। কিন্তু অন্যায় পথে অবৈধ কাজের দ্বারা মহৎ লক্ষ্য অর্জনকে তুমি বৈধ মনে করনি।
থামল অধ্যাপক হুয়াং।
আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল, স্যার, এই নীতিবোধের জন্যে ব্যক্তি হিসাবে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। আমার জীবনের প্রতিটি কর্মে আমি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আমার ধর্মের আদর্শবাদকে অনুসরণ করে থাকি।
জানি আমি ইয়ং ম্যান। আমি আমার ধর্মকে খুব ভালোবাসি। তবু বলি, তোমাদের ইসলাম একটা জীবন্ত ধর্ম। এর আদর্শবাদ, এমনকি এর দৈনন্দিন আচারও মানুষের বাস্তব জীবন ঘিরে। তোমার ধর্মের উৎস অলৌকিক, কিন্তু এর বিধানগুলো সব লৌকিক, মানুষের মঙ্গলের জন্যে।
লু ঝি নির্বাকভাবে আহমদ মুসা ও অধ্যাপক হুয়াং-এর কথা শুনছিল। তার মুখমন্ডল বিস্ময়ে জড়ানো। তার মেহমান আহমদ নামের এই লোকটি কে! ইতিমধ্যেই সে জেনেছে লোকটি অসাধারণ। আজকে আসার পথে যা ঘটল, তা শুধু অসাধারণ নয়, অতি অসাধারণ। পাথরের মতো শক্ত নার্ভ যার, এমন একজন মানুষ, যিনি শ্রেষ্ঠদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ড্রাইভিং-এ, তাঁর পক্ষেই মাত্র সম্ভব এমন ঝুঁকি নেয়ার চিন্তা করা। তার বড় মামা যে প্রশংসা করলেন, তার উপযুক্ত মাত্র তিনিই। আশ্চর্য, তার বড় মামা নিজের প্রশংসা যেমন পছন্দ করেন না, তেমনি কারও প্রশংসা বিশেষ করে সাক্ষাতে প্রশংসা তিনি করেন না। সেই তার বড় মামা যে বাধভাঙা প্রশংসা তার করলেন, তাতেও বোঝা যায় ইনি অনন্য কেউ।
অধ্যাপক হুয়াং থামলে লু ঝি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল, বড় মামা, আমি কিন্তু অন্ধকারে।
হাসল অধ্যাপক হুয়াং। বলল, তোমার মেহমানের আহমদ নামের সাথে যোগ কর, মুসা। এটাই ওঁর নাম। নাম থেকে পরিচয় পাও কিনা। দেখ।
তার মানে মামা ইনি আহমদ মুসা। ও গড! বলে উঠে দাঁড়াল লু ঝি। বলল, সেই কিংবদন্তীর আহমদ মুসা চীনে? আমাদের জিবেরাতে আমাদের সামনে? আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে বড় মামা। তার চোখে বিস্ময় আর আনন্দের ঔজ্জ্বল্য।
তোমার প্রশ্নগুলো আমারও লু ঝি। ইন্টারনেটের কমেন্টগুলোতে একটা কথা বহুল প্রচলিত যে, আহমদ মুসা যেখানে যায়, সেখানে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। কথাটা যে সত্য তার প্রমাণ দেখেছি সিংকিয়াং-এ। আহমদ মুসা দুবার সেখানে এসেছিল, দুবারই চীনের জন্যে মঙ্গলকর পরিবর্তন সেখানে এসেছিল। আমার মনে এখন প্রশ্ন, এবার আহমদ মুসা চীনে কি পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে এসেছে। বলল অধ্যাপক হুয়াং।
বড় মামা, এবার উনি সিংকিয়াং-এ নয়, এসেছেন চীনের কেন্দ্রে। এখানে কি ধরনের পরিবর্তনের বার্তা থাকতে পারে? লু ঝি বলল।
স্যরি, আমি কোনো বার্তা নিয়ে আসিনি। আমি ছোট একটা কাজ নিয়ে এসেছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
কি কাজ নিয়ে এসেছিলে? জিজ্ঞাসা অধ্যাপক হুয়াং-এর।
আমার স্নেহভাজন এবং ছোট ভাইয়ের মতো আহমদ ইয়াং উইঘুর থেকে কিডন্যাপ হয়েছে। অনেক চেষ্টাতেও তার কোন হদিস মেলেনি। আমি তার খোঁজ নিতে এসেছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু জনাব, আপনি কথাগুলো পাস্ট টেন্সে বলছেন। তাঁকে উদ্ধারের কাজে আপনি এখন নেই? লু ঝি বলল।
অবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। অতীতে ছিল শুধু আহমদ ইয়াংকে উদ্ধার করা এবং উইঘুর পরিস্থিতিকে কুলডাউনের চেষ্টা করা। কিন্তু বিমানে ঐ ঘটনার পর আমি এখন নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি। মনে হচ্ছে আহমদ ইয়াং থেকে শুরু করে সর্বশেষে কিডন্যাপ হওয়া ইরকিন আহমেত ইয়াং পর্যন্ত সব কিডন্যাপ একসাথে জড়িয়ে গেছে। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে আর কিডন্যাপগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকছে না। সব মিলিয়ে চীনের জন্যে একটা বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং অজ্ঞাতেই আহমদ মুসা তার সাথে জড়িয়ে পড়েছে। আমরা এখন ভাবতে পারি, ছোট হোক, বড় হোক একটা পরিবর্তন চীনে আসছে। অধ্যাপক হুয়াং বলল। হালকা নয়, গম্ভীর কণ্ঠ অধ্যাপক হুয়াং-এর।
আমি সেরকম কিছু চিন্তা করি না স্যার। চীন একটা মহান দেশ। চীনের সমাজ ও রাজনীতির সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। আমি চাই এই সম্পর্ক আরও গভীর হোক, চীন ও চীনের মানুষের জন্যে কল্যাণকর হোক। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমি জানি, তুমি সব সময় শান্তির পক্ষে। অধ্যাপক হুয়াং বলল।
স্যার, আমাদের ধর্ম ইসলাম-এর অর্থ শান্তি। আমাদের ধর্ম চায় ইহকাল পরকাল-দুই কালেরই শান্তি। বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি’র বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার পরিচয় পাওয়ার পর থেকেই লু ঝি অনেকখানি সংকুচিত হয়ে গেছে। তার মুগ্ধ দৃষ্টির পাশে তার মধ্যে একটা বিব্রত ভাবও সৃষ্টি হয়েছে। আনন্দ আশঙ্কা তার হৃদয়কে তোলপাড় করে তুলেছে। বিমান-এর ঘটনা থেকে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব কথাই তার মনে পড়ছে। স্বপ্নের মতো লাগছে যে, আহমদ মুসাকে সাহায্য সেবা দেয়ার দুর্লভ সুযোগ সে লাভ করেছে। তার দেহের প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রীতে অব্যক্ত ও অপরিচিত এক শিহরণ উঠল। অবচেতন মনে অপরিচিত এক ভাবের অনুরণন সে শুনতে পেল। লু ঝি’র। বাইরের বিব্রত ভাবটা আরও গম্ভীর হয়ে উঠল।
জানি আমি সেটা আহমদ মুসা। আমি শ্রদ্ধা করি তোমাদের ধর্মকে। বলল অধ্যাপক হুয়াং।
কথা শেষ করেই অধ্যাপক হুয়াং শরীরটাকে সোফায় এলিয়ে দিয়ে বলল, বল আহমদ মুসা। তোমার কি যেন জানার ছিল।
ধন্যবাদ স্যার! বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে একখণ্ড কাগজ বের করে অধ্যাপক হুয়াং-এর হাতে দিয়ে বলল, আমার মনে হয় চীনের প্রাচীন একটা বর্ণ এটা।
কাগজটা হাত পেতে নিল অধ্যাপক হুয়াং। নজর বুলাল আহমদ মুসা। কথিত বর্ণটির উপর। কুঞ্চিত হলো অধ্যাপক হুয়াং-এর। বলল, হ্যাঁ, আহমদ মুসা, প্রাচীন চীনের অতিপ্রাচীন হানজু বর্ণমালার প্রথম বর্ণ এটা। এ বর্ণমালা মুছে গেছে। অনেক পরিবর্তিত হয়ে সে বর্ণমালা এখন একটা রূপ নিয়েছে। মুছে যাওয়া অতীতকে তুমি টেনে আনছ কেন? কি বলতে চাচ্ছ তুমি?
এই বর্ণটা কোনো সিম্বল হতে পারে কি না? বলল আহমদ মুসা।
সিম্বল? স্বতকণ্ঠে উচ্চারণ করল অধ্যাপক হুয়াং। ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে তার। স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। ভাবছে সে।
সিম্বল-এর অর্থ হলো কেউ এটা ব্যবহার করে। বল তো ব্যবহারকারী একজন ব্যক্তি, একটি গ্রুপ, না একটা ক্যুনিটি? বলল অধ্যাপক হুয়াং।
ভাবল আহমদ মুসা। একটা সন্ত্রাসী গ্রুপ এটা ব্যবহার করে এটা সে জানাতে চায় না। বলল সে, গ্রুপও হতে পারে, ক্যুনিটিও হতে পারে।
মামা আমি বর্ণটা কি দেখতে পারি। লু ঝি বলল।
অধ্যাপক হুয়াং কাগজটা লু ঝি’র হাতে দিল। বর্ণটির উপর নজর বুলাল লু ঝি।
হঠাৎ একটা বিস্ময়ের ছায়া খেলে গেল লু ঝি’র চোখে-মুখে।
প্রাচীন এই বর্ণ, প্রাচীন বর্ণমালা ঐতিহ্যিক সিম্বল হতে পারে। প্রাচীন বর্ণমালার সাথে আবেগপূর্ণ অতীতের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। যাকে বলে চীনের স্বর্ণযুগ, তার উত্থান ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ সালে। গোল্ডেন এজ এর প্রথম সম্রাট ছিলেন হোয়াং দি। তাকে ইয়েলো ম্রাটও বলা হয়। আমাদের ইয়েলো নদীর অববাহিকায় উ জিয়া নামে এক জাতি-গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। ইয়েলো ম্রাট উ জিয়া জাতি-গোষ্ঠীর নেতা। হানজু এদেরই ভাষা ছিল। উ জিয়া যেমন হানদের পূর্ব পুরুষ, তেমনি হানজু ভাষা থেকেই বর্তমান চীনা ভাষার উদ্ভব। সুতরাং ঐতিহ্যবাদী, জাতীয়তাবাদী কেউ বা কোনো ক্যুনিটি এই সিম্বল ব্যবহার করতে পারেন। বলল অধ্যাপক হুয়াং।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মনে মনে বলল, কিন্তু সন্ত্রাসীরা এই সিম্বল ব্যবহার করছে কেন? কোন উদ্দেশ্যে? প্রশ্নগুলো আহমদ মুসার মনে আকুলি-বিকুলি করে উঠল।
প্রশ্নগুলো চাপা দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ধন্যবাদ স্যার।
একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল আবার, স্যার, জাতীয়তাবাদী বা কল্পকাহিনী, লোককাহিনীভিত্তিক কোনো চরমপন্থী আন্দোলন কি কখনও হয়েছে চীনে?
অধ্যাপক হুয়াং তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার দৃষ্টিটা লক্ষ্যহীন।
ভাবছে অধ্যাপক হুয়াং। বলল, এমন সংঘবদ্ধ কোনো আন্দোলন কখনও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে আমাদের ইতিহাসের প্রাচীন অধ্যায় লেজেন্ডারি বীর ও লেজেন্ডারি কাহিনীতে ভরা এবং সে বীররা ও কাহিনীগুলো চীনাদের সাহস, শক্তি, অনুপ্রেরণার উৎস। এসব মানুষের ঐক্য ও সংগ্রামেরও উৎস হতে পারে। তবে এমনটা এখনও হয়নি।
ধন্যবাদ স্যার। ভিন্ন রকম একটা চিন্তা। বলেই চুপ করল আহমদ মুসা। সে বলতে চেয়েছিল, কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ কি চীনের জাতীয়তাবাদী লেজেন্ডারি বীর ও কাহিনীকে ব্যবহার করতে পারে তাদের স্বার্থে মানুষের আবেগ কাজে লাগাবার জন্যে! কিন্তু ভাবল আহমদ মুসা, সন্ত্রাসীদের পরিচয় এই মুহূর্তে এত স্পষ্ট করা ঠিক হবে না। তাকে আগে আরও নিশ্চিত হতে হবে।
চিন্তাগুলো চেপে রেখে বলল আহমদ মুসা, স্যার, কিডন্যাপগুলো আমার মতে একসূত্রে গাঁথা। কিন্তু কারা এই কাজ করতে পারে, কোন স্বার্থে? আপনি প্লিজ কিছু ধারণা করতে পারেন?
অধ্যাপক হুয়াং একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল! কপাল তার কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। ভাবছে সে।
সোফায় গা এলিয়ে দিল অধ্যাপক হুয়াং। চোখ খুলে গেল তার। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, কে বা কারা এই কাজ করছে, করেছে আমি জানি না। তবে এর সাথে রাজনৈতিক অনুসঙ্গতা প্রধান বলে আমি মনে করি। অন্য কারণগুলো রাজনৈতিক লক্ষ্যেরই সহযোগী।। ধন্যবাদ স্যার, আপনার শেষ কথাগুলোর সাথে আমিও একমত। এ পর্যন্ত তিন ধরনের লোক অপহরণের শিকার হয়েছে। রাজনীতিকের সংখ্যা তিনজন, একজন কৌশলগত অস্ত্রবিজ্ঞানী এবং দুজন নিষিদ্ধ নগরীর খননের সাথে যুক্ত প্রত্নবিজ্ঞানী। আজকের দিনে রাজনীতির প্রধান অনুসঙ্গ হলো অর্থ এবং কৌশলগত অস্ত্রের শক্তি অপহরণকারীরা এই তিন দিকেই কাজ করছে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক বলেছ আহমদ মুসা। ওরা কে জানা না গেলেও ওদের লক্ষ্য কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে। অধ্যাপক হুয়াং বলল।
লু ঝি জানার অফুরান তৃষ্ণা নিয়ে দুজনের কথা শুনছে। উদ্বেগ-আতঙ্কে তার সুন্দর, লাবন্যের দীপ্তি ছড়ানো মুখ পার হয়ে উঠেছে। অধ্যাপক হুয়াং থামতেই লু ঝি বলে উঠল, তাহলে ঘটনাগুলো ক্রিমিনাল নয়, রাজনৈতিক ক্রাইম।
হ্যাঁ সেটাই মনে হচ্ছে। বলল অধ্যাপক হুয়াং।
এটা খুব খারাপ খবর। লু ঝি বলল।
একটু থেমেই লু ঝি আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, স্যার আপনার কথা তো শেষ?
হ্যাঁ লু ঝি। আপাতত শেষ। ভবিষ্যতে তাঁকে আবার বিরক্ত করতে পারি। বলল আহমদ মুসা।
ওয়েলকাম আহমদ মুসা। তোমাকে শতবার সময় দিতে আমি প্রস্তুত। সেটা হবে আমার জন্যে গৌরবের। অধ্যাপক হুয়াং বলল।
বড় মামা, স্যার চাইলে আমরা বোধ হয় এখন উঠতে পারি। অনেক রাত হলো। বলল লু ঝি।
হ্যাঁ স্যার, আমরা আপনার অনেক সময় নিয়েছি। বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াল আহমদ মুসাও।
আহমদ মুসা চীনে তোমার মিশন সফল হোক। সবার মঙ্গল হোক। বলল অধ্যাপক হুয়াং।
অধ্যাপক হুয়াং সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত আহমদ মুসাদের এগিয়ে দিল।
বড় মামা, বড় মামী ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে আর বিরক্ত করলাম না। আমি যাচ্ছি, তুমি তাঁকে বলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল লু ঝি।
৭
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে লু ঝি আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, প্রাচীন বর্ণের যে সিম্বলটা আপনি দেখালেন, সেটা আমি এর আগেও দেখেছি।
দেখেছ? কোথায়? বলল আহমদ মুসা।
বাবার সোনার আঙটিতে এ সিম্বল আছে। লু ঝি বলল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই সাবধান হল আহমদ মুসা। প্রকাশ হতে দিল না তার চমকে উঠা ভাবটা। বলল, নিশ্চয় তার ওটা কেনা আংটি?
হ্যাঁ, বাবার অনেকগুলো আংটি আছে। একেক সময় একেকটা পরেন। তবে সিম্বলিক আংটিটাই তার বেশি পছন্দ। সফর ধরনের কোথাও গেলে তিনি ঐ আংটি পরেন। লু ঝি বলল।
সিম্বলটা কি, তা কি তোমার বাবা জানেন? বলল আহমদ মুসা।
আমি আগে মনে করতাম ওটা বাবা বা কারও নামের আদ্যাক্ষর হবে। একদিন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তরে তিনি বড় মামার মতোই বলেছিলেন যে, আমাদের আদি ভাষার প্রথম পবিত্র বর্ণ এটা। ইয়েলো নদী বিধৌত আমাদের এই শ্যানডং আদি ভাষার আদিভূমি। লু ঝি বলল।
আবারও আহমদ মুসার চমকে উঠার পালা। তাই তো, এই শ্যানডং রাজ্যের মধ্য দিয়েই ইয়েলো নদী, ইয়েলো সাগর যা পীত সাগরে গিয়ে পড়েছে। এই ইয়েলো নদী অববাহিকায় তো উ জিয়া জাতি-গোষ্ঠীর হানজু ভাষার জন্ম। বলল আহমদ মুসা, হ্যাঁ লু ঝি, তোমার বড় মামাও বলেছেন সিম্বলটা ঐতিহ্যবাদীই হবে।
কিন্তু মুখে এই কথা বললেও ভাবছিল আহমদ মুসা। মিলিয়ে দেখছিল শ্যানডং-এর জিরো শহরে আসার পর যা ঘটেছে। অংক মিলাতে গিয়ে প্রবল অস্বস্তি ও সন্দেহের পুঞ্জীভূত মেঘ মনের আকাশে দানা বেঁধে উঠল। লু ঝি’র বড় মামা অধ্যাপক হুয়াং-এর এখানে আসার সময় যে ভয়াবহ আক্রমণটা হলো, সেখানে এসে চিন্তা কেন্দ্রীভূত হলো আহমদ মুসার। লু ঝি’র বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ওরা নিশ্চয় আহমদ মুসাদের পিছু নিয়েছিল। তার মানে ওরা জানত আহমদ মুসা লু ঝি’র ওখানেই আছে। কোনো সুযোগ পাবে আহমদ মুসার উপর চড়াও হবার- এই আশাতেই ওরা ওতপেতে ছিল। কি করে তারা আহমদ মুসার সেখানে থাকার ব্যাপারে। নিশ্চিত হলো? অনেক প্রশ্ন, অনেক সন্দেহ আহমদ মুসার মনে দানা বেঁধে উঠল। আহমদ মুসার মনে প্রশ্ন- লু ঝিকেও ওরা মেরে ফেলতে চেয়েছিল কেন? ওরা ব্যর্থ হবার পর এখন ওদের কি পরিকল্পনা?
আহমদ মুসার মনে অনেক জরুরি কথা এসে ভিড় জমাল। তাকাল আহমদ মুসা লু ঝি’র দিকে। বলল, লু ঝি গাড়িটা কি আশেপাশে কোথাও পার্ক করা যাবে?
তাকাল লু ঝি আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, করা যাবে। পার্ক করব?
হ্যাঁ। বলল আহমদ মুসা।
লু ঝি রাস্তা থেকে গাড়ি সরিয়ে নিয়ে একটা টিলার পাশে গাড়ি দাঁড় করাল।
কিছু ঘটেছে কি স্যার? আমরা কি নামবো গাড়ি থেকে? জিজ্ঞাসা লু ঝি’র।
না লু ঝি। গাড়িতে বসেই আলাপ হবে।
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, ভাবছি আমি লু ঝি, তোমার বাড়ি এখন নিরাপদ কি না।
কেন ভাবছেন এমন? লু ঝি বলল।
আহমদ মুসার সন্দেহের সব কথা বুঝিয়ে বলল লু ঝিকে।
শুনে লু ঝি বলল, ঠিক স্যার, আমার বাড়ির আশেপাশে কোথাও ওরা। ওতপেতে ছিল, ওরা জানত যে আপনি আমার বাড়িতে আছেন। তারপর আমাদের ফলো করে আমাদের উপর আক্রমণ করে। আক্রমণে চূড়ান্ত ব্যর্থ হবার পর আবার আপনাকে ধরার জন্যে আমার বাড়ির আশেপাশেই ওরা। ওতপাতবে এটা স্বাভাবিক। ঠিক স্যার, আমার বাড়ি এখন আর নিরাপদ নয়।
মুহূর্ত কয়েকের জন্যে থামল লু ঝি। একটু ভাবল। বলল, স্যার আপাতত আপনাকে আমার হোটেল স্যুটে নিয়ে যাচ্ছি। ঐ হোটেল স্যুটের খবর আমার পিএসও জানে না। অন্য কেউ জানে না। যখন আমি নিরিবিলি সময় কাটাতে। চাই, তখন ওখানে উঠি। অন্য নাম নিয়ে থাকি। আপনাকে ওখানে রেখে বাড়ি। গিয়ে দেখব ওদিকের কি অবস্থা। দরকার হলে বাবাকে সব বলে আমাকে তার সাহায্য নিতে হবে। আজকের ঘটনা শুধু আপনাকে মারার অভিযান ছিল না, আমাকেও ওরা মারতে চেয়েছিল। দেখছি, ওরা ড্রাগনের চেয়েও হিংস্র ভয়ংকর। বলেই লু ঝি গাড়ি স্টার্ট দিতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাকে নিষেধ করে বলল, লু ঝি আমি মোটামুটি সুস্থ, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে সক্ষম। আমি চলে যেতে চাই লু ঝি। তোমাকে আমি ইতিমধ্যেই অনেক সন্দেহ-সংকটে জড়িয়েছি।
লু ঝি কিছু বলল না। চমকে উঠার মতো আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ নিচু করল।
নীরব লু ঝি। আহমদ মুসাও নীরব।
বেশ সময় পরে মুখ না তুলেই লু ঝি বলল, আপনি আহমদ মুসা। সামান্য লু ঝি আপনাকে আটকে রাখবে কেমন করে? কিন্তু এভাবে আমি আপনাকে যেতে দেব না। লু ঝি’র বাধো বাধো গলা অবশেষে কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল।
বিব্রত আহমদ মুসা। লু ঝি এভাবে কেঁদে ফেলবে আহমদ মুসা তা আশা। করেনি।
আহমদ মুসাও সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলতে পারল না।
লু ঝি নিজেকে একটু সামলে নিলে আহমদ মুসা বলল, লুঝি, তুমি সবই বুঝতে পারছ। তোমাকে শক্ত হতে হবে। সংকট আমাদের সামনে অনেক বড়। সংকট আরও বাড়িয়ে লাভ কি!
মুখ না তুলেই লু ঝি বলল, আমাকে সময় দিন। বাবাকে সব বলে দেখি।
ঠিক আছে লু ঝি। আমি হোটেল স্যুটে উঠব। আমি কিন্তু তোমার নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন লু ঝি।
এই উদ্বেগ নিয়ে আমাকে ফেলে যাবেন কি করে? বলল লু ঝি মুখ না তুলেই। ভারি কণ্ঠ তার।
কিন্তু লু ঝি আমি তোমার বিপদ বাড়াচ্ছি। বলল আহমদ মুসা।
সেজন্যেই বললাম। আমি বাবার সাহায্য চাইব। আমাকে সময় দিন। লু ঝি বলল।
আমি তোমার কথা মেনে নিয়েছি লু ঝি। এবার তাহলে গাড়ি স্টার্ট দাও। আগের রাস্তা নয়, ভিন্ন রাস্তা দিয়ে চল হোটেলে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ বলে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চোখের জল মুছে গাড়ি স্টার্ট দিল লু ঝি।
চলছে গাড়ি।
লু ঝি’র মুখ ভারি। এখনও সে স্বাভাবিক হতে পারেনি।
লু ঝি তুমি কি বেশির ভাগ সময় জিবেরা শহরের এই বাড়িটাতেই থাক? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
না স্যার। আমি বেশিরভাগ সময় পরিবারের অন্যান্যদের মতো বেজিং এর বাড়িতে থাকি, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে।
ছুটিতে এখানে আস? বলল আহমদ মুসা।
কোনো কোনো সময় শীতের ছুটিতে আসি। আর গ্রীষ্মের ছুটিতে যাই উডাংশান (উডাং মাউন্টেন) এর বাড়িতে। লু ঝি বলল।
উডাংশান, মানে উডাং পর্বতে তোমাদের বাড়ি আছে? বলল আহমদ মুসা।
উডাংশান বাবার খুব প্রিয়। ওখানে আমাদের চারটা বাড়ি আছে। পারপল ক্লাউড টেম্পল, গোল্ডেন হল, উঝেন প্যালেস এবং নানজান (নানইয়ান) টেম্পল এলাকায় আমাদের সে বাড়িগুলো। লু ঝি বলল।
উডাং পর্বতে কি প্রাইভেট বাড়ির অনুমতি আছে? আমি তো শুনেছি ওটা মন্দির এলাকা। তাদের নানা রকমের নানা সময়ের মন্দিরে ভরা এলাকাটা।
হ্যাঁ তাই। তবে মন্দির ছাড়াও প্রাইভেট বাড়ি প্রাচীনকাল থেকে আছে। নতুন বাড়ি তৈরির সুযোগ সেখানে নেই। প্রাচীন প্রাইভেট বাড়িগুলিই হস্তান্তরিত হয়ে আসছে। তবে পাহাড়ের নিমাঞ্চলে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠছে। লু ঝি বলল।
ধন্যবাদ। উডাং সত্যিই মনোমুগ্ধকর পাহাড়ী অঞ্চল। বলল আহমদ মুসা।
উডাং-এ যাবেন স্যার। নিয়ে যাব আমি। লু ঝি বলল। তার চোখে মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে।
এখন নয় লু ঝি। সংকট কেটে যাক। যাব এক সময়। কিন্তু চিনব। কেমন করে তোমাদের বাড়ি? বলল আহমদ মুসা।
আপনার সাধ্যের বাইরে কিছু আছে স্যার? আর আমার মোবাইল নাম্বার আপনার কাছে সব সময় থাকবে। লু ঝি বলল।
চলছেই গল্প। স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে লু ঝি। মেঘ কেটে গেছে তার মুখ থেকে। মূল শহরে প্রবেশ করেছে গাড়ি।
লু ঝি’র সে হোটেল পাহাড়ের অনেকখানি উপরে শহরের উত্তর-পূর্ব এলাকায়।
চলছে গাড়ি। চলছে গল্পও। গল্পের মধ্যেই আহমদ মুসা জেনে নিচ্ছে লু ঝি’র বাবা সম্পর্কে নানা তথ্য।
.
মোবাইলে রিং বাজছে। ঘুম ভেঙে গেল আহমদ মুসার। মোবাইলে কল অন করল। কথা-কাটাকাটির শব্দ শুনতে পেল।
তোমারা কে? কি চাও তোমরা? চিৎকার করে বলছে লু ঝি।
আপনার সঙ্গী শয়তানটার খোঁজে এসেছিলাম। তাকে পাওয়া গেল না। নিশ্চয় পালিয়ে যেতে দিয়েছেন। এখন আপনি একাই চলুন।
লোকটি থামতেই আরেকটা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, কথা বলতে দিচ্ছ কেন? তোমরা ধর ওঁকে, বেঁধে ফেল। মুখে টেপ পেস্ট করে দাও। সময় নেই। মাত্র ১০ মিনিট সময় নিয়ে এসেছি।
আমাকে বাঁধতে হবে না। আমিই যাচ্ছি।
কোথায় যেতে হবে? কণ্ঠটা লু ঝি’র।
কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না। আপনি চলুন। আর শুনুন, হৈচৈ করার চেষ্টা করবেন না বাইরে বেরিয়ে। কেউ সাহায্য করতে আসবে না। মাঝখানে জীবন যাবে আপনার।
লোকটি একটু থেমেই আবার বলল, ম্যাডামের পিএসকে বেঁধে গাড়িতে তুলেছ?
হ্যাঁ, তোলা হয়েছে। বলে উঠল একজন।
সে কি দোষ করেছে, তাকে নিচ্ছ কেন? বলল চিৎকার করে লু ঝি। কান্নাজড়িত কণ্ঠ তার।
সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, ওঁর মুখে টেপ এঁটে দিয়ে গাড়িতে তোল। চল সবাই।
এই কথার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মোবাইলে আসা কথা বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা বুঝল, মোবাইল থেকে ওরা দূরে চলে গেছে। আক্রান্ত হবার সময় নিশ্চয় লু ঝি আমার নাম্বারে মোবাইল করে আড়াল মতো কোনো স্থানে মোবাইল ফেলে দিয়েছিল।
মনে মনে ধন্যবাদ দিল লু ঝিকে। চরম বিপদকালেও সে তার অবস্থার কথা আমাকে জানাবার ব্যবস্থা করেছে। আহমদ মুসা বিছানায় উঠে বসল।
ঘড়িতে দেখল সাড়ে তিনটা বাজে। এই সময় লু ঝি’র জন্যে তার কিছু করণীয় নেই।
আহমদ মুসা তাহাজ্জুদের নামায শেষ করে ঘড়ি দেখে ফজরের নামাযটা পড়ে নিল।
নামাজের আসনে বসেই ভাবল, লু ঝি’র দেয়া এই আশ্রয় এখনই ছাড়তে হবে। লু ঝি ওদের হাতে পড়ার পর এ জায়গা আর নিরাপদ নয়।
কোথায় যাবে আহমদ মুসা?
আপাতত লু ঝিকে উদ্ধার করাই তার টার্গেট। এ বিষয়ে কিছু কু তার। জানা আছে।
তৈরি হলো আহমদ মুসা বেরুবার জন্যে। আহমদ মুসার মন বলছে, তার সন্দেহ-অনুমান সত্য হলে লু ঝিকে জিরোতে কিংবা বেজিং-এর কোথাও নয়, উড্যাং-এর কোথাও রাখা হতে পারে।
আহমদ মুসা ফ্ল্যাটের চাবি নিজের পকেটে ফেলেই বেরিয়ে এল হোটেল থেকে।
লু ঝি আহমদ মুসার জন্যে গাড়ি রেখে গেছে। গাড়িটা এখন আহমদ মুসার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। মনে মনে আবারও ধন্যবাদ লু ঝিকে।
গাড়িতে উঠল আহমদ মুসা। স্টার্ট নিল গাড়ি।
বেরিয়ে এল গাড়ি হোটেলের কারপার্ক থেকে রাস্তায়।
ছুটতে শুরু করল গাড়ি।
কোথায় যাবে আহমদ মুসা? উড্যাং পর্বতে?
উড্যাং পর্বতের কোথায়, কীভাবে?
আসলেই কি লু ঝিকে সেখানে পাওয়া যাবে? আহমদ ইয়াং, মা ঝু সুলতান, ফা জি ঝাও, ড. ডা, ইরকিন আহমেত ওয়াংরাই বা কোথায়?
আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনে। ছুটে চলছে গাড়ি শ্যানডং-বেজিং হাইওয়ে ধরে।
[পরবর্তী বই ড্রাগন ভয়ংকর]
Leave a Reply