সাইমুম ৫৯ – বিপন্ন রত্নদ্বীপ – আবুল আসাদ
[একের পর বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত সন্ত্রাসী সংগঠন ব্ল্যাক সিন্ডিকেট। ব্ল্যাক সিন্ডিকেট পাগল হয়ে উঠেছে আহমদ মুসাকে হত্যার জন্যে। ইউরোপ চ্যাম্পিয়ান শুটারকে ভাড়া করেছে তারা আহমদ মুসাকে দেখামাত্র হত্যার জন্যে। শুটার সারা সোফিয়ার আগমন, রত্নদ্বীপ নিয়ে এল নতুন কাহিনী। কী সেই কাহিনী? শ্বাসরূদ্ধকর এক দৃশ্যে জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি সারা সোফিয়া ও আহমদ মুসা- গুলিটা আগে করার সুযোগ পেল সারা সোফিয়া পর পর চারবার- কিন্তু কি ঘটল তারপর? – অনেক কথা, অনেক কাহিনী, সংঘাত-সংঘর্ষ! ব্ল্যাক সিন্ডিকেট অবশেষে রত্নদ্বীপে তার প্রধান ঘাঁটিও হারাল। কিন্তু এই পরাজয় ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের অদৃশ্য ডোনারকে অর্থাৎ আসল ষড়যন্ত্রকারীদের মরিয়া করে তুলে। রত্নদ্বীপের উপর ঘনিয়ে এল মহাবিপদ, যে বিপদ ধুলায় মিশিয়ে দেবে রত্নদ্বীপকে। কি সেই মহাবিপদ? সবমিলিয়ে অন্যবদ্য এক কাহিনী নিয়ে এসেছে ‘বিপন্ন রত্নদ্বীপ’।]
.
১
দাদী,
আমার সালাম নিও। তোমার মেসেজ আমি পেয়েছি। আমার জন্যে যে তুমি কতটা উদ্বিগ্ন থাক, আমি বুঝতে পারি। আল্লাহর উপর ভরসা করা ছাড়া কোনো উপায় আছে কি দাদী? নেই। শুধু আল্লাহর উপর ভরসা কর দেখবে উদ্বেগ কমে যাবে, প্রশান্তি আসবে মনে।
জানতে চেয়েছ আমি কিছুটা এগিয়েছি কিনা। না দাদী, পারিনি। চেষ্টার ত্রুটি নেই। ডায়েরির তথ্যসূত্র যেন কয়েকশ বছরে রত্নদ্বীপ থেকে মুছে গেছে। গত এক বছরে দাদী সাধ্যের মধ্যে আছে রত্নদ্বীপের এমন কোনো জায়গা আমার অনুসন্ধানের বাইরে নেই। কিন্তু ডায়েরির তথ্য, চিত্র, চিহ্ন কোথাও আমি পাইনি। পাইনি বলে নেই, তা নয়। আমি খুঁজছি, খুঁজব। একই সাথে আমি তাঁরও সন্ধান করছি দাদী। সম্প্রতি আমার আশা বেড়েছে দাদী। রত্নদ্বীপে পংখীরাজ ঘোড়ায় চড়ে তোমার সেই সহজ সরল সুন্দর একজন রাজকুমার অবশেষে এসেছেন। যিনি শত রাজকুমারের সমান। আবার আমার রাজকুমার বলে আনন্দে তুমি লাফিয়ে উঠো না। আমাকে তুমি শাহজাদী বল তো তাই বললাম। কিন্তু তুমি জান না দাদী, আমার মতো উত্তরাধিকারের শত শাহজাদীও তাকে আঁচলে বাঁধতে পারে না। আসলে তিনি সবার স্বপ্নের রাজকুমার। নাম শুনলে আমার কথা তুমি মেনে নেবে। কিন্তু নাম এখন বলব না দাদী।
আমি এখন আমার মিশনের ব্যাপারে আশাবাদী দাদী। আমার মিশনের কথা আমাদের বংশের বাইরে শুধু তাকেই বলা যায়। তিনি আরেক ধারার নতুন এক তারিক বিন জিয়াদ। অনেকে বলেন তিনি এক নতুন হাতেম তাঈ। তাঁকে আমি ডেকেছি আজ। তিনি আমার কথা শুনতে চান। দোয়া করো দাদী, আমাদের শাহমাতার ধনভাণ্ডার যেন উদ্ধার হয়। তার মহৎ স্বপ্ন যেন সফল হয়। আজ এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
তোমার শাহজাদী
জাহরা তার ল্যাপটপে মেসেজটি টাইপ করে সেন্ড বাটনে ক্লিক করে তার দাদীর নাম্বারে পাঠিয়ে দিল। ল্যাপটপটিকে জাহরা একটু সামনে ঠেলে দিল। চেয়ারে গা এলিয়ে দিল জাহরা।
চোখ দুটিও বন্ধ করল।
মেসেজটি পাঠিয়ে খুব ভালো লাগছে জাহরার। আগে কখনো এমনভাবে দাদীকে তার আশার কথা শোনাতে পারেনি জাহরা। এই আশা কি সত্যিই ফল নিয়ে আসবে? ছয়শত বছরের বন্ধ দরজা কি খুলবে? পেছনে ছুটে গেল তার মন। একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার। বুক থেকে।
কিন্তু আবার তার মুখে ফুটে উঠল হাসি। ছয়শত বছরের অন্ধকার দূর করতে পারেনি সে, কিন্তু জমাট অন্ধকারের বুকে সে একটা ক্যান্ডল জ্বালতে পেরেছে। তার আগে তো রত্নদ্বীপে কেউ আসেনি তার বংশ থেকে।
ভেবে চলে জাহরা, নিঃসীম অন্ধকারে আমি একখণ্ড আলো জ্বেলেছি বটে, কিন্তু অন্ধকারকে আলোকিত করার সাধ্য আমার নেই। দাদী বলেছিলেন, তার স্বপ্নের শাহজাদা শুধু স্বপ্নের নয়, বাস্তবেও তুমি দেখো। সে আসবে। সে ইতিহাসকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসবে। যারাজুনুব পাহাড়ে যখন আমার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা আমাকে বিস্ময়করভাবে বাঁচালেন, তখনই আমার মনে হয়েছিল তিনিই দাদীর সেই স্বপ্নের শাহজাদা যিনি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শাহমাতার স্বপ্ন সফল করবেন। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই সব তাঁকে বলব।
আলহামদুলিল্লাহ, তিনি আসছেন।
মনের কথা মন থেকে মিলিয়ে যাবার আগে দরজায় নক হলো।
জাহরা তাকাল তার হাতঘড়ির দিকে। দেখল দুপুর ১২ টা। মন তার খুশি হয়ে উঠল, নিশ্চয় দাদীর শাহজাদা আহমদ মুসা এসেছেন।
জাহরা দ্রুত স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং-এর ভেতর দিয়ে গিয়ে দরজা খুলল।
আসোলামু আলায়কুম। দরজা খুলে আহমদ মুসাকে সালাম দিল জাহরা।
সালাম নিল আহমদ মুসা। ভেতরে ঢুকল। চারদিকে তাকাল। বলল, এটা দেখছি তোমার ডাইনিং কিচেন। আর ওটা?
ওটা স্যার আমার স্টাডিরুম। তার পাশে বড় রুমটা আমার বেডরুম। বলল জাহরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হোস্টেল কিন্তু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের মতো মনে হচ্ছে না। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক স্যার। রত্নদ্বীপ স্টেট ইউনিভার্সিটির হোস্টেল দুই রকমের আছে। ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান রুম- এই ব্যবস্থার হোস্টেল সাধারণভাবে সকল ছাত্রের জন্যে। বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে কিছু ডরমিটরি আছে বিদেশি ও ভিআইপি কিছু ছাত্রের জন্যে। আমার ডরমিটরিটা সেগুলোরই একটা। এর সুবিধা হলো, নিজের খানা নিজেই রান্না করে খাওয়া যায়। একদম নিরিবিলি পরিবেশ, পড়াশুনার জন্য খুবই ভালো। বলল জাহরা।
একটু থেমেই আবার সে বলে উঠল, আসুন স্যার বসি।
কোথায়? বলল আহমদ মুসা।
ড্রয়িং রুম তো নেই। স্টাডি রুমে একটা মাত্র চেয়ার। বেড রুমেই মাত্র তিনটা সোফা ও একটা সেন্টার টেবিল আছে। ওটা আমার ড্রয়িং রুমও। ওখানেই আমরা বসব। জাহরা বলল।
আচ্ছা জাহরা, তোমার ডরমিটরিতে ঢোকার সময় তোমার ডরমিটরির সাথে অ্যাটাস্ট ছোট একটা এনক্লোজার দেখলাম। দুটি সোফাও দেখলাম সেখানে। ওটা….?
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই জাহরা বলল, ওটা আমার বাইরে বসার একটা জায়গা। বান্ধবীরা ছাড়া কেউ দেখা করতে এলে ওখানে বসেই তাদের সাথে কথা বলি।
সুন্দর ব্যবস্থা জাহরা। আমরা ওখানেই বসব। বলল আহমদ মুসা।
জাহরা হাসল। বলল, ঐ বসার জায়গাটা অনাত্মীয় ও বাইরের লোকদের জন্যে। আপনার জন্যে নয়।
তোমার বান্ধবীরা ও পরিবার ছাড়া সবার জন্যে ওটাই বসার জায়গা। বলল আহমদ মুসা।
আপনি আত্মীয়-বন্ধুর চেয়ে অনেক বড়। জাহরা বলল।
আমরা সেজন্যেই বন্ধ ডরমিটরিতে বসতে পারি না। আল্লাহর রাসুল স.-এর তাৎপর্যপূর্ণ একটা হাদিস আছে। হাদিসটা এই রকম- উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রা. ও তাঁর পিতা আবু বকর রা. একটা ঘরে নিরিবিলি বসে কথা বলছিলেন। সেই সময় আল্লাহর রাসুল স. সেখানে আসেন। আল্লাহর রাসুল স. নিরিবিলি একটা ঘরে বসে বাবা-মেয়ের এই আলাপ পছন্দ করেননি। তিনি বলেছিলেন যে, তোমাদের দুজনের মাঝে তৃতীয় একজন ছিল। সে হলো শয়তান। এই শয়তান এখনও আছে জাহরা। আর ঈমানের দিক দিয়ে তাঁদের চেয়ে আমরা অনেক বেশি দুর্বল। বলল আহমদ মুসা।
আল্লাহু আকবর! বলে দুহাতে মুখ ঢাকল জাহরা। কয়েক মুহূর্ত পরে মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল, স্যরি স্যার, ইসলাম ও বাস্তবতা- দুটি থেকেই আমরা আজ বহু দূরে। জাহরার দুই চোখে লজ্জা ও অশ্রুর অপরূপ মিশ্রণ।
চলুন স্যার বাইরে গিয়ে বসি। জাহরা বলল।
দুজনে গিয়ে বসল বাইরের এনক্লোজারটায়।
জায়গাটা এক প্রশস্ত বারান্দার মতো। বারান্দাকেই ছোট ও সুন্দর একটা এনক্লোজারের মতো করা হয়েছে।
বসেই আহমদ মুসা বলল, কথা শুরু কর জাহরা।
মুখে গাম্ভীর্য নেমে আসল জাহরার। মুখ নিচু করল। ভাবল। খুলল তার হাতের ব্যাগ। বের করল ভাঁজ করা কাগজ।
তার হাতের ভাঁজ করা কাগজ আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, এগুলো একটা ডায়েরির অংশ স্যার।
ডায়েরির অংশটা হাত বাড়িয়ে আহমদ মুসার দিকে দিতে দিতে বলল, প্রথমে ডায়েরির অংশটা পড়ুন স্যার। পরে কথা হবে।
আহমদ মুসা কাগজ হাতে নিল।
কাগজের ভাঁজ খুলে দেখল, ডায়েরির কয়েকটা পাতা। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা। লেখাটা ফটোকপি।
আহমদ মুসা তাকাল জাহরার দিকে। বলল, ডায়েরির স্টাইলেই লেখা দেখছি। কার ডায়েরি?
জাহরার গম্ভীর মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বলল, প্লিজ স্যার পড়ন। আমি জানি উত্তরটা আপনিই খুঁজে পাবেন।
কিছু না বলে আহমদ মুসা ডায়েরির পাতার দিকে তাকাল। স্পষ্ট ও সুন্দর হাতের লেখা। পড়তে কোনোই কষ্ট হবার কথা নয়। পড়তে শুরু করল আহমদ মুসা–
খবর পেলাম, আমার ছেলে আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আল-সানি আশারা বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সিংহাসনে ফিরে আসার জন্যে কাস্টেলিয়ানদের সাথে চুক্তি করেছে। আমার এই দুর্ভাগা ছেলে ১৪৮২ সালে গ্রানাডার সিংহাসনে বসার পরই আমার উপদেশ উপেক্ষা করে ১৪৮৩ সালে কাস্টেলিয়ানদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং পরাজিত ও বন্দী হয়। সেই বন্দীত্ব থেকে মুক্তি ও সিংহাসনে ফিরে আসার জন্যে কাস্টেলিয়ানদের সাথে চুক্তি করেছে খুবই অপমানজনক শর্তে। গুপ্তচরের কাছে চুক্তির যে কপি পেলাম তাতে দেখা যাচ্ছে, গ্রানাডা রাজ্য করদ রাজ্যে পরিণত হবে কাস্ট্রেলিয়ান ক্যাথলিক খৃস্টান রাজার অধীনে। দ্বিতীয়ত স্পেনের উপকূলীয় দুর্গনগরী মালাগায় ক্যাথলিক খৃস্টান রাজার যে অবরোধ চলছে, তাতে গ্রানাডা হস্তক্ষেপ করবে না। আমি দাঁড়িয়ে খবরটা পড়ছিলাম। এটুকু পড়ার পর দাঁড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব হলো না। ইশারা পেয়ে পরিচারিকা গুপ্তচরকে বাইরে নিয়ে গেল। কয়েক ধাপ পেছনে হটে আমি এলাম কুরসির কাছে। আমার দেহটা খসে পড়ল কুয়সির উপর। আমার মনে তখন গ্রানাডা রাজ্যের নতজানু এক সুলতানের অপমান নয়, মহান এক পরিবারের অপমান নয়, স্পেনীয় মুসলমানদের শেষ আশা ও ঐতিহ্যের অপমান নয়, আমার চোখে ভেসে উঠেছে স্পেনে মুসলমানদের মহান শাসন ও সভ্যতার সমাধিস্থ হওয়ার দৃশ্য। ইসলামের মহান সেনাধ্যক্ষ তারিক বিন যিয়াদ স্পেনের মাটিতে পা রাখার ৭৭৬ বছর পর আমি দেখছি ইসলামের অর্ধচন্দ্র পতাকা ভূলণ্ঠিত হলো স্পেনের মাটিতে এবং সেটা আমার ছেলের হাতে। চেষ্টা করেও চোখের অশ্রুর প্রস্রবণ আমি রোধ করতে পারলাম না। কুরসিতে পড়ে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম জানি না। সম্মোহিত অবস্থা থেকে যখন জাগলাম, মন অনেক শান্ত, স্থির। মনের স্থির কণ্ঠ শুনতে পেলাম, নিশ্চিতভাবে এই ১৪৮৭-তেই মালাগা মুসলমানদের হাতছাড়া হচ্ছে। তারপর একে একে যাবে গ্রানাডা রাজ্যের খুঁটিগুলো বাযা, আলমুনেকার, সোলেব্রেফিয়া এবং আলমেরিয়া। এর পরেই গ্রানাডার গলা টিপে ধরা হবে। এই চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার আছে আমার। গ্রানাডার পতন ঘটলে করদ রাজ্যের রাজা হিসেবে তার পক্ষে যা নেয়া সম্ভব সে সম্পদ তাকে নিয়ে যেতে দেয়া হবে। তা হবে আমার ছেলের ব্যক্তিগত সম্পদ। বংশের শেষ শাহমাতা হিসেবে আমার কাছে যে সম্পদ জমা আছে, তা না আমার ছেলের হাতে পড়তে দেব, না দখলদারদের হাতে যেতে দেব। কর্ডোভার পতনের আগে সেখানকার শেষ সুলতান তৃতীয় হিশামের মাতা তার কাছে সঞ্চিত সম্পদ আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারের জন্যে। সেই বিশাল সম্পদেরও দায়িত্ব আমার উপর। এই সম্পদের সংরক্ষণ আমাকে করতে হবে। এই সম্পদ স্পেনের বাইরে নিতে হবে নিরাপদ করার জন্যে। কিন্তু কিভাবে? এই চিন্তা করতে গিয়েই আমি ডাকলাম আমার খালাত ভাই নৌ কমান্ডার তারিক ফতেহ আলীকে। ডাকলাম আমার প্রাসাদ মসজিদের দ্বিতীয় ইমাম আবু আমর আবদুল্লাহকে। নৌ কমান্ডার তারিক ফতেহ আলীকে এজন্যে ডাকলাম যে, নৌ-পথকেই আমি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করি এবং তারিক ফতেহ আলী মালাগাভিত্তিক একটা ফ্লিটের কমান্ডার ছিলেন। সে ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ ও পাহাড় বিশারদ। আর ইমাম আবু আমর। আবদুল্লাহ ছিলেন আমার স্বামী সুলতান আবু হাসান আলীর একটা বিশেষ কমান্ডো বাহিনীর নেতা। একজন সৎ ও খোদাভীরু মানুষ সে। আমি তাদের ডেকে আমার পরিকল্পনার কথা বললাম। জানালাম যে, গোল্ড কয়েন ও স্বর্ণালংকারের বিপুল এই ভাণ্ডার আমি একটা অসিয়তসহ ভবিষ্যত এক জেনারেশনের জন্যে রেখে যেতে চাই। আমার পরিকল্পনা শোনার পর আমার নৌকমান্ডার ভাই বলল, মুহতারামা শাহমাতা, আপনার কথা শোনার সাথে সাথে একটা নির্জন দ্বীপের কথা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যাওয়া-আসার পথে দুবার আমি দ্বীপটিতে উঠেছি মিঠা পানি ও ফল-মুলের সন্ধানে। পাহাড়ের দেয়াল ঘেরা ও পার্বত্য টিলার পূর্ণ দ্বীপটি খুবই দুর্গম, সাধারণভাবে জনবসতির উপযুক্ত নয়। চারপাশে সাড়ে চারশ-পাঁচশ মাইলের মধ্যে কোনো দ্বীপ বা দেশ নেই। আল্লাহর উপর ভরসা করে এমন একটা দ্বীপের কথা আমরা চিন্তা করতে পারি। শুনেই আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। এই দ্বীপ আমি পছন্দ করলাম। আমি আবু আমর আবদুল্লাহকে বললাম, আমার ডাকে সাড়া দেবার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। আমি চাচ্ছি, কমান্ডার ফতেহ আলীর নেতৃত্বে আপনি এই মিশনে অংশ নেবেন এবং জাহাজের নিরাপত্তার জন্যে একটা টিম গড়ে নেবেন। প্রয়োজনীয় সব আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো, পরবর্তী ছয়মাসের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। আরেকটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলো এই দুইজন ছাড়া দ্বীপটির নাম ও লোকেশন সম্পর্কে কেউ কিছু জানবে না। কোনো সেফ কাস্টোডির বাইরে সাধারণভাবে কোনো ঘড়ি, ক্যালেন্ডার ও কম্পাস জাহাজে থাকবে না, এ বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
ডায়েরির একটা অংশ পড়া শেষ হলো। এর সাথে ডায়েরির আরেকটি অংশ আছে ছয় মাস পরের। তারিখটা ১৪৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন। ডায়েরির সে অংশে লেখা হয়েছে–
আল হামদুলিল্লাহ, ছয় মাসের মধ্যেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিপটির সবচেয়ে নিরাপদ, দুর্গম ও সুচিহ্নিত একটি স্থানে। স্বর্ণভাণ্ডার লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। আজ পথ ও পাহাড়ের স্কেস ও সাংকেতিক চিহ্ন সংবলিত ডকুমেন্ট আমি তারিক ফতেহ আলীর কাছ থেকে পেলাম। আল্লাহর হাজার শোকর। তিনি যেমন এই সম্পদ নিরাপদে সংরক্ষণের সুযোগ দিয়েছেন, তেমনি এই সম্পদ যাতে অসিয়ত অনুসারে আল্লাহর মনোনীত বান্দাদের কাজে লাগতে পারে তারও ব্যবস্থা। যেন মহান আল্লাহ দয়া করে করেন।
ডায়েরির দ্বিতীয় অংশ পড়া শেষ হবার পর তৃতীয় আরেকটা অংশ পেলাম। ডায়েরির তারিখ ১৫১১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি। ডায়েরিতে এ দিনের পাতায় লেখা
আমার বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছে। গ্রানাডার প্রাসাদ ছেড়ে মরক্কো রাজ্যের আশ্রিত হিসাবে ফেজ-এর এই বাড়িটাতে ১৯ বছর বাস করছি। বুঝতে পারছি এই পরিবারের জন্যে ক্রমশ খারাপ দিন আসছে। খুবই দুঃখ বোধ হচ্ছে, সে খারাপ দিনগুলো দেখার জন্যে আমি বেঁচে থাকবো না। সুদিনের চেয়ে দুর্দিনে দৃঢ়তা ও ধৈর্য বেশি দরকার হয়। আমার ছেলের সেটা নেই। সুদিনে দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না থেকে দুঃখে ভেঙে পড়াই তার চরিত্র। যাক, যিনি সবার কথা ভাবেন, যিনি সবাইকে পালন করেন, যিনি দুঃখের তিমিরেও সুখের সোবহে সাদেকের আয়োজন রাখেন, সেই সর্বশক্তিমান আল্লাই আমার পরিবারকেও দেখবেন। আগে আমার অনেকবার অসুখ হয়েছে, কিন্তু বর্তমান অসুস্থতা আমাকে বলছে প্রভুর সান্নিধ্যে ফেরার সময় আমার হয়েছে। আমার সামনে খুব বড় সমস্যা ছিল সেই দ্বীপে লুকিয়ে রাখা ধন-ভাণ্ডারের ডকুমেন্ট হেফাজতের দায়িত্ব কার হাতে রেখে যাব। সে সমস্যারও সমাধান আমি করেছি। আমার ছেলে ক্ষমতাচ্যুত সুলতান আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আল সানি আশারার তিন সন্তান আহমাদ, আয়েশা এবং ইউসুফ। আয়েশার নাম ওর বাবা আমার নাম অনুসারে রেখেছে। ভাই বোনদের মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ়চেতা সে। ছোটবেলা থেকেই আমি তাকে চোখে চোখে রাখছি। কোরআন শরিফ ও ইতিহাস আমিই তাকে পড়িয়েছি। আমার আশা, স্পেনের নাসেরাইদ রাজপরিবারের যোগ্য এক শাহজাদী হবে সে। ভবিষ্যতে কি করবে সে আমি জানি না। আমি দোয়া করি সর্বহারা এই বংশের দুঃখের দিনে আল্লাহ তাকে এক কাণ্ডারী হওয়ার তৌফিক দিন। আমি আয়েশা বিনতে আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদকেই আমার গুপ্তধনভাণ্ডারের ডকুমেন্ট হেফাজত করার দায়িত্ব দেয়ার বিষয় চূড়ান্ত করলাম। দুই ইঞ্চি পুরু চার ইঞ্চি প্রস্থের একটা আয়তাকার রূপার কাসকেটে ধনভাণ্ডারের ডকুমেন্ট আমি রেখেছি। কাসকেটের লক খোলার জন্যে পাশাপাশি পাঁচটি বোতাম রয়েছে। বোতামগুলোর পাশে একটা করে ছবি ও বোতামের উপর এক অংকের একটা করে নাম্বার। ছবি দেখে সঠিক বোতাম চিহ্নিত করতে হবে। সে বোতামে পুশ করলেই কাসকেট খুলে যাবে। যদি ভুল পুশ হয়, তাহলে কোনো বোতাম পুশ করলেও আর কাসকেট খুলবে না। সেক্ষেত্রে আর একটা মাত্র বিকল্প অবশিষ্ট থাকবে, সেটা হলো, কাসকেটের উপর কোরআন শরিফের একটা আয়াত লেখা রয়েছে। আয়াতে তিন শব্দের একটা করে গুচ্ছ আছে। প্রতিটি গুচ্ছের রয়েছে এক অংকের একটি করে নাম্বার। গুচ্ছগুলোর নাম্বার বোতামেও আছে। গুচ্ছগুলোর সঠিক নাম্বার সিলেকশন করতে পারলে, সে নাম্বারেই কাসকেট খুলবে। কাসকেট খোলার ব্যবস্থা একটু জটিল করেছি এজন্যেই যে, যাতে করে যে কেউ যেন কাসকেট খুলে ডকুমেন্ট লোপাট বা নষ্ট করতে না পারে। যে ব্যবস্থা আমি করেছি তাতে, ইসলামকে যে তার সঠিক রূপে জেনেছে, সেই কাসকেটের ধাঁধা বুঝতে পারবে। আজ ফজরের নামাজ শেষে প্রতিদিনের কোরআন পাঠের পর আয়েশাকে ডেকে আল্লাহর উপর ভরসা করে কাসকেট তার হাতে দিলাম। বললাম, আমার দেয়া এই ডকুমেন্টকে আল্লাহর আমানত মনে করবে। আমার মতো তোমারও দিন শেষ হয়ে যাবে একদিন। সে দিনটি আসার আগেই আল্লাহর আমানত বংশের এমন একজন মেয়ে বা ছেলের হাতে তুলে দেবে যে নামাজ পড়ে, মিথ্যা কথা বলে না এবং ইতিহাসের উপর জ্ঞান রাখে। কাসকেট খোলার অধিকার তারই যে লকের ধাঁধা বুঝতে পারবে। কাসকেট যে পাবে, আমার ডায়েরিটাও সে পেয়ে যাবে। ডায়েরিতে গুপ্তধনভাণ্ডারের সংকেত আছে। কাসকেট কোনো কারণে যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে ধনভাণ্ডার উদ্ধারের বিস্তারিত সংকেত ও স্কেচ হারিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে এই সংকেত কাজে লাগাতে হবে?
দক্ষিণের মধ্য ভূমধ্যসাগরে এক দ্বীপ, বেনগাজীর উত্তর-পশ্চিম, ত্রিপলীর উত্তর-পূর্ব ক্রীটের দক্ষিণ-পশ্চিম মাল্টার পূর্ব দক্ষিণের এক মিলনগ্রন্থি, এই তার নিরিখ।
এবং
পাহাড়ের কোলে পাহাড়
তার কোলে সন্তান
দেয়াল করবে খান খান।
আমার ডায়েরির এখানেই সমাপ্তি। আল্লাহ রাব্বল আলামিনের কাছে আমারা প্রার্থনা- মানবীয় সাধ্যের মধ্যে যা সম্ভব আমি তা করেছি, ধনভাণ্ডারের সংরক্ষণ ও কাজে লাগাবার জন্যে। ফল দেয়ার মালিক শুধু তুমিই প্রভু। তোমার উপর, শুধু তোমারই উপর ভরসা করছি। দয়াময় হাফেজ তুমি সর্বাবস্থায়।
ডায়েরির পাতাগুলো পড়া শেষ করে আহমদ মুসা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তার চোখ ডায়েরির পাতার দিকেই।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল জাহরার দিকে। বলল, শাহজাদী জায়নেব জাহরা, বুঝলাম ডায়েরিটা গ্রানাডার শেষ সুলতান আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ-এর মা শাহমাতা আয়েশার, যাকে ইউরোপের ইতিহাস অদম্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা বলে অভিহিত করেছে। আমি আরও বুঝতে পারছি, তুমি এই শাহমাতার বংশেরই এক অধস্তন। শাহজাদী। কিন্তু মাঝখানে কেটে গেছে সাতশ বছর। এই সময়টা অন্ধকার একটা কাল। তোমার পরিচয়, তোমাদের অতীত সম্পর্কে কিছু বল।
বলছি। কিন্তু তার আগে বলুন আমি শাহজাদী জায়নেব জাহরা এটা কি করে জানলেন? ডায়েরির ঐ পাতাগুলোতে এ সম্পর্কে কিছুই থাকার কথা নয়। বলল জাহরা।
গতকাল তোমার গাড়ির সিটে তোমার হাতব্যাগের সবকিছু পড়ে ছিল। ব্যাগে সেসব তুলতে গিয়ে একটা গ্রুপ ফটো পেয়েছিলাম। অভ্যাসবশতই ফটোটা দেখি। সেখানেই তোমার ছবি দেখি এবং নামটাও পড়ি। আহমদ মুসা বলল।
বুঝেছি স্যার।
বলে একটু থামল জাহরা। বলতে শুরু করল আবার, আমি শাহমাতা। আয়েশার নবম উত্তরসূরি। গ্রানাডা থেকে এসে আমাদের পরিবার মরক্কোর ফেজ নগরীতে বসতি স্থাপন করে। যোড়শ শতক পর্যন্ত আমাদের অবস্থা ভালোই গেছে বলে আমরা জানতে পারি। শাহমাতা যাকে ডায়েরি ও ডকুমেন্টের উত্তরাধিকার দিয়েছিলেন সেই আয়েশা বিনতে আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ বেঁচে থাকা পর্যন্ত সংসার খুবই ভালো চলেছে। ১৫৬০ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে সংসারে বিপর্যয় নামতে শুরু করে। বংশীয় আভিজাত্য ব্যবসায় ও চাকরি থেকে পরিবারের সদস্যদের বিরত রাখে। যাকাতনির্ভর হয়ে পড়ে আমাদের পরিবারটি। পরিবারের উত্তরাধিকারিত্ব আমার দাদী বেগম আয়েশা আবদুল্লাহ নাসিরী-এর হাতে আসার পর তিনি অতীতের সব নিয়ম ভেঙে ফেলেন। আধুনিক উচ্চ শিক্ষা ও ব্যবসায় ও চাকরির দরজা খুলে দেন। পরিবার আত্মনির্ভরশীলতা, সেই সাথে সমাজের মূল স্রোতে শামিল হয়ে মানুষের কাজে লাগতেও সমর্থ হয়। আমি রাবাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছি। দাদীর বয়স এখন বিরানব্বই। তিনি আমাকে উত্তরাধিকারিত্ব অর্পণ করেছেন। থামল জাহরা।
কিন্তু তুমি রত্নদ্বীপে কেন? সেই রুপোর কাসকেটে ধাঁধা কি তুমি সমাধান করেছ? রত্নদ্বীপের সন্ধান তুমি পেলে কি করে? এলে কেমন করে রত্নদ্বীপে? বলল আহমদ মুসা।
না, রুপোর কাসকেটের ধাঁধা আমি ভাঙতে পারিনি। রত্নদ্বীপের সন্ধান পাওয়া এখন আর কোনো কঠিন কাজ নয়। শাহমাতার ডায়েরিতে দ্বীপের যে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সে নির্দেশনা সামনে রেখে স্যাটেলাইট ম্যাপ দেখে দ্বীপটা বের করেছি। এই দ্বীপের চারশ সাড়ে চারশ কিলোমিটারের মধ্যে আর কোনো দ্বীপ নেই। সুতরাং এ দ্বীপই। শাহমাতার দ্বীপ। জাহরা বলল।
কিন্তু জাহরা, ডায়েরি অনুসারে কাসকেটের ধাঁধা ভেঙে ভেতরের ডকুমেন্ট থেকে নির্দেশনা নিয়ে এবং শাহমাতার অসিয়ত অনুসারে ধনভাণ্ডার ব্যবহারের নিয়ত নিয়ে রত্নদ্বীপে আসার কথা। ডকুমেন্টের কাসকেট না খুলে রত্নদ্বীপে এলে কেন? ডায়েরি অনুসারে কাসকেটটি হাতছাড়া হলেই শুধু ডায়েরির কোড ব্যবহার করার কথা। বলল আহমদ মুসা।
স্যার ঠিক বলেছেন। ডায়েরির নির্দেশ ব্যবহার করে কাসকেট নিয়ে আমার রত্নদ্বীপে আসার পেছনে একটা কাহিনী আছে। কাহিনীটা শুনলেই সব বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে। জাহরা বলল।
কাহিনীটা কি? বল। বলল আহমদ মুসা।
জাহরা সোজা হয়ে বসল।
মাথার কাপড়টা কপালের উপর আর একটু টেনে নিল। বলল, স্যার আমার দাদী বেগম আয়েশা আবু আবদুল্লাহ নাসিরী খুবই ধর্মভীরু মানুষ। সুখে-দুঃখে আল্লাহর প্রশংসা করেন, আল্লাহর উপরই ভরসা করেন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সব সংকটে আমি তাঁকে স্থির ও শান্ত দেখেছি, কোনো মিথ্যা কথা বলতে তাকে শুনিনি। একদিন ভোরে নামাজের পর। জায়নামাজে বসেই তিনি আমাকে ডাকলেন। ছোটবেলা থেকেই দাদীর পাশের ঘরে আমার শোবার ব্যবস্থা। দুই ঘরের মধ্যে একটা কানেকটিং দরজা আছে। আগে দাদী ছোট্ট আমার উপর নজর রাখতেন, এখন বৃদ্ধা দাদীর উপর আমি নজর রাখি।
হঠাৎ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল জাহরার গলা। থেমে গেল সে। মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে শামলে নিল জাহরা। বলল, স্যরি স্যার, হঠাৎ মনটা বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল। দাদীকে আমার অসুস্থ মা কতটা দেখাশুনা করতে পারছেন, সেটাই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমার বড় ভাই মরক্কোর নৌবাহিনীতে এবং বাবা রাবাতে এক সরকারি চাকরি করেন। মাকে ফজর নামাজ পড়ে কিছুটা ঘুমাতে হয়। দাদী হয়তো অভ্যাসবশত আমাকেই বার বার ডাকেন, কিন্তু পান না। থামল জাহরা। তার কণ্ঠ ভেজা।
ভেব না জাহরা। অবস্থা যখন মানুষের আয়ত্তের বাইরে যায়, তখন স্বয়ং আল্লাহ তার দায়িত্ব নেন। সান্ত্বনার সুরে বলল আহমদ মুসা।
হাসবুনাল্লাহ! বলে একটু থামল জাহরা। বলতে শুরু করল আবার, দাদীর ডাক পেয়ে আমি আমার জায়নামাজ থেকে উঠে দাদীর ঘরে গেলাম। দাদী বললেন, বস বোন শাহজাদী। আমি দাদীর জায়নামাজের পাশে কার্পেটের উপর বসলাম। দাদী একটু সরে বসে জায়নামাজে জায়গা বের করে বললেন, শাহজাদী মাটিতে বসবে কেন? জায়নামাজে বস। আমি দাদীর নির্দেশ মতো জায়নামাজে বসে বললাম, দাদী ছোটবেলায় আমাকে শাহজাদী বলেছ ঠিক আছে, এখনও আমাকে শাহজাদী বল কেন? আমার লজ্জা লাগে। আমি তো শাহজাদী নই। দাদী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন না। একটু গম্ভীর হয়ে উঠলেন তিনি। পরে ধীরকণ্ঠে বললেন, ছোটবেলায় তোমাকে শাহজাদী বলেছি আদর করে, কিন্তু এখন বলি তোমার অতীত, তোমাদের ক্ষমার অযোগ্য ব্যর্থতা এবং তোমার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যে। দিন কারো সমান যায় না, একথা ঠিক। কোনো সাম্রাজ্য চিরদিন টিকে থাকে না, এটাও সত্য। কিন্তু স্পেনে তোমার পূর্বসূরিরা নিছক ক্ষমতা লিপ্সার কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে যে নিষ্ঠুর লড়াই করেছে, তা আল্লাহ মাফ করেননি। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে দীপ্ত, ইউরোপের শিক্ষা হিসাবে বরিত, গৌরবপূর্ণ ও উদার শাসনের মুসলিম স্পেন তাই মুসলমানদের গোরস্তানে পরিণত হয়েছিল। আটশত বছর সেখানে বাস করেও, মাতৃভূমি হিসাবে আঁকড়ে ধরেও নিরাপদে বাস করার একখণ্ড ভূমিও সেখানে পাইনি। থামলেন দাদী। তার কণ্ঠে যেন অশ্রু ঝরে পড়ল। কিন্তু তার চোখ দেখলাম শুষ্ক। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। জানি জিজ্ঞাসা করলেই তিনি বলবেন, চোখের পানি শেষ হয়ে গেছে। আমি আমার ডান হাত দাদীর কাঁধে রেখে অনেকটা সান্ত্বনার স্বরে বললাম, ঠিক আছে দাদী তুমি আমাকে শাহজাদীই বলো। আঘাতটুকু তো আমার জন্যে প্রাপ্যই। দাদী কিছু বললেন না। একদম নীরব হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর মুখ তুললেন। বললেন, তোমাকে ডেকেছি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্যে শাহজাদী। আমি বললাম, বলুন দাদী। দেখলাম দাদীর চোখ দুটি জানালা দিয়ে বাইরে। বাইরের আকাশ তখন সফেদ হয়ে উঠেছে। না দিন, না রাত। অপার্থিব এক প্রশান্তি ও স্নিগ্ধতা চারদিকে। দাদী বললেন, শাহজাদী, গত তিন দিন ধরে নামাজে উঠার আগে আমি একই স্বপ্ন দেখে আসছি।… দাদীর কথার মাঝখানেই আমি বলে উঠলাম, তিন দিন ধরে একই স্বপ্ন দাদী! দারুণ মজার ব্যাপার! দাদী বললেন, মজার ব্যাপার বলে একে হালকা করে ফেলো না শাহজাদী। আমার কাছে এটা একটা পবিত্র ঘটনা। বললাম আমি, স্যরি, বল দাদী। দাদী বলতে শুরু করলেন, চারদিকে অথৈ সাগর। তার মাঝে ছোট্ট সোনালি একটা দ্বীপ। চারদিকে সোবহে সাদেকের পবিত্রতা। আপাদমস্তক শুভ্র পোষাকে সজ্জিত নেকাবে ঢাকা মুখ শাহমাতা এলেন। আমার কাছ থেকে তোমাকে টেনে নিলেন। নামিয়ে দিলেন তোমাকে সেই সুন্দর সোনালি ছোট দ্বীপটিতে। তোমার হাতে তাঁর সেই ডায়েরি এবং কাসকেট। দ্বীপের কোনো এক প্রান্ত থেকে সাদা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে একজন এলেন সহজ, সরল সুন্দর চেহারার, কিন্তু ইস্পাতের মতো দৃঢ় ও ঋজু। তিনি রাজকুমার নন, কিন্তু মনে হলো শত রাজকুমারের সমান তিনি। তুমি তার হাতে তুলে দিলে শাহমাতার ডায়েরি এবং কাসকেট। আমার স্বপ্ন এতটুকুই। এই স্বপ্নই আমি পরপর তিনদিন দেখলাম। এরপরেই দাদী আমাকে পাঠিয়ে দিলেন এই রত্নদ্বীপে। দ্বীপে আসার পর অনেক দিন ধরে আমি অবিরাম খুঁজছি সহজ, সরল, সুন্দর শত রাজকুমারের সমান মানুষটিকে। কিন্তু পেলাম না কোথাও। আমি হতাশ হয়ে পড়ায় খোঁজার আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে গেল। প্রায় ভুলেই গেলাম তাঁকে। ডায়েরির নির্দেশনা অনুসারে আমি নিজেই খুঁজতে লাগলাম শাহমাতার ধনভাণ্ডার। এই সময়ই দেখা পেলাম আপনার। প্রথম, দ্বিতীয় দেখায় আমি বুঝতে পারিনি, মনের দরজাও খোলেনি। কিন্তু গতকাল রাতে যখন আপনি জীবন ও সম্মান শেষ হওয়া থেকে আমাকে বাঁচালেন, তখন হঠাৎ করেই আমার মনের দরজা খুলে গেল। আপনাকে চেনা আমার সম্পূর্ণ হলো। এখন দাদীর স্বপ্নের শেষ অংশের বাস্তবায়ন শুধু ফাঁকি স্যার।
গম্ভীর আহমদ মুসার মুখ। বলল, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের স্বপ্ন আল্লাহর ইচ্ছায় সত্য হয়ে থাকে। যার হাতে ডায়েরি ও কাসকেট তুলে দেয়া হয়েছিল, স্বপ্নের সেই ব্যক্তি যে আমি তা নিশ্চিত হওয়া গেল কি করে?
আপনি ছাড়া মানুষ চেনে-জানে এমন একজন দ্বিতীয় হাতেম তায়ীর নাম আপনি করুন। পারবেন না। আর আপনি রত্নদ্বীপে এসেছেন, ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। এমন হাজারো সংকট আপনি সমাধান করেছেন। সুতরাং সবদিকের বিচারে আপনি সেই ব্যক্তি, এতে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই স্যার। সবচেয়ে বড় কথা স্যার, শাহমাতা যার মাধ্যমে ডায়েরি ও কাসকেট রত্নদ্বীপে আপনার জন্যে পাঠিয়েছেন। সেই আমার মন বলছে আমি যাকে খুঁজছিলাম তাকে পেয়ে গেছি। এরপর আর কোনো কথা চলতে পারে না। বলল জাহরা। তার মুখে হাসি।
কিন্তু আহমদ মুসার মুখে হাসি নেই। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে জাহরা, তুমি আমাকে কাসকেটটা দেখাও।
ধন্যবাদ স্যার। এখানে আনব? বলল জাহরা।
আহমদ মুসা দেয়াল ও উপরের দিকে তাকাল। বলল। এখানে সিসি ক্যামেরা নেই তো?
আছে স্যার। প্রত্যেক ডরমিটরির প্রবেশ পথে সিসি ক্যামেরা আছে। বলল জাহরা।
তাহলে তো এখানে কাসকেটটি দেখা নিরাপদ নয়। তাহলে চল তোমাদের বাগানে গিয়ে বসি। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে স্যার। আমি কাসকেটটা নিয়ে আসি।
জাহরা দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল এবং কাসকেট নিয়ে ফিরে এল।
আহমদ মুসা আগেই উঠে দাঁড়িয়েছিল।
জাহরা এলেই তারা নিচে নামতে শুরু করল।
.
ডরমিটরি বিল্ডিংটা চারদিকে ঘুরানো। বের হবার মাত্র একটা গেট। গেটে ভারি গ্রীলের দরজা। দরজার নিচের অংশ আইনশীট দিয়ে ব্লাইন্ড করে দেয়া, দারোয়ানদের লুকিং হোল ছাড়া। ডরমিটরি বিল্ডিং-এর মাঝখানে বিশাল ফাঁকা জায়গাটায় পাশাপাশি একটা খেলার মাঠ এবং একটি বাগান। বাগানের এখানে সেখানে স্টিলের বেঞ্চ, স্টিলের টেবিল এবং উপরে স্টিলের রঙিন ছাতা।
আহমদ মুসা ও জাহরা দুজন ডরমিটরি থেকে নেমে বাগানের দিকে চলল। পেছন দিক থেকে গাড়ি ছুটে আসার মতো একটা শব্দ শুনতে পেল। আহমদ মুসার গোটা স্নায়ুতন্ত্রী একসাথে যেন সাইরেন দিয়ে উঠল।
চোখের পলকে আহমদ মুসা জাহরাকে ডান দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে বাম দিকে জাম্প দিল। তার সাথে সাথে শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করে নিল এম-১৬ মেশিন রিভলবার। পেছন দিকে তাকিয়ে দেখল একটা। মাইক্রো ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে। চিন্তাটাও ঝড়ের বেগে মাথায় এলো আহমদ মুসার। শুরুতেই গুলি করলো মাইক্রোর পেছনের টায়ারে।
দশ পনের গজ গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মাইক্রো।
মাইক্রো থেকে নামল ছয় সাতজন স্টেনগানধারী। তাদের সকলের দৃষ্টি পেছন দিকে। তাদের স্টেনগান আহমদ মুসা লক্ষ্যে উঠে আসছে।
আহমদ মুসার এম-১৬ মেশিন রিভলবার প্রস্তুত ছিল। ট্রিগার টিপে ধরল শুধু।
মাইক্রোর বাম পাশে দুটি দরজা এবং তা পাশাপাশি। তারা একসাথেই গাড়ি থেকে নেমেছিল এবং একসাথেই গুলির শিকার হলো।
আহমদ মুসা উঠে বসল। তাকাল জাহরার দিকে। সে মাটির সাথে লেপটে পড়ে আছে।
তুমি ঠিক আছ জাহরা? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
মাথা তুলে তাকাল জাহরা। ভয়-আতংকে কুকড়ে যাওয়া তার মুখ। দেহের কাঁপুনি তার থামেনি এখনও। মৃত্যু থেকে তার ব্যবধান ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। স্যার ধাক্কাটা না দিলে মাইক্রোর তলায় সে পিষ্ট হয়ে যেত।
উঠে বসল জাহরা। বলল, স্যার আমি বেঁচে আছি, ভালো আছি। স্যার।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
গেটের দিকে একটা শব্দ পেয়ে আহমদ মুসা ফিরে তাকাল। চমকে উঠল ফিরে তাকিয়েই। একজন লোক ছুটে আসছে। তার গায়ে ডরমিটরির সিকিউরিটি স্টাফদের পোষাক। দৌড়ের মধ্যেই তার এক হাত উপরে উঠেছে আহমদ মুসার লক্ষ্যে। সেই সাথে দেখতে পেল একটা কার গেট ঠেলে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করছে। সম্ভবত নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি। এক পলকের দৃষ্টিতে আহমদ মুসার নজরে পড়ল এসব।
দৃষ্টির চেয়ে দ্রুত কাজ করল আহমদ মুসার চিন্তা। লোকটিকে চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা মাথা নিচু করে জাম্প দিল এবং দেহকে গুটিয়ে বলের মতো করে ছুটল লোকটির দিকে।
লোকটি বোমা ছুঁড়েছে।
বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটার প্রায় সাথে সাথেই আহমদ মুসার গড়ানো দেহ গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করল লোকটির দুপাসহ হাঁটুর নিচটায়। লোকটি পড়ে গেল। আহমদ মুসা স্পিং-এর মতো উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা লোকটির দিকে রিভলবার তাক করে বলল, যেমন আছ ঠিক তেমন থাক। হাত-পা নাড়াচাড়া করতে…।
কিন্তু আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই লোকটি বেপরোয়া ভংগিতে তার ডান হাতের অনামিকা কামড়ে ধরেছে।
আহমদ মুসা কথা শেষ না করেই ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির হাত লক্ষ্যে। টেনে বের করল তার অনামিকা। কিন্তু আঙুলের রিংটা তার মুখেই রয়ে গেছে।
হতাশভাবে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাদের পাশেই নিরাপত্তা বাহিনীর একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে।
গাড়ি থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সহকারী প্রধান মেজর পাভেল।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে সামনে মেজর পাভেলকে দেখতে পেয়ে বলল, একেও জীবন্ত ধরা গেল না মেজর পাভেল।
একদম বেপরোয়া এদের আচরণ। অবাক ব্যাপার! এদের একই রকম দেখছি।
বলে মেজর পাভেল একটু থামল। বলল আবার, স্যার এরা এই ডরমিটরির ৮জনকে হত্যা করে তাদের পোষাক ও গাড়ি নিয়ে ডরমিটরিতে আপনার উপর হামলা করতে আসে। মিনিট বিশেক আগে আমরা টেলিফোন পাই একজন পেট্রোল-নিরাপত্তা কর্মীর কাছ থেকে। সে জানায়, রাস্তার ধারে একটা টিলার আড়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিমেল ডরমিটরির নিরাপত্তা প্রহরীর লাশ পড়ে আছে। তাদের একজনের গায়েই শুধু ইউনিফরম ছিল। অন্যদের খালি গা। আপনি এই ডরমিটরিতে এসেছেন, এ তথ্য আমাদের কাছে ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা নিশ্চিত হই, ডরমিটরি নিরাপত্তাকর্মীদের পোষাক ও গাড়ি নিয়ে ওরা আপনার সন্ধানেই ডরমিটরিতে গেছে। তার পরেই আমরা ছুটে এসেছি।
থামল মেজর পাভেল। তার চেহারা উদ্বেগ-আতংকে বিধ্বস্ত।
জাহরা ডায়েরি ও কাসকেট রাখা ব্যাগটা কুড়িয়ে আহমদ মুসাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
ডরমিটরির মেয়েরা অনেকেই গোটা দৃশ্য দেখেছে। তারা সবাই নিচে নেমে এসেছে অভূতপূর্ব ঘটনা এবং এর কারণ কি ও কেন তা জানার জন্যে।
তারা এসে জমা হয়েছে আহমদ মুসা, জাহরা, মেজর পাভেলদের ঘিরে। দৃষ্টি তাদের জাহরা ও আহমদ মুসার দিকে। তাদের জাহরাকে নিয়ে কি ঘটল? জাহরার সাথে লোকটি কে? একদম ফিল্মের মতো ঘটনা ঘটাল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, ৮টা লাশ পড়ে গেল?
মেজর পাভেলের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, ধন্যবাদ মেজর। মেজর পাভেল একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, আমি এখানে এসেছি এটা শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস ও কর্নেল জেনারেল রিদা জানেন। এত তাড়াতাড়ি ওরা জেনে গেল কি করে?
স্যার, মনে হয় ওরা প্রেসিডেন্ট হাউজে আপনাকে ফলো করেছে, তারপর ডরমিটরিতেও আপনাকে ফলো করে এসেছে।
তার মানে ওরা সব সময় আমাকে ফলো করছে। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আমাদের তো তাই মনে হচ্ছে। মেজর পাভের বলল।
মেজর পাভেল, আপনি এই লাশগুলোর ব্যবস্থা করুন এবং ডরমিটরির নিরাপত্তা আরও জোরদার করার ব্যবস্থা করতে হবে।
বলেই আহমদ মুসা তাকাল জাহরার দিকে। বলল, দেখ ডরমিটরির মেয়েরা নেমে এসেছে। তারা জানতে চায়, শুনতে চায়। যা ঘটেছে তা বল সবাইকে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই চারদিক থেকে ডরমিটরির মেয়েরা আহমদ মুসাদের আশেপাশে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের সকলের মুখেই উদ্বেগ-আতংক।
আহমদ মুসা এবার তাকাল মেজর পাভেলের দিকে। বলল, মনে করেছিলাম জাহরা বললেই হবে। কিন্তু সে তাদেরই একজন। তার কথা সবার কাছে সমান গুরুত্ববহ হবে না। পাভেল, তুমিই বিষয়টা সবার কাছে পরিষ্কার করে দাও।
পাভেল মেয়েদের দিকে এগিয়ে গেল। তার আগেই জাহরা মেয়েদের কাছে চলে গিয়েছিল। উত্সক ও আতংকগ্রস্ত মেয়েরা তাকে এসে ঘিরে ধরেছিল বিষয়টা কি তা জানার জন্যে। মেয়েদের পেছনে অনেক ছাত্রকেও দেখা গেল। খোলা গেট দিয়ে তারা এসেছে। তাদের সংখ্যা বাড়ছে।
মেজর পাভেল সামনে গিয়ে দুই হাত তুলে বলল, ছেলেমেয়েরা শোন, এখন আর উদ্বেগের কিছু নেই। সন্ত্রাসীরা যারা ভেতরে ঢুকেছিল, সবাই মারা পড়েছে। সন্ত্রাসীদের আমরা চিনতে পেরেছি। দেশের কয়েক জায়গায় সন্ত্রাস করতে গিয়ে যারা মারা পড়েছে, এরা তাদের গ্রুপেরই। আমাদের একজন সম্মানিত ভাই সন্ত্রাস দমনে যিনি আমাদের সহযোগিতা করছেন, তাঁকে টার্গেট করেই সন্ত্রাসীদের এই অভিযান ছিল। আল্লাহ তাদের সন্ত্রাসী অভিযান ব্যর্থ করে দিয়েছেন। সবাই আপনারা প্রার্থনা করুন গোটা দ্বীপ থেকেই সন্ত্রাসীরা যেন উৎখাত হয়ে যায়। থামল মেজর পাভেল।
সঙ্গে সঙ্গেই একটি মেয়ে বলে উঠল, সম্মানিত ভাইটি কে? আমরা যা দেখলাম, যেভাবে তিনি বাঁচলেন, বাঁচালেন এবং মারলেন সবাইকে, তা অবিশ্বাস্য। তিনি রত্নদ্বীপের নিশ্চয় নন।
আহমদ মুসা রত্নদ্বীপের নয়, বেড়াতে আসা এক মেহমান তিনি। এই পরিচয় দিয়ে মেজর পাভেল বলল, এর বেশি তার পরিচয় সম্পর্কে আমরা বলতে পারবো না। নানা কারণে বিষয়টা গোপন রাখা হয়েছে। প্লিজ, এ বিষয়ে কেউ আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।
মেজর পাভেল থামতেই আরেকজন উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল, আপনাদের সম্মানিত ভাই আমাদের সম্মানিত স্যার। তাঁর কাছে। দুএকটা কথা আমরা শুনতে চাই। অবশ্যই বলবেন তিনি আমরা আশা করি।
মেজর পাভেল তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
ঠিক আছে ওরা চাইছে বলব আমি।
বলে আহমদ মুসা সামনে এগোলো।
সবাইকে লক্ষ্য করে সালাম দিয়ে বলল, তোমরা আমার কাছে কি কথা শুনতে চাও আমি জানি না। কিন্তু আমি কিছু বলতে চাই তোমাদেরকে। এই ঘটনায় তোমাদের সবার মুখে আমি উদ্বেগ দেখছি। রত্নদ্বীপের নতুন প্রজন্মের এই চেহারা আমার ভালো লাগেনি। সন্ত্রাস, বিপদ ইত্যাদি সামনে এলে ভয়, উদ্বেগের বদলে তোমাদের মুখ প্রতিবাদ প্রতিরোধে দৃঢ় হওয়া উচিত। আজ রত্নদ্বীপে সন্ত্রাসীরা যে বিপদ নিয়ে এসেছে, সেটা আমি মনে করি রত্নদ্বীপ, রত্নদ্বীপের মানুষের ক্ষতি নয়, উপকারে আসবে। রত্নদ্বীপের সংবিধান, তার ফল হিসাবে রত্নদ্বীপের শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দৃষ্টান্তযোগ্য একটা মডেল। আমি অভিবাদন জানাই রত্নদ্বীপের মানুষকে ও তাদের নেতাকে। রত্নদ্বীপের এই প্রশংসার সাথে সাথে আমি রত্নদ্বীপের একটা বিচ্যুতির কথা বলতে চাই। রত্নদ্বীপের মানুষ দেশে শান্তি এনেছে, শান্তি এনেছে তাদের। জীবনে, কিন্তু এই শান্তি রক্ষার জন্যে, শান্তিকে বাইরের সন্ত্রাস, ষড়যন্ত্র, আগ্রাসন থেকে রক্ষার জন্যে যে শক্তি প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করেনি। স্বাধীনতা ও শক্তি সমার্থক। এক থেকে অন্যকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। শক্তিহীন স্বাধীনতা হলো পরনির্ভরতা, অন্য কথায় পরাধীনতা। রত্নদ্বীপকে তার এই ভুল শোধরাতে হবে। রত্নদ্বীপকে পরিণত হতে হবে এক অজেয় শক্তিকে। ছোট দেশ হলেই তার শক্তি ছোট হবে তা ঠিক নয়। ছোট দ্বীপকে বরং পরিণত হতে হবে বড় শক্তিতে। রত্নদ্বীপ নিয়মিত-অনিয়মিত মিলে এক লাখ সৈন্যের একটা বাহিনী গড়ে তুলতে পারে। আধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার ব্যবহার করলে এই বাহিনী অজেয় এক বাহিনীতে পরিণত করা সম্ভব। রত্নদ্বীপ একটা প্রাকৃতিক দুর্গ। প্রাকৃতিক এই সুযোগও তার প্রতিরক্ষার একটা বড় শক্তি। রত্নদ্বীপের নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতা ও শক্তির মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। বর্তমান সংকটে রত্নদ্বীপের নতুন প্রজন্মের প্রত্যেক সদস্যকে এ কথা বুঝতে হবে এবং তাদের চারপাশে শান্তি রক্ষা করে চলতে হবে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। জনগণের সরকার ও সংবিধান যাতে দুর্বল না হয়ে পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি একজন বিদেশি। আমার এই কথাগুলো রত্নদ্বীপের প্রতি, রত্নদ্বীপের জনগণের প্রতি আমার ভালোবাসা।
সবাইকে সালাম নিয়ে আহমদ মুসা তার কথা শেষ করল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই গোটা মাঠ হাততালিতে যেন ফেটে পড়ল।
মাঠ ভরে গেছে ছাত্র-ছাত্রীতে। ছাত্রী ডরমিটরির বিশাল হোস্টেল। ডরমিটরির ঘটনা তাদের কানে পৌঁছেছে। তারা সবাই ছুটে এসেছে। ডরমিটরিতে।
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে একজন সামনে এগিয়ে এল। দেখেই আহমদ মুসা চিনল তাকে। প্রেসিডেন্টের ছেলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হামযা আনাস আমিন। সে সকল ছাত্র-ছাত্রীর তরফ থেকে আহমদ, মুসাকে সালাম দিয়ে বলল, আপনি নিজেকে বিদেশি বলে পরিচয় দিয়েছেন। কোনো বিদেশি এমন আপনজন হয় না। আপনি নতুন এক রত্নদ্বীপকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এই দিকটা আমরা রত্নদ্বীপবাসীরা কখনো কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। আমরা আশা করি, শান্তি ও শক্তিতে সজ্জিত যে রত্নদ্বীপের কথা আপনি বলেছেন, সেটাই হবে ভবিষ্যতের রত্নদ্বীপ। রত্নদ্বীপের নতুন প্রজন্ম আমরা চাই নতুন রত্নদ্বীপ গড়ার সংগ্রামে আপনি রত্নদ্বীপের সাথী হোন। স্বপ্ন যিনি দেখান, স্বপ্নের বাস্তবায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন তিনি থাকেন না। রত্নদ্বীপের তরুণ প্রজন্মের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। নতুন রত্নদ্বীপের সৈনিক আমরা নতুন প্রজন্মের সকলেই, এই নিশ্চয়তা আমরা দিতে চাই আপনাকে।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে কথা শেষ করল হামযা আনাস আমিন।
আহমদ মুসা ধন্যবাদ জানাল সকলকে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করে মেজর পাভেলের দিকে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল–এ সময় ছাত্র-ছাত্রীদের সারি থেকে একটা মেয়ে ও একটা ছেলে ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে।
তাদেরকে ছুটে আসতে দেখে আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল।
মেয়ে ও ছেলেটা এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। মেয়েটা বিশ একুশ বছরের। ছেলেটা দুএক বছরের ছোট হবে। তাদের চোখে-মুখে গ্রিক ও স্প্যানিশ চেহারার মিশ্রণ। তবে শহুরে নয়, বন্য-লাবন্য তাদের সুষমায়। খুব ঋজু, খুব সরল তাদের ভঙ্গিমা।
মেয়েটি বলল, আমি লরা সোফিয়া, আর আমার সাথে আমার ছোট ভাই লরেঞ্জো। দ্বীপের পূর্বাঞ্চলে গোয়দিয়া পাহাড় অঞ্চলে থাকি। সেখান। থেকেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। আজ জরুরি একটা কাজে আমরা। এদিকে এসেছিলাম। ভাগ্যবলেই আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল।
একটু থামল মেয়েটি। একটু ভাবল বা নিজেকে মনে হয় একটু গুছিয়ে নিল। বলল, স্যার, আপনাকে একটা ইনফরমেশন দিতে চাই। আর কিছু না হোক, বিপদ থেকে বাঁচার জন্যে এটা আমাদের প্রয়োজন।
ইনফরমেশন? এখানেই বলবে, কোথাও বসতে চাও? বলল আহমদ মুসা।
আপনার ইচ্ছা স্যার। বলল লরা সোফিয়া।
একটু অপেক্ষা করতে পারবে তোমরা? বলল আহমদ মুসা।
অসুবিধা নেই স্যার, আমাদের কোনো তাড়া নেই। আমরা অপেক্ষা করব। লরা সোফিয়া বলল।
তাহলে তোমরা একটু দাঁড়াও।
বলে আহমদ মুসা তাকাল মেজর পাভেলের দিকে। বলল, লাশগুলো নেয়ার ব্যবস্থা কর। তার আগে চল লাশগুলোকে সার্চ করি। ডরমিটরির নিরাপত্তার জন্যে শুধু এর প্রহরীরা যথেষ্ট নয়। তাদের সাথে কয়েকজন করে নিরাপত্তা সৈনিকও রাখতে হবে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করেই লাশের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
মেজর পাভেল আহমদ মুসার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ডরমিটরি, মেয়েদের ও ছেলেদের হলের গেটে নিরাপত্তা সৈনিক। মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হয়েছে স্যার।
ধন্যবাদ মেজর। আসুন। বলল আহমদ মুসা।
জাহরা ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। বলল, স্যার ডায়েরি এবং কাসকেট আমার হাতে।
হ্যাঁ জাহরা, ওগুলো তোমার হাতে রাখ। ডরমিটরি থেকে বেরোবার আগে তোমার সাথে আমার সাক্ষাত হবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। জাহরা বলল।
ওয়েলকাম। বলে আহমদ মুসা আবার হাঁটতে শুরু করল।
হঠাৎ ঝড়ের বেগে একটা কথা আহমদ মুসার মনে এলো। লরাদের বিপদের কথা না শুনা ভুল হয়েছে। কি বিপদ না জেনে তাদের অপেক্ষা করতে বলাটা আল্লাহর ইচ্ছার খেলাফ হতে পারে। আল্লাহর ইচ্ছাতেই তো ওরা এসেছিল আমার কাছে।
কথাটা মনে হওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা লরারা কোথায় তা দেখার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল। পেছন ফিরেই দেখতে পেল, লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জো তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। গল্প করছে তারা।
সেই সাথেই স্টার্ট নিয়ে উঠা মটর সাইকেলের দিকে তার দুই চোখ ছুটে গেল। দেখল মোটর সাইকেলে তিনজন আরোহী। তাদের পেছনের দুইজনের হাতের রিভলবার এদিকে উঠে আসছে। দেখার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বুঝল, লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জো ওদের টার্গেট।
ওটা দেখার সাথে সাথেই আহমদ মুসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে। আহমদ মুসার হাত জ্যাকেটের পকেট থেকে বেরিয়ে এল রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনি রেখে। নতুন করে টার্গেটের সময় নেই, জ্যাকেটের পকেট থেকে হাত বের হবার সাথে সাথেই ট্রিগারে চেপে বসল তার আঙুল। বেরিয়ে এলো দুটি গুলি পরপর।
আহমদ মুসার অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতাই জিতে গেল। মোটর সাইকেলের পেছনের দুইজন রিভলবারধারী গুলিবিদ্ধ হলো। তাদের তর্জনিও ট্রিগার টিপেছিল। কিন্তু গুলি খাওয়ার ঝাঁকুনি তাদের টার্গেট থেকে সরিয়ে দিল। রিভলবারের নল নড়ে গিয়ে অনেকখানি নিচে ও পাশে সরে গিয়েছিল। গুলি দুটি অল্প দূরে দাঁড়ানো দুটি ছেলের একজনের উরু, অন্যজনের হাঁটুর নিচের পেশিটাকে বিদ্ধ করল। ছেলে দুটি যন্ত্রণায় চিৎকার করে বসে পড়েছিল। আর মোটর সাইকেলের রিভলবারধারী দুজন গুলি খেয়ে মোটর সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিল।
মোটর সাইকেলের তৃতীয়জন ছুটে পালাচ্ছিল।
ঘটনার সাক্ষী হিসাবে তাকে পালাতে দিতে চাইল না আহমদ মুসা।
আপনাতেই তার রিভলবার টার্গেটে উঠে গিয়েছিল। আহমদ মুসা তর্জনি চাপল ট্রিগারে। বুলেট ছুটল মোটর সাইকেলে ছুটে চলা লোকটির পেছনে। চার পাঁচ গজও এগোতে পারল না লোকটা। গুলি খেয়ে পড়ে গেল।
বিস্ময় আতংকে অভিভূত মাঠভর্তি ছাত্র-ছাত্রীরা দেখছিল তাদের মাঝে সংঘটিত এই ঘটনা।
লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জোরা শুরুতে বুঝতেই পারেনি যে, তারা। টার্গেট। পরে বুঝতে পেরে বাকহীন পাথরের মতো হয়ে গিয়েছিল তারা।
অন্য সবাই প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি বিষয়টা। ডরমিটরির সিকিউরিটির পোষাক পরা মোটর সাইকেলের রিভলবারধারী আরোহীকে দেখে তাদের কিছু মনে হয়নি। কিন্তু রিভলবারধারীরা যখন দুজন ছাত্র ছাত্রীর দিকে রিভলবার তুলল এবং আহমদ মুসা যখন ওদের গুলি করল, তখনই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল সবার কাছে। আতংক, বিস্ময় ফুটে উঠে তাদের চোখে-মুখে। তাদের সবার চোখ আহমদ মুসার দিকে। সিকিউরিটির লোকরা ছুটে এসে গুলিবিদ্ধদের ঘিরে ফেলেছে।
আহমদ মুসা মেজর পাভেলকে বলল আহত দুজন ছাত্রকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করতে।
আহমদ মুসা এগোলো লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জোর দিকে।
আহমদ মুসাকে সামনে দেখেই লরা বলল, স্যার, আপনি আমাদের দুজনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আমরা আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকবো। ভীত, ভারি কণ্ঠস্বর লরা সোফিয়ার।
আহমদ মুসা লরা সোফিয়ার কথার কোনো উত্তর দিল না। প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল, ওরা তোমাদের টার্গেট করেছিল কেন? ওদের চেন? কারা ওরা জান?
জানি না স্যার। তবে আমার মনে হচ্ছে, যারা আমাদের বিপদ ঘটিয়েছে, যাদের কথা আমরা আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম, এরা তাদের কেউ হতে পারে। তারা না হলে আমাদের চিনল কি করে? লরা সোফিয়া বলল।
কিন্তু ওরা তোমাদের মারতে চাচ্ছিল কেন? বলল আহমদ মুসা।
তাদের কোনো কথা কাউকে বলার ক্ষেত্রে নিষেধ আছে আমাদের পরিবারের সকলের উপর। এমন কি যা ঘটেছে, সে সম্পর্কেও কাউকে কিছু বলা যাবে না। আপনার সাথে আমরা কথা বলায় তারা হয়তো সন্দেহ করেছে যে, আমরা আপনাকে কিছু বলতে যাচ্ছি। লরা সোফিয়া বলল।
তাহলে কি তারা তোমাদের ফলো করে? তোমরা কাদের সাথে কি কথা বলছ, তা কি তারা মনিটর করে? বলল আহমদ মুসা।
আমরা এটা খেয়াল করিনি। এটা তারা করতে পারে স্যার। তারা। সাংঘাতিক তৎপর, নাছোড়বান্দা স্যার। লরা সোফিয়া বলল।
তোমাদের ঘটনা কি, এখনি জানতে হচ্ছে লরা সোফিয়া। শুন, তোমরা জাহরার সাথে তার ডরমিটরিতে যাও। আমি আসছি।
বলেই পাশে দাঁড়ানো জাহরাকে বলল, তুমি এদের নিয়ে যাও।
যাচ্ছি স্যার। জাহরা বলল।
তাকাল জাহরা লরা সোফিয়ার দিকে। বলল, আসুন আমরা চলি।
তারা তিনজন এগোলো জাহরার ঘরের দিকে।
আহমদ মুসা মোবাইল বের করল পকেট থেকে।
কল করল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসকে।
মোবাইলের ওপ্রান্ত থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গলা পেয়েই বলল আহমদ মুসা, মি. কনস্টানটিনোস, আপনি নিশ্চয় এ দিকের খবর পেয়েছেন।
হ্যাঁ মি. আহমদ মুসা, সব খবর পেয়েছি। আবার আপনাকে আমাদের হৃদয়পূর্ণ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ডরমিটরির ভেতরে তাদের দু দুটি ভয়াবহ অভিযান আপনি ব্যর্থ করে দিয়েছেন। সাক্ষী হবার মতোও কেউ বাঁচেনি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
মি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আসুন আমরা অতীত নয়, ভবিষ্যতের কথা ভাবি। আমরা যে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করছি, তারা খুবই দুঃসাহসী, বেপরোয়া এবং প্রাণ থাকা পর্যন্ত পিছু হটে না। ওদের অনেক ক্ষতি হয়েছে কিন্তু তা তারা বুঝতে দিচ্ছে না আক্রমণ অব্যাহত রেখে। পথের কাঁটা দূর করার কোনো সুযোগই তারা মিস করছে না। বলল আহমদ মুসা।
এটাই তো আমাদের সবার জন্যে উদ্বেগের মি. আহমদ মুসা। এখন বলুন আমাদের কি করণীয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত পাহারার ব্যবস্থা করুন। স্টেট সিকিউরিটি ফোর্সসহ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যে ফটোসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দস্তখত সংবলিত নতুন আইডি কার্ডের ব্যবস্থা করুন। সিকিউরিটি ফোর্সসহ সকলের জন্যে আইডি কার্ড শো করা। বাধ্যতামূলক করতে হবে। আপনাদের প্রত্যেক নাগরিকের যে ন্যাশনাল আইডি কার্ড রয়েছে তার দ্রুত নবায়নের ব্যবস্থা করুন। অঞ্চলভিত্তিকভাবে বসে পরিচয় নিশ্চিত করে কার্ড নবায়ন করতে হবে। কার্ড ও পাসপোর্ট-ভিসাবিহীন কোনো লোক পেলে তাকে গ্রেফতার করতে হবে। আমার মনে হয় এই কাজগুলো সম্পন্ন হলে সন্ত্রাসীদের অবাধ চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং তারা অনেকটাই চাপে পড়বে। আরও কিছু বিষয় আছে, ওগুলো নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা মোবাইল অফ করে পাভেলদের কাজের দিকে একবার তাকিয়ে হাঁটা দিল জাহরার ডরমিটরির দিকে।
২
একটা হাইল্যান্ডার জীপ পূর্বমুখী হাইওয়ে ধরে গোয়াদিয়া অঞ্চলের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
জীপের ড্রাইভিং সিটে বসে আছে আহমদ মুসা। পেছনের সিটে লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জে।
আহমদ মুসা জাহরার ডরমিটরির দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু যাওয়া হয়নি। সে দেখতে পেয়েছিল লরা সোফিয়ারা তার দিকে ছুটে আসছে। ঠিক এই সময় আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠে। টেলিফোন এসেছে সিকিউরিটি বাহিনীর প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ আমেদিও-এর কাছ থেকে। উদ্বিগ্ন রিদা আহমদ জানায়, গোয়াদিয়ার আরকাড়ি গ্রামে একটা পরিবার আক্রান্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যা জানা গেছে তাতে পরিবারের সবাই মারা গেছে। ঐ অঞ্চলে আমাদের এগারো সদস্যের পেট্রোল টিম ছিল। খবর পেয়েই তারা ছুটে যায়। সে পেট্রোল টীমেরও কোনো খোঁজ নেই।
ঐ অঞ্চলের আরও কিছু কথা আমি শুনেছি। এখানে সর্বশেষ যে। ঘটনা ঘটল, তার সাথে ঐ ঘটনার কোনো যোগ আছে কি না জানি না, তবে ঐ অঞ্চলের ঘটনার যোগ আছে। ঠিক আছে কর্নেল জেনারেল রিদা, আমি যাচ্ছি সেখানে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার, আমিও যাচ্ছি। বলল সিকিউরিটি বাহিনীর প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ আমেদিও।
ও,কে, ওখানে দেখা হচ্ছে আমাদের। বলল আহমদ মুসা।
বলে আহমদ মুসা মোবাইল বন্ধ করতেই তার কাছে পৌঁছে গেল লরা। সোফিয়ারা।
তারা মুখ খোলার আগেই আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করেছিল, লরা, লরেঞ্জো তোমাদের বাড়ি কি গোয়াদিয়ার আরকাড়ি গ্রামে?
হ্যাঁ, আপনি কি শুনেছেন সব? লরা সোফিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল।
সব শুনিনি, কিছু শুনেছি। চল আমরা সেখানে যাব। বলল আহমদ মুসা।
যাবেন স্যার আপনি! আল-হামদুলিল্লাহ। লরা সোফিয়া বলল।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন সার্কুলার হাইওয়ে থেকে উঠে এসেছে। পাহাড়ী পথে।
লরা-লরেঞ্জো তোমাদের বাড়ি আর কতটা দূরে? বলল আহমদ। মুসা।
বেশি দূরে নয় স্যার, আড়াই মাইলের মতো। কিন্তু রাস্তা ভালো নয়, আঁকাবাঁকা এবং উঁচুনিচু। লরা সোফিয়া বলল।
আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনে। দৃষ্টি সামনে রেখেই বলল, খুব সংক্ষেপে বল তো কিভাবে, কি ঘটনা ঘটেছিল ওদের সাথে?
স্যার, পাহাড়ের অনেক ভেতরে আমাদের বেশ বড় একটা ফলের বাগান আছে। তার সাথে উপত্যকায় কিছু ফসলও হয়। আমাদের আব্বা, দাদু, চাচা ও ভাইরা গিয়েছিল সেখানে। আমাদের বাগানের প্রায় ধার ঘেঁষেই পাহাড়ি রাস্তা পাহাড়ের আরও ভেতরে চলে গেছে। আমাদের। বাগনের পাশে ঐ রাস্তায় সেদিন মারাত্মক একটি দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার শব্দ শুনে আমার আব্বারা সেখানে ছুটে যান। দুটি গাড়ি যাচ্ছিল। সামনের গাড়িটি পাহাড়ের বাঁকে উপরে উঠতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে নিচের রাস্তায় পেছনের গাড়ির সামনেই পড়ে যায়। আমার আব্বারা গিয়ে দেখল গাড়িটা ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। আগের গাড়িটা ছিল কাভার্ড ভ্যান। কাভার্ড ভ্যানের ভেতরের বাক্সগুলোও ভেঙে পড়েছে। ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি বিভিন্ন ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। বাক্সগুলোর সাথে বিভিন্ন ধরনের ফলও কাভার্ড ভ্যানে ছিল। ফল দিয়ে অস্ত্রের বাক্সগুলোকে আড়াল করা ছিল। ফলগুলোও চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ড্রাইভার মারা গিয়েছিল, সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না তাদের। পেছনের মাইক্রোর আট-দশজন লোক অস্ত্র আড়াল করতে ব্যস্ত ছিল। আমার আব্বাদের কয়েকজনকে দেখে তারা ক্ষেপে যায় এবং অস্ত্রের মুখে তাদের আটক করে ফেলে। এরপর পুলিশের বাঁশি শুনে তারা তাড়াহুড়া করে আমার আব্বাসহ সবাইকে কাজে লাগিয়ে ছিটিয়ে পড়া অস্ত্রগুলো মাইক্রোতে তুলে। দ্রুত তারা। গাড়িতে উঠে পড়ে। তাদের সাথে আব্বাকেও গাড়িতে তুলে নেয়। তারা চাচুদের বলে, পুলিশের গাড়ি আসলে বলতে হবে, আপনাদের ফলের বাগান থেকে কাভার্ড ভ্যানে ফল বোঝাই করে ফেরার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আপনারা যা দেখেছেন তার কোনো কথাই পুলিশ বা কাউকে বলা যাবে না। আমাদের কথা মতো কাজ না করলে যাকে নিয়ে যাচ্ছি, তাকেই শুধু নয়, আপনাদের গোটা পরিবার ধ্বংস করে দেয়া হবে। ভয় ও আতংকে ওরা যেভাবে বলেছে সেভাবেই কাজ করে আমার দাদু চাচুরা। পরদিন চাচা ও একজন চাচাতো ভাই ওদের টেলিফোন পেয়ে পাহাড়ে যায় এবং বাবাকে ফিরিয়ে আনে তাদের শর্ত মেনে। শর্তের একটি হলো, তাদের কোনো কথা পুলিশ বা কেউ জানলে এর জন্যে দায়ী। হবে আমাদের পরিবার। তাদের একজন ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যাবতীয় ব্যবস্থা আমাদের করে দিতে হবে, তবে তার পরিচয় আমরা জানতে পারবো না, এটা তাদের দ্বিতীয় শর্ত। আর তৃতীয় শর্ত হলো, তারা যখন চাইবে, তখন আমাদের গাড়ি ও ড্রাইভার তাদের দিতে হবে। আমাদের গাড়ি তারা বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছে। ওরা সর্বক্ষণ আমাদের আতংকের মধ্যে রেখেছে। যে কোনো সময় যা ইচ্ছা তা তারা ঘটাতে পারে। থামল লরা সোফিয়া।
ধন্যবাদ লরা সোফিয়া। তোমাদের গাড়ি ওরা সাধারণত কোন সময় নিত?
রাতে। এক সময়ে নয়, রাতের বিভিন্ন সময়ে। লরা সোফিয়া। বলল।
ওদের যে ছেলেটিকে ভর্তি করে দিয়েছ তোমরা, তাকে দেখনি, চেনও না। কিন্তু কোন বিষয়ে কোন ইয়ারে ভর্তি হয়েছে তা জান? বলল আহমদ মুসা।
তাও জানি না। লোকাল গার্ডিয়ানের জায়গায় বাবার দস্তখত নিয়েছে মাত্র। লরা সোফিয়া বলল।
তোমাদের বাড়ির ঠিকানা তার ভর্তি ফরমে নিশ্চয় আছে? বলল আহমদ মুসা।
সেটা থাকারই কথা। লরা সোফিয়া বলল। _ দস্তখতের সাথে তোমাদের আব্বার নামও অবশ্যই ফরমে থাকবে। কারণ নাম ছাড়া ঠিকানার কোনো অর্থ হয় না। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক স্যার।
বলেই লরা সোফিয়া তার কথার সাথে যোগ করল, স্যার, আমরা এসে গেছি। লরা সোফিয়ার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।
বাড়ির সামনে প্রচুর সিকিউরিটি ফোর্সের লোক।
আহমদ মুসার গাড়ি পৌঁছল বাড়ির কম্পাউন্ডে। গাড়িতে আহমদ মুসাকে দেখে সিকিউরিটি ফোর্সের লোকরা সরে দাঁড়িয়ে রাস্তা করে দিল।
গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল বিধ্বস্ত গাড়ি বারান্দার সামনে।
সন্ত্রাসীরা তাদের অপারেশন শেষ করে যাওয়ার সময় একটা ডিনামাইট ফাটিয়ে গেছে। ডিনামাইট গাড়ি বারান্দাসহ বাড়ির সামনেটা ধ্বসে গেছে।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামতেই ছুটে এল কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ।
গাড়ি থেকে নেমেছিল লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জো। তারা ছুটে গেল ভেতরে।
স্যার, ঝড়ের মতো ওরা এসেছিল এবং বাড়িতে ঢুকে যাকে পেয়েছে। তাকেই হত্যা করে চলে গেছে। যাওয়ার সময় তারা চিৎকার করে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়া শেষ হলো না, বাকি থাকল। আসল আসামী দুজন বাকি থাকল। বলল কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ।
চলুন দেখি কি ঘটেছে। আসল আসামী বলতে ওরা কাকে বুঝিয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
চলতে শুরু করে কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ বলল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার প্রতিশোধ প্রসঙ্গেই সে এ কথা বলেছে। সুতরাং আসল আসামী বলতে এ পরিবারের লরা সোফিয়া ও লরেঞ্জোকে বুঝাতে পারে।
আমিও তাই মনে করি কর্নেল জেনারেল রিদা। বলল আহমদ মুসা। বাড়ির ভেতরে ডুকে রক্তে ভেসে যাওয়া আঙিনার উপর নজর পড়ল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা আঙিনায় প্রবেশ করতেই লরা সোফিয়া এল আহমদ। মুসার কাছে। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, স্যার, আমার সব গেছে স্যার। আমার বাবা, মা, ছোট ভাইবোন, বেড়াতে আসা মামা, মামি, খালা সব হারিয়েছি আমি। আমরা বাঁচলাম কেন? বেঁচে কি লাভ হলো স্যার!
একজন তরুণ যুবক এসে দাঁড়াল লরা সোফিয়ার পাশাপাশি। সে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা লরা সোফিয়াকে কিছু বলতে গিয়ে তাকাল যুবকটির দিকে।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো যুবকটির দিকে তাকিয়ে। দেখল তার চোখে ভয়, উদ্বেগ নয়, বিস্ময় ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি। হঠাৎ মোবাইলে কথা বলার জন্যে দ্রুত চলে গেল যুবকটি।
কিন্তু আহমদ মুসা সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে তাকাল লরা সোফিয়ার দিকে।
লরা সোফিয়া, যা ঘটেছে তা সীমাহীন দুঃখের। এই দুঃখ-বেদনা পরিমাপ করা যাবে না। কিন্তু লরা কান্নার সময় এটা নয়, তোমাকে শক্ত হতে হবে। তুমি, আমরা যত ভয় পাব, শত্রু ততই শক্তিশালী হবে। দুর্বল হলে চলবে না লরা, সামনে এগোতে হবে।
লরা সোফিয়া কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছিল। চোখ মুছতে মুছতে সে উঠে দাঁড়াল। কিছু বলল না।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা চোখ ফিরিয়েই দেখতে পেল, সেই যুবকটি দ্রুত আঙিনার ওপারে একটা ঘরের আড়ালে চলে গেল। সে তখন মোবাইলে কথা বলছিল।
একটা প্রশ্ন সামনে এল আহমদ মুসার। যুবকটির এমন মানসিকতা কেন? মোবাইলে কথা বলার জন্যে দ্রুত ওভাবে চলে গেল কেন? হঠাৎ আশংকার একটা কালো মেঘ ঝড়ের বেগে এসে তার মনের আকাশ আছন্ন করল।
লরা সোফিয়া, এখানে দাঁড়িয়েছিল যুবকটি কে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
আমার চাচাতো ভাই। মার্টিন। লরা সোফিয়া বলল।
তোমার এই ভাই ও চাচা কি পাহাড়ে গিয়েছিল তোমার বাবাকে আনতে? বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ স্যার। লরা সোফিয়া বলল।
আচ্ছা, আজ তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলে এ তথ্য ওরা জানল কি করে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের ছেলেটার মাধ্যমে, না পাহাড়ের ওরাই প্রথমে বিষয়টা জানাতে পারে? অনেকটা স্বগত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
আমাদের মনেও এ প্রশ্ন জেগেছে স্যার। লরা সোফিয়া বলল।
আহমদ মুসা লরা সোফিয়াকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ বলল, স্যার, পুলিশের কাজ শেষ। তারা লাশগুলো নিয়ে চলে যাচ্ছে। গোয়েন্দারা থাকছে, তারা আরও কিছু কাজ করবে।
কয়েকজন পুলিশকে এ বাড়িতে রাখছেন তো? কিছু দিন তাদের এ বাড়িতে থাকতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
সে ব্যবস্থা হয়েছে স্যার। সাত-আটজন পুলিশ সার্বক্ষণিকভাবে এ বাড়িতে থাকবে। কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ বলল।
ধন্যবাদ কর্নেল জেনারেল। বলল আহমদ মুসা।
ওয়েলকাম স্যার। আমি ওদিকে পুলিশদের যাওয়ার ব্যাপারটা একটু দেখি স্যার। আমি আসছি।
বলে পুলিশের দিকে চলে গেল কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ। কর্নেল জেনারেল রিদা চলে যেতেই লরা সোফিয়া প্রশ্ন করল, মার্টিনের পাহাড়ে যাওয়া নিয়ে কেন প্রশ্ন করলেন স্যার?।
আচ্ছা লরা সোফিয়া, খুব খেয়াল করে বল তো মার্টিন পাহাড় থেকে আসার পর তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেছ? বলল আহমদ মুসা।
লরা কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তার চোখে-মুখে গভীর চিন্তার ছায়া। চিন্তার মধ্যে ডুবে থেকেই অনেকটা স্বতকণ্ঠে বলল, হ্যাঁ স্যার, তাকে আগের চেয়ে একটু যেন বিমর্ষ মনে হতো। সবকিছুর মধ্যে থেকেও যেন সে সবকিছু থেকে আলাদা। কেন এ কথা বলছেন স্যার? তাকে আপনি কোন দিক দিয়ে সন্দেহ করেন?
সন্দেহ করার মতো কিছু সে কি করেছে? বলল আহমদ মুসা।
না, তা আমি মনে করি না স্যার। সে ভালো ছাত্র। ভালো রেজাল্ট করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছে। সে ভালো চাকরিও পেয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকতে চায় এজন্যে চাকরিতে না ঢুকে পারিবারিক ব্যবসায়ে যোগ দিয়েছে। এরপর ইতালিতেও সে একটা ভালো চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু দেশ ছাড়তে রাজি হয়নি সে।
কিন্তু সে যখন এখানে এসে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকাল, তখন তার চোখে আমি অন্য কিছু দেখেছি। তারপর একটা টেলিফোন করার জন্যে সে দ্রুত আড়ালে চলে গেছে। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, তাহলে পাহাড়ে গিয়ে তার কি কিছু ঘটেছে? সে কি বিশ্বাসঘাতক হয়ে গেছে? লরা সোফিয়া বলল। তার চোখে-মুখে অন্ধকার, কষ্টের প্রকাশ।
আহমদ মুসা লরা সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিন্তিত হলো। একটু বেশিই যেন আহত হয়েছে লরা সোফিয়া। ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। আবার মনে মনে খুশিও হলো সে। মার্টিনের কাছ থেকে কথা আদায়ে লরা সাহায্য করতে পারে। মনের সম্পর্ক অনেক সময় সবচেয়ে বড় হয়ে থাকে। বলল আহমদ মুসা, এখনি কি তাকে আমরা ডাকতে পারি?
লরা সোফিয়া আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, ডাকছি স্যার। শুকনো কণ্ঠ তার।
ঘুরে দাঁড়িয়ে খুঁজল কাউকে, তারপর নিজেই ছুটল।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই লরা সোফিয়া মার্টিনকে নিয়ে এসে পড়ল।
মার্টিন স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও তার চোখে-মুখে এক ধরনের অপরাধের ছায়া স্পষ্ট।
আহমদ মুসা তাকিয়েছিল মার্টিনের দিকে। হাসিমাখা তার মুখ। বলল, পাহাড়ে ওদের কাছে টেলিফোন করেছিলে তুমি, ওরা কি বলে গিয়েছিল?
ভূত দেখার মতো চমকে উঠল মার্টিন। এক পোঁচ কালি যেন তার গোটা মুখ আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। কোনো কথা বলল না। লরা সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করল সে।
লরা সোফিয়া বিস্ময়াবিষ্ট স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল মার্টিনের দিকে। তার সামনের জগন্টা যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। কিন্তু আহমদ মুসা যা বলছেন, তা মিথ্যা হবার নয়। আর মার্টিনের অবস্থা ও নীরবতা আহমদ মুসার কথাকেই সত্য প্রমাণ করছে। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ল তার হৃদয়।
নীরবতা ভাঙল মার্টিন। আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ নিচু করল। বলল, আমাকে টেলিফোন করতে বলা হয়েছিল স্যার। শুকনো গলা কাঁপছিল মার্টিনের।
কি বলা হয়েছিল? বলল আহমদ মুসা।
আপনি যদি আসেন, তাহলে সেটা নিশ্চিত হয়ে তাদেরকে সঙ্গে সঙ্গেই যেন জানাই। মার্টিন বলল। প্রবল ভয় ও অনুতাপে দগ্ধ তার চেহারা।
নিরাপত্তাবাহিনীর প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদা এদিকে আসছিল। আহমদ মুসা তার দিকে চেয়ে বলল, পুলিশরা কি লাশ নিয়ে চলে গেছে?
হ্যাঁ স্যার। কর্নেল জেনারেল রিদা বলল।
কয়জন পুলিশ আছে? বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ আছে চারজন। তাদের রাস্তার লাগোয়া বাড়ির প্রধান গেটে মোতায়েন রাখা হয়েছে। কর্নেল জেনারেল রিদা বলল।
কর্নেল জেনারেল রিদা, আমি মনে করছি এ বাড়ি আবার আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। আমি এখানে এসেছি, এ খবর শত্রুরা পেয়ে গেছে। আমার এখন মনে হচ্ছে, আমাকে এখানে আনার জন্যেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আমাকেই তারা চাচ্ছে। বলল আহমদ মুসা।
আমি যেসব পুলিশকে পাঠিয়ে দিলাম স্যার, ওদেরকে কি ফেরাব? কর্নেল রিদা বলল। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
লরা সোফিয়া ও মার্টিন দুজনেরই মুখ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় পার হয়ে গেছে। তার সাথে লরা সোফিয়ার হৃদয় দলিত-মথিত হচ্ছে প্রবল অপরাধবোধে। তাকাল লরা সোফিয়া মার্টিনের দিকে। মার্টিন মাথা নিচু করল। তার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা হলো না। বাড়ির গেটের দিক থেকে একটানা গুলির শব্দ ভেসে এল।
উৎকণ্ঠিত কর্নেল জেনারেল রিদা চিৎকার করে উঠল, ওরা আক্রমণ করেছে স্যার।
বলেই বাইরে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল কর্নেল জেনারেল রিদা। ছুটতে যাচ্ছিল সে।
কর্নেল জেনারেল রিদা বাইরে যাবেন না। গেটের পুলিশরা হয় নিহত হয়েছে, না হয় আত্মসমর্পণ করেছে। নিশ্চয় ওরা ভেতরে ছুটে আসছে।
মুহূর্তের জন্যে থেমেই নির্দেশের স্বরে শক্ত কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল, মি. কর্নেল জেনারেল রিদা, এই মুহূর্তে আপনি লরাদের নিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় কোনো কিছুর আড়াল নিন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন।
কর্নেল জেনারেল রিদা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা শান্ত, কিন্তু শক্ত কণ্ঠে বলল, মি. প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসাবে আমি আপনাকে নির্দেশ করছি। আপনারা যান।
স্যরি স্যার।
বলে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল কর্নেল জেনারেল রিদা। লরা সোফিয়ারাও।
সেই সময়ই গুলি করতে করতে ভেতরের আঙিনায় প্রবেশ করল সন্ত্রাসীরা।
আহমদ মুসা একবার সেদিকে তাকিয়ে ছুটে গিয়ে দুই হাত উপরে তুলে সবার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, আমি আহমদ মুসা। আমাকেই হত্যা বা ধরে নিয়ে যেতে তোমরা এসেছ। আমি তোমাদের সামনে হাজির। শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও নির্দোষ যারা এই আঙিনায় রয়েছে, তোমরা তাদের যেতে দাও।
গুলি থেমে গেল। কিন্তু ওদের স্টেনগানগুলো টার্গেট থেকে নামলো না।
সন্ত্রাসীদের একজন বলল চিৎকার করে, হ্যাঁ, আমরা তোমাকে চাই। অন্য সবাই যেতে পারে।
একটু থামল লোকটি। এই লোকটিই তাহলে ওদের কমান্ডার, ভাবল আহমদ মুসা। কমান্ডার লোকটি বলল আবার তার সাথীদের লক্ষ্য করে, সামনে আগাও। বেঁধে তুলে নাও আহমদ মুসাকে।
আবার একটু থেমে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, তোমাকে দেখার সাথে সাথেই মেরে ফেলতাম। কিন্তু তোমাকে জীবন্ত দেখলে বস খুশি হবেন। তোমাকে হত্যার গৌরব তাদেরই প্রাপ্য।
ওরা দশ বারোজনের মতো সন্ত্রাসী। স্টেনগান উঁচিয়ে সার বেঁধে এগিয়ে আসছিল কমব্যাট আর্মির মতো। কমান্ডার লোকটি সে কমব্যাট কলামের মাঝখানে তার হাতে লেটেস্ট মডেলের ভয়ংকর হ্যান্ডমেশিন। গান।
একটু থেমে কমান্ডার লোকটি হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আমি শুনেছি, তুমি আমাদের অনেক লোক মেরেছ। তোমার যম এবার এসেছে। মরতে হবে তোমাকে।
মি. কমান্ডার তোমার উপর নির্দেশ ছিল দেখামাত্র আমাকে হত্যা করার। তা পারনি। আর পারবে না। পেছনে দেখ। হাসি মেশানো মুখে খুব হাল্কা, স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা। কণ্ঠটা এতটাই নিশ্চিন্ত ও স্বাভাবিক ছিল, যা যে কাউকে বাধ্য করবে ভাবতে যে, সব শেষ হয়ে গেছে, আহমদ মুসা যুদ্ধে জিতে গেছে।
সন্ত্রাসীদের কমান্ডারসহ ওরা সকলেই যেন কোনো এক অমোঘ নির্দেশে পেছনে তাকাল। তখনই ওদের হ্যান্ড মেশিনগানগুলো নড়ে গেছে। সরে গেছে টার্গেট থেকে।
আহমদ মুসার হাত বিদ্যুৎ গতিতে শোল্ডার হোলস্টার থেকে মেশিন। রিভলবার এম-১৬ বের করেই গুলি বর্ষণ শুরু করল।
ওরা পেছন দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল তারা ফাঁদে পড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই ওরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। টার্গেটের দিকে তাদের হ্যান্ড মেশিনগানের ব্যারেল ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। এই দুই কাজে ওরা যে সময় নিল সে সময়ে আহমদ মুসার এম-১৬-এর গুলিবৃষ্টি ওদের জড়িয়ে ধরল।
কিন্তু ওদের কমান্ডার তারা ফাঁদে পড়েছে এটা বুঝার সাথে সাথে শুয়ে পড়েছিল। শুয়ে পড়েই সে তার হ্যান্ড মেশিনগান ঘুরিয়ে নিয়ে আহমদ। মুসাকে লক্ষ্য করে গুলি করেছিল।
কমান্ডার যে শুয়ে পড়েছে, সেটা আহমদ মুসারও নজর এড়ায়নি। কিন্তু তার মেশিন রিভলবারের ব্যারেল ঘুরিয়ে তার দিকে নেবার আগেই গুলি করেছে ওদের কমান্ডার।
শেষ মুহূর্তে আহমদ মুসা শুয়ে পড়েছিল। দাঁড়ানো আহমদ মুসার লক্ষ্যে ছুঁড়া প্রথম এক পশলা গুলি শুয়ে পড়া আহমদ মুসার অনেকখানি পাশ দিয়ে চলে গেল।
শুয়ে পড়ার সময়ই আহমদ মুসা তার এম-১৬-এর ব্যারেল ঘুরিয়ে নিয়েছিল। যে সুযোগটুকু সে পেয়েছিল, তাকে কাজে লাগাল। তার এম ১৬ থেকে গুলির আঁক বেরিয়ে গেল কমান্ডারকে লক্ষ্য করে।
কিন্তু আহমদ মুসা দেখতে পেল কমান্ডার লোকটি লাশের মধ্যে শুয়ে আছে। তার দিক থেকেও গুলি আসছে। আহমদ মুসা তার গুলির ফল বুঝতে পারলো না।
আহমদ মুসা গুলি বন্ধ রেখে গড়িয়ে দ্রুত পশ্চিম-উত্তর দিকে লাশের। সারির বাঁ দিকের প্রান্তে এগিয়ে চলল। আহমদ মুসাও লাশের কভার নিতে চাইল এবং দেখতে চাইল কমান্ডার লোকটির গুলি দিক পরিবর্তন। করে কি না, আহমদ মুসাকে সে ফলো করতে পারছে কি না।
আহমদ মুসা লাশের সারির বাঁ দিকের প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল। কমান্ডার লোকটির হ্যান্ড মেশিনগানের গুলির দিক পরিবর্তন হয়নি।
আহমদ মুসার গুলি বন্ধ হবার পর অল্প কিছুক্ষণ কমাণ্ডার লোকটির গুলি অব্যাহত থাকল। অত:পর তার গুলিও বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা যখন লাশের প্রান্তে পৌঁছল, তখন কমান্ডার লোকটির গুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা ভাবল, কমান্ডার লোকটি নিশ্চয় এখন উভয় সংকটে পড়েছে। আহমদ মুসা মারা গেল, না পালালো তা দেখার জন্যে নিশ্চয় সে এখন মাথা তুলবে। মেশিন রিভলবার এম-১৬-এর ট্রিগারে তর্জনি রেখে আহমদ মুসা প্রস্তুত হলো।
অপেক্ষা করতে হলো না। দেখতে পেল লোকটি মাথা তুলল। তার দৃষ্টি সামনে। হাতে বাগিয়ে ধরা হ্যান্ড মেশিনগান।
আগে আহমদ মুসা লোকটার সামনে ছিল। এখন তার বাঁ দিকে। মাথা তুলে আহমদ মুসাকে দেখতে না পেয়েই দ্রুত উঠে বসে চারদিকে তাকাতে গেল।
আহমদ মুসা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছে। মেশিন রিভলবার এম ১৬-এর ট্রিগারে তার তর্জনি। চিৎকার করে বলল, বাঁচতে চাইলে হাতের গানটা ফেলে দাও…।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলো না। বোঁ করে ঘুরে এল লোকটির হ্যান্ড মেশিনগান। যেন এক অবচেতন নির্দেশেই আহমদ মুসার তর্জনি তার মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে চেপে বসল। কমান্ডার লোকটির গান থেকে গুলি বেরোবার আগেই সে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়ল।
কর্নেল জেনারেল রিদাসহ সবাই ছুটে এসেছে। এসেছে লরা সোফিয়ার সাথে মার্টিনও।
মাটিন ছুটে এসে আহমদ মুসার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে বলল, স্যার, আমাকে মাফ করবেন। আমি ব্ল্যাক মেইলের শিকার হয়েছি। চাচাকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে একটা শর্তে আমাকে রাজি হতে বাধ্য হতে হয়েছিল। আমাকে রাজি হতে হয়েছিল, তারা। যে সাহায্য চাইবে, আমি তা করব। আর আজ ওরা চাচার পরিবারকে হত্যা করে যাবার সময় আমাকে বলেছিল, লরা ও তার ভাই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যা করেছে তার প্রতিশোধ নিলাম। আহমদ মুসা এখানে। আসলে সেটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে জানাবে। না জানালে তোমাদের পরিবারকেও এইভাবে শেষ করব। চাচার পরিবার তো গেছে, তাই আমাদের পরিবারকে বাঁচার জন্যেই আমি ওদের টেলিফোন করেছিলাম।
আমি জানি তুমি বাধ্য হয়েই করেছ। তুমি ওদের আর কি সাহায্য করেছ? বলল আহমদ মুসা।
আমি ওদের লোককে উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সাহায্য করেছি। মার্টিন বলল।
তুমি সেই ছেলেটিকে চেন নিশ্চয়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হ্যাঁ, আমি চিনি স্যার। মার্টিন বলল।
তার নাম কি? সে কোথায় থাকে জান? বলল আহমদ মুসা।
নাম আলবো আলবারতো। ডরমিটরির ব্লক তিনের নিচতলার শেষ রুমটাতে থাকে। মার্টিন বলল।
ধন্যবাদ মার্টিন।
বলে আহমদ মুসা তাকাল কর্নেল জেনারেল রিদার দিকে। বলল, কর্নেল জেনারেল রিদা, আপনি বিশ্ববিদ্যালয় ডরমিটরির ওখানে আপনার লোকদের টেলিফোন করুন। দেখুন ওখানে মেজর পাভেল আছে কি না। থাকলে আমাকে একটু দিন।
স্যার, আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি। এক কঠিন সংকটে আমাদেরকে রক্ষা করা এবং নিজেকে রক্ষার তৌফিক আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন। শুধু রত্নদ্বীপকে রক্ষা নয়, আমাদের শিক্ষিত করার জন্যেও আল্লাহ আপনাকে পাঠিয়েছেন। আল-হামদুলিল্লাহ।
কর্নেল জেনারেল রিদা একটু থেমেই আবার বলল, স্যার, আমি টেলিফোন করছি।
কর্নেল জেনারেল রিদা টেলিফোন করল এবং মেজর পাভেলের সাথে যোগাযোগ করে মোবাইল আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
মেজর পাভেল খুব জরুরি বিষয়। ডরমিটরির তিন নাম্বার ব্লকের নিচতলার রুম-সিরিয়ালের শেষ ঘরটিতে থাকে মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের আলবো আলবারতো নামে একজন সদস্য ছাত্রের ছদ্মবেশে। তাকে জীবন্ত ধরার চেষ্টা করতে হবে। আর এটা করতে হবে সে সবকিছু জানার আগেই। দেখ পাখি যেন কোনোভাবেই উড়ে না যায়। আমরা আসছি। বলল আহমদ মুসা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরির এক থেকে ছয় নাম্বার পর্যন্ত ছেলেদের আবাস। সামনে মাঠ। তার ওপাশে চারটি ডরমিটরি মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ। মাঠের মাঝ বরাবর ঝাউগাছের সারি ও বাগান দুই অংশকে আলাদা করেছে।
আহমদ মুসার গাড়ি ছেলেদের ডরমিটরি অংশের তিন নাম্বার ব্লকের গাড়ি বারান্দায় পৌঁছল।
একজন পুলিশ দাঁড়িয়েছিল গাড়ি বারান্দায়। সে এগিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আহমদ মুসা বেরিয়ে এল।
পুলিশটি স্যালুট দিল।
মেজর পাভেল কোথায়? জিজ্ঞাসা করল সিকিউরিটির লোকটিকে।
রাস্তায় থাকতেই আহমদ মুসা খবর পেয়েছে, মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের আলবো আলবারতো ছেলেটিকে জীবন্ত ধরা গেছে। আহমদ মুসার টেলিফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেজর পাভেল কক্ষটিতে নিজে গিয়ে নিশ্চিত হয় ছেলেটি ঘরে আছে। মেজর পাভেল ঘরটির আশেপাশে লোক মোতায়েন করে পাশের কক্ষের ছেলেটিকে খুঁজে বের করে। তাকে দিয়ে। ডেকে আলবো আলবারতোকে বের করে মাঠে নিয়ে যায়। ওখানেই মেজর পাভেল গ্রেফতার করে আলবো আলবারতোকে
ঐ ঘরে আছেন স্যার। আপনার অপেক্ষা করছেন। সিকিউরিটির লোকটি বলল।
ঘরের দরজা ও বারান্দায় পুলিশ প্রহরা ছিল। তারা আহমদ মুসাকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
মেজর পাভেল খবর পেয়ে ছুটে এসেছে দরজায়। আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে ভেতরে নিয়ে বসাল।
বসতে বসতে আহমদ মুসা বলল, মেজর পাভেল, সালাম রপ্ত করলে কবে?
মুখ হাসিতে ভরে গেল মেজর পাভেলের। বলল, স্যার, ক্যাপ্টেন আলিয়াকে জিজ্ঞাসা করলে সব জানবেন।
মেজর পাভেল তুমি কি জান, দ্বীপে কনভারশনের ট্রেন্ডটা কেমন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ট্রেন্ড বলা যায় একমুখী। সব দেখে সত্যকেই মানুষ গ্রহণ করছে। মেজর পাভেল বলল।
এ নিয়ে আবার কথা উঠবে না তো? বলল আহমদ মুসা।
রত্নদ্বীপে কোনো কথা তোলার সুযোগ নেই। এখানে সবার কাজ সবাই দেখছে। কারও পক্ষে কোনো বৈষম্যের সুযোগ এখানে নেই। আসল কথা স্যার, সমাজে, দেশে, পৃথিবীতে শান্তি থাকলে সত্য, স্বাভাবিকতা ও যুক্তির লাভ সবচেয়ে বেশি। মানুষ এ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সত্য, স্বাভাবিকতাকে বেছে নেয় সুযোগ পেয়ে। এই সুযোগই ইসলাম রত্নদ্বীপে পাচ্ছে। মেজর পাভেল বলল।
এস আসল প্রসঙ্গে আসি।
বলে আহমদ মুসা তাকাল আলববা আলবারতোর দিকে। তার দুহাত পিছমোড়া করে বাঁধা। দুই পাও বাঁধা রয়েছে। বসে আছে সে চেয়ারে। বাইশ তেইশ বছরের একটি ছেলে। তার চোখ-মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে, সে এখনো পাকা ক্রিমিনাল হয়ে সারেনি।
আহমদ মুসা তার চেয়ার ছেলেটার দিকে একটু টেনে নিয়ে বলল, আলবো আলবারতো তোমার বয়স কত?
২৪ বছর স্যার। আলবো আলবারতো বলল।
তোমার তো পড়াশুনার বয়স এটা, ভয়ানক ঐ গ্যাংটার সাথে তুমি জুটলে কি করে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আলবো আলবারতো কোনো জবাব দিল না। নীরবে মাথা নিচু করল।
ঠিক আছে ওটা ব্যক্তিগত চয়েজের ব্যাপার। আমি জানতে চাইব না।
একটু থামল আহমদ মুসা। বলল আলবো আলবারতোকে আবার, তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো। ঠিক ঠিক জবাব দিবে আশা করি। এক প্রশ্ন আমি দুবার জিজ্ঞাসা করি না আলবারতো। শান্ত, কিন্তু শক্ত কণ্ঠ আহমদ মুসার। আলবো আলবারতো মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কিছু বলল না সে।
মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টার কোথায় আলবো আলবারতো?
আলবারতো নীরবে মুখ তুলল। ভাবলেশহীন মুখ। কোনো জবাব দিল না।
শক্ত হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। তার ডান হাত রিভলবার নিয়ে। বেরিয়ে এল পকেট থেকে। রিভলবার তুলেই আহমদ মুসা গুলি করতে যাচ্ছিল আলবো আলবারতোকে।
আলবো আলবারতো দুহাত জোড় করে বলল, বলছি স্যার।
আহমদ মুসা রিভলবার নামিয়ে নিল।
স্যার, ওদের হেডকোয়ার্টার সিসিলি দ্বীপের ক্যাটলিয়া শহরে। আলবো, আলবারতো বলল।
ওদের হেডকোয়ার্টার বললে। তোমার হেডকোয়ার্টার নয় ওটা? বলল আহমদ মুসা।
প্রশ্ন শুনে ছেলেটি মুখ নামিয়ে নিল। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল, স্যার, আমি ক্যাটলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরা দুই ভাইবোন। পিতা নেই। সিংগল মার সন্তান আমরা। মা এখন শহরে অন্যের ঘর করেন। অসচ্ছলতার মধ্য দিয়ে জীবন চলে আসছে। পেশায় নাবিক একজন একদিন আমাকে বলল, আমি যদি তাদের এনজিও-এর সাথে কাজ করতে রাজি হই এবং রত্নদ্বীপের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি ভালো বেতন পাব। এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে অল্প কিছু দিন আগে রত্নদ্বীপে আসি। আমি পড়ার বাইরে ওরা যে কাজ দিচ্ছে, সেই কাজ আমি করছি। আমি ওদের দলের কেউ নই।
ওরা কি কাজ তোমাকে দিচ্ছে? বলল আহমদ মুসা।
প্রথমে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ও সক্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়। বিশেষ করে মুসলিম, খৃস্টান ও ইহুদি রাজনীতিক ও নেতাদের ছেলেমেয়েদের ছবিসহ তালিকা। এর সাথে বলা হয় গুরুত্বপূর্ণ সব মসজিদ, গির্জা ও সিনাগগের নাম এবং অবস্থানের তালিকা তৈরি করতে। তার পরের কাজ ছিল মুসলিম, খৃস্টান ও ইহুদিদের প্রধান উৎসবের স্থানের নাম যোগাড়। এখন আমার কাজ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের কারা আহমদ মুসা ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকদের সাথে কথা বলে, যোগাযোগ করে তাদের নাম ওদেরকে দেয়া এবং আহমদ মুসা ও নিরাপত্তা বাহিনীর যে খবরই পাওয়া যাক, তা তাদের সঙ্গে সঙ্গে জানানো। আরেকটা দায়িত্ব আমাকে খুব সম্প্রতি দেয়া হয়েছে। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক বিভাগে ভর্তি করা হবে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বর্তমান অফিসারদের নাম, পদবি, ঠিকানা ও ছবিসহ তালিকা তাদের খুব তাড়াতাড়ি জানাতে হবে। আলবো আলবারতো বলল।
ধন্যবাদ আলবো আলবারতো। আচ্ছা বল তো, পূর্বের পাহাড়ে, ওদের গোয়াদিয়া অঞ্চলের ঘাটিতে তুমি কত দিন ছিলে? বলল আহমদ মুসা।
আলবা আলবারতো আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে মুখে একটা দ্বিধাগ্রস্ততা। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যে। তার পরেই সে বলল, তিন চার সপ্তাহ ছিলাম স্যার।
ঘাঁটিটার লোকেশান নিশ্চয় তুমি বলতে পারবে? বলল আহমদ মুসা।
আলবো আলবারতো তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, আমার এই ঘটনা নিশ্চয় ওদের কানে যাবে এবং আমাকে ওরা অবশ্যই বাঁচতে দেবে না। তবু যা জানি সব আমি বলব। ওদের পক্ষে কাজ করতে আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু ওদের হত্যা-ধ্বংসের সাথী হতে আমি চাইনি। একটু থামলো আলবো আলবারতো। কথা শুরু করল আবার, স্যার, কয়েকদিন আগে গোয়াদিয়ার পাহাড়ী সড়কে যে ঘটনা ঘটে গেল তা থেকে দুই বাঁক অর্থাৎ দুইটা শৃঙ্গ পেরিয়ে তৃতীয় বাকে আরেকটা শৃঙ্গ পাওয়া যাবে। গোয়াদিয়া পাহাড় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শৃঙ্গ এটা। এ শৃঙ্গের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, শৃঙ্গটি যেন সমভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে। শৃঙ্গটির পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবেশ করে উত্তরে এগোতে হবে। চার পাঁচশ গজ এগোলে মুখোমুখি আরেকটি ছোট শৃঙ্গ পাওয়া যাবে। সে শৃঙ্গের দক্ষিণ পাশ দিয়ে পশ্চিমে কিছুটা এগিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত ঢাল দিয়ে একটা উপত্যকায় নামা যায়। বৃক্ষাচ্ছাদিত ছায়া ঘেরা সেই উপত্যকাতেই ওদের ঘাঁটি।
ধন্যবাদ আলবো আলবারতো। ওদের এই ঘাঁটিতে সাধারণত কত লোক থাকে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্থায়ীভাবে কেউ থাকে না। কেউ আসে কেউ যায়। তবে গড়ে দশ পনের জন লোক থাকেই। আলবো আলবারতো বলল।
আরেকটা বিষয়, গ্যাং-এর লোকরা কি সিসিলির? বলল আহমদ মুসা।
না স্যার। বরং সিসিলির লোক সবচেয়ে কম। স্যার স্পেন, ইতালি, মাল্টা, ক্রিট, গ্রিস প্রভৃতি ইউরোপীয় অনেক দেশেরই লোক দেখেছি। আমার মনে হয়েছে স্যার, এরা সবাই নাবিক শ্রেণির জলদস্যু ধরনের লোক। যেমন ওরা আগে জাহাজ লুট করতো, এখন তেমনি লুট করতে এসেছে একটা দেশ। আলবো আলবারতো বলল।
ওরা অর্থ ও শক্তি পাচ্ছে কোত্থেকে? বলল আহমদ মুসা।
তা আমি জানি না স্যার। তবে ক্যাটেলিয়ায় ওদের হেডকোয়ার্টারে বসে থাকার সময় পাশেই ওদের কয়েকজনের আলোচনা শুনেছিলাম। তাদের একজন বলছিল, একটা শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা নাকি রত্নদ্বীপের সরকার ব্যবস্থার পতন চায় এবং সেখানে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধাতে চায়। এজন্যে যে অর্থই লাগুক তারা খরচ করতে রাজি। তাই বোধ হয় মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের অর্থের কোনো অভাব নেই। ওদের গোয়াদিয়া ঘাঁটিতে থাকার সময় ওদের আর একটা আলোচনা শুনেছিলাম। তারা বলছিল সাফল্য তাদের অবধারিত। তাদের দুটি লক্ষ্য অর্জনের জন্যে দরকার হলে তারা বাইরে থেকে যোদ্ধা নিয়ে আসবে। আলবো আলবারতো বলল।
এই গ্যাংয়ের টপ বকে দেখেছ? কি নাম জান? বলল আহমদ মুসা।
তাকে দেখিনি স্যার। নাম অগাস্টিন ইম্যানুয়েল। আলবো আলবারতো বলল।
গোয়াদিয়ার মতো ওদের কয়টা ঘাটি রত্নদ্বীপে রয়েছে? বলল আহমদ মুসা।
ওদের প্রধান ঘাঁটি পশ্চিম রত্নদ্বীপের কোনো একটা দুর্গে। এর বেশি ওদের ঘাঁটি সম্পর্কে আর কিছু জানি না স্যার।
তোমার সাথে ওদের যোগাযোগ হতো কিভাবে? বলল আহমদ মুসা।
খোঁজ-খবর নেয়ার মতো কাজ টেলিফোনে হতো। তাদের কোনো নির্দেশ এবং কাজের কথা বলার থাকলে তারা লোক পাঠাতো। আলবো আলবারতো বলল।
তোমার বোন কোথায় থাকে? বলল আহমদ মুসা।
ক্যাটেলিয়ায় এক স্কুলে পড়ে। থাকে স্কুলের হোস্টেলে। আলবো আলবারতো বলল।
তার ঠিকানা, তার স্কুলের নাম কি ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের কেউ জানে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
না কেউ জানে না। আলবো আলবারতো বলল।
গুড, তাহলে ওদিক থেকে কোনো চিন্তা নেই। আচ্ছা, তোমার বোনকে কি তোমার টাকা পাঠাতে হয়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আমার বোন পড়ার সাথে সাথে কিছু কাজও করে। আমরা যে ফ্লাটে ছিলাম, সে ফ্লাটেই সে আছে। একার জন্যে বেশ খরচ। আমি টাকা, পাঠাই। আলবো আলবারতো বলল।
তোমাকে কিছুদিন ওদের চোখের আড়ালে থাকতে হবে। এমনকি টাকা পাঠানোর জন্যে বেরোনো তোমার ঠিক হবে না। টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। বলল আহমদ মুসা।
আমি বুঝেছি স্যার। আলবো আলবার্তো বলল।
তুমি অসুবিধা মনে করছ না তো? বলল আহমদ মুসা।
আমি জানি স্যার, ওরা আমাকে পেলে মেরে ফেলবে। আলবো আলবারতো বলল।
ধন্যবাদ! বলে আহমদ মুসা তাকাল মেজর পাভেলের দিকে। বলল, মেজর পাভেল, আলবারতো এই ঘরেই থাকবে।
একজন দায়িত্বশীলের অধীনে কয়েকজন গোপনে এই ঘরের আশেপাশে অবস্থান করে আলবারতোর নিরাপত্তা বিধান করবে। বলল। আহমদ মুসা।
স্যার, এই ব্যবস্থা আমি এখনি করছি। মেজর পাভেল বলল।
তুমি তাড়াতাড়ি এস পাভেল। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
বেরিয়ে এল বাইরে।
.
একটা জীপ ও একটা মাইক্রো এগিয়ে চলেছে গোয়াদিয়ার পাহাড়ি পথে।
জীপটি চালাচ্ছে রত্নদ্বীপ নিরাপত্তা বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। পাশের সিটে মেজর পাভেল। পেছনের সিটে আহমদ মুসা ও কর্নেল জেনারেল রিদা।
আলবো আলবারতোর কাছ থেকে গোয়াদিয়া অঞ্চলের ঠিকানা জানার পর আহমদ মুসা আর দেরি করেনি। সঙ্গে সঙ্গেই মেজর পাভেলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। রত্নদ্বীপ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদাকে সবকিছু জানিয়ে তাকে ডেকে নিয়েছে।
দুটি গাড়ির বহর চলছে এক নাম্বার সার্কুলার রোড ধরে গোয়াদিয়ার দিকে।
সামনেই সার্কুলার রোডের একটা ক্রসিং। এই ক্রসিং নাম্বার-১১ থেকেই একটা সড়ক এঁকেবেঁকে উঠে গেছে গোয়াদিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে।
ক্রসিং-এ গিয়ে টার্ন নিল গাড়ি পাহাড়ে উঠার জন্যে।
ক্রসিংটির পাশেই সিকিউরিটি ফোর্সের একটা ফাঁড়ি।
উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সার্কুলার রোডগুলোর প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ। ক্রসিং-এ একটি সিকিউরিটি ফোর্সের ফাঁড়ি বসানো হয়েছে।
ক্রসিং-এর পূর্ব পাশে একটা গাড়ি দাঁড় করানো দেখতে পেল আহমদ মুসা। গাড়িটা সিকিউরিটি ফোর্সের ফাঁড়ির পাশে দাঁড় করানো রয়েছে।
কর্নেল জেনারেল রিদা গাড়ি দাঁড় করাতে বলল।
গাড়ি দাঁড়াল।
ফাঁড়ি থেকে সিকিউরিটির দুজন লোক ছুটে এল গাড়ির কাছে।
কোনো খবর নেই তো? সবকিছু ঠিকঠাক এ দিকের? বলল কর্নেল জেনারেল রিদা।
অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ানো দুজন সিকিউরিটির লোক। তাদের মধ্য থেকে একজন বলল, সব ঠিক আছে স্যার।
অল্প দূরে ফাঁড়ির পাশে দাঁড়ানো গাড়ির দিকে তাকিয়ে কর্নেল জেনারেল রিদা বলল, ও গাড়িটা আমাদের নয়, কার গাড়ি?
স্যার দুটি গাড়ি নিয়ে কয়েকজন ট্যুরিস্ট যাচ্ছিল পাহাড়ের দিকে। গাড়িটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রেখে গেছে। সিকিউরিটির লোকটি বলল।
গাড়ি নষ্ট হওয়ার কথা শুনে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। একদম নতুন গাড়ি। চাকা দেখে মনে হচ্ছে, গাড়িটা কয়েক কিলোর বেশি চলেনি। মনে হচ্ছে আজকেই যেন গাড়িটা রাস্তায় নেমেছে।
ফাঁড়ির লোকদের সাথে কথা বলে কর্নেল জেনারেল রিদা ধন্যবাদ বলে মুখ ঘুরিয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকাচ্ছিল। বোধ হয় গাড়ি ছাড়তে বলতে যাচ্ছিল জেনারেল রিদা।
কর্নেল জেনারেল রিদা, আমি ঐ গাড়িটা একটু দেখতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। চলুন স্যার দেখবেন। কর্নেল জেনারেল রিদা বলল।
নামল আহমদ মুসা ও জেনারেল রিদা দুজনেই।
ব্রান্ডনিউ ল্যান্ড ক্রুজার। গাড়িটার কাছে গিয়ে আহমদ মুসা দরজা টান দিয়ে দেখল দরজা খোলা আছে। আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। দেখল, কী হোলে চাবি নেই। অর্থাৎ এমন নতুন গাড়ির কি ঘটেছে তা দেখার আর সুযোগ রইল না।
আহমদ মুসার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার মনে অপরিচিত যে একটা বিষয় মাথা তুলেছিল, তা আরও বেড়ে গেল।
আহমদ মুসা চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে নামতে যাচ্ছিল গাড়ি থেকে। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল স্টিয়ারিং হুইলের কেন্দ্রে হর্ন বাজানোর পুশনবের উপর আঁকা মাস্তুল ওয়ালা জলজাহাজের কাঠামোর উপর। দেখেই আহমদ মুসা চিনতে পারল ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের মনোগ্রাম। তার মানে এটা ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের গাড়ি।
সঙ্গে সঙ্গেই একরাশ চিন্তা এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা জেনারেল রিদার দিকে তাকিয়ে বলল, ফাঁড়ির লোকদের সাথে একটু কথা বলতে হবে।
জেনারেল রিদা গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আহমদ মুসাও গাড়ি থেকে নামল। জেনারেল রিদা ডেকেছিল ফাঁড়ির লোকদের। ওরা আসছে।
কিছু পেলেন? কিছু ঘটেছে স্যার? জেনারেল রিদা বলল।
গাড়িটা ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের জেনারেল রিদা। বলল আহমদ মুসা।
ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের! আঁৎকে উঠা কণ্ঠে বলল জেনারেল রিদা।
হ্যাঁ মি. রিদা। বলল আহমদ মুসা।
ফাঁড়ির দুজন এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়াল।
যারা গাড়িটা রেখে গেছে তারা কতজন লোক ছিল? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
চারজন স্যার। তিনজন মাইক্রোতে, একজন এই জীপে। সিকিউরিটির একজন লোক বলল।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বলল, ওরা গাড়ি রেখে যাবার সময় কি বলেছিল?
দুজন সিকিউরিটির আগের লোকটিই বলল, ওরা বলেছিল, গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। রেখে গেলাম। আমরা খুব তাড়াতাড়ি ফিরব। তখন আমাদের আরও গাড়ি, আরও লোক এখানে আসবে। গাড়িটা আমরা তখন নিয়ে যাব।
সিকিউরিটি লোকটির কথা শুনতে শুনতে আহমদ মুসার ভ্রু কুচকে উঠেছিল। ধীরে ধীরে তার মুখে আবার একটা স্বস্তির আলো ফুটে উঠল।
আহমদ মুসা তাকাল কর্নেল জেনারেল রিদার দিকে। বলল, আমরা গোয়াদিয়ার যে এলাকায় যাচ্ছি, সেখানে যাবার মতো আর কোনো সড়ক আছে?
স্যার, আমরা সার্কুলার রোড থেকে যেখানে দক্ষিণ দিকে টার্ন নিলাম, তার একটু দক্ষিণ থেকে একটা সড়ক পাহাড়ের পথে এঁকেবেঁকে গোয়াদিয়ার ঐ এলাকায় গিয়ে আমাদের এই সড়কের কাছাকাছি শেষ হয়েছে। সড়কটি খুবই আঁকাবাকা, দুর্গম এবং অনেক বেশি সময় লাগে। এছাড়া গোয়াদিয়া অঞ্চলে যাবার আর পথ নেই স্যার। জেনারেল রিদা বলল।
আমরা গোয়াদিয়ার যেখানে যাচ্ছি, সেখান থেকে কি আমরা ঐ পথে বেরোতে পারি না জেনারেল রিদা? বলল আহমদ মুসা।
জি স্যার, বেরোনো যায়। ওদের ঘাঁটি যে উপত্যকায়, সে উপত্যকার দক্ষিণ ও উত্তর প্রান্তে গিয়ে দুটি সড়কই শেষ হয়েছে। উপত্যকার লোকরা দুটি সড়কই ব্যবহার করতে পারে। কর্নেল জেনারেল রিদা বলল।
কথা বলল না আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গেই। তার চোখে-মুখে চিন্তার প্রকাশ।
আহমদ মুসা একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে ফাঁড়ির দুই নিরাপত্তা কর্মীর দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা গাড়ি রেখে কতক্ষণ আগে গেছে?
ঘণ্টাখানেক হবে স্যার। দুই কর্মীর একজন বলল।
আহমদ মুসা তাকাল জেনারেল রিদার দিকে। বলল, মি. রিদা আমি বলেছি, এই গাড়িটা ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের। গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের হর্ন নবে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের মনোগ্রাম রয়েছে। গাড়িটা ওরা পরিকল্পনা করেই এখানে রেখে গেছে আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে।
বিভ্রান্ত করার কথা কেন বলছেন স্যার, কি করতে চায় ওরা? বলল জেনারেল রিদা।
কেন বলছি। তা জানার আগে শুনুন, সার্কুলার রোডের ওদিক থেকে দ্বিতীয় যে রাস্তাটি গোয়াদিয়ায় ঢুকেছে, এখনি আমাদেরকে সে রাস্তা দিয়ে গোয়াদিয়ায় ওদের ঘাটির দিকে যেতে হবে। আমার অনুমান সত্য হলে, ওরা ঐ রাস্তা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। ওদের ঘাটির লোকেশন আমাদের কাছে ধরা পড়ে গেছে এটা ওরা জানতে পেরেছে। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় ফুটে উঠল জেনারেল রিদার চোখে-মুখে। বলল, আপনারাই তো জানলেন কিছুক্ষণ আগে। মাত্র কয়েক মিনিট লেগেছে ওখান থেকে এখানে আসতে। এর মধ্যে ওরা জানতে পারল কেমন করে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ওদের ছেলেটি যে আমাদের হাতে ধরা পড়েছে, সেটা ওরা জানতে পেরেছে সাথে সাথেই। নিশ্চয় ওখানে ওদের লোক আছে। ছেলেটা গোয়াদিয়ায় ওদের ঘাঁটির লোকেশন জানে। ছেলেটার কাছ থেকে আমরা তা জানতে পেরেছি, সেটা গোয়াদিয়ার দিকে আমাদের সদলবলে রওয়ানা হওয়া থেকেই ওরা বুঝতে পেরেছে। বলল আহমদ মুসা।
ওরা ঐ পথে পলাবে- এটা নিশ্চিত হওয়া গেল কি করে স্যার? জেনারেল রিদা বলল।
গাড়িটা এখানে রেখে ওরা এ পথে আসবে, এ কথা জানান দেয়া থেকেই এটা প্রমাণিত হয়। আমি নিশ্চিত গাড়িটা খারাপ হয়নি। বলল আহমদ মুসা।
এটা তো স্যার আমরা পরীক্ষা করে দেখিনি। জেনারেল রিদা বলল। তার চোখে-মুখে ঔৎসুক্য।
সত্যিই খারাপ হলে ওরা এভাবে গাড়িটা রেখে যেত না। গাড়িটা আমরা যাতে পরীক্ষা করতে না পারি এজন্যেই তারা গাড়ি লক করে গেছে। বলল আহমদ মুসা।
আল হামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ স্যার। আপনি এত দ্রুত এত চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন স্যার? গাড়ি খারাপ হওয়ার কারণে রেখে যাওয়াকে আমি স্বাভাবিক একটা ঘটনা বলেই মনে করেছি। আপনার মনে সন্দেহ এল কি করে স্যার? জেনারেল রিদা বলল।
এমন একটা ব্রান্ড নিউ গাড়ি খারাপ হওয়া এবং তা রেখে যাওয়ার কথায় আমার মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর একটি মাইক্রো ও একটা জীপ মিলে চারজন আরোহীর কথা শুনে আমার বিস্ময়টা সন্দেহে পরিণত হয়েছিল। সংখ্যায় তারা এক গাড়ির লোকও নয়, অথচ সাথে দুটি গাড়ি কেন? এই গাড়িটা আনা হয়েছিল এখানে রেখে যাওয়ার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
আমরা এই পথে অভিযানে যাব, তারা ঐ পথে পালাতে পারে, এ বিষয়টা তাদের কাছে পরিষ্কার হবার পর তারা আবার এই আয়োজন। করল কেন? জিজ্ঞাসা জেনারেল রিদার।
তারা সম্ভবত আমাদেরকে কিছুটা সময় বা সবটা সময় এখানে আটকে রেখে পালানোর জন্যে সময় বের করতে চাচ্ছিল। অন্যদিকে ঐ পথে তারা পালাতে পারে, এই চিন্তা আমাদের মন থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছিল। বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা জেনারেল রিদাকে বলল, গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে বলুন।
সাথে সাথে গাড়ি দুটি ঘুরে গেল। আহমদ মুসা এবার গিয়ে জীপের ড্রাইভিং সিটে উঠল। তার পাশে কর্নেল জেনারেল রিদা। পেছনের সিটে মেজর পাভেল এবং ক্যাপ্টেন ছেলেটি।
দুটি গাড়ি তীরবেগে এগিয়ে চলল ১নং সার্কুলার রোড ধরে। এই সার্কুলার রোড থেকে গোয়দিয়ার পাহাড় অঞ্চলে উঠে যাওয়া দ্বিতীয় সড়কটি দিয়ে তারা গোয়াদিয়ায় উঠবে ওদের মুখোমুখি হওয়ার জন্যে।
আহমদ মুসা এক সময় হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা এই সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় সড়কটি দিয়ে গোয়াদিয়ার অর্ধেকের বেশি পথ নেমে আসার কথা। আপনার কি মনে হয় মি. রিদা?
তা হবে স্যার। ঐ সড়কের উপরের দিকটা ড্রাইভিং-এর জন্যে ভালে নয়। শেষ দিকের অংশটাই এবড়োথেবড়ো ও আঁকাবাঁকা বেশি। জেনারেল রিদা বলল।
.
ফাঁকা রাস্তা।
ঝড়ের বেগে চলছিল আহমদ মুসার জীপ।
সড়কটি আর বেশি দূরে নয় স্যার। সামনে রাস্তার ডানপাশে যে বড় টিলা দেখা যাচ্ছে, তার ওপাশ দিয়ে দ্বিতীয় সড়কটি উঠে গেছে গোয়াদিয়ায়। জেনারেল রিদা বলল।
আহমদ মুসা চিন্তা করছিল। বলল, মি. রিদা, আমরা শত্রুর জন্যে এই টিলার আড়ালে অপেক্ষা করতে পারি। আমরা জীপ নিয়ে এখানে দাঁড়াব। আর মাইক্রো যাবে আরেকটু নিচে মেজর পাভেলের নেতৃত্বে। সন্ত্রাসীদের যারা ঐ দিক থেকে পালাতে চেষ্টা করবে, তাদের ওরা আটকাবে।
টিলার কাছাকাছি গিয়ে আহমদ মুসা গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিল। তাকাল পেছন দিকে মাইক্রোকে নির্দেশ দেবার জন্যে। ঠিক এই সময় একটা গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ হলো টিলার কিছুটা পূর্ব দিকে।
উৎকর্ণ হলো আহমদ মুসা।
পাশে রাখা এম-১৬-এ একবার ডান হাতটা রাখল।
গাড়ি সামনে এগিয়ে চলছিল। টিলার ওপাশে পাহাড় থেকে নেমে আসা সড়কটির মুখ বেশি দূরে নয়। সড়কটির মুখ থেকে একটা গাড়ি সার্কুলার রোডে এসে পড়ল। সেই সাথেই গাড়িটা থেকে নারী-কণ্ঠের একটা বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার কানে এল আহমদ মুসার।
একটাই গাড়ি। কোনো গাড়ি আর তার পেছনে এল না। গাড়িটা ছুটছে। নারী-কণ্ঠের চিৎকার চলছেই।
ভ্রূ-কুঞ্চিত হয়েছে আহমদ মুসার।
গাড়িটা সার্কুলার রোডে পড়ার মুহূর্ত থেকে নারী-কণ্ঠের চিৎকার শুরু হলো কেন? নিশ্চয় এই গাড়িটারই স্টার্ট নেয়ার শব্দ সে শুনেছে। কিন্তু নারী-কণ্ঠের এই চিৎকার আগেই উঠেনি কেন? আহমদ মুসার ঠোঁটে একটা বোদ্ধার হাসি ফুটে উঠল।
আহমদ মুসা তাকাল কর্নেল জেনারেল রিদার দিকে। বলল, মি. রিদা, আমি ঐ গাড়িটাকে ফলো করতে চাই। আপনি মেজর পাভেল ও ক্যাপ্টেনকে নিয়ে নেমে পড়ন। মাইক্রোর নিরাপত্তা কর্মীদের নিয়ে আপনারা এই টিলার আড়ালে ওদের জন্যে অপেক্ষা করুন। হয় ওদের। আটকাতে হবে, না হয় ওদের ফলো করতে হবে। আমি আসছি।
আহমদ মুসা গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিল।
আসুন স্যার, ধন্যবাদ। বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল জেনারেল রিদা। তার সাথে সাথে নামল মেজর প্যাভেল ও ক্যাপ্টেন ছেলেটি।
আসছি, আল্লাহ হাফেজ! বলে আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিল।
ছুটে চলল আহমদ মুসার গাড়ি। সামনের গাড়িটা তখনও আহমদ মুসার চোখের আড়াল হয়নি। আহমদ মুসা গাড়ির স্পীড আরও বাড়িয়ে দিল।
গাড়ির স্পীড তখন একশ বিশ কিলোমিটার ছাড়িয়েছে। এই রাস্তার জন্যে এই স্পীড বিপজ্জনক। রোডটা সার্কুলার হাইওয়ে হলেও বেশ উঁচু নিচু এবং অনেকখানিই আঁকাবাঁকা।
সামনের গাড়িটাও স্পীড বাড়িয়ে দিয়েছিল।
তিন চার কিলোমিটার চলার পর সাকুলার রোডটা আরও খারাপ। আহমদ মুসার গাড়ি সামনের গাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। গাড়িটা মরিয়া হয়ে স্পীড বাড়িয়ে দিল।
মাত্র দুতিন মিনিট চলার পর ছোট্ট একটা বাঁক নিতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করল গাড়িটা। তীব্র গতির গাড়িটা খেলনার মতো কয়েকবার ওলটপালট খেয়ে ছিটকে গিয়ে ধাক্কা খেল ছোট একটা পাথুরে টিলার সাথে।
আহমদ মুসার গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত নামল আহমদ মুসা গাড়ি। থেকে। ছুটল সে দুর্ঘটনায় পড়া গাড়ির দিকে।
গাড়িটা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছে।
সামনের দিকে একটা দরজা ভেঙে খুলে গেছে গাড়িটা। ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটা ভিতরে ঢুকে গেছে। আহমদ মুসা উঁকি দিয়ে দেখল ড্রইভার লোকটি স্টিয়ারিং হুইলের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ভেতরে ঢুকে পড়া দরজা তার উপর চেপে বসে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ড্রাইভারের দেহ। আর পেছনে একটি মেয়ের দেহ গাড়ির মেঝেতে দরজার সাথে ঠেস দিয়ে পড়ে আছে। তার কপাল ও মুখ রক্তাক্ত। মেয়েটা উঠে বসার চেষ্টা করছে, দেখল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ভাঙা দরজা দিয়ে গাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমে ড্রাইভারকে উদ্ধারের উদ্যোগ নিল। তখন গাড়িতে আগুন ধরে গেছে।
ম্যাডাম আপনি কষ্ট করে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসুন, আমি ড্রাইভারকে দেখছি। বলে আহমদ মুসা ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে গেল।
মেয়েটি তখন সিটের উপর উঠে বসেছে। মেয়েটি লাথি মেরে গাড়ির একটা দরজা খুলে জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে। তাক করল আহমদ মুসার লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা দরজা খোলার শব্দ শুনে অভ্যাস বশতই তাকিয়েছিল দরজার দিকে। সে মনে মনে ভাবছিল মেয়েটি নিশ্চয় এই ব্যাপারে অভিজ্ঞ হবে।
আহমদ মুসা তাকিয়েই দেখতে পেল মেয়েটির রিভলবার তার দিকে উঠে এসেছে। মেয়েটির তর্জনি চেপে বসছে ট্রিগারে। আহমদ মুসার হাতে তখন পাল্টা কিছু করার সময় ছিল না। আহমদ মুসা সে সময় দুহাত বাড়িয়ে ড্রাইভার লোকটির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। আত্মরক্ষার জন্যে আহমদ মুসা যা করতে পারল তা হলো সে যেভাবে ছিল সে অবস্থা থেকে নিজেকে ড্রাইভার লোকটির দেহের উপর নিক্ষেপ করল। তার মাথার উপর দিয়ে গুলিটা চলে গেল। গুলির শব্দ হওয়ার পর মুহূর্তেই আহমদ মুসা মাথাটা পেছন দিকে ছুঁড়ে দিয়ে অদ্ভুত কৌশল ও ক্ষীপ্রতায় দেহটা শূন্যের উপর ঘুরিয়ে নিয়ে দুই পা দিয়ে পেছনের সিটে বসা মেয়েটিকে আঘাত করল। মেয়েটি আহমদ মুসার দুপায়ের প্রচণ্ড আঘাতে ভর্তার মতো সিটের উপর মুখ থুবড়ে পড়ল। আহমদ মুসাও পড়ে গিয়েছিল নিচে। তার পা পড়েছিল সিটের উপর মেয়েটির পাশে, মাথা পড়েছিল গাড়ির মেঝেতে। পড়ে গিয়েই আহমদ মুসা পা দুটি সিটের উপর থেকে নামিয়ে মেয়েটার হাতের ছিটকে পড়া রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
মেয়েটিও নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসেছিল।
আহমদ মুসা রিভলবার দিয়ে বাইরের দিকে ইশারা করে বলল, গাড়ি থেকে বেরিয়ে যান এখনি।
মেয়েটি আহমদ মুসার রিভলবারের দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত নেমে গেল গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসা দ্রুত এগোলো ড্রাইভার লোকটির দিকে। গাড়ির দরজা ও স্টিয়ারিং হুইলের ট্র্যাপ থেকে তাকে বের করে নিয়ে এল বাইরে। প্রচণ্ড আগুনের তাপে দুজনের শরীরের এখানে-সেখানে পুড়ে যাবার মতো। হয়েছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। ফুয়েল ট্যাংকারে আগুন লাগলে তার পক্ষে এদের উদ্ধার করা সম্ভব হতো না।
আহমদ মুসার চিন্তা শেষ হতে পারলো না। ভীষণ শব্দে গাড়ির ফুয়েল ট্যাংকারে বিস্ফোরণ ঘটল। গোটা গাড়িটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা অভ্যাস মতো তাকিয়ে ছিল বিস্ফোরিত গাড়ির দিকে। দেখতে পেল, গাড়ি থেকে বের হওয়া আহত মহিলাটি ছুটে পালাচ্ছে।
আহমদ মুসা উচ্চস্বরে বলল, ম্যাডাম আর এক পা এগোবেন না। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। আহমদ মুসার হাতে উঠে এসেছে রিভলবার।
মহিলাটি একবার পেছনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
চেষ্টা করে লাভ নেই। আপনি পালাতে পারবেন না। আপনি আসুন। আহমদ মুসা সেই উচ্চকণ্ঠে আবার বলল।
মহিলাটি এক, দুপা করে এগিয়ে আসছে। তার মুখ জুড়ে ভয় ও উদ্বেগের চিহ্ন। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের মতো হবে। খুবই সুন্দরী। এসব মেয়েকেই গ্যাঙরা কাজে লাগায়।
আহমদ মুসা ড্রাইভার লোকটার পাশে বসল। তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর। বয়স। চেহারায় পাপের ছাপ। লোকটির শরীরের কয়েকটা স্থান মারাত্মকভাবে কেটে ও ঘেঁতলে গেছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে সবগুলো কাটা থেকেই।
পায়ের শব্দে বুঝল মেয়েটি কাছাকাছি এসে গেছে। আহমদ মুসা মুখ। তুলে চাইল তার দিকে।
আহমদ মুসা তার দিকে চাইতেই মেয়েটি জ্যাকেটের তলা থেকে তার হাতটা টেনে নিল।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, অ্যাবাউট টার্ন করুন।
মেয়েটি আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
এবার আপনি জ্যাকেটের তলায় লুকিয়ে রাখা ছুরিটা বের করে ফেলে দিন। নির্দেশ আহমদ মুসার।
কয়েক মুহূর্ত। মেয়েটি জ্যাকেটের তলায় হাত দিয়ে ছুরিটা বের করল। হঠাৎ সে এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়াবার সাথে সাথেই তার হাতের ছুরি চোখের পলকে ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
ঘটে গেল ঘটনাটা চোখের পলকে।
আহমদ মুসা মেয়েটিকে অ্যাবাউট টার্ন করিয়েছিল এজন্যে যে, সে যাতে তার জ্যাকেটের তলায় লুকানো ছুরি ব্যবহারের সুযোগ না পায়। একটা মেয়ের সাথে অস্ত্রের লড়াই করতে তার মন চাইছিল না। ড্রাইভার। লোকটির দ্রুত শুশ্রূষা দরকার। সে জন্যেই আহমদ মুসা তার পাশে এসে। বসেছিল। রিলভলারও বের করে হাতে রাখেনি সে।
অদ্ভুত দক্ষতায় ছোঁড়া ছুরিটার লকলকে ফলা ছুটে আসছিল আহমদ মুসার দিকে। দূরত্ব এতটাই কম এবং এতই দ্রুত ঘটনা ঘটল যে, নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আত্মরক্ষার সময়ও পেল না আহমদ মুসা। আপনাতেই, যেন কোনো এক অমোঘ নির্দেশে আহমদ মুসার বাম হাত ও ডান হাত একই প্যারালালে উপরে উঠল। বাম হাত লম্বভাবে, ডান হাত হোরাইজেন্টালি। তার হাতের আঙুলগুলো ছিল প্রসারিত। আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি ছিল ধেয়ে আসা ছুরির দিকে। তার দুই চোখের মতো দুই হাতও অদৃশ্য শক্তির পরিচালনায় ছুরিটার চলমান গতির সাথে অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছে। ছুরিটা এসে আহমদ মুসাকে আঘাত করতে হলে প্রথমে বাম হাতকে এড়িয়ে সামনে যেতে হবে। তা যদি ছুরিটা পারে, তাহলে ডান হাতের প্রসারিত দেয়াল ছুরিটাকে ভেদ করতে হবে।
কিন্তু ছুরিটা ডান হাত পর্যন্ত পৌঁছতেই পারল না। বাম হাতের ফাঁদেই তাকে ধরা পড়তে হলো। আহমদ মুসা অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ছুরিটা ধরে ফেলল। ছুরির দুধারী ভয়ংকর ফলা আহমদ মুসার বাম হাত অতিক্রম করেছিল, কিন্তু বাট আটকে গেল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা ছুরিসহ হাত নামিয়ে নিল। ছুরির দুধারী আঘাতে আহমদ মুসার পাঁচটি আঙুলই কিছুটা কেটে গিয়েছিল। ঝর ঝর করে তা থেকে বেরিয়ে আসছে রক্ত।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল শান্ত কণ্ঠে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, এই ছুরিটা এবার আপনার দিকে ছুটতে পারে। এর আঘাত থেকে বাঁচার সাধ্য আপনার নেই।
মেয়েটি ভয়-উদ্বেগ-বিস্ময়ে নির্বাক। বিস্মিত এই কারণে যে, সে বন্দুকবাজ, ছুরিবাজ দুইই। এই দুই ক্ষেত্রে সে ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন। এই যোগ্যতার বলেই সে পাঁচ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে একমাসের চুক্তিতে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের কাজ নিয়ে কয়েক সপ্তাহ আগে রত্নদ্বীপে এসেছে। তার টার্গেট আহমদ মুসা। আহমদ মুসাকে নাগালের মধ্যে পাওয়ার জন্যেই তার আজকের এই নাটক। এখন তার মনে প্রশ্ন, এই লোকটি কে? এই লোকটিই কি আহমদ মুসা! সে ছাড়া এমন ক্ষীপ্র আর কে হবে? খুবই শর্ট রেঞ্জের গুলি ও ছুরি থেকে অদ্ভুত কৌশলে সে নিজেকে বাঁচিয়েছে। সে লক্ষ্যভেদে হয়তো খুবই দক্ষ, কিন্তু এমন গুলি ও ছুরির ছোবল থেকে বাঁচার সাধ্য কারও থাকার কথা নয়। মেয়েটার উঁচু মাথা যেন অনেকটা নুয়ে গেল। আহমদ মুসার কথার জবাবে সে কিছু বলল না।
আহমদ মুসা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল ছুরিটা। সে তাকিয়ে ছিল মেয়েটার দিকে কিছু বলার জন্যে। দেখল মেয়েটা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে আসছে।
ড্রাইভার লোকটার ওপাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল মেয়েটা।
এখন কি মুমূর্ষ লোকটার দিকে মনোযোগ দেব, না আপনার নতুন আক্রমণের বিষয়ে ভাবব? মেয়েটাকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
বিদ্রূপ করবেন না। আক্রমণের ক্ষমতা আমার আছে। মেয়েটা বলল গম্ভীর কণ্ঠে।
আছে আমি জানি। একটা ডেথ গ্যাস বম্ব আপনার কাছে আছে তা জানি। কিন্তু সেটা এখন এত কাছে থেকে আর ব্যবহার করতে পারবেন না। পারলে ছুরির আগেই তা ব্যবহার করতেন। কিন্তু ঐ অস্ত্রের উপর আস্থা রাখতে পারেননি। বলল আহমদ মুসা।
ওটা ডেথ বোমা কিংবা কোনো অস্ত্র আমার কাছে আছে সেটা কি করে জানলেন? মেয়েটি বলল।
মেয়েটির চোখে-মুখে আগের সেই বিস্ময় আবার এসে যেন আছড়ে পড়েছে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত, তার মুখ আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সেই আবার বলল, আহমদ মুসা, আপনি সত্যিই অতিমানব। যা শুনেছিলাম তাই।
আপনার প্রশ্নের উত্তর বলব পরে। এখন তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। অবিলম্বে রক্ত পড়া বন্ধ না হলে লোকটিকে আর বাঁচানো। যাবে না।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা মোবাইলে একটা কল করল এবং সব ব্যবস্থাসহ একটা অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলল কয়েকজন সিকিউরিটিসহ খুব দ্রুত।
মোবাইলের কল অফ করে আহমদ মুসা মেয়েটিকে লক্ষ্য করে বলল, এর মাথার রক্তক্ষরণ এখনি বন্ধ করতে না পারলে একে বাঁচানো কঠিন হবে। আপনি একে একটু দেখুন। আমি গাড়ি থেকে ব্যান্ডেজ নিয়ে আসি।
আহমদ মুসার গাড়িটা চৌদ্দ পনের গজ দূরে রাস্তার উপর ছিল।
আহমদ মুসা একধাপ এগিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল। বলল মেয়েটিকে, আপনার ডেথ গ্যাস বম্বটা আমাকে দিয়ে দিন।
মেয়েটা তৎক্ষণাতই জ্যাকেটের পকেট থেকে বম্বটি আহমদ মুসাকে দিয়ে দিল। দেবার সময় তার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল, খেয়াল করল আহমদ মুসা। ছুটল আহমদ মুসা গাড়ির দিকে।
গাড়িতে উঠার সময় আহমদ মুসা বিনা কারণেই পেছনে তাকাল। দেখল মেয়েটা ড্রাইভার লোকটার পকেট হাতড়াচ্ছে অস্থির হাতে। আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। দ্রুত গাড়িতে উঠে গেল সে। ব্যাগ থেকে বিশেষ মেডিকেটেড ব্যান্ডেজ বের করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াল। গাড়ির বাইরে পা রাখার সময় আহমদ মুসা ব্যান্ডেজটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতটা জ্যাকেটের পকেটে ঢুকাল। হাতটা স্পর্শ করল লেটেস্ট মডেলের ক্ষুদ্র কিন্তু ভয়ংকর রিভলবারটায়। এর ম্যাগনেটিক বুলেট কোনো রিভলবারধারী ও বিস্ফোরক বাহক টার্গেটের ক্ষেত্রে অব্যর্থ।
আহমদ মুসা গাড়ির বাইরে পা রেখে মাথা একটু নামিয়ে মাথা বের করে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল, সেই মেয়েটার হাতের উদ্যত রিভলবার একটু নড়ে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসার দেহটা খসে পড়ল গাড়ির দরজার সামনে, আর তার হাতের রিভলবার থেকে বেরিয়ে গেল একটা গুলি একই সাথে। _ মেয়েটা আহমদ মুসার দিক থেকে পাল্টা গুলি আশা করেনি, এত দ্রুত তো নয়ই। সে বুঝে উঠার আগেই তার রিভলবার ধরা ডান হাত গুলিবিদ্ধ হলো।
গুলি খেয়ে মেয়েটির মুখে চিৎকার উঠল না, দুচোখে আগুন, আর মুখে ফুটে উঠেছে বেপরোয়া ভাব। তার বাম হাত ছুটে গেল জ্যাকেটের বাম পকেটে। বেরিয়ে এল পিংপং বলের মতো একটা গোলাকার জিনিস নিয়ে।
মেয়েটার বাম হাত জ্যাকেট থেকে বের হওয়া দেখে বুঝল আহমদ মুসা, তার কাছে সত্যিই ডেথ গ্যাস বম্ব আরও একটা ছিল!
আহমদ মুসার রিভলবার দ্বিতীয়বার অগ্নিবর্ষণ করল। মেয়েটার বাম বাহু লক্ষ্যে গুলি করেছে আহমদ মুসা বোমাটির বিস্ফোরণ এড়াবার, জন্যে।
ঠিকই আহমদ মুসার হুঁড়া বুলেট গিয়ে বিদ্ধ করেছে মেয়েটার বাম কনুই-এর একটু উপরের জায়গাটায়। কোনো চিৎকার নয়, দুই আহত হাত নিয়ে মেয়েটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। মেয়েটা কোনো চিৎকার বা আর্তনাদ করল না, শুধুমাত্র নিঃশব্দ কান্নায় লুটিয়ে পড়ল কেন! অদ্ভুত শক্ত নার্ভ মেয়েটির। কিন্তু তার এই কান্না কেন? এ কান্না তো তার আঘাতের নয়!
আহমদ মুসা দ্রুত চলে এল মেয়েটার পাশ দিয়ে ড্রাইভার লোকটার কাছে।
খুব খারাপ অবস্থা লোকটার। খুব নেতিয়ে পড়লেও সংজ্ঞা কিছুটা ছিল। সেটাও এখন নেই। তার মাথার আঘাত থেকে স্রোতের মতো রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।
আহমদ মুসা দ্রুত কিছু তুলাসহ মেডিকেটেড ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল তার মাথায়। খুশি হলো আহমদ মুসা, অন্তত রক্তটা বন্ধ হবে এতে।
আহমদ মুসা এল মেয়েটির কাছে। মেয়েটির গুলিবিদ্ধ বাম বাহু ও ডান হাত থেকে বেশ বেগেই রক্ত গড়াচ্ছিল।
আহমদ মুসা মেয়েটার সামনে বসল।
কাঁদছিল মেয়েটি।
আহমদ মুসা কোনো কথা না বলে মেয়েটার ডান হাত টেনে নিতে যাচ্ছিল।
মেয়েটা হাত টেনে নিয়ে বলল, ব্যান্ডেজের কোনো দরকার নেই। আমি মরে যেতে চাই।
আহমদ মুসা কোনো কথা বলল না। তার দিকে তাকালোও না। তার হাতটা ধরে জোরের সাথে টেনে নিল। মেয়েটা বাধা দিল না, আর কিছু বললও না।
আহমদ মুসা যতটা সম্ভব মেয়েটার হাতের রক্ত মুছে ফেলে আহত আঙুলগুলোসহ হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। তার আহত বাম বাহুতেও ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। বলল, সুখবর যে, হাত কিংবা বাহু কোথাও বুলেট বিধে নেই।
আহমদ মুসা মেয়েটার দিকে না তাকিয়েই বলল কথাগুলো।
মৃত্যুই আমার জন্যে ছিল সুখকর। মেয়েটি বলল। কান্নায় ভেঙে পড়া কণ্ঠ তার।
কিন্তু গত কয়েক মিনিটে আমাকে আপনি চার বার হত্যার চেষ্টা করেছেন। মৃত্যুকামী কেউ তো এভাবে অন্যের জীবন নেবার জন্যে বেপরোয়া হয়ে উঠে না? বলল আহমদ মুসা।
ওটা ছিল আমার বাঁচার চেষ্টা। সে চেষ্টা আমার সফল হয়নি বলে এখন মৃত্যুই আমার বাঁচার উপায়। মেয়েটা বলল। মেয়েটার কান্না থামেনি। কাঁদতে কাঁদতেই বলল মেয়েটা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। তাকাল আহমদ মুসা একবার মেয়েটির দিকে। বলল, বুঝতে পারছি ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আপনি এসেছেন। সে অ্যাসাইনমেন্টটা ছিল আমাকে হত্যা করা। ব্যর্থ হওয়ায় এখন আপনি মৃত্যু কামনা করছেন। কেন? কি এমন শর্ত ছিল ওদের সাথে যে, আপনাকে মৃত্যু কামনা করতে হচ্ছে?
মেয়েটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। স্থির তার দৃষ্টি। তারপর দৃষ্টি নামিয়ে নিল সে। বলল, আপনি আমাকে মেরে ফেলতে পারতেন। শেষবারে আমার হাত দুটিকে গুলিবিদ্ধ করলেন। মেরে ফেললেন না কেন আমাকে? আপনাকে হত্যার চারবার সুযোগের কোনোটাই আমি হাতছাড়া করিনি। চারটি সুযোগ আপনিও পেয়েছিলেন, কিন্তু কেন আমাকে হত্যা করনেনি? কান্নারুদ্ধ কণ্ঠ মেয়েটির।
আপনি ব্ল্যাক সিন্ডিকেট দলের নন। সেই জন্যেই বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম আপনাকে। বলল আহমদ মুসা।
মেয়েটা আহমদ মুসার দিকেই তাকিয়েছিল। বলল, আমি ব্ল্যাক সিন্ডিকেট দলের লোক নই কি করে বুঝলেন আপনি? কান্না থেমে গেছে। মেয়েটার। তার ভ্রু কুঞ্চিত।
ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের প্রত্যেকের বাহুতে বিশেষ একটা উল্কি থাকে, আপনার নেই। জামা, জ্যাকেট যাই হোক সবকিছুই ফুল হাতা পরে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের লোকরা। আপনার জ্যাকেট হাতা কাটা। আর আপনার জ্যাকেটটা ইউরো সুটিং অ্যাসোসিয়েশনের। আমি জানি ঐ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছাড়া এ জ্যাকেট অন্য কেউ পরতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা, ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের মতো আপনাকে ক্রিমিনাল মনে হয়নি। বলল আহমদ মুসা।
মাথা নিচু করল মেয়েটি। আহমদ মুসা থামলেও সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না মেয়েটা।
একটু পরে মুখ তুলল সে। দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার। বলল, আপনি সত্যিই অনন্য। আপনার বিবেচনা বোধের কাছে আমাদের মতো লোকরা সত্যিই শিশু। আমার আকাশচুম্বি অহংকার আপনার পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে গেছে। রিভলবার ও ছুরি চালনায় ক্ষিপ্রতা ও লক্ষ্যভেদে আমি তিন বছর ধরে ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন। কোনো টার্গেট আমার চোখে পড়ার পর দ্বিতীয় পলক পড়ার আগেই তাকে আমার বুলেট শিকার করতে পারে। এই অহংকার নিয়েই আমি রত্নদ্বীপে এসেছিলাম ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। আমি ওদের বলেছিলাম, আপনাকে যদি তারা আমার চোখের সামনে এনে দিতে পারে, তাহলে আপনাকে হত্যা করা আমার বাম হাতের কাজ। সে অহংকার আমার আপনি আজ খুঁড়িয়ে দিয়েছেন এবং তা একবার নয়, বারবার। কথা শেষ করল মেয়েটি। কান্নায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
দেখলাম, আঘাতের অসহ্য যন্ত্রণার চেয়েও আপনার দুঃখের কান্না বড় হয়ে উঠেছে। এই কান্না কি আপনার অহংকার গুঁড়িয়ে যাওয়ার জন্যে? বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না মেয়েটি।
প্রশ্ন শুনেই মাথা নিচু করেছিল সে।
মাথা নিচু রেখেই বলল, যুক্তি এটাই আসে যে আমার দর্পচূর্ণ হওয়ার অসহনীয় দুঃখেই আমি কেঁদেছি। কিন্তু তা নয়। আমি কেঁদেছি ঐ ধরনের কোনো অশরীরী কষ্টের জন্যে নয়, আমি কেঁদেছি একটা সংকীর্ণ স্বার্থহানির জন্যে, সে স্বার্থ সংকীর্ণ হলেও তা এখন আমার কাছে জীবনের অস্তিত্বের মতোই বড়।
বুঝতে পারছি, বিষয়টি অ্যাসাইনমেন্টের শর্তের সাথে সম্পর্কিত। কি সেটা জানতে পারি কি? বলল আহমদ মুসা।
জানতে পারবেন না কেন? আমার তো সবই শেষ। আপনি জানলে আর ক্ষতি নেই। বলে একটু থামল মেয়েটি।
মাথা না তুলেই মেয়েটি কথা শুরু করল, আমার নাম সারা সোফিয়া। সিসিলির পালারমো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক সিকিউরিটি স্ট্যাডিজের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার পর সিসিলির গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি পাই। মাত্র এক বছর চাকরি করার পর গোয়েন্দার চাকরি ছেড়ে দেই। পাবলিক নিরাপত্তার জন্যে চাকরি নিয়েছিলাম, কিন্তু নিজের সম্মান-সম্ভ্রম যখন বিপন্ন দেখলাম, তখনই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। চাকরি ছাড়ার পর সেলফ ডিফেন্স ও সিভিল ডিফেন্সের উপর একটা প্রাইভেট স্কুল চালু করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই বিভিন্ন ধরনের বন্দুক ও ছুরি চালনায় বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হই। আর ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি গত তিন বছর। আমার স্কুলটি বেশ নাম করে। কিন্তু এর আয় দিয়ে আমার পারিবারিক প্রয়োজন পূরণ হয় না। আমার বাবা জ্যাকব এস্তেবান ছিলেন পালারমো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। আমার মাকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। সাগরতীরের একটা বাড়ি আমার মার খুবই পছন্দ ছিল। বাবা ঋণ করে বাড়িটা তাঁকে কিনে দেন। মাসিক কিস্তিতে উনি দেনা শোধ করবেন, এটাই ছিল তার ইচ্ছা। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় বাবা অচল হয়ে পড়েন, চাকরি হারান। দেনার দায়ে বাড়িটা আমরা হারাই। বাবা এই আঘাত সহ্য করতে পারেননি। তিনি মারা যান। বাবার শোকে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। জীবন্ত আজ তিনি। কিন্তু জ্ঞানটুকু টনটনে আছে। কিছুই ভোলেননি। সবচেয়ে বেশি মনে আছে বাড়িটা হারানোর কথা, যা হারানোর শোক বাবা সহ্য করতে পারেননি। এর ফলে তিনি মারা গেছেন। প্রতি উইক এন্ডে মাকে নিয়ে যেতে হয় বাড়িটার পাশের। পার্কটায়। পার্কের বেঞ্চিতে বসে তিনি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার দুচোখ থেকে। মার এই অশ্রু আমার কাছে গোটা দুনিয়ার চেয়ে ভারি। আমি চেষ্টা করতে লাগলাম বাড়িটা কি করে আমি ফেরত পেতে পারি। মায়ের অশ্রু মোছাবার এটাই একমাত্র পথ। আমি বিভিন্ন মাধ্যমে কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে জানলাম আমি। যদি একসাথে ওদের কমপক্ষে ৬ লাখ ইউরো পরিশোধ করতে পারি, তাহলে বাজার মূল্য তারা দাবি করবে না। বাড়িটা আমি পেয়ে যেতে পরি। লাখ খানেক ইউরোর যোগাড় আমার জন্যে সম্ভব, কিন্তু বাকি পাঁচ লাখ! আমি যখন চোখে অন্ধকার দেখছি, সেই সময় সিসিলি শুটিং ক্লাবের আমার একজন বান্ধবী আমাকে এসে বলল, তুমি ইউরোপের একজন। অদ্বিতীয় টার্গেট শুটার। তুমি একে কাজে লাগিয়ে তোমার প্রয়োজন পূরণ করতে পার। কিভাবে সেটা সম্ভব জানতে চাইলে সে বলল, সিসিলির একটা গ্রুপ একটা কাজ দিতে চায়, তাদের সে কাজটা তুমি করে দিলে তোমাকে তারা পাঁচ লাখ ইউরো দেবে। সেই গ্রুপটাই ব্ল্যাক সিন্ডিকেট। তাদের সাথে আমার কথা হলো। জানলাম, আমি যদি রত্নদ্বীপে যেতে রাজি হই, তাদের টার্গেটেড লোককে হত্যা করি, তাহলে পাঁচ লাখ ইউরো তারা আমাকে দেবে। আমি তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। কয়েক দিন আমি এ নিয়ে ভাবি। অর্থ সংস্থানের আর কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে অবশেষে আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। কিন্তু তখনও আমি জানতে পারিনি কাকে মারতে হবে। রত্নদ্বীপে এসে জানলাম আহমদ মুসা নামে বিদেশি একজনকে হত্যা করতে হবে, যিনি অত্যন্ত দক্ষ ও ক্ষীপ্র শুটার। অপরাজেয় শুটার হিসেবে আপনার আরও যেসব প্রশংসা শুনলাম, তাতে আমার জেদ চেপে গেল। আমার চেয়ে ভালো শুটার কেউ হতে পারে তা আমি মানতে রাজি নই। তাই আমি আপনার সাক্ষাৎ পাওয়া ও আমার শুটিং পরীক্ষা দেয়ার জন্যে উগ্রীব ছিলাম। দেখা হলো কিন্তু আমি হেরে গেলাম। আমার দুই হাতও শেষ। আমার স্বপ্নেরও এখানে সমাপ্তি। মার চোখের অশ্রুও মুছানো আর হলো না। আমি তাদের অ্যাসাইনমেন্ট নেয়ার সময় শর্ত দিয়েছিলাম রত্নদ্বীপে যাওয়ার পরই আমাকে পাঁচ লাখ ইউরো দিতে হবে। পালারমোর বাড়ির মালিক কোম্পানিটি আমাকে এক মাসের সময় দিয়েছিল। এর মধ্যে বাড়িটা না নিলে অন্যের হাতে চলে যাবে ওটা। টাকা পরিশোধের জন্যে ওদের দেয়া এক মাস সময়ের মাত্র আর তিন দিন বাকি আছে। আমার এই প্রথম চেষ্টার পর আজই ওরা আমাকে টাকা দেয়ার পাকা কথা দিয়েছিল। সেই অনুসারে আমি সে কোম্পানিকেও বলে রেখেছি আগামী কালকের তারিখেই আমি ওদের একাউন্টে টাকা দিয়ে দেব। এখন আমার সবই গেল, সব আশাই শেষ। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল সারা সোফিয়া নামের মেয়েটি।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে নেমে এসেছে বেদনার ছায়া। এর সাথে তার হৃদয়ে বিস্ময় ও বেদনায় জড়াজড়ি। একটি মেয়ের তার মা-কে রক্ষার জন্যে কি অসম্ভব রকমের চেষ্টা! কত অসহায় অবস্থায় পড়ে মানুষ। অবস্থা কি করে একজন ভালো মানুষকে খুনি বানায়! শয়তানী শক্তির কারণে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের এই অসহায়ত্বে বেদনায় মনটা মোচড় দিয়ে উঠল আহমদ মুসার।
কাঁদবেন না মিস সোফিয়া। কান্না মানুষকে দুর্বল করে। তার এগিয়ে চলার গতি থামিয়ে দেয়। বলল আহমদ মুসা।
গতি আমার থেমে গেছে। আমি হেরে গেছি। সারা সোফিয়া বলল। তার কান্না থামলো না।
বর্তমানই শেষ নয়। ভবিষ্যত আছে, থাকবেই। বলল আহমদ মুসা।
কিছু বলার জন্যে মুখ তুলেছিল সারা সোফিয়া।
অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা গেল। আহমদ মুসা সেদিকে তাকাল।
সারা সোফিয়া কথা না বলে তাকাল অ্যাম্বুলেন্সের দিকে।
অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার পাশে।
অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে একজন ক্যাপ্টেন, সিকিউরিটি অফিসার, ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। একটা স্যালুট দিয়ে বলল, নির্দেশ করুন স্যার।
অ্যাম্বুলেন্স থেকে স্বয়ংক্রিয় একটি ক্যারিয়ার ও কর্মীরা নেমে এল।
আহমদ মুসা ক্যাপ্টেন লোকটির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওর খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন। তাড়াতাড়ি ওকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হবে, হয়তো অক্সিজেনেরও দরকার হতে পারে। আর সারা সোফিয়াকে দেখিয়ে বলল, ওর হাত ও বাহু আহত।
ক্যাপ্টেন অফিসারটি এগোলে অ্যাম্বুলেন্সের কর্মীদের দিকে।
আহমদ মুসা এগোলো সারা সোফিয়ার দিকে। বলল, আপনার সাথে আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি। আমি পরে আসছি।
হ্যাঁ, জিজ্ঞাসবাদ তো শুরুই হয়নি। আমি জানি। সারা সোফিয়া বলল।
জিজ্ঞাসাবাদ নয় মিস, আমরা আপনার সহযোগিতা চাই।
হ্যাঁ, সহযোগিতা করতে আমি বাধ্য। সারা সোফিয়া বলল।
শুনে নিশ্চয় হাসবেন। আপনার সহযোগিতা চাই শুধু নয়, আপনাকে সহযোগিতা করতেও চাই আমরা। বলল আহমদ মুসা।
হাসারই কথা। কিন্তু হাসি আমার আসছে না। আপনি হাসির পাত্র নন, এটুকু আমি এর মধ্যে বুঝেছি। বলেছি, আপনি চারবার জীবন দিয়েছেন একজন ভয়ানক শত্রুকে। শত্রুর এমন সেবা-শুশ্রূষা কেউ করে, আমার জগতে আমি এটাই এত দিন দেখেছি। সারা সোফিয়া বলল।
আমি শত্রুকে বাঁচাইনি, শত্রুর সেবা করিনি। শত্রু বলে কারও নাম নেই। আমরা সবাই মানুষ। আমি যা করেছি, তা মানুষের জন্যে।
কিন্তু মানুষ অমানুষ না হলে সে ভাড়াটে খুনি হয় না। বলতে গিয়ে কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল সারা সোফিয়ার কণ্ঠ।
কোনো অমানুষের হৃদয়ে মানবাত্মার কান্না শোনা যায় না, আর তার চোখে মানবিক অশ্রুও কখনো গড়ায় না মিস সারা সোফিয়া। বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলল, আপনারা এখন হাসপাতালে যাবেন।
আপনি যাবেন না? সারা সোফিয়া বলল।
না, আমি জরুরি কাজ ফেলে এসেছি। ওদিকে আবার ফিরে যেতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
বললেন যে, আপনার কথা শেষ হয়নি? সারা সোফিয়া বলল।
পরে আমি সময় করে নেব। বলল আহমদ মুসা।
আমার পা দুটি কিন্তু সুস্থ, আমি যদি পালিয়ে যাই। সারা সোফিয়া বলল।
আমি জানি আপনি পালাবেন না। ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের কাছে আপনি আর ফিরতে পারেন না। বলল আহমদ মুসা।
কেন ফিরতে পারি না? সারা সোফিয়া বলল।
উত্তর আপনি জানেন। আমি আশা করি, আপনি আমাদের সহযোগিতা করবেন, যাতে উভয় পক্ষের কল্যাণ আছে। বলল আহমদ মুসা।
আপনার এই আশাবাদের কারণ? সারা সোফিয়ার জিজ্ঞাসা।
প্রথমত আপনার অশ্রু, দ্বিতীয়, আপনাকে বোধ হয় আমি বুঝতে পেরেছি।
সারা সোফিয়া কোনো উত্তর দিল না। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে বিস্ময় ও মুগ্ধতার জড়াজড়ি।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল ক্যাপ্টেন ছেলেটার দিকে। সে একটু দূরেই অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা তার দিকে তাকাতেই বলল, স্যার অ্যাম্বুলেন্স রেডি।
আহমদ মুসা তাকাল সারা সোফিয়ার দিকে। বলল, প্লিজ মিস সারা…।
ধন্যবাদ! বলে সারা চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসাও হাঁটছিল ক্যাপ্টেনের পাশাপাশি।
অ্যাম্বুলেন্সটা ছিল অ্যাম্বুলেন্স-কাম-সিকিউরিটি ভ্যান। ড্রাইভিং সিটে লেফটেন্যান্ট ব্যাংকের একজন অফিসার।
ক্যাপ্টেন তার পাশের সিটে উঠে বসল।
অ্যাম্বুলেন্সের কর্মীরা সারা সোফিয়াকে তুলে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে।
আহমদ মুসাকে স্যালুট দিয়ে কর্মীরা অ্যাম্বুলেন্সের দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা ইশারা করল দরজা বন্ধ না করার জন্যে। কর্মীরা দরজা বন্ধ না করে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা অ্যাম্বুলেন্সের দরজায় গিয়ে সারা সোফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, মিস সারা সোফিয়া আপনার একটু সহযোগিতা চাই।
বলুন স্যার। ফিরে তাকিয়ে বলল সোফিয়া।
সেই বাড়িটা এখন যে কোম্পানির, যাদের সাথে আপনার কথা হয়েছে, সেই কোম্পানির নাম, একাউন্ট নাম্বার, আপনার মা-বাবার নাম ও আপনার মার মা-বাবার নাম এবং বাড়ির নাম্বার আমাকে দিন প্লিজ। তার সাথে আপনার নাম, যে নামে কোম্পানি আপনাকে চেনে তাও দিন।
বলেই আহমদ মুসা ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ক্যাপ্টেন তোমার পকেটে কাগজ কলম আছে। তুমি লিখে নাও ম্যাডাম যা বলেন।
ইয়েস স্যার। ক্যাপ্টেন বলল।
সারা সোফিয়া বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। কথা বলতে সে শুরু করেছিল। আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, প্লিজ, কোনো কথা নয়। আমি সব প্রশ্নের উত্তর দেব। আমাকে বিশ্বাস করলে বলুন।
মেয়েটা মানে সারা সোফিয়া, পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে। তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে। বলতে লাগল তথ্যগুলো আহমদ মুসা যা চেয়েছিল।
আহমদ মুসা কর্মীদের অ্যাম্বুলেন্সের দরজা বন্ধ করতে বলে এগোলো ক্যাপ্টেনের দিকে।
ক্যাপ্টেনের লেখা হয়ে গিয়েছিল। আহমদ মুসাকে দেখে তাড়াতাড়ি গাড়ির সিট থেকে নেমে আসছিল সে।
নেমো না ক্যাপ্টেন। একটু কষ্ট করে লেখাটা ম্যাডামকে দেখিয়ে কনফার্ম করো। বলল আহমদ মুসা।
ক্যাপ্টেন ভেতরের দরজা ওপেন করে এগিয়ে গিয়ে সারা সোফিয়াকে কাগজটি দেখাল।
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন সব ঠিক আছে। বলল সারা সোফিয়া।
ক্যাপ্টেন কাগজটি নিয়ে নিচে এল। কাগজটি দিল সে আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা কাগজটির উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন। যাও।
ক্যাপ্টেন আহমদ মুসাকে একটা স্যালুট দিয়ে গাড়িতে উঠে গেল। স্টার্ট নিল অ্যাম্বুলেন্স।
আহমদ মুসা নিজের গাড়ির দিকে এগোলো। গোয়াদিয়ার সেই পাহাড়ি এলাকার দিকে আবার ফিরে চলল আহমদ মুসা।
৩
গোয়াদিয়া পাহাড় অঞ্চলের সেই দ্বিতীয় রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছে। আহমদ মুসাদের সেই দুটি গাড়ি।
সামনের জীপটার ড্রাইভিং সিটে একজন মেজর বেন ইয়ামিন। পেছনের সিটে পাশাপাশি বসে আছে আহমদ মুসা এবং জেনারেল রিদা।
মি. রিদা, গোয়াদিয়া পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশের প্রথম সড়কটির মুখে। সিকিউরিটি পুলিশের যে আউটপোস্ট ছিল, সেটা তো ঠিক আছে? ওদিক দিয়ে ওরা তো পালাতে পারবে না? আহমদ মুসা বলল।
না, তা পারবে না। আমরা এ বিষয়টা বিবেচনা করেছি। আমরা এ রাস্তায় অবস্থান নেয়ার সময়ই পোস্টটির শক্তি বৃদ্ধি করেছি। পনেরজনের আরেকটা টিম আমরা সেখানে পাঠিয়েছি। কর্নেল জেনারেল রিদা বলল।
ধন্যবাদ কর্নেল জেনারেল রিদা।
একটু থামল আহমদ মুসা। বলল আবার সাথে সাথেই, ওরা যদি। ওদিক দিয়ে পালাতে না পারে, তাহলে কি করতে পারে ওরা এখন?
আমরা তো পাহাড়ের অনেকটা পথ এলাম, ওদের কোনো তৎপরতা তো এখনও চোখে পড়ল না। কর্নেল জেনারেল রিদা বলল।
সেটাই তো চিন্তার বিষয়। এর দুটি অর্থ হতে পারে। এক, কোনো গোপন পথ দিয়ে বা বিভিন্নভাবে ওরা পালিয়ে যেতে পারে। দুই, ওরা কোনো আক্রমণের আয়োজনে থাকতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক স্যার। এই দুই অপশনের যে কোনো একটা তারা নিতে পারে। কিন্তু মনে হয় তারা সংঘর্ষে আসবে না। সংঘর্ষ চাইলে আমাদের মাত্র একটা গাড়ি দেখে তারা পিছু হটতো না। কর্নেল জেনারেল রিদা বলল।
আমার মনে হয় ওরা সম্মুখযুদ্ধ এড়াতে চেয়েছে। সম্মুখযুদ্ধের বিকল্প তারা কিছু খুঁজতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো জেনারেল রিদার। বলল, ঠিক বলেছেন স্যার। ওরা পেছনে হটেছে নিশ্চয় পরিকল্পনা করেই।
মি. রিদা, ওদের ঘাঁটি বলে জানা গেছে সেই জাদোক এলাকাটা আর কত দূর? বলল আহমদ মুসা।
আমরা অর্ধেকটা পথ এসেছি স্যার। জেনারেল রিদা বলল।
সামনের পথটা কেমন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আরও দুর্গম হবে। চড়াই-উতরাই ক্রমশই বাড়বে। পাহাড়ের এপাশ-ওপাশ ঘুরে আঁকাবাঁকা পথে সামনে এগোতে হবে। জেনারেল রিদা বলল।
আপনার কাছে এ অঞ্চলের একটা ম্যাপ দেখেছিলাম। এখন আছে। কি সেটা? বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ আছে স্যার। বলে গোয়াদিয়া অঞ্চলের একটা ভূ-মানচিত্র এগিয়ে দিল আহমদ মুসার দিকে।
ফোল্ডিং মানচিত্রটা খুলে নজর বুলাতে লাগল আহমদ মুসা। মানচিত্রটা খুবই বিস্তারিত। পাহাড় ও টিলাগুলোর লোকেশন, পাকা রাস্তা, কাঁচা রাস্তা, পায়ে চলার পথ, গাছ-গাছড়া, জংগল- সবই পরিষ্কারভাবে দেখানো আছে মানচিত্রে।
আহমদ মুসা জাদোক পর্যন্ত রাস্তাটার উপর ভালোভাবে নজর বুলিয়ে দ্রুত মানচিত্র থেকে চোখ তুলে তাকাল সামনের দিকে। দেখল হঠাৎ করেই সামনে যেন পাহাড়ের দেয়াল এসে দাঁড়িয়েছে। বড় ছোট অনেক পাহাড় হঠাৎ করেই যেন গজিয়ে উঠেছে এবং তা এখন একদম নাকের ডগার সামনে। মানচিত্রের সেই পাহাড়গুলোর দিকেই আবার তাকাল আহমদ মুসা। মানচিত্রের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছে।
আহমদ মুসাদের গাড়ি পাহাড়ের দেয়ালের ভেতরে প্রবেশ করেছে।
এলাকাটা মজার। একদম ডিম্বাকৃতি সাইজের। ছোট-বড় পাহাড়ে ঘেরা। মাঝখান দিয়ে এবড়োথেবড়ো উপত্যকা। এ উপত্যকার মাঝখান দিয়ে সড়ক। এই সড়কটাই মাত্র এ উপত্যকায় ঢোকার ও বেরোবার পথ। উপত্যকাটা প্রশস্ত সুড়ঙ্গ পথের মতোই। পার্থক্য শুধু এর উপর দিকটা উন্মুক্ত।
উপত্যকাটিতে ঢুকে গাড়ি চার পাঁচ গজের মতো এগিয়েছে তখন। গাড়ির দুপাশে এবং সামনে ছিল আহমদ মুসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। তার মন বলছে এক বিপজ্জনক বলয়ে তারা প্রবেশ করেছে। সতর্ক আহমদ মুসা।
গাড়ি উপত্যকায় প্রবেশের সময় আহমদ মুসা পেছনের সিট থেকে এসে সামনে ড্রাইভার মেজরের পাশের সিটে বসেছিল।
আহমদ মুসার দৃষ্টি হঠাৎ আটকে গেল মাস্তুল ওয়ালা নৌকার কালো কাঠামোর উপর। নৌকার কালো কাঠামোর নিচ দিয়ে সড়কটিতে আড়াআড়ি একটা রেড লাইন। রেড লাইনটির মাঝে মাঝেই ছেদ, যেন ক্ষয়ে গেছে পুরানো লাইনটা। কিন্তু আহমদ মুসার মনে হলো ওটা ক্যামোফ্লেজ।
সড়কের এবড়োথেবড়ো বুকের উপর আঁকা নৌকার কালো কাঠামো ও রেড লাইনটা এমনভাবে আঁকা তা সড়কের এক বিশেষ অ্যাংগেলে এলেই তা দেখা যায়। এটা আহমদ মুসা বুঝল গাড়িটা আরও গজখানেক এগোবার পর। যেখানে গাড়িটা থামল, সেখান থেকে কাঠামোটা আর দেখা গেল না।
নৌকার কালো কাঠামো ও রেড লাইন চোখে পড়তেই আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি থামাতে নির্দেশ দিল। গাড়িটা ব্রেক কষার পরেও গজখানেক এগিয়ে গেল।
গাড়ি থামতেই আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে জেনারেল রিদাকে বলল সবাইকে কমব্যাট এলার্টের নির্দেশ দেয়ার জন্যে।
গাড়ি থেকে না নেমেই আহমদ মুসা দুদিকের পাহাড় এবং সামনের সড়টার দিকে তাকাচ্ছিল। সামনের সড়কটা শুধু এবড়োথেবড়োই নয়, দুই দিক দিয়ে আসা ময়লায় অপরিচ্ছন্ন কিন্তু পেছনের সড়কে এমন অবস্থা সে দেখেনি। এসব ময়লা আবর্জনার মধ্যে আহমদ মুসা এক ধরনের পাহাড়ি ফল দেখতে পেল। ক্রিকেট বলের মতো ফলগুলো পাকা ধরনের ও পুরানো মনে হল। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা ফলগুলো অক্ষত আছে দেখে। এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করেছে, তাতে এ ফলগুলো থেঁতলে, পিষ্ট হয়ে যাবার কথা। তা যখন হয়নি, তখন বুঝা যাচ্ছে ফলগুলো গাড়ি চলে যাবার পরে এখানে এসেছে। কেন? এই কেনর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা। ওগুলো তাহলে কি ফাঁদ?
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল ডিটেকশন অপশন অন করা নেই। অপশনটি অন করল। সঙ্গে সঙ্গেই বিপ বিপ শব্দ উঠল এবং একটা রেড ডট ফ্লাশ করতে শুরু করল। এই সাথে লম্বালম্বি অবস্থানে অনেকগুলো রেড ডট দেখতে পেল আহমদ মুসা।
মি. রিদা, সামনের রাস্তায় অনেকগুলো বিস্ফোরক পাতা আছে। এই অবস্থায় সামনে এগোনো যাচ্ছে না। পেছনে রিদার দিকে তাকিয়ে বলল আহমদ মুসা।
বিস্ফোরক পাতা আছে? ঠিক সময়ে গাড়ি দাঁড় করিয়েছেন আপনি। আল হামদুলিল্লাহ। এটা জানতে পারলেন কিভাবে স্যার? জেনারেল রিদা বলল। তার চোখে মুখে বিস্ময় ও উদ্বেগ। _ একটু থেমেই জেনারেল রিদা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, স্যার, আমাদের টীমে একজন বিস্ফোরক এক্সপার্ট আছে। আমরা বিস্ফোরক সরিয়ে সামনে এগোতে পারি।
বিস্ফোরক সরাবার পরেও সামনের রাস্তার উপর দিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়। শত্রুরা ওঁৎ পেতে থাকার আশংকা বেশি। যদি তা হয়, ওখানে যেই যাবে গুলির মুখে পড়তে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক স্যার। কিন্তু তাহলে আমরা কি করব? পেছনে হটব? জেনারেল রিদা বলল।
হ্যাঁ জেনারেল রিদা, পিছু হটতে হবে। কিন্তু তা হটে যাবার জন্যে নয়, শত্রুকে সামনে নিয়ে আসার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
কিভাবে স্যার? জেনারেল রিদা বলল।
যারা বিস্ফোরক পেতেছে, তাদেরকে অ্যাকশনে আনা। আমরা পিছু হটলে আমরা পালাচ্ছি মনে করে তারা আমাদের উপর আক্রমণে আসবে। তখন আমরাও কি করব তা ঠিক করতে পারব। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। তাহলে নির্দেশ দিচ্ছি পেছনে হটার। জেনারেল রিদা বলল।
সকলে যেন সাবধান হয়। এখন দুপাশ থেকে গুলি আসার আশংকা বেশি। আপনি বলে দিন সকলকে। বলল আহমদ মুসা।
আকস্মিক ও দ্রুত দুটি গাড়ি পিছু হটতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গেই দুইপাশ থেকে গুলি বৃষ্টি এসে ঘেঁকে ধরল গাড়ি দুটিকে। ভাগ্য ভালো গুলিগুলোর অধিকাংশই লেগেছে গাড়ি দুটির ছাদে কিছুটা কৌণিকভাবে। গাড়ির ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ভেতরে লোকদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
গাড়ি দুটি গিয়ে দাঁড়াল উপত্যকার প্রবেশপথে। শেষদিকে গুলি আর গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছল না। গুলি বর্ষণ কমে গেল, কিন্তু বন্ধ হলো না।
ওরা অহেতুক এভাবে গুলি করছে কেন? জেনারেল রিদা বলল।
ভাবছিল আহমদ মুসা। মাথা তুলে বলল, মি. রিদা, আপনি মেজর বেন ইয়ামিনকে দুজন সিকিউরিটিসহ পূর্বদিকে পাহাড় পাঠান। কারো চোখে না পড়ে এভাবে তাদের এগোতে হবে, শত্রুরা তাদের দেখতে পাওয়ার আগেই তাদের শত্রুকে ডিটেক্ট করতে হবে এবং আক্রমণে যেতে হবে। আর আমি যাচ্ছি পশ্চিম পাশের পাহাড়ে। ভেতর দিয়ে ওরা যদি এদিকে আসতে চায়, তাহলে ওদের আক্রমণের দায়িত্ব আপনার উপর থাকল। গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলো বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। আপনার নির্দেশ পালিত হবে। কিন্তু স্যার আমাদের। জনশক্তি কি বেশি রকম ভাগ হয়ে গেল না? জেনারেল রিদা বলল।
ওরাও ভাগ হয়েই আসছে জেনারেল রিদা। বলল আহমদ মুসা।
ওরা আসছে! কিন্তু স্যার ওদের গুলি তো এক জায়গা থেকেই আসছে। জেনারেল রিদা বলল।
আমি মনে করি অব্যাহত ঐ অর্থহীন গুলি আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে, আমাদের মনোযোগ ওদিকে আটকে রাখার জন্যে। এই সুযোগে ওরা আমদের পেছন থেকে আক্রমণ করবে। সামনে থাকবে বিস্ফোরকের ফাঁদ, আর পেছনে ওরা। বলল আহমদ মুসা। ১ জেনারেল রিদার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ঠিক ভেবেছেন স্যার। আপনাকে ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।
মেজর বেন ইয়ামিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটা গ্রুপ এগোলো পূর্ব দিকে। আর আহমদ মুসা এগোলো পশ্চিম দিকের পাহাড়ে উঠার জন্যে।
পশ্চিম দিকের পাহাড়ের পশ্চিম ঢালে যাবার পথে প্রথমেই আহমদ মুসার সামনে পড়ল টিলার মতো পাহাড়ের ছোট একটা শৃঙ্গ। শৃঙ্গটিকে পাশ কাটাবার জন্যে ক্রলিং করে শৃঙ্গের পাশ দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। আহমদ মুসা। শৃঙ্গের এ পাশটা পনের বিশ গজ উপরে উঠার পর আবার ঢালু হয়ে কিছুটা নেমে সমান্তরাল দক্ষিণে এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা পনের বিশ গজের দূরত্ব পেরিয়ে শৃঙ্গের পাশটা যেখান থেকে ঢালু হয়ে দক্ষিণে নেমে গেছে, সেখানে পৌঁছে ওপাশের দিকটা দেখার জন্যে ল্যান্ডিং-এর মতো জায়গাটায় উঠে বসতে গেল। মাথা তুলে শরীরটাকে ল্যান্ডিং-এর উপর স্থাপন করতে গিয়ে সামনে নজর পড়তেই আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা এবং সেই সঙ্গে মাথাটাকে পেছন দিকে ঠেলে দিল সে। শুনতে পেল বেশ কয়েকটা স্টেনগানের একসঙ্গে গর্জে উঠার শব্দ।
পেছন দিকে আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার দেহ। কয়েকবার ওলটপালট খেয়ে দেহটা এক জায়গায় এসে স্থির হলো। আহমদ মুসা অনুভব করল তার দেহে কোনো গুলি লাগেনি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল সে।
আহমদ মুসা বিস্মিত হলো, এদিকের উপত্যকার প্রবেশ পথের এত কাছে চলে এসেছে ওরা! এত দ্রুত আসল কি করে! এ পাশে এদিকের পথটা তাহলে ভালো। একঝলক ওদিকে তাকিয়ে আহমদ মুসারও এটাই মনে হয়েছে।
ওপর দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বুঝল, প্রায় আট দশ গজ সে গড়িয়ে পড়েছে। আহমদ মুসা দ্রুত উঠতে লাগল আবার। ওরা যদি এসে ল্যান্ডিংটা দখল করতে পারে, তাহলে বিপদ হবে। শৃঙ্গের এ পাশটার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে ওদের হাতে।
আহমদ মুসা দূরত্বটা দ্রুত কভার করে ল্যান্ডিং-এর ওপর দিয়ে মাথা তুলল ওপাশটা দেখার জন্যে।
এবারও ওদিক থেকে এল গুলির ঝাঁক। কিন্তু ততক্ষণে আহমদ মুসা একঝলক দেখেই মাথা নামিয়ে নিয়েছে।
ওদের দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসা। ওরা সাত-আটজন স্টেনগানধারী এগিয়ে আসছে। এই শৃঙ্গের দক্ষিণ ঢালে ওরা পৌঁছে গেছে। ওদেরকে উঠে এসে এই ল্যান্ডিং পেরিয়ে শৃঙ্গের উত্তর পাশ দিয়েই এগোতে হবে। এই শৃঙ্গের দক্ষিণ ঢাল আট-দশ গজ নিচে গিয়েই আটকে গেছে দক্ষিণ দিক থেকে আসা পাহাড়ের দেয়ালে।
ওরা কি করছে? উঠে আসছে উপরে? এ ভাবনা এসে প্রবেশ করল আহমদ মুসার মনে।
উপত্যকার পুব দিক থেকে স্টেনগানের গুলির শব্দ ভেসে এল। একযোগে বেশ কয়েকটি স্টেনগানের অব্যাহত গুলি। কান পেতে শুনে বুঝল আহমদ মুসা, গুলির উৎস উপত্যকার এদিকের প্রবেশ পথের কাছাকাছি জায়গায়। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা দুই দিক দিয়েই ওরা সমান গতিতে এগিয়ে এসেছিল পেছন দিক থেকে ঘিরে ফেলা ও আক্রমণের জন্যে। ওরা প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিল। আর মিনিট পাঁচেক সময় পেলেই উপত্যকার প্রবেশ পথ আটকে দিতে পারত ওরা। ওদিকের কি অবস্থা, মেজর বেন ইয়ামিনের দল ওদের সামলাতে পারছে তো?
আহমদ মুসা তার মনোযোগ ফিরিয়ে আনল সামনে ল্যান্ডিংটার ওপাশের ঢালে ওদের অবস্থানের দিকে। ভাবল, ওরা যদি এই শৃঙ্গের ঢালে এসে পৌঁছে থাকে, তাহলে ল্যান্ডিং-এর এপ্রান্তে বসলে ওরা দেখতে পাওয়ার কথা নয়। তাছাড়া ঝুঁকি নিতেই হবে।
আহমদ মুসা সংকীর্ণ ল্যান্ডিংটার এ প্রান্ত ঘেঁষে উঠে বসল। ওদিকের কাউকে নজরে পড়ল না। তাহলে ওরা সবাই শৃঙ্গের দক্ষিণ ঢালে এসে গেছে?
আহমদ মুসা সন্তর্পণে এবং দ্রুত ঢালের দিকে একবার উঁকি দিল। কাউকেই দেখতে পেল না আহমদ মুসা।
এবার আরও এগিয়ে এসে আরও ভালোভাবে দক্ষিণ ঢালে নজর বুলাল আহমদ মুসা। না, কেউ নেই! গেল কোথায় ওরা সকলে! ওরা কি এ পথ বাদ দিয়ে পেছনে হটে অন্য পথ ধরেছে? কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তা অবশ্যই সম্ভব নয়। তাহলে? তাহলে কি এ শৃঙ্গের সাথে এসে মেশা পাহাড়ের ঐ দেয়ালে কোনো গোপন পথ আছে? ওরা কি সেপথে শৃঙ্গের পশ্চিম পাশ ঘুরে তাকে পেছন দিয়ে আক্রমণ করতে চায়? এবং পৌঁছতে চায় উপত্যকার প্রবেশ পথে!
আহমদ মুসা দ্রুত লান্ডিং থেকে পাহাড়ের উত্তর দিকে সরে এল এবং কতকটা গড়িয়েই নিচে নামতে লাগল। শৃঙ্গের গোড়ায় পৌঁছে তার দেহ স্থির হবার সাথে সাথেই সামনের একটা বড় পাথরের ওপাশে পায়ের শব্দ শুনতে পেল।
দ্রুত আহমদ মুসা কাঁধের হোলস্টারে আটকে রাখা এম-১৬ বের করে পাথরের আড়াল নিয়ে তার প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছল।
পায়ের শব্দগুলো একদম কাছে এসে গেছে। ওদের ফিসফিসে একটা কণ্ঠ কানে আসছে। কেউ বলছে, ও ব্যাটা নিশ্চয় ঐ ল্যান্ডিং-এ আমাদের জন্যে ওঁৎ পেতে আছে।
আরেকজনের ফিসফিসে কণ্ঠ, সেটাই আমাদের জন্যে সুযোগ। এ পাথরের ওপারে গেলেই তাকে আমরা দেখতে পাব। সঙ্গে সঙ্গেই ওকে শেষ করে দিতে হবে।
ফিসফিসে কথা ওদের বন্ধ হয়ে গেল। পায়ের শব্দও যেন বন্ধ হয়ে গেল।
ওরা কি দাঁড়িয়ে গেছে? না সাবধানে-সন্তর্পণে এগোবার লক্ষণ এটা! আগেই আহমদ মুসার হাতে উঠেছিল এম-১৬ পাথরের সামনেটা লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসার চিন্তা শেষ হবার আগেই ওরা পাথরের সামনে চলে এল। এসেই ওরা শৃঙ্গের এপাশে ফিরে তাকিয়েছে। তাদের লক্ষ্যে উদ্যত আহমদ মুসার এম-১৬ রিভলবারও তারা দেখেছে। কিন্তু বেপরোয়া তাদের স্টেনগান টার্গেট করল আহমদ মুসাকে অস্বাভাভিক দ্রুতগতিতে।
ওদের সাবধান করার সুযোগ আহমদ মুসার হলো না। আহমদ মুসার উদ্যত এম-১৬ থেকে গুলির ঝাঁক এগিয়ে গেল ওদের দিকে। ওদের স্টেনগানের ব্যারেল উপরে উঠলেও গুলি করার সময় তারা পেল না।
গুলিতে ঝাঁঝরা সাতটি দেহ একসাথেই ভূমিশয্যা নিল। আহমদ মুসা গুলিবিদ্ধদের কাছে গেল। দেখল ওদের কেউ বেঁচে নেই।
এদিক থেকে নিশ্চিত হয়েই আহমদ মুসা ছুটল উপত্যকার পুবের পাহাড়ের দিকে। ওদিক থেকে মাঝে মাঝেই গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ওদিকে গিয়েছিল মেজর বেন ইয়ামিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটা দল।
উপত্যকার প্রবেশ পথ পেরিয়ে আহমদ মুসা ওপ্রান্তের পাহাড়ে গিয়ে পৌঁছল। এগোচ্ছিল আহমদ মুসা সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে।
এদিকের পাহাড়ের অবস্থান পশ্চিম দিক থেকে ভিন্ন।
পশ্চিম দিকে পাহাড়ের উপত্যকার দিকটা ঢালু, পূর্ব পাশটা খাড়া। এই খাড়া প্রান্তের মাত্র দুই জায়গায় ঢালু। এ প্রান্তের পাহাড়ের পাদদেশটা ছোট বড় টিলায় ভরা।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিল পাহাড়ের পাদদেশের টিলাগুলো ও পাহাড়ের খাড়া দেয়ালের মাঝখান দিয়ে পাহাড়ের দেয়ালের একদম গা ঘেঁষে সামনে এগোবার জন্যে। এতে ডান দিক নিরাপদ হবে এবং বাম পাশ এবং সামনের দিকেও ভালো নজর রাখা যাবে।
চলতে শুরু করেছে আহমদ মুসা।
মেজর বেন ইয়ামিনরা কোথায়? পশ্চিম পাশে আহমদ মুসা যা
দেখেছে, তাতে শত্রুরা খুব কাছেই কোথাও থাকার কথা। মেজর বেন। ইয়ামিনরাও তো আশেপাশেই থাকার কথা।
একটা বড় টিলার ওপারে পৌঁছে বাঁ দিকে নজর দিতেই দেখতে পেল একটা ফাঁকা জায়গা। তারপরেই একটা টিলা। টিলার উপর নজর পড়তেই দেখতে পেল দুটি লাশ। আঁৎকে উঠল আহমদ মুসা, ইউনিফরম দেখেই বুঝতে পেরেছে ওরা মেজর বেন ইয়ামিনের সাথী। তাহলে মেজর বেন ইয়ামিন কোথায়? দুজন সাথীর মৃত্যুর পর মেজর বেন ইয়ামিন নিশ্চয় সাবধান হয়েছে এবং ওদের গুলির টার্গেট না হয়ে ওদেরকেই টার্গেট করার চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা আরও একটা জিনিস বুঝল। সিকিউরিটির লোক দুজন। যেহেতু টিলার মাথায় গুলি খেয়েছে, তাই গুলি নিশ্চয় আরও উঁচু কোনো টিলা থেকে এসেছে। কিছুটা দক্ষিণে পাশাপাশি দুটি উঁচু টিলা দেখতে পেল আহমদ মুসা। হতে পারে ঐ টিলা থেকেই তারা গুলি করেছে। ওরা কি ঐ টিলাতেই আছে? তা থাকার কথা নয়। সামনে এগোবার কথা তাদের।
আহমদ মুসা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল না। টিলা ও পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পাহাড়ের দেয়ালের গা ঘেঁষে আবারও চলতে শুরু করল আহমদ মুসা।
উঁচু বড় দুটি টিলা তখন আহমদ মুসার বাম পাশে। এ দুটি টিলার উত্তর বরাবর নিচের স্থানটা বেশ ফাঁকা। তার পরেই জায়গাটা এবড়োথেবড়ো ও ছোটখাট টিলায় ভরা। আহমদ মুসা ভালো করে তাকাতে গিয়ে দেখতে পেল সেই উঁচু দুটি টিলার সংযোগস্থলে টিলা দুটিকে বিচ্ছিন্নকারী গিরিপথটার একটু উত্তরে ফাঁকা জায়গাটায় দুটি লাশ পড়ে আছে। লাশ দুটি নিশ্চিতভাবেই ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের। এর অর্থ ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের লোকরা এই উঁচু দুটি টিলার ওপাশ থেকে গিরিপথটা দিয়ে সামনে এগোবার সময় গুলির মুখে পড়ে এবং দুজনই নিহত হয়। এরপর ওরা পেছনে হটে যায়। ওরা কি তাহলে বড় দুটি টিলার আড়ালে আছে? আর মেজর বেন ইয়ামিনও মনে হচ্ছে এবড়োথেবড়ো ও টিলা-আকৃতির পাহাড়ের পাশের জায়গাটায় কোথাও লুকিয়ে আছে কিংবা বড় দুই টিলার ওদিকে এগোচ্ছে। দুইজন লোক মরেছে বলে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের লোকরা নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবে তা হতে পারে না। কি করছে ওরা? বড় দুই টিলার মাঝখান দিয়ে এগোতে চেয়েছিল, তা পারেনি। এখন তারা কোনো এক প্রান্ত বা ডান-বাম দুই প্রান্ত দিয়েই এগোতে পারে।
আহমদ মুসা এগোতে লাগল আগের সে পথ ধরেই, পাহাড়ের দেয়াল ডাইনে এবং বিক্ষিপ্ত টিলাগুলোকে বামে রেখে।
সামনেই একটা বিদঘুঁটে টিলার মুখোমুখি হলো আহমদ মুসা। টিলাটা পাহাড়েরই একটা অংশ। পাহাড়ের গা দিয়ে নেমে আসা। আগ্নেয়গিরির লাভা যেমন ঠান্ডা হয়ে পাহাড়ের গায়ে একটা বাড়তি অংশ এবং পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে টিলার সৃষ্টি করে, এটা ঠিক তেমনি। পাহাড় ও টিলার মধ্যকার এই সংযোগস্থলটা বেশ উঁচু এবং প্রশস্ত। এই সংযোগকারী অংশটা পূর্বের বড় টিলার সাথেও গিয়ে জোড়া লেগেছে। জোড়ার এই স্থানটাও বেশ উঁচু। আহমদ মুসাকে ওপারে যেতে হলে দুই বাধার যেকোনো একটাকে ডিঙাতেই হবে।
আহমদ মুসা তার চোখ পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসছিল। যেদিকে তার চোখ ঘুরে আসছিল, ঠিক সেদিক থেকে একটা ধাতব শব্দ ভেসে এল, যেন ফাপা ধাতব কিছু পাথরের সাথে বাড়ি খেল। অদ্ভুত সচেতন আহমদ মুসার নার্ভ। শব্দটা তার কানে যাওয়ার সাথে। সাথেই পেছন দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে নিজের দেহটাকে। তার পৃষ্ঠদেশটা মাটি ছোবার সাথেই তার ডান হাতের এম-১৬ টার্গেটে উঠে এসেছে, বেরিয়ে গেছে এক ঝাক গুলি।
টিলা ও পাহাড়ের সংযোগকারী ল্যান্ডিংটার উপর হাঁটু গেড়ে একজন। লোক বসে আছে। তার কাঁধে ঝুলানো স্টেনগান এবং হাতে উদ্যত রিভলবার। ঐ রিভলবার থেকেই গুলি এসেছে। তার দেহটা ছিটকে না। পড়লে তার মাথাটা গুড়ো হয়ে যেত।
আহমদ মুসা হাঁটু গেড়ে বসে থাকা গুলিবর্ষণকারী লোকটাকে লক্ষ্য করেই গুলি ছুঁড়েছিল। কিন্তু গুলি করার পরমুহূর্তেই লোকটির পাশে উঠে এল আরও চারজন। লোকটির সাথে সাথে তারাও অব্যাহত গুলির ঝাঁকের মধ্যে পড়ে গেল। প্রায় একসাথেই পড়ে গেল পাঁচটি লাশ।
শুয়ে থেকেই আরও কিছু সময় অপেক্ষা করল আহমদ মুসা। কোনো দিক থেকেই কারো কোনো সাড়া পেল না।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। এগোলো টিলা ও পাহাড়ের সংযোগকারী ল্যান্ডিংটার দিকে।
ল্যান্ডিং-এ উঠল আহমদ মুসা। টিলার ওপাশে উঁকি দিল। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। কোথাও কাউকে দেখল না। মেজর বেন ইয়ামিন কোথায়? তার তো এই টিলার সারিটার আশেপাশেই থাকার কথা। _ আহমদ মুসা টিলার দক্ষিণ পাশে নামতে যাচ্ছিল। এ সময়। ভূমধ্যসাগরীয় এক ধরনের সি-গালের ডাক শুনতে পেল। পর পর তিন বার।
খুশি হলো আহমদ মুসা। রত্নদ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনীর নিজস্ব সংকেত এটা। এই সংকেতের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য আদান-প্রদান করা হয়। একে অপরের অবস্থান জানায় এ সংকেতের মাধ্যমে।
সংকেতটা যে মেজর বেন ইয়ামিনের, এ ব্যাপারে নিশ্চিত আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা মেজর বেন ইয়ামিনের সংকেতের জবাব দিল। জানাল। তার নামের আদ্যাক্ষর। তার সাথে জানাল অল ক্লিয়ার।
অল্পক্ষণের মধ্যেই মেজর বেন ইয়ামিন এল আহমদ মুসার কাছে। জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, স্যার দুজন সাথীকে হারিয়ে আমি সংকটে পড়েছিলাম। লুকোচুরির এ যুদ্ধ সহজ নয় স্যার। আমার মন বলছিল আপনি আসবেন। বুঝতে পেরেছিলাম ওদিকের যুদ্ধ শেষ হয়েছে।
মেজর, তুমি জেনারেল রিদাকে জানাও এ দিকের খবর। দুপাশের লাশগুলো সংগ্রহ করতে হবে। আমরা আসছি। বলল আহমদ মুসা।
মেজর বেন ইয়ামিন সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইল করল জেনারেল রিদাকে। বলল, স্যার ওপারে সবাই মারা পড়েছে। আমাদের এ পাশে আমাদের দুজন নিরাপত্তা সেনা মারা পড়েছে। স্যার এ পাশে এসেছেন। এ দিকের শত্রু সবাই মারা পড়েছে। আমরা আসছি। স্যার বললেন, লাশগুলো নিয়ে। যেতে হবে।
স্যারকে অশেষ ধন্যবাদ আমার, তোমাকেও। আমি ব্যবস্থা করছি লাশ নেয়ার। ওপার থেকে বলল জেনারেল রিদা।
মোবাইলের কল অফ করে বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, কর্নেল জেনারেল স্যার আপনার শুকরিয়া আদায় করেছেন। তিনি লাশ নেয়ার ব্যবস্থা করছেন।
ধন্যবাদ মেজর। চল আমরা যাই। বলল আহমদ মুসা।
স্যার আমরা এদের অস্ত্রগুলো নিতে পারি। মেজর বেন ইয়ামিন বলল।
না মেজর বেন ইয়ামিন, যা যেমন আছে, তেমনি থাকা উচিত। বলল আহমদ মুসা।
চলতে শুরু করল আহমদ মুসা। তার সাথে মেজর বেন ইয়ামিনও।
স্যার, অনুমতি দিলে একটা কথা বলতে চাই। মেজর বেন ইয়ামিন বলল।
অনুমতি কেন, বল মেজর। বলল আহমদ মুসা।
স্যার আমি শুনেছিলাম আপনি অন্য ধর্মকে দেখতে পারেন না, বিশেষ করে আপনি নাকি চরম ইহুদি বিদ্বেষী। আমি ইতালিতে ট্রেনিং-এ থাকা কালে কয়েকজন ইসরাইলি আর্মি অফিসারের সাথে পরিচয় হয়েছিল। একদিন কি এক প্রসঙ্গে আপনার কথা উঠেছিল। সেই ইসরাইলি আর্মি অফিসারসহ আরও কয়েকজন এই কথা বলেছিল। কিন্তু গত কয়েক দিনে আপনাকে দেখে, আপনার কথা শুনে আমার সে রকম মনে হয়নি। আমার এই রত্নদ্বীপ ইহুদি, খৃস্টান, মুসলমান মিলে শাসন করছে। আপনি এই রাষ্ট্রব্যবস্থার যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনি এ রাষ্ট্রব্যবস্থা রক্ষার জন্যে কাজও করছেন। আমার মতো ইহুদি অফিসারদের সাথে আপনি শুভেচ্ছাকামী, স্নেহপরায়ণ ভাইয়ের মতো ব্যবহার করেছেন। মেজর বেন ইয়ামিন বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, তারা যা বলেছে, তার জবাব তুমি তো দিয়ে দিলে। আসল ব্যাপার হলো বেন ইয়ামিন। মুসলমান, খৃস্টান, ইহুদি যেই অপরাধ করুক, আমি সেই অপরাধের বিরুদ্ধে। আমি কোনো ধর্ম, কিংবা ধর্ম বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে নই। সত্যিকার ধর্মভিরু একজন মুসলমান, একজন খৃস্টান ও একজন ইহুদির পরস্পরের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ থাকে না, থাকতে পারে না। আমি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বড় বড় ঘটনায় ইহুদিদের সহযোগিতা পেয়েছি। ইহুদিদের ক্রাইমের বিরুদ্ধে ইহুদিরাই আমাকে সহযোগিতা করেছে। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, ওরা আপনাকে মুসলমানদের বন্ধু ও সাহায্যকারী হিসেবে চিত্রিত করে। মেজর বেন ইয়ামিন বলল।
দেখ মেজর, নিজের প্রতি ভালোবাসা মানুষের সহজাত। এই ভালোবাসা যদি অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে এই ভালোবাসায় কোনো দোষ নেই। জাতির ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। নিজেকে ভালোবাসা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি নিজের জাতিকে ভালোবাসাও খুবই স্বাভাবিক। নিজের জাতির প্রতি ভালোবাসা যদি অন্য জাতির ক্ষতি না করে, তাহলে সেই ভালোবাসা অন্যায় নয়। আমি আমার মুসলিম জাতিকে ভালোবাসি। দুনিয়ায় আজ তারা সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি। দীর্ঘ পরাধীনতার ধ্বংস-নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভের পর উঠে দাঁড়াবার আগেই ভেতর-বাইরের নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে তাদের স্বাধীনতা জড়িয়ে পড়েছে। তার উপর শান্তি, সুবিচার, সহমর্মিতার ধর্ম ইসলামের উপর সন্ত্রাসের অভিযোগ চাপানো হচ্ছে এবং মুসলমানরা নানাভাবে হত্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই অবস্থায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা আমি করি, এটা অন্য ধর্ম বা জাতির বিরুদ্ধে নয়। এতে কারও কোনো আপত্তি উঠার কথা নয়। আমার কাজ সব মানুষের জন্যে। আমি সব মানুষের অশ্রু মুছাতে চাই। মুসলমানদের চোখে অশ্রু বেশি বলেই তাদের অশ্রু মুছানো সবার নজরে পড়ে। কোনো দুর্গত, নির্যাতিত মানুষ যখন আমার চোখে পড়ে, তখন তার জাতি, ধর্ম পরিচয় আমি দেখি না, মুসলিম দেশ, অমুসলিম দেশ বলেও আমি কোনো পার্থক্য করি না। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। রত্নদ্বীপের ক্ষেত্রে আমরা আপনাকে মুসলমান, খৃস্টান, ইহুদি সবার বন্ধু হিসাবে দেখছি। ঈশ্বর তার সব মঙ্গল আপনাকে দান করুন। মেজর বেন ইয়ামিন বলল।
আহমদ মুসারা পৌঁছে গেল উপত্যকার প্রবেশ মুখে।
গাড়ি থেকে নেমে সবাই দাঁড়িয়েছিল।
সবার আগে দাঁড়ানো ছিল জেনারেল রিদা। স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে। বলল, স্যার প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকলেই আপনার শুকরিয়া আদায় করেছেন।
শুধু আমাকে কেন, আমাদের টিমের সম্মিলিত কাজের ফল এটা। আর জেনারেল রিদা, আসল কাজই তো আমাদের বাকি। আমরা এখনও তো ঘাঁটিতেই পৌঁছতে পারলাম না।
সম্ভবত আর কোনো বাধা নেই স্যার আমাদের সামনে। জেনারেল রিদা বলল।
বিস্ফোরকগুলো তো সরিয়েছেন। কি ধরনের বিস্ফোরক ছিল ওগুলো, দূরনিয়ন্ত্রিত? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ওগুলো দূরনিয়ন্ত্রিত ছিল স্যার। আপনি কি করে আন্দাজ করলেন? জেনারেল রিদা বলল।
চলমান কোনো কিছু ধ্বংস করার জন্যে দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা বেশি কার্যকরি। আসুন এবার আমরা সামনের কথা ভাবি। লাশগুলো কখন আমরা হ্যান্ডওভার করতে পারব? আমরা কি একজনকে রেখে চলে যেতে পারি না? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, ওরা এখনি এসে পড়বে। আমি ওদের জন্যে ওয়েট করতে চাই আরও একটি কারণে। আমাদের টিমে আরও কয়েকজন সদস্য বাড়াতে চাই স্যার। জেনারেল রিদা বলল।
ধন্যবাদ জেনারেল রিদা। আপনি ঠিক চিন্তা করেছেন। দুজন সদস্য আমাদের কমেছে। কয়েকজন সদস্য আমরা বাড়াতে পারি। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আপনি কি ভাবছেন? ওরা ওদের ঘাঁটি জাদোক-এ কি রকম প্রতিরোধ ব্যবস্থা রেখেছে? জেনারেল রিদা বলল।
ওরা ওদের চূড়ান্ত প্রতিরোধের ব্যবস্থা এখানেই করেছিল বলে আমার মনে হয়। ওদের ঘাঁটি জাদোকে ওরা তেমন জনশক্তি রেখেছে বলে যুক্তি বলে না। তবে ওদের ঘাঁটিকে রক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখেনি তা ঠিক নয়। সেই সাথে এটাও বাস্তবতা যে, এখানকার বিপর্যয়ের খবর ওদের ঘাঁটিতে পৌঁছলে ওরা হতাশ হয়ে পড়ার কথা। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে স্যার আমাদের সব অবস্থার জন্যে তৈরি থাকতে হবে। জেনারেল রিদা বলল।
জেনারেল রিদার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই দুটি গাড়ি ছুটে আসতে দেখা গেল। নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি।
ওরা এসে গেছে স্যার। জেনারেল রিদা বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
ধন্যবাদ জেনারেল রিদা। ওদের সাথে তাড়াতাড়ি কাজটা সেরে নিন।
গাড়ি দুটি এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসাকে ইয়েস স্যার বলে জেনারেল রিদা এগোলো গাড়ির দিকে। গাড়ি থেকে নেমে কয়েকজন অফিসারও ছুটে এল।
.
উঁচু একটা অধিত্যকায় গাড়ি উঠতেই জাদোক উপত্যকা নজরে এল আহমদ মুসার। জেনারেল রিদা বলেছিল, উঁচু যে অধিত্যকা সামনে দেখছেন স্যার, ওখানে উঠলে যে ল্যান্ডস্কেপ আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে ওটাই জাদোক উপত্যকা।
সুন্দর জাদোক উপত্যকা। উঁচু, স্টিপ পাহাড়ের পাদদেশে সুন্দর এই উপত্যকা। প্রাচীরের মতো পাহাড় দিয়ে ঘেরা।
জাদোক উপত্যকায় প্রবেশের মুখ একদম সামনে। প্রবেশ পথ একেবারেই প্রাকৃতিক। উত্তর পাশের পূর্বের অংশের এক জায়গায় প্রাচীরসম পাহাড়ের দুই প্রান্ত এসে থেমে গেছে। মাঝখানে ৫০ ফিটের মতো জায়গা উন্মুক্ত। সেই উন্মুক্ত স্থানও খুব এবড়োথেবড়ো গাড়ি ঢোকার মতো নয়।
আহমদ মুসাদের গাড়ি সেই এবড়োথেবড়ো উপত্যকার মুখের সামনে এসে পৌঁছল।
আহমদ মুসা জাদোক উপত্যকার প্রবেশ পথের দিকে তাকিয়েছিল। প্রবেশ পথের সামনে অনেকগুলো শুকনো পাতা পড়েছিল। পাতাগুলে এমনভাবে পড়ে আছে যেন সাজানো। গোটা প্রবেশ পথ এলাকায় পাতাগুলো পড়ে আছে। মাঝে মাঝে ফাঁক থাকলেও যেখানে পাতাগুলো আছে, তা সাজিয়ে রাখার মতো। আহমদ মুসা দেখেছে প্রবেশ পথের আশেপাশে কোনো গাছ নেই। আর আশেপাশে ঐভাবে কোনো পাতাও পড়ে থাকতে দেখলো না।
ভ্রূকুঞ্চিত হচ্ছিল আহমদ মুসার। বলল ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে, মেজর গাড়ি উপত্যকার প্রবেশ পথের সামনে নিও না, বিপরীত দিকে রাস্তার বাম পাশে দাঁড় করাও।
মেজর বেন ইয়ামিন রাস্তার বামপাশে নিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল।
স্যার, আপনি কিছু সন্দেহ করছেন? জিজ্ঞাসা জেনারেল রিদার।
গেটের সামনে দেখ জেনারেল রিদা। গেটের আশেপাশে কোনো গাছ। নেই, পাতাগুলো তাহলে কোখকে এল? পাতাগুলো সাজিয়ে রাখার মতো কেন? বলল আহমদ মুসা।
কর্নেল জেনারেল রিদা এবং মেজর বেন ইয়ামিন দুজনেই তাকাল গেটের দিকে। তারা তাকিয়ে আশপাশটাও দেখল। ধীরে ধীরে তাদের মুখেও বিস্ময় ফুটে উঠল।
ঠিক স্যার, পাতাগুলো এখানে থাকা স্বাভাবিক নয়। আর পাতাগুলো সাজিয়ে রাখা বলেই মনে হচ্ছে। এর অর্থ কি স্যার? আপনি কি মনে করছেন? জেনারেল রিদা বলল।
আমার মনে হচ্ছে পাতা দিয়ে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে কি ওখানে বিস্ফোরক পাতা রয়েছে স্যার? জিজ্ঞাসা জেনারেল রিদার।
ঠিক ধরেছেন জেনারেল রিদা।
আমার হাতঘড়ির ইন্ডিকেটর এটাই বলছে। সন্দেহ হবার পর হাতঘড়ির বিস্ফোরক ডিটেক্টর অপশন অন করে দিয়েছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে কি স্যার ঘাঁটিতে ওরা কেউ নেই? জেনারেল রিদা বলল।
না থাকাই স্বাভাবিক। পথের ঐ বিপজ্জনক উপত্যকায় বাধা দেয়াই ছিল ওদের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর মৃত্যুকে স্বাগত জানানোর জন্যে ঘাঁটিতে থাকাকে তারা যুক্তিযুক্ত মনে করেনি। আর ঘাঁটিটি রত্নদ্বীপ সরকারের কাছে ধরা পড়ে যাবার পর একে রক্ষা করার কোনো প্রয়োজন তাদের নেই। তারা চেয়েছিল তোমাদের, তার সাথে আমার, সর্বোচ্চ ক্ষতি করতে। জাদোকের প্রবেশ পথে তারা বিস্ফোরক পেতে রেখে আমিসহ আমাদের গোটা টিমকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। পাতাগুলো সাজানোর দিকেই দেখুন। আমাদের গাড়ি দুটি প্রবেশ পথের মুখে পাশাপাশি দাঁড়াক কিংবা আগে-পিছে দাঁড়াক তা বিস্ফোরণের আওতার বাইরে থাকবে না। বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করে মুহূর্তকাল থেমেই আবার বলল, কি ঘটত দেখুন।
আহমদ মুসা তার হাতঘড়ির পাওয়ারফুল ডেটনেটরে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গেই জাদোকের প্রবেশ পথের গোটা এলাকা বিস্ফোরণে উড়ে গেল। মাটির যে কম্পন হলো, তাতে আহমদ মুসাদের গাড়ি দুটিও প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।
জেনারেল রিদা ও মেজর বেন ইয়ামিনের চোখে-মুখে প্রবল উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ল। তাদের দুই গাড়ি জাদোকের প্রবেশ পথের রাস্তায় দাঁড়ালে বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।
আহমদ মুসাও বিস্ফোরণ দেখে বিস্মিত হয়েছিল। এত প্রচণ্ড শক্তির বিস্ফোরক সেখানে পাতা আছে, আহমদ মুসার ভাবনাতেও আসেনি। এক ভয়াবহ ধ্বংস থেকে বাঁচানোর জন্যে আহমদ মুসা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল।
আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। তিনি দয়া করে আপনাকে আমাদের ত্রাতা হিসাবে পাঠিয়েছেন। পাতাগুলো আমাদেরও চোখে পড়েছিল স্যার, কিন্তু ওগুলোর মধ্যে আমি কোনো অর্থ খুঁজে পাইনি। আমাদের মতো মানুষদের জন্যে আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন। জেনারেল রিদা বলল। আবেগে রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল জেনারেল রিদার কণ্ঠ।
আহমদ মুসা জেনারেল রিদার পিঠ চাপড়ে বলল, ওদিকে আপনি ভালোভাবে তাকাননি তাই বুঝতে পারেননি। যাক। চলুন আমরা শূন্য। হলেও ঘাঁটিটা ভালো করে দেখি। কিছু পেয়েও যেতে পারি, যা পরবর্তী অভিযানে আমাদের কাজে লাগবে। গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা।
জেনারেল রিদাও নামল। মেজর বেন ইয়ামিনও নেমে পড়েছে।
জেনারেল রিদা বেন ইয়ামিনের দিকে চেয়ে বলল, মেজর তুমি সিকিউরিটির এক অংশকে গেটে রেখে, অবশিষ্টদের নিয়ে ভেতরে এস।
ঘাঁটিতে বড় কোনো স্থাপনা ছিল না। পাহাড় ও গাছ-গাছড়ার আড়াল নিয়ে তৈরি কতকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একতলা ঘর। পাহাড়ের। গায়ে কিছু গুহার মতো স্থানকে বাসগৃহ ও অস্ত্রাগারে পরিণত করা হয়েছিল।
শুরুতেই গোটা এলাকা দেখে নিল আহমদ মুসারা। কেউ কোথাও নেই। তৈজসপত্রসহ ব্যবহার্য সব জিনিসই পড়ে আছে। সম্ভবত শুধু অস্ত্রই নিয়ে গেছে, আর কিছু নয়। এটা পরিষ্কার যে, তারা তাড়াহুড়া করে ঘাঁটি ত্যাগ করেছে। দুএক জায়গায় শুকাতে দেয়া কাপড়ও তারা দেখল। একটা ঘরে আহমদ মুসা টেবিল ক্লথের আড়ালে থাকা টেবিলের একটা ড্রয়ার তালাবদ্ধ দেখতে পেল। তাড়াহুড়ার মধ্যে ওরা নিশ্চয় ড্রয়ারটা দেখতে পায়নি টেবিল ক্লথে ঢাকা থাকার কারণে। আহমদ মুসা গুলি করে ড্রয়ারের তালা ভেঙে ফেলল। ভেতরে পেল পকেট সাইজের একটা কম্পিউটার নোটবুক এবং একটি মানি ব্যাগ। মানিব্যাগ খুলে বড় বড় কিছু ইউরো নোটের কারেন্সি পেল এবং পেল চিরকুট জাতীয় কিছু কাগজপত্রও। আহমদ মুসা টাকাগুলো জেনারেল রিদার হাতে দিয়ে বলল, এগুলো আপনি রাখুন, আপনাদের রীতি অনুসারে ব্যবস্থা করবেন। আর আহমদ মুসা কম্পিউটার নোটবুক এবং চিরকুট সমেত মানিব্যাগ। জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিল।
ঘাঁটির ঠিক মাঝ বরাবর পাহাড়ের একটা গুহাঘর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে এগোবার সময় পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে থাকা একটা বড় কালো পাথর আহমদ মুসার দৃষ্টিতে পড়ল। পাথরের উপরের দিকটা গম্বুজ আকৃতির। গম্বুজাকৃতিটা খুব স্পষ্ট নয়, অনেকটাই এবড়োথেবড়ো। কিন্তু তবু বুঝা যায় আকৃতিটা গম্বুজের। আহমদ মুসা পাথরটিকে ভালো করে দেখতে গিয়ে বুঝল, গম্বুজের আকৃতিটা অবশ্যই প্রাকৃতিক নয়। পাথর কেটেই ওটা তৈরি করা হয়েছে এবং এবড়োথেবড়ো অবস্থাটাও আহমদ মুসার কাছে মনে হলো ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। আহমদ মুসা পাথরটির আরও ঘনিষ্ঠ হলো আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, সত্যিই কি পাথরটিকে কেউ গম্বুজাকৃতি দিয়েছে। পাথরটির উপর ভালোভাবে নজর বুলাতে গিয়ে আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে দেখল পাথরের গায়ে একটা কালো রেখাচিত্র। হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল রেখাচিত্র নয়, সুক্ষ্মভাবে খোদাই করে তৈরি। আরও বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, খোদাই করে তৈরি রেখাচিত্রটি হুবহু কাবা শরিফের লে আউট। কাবা শরিফের লে-আউট! দুর্গম পাহাড়ের একটা নির্জন * উপত্যকার এত গভীরে একটা পাথরের গায়ে কাবা শরীফের লে-আউট এলো কি করে! আহমদ মুসা খোদাই-এর উপর হাত বুলিয়ে দেখেছে খোদাইয়ের পর পাথরের গায়ে যে তীক্ষ্ণতা থাকে, সেটা নেই, শুধু তাই নয়, পাথরের গা যেন অনেকখানি ভরাট হয়ে উঠেছে। এর অর্থ বহু শতাব্দীর স্পর্শ এর উপর দিয়ে গড়িয়ে গেছে। আহমদ মুসা তাকাল গম্বুজাকৃতিটার শীর্ষদেশটায়। ওখানে গুচ্ছাকার কিছু তার নজরে পড়ল। তাকিয়ে দেখতে পেল গুচ্ছাকার কিছু জিনিসটা একটা আরবি ক্যালিওগ্রাফি। ক্যালিওগ্রাফিটা জটিল জিওমেট্রিক ভারসাম্যে তৈরি। আরবি ভাষা সম্পর্কে জানা না থাকলে এর পাঠোদ্ধার সম্ভব নয়। ক্যালিওগ্রাফিটিতে একটা শব্দই লেখা, সেটা মাশরিক, পড়ল আহমদ। মুসা। মাশরিক অর্থ পূর্ব। ক্যালিওগ্রাফিটির মাথার উপর আরবিতে ৬ অংক লেখা। ছয়ের উপর একটা চিত্র, একটা দণ্ডের উপর পাশ ও ঊর্ধ্বমুখী পাঁচটি বাহু। সঙ্গে সঙ্গেই অর্থটা আহমদ মুসার মনে উদয় হয়ে গেল। পূর্ব দিকে ছয় হাত দূরের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ছয় হাত দূরে কি? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল রত্নদ্বীপে লুকানো গুপ্তধনের কথা। ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের ফাইল থেকে দ্বীপের চার স্থানে এবং জাহরার তথ্য থেকে এক স্থানে, মোট পাঁচ স্থানে গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার বিষয় জানা গেছে। তাহলে এই উপত্যকা ও পাহাড় এই পাঁচ গুপ্তধনভাণ্ডারের কোনো একটির স্থান? যেহেতু এখানে কাবার স্কেচ এবং আরবি বর্ণমালার সংকেত পাওয়া গেছে, তাই এখানে লুকানো রয়েছে হয় ভূমধ্যসাগরের অবিস্মরণীয় এডমিরাল খয়ের উদ্দিন বাবারোসার গুপ্তধন, নয়তো স্পেনের শাহমাতা আয়েশার গুপ্তধন। যার সন্ধানে জাহরা রত্নদ্বীপে এসেছে, ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা পাহাড়ের এই অংশটাকে ওয়াইড রেঞ্জে দেখার জন্যে অনেকখানি পেছনে সরে এল।
পাহাড়ের পাদদেশসহ শীর্ষ পর্যন্ত আহমদ মুসার নজরে এল। শীর্ষদেশ থেকে খাড়াভাবে নেমে এসেছে পাহাড়টি। মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে আরেকটা পাহাড় শৃঙ্গের পেছন দিয়ে নিচে নেমে গেছে। মাঝের পাহাড় শৃঙ্গটা যেন পেছনের উঁচু পাহাড়ের কোলে বসে আছে। বড় পাহাড়ের কোলে বসা মাঝের পাহাড়টিও খাড়াভাবে নিচে নেমে এসেছে। ঠিক গ্রীন লাইনের উপরে পাহাড়ের গোলাকার এবং লম্বা একটা ধাপ আড়াআড়িভাবে পাহাড়ের গায়ে আটকে আছে। এর উত্তরের মাথাটা একটু উঁচু, দক্ষিণের অংশটা কিছুটা নিচু। প্রথম দৃষ্টিতেই আহমদ মুসার মনে হলো মায়ের কোলে যেন শিশু এ চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল জাহরার ডকুমেন্টে পড়া একটা কবিতার কথা:
পাহাড়ের কোলে পাহাড়,
তার-কোলে সন্তান,
দেয়াল করবে খান খান।
কবিতাটি রত্নদ্বীপে লুকিয়ে রাখা গ্রানাডার শেষ সুলতানের মা। শাহমাতা বেগম আয়েশার গুপ্তধনভাণ্ডারের একটা সংকেত। তার মানে শাহমাতা বেগম আয়েশার ধনভাণ্ডার এখানে লুকানো আছে! হঠাৎ এই প্রাপ্তিতে আনন্দে নেচে উঠল আহমদ মুসার মন। তার সাথে একটা আবেগও তাকে এসে ঘিরে ধরল। স্পেনের হতভাগ্য সুলতানের মায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময় আল্লাহ এই সময় নির্ধারণ করেছেন। তার মতো এক নগণ্য বান্দার হাতে তাহলে শাহমাতার ধনভাণ্ডারের বহু শতাব্দীর ঘুম ভাঙবে! সেই স্পেন নেই। সেই স্পেনের গৌরবদীপ্ত সালতানাত নেই। তাদের অর্থভাণ্ডারের একটা অংশ এখানে গচ্ছিত আছে। যে অর্থ সেদিন। পতন রোধে কোনো কাজে লাগেনি, স্পেন থেকে সরানো সেই ধনভাণ্ডার শাহমাতা এখন কোনো কাজে লাগাতে চান! বর্তমানকে রক্ষার জন্যে শাহমাতা সেদিন কিছুই করতে পারেননি, তাই বোধ হয় ভবিষ্যত রক্ষার জন্যে কিছু একটা তিনি ভেবেছেন, এটা ভাবতে খুবই ভালো লাগল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার চোখ দুটি পাহাড়ের দিকে নিবদ্ধ থাকলেও মনটা তার হারিয়ে গিয়েছিল অনেক দূরের অতীতে।
কর্নেল জেনারেল রিদা, তার সাথে মেজর বেন ইয়ামিন ওদিক থেকে এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। আহমদ মুসার তন্ময়তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা সময় অপেক্ষা করে বলল, স্যার, আমাদের সার্চকে কি আমরা শেষ হয়েছে বলতে পারি?
সম্বিৎ ফিরে পেল আহমদ মুসা। তাকাল জেনারেল রিদার দিকে। বলল, সব ঘর, পাহাড়ের সব গুহাঘর তো আমরা দেখেছি না?
হ্যাঁ, স্যার। জেনারেল রিদা বলল।
আর কিছু পাওয়া গেল, উল্লেখযোগ্য? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
কিছু অস্ত্র পাওয়া গেছে, ওরা সব অস্ত্র নিয়ে যেতে পারেনি। জেনারেল রিদা বলল।
অস্ত্রগুলো আলাদা রাখতে হবে। কান্ট্রি অব অরিজিনের মার্কিং পাওয়া যাবে অস্ত্রগুলোতে। বিষয়টা জরুরি। বলল আহমদ মুসা।
অবশ্যই স্যার। এখানে পাওয়া সবকিছু আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হবে।
একটু থামল জেনারেল রিদা। বলল আবার, আরও দুটি টিম আসতে বলেছি স্যার। একটা টিমকে এখানে মোতায়েন রাখা হবে। আরেকটা টিম অস্ত্র-শস্ত্র, জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্যে লাগবে।
ধন্যবাদ জেনারেল রিদা। ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্তত কয়েকদিন কিছু প্রহরী এখানে থাকা দরকার, ঘাঁটিটির সম্পূর্ণ ডিসম্যানটল হওয়া পর্যন্ত। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে তাই হবে স্যার। জেনারেল রিদা বলল।
বাইরে রাস্তায় গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ হলো।
স্যার, আমাদের টিম দুটো এসে গেছে। জেনারেল রিদা বলল।
গুড। আমাদের ফেরা সম্পর্কে আপনার পরিকল্পনা কি? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আমি ও আপনি এখনি চলে যাব। মেজর বেন ইয়ামিনের নেতৃত্বে অন্যেরা পরে আসবে। অনেক কিছু পাওয়া গেছে। ওগুলো লোড। করতে সময় লাগবে। মেজর আমর আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ঘাঁটিটির পাহারার জন্য একটা টিম থেকে যাবে।
কথা শেষ করে মুখ ফিরিয়ে গাড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, স্যার, আপনি গাড়িতে বসুন। আমি মেজর বেন ইয়ামিন ও আমর আবদুল্লাহদের সাথে কয়েকটা কথা বলে আসছি।
জেনারেল রিদা এগোলো মেজর বেন ইয়ামিন ও মেজর আমর আবদুল্লাহর দিকে।
আর আহমদ মুসা এগোলো গাড়ির দিকে।
৪
কেবিনে আহমদ মুসাকে ঢুকতে দেখে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল সারা সোফিয়ার।
বেশ বড়সড় কেবিন। কেবিনের সাথে অ্যাটাস্ট নার্সের একটা ছোট্ট কেবিন। গেস্টের জন্যেও আলাদা কেবিন আছে।
আহমদ মুসার অনুরোধে সরকার সারা সোফিয়ার জন্যে ভিআইপি কেবিনের ব্যবস্থা করেছে। সারা সোফিয়ার নিরাপত্তার দিকটা বিবেচনা করেই এই অনুরোধ করেছিল আহমদ মুসা। ৩ বেডের কাছাকাছি পৌঁছে আহমদ মুসা বলল, কেমন আছেন মিস সারা সোফিয়া?
খুব ভালো স্যার। ভিআইপি কেবিনে আছি সাধারণ একজন মানুষ। আমি। খারাপ থাকতে পারি? বলল সারা সোফিয়া।
কিন্তু আপনাকে দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না। অনেকখানি অবসাদগ্রস্ত মনে হচ্ছে আপনাকে। বলল আহমদ মুসা।
ওটা মনের রোগ। আমি দৈহিকভাবে খুব ভালো আছি। সারা সোফিয়া বলল।
আপনি কি কোনো কিছু খুব বেশি করে ভাবছেন? বলল আহমদ মুসা।
না, ভাবনা, ছেড়ে দিয়েছি। ভাবনা তখন থাকে, যখন আশা অবশিষ্ট আছে দেখা যায়। সারা সোফিয়া বলল।
কথা শেষ করেই মুহূর্ত থেমে সারা সোফিয়া বলে উঠল, স্যার, আমি মনে করেছিলাম, আপনি আরও আগে আসবেন। আপনার অপেক্ষা করছিলাম আমি।
হ্যাঁ, একটু দেরি হলো। একটা জরুরি কাজে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আপনার সাথে কথা বলা খুব জরুরি। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, সেদিন আপনি একটা কথা বলেছিলেন। আমার অপেক্ষা ছিল সে কারণেই। বলুন স্যার, আপনি কি বলতে চান। কি জানতে চান। আপনি? সারা সোফিয়া বলল।
বিশেষ কিছু নয়। আপনার সম্পর্কে সব জানা আমার হয়নি। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার সাথে সারা সোফিয়ার কেবিনে প্রবেশ করেছিল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হামযা আমির। সে একটা সিঙ্গেল সোফা টেনে এনে সারা সোফিয়ার বেডের কাছে দিল।
ধন্যবাদ মি. হামযা। এ কাজের জন্যে আপনি অ্যাটেনড্যান্টকে ডাকলেই পারতেন। বলল আহমদ মুসা।
আপনার সেবা করার জন্যে এটুকু সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য স্যার। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হামযা আমির বলল।
ধন্যবাদ। মানুষের জন্যে কিছু করতে পারা আমারও খুব প্রিয়। ধন্যবাদ। বলল আহমদ মুসা।
ওয়েলকাম স্যার। আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি। হামযা আমির বলল।
আহমদ মুসা বসল সোফায়।
নার্স বালিশে ঠেস দিয়ে রসিয়ে গেছে সারা সোফিয়াকে।
মিস সারা সোফিয়া, আমরা আপনার সাহায্য চাই। বলল আহমদ মুসা।
আমি আপনাদের কি সাহায্য করতে পারি? পারলে খুশি হবো। বলুন। আসলেই স্যার আজ আর আমার পাবার কিছু নেই, দেবারও কিছু নেই। এরপরও যদি কিছু থাকে বলুন। সব বলব, সব করব স্যার। সারা সোফিয়া বলল।
ধন্যবাদ সারা সোফিয়া।
একটু থামল আহমদ মুসা। আবার শুরু করল, আপনাকে যারা রত্নদ্বীপে নিয়ে এসেছিল, তাদের একটা লক্ষ্য ছিল আপনাকে দিয়ে আমাকে হত্যা করানো। কিন্তু আমাকে হত্যা করে ওরা রত্নদ্বীপে কি করতে চায়? বলল আহমদ মুসা।
আমাকে যে কাজ ওরা দিয়েছিল, তার বাইরে ওদের কাজ, লক্ষ্য ইত্যাদি সম্পর্কে সিসিলিতে থাকতে আমি কিছুই জনতাম না। এখানে এসে দিন পনের আমাকে বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে, অনেকের সাথে মিশতে হয়েছে। তাতে কিছু কিছু বিষয় জানতে পেরেছি। আমি ওদের কানাকানির কথা থেকে জেনেছি, এখানে অনেক গোপন ধনভাণ্ডার লুকানো আছে, সেই ধনভাণ্ডার তারা হাত করতে চায়। এই কাজ তারা যাতে নিরপদ্রবে করতে পারে তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। এই কথা আমি ওদের অনেকের কাছে শুনেছি। আর একটা কথা শুনেছি। কথাটা রাজনৈতিক। রত্নদ্বীপে ওদের নেতা পাশের কক্ষে একজনকে ব্রিফ করছিল। আমি তা পাশের কক্ষ থেকে সব শুনতে পেয়েছি। বিষয়টাকে আমার কাছে খুবই রাজনৈতিক ও ষড়যন্ত্রমূলক মনে হয়েছে। সারা সোফিয়া বলল।
সেই রাজনৈতিক ও ষড়যন্ত্রমূলক বিষয়টা কি? জিজ্ঞাসা আহমদ। মুসার।
সারা সোফিয়া বলতে শুরু করল, স্যার, ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের লোকদের কথাবার্তা শুনে যা বুঝেছি তা হচ্ছে, এক মানুষ এক পৃথিবী নামের একটা আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট রত্নদ্বীপের শাসনব্যবস্থা ও সংবিধান পছন্দ করে না। তারা চায় না যে খৃস্টান, ইহুদি ও মুসলমান পরস্পর সহযোগী হয়ে দেশ চালাক। তারা চায় রত্নদ্বীপে এই তিন ধর্মের জাতির মধ্যে সংঘাত বাধাতে এবং এর মাধ্যমে তারা চায় রত্নদ্বীপের শাসনব্যবস্থা ও সংবিধানকে অকার্যকর করে দিতে। এক মানুষ এক পৃথিবী নামের সিন্ডিকেট জানতে পারে গুপ্তধন সন্ধানী ভূমধ্যসাগরীয় ব্ল্যাক সিন্ডিকেট রত্নদ্বীপে যাচ্ছে তাদের মিশন নিয়ে। তখন এক মানুষ এক পৃথিবী নামের সিন্ডিকেট ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের সাথে যোগাযোগ করে রত্নদ্বীপে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার কাজ তাদেরকে দেয়। বিনিময়ে তারা ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের মিশন এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির কাজের খরচের জন্যে অঢেল টাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। ইতিমধ্যেই কয়েক মিলিয়ন ডলার তারা দিয়েছে। সুতরাং যতই সংকট হোক, তাদের দেয়া কাজ না করে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের কোনো উপায় নেই। করতেই হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই কাজ ব্ল্যাক সিন্ডিকেট বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা করা নাকি তাদের ঠিক হয়নি। আবার তাদের কাজ শুরু করতে হবে।
নেতা গোছের একজন লোক এসব ব্রিফিং করছিল। ব্রিফিং-এর মাঝখানেই অন্য একজন বলে উঠল, স্যরি, আমি নতুন এসেছি, সেজন্যেই একটা কথা বলতে চাচ্ছি। বলুন। বলল সেই নেতা লোকটি। আমি সিসিলি হেডকোয়ার্টারে থাকতে শুনেছি, রত্নদ্বীপে সংঘাত সৃষ্টির কাজটিকে খুবই সহজ মনে করা হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল যে, রত্নদ্বীপে পুলিশ, সেনাবাহিনী নেই, আছে মাত্র আধাসামরিক নিরাপত্তা বাহিনী। অনভিজ্ঞ, অনভ্যস্ত এই বাহিনী সংঘাত ও নাশকতামূলক কাজ দমনের যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু দেখা গেল, আমাদের ব্ল্যাক সিন্ডিকেট প্রথমে যে জনশক্তি নিয়ে রত্নদ্বীপে এসেছিল, সেই জনশক্তি প্রায় শেষ হয়ে। গেছে। এখন বলা যায় আমরা একদম কোণঠাসা। এই অবস্থায় আমরা কতটা আশাবাদী হতে পারি? উত্তরে বলল ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের নেতা লোকটি, এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমাদের গোটা বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে একজন লোক। তার ব্যবস্থা আমরা আলাদাভাবে করছি। সেই লোকটাকে সরাতে পারলে ওদের গোটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আমরা যদি এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হই, তাহলে চূড়ান্ত পদক্ষেপে যাওয়া হবে। আশপাশ থেকে অস্ত্রসজ্জিত সরকারি সৈন্য ভাড়া করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তখন এক রাতে রত্নদ্বীপের জনপদ ধ্বংস হয়ে যাবে। কোনো মানুষ অবশিষ্ট থাকলে তারা অবশ্যই দ্বীপ ত্যাগ করবে। অতএব ভাবনার কিছু নেই। দীর্ঘ আলোচনা করে থামল সারা সোফিয়া।
শেষ কথাটা শুনে কুঞ্চিত হয়েছে আহমদ মুসার। সেই সাথে তার স্থির, শান্ত মনটাও অস্থির হয়ে উঠেছিল মুহূর্তের জন্যে। কি সর্বনাশা চিন্তা! একটা শাসনব্যবস্থা, একটা সংবিধান অকার্যকর করার জন্যে একটা বিশাল জনপদকেই ধ্বংস করা হবে! মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল আহমদ মুসা।
তাকাল সারা সোফিয়ার দিকে। বলল, ধন্যবাদ মিস সোফিয়া। আপনি কি এক পৃথিবী এক দেশ নামের সংস্থা সম্পর্কে আর কিছু জানেন?
জানি না। তবে এটুকু শুনেছি যে ওরা ইহুদিদের একটা রাজনৈতিক গ্রুপ। ওরা নাকি খুব অর্থশালী, শক্তিশালী। বলল সারা সোফিয়া।
আহমদ মুসা সাথে সাথেই কিছু বলল না। একটু পর বলল, মিস সোফিয়া, আপনি সিসিলি থেকে প্রথমে কোথায় আসেন?
রেনেটায় আসি। সারা সোফিয়া বলল।
রেনেটা জায়গার নাম, না বাড়ির নাম? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আমি এটা ঠিক জানি না। জিজ্ঞাসাও করিনি। লোকরা বলত রেনেটায় আছি, রেনেটা থেকে বলছি। আমিও মনে করেছি আমি রেনেটায় এসেছি। এ নাম স্থান ও বাড়ি- দুটিরই হতে পারে। বলল সারা সোফিয়া।
রত্নদ্বীপে ব্ল্যাক সিন্ডিকেট প্রধানের স্টেশন কি রেনেটায় ছিল? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আমি তাই মনে করছি। সারা সোফিয়া বলল।
আপনি সিসিলি থেকে এসে রত্নদ্বীপের কোন দিকে নেমেছিলেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
পশ্চিম দিকে নেমেছিলাম। সারা সোফিয়া বলল।
পশ্চিম দিকে নেমেই তো উঠেছিলেন রেনেটায়? বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। সারা সোফিয়া বলল।
পশ্চিম প্রান্তের সে এলাকার লোকেশনটা কোথায় হতে পারে? বলল আহমদ মুসা।
আমি বুঝতে পারিনি, খেয়াল করে দেখিনি স্যার। সারা সোফিয়া বলল।
আচ্ছা থাক এ প্রসঙ্গ। আমি কি আপনাকে আপনার পরিবার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আমার পরিবার সম্পর্কে? কেন স্যার? সারা সোফিয়া বলল।
আমি কি আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে পারি না? বলল আহমদ মুসা।
অবশ্যই পারেন স্যার। বলুন কি জানতে চান? সারা সোফিয়া বলল।
আপনি যে বাড়িটা আপনার মায়ের জন্যে কিনতে চাচ্ছেন, সেই বাড়িটার মালিক কে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
একটা কোম্পানি। খুব বড় একটা কোম্পানি। অনেক রকম বিজনেস আছে তাদের। সারা সোফিয়া বলল।
আচ্ছা মিস সোফিয়া, বাড়িটার প্রতি আপনার আম্মার যে বিশেষ আগ্রহ তার কারণ কি? বাড়িটা কি খুব সুন্দর? খুব ভালো ডিজাইনের? বলল আহমদ মুসা।
হাসল সারা সোফিয়া। বলল, সৌন্দর্য, ডিজাইন এ সবের বিষয়ে আমার মার কোনো বিশেষ আগ্রহ নেই। বাড়িটা বিশাল, কিন্তু খুবই পুরানো, একেবারেই ওল্ড ডিজাইনের। বাড়িটার নির্মাণ খুব ভালো মানের হলে বাড়িটা অনেক দিন আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল।
তাহলে বাড়িটার প্রতি আপনার মার এতটা আকর্ষণ কেন? বলল আহমদ মুসা।
কেন জানি না স্যার। আমার বাবা জানতেন কি না জানি না। সারা সোফিয়া বলল।
আপনার নানীর বাড়ি কোথায় ছিল? বলল আহমদ মুসা।
নানীর বাড়ি?
বলে হাসল সারা সোফিয়া। বলল, আমার নানীর বাড়ির খবর জেনে কি করবেন? এসব প্রশ্ন কেন?
আপত্তি না থাকলে প্লিজ বলুন।গম্ভীর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
সারা সোফিয়া আহমদ মুসার গম্ভীর মুখের দিকে তাকাল। বলল, আপনার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে আমার আপত্তি নেই স্যার।
একটু থামল সারা সোফিয়া। বলল আবার, আমার নানীর মায়ের বাড়ি এবং আমার নানার বাবার বাড়ি একই জায়গায়, দক্ষিণ পালারমোর ব্লু কোস্ট অঞ্চলে।
কিন্তু আপনার নানীর মা-বাবারা বু কোস্টের বাসিন্দা আগে ছিলেন। আপনার নানারা বু, কোস্ট এলাকায় পরে বাড়ি করেছেন, এরকম কিছু আপনার জানা আছে? বলল আহমদ মুসা।
সারা সোফিয়ার চোখে বিস্ময়। বলল, আপনি এসব বিষয় জানলেন কি করে স্যার। আমি ঐ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানি না। মা কোনো দিন এ বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে এটুকু শুনেছি, নানীর মা বাবাদের পরিবারে ভয়ানক সংকট গেছে। এর বেশি আমি আর কিছু জানি না।
আপনারা ক্যাথলিক না? বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ স্যার। সারা সোফিয়া বলল।
আপনার নানা-নানী উভয়ের পরিবার গ্রিক অরথোডক্স ছিলেন, এটা জানেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
গ্রিক অরথোডক্স খৃস্টান ছিলেন? সারা সোফিয়া বলল। কণ্ঠ তার চিল্কারের মতো শুনাল। বিস্ময়ে বিস্ফারিত তার দুই চোখ।
অভাবিত ও অকল্পনীয় একটা বিষয় জেনে অভিভূতের মতো আচ্ছন্ন। হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, স্যার আপনি এত কথা কি করে জানলেন?
আহমদ মুসা উত্তর দিল না সারা সোফিয়ার জিজ্ঞাসার।
জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ইনভেলাপ বের করে তুলে ধরল সারা সোফিয়ার দিকে।
সারা সোফিয়া বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিল। সোজা হয়ে বসে আস্তে আস্তে বাম হাতটা তুলে ইনভেলাপটি নিয়ে নিল। ইনভেলাপ থেকে একটা চিঠির মতো কাগজ বের করল। দ্রুত চোখ বুলাল তাতে।
চোখ বুলাবার পরেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। বলল, একি দেখছি স্যার? তার কণ্ঠ আবেগে ভেঙে পড়ল।
কিছু না, এটা তোমার মায়ের ভাগ্য মিস সোফিয়া। তাঁর যা পাবার ছিল, তাই পেয়েছেন। বলল আহমদ মুসা।
তৎক্ষণাৎ কোনো কথা এল না সারা সোফিয়ার কাছ থেকে।
সে চোখ বুজে ছিল।
বন্ধ চোখের বাধা পেরিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল তার দুচোখ থেকে। চোখ খুলল সে। অশ্রুর একটা স্রোত নেমে এল তার দুগণ্ড বেয়ে। বলল সে অঞরুদ্ধ কণ্ঠে, স্যার, এটা কেন করলেন আমার জন্যে, আমার মায়ের জন্যে? কিভাবে করলেন?
দেখুন মিস সারা সোফিয়া, যা ঘটে বা যা ঘটবার তা আল্লাহই ঘটান। আর আমি মনে করেছি, একজন মায়ের এমন চাওয়া পূরণ হওয়া উচিত। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু কঠিন এক ঋণে আবদ্ধ হলাম স্যার। এ ঋণ আমি শোধ করব কি করে? সারা সোফিয়া ভাঙা কণ্ঠে বলল।
সারা সোফিয়া, ঋণ কোথায়? আমি তো এক পয়সাও খরচ করিনি। বাড়ির মূল্য পরিশোধ করার প্রয়োজন হয়নি। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকাল সারা সোফিয়া আহমদ মুসার দিকে। একটা বোবা বিস্ময় যেন তাকে আচ্ছন্ন করেছে। তার মুখে কথা আসছে না। তার মনে বিস্ময় বিজড়িত একটা প্রশ্নই মাথা তুলছে। একদমই অসম্ভব, স্বপ্নের অতীত যা, তা কিভাবে ঘটল, কিভাবে ঘটতে পারে! কিন্তু প্রশ্নটা মুখ দিয়ে প্রকাশ করতে পারছে না।
ঘটনা আমাকেও বিস্মিত করেছে মিস সারা সোফিয়া। কিন্তু বিস্ময়ের কিছু নেই। আল্লাহ যা ঘটাতে চান, এভাবেই ঘটান। বলল আহমদ মুসা।
প্লিজ বলুন, কি ঘটেছে? বিস্ময়কর ঐসব প্রশ্ন- যা আমাকে আপনি করলেন, কেন? সারা সোফিয়া বলল।
সামনের ঘটনা ঘোট। ঘটনার পেছনের কাহিনী বিশাল। ঘটনাটাই শুনুন।
বলে আহমদ মুসা শুরু করল, আপনাদের পালারমোতে আমার একজন পরিচিত লোক আছে। বেশ কয়েক বছর আগে সউদি আরবে যুবকটির সাথে আমার পরিচয়। পালারমোতে তার ব্যবসায় আছে। গোটা ইউরোপ এবং আফ্রিকায় তার ব্যবসায় বিস্তৃত। তার রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী পরিবার বার তেরশ বছর ধরে পালারমোতে বাস করছে। রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক সংঘাতের শিকার হয়ে তাকে পালারমো থেকে পালাতে হয়। নানা জায়গায় ঘুরে সউদি আরবে আশ্রয় নেয়। মক্কা শরিফে এক অনুষ্ঠানে তার সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি সবকিছু আমাকে বলেন। তার পরিবারের কাহিনী আমাকে অভিভূত করে। সে পালারমোতে যাতে ফিরতে পারে, এজন্যে সে আমার সহযোগিতা চায়। আমি সউদি আরব সরকারের সাথে তার বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করি। পৃথিবীর বিপন্ন মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে এসে থাকে সউদি আরব সব সময়। এক্ষেত্রেও তারা সাহায্যের হাত বাড়ায়। সিসিলি সরকারের সাথে আলোচনা করে সউদি আরব তাকে পালারমোতে পুনর্বাসন সফল হয়। আপনার কাছ থেকে আপনার মা, বাবা, নানী ও কোম্পানির নাম নিয়েছিলাম, সেসব তাকে দিয়ে বলি, আজই অল্পক্ষণের মধ্যে আমি টাকা পাঠাচ্ছি। আপনি কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে বাড়িটা রক্ষার ব্যবস্থা করুন সময় শেষ হবার আগে। তিনি উত্তরে বলেন, কোনো চিন্তা করবেন না। ঐ রিয়েল এস্টেট কোম্পানিটা আমার কোম্পানিরই একটা অংশ, তবে সরাসরি আমি ওটা দেখভাল করি না। আমি দেখছি। তার সাথে কথা হওয়ার ঘন্টাখানেক পর তিনি আমাকে টেলিফোন করলেন। খুব খুশি মনে হলো তাকে। তিনি বললেন, বাড়িটা ঐতিহাসিক, যাকে বাড়ি দিতে বলেছেন, তার পরিবারও ঐতিহাসিক। আর এই পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। আমার পারিবারিক ডায়েরিতে দেখলাম বাড়িটাতে এবং বাড়িটা নিয়ে অনেক কিছু ঘটেছে। আল হামদুলিল্লাহ বাড়িটা এখন আমাদের আয়ত্তে। আমি আজই বাড়িটা ম্যাডামের দখলে দেবার নির্দেশ দিয়েছি। আমিও আজই ম্যাডামের সাথে দেখা করব। যাদের বাড়ি তারাই পেলেন, অতএব মূল্যের কোনো প্রশ্ন নেই।
আমি বললাম, আল হামদুলিল্লাহ। যাক, বাড়িটার প্রসঙ্গ শেষ হলো। কিন্তু আমার নতুন কৌতূহলের শুরু হলো। ঐতিহাসিক বাড়ি, দুই ঐতিহাসিক পরিবারের মধ্যকার সম্পর্ক ইত্যাদি সব বিষয়ই আমার। জানতে ইচ্ছা করছে। তিনি বললেন, সে এক মহাকাব্য স্যার। আমিও সবকিছু জানি না। আমি ডায়েরি দেখে লিখে পাঠাচ্ছি, সম্ভব হলে আজই। রাতেই আমি পেয়ে গেলাম সেই ঐতিহাসিক কাহিনী। রাতেই আমি পড়ে ফেলেছিলাম পুরোটা। পড়ে যা জেনেছি, সেই জানা থেকেই কয়েকটা কথা আপনাকে আমি বলেছিলাম। থামল আহমদ মুসা।
স্যার, উনি যা বলেছেন, তার কিছুই আমি জানি না। সত্যিই মন আমার অস্থির সবকিছু জানার জন্যে। আপনি স্যার সেই কাহিনী এনেছেন? সারা সোফিয়া বলল। আবেগে ভারি তার কণ্ঠ।
এনেছি মিস সারা সোফিয়া। ল্যাটিন ভাষায় লেখা। আপনি পড়ন, আমিও শুনব। কিছু ল্যাটিন শব্দ আমার জানা নেই। বলে আহমদ মুসা। কাগজের কয়েকটা শীট সারা সোফিয়ার হাতে তুলে দিল।
সারা বালিশে হেলান দিয়ে থেকেই কাগজটা হাতে নিল। বলল, স্যার, সেই ভদ্রলোকের- যার সাথে আপনার কথা হয়েছিল, তার নাম কি?
আবু ফিহর আবদুল্লাহ আল হাবিব আল ফিহরী। সাধারণভাবে তিনি আল ফিহরী বা ফিহরী নামে পরিচিত। বলল আহমদ মুসা।
ফিহরী? এ নাম তো আমার পরিচিত। তিনি তো শিল্পপতি এবং একটা শিপিং লাইনের মালিক। সারা সোফিয়া বলল।
হ্যাঁ মিস সোফিয়া। বলল আহমদ মুসা।
তাকে পুরস্কার বিতরণী এক সভায় আমি দেখেছি। ঐ অনুষ্ঠানে আমিও পুরস্কার নিয়েছিলাম তার হাত থেকে। নাম শুনলে খুব ভারি মনে হয়, কিন্তু বয়স তো কম।
হ্যাঁ, সউদি আরবে যখন দেখা হয়, তখন পর্যন্ত তিনি বিয়েই করেননি। বলল আহমদ মুসা।
একদিকে তারা মুসলিম, অন্যদিকে তারা বিশাল পরিবার। ওঁদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কিভাবে হতে পারে? সারা সোফিয়া বলল।
হতে পারে। বলেছি না তোমার বাবা ক্যাথলিক। তোমার মা, তোমার নানী ও নানার পরিবার কেউ ক্যাথলিক নন। সবাই বাইজান্টাইন অরথোডক্স খৃস্টান। সিসিলিতে বাইজান্টাইন অরথোডক্স খৃস্টানদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক ভালো। সিসিলিতে মুসলমানরা বাইজান্টাইন শাসকদের হাত থেকে সিসিলির শাসনক্ষমতা নিয়েছিল। প্রতিপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও মুসলিম শাসন আমলে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে সব অধিকার বাইজান্টাইন খৃস্টানরা ভোগ করেছে। মুসলমানদের হাত থেকে ক্যাথলিকরা সিসিলি কেড়ে নেবার পর মুসলমান ও বাইজান্টাইন অরথোডক্স খৃস্টানরা একইভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। এই পরিস্থিতি মুসলমান ও বাইজান্টাইন খৃস্টানদের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। কাহিনীটা পড়ন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার বলে সারা সোফিয়া হাতে নেয়া কাগজটার দিকে মনোযোগ দিল। বলল, স্যার অনুমতি দিন পড়তে শুরু করি।
প্লিজ পড়ন। বলল আহমদ মুসা।
পড়তে শুরু করল সারা সোফিয়া :
দুই পরিবারের কথা বলার আগে আমার পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ পুরুষ হিসাবে আমার কথা দিয়েই শুরু করি। আমার নাম আবু ফিহর আবদুল্লাহ আল হাবিব আল ফিহরী। আমার এই বিশাল মজার নাম সম্পর্কে আব্বা আমাকে বলেছিলেন। সিসিলির মুসলিম ইতিহাসে দুই ফিহর খুব উল্লেখযোগ্য। প্রথম ফিহর ৭৪০ সালে সিসিলির পূর্ব উপকূলের সাইরাসে প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাকারী সেনাপতি হাবিব ইবনে আমির ওবায়দা আল ফিহরী। তার আগে সিসিলিতে প্রথম মুসলিম অভিযান হয় সিরীয় গভর্নর মুয়াবিয়া রা.-এর মাধ্যমে তখনকার খলিফা হযরত ওসমান রা. নির্দেশে ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে, পরে বিভিন্ন সময়ে আরও ৮টি অভিযান প্রেরিত হয় সিসিলিতে। কিন্তু প্রথম শাসন আল ফিহরের দ্বারাই। এ শাসন অবশ্য বেশি দিন টিকেনি। দ্বিতীয় ফিহর সিসিলিতে স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠাকারী আবু ফিহর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ। পালারমো বিজিত হয় ৮৩১ সালে। ৮৩২ সালে আবু ফিহর মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ সুলতান অব সিসিলি হিসেবে ঘোষিত হন। পালারমো হয় রাজধানী। এই দুই ফিহরের নামের অংশবিশেষ যোগ করে আমার নামকরণ হয়।
সিসিলির মুসলিম রাজধানী আমার জন্মস্থান পালারমোর নাম যখন এলই, তখন পালারমো সম্পর্কে দুএকটা কথা বলতে হয়। সিসিলিতে মুসলিম শাসন ছিল ২৬৪ বছর। মোটামুটি এই সময়টা পালারমোর স্বর্ণযুগ। সিসিলির মুসলিম রাজধানী পালারমোর সাথে তুলনা চলতে পারে এমন কোনো শহর গোটা ভূমধ্যসাগর ও ইউরোপ অঞ্চলে ছিল না। শুধু স্পেনের কর্ডোভার সাথেই এর তুলনা চলতে পারে। পালারমোর স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইউরোপের জন্যে আলোকবর্তিকা। ইতিহাসকাররা স্বীকার করেছেন The School of Muslim Sicily, just as those of Muslim Spain, had long been the resort of students, ambitious of literary attainments and destina tion, from every country in Europe. এই কথাগুলো বলেছেন খৃস্টান সন্ন্যাসী (Monk) Theodosius. তিনি পালারমোর ও সিসিলির সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সহাবস্থান বিষয়ে বলেছেন, Full of citizens and strangers… Blended with Sicilians, The Geek, The Lombards and the Jews, There are Arabs, Berbers, Tartars, Negroes, some wrapped in long robes and tur bans, some a lad in skim and some half-naked, faces oval, square, or round, of every complexion and profile, beards and hair of every variety of colors of cut. এই সাথে ধর্মপালনের দিক দিয়ে পালারমোর মুসলমানরা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। পালারমো ছিল মসজিদের শহর। পালারমোর যে পরিসরে তখন তিনশত মসজিদ ছিল, অন্য কোনো মুসলিম দেশে এর দ্বিগুণ বড় শহরেও এত মসজিদ ছিল না। উৎপাদন ও ব্যবসায়ের মতো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পালারমো ছিল মুসলিম স্পেনের মতোই, ইউরোপের দিশারী।
স্যার আমার সিসিলি, পালারমো সম্পর্কে কতকটা অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই এত কথা বললাম এজন্যেই যে আপনি যাতে পালারমোতে আসতে আগ্রহী হন। পালারমো, সিসিলিতে আপনি আসেননি।
সিসিলিতে বাইজান্টাইন অরথোডক্স খৃস্টানদের হাত থেকে ক্ষমতা মুসলমানদের হাতে যায়। প্রতিপক্ষ হলেও ইসলামের নীতি ও মসলমানদের ব্যবহারের কারণেই বাইজান্টাইন খৃস্টানরা মুসলমানদের
হয়ে যায়। গোটা মুসলিম শাসনকালে এই অবস্থা ছিল। কিন্তু ক্যাথলিক খৃস্টানরা যখন মুসলমানদের হাত থেকে সিসিলির ক্ষমতা দখল করে, তখন দৃশ্যপট বিপরীত হয়ে যায়। মুসলমানরা গণহত্যা ও টোটাল উচ্ছেদের শিকার হয়। এই সাথে ক্যাথলিকদের ধর্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বী বাইজান্টাইন খৃস্টানদের জীবনেও নেমে আসে মহাবিপদ, তবে মুসলমানদের মতো অত ভয়াবহ নয়। বাইজান্টাইন খৃস্টানদের উপর বিপদ সত্ত্বেও তারা মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। আশ্রয় দেয়াসহ নানাভাবে সাহায্য করে। আমাদের পরিবারও একটা বাইজান্টাইন পরিবারের সাহায্য ও ভালোবাসা পায়, যার তুলনা পাওয়া ভার।
আমাদের পরিবারের কাজ প্রথমে সেনাবাহিনীতে ছিল। তারপর রাজকার্যে যুক্ত হয়। আমাদের পরিবার এক সময় পালারমো অঞ্চলের শাসনকর্তার দায়িত্ব পালন করে। পালারমো যখন ক্যাথলিক খৃস্টানদের হাতে যায় ১০৭১ সালে, তখন আমাদের পরিবার শাসনকার্যে ছিল না। বড় ব্যবসায়-হাউজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমাদের ব্যবসায়ের সহযোগী ছিল বাইজান্টাইন খৃস্টান এক পরিবার। আমাদের পরিবারের নাম কোহর পরিবার। আহমদ ইবনে কোহর ছিলেন সিসিলির প্রথম স্বাধীন সুলতান। এই স্বাধীন সালতানাত সিসিলিতে রাজত্ব করে ৯৬৫ সাল থেকে ১০৯১ সাল পর্যন্ত। এই প্রথম স্বাধীন সুলতানের নাম অনুসারেই আমাদের পরিবারের নামকরণ হয়। বলা হয়ে থাকে আহমদ ইবনে কোহর-এর কোনো এক সন্তানের আমরা বংশধর। তিনি কে আমাদের জানা নেই। আহমদ ইবনে কোহরকেই আমাদের পরিবারের প্রথম পুরুষ ধরা হয়। আর বাইজান্টাইন খৃস্টান পরিবারটি থিয়েভোর পরিবার। আমাদের পরিবারের ডায়েরি অনুসারে সিসিলিতে থিয়োডর পরিবারের প্রথম ব্যক্তি ছিলেন থিয়োডর ডুকাস কিফ্রিয়ানোস। বাইজান্টাইন ম্রাট কনস্ট্যান্টস দ্বিতীয় ৬৬৩ সালে কনস্ট্যানটিনোপল থেকে সিসিলির সাইরাকাসে এসে উঠেন ইতালি বিজয়ের লক্ষ্য নিয়ে। সেই বাহিনীতে থিয়োড়র ডুকাস কিফ্রিয়ানোস একজন সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। সম্রাট চলে যাওয়ার সময় একটা ফ্লিটসহ তাকে রেখে যান সিসিলিতে বাইজান্টাইন শাসনের সাহায্যকারী হিসেবে। মুসলিম শাসনে এই পরিবারটিই একটা বড় ব্যবসায় হাউজ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। পারস্পরিক সাহায্যে দুই পরিবারই ব্যবসায়ে প্রভূত উন্নতি করে।
তারপর এল ১০৭১ সালের এক ভয়াবহ দিন। ক্যাথলিক নর্মানরা সিসিলির সর্ব উত্তরের মেসিনা এলাকা ১০৬১ সালেই দখল করে নিয়েছিল। দ্বিতীয় বড় লক্ষ্য হিসাবে ওরা পালারমোর দিকে এগিয়ে আসে। সিসিলির মুসলিম শাসককুল বহু বিভাগে বিভক্ত এবং বিবাদে লিপ্ত ছিল। ১৯৭১ সালের দিনটিতে প্রচণ্ড ও চূড়ান্ত নৌ ও স্থলযুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরাজিত হয় সুলতানের বাহিনী। পতন ঘটে পালামোর। গণহত্যা ও ধ্বংসের শিকার হয় নগরী। আমাদের কোহর পরিবার খালি হাতে রাস্তায় নামে, তাদের কয়েকজন নিহত হয়, আহত হয় অনেকে। ক্যাথালিকদের বাইজান্টাইন খৃস্টানরাও হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে, সামগ্রিকভাবে নয়। থিয়োডর পরিবার প্রভাবশালী ছিল বলে রক্ষা পায়। ছুটে আসে থিয়োডর পরিবার কোহর পরিবারের সাহায্যে। কোহর পরিবারের অবশিষ্ট লোকজনদের তারা নিয়ে যায় গণহত্যার সয়লাব থেকে বাঁচিয়ে। সারা সোফিয়ার মাকে যে বাড়িটা দেয়া হলো, ঐ বাড়িতেই তখন থিয়োডর পরিবার থাকতো। কোহর পরিবার ঐ বাড়িতেই গিয়ে আশ্রয় নিল। দীর্ঘ ছয়মাস কোহর পরিবার ওখানে লুকিয়ে থাকল। এই ছয়মাস থিয়োডর পরিবার শুধু কোহর পরিবারকে আশ্রয় দেয়নি, তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যও থিয়োডর পরিবার রক্ষা করেছে। ছয় মাস পর অবস্থা কিছুটা শান্ত হলে কোহর পরিবার ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে। ব্যবসায়-বাণিজ্য শুরু করে। নানা বাধা বিপত্তি, সমস্যা-সংকটের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে জীবন। আসে আবার ভয়াবহ দুর্দিন। হোলি রোমান সম্রাট ফ্রেডারিক দ্বিতীয় ১২৪৫ সালে সিসিলি থেকে মুসলমানদের টোটাল উচ্ছেদের ঘোষণা করে। মুসলমানদেরকে গরু-ছাগলের মতো জাহাজ বোঝাই করে ইতালির উত্তর সীমান্তে লুক্ৰায় চালান করা হয়। কাউকে পালাবার সুযোগ দেয়া হয়নি। কোহর পরিবারকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছে থিয়োডর পরিবার, কিন্তু পারেনি। কোহর পরিবার চালান হওয়ার আগে বাড়ি-ঘর, ব্যবসায় বাণিজ্যের চাবি, কাগজ-পত্র সব থিয়োডর পরিবারকে দিয়ে আসে। বাড়ি ঘর রক্ষা করতে না পারলেও থিয়োডর পরিবার কোহর পরিবারের ব্যবসায়-বাণিজ্যের অনেকাংশ রক্ষা করতে সমর্থ হয়। থিয়োডর পরিবার লুক্রায় নির্বাসিত কোহর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে এবং নিয়মিত টাকা-পয়সা পাঠাতে থাকে। সিসিলির মুসলমানরা ইতালির লুক্ৰায় ৫৫ বছর নির্বাসিত জীবন কাটায়। এরপর তাদের জীবনে সর্ববিনাশী এক মহাঝড় আসে। রোম সম্রাটের অধীন আলতামুরার কাউন্ট জিওভানি। পেপিনো ১৩০০ সালে ঘোষণা করে মুসলমানদের এবার লুক্রা থেকেও উচ্ছেদ করার কথা। সঙ্গে সঙ্গেই কাউন্ট জিওভানির সেনাবাহিনী লুক্রা দখল করে নিয়ে মুসলমানদেরকে সাগরে ভাসিয়ে দেয়, যারা বাদ পড়ে তাদের দাস বানানো হয়। একটা নৌকায় করে অন্যান্য সবার মতো কোহর পরিবারেরও অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হয়। আল্লাহর কি ইচ্ছা, এক প্রবল ঝড়ে কোহর পরিবারের নৌকা ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের জন্মভূমি সিসিলিতেই। সিসিলি উপকূলে পৌঁছার পর ঢেউয়ের উপকূলীয় ধাক্কাধাক্কিতে কোহর পরিবারের জাহাজটি ডুবে যায়। কোহর পরিবারের তখনকার প্রধান আহমদ ইবনে আবদুল্লাহসহ পরিবারের সবাই মারা যায় দুজন ছাড়া। একজন আহমদ ইবনে আবদুল্লাহর বড় ছেলে আবু কোহর ইবনে আবদুল্লাহ এবং মেয়ে ফাতিমা আবদুল্লাহ। দুজনকেই সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করে সিসিলির পূর্ব উপকূলের অ্যাপোেলা শহরের নিকটবর্তী একটা গ্রামের এক জেলে পরিবার। ঐ দিন ঐ ঝড়েই উপকূলে এক নৌকা ডুবিতে এই জেলে পরিবারের বড় ছেলে এবং বড় মেয়ে মারা। যায়। সংজ্ঞাহীন আবু কোহর আবদুল্লাহ ও ফাতেমা আবদুল্লাহকে তারা সমুদ্র থেকে তুলেছিল নিজেদের ছেলেমেয়ে মনে করে। তুলে দেখে সংজ্ঞাহীন ছেলেমেয়ে তাদের সন্তান নয়। সংজ্ঞাহীন দুজনকে তারা বাড়ি নিয়ে যায়। সংজ্ঞা ফিরলে জেলে পরিবার তাদের কাছ থেকে সব শুনে। তারা দুজন ছাড়া পরিবারের সবাই নৌকা ডুবিতে মারা গেছে। জেলে পরিবার জিজ্ঞাসা করে আরও জানে যে, তারা মুসলমান এবং তাদের এখন আর কোনে ঠিকানা নেই। তাদের যোগাড় করে নিতে হবে নতুন ঠিকানা। জেলে পরিবার তাদের জানায় যে, তোমাদের মতোই আমাদের এক ছেলে এক মেয়ে আজ সাগরে ডুবে মারা গেছে। তাদের বদলে ঈশ্বর তোমাদের দুজনকে আমাদের দিয়েছেন। তোমরা যদি রাজি থাকো, তাহলে তোমাদেরকে আপন ছেলেমেয়ে হিসেবে গ্রহণ করতে আমরা রাজি আছি এবং আমরা খুব খুশি হবো তোমাদের পেলে। তবে একটাই শর্ত- তোমাদের মুসলিম পরিচয় বাইরে গোপন রাখতে হবে। গোপনে। মুসলমান থাকলে ক্ষতি নেই। আমরা ক্যাথলিক নই, বাইজান্টাইন খৃস্টান। মুসলমানদেরকে আমরা ভালো জানি, ভালোবাসি। মুসলিম শাসন আমলে আমরা খুব সুখে ছিলাম। আবু কোহর ইবনে আবদুল্লাহ এবং ফাতিমা আবদুল্লাহ দুজনেই রাজি হয়। তারা এরপর জেলে পরিবারটির সদস্য হয়ে যায়। পরবর্তীকালে আবু কোহর জেলে পরিবারটির মেয়েকে বিয়ে করে এবং বোন ফাতিমাকেও জেলে পরিবারটির ছেলের সাথে বিয়ে দেয়। এখানেও কোহর পরিবার আল্লাহর সাহায্য পায়। বিয়ের আগে জেলে পরিবারটির ছেলেমেয়ে দুজন নিজের ইচ্ছাতেই ইসলাম গ্রহণ করে। আবু কোহর ও ফাতিমা আবদুল্লাহ যোগ্যতা ও চেষ্টায় জেলে পরিবার শীঘ্রই বড় মাছ ব্যবসায়ী, পরে বড় ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিক পরিবারে পরিণত হয়।
নতুন পরিচয়ের মধ্যে কোহর পরিবার হয়তো হারিয়েই যেত। কিন্তু তা হয়নি। লুক্রা থেকে নৌকায় উঠার আগে পরিবারের প্রধান আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ পরিবারের ডায়েরি, পারিবারিক কিছু স্মারক, কিছু দলিলপত্র এবং পালারমো থেকে থিয়োডর পরিবারের সর্বশেষ পাঠানো টাকা একটা ওয়াটার প্রুফ ব্যাগে পুরে প্রথম উত্তরসূরি বড় ছেলে আবু কোহর ইবনে আবদুল্লাহর হাতে তুলে দিয়েছিল এবং সেসব রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছিল। আবু কোহর সে ব্যাগ পিঠে বেঁধে রেখেছিল। তাই সব হারালেও কোহর পরিবারের অতীত তারা হারিয়ে ফেলল না। উল্টে চলে কালের পাতা। সমৃদ্ধ হতে থাকে কোহর পরিবারের পারিবারিক ডায়েরি। জেলেদের সেই গ্রামটি এখন শহর। জেলে পরিবার নামে কোনো পরিবার এখন আর নেই। এখন বড় শিল্প-ব্যবসায়ী পরিবার, থাকে সুন্দর বাড়িতে।
সুন্দর এক সকাল। কোহর পরিবারের কনিষ্ঠতম বংশধর ইবনে। কোহর কিফ্রিয়ানোস ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন শরিফ পড়ার পর পারিবারিক ডায়েরি নিয়ে বসেছিল। কতবার যে এ ডায়েরি সে পড়েছে। তার ঠিক নেই। আজও পড়ছে। শেষ করল পড়া। অশ্রু গড়াচ্ছিল দুচোখ দিয়ে। প্রতিদিনের মতো আজও কিছু কথা সংযোজন করল ডায়েরিতে। ডায়েরি বন্ধ করল।
কাঁধে হাতের একটা নরম স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকাল ইবনে কোহর কিস্ফিয়ানোস। দেখল স্ত্রী আয়েশা আবদুল্লাহ ইবনে কোহর তাকে সালাম দিল।
ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বলে নিজের ওড়নার প্রান্ত দিয়ে ইবনে কোহরের চোখ দুটি মুছে দিয়ে বলল, তুমি বর্তমান নিয়ে খুব সুখী নও জানি। তুমি অতীতকে বর্তমানের চেয়ে বেশি ভালোবাস।
বেশি ভালোবাসা, কম ভালোবাসার প্রশ্ন এখানে নেই। বর্তমানটা আমার জীবন, অতীত আমার শক্তি, আমার প্রেরণা। বলল ইবনে কোহর।
তাহলে তোমার চোখে অশ্রু কেন? আয়েশা বলল।
চোখের এই অঞই অতীতকে জীবন্ত রাখে। অতীত জীবন্ত থাকলেই তা থেকে শক্তি ও প্রেরণা সঞ্চারিত হয়।
আমার আব্বা, আমার পূর্বপুরুষরা আমার কাছে এটাই চেয়েছেন। দেখ আমার নামের প্রথম অংশ ইবনে কোহর। আমার পরিবারের আদি পুরুষের নামের একটা অংশ কোহর। এ নাম অনুসারে আমার পরিবারের নাম কোহর। আমার নাম ইবনে কোহর রেখে আমার পরিবারের অতীতের সাথে আমাকে গেঁথে ফেলা হয়েছে। আমার নামের দ্বিতীয় অংশ কিষ্ক্রিানোস। আমাদের কোহর পরিবারের সুদিন, দুর্দিনের অকৃত্রিম বন্ধু থিয়োডর পরিবারের যিনি প্রতিষ্ঠাতা তার নামের একটা অংশ কিক্রিয়ানোস। তাঁর নামকে আমার নামের সাথে জুড়ে দিয়ে ঐ বন্ধু পরিবারকে স্মরণে রাখতে বলা হয়েছে। এই কারণেই আয়েশা আমি অতীতকে সব সময় জীবন্ত রাখতে চেষ্টা করি। বলল ইবনে কোহর কিফিয়ানোস।
আমিও যে তা চাই না, তা নয়, কিন্তু তোমার চোখের জল আমি সহ্য করতে পারি না। আয়েশা বলল।
বলেই আয়েশা উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি তোমার চা, আর আজকের পত্রিকা নিয়ে আসি।
বাইরে গেল আয়েশা আবদুল্লাহ।
চা খেতে খেতে সদ্য আসা সংবাদপত্র লামন্ডের পাতায় চোখ বুলাচ্ছিল ইবনে কোহর। পত্রিকার পাতা উল্টানোর সময় ক্লাসিফায়েড বিজ্ঞাপনের পাতায় বিজ্ঞাপনের একটা শিরোনামে চোখ দুটি আটকে গেল ইবনে কোহরের। বড় বড় অক্ষরে শিরোনাম হলো: কোহর পরিবার। বিস্মিত হলো ইবনে কোহর বিজ্ঞাপনের শিরোনামে তার পরিবারের নাম দেখে। কাকতালীয় ব্যাপার কি? কোহর নামে আরও পরিবার আছে কি? বিজ্ঞাপনে চোখ বুলাল ইবনে কোহর। বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে: কোহর আমাদের একান্ত বন্ধু পরিবার। অনেকদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাদের পরিবারের কেউ, কিংবা তাদের পরিচিত কেউ এই বিজ্ঞাপনটি পড়লে তারা দয়া করে নিম্ন ঠিকানায় কোহর পরিবারের ঠিকনা দিলে খুবই বাধিত হবো। ঠিকানার জায়গায় লেখা : থিয়োডর পরিবারের পক্ষে থিয়োডর ডুকাস স্পারটেনাস। নামের পরে ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার দেয়া আছে। ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার পালারমো শহরের।
বিজ্ঞাপন পড়েই চিৎকার করে উঠল, আয়েশা তুমি কোথায়, এস।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল আয়েশা। বলল, কি হয়েছে, হঠাৎ এভাবে ডাক কেন?
ইবনে কোহর কিক্রিয়ানোস কাগজের বিজ্ঞাপনটা এগিয়ে দিল। আয়েশার দিকে।
আয়েশা বিজ্ঞাপন পড়ে তাকাল স্বামী ইবনে কোহরের দিকে। তার মুখ উজ্জ্বল। বলল, বিজ্ঞাপন নিয়ে তুমি কি চিন্তা করছ? ওরা সত্যিই সেই থিয়োডর পরিবার?
আমার কোনো সন্দেহ নেই আয়েশা। নাম, ঠিকানা, পরিবারের নাম, শহরের নাম সবই মিলে গেছে। বলল ইবনে কোহর।
এখন কি করতে চাচ্ছ? আয়েশা বলল।
আমি ওদের সাথে যোগাযোগ করব। তারপর যা হয় করা যাবে। বলল ইবনে কোহর।
বলেই টেলিফোনের কাছে বসল ইবনে কোহর। টেলিফোন করল বিজ্ঞাপনে পাওয়া নাম্বারে। ওপার থেকে একজন মহিলার হ্যালো কণ্ঠ ভেসে এল। ইবনে কোহর বলল, আমি সিসিলির ইস্ট কোস্ট অ্যাভোলা থেকে টেলিফোন করছি। আমি থিয়োডর ডুকাস স্পারটেনোস-এর সাথে। কথা বলতে চাই।
আমি তার স্ত্রী বলছি। একটু ধরুন ডেকে দিচ্ছি। ওপ্রান্ত থেকে বলল মহিলাটি
আধা মিনিটের মধ্যেই ওপার থেকে একটা ভারি কণ্ঠ শোনা গেল, আমি থিয়োডর ডুকাস। আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি?
আমি ইবনে কোহর কিক্রিয়ানোস। আমি…।
ইবনে কোহর কথা শেষ করার আগেই ওপর থেকে থিয়োডর ডুকাস দ্রুত কণ্ঠে বলল, আপনি কি কোহর পরিবারের কেউ?
হ্যাঁ, আমি কোহর পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। বলল ইবনে। কোহর। পূর্ব উপকূলে অ্যাভোলার কাছে এক ছোট্ট শহরে বাস করি। বলল ইবনে কোহর।
ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। সত্যই আপনি কোহর পরিবারের সন্তান! বিশ্বাস হতে মন চাইছে না। কত বিজ্ঞাপন দিয়েছি, আমার বাবা দিয়েছেন। তার আগেও দেয়া হয়েছে। কোনো সাড়া আমরা পাইনি। থিয়োডর ডুকাস বলল ওপ্রান্ত থেকে। তার কণ্ঠ আবেগে ভারি। তার শেষের কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছিল।
সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য। কয়েকশ বছর ধরে আমাদের পরিবার রয়েছে অ্যাভোলার এই গ্রামে। বলল ইবনে কোহর।
কিন্তু ওখানে কিভাবে? জিজ্ঞাসা ওপার থেকে থিয়োডর ডুকাসের।
ইতালির উত্তর কোস্ট লুক্রা থেকে উচ্ছেদ হবার পর আমাদের পরিবার নৌকায় করে যাচ্ছিল অনিশ্চিতের পথে। ভূমধ্যসাগরে এক প্রবল ঝড় আমাদের পরিবারের সেই নৌকা ভাসিয়ে সিসিলির পূর্ব উপকূলে নিয়ে আসে। উপকূলে এসে নৌকা ডুবি হয়। সবাই মারা যায়। শুধু। আমাদের পরিবারের প্রধান আহমেদ ইবনে আবদুল্লাহর বড় ছেলে ও বড় মেয়ে রক্ষা পায়। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এক জেলে পরিবার তাদের তুলে নিয়ে আসে। আমরা এখনও সেখানেই আছি। বলল ইবনে কোহর।
ও গড! বিপদের উপর বিপদ! তবু ঈশ্বর দুজনকে তো বাঁচিয়েছেন! আচ্ছা, আপনারা থিয়োডর পরিবারের কোনো কথা জানতেন না? থিয়োডর ডুকাস বলল ওপার থেকে।
জানতাম। ফ্যামিলি ডায়েরি, ফ্যামিলি ডকুমেন্ট ছিল আহমেদ ইবনে। আবদুল্লাহর বড় ছেলের কাছে। সে রক্ষা পাওয়ায় সেসব আমাদের পরিবারে এখনও এবং সযত্নে রক্ষা করছি। বলল ইবনে কোহর।
ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। এখন বলুন, আপনারা এখানে, না আমি ওখানে যাব? থিয়োডর ডুকাস বলল।
স্মৃতির এক স্বর্গভূমি পালারমোকে দেখার আমার আবাল্য ইচ্ছা। আমরাই যাব সেখানে। বলল ইবনে কোহর।
ওয়েলকাম। প্লিজ আসুন। আমার পরিবার অসীম খুশি হবে কোহর পরিবারকে কাছে পেলে। আর কাজও আছে। থিয়োডর ডুকাস বলল।
আরও কিছু কথার পর তাদের কথা সেদিনের মতো শেষ হলো। খুব শীঘ্রই ইবনে কোহর এবং তার স্ত্রী আয়েশা পালারমো গিয়েছিল। সারা সোফিয়ার মাকে যে বাড়িটা ফেরত দেয়া হলো, সেই বাড়িতেই তখনও বাস করত থিয়োডর পরিবার। আরও বড়, আরও সুন্দুর করা হয়েছে বাড়িটাকে। ইবনে কোহর ও স্ত্রী আয়েশা আবদুল্লাহ সেই বাড়িতেই গিয়ে উঠল।
ধীরে ধীরে প্রায় গোটা কোহর পরিবার উঠে এল পালারমোতে। একটা অংশ মাত্র থাকল অ্যাভোলায়। কোহর পরিবারের গোটা ব্যবসায় ফেরত দিয়েছে থিয়োডর পরিবার। বাড়িটা অন্যের দখলে চলে যাওয়ায়, সেটা আর পাওয়া যায়নি। চেষ্টাও করা হয়নি হৈ চৈ হওয়ার আশংকায়। কোহর পরিবারের নাম, পরিচয় গোপন রেখে ব্যবসায়-বাণিজ্য সবকিছু পরিচালনা করা হচ্ছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় ব্যবসায়টা থিয়োডর পরিবারের।
কালের পাতা উল্টে চলল এইভাবে। এখন সিসিলিও পরিবর্তিত হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়। সব নাগরিকের সমান অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত। কিন্তু সবকিছুর অন্তরালে সামাজিক বিভক্তি কিন্তু পুরোপুরিই জীবন্ত। নানা ঘটনায় মাঝে মাঝেই তা মাথা তুলে। এর মধ্যে দিয়ে থিয়োডর পরিবার ও কোহর পরিবার অলক্ষেই এক চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। যে সময়ের কথা এখন বলছি, তখন বিশ্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল পাড়ি দিয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তেজনা কিন্তু পুরোদমে চলছে। ইতালিতে গণতন্ত্র আবার ফিরে এসেছে, সিসিলিতেও। এক নির্বাচন এল সিসিলিতে। দুই প্রধান দল নির্বাচনে। দুই দলই। অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একদল ক্যাথলিক, অন্য দল বাইজান্টাইন অরথোডক্স। পালারমোর দুই আসনেই জিতল বাইজান্টাইন অরথোডক্স প্রার্থী। পালারমোর ক্যাথলিকদের মধ্যে বাইজান্টাইন অরথোডক্স বিরোধী বিদ্বেষ প্রচণ্ডভাবে জেগে উঠল পালারমোতে। আক্রান্ত হলো বাইজান্টাইন অরথোডক্সদের বাড়িগুলো। বড় টার্গেট ছিল থিয়োডর পারিবারিক বাড়ি। ক্যাথলিক স্বেচ্ছাসেবকরা ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের বাড়ির উপর। থিয়োডর পরিবারের সহযোগী হিসাবে কোহর পরিবারের বাড়িও হামলার শিকার হলো। দুই ঘটনাই এত আকস্মিক ছিল যে প্রতিরোধ কিংবা পালানোর কোনো সুযোগই হয়নি। থিয়োড়র পরিবারের প্রায় সবাই নিহত হয়। লাশের স্তূপে আহত অবস্থায় বেঁচেছিল মাত্র দুজন। থিয়োডর পরিবার প্রধানের স্ত্রী পলা অ্যাঞ্জেলোসা এবং তার একমাত্র কিশোরী মেয়ে থিয়োডরা দিমিত্রা। এই কিশোরী দিমিত্রাই সারা সোফিয়ার নানী। কোহর পরিবারের বাড়িতেও হত্যাকাণ্ড ঘটে। হত্যাকাণ্ড থেকে আহত অবস্থায় বেঁচে যায় কোহর পরিবারের প্রধান মুহাম্মদ বিন আবু কোহর, তার স্ত্রী জয়নাব আগলাবী এবং শিশুপুত্র আবদুল্লাহ হোদায়বী ইবনে কোহর। এই শিশুপুত্র আবদুল্লাহ হোদায়বী আমার বাবা।… থেমে গেল সারা সোফিয়া। তার কণ্ঠ ভেঙে পড়ল কান্নায়।
সারা সোফিয়ার দুচোখ থেকে অশ্রু গড়াচ্ছিল। অশ্রু এবার বাধ ভাঙা কান্নায় রূপ নিল। সে কাগজটি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, স্যার আমি আর পড়তে পারছি না। প্লিজ আপনি পড়ন।
তাহলে এখন থাক। পরে পড়া যাবে। বলল আহমদ মুসা।
সারা সোফিয়া দুই হাত জোড় করে বলল, স্যার পড়া বন্ধ করা যাবে na। শুনতে চাই চূড়ান্তটা, এখনই। অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
ঠিক আছে, শোন। বলে পড়তে লাগল আহমদ মুসা :
দাঙ্গাবাজরা চলে গেলে আমার দাদা ও দাদী নিজেদের কেউ বেঁচে নেই দেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ছুটে যায় থিয়োডর পরিবারের বাড়িতে। লাশের স্তূপের মধ্যে সারা সোফিয়ার নানী থিয়োডরা দিমিত্রা ও নানীর মা পলা অ্যাঞ্জেলোসাকে জীবিত দেখতে পেল। তারা আহত ছিল, খুব সিরিয়াস নয়। দাদা ও দাদী তাদের তুলে গাড়িতে করে নিয়ে আসে। তারপর নিরাপদ এক স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। পলা অ্যাঞ্জেলোসার সাথে পরামর্শ করে তাদেরকে তার বাবা-মায়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় উত্তর পালারমোর সম্প্রসারিত অঞ্চলের বাড়িতে। এলাকাটা ক্যাথলিক। আমার দাদা-দাদী তাদেরকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে সেই রাতেই আমার দাদার বন্ধু পুলিশ প্রধানের সাথে দেখা করেন। পুলিশ প্রধান দাদাকে বাইরে কোথাও চলে যাবার পরামর্শ দেন। বলেন যে, এটা শুধুই দাঙ্গা নয়। একটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা। এর পেছনে গভীর রাজনীতি আছে। আমরা পুলিশও জানি না কি হতে যাচ্ছে! দাদা ঐ রাতেই তার ব্যবসায়ের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সাথে দেখা করে ব্যবসায়ের দায়-দায়িত্ব তাদের বুঝিয়ে দেন এবং রাতেই পালারমো ত্যাগ করেন। এরপর সিসিলি ত্যাগ করেন। চলে যান মিশরে। মিশর থেকে কুয়েতে। সেখান থেকে সউদি আরবে। শেষ পর্যন্ত সউদি আরবেই বসবাসের ব্যবস্থা করেন। সউদি আরবের উদার সাহায্য তিনি পান।
ঐ রাতের ঘটনায় তারা এতই মুষড়ে পড়েছিলেন যে, তার জীবদ্দশায় সিসিলিতে ফেরার কথা কেউ তুলতে পারেননি। দাদা মারা যান, দাদীও মারা যান। পালারমোর সাথে যোগাযোগ রাখলেও নানা কারণে সিসিলিতে আর যাওয়া হয়নি। দূর থেকেই ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যবস্থাপনা দেখাশোনা করা হতো। অপরিণত বয়সে বাবা মারা যান, পরে মাও ইন্তেকাল করেন। আমি সিসিলিতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। ইসলামী বিশ্বের কিংবদন্তী পুরুষ আহমদ মুসার সাথে এই সময় আমার দেখা হয়। আমি জানতাম সউদি আরবের সাথে তার সম্পর্কের কথা। আমি তাকে অনুরোধ করলাম সাহায্যের। তার সাহায্যেই আজ আমি সিসিলিতে। সউদি সরকার, ইতালি সরকার ও সিসিলি প্রশাসনের আলোচনা মাধ্যমে। আমার ফেরার ব্যবস্থা করা হয়। থিয়োর্ডর পরিবারের সবকিছু আমাদের ফ্যামিলি ডায়েরি থেকে পেয়েছি। সেটা তো পরের ঘটনা, কিন্তু তার আগেই দাদু ও বাবার কাছে থিয়োডর পরিবারের খবর জানতে পারি। সারা সোফিয়ার নানী থিয়োডরা দিমিত্রার ক্যাথলিক পরিবারে বিয়ে হয়েছে, থিয়োডরা, দিমিত্রার মেয়ে হয়েছে, নাম রেখেছে পলা অ্যাঞ্জেলানোস জুনিয়র, নিজের মায়ের নামে। থিয়োড়র পরিবারের খবর এ পর্যন্তই আমার জানা। পরে যখন আহমদ মুসা স্যারের কাছ থেকে সারা সোফিয়ার মায়ের জন্যে বাড়ির ব্যাপারে অনুরোধ পেলাম এবং বাড়ি ও সারা সোফিয়ার মা, নানীর নাম জানতে পারলাম, তখন জানলাম, এরা অবশ্যই থিয়োডর পরিবারের সদস্য। অতীতের কাহিনীগুলো মনে পড়ে গেল। থিয়োডর পরিবারের ঐতিহাসিক বাড়িটার কথাও স্মরণে এল। এ বাড়িটার প্রতি সারা সোফিয়ার মার অমোঘ আকর্ষণ খুবই স্বাভাবিক। আমি তার সাথে দেখা করে বাড়ির কাগজপত্র তাকে বুঝিয়ে দিলে তিনি খুব খুশি হলেন। বেশি খুশি হলেন কোহর পরিবারের একজনকে কাছে পেয়ে, মনে হলো বহুল আকাঙ্ক্ষিত কাউকে যেন পাশে পেলেন। কিন্তু এই আনন্দের পরেই হঠাৎ তিনি কেঁদে ফেললেন। অনেক কেঁদেছেন। আমি তাকে বাধা দেয়নি। বাড়ি পরিষ্কার করা হচ্ছে জানিয়ে বাড়িতে তাকে উঠতে বললাম। তিনি রাজি হলেন না। বললেন, সোফিয়া আসুক। একসাথে উঠব। তারপর একটু থেমেই বলল, তুমি বাবা গিয়ে সোফিকে নিয়ে এস। মায়ের কথা শিরোধার্য। খুব খুশি এই কারণেও যে, আহমদ মুসা স্যারের সাথে দেখা হবে। আমি আসছি স্যার। থামল আহমদ মুসা।
চোখ মুছল সারা সোফিয়া। বলল সারা সোফিয়া, তাহলে উনি কি সত্যিই আসছেন?
হ্যাঁ, টেলিফোনও করেছিলেন। যে কোনো সময় এসে পড়তে পারেন। বলল আহমদ মুসা।
দরজায় নক হলো।
নার্স তার রুম থেকে উঠে দরজা খুলে কথা বলে ফিরে এসে আহমদ মুসাকে বলল, স্যার সিসিলি থেকে একজন এসেছেন। নাম আবু ফিহর আবদুল্লাহ।
নিয়ে এস নার্স। আহমদ মুসা বলল।
নার্স গিয়ে নিয়ে এল আবু ফিহর আবদুল্লাহকে। ঘরে ঢুকেই আবু ফিহর আবদুল্লাহ সালাম বলল। সালামের উত্তর দিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। স্বাগত জানাল আবু ফিহর আবদুল্লাহকে।
আবু ফিহর আবদুল্লাহ জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, স্যার, আমার বিরাট সৌভাগ্য। আপনার আবার দেখা পেয়েছি।
আল হামদুলিল্লাহ। কিন্তু আবু ফিহর যাকে নিতে এসেছ, তাকে চিনতে পেরেছ? বলল আহমদ মুসা।
আবু ফিহর আবদুল্লাহ আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে তাকাল সারা সোফিয়ার দিকে।
সারা সোফিয়াও তাকিয়েছে আবু ফিহর আবদুল্লাহর দিকে।
দুজনেরই নিষ্পলক দৃষ্টি। যেন আঠার মতো লেগে গেছে। দুজনের কারও মুখেই কোনো কথা নেই।
পল পল করে সময় বয়ে গেল।
অবাক হলো আহমদ মুসা। কিন্তু আবার ভাবল। দুই পরিবারের যে ইতিহাস, যে মিলন, যে বিচ্ছেদ, যে পরিচয়, যে আকুলতা, তাতে সেই দুই পরিবারের দুই সর্বকনিষ্ঠের প্রথম দৃষ্টির মধ্যে একটা ভিন্নতর আবেগ। থাকতে পারে।
এক সময় কিছু না বলেই মাথা নিচু করল সারা সোফিয়া।
স্যরি মিস সোফিয়া। আমি আবু ফিহর আবদুল্লাহ। আপনার মার কাছ থেকে যা শুনেছিলাম, আপনি তাই।
সারা সোফিয়া মুখ না তুলেই বলল, মার কাছে কি শুনেছিলেন? লজ্জা জড়ানো সারা সোফিয়ার কণ্ঠ।
অনেক প্রশংসা। যাক সে কথা। আপনি কেমন আছেন?
ভালো আছি। স্যারের অনুগ্রহে সময়ের আগেই ভালো হয়ে গেছি। মাথা না তুলেই বলল সারা সোফিয়া।
তোমাদের দুজনকে ওয়েলকাম। তোমাদের দুজনের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকে ওয়েলকাম। তোমরা কতটা খুশি হয়েছ জানি না। কিন্তু আমি। ঐতিহাসিক সম্পর্কযুক্ত দুই পরিবারের দুই সর্বকনিষ্ঠের প্রথম সাক্ষাৎকে মহান আল্লাহর বড় অনুগ্রহ বলে মনে করছি।
সত্যিই স্যার আল্লাহর এটা মহাঅনুগ্রহ। দেখবেন স্যার, পরিবার দুটি যেন আর বিচ্ছিন্ন না হয়। আবু ফিহর আবদুল্লাহ বলল। তার কণ্ঠ আবেগে ভারি।
মি. আবু ফিহর যা বলেছেন, সেটা আমারও কথা স্যার। বেদনা বিচ্ছেদ, ধ্বংস-গড়ার দীর্ঘ ইতিহাস পাড়ি দিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় আপনার সাহায্যে আমরা আবার একত্রিত হতে পেরেছি। আল্লাহ যেন এটা অটুট রাখেন। বলল সারা সোফিয়া। তার কণ্ঠও আবেগে ভারি।
আল্লাহ সাহায্য করবেন। কিন্তু তোমাদের দুজনকেই এ নিয়ে ভাবতে হবে। নির্ভর করছে এটা তোমাদের দুজনের সিদ্ধান্তের উপর। বলল আহমদ মুসা।
কি সিদ্ধান্ত? কি বিষয়ে? বুঝতে পারছি না। সারা সোফিয়া ও আবু ফিহর আবদুল্লাহ প্রায় একসাথে বলে উঠল।
বুঝে কাজ নেই। সুযোগ পেলে মিস সারা সোফিয়ার মার সাথে এ নিয়ে কথা বলব। তিনি তো আবু ফিহর আবদুল্লাহরও অভিভাবক। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার শেষ কথায় সারা সোফিয়া ও আবু ফিহর আবদুল্লাহ দুজনেই দুজনের দিকে তাকাল। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠল সলজ্জ বিব্রত ভাব। দুজনের কেউই কথা বলল না।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল হাতে নিয়ে তাকাল স্ক্রিনের দিকে আহমদ মুসা। প্রেসিডেন্টের টেলিফোন।
তাড়াতাড়ি আহমদ মুসা মোবাইল অন করে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে ওপর থেকে প্রেসিডেন্ট বলল, মি, আহমদ মুসা সবাই এসে গেছে। আপনি কোথাও আটকা পড়েননি তো?
স্যরি মি. প্রেসিডেন্ট। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সময়ের মধ্যে পৌঁছতে পারব ইনশাআল্লাহ। আমি এখন হাসপাতালে। সিসিলি থেকে আমাদের একজন ভাই এসেছেন সারা সোফিয়াকে নিয়ে যাবার জন্য। ওরা চলে যাচ্ছে। বলল আহমদ মুসা।
কোনো অসুবিধা নেই ওদের? প্রেসিডেন্ট বলল ওপার থেকে।
কোনো অসুবিধা নেই তো ওদের। ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট, আপনার সাহায্যে চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থা হয়েছে। দ্রুত সেরে উঠতে পেরেছে। সারা সোফিয়া। বলল আহমদ মুসা।
মি. আহমদ মুসা, সব কাজ তো আপনিই করেন ভাই। আমি তো শুধু ইয়েস করি। সব কৃতিত্ব আল্লাহর পরে আপনার। প্রেসিডেন্ট বলল।
আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। আমি আসছি মি. প্রেসিডেন্ট।
সালাম দিয়ে মোবাইল রেখে দিয়ে তাকাল আহমদ মুসা আবু ফিহর। আবদুল্লাহ ও সারা সোফিয়ার দিকে। বলল, তাহলে আপনারা থাকুন। আমি মনে করি, আবু ফিহর আবদুল্লাহ রত্নদ্বীপে নতুন। কিছুটা ঘুরে ফিরে দেখুন। আমাকে যেতে হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের সাথে জরুরি একটা বৈঠক আছে।
স্যরি স্যার, একটা বিষয়ে আপনার নির্দেশ দরকার। রত্নদ্বীপ থেকে সন্ধ্যা ৬টায় একটা প্লেন এথেন্স, তিরানা, রোম হয়ে পালারমো, তিউনিস রুটে যাবে। আরেকটা রাত ১২টায় ত্রিপলি, তিউনিস, মাল্টা, পালারমো। হয়ে রোমের দিকে যাবে। আমি দুই রুটেই বুকিং দিয়েছি। এখন আপনার নির্দেশনা চাই স্যার। আবু ফিহর আবদুল্লাহ বলল।
রাত ১২টার রুট নাও। এদিকে একটু বেড়াবার সুযোগ পাবে আর রুটটাও কিছু সংক্ষিপ্ত হবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। তাহলে ১২টার রুট আমি কনফার্ম করছি। আবু ফিহর বলল।
আবু ফিহর তুমি সারা সোফিয়ার কাছে হাসপাতালেই থাক। নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাপ্টেন আলিয়ার নেতৃত্বে একটা নিরাপত্তা টিম তোমাদের। বেড়াতে নিয়ে যাবে। তোমাদের একা কোথাও বেরোনো চলবে না। আমি তাহলে আসছি। আবু ফিহর, সারা সোফিয়া। বলল আহমদ মুসা।
আপনার সাথে আবার কখন দেখা হচ্ছে স্যার? সারা সোফিয়া বলল।
আমি প্রেসিডেন্টের কাছে যাচ্ছি। একটা মিটিং আছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে। সেখান থেকে পরিস্থিতি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে আমি জানি না। তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে যাব। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আমি শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন, আর পরিবারকে নতুন জীবন দিয়েছেন, আমাদের দুই পরিবারকে একত্রিত করেছেন। আপনার সাথে আমাদের এটাই শেষ দেখা হতে পারে না।….।
কথা শেষ করতে পারল না সারা সোফিয়া। কেঁদে ফেলল।
সারা সোফিয়া তুমি খুবই সচেতন, বাস্তববাদী মেয়ে। পৃথিবীকে তুমি বুঝেছ এর মধ্যে। কাঁদবে না। আমি চেষ্টা করব তোমাদের বিদায় জানাতে। না পারলে আমার অপারগতা তোমরা বুঝবে। বলল আহমদ মুসা।
সারা সোফিয়া মুখ তুলে মুহূর্তের জন্যে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। কিছুটা দ্বিধা করল। বলল, আপনার সাথে আর দেখা হবে কিনা তাই বলছি…
কথা তার থেমে গেল কান্নায়। নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করল। চোখ মুছল। বলল, স্যার আপনি একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন দুই পরিবারের দুই সর্বকনিষ্ঠের জন্যে। আমি ইঙ্গিত বুঝেছি স্যার। চিন্তা করেছি। আপনার ইঙ্গিতকে আমি স্রষ্টার ইচ্ছা বলে মনে করেছি। নরম ভারি লজ্জাজড়িত কণ্ঠ সারা সোফিয়ার।
ধন্যবাদ বোন। বলে আহমদ মুসা তাকাল আবু ফিহর আবদুল্লাহর দিকে। মাথা নিচু করল সে। বিব্রত তারও মুখ। বলল, স্যার, উনি যা বলেছেন, সেটাই আমারও কথা।
ধন্যবাদ। আল্লাহ তোমাদের সিদ্ধান্তে বরকত দিন। দুই পরিবারের দুই ধারা এক ধারায় পরিণত হোক। আল্লাহ হাফেজ আসছি। বলল আহমদ মুসা।
যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল আহমদ মুসা।
স্যার দয়া করে আমাকে বোন বলেছেন। বোনের একটা শর্ত আছে। শর্ত হলো, ভাই সিসিলি না গেলে বোন কিছুই করবে না, কিছুই হবে না। সারা সোফিয়া বলল।
শর্তের কথাটা আমাকে নয় বোন, আল্লাহকে বল।
বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল।
৫
বৈঠকটা প্রেসিডেন্টের বাড়িতে। বাদ মাগরিব বৈঠক।
আহমদ মুসা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের রিসিপশনে পৌঁছল মাগরিব নামাজের দশ মিনিট আগে।
প্রেসিডেন্টের ভিআইপি ওয়েটিং রুমে ঢুকে দেখল জায়নেব জাহরা বসে আছে।
আহমদ মুসা ঢুকতেই জায়নেব জাহরা উঠে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে আহমদ মুসা বলল, ধন্যবাদ জাহরা। ঠক সময়েই এসেছ। চল প্রাসাদের মসজিদে নামাজ পড়ে এসে বসি।
রত্নদ্বীপে জুমা ও ওয়াক্তিয়া সব নামাজই ছেলেমেয়ে সবাই মসজিদে গিয়ে পড়ে।
জাহরা বলল, চলুন স্যার।
দুজনেই হাঁটতে লাগল মসজিদের দিকে।
স্যার, প্রেসিডেন্টের সাথে স্বর্ণভাণ্ডার নিয়েই কি আলোচনা করবেন? উনারা কি বলবেন। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে স্যার। জাহরা বলল।
হ্যাঁ, জাহরা। স্বর্ণভাণ্ডারের ইতিহাসের উপর কয়েক পাতার যে ব্রিফ ছিল, ওটা তো এনেছ তুমি। বলল আহমদ মুসা।
জি স্যার। জাহরা বলল।
আর ডায়েরিটা? বলল আহমদ মুসা।
ওটা আনতে বলেছিলেন, এনেছি। জাহরা বলল।
ধন্যবাদ জাহরা। বলল আহমদ মুসা।
নামায শেষে আহমদ মুসা ও জাহরা ভিআইপি ওয়েটিং রুমে ফিরে এল। এসে দেখল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস, অর্থমন্ত্রী বেন নাহান। আরমিনো এবং তাদের পিএসরা। প্রেসিডেন্টের পিএসও এসেছেন। অতিথিদের স্বাগত জানাতে। আহমদ মুসা ও জাহরা ঘরে ঢুকতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টের পিএস এগিয়ে এসে স্বাগত জানাল আহমদ মুসা ও জাহরাকে।
আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল, আপনি আমাদের বুক গর্বে ভরে দিয়েছেন। আমরা হাতেম তাইকে দেখিনি, রবিন হুডকে দেখিনি, কিন্তু তাদের বড় আহমদ মুসাকে আমরা দেখছি। রত্নদ্বীপের পরম সৌভাগ্য।
কিছুটা অস্বস্তির ভাব আহমদ মুসার চোখে-মুখে। কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের পিএস এগিয়ে এল। বলল, সময় হয়েছে স্যার। আপনারা আসুন। প্রেসিডেন্ট আসছেন।
সকলেই মিটিংরুমের দিকে এগিয়ে চলল।
কিন্তু প্রেসিডেন্টের পিএস মিটিংরুমের পাশ কাটিয়ে সকলকে নিয়ে চলল সামনে। বলল পিএস, স্যার, প্রেসিডেন্ট বসবেন তার অফিস কক্ষে। সেখানেই মিটিং হবে।
প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষে সবাই গিয়ে বসল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট এসে প্রবেশ করল তার অফিস কক্ষে।
সবাই উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট সবাইকে বসতে বলে নিজে বসে বলল, মিটিং রুম, কমিটি কক্ষ সবই বড়। আমাদের চার পাঁচজনের মিটিং ওখানে মানায় না। তাই অফিসেই বসলাম।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে তো ভাই আহমদ মুসা?
অবশ্যই এক্সিলেন্সি। এখানে বসাটা আরও ভালো হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
ভাই আহমদ মুসার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে। আপনি প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই কাজের ময়দানে আছেন। এমনকি রাতেও আপনি বেরিয়ে যান। আপনার রেস্ট হয় না, আপনি রেস্ট নেন না? প্রেসিডেন্ট বলল।
আহমদ মুসা একটু হেসে বলল, এক্সিলেন্সি আপনার কাছে। একদিকের রিপোর্ট রয়েছে। আমি যে চব্বিশ ঘন্টা শুয়েও থাকি, এ রিপোর্ট আপনার কাছে নেই।
সবাই হেসে উঠল। প্রেসিডেন্টও।
আপনার চব্বিশ ঘন্টা শুয়ে থাকার ও রেস্টের সময় রত্নদ্বীপে নিশ্চয় হয়নি? বলল প্রেসিডেন্ট।
চব্বিশ ঘন্টা না হলেও রেস্ট আমি নিয়ে থাকি এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। আমরা এটাই চাই। আপনার সুস্থতা সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি। আপনি রত্নদ্বীপের জন্যে যে জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন ভাবলে আমার আতংক বোধ হয়। আল্লাহ আপনাকে এবং রত্নদ্বীপকে দয়া করুন, সাহায্য করুন। বলল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট একটু থেমেই আবার বলল, দুই হাতে গুলিবিদ্ধ সিসিলির যে মেয়েটি হাসপাতালে ভর্তি ছিল তার শেষ খবর কি? তাকে নিয়ে যাবার জন্যে সিসিলি থেকে যার আসার কথা ছিল, তিনি কি এসেছেন?
জি এক্সিলেন্সি, তিনি এসেছেন। আমি হাসপাতাল থেকেই আসছি। ওরা আজ রাত ১২টার প্লেনে সিসিলি ফিরছে।
আলহামদুলিল্লাহ। আপনি যে দুই পরিবারকে মিলিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন, তা একটা বড় কাজ ভাই আহমদ মুসা। সিসিলি থেকে মুসলমানদের নির্মূল হবার কাহিনী এবং খৃস্টান ও মুসলিম দুই পরিবারের। পরস্পর সহযোগী হবার রূপকথার মতো স্টোরি শুনে আমি সত্যিই। অভিভূত হয়েছি। আমরা রত্নদ্বীপে মুসলমান, খৃস্টান ও ইহুদি জনগোষ্ঠীর। মধ্যে এমন সহযোগিতা, সহমর্মিতার সম্পর্কই গড়ে তুলতে চাই, যা যুগ যুগান্তর ধরে অটুট থাকবে। এখানে রাষ্ট্র, ধর্ম ও মানুষ এক হয়ে যাবে। এই এককের মধ্যেই আবার সব ধর্মবিশ্বাসীরা হবে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। সবচেয়ে বড় মূল্য দেয়া হবে ব্যক্তির মতকে। এজন্যে ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনকে ঈর্ষা, বিদ্বেষ নয়, সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হবে। আলহামদুলিল্লাহ, এই মহাযাত্রায় ইতিমধ্যেই আমরা অনেকখানি সফল। হয়েছি।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, রত্নদ্বীপ এটা পেরেছে এক্সিলেন্সি। রাষ্ট্র, সমাজে ধর্মবিশ্বাসীদের সহাবস্থানকে আমরা আরও সুন্দর ও কার্যকরি করে তুলব। আমাদের এই উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেবার জন্যে বাইরে থেকে কুৎসিত ষড়যন্ত্র ছুটে এসেছে, এদের কালো হাত অবশ্যই আমাদের ভেঙে দিতে হবে। বলল অর্থমন্ত্রী ইহুদি নেতা বেন নাহান আরমিননা।
ঈশ্বরের ইচ্ছায় ওদের ষড়যন্ত্র অবশ্যই ব্যর্থ হবে। ওদের চারটি ঘাঁটির দুটির পতন ইতিমধ্যেই ঘটেছে। যে সন্ত্রাসী জনশক্তি নিয়ে ওরা দ্বীপে অনুপ্রবেশ করেছিল, সে মূল জনশক্তি নির্মূল হয়ে গেছে। বাইরে থেকে বাড়তি জনশক্তি তারা আনছে। আক্রমণ নয়, ওরা আত্মরক্ষায় এখন ব্যস্ত। সামনে ওদের আত্মরক্ষার শক্তিও থাকবে না। আমাদের সবার পরম ভাই আহমদ মুসার অগ্রগতি আমাদের এই আশার বাণীই শোনাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খৃস্টান নেতা ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
রত্নদ্বীপের উপর আল্লাহর অসীম রহমত আছে। তিনি আমাদের ভালোবাসেন বলেই ভাই আহমদ মুসাকে দয়া করে আমাদের সাহায্যে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর এই সাহায্য না পেলে আমরা কি অবস্থায় পড়তাম তা ভাবতেও আতংক বোধ হয়। বলল প্রেসিডেন্ট।
কথা শেষ করে প্রেসিডেন্ট তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তারপর তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দিকে। বলল, আজকের এই বৈঠকটা ডেকেছি আহমদ মুসার পরামর্শে। তিনি ভবিষ্যতের কাজ এবং আরও একটা বিষয়ে কথা বলতে চান! কথা শুরু করার জন্যে আমি ভাই আহমদ মুসাকে অনুরোধ করছি।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসে তাকাল পাশে বসা জাহরার দিকে। তারপর প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কথা শুরুর আগে আমাদের এক বোনের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই। এ হলো জায়নেব জাহরা। সে রত্নদ্বীপ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ছাত্র হিসাবে পড়া শুনা করছে। এর যে পরিচয়টা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো স্পেনের গ্রানাডার শেষ সুলতান আবদুল্লাহর সে সর্বকনিষ্ঠ উত্তরসূরি। মরক্কোর ছোট্ট এক শহরে সে বাস করে। স্পেনের সুলতান আবদুল্লাহর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের পর তার পরিবার মরক্কোর এই ছোট শহরেই এসে আশ্রয়। নেয়। সেখানেই সুলতানের অধস্তন বংশধররা এখনও বাস করে। সুলতান আবদুল্লাহর পতন যখন অবধারিত হয়ে উঠেছিল, তখন সুলতানের মা শাহমাতা তার অর্থ ও অলংকার সব তিনি স্পেন থেকে সরিয়ে কোনো এক নিরাপদ স্থানে গচ্ছিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং এর দায়িত্ব তিনি তার অতি বিশ্বস্ত কয়েকজনের উপর দেন। তারা এই সম্পদ সুদূর স্পেন থেকে সরিয়ে এনে এই রত্নদ্বীপের এক জায়গায় গচ্ছিত রাখেন। তখন এই রত্নদ্বীপে কোনো জনবসতি ছিল না। শুধু ভূমধ্যসাগরে চলাচলকারী জাহাজের নাবিকরা পাহাড়ের দেয়াল ঘেরা এই দুর্গম দ্বীপে নামতো মিঠা পানি ও ফল-মূলের সন্ধানে। তার গোপন ধনভাণ্ডারের খবর যাতে তার বংশধরদের কাছে পৌঁছে সে ব্যবস্থাও শাহমাতা করে যান। জায়নেব জাহরার দাদী বংশের সর্বশেষ ব্যক্তি যার কাছে গুপ্তধনের। ডকুমেন্ট গচ্ছিত ছিল। এরা এখনও জানেন না সাংকেতিক পদ্ধতিতে বন্ধ ছোট বাক্সে রাখা গুপ্তধনভাণ্ডারের দলিলে কি আছে, গুপ্তধনভাণ্ডার উদ্ধারের নির্দেশিকায় কি আছে, শাহমাতার সার্বিক নির্দেশে কি আছে? তবে যে বা যারা বাক্সটা খুলতে পারবে, তারাই সেই ধনভাণ্ডার উদ্ধার করবে। শাহমাতার একটা বক্তব্য তিন চার পৃষ্ঠার কাগজে লিখিত ছিল। এতে গুপ্তধনভাণ্ডার সম্পর্কে শাহমাতার কথা এবং গুপ্তধন উদ্ধারের সংক্ষিপ্ত একটা নির্দেশিকা চার লাইনের একটি কবিতায় উল্লেখ ছিল। কিছুদিন আগে জায়নেব জাহরার দাদী একটা স্বপ্ন দেখেন। শাহমাতার লিখিত বক্তব্যে গুপ্তধনভাণ্ডার যে দ্বীপে গচ্ছিত আছে, যে দ্বীপের লোকেশন সম্পর্কে একটা সংকেত দেয়া আছে- স্বপ্নে তাকে ঐ দ্বীপে যেতে বলা হয়। বলা হয় যে, ঐ দ্বীপে গেলে যার হাতে গুপ্তধনভাণ্ডারের উদ্ধার হবে, তাকে পেয়ে যাবে। এই স্বপ্নের পর জায়নেব জাহরার দাদী গুপ্তধনভাণ্ডারের দলিল সংবলিত বাক্স, শাহমাতার বক্তব্য সংবলিত যে। ডায়েরি রয়েছে, সেটাসহ সবকিছু জায়নেব জাহরার দায়িত্বে দিয়ে তাকে। বংশের সর্বকনিষ্ঠ উত্তরসূরির মর্যাদা দিয়ে তাকে অজানা ঐ দ্বীপে যেতে বলেন। দ্বীপের লোকেশনের যে সংকেত পাওয়া গেছে, সে অনুসারে মাপ-জোক ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে রত্নদ্বীপকেই তারা চিহ্নিত করে। জাহরা চলে আসে ছাত্রের পরিচয় নিয়ে রত্নদ্বীপে। ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, যদিও রাবাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি তার ছিল। জাহরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-শুনা করতে থাকে এবং একই সাথে সন্ধান। করতে থাকে সেই লোকটিকে- দাদীর স্বপ্নে যার কথা বলা হয়েছে, যিনি গুপ্তধনভাণ্ডার উদ্ধারে সহযোগিতা করবেন। ইতিমধ্যে রত্নদ্বীপে কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে। সেই সন্ত্রাস দমনে আমি আপনাদের শামিল হয়ে যাই। এই সময় জাহরার সাথে আমার পরিচয় হয়। পরিচয়ের বেশ কিছু দিন পর একদিন সে আমাকে তার পরিচয় দেয়, শাহমাতার গুপ্তধনভাণ্ডারের কথা বলে এবং বলে যে আমিই সেই ব্যক্তি দাদীর স্বপ্নে যার কথা বলা হয়েছে। এরপর শাহমাতার বক্তব্য সে আমাকে পড়তে দেয়। সে বক্তব্য পাঠ করে আমি গুপ্তধনভাণ্ডারের সংক্ষিপ্ত সংকেতটাও জেনে নেই। তারপর সেদিন আমি গোয়াদিয়া অঞ্চলে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের জাদোক ঘাঁটিতে অভিযানে যাই। এই জাদোকের পূর্ব দিকের পাহাড়ের সুন্দর গঠনের দিকে নজর বুলাতে গিয়ে শাহমাতার গুপ্তধনভাণ্ডারের সংক্ষিপ্ত সংকেত আমার মনে হয় এবং নিশ্চিত হই যে, এখানেই শাহমাতার সেই লুকানো ধনভাণ্ডার আছে। এরপর বিষয়টা আমি জাহরাকে বলি এবং আপনাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেই। আজকের বৈঠকে আমি আরও যেসব বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছি তার মধ্যে এ বিষয়টাও আছে। থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস ও অর্থমন্ত্রী বেন নাহন আরমিনো ঘুরে বসে জাহরার দিকে তাকিয়ে বলল, ওয়েলকাম শাহজাদী জায়নেব জাহরা। গ্রানাডার সুলতান আবদুল্লাহ ও তার পরিবারকে যদিও দুর্ভাগ্য গ্রাস করেছে, তবু আমরা সম্মান করি সুলতানকে। তার উত্তরসূরি তোমাকে পেয়ে সত্যিই অভিভূত হয়েছি। এ এমন বাস্তবতা, যা স্বপ্নের চেয়েও বড় স্বপ্ন। তোমাকে সামনে সশরীরে? উপস্থিত দেখেও স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
ভাই আহমদ মুসা, জায়নেব জাহরার পরিচয় প্রকাশ হওয়ার পর সে আর তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা ঠিক মনে করছে না। আপনার মত কি? বলল প্রেসিডেন্ট।
আপনার সাথে আমিও একমত এক্সিলেন্সি। এখন সে আপনার অতিথি হতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমি আজই নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি। যাতে জাহরা মা আজকেই চলে আসতে পারে হল থেকে। বলল প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আমি মূল আলোচনায় ফিরে আসতে চাই। শাহমাতার ধনভাণ্ডারের বিষয়ে আমি কিছু কথা বলেছি। বিস্তারিত ও মূল্যবান অনেক কথা আছে সুলতান আবদুল্লাহর মা শাহমাতার লিখিত বক্তবে। যা তার ডায়েরিতে সংরক্ষিত আছে। সে লেখার সবটা শোনার সময় হবে না, আমি চাই শেষ প্যারাটা পড়া হোক। এক্সিলেন্সি অনুমতি দিলে শাহজাদী জায়নেব জাহরা পড়তে পারে। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, শুনলে আমরা খুশি হবো। শাহমাতার নিজের হাতের লেখায় তার কথা শোনা একটা দুর্লভ সুযোগ। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
পড়তে শুরু করার আগে জায়নেব জাহরা বলল, আমি ডায়েরির শেষ প্যারাটি পড়ছি। ১৫১১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি এই শেষ অংশটি লেখা হয়েছে। পড়া শুরু করল জাহরা।
পড়া যখন শেষ করল তখন গোটা কক্ষে পিনপতন নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস। উঠে দাঁড়িয়ে শাহমাতার বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে একটা বাউ করে বলল, উপসংহারের কয়েকটি কথায় শাহমাতা ঈশ্বর নির্ভরতা, দূরদর্শিতা, নিখুঁত পরিকল্পনা, ধনভাণ্ডার লুকিয়ে রাখা ও উদ্ধারের নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে যে মেধা, যোগ্যতা ও ভবিষ্যৎ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা অনন্য। শত শত বছর আগে এই কাজ তিনি করেছেন। তাঁকে হাজারো সালাম।
আমারও এই কথা মি. ক্রিস কনস্টানটিনোস। তার ধনভাণ্ডার উদ্ধারে আমরা তার উত্তরসূরি শাহজাদী জাহরাকে অবশ্যই সাহায্য করবো। বলল অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিনো।
থ্যাংক ইউ এক্সিলেন্সি। আমাদের শাহ পরিবার আপনাদের কাছে। কৃতজ্ঞ থাকবে। জাহরা বলল।
মি. এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট, অর্থমন্ত্রী মি. বেন নাহান গোপন ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে সাহায্য দেয়ার কথা বলেছেন। আমি একটা অনুরোধ করব, গোপন ধনভাণ্ডার উদ্ধার অভিযানে এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্টসহ এখানে উপস্থিত দুই মাননীয় মন্ত্রীকে শামিল হতে হবে। এই ধনভাণ্ডার শুধুই একটা ধনভাণ্ডার নয়, একটা ঐতিহ্যবাহী শাসক বংশের সম্পদ এটা। এর সাথে নিশ্চয় সম্পদ ব্যবহারেরও নির্দেশিকা থাকবে। বলল আহমদ। মুসা।
প্রেসিডেন্ট আবদুল করিম হিশামের মুখে এক টুকরো মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ভাই আহমদ মুসা, আপনি সত্যিই অনন্য এক দূরদর্শী মানুষ! কারো মনে সন্দেহের সামান্যতম সুযোগও আপনি রাখতে চান
। ধনভাণ্ডারের সবকিছু আপনি রত্নদ্বীপ রাষ্ট্রের সবার চোখের সামনে উন্মুক্ত করতে চান। আমরা আপনার সাথী হতে রাজি আছি ভাই আহমদ মুসা। সত্যিই আমার জানার খুব অগ্রহ- সবার সম্মানিত শাহমাতা শত শত বছর আগে তার গচ্ছিত সম্পদ বিতরণের কি ব্যবস্থা করে গেছেন।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আপনার এই সিদ্ধান্ত শাহমাতাকে সম্মানিত করেছে। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা বলল, এক্সিলেন্সি এবার আমি অন্য প্রসঙ্গে আসতে চাই।
হ্যাঁ, প্লিজ বলুন মি. আহমদ মুসা। বলল প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। হাতঘড়ির দিকে একটু তাকাল। মুখ তুলে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, সিসিলির মেয়ে সারা সোফিয়া দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে একটি…।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে উঠল, সারা সোফিয়া মেয়েটা তো চলে যাচ্ছে। সে তো আপনাকে হত্যা করার জন্যে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে রত্নদ্বীপে এসেছিল এবং হত্যার চেষ্টাও করেছিল। তার বিস্তারিত ঘটনাটা জানতে চাই জনাব।
সে এক বিরাট ঘটনা জনাব। সে আমাকে চারবার হত্যার সুযোগ পায়। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। সে ব্যর্থ হবার পর তাকে হত্যারও সুযোগ আমার হয়েছিল। তবুও আমি তাকে হত্যা করিনি দুই কারণে। এক, সে ব্ল্যাক সিন্ডিকেডের লোক নয়, দুই, তাকে বাঁচিয়ে রাখলে তার। কাছ থেকে কিছু জানার সুযোগ হতে পারে। সে সুযোগ হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানা গেছে তার কাছ থেকে। তাছাড়া বিরাট একটা লাভ হয়েছে সিসিলির মুসলমানদের জন্যে।
সে কি মুসলমান? জিজ্ঞাসা বেন নাহানের।
না, সে মুসলমান নয়, তবে সিসিলির বিখ্যাত এক মুসলিম পরিবারের সাহায্যকারী এক বিখ্যাত খৃস্টান পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান সে। বলল আহমদ মুসা।
তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কি জানা গেছে ভাই আহমদ মুসা? প্রেসিডেন্ট বলল।
একটা জায়গার নাম পাওয়া গেছে। সেটাই রত্নদ্বীপে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টার। নাম রেনেটা। বলল আহমদ মুসা।
রেনেটা? স্বগত উচ্চারণ করল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
জি, স্থানটার নাম রেনেটা। বলল আহমদ মুসা আবার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটু ভেবে বলল, কিন্তু ঐ নামে তো রত্নদ্বীপে কোনো। স্থান বা বাড়ি নেই!
অর্থমন্ত্রী নাহানও ভাবছিল। বলল, হ্যাঁ, এই নামে আমাদের রত্নদ্বীপে কোনো জায়গা নেই, বাড়িও নেই- এখানে যা আছে সবই আমাদের চোখের সামনে।
আপনাদের কথা ঠিক, ঐ নামে কোনো স্থান এখন নেই। হয়তো কখনো ছিল। আমাদের আরও ভাবতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। আপনি ঠিকই বলেছেন। অমনটা হতে পারে। অনেক পুরানো নাম তো এখন নেই। প্রেসিডেন্ট বলল।
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট আবার বলে উঠল, হ্যাঁ ভাই আহমদ মুসা, মেয়েটি আর কি তথ্য দিয়েছে? এ তথ্যটা মেয়েটার শোনা কথা। শোনা কথা হলেও কথাটা আমার কাছে সঠিক মনে হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
কি সেই তথ্য? গুরুতর কিছু? জিজ্ঞাসা আবার প্রেসিডেন্টের।
সে যা বলেছে তার অর্থ দাঁড়ায়, ব্ল্যাক সিন্ডিকেট একের পর এক হেরেছে। হারার এক পর্যায়ে তারা চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারে। আর সেটা হলো, ভাড়াটে সৈন্য এনে রত্নদ্বীপ আক্রমণ করা, সরকারের পতন ঘটিয়ে রত্নদ্বীপ দখল করে নেয়া। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সকলেই চমকে উঠল। তাদের চোখে-মুখে নেমে এল উদ্বেগের ছায়া।
কিছুক্ষণ তারা কেউ কথা বলতে পারল না।
প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছে। এক সময় এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে। বলল, ভাই আহমদ মুসা, আপনি অনেক অভিজ্ঞ। অনেক সংঘাত-সংঘর্ষ আপনি মোকাবিলা করেছেন। বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসী শক্তির দম্ভ আপনি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো দেশও সন্ত্রাস মোকাবেলায় আপনার সাহায্য নিয়েছে। আপনি প্লিজ বলুন, গুপ্তধন সন্ধানী একটা সন্ত্রাসী গ্রুপ কি আমাদের রত্নদ্বীপ দখল করে নিতে পারে?
তা সম্ভবপর এক্সিলেন্সি। এখন ব্ল্যাক সিন্ডিকেট তো আসছে না, আসছে তাদের ভাড়াটে সৈন্যরা। অর্থ থাকলে ভূমধ্যসাগরের ইউরোপীয় উপকূল অঞ্চলে প্রচুর ভাড়াটে সৈন্য এখনও মিলে। আর টাকা দেয়ার লোক ওদের আছে। আপনারা জানেন ব্ল্যাক সিন্ডিকেট গুপ্তধন হাত করতে চায়। কিন্তু এদের পেছনে আরেকটা গোপন পক্ষ আছে যারা রত্নদ্বীপে মুসলমান, খৃস্টান, ইহুদিদের সহাবস্থান ও মৈত্রী পছন্দ করে না। তারা রত্নদ্বীপের সংবিধান ব্যর্থ এবং এখানকার সরকারের পতন ঘটাতে চায়। এই গোপন গ্রুপই ব্ল্যাক সিন্ডিকেটকে টাকা দিয়েছিল সন্ত্রাস, খুন-খারাবির মাধ্যমে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে। ব্ল্যাক সিন্ডিকেট যখন এটা করতে পারছে না, তখন গোপন কোনো সন্ত্রাসী সৈন্য ভাড়া করার কর্মসূচি তারা নিতে পারে। ভেতর থেকে ব্ল্যাক সিন্ডিকেট তাদের সহযোগিতা করবে। ওদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, রত্নদ্বীপের চারদিকে পাঁচশ মাইলের মধ্যে কোনো দেশ নেই। সুতরাং রত্নদ্বীপে কি ঘটছে দুনিয়ার কেউ তা জানবে না, কারও সাহায্যও চাওয়া যাবে না, আর কোনো সাহায্য আসবেও না।
মুখ শুকিয়ে গেল প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সকলের। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তারা সকলেই। তারা বুঝতে পারছে আহমদ মুসা যা বলেছে, তার প্রতিটি কথা বাস্তব। একটি কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। কামান, মর্টার, স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রসজ্জিত কোনো বড় বাহিনী যদি আসে, তাদের সাথে সামরিক হেলিকপ্টার যদি থাকে, তাহলে এই ছোট দ্বীপকে তারা ধুলো করে দিতে পারে।
বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সকলেই।
নীরবতা ভাঙল অর্থমন্ত্রী বেন নাহান। বলল, জনাব আহমদ মুসা, আপনার প্রতিটি কথা আমরা সত্যি মনে করছি, কিন্তু ছোট্ট এই রত্নদ্বীপ কি তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে? ধ্বংস হয়ে যাবে শান্তি, সহাবস্থানের সুন্দর এই সংবিধান? সব আশা-আকাক্ষা শেষ হয়ে যাবে কি এই দ্বীপের মানুষের? অবরুদ্ধ আবেগে ভেঙে পড়ল অর্থমন্ত্রী ইহুদি নেতা বেন নাহানের কণ্ঠ।
আমি বলেছি, ষড়যন্ত্র যা হয়েছে সেটা। কিন্তু হতাশ হবার কিছু নেই। যারা রত্নদ্বীপের শাসন ও সংবিধান ধ্বংসের জন্য কাজ করছে, তাদের শক্তি আল্লাহ রাব্বল আলামিনের কাছে কিছুই নয়। তার উপর নির্ভর করে তাদের প্রতিরোধ, প্রতিহতের জন্যে আমাদের কাজ করা দরকার। আমরা ইনশাআল্লাহ বিজয়ী হবো। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, আমরা হতাশ হলেও, ভীত হলেও আমাদের নিয়ে আপনি হতাশ নন। সত্যি ভাই আহমদ মুসা, আমরা বিপদের মধ্য দিয়েই চলছি, কিন্তু যে বিপদের কথা আপনি বললেন তা আমাদের অস্তিত্বের জন্যেই বিপজ্জনক। এখন কিভাবে এ থেকে রত্নদ্বীপের মানুষকে রক্ষা করতে পারি? প্রতিরোধ ও প্রতিহতের জন্যে কাজ করার কথা বলেছেন, সেটা কিভাবে? এ সব আপনাকেই ভাবতে হবে। ভেবেছেন কিছু? বলল প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্টের কণ্ঠও আবেগে ভারি।
এক্সিলেন্সি আমি গোটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছি। আমাদের প্রথম কাজ হলো, যাদের উপর ভর করে ভাড়াটে সৈন্য আসবে তাদের আশ্রয় এবং তাদের জনশক্তিকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়া হবে, যেন বাইরের কাউকে সাহায্যের শক্তি ও সুযোগ তাদের না থাকে। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ওদের ভাড়া করা সৈন্যদের মোকাবিলায় আমাদের নিজেদের প্রস্তুত করা এবং আশেপাশের বন্ধুদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য নেয়া। বলল আহমদ মুসা।
আশেপাশে তেমন কোনো বন্ধু কি আমাদের আছে? প্রেসিডেন্ট বলল।
ও বিষয়টা আমার হাতে ছেড়ে দিন। আমি ইতিমধ্যেই তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি। আমরা চাইলে ম্যান-ম্যাটেরিয়াল সব সাহায্যই তারা দেবে। এ বিষয়টা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব মি. প্রেসিডেন্ট। এখন প্রথম কাজটাই আমাদের দ্রুত করা দরকার। এতে আমরা সফল হলে ভাড়াটে সৈন্যদের আক্রমণের আশংকা দূর হবে, এমনকি নাও থাকতে পারে। ভেতর থেকে শক্তিশালী সাপোর্ট না পেলে বাইরের শক্তি সুবিধা করতে পারে না। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক মি. আহমদ মুসা। ভেতরের ষড়যন্ত্রকে নির্মূল করতে পারলে বাইরের কারও এদিকে হাত বাড়াবার সাহস অনেক কমবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের দুটি ঘাঁটির পতন ঘটেছে এ পর্যন্ত। শতাধিকের মতো লোক ওদের নিহত হয়েছে। সারা সোফিয়ার কাছ থেকে একটা তথ্যে জানা গেছে, উত্তরের আমোড়ি অঞ্চলে আরাগনে একটা ঘাঁটি ছিল ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের। উপযুক্ত ও বিশ্বস্ত জনশক্তির অভাবে আরাগন ঘাঁটি ওরা বন্ধ করে দিয়ে ওখানকার জনশক্তিকে হেডকোয়ার্টারের অধীনে নিয়ে গেছে। এখন ব্ল্যাক সিন্ডিকেট বলতে গেলে তাদের হেডকোয়ার্টারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই ঘাঁটিটা যদি ওদের ধ্বংস করা যায়, তাহলে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটকে বেঘর করা যাবে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া তাদের অবশিষ্ট লোকদের খুঁজে খুঁজে কাস্টোডিতে নিতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ আহমদ মুসা। খারাপ খবরের মধ্যে এই খবর আমাদের জন্যে আনন্দের। এখন তাহলে আমাদের টার্গেট ওদের হেডকোয়ার্টার খুঁজে বের করা। কিন্তু যে নামটা পাওয়া গেছে, সেটা সমস্যা বাড়িয়েছে। এ সমস্যার মোকাবিলা আপনাকেই করতে হবে ভাই আহমদ মুসা। আমাদের সব সাহায্য আপনার সাথে আছে।
আমি নামের ধাঁধা থেকে ঠিকানাটা বের করে আনার চেষ্টা শুরু করেছি। ইতিমধ্যে এক্সিলেন্সি জাহরার শাহমাতার ধনভাণ্ডার উদ্ধারের কাজটা আমরা সারতে পারি। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ আহমদ মুসা, এই কাজটা হয়ে যেতে পারে। এ কাজটা আমরা সাফল্যের সাথে করতে পারলে আল্লাহও খুশি হবেন। শাহমাতার ধনভাণ্ডার উদ্ধারের আয়োজন করুন আহমদ মুসা। বলল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট কথা শেষ করতেই অর্থমন্ত্রী বলল, হ্যাঁ মি. প্রেসিডেন্ট, ধনভাণ্ডারটা আমাদের দেশে শাহমাতার পবিত্র আমানত। আমরা যদি এটা উদ্ধার করে তার উত্তরসূরিদের হাতে তুলে দিতে পারি, তাহলে অবশ্যই তা হবে এক পুণ্যের কাজ। এ কাজ অবিলম্বে শুরু করা যেতে পারে।
ধন্যবাদ সকলকে। শাহমাতার দুর্ভাগা পরিবার কৃতজ্ঞ থাকবে আপনার প্রতি। বলল আহমদ মুসা।
আর তাদেরকে সাহায্য করতে পারা আমাদের জন্যে আরও বেশি আনন্দের।
বলেই প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি আসছি মি. আহমদ মুসা। আপনি তাড়াতাড়ি উদ্ধার অভিযানের প্ল্যানটা করে ফেলুন। আমরা প্রস্তুত আছি। যখনই আমাদের ডাকবেন, পাবেন আমাদের।
আহমদ মুসা ধন্যবাদ দিয়ে সালাম জানাল প্রেসিডেন্টকে।
সালাম নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট হাঁটতে লাগল তার পেছনের উন্মুক্ত দরজার দিকে।
.
সেই গম্বুজাকৃতি পাথরের সংকেত মোতাবেক আহমদ মুসা উপরে পাহাড়ের কার্নিশে উঠে এল। তার সাথে সাথে উঠে এল প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, জাহরা এবং কয়েকজন কর্মী।
আহমদ মুসা গম্বুজাকৃতি পাথরের ঠিক বরাবর সামনে দাঁড়িয়ে গুনে গুনে ছয় হাত সামনে এগোলো। আহমদ মুসা এমন জায়গায় এসে দাঁড়াল, যেখানে সামনে এবড়োথেবড়ো পাথরের সমারোহ আর মাথার উপরে পাহাড়ের কোলে শিশুর মতো শুয়ে থাকা উত্তর-দক্ষিণে বিলম্বিত গোলাকৃতি একটি পাথর থেকে বেরিয়ে আসা হস্তাকৃতির মতো একটা অংশ। অনেকটাই গাড়ি বারান্দার ছাদের মতো।
তাকাল আহমদ মুসা আশপাশ ও সামনের দিকে। আশাব্যঞ্জক কিছু নজরে পড়ল না।
আহমদ মুসা জাহরার কাছ থেকে পাওয়া সেই গোপন ধনভাণ্ডারের সংকেত নক্সা বের করল। দেখল, ছয় হাত পরে ভাঙা ভাঙা সাগরের ঢেউ। ঢেউভাঙা সাগরের দিগন্তে দাঁড়ানো একটা লণ্ঠন।
গভীর ভাবনার একটা রেখা ফুটে উঠল আহমদ মুসার চোখে মুখে। তাকাল আহমদ মুসা জাহরার দিকে, তারপর প্রেসিডেন্টর দিকে।
কি বুঝলেন ভাই আহমদ মুসা? কোনো সমস্যা? প্রেসিডেন্ট বলল।
সমস্যা তো বটেই।
এক মুহূর্ত থেমে আহমদ মুসা বলল, গম্বুজাকৃতি পাথর, তাতে লেখা, ৬ হাতের সংকেতের কথা আপনাদের বলেছি। সংকেতে ৬ হাতের পর দেখা যাচ্ছে, ভাঙা ভাঙা ঢেউয়ের একটা সাগর চিত্র। তার দিগন্তে একটা লণ্ঠন ভাসছে।
এখানে সাগর কোত্থেকে আসবে? তার উপর লণ্ঠন! অর্থ কি এর? প্রেসিডেন্ট বলল।
আহমদ মুসা ভাবছিল। এক সময় মুখ তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, মি. প্রেসিডেন্ট, সামনের ভাঙা পাথরগুলোকে আমরা ভাঙা ভাঙা ঢেউ বলতে পারি। দেখুন স্থানটা ভাঙা ঢেউয়ের মতোই বিশৃঙ্খল ও অসমতল। ওগুলোকে সাগরের ভাঙা ঢেউ কল্পনা করা যায়।
প্রেসিডেন্টসহ সবাই তাকাল পড়ে থাকা পাথরগুলোর দিকে। তাদের চোখে বিস্ময়। বলল প্রেসিডেন্ট, হ্যাঁ ভাই আহমদ মুসা, সামনের ভাঙা, ফ্ল্যাট ও উঁচু-নিচু পাথরগুলোকে আমরা সাগরের ভাঙা ঢেউ ধরে নিতে পারি, কিন্তু লণ্ঠন কোথায়?
ভাবনায় আচ্ছন্ন আহমদ মুসা তখনও। প্রেসিডেন্টের জিজ্ঞাসার জবাব দিতে একটু দেরি হলো। বলল, লণ্ঠন ওখানে থাকবে বিষয়টা এমন নয়। ওটা ইঙ্গিতমূলকও হতে পারে। প্রশ্ন হলো মি. প্রেসিডেন্ট, লণ্ঠন দিয়ে কি হয়, আমরা কি করি? আহমদ মুসা একটু থামল।
আহমদ মুসা থামতেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, লণ্ঠন আলো দেয়, লণ্ঠন নিয়ে আমরা অন্ধকারে পথ চলি।
মি. প্রেসিডেন্ট, তাহলে দাঁড়াচ্ছে, লণ্ঠন আসলে আলোর প্রতীক। আলো দিয়ে অনেক কাজ হয়। অন্ধকারে কিছু সন্ধান করতে হলে আলোর দরকার হয়। সুতরাং আলো সন্ধান কাজেরও ইঙ্গিত দেয়। লণ্ঠন আমাদের এই সন্ধান কাজের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন আসুন পাথরের সাগর পাড়ি দিয়ে ওপ্রান্তের দিকে কিছু খুঁজি।
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে লাগল ওপ্রান্তের দিকে। দাঁড়াল গিয়ে পাহাড়ের এবড়োথেবড়ো খাড়া গায়ের একদম গা ঘেঁষে।
সবাই এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার চারপাশে।
সবারই চোখ স্থানটার চারপাশে ঘুরছে।
ভাই আহমদ মুসা, আমরা কি খুঁজব? বলল প্রেসিডেন্ট।
যা কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়, সবই খোঁজার বস্তু। বলল আহমদ মুসা।
অনেকক্ষণ ধরে সবার চোখ খুঁজে বেড়াল অস্বাভাবিক কিছু পাবার জন্যে। কিন্তু তেমন কিছুই মিলল না। সবাই হতাশ হয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার চোখে-মুখে কোনো হতাশা নেই। শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন তার চেহারা। পলকহীন তার দৃষ্টি ঘুরছে একটা স্থানের এদিক থেকে ওদিকে, যে স্থানটাকে এইমাত্র প্রেসিডেন্ট ও তার মন্ত্রীরা দেখে এসেছে।
আহমদ মুসার অনুসন্ধিৎসু চোখ দুটি প্রায় সাজানো কতকগুলো পাথরের উপর ঘোরাফিরার পর স্থির হলো একটা তীরের আকৃতির উপর। সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসার মনে পড়ল জাহরার কাছ থেকে পাওয়া গুপ্তধনভাণ্ডারের সংকেত-তালিকায় সাগর ও লণ্ঠনের পর রয়েছে একটি তীরের নির্দেশ।
মি. প্রেসিডেন্ট, সাগর ও লন্ঠনের পরবর্তী সংকেতে আপনি দেখেছেন, তীরের নির্দেশ দেখতে বলা হয়েছে। তীরটি পাওয়া গেছে। তীরের নির্দেশও বোধ হয় পেয়ে গেছি মি, প্রেসিডেন্ট।
কোথায় তীরটা? প্রেসিডেট বলল।
আহমদ মুসা পাথরগুলো দেখিয়ে দিল কিভাবে ওগুলো একটা তীরের আকৃতি সৃষ্টি করেছে।
প্রেসিডেন্ট ও দুই মন্ত্রী একসাথেই সানন্দে বলে উঠল, ঠিক ঠিক, আহমদ মুসা, পাথরগুলো এবড়োথেবড়ো ও লাইন মতো না হলেও সঠিক তীরের আকৃতি তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্যেরা থামলেও প্রেসিডেন্ট বলেই চলল, কিন্তু তীরের নির্দেশ কোথায়, কোন দিকে ভাই আহমদ মুসা?
মি.. প্রেসিডেন্ট তীরের শীর্ষ ভাগের পাথরটার দিকে ভালো করে নজর করুন। দেখুন সেখানে খোদাই করে আরবি দুই অংকটি লেখা আছে। তার উপরে দেখুন খোদাই করেই আরবি ইয়া ও দাল বর্ণমালা দুটি লেখা। ইয়া ও দাল বর্ণমালা দিয়ে হাত বুঝানো হয়েছে। সব মিলিয়ে তীরের নির্দেশটি দাঁড়াচ্ছে সামনে দুই হাত পর্যন্ত আমাদের এগোতে হবে।
মারহাবা। ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। আপনি ছাড়া এই জটিল ধাঁধাগুলো কে ভাঙতে পারতো! প্রেসিডেন্ট বলল।
না এক্সিলেন্সি, ধাঁধাগুলো এমনভাবে সেট করা যে, মুসলিম কিংবা আরবি ভাষা ও ইসলামী ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত যে কেউ চেষ্টা করলে এই ধাঁধা ভাঙতে পারবে।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, আসুন আমরা আরো সামনে দেখি।
আহমদ মুসা তীরের নির্দেশ অনুসারে দুহাত এগিয়ে পাহাড়ের দেয়ালের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।
দুহাত পরে নিশ্চয় একটা সংকেত আছে সামনে এগোবার। আহমদ মুসা পাহাড়ের খাড়া গা এবং নিচে ফ্লোরে পাহাড়ের গা সন্নিহিত এলাকার উপর চোখ বুলাতে লাগল।
পাহাড়ের গা এবং নিচে ফ্লোরে কিছু খুঁজতে হলে অবশ্যই আমাদের। নিচের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, আহমদ মুসা ভাই? বলল প্রেসিডেন্ট।
হ্যাঁ এক্সিলেন্সি অস্বাভাবিক কিছু, ইঙ্গিতমূলক কিছু দেখুন। বলল আহমদ মুসা।
উপস্থিত পাঁচজনের দশটি চোখ তন্নতন্ন করে খুঁজল প্রায় দশ মিনিট ধরে। পাহাড়ের গা ও নিচের ফ্লোরের প্রতি ইঞ্চি জায়গা তারা খুঁজল। কিন্তু অস্বাভাবিক কিংবা ইঙ্গিতমূলক কিছুই মিলল না।
এই দশটি মিনিট একটা কথাও কেউ বলেনি। সবটুকু স্থান মনোযোগ দিয়ে খুঁজেছে সবাই। ক্লান্ত যেন সবারই চোখ।
পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে বসল আহমদ মুসা।
অন্যেরা সবাই স্থির হয়ে দাঁড়াল দুপাশে।
ভাই আহমদ মুসা আপনি বসে পড়লে আমরা দাঁড়িয়ে থাকব কি করে? বলল প্রেসিডেন্ট। তার মুখে হাসি।
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, এটা বসা নয় এক্সিলেন্সি, নতুন করে দাঁড়াবার আয়োজন।
বলেই আহমদ মুসা তাকাল জাহরার দিকে। বলল, জাহরা তোমার সংকেত তালিকাটা দাও। আবার দেখি।
শুধু মুখ খোলা এবং শরীর কালো কাপড়ে আবৃতা জাহরা এগিয়ে এলো। আহমদ মুসার সামনে এক খণ্ড কাগজ এগিয়ে ধরল।
কাগজখণ্ডটি নিয়ে আহমদ মুসা আবার তাতে চোখ বুলাল। সবাইকে শুনিয়ে দুহাত-এর পরের সংকেতটা পড়ল আহমদ মুসা: হাত দুই যখন। সামনে এগোবে, তখন মাটিতে আকাশের চাঁদ পাবে।
সবাই শুনলো ইঙ্গিতটা আবার।
অর্থমন্ত্রী বেন নাহান বলল, আকাশের চাঁদ বলতে নিশ্চিতভাবেই ধনভাণ্ডার বুঝানো হয়েছে।
সেই ধনভাণ্ডার আমরা পাব কি করে, এটাই কিন্তু এখনকার জিজ্ঞাসা। এ জিজ্ঞাসার জবাবই এই সংকেতে থাকার কথা। বলল প্রেসিডেন্ট।
ঠিক বলেছেন এক্সিলেন্সি। এখন ধনভাণ্ডার নয়, ধনভাণ্ডার পাবার পথ। আমরা এ সংকেতে পেতে চাই। সুতরাং আকাশের চাঁদ ধনভাণ্ডার নয়, অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেবার কথা। সেটা কি? বলল আহমদ মুসা।
সেটা কি? এই প্রশ্ন মুখে নিয়েই আহমদ মুসা আনমনে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খাওয়ায় আহমদ মুসার দেহটা সামনের দিকে সরে এল। হাত থেকে সেই কাগজখণ্ডটি পড়ে গেল। আহমদ মুসা নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পড়ে যাওয়া কাগজের খণ্ডটি তোলার জন্যে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে পাহাড়মুখো হলো। নিচু হয়ে পাহাড়ের গার কাছাকাছি ফ্লোরে পড়ে থাকা কাগজের খণ্ডটি তুলতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে কালো পাথরে খোদাই করা কালো একটা বড় বৃত্ত তার নজরে পড়ল চমকে উঠে ভালো করে তাকাতে গিয়ে দেখল কালো বৃত্তের মাঝ বরাবর থেকে নিচে পাথরের রংটা আরও গাঢ় কালো। সেই কালোর মাঝে একটা হাতুড়ি আঁকা।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আল হামদুলিল্লাহ! বলে সোজা হয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, এক্সিলেন্সি আমরা আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছি।
সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলে উঠল, কোথায় পেলেন, কি পেলেন, দেখি?
আহমদ মুসা একটু নিচু হয়ে বড় কালো বৃত্তটি দেখিয়ে বলল, গোলাকার বৃত্তটিকে চাঁদ মনে করুন। দেখুন বৃত্তের নিচের অংশটা আরও গাঢ় কালো। ওটাকে চাঁদের কলংক বলতে পারি আমরা।
সবাই দেখে বলে উঠল, ঠিক মি. আহমদ মুসা। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার চোখের জুড়ি নেই।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে প্রেসিডেন্ট আবার বলল, আল্লাহ বৃত্তটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবেন বলেই আপনাকে এখানে এনে বসিয়েছিলেন। দয়ালু আল্লাহ এভাবেই তার বান্দাদের সাহায্য করেন।
একটু থেমেই প্রেসিডেন্ট আবার বলল, ভাই আহমদ মুসা, ধনভাণ্ডারে ঢোকার চাবি আপনি পেয়েছেন বললেন, সেটা কি, কোথায়?
এক্সিলেন্সি, বড় কালো বৃত্তের নিচের কালো অংশটায় কালো রঙের ছোট একটা হাতুড়ি খোদাই করা আছে। সেটাই ধনভাণ্ডারে ঢোকার চাবি, চাবি মানে ধনভাণ্ডার ঢাকার ওটা অস্ত্র। বলল আহমদ মুসা।
এর অর্থ হাতুড়ি দিয়ে এই পাথরটা ভাঙতে হবে। এই পাথরটাই তাহলে ধনভাণ্ডারের দরজা অথবা ধনভাণ্ডারে পৌঁছার সুড়ঙ্গের মুখ। প্রেসিডেন্ট বলল।
অর্থ এটাই এক্সিলেন্সি। এখন এক্সিলেন্সি আপনার লোকদের নির্দেশ দিন তারা এসে পাথরটি ভাঙাবে। বলল আহমদ মুসা।
খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল প্রেসিডেন্টের। তাকালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের দিকে।
আমি লোকদের ডাকছি, নির্দেশ দিচ্ছি এক্সিলেন্সি। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
লোকরা বসে অপেক্ষা করছিল পাহাড়ের এই প্রকাণ্ড কার্নিশ বা বারান্দার নিচে, উপত্যকায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এগোলো সেদিকে।
ভাই আহমদ মুসা, আপনি অনেক পুণ্যবান মানুষ, আল্লাহর অনেক প্রিয় আপনি। আল্লাহর ইচ্ছায় স্পেনের শাহমাতার ধনভাণ্ডার আপনারই জন্য অপেক্ষা করছিল শত শত বছর ধরে, আল্লাহ আপনাকেই মনোনীত রেখেছিলেন এই কাজের জন্যে। বলল প্রেসিডেন্ট। আবেগে ভারি প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ।
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অসীম মেহেরবান। তার বিশ্ব ব্যবস্থার। কোন্ কাজ আল্লাহ কাকে দিয়ে করাবেন, সে এক্তিয়ার শুধুই তার। বান্দাদের এখানে কৃতিত্বের কিছু নেই। আল্লাহ আমাকে যেমন দয়া
করেছেন, তেমনি আল্লাহ আপনাদের রত্নদ্বীপাকে বাছাই করেছিলেন ধনভাণ্ডার আমানত রাখার জন্যে, আবার এক্সিলেন্সি আপনাদের শাসনকালকেই আল্লাহ নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন ধনভাণ্ডার উদ্ধারের জন্যে, যে ঘটনায় প্রেসিডেন্ট হিসাবে আপনি ও আপনার সিনিয়র মন্ত্রীরা হাজির থাকবেন। বলল আহমদ মুসা অশ্রুভেজা কন্ঠে।
প্রেসিডেন্ট শিশুর মতো কেঁদে উঠল। দুহাত উপরে তুলে চিৎকার করে বলল, রাব্বল আলামিন, আপনার হাজার শোকর! আপনি আমাদের ক্ষুদ্র, দুর্বল রত্নদ্বীপের সরকারকে এত বড় নিয়ামত দান করেছেন। আপনার হাজার শোকর!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার লোকদের নিয়ে এসে পৌঁছল। কর্মীর পোষাকে আসা লোকদের সবাই রত্নদ্বীপের নবগঠিত কমান্ডো বাহিনীর সদস্য। আহমদ মুসাই গড়ে দিয়েছে রত্নদ্বীপের জন্যে এই বাহিনী। আহমদ মুসা বলেছে, এদের দিয়েই রত্নদ্বীপে সেনাবাহিনী গড়ার কাজ শুরু। এই বাহিনীর সদস্য হওয়ার জন্যে শিক্ষিত, যোগ্য ও ধর্মভীরু হওয়া অপরিহার্য শর্ত করে দিয়েছে আহমদ মুসা।
.
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের এই কক্ষে প্রেসিডেন্টসহ তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী হাজির আছেন। হাজির আছেন শাহজাদী জাহরা এবং রত্নদ্বীপের গ্রান্ড মুফতি ও কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম আবু আবদুল্লাহ হোজায়ফা।
রূপোর কাসকেট থেকে অসিয়তটা বের করে আহমদ মুসা তা তুলে দিল শাহজাদী জারার হাতে। বলল, শাহমাতার দায়িত্বপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারী হিসাবে তোমারই এটা পড়া উচিত। সম্পদ তোমাদের, আমরা সাহায্যকারী মাত্র। অসিয়ত হিসাবে সম্পদের দায়িত্বও তোমারই।
আজ সকালেই পাহাড়ের বিশাল গুহায় লুকায়িত সম্পদ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে আনা হয়েছে। তবে তা রাখা হয়েছে সরকারি খাজাঞ্চিখানায় নয়, শাহাজাদী জাহরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের যে ঘরে থাকছেন, সে ঘরের। পাশের ঘরটায় এবং ঘরের চারদিকে কমান্ডো পাহারার ব্যবস্থা করা। হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নিজে এ সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেছেন, এ ধনভাণ্ডার জাহরার পরিবারের। তার চোখের সামনেই তা থাকা দরকার।
সম্পদের পরিমাণও বিশাল। শুধু স্বর্ণমুদ্রার পরিমাণই দুই টন এবং হীরা জহরত সোনার অলংকারের পরিমাণ তিন টনের বেশি। গ্রানাডা ও কর্ডোভার হেরেমের শত শত বছরের সংগ্রহ এগুলো। দুইজন শাহমাতার মাধ্যমে এসেছে এই ধনভাণ্ডার রত্নদ্বীপে।
আহমদ মুসার হাত থেকে অসিয়তনামাটা নিতে নিতে বলল জাহরা, আপনার বাড়ানো হাত ফিরিয়ে দেয়ার কোনো সাধ্য আমার নেই স্যার। কিন্তু আমি শাহমাতার উত্তরাধিকারী হলেও তার ধনভাণ্ডারের ব্যাপারে কিছু বলার অবস্থানে আমি নেই। আমার দাদীর স্বপ্নের কথা আপনি জানেন। সে স্বপ্নের আদেশেই দাদী আমাকে এই রত্নদ্বীপে পাঠিয়েছেন। আপনার সন্ধানে। আপনাকে পেয়েছি। স্বপ্নের নির্দেশ অনুসারে শাহমাতার গুপ্তধনের সকল ডকুমেন্ট আপনাকে দিয়েছি। এখন অসিয়ত পড়ে সেই অনুযায়ী আপনার উদ্ধার করা শাহমাতার ধনভাণ্ডারের সব ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করাও আপনার দায়িত্ব।
কথা শেষ করেই শাহজাদী জাহরা অসিয়তটি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, আপনি আমাদের ভাই, আমাদের এখনকার অভিভাবক, আমাদের নেতা। প্লিজ এটা নিন।
হ্যাঁ ভাই আহমদ মুসা, শাহজাদী জাহরা ঠিকই বলেছেন। ধনভাণ্ডারের দায়িত্ব আপনার। আপনিই অসিয়তটা পড়ন। বলল প্রেসিডেন্ট।
শাহজাদী জাহরার হাত থেকে আহমদ মুসা অসিয়তের কাগজটি নিয়ে। নিল। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, পড়ছি আমি।
অসিয়তের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, এই অসিয়তটি লেখা, হয়েছে ১৪৮৯ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি। লিখেছেন শাহমাতা বেগম আয়েশা। তিনি ছিলেন মহান, অনড় চরিত্রের দূরদর্শী এক মহীয়সী মহিলা। যাকে পশ্চিমী ঐতিহাসিকরাও বলেছেন Indomitable Mother of last Sultan of Granada. stolus cast 1999 og সন্তান সুলতানকে নিয়ে। সুলতান ছিল দুর্বল চরিত্রের এবং অনেক ক্ষেত্রেই নীতিহীন। তাঁর এই অসিয়তটা লেখা ছিল খুবই অল্প কথায়। পড়া শুরু করছি।
আল্লাহর প্রশংসা গুণগান, রাসূল স.-এর প্রতি দরূদ ও সালাম জানিয়ে, আহলে বায়েত ও সাহাবাদের জন্যে দোয়া করে তিনি লিখছেন, স্পেনের পতন লোকবল ও অর্থবলের অভাবের কারণে হয়নি, হয়েছে ক্ষমতার লোভজনিত ফেতরাতের কারণে। আমাদের নিজেদের মধ্যকার লড়াই যেমন স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্যকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে, তেমনি তা আমাদের ভাগ্যকে করেছে ধংসের তিমিরে নিমজ্জিত। সীমাহীন লোভ, ক্ষমতার এই দ্বন্দ্বের কারণ ফি সাবিসিল্লাহর আদর্শ থেকে আমাদের সুলতান ও শাসকরা একেবারেই সরে এসেছিলেন। তাদের সিংহাসন, তাদের রাজ্য, তাদের সম্পদ-সমৃদ্ধি সবাই ছিল নিজের বা বংশের স্বার্থে। এই মানসিকতা একটা নব্য জাহিলিয়াত। কুরআন, হাদিস, ইতিহাসের জ্ঞান না থাকার ফলেই ঘটেছে এটা। আমার এই সম্পদকে আমি আল্লাহর পথে কাজে লাগাতে চাই। আমার এই সম্পদ যত ছোট কিংবা বড় হোক আমার সন্তান গ্রানাডার সুলতানের হাতে দিতে আমি চাই না। ফি সাবিলিল্লাহর পথে এই সম্পদ খরচ করার কোনো যোগ্যতা তার নেই। কর্দোভার শেষ সুলতান হিশাম তৃতীয়-এর মা শাহমাতা আবিদা আজিমার ধনভাণ্ডার আমার সম্পদের সাথে যুক্ত আছে। কর্ডোভার পতনের আগে তিনি তার ধনভাণ্ডার একটা চিঠিসহ গ্রানাডার হেরেমে পাঠিয়েছিলেন। তিনিও আমার মতোই চেয়েছেন তার সম্পদ ফি সাবিলিল্লাহর পথে খরচ হোক। তিনিও তার সম্পদ তার ছেলে হিশামকে দেননি। তিনি দুঃখ করে লিখেছিলেন, উমাইয়া শাহজাদী হিসাবে আমি হিশামের বাবার সাথে। বিবাহিত হই। আমি চাইতাম না সিংহাসন নিয়ে ব্যক্তি ও বংশীয় লড়াই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমি হয়ে গেলাম কর্দোভার শেষ সুলতানেয় মা। যে পতন আসন্ন হয়ে উঠেছে (১০৩১ সালে কর্ডোভার পতন হয়), তার চেয়ে ভালো কিছু আমি আশা করিনি। আমি আমার চোখের সামনে দেখেছি, ১০১৬ সাল থেকে ১০২৬ সাল পর্যন্ত (হিশাম তৃতীয়-এর সিংহাসন আরোহণ পর্যন্ত) এই দশ বছরে কর্দোভায় আটজন সুলতান সিংহাসনে বসেছেন। এমন রাজ্যের ভাগ্য লেখা পতন ছাড়া আর কি হতে পারে? আমার গ্রানাডার ইতিহাসও এটাই। এ পরিস্থিতিতেই আমি আমাদের হেরেমের ধনভাণ্ডার কোনো এক ভালো ভবিষ্যতের আশায় স্পেনের বাইরে গচ্ছিত রাখার সিদ্ধান্ত নিই। আমার দয়াময় আল্লাহ আমার সিদ্ধান্ত কবুল করেছেন। একটা ভালো জায়গায় আমার ধনভাণ্ডার আমানত রাখতে পারছি। আমি নিশ্চিত, আল্লাহর কাছে আমি কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছি, একজন যোগ্য আল্লাহর বান্দা এই ধনভাণ্ডার উদ্ধার করবেন এবং আমি আশা করি যেমনটা আমি চেয়েছি তেমনভাবে এই ধনভাণ্ডার কাজে লাগানো হবে অথবা মানুষের কল্যাণে, আমার নির্যাতিত ভাই-বোনদের জন্যে এই সম্পদ ব্যয় করবেন। কবে এই সম্পদ উদ্ধার হবে জানি না, সেই সময় সম্পদের অবস্থা কি হবে তাও জানি না, তাই উদ্ধারকারী মহান। ভাই-বোনদের উপর আমি নির্ভর করছি। আল্লাহ তাদের নিশ্চয় সাফল্য দান করবেন।
সম্পদ খরচ বা বণ্টন প্রশ্নে আমার পরামর্শ- এই নামহীন, জনমানবহীন এমন একটা দ্বীপে আমি আমার ধনভাণ্ডার আমানত রাখলাম, যাকে জাহাজীরা মিডওয়ে বলে। আমি জানি এই দ্বীপের একদিন নাম হবে, এখানে মানব বসতিও সৃষ্টি হবে। তাদের যে পরিচয়ই হোক, তারা আল্লাহর বান্দার বাইরে কিছু হবে না। তাদের মাটিতে আমরা সম্পদ আমানত রেখেছি। এই সম্পদের চার ভাগের এক ভাগ পাবে এই দ্বীপের জনগণ, তা ছোট দ্বীপটার প্রতিরক্ষার জন্যে ব্যয় হবে। অবশিষ্ট তিন ভাগের এক ভাগ ব্যয় হবে স্পেনের ভাগ্যাহত মুসলমানদের ইসলামী ও বিজ্ঞান বিষয়ক উচ্চতর শিক্ষার ছাত্রবৃত্তি হিসাবে। বাকি দুই ভাগের এক ভাগ পাবে আমার পরিবার, যদি তাদের কেউ তখন বেঁচে থাকে। এই অর্থ তারা নিজেদের ও স্বজনদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাবে। শেষ ভাগটি পাবে এ সম্পদের উদ্ধারকারী মহান ব্যক্তি বা তাঁর মনোনীত দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান যারা মজলুম মানুষের সাহায্যে এই অর্থ ব্যয় করবে।
এই পরামর্শটা আমার ইচ্ছা মাত্র। আল্লাহ রাব্বল আলামিনের প্রতি আমার স্থির বিশ্বাস আছে। তিনি এমন একজনের হাত দিয়ে ধনভাণ্ডার উদ্ধার করাবেন যিনি ধনভাণ্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও বেশি যোগ্যতার অধিকারী হবেন। সবার উপরে আমি আল্লাহর ইচ্ছার উপরই নির্ভর করছি। আল্লাহ যেন আমার এই ক্ষুদ্র উদ্যোগকে দয়া করে কাজে লাগান। আমিন।
পড়া শেষ করে থামল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গে কেউ কথা বলল না। নীরব সবাই। সবার চোখে-মুখে আনন্দ, বিস্ময় ও ভাবনার চিহ্ন।
নীরবতা ভাঙল প্রেসিডেন্ট। বলল, আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে মোবারকবাদ শাহমাতা বেগম আয়েশা মরহুমাকে। তিনি শত শত বছর আগে আমাদের এই ছোট দ্বীপের মানুষের কথা ভেবেছেন, দ্বীপের প্রতিরক্ষার কথা ভেবেছেন। আশ্চর্য, দেশরক্ষা সমস্যাই এখন এই দ্বীপের মানুষের প্রধান সমস্যা। এটা আল্লাহর ইচ্ছা না হলে, আল্লাহর পরিকল্পনা হলে, শাহমাতা এতদিন আগে এটা ভাবলেন কি করে?
একটু থেমেই প্রেসিডেন্ট আবার বলে উঠল, ভাই আহমদ মুসা। মরহুমা বেগম সাহেবা কার্যত সব দায়িত্ব আপনার উপর অর্পণ করেছেন। তাঁর বন্টন-পরিকল্পনাকে তিনি পরামর্শ বলে উল্লেখ করেছেন। বলুন। আপনি কি ভাবছেন।
আহমদ মুসা কোনো কথা বলল না। তাকাল শাহজাদী জাহরার। দিকে। বলল জাহরা তুমি তো শাহমাতা আয়েশার বংশপরম্পরা ও আইনি উভয় দিক দিয়েই উত্তরসূরি। তাঁর পক্ষে কথা বলার অধিকার তোমারই। বল তোমার কথা।
শাহজাদী জাহরা হাসল। বলল, উত্তরসূরির কথা বলার কোনো সুযোগ শাহমাতা রাখেননি। তিনি তার অসিয়তে স্পষ্টই বলে দিয়েছেন। এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্টও সেই কথাই বললেন। শাহমাতা একটা পরামর্শ দিয়েছেন বটে, কিন্তু কার্যত তিনি সব দায়িত্ব আপনার উপরই অর্পণ করেছেন। এখন কথা আপনি বলবেন স্যার।
মাননীয় প্রেসিডেন্ট ও শাহজাদী জাহরা যা বলেছেন সেটা আমারও কথা। এই সাথে একটি কথা বলতে চাচ্ছি, শাহমাতা মরহুমা বেগম সাহেবা ধনভাণ্ডার উদ্ধারকারীর হাতেই বলা যায় সব দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, উদ্ধারকারী যদি ডাকাত, জলদস্যু বা দুষ্ট প্রকৃতির কেউ হতো, তাহলে তো অন্য ধরনের কিছু ঘটতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
হাসল প্রেসিডেন্ট। বলল, মি. কনস্টানটিনোস, আপনি ঠিক ধরেছেন। সেক্ষেত্রে মরহুমা বেগম সাহেবা যা চেয়েছেন তার উল্টোটাই ঘটতো। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছার কাছে মানুষ অসহায়! আল্লাহর যা ইচ্ছা সেটাই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অতএব বর্তমান সময়ের সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষের হাতে আল্লাহ এই ধনভাণ্ডার তুলে দিয়েছেন। নিশ্চয় এটাই ঘটার ছিল। বেগম সাহেবা যা করেছেন আল্লাহর ইচ্ছাতেই করেছেন, অসিয়তে যা বলেছেন আল্লাহর ইচ্ছাতেই বলেছেন। আবার শাহজাদী জাহরার দাদী সাহেবা যে স্বপ্নের নির্দেশ পেয়ে শাহজাদী জাহরাকে রত্নদ্বীপে পাঠিয়েছেন এবং স্বপ্নের নির্দেশিত ব্যক্তি হিসাবে জনাব আহমদ মুসাকে ধনভাণ্ডারের দায়িত্ব দিয়েছেন, তার মধ্যে তো আল্লাহর ইচ্ছা আরও স্পষ্ট। সুতরাং শাহমাতা যা চেয়েছিলেন তার অন্যথা ঘটার উপায় ছিল না। সত্যিই শাহমাতা ছিলেন খুবই পুণ্যাত্মা মহীয়সী নারি।
ঠিক বলেছেন মি. প্রসিডেন্ট, ভালো নিয়তের মহান কাজগুলো প্রভু জিহোভার প্রেরণা হিসাবে যেমন মানুষের মাথায় আসে, তেমনি প্রভু জিহোভা সেই কাজকে প্রটেক্টও করেন। অর্থমন্ত্রী বেন নাহান বলল।
ধন্যবাদ মি. নাহান।
বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, এবার ভাই। আহমদ মুসা, শাহজাদী জাহরাকে আপনার রায় দিন।
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। মুহূর্তের জন্য চোখ বুজল আহমদ মুসা। পরে মুখ তুলে তাকাল আহমদ মুসা। তার মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, শাহমাতা মুহতারেমা বেগম আয়েশার এই ধনভাণ্ডারের সাথে আনন্দ নয়, অশ্রু জড়িয়ে আছে। সে অশ্রু শুধু শাহমাতার নয়, গ্রানাডা, কর্দোভার হেরেমের অসহায় বেগম, শাহজাদীদের নয়, এই অশ্রু স্পেনের ভাগ্যাহত সব মুসলমানের, যারা শাসকদের ভুলে চূড়ান্ত মুল্য দিয়েছে। শাহমাতা বেগম আয়েশা সবকিছু বিবেচনা করেই তার সম্পদ বন্টন করেছেন। আমি তাঁর বন্টনকে আজকের জন্যও যুগোপযোগী মনে করি। শুধু একটা সংশোধনী আমি আনতে চাই। সেটা হলো, আমার দায়িত্বে দেয়া এক-চতুর্থাংশ ধনভাণ্ডার আমি দিতে চাই মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে। এই টাকায় তারা ইসলাম, কম্পারেটিভ রিলিজিওন, ইতিহাস এবং হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ বিষয়গুলো যুক্ত করে একটি বিভাগ খুলবেন। বিভিন্ন দেশ থেকে স্কলার শিপ দিয়ে যোগ্য শিক্ষার্থী আনবেন। যারা শিক্ষাশেষে হিংসা-বিদ্বেষ সন্ত্রাস পথভ্রষ্টতার মোকাবিলায় হব্দুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ-এর প্রতিষ্ঠা ও মানবসেবার মুবাল্লেগ হিসাবে গোটা দুনিয়ায় কাজ করবে। শাহমাতা বেগম সাহেবার পরামর্শে এই দিকটা অনুপস্থিত হয়েছে। এই উদ্যোগ তার পরামর্শকে ষোলকলায় পূর্ণ করবে।
আলহামদুলিল্লাহ। আমিও আপনার সাথে একমত স্যার। আমার মতে এটাই হবে শাহমাতার সম্পদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার।
আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে শাহমাতার সম্পদের বন্টন চূড়ান্ত হয়ে গেল। রত্নদ্বীপের সরকার ও জনগণ তাদের শাহমাতার দানে সবচেয়ে খুশি হবে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, রত্নদ্বীপের প্রতিরক্ষাখাতের জন্যে যখন অর্থের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, সে সময়ই পাওয়া গেল শাহমাতার এই দান। আল্লাহ তাকে জাযাহ দান করুন। প্রেসিডেন্ট বলল।
আমার বিস্ময় লাগছে আজ প্রতিরক্ষাই আমাদের এই ছোট দ্বীপের যে প্রধান সমস্যা, তা শত শত বছর আগে মরহুমা বেগম সাহেবা জানলেন কি করে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
জেনে এই ব্যবস্থা মোহতারেমা বেগম সাহেবা করেননি অবশ্যই। তিনি রাজনীতিতে অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী ছিলেন। ছোট ছোট স্বাধীন দেশের প্রধান সমস্যা কি হয়ে থাকে তা তিনি জানতেন। জানতেন তিনি ছোট স্বাধীন দেশকে তার প্রতিরক্ষা খাতকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। এই জানা থেকেই তিনি রত্নদ্বীপের জন্যে ঐ ব্যবস্থা করেছেন।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। ঠিক বলেছেন। আরও একটা কথা, মরহুমা বেগম সাহেবা এর দ্বারা দুনিয়ার বিশেষ করে স্বাধীন দেশকে সচেতন করে দিয়েছেন। বলেছেন, প্রতিরক্ষা খাতকেই প্রথম ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে হবে তাদের। প্রেসিডেন্ট বলল।
কথা শেষ করেই আবার প্রেসিডেন্ট বলল, আলোচনা এখনকার মতো এখানেই শেষ। বিকেলে আহমদ মুসা সম্পদ বণ্টন করবেন। আহমদ মুসার পরামর্শ অনুসারে রত্নদ্বীপ সরকার ভাগ হওয়া সম্পদ যথাস্থানে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নেবে। বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসাসহ সকলেই।
যাবার জন্যে পা তুলেও প্রেসিডেন্ট ফিরে দাঁড়িয়ে শাহজাদী জাহরাকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি দাদীমাকে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাও, যদি প্রয়োজন মনে কর।
ইয়েস এক্সিলেন্সি, জনাব। শাহজাদী জাহরা বলল।
আর একটা কথা শাহজাদী জাহরা, বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার পড়াটা ছিল একটা ছদ্মবেশ। তুমি চলে যাচ্ছ, না লেখা-পড়া অব্যাহত রাখবে? বলল প্রেসিডেন্ট।
শাহজাদী জাহরা কিছু বলার আগেই আহমদ মুসা বলল, সে এভাবে যাচ্ছে না এক্সিলেন্সি। সে বাঁধা পড়েছে রত্নদ্বীপের সাথে। আহমদ মুসার মুখে হাসি।
বুঝলাম না ভাই আহমদ মুসা। বলল প্রেসিডেন্ট।
কি জাহরা এক্সিলেন্সিকে তুমিই বুঝাবে, না আমি বুঝাব? আহমদ মুসা বলল।
শাহজাদী জাহরার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কিছু বলল না। মাথা নিচু করল।
ভাই আহমদ মুসা আপনিই বলুন। বলল প্রেসিডেন্ট।
বিষয়টা এখন থাক এক্সিলেন্সি। আমাকে তার আগে আপনার বড় ছেলে মেজর অধ্যাপক যোবায়ের খালেদ-এর সাথে কথা বলতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে বিস্ময়ের একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসার দিকে।
সেটা ভালো। আলহামদুলিল্লাহ। আমি চলছি। বলে প্রেসিডেন্ট ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল। তার মুখটা উজ্জ্বল।
শাহজাদী জাহরা সেই যে মুখ নিচু করেছে, আর মুখ তোলেনি।
সবাই চলা শুরু করল। পেছনে পেছনে শাহজাদী জাহরাও।
জাহরা আহমদ মুসার কিছুটা পেছনে থেকে পাশাপাশি হাঁটছিল মুখ নিচু করে। এক সময় বলল সে, স্যার, বিষয়টা এক্সিলেন্সিকে এভাবে বলাটা…।
শাহজাদী জাহরার কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা বলল, বিষয়টা অভিভাবকরাই তো জানার কথা, তাদেরকেই তো বলার কথা। তা না হলে বিষয়টা এগোবে কি করে? আমি তোমার দাদী মার সাথেও কথা বলব।
শাহজাদী জাহরার বিব্রত মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। বলল, স্যার বিষয়টা এত বড় কিছু নয়। আর দাদী মা তো তার শাহজাদীর জন্যে রত্নদ্বীপের আর একজনকে শাহজাদা ভেবে বসে আছেন।
তার ভুল তো তুমি ভেঙে দিয়েছ। বলল আহমদ মুসা।
জি হ্যাঁ। বলেই জাহরা জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি করে বিষয়টা জানলেন স্যার?
দেখ, ছেলেমেয়েরা অভিভাবকদের বোকা ও নিজেদের চালাক মনে করে। কিন্তু অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের দেখলেই সব বুঝতে পারে। শেষবার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক শাখায় আমি যাই, তখন তোমাকে। ও মেজর যোবায়ের খালেদকে ডেকেছিলাম। তোমরা আমার সাথে কথা বলেছিলে, কিন্তু পরস্পরের মধ্যে কথা বলনি, দুজনেই এড়িয়ে গেছ দুজনকে। দুজন দুজনের সাথে কিছুতেই সহজ হতে পারনি। অথচ তোমরা শিক্ষক-ছাত্রী। সতর্ক অভিভাবকের জন্যে এর চেয়ে বেশি কিছুর দরকার হয় না। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, বিষয়টা নিয়ে আমি জটিলতা সৃষ্টির ভয় করছি। প্লিজ আপনি…।
আহমদ মুসা জাহরাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার না, এসব অভিভাবকদের ভাববার বিষয়। বলে আহমদ মুসা তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।
৬
রাত দুইটা। চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
অমাবস্যার রাত বলেই মেঘ-কুয়াশাহীন আকাশের তারাগুলোকে খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। কিন্তু অন্ধকারের সাথে লড়াইয়ে তারারা চিরদিন হেরেছে, আজকেও হারছে।
রত্নদ্বীপের জন্য সদ্য কেনা বাতি নিভানো একটা পেট্রোল বোট আহমদ মুসা ও মেজর আনাস আবদুল্লাহকে রত্নদ্বীপের পশ্চিম উপকূলে গার্ডওয়াল পাহাড় থেকে আধা মাইল উত্তরে নামিয়ে দিল পাহাড়ের অদৃশ্য একটা প্লাটফরমে।
সারা সোফিয়া গার্ডওয়াল পাহাড়ের নাম বলেছিল। সিসিলি আনার পর তাকে রত্নদ্বীপের এই পাহাড়েরই কোনো এক স্থানে নামানো হয়েছিল। এই পাহাড় ডিঙিয়ে পাহাড়ের দুর্গম পথেই রেনেটা, ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের রত্নদ্বীপ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছা যায়। রেনেটার পরিচয় ও অবস্থানের তথ্য তখন আহমদ মুসা না জানালেও সারা সোফিয়া বলতে
পারলেও এখন জেনেছে আহমদ মুসা। ষোড়শ শতকের একটা ম্যাপ থেকে আহমদ মুসা রেনেটার পরিচয় উদ্ধার করেছে। ভূমধ্যসাগরের একটা বড় জলদস্যু হেডকোয়ার্টার ছিল এটা। পরে রেনেটা দুর্গ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ইতিহাস ও মানচিত্র থেকেও হারিয়ে যায়। ব্ল্যাক সিন্ডিকেট পুরনো একটা নথি থেকে দুর্গম পাহাড়ের মধ্যে নিরাপদ এই রেনেটা দুর্গের সন্ধান পায়। একেই তারা তাদের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান ঘাঁটি বানায় এবং এই ঘাঁটির আশেপাশের কোথাও বিশাল। ধনভাণ্ডার লুকানো আছে তাও তারা জানতে পারে। আজ ব্ল্যাক সিন্ডিকেট রত্নদ্বীপে তাদের অবশিষ্ট ঘাঁটি গুটিয়ে নিয়ে রেনেটা দুর্গে কেন্দ্রিভূত করেছে। তাদের জনশক্তির কাজও ব্ল্যাক সিন্ডিকেট রেনেটা দুর্গকেন্দ্রিক করেছে। ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের এই তৎপরতার অর্থ কি আহমদ মুসা তাও চিন্তা করেছে। তার মনে হয়েছে, ব্ল্যাক সিন্ডিকেট বড় কিছুর জন্যে তৈরি হচ্ছে। সেটা কি? সারা সোফিয়া যেটা বলেছে, রত্নদ্বীপের উপর বাইরে থেকে সসৈন্যে সশস্ত্র আক্রমণ হতে পারে, সেটাই কি ঘটতে যাচ্ছে? যাই হোক আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রত্নদ্বীপের ব্ল্যাক সিন্ডিকেট হেডকোয়ার্টার আগে ধ্বংস করে দিতে হবে যাতে ভেতর থেকে কেউ বাইরের কাউকে সাহায্য করতে না পারে। ফলে অন্যদিকে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের সন্ত্রাস-ষড়যন্ত্র থেকে রত্নদ্বীপ রক্ষা পাবে প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকলেই আহমদ মুসার এই চিন্তার সাথে একমত হয়েছে। সাম্মলিত সিদ্ধান্তের ফল হিসেবেই আহমদ মুসার এই অভিযান ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের সর্বশেষ শক্তিটুকু ধ্বংস করতে।
আহমদ মুসা ও মেজর আনাস আবদুল্লাহকে নামিয়ে চলে গেল বোটটি।
মেজর আনাস আবদুল্লাহ রত্নদ্বীপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক শাখার একজন ইনস্ট্রাকটার। সেই সাথে সে রত্নদ্বীপে নবগঠিত কমান্ডো গ্রুপের একজন অধিনায়ক। মেজর আনাস আবদুল্লাহ রত্নদ্বীপের জিওগ্রাফি এবং পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ। আহমদ মুসা তার অভিযানে সাথী হিসাবে তাকেই বাছাই করেছে।
আহমদ মুসারা যে পাথুরে প্লাটফরমে এসে নেমেছিল তার সামনে একটা গিরিপথের মতো জায়গা। পাথুরে প্লাটফরমটা প্রাকৃতিক জেটির মতো, দশ ফুটের মতো প্রশস্ত। গিরিপথের মতো জায়গাটা প্লাটফরম। থেকে পনের বিশ ফিট উঁচুতে। দুই পাহাড় এখানে হ্যান্ডশেক করেনি, একটি অপরটির গা ঘেঁষে চলে গেছে পাশ কাটিয়ে। পাশ কাটানোর মধ্যবর্তী জায়গাকে নিচু গিরিপথ বলা যেতে পারে।
.
আহমদ মুসা প্লাটফরমে নেমে কয়েক ধাপ এগিয়ে পেছন ফিরে দেখল তাদের বোটটি জমাট একখণ্ড অন্ধকারের মতো দ্রুত উত্তর দিকে সরে যাচ্ছে।
অন্ধকারেই বুঝল আহমদ মুসা পাথুরে প্লাটফরমটি ভেজা। সী লেভেলের প্রায় সমান্তরাল বলে সাগরের ঢেউ মাঝে মাঝে এসে প্লাটফরমটি ধুয়ে দিয়ে যায়।
সামনে এগোচ্ছে আহমদ মুসা ও মেজর আনাস আবদুল্লাহ। দুজনের পিঠে একটি করে ব্যাগ, এক কাঁধে ঝুলানো গ্যাস মাস্ক, অন্য কাঁধে এক ফুট দৈর্ঘ্যের লেটেস্ট মডেলের কারবাইন। এর বুলেটগুলো বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, আবার বিদ্ধও করতে পারে। তাদের গলায় মিনি ডিস্ট্যাঞ্চের স্বয়ংক্রিয় স্পীকার। এটা পাশাপাশিও কথা বলা যেতে পারে, আবার আধা মাইল দূরত্ব পর্যন্ত কথা বলা সম্ভব। কথাবার্তা হয় নিঃশব্দে, পাশে দাঁড়িয়েও তা শোনা যায় না। রিভলবারের নলের ঠিক নাকে পাওয়ার টর্চ ফিট করা আছে। টর্চের নিয়ন্ত্রিত আলো এক বর্গফুট ব্যাস নিয়ে ছুটে গিয়ে চারশ গজ দূর পর্যন্ত একটা মার্বেল বলকেও চিহ্নিত করতে পারে। আবার এই দূরত্বকে এক গজের মধ্যেও নিয়ন্ত্রিত করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই আলো এক বর্গ-ব্যাসের বাইরে ছড়ায় না।
পাথুরে প্লাটফরমের সমুদ্রপ্রান্ত থেকে পাহাড়ের গা পর্যন্ত দূরত্ব পনেরো ফিটের মতো। পাহাড়ের গা পর্যন্ত প্রায় পৌঁছে গেছে আহমদ মুসা। তার পেছনে মেজর আনাস আবদুল্লাহ।
এই ল্যান্ডিং প্লাটফরম আবিষ্কার মেজর আনাস আবদুল্লাহর কৃতিত্ব। আহমদ মুসার এই অভিযানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর মেজর আনাস আবদুল্লাহ এই প্লাটফরম খুঁজে বের করে।
উপরে গিরিপথ পর্যন্ত উচ্চতা পনেরো-বিশ ফিটের বেশি নয়। কিন্তু সোজাসুজি উঠার উপায় নেই। নানা রকম পাথর ও খাদের বাধা পেরিয়ে অনেক ঘুরে কোথাও হেঁটে, কোথাও হামাগুড়ি দিয়ে, ক্রলিং করে গিরিপথে উঠতে হয়।
রিভলবার টর্চের হাফ শেড আলোয় কোনো মতে রাস্তা দেখে উঠতে হচ্ছে আহমদ মুসা ও মেজর আনাস আবদুল্লাহকে। সামনে আহমদ মুসা, পেছনে মেজর আবদুল্লাহ আনাস।
হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল আহমদ মুসা। হঠাৎ ডান হাঁটুর তলায় কি যেন ভেঙে গেল। প্লাস্টিকের মতো কিছু।
থমকে গেল আহমদ মুসা। বসল হাঁটু তুলে। টর্চের আলো ফেলে কি, ভাঙল সেটা দেখল আহমদ মুসা। প্লাস্টিকের সুদৃশ্য একটি কভার। চমকে উঠল আহমদ মুসা। এখানে প্লাস্টিকের কভার আসবে কি করে? হাত দিয়ে তুলে নিল ভাঙা প্লাস্টিকের কভারটা। আহমদ মুসার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভাঙা কেসটার ভেতরে ইনফরমেশন চিপস-এর মতো কিছু দেখে। তাড়াতাড়ি বের করল জিনিসটি। ওটা একটা মালটিপারপাস। আলট্রা পাওয়ারফুল ইনফরমেশন চিপস। এটা একই সাথে রিসিভার রিমিটার ও রেকর্ডার। এই ধরনের আলট্রা পাওয়ারফুল মাইক্রো চিপস কোত্থেকে এল? পশ্চিম উপকূলের রেনেটায় ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টার। এটা ওদের একটা রুট? এই মাইক্রো চিপস ওদের? খুশি হলো আহমদ মুসা, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে বলল, মেজর আনাস আবদুল্লাহ, আমরা ঠিক পথেই চলছি। কুড়িয়ে যেটা পেলাম ওটা একটা মাইক্রো চিপস। নিশ্চয় এ পথেও ওরা যাতায়াত করে।
আলহামদুলিল্লাহ। নিশ্চয় ওতে আমরা প্রয়োজনীয় কিছু পাবো স্যার। মেজর আনাস আবদুল্লাহ বলল।
আশা করছি মেজর আনাস আবদুল্লাহ। বলল আহমদ মুসা। চলতে লাগল আহমদ মুসা আবার।
একটা চিন্তা এসে আহমদ মুসার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। সারা সোফিয়া তো বলেছিল সে সিসিলি থেকে এসে নামে গার্ডওয়াল পাহাড়ে। এটা তো গার্ডওয়াল পাহাড় নয়, একে বলে সী-ডটার। এ পাহাড়ের বেশির ভাগই সাগরে ডোবা। গার্ডওয়ালে আসার আরেকটা রাস্তা আছে যে রাস্তা তারা ব্যবহার করে। ঐ রাস্তা দিয়েই তারা সারা সোফিয়াকে তাদের ঘাটিতে নিয়ে এসেছিল। তাহলে এ রাস্তা কি, কেন? এই রাস্তায় মাইক্রো চিপস পাওয়া গেল? এটা কি তাদের কোনো বিকল্প গোপন পথ? বিশেষ সময় বা বিশেষ কারও জন্যেই কি এটা ব্যবহার করা হয়? যদি তাই হয়, তাহলে তো এ পথে বেশি পাহারা থাকার কথা নয়। আবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসারা উঠে এল গিরিপথটায়। যাকে গিরিপথ বলে এটা সেই ধরনের গিরিপথ নয়। ওপর থেকে দুটি রেখা যদি কৌণিকভাবে এসে ভূমিতে মিলিত হয়, তখন যে কোণ সৃষ্টি হয় এটা সেই কোণের মতো। এখানে কোনো সমতল ভূমি নেই। কোনো মতে পা ফেলে এগিয়ে যাওয়া। যায় মাত্র, দৌড়ানো বা জোরে চলা কঠিন।
আশেপাশে বেরোবার মতো কোনো বিকল্প পথ নেই, নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা।
কৌণিক সেই পথ ধরে এগিয়ে চলল আহমদ মুসা এবং মেজর আনাস আবদুল্লাহ।
.
কি বলছ তুমি? রত্নদ্বীপের সেই শয়তান আমাদের একটা ধনভাণ্ডার লুণ্ঠন করেছে? কোন জায়গার? কোন ধনভাণ্ডার? উত্তেজিত কণ্ঠে বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
অগাস্টিন ইমানুয়েল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের প্রধান।
পূর্ব সীমান্তের পাহাড় গোয়াদিয়া থেকে সেই গুপ্তধন তারা উদ্ধার করেছে স্যার। বলল জন এ্যাপ্রেনোস, রেনেটা দুর্গের প্রধান। এ্যাপ্রেনোস এখন রত্নদ্বীপে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
ওখানে জাদোকেই তো আমাদের ঘাঁটি ছিল! ঐ জাদোকেই তো খয়ের উদ্দিন বার্বারোসার গুপ্তধন লুকানো আছে? ঐ ধনভাণ্ডারই কি ওরা লুট করল? বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
আমাদের ইনফরমার জাদোকের নামই বলেছে স্যার। শুকনো কণ্ঠে বলল জন এ্যাপ্রেসে।
সর্বনাশ! বলে চিৎকার করে উঠল অগাস্টিন ইমানুয়েল। বলল, ডাকো তাকে।
ইনফামার ফিলিপ এল।
যে গুপ্তধন সরিয়ে নিয়েছে সেই গুপ্তধনের ঠিক লোকেশানটা কি বল? বলল জন এ্যাপ্রেনোস।
আমাদের জাদোক ঘাঁটির সাথেই গুপ্তধনের স্থানটা, তবে সঠিক স্থানটা বলা যাচ্ছে না। আমরা কেউ ওখানে যেতে পারিনি। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকরা এখনও ঘিরে রেখেছে জায়গাটা। ফিলিপ বলল।
সর্বনাশ! জাদোক ঘাঁটির সাথেই যে খয়েরুদ্দিন বার্বারোসার গুপ্তধন লুকানো আছে!
বলে একটু থেমেই অগাস্টিন ইমানুয়েল প্রশ্ন করল, কয়দিন আগে এ ঘটনা ঘটেছে?
তিন দিন আগে স্যার। ফিলিপ বলল।
উদ্ধার করা গুপ্তধন ওরা কোন সময় নিয়ে গেছে, রাতে না দিনে? জিজ্ঞাসা অগাস্টিন ইমানুয়েলের।
সন্ধ্যার পরে। ফিলিপ বলল।
কিসে করে নিয়ে যায়? বলল ইমানুয়েল।
কাভার্ড ভ্যানে করে। ফিলিপ জানাল।
কয়টা ভ্যান ছিল? বলল ইমানুয়েল।
আমি সাত-আটটার কথা শুনেছি স্যার। বলল ফিলিপ।
ও গড! আমি শুনেছিলাম খয়েরুদ্দিন বার্বারোসার ধনভাণ্ডার দ্বিতীয় বৃহত্তম। তাহলে সে কথা ঠিক।
বলেই অগাস্টিন ইমানুয়েল তাকাল ফিলিপের দিকে। বলল, যাও এখন।
চলে গেল ফিলিপ।
আমরা যে ধনভাণ্ডারের জন্যে অঢেল টাকা খরচ করছি, সেই ধনভাণ্ডার লুট করে নিচ্ছে রত্নদ্বীপের শয়তান সরকার। শয়তান আহমদ মুসা আমাদের ইপিজি ঘাঁটি থেকে গুপ্তধনের সব সন্ধানই পেয়ে গেছে। সব ধনভাণ্ডার ওরা একে একে লুট করবে। আর ওদের সময় দেয়া যায় না। এখনই এদের ধ্বংস করতে হবে। খয়েরুদ্দিন বার্বারোসার ধনভাণ্ডারের হীরা-জহরত ও সোনা-দানা এরা বিদেশে সরাবার আগেই রত্নদ্বীপ আমাদের দখল করতে হবে। আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নয়, যে তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সেই তারিখেই রত্নদ্বীপে অপারেশন চালাতে হবে। বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল অস্থির কণ্ঠে চিৎকার করে।
আমাদের শেষ প্রস্তাবটায় ওরা কি রাজি হয়েছে স্যার? জন এ্যাপ্রেনোস বলল।
রাজি হয়নি। ওরা রত্নদ্বীপ সরকারের ধ্বংস চায় আবার ধনভাণ্ডারের অর্ধেকও চায়। বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদেরই রাজি হতে হয়েছে। উপায় কি? ওরাই তো সব টাকা খরচ করছে। সৈন্য ও অস্ত্র-শস্ত্রের সরবরাহ ওরাই দেবে। বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
রত্নদ্বীপে যে অপারেশন চালানো হবে, তাতে আমাদের দায়িত্ব কি হবে? জন এ্যাপ্রেসে বলল।
আমরা ভেতর থেকে ওদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করব। আক্রমণ ও শত্রুকে পরাভূত করার দায়িত্ব ওদের। বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
কি কি তথ্য দেয়ার দায়িত্ব আমাদের? জিজ্ঞাসা জন এ্যাপ্রেনাসের।
দ্বীপের সিকিউরিটি আউটপোস্টের সংখ্যা, লোকেশন ও জনশক্তি আগেই ওদের জানাতে হবে। লেটেস্ট কি অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করেছে তার বিবরণ ওদের নির্দিষ্ট দিনের আগেই দিতে হবে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় দ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনী কিভাবে কোথায় রয়েছে, তাদের সংখ্যা ও অস্ত্রের বিবরণ ওদেরকে রাত দশটার মধ্যে জানাতে হবে। প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রীরা কে কোথায় থাকছেন, সে তথ্যও তাদের দিতে হবে রাত দশটায়। এই সব তথ্য দিলেই আমাদের প্রধান দায়িত্ব শেষ। এর বাইরে আমাদের লোকরা যে যেখানে যেটুকু সহযোগিতা করতে পারে করবে। ঐদিন আমাদের লোকরা ওদের সৈনিকদের মতো একই পোষাক পরিধান করবে। ওদের সাথে চুক্তি এবং রত্নদ্বীপ অপারেশনের যাবতীয় আমি রেকর্ড করে এনেছি একটা মাইক্রো চিপসে। তোমাদের কজনকে সেটা আমি দেখাব। বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
ধন্যবাদ স্যার। আমাদের দায়িত্ব আমরা অবশ্যই সঠিকভাবে পালন করতে পারব। আমরা চাই সফলতা। জন এ্যাপ্রেনোস বলল।
ধন্যবাদ জন এ্যাপ্রেনোস। এখন বল আমাদের শেষ ঘাঁটি রেনেটা দুর্গের নিরাপত্তার অবস্থা কি? বলর অগাস্টিন ইমানুয়েল।
স্যার, সারা সোফিয়া উপকূলের গার্ডওয়াল পাহাড় থেকে আমাদের রেনেটা দুর্গে আসার রুট সম্পর্কে কিছু জানতো। সে ধরা পড়ার পর আপনার নির্দেশে সে রুট আমরা বন্ধ করে দিয়েছি পাহাড়ের টানেলে দেয়াল তুলে। সেটা যে একটা দেয়াল ওদিক থেকে এসে তা কেউ বুঝতে পারবে না। আমরা উপকূলের জেটিটাকেও ধ্বংস করে দিয়েছি। অতএব ওদিক থেকে কোনো ভয় নেই। জন এ্যাপ্রেনোস বলল।
বিকল্প রাস্তার কি অবস্থা? বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
এ বিকল্প রাস্তার খবর কেউ জানে না। এরপরও রাস্তার তিন জায়গায় আমরা পাহারা বসিয়েছি। এছাড়া ঐ রাস্তা দিয়ে আমাদের ঘাঁটিতে প্রবেশের মুখে আমরা ছাউনি তৈরি করেছি। আপনার কথা মতো সেখানেই আমরা আমাদের জনশক্তিকে আজ একত্রিত করেছি আপনার শেষ ব্রিফিং শোনার জন্যে। অনুষ্ঠানের পর আমাদের জনশক্তির বিরাট একটা উপস্থিতি এখানে থাকবে ঘটনার দিন সকাল পর্যন্ত। বলল জন এ্যাপ্রেনোস।
আমাদের রেনেটা দুর্গের পূর্ব দিকটা তো প্রাকৃতিকভাবেই নিরাপদ তাই না? বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
ইয়েস স্যার, ওদিক থেকে আমার পথে যেসব ধাঁধা আছে, তা নক্সা ছাড়া সমাধান প্রায় অসম্ভব। এরপরও প্রত্যেক ধাঁধার পরে পাহারার জন্যে একটা চৌকি রেখেছি। কেউ ধাঁধা ভাঙতে পারলে তাকে সঙ্গে সঙ্গেই যাতে হত্যা করা যায়।
সুতরাং আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি স্যার। জন এ্যাপ্রেনোস বলল।
ধন্যবাদ জন। বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল। দরজায় নক হলো।
এস। বলল জন এ্যাপ্রেনোস। প্রবেশ করল ঘাঁটির সিকিউরিটি ইনচার্জ নিকোলাস।
বস। জন এ্যাপ্রেনোস বলল।
না বসেই নিকোলাস বলল, একটা জরুরি খবর আছে স্যার।
কি খবর? বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
আমরা বিকল্প রাস্তার অগ্রবর্তী তিন আউটপোস্টের কোনোটি থেকেই কোনো রেসপন্স পাচ্ছি না। প্রতি ঘন্টায় মেসেজ পাঠানোর কথা। গত তিন ঘন্টা থেকে একটা মেসেজও পাওয়া যায়নি। আমরা টেলিফোন করেছি বারো বার, দশটার মতো মেসেজ পাঠিয়েছি, কিন্তু ওদিক থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। প্রথম দিকে আমরা মনে করেছি ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তিনটি আউটপোস্টেই একই অবস্থা হবে, এটা অস্বাভাবিক। সবচেয়ে কাছের আউটপোস্টের কি অবস্থা দেখার জন্যে তিনজনকে পাঠিয়েছি। প্রতি দশ মিনিট অন্তর তাদের কাছ থেকে অয়্যারলেস মেসেজ পেয়েছি। কিন্তু আধা ঘন্টা থেকে তারাও নীরব। আমরা উদ্বেগ বোধ করছি। লোক পাঠাতেও আর সাহস পাচ্ছি না। নির্দেশের জন্যে আপনাদের কাছে এসেছি।
অগাস্টিন ইমানুয়েল ও জন এ্যাপ্রেনোস দুজনের মুখই উদ্বেগে আচ্ছন্ন। অগাস্টিন ইমানুয়েল চিৎকার করে উঠল, এতটা সময় নষ্ট করেছ কেন? বলেই উঠে দাঁড়াল অগাস্টিন ইমানুয়েল। জন এ্যাপ্রেনোসও উঠে দাঁড়াল।
ঠিক এই সময়েই ব্রাশ ফায়ারের শব্দ, তার সাথে একের পর এক বোমা বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল।
আমাদের ছাউনি এলাকা থেকে গোলাগুলি ও বোমার শব্দ ভেসে আসছে। চিৎকার করে বলল জন এ্যাপ্রেনোস।
আমার মনে হচ্ছে আমাদের লোকরাই প্রথম আক্রমণ করেছে। আমাদের স্টেনগানের শব্দই আমি প্রথম পেয়েছি। তারপর গুলি এসেছে। পাল্টা শত্রুর তরফ থেকে। কিন্তু আমাদের গুলি শুরু হবার পর পরই দশ বারোটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটল। এর মধ্যে দুটিকে গ্যাস বোমা বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। এ বোমাগুলো আমাদের নয় নিশ্চিত। তার মানে ওরা ডেথ গ্যাস বোমা বা চেতনা লোপকারী গ্যাস বোমার যদি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকে তাহলে সর্বনাশ ঘটতে যাচ্ছে।
এ কথাগুলো বলেই অগাস্টিন ইমানুয়েল তাকাল নিকোলাসের দিকে। বলল, যাও সকলকে গ্যাস মাস্ক পরতে বল। জানি না ছাউনির আমাদের লোকদের অবস্থা কি? দেখ, স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার থেমে গেছে। তার মানে… তার মানে কি ছাউনির প্রতিরোধ শেষ!
কথা শেষ করেই পাগলের মতো তাকাল জন এ্যাপ্রেনোসের দিকে। বলল, রেনেটা দুর্গ থেকে পূর্ব দিকে যাবার পথ বন্ধ করার কি কোনো ব্যবস্থা তোমাদের আছে?
সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে রেনেটা থেকে বেরোবার দুই শত গজের মাথায় পাহাড়ের একটা বড় ধরনের ক্রিক আছে। সেখানে স্টিলের একটি স্থানান্তরযোগ্য ব্রিজ আছে। ব্রিজটা সরিয়ে নিলে কারও পক্ষেই ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব নয়। জন এ্যাপ্রেনোস বলল।
গুড। ওপার থেকে ব্রিজটাকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা আছে তো? বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
হ্যাঁ, দুদিক থেকেই ব্রিজটাকে অপারেট করা যায়। জন এ্যাপ্রেনোস বলল।
চল, রেনেটা দুর্গ আমাদের ত্যাগ করতে হবে। ওরা অনেক বড় শক্তি। নিয়ে আক্রমণ করেছে। নিকোলাসকেই এখানকার পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এখনি বাইরের ওদের জানিয়ে দিয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্যেই দ্রুত আমাদের বেরোনো দরকার এই পরিবেশ থেকে। চল, আর দেরি নয়। বলল অগাস্টিন ইমানুয়েল।
চলুন স্যার। আমি নিকোলাসকে একটা নির্দেশ দিয়ে আসব এখনি আসছি। জন এ্যাপ্রেসে বলল।
না জন, ওর মতো ওকে এগোতে দাও। তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করো না। চল, আমাদের পোষাকও পাল্টাতে হবে। বলে অগাস্টিন নিকোলাস ঘর থেকে বেরোবার জন্যে হাঁটতে শুরু করল।
তার পেছনে জন এ্যাপ্রেনোসও।
.
স্যার, আমি দেখে এলাম ছাউনির বাইরে কোনো পাহারা নেই। ছাউনি ভর্তি মানুষ। সবাই গল্পগুজবে মত্ত। বলল মেজর আনাস আবদুল্লাহ। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। আজ অভিযানের শুরু থেকেই আল্লাহর অশেষ করুণা আমরা পেয়েছি। পথে পাহারার জন্যে ওদের তিনটি আউটপোস্ট ছিল। তিনটি আউটপোস্টেই প্রহরীদের ঘুমানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। ক্লোরোফরম করে ওদের ঘুমকে আরও গাঢ় করা হয়েছে। ২৪ ঘন্টার আগে ওদের আর ঘুম ভাঙবে না। এখানেও আল্লাহর সাহায্য আসবে। আলহামদুলিল্লাহ।
আহমদ মুসা তাকাল মেজর আনাস আবদুল্লাহর দিকে। বলল, ওরা কতজন হবে?
বিশাল ছাউনি। আমার ধারণা ওদের সংখ্যা সত্তর-আশির কম হবে না। মনে হচ্ছে যেন রত্নদ্বীপের গোটা জনশক্তিকে ওরা একত্রিত করছে। এখানে। ছাউনিটা একদম নতুন। যেন আজকালের মধ্যে এটা তৈরি হয়েছে। মেজর আনাস আবদুল্লাহ বলল।
হতে পারে কোনো সম্মেলন বা ব্রিফিং-এর জন্যে ওদের ডাকা হয়েছে। যাক, তুমি এক কাজ কর, ক্যাম্পের চারদিকে বোমা পাত। একটি মাত্র চেতনা লোপকারী গ্যাস বোমা অবশিষ্ট আছে। ওটাও ছাউনির সীমানার মাঝ বরাবর পাতার চেষ্টা কর। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, ওদের সংজ্ঞাহীন করে দিলেই তো হয়ে যায়, বিস্ফোরণের জন্যে বোমা পাতার তো দরকার পড়ে না। মেজর আনাস আবদুল্লাহ বলল।
আমরা যে চেতনা লোপকারী বোমা নিয়ে এসেছি সেটার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এর ক্লোরোফরম গ্যাসটা ভারি এবং চার বর্গগজের বাইরে যায় না। সুতরাং মাত্র একটি গ্যাস বোমায় একসঙ্গে এত লোকের সংজ্ঞা লোপ করা যাবে না। ওদের জন্যে অন্য বিস্ফোরক পাততে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। বলে মেজর আনাস আবদুল্লাহ ছাউনির দিকে হাঁটা দিল।
সবচেয়ে দূরের কোণ থেকে বিস্ফোরক পাতা শুরু করেছে তারা। নিঃশব্দে, অতি সন্তর্পণে বিস্ফোরক পাতা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সবচেয়ে কাছের শেষ কোণাটায় বিস্ফোরক পাততে যাচ্ছে, এমন সময় ভেতর থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, বাইরে শত্রু! ছাউনিতে বোমা। পেতেছে, টিভি মনিটরে দেখ।
সঙ্গে সঙ্গেই ছাউনির তিন দিক থেকে স্টেনগান গর্জন করে উঠল। সেই সাথে ছাউনির মুভেবল প্লাস্টিক ওয়াল ঠেলে চারদিক থেকে গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসছে মানুষ।
ভেতর থেকে চিৎকার উঠার সঙ্গে সঙ্গেই মেজর আনাস আবদুল্লাহ দ্রুত গড়িয়ে চলে এল আহমদ মসুর কাছে।
মেজর আবদুল্লাহ, রিমোট নিয়ে প্রস্তুত থাক। বলে আহমদ মুসা তার নতুন কারবাইনের ট্রিগার চেপে সামনে গুলির দেয়াল সৃষ্টি করল এবং চিৎকার করে বলল, তোমরা অস্ত্র ফেলে দাও, না হলে কেউ বাঁচবে না। তোমরা।
আহমদ মুসা গুলি বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ওদের বৃষ্টির মতো গুলি চলতেই থাকল।
মেজর আবদুল্লাহ এবার তোমার রিমোট ব্যবহার কর। বলল আহমদ মুসা। একটা গ্যাস বোমাসহ মোট সাতটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটল পর পর। সেই সাথে শুরু হলো আহমদ মুসা ও মেজর আনাস আবদুল্লাহর কারবাইন থেকে গুলি বৃষ্টি।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে গোটা ছাউনি এবং তার আশপাশ অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো।
মেজর আবদুল্লাহ, ছাউনির পূর্ব-দক্ষিণে দেখ ওদের রেনেটা ঘাটির মূল স্থাপনা। পুরনো দুর্গের বিল্ডিংকেই ওরা সংস্কার করে ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে। ঘাঁটি থেকে তেমন কেউ বেরোলো না। তার অর্থ ঘাঁটির সবাই এই ছাউনিতে এসে জমা হয়েছিল। তুমি ছাউনি ও ঘাটির মাঝখানে ঐ যে বড় পাথরটা দেখছ, ওটার আড়ালে গিয়ে অপেক্ষা কর। ঘাঁটিতে কেউ ঢুকতে গেলে বা বের হয়ে পালাতে চাইলে থামতে বলবে, না থামলে গুলি করবে। আমি ঘাটিতে ঢুকব। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আমি কি সাথে থাকতে পারি না? মেজর আনাস আবদুল্লাহ বলল।
এখানেই তোমার কাজ আছে মেজর আবদুল্লাহ। এক, তুমি ঘাঁটির প্রবেশ পথ নিয়ন্ত্রণ করবে। দুই, নিজের নিরাপত্তা ঠিক রেখে কোনো নিরস্ত্র ও আহতের সাহায্যের প্রয়োজন হলে করবে।
বলেই আহমদ মুসা ক্রলিং করে দ্রুত এগোতে লাগল দুর্গের দিকে। সদর দরজা দিয়ে না ঢুকে আহমদ মুসা দুর্গের পেছনে গাছ-গাছালির আড়ালে দুতলায় উঠা সিঁড়ির দিকে এগোলো।
দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল আহমদ মুসা।
সিঁড়ি একটা দরজায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে দরজায় চাপ দিল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। লক করা নয় দরজা। বোঝা যাচ্ছে স্টিলের দরজা হুড়কো। দিয়ে বন্ধ।
আহমদ মুসা দরজা কাটার সিদ্ধান্ত নিল। লেজার কাটার বের করে দরজার নিচের দিকের বিরাট অংশ কেটে ফেলল।
সেই কাটা অংশ দিয়ে এক খণ্ড আলো বাইরে এসে পড়ল।
অপেক্ষা করল আহমদ মুসা কিছুক্ষণ। তারপর ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরটা আলোকিত, একটা লম্বা ধরনের ঘর। ঘরের দেয়ালে বিভিন্ন রকমের অস্ত্র টাঙানো। ঘরে কোনো ফার্নিচার নেই। বসার মতোও কিছু নেই। আহমদ মুসা বুঝল, এটা একটা এক্সিট বা পালানোর রুম। কোনো অবস্থাতেই অস্ত্র ছাড়া যাতে পালাতে না হয় এজন্যে এ ঘরে এমনভাবে অস্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
আয়তাকার লম্বা ঘরটির পূর্ব দেয়ালের উত্তর প্রান্তে একটা উন্মুক্ত দরজা। দরজার ওপাশেও আলো দেখা যাচ্ছে। এই ঘরের একদম দক্ষিণ প্রান্তে আরেকটা দরজা। দেখার জন্যে বন্ধ দরজাটির দিকে দ্রুত এগোলো আহমদ মুসা। দেখল এ দরজাও হুড়কো দিয়ে বন্ধ। _ হুড়কো দ্রুত খুলল আহমদ মুসা। দেখল দরজা থেকে একটা সিঁড়ি পূর্ব দিকে নেমে গেছে। বুঝল আহমদ মুসা। এটা পালাবার বিকল্প পথ। এ পথ দিয়ে সম্ভবত পূর্ব দিকে পালানো যায়। আর যে দরজা দিয়ে সে। প্রবেশ করেছে ওটা দিয়ে পশ্চিম দিকে পালানো যায়। তাদের ভিআইপিদের পালাবার সব ব্যবস্থাই তারা করে রেখেছে।
দরজা বন্ধ করার জন্যে একটু পেছনে সরে এল আহমদ মুসা। ডান হাতের রিভলবারটা একটু উপরে তুলে বাম হাত দিয়ে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। এ সময় উত্তর দিকের দরজা থেকে একটা শব্দ হলো। শব্দটা দরজা দেয়ালের সাথে ধাক্কা খাওয়ার মতো।
আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগার তর্জনি চেপে বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। দেখতে পেল দরজা দিয়ে দুজন প্রবেশ করছে। একজন প্রবেশ করেছে, আরেকজন প্রবেশের পথে।
ওরা পশ্চিমমুখী হয়ে দরজা দিয়ে প্রবেশ করছিল। ওরা আহমদ মুসাকে দেখতে পেল একটু দেরিতে। আহমদ মুসার রিভলবার তখন ওদের দিকে তাক করা।
দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা তাদের রিভলবার তুলতে যাচ্ছিল।
রিভলবার তুলো না, ফেলে দাও রিভলবার। নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
ওরা বেপরোয়া। ওদের রিভলবার উঠে এসেছে। কিন্তু ট্রিগার চাপার সুযোগ পেল না। আহমদ মুসার রিভলবারের পরপর দুটি গুলি ওদের দুজনের মাথা গুড়ো করে দিল।
দরজার সামনে ওরা পড়ে গেল।
ছুটে গেল আহমদ মুসা ওদের দিকে। ওরা নিশ্চয় পালাবার জন্যেই এ ঘরে আসছিল। তার মানে ওরা দলের নেতা বা নেতা গোছের কেউ।
ওদের পরনে রত্নদ্বীপ-নিরাপত্তা বাহিনীর ইউনিফরম। ওরা পালাবার জন্যেই এই পোষাক পরেছিল সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্যে।
আহমদ মুসা চিৎ করে শোয়াল ওদের। প্রথমে দুজনেরই কলার-ব্যান্ড চেক করল। দুজনেরই কলার ব্যান্ডে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের মনোগ্রাম দেখতে পেল। তার সাথে তাদের নামও। একজনের নাম অগাস্টিন ইমানুয়েল। নামটা দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। অগাস্টিন ইমানুয়েল তো ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের প্রধান! তাহলে এই-ই ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের প্রধান? স্বয়ং প্রধান আজ এসেছিল এ ঘাঁটিতে! তার আসা উপলক্ষেই তাহলে আয়োজন হয়েছিল রত্নদ্বীপে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের নেতা-কর্মীদের এই সম্মেলন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। আল্লাহর অসীম সাহায্য এটা রত্নদ্বীপের জন্যে।
আরেকটা নাম জন এ্যাপ্রেনোস। আহমদ মুসা ধরে নিল, এই লোকটি তাহলে রেনেটা দুর্গ বা রত্নদ্বীপ ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের প্রধান হবে।
খুশি হলো আহমদ মুসা। ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের রত্নদ্বীপ-হেডকোয়ার্টারের পতন ঘটেছে, তা নিশ্চিত হয়ে গেল এদের মৃত্যু দিয়ে।
আহমদ মুসা ওদের লাশ ডিঙিয়ে প্রবেশ করল ভেতরের করিডোরে। এক নজরে তিনতলা, দুতলা ও একতলার সব ঘর দেখল আহমদ মুসা। কোনো ঘরেই কেউ নেই। আহমদ মুসা বেরিয়ে এল দুর্গ থেকে।
আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল মেজর আনাস আবদুল্লাহ।
সুখবর মেজর আবদুল্লাহ। ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের প্রধান অগাস্টিন ইমানুয়েল ও রত্নদ্বীপের ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের প্রধান জন, এ্যাপ্রেনোস পালাচ্ছিল। দুজনেই মারা পড়েছে। বলল আহমদ মুসা।
আলহামদুলিল্লাহ। স্যার এদিকে দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসছিল। একজন। সে মারা পড়েছে। আমি…।
মেজর আনাস আবদুল্লাহর কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, একটা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনেছিলাম, সেটা তাহলে তোমার? একটা রিভলবারের গুলিও হয়েছিল।
না স্যার, ব্রাশ ফায়ার করেছিল দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসা লোকটি। আমি তাকে দাঁড়াতে বলেছিলাম এবং তার স্টেনগান ফেলে দিতে বলে ছিলাম। উত্তরে সে ব্রাশ ফায়ার করেছিল আমার অবস্থান লক্ষ্যে। গুলিটা পাথরের আড়াল থেকে আমিই করেছিলাম। মেজর আনাস আবদুল্লাহ বলল।
লোকটির লাশ পরীক্ষা করছ? নাম জানতে পারলে ভালো হয়। বলল আহমদ মুসা।
এদিকে ব্যস্ত থাকায় আমি ওটা পারিনি স্যার। বলল মেজর আনাস আবদুল্লাহ।
এদিকে লোকদের খোঁজ নিয়েছ? বলল আহমদ মুসা। কয়েকজন বেঁচেছে স্যার। তাদেরকে আমি আলাদা করেছি। অবিলম্বে ওদের চিকিৎসা দরকার। মেজর আনাস আবদুল্লাহ বলল।
চল ওদের দেখতে হবে। তার আগে দুটো টেলিফোন করা দরকার। কর্নেল জেনারেল রিদারা সমুদ্রে অপেক্ষা করছে। ওদের এখানকার খবর জানাও। আর বল, ওঁরা যেন সবাই চলে আসেন। তাড়াতাড়ি। কিছু লোকের জরুরি চিকিৎসা দরকার। আর আমি প্রেসিডেন্টকে টেলিফোন করছি। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের সাথে টেলিফোনে আলাপ করার পর আহমদ মুসা ডাকল মেজর আনাস আবদুল্লাহকে। মেজর আবদুল্লাহ এলে আহমদ মুসা বলল, প্রেসিডেন্ট আসছেন এখানে। তার সাথে সিনিয়র মিনিস্টাররাও থাকতে পারেন।
তারা আসছেন? কিভাবে? মেজর আনাস আবদুল্লাহ বলল।
নতুন হেলিকপ্টার আনা হয়েছে রত্নদ্বীপের জন্যে। ঐ হেলিকপ্টার পাহাড়ের নির্দিষ্ট পরিসরে ল্যান্ড করতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
আলহামদুলিল্লাহ। খুশির খবর। আর স্যার কর্নেল জেনারেল রিদা স্যারও আসছেন। উনারা এখন পথে। সবাই দারুণ খুশি স্যার। মেজর আনাস আবদুল্লাহ বলল।
চল মেজর আবদুল্লাহ দুর্গের উপরটা একটু দেখি। বলল আহমদ মুসা।
দুজনে চলল দুর্গের দিকে।
.
ভাই আহমদ মুসা তুমি যা চেয়েছিলে তা করেছি। আহতদের সবাইকে আমার হেলিকপ্টারে সামরিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি যাতে তারা ভালো চিকিৎসা পায়, আবার নিরাপত্তার দিকটাও যাতে ঠিক থাকে। বলল প্রেসিডেন্ট।
সকাল ৭টার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী রেনেটা দুর্গে এসে পৌঁছে। হেলিকপ্টার থেকে নেমেই প্রেসিডেন্ট জড়িয়ে ধরে আহমদ মুসাকে। একে একে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীও।
সকাল ৮টার মধ্যে পৌঁছে যায় কর্নেল জেনারেল রিদা ও তার লোকজন।
রেনেটা দুর্গ, ধ্বংসস্তূপ ও আশপাশ পরীক্ষা করে দেখা গেল ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের ৭০জন লোক নিহত হয়েছে। আহত পাওয়া গেছে ১০জনকে। ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের প্রধান অগাস্টিন ইমানুয়েল ও রত্নদ্বীপের ব্ল্যাক সিন্ডিকেট প্রধান জন এ্যাপ্রোসসহ মৃতের সংখ্যা বাহাত্তর জন। আহমদ মুসার অনুরোধে ১০জন আহতকে সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টারে।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি, মানুষকে, বিশেষ করে বিপদগ্রস্ত ও অসুস্থ। মানুষকে সেবা দানকে সবচেয়ে দয়ার দৃষ্টিতে দেখেন আল্লাহ তায়ালা। আপনাকে ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।
ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য, ভাই আহমদ মুসা। পাঠানোর প্রস্তাব আপনার। বলল প্রেসিডেন্ট।
আপনি বলেই সে প্রস্তাবের সাহস আমি পেয়েছি প্রেসিডেন্ট। আহমদ মুসা বলল।
এসব থাক। হেলিকপ্টার ফিরে আসা পর্যন্ত দুর্গটা আরও একটু ভালো করে দেখতে চাই। বলল প্রেসিডেন্ট।
ঠিক আছে, চলুন। বলে উঠল আহমদ মুসা।
উঠল প্রেসিডেন্ট ও দুই মন্ত্রী।
পেছনে পেছনে চলল জেনারেল রিদা এবং মেজর আনাস আবদুল্লাহ।
চলল সবাই দুর্গের দিকে। পাহাড়ের ছাদের নিচে পাহাড়ের কোলের দুর্গটি ছোট তিনতলা একটা বাড়ি।
বাড়ির দেয়াল ছোট-বড় পাথর মিলিয়ে মজবুত করে তৈরি। ছাদও সমতল নয়, ঢালু এবং এবড়োথেবড়ো পাথরে ঢাকা। উপর থেকে খুব কাছ থেকে দেখলেও বাড়ি বলে মনে হয় না। মনে হয় পাহাড়ের নিচু একটা অংশ।
দুৰ্গটার প্রধান প্রবেশ পথের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রেসিডেন্ট। প্রবেশ পথের মাথার উপর তাকিয়ে দেখে সী-গাল ধরনের উড়ন্ত এক সামুদ্রিক পাখি। প্রতীক এই পাখিটাই দুর্গার প্রতি আমার আকর্ষণ, আগ্রহ বাড়িয়েছে। আমি নিশ্চিত, এটিই রেনেটা দুর্গ। দুৰ্গটা কোনো জলদস্যুর। গোপন ও নিরাপদ আশ্রয় হিসাবেই বানানো। কোনো বিপর্যয়ে তাদের পালাবার জায়গাও হতে পারে এটা। কিন্তু গেটের উপরে সামুদ্রিক পাখির প্রতীক খোদাই করা কেন? সামুদ্রিক পাখি মানুষকে আশা, নিরাপত্তা, স্বস্তির বাণী শোনায়। একজন দস্যুর ডেরায় এই পাখির প্রতীক আঁকা থাকবে কেন?
এক্সিলেন্সি হতে পারে, সেই দস্যুর জন্যে আশা, নিরাপত্তা ও স্বস্তির আলয় এই বাড়ি। বলল আহমদ মুসা।
পাহাড়ের অতি দুর্গম স্থানে লুকানো তার এই বাড়িটা তার জন্যে অবশ্যই স্বস্তি, নিরাপত্তা ও আশার আলয়। এর জন্যে পাখির প্রতীকের প্রদর্শনীর দরকার ছিল না। প্রদর্শনী তো হয় অন্যের দেখার জন্যে। প্রেসিডেন্ট বলল।
আহমদ মুসার ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। ভাবল একটু। বলল, এক্সিলেন্সি, আপনি ঠিক বলেছেন পাখির প্রতীক প্রদর্শনীর জন্যে। কিন্তু কেন? কেন মানুষের মনে আশা জাগানোর জন্য এই প্রতীক?
এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কেউ কিছু বলল না। সবাই আবার হাঁটা। শুরু করল। প্রবেশ করল দুর্গে।
দুর্গে অনেক ঘর। নিচতলাকে মনে হয় ব্যারাকের মতো। পঞ্চাশ ষাটজন লোকের অ্যাকোমোডেশন হতে পারে এখানে।
প্রেসিডেন্ট বলল, এই নিচতলাটা নিশ্চয় সৈন্য-সামন্ত রাখার জায়গা।
সৈনিকের অবস্থান দুর্গের অবিচ্ছেদ্য অংশ এক্সিলেন্সি। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু জলদস্যুদের কোনো সৈন্য থাকে না, থাকে ভাড়া করা সৈন্য বা ভাগিদার লোক। তাদেরকে জলদস্যু নেতা তার নিজস্ব ডেরায় নিয়ে যায় না। বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি সবকিছুর একটা এক্সেপশন আছে। তাছাড়া সৈনিকদের জন্যে ডেরার ব্যবস্থা থাকলেই সৈন্য রাখতে হবে তা নয়। আহমদ মুসা বলল।
দুতলা, তিনতলার সবকিছুই দেখা হলো।
সবশেষে তিনতলার পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তের পাহাড়ের গা কেটে তৈরি সর্বশেষ কক্ষটি দেখে বেরিয়ে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সবাই। আহমদ মুসাও।
ঘুরে দাঁড়িয়েই আহমদ মুসা দেখতে পেল সী-গাল জাতীয় সেই পাখির রেখাচিত্র, দরজা থেকে বেশ ভেতরে মেঝের পাথরে খোদাই করা। উড়ন্ত পাখিটার মুখ নিম্নমুখী।
পাখির স্কেচটার উপর চোখ পড়তেই আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল।
কি হল ভাই আহমদ মুসা চলুন। বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি দেখুন আবার সেই সামুদ্রিক পাখি। আমাদের সামনে, মেঝের উপর পাথরে খোদাই করা। আহমদ মুসা বলল।
মনে হয় দুর্গ নির্মাতাদের মধ্যে সমুদ্রচারী কোনো শিল্পী ছিল। সেই পাখির ছবি দুটি এঁকেছে, একটি শুরুতে, আরেকটা শেষে এবং একটি মাথার উপরে, আরেকটা পায়ের তলে। সেই শিল্পীর মধ্যে শুধু শিল্প জ্ঞান নয়, তীক্ষ্ণ রসবোধও ছিল।
প্রেসিডেন্ট একটু থেমেই আবার বলল, তাহলে এবার আমরা চলি ভাই আহমদ মুসা।
কিন্তু আহমদ মুসার কোনো দিকেই ভ্রূক্ষেপ নেই। সেই পাখির রেখাচিত্রের দিকে তাকিয়েছিল। গভীর চিন্তার প্রকাশ তার চোখে-মুখে।
প্রেসিডেন্টের ভ্রূকুঞ্চিত হলো। বলল, কিছু ভাবছেন ভাই আহমদ মুসা?।
এক্সিলেন্সি আমার অনুমান মিথ্যা না হলে এই ঘরে একটা রহস্য। আছে। বলল আহমদ মুসা।
রহস্য? কি রহস্য? প্রেসিডেন্ট বলল।
রহস্য বের করতে হবে। তবে আমি মনে করি পাখিটা আশার বার্তা দিচ্ছে। অথবা কোনো আশা ও আনন্দের দিকে আমাদের ডাকছে। বলল আহমদ মুসা।
আপনার উপরে আমার প্রশ্নাতীত আস্থা আছে। কি করতে চাচ্ছেন আপনি এখন? প্রেসিডেন্ট বলল।
ঘরের সবকিছু আমি আবার দেখতে চাই এক্সিলেন্সি। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে, শুরু করুন ভাই আহমদ মুসা। আমরা আপনার পাশে আছি। প্রেসিডেন্ট বলল।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।
বলে আহমদ মুসা এগোলো ঘরের দেয়ালের দিকে।
ঘরের দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করল আহমদ মুসা। নানা আকারের, নানা ধরনের সংকেত আছে। তার কোনোটি দেয়ালে দেখতে পায় কিনা, তার সন্ধান করল আহমদ মুসা সমন্ত মনোযোগ দিয়ে। দেয়ালের সবটা ভারি হুড়কো দিয়ে বাড়ি দিয়ে দেখল কোনো শব্দ সংকেত আসে কি না। না, কিছুই মিলল না। অবশেষে আহমদ মুসা এসে দাঁড়াল পাখির রেখাচিত্র ওয়ালা পাথরের পাশে।
সবাই তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। দেখছিল তার প্রতিটি কাজ।
আহমদ মুসাকে তার আগের জায়গায় পাথরের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখে প্রেসিডেন্ট বলল, ভাই আহমদ মুসা, আপনি এভাবে কি সন্ধান করছেন? কি জানতে চাচ্ছেন? আপনি এখন কি মনে করছেন?
আহমদ মুসা দেখছে পাথরে খোদাই করা পাখির সেই রেখাচিত্রকে। প্রেসিডেন্টের কথা হয় তার কানে পৌঁছেনি, নয় তো পৌঁছলেও জবাব দেয়ার মতো অবস্থায় তার মন ছিল না।
পাখির পায়ের দিকে দৃষ্টি আটকে গেছে আহমদ মুসার। বিস্ময়ভরা দৃষ্টি তার।
পাখির পা দুটি সমান্তরাল বিস্তৃত এবং পায়ের আঙুলগুলি নিম্নমুখী। গলাটা লম্বা হয়েছে, ঠোঁটটাও নিম্নমুখী। অর্থাৎ পাথরটির উপর যেন পাখিটি ল্যান্ড করছে।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার।
তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে। বলল, এক্সিলেন্সি হাতুড়ি ধরনের কিছু দরকার।
আমরা তো গোটা বাড়ি দেখলাম। হাতুড়ি ধরনের কিছু তো দেখিনি! বলল প্রেসিডেন্ট।
কর্নেল জেনারেল রিদা দুধাপ এগিয়ে এসে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, স্যার, মুখ সরু, বড় ও লম্বা পাথরখণ্ড হলে কি কাজ চলতে পারে?
হ্যাঁ, হতে পারে জেনারেল রিদা। কাজটা হলো, পাখির রেখাচিত্র। আঁকা এই পাথরটা ভাঙতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
আমরা চেষ্টা করছি স্যার। বলল কর্নেল জেনারেল রিদা।
কর্নেল জেনারেল রিদা মোবাইল করে জনৈক ক্যাপ্টেনকে গেটের পাশে পড়ে থাকা মুখ সরু বড় পাথরখণ্ডটাকে তিনতলায় আনতে বলল।
পাথরখণ্ডটি পাঁচ ফুটের মতো লম্বা। এক প্রান্ত সরু হলেও তার পরের অংশটি দুই ফুটের মতো বেড় হবে।
তিনজনে ধরে পাথরখণ্ডটি দিয়ে পাখি খোদাই করা মেঝের পাথরটির উপর আঘাত করতে লাগল। কয়েকটি আঘাতেই পাথরটি ভেঙে পড়ল। পড়ল সিঁড়িমুখের ল্যান্ডিং-এর উপর।
আনন্দে আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্টসহ সবাই বিস্ময়-বিমূঢ়। তাদের মুখে কোনো কথা নেই।
নীরবতা ভাঙল প্রেসিডেন্ট। বলল, অনেক ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। আল্লাহ আপনার এই দৃষ্টি ও বিবেচনা শক্তি আরো বাড়িয়ে দিন। আমরা কিছু বুঝিনি। কিন্তু মেঝে ভেঙে জলজ্যান্ত একটা সিঁড়ি পথ বের করে ফেললেন। মেঝে ভাঙার চিন্তা আপনার মাথায় কি করে এল?
আহমদ মুসা পাখির ল্যান্ডিং পোজের কথা বলল।
এটুকু দেখেই আপনি বুঝলেন মেঝের তলায় কিছু আছে! কিন্তু এই সিঁড়ি কেন? মানুষ বিপদকালীন ব্যবহারের জন্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে সিঁড়ি রাখে। কিন্তু এটা সেরকম নয়, একদম ক্লোজ করা। বলল প্রেসিডেন্ট।
পাখির দেয়া সংকেত যদি আমি বুঝে থাকি, তাহলে এক্সিলেন্সি আমরা একটা গুপ্তধনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। আমি মনে করি এই সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে আমরা একটা গোপন ধনভাণ্ডার পাব। আহমদ মুসা বলল।
প্রেসিডেন্টসহ উপস্থিত সকলের মুখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল।
কি বলছেন ভাই আহমদ মুসা, আপনি রসিকতা করছেন না তো? বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠ অনেকটা চিল্কারের মতো শোনাল।
না এক্সিলেন্সি। আপনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। ব্ল্যাক সিন্ডিকেট যে গুপ্তধনের সন্ধানে এ দ্বীপে এসেছে, তার একটা ইনশাআল্লাহ আমরা পেতে যাচ্ছি। আহমদ মুসা বলল।
ব্ল্যাক সিন্ডিকেট তো এখানে ঘাঁটি করেছিল। কিন্তু ওরা এই গুপ্তধনের সন্ধান পায়নি কেন? বলল প্রেসিডেন্ট।
ওরা জানতো এই দুর্গকে কেন্দ্র করেই কোথাও গোপন ধনভাণ্ডার আছে। তবে দুর্গেই আছে তা তারা জানতো না। তারা পাখির সংকেত বুঝেনি। আহমদ মুসা বলল।
ভাই আহমদ মুসা আল্লাহ আপনাকে কত ভালোবাসেন। এই ধনভাণ্ডারও আল্লাহ আপনার জন্যেই রেখেছেন। বলল প্রেসিডেন্ট। আবেগে তার কণ্ঠ ভেঙে পড়ল। চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু নেমে এল। তার দুই গণ্ডে।
না এক্সিলেন্সি, আল্লাহ রত্নদ্বীপকে ভালোবাসেন। তার জন্যেই এ সৌভাগ্য। আহমদ মুসা বলল।
না মি. আহমদ মুসা, আপনার ভাগ্যই রত্নদ্বীপকে ভাগ্যবান করেছে। ঈশ্বর তাঁর প্রিয় বান্দার মাধ্যমে রত্নদ্বীপকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন, এইটুকু পর্যন্ত বলা যায়। বলল অর্থমন্ত্রী ইহুদি নেতা বেন নাহান।
প্রধান চরিত্র এখানে আহমদ মুসা নয়, রত্নদ্বীপ। আল্লাহ রত্নদ্বীপকে সৌভাগ্যবান করতে চান। আহমদ মুসা বলল।
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, সিঁড়ি দিয়ে ভেতরে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
এটা আপনার দায়িত্ব। আপনিই ঠিক করুন কি করতে হবে। কাকে কি করতে হবে নির্দেশ করুন। বলল প্রেসিডেন্ট।
আমার সাথে মেজর আনাস আবদুল্লাহ নামবে। কর্নেল জেনারেল রিদা বাইরে যদি তেমন কাজ না থাকে তাহলে তাকেও নামতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। বলল জেনারেল রিদা।
এখন কোনো কাজ নেই। বাইরের জন্যে ব্যবস্থা রয়েছে। কর্নেল রিদা আপনার সাথী হতে পারে। বলল প্রেসিডেন্ট।
ওয়েলকাম জেনারেল রিদা। তিনটা গ্যাস মাস্ক, তিনটা বড় কি যোগাড় করা যাবে? অবশ্য আমার ও মেজর আবদুল্লাহর গ্যাস মাস্ক আছে। আপাতত একটা হলেই চলবে। বলল আহমদ মুসা।
ব্যবস্থা করছি স্যার। বলল জেনারেল রিদা।
বলেই জেনারেল রিদা টেলিফোন করল নিচ থেকে তিনটি বড় টর্চ, ১টি গ্যাস মাস্ক এবং ১টি প্রেসার ব্রেকার উপরে এখনি নিয়ে আসার জন্যে।
জেনারেল রিদা মুখ মোবাইল থেকে সরাতেই আহমদ মুসা বলল, ধন্যবাদ জেনারেল রিদা, প্রেশার ব্রেকারটা আমাদের কাজে লাগতে পারে।
টর্চ, গ্যাস মাস্ক, প্রেশার ব্রেকারসহ সব জিনিসপত্র এসে গেল।
বিসমিল্লাহ বলে প্রথমে সুড়ঙ্গে নামল আহমদ মুসা। জেনারেল রিদা তাকে ফলো করল। সবশেষে নামল মেজর আনাস আবদুল্লাহ।
তারা নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে।
বাইরে বসে অপেক্ষার পালা শুরু হলো প্রেসিডেন্ট ও দুই মন্ত্রীর।
প্রেসিডেন্টদের বসার জন্যে ক্যাম্প চেয়ার আনা হয়েছে। সিঁড়ি মুখটা ঘিরে তারা তিনজন বসেছে।
উৎকর্ণ তারা যদি কিছু শোনা যায় ভেতর থেকে সেজন্যে।
নীরব তিনজনই।
এক সময় নীরবতা ভেঙে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল, আমি যতই দেখছি আহমদ মুসাকে, ততই অভিভূত হচ্ছি। সংগ্রামে শান্তিতে সমান দক্ষ। অথচ এজন্যে আমিত্বের কোনো অহংকার তাঁর মধ্যে নেই।
দয়াময় ঈশ্বর তাকে ভালোবেসে অনেক গুণ তাকে ঢেলে দিয়েছেন। এটা তাকে অহংকারী নয়, কৃতজ্ঞ করেছে। আমরা ইহুদিরা তাঁর অনুগ্রহ এভাবেই পেয়েছিলাম। সে দানে আমরা
অহংকারী হয়েছিলাম, কৃতজ্ঞ হইনি। বলল অর্থমন্ত্রী ইহুদি নেতা বেন নাহান।
মানুষ আল্লাহর হলে, আল্লাহও মানুষের হয়ে যান। আহমদ মুসার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আহমদ মুসা যখন যা চান, আল্লাহ তার দোয়া মঞ্জুর করেন। প্রেসিডেন্ট বলল।
কি আশ্চর্য দেখুন, তিনি পরিবার নিয়ে এসছিলেন বেড়াতে। পরিবার পাঠিয়ে দিয়ে তিনি থেকে গেলেন আমাদের কাজে। আমাদের কাজকে তিনি নিজের কাজ বানিয়ে নিয়েছেন। কোনো দ্বিধা না করে তিনি মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আহমদ মুসাকে না। দেখলে এমন মানুষ দুনিয়াতে আছেন, তা বিশ্বাস করতাম না। বলল ক্রিস কনস্টানটিনোস।
ইসলাম মেনে চললে এ ধরনের মানুষ তৈরি হয়। ইসলামে ফি সাবিলিল্লাহর শিক্ষা এটাই। মানুষের জন্যে কাজ করা মানে আল্লাহর জন্যে কাজ করা, আল্লাহর জন্যে কাজ করার অর্থ মানুষের জন্যে কাজ করা। এই কাজে আমিত্ব থাকে না। অহংকার থাকে না, বিনিময় লাভের প্রত্যাশা থাকে না। কিন্তু আমাদের কাজ এমনটা হয় না। আমাদের ইসলাম মেনে চলা পূর্ণাঙ্গ নয়। আহমদ মুসা আমাদের অবস্থান থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। প্রেসিডেন্ট বলল।
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট উৎকর্ণ হলো। ঝুঁকে পড়ে তাকাল সিঁড়ি মুখের দিকে।
তাকাল অন্য সবাই।
.
স্বর্ণের এক বিশাল ভাণ্ডার পাওয়া গেছে রেনেটা দুর্গের সেই গোপন ধনাগার থেকে। ভাণ্ডারটা যেন সোনার খনি। টন টন সোনা উদ্ধার হয়েছে সেখান থেকে। রাজধানীতে সোনা পৌঁছাতে কয়েকটা হেলিকপ্টার কয়েকবার আসা-যাওয়ার দরকার হয়েছে।
স্বর্ণভাণ্ডারের মুখে পাওয়া গেছে একটা রুপোর কাসকেটে সিলগালা করা একটা চামড়ার ইনভেলাপ। ইনভেলাপটির উপর লেখা ছিল, যারা স্বর্ণভাণ্ডার খুঁজে পাবেন, তারা সকলে মিলে ইনভেলাপের ভেতরের লেখাটা পড়বেন।
লেখাটা পড়ার জন্যেই সকলে একত্রিত হয়েছে।
প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষ।
প্রেসিডেন্ট এসে বসল তার আসনে। তার সামনে টেবিলের এপাশে বসে ক্রিস কনস্টানটিনোস, বেন নাহান এবং আহমদ মুসা। তাদের পেছনে কর্নেল জেনারেল রিদা এবং আনাস আবদুল্লাহ।
প্রেসিডেন্ট বসেই তার টেবিলের উপর সিলগালা করা ইনভেলাপ আহমদ মুসার সামনে তুলে ধরে বলল, ভাই আহমদ মুসা, আপনি ইনভেলাপ খুলুন এবং পড়ুন। গোপন ধনভাণ্ডারের আবিষ্কার আপনার, এর সব ব্যবস্থাপনার মতো ইনভেলাপের ভেতরে যে লেখা আর তা পড়ার দায়িত্ব আপনার।
এ দায়িত্ব সকলের এক্সিলেন্সি। আমি সবার পক্ষ থেকে পড়ছি।
বলে আহমদ মুসা চামড়ার ইনভেলাপটি খুলল। ইনভেলাপ থেকে বের হলো, রাজকীয় ফরমানের লম্বা একটি চামড়ার কাগজ।
লেখার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল আহমদ মুসা। পরিষ্কার আরবি ভাষায় লেখা চামড়ার কাগজটাতে।
লেখার প্রতি প্রেসিডেন্ট ও অন্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আহমদ মুসা বলল, চামড়ার কাগজটায় আরবি ভাষায় লেখা। তাহলে কোনো আরবীয় বা নর্থ আফ্রিকান জলদস্যুর সংরক্ষিত স্বর্ণ এগুলো?
উত্তরটা পাওয়া যাবে লেখা পড়লেই। আপনার জন্য ভালোই হলো আহমদ মুসা। লেখা আরবি ভাষায়। পড়ন ভাই আহমদ মুসা। বলল প্রেসিডেন্ট।
পড়ছি এক্সিলেন্সি! বলে পড়া শুরু করল আহমদ মুসা:
আমি জন জানজু। বাড়ি হল্যান্ডে। অনেকের মতো আমিও নাবিক-এর জীবন গ্রহণ করি। প্রধান লক্ষ্য ছিল,স্প্যানিশ প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবেলা করা। পরে নাবিক জীবনের এক পর্যায়ে আমি ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ার লক্ষ্যে জলদস্যু হয়ে দাঁড়াই। যেখানে যা পাই, যেমনভাবে পাই সম্পদ সংগ্রহ করা আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সে সময়টা ছিল লুণ্ঠন ব্যবসায়ের স্বর্ণযুগ। ইউরোপীয় সমুদ্র জাহাজগুলো উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে আসছিল ইউরোপে। বিশেষ করে স্পেনীয় নাবিকদের জাহাজগুলো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে আসছিল জাহাজ বোঝাই স্বর্ণ। স্পেনীয় নাবিকদের জাহাজগুলো নির্দয়, নির্বিচারে লুণ্ঠন করে দক্ষিণ আমেরিকায় গড়ে উঠে ইনকা ও মায়া সভ্যতার সমৃদ্ধ স্বর্ণখনি ও মন্দিরগুলো। তালতাল স্বর্ণ এবং স্বর্ণখনিগুলোর অঢেল স্বর্ণ সম্পদ এসব মন্দিরে জমা করা হয়। এই স্বর্ণ বোঝাই জাহাজগুলো আমার লুণ্ঠনের টার্গেট হয়ে দাঁড়ায়। একের পর এক স্বর্ণ বোঝাই জাহাজ আমি লুণ্ঠন করি। এই লুণ্ঠন ছিল আমার জন্যে অসীম আনন্দের। একদিকে স্পেনীয়দের প্রতি বিদ্বেষ, অন্যদিকে স্বর্ণ প্রাপ্তি এই দুই কারণে এই আনন্দ ছিল অত্যন্ত উপভোগ্য। জাহাজ লুণ্ঠনের সাথে সাথে আমি দাস। ব্যবসায়ীও ছিলাম। আয়ারল্যান্ড থেকে আইসল্যান্ড, নরওয়ে থেকে মধ্য আটলান্টিক পর্যন্ত ছিল আমার সাম্রাজ্য। আমার লুণ্ঠন থেকে হল্যান্ডের জাহাজও রক্ষা পেত না। আমার লুণ্ঠিত স্বর্ণভাণ্ডার দেশে নিয়ে যাবার কোনো উপায় ছিল না। তাই ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন নির্জন দ্বীপে স্বর্ণ আমি জমা করে রাখতাম। আমার লুণ্ঠন কাজ ভূমধ্যসাগরেও বিস্তৃত ছিল। ১৬১৮ সালের দুর্ভাগ্য অথবা সৌভাগ্যের একদিনে আমার নৌবহর আলজেরীয় এক সমুদ্রচারী বাহিনীর হাতে বিধ্বস্ত হয়। আমি বন্দী হই। এই প্রথম মুসলমানদের সাথে গভীরভাবে মেশবার সুযোগ হয়। এর আগে স্পেনীয় জাহাজ থেকে বন্দী ক্রীতদাসদের মধ্যে একজন মুসলিম অফিসার পেয়েছিলাম। ক্রীতদাস হিসেবে তাকে আমি আমার কাছে। রেখেছিলাম। সে ছিল অত্যন্ত সৎ ও ধর্মভীরু। তাকে কখনও মিথ্যা বলতে শুনিনি। সে আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি তাকে স্বাধীন করে দেই। মুসলমানদের হাতে বন্দী হবার পর মুসলমানদের সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জানার আমার সুযোগ হলো। তাদের অনেকেই ভালো ছিল।, চরিত্রে আমার মতোই ছিল। তবে অনেকে ছিল ফেরেশতার মতো। আমি ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করি এবং তাদের নৌবহরে যোগ দেই। একদিন আলজিয়ার্সের এক দাস-মার্কেটে এক পর্দানশীন তরুণী মহিলাকে দেখি। আমার মনে হলো এমন সুন্দরী মহিলা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তাকে কেনার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় আমি জিতে যাই। তখন আমার হাতে যে সম্পদ ছিল সব দিয়ে আমি সে তরুণীকে ক্রয় করি। আমি আমার সমস্ত পরিচয় খুলে বলে তাকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দেই। সে শর্ত দেয়, সমস্ত হারাম উপার্জন আমাকে পরিত্যাগ করতে হবে। অতীত পাপের জন্য তওবা করে ভবিষ্যতে হারাম উপার্জন থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। আমি বললাম, বিয়ের জন্যে এমন কঠিন শর্ত দিচ্ছ কেন? আমি তোমাকে কিনেছি। তোমাকে ভোগ-দখল করার অধিকার আমি লাভ করেছি। সে বলল, হ্যাঁ তা পারেন। সেক্ষেত্রে আমি আপনার স্ত্রী হবো না। আপনিও আমার স্বামী হবেন না। আপনার পাপের দায় আমার উপর বর্তাবে না, আপনার কোনো ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমাকে জবাবদিহিও করতে হবে না। মেয়েটির এই কথায় হঠাৎ আমার যেন কি হয়ে গেল। তার কথাগুলো আমার মর্মমূলে বিদ্ধ হলো। একজন ক্রীতদাসী আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ভয়ে অঢেল সম্পদকে পায়ে ঠেলছে। আল্লাহর ভয়ে সে যা পারছে, আমি তা পারছি না কেন? আল্লাহর ভয় থেকে আমি নিজেকে মুক্ত মনে করছি কিভাবে! আমার হৃদয়ের বন্ধ দরজা যেন খুলে গেল। আলোর একটা স্নিগ্ধ ঝলক এসে আমার হৃদয়কে আলোকিত করে দিল। আমি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলাম, আমি তোমার শর্ত গ্রহণ করলাম। সমস্ত হারাম সম্পদ আমি পরিত্যাগ করলাম। তবে একটা অনুমতি দিতে হবে। সে বলল, সেটা কি? আমি বললাম, বিভিন্ন স্থানের আমার সম্পদ একত্র করে আমি এটাকে গচ্ছিত করে রাখতে চাই। আমার অনুরোধ থাকবে, যারা এই সম্পদ পাবেন, তারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় যে কাজেই ব্যয় করুন না কেন, সেটা হালাল কাজের জন্যে যেন হয়, মানুষের উপকারের জন্যে যেন হয়। আমি তার অনুমতি পেয়ে গেলাম। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার সমস্ত স্বর্ণভাণ্ডার তুলে এনে আমার সবচেয়ে গোপন ও শক্তিশালী ঘাঁটি রেনেটা দুর্গে রাখলাম। আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, এই বিপুল স্বর্ণভাণ্ডার যেন তিনি ভালো লোকের হাতে দেন এবং তারা যেন এই সম্পদ মানুষের উপকারেই ব্যয় করতে পারেন। তাহলে আমি যেমন খুশি হবো, তার চেয়ে বেশি খুশি হবে দক্ষিণ আমেরিকার হতভাগ্য মানুষ, যাদের স্বর্ণভাণ্ডার লুণ্ঠন করা হয়েছিল।
অবশেষে নিজের কথা আর একটু বলি। আল্লাহর ওয়াস্তে এই স্বর্ণ ভাণ্ডার ত্যাগ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল আমি বোধ হয় দরিদ্র হয়ে গেলাম। তা হইনি। আল্লাহ আমাকে ভালো রাখেন। আমি মুরাদ রইস নাম গ্রহণ করে মরক্কোর একটি শহর কোয়ালিদিয়ার গভর্নর হিসাবে আমার শেষ জীবন কাটাচ্ছি। ইহকালে আমি আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ পেয়েছি। আল্লাহ যদি শেষ বিচারের দিনে দয়া করে এই বান্দাকে কিছু জাযাহ দেন, তাহলে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি জাযাহ তিনি দয়া করে যেন দেন আমার স্ত্রী আমিনাকে।
পড়া শেষ হলো।
আহমদ মুসা কাগজটি ভাঁজ করে ইনভেলাপে ঢুকিয়ে রাখল।
প্রেসিডেন্টসহ সবাই অভিভূত হয়ে পড়ল। তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে। তাদের মনে নানা কথার তোলপাড়।
একজন অমানুষ মানুষ হবার অদ্ভুত এক ও অপরূপ কাহিনী এটা। আল্লাহর ওয়াস্তে সর্বস্ব ত্যাগের এক মহান দৃষ্টান্ত সে। আল্লাহ তাকে এর জাযাহ দিন। বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠ আবেগে ভারি।
পরশ পাথরের স্পর্শে লোহা যেমন সোনা হয়, তেমনি ক্রীতদাসী। আমিনা ছিল পরশ পাথর। তার স্পর্শে অমানুষ মানুষ হয়েছে। বলল ক্রিস কনস্টানটিনোস।
ঠিক বলেছেন মি, কনস্টানটিনোস। ক্রীতদাসী আমিনা আমাকে অভিভূত করেছে। ভাগ্যের ফেরে সে ক্রীতদাসী হয়েছে। এজন্যে বিশ্বপালক ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তার অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই। বরং ঈমান যেন তার আরও বৃদ্ধি পায়। কি অদ্ভুত তার বিশ্বাসের শক্তি, ঈশ্বরের প্রতি তার আনুগত্যের দৃঢ়তা! ক্রীতদাসী থেকে স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য এবং অঢেল সম্পদকে সে পায়ে ঠেলেছে। ঈশ্বরের ভয়ে যে ক্রীতদাসীর। জীবনকেই বেছে নিয়েছিল। স্যালুট তাঁকে। অর্থমন্ত্রী বেন নেহান বলল।
আলহামদুলিল্লাহ। মুরাদ রইস ও আমিনার পবিত্র জীবনের মতো তাদের স্বর্ণভাণ্ডারকে পবিত্র মনে হচ্ছে। এখন এই বিশাল স্বর্ণভাণ্ডার নিয়ে কি করব আমরা? বলল প্রেসিডেন্ট।
মন্ত্রীসভায় বসে আপনারা সিদ্ধান্ত নিন। আহমদ মুসা বলল।
না মন্ত্রীসভায় বসে এ সিদ্ধান্ত হবে না ভাই আহমদ মুসা। এই বিশাল স্বর্ণভাণ্ডার আপনার আবিষ্কার। স্বর্ণভাণ্ডারের মালিকের ইচ্ছে যিনি বা যারা এই স্বর্ণভাণ্ডার আবিষ্কার করবেন তিনি বা তারাই এই সম্পদ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেবেন। অতএব প্লিজ, আপনাকেই এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বলল প্রেসিডেন্ট।
এখানে উপস্থিত সবারই কি এই মত? আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করল।
এক মুহূর্ত দেরি না করে সবাই একবাক্যে বলে উঠল, আমাদের মতও এটাই।
ধন্যবাদ সকলকে। একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, স্বর্ণভাণ্ডারের মালিক তার সম্পদ ব্যবহারের যে নির্দেশিকা দিয়েছেন, তাতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক রাষ্ট্রীয় সব খাতেই এই স্বর্ণভাণ্ডার ব্যবহার করা যাবে। শুধু শর্ত হালাল বা বৈধ কাজে যেন ব্যবহার এই দৃষ্টিকোণ থেকে স্বর্ণভাণ্ডারের বণ্টন আমি এভাবে করতে চাই- এক. স্বর্ণভাণ্ডার আবিষ্কারের সময় রেনেটা দুর্গ এলাকায় যারাই ছিলেন, তারা প্রত্যেকেই স্বর্ণভাণ্ডার থেকে তাদের পছন্দ মতো একসেট করে স্বর্ণালংকার নেবেন উপস্থিতির স্মারক হিসেবে। দুই. ইসলামী বিধান অনুসারে যে দেশে গুপ্তধন আবিষ্কৃত হয়, গুপ্তধন সেই দেশের হয়ে থাকে। কিন্তু এই গুপ্তধনের মালিকের ইচ্ছা আমাদের কাছে এসেছে। সব দিক বিবেচনা করার পর আমার মত হল, উদ্ধারকৃত স্বর্ণভাণ্ডারের অর্ধেক পাবে রত্নদ্বীপ। দ্বিতীয় অর্ধেকের দুই ভাগ হবে। একভাগ যাবে ইউনিসেফ ফান্ডে। ইউনিসেফ এই টাকা খরচ করবে ল্যাটিন আমেরিকার শিশুদের কল্যাণে। দ্বিতীয় ভাগ যাবে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (OIC)-এর বিজ্ঞান ও ইসলামিক স্টাডিজ শিক্ষা ফান্ডে। এই দুই সংস্থা শিক্ষার উন্নয়ন, স্পেশাল স্কলারশিপ কর্মসূচিতে তারা এই অর্থ খরচ করবে। থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। সকলেরই মুখ আনন্দে উজ্জ্বল।
ভাই আহমদ মুসা, আপনি রত্নদ্বীপকে খুব ভালোবাসেন। রত্নদ্বীপ যা পেতে পারে, তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছেন আপনি। বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি আমি রত্নদ্বীপকে নয়, রত্নদ্বীপের সংবিধানকে, তার সরকার ব্যবস্থাকে এবং তার বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সহযোগিতা ও সহাবস্থানকে আমি ভালোবাসি। আমি চাই সব দেশের জন্যে এটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াক। আহমদ মুসা বলল।
মুহূর্তকাল থেমেই আহমদ মুসা বলল, স্বর্ণ বণ্টন হবার আগেই রেনেটা দুর্গে উপস্থিতরা তাদের পছন্দমত গহনা সেট নিয়ে নেবেন।
তাহলে আপনাকে দিয়েই শুরু হোক। আপনার পর আমরা পছন্দ করব। বলল প্রেসিডেন্ট।
এখানে উপস্থিত সর্বকনিষ্ঠ মেজর আনাস আবদুল্লাহ আমার সেটটা পছন্দ করবে। আহমদ মুসা বলল।
সবাই এগোলো স্বর্ণভাণ্ডারের দিকে।
৭
প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষ। বৈঠক শুরু সকাল সাতটা থেকে।
জরুরি বৈঠক।
আহমদ মুসার অনুরোধেই এই বৈঠক ডেকেছে প্রেসিডেন্ট।
সব মন্ত্রীই বৈঠকে উপস্থিত।
আরও উপস্থিত গোয়েন্দা প্রধান ওসমান তাসফিন এবং নিরাপত্তা বাহিনী প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদা।
বিরাট অর্ধচন্দ্রাকার টেবিল।
প্রেসিডেন্টের ডান পাশে টেবিলের প্রান্তে বসেছে আহমদ মুসা। আর বামপাশে টেবিলের প্রথমে বসেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
মিটিং রুম থমথমে।
প্রেসিডেন্ট বলছিল, ভাই আহমদ মুসা সব শুনলাম, সব জানলাম। রত্নদ্বীপে ব্ল্যাক সিন্ডিকেট ধ্বংস হবার পার ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের পেছনে এসে দাঁড়ানো বিপজ্জনক সংস্থাটি রত্নদ্বীপ ধ্বংস করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভাড়াটিয়া সৈন্যবাহিনী নিয়ে ওরা তৈরি হচ্ছে কোনো এক রাতের অন্ধকারে আক্রমণের জন্যে। আমরা কি করব, কি করে ওদের আক্রমণ ঠেকাব? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই ভাই আহমদ মুসা। রত্নদ্বীপ রক্ষা পাবে কি করে, সে চিন্তা, সে ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে। আমরা আতংকিত। আপনার চিন্তা বলুন ভাই আহমদ মুসা।
ভাবছিল আহমদ মুসা।
মুখ তুলল প্রেসিডেন্টের কথায়। বলল, এই চিন্তা আমি আগেই শুরু করেছি। কাজও কিছু করেছি। আরও কাজ বাকি আছে। বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দিন এক্সিলেন্সি। ইনশাআল্লাহ রত্নদ্বীপ শুধু রক্ষা পাবে তাই নয়, সেই শয়তান শত্রুও ধ্বংস হবে আল্লাহর ইচ্ছায়। আহমদ মুসার কণ্ঠ স্বাভাবিক, তাতে উদ্বেগের কোনো চিহ্ন নেই।
আল হামদুলিল্লাহ।
বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। এল আহমদ মুসার কাছে। আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল। প্রেসিডেন্ট জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, কি কথা বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব, কোন্ ভাষায় আপনাকে ধন্যবাদ দেব, তা আমার জানা নেই। শুধু বলব, ছোট দুর্বল আমাদের রত্নদ্বীপকে আল্লাহ দয়া করেছেন। প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ আবেগে ভেঙে পড়ল।
মিটিং শেষ হলো।
সবাই চলে গেল। প্রেসিডেন্টের অনুরোধে থাকল শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, নিরাপত্তা বাহিনী প্রধান, গোয়েন্দা প্রধান ও আহমদ মুসা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, জেনারেল রিদা, গোয়েন্দা প্রধান এই চারজনকে নিয়ে ক্রাইসিস কমিটি গঠন করা হলো। এই কমিটি সর্বক্ষণ বৈঠকরত অবস্থায় থাকবে। পরিস্থিতির সার্বক্ষণিক মূল্যায়নসহ আহমদ মুসার প্রয়োজন পূরণ ও তার নির্দেশ পালন করবে। ধন্যবাদ শুধু এজন্যেই আপনাদের বসতে বলেছিলাম। বলল প্রেসিডেন্ট।
সবাই উঠল। আহমদ মুসাও।
প্রেসিডেন্ট ড্রয়ার থেকে সুদৃশ্য ও বহুমূল্য গহনার একটি সেট বের করে আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, ভাই আহমদ মুসা। সেদিন এটা রেখে গিয়েছিলেন। নিয়ে নিন।
এক্সিলেন্সি, এই গহনা সেটটি আমি এখানে রেখেছি গোয়াদিয়া অঞ্চলের সেই পাহাড়ি পরিবারের মেয়ে লরা সোফিয়ার জন্যে। এক ভাই ছাড়া পরিবারের সবাইকে সে হারিয়েছে ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের হাতে। সামনে ওর বিয়ে। তার বিয়েতে আমার এই উপহার। প্লিজ, আপনি আপনার লোক মারফত তার কাছে এই গহনা পৌঁছালে আমি খুব খুশি হবো। আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময়ে ছেয়ে গেল প্রেসিডেন্টের মুখ।
উপস্থিত অন্য সকলেরও।
গোপন ধনভাণ্ডার উদ্ধারের সময় যারা রেনেটা দুর্গে উপস্থিত ছিল, তারা সকলেই একসেট করে গহনা নিয়েছে আহমদ মুসার প্রস্তাব ক্রমে। আহমদ মুসার জন্যে আনা সেই এক সেট গহনা, সে দিয়ে দিচ্ছে বাপ-মা, পরিবার হারা এক মেয়েকে! তার মানে আহমদ মুসা তার উদ্ধার করা স্বর্ণভাণ্ডার থেকে কিছুই নিল না। এই চিন্তা পীড়া দিচ্ছে সকলের মনকে। সেই পীড়া থেকেই তাদের বেদনা ও বিস্ময়!
ভাই আহমদ মুসা আপনি কি শুধু দেবার জন্যেই জন্মেছেন? নেবেন না কিছুই? মাত্র একসেট গহনা, তাও নয়! বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠ আবেগে কাঁপছে।
উপস্থিত সবার চেহারাই আবেগে ভারি হয়ে উঠেছে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, কে বলল আমি নিচ্ছি না! আমি নিজ হাতে মূল্যবান একসেট গহনা নিয়েছি আমার এক অসহায় বোনের জন্য। আমার আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। তার শোকর আদায়ের শক্তি আমার নেই। বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠও আবেগে ভারি।
সবাই নীরব।
পরিবেশটা আরও ভারি হয়ে উঠেছে।
অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, এখন আবেগ নয়, চোখে আগুন জ্বালাবার সময়। শত্রু যারা ধেয়ে আসছে। রত্নদ্বীপের দিকে তারা এসে যেন দেখে নতুন এক রত্নদ্বীপকে। তারা এসে যেন দেখে রত্নদ্বীপের চারদিকে সাজানো রয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের হিংসা, সন্ত্রাস ও যুদ্ধ-আয়োজন ধ্বংসের শক্তিমান মঞ্চ!!!
[পরবর্তী বই হুই উইঘুরের হৃদয়ে]
Rakibe
Good