সাইমুম ৫৭ – আতংকের দিভিন উপত্যকা – আবুল আসাদ
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০১৬
[আহমদ মুসা দিভিন উপত্যকায় যাচ্ছে এটা সে কাউকেই জানতে দেয়নি। ঘটনাচক্রে ইভা নারিন তার সাথী হয়েছে। ইভা নারিন কোথায় যাচ্ছে তাও সে আহমদ মুসাকে বলেনি। শেষে দেখা গেল আহমদ মুসা তার মিশন নিয়ে যাচ্ছে দিভিনে আর ইভা নারিন দিভিনেই যাচ্ছে সেখানকার ঘটনাবলীর তদন্ত করতে। পথে পথে পথে ভয়ংকর সব ফাঁদ… সব ফাঁদ মাড়িয়ে তারা পৌছল দিভিনে- সেখানেও একের পর এক প্রাণঘাতি হামলা আর ভেতরের সব ষড়যন্ত্র। দৃশ্যপটে এল সরদার আসতি আওয়াত, শেপল, আহমদ নেবেজ, শিন সেনগার, এরদেলান আরও অনেকে। দিভিন সংকটের সমাধান শেষে আহমদ মুসা ছুটল সব ষড়যন্ত্রের, সব সন্ত্রাসের হোতা সেন্ট সেমভেলের সন্ধানে… গোয়েন্দা অফিসার ইভা নারিন গোপনে অনুসরণ করল আহমদ মুসাকে- কিন্তু কেন?… শুধুই কি সাহায্যের জন্য, না অন্য কিছু? অনেক পথ পেরিয়ে, অনেক ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে, অনেক ঘটনা ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত আহমদ মুসা সন্ধান পেল সেন্ট সেমভেলের প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব নগরী দিভিনের সেন্ট গ্রেগরি চার্চ কমপ্লেক্স!… সবচেয়ে সুরক্ষিত, ভয়ংকর বিপজ্জনক সে ঘাঁটিতে আহমদ মুসার অভিযান, পেছনে সংগোপনে ইভা নারিন- কি ঘটবে সেখানে? আহমদ মুসার বিপজ্জনক সে অভিযানটা কেমন হবে? ইভা নারিনের ভাগ্যেই বা কি ঘটবে- কি অপেক্ষা করছে তার জন্যে? সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হাজির হলো শ্বাসরুদ্ধকর এক কাহিনী “আতংকের দিভিন উপত্যকা”।]
.
এই বইয়ের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত অথবা মৃত কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে এর কোন প্রকার সম্পর্ক নেই। –লেখক
.
১
টিলার গা ঢালু। সোজা রাস্তায় সেই টিলায় উঠে যেতে কোনই কষ্ট হলো না আহমদ মুসার। টিলার মাথায় উঠে যেতেই আগুনের ভয়াবহ দৃশ্যটা তাদের সামনে এল।
মুখোমুখি দুটি একতলা বিল্ডিং-এ দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।
এ দুটি বিল্ডিংই এল প্যাটার্নের এবং মুখোমুখি। দুই এল-এর বটম টিলার দক্ষিণ দিক কভার করেছে। মাঝখানে একটা স্পেস, সম্ভবত ওপাশটায় মানুষ ও গাড়ি চলাচলের জন্য। আর দুই এল-এর লম্ব দুটি কভার করেছে পশ্চিম ও পুব প্রান্ত। টিলার উত্তর প্রান্ত উন্মুক্ত দুই এল-এর দুই লম্বের মাঝে বিরাট উন্মুক্ত চত্বর। চত্বরের মাঝখানে গোলাকার একটা শেড কয়েকটা পিলারের উপর দাঁড়ানো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওটা বিশ্রামকক্ষ কাম রেস্টুরেন্ট।
পশ্চিমের কিছু অংশ ছাড়া এল প্যাটার্নের দুটি বিল্ডিংই জ্বলছে।
চত্বরের মাঝখানের গোলাকার শেডটায় তখনও আগুন লাগেনি। উত্তর প্রান্ত দিয়েই রাস্তা উঠে এসেছে টিলায়। টিলাতে উঠেই গাড়িতে ব্রেক কষেছে আহমদ মুসা। গাড়ি দাঁড় করিয়েই গাড়ি থেকে নামল সে।
নামল ইভা নারিনও।
আহমদ মুসার দৃষ্টি দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে। তার কপাল কুঞ্চিত হলো। একটা উদ্বেগের ছায়া নেমে এল তার চোখে-মুখে।
ইভা নারিনের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, মিস ইভা নারিন, আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে দেখুন।
ইভা নারিন তাকাল আগুনের শিখার দিকে।
দেখছি আগুন! কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিনে মিস্টার আহমদ আবদুল্লাহ। বলল ইভা নারিন।
আগুনের ঊর্ধ্বমুখী শিখা তার শেষ প্রান্তে গিয়ে রেডিশ ব্ল্যাক হয়ে ধোঁয়ায় পরিণত হওয়ার কথা, কিন্তু দেখুন রেডিশ ব্ল্যাক না হয়ে সেটা বুয়িশ ব্ল্যাক রং ধারণ করছে। আহমদ মুসা বলল।
এটা কেন হচ্ছে? আপনি কিছু মনে করছেন কিনা? বলল ইভা নারিন।
আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে আমি মনে করি আগুনের সাথে SMG নামে এক প্রকার গ্যাসও পুড়ছে। সারিন মাল্টিপুল গ্যাস আগুনের সাথে মিশে ধোঁয়ায় পরিণত হলে তা ভয়ংকর প্রাণঘাতী হয়ে। ওঠে। আহমদ মুসা বলল।
ও গড! তাহলে তো ধোঁয়ার সংস্পর্শে এলেই মৃত্যু! বলল ইভা নারিন।
হ্যাঁ, ধোঁয়া থেকে কমপক্ষে ২০ ফুটের বেশি দূরে থাকতে হবে। ধোঁয়া থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত SMG গ্যাসের অদৃশ্য প্রভাব থাকে। আহমদ মুসা বলল।
ভেতরে কেউ থাকলে তারা তো আগুন জ্বলে ওঠার সংগে সংগেই মারা গেছে। বলল ইভা নারিন।
কেউ যেহেতু বেরিয়ে আসেনি, বেরিয়ে আসছে না, তার অর্থ আপনি যা বলেছেন সেটাই। তবু একবার দেখতে হয় ভেতরে কেউ আছে কিনা।
বলেই আহমদ মুসা গাড়ির ভেতর থেকে তার ব্যাগ নিয়ে একটা মিনি গ্যাস মুখোশ বের করে নিল। বলল, ইভা নারিন, একটাই গ্যাস মুখোশ আছে। অতএব আপনি এখানে অপেক্ষা করুন।
আহমদ মুসা মুখোশ পরতে যাচ্ছিল। এমন সময় পেছনে একসাথে। অনেক হৈ চৈ শুনতে পেল।
পেছনে তাকাল আহমদ মুসা ও ইভা নারিন দুজনেই। আগুনের আবছা আলোয় দেখল একদল লোক এদিকে ছুটে আসছে।
এলাকার লোক নিশ্চয়! আগুন লাগা দেখে ওরা এদিকে ছুটে আসছে। আপনি ওদের আটকে রাখুন। আমি আসছি। বলেই ছুটল আহমদ মুসা জ্বলন্ত ঘরগুলোর দিকে। ধোঁয়ায় তখন মাঝখানের চত্বরটা আচ্ছন্ন। ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে মাঝখানের শেডটা। স্বাভাবিক ধোঁয়ার চেয়ে এ ধোঁয়া ভারি। এত নিচে এত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণ এটাই।
আহমদ মুসার গাড়ি দাঁড়িয়েছিল বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে। বাড়ির পাশেই দাঁড়িয়েছিল ইভা নারিন। স্থানীয় লোকগুলো ছুটে আসছিল প্রজ্বলিত টিলার দিকে।
টিলার গোড়ায় গ্যাস বাতির আলোতে ওদের দেখা গেল। অনেক লোক ওরা।
আরও কয়েক মিনিট সময় নিল ওরা টিলার উপর পৌঁছতে। গাড়ি দাঁড়িয়েছিল রাস্তার পাশে। গাড়ির পাশে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিল ইভা নারিন।
লোকরা দৌড়েই আসছে। টিলাতে উঠেও তারা ছুটে আসছিল।
ইভা নারিন কয়েক পা সামনে হেঁটে দুহাত তুলে দাঁড়াল। বলল, সামনে আর এগোনো যাবে না। প্লিজ।
ছুটে আসা লোকগুলোর সামনে মাঝবয়সী আর একজন মেয়ে। তার দুপাশে দুজন তরুণ-তরুণী।
তারাসহ ছুটে আসা লোকগুলো থমকে দাঁড়াল। তরুণটি চিৎকার করে বলল, তোমরা কে, কেন আমাদের বাধা দিচ্ছ, যখন আমাদের সম্পদ পুড়ছে, মানুষ পুড়ছে? আগুন নেভাতে হবে। সরে দাঁড়াও।
বলে আবার তারা ছুটতে শুরু করল।
প্লিজ আপনারা এগোবেন না। আগুনের ধোঁয়া প্রাণহানিকর, বিষাক্ত। প্লিজ! চিৎকার করে বলল ইভা নারিন।
আবার থমকে দাঁড়াল লোকগুলো।
সেই তরুণটিই বলল, কে আপনারা? এসব কি বলছেন? আমাদের যেতে বাধা দিচ্ছেন কেন?
এই তরুণটি আহমদ নেবেজ। দিভিন উপত্যকার যুব নেতা। ইয়েরেভেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র।
আহমদ নেবেজ থামতেই তার পাশের এক তরুণী বলে উঠল, সবাই এখানে দাঁড়াক। চল আমরা আগে ওর কাছ থেকে বিষয়টা কি জানি। যে মহিলা কথা বলছে, আমাদের যেতে বাধা দিচ্ছে, তাকে তো এই। উপত্যকার লোক কিংবা কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।
কিন্তু কথা বলার সময় কোথায়? সময় নষ্ট করা কি ঠিক হবে? বলল আহমদ নেবেজ। তার কণ্ঠ কিছুটা শান্ত। যে তরুণীটি তার আগে কথা বলল সে দিভিন উপত্যকার সরদার মোহাম্মদ আসতি আওয়াতের মেয়ে শেপল। সেও দিভিন মেডিকেল কলেজের ছাত্রী এবং একজন তুখোড় সমাজকর্মী।
আহমদ নেবেজের কথা শেষ হতেই পাশ থেকে মাঝ বয়সী একজন মেয়ে বলল দ্রুত কণ্ঠে, ধোঁয়া বিষাক্ত, প্রাণহানিকর! এসব কথা ভুয়া! আসলে এরাই আগুন দিয়েছে। আহমদ নেবেজ ঠিকই বলেছে, আর সময় নষ্ট করা যায় না।
বলে সে সামনে ছুটতে শুরু করল। তাঁর সাথে সাথে সবাই।
ইভা নারিনও তখন মরিয়া।
সে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে চিৎকার বলে বলল, সামনে যাওয়া যাবে না, ভয়ংকর বিপদ আছে সামনে।
উত্তেজনাকর অবস্থা। মিছিলের সামনের সারি থেকে এসে শেপল ফিরে দাঁড়িয়েছিল। তার সাথে আহমদ নেবেজও ফিরে দাঁড়াল। তারা হাত তুলে মিছিল থামাতে চেষ্টা করল। ঠিক এ সময় গুলির শব্দ হলো।
গুলি করা হয়েছিল ইভা নারিনকে লক্ষ করে। সে সংগে সংগে নিজেকে কিছুটা সরিয়ে নিতে না পারলে যে গুলিটা তার বাহুতে বিদ্ধ হয়েছে, তা তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিত।
ইভা নারিন গুলি খেয়েও মিছিলের সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়নি। সে ডান হাত দিয়ে তার বাম বাহুটা চেপে ধরেছে মাত্র।
বিশৃঙ্খল অবস্থা। মিছিলের কেউ থমকে দাঁড়িয়েছিল, কেউ কেউ সামনে এগোচ্ছিল।
গুলি করেছিল মাঝ বয়সী ঐ মেয়েটি, যে কথা বলার পর মিছিল থেকে সামনে ছুটে গিয়েছিল।
প্রথম গুলির টার্গেট ব্যর্থ হতে দেখে মেয়েটি দ্বিতীয় গুলি করার জন্যে রিভলবার তুলেছিল ইভা নারিনের লক্ষে।
আহমদ মুসা বেরিয়ে আসছিল প্রজ্বলিত আগুন ও ধোঁয়ার দিক থেকে। তার কাঁধে একজন মানুষ। প্রথম গুলির শব্দ শুনে সে দ্রুত আসছিল। ঘটনাস্থলের দিকে। ইভা নারিন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল তা দেখতে পেল সে।
সে দেখতে পেল মিছিলের সামনে থেকে আবার একটি রিভালবার ওপরে উঠেছে ইভা নারিন লক্ষে। ইভা নারিনের দৃষ্টি ছিল নিজের আহত বাহুর দিকে। গুলিটা তার বাম বুকে লাগার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে কিছুটা সরিয়ে নিতে পারায় গুলিটা বাম বুকে না লেগে বাম বাহুতে লেগেছে।
সময় ছিল না আহমদ মুসার হাতে। লোকটিকে কাঁধে রেখেই ডান হাত দিয়ে জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুলি করল রিভলবার তুলে ধরা মেয়েটির হাত লক্ষে। _ ইভা নারিনকে লক্ষ করে রিভলবার তুলেছিল মেয়েটি। আহমদ মুসার গুলি তার ডান হাতকে বিদ্ধ করল। পড়ে গেল মেয়েটির হাত থেকে রিভলবার।
গুলি খেয়ে মেয়েটি একটু থমকে গিয়েছিল, কেঁপে উঠেছিল তার দেহটা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে নিজেকে মুহূর্তেই সামলে নিয়ে মেয়েটি বাম হাত দিয়ে তার কামিজের পকেট থেকে একটা ছোট্ট গোলাকার জিনিস বের করে ছুঁড়তে গেল আহমদ মুসাদের লক্ষ করে।
ব্যাপারটা দেখতে পেল আহমদ মুসা। বিস্মিত হলো সে, মেয়েটি গুলিবিদ্ধ হয়েও পাল্টা আক্রমণে আসতে পারল! কি ছুড়ছে ওটা! বিষাক্ত গ্যাসের মত কিছু নয়তো!
আহমদ মুসা আর চিন্তা করতে পারল না। সে খুব সাবধানে গুলি করল মেয়েটির হাত নয়, বাম বাহু লক্ষে, যাতে বম্ব বা গ্যাস বম্ব জাতীয় বস্তুটি বিস্ফোরিত হবার কোন সুযোগ না পায়।
মেয়েটি চিৎকার করে উঠল, শেপল, আহমদ নেবেজ, তোমরা সামনে। আগাও। ওরাই আমাদের সেন্টারে আগুন দিয়েছে, আমাদের সব ক্ষতির জন্যে ওরাই দায়ী। ওদের বাঁচতে দেয়া যায় না।
কথা শেষ করেই মেয়েটি আহত দুই হাত নিয়ে বসে পড়েছে।
মেয়েটির কথা শেষ হতেই সব লোক চিৎকার করে উঠল, ধর ওদের, যেন পালাতে না পারে। আমাদের সর্বনাশ করেছে ওরা।
লোকরা আবার ছুটতে শুরু করুল আহমদ মুসাদের দিকে।
আহমদ মুসা এসে ইভা নারিনের সামনে দাঁড়াল। কাঁধ থেকে লোকটিকে দ্রুত নামাল। খুলে ফেলল মুখ থেকে মুখোশ। পকেট থেকে বের করল অটো মেশিন রিভলবার। কয়েক ধাপ সামনে এগিয়ে গিয়ে দৌড়ে আসা লোকদের একদম সামনে এসে দাঁড়াল দুই হাত তুলে ওদের বাধা দেয়ার ভংগিতে। শূন্যে এক পশলা গুলি ছুঁড়ে আহমদ মুসা চিৎকার করে বলল, দাঁড়াও তোমরা! দেখ, তোমরা আমাদের মারতে চাইলে তোমরাও বাঁচবে না। আমরা তোমাদের শত্রু নই। আমরা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, আগুন লাগা দেখে আমরা এখানে এসেছি।
শেপল ও আহমদ নেবেজ তখন লোকদের সামনের সারিতে। শেপল থমকে দাঁড়াল। তার দিকে তাকিয়ে আহমদ নেবেজও দাঁড়িয়ে পড়ল।
আমি মনে করি লোকটি ঠিক বলছে। সে ভেতর থেকে আমাদের একজন লোককে নিয়ে এসেছে। লোকটি গ্যাস মাস্ক পরে ছিল। তার মানে ধোঁয়া বিষাক্ত হওয়ার কথা মিথ্যা নয়। বলল শেপল উচ্চস্বরে পেছনের সবাইকে লক্ষ করে।
লোকরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে।
তোমার কথা ঠিক হতে পারে। কিন্তু বল তো, লোকটা ত্রিফা আপার দুহাতে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে কেন? কেন ঘটানো হলো এটা? বলল আহমদ নেবেজ শেপলকে লক্ষ করে।
ত্রিফা আপাই প্রথম গুলি করেছে ঐ মেয়েটিকে। হাতে গুলি খেয়ে আহত হয়েছে মেয়েটি। সেই আহত মেয়েটিকেই আবার গুলি করে মারতে গিয়েছিল ত্রিফা। এই অবস্থাতেই তো প্রথমবার লোকটি ত্রিফা আপার হাতে গুলি করেছে। গুলি খাওয়ার পরেও কিন্তু আপা বোমা ছুঁড়তে গিয়েছিল। দ্বিতীয় গুলি করেছে লোকটি এই কারণেই। সুতরাং ত্রিফা আপাকে আহত করার জন্যে তুমি ওদের কাউকেই কোনভাবে দায়ী করতে পার না। বলল শেপল।
ভ্রূ কুঞ্চিত হলো আহমদ নেবেজের। বলল, আমার ওদিকটায় খেয়াল ছিল না। মনোযোগ ছিল আমার আগুনের দিকে। গুলির শব্দ শুনেছি। যখন এদিকে তাকিয়েছি তখন ত্রিফা আপাকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি। ঠিক আছে শেপল। লোকদের আমরা এখানে দাঁড়াতে বলি। চল আমরা আগে কথা বলি লোকটার সাথে।
কথা শেষ করেই আহমদ নেবেজ লোকদের সামনে গিয়ে তাদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা দাঁড়ান। আমরা ওদের সাথে কথা বলছি।
আহমদ নেবেজের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শেপল। তারা দুজন এগোলো আহমদ মুসার দিকে। দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে।
আমাদের প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়ে গেল। বলুন, আপনার কি বলার আছে? বলল শেপল শক্ত গলায়।
সেসব কথা পরে হবে। আগে এই লোকটিকে বাঁচাতে হবে। ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্যে সে নাকে-মুখে কাপড় দিয়েছিল এবং শ্বাস বন্ধ রাখার চেষ্টা করেছিল বলে এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু সে নিরাপদ নয়। তার শরীরে প্রচুর পানি ঢালতে হবে। তার বাঁচার এটাই একমাত্র উপায়। বলল আহমদ মুসা।
কথা কয়টা বলেই আবার বলে উঠল আহমদ মুসা, মেয়েটির দুহাতে গুলি লেগেছে, বুলেট হাতে ঢুকে নেই। কিন্তু অবিলম্বে তার চিকিৎসা দরকার। তার বোমাটি তার সামনেই পড়ে আছে। বিষাক্ত গ্যাস বোমা ওটা। পিন নেই বোমায়। আর দুতিন মিনিটের মধ্যেই ওটায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে। বোমা সরিয়ে ফেলুন অথবা লোকদের সরে যেতে বলুন অন্তত বিশ গজ দূরে। বলেই আহমদ মুসা এগোলো ইভা নারিনের দিকে। _ শেপলের বিস্ময়ভরা দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে! অদ্ভুত লোক! আমাদের লোককে বাঁচানোর জন্য তার উদ্যোগটাই যেন বেশি। তার গুলিতেই আমাদের ত্রিফা আপা আহত হয়েছে। অথচ সেই-ই তার চিকিৎসার জন্যে তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু তার হাতে বুলেট ঢুকে নেই, লোকটি বুঝল কি করে? বিষাক্ত বোমা, পিন নেই তাতে, দুতিন মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটবে, তাই বা জানল কি করে লোকটা? আর তার পরামর্শগুলো সবই হুকুমের সুরে। আর মনে হচ্ছে, তার হুকুমগুলো শিরোধার্য হয়ে উঠেছে। কে এই লোক!
বিস্ময়ভরা প্রশ্নগুলো নিয়েই সে তাকাল আহমদ নেবেজের দিকে। বলল, কি ভাবছ তুমি?
ভাবছি না, বিস্ময় সামলাচ্ছি। অদ্ভুত এই লোক তো? যেন সে আমাদের পক্ষে কাজ করছে, আমাদেরই নেতা সে। আহমদ নেবেজ বলল।
কিন্তু যা বলেছে তা তো এখনি করতে হবে।
বলেই শেপল তাকাল আহমদ নেবেজের দিকে। বলল, তুমি কাউকে নিয়ে দারিস্তান আংকেলের গায়ে পানি ঢালার ব্যবস্থা কর। আমি ওদিকটা দেখছি।
শেপল গিয়ে ত্রিফা বেফ্রিনের পাশে দাঁড়িয়ে লোকদের দিকে চেয়ে : চিৎকার করে বলল, তোমরা সকলে অন্তত বিশ গজ দূরে সরে যাও। এখনই এখানে বোমা ফাটবে।
বলার সাথে সাথেই শেপল ত্রিফা বেফ্রিনকে ধরে দাঁড় করাল। বলল, চলুন, ক্লিনিকে যেতে হবে। রক্ত দেখছি এখনও সমানে বের হচ্ছে।
দ্রুত লোকরা সরে গেল। শেপল ত্রিফা বেফ্রিনকে ধরে নিয়ে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা ইভা নারিনের বাহুতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছিল। শেপলদেরকে বসতি এলাকার দিকে যেতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শুনুন মিস…।
শেপল শুনতে পেয়েছে আহমদ মুসার ডাক। সে ঘুরে দাঁড়াল।
তোমাদের ক্লিনিক, ডাক্তারখানা এখান থেকে কত দূর? আহমদ মুসা। বলল
আমার নাম শাহিন শেপল। একটা ক্লিনিকের মত আছে। সেটা বেশ দূরে, বসতির মাঝখানে। বলল শেপল।
তাহলে এখানে আসুন। আমাদের গাড়িতে ব্যান্ডেজ ও অন্যান্য কিছু আছে। প্লিজ আসুন। আহমদ মুসা বলল।
শেপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ত্রিফা বেফ্রিনকে নিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।
ইভা নারিনের ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। ইভা নারিন আহমদ। মুসাকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
শেপলরা এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছিল। ত্রিফা বেফ্রিনের দুহাত কাঁপছিল। সে দাঁড়াতে পারছিল না।
মিস ইভা নারিন, আপনি ওকে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিন। বলল আহমদ মুসা।
উনিও তো আহত। আমিই ত্রিফা আপাকে শুইয়ে দিচ্ছি। শেপল বলল।
গাড়ির দরজা খোলাই ছিল। শেপল ত্রিফাঁকে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, আমি মেডিকেল কলেজে পড়ি।
আমি এর ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছি।
ধন্যবাদ মিস শেপল। বলল আহমদ মুসা শেপলকে।
ইভা নারিন মেডিকেল কিটটা এগিয়ে দিল শেপলের দিকে।
আমি ওদিকে দেখি লোকটির গায়ে পানি ঢালার কি হলো। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনতে পেয়েই শেপল বলল, স্যার, পানি ঢালার দায়িত্ব যাকে দেয়া হয়েছে, সে আহমদ নেবেজ। সেও মেডিকেল কলেজের ছাত্র।
গুড নিউজ, ধন্যবাদ মিস শেপল। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা গেল আহমদ নেবেজের কাছে।
কারিগরি কমপ্লেক্সের বাইরে পেছনের দিকে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্যে একটা চৌবাচ্চা রয়েছে। এই জায়গাটা বাতাসের বিপরীতে বলে। এখানে ধোঁয়া নেই, আগুনও এপর্যন্ত আসেনি। এখানেই প্রায় সংজ্ঞাহীন দারা দারিস্তানকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পানির কলের নিচে একটা তক্তপোশের উপর তাকে শুইয়ে তার গায়ে পানি ঢালা হচ্ছে।
আহমদ মুসা গিয়ে লোকটির মাথায় হাত রাখল। তার মনে হলো, এই ঠান্ডা ধোঁয়াটে কোন কিছুর পরমাণুকে জমাট করার জন্যে যথেষ্ট হতে পারে। আর ঐ বিষাক্ত গ্যাসটির পরমাণু জমাট বাঁধার সাথে সাথে বিষের অ্যাকশন কভার্ডও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
আহমদ নেবেজ আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসা তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো মেডিকেলের ছাত্র। কি বুঝছ তুমি?
সংজ্ঞা ফিরে আসছে স্যার। এখনি কথা বলার পর্যায়ে আসবে।
কথা শেষ করেই আহমদ নেবেজ আবার বলে উঠল, স্যার এর গায়ে পানি ঢালতে বললেন কেন? ধোঁয়া যদি বিষাক্তই হয় এবং সে বিষে যদি সে আক্রান্তই হয়ে থাকে তাহলে পানি কি করে তাকে বাঁচাবে?
আহমদ নেবেজ তুমি খেয়াল করনি তার নাক মুখ ভিজে কাপড়ে বাঁধা। ছিল। ভিজে কাপড় ধোঁয়ার সাথে বিষকেও শুষে নিয়েছিল। কিন্তু ফিলটারড হয়ে যেটুকু দেহের ভেতরে প্রবেশ করেছিল, তাতেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ওয়াটার থেরাপি করতে যদি বেশি দেরি হয়ে যেত, তাহলে তাকে বাঁচানো যেত না। দেহে পানি ঢালার ফলে ঠান্ডায় দেহের ভেতরে ক্ষতিকর বিষ যেটুকু ঢুকেছিল, তা জমাট বাঁধার ফলে কভারড হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। বলল আহমদ মুসা।
শেপলও এসে আহমদ নেবেজের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে উদ্বিগ্ন ছিল দারা দারিস্তানের অবস্থা নিয়ে।
আমার খুব বিস্ময় লাগছে, এটা যদি সত্য হয় আপনি আগুন দেখে এখানে এসেছেন, তাহলে এসেই বুঝলেন কি করে যে, ধোঁয়াটা বিষাক্ত। আমরা তো বুঝতে পারিনি। আহমদ নেবেজ বলল।
আগুনের শিখা যেখানে বুইশ ব্ল্যাক রং নিয়েছে তা দেখেই আমি নিশ্চিত হই যে, আগুনে কোন ধরনের গ্যাসের সংমিশ্রণ আছে। দিভিন উপত্যকার ঘটনাবলির কিছু কিছু আমি জানি। সেই জানা থেকেই আমার সন্দেহ হয় যে, গ্যাসটা বিষাক্ত হতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
শেপল ও আহমদ নেবেজের চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল শেপল, স্যার, আপনি কি গ্যাস-রসায়ন বিশেষজ্ঞ? সূক্ষ্ম পার্থক্যটা আপনি বুঝলেন কি করে? আর দিভিনের ঘটনাবলি কি করে জানলেন? এসব তো কোন পত্রিকায় বা কোন মিডিয়ায় আসেনি! আপনি তো বিদেশি। দিভিন উপত্যকায়ই বা আপনারা ঢুকেছিলেন কেন? এই রাস্তা দিভিনের মানুষ ও সরকারি লোক ছাড়া কেউ, বিশেষ করে ট্যুরিস্টরা এ রাস্তা ব্যবহার করে না।
মিস শেপল, তুমি যত প্রশ্ন করেছ, জবাব দিতে সময় লাগবে। আমার কথা বিশ্বাস করা, না করা দুই অধিকারই তোমাদের রয়েছে।
বলে মুহূর্তের জন্যে থামল আহমদ মুসা। আবার বলল, এই মুহূর্তের জরুরি কাজ হলো, সংজ্ঞাহীন লোকটির সংজ্ঞায় ফিরিয়ে আনা, তাকে এবং ত্রিফাঁকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া অথবা তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় কাজ হলো, এই প্রতিষ্ঠানটি কে বা কারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং আগুনের সাথে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করেছে- এই অভিযোগে থানায় মামলা দায়ের করা। তৃতীয় কাজ হলো, পুড়ে যাওয়া এই প্রতিষ্ঠান পাহারা দেয়া, যাতে পুলিশ আসার আগে কেউ আলামত নষ্ট করতে না পারে। থামল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে শেপল এবং আহমদ নেবেজের মুখ। তারা বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। তারা ভেবে। পাচ্ছে না, তাদের যা করার কথা, যা বলার কথা, তা সেই বলছে। যেন সেই আমাদের নেতা। আমাদের করণীয় বলছে, পরামর্শ দিচ্ছে। যা করার কথা তাদের মাথায়ই আসেনি, সে কাজের কথাগুলো সে গড়গড় করে বলে গেল। কে এই লোক! শেপলরা তাকে শত্রু ভেবে গুলি করতে গেছে, তার সংগীকে গুলি করে আহত করেছে, হত্যাও করতে যাচ্ছিল। যে কারণে সেও শেপলদের একজনের দুহাত গুলিবদ্ধ করেছে। এসবের কোন ফয়সালা এখনও হয়নি। কিন্তু এসব কিছুই যেন তার মনে নেই। সে অযাচিতভাবে শেপলদের পরামর্শদাতা সেজেছে। কে এই অদ্ভুত লোক! ত্রিফার দুহাতে গুলি করা থেকে বুঝা গেছে সে সাংঘাতিক ক্ষিপ্র ও নিখুঁত লক্ষভেদি। আবার ধোঁয়ার রং দেখে বিষাক্ত গ্যাস চিহ্নিত করা এবং বিষাক্ত গ্যাস আক্রান্ত মানুষকে ওয়াটার থেরাপি দেয়া- এসব তার অসাধারণত্বের প্রমাণ। কে এই অসাধারণ মানুষ!
কিছু বলতে যাচ্ছিল শেপল।
সেখানে দ্রুত এল ইভা নারিন। আহমদ মুসাকে বলল, ত্রিফা বেদনায় কষ্ট পাচ্ছে।
আপনাকে যে ট্যাবলেট দিয়েছিলাম, সে ট্যাবলেট আমার ব্যাগে আরও আছে। সেখান থেকে একটা খাইয়ে দিন। আর আপনি কেমন আছেন? বলল আহমদ মুসা।
আমি ভালো আছি। আমার অভ্যাসও আছে। ঠিক আছে যাই। মিসেস ত্রিফাঁকে ট্যাবলেট খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি। বলল ইভা নারিন।
ইভা নারিন চলে গেল।
স্যার আপনারা কে? আপনাদের নাম পরিচয় জানা হয়নি। আমাদের চেয়ে আমাদের নিয়ে আপনাদের উদ্বেগই বেশি! আপনাদের পরিচয় জানতে পারলে আমরা খুশি হতাম।
এসব এখন থাক মিস শেপল। আমার পরামর্শের সাথে তোমরা একমত হলে কাজগুলো এখনই করা দরকার। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, এখনি থানায় লোক পাঠাচ্ছি। তারা থানায় মামলা দায়ের করে আসবে। পাহারার ব্যবস্থাও এখনি করছি। আমাদের সহকারী নিরাপত্তা প্রধান দারা দারিস্তান জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন। তাদের রেস্টের জন্যে তাদের বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর এসব ঘটনার সব বিষয় দিভিনের সরদারকে এখনি জানাতে হবে। স্যার, আপনাদের ব্যাপারে আমরা কি করতে পারি? আহমদ নেবেজ বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, মেজবান মেহমানদের কি ব্যবস্থা। করবেন, এটা মেহমানই বলে দেবে? বলল আহমদ মুসা।
দুই হাত জোড় করে বিব্রত কণ্ঠে শেপল বলল, ব্যাপারটা তা নয়। স্যার। আপনাদের পরবর্তী কোন প্রোগ্রাম আছে কিনা, এটা স্যার আমরা জানতে চাচ্ছি।
এখন রাত অনেক। তোমরা কোন আগম্ভককে এত রাতে রাস্তায় ছেড়ে দেবে, তা হতে দিতে পারি না। আমরা জোর করেই মেহমান সাজব, এটা আমরা ঠিক করে ফেলেছি। হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল শেপল ও আহমদ নেবেজ দুজনেরই। * বলল শেপল, ধন্যবাদ স্যার, আমরা আপনাদের মেহমান মনে করছি না। আপনারা এ পর্যন্ত যা করেছেন, তা কোন মেহমানের কাজ নয়, আপন জনেরে কাজ। চলুন স্যার, আমরা সরদারের ওখানে যাব। তিনিই সব ব্যবস্থা করবেন।
তোমাদের সরদার কে? কোথায় থাকেন? বলল আহমদ মুসা।
আমাদের সমাজ প্রধান মানে সরদার মোহাম্মদ আসতি আওয়াত। শেপল তার মেয়ে। বাড়ি দিভিন উপত্যকার মাঝামাঝি।
আহমদ মুসা শেপলের দিকে তাকাল। বলল, পিতার সরদারী গুণ তুমি পেয়েছ। পরিস্থিতি সামাল দিতে যা করেছ আমি তা লক্ষ করেছি।
কথা শেষ করেই তাকাল আহমদ মুসা ইভা নারিনের দিকে। স্বর একটু নামিয়ে বলল, মেহমান হওয়ার তো কোন বিকল্প নেই। আপনি কি ভাবছেন?
বড় একটা ঘটনা ঘটল। কয়েকজন লোক মারা গেছে, তাই শুধু নয়। হত্যা করা হয়েছে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে অত্যন্ত কৌশলে। যাতে সবাই বুঝে কোন কারণে আগুন লেগে বিরাট রকমের ক্ষতি হয়েছে, লোকও মারা। গেছে। দিভিনে যা ঘটছে, এটা তারই একটা ধারাবাহিকতা। এখান থেকেই আপনার কাজ শুরু হতে পারে।
আপনার কাজও তো এটাই। বলল আহমদ মুসা।
আমি তো আগারাক যাচ্ছি আমাদের একজন অফিসারের নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে। ইভা নারিন বলল।
সত্যের অর্ধেকটা বললেন। অন্য অর্ধেকটা বলুন। বলল আহমদ মুসা।
অস্পষ্ট এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ইভা নারিনের ঠোঁটে। বলল, হ্যাঁ, বাবা আমাকে আমাদের অফিসারের নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্তের সাথে সাথে দিভিন উপত্যকার ঘটনাবলির উপর নজর রাখতে বলেছেন। কিন্তু আপনি এটা জানলেন কি করে?
আপনার দিভিন পর্যন্ত আসা থেকেই আমি এটা বুঝেছি। আপনার ডিস্টিনেশন শুধু আগারাক হলে আপনি কিছুতেই এ পথে আসতেন না। আর আপনি যে ঘটনার তদন্তে আগারাক যাচ্ছেন, তার মূল তো দিভিনে। বলল আহমদ মুসা।
আপনার কথা সত্য। তবে মিশন যাকে বলে, সে রকম কিছু নিয়ে আমি আসিনি। আগারাক গিয়ে কি সিদ্ধান্ত হয় দেখতে হবে। ইভা নারিন বলল।
তাহলে আপনি আগারাক যাচ্ছেন। কিন্তু আমি এদের আতিথ্য গ্রহণ করেছি। আপনিও শামিল আছেন। যা ঘটেছে তার গুরুত্ব আপনিও জানেন। তাছাড়া আপনি আহত। আপনার ড্রাইভ করা ঠিক হবে না, বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায়, তাও আবার রাতে! বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ, ঘটনার প্রতি আমারও আগ্রহ আছে। আমি থেকে যাচ্ছি। কিন্তু ভাবছি, ওদের বিব্রত করা হবে না তো? ইভা নারিন বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, এটা ওদের ব্যাপার। জোর করেই তো আতিথ্য নিলাম, আমাদের গরজে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও ইভা নারিন কিছুটা নিচু স্বরে কথা বলছিল। আর শেপলরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল দারা দারিস্তান ও ত্রিফা বেফ্রিনকে পাঠানো, পাহারাদার ঠিক করা ও থানায় লোক পাঠানোর কাজে।
অল্পক্ষণ পর শেপলরা ফিরে এল। বলল শেপলই, এদিকের কাজ শেষ স্যার। আমরা এবার যেতে পারি।
তোমাদের গাড়ি আসবে, তারপর আহত ও অসুস্থদের নিয়ে যাবে। তাতে দেরি হবে। আমাদের গাড়ি করে ওদের নেয়া যায়। মাঝের সিটে শেপল মিসেস ত্রিফাঁকে নিয়ে বসবে, পেছনের সিটে আহমদ নেবেজ দারা দারিস্তানকে নিয়ে বসবে। অসুবিধা নেই। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। তবে আমাদের ত্রিফা আপা ইয়েরেভেন যেতে চাচ্ছেন। ইয়েরেভেনের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান। বলল শেপল।
আহমদ মুসা তাকাল শেপল ও আহমদ নেবেজের দিকে। একটু ভাবল আহমদ মুসা। বলল, কেন যেতে চান? তার দুহাতই আহত, কিন্তু কোনটাই বড় কিছু নয়। তার ইয়েরেভেন হাসপাতালে যাওয়া কি নিরাপদ হবে? তোমরা কি মনে কর? বলল আহমদ মুসা।
আপনারাও জানেন দেখছি স্যার। অনেক ধন্যবাদ। আমি ও আহমদ নেবেজ দুজনেই ইয়েরেভেন মেডিকেল কলেজে পড়ি। কলেজে আমরা যেতে পারি না। ইয়েরেভেনের হাসপাতাল, ক্লিনিক, এমনকি ঔষধের দোকানগুলোতেও আমরা অবাঞ্ছিত। প্রায় এক বছর ধরে ইয়েরেভেনের হাসপাতাল ক্লিনিকগুলো আমাদের জন্যে বলা যায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আমাদের দিভিনের নিরাপত্তা প্রধান মোহাম্মাদ বেহেজের স্ত্রী এবং দিভিনের একজন অ্যাকটিভিস্ট হিসাবে ত্রিফা আপা আরও বেশি। পরিচিত। সুতরাং ইয়েরেভেন তার জন্যে নিরাপদ নয়। বলল শেপল।
তাহলে এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কেন? বলল আহমদ মুসা।
ত্রিফা আপা টেলিফোনে কার সাথে যেন আলাপ করলেন। তার পরেই এই সিদ্ধান্ত নিলেন। আহমদ নেবেজ বলল।
মিসেস ত্রিফা বেফ্রিনের স্বামী মানে আপনাদের নিরাপত্তা প্রধান। মোহাম্মাদ বেহেজ কোথায়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
উনি সন্ধ্যার আগে নদী-বন্দরে গেছেন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে। রাতের মধ্যেই ফিরবেন। শেপল বলল।
অনেকক্ষণ ধরেই একটা চিন্তা উঁকি দিচ্ছিল আহমদ মুসার মনে। মিসেস ত্রিফা কি শেপল, আহমেদ নেবেজ এবং অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা? মিসেস ত্রিফা ইভা নারিন মানে আমাদের মেরে ফেলার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? এতটা বৈরিতার কিছু তো সেখানে ঘটেনি? মাত্র একটা সন্দেহ যে, আমরা আগুন লাগানোদের সাথের লোক কিনা! শুধু এজন্যেই কি কেউ এতটা মরিয়া হতে পারে মেরে ফেলার জন্যে! তার মানসিকতা যদি এটাই হয়, তাহলে সে ইয়েরেভেন হাসপাতালে যাওয়ার কথা নয়। অংক মিলছে না! কেন মিলছে না?
আহমদ নেবেজের কথা আহমদ মুসার কানে গিয়েছিল, কিন্তু উত্তর দেয়া হয়নি। সেই উত্তরটাই অবশেষে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল আহমদ মুসা, তাহলে আহমদ নেবেজ তুমি মিসেস ত্রিফাঁকে বল যে, মোহাম্মাদ বেহেজ ফিরে না আসা পর্যন্ত তার ইয়েরেভেন হাসপাতালে যাওয়ার বিষয়টা চূড়ান্ত করা যাবে না।
ঠিক আছে স্যার, আমি তার সাথে কথা বলি।
বলেই আহমদ নেবেজ ছুটল মিসেস ত্রিফার দিকে। ব্যান্ডেজ শেষ হবার পরেই গাড়ির কাছ থেকে সরে গিয়ে একটু দূরে মোবাইল নিয়ে সে বসেছিল। তার সাথে কথা বলল আহমদ নেবেজ।
মিনিট দুই পরেই ফিরে এল আহমদ নেবেজ। তার মনটা খারাপ। আহমদ মুসা প্রশ্ন করতেই সে বলল, না স্যার, রাজি হলেন না। হাসপাতালেই যাচ্ছেন। হাসপাতালের সাথে কথা হয়েছে। উনি হাসপাতালেই যাবেন স্যার। উনি আমাদের নিরাপত্তা প্রধান মোহাম্মাদ বেহেজের সাথেও কথা বলেছেন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, এরপর আর কোন কথা থাকতে পারে। উনি কি এখনি যাচ্ছেন? গাড়ি রেডি। এখনি বেরুচ্ছেন তারা। বলল আহমদ নেবেজ।
ঠিক আছে। এখন মাঝের সিটে উঠবে শেপল ইভা নারিনের সাথে আর তুমি দারা দারিস্তানকে নিয়ে পেছনের সিটে বস। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার বলল আহমদ মুসা, যাওয়ার আগে আহমদ নেবেজ একটু দেখে নাও পাহারাদাররা তাদের দায়িত্ব নিয়েছে কিনা? থানায় যাদের পাঠিয়েছ তাদের খবর কিছু আছে কিনা। আর পাহারাদারদের ভালো করে বলে যাও পুলিশ আসার আগে অগ্নিদগ্ধ স্থানে। কোথাও যেন কেউ প্রবেশ না করে।
ঠিক আছে স্যার। সব খবর আমি নিচ্ছি। আর পাহারাদারদের দায়িত্ব। নিয়েছেন আমাদের এই ক্যুনিটি কমপ্লেক্সের পরিচালক জনাব বারজানি। তাঁকেই বিষয়টা বুঝিয়ে আসছি।
চলে গেল আহমদ নেবেজ কথা শেষ করেই।
সবাইকে নিয়ে আহমদ মুসাদের গাড়ি তখন যাত্রা শুরু করেছে।
গাড়ির পেছনে মোবাইল বেজে উঠল।
আহমদ নেবেজের মোবাইল।
আহমদ মুসার দৃষ্টি সামনে, মনোযোগও সামনে, ভাবনাও সামনের সময়কে নিয়ে।
টেলিফোনে আহমদ নেবেজের কথা আর তার কানে যায়নি।
কথা শেষ হয়ে গেছে আহমদ নেবেজের।
কল অফ করেই সে বলে উঠল, স্যার, একটা সুসংবাদ। ত্রিফা আপা ইয়েরেভেনের হাসপাতালে যাচ্ছেন না।
শুনেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, কেন? কোন কিছু ঘটেনি তো?
না কিছু ঘটেনি। উনি মত পাল্টেছেন। আহমদ নেবেজ বলল।
আহমদ মুসার মনে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। বলল, আহমদ নেবেজ, তোমাদের মোহাম্মাদ বেহেজ দিভিনের নিরাপত্তা প্রধান, তোমাদের ত্রিফা আপাও নিশ্চয় একজন অ্যাকটিভিস্ট?
না স্যার, ত্রিফা আপা শান্তশিষ্ট স্বভাবের, চুপচাপ থাকতেই ভালোবাসেন। তবে তিনি সব প্রোগ্রামে যান। সব কাজে উপস্থিত থাকেন।
তিনি অ্যাকটিভিস্ট না হলে তার হাতে রিভলবার ও পয়জন বম্ব এল, কি করে? গুলি ছোঁড়ায় তার ভালো হাত আছে। তাকে খুব সাহসী ও বেপরোয়া মনে হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
সেটা তো আমরাও ভাবছি স্যার। হঠাৎ উনি একি করলেন? সত্যিকারের রিভলবার বোমা তার কাছে থাকবে, এটা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। শেপল বলল।
থাক এসব কথা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, তিনি দিভিনের নিরাপত্তা প্রধানের স্ত্রী। আকস্মিক সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি তার থাকতে পারে।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, আর কত দূরে তোমাদের বাড়ি শেপল?
এসে গেছি স্যার। আর অল্প পথ।
একটু থেমেই শেপল বলল, স্যার, একটা কথা বলা হয়নি আপনাকে। আজ সন্ধ্যায় আমার আম্মা মারা গেছেন। গম্ভীর, ভারি কণ্ঠ শেপলের।
তোমার মা মানে সরদারের স্ত্রী মারা গেছেন? বলল, আহমদ মুসা। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই আবার বলে উঠল আহমদ মুসা, দাফন হয়েছে?
না স্যার, দাফন হয়নি। মৃত্যুটা খুব স্বাভাবিক নয়। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এ নিয়েই আলোচনা চলছিল, এরই মধ্যে আগুন লাগার খবর পাওয়া যায়। আমরা এদিকে ছুটে আসি। শেপল বলল।
বুঝলাম। মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় মানে অস্বাভাবিক। সেটা কি? বলল আহমদ মুসা।
শেপল তার অসুস্থতা ও ঔষধ না পাওয়ার বিষয় জানিয়ে বলল, মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্যে ১২ ঘন্টার মধ্যে যে ঔষধের দরকার ছিল, তা দিভিনে ছিল না, অন্য কেউ আমাদের কাছে বিক্রি করতেও চায়নি।
স্যরি। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। এই অবস্থার মধ্যে আমরা যাচ্ছি। তোমাদের বাড়িতে। খুবই খারাপ লাগছে। বলল আহমদ মুসা।
খারাপ বোধ করার প্রয়োজন নেই স্যার। এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা দিভিনে এতই ঘটেছে এবং ঘটছে যে, দিভিবাসীদের কাছে সব মর্মান্তিক ঘটনাই আজ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বলল শেপল। ভারি কণ্ঠ। তার।
শেপল থামতেই আহমদ নেবেজ বলল, স্যার, গাড়িটা ডাইনের লেনটায় নিতে হবে। ডান দিকে সামনের টিলাটায় শেপলদের বাড়ি। ডানের লেনটাই টিলায় উঠে গেছে।
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।
আহমদ মুসা এবং সবার দৃষ্টি এখন সামনে, শেপলদের বাড়ির দিকে।
.
রাতে লাশ দাফন হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে সকালে লাশ দাফন করা হবে, দিভিন প্রধান মোহাম্মদ আসতি আওয়াতের স্ত্রীর।
স্ত্রীর লাশ যে ঘরে রাখা আছে তার দরজার সামনেই বসে আছে। মোহাম্মদ আসতি আওয়াত।
বাইরের উঠানের শেষ প্রান্তে যে উন্মুক্ত বৈঠকখানা সেখানে বসে আট দশজন লোক।
তাদের মধ্যে আহমদ নেবেজও রয়েছে। তারাও সারারাত থাকবে মাইয়েতের বাড়িতে।
বাইরের দিক থেকে এসে ছেলে এরদেলান মোহাম্মদ তার পিতা মোহাম্মদ আসতি আওয়াতের পাশে বসল। বলল, বাবা আমি তো আছিই, আপনি একটু গিয়ে রেস্ট নিন।
রেস্ট নেয়ার সময় অনেক পাওয়া যাবে বেটা, এই রাত তো আর আসবে না। বলল মোহাম্মদ আসতি আওয়াত।
সজল হয়ে উঠেছে এরদেলান মোহাম্মদের দুই চোখ। উত্তরে কিছু বলল না সে।
শেপল তার ঘরের দিক থেকে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল বসে থাকা পিতা ও ভাইয়ের সামনে।
মোহাম্মদ আসতি আওয়াত হাতঘড়ির দিকে তাকাল। রাত তিনটা তখন। বলল সে, মা শেপল ঘুমাওনি? আবার উঠে এলে কেন?।
বাবা ঘুম ধরছে না। ভাবলাম, মায়ের পাশে বসে একটু কুরআন শরিফ পড়ি। শেপল বলল।
বস মা। মেহমানদের শোবার কি ব্যবস্থা করেছ? জিজ্ঞাসা করতে চেয়ে ভুলেই গেছি। বলল মোহাম্মদ আসতি আওয়াত।
শেপল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ভাইয়ের পাশে বসল। বলল, আমাদের বাইরের মেহমানখানার দুটো রুম তাঁদের দিয়েছি বাবা।
আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তারা স্বামী স্ত্রী কি না? বলল আসতি আওয়াত।
আমিও জানি না বাবা, জিজ্ঞাসা করিনি। তবে স্যার বলেছিলেন, তোমার ম্যাডাম ইভা নারিনের জন্যে আলাদা একটা রুমের ব্যবস্থা কর। আমি যেকোন জায়গায় থাকতে পারব। শেপল বলল।
তোমার স্যারের নাম কি? নানা ঘটনায় আজ মনটা এতই বিক্ষিপ্ত যে, তার সাথে ভালো করে আলাপও করতে পারলাম না। নাম জিজ্ঞাসার কথাও মনে ছিল না। বলল আসতি আওয়াত।
স্যরি বাবা, নাম জিজ্ঞাসা করার তেমন সুযোগ আমরাও পাইনি। দুএকবার পরিচয় জানতে চেয়েছি। উনি বলেছেন, পরিচয় জানার সুযোগ অনেক পাবে, এসময়ের কাজগুলো করার সুযোগ সামনে আর আসবে না। আমরা আর কিছু বলতে পারিনি। শেপল বলল।
আমিও আশ্চর্য হয়েছি মা। খুব ভদ্র, শান্ত ও বিনয়ী লোকটি কিন্তু কথা যা বলে, করণীয় সম্পর্কে যে পরামর্শ দেয়, তা অনড় ও নির্দেশের শক্তিশালী মনে হয়। লোকটি কে? বলল আসতি আওয়াত।
সত্যি বাবা, অদ্ভুত তার কথার শক্তি।
ত্রিফা আপার গুলিতে ম্যাডাম ইভা নারিন আহত হওয়া, ত্রিফা আপা দ্বিতীয় গুলি করে ইভা নারিন ম্যাডামকে হত্যা করতে চেষ্টা করা, স্যার গুলি করে ত্রিফা আপার দুই হাত আহত করা, তারপর যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ঘটতে যাচ্ছিল- সেটাকে স্যার কয়েকটা কথা বলে থামিয়ে দেন। তাঁর কথার অদ্ভুত শক্তি ও প্রভাবের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এরপর পরিস্থিতি তিনি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন এবং তিনি আমাদের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আমরা সবাই বিনা দ্বিধায় তার নির্দেশ-পরামর্শ মেনে চলেছি। মনে হয়েছে তিনি বন্ধু বা সাহায্যকারীর চেয়েও বড় কিছু। এ নিয়ে আমার বিস্ময় এখনও কমেনি বাবা। শেপুল বলল।
বাবা, নিশ্চয় আপনি খেয়াল করেছেন, আমাদের সাথে কথা বলার সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক ষড়যন্ত্রের উত্থান পর্ব থাকে। এক পর্যায়ে কোন ঘটনার প্রবল ধাক্কায় সে ষড়যন্ত্রের পতন পর্ব শুরু হয়। আজকের ঘটনা সেরকমই কিছু হতে পারে। তার একথার মধ্যে শুধু আমাদের জন্যে সান্ত্বনা নয়, তার তরফ থেকে একটা প্রতিশ্রুতিও আছে। এ থেকে তার কি পরিচয়, তা আমাদের কাছে খুব বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বলল এরদেলান মোহাম্মদ।
এরদেলান মোহাম্মদের কথা শেষ হতেই শেপল বলে উঠল দ্রুত কণ্ঠে, হ্যাঁ ভাইয়া, কথাটা আমিও খেয়াল করেছি। তোমার কথা ঠিক। তুমি বুদ্ধিজীবী বলেই কথাটার তুমি ভেতরের অর্থও বের করেছ, আমি পারিনি। শেপল বলল।
তার মানে তোমরা বলতে চাচ্ছ, তিনি বা তারা দিভিনের পক্ষের? কিন্তু কে তারা? কি করবেন তারা? এর আগে পুলিশ, গোয়েন্দা, কিংবা বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষী যারাই দিভিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তারাই নিহত হয়েছেন। সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা নয়। বলল আসতি আওয়াত।
আসতি আওয়াতের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই একসাথে কয়েকটা স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারের শব্দ হলো। শব্দ শেষ হবার পরেই একটা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, য়ে আমাদের বাধা দেবে, যে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে, তাকেই ঝাঁঝরা করে দেবে আমাদের গুলির ঝাঁক। বাঁচতে চাইলে যে দুজন লোক এখানে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের আমাদের হাতে তুলে। দাও আমরা চলে যাব।
আসতি আওয়াতরা তিনজনই উঠে দাঁড়িয়েছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তারা নির্বাক। শেপল একটু এগিয়ে উঁকি মেরে দেখল, তাদের উঠানের বিভিন্ন স্থানে মুখোশধারীরা স্টেনগান হাতে পজিশন নিয়েছে। কয়েকজন স্টেনগানধারী বৈঠকখানার লোকদের ঘিরে রেখেছে। শেপল ফিরে এসে আসতি আওয়াতদের সবটা জানিয়ে বলল, বাবা ওদের কথার কি জবাব দেবে?
আমরা কি জবাব দেব। মেহমানদের কেমন করে আমরা ওদের হাতে তুলে দেব। আমরা তা পারব না। যা ঘটার তাই ঘটবে। বলল আসতি আওয়াত।
বলেই আসতি আওয়াত এরদেলানকে বলল, হ্যান্ড মাইক্রোফোনটা নিয়ে এস।
এরদেলান দৌড় দিয়ে গিয়ে মাইক্রোফোনটা নিয়ে এল। আসতি আওয়াত মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বারান্দার আর একটু সামনে এগিয়ে মাইক্রোফোন মুখে তুলে উচ্চঃস্বরে বলল, তোমরা কে জানি না, তোমরা আমাদের মেহমানকে কেন চাও তাও জানি না, কিন্তু আমরা বলে দিচ্ছি, আমাদের মেহমানকে কোন অবস্থাতেই কারও হাতে আমরা তুলে দেব না।
এ কথার সঙ্গে সঙ্গে উঠান থেকে সেই কণ্ঠ আবার চিৎকার করে উঠল, আমরা যা বলি তা করি। এখন থেকে দশ পর্যন্ত গুনার মধ্যে যদি দুজনকে আমাদের হাতে তুলে না দেয়া হয়, তাহলে এখানে আটকে থাকা দশজনের মধ্যে থেকে প্রতি মিনিটে একজনকে হত্যা করা হবে।
কথা শেষ করেই লোকটি উচ্চঃস্বরে গুনা শুরু করল।
শেপল, এরদেলানরা আতংকিত হয়ে পড়ল। গম্ভীর আসতি, আওয়াত।
বাবা, এখন কি হবে? আমি মনে করি, ওরা যা বলেছে তা করবে। বলল শেপল শুকনো, ভয়ার্ত কণ্ঠে।
আমরা কি মেহমানদের ওদের হাতে তুলে দেব? না, তা হবে না। যা হয় হবে, আল্লাহ ভরসা।
এক গুনা শেষ হতেই বাড়ির পুবের অংশ থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল। বলল সে, তোমরা যে দুজনকে হাতে পেতে চাচ্ছ আমি তার একজন। তোমাদের দাবি মেনে আমি তোমাদের কাছে আসছি দুই শর্তে। এক, বাড়ির বিভিন্ন স্থানে মোতায়েনকৃত তোমাদের সব লোককে তোমার ওখানে সরিয়ে নাও, দুই. বৈঠকখানায় আটকে রাখা দশজনকে মুক্তি দিয়ে তাদেরকে এদিকে আসতে দাও। ওরা বাড়ির বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছবে, আমিও তোমাদের কাছে পৌঁছব।
আহমদ মুসা কথা শেষ করল। শান্ত-স্থির তার কণ্ঠ। আমরা তোমার শর্ত মানছি। কিন্তু তুমি একা আসলে হবে না, তোমার। সাথেরজনকেও নিয়ে আসতে হবে। বলল উচ্চঃস্বরে সেই কণ্ঠই।
দ্বিতীয়জন মহিলা, অসুস্থ। তারপরেও তোমরা জোর করলে ওরা দশজন এসে নিরাপদ হবার পর সে যাবে। চিন্তা কি! আমি তো তোমাদের হাতেই থাকছি। বলল আহমদ মুসা। তার সেই শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠ।
ঠিক আছে, আমরা মেনে নিলাম। কিন্তু ওরা দশজন ভেতরে প্রবেশের পরই তাকে আসতে হবে। আমরা এদের ছেড়ে দিচ্ছি, তুমি এস। সেই লোকটি বলল চিৎকার করেই।
এতক্ষণে উদ্বেগ-আতংকে আসতি আওয়াতের মুখ ছেয়ে গেছে। বলল, আমরা মেহমানদের রক্ষা করতে পারলাম না।
বলেই আসতি আওয়াত মাইক্রোফোন মুখে তুলে নিল। বলল সে, আমি সম্মানিত মেহমানকে বলছি। আমরা সন্ত্রাসীদের কোন দাবিই মেনে নেব না। এতে যে পরিণতি হয় হোক, একসাথেই তা আমরা বরণ করব। প্লিজ মেহমান, আমরা অনেক কষ্টে আছি, কষ্ট দয়া করে আর বাড়াবেন না। প্লিজ! দৃঢ় কণ্ঠে কথা শুরু করেছিল আসতি আওয়াত, কিন্তু শেষে কণ্ঠটা তার কান্নায় ভেঙে পড়ল।
শেপল ও এরদেলানের চোখ থেকেও অশ্রু গড়িয়ে এল।
দিভিনের সম্মানিত প্রধান আসতি আওয়াত, নিজেদের ইচ্ছায় ভেবে চিন্তেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্লিজ, বাধা দেবেন না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। জীবন-মৃত্যুর মালিক তিনি।
কথা বলার সাথে সাথে আহমদ মুসা চলতেও শুরু করেছে।
আসতি আওয়াত, শেপল, এরদেলান এগিয়ে তাদের বারান্দার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা দেখল আহমদ মুসা ধীরপায়ে শান্তভাবে এগিয়ে। যাচ্ছে। চত্বরের মাঝখানে খুঁটিতে টাঙানো গ্যাস বাতির আলো আহমদ মুসার মুখে গিয়ে পড়েছে। মুখ একেবারেই শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন। এরদেলান বলল, বাবা আমাদের মেহমানকে দেখ, আমরা উদ্বিগ্ন, আতংকিত, কিন্তু উনি দেখ একদম নিশ্চিন্ত। ভয়-উদ্বেগের চিহ্ন তার চোখে-মুখে নেই।
কি ঘটতে যাচ্ছে, আমার বুক কাঁপছে। স্যার কি কিছুই বুঝতে পারছেন না? না তিনি অবস্থার কাছে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন! বলল শেপল।
আগুন লাগার ওখানে তিনি যে কাজ করেছেন, এখনও সেই কাজই তিনি করতে যাচ্ছেন। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কিছু মানুষকে বাঁচাতে যাচ্ছেন। এমন মানুষ দুনিয়াতে খুব কম আছে। জানা হলো না কে তিনি! আসতি আওয়াত বলল। তার শেষের কথাগুলো কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা যেমন ওদের কাছে যাচ্ছে, তেমনি শেপলরা দেখল যে দশজন আহমদ মুসা যে মেহমানখানা থেকে বেরিয়েছে, সেই মেহমানখানার দিকে একসাথে আসছে। ওদের দশজনের সামনে হাঁটছিল আহমদ নেবেজ।
মাঝপথে আহমদ মুসার সাথে তাদের দেখা হয়ে গেল। আহমদ নেবেজ কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, স্যার এ কি করলেন? আপনার বিনিময়ে আমরা বাঁচতে চাই না স্যার।
আহমদ নেবেজ দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার সাথে অন্যেরাও।
আহমদ নেবেজ, অশ্রু মুছে ফেল। বিপদের সময় কাঁদার অর্থ মরার আগে মরে যাওয়া। যা এখন ঘটছে তা ঘটতে দাও। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। যাও। নির্দেশের স্বরে বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ গম্ভীর, বলিষ্ঠ।
আহমদ নেবেজ চোখ মুছে মাথা নিচু করে আবার হাঁটতে শুরু করল।
অদ্ভুত, অদ্ভুত! এমন কথা, এমন কণ্ঠ কখনও কোথাও শুনিনি। কথায়। যেন যাদু আছে। মনে হচ্ছে, শক্তি, সাহস কোত্থেকে আমার মধ্যে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আল্লাহ আমাদের এই ভাইটিকে রক্ষা করুন। অনেকটা শান্ত ও স্বগত কণ্ঠে বলল আসতি আওয়াত।
শেপল, এরদেলান দুজনেই বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। শেপলের স্বগত কণ্ঠ বলল, বাবা, শুরু থেকেই তাঁকে নেতার ভূমিকায় দেখছি। এখনও তিনি নেতার মতই নির্দেশ দিলেন। জানা হলো না বাবা এই বিস্ময়কর মানুষটির নাম-পরিচয়। শেপলের শেষের কথাগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ল।
উনি কাঁদতে নিষেধ করেছেন শেপল। বলল এরদেলান মোহাম্মদ। তার কণ্ঠ ভারি।
উনি মরার আগে মরতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু আমরা তো মরেই গেছি ভাইয়া। শেপল বলল কান্নাজড়িত কণ্ঠে।
সন্ত্রাসীরা বৈঠকখানার সামনে এসে সবাই জমা হয়েছিল। তাদের স্টেনগান উদ্যত আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা হাঁটছিল ওদের লক্ষে।
আহমদ মুসা তখন চত্বরের মাঝামাঝি পৌঁছেছে। ওরা তখনও আহমদ মুসা থেকে পঁচিশ তিরিশ ফিট দূরে।
আহমদ মুসা চত্বরের মাঝামাঝি পৌঁছতেই ওদের মধ্যে থেকে সেই আগের লোকটি নির্দেশের স্বরে বলে উঠল, তুমি ওখানেই দাঁড়াও। তোমাকে সার্চ করা হবে, তারপর তুমি আসবে। তুমি দুহাত উপরে তোল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা, দুহাত উপরে তুলল। তবে দুকানের উপরে নয়। দুহাত তার দুকানের পেছন বরাবর গিয়ে স্থির হলো।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে দুহাত উপরে তুলতেই ওদের মধ্যে থেকে একজন স্টেনগাধারী আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এল তাকে সার্চ করার জন্যে।
স্টেনগানধারী আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল। হাতের স্টেনগানটা কাঁধে ঝুলিয়ে দুহাত মুক্ত করে সার্চ করা শুরু করতে গেল। লোকটি আহমদ মুসার কাঁধ থেকে।
চোখের পলকে আহমদ মুসার দুহাত নেমে এল এবং লোকটিকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে চেপে ধরল বুকের সাথে। তার সাথে সাথেই আহমদ মুসার ডান হাত মাথার পেছনে গিয়ে জ্যাকেটের নিচে আটকানো অটো হ্যান্ড মেশিন রিভলবার বের করে নিল এবং ডান হাতটা দ্রুত সামনে এনেই ফায়ার শুরু করল।
সন্ত্রাসী ওরাও সবই দেখতে পেয়েছিল। তাদের স্টেনগানও উঠে এসেছিল আহমদ মুসার লক্ষে। কিন্তু গুলি করতে পারেনি। গুলি করলে তা আহমদ মুসাকে নয়, তাদের আজকের দলপতির দেহকেই ঝাঁঝরা করে দেবে। তাদের এই দ্বিধার সুযোগ আহমদ মুসা গ্রহণ করলো। তার অটো হ্যান্ড মেশিন রিভলবারের গুলির বৃষ্টি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এক ঝাঁক সন্ত্রাসীকে মাটিতে শুইয়ে দিল লাশ বানিয়ে। আর যার কণ্ঠনালিকে বাম হাত দিয়ে সাঁড়াশির মত পেঁচিয়ে ধরেছিল, সেও লাশ হয়ে ঝুলে পড়েছে আহমদ মুসার হাতে। বাঁ হাত সরিয়ে নল। চত্বরের উপর ঝরে পড়ল লোকটির লাশ।
ইভা নারিন এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। তার পেছনে এল আহমদ নেবেজরা। আসতি আওয়াত এবং শেপলরাও ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে।
সবার বিস্ময় দৃষ্টি লাশের স্তূপের দিকে আর আহমদ মুসার দিকে। তাদের সামনে ভোজবাজির মত ঘটে গেল ঘটনা। মুহূর্তেই। আক্রমণকারীরা হলো আক্রান্ত আর অসহায় আক্রান্ত উঠে এল আক্রমণকারীর ভূমিকায়। একজন মানুষ এক ঝাঁক অস্ত্রধারীর সামনে এসে এই অঘটন ঘটাল! কে এই মানুষ!
আসতি আওয়াত এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, আমরা আপনাকে বুঝতে পারিনি। আপনি আমাদের সব চিন্তা ও বিবেচনাকে হার মানিয়েছেন। আপনি কে জানি না। কিন্তু দিভিনকে আজ নতুন কিছু শিখালেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, খোশ আমদেদ আপনাকে।
জনাব, এসব কথা বলার সময় এটা নয়। জরুরি কিছু করণীয়। আছে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে মোহাম্মদ আসতি আওয়াত বলল, কি সেই জরুরি বিষয়টা?
প্রথম বিষয় হলো, নিহতরা যে যেমন আছে, পুলিশ আসা পর্যন্ত সেভাবেই থাকবে। তাদের অস্ত্রেও হাত দেয়া যাবে না। দ্বিতীয় বিষয়। হলো, এই মুহূর্তে পুলিশ স্টেশনে লোক পাঠান। অভিযোগে বলুন, একদল অজ্ঞাত লোক আক্রমণ করেছিল, সংঘর্ষে তাদের সবাই মারা পড়েছে।
বলেই আহমদ মুসা তাকাল ইভা নারিনের দিকে। ইভা নারিন মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে, ধন্যবাদ।
আসতি, আওয়াত খিবাত খলিলকে ডেকে বলল, তুমি কয়েকজনকে। সাথে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে যাও।
খেবাত খলিল স্থানীয় সরকারের অধীন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য। মধ্যবয়সী মানুষ। থানা, পুলিশ, সরকারি অফিস মহলে তার যাতায়াত আছে।
আমি যাচ্ছি জনাব। আমাদের আরও লোকজনদের খবর পাঠান। তারা আসুক। সন্ধ্যা থেকে দুইটা বড় ঘটনা ঘটল। আর ঘটবে না বলা যায় না। বলল খিবাত খলিল।
ঠিক আছি আমি দেখছি। তোমরা যাও। আসতি আওয়াত বলল। খেবাত খলিল আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে দ্রুত চলে গেল।
দিভিন প্রধান আসতি আওয়াত আহমদ মুসা ও ইভা নারিনের দিকে চেয়ে বলল, প্লিজ চলুন ঐ আটচালা টঙটায় আমরা বসি।
হাঁটা শুরু করল আসতি আওয়াত।
তার সাথে আহমদ মুসা ও ইভা নারিনও হাঁটতে লাগল। অন্যরাও।
আটচালা টঙঘরে গেল আসতি, আওয়াত ও অন্যরা। ঘরটা অনেক বড়। উপরে সিমেন্ট-পাথরের ঢালাই ছাদ। চারপাশ উন্মুক্ত। তবে প্রয়োজন হলে তাঁবুর মত চারদিক ঘেরার ব্যবস্থাও আছে। ফোল্ডিং চেয়ার পাতা রয়েছে ফ্লোরে। সামনে কয়েকটা বড় হাতাওয়ালা চেয়ার।
আসতি আওয়াত সামনের চেয়ারগুলোর দুটিতে বসাল আহমদ মুসা। ও ইভা নারিনকে বসাল। নিজে একটাতে বসল। অন্যেরা কেউ বসল। টঙঘরে, কেউ কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। সবাই গ্রুপ গ্রুপ হয়ে গল্প করছে।
আহমদ মুসাদের সামনে তিনটি ফোল্ডিং চেয়ারে বসেছে এরদেলান, আহমদ নেবেজ ও শেপল।
বসেই ইভা নারিন বলল ফিস ফিসেকণ্ঠে আহমদ মুসাকে, আমাদের। যারা পথে অনুসরণ করে এসেছে এবং এখানে কাজে বাধা দিয়েছে, হত্যার চেষ্টা করেছে, এরা কি তারা হতে পারে?
আমাদেরকে লোকেট করবার জন্যে তাদের যে অবলম্বন ছিল, সেটা নেই। আমি মনে করি এরা তারা নয়। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে এরা কারা? যারা আগুন দিয়েছে তারাই কি এরা? ইভা নারিন। বলল।
এটা হতে পারে। কিন্তু তারা আমাদের ব্যাপারে এতটা মরিয়া হওয়ার কারণ?
কথাটা বলেই আহমদ মুসার মনে পড়ল ত্রিফা বেফ্রিনের কথা। সে ইভা নারিনকে হত্যার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? দুই ঘটনা কি কাকতালীয়? না…!
আপনার প্রশ্নটা আমারও প্রশ্ন! এমন মরিয়া হওয়ার কারণ কি? ইভা নারিন বলল।
আরেকজন মানে ত্রিফা বেফ্রিনও আপনাকে হত্যার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বলল আহমদ মুসা।
আপনিও বিষয়টা তাহলে খেয়াল করেছেন? এ ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও দুর্বোধ্য। ইভা নারিন বলল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই মোহাম্মদ আসতি আওয়াত বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, জনাব শেপল আমাকে সব বলেছে। আগুন লাগার ঐ স্থান থেকে এখন পর্যন্ত বিস্ময়কর যেসব ঘটনা আপনি ঘটিয়েছেন, আমরা আপনাকে জানি না, আপনিও আমাদের জানার কথা নয়। তারপরও গতরাত থেকে সব কাজের দায়িত্ব আপনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন, আজ আরও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। ওরা আপনাদের ধরতে এসেছিল কেন? কে তারা? গতকালের আগুন লাগার ঘটনার সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে কিনা? আপনারা এ বাড়িতে আছেন, এমনকি কোন্ কোন্ ঘরে আছেন, তাও ওরা জানল কি করে? এসব প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে তুলেছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো আপনি কে? আপনারা কে? প্লিজ আমাদের অন্ধকারে রাখবেন না।
সংগে সংগে আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না। একটু ভাবল। মনে মনে বলল, সত্যি ওদের কিছু বলার সময় এসেছে। সামনে এগোতে হলে ওদের সাহায্য দরকার। এই চিন্তা করে আহমদ মুসা আহমদ নেবেজকে লক্ষ করে বলল, সামনে তোমার লোকজন যারা ঘুরাফেরা করছে, তাদেরকে বাড়ির চারদিকে একটু নজর রাখতে বল। পুলিশ আসার আগে আমাদের সাবধান থাকা দরকার।
আহমদ নেবেজ আহমদ মুসার কথাটার অর্থ বুঝল। সে দ্রুত উঠে গিয়ে সরদার আসতি আওয়াতের বরাত দিয়ে ওদের বাড়ির চারদিকে নজর রাখার জন্যে কয়েকজন লোককে পাঠিয়ে দিল।
ফিরে এল আহমদ নেবেজ তার আসনে।
ধন্যবাদ আহমদ নেবেজ। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার শুরু করল, আমি আপনাদের একজন ভাই। বাইরের কোন এক দেশ থেকে এসেছি। দিভিন উপত্যকার ঘটনাবলি সম্পর্কে আমি মোটামুটি জানি। আরও জানার জন্যে দিভিনে এসেছি। আমার পরিচয় সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন এখন নেই।
থামল আহমদ মুসা। বলল ইভা নারিনের দিকে তাকিয়ে, ইভা নারিন, প্লিজ আপনার পরিচয়টা দিন।
আমিও একটা সংস্থার পক্ষ থেকে দিভিন সংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে কাজ করছি। ইয়েরেভেনে আমার বাড়ি। একটা সুযোগে আপনাদের এই অতিথির সাথে দিভিনে এসেছি। বলল ইভা নারিন।
ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের।
একটু থামল আসতি আওয়াত। বড় একটা নিশ্বাস ফেলল যেন সে। বলল, আমাদের বিষয়টা দেখার জন্যে যে আপনারা এসেছেন সেজন্যে আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আমাদের সামনে হতাশার। অন্ধকারই শুধু, কোন আলো নেই। আমরা খুব খুশি হয়েছি।
আসতি আওয়াত আবারও একটু থেমে পুনরায় শুরু করল, আমাদের। সম্মানিত অতিথির নাম কি আমরা জানতে পারি না?
আমাকে আহমদ আব্দুল্লাহ বলে ডাকবেন। হেসে বলল আহমদ মুসা।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার কপালে সিজদার চিহ্ন দেখে আগেই বুঝেছিলাম আপনি মুসলিম। আপনি আপনাকে ডাকার জন্যে একটা নাম দিলেন। এটা তাহলে কি আপনার নাম নয়? আসতি আওয়াত বলল।
দুঃখিত জনাব। নানা কারণে আমি নামটা এখন বলব না। এক সময় সবই জানতে পারবেন। হয়তো নামটা তার আগে প্রকাশও হয়ে পড়তে পারে। শত্রুরা নামটা ইতিমধ্যে জেনেও ফেলতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
থাক বাবা। নামটা প্রকাশ না হওয়ার মধ্যেই হয়তো কল্যাণ আছে। নামটা খুবই পরিচিত বা খুবই গুরুত্বপূর্ণ না হলে তা নিশ্চয় লুকাবার দরকার হতো না। শেপল বলল।
ঠিক বলেছ মা। কথা শেষ করেই আহমদ মুসার দিকে চেয়ে আসতি আওয়াত বলল, আপনাদের শত্রু কারা?
এখনও মনে হচ্ছে আপনাদের শত্রু যারা, তারাই আমাদের শত্রু। বলল আহমদ মুসা।
আপনারা রাতেই মাত্র এলেন। আমাদের শত্রুরা আপনাদের শত্রু বানাবার সময় পেল কখন? কেন শত্রু বানাবে? আর আমাদের চেয়ে বড় শত্রু তাদের কাছে আপনারা হলেন কি করে? শেপল বলল।
আরও প্রশ্ন আছে শেপল, আমরা যে তোমাদের বাড়িতে আছি এবং ঐ দুই ঘরে আছি তা তারা জানতে পারল কি করে? বলল আহমদ মুসা।
অপার বিস্ময়ের ছায়া নামল আসতি আওয়াত, শেপল, এরদেলান ও আহমদ নেবেজদের চোখে-মুখে।
ঠিক বলেছেন, এটা তো আরও বিস্ময়ের! কোন্ দুই ঘরে আপনারা শোবেন, শোবার আগের সিদ্ধান্ত বাইরের কেউ এটা জানার কথা নয়। কিন্তু দূরের শত্রুরাও তা জানল কি করে? আসতি আওয়াত বলল।
কাছেও শত্রু থাকতে পারে জনাব। বলল আহমদ মুসা।
আসতি আওয়াত নড়ে-চড়ে বসল। চমকে উঠল শেপলরা।
কাছেও শত্রু মানে আমাদের মধ্যে কেউ এ রকম আছে? আপনি কি এটা মনে করেন? আসতি আওয়াত বলল।
বিদ্যুৎ চমকের মত ত্রিফা বেফ্রিনের চেহারা আহমদ মুসার মনে ঝিলিক দিয়ে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। বলল আহমদ মুসা, আপনাদের কেউ আছে বা নেই কোনটাই আমি এখন বলতে পারবো না। তবে শত্রুর কাছে ইনফরমেশন গেছে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
আসতি আওয়াত, শেপলদের মুখ ম্লান হয়ে গেল। বলল আসুতি আওয়াত, ইনফরমেশন যখন গেছে, তখন কেউ পাঠিয়েছে। কে সে? আমি খুব উদ্বেগ বোধ করছি। ভেতরে শত্রু থাকলে তো আরও অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে।
কে সে, এটা জানার জন্যে আরও সময় প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে সাবধান থাকা দরকার। কিছুক্ষণ আগে যা ঘটল, তা শেষ আঘাত নয়। আমি ওদের যতটুকু জানি, তাতে আমার কাছে এটাই মনে হচ্ছে। বলল আহমদ মুসা।
আসতি আওয়াতের চোখ-মুখ উদ্বেগে ছেয়ে গেছে। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, কিন্তু বলা হলো না। পুলিশের দুই তিনটি গাড়ি এসে প্রবেশ করল বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে।
আহমদ মুসা, আসতি আওয়াতসহ সকলেই উঠে দাঁড়াল।
.
২.
পুলিশ চলে গেছে লাশগুলো নিয়ে। ভোর ৫টা বাজে। রাতের বাকি এখনও আড়াই ঘন্টা। আহমদ মুসা, আসতি আওয়াতরা। বাইরের টংঘরে বসে গল্প করছিল পুলিশের বিষয় নিয়ে। ইভা নারিন, আহমদ নেবেজ, শেপল ছাড়াও দিভিনের গণ্যমান্য কয়েকজন ছিল সেখানে।
এরদেলান হঠাৎ উঠে গিয়েছিল। সেও ফিরে এসে তার চেয়ারে বসল।
ছেলেটা কে এসেছিল এরদেলান? বলল আসতি আওয়াত।
ও মোহাম্মাদ বেহেজ আংকেলের ভাগিনা। পাঠিয়েছিলেন ত্রিফা আপা একটা চিঠি দিয়ে। এরদেলান বলল।
এত রাতে? কোন খারাপ খবর? উনি ভালো আছেন তো? বলল। আসতি আওয়াত।
উনি ভালো আছেন বাবা। মোহাম্মাদ বেহেজ ভাই কয়েকদিন আগে। একটা প্যাকেট দিয়ে গিয়েছিলেন। ওতে ত্রিফা আপার জরুরি কি যেন আছে, সেটাই নিতে পাঠিয়েছিলেন। ওটা দিতেই গিয়েছিলাম।
আচ্ছা।
বলে আসতি আওয়াত মনোযোগ দিল আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু আহমদ মুসার সমস্ত মনোযোগ তখন এরদেলানের দিকে। তার কথা আলোড়ন তুলল আহমদ মুসার মনে। ভোর পাঁচটায় একজন ছেলেকে একটা প্যাকেট নিতে পাঠিয়েছেন ত্রিফা বেফ্রিন! এটা কিছুতেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছিল না আহমদ মুসা। বিশেষ করে আজকের মত এই রাতে! তিনি কি ঘুমাননি! কি এমন জিনিস তার ঐ প্যাকেটে ছিল?
এসব চিন্তার মধ্যে আহমদ মুসা কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল।
আপনি কি কিছু ভাবছেন জনাব আহমদ আব্দুল্লাহ? কেমন অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে আপনাকে। বলল আসতি আওয়াত।
স্যরি জনাব। আমি এরদেলানের কথা নিয়ে ভাবছিলাম।
বলেই আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করল এরদেলানকে, ঐ প্যাকেটে কি ছিল এরদেলান?
কেন? আমি খুলে তো দেখিনি। তবে বেহেজ ভাই বলেছিলেন, ওতে কয়েকটি গ্যাস মাস্ক আছে। আমাদের জন্যে এনেছেন। এরদেলান বলল।
গ্যাস মাস্ক? বিস্ময় ফুটে উঠল আহমদ মুসার কণ্ঠে। তার সাথে মনে ভিড় করল একরাশ প্রশ্ন। এরদেলানদের জন্যে আনা প্যাকেটে ত্রিফা বেফ্রিনের জিনিস থাকে কি করে? জিনিস থাকলে সেটাই চাইতেন। প্যাকেট খুলে সেটা তাকে দেয়া যেত। গোটা প্যাকেট চেয়ে পাঠানো অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য। আসলে কি তিনি গ্যাস মাস্ক সরিয়ে নিয়েছেন? কেন? তাও আবার তাড়াহুড়া করে রাতের এই সময়ে কেন? তাহলে রাতেই কি আরও কিছু ঘটনা ঘটবে?
শেষ প্রশ্নটা মনে ওঠার সাথে সাথে আহমদ মুসার গোটা শরীরে একটা তড়িৎ প্রবাহ খেলে গেল।
আহমদ মুসার চিন্তার মধ্যে ডুবে যাওয়া ভাবটা কাটল এরদেলানের কথায়। এরদেলান বলছিল, আপনি কি ভাবছেন স্যার?
এরদেলানের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, এখানে মসজিদটা কোথায়?
দুশ, আড়াইশ গজ দূরে। বলল এরদেলান।
আমি অনুরোধ করছি একে একে সবাইকে মসজিদে চলে যাবার জন্যে। ওখানে কয়েক রাকায়াত কিয়ামুল লাইল পড়তে পড়তেই ফজরের। আজান হয়ে যাবে। ফজরের নামাজ পড়ে আমরা ফিরে আসব।
একটু থেমেই আহমদ মুসা কথা বলার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিল। তার আগেই মোহাম্মদ আসতি আওয়াত বলে উঠল, নামাজের মসজিদে যাওয়া যাবে। কিন্তু এখন, এভাবে মসজিদে যেতে বলছেন কেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না জনাব।
প্লিজ জনাব, পরে সব বলব। এখন সময় নেই। মসজিদে শেপল, ইভা নারিনসহ সকলেই যাবে। যাবার সময় ইভা নারিন ও আমারটা ছাড়া স্থানীয় সকলের মোবাইল এখানে রেখে যেতে হবে। কারো হাতে বা কোথাও। সোনার আংটি থাকলে কিংবা নিয়মিত পরে থাকে এমন অলংকার কারও শরীরে থাকলে সেটাও এখানে রেখে যেতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
আসতি আওয়াত ও শেপলরাসহ সকলের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তাদের মনে প্রশ্ন, এসব কেন রেখে যেতে হবে? এমন চিন্তার কারণ কি? মেহমান এসব কি বলছেন, কেন বলছেন?
সবার মনেই এসব প্রশ্নের তোলপাড়। কিন্তু আহমদ মুসার পরামর্শ বা নির্দেশের ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুলতে চাইল না। আসতি আওয়াতও না।
সকলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আসতি আওয়াত বলল, সকলকেই আমি বলছি। সম্মানিত মেহমান, আমাদের ভাই যে পরামর্শ দিয়েছেন আমরা তা মেনে নিচ্ছি, যদিও জানি না এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কারণ কি! এ বিষয়ে পরে তিনি বলবেন বলেছেন। আমরা তার জন্য অপেক্ষা করব। আপনারা আপনাদের মোবাইল, রিং ইত্যাদি আমার ঘরে রেখে আসুন। অথবা এরদেলানাকে দিয়ে দিন। সে রেখে আসবে।
সম্মানিত সরদার যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা দ্রুত করুন। আর একটি কথা, এখানে যারা উপস্থিত আছেন তারা কোথায় যাচ্ছেন কাউকে বলবেন না। একা একা বিভিন্ন পথ দিয়ে মসজিদে চলে যাবেন। সবাই আমরা মসজিদে পৌঁছে গেছি, এটা নিশ্চিত হবার পর সবশেষে যাব আমি ও এরদেলান। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই সবাই উঠে দাঁড়াল। একে একে সবাই তাদের মোবাইল এরদেলানকে দিয়ে দিল। শেপল তার হাতের রিং ছাড়াও সোনার চুড়ি, গলার চেন ও কানের রিং এরদেলানকে দিয়ে দিল।
সবাই এক এক করে বাড়ি থেকে চলে যেতে শুরু করেছে।
এ সময় আহমদ নেবেজের মোবাইল বেজে উঠল যখন সে মোবাইল এরদেলানকে দিতে যাচ্ছিল। এরদেলান ও আহমদ নেবেজ আহমদ মুসার সামনেই দাঁড়িয়েছিল।
কলটা ধরার জন্যে আহমদ নেবেজ তার মোবাইলটা আবার টেনে নিয়েছিল। কিন্তু কলটা অন করার আগেই আহমদ মুসা বলল, আহমদ নেবেজ, আমরা, তোমরা কি করছি জানতে চাইলে বলবে, আমরা। সরদারের বাড়িতে বাকি রাতটার জন্যে ঘুমাতে যাচ্ছি।
আহমদ নেবেজ আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে কল অন করতে করতে বলল, ঠিক আছে স্যার।
উপস্থিত সবার নজর তখন আহমদ নেবেজের দিকে।
সবাইকে বিস্মিত করে আহমদ নেবেজ আহমদ মুসা যা বলতে। বলেছিল, সেই কথাই বলল।
টেলিফোন ধরেই ওপারের কথা শুনার পর বলেছিল, হ্যাঁ আপা সবাই আমরা সরদার সাহেবের বাড়িতে আছি। ভালো আছি আমরা। বাকি রাতটা আমরা এখানেই থাকব, ঘুমাতে যাচ্ছি আমরা।
আহমদ নেবেজ থামতেই শেপল বলে উঠল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, স্যার, কি করে আপনি জানলেন, যে টেলিফোন এসেছে আহমদ। নেবেজের কাছে তাতে তাকে এই প্রশ্নটাই জিজ্ঞেস করা হবে? অপার বিস্ময়জড়িত শেপলের চোখ-মুখ।
আহমদ মুসা গম্ভীর। বলল, সবই জানতে পারবে, তবে এখন নয়।
তাকাল আহমদ মুসা এরদেলানের দিকে। বলল, এরদেলান তোমার কাজ শেষ কর।
এরদেলানের চোখে-মুখেও বিস্ময়। আহমদ মুসার কথায় সে তৎপর হয়ে উঠল। মোবাইল, রিং, অরনামেন্ট নিয়ে সে ছুটল ঘরের দিকে রেখে আসার জন্যে।
প্রায় সবাই চলে গেছে।
আসতি আওয়াতের সাথে হ্যান্ডশেক করে বিদায় দিল আহমদ মুসা তাকে এবং শেপল ও ইভা নারিনকে।
বিদায়ের সময় আসতি আওয়াত ভারি কণ্ঠে বলল, আমার মাইয়েতের লাশ একা থাকল আমার ঘরে।
ধৈর্য ধরুন জনাব। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। এখানে স্বাভাবিক সময়ের কোন আইন, নিয়ম কার্যকর নয় জনাব।
আল্লাহু আকবার। আমি মেনে নিয়েছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জনাব, আপনি আমার পিতার বয়সের। আপনি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করলে আমার খুব খারাপ লাগে। প্লিজ আমাকে তুমি বলবেন। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ আব্দুল্লাহ। আসতি আওয়াত বলল।
আসতি আওয়াতরা বিদায় নিয়ে চলে গেল।
সবাই চলে গেলে আহমদ মুসা চত্বরের মাঝখানে যে লাইট-পোলটা রয়েছে, তার গোড়ায় লেগে থাকা ধুলার মধ্যে ক্ষুদ্র সাদা বোতামের মত একটা চিপস রেখে দিল। পাশেই দাঁড়িয়েছিল এরদেলান। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এদিকের কাজ শেষ। চল এবার। আহমদ মুসা আসতি আওয়াতের বাড়ি থেকে নিচের উপত্যকায় নেমে এল এরদেলানকে নিয়ে। উপত্যকায় নেমে এসে আহমদ মুসা চারদিকে চাইল। কাউকে দেখতে পেল না।
আহমদ মুসার চোখে নাইটভিশন গগলস। বলল আহমদ মুসা, এরদেলান পশ্চিমে যে পাহাড় শৃঙ্গগুলো দেখা যাচ্ছে, সেখানে কি বসতি আছে? কিংবা কোন পথ ঘাট?
কিছু পশ্চিম পর্যন্ত দিভিনের বসতি রয়েছে। তারপর পাহাড়ের এই অংশে আর কোন বসতি নেই। পায়ে চলার মত সুযোগ রয়েছে পাহাড়ের এই অঞ্চলে, কিন্তু ব্যবহৃত হচ্ছে এমন কোন রাস্তা নেই।
আর দক্ষিণ ও উত্তরে কি আছে? বলল আহমদ মুসা।
দিভিনের বসতি দুপাশেই। এরদেলান বলল।
তোমাদের ত্রিফা আপার বাড়ি কোন পাশে, কোথায়? বলল আহমদ মুসা।
উত্তর দিকের একটা বড় টিলার শীর্ষে। ঠিক আমাদের বাড়ির মতই। এ প্রশ্ন কেন স্যার? এরদেলান বলল।
ঐ টিলার শীর্ষে কয়টা বাড়ি আছে? বলল আহমদ মুসা।
টিলাটায় নতুন বাড়ি তৈরি করেছে তারা গোটা টিলা কিনে নিয়ে। সেখানে আর কোন বাড়ি নেই। এরদেলান বলল।
চল এরদেলান, মসজিদের দিকে যায়। দেখি ওরা কি করছেন। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আপনি ত্রিফা আপার কথা কেন বললেন? তার কোন বিপদ নেই তো? এরদেলান বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, এখন কোন কথা বলব না এরদেলান। চল যায়।
মসজিদে পৌঁছল আহমদ মুসারা। দেখল সবাই নামাজ পড়ছে।
ইভা নারিন মসজিদের বাইরের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছে।
এরদেলান মসজিদে পৌঁছে ভেতরে চলে গেল। আহমদ মুসা গেল ইভা নারিনের কাছে। বলল, আপনার তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না?
না কোন অসুবিধা হয়নি। আমি বরং এনজয় করছি। কিন্তু আপনি প্লিজ বলুন, ওখানে আপনি কি ধরনের আক্রমণের আশংকা করছেন? ইভা নারিন বলল।
হ্যাঁ, কোন ধরনের বিষক্ত গ্যাস বোমার আক্রমণ হবে বলে আমি আশংকা করছি। বলল আহমদ মুসা।
কেন এমন আশংকা? ফায়ারে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহৃত হয়েছিল বলে? ইভা নারিন বলল।
না, শেপলদের বাড়ি থেকে রাতের এমন শেষ প্রহরে গ্যাস মাস্ক নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে। বলল আহমদ মুসা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো ইভা নারিনের। বলল, ঠিক তো রাতের এই সময় গ্যাস মাস্কের প্যাকেট নিয়ে গেলেন কেন?
মুহূর্তকালের জন্যে থামল ইভা নারিন। বলল আবার, আপনি তাহলে তো ত্রিফা বেফ্রিনকে ওদের একজন ভাবেন?
ভাবার মত অনেক কারণ ঘটেছে। আরও নিশ্চিত হবার জন্যে বর্তমান ঘটনার পরিণতি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। আগের ঘটনাগুলো আমি ফলো করতে পারিনি। ঐ রকম। রাতে গ্যাস মাস্ক নিতে আসায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তবে ভেবেছিলাম আজ দিভিনের কেউ ঘুমায়নি নিশ্চয় এবং তারা : জরুরি অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে। আমি গ্যাস মাস্ক নেয়াকে অবশেষে এরই অংশ মনে করেছিলাম। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার ভাবনাটাই সত্য। সত্যই অনন্য আপনি। জনাব আসতি আওয়াতরা যেমন আপনাকে জানতে চাইছেন, তেমনি আমিও উনুখ। মনের আকুলতা সত্যিই ধরে রাখতে পারছি না। ইভা নারিন বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, সময় যায়নি ইভা নারিন। আমাকে গন্তব্যে পৌঁছাতে এসে, গন্তব্যের ঘটনার সাথে আমার সাথে আপনি জড়িয়ে পড়েছেন অজান্তেই। আমরা না চাইলেও আমাদের ক্ষেত্র বোধ হয় একই হতে যাচ্ছে।
আমি কিন্তু চাই। এটা আমার জন্যে হবে সৌভাগ্যের। তবে আমি জানি, আপনার প্রয়োজন নেই আমার মত কারও সাহায্যের। ইভা নারিন বলল।
প্রকৃতই কাজের লোক যারা, তারা এ ধরনের বিনয়ীই হয়ে থাকেন।
একটু থামল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, আপনি আর একটু বসুন, আসছি আমি।
মসজিদের ভেতরে ঢুকে গেল আহমদ মুসা।
কিয়ামুল লাইলে সবার সাথে শরীক হলো সে।
আহমদ মুসার সাথে ইভা নারিনও মসজিদে প্রবেশ করল। বসে পড়ল দরজার বামপাশের কোনাটায়। আহমদ মুসা গিয়ে নামাজে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা যখন তাহাজ্জুদের অষ্টম রাকায়াত পড়ছে, তখন তার ঘড়ি বিপ বিপ সিগন্যাল দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসা নামাজ শেষ করে হাতঘড়ির স্ক্রিনের দিকে তাকাল। বিপ বিপ শুনেই সে নিশ্চিত হয়েছে, সরদার আসতি আওয়াতের বাড়ির চত্বরে পেতে রেখে আসা চিপস-ট্রান্সমিটারই তাকে সিগন্যাল দিয়েছে। দেখল সে, ঠিক তার ট্রান্সমিটার চিপসেরই সিগন্যাল, আহমদ মুসার অনুমান সত্য প্রমাণ হয়েছে। এই মাত্র আসতি আওয়াতের বাড়িতে গ্যাস বোমার আক্রমণ হয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে পরপর তিনটি গ্যাস বোমা পড়েছে। মনিটর বিস্ফোরিত গ্যাস বোমার সাউন্ড এবং গ্যাসীয় কণার বিস্তার-গতিবেগ নিখুঁতভাবে রিলে করেছে। এই গতিবেগের রেট অতি বিষাক্ত গ্যাসীয় কণার গতিবেগের সাথে হুবহু মিলে যায়।
আহমদ মুসা চেয়ে দেখল সকলেরই নামাজ শেষ। বসে বসে কেউ কুরআন পড়ছে, কেউ তসবি জপছে, কেউ কেউ আবার গল্প করছে।
আহমদ মুসা উঠে আসতি আওয়াতের কাছে গিয়ে বসল। বলল, জনাব আমার অনুমান সত্য প্রমাণ হয়েছে। আপনার বাড়িতে এই মাত্র জীবন সংহারী বিষাক্ত গ্যাস বোমা ফেলা হয়েছে।
জীবন সংহারী বিষাক্ত গ্যাস বোমা? তার মানে আমাদের সকলকে। হত্যার জন্যে এটা করা হয়েছে?
আমরা থাকলে সবাই মরে যেতাম! ইন্না লিল্লাহ। বলল সরদার আসতি আওয়াত।
কথা শেষ করেই সে সকলের দিকে তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলল, ভাইসব, এইমাত্র আমার বাড়িতে জীবন সংহারী বিষাক্ত গ্যাস বোমার আক্রমণ হয়েছে। আসুন আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি যে, আমরা বাড়ি থেকে সরে আসতে পেরেছিলাম।
সকলেই আল হামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে সরদারের কাছে ছুটে এল। শেপলও এল, ইভা নারিনও এল।
প্রায় একযোগেই সবাই বলে উঠল, কি করে জানা গেল, আর কি ঘটেছে সেখানে?
আসতি আওয়াত তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আমিই ওকে খবরটা দিয়েছি। আমার কাছে ওখান থেকে একটা সংকেত এসেছে। ওখানে…।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই শেপল বলে উঠল, আপনি আমাদের সাথে এখানেই ছিলেন। কিভাবে সংকেত আসতে পারে?
আহমদ মুসা একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, আমার রিস্ট ওয়াচে ওখান থেকে সংকেত এসেছে। আমি ওখানে একটা ট্রান্সমিটার চিপস রেখে এসেছিলাম।
রিস্ট ওয়াচে? সংকেত কি বলেছে? শেপলই আবার বলল।
এটুকুই জানা গেছে, তিনটি বিষাক্ত বোমা ফেলা হয়েছে সরদার সাহেবের বাড়িতে। সিগন্যাল থেকে প্রমাণ হয়েছে ওগুলো জীবন সংহারী। বোমা। বলল আহমদ মুসা।
ক্ষতি সম্পর্কে তো কিছু জানা যায়নি? এরদেলান বলল।
পশু-পাখির মত জীবন্ত ওখানে কিছু কি আছে? বলল আহমদ মুসা।
বাড়ির পেছনেই ভেড়ার পালের একটা খামার আছে আমাদের। এরদেলানই বলল।
স্যরি, এ বিষয়টা তো আমি জানতাম না। বলল আহমদ মুসা।
আমরা কি যেতে পারি এখন বাড়িতে? শেপল বলল।
এখন যেতে অসুবিধা নেই। কিন্তু যাওয়া যাবে না। বোমা নিক্ষেপকারীরাই সম্ভবত এখন আবার তোমাদের বাড়িতে তাদের বোমার সাফল্য দেখতে এবং আমাদের লাশ নিয়ে যেতে আসতে পারে।
বলেই আহমদ মুসা তাকাল ইভা নারিনের দিকে। বলল, মিস নারিন আপনি শেপলদের কয়েকজনকে নিয়ে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে গিয়ে দেখতে পারেন কি ঘটেছে। আর আমি বাড়ির সামনের রাস্তার দিকে যাচ্ছি। দেখা যাক, ওদের কাউকে যদি পাওয়া যায়। আমার সাথে যাবে, এরদেলান।
বাড়ির পেছন দিক দিয়ে আমরা সবাই তো একসাথে যেতে পারি। বলল আসতি আওয়াত।
যেতে পারেন। বলল আহমদ মুসা।
তাকাল আহমদ মুসা ইভা নারিনের দিকে। বলল, মিস নারিন, সামনের দিক থেকে সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত আপনারা বাড়ির পেছনেই অপেক্ষা করবেন।
কারণ? ওরা তো অন্যভাবেও সরদার সাহেবের বাড়িতে আসতে পারে মানে খোঁজ নিতে পারে। বলল ইভা নারিন।
যাদের কাছ থেকে খোঁজ নেবার তাদের সুযোগ ছিল, তাদের সবার মোবাইল তো বাড়িতে রেখে আসা হয়েছে। আমার সন্দেহ সত্য হলে তিনি তো ইতিমধ্যে টেলিফোন অবশ্যই করেছেন। কারও টেলিফোন থেকে রেসপন্স না পেয়ে তিনি নিশ্চয় মনে করছেন তারা সবাই মারা পড়েছে। মারা পড়েছে, সেটা চোখে দেখে নিশ্চিত হবার জন্যে অবশ্যই তারা আসবেন। তাছাড়া আমার আপনার লাশ তাদের প্রয়োজন। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক বলেছেন। আমাদের মিশন তো কি ঘটেছে তা দেখা, কিন্তু। আপনার মিশন? ইভা নারিন বলল।
সত্যি এখনও তা ঠিক করিনি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। তবে ওদের দুএকজনকে আটক করা খুবই দরকার। বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, আর কোন কথা নয়। সবাইকে ফি আমানিল্লাহ। সবাইকে সালাম।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল। তার পেছনে এরদেলান।
ইভা নারিনও উঠে দাঁড়াল।
.
দিভিনের উত্তরে আলা নামের একটা টিলা।
টিলাটা তিন দিক থেকে উঠে আসা গাছে ঢাকা। টিলাটার মজার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট উঁচু টিলা শীর্ষের নিচে বিরাট একটা সমতল চত্বর। এ চত্বর থেকে শীর্ষদেশটা অনেকটাই দেয়ালের মত উপরে উঠে গেছে। বিরাট সমতলটায় একটা মাত্র বাড়ি। টিলাতে আর কোন বাড়ি নেই। টিলার একমাত্র এ বাড়ির মালিক মোহাম্মদ বেহেজ। ত্রিফা বেফ্রিন তাঁর স্ত্রী।
টিলার দেয়ালটির মাথায় গাছের আড়ালে বসে আছে তিনজন লোক। তাদের সামনে কম্পিউটারাইজড একটা ছোট লাঞ্চার, অনেকটাই মেশিনগানের মত।
তিনজনের একজন ঘড়ি দেখে বলল, পয়জন বোমার কাজ তো শেষ হয়ে গেছে। লোভেন তুমি ত্রিফা ম্যাডামকে ওখানকার খবর নিতে বল। তাকে বলো, তিনটি ফায়ারই আমাদের ও.কে হয়েছে, কম্পিউটার স্ক্রিনের ছবিতে দেখা গেছে ওগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় পড়েছে।
লোভেন নামের লোকটি মোবাইল বের করে কল করল ত্রিফা ম্যাডামকে এবং বলল তাকে খবর নেয়ার জন্যে। ওপ্রান্ত থেকে ত্রিফা ম্যাডামের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, ধন্যবাদ, এখনি আমি খোঁজ নিচ্ছি। জানাচ্ছি আপনাদের।
লোভেনের কল অফ হয়ে গেল। মোবাইল পকেটে রেখে লোভেন বলল, শয়তান ও শয়তানী দুজন ওখানে ঠিক আছে তো?
ত্রিফা ম্যাডাম আজ রাতে যখন খবর নিয়েছেন, তখন ঐ দুজনসহ সবাই ঘুমাতে যাচ্ছিল। অতএব তারা আছে। বলল প্রথম কথা বলা। লোকটা।
দুই শয়তানের বাচ্চাকে যদি জ্যান্ত ধরা যেত! তারা আজ সরদারের। বাড়িতেই আমাদের ডজনখানেক লোককে মারল। রাফায়েল স্যার। আপনার কাছেই তো শুনলাম, পুরুষ শয়তানটার হাতে এর আগেও আমাদের অনেক লোক মারা গেছে। তৃতীয়জন বলল সরদার গোছের রাফায়েলকে লক্ষ করে।
রুবেন, বলেছি না যেকোন মূল্যে, যেকোন উপায়ে তাকে হত্যা করতে হবে। তাকে ধরা, মেরে ফেলার আগের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের লোক ক্ষয় হয়েছে প্রচুর। একজন শীর্ষ মহিলা গোয়েন্দা অফিসার আমাদের সদস্য তাকে মারতে গিয়ে তারই পক্ষে চলে গেছে। বলল রাফায়েল।
লোকটি কে স্যার? দ্বিতীয় ব্যক্তি লোভেন বলল।
আমাকে জানানো হয়নি। তবে সাংঘাতিক কেউ হবে। গোটা দুনিয়ার আন্ডার ওয়ার্ল্ড তার বিরুদ্ধে একমত। বলল রাফায়েল। তাকে মারতে পারলে তার লাশেরই দাম হবে বিলিয়ন ডলার। বলল রাফায়েল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল লোভেন।
তখন বেজে উঠল রাফায়েলের মোবাইল। কল অন করেই বলল সে, ম্যাডাম ত্রিফা। আমি রাফায়েল। বলুন। ওদিকের কি খবর?
মি. রাফায়েল ওদিকের সব মোবাইল নীরব। আহমদ নেবেজ, সরদারের ছেলে এরদেলান, মেয়ে শেপল
সকলের মোবাইল নীরব। শেষে সরদার আসতি আওয়াতকেও ফোন করেছিলাম। তারও টেলিফোন। রেসপন্স করেনি। এ রকমটা হতেই পারে না। বিশেষ করে নামাজের জন্যে সবাই এসময় উঠে যায়। তাদের সকলের মোবাইল নীরব থাকার অর্থ একটাই, তারা কেউ বেঁচে নেই।
থ্যাংক যিশু, থ্যাংক মেরী। আপনার কথা সত্য হোক। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে বিষয়টা যাচাই হওয়া দরকার। এই টিলার নিচে আমাদের একটা টিম প্রস্তুত রয়েছে। তাদেরকে আমি পাঠাচ্ছি। বলল রাফায়েল।
ওরা কয়জন? ত্রিফা বেফ্রিন বলল।
সাতজন। বলল রাফায়েল।
খুবই সাবধানে যেতে হবে। কোনভাবেই ধরা পড়া যাবে না। ত্রিফা বলল।
আমাদের লোকদের এটা বলার দরকার নেই ম্যাডাম। আর এদেরকে পাঠানো হয়েছে সেন্ট্রাল কমান্ডো ইউনিট থেকে। সেরা কমান্ডোদেরই ওরা পাঠিয়েছে। বলল রাফায়েল।
আমি মহান সেন্ট সেমভেলের কাছে শুনেছি, এই লোকটা অপ্রতিরোধ্য। আমাদের অপারেশন কমান্ডার গ্যাসিক লেভন সর্বাত্মক চেষ্টা করেও লোকটার সাথে এঁটে উঠতে পারেননি। তাঁর ভাই একজন জেনারেল, সে তো মারাই গেছে তার হাতে। ত্রিফা বলল।
আমরা ওদের একটা বিষয়ে কনফারম হতে চাই। ওখানে নিশ্চয় কেউ। বেঁচে নেই। তবু তারা অবশ্যই শতভাগ সাবধান থাকবে। বলল রাফায়েল।
ও.কে। খ্রিষ্ট আমাদের সফল করুন। ত্রিফা বলল।
ওপার থেকে কল অফ হয়ে গেল। রাফায়েলও কল অফ করে নতুন কল করল টিলার গোড়ায় অপেক্ষমাণ তাদের সাত সদস্যের টিমের সাথে। টিমের নেতা সারজেই গ্যারিককে ত্রিফার সাথে যা কথা হয়েছে সেইমত নির্দেশ দিয়ে বলল, চোখ-কান খোলা রাখবে সব সময়। শত্রু কোন সুযোগ যাতে না পায়। স্পটে সবাইকে যদি মৃত পাও, আমাদের টার্গেট দুজনকে নিয়ে আসবে। মনে রাখবে তাদের জীবিত অবস্থার মতই তারা এখনও মূল্যবান।
কল অফ করে ফোন পকেটে রাখল রাফায়েল।
ভয়ের কি কিছু আছে? ওরা তো সবাই মৃত। লোভেল বলল।
ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু সাবধান হওয়ার মধ্যে ক্ষতি নেই। বলল রাফায়েল।
ম্যাডাম ত্রিফা খোঁজ নেবার জন্যে যেতে পারতেন। উনি টেলিফোন করে কারও কোন সাড়া না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজ নিতে গেছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক হতো। লোভেন বলল।
বুদ্ধির ঢেঁকি তো তোমরা। প্রশ্ন উঠতো, অসুস্থ ত্রিফা বেফ্রিন ঘুমানোর কথা। রাতের ঐ সময় খোঁজ নেবার জন্যে কেন টেলিফোন করেছিলেন? অসুস্থ অবস্থায় খোঁজ নিতে যাওয়ার গরজ তার পড়ল কেন? এসব নানা প্রশ্ন উঠতো। তাছাড়া ত্রিফা ম্যাডামের কাজ ভিন্ন, আমাদের কোন কাজে তাকে ইনভলভ করার কোন সিদ্ধান্ত নেই। ইভা নারিনকে গুলি করা তার ঠিক হয়নি, বড় ধরনের ভুল হয়েছে। এটা তিনিও এখন বুঝেছেন। দিভিনের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে তিনি যে মূল্যবান সাহায্য করছেন, সেটাই তাঁকে করতে হবে। বলল রাফায়েল।
কথা শেষ করেই রাফায়েল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, এখানে আর কোন কাজ নেই। চল আমরাও নিচে যাব। আমরাও এগিয়ে দেখি ওদিকের কি অবস্থা।
পাহাড়শীর্ষ থেকে ওরা তিনজন নেমে এল। দাঁড়াল এসে ত্রিফা বেফ্রিনদের বাড়ির বাইরের চত্বরে এসে। চত্বরটি আলোকিত। নিজস্ব জেনারেটরের বিদ্যুতে চলে ত্রিফাঁদের বাড়ির বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। এ সুযোগ অন্যকারও নেই, এমনকি দিভিনের প্রধান আসতি আওয়াতের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা নেই। ত্রিফা বেফ্রিনের নিজস্ব উদ্যোগেই এই বিশেষ জেনারেটরের ব্যবস্থা হয়েছে।
রাফায়েল চত্বরে দাঁড়াতেই দুতলার একটা জানালা থেকে ত্রিফা বেফ্রিনের গলা শোনা গেল। বলল, মি. রাফায়েল, আপনারা নিচে যাচ্ছেন?
জি হ্যাঁ, ম্যাডাম। দেখি ওদিকে কি অবস্থা। রাফায়েল বলল।
আপনারা দাঁড়ান। আমি নিচে আসছি। কথা আছে। বলল ত্রিফা বেফ্রিন।
আসুন। আমরা দাঁড়াচ্ছি। রাফায়েল বলল।
.
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল শিন সেনগারের। অগ্নিকাণ্ডের স্থান থেকে ফিরে আহত মায়ের সেবা-শুশ্রূষা করে মাকে ঘুমিয়ে রেখে তারপর এসে শুয়েছিল। ঘুম ভেঙে যাবার কথা নয় এ সময়। শিন সেনগার ভেবেছিল টেনশনের কারণেই এটা হয়েছে। মুক্ত বাতাসের জন্যে শিন সেনগার ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল।
শিন সেনগার মোহাম্মাদ বেহেজ ও ত্রিফা বেফ্রিনের একমাত্র মেয়ে। খুব আদরের মেয়ে। শিন সেনগার ইয়েরেভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স অনার্সের ছাত্রী। খুব বুদ্ধিমতি।
বাইরে বেরিয়ে শিন সেনগার লিভিংরুমে এসে দাঁড়িয়েছিল। উদ্দেশ্য লিভিংরুম পেরিয়ে দক্ষিণের খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াবে।
ঠিক এই সময়েই তার মায়ের ঘরে মোবাইল বেজে উঠেছিল।
ঘুরে দাঁড়িয়েছিল শিন সেনগার। এত রাতে মায়ের টেলিফোনে কে টেলিফোন করল? নিশ্চয় বাবা। মা তো টেলিফোন ধরতে পারবে না, যদিও মোবাইল হাতের কাছে রয়েছে। তাছাড়া মা তো ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। তার ঘুম ভাঙা ঠিক হবে না।
ছুট গিয়েছিল শিন সেনগার তার মায়ের ঘরের দিকে। দরজায় পৌঁছতেই দেখতে পেয়েছিল তার মা টেলিফোন ধরেছে। কথা বলতে শুরু করেছে।
দাঁড়িয়ে পড়েছিল শিন সেনগার দরজাতেই। চলে আসবে কিনা ভাবছিল। এই সময় তার মা কাউকে রাফায়েল বলে সম্বোধন করেছিল। এতরাতে কোন্ রাফায়েল তার মাকে টেলিফোন করেছে! রাফায়েল তো কোন মুসলিম নয়!
অনিচ্ছা সত্ত্বেও টেলিফোনে মায়ের কথা শুনতে শুরু করেছিল। প্রচণ্ড কৌতূহলের কারণে সে সরতে পারছিল না। কে এই রাফায়েল? কেন এত রাতে তার অসুস্থ মাকে টেলিফোন করেছে?
কৌতূহল নিয়ে শুনতে গিয়ে কয়েকটি বাক্য শুনতেই আতংক-উদ্বেগে তার মন ছেয়ে গিয়েছিল। সর্দার আসতি আওয়াত, শেপল, এরদেলান, আহমদ নেবেজ বেঁচে নেই- একথা বলা হচ্ছে কেন? আর এই কথা তার মা নিশ্চিন্তে নিরুদ্বেগে শুনতে পারছেন কি করে?
শিন সেনগারের এই চিন্তার মধ্যে তার মায়ের মোবাইলে কথা বলা আরও এগিয়েছিল। মায়ের একটা কথার প্রতি তার কান আবার আটকে গিয়েছিল। তার মা বলছিল খুবই সাবধানে যেতে হবে, কিছুতেই ধরা পড়া যাবে না। তার মা তো কোন এক অভিযানের কথা বলছেন! কিসের অভিযান? কাদের ধরা পড়া চলবে না? রাফায়েলরা কে? প্রতিপক্ষ কে? তার মা এভাবে রাফায়েলকে সাবধান করছে কেন? রাফায়েলদের সাথে কি সম্পর্ক তার মায়ের?
শিন সেনগারের মনের প্রশ্ন বাড়ছেই। কোনটারই কোন উত্তর তার কাছে নেই। এই চিন্তা নিয়ে শিন সেনগার যখন বিব্রত, তখন মোবাইলে তার মায়ের আরেকটা কথা তাকে ভীষণভাবে চমকে দিয়েছিল। সে শুনছিল তার মা বলছিল, আমি মহান সেন্ট সেমভেলের কাছে শুনেছি, এই লোকটা অপ্রতিরোধ্য। আমাদের অপারেশন কমান্ডার গ্যাসিক লেভন সর্বাত্মক চেষ্টা করেও লোকটার সাথে এঁটে উঠতে পারেনি। তার ভাই, একজন জেনারেল, সে তো মারাই গেছে তার হাতে। রুদ্ধশ্বাসে শিন সেনগার তার মায়ের এই কথাগুলো শুনছিল। নতুন করে এক ঝাঁক প্রশ্ন এসে তার মনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেন্ট সেমভেল কে? নিশ্চয় খৃস্টান কোন ধর্মনেতা। তার সাথে তার মায়ের কি সম্পর্ক? গ্যাসিক লেভন কিসের অপারেশন কমান্ডার? এদের কথা সেন্ট সেমভেল তার মাকে বলবেন কেন? সেন্ট সেমভেল, গ্যাসিক লেভন কোন লোকটাকে এঁটে উঠতে পারেনি? তাদের প্রতিপক্ষ অপ্রতিরোধ্য সেই লোকটা কে? সেন্ট সেমভেল, রাফায়েল সবাই তো খৃস্টান। মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কোন কিছুর সাথে জড়িত। এদের সাথে তার মায়ের সম্পর্ক কেন? উত্তর না জানা এই সব সাংঘাতিক প্রশ্নে বিপর্যস্ত শিন সেনগার নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। এরই মধ্যে মোবাইলে তার মায়ের বিদায়ী কথাটা তার কানে এল, ও.কে, খ্রিষ্ট আমাদের সফল করুন। কথাটা শিন সেনগারের মাথায় বাজ পড়ার মত আওয়াজ করে উঠতে যাচ্ছিল। শিন সেনগার মনের সমস্ত শক্তি একত্র করে দুহাতে মুখ চেপে ধরে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এল। মায়ের কাছে তার ধরা পড়া যাবে না। মা তাহলে বিব্রত হবেন, হয়তো ক্রুদ্ধও হতে পারেন। আড়ি পেতে কথা শোনার মধ্যে তার কোন যুক্তি নেই।
শিন সেনগার ছুটে এসে লিভিং রুমের এক অন্ধকার কোণের এক সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। তার মা খ্রিষ্টের সাফল্য চাইলেন কেন? তার মা খৃস্টান? আকস্মিক এক বজ্রাঘাতে তার জীবনের সবকিছু যেন ধ্বংস হয়ে গেল। নিভে গেল যেন তার জীবনের সব আলো। জ্ঞান, বুদ্ধি সব যেন ভোতা হয়ে গেল তার। সোফার উপর আচ্ছন্নের মত পড়ে রইল কিছুক্ষণ। এক সময় বিপর্যস্ত, বিস্মিত, আচ্ছন্ন অবস্থার পাশে রাজ্যের ভয়। এসে তার মনে প্রবেশ করল। মা কি দিভিনের বিরুদ্ধে কোন তৎপরতার সাথে জড়িত? সর্দার আসতি আওয়াতদের টেলিফোনে সাড়া না পেয়েই মা কি করে বলল তারা কেউ বেঁচে নেই? তাহলে কি তাদের হত্যার কোন ষড়যন্ত্র হয়েছে, যা তার মা জানত। যাদের সাথে তার মা কথা বলল তারাই কি সেই ষড়যন্ত্রকারী? তার মা কি তাদের সাথে শামিল? শিন সেনগারের ভেতরটা থর থর করে কেঁপে উঠল। একি ভাবছে সে? কিন্তু তার মা দিভিনের বিরুদ্ধ পক্ষ না হলে সেন্ট সেমভেল, রাফায়েলরা আসতি আওয়াতদের লাশ দেখার জন্যে তার মায়ের সাথে কেন কথা বলল?
তার মায়ের কণ্ঠ এ সময় তার চিন্তার ছেদ ঘটাল। তার মা রাফায়েল বলে সম্বোধন করে বললেন, আপনারা নিচে যাচ্ছেন? কয়েক মুহূর্তের বিরতি। তারপর তার মায়ের কণ্ঠ আবার কাউকে দাঁড়াতে বললেন এবং বললেন তিনি নিচে নামছেন।
তার মানে তার মা নিচে নামছেন। এটা শোনার সাথে সাথেই শিন। সেনগার উঠে দাঁড়াল। ছুটল তার মায়ের ঘরের দিকে। কিন্তু লিভিং রুমের দরজায় গিয়েই দেখল, তার মা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছেন।
মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল শিন সেনগার। মাকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল সে। মা হয়তো বিব্রত হবেন, মাকে বিব্রত করতে চায় না সে। সিদ্ধান্ত নিল গোপনে তার মায়ের পিছনে পিছনে যাবে। আড়ালে দাঁড়িয়ে সে দেখবে কি হচ্ছে।
শিন সেনগারের মা ত্রিফা বেফ্রিন সিঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। দরজা সে বন্ধও করল না।
শিন সেনগার সতর্ক পায়ে নিঃশব্দে নামল সিঁড়ি দিয়ে। গিয়ে দাঁড়াল দরজার পাশে দেয়ালের আড়ালে।
তিনজন লোক দাঁড়িয়েছিল। তার মা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গেট থেকে জায়গাটা খুব কাছেই। তাদের সব কথাই শোনা যাচ্ছে।
তার মা বলছিল, মি. রাফায়েল আপনারা শুনুন, আজকের মিশন ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। পয়জন বোমায় যদি তারা মরে গিয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে এক ঐতিহাসিক জয় আমাদের হাত দিয়ে হয়েছে। কিন্তু লাশ হাতে পাওয়ার আগে বলা যাবে না, জয় আমাদের হয়েছে। লোকটি হাজারো ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসা লোক। আমাদের চেয়ে বহুগুণে শক্তিধররা তার সাথে এঁটে উঠতে পারেনি। সুতরাং আমাদের সাবধান হতে হবে। সাতজনের যে দলটিকে পাঠানো হয়েছে, ওখানে কি ঘটেছে তা দেখার জন্যে। তাদের আপনারা ফলো করুন। তাদের আপনারা নিরাপত্তা দেবেন। তারা কোন কারণে ব্যর্থ হলে আপনারা ফাইনাল আঘাত হানার জন্যে তৈরি থাকবেন। মনে রাখবেন আজকের মিশন আমাদের সফল করতে হবে। অন্তত ঐ লোকটিকে হত্যা করতে হবে। আসতি আওয়াতরা কোন ফ্যাক্টর নয়। যখন ইচ্ছা তখন আমরা ওদের শেষ করতে পারি।
মায়ের কথা শুনে শিন সেনগারের দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। ভয়-উদ্বেগে ঘামতে শুরু করেছে সে। তার মায়ের কি হলো? এসব কি বলছে সে?
ত্রিফা বেফ্রিন থামার সংগে সংগেই বলে উঠল রাফায়েল, ম্যাডাম আপনি লোকটিকে সাংঘাতিক গুরুত্ব দিলেন, একেবারে আকাশস্পর্শী করে তুলেছেন তাকে। আসলে কে সে? এটা এখনও আমরা জানতে পারিনি। আমাদের তাড়াহুড়া করে পাঠানো হয়েছে হেলিকপ্টারে করে। শুধু বলা হয়েছে, এটা ভিভিআইপি মিশন। যেকোন মূল্যে সফল করতে হবে। ম্যাডাম ত্রিফা তোমাদের সহযোগিতা করবে। উত্তরে আমার কিছু বলার সুযোগ হয়নি।
তার নাম শুনতে চান। চমকে উঠবেন না তো? ভয় পাবার মত নামটা কিন্তু। বলল ত্রিফা বেফ্রিন। গম্ভীর তার মুখ।
ম্যাডাম ত্রিফা বেফ্রিন, আমি ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার-এর কমান্ডো নেতা। বিশ্ববিখ্যাত কমান্ডো কলিন কোহেনসহ পৃথিবীর শীর্ষ কমান্ডোদের সাথে আমি কাজ করেছি। দিভিনে কে একজন এসেছে তাকে ভয় করব? রাফায়েল বলল।
হাসল ত্রিফা বেফ্রিন। বলল, ধন্যবাদ রাফায়েল। তাঁর নাম আহমদ মুসা।
সত্যিই চমকে উঠল রাফায়েল। বলল দ্রুতকণ্ঠে, কোন আহমদ মুসা? যাকে আমরা বিশ্বের ত্রাস বলি, সে অবশ্যই নয়।
অবশ্যই। সেই আহমদ মুসাই। আপনি যাকে ত্রাস বলছেন, দুনিয়ার মজলুমরা তাকে বলে রক্ষক। বলল ত্রিফা বেফ্রিন।
ও গড! বলে বসে পড়ল রাফায়েল। বলল, আপনি ম্যাডাম আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন না তো? সেই আহমদ মুসা এই অখ্যাত দিভিনে কেন আসবে?
শুধু ভয় পাওয়া নয়, একেবারে যে বসে পড়লেন মি. রাফায়েল! উঠুন সময় বেশি নেই। বলল ত্রিফা বেফ্রিন।
উঠল রাফায়েল। তার মুখ তখনও বিস্ময়ে আচ্ছন্ন। বলল, আপনার ইনফরমেশন ঠিক আছে তো? সত্যিই তিনি আসল আহমদ মুসা?
ইনফরমেশনে কোন ভুল নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব সূত্র কনফার্ম করেছে,-আহমদ মুসা আর্মেনিয়ায় এসেছে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এখানে এসেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ওআইসি ও রাবেতার অনুরোধে তিনি দিভিনে এসেছেন। বলল ত্রিফা বেফ্রিন।
ঠিক আছে ম্যাডাম আর সময় নষ্ট আমরা করছি না। যাই আমরা। আমাদের জন্যে একটা বড় সুযোগ হলো, আহমদ মুসা আমাদের পয়জন। বোমা থেকে বেঁচেছে বলে মনে হয় না। বাঁচলেও তারা আমাদের এই প্রস্তুতির কথা জানে না। অসতর্ক অবস্থায় তাকে শেষ করতে হবে। রাফায়েল বলল।
ঠিক আছে! তবে হাতে সময় কম। আপনারা যান। খ্রিষ্ট আপনাদের সাথে আছেন। গুড বাই। বলে ত্রিফা ঘুরে দাঁড়াল বাড়ির দিকে।
রাফায়েলরা তখন হাঁটা শুরু করেছে। নেমে যাচ্ছে তারা বাড়ি থেকে।
মাকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে শিন সেনগার আড়াল থেকে সিঁড়ির দিকে ছুটল। বিড়ালের মত নিঃশব্দে এক দৌড়ে উঠে গেল তিন তলায়, একেবারে নিজের ঘরে।
মায়ের মুখ থেকে এসব কথা শুনে খুব কষ্ট লাগল শিন সেনগারের। যে মা তার সব আস্থা, সব ভালোবাসার কেন্দ্র, সেই মা যেন হঠাৎ অনেক দূরে সরে গেল। মা যেন হঠাৎ করেই ভয় ও আতংকের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। তার মা কেন তার ধর্ম পরিচয় গোপন রেখেছে? তার মা কবে খৃস্টান হলো? খৃস্টান হওয়ার চেয়ে তাঁর কাছে বড় মনে হচ্ছে, দিভিনকে ধ্বংস করা। দিভিনকে যারা ধ্বংস করতে চাচ্ছে, তাদের একজন নেতা হয়ে গেলেন কি করে তার মা! এমন হলেন কেন মা? কি হলো তার? এখন কি করবে সে? কি তার করণীয়? আহমদ মুসাকে হত্যার জন্যে ওরা পাগল হয়ে উঠেছে। আহমদ মুসা কে? বুঝা গেছে খুব বড় কেউ, জগৎ জোড়া যার নাম। রাফায়েলরা তাকে সাংঘাতিক ভয় করে। মা তাকে বলেছেন মজলুমদের রক্ষক। ওআইসি ও রাবেতার আহ্বানে সে দিভিনে এসেছে আমাদের সাহায্য করার জন্যে। পয়জন বোমায় সে হয়তো মরেই গেছে। বেঁচে থাকলে আজকেই হয়তো তার শেষ রাত। ভাবতে গিয়ে শিন সেনগারের মন হুহু করে কেঁদে উঠল। সে আহমদ মুসাকে জানে না, চেনে না, কিন্তু সে মজলুম মানুষের বন্ধু, দিভিনের বন্ধু! সে তো নিজের কোন স্বার্থ নিয়ে এখানে আসেনি, এসেছে মানুষের কাজে। সে জানতে পেরেছে তার মহাবিপদের কথা, কিন্তু কিছু করার তো ক্ষমতা তার নেই। জানতে পারাই তার এখন বড় যন্ত্রণা। মনে পড়ল এরদেলানের কথা। সংগে সংগে কেঁপে উঠল তার মন। সেও কি বেঁচে নেই?
এবার বাঁধভাঙা অশ্রু নেমে এল তার দুচোখ দিয়ে। হৃদয়টা তার হাহাকার করে উঠল। সবচেয়ে কাছের যে, সেই মা এখন তার কাছে। নেই। হৃদয়ের মণিকোঠায় যার অধিষ্ঠান, সেই থাকল না?
শিন সেনগারের চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেল মেশিনগান, সাব মেশিনগানের একটানা শব্দে।
চমকে উঠে বসল শিন সেনগার।
ছুটে বেরিয়ে এল তার দক্ষিণের বারান্দায়।
শব্দ আসছে এরদেলানদের বাড়ির খুব কাছাকাছি জায়গা থেকে।
বুক কেঁপে উঠল শিন সেনগারের।
রাফায়েলদের লোকরা কি আক্রমণ করল আহমদ মুসা ও আমাদের লোকদের? তাহলে আহমদ মুসারা কি বেঁচে আছে? তাদের সাথেই কি সংঘাত, না রাফায়েলরা এক একতরফা আক্রমণ করেছে? প্রায় মিনিট খানেক ধরে মেশিনগান, সাব-মেশিনগানের শব্দ থেমে থেমে শোনা গেল। তারপর সব চুপচাপ।
চুপচাপ কেন সব? সব কি শেষ হয়ে গেল? আহমদ মুসা, এরদেলানরা, সর্দার আসতি আওয়াতরা কি সবাই শেষ হয়ে গেল? ব্যাকুল হয়ে উঠল শিন সেনগারের হৃদয়। মন জুড়ে নামল রাজ্যের হতাশা। ভেতরটা তার কাঁপছে, শরীরটাও যেন কাঁপছে তার সাথে সাথে।
টলতে টলতে ঘরে এসে নিজেকে ছেড়ে দিল বিছানায়। আর সে ভাবতে পারছে না। তার পরিচিত পৃথিবীটা যেন ছোট হয়ে আসছে। চারদিকের নিঃসীম আঁধারে সে যেন একা। অন্ধকারের পুরু চাদর যেন। তার অস্তিত্বকেও ঢেকে দিয়েছে।
তার দুকানে সেই দক্ষিণ থেকেই আবার গুলির শব্দ ভেসে এল। একটানা চলল কিছুক্ষণ। হয়তো একমিনিট বা তার কম।
এই শব্দ শিন সেনুগারের হতাশা আরও বাড়িয়ে দিল। শুয়ে থাকতে পারছিল না সে। উঠে দাঁড়াল। কিছু করতে হবে তাকে। কি করবে সে?
.
কৃষ্ণপক্ষের রাত। শেষ রাতের চাঁদটা পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। রাত কৃষ্ণপক্ষের হলেও আকাশ মেঘ ও কুয়াশামুক্ত হবার কারণে অন্ধকারটা সে রকম গাঢ় নয়।
আহমদ মুসা রাস্তার পাশ দিয়ে অনেকটা হামাগুড়ি দেয়ার স্টাইলে এগোচ্ছিল। পেছনে আসছিল এরদেলান। এরদেলানদের বাড়ি থেকে প্রাইভেট রাস্তাটা নেমে উত্তর-দক্ষিণ সড়কের সাথে যেখানে মিশেছে, সে মোড়ের কিছুটা উত্তরে এগিয়ে সড়কটার উপর চোখ রাখা তাদের লক্ষ। আহমদ মুসার বিশ্বাস আসতি আওয়াতদের বাড়িতে খোঁজ নিতে যারা আসবে, তারা নিশ্চয় উত্তরের কোন স্থান থেকে আসবে। রাতের অভিযানে আসতি আওয়াতের বাড়িতে যারা এসেছিল, তারাও এসেছিল উত্তর দিক থেকে।
মোড় পেরিয়ে এসেছে আহমদ মুসারা।
রাস্তা থেকে দশ বারো ফিট দূর দিয়ে ক্রলিং করে এগোচ্ছে আহমদ মুসারা। আগে আহমদ মুসা, পেছনে এরদেলান।
হঠাৎ সামনে ও পেছনে একটা পাথরের সাথে একটা ধাতব কিছু ঠুকে যাওয়ার এবং একটা শুকনো ডাল ভাঙার শব্দ হলো। আহমদ মুসার সমগ্র সত্তায় চিন্তার একটা তড়িৎপ্রবাহ খেলে গেল, আমরা ঘেরাও হয়ে পড়েছি। চিন্তার সংগে সংগেই মেশিন রিভলবার বাগিয়ে চিৎ হয়ে গেল। চিৎ হয়েই সে দেখতে পেল চারদিক থেকে পাঁচ ছয় জনের মত লোক উঠে দাঁড়াচ্ছে। দেখতে পাওয়া এবং আহমদ মুসার রিভলবার যেন একসাথে কাজ করল। তার রিভলবার থেকে তিনপাশে চারটি গুলি বেরিয়ে গেল।
গুলি করেই আহমদ মুসা চোখের পলকে নিজের দেহকে ডান দিকে গড়িয়ে নিল। ঠিক সে সময়েই মাথার দিকে একটা গুলি এসে আহমদ মুসার মাথা যেখানে ছিল, সেখানে এসে বিদ্ধ হলো। আহমদ মুসা গড়িয়ে গিয়েই মাথার পেছন দিক থেকে আসা গুলির শব্দ লক্ষে গুলি করল। গুলির সাথে সাথে আহমদ মুসার চোখটিও চলে গেল, মাথার পেছনের দিকে। দেখল আহমদ মুসার দিকে রিভলবারের নল ঘুরিয়ে নেয়া একজন লোক গুলি খেয়ে পড়ে গেল।
আতংকিত এরদেলান উঠে বসতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা নিষেধ করে বলল, ওদের আরও লোক থাকতে পারে।
আহমদ মুসার চোখে নাইটভিশন গগলস। একটা বড় পাথরে মাথা। রেখে আহমদ মুসা চারদিকে চোখ রাখছে। চারদিক নীরব, নিঝুম।
সময় বয়ে যাচ্ছে পল পল করে।
নিঃশব্দে কেটে গেল মিনিট পাঁচেক সময়।
আহমদ মুসার চোখ উত্তর দিক দিয়ে ঘুরে আসছিল, হঠাৎ দুটি অবয়ব। আহমদ মুসার গগলসে ধরা পড়ল। দুটি মানুষ ক্রলিং করে এদিকে এগিয়ে আসছে। তাদের দুজনের হাতেই একটি করে রিভলবার। তাদেরও চোখে নাইটভিশন গগলস।
আহমদ মুসা তার মাথা পাথরের সাথে সেঁটে রেখে রিভলবার বাড়িয়ে ধরে পাথরের মত স্থির হয়ে রইল।
ওরা আসছে বিড়ালের মত নিঃশব্দে।
অনেকখানি কাছে এসে গেছে ওরা।
আহমদ মুসার মাথার পেছনে যে লোকটি গুলি খেয়ে মারা পড়েছে, তাকে ওরা দেখতে পেয়েছে বলে মনে হলো আহমদ মুসার কাছে।
ওদের গগলস চারদিকে ঘুরছে। ওরা যেন আরও সতর্ক হয়েছে। রিভলবারের ট্রিগারে ওদের হাত।
ওরা আসছে ওদের সাথীর কাছে মৃত না আহত তা দেখার জন্যে। ওরা দুজন এসে গেছে।
একজন পরীক্ষার জন্যে ঝুঁকে পড়েছে তার সাথীর উপর। অন্যজন হাঁটু গেড়ে বসে রিভলবার বাগিয়ে চোখ রাখছে চারদিকে। নাইটভিশন গগলস তার চোখে।
এরদেলান সম্ভবত এদিকে প্রথম তাকাল এবং দেখতে পেল লোকটিকে রিভলবার হাতে। সংগে সংগেই সে চাপা কণ্ঠে স্যার বলে ডেকে উঠল।
এরদেলানের গলার শব্দ পাওয়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার চোখ পেছনে সরে গিয়েছিল। চোখের পলকেই আবার তা সামনে ফিরে এল। আহমদ মুসা দেখল, লোকটি গুলি ছুড়ছে এরদেলান লক্ষে।
আহমদ মুসার রিভলবার সামনে তাক করাই ছিল। ট্রিগার টিপল আহমদ মুসা সংগে সংগেই।
দুটি গুলির শব্দ হলো দুই এক সেকেন্ডের ব্যবধানে।
আহমদ মুসার গুলি প্রতিআক্রমণের হলেও তার গুলি আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল। লোকটি গুলিবিদ্ধ হওয়া ও ট্রিগার টেপা একসংগেই ঘটল। শেষ মুহূর্তে তার হাতটা ঝুঁকে গিয়েছিল গুলির আঘাতে। বসে থাকা এরদেলানের মাথায় গুলিটা না লেগে তা বিদ্ধ করল তার ডান কাঁধকে। আহমদ মুসা এরদেলানের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল।
লোকটি মাথায় গুলি খেয়ে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা চোখ ফেরাতে যাচ্ছিল এরদেলানের দিকে। কিন্তু তার চোখে পড়ল, দ্বিতীয় ব্যক্তি ঝুঁকে পড়া অবস্থা থেকে উঠে বসেছে। তার হাতে উদ্যত রিভলবার। লক্ষ আহমদ মুসা। তার হাত চিন্তার মতই দ্রুত ঘুরে এল, সাথে সাথে তার মাথা দ্রুত নিচে নেমে গেল। স্থির ডান হাতের রিভলবার-থেকে একটা গুলি বেরিয়ে গেল। ওদিক থেকে আরেকটা গুলি তার হাতের উপর দিয়ে চলে গেল মুহূর্ত কয়েক পরেই। নামিয়ে না নিলে তার মাথাটা ছাতু হয়ে যেত। অন্যদিকে আহমদ মুসার গুলি এ লোকটিরও মাথা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মিনিট খানেক অপেক্ষা করল, ওদিক কিংবা আর কোন দিক দিয়ে গুলি আসে কিনা তা দেখার জন্যে।
গুলি এল না। কোন নড়াচড়াও কোন দিক দিয়ে দেখা গেল না।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে মাথা তুলল। দেখল দ্বিতীয় লোকটিও ছিটকে পড়ার মত পড়ে আছে। ল আহমদ মুসা দ্রুত ক্রলিং করে এগোলো এরদেলানের দিকে।
কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, এরদেলান কোথায় গুলি লেগেছে? কেমন আছ তুমি?
আমি ভালো আছি। কাঁধের উপরে গুলি লেগেছে। ওদিকের কি অবস্থা? এরদেলান বলল।
মনে হচ্ছে ওরা সাতজনই মারা গেছে। গুলি তোমার কাঁধের ভেতরে ঢুকেছে মনে করছ? বলল আহমদ মুসা।
বুঝতে পারছি না স্যার। এরদেলান বলল।
কাঁধের ভেতরটা কি ভারি মনে করছ? বলল আহমদ মুসা।
না। কাঁধের মাথাটায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। এরদেলান বলল।
হাজার শোকর আল্লাহর। তোমার কাঁধে গুলি নেই মনে হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ…।।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই যেখানে তিনটি লাশ পড়ে আছে, সেখান থেকে মোবাইল বেজে উঠার শব্দ শুনতে পেল।
এরদেলান তোমার কষ্ট হচ্ছে, একটু অপেক্ষা কর।
বলেই আহমদ মুসা দ্রুত ক্রলিং করে এগোলো মোবাইলের রিং যেদিক থেকে আসছে সেদিকে। সেখানে পৌঁছল আহমদ মুসা।
তার মাথার পেছনে তিনটি লাশের মধ্যে যে লোকটি প্রথম মারা গিয়েছিল, তার পকেটের মোবাইলটিই বাজছে।
আহমদ মুসা তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিল। স্ক্রিনের দিকে তাকাল। রাফায়েল নামের একজন লোকের কল।
আহমদ মুসা মোবাইলটা ধরল ওপারের কথা শোনার জন্যে।
ওদিক থেকে রাফায়েলই সম্ভবত পাগলের মত চিৎকার করছে, সারজেই গ্যারিক কথা বলছ না কেন? ওদিকের খবর কি? গোলাগুলি কেন? গ্যারিক কি হলো, কথা বল, কথা বল…।
একটু থেমেই রাফায়েল নামক লোকটি পাশের কাউকে বলল, ব্যাপারটা খুবই বিদঘুঁটে লোভেন। কল ওপেন হলো, অথচ কেউ কথা বলছে না। চল আমরা ওদিকে এগোই।
উত্তরে একটা কণ্ঠ বলল, কিছুই যখন জানা যাচ্ছে না, তখন সামনে এগিয়ে দেখাই দরকার। হতে পারে কল ওপেন করলেও কথা বলার পর্যায়ে নেই সে। তাদের সাহায্যে এগোনো দরকার আমাদের।
আবার রাফায়েলের গলা শোনা গেল। বলল, তাদের সাথে গোলাগুলি কারা করল। ওরা যদি সবাই মরে গিয়ে থাকে, তাহলে কার এমন সাহস হতে পারে যে গুলি চালাতে যাবে! দিভিনের লোকদের এমন সাহস কোন দিন হয়নি!
চলুন আমরা এগোই। বলল একটা নতুন গলা।
হ্যাঁ, এগোতেই হবে। চল। বলল রাফায়েল।
ওদিকের কথা থেমে গেল।
তাহলে ওরা এদিকে আসছে। মনে মনে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা আবার দ্রুত সরে এল এরদেলানের কাছে। তাকে উঁচু একটা পাথরের আড়ালে সরিয়ে নিয়ে গেল। বলল, এরদেলান ব্লিডিং তোমার বন্ধ হয়নি। বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের আরও কিছুটা সময় এদিকে অপেক্ষা করতে হবে।
আহমদ মুসা এরদেলানের শার্ট ছিঁড়ে ফেলল। জ্যাকেটের পকেট থেকে এক খণ্ড ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ বের করল। দ্রুত রক্ত মুছে নিয়ে ব্যান্ডেজটা আটকে দিল এরদেলানের আহত জায়গাটায়। বলল আহমদ মুসা এরদেলানকে, তুমি এখানে থাক। আমি ওদিকে দেখছি। ওদের আরও লোক আছে কিনা।
স্যার, তখন ঐভাবে আমার কথা বলে ওঠা ঠিক হয়নি। এরদেলান। বলল।
এসব নিয়ে ভেব না। যা ঘটবার তাই ঘটেছে। সব সময় আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। বলে আহমদ মুসা ওদিকে ফিরল।
ফিরেই দেখতে পেল তিনটি স্টেনগান তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। স্টেনগানের পেছনে তিনজন ওরা যমদূতের মত দাঁড়িয়ে আছে।
ওরা আহমদ মুসার দেখে পড়ার সাথে সাথে সে চোখের পলকে গড়িয়ে চিৎ হয়েই পা দুটো আকাশের দিকে তুলে সামনের দিকে ছুঁড়ে দিল। তার দেহটা শূন্যে একবার সম্পূর্ণ পাক খেয়ে আবার চিৎ হলো এবং তার ছুটে চলা পাদুটো প্রচণ্ড গতিতে আঘাত করল পাশাপাশি দাঁড়ানো। দুজনকে। ওদের দুজনের দেহ পেছন দিকে ছিটকে পড়ল। তৃতীয় জন। তখনও বিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে।
আহমদ মুসার দেহও পড়ল গিয়ে মাটিতে। দেহটা মাটিতে পড়ার সময়ই আহমদ মুসা তার ডান হাতের রিভলবার থেকে গুলি ছুঁড়ল দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে।
তৃতীয় লোকটি তখন দেড় গজ দুগজের মধ্যে, মাথাটা তার আহমদ মুসার পড়ন্ত দেহ থেকে ৪৫ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থানে। সুতরাং আহমদ মুসার নিক্ষিপ্ত গুলি লোকটার কণ্ঠনালির পাশ দিয়ে গিয়ে মাথা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
আহমদ মুসার দেহ যেমনটা মাটিতে পড়েছিল, তেমনটাই পড়ে থাকল।
আহমদ মুসার চোখ দুটি সামনে প্রসারিত, ওরা দুজন যেখানে পড়েছিল সেদিকে। তার রিভলবারও সেদিকেই তাক করা আছে।
লোক দুটি ছিটকে পড়ার সময় তাদের হাত থেকে স্টেনগানও ছুটে গিয়েছিল। ওরা মাটিতে পড়েই উঠে বসেছিল এবং পকেট থেকে বের করছিল টেবিলটেনিস বলের মত গোলাকার বস্তু।
আহমদ মুসাকে শোয়া অবস্থা থেকে উঠতে না দেখে ওরা আশান্বিত হয়েছিল যে, হয়তো আহমদ মুসা মারাত্মকভাবে আহত কিংবা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে সংগে সংগে ওরা বোমা ছুঁড়েনি।
কিন্তু ওরা আহমদ মুসার দিকে মুখ ফেরাতেই দেখতে পেল উদ্যত রিভলবার।
চোখের পলকেই ওদের হাত উপরে উঠেছিল এবং হাতের বোমা ছুঁড়তে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা এই সময়েরই অপেক্ষা করছিল। তার রিভলবার থেকে জোড়া গুলি বেরিয়ে গেল লোক দুটির উদ্দেশ্যে। তাদের হাত থেকে বোমা দুটি খসে পড়ল। তাদের দেহ পাক খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। এগোলো ঐ তিনজনের দিকে। দাঁড়াল গিয়ে ওদের তিনজনের লাশের সামনে। মনে মনে বলল, এদেরই একজন। রাফায়েল। তিনজনের পকেট সার্চ করল সে। কাগজপত্র কিছু পেল না। পেল তিনটি মোবাইল, তিনটি মানিব্যাগ, তিনটি রিভলবার। মানিব্যাগ ওদের পকেটে রেখে দিয়ে তিনটি মোবাইল ও তিনটি রিভলবার পকেটে পুরল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতেই দেখল, এরদেলান পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পাশের পাথরটায় বসা এরদেলান। আমরা এখানে দশ মিনিট। অপেক্ষা করব। তারপর তোমাদের বাসার দিকে যাব।
বলে আহমদ মুসা আরেকটা পাথরের উপর বসল।
আহত কাঁধের বাহুটা চেপে ধরে এরদেলান পাশের পাথরে বসল।
বসেই বলল, স্যার, একটা কথা, আপনি তিনটি উদ্যত স্টেনগানের মুখে যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তখন যদি গুলি হতো।
গুলি হবে না বলেই তো ঝাঁপ দিয়েছি। বলল আহমদ মুসা।
কেমন করে বুঝলেন? এরদেলান বলল।
ওরা তিনজন স্টেনগানধারী হওয়ায় এবং আমাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পাওয়ায় তাদের আত্মবিশ্বাস এতটাই ছিল যে, আমাকে দেখামাত্র আক্রমণের তারা প্রয়োজন দেখেনি। তৎক্ষণাৎ আমি ভাবলাম যখন আমি ওদের উপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ব, তখন ওরা কিছু সময়ের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়বে। সেই সুযোগে আমিই প্রথমে আক্রমণে যেতে পারব। এই সব বিবেচনা আমার সামনে ছিল। বলল আহমদ মুসা।
এত বিবেচনার জন্যে সময় কোথায় পেলেন আপনি? এরদেলান বলল।
আল্লাহর দেয়া মস্তিষ্কের ক্ষমতা যে কত তা বিজ্ঞান নিরূপণ করতে পারেনি। মুহূর্তে এই মাথা ভয়ানক সব জটিলতার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা এরদেলানকে বলল, তুমি হাঁটতে পারবে?
পারব। কেন? এরদেলান বলল।
তোমাকে বাড়িতে যেতে হবে। ওরা নিশ্চয় বাড়িতে এসেছে। এদিকের গোলাগুলির শব্দ সবার কানে গেছে। সবাই নিশ্চয় উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। তুমি সবাইকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলো। আর একটা কথা, ত্রিফা বেফ্রিনের কোন খোঁজ নিতে পার কিনা দেখ?
কি খোঁজ স্যার। এরদেলান বলল।
রাতে তিনি কেমন ছিলেন, রাতে অ্যাটেনডেন্ট হিসাবে কেউ তার কাছে ছিল কিনা? ইত্যাদি। বলল আহমদ মুসা।
আংকেল তো নেই। আমি তার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করতে পারি স্যার। বলল এরদেলান।
আমি বাড়ি গিয়ে মোবাইল নিয়ে তাকে টেলিফোন করবো স্যার। এরদেলান বলল।
এরদেলান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, স্যার, আপনি কি আরও কিছুক্ষণ এখানে থাকবেন? শত্রুরা কেউ এদিকে আছে বলে সন্দেহ করছেন?
ঠিক সন্দেহ নয় এরদেলান, একটু সাবধানতা অবলম্বন করছি। আর একটু এখানে থেকে যেতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে স্যার। আমি চলছি। আল্লাহ হাফেজ। এরদেলান বলল।
চলে গেল এরদেলান।
আহমদ মুসা হামাগুড়ি দিয়ে সড়কের পাশে পৌঁছল। একটা পাথরের আড়ালে বসল সে, যেখান থেকে উত্তর দিকে সড়কের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।
পকেট থেকে রাফায়েলের মোবাইলটা বের করল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা ভাবছিল, রাফায়েল নেতা গোছের কেউ হবে। সেই তো টেলিফোনে তার লোকদের খোঁজ নিচ্ছিল। তারপর রাফায়েলরাই তো ছুটে এসেছে তাদের লোকদের খোঁজ-খবর নিতে বা উদ্ধার করার জন্যে। তার মোবাইল কললিস্টে পাওয়া যাবে তারা অপারেশনে এসে কার বা কাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। আহমদ মুসার প্রয়োজন লোকাল কারও নাম। দিভিন এলাকার কার সাথে তাদের যোগাযোগ আছে, এটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাফায়েলের কললিস্ট ওপেন করতেই প্রথমেই ত্রিফা বেফ্রিনের নাম পেয়ে গেল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা খুব বিস্মিত হলো না। তার সন্দেহ পাকাপোক্ত হওয়ায় সে বরং খুশিই হলো। দিভিনে শত্রুদের একটা লিংক পাওয়া গেল। কললিস্ট পরীক্ষা করে আহমদ মুসা দেখতে পেল, গত পৌনে এক ঘন্টার মধ্যে রাফায়েল ও ত্রিফা বেফ্রিনের মধ্যে দুইবার যোগাযোগ হয়েছে। তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে তা জানা না গেলেও যোগাযোগের ব্যাপারটা প্রমাণ হিসাবে মূল্যবান।
রাফায়েলের মোবাইলটা আহমদ মুসা পকেটে পুরে পাথরের আড়ালে বসেই ফজরের নামাজ পড়ে নিল।
নামাজ পড়ে উঠে আহমদ মুসা সড়ক বরাবর উত্তর দিকে তাকাল। কিছু দূরে এই সড়কের পশ্চিম পাশে ত্রিফা বেফ্রিনদের বাড়ি।
ত্রিফা বেফ্রিনদের বাড়ি যাবে কিনা, ভাবতে লাগল আহমদ মুসা। এদিকে এ ঘটনা ঘটছে, রাফায়েলরা মারা গেছে! অবশ্যই তার ঘুমিয়ে থাকার কথা নয়। কি করছে সে? দিভিন বিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে সে কতটা জড়িত? দিভিনবাসী হয়ে কেন সে এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেবে? তার কি অন্য কোন পরিচয় আছে? ত্রিফার বাড়িতে যাবার কথাই অবশেষে চিন্তা করল আহমদ মুসা। না
আহমদ মুসা উঠতে যাচ্ছে, এমন সময় দেখল কে একজন উত্তর দিকের রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে।
রাতের অন্ধকার আর নেই। পুবের আকাশ একদম ফর্সা হয়ে গেছে। চারদিকের সবকিছু এখন দেখা যাচ্ছে।
আহমদ মুসা দেখতে পেল, একজন তরুণী ছুটে আসছে সড়ক দিয়ে। পরনে তার রাতের পোষাক। মাত্র একটা ওড়না জড়ানো মাথায়। ছুটছিল আর পেছনে তাকাচ্ছিল সে।
তরুণীটি আহমদ মুসা বরাবর এসে পড়েছে।
উত্তর দিক থেকে একটা গাড়ির শব্দ পেল আহমদ মুসা। তাকাল সেদিকে। দেখল আহমদ মুসা একটা গাড়ি তীরবেগে ছুটে আসছে।
গাড়ির দিকে চোখ পড়তেই তরুণীটি আরও জোরে ছুটার চেষ্টা করল। কিন্তু গাড়িটি পাগলের মত ছুটে এসে তরুণীটিকে ওভারটেক করে তরুণীটির পথ রোধ করে দাঁড়াল।
গাড়ি থেকে দ্রুত নামল একজন মহিলা।
মহিলাটি ত্রিফা বেফ্রিন, দেখেই চিনতে পারল আহমদ মুসা। তার হাতে ব্যান্ডেজ। এই অবস্থায়ও সে গাড়ি চালিয়ে এসেছে! তরুণীটি কে? তার মেয়ে?
আহমদ মুসা যে পাথরের আড়ালে বসে রয়েছে, সেখান থেকে ওরা খুব কাছেই বলা যায়।
ত্রিফা বেফ্রিন গাড়ি থেকে নেমেই বলল তরুণীটিকে, শিন সেনগার গাড়িতে উঠ।
না আমাকে সরদারের ওখানে যেতে হবে। আমি যাব। বলল জোরের সাথে শিন সেনগার।
তোমাকে অনেক বুঝিয়েছি। আর নয়। তিন পর্যন্ত গুনব, এর মধ্যে গাড়িতে উঠবে। না উঠলে আমার মেয়ে বলে কেউ দুনিয়াতে থাকবে না। বলল ত্রিফা বেফ্রিন। কঠোর তার কণ্ঠ।
আহত হাতেই রিভলবার উঠে এসেছে ত্রিফা বেফ্রিনের। শিন সেনগার লক্ষে উঠে এল তার রিভলবার। এক…। গুনতে শুরু করল ত্রিফা। বেফ্রিন।
ভীষণ ধাঁধায় পড়েছে আহমদ মুসা। কি নিয়ে মেয়ের সাথে বিরোধ! তার কারণে নিজ হাতে মেয়েকে হত্যা করবে? এর অর্থ, হয় মেয়ে তার কথা শুনবে, না হয় মেয়েকে মরতে হবে। কেন? মেয়ে কি তার বিপদের কারণ? কি বিপদ? মেয়ের কাছে কি তার পরিচয় ধরা পড়ে গেছে?
আহমদ মুসার চিন্তা আর এগোতে পারল না।
গুনছে ত্রিফা বেফ্রিন। তার কণ্ঠে তিন শব্দ উচ্চারিত হবার সংগে সংগে শিন সেনগার চিৎকার করে বলল, তুমি আমাকে মেরে ফেলতে পার মা, তবে আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না।
শিন সেনগারের কথা শেষ করার আগেই ত্রিফা বেফ্রিনের তর্জুনি রিভলবারের ট্রিগারের উপর চেপে বসতে শুরু করেছিল।
আহমদ মুসা ত্রিফার আঙুলের উপর নজর রেখেছিল। তার গুলি করা নিশ্চিত হবার সংগে সংগেই আহমদ মুসার রিভলবার গর্জন করে উঠল।
ত্রিফার হাত আহত হয়েছিল আগেই। এবার আহমদ মুসার টার্গেট ছিল ত্রিফার হাতের রিভলবার।
আহমদ মুসার রিভলবারের গুলি ত্রিফার রিভলবারে লাগায় তার গুলি লক্ষভ্রষ্ট হয়ে গেল। গুলিটা শিন সেনগারের বাম বাহুর কিছুটা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। আর্তনাদ করে উঠে শিন সেনগার ডান হাত দিয়ে বাম বাহু চেপে ধরেছিল।
আহমদ মুসা গুলি করেই দৌড়ে গেল ওদের কাছে। দাঁড়াল গিয়ে ত্রিফা বেফ্রিনের সামনে। বলল, মিসেস ত্রিফা আপনাদের কি হলো? আপনার মেয়েকে সামান্য কারণে হত্যা করছিলেন কেন?
আহমদ মুসার দিকে তাকাল ত্রিফা বেফ্রিন। তার দুচোখে আগুন। কিন্তু কিছু বলল না। তাকাল আবার শিন সেনগারের দিকে। বলল, তুমি বাসায় যাবে কিনা শিন সেনগার? আমার শরীরটা ভালো নয়।
না মা, আমি এখন যাব না। সরদার আসতি আওয়াতের ওখানে আমার যেতে হবে। তারপর বাসায় ফিরব মা। শিন সেনগার বলল।
না আগে বাসায় ফিরবে। এস। বলল ত্রিফা বেফ্রিন।
মিসেস ত্রিফা বেফ্রিন, আপনার মেয়ে ফিরছে তো একটু পরেই। যেতে দিন ওকে সরদার সাহেবের বাড়িতে। চলুন আমি আপনাকে আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেব। আহমদ মুসা বলল।
আবার আগুনে দৃষ্টিতে ত্রিফা বেফ্রিন আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, আপনি কে? আমাদের মধ্যে আসছেন কোন্ অধিকারে? আপনিই তো এর আগে আমার হাতে গুলি করেছেন। এখন আবার গুলি করলেন। কিছুক্ষণ আগে এখানে দশ বারোজন আর্মেনীয় মানুষ নিহত হয়েছে। তাদের হত্যা তাহলে আপনিই করেছেন। আপনাকে বিশ্বাস করব কেন?
আমাকে অবাক করলেন মিসেস ত্রিফা বেফ্রিন। যদি মেরে থাকি, তাহলে আপনার ও দিভিনের শত্রুকে মেরেছি। আপনার তো আমাকে আরও বেশি বিশ্বাস করা দরকার। আহমদ মুসা বলল।
ত্রিফা বেফ্রিন কোন জবাব দিল না। তাকাল শিন সেনগারের দিকে।
ঠিক সে সময়েই শিন সেনগার বলল, মা আমি চললাম।
বলে চলা শুরু করল শন সেনগার।
ত্রিফা বেফ্রিন শিন সেনগার চিৎকার করে উঠল এবং সেই সাথে গলার চেনের লকেটটা কামড়ে ধরল।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে চেন ধরে টান দিয়ে মুখ থেকে লকেটটা বের করতে চাইল। কিন্তু হলো না। চেনটা ছিঁড়ে বেরিয়ে এল।
ত্রিফা বেফ্রিনের দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
শিন সেনগার ছুটে এল মায়ের কাছে। বলল, কি হলো মায়ের?
আহমদ মুসা বসে পড়ে ত্রিফা বেফ্রিনের নাড়ী পরীক্ষা করছিল। মাথা তুলে তাকাল সে শিন সেনগারের দিকে। বলল, স্যরি শিন সেনগার। তোমার মা আর নেই। উনি গলার লকেটে লুকিয়ে রাখা পটাশিয়াম সায়নাইড খেয়েছেন।
শিন সেনগার চিৎকার করে মায়ের লাশের উপর আছড়ে পড়ল।
.
সকাল হয়ে গেছে। সরদার আসতি আওয়াতের বাসা থেকে সবাই এল সেখানে। প্রথমে এসেছিল ইভা নারিন।
এরদেলানের কাছ থেকে আগের খবর সবাই তারা জেনেছিল। শিন সেনগার ও ত্রিপা বেফ্রিনের ঘটনাও তারা জানল।
সব বিষয় থানায় জানাবার নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
ছুটল কয়েকজন থানার দিকে।
অবশিষ্টরা বসে অপেক্ষা করতে লাগল পুলিশের।
.
৩.
দিভিনের সরদার আসতি আওয়াতের স্ত্রীর লাশ দাফন করে মসজিদে জোহরের নামাজ পড়ে সবাই এসে বসেছে আসতি আওয়াতের বৈঠকখানায়।
দিভিনের প্রধান শাইখ ও প্রধান জুমআ মসজিদের ইমাম আব্দুল হক আল মাদানী আল আজহারীসহ দিভিনের অন্য মসজিদের ইমামরাও এসেছেন। এসেছেন দিভিনের সব সমাজপ্রধান। তাদের সবাইকে দাওয়াত করেছেন সরদার আসতি আওয়াত।
আহমদ মুসা ও ইভা নারিন তখনও আসেননি। আহমদ মুসা মসজিদ থেকে এসে তার রুমে গেছেন।
সরদার সাহেব আমি মেগ্রি থেকে সকালে এসে পৌঁছেছি। এসেই সব শুনলাম। বিশ পঁচিশজনের মত লোক নিহত হয়েছে গত রাতেই। তাদের কেউ নাকি দিভিনের নয়। যিনি মেরেছেন তিনিও দিভিনের নন। একজন। লোক এতজনকে মারলেন কি করে? থানা কি বলছে এসব নিয়ে? শুনলাম দিভিনের গুরুত্বপূর্ণ একজন মোহাম্মাদ বেহেজের স্ত্রীও নাকি মারা পড়েছে তাঁর হাতে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এমনিতেই আমাদের দিভিন বিপদগ্রস্ত। এসব নিয়ে কি ঘটতে যাচ্ছে, সেটা চিন্তার বিষয়। বলল শাইখ আব্দুল হক আল মাদানী। শাইখের বয়স তিরিশের বেশি নয়।
চিন্তার বিষয় অবশ্যই শাইখ। কিন্তু জনাব, যা ঘটেছে তা ঘটারই ছিল। কারো কিছুই করার ছিল না।
বলে সরদার আসতি আওয়াত গত সন্ধ্যারাতে দিভিনের কারিগরি কেন্দ্রের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থেকে শুরু করে রাতে দশ-বারোজন সশস্ত্র আক্রমণকারীর আক্রমণ, জীবন বিধ্বংসী গ্যাস বোমার আক্রমণ এবং ভোর রাতে পুনরায় শত্রুদের আগমন বিষয়ে সংক্ষেপে সবকিছু জানিয়ে বললেন, লোকটি আল্লাহর ফেরেশতা হিসাবে এসেছেন। তিনি না এলে শত্রুদের হয়তো একজন লোকও মরত না, কিন্তু আমাদের কত লোক মারা যেত জানি না।
সরদার সাহেব, আপনি যা বললেন তা অবশ্যই সত্য এবং ঘটনা যা ঘটেছে তাও সত্য। কিন্তু সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এমন মানুষ কোত্থেকে এল। আর বাড়িতে গ্যাস বোমা ফেলা হবে, সেটা আন্দাজ করলেন কিভাবে? ম্যাডাম ত্রিফা বেফ্রিনের টেলিফোন এবং গ্যাস মাস্ক হারিয়ে যাওয়া থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন যুক্তি নেই। কিন্তু তিনি বলেছেন এবং ঘটনাও ঘটেছে। বাড়ির সব ছাগল, ভেড়া ও ঘোড়ার মৃত্যু প্রমাণ করে কতটা ভয়াবহ ছিল গ্যাস বোমা। আপনাদের সবার একই অবস্থা হতো, যদি তার কথা শুনে আপনারা সরে না যেতেন। তবে আমি মনে করি বেহেজ সাহেবের স্ত্রীর মৃত্যুর ব্যাপারটা ভালো করে দেখা দরকার। বলল, শাইখ আব্দুল হক।
হ্যাঁ, মুহতারাম শাইখ। ম্যাডাম ত্রিফা বেফ্রিনের মেয়ে সিন সেনগার সবকিছু জানেন এবং দেখেছেন। তার কাছ থেকেও সব জানা যাবে। বলল সরদার আসতি আওয়াত।
সরদার আসতি আওয়াতের কথার শেষ দিকে এরদেলান, আহমদ নেবেজ, শেপল আহমদ মুসা ও ইভা নারিনকে নিয়ে বৈঠকখানায় প্রবেশ করল।
শাইখ আব্দুল হক সরদার আসতি আওয়াতের দিকে তাকিয়েছিল। কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসারা তাদের সামনে চলে গিয়েছিল।
একটা বিশেষ সোফায় বসেছিলেন আসতি আওয়াত। তাঁর পাশে আরেকটি বিশেষ সোফা সেট করা হয়েছিল শাইখের জন্যে। এ দুটি সোফা ছিল পাশাপাশি। এই দুই সোফা থেকে একটু ব্যবধানে সরদার, আসতি আওয়াতের বাম পাশে একটা সোফা নির্দিষ্ট ছিল আহমদ মুসার জন্যে। আর শাইখের বাম পাশে একটু ব্যবধানে বসেছিলেন দিভিনের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি এবং দিভিনের সাবেক সরদার অ্যালান ফারহাদ। অন্যরা বসেছিলেন সবাই সামনে। ইভা নারিনের জায়গা হয়েছিল শেপল ও শিন সেনগারের সাথে।
সরদার আসতি আওয়াতকে সামনের দিকে চোখ ফেরাতে দেখে শাইখ আব্দুল হকও তাকাল সামনে। চোখ পড়ল আহমদ মুসার উপর। ভূত দেখার মত চমকে উঠে দাঁড়াল শাইখ আব্দুল হক।
আরেকটু ভালো করে দেখেই শাইখ আব্দুল হক এগিয়ে এল আহমদ মুসার কাছে। সালাম দেয়ার সাথে হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, স্যার আপনি? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? কিভাবে সম্ভব আপনি দিভিনে?
আহমদ মুসা সালাম নিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, আপনি ভুল দেখছেন কি না, তা আমি বলতে পারবো না। কিন্তু আমি জনাবকে চিনতে পারলাম না।
আপনি আমাকে দেখেননি, চিনবেনও না স্যার আমাকে। মদীনা শরীফে এক অনুষ্ঠানে আপনাকে আমি দেখেছি। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদে নববীর কর্মচারী-কর্মকর্তারা আপনাকে সম্বর্ধনা দিয়েছিল। চীফ গেস্ট ছিলেন মদীনার গভর্নর। গভর্নরের পাশে আপনি বসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
বলেই শাইখ আব্দুল হক আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে নিজের আসনে বসাল। পাশে দাঁড়িয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। এমন এক মহান ভাইয়ের দেখা আমরা পেয়েছি, যার দেখা পাওয়া, হ্যান্ডশেক করা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। আরেকটা কথা আমি বলছি, আল্লাহ আমাদের দিভিনের দুঃখের দিনের শেষ করেছেন।
বলে শাইখ আব্দুল হক সামনে অন্য কয়েকজন ইমামের পাশে গিয়ে বসলেন।
সরদার আসতি আওয়াতসহ সকলের চোখে মুখে বিস্ময়! তারা একবার তাকাচ্ছে আহমদ মুসার দিকে, আবার তাকাচ্ছে শাইখ আব্দুল হক আল মাদানীর দিকে। শাইখের বয়স বেশি নয়, কিন্তু জ্ঞান, বিদ্যা ও আমলে প্রবীণ। তিনি শুধু আর্মেনিয়া অঞ্চলে নন, আরব বিশ্বেও বিশেষভাবে সম্মানিত। ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে তার অভিমতকে উচ্চমূল্য দেয়া যায়। সেই শাইখ অতিথিকে স্যার বলছেন, তাকে নিজের আসন ছেড়ে দিয়ে পেছনে সরে এসেছেন মানে গুরুর জন্যে ছাত্র যা করে।
সরদার আসতি আওয়াত শাইখের দিকে তাকিয়ে বলল, মুহতারাম শাইখ, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি দয়া করে বলুন আমাদের। অতিথির কি পরিচয় আপনি জানেন।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, মুহতারাম সরদার আসতি আওয়াত, উনি যা বলবেন, সেটা আমিই বলছি।
শাইখ আব্দুল হক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, স্যরি স্যার, আমি জানতাম না যে, আপনি আপনার পরিচয় গোপন রাখতে চান। আমি মনে করি, আপনি যা চাইবেন তার মধ্যে নিশ্চয় আল্লাহ সবার কল্যাণ রেখেছেন। আপনার পরিচয় বলার দরকার নেই। খ
ধন্যবাদ মুহতারাম শাইখ! আপনি এবং উপস্থিত সবাইকে বলছি, আমার পরিচয় গোপন করার কারণ হলো, শত্রুকে অন্ধকারে রাখা, কম ঝামেলায় শত্রুকে খুঁজে বের করার সুযোগ নেয়া এবং দিভিনকে বাড়তি বিপদের হাত থেকে রক্ষা করা। আমার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে দিভিনের জন্যে কাজ করা আমার জন্যে কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এই ধরনের অনেক ক্ষেত্রেই আমাকে নাম গোপন রেখে কাজ করতে হয়। এখানেও তাই করেছি। বলে একটু থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই উঠে দাঁড়াল শিন সেনগার। বলল, মুহতারাম সরদার আমি কিছু বলতে চাই, অনুমতি পেলে।
নিশ্চয় বল মা।
সেই সাথে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, এ আমাদের মোহাম্মাদ বেহেজ ও ত্রিফা বেফ্রিনের একমাত্র মেয়ে। নাম শিন সেনগার।
আবার শিন সেনগারেরর দিকে ফিরে তাকাল সরদার আসতি আওয়াত। বলল, বল মা।
মুহতারাম স্যার, আপনার সব পরিচয় শত্রুরা জেনে গেছে। আপনাকে অপ্রতিরোধ্য বিশ্বাস বলে মনে করে ওরা। আপনার অবস্থান জানতে পারার পর আপনাকে মারার জন্যেই ওরা বিষাক্ত গ্যাস আক্রমণ করেছিল। মরেছেন কিনা, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিল না। একদিকে সন্ধান জানা, অন্যদিকে বেঁচে থাকলে অতর্কিত হামলায় আপনাকে হত্যার জন্যে ভোর রাতেই পরপর দুটি অভিযান তারা চালিয়েছিল। ওদের আশা ছিল গত রাতটাই হবে আপনার শেষ রাত। আপনি সোজা আমেরিকা থেকে এখানে এসেছেন এবং রাবেতা আলমে আল ইসলামী এবং ওআইসি দিভিনকে সাহায্যের জন্যে আপনাকে ডেকে এনেছেন, এসবও তারা জেনে গেছে। থামল শিন সেনগার।
তুমি তাদের এ বিষয়গুলো কি করে জানলে? বলল আহমদ মুসা।
আমার মায়ের সাথে ওদের আলোচনা আমি আড়ি পেতে শুনেছি আজ ভোর রাতে। শিন সেনগার বলল।
আলোচনায় আর কি শুনেছ? তোমার মা ও ওদের সম্পর্কে আর কি জানতে পেরেছ?
আমার মা জন্মগত খৃস্টান অথবা কনভারটেড খৃস্টান ছিলেন। তাঁর যোগাযোগ ছিল সেন্ট সেমভেলের সাথে। ওরা ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার-এর কমান্ডো ছিল। ওদের অপারেশন কমান্ডার গ্যাসিক লেভন আপনাকে আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে। তার ভাই একজন জেনারেল। সেও আপনার হাতে নিহত হয়েছে। এই কথাগুলোই আমার মনে আছে। শিন সেনগার বলল।
শিন সেনগার, যা জানার তুমি সবই জানিয়েছ। ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি মূল্যবান তথ্য আমাদের দিয়েছ। ষড়যন্ত্রটা এখন আমার কাছে পরিষ্কার। বলল আহমদ মুসা।
তাকাল আহমদ মুসা ইভা নারিনের দিকে। বলল, ঠিক কিনা মিস ইভা নারিন?
ঠিক বলেছেন। সন্দেহটাই সত্য প্রমাণ হলো। শিন সেনগার আমাদের কাজ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ধন্যবাদ শিন সেনগার। ইভা নারিন বলল।
শিন সেনগার, তুমি সরদার সাহেবের বাড়ির দিকে ছুটছিলে কেন? বলল আহমদ মুসা।
আমি এরদেলানের খোঁজে আসছিলাম। তাকে কিংবা যাকেই পাব আমি যা জেনেছি তাকে তা জানাতে চেয়েছিলাম। মা এটা হতে দিতে চাচ্ছিল না। স্যার, আপনি না এসে পড়লে মা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলত। আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন।
আমাকে যা বললে কাউকে বলেছ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
শিন সেনগার একটু মাথা নিচু করল। বলল, এরদেলানকে সব কথা। বলেছি।
আহমদ মুসার মুখে অস্পষ্ট একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। বলল, ঠিক আছে শিন সেনগার। আচ্ছা, বল তো তুমি তোমার মাকে খৃস্টান বলছ কেন?
মা ওদের সাথে কথা শেষ করে বলেছিলেন, খ্রিষ্ট আমাদের রক্ষা করুন। এই কথা একজন খৃস্টান ছাড়া কোন মুসলমানের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। শিন সেনগার বলল।
ধন্যবাদ শিন সেনগার।
বলেই তাকাল আহমদ মুসা সরদার আসতি আওয়াতের দিকে। বলল, মোহাম্মাদ বেহেজের স্ত্রী খৃস্টান, তিনি শত্রু পক্ষের একজন এটা কি করে সম্ভব?
হতেও পারে। এ আলোচনা পরে করা যাবে জনাব। বলল আসতি আওয়াত।
হাজার শোকর আল্লাহ তায়ালার কাছে। গত রাত এমন এক ঐতিহাসিক রাত, যখন দিভিন প্রথমবারের মত শত্রুকে কঠিন একটা আঘাত হানতে পেরেছে। যার সবটা কৃতিত্ব আল্লাহর পরে আমাদের সম্মানিত মেহমানের উপর বর্তায়। কিন্তু সম্মানিত মেহমানের নামটাও আমাদের জানা হয়নি। মুহতারাম শাইখ তার সম্পর্কে যা বলেছেন, তারপর তার নাম না জেনে থাকতে পারছি না। দিভিনের সাবেক প্রধান এবং দিভিনের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তিত্ব অ্যালন ফরহাদ বলল।
শিন সেনগার, তোমার মা এবং দিভিনের শত্রুরা কি আমার নাম বলেছে? বলল আহমদ মুসা।
নাম বলেছে স্যার। আমি বুঝেছি, আপনার নামই তারা বলেছে। শিন সেনগার বলল।
নামটা বল। শত্রুরা যদি নামটা জেনেই থাকে, তাহলে তা গোপন। রাখার প্রয়োজন নেই। বলল আহমদ মুসা।
ওরা নামটা বলেছে আহমদ মুসা। শিন সেনগার বলল।
নামটা উচ্চারিত হবার সাথে সাথে সকলের দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার মুখের ওপর।
চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে সরদার আসতি আওয়াতের। সোজা হয়ে বসেছে ইভা নারিন। একরাশ রক্তিম উজ্জ্বলতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার চোখে-মুখে। শেপল, এরদেলান, আহমদ নেবেজদের চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময় এবং তা আনন্দে টইটম্বুর।
সরদার আসতি আওয়াত উঠে দাঁড়াল। বলে উঠল, আমি আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি। পরম দয়ালু আল্লাহ আর্মনিয়ার সন্তানদের প্রতি খুবই সদয়। এর আগে আমাদের পরম সম্মানিত মেহমান আহমদ মুসা দুইবার আর্মেনিয়ায় এসেছেন। দুই সংকট থেকে আর্মেনিয়ার মুসলমানদের বাঁচিয়েছেন। আবার তাকে স্বাগত জানাবার পরম সৌভাগ্য আল্লাহ দিভিনবাসীকে দিলেন। আমরা আমাদের মুহতারাম ভাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। এবার দিভিনবাসীর জীবন থেকে আল্লাহ কাল রাতের অবসান ঘটাবেন আশা করছি।
সরদার আসতি আওয়াত কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে এসে তার চেয়ারে বসে পড়ল।
আসতি আওয়াত বসে পড়ার সাথে সাথে চারদিক থেকে আনেকগুলো কণ্ঠ কথা বলে উঠল। নানা রকম প্রশ্ন আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে।
আমার সম্পর্কে কোন প্রশ্নের প্রয়োজন নেই। যা জেনেছেন যথেষ্ট। আমি আর্মেনিয়ায় নতুন নই।
একটু থামল আহমদ মুসা। কথা শুরু করল আবার, আমাদের বেশ কিছু জরুরি কাজ বাকি আছে।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে থেমেছিল। সেই ফাঁকে, স্বয়ং আসতি আওয়াত বলল, ম্যাডামের পরিচয় কিন্তু জানা হয়নি।
আমি তাঁর পরিচয় আপনাদের জানাব জনাব। বলল আহমদ মুসা।
আবার একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। বলল, জরুরি তিনটা কাজ- এক, এখনি কাউকে শিন সেনগারের সাথে ত্রিফা বেফ্রিনের বাড়িতে পাঠিয়ে তার পার্সোনাল কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল এবং তার পার্সোনাল ফাইল সরিয়ে আনতে হবে। দেরি হয়ে গেছে। দরকার ছিল এটা সংগে সংগেই করা। দুই. শত্রুদের এক বা একাধিক লোক দিভিনে থাকতে পারে। এ বিষয়ে সাবধান থাকা। তিন. দিভিনের এন্ট্রান্সগুলোতে গোপনে পাহারা বসানো। শত্রুদের পরবর্তী আঘাত কি হবে আমরা জানি না। সতর্ক থাকতে হবে।
সরদার আসতি আওয়াত কিছু বলতে যাচ্ছিল। বলা হলো না। একটা বিস্ফোরণের শব্দ এল উত্তর দিক থেকে। আহমদ মুসাসহ সবাই উৎকর্ণ হলো।
আহমদ নেবেজ ও শেপল উঠে দাঁড়িয়েছে বাইরে বেরুবার জন্যে।
একজন দৌড়ে প্রবেশ করল বৈঠকখানায়। বলল, বিস্ফোরণ মোহাম্মাদ বেহেজ সাহেবের বাসায় ঘটেছে।
আমাদের বাসায়? বলে উঠে দাঁড়াল শিন সেনগার। দ্রুত মোবাইলে একটা কল করল।
ওপার থেকে কল ধরলে ও বলল, আমি শিন সেনগার, কি ঘটেছে বাড়িতে?
ওপার থেকে কথা শুনে বলল। তোমরা সবাই এখন বাড়ির বাইরে? আমি আসছি।
কল অফ করে দিয়ে বলল আহমদ মুসার দিকে লক্ষ করে, স্যার, বিস্ফোরণে আমার বাবা ও মায়ের ঘর পুড়ে গেছে। মুখোশধারী কয়েকজন লোক অস্ত্রের মুখে বাড়ির কর্মী কয়েকজনকে আটক করে রেখে বাবা ও মায়ের ঘর থেকে কিছু জিনিস নিয়ে ঘর দুটি পুড়িয়ে দিয়েছে। আগুন দেয়ার পর ঘর দুটির পুড়ে যাওয় নিশ্চিত করে ওরা চলে গেছে।
কোন দিকে গেছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্যরি, এটা আমি জিজ্ঞাসা করিনি। শিন সেনগার বলল।
ঠিক আছে তুমি যাও। শেপল তোমার সাথে যাবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। আমি আসছি।
বলে শিন সেনগার শেপলের সাথে চলতে শুরু করল।
জনাব আপনি বলতে বলতেই ঘটনা ঘটে গেল। বলল আসতি আওয়াত।
তারা আরও আগে এ ঘটনা ঘটানোর কথা। তারা এই চিন্তা অবশ্যই করে থাকবে যে, আমরা তো সকালে গিয়ে ত্রিফার ঘর সার্চ করতে পারি। তারা দেরি করল কেন? সম্ভবত আশেপাশে তাদের আর সে রকম লোক ছিল না। বাইরে থেকে তোক আনতে হয়েছে। কিন্তু আমরা বাড়ি সার্চ করিনি, সেটা তারা জানতে পারল কি করে? আহমদ মুসা বলল।
দিভিন থেকে নিশ্চয় তারা জেনেছে যে বাড়িটা সার্চ করা হয়নি, কেউ যায়নি সেখানে। এই রিপোর্ট তারা কনটিনিউয়াসলি পেয়েছে। আমার ধারণা। বলল ইভা নারিন।
তাহলে ওদের এক বা একাধিক লোক এদিকে আছে।
বলেই আহমদ মুসা তাকাল সরদার আসতি আওয়াতের দিকে। বলল, মোহাম্মাদ বেহেজের খবর কি?
উনি সকালেই টেলিফোন করেছিলেন। বাড়ির লোকদের কাছে। টেলিফোন করে উনি সবকিছু জেনেছেন। মেয়ে কোথায় জিজ্ঞাসা করে মেয়েকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন তাড়াতাড়ি। আমি মনে করেছিলাম বেহেজ বাড়িতে একা আছেন সে যাক। কিন্তু বেহেজ যখন। বললেন তার কাছে সবকিছু না জেনে মেয়েকে কোথাও যেতে দেয়া যাবে না, তখন মেয়েকে আর পাঠাইনি। এদিকে আমার স্ত্রীর দাফন শেষ হয়েছে, এই সময় তার আবার টেলিফোন পেয়েছিলাম। মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন মেয়েকে ছাড়া কাউকে যেন বাড়িতে ঢুকতে না দেয়া হয়, আমি না আসা পর্যন্ত পুলিশকেও নয়। আমি বলেছিলাম, নিরাপত্তার কথা ভেবে তার মেয়েকে একা বাড়িতে পাঠানো হয়নি। দেখা যাক, পুলিশ কি বলে সেটা শুনে নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা করে তাকে পাঠাব। আর বলেছিলাম, বেহেজ বাড়িতে ফিরলে পরে যা সিদ্ধান্ত হয় তা করা হবে। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
ঘটনা সম্পর্কে তিনি বিশদ জানতে চাননি? বলল আহমদ মুসা।
না, জিজ্ঞাসা করেননি। মনে হলো তিনি সব জানেন। বাড়িতে টেলিফোন করে আগেই সব জেনে নিয়েছেন। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
আহমদ মুসার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন আবার এসে জমা হলো। বাড়ির কর্মীশ্রেণির লোকেরাই তো সব জানার কথা নয়, তারা জানাল কি করে? সকালেই তিনি মেয়েকে বাড়িতে পাঠাতে চাচ্ছিলেন কেন? মুখোশধারীদের অপারেশনের সময় সে থাকলে নির্ঘাত মারা পড়ত। সে আসার আগে দিভিনের কেউ কিংবা পুলিশ তার বাড়িতে ঢুকুক তা তিনি চাচ্ছিলেন না কেন?
আহমদ মুসা প্রশ্নগুলো সরদারের কাছে তুলতে চাইল না। একটা নাম-পরিচয়হীন সন্দেহ তার মনে প্রবলভাবে মাথা তুলতে চাচ্ছে।
আচ্ছা জনাব, ত্রিফা বেফ্রিন সম্পর্কে কিছু কথা আছে বলেছিলেন, সেটা কি? বলল আহমদ মুসা।
ভালোই হলো, শিন সেনগার নেই। কথাগুলো তার না শোনাই ভালো। ত্রিফা বেফ্রিন দিভিনের বংশধারার মেয়ে নয়। সে জর্জিয়ার এক মুসলিম পরিবারের মেয়ে। আমাদের মোহাম্মাদ বেহেজ আর্মেনিয়ার গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেয়ার কিছু দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়লে ইয়েরেভেনের এক হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। সেই হাসপাতালের একজন নার্স হিসাবে ত্রিফা বেফ্রিন অন্য হাসপাতাল থেকে ট্রান্সফার হয়ে আসে এবং মোহাম্মাদ বেহেজের নার্স ছিল সে। ত্রিফার আর্মেনিয়ায় ঘনিষ্ঠ কোন আত্মীয় ছিল না, তার উপর সে মুসলিম মেয়ে। অনেকটাই অসহায় অবস্থা তার। এক পর্যায়ে মোহাম্মাদ বেহেজ তাকে বিয়ে করে ফেলেন। বছর খানেক পরে মোহাম্মাদ বেহেজের চাকরি চলে যায় মুসলিম হওয়ার কারণে। সে দিভিনে ফিরে আসে। এক সময় তার গোয়েন্দা ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্যে তাকে দিভিনের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়।
থামল সরদার আসতি আওয়াত।
জর্জিয়ার সেই মুসলিম পরিবারে ত্রিফার যোগাযোগ ছিল কিংবা আপনাদের কারো তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল? বলল আহমদ মুসা।
ত্রিফা কিংবা কারো সাথে জর্জিয়ার তার পরিবারের যোগাযোগ ছিল। বা হয়েছিল, এ ধরনের কোন কথা আমার কানে আসেনি। তবে ত্রিফা কোন কোন সময় ইয়েরেভেন কিংবা অন্য কোনও স্থানে কয়েকদিনের জন্যে যেত। কিন্তু ত্রিফা যে তার পিতার পরিবারে যেত, এমন কথা মোহাম্মাদ বেহেজও কোনদিন বলেনি। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
ত্রিফা বেফ্রিন তো কুর্দি নাম। নার্স হিসাবে তার এটাই কি নাম ছিল? বলল আহমদ মুসা।
না তার নাম ছিল আশিরা ইফরাত। সে নামটা বৃদলে কুর্দি নাম ত্রিফা বেফ্রিন রাখা হয়।
কিন্তু জনাব জর্জিয়ায় মুসলমানদের মধ্যে তো এমন নাম প্রচলিত নেই! বলল আহমদ মুসা।
হয়তো তারা কেউ পুরোপুরি একটা আরবী নাম রেখেছে, প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে।
জনাব নামের শব্দগুলো আরবীর মত শোনালেও শব্দগুলো আরবী নয়, পুরোপুরিই হিব্রু, ইহুদিদের প্রাচীন ধরনের নাম।
সরদার আসতি আওয়াত সোজা হয়ে বসল। বলল, সত্যি এটা হিব্রু নাম? তাহলে শিন সেনগার তো ঠিকই বলেছে, তার মা মুসলমান নয়। কিন্তু সে যা বলল তাতে তার মা খৃস্টান। নাম তো দেখছি ইহুদি!
মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্বার্থসিদ্ধির জন্যে একশ্রেণির মতলববাজ ইহুদি খৃস্টান হয়ে থাকে। ত্রিফা বেফ্রিনের ক্ষেত্রে নিশ্চয় এটাই ঘটেছে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ জনাব আপনাকে। এসব আমাদের মাথায় আসতো না কোনভাবেই। এখন আমাদের কি করণীয়, সেটাই ভাবতে হবে। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
সেটা তো ভাবতেই হবে। মোহাম্মাদ বেহেজের বাড়িতে বিস্ফোরণ প্রমাণ করছে, ওরী বসে নেই, বসে থাকবে না। তবে এখন উঠা যাক। কিছু কাজ আছে। পরে আবার বসা যাবে।
সবাইকে সালাম ও ধন্যবাদ দিয়ে সরদার আসতি আওয়াত উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।
.
৪.
এশার নামাজ পড়ে এসে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। সারাদিন নানান কাজে, নানান ঘুরাঘুরিতে বিশ্রামের কোন সুযোগ হয়নি তার। ত্রিফা বেফ্রিনের বাড়িতে যাওয়া ছাড়াও গোটা দিভিন সে ঘুরে বেড়িয়েছে। সাথে। ছিল ইভা নারিন, আহমদ নেবেজ, শেপল এবং মসজিদের ইমাম শাইখ আব্দুল হক। অধিকাংশ বাড়ির নাম-পরিচয় জানার চেষ্টা করেছে আহমদ মুসা। বিশাল এলাকা দিভিন। অনেক পরিশ্রম হয়েছে ঘুরতে। ইভা নারিন ও শেপল কয়েকবার গাড়ি থেকে নামতেই চায়নি ক্লান্তির কথা বলে। খুব খুশি হয়েছে আহমদ মুসা। দিভিন সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা সে লাভ করেছে। আরেকটা বড় কাজ হয়েছে। আহমদ মুসা সরদার আসতি মাওয়াতকে বলেছিল, দিভিনের উল্লেখযোগ্য সব লোকের টেলিফোন নাম্বার এবং তাদের জন্মস্থান আজকের মধ্যে তাকে দেবার জন্যে। বিকেলেই সেটা হাতে পেয়েছে আহমদ মুসা। কয়েক হাজার লোকের জন্মস্থান ও টেলিফোন নাম্বার। বিকেলেই তালিকায় চোখ বুলিয়েছে আহমদ মুসা।
রাফায়েলের মোবাইলের কল লিস্টে যে টেলিফোন নাম্বার পেয়েছে, সেই নাম্বারটাও এ তালিকাতে আছে। রাফায়েল ত্রিফা বেফ্রিনের সাথে কথা বলার পর এই টেলিফোন নাম্বারেও কথা বলেছে প্রায় ৫ মিনিট সময় নিয়ে। আহমদ মুসার সন্দেহ সত্য প্রমাণ হয়েছে। কয়েক হাজার লোকের। জন্মস্থানের মধ্যে মাত্র একজনের জন্মস্থানই শুধু আর্মেনিয়ার বাইরে। ইরানে। এ লোকটিই ঐ টেলিফোন নাম্বারের মালিক। সন্দেহ এতে আরও পাকাপোক্ত হয়েছে আহমদ মুসার। খুশি হওয়ার সাথে সাথে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। ত্রিফা বেফ্রিন এবং তার স্বামী মোহাম্মাদ বেহেজ দুজনকেই দেখা যাচ্ছে একই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকতে। আগেই জানা গেছে ত্রিফা বেফ্রিন দিভিনের মেয়ে নয়। এমনকি এ বংশেরও নয়। কিন্তু মোহাম্মাদ বেহেজের বিষয়টা কি? ইরানে জন্ম হলেই যে এই বংশের হবে না, তা তো নয়। এ সম্পর্কে জানতে হবে। তবে সে যে শত্রুপক্ষের সাথে। যুক্ত আছে সে বিষয়ে সন্দেহ আর থাকল না। আজ সকালে ত্রিফার বাড়িতে মোহাম্মাদ বেহেজের সাথে আহমদ মুসার দেখা হয়েছে। সে উচ্ছ্বসিত আনন্দে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানালেও তার আনন্দের আড়ালে ছিল জমাট অন্ধকার। সেটা তার চোখ-মুখের চেহারা দেখেই বুঝা গেছে। আহমদ মুসা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল তার স্ত্রী সম্পর্কে। কখনো স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ করার মত বা তাকে প্রশ্ন করার মত কিছু সে দেখেছে কিনা। সে বলেছে, কখনই কিছু সে আঁচ করতে পারেনি। সে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, সে দিভিনের নিরাপত্তা প্রধান, আর তার বাড়িতেই শত্রু লুকিয়েছিল! এটা ঠিক বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার মত। আহমদ মুসা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি আসার আগে আপনাদের ঘরে কাউকে ঢুকতে নিষেধ করেছিলেন কেন?
গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও কাগজপত্র হারিয়ে যেতে বা নষ্ট হতে পারে বলে। বলেছিল মোহাম্মাদ বেহেজ।
কিন্তু এখন তো সবই শেষ হয়ে গেছে মোহাম্মাদ বেহেজ? আহমদ মুসা বলেছিল।
আমি যা রোধ করতে চেয়েছিলাম, সেটাই ঘটেছে। বলেছিল মোহাম্মাদ বেহেজ।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দেয়নি। কে জানে, হয়তো আপনি এটাই চেয়েছিলেন। সন্দেহ বশেই মনে মনে আহমদ মুসা এটা বলেছিল। সেই সন্দেহ এখন পাকাপোক্ত হয়েছে। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দশটা। মিটিং শুরু হতে আর আধাঘন্টা বাকি। এ মিটিং ডাকার জন্যে মোহাম্মাদ বেহেজ অনুরোধ করেছে সরদার আসতি আওয়াতকে। এ মিটিং-এ ডাকা হয়েছে দিভিনের উল্লেখযোগ্য সবাইকে। দিভিনের নিরাপত্তা নিয়ে এখানে আলোচনা হবে এবং নিরাপত্তার নানান বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আহমদ মুসা সরদার আসতি আওয়াতকে বলেছিল, নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনা এত লোককে নিয়ে হয় না। যারা সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে দায়িত্বশীল, তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে তা। বাস্তবায়নের জন্যে উপযুক্তদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে দিতে পারে। সরদার আসতি আওয়াত আহমদ মুসার সাথে একমত হয়ে বলেছে, এটাই ঠিক। তবে মিটিং যখন ডাকা হয়েছে, তখন মিটিংটা হয়ে যাক। পরিস্থিতির উপর মানুষকে একটা ব্রিফিং দিয়ে দিলেই চলবে। কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। সরদার দুঃখ প্রকাশ করে এও বলেছে, আহমদ মুসাকে না জানিয়ে এটা করা তার ঠিক হয়নি। ভবিষ্যতে আর এমন হবে না। আহমদ মুসা আর কথা না বাড়িয়ে বলেছে- ঠিক আছে, ডাকা যখন হয়েছে তখন মিটিং হয়েই যাক।
আহমদ মুসা পাশ ফিরল। নতুন করে আরেকটা ভাবনা তার মাথায় এল। মোহাম্মাদ বেহেজ এ ধরনের বিশাল মিটিং ডাকার জন্য অনুরোধ করল কেন? তার তৎপরতা শো করার জন্যে, না অন্য কিছু রয়েছে তার মাথায়! কি থাকতে পারে?
আহমদ মুসার দরজায় নক হলো।
দ্বিতীয়বার নক হতেই আহমদ মুসা বুঝল, ইভা নারিন নক করছে।
এস ইভা নারিন। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ইভা নারিনকে সম্বোধনে তুমিতে নেমে এসেছে এবং তা ইভা নারিনের অনুরোধেই।
আহমদ মুসার পরিচয় প্রকাশ হওয়ার পর ইভা নারিন আহমদ মুসাকে বলেছে, আর তো আমাকে আপনি বললে আমি মানব না। আমরা যারা গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করি, শুধু আর্মেনিয়ার নয় গোটা দুনিয়ার, তারা অনেকেই আপনার মুখোমুখি হওয়াকে ভয় করে। আবার অনেকে আপনাকে ভালোবাসে। যারা আপনাকে ভয় করে, তাদেরও অনেকে আপনাকে ভালোবাসে এই জন্যে যে, এ পর্যন্ত আপনার যত কাজ সবই ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, কল্যাণের পক্ষে। আরেকটি বিষয় হলো, আপনার সব কাজই নিঃস্বার্থ, ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ তাতে জড়িত নেই। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, ব্যক্তিগত না হলেও জাতির স্বার্থে আপনি কাজ করেন। যেখানে মুসলমানদের বিপদ সেখানেই আপনি ছুটে যান। এ অভিযোগেরও জবাব পায় তারা। জাতি হিসাবে মুসলমানরা সত্যই মজলুম। ঔপনিবেশিক শাসন। থেকে মুক্ত হবার পর তারা নিজের পায়ে দাঁড়াবার আগেই একবার ঠান্ডাযুদ্ধে তারা পিষ্ট হয়েছে। আবার ঠান্ডাযুদ্ধ শেষ হবার পর নিশ্বাস ফেলার আগেই মুসলমানরা জাতিগত বৈরিতার শিকার। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণের কিছু ষড়যন্ত্র তাদের জাতিগত স্বার্থে মুসলমানদের জাতিগত উত্থানকে পিষে ফেলতে বদ্ধপরিকর। এই সংকটে আহমদ মুসা মুসলমানদের যে সাহায্য করেছে, তাকে মুসলমানদের পক্ষে না। বলে, মজলুমের পক্ষে বলাই যুক্তিসংগত। যদি খৃস্টান, ইহুদিরাও এমন মজলুম হয়, তাহলে আহমদ মুসা নিশ্চয় তাদের সাহায্যেও ছুটে যাবেন। এর বড় প্রমাণ আহমদ মুসা কোন জালেম মুসলমানের সাহায্যে এখনো যায়নি।
ইভা নারিন এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু ম্লান হেসেছিল। বলেছিল, গোয়েন্দারা যারা আপনার কাজকে ভালোবাসে, তাদের মধ্যে আমি একজন এবং সেটা গোয়েন্দা বিভাগে সক্রিয় হবার আগে থেকেই। কদিন থেকে আপনার কাজ দেখে আমার মনে হচ্ছিল, তাহলে দ্বিতীয় আহমদ মুসা দুনিয়াতে আছে। মনটা আমার খারাপ হয়েছিল। যখন জানলাম আপনিই আহমদ মুসা, তখন মনটা আনন্দে ভরে গিয়েছিল। সুতরাং আমি আহমদ মুসার ভক্ত একজন গোয়েন্দা কর্মী ছাড়া আর কিছু নই। আমাকে আপনি আপনি বলবেন না প্লিজ।
বিষয়টা পারস্পরিক হওয়া প্রয়োজন। তাহলে তুমিও আমাকে তুমি বলতে হয়। আহমদ মুসা বলেছিল।
না, তা হয় না। আপনি কিছু না হলেও বয়সে বড়। সুতরাং আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন। আমি সেটা বলব কোন অধিকারে? সে রকম কোন অধিকার আমার নেই। বলেছিল ইভা নারিন। তার মুখ হঠাৎ ম্লান হয়ে গিয়েছিল। কণ্ঠও অনেকটা শুষ্ক।
আহমদ মুসা ইভা নারিনের ম্লান মুখ ও শুষ্ক কণ্ঠের অর্থ কিছুটা আঁচ করতে পেরে বিষয়টাকে অন্যদিকে সরিয়ে নেবার জন্যে বলেছিল, পরিচয়ও মানুষকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বাঁধে এবং তুমির সম্পর্কে তারা নেমে আসে।
একটু হেসেছিল ইভা নারিন। বলেছিল, সম্রাট ও সাধারণের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় না। তাদের মধ্যকার দূরত্ব টপ আর বটমের মত।
ইভা নারিন, এ কদিনে তাহলে আমি প্রমাণ করেছি, আমি সম্রাট আর তুমি সাধারণ!
ওটা উদাহরণের কথা। কদিনে অন্তত একথা প্রমাণ হয়ে গেছে সংঘাত মোকাবেলা ও গোয়েন্দা কর্মে আপনি শিক্ষক আর আমি ছাত্রের মত। এ সম্পর্কটা ভক্তি ও সম্মানের। মাফ করবেন, কোন আকাশকুসুম। কথা এটা নয়। এ সম্পর্কেই আমাকে খুশি থাকতে দিন।
আহমদ মুসা আর কথা বাড়ায়নি। অন্য প্রসংগে চলে গিয়েছিল সে।
আহমদ মুসা অনুমতি দেয়ার সংগে সংগেই ইভা নারিন দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরে ঢুকেই ইভা নারিন ঠেলে দরজা বন্ধ করে দিল।
আবার দরজার প্রতি অবিচার করছ ইভা নারিন। দরজা খোলা থাক। বলল আহমদ মুসা।
হেসে উঠল ইভা নারিন। বলল, স্যরি, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করাই আমাদের অভ্যাস। তাই বারবার ভুল হয়। দরজা খুলে দিল ইভা নারিন এবং বলল, কিন্তু বলুন তো, আমরা এ কয়দিনে একে অপরকে যতটুকু চিনেছি, তাতে কারো প্রতি কি অনাস্থা বা ভয়ের কোন সুযোগ আছে?
আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, এটা ভয় বা অনাস্থার বিষয় নয়, এটা একটা নীতির বিষয়। মানুষের যিনি স্রষ্টা, তিনিই এ বিধান দিয়েছেন তার রাসূল স.-এর মাধ্যমে। এ বিধান মানব কি মানব না, এটাই নীতিগত প্রশ্ন। বলল আহমদ মুসা।
প্রত্যেক আইনের একটা ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে। স্রষ্টার এই বিধানেরও একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সেটা কি অনাস্থা বা ভয়ের বিষয় নয়? ইভা নারিন বলল।
স্রষ্টার ক্ষেত্রে তার সৃষ্টির ব্যাপারে অনাস্থা ও ভয় শব্দের প্রয়োগ মানায় না, সংগত এবং সত্যও নয়। প্রকৃত বিষয় হলো, আল্লাহ নারী ও পুরুষকে জন্মগত কিছু ফেতরাত দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কোন কোন ফেতরাতের কিছু দাবি আছে। সে দাবি প্রতিরোধ্য ও অপ্রতিরোধ্য দুই-ই হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে শয়তান, যে মানুষের ক্ষতি করতে, পথভ্রষ্ট করতে সব সময় সচেষ্ট, কুমন্ত্রণা দিয়ে সেই দাবিকে অপ্রতিরোধ্য। করে যেকোন সময় পারে অঘটন ঘটাতে। সেই সুযোগ যাতে শয়তান না পায়, এজন্যেই এমন সব বিধানের ব্যবস্থা আল্লাহ করেছেন। বলল। আহমদ মুসা।
বুঝলাম, এটা সাধারণভাবে সকলের জন্যে প্রযোজ্য একটা সাবধানতা বা প্রতিরোধমূলক বিধান। ধন্যবাদ।
বলে সোফায় নড়ে-চড়ে বসল ইভা নারিন।
কিছুক্ষণ পরেই তো মিটিং। ওদিকে না গিয়ে এদিকে যখন এসেছ, কিছু বলবে নিশ্চয়ই। বলল আহমদ মুসা।
আপনি মিটিংটা চাইছিলেন না কেন? ইভা নারিন বলল।
হ্যাঁ, সরদার আসতি আওয়াতকে এটা বলেছিলাম। কিন্তু তুমি জানলে কি করে? তুমি তো সেখানে ছিলে না। বলল আহমদ মুসা।
শেপল আমাকে এটা বলেছে। আপনি বলার পর তার বাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার মনেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইভা নারিন বলল।
সকলকে নিয়ে মোহাম্মাদ বেহেজ এধরনের মিটিং-এর অনুরোধ কেন করেছে, সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। বলল আহমদ মুসা।
কয়েকটা কারণে মোহাম্মাদ বেহেজ সন্দেহের তালিকায়। সে জন্যেই। কি? দিভিনের নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে এতবড় ঘটনার পর সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং ডাকার অনুরোধ সে করতেই পারে। ইভা নারিন বলল।
আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে ইভা নারিন। সে সন্দেহের তালিকায় নয় এখন। সে দিভিনের নিশ্চিত শক্র। বলেই বেহেজের জন্মস্থান ও টেলিফোন নাম্বার মিলে যাবার বিষয়টা ইভা নারিনকে জানাল আহমদ মুসা।
উদ্বেগে ছেয়ে গেল ইভা নারিনের মুখ। বলল, তাহলে এ মিটিং মোহাম্মাদ বেহেজ কেন ডাকল? আপনি জোর দিয়ে মিটিং বন্ধ করলেন না কেন?
আমি শুধু মিটিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি সরদার আসতি আওয়াতের কাছে। মিটিং বন্ধ করতে আমি চাইনি। মিটিং থেকে মোহাম্মাদ বেহেজ কি পেতে চায়, সেটা আমি দেখতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
কি চাইতে পারে? জিজ্ঞাসা ইভা নারিনের।
সেটাই এখন জানার চেষ্টা করতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
বাবা আমাকে সন্ধ্যায় টেলিফোন করেছিলেন। বললেন, ব্ল্যাক আমেরিকান টাইগার-এর একটা মেসেজ গোয়েন্দা বিভাগ ডিকোড করেছে। তাতে বলা হয়েছে, আমাদের TA-এর যতগুলো ডট নিউ ডেভিল মুছে দিয়েছে, তার কয়েক হাজারগুণ ডট ডিভি থেকে আমাদের মুছে ফেলতে হবে। আমাদের পরবর্তী কাজ হলো নিউ ডেভিলকে দেশ থেকে একদম মুছে ফেলা। ইতিমধ্যে তাকে মুছে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। আগামী কালের সূর্যোদয়ের আগে এর বাস্তবায়ন অবশ্যই হতে হবে। এই মেসেজের ব্যাখ্যায় বাবাও বলেছে, আমিও বলছি, এই নির্দেশটা দিভিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। ইভা নারিন বলল।
তাই হবে। TA-এর অর্থ নিশ্চয় টাইগার আর্মেনিয়ান। ডট অর্থ মানুষ। আর ডিভি অর্থ দিভিন।
বলে আহমদ মুসা তার মাথা একটু নিচু করল। তার চোখে-মুখে গভীর ভাবনার ছাপ। ভাবতে গিয়ে আঁতকে উঠল আহমদ মুসা। এটা তো গণহত্যার পরিকল্পনা। মনের এ কথাটা একটু উচ্চকণ্ঠেই হয়ে গেল। শুনতে পেল ইভা নারিন।
একে আপনি গণহত্যার পরিকল্পনা বলছেন? কেন? ইভা নারিন বলল।
তুমি তোমার আব্বার মেসেজটা আরও একবার ভালো করে পড়। বলল আহমদ মুসা।
মেসেজটিতে আবার চোখ বুলাল ইভা নারিন। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, হ্যাঁ, দশগুণ ডট মুছে ফেলার অর্থ তো এটাই। কিন্তু এটা কখন, কিভাবে? তবে সে নির্দেশনাটা এই মুহূর্তের জন্যেও হতে পারে, আবার একদিন দুইদিন পরেও হতে পারে। সবচেয়ে খারাপটাই ধরে নিতে হবে আমাদের। বলল আহমদ মুসা।
তার মানে নির্দেশটা তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, আপনি মনে করছেন। ইভা নারিন বলল।
এটাই ধরে নিতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ইভা, নারিনের চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগ নেমে এল। বলল, তাৎক্ষণিক এই আক্রমণটা কোন্ দিক থেকে কিভাবে আসবে? এর আগে ওরা দলবদ্ধভাবে আক্রমণও করেছে, বিষাক্ত গ্যাস বোমাও ফেলেছে, এবার কি ঘটবে?
বাইরে থেকে আক্রমণ করে ওরা লাভ করতে পারেনি। এবার ওরা নতুন কিছু ভাবার কথা। বলল আহমদ মুসা।
আসন্ন মিটিংটা তো ভেতরের ব্যাপার। ডেকেছেনও শত্রুর লোক। ওটা নিয়েই কি কিছু ভাবছেন? ইভা নারিন বলল।
হ্যাঁ, এ বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম ইভা নারিন। তারা কি করবে, কি করতে পারে, এটাই ভাবনার বিষয়।
একটু থামল আহমদ মুসা। আবার দ্রুতই বলে উঠল, শিন সেনগার এখন বাড়িতে নিশ্চয়? মিটিং-এ আমন্ত্রিতদের তালিকায় তার নাম দেখিনি। ইভা নারিন তাকে একটা কল করত।
আচ্ছা। বলে মোবাইল হাতে নিয়ে কল করল ইভা নারিন। ওপার থেকে শিন সেনগারের গলা পেতেই ইভা নারিন বলল, তুমি আহমদ মুসা। স্যারের সাথে কথা বল।
স্যার আমার সাথে কথা বলবেন? সৌভাগ্য আমার! দিন তাকে।
আহমদ মুসা মোবাইল হাতে নিয়ে সালাম দিয়ে বলল, শিন সেনগার তুমি মিটিং-এ আসছ তো?
আমাকে তো সরদার বলেননি। শিন সেনগার বলল।
তার পক্ষ থেকে আমি তোমাকে দাওয়াত করছি। তুমি কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তোমার আসা প্রয়োজন। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে স্যার, আমি আসছি। শিন সেনগার বলল।
তোমার বাবা কি বেরিয়েছেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
এই তো কমিনিট আগেই তিনি বেরিয়েছেন। শিন সেনগার বলল।
একা? বলল আহমদ মুসা।
জি, একা? শিন সেনগার বলল।
বিকেলে বা সন্ধ্যার পরে তোমাদের ওখানে কেউ যায়নি? বলল আহমদ মুসা।
কেউ কি আসার কথা ছিল? তেমন তো কেউ আসেনি! তবে দিভিনের দুজন এসেছিল। একজন সন্ধ্যার আগে, অন্যজন আব্বা যাবার কিছুক্ষণ। আগে।
কারা তারা? বলল আহমদ মুসা।
বিকেলে যে এসেছিল, বাইরের চত্বর থেকে বাবার সাথে কথা বলেই সে চলে গিয়েছিল। দ্বিতীয়জন সন্ধ্যার পরে বাবার কক্ষে এসেছিল। দ্বিতীয়জনকে আমি দেখেছি। বাবার টিমের সদস্য। নাম হেদি হোয়ারি। শিন সেনগার বলল।
তোমার বাবার শোবার ঘরে তার টিমের সদস্যরা আসেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
এমনটা কোন দিন দেখিনি। মি. হেদি হোয়ারি কোন প্রকার জানান দেয়া ছাড়াই বাড়িতে ঢুকেছিলেন এবং বাবার অনুমতি না নিয়েই তার ঘরে প্রবেশ করেছিলেন। শিন সেনগার বলল।
তার হাঁটার ধরনটা কি দ্রুত ছিল, না স্বাভাবিক ছিল। বলল আহমদ মুসা।
নিঃশব্দ ও দ্রুত ছিল। শিন সেনগার বলল।
আশেপাশে তিনি তাকিয়েছিলেন কি? বলল আহমদ মুসা।
তাকাননি। সামনে স্থির চোখ রেখে হন হন করে গিয়ে ঢুকেছে বাবার কক্ষে। কিন্তু স্যার, এসর খোঁজ নিচ্ছেন কেন? কিছু ঘটেছে স্যার? শিন সেনগার বলল।
কিছু ঘটেনি। আর যাতে না ঘটে সেজন্যে খোঁজখবর নিচ্ছি! তুমি এসব কথা আর কাউকে বলো না, তোমার বাবাকেও নয়। ধন্যবাদ শিন। তুমি এস।
অবশ্যই স্যার। ধন্যবাদ টেলিফোনের জন্যে। আমি আসছি। শিন সেনগার বলল।
সালাম বিনিময়ের পর তাদের মোবাইল অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা কল অফ করতেই ইভা নারিন বলল, কিছু পেলেন বলে মনে হচ্ছে?
পেলাম একটা নতুন সন্দেহ। এখন দেখতে হবে, সন্দেহটা সত্য পর্যন্ত পৌঁছায় কিনা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা বলল, আজ দুজন লোক দেখা করতে গিয়েছিল মোহাম্মাদ বেহেজের সাথে। তাদের একজনের নাম হেদি হোয়ারি। বেশি সন্দেহভাজন এই লোকটিই। দ্বিতীয়জন বাইরে থেকে বেহেজের সাথে কথা বলে চলে গেছে। ইভা নারিন, তুমি একটু শেপলকে বল খুঁজে দেখতে এই হেদি হোয়ারি মিটিং-এ এসেছে কিনা। না এসে থাকলে বাড়ির বাইরে থেকেই তাকে ধরতে হবে। আর এসে থাকলে আমাকে জানাও। এখনি তার সাথে আমি কথা বলব।
ইভা নারিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, মিটিং-এই কি কিছু ঘটতে যাচ্ছে?
আপাতত মিটিং-ই ওদের টার্গেট হতে পারে, যেহেতু মিটিং-এর খোদ আয়োজক ওদের লোক। এ বিষয়টাই নিশ্চিত হতে হবে এবং জানতে হবে কি ঘটতে যাচ্ছে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক জনাব। আমি দেখছি। বলে বেরিয়ে গেল ইভা নারিন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইভা নারিনের টেলিফোন এল। বলল, হেদি হোয়ারি এইমাত্র এসে পৌঁছল। সে বাইরের বৈঠকখানায় বসে মোহাম্মাদ বেহেজের জন্যে অপেক্ষা করছে।
ঠিক তোমরা চলে এস। আমি তাকে নিয়ে আসছি। আহমদ মুসা উঠল।
মিটিং শুরু হবার আর মাত্র ৫ মিনিট বাকি। এখনি বেহেজ এসে পড়বে।
আহমদ মুসা দ্রুত বাইরের বৈঠকখানায় গিয়ে দেখতে পেল হেদি হোয়ারিকে। সেখানে কেউ ছিল না। দুচার জন যারা এসেছে তারা সরাসরি মিটিংরুমে চলে গেছে।
হোয়ারি, মোহাম্মাদ বেহেজের দেরি হচ্ছে কেন আসতে? জান কিছু? বৈঠকখানায় পৌঁছেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা।
হেদি হোয়ারি উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, স্যার, উনি এখনি এসে পড়বেন। বলেছিলেন আসার আগে একটু ল্যাবে যাবেন তিনি।
ল্যাবে যাবেন। কথাটা মনে মনে উচ্চারণ করল আহমদ মুসা। অজান্তেই যেন তার মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হলো। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন কথা তুলে আহমদ মুসা বলল, হোয়ারি তুমি আমার সাথে একটু এস।
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল।
নীরবেই হেদি হোয়ারি অনুসরণ করল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসার কক্ষের সামনে দাঁড়িয়েছিল ইভা নারিন ও শেপল। আহমদ মুসাকে হেদি হোয়ারিসহ আসতে দেখে ওরা দুজন চলে যাচ্ছিল।
যেও না তোমরা। দরজার সামনে একটু দাঁড়াও। কেউ আসতে চাইলে বলো আমি একটু ব্যস্ত আছি। ওদের দুজনকে লক্ষ করে বলল। আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা হোয়ারিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসা ও হোয়ারি মুখোমুখি সোফায় বসল।
হেদি হোয়ারি সোফায় বসতে ইতস্তত করছিল। আহমদ মুসা তাকে টেনে এনে সোফায় বসিয়ে দিল।
হোয়ারি তোমার বাপ-দাদা সবাই দিভিনের তাই না? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্যার, আমাদের পরিবার শত শত বছর ধরে দিভিনে। আমরা দিভিন পরিবারের একজন। হোয়ারি বলল।
তুমি দিভিনকে ভালোবাস অবশ্যই? বলল আহমদ মুসা।
হেদি হোয়ারি বলল। একটু চুপ থেকে বলল, অবশ্যই ভালোবাসি স্যার।
দিভিন যে আজ বিপদে পড়েছে, এ সম্পর্কে তুমি কি ভাব? বলল আহমদ মুসা।
একটুক্ষণ চুপ করে থাকল হোয়ারি। তারপর এদিক-ওদিক তাকাল। বলল, বিপদে ফেলা হয়েছে স্যার।
মাথা নিচু করল হোয়ারি।
আহমদ মুসা ভাবছিল। বুঝল সে, হোয়ারি ত্রিফা ও বেহেজদের মত নয়। তার ভেতরে একটা অনুতাপের আগুন আছে। তার কথা তার আচরণ, সেটাই প্রমাণ করছে।
আহমদ মুসা এবার সরাসরি কথায় এল। বলল, হোয়ারি আজ সন্ধ্যায় তুমি কি নিয়ে বেহেজের কাছে গিয়েছিলে?
চট করে মুখ তুলে তাকাল হোয়ারি আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার দিকে তার বিস্ফারিত চোখ। মুখে তার কোন কথা নেই।
বল হোয়ারি, বেহেজকে কি দিয়ে এসেছ বা খবর দিয়েছ তাকে? বলল আহমদ মুসা।
হোয়ারি তার মুখ নিচু করল মুহূর্তের জন্যে। মুখ তুলেই বলল, একটা প্যাকেট পৌঁছে দিয়েছি।
প্যাকেটে কি ছিল? বলল আহমদ মুসা।
সেটা জানি না স্যার। তবে প্যাকেটটা খুব বড় নয়। শক্ত, বর্গাকৃতির। খুব সাবধানে আনতে হয়েছে। কোন প্রকার নড়ানো, ঝুঁকি লাগানো নিষেধ ছিল। হোয়ারি বলল।
প্যাকেট তোমাকে কে দিয়েছিল? বলল আহমদ মুসা।
কেউ দেয়নি স্যার। আমাদের দিভিন উপত্যকার বাইরে আরও কিছু উত্তরে কাঁপান-আগারাক রোডের উপর একটা জীপ গাড়ির সিটের উপর প্যাকেটটা ছিল। সেখান থেকে আমি ওটা নিয়ে এসেছি। আমাকে এ রকমই নির্দেশ দিয়েছিলেন মোহাম্মাদ বেহেজ স্যার।
বাইরের বৈঠকখানায় তুমি জনাব বেহেজের জন্যে অপেক্ষা করছিলে, কিছু নির্দেশ আছে কি তোমার উপর?
আছে স্যার। মিটিং চলাকালে আমাকে এই বৈঠকখানায় অপেক্ষা করতে হবে। একটা মোবাইল তিনি আমাকে দিয়ে যাবেন। মিটিং চলাকালে সে মোবাইলে একটা মিসকল আসবে। সংগে সংগে মিটিংরুমের দরজায় গিয়ে মোবাইলটি তাকে দেখাতে হবে। মোবাইল ধরার জন্যে তিনি বেরিয়ে আসবেন। এটুকুই আমার উপর আদেশ।
ধন্যবাদ হেদি হোয়ারি। তুমি বাইরের বৈঠকখানায় গিয়ে তোমার মত করে বসে থাক। আমাদের সাথে যেসব কথা হলো, তা কাউকে তুমি বলবে না। বলল আহমদ মুসা।
চোখ তুলল হেদি হোয়ারি। তার চোখ অশ্রুসজল। বলল, স্যার, আমি যা করছি, আমি তার বিরুদ্ধে। যে দিভিনকে ভালোবাসি, সেই দিভিনের আমি সর্বনাশ করছি। নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচানোর জন্যে এটা আমি করতে বাধ্য হচ্ছি স্যার। তার অবাধ্য হওয়ার কারণে এর আগে দুটি পরিবারকে তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠ হোয়ারির।
যাও তোমার আর ভয় নেই। আল্লাহ চাহে তো তোমার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। বলল আহমদ মুসা।
সালাম দিয়ে চলে গেল হোয়ারি। ঘরে ঢুকল ইভা নারিন এবং শেপল।
বলল ধন্যবাদ জনাব। বুলেট তো দূরের কথা, একটা ধমকেরও ব্যবহার করতে হয়নি আপনাকে। ষোলআনা কাজই হাসিল করে নিয়েছেন। ইভা নারিন বলল।
আসলে দিভিনের লোকগুলো খুব ভালো। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু ত্রিফা বেফ্রিন ও মোহাম্মাদ বেহেজ আংকেলও তো দিভিনের লোক? শেপল বলল।
ত্রিফা ও বেহেজ- কেউই দিভিনের লোক নয়। হয় তাদের দিভিনে বসানো হয়েছে, নয়তো তারা দিভিনের লোক না হওয়ার কারণে শত্রুরা তাদের হাত করতে পেরেছে। বলল আহমদ মুসা।
বেহেজ আংকেলও দিভিনের বাইরের লোক? শেপল জিজ্ঞাসা করল।
পশ্চিম ইরানের ছোট্ট যে শহরে তার জন্ম সেখানে শিয়া মুসলমানদের বসবাস খুবই কম। খৃস্টান ও ইহুদিরাই সেখানে মেজরিটি। বেহেজের পরিবার সেখান থেকে কোথায় গেল আর যুবক বেহেজ কি করে সে শহর থেকে পরিবার ছাড়া হয়ে সরাসরি দিভিনে চলে এল, এ বিষয়টা এখনো অন্ধকারে।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, থাক এ প্রসঙ্গ। কাজের কথায় আসা যাক। হোয়ারির কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। শুধু একটা বিষয় অস্পষ্ট রয়ে গেছে। সেটা হলো, যে ধরনের বোমাই হোক, সেটা এখানকার কেউ ফাটাবে, না বাইরে থেকে ফাটানো হবে রিমোট কনট্রোলের মাধ্যমে।
জি, সেটাই বড় প্রশ্ন। মিসকল দিয়ে মোহাম্মাদ বেহেজকে বের করে নিয়ে যাওয়া হবে মিটিং থেকে। তারপরই বোমাটা বা বোমাগুলো ফাটবে। ইভা নারিন বলল।
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, ঠিক বলেছ ইভা নারিন। এখন আমাদের করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে।
কথা কয়টি বলেই মুখ তুলে আহমদ মুসা তাকাল ইভা নারিনের দিকে। বলল, তোমরা যাও। মিটিং-এ যাবার জন্যে রেডি হও। মিটিং
শুরুর আগেই তোমাকে আরও কিছু কথা বলব ইভা নারিন।
মিটিং-এ কিন্তু লোক এসে গেছে স্যার। বলে শেপল ও ইভা নারিন। আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে ঘরের বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
ইভা নারিন, এটা কি তোমার প্রথম সালাম? পেছন থেকে বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিন থমকে দাঁড়াল। পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, প্রকাশ্যে এটা প্রথমই বটে।
অপ্রকাশ্যে তো সালাম নেই। বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।
চর্চা অপ্রকাশ্যে চলতে পারে। ইভা নারিন বলল।
কদিন থেকে তোমার পোষাকেও পরিবর্তন এসেছে। ফুলহাতা ফুলড্রেস, মাথা থেকে গায়ে ওড়না জড়ানো। এটা কি দেখাদেখি ব্যাপার,
সালাম-এর সাথে এরও সম্পর্ক আছে? বলল আহমদ মুসা।
চোখ নয়, মন আমাকে গাইড করে। ইভা নারিন বলল।
কনগ্রাচুলেশন ইভা নারিন। বলল আহমদ মুসা।
এই কনগ্রাচুলেশন আপনার প্রাপ্য। অন্য কাউকে যদি দিতে হয় তাহলে সেটা প্রাপ্য আন্না এলিনার। সে আপনার অন্ধ ভক্ত। আপনি তার মডেল। মডেলের ধর্ম তার ধর্ম হয়ে গেছে। বাবা মাকে হাফ কনভার্ট বানিয়ে ফেলেছে। প্রতিদিনই সে আমার খোঁজ নেয়। আমি কি করি বলুন? ইভা নারিন বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, কিছু করার না পেয়েই কি ইসলাম গ্রহণ করেছ?
ওটা আমার একটা উপলক্ষের কথা বলেছি। বলছি না যে, কনগ্রাচুলেশন আপনার প্রাপ্য। হাজার পাতা লেখা, হাজার ঘন্টার উপদেশের চাইতে এক ঘন্টার জীবন্ত দৃষ্টান্ত অনেক বেশি শিক্ষা দেয়, অনেক বেশি আকর্ষণ করে। যে জীবন্ত দৃষ্টান্ত আন্না এলিনাকে অন্ধভক্ত বানিয়েছে, সে জীবন্ত দৃষ্টান্ত তো আমার সামনেও! আমার মনটা তো মৃত নয়।
বলেই ইভা নারিন ঘর থেকে বের হবার জন্যে হাঁটা শুরু করল।
শেপল সরদার সাহেবকে বলে দিও মিটিং-এ যেতে আমার একটু দেরি হবে। পেছন থেকে শেপলকে লক্ষ করে বলল আহমদ মুসা।
ওরা বেরিয়ে যেতেই সোফায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা। রিল্যাক্স মুডে এসে মাথাকে নির্ভার চিন্তার সুযোগ দিল। চোখ বন্ধ হয়ে এল আহমদ মুসার।
কয়েক মুহূর্ত পর সোজা হয়ে বসল সোফায়। টেলিফোন করল আহমদ নেবেজকে। বলল আহমদ মুসা সালাম দিয়ে, তুমি কি মিটিংরুমে।
জি হ্যাঁ স্যার। আহমদ নেবেজ বলল।
সংক্ষেপে কিছু বল। বলল আহমদ মুসা।
আপনার নির্দেশমত মিটিং শুরুর ১ ঘন্টা আগে থেকে আমি পাশের রুমে ছিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে জনাব মোহাম্মাদ বেহেজ মিটিংরুমে ঢোকেন। তিনি চেয়ারের সেটিং দেখেন। কে কোথায় বসছে, সে নেম প্লেটও দেখেন। যারা অডিয়েন্সের মুখোমুখি বসবেন, নিজের চেয়ারসহ তাদের চেয়ারগুলো উল্টে-পাল্টে দেখেন। তাছাড়া সারা হলঘরই তিনি ঘুরেন। মাঝে মাঝে কয়েকটি চেয়ারেও তিনি বসেন। কোন কোন চেয়ার উল্টে-পাল্টেও দেখেন। পরে বেরিয়ে চলে যান। তিনি চলে যাবার আধাঘন্টা পর জনাব সরদার আসতি আওয়াত এরদেলানকে নিয়ে মিটিংরুমে ঢোকেন। একটু ঘুরে ফিরে দেখে ৫ মিনিটের মধ্যেই চলে যান। মিটিং-এর নির্দিষ্ট সময়ের ৫ মিনিট আগে জনাব মোহাম্মাদ বেহেজ আবার আসেন। তার চেয়ারে তিনি কিছুক্ষণ বসে আপনার চেয়ারে আরও কিছুক্ষণ বসেন। আবার তিনি ফিরে আসেন নিজের চেয়ারে। ইতিমধ্যে মিটিং-এ আমন্ত্রিতদের দু একজন করে আসা শুরু হয়ে যায়। দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল আহমদ নেবেজ।
মিটিংরুমের ভেতরের কাজ তোমার শেষ। এখন বাইরে যাও। দেখবে বাইরের বৈঠকখানায় হেদি হোয়ারি বসে আছে। আড়াল থেকে তার দিকে চোখ রাখবে। তার কাছে কে যায়, কারা কথা বলে তা লক্ষ রাখবে। ম্যাডাম ইভা নারিনের কথামত কাজ করবে। পকেটে লোডেড রিভলবার আছে তো? প্রয়োজনে ওটার ব্যবহারে যেন দেরি না হয়। বলল আহমদ মুসা।
ও.কে স্যার। আহমদ নেবেজ বলল।
আহমদ মুসা মোবাইল টেবিলে রেখে মিটিং-এ যাবার জন্যে পোষাক পাল্টে নিল।
আহমদ মুসা তৈরি হয়ে বাইরে এল। ঠিক এই সময়েই ইভা নারিন ও শেপল মিটিং-এ যাওয়ার পথে তার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
ধন্যবাদ তোমাদের ইভা নারিন। তোমার উপর দায়িত্ব হলো মোহাম্মাদ বেহেজ মিটিংরুম থেকে বেরিয়ে কোন মোবাইলেই যেন কথা বলতে না পারে এবং হেদি হোয়ারির মোবাইল যেন সে হাতে না পায়। বলল আহমদ মুসা।
ওটা কি তাহলে রিমোট কনট্রোলও? ইভা নারিন বলল।
হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে ডবল রিমোট কনট্রোল থাকতে পারে। বাইরে থেকেও বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
তাহলে তো পরিস্থিতি বিপজ্জনক! আমরা কি লোকটিকে এখনি আটক করে বোমাগুলো নিষ্ক্রিয় করতে পারি না? বলল ইভা নারিন।
বোমা বা বোমাগুলো কোথায়, আদৌ আছে কিনা আমরা জানি না। কি অবস্থায় আছে তাও জানি না। হিতে বিপরীত হোক, সেটাও আমাদের এড়াতে হবে। মিটিং-এ আমরা না বসা পর্যন্ত চিন্তা আমাদের পরিণত হতে পারছে না। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে আমরা এখনও অনিশ্চিতের মধ্যে আছি। এটা তো ভয়ের কথা। ইভা নারিন বলল।
আমি যে দায়িত্ব তোমাকে দিয়েছি ইভা নারিন, তা ঠিকভাবে পালন করলে ভয়ের সিংহভাগ চলে যাবে। শুধু একটা ভয়ই থাকবে। সেটা হলো ওরা বেহেজের কল না পেয়েই যদি ওদের রিমোটে ফায়ার করে দেয় এবং রিমোটের শক্তি যদি খুব বেশি হয়? যাক, কিছু তো ঝুঁকি থাকবেই, তোমরা চিন্তা করো না। বলল আহমদ মুসা।
আপনিও তো বেহেজের সাথে বেরিয়ে আসতে পারেন। ইভা নারিন বলল।
না ওখানেও আমার একটা বড় কাজ আছে। আহমদ মুসা বলল।
আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। আমরা যাচ্ছি।
বলে ইভা নারিন ও শেপল মিটিংরুমের দিকে পা বাড়াল।
আহমদ মুসা ওদের বিদায় দিয়ে পকেট থেকে বের করল তার নতুন। মোবাইলটা। ইয়েরেভেনে আসার পর এ মোবাইলটা তাকে গিফট করেছে সেখানকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি জর্জ আব্রাহাম জনসনের বন্ধু। মোবাইলটা একই সাথে টেলিফোন, ট্রান্সমিটার, বিস্ফোরক ও মেটাল ডিটেকটর এবং জ্যামিং মেশিন হিসাবে কাজ করে। দশ বর্গমিটার রেডিয়াসের মধ্যে যেকোন বোমা-বিস্ফোরকের অবস্থান চিহ্নিত হয় এর স্ক্রিনে। এর জ্যামিং মেশিন বোমাকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না। তবে রিমোট কনট্রোলের ইলেকট্রনিক কমান্ডকে আটকে ফেলতে পারে জ্যাম সৃষ্টি করে। মোবাইলটার আজকেই প্রথম পরীক্ষা হবে। আল্লাহর সাহায্য চাইল আহমদ মুসা।
হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে মিটিংরুমের দিকে হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসা।
.
আহমদ মুসা তার চেয়ারে বসেই তার মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল।
মোবাইল স্ক্রিনে হলরুমের আয়তাকার একটা স্কেচ ফুটে উঠেছে। স্কেচে পাঁচটি জায়গা ফ্লাসিং রেড ডট হচ্ছে। চারটা চার প্রান্তে এবং পঞ্চমটি মঞ্চে, হয় সরদার আসতি আওয়াতের চেয়ার অথবা আহমদ মুসার চেয়ারের নিচে।
প্রবল অস্বস্তিতে পড়ল আহমদ মুসা। মঞ্চ মিটিংরুমের এক প্রান্তে। তার মোবাইলের জ্যামিং পাওয়ার দশ রেডিয়াস মিটার, যা মিটিংরুমের মাঝ বরাবর যাবে। তার মানে দুইটি বোমা জ্যামিং-এর বাইরে থাকছে। স্ক্রিনে বোমার স্পেসিফিকেশন কলামে বোমার যে ক্ষমতার কথা লেখা হয়েছে তা শিউরে উঠার মত। পঞ্চাশ গ্রামের একটা বোমা পঁচিশ রেডিয়াস মিটার এলাকার সব স্থাপনাকে ধুলায় পরিণত করতে পারে। সেই বোমার পাঁচটি পাতা হয়েছে এই মিটিংরুমে। কত হিংস্র পরিকল্পনা!
মিটিং তখনও শুরু হয়নি। আহমদ মুসার জন্যেই অপেক্ষা করা হচ্ছিল। আহমদ মুসা মিটিংরুমে প্রবেশের পর মিটিং শুরুর আয়োজন শুরু হয়ে গেল।
আহমদ মুসা চেয়ার থেকে উঠে সরদার আসতি আওয়াতের কাছাকাছি হয়ে বলল, জনাব এই মিটিং আপনাদের নিজস্ব প্রয়োজনে। আমি এই সারিতে এখন বসতে চাচ্ছি না, আমি দর্শক সারিতে গেলাম। প্লিজ এটা আমার সিদ্ধান্ত।
সরদার আসতি আওয়াত তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার কথা তার কাছে অমোঘ আদেশের মত মনে হলো। বিরোধিতা করতে পারল না। উঠে দাঁড়াল আসতি আওয়াত। বলল, আপনার কথার বাইরে আমার কোন কথা নেই।
ধন্যবাদ জনাব।
বলে আহমদ মুসা মিটিংরুমের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে মাঝখানের একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। তার হাতে তখন ছিল মোবাইল। এরদেলান এসে আহমদ মুসার পাশে বসল।
সবাই বিস্মিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখে-মুখে প্রশ্ন তাদের।
সরদার আসতি আওয়াত সকলের উদ্দেশ্যে বলল, আমাদের নেতা, আমাদের সম্মানিত মেহমান, আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাই আহমদ মুসা মনে করেন আজ মিটিং-এ তার বলার কিছু নেই, তাই তিনি দর্শক সারিতে বসতে চাচ্ছেন। তার ইচ্ছা আমাদেরও ইচ্ছা। আসুন আমরা মিটিং-এর। কাজ শুরু করি।
মিটিং-এর প্রথম বিষয় হিসাবে কুরআন তেলাওয়াত শুরু হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা এরদেলানের কানে কানে বলল, তুমি পাঁচজন চৌকস লোক ঠিক কর। আমি যখনই বলব, তখনই পাঁচজনকে পাঁচটি চেয়ার এই কক্ষের পেছন দরজা দিয়ে দ্রুত বাইরে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের ঢালে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। আর তুমি এখনই পেছনের দরজাটা খুলে দিয়ে এস।
এরদেলান তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। কিন্তু কিছু বলতে সাহস পেল না। উঠে গিয়ে পেছনের দরজাটা খুলে দিল এরদেলান। তারপর ঐখানে আড়ালে দাঁড়িয়ে একজন অ্যাটেনডেন্টকে দিয়ে তার বাছাই করা পাঁচজনকে একে একে ডেকে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল।
মিটিং চলছে। উদ্বোধনী ভাষণ দিচ্ছেন সরদার আসতি আওয়াত।
তার বক্তৃতার মাঝখানে হেদি হোয়ারি এসে মিটিংরুমের দরজায় দাঁড়াল এবং হাতের মোবাইলটা মোহাম্মাদ বেহেজকে দেখাল। সংগে সংগে বেহেজ চেয়ার থেকে উঠে সরদার আসতি আওয়াতের কানে কানে বলল, জনাব একটা কল এসেছে। ধরে আসছি।
কথার মধ্যেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল সরদার আসতি আওয়াত।
মোহাম্মাদ বেহেজ বাইরে চলে গেল।
এরদেলান পেছন দিক থেকে তৃতীয় সারির তৃতীয় ও দশম চেয়ার, সামনে থেকে দ্বিতীয় সারির তৃতীয় ও দশম চেয়ার এবং জনাব সরদার আসতি চেয়ার অর্থাৎ এই পাঁচটি চেয়ারের কাছে তোমার লোকদের যেতে বল। বাইরে একটা গুলির শব্দ হবে এবং আমিও হাত তুলব। সংগে সংগে খুব সাবধানে চেয়ারগুলো নিয়ে তোমার লোকদেরকে পাহাড়ের ঢালে ছুঁড়ে দিতে বলবে।
এরদেলান দ্রুত উঠে পাঁচজনকে ইশারা করল। তারা এলে পাঁচটি চেয়ার দেখিয়ে দিল। বিষয়টা আবারও তাদের বুঝিয়ে বলল।
লোক পাঁচজন গিয়ে চেয়ারের কাছে দাঁড়াতেই পরপর তিনটি গুলি হলো।
প্রথম গুলির শব্দ পেতেই আহমদ মুসা হাত তুলেছিল। ওরা পাঁচজন সাথে সাথেই চেয়ারগুলো সাবধানে নিয়ে ছুটল বাইরের দিকে।
অন্যদিকে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা চুপ করে বসুন, কোন ভয় নেই। বলেই ছুটল সে ঘর থেকে বাইরে বেরুবার জন্যে।
আহমদ মুসা সবে দরজায় পৌঁছেছে, এই সময় মিটিংরুমের পেছনের দক্ষিণ দিক থেকে পরপর চারটি আকাশ ফাটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো। কেঁপে উঠল সমস্ত মিটিংরুম, গোটা টিলা।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে বলল, এরদেলান, তুমি একটু দেখ, চেয়ারগুলো ঠিকমতো ফেলতে পেরেছে কি না, ভাইরা ঠিকঠাক আছে কিনা।
যাচ্ছি স্যার। বলে ছুটল এরদেলান ঘরের পেছন দিকে। তার পেছনে পেছনে ছুটল বিস্ফারিত চোখে শিন সেনগার।
বিস্ফারিত চোখ তখন মিটিংরুমের সব মানুষেরই। তাদের সকলের চেহারা ভয় ও উদ্বেগে আড়ষ্ট।
সরদার আসতি আওয়াত পাথরের মত বসে আছে।
আহমদ মুসা মিটিংরুম থেকে বেরিয়ে এল। করিডোর ঘুরে পৌঁছল চত্বরের মুখে। দেখল হাতে ও কাঁধে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মোহাম্মাদ বেহেজ মাটিতে পড়ে আছে। রিভলবার তাক করে তার সামনে ইভা নারিন। দাঁড়িয়ে আছে। ইভা নারিনের বাম হাতে বড় সাইজের একটা মোবাইল। আহমদ মুসা বুঝল, মোহাম্মাদ বেহেজ হেদি হোয়ারির কাছ থেকে মোবাইলটা নেবার আগেই ইভা নারিন ওটা হোয়ারির কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিল। এটা নিয়েই শুরু হয় গোলাগুলি। চত্বরের মাঝখানে বাহুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে আহমদ নেবেজ। তার বাহুটা চেপে ধরে তার পাশে বসে আছে শেপল।
ধন্যবাদ, ইভা নারিন। ঠিক ঠিক কাজটা তুমি করেছ। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ নেবেজকে দিন। সে মোহাম্মাদ বেহেজকে গুলি না করলে আমাকেই বেহেজের গুলি খেতে হতো। যখন আমি হোয়ারির হাত থেকে, মোবাইলটা কেড়ে নিচ্ছিলাম তখন আমি বুঝতেই পারিনি যে, মোহাম্মাদ বেহেজ এতটা যাবে, আমাকে গুলি করবে। ইভা নারিন বলল।
আহমদ নেবেজ গুলি খেল কিভাবে? বলল আহমদ মুসা।
মোহাম্মাদ বেহেজ গুলি খেয়েই ডান হাতের রিভলবার বাম হাতে নিয়ে গুলি করে আহমদ নেবেজকে। আমিও সংগে সংগে গুলি করি মোহাম্মাদ বেহেজের বাম হাত লক্ষে। কিন্তু তার আগেই বেহেজ তার রিভলবারের ট্রিগার চেপে দিয়েছিল। ইভা নারিন বলল।
কিছুই বুঝতে পারছি না আমি জনাব আহমদ মুসা, কোথা দিয়ে কি সব হয়ে গেল। বলল সরদার আসতি আওয়াত।
সরদার আসতি আওয়াতসহ কয়েকজন প্রবীণ, এরদেলান, শিন সেনগার ও অনেকেই প্রায় আহমদ মুসার পিছে পিছে এসে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বিস্ময় উদ্বেগে তারা বাকরুদ্ধ। শিন সেনগারের চোখে বিস্ময় নয়, বেদনা আছে। নিজের অজান্তেই যেন সে এরদেলানের হাত আঁকড়ে ধরেছিল।
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে সরদার আসতি আওয়াতদের সামনে নিয়ে এল। বলল, জনাব আপনি ইভা নারিনের কথা থেকে এখানকার ঘটনাটা জেনেছেন।
হেদি হোয়ারির কাছ থেকে মোবাইল নেয়া থেকে দেখছি এই ঘটনা ঘটল। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
ওটা শুধু মোবাইল নয়, রিমোট কনট্রোলও। মোবাইলে মোহাম্মাদ বেহেজের জন্যে একটা মিসকল এসেছিল। হেদি হোয়ারি এই খবরটা মোহাম্মাদ বেহেজকে দেবার জন্যে গিয়েছিল। বেহেজ বেরিয়ে এসেছিল। টেলিফোনটা করার জন্যে। কলটা করতে পারলেই বেহেজ বোমার বিস্ফোরণ ঘটাবার কোড নাম্বারটা জানতে পারতেন। ওটা তিনি জানতে পারলেই রিমোটের একটা বোতাম টিপেই মিটিংরুমের পাঁচটা বোমার। বিস্ফোরণ ঘটাতে পারতেন। যাতে তা করতে না পারেন এই জন্যেই মোহাম্মাদ বেহেজ মোবাইলটা হোয়ারির কাছ থেকে নেবার আগেই ইভা নারিন নিয়ে নিয়েছিল।
আল্লাহর হাজার (শাকর। ধন্যবাদ আহমদ মুসা, ধন্যবাদ ম্যাডাম ইভা নারিন।
কান্না জড়িত কণ্ঠে কথা কয়টি বলতে বলতে মেঝেয় বসে পড়ল। সরদার আসতি আওয়াত।
আহমদ মুসাও আসতি আওয়াতের সামনে বসে পড়ল। বলল, জনাব দুঃখ করা, ভেঙে পড়ার সময় এটা নয়, এটা শুকরিয়া আদায়ের সময়।
ওদের কি ভয়ানক ষড়যন্ত্র ছিল। উপস্থিত একজন লোকও তো আমরা বাঁচতাম না। বুঝতে পারছি না আমরা কার কি ক্ষতি করেছি! কি দোষ আমাদের যে মোহাম্মাদ বেহেজ, ত্রিফা বেফ্রিনের মতো আমাদের সমাজের মাথারাও শত্রু পক্ষে যোগ দিল?
আহমদ মুসা বলতে যাচ্ছিল কিছু। এরই মধ্যে শিন সেনগার চিৎকার। করে উঠল, দেখুন, বাবার যেন কিছু হলো। ঢলে পড়েছেন মাটিতে।
আহমদ মুসা উঠে ছুটে গেল তার কাছে। দেখল মোহাম্মাদ বেহেজের দেহ স্থির। তার বাম হাতের অনামিকার পুরোটাই বেহেজের মুখের মধ্যে। চোখ-মুখের চেহারাও প্রমাণ দিচ্ছে সে পটাশিয়াম সায়নাইড খেয়েছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, মোহাম্মাদ বেহেজের মৃত্যু ঘটেছে। ত্রিফার মত সেও পটাশিয়াম সায়নাইড খেয়েছে।
শিন সেনগার পিতার দেহের উপর আছড়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। এরদেলান শিন সেনগারের পাশে বসে পড়ল। সদ্য বাবা-মা হারা, সব অবলম্বন হারা একজন তরুণীর তো একটা অবলম্বন চাই!
ত্রিফার মত একই পরিণতি হবে বেহেজের এটা আমি কয়েক মুহূর্ত আগেও আশা করিনি। নিঃসন্দেহে সে প্রমাণ করে গেল, সে কোন ষড়যন্ত্র বা বিভ্রান্তির শিকার হয়নি, মহাশত্রু ক্রিমিনালদের সেও একজন। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল সরদার আসতি আওয়াত।
দিভিনের এটা একটা দুর্ভাগ্য জনাব। কিছুই করার নেই। পৃথিবীতে বড় বড় যেসব বিপর্যয় ঘটেছে, তার অধিকাংশের পেছনে রয়েছে। বিশ্বাসঘাতকদের ভূমিকা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা সরদার আসতি আওয়াতকে বলল, জনাব, আপনারা মিটিংরুমে বসুন। আমরা আসছি। আহমদ নেবেজের রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার জন্য ওকে একটা ফাস্ট এইড দিতে হবে। ডাক্তারও ডাকতে হবে। আর দেখুন পুলিশ স্টেশনে কাদের পাঠানো যায়।
আপনারা আসুন। বলে আসতি আওয়াতরা মিটিংরুমের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
আসতি আওয়াতরা চলে যেতেই হেদি হোয়ারি আহমদ মুসার কাছে
এসে মাথা নিচু করে বলল, আমি কি করব স্যার?
ধন্যবাদ হোয়ারি, তুমি মিটিংরুমে যাও। আচ্ছা, হোয়ারি তুমি যা ঘটল তাতে খুশি না বেজার? বলল আহমদ মুসা।
দিভিন বেঁচেছে, আমি মরে গেলেও খুশি হতাম স্যার। হোয়ারি বলল।
ধন্যবাদ হোয়ারি, তুমি যাও। বলল আহমদ মুসা।
মাথা নিচু করে হোয়ারি হাঁটতে শুরু করল মিটিংরুমের দিকে।
শেপল আহমদ নেবেজকে নিয়ে আহমদ মুসার কাছে এল। বলল, স্যার, রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্যে আপাতত একটা ব্যান্ডেজ কি আহমদ নেবেজকে বেঁধে দেব?
ঠিক আছে দাও। মনে হচ্ছে বাহু আহত করে বুলেটটা বেরিয়ে গেছে। বলল আহমদ মুসা।
স্যার আমারও মনে হয়েছে আহত জায়গায় বুলেট নেই। মোটামুটি একটা ব্যান্ডেজ হলেই চলে। আহমদ নেবেজ বলল।
দেখ, ডাক্তাররা নিজের চিকিৎসা করে না। ব্যান্ডেজ কেমন হবে সেটা শেপলের উপর ছেড়ে দাও। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমে আহমদ নেবেজের পিঠ চাপড়ে বলল, তুমি গুলিটা ঠিক সময়ে করেছিলে। ধন্যবাদ আহমদ নেবেজ।
আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন স্যার? আপনাকে কে ধন্যবাদ দেবে? আজও আপনি দিভিনের প্রায় অর্ধশত শীর্ষ মানুষকে বাঁচিয়ে দিভিনকে রক্ষা করেছেন। কিছুতেই মাথায় আসছে না, এত সব কখন আপনি বুঝলেন, অসাধ্য সাধনটা করলেন কিভাবে! আমি তো গুলি করেছি, কিন্তু সে গুলিটা আপনিই করতে বলেছিলেন। তার মানে আপনি জানতেন, এমনটা ঘটবে এবং আমাকে গুলি করতে হবে। আপনাকে ধন্যবাদ দেবার মতো কোন ভাষা আমার জানা নেই স্যার। আহমদ নেবেজ বলল। তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। শেষে তার কণ্ঠ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আহমদ নেবেজ, এটা যুদ্ধক্ষেত্র। ইমোশনাল হয়ো না। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তাকাল শেপলের দিকে। বলল, শেপল, ব্যান্ডেজটা ডাক্তার হিসেবে বেঁধে দাও। ইমোশন বা কষ্টকে প্রশ্রয় দেবে না।
শেপলের মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, স্যার, আপনি পরশ পাথর।
আমরা আর সেই আগের আমরা নেই। চিন্তা করবেন না স্যার।
ধন্যবাদ। পরশ পাথর বলে কিছু নেই। আছে আল্লাহর দ্বীনের প্রাকৃতিক শক্তি। আসি। তোমরা এস।
বলে আহমদ মুসা মিটিংরুমের দিকে পা বাড়িয়েও ঘুরে দাঁড়াল শিন সেনগারের দিকে। সে পিতার পাশে বসেছিল। অধোঁয়া তার মুখ। এরদেলান তার পাশে নির্বাক বসে আছে।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল শিন সেনগারের দিকে। আস্তে করে একটা হাত শিন সেনগারের মাথায় রেখে বলল, স্যরি বোন।
দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল শিন সেনগার।
আহমদ মুসা তার পাশে বসল। বলল, অসীম বেদনা চোখে অশ্রুর জোয়ার আনবে অবশ্যই, কিন্তু এখন আমাদের সামনে তাকাবার সময় বোন। যে চোখ সামনে তাকাবে তাতে অশ্রু থাকলে চলবে না।
শিন সেনগার চোখ থেকে হাত সরাল। অশ্রুতে তার দুই গণ্ড ভেসে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে রুমাল বের করে শিন সেনগারের হাতে দিল।
শিন সেনগার মুখ থেকে অশ্রু মুছে ফেলল। বলল, স্যরি স্যার। মায়ের কাছে যত ভালোবাসা পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসা পেয়েছি বাবার কাছে। মা আমার ধার্মিকতাকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু বাবা আমাকে বলতেন, যেমনটা তোমার পছন্দ তুমি সেভাবেই গড়ে ওঠ। দিভিনের স্বেচ্ছাসেবক দলে আমি যোগ দিয়েছিলাম। মায়ের তরফ থেকে আমি বাধা পেয়েছি। কিন্তু বাবা দিভিনের প্রতি আমার ভালোবাসাকে, দিভিনের মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসাকে কোন দিন নিরুৎসাহিত করেননি। আমার সেই বাবার এমনটা হলো কেন?
শেষের কথাগুলো কান্নায় জড়িয়ে গেল শিন সেনগারের।
ধীরে ধীরে সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে। আমি উঠছি, তোমরা এস। লাশ যেমন আছে, পুলিশ আসা পর্যন্ত তেমনই থাকবে।
বলে আহমদ উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে লাগল মিটিংরুমের উদ্দেশ্যে।
ইভা নারিনও আহমদ মুসার সাথে হাঁটতে লাগল।
ইভা নারিন, আমার মনে হয় তোমার বাবাকে এবং থানায় তোমার টেলিফোন করা দরকার। বলল আহমদ মুসা।
আমারও মনে হচ্ছে এ দুটো টেলিফোন করা, বিশেষ করে বাবাকে টেলিফোন করা দরকার। ইভা নারিন বলল।
থানাতেও টেলিফোন করা দরকার। তাহলে চল, বাইরের ঐ বৈঠকখানায় বসে টেলিফোন কর। বলল আহমদ মুসা।
বাইরের বৈঠকখানা উন্মুক্ত। অস্থায়ী দেয়াল ফোল্ড করে রাখা হয়েছে।
ইভা নারিন একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। কল করা শুরু করল।
আহমদ মুসা এদিক-ওদিক পায়চারি করতে লাগল। দুটো টেলিফোন শেষ করতে বেশ সময় লাগল ইভা নারিনের।
টেলিফোন শেষ করে বেরিয়ে এল ইভা নারিন। বলল আহমদ মুসাকে, বাবা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পুলিশ গোয়েন্দারা গত কয়েক বছরে যে সন্ত্রাসীদের টিকির সন্ধান পায়নি, আপনি দেড় দিনে। তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছেন, তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। পুলিশের পক্ষেও কিছু করার এখন সুযোগ হয়েছে। একটু থামল ইভা নারিন।
ধন্যবাদের বিষয়টা বাদ দাও। কাজের কথা কি হলো সেটা বলো। বলল আহমদ মুসা।
আমি বাবাকে সব বলেছি। তিনি খুঁটে খুঁটে জিজ্ঞাসা করে সব জেনেছেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আহমদ মুসা এই জন্যেই আহমদ মুসা। অসাধ্য সাধন করাই তার কা…।
আহমদ মুসা ইভা নারিনকে বাধা দিয়ে বলল, আবার সেই ব্যক্তিগত কথা। প্লিজ বল, উনি কাজের কথা কি বলেছেন?
সেটাই তো বলতে যাচ্ছিলাম। বাবা বলেছেন, পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগারকে ফলো করার জন্যে। তিনি গোয়েন্দা লাগিয়েছেন সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল কে কি কোথায় তা খুঁজে বের করার জন্যে। আরেকটা তথ্য তিনি দিয়েছেন, তা কোন কাজের নাও হতে পারে। সেটা হলো, আর্মেনিয়ান আর্মির সাউথ আর্মেনিয়া কমান্ডের একজন শীর্ষ অফিসার আমাদের গোয়েন্দাকে বলেছে, আন্ট্রা খৃস্টান নামের একটা গোপন সংস্থা আর্মেনিয়ায় কোন কাজে একটা সেনা ইউনিটের সাহায্য চাচ্ছে। তারা সেনা গোয়েন্দা সূত্রে এটা জেনেছেন। তবে কোথায়, কোন্ কাজে তা জানতে পারেননি। শেষ কথা হলো, সাউথ আর্মেনিয়ার পুলিশ প্রধানকে বাবা দিভিনের ব্যাপারে ব্রিফ করেছেন। থানায় টেলিফোন করেও এটা আমি বুঝলাম। থানার অফিসার ইনচার্জ বললেন, একটা সন্ত্রাসী সংস্থা দিভিনে বারবার আক্রমণ করছে, এ ব্যাপারে পুলিশকে তৎপর হওয়ার জন্যে উপর থেকে নির্দেশ এসেছে। আজকের খবর পুলিশ স্টেশন আগেই পেয়েছে, তারা আসছে।
ধন্যবাদ ইভা নারিন, অনেকগুলো ভালো খবর দিয়েছ। ধন্যবাদ তোমার বাবাকে, না চাইতেই তিনি সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। বলল আহমদ মুসা।
বাবা আপনাকে সাহায্য করছে না বরং আপনিই বাবাকে সাহায্য করছেন। এ কাজ তো বাবার ছিল। বাবা চারজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে হারিয়েও কিছু করতে পারেননি। বাবা আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এ কারণেই। ইভা নারিন বলল।
সবাই আমরা মানুষ। সবাই আমরা মানুষকে সাহায্য করছি। এখানে। আমি তুমি বলে কিছু নেই। সবাই আমরা সবার তরে, এমন সামাজিক সম্পর্কই আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহ চান। যাক, চল মিটিংরুমে, দেরি হয়ে গেল। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও ইভা নারিন মিটিংরুমে প্রবেশ করল। শেপল, আহমদ। নেবেজ, শিন সেনগার, এরদেলানরাও এসে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা সরদার আসতি আওয়াতের পাশে তার চেয়ারে গিয়ে বসল। ইভা নারিন গিয়ে বসল শেপল, শিন সেনগারদের পাশে।
আহমদ মুসা বসার কিছু সময় পরেই দিভিন কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম ও দিভিনের শাইখ আব্দুল হক উঠে দাঁড়াল। বলল, আমাদের বুজুর্গ মেহমান, সম্মানিত ভাই আমি একটা প্রশ্ন করব যদি তিনি অনুমতি দেন। তার মুখে হাসি।
মিটিং শুরু হয়নি, প্রশ্ন করতে পারেন সম্মানিত শাইখ। বলল আহমদ মুসা।
আমাদের ভাই আহমদ মুসা তখন বসেছিলেন ঘরের মাঝখানে শ্রোতার চেয়ারে গিয়ে, এখন তিনি তাঁর চেয়ারে ফিরে এসেছেন। কারণ আমরা বুঝতে পারছি না? শাইখ আব্দুল হক বলল।
তাকাল আহমদ মুসা সরদার আসতি আওয়াতের দিকে।
জনাব উত্তর দিতে পারেন, যদি বলার মত হয়।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, একটা জরুরি বিষয়ের প্রয়োজনে অভিনয়টা করতে হয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম মিটিংরুমে বোমা পাতা হয়েছে। কয়টা বোমা, কোথায় পাতা হয়েছে জানতাম না। এসে আমার চেয়ারে বসার পরেই আমার ডিটেকটরের স্ক্রিনে দেখলাম ঘরের চারদিকে চারটা এবং আমাদের এই সারির মাঝখানে একটা, এই পাঁচটা বোমা পাতা আছে। বোমাগুলোর সবই রিমোট কনট্রোলড। আমার কাছে। রিমোটের কমান্ড জ্যাম করার যে ব্যবস্থা রয়েছে তা মাত্র দশ রেডিয়াসের মধ্যে কাজ করে। এতে ঘরের অর্ধেক পর্যন্ত কভার হয়। সুতরাং ঘরের সবগুলো, বোমা জ্যামিং-এর আওতায় আনতে হলে আমাকে ঘরের মাঝখানে বসতে হবে। আমি একটা কারণ দেখিয়ে ঘরের মাঝখানে গিয়ে বসেছিলাম।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা চেয়ারে ফিরতে যাচ্ছিল তখন আর একটি প্রশ্ন তার দিকে ছুটে এল। বোমা পাতা হয়েছে, বেহেজ বোমা পেতেছে এই বিষয়টা কিভাবে জানতে পারলেন আপনি জনাব। প্রশ্নটি এবার এল স্বয়ং আসতি আওয়াতের কাছ থেকে।
ধন্যবাদ জনাব। সেদিন ভোররাতে শত্রুদের যারা নিহত হয়, তাদের নেতা রাফায়েলের মোবাইলটা আমি নিয়ে নেই। রাফায়েল এই মোবাইলে দুইবার ত্রিফার সাথে কথা বলে। দ্বিতীয়বার কথা বলার কাছাকাছি সময়ে সে আরেকটি টেলিফোনে দীর্ঘ কথা বলে। পরে প্রমাণ হয় টেলিফোন নাম্বারটি মোহাম্মাদ বেহেজের। তখনই তার প্রতি সন্দেহ আমার নিশ্চিত হয়। এরপর তার গতিবিধি নজরে রাখার চেষ্টা করি। শিন সেনগারের কাছ থেকে জেনেছি দুজন লোক বেহেজের সাথে দেখা করতে যায়। সেনগারের কথা শুনে বুঝেছি, সন্ধ্যায় যে যায়, তাকে সন্দেহজনক মনে হয়। তার নাম শিন সেনগারের কাছ থেকেই জেনেছিলাম। তাকে ডেকে কথা বললাম। সে স্বীকার করল, সে একটা প্যাকেট এনে বেহেজকে দিয়েছিল। প্যাকেটের বিবরণ শুনে বুঝলাম, ওটা বোমার প্যাকেট। তারপরেই আমি পরিকল্পনা করলাম, কি করে। ওদের বোমার বিস্ফোরণ ঠেকানো যায়। বেহেজ মিটিং থেকে বেরিয়ে যাতে হোয়ারির মোবাইল হাতে না পায় আর কারও কাছে যেন। টেলিফোন না করতে পারে এবং ওটা রিমোট হিসাবে যেন ব্যবহার করতে না পারে, এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দিলাম ইভা নারিনকে। অন্যদিকে আরও রিমোট কারও হাতে থাকলে, তারা যাতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে না পারে, সেজন্যে বেহেজ বাইরে যাওয়ার সাথে সাথে চেয়ারসমেত বোমা টিলার নিচে ফেলে দেবার ব্যবস্থা করলাম। আহমদ মুসা থামল। _ সংগে সংগেই আরেকটা প্রশ্ন করা হলো, বোমাগুলো ফেলে দেয়ার ক্ষেত্রে বাইরে থেকে গুলির শব্দ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছিলেন কেন? প্রশ্নটি এরদেলানের।
বাইরে গুলির শব্দ পাওয়ার অর্থ হলো, রিমোট-মোবাইলটা বেহেজ হাত করতে পারেনি, বাইরে কারো কাছে টেলিফোনও করতে পারেনি এবং বোমা বিস্ফোরণ, কোড নাম্বারও সে পায়নি। তখনই ভাবলাম এটাই বোমাগুলো বাইরে ফেলে দিয়ে তা ধ্বংস করার উপযুক্ত সময়। তাই করা হয়েছে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই শেপল বলল, যদি এই সময় বাইরে থেকে বিকল্প রিমোট দিয়ে কেউ বিস্ফোরণ ঘটাতো?
বেহেজের টেলিফোন না পাওয়া পর্যন্ত তার সম্ভাবনা ছিল না। বলল আহমদ মুসা।
আর কোন প্রশ্ন এল না। সবাই আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ জানাল।
মিটিং-এর কাজ শুরু করার কথা বলল শাইখ আব্দুল হক।
মিটিং-এর কাজ তো শুরু হয়েই গেছে। এগুলোও তো আমাদের জানার বিষয় ছিল। দুটো প্রশ্ন এখন আমাদের সামনে বড় হয়ে রয়ে গেছে। একটি হলো- এই বিপদ আমাদের উপর কেন? আমাদের দোষ কি? আমরা আর্মেনিয়ার সবচেয়ে শান্তিবাদী সম্প্রদায়। দ্বিতীয় বিষয় হলো, সংকট যে অবস্থায় পৌঁছেছে, সেখান থেকে আমাদের উদ্ধার কিসে, কিভাবে?
একটু থামল সরদার আসতি আওয়াত। একটু দম নিয়ে বলল, অসহায় দিভিনের জন্যে আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত আমাদের বুজর্গ ভাই জনাব আহমদ মুসাকে অনুরোধ করছি, এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলুন।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, সরদার সাহেব যে দুটি প্রশ্ন তুলেছেন, তা আজকের সময়ের মৌলিক প্রশ্ন। আজকের সংকটের উৎস। ও সমাধান এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। থামল আহমদ মুসা। মিটিংরুমের সকলের চোখ আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ।
আবার কথা শুরু করল আহমদ মুসা। বলল, প্রথম প্রশ্ন হলো, কেন দিভিনের মানুষের উপর এই বিপদ। কোন গ্রাম, এলাকা বা জনগোষ্ঠি রাজনৈতিক, অপরাধমূলক কারণে বৈরিতা, হিংসা-প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে। দিভিন সেরকম কোন কিছুর সাথে জড়িত নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন সামনে এসেছে যে, তাহলে দিভিনের উপর বিপদ কেন? এই প্রশ্নের সমাধান খুঁজে দেখার আগে আপনাদের কাছে আমার কিছু জানার আছে। আপনারা যারা দিভিনে একসাথে বাস করছেন, তাদের পরিচয় সম্পর্কে আপনারা কি জানেন? আপনারা কোন্ বংশের অধস্তন বা উত্তরসূরি হতে পারেন? আর সেটা কোন বংশ? থামল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে উঠে দাঁড়িয়ে সরদার আসতি আওয়াত বলল, দায়িত্বের দিক থেকে এ প্রশ্নের উত্তর আমাকেই দিতে হয়। কারও বাড়তি কিছু জানা থাকলে আমাকে সাহায্য করবেন।
একটু থামল সরদার আসতি আওয়াত। একটু ভাবল, সম্ভবত কথা গুছিয়ে নিল। বলল সরদার আসতি আওয়াত, আমাদের সম্মানিত ভাই আমাদের বংশপরিচয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, তা আমরাও জানি না, যদি বিশেষ তেমন কিছু থাকে। আমাদের কয়েক পুরুষ আগের অতীত সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। এই দিভিন উপত্যকা আমার মূল বসতির জায়গা নয়। আর্মেনিয়ার প্রাচীন রাজধানী দিভিন আমাদের এই কবিলার জন্মস্থান, মূল বসতির জায়গা। শত শত বছর ধরে আমরা সেখানে বাস করেছি। দিভিনের পূর্ব কোন ইতিহাস আমাদের আছে কিনা আমরা তাও জানি না। দিভিনের অতীত ইতিহাসও আমাদের কাছে অস্পষ্ট। ১৯২৫ সালে দিভিনে আমাদের উপর সোভিয়েত হামলা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মুখে আমাদের দাদু-দাদিরা সব হারিয়ে দিভিন থেকে এই উপত্যকায় পালিয়ে এসেছিলেন। দিভিন তাদের জন্মস্থান, ভালোবাসার স্থান ছিল বলে এই উপত্যকারও নাম রেখেছিলেন দিভিন। সোভিয়েত আক্রমণ আমাদের দিভিনের ইতিহাস এবং আগের কিছু পরিচয় থাকলে তাও মুছে দিয়েছে। সুতরাং আমাদের পরিচয় সম্পর্কে যা জানতে চাচ্ছেন, তার কিছু আমরা জানি না। অনেকেই আমাদের কুর্দিদের সাথে শামিল করেন, কিন্তু আমরা দেখেছি আমাদের বাপ-দাদারা কুর্দিদের রাজনীতি, রীতিনীতি, সামাজিকতার সাথে কখনো একাকার হয়ে যাননি। তারা নিজেদেরকে আলাদা মনে করতেন এবং সব সময় আলাদা থাকতেন। স্বার্থবাদী, কলুষিত রাজনীতির সাথে কোন সময়ই মিলিত হতে চাননি। তাই বলে আমরা রাজনীতি বিমুখ নই। এক সময়ের মেসোপটেমিয়া, আরব, ফিলিস্তিন, আনাতোলিয়ার মুসলমানদের শতধাবিভক্তি আমাদের কষ্ট দিয়েছে। এর সমাধান ঐক্য শক্তি উত্থান ও প্রতিষ্ঠা। এটা আমাদের চিন্তা, কিন্তু বাস্তবে আমাদের ক্ষমতা নেই, সামর্থ্যও নেই। এর বেশি আমাদের পরিচয় নিয়ে আমার কোন কথা নেই। থামল সরদার আসতি আওয়াত।
এই পরিচয় থেকে দিভিন প্রাণঘাতী বৈরিতার শিকার হওয়ার কারণ। জানা যায় না। অনেক গাছের ভিড়ে ছোট গাছে ঝড় লাগে না, ঝড়ের আঘাতের শিকার হয় বড় গাছ। সেই দিভিনবাসীদের বড় একটা ইতিহাস আছে, বড় একটা পরিচয় আছে। এই পরিচয়, এই ইতিহাসই দিভিবাসীদের বিপদের কারণ। দিভিনবাসী আজ যাকে তাদের দুর্ভাগ্য বলছে, সেই দুর্ভাগ্য তাদের পরম সৌভাগ্যের কারণেই। সে পরম সৌভাগ্যটা হলো দিভিনবাসীরা ইতিহাসের মহান এক চরিত্র, ক্রুসেড বিজয়ী বীর গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর একমাত্র জীবিত বংশধর। থামল আহমদ মুসা।
ঘরে বাজ পড়লেও যতটা চমকে উঠত না মানুষ, তার চেয়ে বেশি চমকে উঠল মিটিংরুমের সব মানুষ। চমকে উঠা ভাব মুছে যেতেই বিস্ময় নেমে এল তাদের চোখে-মুখে। এরদেলান, শেপল, আহমদ নেবেজ, শিন সেনগারের মত তরুণদের চোখে-মুখে বিস্ময়ের ও আনন্দের ঝলক।
সরদার আসতি আওয়াত হা করে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। সে যেন সম্বিত হারিয়ে ফেলেছে।
এক সময় সরদার আসতি আওয়াত স্বপ্লেখিতের মত বলল, আপনার এ তথ্য ঠিক জনাব? এমন দাবি কিন্তু প্রমাণ চায়। কিভাবে প্রমাণ করবো আমরা?
আমি কথা শেষ করিনি জনাব। এক কথায় আমি আপনাদের পরিচয়টা বলেছি। পরিচয়ের পেছনের ইতিহাসটা বলিনি এখনও! বলল আহমদ মুসা।
আবার বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, দিভিনের জনগোষ্ঠি যে গাজী সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বংশধর, তার প্রমাণ তাদের ইতিহাস। ১১৯৩ সালে গাজী সুলতান সালাহউদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁর সন্তান ও ভাইদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়, সেই সময় সুলতান সালাহউদ্দীনের সপ্তম পুত্র ও তার পরিবার ফেতনার সংস্পর্শ থেকে বেঁচে থাকার জন্যে সংঘাতের এলাকা থেকে পূর্ব আনাতোলিয়ার হিসন কেইফায় হিজরত করে। ১২৩২ সালে এখানেও সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরিবারটি দ্বন্দ্বমান রাজনীতি থেকে দূরে থাকারই সিদ্ধান্ত নেয়। হিসন কেইফাসহ সমগ্র এলাকা ১২৬০ সালে মোঙ্গল আক্রমণের শিকার হয়। এই মোঙ্গল ঝড়ের সময় সালাহউদ্দীন। আইয়ুবীর সপ্তম পুত্রের পরিবারটি হিসন কেইফা থেকে আর্মেনিয়ার প্রাচীন নগরী দিভিনে হিজরত করে। এই দ্বিতীয় হিজরত ও আর্মেনিয়ার প্রাচীন নগরী দিভিনে আসার পেছনে একটা কাহিনী আছে। আর্মেনিয়ায় তখন সম্রাট হিতুম-১ এর শাসন চলছিল। সালাহউদ্দীনের পরিবার হিসন কেইফা থেকে হিজরত করার আগে সম্রাট হিতুম-১ এর কাছে দরখাস্ত করে। হিজরতের জন্যে কেন প্রাচীন নগরী দিভিনকে বেছে নিয়েছে, তার পক্ষে যুক্তি হিসাবে তারা তাদের পরিবারের অতীত ইতিহাস তুলে ধরে একটা দলিল দরখাস্তের সাথে গেঁথে দেয়। ঐ দলিলে বলা হয়, তাদের। পূর্বপুরুষরা এক সময় দিভিনেরই বাসিন্দা ছিল। ৮৯৩ খৃস্টাব্দে আর্মেনিয়ায় প্রলয়ংকরী এক ভূমিকম্প হয়। সেই ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়। দিভিন। ৭০ হাজার লোক এই দিভিনেই মারা যায়। অন্যদের সাথে তাদের পূর্বপুরুষরাও দিভিন ছেড়ে চলে যায় মেসোপটেমিয়া এলাকায়। এরাই সালাহউদ্দীনের পূর্বপুরুষ। সেই সালাহউদ্দীনের সপ্তম সন্তানের উত্তরপুরুষরা হিসন কেইফা থেকে দিভিনে আবার হিজরত করতে চায়। এই দলিলটি দিভিন যাদুঘরের ঐতিহাসিক দলিল বিভাগে এখনও সংরক্ষিত আছে। দিভিনবাসীদের অতীত পরিচয় সম্পর্কে এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর হয় না। থামল আহমদ মুসা।
মিটিংকক্ষে তখন পিনপতন নীরবতা।
সকলের চোখে-মুখে বিস্ময় ও আনন্দের বিচ্ছুরণ। সরদার আসতি আওয়াত, শাইখ আব্দুল হক, শেপল, এরদেলান, আহমদ নেবেজসহ অনেকের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দের নীরব অশ্রু।
সরদার আসতি আওয়াতেরও দুচোখ দিয়ে নীরব অশ্রুপাত হচ্ছে। তবুও তার দুই চোখ নিবদ্ধ ছিল আহমদ মুসার মুখের দিকে। এক সময় তার নির্বাক দুই ঠোঁট নড়ে উঠল। বলল, সম্রাট হিম-১ সব জেনে শুনেই আমাদের দিভিনে ফিরিয়ে এনেছিলেন। আমাদের এই সৌভাগ্য আজ আমাদের দুর্ভাগ্যে পরিণত হলো কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনও আমার জানা নেই। এই প্রশ্নের সন্ধানেই আমি আর্মেনিয়ায় এসেছি। এ প্রশ্নের উত্তর জানা গেলে শত্রুকেও জানা যাবে। তবে এর আগে আর্মেনিয়ায় আমাকে দুবার আসতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা এবং এবার যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে ধর্মের পরিচয় দিয়ে চরমপন্থী একটা গ্রুপ দিভিনবাসীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। তারা দিভিবাসীদের নির্মূল করতে চায় অথবা আর্মেনিয়া থেকে বহিষ্কার করতে চায়। আমার মনে হয় তারা দিভিবাসীদের আসল পরিচয় জানে। জানার পরেই তারা গাজী সালাহউদ্দীনের বংশধরদের বিরুদ্ধে চরমপন্থা গ্রহণ করেছে। গাজী সুলতান সালাহউদ্দীন যতই উদার হোন, তার মধ্যে যতই মহানুভবতা থাক- ক্রুসেড বিজেতা, জেরুসালেম উদ্ধারকারী গাজী। সুলতান সালাহউদ্দীন ধর্মীয় পরিচয়ের ঐ চরমপন্থীদের কাছে চিরশত্রু বলে বিবেচিত। তারা সালাহউদ্দীনের বংশধরদের আর্মেনিয়ার মাটিতে থাকতে দিতে চায় না। আহমদ মুসা থামল।
সরদার আসতি আওয়াতসহ সকলের চোখে-মুখে উদ্বেগ ও হতাশার। ছায়া নামল।
চরমপন্থীরা এটা চাচ্ছে, সরকারের তো এটা পলিসি নয়। বলল শেপল।
হ্যাঁ, সরকারের এটা পলিসি নয়। এখানে উপস্থিত আর্মেনিয়ার একজন শীর্ষ গোয়েন্দা অফিসার, যাকে ইতোমধ্যে আপনারা সকলেই জেনেছেন, তাকে আমি অনুরোধ করছি এ বিষয়ে কিছু বলার জন্যে। আহমদ মুসা বলল।
শেপল থামতেই দিভিন সরকারি লোকাল কাউন্সিলের সদস্য খিবাত খলিল মিটিংরুমে প্রবেশ করল। সরদার আসতি আওয়াতের কাছে নিচু কণ্ঠে বলল, পুলিশ এসেছে।
পুলিশ এসেছে। ঠিক আছে, ওদের সাথে কথা বল। বসতে দাও। দারা দারিস্তানকে নিয়ে যাও। আমরা আসছি। বলল সরদার আসতি আওয়াত।
খিবাত খলিলকে কথা কয়টি বলেই আসতি আওয়াত সবাইকে শুনিয়ে বলল, পুলিশ এসেছে। দারা দারিস্তান তুমি খলিলের সাথে যাও।
তারা বেরিয়ে গেল।
ইভা নারিন উঠে দাঁড়াল। বলল, আর্মেনিয়ার সংবিধানে ধর্মপরিচয় নির্বিশেষে সকলেই আর্মেনিয়ার নাগরিক। এখানে সকলের সমান অধিকার। আর্মেনিয়া যেমন খৃস্টান নাগরিকদের, তেমনি মুসলিম নাগরিকদেরও। সরকার এই নীতিই অনুসরণ করছে। যারা দিভিবাসীদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তারা আইনের চোখে অপরাধী। সরকার তাদের চিহ্নিত করা ও ধরার চেষ্টা করছে। এতদিন সরকার সফল হয়নি। বিষয়টা তদন্ত করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই চারজন গোয়েন্দা অফিসার মারা গেছে। দুনিয়ার গোয়েন্দা জগতের কিংবদন্তী, দুনিয়ার অনেক অসম্ভব যুদ্ধে জিতে আসা মহানায়ক আহমদ মুসা আসার পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আহমদ মুসা আর্মেনিয়ায় পা দেবার পর এ পর্যন্ত শত্রুপক্ষের প্রায় একশতের মত লোক মারা গেছে তার হাতে। শত্রুরা চিহ্নিত হয়েছে, সরকারও আহমদ মুসার সহযোগিতা নিচ্ছে। আমি নিশ্চিত, অনেক যুদ্ধের মত এ যুদ্ধেও আহমদ মুসা জিতবেন।
ধন্যবাদ ম্যাডাম ইভা নারিন। আল্লাহ আপনার কথা কবুল করুন। আপনি আমাদের আশার কথা শুনিয়েছেন। আপনার মাধ্যমে সরকারকেও আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সরদার আসতি আওয়াত একটু থেমেই আবার বলল, আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসার কথা অনুসারে আমরা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু আমরা কিছুই করার দেখছি না। এখন কি করণীয় আমাদের সেটাই আমরা জানতে চাচ্ছি তাঁর কাছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, যা করার এখন শত্রুরাই করছে। আমরা শুধু আত্মরক্ষা করছি। এখন ওদের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে আমরা ওদের নিষ্ক্রিয় করার জন্যে আক্রমণে যেতে পারছি না। তবে আমি মনে করি শীঘ্রই সে সুযোগ আসবে। সুখবর সম্ভবত তারপরেই আসবে।
আহমদ মুসা থামতেই খিবাত খলিল মিটিংরুমে আবার প্রবেশ করল। বলল, সেনাবাহিনীর লোকরাও এসেছে। এই মাত্র এল।
চমকে উঠল সরদার আসতি আওয়াত। তার পাশে বসা আহমদ মুসারও ভ্রু কুঁচকে গেল। আহমদ মুসার দিকে তাকাল আসতি আওয়াত।
আহমদ মুসা বলল, আপনি যান, আমি আসছি। ইভা নারিনকে সাথে নিয়ে যান।
আসতি আওয়াত উঠে দাঁড়াল।
ইভা নারিন আহমদ মুসার কাছে এল। বলল, পুলিশ তো ইনভেস্টিগেটিভ অথরিটি। সেনাবাহিনী এল কেন?
বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। সরকারেরই কোন মহল তাদের ডাকতেও পারে। দেখ গিয়ে, আমি আসছি।
সরদার আসতি আওয়াত ও ইভা নারিন বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা উঠল। এগোলো তার ঘরের দিকে।
সেনাবাহিনীর লোক আসার কথা শুনেই আহমদ মুসার মনে পড়েছিল ইভা নারিনের তথ্য। একটা আট্রা রাইট ধর্মীয় গোপন সংস্থা দক্ষিণ আর্মেনিয়ান সেনা কমান্ডের এক ঊর্ধ্বতন অফিসারের কাছে একটা সেনা ইউনিটের সাহায্য চেয়েছে। আহমদ মুসার কেন জানি মনে হলো, এই সেনা ইউনিটই সেই সেনা ইউনিট। এই কথা মনে হবার সাথে সাথে আহমদ মুসা বিষয়টা একটু যাচাই করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
.
৫.
সরদার আসতি আওয়াত চত্বর পেরিয়ে বাইরের বৈঠকখানায় ঢুকে দেখল সেনা ইউনিটের একজন অফিসার তার চেয়ারে বসেছে। সেনা ইউনিটের অফিসারটির ডান পাশে ১০জন সেনা সদস্য দাঁড়িয়ে আছে অ্যাটেনশন অবস্থায়। তাদের হাতের অস্ত্র বাগিয়ে ধরা, কিন্তু ব্যারেলগুলো নিচে নামানো।
পুলিশরা বসেছে সেনা অফিসারদের সামনে। পুলিশের সংখ্যা। পাঁচজন। সেনা অফিসারের বাম দিকে কয়েকটা চেয়ার খালি আছে।
সরদার আসতি আওয়াত তার ডান পাশে একটা চেয়ার খালি রেখে বসল। তার বাম পাশে বসল ইভা নারিন। খিবাত খলিল ও দারা দারিস্তান পুলিশদের ডান পাশে ফাঁকা চেয়ারগুলোর দুটিতে বসেছে।
সরকার আসতি আওয়াত বসতেই খিবাত খলিল সেনা অফিসারের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিল।
পরিচয় পেয়েই সেনা অফিসার বলল, মি. আওয়াত, বাইরের যে দুজন লোক এখানে আছে তারা কোথায়?
সরদার আসতি আওয়াত ইভা নারিনকে দেখিয়ে বলল, এই তো একজন, আরেকজন আসছেন। এখন আপনাদের কথা বলুন। কি উদ্দেশ্যে এসেছেন, আমরা আপনাদের জন্যে কি করতে পারি।
গত দেড়, দুদিনে পঁচিশ তিরিশজন লোক খুন হয়েছে, ভয়াবহ কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে। আমরা জানতে পেরেছি, বাইরের একজন লোকের হাতে সবগুলো খুনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা সেনা বাহিনীর টেরর প্রিভেনশন ইউনিটের সদস্য। দিভিনের কেসটা সেনাবাহিনী গ্রহণ করেছে। আমরা তদন্তের স্বার্থে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে যাবার জন্যে এসেছি। বলল সেনা অফিসার।
ইভা নারিন ও একজন পুলিশ অফিসার চেয়ার থেকে উঠল বাইরে যাবার জন্যে।
সংগে সংগেই সেনা অফিসার বলে উঠল, আপনারা যে-ই হোন, এখান থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবেন না। মোবাইলও ব্যবহার করতে পারবেন না।
সরদার আসতি আওয়াত এবং তার সাথী অন্যদের মুখ শুকিয়ে গেল। উদ্বেগ ফুটে উঠল তাদের চোখে-মুখে। ইভা নারিন ও পুলিশ অফিসারের চোখেও বিস্ময় ফুটে উঠল।
কিন্তু অফিসার আপনি হয়তো জানেন না। পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তাদের তদন্ত চলছে। এই তদন্ত অন্য কোন বিভাগে ট্রান্সফারের সরকারি সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। বলল ইভা নারিন।
সন্ত্রাস দমন, এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। চোর-ছ্যাচড় নিয়ে পুলিশের কাজ, সন্ত্রাস নয়। সেনা অফিসার বলল।
দিভিনের ঘটনাকে যদি সন্ত্রাস দমনের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়, তাহলে সে সিদ্ধান্তও সরকারি প্রশাসনকেই নিতে হবে। বলল ইভা নারিন।
দেখুন আপনি কথা বাড়াবেন না। আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। আপনাকে আমরা চিনি। আপনি আর্মেনিয়ার একজন গোয়েন্দা অফিসার। আপনি অন্যায়ভাবে একজন বিদেশিকে সাহায্য করছেন। এ জন্যে আপনাকেও আমরা দিভিনের সন্ত্রাসের সাথে জড়িত করতে পারি। সেনা অফিসার বলল।
তাহলে তো আপনাদের ক্ষমতা অনেক এবং সরকারের কাজে আপনারাও সহযোগিতা করছেন। আমাদের টেলিফোন করাকে তাহলে আপনারা ভয় করছেন কেন? আমরা ঊর্ধ্বতনকে বিষয়টা জানাই। তারা বললে পুলিশ চলে যাবে। আপনাদের কাজ করা সহজ হবে। বলল ইভা নারিন।
আমরা কোন টেলিফোনকে ভয় করি না। কারও কাছে জবাবদিহী করি না। কারও অনুমতি, আদেশও আমাদের দরকার নেই। উপরের কমান্ড থেকে আমাদের উপর আদেশ হয়েছে। আমরা সে আদেশ পালন করব। যারা বাধা হবে, তাদের আমরা সরিয়ে দেব। সেনা অফিসার বলল।
দেখুন আমরা সবাই সংবিধানের অধীন। সেনাবাহিনীও। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সেনা কমান্ড যে আদেশ করে, সেটাও আইনের। অধীনেই করে থাকে। যদি মামলার ভার টেরর প্রিভেনশনকে দেয়া হয়, সে সিদ্ধান্তও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থানায় জানাবেন। তারপর সংশ্লিষ্ট থানা। কাগজপত্র আপনাদের দিয়ে দেবে- এটাই আইন। বলল ইভা নারিন।
সেনা অফিসারের দুই চোখ আগুনের মত জ্বলে উঠল। তার ডান হাত পকেট থেকে রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে এল। চোখের পলকে তা উঠে এল ইভা নারিনের বুক লক্ষ করে। তার অনামিকা চেপে বসছিল।
ইভা নারিন স্তম্ভিত! তার করার কিছু নেই।
অন্য সবাই বাকরুদ্ধ।
গুলি এসে বিদ্ধ করছে তাকে, ইভা নারিন চোখ বন্ধ করেছে।
গুলির শব্দ হলো।
ক্ষণিকের জন্যে চিন্তার ক্ষমতা ভোতা হয়ে গিয়েছিল ইভা নারিনের।
এক দুই করে সেকেন্ড পার হতে লাগল। কিন্তু গুলি তো তার গায়ে লাগেনি! তাহলে গুলি গেল কোথায়?
চোখ খুলল ইভা নারিন। তার চোখ পড়ল সেনা অফিসারের উপর।
ডান হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তার হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেছে।
ইভা নারিনের চোখ ডান দিকে ঘুরে এল। দেখল আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে, তার দুই হাতে দুই রিভলবার। তার একটি রিভলবার সেনা অফিসারের দিকে তাক করা, অন্য রিভলবার তাক করেছে পাশে দাঁড়ানো সৈনিকদের দিকে। ক্ষণিকের জন্যে বিমূঢ় সেনা অফিসারের বাম হাত আরেকটি রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে এল।
অফিসার, রিভলবার তুলবে না। হাত গুঁড়ো হয়েছে, এবার মাথা। গুঁড়ো করে দেব। আমার গুলি লক্ষভ্রষ্ট হয় না, আমি দুবার এক কথা বলি না। ফেলে দাও রিভলবার সেনা অফিসার। আহমদ মুসার ঠান্ডা, স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে রিভলবার আর উপরে তুলল না সেনা অফিসার। হাত থেকে পড়ে গেল তার রিভলবার। সেনা সদস্যরা তাদের স্টেনগান উপরে তুলছিল। আহমদ মুসা তাদের লক্ষে কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দিল, তোমাদের স্টেনগানের গুলি বেরুবার আগেই….।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। ওদের স্টেনগান বেপরোয়াভাবে উপরে উঠছে।
আহমদ মুসার দুই হাতের রিভলবার সক্রিয় হয়ে উঠল। সেই সাথে আহমদ মুসার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো, ইভা নারিন তুমি অফিসারকে দেখ।
ইভা নারিন আদেশ পাওয়ার আগেই তার রিভলবার হাতে নিয়েছিল। ওদিকে আহমদ মুসার রিভলবার সরে যাবার সাথে সাথে সেনা অফিসার তার রিভলবার তুলে নিচ্ছিল। ইভা নারিন আহমদ মুসার নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে টার্গেট করেছিল সেনা অফিসারকে। সেনা অফিসারকে রিভলবার তুলে নেয়া দেখে ইভা নারিন বলল, রিভলবার ফেলে দিন অফিসার।
ইভা নারিনের কথা যেন শুনতেই পায়নি সেনা অফিসার। তার হাত বেপরোয়া গতিতে উঠে আসছিল আহমদ মুসা লক্ষে।
আর সুযোগ দিল না ইভা নারিন। গুলি করল তার হাত লক্ষে। কিন্তু তাড়াহুড়ার কারণে গুলিটা গিয়ে বিদ্ধ হলো বাম বাহুসন্ধিতে। সেনা অফিসারের হাত থেকে পড়ে গেল রিভলবার।
ওদিকে আহমদ মুসা যা বলেছিল তাই ঘটল। ওদের স্টেনগান টার্গেটে উঠে আসার আগেই আহমদ মুসার দুই হাতের রিভলবার থেকে দশটি গুলি বের হয়ে গেল। গুলির অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা সেনা সদস্যদের ভীত করে তুলেছিল। অবচেতনভাবেই যেন তারা আত্মরক্ষা করে গুলি করার কথা ভেবেছিল। তাদের এই দুর্বলতাই আহমদ মুসাকে দশটি গুলি সম্পূর্ণ করার সুযোগ দেয়।
এবার আহমদ মুসা মনোযোগ দিল সেনা অফিসারের দিকে।
যন্ত্রণায় কাতরানোর বদলে সে গজরাচ্ছিল। বলছিল, সেনা সদস্যদের গায়ে হাত তুলেছ, তোমাদের দেখাচ্ছি মজা।
অফিসার তোমার নাম কি? আর্মেনিয়ার দক্ষিণ কমান্ডের কোন ইউনিটের তুমি সদস্য? তোমার ইউনিট কমন্ডারের নাম কি? বলল আহমদ মুসা।
তোমাদের কোন প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ফিরে আসছি।
কথা শেষে করেই সে পুলিশের উদ্দেশ্যে বলল, আমি নির্দেশ দিচ্ছি, তোমাদের একজন আমাদের সাথে চল। গাড়ি ড্রাইভ করবে।
অফিসার আপনাকে এক পাও নড়তে দেব না, যেমন আছেন তেমনি বসে থাকেন। বলল আহমদ মুসা।
ভয় তাহলে ঢুকে গেছে। কিন্তু আমাকে যেতে হবে। আমি আহত, সেনা সদস্যরা নিহত, এই খবর কমান্ড ইউনিটকে দিতে হবে। সেনা অফিসার বলল।
আপনার কমান্ডারের নাম, পদবী ও ইউনিটের নাম্বার বলুন, টেলিফোন নাম্বার দিন। আমি ওদের টেলিফোন করে দিচ্ছি। ওরা এসে যাবে।
কিলারদের কোন সহযোগিতা চাই না। সেনা অফিসার বলল।
হাসল আহমদ মুসা। পরক্ষণেই আহমদ মুসার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। তাকাল ইভা নারিনের দিকে। বলল, পুলিশ অফিসারকে বল তাকে গ্রেফতার করতে। আমি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করব।
কিন্তু জনাব, সেনা অফিসারকে পুলিশ কতৃক গ্রেফতার করতে হলে সুস্পষ্ট অভিযোগ চাই, ওপরের অনুমতিও দরকার। ইভা নারিন বলল।
নকল সেনা অফিসার ও সদস্যকে গ্রেফতার করতে কি অনুমতি ও আগাম অভিযোগ দায়েরের দরকার আছে? বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় ফুটে উঠল ইভা নারিনের চোখে-মুখে। বলল, প্রথমে আমি ভয় পেয়ে গেলেও পরে আমি এমন ধারণাই করেছিলাম। আপনি নিশ্চিত তো?
অবশ্যই। বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিন তাকাল পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, সেনা। অফিসারের ছদ্মবেশ ধারণ, পুলিশের প্রতি অসদাচরণ ও কিডন্যাপ চেষ্টার দায়ে নকল সেনা অফিসারকে গ্রেফতার করুন।
পুলিশ অফিসার ও পুলিশ সদস্যরা শুরু থেকেই ভয়ানক বিব্রত অবস্থায় ছিল ও পরে ভীত হয়ে পড়েছিল। তাদের অফিসার ইভা নারিনের প্রতি সেনা অফিসারের ব্যবহার তাদের বিক্ষুব্ধ করলেও সেনা সদস্যদের হত্যা ও সেনা অফিসারকে আহত করাকে তারা সমর্থন করতে পারেনি। তাদের সামনে এঘটনা ঘটায় এবং তারা কিছু করতে না পারায় তারা ভীত। হয়ে পড়েছিল।
ইভা নারিনের নির্দেশে তাদের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।
পুলিশ অফিসার এগোলো নকল সেনা অফিসারকে গ্রেপ্তার করতে।
আমাকে গ্রেপ্তার করবে আহমদ মুসা! বলে হো হো করে হেসে উঠে ইউনিফরমের কলারের একটা বোতাম কামড়ে ধরল নকল সেনা। অফিসার।
শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরে আহমদ মুসা ছুটে গেল নকল সেনা অফিসারের কাছে। কিন্তু দেখল সব শেষ। ভয়ংকর পটাশিয়াম সায়নাইড মুহূর্তও সময় দেয় না।
বৈঠকখানার তিন দিকের চত্বর তখন লোকে ভরে গেছে। প্রথম গুলি হবার পরই মিটিংরুম থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে। চারদিকের যারা শুনেছে তারাও ছুটে এসেছে।
ঘটনা তাদেরকে ভীষণ ভীত, উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। বিশেষ করে আহমদ মুসার নিরাপত্তা চিন্তায় তারা আতংকিত হয়ে পড়েছিল। সেনাবাহিনীর একজনও নিহত হওয়া বড় ব্যাপার! আর আহমদ মুসা দশজন সেনা সদস্যকে হত্যা করেছে এবং একজন সেনা অফিসারকে আহত করেছে এটা ভয়ানক ব্যাপার! এনিয়ে দেশে হুলুস্থুল পড়ে যাবে। সেনা অফিসার ও সেনা সদস্যরা নকল জানার পর তাদের উদ্বেগ দূর হলো। কিন্তু বড় প্রশ্ন তাদের সামনে এল, আহমদ মুসা জানল কি করে যে, ওরা আসল নয়, নকল সৈনিক?
দুর্ভাগ্য, এদের কাউকেই জীবন্ত ধরা যাচ্ছে না। ধরা পড়া নিশ্চিত হলেই এরা সবাই একই পথ অনুসরণ করছে। বলল আহমদ মুসা।
আল্লাহর হাজার শুকরিয়া। মহান, ভাই আহমদ মুসা আবার আমাদেরকে মহাবিপদ থেকে বাঁচালেন। ওরা সন্ত্রাসী পাঠিয়ে, বোমা মেরে যা করতে পারেনি, সেটাই তারা করত সেনা সদস্য সেজে আমাদের সকলকে ধরে নিয়ে গিয়ে। আমি, সম্ভবত আমরা কেউই বুঝতে পারছি না, জনাব আহমদ মুসা সবার শেষে এখানে এলেন কেন, কি করে তিনি বুঝলেন যে ওরা আসল সৈনিক নয়? তিনি আমাদের এ কৌতূহল নিবৃত্ত করলে আমরা খুশি হবো। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
সরদারের কথা শেষ হতেই সবাই একবাক্যে বলে উঠল, আমরাও জানতে চাই। আমরা ভয়ানক আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম সেনা সদস্য মারা পড়া দেখে। এমন একটা ঘটনা দিভিন উপত্যকার অস্তিত্বই শেষ করে দিতে পারত।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল আহমদ মুসা, সেনা ইউনিট আসার বিষয়টাকেই আমি সন্দেহের চোখে দেখেছিলাম। পুলিশ যেখানে তদন্তে এসেছে সেখানে সেনাবাহিনীর কেউ আসার কথা নয়। সন্দেহের আরেকটা কারণ ছিল, ইভা নারিন তার বাবার কাছ থেকে তথ্য পেয়েছিলেন আর্মেনিয়ার দক্ষিণ কমান্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কমান্ডারের কাছে একটা চরমপন্থী ধর্মীয়গোষ্ঠি একটা সেনা ইউনিটের সাহায্য চেয়েছিলেন। শুনেই আমার মনে হয়েছে দিভিনের জন্যে এটা চাওয়া হতে পারে। প্রকৃত ঘটনা কি সে বিষয়ে চিন্তার জন্যে আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন। এজন্যে সরদার সাহেবদের পাঠিয়ে আমি আমার ঘরে গিয়েছিলাম। প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল, সেনা সদস্য যারা এসেছে তাদেরকে ভালো করে দেখা দরকার। আমার ব্যালকনি থেকে বৈঠকখানার সবাইকে দেখা যায়। আমি চোখে দূরবীণ লাগিয়ে সেনা সদস্যদের দেখতে গিয়ে বড় একটা অসংগতি দেখলাম। আর্মেনিয়ান সেনাবাহিনীর বর্তমান ইউনিফর্ম তিন কালারের সাদা জমিনের উপর ডার্ক গ্রে ও লাইট গ্রীন রং। আর এদের ইউনিফরমে দেখুন দুই রং সাদা জমিনের উপর ডার্ক গ্রে রং। এই দুই রঙের ইউনিফরম একমাস। আগে পর্যন্ত ছিল, এক মাস আগে এক হ্যান্ডআউট প্রকাশের মাধ্যমে পোষাক পরিবর্তন করা হয়েছে এবং সংগে সংগেই তা কার্যকর করা হয়েছে। আমার সন্দেহের পক্ষে এটা একটা বড় প্রমাণ হয়ে দাঁড়াল। এরপর আমি ইভা নারিনের বাবাকে টেলিফোন করলাম এটা জানার। জন্যে যে, আজ সন্ধ্যার পরে আর্মেনিয়ার দক্ষিণ কমান্ডের কোন সেনা ইউনিটকে দিভিনে পাঠানো হয়েছে কি না। তিনি খোঁজ নিয়ে অল্পক্ষণ পরেই জানালেন, দিভিনে কেন দক্ষিণ আর্মেনিয়ার কোথাও কোন সেনা ইউনিট পাঠানো হয়নি সন্ধ্যার পরে। আমি আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, সেনা সদস্যের ছদ্মবেশে আমাদের শত্রুরাই তাহলে এসেছে। বৈঠকখানায় ঢুকতেই দেখলাম, সেনা অফিসার ইভা নারিনকে গুলি করতে যাচ্ছে। তার পরের ঘটনা আপনারা সবাই জানেন। থামল আহমদ মুসা।
মহান ভাই আহমদ মুসা, আল্লাহ আপনাকে অসীম নেয়ামতের মালিক করেছেন। আল্লাহ দীর্ঘজীবী করুন আপনাকে! আমরা, পুলিশ এমনকি ম্যাডাম ইভা নারিন পর্যন্ত সেনা সদস্যদের ইউনিফরম-এর রঙ দেখে কোন সন্দেহ করতে পারিনি। কিন্তু আপনি এদেশের লোক না হয়েও সেনাবাহিনীর ইউনিফরম পরিবর্তনের বিষয়টি মনে রেখেছেন! আল্লাহর হাজার শোকর, আর ধন্যবাদ আপনাকে। বলল সরদার আসতি আওয়াত।
মানুষ মাত্র মাধ্যম। বিভিন্ন উপলক্ষের মাধ্যমে আল্লাহই সাহায্য করেন। তার জন্যেই আমাদের সব কৃতজ্ঞতা। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ইভা নারিন, পুলিশকে তাদের কাজ শেষ করতে বল। ভুয়া সেনা ইউনিট আমাদের একটা ক্লেশ। বাড়াল এবং পুলিশের কাজও বাড়ল।
ঠিক বলেছেন জনাব।
বলে ইভা নারিন পুলিশের দিকে এগোলো। পেছনে তাকিয়ে সরদার আসতি আওয়াতকে বলল, জনাব, আপনিও আসুন।
জি জনাব আপনিও যান। আহমদ নেবেজ ও মোহাম্মাদ বেহেজের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেবে হেদি হোয়ারি আর ভুয়া সেনা ইউনিটের ঘটনার বিবরণ দেবেন আপনি। পুলিশও এখানে প্রত্যক্ষদর্শী। বলল আহমদ মুসা।
যাচ্ছি জনাব। একটা প্রশ্ন, কেন আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা, এটা জানলাম। কিন্তু কারা এই শত্রুতা করছে, এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়নি। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
তাদের নাম দুএক কথায় এসেছে, কিন্তু তাদের পরিচয় বলা হয়নি। দুঃখিত। এদের সংস্থার নাম ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার। এপর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে তাতে এই দল বা গ্রুপের নেতার নাম সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল। ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার একটা চরমপন্থী ধর্মীয় সংগঠন। খুশির খবর হলো, ইভা নারিনের বাবা সেন্ট সেমভেলের খোঁজ নিয়ে তার বিষয়ে জানাতে চেয়েছেন। তিনি জানালে আমরা সবাই জানতে পারব। দিভিনের ঘটনাগুলোর একটা কিনারা করে আমরাও এবার সন্ধানে বের। হবো। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা। আমি আসছি। বলে সরদার আওয়াত ইভা নারিনের পেছনে পেছনে হাঁটা শুরু করল।
আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল শিন সেনগার। আহমদ মুসার চোখ তার উপর পড়তেই তাকে ডাকল।
শিন সেনগার এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। মুখ গম্ভীর। অনেক কান্নাকাটি করায় চোখ তার ফোলা ফোলা।
বোন শিন সেনগার, আমি তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু বলতে পারি? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আমাকে বোন বলার পর আবার এ কথা বলছেন কেন? শিন সেনগার বলল।
তুমিও আমাকে স্যার বলেছ, ভাই বলনি। বলল আহমদ মুসা। স্নেহমাখা কণ্ঠে।
হঠাৎ শিন সেনগার ছুটে এসে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে পড়ল। আহমদ মুসার হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠল। বলল কাঁদতে কাঁদতে, সাহস পাইনি ভাইয়া।
আহমদ মুসা সান্ত্বনা দিয়ে তাকে তুলে পাশের চেয়ারে বসাতে গেল। কিন্তু সে চেয়ারে বসল না, চেয়ার ছেড়ে আহমদ মুসার পায়ের কাছে। মাটিতেই বসল।
এখন তুমি কোথায় থাকবে ঠিক করেছ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
কেন, বাড়িতে? শিন সেনগার বলল।
ওবাড়িতে তোমার তো আপন কেউ নেই। বলল আহমদ মুসা।
চাকর-বাকর সবাই পুরানো, বিশ্বস্ত। শিন সেনগার বলল।
তবুও তারা তোমার আপন কেউ নয়। তুমি সেখানে থাকতে পার না। দিভিনে তোমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই? বলল আহমদ মুসা।
তেমন কেউ নেই ভাইয়া। শিন সেনগার বলল।
তুমি এরদেলানকে কেমন মনে কর বোন? বলল আহমদ মুসা।
প্রশ্ন শুনেই মুখ রাঙা হয়ে উঠল শিন সেনগারের। সংগে সংগে কোন উত্তর দিল না সে।
দেখ, বড় ভাইয়ের কাছে কিছু লুকোতে নেই। বলল আহমদ মুসা।
তাকে ভালো জানি ভাইয়া। শিন সেনগার বলল।
এই ভালো জানার কি সীমা আছে? বলল আহমদ মুসা।
লজ্জারাঙা মুখ নিচু করল শিন সেনগার। বলল, নেই ভাইয়া।
আহমদ মুসা ডাকল এরদেলানকে।
এরদেলান, শেপল, আহমদ নেবেজরা দাঁড়িয়েছিল বৈঠকখানার বাইরে, চত্বরে। তারা আহমদ মুসাদের দিকেই তাকিয়েছিল।
এরদেলান এল। তার সাথে সাথে শেপল এবং আহমদ নেবেজও।
ওদের আসতে দেখে শিন সেনগার উঠে আহমদ মুসার চেয়ারের পাশে। দাঁড়াল। এরদেলানরা এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে।
এরদেলান তোমাকে একটা প্রশ্ন করব, ঠিকঠাক জবাব দেবে। সংসার নিয়ে কি তোমার কোন স্বপ্ন আছে? বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে জবাব দিল না। তাকাল শেপলদের দিকে, তাকাল। জড়োসড়োভাবে দাঁড়ানো শিন সেনগারের দিকে। বলল, আছে স্যার।
আমার কথা তুমি বুঝেছ? বলল আহমদ মুসা।
বুঝেছি স্যার। এরদেলান বলল। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বিব্রত ভাব তাতে। _ ঠিক এ সময় সেখানে এল সরদার আসতি আওয়াত ও ইভা নারিন। সরদার আসতি আওয়াত বলল, তাড়াতাড়িই কাজ শেষ হয়ে গেল! ম্যাডাম ইভা নারিনের নির্দেশমত পুলিশ সব লিখেই রেখেছিল। শুধু দস্তখত করতে হলো।
কথা বলতে বলতেই সরদার আসতি আওয়াত আহমদ মুসার পাশের চেয়ার টেনে নিয়ে দক্ষিণ পাশে আহমদ মুসার দিকে মুখ করে বসল।
ইভা নারিন শেপলকে টেনে নিয়ে পাশাপাশি দুই চেয়ারে বসল।
সরদার সাহেব আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন। আমি আপনাকেই আশা করছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
বলুন কি ব্যাপার? নতুন কিছু। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
শুধু নতুন নয়, ভারি কিছু। বলল আহমদ মুসা।
গম্ভীর হয়ে উঠল সরদার আসতি আওয়াতের মুখ।
ভারি সব ঘটনার মধ্যে দিয়ে চলছি। আবার ভারি কিছু! ভয় করছে। শুনতে। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
ভয়ের নয়, এই ভারি বিষয়টা আনন্দের, যদি আপনি দ্বিমত না করেন। বলল আহমদ মুসা।
আলহামদুলিল্লাহ, বলুন প্লিজ। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
আহমদ মুসা শিন সেনগারকে দেখিয়ে বলল, এ আমার ইয়াতিম ছোট বোন। আমার এই ইয়াতিম বোনকে কি আপনি আপনার পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন?
সরদার আসতি আওয়াত শোনার সংগে সংগে উঠে গিয়ে আহমদ মুসার দুই হাত জড়িয়ে ধরে বলল, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আপনার ছোট বোনকে পাওয়া আমাদের পরম সৌভাগ্য। এমন সুন্দর প্রস্তাবের জন্যে আল্লাহ আপনাকে যাযাহ দান করুন।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল সরদার আসতি আওয়াত। সে এগিয়ে গিয়ে শিন সেনগারের মাথায় হাত বুলিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, এই মায়ের কথা অনেকক্ষণ ভেবেছি। সে পিতা-মাতা দুইজনকে হারাল। সে থাকবে কোথায়, কার কাছে থাকবে। দিভিনে তার তেমন কোন আত্মীয় সৃজনও নেই। আমি এর সমাধান খুঁজে পাইনি। আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা ইতিমধ্যে তাকে বোন বানিয়ে নিয়েছেন, তার সমস্যার সমাধানও করে ফেলেছেন। আল্লাহর হাজার শোকর। হাজার মোবারকবাদ আমাদের মহান ভাইকে। থামল সরদার।
সরদার আসতি ফিরে গিয়ে তার চেয়ারে বসল। বলল, সম্মানিত ভাই, এবার আপনার বোনটিকে আমরা কবে পাচ্ছি?
বিয়ে আজ হতেও আমার কোন আপত্তি নেই। তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত শিন সেনগার শেপলের কাছে থাকবে।
আমাদের সম্মানিত ভাইয়ের আপত্তি না থাকলে আমারও আপত্তি নেই। আজই বিয়ে হবে আর ভাই আহমদ মুসা বিয়ে পড়াবেন। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
আল হামদুলিল্লাহ। বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, বিয়ের কথাই যখন হচ্ছে, তখন আরেকটা প্রস্তাবও আমি আপনার সামনে আনছি। আমি মনে। করি, শেপল ও আহমদ নেবেজের বিয়েও হয়ে যাওয়া দরকার। দিভিনের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে তাদের দুজনকে একত্রে মুভ করতে হচ্ছে, কাজ করতে হচ্ছে। বিয়ে-বহির্ভূত এই মেলামেশা ঠিক নয়।
সম্মানিত ভাই আহমদ মুসা ঠিকই বলেছেন। বিষয়টা সত্যিই দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে। মহান ভাইকে জানাচ্ছি, তাদের বিয়ের ব্যাপারে একটা অঘোষিত সিদ্ধান্ত হয়েই আছে। আমিও মনে করি অবিলম্বে বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
শিন সেনগার আহমদ মুসার চেয়ারের পেছনে বসে পড়েছিল। আর শেপল উঠে বাইরে চলে যাচ্ছিল ইভা নারিনের কাছ থেকে।
ইভা নারিন কয়েক ধাপ ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল। ধরে নিয়ে এসে আবার বসাল তার পাশের চেয়ারে। শেপলের কানের কাছে মুখ। নিয়ে বলল, পালাচ্ছ কেন? আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ দাও। একেই বলে সত্যিকার নেতা। দেখ, শিন সেনগার বাপ-মা হারিয়ে অসহায় হওয়ার সংগে সংগে আহমদ মুসা তার বড় ভাই হয়ে গিয়ে তার আশ্রয় হয়ে দাঁড়ালেন এবং বিয়ে দিয়ে স্থায়ী ও গৌরবপূর্ণ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন।
ওটা ঠিক ছিল, কিন্তু আমাদের প্রসঙ্গটা….। কথা শেষ না করেই থেমে গেল শেপল।
দেখ, পোষাকী কথা বলো না। মনের কথা বলো। তোমাদের মন যা। চায়, আহমদ মুসা কি সেটাই করেননি? বলল ইভা নারিন।
আমি জানি না। এ বিষয়টা এমন ঘনিষ্ঠভাবে কখনও ভাবিনি। শেপল বলল।
ভাবনি, এটা কি ঠিক? বলল ইভা নারিন।
রাঙা হয়ে উঠা শেপলের মুখ আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে। বলল, ভাবিনি তা নয়। কিন্তু আমরা কেউ কাউকে কিছু বলিনি।
শেপলের কথা ইভা নারিনের কানে খুব বেশি ঢুকেনি। তার মনোযোগ ছুটে গিয়েছিল আহমদ মুসাদের নতুন আলোচনার দিকে।
শুনেই ইভা নারিন খুশিতে জড়িয়ে ধরল শেপলকে। বলল, তোমাদেরও আজ বিয়ে হচ্ছে। একদিনে একই সময়ে দুই জোড়া বিয়ে। এমন থ্রিল আমার জীবনে দ্বিতীয় আসেনি।
কথাটা শেষ করেই ইভা নারিন শেপলের মুখ সামনে টেনে এনে বলল, আজ বিয়ে, কি মনে হচ্ছে বল তো?
কিছু ভাবতে পারছি না। সবগুলিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রস্তুত নই। শেপল বলল।
হাসি ফুটে উঠল ইভা নারিনের ঠোঁটে। বলল, বিয়ের জন্যে আবার প্রস্তুতি কি?
তাও আমি জানি না। শেপল বলল। তার রাঙা মুখটি বিব্রত।
শেপলের উত্তর শুনে হাসল ইভা নারিন।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ইভা নারিন, কিন্তু তার ডাক পড়ল। আহমদ মুসা। তাকে ডাকল।
কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল সে। এগোলো আহমদ মুসার দিকে।
ইভা নারিন, তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। তুমি শেপল ও শিন। সেনগারকে তৈরি করার দায়িত্ব নাও। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। আমি খুব খুশি। ইভা নারিন বলল।
ধন্যবাদ ম্যাডাম ইভা নারিন। আমি খুব খুশি হলাম। আমার বাড়ি এখন শূন্য। আত্মীয়-স্বজন ডাকারও তৈমন সুযোগ নেই। আর অনুষ্ঠান আমরা খুব সিম্পল করতে চাই। সরদার আসতি আওয়াত বলল।
ওয়েলকাম আপনাদের সিদ্ধান্তকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সিম্পল ও সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান হওয়াই উচিত। ইভা নারিন বলল।
ধন্যবাদ ইভা নারিন। আপনি কাজে লেগে যান। আজকের রাতটা নিশ্চয় মনে রাখার মত হবে। বলল আহমদ মুসা।
অবশ্যই জনাব। তবে বাড়ি থেকে বেরুবার পর যতগুলো মুহূর্ত গেছে। সবই আমার জন্যে অবিস্মরণীয়, জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার। ইভা নারিন বলল। ইভা নারিনের কথা শুনতে পায়নি, এমন ভাব করে আবার সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
.
বেলা দশটা।
ইভা নারিন ছুটে এসে আহমদ মুসার ঘরে ঢুকল। বলল, জনাব আহমদ মুসা। বাবা কথা বলবেন আপনার সাথে।
আহমদ মুসা দ্রুত মোবাইল নিল ইভা নারিনের হাত থেকে।
গুড মর্নিং স্যার। আমি আহমদ মুসা।
আপনি আহমদ মুসা, এটা আপনি আমাকে জানাননি, ইভাও আমাকে এটা জানায়নি, গোয়েন্দা তথ্যে আমি জেনেছি। বলল ইভা নারিনের বাবা আর্মেনিয়ার পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক।
স্যরি স্যার। শুধু কাজের স্বার্থেই আমি বলতে পারিনি। নীতি হিসাবে কাউকেই বলিনি বলে আপনাকেও বলা হয়নি। দিভিনের শাইখ আমাকে চিনতে পারে। তার ফলেই আমার নাম প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
একটু থামল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই আবার বলল আহমদ মুসা, স্যার আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করেছেন, এটা আমাকে লজ্জা দেয়া।
বলেন কি! মার্কিন প্রেসিডেন্টের পাশে বসে মিটিং করেন। শুধু তাই নয়। আপনার কাহিনীগুলো আমাদের বিস্মিত করে, অনুপ্রাণিত করে। আপনি যা করেন সবই মানুষের স্বার্থে, মজলুমের স্বার্থে, অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে এবং ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। না দেখেই আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করে আসছি। তুমি সম্বোধন আমার ধৃষ্টতা হবে।
আপনি আন্না এলিনা আর ইভা নারিনের বাবা। আমার বাবার মত। আপনি আমাকে আপনি সম্বোধন করতে পারেন না। আমি এটা মানব না। বলল আহমদ মুসা।
সত্যি আহমদ মুসা অনেক যোগ্যতা ও গুণে তুমি অতুলনীয়। আমার মনে হয়, তোমার সবচেয়ে বড় গুণ তোমার মানবিকতা, পরার্থে তোমার জীবন উৎসর্গ। এই গুণ তুমি কোথায় পেলে? তোমার আদর্শ কে? বলল ইভা নারিনের বাবা পুলিশ প্রধান আবেগ জড়িত কণ্ঠে।
আমার আদর্শ আমার নবী, শেষ প্রোফেট মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ স.। আমার রাসূলের পথে একজন বৃদ্ধা মহিলা কাঁটা বিছিয়ে রাখত। রাসূল স. তার পথে কয়দিন কাঁটা পেলেন না। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন আল্লাহর রাসূল স.। ভাবলেন মহিলাটির অসুখ-বিসুখ হয়নি তো! মহিলাটির বাড়িতে গেলেন রাসূল স.। দেখলেন, সত্যিই সে অসুস্থ। আল্লাহর রাসূল স. সেরা যত্ন করে তাকে সুস্থ করে তুললেন। আর একটি ঘটনা, শত্রুপক্ষের একজন মেহমান সেজে তাঁর বাড়িতে এসে শোবার বিছানাপত্র পায়খানা করে নষ্ট করে ফেলল। রাসূল স. মেহমানকে কিছুই বলেননি। নিজহাতে বিছানাপত্র পরিষ্কার করেছেন। আমাদের প্রিয় নবীর সব যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষার যুদ্ধ। নিজেরা না খেয়ে বন্দী সৈনিককে খাইয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত শত্রু সৈন্যের চিকিৎসাকে সমান চোখে দেখেছেন। আমাদের ধর্মের প্রধান নির্দেশ, প্রধান প্রেরণাই হলো ফি সাবিলিল্লাহর কাজ করা। ফি সাবিলিল্লাহর অর্থ হলো নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর জন্যে অর্থাৎ সত্য, ন্যায় ও মানুষের কল্যাণের জন্যে কাজ করা। যুদ্ধ যদি করতেই হয়, তাহলে সেটা নিজ বা কারও স্বার্থ পূরণের জন্যে নয়, সত্য, ন্যায় ও মানুষের মঙ্গলের জন্যে হতে হবে এবং তা হতে হবে আইন। সংগত অথরিটির অধীনে। এই আদর্শের অনুসরণেই আমি কিছু করার চেষ্টা করি জনাব। থামল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। তুমি যা বললে, তা দিয়ে একটা মহাগ্রন্থ রচনা করা যায়। তোমাদের ধর্ম ও তোমাদের রাসূল মোহাম্মদ সম্পর্কে কিছু পড়েছি আমেরিকায় ট্রেনিং-এর সময়। সত্যিই তোমাদের ধর্ম আধুনিক যুগের আধুনিক মানুষের জন্যে। আমি আনন্দিত যে, তোমার মধ্যে জীবন্ত ইসলামকে দেখার সুযোগ হলো। ইভা নারিন আমাকে সব বলেছে। তোমার চরিত্রের মত চরিত্রের কথা আমরা স্বপ্নে ভাবারও যোগ্যতা হারিয়েছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ.। বলল ইভা নারিনের বাবা পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক।
আমাদের রাসূল স.-এর একটা উক্তি ও ইসলামী সমাজে একজন সুন্দরী নারী অর্থ-সম্পদ সাথে নিয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একা সফর করলেও তার দেহ, অর্থ-বিত্ত সবই নিরাপদ থাকবে। আহমদ মুসা বলল।
তুমি বলছ সোনার মানুষ আর সোনার সমাজের কথা। আমরাও এর। স্বপ্ন দেখি। কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কোন উপায় আমাদের হাতে নেই। বলল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক।
কিন্তু স্যার মানব মনে বাস্তব যে চাওয়ার সৃষ্টি হয়, তার পূরণের ব্যবস্থাও আল্লাহ দুনিয়াতে রাখেন। আহমদ মুসা বলল।
হাসল অ্যারাম আড্রানিক। মিষ্টি হাসি। বলল, আমি জানি আহমদ মুসা, ইসলাম যাদের ধর্ম, তাদের এ কথা বলার অধিকার আছে।
একটু থামল অ্যারাম আভ্রানিক। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, আহমদ মুসা, এবার তোমার কাজটার কথায় আসি। তোমার সেন্ট আর্থার অ্যালেক্স সেমভেলকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। আর্মেনিয়ায় যতগুলো চার্চ সংগঠন আছে, প্রত্যেকটিতে আমাদের লোক গেছে, চার্চগুলোতে খোঁজ নিয়েছে, কিন্তু ঐ নামের কোন যাজক, ফাদার, খ্রিষ্ট ধর্মনেতাকে পাওয়া যায়নি। সব শেষে আর্মেনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত সবচেয়ে দায়িত্ববান ধর্মগুরু সেন্ট গ্রেগরির চার্চে আমি নিজে গিয়েছিলাম। তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম এই নামের কোন খ্রিষ্ট ধর্মনেতা বা খৃস্টান নেতা তার জানার মধ্যে থাকলে আমাদের সন্ধান দেবার জন্যে। তিনি একটু চিন্তা করে জানালেন, চার্চ কিংবা কোন ধর্মীয় সংগঠনে এই নামের কোন নেতা নেই। কিন্তু নাম শুনে মনে হচ্ছে চার্চের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন ধর্মগুরুর নাম এমন হতে পারে না। তারপর আবার তিনি ভাবলেন। বললেন, এমন নাম আপনারা কোথায় পেলেন? আমি বলেছিলাম, এক গোয়েন্দা রিপোর্টে এই নাম এসেছে। তাহলে তিনি কি কোন ক্রাইমের সাথে জড়িত? জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়নি, তবে চিন্তার দিক দিয়ে তিনি চরমপন্থী ধরনের। বলেছিলাম আমি। আপনাদের কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হওয়ার পরেই তো তার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া উচিত নাকি?
বলেছিলেন তিনি, আমি হতাশ হয়ে চলে আসছিলাম। সবশেষে তিনি একটা পরামর্শ দিলেন। বললেন, আমি দেশের প্রাচীনতম মন্দিরের সেবায়েত। আমার চিন্তার সবটুকু জুড়ে খ্রিষ্ট ধর্ম। আমি দেখতে পাচ্ছি, আমাদের অবস্থান অব্যাহতভাবে সংকুচিত হচ্ছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি, সরকারেরও এ নিয়ে ভাবা দরকার। আমার কথা তো বললাম, এখন তুমি কি ভাবছ বল। বলল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক।
ইভা নারিনের অভিজ্ঞতা থেকে যা জানতে পেরেছি এবং ত্রিফা। বেফ্রিনের সাথে সংশ্লিষ্ট যে তথ্য পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল ইয়েরেভেনেই থাকেন। আপনারা অনুসন্ধান বন্ধ করবেন না প্লিজ। আমিও ইয়েরেভেনে আসব। একটা অনুরোধ, দিভিনের সবগুলো প্রবেশ পথে পুলিশ পাহারা বসাবার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। আর দিভিনের জন্যে সার্বক্ষণিক শক্তিশালী ভ্রাম্যমাণ একটা ইউনিট চাই, প্লিজ। আহমদ মুসা বলল।
তোমার সবগুলো পরামর্শই বাস্তবায়িত হবে। তবে শর্ত হলো, তুমি
ইয়েরেভেনে এসে আমার বাসায় উঠবে। বলল অ্যারাম আড্রানিক।
আপনার বাসায় উঠতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু ইয়েরেভেনে আমার উপস্থিতি সম্পূর্ণ গোপন রাখতে চাই। আপনার বাসায় উঠলে সেটা হবে না। আহমদ মুসা বলল।
বুঝেছি আহমদ মুসা। আমার দ্বিতীয় আরো একটা প্রস্তাব আছে। ইয়েরেভেনের বিদেশি অধ্যুসিত অভিজাত এলাকায় ইভা নারিনের একটা ফ্ল্যাট আছে। ফ্ল্যাটটা পড়েই আছে। ফ্ল্যাটের সাথে আমাদের সংশ্লিষ্টতার কথা কেউ জানে না। আমাদের বাড়িতে অসুবিধা হলে তুমি সেখানেই উঠ। বলল অ্যারাম আভ্রানিক।
ধন্যবাদ স্যার। আমার ভালো লেগেছে এই প্রস্তাব। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে কবে আসছ? বলল অ্যারাম আড্রানিক।
দিভিনের নিরাপত্তা আপনি যত তাড়াতাড়ি নিশ্চিত করতে পারবেন, তত তাড়াতাড়ি আমি আসতে পারব। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে, ওটা ইমিডিয়েটলি হয়ে যাবে। বলল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক।
ধন্যবাদ স্যার। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে, আমি রাখছি। সব ক্ষেত্রে সব কাজে তোমার সাফল্য কামনা করি। বাই।
বাই, স্যার। বলে আহমদ কল অফ করে ইভা নারিনকে দিয়ে দিল।
আমি টায়ার্ড আপনাদের কথা শুনতে শুনতে। এত লম্বা টেলিফোন বাবা আপনাকে করল! অথচ দুতিন মিনিট পার হতেই বাবা ধমকে আমার টেলিফোন রেখে দেন। বলেন, টেলিফোন জরুরি প্রয়োজনের জিনিস। এটা আটকে রাখা ঠিক নয়। ইভা নারিন বলল।
আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ যে, তিনি সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেলের বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু তার তো সন্ধান মিলল না।
ইভা নারিন বলল।
এই যে ব্যাপক চেষ্টা তিনি করেছেন এটা খুব বড় বিষয়। এর মধ্যে দিয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের একটা মটিভেশন হয়ে গেল যে, তারা সেন্ট সেমভলের বিরুদ্ধে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক বলেছেন। এটা একটা বড় লাভ।
বলেই একটা দম নিয়ে আবার বলে উঠল, বুঝলাম আপনি ইয়েরেভেন যাচ্ছেন এবং সেটা ব্ল্যাক আর্মেনিয়ার টাইগারের সন্ধানে। এর
অর্থ আপনি অত্মরক্ষা থেকে আক্রমণে যাচ্ছেন।
হ্যাঁ ইভা নারিন, ঐ সন্ত্রাসীদের পরাজিত না করা পর্যন্ত দিভিন ও দিভিনবাসীরা নিরাপদ হবে না এবং আর্মেনিয়াও সন্ত্রাসমুক্ত হবে না। বলল আহমদ মুসা।
আমার খুব খুশি লাগছে। নিশ্চয় আমি সাথে থাকছি। বাবাকেও আমি বলেছি। ইভা নারিন বলল।
এ ধরনের কাজ একা করার মধ্যেই নিরাপত্তা বেশি আছে। আমি সেটাই করতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
আপনি ঠিক বলেছেন। এ ধরনের কাজে নিরিবিলি ও নিঃশব্দে এগোতে হয়। তাহলে আমারও তো একা চলার অধিকার আছে। আর্মেনিয়ার গোয়েন্দা বিভাগ ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার (BAT)-এর বিষয়টা ডিল করার দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করেছে। ইভা নারিন বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, এটা আমার জন্যে সুসংবাদ ইভা নারিন। আর্মেনীয় পুলিশকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে ইভা নারিন এই গ্রুপটা অমানুষ এবং নৃশংস। তোমার উপর এমনিতেই ওদের রাগ আছে, তুমি তাদের হত্যার টার্গেট। তুমি এ দায়িত্ব নিও না।
ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আপনি ওদের কাছে আমার চেয়ে বড় টার্গেট। এত বড় টার্গেট যে, আপনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে যেকোন মূল্য দিতে তারা রাজি এই অবস্থায় আপনি পিছু না হটে সামনে এগোচ্ছেন। আমি পিছু হটব কেন?
পিছু হটতে তোমাকে বলছি না। গোয়েন্দা তদন্ত স্বাভাবিক নিয়মে যেভাবে চলে সেভাবে এগোও। অফেনসিভে যাওয়া যাকে বলে সেটা করো না। বলল আহমদ মুসা।
কেন? ইভা নারিন বলল। তার পলকহীন দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
ব্যক্তি হিসেবে তোমার প্রতি তাদের যে ক্রোধ আছে, সেটা তোমাকে বিপদে ফেলবে। বলল আহমদ মুসা।
পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ। আমি সাবধান হয়েই আমার পথে চলব। একজন গোয়েন্দাকে তো এতটুক করতেই হবে। ইভা নারিন বলল।
তুমি এসব ক্ষোভ থেকে বলছ না তো? সত্যিই আমি যে কাজগুলো করতে যাচ্ছি, তাতে একা এগোনোই সুবিধাজনক। বলল আহমদ মুসা।
ঠোঁটে এক টুকরো ম্লান হাসি ফুটে উঠল ইভা নারিনের। বলল, ক্ষোভ হলে সেটা কি দোষের হবে?
একটু থামল। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, থাক ওসব কথা, আপোসের জন্যে আমার একটা প্রস্তাব আছে।
বলুন। আহমদ মুসা বলল।
আমি চাই, আপনার ফাইন্ডিংসগুলো আমার সাথে শেয়ার করবেন। বলল ইভা নারিন।
তার প্রয়োজন হতেই পারে। বলল আহমদ মুসা।
এতেই হবে। আপনার সাথে যোগাযোগের অনুমতি থাকলেই চলবে। ধন্যবাদ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ইভা নারিন।
ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় খোলা দরজা বন্ধ করে গেল।
আহমদ মুসাও মনে মনে হাসল ইভা নারিনের চেহারা মনে করে। আগের ইভা নারিন ও বর্তমান ইভা নারিনের মধ্যে কত পার্থক্য। এখন ইভা নারিনকে দেখে মনে হচ্ছে, তুর্কি কোন পর্দানশীন মহিলা।
.
৬
পেছনের ঘটনাবলি নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে অবশেষে বলল সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল, আমি যা করছি জেসাসের সন্তানদের জন্যে করছি। আমার কোন সংসার নেই। আমার কোন স্বার্থও নেই। আমার জানামতে আমি চেষ্টার কোন ত্রুটি করনি। চেষ্টার সর্বোচ্চটাই করেছি। এরপরও যে ব্যর্থতা, তার কারণ কি আপনারা বলুন। আর কাউকে ডাকিনি এই আলোচনায়। আপনারা দুজনেই স্পেশালিস্ট। আপনাদের কাছ থেকে প্রকৃত অবস্থা জানতে চাই। আলোচনায় ওয়েলকাম আপনাদের।
ধন্যবাদ ফাদার, আমার বিষয়টাই আমি প্রথম বলছি। আমার কাছে। একটা সেনা ইউনিট চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোন সেনা ইউনিট এভাবে মুভ করতে পারে না। একটা ইউনিট মুভ করাতে হলে কমান্ড প্রধানকে অবশ্যই জানাতে হবে, অনুমতি দিতে হবে। তাছাড়া কোন ইউনিট কোথায় কি জন্যে মুভ করছে তা সেন্ট্রাল লগে এন্ট্রি থাকতে হবে। সুতরাং এমন সেনা ইউনিট আমি দিতে পারিনি। কিন্তু সেনা ইউনিটের সবকিছু দিয়ে একটা ইউনিট তৈরি করে দিয়েছিলাম। ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগারের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে আমি মনে করি এটা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, গোটা ইউনিটটাই ধ্বংস হয়ে গেল! তারা কিছুই করতে পারল না! এই বিস্ময়টা মাথায় নিয়ে খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করেছি আমাদের গোয়েন্দা সূত্রে। যা জানতে পেরেছি তা ভয়াবহ। যে দুজনকে হত্যা করা অথবা ধরে আনার জন্যে ওদের পাঠানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে পুরুষ যিনি, তিনি আহমদ মুসা এবং মহিলাটি খোদ আমাদের পুলিশ প্রধানের মেয়ে এবং পুলিশের একজন শীর্ষ গোয়েন্দা অফিসার ইভা নারিন। আহমদ মুসা গোটা দুনিয়ায় সম্মানিত, তার শত্রুদের কাছে ভয়ংকর এবং অজেয় এক ব্যক্তিত্ব। এই তথ্য জানার পর আমার আগের বিস্ময়টা আর থাকেনি। তাদের মোকাবিলায় এ ধরনের একটা সেনা ইউনিট ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। রেসপেকটেড ফাদার, আমি এবং আমরা আপনার সাথে। আছি। কিন্তু বিষয়টা এ পর্যন্ত গড়াল কি করে? আহমদ মুসা এখানে এসে পড়ল কি করে? চারজন গোয়েন্দা অফিসার মারা যাওয়ায় সরকার এমনিতেই আরও হোস্টাইল হয়ে উঠেছে। সুতরাং আমাদের কিছু করতে হলে সব কুল বজায় রেখে করতে হবে। দিভিন উপত্যকায় ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগারের ব্যর্থতা, তার কারণ অনুসন্ধানের জন্যে কোন বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। আহমদ মুসার মোকাবিলায় এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক ছিল। কথাগুলো আমাদের জন্যে তিক্ত, তবে বাস্তবতা এটাই। ভবিষ্যত চিন্তার জন্যে সম্মানিত ফাদারকে বিষয়টা বিবেচনায় নিতে হবে। থামল কমান্ডার রাজু বখোস।
ধন্যবাদ কমান্ডার। বলে সেন্ট সেমভেল তাকাল ইয়েরেভেনের পুলিশ প্রধান হায়েক হেনরিকের দিকে। বলল, কমান্ডার তার অবজারভেশন বলেছেন। এখন আপনি কিছু বলুন।
আহমদ মুসা আসার আগের অবস্থা এবং পরের অবস্থার মধ্যে। আসমান-জমিনের মত ব্যবধান ঘটেছে। তখন দিভিন ছিল অসহায়, নির্বাক, নিষ্ক্রিয়। যা ইচ্ছা তাই করা গেছে। কিন্তু এখন যা করতে যাওয়া হচ্ছে, তাই ব্যর্থতা বরণ করছে। ট্রেনের ঘটনাবলী যা আহমদ মুসা। দিভিনে আসার পথে ঘটেছে এবং দিভিনে যা এ পর্যন্ত ঘটল। তাতে ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগারের বেস্ট কমান্ডোদের একশর মত সদস্য প্রাণ হারিয়েছে। আহমদ মুসা ও দিভিনের কোন ক্ষতি করা যায়নি আহমদ মুসার কারণে। আরেকটা দিক হলো, আহমদ মুসা ট্রেনের ঘটনায় ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগারের হাত থেকে আমাদের পুলিশ প্রধানের মেয়ে ও জামাইকে বাঁচিয়েছিলেন। সবার অনুরোধে আহমদ মুসা দুই তিন দিন তাদের বাড়িতে ছিলেন। সেখানেও ব্ল্যাক টাইগার তাকে মারার চেষ্টা করেছে। সে সময় পুলিশ প্রধান আহমদ মুসার পরিচয় জানতেন না। পরে জেনেছেন। নিজের গোয়েন্দা অফিসার মেয়েকে তিনি দিভিনের তদন্তে আহমদ মুসার সাথে দিয়েছেন। অতএব সরকারি সহায়তা আহমদ মুসা পাবেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। ইয়েরেভেনের মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাদের সরকারকে আহমদ মুসা সম্পর্কে মার্কিন মনোভাব জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে আহমদ মুসা আর্মেনীয় সরকারের মেহমানের স্ট্যাটাস পেয়ে গেছেন। সুতরাং সরকারি কোন। ব্যবস্থাকে তার বিরুদ্ধে কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। ফাদারকে এই বাস্তবতা সামনে রেখেই চিন্তা করতে হবে।
থামল দিভিনের পুলিশ প্রধান হায়েক হেনরিক।
হায়েক হেনরিক থামলেও কথা বলল না সেন্ট সেমভেল। সে অনেকটাই আত্মমুখী। ভাবছিল সে।
এক সময় মুখ তুলল সেন্ট সেমভেল। বলল, মি. হেনরিক, সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেলকে কি আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগ খুঁজছে?
স্যরি ফাদার, এ কথা বলতে ভুলেই গেছি। উপর থেকে নির্দেশ সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল নামে ধর্মীয় সংগঠনের, চার্চের বা কোন ধর্মনেতার নাম আছে কিনা, তা সন্ধান করে জানাতে হবে। দিভিন থেকে। আমরা যে তালিকা দিয়েছি, তাতে ঐ নামের কেউ নেই। বলল হায়েক হেনরিক।
এই নামটা সরকার পেল কার কাছ থেকে? বলল সেন্ট সেমভেল।
এ নামটা সম্ভবত আহমদ মুসাই আগে পায়। দিভিনে ত্রিফা বেফ্রিন ও মোহাম্মাদ বেহেজ মারা গেছেন, কিন্তু তাদের মোবাইল ও কাগজপত্রে থেকে কিছু নিশ্চয় পেয়ে গেছে। তাছাড়া শিন সেনগার বুদ্ধিমতি মেয়ে। তার বাবা-মা সম্পর্কে অনেক কিছুই হয়তো সে জানত। হায়েক হেনরিক বলল।
হ্যাঁ, এর সম্ভাবনা আছে। তার বাবা-মার অন্যদের সাথে টেলিফোন আলাপের অনেক কিছুই সে হয়তো শুনেছে। তখন হয়তো সে কিছুই বুঝেনি। কিন্তু ঘটনার পর মেয়েটি নিশ্চয় অতীতের স্মৃতিচারণ করেছে। আহমদ মুসাও প্রয়োজনীয় তথ্য তার কাছ থেকে বের করে নিয়েছে। বলল সেন্ট সেমভেল।
কথা শেষ করেই একটু থেমে আবার বলল, আপনাদের দুজনের মতামতের জন্যে ধন্যবাদ। আপনারা পোষাকি কোন কথা না বলে বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছেন। কিন্তু পথ তো আপনারা দেখালেন না।
পথ খোঁজার আমরা দরকার মনে করিনি। কারণ, একজন মানুষ দিভিনে আসার পর আমাদের এই বিপর্যয়। সেই মানুষটিই সমস্যা। তাকে যদি আর্মেনিয়া থেকে সরানো যায়, তাহলে ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে। বলল হায়েক হেনরিক, দিভিনের পুলিশ প্রধান।
আমারও এই একই কথা। হেনরিক থামতেই কমান্ডার রাজু বখোস বলল।
সরাতে হবে আর্মেনিয়া থেকে নয়, পৃথিবী থেকে। আমাদের সমস্যার এটাই সমাধান। কিন্তু কিভাবে? আমাদের ইতিপূর্বেকার সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। বলল সেন্ট সেমভেল।
এখন সব কাজ বাদ দিয়ে তার পেছনে লাগুন। তাকে ফলো করুন। সুযোগ এক সময় একটা পেয়েই যাবেন। বলল হায়েক হেনরিক।
সেন্ট সেমভেল একটু ভাবল। বলল, ধন্যবাদ মি. হেনরিক। আমিও এটাই ভেবেছি। এ ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। দিভিনে আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, কোনটাই ভালো ফল দেয়নি, ডেকে এনেছে আমাদের বিপর্যয়। তাকে ফলো করা বড় কথা নয়, বড় কথা রেজাল্ট পাওয়া। এ ব্যাপারে ইয়েরেভেন পুলিশ আমাদের কি সাহায্য করতে পারে?
মি. আহমদ মুসা তো দিভিনে। ইয়েরেভেন পুলিশ কি সাহায্য করবে ফাদার? হায়েক হেনরিক বলল।
সুনির্দিষ্ট খবর আমি দিভিন থেকে পাইনি। তবে দিভিনের কাজ শেষ হলে আহমদ মুসার আর দিভিনে থাকার কথা নয়। আমাকে খোঁজার যে কাজ গোয়েন্দা বিভাগ শুরু করেছে, তার উদ্যোগ আহমদ মুসা থেকেই এসেছে। সুতরাং তাকে আসতেই হবে আমার খোঁজে এবং সেটা অবশ্যই প্রথমে ইয়েরেভেনে। বলল সেন্ট সেমভেল।
হ্যাঁ ঠিক। আহমদ মুসা ইয়েরেভেনে আসবেই। এটা হবে ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগারের জন্যে বিরাট একটা সুযোগ। ফাদার সেন্ট সেমভেলের সন্ধানে নিশ্চিতভাবে অন্ধকারে তাকে হাতড়াতে হবে। তাকে যেতে হবে আপনার যেখানে খোঁজ পাওয়া যায়, এমন সব স্থানেই। সুতরাং তাকে ফাঁদে ফেলা সহজ হবে। হায়েক হেনরিক বলল।
আমি সেই সুযোগেরই অপেক্ষা করছি। এক্ষেত্রে আপনার কিছু করার আছে কিনা? বলল সেন্ট সেমভেল।
আমার একটাই করার আছে, সেটা তথ্য দিয়ে সাহায্য করা। আমি সে চেষ্টা করব।
ধন্যবাদ মি. হেনরিক, ধন্যবাদ কমান্ডার রাজু বখোস। আমি খুশি। যে, সামনের পদক্ষেপের ব্যাপারে আমাদের সকলের একই চিন্তা। অতএব এটাই আকাঙ্ক্ষিত পথ, যা সাফল্য দিবে বলে আমি মনে করি। বলল সেন্ট সেমভেল।
জেসাস আমাদের সাফল্য দিন। বলল রাবজু বখোস।
আমেন। বলল সেন্ট সেমভেল ও হায়েক হেনরিক দুজনেই।
.
আহমদ মুসা তার প্রত্নতত্ত্ব নগরী দিভিনের ভাড়া নেয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে চারশ গজ দূরে এসে একটা ট্যাক্সি নিল।
গতকাল বিকেলে আহমদ মুসা ইয়েরেভেন থেকে এখানে এসেছে। দুদিন ইয়েরেভেনে ঘুরে ফিরে আহমদ মুসার কেন জানি মনে হয়েছে। সেন্ট সেমভেলের সন্ধান মডার্ন ইয়েরেভেনে নয়, প্রাচীন রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ প্রত্নতত্ত্ব নগরী দিভিনেই পাওয়া যাবে। আর্মেনিয়ায় খ্রিষ্ট ধর্মের আদি পাদপীঠ এই দিভিনেই। তাই ধর্মীয় ব্যাপারে আবেগ বেশি রয়েছে এখানে। আর্মেনিয়ায় খৃস্টানদের প্রাচীনতম চার্চ দিভিনে প্রতিষ্ঠা হয় খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের সেই সেন্ট গ্রেগরি চার্চ। মাটির তলা থেকে উদ্ধার করা যায়নি। একটা অবয়ব উদ্ধার হয়েছে মাত্র। সম্পূর্ণ চার্চ কমপ্লেক্সের অবয়ব অনুসরণ করে তার একটা রিপ্লিকা তৈরি হয়েছে। নামও দেয়া হয়েছে সেন্ট গ্রেগরি চার্চ। কাকতালীয়ভাবে এর পরিচালনায় যিনি আছেন তার নামও সেন্ট গ্রেগরি। কার্যত ইনি সার্বিক উদ্যোগ নিয়ে সেন্ট গ্রেগরি চার্চের রিপ্লিকা তৈরি করেছেন। ফাদার সেন্ট গ্রেগরি এখন আর্মেনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত ধর্মনেতা। দিভিনের এই অতীত-বর্তমান ইতিহাস আহমদ মুসাকে দিভিনে টেনে নিয়ে এসেছে।
ট্যাক্সিওয়ালা কোথায় যাবে জানতে চাইলে আহমদ মুসা বিপদে পড়ে গেল। কোথায় যাবে সে, এটা ঠিক করাই হয়নি।
আমি দিভিনে বেড়াতে এসেছি। এখনকার তেমন কিছু চিনি না। কোথায় যাওয়া যায় বল তো? আহমদ মুসা বলল ট্যাক্সিওয়ালাকে।
স্যার, পুরানো না নতুন কিছু আপনার ভালো লাগবে? ট্যাক্সিওয়ালা বলল।
পুরানোর প্রতিই আমার আকর্ষণ বেশি। বলল আহমদ মুসা।
পুরাতনটাই দিভিনে বেশি উজ্জ্বল। পুরাতনকে দেখার জন্যেই আর্মেনিয়ায় আসা ট্যুরিস্টরা দিভিনে আসে। দিভিনে পুরাতন অনেক কিছু আছে। কোথায় যাবেন স্যার? ট্যাক্সিওয়ালা বলল।
সব জানলে-চিনলে না বাছাই করব, তুমি একটা পছন্দ কর। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে তৃতীয় শতকে তৈরি সেন্ট গ্রেগরি চার্চের যে প্রতিরূপ তৈরি হয়েছে, সেখানেই চলুন স্যার। বিশাল চার্চ-কমপ্লেক্স। চার্চ বিল্ডিং, বিভিন্ন ধরনের সেবায়েতদের থাকার বিশাল হাউজ-কমপ্লেক্স। ফাদার সেন্ট গ্রেগরির বাড়ি। সবকিছুর মধ্যেই অতীতকে খুঁজে পাওয়া যায়।
ওখানে হোটেল-মোটেল, দোকানপাট আছে কি? বলল আহমদ মুসা।
বলেন কি স্যার! দিভিনের সবচেয়ে বেশি জনসমাগমের জায়গা এই সেন্ট গ্রেগরি চার্চ। সব পাবেন স্যার সেখানে। কমপ্লেক্সের দক্ষিণ দিক, যেদিকে সেন্ট গ্রেগরির বাড়ি, সংরক্ষিত এই পুরাকীর্তি এলাকার বাইরে তিন দিকেই দোকান, অনেক হোটেল, আবাসিক ভবন তৈরি হয়েছে এখানে। ট্যাক্সিওয়ালা বলল।,
বেশ চল সেন্ট গ্রেগরি চার্চে। বলল আহমদ মুসা।
ট্যাক্সি ছুটতে শুরু করল। অভ্যাস বশতই আহমদ মুসার চোখ ছুটে যাচ্ছিল ট্যাক্সির রিয়ারভিউয়ের দিকে। পাঁচ মিনিট ধরে আহমদ মুসা দেখছে একটা প্রাইভেট কার তার ট্যাক্সির পেছনে আসছে। তার ট্যাক্সির মত একই গতিতে। হয়তো গাড়িটাকে সন্দেহ করার কিছুই নেই। গাড়ির স্পিডের ব্যাপারটা কাকতালীয় হতেও পারে। কিন্তু তবুও সতর্ক হলো আহমদ মুসা। কারণ সে দেখেছে, ইয়েরেভেনে থাকাকালীন দুদিনই তাকে বিভিন্নভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। দুদিনের কোন সময়ই গাড়ি নিয়ে তার থাকার বাড়িটা পর্যন্ত যেতে পারেনি। বাড়ি থেকে দূরে নেমে এগলি সেগলি ঘুরে অনুসরণকারীদের চোখে ধুলা দিয়ে বাসায় পৌঁছেছে। আহমদ মুসা বুঝেছে, শত্রুরা তার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করতে চাচ্ছে। আর এটা দুই কারণে, সুযোগ পেলে ফাঁদে ফেলা এবং তার অনুসন্ধানের জায়গাগুলো নখদর্পণে রাখা। সুতরাং ইয়েরেভেনে তারা যা করেছে, দিভিনে সেটাই তারা করবে। সুতরাং সন্দেহকে ছোট করে দেখতে চাইল না সে। অনুসরণ সত্য হলে সেন্ট গ্রেগরি চার্চের এলাকা তাদের লোকরা আহমদ মুসার উপস্থিতির কথা আগাম জেনে ফেলবে! সুতরাং চার্চ এলাকার কোথাও সে নিরাপদ নয়, সেটাই ধরে নিতে হবে।
ড্রাইভার তোমার লক্ষ তো সেন্ট গ্রেগরি চার্চ এলাকা? এলাকার চারদিকটা তো ঘিরে আছে সেন্ট গ্রেগরি অ্যাভেনিউ। আমরা এখন কোন পথে যাচ্ছি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্যার, আমরা দুএক মিনিটের মধ্যেই এনদিন আয়াপ স্ট্রিটে গিয়ে পড়ব। এই স্ট্রিট সোজা দুকিলোর মত এগিয়ে সেন্ট গ্রেগরি অ্যাভেনিউতে গিয়ে পড়েছে।
আচ্ছা ড্রাইভার, কি নাম বললে স্ট্রিটটার যেখানে পড়তে যাচ্ছি? লল আহমদ মুসা।
এনদিন আয়াপ স্ট্রিট। ড্রাইভার বলল।
শব্দগুলো অপরিচিত লাগছে। এগুলো তো আর্মেনীয় শব্দ নয়। বলল আহমদ মুসা।
না স্যার, এ দুটি আর্মেনীয় শব্দ নয়। ড্রাইভার বলল।
এই শব্দগুলোর ইংরেজি বানান বলতে পারবে? বলল আহমদ মুসা।
স্যার মনে নেই। রোডের মুখেই নৈমপ্লেট আছে। তাতেই সব পাওয়া যাবে।
একটু থেমেই বলে উঠল ড্রাইভার, স্যার এসে গেছি। ঐতো সামনে পশ্চিম দিকে মোড় নেব। ওটাই এনদিন আয়াপ স্ট্রিটের মুখ। ওখানেই নেমপ্লেট আছে। মুখে একটা ইমার্জেন্সি পার্কিং আছে।
টার্ন নেয়ার সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলছিল। আহমদ মুসার গাড়ি যখন টার্ন নিতে গেল, তখন লাল সিগন্যাল জ্বলে উঠল।
আহমদ মুসা মনে মনে খুশি হলো। পার্ক করার চাইতে এটা অটোমেটিক পার্কিং হয়ে গেল। দেখা যাক, পেছনের গাড়িটার যাচাই এবার হয়ে যাবে। এ মোড়ে কিছুটা দেরি করা ছিল মূল উদ্দেশ্য।
আহমদ মুসা রিয়ারভিউতে দেখল, পেছনের কারটি তাদের ট্যাক্সির একদম পেছনে। দেখতে দেখতেই কারটি আহমদ মুসার ট্যাক্সির পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
আহমদ মুসার চোখ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল গাড়িওয়ালার ভাবগতিক দেখার জন্যে। আহমদ মুসার চোখ তাকে দেখল। লোকটি নির্বিকারভাবে সামনে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তের জন্যেও সে এদিকে বা কোন দিকে তাকাচ্ছে না। মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। কাঁচা চোরের এমনটাই অভ্যেস। সে চোখ বন্ধ রেখে মনে করে কেউ তাকে দেখছে না। লোকটির এমন ভালোমানুষ সাজার কসরতই প্রমাণ করে সে এ গাড়িটাকে ফলো করছে।
স্যার দেখুন, রাস্তার নেমপ্লেটটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভার বলল।
আহমদ মুসা তাকাল নেমপ্লেটটির দিকে। কাছেই মোড়ের আইল্যান্ডের উপর প্লেটটি। প্লেটে পরিষ্কার লেখা দেখতে পেল Ndin Ayap এবং নামের নিচেই আরও কিছু লেখা দেখতে পেল। পড়ল আহমদ মুসা ও দিভিনের জনগণের কাছে Ndin Ayap নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম নাজমদ্দিন আয়ুব। দিভিনের মাটিতে জন্মগ্রহণকারী তিনি একজন জেনারেল। আর্মেনিয়াসহ গোটা এশিয়া মাইনরে প্রভাব বিস্তারকারী দিভিনের একজন কৃতী সন্তান তিনি। রাস্তার এই মুখটিতেই তার পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল, যেখানে, তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ইউনেস্কো তার অনুসন্ধানে এটা পাবার পর দিভিন প্রশাসনের সম্মতিক্রমে এই রাস্তার নাম তার নামে করা হয়েছে।
খুব খুশি হলো আহমদ মুসা। এটা সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বংশের সাথে দিভিনের সম্পর্কের আরো একটা বড় প্রমাণ।
এনদিন আয়াপ স্ট্রিটে ঢোকার গ্রিন সিগন্যাল অন হয়ে গেল।
আহমদ মুসার গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসাদের ফলো করা গাড়ি আগে যাবার সুযোগ পেয়েও সামনে গেল না। বেশ ব্যবধান নিয়ে আহমদ মুসাদের গাড়ির পিছু পিছু আসতে লাগল।
ওরা পিছু নিয়ে কি করতে চায়, নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। অনুসরণকারী লোকটি নিশ্চয় তার লোকদের আহমদ মুসার অবস্থান। জানিয়ে দিচ্ছে। কি উদ্দেশ্য ওদের? ওরা কি আহমদ মুসার গন্তব্য জানতে চায়? গন্তব্যে পৌঁছার পর তারা অ্যাকশনে যাবে? না, তারা আহমদ মুসা কার কাছে, কোথায় যায়, এসবই আগে জেনে নিচ্ছে। তারপর তারা ফাঁদ পাতবে। এতটা ধৈর্য কি ব্ল্যাক টাইগারদের আছে? এসব ভাবল আহমদ মুসা। তারপর মনে মনে বলল, তার সেন্ট গ্রেগরি চার্চে যাওয়ার ব্যাপারটা গোপন রাখা দরকার। সেন্ট সেমভেলের সন্ধান পাওয়ার যতগুলো জায়গা হতে পারে, তার মধ্যে সেন্ট গ্রেগরি চার্চ একটি। তাছাড়া পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিকের সাথে সেন্ট গ্রেগরির যে কথাবার্তা হয়েছিল, তার মধ্য দিয়ে তার প্রো-র্যাডিক্যাল মেসেজ কিছুটা ফুটে উঠেছিল। তার নিরুপদ্রব সাক্ষাৎ আহমদ মুসার পাওয়া দরকার। পেছনে আসা ফেউকে সরাতে না পারলে সেটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে।
ড্রাইভার, এ রাস্তার পাশে কোথাও পার্কজাতীয় বা কোন স্পেস আছে, যেখানে কিছুক্ষণের জন্যে যাওয়া যায়। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার ইচ্ছা, অনুসরণকারীর গাড়িও সেখানে যাক। ব্ল্যাক টাইগারের কাউকেই এ পর্যন্ত জীবন্ত ধরা যায়নি। তাকে যদি ধরা যায়, তাহলে বিরাট কাজ হবে। সেন্ট সেমভেল সম্পর্কে জানা এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি কাজ।
হ্যাঁ স্যার। আমাদের রাস্তার এ পাশেই একটা পার্ক আছে। কিন্তু সেটা সংরক্ষিত। তবে গেটের বাইরের চত্বরটাও বিরাট। ট্যাক্সিওয়ালা বলল।
ঠিক আছে ঐ চত্বরে গেলেই চলবে। বলল আহমদ মুসা।
ফাঁকা রাস্তা। ছুটে চলেছে আহমদ মুসার ট্যাক্সি।
দিভিনের পুরাকীর্তি এলাকায় সাধারণ জনবসতি নেই বললেই চলে। তবে পুরাকীর্তি এলাকার খনন ও অন্যান্য কাজের সাথে জড়িত লোকদের অস্থায়ী আবাস এখানে আছে। এর সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনরাও এই পুরাকীর্তি এলাকায় বাস করে। সব মিলিয়েও এই বসতি দৃষ্টিগোচর যোগ্য নয়। তাই সবগুলো রাস্তাই শুনসান। গাড়ি, ঘোড়া, লোকজন চোখে না পড়ার মত। শুধু পুরাকীর্তির ভেন্যুগুলোতেই লোকজন আছে, দোকান-পাট ও গাড়ি-ঘোড়ার কিছু জট দেখা যায়। সেখানে।
অনেকটা কাছাকাছি এসে ট্যাক্সিওয়ালা বলল, স্যার, আমরা এসে গেছি। ঐ তো সামনেই গাড়ি ডান দিকে টার্ন নিতে হবে।
টার্ন নেবার আগে আহমদ মুসা পেছনে তাকাল। দেখল, পেছনে আরও তিনটা গাড়ি অনুসরণকারী গাড়ির পেছনে আসছে। ভ্রু কুঁচকে গেল আহমদ মুসার। নতুন তিনটা গাড়ি কি অনুসরণকারীর সাথী, না ব্যাপারটা কাকতালীয়। গাড়ি চারটা আহমদ মুসার গাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।
আহমদ মুসার গাড়ি দুতিন বার হর্ন দিয়ে উঠল। তার সাথে ড্রাইভার বলছে, দেখুন স্যার, কাণ্ড দেখুন।
হর্নের শব্দ ও ড্রাইভারের কণ্ঠ শুনে আহমদ মুসা সামনে তাকাল। দেখল, চারটি গাড়ি এসে তার গাড়ির সামনে দাঁড়াচ্ছে। এই গাড়ি চারটাকে আহমদ মুসা পার্কের দিক থেকে রাস্তার দিকে আসতে দেখেছিল। ওগুলোও ব্ল্যাক টাইগারদের গাড়ি!
আহমদ মুসার গোটা শরীরে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। বুঝতে তার একটুও কষ্ট হয়নি, অনুসরণকারীকে ফাঁদে ফেলতে গিয়ে সে নিজেই ফাঁদে পড়েছে। সামনে ও পেছন থেকে আটটি গাড়ি ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার উপর।
গাড়ি দাঁড় করাও ড্রাইভার। বলে আহমদ মুসা শোল্ডার হোলস্টার থেকে হ্যান্ড মেশিনগানের নতুন সংস্করণ অর্থাৎ রিভলবার সাইজের মেশিন রিভলবার, যার ব্যারেল মিনিটে ৩০০ গুলি উদগীরণ করে, তা বের করে নিল। সেই সাথে জ্যাকেটের পকেট থেকে পিংপং বলের সাইজের দুটি স্মোক বোমা বের করে নিল।
তুমি গাড়ির ফ্লোরে শুয়ে পড় ড্রাইভার। বলে আহমদ মুসা হ্যান্ড মেশিন রিভলবারের বাট দিয়ে উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে ফেলে একটা পিংপং বল ছুঁড়ে দিল সামনে। তারপর লাফ দিয়ে সিট ডিঙিয়ে ডান দিকের দরজা খুলে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। কিছুটা গড়িয়ে গিয়ে আরেকটা বল ছুঁড়ে মারল পেছনের গাড়িগুলো লক্ষে।
গুলিবৃষ্টি তখন শুরু হয়ে গেছে সামনে ও পেছন থেকে। তার সাথে কালো গাঢ় ধোঁয়ার মধ্যে ঢাকা পড়ল গাড়িগুলো এবং আশপাশ।
আহমদ মুসা গড়িয়েই ডান পাশের ফুটপাতে গিয়ে উঠল। আহমদ মুসা দেখল, গাড়ির সামনে ও পেছন থেকে কয়েকজন গুলি করতে করতে ধোঁয়ার বাইরে চলে এল। তাদের চোখ গাড়ির দিকে। গাড়ি লক্ষেই তারা গুলি ছুড়ছে।
আহমদ মুসার দুই হাতে মেশিন রিভলবার। ফাঁকা গুলি ছুড়ল আহমদ মুসা।
দুপাশ থেকেই ওরা পেছনে ফিরে তাকাল। আহমদ মুসাকে দেখেই ওরা ওদের স্টেনগান ঘুরিয়ে নিচ্ছিল।
আহমদ মুসার দুই হাতের মেশিন রিভলবার দুই পাশের লক্ষের দিকে তাক করা ছিল। মাথাটা একটু উঁচুতে তুলে আহমদ মুসা চিৎকার করে বলল, তোমরা স্টেনগান ফেলে দাও।
কিন্তু বেপরোয়া ওরা। ঘুরে আসছিল ওদের স্টেনগান।
আহমদ মুসার দুই তর্জনি দুই ট্রিগারে চেপে বসল।
দুপাশের ওরা আটজন তাদের স্টেনগান ঘুরিয়ে নিয়ে ট্রিগার টেপার আগেই আহমদ মুসার মেশিন রিভলবারের গুলিবৃষ্টি ওদের উপর গিয়ে পড়ল। ওরা মাটিতে পড়ে মুহূর্তেই লাশ হয়ে গেল।
মাথা নিচু করে শুয়ে থেকে কিছু সময় অপেক্ষা করল আহমদ মুসা। না, গাড়িগুলো থেকে আর কেউ বেরুল না। ওদিকের গুলি বর্ষণও বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে কি প্রত্যেক গাড়িতে একজন করেই ছিল! হতে পারে, ওরা প্রত্যেকেই দিভিনের বিভিন্ন রাস্তায় পাহারা দিচ্ছিল। টেলিফোন পেয়ে এখানে এসেছে আহমদ মুসাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে। ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত নয়, অবস্থার সৃষ্টি।
আহমদ মুসা মাথা তুলে বসল। দাঁড়াতে যাচ্ছিল।
যেমন আছ, তেমনি থাক আহমদ মুসা। মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও! সেন্ট সেমভেলকে খুঁজতে এসেছিলে না? তার রাজধানীকে তুমি অপবিত্র করেছ। তার শাস্তি এখন গ্রহণ কর।
যে কণ্ঠের এসব উচ্চারণ, সে কণ্ঠ যেন তার পিঠের উপর। একটা ধাতব নলের আঘাত আহমদ মুসা অনুভব করতে পারছে তার মাথায়। এ নিশ্চয় ব্ল্যাক টাইগারদের একজন। রিয়ারগার্ড হিসেবে সে কি পার্কের দিকে রয়ে গিয়েছিল? আহমদ মুসার সমস্ত মনোযোগ সামনের দিকে থাকায় পেছনের দিকের কথা তার মনে আসেনি।
মাথার পেছনে একটা ধাতব শব্দ হলো। এ শব্দ আহমদ মুসা চেনে। গুলি বর্ষণের জন্যে রিভলবারের শেষ প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো।
সব সময়ের মত আত্মরক্ষার ছক মাথায় তার রেডি। সমস্ত মনোযোগ একত্রিত করে দেহটাকে নিচের দিকে অর্ধচন্দ্রাকারে ছুঁড়ে দিয়ে আক্রমণে ফিরে আসার জন্যে আহমদ মুসা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
পেছন থেকে একটা গুলির শব্দ হলো। গুলিটা আহমদ মুসাকে আঘাত করেনি, এটা অনুভব করেই বোঁ ঘুরে দাঁড়াল সে। দেখল, পেছনের লোকটি মাথায় গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। সামনে তাকিয়ে দেখল, একটা গাড়ি পার্কের দিকে যাওয়া রাস্তা থেকে ছুটে বেরিয়ে পার্কের ডাইভারশন রোড দিয়ে চলে যাচ্ছে। আহমদ মুসা গাড়ির নাম্বার দেখার চেষ্টা করেও পারল না। বেশ দূরে চলে গেছে গাড়িটি। কে হতে পারে তার এই সাহায্যকারী? দিভিনে তো এমন কেউ নেই! তাহলে ইভা নারিন? ইভা নারিন হলে এভাবে চলে যাবে কেন?
পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পেল আহমদ মুসা। দুই দিক থেকেই ওরা আসছে। কে খবর দিল ওদের?
এসে গেল পুলিশের গাড়ি।
গাড়ি থেকে পুলিশরা নামল।
দুদিক থেকে দুজন অফিসার আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে আসছে।
পুলিশ অফিসারকে কি বলতে হবে, তা গুছিয়ে নিল আহমদ মুসা।
দুজন অফিসারই আহমদ মুসাকে স্যালুট করে বলল, স্যার আপনি ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। তবে আমার ট্যাক্সি ড্রাইভার ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে। গাড়িটা তো ওরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
বলে আহমদ এগোলো ট্যাক্সির দিকে। পুলিশ অফিসার দুজনও আহমদ মুসার সাথে চলল
ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল। আহমদ মুসাকে দেখে গাড়ির ফ্লোরে শোয়া ট্যাক্সি ড্রাইভার সিটের উপর উঠে এল।
তুমি ভালো আছ? বলল আহমদ মুসা।
জি স্যার, আমি ভালো আছি। ড্রাইভার বলল।
আহমদ মুসা তাকে টেনে গাড়ির ভাঙা জানালা দিয়ে বের করে আনল। বলল, তোমার কোন চিন্তা নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আহমদ মুসা ফিরল দুজন অফিসারের দিকে। বলল, সবই তো দেখছেন, বলুন আমি আপনাদের কি সহযোগিতা করতে পারি।
স্যার, আমরা সব জেনে গেছি। আপনি চলে যেতে পারেন। শুধু ট্যাক্সিওয়ালার ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার দরকার, সাক্ষী হিসাবে তার দরকার হতে পারে। ট্যাক্সিটাকেও আমরা এভিডেন্স হিসাবে নিয়ে যাব। একজন অফিসার বলল।
ধন্যবাদ। ড্রাইভারের ওগুলো লিখে নিন। কিন্তু অফিসার আপনারা এই ইনসিডেন্টের কথা এত তাড়াতাড়ি জানতে পারলেন কি করে?
একজন ড্রাইভারের বিষয়গুলো লিখে নিচ্ছিল। আরেকজন পুলিশ, অফিসার বলল আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তরে, আমাদের দুজনকে টেলিফোনে জানানো হয়েছে। জানিয়েছেন দিভিন পুলিশের একজন বড় কর্তা। ঠিক আছে স্যার, আমরা এদিকটা দেখছি। আপনাকে কি একটা গাড়ি ডেকে দেবো স্যার?
কি বল ড্রাইভার? বলল আহমদ মুসা ড্রাইভারকে লক্ষ করে।
ঠিক আছে গাড়ি আমরা পেয়ে যাব স্যার। চলুন। ড্রাইভার বলল। পার্কের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে এসে ট্যাক্সি পাওয়া গেল। ট্যাক্সি ড্রাইভার পরিচিত আহমদ মুসার ড্রাইভারের।
কোথায় যাব স্যার? আহমদ মুসার ড্রাইভার বলল।
যেখানে তোমার গাড়িতে উঠেছিলাম, সেখানেই ফিরে চল। সেন্ট গ্রেগরি চার্চে যাওয়া আর হলো না। বলল আহমদ মুসা।
সবটা আমার কাছে ভয়ংকর স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আমার ভেতরটা এখনও কাঁপছে স্যার। আমাদের গাড়িটারই শুধু ক্ষতি হলো তা নয় ওরাও তো নয়জন মারা গেল আপনার হাতে। কিন্তু ওরা তো এসেছিল আপনাকে মারতে। ধন্যবাদ স্যার আপনাকে। আহমদ মুসার ড্রাইভার বরল।
ধন্যবাদ কেন? তোমার গাড়ি তো শেষ হলো আমার জন্যে। তোমার ট্যাক্সির দাম কত ছিল? বলল আহমদ মুসা।
ছয় মাস আগে সেকেন্ড হ্যান্ড কিনেছিলাম ১০ লাখ ড্রাম দিয়ে। ড্রাইভার বলল।
নতুন ট্যাক্সির দাম কত? বলল আহমদ মুসা।
বিশ থেকে পঁচিশ লাখ ড্রাম স্যার। ড্রাইভার বলল।
আচ্ছা। বলল আহমদ মুসা।
স্যার যে এলাকায় যাচ্ছি, আমি ঐ এলাকায় থাকি স্যার। বলল নতুন ট্যাক্সি ড্রাইভার।
তোমার বাড়ি বোধ হয়? বলল আহমদ মুসা।
না স্যার। এক স্যারের গ্যারেজের পাশে একটা কক্ষে থাকি। স্যারের গ্যারেজে তিনটা ট্যাক্সি আছে। স্যার কি এ এলাকায় থাকেন?
না, আমি একজন ট্যুরিস্ট। একটা ডরমিটরিতে উঠেছি।
আহমদ মুসা এসে পৌঁছল তার নেমে যাবার জায়গায়।
আমাদের এখানেই নামিয়ে দাও ড্রাইভার। বলল আহমদ মুসা।
এখানে কেন স্যার, আপনার ডরমিটরিতে নামিয়ে দেব।
কাজ আছে, এখানেই নামব। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে স্যার। নতুন ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল। তার কণ্ঠে হতাশার সুর।
তার এই হতাশা আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সে মনে মনে। হাসল ও বলল, তোমার বকশিশ কমবে না ড্রাইভার।
গাড়ি থেমে গিয়েছিল নতুন ড্রাইভার।
আহমদ মুসা মিটার দেখে নিয়ে ভাড়ার উপর আরও এক হাজার ড্রাম দিয়ে দিল। আহমদ মুসা ও ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামল।
একদম সামনেই অ্যাভেনিউটি ডান দিকে টার্ন নিয়েছে।
ট্যাক্সি নিয়ে নতুন ড্রাইভার চলে গেল সেদিকে।
আহমদ মুসা ক্ষতিগ্রস্ত ড্রাইভারকে পাঁচ হাজার ডলারের একটা চেক দিয়ে বলল, যেকোন ব্যাংকে এটা ভাঙাতে পারবে। এই টাকা দিয়ে একটা নতুন গাড়ি কিনে নিও।
ট্যাক্সি ড্রাইভার চেকটি চোখের সামনে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল এত টাকা স্যার! আমার গাড়িটা ছিল মাত্র ১০ লাখ ড্রামের।
রাখ, মনে কর তোমার এক ভাই তোমাকে এটা দিয়েছে। আর গাড়ি কিনতে পারলে আগামীকাল বেলা দশটায় এখানে এস।
আজই কিনে ফেলব। ঠিক কাল দশটায় আমি আসব।
ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। গুড বাই।
বলে আহমদ মুসা পা বাড়াল তার ডরমিটরিতে ফেরার জন্যে। ঠায় দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে রইল বিস্মিত-বিমোহিত ড্রাইভার।
.
রাত ১০ টা। আহমদ মুসা তার ছোট ডরমিটরির ড্রইংরুমে সেদিনের খবরের কাগজ দেখছিল, তার সাথে টিভির দিকেও নজর রেখেছিল। ডরমিটরিটি ভাড়া নিয়েছে আহমদ মুসা।
ইভা নারিন তার পিতার পক্ষ থেকে তার গোয়েন্দা চ্যানেলে এ ডরমিটরি ঠিক করে দিয়েছে। কয়েকদিনের জন্যে ভাড়ার কথা বলেছিল আহমদ মুসা, কিন্তু দেখা গেল, পনের দিনের কমে ভাড়া দেয়া হয় না। ডরমিটরি ভাড়া নেয়ার এটাই নাকি সর্ব নিম্ন মেয়াদ।
ভালো লোকেশনে ডরমিটরিটা। পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রাইভেট ধরনের রাস্তা। বেশ প্রশস্ত। পূর্বদিকে একটা ঝিলের মত। শুধু উত্তর দিকে লাগোয়া একটা বাড়ি।
ছোট সুন্দর ডরমিটরিতে একটা বেড রুম, একটা লিভিং রুম এবং কিচেন-ডাইনিং রয়েছে।
উঁচু একটা টিলার মত স্থানে তৈরি ডরমিটরিটা। একতলা এসব ডরমিটরির ভাড়া প্রচুর। আহমদ মুসা ইভা নারিনকে জিজ্ঞাসা করেছিল ভাড়া কত দিতে হয়েছে বা দিতে হবে। ইভা নারিন সোজা জবাব দিয়েছে, এই জিজ্ঞাসা বাবাকে করবেন। তার নির্দেশেই আমি সবকিছু করেছি। আহমদ মুসা বুঝেছে, এই যুক্তি তুলে ইভা নারিন ডরমিটরির ভাড়ার ব্যাপারকে ক্লোজ করে দিয়েছে।
টেলিভিশনে সন্ধ্যার প্রধান খবর শুরু হলো। আহমদ মুসা হাতের পত্রিকা থেকে মুখ সরিয়ে তাকাল টেলিভিশনের দিকে। উদ্দেশ্য, আজ পার্কের সামনে যে বিরাট ঘটনা ঘটেছে, তাকে আর্মেনিয়ার টেলিভিশন কিভাবে প্রচার করে তা দেখা।
প্রচার হলো নিউজটা। নিউজে বলা হলো, শহরের সংরক্ষিত সেন্ট্রাল পার্কের অ্যাপ্রোস রোডের সামনে এনদিন আয়াপ রোডে এক সংঘর্ষে নয়জন সন্ত্রাসী মারা গেছে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, দক্ষিণ আর্মেনিয়ার আরিশ মধ্য উপত্যকায়- যাকে ওখানকার অধিবাসীরা দিভিন বলে, সেখানকার কয়েকটি ঘটনায় যেসব সন্ত্রাসী, যারা মারা পড়েছে, আজকের নিহত সন্ত্রাসীদের সাথে তাদের মিল আছে। তারা সকলেই একটা সন্ত্রাসী দলের সদস্য বলে মনে করা হচ্ছে। তদন্ত চলছে।
খবর দেখে মিষ্টি হাসল আহমদ মুসা। টিভি আহমদ মুসাকে সবদিক থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ধন্যবাদ পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক।
আহমদ মুসা টেলিফোন করল ইভা নারিনকে।
আসোলামু আলাইকুম। দিভিনের নিউজটা দেখেছ ইভা নারিন? বলল আহমদ মুসা।..
দেখেছি। কেন? ইভা নারিন বলল।
তোমার বাবাকে আমার ধন্যবাদ দিও। আমার গায়ে আঁচড়ও লাগতে দেননি তিনি। বলল আহমদ মুসা।
আব্বার তরফ থেকে আমি আপনাকে ওয়েলকাম করছি। আরেকটা খবর আছে। ইভা নারিন বলল।
কি সেটা? বলল আহমদ মুসা দিভিনের পুলিশ প্রধানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি আপনাকে আক্রমণকারী সাজিয়ে সন্ত্রাসীদের আক্রান্ত সাজাতে চেষ্টা করেছিলেন। ইভা নারিন বলল।
আলহামদুলিল্লাহ। তিনি মহাউপকার করেছেন। তাঁকে প্লিজ আমার কৃতজ্ঞতা জানাবে। সত্যি…।
আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে ইভা নারিন বলে উঠল, ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতার পালা এটা নয়। আপনি শুধু আপনার কাজ করছেন না, আর্মেনিয়ারও কাজ করছেন। এখন বলুন, সেন্ট সেমভেল কি দিভিনে আছে বলে আপনি মনে করেন?
আগে সন্দেহ করতাম যে তিনি এখানে থাকতে পারেন। আজকের ঘটনার পর আমি নিশ্চিত যে, দিভিনেই তার হেডকোয়ার্টার এবং তিনি দিভিনেই আছেন।বলল আহমদ মুসা।
এমন নিশ্চিত হলেন কি করে? জিজ্ঞাসা ইভা নারিনের।
তুমি নবম যে লোককে গুলি করে মেরে আমাকে বাঁচিয়েছ, সেই লোক আমার মৃত্যু নিশ্চিত জেনে বলে দিয়েছিল, দিভিন সেন্ট সেমভেলের রাজধানী, তাকে আমি অপবিত্র করেছি। তারই শাস্তি হিসাবে আমাকে। গুলি করে মারতে যাচ্ছিল সে।
আমি তাকে গুলি করে মেরেছি, এটা আপনি জানলেন কি করে? আমি তো ইয়েরেভেনে। ইভা নারিন বলল।
আমি জানি না, আমি বুঝেছি। আমাকে এইভাবে সেভ করার আর কেউ দিভিন বা আর্মেনিয়ায় নেই।
একটু থেমেই আহমদ মুসা বলল, থাক, আমি তোমাকে ধন্যবাদ দেইনি। ধন্যবাদ পাবার চেয়েও অনেক বড় কাজ তুমি করেছ। আল্লাহ তোমাকে এর জাযাহ দিন। আচ্ছা ইভা নারিন, এখন রাখি। আসোলামু আলাইকুম।
ওয়া আলাইকুম সালাম। ইভা নারিন বলল। তার গলা ভারি।
আহমদ মুসা আবার পত্রিকার পাতায় ফিরে এল।
ডরমিটরির পেছনের দরজায় নক হলো। পত্রিকা রেখে আহমদ মুসা উৎকর্ণ হলো। নক হলো আরও দুবার। ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। পেছনের দরজায় নক করবে কে? আহমদ মুসা উঠল। আরও দুবার নক হলো। নক করার মধ্যে শক্তির প্রকাশ নেই, আছে ভীতি ও দ্বিধার ভাব।
আহমদ মুসা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। এ দরজার পরেই একটা পায়ে চলার পথ ঝিলের ধার দিয়ে গেছে। + সাবধান হয়েই আহমদ মুসা দরজা খুলল। জ্যাকেটের রিভলবারে তার ডান হাত।
দরজা খুলে যেতেই ওপার থেকে বলল, আমি ড্রাইভার গোহার স্যার।
তুমি? এত রাতে? আহমদ মুসা তাকে ভেতরে টেনে নিতে নিতে বলল।
স্যার, মাফ করবেন, একটা খবর দিতে এসেছি। ড্রাইভার গোহার বলল।
খবর? কি খবর? ড্রইংরুমে সোফায় বসতে বসতে বলল আহমদ। মুসা।
ড্রাইভার গোহার সোফায় না বসে, মেঝেতে কার্পেটের উপর বসতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে মেঝেয় বসতে নিষেধ করে সোফায় বসতে বলল।
ড্রাইভার ইতস্তত করে বলল, স্যার, আমি দাঁড়িয়ে থেকে দুএকটা কথা বলেই চলে যাব।
না, বসার আগে কোন কথা নয়। আগে বস, তারপর কথা বল। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দূরের সোফার এক কোণে গিয়ে বসল সে।
বল, কি খবর? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
খবরটা হয়তো তেমন কিছু নয়, কিন্তু আমার মনে হয় বিষয়টা আপনার জানা দরকার। মনে হয় আপনার শত্রু অনেক। ড্রাইভার গোহার বলল।
ধন্যবাদ। বল। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, আপনি চলে এলে আমি রাস্তার ওপাশে মোড়ের উপরই একটা দোকান থেকে খাবার কিনছিলাম। আমার চোখ হঠাৎ কেন জানি গিয়েছিল রাস্তার ওপাশে যেখান থেকে আমি এসেছিলাম সেখানে। দেখলাম যার ট্যাক্সিতে আমরা এলাম, সেই ড্রাইভার গুরেন হন্তদন্ত হয়ে আপনি যেদিকে যাচ্ছেন সেও সেদিকে যাচ্ছে। তার সাথে গাড়ি নেই আর তার বাড়ি আরও দক্ষিণে এ এলাকার অনেক বাইরে। হঠাৎ আমার মন বলল, সে আপনার খোঁজে যাচ্ছে। হয়তো কোন কাজে কিংবা কোন খারাপ উদ্দেশ্যে। আমি তাড়াতাড়ি খাবার দাম চুকিয়ে দিয়ে তার পিছু নিলাম। আমি দূর থেকে অনুসরণ করলাম, যাতে তার কাছে আমি ধরা না পড়ে যাই। সে আপনাকে দেখতে পাওয়ার পর আস্তে এবং লুকিয়ে লুকিয়ে চলতে লাগল। বুঝলাম, আপনার সাথে কোন ব্যাপারে সাক্ষাৎ করা তার লক্ষ নয়, অন্য কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে। আপনি আপনার ডরমিটরিতে ঢুকলে সে এই বাড়ির নাম্বার টুকে নিল। তারপর একটা আড়াল নিয়ে বাড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। প্রায় এক মিনিট। তারপরে টেলিফোনে কারও সাথে কথা বলল। তারপর সে ফিরে গেল। সে চলে গেলে একটু পরে অন্য রাস্তা ধরে আমিও চলে গেলাম। থামল ড্রাইভার। গোহার।
আহমদ মুসা মনোযোগের সাথে ড্রাইভার গোহারের কথা আর তাকে পরখ করছিল। তার কথাবার্তা, তার চেহারা, সবমিলিয়ে গোহারকে কোন দিক দিয়েই সন্দেহ করতে পারল না আহমদ মুসা। ট্যাক্সিতে যাবার সময় গোহারের অকপট কথাগুলোও আহমদ মুসা বিবেচনা করেছে।
গোহারের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ট্যাক্সি ড্রাইভার গুরেনকে কতদিন ধরে চেন?
স্যার, সে আগে ম্যাসিস-এ গাড়ি চালাত। দুবছর আগে সে দিভিনে আসে। সেই থেকে সে দিভিনে আছে, গাড়ি চালাচ্ছে। গোহার বলল।
তার সম্পর্কে আর কি জান? তোমার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা কেমন? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, তার সাথে আমাদের সম্পর্ক কাজ নিয়ে। মাঝে মাঝেই তার কাছ থেকে আমরা কাজ পাই। তা থেকে ভালো পয়সা আসে। গোহার বলল।
কি ধরনের কাজ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
লোক নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা। তাতে ভালো ভাড়া পাওয়া যায়, তার সাথে বকশিশও। গোহার বলল।
বলতে পার গোহার, সাধারণত কোথা থেকে লোক নিয়ে যাওয়া হয়, কোথা থেকে আনা হয়? বলল আহমদ মুসা।
একটু চিন্তা করল গোহার। বলল, বিশেষ করে এয়ারপোর্ট, রেল স্টেশন, আন্ত:শহর বাস স্টেশন থেকে তোক নিয়ে আসা হয়, পৌঁছে দেয়া হয়। গোহার বলল।
সাধারণত ঐ সব স্থান থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় লোকদের? বলল আহমদ মুসা।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেন্ট গ্রেগরি গির্জায় আনা হয়। গোহার বলল।
আচ্ছা, সেন্ট গ্রেগরি গির্জা কমপ্লেক্সে গির্জা রয়েছে, গির্জার। সেবায়েত-কর্মচারীদের আবাস রয়েছে, আর রয়েছে সেন্ট গ্রেগরির বাসা। গির্জাতে তো ঢুকেছই। এছাড়া আর কোথাও গেছ কিনা? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, একদিন আহত লোক নিয়ে সেন্ট গ্রেগরি গির্জায় গিয়েছিলাম। আমার গাড়ি গির্জায় না নিয়ে সেন্ট গ্রেগরির বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। গাড়ি থেকে আহত লোকটিকে আমিই বহন করে এনেছিলাম। সেন্ট গ্রেগরির বাড়িতে ঢুকে একটা সিঁড়ি দিয়ে আহত লোকটিকে আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে গিয়েছিলাম। যে ঘরে নিয়ে তাকে রেখেছিল, সেটা আমার মনে হয় সেন্ট গ্রেগরির বাড়ির বেশ উত্তরে হবে। আবার ফিরে এসেছিলাম গির্জার পাশের একটা ঘর দিয়ে। ঐ একবারই সেন্ট গ্রেগরির বাড়িতে ঢুকেছিলাম। গোহার বলল।
আহমদ মুসার যুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। বলল, আহত লোকটি কি গুলিবিদ্ধ ছিল গোহার?
জি হ্যাঁ, স্যার। পাঁজরে গুলিবিদ্ধ ছিল। গোহার বলল।
যেখানে তাকে নিয়ে গিয়েছিলে, সেটা কি ক্লিনিকের মত কিছু? বলল আহমদ মুসা।
তাই মনে হয়েছে। ঐ ধরনের যন্ত্রপাতি, বেড দেখেছি। ঔষধেরও গন্ধ পেয়েছি। গোহার বলল। টি চার্চের ঘর দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে উঠেছিলে, সেটা চার্চের দক্ষিণ পাশে, না পূর্ব বা পশ্চিম পাশে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
দক্ষিণ পাশে। লিফট রুমের কাছে কক্ষটি, কিন্তু কক্ষটি বড়। গোহার বলল।
তুমি সিঁড়ি দিয়ে, না লিফট দিয়ে উঠেছিলে? বলল আহমদ মুসা।
সিঁড়ি দিয়ে উঠেছি। কিন্তু লিফটও দেখেছি। গোহার বলল।
আন্ডারগ্রাউন্ডে তুমি কি শুধু ঐ ক্লিনিকই দেখেছ? বলল আহমদ মুসা।
ন্যা স্যার, অনেক ঘর। অনেকটা প্রাসাদের মত সুন্দর। গোহার বলল।
ধন্যবাদ গোহার। তুমি অনেক কথা বলেছ, অনেক তথ্য দিয়েছ। বলল আহমদ মুসা।
আমি যাই স্যার। বলে গোহার উঠে দাঁড়াল। যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়িয়েও আবার ফিরল। বলল, স্যার, আপনার ঐ সাংঘাতিক শত্রুদের। সেন্ট গ্রেগরি গির্জার সাথে সম্পর্ক আছে?
গোহার, আমি সন্ধান করছি। এখনও পুরো নিশ্চিত হইনি।
স্যার, আমি যেদিন আহত লোকটিকে ঐ আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাই, তখন পাশের রুমের দুজনের কথা শুনেছিলাম। সে কক্ষের ওয়াশরুমে আমি রক্তমাখা জামা-কাপড় ছাড়ছিলাম এবং হাত মুখ পরিষ্কার করছিলাম। একজন বলছিল, আহমদ মুসাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে না দিতে পারলে আমরা নিরাপদ নই। সে যদি বেঁচে থাকে, তাকে কোনও ভাবেই আটকানো যাবে না। এমনকি এখানেও এসে পড়তে পারে। এখন পুলিশও তার পক্ষে গেছে। তার কথায় বাধা দিয়ে আরেকজন বলল, মরার আগে মরে যেও না। সে অজেয় নয়। এখানে যেদিন আসবে সেটা হবে তার শেষ দিন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঢুকলে দুতিন সেকেন্ডেই সে লাশ হয়ে যাবে। আসুক সে এখানে।
বলে একটু থেমেই সে বলল, স্যার, মাফ করবেন, আপনিই কি আহমদ মুসা?
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। বলল, এমনটা তোমার মনে হলো কেন?
আজ আটজন মারাত্মক অস্ত্রধারী লোক আপনার হাতে যেভাবে মারা গেল এবং পুলিশ যেভাবে আপনাকে সম্মান করল ও অনুগতের মত কাজ করল, তাই দেখে হঠাৎ আমার এটা মনে হয়েছে। গোহার বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, তোমার মনে হলে এটা ধরে নিতে পার।
এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে গোহার আহমদ মুসার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে লম্বা একটা বাউ করল।
এভাবে তুমি আমাকে বাউ করলে কেন? বলল আহমদ মুসা।
আপনি মুসলিম এবং আপনি মজলুম মানুষের নিঃস্বার্থ সাহায্যকরী। গোহার বলল।
হাসপাতালের একজন নার্সের কাছে আহমদ মুসা সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি স্যার। নার্সটি মুসলমান। কিন্তু নাম আর্মেনিয়ান। গোহার বলল।
আচ্ছা গোহার তোমার নাম তো আর্মেনিয়ান নয়, ইরানিয়ান নামের অপভ্রংশ। বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে কথা বলল না গোহার। মাথা নিচু করেছিল। মাথা নিচু রেখেই বলল, আমি দাদীর কাছে শুনেছি আমাদের পূর্বপুরুষরা নাকি মুসলমান ছিল। ইরানের জাহেদান থেকে বহু যুগ আগে এসেছিল ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে আর্মেনিয়ায়। এক রাজনৈতিক গণ্ডগোলের সময় নিজেদের বাঁচাবার জন্যে খৃস্টান নাম গ্রহণ করে এবং পরে খৃস্টানই হয়ে যায়। আমার নাম রেখেছিলেন আমার দাদী। থামল গোহার। তার গলাটা ভারি।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে গোহারের মাথায় হাত রাখল। বাম হাত দিয়ে। তার মুখটা তুলে ধরল। দেখল তার দুই চোখ ভরা পানি। আহমদ মুসা চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, দুঃখ কেন? আসলে তোমার নাম গাওহার। আমার এক ভাই তুমি। যাও, কাল দশটায় গাড়ি নিয়ে এস।
গাওহারের দুই চোখের পানি আরও বেড়ে গিয়েছিল। দুই হাতে চোখ মুছে আপনি সাবধান থাকবেন স্যার বলে ঘুরে দৌড় দিল পেছনের দরজার দিকে।
.
রাত তিনটায় তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আবার শুয়েছিল আহমদ মুসা। গাওহার চলে যাবার পরই সে ঘুমিয়ে পড়ে। আহমদ মুসা নিশ্চিত ছিল, রাতের অতিথিরা যদি আসেই, তাহলে আসবে তারা রাত ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে। পশ্চিমী কালচারে এটাই গভীর ঘুমের সময়।
শুয়ে থেকে সদ্য পাওয়া জেনস ডিফেন্স জার্নালে চোখ বুলাচ্ছিল আহমদ মুসা। কিন্তু ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসায় জার্নাল পড়া হলো না। জার্নাল রেখে হাত বাড়িয়ে বেড সুইচ অফ করে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা।
শুয়ে পড়ার সাথে সাথে একটা চিন্তা তার মাথায় ঝড়ের মত প্রবেশ করল। সেন্ট গ্রেগরি চার্চ ব্ল্যাক টাইগারদের একটা ঘাঁটি বা প্রধান ঘাঁটি হতে পারে, কিন্তু সেন্ট সেমভেল সম্পর্কে তো কিছুই জানা গেল না। দিভিন সেন্ট সেমভেলের রাজধানী। সাধারণত রাজধানীতে রাজা থাকেন। সেন্ট সেমভেল কি এখানে আছেন। সেন্ট গ্রেগরি কি তিনিই। এর কোন প্রমাণ নেই। সেন্ট সেমভেল তিনি হতে পারেন, নাও হতে পারেন। সেন্ট গ্রেগরি চার্চের প্রধান, কিন্তু সেন্ট সেমভেল তো একটা চরমপন্থী সন্ত্রাসী দলের প্রধান। দুয়ের প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। আহমদ মুসার মনে হলো সেন্ট গ্রেগরির সাথে তার একটা সাক্ষাৎ দরকার। এই সাক্ষাতে তার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে।
চোখের ঘুম কোথায় উবে গেল আহমদ মুসার। এপাশ ওপাশ করে আহমদ মুসা বেড সাইড আলো জ্বালতে যাচ্ছিল। হঠাৎ বাইরে ধাতব কিছু পড়ার শব্দ হলো। খুবই ছোট শব্দ। কিন্তু নিঃশব্দ রাতে ঐ শব্দটুকুও কানে ভালোভাবেই এসে প্রবেশ করল তার।
আহমদ মুসা হাত টেনে নিল সুইচ থেকে। প্রায় শ্বাসরুদ্ধভাবে অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। স্থির দৃষ্টি দরজার দিকে। না, দরজায় কোন প্রকার শব্দ নেই। উঠল আহমদ মুসা। এ বিড়ালের মত নিঃশব্দে গেল দরজার কাছে। দরজার পাল্লার নিচের
প্রান্ত এবং মেঝে এই দুয়ের মাঝ বরাবর বাইরের ডিম লাইটের অস্পষ্ট, আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ দেখতে পেল হালকা হলুদ রঙের ফাঁপা তার প্রবেশ করছে ঘরের মধ্যে।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। আবার ওদের গ্যাস-আক্রমণ? সংজ্ঞালোপকারী গ্যাস, না প্রাণ সংহারক?
আহমদ মুসা দ্রুত সরে এসে বালিশের তলা থেকে গ্যাস-মুখোশ পরে নিল।
বেডসাইড সোফায় এসে বসল আহমদ মুসা। কি ঘটতে পারে? ভাবতে লাগল সে। সাধারণভাবে যেটা ঘটার সেটা ঘটবে, আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়বে। তারপর ওরা ভেতরে ঢুকে তাকে ধরে নিয়ে যাবে অথবা মেরে ফেলবে। আরেকটা হতে পারে, গ্যাসটা মৃত্যু বিষ। আহমদ মুসা এ বিষে মারা যাবে। ওরা ভেতরে তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চলে যাবে অথবা তাদের সাফল্যের নিদর্শন হিসাবে লাশটা নিয়ে যাবে। তবে এখন আহমদ মুসার জন্যে একটাই অপশন, ওদের জন্যে অপেক্ষা করা। মেশিন রিভলবারটা পাশে নিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকতে পারে ওরা ঢোকা পর্যন্ত। ঘরের ভেতরে গ্যাস আগেই পাম্প করা হয়েছে।
হাতঘড়ির দিকে তাকাল আহমদ মুসা। প্রায় দশ মিনিট হয়েছে, ওরা গ্যাস পাম্প করার সময় থেকে। ওরা এতক্ষণ নিশ্চিত হয়েছে, আমি সংজ্ঞা হারিয়েছি বা মারা গেছি। অতএব ওদের এখন ঘরে ঢোকার পালা।
আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠল। এগোলে বেডের দিকে শোবার জন্যে।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, ওরা যদি গুলি করার বদলে একযোগে কয়েকজন বোমা ছুঁড়ে, তাহলে হ্যান্ড মেশিন রিভলবার তার মোকাবিলা করতে পারবে না। ওরা তো মরিয়া তাকে মেরে ফেলার জন্যে। সুতরাং তা ওরা করতে পারে। এমন আশংকার কথাই যদি ভাবা হয়, তাহলে দরজার সামনের কোন স্থানই তার জন্যে নিরাপদ নয়।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল এবং বেড ঘুরে দরজার সামনে দিয়ে লিভিং রুমের সাথে যে পার্টিশন ডোর আছে সেদিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল দরজার নিচ দিয়ে আগের তারের পাশ দিয়ে অপেক্ষাকৃত মোটা হালকা লাল একটা তার প্রবেশ করছে। সে দেখল এটা আসলে তার নয়, এক ধরনের সরু নল।
থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ভ্রু কুঞ্চিত হলো তার। এ নল দিয়ে নিশ্চয় তরল কিংবা অন্য কোন গ্যাস বেশি পরিমাণে ঘরের মধ্যে পাম্প করা হবে। দ্রুত প্রবেশ করছে নলটি। আগের তারটা মাত্র দুগজের মত ঘরের ভিতরে ঢুকেছিল। কিন্তু এই নলটি ঘরের মাঝ বরাবর চলে এল। ঘরের মাঝখানে এসে নলটি থেমে গেল।
আহমদ মুসা বসে পড়ল নলের সামনে। পাম্প শুরু হবার জন্যে একটু অপেক্ষা করল আহমদ মুসা। কয়েক মিনিট পার হলো।
নলের মুখে হাত দিয়েই চমকে উঠল আহমদ মুসা। তীব্র বেগে গ্যাসীয় লিকুইড স্প্রে হচ্ছে। আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে বুঝল, সেটি গ্যাসীয় প্রচণ্ড দাহ্য পদার্থ।
ওদের প্ল্যান বুঝে ফেলল আহমদ মুসা। নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাসীয় লিকুইড স্প্রে হবার পর বাহির থেকেই ওরা এতে আগুন ধরিয়ে দেবে। অর্থাৎ আহমদ মুসাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। জ্বালিয়ে দেবে। ঘরে ঢোকার ঝুঁকিও তারা নিতে চাচ্ছে না।
হাসল আহমদ মুসা। উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে হ্যান্ড ব্যাগ ও বেডের উপর থেকে মেশিন রিভলবারটা হাতে নিয়ে পার্টিশন ডোর দিয়ে লিভিংরুম, লিভিংরুম থেকে ডাইনিং কাম-কিচেনে বেরিয়ে এল। কিচেন। থেকে পেছনের গেট দিয়ে বেরুবার একটা দরজা আছে।
পেছনের দরজা থেকে আহমদ মুসার বেডরুম পর্যন্ত জায়গাটা মোটামুটি আলোকিত।
আহমদ মুসা মেশিন রিভলবার শোল্ডার হোলস্টারে রেখে হাতে নিল সাইলেন্সর লাগানো রিভলবার।
আস্তে আস্তে দরজা খুলল আহমদ মুসা। দেখল, পেছনের দরজায় বাইরের দিকে মুখ করে রিভলবার বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন। তারও মুখে গ্যাস মাস্ক।
এই লোকটিকে এভাবে রেখে তার ঘরের বাইরে যারা কাজ করছে, তাদের দিকে এগোনো যায় না।
আহমদ মুসা রিভলবার বাগিয়ে বিড়ালের মত নিঃশব্দে তার দিকে এগোলো। লোকটির দুই গজের মধ্যে পৌঁছে গেছে। আহমদ মুসার ইচ্ছা। তাকে সংজ্ঞাহীন করে ধরে ফেলা।
পেছনে খুব কাছে থেকে রিভলবারের ক্লাচ অন করার শব্দ পেল আহমদ মুসা।
আওয়াজটা বাতাসে ভেসে আসার সাথে সাথেই আহমদ মুসা গাছ থেকে ফল পড়ার মতো পট করে বসে পড়ল এবং সাথে সাথেই ডান হাতের রিভলবারের নল পেছন দিকে ঘুরে গিয়ে শব্দ লক্ষে গুলি করল। এর মুহূর্তকাল আগে আহমদ মুসার পেছন থেকে গুলি হয়েছিল।
আহমদ মুসা গুলি করেই তাকিয়েছিল সামনে দরজায় দাঁড়ানো লোকটার দিকে। সেও ঘুরে দাঁড়িয়ে আক্রমণে আসার কথা। আহমদ মুসার চোখ যখন তার উপর পড়ল, দেখল সে মাথায় গুলি খেয়ে পড়ে গেছে। আহমদ মুসা ঠিক সময়ে বসে পড়তে না পারলে ঐ বুলেটটা তারই মাথা গুঁড়িয়ে দিত। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল, পেছনের লোকটিও কণ্ঠনালিতে গুলি খেয়েছে। গুলিটা মাথার পিছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এগুলিটাই আহমদ মুসা করেছিল।
সামনে থেকে ছুটে আসা পায়ের শব্দ ভেসে এল। এসে পড়েছে। ওরা। আড়াল নেয়ার সময় আর নেই। লাশের পাশে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা মেশিন রিভলবার হাতে রেখে।
লাশগুলো নজরে পড়তেই ওরা থমকে দাঁড়িয়েছে। একজন বলে। উঠল, তিনজনই লাশ? কে কাকে মারল?
চুপ! দেখ ঐ লোকটি আহমদ মুসা কিনা। তার মৃত্যুটা আমাদের দেখার বিষয়, আর সব জাহান্নামে যাক।
মেশিন রিভলবার বাগিয়ে, এক ঝটকায় উঠে বসল আহমদ মুসা। সামনে ওরা পাঁচজন। কিন্তু কারোরই রিভলবার, স্টেনগান গুলি করার পর্যায়ে নেই।
তোমরা অস্ত্র ফেলে দাও। নির্দেশ দিল আহমদ মুসা। কিন্তু ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগারের সবাই সমান বেপরোয়া। আহমদ মুসার কথা শেষ হতে দিল না। সবাই চোখের পলকে তাদের অস্ত্র টার্গেটে তুলে নিচ্ছিল।
আহমদ মুসার তর্জনি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। ট্রিগারে চেপে বসল আহমদ মুসার তর্জনি। ঘুরিয়ে নিল মেশিন রিভলবারের ব্যারেল ওদের পাঁচজনের উপর দিয়ে।
সাতটি লাশের পাশে বসে আহমদ মুসা টেলিফোন করল দিভিন শহরের নতুন পুলিশ প্রধান ভাহান ভাবদানকে। তাকে সব জানাল। ওপার থেকে ভাহান ভাবান বলল, স্যার, আমরা আসছি স্যার। ম্যাডাম ইভা নারিনও টেলিফোন করেছিলেন আপনার বাসায় কয়েকজন প্রবেশ করেছে বলে।
আসুন প্লিজ। বলল আহমদ মুসা।
মোবাইল অফ করতে করতে আহমদ মুসা ভাবল আমার এখানে হামলার বিষয়টা ইভা নারিন জানল কি করে? সেকি পাহারা বসিয়েছে, না সে নিজেই পাহারায় ছিল! না, সে পাহারায় ছিল না। থাকলে এদের পেছন পেছন সে বাড়িতে প্রবেশ করতো।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। সব জেনেও ইভা নারিন কিছুটা বাড়াবাড়িই করছে। অবশ্য তার বাবার অনুমতিতেই সে ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগারের বিরুদ্ধে আহমদ মুসার অভিযানের খোঁজ-খবর রাখছে এবং প্রয়োজনে সাহায্যেও আসছে। এই কাজে বাধা দেবার ইখতিয়ার আহমদ মুসার নেই। তার বাবার লক্ষ আহমদ মুসাকে এই গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে সাহায্য করা।
ভাবনার আরও গভীরে প্রবেশ করল আহমদ মুসার মন। বিস্ময়কর মখলুকাত আল্লাহর এই পৃথিবী! তার চেয়েও বিস্ময়কর মানুষ! সুকৃতির আলো, দুষ্কৃতির কালো দিয়ে সাজানো মানুষের জীবন। মানব প্রজাতির চলমানতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নারী-পুরুষের দুর্লঙ্ এক সম্পর্ক। এই সম্পর্ককেও আল্লাহ সাজিয়েছেন সুকৃতির আলো ও দুষ্কৃতির কালো দিয়ে। সুকৃতির প্রদীপ এখানে প্রজ্বলিত না রাখলে, দুষ্কৃতির কালোতে ভরে যায় জীবন। জীবনকে সুকৃতি অর্থাৎ স্বাভাবিক আলোময় রাখতে হলে ধৈর্য ও ত্যাগের শক্তি দরকার। আহমদ মুসা আনন্দিত যে, ইভা নারিন এই শক্তি অর্জন করছে।
.
৭.
মাই লর্ড, আমাদের লোকদের অযোগ্যতা নয়, আহমদ মুসার অধিকতর যোগ্যতার কারণেই দিভিনেও আমাদের বিপর্যয় ঘটল। আমরা মনে করতাম ক্ষিপ্রতা, মৃত্যুভয় জয় করে বেপরোয়া হয়ে উঠার ক্ষেত্রে আমাদের কমান্ডোরা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। কিন্তু আহমদ মুসা তার চেয়ে ক্ষিপ্র, তার চেয়েও বেপরোয়া। তবে আমাদের লোকরা কোথাও মৃত্যুভয়ে পালিয়ে যায়নি। তারা মৃত্যুবরণ করেছে, কিন্তু ধরা দেয়নি। আমাদের একজন লোককেও তারা এ পর্যন্ত জীবন্ত ধরতে পারেনি। আমাদের চেষ্টার কোথাও ত্রুটি হয়নি মাই লর্ড। বলল সেভান সেরকিস-ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার-এর নতুন কমান্ডার।
সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল চোখ বন্ধ করে বসেছিল।
সেভান সেরকিসের কথা শেষ হলেও সেন্ট সেমভেল কিছু বলল না।
অনেকক্ষণ পর চোখ খুলল। বলল, এভাবে যুক্তি দিতে, সাফাই গাইতে লজ্জা হচ্ছে না? আগের কথা বাদ দিলাম, দিভিনে একটা নির্জন রাস্তায় ৮টি গাড়ি দিয়ে তাকে ঘিরে ফেলেও তার গায়ে আঁচড় দিতে পারলে না, মাঝখানে আমাদের সবাই মারা পড়ল। সেদিন গভীর রাতে একটা বন্ধ ঘরে তাকে পেয়েও তোমাদের সাতজন সবরকম অস্ত্রে সজ্জিত হয়েও তোমরা সবাই মারা গেছ। বল, এরপর তোমরা কি করবে?
সেন্ট সেমভেলের বাম দিকের এক পাশে একটা লাল বাতি জ্বলে উঠল। তার সাথে সাথে তিনবার বিপ বিপ শব্দ হলো।
সেন্ট সেমভেল তাকাল কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে। সেখানে একটা ছবি ভেসে উঠেছে। গোয়েন্দা প্রধান সোনা সোসানার ছবি।
সেন্ট সেমভেল পা দিয়ে একটা সুইচ চেপে ধরে বলল, এস সোসানা।
সোনা সোনা ঘরে প্রবেশ করল। দরজা আগেই খুলে গিয়েছিল।
সোনা সোসানা এসে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বড় একটা বাউ করল।
সোনা সোসানাকে বসতে ইংগিত করে সেন্ট সেমভেল বলল, তোমার তো এখন আসার কথা নয় সোসা? বল কি খবর?
মাই লর্ড, সেখানে যাবার পথে একটা তথ্য জানতে আমি অফিসে এসেছিলাম। এ সময় একটা চিঠি এল অফিসে। সে চিঠি নিয়েই আমি আপনার কাছে এসেছি। খুব জরুরি মনে করেছি মাই লর্ড। বলল সোনা সোসানা।
কার চিঠি? সেন্ট সেমভেল বলল।
আহমদ মুসার, মাই লর্ড। বলল সোনা সোসানা।
আহমদ মুসার চিঠি? বলছ কি তুমি? সেন্ট সেমভেল নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল।
ইয়েস মাই লর্ড আহমদ মুসা চিঠিতে আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছেন। বলল সোনা সোসানা।
সাক্ষাৎ প্রার্থনা? আমার? বলল সেন্ট সেমভেল। তার কণ্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ল।
কথা শেষ করেই আবার বলে উঠল, দাও চিঠিটা।
চিঠি হাতে নিয়ে পড়ল সেন্ট সেমভেল :
এক্সেলেন্সি সেন্ট গ্রেগরি,
সেন্ট গ্রেগরি চার্চ, দিভিন।
আমি আপনার এবং আর্মেনিয়ার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনি আর্মেনিয়ার সর্বজন সম্মানিত একজন ধর্মগুরু। একটি ব্যাপারে আপনার সাহায্য আমার প্রয়োজন। যা আমি সাক্ষাতেই বলতেই চাই। দুএক দিনের মধ্যে মহামান্যের সাথে আমার একটা সাক্ষাৎকার মঞ্জুর করলে আমি বাধিত হবো। প্যাডের মোবাইল নাম্বারে সম্মতি-সংবাদের অপেক্ষায় রইলাম। –আহমদ মুসা।
সেন্ট সেমভেল আহমদ মুসার চিঠিটা পড়ার পর তা অপারেশন কমান্ডার সেভান সেরকিসের হাতে দিয়ে দিল কোন কথা না বলেই।
সেন্ট সেমভেলের চোখে চিন্তার ছাপ। তার সাথে চোখের কোণায় একটা ঔজ্জ্বল্যও।। চিঠি পড়ল সেভান সেরকিসও। তারপর চিঠিটা এগিয়ে দিল সেন্ট সেমভেলের দিকে।
চিঠিটায় সেমভেল আরও একবার চোখ বুলিয়ে তাকাল সেভান। সেরকিস ও সোনা সোসানার দিকে। বলল, তোমরা চিঠি পড়ে কি বুঝেছ?
আমার মনে হচ্ছে মাই লর্ড আহমদ মুসা আপনাকে সেন্ট গ্রেগরি বলেই জানে। সে সেন্ট সেমভেলের ব্যাপারে কোন তথ্য জানতে চায়। বলল সেভান সেরকিস।
সেন্ট সেমভেল তাকাল সোনা সোসানার দিকে।
এ পর্যন্ত যা ঘটেছে, সেটা সামনে রেখে আমার মনে হচ্ছে আহমদ। মুসা আপনাকে শুধু সেন্ট গ্রেগরি মনে করে না, আবার সেন্ট সেমলেও মনে করে না। সে পরখ করার জন্যে সাক্ষাৎকার চেয়েছে। খোঁজ করে হয়তো আরও পথ সে বের করতে পারত, কিন্তু সবচেয়ে নিরাপদ পথটাই সে বেছে নিয়েছে। বলল সোনা সোনা।
আমার কাছে পুলিশ প্রধান আভ্রানিকও এসেছিলেন সেন্ট সেমভেলের খবর জানতে। আহমদ মুসার সাক্ষাতের বিষয়টাও কি সেরকম কিছু? সেন্ট সেমভেল বলল।
আমার ধারণা পুলিশ প্রধান এসেছিলেন অনুসন্ধানের জন্যে আর আহমদ মুসা আসবে পরখ করার জন্যে। বলল সোনা সোনা।
তাহলে তো তাকে ফিরে যেতে দেয়া যাবে না। সেন্ট সেমভেল বলল।
অবশ্যই না। কিন্তু মাই লর্ড, সেতো যথারীতি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসছে। এ বিষয়টা ইভা নারিনের মত কাউকে জানিয়ে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রব্লেম হতে পারে। বলল সেভান সেরকিস।
আহমদ মুসাকে সরিয়ে ফেলতে পারলে কোন প্রব্লেমই আমার কাছে বড় নয়। আর সেসব সামাল দেয়া আমার কাছে কিছুই নয়। এখন তোমরা একটা পরিকল্পনা কর, কিভাবে তাকে স্বাগত জানানো হবে। সেন্ট সেমভেল বলল।
মাই লর্ড তাকে কোথায় সাক্ষাৎ দেবেন, বাড়িতে, না আন্ডারগ্রাউন্ড অফিসে? জিজ্ঞাসা সেভান সেরকিসের।
তোমরা কি মনে কর? জিজ্ঞাসা করল সেন্ট সেমভেল।
মাই লর্ড তাকে ভালোভাবে ফাঁদে আটকিয়ে মারা দরকার। তার জন্যে আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড হেডকোয়ার্টারই ভালো। বলল সেভান সেরকিস।
আমিও তাই মনে করি মাই লর্ড। সোনা সোসানা বলল।
আমি উঠছি। তোমরা প্ল্যান তৈরি করে আমাকে দেখাবে।
সেন্ট সেমভেলের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তাকে সমেত তার চেয়ার-টেবিল চোখের পলকে নিচে নেমে গেল আর তার জায়গায় এল। তার পি.এ. আনুশা আনাহিতির চেয়ার-টেবিল। সেন্ট সেমভেলের পি.এ, আনুশা আনাহিতি চেয়ারে বসে কাজ করছিল।
চেয়ার-টেবিল স্থির হয়ে দাঁড়াতেই আনুশা আনাহিতি কাজ বন্ধ করে চোখ তুলে তাকাল সেভান সেরকিস ও সোনা সোসানার দিকে। বলল, মিস সোসা, বাইরের সব প্রোগ্রাম বাতিল করে আপনাকে এখানে থাকতে বলেছেন। হেডকোয়ার্টারের নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হয়েছে। আর মি. সেরকিস অপারেশন-হেডকোয়ার্টারের সব দায়িত্ব আপনার উপর অর্পণ করা হয়েছে। আপনাদের পরিকল্পনা অবিলম্বে মাই লর্ডকে জানাবেন। আর তৃতীয় বিষয় হলো, মিস সোসা হেডকোয়ার্টারের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন কথা থাকলে মাই লর্ডকে জানাবেন। ও.কে।
ধন্যবাদ মিস আনুশা আনাহিতি। বলল সেভান সেরকিস।
সেভান সেরকিস এবং সোনা সোসানা দুজনেই যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল।
মিস আনুশা আনাহিতি তার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, মিস সোসা, আপনি একটু বসুন। আর মি. সেভান সেরকিস আপনি ওয়েটিং-এ একটু অপেক্ষা করুন মিস সোসানার জন্যে।
সেভান সেরকিস চলে গেল।
কি ব্যাপার মিস আনুশা? জিজ্ঞাসা করল সোনা সোনা।
একটা জরুরি বিষয় মাই লর্ড আপনার সাথে আলোচনা করতে চান। এই মুহূর্তে। আপনি কি তার কাছে যাওয়া প্রেফার করবেন, না ইন্টারকমে কথা বলবেন?
ইন্টারকম প্রেফার করছি। বলল দ্রুত সোনা সোসানা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আনুশা আনাহিতির। তাকাল সে সোনা সোনার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে।
সোনা সোসানাও বুঝতে পারল তার প্রেফারেন্স বলার তাড়াহুড়াটা দৃষ্টিকটু ধরনের হয়ে গেছে। বলল, ও কিছু না। অ্যাবসেন্ট মাইন্ড হবার ফল। নিরাপত্তা, সাক্ষাৎকার এ বিষয় নিয়ে মন উদ্বিগ্ন।
হাসল আনুশা আনাহিতি। সে একখণ্ড চিরকুটে কিছু লিখে সোনা সোসানার দিকে ঠেলে দিল।
পড়ল সোনা সোসানা, মাই লর্ডের সাথে প্রাইভেট সাক্ষাৎকার তুমি যতটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করছ, এটা আমি লক্ষ করেছি। ভয় করো না, তোমার মত আমিও তা চাই, কিন্তু পারি না। মেয়েদের পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টশীপ, প্রাইভেট সেক্রেটারিশীপ এতটাই অভিশপ্ত জানতাম না। যখন জানলাম তখন আমি অনেকটাই বন্দীর মত।
চিরকুটটার অন্য পিঠে লিখল সোনা সোসানা, শুধু তুমি কেন আনুশা। আমি সোসানার মত আরও যারা আছে, সবাই বন্দীর মত। নামে বন্দী না। হয়েও কাজে বন্দী। আমাদের হা-এর যেমন প্রয়োজন দেখে না তারা, তেমনি না-এর কোন মূল্য নেই তাদের কাছে।
চিরকুটটা সোনা সোসানা ঠেলে দিল আনুশা আনাহিতির দিকে।
পড়ে আনুশা আনাহিতি হাসতে গিয়েও পারল না। বেদনায় ছেয়ে গেল তার মুখ। ফুলের মত সর্বাঙ্গ সুন্দর এক মেয়ে আনুশা আনাহিতি। শীতের মত নির্দয় এক ছোবল এসে যেন তাকে কুঁকড়ে দিয়েছে। মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল সে। নিজেকে সামলে নিল। বলল, মিস সোসানা, মাই লর্ডের সাথে কথা বলুন।
বলেই ইন্টারকম অন করে বলল, মাই লর্ড সোনা সোসানাকে লাইন। দেব?
হ্যাঁ। তার সাথে একটা বিষয়ে কথা বলা বাকি আছে। বলল, সেন্ট সেমভেল।
মাই লর্ড, সোনা সোনা লাইনে আছে। বলল আনুশা আনাহিতি।
সোনা সোসানা!
মাই লর্ড, আদেশ করুন। সোনা সোসানা বলল।
সোসা, একটা কথা বল তো, সেদিন আহমদ মুসার ওখানে যে অভিযান হলো, সেটা সে আগে থেকেই জানতে পারল কেমন করে? সেরাতের অভিযান সম্পর্কে যতটুক জানা গেছে তাতে প্রমাণ হয়, আহমদ মুসা এর জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। বলল সেন্ট সেমভেল।
মাই লর্ড, এই সন্দেহ আমার মনেও জেগেছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারিনি যে, এমনটা সত্যিই ঘটেছে। এই বিষয় জানার জন্যে ড্রাইভার গুরেনকে দরকার ছিল। তাকে ব্যবহার করেই আমরা আহমদ মুসার বাসার সন্ধান পেয়েছিলাম। ড্রাইভার গুরেন সেই রাত থেকেই নিখোঁজ। সে দিভিন থেকে পালিয়েছে, না পুলিশের হাতে পড়েছে, এটা এখনও নিশ্চিত জানা যায়নি। সোনা সোসানা বলল।
সত্যি বলেছ সোসা, ড্রাইভার গুরেন আমাদের জন্যে একটা দুর্বল পয়েন্ট। কে জানে সে দুমুখো ছিল কিনা? যাক, এ বিষয় নিয়ে তোমার উপর রাগ হচ্ছিল। কেন এ বিষয়টা নজর এড়িয়ে গেল, কেন এ বিষয়টা তুমি চিন্তা করনি। ধন্যবাদ সোসা, তুমি যা চিন্তা করেছ, ঠিক চিন্তা করেছ। বলল সেন্ট সেমভেল।
কথা শেষ করে মুহূর্তকাল থেমেই সেন্ট সেমভেল বলল, তুমি কি মনে। কর সোসা, শেষ যুদ্ধটা আমাদের কেমন হবে?
আহমদ মুসা আমাদের হেডকোয়ার্টারে আসার পর তার সাথে আমাদের যে সংঘাত হবে, তাকে আপনি শেষ যুদ্ধ বলছেন কেন মাই লর্ড? সোনা সোনা বলল।
কারণ এই যুদ্ধে আহমদ মুসাকে মরতেই হবে। সে না মরলে আমাদের ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগারকে নিশ্চিহ্ন হতে হবে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। সুতরাং মরতেই হবে আহমদ মুসাকে। বলল সেন্ট সেমভেল।
ধন্যবাদ মাই লর্ড, এটা আমাদের সকলের কথা। যিশু আমাদের সফল করুন। সোনা সোসানা বলল।
আমেন। ও,কে। বাই। ওপার থেকে কথা শেষ করল সেন্ট সেমভেল।
অফ হয়ে গেল ইন্টারকম।
একা একজন মানুষ অবশ্যই অজেয় হতে পারে না মিস সোসা। বলল আনুশা আনাহিতি।
হাসল সোনা সোসানা। বলল, উনি নাকি বলেন, তিনি একা নন, তার সাথে তার আল্লাহ থাকেন। কারণ তার লড়াই নাকি ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
কথা শেষ করেই সোনা সোনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই মিস আনুশা। সেভান সেরকিস অপেক্ষা করছে। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।
সোনা সোসানা হাঁটা শুরু করল দরজার দিকে।
আনুশা আনাহিতির দুই চোখ তাকিয়ে আছে সোনা সোসানার দিকে। তার মনে অনেক চিন্তা। তার মধ্যে তার ভাগ্যের কি হবে, সেই চিন্তাই বড়। তার কাছে এখন নিজের সত্ত্বা ও সত্ত্বার সম্মানই সবচেয়ে বড়।
স্যার একটু বসুন। মাই লর্ড আপনার জন্যে ওয়েট করছেন। তাঁকে বলছি আপনি এসেছেন। বলে সেন্ট গ্রেগরির পি.এ. মিস আনুশা আনাহিতি ইংরেজি একটা দৈনিক আহমদ মুসার সামনে দিয়ে ভেতরে চলে গেল।
আহমদ মুসা খুশি হলো এ পর্যন্ত সে খাতির পেয়েছে এজন্য। পার্কিং এ একজন কর্মকর্তা তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। সেই তাকে রিসেপশন পর্যন্ত নিয়ে আসে। রিসেপশন থেকে একজন কর্মকর্তা তাকে আন্ডারগ্রাউন্ডের এই প্যালেস-সদৃশ বাড়িতে নিয়ে আসে। মাঝখানে তার রুটিন সিকুরিটি চেক হয়েছে, সিকুরিটি স্ক্যানিং-এর মধ্যে দিয়ে তাকে আসতে হয়েছে। আহমদ মুসার কাছে কিছুই তারা পায়নি। তারা বলেছে, স্যার, এগুলো সবই রুটিন চেকিং। নানা রকমের লোক তো মাই লর্ডের কাছে আসে, তাই এই ব্যবস্থা। কিছু মনে করবেন না স্যার। আহমদ মুসা কিছুই মনে করেনি। কিন্তু মনে মনে বলেছে, তোমাদের স্ক্যানিং-এ ধরা পড়বে, এমন অস্ত্র নিয়ে আমি অনিশ্চিতের এই অভিযানে আসিনি।
আহমদ মুসার মন ফিরে এল সামনের কাগজের দিকে। ভাঁজ করা সংবাদ পত্রের উপর হাত রাখল তা একটু কাছে টানার জন্যে। ভাঁজের পাশে যেখানে বাম হাতটা রাখল আহমদ মুসা, সে জায়গাটা একটু উঁচু মনে হলো। মনে হলো তার ভেতরে যেন একটা কিছু আছে।
আহমদ মুসা পত্রিকার ভাঁজ খুলল এবং প্রথম পাতা উল্টিয়ে দেখতে পেল চার ভাঁজ করা একটা কাগজ। ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। কাগজটা কাছে এনে একটা ছোট নিউজ পড়ছে এমন একটা ভান করে। আহমদ মুসা কাগজের আড়াল নিয়ে ভাঁজ করা কাগজটা খুলল। দেখল ওটা একটা স্কেচ।
সংগে সংগে কাগজটা ভাঁজ করে সামলে রাখল। এক সময় ভাঁজ করা কাগজটাকে নিজের কাছে নিয়ে এল এবং জ্যাকেটের পকেটে তুলল।
সেন্ট গ্রেগরির পি.এ. আনুশা আনাহিতি এসে গেল। বলল, স্যার চলুন, মাই লর্ড আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
আহমদ মুসা তাকাল আনুশা আনাহিতির দিকে।
চোখ দুটি আনুশা আনাহিতির শান্ত, ভাবলেশহীন। তবে ঐ চোখ। শত্রুর নয়, এটা নিশ্চিত আহমদ মুসা। তাহলে আনুশাই কি স্কেচটা তাকে দিয়েছে? স্কেচটা নিশ্চয় এই বিল্ডিং-এর। অন্য কেউ তো ভুলে কাগজের মধ্যে এটা রাখতে পারে? প্রশ্ন জাগল আহমদ মুসার মনে। কিন্তু অন্য কেউ রাখলে পত্রিকা আনার সময় তা পড়ে যেত বা আনুশার হাতে ধরা। পড়ত। আনুশা পত্রিকা না দেখে নিশ্চয় আহমদ মুসাকে দেয়নি।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন মিস আনুশা।
চলতে শুরু করল তারা। আগে আনুশা। পেছনে আহমদ মুসা।
ওয়েটিং রুম থেকে আনুশা একটা দরজা দিয়ে যেখানে বেরুল সেটা একটা করিডোর। করিডোর ধরে অল্প কিছু দূর চলার পর ঠিক নাক বরাবর চার পাঁচ ধাপের একটা সিঁড়ি।
সিঁড়িটা দিয়ে উঠতে গিয়ে তৃতীয় ধাপে এসে পা পিছলে পড়ে গেল। মিস আনুশা।
আহমদ মুসা পেছনেই ছিল। লাফ দিয়ে গিয়ে আহমদ মুসা ধরে তুলল তাকে। তোলার সময় আনুশা আহমদ মুসার জ্যাকেটের পকেটে কিছু একটা ঢুকিয়ে দিল। আহমদ মুসাও তা দেখতে পেল। বুঝল আহমদ মুসা, তাকে একটা কিছু দেয়ার জন্যে সে পড়ার ভান করেছিল।
স্যরি, পা হঠাৎ পিছলে গিয়েছিল। ধন্যবাদ আপনাকে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল আনুশা আনাহিতি।
মোস্ট ওয়েলকাম মিস আনুশা। পায়ে কোন আঘাত পাননি তো? বলল আহমদ মুসা।
না, তেমন কিছু নয়। আসুন। বলে আবার চলতে শুরু করল আনুশা আনাহিতি। তার পেছনে হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসাও।
আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল বের করল। তার সাথে বের করল আনুশার সদ্য দেওয়া চিরকুটটি। বাম হাতে মোবাইল রেখে, তার উপর ডান হাত রেখে আনুশার দেয়া চিরকুটটি বের করল। যেন মোবাইলের কোন নাম্বার দেখছে আহমদ মুসা। পড়ল আহমদ মুসা চিরকুটের লেখা ঘরটির মেঝের সব অংশ সব দিকে মুভ করতে পারে। চেয়ারের ব্যাকে স্বয়ংক্রিয় গুলির ব্যবস্থা আছে। চেয়ারগুলো তাতে বসা লোকদের শৃংঙ্খলিত করতে পারে। অস্বাভাবিকভাবে চেয়ারে বসা এর রিমেডি।
চিরকুটটি পড়ে আহমদ মুসার শক্ত-শান্ত-স্থির মনও মুহূর্তের জন্যে কেঁপে উঠল। কি বিপজ্জনক ফাঁদ! কি আটঘাট বাঁধা এদের কৌশল! এদের ঐ চেয়ারে বসার মানেই হলো বন্দী হয়ে যাওয়া, নয় তো বেঘোরে মৃত্যুবরণ করা। আনুশা তার চিরকুটে এর রিমেডিও বলেছে। সেটা অস্বাভাবিকভাবে চেয়ারে বসা। তার মানে অস্বাভাবিকভাবে বসলে চেয়ারে বসা লোককে শৃঙ্খলিত করা ও গুলি করার ব্যবস্থা কার্যকর হয় না। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল আনুশাকে। আনুশার দ্বিতীয় তথ্য, যে ঘরে আহমদ মুসা সেন্ট গ্রেগরির সাথে সাক্ষাতে বসতে যাচ্ছে, সে ঘরের সব অংশ সব দিকে মুভ করতে পারে। এর অর্থ ঘরটির মেঝে কয়েকটি পরিকল্পিত খণ্ডে বিভক্ত। প্রত্যেকটি খণ্ডকে আলাদাভাবে উপরে-নিচে, ডানে-বামে, সামনে-পেছনে সব দিকেই মুভ করানো যায়। সেন্ট গ্রেগরির চেয়ার টেবিল একটা খণ্ডে হতে পারে। আমার মত মেহমানরা সামনের যে চেয়ারগুলোতে বসবে, সেটা আরেকটা খণ্ড হতে পারে। এভাবে আরও খণ্ড রয়েছে। এ থেকে নিরাপদ থাকার কোন পথ নেই বলেই হয়তো আনুশ। তা বাতলায়নি। আর আনুশার দেয়া তথ্য থেকে তৃতীয় যে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে সেটা হলো সেন্ট গ্রেগরিই আসলে সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল। আহমদ মুসা আল্লাহ রাব্বল আলামিনের শুকরিয়া আদায় করল যে, সেন্ট সেমভেলের পরিচয় তার কাছে শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে গেল।
একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আনুশা আনাহিতি। এক সারিতে অনেকগুলো দরজার মধ্যে এটি একটি।
দরজাগুলোর দিকে ইংগিত করে আনুশা বলল, ফাদার সেন্ট গ্রেগরির ব্যক্তিগত অফিস এগুলো। এখন এই অফিসে ফাদার আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
সামনের দরজাটা খুলে গেল।
প্লিজ স্যার, ভেতরেই আছেন ফাদার সেন্ট গ্রেগরি। আহমদ মুসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আনুশা আনাহিতি বলল।
আহমদ মুসা তাকাল আনুশার মুখের দিকে। আনুশার চোখ। ভাবলেশহীন হলেও তাতে উদ্বেগ ও বেদনার ছায়া আছে। আহমদ মুসা বলল, অনেক ধন্যবাদ মিস আনুশা আনাহিতি।
আনুশার চোখে উদ্বেগ-বেদনা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার ঠোঁট দুটি একটু নড়ল। অস্ফুটে বের হয়ে এল, গড় ব্লেস ইউ।
কক্ষটিতে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। বেশ বড় ঘর।
ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের পাশে একটা রাজাসন তাতে বসে আছে সেন্টদের পোষাকে সেন্ট গ্রেগরি ওরফে সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল।
টেবিলের সামনে একটি মাত্র চেয়ার। সেটা আহমদ মুসার জন্যে।
ঘরটিকে নিরাভরণ বলা যায়। তবে যা আছে সবই মূল্যবান অ্যানটিকস। টেবিল, দুটি চেয়ার, বড় আলমারি সব দৃষ্টিনন্দন অ্যানটিকস। বিস্ময়ের ব্যাপার ঘরে কোন কম্পিউটার নেই। সাইড টেবিলও নেই। টেবিলের দিকে তাকিয়েই আহমদ মুসা বুঝল টেবিলটাই একটা কম্পিউটার।
আহমদ মুসাকে ঢুকতে দেখে ফাদার সেন্ট গ্রেগরি উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ওয়েলকাম আহমদ মুসা। দুনিয়ার এক, কিংবদন্তী আপনি। আপনাকে আমার অফিসে এভাবে পাওয়া আমার জন্যে এক অসীম সৌভাগ্য।
আহমদ মুসার সাথে হ্যান্ডশেক করে তার জন্যে নির্দিষ্ট চেয়ার দেখিয়ে বলল, প্লিজ বসুন।
চেয়ারের কথা শুনে চমকে উঠল আহমদ মুসা- ওতো মৃত্যু-আসন। অস্বাভাবিকভাবে বসাটা আসলে কি? যেভাবে বসা হয় চেয়ারে, তারচেয়ে। ব্যতিক্রমভাবে বসাটাই কি অস্বাভাবিকভাবে বসা।
আহমদ মুসা এগোলো চেয়ারের দিকে। ধন্যবাদ ফাদার! বলে। চেয়ারের একেবারে সন্মুখ প্রান্তের উপর বসল এবং হাত দুটি চেয়ারের। হাতলে না রেখে টেবিলের উপর রাখল।
আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি সেন্ট সেমভেলের দিকে।
আহমদ মুসার ওভাবে বসতে দেখে মুহূর্তের জন্যে ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল সেন্ট সেমভেলের। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে উঠে বলল, বি ইজি আহমদ মুসা। ভালো করে বসুন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ঠিক আছে ফাদার। একেকজনের একেক ধরনের অসুবিধা আছে জনাব। আমার মেরুদণ্ডকে শক্ত জায়গায়। রাখতে হয়। এই কারণে কুশন আমি অ্যাভয়েড করি। এসব বিষয় থাক। ফাদার। আমি বিশেষ একটা সাহায্য চাইতে আপনার কাছে এসেছি।
আহমদ মুসার কথাটা শুনেই কিছুটা আত্মস্থ হলো যেন সেন্ট সেমভেল। মুহূর্ত কয়েক সময় নিয়ে বলল, বলুন কি সাহায্য?
সেন্ট সেমভেলকে আমরা খুঁজছি। আপনি আর্মেনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগুরু। আপনার পক্ষেই তাকে চেনা সম্ভব। সে জন্যেই আপনার কাছে এসেছি। বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ প্রধানও এসেছিলেন তার খোঁজে। আপনিও এসেছেন। কি ব্যাপার? তাকে কি দরকার? সেন্ট সেমভেল বলল। তার কণ্ঠে কিছুটা বিরক্তি।
তিনি আর্মেনিয়ার একটি জনগোষ্ঠিকে নির্মূল করার জন্যে কাজ করছেন। ইতিমধ্যেই তিনি অনেক জীবন ও সম্পদ নাশের অপরাধ করেছেন। বলল আহমদ মুসা।
চোখ দুটি জ্বলে উঠল সেন্ট সেমভেলের। চোখের পলকে অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল। আহমদ মুসার কথার রেশ মেলাবার আগেই সেন্ট সেমভেলের হাতে উঠে এল রিভলবার। গুলি করল সংগে সংগেই আহমদ মুসার মাথা লক্ষ করে।
আহমদ মুসা সেন্ট সেমভেলের দিকে তাকিয়েই ছিল। কিন্তু আশা করেনি যে, তার প্রতিক্রিয়াটা এভাবে সে গুলির মাধ্যমে দেখাবে। যখন বুঝল, তখন আহমদ মুসা নিজেকে রক্ষা করার জন্যে মাথাটা একটু নিচু করেছিল। এর কারণে সে একটা সুযোগও পেয়েছে। এই সুযোগেই আহমদ মুসা ঘাড়ের উপরে জ্যাকেটের কলার ব্যান্ডের নিচ থেকে ছোট একটা ল্যাসারগান বের করেই গুলি করতে পেরেছিল সেন্ট সেমভেলকে।
সেন্ট সেমভেল তার গুলি ব্যর্থ হবে এবং সংগে সংগে গুলির উত্তরও পাবে, এটা আশা করেনি। কিছু বুঝার আগেই সেন্ট সেমভেলের ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত উড়ে গেল ল্যাসার বুলেটের আঘাতে।
আশ্চর্য নার্ভ সেন্ট সেমভেলের। হাত হারিয়ে সে একটা আঃ উঃ পর্যন্ত করেনি।
টেবিল সমেত সেন্ট সেমভেলের চেয়ার নিচে নামছিল। টেবিলের উপরই ছিল আহমদ মুসার দুই হাত, শরীরের ভারও। আহমদ মুসা শুধু দেহটাকে গড়িয়ে দিল টেবিলের উপর।
সেন্ট সেমভেল আহমদ মুসার দেহকে টেবিলের উপর দেখেই তার বাম হাতের রিভলবার দিয়ে আহমদ মুসাকে গুলি করতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসার ডান হাত তখন নিজের মাথার কাছে। ল্যাসারগানের ব্যারেলটাও অন্যদিকে। ঘুরাবার সময় ছিল না। উপায়য়ান্তর না দেখে ডান। পায়ের লাথি ছুঁড়ে মারল সেমভেলের রিভলবার ধরা হাত লক্ষে। রিভলবার সেন্ট সেমভেলের হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল।
রিভালবার হাত থেকে ছিটকে পড়ার সংগে সংগেই সেন্ট সেমভেল বুক পকেট থেকে পিংপং বলের মত গোলাকার কিছু একটা বের করল।
আহমদ মুসা ততক্ষণে তার ডান হাত ঘুরিয়ে নিয়েছে। এবার তার ল্যাসারগানের দ্বিতীয় গুলি সেন্ট সেমভেলের বাম হাত লক্ষে ছুটে গেল। আহমদ মুসা সেন্ট সেমভেলের হাতের সংজ্ঞালোপকারী বোমার বিস্ফোরণ ঠেকাবার জন্যে গুলি তার হাতে না করে বাহুতে করেছে।
এবার সেন্ট সেমভেল আর্তনাদ করে, চেয়ারে বসে পড়ল।
তার সাথে সাথে টেবিল-চেয়ার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
আহমদ মুসা তুমি আপাতত বেঁচে গেছ, আমার দুই হাতকে উড়িয়ে দিয়েছ। কিন্তু তুমি ফাঁদে আটকা পড়েছ। তোমাকে মরতেই হবে। গোটা ইস্টাবলিশমেন্টে এখন অ্যালারম বাজছে। সবাই ছুটে আসছে এদিকে। হুংকার দিয়ে বলে উঠল সেন্ট সেমভেল। __ চেয়ার-টেবিল সমেত তারা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেটা চারদেয়ালে আবদ্ধ একটা কুঠরি। যার জানালা দরজা কিছুই নেই। সেন্ট সেমভেলের কথায় বুঝা যাচ্ছে এটা তার জন্যে মরণ ফাঁদ। এ ফাঁদের দরজা খোলার চাবিকাঠি সেন্ট সেমভেলের কাছে রয়েছে। দরজা খোলার সেই সুইচ নিশ্চয় এই টেবিলের কোথাও আছে, সেন্ট সেমভেলের নাগালের মধ্যে।
সেন্ট সেমভেলকে ঐভাবে চেয়ারে বসিয়ে রেখে মেঝেয় নামা ঠিক হবে না। টেবিলের উপর দিয়ে এগোলো আহমদ মুসা সেন্ট সেমভেলের দিকে। এগগাবার সময় টেবিলে পড়ে থাকা সংজ্ঞালোপকারী বোমাটা পকেটে পুরল সে।
তুমি আমাকে কি করতে চাও আহমদ মুসা? বলল সেন্ট সেমভেল। তার কণ্ঠে উদ্বেগ। * এই মুহূর্তে কিছু করব না। বলে আহমদ মুসা সেন্ট সেমভেলের চেয়ারের হাতলটা ধরে ঘুরিয়ে ঠেলে দিল চেয়ারটা টেবিল থেকে কিছুটা দূরে। দেখল চেয়ারের সাথে কোন কিছুর কানেকশন নেই।
এবার টেবিল থেকে নামল আহমদ মুসা। দ্রুত টেবিলের দুপাশের ড্রয়ার খুলল। এক ড্রয়ারে পেল একটা মেশিন রিভলবার। অন্য ড্রয়ারে দেখল ছোট-খাটো কিছু ইলেকট্রনিক জিনিস ও কাগজপত্র।
আহমদ মুসা মেশিন রিভলবার কাঁধে ঝুলিয়ে বসে পড়ল টেবিলের নিচেরটা দেখার জন্যে, যেখানে পা দিয়ে অপারেট করার মত সুইচ আছে বা থাকতে পারে এবং বোর্ড বা ডিজিটাল কী-বোর্ডের মত কিছু পাওয়া যেতে পারে। দেখতে শুরু করেছে আহমদ মুসা। ঘন চকলেট রঙের পা রাখার মত একটা বোর্ড আছে সত্য, কিন্তু প্রথম নজরে কিছুই চোখে পড়ল না। আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখতে গেল। এই সময় পাশে শব্দ হওয়ায় সে ফিরে তাকাল সেন্ট সেমভেলের দিকে। দেখল সেন্ট সেমভেলকে নিয়ে চেয়ার বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। সেই সাথে শুনতে পেল সেন্ট সেমভেলের চিৎকার, এবার গ্যাস চেম্বারে মর আহমদ মুসা।
কথা শেষ হবার সাথে সাথেই চেয়ার ওপারে চলে গেল। চেয়ার চলছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। চেয়ার বের হবার সাথে সাথেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ফাইবার পার্টিশনটা আগের মতই হয়ে গেল।
মুহূর্তেই ঘটে গেল ঘটনাটা। যখন আহমদ মুসা দেখতে পেয়েছে, তখন তার আর করার কিছুই ছিল না।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াল গিয়ে ফাইবার ওয়ালটার সামনে। দরজার জায়গাটা পরীক্ষা করল। ফাইবার ওয়ালের গায়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত নিলচে একটা লাইন দেখতে পেল। বুঝল আহমদ মুসা দরজাটা চুম্বক-নিয়ন্ত্রিত। চেয়ার যেমন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালাবার ব্যবস্থা ছিল, তেমনি দরজা নিয়ন্ত্রণের জন্যে ম্যাগনেটিক কমান্ড চেয়ারেই ছিল। চমকে উঠল আহমদ মুসা সেই সাথে, তাহলে তো দরজা খোলার আর কোন ব্যবস্থা ঘরে অবশিষ্ট নেই? সেই সাথে আবার তার মনে হলো, সেন্ট সেমভেলের মত ক্রিমিনালরা মাত্র একটা অপশন রাখে না, একাধিক বিকল্প তারা প্রস্তুত রাখে। চেয়ারে দরজার যেমন একটা ব্যবস্থা ছিল, তেমনি টেবিলে বা অন্য কোথাও এক একাধিক ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল টেবিলের দিকে। ঠিক সে সময়েই ঘরটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। একেবারে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সেই সাথে একটা কণ্ঠ ধ্বনিত হলো, আহমদ মুসা, গ্যাস চেম্বারে আমরা তোমাকে তিল তিল করে মারব। গ্যাস চেম্বারে অক্সিজেন ধীরে ধীরে কমে যাবে, ঘাতকগ্যাস ধীরে ধীরে বেড়ে যাবে, তুমি তিল তিল করে মরবে। কোন বুলেট দিয়ে পার্টিশনের ফাইবার গ্লাস ফুটোও করতে পারবে না, ভাঙা তো দূরের কথা। ল্যাসারগান দিয়ে বড় জোর ফাইবার গ্লাস ফুটো করতে পারবে। তাতে লাভ হবে না। ঐ ফুটো দিয়ে আমরা তখন বিশেষ নার্ভ গ্যাস ঢুকিয়ে দেব তোমার মৃত্যুকে আরও যন্ত্রণাদায়ক করার জন্যে।
সেন্ট সেমভেলের হুমকি মিথ্যা নয়, ভাবল আহমদ মুসা। ঘরে আলো না থাকায় দরজা খোলার বিকল্প ব্যবস্থা সন্ধান করা কঠিন হয়ে গেল। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগল, এই ঘরের আলো জ্বালানো কি শুধুমাত্র বাইরের উপর নির্ভরশীল ছিল? দরজা খোলার বিকল্প থাকার মতই আহমদ মুসার মনে হলো ঘরে আলো জ্বালানোরও বিকল্প ব্যবস্থা আছে। সে ব্যবস্থা কি হতে পারে? আবার নিজের কাছেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। সে ব্যবস্থাটা এমন হবে, ভাবল আহমদ মুসা, যেন না হাতড়িয়ে বা না উঠে গিয়ে নিচু হবার মত অবস্থায় না গিয়ে আলো জ্বালানো যায়। কিংবা ব্যবস্থাটা এমন হবে যাতে অন্ধকারেও তা সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। চেয়ারে বসা বা অন্ধকারে দাঁড়ানো একজন লোকের জন্যে এমন সহজ জায়গা কোনটা হতে পারে? আহমদ মুসার মনে হলো সে জায়গাটা হতে পারে দুপাশের দুই ড্রয়ার। অন্ধকারে চেয়ারে বসে থাকা কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা লোকের জন্যে উপযুক্ত স্থান হিসেবে দুপাশের দুই ড্রয়ার খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে সহজ।
আহমদ মুসা অন্ধকারে টেবিল খুঁজে নিয়ে ডান পাশের ড্রয়ার খুলল বিসমিল্লাহ বলে। সংগে সংগে ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। আহমদ মুসা। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ড্রয়ারের ওপাশে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
এ সময় সেই কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো। বলল, ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি আহমদ মুসা। আলো জ্বালাতে তুমি পেরেছ। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে তুমি পারবে না। আমরা আর দেরি করতে চাচ্ছি না। গ্যাস চেম্বার কাজ শুরু করেছে। তুমি আর বেশিক্ষণ বেঁচে নেই। বিদায় আহমদ মুসা।
কণ্ঠ থেমে গেল।
কণ্ঠ থেমে যেতেই আহমদ মুসার দুবার কাশি হলো। কাশি আহমদ মুসার ভেতরের নীরব অস্বস্তির প্রমাণ।
আল্লাহ আমার সহায়। বলে আহমদ মুসা দরজা খোলার বিকল্প ব্যবস্থা তালাশের জন্যে টেবিলের নিচটা দেখার জন্যে বসতে যাচ্ছিল, হঠাৎ আহমদ মুসার নজর গিয়ে পড়ল টেবিলের সারফেসে অদৃশ্য প্রায় একটা ডিজিটাল ছকের উপর।
আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ল ছকটার উপর। বিস্ময়ের সাথে আহমদ মুসা দেখল, ছকে অংকের ডিজিট নেই, আছে কিছু বর্ণ ও কিছু অস্পষ্ট ধ্বনের ক্ষুদ্র ছবি। যেমন U রয়েছে ছকের বিভিন্ন জায়গায় তিনটা, D রয়েছে। ছয়টা এবং S রয়েছে তিনটা। মুহূর্তকাল চিন্তা করেই আহমদ মুসা ধরে নিল বর্ণগুলো কাজের পরিচয় জ্ঞাপক। ঘরে কি কি কাজ হয়, নিজেকে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা। উত্তরে নিজেই বলল, উপরে উঠা হয়, নিচে নামা হয়। আর কি হয়, লাইট জ্বালানো হয়। আর কি কাজ? উত্তরটা আহমদ মুসার মাথায় যেন নাজিল হলো D দরজা খোলা হয়। এই হিসেবে কাজ চারটা। বর্ণগুলো পরিচয় জ্ঞাপক হলে চারটা কাজের জন্যে চারটা বর্ণ হতে হবে। কিন্তু বর্ণ তো তিনটা ও U, D এবং S ঝামেলায় পড়ে গেল আহমদ মুসা। হঠাৎ ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠল। দুটি কাজের পরিচয় জ্ঞাপক শব্দের প্রথম বর্ণ একই। যেমন ডাউন-এ D এবং ডোর-এও D। খুশি হলো দুই কাজের জন্যে ঠিকই D বর্ণটি ছয়বার আছে, যেমন আছে U তিন বার এবং S তিনবার। এরপর যে প্রশ্ন আহমদ মুসার সামনে বড় হয়ে দাঁড়াল, সেটা হলো প্রত্যেকটা কাজের জন্যে একই বর্ণ তিনবার করে আছে কেন? এ প্রশ্ন সামনে আসার সাথে সাথেই তার মনে হলো এটা একটা ধাঁধা। তিন বর্ণের একটা বর্ণ দিয়েই কাজটা হবে। সেই বর্ণ বের করাই ধাঁধার সমাধান। চোখ বুলাতে লাগল আহমদ মুসা। নিশ্চয় তিন বর্ণের মধ্যে এমন কোন বিশেষত্ব আছে, যা দেখে বর্ণটাকে চেনা যাবে। একবার আহমদ মুসার মনে হলো, একই কাজের জন্যে তিন বর্ণেই যদি ক্লিক করা যায়, তাহলে সঠিক বর্ণে ক্লিক হবে এবং তাতেই দরজা খুলে যাবার কথা। এর জবাব তৎক্ষণাতই এল মন থেকে, তাহলে ধাঁধা দিল কেন? ধাঁধা দেওয়ার অর্থ হলো, সঠিক বর্ণে যদি ক্লিক না পড়ে, তাহলে বিপরীত ফল হবে। সঠিক বর্ণে তখন ক্লিক করলেও আর কাজটা হবে না। এ যুক্তি মেনে নিল। আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা আবার কাশল কয়েকবার। এবার বড় ধরনের কষ্টকর কাশি। তার হৃদপিণ্ড অক্সিজেন চাচ্ছে, হৃদপিণ্ডে অবাঞ্ছিত কিছু প্রবেশ করছে। গোটা বুকে অস্বস্তি দ্রুত বাড়ছে।
আহমদ মুসা মনোযোগ দিল কাজে। পরিস্থিতি তাকে বেশি সময় দেবে না, কয়েক মিনিটের বেশি নয়।
ছয়টি D বর্ণ আছে। তার মধ্যে D অর্থাৎ Down বা নিচে নামার জন্যে তিনটি বর্ণ এবং Door বা দরজা খোলা ও বন্ধের জন্যে তিনটি বর্ণ। দূরজার জন্যে আলাদা তিনটি D নির্দিষ্ট আছে। দরজার জন্যে নির্দিষ্ট D ছয়টি D-এর মধ্যে থেকেই বেছে নিতে হবে।
সময় বলছে তাড়াতাড়ি করতে। কিন্তু আহমদ মুসা আল্লাহর উপর ভরসা করে ছয়টি বর্ণের মধ্যে বিশেষত্ব কোন্ দুটিতে তা বেছে বের করার কাজ শুরু করল। বারো ঘরের ডিজিটাল ছকে হোরাইজন্টাল প্রথম কলামের তৃতীয়, দ্বিতীয় কলামের দ্বিতীয় ও তৃতীয়, তৃতীয় কলামের প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ কলামের প্রথম ঘরে D বর্ণ আছে। আহমদ মুসা দ্বিতীয় কলামের তৃতীয় ঘরের D-এর লম্ব দণ্ডটার নিচের মাথাকে অর্ধচন্দ্রের মত কিঞ্চিত বাঁকানো দেখল, যা অন্য কোন D-তে পেল না। খুশি হলো আহমদ মুসা এজন্য যে, এই D নিচের দিকে ইংগিত করছে এবং এটা নিশ্চয় নিচের দিকে মুভ করার বাটন। পরবর্তী দুই D-তে কিছুই পেল না। আহমদ মুসার উদ্বিগ্ন চোখটা। আছড়ে পড়ল শেষ কলামের শেষ D-এর উপর। কিন্তু D-এর আকারে কোন ব্যতিক্রম পেল না, ক্ষুদ্রাকার দরজার সিম্বল আশা করছিল, তাও পেল না। অন্যদিকে বুকের দুর্বহ চাপটা শ্বাসনালিতে উঠে এসেছে। কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে। কিন্তু কোন অস্থিরতা আহমদ মুসাকে গ্রাস করেনি। মৃত্যু শুধু আল্লাহ দিতে পারেন এবং তার জন্যে সময় তিনি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। সে সময় যদি এসেই গিয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহর ইচ্ছাই তো বান্দার জন্যে হাসিমুখে বরণীয়। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বান্দার যা করণীয় তা করতে বলেছেন আল্লাহ।
আহমদ মুসার চোখ আবার ফিরে এল শেষ D-টার উপর। এবার D-এর প্রতিটি বিন্দু পরিমাণ জায়গা পরখ করতে গিয়ে D-এর পেটে ক্ষুদ্র একটা বিন্দু। পেল। বিন্দুটা গোল নয়, লম্বাটে এবং মধ্যখানটা কিঞ্চিত মোটা এবং মাথাটাও কিছুটা বড় ও গোলাকার।
আহমদ মুসা আল হামদুলিল্লাহ বলে উঠল। নিশ্চিত সে, এটা কী হোল এর সিম্বল। এটাই সেই D যেটা সে খুঁজছে। আহমদ মুসা পকেট থেকে সংজ্ঞালোপকারী গ্যাস বোমাটা পকেট থেকে হাতে নিল। কাঁধের মেশিন রিভলবারটা নামিয়ে টেবিলের উপর রাখল। ডান হাতের শাহাদাত আঙুলি দিয়ে বিছমিল্লাহ বলে ক্লিক করল শেষ Dটায়।
D-তে চাপ দিয়েই মেশিন রিভলবারটা ডান হাতে নিয়ে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। দেখল ফাইবার ডোরটা নিঃশব্দে খুলে যাচ্ছে।
আহমদ মুসা ছুটে গিয়ে দাঁড়াল দরজায়। ডান হাতে মেশিন রিভলবার প্রস্তুত।
সামনে তাকিয়েই দেখতে পেল ডজনখানেক স্টেনগান তার দিকে তাক করা। সবার হাত নিশ্চয় স্টেনগানের ট্রিগারেই। এই সাথে হো হো করে হাসতে লাগল একটা কণ্ঠ।
স্টেনগানধারীরা আহমদ মুসার চোখে পড়ার পর সে এক মুহূর্তও দেরি করেনি।
দেহটাকে চোখের পলকে মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়ে গুলি শুরু করল। মেশিন। রিভলবারটা সবার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এল।
হো হো হাসিটা বন্ধ হয়ে গেছে। স্টেনগানধারীরা তাদের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে ধরাশায়ী।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে কাউকে দেখল না। জ্যাকেটের পকেট থেকে দ্রুত বের করল আনুশার দেয়া স্কেচটা। স্কেচটার দিকে তাকিয়ে নিজের লোকেশনটা দেখে নিয়ে পরে চারপাশের অবস্থান, উপরে উঠার পয়েন্টগুলো এবং এক্সিটগুলো দেখে নিল।
ছুটল আহমদ মুসা ঘরের দরজার দিকে। দরজাটা চোখে পড়তেই দেখল দুই হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা সেন্ট সেমভেলকে একটা যন্ত্রচালিত ট্রলিতে করে মেডিকেল এ্যাপ্রোণ পরা চারজন লোক দরজায় পৌঁছে গেছে।
আহমদ মুসা ট্রলির টায়ার লক্ষে এক ঝাঁক গুলি বর্ষণ করল। লক্ষ অর্জিত হলো। এক জোড়া টায়ার ফাটার শব্দ হলো। আহমদ মুসা ছুটল দরজার দিকে।
ট্রলিটা দরজার বাইরে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছে। ট্রলি থেকে নেমে সেন্ট সেমভেল ছুটছে উপরে উঠার সিঁড়ির দিকে। দুজন স্টেনগানধারী তাকে দুদিক থেকে ধরে নিয়ে ছুটছে।
মেডিকেল এ্যাপ্রোণ পরা দুজন লোক অচল ট্রলির পাশে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসাকে দেখেই তারা রিভলবার তুলছিল আহমদ মুসাকে গুলি করার জন্যে।
আহমদ মুসার মেশিন রিভলবারের ব্যারেল টার্গেটের জন্যে তৈরি ছিল। আহমদ মুসা ওদের রিভলবার ফেলে দিতে বলল। কিন্তু বেপরোয়া
ওরা। আহমদ মুসার মেশিন রিভলবারের গুলি ওদের থামিয়ে দিল।
আহমদ মুসা ছুটল সেন্ট সেমভেলের দিকে। ওরা তখন উপরে উঠার। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে গেছে।
কয়েক ধাপ এগোতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল ডান ও বাম দিক। থেকে দুদল লোক ছুটে আসছে। সংগে সংগে আহমদ মুসা বাম হাতের গ্যাস-বোমাটা ডান দিক থেকে ছুটে আসা লোকদের দিকে ছুঁড়ে দিল। ওরী তখনও বিশ পঁচিশ ফিট দূরে।
গ্যাস বোমা ছোঁড়ার সাথে সাথে আহমদ মুসা শুয়ে পড়েছে মেঝেতে।
বাম দিকের ওরা গুলি করা শুরু করেছে। এক ঝাঁক গুলি আহমদ মুসার কয়েক ফুট উপর দিয়ে চলে গেল। ঠিক সময়ে শুয়ে পড়ায় রক্ষা পেল। আহমদ মুসা।
ওরা ওদের টার্গেট পরিবর্তন করার আগেই ওদের উপর পাল্টা আক্রমণের সুযোগ নিল আহমদ মুসা। শুয়ে পড়ার সাথে সাথে আহমদ। মুসা নিজের দেহটাকে ঘুরিয়ে ডান হাতকে গুলি করার পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। মেশিন রিভলবারের ট্রিগার চেপে তা ঘুরিয়ে নিল বাম দিকের গোটা করিডোরের উপর।
ওদিকের গুলি বন্ধ হয়ে গেল। সেখানে কি ঘটেছে তা দেখার প্রয়োজন। বোধ করল না আহমদ মুসা। শোয়া থেকে উঠে মেশিন রিভলবারের ট্রিগারে হাত রেখে আহমদ মুসা ছুটল সিঁড়ির দিকে।
সেন্ট সেমভেলকে নিয়ে দুজন স্টেনগানধারী সিঁড়ির মাথায় পৌঁছেছে। দুই স্টেনগানধারী কি যেন বলে আহমদ মুসার দিকে ফিরে তাকাল।
আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার ওদের দিকে তাক করা দেখে ওরা ওদের স্টেনগান না ঘুরিয়ে সেন্ট সেমভেলকে নিয়ে আরও দ্রুত ছুটতে লাগল।
আহমদ মুসা ইচ্ছা করেই ওদের গুলি করল না। সেন্ট সেমভেলকে জীবিত ধরা দরকার। কিন্তু তাকে পালিয়ে যেতে দেয়া যাবে না।
আহমদ মুসা জ্যাকেটের পকেট থেকে বাম হাতে রিভলবার তুলে নিল।
ওরা উপরে উঠে গেল। ওটা মূল গ্রাউন্ড ফ্লোর কি? হতেও পারে।
আহমদ মুসা সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে উঠে গেল।
চিনতে পারল আহমদ মুসা, এটাই মূল আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর, যেখান। থেকে সে সেন্ট সেমভেলের কক্ষ থেকে নিচে নেমেছিল।
সিঁড়ি থেকে উপরে উঠতেই পেছনে একটা শব্দ হলো। চমকে উঠে পেছনে ফিরে দেখল সিঁড়িটা আর নেই। সেখানে একটা ঘর। বুঝল আহমদ মুসা, সিঁড়িতে উঠতে তার একটু দেরি হলে সিঁড়িটা আর সে পেত না।
পেছন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আহমদ মুসা তাকাল এবার সামনে। সামনে সেই প্রশস্ত কড়িডোর। দুপাশে ঘর। করিডোরের উত্তর মাথা গির্জায় গিয়ে উঠেছে, আর দক্ষিণ মাথা সেন্ট সেমভেল ওরফে সেন্ট গ্রেগরির বাড়িতে গিয়ে মিশেছে।
আহমদ মুসা দেখল, সেন্ট সেমভেলকে একটা গাড়িতে তোলা হচ্ছে। গাড়ির পাশে চারজন স্টেনগানধারী।
আহমদ মুসা হাঁটু গেড়ে বসে গুলি করল গাড়ি অচল করে দেবার জন্যে। গাড়ির বাম পাশের সামনের ও পিছনের দুই চাকাই ঝাঁঝরা হয়ে গেল।
গাড়ির পাশের চার স্টেনগানধারী সেন্ট সেমভেলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পেছনের দিকে খেয়াল রাখতে পারেনি।
আহমদ মুসার গুলির শব্দে ওরা চারজনই ফিরে তাকিয়েছিল পেছন দিকে। সেই সাথে স্টেনগানও ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
কিন্তু আহমদ মুসা তাদেরকে গুলি করার সুযোগ দিল না। আহমদ মুসার মেশিন রিভলবারের ব্যারেল একটু নিচু ছিল, তা একটু উপরে উঠল মাত্র। এক ঝাঁক গুলি গিয়ে ওদের চারজনকে জড়িয়ে ধরল।
আহমদ মুসা ছুটল গাড়ির দিকে, গাড়ির ভেতরে রয়েছে সেন্ট সেমভেল।
এই সময় পেছন থেকে দৌড়ে আসা অনেকগুলো পায়ের শব্দ এবং একদম পাশ থেকেই একটা কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেল, আহমদ মুসা গুলি!
কিছু করার আগেই পেছনে একটা গুলির শব্দ, সেই সাথে আর্ত কণ্ঠের একটি চিৎকার।
দুই কণ্ঠই ইভা নারিনের, বুঝতে পেরেছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা দ্রুত ঘুরিয়ে নিল নিজেকে। দেখল ইভা নারিন গুলি খেয়ে। পড়ে আছে তার পেছনে নয়, তিন চার ফুট বাম দিকে। গুলির শব্দ লক্ষে তাকাল আহমদ মুসা। দেখল, একজন মহিলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। তার হাতে উদ্ধত রিভলবার, হিংস্র তার চেহারা।
আহমদ মুসা তার রিভলবার টার্গেটে আনার সময় পেল না। বসে পড়ল সে। একটা গুলি তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
আহমদ মুসা বসে পড়ার সুযোগ নিয়ে তার রিভলবারকে টার্গেট নিয়ে এল এবং গুলি করল মহিলাটিকে। মহিলাটির রিভলবার নতুন টার্গেটে স্থির হবার আগেই গুলি খেয়ে পড়ে গেল মহিলাটি।
আহমদ মুসা ছুটে গেল ইভা নারিনের দিকে।
কুঁকড়ে গেছে তার দেহ। ডান হাত দিয়ে বাম পাঁজরটা চেপে ধরে আছে। তার চোখ বন্ধ।
আহমদ মুসা তার মাথাটা নিজের হাতে তুলে নিল। বলল, ইভা নারিন। কেমন বোধ করছ? হঠাৎ কোত্থেকে এলে? গুলিটা তো আমাকে করেছিল।
এ তুমি কি করলে? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে কি করলে তুমি! কি বলব। তোমার বাবাকে?
দিভিনের পুলিশ প্রধান ভাহান ভারদান ও আরও কয়েকজন পুলিশ এসে পড়ল।
কি সর্বনাশ! ম্যাডাম ইভা নারিনের একি সর্বনাশ হলো। তিনিই। আমাকে সেন্ট গ্রেগরি কমপ্লেক্সের খবর দিয়ে ছিলেন। তিনি কেন কখন কিভাবে এখানে ঢুকে পড়েছেন, তার কিছুই আমরা জানি না। আমরা দেখতে পেয়েছি, পাশের ঐ জানালা দিয়ে মহিলাটি গুলি করেছে। ম্যাডাম নারিন পেছনের রুম থেকে আপনার দিকে ছুটে আসছিল। সেও শেষ। মুহূর্তে দেখতে পেয়েছিল মহিলাটি গুলি করছে। তখন করার কিছুই ছিল না। ম্যাডাম আপনাকে আড়াল করে গুলির সামনে দাঁড়ায়। আর…।
দিভিনের পুলিশ প্রধানের কথার মধ্যেই আহমদ মুসা বলে উঠল, প্লিজ মি. ভাবদান, এই গাড়িতে সেন্ট গ্রেগরি ওরফে সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল পালাচ্ছিলেন। এখনও গাড়ির ভেতরে আছেন। তাকে গ্রেপ্তার করুন প্লিজ। সে মারাত্মক আহত।
সেন্ট গ্রেগরিই কি সেন্ট সেমভেল স্যার? বলল দিভিনের পুলিশ প্রধান ভাহান ভাবদান। তার কণ্ঠে অপার বিস্ময়।
হ্যাঁ, মি. ভাবদান। আহমদ মুসা বলল।
স্যার, গোটা গ্রেগরি চার্চ কমপ্লেক্স পুলিশ ঘিরে আছে। কেউ পালাতে পারবে না। আমি সেন্ট সেমভেলকে গ্রেপ্তার করছি স্যার। ম্যাডামের জন্যে অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলি। বাইরে আছে কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স। বলল ভাহান। ভাবদান।
তাড়াতাড়ি বলুন, প্লিজ। ওকে পুলিশ হাসপাতালেই নিতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলল, একটা অনুরোধ করব মি. ভাবদান। সেন্ট গ্রেগরি গির্জা, আন্ডারগ্রাউন্ড এই এলাকা এবং সেন্ট গ্রেগরি ওরফে সেন্ট সেমভেলের বাড়ির সমস্ত কম্পিউটার, দলিল দস্তাবেজ, ইত্যাদি সব কিছু এভিডেন্স হিসাবে কবজা করা দরকার।
অবশ্যই স্যার। লাশগুলোর সুরতহাল নেয়ার পর এটাই হবে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ধন্যবাদ স্যার।
অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল। আহমদ মুসার হাতের উপর মাথা থাকতেই ইভা নারিন চোখ খুলল। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, আপনার কি এখানে খুব কাজ? একটা অনুরোধ করতে পারি?
বলেই আবার ক্লান্তিতে চোখ বুজল ইভী নারিন।
বল, ইভা নারিন। বলল আহমদ মুসা।
চোখ না খুলেই বলল, অ্যাম্বুলেন্সে কি যেতে পারবেন আমার সাথে? আমার সময় বেশি নেই।
হ্যাঁ, আমি অবশ্যই থাকছি তোমার সাথে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আপনাকে। বাবাকে একটু জানান। ইভা নারিন বলল।
ইভা নারিনকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো। তার পাশেই অ্যাটেনডেন্টের ছোট্ট চেয়ারে বসল আহমদ মুসা। চলছে অ্যাম্বুলেন্স।
চোখ বন্ধ করে আছে ইভা নারিন।
এক সময় চোখ খুলল। বলল আস্তে আস্তে, জানেন সেন্ট সেমভেলের মহিলা পি.এ. আনুশা আমাকে আন্ডারগ্রাউন্ড কমপ্লেক্সে ঢুকতে সাহায্য করেছে এবং বলেছে আপনি বিপদে পড়েছেন। এখানে কোন এক ঘরে নিচে নামার সিঁড়ি সেটাও তিনি আমাকে বলেছিলেন। সেই সিঁড়িই আমি খুঁজছিলাম। ভেতরে গোলাগুলির শব্দ পেয়ে বুঝেছিলাম ওরা আপনাকে ফাঁদে আটকাতে পারেনি। এই সময় পেছনের ঘরটা পেরিয়েই দেখতে পেলাম আপনি গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন। যে মেয়েটা আপনাকে গুলি করছিল, তাকে আমি চিনি। সে ব্ল্যাক আর্মেনিয়াম টাইগার-এর গোয়েন্দা প্রধান সোনা সোসানা। বিপজ্জনক এক মহিলা। মেরে ভালো করেছেন। সেন্ট সেমভেল কেমন আহত? ক্ষীণ কণ্ঠ থেমে গেল ইভা নারিনের।
ইভা নারিন তুমি এখন আর কথা বলো না। পরে সব জানতে পারবে, সব বলব। বলল আহমদ মুসা
বেদনার এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ইভা নারিনের ঠোঁটে। চোখ বন্ধ করল সে। দুই ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, সে সময় আর হবে না! আমি সে সময় চাইও না।
-পরবর্তী বই রত্ন দ্বীপ-
Leave a Reply