সাইমুম ৫৮ – রত্ন দ্বীপ – আবুল আসাদ
প্রথম প্রকাশ – জুন ২০১৬
[ভূমধ্য সাগরের অথৈ জলে ভাসমান- সবার চোখের আড়ালে গুপ্তধন সঞ্চিত একটা দ্বীপ। নাম নিউ ট্রেজার আইল্যান্ড-ন্তুন রত্ন দ্বীপ। এই নতুন রত্ন দ্বীপে দুই লাখ লোকের বাস। দ্বীপের ২০ হাজার পরিবারের মধ্যে ১২ হাজার মুসলিম, ৭ হাজার খ্রিষ্টান এবং ১ হাজার ইহুদী। শান্তি, সমৃদ্ধি ও গনতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি যেন দ্বীপটা- সব ধর্মের লোক সরকারে অপরিহার্য। ধীরে ধীরে দ্বীপের সুখ, শান্তি ও গনতন্ত্রে লাগল আগুন, সন্দেহ, অবিশ্বাস আর বিভেদ। সংঘাত মাথা তুলল দ্বীপে, আতংকিত হয়ে উঠল মানুষ! দৈবচক্রে অবসর কাটাতে আসা আহমদ মূসা জড়িয়ে পড়ল ঘটনায়… পরিচয় পেয়ে দ্বীপের ভীত-সন্ত্রস্ত সরকার আহমদ মুসার সাহায্য নিল। সামনে এগোতে গিয়ে আহমদ মুসা দেখল দৃশ্যমান যে সংকট তার চেয়ে ষড়যন্ত্র অনেক বড়! আর এই সংকট ষড়যন্ত্রের মূল টার্গেট নয়, সিঁড়ি মাত্র। এই সিঁড়ি কোথায় পৌছার জন্যে? প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়ে আহমদ মুসার সামনে আসে ভূমধ্য সাগরের বিশাল ইতিহাস। ক্ষুদ্র এই নতুন রত্ন দ্বীপের মাটিতে সঞ্চিত আছে কাড়ি কাড়ি স্বররণ মুদ্রা? কাদের এই অঢেল স্বররণ মুদ্রা? স্পেন থেকে বিতারিত ভাগ্যাহত, ভূমধ্য সাগরে ডুবে যাওয়া মুসলমানদের? আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের? না অন্য কারো? সোনার টানে ছুটে এলো ষড়যন্ত্রের পেছনের ভয়ংকর সব দানবরা… ওদের দেশ নেই, নাম নেই, পরিচয় নেই, অদৃশ্য ওরা! ছায়ার সাথে শুরু হল ভয়ংকর লড়াই। ‘রত্ন দ্বীপ’ নিয়ে এল সেই ভয়ংকর লড়াইয়ের চরম কাহিনী।]
১.
ইভা নারিনকে ও.টি-তে নেবার আগেই তার বাবা পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক, তার মা মেরী মার্গারিটা এবং ছোট বোন আন্না এলিনা এসে পৌঁছিল পুলিশ হাসপাতালে। হেলিকপ্টার থেকে নেমেই তারা ছুটল প্রি ও.টি. সেকশনের দিকে।
ইভা নারিনকে দেখতে পেয়েই ছুটে গিয়ে ইভা নারিনের মুখের উপর মুখ রেখে কেঁদে উঠল তার মা মেরী মার্গারিটা। বাবা এবং অতি আদরের ছোট বোনও তার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়েছিল ডাক্তারদের পাশে নির্বাক বেদনা নিয়ে।
আহমদ মুসা ডাক্তারকে ফিসফিসে কণ্ঠে বলল, ম্যাডাম নারিনকে শীঘ্রই ও.টি-তে নেয়া দরকার।
ও.টির প্রধান ডাক্তার আরেভিক আভেডিস বলল, স্যার, সবে এসে বসলেন মেয়ের পাশে। কি করে বলি। আপনি আমাদের সাহায্য করুন।
আহমদ মুসা আস্তে আস্তে গিয়ে অ্যারাম আভ্রানিকের পাশে দাঁড়াল। ধীরকণ্ঠে বলল, স্যার, দেরি হয়ে যাচ্ছে। ইভা নারিনকে ও.টি-তে নেয়া দরকার।
মাথা ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। উঠে দাঁড়াল সংগে সংগেই। জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, কনগ্রাচুলেশন আহমদ মুসা। তুমি অসাধ্য সাধন করেছ। কিন্তু ইভা মার একি হল?
দুঃখিত স্যার, যে গুলিটা আমাকে বিদ্ধ করত, সেই গুলি সে নিজের বুক পেতে নিয়েছে। বলল আহমদ মুসা অশ্রুভেজা কণ্ঠে।
বাবা, উনি দুঃখিত, কিন্তু আমি গর্বিত। জীবনে একটা বড় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, সে কাজ আমি করেছি বাবা! কণ্ঠ টেনে সর্বশক্তি দিয়ে যেন কথাগুলো বলল ইভা নারিন।
স্যার, ওকে ও.টি-তে নিতে আর দেরি করা ঠিক হবে না। বলল আহমদ মুসা ইভা নারিনের বাবাকে।
ঠিক।
বলে অ্যারাম আড্রানিক তাকাল ডাক্তারদের দিকে। বলল, ডাক্তার, এবার আপনারা কাজ শুরু করুন।
স্যার, আমরা আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি। বলল ডাক্তার আরেভিক আভেড়িস।
ডাক্তাররা চললো ইভা নারিনের দিকে। ইভা নারিনের মা ও বোন উঠে ইভা নারিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
ডাক্তাররা ইভা নারিনকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হলো।
ডাক্তার আংকেল, আমি ডাক্তার নই, কিন্তু আমার আঘাত আমি অনুভব করছি। কোনো অপারেশনই তা নিরাময় করার জন্যে যথেষ্ট হবে না। আংকেল, আমি সত্যি বলছি কি না? বলল ইভা নারিন।
ডাক্তার আরেভিক আভেডিস মাথা নিচু করল। মুহূর্তকাল পরে বলল, মা, আমরা শুধু চেষ্টাই করতে পারি।
বাবা, শুনলে ডাক্তার আংকেলের কথা। বাবা, আমাকে অপারেশন থিয়েটারে মেরো না বাবা। আমার জীবন আজ ধন্য হয়ে গেছে বাবা। দুনিয়াতে আমার আর পাওয়ার কিছু নেই। আমি যতক্ষণ দুনিয়াতে আছি তোমাদের পাশে থাকতে চাই। বলল নারিন বাধো বাধো ক্ষীণ কণ্ঠে।
না আপা, তুমি বাঁচবে। তুমি মরতে পার না। আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে পার না। কাঁদতে কাঁদতে বলল আন্না এলিনা, তার ছোট বোন।
ইভা নারিনের যন্ত্রণাকাতর মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমার স্যারকে জিজ্ঞেস কর, উনিও জানেন অপারেশন প্রথাগত দায়িত্ব পালনের জন্যে।
ইভা নারিনের মৃত্যুর সময় আল্লাহ নির্দিষ্ট রেখেছেন, যা আমরা কেউ জানি না। সেজন্যে তাকে বাঁচানো বা তার বাঁচার জন্যে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে হয়। তোমার ঐ ধরনের একটা শেষ মুহূর্তের চেষ্টায় আমি বেঁচে গেছি। সেই শেষ চেষ্টাটা আমাদেরকে করতে দাও তুমি। শাত, নরম কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ইভা নারিনের। বলল, আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। কিন্তু আমার মন বলছে আমার সময় শেষ। তবু আপনি চাইলে, করুন শেষ চেষ্টা।
কথা শেষ করার পর পরই দেহটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল ইভা নারিনের। কি এক প্রবল কষ্টে ধুঁকতে লাগল ইভা নারিন। কেঁদে উঠল ইভা নারিনের মা, বোন।
ডাক্তার তাকে ঘিরে ধরল। মুখে অক্সিজেন মাস্ক বসাতে গেল।
মুখ নেড়ে নিষেধ করল ইভা নারিন।
বলল, মা-বাবা, আমাকে মুসলিম ম-তে কবর দিও। এলিনার স্যার যেন আ-মা-র জা-না-যা প-ড়া-ন। কথাগুলো কষ্ট করে টেনে টেনে বলল ইভা নারিন। গভীর অবসাদ যেন তার চোখ বুজিয়ে দিল। ধীরে ধীরে এক বার চোখ খুলল ইভা নারিন। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, এলিনার স্যার কোথায়? আমার একটা হাত ধরুন।
আহমদ মুসা পাশে বসল। আলতোভাবে নিজের হাতটা ইভা নারিনের হাতে রাখল। ইভা নারিনের দুর্বল হাত আহমদ মুসার হাত ধরার চেষ্টা করেও পারল না। বলল, কিছু মনে করবেন না। এটুকু অপরাধ আল্লাহ মাফ করে দেবেন। বলুন, বেহেশতে সবাই কি সবার দেখা পাবে?
সেটা মানুষের চাওয়া ও আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভর। বলল আহমদ মুসা।
আল্লাহ এক, মুহাম্মদ স, তাঁর রাসূল। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। গলগল করে তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে একদিকে গড়িয়ে পড়ল তার মাথা।
আহমদ মুসা ইন্নালিল্লাহ বলে উঠে দাঁড়াল। কেঁদে উঠল ইভা নারিনের মা, বোন। মাথা নিচু করল ইভা নারিনের বাবা। অশ্রু গড়াচ্ছিল তার দুগণ্ড বেয়ে।
চারদিকে দাঁড়ানো পুলিশরা তাদের মাথার হ্যাট নামিয়ে নিল।
দিভিনের পুলিশ প্রধান ভাহান ভাবান হন্তদন্ত হয়ে সেখানে এল। খবর শুনে মাথার হ্যাট নামিয়ে বলল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিককে লক্ষ্য করে, স্যরি স্যার। সে শুধু আপনার ভালো মেয়েই নয়, দেশের সফল একজন গোয়েন্দা অফিসার ছিলেন। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম স্যার।
সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা ভাবদান। ওদিকের কি খবর? বলল পুলিশ প্রধান।
খারাপ খবর স্যার। সেন্ট সেমভেল পটাশিয়াম সাইনাইড খেয়েছেন। আমরা গাড়িতেই মৃত অবস্থায় পেয়েছি। বলল ভাহান ভাবদান।
দিভিনের পুলিশ প্রধানকে কথা বলতে দেখে আহমদ মুসাও পাশে এসে
দাঁড়িয়েছিল। বলল, তার মানে তিনি জীবন্ত ধরা দিলেন না।
দেখছি, ওরা এক বিপজ্জনক দল স্যার। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি এদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন। ভাহান ভাবান বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
এখানে আসার পথে আমি প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন পেয়েছি। তিনি আহমদ মুসাকে মোবারকবাদ জানিয়েছেন। তিনি আহমদ মুসার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছেন। বলল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক।
ধন্যবাদ স্যার, তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারলে আমি খুশি হবো। বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল পুলিশ প্রধান ইভা নারিনের আব্বাকে, স্যার, সবাই কাঁদছে। ওদিকে দেখুন।
ইভা নারিনের বাবা চললো তার স্ত্রী ও মেয়ের দিকে। পুলিশকে নির্দেশ দিল তাদের ফর্মালিটি সম্পূর্ণ করার জন্যে।
পুলিশরা তৎপর হয়ে উঠল।
.
সবার অনুরোধের চাপে আহমদ মুসা সেন্ট সেমভেলের সেন্ট গ্রেগরি চার্চে তার অভিযানের কাহিনী বলছিল। কাহিনী শেষ করে উপসংহারে বলল, ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার-এর সবাই ধরা পড়েছে। সেদিন চার্চ কমপ্লেক্সেই ওদের তিরিশ জন ধরা পড়েছিল, নিহত হয়েছিল প্রায় বিশজন। যারা না জেনে বা নিছক আবেগবশত ওদের দলে যোগ দিয়েছিল, তারা ওদের সন্ত্রাসী ঘটনা জানার পর অনুতপ্ত হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ দিভিন উপত্যকার অধিবাসীরা এখন নিরাপদ। থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামার সাথে সাথেই দিভিনের সরদার আসতি আওয়াত বলল, ম্যাডাম ইভা নারিনের ঘটনা আমাদের খুব আহত করেছে, দুঃখিত করেছে। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা সকলেই তার জন্যে দোয়া করছি। তার নিহত হওয়া সম্পর্কে আপনি বেশি কিছু বলেননি।
আজই ঘন্টা দেড়েক আগে দিভিন উপত্যকায় এসেছে দিভিনের লোকরা। তারা আহমদ মুসার জন্যে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল। আহমদ মুসা আসার খবরে দিভিনের লোকেরা ঢলের মতো ছুটে এসেছিল সরদার আসতি আওয়াতের বাড়িতে। আহমদ মুসাকে তাদের উদ্দেশ্যে কথা বলতে হয়েছে। এরপর আহমদ মুসা সবাইকে দশটার মধ্যে জমায়েত হতে বলেছে। সেখানে আরও কথা হবে। আশ্বস্ত হয়ে সবাই মসজিদের দিকে চলে গেছে। কিন্তু সরদার আসতি আওয়াত, শেপল, এরদেলান, আহমদ নেবেজ, সিন সেনগাররা আহমদ মুসাকে ধরেছে তার অসাধ্য সাধনের কাহিনী বলার জন্যে, যা খবরের কাগজে বের হয়নি। খবরের কাগজে আহমদ মুসার কাহিনী কিছুই বলা হয়নি। বলা হয়েছে পুলিশের কৃতিত্বের কথা। আহমদ মুসার অনুরোধেই আর্মেনীয় সরকার এটা করেছে।
আজ সকাল দশটায় আর্মেনীয় সরকারের তরফ থেকে দিভিন। উপত্যকার অধিবাসীদের তাদের বড় মসজিদে সমবেত হতে আহবান জানিয়েছে। সেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধান আসবেন।
আহমদ মুসা আগেই দিভিন চলে এসেছে। সকাল ৭টার মধ্যেই সে দিভিন এসে পৌঁছেছে। আসতি আওয়াতের প্রশ্নের উত্তরে আহমদ মুসা বলল, প্রাচীন শহর দিভিনে সেন্ট সেমভেলকে ধরার অভিযানে আমি ইচ্ছা। করেই ইভা নারিনকে শামিল করিনি। ক্রিমিনালদের সাথে সংঘাতে পুরুষরা বিকল্প থাকতে মেয়েদের শামিল করা আমি উচিত মনে করি না। কিন্তু সে নিজের ইচ্ছাতেই গোপনে (পরে শুনেছি সে তার বাবার অনুমতি নিয়ে) আমার অনুসরণ করে। চার্চ গ্রেগরিতে অভিযানের আগে দিভিন শহরেরই অন্যত্র এক স্থানে মারাত্মক সংঘাতকালে সে আমার জীবন বাঁচায়। আমি সেদিন চার্চ গ্রেগরিতে ঢোকার পর সে এক সময় আমাকে সাহায্যের জন্যে চার্চ গ্রেগরিতে ঢুকে পড়ে। অভিযানের শেষ দিকে আমি যখন আহত ও পলায়নরত সেন্ট সেমভেলের দিকে ছুটছি, সে সময় সে পেছন থেকে আমার দিকে ছুটে আসতে থাকে। আমি তখন সামনের সেন্ট সেমভেল ও তার চারজন সহযোদ্ধা স্টেনগানধারীকে সামলাতে ব্যস্ত, সে সময় সেন্ট সেমভেলের গোয়েন্দা প্রধান সোনা সোনা পাশের এক আড়াল থেকে আমাকে গুলি করে। ইভা নারিন তখন আমার পেছনে পৌঁছে গেছে। আমাকে পাশের আড়াল থেকে গুলি করার বিষয়টা সে শেষ মুহূর্তে দেখতে পায়। তখন তার পক্ষে পাল্টা কিছু করার ছিল না। আমাকে রক্ষার জন্যে আমার দেহকে আড়াল করে গুলির সামনে এসে সে দাঁড়ায়। তার জীবনের বিনিময়ে আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেন। বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা থামল।
কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই নীরব। গভীর বেদনার ছায়া সকলের চোখে-মুখে।
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়েছেন। আপনার জন্যে জীবন দেয়ার মাধ্যমে ইভা নারিন আপা তার হৃদয়ের এক চাওয়াকে মহী য়ান করে গেলেন। আল্লাহ তাকে জাযাহ দিন। বলল শেপল। তার কণ্ঠ ভারি।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, সময় কিন্তু বেশি নেই। মেহমানরা আসার আগেই আমাদের সেখানে পৌঁছা দরকার। ব্যবস্থাপনা দেখা দরকার, যদিও সরকারিভাবে সব হচ্ছে। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল আহমদ মুসা।
সবার অবস্থা স্বপ্লেখিতের মতো হলো। শোকের আবহ কেটে গেল। জেগে উঠল সবাই। সবাই উঠে দাঁড়াল। সরদার আসতি আওয়াত সবাইকে দুতিন মিনিটের মধ্যে তৈরি হতে বলল।
সবাই দ্রুত চলে যাচ্ছিল।
সিন সেনগার আস্তে আস্তে এসে আহমদ মুসার পাশের চেয়ারে বসল।
ওড়নার ঘোমটার মধ্যে তাকে চেনাই কষ্ট হচ্ছিল।
কেমন আছ বোন? বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা যেন সে শুনতেই পায়নি। আপন মনেই অনেকটা স্বগতকণ্ঠে বলল, ভাইয়া এভাবেই কি আপনি মৃত্যুকে সাথে নিয়ে চলেন?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, আমি একা কেন, সব মানুষই তো মৃত্যু সাথে নিয়ে পথ চলে।
কিন্তু আপনার সাথে মৃত্যুর সাক্ষাৎ বারবার হয়, আমার বা অন্যদের তা হয় না ভাইয়া। বলল সিন সেনগার।
আমার সাথে মৃত্যুর সাক্ষাৎ হয়, আমি বাঁচিও তা থেকে। অনেকের কাছে সাক্ষাৎ ছাড়া আসে বলে তা থেকে বাঁচারও সৌভাগ্য হয় না। সেদিক থেকে আল্লাহ আমাকে সৌভাগ্যবান করেছেন সিন সেনগার। আহমদ মুসা বলল।
আপনার সাথে যুক্তিতে আমি পারব কেন? আশ্চর্যের বিষয় এবং আমার সৌভাগ্য যে ভাবীকে আপনার সম্পর্কে বলতে শুনলাম। বলল সিন সেনগার।
তোমার ভাবীর সাথে কবে কথা বললে? আহমদ মুসা বলল।
ঘটনার পরদিন টেলিফোন করেছিলেন। দেখলাম, আপনি সব কথাই তাকে জানিয়েছেন। তিনি আমাদের সকলের খোঁজ-খবর নিলেন এবং খুবই দুঃখ করলেন ইভা নারিন ম্যাডামের জন্যে। ভাইয়া, আপনার পরিবারও মডেল পরিবার। বলল সিন সেনগার।
মডেল পরিবার নয়, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানার চেষ্টাকারী একটি পরিবার মাত্র। রাসুল স.-এর পরিবারই একমাত্র মডেল পরিবার। আহমদ মুসা বলল।
স্যরি ভাইয়া। আর ভুল হবে না। ভাইয়া, আপনি নাকি আজ রাতেই চলে যাচ্ছেন? বলল সিন সেনগার।
হ্যাঁ, যেতে হবে বোন।
জানি ভাইয়া। এটাই তো শেষ যাওয়া। আর কি আসবেন আপনি? বলল সিন সেনগার। অশ্রুভেজা তার কণ্ঠ।
আল্লাহ ছাড়া এটা কেউ জানে না বোন। আর শুধু আমি আসব কেন? তোমরাও যেতে পার। মদিনায় এস তোমরা। আহমদ মুসা বলল।
মদিনায় গেলেই তো আপনার দেখা মিলবে না। বলল সিন সেনগার।
কেন ভাবীদের পাবে। আর মদিনায় গেলে যাকে পেলে মানুষ সবাইকে ভুলে যায় সেই রাহমাতুল্লিল আলামিনকে পাবে। তার সামনে গেলে দুনিয়ার আর কোনো চাওয়ার কথাই মনে থাকবে না। আহমদ মুসা বলল। আবেগ ঝরা তার কণ্ঠ।
ধন্যবাদ, সে নসিব যেন হয় ভাইয়া। বলল সিন সেনগার।
ভেতর থেকে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলো সরদার আসতি আওয়াত, এরদেলান, শেপল ও আহমদ নেবেজ।
ভাই-বোনে কি আলোচনা হচ্ছে? স্নেহভরা কণ্ঠে বলল সরদার আসতি আওয়াত সিন সেনগারকে লক্ষ্য করে।
বাবা, ভাইয়া চলে যাচ্ছেন, সেটা নিয়েই কথা বলছি।বলল সিন সেনগার।
কে যাবেন? তোমার ভাইয়া, মানে জনাব আহমদ মুসা? সরদার আসতি আওয়াত বলল।
হ্যাঁ বাবা, ভাইয়া আজ রাতেই চলে যাচ্ছেন। বলল সিন সেনগার।
সরদার আসতি আওয়াত তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, এ কি শুনছি জনাব আহমদ মুসা? আপনি সবে তো এলেন দিভিন উপত্যকায়। এখনই আমরা আপনাকে ছাড়তে পারি না।
শেপল, এরদেলান, সিন সেনগার, আহমদ নেবেজ সকলের চোখে-মুখে বেদনার কালো ছায়া।
আহমদ মুসা গম্ভীর। বলল, আমি আপনাদের সাথে আরও কয়েকদিন থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। আজ রাতে মদিনা শরিফে যাব। কাল জরুরি কিছু কাজ আছে। পরদিন সকালেই আমার ফ্লাইট ভূমধ্যসাগরের রত্ন দ্বীপে যাবার জন্যে তৈরি থাকবে। আমেরিকা থেকে আমার পরিবার মদিনা যাবার পথে পরশু ঐ দ্বীপে আসছে মাত্র দুদিনের জন্যে। আমার এখানকার কাজ আপাতত শেষ হয়ে গেছে এটা জানার পর এই প্রোগ্রাম তারা করেছে। সুতরাং জনাব আমার কিছু করার নেই। আপনারা আমাকে মাফ করবেন।
জানি জনাব আহমদ মুসা, আমাদের ডাকে নয়, হঠাৎ করেই আপনি এখানে এসেছিলেন আবার হঠাৎ করেই চলে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন বিনা নোটিশে যাবেন তা আমরা ভাবিনি।
একটু থামল সরদার আসতি আওয়াত। থেমেই আবার শুরু করল, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো কিন্তু আমরা সকলেই জানি, সাধারণত যা ঘটে, তা আহমদ মুসার কাছে আশা করা ঠিক নয়। বিয়ের মেহেদির রং শুকানোর আগেই জীবন-মরণ সগ্রামের অভিযানে তিনি এসেছিলেন অনেকের মন ভেঙে দিয়ে, আজ যেমন আমাদের মন ভেঙে যাচ্ছে। এইভাবে মন ভাঙতে গিয়ে এই মহান মানুষটির মনও যে রক্তাক্ত হয়, সে খবর আমরা কিন্তু কেউ রাখি না। আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন, আমাদের মতো মজলুম মানুষদের পাশে দাঁড়াবার তৌফিক আল্লাহ তাকে আরও বেশি বেশি দিন।
একটু থেমেই আবার সে বলল, চলুন জনাব আহমদ মুসা, সময় বেশি নেই।
তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে সরদার আসতি আওয়াত বলল, চল সবাই।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
মন ভাঙার বেদনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন স্যার, কিন্তু আমাদের মন ভাঙা তো নতুন, তাই বেশি খারাপ লাগছে আমাদের। বলল আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে শেপল।
সবাই হাঁটতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা হাসল। হেসে সে পরিস্থিতি হালকা করতে চাইল। বলল, শেপল। মন না থাকলে মন ভাঙবে কি করে, এমনটা ভাব না কেন?
বরং আপনার মনটাই সবচেয়ে সজীব, সবচেয়ে স্পর্শকাতর। তা না হলে, আমরা ভাবার আগেই ইয়াতিম, সহায় হয়ে পড়া সিন সেনগারকে আপনি বোন বানিয়ে নিলেন কি করে? শেপলই বলল। তার কণ্ঠ ভারি, ভাঙা ভাঙা।
সবাইকে ধন্যবাদ। এস আমরা সামনের প্রোগ্রাম নিয়ে ভাবি। এই আয়োজনটা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অফিস। তিনিই কথা বলবেন। আর দিভিনের পক্ষ থেকে কথা বলবেন সরদার সাহেব। বলল আহমদ মুসা।
জনাব আহমদ মুসা আপনাকেও কথা বলতে হবে। আর আমি কি কথা বলব। প্রধানমন্ত্রীর সামনে আমি আগে তো কোনো দিন কথা বলিনি। সরদার আনতি আওয়াত বলল।
প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনলেই বলার বিষয় খুঁজে পাবেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন দক্ষিণ আর্মেনিয়া প্রদেশের কমিশনার। তার পরেই কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরে বক্তব্য রাখবেন আপনি। এখানে আসার জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানাবেন। ধন্যবাদ জানাবেন দিভিবাসীদের জন্যে কথা বলা ও কাজ করার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
প্রধানমন্ত্রী কি বলবেন, কিছু জানেন জনাব আপনি? সরদার আসতি আওয়াত বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার সাক্ষাতের সময় আমি কিছু কথা বলেছিলাম। তিনিও বলেছিলেন। এখন তিনি এখানে কতটুকু কি বলবেন আমি ঠিক জানি না। চলুন, সময় তো প্রায় হয়ে গেছে।
.
চত্বরসহ দিভিনের বিশাল মসজিদ। চত্বর ও চত্বরের তিন পাশ জুড়ে দিভিনের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার বিশাল সমাবেশ।
প্রধানমন্ত্রীর ডানপাশে বসেছে আহমদ মুসা, আহমদ মুসার পাশে বসেছে দিভিনের সরদার আসতি আওয়াত। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বামপাশে বসেছে আর্মেনিয়ার দক্ষিণ প্রদেশের কমিশনার এবং তার পাশে বসেছে। আর্মেনিয়ার পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক। তাদের পেছনে বসেছে। সরকারি অফিসিয়াল, সিকিউরিটি ও পুলিশের লোকরা। সামনে, ডাইনে, বামে বসেছে দিভিনের হাজার হাজার লোক।
উদ্বোধনী ও স্বাগত বক্তব্য শেষ হয়েছে মাত্র। এখন প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেবেন। চারদিকে প্রবল আবেগ ও উত্তেজনা।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য শুরু করে প্রথমেই দিভিনবাসীদের বিরাট সংখ্যার যে প্রাণহানি ঘটেছে, ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, তাদের উপর যে জুলুম অত্যাচার হয়েছে তার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করল। তবে বলল, হত্যা, গুম, জুলুম অত্যাচার বন্ধে সরকারের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। অবশেষে সাফল্য। এসেছে। এ সাফল্য যার হাত দিয়ে এসেছে, যাদের হাত দিয়ে এসেছে, তার। এবং তাদের প্রতি আমি আমার সরকার ও আর্মেনীয় জনগণ কৃতজ্ঞ। আর্মেনিয়া একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদিসহ সব ধর্মের লোকের সমান অধিকার। এটা আমাদের রাষ্ট্রের নীতি। এই নীতি আমাদের জনগণ সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করবে। আমি আজ এখানে দ্ব্যর্থহীন। ভাষায় ঘোষণা করছি, দিভিনের বাসিন্দারা মহান সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর বংশধর! এটা সমগ্র আর্মেনিয়ার জন্যে একটা গর্বের বিষয়। এটা জেনে আমি ও আমরা আর্মেনীয়রা গর্ববোধ করছি। আরও গর্ববোধ করছি। এটা জেনে যে, মহান সুলতান সালাহ উদ্দিনের পূর্বপুরুষরা আর্মেনিয়ার। দিভিন নগরীর বাসিন্দা ছিলেন। এখন থেকে দিভিনবাসীরা স্ব পরিচয়েই আর্মেনিয়ায় থাকবেন আর্মেনীয় জনগণের আবহমান অংশ হিসাবে। দিভিবাসীদের উপর যে অবিচার হয়েছে, তাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুরণ করা অসম্ভব। তবে তাদের অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি হিসাবে দিভিন নগরীতে তাদের যে বসতি ছিল, তা তাদের ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তারা দিভিন উপত্যকা ও দিভিন নগরী দুজায়গাতেই থাকতে পারবেন। দিভিন নগরীতে যেখানে তাদের বসতি ছিল, সেখানেই তাদের নতুন বসতি গড়ে দেয়া হবে। গত কয়েক বছরে দিভিন উপত্যকার যে ক্ষতি হয়েছে, তার কিছুটা পূরণ করে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা দিভিবাসীদের ক্ষতি করেছে তারা আর্মেনিয়ারই ক্ষতি করেছে। তাদের পরিচয় যাই হোক, আর্মেনীয় জনগণ। তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। এদের সাথে সীমান্ত পারের এক শ্রেণির লোকেরও যোগসাজস ছিল। তাদেরও খুঁজে বের করা হচ্ছে।
বক্তব্য শেষ করার আগে প্রধানমন্ত্রী বলল, ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে আর্মেনীয় জনগণের যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, সে বিজয় এনেছেন আর্মেনীয় জনগণের এমন একজন বন্ধু যিনি, আমি মনে করি, তিনি পৃথিবীর সব মানুষের গর্ব। তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। যিনি নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্যে এভাবেই নীরবে-নিভৃতে থেকে কাজ করে যাবেন। তার নাম না জানলেও প্রত্যেক আর্মেনিয়ান ভালোবাসা দিয়ে তাকে সিক্ত করবে। তাকে আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা। সেই সাথে আমি আমাদের পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিকের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি এই মহৎ মানুষটিকে সাধ্যমত সহযোগিতা করেছেন। সবচেয়ে বেশি আমি স্মরণ করছি, আমাদের পুলিশ প্রধানের বড় মেয়ে আমাদের গোয়েন্দা অফিসার ইভা নারিনকে। তিনি শুরু থেকেই ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে অভিযানে আর্মেনিয়ার। বন্ধু মহান ব্যক্তিটিকে সঙ্গ দিয়েছেন, সাহায্য দিয়েছেন এবং শত্রুর বুলেটে জীবন দিয়ে তাকে বিজয়ী করে গেছেন। আমার দেশ, আমাদের পুলিশ বাহিনী সব সময় ইভা নারিনকে গর্ব ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। তার পিতা-মাতা এবং পরিবারের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আমি দিভিবাসীদের নতুন জীবনে স্বাগত জানিয়ে আমার কথা শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ। কথা শেষ করল প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঘোষণা করা হলো সরদার আসতি আওয়াতের নাম।
সরদার আসতি আওয়াত শুরুতেই দিনিবাসীদের পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানাল দিভিনে আসার জন্যে এবং আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল দিভিনবাসীদের প্রতি তার শুভেচ্ছার জন্যে। ইভা নারিনকেও স্মরণ করল এবং তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করল। সবশেষে বলল, আর্মেনিয়া তাদের মাতৃভূমি। আমরা নিজেদের যতটা ভালোবাসি, আর্মেনিয়াকে আমরা ততটাই ভালোবাসি। আমাদের ধর্ম ইসলামেরও শিক্ষা এটাই। আমাদের উপর অতীতে যা ঘটেছে, তার জন্যে দায়ী কিছু ক্রিমিনাল। আমাদের দুঃসময়ে জনগণ ও জনগণের সরকার আমাদের সাথে। ছিল। আমরা কৃতজ্ঞ তার কাছে, যে মহান ভাইয়ের সাহায্যে আমাদের দুঃসময়ের অবসান ঘটল, আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাই না। প্রার্থনা করব, আল্লাহ যেন এই জগতে এবং পরজগতে এর উপযুক্ত জাযাহ তাকে দেন। তাকে দীর্ঘজীবী করুন এবং দুনিয়ার সব মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়াতে আল্লাহ যেন তাকে তৌফিক দান করেন।
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং সবশেষে মহান আল্লাহর শোকর আদায় করে সরদার আসক্তি আওয়াত তার কথা শেষ করল। সম্মেলন শেষ হলো।
আনন্দে আপুত দিভিনবাসীরা ধীরে ধীরে চলে যেতে শুরু করলো।
প্রধানমন্ত্রী সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল। তার সিকিউরিটি টিম ও সংগীরা প্রস্তুত হলো।
পুলিশ প্রধান প্রধানমন্ত্রীকে জানালো সে একটু পরে যাবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনি ওদের সাথে কথা বলে আসুন। আপনি আহমদ মুসার সাথে এয়ারপোর্টে যাচ্ছেন তো?
জি স্যার, আমার গোটা পরিবারই যাবে। বলল পুলিশ প্রধান।
সেটাই ভালো। তাকে বিদায় দেয়াটা সরকারি না হয়ে পারিবারিক হোক, আহমদ মুসা এটাই চায়। প্রধানমন্ত্রী বলল।
বিদায়ের সময় আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, বিদায় বলব না, আসুন বলব। আর আমি যে কথাটা বলেছি, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কথাটা সুযোগ বুঝে বললে আমি বাধিত হবো।
অবশ্যই বলব মি, প্রধানমন্ত্রী। ধন্যবাদ। বলে আহমদ মুসা বিদায় জানাল প্রধানমন্ত্রীকে।
চলে গেল প্রধানমন্ত্রী দল-বল নিয়ে। পুলিশ প্রধানকে নিয়ে আহমদ মুসা, আসতি আওয়াত ও অন্যরা যা করল সরদার আসতি আওয়াতের বাড়ির দিকে।
.
ডিনার সেরে নিজের ঘরে এসে বসল আহমদ মুসা।
ঘড়ির দিকে তাকাল। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। মাত্র ঘন্টা দেড়েক আগে আহমদ মুসা দিভিন উপত্যকা থেকে ইভা নারিনদের বাসায় এসে পৌঁছেছে। দেরি হয়ে গেছে ওখান থেকে বেরুতেই। দিভিন থেকে বিদায় নয়া তার জন্য কষ্টকর হয়েছে। এরদেলান, আহমদ নেবেজ, শেপল, সিন সেনগারসহ দিভিনের নতুন প্রজন্মের অশ্রু মাড়িয়ে আসতে হয়েছে তাকে। ওরা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছে, এ কয়েকটা দিন তো আর স্বপ্ন ছিল না যে, আমরা এত সহজেই সবকিছু ভুলে যাব, ভুলে যেতে পারব? উত্তরে আহমদ মুসা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, এটাই জীবন। আল্লাহ মানুষের জীবনকে হাসি-কান্না দিয়ে এভাবেই সাজিয়েছেন। আমরা আনন্দঘন মিলনকে এনজয় করব, বিচ্ছেদে ধৈর্য ধারণ করব, এটাই মহান আল্লাহ চান। আহমদ মুসার এ কথাগুলো ওদের কান্না আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল, থামায়নি মোটেও। সিন। সেনগার বলেছিল, এ কান্না থামবে না ভাইয়া, এ কান্না দুঃখের নয়, বিচ্ছেদের নয়, ভালোবাসার। কান্নার সব প্রস্রবণ পেছনে ফেলেই আহমদ মুসাকে আসতে হয়েছে।
আহমদ মুসা তার ব্যাগ গুছিয়ে নিল। এয়ার লাইন্স টিকিট এখানেই দিয়ে যাওয়ার কথা। টিকিট ও বিদায় নেয়ার জন্যে তাকে আসতে হয়েছে। অ্যারাম আড্রানিক, আন্না এলিনা, সবার কাছেই।
আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু গড়িয়ে নেবার জন্যে শুতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা। কিন্তু পারল না।
বাইরে পায়ের শব্দ পেল। সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা।
দরজায় নক হলো।
এসো আন্না এলিনা। বলল আহমদ মুসা।
ঘরে প্রবেশ করল আন্না এলিনা, তার বাবা পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক ও মা মেরী মার্গারিটা।
স্যার, দরজা বন্ধ ছিল। কেমন করে বুঝলেন আমি নক করেছি। আন্না এলিনা বলল।
তুমি সব সময় তর্জনি ও বুড়ো আঙুল একসংগে করে নক কর। শব্দটা মোটা ও ফাপা ধরনের হয়। বলল আহমদ মুসা।
বাবা, তুমি প্রত্যেকটা বিষয়কে এত সূক্ষ্মভাবে দেখ! সত্যিই একটা বিস্ময় তুমি বাবা! আমার ইভা মা দিভিন যাবার সময় আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলে সে বলেছিল, উদ্বিগ্ন হয়ো না মা, আহমদ মুসার ছায়ায় কাজ করে মৃত্যুতেও আনন্দ আছে। তিনি মানুষের জন্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। ইভা নারিন ও আন্না এলিনার মা ও পুলিশ প্রধানের স্ত্রী মেরী মার্গারিটা। বলল।
সেও নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্যে জীবন দিয়েছে মা। আমাদের বিশ্বাস মতে সে শহীদের মর্যাদা পাবে, যাদের জন্যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে। বলল আহমদ মুসা।
এটাই আমাদের জন্যে সান্ত্বনা বাবা। মা আমার কাজের মধ্যে ডুবে থেকে যেন কোনো এক শূন্যতা ঢেকে রাখতে চাইত। কিন্তু মৃত্যুকালে তার চোখে-মুখে সেই শূন্যতা আমি দেখিনি, দেখেছি পরিতৃপ্তি। সে মৃত্যুকে স্বাগত জানাতে পেরেছে বাবা। এটাও আরেক সান্ত্বনা আমাদের। মেরী মার্গারিটা বলল।
স্যারের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর আপা একদমই বদলে গিয়েছিলেন। একদিন আপা বললেন, এলিনা, অবশেষে আমি আলোর দেখা পেলাম। আমার জীবনে কোনো অন্ধকার এখন আর নেই। বলে একটু থেমেছিলেন। আপা। আবার বলে উঠেছিলেন, সে আলো আমার নয় এলিনা, কিন্তু সে আলো আমাকে পথ দেখিয়েছে, আমার জীবনকে পূর্ণ করেছে। মৃত্যুকালেও আপা একথাই বলে গেছেন। বলল আন্না এলিনা, ইভা নারিনের বোন।
মায়ের আত্মা শান্তি পাক, তার বেহেশত নসীব হোক, এই প্রার্থনাই আমরা করতে থাকব।
মুহূর্তকাল থেমেই পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত তোমার টিকিট আহমদ মুসা টার্কিস এয়ার লাইন্সেই হয়েছে। টার্কিস যে প্লেনটা আজারবাইজানের বাকু থেকে আসছে, সেটা ইয়েরেভেনে রাত ৯টায় ল্যান্ড করবে এবং সাড়ে ৯টায় বাগদাদ, রিয়াদ হয়ে মদিনা শরিফ যাবে। সুতরাং তোমার সময়টা আধা ঘন্টা এগিয়ে এসেছে।
তাহলে তো সময় বেশি নেই। বেরুতে হবে আমাকে। আমি প্রস্তুত জনাব। বলল আহমদ মুসা।
এলিনা আরও কি যেন দেবার জন্যে এনেছে। অ্যারাম আভ্রানিক, এলিনার বাবা বলল।
আবার কি আছে এলিনার কাছে। তার ও আপনাদের গিফটে বড় ব্যাগটা তো ভরে দিয়েছেন। বলল আহমদ মুসা।
এটা গিফট নয়, আর আমারও নয়। আপা একদিন এই প্যাকেট আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, এগুলো কাজে লাগাবার সুযোগ আমার আসেই না। তোমার স্যারের এগুলো খুব কাজে লাগবে। তুমি রাখ এবং যখন মনে করবে তখন তাকে এটা দিয়ে দিয়ো।বলে আন্না এলিনা প্যাকেটটা আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
হাত বাড়িয়ে নিল আহমদ মুসা। বলল, প্যাকেটে কি আছে এলিনা, জান?
না, জানিনা স্যার। আমি পৌঁছে দেয়ার বাহক মাত্র। আন্না এলিনা বলল।
আহমদ মুসা খুলে ফেলল প্যাকেটটা। দেখল, ভেতরে আরও দুটো কার্টুন প্যাকেট এবং সেই সাথে ভেলভেট কাপড়ে মোড়া ক্ষুদ্র সাদা একটা রিভলবার।
জিনিসগুলোর দিকে চোখ পড়তেই পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক বলে উঠল, আহমদ মুসা তুমি নিশ্চয় চিনতে পারছ জিনিসগুলো। অতি কাজের এই দুর্লভ জিনিসগুলো আমিই এনে দিয়েছিলাম ইভা নারিনকে।
হ্যাঁ, একটা দেখছি স্কিন স্পাই সেট, আরেকটা ক্লথ স্পাই সেট এবং রিভলবারটি নিশ্চয় পিনের মতো পাতলা ও পয়জনস বুলেট স্প্রে করে। এ রিভলবার আমি ব্যবহার করিনি, তবে এ সম্পর্কে আমি জানি। কিন্তু স্কিন স্পাই সেট ও ক্লথ স্পাই সেটের নাম শুনেছি, বিস্তারিত কিছু জানি না। বলল আহমদ মুসা।
স্কিন স্পাই সেট ও ক্লথ স্পাই সেটের স্পাই অস্ত্রগুলো প্রায় একই ধরনের, ফাংশনও একই রকমের। পার্থক্য হলো একগুলো স্কীনে পেস্ট হয় আর অন্যগুলো কাপড়ে পেস্ট হয়। স্কিনের পেস্টটা পেস্ট করার সংগে সংগেই তা চামড়ার রং ধারণ করে, আর কাপড়েরটা স্কিনে পেস্ট করার পরে তা কাপড়ের রং নেয়। স্পাই সেটের ক্ষুদ্র অস্ত্রগুলো বিভিন্ন কাজের। এর মধ্যে সাউন্ড মনিটর, রিসিভার, রিমিটার আছে, বিস্ফোরক চীপস আছে যা দিয়ে যেকোনো কংক্রিটের দেয়ালও ১ বর্গগজের মতো ফুটো করা যায়। ল্যাসার কাটার আছে, সাময়িক অন্ধত্ব সৃষ্টিকারী গ্যাস চীপসও আছে, আছে অ্যান্টিগ্যাস চীপস- যা যেকোনো গ্যাস আক্রমণ এক ঘন্টা ঠেকিয়ে রাখতে পারে এবং আছে ভিটামিন চীপস যা খেয়ে কয়েকদিন মানুষ সুস্থ ও সবল থাকতে পারে। অ্যারাম আড্রানিকু বলল।
দারুণ দরকারী জিনিসগুলো তো! এসব তো মার্কেটে পাওয়া যায় না! বলল আহমদ মুসা।
না, এগুলো মার্কেটে পাওয়া যায় না। খুবই গোপন অস্ত্র এগুলো। আমি এগুলো মার্কিন স্পাই নেটওয়ার্ক থেকে যোগাড় করেছি। মা ইভা নারিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি খুশি হবো আমার মায়ের গিফটগুলো গ্রহণ করলে। অ্যারাম আড্রানিক বলল।
আল্লাহ ইভা নারিনকে এর উপযুক্ত জাযাহ দিন। আমি কৃতজ্ঞ এলিনা ও আপনার কাছেও। আমি আপনাদের কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেলাম! বলল আহমদ মুসা।
তোমার সৌজন্যবোধও অনুকরণীয় আহমদ মুসা। কিন্তু তুমি শুধু নিয়ে গেলে, এটা ঠিক নয়। তুমি আর্মেনিয়ায় পা দেবার পর থেকেই যা করেছ, সবই আর্মেনিয়ার জন্যে, আর্মেনিয়ার জনগণের জন্যে করেছ। ইভা নারিনের মৃত্যু তোমাকে আহত করেছে, কিন্তু সেও তো জীবন দিয়েছে আর্মেনিয়ার জন্যে। তোমাকে বাঁচাতে না পারলে সেন্ট সেমভেলকে ধরা যেত না। আর তাকে ধরা না গেলে গোটা পরিস্থিতি পাল্টে যেত। পরে পুলিশকেই আসামী হতে হতো। সেরকম একটা আয়োজনের জন্যে একটা চক্র মুখিয়ে ছিল। আমার ইভা মা তোমাকে বাঁচিয়ে আর্মেনিয়াকেই বাঁচিয়েছে এক প্রবল সন্ত্রাসী চক্রের হাত থেকে। সুতরাং আমরা এবং আর্মেনিয়াবাসী তোমার কাছে। অনেক ঋণি আহমদ মুসা। এই পরিবারেরও তুমি অশেষ উপকার করেছ। ইভা মার কথা ধরো না। অনেক সময় বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ আনন্দের হয়। ইভা মাকে দেখে আমার তাই মনে হয়েছে।
একটু থামল অ্যারাম আভ্রানিক। সংগে সংগেই আবার বলল, এবার উঠতে হয় আহমদ মুসা।
হ্যাঁ, চলুন।
বলে আহমদ মুসা অ্যারাম আভ্রানিকের সাথে উঠে দাঁড়াল। তার হাতে তার ছোট ব্যাগটা।
বেয়ারা এসে আহমদ মুসার বড় ব্যাগটা নিয়ে গেল।
আগে হাঁটছিল আড্রানিক। তার পাশে আহমদ মুসা। তাদের পেছনে মেরী মার্গারিটা ও আন্না এলিনা। তাদের দুজনেরই মাথা ও গায়ে ওড়না। জড়ানো। ঢিলা ট্রাউজারের উপর গায়ে ফুলহাতা শার্ট।
অশ্রুতে আন্না এলিনার চোখ ভেজা।
স্যার, আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে, আপনার কষ্ট হচ্ছে না এভাবে চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে! বলল আন্না এলিনা। কান্নায় ভেঙে পড়ল এলিনার শেষ কথাগুলো।
এই কান্নাকে ভয় করে আহমদ মুসা। অথচ এই কান্নার মুখোমুখি হতে হয় তাকে অবিরামভাবে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। বলল নরম কণ্ঠে, বোন এলিনা, মানুষ হিসেবে তোমার এ ভাইয়ের মনও তোমার মনের মতোই নরম। কিন্তু মনের চাওয়া এবং জীবনের গতি সব সময় মেলে না। যখন মেলে না তখন জীবনের গতিকেই প্রাধান্য দিতে হয়। আর চিরদিনের কথা বলছ কেন? আমরা তো সবাই সবার টেলিফোন নাম্বার জানি। আর আমাদের বাড়ির দূরত্ব এয়ারে তিন ঘন্টারও কম। কষ্ট পেয়ো না বোন, আমি তোমাদের পাশেই আছি মনে করো।
আন্না এলিনা চোখ মুছে বলল, বোন বলেছেন আমাকে! খুশিতে আরও কাঁদতে ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু বকবেন, তাই কাঁদবো না। কিন্তু বোনের দাবি অনেক, ভাইয়ের দায়িত্বও অনেক, কথাটা মনে রাখবেন। আর আমার আবদার কিন্তু বেশি। ভাই ছিল না। ভাই পেয়ে আবদার আরও বাড়বে।
বলতে বলতে আবার কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল তার কণ্ঠ।
শুনব আবদার। কিন্তু আর কান্নাকাটি নয়। বলল আহমদ মুসা।
এলিনার ভাই হয়ে তো আমাদের ছেলে হয়ে গেছ আহদ মুসা। আমরা আবদার নয়, আদেশ করতে পারি। এলিনার মা মে মার্গারিটা বলল।
মা, আমি তো ছেলে হয়েই আছি। মায়ের আদেশকে ছেলেরা ভয় করে।। মমতাময়ী মায়েরা ছেলের সামর্থ্য দেখেই আদেশ করেন। বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল আবার।
.
২.
শুকতারা সবে দিগন্তের উপরে উঠেছে।
একটা মাইক্রো এসে সড়কের পাশে একটা পুরানো সিনাগগের ধার ঘেঁষে দাঁড়াল।
মাইক্রো থেকে লাফ দিয়ে নামল চারজন মানুষ। চারজনই মুখোশ পরা।
ছুটল সিনাগগের দিকে, সিনাগগের বিভিন্ন অংশের দিকে।
সিনাগগটি খুবই পুরানো। কয়েকশ বছরের পুরানো।
সিনাগগটি দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে। একেবারে উপকূলে নয়। এই অংশের উপকূলটা এবড়ো-থেবড়ো পাহাড়ে ঢাকা। পাহাড়ী উপকূল থেকে দ্বীপের অভ্যন্তরে একটু এগোলেই একটা সমতল উপত্যকা। এ উর্বর উপত্যকায় রয়েছে বসতি। উপত্যকার মাঝখান দিয়ে দ্বীপের একটা প্রধান। সড়ক। এই সড়কের পাশেই সিনাগগটা।
দ্বীপটার নাম রত্ন দ্বীপ। ইংরেজি, স্প্যানিশ ভাষায় এটার নাম নিউ ট্রেজার আইল্যান্ড, সংক্ষেপে রত্ন দ্বীপ।
দ্বীপটি ভূমধ্যসাগরের মানচিত্রে প্রায় অদৃশ্য। একশ ষাট বর্গমাইল। আয়তনের ও দুই লাখ মানুষের ছোট্ট দ্বীপ এটা। সুন্দর ও মজার ভূ-প্রকৃতি এই রত্ন দ্বীপের। পাহাড়ের দেয়ালে দ্বীপের চারদিকটাই ঘেরা। দক্ষিণ ও উত্তর উপকূলে দুটি মাত্র উন্মুক্ত স্থান। দ্বীপে প্রবেশের পথ মাত্র এই দুটিই। কোনো কোনো স্থানে পাহাড় ডিঙানো হয়তো অসম্ভব নয়, কিন্তু তা খুবই কষ্টকর ও বিপজ্জনক। এ পর্যন্ত যারাই এ চেষ্টা করেছে শখের বশে, তাদের অনেকেই সফল হয়নি। কয়েকজন মারাও পড়েছে। সুতরাং দ্বীপটা একটা প্রাকৃতিক দুর্গ। দুর্গের ভেতরের দৃশ্য সুন্দর এবং বিস্ময়কর। দ্বীপের চারদিকের পাহাড় থেকে ভূমি কিছুটা ঢালু হয়ে দ্বীপের কেন্দ্রের দিকে নেমে গেছে। ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে মিঠা পানির প্রাকৃতিক হ্রদ, যা সেচ ও খাবার পানির যোগান দেয়। হ্রদটির নাম লেক ফরচুন। আসলেই দ্বীপটির। মানুষের জন্যে লেকটি সৌভাগ্য-সমুদ্র। দ্বীপের মধ্যে ছোট ছোট টিলা এবং উর্বর উপত্যকার সারি। টিলাগুলোর মাথায় মানুষের বাড়ি ও গাছ-পালা এবং উপত্যকায় তাদের ফসল।
দ্বীপের বসতিটাও এক মজার কাহিনী। ইউরোপীয় মধ্যযুগের শেষ দিকে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার নির্যাতিত মানুষরাই এই নির্জন ও নিরাপদ দ্বীপে বসতি গড়তে শুরু করে। এর মধ্যে ছিল মুসলিম খ্রিস্টান ইহুদি সব ধরনের লোকই। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সংখ্যা আসে স্পেন থেকে। স্পেনে মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা খ্রিস্টানদের হাতে চলে যাবার পর হত্যা ও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার জন্যে এবং বেঁচে যাওয়া নির্যাতিত, সর্বহারা মানুষের যে ঢল ভূমধ্যসাগরে নেমেছিল, তাদের বড় অংশ ডুবে মারা যায় অথবা জলদস্যুদের দ্বারা লুষ্ঠিত ও নিহত হয়েছিল। অবশিষ্টদের একটা অংশ ফরাসি উপকূলে আশ্রয় পেয়েছিল আর একটা বড় অংশ উঠেছিল বিভিন্ন দ্বীপে। নির্জন রত্ন দ্বীপেও এসেছিল প্রচুর মানুষ। এভাবে ইউরোপের রাজনৈতিক হানাহানিতে উদ্বাস্তু এবং নিরাপত্তার সন্ধানে খ্রিস্টানরা বিভিন্ন দিক থেকে এসেছিল এই দ্বীপে। ইউরোপের নির্যাতিত লাখ লাখ মানুষ এবং ফিলিস্তিনের ইহুদি-মুসলিমদের মধ্যকার হানাহানি এড়াবার জন্য কিছু ফিলিস্তিনিও এই রত্ন দ্বীপে এসেছিল। এই সব নির্যাতিত মানুষের উত্তরসূরিরাই আজ রত্ন দ্বীপের বাসিন্দা। শুরু থেকে কিছু জলদস্যুও ঘাঁটি গেড়েছিল দ্বীপটিতে।
দ্বীপটির উপর চারপাশের অনেক দেশেরই ক্ষমতাধরদের চোখ পড়েছিল। দ্বীপটি কোনো দিক দিয়েই কারো খুব কাছকাছি নয়, তবু দ্বীপটিকে দখলে নেয়ার জন্যে এক সময় সকলেই উঠে পড়ে লেগেছিল। দ্বীপটির অবস্থান লিবিয়া থেকে ৪০০ মাইল উত্তরে, ক্রিট দ্বীপ থেকে ৫০০ মাইল পশ্চিমে, গ্রিস থেকে ৫০০ মাইল দক্ষিণে, মাল্টা থেকে ৫৫০ মাইল পুর্বে এবং ইটালি থেকে ৬০০ মাইলেরও বেশি দক্ষিণ-পূর্বে। দ্বীপটি নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টানা-হেঁচড়া বেশি হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে দ্বীপটির স্বাধীনতা রক্ষা পায়। সবাই মেনে নেয় দ্বীপটি নিরপেক্ষ থাকবে এবং কেউ কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। দ্বীপটিতে সেনাবাহিনী নেই। আনুষ্ঠানিক কোনো পুলিশ বাহিনীও নেই। স্থানীয়ভাবে তৈরি ক্যুনিটি পুলিশ শান্তি রক্ষা ও সামাজিক সাহায্য-সহযোগিতার কাজ করে। আঞ্চলিক কমুনিটি পুলিশের প্রতিনিধি নিয়ে পাঁচ হাজার সদস্যের একটা কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। এই বাহিনীর একশ করে সদস্য দ্বীপের ১৫টি প্রশাসনিক জোনের প্রশাসনিক কেন্দ্রে মোতায়েন রয়েছে। আর পাঁচশ করে সদস্য রয়েছে দ্বীপের দুই প্রবেশ পথের বন্দর এলাকায়। অবশিষ্ট আড়াই হাজার সদস্য রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে মোতায়েন রয়েছে দ্বীপের রাজধানী কাবার্বা ক্যাসলে। রাজধানীর এই কাবার্বা ক্যাসলের নাম মূলত ছিল খায়ের উদ্দিন বার্বারোসা ক্যাসল। কালক্রমে তা পরিবর্তিত হয়ে রূপ নিয়েছে কাবাবা ক্যাসলে। রত্ন দ্বীপ রাষ্ট্রে রূপ নেবার পর এই কাবার্বা ক্যাসল রাজধানী হয়েছে। আজ এই দ্বীপ রাষ্ট্র সব ধর্মের লোকদের আবাসভূমি। সব ধর্মের প্রতিনিধিদের থেকে নির্বাচিত একটা গণতান্ত্রিক সরকার দ্বীপের শাসনকাজ পরিচালনা করে।
চারজন যারা সিনাগগে প্রবেশ করেছিল, তাদের মধ্য থেকে একজন একজন করে দেড় মিনিটের মধ্যেই সিনাগগ থেকে বেরিয়ে এসে ছুটে গিয়ে গাড়িতে চড়ল। তারা গাড়িতে ওঠার সংগে সংগেই গাড়ি ছুটতে শুরু করল।
মাত্র তিন মিনিট। গাড়িটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে। এরপরই সিনাগগে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো। ভোরের নীরবতা খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল। সিনাগগের কয়েকটা অংশ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে গেল। পুরনো সিনাগগের কয়েকটা অংশ সম্প্রতি পুনর্নির্মিত হয়েছে। অন্যান্য অংশ রিপেয়ার করে সুন্দর রূপ দেয়া হয়েছে। বিস্ফোরণে পুনর্নির্মিত অংশগুলো ধ্বংস হয়ে গেল। সিনাগগের কয়েকজন কর্মচারী ও সিনাগগের পুরোহিত। রাব্বি বারুস বেনইয়ামিন বেরিয়ে এসেছে তাদের বাড়ি থেকে। সিনাগগের অল্প কয়েকশ গজ দূরেই তাদের বাড়ি। বেরিয়ে এসে তারা চিৎকার এবং হৈচৈ শুরু করেছে।
আশেপাশের এলাকা থেকে আরও লোক ছুটে এল। ছুটে এলো কমুনিটি পুলিশরাও। কয়েক মিনিটের মধ্যে দমকলও এসে হাজির হলো। চারদিকে চেঁচামেচি হৈচৈ।
কম্যুনিটি পুলিশ চেষ্টা করতে লাগল দুর্ঘটনার মূল স্থান থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে, যাতে কোনো আলামত থাকলে তা নষ্ট না হয়ে যায়। ক্যুনিটি পুলিশরা আশপাশ এবং দগ্ধবিশিষ্ট জিনিসপত্রের মধ্যে আঁতিপাতি করে প্রয়োজনীয় আলামতকে খুঁজতে লাগলো। এ
অল্পক্ষণের মধ্যে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের লোকরাও এসে গেল। সাংবাদিকদের ছুটাছুটি ও তাদের ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে নতুন দৃশ্যের অবতারণা হলো। তারা কথা বলতে লাগলো বিভিন্ন জনের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে।
এই দিনই রত্ন দ্বীপের বিভিন্ন পত্রিকার মর্নিং এডিসনে সিনাগগে নাশকতার ঘটনা ও ছবি নিয়ে বিস্তারিত খবর বেরুল। রত্ন দ্বীপ ছোট-একটা ভূখণ্ড হলেও, সেখানে অনেকগুলো দৈনিক রয়েছে। স্প্যানিশ, আরবি, ইংরেজি, ইতালীয়, গ্রিস ভাষার দৈনিকগুলোর ভালো কাটতি আছে দ্বীপে। এদের মধ্যে স্প্যানিশ, আরবি ও ইংরেজি ভাষার দৈনিক বেশি জনপ্রিয়। সাকুলেশনের দিক দিয়ে আরবি দৈনিক রয়েছে সবার উপরে। কিন্তু দ্বীপের এলিট ও রাজনৈতিক মহলের মধ্যে ইংরেজি দৈনিক বেশি চলে।
ইংরেজি দৈনিক রত্ন দ্বীপ টাইমস সিনাগগের এই ঘটনার খবর নিয়ে লিখেছে :
আজ সূর্যোদয়ের ঘণ্টাখানেক আগে দ্বীপের আরাগন এলাকার একটা সিনাগগে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে সিনাগগের একটা বড় অংশ সম্পূর্ণ ধ্বসে গেছে। এই ঘটনায় মানুষের মধ্যে ভয়, বিস্ময় এবং তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
রাজধানী কাবাবা ক্যাসল থেকে যে হাইওয়েটা লেক ফরচুনের চারদিক ঘিরে তৈরি রিং রোডে গিয়ে পড়েছে, সেই হাইওয়ের একটা শাখা পশ্চিমে এগিয়ে আরাগন অঞ্চলের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। এই সড়কের ধারেই সিনাগগটি। সিনাগগটি শত বছরেরও বেশি পুরনো। সম্প্রতি এর সংস্কার হয়েছে। ভেঙে পড়া অংশটি আগের আদলেই নির্মাণ করা হয়েছিল। বিস্ফোরণে সেই অংশটিও ধ্বসে পড়েছে। সিনাগগের পুরোহিত রাব্বি রারুস বেনইয়ামিন জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের পর প্রার্থনাগৃহটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কিভাবে ঘটল, কারা ঘটিয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, এ ঘটনায় তিনি হতবাক হয়েছেন। তার কল্পনারও বাইরে এমন ঘটনার বিষয়টি। এই ঘটনা ঘটাতে পারে এমন কেউ আমার সন্দেহের মধ্যেও নেই। অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাপ্টেন জানিয়েছেন, ঘটনা। হিসাবে খুবই নতুন এটা। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে, এমন ক্রিমিনাল
আমাদের তালিকায় নেই, রত্ন দ্বীপেও নেই। তবে কারা জড়িত আমরা তা। খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি, করবো। তেমন কোনো আলামত এখনও আমাদের হাতে আসেনি। আধাপোড়া অবস্থায় একটি আরবি দৈনিকের অংশ বিশেষ পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে বোমাগুলো ঐ কাগজে মুড়িয়ে আনা হয়ে থাকতে পারে। আরবি কাগজ কোনো আলামত হতে পারে কি না? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, এ ঘটনা কারা ঘটাতে পারে তা নিয়ে কোনো চিন্তা আমরা করিনি।
রত্ন দ্বীপে এটা একটা ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক ঘটনা। এ রকম ঘটনা আগে ঘটলেও তাৎপর্যপূর্ণ দুটি ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছে। ধ্বংসকারিতার দিক দিয়ে না হলেও, প্রকৃতির দিক দিয়ে তিনটি ঘটনা একই রকম। ছয় মাস আগে ঈদুল ফিতরের আগের রাতে রাজধানীতে ঈদের নামাজের জন্যে তৈরি প্যান্ডেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ঈদগাহের মেহরাবটাও ধ্বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। তার তিন মাস পরে ২৫ ডিসেম্বর বড় দিনের উৎসবের আগের রাতে রাজধানীর কেন্দ্রীয় গির্জার চত্বরে তৈরি দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ক্রিসমাস ট্রি পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলা হয়। লক্ষ্য করার বিষয় সিনাগগের ধ্বংসকাণ্ডে ব্যবহৃত বোমার মোড়ক হিসাবে যেমন আরবি কাগজ পাওয়া যায়, তেমনি ঈদগাহের ধ্বংসের স্থানে পাওয়া যায় কারও গলা থেকে ছিঁড়ে পড়া একটা ক্রস এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া ক্রিসমাস ট্রির স্থানের একটু দূরে ফুলগাছের ঝোপে পাওয়া যায় একটা দীর্ঘ ফলার ছুরি- যা দিয়ে কাটা হয়েছে ক্রিসমাস ট্রিকে। ছুরির গোড়ায় আল্লাহু আকবার শব্দ লেখা। এই তিনটি ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, তারা চিহ্নিত ও গ্রেফতার হয়েছে বলে এখনো জানা যায়নি। কিন্তু তিনটি ঘটনার মাধ্যমে রত্ন দ্বীপের প্রধান তিন কম্যুনিটির মধ্যে অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি এবং রত্ন দ্বীপের শান্তি-শৃঙ্খলা ও শাসনব্যবস্থা ধ্বংসেরই যেন চেষ্টা করা হয়েছে। দ্বীপের চিন্তাশীল মহল এই কথাই বলছেন। তবে সবগুলো ঘটনার তদন্ত সম্পূর্ণ হলেই জানা যাবে ঘটনাগুলোর পেছনে কি রয়েছে এবং কতটা গভীর ঘটনাগুলো।
সন্ত্রাসী এই ঘটনাগুলো মানুষের মধ্যে নিদারুণ উদ্বেগ ছড়িয়ে দিয়েছে। শত বছর আগে দ্বীপে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর শান্তির নিলয় হয়ে উঠেছিল রত্ন দ্বীপ। এখন মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদিরা পরম সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করছে। দ্বীপের ২ লাখ জনসংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগ মানে দেড় লাখ মুসলমান, অবশিষ্ট জনসংখ্যার ৪০ হাজার খ্রিস্টান এবং দশ হাজার ইহুদি। সংখ্যাধিক্যের কারণে মুসলমানরা কতৃত্বের ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পেলেও সেখানে আধিপত্যের নাম গন্ধও নেই। মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ভাগ করে নেয়া হয়েছে। পার্লামেন্টে তিন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার হলেও প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারেন না, বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া তিনি মন্ত্রীদেরও বরখাস্ত করতে পারেন না। দ্বীপের সরকারে। প্রেসিডেন্ট মুসলিম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খ্রিস্টান এবং অর্থমন্ত্রী ইহুদি। এই ব্যবস্থার অধীনে অখণ্ড শান্তির মধ্যে বাস করছে রত্ন দ্বীপের মানুষ। এখানে ছোট ছোট ক্রাইম সংঘটিত হয়, কিন্তু কোনো সন্ত্রাসের ঘটনা গত একশ বছরে ঘটেনি। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, মানুষ তা ভুলেই গিয়েছিল। সুতরাং তিনটি সন্ত্রাসী ঘটনা মানুষকে উদ্বেগাকুল করে তুলেছে।
দৈনিক রত্ন দ্বীপ টাইমস এই ব্যাপারে দ্বীপের অপরাধ বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সমাজ নেতাদের সাথে কথা বলেছে। তারা বলেছেন, সন্ত্রাসী ঘটনা তিনটি খুবই বিস্ময়কর এবং দ্বীপের সমাজ ও রাজনীতির সাথে একান্তই বেমানান। তিনটি অপরাধের সবগুলোই ব্যক্তি নয়, গ্রুপভিত্তিক অপরাধ। আর অপরাধগুলোর মধ্য দিয়ে যে মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে, সেই মানসিকতা আমাদের দ্বীপে গ্রুপভিত্তিকভাবে থাকা তো দূরের কথা, কোনো ব্যক্তির মধ্যে থাকারও কোনো প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাদের সকলের অভিমত, ঘটনাংলো নিয়ে ব্যাপক ও গভীর তদন্ত প্রয়োজন। ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করারও কোনো সুযোগ নেই। ঘটনাগুলোই প্রমাণ করছে, ঘটনা বিভিন্ন হলেও সেসবের পেছনে একই উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সব সন্দেহ সম্ভাবনা সামনে রেখেই তদন্ত হাতে নেয়া হচ্ছে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে। আগের ঘটনাগুলোও সঠিকভাবে সামনে এগোচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন। সব তদন্ত সম্পূর্ণ হবার আগে তারা কিছু বলতে নারাজ। তবে এটুকু জানিয়েছেন যে, ঘটনাগুলো সাম্প্রদায়িক নয় বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
রত্ন দ্বীপের অন্যান্য ইংরেজি, আরবি, স্প্যানিস, ল্যাটিন ও গ্রিস ভাষার কাগজগুলো প্রায় একই ধরনের খবর প্রকাশ করেছে। তারাও ঘটনাগুলোর গোড়া বিদেশে বা বিদেশিদের মধ্যে থাকতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছে।
.
সকালেই কাবাবা ক্যাসলে মন্ত্রীসভার বৈঠক বসেছে।
রত্ন দ্বীপের প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট মন্ত্রীসভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনিই দেশের নির্বাহী প্রধান। প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ রত্ন দ্বীপের সংবিধানে নেই। সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্টের পরেই মর্যাদার দিক দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্থান। এরপর রয়েছে অর্থমন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রয়েছে চতুর্থ স্থানে। প্রেসিডেন্ট ও পররষ্ট্রমন্ত্রীর পদ মুসলিম কম্যুনিটির জন্যে নির্দিষ্ট। খ্রিস্টান ক্যুনিটির জন্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইহুদি ক্যুনিটির জন্যে অর্থমন্ত্রীর পদ বরাদ্দ রয়েছে সংবিধানে। অবশিষ্ট ৭জন মন্ত্রীর মধ্যে ৪জন প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য মন্ত্রীর মতো সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়। এই চারজনের মধ্যে দুজন মুসলিম ক্যুনিটির এবং একজন করে খ্রিস্টান ও ইহুদি কম্যুনিটির জন্যে বরাদ্দ। বাকি তিনজন মন্ত্রী নির্বাচিত হন সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নয়। এরা বাইরে থেকে মনোনীত। দ্বীপের মসজিদ সমিতি, গির্জা সমিতি ও সিনাগগ সমিতি কর্তৃক তারা মনোনীত হন। এরা মন্ত্রীসভায় স্ব স্ব ক্যুনিটির ধর্মমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বীপের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কিনা এবং স্ব স্ব ক্যুনিটিতে নিজেদের ধর্মের অনুশাসন ঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করে এই ধর্মমন্ত্রীরা। মন্ত্রীসভায় সব সদস্যের একটি করে ভোট রয়েছে, শুধু প্রেসিডেন্টের দুটি ভোট, একটি প্রেসিডেন্ট হিসাবে, অন্যটি মন্ত্রীসভার সভাপতি হিসাবে। প্রেসিডেন্ট মন্ত্রীসভায় গরহাজির থাকলে যিনি মন্ত্রী সভায় সভাপতিত্ব করবেন, তিনিই দুই ভোটের মালিক হবেন। মজার ব্যাপার হলো ছোট দ্বীপটিতে কোনো আমলাতন্ত্র নেই। নির্বাচিত প্রত্যেক সংসদ সদস্যের জন্য তার নির্দিষ্ট এলাকায় একটি করে সরকারি অফিস রয়েছে। ওই অফিস থেকেই এলাকার উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করা হয়। নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং তার এলাকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্ত ব্যক্তি মানে তার প্রতিপক্ষ একসাথে মিলে অফিসের যাবতীয় কাজ। পরিচালনা করেন। নিরাপত্তা, উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের সহায়তা করে। এরা আঞ্চলিক অফিস কর্তৃক নিয়োগকৃত এবং এলাকার মানুষের অর্থে এদের ভাতার ব্যবস্থা হয়। কেন্দ্রীয় অর্থবিভাগ সবকিছুর সমন্বয় করে। সংসদ সদস্যরা পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে স্ব স্ব কম্যুনিটির ভোটে নির্বাচিত হয়। সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক ক্যুনিটি তাদের সংখ্যার, প্রতি পাঁচ হাজারে একজন অনুপাতে সংসদ সদস্য পায়। তবে সংখ্যা যাই হোক, প্রত্যেক কম্যুনিটি কমপক্ষে দশ জন সংসদ সদস্য পাবে। এই হিসাবে বর্তমান পার্লামেন্টে ৪০ জনের জায়গায় সংসদ সদস্য ৫০জন। মুসলিমরা তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে পেয়েছে ৩০জন সদস্য। আর খ্রিস্টান ও ইহুদিরা যথাক্রমে ৮ ও ২জনের স্থলে পেয়েছে ১০জন করে। সুতরাং রত্ন। দ্বীপে একজন সংসদ সদস্য যেমন জনপ্রতিনিধি, তেমনি তার দশ বছর মেয়াদকালীন সময়ের জন্যে এলাকার প্রশাসকও। আর মন্ত্রীরা তাদের স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের অধীন কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যদের গার্ডিয়ান ও গাউড। দেশের প্রধান নির্বাহী প্রেসিডেন্টের অধীনে মন্ত্রীসভা দ্বীপে সুশাসন ও শান্তি নিশ্চিত করে থাকে। ধর্ম-মত নির্বিশেষে মানুষ একে অপরের ভাই হিসাবে শান্তিতে বসবাস করে। দ্বীপের সব সক্ষম হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করা হয়েছে, সক্ষম, শিক্ষিতের কোন বেকারত্ব দ্বীপে নেই। অক্ষম অসহায়দের দ্বীপ সরকার ও জনগণ মর্যাদার সাথে পুনরবাসিত করেছে। মিনিমাম চাহিদা নিয়ে কোনো অভিযোগ কারও নেই।
শান্তির এই দ্বীপে আজ হঠাৎ করে এসব কি ঘটছে? কেন ঘটছে? কারা ঘটাচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধানেই আজকের এই মন্ত্রীসভার বৈঠক।
ঘড়িতে মিনিট ও সেকেন্ডের কাঁটা ১২ টা এবং ঘন্টার কাঁটা ১০ টা স্পর্শ করতেই রত্ন দ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল করিম হিশাম মন্ত্রীসভায় সভাপতির আসনে এসে বসল।
মন্ত্রীসভার অন্য দশজন আগেই এসে তাদের স্ব স্ব আসন নিয়েছে। প্রেসিডেন্টের সামনে ডান পাশে পাঁচজন মন্ত্রী, বাম পাশে পাঁচ জন।
প্রেসিডেন্টের ডান পাশের সারির প্রথমে বসেছে হোম মিনিস্টার ক্রিস কনস্টানটিনোস এবং বাম পাশের সারির প্রথমে বসেছে অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিনো। অন্য আটজন ৪জন করে দুপাশে বসেছে।
প্রেসিডেন্ট আবদুল করিম হিশাম বসে সবার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মন্ত্রীসভার কাজ শুরু করল। প্রেসিডেন্ট আল্লাহর ওপর হামদ-ছানা পাঠ করে, রাসূল স.-এর উপর দরূদ পড়ে বলল, আমি মন্ত্রীসভার জরুরি বৈঠকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আপনারা অবশ্যই জানেন কেন মন্ত্রীপরিষদের জরুরি এই বৈঠক। আজ আমাদের এক সিনাগগে ভয়াবহ সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। তাতে বিধ্বস্ত সিনাগগটি। বিধ্বস্ত হয়েছে শুধু সিনাগগ নয়, আহত হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রের আদর্শ, দেশের শান্তি আর জনগণের সুখ। এর আগে ঈদ উৎসবের আগের রাতে ঈদ নামাজের প্যান্ডেল পোড়ানো, মেহরাব ধ্বংস করা, ক্রিসমাস উৎসবের আগের দিন কেন্দ্রীয় ক্রিসমাস ট্রি কেটে নষ্ট করে ফেলা একই ধরনের ঘটনা এবং একই মানসিকতা থেকে সৃষ্ট। এসব ঘটনা শুধু মানুষকে ভীত করেনি, তাদের মনে প্রশ্নেরও সৃষ্টি হয়েছে। আগের দুটি ঘটনায় দায়ী ক্রিমিনালরা ধরা পড়েনি। যা নিয়ে মানুষের মনে বিভ্রান্তি, সন্দেহ, অবিশ্বাস সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। সকলেই আমরা জানি এ নিয়ে গোপন প্রচার পত্রের মাধ্যমে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের একে অপরের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সকলেই আমরা জানি আজকের ঘটনাসহ ঐসব ঘটনা এবং গোপন প্রচারণা ষড়যন্ত্রকারীদের, যারা রত্ন দ্বীপের শান্তি, সমৃদ্ধি, সহাবস্থান বিনষ্ট করতে চায়। কিন্তু তারা কারা, কি তাদের উদ্দেশ্য তা জনগণকে জানাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এই ব্যর্থতা ষড়যন্ত্রকারীদের প্রপাগান্ডাকেই মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে। যা এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
আজকের ঘটনা এই উদ্বেগকে আরও ভয়ংকর করে তুলবে, যদি আমরা। ক্রিমিনালদের দিনের আলোতে আনতে ব্যর্থ হই, তাদের ষড়যন্ত্রের কাহিনী আমরা জনগণের কাছে প্রকাশ করে দিতে না পারি। এই পরিস্থিতি সামনে রেখেই আমি মন্ত্রীসভার এই জরুরি বৈঠক আহবান করেছি। সবার কথা আমি শুনতে চাই। ব্যর্থতা থেকে মুক্ত হবার একটা পথ আমাদের অবশ্যই বের করতে হবে। এই কথাগুলোর সাথে আমি মন্ত্রীসভার আলোচনার উদ্বোধন ঘোষণা করছি। থামল প্রেসিডেন্ট আবদুল করিম হিশাম।
সামনের গ্লাস থেকে একটু পানি পান করে আবার সোজা হয়ে বসল প্রেসিডেন্ট। মুখ তুলে চাইল সবার দিকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস একটু নড়ে-চড়ে বসে সামনের কাগজগুলো একটু ঠিক করে নিয়ে বলল, মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আপনি আপনার উদ্বোধনী বক্তব্যে এ সময়ের জন্য জরুরি সব কথাই সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি যথার্থই বলেছেন মাননীয়। প্রেসিডেন্ট যে, আজ মারাত্মক ঘটনার সাথে জড়িত ক্রিমিনালদের যদি ধরতে আমরা ব্যর্থ হই, ষড়যন্ত্রটা কি তা যদি জনগণের সামনে তুলে ধরতে না পারি, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে! দ্বীপের শান্ত পরিবেশ ও শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যে সম্প্রদায়গত অবিশ্বাস সৃষ্টি হতে পারে, অবিশ্বাস এক সময় হানাহানিতেও রূপ নিতে পারে। সুতরাং আজকে যা ঘটেছে, তাকে আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ক্রিমিনালদের পাকড়াও করতেই হবে। তাদের ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করতেই হবে। একটু থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিম কনস্টানটিনোস। টেবিলের কাগজ পত্রের দিকে একটু চোখ বুলাল। বলল প্রেসিডেন্টের দিকে মুখ তুলে, মাননীয় প্রেসিডেন্ট, কমিনিট আগ পর্যন্ত আমার কাছে গোয়েন্দা ও অন্যান্য সূত্রে। থেকে কিছু তথ্য এসেছে, তাতে সামনে এগোবার কোনো কু আমাদের হাতে আসেনি। যা আলামত আমাদের হাতে এসেছে তা হচ্ছে, একটি চারপাতার। আরবি দৈনিক পত্রিকার অংশবিশেষ- যা দিয়ে বোমার
মোড়ক ধাঁধা হয়েছিল, সাথে পত্রিকাটির ভেতরে একটি ইসলামি সংস্থার প্রচারপত্র, চারজন লোকের জুতার ছাপ এবং সন্ত্রাসীদের গাড়ির চাকার ছাপ। আলামতগুলো পাবার সাথে সাথেই দ্রুত তথ্য যোগাড়ে লেগে যায় আমাদের সংস্থাগুলো। গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলামতের ব্যাপারে প্রাথমিক কিছু তথ্য তারা যোগাড়ও করেছে। আরবি দৈনিকটি দ্বীপের নর্থ পোর্ট-এর পশ্চিমে আথিনা উপত্যকা এলাকায় বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু পত্রিকার ভেতরে ইসলামি সংস্থার যে প্রচারপত্র পাওয়া গেছে, সেটা পত্রিকার মাধ্যমে বিলি করা হয়নি। চাকার দাগ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সন্ত্রাসীদের ক্যারিয়ারটা ছিল একটা মিনিমাইক্রো। চার চাকার একটা পুরাতন, অবশিষ্ট তিনটি চাকাই। একেবারে নতুন এবং চাকাগুলো টয়োটা কোম্পানির। চাকাগুলো কারা, কোন্ দোকান থেকে কিনেছে, তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। ক্রিমিনালদের ফিংগার প্রিন্ট পাবার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। মনে করা হয়েছিল মোড়কের
কাগজে মোড়কারীর আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে। কিন্তু মোড়ককারীর আঙুলের ছাপ কাগজে পাওয়া যায়নি। সম্ভবত তাদের হাতে গ্লাভস পরা ছিল। সব মিলিয়ে এসব থেকে সন্ত্রাসী কারা তার প্রত্যক্ষ আলামত পাওয়া। কঠিন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের কথার মাঝখানেই অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিনো বলে উঠল, স্যরি টু ইন্টারূপট মি. কনস্টানটিনোস। আচ্ছা, টায়ার ক্রেতার সন্ধান পাওয়া গেলে কি ক্রিমিনাল চিহ্নিত হবে?
ওটা একটা সম্ভাবন মাত্র। নিশ্চিত কিছু নয়। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
বোমার মোড়ক মানে আরবি পত্রিকাটির মধ্যে একটা ইসলামি সংস্থার প্রচারপত্র পাওয়ার আর র্তৈ গুরুত্ব থাকছে না। ওটা নিজেদের আড়াল করার জন্যে একটা ক্যামোফ্লেজ চক্রান্তকারীদের। তার মানে এ ঘটনায় কোনো আলামত আমরা পাচ্ছি না। অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিনো বলল।
আপাতত এটাই ঠিক মি. আরমিনো। তবে এই ঘটনা থেকে একটা বিষয় সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এই ঘটনাগুলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটানো হচ্ছে দ্বীপের শান্তি এবং আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্যে। বলল ক্রিস কনস্টানটিনোস।
এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে সামনে আসার পর উদ্বেগ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে মি. ক্রিস কনস্টানটিনোস। এ ধরনের ঘটনা কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের অপরাধমূলক কিছু হলে ভয়ের তেমন কিছু ছিল না। অপরাধীদের পাকড়াও করে এর সমাধান করা যেত। দ্বীপের শান্তি ও মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্যে হওয়ায় ঘটনাগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো বড় চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র এর পেছনে রয়েছে এবং সেটা হলো সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বিষ ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ, হানাহানির সৃষ্টি করা। তাতে আমাদের শান্ত দ্বীপটি অশান্তির আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে, ভেঙে পড়বে দ্বীপের শত বছরের পুরনো রাষ্ট্র-কাঠামো। এ ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্যে ষড়যন্ত্রের মূলোচ্ছেদ ঘটানোর মাধ্যমে জনগণকে সব জানিয়ে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। বলল প্রেসিডেন্ট আবদুল করিম হিশাম।
মাননীয় প্রেসিডেন্টের আশঙ্কার সাথে আমরা একমত। ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ পেলে এই অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। তবে, মাননীয় প্রেসিডেন্ট, রত্ন। দ্বীপের মানুষের ঐক্য, সমঝোতা,সম্প্রীতি ভংগুর নয় বলে আমি মনে করি। বহু বছরের সমঝোতা, বহু বছরের আস্থা, বিশ্বাস ও পারস্পরিক নিরাপদ নির্ভরতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মানুষের ঐক্যের ভিত্তি এতই মজবুত যে, এমন উটকো ঘটনা তার ক্ষতি করতে পারবে না। মানুষের আস্থা, বিশ্বাস নড়বড়ে হয়, অভিযোগ দানা বেঁধে ওঠে বঞ্চনার বেদনা থেকে, বঞ্চিত হবার জ্বালা থেকে। আমাদের রত্ন দ্বীপের কোনো গ্রুপ, কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে বঞ্চনা, বেদনা সৃষ্টি হবার কোনো সুযোগ নেই। সাধারণত দেখা যায় সংখ্যাগুরুর দ্বারা সংখ্যালঘিষ্ঠরা নানাভাবে নির্যাতিত, বঞ্চিতই হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে থাকে। কিন্তু আমাদের রত্ন দ্বীপ সবার থেকে ব্যতিক্রম। দ্বীপের চার ভাগের তিন ভাগ। মানুষ মুসলিম। আমাদের সংবিধান তাদের দিয়েছে মাত্র তিরিশজন সংসদ সদস্য, মন্ত্রীসভায় প্রেসিডেন্টসহ ৫জন সদস্য। আর খ্রিস্টানরা জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের একভাগ হওয়া সত্ত্বেও সংবিধান তাদের দিয়েছে ১০টি সংসদ সদস্য ও তিনটি মন্ত্রীর পদ। অন্য দিকে জনসংখ্যার বিশভাগের এক ভাগ হয়েও ইহুদিদের জন্য সংবিধান দশজন সংসদ সদস্য ও তিনজন মন্ত্রী দিয়েছে। এভাবে সব ক্ষেত্রেই দেশের সংবিধান সংখ্যালঘুদেরকে তাদের চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছে। সংসদে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দশজন সদস্য বেশি রয়েছে, কিন্তু দেশের নির্বাহী পরিষদ মন্ত্রীসভায় সংখ্যালঘুরা সংখ্যাধিক্য পেয়েছে। সংবিধান এই ব্যবস্থা করেছে • এজন্যে যে, সম্প্রদায়গত বিভেদ-বৈষম্যের অনুভূতি যাতে সৃষ্টি হতেই না পারে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। আমাদের দ্বীপ রাষ্ট্রটি সব মানুষের ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতি, সহযোগিতার রত্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ষড়যন্ত্রের কালো হাত এই বন্ধনকে ভাঙতে পারা অবশ্যই সহজ নয় মাননীয় প্রেসিডেন্ট। ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস যা বলেছেন আমিও তার সাথে একমত। বিগত তিনটি ঘটনা দ্বারা ষড়যন্ত্রকারীরা লোকদের যতটা বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল, মানুষের মধ্যে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, সেরকম কিছু বাস্তবে ঘটেনি। জিহোবা আমাদের সহায় হবেন। সব ষড়যন্ত্রের আমরা মূলোচ্ছেদ করতে পারবো মাননীয় প্রেসিডেন্ট। বলল অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিনো।
আপনাদের কথা সত্য হোক। আল্লাহ রাব্বল আলামিন আপনাদের কথা কবুল করুন।
একটু থামল প্রেসিডেন্ট। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল প্রেসিডেন্ট মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি তিন সম্প্রদায়ের ধর্মনেতাদের মনোনীত তিন-ধর্মমন্ত্রী, ড. শাইখ ইউসেফ ইয়াসিন আল আজহারী, ফাদার স্টিভেন অ্যানজেলোস এবং রাব্বি ড্যান দানিয়েলের দিকে। বলল তাদের লক্ষ্য করে, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের চিন্তা-ভাবনা আপনাদের বেশি জানার কথা। আপনাদের মন্তব্য আমাদের সবাইকে সাহায্য করতে পারে।
প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হলে মুসলিম ক্যুনিটি থেকে ধর্মমন্ত্রী এবং রত্ন দ্বীপের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব ড. শাইখ ইউসেফ ইয়াসিন বলল, মান নীয় প্রেসিডেন্ট, সাধারণ যে প্রতিক্রিয়া আমি লক্ষ্য করে আসছি, তা মোটামুটি একই রকম। তারা বিশ্বাস করছে না যে ঘটনাগুলো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে হয়েছে। কিন্তু তারা বিস্মিত, কি করে তাহলে ঘটছে ঘটনাগুলো! আজ ফজরের নামাজের পর একটা সমাবেশ ছিল। সমাবেশ চলাকালীন খবরটি সেখানে পৌঁছে। উদ্বিগ্ন, বিস্মিত মানুষের মুখে একই রকম প্রশ্ন, এসব কারা করছে? কেন করছে? তারা ধরা পড়ছে না কেন? ঘটনার ভয়াবহতা তো ক্রমশ ঘটছেই। অপরাধীদের ধরতে সরকারের চেষ্টা যথেষ্ট হচ্ছে কিনা? এসব প্রশ্নই মুখ্য। সকলেই চাচ্ছে আশু এই অপরাধের সমাপ্তি ঘটুক। থামল মুসলিম ধর্মমন্ত্রী।
প্রেসিডেন্ট শাইখ ইউসেফ ইয়াসিনকে ধন্যবাদ দিয়ে তাকাল খ্রিস্টান ধর্মমন্ত্রী ফাদার স্টিভেন অ্যানজেলোস এবং ইহুদী ধর্মমন্ত্রী রাব্বি ড্যান দানিয়েলের দিকে।
নড়ে-চড়ে বসল ফাদার স্টিভেন অ্যানজেলোস। বলল, এক্সেলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, ভাই শাইখ ইউসেফ ইয়াসিন যা বলেছেন তার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। সম্প্রদায় নির্বিশেষে এই প্রশ্নগুলোই সব মানুষের মধ্যে।
আমি তার সাথে একটা কথাই যোগ করব। সেটা হলো, আজকের ঘটনায়। মানুষের মধ্যে ভীতিও ছড়িয়ে পড়েছে। অপরাধীদের পাকড়াও করতে সরকার পারছে না, এই চিন্তাই মানুষের মধ্যে যেন বড় হয়ে উঠছে।
ফাদার স্টিভেন অ্যানজেলোস থামতেই ইহুদি ধর্মমন্ত্রী রাব্বি ড্যান দানিয়েল সোজা হয়ে বসল। বলল, আমার সহযোগী দুই মাননীয় মন্ত্রী যা বলেছেন, সেটাই আমাদের জনমনের প্রকৃত চিত্র। বিস্ময়, উদ্বেগ, ভয় মানুষের মধ্যে বাড়ছে। তাদের বাইরে নতুন কোনো কথা আমার কাছে নেই। তবে আমার ভয় হচ্ছে, মাননীয় প্রেসিডেন্ট একটু আগেই যা বললেন, অপরাধীরা খুব তাড়াতাড়ি ধরা না পড়ে, মানুষকে যদি সত্যটা জানানো না যায়, তাহলে ভয়, ব্যর্থতা থেকে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস দেখা দিতে পারে। সেটা হবে খুবই ভয়ের কথা। থামল রাব্বি ভ্যান দানিয়েল।
প্রেসিডেন্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, আমাদের তিনজন ধর্মমন্ত্রীর কথায় যা প্রকাশ পেল তা হলো, আমাদের প্রাথমিক বিস্ময় এখন। উদ্বেগের মধ্য দিয়ে, ভয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। অপরাধীদের পাকড়াও করে যদি আমরা ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করতে না পারি, তাহলে আমাদের জনগণের এই ভয় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থায় রূপান্তরিত হবে, যা এক পর্যায়ে পারস্পরিক অনৈক্য, সংঘাতে রূপ নিতে পারে এবং শত্রুরা এটাই
প্রেসিডেন্ট একটু থামল। সকলের দিকে তাকাল প্রেসিডেন্ট। তার গম্ভীর মুখে ফুটে উঠল অসন্তুষ্টির একটা চিহ্ন। বলল, আমরা অপরাধীদের ধরতে পারিনি, ষড়যন্ত্রের উৎস্য উন্মোচন করতে পারিনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা। জনগণ ধৈর্য ধরেছে। জনগণ আর আমাদের সময় দেবে না। একটা সময় আমি নির্দিষ্ট করতে চাই। এই সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধানে আমরা ব্যর্থ হলে আমি পার্লামেন্টের অধিবেশন ডেকে নতুন সরকার, নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আহ্বান জানাব। জনগণ একবার সরকারের উপর আস্থাহীন হয়ে পড়লে তা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে এবং ভবিষ্যতের সরকার বিপদে পড়বে। এতে করে আমাদের প্রিয় রত্ন দ্বীপের শান্তি, স্থিতিশীলতা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি আপনাদের সুচিন্তিত মতামত চাই। থামল প্রেসিডেন্ট।
কেউ কোনো কথা বলল না প্রেসিডেন্ট থামলেও। পিনপতন নীরবতা। সবারই মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। সবার মুখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট।
নীরবতা ভাঙলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলল, আমাদের সম্মানিত মহামান্য প্রেসিডেন্ট একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। একজন দেশ ও জাতিগত প্রাণ প্রেসিডেন্ট তার উপযুক্ত মত প্রকাশ করেছেন। আসলে আমরা শাসক নই, দেশ ও জাতির সেবক। আমরা নির্বাচিত হয়েছি, দায়িত্ব পেয়েছি জনগণের কাজ করার জন্যে, জনগণকে সুখে শান্তিতে রাখার জন্যে, দেশে শৃঙ্খলা ও নির্ভয় পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্যে। আমরা যদি তা করতে না পারি, তাহলে দায়িত্ব আমাদের ছেড়ে দেয়া উচিত। আমাদের প্রেসিডেন্ট এই কথাই বলেছেন। তবে মহামান্য প্রেসিডেন্ট আমি মনে করি, আমাদের প্রেসিডেন্ট ও সরকারের জন্যে সেই সময় এখনও আসেনি। আমরা ব্যর্থ হয়েছি, আমাদের জনগণও তা মনে করে না। তিন ধর্মমন্ত্রীর কথা থেকেও এটা পরিষ্কার হয়েছে। তিনটি ঘটনার মধ্যে আজকের ঘটনাই বড় এবং এই ঘটনার মধ্য দিয়েই ষড়যন্ত্রের বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। আগের দুটি ঘটনা বড় কিছু নয়। ঘটনা দুটির পেছনের ক্রিমিনাল ধরা পড়েনি বটে, কিন্তু আমরা সব অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক হয়েছি। এরপর কোনো অনুষ্ঠানে ঐ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি। আজকের সন্ত্রাসী ঘটনা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের এবং ধ্বংসাত্মক ঘটনা। এই ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। এখন অন্য কোনো চিন্তা না করে এই তদন্তকে সফল করে তোলা দরকার। মহামান্য প্রেসিডেন্টের সাথে আমি একমত যে, তদন্তের জন্যে একটা সময় সীমা নির্দিষ্ট করা দরকার এবং জনগণের অবগতির জন্যে তা ঘোষণাও করা উচিত।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের কথা শেষ হবার সাথে সাথে অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিনো বলে উঠল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। আমরা ব্যর্থ হয়েছি, একথা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে মাননীয় প্রেসিডেন্ট যা বলেছেন, তদন্তের সময়সীমা নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তাতে তদন্তের গতি ও গভীরতা দুই বাড়বে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের বড় ঘটনা তদন্তের অভিজ্ঞতা আমাদের লোকদে কম আছে। শু; তাদের দিয়ে এ কাজ কতটা সম্ভব হবে, সেটা নিয়েও আমাদের ভাবা দরকার এখনই। মাননীয় প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে কিছু বললে…।
অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিনোর কথার মধ্যেই উঠে দাঁড়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস। তার অয়্যারলেস তার কান পর্যন্ত উঠানো। বলল সে
প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে, মহামান্য প্রেসিডেন্ট জরুরি কল এসেছে।
কথা বলে আসুন মি. কনস্টানটিনোস। আমরা অপেক্ষা করছি। বলল প্রেসিডেন্ট।
পাঁচ মিনিট পরেই মিটিং কক্ষে এলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কনস্টাটিনোস। ধীর পদক্ষেপে এলো সে ঘরে। জড়তা যেন তার দুই পাকে জড়িয়ে ধরেছে। বসল তার সিটে। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
সবার দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। তাদেরও চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। বসেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল, খুব বড় দুঃসংবাদ মি. প্রেসিডেন্ট। আমার মেয়ে জোনা ডেসপিনা কিডন্যাপড় হয়েছিল। কিডন্যাপড হওয়া ডেসপিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে মাননীয় প্রেসিডেন্টের ছেলে হামযা আনাস আমিন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ডিন্যাপারদের গাড়ি আটকাতে গিয়ে একজন ক্যাপটেনসহ চারজন সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্য নিহত হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শান্ত, ভারি কণ্ঠ একটা দম নিল।
প্রেসিডেন্ট শান্তভাবে শুনছিল। মন্ত্রীসভার অন্য সবার চোখে-মুখে প্রচণ্ড উদ্বেগ।
তারপর মি. কনস্টানটিনোস? জিজ্ঞাসা প্রেসিডেন্টের। শান্ত কণ্ঠ তার।
সিকিউরিটির লোকরা যখন কিডন্যাপারদের বাধা দেয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি মেয়ে ডেসপিনাকে উদ্ধারে এগিয়ে যায়। কিডন্যাপাররা কে আহত করে এবং ধরে নিয়ে যায়। এক নম্বর সার্কুলার রোড ধরে ওরা পোর্টের দিকে পালিয়ে যায়। পরবর্তী খবর হলো মহামান্য প্রেসিডেন্টের পারিবারিক মেহমান জনাব আহমদ মুসা বিমান বন্দর থেকে ঐ রাস্তা হয়ে ফিরছিলেন। তিনি মেয়েদের চিৎকার শুনতে পান। তার গাড়ি দিয়ে তিনি কিডন্যাপারদের গতিরোধ করে ওদের চ্যালেঞ্জ করেন। রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষে ৬ জন কিডন্যাপারদের সকলেই মারা যায়। আমার মেয়ে ডেসপিনাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ মেয়েটির আর কোনো ক্ষতি ছাড়াই উদ্ধার হয়েছে। সন্ত্রাসীদের গাড়িটাও আমাদের সিকিউরিটি ফোর্সের হাতে এখন।
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তায়ালার হাজার শোকরিয়া তিনি আমাদেরকে আরও বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছেন। একটু থামল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট থামতেই মন্ত্রীপরিষদ সদস্যরা কেউ আল্লাহকে, কেউ জিহ্বাকে, কেউ ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল।
অতিথি আহমদ মুসা কি একা ছিলেন? ধন্যবাদ দেয়া শেষ করেই বলল অর্থমন্ত্রী বেন নাহান।
হ্যাঁ, একাই গাড়িতে করে ফিরছিলেন। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কাটিনোস।
___ একাই ফেরার কথা। তিনি তার পরিবারকে বিমানে তুলে দিতে গিয়েছলেন। একটা সিকিউরিটি গাড়ি আমি সাথে দিতে চেয়েছিলাম। তিনি পছন্দ করেননি। তার একা ফেরার পথে একজন সিকিউরিটি অফিসারকে বিমান বন্দর থেকে সাথে আসার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম। তাতেও রাজি হননি তিনি। বলল প্রেসিডেন্ট।
মজার লোক তো! মানুষ সিকিউরিটি সাথে পেলে খুশি হয়। আর তিনি নিতেই চাননি। বলল অর্থমন্ত্রী বেন নাহান।
মজার চেয়ে অনেক বড় বিস্ময়ের হলো, যেখানে আমাদের চারজন সিকিউরিটি কিডন্যাপারদের বাধা দিয়ে আটকাতে পারেনি, সেখানে তিনি একা ওদের বাধা দিয়ে ৬ জনকে হত্যা করে আমাদের মেয়েদের উদ্ধার করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি সিকিউরিটি ফোর্সকে টেলিফোন করে সেখানে ডেকে নিহত কিডন্যাপারদের এবং গাড়ি সার্চের বিভিন্ন ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন এবং গাড়ি ও নিহতদের তাদের হাওলায় দিয়ে আমাদের মেয়ে দুটিকে হাসপাতালে এনেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।? সত্যি অতিথি একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি! কে তিনি? বলল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ ঘানুসি।
হ্যাঁ, এই অবস্থায় অবশ্যই তার পরিচয় আপনারা জানতে চাইবেন এবং জানা উচিত। কিন্তু আমি বিষয়টা নিয়ে তার সাথে আলোচনা করতে চাই। তার কোনো অসুবিধা আছে কিনা তা জেনে নিতে হবে। তবে এটুকু আমি বলতে পারি যে, তিনি অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস-ষড়যন্ত্র দমনে জগৎ জোড়া তার নাম। তবে তিনি প্রফেশনাল নন, দেশ ও মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা তিনি নিজ ইচ্ছাতেই করে থাকেন। ইসলামের পরিভাষায় ফি সাবিলিল্লাহ মানে আল্লাহর জন্যে তিনি কাজ করেন। বলল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হতেই অর্থমন্ত্রী বেন নাহান লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কিছু বলতে গিয়ে প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে সংগে সংগেই বসে পড়ল। বলল, মাননীয় প্রেসিডেন্ট মাফ করবেন, মাফ করবেন আমার প্রিয় সহকর্মীরা, আমি আমার ভেতরের উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারি নি। আমি তাকে চিনতে পেরেছি। তিনি আহমদ মুসা। গোটা দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাজধানী, এমনকি হোয়াইট হাউজ এবং ক্রেমলিনের তিনি প্রিয়ভাজনই শুধু নয়, তারা তাকে সমীহ করে, সম্মান করে। এই তো কয়েক মাস আগে তিনি আমেরিকায় ছিলেন। আমেরিকাকে এই মহাসংকট থেকে বাঁচিয়েছেন। কদিন আগে তিনি ছিলেন আর্মেনিয়ায়। তিনি আর্মেনিয়াকে এক ভয়ানক ও জটিল ষড়যন্ত্র থেকে উদ্ধার করেছেন। তিনি শুধু অসাধারণ নন, বিস্ময়কর ও মিরাকল এক ব্যক্তিত্ব। মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে তার পা পড়েছে আমাদের রত্ন দ্বীপে।
বেন নাহান থামতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ ঘানুসি বলল, হ্যাঁ, খুব সম্প্রতি আমেরিকায় সন্ত্রাসীদের উদ্ভাবিত ভয়াবহ ধরনের আনবিক অস্ত্র নিয়ে মহাসংকটে পড়েছিল, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে আমি এটা শুনেছি। কদিন আগে আর্মেনিয়া একটা মহাসংকটে পড়েছিল, অতি সম্প্রতি আর্মেনিয়া সেই সংকট থেকে মুক্ত হয়েছে, সেটাও আমি জানি। কিন্তু জনাব আহমদ মুসাই সংকটগুলোর সমাধান করেছে কিনা, সেটা আমি জানি না। কোনো সূত্র থেকেই তার নাম বলা হয়নি।
আহমদ মুসার নাম প্রকাশ হওয়ার কথা নয়। তিনি নামের জন্যে কাজ করেন না। তার নাম গোপন রাখা হবে এই শর্তেই তিনি কাজ করেন। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি আমাদের এক ইহুদি সূত্র থেকে। আপনারা নিশ্চয় জানেন না, ইহুদিরা নয়, একটি ইহুদি গ্রুপ মানে জায়নবাদী গ্রুপ আহমদ মুসার ঘোরতর শত্রু। জায়নবাদীরা যেখানেই যে ষড়যন্ত্র করেছে, তার মূলোচ্ছেদ করেছে আহমদ মুসা। সুতরাং জায়নবাদী ইহুদিরা তার সব খবর রাখে। তাদের সূত্র থেকেই আহমদ মুসার এই খবরগুলো আমি জানতে পেরেছি। বলল বেন নাহান, রত্ন দ্বীপের ইহুদি অর্থমন্ত্রী।
মি. নাহান, আহমদ মুসার পরিচয় আপনি যেভাবে তুলে ধরলেন, তাতে মনে হচ্ছে আহমদ মুসা আপনার খুবই প্রিয়। কিন্তু আপনিই বললেন, আহমদ মুসা ইহুদিদের ক্ষতি করেছে সবচেয়ে বেশি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ ঘানুসি বলল।
না, তিনি ইহুদিদের শত্রু এ কথা বলিনি, তিনি ইহুদিদের কোনো ক্ষতি করেননি। জায়াদী ইহুদি গ্রুপ তাকে শত্রু বলে মনে করে। তাদেরই নানা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত আহমদ মুসা বারবার বানচাল করে দিয়েছেন। আমরা ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা তাকে খুবই ভালো জানি। সেজন্যে আহমদ মুসার ভয়ানক কিছু বিপদ ও দুঃসময়ে অনেক ইহুদি তাকে সাহায্য করেছে। বলল বেন নাহান।
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। বিশেষ করে ধন্যবাদ দিচ্ছি অর্থমন্ত্রী। বেন নাহানকে। তিনি আহমদ মুসার যে পরিচয় তুলে ধরেছেন, তা আমি জানতাম না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবের তথ্যও গুরুত্বপূর্ণ। এক হজ্জের সময় সৌদি আরবের মুহতারাম ভ্রাতৃপ্রতিম বাদশাহ আহমদ মুসার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। দিন পনের আগে সৌদি আরব থেকে আমাকে জানায় যে, আহমদ মুসা অবকাশ কাটাবার জন্যে পরিবারসহ রত্ন দ্বীপে। যাবে। আমরা তাকে আতিথ্য দিলে তারা খুশি হবেন। সেই সূত্রেই আমি তাকে আমার পারিবারিক অতিথি হিসাবে গ্রহণ করি।
একটু থামল প্রেসিডেন্ট। সোজা হয়ে বসল। বলল, আল্লাহর হাজার শোকর যে, এই সময়ে আল্লাহ তায়ালা আহমদ মুসাকে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছেন। আমরা আশা করব রত্ন দ্বীপের এই সংকটে তিনি আমাদের পাশে দাঁড়াবেন।
কিন্তু আপনিই তো বললেন, তিনি প্রফেশনাল নন। কাজ করলে নিজের ইচ্ছাতেই করেন। তিনি কি ইচ্ছা করবেন? বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
আজ তিনি আমাদের দুটি মেয়েকে বাঁচালেন। ছয়জন কিডন্যাপারকে হত্যা করলেন, এটা তো তিনি নিজ ইচ্ছাতেই করেছেন। এই শুভেচ্ছাই আমরা তার কাছে চাইব। তাছাড়া আমি শুনেছি, তিনি মজলুমদের সাহায্য করার, মানুষকে ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচাবার কোনো আহ্বানই প্রত্যাখ্যান করেন না। প্রেসিডেন্ট বলল।
আবার টেলিফোন বেজে উঠল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের অয়্যারলেস।
মাফ করবেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট বলে উঠে দাঁড়াচ্ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. কনস্টানটিনোস আপনি বসুন। এখানে বসেই কথা বলুন। মন্ত্রীসভার কাজ স্থগিত থাকবে ততক্ষণ। বলেিডন্ট।
বসল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অয়্যারলেসে কথা বলল। বলল মানে বেশির ভাগই শুনল ওপারের কথা। মাঝে মাঝে দুএকটা প্রশ্ন করল আর হু-হা করল, এই যা। সবশেষে বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তোমরা সবদিক থেকে সতর্ক থেকো, কি করা যায় আমি দেখছি।
অয়্যারলেস রেখে দিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাকাল সে প্রেসিডেন্টের দিকে। বলল, মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আরও কিছু জরুরি খবর আছে।
মুহূর্তের জন্যে থেমেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার শুরু করল, সন্ত্রাসী চক্রটি এবার কিডন্যাপ করতে এসে একটি প্রচারপত্র ফেলে যায়।
প্রচারপত্র? কিসের প্রচারপত্র? বলল বেন নাহান আরমিনো।
বিপজ্জনক প্রচারপত্র। যা বলা হয়েছে প্রচার পত্রে, তার সারাংশ হলো, রত্ন দ্বীপের মুসলিমরা শোষিত, বঞ্চিত, প্রতারিত হয়ে আসছে। দ্বীপের মোট জনসংখ্যার চারভাগের তিনভাগ হয়েও সংসদে সদস্য সংখ্যা মাত্র ৩০জন আর মন্ত্রীর সংখ্যা মাত্র ৪। আর খ্রিস্টান ও ইহুদিরা মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে ৫ ভাগের এক ভাগ এবং ২০ভাগের ১ ভাগ হয়েও সংসদে ১০জন করে সদস্য ও ৩জন করে মন্ত্রীর অধিকারী। অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ ইহুদি ও খ্রিস্টানদের দখলে। এভাবে দ্বীপের জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগের হাতে চলে গেছে সুযোগ-সুবিধার সিংহভাগ। দ্বীপের মুসলিম জনগণ এটা মানবে না। আমরা সংগ্রাম শুরু করেছি, শেষ হবে আমাদের অধিকার ফিরিয়ে আনার মধ্যে দিয়ে। এই সরকার ও সংবিধান মুসলিম জনগণের শত্রু। শত্রুদের আইন ও নিয়ন্ত্রণ আমরা মানি না। সংক্ষেপে প্রচারপত্রের সারাংশ এটাই। আরেকটা কথা ওরা জানাল, সেটা হলো…।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার মধ্যেই কথা বলে উঠলেন প্রেসিডেন্ট। তার চোখে মুখে প্রবল অস্বস্তি ও উদ্বেগের চিহ্ন। বলল, মি. কনস্টানটিনোস, ওরা কথাগুলো ঠিক ঠিক বলেছে এবং আপনি ঠিক ঠিক শুনেছেন তো?
মহামান্য প্রেসিডেন্ট, ওরা আমাকে প্রচারপত্রটি পড়ে শুনিয়েছে। আমি যা বলেছি, তাতে কোনো ভুল নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
রত্ন দ্বীপের কোনো মুসলিমের এই বক্তব্য হতে পারে না। রত্ন দ্বীপের দেড় লাখ মুসলিমের সবার মুখ আমার সামনে আছে বলা যায়। তাদের কারও পক্ষেই এমন কিছু লেখা অসম্ভব। বলল প্রেসিডেন্ট।
অসম্ভব বলেই বিষয়টা আরও বেশি শংকা ও উদ্বেগের বিষয় মাননীয় প্রেসিডেন্ট। কেমন করে অসম্ভবটা সম্ভব হলো?
সবাই নীরব। উত্তরটা হয়তো কারো জানা নেই। প্রেসিডেন্টের মুখ নিচু হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে মুখ তুলল প্রেসিডেন্ট। তার মুখ শক্ত, চোখে কঠিন দৃষ্টি। বলল, মি. কনস্টানটিনোস, আরো কি যেন বলছিলেন। আপনার কথা শেষ করুন।
হ্যাঁ, মহামান্য প্রেসিডেন্ট, বলছি। গোয়েন্দারা আমাকে জানাল, আহমদ মুসা মোবাইলে বারবার চেষ্টা করেও আপনাকে পায়নি। তিনি আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা বলতে চান।
আকস্মিক জেগে ওঠার মতো নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল প্রেসিডেন্ট। বলল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি, কনস্টানটিনোস, আপনি গোয়েন্দা প্রধানকে বলুন, আহমদ মুসাকে অনুরোধ করে এখানে নিয়ে আসতে। আমারও কিছু জরুরি কথা আছে তার সাথে।
এখনই আমি গোয়েন্দা প্রধানকে বলছি মহামান্য প্রেসিডেন্ট।
বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কনস্টানটিনোস তার অয়্যারলেসে কল করল রত্ন দ্বীপের গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিনকে। বলল সে ওসমান আবু তাসফিনকে, জনাব, আমার সামনে মহামান্য প্রেসিডেন্ট বসে আছেন। তিনি চান আপনি জনাব আহমদ মুসাকে নিয়ে আমাদের বৈঠকের এখানে আসুন। আপনি মহামান্য প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার কথা বলে তাকে অনুরোধ করুন এখানে আসার জন্যে।
ওপর থেকে গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তসফিন বলল, ও.কে স্যার, জনাব আহমদ মুসা এখানেই আছেন। তার মাছ থেকেই আমরা ব্রিফ নিচ্ছিলাম। আমি তাকে অনুরোধ করছি এবং এখনি নিয়ে আসছি স্যার।
১৫ মিনিটের মধ্যেই গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফি আহমদ মুসাকে সাথে নিয়ে এসে পৌঁছল প্রেসিডেন্সিয় ল সেক্রেটারিয়েটে।
প্রেসিডেন্টের অতিথি রুমে আহমদ মুসাকে বসিয়ে, প্রেসিডেন্টের পি. এ.-কে সেখানে থাকতে বলে গোয়েন্দা প্রধান মন্ত্রীপরিষদ কক্ষের স্বরাষ্ট্রমন্ত্র। র দিকে এগোলো। আহমদ মুসা এসেছে, সেটা আগেই জানিয়েছে গোয়েন্দা প্রধান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সংগে সংগে আহমদ মুসা এসেছেন তা জানিয়েছে প্রেসিডেন্টকে।
প্রেসিডেন্ট বলল, মি. ক্রিস কনস্টানটিনোস, আপনি নিজে গিয়ে আহমদ মুসাকে আমাদের এই সভাকক্ষে নিয়ে আসুন। যা এ পর্যন্ত ঘটেছে আজ, সে সম্পর্কে আহমদ মুসার কথা এবং তার মত জানতে মন্ত্রীসভার সকলেই আগ্রহী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংগে সংগেই বাইরে চলে যায়। গোয়েন্দা প্রধান আবু তাসফিনও সাথে সাথে এসে গিয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে নিয়ে চলে যায়। প্রেসিডেন্টের অতিথি কক্ষে এবং আহমদ মুসার সাথে আলাপ-পরিচয় করে। তাঁকে ও গোয়েন্দা প্রধানকে নিয়ে চলে আসে মন্ত্রীপরিষদের সভাকক্ষে।
প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়িয়ে সবার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিল।
সব মন্ত্রীই উঠে দাঁড়িয়েছিল প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াবার সাথে সাথেই।
প্রেসিডেন্ট বসতে বলল আহমদ মুসাকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ডান পাশে প্রেসিডেন্টের কাছাকাছি আরেকটা চেয়ার এনে। রাখা হয়েছিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস আহমদ মুসাকে নিয়ে সে চেয়ারে বসাল।
আহমদ মুসা বসলে প্রেসিডেন্টই কথা বলে উঠল, মুহতারাম আহমদ মুসা, আপনাকে স্বাগত, গল্প-কাব্যে-রূপকথায় আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার যে আনন্দ আমরা দেখি, আপনাকে পেয়ে আমরা সেরকমটাই খুশি হয়েছি। আমার মনে হয়েছে আমাদের রত্ন দ্বীপকে বিশেষভাবে ভালোবাসেন আমাদের আল্লাহ। রত্ন দ্বীপে আমরা সব ধর্মের লোক সম্মিলিত হয়েছি সকলের স্ব স্ব অধিকারের ভিত্তিতে। এখানে কেউ কারও উপর আধিপত্য করে না। পার্লামেন্ট ও মন্ত্রীসভায় সব ধর্মের শক্তিশালী উপস্থিতি আছে। যে মানুষ যে ধর্মের, সে তার ধর্মের বিধান ও অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয়। কোনো মুসলিম যদি স্বভাবে চোর, মানে জীবন রক্ষার প্রয়োজনে নয়, আর এটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তার হাত কাটা যাবে, কিন্তু খ্রিস্টান ইহুদিদের ক্ষেত্রে এই আইন বর্তাবে যদি না তারা একে কল্যাণকর বলে গ্রহণ করে। প্রতিটি মানুষের স্বাধীন মতামতকে এখানে সম্মান করা হয়। সবাই তাদের ধর্মের ভালো দিক তারা প্রচার করতে পারবে। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারে অর্থাৎ কোনো প্রকার অন্যায় প্রভাব-প্রলোভনের শিকার না হয়ে তার ধর্মমত পরিবর্তনও করতে পারবে। কোনো ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিধান রাষ্ট্রীয় আইন হিসাবে সব ধর্মের লোকের জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য। এই রত্ন দ্বীপের একশ বছরের ঐতিহ্য এটা। এই নীতি রত্ন দ্বীপ রাষ্ট্রকে শান্তি ও সুখ এনে দিয়েছে, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি গড়ে দিয়েছে। সবাই এখানে সবার সহযোগী। এই শান্তি-সম্প্রীতির ঘরে আজ কেউ আগুন লাগাতে চাচ্ছে। এ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ধরনের তিনটি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। আজ প্রথম ভয়াবহ কিডন্যাপের ঘটনা ঘটল এবং এতে ১১ জন মানুষের জীবনহানি ঘটল। রত্ন দ্বীপ রাষ্ট্রের দীর্ঘ ইতিহাসে এমন ঘটনার নজীর নেই। রাম্বুল আলামিন আল্লাহ যেন বিশেষ দয়া করে আপনাকে পাঠিয়েছেন আমাদের দুটি মেয়ের জীবন ও সম্মান রক্ষার জন্যে। আমরা এবং আমাদের রাষ্ট্র মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ, সেই সাথে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আপনাকেও। নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাদের দুই মেয়েকে রক্ষা করেছেন আপনি। মহান ভাই আহমদ মুসা, আমাদের একান্ত চাওয়া যে, রত্ন দ্বীপের শান্তির ঘরে যারা আগুন লাগাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আপনি আমাদের সাহায্য করুন। থামল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস ও অর্থমন্ত্রী বেন নাহান আরমিনোসহ সকলেই বলে উঠল, মাননীয় প্রেসিডেন্ট আমাদের কথাই বলেছেন। রত্ন দ্বীপ আজ অদৃশ্যপূর্ব এক সংকটে পড়েছে। আমরা আপনার সাহায্য চাই। আপনার কথা আমরা জেনেছি। আমরা আনন্দিত যে, স্রষ্টা বিশেষ অনুগ্রহ করে আপনাকে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছেন।
ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে। আমি মনে করছি, ধর্ম-মত নির্বিশেষে সকলের সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আপনার স্থাপন করেছেন রত্ন দ্বীপে। আপনাদের এই সাফল্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। মহামান্য প্রেসিডেন্ট যে সংকটের কথা তুলে ধরেছেন, সে ব্যাপারে আমি কি করতে পারব জানি না। তবে বিষয়টা আমি আরও জানতে চাই। সেজন্যে মহামান্য প্রেসিডেন্টের আমি সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছিলাম।
আহমদ মুসা একটু থামল।
সংগে সংগেই প্রেসিডেন্ট বলল, মহান ভাই আহমদ মুসা, আপনার কাছে ঘটনা সব শুনব, তারপর আমরাও কিছু বলব এজন্যেই আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। প্লিজ বলুন, কেন আপনি প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন। যদি। কথাগুলো বিশেষ হয়, তাহলে আমরা অন্যকক্ষেও যেতে পারি।
না মহামান্য প্রেসিডেন্ট, এখানে বলতে আমার কোনো আপত্তি নেই। রত্ন দ্বীপের যে সংকট নিয়ে কথা হচ্ছে, সে বিষয়েই আমার কথা।
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার শুরু করল, আজকের কিডন্যাপের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কন্যা, মাননীয় প্রেসিডেন্টের ছেলে এবং যে আরেকটি মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছিল, তাদের সাথে কথা বলার অনুমতি চাই। দ্বিতীয় বিষয় হলো, যারা এ পর্যন্ত চারটি সাম্প্রদায়িক ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাল, তাদের কারও কোনো পরিচয় জানা আছে কিনা, তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, না কোনো ক্রিমিনাল পক্ষ এবং তারা দেশি না বিদেশি? এই প্রশ্নগুলো এখন আমার সামনে আছে যা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। থামল আহমদ মুসা।
উত্তর এলো স্বয়ং প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। বলল, মহান ভাই আহমদ মুসা, যাদের সাথে আপনি কথা বলতে চান, তাদের সাথে কথা বলার জন্যে কোনো অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। তবু আপনি চেয়েছেন, তাই অনুমতি দিয়ে দিলাম। শুধু এই তিনজন নয়, রত্ন দ্বীপের যেকোনো কারো সাথেই কথা বলতে আপনার কোনো প্রকার অনুমতির দরকার নেই।
একটু থেমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলল, মি. কনস্টানটিনোস, আমাদের সিকিউরিটি ফোর্সের দায়িত্বশীল, প্রশাসনের লোকজন, প্রশাসনিক ইউনিটগুলোর লোকজন সবাইকে বলে দেবেন তারা যেন আহমদ মুসাকে সব রকমের সহযোগিতা করে।
কথাগুলো শেষ করেই প্রেসিডেন্ট আবার ফিরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, প্রিয় ভাই, আপনি দ্বিতীয় যে বিষয়টা বলেছেন, তার কোনটাই আমাদের জানা নেই। আমরা এখনো একেবারেই অন্ধকারে আছি। আমাদের আগের তদন্তগুলোতে কোনো লোককে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি, এ পর্যন্ত কোনো লোক ধরাও পড়েনি। সুতরাং বলা মুশকিল শত্রুপক্ষ দেশি, না বিদেশি। তবে আমাদের কাছে দেশি কেউ বা বিদেশি কোনো রাষ্ট্র জড়িত থাকার বিষয়টা অসম্ভব বলে মনে হয়। আমরা যতটা অনুসন্ধান করেছি, যতটা তথ্য আমাদের কাছে তাছে, তাতে রত্ন দ্বীপের কেউ এ ধরনের কাজে জড়িত থাকতে পারে। অন্যদিকে কোনো বিদেশি রাষ্ট্র কোনো দিক দিয়েই আমাদের শত্রু তালিকায় নেই।
ধন্যবাদ মহামান্য প্রেসিডেন্ট। আজ কিডন্যাপারদের ৭জন মারা পড়েছে। এদের তো সিকিউরিটি ফোর্স ও গোয়েন্দারা পরীক্ষা করেছে এবং লাশগুলো পরীক্ষার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের কোনো প্রকার
পরিচয় জানা গেছে কিনা? বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটু নড়েচড়ে বসল। বলল গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিনকে লক্ষ্য করে, এ ব্যাপারে নিশ্চয় বলবেন কিছু মি. ওসমান।
বলছি স্যার।
গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন প্রেসিডেন্ট ও আহমদ মুসাকে সম্বোধন করে বলল, তারা দেশি কি বিদেশি, এখনি তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সাতজনের দেহে একই রকমের উল্কি পাওয়া গেছে। এতে মনে হয় এরা একটা গ্রুপের লোক। উল্কিগুলোতে দেখা গেছে ধনুকের পেটে এন্টেনার মতো কিছু। রত্ন দ্বীপের কেউ কেউ উল্কির ব্যবহার করেন, কি এ ধরনের গ্রুপ উল্কি আগে কখনো দেখা যায়নি। ওদের সাতজনের নামও পাওয়া গেছে। ওদের প্রত্যেকের কপালে তাদের স্কিনের রঙে অ চন্দ্রাকারে লেখা। আনকমন হলেও এ ধরনের কোনো নাম রত্ন দ্বীপে আছে। নিশ্চয়। সুতরাং তারা দেশি, না বিদেশি চিহ্নিত করা যায়নি। থামল গোয়েন্দা প্রধান।
প্রিয় ভাই আহমদ মুসা, আপনিও ওদের লাশ দেখেছেন। আপনি কিছু কি সন্দেহ করছেন?
মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আমিও ওদের লাশগুলোকে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। যা দেখেছি তা নিয়ে চিন্তাও করেছি। গোয়েন্দা প্রধান ঠিকই বলেছেন, ওদের পরিচয় এখন নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে ওদের নাম ও উল্কিকে একত্র করে দেখলে ওদের একটা গুরুতর পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। থামল একটু আহমদ মুসা।
গুরুতর পরিচয়? বলল প্রেসিডেন্ট। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গোয়েন্দা প্রধানসহ সকলেরই বিস্ময় দৃষ্টি আছড়ে পড়েছিল আহমদ মুসার মুখের উপর।
আবার শুরু করল আহমদ মুসা, ওদের সাতজনের বাহুতে যে উল্কি আছে, তার ভিন্ন আর একটা পরিচয়ও হতে পারে, যা ধনুকের মতো মনে হচ্ছে। তা আসলে হতে পারে মধ্যযুগের সমুদ্রগামী জাহাজের মূল ফ্রেমের ছবি। আর যাকে মনে হচ্ছে এন্টেনা, সেটা আসলে মাস্তুল স্ট্যান্ড, যাতে অনেকগুলো পাল টাঙানো যায়। এর অর্থ ওদের কাঁধের উল্কি মধ্যযুগের পালের জাহাজের প্রতীক। আর ওদের নামগুলোকে একসাথে করে দেখলে তাও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ওদের সাতজনের নাম- সিলভা, জীম, লেভেজি, আব্রাহাম গ্রে, বেনগান, স্মোলেট এবং ট্রেলেওয়ানী। এই সাতটা নাম ট্রেজার আইল্যান্ড বইয়ের ধনভাণ্ডার উদ্ধারকারী সাতজনের নামের সাথে হুবহু মিলে যায়। একদিকে ওদের কাঁধে মধ্যযুগীয় পালতোলা জাহাজের প্রতীক চিহ্ন, অন্যদিকে ট্রেজার আইল্যান্ডের সাত চরিত্রের সাথে এদের সাতজনের নামের হুবহু মিল- এই দুই বিষয়কে সামনে রেখ আমার মনে হচ্ছে, বাইরের একটি গ্রুপ রত্ন দ্বীপে তাদের কোনো স্বার্থসি ন্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। থামল আহমদ মুসা।
কেউ কোনো কথা বলল না। সবার চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তাদের চোখে বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি। গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন এর দুচোখ তো বিস্ময়ে ছানাবড়া। তার মনে হচ্ছে, কোনো অলৌকিক শক্তি না থাকলে একজন কেমন করে ঐ দুটি বিষয়ের এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারে! কোথায় ট্রেজার আইল্যান্ডের সাত চরিত্র আর কোথায় আজকের সাত কিডনপার। একটা ধনুকাকৃতির সিংগল রৈখিক একটা কাঠামো ও তার উপর এ্যান্টেনার মতো লম্বকে মধ্যযুগীয় পাল তোলা সমুদ্রগামী জাহাজ ধরে নেয়া খুবই শক্তিশালী একটা কল্পনা। কিন্তু মনে হচ্ছে এই কল্পনার শতভাগই বাস্তব। আহমদ মুসার প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে গেল গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসকিনের সুন।
পিনপতন নীরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল প্রেসিডেন্ট, ধন্যবাদ আহমদ। মুসা! উল্কি এবং সাত নামের যে পরিচয় তুলে ধরেছেন, তা আমার কাছে খুব বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে এবং শুক্র গ্রুপটা যে বাইরের, সেটাও আমার কাছে এখন নিঃসন্দেহ মনে হচ্ছে। অনিশ্চয়তার জমাট অন্ধকারে এটা আমাদের জন্যে এক উজ্জ্বল আলো। আল্লাহ আপনাকে বিচারবুদ্ধির যে।
সাধারণ তীক্ষ্ণতা ও দূরদর্শিতা দান করেছেন তার জন্যে আমি আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি। আমার কাছে যে প্রশ্নটা এখন বড় হয়ে উঠছে, সেটা হলো রত্ন দ্বীপে তাদের স্বার্থটা কি? ছোট্ট আমাদের রত্ন দ্বীপ। এখানে লোভনীয় কোনো সম্পদ নেই, যেমনটা ছিল ট্রেজার আইল্যান্ডে। তাহলে স্বার্থটা কি, যেজন্যে বাইরের সন্ত্রাসী গ্রুপ আসবে রত্ন দ্বীপে?
তাদের স্বার্থটা কি, তা বলা মুশকিল এখন। সন্ত্রাসীরা কারা, তারা চরিত্রের দিক দিয়ে রাজনীতিক, না অপরাধী, রত্ন দ্বীপের কারো সাথে তাদের সম্পর্ক আছে কিনা, থাকলে কাদের সাথে? ইত্যাদি বিষয় সুস্পষ্ট না হলে বলা যাবে না তাদের স্বার্থটা কি। তবে আমার মনে হচ্ছে ওরা মূলত সম্পদ লোভী লোক। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু তারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে কেন বা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিচ্ছে কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মেয়েকে কিডন্যাপের চেষ্টাও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হতে পারে। তাদের প্রচারিত প্রচারপত্র এই কথাই প্রমাণ করে। অর্থমন্ত্রী বেন নাহান বলল।
একটা লক্ষ্যে পৌঁছার নানা পথ হতে পারে। যে পথ সহজেই সুফল দিতে পারে, সাধারণত সে পথই গ্রহণ করা হয়ে থাকে। রত্ন দ্বীপের শত্রু সন্ত্রাসীরা কেন এই পথ বেছে নিয়েছে, এটা বুঝার জন্যে তাদের লক্ষ্য কি সেটা আমাদের জানতে হবে। যেটকু আমার মনে হচ্ছে তা হলো, তাদের লক্ষ্য ছোট কোনো কাজ নয়। ছোট কোনো কাজ তাদের লক্ষ্য হলে তারা হৈচৈ সৃষ্টির মতো এসব কাজ করত না। নিশ্চয় তারা এমন কিছু করতে চাচ্ছে, যার জন্যে সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়া দরকার। সরকার ব্যবস্থা ভাঙার জন্যেই তাদের দরকার সাম্প্রদায়িক ও সামাজিক অবিশ্বাস, অনৈক্য ও সংঘাত সৃষ্টি করা। বলা যায়, এই কাজটাই তারা করছে। বলল আহমদ মুসা।
সবাই আহমদ মুসার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ।
প্রেসিডেন্টের মুখেও নেমেছে একটা নিবিষ্টতা। বলল, সে বড় টার্গেটটা কি হতে পারে, যার জন্যে তারা সাম্প্রদায়িক ও সামাজিক ঐক্য সংহতি ধ্বংস করতে এবং সরকার ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চাচ্ছে? আপনি বলেছেন। তারা লোভী। তাদের লোভটা কি অর্থ-সম্পদের, না ক্ষমতার, না রত্ন দ্বীপের ধর্মীয় ও সামাজিক সংহতি-সমঝোতা ধ্বংস করার?
কোটা তাদের লক্ষ্য আর কোন্টা উপলক্ষ তা এখন নিশ্চিত করে বলা, অসম্ভব। তবে আমি বলেছি, তারা বড় কোনো একটা লক্ষ্যে রত্ন দ্বীপের শান্তির রাজ্যে সংঘাত, সংঘর্ষ, ধ্বংস ডেকে আনতে চাচ্ছে। বলল আহমদ মুসা।
সবাই নীরব। সকলের চোখে-মুখে বাকরুদ্ধ এক উদ্বেগ যেন।
নীরবতা ভাঙল প্রেসিডেন্ট। বলল, এখন তাহলে করণীয় কি প্রিয় ভাই আহমদ মুসা। অতীতে আমরা তদন্ত করেছি, আজকের দুটি ঘটনা তদন্তের জন্যেও আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করব। কিন্তু আমরা চাচ্ছি, আল্লাহ যখন আপনাকে আমাদের মাঝে দয়া করে প্রেরণ করেছেন, তখন আপনি এই তদন্তের দায়িত্বভার গ্রহণ করুন, প্লীজ। আমার এবং আমার গোটা মন্ত্রীসভার অনুরোধ এটা।
ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট। আপনাদের অনুরোধ আমার কাছে আদেশের মতো। কিন্তু আমি এই দায়িত্ব পালন করব অন্যভাবে। আপনারা আপনাদের মতো করে তদন্ত কমিটি গঠন করুন। কমিটি কাজ করুক। আর আমাকে আমার মতো করে কাজ করতে দিন। চাইলে সবাই যেন আমাকে সাহায্য করেন, আমার কথা শোনেন, এটা দয়া করে নিশ্চিত করুন।
প্রেসিডেন্ট সবার দিকে তাকাল। তার দুচোখ ঘুরে এসে আবার নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার উপর। বলল, ধন্যবাদ প্রিয় ভাই আহমদ মুসা। আপনি যা বলবেন, তা শিরোধার্য আমাদের জন্যে। আমরা আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম। আমাদের দ্বীপের গোটা সিকিউরিটি ব্যবস্থা এবং প্রশাসন আপনি যা বলবেন সেই নির্দেশ পালন করবে। আমাদের তদন্ত কমিটিও আপনার সাথে যোগাযোগ রেখে কাজ করে যাবে। অনেক ধন্যবাদ প্রিয় ভাই। আপনাকে।
ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট। এখন যে দুটি মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছিল এবং যে ছেলেটি আহত হয়েছে, তাদের সাথে আমার কথা বলতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ওরা তিনজন স্টেট সিকিউরিটি হাসপাতালে আছে। আপনি যেকোনো সময় তাদের সাথে কথা বলতে পারেন। বলল প্রেসিডেন্ট। কথা শেষ। করেই তাকাল গোয়েন্দা প্রধানের দিকে। বলল, মি. ওসমান আবু তাসফিন, ভাই আহমদ মুসাকে তুমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেবে।
ইয়েস মহামান্য প্রেসিডেন্ট। বলল গোয়েন্দা প্রধান।
মি. প্রেসিডেন্ট, আমি এখন উঠতে চাই, যদি আপনি অনুমতি দেন। আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ, প্রিয় ভাই আহমদ মুসা। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন, আপনাকে সফল করুন। আপনাকে পেয়ে আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। প্রেসিডেন্টসহ সকলকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আহমদ মুসা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল।
গোয়েন্দা প্রধান তাকে গাইড করছিল।
.
হাসপাতাল কক্ষের দরজা নীরবে খুলে গেল।
দরজা দিয়ে প্রবেশ করুল হামযা আনাস। সেমেটিক ও ইউরোপীয় আর্য রঙের মিশ্রণ তার দেহে। সুন্দর, সুগঠিত তার দেহ। রত্ন দ্বীপের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় রত্ন দ্বীপ স্টেট ইউনিভার্সিটির মিলিটারি ফ্যাকাল্টির ছাত্র সে। রত্ন দ্বীপে ছেলে-মেয়ে সবার জন্যে মিলিটারি ট্রেনিং অপরিহার্য, কিন্তু কেউ কেউ আবার বিশেষভাবে মিলিটারি সাবজেক্টের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নেয়। এরাই দ্বীপে সিকিউরিটি ফোর্সের কমান্ডারের দায়িত্ব পায়।
হামযা আনাস আমিনের বাম বাহুতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। তার বাম হাতটি গলার সাথে ঝুলিয়ে রাখা।
হাসপাতালের কক্ষটিতে দুগ্ধ ফেনিল একটা মেডিকেল বেড। বেডে শুয়ে আছে এক তরুণী, একটা শুভ্র ফুলের মতো দেখতে। তার কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা। তরুণী জোনা ডেসপিনার চোখ দুটি বোজা।
জোনা ডেসপিনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের মেয়ে। রত্ন দ্বীপ স্টেট ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব জেনারেল হিস্ট্রির ছাত্রী।
হামযা আনাস আমিন এগোচ্ছে জোনা ডেসপিনার দিকে। জোনা ডেসপিনার বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে এগোলো তার মাথার দিকে। ডেসপিনার ব্যান্ডেজটি সে ভালো করে দেখল। ব্যান্ডেজে তাজা রক্ত দেখে বুঝল ডেসপিনার আহত স্থান থেকে রক্তক্ষরণ এখনও বন্ধ হয়নি। জ্বর আছে কিনা গায়ে?
হামযা আবার তার পাশে এসে দাঁড়াল। ঝুঁকে পড়ে ডেসপিনার একটা হাত তুলে নিল। হাত ঠাণ্ডা। না, জ্বর নেই, নিশ্চিত হলো হামযা আনাস। শশুশি হলো।
জোনা ডেসপিলার হাত ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল হামযা আনাস চলে যাবার জন্যে।
হাতে টান অনুভব করে মুখ ঘুরিয়ে নিল হামযা আনাস। দেখল জোনা ডেসপিনার হাত তার হাত জড়িয়ে ধরেছে।
হান্য একটু বস। বলল জোনা ডেসপিনা। ডেসপিনার দুই চোখ তখনও নেজা।
আমি মনে করেছিলাম ডেসপিনা তুমি ঘুমাচ্ছ! তুমি তো এখনও চোখ বুজে আছ। কি করে বুঝলে আমি ম্যা?
চোখ খুলল জোনা ডেসপিনা। বলল, তোমার গন্ধ আমার চেনা। তুমি যে একটা মাইল্ড ও মিষ্টি সেন্ট ব্যবহার কর, তা অদ্বিতীয়।
ডেসপিনার ফুলের মতো ঠোঁটে সুন্দর এক টুকরো হাসি।
ডেসপিনার পাশে বসল হামযা তার দিকে মুখ করে।
তুমি তো মারাত্মক আহত হয়েছ। বন্দুকধারীদের সামনে কো তুমি
ঐভাবে আমাকে রক্ষা করতে গিয়েছিলে? বলল জোনা ডেসৃপিনা। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে দেখলে তুমি খুশি হতে? বলল হামযা আনাস
আমার চেয়ে তোমার জীবন মূল্যবান আমার কাছে। জোনা ডেসপিনা বলল।
আমার মূল্যবান জীবন নিয়ে আমি বসে থাকি, আর তোমার মূল্যহীন জীবন ধ্বংস হয়ে যা, তাই না? বলল হামযা আনাস আমিন।
গুলিটা যদি তোমার আর ৪ ইঞ্চি নিচে লাগত, তাহলে কি হতো বল তো? বলল ডেসপিনা।
কিন্তু লাগেনি। বলল হামযা।
লাগেনি বলেই তোমাকে কথাগুলো বলতে পারলাম! লাগলে কি হতো। সেটাই আমার কথা।
যা ঘটেনি তা নিয়ে আর কথা নয়। এখন বল, কেমন আছ তুমি? বলল হামযা আনাস।
তোমার এই অবস্থায় তুমি কেন হাসপাতালের বেড থেকে উঠে এসেছ? শুধু আমি কেমন আছি এটা জানার জন্যে? জোনা ডেসপিনা বলল।
দোষ এতে অবশ্যই হয়নি। বলল হামযা আমিন।
চারজন সিকিউরিটির লোককে গুলি খেয়ে মরতে দেখেও তুমি আমাকে উদ্ধারের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে, আবার এত বড় একটা আহত অবস্থা নিয়ে হাসপাতালের বেড থেকে তুমি উঠেছ, তোমার এই আবেগকে আমি ভয় করি। জোনা ডেসপিনা বলল। তার কণ্ঠ ভারি।
হামা আমিন মুখ তুলে মুহূর্তের জন্যে ডেসপিনার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার আবেগকে দোষ দিচ্ছ আমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই তো? তোমার যেখানে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন, সেখানে আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে কি বসে থাকতে পারি, বল?
আমি তোমাকে বুঝাতে পারব না, মুক্ত হয়ে যতক্ষণ না তোমার খবর পেয়েছি, ততক্ষণ কি দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে আমার সময় কেটেছে। আমার বেঁচে আসাটা নিরর্থক হয়ে গিয়েছিল। বলল জোনা ডেসপিনা। তার দুচোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল দুগণ্ড বেয়ে।
তোমার চেয়ে আমার যন্ত্রণা আরও বেশি ছিল। আমি তোমার অসহায় চিৎকার শুনেছি, বাঁচাতে পারিনি। সেই যন্ত্রণা আমাকে হাসপাতালের বেডেও স্থির থাকতে দেয়নি। তোমাকে একবার নিজ চোখে দেখতে চেয়েছি। হামযা আনাস বলল।
ডেসপিনা চোখ বুজে ছিল। হামযা আনাসের কথা শেষ হতেই চোখ। খুলল। ডেসপিনার অশ্রুধোয়া মুখ অনেকটাই রক্তিম হয়ে উঠেছে। তার ঠোঁটে আনন্দের সূক্ষ্ম কম্পন। বলল একটু সময় নিয়ে ধীরকণ্ঠে, আল হামদুলিল্লাহ। আমার সৌভাগ্য। হৃদয়বান তুমি, আবেগ একটু বেশি।
হামযা আনাসের বিমুগ্ধ দৃষ্টি ডেসপিনার দিকে। বলল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খ্রিস্টান নেতা ক্রিস কনস্টানটিনোসের মেয়ের মুখে যে সোজাসুজি আলহামদুলিল্লাহ! আগে তো শুনিনি?
হাসল ডেসপিনা। বলল, মৃত্যুর মুখ থেকে একবার বেঁচে এসেছি, জীবন নিয়ে ভরসা আর আগের মতো রাখতে পারছি না। কেন নিজেকে আর গোপন রাখব?
কবে থেকে নিজেকে গোপন রাখছ? বলল হামযা আনাস। তার ঠোঁটে হাসি।
হাসল ডেসপিনাও। বলল, মনে করো না, তোমাকে ভালোবেসে আমি ইসলামকে ভালোবেসেছি। ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই ছিল।
ইন্টারেস্টিং! সে কেমন করে? বলল হামযা আনাস।
সত্যিই ইন্টারেস্টিং। আমাদের পূর্বপুরুষ যারা স্পেন থেকে ইতালিতে মাইগ্রেট করে, তাদের পারিবারিক প্রধান ছিলেন ক্রিশ্চিয়ান ক্রিস্টোফার। তিনি ছিলেন পেশায় ডাক্তার, নেশা ছিল সমাজ সেবা। তিনি বাপ-মা, পরিবার-পরিজন হারা একজন মরিস্কো মেয়েকে বিয়ে করেন। মরিস্কো এই স্ত্রীকে নিরাপদ করার জন্যেই আমাদের পূর্বপুরুষ ক্রিশ্চিয়ান ক্রিস্টোফার। ইতালিতে মাইগ্রেট করেন। এই…।
ডেসপিনার কথার মাঝখানে হামযা আনাস বলে উঠল, মরিস্কো কি ডেসপিনা?
তোমার এ প্রশ্ন করারই কথা। আমিও জানতাম না। বাবার কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি। ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের মাধ্যমে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং খ্রিস্টান রাজত্বের পত্তন হয়। ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে আমি জানি এই তথাকথিত খ্রিস্টান শাসন ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অমানবিক। সমস্ত স্পেন জুড়ে চলে গণহত্যা, লুট তরাজ ও অগ্নিসংযোগ। ইসলাম ধর্মত্যাগ ও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করাই ছিল তখন বাঁচার একমাত্র উপায়। তাই বাঁচার জন্যে অনেক মুসলিম খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও খ্রিস্টান সমাজ এদেরকে খ্রিস্টান বলে গ্রহণ করেনি। মনে করেছে এরা ছদ্মবেশী মুসলমান। অন্যদিকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে বলে মুসলিম সমাজ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। না ঘরকা, না ঘাটকা এই হতভাগ্য মানুষরাই মরিস্কো নামে অবিহিত। এমন একজন মরিস্কো তরুণীকেই বিয়ে করেন আমার পূর্বপুরুষ ক্রিশ্চিয়ান ক্রিস্টোফার। তরুণীর নাম ছিল মরিয়ম। তিনি ছিলেন মালাগা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলের ছাত্রী। একটা লাশের স্তূপ থেকে আমার পূর্বপুরুষ তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। বাসায় নিয়ে যায়। তারপরে সুস্থ করে তোলে। বিয়েও হয়ে যায় তাদের। মধ্যে। কিন্তু বিয়ের আগে আমাদের ইতালির নতুন জেনারেশনের আদি মা মরিয়ম যয়নব জাহরা বলেন, আমার পরিবার বাঁচার জন্যে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও আমি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করিনি। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেও আমার পরিবারের সদস্যরা কেউই বাঁচেনি, কিন্তু ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে গেছি। হাজারো লাশের স্তূপ থেকে আমাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তখন আমি আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম যে, আমি মুসলিম হয়েই বাঁচতে চাই। আমাদের সেই পূর্বপুরুষ ক্রিশ্চিয়ান ক্রিস্টোফার এটা মেনে নেন। তবে ক্রিস্টোফার অনুরোধ করেন, তার নামটা একটু পাল্টাতে হবে। মেনে নেন মরিয়ম জয়নব জাহরা। তার নতুন নাম হয়ে যায় মেরী জোনা জুলিয়া, আগের নামের অনেকটা প্রতিধ্বনির মতো। তবে সারাজীবন তিনি স্বাধীনভাবে নিজের ধর্ম ইসলাম পালন করেছেন। আমাদের ইতালীয় জেনারেশনের আদি পিতা ক্রিশ্চিয়ান ক্রিস্টোফার তার ধর্মকে সম্মান। করেছেন, তাকে সব রকম সহযোগিতা করেছেন। তার নিরাপত্তার জন্যে তিনি ইতালিতে মাইগ্রেটও করেছেন। এই কাহিনী আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের অংশ। এ ইতিহাস পরিবারের সবাইকেই জানতে হয়। আরেকটা মজার ইতিহাস হলো, আমাদের পরিবারের সাতজন মেয়ে এ পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তাদেরকে সম্মানের চোখেই দেখা হতো এবং তারা ও তাদের পরিবার আমাদের বৃহত্তর পরিবারের সদস্য ছিলেন। আমি তাদের তালিকার ইসলাম গ্রহণকারী অষ্টম সদস্য। আমার নামের জোনা শব্দ টি আমার আদি মায়ের নামের অংশ। আমি গর্বিত সেজন্যে।
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল জোনা ডেসপিনা।
হামযা আনাস হাসিমুখে প্রথম সালাম দিল জোনা ডেসপিনাকে। বলল, তোমার নতুন পরিচয়কে স্বাগত ডেসপিনা। তোমাদের পরিবারকেও অভিনন্দন। তোমার পরিবারের এই কাহিনী আমার এত ভালো লেগেছে যে, আমি ঔপন্যাসিক হলে এই কাহিনী নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতাম। অদ্ভুত এই কাহিনী ডেসপিনা। অবিরল অশ্রু, অন্তহীন আনন্দ, অতলান্ত মানবিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ আছে এই কাহিনীর পরতে পরতে। জানি না, হয়তো এমন হাজারো কাহিনীর সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল। চোখের আড়ালেই তার আবার মৃত্যুও ঘটেছে।
হামযা আনাসের কণ্ঠ আবেগে ভারি হয়ে উঠেছে। জোনা ডেসপিনা ধীরে ধীরে উঠে বসল।
হামযা আনাস একটু দ্বিধা করে, তারপর একটু এগিয়ে ডেসপিনার দুকাধ ধরে তাকে উঠে বসতে সাহায্য করতে চেয়েছিল। ডেসপিনা তাকে নিষেধ করে বলল, দেখ আমি মুসলিম। আমি যখন একাই উঠে বসতে পারব, তখন অহেতুক স্পর্শ আমাদের এড়িয়ে চলাই ভালো।
ধন্যবাদ ডেসপিনা। বলে হাম্য আনাস তার জায়গায় ফিরে এল।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ হামা। তুমি আমার আদি মায়ের হৃদয়ের অবরুদ্ধ কান্না শুনতে পেয়েছ। আমিও এই কান্না শুনতে পাই। উঠে বসেই বলল ডেসপিনা। তার কণ্ঠ কান্নায় ভেজা।
এস ডেসপিনা আমরা তার কান্না ভুলে তার আনন্দকে স্মরণ করি। তিনি কান্নার উপর আনন্দের সৌধ নির্মাণ করেছেন। সেই সৌধ তোমাদের পরিবার। বলল হামযা আনাস।
হ্যাঁ হামযা। আমি গর্বিত যে আমি সেই পরিবারের সদস্য। জোনা ভেসপিনা বলল।
তোমার এ কথা কি তোমার বাবা-মা জানেন? জিজ্ঞাসা হামযা আনাসের।
জানেন। ডেসপিনা বলল।
তাদের প্রতিক্রিয়া কি? জিজ্ঞাসা করল হামযা আনাস।
আমাদের পরিবারে এটা সাধারণ ব্যাপার। বলেছি না যে, এর আগে আমাদের পরিবারের আরও সাতজন মেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তবে বাবা বলেছেন, এ নিয়ে কোন হৈ চৈ করো না। ধর্ম গ্রহণ-বর্জন এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। রত্ন দ্বীপ একে মানবাধিকার হিসাবে গ্রহণ করেছে। একটা মজার ব্যাপার ডেসপিনা, রত্ন দ্বীপে যা ধর্মান্তর ঘটেছে, তা সবই সলামের পক্ষে। এটা স্বাভাবিক কারণেই হচ্ছে, কোনো চাপ-প্রলোভন এখানে নেই। তবু বিষয়টা নিয়ে হৈ চৈ না করাই ভালো এবং মুসলিমরাও তা করছে না। বাবার এ কথা ঠিক। আমি এ কারণেই বিষয়টা কাউকেই জানাইনি। তোমাকেও নয়। আজ বিশেষ এক মুহূর্তে বলেই ফেললাম। বলল জোনা ডেসপি।
ধন্যবাদ ডেসপিনা। খুব খুশি হয়েছি আমি। হামযা আনাস বলল।
কেন, আগে খুশি ছিলে না? বলল ডেসপিনা।
ছিলাম।তবে এ খুশির স্বাদ আলাদা। হামযা আনাস বলল।
মিষ্টি হাসল জোনা ডেসপিনা। বলল, আমিও খুব খুশি হয়েছি। হতে পারে এটা তোমার ঐ নতুন স্বাদের ফলেই।
ধন্যবাদ ডেসপিনা! কিন্তু আর বসো না, শুয়ে পড়। বসলে মাথায় চাপ বাড়ে। হামযা আনাস বলল।
শুয়ে পড়ছি এখনি। জান, নামটাও আমি বদলে ফেলেছি। আমার আদি মার নামের শেষ দুই অংশ, যয়নাব জাহরা, গ্রহণ করেছি। আমি এখন যয়নাব জাহিরা। বলল ডেসপিনা। তার চোখে-মুখে উজ্জ্বল আনন্দ।
ওয়েলকাম জাহরা। খুব প্রিয় নাম এটা! জাহরা মানে জান- রক্তিম। কিন্তু তুমি তো সাদা! হামযা আনাস বলল একটু হেসে।
এবার সাদার সাথে লাল মেশীলাম। বলল ডেসপিনা। বলে একটা দম নিয়েই বলল, তুমি অনেকক্ষণ এভাবে বসে আছ। আর নয়, তুমি যাও। আমার মাথায় যে চাপ পড়ার কথা বলেছিলে, তার চেয়ে
অনেক বেশি চাপ তোমার আহত কাঁধে পড়ছে। যাও, উঠ।
উঠছি। চলে যেতে বলার জন্যে ধন্যবাদ। বলল হামযা আনাস। তার মুখে হাসি!
এটা চলে যেতে বলা নয়। হাসপাতালের বেড় থেকে উঠে এসে যে অন্যায় কবেছ, তার প্রতিবিধান করতে বলেছি। জোনা ডেসপিনা বলল।
তার মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য।
কিছু না এলে এত কথা হতো? বলল হামযা আনাস।
তাও ঠিক। ধন্যবাদ। এবার এসো। মিষ্টি হাসির সাথে বলল জোন ডেসপিনা।
ডেসপিনার কথা শেষ হতেই কক্ষে ঢুকল মেট্রন। এসে দাঁড়াল ডেসপিনার সামনে। বলল, ম্যাডাম, জাহরা ম্যাডামকে আপনি আপনার কক্ষে নিয়ে আসতে বলেছেন?
হ্যাঁ। খুব একাকী লাগছে। জাহরাকে এখানে আনলে দুজনে গল্প করতে পারতাম। আমার কক্ষ বেশ বড়, কোনোই অসুবিধা হবে না। বলল জোনা ডেসপিনা।
আপাতত উনি আসছেন। তার রুমে আবার ফিরতেও পারবেন। এই ব্যবস্থাই তাহলে করছি ম্যাডাম। বলে মেট্রন চলে গেল।
আসি জোনা ডেসপিনা। জাহরা এলে ভালোই হবে। ভালো সময় কাটবে তোমাদের। ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। কিন্তু জাহরা হাসপাতালের বেড়ে কেন? বলল হামযা আনাস।
ও, তুমি জান না। তুমি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলে জাহরা ছুটে এসেছিল আমাকে বাঁচাতে। শয়তানরা তারও পায়ে গুলি করে এবং আমার সাথে তাকেও গাড়িতে তুলে নেয়। সেও আমার সাথে কিডন্যাপড হয়। জাহরাকে তুমি চেন? জোনা ডেসপিনা বলল।
ঠিক চিনাচিনি নেই। আসলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন্ বিভাগের ছাত্রী জানি না। সে আক্রমণ ও আত্মরক্ষা-কৌশল-এর একটা মিলিটারি কোর্স করে বাড়তি একটা বিষয় হিসেবে। ক্লাসে তাকে দেখেছি, নামও শুনেছি। সে আমাকে চেনে বলে মনে হয় না। বলল হামযা আনাস।
জোনা ডেসপিনার কক্ষের দরজা আবার খুলে গেল, একটা বেড় ঠেলে নিয়ে নার্সরা প্রবেশ করল ঘরে। বেডে শুয়ে আছে যাইনেব জাহরা।
গুড ইভেনিং জাহরা। বলল জোনা ডেসপিনা জাহরাকে লক্ষ্য করে।
জাহরা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। ডেসপিনার কষ্ট পেয়ে চোখ খুলে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল জোনা ডেসপিনার দিকে। ডেসপিনাকে দেখেই মুখে হাসি টেনে বলল, গুড ইভেনিং ডেসপিনা। কেমন আছ তুমি?
ভালো জাহরা। তুমি কেমন আছ? বলল জোনা ডেসপিনা।
জাহরার বেড ডেসপিনার বেডের পাশাপাশি সেট করা হয়েছে।
আমি ভালো আছি ডেসপিনা। আল্লাহর রহমতে গুলিটা গোড়ালির ৪ ইঞ্চি উপরের মাস্ল ভেদ করে গেছে। হাড় স্পর্শ করেনি। গুলিটাও বের হয়ে গেছে। সুতরাং বেঁচে গেছি আমি বড় ধরনের কাটাকুটি থেকে। তোমার কি অবস্থা? শুনলাম, তোমার আঘাতের যে ধরন, তাতে আঘাতটা যদি আর দেড় ইঞ্চি কানের দিকে এগিয়ে গিয়ে লাগত, তাহলে তোমার বড় ক্ষতি হয়ে যেত। যাক, আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। জাহরা বলল।
ঠিক শুনেছ জাহরা। অল্পের জন্যে বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে গেছি। মনে করেছিলাম দুএকদিনের মধ্যে ছাড়া পাব। কিন্তু ডাক্তার বলছেন, তিন দিন দেখার পর তারা বলবেন কখন ছাড়বেন। বুঝছি না এমন কি হয়েছে। বলল জোনা ডেসপিনা।
মাথার আঘাত। কোনো তাড়াহুড়া করা যাবে না ডেসপিনা। ডাক্তার যা বলবেন, তা মানতে হবে। জাহরা বলল।
হঠাৎ চুপ হয়ে গেল ডেসপিনা।
তার হাতের কব্জির দিকে তার চোখ দুটি নিবদ্ধ।
তার হাতের কব্জিতে একটা মেডিকেল স্ট্রিপ পেস্ট করা দেখা যাচ্ছে। ডেসপিনা স্ট্রিপটার দিকেই তাকিয়েছিল।
বিস্মিত হয়েছিল যাইনেব জাহরা। বলল, কি হলো ডেসপিনা? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে যে? কি দেখছ তুমি?
মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ডেসপিনার। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, আমার কব্জির এই মেডিকেল স্ট্রিপটি দেখে হঠাৎ আমার মনে পড়ল আমাদের যিনি বাঁচিয়েছিলেন, উদ্ধার করেছিলেন সেই দেবদূতের কথা। আমার আহত কব্জিতে তিনি এই মেডিকেটেড স্ট্রিপ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ধ্বস্তাধস্তির সময় আমার ঘড়ির চেন লেগেই কব্জির ঐ জায়গাটা গভীরভাবে কেটে গিয়েছিল। খুব ব্লিডিং হচ্ছিল। তাড়াহুড়ার মধ্যেই ঐ স্ট্রিপটি লাগিয়ে দিয়েছিলেন সেই দেবদূত।
হ্যাঁ, আমি দেখেছি ডেসপিনা। কিন্তু ওটা তো পুরনো কথা। এখন তোমার কি হলো ওটা নিয়ে? জাহরা বলল।
ডাক্তারের একটা কথা মনে পড়ায় নতুনভাবে স্ট্রিপটাকে দেখছিলাম। বলল ডেসপিনা।
ডাক্তারের কি কথা? জাহরা বলল। তার চোখে বিস্ময়।
আমার মাথাটা ব্যান্ডেজের পর বাম হাতটা এগিয়ে দিয়েছিলাম, ডাক্তারের দিকে। তিনি আমার কব্জির দিকে একবার তাকিয়েই বললেন, ___ ম্যাজিক স্ট্রিপটা কোত্থেকে লাগালেন, কোথায় পেলেন?
আমি বললাম, আমাকে যিনি উদ্ধার করেছিলেন, তিনি এটা পয়ে দিয়েছিলেন।
এই ম্যাজিক স্ট্রিপ নতুন বের হয়েছে আমেরিকায়। মার্কিন সেনাবাহিনী, এটা ব্যবহার করছে এখন। আমেরিকার বাইরে এটা এখনও যায়নি। খুব মজার স্ট্রিপ এটা। এখানে ওষুধ, ব্যান্ডেজ কোনো কিছুরই দরকার নেই। দেখবেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে স্থানটা নিরাময় করে ট্রিপটা আপনাতেই উঠে যাবে। বলেছিলেন ডাক্তার। আমি ডাক্তারের সে কথাটাই ভাবছিলাম। কে এই লোকটি? লোকটি কি আমেরিকান ট্যুরিস্ট? লোকটি সম্পর্কে তুমি কিছু জান জাহরা? বলল ডেসপিনা।
আমিও লোকটির কথা সর্বক্ষণ ভাবছি। কিন্তু লোকটি সম্পর্কে তো এখনো কিছু জানা হয়নি। এখনও আমার মনে হচ্ছে যেন ঘটনাটা ফিলোর একটা অংশ ছিল। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা বাস্তবে চোখের সামনে দেখব, তা কখনও ভাবিনি। জাহরা বলল।
ঠিক বলেছ জাহরা। সে সময়ের কথা মনে হলে বুক আমার শিউরে ওঠে ভয়ে। লোকটির গাড়ি আমাদের বহনকারী কিডন্যাপারদের গাড়ি অতিক্রম করে চলমান আমাদের গাড়ির গতি রোধ করে সামনে দাঁড়াল। শান্ত কণ্ঠের একটা নির্দেশ ছুটে এল, গাড়ির মধ্যে যে বা যারা কাঁদছে, তাদের ছেড়ে দাও। উত্তর না দিয়ে, আদেশ পালন না করে কিডন্যাপাররা লোকটির গাড়ি লক্ষ্যে কয়েকটা গুলি করে লোকটির গাড়ির পাশ কাটিয়ে চলতে চেষ্টা করল। লোকটির গাড়ির দিক থেকেও কয়েকটি গুলি এল। কিডন্যাপারদের সামনের গাড়ির টায়ার প্রচণ্ড শব্দে ফেটে গেল। সংগে সংগে দুটি গাড়ি থেকে কিডন্যাপাররা বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির ওপর। লোকটি আগেই বেরিয়ে এসেছিল। অসম্ভব এক অসম লড়াই শুরু হলো। তোমার নিশ্চয় মনে আছে, আমাদের তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। ওরা গাড়ি লক করে গেছে। বের হয়ে পালাবার কোনো উপায় আমাদের নেই। হঠাৎ গোলাগুলি থেমে গেল। রিভলবার হাতে লোকটি এসে গুলি করে আমাদের গাড়ির দরজা খুলে ফেলল। ভেতরে উঁকি দিয়ে আমাদের দেখে শান্ত কণ্ঠে বলল, আপনারা ঠিক আছেন?
আমি ভাবছিলাম লোকটি সম্পর্কে। তুমিই তখন উত্তরে বলেছিলে আমরা ভালো আছি। আপনি কি সামনের লোক? কিডন্যাপাররা কোথায়?
সে তখন পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা কল করে একজনকে বলল, সাতজন কিডন্যাপার সবাই মারা গেছে। তার শান্ত কণ্ঠ, শান্ত চেহারা, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কিছুই ঘটেনি।
আমি কিছু বললাম না। তুমিও কিছু বললে না। লোকটি টেলিফোনে বলল, স্টেট সিকিউরিটি হেডকোয়ার্টার?
ওপারের কথা শুনে লোকটি বলল, ফাস্ট সার্কেল হাইওয়ে এবং এয়ারপোর্ট রোডের লিংকে সাতজন কিডন্যাপার মারা পড়েছে এবং কিডন্যাপ হওয়া দুজন মেয়ে উদ্ধার হয়েছে। আপনারা আসুন।
ওপারের কথা আবার সে শুনল এবং বলল, আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। আমি অপেক্ষা করাছি। আপনারা আসুন।
মোবাইল অফ করে আমাদের দিকে তাকিয়েই সে বলল, আপনারা দুজন গাড়িতে একটু বসতে পারবেন? আমি যাব লাশগুলো দেখতে। অসুবিধা মনে করলে আমার সাথে আসতেও পারেন। তোমার মনে আছে। জাহরা কি শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে কথাগুলো বলেছিল লোকটি। এত বড় একটা ঘটনা ঘটল, সাতজন কিডন্যাপার হত্যার ঘটনা, কোনো কিছুরই কোনো উত্তাপ তার মধ্যে নেই। আমাদের দিকে চেয়ে দেখছে না, যেন আমরা কোনো দর্শনীয় বস্তুই নই।
আমরা তার পেছনে পেছনে গেলাম। সে এক এক করে লাশগুলোকে উল্টে-পাল্টে দেখল। একজন মেজরের নেতৃত্বে সিকিউরিটির লোকরা এল। তার সাথে পরিচয় করে লোকটি তাকে বলল, আপনারা লাশগুলো ও দুটি গাড়ির দায়িত্ব নিন। আমার ও কিডন্যপারদের একটা- এই দুটি গাড়িই অকেজো হয়ে পড়েছে। আমি কিডন্যাপারদের দ্বিতীয় গাড়িতে করে আহত মেয়েদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।
আপনার পরিচয় ও স্টেটমেন্ট কিছুই তো আমরা পেলাম না। বলল সিকিউরিটির মেজর লোকটি।
লোকটি সিকিউরিটিকে একটা কার্ড দেখাল। সংগে সংগে সিকিউরিটির মেজর লোকটিকে একটা স্যালুট দিয়ে বলল, স্যরি স্যার, আপনি যান।
লোকটি দ্বিতীয় গাড়িতে উঠে আমাদেরকে বসতে বলল। শান্ত কণ্ঠের একটা নির্দেশ। আমরা কোনো প্রশ্ন না তুলে গিয়ে বসলাম। লোকটি তার গাড়ি থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলো মিনিটখানেকের মধ্যেই। আমাদের সামনে এলো ব্যাগটা নিয়ে। আমাকে বলল, আমার চোখে চোখ
রেখেই, আপনার কপালটা থেতলে গেছে। আঘাত মারাত্মক, কিন্তু রক্ত খুব বেশি আর আসছে না। ডান হাতটা এদিকে দিন। কব্জি থেকে এখনও বেশ রক্ত ঝরছে। শান্ত, নরম গলার একটা আদেশ। আপন কারো আদেশের মতো। আমি তা পালন করলাম।
তারপর তিনি তোমার কাছে গেলেন। তারপর কি অসাধারণ ব্যবহার করলেন, তুমি তার সাক্ষি। এত কথা আমি বললাম শুধু একটা কথা বলার জন্যে যে, লোকটি ভয়ঙ্কর নয়, স্বচ্ছ-সুন্দর সাধারণ একটা মানুষ, কিন্তু তার কথা ও কাজ বিস্ময়কর! কোনো প্রশ্ন না তুলেই তার আদেশ আমরা পালন করেছি। সিকিউরিটির লোকরাও তার আদেশ পালন করেছে। কিডন্যাপাররা।
তার আদেশ পালন না করে সাতজনই জীবন দিয়েছে। কে এই লোক? ভয় নেই, উদ্বেগ নেই, সুন্দরী মহিলাদের কাছে নিজের বাহাদুরী জাহির করার কোনো চেষ্টা নেই, দায়িত্ব পালনে কোনো এদিক সেদিক নেই এবং একজন সৈনিক বা প্রফেশনাল গোয়েন্দার মতো দৃষ্টি। কে এই লোক? দীর্ঘ একটা বক্তব্য দিয়ে থামল জোনা ডেসপিনা।
ঠিক বলেছ ডেসপিনা। সেদিন থেকেই আমার মাথায় এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যে, লোকটি আসলে কে? ম্যাজিকের মতো সাতজন সন্ত্রাসীকে একাই মেরে ফেলল এত দ্রুত! লোকটি রত্ন দ্বীপে একদমই নতুন, কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিকই সে চিনত না। দেখ, একবারও সে আমাদের নাম পরিচয় জিজ্ঞাসা করেনি। হাসপাতালে গিয়েও যখন সবাইকে আমাদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখল, তুমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মেয়ে জানাজানি হয়ে গেল, তখনও তার চোখে-মুখে কোনো ভাবান্তর দেখিনি, যেন এটা কোনো ব্যাপারই নয়। আমাদেরকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার আগে দেখ তুমি ও আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি প্রথমবারের মতো একটু হেসে বলল, স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি সাহায্য করেছেন। তারপরেই উপস্থিত সিকিউরিটির লোকদের শান্ত, নরম কণ্ঠে নির্দেশ দিলেন সাতজন সন্ত্রাসী মারা গেলেও প্রতিশোধের জন্যে ওদের সাথীরা সুযোগের সন্ধানে থাকতে পারে। সুতরাং হাসপাতালে উপযুক্ত সিকিউরিটি রাখবেন। এখানেও তার এই অযাচিত নির্দেশ সিকিউরিটিরা পা ঠুকে, স্যালুট দিয়ে সবকিছু অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছে। সত্যিই অস্বাভাবিক, অসাধারণ এই মানুষ। কে এই মানুষ রত্ন দ্বীপে? জাহরা বলল।
ডাক্তাররাও জিজ্ঞাসা করেছিলেন লোকটি সম্পর্কে। তারাও কিছু জানেন না। বলল ডেসপিনা।
একটু থেমেই ডেসপিনা আবার বলল, দেখি, বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। S ডেসপিনার টেলিফোন বেজে উঠল। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ডেসপিনা বলে উঠল, জাহরা বাবার টেলিফোন। এখনই জানতে পারব সব। বলে মোবাইলের লাউড স্পীকার অন করে দিল ডেসপিনা।
হ্যালো বাবা, বল কেমন আছ? ডেসপিনা কল রিসিভ করেই বলল।
কেমন আছ সেটা আগে বল মা। সবাই আমরা আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। বল মা, এখন তোমার শরীর কেমন? ওপার থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ত্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
ভালো বাবা। মাথাটা একটু ভারি। মাথা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। শুয়ে থাকতে কোনো সমস্যা নেই।
বাম কব্জির অবস্থাও ভালো বাবা। ডেসপিনা বলল।
আরেকটা মেয়ে আহত হয়েছিল, তার কি অবস্থা? বলল ওপার থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
ওর নাম জাহরা বাবা। আমার বন্ধু। ওর হাঁটুর নিচের মাসলে গুলি লেগেছে। সে এখন ভালো আছে বাবা। বলল ডেসপিনা।
মন্ত্রীসভার বৈঠক শেষ হলেই আমি আসব। শুনলাম, তোমার মা ও অন্যরা এদিক হয়ে যাওয়ার সময় আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবে।
মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই আবার বলল, শোন মা, একটা কথা বলছি। তোমাদের যিনি উদ্ধার করেছেন সন্ত্রাসীর হাত থেকে, তিনি বেসরকারিভাবে এই ঘটনাসহ আগের ঘটনাগুলোরও তদন্ত করবেন। প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রীসভা তাকে এ দায়িত্ব দিয়েছে। তোমাদেরকে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করবেন তিনি। তিনি যা জিজ্ঞাসা করবেন, যা জান বলবে। তার কোনো অসম্মান যেন না হয় দেখো। আমাদের গোয়েন্দা প্রধান আবু তাসফিন তাকে নিয়ে যাবেন।
অবশ্যই বাবা, আমরা তাকে সহযোগিতা করব। আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু একটা জিজ্ঞাসা বাবা, তিনি কে? বলল ডেসপিনা।
মা, উনি খুব বড় মানুষ! রত্ন দ্বীপের সৌভাগ্য যে, তাকে এই সময়ে আমরা রত্ন দ্বীপে পেয়েছি। আমেরিকা রাশিয়ার মতো দেশও তার সাহায্য পেলে ধন্য হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট, রাশিয়ার ম্রাজ্ঞীর মতো ব্যক্তিত্বরাও তাকে সম্মান করেন। ওর নাম আহমদ মুসা মা। তুমি চিনবে না। তিনি একজন মিরাকল মা। এখন রাখি মা। তোমার মাকে নিয়ে আমি এখনই আসছি।
ও.কে বাবা। এসো। বলল ডেসপিনা।
ও.কে। আসছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
ওপার থেকে কল অফ হয়ে গেল।
ডেসপিনাও কল অফ করে তাকাল জাহরার দিকে। জাহরা কিছু বলার জন্যে উসখুস করছে। ডেসপিনা বলল, বল জাহরা।
আমি একজন আহমদ মুসা সম্পর্কে কিছু জানি ডেসপিনা। জাহরা বলল।
জান? কোথায় বাড়ি? কি করেন? বলল ডেসপিনা।
অতটা জানি না। তার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে প্রচার খুব কমই হয়। ইন্টারনেট থেকে তার অ্যাকশন অ্যাকটিভিটি সম্পর্কে কিছু জেনেছি, আরও কিছু জেনেছি মদিনায় গিয়ে। মানুষের সংকট নিয়ে তার কাজ। এই সংকট সমাধানে তার পদধূলি পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন দেশে। তার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি একই সাথে রবিনহুড, হাতেমতাই, জেমসবন্ড, মহান মুসলিম সংস্কারক ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও জামালউদ্দিন আফগানির চরিত্র, চিন্তা ও কাজের অপূর্ব সমন্বয়। তার সম্পর্কিত ওয়েব সাইটগুলোতে গেলে তুমি বিস্তারিত অনেক কিছু জানতে পারবে।
কিন্তু সংবাদপত্রে এসব আসে না কেন? বলল ডেসপিনা।
অনেক সংকট অভ্যন্তরীণ ও সেনসেটিভ বলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তা প্রকাশ করে না। যেগুলো প্রকাশ হয়, প্রকাশ হতে পারে, সেখানে আহমদ মুসার শর্ত থাকে তার নাম, তার সংশ্লিষ্টতা তিনি প্রকাশ করতে দেবেন না। তিনি কাজ করেন নাম কিংবা কোনো লাভের জন্যে নয়। তার কাজ সংশ্লিষ্ট সেই দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর কাজ হিসাবে দেখানো হয়। জাহরা বলল।
তার কে আছে বলতে পার জাহরা? জিজ্ঞাসা ডেসপিনার।
স্যরি ডেসপিনা, তার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমি কোথাও কিছু পাইনি। জাহরা বলল।
আজই যা আমি দেখলাম। অস্ত্রধারী সাতজন সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে একা ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পরিবার-পরিজন থাকলে, কোনো পিছুটান থাকলে তার পক্ষে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়া কঠিন। বলল ডেসপিনা।
ডেসপিনার কথা শেষ হবার আগেই একজন ডাক্তার এবং একজন সিকিউরিটির লোক প্রবেশ করল। সিকিউরিটির লোকটি বলল ডেসপিনাকে লক্ষ্য করে, ম্যাডাম, প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিয়ে একজন লোক এসেছেন আপনাদের সাথে কথা বলতে। তিনিই আপনাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি কি এখন ভেতরে আসতে পারেন?
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডেসপিনা ও জাহরার। ডেসপিনা বলল, তাকে নিয়ে আসুন। আমরা জানি তিনি আসবেন।
স্যালুট দিয়ে সিকিউরিটির লোকটি চলে গেল। ডাক্তার রুমের অ্যাটেনড্যান্টকে ঘরটা একটু ঠিকঠাক করা এবং সোফাটাকে বেডের একটু কাছে নিয়ে আসার নির্দেশ দিল।
.
৩.
আহমদ মুসাকে বসিয়ে দিয়ে সিকিউরিটির লোকটা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। তার সাথে ডাক্তারও।
বেড থেকে উঠে বসে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল ডেসপিনা ও জাহরা। অসুস্থতার কথা জেনেও তাদের ডিস্টার্ব করতে আসার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে আহমদ মুসা।
কক্ষটি বেশ বড়।
কক্ষের দরজা পূর্ব দিকে। ঘরের মাঝখানে ডেসপিনার বেড, উত্তর দক্ষিণে লম্বা। তার মাথা দক্ষিণ দিকে। তার প্রায় পাশেই জাহরার বেড। তার বেড়ও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা, মাথা দক্ষিণে। তাদের পুব পাশে বেডের উত্তর প্রান্তের সমান্তরালে আহমদ মুসার বসার সোফা, দক্ষিণমুখী। ডেসপিনা ও জাহরার বেডের মাথার দিক উঁচু করা হয়েছে, যাতে তারা হেলান দিয়ে বসতে পারে কথা বলার জন্যে।
আহমদ মুসা সোফায় বসে আছে। ডেসপিনা ও জাহরা হেলান দিয়ে বসে আছে বেড়ে। তারা মুখোমুখি বসেছে।
আমি আগেই বলেছি কয়েকটা বিষয় তোমাদের কাছ থেকে আমার জানা দরকার। বলল আহমদ মুসা ডেসপিনা ও জাহরাকে।
আমরা আপনার পরিচয় জেনেছি জনাব আহমদ মুসা। আমরা গর্বিত আপনার দেখা পেয়ে। আপনার দেখা পাওয়া, আপনার সাথে কথা বলতে পারা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আবারও আমরা কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনাকে। আপনি আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন, সম্মান বাঁচিয়েছেন। বলুন স্যার, কি জানতে চান? ডেসপিনা বলল।
দেখ ডেসপিনা, জাহরা সামনাসামনি কোনো মানুষের প্রশংসা করা ঠিক নয়। এতে যে মানুষের প্রশংসা করা হয়, তার দুই ধরনের ক্ষতি হয়। এক, সে প্রশংসা কামনা করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, অবশেষে তার কাজের সে বিনিময়ও কামনা করতে শেখে। মানুষের জন্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার চেতনা তার মধ্য থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। দুই. প্রশংসা লাভ মানুষের। মনে অহংকারের অনুভূতি সৃষ্টি করে। শয়তান এই সুযোগ গ্রহণ করে। অহংকার তার আরও বৃদ্ধি পায়। স্রষ্টার নেয়ামত অস্বীকারের প্রবণতা তার মধ্যে বাড়তে থাকে। এভাবে তাঁর নৈতিক জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। বলল আহমদ মুসা নরম কণ্ঠে।
চোখ দুটি কিঞ্চিত নিচু রেখে কথা বলছিল আহমদ মুসা। আর ডেসপিনা ও জাহরা দুজন পলকহীন চোখে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়-বিমুগ্ধতা।
স্যার, আপনার কোনো যুক্তি অস্বীকার করার সাধ্য আমাদের নেই। তবে, একটা কথা স্যার, প্রশংসা আসলে কৃতজ্ঞতার বহিপ্রকাশ। এটা তো একজন উপকারীর প্রাপ্য। ডেসপিনা বলল।
প্রাপ্য হিসেবে ধন্যবাদই যথেষ্ট হতে পারে। আমাকে রক্ষা করেছেন, আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন- এ ধরনের বিবরণের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। জীবন বাঁচাতে পারেন শুধু মাত্র আল্লাহ। জীবন-মৃত্যু একমাত্র তাঁরই হাতে। বলল আহমদ মুসা।
স্যরি স্যার, একটা কথা। যে সূক্ষ্ম মানবতা বোধ, যে ধরনের স্রষ্টার উপর নির্ভরতা আপনার, তাতে তো মারামারির মধ্যে আপনার থাকার কথা। নয়? বলল ডেসপিনা।
ওটা মারামারি নয়। দুটি পক্ষের মধ্যে অন্যায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব যেখানে, সেটা মারামারি। কিন্তু আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, কল্যাণের জন্য যুদ্ধ বা সংগ্রাম, এটা মারামারি নয়। এই নিঃস্বার্থ কল্যাণের জন্য যুদ্ধকে মানুষের ধর্ম ইসলামের পরিভাষায় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বলা হয়। আজ কিডন্যাপারদের বিরুদ্ধে আমি যে প্রতিরোধ করেছি, সেটা আমার জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। কারণ এই প্রতিরোধ আমি নিঃস্বার্থভাবে করেছি, আল্লাহকে খুশি করার জন্যে করেছি, মানবতার জন্যে করেছি। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু স্যার, মুসলমানদের জিহাদ নিয়ে তো নানা কথা আছে। জিহাদ ও সন্ত্রাসকে এক করে দেখছেন অনেকেই। ডেসপিনা বলল।
এটা অজ্ঞতার ফল। কোথাও কোথাও বিদ্বেষ থেকেও এটা করা হচ্ছে। যারা এক সময় ধর্মকে আফিম বলত, তাদের মতো লোকরাই এখন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহকে সন্ত্রাস বলছে। এরা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ইতিহাসের মুসলিম রাজা বা শাসকদের রাজ্য ও রাজকোষ বৃদ্ধির যুদ্ধকে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। অথচ এ সব ব্যক্তি বা গ্রুপ স্বার্থের দ্বন্দ্বে যুদ্ধ করেছে বা করছে, এসব জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ নয়।
ধন্যবাদ স্যার। এসব মূল্যবান কথা শুনে আমরা উপকৃত হলাম, কিন্তু আপনার বেশ কিছু সময় নষ্ট হলো। এখন আপনার নির্দেশ বলুন স্যার। ডেসপিনাই বলল।
নির্দেশ? আমি কি করে তোমাদের নির্দেশ দিতে পারি? আমার অনুরোধ আছে তোমাদের কাছে। বলল আহমদ মুসা।
পারেন স্যার। আমরা হয়তো আপনার বোন হতে পারবো না, কারণ আপনার বোন হবার মতো যোগ্যতা আমাদের নেই। কিন্তু আমরা আপনার ছাত্র তো হতে পারি। ডেসপিনা বলল। তার কণ্ঠ আবেগ-জড়ানো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ইসলাম ধর্ম অনুসারে সবাই আমরা ভাই বোন। এখানে কোনো নতুন যোগ্যতার দরকার নেই। বলল আহমদ মুসা। * তবু মুসলিম হওয়া তো শর্ত। ডেসপিনা বলল।
এটা যদি মেনেও নিতে হয়, তাহলে বলব, তুমি তো মুসলিম। বলল, আহমদ মুসা।
বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ল ডেসপিনার চোখে-মুখে। বলল, জি এ কথা কেন বলছেন? আমি মুসলিম কেউ কি তা আপনাকে বলেছে?
তুমি বলেছ। বলল আহমদ মুসা।
আমি বলেছি? আপনাকে? ডেসপিনা বলল। তার চোখে-মুখে জমাট বিস্ময়।
সত্যিই তোমার কাছ থেকেই জেনেছি। কিডন্যাপারদের গাড়িতে জাহরা যখন আল্লাহকে ডাকছিল, তখন তুমিও আল্লাহকে স্মরণ করেছিলে। গুলি করে লক ভেঙে যখন আমি তোমাদের কিডন্যাপারদের গাড়ি থেকে নামাচ্ছিলাম, তখন গাড়ির মেঝে থেকে কয়েক পাতার একটা পকেট বুক তুলে নিয়ে তাতে চুমু খেয়ে পকেটে রেখে দিয়েছিলে। পকেট বইটার নাম ছিল গাইডেন্স টু ইবাদাহ। তোমার ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যে এ দুটি ঘটনাই আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। এত সূক্ষ্ম দৃষ্টি আপনার? প্রাণান্তকর উত্তেজনার মুহূর্তে এমন সুস্থ ও সূক্ষ্ম দৃষ্টি কি করে সম্ভব স্যার। ডেসপিনা বলল।
সম্ভব যদি তুমি উত্তপ্ত ও উত্তেজনাকর মুহূর্তে নিজেকে ঠাণ্ডা রাখতে পার, স্থির চিত্ত হতে পার। বলল আহমদ মুসা।
সমস্যা এটাই তো স্যার। আগুনের মতো উত্তপ্ত মুহূর্তে ঠাণ্ডা থাকা কি করে সম্ভব! স্থির চিত্ত হবো কি করে? বলল ডেসপিনা।
ভয় দূর করলেই ঠাণ্ডা থাকা, স্থিরচিত্ত হওয়া যাবে। ভয় দূর করার জন্যে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, জীবন-মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ। কোনো মানুষ যেমন জীবন দিতে পারে না, তেমনি মৃত্যুও আনতে পারে না, যদি মহান আল্লাহ তা না চান। আর যদি আল্লাহ চান, মৃত্যুর সময় যদি এসেই যায়, তাহলে তা রোধ করার ক্ষমতা পৃথিবীর কারো নেই। সুতরাং কাউকে, কোনো কিছুকে ভয় করার কোনো কারণ নেই। সব ব্যাপারে আল্লাহর উপর নির্ভর করলেই ভয়ের-ভার থেকে মুক্ত হওয়া যায়। বলল আহমদ মুসা।
গম্ভীর হয়ে উঠেছে ডেসপিনা এবং জাহরার মুখ। বলল ডেসপিনা, স্যার, যে দর্শনটা আপনি তুলে ধরলেন তা যতটা সত্য ততটাই ভারি। এই ভার সহ্য করার মতো ক্ষমতা থাকলেই তখন সত্যটা পাওয়া যাবে। এই ক্ষমতা পাওয়ার সাধ্য আমাদের মতো দুর্বলদের নেই স্যার।
গম্ভীর হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। নরম কিন্তু শক্ত উচ্চারণে বলল, দেখ মানুষ যখন নিজেকে ছোট ধরে নেয়, তখন আল্লাহ অখুশি হন। এটা মহান স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি অমূলক দোষ আরোপের শামিল। আল্লাহ মানুষকে সীমার মধ্যে অসীম সম্ভাবনা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। দেহ ও মন দুইই এই সম্ভাবনার আকর। এই সম্ভাবনার ব্যবহার না করে নিজেকে দুর্বল ভাবা অনুচিত।
মুহূর্তের জন্যে থামল আহমদ মুসা। তারপরেই বলল, এসো আমার আসল কথায় আসি। আমার…
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। কক্ষের বাইরে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলো। কক্ষের দরজা বন্ধ।
আহমদ মুসা দরজার দিকে একবার তাকিয়েই বলে উঠল দ্রুত কণ্ঠে, ডেসপিনা, জাহরা তোমরা বেড় থেকে নেমে দ্রুত মেঝেয় চলে যাও। কুইক।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতে পারল না। ঝড়ের বেগে এক ঝটকায় দরজা খুলে গেল। কথা বলার সাথে সাথেই আহমদ মুসা সোফার পশ্চিম পাশে গড়িয়ে পড়ল। জ্যাকেটের পকেটের এম-১০ মেশিন রিভলবারের নতুন ভার্সন এম-১৬ বের করতে যাচ্ছিল। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করে বের করে নিল স্মোক বোম। মেঝেতে পড়েই সে বোমটি ছুঁড়ল দরজা লক্ষ্যে। র দরজার দিক থেকে প্রায় একই সাথে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলো। শব্দের সাথে সাথে স্মোক বোমের বিস্ফোরণও ঘটে গেল।
স্মোক বোম ছোঁড়ার পরই সোফার আড়াল নিয়ে আহমদ মুসা দরজা লক্ষ্যে এম-১৬-এর গুলি বর্ষণ শুরু করেছিল। ওপারের গুলি ছোঁড়া বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আহমদ মুসা এম-১৬-এর ট্রিগার থেকে তার তর্জনি আলগা করল না। রিভলবারের নল সে অব্যাহতভাবে ঘুরিয়ে নিল দরজা এবং দরজা সংলগ্ন গোটা এলাকা দিয়ে।
সাদা ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল গোটা ঘর।
তিরিশ, পঁয়ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে দরজার দিক থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
গুলি বন্ধ করে আহমদ মুসা স্থান চেঞ্জ করে আরও একটু উত্তর দিকে সরে গেল তার সোফা ও বেডের দিক থেকে। আক্রমণকারীরা সব মরে গেছে, কিংবা গুলি বন্ধ করে সুযোগের অপেক্ষা করছে কিনা, তার একটা টেস্ট হওয়া দরকার।
আহমদ মুসা শুয়ে থেকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ডেসপিনা তোমরা ঠিক আছ কিনা? মেঝেতে শুয়ে থেকেই জবাব দেবে এক শব্দে।
ইয়েস। ডেসপিনাদের দিক থেকে ভেসে এলো শব্দটি।
কিন্তু শত্রুদের তরফ থেকে গুলি এলো না।
আহমাদ মুসা নিশ্চিত হলো, ওরা বেঁচে নেই কিংবা সরে গেছে। কিংবা হতে পারে ওরা নিজেদের প্রকাশ না করে কাছ থেকে আক্রমণের সুযোগ নেবার জন্যে এদিকে এগিয়ে আসছে।
আহমদ মুসা সোফা ও বেডের সামনে থেকে এগোবার সিদ্ধান্ত নিল। হাতের রিস্টওয়াচের ডিটেক্টর অপশন অন করে সোফা ও বেডের সামনে বরাবর জায়গার দিকে এগোতে লাগল।
রিস্ট ওয়াচের বিশেষ ডিটেক্টরটি জীবন্ত ও ধাতব কোনো কিছু লোকেশন ও দূরত্ব ডিকেক্ট করতে পারে ৩০ ফুট পর্যন্ত। জীবন্ত কোনো কিছুর ক্ষেত্রে লাল রং এবং ধাতব বস্তুর ক্ষেত্রে বেগুনি রং ইন্ডিকেট করে।
এগোচ্ছে আহমদ মুসা সোফা ও ডেসপিনাদের বেডের সামনে বরাবর। সে তার রিস্টওয়াচ স্ক্রিনে দেখতে পেল কক্ষের বিভিন্ন জায়গায় ৫টি লাল ডট। একটি সে নিজে, তার সামনে কক্ষের মধ্য পশ্চিম অংশের দুই রেড ডট ডেসপিনা ও জাহরাকে ইন্ডিকেট করছে। আর ঘরের মধ্য পূর্ব অংশে তিনটি রেড ডট নিশ্চয় হবে আক্রমণকারীদের। আহমদ মুসা থমকে গেল। আগে দেখতে হবে ওরা এগোচ্ছে, না স্থির হয়ে বসে সুযোগের অপেক্ষা করছে। পল পল করে বয়ে গেল পঁচিশ তিরিশ সেকেন্ড। হ্যাঁ, তিনটি রেড ডটই এগোচ্ছে।
আহমদ মুসা তখন সোফার সামনে বরাবর এসে গেছে। ডেসপিনাদের বেড় আরও একটু সামনে। এখান থেকেই ওদের একটু অবজার্ভ করার। সিদ্ধান্ত নিল।
হঠাৎ আহমদ মুসা দেখল, এগিয়ে আসা তিনটি রেড ডটের সামনে তিনটি বেগুনি ড্যাশ ফুটে উঠেছে এবং তিনটি ড্যাশ একসাথেই তার দিকে এঁকেবেঁকে এগোচ্ছে। চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার মানে ওদের তিনজনের হাতের স্টেনগান তাকেই টার্গেট করেছে। কিভাবে? কেন? তাহলে ওদের কাছেও কি ডিটেক্টরের মতো কিছু আছে? না থাকলে তাকে লোকেট করল কেমন করে? কিন্তু ওরা ডেসপিনাদের টার্গেট করেনি কেন? তাহলে ওদের ডিটেক্টর কি কম শক্তিশালী? হতে পারে। আহমদ মুসার সাথে ওদের যে দূরত্ব, তার চেয়ে ডাবল হবে ডেসপিনাদের দূরত্ব, যদি তারা মেঝেয় নেমে ঘরের পশ্চিম পাশে সরে গিয়ে থাকে। এই কারণেই শত্রুদের ডিটেক্টরে ডেসপিনারা এখনও ধরা পড়েনি।
আহমদ মুসা তার মেশিন রিভলবার এম-১৬ পকেট থেকে হাতে তুলে নিল। শত্রুদের বেগুনি ড্যাশ মানে স্টেনগান বেঁকে এসে আহমদ মুসাকে তাক করে স্থির হয়ে গেল। এখনি ওদের তিনটি স্টেনগান একসাথে গর্জে উঠতে পারে।
আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনি রেখে চোখের পলকে গড়িয়ে কয়েক গজ সামনে বেডের কাছে এগিয়ে গেল। এই কারণে তিনটি স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার থেকে রক্ষা পেল আহমদ মুসা। সরে যেতে আর মুহূর্তকাল দেরি করলেই তিনটি স্টেনগানের মিলিত ব্রাশ ফায়ারের গ্রাসে পড়ত আহমদ মুসা।
গড়িয়ে আহমদ মুসার দেহস্থির হবার আগেই তার হাতের এম-১৬ গুলি বৃষ্টি শুরু করেছে। স্থির হয়েও গুলিবৃষ্টি অব্যাহত রাখল আহমদ মুসা।
ওপারের গুলিবৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনটি রেড মুছে গেল স্ক্রিন থেকে। তার মানে ওরা তিনজন গুলিবৃষ্টির গ্রাসে শেষ হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা উঠে বসল।
ঘরের এদিকে ধোঁয়া তখন হালকা হয়ে গেছে।
তাকাল ডেসপিনাদের দিকে। তারা মাথা গুঁজে শুয়ে আছে ঘরের পশ্চিম দেয়াল ঘেঁষে।
ডেসপিনা, জাহরা তোমরা এখন উঠে বসতে পার। বলল আহমদ মুসা।
___ উঠে বসল দুজন। বিধ্বস্ত ওদের চেহারা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল বাইরে বেরুবার জন্যে।
ঘরের ভিতরের সফেদ রঙের গাঢ় ধোঁয়াও এখন ফিকে হয়ে গেছে। চার দিক এখন স্বচ্ছ হয়ে উঠছে।
কক্ষের বাইরে স্টেট সিকিউরিটির চারজনের লাশ পড়ে আছে। অল্পক্ষণের মধ্যে খবর পেয়ে রত্ন দ্বীপের সিকিউরিটি ফোর্সের প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ আমেদিও এসে পড়ল। খবর পেয়ে দ্রুত ফিরে। এসেছে গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস ও তার স্ত্রীও এসে হাজির তাদের মেয়ে ডেসপিনাকে দেখতে। স্টেট সিকিউরিটি হাসপাতালের লনে হাসপাতালের লোকসহ বিভিন্ন ধরনের মানুষের প্রচণ্ড ভিড়।
কর্নেল রিদা আহমদ আমেদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার স্ত্রী প্রায় একসাথে এসে পৌঁছে। তাদের পরে পরেই আসে গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন।
তখন ঘরের মধ্যে প্রচণ্ড গুলাগুলির শব্দ হচ্ছে। কালচে সাদা ধোঁয়ায় ঘর ভর্তি। কে কাকে গুলি করছে বুঝার উপায় নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তার স্ত্রী, কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ, গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন সকলেই বিমূঢ়, হতবিহ্বল। উদ্বেগ-উত্তেজনা তাদের চরমে। হাসপাতালের এই কক্ষেই আছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের মেয়ে ডেসপিনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটি ছাত্রী জাহারা এবং আহমদ মুসা।
রিদা আহমদের প্রশ্নের জবাবে একজন নার্স বলল, প্রায় সাত আটজন লোক আসে ডাক্তারের পোষাকে। আকস্মিকভাবে অ্যাপ্রনের ভেতর থেকে স্টেনগান বের করে তারা একসাথে গুলি করে সিকিউরিটির লোকদের। সিকিউরিটির লোকরা অস্ত্র তোলারও সুযোগ পায়নি। সিকিউরিটির লোকদের গুলি করেই তারা ম্যাডাম ডেসপিনার কক্ষের দিকে এগোেয়। লাথি মেরে তারা খুলে ফেলে দরজা। এই সময় কক্ষের ভেতরে বোমা ফাটার মতো একটা আওয়াজ হয় এবং সংগে সংগেই ব্রাশ ফায়ার শুরু হয়ে গেল। তখন দেখা যায় ধোঁয়ায় ঘর ভর্তি।
অস্ত্রধারীদের হাতে কি কি অস্ত্র ছিল? নার্সকে জিজ্ঞাসা করল কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ।
ওরা সবাই অ্যাপ্রনের আড়াল থেকে স্টেনগান বের করেছিল। আর কোনো অস্ত্র দেখিনি। নার্সটি বলল।
এ সময় হঠাৎ কক্ষের ভেতরের গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল।
কক্ষের ভেতর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল কেন? সব কি শেষ? সন্ত্রাসীরা কি এখনই বেরিয়ে আসবে? ওদের পাকড়াও করার ব্যবস্থা কর। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার কণ্ঠ আর্তচিৎকারের মতো শুনালো।
তার স্ত্রী লুটিয়ে পড়েছে করিডোরের উপর। সে যেন কাঁদতেও ভুলে গেছে।
ওসমান আবু তাসফিন কয়েক পা এগিয়ে দরজায় উঁকি দিল। ঘরে জমাট ধোঁয়ার কুণ্ডলি বেরুতে পারছে না। দরজা দিয়ে কতটুকু আর বেরুবে।
গুলি থামলেও সন্ত্রাসীরা বেরিয়ে এলো না।
ঘরে ঢোকা যায় কিনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
ধোঁয়া না সরলে বা কেন গোলা-গুলি বন্ধ হলো না জানলে ঘরে ঢোকা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। অন্যদিকে ধোঁয়ার অন্ধকারে ঢুকে কোনো কিছুই করা যাবে না। বলল গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ বলল, স্যার, দুই ধরনের গোলাগুলির শব্দ শোনা গেল। স্টেনগানের শব্দ, তার পাশে মেশিন রিভলবারের শব্দ।
স্টেনগান ব্যবহার করেছে সন্ত্রাসীরা, মেশিন রিভলবার তাহলে ব্যবহার করেছে জনাব আহমদ মুসা। আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় স্যার, স্টেনগানের শব্দ আগে বন্ধ হয়েছে, তার কিছুক্ষণ পরে বন্ধ হয়েছে মেশিন রিভলবারের শব্দ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, আহমদ মুসাই সন্ত্রাসীদের উপর ডমিনেট করছে! এ ঘটনাতেও কি তা বলা যায়?
তা বলা যায় না স্যার। কিন্তু এটুকু তো বলা যায় যে, শত্রুকে আক্রমণের পর্যায়ে আহমদ মুসা আছেন এখনও। আর স্যার, তিনি শত্রুর মোকাবেলায় থাকার অর্থ তিনি ম্যাডামদের নিরাপদে রাখবেন। বলল রিদা আহমদ আমেদি।
আহমদ মুসার উপর ভরসা আমাদের আছে। ঈশ্বর তোমার কথা সত্য করুন। আহমদ মুসাকে সাহায্য করুন ঈশ্বর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
কক্ষের ভেতর গোলাগুলি আবার শুরু হয়ে গেল।
নতুন করে উৎকণ্ঠা-উদ্বেগের ঝড় বয়ে গেল কক্ষের বাইরে করিডোরে উপস্থিত সকলের উপর দিয়ে। সবাই অ্যাটেনশন দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কোনো কথা নেই।
ভেতরে কি হচ্ছে রিদা! আবার গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার কণ্ঠ শুষ্ক ও কম্পিত।
রিদা আহমদ কিংবা ওসমান আবু তাসফিন কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। মিনিটখানেকের মধ্যেই গোলাগুলির শব্দ থেমে গেল।
স্যার দেখুন, এবারও স্টেনগান থেকেই গুলি শুরু হয়েছিল। এবারও স্টেনগানের গুলি থেমে যাবার পর প্রায় ১০ সেকেন্টের মতো মেশিন রিভলবারের গুলি চলেছে। বলল রিদা আহমদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গোয়েন্দা প্রধানকে উদ্দেশ্য করে।
হ্যাঁ রিদা, তুমি ঠিক বলেছ। বিষয়টা আমিও লক্ষ্য করেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল। এ
রিদা আহমদ, চল এবার ঘরে ঢুকতে হবে। ধোঁয়া কেটে যাচ্ছে। দরজায় দেখ এখন আর ধোঁয়া নেই। বলল গোয়েন্দা প্রধান।
চলুন স্যার। বলে চলতে শুরু করল কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ। তার সাথে সিকিউরিটি ফোর্সের কয়েকজন অফিসার। তাদের হাতের স্টেনগান উদ্যত।
স্যার, দেখি আগে ঘরের কি অবস্থা। আপনি একটু দাঁড়ান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলল গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন।
ওসমান আবু তাসফিন ও রিদা আহমদরা দরজার দিকে পা বাড়াতেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো আহমদ মুসা। তার হাতে তখনও রিভলবার। বলল সে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্য সবাইকে লক্ষ্য করে, আসুন আপনারা, লাশগুলোর ব্যবস্থা করুন। ডেসপিনারা ভালো আছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার স্ত্রী ছুটে এসে কক্ষে ঢুকে গেল।
গোয়েন্দা প্রধান ও রিদা আহমদরা তাদের পেছনে যাচ্ছিল। আহমদ মুসার পাশে গিয়ে তারা থমকে দাঁড়াল। বলল গোয়েন্দা প্রধান আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, স্যার চলুন।
আহমদ মুসাও থমকে দাঁড়িয়েছিল।
বলল গোয়েন্দা প্রধানকে, স্টেট সিকিউরিটি ফোর্সের হাসপাতালের প্রধান বা বড় দায়িত্বশীল কি এখানে এসেছেন?
না, তেমন কাউকে আমি দেখিনি। কেন স্যার? গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন বলল।
হাসপাতালটিতে ঢোকা ও বের হবার মোট গেট কয়টা? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
দুটি। একটি ঢোকার, আরেকটি বের হবার। বলল গোয়েন্দা প্রধান।
কোনো গোপন গেট নেই? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
আছে স্যার, একটি। বলল গোয়েন্দা প্রধান।
এই মুহূর্তে সমস্ত গেট বন্ধ করে দিতে হবে। আপাতত ডাক্তার, নার্স, রোগী এবং অন্য কেউ হাসপাতালে ঢুকতেও পারবে না, বের হতেও পারবে না। আহমদ মুসা বলল।
রত্ন দ্বীপের সিকিউরিটি ফোর্সের প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সে এগিয়ে এলো। বলল, স্যার আমাদের ভুল হয়েছে। এই কাজ আরও আগে আমাদের করা উচিত ছিল। _ কথা শেষ করেই সে তাকাল গোয়েন্দা প্রধানের দিকে। বলল, স্যার, তাহলে আমি ওদিকটা দেখি। সব গেট বন্ধ করার ব্যবস্থা করে আমি আসছি।
বলে কর্নেল জেনারেল রিদা আহমাদ ছুটল বাইরে বেরুবার জন্যে।
স্যরি স্যার, আমাদের বড় ভুল হয়ে গেছে। কক্ষের ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, এই চিন্তা মাথায় আসেনি। বলল ওসমান আবু তাসফিন।
ঠিক আছে মি. ওসমান। এখানকার সবকিছু বাইরে জানাজানি হয়নি। সুতরাং সময় পার হয়ে যায়নি বলে আমি মনে করি। ওদিক এখন মি. রিদা। আহমদ দেখবেন। চলুন লাশগুলো পরীক্ষা করতে হবে।
বলে আহমদ মুসা কক্ষে ঢোকার জন্যে পা বাড়াল। তার সাথে ওসমান আবু তাসফিনও।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকতেই ছুটে এলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস। পাগলের মতো জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলতে লাগল, আপনি অসাধ্য সাধন করেছেন আহমদ মুসা। সন্ত্রাসী সাতজনকে মেরেছেন, রক্ষা করেছেন আমাদের দুই মেয়েকে আবার।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে গেল দুই বেডের কাছে। বেডের অবস্থা দেখিয়ে বলল, দেখুন কিভাবে বেড দুটি স্টেনগানের গুলিতে এফোঁড়-ওফোড় হয়ে গেছে। সেই সাংঘাতিক মুহূর্তে যদি আপনি মেয়ে দুটিকে বেড থেকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়তে না বলতেন, তাহলে ওরা ঝাঁঝরা হয়ে যেতে স্টেনগানের গুলিতে।
মি, কনস্টানটিনোস আজ কিন্তু আমিই ওদের প্রথম টার্গেট ছিলাম।
বলে আহমদ মুসা তার বসে থাকা সোফা দেখিয়ে বলল, আমি ঐ সোফায় বসে ছিলাম। দেখুন, সোফার স্টিলের ফ্রেম শুধু আছে আর কিছু নেই।
তাইতো! সাংঘাতিক ব্যাপার। মনে হচ্ছে স্টেনগানের গোটা ম্যাগজিন এখানে শেষ করেছে। কিন্তু আপনাকে প্রথম টার্গেট করল কেন? বলল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কনস্টানটিনোস।
ওদের দুই শিকার আমি কেড়ে নিয়েছি। তার উপর ওদের সাতজন আমার হাতে মারা পড়েছে। প্রতিশোধ নেবার জন্যেই আজ ওরা এসেছিল। প্রথমে তারা হাসপাতালে ভর্তি মেয়ে দুটিকে টার্গেট করে। পরে জানতে পারে আমি এখানে আসছি ওদের সাথে দেখা করতে। তখন তারা একসাথে তিন পাখি মারার সিদ্ধান্ত নেয়। আহমদ মুসা বলল।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, ওদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন।
বলে আহমদ মুসা এগোলো লাশগুলোর দিকে। সাতটি লাশের প্রত্যেকটির পকেট, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, এমনকি চুলও নেড়ে-চেড়ে দেখল। তার পাশেই দাঁড়িয়েছিল গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন।
আহমদ মুসা সার্চ শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিনকে বলল, মি. ওসমান তাসফিন, এবারও ওরা সংখ্যায় সাতজন। সাতজনের উল্কিতে এবারও সেই প্রাচীন ও মধ্যযুগের পালতোলা জাহাজের। সিম্বল। কিন্তু এবার ওদের নাম নেই। নামের বদলে আছে উল্কির নিচে একটা করে আরবি হরফ। হরফগুলো যদি ওদের নামের আদ্যাক্ষর হয়, তাহলে আগের সেই সাত নামই এদের সাতজনের।
এদেরও সেই একই নাম হবে কেন স্যার? বলল গোয়েন্দা প্রধান।
নামগুলো আসলে ওদের নাম নয়। নামগুলোও সিম্বল। এই সাত নামই ট্রেজার আইল্যান্ডের অভিযানে বিজয়ী হয়েছিল। আমার মনে হয় এরাও বিজয় না আসা পর্যন্ত এই সাত নামে অভিযান চালানো অব্যাহত রাখবে। আহমদ মুসা বলল।
মি. আহমদ মুসা, আপনার কাছ থেকে শোনার পর ইন্টারনেটে ট্রেজার আইল্যান্ডের কাহিনীর আউটলাইন পড়লাম। ঐ সাতজন তো ট্রেজার আইল্যান্ডে দ্বীপ জয় করতে যায়নি, গিয়েছিল ট্রেজার আইল্যান্ডের ধন ভাণ্ডার জয় করতে। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
এদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি তা আমরা জানি না মি. কনস্টানটিনোস। এর আগে আমি বলেছি, এরা কোনো একটা বড় লাভের জন্যে এসেছে। সেই লক্ষ্য তারা সামনে আনেনি। এখন তারা একটা উপলক্ষ কাজে লাগিয়ে বড় লাভের পথ পরিষ্কার করতে চায়। আহমদ মুসা বলল।
কক্ষে দ্রুত প্রবেশ করল কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ। আহমদ মুসার সামনে ছুটে এসে বলল, স্যার, আপনি যেভাবে বলেছিলেন, তিনটি গেটই সেভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের কথা ছড়িয়ে পড়ার পর দুজন ডাক্তার পেছন, গেট দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যখন দেখল যে পালানো যাবে না, তখন তারা জীবন দিয়েছে পটাশিয়াম সাইনাইড খেয়ে। থামল কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ।
ওদের কি সার্চ করা হয়েছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
না স্যার, এখনও সার্চ করা হয়নি। ঘটনার পরই আমি চলে এসেছি। বলল কর্নেল্ল জেনারেল রিদা আহমদ।
চলুন গিয়ে দেখি, ওরা ভেতরের না বাইরের লোক। ডাক্তার, না, ছদ্মবেশী। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিনকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি এখানেই থাকুন, মিনিস্টার সাহেব আছেন।
ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। বলল, হোম মিনিস্টার মি, কনস্টানটিনোস, ডেসপিনাদের সাথে আমার কথা শেষ হয়নি। আমি এখনি আসছি।
এরা অন্যকক্ষে যাচ্ছে। আপনি আসুন আহমদ মুসা। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
ধন্যবাদ! বলে আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কি ব্যাপার ক্রিস, লোকটি দেখছি তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করছে, ইকুম দিচ্ছে, গাইড করছে! বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের স্ত্রী লিসা ক্রিস্টিনা।
কি বলছ মা, উনি তো আহমদ মুসা। আজ দুবার তিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়েছেন। বলল ডেসপিনা।
আমি খারাপ অর্থে বলিনি মা। তার প্রতি আমার অফুরান শ্রদ্ধা আছে। তিনি শুধু তোমাদের বাঁচাননি, তিনিও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। উনি তো বলছেন, তিনিই ছিলেন প্রধান টার্গেট। সত্যি দেখ, যে সোফায় তিনি বসেছিলেন, সে সোফার কি ত বস্থা। আমি যে কথাটা বলছি, সেটা হলো, বিদেশি হয়েও পরিস্থিতির ৫ টা নিয়ন্ত্রণ তিনি হাতে নিয়েছেন। আমরা পারিনি বলেই তাকে দায়িত্বটা নিতে হয়েছে। এই বিষয়টার দিকেই আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ডেসপিনার মা বলল।
লিসা ক্রিসিনা তুমি ঠিক ধরেছ, ঠিক বলেছ। আজ ভোর থেকে অল্প দ্বীপে যে তিনটি ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে, সে ধরনের ঘটনা আমাদের রত্ন দ্বীপে কখনও ঘটেনি। এ ধরনের ঘটনা সফলভাবে মোকাবেলার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। এই কারণেই আহমদ মুসা স্বত:স্ফূর্তভাবেই যা করণীয় তা করছেন। এই দুর্দিনে ঈশ্বর তাকে পাঠিয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন। তিনি যে বিস্ময়করভাবে কিডন্যাপারদের হাত থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেন, যেভাবে আকস্মিকভাবে সাতজন অস্ত্রধারীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েও নিজেকে রক্ষা করেছেন, দুই মেয়েকে রক্ষা করেছেন, শুধু নয় ওদের সাতজনকেই হত্যা করেছেন। স্বীকার করতেই হবে এমনটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। এমন ট্রেনিং আমাদের লোকদের নেই। প্রয়োজনও আমরা মনে করিনি কখনও। এই অবস্থায় অদৃশ্য শত্রুদের মোকাবেলার দায়িত্ব আমরা আহমদ মুসার উপর সব ছেড়ে দিয়েছি। এই কাজে তিনি আমাদের পরিচালনা করবেন এবং তিনি সেটাই করছেন লিসা ক্রিস্টিনা। আরেকটা কথা বিবেচনা কর লিসা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেখানে তার সাহায্য নেন, রুশ সম্রাজ্ঞী যেখানে তার সাহায্য কামনা করেন, সেখানে আমাদের তো তাকে স্বর্গের দেবদূত ভাবতে হবে।
থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস। ডেসপিনার মা লিসা ক্রিস্টিনার চোখ-মুখ বিস্ময়ে ভরে গেছে। বলল, তাকে দেবদূত বলছ কেন? তিনি দেবদূতদের চেয়ে বড়। দেবদূতদের মৃত্যুভয় থাকে না। কিন্তু তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মেয়ে দুটিকে উদ্ধার করেছিলেন, আবার এখানে মৃত্যুকে মাথায় নিয়ে লড়াই করে নিজেকে এবং মেয়ে দুটিকে রক্ষা করেছেন। তিনি জয়ী হয়েছেন, কিন্তু মরেও যেতে পারতেন। কিন্তু দেখলাম সে চিন্তা তার মাথায় নেই। তার দৃষ্টি যেন শুধুই সামনে, পেছনে তাকাচ্ছেন না তিনি।
একটু থামল লিসা ক্রিস্টিনা। আবার বলল, কিন্তু তিনি হঠাৎ রত্ন দ্বীপে কিভাবে এলেন?
আমি ঠিক জানি না। উনি প্রেসিডেন্টের মেহমান। আহমদ মুসা রত্ন দ্বীপে কয়েকদিন অবসর যাপন করবেন, একথা সৌদি সরকার আমাদের প্রেসিডেন্টকে জানায়। প্রেসিডেন্ট তখনি তার আতিথ্য অফার করেন। তিনি রত্ন দ্বীপে আসেন আর্মেনিয়া থেকে, আর্মেনিয়ার বিশেষ এক বিমানে। অন্যদিকে তার পরিবার রত্ন দ্বীপে আসেন সৌদিয়ার এক বিশেষ বিমানে আমেরিকা থেকে।
বিশেষ বিমানে? বলল লিসা ক্রিস্টিনা। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
হ্যাঁ, বিশেষ বিমানে। আমি প্রেসিডেন্টের কাছে শুনেছি, সৌদি আরবসহ মুসলিম সরকারগুলো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো বড় দেশ ও বিমান সংস্থাগুলো ভিভিআইপির মর্যাদা দেয় তাকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
এ ধরনের মানুষের জীবনের মূল্য অনেক। অথচ দেখ, রত্ন দ্বীপের দুজন মেয়েকে বাঁচাতে, রত্ন দ্বীপের একটা সমস্যা দূর করতে তিনি সেই জীবনকেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন! তিনি ভিভিআইপি হলেও অন্য ভিভিআইপির মতো নন। তিনি খুবই অসাধারণ। বলল লিসা ক্রিস্টিনা।
অল্প সময়ে তুমি তার ভক্ত হয়ে গেলে দেখছি। যাক, তুমি ঠিক বলেছ, তিন সত্যিই অসাধারণ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
তিনি পরিবারসহ কোথায় থাকছেন? স্টেট গেস্ট হাউসে? জিজ্ঞাসা লিসা ক্রিস্টিনার।
হ্যাঁ, স্টেট গেস্ট হাউজে। যে স্টেট গেস্ট হাউজটি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সাথে অ্যাটাক্ট সেই স্টেট গেস্ট হাউজে। কিন্তু তার পরিবার চলে গেছে আজ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস বলল।
পরিবার চলে গেছে, উনি যাননি? বলল লিসা ক্রিস্টিনা।
সকালের ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট তাকে কয়েকদিন থেকে যাবার। অনুরোধ করেছিলেন। প্রেসিডেন্টের অনুরোধ তিনি রেখেছেন, কিন্তু পরিবার। পাঠিয়ে দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
ধন্যবাদ আহমদ মুসাকে। দুই লাখ লোকের ছোট্ট রত্ন দ্বীপের কথা তিনি শুনেছেন, গুরুত্ব দিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ তাকে। বলল লিসা ক্রিস্টিনা। তার মুখ গম্ভীর। কণ্ঠ আবেগে ভারি।
হাসপাতালের কর্মকর্তাদের একজন কক্ষে প্রবেশ করল। বিনীত কণ্ঠে বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে, স্যার, ম্যাডামদের কক্ষ রেডি। আমরা নিয়ে যেতে চাই।
দুটি ক্যারিয়ার ট্রলিও ঘরে প্রবেশ করেছে।
দুমিনিটের মধ্যেই তিন তলার ভিভিআইপি কক্ষে ডেসপিনাদের ট্রান্সফার করা হলো। এ কক্ষটি আরও বড়।
সামান্য স্পেস দিয়ে ডেসপিনা ও জাহরার বেডকে পাশাপাশি রাখা হয়েছে। বেড় দুটির দুপাশে চারটি করে সোফা রাখা হয়েছে। কক্ষটি ছাড়াও একটা গেস্টরুম এর সাথে অ্যাটাস্ট রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার স্ত্রী পাশাপাশি সোফায় বসে ডেসপিনাদের কাছে। শুনছে তাদের উদ্ধার ও তাদের কক্ষে লড়াইয়ের কাহিনী।
গোয়েন্দা প্রধান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে একটু বাইরে গিয়েছিল।
গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিন ও কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ মুসাকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস উঠে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসাকে তার পাশের সোফায় বসাল। বলল, সার্চ করে কিছু পাওয়া গেল জনাব আহমদ মুসা।
দুজন ডাক্তারই নকল। সন্ত্রাসী দলের সদস্য ছিল তারা। তাদের কাঁধে উল্কি আঁকা ছিল। কিন্তু তাদের নাম বা নামের আদ্যাক্ষর উল্কীর্ণ ছিল না।
একটু থামল আহমদ মুসা এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, আচ্ছা মি. ক্রিস কনস্টানটিনোস হোয়াইট বিয়ার ও থ্রি স্টার ব্রান্ডের গার্মেন্টস কি রত্ন দ্বীপে উৎপাদিত বা বাজারজাত হয়?
না মি. আহমদ মুসা, কোনো কাপড়ই রত্ন দ্বীপে উৎপাদিত হয় না। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এই দুই ব্রান্ডের কাপড় কোন দেশ থেকে ইম্পোর্ট করে কি রত্ন দ্বীপ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
না মি. আহমদ মুসা, এই দুই ব্রান্ডের কোনো কাপড়ই ইম্পোর্ট হয় না রত্ন দ্বীপে। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
ইম্পোর্ট হয় না, এই দুই ব্রান্ডের কাপড় কি কোনওভাবে রত্ন দ্বীপে আসে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। ইম্পোর্ট হয় না, এমন পণ্যদ্রব্য রত্ন দ্বীপে পাওয়া যায় না। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আহমদ মুসা কিছু দূরে বসা গোয়েন্দা প্রধান ওসমান আবু তাসফিনের দিকে তাকাল। বলল, মি. ওসমান, আপনি খেয়াল করেছেন আগে যে সাতজন নিহত হয়েছে, এখানে যারা নিহত হলো, তাদের চুল কাটার ধরন মোটামুটি একই রকম।
ঠিক স্যার, একই রকম বলা যায়। বলল ওসমান তাসফিন।
এবং আমি এ কয়দিনে যতটা লক্ষ্য করেছি, রত্ন দ্বীপের কারও এ ধরনের চুল কাটা দেখিনি। আহমদ মুসা বলল।
একেবারে ঠিক স্যার। ওসমান তাসফিন বলল।
এসব দ্বারা মি. আহমদ মুসা কি বুঝাতে চাচ্ছেন? ওসমান তাসফিনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে বলে উঠল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
নিহত এ ষোলজন সন্ত্রাসী কেউই আমার মনে হচ্ছে রত্ন দ্বীপের নয়। বলল আহমদ মুসা।
রত্ন দ্বীপের নয়? তার মানে বাইরের। কিন্তু বাইরের কে আসবে, কেন আসবে এই শক্রতার জন্যে? অবিশ্বাস্য লাগছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ আমরা জানি না বলে মনে হয়।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, মিস ডেসপিনাদের কাছ থেকে আমি কিছু জানতে চেয়েছিলাম। তাদের সাথে কথা আমার শেষ হয়নি।
ঠিক আছে কথা বলুন। ভালো আছে ওরা, কোনো অসুবিধা নেই। আমরা কি বাইরে যাব? বলল ডেসপিনার মা লিসা ক্রিস্টিনা।
না না, আপনারা থাকলে অসুবিধা নেই। বলল আহমদ মুসা।
ডেসপিনা ও জাহরার বেডের সামনের দিকটা একটু উঁচু করে দেয়া হয়েছিল। তারা দুজনেই উঠে হেলান দিয়ে বসেছে। মাথার নীচে বালিশ দিয়ে আরো আরামদায়ক করা হয়েছে বসাটাকে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ডেসপিনা বলল, বলুন স্যার, তখন তো আপনি কথা শুরু করার মুহূর্তেই ঘটনাটা ঘটে গেল।
জাহরা বলল, আমাদেরও কিছু প্রশ্ন আছে স্যার।
ঠিক আছে। আচ্ছা তোমরা কিডন্যাপ হবার পর বেশ কিছু পথ ওদের গাড়িতে ছিলে। ওরা নিশ্চয় পরস্পর কথা বলেছে। ওদের এমন কোনো কথা কি তোমরা শুনেছ যা তোমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে? বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে কথা বলল না ওরা। ভাবছে দুজনেই। প্রথমে ডেসপিনাই বলল, স্যার আমরা খুব টেনশনে ছিলাম। চিৎকার, কান্নাকাটি করছিলাম। ওদের কথা শুনবার মতো অবস্থায় আমরা ছিলাম না। কিছুই তেমন মনে পড়ছে না স্যার।
আচ্ছা, ওরা ঐ সময়ের মধ্যে টেলিফোনে কারও সাথে কথা বলেছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হ্যাঁ স্যার, টেলিফোনে কথা বলেছিল। ডেসপিনা বলল।
টেলিফোন এসেছিল, না ওরা টেলিফোন করেছিল? বলল আহমদ মুসা।
ডেসপিনা কোনও কথা বলল না। ভাবছিল। জাহরাই জবাব দিল। বলল, টেলিফোনের রিং বাজতে শুনেছি স্যার, তার মানে টেলিফোন এসেছিল।
কি বলে টেলিফোন ধরেছিল? কোনো নাম বলেছিল, হ্যালো বলেছিল, না কি অন্য কিছু বলেছিল? ডেসপিনা জাহরা দুজনেই চিন্তা করতে লাগল।
ওরা কারও নাম বলেনি। হ্যালোও বলেনি। ইটালিয়ান স্টাইলে ওরা সম্বোধন করেছিল। বলল ডেসপিনা।
ইটালিয়ান স্টাইলে? ওদের কোনো কথা কি মনে আছে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
কথা বলল না দুজনের কেউ। ভাবছে ওরা।
একটা কথা মনে পড়ছে স্যার। বলছিল, মিশন সাকসেসফুল। আমরা ফিরছি শিকার নিয়ে।
আরও কোনো কথা? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
তৎক্ষণাৎ কারও কাছ থেকেই কোনো উত্তর এলো না। দুজনেরই দ্রু কুঞ্চিত হলো। স্মৃতি হাতড়াচ্ছে ওরা দুজনেই।
নীরবতা ভাঙল এবার জাহরা। বলল, টেলিফোনে যে লোকটি কথা বলছিল, সে সম্ভবত, ওপ্রান্তের কোনো প্রশ্নের জবাবে ওবাদিয়ার নাম করেছিল। বলেছিল, না আমরা তা করছি না, ওবাদিয়াতেই তাদের আমরা নিয়ে যাব।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। মনে মনে একবার উচ্চারণ করল ওবাদিয়া রত্ন দ্বীপের একটা ছোট পার্বত্য এলাকার নাম। কিন্তু মুখে সে বলল, তোমাদের কিছু বলেছিল ওরা?
আমরা কান্নাকাটি ও সাহায্যের জন্যে চিৎকার করতে থাকলে ওরা ধমক দিয়ে বলেছে, রত্ন দ্বীপের কারও সাধ্য নেই আমাদের হাত থেকে তোদের বাঁচায়। তোদর নিরাপত্তা বাহিনীকে আমরা গণার মধ্যেই ধরি না। মোটামুটি এ রকম কথাই তারা বলেছিল। বলল জাহরা।
ওদের কথা-বার্তা শুনে কি তোমাদের মনে হয়েছে ওরা রত্ন দ্বীপের লোক? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
তারা রত্ন দ্বীপের ভাষাতেই কথা বলেছে, কিন্তু শব্দের ব্যবহার ও অনেক শব্দের উচ্চারণ রত্ন দ্বীপবাসীদের মতো মনে হয়নি। ডেসপিনা বলল।
অনেক ধন্যবাদ ডেসপিনা, জাহরা। তোমাদের কথা তদন্তে কাজে লাগবে। ধন্যবাদ। ও ডেসপিনাদের ধন্যবাদ দিয়েই আহমদ মুসা তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। বলল, আমাকে এখন উঠতে হবে।। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস কথা বলার আগেই ডেসপিনা দ্রুত কণ্ঠে বলল, স্যার, আপনার কথা শেষ হয়েছে। কিন্তু আমাদের কথা আছে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ঠিক আছে, প্রয়োজনীয় হলে বল।
ঠিক প্রয়োজন বলব না। আমাদের কৌতূহল এটা। বলল ডেসপিনা।
ঠিক আছে, বল। আহমদ মুসা বলল।
বল জাহরা, তুমিই তো ভালো জান। বলল ডেসপিনা।
স্যার আপনার ব্যাপারে আমরা অনেক কিছু শুনেছি, পড়েছি। আমি হজ্জে গিয়েও আপনার বিষয়ে অনেক কথা শুনেছি। আমাদের কৌতূহল হলো, আপনার দেশ কোথায়। আপনার পরিবারে কে কে আছে?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, আমার দেশ বলতে কোনো দেশ আর এখন নেই। তবে আমার জন্মস্থান আছে। সেটা বর্তমান পূর্ব তুর্কিস্তান, যা এখন চিনের সিংকিয়াং এলাকা। স্ত্রী, একটি ছেলে নিয়ে আমার একটা পরিবার আছে। আমার পারিবারিক বাসস্থান এখন মদিনা শরিফে।
আপনার স্ত্রী ও ছেলের নাম কি? স্ত্রী কোন দেশের মেয়ে? বলল জাহরাই।
আমার স্ত্রীর নাম মারিয়া জোসেফাইন এবং সারা জেফারসন। মারিয়া জোসেফাইন ফরাসি আর সারা জেফারসন আমেরিকান। ছেলের নাম। আহমদ আব্দুল্লাহ। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার দুই স্ত্রীর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকালো উপস্থিত সকলেই।
স্ত্রীর অধিকার লংঘন হয় বলে একাধিক স্ত্রীর বিষয়টিকে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয় না। জাহরাই বলল।
তুমি যা বলেছ, সেটা ঠিক। আবার এটাও ঠিক যে, এ ধরনের ব্যতিক্রম যদি না থাকে তাহলে অনেক মানুষের মানবাধিকার পদদলিত হতে পারে। মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ যখন এমন একটা ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা করেছেন, তখন সব মানুষের অধিকার, সব মানুষের প্রয়োজন এবং মানুষের সব অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়েই এমন বিধান করেছেন। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। আপনি দুই বাক্যে যা বলেছেন, তার ব্যাখ্যা দুই ঘন্টাতেও সম্ভব নয়। স্যার, এটাই বাস্তব, সারা জীবনের জন্যে যে বিধান, যে বিধান দুই জীবনের জন্যে শুধু নয় তাদের বংশ পরম্পরার সাথে সংশ্লিষ্ট, সংশ্লিষ্ট সমাজ সংস্কৃতির স্বাভাবিক চাহিদার সাথে, সেরকম বিধানের ব্যতিক্রম, বিকল্প থাকা প্রয়োজন, যার বিধান আল্লাহ করেছেন। জাহরা বলল।
ধন্যবাদ জাহরা। তুমি সুন্দর বলেছ। কিন্তু সত্যিই আমার কৌতূহল হচ্ছে, পরার্থে যার জীবন, নিজের কোনো স্বার্থ ছাড়াই মানুষের স্বার্থে যিনি মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তিনি নিজের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থে দ্বিতীয় বিয় করতে পারেন বলে আমি মনে করি না, তাহলে দ্বিতীয় মানে সারা জেফারসনের সাথে আপনার বিয়েটা কিভাবে হলো? এর মধ্যে নিশ্চয় একটা শিক্ষা আছে। সেটা আমি জানতে চাই। বলল ডেসপিনা।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ডেসপিনা এটা জানতে চাইলে তোমাকে মারিয়া জোসেফাইনের সাথে কথা বলতে হবে।
উনি তো সারা জেফারসনের প্রতিদ্বন্দ্বী। তার কাছে সত্যিকার কাহিনী জানা যাবে কেমন করে? বলল ডেসপিনা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, উনিই তো ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিনিই জানেন ঘটনার সব।
কিন্তু এটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। বলল ডেসপিনা।
অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস্য বলেই তো ঘটনা ঘটেছে এবং এ ধরনের ক্ষেত্রেই বিশেষ ব্যতিক্রম হিসেবে দ্বিতীয় বিয়ের মতো ঘটনা। ঘটতে পারে। আহমদ মুসা বলল। * একটু থেমেই আহমদ মুসা বলল, এবার উঠতে হয়। মি. ক্রিস কনস্টানটিনোস আমি উঠছি। আমি কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদকে একটু সাথে নিতে চাই। একটু কাজ আছে।
ঠিক আছে আহমদ মুসা। আপনি কাজের মানুষ। ঈশ্বর আপনাকে সাহায্য করুন। যার যখন প্রয়োজন তাকে আপনি ডাকতে পারেন। যেখানে প্রয়োজন সেখানেই যেতে পারেন। আপনি আপনার কাজের ব্যাপারে স্বাধীন। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
ধন্যবাদ মি. ক্রিস কনস্টানটিনোস।
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
স্যার, আমাদের কথা কিন্তু শেষ হয়নি। বলল ডেসপিনা।
পার্সোনাল কথা নিয়ে তোমাদের সময় নষ্ট করা উচিত নয়। অন্য কথা থাকলে তা বলার সময় সামনে আছে। রত্ন দ্বীপে আরও কিছু দিন আমাকে থাকতে হবে। আচ্ছা আসি।
বলে আহমদ মুসা হাঁটা শুরু করল কক্ষের বাইরের দিকে।
.
বলেছিলে রত্ন দ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনী কিছুই করতে পারবে না। কি হচ্ছে, কারা করছে, এটা বুঝার আগেই সুতা কাটা মালার মতো রত্ন দ্বীপের সমাজ ও সরকার ধ্বংসের মুখে পড়বে! কিন্তু শুরুতেই তোমরা ধ্বসে পড়লে? একদিনের ঘটনায় জীবন হারালো আমাদের ষোলজন মানুষ! ওরা প্রত্যেকেই ছিল এক একটি রত্ন। তুমি ব্যর্থ হয়েছ লিউনার্দো। তোমার নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে। টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে বলল মিডিটেরিয়ান ব্ল্যাক সিন্ডিকেট (মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট)-এর প্রধান অগাস্টিন ইমানুয়েল।
টেলিফোনের ওপ্রান্তটি রত্ন দ্বীপে নয়, সিসিলি দ্বীপের ক্যাটানিয়ায়। এই ক্যাটানিয়াতেই মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট-এর হেডকোয়ার্টার।
টেলিফোনের এপ্রান্তে রয়েছে, অপারেশন রত্ন দ্বীপ-এর নেতা ক্রিস্টোফার লিউনার্দো। তার হেডকোয়ার্টার রত্ন দ্বীপের রেনেটা ক্যাসলে।
রেনেটা ক্যাসল রত্ন দ্বীপের ভূগোল থেকে মুছে যাওয়া একটি নাম। ক্যাসলটি রত্ন দ্বীপের পশ্চিম উপকূলের পাহাড়ী এলাকায়। উঁচু পাহাড়ের দেয়াল ঘেরা ক্ষুদ্র একটা উপত্যকায় ক্ষুদ্র এই দুর্গটি। রেনেটা ক্যাসল তৈরি হয়েছিল জলদস্যুদের দ্বারা। উপকূলে নেমে পাহাড়ের আকাঁবাকা গিরিপথ দিয়ে সহজেই রেনেটা ক্যাসলে পৌঁছা যায়। কিন্তু এখান থেকে দ্বীপের অভ্যন্তরে যাবার পথ খুবই দুর্গম। শত শত বছর ধরে এখানে মানুষের যাওয়াত ছিল না।
মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট জলদস্যুদের একটা পুরানো দলিল থেকে এই রেনেটা ক্যাসলের সন্ধান পেয়েছে। তারা জলদস্যুদের নকশা অনুসরণ করে রেনেটা ক্যাসল-এ আসে এবং একেই তারা অপারেশন রত্ন দ্বীপ-এর হেডকোয়ার্টার মনোনীত করে। এ ক্যাসলটি অনেকটা পাহাড়ে ঢাকা হওয়ার কারণে বিমান বা হেলিকপ্টার থেকেও একে দেখা যায় না।
নেতা অগাস্টিন ইমানুয়েলের কঠোর অভিযোগের জবাবে রত্ন দ্বীপে অপারেশনের চীফ ক্রিস্টোফার লিউনার্দো বলল, আমরা রত্ন দ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা সরকারের হাতে পরাজিত হইনি। আমরা পরাজিত হয়েছি, আমাদের ষোলজন লোক মারা গেছে শুধুমাত্র এক ব্যক্তির হাতে, যে রত্ন দ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারের কেউ নয়।
শুকনো গলায় একটা ডোক গিলার জন্যে থামল ক্রিস্টোফার লিউনার্দো।
সংগে সংগেই ওপ্রান্ত থেকে বলে উঠল অগাস্টিন ইমানুয়েল, এটা তো আরও বড় ব্যর্থতা লিউনার্দো। একজন মাত্র ব্যক্তি একটা বাহিনী নয়। সে যেই হোক না কেন তার কাছে পরাজয় তোমার জন্য আরও বড় অপরাধ। শোন, তুমি মিটিং বন্ধ কর। আলেকজান্দ্রোকে পাঠিয়েছি। সে ওখানে যাচ্ছে। তাকেই সব দায়িত্ব বুঝে দিয়ে তুমি রত্ন দ্বীপ ত্যাগ করো। হেডকোয়ার্টারে এসে আমার কাছে রিপোর্ট করো।
দপ করে মুখের আলো নিভে গেল ক্রিস্টোফার লিউনার্দোর। তার চোখে নামল অন্ধকার। হেডকোয়ার্টারে তাকে কেন ডাকা হয়েছে, সেখানে তার ভাগ্যে কি ঘটবে তা সে জানে। মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটে ব্যর্থতার কোনো স্থান নেই। যারা ব্যর্থ হয় তাদেরকে সংগঠন থেকে নয়, জীবন থেকেই ঝেড়ে ফেলা হয়।
টেলিফোন রাখল ক্রিস্টোফার লিউনার্দো। তাকাল টেবিলের তিন দিকে বসা সহকর্মীদের দিকে। বলল, মিটিং মুলতবি করছি। দিয়াগো আলেকজান্দ্রো আসছে, সেই রত্ন দ্বীপের দায়িত্ব নেবে।
বলে সে উঠে দাঁড়াল। কক্ষের বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়াল ক্রিস্টোফার লিউনার্দো। ঘর থেকে বাইরে সে পা রেখেছে, এই সময় দিয়াগো আলেকজান্দ্রো সেখানে এসে পৌঁছল।
লিউনার্দো কোথায় যাচ্ছ? ভেতরে সবাই আছে? চল ভেতরে। বলল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো।
দিয়াগো আলেকজান্দ্রোর সাথে আরও দুজন। ক্রিস্টোফার লিউনার্দো ঘরে ঢুকল। তার সাথে দিয়াগো আলেকজান্দ্রোও।
ঘরে ঢুকে দিয়াগো আলেকজান্দ্রো গিয়ে বসল ক্রিস্টোফার লিউনার্দোর চেয়ারে।
ক্রিস্টোফারের সাথে আসা দুজন দরজায় দাঁড়াল। আর ক্রিস্টোফার লিউনার্দো দাঁড়াল ঘরের এক পাশে।
চেয়ারে বসেই দিয়াগো আলেকজান্দ্রো বলল নিউনার্দোকে লক্ষ্য করে, লিউনার্দো, তোমার অস্ত্রগুলো টেবিলে রাখ।
লিউনার্দো কোনো কথা না বলে দুটি রিভলবার ও একটি ছুরি টেবিলে রাখল।
দিয়াগো আলেকজান্দ্রো দরজায় দাঁড়ানো দুইজনকে দেখিয়ে বলল, ওদের সাথে তুমি যাও লিউনার্দো। ওরাই তোমাকে হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দেবে।
ঠিক আছে আলেকজান্দ্রো আমি যাচ্ছি। বলে বেরুবার জন্যে দরজার দিকে পা বাড়াল। লিউনার্দো জানে অন্যথা করার কোনো সুযোগ তার নেই। আসলে সে এখন বন্দী। ঐ দুজন লোক তার সশস্ত্র প্রহরী। তাকে গুলি করে হত্যাসহ সব ক্ষমতা তাদের দেয়া আছে।
প্রহরী দুজনের সাথে চলে গেল ক্রিস্টোফার লিউনার্দো।
দিয়াগো তার টেবিলের তিন পাশের দিকে তাকিয়ে বলল, একদিনে আমাদের ষোলজন লোক মারা গেল, তোমাদের কারও কোনও বক্তব্য আছে? কেন ঘটল?
বিশাল টেবিলটার তিন পাশে ওরা সাতজন বসে। তাদের প্রত্যেকেরই চোখ-মুখ পাথরের মতো শক্ত ও মৌন।
প্রশ্নের উত্তরে সংগে সংগেই তারা কেউ কথা বলল না। অবশেষে নীরবতা ভেঙে একজন বলল, বস, আমি দুটি ঘটনার কোনোটাতেই ছিলাম না। দূরে পাহারায় প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে যা শুনেছি, তাতে ঘটনা আমার কাছে মিরাকল মনে হয়েছে। দুটি ঘটনার কোনটাতেই লোকটা বাঁচার কথা ছিল না, কিন্তু সে শুধু বাঁচেইনি, দুটি ঘটনায় আমাদের ষোলজন লোককে হত্যা করেছে। থামল লোকটি।
অবশিষ্ট তোমরা কি মনে করো, বল। বলল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো।
তারাও বলল, দুটি ঘটনা আমাদেরকেও বিস্মিত করেছে। আমাদের দক্ষ যোদ্ধারা এই ভাবে অসহায় পাখির মতো গুলি খেয়ে মারা গেল মাত্র একজনের হাতে, এই দায় একজন বা কারো ঘাড়ে চাপিয়ে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তোমরাও দেখছি মরার আগে মরে বসে আছ, তাহলে আমরা অগ্রসর। হবো কি করে? আমাদের মূল কাজের তো কিছুই হয়নি। বলল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো।
কাজের ব্যাপারেই আমরা কথা বলতে চাই। কাজটা আমাদের করতে হবে, লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছতে হবে। এই বিষয়ে কথা বলুন। সামনে বসা আগের সেই লোকটিই বলল।
আমি সে জন্যেই এসেছি। বলল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো।
তাহলে সেই কাজই শুরু করুন। প্রথমেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মেয়েকে কিডন্যাপ করার কি দরকার ছিল? সাধারণত বড় ঘটনার বড় রকম প্রতিরোধ হয়। তার চেয়ে সিনাগগ ধ্বসিয়ে দেয়ার মতো ছোট ঘটনা ঘটিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও সরকারের পতন ঘটানো সহজ ছিল। সম্মুখ সংঘাত এড়িয়েও এই ধরনের কাজ করা যায়। মাগের ললাবটিই বলল।
কর্মসূচির ব্যাপারে তুমি নতুন কথা বলেছ। আমার ভালো লেগেছে। আমি হেডকোয়ার্টারের সাথে এ নিয়ে আলাপ করব। ন্তু এই মুহূর্তে প্রতিশোধমূলক বড় কিছু না ঘটালে মানুষ আমাদের ভয় করবে না, দুর্বল। ভাববে। কিছু একটা করতে হবে। বলল দিয়াগো আলেকজাতো।
হাসপাতালে আক্রমণ প্রতিশোধ নেয়ার জন্যেই ছিল। এই আক্রমণ আমাদের ক্ষতি করেছে। সম্মুখ আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা আবারও করা যায়। কিন্তু সেটা আমাদের ভালো ফল দেবে এ ব্যাপারে। আমরা নিশ্চিত নই। সম্মুখে বসাদের মধ্য থেকে আরেকজন বলল।
তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু তাই বলে তো আমরা বসে থাকতে পারি না। বলল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো।
আমাদের বর্তমান বিপর্যয়ের কারণ মাত্র একজন লোক। সে যেমন আমাদের বিপর্যয়ের কারণ, তেমনি সে সরকার ও রত্ন দ্বীপের মানুষের জন্যে উৎসাহ ও শক্তির ভিত্তি। যদি এই মুহূর্তে কিছু করতেই হয়, তাহলে হওয়া উচিত এই লোকটার উপর আঘাত হানা। বলল সামনে বসাদের অন্য একজন।
তুমি ঠিক বলেছ। আমাদের বসদের এ রকমই চিন্তা। ঠিক এই মুহূর্তে লোকটির উপর আক্রমণকেই আমরা টার্গেট হিসাবে নিচ্ছি। বল তোমাদের আর কোনো কথা আছে? বলল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো।
আমাদের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে আগে আমাদের তেমন ব্রিফ করা হয়নি। বলা হয়েছিল, রত্ন দ্বীপে গেলেই সব জানতে পারবে। কিন্তু তা জানানো হয়নি। রত্ন দ্বীপে এখন একশ লোকের একটা বাহিনী আছে। তারা। সকলেই মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট এর কাজের ব্যাপারে। কিন্তু অহরহই আমাদেরকে তাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, আমরা কোন লক্ষ্যে কাজ করছি? বিশেষ করে যোজনের হত্যাকাণ্ডের পর এই প্রশ্ন আরও বড় হয়ে উঠেছে। বলল সামনে-বসা সেই প্রথম লোকটিই।
তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না দিয়াগো আলেকজান্দ্রো। একটু চিন্তা করল। বলল, অপারেশন রত্ন দ্বীপ কোন্ উদ্দেশ্যে গঠিত তা সবারই জানার কথা। আর মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট-এর আপনারা যারা সদস্য, তাদের সবার এটা অবশ্যই জানতে হবে।
একটু থামল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো। পরমুহূর্তেই বলল, এই রত্ন দ্বীপ আসলেই একটা রত্ন দ্বীপ। এখানে লুকানো রয়েছে রত্নের ভাণ্ডার। প্রাচীন যুগে রোমানদের তাড়া খাওয়া, মধ্যযুগে ও আধুনিক যুগের শুরুতে কোথাও টিকতে না পরা দিশেহারা জলদস্যুদের অঢেল সম্পদ এসেছে নির্জন ও প্রাকৃতিক দুর্গের মতো এই দ্বীপে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপাঞ্চল ও আমেরিকা অঞ্চল থেকে জাহাজ বোঝাই করে আনা স্বর্ণ লুণ্ঠিত হয় জলদস্যুদের দ্বারা। কোথাও নিরাপত্তা না পেয়ে সেগুলোও আনা হয় এই দ্বীপে। সেই অঢেল ধনভাণ্ডার উদ্ধার করাই আমাদের মিশন। আর রত্নভাণ্ডার আমাদেরই, কারণ যে জলদস্যুগ্রুপ তাদের ধনভাণ্ডার নিরাপদ করার জন্যে এই নির্জন দ্বীপে লুকিয়ে রেখেছিলেন, আমরা সেই জলদস্যুদের উত্তরসূরি। এর বেশি এখন জানার দরকার নেই বলে আমি মনে করি।
তাহলে আমরা ধনভাণ্ডার সন্ধান করলেই তো হয়। ধনভাণ্ডার উদ্ধার হলেই আমাদের মিশন শেষ। তাহলে আমরা কেন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছি, কেন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও সরকারের পতন আমাদের। লক্ষ্য? বলল সামনে বসে থাকা লোকদের একজন।
হাসল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো। একটুক্ষণ চুপ করে থাকল।
অ্যাটেনশন হওয়ার মতো একটু নড়েচড়ে বসল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো। বলল, দুই কারণে এই কাজগুলো আমাদের করতে হচ্ছে। সরকারের পতন ঘটাতে না পারলে ধনভাণ্ডার উদ্ধারে আমাদের সফল হওয়া কঠিন। আরেকটা কারণ আছে। সেটা বলা যাবে না। আমাদের মিশনে অনেক টাকা প্রয়োজন। সেই টাকা আমরা একটা মহলের কাছ থেকে পেয়েছি একটা শর্তে। তারা আমাদের ধনভাণ্ডারের অংশ চায় না। তারা অন্যরকম একটা শর্ত দিয়েছে। সেই শর্তের কারণে আমাদের অনেক কিছু করতে হচ্ছে। তারা গোপন রাখতে বলেছে বলে সেটা প্রকাশ করা হচ্ছে না।
ঠিক আছে এখন করণীয় বলুন বস। আমরা কাজ করতে চাই। বলুন এখন কি করতে হবে আমাদের? বলল সামনে বসাদের একজন।
প্রথম কাজ অজ্ঞাত সেই লোকটির সন্ধান করা এবং তাকে হত্যা করা। দ্বিতীয় কাজ দ্বীপের মানুষের ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করা। প্রধান তিনটি ধর্মের বিভিন্ন স্বার্থে আঘাত হেনে তাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও সংঘাতের সৃষ্টি করা। বলল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো।
যুগ যুগ ধরে তাদের মধ্যে পারস্পরিক যে আস্থা গড়ে উঠেছে, তা নষ্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের সব চেষ্টা এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। বলল সামনে বসাদের একজন।
আমরা কাজ করে গেলে ওদের এই আস্থা ও বিশ্বাস দেখবে খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়বে।
চলুন তাহলে আমরা অগ্রসর হই। আমরা চুপ করে থাকলে ভীতি আমাদেরকে আরও গ্রাস করবে। চল আমরা এখন উঠি। বিকেলে আমরা তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে রাজধানীতে যাব। উদ্দেশ্য লোকটিকে সন্ধান করা, সুযোগ পেলে তাকে হত্যা করা। বলে উঠে দাঁড়াল দিয়াগো আলেকজান্দ্রো। সবাই উঠলো।
.
এক নম্বর সার্কুলার রোড ধরে ছুটে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ি। এক নম্বর সার্কুলার রোডটি গোটা দ্বীপকেই বেষ্টন করেছে। এই সার্কুলার রোডের সমান্তরালে পরপর আরও দুটি সার্কুলার রোড রয়েছে।
আহমদ মুসা ড্রাইভ করছে গাড়ি।
তার পাশে মেজর পাওয়েল পাভেল।
মেজর পাভেলেরই গাড়ি ড্রাইভ করার কথা ছিল।
নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান রিদা আহমদ এই নির্দেশই মেজর পাভেলকে দিয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসা তাকে ড্রাইভিং-এর পাশের সিটে বসিয়ে নিজে বসেছে ড্রাইভিং সিটে। আহমদ মুসা তাকে বলেছে, তোমাদের রাস্তায় গাড়ি চালানোতে আমি অভ্যস্ত হতে চাই, তুমি তো অভ্যস্ত আছই। সুতরাং অগ্রাধিকার আমারই।
মেজর পাভেল বিনীত হেসে বলেছে, স্যার, কোনো কিছুতেই আপনার অভ্যস্ত হবার প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর প্রয়োজনীয় সবকিছুই আপনাকে অঢেলভাবে দিয়েছেন।
বলে মেজর পাভেল আহমদ মুসার পাশের সিটে গিয়ে বসল।
গাড়ি চলছে।
মেজর পাভেল, মনে হচ্ছে তুমি আমার সাথে আসতে চাচ্ছিলে না। কেন? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আপনার সাথে আসতে চাইনি, এটা নয়। আমি ওবাদিয়া এলাকায় আসতে চাচ্ছিলাম না। মেজর পাভেল বলল।
কেন? ওবাদিয়ায় আসতে চাচ্ছিলে না কেন? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, অনেকদিন আমি ওবাদিয়া এলাকার দায়িত্বে ছিলাম। একটা কারণে রিলিজ নিয়ে এই এলাকা থেকে চলে যাই। সেজন্যে এই এলাকায়। আসা আমি অ্যাভয়েড করতে যাচ্ছিলাম। মেজর পাভেল বলল।
মেজর পাভেল, তুমি নিরাপত্তা বাহিনীর লোক। কোনো এলাকা সম্পর্কে তোমার নিজের উপর এমন বিধি-নিষেধ আরোপ ঠিক নয়। কি এমন ঘটেছিল মেজর পাভেল, যার কারণে তুমি এমন চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছ? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আপনি জিজ্ঞাসা করলে আমার কিছুই আপনাকে না বলার থাকতে পারে না। বলছি স্যার।
একটু থামল মেজর পাভেল!
শুরু করল তার কথা আবার, ওবাদিয়া এলাকায় ডেভিড অ্যারিয়েল একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। এক সময় সে রত্ন দ্বীপ পার্লামেন্টে ইহুদি ধর্মীয় গ্রুপ থেকে সদস্যও ছিল। তার বিভিন্ন কাজে ইহুদি সম্প্রদায় মনে করে সে ধর্ম পালন যেমন করে না, তেমনি সুনীতিরও ধার ধারে না। এই কারণেই ইহুদি ধর্ম-গ্রুপের পক্ষ থেকে পার্লামেন্টে কোনো নমিনেশন আর পায়নি। তার একটি মেয়ে নিরাপত্তা বাহিনীতে আছে ক্যাপ্টেন র্যাংকে, নাম। আয়লা আলিয়া। দায়িত্ব পালন উপলক্ষেই তার সংগে আমার দেখা হতো। প্রায়ই। এরপর আমি যখন ওবাদিয়ায় দায়িত্ব নিয়ে গেলাম, সেও তখন বদলি হয়ে ওবাদিয়ায় এলো। তখন এই দেখা-সাক্ষাৎ আরও বাড়ল। দুজনের মধ্যে সম্পর্কও হয়ে গেল। ইনিশিয়েটিভ তার পক্ষ থেকেই ছিল। তার পরিবারের প্রকাশ্য সায়ও ছিল। আমারও অনিচ্ছা ছিল না। ভালো লাগত আমার তাকে। হঠাৎ কি হয়ে গেল। কয়েক দিনের জন্যে কোথাও চলে গিয়েছিল তার পিতা ডেভিড অ্যারিয়েল। ফিরে এলো অনেকটাই যেন নতুন মানুষ হয়ে। তার আচরণ আমার কাছে নতুন মনে হলো। ধীরে ধীরে আমার মনে হলো, শুধু আমার সাথে নয়, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকদের সাথেও আচরণ তার ভালো নয়। তারপর মেয়েকেও চাকরি ছাড়ার জন্যে চাপ দিল। বলল তাকে, যাদের কাছে আমি সুব্যবহার পাইনি, তাদের। অধীনে তোমার চাকরি করার প্রয়োজন নেই। এখানেই শেষ নয়। একদিন। তাদের বাড়িতে আয়লা আলিয়ার উপস্থিতিতেই আমাকে বলল, পাভেল তুমি আর এখানে এসো না। আলিয়ার সাথে তোমার মেলামেশাও আমি পছন্দ করছি না। সংগে সংগেই আলিয়া তার বাবার এই অসৌজন্যমূলক ব্যবহারের তীব্র প্রতিবাদ করে। আমাকে নিয়ে বাবার সাথে তার বিতর্ক করা ঠিক নয় এ কথা বলে আমি চলে আসি। কাঁদতে শুরু করে আলিয়া। এ ঘটনার পর আমি ওবাদিয়া থেকে রিলিজ নিয়ে চলে আসি। ওবাদিয়ায় আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর আংলিক অফিস আলিয়াদের বাদুর। পাশেই। থামল মেজর পাভেল।
আহমদ মুসা গভীর মনোযোগের সাথে শুনছিল মেজর পাভেলের কথা। তার দুই চোখে কিছুটা আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। বলল, মেজর পাভেল, তোমার সাথে আলিয়ার যোগাযোগ নেই?
আছে স্যার। আমরা মাঝে মাঝেই কথা বলি। তবে তাকে আমি আমার আগের কথাই বলি যে, আমাকে নিয়ে তার বাবার সাথে কোনো বিরোধ হোক আমি চাই না। কিন্তু এ কথা সে মানতে নারাজ। বলে সে, বিষয়টা বাবার নয়, আমার। বাবা আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে জড়াবেন না আমি আশা করি। বলল মেজর পাভেল।
তুমি টেলিফোন কর আলিয়াকে। দেখ কোথায় সে। যদি পাও তাহলে আমি তার সাথে কর্থা বলতে চাই। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে স্যার। বলে মেজর পাভেল টেলিফোন করল ক্যাপ্টেন আলিয়াকে।
আহমদ মুসা তার সাথে কথা বলতে চায় এটা আলিয়াকে বলল মেজর পাভেল।
কথা বলা শেষ করে আহমদ মুসাকে জানাল, স্যার, আলিয়া ওবাদিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসেই আছে। আপনি তার সাথে কথা। বলবেন জেনে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হয়েছে সে। তবে তার মত হলো ওবাদিয়ার পাহাড়ী এলাকায় কতগুলো ট্যুরিস্ট স্পট আছে। তারই একটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর একটা আউটপোস্ট আছে। সেখানে বসেই সে কথাবার্তা বলতে চায়।
ঠিক আছে, ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে আলিয়া। সম্ভবত তোমার কথা ভেবেই এটা করেছে সে। তোমাকেও বিব্রত করতে চায় না, আবার তার বাবাকেও নতুন কথা বলার সুযোগ করে দিতে চায় না সে। আহমদ মুসা বলল।
.
ওবাদিয়া ইহুদি অধ্যুসিত এলাকা। দ্বীপের দশ হাজার ইহুদি অধিবাসীদের অর্ধেকের মতো বাস করে ওবাদিয়াতেই। ওবাদিয়া পাহাড়ী এলাকা। পাহাড়গুলো ভূমধ্যসাগরীয় ফলের বাগানে শোভিত। পাহাড়ের মধ্যে একটা সুন্দর উপত্যকা আছে ওবাদিয়ায়। খুবই উর্বর। প্রচুর গম ও সবজি উৎপাদন হয় এখানে। ওবাদিয়ার দক্ষিণ অংশটা পাহাড়। খুবই দুর্গম। খুব উৎসাহী ট্যুরিস্টরাও কিছু দূর পর্যন্ত যেতে পারে পাহাড় ডিঙিয়ে, খুব বেশি দূর ঢুকতে কেউ পারে না।
ওবাদিয়ার আউটলেট সেকশনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। দ্বীপ থেকে বেরুবার উত্তর দক্ষিণে যে দুটি আউটলেট, তার দক্ষিণের আউটলেটটি ওবাদিয়ার গা ঘেঁষেই সাগরে নেমে গেছে। জনশ্রুতি আছে, প্রাচীন কালে ত্রিপলী ও বেনগাজি এলাকার আরব মুসলিমরা দ্বীপের দক্ষিণের আউলেট দিয়ে দ্বীপে প্রবেশ করে এবং ওবাদিয়া এলাকাতেই তারা বসতি গড়ে তোলে। জনশ্রুতি মতে ওয়াদিয়া ছিল এই এলাকাটার নাম। পরে ওয়াদিয়াও ওবাদি হয়ে যায়।
এক মিনিটের মধ্যেই আহমদ মুসার গাড়ি পৌঁছে গেল ওবাদিয়ার সেহ ট্যুরস্ট স্পটে।
নিরাপত্তা বাহিনীর আউটপোস্টের আঙিনায় থামল আহমদ মুসার গাড়ি।
জানতে পেরেই অফিস থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো ক্যাপ্টেন আয়লা আলিয়া।
আহমদ মুসারা তখন গাড়ি থেকে নেমেছিল।
___ আয়লা আলিয়া ছুটে এসে আহমদ মুসাকে প্রথমে স্যালুট দিল এবং মাথা নিচু করে বাউ করল। পরে দুধাপ সরে এসে মেজর পাভেলকে স্যালুট দিল। আহমদ মুসার কাছে ফিরে এলো আবার ক্যাপ্টেন আলিয়া। বলল, স্যার, ক্যাপ্টেন আলিয়া হিসাবে আপনাকে স্যালুট দিয়েছি, মানুষ আলিয়া হিসাবে আপনাকে বাউ করেছি। স্যালুট দিয়ে মন ভরে না স্যার, বিশাল পাহাড়ের উচ্চতার সামনে মাথা নুইয়ে বাউ করেই শুধু তার বড়ত্বের সম্মান দেয়া যায়।
ক্যাপ্টেন আলিয়া, মানুষের কাছে মানুষের মাথা নোয়ানো ঠিক নয়। তাতে মানবতার অপমান হয়। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, একথা আপনি বলবেন আমি জানি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপনি সৈনিক, শান্তি ও আদর্শের আপনি দূত। কিন্তু আপনার সবচেয়ে বড় পরিচয় আপনি মানুষ, আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দা। স্যার, মাথা নোয়ানো সব সময় সব ক্ষেত্রে প্রভু ও দাসের অর্থ বহন করে না, বড়দের প্রতি সম্মান ও বিনয়ের নিদর্শনও হতে পারে। বলল ক্যাপ্টেন আলিয়া।
চমৎকার ক্যাপ্টেন আলিয়া, তুমি এসব কথা এভাবে বলতে পারছ কেমন করে? বলল আহমদ মুসা।
হাসল ক্যাপ্টেন আলিয়া। বলল, আমার ক্যাপ্টেন বন্ধু আছে। নাম ফাতমা ফায়জা। কলেজ থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। নিরাপত্তা বাহিনীর ট্রেনিং-এ আমরা ব্যাসমেট। রুমমেটও ছিলাম আমরা। তার কাছ থেকে অনেক কিছু আমি শিখেছি। আপনার সম্পর্কেও আমি তার কাছ থেকে জেনেছি। তার কাছে আপনি স্বপ্নের রাজপুত্র, নতুন যুগের হাতেম তাঈ। যা-ই হোক, আমি এখন হাফ মুসলমান।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, হাফ মুসলমান! হাফ মুসলমান কাকে বলে?
বিশ্বাসে মুসলমান, কিন্তু কর্মে নয়। বলল ক্যাপ্টেন আলিয়া।
বিশ্বাস শক্তিশালী হলে কর্মতো পরিবর্তন হয়ে যায়। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক বলেছেন স্যার। তবে বিশ্বাসকে এখনও শক্তিশালী করছি। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
কথা শেষ করেই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, স্যরি, আপনাদের দাঁড়িয়ে রেখে কথা বলছি। আসুন স্যার।
বলে ক্যাপ্টেন আলিয়া আহমদ মুসার সামনে থেকে একটু সরে পাশে গিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসা ও মেজর পাভেলও হাঁটতে শুরু করেছে।
.
৪.
ক্যাপ্টেন আলিয়া, তোমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যাপারে কথা বলছি, তুমি কিছু মনে করছ না তো? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আপনি কথা বলবেন, আর আমি কিছু মনে করব, এটা আমার, ভাবনারও অতীত স্যার। আপনার প্রতি আমার আস্থা প্রবল, ভংগুর নয় বলে আমি মনে করি। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল। আবেগ জড়িত তার কণ্ঠ।
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন আলিয়া। মেজর পাভেল ওবাদিয়ায় আসতে চাচ্ছিল। কারণ জিজ্ঞাসা করায় তোমাদের কাহিনী আমি তার কাছ থেকে জানতে পারি। বলল আহমদ মুসা।
পাভেল খুব ভালো ছেলে স্যার। মানুষ হিসাবেও সৎ ছেলে, অফিসার হিসাবেও অত্যন্ত দায়িত্বশীল। তাকে নিয়ে আমি গর্বিত স্যার। কিন্তু বাবা তার প্রতি অবিচার করেছেন। এখন ওবাদিয়া আসা তার জন্যে কঠিন। প্রায় লাগালাগি হওয়ায় তিনি গ্যারিসনে আসলেই বাবা টের পাবেন। বাবা আমার কাছে তার আসা পছন্দ করবেন না বলেই আমি এখানে আমাদের আলোচনার ব্যবস্থা করেছি। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
তোমার বাবার এই পরিবর্তনটা কেন? এ নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করেছ? বলল আহমদ মুসা।
চিন্তা করেছি স্যার। কিন্তু বুঝতে পারিনি, কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি। তিনি কোথাও গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে আসার পরই তাঁর এই পরিবর্তন। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
তিনি কি কোনো আত্মীয় বাড়ি গিয়েছিলেন? বলল আহমদ মুসা।
না, তিনি আত্মীয় বাড়ি যাননি। কোথায় যাচ্ছেন তা বাড়িতে বলেও যাননি। বাড়িতে আমরা মহাদুশ্চিন্তায় ছিলাম। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে খোঁজ নেবার পর তাকে নিখোঁজ রেকর্ড করে আমরা সরকারিভাবে অনুসন্ধানের কাজ শুরু করতে যাচ্ছিলাম। এই সময় উধাও হয়ে যাবার পঞ্চম দিনে তিনি বাড়িতে ফিরে এলেন। কিন্তু তিনি জানালেন না কোথায় গিয়েছিলেন। তিনি এটুকুই শুধু বলেছিলেন; ব্যবসায়ের কাজে আমি কয়েকদিন বাইরে ছিলাম। রত্ন দ্বীপের বাইরে গিয়েছিলেন কিনা তাও তিনি জানাননি।
তোমার কি মনে আছে, তিনি উধাও হয়েছিলেন বা চলে গিয়েছিলেন কোথা থেকে? বলল আহমদ মুসা।
আমি সেদিন হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলাম। তাই তার সাথে ঐ দিন আমার দেখা হয়নি। তবে বাড়ি আসলে মা বললেন, তোর বাবা লাঞ্চে আসেননি। সাধারণ একটা শার্ট পরে সকালে বেরিয়ে গেছেন। কোট জ্যাকেট কিছুই নেননি। মায়ের কথাকে আমি তখন খুব গুরুত্ব দেইনি। রাতে তিনি যখন ফিরলেন না, তখন আমার চিন্তা হলো বাবা তো এমন। ইনফরমাল পোষাক পরে বাড়ির পরিমণ্ডলের বাইরে কখনই কোথাও যান না। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
ক্যাপ্টেন আলিয়া, আমাদের একজন নিরাপত্তা কর্মী একটা তথ্য। দিয়েছিল, সেটা নিশ্চয় ভুলে গেছ। বলল মেজর পাভেল।
ও, ইয়েস। ধন্যবাদ মেজর পাভেল। স্যার, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। আমার বাবা যেদিন বাড়ি থেকে বের হন, সেদিনই আমাদের একজন নিরাপত্তা কর্মী আমার বাবাকে পাহাড়ে আমাদের বাগানে ঘুরতে দেখেছে। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
আপনাদের বাগানটা এই নিরাপত্তা আউটপোস্ট থেকে কোন্ দিকে? বলল আহমদ মুসা।
এখান থেকে আরও কিছুটা দক্ষিণে। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
তার মানে পাহাড়ের আরও গভীরে? আচ্ছা বল তো ক্যাপ্টেন আলিয়া, উনি কি মাঝে-মধ্যেই বাগানে যেতেন? বলল আহমদ মুসা।
বাগানটা বাবার খুব প্রিয়। কিছুটা অবসরে থাকলেই তিনি বাগানে। গিয়ে সময় কাটান। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন বাগানটা পাহাড়ের আরও একটু গভীরে। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
ক্যাপ্টেন আলিয়া বলতে পারেন, উনি বাসায় ফিরেছিলেন কোন পথে কোন্ দিক দিয়ে? বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে উত্তর দিল না ক্যাপ্টেন আলিয়া। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে অবাক দৃষ্টি। এমন প্রশ্নের অর্থ কি? অন্য কেউ এমন প্রশ্ন করলে হাসতাম। কিন্তু প্রশ্ন করেছে আহমদ মুসা। অতএব অবাক না হয়ে উপাই নেই। মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল, বাবা যখন বাড়ি ফেরেন, তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না, আমাদের গ্যারিসন অফিসেও ছিলাম না। আমি নিজে কিছু। দেখিনি। তবে কাবার্বা, ক্যাসলে যাবার সম. ওবাদিয়ার পাহাড়ী আউটপোস্ট থেকে একটা টেলিফোন পেলাম। জানাল, আউটপোস্টের একজন নিরাপত্তা কর্মী দেখেছে একটা গাড়িতে আমার বাবা বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। এর অর্থ তিনি পাহাড়ের দিক থেকে এসেছিলেন।
ক্যাপ্টেন আলিয়া কথা শেষ করার পর আহমদ মুসা সংগে সংগেই কিছু বলল না। ভাবছিল সে।
ক্যাপ্টেন আলিয়া, ফেরার পর তাকে কেমন মনে হয়েছে আপনাদের? বলল আহমদ মুসা।
বাবাকে ক্লান্ত মনে হয়েছে আমার কাছে। কথা-বার্তার মধ্যে স্বতস্ফূর্ততার অভাব ছিল। তার আনন্দ প্রকাশের অন্তরালে কেমন একটা প্রচ্ছন্ন বিষণ্ণতা ছিল। দুএক দিনের মধ্যে তার ভেতরে পাভেল সম্পর্কে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে শুরু করলাম। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
ওবাদিয়ার পেছনের পাহাড় সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন আছে ক্যাপ্টেন আলিয়া? বলল আহমদ মুসা।
ক্যাপ্টেন আলিয়া তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, স্যার, ঠিক কি জানতে চান?
ওবাদিয়ার পাহাড়ী অঞ্চলে কোনো গোপন স্থাপনা, গোপন ঘাঁটি বা লুকানোর মতো গুহার সন্ধান করছি। তুমি এই এলাকার মানুষ। তুমি কিছু জান কিনা? বলল আহমদ মুসা।
ক্যাপ্টেন আলিয়ার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। তার চোখে-মুখে অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। বলল, স্যার আপনি বাবাকে সন্দেহ করছেন?
না, তোমার বাবাকে সন্দেহ করিনি। কিন্তু উনি বিপদগ্রস্ত হয়েছেন কিনা, এটা আমি ভাবছি। বলল আহমদ মুসা।
কিভাবে বিপদে পড়তে পারেন? কারা বিপদে ফেলতে পারে? জিজ্ঞাসা ক্যাপ্টেন আলিয়ার।
সেটা আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। আমার মাথায় দুটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে! এক. তোমার বাবা ওবাদিয়ার পাহাড়ী অঞ্চলে কোথায় ছিলেন? আমার মনে হচ্ছে তিনি ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিলেন। দুই, যারা সেদিন কিডন্যাপ হয়েছিল, তারা কিডন্যাপারদের মুখে শুনেছিলেন, তাদেরকে ওবাদিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে। বলল আহমদ মুসা।
ক্যাপ্টেন আলিয়া, মেজর পাভেলের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কথা সরল না ক্যাপ্টেন আলিয়ার মুখ থেকে। এক সময় তার মুখ থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এলো ও গড?
ঠিক স্যার, ওবাদিয়ার পাহাড়ী অঞ্চলে সন্ত্রাসী মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের কোনো ঘাটি থাকলে, কয়েকদিন ওবাদিয়ার পাহাড়ী অঞ্চলে বাবা কোথায় ছিলেন, এ প্রশ্ন বড় হয়ে উঠে। তাছাড়া বাবার পরিবর্তনও তাৎপর্যময় হয়ে উঠে। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন আলিয়া। এখন বল আমাদের করণীয় কি? বলল আহমদ মুসা।
একটু ভাবল ক্যাপ্টেন আলিয়া। বলল, এখন কি করণীয়- এটা বলা স্যার আমার বুদ্ধিতে কুলোবে না। ওটা আপনিই বলবেন। আমি এটুকু বলতে পারি যে, ওবাদিয়ার পাহাড়ী অঞ্চলে সন্দেহজনক স্থাপনা, ঘটি বা বাড়ির খোঁজ করতে হবে। আর বাবার জীবনে কি ঘটেছে তা জানতে হবে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, করণীয় তো বলেই ফেললে ক্যাপ্টেন আলিয়া। ধন্যবাদ। এখন কিভাবে এগোনো যাবে, সে সম্পর্কে তোমাদের ধারণা বল।
বলুন মেজর পাভেল স্যার। আপনি শুরু করুন। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
আমি মনে করি ওবাদিয়ার পাহাড়ী এলাকা খুব বড় নয়। এক দিনের একটি কম্বিং অপারেশন হলেই গোপন কোনো স্থাপনা বা ঘাঁটি থাকলে তা বেরিয়ে পড়বে। বলল মেজর পাভেল।
ঠিক তো একথা আমার মনেই হয়নি। আমি ভাবছিলাম কোন পথে এগোনো যায়। এটা তো সহজ ও নিশ্চিত একটা পদক্ষেপ। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
তোমরা দুজনেই সহজ ও নিশ্চিত একটা পথ বাতলিয়েছ। ধন্যবাদ। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য শুধু ওদের ঘাঁটি বা বাড়ি খুঁজে বের করা নয়। আমাদের আরও বড় লক্ষ্য হলো, ওদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানা যায় এমন সব তথ্য যোগাড় করা এবং সম্ভব হলে ওদের জীবন্ত পাকড়াও করা। এ দুটি কাজের মাধ্যমে বাড়ি, ঘাটিরও সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু কম্বিং অপারেশনে গেলে ওরা সবসহ পালাবে। শূন্য ঘাঁটি পেলেও ওতে আমাদের কোনো লাভ হবে না। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক বলেছেন স্যার। আমরা এতোটা গভীরে গিয়ে ভাবিনি। আমরা তো চাচ্ছি, মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্র উন্মোচন করা এবং এই অকল্যাণের শক্তিকে ধ্বংস করা। আপনি ঠিক বলেছেন স্যার, ওদের জানা ও পাকড়াও করা আমাদের লক্ষ্য। এটা করতে গেলে ওদের ঘাঁটি বা বাড়িও আমরা পেয়ে যাব। মেজর পাভেল বলল।
আমার বাবা যদি সত্যিই ওদের কবলে পড়ে থাকেন, তাহলে তার কাছ থেকে কোনো সাহায্য আমরা পেতে পারি না? বলল ক্যাপ্টেন আলিয়া।
প্রত্যক্ষ কোনো সাহায্য আমরা তাঁর কাছ থেকে পাব না। কিন্তু তার মাধ্যমে ব্যবস্থা করে আমরা মূল্যবান তথ্য যোগাড় করতে পারি।আমি ক্যাপ্টেন আলিয়াকে অনুরোধ করব, তাকে তার বাবার সবগুলো মোবাইল মনিটর করতে হবে এবং তার সাথে কারা সাক্ষাৎ করতে আসে, যতটা পারা যায় তাদের চিহ্নিত করতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তাকাল মেজর পাভেলের দিকে। বলল, মেজর পাভেল, তোমাদের কি মোবাইল ট্রাকিং যন্ত্র আছে?
জি, আছে স্যার। মেজর পাভেল বলল।
তাহলে ক্যাপ্টেন আলিয়া তার বাবার মোবাইলগুলো ট্রাকিং করতে পারে। এই সাথে তার বাবার সঙ্গে কারা কখন দেখা করছেন, সেটা দেখা এবং যতটা সম্ভব তাদের পরিচয় যোগাড় করাও তার দায়িত্বের মধ্যে থাকবে। বলল আহমদ মুসা।
বাবার টেলিফোন ট্রাকিং করবে তার মেয়ে, ব্যাপারটা বিব্রতকর। এই দায়িত্বটা অন্য কাউকে দিলে দ্বিতীয় কাজটা আমি সহজেই করতে পারি। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
ঠিক বলেছ ক্যাপ্টেন আলিয়া। তোমার বাবার মোবাইল ও টেলিফোন ট্রাকিং তোমার জন্যে বিব্রতকর, কিন্তু অন্য কেউ তা করলে সেটা হতে পারে তোমাদের পরিবারের জন্যে ক্ষতিকর। আমি চাই, ঐ একটি মাত্র বিষয় ছাড়া তোমাদের পারিবারিক সিক্রেসি তোমাদের কাছেই থাকবে। এজন্যে দায়িত্বটা তোমার উপর থাকাই ভালো। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। দেখছি, কোনো বিষয়ই আপনার বিবেচনার বাইরে থাকে না। আমি এদিকটা একেবারে চিন্তাই করিনি। অনেক ধন্যবাদ স্যার। আপনাকে। আপনার দেয়া দায়িত্ব আমি গ্রহণ করলাম স্যার। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
ক্যাপ্টেন আলিয়ার ইন্টারকমের নীল বাতি নিভে গিয়ে লাল বাতি জ্বলে উঠল।
ক্যাপ্টেন ইন্টারকমের স্পীকার অন না করে রিসিভারটা তুলে নিল। ওপারের কথা শুনে বলল, হ্যাঁ বল লেফটেন্যান্ট জামিল।
ওপাশের কথা শোনার পর বলল, কতক্ষণ আগে? ক্যামেরা হাতে ছিল?,
কোন দিকে পালিয়েছে?
আচ্ছা। বিষয়টা এত দেরিতে জানালে কেন? লোকটা কেমন দেখতে, রত্ন দ্বীপের?
ওপারের কথা বেশ কিছুক্ষণ ধরে শুনে বলল, ঠিক আছে লেফটেন্যান্ট জামিল। ও.কে ধন্যবাদ। কল অফ করে ক্যাপ্টেন আলিয়া ফিরে দাঁড়াল আহমদ মুসার দিকে। বলল, স্যার একটা ঘটনা ঘটেছে। আপনারা যখন আমাদের আউটপোস্টের গেট দিয়ে প্রবেশ করেন, তখন গেটের বিপরীত দিকের বাগানের ভেতর দাঁড়িয়ে একজন লোক ফটো তুলেছে। আপনাদের। আমাদের লোকরা তাদের ধরার চেষ্টা করলে তারা পালিয়ে যায়।
ভ্রূ কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। একটু চিন্তা করে বলল, ওরা কোন্ দিকে পালিয়ে গেছে?
পশ্চিম দিকে। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
আহমদ মুসা কোনো কথা বলল না। ভাবছিল সে। আহমদ মুসা। এখানে আসছে, এটা ওরা কি করে জানতে পারল? বলল আহমদ মুসা, ক্যাপ্টেন আলিয়া আমি এখানে আসছি, এ খবর ফাঁস হয়ে গেছে। শত্রুরা জানতে পেরেছে এ খবর। ফটোগ্রাফার হিসেবে যাকে তোমাদের লোক দেখেছে, সে আসলে কনফার্ম হতে এসেছি। ফটোও সেই তুলেছে।
থামল আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে, সংগে সংগেই আবার বলল, ক্যাপ্টেন আলিয়া এই আউটপোস্টে তোমার সিকিউরিটি ফোর্সরা এখন কোথায়?
ক্যাপ্টেন আলিয়া একটু চমকে ওঠার মতো চেহারা নিয়ে বলল, স্যার এটা জিজ্ঞাসা করছেন কেন? ওদের কয়েকজন গেটে আছে। অধিকাংশই চারদিকে পাহারায় আছে।
রুটিন পাহারা? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হ্যাঁ, তাই তো। কিন্তু এসব জিজ্ঞাসা করছেন কেন স্যার? ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
ক্যাপ্টেন আলিয়া, মেজর পাভেল আমি মনে করছি যেকোনো সময় তোমাদের এই আউটপোস্ট আক্রান্ত হবে। বলল আহমদ মুসা।
লাফ দিয়ে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল মেজর পাভেল ও ক্যাপ্টেন আলিয়া। তাদের চোখে-মুখে অপার বিস্ময়! বলল মেজর পাভেল, সত্যিই কি আমরা এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছি? আমাদের সিকিউরিটি ফোর্সকে সেভাবে এলার্ট করা নেই!
আমি আসার পর এক ঘন্টার মতো সময় গেছে। আমি আসার সাথে সাথে ওদের কাছে গ্রীন সিগন্যাল পৌঁছেছে। ওরা প্রস্তুত হয়ে আসতে কতটুকু সময় লাগবে আমি জানি না। তবে এক ঘন্টা সোয়া ঘন্টা সময় যথেষ্ট হতে পারে। তারা নিশ্চয় ধারণা করবে আমি বেশি সময় একটা সিকিউরিটি পোস্টে দেব না। সুতরাং তাড়াহুড়া করবে এটা স্বাভাবিক। বলল আহমদ মুসা।
আমি বুঝতে পেরেছি স্যার। আমাদের আরও সাবধান হওয়ার দরকার ছিল। আপনার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়া নিশ্চয় আমরা ঠেকাতে পারতাম। স্যার আমি আসছি, বাইরের ব্যবস্থা আমি দেখি কি করা যায়।
বলেই ডবল মার্চ করে ছুটল দরজার দিকে, বাইরে বেরুবার জন্যে।
দরজার পরেই একটা কোর্ট ইয়ার্ড। বেশ বড়। কোর্ট ইয়ার্ডের উত্তর। পাশে পূর্ব অংশে আউটপোস্টের অফিস। এর পশ্চিম অংশ ও পশ্চিম পাশ জুড়ে সিকিউরিটি ফোর্সের ব্যারাক। আউটপোস্টে ঢোকার গেটটা পূর্ব। অংশের মাঝামাঝি জায়গায়। গোটা আউটপোস্টটাই প্রাচীর ঘেরা।
ক্যাপ্টেন আলিয়া দরজায় পৌঁছতেই আউটপোস্টের চারপাশ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র গর্জন করে উঠল প্রায় একই সাথে।
স্টেনগানের ব্রাশফায়ার।
দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাল ক্যাপ্টেন আলিয়া।
ক্যাপ্টেন আলিয়া ফিরে এস। অনেকটা নির্দেশের কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ শান্ত, সহজ। মুখ উদ্বেগহীন। যেন ঘটনা তার উপর কোনো ক্রিয়া করেনি।
থমকে দাঁড়িয়েই ক্যাপ্টেন আলিয়া তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। তার মুখ উদ্বেগ-উত্তেজনায় পিষ্ট।
মেজর পাভেলেরও একই অবস্থা। সেও তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। আকস্মিকতায় সে হতভম্ব, বিমূঢ়।
আহমদ মুসার নির্দেশ পেয়ে ক্যাপ্টেন আলিয়া আহমদ মুসার সামনে এসে মেজর পাভেলের পাশে দাঁড়াল।
এখনি দুজনে দুটি স্টেনগান ও কিছু ম্যাগজিন নিয়ে তোমরা পূর্বদিক থেকে ব্যারাকের প্রথম যে ঘর সেখানে পজিশন নাও। আর…..।
আহমদ মুসা কথা শেষ করার আগেই মেজর পাভেল বলল, স্যার, ওঁরা এখনও ভেতরে ঢোকেনি। আমরা গেটে গিয়ে ওদের বাধা দিতে পারি।
ধন্যবাদ মেজর। কিন্তু না। ওদের ভেতরে ঢোকার সুযোগ দাও। সবাই ওরা ভেতরে ঢুকুক। ওদের যখন ভেতরে ঢোকা শেষ হবে, কোর্ট ইয়ার্ডের মাঝামাঝি যখন ওরা পৌঁছবে, তখন তোমরা গুলি শুরু করবে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত গুলি তোমাদের থামবে না। ঠিক আছে? যাও, আল্লাহ হাফেজ। বলল আহমদ মুসা।
ওদের বিস্ময় লাগল আহমদ মুসার সহজ, শা ও হাসিমাখা মুখ দেখে। মুখটিতে তারা অভয় আলোর যে প্রকাশ দেখল, তা যেন তাদের মনের ভয়, উদ্বেগকে দূর করে দিল। মেজর পাভেল ও ক্যাপ্টেন আলিয়া পরস্পর একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ছুটল ব্যারাকের সেই প্রথম ঘরটিতে পজিশন নেবার জন্যে।
আহমদ মুসা অফিসের পাশাপাশি তিনটি কক্ষের দরজা খুলে দিল। তারপর মাঝের দরজার আড়ালে পজিশন নিল। তার দুই হাতে দুটি এম ১৬ মেশিন রিভলবার।
এক দেড় মিনিটের মধ্যেই গুলি করতে করতে শর্করা প্রবেশ করল আউটপোস্টের কোর্ট ইয়ার্ডে। কোর্ট ইয়ার্ডের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসেই তাদের দ্বিধাগ্রস্ততা দেখা দিল। কোনো দিক থেকে কোনো বাধা এ পর্যন্ত না পাওয়ায় তারা যেন বুঝতে পারছিল না কোন দিকে যাবে তারা, ব্যারাকের দিকে, না অফিসের দিকে?।
তাদের এই দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় ব্যারাক থেকে মেজর পাভেল ও ক্যাপ্টেন। আলিয়ার গুলি বর্ষণ শুরু হলো। ( উন্মুক্ত কোর্ট ইয়ার্ডে এভাবে আকস্মিক আক্রমণের শিকার হয়ে তারা কেউ শুয়ে পড়ল, কেউ কেউ অফিস কক্ষের উন্মুক্ত দরজার দিকে দৌড়াতে লাগল।
ওরা দরজার কাছাকাছি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল আহমদ মুসা। যারা দরজার দিকে ছুটে আসছিল, তাদের সামনে শত্রু ছিল না বলে তাদের সবারই স্টেনগানের ব্যারেল নিচে নামানো।
আহমদ মুসা তার দুই তর্জনী দুই এম-১৬ এর ট্রিগারে রেখে বেরিয়ে এল। চিৎকার করে বলল, ফেলে দাও তোমরা তোমাদের হাতের স্টেনগান।
উত্তরে ওদের সবার স্টেনগান উপরে উঠে আসছিল আহমদ মুসার লক্ষ্যে। আহমদ মুসার দুই এম-১৬ দুই প্রান্ত থেকে গুলি শুরু করল। দুই প্রান্ত থেকে দুই হাত সামনে এসে জোড় হবার আগেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে আহমদ মুসা সামনে থেকে আসা গুলি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে। সামনে যে কয়েকজন তাদের পেছনে বিক্ষিপ্তভাবে ছিল আরও কয়েকজন টার্গেটে চলে এলো।
সামনে গুলি বর্ষণ শেষ হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা মাথা সামনে ছুঁড়ে দিয়ে দেহটাক দুই বার ঘুরিয়ে নিল এবং আবার চিৎ হয়েই ভূমিশয্যা নিল। তার হাতে প্রস্তুত দুই এম-১৬ মেশিন রিভলবার। মাটিতে দেহ স্থির হবার আগেই আহমদ মুসার দুই মেশিন রিভলবার অগ্নিবৃষ্টি শুরু করল।
পেছনে আরও যারা আসছিল খোলা দরজা দিয়ে অফিস রুমের দিকে তারাও আহমদ মুসার এই গুলি বৃষ্টির শিকারে পরিণত হলো।
ওদিকে যারা কোনো শেল্টার না পেয়ে মাঠের মাঝখানে শুয়ে পড়েছিল আত্মরক্ষার জন্যে, মেজর পাভেল ও ক্যাপ্টেন আলিয়ার অবিরাম গুলি বৃষ্টির শিকার হওয়ায় তারাও কোনো দিকেই আর সরে যেতে পারেনি। শোয়া অবস্থাতেই তাদের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা গুলি বন্ধ করে চারদিকটা দেখে প্রথমে উঠে বসল, তারপর উঠে দাঁড়াল।
প্রথম থেকেই মেজর পাভেল ও ক্যাপ্টেন আলিয়া আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছিল। তারা আহমদ মুসাকে উঠে দাঁড়াতে দেখল, তখন মেজর পাভেল ও ক্যাপ্টেন আলিয়া গুলি বর্ষণ বন্ধ করে ছুটে বেরিয়ে এলো আহমদ মুসার কাছে।
ধন্যবাদ স্যার, আমরা যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। বলল মেজর পাভেল ও ক্যাপ্টেন আলিয়া একসাথে। আবেগে প্রায় অবরুদ্ধ তাদের কণ্ঠ।
ধন্যবাদ তোমাদের। তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছ। এরা দেখছি বিরাট সংখ্যায় এসেছিল। এই মাঠেই দেখা যাচ্ছে। ওদের পঁচিশটি লাশ পড়ে আছে। চল দেখি বাইরে ওরা আমাদের কি ক্ষতি করেছে। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আপনি ভেতরেই অপেক্ষা করুন। বাইরে কোনো শত্রু ওঁৎ পেতে থাকতে পারে। আপনাকে হত্যার জন্যেই তারা এই বিরাট আয়োজন করেছিল। বাইরেটা আমরাই দেখে আসছি। মেজর পাভেল বলল।
স্যার, মেজর পাভেল স্যার ঠিকই বলেছেন। বাইরে শত্রু ওঁৎ পেতে থাকার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। ক্যাপ্টেন আলিয়া বলল।
বাইরে ওদের কোনো লোক নেই। বাইরেটা নিরাপদ করে ওরা সর্বশক্তি নিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল। বাইরে কিছু দূরে তাদের ইনফরমার থাকতে পারে। চল। বলল আহমদ মুসা।
সবাই বাইরে এল। গেটে দাঁড়ানো দুইজনসহ মোট ছয়জন নিরাপত্তা। কর্মী মারা গেছে। নিহত প্রত্যেক নিরাপত্তা কর্মীকে চেক করে দেখতে। পেল তাদের উপর আক্রমণ এতোটাই আকস্মিক ছিল যে, কেউ তাদের স্টেনগান হাতে নেবারও সুযোগ পায়নি।
রত্ন দ্বীপের নিরাপত্তা কর্মীরা আগে লাঠি ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র বহন করতো না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কন্যা ডেসপিনা ও জাহরা নামের অন্য একজন মেয়ে কিডন্যাপ হওয়া ও চারজন নিরাপত্তা কর্মী মারা যাওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই নিরাপত্তা কর্মীদের স্টেনগান ও রিভলবার দেয়া হয়েছে।
ক্যাপ্টেন আলিয়া, আপনি আপনার গ্যারিসন থেকে কিছু নিরাপত্তা কর্মীকে ডেকে পাঠান এই মুহূর্তে। আর মেজর পাভেল, আপনি কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদকে এক্ষণি সব ঘটনা জানান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও অবহিত করুন। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। আর যতক্ষণ নিরাপত্তা কর্মীরা না আসছে, ততক্ষণ আমরাই বাইরের গেটে পাহারায়। থাকবো।
দশ মিনিটের মধ্যেই ক্যাপ্টেন আলিয়ার গ্যারিসন থেকে দশজন নিরাপত্তাকর্মী এসে গেল। বিশ মিনিটের মধ্যেই এসে গেল স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস এবং নিরাপত্তা ফোর্সের প্রধান কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ ও তার সাথের অন্যান্য অফিসার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস, কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ, মেজর পাভেল, ক্যাপ্টেন আলিয়া এবং অন্যান্য অফিসারসহ আহমদ মুসা বসা ওবাদিয়ার পাহাড়ী আউটপোস্ট অফিসে।
গোটা ঘটনার রিপোর্ট দিচ্ছিল মেজর পাভেল। সবে বক্তব্য শেষ করেছে মেজর পাভেল। তখন ক্যাপ্টেন আলিয়ার ইন্টারকম রেড সিগন্যাল দিতে শুরু করল।
ক্যাপ্টেন আলিয়া, দেখ তোমার ইন্টারকম কি বলে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
স্যরি ফর ডিস্টারবিং। আমি দেখছি স্যার।
ক্যাপ্টেন আলিয়া ইন্টারকমে কথা বলল।
কথা বলার পর ইন্টারকম হোন্ড করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল, স্যার, আমার বাবা পাশের রুমে। তিনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন।
তোমার বাবা মানে ডেভিড অ্যারিয়েল? ডাক, তাকে এখানে ডাক। পাশের রুমে কেন? এ কথা শেষ করেই বলল, ঠিক আছে তুমি নয়, আমিই তার সাথে কথা বলছি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন আলিয়ার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে কথা বলল ডেভিড অ্যারিয়েলের সাথে। আসতে বলল এই কক্ষে।
ডেভিড অ্যারিয়েল ও তার বডিগার্ড আসার কথা শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ক্যাপ্টেন আলিয়ার পি.এ মার্গারেট ক্যাপ্টেন আলিয়ার বাবা ডেভিড অ্যারিয়েলকে নিয়ে এ ঘরে প্রবেশ করল।
একটা অস্পষ্ট বিপ বিপ শব্দ আসছিল আহমদ মুসার কানে। শেষে সে বুঝল শব্দটা তারই রিস্টওয়াচ থেকে।
আহমদ মুসা দ্রুত এবং সবার অলক্ষ্যে তার চোখ দুটি নামিয়ে নিয়ে এলো তার রিস্টওয়াচের দিকে, তার সন্দেহ কি সত্যি হতে যাচ্ছে। দেখল, তার হাতঘড়ির স্ক্রিনে একটা ফ্লাসিং রেড ডট। চমকে উঠল আহমদ মুসা। একটা শক্তিশালী বোমা তাদের বসে থাকার জায়গা থেকে দশ মিটার পশ্চিমে। তার মানে বোমাটা ক্যাপ্টেন আলিয়ার পি.এর কক্ষে। ঘড়ির স্ক্রিনে বোমার যে রেডিয়াস দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে। ক্যাপ্টেন আলিয়ার তিন অফিস কক্ষ, ব্যারাক ও কোর্ট ইয়ার্ডের একাংশ। বোমাটা কার কাছে? কে আনল? বোমাটা যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
আহমদ মুসা দ্রুত এক্সকিউজ মি! বলে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, মি. ডেভিড অ্যারিয়েল আপনি কি একা এসেছেন?
না, সাথে বডিগার্ড এসেছে। কেন? জবাব দিয়ে প্রশ্ন তুলল ডেভিড অ্যারিয়েল। তার মুখে বিরক্তির প্রকাশ স্পষ্ট।
আহমদ মুসা ডেভিড অ্যারিয়েলের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মনে মনে হিসাব করল, ডেভিড অ্যারিয়েল তার বডিগার্ড নিয়ে অফিসে, প্রবেশের কমপক্ষে পাঁচ মিনিট পার হয়েছে। নিশ্চয় বোমাটি দূর নিয়ন্ত্রিত। পাঁচ মিনিট কম সময় নয়, আর কত সময় দেবে ওরা! _ বিব্রত ক্যাপ্টেন আলিয়া, বিস্মিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সবাই তাকিয়ে আছে। আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। বলল, মি, হোম মিনিস্টার ক্রিস কনস্টানটিনোস, আপনার ধ্যমে সবার কাছে আমার অনুরোধ, এই মুহূর্তে এই ঘর ত্যাগ করে আমাদের কোর্ট ইয়ার্ডের দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে হবে এবং সেটা খুবই দ্রুত! বলে নিজে তার ব্যাগটা নিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
কিন্তু কেন মি. আহমদ মুসা? জিজ্ঞাসা করল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
নিচু, কিন্তু স্পষ্ট কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল, আমি আশঙ্কা করছি, যেকোনো সময় এখানে ভয়ংকর বোমার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো কাজ করল। সবাই দ্রুত উঠে দাঁড়াল।
ক্যাপ্টেন আলিয়ার আব্বাও। কিন্তু সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার বডিগার্ডের কাছে আমার একটা জরুরি ডকুমেন্ট আছে, ওটা নিয়ে আমি এখনই আসছি।
বলে পাশের ঘরের দিকে যাবার জন্যে সে পা বাড়াল।
আহমদ মুসা তার সামনে দাঁড়িয়ে বাধা দিয়ে বলল, আপনি ঐ ঘরে যেতে পারেন না। আপনি বাইরে চলুন।
আমি তাহলে বডিগার্ডকে ডাকছি? বলল ক্যাপ্টেন আলিয়ার আব্বা
ডেভিড অ্যারিয়েল একটু শক্ত কণ্ঠে।
আপনি বডিগার্ডকে ডাকতেও পারবেন না, তার সাথে কথাও বলতে পারবেন না। আপনি প্লিজ বাইরে চলুন। আহমদ মুসার কণ্ঠ শান্ত, কিন্তু খুবই শক্ত।
অপমানিত হবার চিহ্ন ফুটে উঠল ডেভিড অ্যারিয়েলের চোখে-মুখে। বলল লে আহমদ মুসাকে, আপনি সৌজন্যের সীমা লংঘন করেছেন।
সে বিচার পরে হবে। আপনি প্লিজ এখন চলুন। আগের সেই শক্ত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
ক্যাপ্টেন আলিয়া এবং মেজর পাভেল দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে। বিমূঢ় ভাবে। তারা বিব্রত। ডেভিড অ্যারিয়েল যা বলছেন, তার পেছনে যুক্তি আছে। কিন্তু আহমদ মুসা কেন বডিগার্ডকে ডাকতে ও কথা বলতেও দিতে রাজি নয়- এটা তারা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। বোমার ব্যাপারটা সত্য হলে বডিগার্ডেরও তো বাঁচা দরকার। কিন্তু তবুও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ মুসার সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করছে।
শেষ পর্যন্ত সবাই প্রায় বেরিয়ে গেলে ক্যাপ্টেন আলিয়া তার বাবাকে ধরে নিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরুবার জন্যে হাঁটতে লাগল।
সবার শেষে আহমদ মুসা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
কোর্ট ইয়ার্ডের দক্ষিণ প্রান্তে অনেকেই পৌঁছে গেছে। অনেকে মাঠের মাঝ বরাবর।
আহমদ মুসা যখন বোমার রেডিয়াস সার্কেল পার হতে যাচ্ছে, তখন ভীষণ শব্দে মাটি কেঁপে উঠল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো।
আহমদ মুসা ছিটকে পড়ার মতো শব্দের সাথে সাথেই লাফ দিয়ে পড়ল গিয়ে বেশ খানিকটা দূরে মাটির উপর।
ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল চারদিক।
আহমদ মুসা মাটির উপর শুয়ে ভাবল ক্যাপ্টেন আলিয়ার পি.এ. মার্গারেটের কথা। কষ্ট লাগল মনে। নিরপরাধ মেয়েটা কি প্রাণ হারাল? ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে ডাকা গেল না। তাকে ডাকতে গেলেই ডেভিড অ্যারিয়েলের বডিগার্ড সব জানতে পারত। বডিগার্ড বেরিয়ে গেলে বিপদ আরও বাড়ত।
ঘন ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে চারদিকটা।
কোর্ট ইয়ার্ডের একদম শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে স্বরাষ্ট্রান্ত্রী, কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ ও অন্যান্য স্টাফ। ওখানে ধোঁয়া তেমন পৌঁছেনি।
সেখানে গিয়ে পরে পৌঁছল তার বাবাসহ ক্যাপ্টেন আলিয়া এবং তাদের সাথে মেজর পাভেলও।
আহমদ মুসা কোথায়? সবাই আমরা এখানে পৌঁছেছি। তিনি কোথায়? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করল মেজর পাভেল ও ক্যাপ্টেন। আলিয়াকে।
উনি সব শেষে কক্ষ থেকে বেরিয়েছেন। উনি আমাদের সাথেই ছিলেন। নিশ্চয় তিনি আছেন কোথাও।
তাকে দেখ। ডাকো। তিনি সাক্ষাৎ দেবদূতের মতো আমাদের রক্ষা করেছেন। ঈশ্বর তাকে কি অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি বাতাস থেকে বিপদের সন্ধান পেলেন এবং আমাদের রক্ষা করলেন। সমস্ত জীবনের জন্যে তিনি আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে বেঁধে ফেলেছেন। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি তো আমাকে হাত ধরে মৃত্যুর মুখ থেকে টেনে এনেছেন। আমি তো তার মত উপেক্ষা করেই ওঘরে যাচ্ছিলাম বডিগার্ডের কাছে। গেলে নির্ঘাত বিস্ফোরণের কবলে পড়তাম। সে সময় আহমদ মুসার রূঢ় আচরণ আমার খুব খারাপ লেগেছিল, কিন্তু তার ঐ রূঢ় আচরণই আমাকে রক্ষা করেছে। তার সম্পর্কে আগেও আমি শুনেছি কিন্তু ভাবিনি, এমন বিস্ময়কর মানুষ তিনি যাকে শুধু শ্রদ্ধাই করা যায়। ক্যাপ্টেন আলিয়ার বাবা ডেভিড অ্যারিয়েল বলল।
আহমদ মুসা এল।
আহমদ মুসাকে দেখেই ক্যাপ্টেন আলিয়ার বাবা ডেভিড অ্যারিয়েল তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার তখনকার ব্যবহারের জন্যে আমি দুঃখিত। আপনার কথা না শুনলে আমি মারা পড়তাম। আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন নির্ঘাত এক মৃত্যুর হাত থেকে।
কাউকে মারা বা বাঁচানো সব আল্লাহ তায়ালার কাজ। তাঁকেই ধন্যবাদ দিন। আমি আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই, বলতে পারি? বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হবো। বলুন। ডেভিড অ্যারিয়েল বলল।
আপনার বডিগার্ড যাকে এনেছিলেন, তাকে কতদিন ধরে চেনেন? বলল আহমদ মুসা।
আমার আগের বডিগার্ড ছুটিতে। নতুন বডিগার্ডকে নিয়োগ দিয়েছি তিন চার দিন হলো। বলল ডেভিড অ্যারিয়েল।
একে কোত্থেকে পেয়েছেন? আগে থেকে পরিচিত?
আগে থেকে পরিচিত নয়। আমার এক বন্ধুর রিকমেন্ডেশনে তাকে আমি নিয়েছি। বলল ডেভিড অ্যারিয়েল।
সেই বন্ধুটি আপনার সাথে পরিচিত কত দিন থেকে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
সপ্তাহ দুই থেকে পরিচিত। হঠাৎ করেই তাদের সাথে পরিচিত হই। বলল ডেভিড অ্যারিয়েল।
আমি নিশ্চিত, আপনার সে বন্ধুরাই আপনার বডিগার্ডের মাধ্যমে বোমাটা পাঠিয়েছিল। আহমদ মুসা বলল।
আমাকে হত্যার জন্যে? বলল ডেভিড অ্যারিয়েল। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
না আপনাকে নয়, আমাকে হত্যার জন্যে। কিন্তু তারা জানত আমাকে এভাবে হত্যা করতে গিয়ে আপনি, আপনার বডিগার্ডসহ সবাই নিহত হবেন। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু বডিগার্ড তো তাদের লোক। তাকে তারা হত্যা করবে কেন? বলল ডেভিড অ্যারিয়েল।
অনেক সময় বড় লাভ করতে গিয়ে ছোট লাভ কুরবানী দিতে হয়। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু বডিগার্ডটি তার মৃত্যুর কথা জেনেও কেন বোমাটি বহন করবে? বলল ডেভিড অ্যারিয়েল।
আমি নিশ্চিত, বডিগার্ড জানত না যে সে বোমা বহন করছে। পকেটে বহন করার মতো একটা প্যাকেট দিয়ে তাকে নিশ্চয় এ ধরনের কথা বলা হয়েছিল যে, প্যাকেটে একটা সাউন্ড মনিটরিং আছে, এটা শুধু বহন করলেই চলবে। আহমদ মুসা বলল।
এত নৃশংস ওরা? তাদের স্বার্থ পূরণের জন্যে তাদের লোক, আমাকেসহ এত লোককে তারা হত্যা করতে চেয়েছে! বলল ডেভিড অ্যারিয়েল।
আহমদ মুসা তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। বলল, মি. হোম মিনিস্টার, আপনি এদিকের জন্যে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তা করুন। আমি মনে করছি, আইন-শৃখলা পরিস্থিতি নিয়ে একটু বসা দরকার।
মি. ডেভিড অ্যারিয়েলের নতুন বন্ধু যারা জড়িত এই বোমা বিস্ফোরণের সাথে, তাদের পাকড়াও করা গেলে তো আমরা অনেক কিছু জানতে পারবো। মি. ডেভিড অ্যারিয়েল নিশ্চয় আমাদের সহযোগিতা করবেন। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
মি. ডেভিড কনস্টানটিনোস এ ব্যাপারে আমাদের কোনো সহযোগিতা করতে পারবেন না, উপরন্তু তাঁর বন্ধুদের ব্যাপারটা যে এখানে আলোচনা হয়েছে, আমরা তাদের সন্দেহ করেছি, এ বিষয়টাও তাদের জানতে দেয়া যাবে না। এ ব্যাপারে মি. ডেভিড অ্যারিয়েল তাদেরকে কিছু জানানো ঠিক হবে না।
কেন? প্রশ্ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
মি. ডেভিডকে কোনওভাবে তারা সন্দেহ করলে, কিংবা মি. ডেভিডের প্রতি তারা বিশ্বাস হারালে, মি. ডেভিডকে তারা বাঁচতে দেবে না। বলল আহমদ মুসা।
ভীতি ও আশঙ্কায় মুখ চুপসে গেছে ডেভিড অ্যারিয়েলের। বলল, জনাব আহমদ মুসা ঠিক বলেছেন। ওরা এটা করতে পারে।
করতে পারে নয় জনাব করবে। আমি তো আশঙ্কা করছি মি. ডেভিড অ্যারিয়েল। যেকোনো সময় বিপদ ঘটতে পারে। এই বোমা বিস্ফোরণের জন্যে আপনার বডিগার্ডকে সন্দেহ করা হবে এবং সেই হেতু আপনিও সন্দেহের তালিকায় পড়বেন। আপনি তাদের কথা ফাঁস করে দিতে পারেন। সুতরাং প্রথমেই ওরা চেষ্টা করবে আপনার মুখ বন্ধ করার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
মি, আহমদ মুসা আপনি যা বলেছেন, সেটাই ঘটবে। আমি তাদের। জানি। তাহলে এখন আমি কি করব? ডেভিড অ্যারিয়েল বলল। তার দিশেহারা অবস্থা।
আমি মনে করি আপনার নিরাপত্তার সহজ উপায় হলো একথা ঘোষণা করে দেয়া যে, নিরাপত্তা বাহিনী আপনাকে গ্রেফতার করেছে। আমি মনে করি আপনি রাজধানীতে গিয়ে কয়েকদিন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রোটেকশনে থাকুন। বলল আহমদ মুসা।
ডেভিড অ্যারিয়েল তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোসের দিকে।
হ্যাঁ মি. ডেভিড অ্যারিয়েল আহমদ মুসা ঠিক বলেছেন। আপনি আমাদের সাথে রাজধানীতে চলুন। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে কয়েকদিন থাকুন আমাদের মেহমান হিসাবে।
বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল কর্নেল জেনারেল রিদার দিকে। বলল, তুমি ওর জন্যে একটা ভালো ব্যবস্থা করো।
আমি যদি রাজধানীতে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকি, কিংবা দেশের বাইরে যাই? বলল ডেভিড অ্যারিয়েল।
দেখুন মি. ডেভিড অ্যারিয়েল, আপনি এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর কাস্টোডিতে থাকলেও আপনাকে ওরা উদ্ধার ও মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করবে। কারণ আপনিই একমাত্র জীবন্ত সাক্ষী তাদের বিরুদ্ধে। বিদেশেও আপনি নিরাপদ নন। আহমদ মুসা বলল।
ডেভিড অ্যারিয়েল হতাশভাবে তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। বলল, আপনি যা বলেছেন তাই করুন।
মি. ডেভিড অ্যারিয়েল, আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। আমি এখনি এই পাহাড়ে ঢুকতে চাই। আমি মনে করি এই ওবাদিয়ার পাহাড়ে ওদের একটা ঘাটি বা আস্তানা ধরনের কিছু আছে। আপনি কি আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারেন? বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ওবাদিয়ার পাহাড়ে ঢুকবে শত্রুদের ঘাঁটির সন্ধানে, একথা শোনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কর্নেল জেনারেল রিদা আহমদ, মেজর পাভেল, ক্যাপ্টেন আলিয়াসহ উপস্থিত সব নিরাপত্তা অফিসারের চোখে মুখে বিস্ময় ও উদ্বেগ দেখা দিল। বিস্ময়ে মুখ ছেয়ে গেছে ডেভিড অ্যারিয়েলেরও। আহমদ মুসার অনুরোধের জবাব সে সংগে সংগে দিল না। তার দুচোখে শূন্য দৃষ্টি। ভাবছে সে। এক সময় তার শূন্য দৃষ্টি গিয়ে নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার মুখে। বলল ধীরকণ্ঠে, আপনার সম্পর্কে আমি শুনেছি আহমদ মুসা। আপনার কাছে আমি কিছুই লুকাতে পারবো না। আপনি ইতিমধ্যেই হয়তো সব জেনে ফেলেছেন। আপনার প্রশ্ন শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে আমার সম্পর্কে আপনার অজানা কিছু নেই। এরপরও আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আপনার চেয়ে বড় বন্ধু আমার আর কেউ নেই। কথা শেষ করতে পারলো না ডেভিড অ্যারিয়েল। কান্নায় কণ্ঠে কথা আটকে গেল তার।
কান্না চেপে ডেভিড অ্যারিয়েল পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছল। বলল সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে, আমি আমার জনগণের কাছে অপরাধ করেছি। আমার দেশ আমাকে যে শাস্তি দেয় আমি তা মাথা পেতে নেব। আমি আমার জীবন ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে ওদের কথায় সায় দিয়ে, ওদের সাহায্য করে আমার দেশকে আমি বিপদে ফেলতে যাচ্ছিলাম। থামল ডেভিড অ্যারিয়েল।
ক্যাপ্টেন আলিয়ার দুচোখ থেকে অশ্রু গড়াচ্ছে। সে আস্তে আস্তে পিতার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পিতার কাঁধে হাত রেখে বলল, বাবা আমি তোমার জন্যে গর্বিত। তুমি দেশকে ভালোবাস বলেই এই সাহসের কথাগুলো বলতে পারলে বাবা।
ডেভিড অ্যারিয়েল তাকাল মেয়ের দিকে। বলল, আহমদ মুসার মানবতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাকে এই সাহস যুগিয়েছে মা, আমাকে সংশোধনও করেছে। ডেভিড অ্যারিয়েলের কণ্ঠ আবেগে ভারি।
হ্যাঁ বাবা, উনি আল্লাহর এমন একজন প্রিয় বান্দাহ যার কাছে বিপন্ন মানুষের সাহায্য ও সেবার চেয়ে বড় কিছু নেই। বলল ক্যাপ্টেন আলিয়া অঞরুদ্ধ কণ্ঠে।
ডেভিড অ্যারিয়েল রুমালে ভালো করে চোখ-মুখ মুছে নিয়ে দুধাপ পিছিয়ে গিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ল। বলল, মি, আহমদ মুসা আসুন। বসে কথা বলি। আহমদ মুসা গিয়ে তার সামনে বসল।
ডেভিড অ্যারিয়েল তার কিডন্যাপ হওয়া থেকে কথা শুরু করল। বন্দী থাকার অবস্থা, মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট তাদের পরিকল্পনার কথা তাকে বলা, প্রলোভন দেখানো ইত্যাদি সবকিছুই একে একে আহমদ মুসাকে সে বলল। তাদের কাছে থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ওদের যা কিছু জেনেছে, দেখেছে সবকিছু সে জানাল আহমদ মুসাকে। তারপর ওদের আস্তানার বিবরণ, সেখানে যাবার পথ সবই বলল সে আহমদ মুসাকে। সবশেষে সে বলল, অঢেল ধনভাণ্ডার উদ্ধার করার জন্যে দ্বীপের যত লোক তাদের মারার দরকার হবে তারা তা মারবে।
শুধু দ্বীপের গোপন ধনভাণ্ডার লুট করাই কি তাদের লক্ষ্য, না আরও। কিছু লক্ষ্য আছে? বলল আহমদ মুসা।
মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের মূল লক্ষ্য দ্বীপের ধনভাণ্ডার লুট করা। তবে যারা তাদের অর্থ যোগাচ্ছে, তারা চায় দ্বীপে মুসলিম-খ্রিস্টান-ইহুদি সমঝোতা ও সহযোগিতাকে ধ্বংস করতে এবং সমঝোতা-সহযোগিতার অনন্য দৃষ্টান্তকে তারা এই দেশ থেকে মুছে ফেলতে চায়। এর মাধ্যমে তারা এই দ্বীপকেও তাদের দখলে আনতে চায়। ডেভিড অ্যারিয়েল বলল।
এই পক্ষটা কে বা কারা? বলল আহমদ মুসা।
আমি এটা জানতে পারিনি। তারা এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি। দেখেছি, মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট ঐ পক্ষকে বাঘের মতো ভয় করে। ওদের কোনো কথার অন্যথা তারা করে না। ডেভিড অ্যারিয়েল বলল।
ধন্যবাদ মি. ডেভিড অ্যারিয়েল। আপনার এই সাহায্য আমার কাছে অমূল্য। অনেক ধন্যবাদ! বলল আহমদ মুসা।
দুজনেই উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাদের দিকে এগিয়ে এলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ধন্যবাদ ডেভিড অ্যারিয়েল। আর মি. আহমদ মুসা। আমরা আনন্দিত যে প্রয়োজনীয় সব তথ্যই পেয়েছেন। রত্ন দ্বীপের স্বার্থে আপনার এই ত্বরিত উদ্যোগকে আমরা অভিনন্দিত করছি। কিন্তু একটা ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত আমরা মানতে পারছি না। এখানে আমরা সবাই আলোচনা করে দেখলাম, আপনাকে এখনই এবং একা.আমরা ওবাদিয়ার পাহাড়ে যেতে দিতে পারি না।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, আমরা বলা যায় এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। শত্রুকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরে ফেলা যুদ্ধের একটা মূল্যবান কৌশল। শত্রু কোনো নতুন পরিকল্পনা করার আগেই শত্রুর নিকট আমি পৌঁছতে চাই।
আমরা আপনার সাথে দ্বিমত করি না। ঠিক আছে আপনি যান। সিকিউরিটি ফোর্স সাথে নিন। মেজর পাভেল, ক্যাপ্টেন আলিয়া তো আপনার পরিচিত হয়ে গেছে। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
আমি ওবাদিয়ার পাহাড়ে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। আমি যাচ্ছি মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে। এ কাজের জন্যে ওদের আস্তানায় ঢুকতে হবে। এই কাজটা করতে হবে গোপনে, অতি সন্তর্পণে। এই ধরনের কাজ তাই একা করতে হয়। আহমদ মুসা বলল।
গোপন অভিযান একাধিক লোক নিয়েও হতে পারে। আপনি অন্তত: মেজর পাভেলকে সাথে নিয়ে যান। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
হা মি. ক্রিস কনস্টানটিনোস, আমি মেজর পাভেলকে সাথে নিতে পারি সে যদি এই ঝুঁকি নিতে রাজি হয়। আহমদ মুসা বলল।
আপনার সাথী হতে পারলে আমি মরতেও রাজী আছি। আপনাকে ধন্যবাদ স্যার। বলল মেজর পাভেল।
ধন্যবাদ মেজর পাভেল। মৃত্যুভয়কে যে জয় করতে পারে, সে ভালো সাথী। আল হামদুলিল্লাহ। আহমদ মুসা বলল।
মেজর পাভেল স্যার যাচ্ছে স্যারের সাথে। আমিও যাব। বলল ক্যাপ্টেন আলিয়া।
না ক্যাপ্টেন আলিয়া। তুমি ওবাদিয়া গ্যারিসনের দায়িত্বে আছ। তোমাকে এখানেই থাকতে হবে প্রস্তুত হয়ে। এটা আমার অনুরোধ। আহমদ মুসা বলল।
অনুরোধ নয় স্যার, আদেশ বলুন। আমি আপনার আদেশ পালন করব। বলল ক্যাপ্টেন আলিয়া।
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন আলিয়া। আহমদ মুসা বলল।
স্যার, আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে। আপনি আমাদের সবার সাথে বসে ছিলেন। আপনি জানলেন কি করে যে, আমার পি.এ-র ঘরে বোমা আছে এবং সে বোমা আছে বাবার বডিগার্ডের কাছে? বলল ক্যাপ্টেন আলিয়া।
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন আলিয়া, এ প্রশ্ন আমারও। সুযোগ হয়নি প্রশ্নটা করার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।
অন্যান্য সবাই একযোগে বলে উঠল, এ বিষয়ে আমাদের মনেও কৌতূহল রয়েছে। আমরাও জানতে চাই তিনি কিভাবে এটা সম্ভব করলেন?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, যখন শুনলাম ডেভিড় অ্যারিয়েল, তার বডিগার্ডসহ এখানে এসেছেন মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের এত বড় বিপর্যয়ের পরও, তখনই মনে হলো মিড় ব্ল্যাক সিন্ডিকেট এদের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক পাল্টা আঘাতের ষড়যন্ত্র করেছে কিনা। চিন্তা করলাম পাল্টা আঘাত কি হতে পারে? এই প্রশ্নের সন্ধান করতে গিয়ে আমি আমার হাতঘড়ির ডেটোনেশন মনিটর অন করে দিয়েছিলাম। হাতঘড়ির এই ডেটোনেটরই পাশের ঘরের বোমা ডিটেক্ট করেছে। আমি সংগে সংগেই বুঝেছিলাম ডেভিড অ্যারিয়েলের বডিগার্ডই জেনে অথবা না জেনে বোমাটি বহন করছে, যা দূর নিয়ন্ত্রিত হবার সম্ভাবনাই বেশি। সম্ভাবনা সত্য প্রমাণ হয়েছে। বাইরের কোনো এক স্থান থেকে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো, হয়েছে।
কথা শেষ করেই কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, আর কোনো কথা নয়। আমাকে এখনি বেরুতে হবে। বলে আহমদ মুসা তাকাল মেজর পাভেলের দিকে।
.
৫.
পাহাড়ী মেষপালকের পোষাকে আহমদ মুসা ও মেজর পাভেল হাঁটছিল পাহাড়ের অপ্রচলিত একটা পাহাড়ী পথ ধরে।
আহমদ মুসা আগে আগে হাঁটছে, মেজর পাভেল তার পেছনে পেছনে।
আহমদ মুসা ও মেজর পাভেল দুজনেরই কাঁধে ঝুলানো মেষপালকের ব্যাগ। হাতে তাদের একটি করে মেষপালকের মতোই বিশেষ লাঠি।
ওবাদিয়ার পাহাড় অঞ্চল খুব বড় নয়। কিন্তু দুর্গম। উঁচু, নিচু পাহাড়ের অবিন্যস্ত সারি। মাঝে মাঝে আঁকা বাঁকা উপত্যকা। বেশির ভাগ পাথুরে অঞ্চল। অনেক উপত্যকা সবুজ ঘাসে ঢাকা। উর্বর উপত্যকাও আছে। পাহাড়ী কিছু মানুষ রত্ন দ্বীপের পাহাড় এলাকায় বাস করে। ওবাদিয়ার পাহাড় এলাকায়ও তারা আছে। পশুপালন ও ফল উৎপাদন তাদের কাজ। দুধ, পশম, চামড়া, গোশত ও ফলের ব্যবসায় তাদের আয়ের উৎস। ফলের গুচ্ছের মতো ওরা চার পাঁচটি করে পরিবার পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে বাস করে। পাহাড়ের বুকে ছোট ছোট স্থাপনা গড়ে ওরা বাস করে থাকে।
ডান দিকে পাহাড়ের উপর একগুচ্ছ স্থাপনা দেখিয়ে আহমদ মুসা বলল, মেজর পাভেল, তুমি এই পাহাড়ীদের কেমন জান? এদের সাথে মিশেছ?
পাহাড়ে এবং পাহাড়ের বাইরেও এদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। ওদের গ্রামেও আমি গিয়েছি। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীতেও এদের কিছু লোক আছে। মেজর পাভেল বলল।
আহমদ মুসারা পথ চলছিল কখনও পরিচিত পথ ধরে, কখনও চিহ্নহীন অপরিচিত পথে। ডেভিড অ্যারিয়েল যে স্কেচ দিয়েছিল, তার সামনে রেখে তার আশপাশ দিয়েই পথ চলছিল আহমদ মুসারা।
ডেভিড অ্যারিয়েল যে পথ বাতলিয়েছে, তাতে মিড় ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের আস্তানার দিকে অগ্রসর হবার প্রথম যে চিহ্ন, ত্রিভুজ পাহাড়, তা এখনও পাওয়া যায়নি। তার মানে এখনও অনেক পথ বাকি।
দুই ঘন্টার পথ চলেছে আহমদ মুসা।
পাহাড় ডিঙিয়ে উপত্যকা ঘুরে আসতে হয়েছে। খুব বেশি দূর আসা যায়নি।
পায়ের নিচে রাস্তাটা পাথুরে এবং এবড়ো-থেবড়ো। সুতরাং আশে পাশে চোখ রাখলেও নিচের দিকে তাকিয়ে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে।
হঠাৎ মাটিতে পড়ে থাকা আধাপোড়া একটা সিগারেটের দিকে আহমদ মুসার নজর পড়ল। আহমদ মুসা সিগারেট খণ্ডটি একটু ঝুঁকে পড়ে তুলে নিল।
সিগারেট খণ্ডে হাত দিয়েই চমকে উঠল আহমদ মুসা। বেশ একটু গরম সিগারেট খণ্ডটি। তার মানে অল্পক্ষণ আগে এই পথ দিয়ে এক বা একাধিক লোক গেছে। কারা ওরা?
মেজর পাভেল, পাহাড়ী লোকরা কি ব্রান্ডের সিগারেট খায়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
পাহাড়ীদের দুএকজন সিগারেট খায়, কিন্ত ব্রান্ডের সিগারেট নয়। পাহাড়ীরা অল্প সংখ্যক যারা ধূমপান করে, তারা এক ধরনের সিগারেট নিজেরা তৈরি করে তামাক পাতা এবং আরও কিছু মিলিয়ে। এগুলো ব্রান্ড সিগারেট থেকে অনেক সফট। তাই ব্রান্ড সিগারেট পাহাড়ে চলে না।
ধন্যবাদ মেজর পাভেল। আমার মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণ আগে এই পথ দিয়ে শক্ররা গেছে বা এসেছে।
বলে দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসা। তার সাথে মেজর পাভেলও তার পাশে এসে দাঁড়াল।
চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা। চারদিকে ভালো করে তাকাতে গিয়ে সামনেই দেখল একটি পাহাড়। যে পাহাড়টাকে তার কাছে ত্রিভুজ বলে মনে হলো। ত্রিভুজের টপটা তাদের নাক বরাবর সামনে।
আহমদ মুসার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিল পাহাড়ের ত্রিভুজ আকৃতি। ডেভিড অ্যারিয়েলের দেয়া তথ্য অনুসারে এই পাহাড়টিই মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের এলাকায় প্রবেশের প্রথম গেটওয়ে।
আহমদ মুসার মনোযোগে ছেদ নামল। পেছন থেকে শব্দ পেল। পায়ের অস্পষ্ট শব্দ বলে মনে হলো
সংগে সংগেই আহমদ মুসা শোল্ডার হোলস্টার থেকে রিভলবার বের করে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। তার আগেই একটা ভারি কিছু মাথার পেছন দিকে চেপে বসল। এই সাথে একটা বাজখাই কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, চালাকির কোনো চেষ্টা করো না। দুই হাত উপরে তোল।
আহমদ মুসা কোনো ঝুঁকি নিল না। শত্রুরা কতজন, কি অবস্থায় আছে, তা সে জানে না।
আহমদ মুসা রিভলবারসহ দুহাত উপরে তুলল। মেজর পাভেলও হাত উপরে তুলেছে।
হাত থেকে রিভলবার ফেলে দাও। সেই বাজখাই গলাই আবার চিৎকার করে উঠল।
আহমদ মুসা হাত থেকে রিভলবার মাটিতে ছেড়ে দিল।
তোমরা কে, কারা? তোমরা আমাদের উপর এভাবে এসে পড়লে কেন?
বলতে বলতে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল অনেকটা বেপরোয়া হয়েই, পেছনটা দেখার জন্যে।
পেছনে ওরা তিনজন। তিনজনের হাতেই রিভলবার।
আহমদ মুসারা তাদের নির্দেশ মোতাবেক হাতের রিভলবার ফেলে দেয়ায় শত্রুরা অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে। রিভলবারের ট্রিগার থেকে তাদের তর্জনি সরে গেছে। তাদের রিভলবারগুলো পয়েন্টেড নয়।
তোমরা কারা? আমাদের দিকে রিভলবার তুলেছ কেন? বলল আহমদ মুসা শত্রুদের উদ্দেশ্যে।
এই প্রশ্ন তো আমাদেরও। তোমাদের তো পাহাড়ের কেউ বলে মনে হচ্ছে না। তোমরা এদিকে কোথায় যাচ্ছ? শত্রুদের একজন বলল।
আমরা পাহাড়ী। থাকি বাইরে। আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছি। বলল আহমদ মুসা।
তোমরা যাচ্ছ ত্রিভুজ পাহাড়ের দিকে। ওদিকে তো গ্রাম নেই। শত্রু সেই লোকটি বলল।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ে গেল ডেভিড অ্যারিয়েলের কাছে শোনা কথা। ত্রিভুজ পাহাড়ের পর ওদের প্রভাবিত এলাকা শুরু হলেও আরও একটু ভেতরে বামদিকে ত্রিয়াদা নামে একটা পাহাড়ী এলাকা আছে। এই এলাকাটা তারা নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করছে।
গ্রামের নামটা মনে হওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ক্রিয়াদার একটা গ্রামে আমরা যাচ্ছি।
ত্রিয়াদার একটা গ্রামে? তোমরা যেতে পারবে না সেখানে। ওদিকে কারও যাওয়া আজ নিষেধ। তোমাদের হাতে রিভলবার কেন?
চারদিকে যে মারামারি চলছে, তাতে বাঁচার জন্যে রিভলবার না রেখে উপায় কি। আপনাদের হাতেও তো রিভলবার দেখছি। যে আশঙ্কায় আপনাদের হাতে রিভলবার, সে আশঙ্কায় আমরাও। বলল আহমদ মুসা।
যা জান না, তা নিয়ে আর বকবক করো না। বলে শত্রুরা তিনজনই রিভলবার তাক করল আহমদ মুসা ও মেজর পাভেলের দিকে। বলল, তোমরা যদি বাঁচতে চাও, তাহলে যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফিরে যাও এখনি।
তোমরা এভাবে নির্দেশ দিচ্ছ কেন? তোমরা তো পুলিশ নও। তাহলে তোমাদের কথা শুনব কেন? বলল আহমদ মুসা।
আমরা তোমাদের কিছুতেই ত্রিয়াদা এলাকায় যেতে দেবো না। আজ ওদিকে অপরিচিত কারও যাওয়া নিষিদ্ধ। বলল শত্রুদের একজন।
আমরা তো ত্রিয়াদায় অপরিচিত নই। আমরা যেতে পারবো না কেন? বলল আহমদ মুসা।
আর একটা কথাও নয়। দশ পর্যন্ত গুণব। এর মধ্যে না গেলে গুলি করব। শত্রুদের একজন বলল।
লোকটি গনা শুরু করেছে। গনা শুরুর সাথে সাথে তাদের তিনজনেরই তর্জনি উঠে এসেছে রিভলবারের ট্রিগারে।
গুণা ছয় অতিক্রম করেছে।
আহমদ মুসা শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল, গনা থামাও। আমাদের মারতে চাইলে তোমরাও মরবে।
আহমদ মুসার উত্তরে ওরা আরও উচ্চস্বরে গনা শুরু করল।
গনা নয় পর্যন্ত পৌঁছতেই আহমদ মুসার উপরে তুলে রাখা হাত যেন চোখের পলকে মাথার পেছনে ছুটে গিয়ে রিভলবার সমেত ফিরে এসেই গুলি বর্ষণ শুরু করল ওদের দিকে।
বিদ্যুৎ চমকের মতোই ঘটে গেল ঘটনাটা। আহমদ মুসাদের রিভলবার কেড়ে নেবার পর শত্রুরা আশা করেনি এভাবে পাল্টা আঘাত আসবে।
ওরা তিনজন লাশ হয়ে পড়ে গেল আহমদ মুসাদের সামনে।
মেজর পাভেল, ওদের অস্ত্রগুলো নিয়ে নাও। আর সার্চ কর ওদের। পকেটগুলো, কোনো কাগজপত্র মেলে কিনা দেখ।
আহমদ মুসা তিনটি লাশকে চলাচলের ট্রাক থেকে সরিয়ে রাখল একটা টিলার আড়ালে।
আবার তারা চলতে শুরু করল।
প্রবেশ করল তারা পাহাড়ের ত্রিভুজে।
মেজর পাভেল, আগে আমরা ত্রিয়াদা এলাকায় যেতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছে ত্রিয়াদা অঞ্চলে আজ কিছু ঘটছে বা ঘটবে। যদি তাই হয় তাহলে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক স্যার। মেজর পাভেল বলল।
আমিও তাই মনে করছি।
ত্রিয়াদা অঞ্চলে ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে। চল, আর সময় নষ্ট করা নয়। বলল আহমদ মুসা।
ত্রিয়াদা অঞ্চলের কোনো পথনির্দেশ ডেভিড অ্যারিয়েলের কাছ থেকে পায়নি আহমদ মুসা। শুধু এইটুকু সে জেনেছে ত্রিভুজ পাহাড় থেকে সোজা পুবে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়-শৃঙ্গ, তার পাদদেশে অনেকগুলো উপত্যকার মেলা। ঐ উপত্যকাগুলো নিয়েই ত্ৰিয়াদা অঞ্চল। উপত্যকাগুলো গোল্ডেন গ্রীন নামে গোটা রত্ন দ্বীপে বিখ্যাত। সোনালি গমের ভাণ্ডার ঐ উপত্যকাগুলো। ভূমধ্যসাগরীয় ফলের সীমাহীন সম্ভারে পূর্ণ ক্ৰিাদা। অঞ্চলের উপত্যকা ও পাহাড়গুলো। ত্ৰিয়াদা অঞ্চলের উপত্যকাগুলোতে যারা বাস করে, তারা সুখী, সাহসী ও ঐক্যবদ্ধ। সম্ভবত এই কারণেই মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট-এর কাছে ওরা বড় শত্রু এবং অসহনীয় তাদের অস্তিত্ব।
ত্রিভুজ পাহাড় থেকে বেরিয়ে পুব দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগল আহমদ মুসারা। তাদের লক্ষ্য পুর দিকের আকাশে পাহাড়শৃঙ্গগুলোর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি।
.
মসজিদ থেকে যোহরের নামাজ পড়ে পরিবার সমেত টিলা থেকে নামছিল ত্ৰিয়াদা এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সিমো সাঈদ আহমাদ। তার সাথে স্ত্রী উম্মে হানি হাফছা, মেয়ে ফাতিমা মারিয়েম ও ছেলে হাদি হাকাম।
এলাকার মসজিদটা টিলার উপরে। বড় মসজিদ। প্রায় হাজারের মতো মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারে। নারী-পুরুষ সবাই মসজিদে। নামাজ আদায় করে।
পাশাপাশি দুটি টিলা। একটিতে মসজিদ। অন্যটিতে কলেজ ও কমুনিটি সেন্টার। মাঝখানের উপত্যকাটা ত্ৰিয়াদা এলাকায় প্রবেশের একমাত্র পথ। দুই পাশের দুই টিলা থেকে পাহাড় শ্রেণি দক্ষিণ ও উত্তরে চলে গেছে। পাহাড়গুলো ডিঙিয়েও ত্ৰিয়াদা উপত্যকা এলাকায় প্রবেশ করা যায়, কিন্তু তা খুব সহজ নয়। সুতরাং দুই টিলার মাঝের এই পথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পথটি দুপাশের দুই টিলা পেরিয়ে একটা সড়কে গিয়ে পড়েছে। সড়কটি দুই টিলার পূর্ব পাশ দিয়ে দুপাশের পাহাড়শ্রেণির পাদদেশ বরাবর উত্তর-দক্ষিণ বিলম্বিত। এই সড়কটিই ত্ৰিয়াদা অঞ্চলের প্রধান সড়ক। গোটা ত্রিয়াদা অঞ্চলকে সার্কেল করে আছে। বৃত্তাকার এই সড়ক থেকে অনেক সড়ক বেরিয়ে ত্ৰিয়াদার উপত্যকাগুলোকে প্রধান সড়কের সাথে যুক্ত করেছে। সড়কগুলোতে গাড়ি চলে না, ঘোড়াই মূল বাহন। এ মসজিদ ও কলেজের বিপরীত দিকে রাস্তার পুবপাশে ত্রিয়াদা এলাকার গ্যারিসন এবং কিছু সরকারি অফিস। এটা ত্রিয়াদা অঞ্চলের শাসনকেন্দ্র। সেখানকার প্রশাসনিক ভবনুশীর্ষে রত্ন দ্বীপের পতাকা উড়ছে।
সিমো সাঈদ মসজিদ থেকে গিয়ে বসল তার বাড়ির ড্রইং রুমে। তাদের বাড়িটা আরও দুই টিলার উত্তরে উপত্যকা সড়কের একদম। পাশেই।
সিমো সাঈদের সাথে তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে সবাই এসে বসেছে।
মেয়ে ফাতিমা মারিয়েম বসতে বসতে বলল, বাবা তুমি ওবাদিয়া আউটপোস্টের খবর নিশ্চয় পেয়েছ?
বিমর্ষতার ছাপ নামল সিমো সাঈদের চোখে-মুখে। বলল, হ্যাঁ মা, প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে কিছুক্ষণ আগে আমাকে জানানো হয়েছে। খুবই খারাপ খবর। কয়েকদিনে পরপর চারটি বড় ঘটনা ঘটল। আমাদের প্রায় দেড় ডজন নিরপত্তা কর্মী মারা গেল। শুনলাম, প্রেসিডেন্ট সাহেবরা খুবই উদ্বিগ্ন। আল্লাহ জানেন দেশে কি ঘটছে।
এ রকম কোনো দিনই হয়নি, এখন হচ্ছে কেন? বলল ফাতিমা মারিয়েম!
সেটাই তো কথা, এসব ঘটছে কেন? খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। আমাদের সরকার। আমাদের সরকার, প্রশাসন ও নিরাপত্তাকর্মীরা এসব। ঘটনায় অভ্যস্ত নয়। এসব ঘটনার মোকাবেলা কিভাবে করতে হয়, সে অভিজ্ঞতা তাদের নেই। মোকাবেলা করার মতো উপযুক্ত অস্ত্র ও তাদের নেই। সিমো সাঈদ বলল।
বাবা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাডেট কোর্সের কমান্ডার গতকাল ক্লাসে আমাদের বললেন, মাত্র একজন লোক রত্ন দ্বীপের পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিয়েছে। রত্ন দ্বীপের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে মাত্র একজন তোক আত্মরক্ষার মতো অসহায় অবস্থা থেকে শক্তিশালী আক্রমণাত্মক অবস্থানে নিয়ে গেছে। লোকটা কে জান বাবা? পত্রিকাগুলো তার সম্পর্কে কিন্তু বেশি কিছু লেখেনি। বলল এমপি সিমো সাঈদের ছেলে হাদি হাকাম।
তার সম্পর্কে আমাদেরকেও বেশি কিছু জানানো হয়নি। তিনি চান না তার সম্পর্কে, তার কাজ সম্পর্কে আলোচনা হোক। এই শর্তেই তিনি আমাদের সরকারকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন। সিমো সাঈদ বলল।
অদ্ভুত লোক তো! মানুষ প্রচার চায়, প্রশংসা চায়। অথচ তিনি…।
হাদি হাকামের কথার মাঝখানেই তার বাবা সিমো সাঈদ বলে উঠল, তিনি এই সাধারণের ক্যাটেগরিতে পড়েন না। তিনি প্রেসিডেন্টের মেহমান। সৌদি আরব সরকার অনুরোধ করেছে তিনি রত্ন দ্বীপে। থাকাকালে তাকে আতিথ্য দেয়ার জন্যে। শুনেছি রাশিয়া-আমেরিকার মতো দেশ বিপদে পড়লে তার শরণাপন্ন হয়।
তাই হবে বাবা। সাধারণ বিবেচনার মধ্যে তিনি পড়েন না। ওবাদিয়া নিরাপত্তা আউটপোস্ট থেকে আমার বান্ধবী ক্যাপ্টেন আলিয়া টেলিফোন করেছিল। তার সম্পর্কে সে বলল, যুদ্ধ-কৌশল নির্ধারণে তিনি যত দ্রুত, ততটাই বিস্ময়কর! ওদের আকস্মিক আক্রমণে আউটপোস্টের বাইরের প্রহরীরা মারা যায়। কিন্তু পরে ওদের একজনও ফিরে যেতে পারেনি। পঁচিশজনই মারা পড়ে। এর পরেই সুইসাইড বোমা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কর্নেল জেনারেল রিদাসহ আমাদের সকলকে হত্যার ওরা চেষ্টা করে। এটাও তার চোখে ধরা পড়ে যায়। বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। যে বোমা বহন করছিল, সেই শুধু মারা যায়। তার পদক্ষেপে আমরা সবাই রক্ষা পেয়ে যাই। আরও অনেক কথা বলল ক্যাপ্টেন আলিয়া তার সম্পর্কে। তিনি শুধু অসাধারণ নন, মনে হয় একজন মিরাকল ম্যান তিনি। বলল ফাতিমা মারিয়েম।
সিমো সাঈদের সোফার পাশে সাইড টেবিলে রাখা ইন্টারকমে কল এলো গেটের সিকিউরিটি বক্স থেকে।
কল ধরল সিমো সাঈদ।
সিকিউরিটি থেকে জানানো হলো ফৈজি এসেছে। দেখা করতে চায়।
সিমো সাঈদ সিকিউরিটিকে বলল ফৈজিকে পাঠিয়ে দিতে।
ফৈজি ত্ৰিয়াদা এলাকার তথ্য-সন্ধানী টিমের সদস্য।
সিমো সাঈদ উঠে দাঁড়াল। বলল, তোমার বস। ততক্ষণে চা। আসুক।
বাড়ির বাইরের অংশে তিনটি ঘর নিয়ে সিমো সাঈদের অফিস।
অফিস কক্ষে গিয়ে বসল সে।
সিমো সাঈদের পিএ এসে ঘরে ঢুকল।
দেখ ফৈজি এসেছে। তাকে নিয়ে এস। পিএ-কে লক্ষ্য করে বলল সিমো সাঈদ।
পিএ চলে গেল। দুমিনিটের মধ্যেই একজনকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
লোকটি ফৈজি। ফৈজি সালাম দিল সিমো সাঈদকে।
ওয়া আলাইকুম সালাম। তোমার তো এ সময় আসার কথ নয়, ফৈজি। জরুরি কিছু? বলল সিমো সাঈদ।
জরুরি স্যার। মোবাইলে এ ধরনের কথা বলতে নিষেধ করেছেন বলে সাক্ষাতেই বলতে এসেছি। ফৈজি বলল।
ধন্যবাদ ফৈজি। বল। বলল সিমো সাঈদ।
স্যার, এনভাইরনমেন্টাল প্রোটেকশন গ্রুপ (ইপিজি) নামের একটি এনজিও পাহাড়ের যে এলাকায় কাজ করছে, সে এলাকায় আমার ডিউটি ছিল। আজ ডিউটিতে যাবার পথে একটা ভয়ংকর জিনিস আমার নজরে পড়ল। ইপিজি অফিস এলাকা থেকে মাইল খানেক নিচে একটা ভাঙা পরিত্যক্ত গির্জা আছে। সেখানে দেখলাম উত্তেজিত একটা সমাবেশ। গির্জার সামনের চত্বরে একটা পতাকা উড়ছে। একটা ব্যানার টাঙানো সেখানে। পতাকায় লেখা আমরা সবাই হাওয়ারী। আর ব্যানারে লেখা হাওয়ারী হত্যার প্রতিকার হবে না, প্রতিশোধ চাই। আপাদমস্তক কালো পোশাক পরা অনেক লোক সেখানে জড়ো হয়েছে। তাদের সকলের হাতে খাটো বাট, খাটো ব্যারেল ও লম্বা ম্যাগজিনের ভয়ংকর সব অটোমেটিক গান। আমি রাস্তা পরিবর্তন করে পেছনের জংগল পথে গিয়ে ভাঙা গির্জায় ঢুকলাম। সেখানে পেলাম খাদ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে। প্যাকেট করা খাদ্যের স্তূপ সেখানে। তারা আমাকে তাদের সাথের কাজের লোক মনে করল। কথায় কথায় আমি জানতে পারলাম, প্যাকেটকৃত খাদ্যগুলো এবং কালো পোষাকের লোকরাও এসেছে ইপিজি থেকে। অস্ত্রও তারা সরবরাহ করেছে। আরও জানতে পারলাম, গত কয়েকদিনে বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধশত খ্রিস্টানকে হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। তারই প্রতিশোধ নিতে ত্ৰিয়াদা এলাকার গ্রামগুলোতে এরা যাচ্ছে। ইপিজি থেকে নেতারা এলেই এরা যাত্রা করবে। সন্ধ্যার মধ্যেই এরা কাজ শেষ করবে। দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ফৈজি।
আতংক-উদ্বেগে ছেয়ে গেছে সিমোসাঈদের মুখ। ফৈজি থামতেই সে বলল, ওরা কতজন লোক?
পঞ্চাশ কিংবা তার কিছু বেশি হবে। ফৈজি বলল।
এত লোক এলো কোত্থেকে? সব মিলিয়ে ইপিজির রেজিস্ট্রিকৃত জনসংখ্যা মাত্র পনের জন। বলল সিমো সাঈদ।
কিন্তু ওরা বলল, সব ইপিজি থেকেই এসেছে। আমাদের কোন পাহাড়ী লোক নেই। এটা জিজ্ঞাসা করে জেনেছি। ফৈজি বলল।
আমাদের এখানকার ত্ৰিয়াদা নিরাপত্তা গ্যারিসন কি জেনেছে এ খবর? জিজ্ঞাসা সিমো সাঈদের।
জি স্যার। আমি আমাদের তথ্য-গ্রুপের প্রধানকে জানিয়েছি। তিনিই। নিরাপত্তা গ্যারিসনকে জানানোর কথা। ফৈজি বলল।
এখন তোমার কাজ কি? বলল সিমো সাঈদ।
আমি গ্যারিসনে ইদরিস আলভির সাথে দেখা করব। তিনিই আসার কাজ ঠিক করবেন। ফৈজি বলল।
ঠিক আছে এখনই ত্ৰিয়াদা নিরাপত্তা গ্যারিসনের প্রধান ক্যাপ্টেন হোয়ারি আব্দুল্লাহকে ডাকছি। বিষয়টি খুব উদ্বেগজনক। ধন্যবাদ ফৈজি। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি নিশ্চর ওদিকে যাচ্ছ। ওদের প্রতি পদক্ষেপের বিবরণ আমি চাই ফৈজি। ইদরিস আলভিকে বলো। বলল সিমো সাঈদ।
স্যার, আমি দেখছি আসার সময় থেকে আমার মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। ইদরিস আলভী স্যারেরও ছিল না। এখনও নেটওয়ার্ক আসেনি। ফৈজি বলল।
সিমো সাঈদ পকেট থেকে মোবাইল বের করল। মোবাইলের দিকে চেয়েই সে বলল, আশ্চর্য! আমার মোবাইলেও নেটওয়ার্ক নেই। উদ্বেগ ও চিন্তায় ছেয়ে গেল সিমো সাঈদের মুখ।
ফৈজি তুমি গ্যারিসনে যাও। ক্যাপ্টেন হোয়ারি আব্দুল্লাহকে এখানে আসতে বল, এখনি। থেমেই আবার বলে উঠল সিমো সাঈদ।
সালাম দিয়ে ফৈজি দ্রুত চলে গেল।
সিমো সাঈদ দুহাতে হাত চেপে ধরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। তার মনে তখন চিন্তার ঝড়।
যতই ভাবছে ততই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ছে সিমো সাঈদ। শয়তানরা নিজেদের হাওয়ারী নাম দিয়েছে? হাওয়ারীরা তো হযরত ঈসা আ.-এর সত্যনিষ্ঠ সাথীর দল। এই নাম গ্রহণ করে তারা রত্ন দ্বীপের অধিবাসী এবং বাইরের দুনিয়ায় এই মেসেজ দিতে চায় যে তারা খ্রিস্টান স্বার্থ রক্ষার পক্ষে একটা সাচ্চা দল। তারা বিভেদ-বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায় রত্ন। দ্বীপে। গত কয়েকদিন ৪১জনের মতো সন্ত্রাসী মারা গেছে। তারা খ্রিস্টান হতে পারে, কিন্তু তারা তো রত্ন দ্বীপের লোক নয়। সবাই বাইরের লোক। সবাই তারা সন্ত্রাসী হামলা চালাতে গিয়ে মারা পড়েছে। তাদের জন্যে রত্ন দ্বীপের একজন খ্রিস্টানেরও সমর্থন নেই, সমবেদনাও নেই। হাওয়ারী নামে এরা কারা? নিশ্চয় মারা পড়া সন্ত্রাসীদেরই অংশ এরা। নিশ্চয় তারা খ্রিস্টান স্বার্থরক্ষার মুখোশ পরে সন্ত্রাস করতে আসছে। ইপিজি কারা? এরা এই সন্ত্রাসে অংশ নিচ্ছে কেন? তাহলে কি এরা সন্ত্রাসীদের সাথী, সাহায্যকারী?
নানা চিন্তা, দুশ্চিন্তার মাঝে ডুবে গিয়েছিল সিমো সাঈদ।
তার পিএ ঘরে ঢুকে সিমা সাঈদকে চিন্তামগ্ন দেখে একটু দ্বিধা করে বলল, এক্সকিউজ মি স্যার,।
সিমো সাঈদ ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতো বলল, কি?
স্যার, ক্যাপ্টেন হোয়ারি আব্দুল্লাহ এসেছেন। পিএ বলল। সিমো সাঈদ সোজা হয়ে বসে বলল, নিয়ে এস তাকে। আমি তার জন্যেই অপেক্ষা করছি।
পিএর সাথে ঘরে ঢুকল ক্যাপ্টেন হোয়ারি আব্দুল্লাহ।
সালাম বিনিময়ের পর হোয়ারি আব্দুল্লাহ বলল, এ সব কি শুনছি স্যার?
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ, সব তো শুনেছেন? কথা শুরু করল সিমো সাঈদ।
জি স্যার ইদরিস আলভীর কাছে সব শুনেছি। বলল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। অয়্যারলেসে কি বিষয়টা জানাতে পেরেছ উপরে? সিমো সাঈদ বলল।
দুঃসংবাদ স্যার। আমাদের অয়্যারলেসও কাজ করছে না। বলল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
কেন অয়্যারলেসের আবার কি হল? শত্রুরা মোবাইল নেটে জ্যাম সৃষ্টি করেছে আমাদের বিপদ বাড়ানোর জন্যে। কিন্তু অয়্যারলেস তো এভাবে ব্লক হয় না কখনো! সিমো সাঈদ বলল।
স্যার, সর্বাধুনিক টেকনোলজিতে গোটা কম্যুনিকেশনই ব্লক করা যায়। বলল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
সর্বনাশ! এখন তাহলে কি হবে। রাজধানী থেকে সাহায্য তো দূরে থাক, আমরা আমাদের দুর্দশার কথা তাদের জানাতেও তো পারবো না। সিমো সাঈদ বলল।
স্যার, এটাই এখন বাস্তবতা। বলল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
তাহলে এখন কি চিন্তা করছ? সিমো সঈদের জিজ্ঞাসা ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহকে।
স্যার, যতদূর আমরা জানতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে, ওদের সশস্ত্র ফাইটিং জনশক্তি আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ। আমাদের বিশজন নিরাপত্তা কর্মীর রয়েছে মাত্র ২০টি স্টেনগান। আশেপাশের ছাত্র যুবকদের একত্রিত করলে আমাদের জনশক্তি পঞ্চাশ হতে পারে। কিন্তু সবার জন্য অস্ত্র তো নেই। বলল ক্যাপ্টেন আব্দুবাহ।
মুখ শুকিয়ে গেছে সিমো সাঈদের। বলল, এক দিকে আমাদের অধিবাসীদের নিরাপত্তা দেয়া, অন্যদিকে লড়াইয়ে শত্রুকে পরাজিত করা এই দুই কাজের জন্যে জনশক্তি থাকলেও আমাদের কাছে অস্ত্র নেই। এই অবস্থা সামনে রেখে আপনারা আত্মরক্ষার জন্য কি কৌশল অবলম্বন করা যায় বলে চিন্তা করছেন?
সব বিবেচনা সামনে রেখে আমরা চিন্তা করেছি। আমাদের ক্ষুদ্র ফাইটিং ফোর্সকে যদি বিভক্ত করে মোতায়েন করি, তাহলে এই শক্তি দিয়ে শত্রুদের পরাভূত করা কঠিন। ওদের জন্যে লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়ে যাবে। এজন্যে আমরা ঠিক করেছি, নিরাপত্তা কর্মীদের এক জায়গায় মোতায়েন করা হবে। আমাদের সকল অধিবাসীকেও এখানে আনা হবে। ছাত্র-যুবকদের হাতে থাকবে দেশীয় অস্ত্র। আমরা সম্মুখযুদ্ধে যাব না। গেরিলা কৌশলে আমরা ওদের উপর আঘাত হানবো দুইটা লক্ষ্যে। এক. যতটা সম্ভব চোরাগুপ্তা আক্রমণ করে ওদের হত্যা করা, দুই. ওদের অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখা। এভাবে ক্রমান্বয়ে ওদের দুর্বল করে এক পর্যায়ে সুযোগ বুঝে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। বলল ক্যাপ্টেন হোয়ারি আব্দুল্লাহ।
ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ। বর্তমান অবস্থায় আত্মরক্ষার জন্যে এই কৌশলের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কি না বলা মুশকিল। দুটি দিক আমার কাছে বড় হয়ে উঠছে। এক, আমাদের গ্রাম ও বাড়িগুলো অরক্ষিত থাকায় এগুলোতে লুটতরাজ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করা ওদের জন্যে সহজ হবে। দুই, ওদের হাতে যদি বোমা, রকেট লাঞ্চার থাকে, তাহলে ওরা খুব কাছে না এসেও অতি সহজেই আমাদের অবস্থানকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারবে। সিমো সাঈদ বলল।
স্যার, আপনার সব আশঙ্কার সাথে আমি একমত। কিন্তু স্যার, আমরা আত্মরক্ষার জন্যে যা করেছি, তার চেয়ে ভালো কিছু এ মুহূর্তে আমরা করতে পারছি না। আরেকটা বিকল্প আছে স্যার, ত্ৰিয়াদা এলাকা পরিত্যাগ করে আমাদের পালিয়ে যাওয়া।
বলল ক্যাপ্টেন হোয়ারি আব্দুল্লাহ।
এতটা নিচে নামার চেয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়া অনেক ভালো। ঘরের ও প্রান্তের দরজার দিক থেকে বলে উঠল ফাতিমা মারিয়েম।
সিমো সাঈদ ও ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বিস্মিত চোখে ঘরের ও প্রান্তের দরজার দিকে তাকাল। দেখল, ওখানে সিমো সাঈদের মেয়ে ফাতিমা মারিয়েম, ছেলে হাদি হাকাম ও স্ত্রী আয়েশা দাঁড়িয়ে আছে।
আমিও তাই মনে করি বাবা, শত্রু ভয়ে সব ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে শাহাদাৎ অনেক বেশি কাম্য। বোন ফাতিমা মারিয়েমের কথা শেষ। হতেই বলে উঠল সিমো সাঈদের ছেলে হাদি হাকাম।
যখন তোমরা এসেই পড়েছে। ভেতরে এসে বস। বলল সিমো সাঈদ।
ওরা এসে বসল সিমো সাঈদের বাম পাশের চেয়ারগুলোতে। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বসে আছে সিমো সাঈদের সামনে, মুখোমুখি।
তোমরা কখন এসেছ? সব কথা শুনেছ তোমরা? সব কথা শোনার পরেই কি তোমাদের ঐ মত? বলল সিমো সাঈদ স্ত্রী, ছেলে মেয়েদের লক্ষ করে।
সব শুনেছি আমরা। তোমরা চায়ের জন্যে কিছু বললে না, চা যখন ঠাণ্ডা হয়ে গেল, তখন দেরি কেন তা দেখার জন্যে আমরা এসেছিলাম। এসেই শুনলাম ভয়াবহ সব কথা এবং করণীয় কি তাও। বলল ফাতিমা মারিয়েম।
তোমরা চরম আবেগ থেকে কথা বলেছ, কিন্তু আমরা ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলছি, শাহাদাতবরণ একটা অপশন হতে পারে। তবে আমরা ঐ সিদ্ধান্ত নেইনি। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ প্রথম যে অপশনটা বলেছে, সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত। বলল সিমো সাঈদ।
ধন্যবাদ স্যার। সময় বোধ হয় আমাদের হাতে খুব বেশি নেই। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যে যা করতে হবে, তাতে প্রচুর সময় লাগতে পারে। আমি উঠতে চাই স্যার। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
হ্যাঁ ঠিক। তোমাকে উঠতে হবে। হা শোন, আমি মনে করছি। আমি আমার পরিবার নিয়ে বাড়িতেই থাকব। বলল সিমো সাঈদ।
স্যার, এটা ঠিক হবে না। আমাদের সঙ্গে আপনার থাকা আরও এজন্যে দরকার যে, আপনার মূল্যবান পরামর্শ আমাদের দরকার হবে। মোবাইল, টেলিফোন, অয়্যারলেস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রয়োজনের মুহূর্তে আপনার সাথে যোগাযোগের আর কোনো মাধ্যম নেই। আমার অনুরোধ আপনি সকলের সাথে থাকুন। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
ঠিক আছে ক্যাপ্টেন, তাই হবে। বলল সিমো সাঈদ।
তাহলে আমাদের লোকরা এসে কি আপনাদের নিয়ে যাবে? কাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
তোমাদের কারও আসার দরকার নেই। এক সময় আমরাই চলে যাব।
ধন্যবাদ স্যার। আমি উঠছি। উঠে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
সবাইকে সালাম দিয়ে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহকে কিছু বলার জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল ফাতিমা। মারিয়েম। পরক্ষণেই চেপে গেল। কিছু বলল না।
তার চোখে-মুখে ভিন্ন ধরনের একটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
.
অনেকটাই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ ত্ৰিয়াদার গ্যারিসনে। সবার মধ্যেই অখণ্ড একটা গাম্ভীর্য। তাদের সাথে উদ্বেগের ছাপ। বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, সেই আশঙ্কায় সবার মধ্যেই একটা অ্যাটেনশন ভাব।
নাম গ্যারিসন বটে, তবে এখানে থাকে মাত্র বিশজন নিরাপত্তা সৈনিক একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে। গ্যারিসন শুধু আবার গ্যারিসনই নয়, এলাকার সরকারি অফিস আদালত তৈরি হয়েছে এই গ্যারিসনকে কেন্দ্র করেই। গ্যারিসন না বলে একে সরকারি অফিস কমপ্লেক্স বলাই ভালো। এখানে সরকারি, আধাসরকারি অফিসের লোকসংখ্যা নিরাপত্তা সেনাদের চেয়ে বেশি।
সিমো সাঈদ, ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ, ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহর সহকারী লেফটেন্যান্ট রাফায়েল রবিন, হাদি হাকাম, ফাতিমা মারিয়েম এবং অন্য কয়েকজন বসে আলাপ করছিল গ্যারিসনের গেট সংলগ্ন অভ্যর্থনা কক্ষে।
গ্যারিসন কমপ্লেক্সে প্রবেশের মুখেই গ্যারিসন অভ্যর্থনা কক্ষ। এরপর রয়েছে সরকারি অফিস-আদালত।
গ্যারিসনের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো পাথরের তৈরি তার নিচু প্রাচীর। যে কেউ লাফ দিয়ে এ প্রাচীর টপকাতে পারে।
গ্যারিসন কমপ্লেক্সটা টিলা ধরনের উচ্চভূমির উপর অবস্থিত। উচ্চভূমির উত্তর ও দক্ষিণ দিকটা পাথরের খাড়া দেয়াল। এই দুই দিক দিয়ে গ্যারিসনে ঢোকা যায় না, বেরোনোও যায় না। পশ্চিম ও পূর্ব দিকে গ্যারিসন কমপ্লেক্সে প্রবেশের দুটি গেট আছে। এর মধ্যে পশ্চিম গেটটা নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য এবং অপর গেটটা বেসামরিক লোকদের ব্যাবহারের জন্যে। দুই গেটের রাস্তা উচ্চ ভূমি থেকে ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে। ঢালু পথ দিয়ে উঠে এসে গেট পেরুতে হয়। গোটা পশ্চিম, গোটা পূর্ব দিকটাই ঢালু। গেটের দুপাশের ঢালু স্থান দিয়ে উঠে এসে নিচু প্রাচীর লাফ দিয়ে পার হলেই গ্যারিসন কমপ্লেক্সে যে কেউ ঢুকতে পারে।
গ্যারিসন কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল সিমো সাঈদ ও ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাদের মধ্যে।
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলছিল, এত নিচু প্রাচীর কোনো নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে তো দূরের কথা, কোনো প্রাইভেট বাড়িরও হয় না, হওয়া উচিত। নয়।
ঠিক বলেছ ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ। কিন্তু সমস্যা হলো, নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা রত্ন দ্বীপে কোনো সময়ই করা হয়নি এবং কখনো এটা কারও মাথায় আসেনি। এখানে বড় কোনো সংঘবদ্ধ পক্ষের দ্বারা রত্ন দ্বীপের শান্তি ভংগ হবে, এখানে স্টেনগান, মেশিনগানের ব্যবহার করতে হবে, এমনটা কেউই কখনও ভাবেনি। এই কারণেই অন্যান্য দেশের মতো এখানে সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজন মনে করা হয়নি। ভারি অস্ত্র আমদানির কথা চিন্তা করা হয়নি। গত ৫০ বছরের মধ্যে রত্ন দ্বীপে কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে মরেনি। কয়েক দিন আগে পর্যন্ত আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীদের হাতে কোনো বন্দুক ছিল না। তার কখনো প্রয়োজনও হয়নি। এই গ্যারিসনের পশ্চিম ও পূর্ব অংশে যখন এই নিচু প্রাচীর তৈরি হয়, তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল এই অহেতুক খরচ কেন? এই প্রাচীর তুলে আমরা কি করতে চাই? নিরাপত্তা দানকারী প্রতিষ্ঠানকে তো নিরাপত্তা দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের রত্ন দ্বীপের সমাজ ও সরকারের কোনো শত্রু নেই। আমরা হাওয়ার সাথে লড়াই করছি কেন? যারা এ প্রশ্ন তুলেছিল, তারা তখন। ঠিক কথাই বলেছিল। আসলে রত্ন দ্বীপে কোনো বিভেদ ছিল না, বৈষম্য ছিল না এবং তাই কোনো হানাহানিও ছিল না। দুচার দিন। ধরে যে হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে, তা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। এমন একটা পরিস্থিতির কথা আমরা কেউ কল্পনাও করিনি। সুতরাং ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দোষ দিতে পারি না। বলল সিমো সাঈদ।
স্যরি স্যার, আমি যা বলছি তা পরিবর্তিত অবস্থার অনুভূতি থেকে। বোধ হয় সামনে আমাদেরকে এভাবেই ভাবতে হবে। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহর কথা শেষ হচ্ছে, তখন গেট দিয়ে প্রবেশ করল আচিলা, ফিলিপ। তথ্য গোয়েন্দা গ্রুপের সদস্য সে।
তাকে দেখেই সিমো সাঈদ তাকে ডাকল। সিমো সাঈদের মুখে নতুন উত্তেজনা।
আচিলা কাছে এলে সিমো সাঈদ বলল দ্রুত কণ্ঠে, ওদের দিকের অবস্থা কি ফিলিপ? ওরা কতজন? কোন পর্যন্ত এসেছে?
স্যার, ওরা সংখ্যায় একশ জনের মতো হবে। ওরা খুব সামনে এসে গেছে। আমাদের সামনে পাহাড়ের ওপাশে যে উপত্যকা, তার পরে যে পাহাড় তার গোড়া পর্যন্ত এসে গেছে ওরা। বলল আচিলা ফিলিপ।
নতুন করে উদ্বেগ-উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল সিমো সাঈদসহ সবার চোখে-মুখে।
তাহলে দশ মিনিটও লাগবে না ওদের এখানে পৌঁছতে!
শুকনো কণ্ঠে কথাটা বলেই আবার প্রশ্ন করল, তাদের অস্ত্র-শস্ত্র কি তোমাদের চোখে পড়েছে?
তাদের প্রত্যেকের হাতে খাট ব্যারেল ও লম্বা ম্যাগাজিনের হ্যান্ড মেশিনগান। তার সাথে অনেকের কাঁধে আছে রকেট লাঞ্চার। এই অস্ত্রগুলো দেখা গেছে। আচিলা ফিলিপ বলল।
ওদের সংখ্যা সম্পর্কে তোমরা নিশ্চিত? বলল সিমো সাঈদ।
স্যার, ওরা একটি সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে আসার সময় আমরা ওদের সংখ্যা গুণেছি। ওদের সংখ্য সাতানব্বই জন। আচিলা ফিলিপ বলল।
ওরা ওদের পতাকা, ব্যানার এখনও বহন করছে? বলল সিমো সাঈদ।
জি স্যার। সবার সামনে আছে ব্যানার। মধ্যখানে আছে পতাকা। ফিলিপ বলল।
ধন্যবাদ ফিলিপ। ঠিক আছে তুমি ফিরে যাও তোমার কাজে। ফিলিপ চলে গেল।
গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে সক্ষম জনশক্তি শামিল করে আমাদের শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটা কত দাঁড়াল ক্যাপ্টেন? সিমো সাঈদ বলল।
তরুণ, যুবকদের শামিল করার পর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় শত। তরুণ, যুবকসহ আমাদের জনশক্তির একটা বড় অংশ এলাকার বাইবে চাকরি, ব্যবসায়, পড়াশুনা ও অন্যান্য কাজে নিয়োজিত আছে। এই মুহূর্তে তাদের তো ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
দেড় শতজনের মধ্যে তোমাদের বিশজন নিরাপত্তা সেনাদের হাতে রয়েছে বিশটি স্টেনগান। অবশিষ্টদের হাতে তো দা, কুড়াল, ছুরির বেশি কিছু নেই। বলল সিমো সাঈদ। তার কণ্ঠের হতাশা সে চেপে রাখতে পারল না।
নিজেদের যা আছে, তাই নিয়ে অল্লাহর উপর ভরসা করে আমাদের লড়তে হবে স্যার। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
তোমাদের গুলির স্টক কি পরিমাণ আছে? জিজ্ঞাস, সিমো সাঈদের।
বিশটা স্টেনগানে বিশ মিনিট চলার মতো গুলি আছে স্যার। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
বাবা, তোমরা এসব হিসাব করো না। এতে ভয় হতাশা বাড়বে। এটা পরিষ্কার, আমাদের শক্তিতে আমরা দাঁড়াতে পারবো না। আমাদেরকে আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে, আর সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা আমৃত্যু লড়াই করব। বলল ফাতিমা মারিয়েম। আবেগরুদ্ধ তার কণ্ঠ।
সিমো সাঈদ তাকাল মেয়ের দিকে। অশ্রুতে তার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে উঠল। গড়িয়ে পড়ল দুই ফোঁটা অশ্রু। বলল, ধন্যবাদ মা। তুমি ঠিক বলেছ। এসব হিসেব-নিকেশ করে আমরা পারবো না। আমরা যুদ্ধে শত্রুদের শক্তির চেয়ে অনেক পেছনে। আল্লাহর সাহায্যই আমাদের সম্বল। এই ন্যায়ের সংগ্রামে আমৃত্যু আমরা আক্রমণে থাকবো, এই সিদ্ধান্ত আমাদের প্রত্যেকের। চল আমরা যাই এ কথাই সবাইকে বলি যে, আল্লাহর উপর ভরসা করে আমরা প্রাণপণ লড়ে যাব। যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে আমৃত্যু আমরা শত্রুর উপর আক্রমণ চালিয়ে যাব।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
ফাতিমা মারিয়েম ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহর পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, আমি কিন্তু তোমার পাশে থাকবো। মরতে হলে দুজন একসাথে মরব, বাঁচলে একসাথেই বাঁচব। মৃত্যু যদি আসেই, সেই সময় প্রার্থনা করব, আদালতে আখেরাতের কঠিন মুহূর্তগুলোতে যেন দুজন আমরা একসাথে থাকতে পারি, জান্নাতে একসাথে যেতে পারি, সেই তৌফিক যেন আল্লাহ আমাদের দেন।
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আমিন বলে হাত বাড়িয়ে দিল ফাতিমা মারিয়েমের দিকে। ফাতিমা মারিয়েম জড়িয়ে ধরল সেই হাত।
হাঁটতে শুরু করল তারা সবার সাথে।
এই সময় ডজন ডজন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র একসাথে গর্জন করে উঠল সামনের পশ্চিমের উপত্যকা ও পাহাড়ের দিক থেকে।
সিমো সাঈদ, ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহরা থমকে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়াল। পশ্চিম দিকে।
সবাই উৎকর্ণ লো শব্দের দিকে।
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি, অবিরাম চলছে।
কিছুক্ষণ কর্ণ হয়ে শুনল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
ওরা কি গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে ক্যাপ্টেন? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল সিমো সাঈদ।
না স্যার, গোলাগুলি স্থির এক জায়গা থেকে হচ্ছে। আর গুলি এক রকমের নয় স্যার। ভারি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিই বেশি। কিছু গুলি স্বয়ংক্রিয় রিভলবারের। ভারি অস্ত্রের গুলি প্রথম শুরু হয়েছে। পরে শুরু হয়েছে মেশিন রিভলবারের গুলি। একটু খেয়াল করে দেখুন স্যার। ভারি ও লাইট স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিও হচ্ছে। একসাথে হচ্ছে, কখনও একটার পর আরেকটা হচ্ছে। বলল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
তুমি কি আন্দাজ করছ ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ?
সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে ভারি ও লাইট স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার যতটা বুঝতে পারছি, তাতে মনে হচ্ছে পাল্টা পাল্টি গোলাগুলি হচ্ছে। ক্যাপ্টেন বলল।
ওদের নিজের মধ্যে হতে পারে কি? জিজ্ঞাসা সিমো সাঈদের।
নিজেদের মধ্যে হলে একই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার হতো। এখানে তা হচ্ছে না। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
তাহলে? প্রশ্ন সিমো সাঈদের।
বুঝতে পারছি না স্যার। বিস্ময়কর লাগছে স্যার! আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করছি, স্বয়ংক্রিয় রিভলবার ব্যবহারের উৎস এক বা দুই- এ ধরনের হবে। অন্যদিকে ভারি অস্ত্র ব্যবহারের উৎস অনেক। বলল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
এর দ্বারা কি বুঝা যাচ্ছে? আবার প্রশ্ন সিমো সাঈদেরই।
ঠিক জানি না। তবে আন্দাজ করছি, দুই পক্ষের এক পক্ষে অনেক লোক, অন্য পক্ষে এক বা দুই এর বেশি লোক হবে বলে মনে হয় না। বলল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
বুঝতে পারছি, প্রবল পক্ষটা আমাদের শত্রুপক্ষ। প্রায় একশত সংখ্যার প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে এক বা দুই জন লোক! কেমন। করে সম্ভব এটা? এই দুঃসাহসি পক্ষটা কে? সিমো সাঈদ বলল।
কিছুই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না স্যার। সবই অনুমান। অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। প্রকৃতই কি ঘটছে না জেনে আমরা কিছুই বলতে পারবো না। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
এ সময় হাদি হাকাম চিৎকার করে উঠল, ঐ যে ফৈজি ছুটে আসছে, নিশ্চয় কোনো খবর আছে।
সবার দৃষ্টি নিচে গেটের দিকে ছুটে গেল। দেখল, তথ্য-গোয়েন্দা গ্রুপের সদস্য ফৈজি দ্রুত উঠে আসছে গ্যারিসনে।
উঠে এল ফৈজি।
গেটেই সবাই দাঁড়িয়েছিল।
জরুরি কোনো খবর আছে, ফৈজি? কি ঘটছে সেখানে? গোলা-গুলি কেন? ফৈজি কাছাকাছি পৌঁছতেই জিজ্ঞাসা সিমো সাঈদের।
সিমো সাঈদের সামনে এসে দাঁড়াল ফৈজি। বলল, স্যার একটা পক্ষকে তো আমরা চিনি, যারা নিজেদের হাওয়ারী বলে পরিচয় দিচ্ছে। অন্য পক্ষকে আমরা বুঝিনি। তবে ত্রিয়াদার পক্ষের লোক হতে পারে তারা।
বুঝলে কেমন করে যে তারা জিয়াদার পক্ষের লোক? হাওয়ারীদের সাথে লড়াই করছে বলে? জিজ্ঞাসা করল সিমো সাঈদ।
স্যার, তাদের কাছাকাছি একটা পাহাড়ের উপর লুকিয়ে ছিলাম। তখন নিচেই উপত্যকায় গোলাগুলি শুরু হয়।
খ্রিস্টার্ন হাওয়ারী লোকরা প্রশস্ত উপত্যকা দিয়ে সৈনিকের ব্যুহ রচনা করে আসছিল গিরিপথের দিকে। তাদের বিশেষ মেশিনগানগুলো সামনের। দিকে তাক করা। কারও কারও হাতে তাক করা রকেট লাঞ্চারও ছিল।
হঠাৎ পাশের জংগল থেকে একজন লোক বেরিয়ে এল। তার পরনে কালো প্যান্ট, গায়ে কালো জ্যাকেট। মাথায় কালো হ্যাট। পিঠে বহন। করছে একটা ব্যাগ।
সে এগোতে লাগল হাওয়ারীদের ব্যুহের দিকে। তাকে ঐভাবে এগোতে দেখে হাওয়ারীদের ব্যুহ দাঁড়িয়ে গেল।
লোকটিও ব্যুহ থেকে সাত আট গজ দূরত্বে গিয়ে দাঁড়াল। জ্যাকেটের দুই পকেটে তার দুই হাত।
সে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে বলল, শোন, তোমরা হাওয়ারী নামের ঐ পতাকা নামিয়ে ফেল। ঈসা আ.-এর সাথী হাওয়ারীরা তোমাদের মতো রক্তপিপাসু হিংসুক ছিল না। তোমরা সন্ত্রাসীরা মিথ্যা পরিচয় নিয়ে ত্রিয়াদায় সন্ত্রাস চালাতে যাচ্ছ। পারবে না যেতে সেখানে।
হাওয়ারীদের ব্যুহের প্রথম সারির মাঝখানে দাঁড়ানো ফাদারের মতো টুপি ও পোষাক পরা একজন চিৎকার করে বলল, আমরা তো এসে গেছি ত্রিয়াদায়। সামনের উপত্যক র পরেই ত্ৰিয়াদা। কে আমাদের বাধা দেবে?
তোমার আমার সকলের স্রষ্টা আল্লাহর সাহায্যে আমিই তোমাদের বাধা দেব। সামনে এগোতে হলে তোমাদেরকে আমার লাশের উপর দিয়ে এগোতে হবে। বলল ব্যুহের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো লোকটা।
ব্যুহের সামনের সারিতে দাঁড়ানো লোকটা আবার চিৎকার করে নির্দেশ দিল, ফায়ার! উড়িয়ে দাও শয়তানের দোসর ঐ লোকটাকে।
একসাথে গর্জন করে উঠল কয়েক ডজন হ্যান্ড মেশিনগান।
আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। বহের সামনে দাঁড়ানো, প্রতিবাদী লোকটার ভয়ানক পরিণতি দেখতে আমি চাইনি। ব্রাশ ফায়ারের জমাট গর্জনে একটু ছেদ নামলে আমি চোখ খুললাম দেখার জন্যে যে কি ঘটেছে, লোকটির অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু চোখ খুলে আমি দেখলাম উল্টো চিত্র। হাওয়ারীদের ব্যুহের সামনের তিন চারটি সারির মানুষ রক্তাক্ত লাশে পরিণত হয়েছে। ব্যুহের পেছনের অংশ থেকে তখন গুলি চলছে। আর ব্যুহের সামনে দাঁড়ানো সেই লোকটি দুই হাতে দুই মেশিন রিভলবার নিয়ে ওদের নিশানা করে। গুলি ছুড়ছে। এক পর্যায়ে সে কয়েকটি লাশের আড়ালে দেহটাকে লুকিয়ে রেখে মাঝে মাঝে মাথা তুলে টার্গেটেড গুলিও চালাচ্ছে। একটু পরে দেখলাম, উপত্যকার এই প্রান্তের জংগল থেকে বেরিয়ে এসে আর একজন লোক গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আগের সেই লোকটির কাছে পৌঁছল। লোকটি তাকে কি যেন বলল। দ্বিতীয় লোকটি গড়িয়ে গড়িয়ে আবার বাম দিকের জংগলে ঢুকে গেল। মিনিট পাঁচেক পরেই ঝুহের পেছন থেকে গুলি বর্ষণ শুরু হলো। ঠিক সে সময় সামনে থেকে প্রথম লোকটিও গুলি বর্ষণ শুরু করল। দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে হাওয়ারী লোকরা দুই পাশের জংগলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু এই স্থানটাতে দুইপাশে ছিল বড় বড় পাথর, যা না ডিঙালে জংগলে ঢাকা সম্ভব নয়। কিন্তু দেখলাম যারাই পাথর ডিঙানোর চেষ্টা করছে, তারাই গুলি খাচ্ছে। এর জবাবে হাওয়ারীরা পাগলের মতো ব্রাশ ফায়ার করছে। কোনো টার্গেট ছাড়াই। এই অবস্থা দেখে আমি চলে এসেছি এই খবর এখানে পৌঁছানোর জন্যে। দীর্ঘ বিবরণ দিয়ে থামল ফৈজি।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথাগুলো শুনছিল সিমো সাঈদ, ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ, হাদি হাকাম, ফাতিমা মারিয়েমসহ উপস্থিত সকলেই।
ফৈজি থামতেই সিমো সাঈদ অনেকটা সম্মোহিতের মতো বলে।
শয়তানদের কত লোক মারা গেছে, তুমি কি আন্দাজ করতে পেরেছ ফৈজি??
আমার মনে হয় তিরিশ চল্লিশজন হবে। তবে তারা যে ফাঁদে পড়েছে, তাতে ওদের কেউ বাঁচবে বলে আমার মনে হয় না। প্রথম লোকটি তো লাশের আড়াল নিয়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয় লোকটি জংগলের আড়ালে থেকে গুলি করছে। তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, সে সবাইকে দেখে টার্গেট করে গুলি করছে। দুপাশের জংগলে যে তারা পালাবে, সেটাও ঝুঁকিপূর্ণ। তারা পাথর ডিঙাতে গেলেই গুলি খাবে। বলল ফৈজি।
তোমার কথাকে আল্লাহ সত্য করুন। ওদের হিংসার গ্রাস থেকে আল্লাহ ত্রিয়াদাকে রক্ষা করুন। কিন্তু বল তো লোকটি কে? বলল সিমো সাঈদ।
তা বলা মুশকিল স্যার। তবে, প্রথম লোকটির উচ্চারণ শুনে তাকে আমার কাছে রত্ন দ্বীপের লোক বলে মনে হয়নি। আর দ্বিতীয় ব্যক্তির কোনো কথা আমি শুনতে পাইনি। ফৈজি বলল।
প্রথম লোকটি আমাদের দেশের না হবার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ তিনি যে ধরনের কথা বলেছেন নকল হাওয়ারীদের উদ্দেশে এবং যে সাহস ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে লোকটিকে ঐ লোক বলেই মনে হচ্ছে। যিনি আমাদের সাহায্য করছেন, যিনি আজ ওবাদিয়ার আউটপোস্টে অত। বড় মিরাকল ঘটিয়েছেন এবং যিনি আজ সকাল পর্যন্ত ওদের চল্লিশজনের বেশি লোক মেরেছেন। বলল ফাতিমা মারিয়েম।
তুমি ঠিক বলেছ মা। তিনিই হবেন। কারণ একশর মতো উদ্যত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ঐ কথাগুলো বলার মতো লোক আমাদের মধ্যে নেই। আমাদের দ্বীপের অখণ্ড শান্তি যেমন আমাদের কিছু উপকার করেছে, তেমনি কিছু ক্ষতিও করেছে। আমরা সাহস হারিয়ে ফেলেছি। হামলাকারী সশস্ত্র শত্রুর সামনে দাঁড়াবার অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা কোনটাই আমাদের নেই। দেখ আমরা দেড়শ লোক, যাদের মধ্যে বিশজন স্টেনগানধারী আছে, একশজন শত্রুর সামনে দাঁড়িয়ে বিজয়ের স্বপ্ন দেখতে পারছিলাম না। অথচ একজন লোক কিভাবে মাত্র ৫ গজ দূর থেকে প্রায় একশ উদ্যত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করল! আমাদের রত্ন। দ্বীপবাসীদের কাছে এটা স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়! নিশ্চয় ইনি তিনিই হবেন! কিন্তু কে তিনি? তার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। কিন্তু নাম কেউ বলেনি। সিমো সাঈদ বলল। তাঁর কণ্ঠ আবেগে ভারি।
নিশ্চয় তিনি এমন বড় কেউ, যাকে আমরা চিনব। এ কারণেই নাম বলা হচ্ছে না। সম্ভবত শত্রুদের অন্ধকারে রাখার জন্যেই। বলল ফাতিমা মারিয়েম।
ঠিক বলেছ ফাতিমা মারিয়েম। শত্রুদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা যুদ্ধের একটা বড় কৌশল। শত্রু যাতে যথাযথভাবে প্রস্তুত হতে না পারে, সতর্ক হতে না পারে, সাহস ও সিদ্ধান্তে যাতে ফাঁক থাকে, এ জন্যেই এমনটা করা হয়।
থামল একটু ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ। কি একটা ভেবেই সংগে সংগে আবার বলল, আমার মনে হয় স্যার, আমাদের ওদিকে এগোনো দরকার।
সিমো সাঈদ সংগে সংগেই তাকাল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, অবশ্যই ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ, আমাদের ওখানে যাওয়া দরকার। তারা জীবনবাজি রেখে আমাদের জন্যে লড়াই করছেন আর আমরা যাব না? এখনি ব্যবস্থা কর ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
ধন্যবাদ স্যার, আমি ব্যবস্থা করছি। আমি মনে করি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাফায়েল রবীনকে গ্যারিসনের দায়িত্বে রেখে পাঁচজন নিরাপত্তা সৈনিককে নিয়ে আমরা দশ বারোজন সেখানে যেতে পারি। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
আমি কিন্তু যাবো বাবা। বলল ফাতিমা মারিয়েম।
না মা, তুমি তোমার মাকে নিয়ে মেয়েদের সাথে এখানে থাক। গোলাগুলির জায়গায় নাইবা গেলে। সিমো সাঈদ বলল।
বাবা রাসূল স-এর যুগে মেয়েরা রণাঙ্গনে গেছে। আমি যেতে পারবো না কেন? আমি তো হিযাবের মধ্যেই আছি। বলল ফাতিমা মারিয়েম ক্ষোভের সাথে।
আচ্ছা যাবে। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ, তুমি ফাতিমা ও হাদি হাকাম দুজনকেই সাথে রাখ। তাড়াতাড়ি কর ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ। গোলাগুলি কিন্তু সেখানে সমানে চলছে।
এখনই যাত্রার ব্যবস্থা আমি করছি স্যার। বলে ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ গ্যারিসনের ভেতর দিকে চলে গেল।
.
৬.
চারদিক স্তব্ধ।
গুলির শব্দ আর নেই।
বুক কাঁপছে সিমো সাঈদ, ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ, ফাতিমা মারিয়েমসহ সকলের। সংকীর্ণ উপত্যকায় ঢোকার গিরিপথ পার হচ্ছে তারা। গিরি পথের ওপারে কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্যে। কি দেখতে পাবে সেখানে গিয়ে তারা। যদি দেখে অন্য কিছু…! না তা হবে না, হতে পারে না। আল্লাহ রাব্বল আলামিন তাঁর সাহায্য আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবেন না।
কিন্তু চারদিক হঠাৎ এভাবে স্তব্ধ হয়ে গেল কেন?
সবার আগে হাঁটছে ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ। তার হাতে স্টেনগান। কোমরে ঝুলানো রিভলবার।
তার পেছনে স্টেনগানধারী পাঁচজন নিরাপত্তা সৈনিক। তাদের পেছনে সিমো সাঈদ, ফাতিমা মারিয়েম, হাদি হাকাম ও অন্যরা।
গিরিপথের মুখে পৌঁছে বাম হাত উপরে তুলে ঘুরে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ। বলল সে সিমো সাঈদকে লক্ষ্য করে, পাঁচজন নিরাপত্তা সৈনিকসহ আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন। আমি উপত্যকায় নেমে সেখানকার পরিস্থিতি দেখে করণীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। পরিস্থিতি অনুকূল হলে আমি, সাদা রুমাল উড়িয়ে আপনাদের সংকেত দেব উপত্যকায় নামার জন্যে। আর যদি বিপরীত কিছু হয় তাহলে আমি ফিরে এসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।
আর যদি আপনার বিপদ হয়? বলল ফাতিমা মারিয়েম।
আমি আমাকে নিরাপদ রেখেই সবকিছু করব। বাকি আল্লাহ ভরসা। আল্লাহ যা করবেন সেটাই হবে। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ বলল।
ফাতিমা মারিয়েম কিছু বলতে গিয়েও চেপে গেল। মুখ নিচু করল।
তোমার পরিকল্পনা ঠিক আছে ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ। তুমি কাউকে সাথে নেবে কিনা বিবেচনা করে দেখ। বলল যিমো সাঈদ।
পরিস্থিতি দেখার যে কাজে আমি যাচ্ছি, তা একার জন্যে সুবিধাজনক স্যার। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ সবাইকে সালাম দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে গিরিপথ থেকে নেমে গেল।
জংগলের আড়াল নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উপত্যকার প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল।
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ গিরিপথ থেকে নেমে জংগলের মধ্য দিয়ে কিছুটা দক্ষিণে এসে পৌঁছল। সেখান থেকে ঘটনার স্থান আরও কাছে এসে গিয়েছিল।
জংগলের প্রান্ত থেকে উঁকি দিয়ে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেল। দেখল, সারি সারি লাশ পড়ে আছে। দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে লাশের পাশে। তারা লাশগুলোকে সার্চ করছে।
সার্চ করতে গিয়ে তাদের দুজনই এদিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দুজনের মধ্যে একজনের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ। উনি তো মেজর পাভেল, তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর ডেপুটি প্রধান।
আনন্দে লাফিয়ে উঠল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
বেরিয়ে এলো জংগল থেকে। উড়িয়ে দিল সাদা রুমাল।
মিনিটখানেকের মধ্যেই সিমো সাঈদরা ছুটে নেমে এলো নিচে, উপত্যকায়। আহমদ মুসারাও দেখতে পেয়েছিল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ এবং সিমো সাঈদদের।
ওরা কি ত্ৰিয়াদা থেকে আসছে? বলল আহমদ মুসা মেজর পাভেলকে।
ইয়েস স্যার। আসুন স্যার, তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এসে গেছে ওরা।
আহমদ মুসা ও মেজর পাভেল একসাথে কয়েক ধাপ এগোলো। সিমো সাঈদরাও এসে পড়েছে।
আহমদ মুসাকে সিমা সাঈদদের সামনে নিয়ে এসে সিমো সাঈদকে দেখিয়ে বলল, ইনি সিমো সাঈদ, জিয়াদা এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তিনি জিয়াদা অঞ্চলের প্রশাসনিক উপদেষ্টাও। মেজর পাভেল বলল। এরপর ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ, ফাতিমা মারিয়েম, হাদি হাকামদের সাথে আহমদ মুসাকে পরিচয় করিয়ে দিল মেজর পাভেল। এরপর মেজর পাভেল আহমদ মুসা সম্পর্কে বলল, আর স্যারের সম্পর্কে তো আপনারা জানেন। তিনি আমাদের সম্মানিত নেতা, আমাদের গাইড।
সংসদের বৈঠকে আমরা তার সম্পর্কে কিছু শুনেছি। কিন্তু পরিচয় জানার সৌভাগ্য হয়নি। বলল সিমো সাঈদ।
নানা কারণে তার পরিচয় সাধারণভাবে জানানো হয় না। আপনারা দায়িত্বশীল ও সচেতন। হ্যাঁ, এখন আপনারা অবশ্যই তার পরিচয় জানবেন। তিনি আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা। মেজর পাভেল বলল।
নাম শোনার সাথে সাথে সবার চোখ গিয়ে আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার ওপর। সিমো সাঈদ স্থির দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত আহমদ মুসার দিকে চেয়ে থেকে আসোলামু আলাইকুম বলে জড়িয়ে ধরল তাকে। ফাতিমা মারিয়েম ও হাদি হাকামের অপ্রতিরোধ্য আবেগ যেন অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাদের চোখ দিয়ে। ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ স্যালুট দিয়ে বলল, স্যার, গোটা দুনিয়ায় আমাদের মতো যারা, তাদের আপনি আলোর মশাল। আপনি আমাদের প্রেরণা, আমাদের শক্তি।
আহমদ মুসা ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহর পিঠ চাপড়ে বলল, ইয়ংম্যান, প্রশংসা শুধু আল্লাহরই প্রাপ্য। আমার বুদ্ধি, আমার জ্ঞান, আমার সাহস, শক্তি, কিছুই তো আমি সৃষ্টি করিনি। এসব যিনি দয়া করে আমাকে দিয়েছেন, প্রশংসা তাঁরই। কারও সাক্ষাতে তার সামনে এই ধরনের প্রশংসা আল্লাহর রাসূল স. পছন্দ করেননি।
স্যার, এগুলো প্রশংসা নয় স্যার। এগুলো সত্যের প্রকাশ। আমাদের জন্যে এটুকুর প্রয়োজন আছে স্যার। আল্লাহ আমাদের মাফ করবেন। বলল ফাতিমা মারিয়েম। তার গালে তখনও অশ্রুর ধারা।
ধন্যবাদ বোন। তোমরা ভালো যুক্তি শিখেছ। আসল কথা কি জান, ব্যক্তি আমাদের কাছে বড় হওয়া উচিত নয়, তার কাজ বড় হতে হবে। যারা ব্যক্তিকে বড় করে দেখে, তারা ব্যক্তির পূজা করে, কিছুই শেখে না, সেই ব্যক্তির রেখে যাওয়া পতাকা তারা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারে না। আর ব্যক্তিকে নয়, কাজকে বড় করে দেখলে, সে কাজ শেখে, তার রেখে যাওয়া কাজ সে করে। এটাই আল্লাহ চান, রেসালাতের শিক্ষাও এটা। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ স্যার। এই যে…।
ইশারা করে ফাতিমা মারিয়েমকে থামিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা সিমো সাঈদের দিকে চেয়ে বলল, জনাব, আমাদের হাতে সময় খুব কম। আমি ও মেজর পাভেল পাহাড়ে ঢুকেছিলাম মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের ঘাঁটি খুঁজে বের করার জন্যে। এই সময় ত্ৰিয়াদার বিপদের কথা শুনে আমরা এদিকে চলে আসি। এ ঘটনার পর এই অঞ্চলের মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের ঘাঁটিতে অভিযান অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এই ওবাদিয়া পাহাড় অঞ্চলের কোথায় মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের ঘাঁটি আছে, এ ব্যাপারে আপনারা কি কোনো সাহায্য করতে পারবেন?
সিমো সাঈদের হঠাৎ মনে পড়ল ফৈজির দেয়া তথ্য যে, ইপিজি-এর ঘাঁটি থেকেই হাওয়ারীদের জনবল, অস্ত্রবল সবই সরবরাহ করা হয়। অন্য কথায় হাওয়ারী নামের ছদ্মবেশে ইপিজিই ত্রিয়াদাকে ধ্বংস করার জন্য এই অভিযানে এসেছিল। ইপিজি কি ছদ্মবেশ? আসলে এরাই কি মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট? এই চিন্তা করে সিমো সাঈদ দ্রুত বলল, জনাব, আমাদের গোয়েন্দা গ্রুপ আজই আমাদের একটা তথ্য দিয়েছে, হাওয়ারীদের এই অভিযানকে জনবল, অস্ত্রবল দিয়ে সাহায্য করেছে এনভাইরনমেন্টাল প্রটেকশন গ্রুপ (ইপিজি) নামের এনজিও। এদের অফিস আছে এই ওবাদিয়ার পাহাড় অঞ্চলের আরও একটু দক্ষিণ-পূর্বে, আরও একটু উপরে। আমার এখন মনে হচ্ছে ইপিজি নামটাও ছদ্মবেশ। এরাই মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট হতে পারে।
অনেক ধন্যবাদ, জনাব। ইপিজির অফিস বা ঘাটির লোকেশনটা কি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আমি যাইনি কখনও ইপিজি অফিস এলাকায়। তবে আমাদের গোয়েন্দা ইনফরমাররা জায়গাটা চেনে। আমি তাদের একজনকে ডাকছি।
একটু থামল সিমো সাঈদ। সংগে সংগেই আবার বলল, জনাব, আপনি আমাদের দোরগোড়ায় এসেছেন। আমরা সর্বান্তকরণে আশা করছি, আমাদেরকে দয়া করে আতিথেয়তার সুযোগ দেবেন।
আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার দাওয়াত গ্রহণ করতে পারলে খুব খুশি হতাম। ক্ষুধাও লেগেছে খুব। কিন্তু এ মুহূর্তে তা সম্ভব নয়। এখান থেকে অনেক লোক পালিয়ে যেতে পেরেছে। তারা জমায়েত হয়ে ওখানে পৌঁছাবার আগেই আমরা তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছতে চাই। সেই গোয়েন্দা ছেলেটিকে আমাদের সাথে দিন অথবা লোকেশন পেলেই চলবে। বলল আহমদ মুসা।
স্যরি স্যার, ওরা জমায়েত হয়ে ঘাঁটিতে গেলেই না লাভ বেশি? তখন ওদের একসাথে পাওয়া যাবে। তাদের আগে পৌঁছলে তো ওদের অনেককেই পাবেন না। বলল ফাতিমা মারিয়েম।
ওদের ঘাঁটিতে গিয়ে লড়াই করা আমাদের লক্ষ্য নয়। ঘাঁটি থেকে এমন কিছু কাগজপত্র, দলিলপত্র আমরা পেতে চাই, যার দ্বারা জানা যাবে, তারা কারা? কেন এসব করছে? কি চায় তারা? তাদের গোড়া কোথায়? এসব জানলে তবেই ওদের সন্ত্রাস নির্মূল করা যাবে। তাছাড়া ওলা দল পরিত্যাগ করে পালাতেও পারে। ওদের যদি ধীরে-সুস্থে ঘাটি ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে সব আলামত নষ্ট করে যাবে অথবা নিয়ে যাবে। আহমদ মুসা বলল।
বুঝেছি জনাব। ফৈজি এখনই আসছে। আমরা কি আপনাদের সাথী হতে পারি? অন্তত অস্ত্রধারীদের আপনারা সাথে নিতে পারেন। বলল সিমো সাঈদ।
জনাব, আসলে আমরা গোপন অভিযানে যাচ্ছি। বেশি লোক নিলে ব্যাপারটা গোপন রাখা নাও যেতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
ফৈজি এসে গেল।
সিমো সাঈদ ফৈজিকে এনে আহমদ মুসার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, এ ফৈজি। আমাদের তথ্য-গোয়েন্দা গ্রুপের সদস্য।
আহমদ মুসা ফৈজিকে সালাম দিয়ে বলল, আপনি ইপিজি অফিসে গেছেন?
জি স্যার। কয়েকবার গেছি। ফৈজি বলল।
খুব অল্প কথায় লোকেশনটা বলতে পারবেন, প্লিজ? বলল আহমদ মুসা।
লোকেশন খুঁজে পেতে মজার চিহ্ন আছে। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ের ত্রিভুজের তৃতীয় ত্রিভুজটির পিরামিড আকৃতির মাথার পরেই গভীর উপত্যকা ঘেরা একটা প্রশস্ত টিলা আছে। ঐ টিলাতেই ইপিজির অফিস। ফৈজি বলল।
পাহাড়ের একটা ত্রিভুজ তো আমরা পার হয়ে এসেছি। পরের ত্রিভুজ দুটি কোথায়? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, এখন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সবচেয়ে উঁচু মাথার একটা নাঙ্গা পাহাড় শীর্ষ দেখতে পাবেন। ওই পাহাড় শীর্ষকে নাক বরাবর রেখে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগোলে পাহাড়ের দুটি ত্রিভুজই পাওয়া যাবে। তৃতীয় ত্রিভুজটি ঐ নাঙ্গা পাহাড়ের নিচেই। ফৈজি বলল।
ত্রিভুজ ছাড়া পথের আর কোনো চিহ্ন আছে? বলল আহমদ মুসা।
ঐ নাঙ্গা পাহাড় সামনে রেখে ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব কোণ বরাবর এগোতে পারলে কোনো পাহাড় ডিঙাতে হবে না। উপত্যকার পর উপত্যকা পেরিয়ে ইপিজি অফিসে পৌঁছা যাবে। পাহাড়ের দ্বিতীয় ত্রিভুজকে বাম পাশে এবং তৃতীয় ত্রিভুজকে ডান পাশে রেখে এগোতে হবে। ফৈজি বলল।
ধন্যবাদ ফৈজি। ইপিজি অফিস বা ঘাটি সম্পর্কে কিছু বল। তুমি কি স্কেচ এঁকে দিতে পার? বলল আহমদ মুসা।
পারব স্যার। ফৈজি বলল।
আহমদ মুসা তার পিঠের ব্যাগ থেকে একখণ্ড কাগজ এবং একটা কলম নিয়ে ফৈজির হাতে তুলে দিল।
ফৈজি বসে কাগজের শিটটি নিয়ে উরুর উপর রেখে স্কেচ আঁকল। প্রবেশ পথসহ প্যাসেজ, দরজা, চত্বর ইত্যাদি যতটা সম্ভব দেখাবার চেষ্টা করল। আঁকা শেষ করে কাগজের শিট ও কলম তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা স্কেচটির ওপর নজর বুলাল। বলল, তোমার স্কেচের উত্তর দিক তো কাগজের উপরের দিক তাই না?
লজ্জিত হলো ফৈজি। বলল, স্যরি স্যার, আমার ভুল হয়েছে। আমি পূর্বমুখী হয়ে বসে স্কেচ করেছি, সে কারণে স্কেচ-শিটের উপরের দিককে পূর্ব দিক ধরে নিয়েছি।
ধন্যবাদ ফৈজি। অসুবিধা নেই।
বলে আহমদ মুসা তাকাল সিমো সাঈদের দিকে। বলল, জনাব, আমরা এখন আসি।
জনাব জিয়াদার কঠিন এক দুঃসময়ে আল্লাহ আমাদের জন্যে আপনাকে পাঠিয়েছেন। ওদের সাথে লড়াইয়ে আমরা জিতব, তা আমরা আশা করতে পারিনি। আমরা মৃত্যুর জন্যে তৈরি হয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ আমাদের বিজয় এনে দিয়েছেন। মহান আল্লাহর অপার মহিমা আমাদের গায়ে একটা কাঁটার আঁচড়ও লাগল না। আপনার দ্বারাই আল্লাহ এই অসাধ্য সাধন করলেন। আমাদের আকুল একটা কামনা ছিল আপনাকে আমরা ত্ৰিয়াদায় নিয়ে যাই। ফেরার পথে কি দয়া করে…!
সিমো সাঈদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠল আহমদ মুসা, আমরা আদৌ ফিরব কিনা, কোন্ পথে কিভাবে ফিরব, সবই আল্লাহর হাতে। আমি কোনো ওয়াদা করতে পারছি না জনাব। তাড়াহুড়ার। প্রয়োজন নেই। আমি তো রত্ন দ্বীপে আরও কিছু দিন আছি।
আমরা আশায় রইলাম স্যার। বলল ফাতিমা মারিয়েম।
ভালো কোনো বিষয়ে আশাহত হতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আহমদ মুসা বলল।
শান্তির এই রত্ন দ্বীপে এই বিপদ কেন এলো স্যার? গত পঞ্চাশ বছরে গুলি কিংবা আগ্নেয় অস্ত্রের আঘাতে একজন লোকও মারা যায়নি, কিন্তু মাত্র গত কয়েকদিনে প্রায় একশর মতো লোক মারা গেল এই দ্বীপে। বলল ফাতিমা মারিয়েম।
আল্লাহ ভালো জানেন। তবে আমি দুটি বিষয় অনুমান করি। এক. বাইরের কোনো গ্রুপ রত্ন দ্বীপে হঠাৎ কোনো স্বার্থের সন্ধান পেয়েছে অথবা রত্ন দ্বীপ নিয়ে কারো কোনো পরিকল্পনা আছে। দুই, আল্লাহ এই উপলক্ষে রত্ন দ্বীপের যোগ্যতা বাড়িয়ে দিতে চান। একটি রাষ্ট্রের আত্মরক্ষার জন্যে যে সর্বনিম্ন প্রস্তুতিটুকু থাকা দরকার তা রত্ন দ্বীপের নেই। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ স্যার। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এই শেষের বিষয়টি আমাদের রাষ্ট্রনেতাদের মাথায় ভালোভাবে ঢুকা দরকার। বলল ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, এটা তোমাদের কাজ, এটা সিমো সাঈদ সাহেবদের কাজ।
কথা শেষ করেই আর কোনো কথা নয় বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল মেজর পাভেলের দিকে। বলল, মেজর পাভেল তুমি রেডি?
জি স্যার, আমি রেডি। আমি কিছু অ্যামুনেশন ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহর কাছ থেকে নিয়েছি। বলল মেজর পাভেল।
ঘটনাটা ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহকে হেড কেয়ার্টারে জানাতে বলেছ? আহমদ মুসা বলল।
জি স্যার। বলল মেজর পাভেল।
ধন্যবাদ। এবার চল।
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম দিয়ে আবার ফিরল।
হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা। তার পেছনে পেছনে মেজর পাভেল।
সবার চোখ তাদের যাত্রাপথের দিকে।
বাবা পোস্ট মডার্ন যুগের আরেক হাতেম তাঈ তিনি। বলল ফাতিমা মারিয়েম। তার কণ্ঠ, ভারি।
অ্যান্থনি হুগো, তোমার গুপ্তধন সার্চ ফাইলটি নিয়ে এসো এখনি। বলল আইভান ম্যাথিউ। আইভান ম্যাথিউ মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট-এর ওবাদিয়া ঘাঁটির প্রধান। আর অ্যান্থনি হুগো রত্ন দ্বীপে মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের গুপ্তধন সার্চ কমিটির সদস্য। অ্যান্থনি হুগো আজই রেনেটা ক্যাসল থেকে ওবাদিয়া ঘাঁটিতে এসেছে।
রেনেটা ক্যাসল রত্ন দ্বীপে মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টার।
অ্যান্থনি হুগো রত্ন দ্বীপে গুপ্তধন সার্চ কমিটির ফাইল নিয়ে আইভান ম্যাথিউ-এর ঘরে এল।
স্যরি অ্যান্থনি, তুমি অনেক সময় আগে এসেছ। কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে পারিনি। জিয়াদা অভিযান নিয়ে সাংঘাতিক টেনশনে পড়েছি। দায়িত্বশীল কারও সাথেই যোগাযোগ করতে পারছি না। সব মোবাইলই বন্ধ। ওদের প্রায় ফিরে আসার সময় হয়ে গেল, কিন্তু কোনো খবরই ওদিক থেকে আসছে না। বলল আইভান ম্যাথিউ।
অ্যান্থনি হুগোরও কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠল। বলল, খারাপ কিছু ঘটেছে বলে আশঙ্কা করছেন? ভালোও তো হতে পারে। হয়তো আনন্দ ফুর্তি করতে গিয়ে খবর দিতে ভুলে গেছে।
কিন্তু ওরা কেউ কল অ্যাটেন্ড করবে না এটা তো হয় না। আশঙ্কার বিষয় এখানেই। বলল আইভান ম্যাথিউ।
খারাপ কিছু ঘটলে, অবশ্যই ওরা জানাবার কথা। অ্যান্থনি হুগো বলল।
দায়িত্বশীল না হলে জানাবার কাজ অন্য কেউ অনেক সময়ই করতে চায় না। পালিয়ে থাকার সুযোগ নেয় তারা। বলল আইভান ম্যাথিউ।
দায়িত্বশীল কেউ থাকবে না, সবাই মারা পড়বে, তার খবরও আসবে।, এমন ভাবার দরকার নেই স্যার। অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। অ্যান্থনি হুগো বলল।
এমন ঘটতেও পারে! আজই তো ঘটেছে। ওবাদিয়া আউটপোস্টে আমাদের সুপরিকল্পিত অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। খবর দেবার মতো একজনও বেঁচে ছিল না। বলল আইভান ম্যাথিউ।
একটু থামল আইভান ম্যাথিউ। বলল আবার সংগে সংগেই, থাক এ বিষয়। আমি তোক পাঠিয়েছি খবর নেয়ার জন্যে। এখন বলুন আপনার কথা।
একটু নড়ে-চড়ে বসল অ্যান্থনি হুগো। বলল, গতকাল চীফ বস্ টেলিফোন করেছিলেন গুপ্তধনের লোকেশন সন্ধানের ব্যাপারে আমরা কতটা এগিয়ে তা জানার জন্য। তিনি খুব অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন যে, আমরা কোনো লোকেশন চিহ্নিত করার কাজে কিছুই এগোয়নি। ইমিডিয়েটলি তিনি রেজাল্ট দেখতে চান। আসলে রত্ন দ্বীপে আমাদের গোটা জনশক্তি দ্বীপ-প্রশাসনের সাথে আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে জড়িয়ে পড়েছে। গুপ্তধন সন্ধানের কাজ বন্ধই হয়ে গেছে। কাজটি এখনি শুরু হওয়া দরকার। থামল অ্যান্থনি হুগো।
এতদিন রেনেটা ক্যাসল থেকে কেন্দ্রীয় একটা টিম এই কাজ করছিল। গুপ্তধন সন্ধানের কোনো ব্যাপারেই আমাদের কিছু জানানো হয়নি। বলল আইভান ম্যাথিউ।
এখন সন্ধানের কাজ দ্রুততার সাথে করতে বলা হয়েছে। এখন রত্ন দ্বীপ সরকার-ব্যবস্থা ধ্বংস ও সরকারের পতন ঘটানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলবে। কিন্তু এজন্যে গুপ্তধন সন্ধানের কাজ বন্ধ রাখা যাবে না। সরকার ব্যবস্থা ও সরকারের পতন হোক না হোক, গুপ্তধন আমাদের উদ্ধার করতে হবে এবং সেটা খুবই তাড়াতাড়ি। এজন্যেই গুপ্তধন সন্ধানের কাজ এখন রেনেটা ক্যাসলসহ সব কেন্দ্র থেকে করা হবে। পশ্চিমের আড্রিয়ানা অঞ্চলে রেনেটা ক্যাসল থেকে, দক্ষিণের ওবাদিয়া অঞ্চলে ইপিজি থেকে, পূর্বের গোয়েন্দালিয়া অঞ্চলে (কাবার্বা ক্যাসলসহ) জাদোক এবং উত্তরে আমোডি অঞ্চলে আরাগন থেকে সন্ধান চালানো হবে। অত্যন্ত দ্রুত কাজ সমাধার জন্যেই এটা করা হয়েছে। বলল অ্যান্থনি হুগো।
গোয়েন্দালিয়া অঞ্চলে জাদোক ও আমোড়ি অঞ্চলে আরাগনসহ রত্ন দ্বীপে মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের ৪টি ঘাঁটি রয়েছে। এই চারটির মধ্যে রেনেটা ক্যাসল হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ধন্যবাদ হুগো। এখন বল হেডকোয়ার্টার আমাদেরকে এ ব্যাপারে কি সাহায্য করবে? আইভান ম্যাথিও বলল।
এ সম্পর্কে যতটুকু তথ্য আছে তা দিয়ে সাহায্য করবে হেডকোয়ার্টার, বাকিটা আপনাদের যোগাড় করতে হবে।
বলে অ্যান্থনি হুগো একটি ফাইল আইভান ম্যাথিউ-এর হাতে দিয়ে বলল, দেখুন এই ফাইলে চারটি স্থানে চারটি গুপ্তধনের ইতিহাস আছে। কোনোটিরই স্থানের নাম নেই, আছে পাহাড়ী পথের একটি করে স্কেচ, কিছু চিহ্ন এবং দুর্বোধ্য কিছু ল্যাটিন ও আরবি অ্যালফাবেট। এসব ব্যবহার করে গুপ্তধনের চারটি স্থান চিহ্নিত করতে হবে। = ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিল আইভান ম্যাথিউ। বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল, মহাব্যাপার অ্যান্থনি হুগো। বিশ্বের বিখ্যাত জলদস্যুদের ধনভাণ্ডার লুকানো আছে এই রত্ন দ্বীপে? দক্ষিণ আমেরিকা থেকে লুট করে আনা ট্রেজার শীপের স্বর্ণ পুনলুণ্ঠিত হয়ে তাও এখন রত্ন দ্বীপের মাটির তলে আছে। স্পেনের পরাজিত ও বিতাড়িত মুসলিমদের শত শত নৌকা জাহাজ লুট করে জলদস্যুরা। লুষ্ঠিত জাহাজ বোঝাই স্বর্ণ, মণি-মানিক্য জলদস্যুরা এই জনমানবহীন রত্ন দ্বীপেই লুকিয়ে রাখে। সত্যিই চমৎকার সব কাহিনী।
কাহিনী চমৎকার, সাত রাজারধনের চেয়েও বড় গুপ্তধনভাণ্ডার আরও বেশি বিস্ময়কর! কিন্তু গুপ্তধনের পথের নক্সা, দুর্বোধ্য চিহ্নগুলো এবং ল্যাটিন ও আরবি বর্ণগুলোর তাৎপর্য উদ্ধার করা তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর। আমাদের হেডকোয়ার্টার এখন সব বাধা দূর করে গুপ্তধন উদ্ধারকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বলল অ্যান্থনি হুগো।
আমাদেরও চাওয়া এটাই। আইভান ম্যাথিউ বলল।
বলেই আইভান ম্যাথিউ তাকাল তার হাতঘড়ির দিকে। দেখল ৭টার বেশি বেজেছে। মনের আতংকটা তার নতুন করে জেগে উঠল। কারো
কোনো খবর নেই কেন? যাদের পাঠানো হলো, তারাও তো কিছু জানাচ্ছে না।
আইভান ম্যাথিও ইন্টারকম অন করে বলল, সাইমন, ওদিকের কোনো খোঁজ জান?
এখন পর্যন্ত কোনো খবর আমি জানি না। এইমাত্র একটি মেসেজ এসেছে ম্যারিও-এর কাছ থেকে। আমি মেসেজটা দেখে বলছি স্যার। বলল সাইমন।
তুমি মেসেজটা নিয়ে এসো এখনি। বলল আইভান ম্যাথিও।
আসছি স্যার। বলে সাইমন দ্রুত এলো।
বসো সাইমন। পড় তোমার মেসেজ। বলল আইভান ম্যাথিউ।
ধন্যবাদ স্যার! বলে বসল সাইমন। পড়ল মেসেজটা : খুব বড় ঘটনা ঘটে গেছে। ত্রিয়াদা পৌঁছার আগেই ক্রিক উপত্যকায় আমরা বাধার মুখে পড়ি। মাত্র একজন লোক আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। একসাথে আমাদের অনেক মেশিনগান তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। কিন্তু অলৌকিকভাবে লোকটা বেঁচে যায় এবং সে পাল্টা আক্রমণ করে। পরে আরেকজন লোক তার সাথে যোগ দেয়। আমাদের অর্ধেকের মতো লোক মারা গেছে। বেঁচে থাকাদের অধিকাংশই আহত। আমিও আহত, চলবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। অল্প কিছু যারা আহত হয়নি তারা পালিয়েছে ভয়ে। থামল সাইমন। মেসেজ পড়া শেষ।
বিষাদের ছায়া নেমেছে আইভান ম্যাথিউ-এর চোখে মুখে। স্বগত:কণ্ঠে বলল, এখানেও সেই একজন লোক। তাকে ধরার জন্যেই তো আমাদের সব আয়োজন। আর সেই কি না আমাদের এত বড় অভিযানকে ভণ্ডুল করে দিল!
আইভান ম্যাথিও তাকাল সাইমনের দিকে। বলল, এখন আমাদের এই ঘাঁটিতে কতজন লোক রয়েছে?
সব মিলিয়ে ১২জন। বলল সাইমন।
তাহলে পাঁচজনকে পাঠিয়ে দাও আহতদের উদ্ধার করার জন্যে। তারা শত্রুর হাতে পড়লে মহাক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের। আইভান। ম্যাথিউ বলল।
ঘাটি অরক্ষিত হয়ে পড়বে না তো? বলল সাইমন।
পাঁচজন পাঠানোর পরও আমরা সাতজন থাকছি। অসুবিধা হবে না। আর ঘাঁটিতে ওরা হামলা চালাতে পারে বলে আমি মনে করি না। ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া সহজ নয়। আইভান ম্যাথিউ বলল।
উঠছি স্যার। বলল সাইমন।
শোন সাইমন, ওদের প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে পাঠাবে।
সাইমন উঠে গেল।
মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট-এর বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। প্রায় একশত খুবই মূল্যবান জীবন আমাদের হারিয়ে গেল। বস্ খুবই ক্রুদ্ধ হয়েছেন। গুপ্তধন উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তিনি গুপ্তধন উদ্ধারের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন সংঘাত এড়িয়ে চলতে বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত খুবই যৌক্তিক। বলল অ্যান্থনি হুগো।
তুমি কথা তুলেছ, সে জন্যেই বলছি। শুধু গুপ্তধনের উদ্ধারই কি আমাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে? যার জন্যে আমরা কোটি কোটি ডলার নিয়েছি, সে কাজটা আমরা কখন করব। গুপ্তধন উদ্ধারের পর ঐ কাজের আবেগ, উৎসাহ কি আমাদের থাকবে? আইভান ম্যাথিউ বলল।
সেকাজটা ছাড়া হচ্ছে না। শুধু অগ্রাধিকার পরিবর্তন হচ্ছে। আগে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল রত্ন দ্বীপে ত্রিধর্মের ঐক্য ভেঙে তাদের মধ্যে অবিশ্বাস ও হানাহানির পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, তারপর সরকারের পতন ঘটানো এবং সেই বিশৃঙ্খল পরিবেশে গুপ্তধনভাণ্ডার উদ্ধার করা। এখন এটুকু পরিবর্তন হয়েছে যে, দুই কাজ একই সময়ে করা হবে। যেহেতু সংঘাতের পরিবেশটা হঠাৎ বেড়ে গেছে, তাই ওদিকটা থেকে একটু সরে এসে গুপ্তধনভাণ্ডারগুলো চিহ্নিত করা এবং তা উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হওয়া দরকার, যাতে প্রয়োজনের মুহূর্তে ধনভাণ্ডারগুলো সরিয়ে নেয়া যায়। তা না হলে বিশৃঙ্খল পরিবেশে বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হবে, যারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়, তারা কি করবে, সেটা অনিশ্চিত। সে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য ধনভাণ্ডার উদ্ধারের কাজ ফেলে রাখা যায় না বলেই অগ্রাধিকারের বিষয়টা পরিবর্তন করা হয়েছে। বলল অ্যান্থনি হুগো।
বলতো যারা আমাদের কোটি কোটি ডলার দিয়েছে রত্ন দ্বীপের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস ও সরকারের পতনের জন্যে, তাদের আসল। লক্ষ্য কি? দ্বীপ দখল? এই ছোট দ্বীপ দখলের জন্যে তো এত কিছুর দরকার হয় না। একদল সৈন্য নিয়ে এলেই তো এ দ্বীপ দখল করে নিতে পারে তারা। আইভান ম্যাথিউ বলল।
শুধু দ্বীপ দখল ওদের লক্ষ্য নয়। রত্ন দ্বীপে তিন ধর্মের সংহতি ভেঙে পড়েছে, তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সংবিধান ধ্বংস হয়েছে, এটা তারা দুনিয়াকে দেখাতে চায়। তারা বিশ্ববাসীকে বলতে চায়, ধর্মীয় সম্প্রীতি, সহাবস্থান সম্ভব নয়। বলল অ্যান্থনি হুগো।
এতে তাদের লাভ কি? কেন তারা এটা করবে? আইভান ম্যাথিউ বলল।
করবে, কারণ তারা ক্ষুদ্র সংহত এক সন্ত্রাসী গ্রুপ ও পাওয়ার ফুল ক্যুনিটির সদস্য। তারা গোটা দুনিয়ায় অবিশ্বাস, সন্ত্রাস ও সংঘাত ছড়িয়ে দিতে চায়। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেও তারা তাদের বশংবদ চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করছে, যারা পরোক্ষভাবে তাদেরকে সাহায্য করে থাকে তাদের লক্ষ্য অর্জনে। এরা দারুণ কুশলী। এরা গোপনে এক হাত দিয়ে সন্ত্রাসী তৈরি করছে এবং অন্য এক হাত দিয়ে প্রকাশ্যে সেই সন্ত্রাসীদের ধ্বংস করার নামে নিরপরাধ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করছে। তারা দুনিয়ার সকলকে দুর্বল ও বিভক্ত করে নিজেদের সবল ও সংহত রাখতে চাচ্ছে। বলল অ্যান্থনি হুগো।
হ্যাঁ, এদের সম্পর্কে আমি শুনেছি। কিন্তু এদের পক্ষেই যে আমরা কাজ করছি, তা আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না। আইভান ম্যাথিউ বলল।
কার কাজ করছি, সেটা মিড ব্লক সিন্ডিকেটের কাছে বড় বিষয় নয়, বড় হলো টাকা। টাকা হলে যে কারও যেকোনো কাজ আমরা করতে। পারি। যখন ওদের সাথে মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের এই ডিল হয়, তখন আমি সিসিলিতে আমাদের হেডকোয়ার্টার ক্যাটেনিয়ায় ছিলাম। সেই কারণে আমি সবটা জানতে পেরেছি। বলল অ্যান্থনি হুগো।
হুগো মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের গোয়েন্দা গ্রুপের একজন অফিসার।
আইভান ম্যাথিউ কিছু বলতে যাচ্ছিল।
তার পাশে রাখা ইন্টারকমে নীল আলোর ফ্লাশ হতে লাগল।
আইভান ইন্টারকমের স্পীকার তুলে নিয়ে ইন্টারকম অন করে দিল।
স্যার, আমাদের ইলেকট্রনিক সার্ভিল্যান্সের প্রথম লাইন অব ডিফেন্স কেউ ক্রস করেছে। আমরা সিগন্যাল পেয়েছি। সাইমন বলল।
ক্রস করেছে ওরা কয়জন? জিজ্ঞেস করল আইভান ম্যাথিউ।
দুজন স্যার। বলল সাইমন।
কতক্ষণ আগে ওরা প্রথম প্রতিরক্ষা লাইন ক্রস করেছে? আইভান ম্যাথিও বলল।
এই মাত্র, দুমিনিটও হবে না। বলল সাইমন।
শোন সাইমন, তুমি তাড়াতাড়ি কাউকে নিয়ে ব্রীজে যাও। ব্রীজের মাঝখানের সংযোগ প্লেট এপারে সরিয়ে নাও। যদিও ইপিজির এই কেন্দ্র আমাদের ঘাঁটি, এটা শত্রুরা কোনো ভাবেই জানার কথা নয়। তবু সাবধান আমাদের হতে হবে। ক্রিক উপত্যকায় দুজন লোক আমাদের সর্বনাশ করেছে। এ পর্যন্ত যত ক্ষতি আমাদের হয়েছে, দুএকজন লোকের দ্বারাই হয়েছে। যাও, দ্রুত যাও আমি যা বলছি, তাই কর। আইভান ম্যাথিও বলল।
.
ইপিজির অফিসটি একটা সমতল প্রশস্ত পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়টি একটা পাহাড়শ্রেণির অংশ। সবুজ পাহাড়ের এই অংশটা আরও বেশি সবুজ। এ সবুজের উত্তর প্রান্ত ঘেঁষে পাহাড়ে একটা বিশাল ক্রিক। অনেকটা ক্যানিয়নের মতো। ক্রিকটি কয়েকশ ফিট গভীর। প্রায় তিরিশ ফিটের মতো প্রশস্ত।
এই ক্রিকটির উপরই তৈরি হয়েছে ব্রীজ। ব্রীজের মাঝখানে স্থানান্তরযোগ্য দশ ফিটের একটা স্ল্যাব আছে। স্ল্যাবটি ইপিজি সেন্টারের দিকে সরিয়ে নেয়া যায় এবং স্প্রিং লক অফ করে আবার তা এভাবে সেট করাও যায়।
।সাইমন গিয়ে প্রিং লক অন করে স্ল্যাব দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে নিল।
বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ইপিজি কেন্দ্র। আর কোনো বিকল্প রাস্তা নেই। ইপিজি-তে যাওয়ার।
সাইমন মোবাইলে জানিয়ে দিল আইভান ম্যাথিউকে যে ব্রীজকে বিচ্ছিন্ন করার কাজ শেষ হয়ে গেছে।
ওপার থেকে আইভান ম্যাথিউ বলল, ধন্যবাদ সাইমন। যদিও কোনো আশঙ্কা আমি করি না, তবু সতর্ক থাকা ভালো। তুমি ব্রীজের গোড়ায় একজন লোককে মোতায়েন রাখ। আর ব্রীজকে করে দাও অন্ধকার। অবশিষ্ট ৪জনকে প্রয়োজন মতো মোতায়েন কর। তোমার দায়িত্ব হলো ইলেকট্রনিক সার্ভিলেন্সের দিকে নজর রাখা। কোনো জন্তু জানোয়ার না হয়ে শত্রুরাই যদি আমাদের প্রথম ইলেকট্রনিক প্রতিরক্ষা লাইন পার হয়ে। থাকে, তাহলে তারা আরও অগ্রসর হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রতিরক্ষা লাইন তাদের পার হতে হবে ব্রীজে পৌঁছার আগেই। তৃতীয় প্রতিরক্ষা লাইনে ফাঁদ পাতা আছে। ফাঁদে তারা পড়ল কিনা জানতে হবে।
ঠিক আছে স্যার। বলল সাইমন।
সাইমন ব্রীজ থেকে ফিরে এলো ঘাঁটিতে। এগোলো দায়িত্ব বণ্টন করে দেবার জন্য সিকিউরিটি ব্যারাকের দিকে।
.
আহমদ মুসা তার ডান পাটা ফেলার পরেই হাতঘড়ির বিফ বিফ সিগন্যালের কনটিনিউয়াস সাউন্ড শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রিস্ট ওয়াচের স্ক্রিনের দিকে তাকাল। চমকে উঠল আহমদ মুসা, তার পায়ের নিচে ইলেকট্রিক তার।
মেজর পাভেল আহমদ মুসার সমান্তরালে চলছিল। সেও থমকে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসাকে ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখে মেজর পাভেল আঁচ করল কিছু একটা ঘটেছে।
স্যার, কিছু ঘটেছে? জিজ্ঞাসা করল মেজর পাভেল।
মেজর পাভেল, তুমি ও আমি দুজনে একটা সূক্ষ্ম ইলেকট্রিক তারের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আগেই সংকেত বেজেছে, কিন্তু আমি খেয়াল করিনি। ভয়ের কিছু নেই। খুবই নিচু ভল্টের তার। কোনো বিস্ফোরক এখানে নেই।
বলে পা তুলে সামনে এগোলো আহমদ মুসা ও মেজর পাভেল।
তাহলে ইলেকট্রিক তার কেন স্যার? বলল মেজর পাভেল।
এটা ওদের ইনফরমেশন নেটওয়ার্কের অংশ। আহমদ মুসা বলল।
তার মানে ওরা আমাদের উপস্থিতি জেনে ফেলেছে? বলল মেজর পাভেল।
জেনে ফেলতেও পারে? আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল, এস মেজর পাভেল। শত্রু সাবধান থাকলেও লাভ, না থাকলেও লাভ।
সেটা কেমন স্যার? বলল মেজর পাভেল।
সাবধান না থাকার সুবিধা তো সকলের জানা। আর সাবধান থাকার সুবিধা হলো শত্ৰু আতংকিত থাকে, কি করব, কি করব না- এমন দ্বিধায় থাকে শত্রু। আহমদ মুসা বলল।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। হাত বাড়িয়ে মেজর পাভেলকেও এগোতে নিষেধ করল।
মেজর পাভেলও দাঁড়িয়ে গেল।
হাতঘড়িতে বিপ বিপ শব্দ শুনেই দাঁড়িয়ে গেছে আহমদ মুসা।
তাকাল আহমদ মুসা তার হাতঘড়ির স্ক্রিনের দিকে। দেখল আগের মতোই হাতঘড়ির স্ক্রিনে কয়েক মিলিমিটার লাল, খুব পাতলা একটা সরল রেখা।
ভয় নেই মেজর পাভেল। তিন ফুট সামনে আগের মতোই একটা ইলেকট্রিক তার বিছানো আছে। সেটারই অ্যালার্ট সিগন্যাল দিচ্ছে। ঘড়িতে। বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা। বলল, মেজর পাভেল, আমার পায়ে পা ফেলে দ্রুত চলে এসো। চার ফিট সামনেই ওটা পাতা আছে। আমরা ওটা টপকে যাব, যাতে ঘাঁটি থেকে দ্বিতীয় সিগনাল আর ওরা না পায়।
এভাবে আহমদ মুসারা তৃতীয় ইলেকট্রিক সিগন্যাল অয়্যারটা পার হয়ে গেল। দাঁড়াল আহমদ মুসা। সাবধানে টর্চের আলো যথাটা সম্ভব নিম্নমুখী রেখে পথ চলছিল তারা। টর্চের আলো নিভিয়ে দিল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওরা দুজন।
তোমাদের গোয়েন্দা ছেলেটার স্কেচ অনুসারে আমার মনে হয় খুব কাছেই হবে ব্রীজটা। আমরা এই পাহাড়ে উঠে এক ঘন্টা হেঁটেছি। স্কেচে ব্রীজ পর্যন্ত হাঁটার পথটা এক ঘন্টারই বলা হয়েছে।
ব্রীজের ওপারেই তো ইপিজির ঘাঁটি। মেজর পাভেল বলল।
হ্যাঁ, বলা যায় ব্রীজের একদম লাগোয়া। বলল আহমদ মুসা।
আবার চলতে লাগল তারা। সাবধানে আলো ফেলে এবার অনেকটা হামাগুড়ি দেয়ার মতো করে চলছে তারা। এক সময় টর্চের আলো গিয়ে পড়ল একটা স্টিল পোলের গোড়ার উপর।
মেজর পাভেল আমরা ব্রীজের গোড়ায় এসে গেছি। বলে আহমদ মুসা তার টর্চের ফোকাস স্টিল পিলারের আশেপাশে ঘোরাল। দ্বিতীয় আরেকটি পিলারও দেখতে পেল, আগের পিলাটির সমান্তরালের সামান্য দূরে। তার কাছে মনে হলো ব্রীজটা টেমপোরারি এবং ঝুলন্ত।
আবার চলতে লাগল আহমদ মুসারা। আলো না জ্বালিয়ে, অনেকটা হাতড়িয়ে এবার চলছে তারা। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে গেল তারা দুজন। গোড়াটা ভালো করে দেখে নিয়ে বসল তারা দুজন পিলারের গোড়ায়। ব্রীজের দিকে মুখ করে। ব্রীজটাও ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
স্কেচ অনুসারে ব্রীজে আলো থাকার কথা মেজর পাভেল। আলো নিভিয়ে রেখেছে কেন ওরা! ইলেকট্রনিক সংকেত পাওয়ার পরই তারা এই কাজ করেছে! বলল আহমদ মুসা।
হতে পারে স্যার। আবার প্রয়োজন না থাকায় তারা আলো নিভিয়েও রাখতে পারে।
হ্যাঁ, মেজর পাভেল দুই সম্ভাবনাই আছে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা দুই মেশিন রিভলবার বের করে পরীক্ষা করতে করতে বলল, মেজর পাভেল, তোমার অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে নাও।
মেজর পাভেলও তার রিভলবারগুলো একবার দেখে নিল। উঠে দাঁড়াল দুজন। ওপারে যাবার জন্যে দুজন হাঁটা শুরু করেছে।
জংগল পথের চেয়ে ব্রীজের অন্ধকার একটুও কম নয়। অন্ধকার এতোটাই জমাট যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ব্রীজের নিচে ক্রিকের অন্ধকার ভয়াবহ ধরনের কালো। সেই অন্ধকার ব্রীজের আশপাশের অন্ধকারকে আরও গভীর করে তুলেছে। ব্রীজের উপর দিয়ে হাঁটছে দুজন পাশাপাশি। আহমদ মুসার দুচোখ স্থির ব্রীজের উপর।
একটু একটু করে দুলছে ব্রীজ। আহমদ মুসারাও হাঁটছে খুব ধীরে ধীরে। হঠাৎ আহমদ মুসা সামনে পা ফেলার জন্যে ডান পা তুলে ভূত দেখার মতো ভয়ানক চমকে উঠে নিজের দেহটাকে পেছন দিকে ঠেলে দিল। সেই সাথে বাম হাত দিয়ে মেজর পাভেলকেও পেছনের দিকে টেনে নিল। টাল সামলাতে না পেরে দুজনেই ব্রীজের ফ্লোরের উপর পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে একটু সামলে নেবার পর মেজর পাভেল ফিসফিসে কণ্ঠে বলল, কিছু কি ঘটেছে স্যার? শত্ৰু কি সামনে?
উঠে বসেছে আহমদ মুসা। বলল, উঠে বসো মেজর পাভেল।
মেজর পাভেল উঠে বসল।
তোমার পায়ের সামনেই ব্রীজের ফ্লোরের দিকে তাকাও।
স্যার এদিকটায় ফ্লোর একটু বেশি অন্ধকার। কেন? সেই ফিসফিসে কণ্ঠে বলল মেজর পাভেল।
তোমার পায়ের পরেই ব্রীজের ফ্লোরে একটু হাত দাও। বলল আহমদ মুসা।
মেজর পাভেল সামনে একটু ঝুঁকে পড়ে ব্রীজের ফ্লোরে হাত দিতে গিয়ে ভীষণ আঁৎকে উঠল। বলল, কি সর্বনাশ! ব্রীজের ফ্লোর দেখছি এখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে! ও গড, আমরা তো প্রায় পড়েই গিয়েছিলাম। গড় ব্লেস ইউ স্যার। আপনিও বেঁচেছেন, আমাকেও বাঁচিয়েছেন ক্রিকের কয়েকশ ফুট গভীরে পড়া থেকে।
আমিও আগে বুঝতে পারিনি। ডান পা সামনে ফেলতে গেলে অন্ধকারের পার্থক্যটা আল্লাহ আমার চোখে ধরি য়ে দেন। সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে আল্লাহ আমাদের বাঁচালেন। আলহামদুলিল্লাহ।
আলহামদুল্লিাহ। মেজর পাভেলও বলল।
মেজর পাভেল তুমি যে আলহামদুল্লিাহ পড়লে? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, সেদিন ক্যাপ্টেন আলিয়া তো বলেছে, আমরা ইদানিং জোরে সোরে ইসলামের চর্চা করছি। স্যার, ইসলাম শুধু লিভিং রিলিজিওন নয়, এটা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ধর্ম, ইহকালেরও র্মি, পরকালেরও ধর্ম। মেজর পাভেল থামল।
ধন্যবাদ মেজর পাভেল।
মুখে কথা বললেও আহমদ মুসার কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সামনের দিকে বলল, সামনে আট দশ ফিট জায়গা থেকে ব্রীজের ফ্লোর সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এই স্থানান্তরযোগ্য অংশটা নিশ্চয় ওপারে টেনে নিয়ে রাখা হয়েছে।
একদম দোর গোড়ায় এসে আছাড় খাওয়ার অবস্থা স্যার! আল্লাহ রক্ষা করেছেন। এখন ওপার থেকে মুভেবল অংশটা কিভাবে এদিকে আনা যাবে স্যার? মেজর পাভেল বলল।
আহমদ মুসা কিছু বলল না। উপরে তাকাল আহমদ মুসা। অন্ধকারেও দেখতে পেল দুই পারে চার পিলারের সংযোগকারী কালো স্টিলের বিশেষ রোপ। এই রোপগুলো আবার বহুমুখী রোপ দিয়ে ব্রীজকে দুপারের উঁচু। পিলারের সাথে টেনে রাখা হয়েছে।
আহমদ মুসা পিঠের ব্যাগ থেকে হুকওয়ালা নাইলনের দড়ি বের করল। বলল, মেজর পাভেল উপরে ব্রীজের স্টিল রোপে নাইলনের কর্ড আটকিয়ে তাতে ঝুলে ব্রীজের ওপারে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই।
মাল্টি হুকের নাইলন কর্ড আপনার কাছে আছে স্যার? মেজর পাভেল বলল।
আছে মেজর প্যাভেল। তোমার কি এ ধরনের রোপে ঝোলার অভ্যেস আছে? বলল আহমদ মুসা।
ট্রেনিং-এর সময় তো শিখেছি। কিন্তু অভ্যেস যাকে বলে সেটা নেই। স্যার। মেজর পাভেল বলল।
অভ্যেস না থাকলে ঝুঁকি নেয়ার প্রয়োজন নেই। আমি ওপারে গিয়ে ব্রীজের মুভেবল অংশ সেট করব। তুমি এখানে বসে অপেক্ষা কর। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা নাইলনের কর্ড গুছিয়ে নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে ছুঁড়ে দিল মাথার উপরের স্টিল রোপের দিকে। প্রথম চেষ্টাতেই সফল হলো আহমদ মুসা।
আটকে গেল নাইলন কর্ডের হুক উপরের রোপের সাথে। কয়েকবার টানাটানি করে দেখল হুক ঠিকভাবে আটকেছে কি না স্টিলের রোপের সাথে।
আহমদ মুসা ডান হাতে রোপটি ধরে রেখে বাম হাত মেজর পাভেলের কাঁধে রেখে বলল, লোডেড অস্ত্র হাতে রেখো। শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথম সুযোগটাকেই তুমি ব্যবহার করবে যদি প্রয়োজন হয়।
আহমদ মুসার দুই হাতেই বিশেষ গ্লাভস। নাইলন কর্ড ডান ও বাম হাতে পেঁচিয়ে ধরে একটু পেছনে সরে এসে সামনে কিছুটা দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে লাফ দিল। নাইলন কর্ডে ঝুলে গেল তার দেহ। ছুটে চলল দ্রুত। মুহূর্তেই গিয়ে ওপারে ল্যান্ড করল। ল্যান্ডিংটাকে নিঃশব্দ করতে চেয়েছিল আহমদ মুসা। কিন্তু পারল না। গিয়ে ল্যান্ড করল সে ব্রীজের মাঝখান থেকে সরিয়ে নেয়া স্লবের উপর। স্লাবটা মনে হয় কিছুটা আলগা হয়েছিল। আহমদ মুসা তার উপর ল্যান্ড করার সাথে সাথেই তা শব্দ করে দেবে গেল। সেই শব্দের সাথে আহমদ মুসাও শুয়ে পড়ল স্ল্যাবটার উপর। তারপর আস্তে আস্তে গড়িয়ে চলে এলো স্ল্যাব থেকে ব্রীজের। মেঝের উপর। বেশ বড় ধরনের শব্দ হওয়ায় প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইল আহমদ মুসা। জ্যাকেটের পকেট থেকে সে হাতে তুলে নিয়েছে আমেরিকা থেকে আনা একটা নতুন অটো-সাইলেন্সার মেশিন রিভলবার।
ল্যান্ড করার সময় শব্দ উঠার সাথে সাথে কোত্থেকে একটা কণ্ঠ কে বলে উঠেছিল। কিন্তু তারপরে সব কেমন যেন নীরব হয়ে গেল। আহমদ মুসা বুঝল, নিশ্চয় ওটা প্রহরীর কণ্ঠ। কথা বলে সে ভুল করেছিল, সে নিশ্চয় এগোচ্ছে কি ঘটেছে তা দেখার জন্যে। তার হাতে অবশ্যই মেশিনগান ধরনের কিছু প্রস্তুত আছে। তারা আবার একাধিকজনও হতে পারে। অপেক্ষা করছে আহমদ মুসা।
তার স্থির দৃষ্টি ব্রীজের গোড়ার দিকে। কিন্তু অন্ধকারটা খুবই গাড়। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে পড়ল নাইট ভিশন গগলসের কথা। মন এদিকে ব্যস্ত থাকায় কথাটা এ পর্যন্ত তার মনেই পড়েনি। জংগলের পথে আসার সময় গগলস প্রয়োজন পড়েনি। তখন দরকার ছিল টর্চের মতো উজ্জ্বলতর আলোর।
পকেটে হাত দিয়ে হার্ড কভারের নাইট ভিশন গগলসটা বের করে নিল। অন্ধকারেই গগলসের বিভিন্ন অংশকে সেট করে নিয়ে চোখে পরল।
সামনের অন্ধকার স্বচ্ছ হয়ে গেল। সে দেখল নীরবে পা বাড়িয়ে মাথা নিচু করে গুঁড়ি মেরে ব্রীজের উপর উঠছে একজন লোক। তার চোখে অন্ধকারে দেখার মতো কোনো গগলস নেই।
আহমদ মুসা নিঃশব্দে গড়িয়ে তার কাছাকাছি গেল। তাকে মারতে চাইল না সে। কাউকে সাবধান না করে কিংবা নিজেকে বাঁচাবার জন্যে না হলে আহমদ মুসা কাউকে মারে না।
আহমদ মুসা লোকটির কাছে গিয়ে উঠে দাঁড়াতেই লোকটি তা টের পেয়ে গেল। সে মাথা সোজা করে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তার রিভলবার আগেই বাম হাতে নিয়ে নিয়েছিল। সে ডান হাতের একটা কারাত চালাল লোকটির ঘাড়ে। জ্ঞান হারাল লোকটি। আহমদ মুসা তার হাত-পা বেঁধে, মুখে টেপ সেঁটে দিল।
আহমদ মুসা ফিরে এলো স্ল্যাবটার কাছে। দেখল, স্ল্যাবটা স্প্রিং লক দিয়ে আটকানো। স্প্রিং লকটা ম্যানুয়াল। লকটা অফ করে দিল আহমদ মুসা। সংগে সংগে স্ল্যাবটা একটা লম্বা শব্দ তুলে ব্রীজের ওপারের অংশের সাথে মিলে গেল।
মেজর পাভেল এসো। আহমদ মুসা ফিসফিসে কণ্ঠে তাকে ডাকল।
ধন্যবাদ স্যার। তাহলে ব্রীজের এদিকেও কোনো পাহারা ছিল না? বলল মেজর পাভেল।
একজন ছিল। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, যতটুকু সময় সে পেয়েছে, এর মধ্যে সে ভেতরে খবর পাঠাতে পেরেছে কি না? তার পকেটে কলিং বেলের রিমোট সুইচ বক্স পেয়েছি। আহমদ মুসা বলল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল মেজর পাভেল।
হঠাৎ জ্বলে উঠল ব্রীজের আলো। তার সাথে সাথে শুরু হলো গুলির বৃষ্টি। আলো জ্বলে উঠার সংগে সংগেই মেজর পাভেলের হাতে একটা টান দিয়ে শুয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা গড়িয়ে ব্রীজের পুব পাশের ধার বরাবর সরে গেল। ব্রীজের দুপাশের ধার বরাবর এক ফুট উঁচু স্টিলের গার্ডার।
আহমদ মুসা ব্রীজের ধার ঘেঁষে ক্রলিং করে দক্ষিণ দিকে ব্রীজের শেষ প্রান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে চলল।
গুলি বৃষ্টি চলছে। গুলিগুলো আসছে ব্রীজের বাম দিকের দক্ষিণ-পূর্ব। তিরিশ পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থান থেকে। ঘাঁটিটির স্কেচ অনুসারে ব্রীজের দক্ষিণ গোড়া থেকে পঞ্চাশ ষাট গজ পুবে এগোলেই ইপিজি ঘাঁটিতে ঢোকার প্রথম গেট। আহমদ মুসা বুঝল, ঐ গেট দিয়েই ঘাঁটির লোকরা বেরিয়ে এসেছে এবং ব্রীজের দিকে মাঝপথ পর্যন্ত এসেই গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে তারা। কিন্তু ওরা ব্রীজ বরাবর এসে গুলি বর্ষণ শুরু করল না কেন? ব্রীজের লাইট আগাম জ্বলে উঠার কারণেই কি! সেটাই হবে। লাইট জ্বলে উঠলে তারা আক্রান্ত হবার আগেই আক্রমণ শুরু করেছে। আহমদ মুসাদের জন্যে এটা আল্লাহর সাহায্য।
বিরতিহীন গুলি চালানোর মধ্য দিয়ে ওরা এগিয়ে আসছে। গুলির দেয়াল সৃষ্টি করে ওরা তার আড়ালে ব্রীজ রাবর পৌঁছতে চায় এবং নিশিচত করতে চায় আহমদ মুসাদের মৃত্যু।
মেজর পাভেলও আহমদ মুসার পাশাপাশি আসছিল। আহমদ মুসা ফিসফিসে কণ্ঠে মেজর পাভেলকে বলল, তোমার মাথা আমার সমান্তরালে থাকলে যে গুলি আমার মাথায় আঘাত করতে পারবে না, তা তোমার মাথায় আঘাত করবে। সুতরাং তোমার মাথা আমার কোমর বরাবর, খুব কম হলে আমার পেট বরাবর রাখতে পার।
আপনার অংক ঠিক স্যার। ধন্যবাদ। বলে মেজর পাভেল পেছনে সরে গেল।
আহমদ মুসা ব্রীজের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছল। সে প্রান্তটিতে একটা প্রশস্ত পিলার। আহমদ মুসা তার মাথা পিলারের আড়ালে রেখে তার। মেশিন রিভলবার সেট করল। রিভলবারের নলটাই শুধু পিলারের বাইরে। রাখল।
ওদের গুলি এসে এখন পিলারের পশ্চিম প্রান্তকেও হিট করছে। তার মানে ওরা ব্রীজের বরাবর অবস্থান থেকে অল্প দূরেই রয়েছে।
ওদের সবচেয়ে কাছের অবস্থানকে ধরে নিয়ে আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে রিভলবারের ট্রিগার চেপে ধরল। রিভলবারের নল যতটা সম্ভব পশ্চিম থেকে পুবদিকে সরিয়ে নিল। এভাবে কয়েকবার সে তার রিভলবারের নল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিল।
এতক্ষণ ওরা গুলি ছুঁড়ছিল একতরফাভাবে। আহমদ মুসা গুলি শুরু করার পর অল্পক্ষণের মধ্যেই ওদের গুলি বৃষ্টি আগের তুলনায় পঞ্চাশ ভাগে নেমে এল। গুলির টার্গেট ক্ষেত্রের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন এলো। তাদের কিছু গুলি পিলারের পাশ ঘেঁষে ব্রীজে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে ওদের গুলি আর পিলার অতিক্রম করে আসছে না। এমনকি ওদের গুলি পিলারের পশ্চিম প্রান্তকে আঘাত করছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। ওদের গুলি এখন পিলারের পূর্ব প্রান্ত এবং পিলার সংলগ্ন ব্রীজের গার্ডারকে আঘাত করছে। = মেজর পাভেল এখন সমান্তরালে উঠে এসো। পিলারের পাশ দিয়ে তুমিও গুলি চালাও। যতটা পার রিভলবারের মাথা পুব দিকে এগিয়ে। নাও।
এবার আহমদ মুসা ও মেজর পাভেল দুজনেই তাদের হাতের মেশিন রিভলবার থেকে গুলি বর্ষণ শুরু করল। একটানা মিনিটখানেক গুলি বর্ষণের পর ওদিকের গুলির শব্দ থেমে গেল। আহমদ মুসারাও গুলি ছোঁড়া বন্ধ করল। মিনিট খানেক অপেক্ষা করল। ওদিক থেকে কোনো গুলি আর এলো না।
মেজর পাভেল, চল আমরা ওদিকে এগোই। যারা এদিকে এসেছিল তারা সবাই মারাও যেতে পারে, আবার পিছু হটে পালাতেও পারে। দেরি করলে ওরা সংঘবদ্ধ হবার সুযোগ পাবে। মেজর পাভেলকে লক্ষ্য করে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও মেজর পাভেল ক্রলিং করে ব্রীজের অভ্যন্তর থেকে সামনের রাস্তায় বেরিয়ে এলো। রাস্তায় কোনো লাইট পোস্ট ছিল না। একটা আলো আছে ব্রীজের উপর, আরেকটা আলো দেখা যাচ্ছে গেটে, তা গেটের ভেতর মাঝ বরাবর। বাইরে আর কোথাও আলো নেই। ভাবল আহমদ মুসা জায়গাটাকে গোপন রাখার জন্যেই এটা করা হয়েছে? বাইরে আলো থাকলে তা দূর থেকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তাহলে ভেতরেও তো উন্মুক্ত আলো নেই!
রাস্তার উপর আবছা অন্ধকারের একটা চাদর। আহমদ মুসারা ক্রলিং করে রাস্তার পাশ ধরে এগিয়ে চলল গেটের দিকে ব্রীজ থেকে একটু পুবে রাস্তার উপর ৩টি লাশ পড়ে থাকতে দেখল তারা। রাস্তাটা একদম উন্মুক্ত, আড়াল নেবার মতো কিছু নেই। গুলি বৃষ্টির মুখে বেচারাদের বেঘোরে জীবন দিতে হয়েছে।
আহমদ মুসা সামনে চোখ রেখে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। রিভলবারের ট্রিগারে তার একটা আঙুল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল দুজন লোক গেটের ভেতর দিক থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলো এবং দুজনের হাত উপরে উঠেছে।
চোখে পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা প্রিং-এর মতো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মেজর পাভেল, সামনের দিকে দৌড় দাও।
কথা বলার সাথে সাথেই আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগার চেপে ধরে সামনে দৌড় দিয়েছে। আহমদ মুসা বুঝে ফেলেছে ওরা বোমা ছুঁড়ছে।
বোমা ফেলায় ব্যস্ত থাকায় ওদের রিভলবার বের করে নিতে দেরি হবে। সেই সময়টুকু কাজে লাগাতে হবে ওদের পরাভূত করার জন্যে।
আহমদ মুসা যখন দৌড় দিয়েছে, তখন ওরা বোমা ছুঁড়ে ফেলেছে। ওরা যেখান থেকে বোমা ফেলছে আর আহমদ মুসা যেখান থেকে দৌড় দিয়েছে, সেই দূরত্বটা আহমদ মুসার বিভলবারের রেঞ্জের ভেতর ছিল। আর আহমদ মুসার গুলি বর্ষণ টার্গেটেড। পেছনে যখন বোমার বিস্ফোরণ ঘটল, তখন আহমদ মুসার রিভলবারের গুলি ওদের দুজনকে ধরে ফেলেছে।
ওদের বোমা ফেলাটাও ছিল টার্গেটেড। কিন্তু আহমদ মুসা ও মেজর পাভেল দৌড় না দিলে তাদের উপরই বোমার বিস্ফোরণ ঘটত। আহমদ মুসারা যে ক্রলিং করে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখেই প্রস্তুতি নিয়ে তারা বোমা ফেলতে এসেছিল।
গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজনেই ওরা ঢলে পড়েছে গেটের সামনের রাস্তায়।
আহমদ মুসা গেট বরাবর পৌঁছে লাশের দিকে গেল না। ছুটল গেটের দিকে। দেখল, দুজন লোক উন্মুক্ত গেটের একটা পিলারের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটছে ভেতরের দিকে। আহমদ মুসাও তাদের পেছনে ছুটল। চিৎকার করে বলল, দাঁড়াও, তা না হলে গুলি করব।
লোক দুটি পলকের মধ্যে চরকির মতো ঘুরে দাঁড়াল। তাদের দুজনের দুহাত উপরে উঠছে।
আহমদ মুসার তর্জনি মেশিন রিভলবারের ট্রিগারেই ছিল। চেপে বসতে একটুও সময় লাগলো না। ছুটে চলল গুলির ঝাঁক।
ওদের দুজনের হাত উপরে উঠল, কিন্তু বোমা ছোঁড়ার সুযোগ পেল না তারা। গুলি বৃষ্টির কবলে পড়ে ঝরে পড়ল তাদের দেহ মাটিতে। প্রহরী বা সিকিউরিটির কেউ হলে পালিয়ে ভেতরে ঢুকতে সাহস পেত না।
আহমদ মুসা চারদিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে দৌড় দিল তাদের দিকে। আহমদ মুসার মনে হয়েছে, এরা ঘাঁটির নেতৃবৃন্দের কেউ হবে। আহমদ মুসা তাদের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। প্রথমে তাদের দুজনের মোবাইল খুঁজে নিল তাদের পকেট থেকে। আহমদ মুসা বসার সময়ই দেখতে পেয়েছিল নিহতদের পাশে একটা ফাইল পড়ে আছে। হামাগুড়ি দিয়ে একটু এগিয়ে ফাইলটা হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা।
পেছনে পায়ের শব্দ শুনে রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনি রেখে বো করে। পেছনে ঘুরল আহমদ মুসা। দেখল, মেজর পাভেল।
আহমদ মুসা হেসে বলল, মেজর পাভেল, শত্রুরা যে লুকিয়ে নেই, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। যদি থাকে তাহলে তারা সামনে না এসে আক্রমণের জন্যে চোরাগুপ্তা পথ বেছে নেবে।
ঘাটির প্রায় চারদিকে ব্যারাকের মতো স্থাপনা আছে। শুধু পশ্চিম দিকের একটা অংশে অফিস টাইপের একটা বিল্ডিং। মেজর পাভেলকে বিল্ডিংটা দেখিয়ে বলল, চল দৌড় দিয়ে ওটায় গিয়ে উঠি।
আহমদ মুসারা দৌড় দিয়ে গিয়ে অফিসে উঠল।
ও ফাইলটা কি স্যার? বলল মেজর পাভেল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
এই দুজনের একজনের হাতে ফাইলটা ছিল। এখনো খুলে দেখিনি কি আছে। বলে আহমদ মুসা ফাইলটা খুলল।
প্রথম পাতাটা দেখেই আহমদ মুসার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উল্টালো একের এক পাতা। যতই দেখছে ততই তার চোখে মুখে ফুটে উঠছে একের পর এক বিস্ময়!
সে ফাইল বন্ধ করে তাকাল মেজর পাভেলের দিকে। বলল, মেজর পাভেল, আমাদের অভিযান সফল। আমি যা খোঁজ করছিলাম, তা পেয়ে গেছি। আলহামদুলিল্লাহ।
আলহামদুলিল্লাহ। ফাইলে কি পেলেন স্যার? মেজর পাভেল বলল।
মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট রত্ন দ্বীপে কি জন্যে, কি করতে এসেছে তার বিবরণ। বলল আহমদ মুসা।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেজর পাভেলের। বলল, ধন্যবাদ স্যার। ধন্য
আপনার দূরদৃষ্টির। অসাধ্য সাধন করেছেন আপনি।
পাভেল তুমি আর ক্যাপ্টেন আলিয়া না কি ইসলাম চর্চা কর। তার কি এই রেজাল্ট? স্রষ্টা, প্রতিপালক, জল, স্থল এবং সর্বোপরি সর্বশক্তির আধার আল্লাহর চিরন্তন অথরিটি তুমি দেখছি উপেক্ষা করতে চাচ্ছ? সব শক্তি সাফল্য তো আমাকে দিয়ে দিলে, আল্লাহর জন্যে রইল কি? বলল আহমদ মুসা।
স্যরি স্যার। চর্চা করছি। প্রাকটিস করছি না বলেই এই ভ্রান্তি। বুঝেছি আমি, ইসলাম শুধু আলোচনার ধর্ম নয়, নিরপেক্ষ নিথর ধর্মও নয়। আরও বুঝেছি স্যার, বিশ্বাস হৃদয়ের জিনিস, কিন্তু কাজে-কর্মে বিশ্বাসের প্রকাশ না ঘটলে, হৃদয়ের বিশ্বাসও উবে যায়। এই বুঝাটা আমাদের কাজে পরিণত হয়নি। মেজর পাভেল বলল।
বাহ, সুন্দর বলেছ। লিখে রাখার মতো। বিশ্বাস ও কর্মে প্রকাশের। অভিষেক তোমাদের কবে হচ্ছে? বলল আহমদ মুসা।
জানি না স্যার, এ ব্যাপারে ক্যাপ্টেন আলিয়া আমার গুরু। এই আলোর পথ সেই আমাকে দেখিয়েছে। মেজর পাভেল বলল।
ঠিক আছে মেজর পাভেল। এবার কাজের কথায় আসি। আমার মনে হয় এই ঘাঁটিতে আর কেউ নেই। সম্ভবত ত্ৰিয়াদা অভিযানে এরা ঘাঁটি উজাড় করে লোক পাঠিয়েছিল। মেজর পাভেল, তুমি তোমার হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন কর। জানাও এদিকের সব কথা। তাঁদের নির্দেশ কি শোন। তারপর চল, অফিসের অন্যান্য ঘর ও ব্যারাকগুলো সার্চ করে দেখি। বলল আহমদ মুসা।
মেজর পাভেল মোবাইল বের করল।
তুমি টেলিফোন কর। আমি পাশের রুমগুলো একটু দেখি।
বলে আহমদ মুসা পাশের ঘরের দিকে চলে গেল।
.
৭.
গভীর রাত।
আহমদ মুসার গাড়ি ছুটছিল রত্ন দ্বীপের এক নাম্বার সার্কুলার রোড ধরে দক্ষিণ দিকে।
ইপিজি ঘাঁটিতে থাকতেই আহমদ আইভান ম্যাথিউ-এর মোবাইলে একটা মেসেজ দেখতে পেয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, আজ রাত ১২টায় যারা জুনুব পাহাড়ের অদি আমন-এ জরুরি বৈঠক। অংশ গ্রহণ অপরিহার্য। এখানে চীফ বস্ স্বয়ং অগাস্টিন ইমানুয়েল আসবেন।
এই মেসেজটা পেয়েছিল আইভান সন্ধ্যা ছটায়। মেসেজটা পড়ার পর আইভান তার অংশগ্রহণ কনফার্ম করে মেসেজও পাঠিয়েছিল। আহমদ মুসার হাতে আইভানসহ তার সাথী অ্যান্থনী হুগো মারা যায় রাত ৮ টার দিকে। এর মধ্যে কোনো টেলিফোন বা মেসেজ কোনো পক্ষ থেকেই আসেনি। সুতরাং মিটিংটা কনফার্ম হয়েই আছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ হানা দেয়ার সুযোগ ছাড়তে আহমদ মুসার মন চায়নি। বিশেষ করে মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট-এর চীফ অগাস্টিনের অংশগ্রহণ তার কাছে বড় আকর্ষণ বলে মনে হয়েছে।
আহমদ মুসা সাড়ে নটায় ইপিজি ঘাঁটি থেকে হেলিকপ্টারে ফিরে আসে রাজধানী কাবাবা ক্যাসলে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিকিউরিটি বাহিনীর প্রধান কর্নেল জেনারেল তাদের রিসিভ করেছিলেন। হেলিকপ্টার থেকে নেমেই আহমদ মুসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে যার জুনুব পাহাড়ে তার অভিযানের কথা বলেছিল। এত বড় অভিযান একে ফিরে এসে আবার রাতে অভিযান! তার রেস্টের প্রয়োজনের কথা বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে রাজি হয়নি। আহমদ মুসা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজি হয়ে যায়। তবে বলে, সকাল ৯টায় প্রেসিডেন্ট মিটিং ডেকেছেন তার অফিসে। সেখানে আপনিই প্রধান ব্যক্তি। সে মিটিং যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন দয়া করে।
আহমদ মুসা বলেছিল, ইনশাআল্লাহ আমি মিটিং-এ ঠিক সময়ে পৌঁছব।
যারা জুনুব পাহাড়ের লোকেশন আহমদ মুসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে জেনে নিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করেছিল, যারা জুনুব পাহাড়ে অদি আমন নামে কোনো উপত্যকা আছে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তরে জানায়, হ্যাঁ এই নামে একটা উপত্যকা আছে। তবে ভুতুড়ে উপত্যকা। তাই পরিত্যক্ত। মানুষ সেখানে যায় না! উপত্যকাটা বাথটাবের মতো। উভয় দিকে ঢালু ঘোরানো পাহাড় চারদিকে। মাঝখানে উঁচু ও এবড়ো-থেবড়ো তলাবিশিষ্ট একটা উপত্যকা। উপত্যকাটা একদম পাথুরে। কোনো প্রকার ফসলের উপযুক্ত নয়। বৃষ্টির পানিও ভেতরে জমে না। কোথাও দিয়ে কিভাবে যেন মাটির নিচে পানি চলে যায়। পাথুরে তলাটায় মাটি, ধুলো-বালিও জমতে দেয় না। উপত্যকার দেয়াল ঘোরানো পাহাড় কিন্তু সবুজ তবে গাছ সেখানে বেশি দিন টিকে না! এই পাহাড়ে এক সময় জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। এখনও তার ধ্বংসাবশেষ আছে। ভাঙা বাড়ি-ঘরগুলো ভূত-প্রেতে ঠাসা। অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে এ নিয়ে। এসব কারণেও আর্থিক কোনো গুরুত্ব নেই বলে উপত্যকাটা পরিত্যক্ত।
উপত্যকাটার বিবরণ শুনে চমৎকৃত হয়েছিল আহমদ মুসা। ভেবেছিল, এই সব জায়গাই তো মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের শয়তানদের আকর্ষণীয় আশ্রয়। অদি আমন উপত্যকার লোকেশনও জেনে নিয়েছিল আহমদ মুসা। সবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ মুসাকে অনুরোধ করেছিল যেন সে খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু রেস্ট নিয়ে তার পরে বের হয়।
.
আহমদ মুসার গাড়িটা একটা হাইল্যান্ডার জীপ। কালো রঙের। পাহাড়ী পথে চালার জন্য উপযুক্ত গাড়ি। বুলেটপ্রুফ নয় গাড়িটা। বুলেটে ছিদ্র হলেও বুলেটপ্রুফ গাড়ির মতো এটা নিরাপদ। তাই গুলি বৃষ্টির মুখে পড়লেও ভেতরের আরোহীরা অনেকটা সময় ধরে নিরাপদে থাকতে পারে। প্রেসিডেন্টের গাড়িগুলোর একটা এটা। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আহমদ, মুসাকে এ গাড়িটা তার ব্যবহারের জন্যে দিয়েছে।
একদম ফাঁকা রাস্তা। প্রথম দিকে গাড়ি ফুল স্পীড়ে এলেও গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিয়ছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসার গাড়ির সব আলোই নিভানো। চারদিক দেখে-শুনে এগিয়ে চলছে সে। তার ঘড়িতে সবে রাত ১১টা বাজে।
এক নাম্বার সার্কুলার রোডের যেখান থেকে একটা রাস্তা যারা জুনুব পাহাড়ের দিকে গেছে, সেখানে গিয়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে গাড়ি দাঁড় করাল আহমদ মুসা। সে দেখতে চায় কোনো গাড়ি পাহাড়টির দিকে যায় কিনা।
আহমদ মুসা সেখানে আধা ঘন্টা অপেক্ষা করল। এই সময়ের মধ্যে মাত্র একটা গাড়ি পাহাড়ের দিকে গেছে এবং তা ১১টা বাজার কিছুক্ষণ পুরেই।
মিটিং-এ তো আরও গাড়ি যাবার কথা, ভাবল আহমদ মুসা। আবার। ভাবল, পাহাড়ে যাবার আরও পথ নিশ্চয় আছে। আর মিটিং-এ অংশ গ্রহণকারীরা একদিক থেকে অবশ্যই আসবে না। বিভিন্ন দিকের লোকরা। বিভিন্ন পথেই আসবে। বিশেষ করে অপ্রচলিত, গোপন পথ তারা ব্যবহার করতে পারে।
সাড়ে ১১টা বাজার পর আহমদ মুসা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে যারা জুনুব পাহাড়ের পথ ধরে চলতে লাগল।
অদি আমন উপত্যকাটি যারা জুনুব পাহাড়ের এক হাজার ফিট উপরে। গাড়ির উচ্চতা-ইনডিকেটরে দেখল, প্রায় ৭০০ ফিট উপরে উঠেছে গাড়ি। সামনের রাস্তাটা বামদিকে ইউটার্ন নিয়েছে। মাঝখানের পাহাড়ী অংশটা বেশ উঁচু এবং জংগলে পূর্ণ।
আহমদ মুসার গাড়ি ইউটার্ন নিল। টার্ন নিয়েই সামনের আর একটা বাকে দেখতে পেল তিন চারজন অস্ত্রধারী ওদিক থেকে আসা একটা গাড়ি আটকে ফেলল এবং জোর করে গাড়িতে উঠল। একটি মেয়ের বাঁচাও, বাঁচাও আর্ত চিৎকার শুনতে পেল আহমদ মুসা। গাড়িটা টার্ন নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে চলল।
আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। ঝড়ের গতি পেল হাইল্যান্ডার জীপটা। পাহাড়ী রাস্তায় উঠেই আহমদ মুসা গাড়ির আলো জ্বেলে দিয়েছিল। পাহাড়ী রাস্তায় ডিস্ট্যান্ট ফ্লাশ জ্বেলে গাড়ি চালাতে হয়। এই আলোতেই সামনের গাড়িটা হাইজ্যাক হওয়ার দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল।
পাহাড়ী রাস্তায় কোথাও একবার লুকালে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই যতটা দ্রুত সম্ভব ওদের কাছে পৌঁছতে চাইল আহমদ। মুসা। সামনের গাড়িটা ফুল স্পীডে চালিয়েও কোনো ফল পেল না। দুই গাড়ির মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই কমতে লাগল। আহমদ মুসার গাড়ির হেডলাইটের পুরো আওতায় এসে গেল গাড়িটা।
গাড়ির ড্যাস বোর্ড থেকে মেশিন রিভলবারটা তুলে নিল আহমদ মুসা। বোতাম টিপে গাড়ির জানালা খুলে ফেলল।
জানালা দিয়ে রিভলবারসমেত ডান হাত বের করে কিছুটা নিচের দিকে নামিয়ে সামনের গাড়ির পেছনের দুই টায়ার সামনে রেখে ট্রিগার টিপে। ধরলো। গুলির একটা ঝাঁক ছুটে গেল টায়ার লক্ষে গাড়ির পেছনের অংশসহ পেছনের দুই টায়ারই ঝাঁঝরা হয়ে গেল। রাস্তার পাশে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল গাড়ি।
গাড়ি থেকে চারজন নামল এবং টেনে নামাল একজন মেয়েকে। আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে ছেড়ে দিন। বলে চিৎকার করছিল। মেয়েটি।
গাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে আহমদ মুসার গাড়ি। আহমদ মুসা। মেশিন রিভলবার রেখে তার ছয়ঘরা রিভলবার হাতে নিল।
ওরা চারজন ধরে মেয়েটিকে গাড়ির সামনে নিয়ে গেছে। তাদের একটু সামনেই জংগলে ঢাকা একটা গলিপথের মতো করিডোর। ঐ করিডোরে ঢোকাই ওদের লক্ষ।
ওরা চারজন মেয়েটাকে সামলে নিয়ে জংগলে আশ্রয় নেবার চেষ্টাতেই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু আহমদ মুসার গাড়ি যখন তাদের গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছল। তখন ওদের দুজন আহমদ মুসাকে আটকাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলি বর্ষণ শুরু করল।
আহমদ মুসা গাড়ি ওদের গাড়ির পাশে দাঁড় করিয়েই গাড়ি থেকে গড়িয়ে নেমে গড়িয়েই ছুটল সামনে। আড়াল নিল গিয়ে ওদেরই গাড়ির এবং সংগে সংগেই দ্রুত এগিয়ে গাড়ির মাথা বরাবর পৌঁছল।
ওরাও টের পেয়েছিল আহমদ মুসা তাদের গাড়ির আড়ালে আশ্রয়। নিয়েছে। আহমদ মুসাও এটা জানে এবং এটাও ধরে নিল ওদের কেউ এবার আহমদ মুসাকে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করবে। আহমদ মুসার সামনে এগোনো বন্ধ করতে এর কোনো বিকল্প ছিল না তাদের কাছে। আহমদ মুসা এজন্যেই আগে দ্রুত সামনের দিকের লোকদের সরিয়ে মেয়েটিকে মুক্ত ও নিরাপদ করতে চাইল।
আহমদ মুসা গাড়ির মাখা বরাবর পৌঁছেই সামনেটা একটু দেখে নিল। দুজন লোক মেয়েটির দুহাত ধরে তাকে হেঁচড়ে জংগলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা চোখের পলকে গড়িয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে গুলি ছুঁড়ল যারা চিৎকাররত মেয়েটিকে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল তাদেরকে লক্ষ্য করে। অব্যর্থ লক্ষ। দুজনেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। গুলি করেই আহমদ মুসা ঘুরে বসল।
যারা গাড়ির পেছনে গেছে আক্রমণ করার জন্যে, তাদের পক্ষ থেকে তখনও কোনো গুলি এলো না। ওরা তাহলে এখন কোথায়? কিছুটা অনিশ্চয়তায় পড়ল আহমদ মুসা। ভাবল কিছুটা ঝুঁকি না নিয়ে অনিশ্চিত বসে থাকলে ওদের আক্রমণের শিকার হতে হবে।
আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগারে তর্জনি রেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখতে পেল, ওরা গাড়ির দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। গাড়ির সামনের দিকে।
ওরাও আহমদ মুসাকে দেখে ফেলেছে। বিমূঢ় অবস্থার প্রথম ধাক্কাটা তাদের চোখে-মুখে। তাদের রিভলবারের টার্গেট তাদের সমান্তরালে।
কিন্তু পরমুহূর্তেই তাদের দুজনার হাত নড়ে উঠল। তারপরেই বিদ্যুৎ বেগে উপরে উঠতে লাগল তাদের রিভলবার।
আহমদ মুসা সংগে সংগেই গুলি করতে পারতো, কিন্তু তা করেনি। ওরা আক্রমণে আসে না আত্মসমর্পন করে তা দেখতে চেয়েছিল। ওদের লোকদের হাতে-নাতে ধরার সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না। কিন্তু ওরা আক্রমণে এলো।
আহমদ মুসার তর্জনি চেপে বসল ট্রিগারে। পর পর দুটি গুলি করল। যে হাত তাদের উপরে উঠছিল, তা নিচে পড়ে গেল। তাদের দুজনের দেহও শুয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে তাকাল মেয়েটার দিকে। মেয়েটা উঠে বসেছে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে কাঁদছে। ভয়ে কুঁকড়ে গেছে তার দেহ। আহমদ মুসা এগোলো মেয়েটার দিকে। মেয়েটার কাছাকাছি হতেই মুখ তুলল মেয়েটা। ছুটে এসে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, স্যার, দ্বিতীয়বার জীবন দিলেন আমাকে। আমাকে চূড়ান্ত অপমান থেকে বাঁচালেন।
আগেই মেয়েটাকে আহমদ মুসার চেনা মনে হয়েছে। কিন্তু আলু থালু চেহারা দেখে ভালো করে চিনতে পারেনি তাকে। কিন্তু মেয়েটার গলা শুনে মনে হলো মেয়েটা জাহরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মেয়ে ডেসপিনার সাথে যাকে সে উদ্ধার করেছিল কিডন্যাপারদের হাত থেকে, পরে দেখাও হয়েছিল হাসপাতালে। ভীষণ অবাক হলো, আহমদ মুসা। এই রাতে এখানে একা জাহরা কি করছে! কেন এসেছে এদিকে! এই গাড়িটা জাহরার, কিডন্যাপ হওয়ার সময় এটা সে দেখেছিল। মনে পড়ল এই গাড়িটাকেই রাত ১১টার দিকে যারা জুনুব পাহাড়ের দিকে উঠে আসতে দেখেছে সে। ভীষণ রাগ হলো আহমদ মুসার। সেবার না হয় কিডন্যাপ হয়েছিল। কিন্তু এবার এভাবে পাগলের মতো এসে বিপদে পড়তে গেল কেন? একটা প্রবল সন্দেহও তার মনে উঁকি দিল। কিন্তু শীঘ্রই মন শান্ত হলো আহমদ মুসার। জাহরার মুখটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। জাহরার চেহারায় শান্ত, কোমল একটা দূতি আছে, অসাধারণ একটা আভিজাত্য আছে, মায়া আছে। এই মেয়ে কোনো খারাপ বা শত্রু পক্ষের হওয়ার মতো সন্দেহের তালিকায় পড়তে পারে না।
জাহরা এই সময়, এমন জায়গায় তুমি কোত্থেকে, কিভাবে? আমি তো আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। বলল আহমদ মুসা শান্ত কণ্ঠে।
আমি আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি স্যার। আমার মহান দাদী আম্মার পুণ্য দোয়ার বরকতে জঘন্য এক মৃত্যু থেকে আমি বাঁচলাম। আমার উচিত ছিল আগেই সবকিছু আপনাকে বলা। আমি ভুল করেছি স্যার। সব আপনাকে বলব।
কি বলবে? বলল আহমদ মুসা।
অনেক কথা স্যার। সে এক ইতিহাস। জাহা বলল।
পায়ের কাছে বসে কাঁদতে কাঁদতেই কথা বলছিল জাহারা।
উঠ জাহরা! তুমি আমার গাড়িতে যাও। আমি লাশগুলো একটু দেখে আসছি।
বলে আহমদ মুসা এগোলো মেয়েটার দুপাশে যে দুটি লাশ পড়েছিল, সেদিকে।
একে একে আহমদ মুসা চারটি লাশের পকেট সার্চ করল। তাদের প্রত্যেকেরই দুই বাহুর উল্কি পরীক্ষা করল। তার সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হলো। চারজনই মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের সদস্য। একজনের পকেট থেকে একটা চিরকুট পেল। একবার তাকিয়েই তা পকেটে রেখে দিল।
আহমদ মুসা গাড়িতে ফিরে এলো। গাড়িতে না উঠেই বলল, জাহরা তোমার গাড়ি রেখে যেতে হবে। তোমার গাড়ির পেছনের দুই টায়ার শেষ হয়ে গেছে। গাড়িতে কি তোমার কিছু আছে?
স্যরি স্যার, আমার হাতব্যাগটা আছে। নিয়ে আসছি স্যার। বলে গাড়ি থেকে থামল জাহরা।
তুমি মাঝের সিটে এসে বসো। আমি ব্যাগটা নিয়ে আসছি। বলল আহমদ মুসা।
জাহরা ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে ছিল।
এগোলো আহমদ মুসা জাহরার গাড়ির দিকে। গাড়ির ভেতরে আলো জ্বলছে। জাহরার হাতব্যাগ কিডন্যাপাররা খুলে ফেলেছিল। জাহরার ব্যাগসহ ব্যাগের জিনিসপত্র মাঝের সিটের উপর পড়ে আছে। জিনিসপত্র ব্যাগে তুলতে গিয়ে একটা গ্রুপ ফটো পেল আহমদ মুসা। অভ্যাসবশতই চোখ গেল গ্রুপ ফটোর উপর। কোড দেখে বুঝল, সদ্য মরক্কো থেকে ই-মেইলে এসেছে ফটোটা। একজন বৃদ্ধা, দুইজন বয়স্ক নারী-পুরুষ এবং একজন তরুণী এই নিয়ে গ্রুপ ফটোটা।টোর নিচে আরবিতে ক্যাপশন লেখা রয়েছে। ক্যাপশনের উপরও aখ গেল আহমদ মুসার। অবাক হলো তরুণীর নাম দেখে- শাহজাদী জাইনেব জাহরা। সন্দেহ রইল না তরুণীটি জাহরা। মনে মনে হল আহমদ মুসা। আদর করে ছেলে-মেয়েদের অনেকে ডাকে প্রিন্স, প্রিন্সেস বলে। অবশ্য জাহরার। চেহারা মনে একটা প্রশ্ন জাগায়। আবার ভাবল, চেহারার জন্যেই তাকে শাহজাদী লিখে থাকতে পারে।
ফিরে এলো আহমদ মুসা। ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে হাতব্যাগটা পেছনে এগিয়ে দিল জাহরার দিকে। হাতঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। রাত তখন ১২টা বেজে কয়েক মিনিট।
জাহরা আমি অদি আমন উপত্যকায় একটা কাজে এসেছি। আরও একটু উপরে উঠতে হবে। অদি আমন উপত্যকায় গাড়ি যাবে না। একটা নিরাপদ জায়গায় গাড়ি রেখে আমি সেখানে যাব। তুমি থাকতে পারবে তো গাড়িতে?
পারব স্যার, কিন্তু আমি আপনার সাথে যেতে চাই। আমি জানি, আপনি নিশ্চয় কোনো মিশনে যাচ্ছেন। অন্তত আমি আপনার পেছনটা তো পাহারা দিতে পারব। বলল জাহরা।
না জাহরা, যেতে পারবে না তুমি। এ মিশনে শুধু একজনই যাবে। এ মিশন লড়াইয়ের নয়, শুধুই জানার! ওদের এখানে একটা মিটিং হওয়ার কথা আছে রাত ১২টায়। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে স্যার, আপনি যা বলবেন, সেটাই হবে। বলল জাহরা।
ধন্যবাদ। আহমদ মুসা বলল।
গাড়ি উপর দিকে চলা শুরু করেছে। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল যখন সে যারা জুনুব পাহাড়ে উঠে আসছিল, তখন আইভান ম্যাথিউ-এর মোবাইলে একটা মেসেজ আসার সংকেত পেয়েছিল। মনে করেছিল কোনো এক স্থানে গাড়ি থামিয়ে মেসেজটা দেখে নেৰে। কিন্তু সেটা আর হয়নি। তাড়াতাড়ি আহমদ গাড়িটা একপাশে দাঁড় করিয়ে আইভান ম্যাথিউ-এল মোবাইলটা বের করল। দেখল, মেসেজে বলা হয়েছে, ইপিজি ঘাঁটিতে বড় কিছু ঘটেছে। কি ঘটেছে জানতে না পারায় যারা জুনুব-এর প্রোগ্রামটা বাতিল করা হয়েছে। মেসেজ অব্যাহত থাকবে।
আহমদ মুসা অবাক হলো, ইপিজি ঘাঁটির অবস্থা জানার পর আইভানের সাথে যোগাযযাগ হওয়ার আগেই তার মোবাইলে গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন মেসেজ পাঠানো হলো কেন? সংগে সংগেই আহমদ মুসার মনে হলো, মেসেজগুলো পাঠানো হয় কম্পিউটারে সেট করা অ্যাড্রেসগুলোতে। নিশ্চয় এই প্রসেসেই মেসেজটা আইভানের মোবাইলে এসেছে। বিষয়টা ওদের নজরে না আসা পর্যন্ত মেসেজ আসতেই থাকবে। খুশি হলো আহমদ মুসা। আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। ফিরে চলল।
স্যার, আপনার যাওয়ার কথা উপরের দিকে, কিন্তু? বলল জাহরা।
আজ ওদের একটা ঘাঁটির পতন হওয়ায় মিটিং ওরা বাতিল করেছে। আহমদ মুসা বলল।
ওবাদিয়ার ঘাঁটি স্যার? যেখানে আপনি অভিযানে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তুমি জানলে কি করে? আহমদ মুসা বলল।
ডেসপিনার কাছে আমি সব শুনেছি।
হ্যাঁ, ওদের ওবাদিয়ার ইপিজি ঘাঁটি আর নেই। আহমদ মুসা বলল।
ঝড়ের বেগে চলছে গাড়ি। আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনে।
স্যার, আমার কথা বলতে চাই। বলল জাহরা।
না এখন নয়। আহমদ মুসা বলল।
না স্যার, এখনি বলতে চাই, কালকের জন্যে আর অপেক্ষা করতে চাই না। বলল জাহরা।
এখন তুমি কিছুটা অস্বাভাবিক অবস্থায় আছ, কিছুটা আবেগ প্রবণ হয়ে আছ। রাতে চিন্তা করে রেখ কাল বলবে। কাল ৯টায় আমার একটা মিটিং আছে। মিটিং-এর পর তোমার ওখানে যাব। ডেসপিনাকেও ডেকে নিও। আহমদ মুসা বলল।
স্যার, মাফ করবেন। আমার কথা শুধু আপনার সাথেই শেয়ার করতে চাই। এ কথাগুলোর সাথে শুধু আমার পরিবার নয়, একটি ইতিহাসের গোপন ও প্রকাশ্য অনেক বিষয় জড়িত।
জাহরার কথা শুনে আহমদ মুসার চোখে শাহজাদী জাইনেব জাহরার নামটা ভেসে উঠল। কথাটা বলতে গিয়েও চেপে গেল আহমদ মুসা। শুধু বলল, তোমার কাহিনীর সাথে রত্ন দ্বীপের কি কোনো সম্পর্ক আছে?
স্যার, রত্ন দ্বীপের সাথে সম্পর্ক আছে বলেই আমি কাহিনীটি আপনাকে বলতে চাই।
ঠিক আছে, কালকে পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা মনোযোগ দিল সামনের দিকে। পাহাড়ী রাস্তা এখানে বেশ আঁকাবাঁকা। একটু অমনোযোগী হলে বিপদ ঘটার আশঙ্কা আছে।
জাহরাও আত্মস্থ। কোনো কথা বলছে না সে।
চলছে গাড়ি রাতের অন্ধকার কেটে তীরবেগে।
.
প্রেসিডেন্টই প্রথম কথা শুরু করল। বলল, আমি আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাচ্ছি। গতকাল ছিল রত্ন দ্বীপের এ পর্যন্তকার ইতিহাসের এক বিপজ্জনক দিন। অদৃশ্য শত্রুর তিনটি বড় আক্রমণ তাকে প্রতিহত করতে হয়েছে। ওবাদিয়া আউটপোস্টের বাইরে পাহারায় থাকা ৮জন নিরাপত্তা সৈনিক অতর্কিত আক্রমণে মারা গেছে। এই আউটপোস্টসহ শত্রুপক্ষের লোক মারা গেছে মোট ৬৬জন। ওবাদিয়া পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থা ইপিজির ছদ্মবেশে মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট কাজ করছিল। তাদের সে ঘাঁটিও আমাদের দখলে এসেছে। এসবই ঘটেছে জনাব আহমদ মুসার হাতে। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তাকে রত্ন দ্বীপের সেভিয়ার হিসেবে পাঠিয়েছেন। একটা বড় সুখবর হলো, আমাদের অদৃশ্য শত্রু সম্পর্কে আমরা এখনও অন্ধকারে আছি। ইপিজি ঘাঁটি থেকে আজ কিছু ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। যাতে ওদের পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা গেছে। সেই বিষয় নিয়েই আজ আমাদের আলোচনা। ভাই আহমদ মুসাই এই গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট উদ্ধার করেছেন এবং তিনি বিষয়টা ভালোভাবে বুঝেছেনও। আমি তাকে অনুরোধ করছি, তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করুন।
কথা শেষ করে তাকাল প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার দিকে। বলল, প্লিজ প্রিয় ভাই আহমদ মুসা…।
ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট। মহামান্য প্রেসিডেন্ট যে ডকুমেন্ট উদ্ধারের কথা বলেছেন, সেটা একটা ফাইল। ফাইলের মধ্যে অনেক ডকুমেন্ট আছে। এই ডকুমেন্টগুলোতে তাদের অতিসাম্প্রতিক একটা পরিকল্পনা পাওয়া গেছে। বাকি ডকুমেন্টগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইনফরমেশন। মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেট রত্ন দ্বীপে দুটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। প্রথমটি হলো, রত্ন দ্বীপের মুসলিম, খৃস্টান ও ইহুদি- এই তিন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার সৃষ্টি করে তাদেরকে সংঘাত ও হানাহানির মধ্যে ঠেলে দেয়া। এভাবে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো এবং বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থা ধ্বংস করা। তাদের দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই কথা বলল অর্থমন্ত্রী ও প্রবীণ ইহুদি নেতা বেন নাহান আরমিনো। বলল, স্যরি, কথা না বলে পারছি না। আমার বুক কাঁপছে। এত ভয়াবহ ষড়যন্ত্র! কিন্তু জনাব, রত্ন দ্বীপের এত বড় সর্বনাশ করে ওদের লাভ কি?
জনাব, সেটাও বলব। আগে ওদের দ্বিতীয় লক্ষ্যের কথা বলে নেই।
স্যরি, বলুন স্যার। বলল বেন নাহান আরমিনো।
যে কথা বলছিলাম, ওদের দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, রত্ন দ্বীপে লুকানো আছে স্বর্ণ ও স্বর্ণমুদ্রার অনেকগুলো ভাণ্ডার, সেই ভাণ্ডার তারা লুট করতে ৯ চায়।
কথা বলার ফাঁকে আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেছিল। সেই সুযোগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ ঘানুসি বলে উঠল, অঢেল এই স্বর্ণভাণ্ডার রত্ন দ্বীপে এলো কোত্থেকে? আমরা যার বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানি না, কিন্তু ওরা জানল কি করে?
তার বিবরণও ওদের ডকুমেন্টে আছে। তা মজার সব কাহিনীও বটে। তা আপনারাও জানবেন। তার আগে জনাব বেন নাহান আরমিনার জিজ্ঞাসার জবাব গুরুত্বপূর্ণ। মিড় ব্ল্যাক সিন্ডিকেট ছাড়া রত্ন দ্বীপের শান্তি বিনষ্ট করার জন্য আরও একটা অদশ্য শত্ৰু কাজ করছে। রত্ন দ্বীপে যে একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণভাবে ও আস্থার সাথে বসবাস করছে, সেটা তারা ধ্বংস কতে চায়। তারা প্রমাণ করতে চায় বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতি, সহমগিতা সম্ভব নয়, বিশেষ করে মুসলমানদের সাথে কারও সহাবস্থান সম্ভবই নয়। আর এটা প্রমাণ করার জন্যেই তারা মুসলমানদের নামে, খৃস্টানদের নামে, ইহুদিদের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে এবং এটাকে দুনিয়ার এক নম্বর সমস্যা হিসাবে দেখাতে চাচ্ছে তাদেরই লোকরা! আমরা দেখছি রত্ন দ্বীপে তারা এই কাজই শুরু করেছে। অদৃশ্য শত্ৰুটি মিড় ব্ল্যাক সিন্ডিকেটকে টাকা দিয়ে এই কাজ করাচ্ছে। রত্ন দ্বীপে গুপ্তধন লুণ্ঠন অভিযানে মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটের যত টাকার দরকার হবে সব টাকাই অদৃশ্য শত্ৰুটি মিড ব্ল্যাক সিন্ডিকেটকে দেবে। বিনিময়ে তারা শুধু চায়, রত্ন দ্বীপ সরকারের পতন ঘটুক এবং দ্বীপের সাংবিধানিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাক।
আহমদ মুসা থামতেই স্বয়ং প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, অদৃশ্য শত্রু এ থেকে কি লাভ করবে? আন্তধর্ম শান্তি, সম্প্রীতি, সহযোগিতা না থাকলে সবাই তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর ওদের কোনো ডকুমেন্টে নেই। তবে এর উত্তর হিসাবে সাধারণভাবে যা মনে করা হয়- ধর্মপালন মানুষের স্বভাবজাত। ধর্ম থেকে মানুষকে কখনই বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন। ধর্মীয় ভাষা, ধর্মীয় শিক্ষা বন্ধ করে, মসজিদ, গির্জা, সিনাগগে তালা লাগিয়ে দিয়ে পৌনে একশ বছর ধরে চেষ্টা করেছে ধর্মকে বিলুপ্ত করার জন্যে। কিন্তু বিলুপ্ত তারা করতে পারেনি, বরং তারাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সুতরাং ধর্মীয় জাতিগুলোর মধ্যকার আস্থা, বিশ্বাস নষ্ট করে তাদের মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি সৃষ্টি করে রাখা যায়, তাহলে পৃথিবী নৈরাজ্যে ভরে যাবে। এই নৈরাজ্যের মধ্যে একটা অদৃশ্য গ্রুপ নিজেদের সংহত, শক্তিশালী করে গড়ে তুলবে এবং বিশৃঙ্খল দুনিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। থামল আহমদ মুসা।
এরা আসলে কারা? প্রশ্ন করল বেন নাহান আরমিনো।
এরা আসমানি গ্রন্থের বা আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন এক রাজনৈতিক ধর্ম। বলল আহমদ মুসা।
এমন ধর্ম কি দুনিয়াতে আছে? বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
উত্তরে আহমদ মুসা মুখ খোলার আগেই অর্থমন্ত্রী ইহুদি ধর্মীয় নেতা বেন নাহান আরমিনো কথা বলে উঠল। বলল, হ্যাঁ, এ ধরনের রাজনৈতিক ধর্ম আছে। আমার মনে হয়, জায়োনিস্টদের খুব সক্রিয় ও প্রভাবশালী একটা অংশ এ ধরনের একটা ধর্মীয় রাজনৈতিক গ্রুপ। আমরা পৃথিবীর ৯০ ভাগ ধর্মপ্রাণ ইহুদিরা মনে করি, এই জায়গানিস্ট ধর্মীয় গ্রুপের কোনো ঈশ্বর নেই, এদের ঈশ্বর যেন রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রের শ্রীবৃদ্ধি, সেই রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধির জন্যে যা কিছু করা হবে সবই বৈধ। রাষ্ট্রটির শান্তিবাদী, নাগরিকরাও এদের বিরোধী। থামল বেন নাহান আরমিনো।
ধন্যবাদ বেন নাহান আরমিনো। একজন শীর্ষ ইহুদি সাংবাদিকও আমাকে এ কথাগুলো এভাবেই বলেছিলেন। বলল আহমদ মুসা।
এবার জনাব রত্ন দ্বীপে লুকানো স্বর্ণভাণ্ডারের কথা জানতে চাই। কিভাবে এসব এলো রত্ন দ্বীপে। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস কনস্টানটিনোস।
রত্ন দ্বীপে স্বর্ণভাণ্ডার, ধনভাণ্ডার এসেছে একাধিক জলদস্যু ও ভূমধ্যসাগরীয় নৌ কমান্ডারদের মাধ্যমে। এ সংক্রান্ত ওদের দলিলে প্রথমেই এসেছে খায়ের উদ্দিন বার্বারোসার নাম। তাকে নিশ্চয় আপনারা জানেন। তিনি ভূমধ্যসাগরে সর্বযুগের একজন শ্রেষ্ঠ কমান্ডার। তাকে ইউরোপীয়রা মাস্টার অব ন্যাভাল ট্রাকটিকস এবং এক্সপার্ট অব অরগানাইজিং শিপস বলে অভিহিত করে। তার বড় ভাই, ইউরোপে রেড বিয়ার্ড নামে কথিত, আরুজ বার্বারোসার মৃত্যুর পর খায়ের উদ্দিন বার্বাবোসা ভাইয়ের শূন্য স্থান পূরণ করেন, ভাইয়ের চেয়েও বড় সাফল্য দেখান তিনি। তার কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে তুর্কি সুলতান সুলাইমান দি গ্রেট, খায়ের উদ্দিন বার্বারোসাকে তুর্কি নৌবাহিনীতে নিয়ে তাকে ভূমধ্যসাগরের গ্রান্ড অ্যাডমিরাল উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ভূমধ্যসাগরে ২৫০টি যুদ্ধজাহাজ সম্বলিত ফ্লিটও কমান্ড করেন। ইটালি, ফ্রান্স, স্পেনের উপকূলে তার অবাধ আনাগোনা ছিল। খায়ের উদ্দিন। বার্বারোসার আগে ও পরে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতক জুছ অনেক মুসলিম নৌকমান্ডারের আবির্ভাব ঘটে। তারা শুধু নৌযুদ্ধে শত্রুদের পরাজিতই করতো না, বিজিত জাহাজ লুণ্ঠনও করতো। এই সময় প্রায় পনের লক্ষ বিজিত ইউরোপীয়কে তারা উত্তর আফ্রিকায় নিয়ে যায়। খাদ্যের উদ্দিন বার্বারোসা ১৫৩৩ সালে তুর্কি বাহিনীতে যোগ দেবার পর তার ধনভাণ্ডারের একটা বড় অংশ রত্ন দ্বীপে লুকিয়ে রাখেন। রত্ন দ্বীপে তিনি একটা দুর্গও তৈরি করেন। এটা ছিল খায়ের উদ্দিন বার্বারোসার অবকাশ কেন্দ্র। সেই দুর্গ নগরীই রত্ন দ্বীপের রাজধানী কাবার্বা ক্যাসল। যা ছিল এক সময় খায়ের উদ্দিন বার্বারোসা ক্যাসল। খায়ের উদ্দিন বার্বারোসার ধনভাণ্ডার রত্ন দ্বীপের কোথায় সে ব্যাপারে কিছু দুর্বোধ্য সংকেত রয়েছে মাত্র।
দ্বিতীয় ডকুমেন্টে এসেছে নাইটস অব সেন্ট জন-দের কথা। এরা মূলত জলদস্যু হলেও নন-খৃস্টানদের বিরুদ্ধে তারা ছিল খড়গহস্ত। এই কারণেই স্পেন থেকে পলাতক মুসলমানদের জাহাজ ও নৌকাই এরা লুণ্ঠন করেছে বেশি। এই ধনভাণ্ডার নিরাপদ করার জন্যে তারা তা লুকিয়ে রাখে নির্জন এই রত্ন দ্বীপে। বিখ্যাত জলদস্যু স্যার হেনরার নাম এসেছে তৃতীয় ডকুমেন্টে। উত্তর আটলান্টিক ও ভূমধ্যসাগরে দস্যুতা ও লুণ্ঠন থেকে লক্ষ লক্ষ স্বর্ণখণ্ড, স্বর্ণমুদ্রা অর্জন করে সে। তার কাছেও ধনভাণ্ডার নিরাপদে লুকিয়ে রাখার জন্যে দুর্গম, নির্জন এই রত্ন দ্বীপ ছিল নিরাপদ জায়গা। তার ধনভাণ্ডারের বৃহত্তর অংশ লুকিয়ে রাখে এই রত্ন দ্বীপে। অবশিষ্ট অংশ নিয়ে যায় ইংল্যান্ডে। এরপর এক সময় সে দস্যুতা ছেড়ে দেয় এবং ইংল্যান্ডের রাজার ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়। পরে গোপনে ধনভাণ্ডার উদ্ধারের চেষ্টা করে রত্ন দ্বীপ থেকে, কিন্তু সাথীদের বিশ্বাসঘাতকতায় তার সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
অর্থ-সম্পদ আহরণের দিক দিয়ে ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে সফল জলদস্যু জেন জানজ। চতুর্থ ডকুমেন্টে তার কথা বলা হয়েছে। হল্যান্ডের লোক সে। তার সবচেয়ে সফল অভিযানগুলো হলো স্পেনের স্বর্ণ বোঝাই জাহাজসমূহের লুণ্ঠন। স্পেনের জাহাজগুলো দক্ষিণ আমেরিকার সোনা জমা রাখা স্বর্ণখচিত মন্দির ও ইনকা মায়াদের স্বর্ণখনি, লুট করা স্বর্ণ দিয়ে বোঝাই করা জাহাজ নিয়ে আসতো স্পেনে। এই জাহাজগুলোকে বলা হতো ট্রেজার শীপ। এসব জাহাজেরই অনেকগুলো। লুণ্ঠন করে জেন জানজ। সেও নিরাপদ মনে করে রত্ন দ্বীপকে। তারও স্বর্ণভাণ্ডারের বৃহত্তর অংশ লুকিয়ে রাখে এই রত্ন দ্বীপে। পরবর্তীকালে সে। ইসলাম গ্রহণ করে মরক্কোর একজন মুসলিম মহিলাকে বিবাহ করে। মরক্কোর গোয়ালিদিয়া নগরীর গভর্নর হিসেবে তার জীবন শেষ হয়। ইসলাম গ্রহণের পর কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে রত্ন দ্বীপের স্বর্ণভাণ্ডার তুলে আনার জন্যে আর এখানে আসেনি।
আহমদ মুসা একটু থামল। থেমেই আবার বলল, যারা এই ডকুমেন্টগুলো সংগ্রহ করেছে, তারা সবশেষে লিখেছে, বড় বড় কয়েকটি ধনভাণ্ডারের সন্ধান তারা করতে পেরেছে। এর বাইরেও অনেক জলদস্যুর ধনভাণ্ডার লুকানো আছে রত্ন দ্বীপে। রত্ন দ্বীপের মালিক হওয়ার মতো লোভনীয় আর কিছু নেই। আহমদ মুসা থামল।
.
উপস্থিত সবার চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া। আহমদ মুসা থামলেও তাদের মুখে কোনো কথা আসছে না। যেন কোনো রূপকথা তাদের বিস্ময়বিমূঢ়তায় নির্বাক করে দিয়েছে।
অবশেষে নীরবতা ভেঙে স্বয়ং প্রেসিডেন্টই প্রশ্ন করল, স্যরি। আমার মনে হচ্ছে, কথাগুলো সবই রূপকথা। বড় সব জলদস্যুর চোখ, রত্ন দ্বীপের দিকে আসে কেমন করে? কেন তাদের অঢেল স্বর্ণভাণ্ডার তারা এখানে রাখবে? কেন রত্ন দ্বীপকে নিরাপদ বোধ করেছে তারা?
এর কারণ হলো, সেসময় ভূমধ্যসাগরে রত্ন দ্বীপের মতো নির্জন ও দুর্গম দ্বীপ আর ছিল না। সারাদিনা, মেজোরকা, সিসিলি, মাল্টা, ক্রিট, রোড়স, সাইপ্রাস, ভিলেফ্রান্সি, মার্সেলিস, নাইস, লিভোরননা, নেপলস, আইওনিয়ান আইল্যান্ডস, বদ্রুম প্রভৃতি দ্বীপ ও এলাকা ছিল জলদস্যুদের অভয়ারণ্য। এগুলো ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং অহরহ হাত বদলের শিকার। জলদস্যুরা এগুলোর কোনটিকেই নিরাপদ মনে করতো না। এই সাথে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো জলদস্যুদের জন্যে বিপজ্জনক ছিল। এই অবস্থায় অথৈ ভূমধ্যসাগরে লুকিয়ে থাকা ছোট, নির্জন ও দুর্গম সীমান্তের এই রত্ন দ্বীপকে তারা তাদের ধনভাণ্ডার নিরাপদ করার সবদিক থেকে উপযুক্ত মনে করে। বলল আহমদ মুসা। ও একটু থামলো আহমদ মুসা। তারপর একটু নড়েচড়ে বসে বলল, আমার মনে হয় রত্ন দ্বীপে যা ঘটছে- তা কেন ঘটছে, কারা ষড়যন্ত্র। করছে, কেন করছে সবকিছুই সবার কাছে এখন পরিষ্কার। অনিশ্চয়তা আর থাকলো না।
অনিশ্চয়তা থাকল না। কিন্তু সবকিছু পরিষ্কার হওয়ায় আতঙ্ক এসে আমাদের উপর চেপে বসল। অর্থ সব অনর্থের মূল হয়ে থাকে। সেই অনর্থের মধ্যেই পড়ে গেল রত্ন দ্বীপ। তার সাথে আবার যোগ হলো অদৃশ্য শত্রুর রাজনৈতিক আগ্রাসন। মনে হচ্ছে সব দিক থেকেই বিপন্ন আমাদের রত্ন দ্বীপ। মি. আহমদ মুসা, সেভিয়ার হিসেবে রত্ন দ্বীপে আপনাকে আমরা পেয়েছি। আসন্ন দুই ভয়াবহ বিপদ থেকে আপনি আমাদের রত্ন দ্বীপকে রক্ষা করুন। বলল অর্থমন্ত্রী ইহুদি নেতা বেন নাহান আরমিনো।
রত্ন দ্বীপ এক শান্তির, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার দ্বীপ। আল্লাহ রত্ন দ্বীপ ও রত্ন দ্বীপের মানুষকে রক্ষা করবেন। বলল আহমদ মুসা।
আমিন। বলল প্রেসিডেন্ট।
সবার দিকে চেয়ে প্রেসিডেন্ট আবার বলে উঠল, একথা ঠিক রত্ন দ্বীপ আজ মহাবিপন্ন অবস্থায় আছে। আমরা যে মহাবিপদে আছি তা আমরা জানতাম না। তা আজ আমরা জানতে পেরেছি। বিপদ মোকাবেলায় এটা আমাদের অগ্রগতি। এই অগ্রগতি বিপদ-মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে এটা সহায়ক হবে। মহান ভাই আহমদ মুসা আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের সাফল্যের পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। ইনশাআল্লাহ তিনি আমাদের সাফল্যের সিংহদ্বারে পৌঁছাবেন।
মানুষ চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু সাফল্য দেন আল্লাহ। তার কাছেই আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত।
একটু থেমেই আহমদ মুসা বলল, আমার জরুরি একটা প্রোগ্রাম আছে। আমি উঠব। অনুমতি চাই।
অবশ্যই ভাই আহমদ মুসা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আহমদ মুসা উঠল।
প্রেসিডেন্টের গ্যারেজেই দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসার গাড়ি। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছিল দুজন প্রহরী। তাদের সাথে দাঁড়িয়েছিল মেজর পাভেল।
মেজর পাভেলকে ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসা গাড়িতে উঠল। গাড়ি ছুটে চলল রত্ন দ্বীপ স্টেট ইউনিভার্সিটির দিকে। এখানে জাহরার সাথে বৈঠক আহমদ মুসার বেলা ১২টায়।
.
[এই সিরিজের পরবর্তী বই ‘বিপন্ন রত্ন দ্বীপ’]
Leave a Reply