আর্মেনিয়া সীমান্তে – সাইমুম ৫৬ – আবুল আসাদ
[ওআইসি ও রাবেতার যৌথ মেসেজ এল। কোন উপায় না দেখে তারা আহমদ মুসার কথা স্মরণ করছে। …. আর্মেনিয়ার দিভিন উপত্যকায় দশ হাজার সদস্যের একটা মুসলিম জনপদ আজ বিপন্ন। এদের আসল পরিচয় হলো এরা সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবীর প্রত্যক্ষ বংশধরদের সর্বশেষ শাখা। …… অদৃশ্য এক ষড়যন্ত্র এসে তাদের ঘিরে ধরেছে। তারা অব্যহত গুম, খুন ও ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার। তাদের শস্যক্ষেত অজ্ঞাত কারণে বিরান এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো রহস্যময় অগ্নিকান্ডের শিকার হচ্ছে। এর তদন্ত ও প্রতিবিধান করতে গিয়ে আর্মেনিয়া সরকারের চার দক্ষ গোয়েন্দা, ইউনেস্কো, ওআইসি আর রাবেতার পাঁচ কর্মকর্তা নির্মমভাবে নিহত হলো। তদন্ত ও প্রতিকার তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে। অসহায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দশ হাজার নারী পুরুষ শিশু। ধ্বংস হওয়াই কি তাদের ভাগ্য? ….. না, আহমদ মুসা ছুটল এবার আর্মেনিয়া সীমান্তে। …. কিন্তু সেখানে পা দিয়েই টের পেল ষড়যন্ত্র জটিল, সর্বব্যাপি! ভয়াবহ রকমের হিংস্র এরা। এদের সামনে দাঁড়ানো মানেই মৃত্যু। এমন অমানুষ শত্রু বহু দিন আহমদ মুসার সামনে পড়েনি। পদে পদে ভয়ংকর ভয়ংকর সব বিপদ, চারদিকে জীবন-মৃত্যুর খেলা। …. রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা শ্বাসরদ্ধকর এক কাহিনী নিয়ে এল এই সিরিজের ৫৬ নম্বর বই আর্মেনিয়া সীমান্তে।]
.
সাইমুম ৫৬ : আর্মেনিয়া সীমান্তে – আবুল আসাদ
বাংলা সাহিত্য পরিষদ
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
.
এই বইয়ের কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তি কিংবা কোন ঘটনার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। — লেখক।
.
১.
আমার মনে হয় জোসেফাইন, তুমি আবেগ নিয়ে বিষয়টাকে দেখছ। কিন্তু বিষয়টা আবেগের নয়। আমার জীবন, তোমার জীবন, সারার জীবন, এমনকি আমাদের আহমদ আব্দুল্লাহর জীবনও এর সাথে জড়িত। সুতরাং বিষয়টা নিয়ে তোমাকে ধীরস্থিরভাবে ভাবতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা শুয়েছিল।
জোসেফাইন বসেছিল আহমদ মুসার মাথার কাছে।
জোসেফাইনের ডান হাতটা আহমদ মুসার মুঠোর মধ্যে।
আহমদ মুসার দিকে জোসেফাইন তাকিয়েছিল পলকহীন চোখে।
আহমদ মুসার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে উঠল জোসেফাইনের মুখ। সে হাত ছাড়িয়ে নিল আহমদ মুসার হাত থেকে। বলল, তুমি আমার চিন্তা, আমার কথাকে আবেগ বলছ? বরং আমার মনে হয়, তুমিই আবেগ থেকে কথা বলছ। আমার চিন্তা হঠাৎ আবেগপ্রসূত নয়। আমি দীর্ঘ দিন ভেবেছি এ বিষয়টা নিয়ে। মনে আছে তোমার, আমি ইস্তাম্বুলে তোপকাপি প্রাসাদে অবস্থানকালে তোমাকে বলেছিলাম আমাকে আমেরিকা সফরের অনুমতি দেয়ার জন্যে। তারও আগে থেকে আমার এই চিন্তার শুরু। আমি একজন মেয়ের মন নিয়ে, তোমার স্ত্রীর মন নিয়ে, সারাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি। অনেক ভারনার ফল আমার এই সিদ্ধান্ত। একে তুমি আবেগপ্রসূত বলে আমার প্রতি অবিচার করতে পার না।
আহমদ মুসার মুখও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। জোসেফাইনের হাত আবার হাতে নিয়ে বলল, আমার আবেগপ্রসূত বলার অর্থ এই নয় যে, তুমি কথাটা হঠাৎ বলছ কিংবা চিন্তা না করে বলছ। আবেগপ্রসূত বলেছি কারণ, গোটা বিষয়টা তোমার জন্যে আবেগের। একজন বান্ধবীর সাথে তোমার সম্পর্কের বা সে রকম একজন মেয়ের সাথে আমার সম্পর্কের বিষয়টা আবেগেরই হওয়ার কথা। এমন ক্ষেত্রে আবেগপ্রবণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তোমার, আমার এটা কোন দোষ নয়। কিন্তু তুমি যে চিন্তা করছ, যে কথা তুমি বলছ, তা অপ্রয়োজনীয়, অন্যায় ও অস্বাভাবিক জোসেফাইন।
অপ্রয়োজনীয়? অন্যায়? অস্বাভাবিক? এটা কি চিন্তা করে বলছ? তুমি আহমদ মুসা, এ কথা তুমি কি করে বলতে পার? অন্যায়ের প্রতিকারের জন্যে যে বিপদের সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যে মানুষের অশ্রু মোছানোর জন্যে নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা সামান্যও ভাবে না, সেই আহমদ মুসা এটা কিভাবে বলতে পারে? তুমি সারা দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কথা ভাব, সারার কথা কোন দিন ভেবেছ তুমি? বলল জোসেফাইন। জোসেফাইনের কণ্ঠ ভারি।
স্যরি জোসেফাইন। পৃথিবীর দুঃখী মানুষের কাতারে তুমি জেফারসন পরিবারের সন্তান সারাকে রাখছ কি করে? বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না জোসেফাইন। তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে স্তম্ভিত দৃষ্টি। জোসেফাইন হাত দিয়ে আহমদ মুসার মুখ একটু তুলে ধরল। আহমদ মুসার চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি এ কথা বলতে পারলে? এত নিষ্ঠুর হতে পারলে সারা জেফারসনের প্রতি?
তুলনাটা করে আহমদ মুসাও একটু বিব্রত হয়েছিল। এভাবে তুলনা করা ঠিক হয়নি, আহমদ মুসাও এটা উপলব্ধি করল। জোসেফাইনের চিন্তার প্রতি কঠোর হতে গিয়েই আহমদ মুসা এটা বলেছে।
আহমদ মুসা যখন এসব ভাবছিল, তখন নীরবতা ভেঙে জোসেফাইনই কথা বলল, শান্তি ও সুখ এক জিনিস নয় আহমদ মুসা। যেমন এক নয় অশান্তি ও কষ্ট। সারার মতো প্রথম শ্রেণীর নাগরিকরা শান্তিতে থাকতে পারে, কিন্তু এই শান্তি তাদের সুখ নিশ্চিত করে না। তুমি সারার শান্তি দেখেছ, তার কষ্টটা দেখনি, তার কান্না দেখনি। জোসেফাইনের কণ্ঠ অরুদ্ধ। ঝর ঝর করে তার দুচোখ থেকে নেমে এসেছে অশ্রু।
স্যরি জোসেফাইন, এভাবে বলো না। তুলনাটা হঠাৎ হয়ে গেছে। আমি সেটা মিন করিনি। বলল আহমদ মুসা। তার নরম কণ্ঠ। গলা। ভারি।
জোসেফাইন চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি সারাকে আমার চেয়ে বেশি চেন। সারার মতো মেয়েরা নীরব কান্না, বিদীর্ণ অন্তর। নিয়ে শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু এরা মুখ খোলে না। সেই যে তোমাকে দেখা না দিয়ে পালিয়ে যাবার আগে চিঠি লিখেছিল, তারপর কি সে তোমার। সামনে এসেছে? আসেনি। সে শেষ হয়ে যাচ্ছে, যাবে, কিন্তু তোমাকে কিংবা কাউকে কিছুই জানতে দেবে না। তার প্রতি কোন অবিচার, আমি বলছি, আল্লাহ সইবে না।
উত্তরে আহমদ মুসা কিছুই বলল না।
জোসেফাইনের একটা হাত হাতে নিয়ে শূন্যে তাকিয়ে চুপ করে রইল। এক সময় সে চোখ ফিরিয়ে তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল ধীরে ধীরে, হ্যাঁ জোসেফাইন, সারাকে আমি চিনি। তাকে নিয়ে আমার কোন কথা নেই। আমার কথা তোমার অস্বাভাবিক চিন্তা নিয়ে।
আমার চিন্তাকে অস্বাভাবিক বলছ কেন? স্বয়ং আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা অস্বাভাবিক হয় কি করে? জোসেফাইন বলল।
হালাল করেছেন, কর্তব্য বলেননি। বিষয়টা বান্দাদের এখতিয়ারে। ছেড়ে দিয়েছেন। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে, বান্দার এখতিয়ারে ছেড়ে দিয়েছেন, কর্তব্য বলে অভিহিত করেননি। কিন্তু হালাল করেছেন কেন? জোসেফাইন বলল।
এর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, এজন্যে হালাল করেছেন। বলল আহমদ মুসা।
আমার যে চিন্তাকে অস্বাভাবিক বলছ, তা কি প্রয়োজন থেকে উদ্ভুত নয়? জোসেফাইন বলল।
প্রয়োজন সম্পর্কে ধারণা সবার এক রকম হয় না। এটা রিলেটিভ। ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে। বলল আহমদ মুসা।
কিছু প্রয়োজন আছে সার্বজনীন। তা ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে না, রিলেটিভ নয়। যে প্রয়োজন থেকে আমার চিন্তাটা এসেছে, তা সার্বজনীন একটা বিষয়। সব মানুষের ক্ষেত্রে তা একই রকম। জোসেফাইন বলল।
উত্তরে আহমদ মুসা কিছু বলল না। চোখ নামিয়ে নিল সে জোসেফাইনের চোখ থেকে। আহমদ মুসার চোখে-মুখে বিব্রত ভাব।
কথা বলল জোসেফাইন, দেখ তোমাকে বুঝ দেবার ক্ষমতা আমার নেই, কোন বিষয়েই সঠিক বুঝের তোমার অভাব নেই অবশ্যই। শুধু কোন বিষয় আমি তোমার কাছে তুলে ধরতে পারি। আমি সেটাই করেছি। জোসেফাইনের কান্নাভেজা কণ্ঠ।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের দুই হাত নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন জোসেফাইন? আমরা তো একে অন্যের অভিভাবক, পরিপূরক। আমি ভুল করলে তা শুধরাবার, কিছু না জানলে তা জানাবার, না বুঝলে তা বুঝাবার- শুধু অধিকার নয়, দায়িত্বও তোমার।
ধন্যবাদ।
বলে জোসেফাইন একটু ক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, তুমি কি সারার জীবন নিয়ে ভেবেছ কোন সময়?
স্যরি, ভাবিনি জোসেফাইন। এ ধরনের ভাবনা আমার কাছে অন্যায় মনে হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
ভাবা অন্যায় হবে কেন? একজন মানুষ তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার বিষয়ে ভাবা অন্যায় হবে কেন? জোসেফাইন বলল।
বিষয়টা নিয়ে এমন ঘনিষ্ঠভাবে আমি ভাবিনি। ভাববার প্রয়োজনও মনে হয়নি। কারও প্রতি দুর্বল হয়ে পড়া, কাউকে ভালোবাসা সব সমাজেরই একটা সাধারণ দৃশ্য। আবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজের দুর্বলতা, ভালোবাসা থেকে সরে আসার ঘটনা কোন সমাজেই দুর্লভ নয়। এজন্যেই আমি তার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছি, সেও আমার থেকে দূরে সরে থেকেছে। আমি নিশ্চিত ভেবেছি, এভাবেই সে সব ভুলে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বলল আহমদ মুসা।
একটা সম্ভাব্য রেজাল্ট তুমি ধরে নিয়ে বসে আছ। এদিকে কি ঘটেছে। জান না। সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সরে যাবার জন্যে, সব ভুলে যাবার জন্যে। কিন্তু সে পারেনি। পারেনি, একথা সে কাউকে জানতে দেয়নি, দিচ্ছেও না। এমনকি তার মাকেও না। দেখতে সে নীরব, শান্ত। কিন্তু ভেতরে তার অগ্নিগিরির জ্বালা। দেশে থাকতে আমি এতটা ভাবিনি। এখানে এসে তার সাথে মিশেও তা বুঝিনি। সে পাথরের মতো শক্ত ও শান্ত। ধীরে ধীরে নানা কথায় নানাভাবে তার মায়ের মুখ খুলতে পেরেছি। সারার অলক্ষ্যে সারার কিছু বিষয় তিনি দেখেছেন। সে সব কাহিনী বলতে গিয়ে তিনিও কেঁদেছেন, আমিও কেঁদেছি। আর তুমি ভালো করেই জান, দূরে সরে যেতে, ভুলে যেতে অনেক মেয়েই পারে, সব মেয়ে পারে না। সারার মতো মেয়েরা তো পারেই না। সুতরাং তুমি যে আশা করেছিলে, তা তার ক্ষেত্রে সফল হয়নি, সফল হবারও নয়। জোসেফাইন বলল।
জোসেফাইন, সারার যে বিষয় তুমি তুলে ধরলে তা তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছে জানি না, কিন্তু আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। খুব ভালো মেয়ে সারা। তার এ অবস্থার জন্য আমি দায়ী। কিন্তু আমি কি করব তার জন্যে? তুমি এমন জীবনের কথা বললে, তেমন জীবনের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আমি অমন জীবনের জন্যে প্রস্তুত নই জোসেফাইন। বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ নরম, ভেজা। যেন অশ্রু সাগর পেরিয়ে এসেছে।
তাহলে সারার কি হবে? সে কি এভাবে তিল তিল করে শেষ হয়ে যাবে? একটা জীবনকে বাঁচানোর চাইতে বড় প্রয়োজন আর কি আছে? এমন প্রয়োজন সামনে রেখেই তো আল্লাহ রাব্বল আলামিন একাধিক বিয়ে হালাল করেছেন। এই প্রয়োজনের দাবি তুমি অস্বীকার করবে কেন? বলল। জোসেফাইন।
আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না জোসেফাইন। কোন জবাব আমার কাছে নেই।
থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। বলল, জোসেফাইন, সারার মাকে তুমি কিছু বলেছ?
হ্যাঁ বলেছি। জোসেফাইন বলল।
কি বলেছ?
জোসেফাইন আহমদ মুসার চোখে চোখ রাখল। বলল, অভয় দাও তো বলতে পারি।
কি অভয়? বলল আহমদ মুসা।
তুমি বকবে না তো আমাকে? জোসেফাইন বলল।
তোমাকে কখনও বকেছি? বলল আহমদ মুসা।
না, বনি। কিন্তু এবার বকুনি খাবার কাজ করেছি। জোসেফাইন বলল।
বকুনি খাবার মতো কাজ করলে কেন? বলল আহমদ মুসা।
তোমার উপর আমার আস্থা আছে। জোসেফাইন বলল।
তাহলে বকুনির ভয় কেন, বল? বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন একটু ভাবল। কথা বোধ হয় গুছিয়ে নিল। বলল, আমি তাকে সুযোগ মতো সরাসরি বলেছি, আমি সারাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তিনি শুনে অনেকক্ষণ চুপ থেকেছেন। তারপর কেঁদেছেন? সারার কথা বলতে গিয়ে আরও কেঁদেছেন। বলেছেন, ইসলাম ধর্মে একাধিক বিয়ে আছে। মুসলিম সমাজে তা প্রচলিত আছে। কিন্তু সারা ভিন্ন প্রকৃতির মেয়ে। সে ভাঙে কিন্তু মচকায় না। তিনি জানালেন, প্রেসিডেন্টের পরামর্শে জর্জ আব্রাহাম জনসন একবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এই বিয়ের ব্যাপারে সারাকে বলতে। কিন্তু অবশেষে তিনি সাহস পাননি। মা আমার কেঁদে কেঁদেই শেষ হয়ে যাবে, কাউকে জানতেও দেবে না, বলবেও না কিছু। কেঁদে কেঁদে এসব কথা বলেছিলেন সারার মা। এসবই কথায় কথায়। হয়েছিল সারার মায়ের সাথে। জোসেফাইন বলল।
সারাকে এসব কথা তুমি নিশ্চয় বলেছ? বলল আহমদ মুসা।
তুমি এত সব আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন? তোমার জবাব জানতে চেয়েছি, সেটা তো বলছ না? জোসেফাইন বলল।
কারণ তুমি আমার স্ত্রী। তুমি কত দূর এগিয়েছ, সেটা আমার জানা। দরকার। বলল আহমদ মুসা।
সারার মাকে যা বলেছি, সারাকে আমি সরাসরি সেটাই বলেছি। বলেছি যে, আমি তাকে চিরদিনের জন্যে নিতে এসেছি। জোসেফাইন বলল।
ইন্না লিল্লাহ…। কথাটা আমার পক্ষ থেকে বলনি তো? মানে প্রস্তাবটা আমার পক্ষ থেকে হয়ে যায়নি তো? বলল আহমদ মুসা।
আমি তা বলিনি, সে তা মনেও করেনি। জোসেফাইন বলল।
আহমদ মুসা কিছু বলল না।
জিজ্ঞাসা করলে না, সারা কি বলেছে? জোসেফাইন বলল।
সারার মায়ের কথা থেকে বুঝা যায় সারা কি বলতে পারে। বলল। আহমদ মুসা।
না জনাব, সারার মার কথা থেকে তা বুঝা যায় না। বরং তোমার কথার সাথে সারার কথার মিল আছে। তুমি আমার চিন্তাকে বলেছ, অস্বাভাবিক আর সে বলেছে, অসম্ভব। আর তোমার সাথে তার পার্থক্য হলো, একথা তোলায় সে কেঁদেছে বেশি, কথা বলেছে কম। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, সারার ভবিষ্যত কি, সারার কি হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে সারা বলেছে, আমি জানি না। আর তুমি বলেছ, এই প্রশ্নের উত্তর। আমার কাছে নেই। দুজনের একই উত্তর। এর অর্থ তোমরা দুজনের কেউই সিদ্ধান্ত নেবার পর্যায়ে নেই। সিদ্ধান্ত তোমাদের বাইরে থেকে আসতে হবে।
জোসেফাইন, যে বিবরণ তুমি দিলে তার অর্থ এও হতে পারে যে, আমি ও সারা দুজনেই সময়ের বাস্তবতাকে মানতে চাচ্ছি। তুমি যে চিন্তা করছ, তা আমরা কেউ করছি না। বলল আহমদ মুসা।
তোমার কথা বলছি না। সারার কথা বলতে পারি, সে ভাবছে না তা নয়। না ভাবলে এত কাঁদছে কেন? কষ্ট নিয়েই তো কাঁদছে, তার জীবন নিয়েই তো কাঁদছে। অসম্ভব বলে যে কথা বলেছে তা নেতিবাচক অর্থে নয়, অবাঞ্ছিত, অসহনীয় চলমান সামাজিক মানসিকতার অর্থে। এই মানসিকতার সে অসহায় শিকার। জোসেফাইন বলল।
অসম্ভব বলতে কি সারা এটুকুই বুঝিয়েছে জোসেফাইন? বলল আহমদ মুসা।
তুমি ঠিকই ধরেছ। শুধু এটুকুই নয়, তার আরও কথা আছে। তোমার পারসোনাল ও প্রাইভেট লাইফে বিপর্যয় নামাতে সে চায় না। তুমি শুধুই আমার। আমার এই এক্সকুসিভ অধিকারে অন্যথা ঘটাতে সে রাজী নয়। বলল জোসেফাইন।
তার কোন্ কথাকে তুমি অস্বীকার কর জোসেফাইন? বলল আহমদ মুসা। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
আমি সব কথাকেই অস্বীকার করেছি। একজনের পারসোনাল ও প্রাইভেট লাইফে বিপর্যয় আসে, যদি অবাঞ্ছিত কিছু ঘটে যায়। এটা অবাঞ্ছিত কিছু ঘটে যাওয়া নয়, বরং এটা একজনের জীবনকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা, একজনের জীবনকে সম্মান করা। আমাদের রাসুল (সা.) এর পরবর্তী বিয়েগুলো সব এই ধরনের। এর পর থাকে তোমার উপর আমার এক্সকুসিভ অধিকারে অন্যথা ঘটানোর প্রশ্ন। আমি তাকে বলেছি, অনেক নদী এক সাগরে গিয়ে পড়ে। কারই আশ্রয়ের অভাব হয় না। আহমদ মুসার হৃদয়টা সাগরের মতোই বড়। সেখানে আমাদের দুজনের স্বাধীন অবস্থানের জন্যে জায়গার কোন অভাব হবে না। তোমাকে ভালোবাসার জন্যে আমার জন্যে তার যে ভালোবাসা তা থেকে কিছু কাটতে হবে না। তা কাটতে হয় না। আল্লাহ মানুষের মনকে এভাবেই তৈরি করেছেন। না হলে একাধিক বিয়ের অনুমতি আল্লাহ দিতেন না। জোসেফাইন বলল।
তুমি ঠিক বলেছ জোসেফাইন। আল্লাহ এভাবে মানুষের মন তৈরি করেছেন। যারা মন এভাবে রাখতে পারবে না, মানে যে একাধিক স্ত্রীকে সমানভাবে দেখতে পারবে না, তাদের একাধিক বিয়েতে নিষেধ করা। হয়েছে। আমার মনেও এ আশঙ্কা আছে জোসেফাইন। বলল আহমদ মুসা।
তুমি তর্কের খাতিরে, তর্কের জন্যেই একথা বলছ। তাই তোমার এ কথার জবাব আমি দেব না। শুধু তোমাকে তোমার মনকে জিজ্ঞাসা করতে বলব, সেখানে জোসেফাইনের পাশে সারার বসার জন্যে স্থানের অভাব ঘটবে কি না? জোসেফাইন বলল। আবেগে তার কণ্ঠ রুদ্ধ।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না। তার গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠল।
জোসেফাইনই আবার মুখ খুলেছিল কথা বলার জন্যে।
এ সময় দরজায় কয়েকটা দ্রুত নক হলো। সাধারণত এমন নক হয় না। বিস্মিত জোসেফাইন দ্রুত এগোলো দরজার দিকে। দরজা খুলল।
দরজায় জিনা জেফারসন। সারার মা দাঁড়িয়ে।
জোসেফাইনকে দেখেই সে ভাঙা গলায় দ্রুত বলে উঠল, মা জোসেফাইন, আমার সারা মা অ্যাকসিডেন্ট করেছে।
অ্যাকসিডেন্ট করেছে? সারা? কোথায় সে এখন? কেমন আছে? আতংকের সুরে বলে উঠল জোসেফাইন। উদ্বেগে আচ্ছন্ন তার মুখ।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে এসে জোসেফাইনের পাশে দাঁড়াল। বলল, কে জানাল? কোথায় সে মা?
পেন্টাগন মিলিটারি হাসপাতাল থেকে কে একজন টেলিফোন করে জানাল। বলল সারার মা জিনা জেফারসন।
অ্যাকসিডেন্টের খবরের সাথে আর কিছু বলেনি? জোসেফাইন বলল।…
জিনা জেফারসন কিছু বলার আগেই তার হাতের মোবাইল আবার বেজে উঠল।
কলটা ধরল জিনা জেফারসন।
কলটা ধরেই ওপারের কথা শুনে বলল। হ্যাঁ, আহমদ মুসা আছে। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
ওপারের কথা শুনে এবং কথা শেষ করেই মোবাইলটি আহমদ মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা কল ধরে সালাম বিনিময়ের পর ওপারের কথা শুনল। মাঝে মধ্যে দুএকটা কথাও বলল। কল শেষ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা জিনা জেফারসন ও জোসেফাইনকে লক্ষ্য করে বলল, সারা জেফারসনের মাথার সামনে আঘাত লেগেছে। তার ডান হাত ও ডান কাঁধেও আঘাত লেগেছে। কিছুক্ষণের জন্যে সে সংজ্ঞা হারিয়েছিল। হাসপাতালে নেয়ার পর তার জ্ঞান ফিরেছে। ভার্জিনিয়া থেকে আসার সময় ওয়াশিংটনে ঢোকার পথে একটা গাড়ি তার গাড়িকে ধাক্কা দেয়। কমান্ডোদের গাড়ি তার পেছনে ছিল। তারাই তাকে হাসপাতালে নেয়। জর্জ আব্রাহাম জনসন হাসপাতালে যাচ্ছেন। আমাদের জন্যে সিকিউরিটি ফোর্সের গাড়ি আসছে।
সারার তো বড় কোন ক্ষতি হয়নি? জোসেফাইন বলল। তার কম্পিত কণ্ঠস্বর।
পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছে। ওর সংজ্ঞা ফিরেছে, বড় ধরনের কোন আশংকা নেই। এস আমরা প্রার্থনা করি, সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক। বলল আহমদ মুসা।
আমিন। বলল জোসেফাইন ও জিনা জেফারসন একই সাথে।
.
আল হামদুলিল্লাহ। সারা তোমাকে আজ অনেক ফ্রেশ লাগছে। তোমার উপর দিয়ে বিরাট ধকল গেল। বলল জোসেফাইন।
সারা জেফারসনের মাথার কাছে চেয়ারে বসে আছে জোসেফাইন। তার একটা হাত সারা জেফারসনের মাথায়।
সারা জেফারসনের হাতে তখনও ব্যান্ডেজ। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হয়েছে। তবে কপালের উপরের ক্ষতটার চিহ্ন এখনও তাজা। ক্ষতস্থানে একটা পেস্টিং ব্যান্ডেজ লাগানো আছে। কাঁধের আঘাতটায় ফ্র্যাকচার ছিল না। তা অনেকটাই সেরে উঠেছে। তবে ওপাশ ফিরে শোবার মতো এখনও হয়নি।
সারা জেফারসনকে মিলিটারি হাসপাতালে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তাকেও হাসপাতালের একটা স্যুটে রাখা হয়েছে। স্যুটে রোগীর। কক্ষ ছাড়াও একটা অ্যাটেনড্যান্ট কক্ষ, একটা গেস্ট রুম, একটা ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম ও ওয়াশ রুম রয়েছে।
সারার মা জিনা জেফারসন প্রতিদিনই হাসপাতালে একবার করে। আসেন। কিন্তু জোসেফাইন সেই যে এসেছে আর ফিরে যায়নি। আহমদ মুসাকেও যেতে দেয়নি। আহমদ আব্দুল্লাহ তো রয়েছেই।
জোসেফাইনের কথা শুনে সারা জেফারসন তাকাল জোসেফাইনের দিকে। মাথা থেকে জোসেফাইনের হাত সে নিজের হাতে তুলে নিল। বলল, ধকলটা আমার চেয়ে তোমার উপর দিয়েই বেশি গেল। আমি তো শুয়ে থেকেই খালাস। তুমি তো সবকিছুই দেখছ, সবকিছুতেই আছ। তোমাকে কি বলে প্রশংসা করব। কিছুই বলার আমার নেই।
থামল সারা জেফারসন। তার দুচোখের কোনায় অশ্রু এসে গেছে।
জোসেফাইন সারা জেফারসনের অশ্রু মুছে দিয়ে হেসে বলল, আরেকজনের কথা বলছ না কেন? সেও তো আমার সাথে তোমার পাশেই। সারাক্ষণ আছে?
সারার মুখ লাল হয়ে উঠল।
একটু হাসল। বলল, তুমি আছ বলেই তো উনি আছেন। সুতরাং কৃতিত্ব, প্রশংসা সব তোমার প্রাপ্য।
জোসেফাইন সারার গাল টিপে দিয়ে বলল, ওরে দুষ্ট। তবু ধরা দেবে না। আমি থাকলেই কি উনি থাকেন? জান, তোমার মাথার আঘাত নিয়ে উনি কি ভীষণ উদ্বেগে ছিলেন?
আপা উনি তো সকলের, সব মানুষের। সব দুর্গত মানুষের পাশেই উনি ছুটে যান। সারা জেফারসন বলল।
জোসেফাইন সারা জেফারসনের চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বলল সে ধীর কণ্ঠে, সারা, এই তুলনা কি তোমার ঠিক হলো? আর দশ জায়গায় যাওয়ার সাথে এখানে তার আসাকে এক করে দেখলে?
সারা জেফারসন কিছু বলল না। চোখ বুজল। মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে।
জোসেফাইন হাসল। সারা জেফারসনের মুখ ঘুরিয়ে নিল সে নিজের দিকে। বলল, তাকাও আমার দিকে সারা।
সারা জেফারসন চোখ খুলল।
সারা জেফারসনের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু খসে পড়ল, গড়িয়ে এল গণ্ড বেয়ে। বলল, আপা, এত দিন ওঁকে রেখেছেন। ওঁকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন? ওঁর সময় কত মূল্যবান? আমার ভাবতেও খারাপ লাগছে, আমার কারণে তিনি এভাবে আছেন। কথাগুলো বলল সারা চোখ নামিয়ে রেখে।
জোসেফাইন সারা জেফারসনের মুখ উপরে তুলে নিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল, এসব পোশাকি কথা বলেবে না সারা। তোমাকে আমি জানি। বল, এখনি যদি আহমদ মুসাকে আমি বলি, চলে যাও! তুমি খুশি হবে?
আবার চোখ বুজল সারা জেফারসন। চোখ ভরে গেছে তার অশ্রুতে। বন্ধ, চোখের বাধা ডিঙিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তার অশ্রু। বালিশ থেকে মাথা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে এনে জোসেফাইনের হাত জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, এসব প্রশ্ন আমাকে করো না আপা। জান তুমি, এসব প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না, জিজ্ঞাসা আমাকে করো না আমার হৃদয় ক্ষত বিক্ষত আপা। অ্যাকসিডেন্টও আমাকে বাঁচিয়ে রেখে গেল, মরতে পারলে বোধ হয় ভালো হতো। কি করব আমি!
জোসেফাইন চেয়ার থেকে উঠে সারা জেফারসনের মাথার কাছে বসল। মাথাটা কোলে টেনে নিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলল, সারা, তুমি তোমার আত্মার আহ্বানকে বহিরাগত চিন্তা দিয়ে দমিয়ে রাখতে চাইছ। তা করো না সারা। আত্মার আহ্বানকে তুমি শোন।
উত্তরে সারা কিছু বলল না। সে জোসেফাইনের হাত আরও জোরে চেপে ধরল।
তোমার ওর সাথে কথা বলা উচিত। সারার কানে কানে বলল জোসেফাইন।
আমাকে বিপদে ফেলো না আপা। সারা জেফারসন বলল।
এমন সরাসারি আলোচনায় দোষ নেই সারা। তোমাদের মধ্যে একবার অন্তত এভাবে কথা হওয়া উচিত। বলল জোসেফাইন।
জোসেফাইনের কথা শেষ হতেই দরজায় নক হলো। উনি এসেছেন। বলে জোসেফাইন তাড়াতাড়ি সারার গায়ে চাদর টেনে দিল। মাথার উড়নাটাও কপাল পর্যন্ত নিয়ে এল। নিজের মাথাতেও চাদর টেনে নিল জোসেফাইন।
এস। বলল জোসেফাইন।
আহমদ মুসা কক্ষে প্রবেশ করল এবং সালাম দিল। তোমার অপেক্ষা করছি। বলল জোসেফাইন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য। করে।
কেন? কোন জরুরি কিছু? সারা ভালো আছে? এক নিশ্বাসে এতগুলো প্রশ্ন করে চুপ করল আহমদ মুসা।
হাসল জোসেফাইন। বলল, এতো উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই।
একটু থামল জোসেফাইন। তারপর আবার বলল, আহমদ আব্দুল্লাহ কোথায়? গোসল ও খাওয়ার সময় ওর পার হয়ে যাচ্ছে।
জবাব দেবার প্রয়োজন হলো না আহমদ মুসার।
আহমদ আব্দুল্লাহ দৌড়ে এসে প্রবেশ করল কক্ষে।
কোথায় গিয়েছিলে আহমদ আব্দুল্লাহ? জোসেফইন বলল।
ঐ তো আম্মা, চিলড্রেন কর্নারে। বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
ঠিক আছে বেটা। বলে গেলে ভালো হতো। জোসেফাইন বলল।
বলে গেছি তো, মাম্মিকে। বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
ঠিক, আমাকে বলে গেছে আপা, ভুলে গেছি তোমাকে বলতে। জোসেফাইন আহমদ আব্দুল্লাহকে কাছে টেনে নিয়ে একটা চুমু খেয়ে বলল, ধন্যবাদ বেটা। এখন চল গোসল করতে হবে, খেতে হবে।
চলুন আম্মি। আমি মাম্মিকে একটা কথা বলে আসি। বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
আচ্ছা! বলে হেসে উঠে দাঁড়াল জোসেফাইন।
আহমদ আব্দুল্লাহ চেয়ারে পা দিয়ে সারা জেফারসনের বেড়ে উঠে তার মাথার কাছে বসল। পকেট থেকে চকলেটবার বের করে ফিসফিস করে সারা জেফারসনকে বলল, মাম্মি, এই চকলেটবারটি তুমি রাখ। ডাক্তার যেন না দেখে। ওরা তোমাকে তো চকলেট দেয় না। তুমি চুপে চুপে এটা খেয়ে নিও।
হেসে উঠল সারা জেফারসন। আহমদ আব্দুল্লাহকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, খেয়ে নেব বাবা। তুমি দিলে না খেয়ে আমি পারি।
আহমদ মুসা ও জোসেফাইন মুখ টিপে হাসছে।
আহমদ মুসা বলল, বেটা আহমদ আব্দুল্লাহ, চকলেটবার আমাদের জন্যে নেই?
মাম্মি অসুস্থ। তোমরা তো অসুস্থ নও বাবা। মাম্মি চকলেট পছন্দ করে। অনেক দিন হলো কেউ তাকে দেয়নি। বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
তোমাকে বলেছে বুঝি? জোসেফাইন বলল। আজই তো বলেছে। বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
সারা জেফারসনের চোখে-মুখে বিব্রতভাব ফুটে উঠেছে। সে চাদর টেনে নিল মুখের উপর।
হেসে উঠল আহমদ মুসা ও জোসেফাইন। বলল জোসেফাইন হাসতে হাসতে, আহমদ আব্দুল্লাহ তোমার মাম্মির সিক্রেট ফাস করে দিলে? আমার তো চোখে পড়েনি তার চকলেট প্রীতির কথা? তুমি জানলে কি করে?
কেন, মাম্মি তো সব সময় আমাকে সাথে নিয়ে চকলেট খায়। বলল আহমদ আব্দুল্লাহ।
সারা মুখ থেকে চাদর সরিয়ে নিয়ে আহমদ আব্দুল্লাহ! বলে ধরতে গেল তাকে।
আহমদ আব্দুল্লাহ না বলে উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে লাফ দিল বেড থেকে।
মেঝেতে পড়েই আহমদ আব্দুল্লাহ আহ! বলে ঝাঁকিয়ে উঠল।
আহমদ আব্দুল্লাহ! বলে চিৎকার করে উঠে সারা জেফারসন মাথা তুলে ঝুঁকে পড়তে গেল বেডের পাশে। পারল না অতদূর মাথা নিতে। তার আগেই ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল সারা জেফারসন। তার মাথাটা বালিশের উপর পড়ে গেল।
আহমদ আব্দুল্লাহর দিকে ছুটে গিয়েছিল জোসেফাইন।
আহমদ মুসাও ছুটে এল জেফারসনকে ধরতে।
জোসেফাইন পাঁজাকোলা করে আহমদ আব্দুল্লাহকে কোলে তুলে নিয়েছে। দেখতে লাগল ব্যথা কোথায় লেগেছে।
আহমদ আব্দুল্লাহ থেমে গেছে। সে বলছে, পায়ে লেগেছিল, এখন আর ব্যথা নেই।
ওদিকে আহমদ মুসা সারা জেফারসনের ডান কাঁধ ও মাথা ধরে আস্তে করে বালিশের উপর শুইয়ে দিল। আলগা হয়ে পড়া গায়ের চাদর ঠিক করে দিল।
সারা চোখ বুজে ছিল।
আহমদ মুসা বলল, মিস সারা, কাঁধের যন্ত্রণাটা বাড়ছে, না কমছে? হাতের আঘাতটায় কোন চাপ লাগেনি তো?
ধন্যবাদ! হঠাৎ ওঠায় ব্যথা লেগেছিল। এখন কমে যাচ্ছে। হাত ঠিক আছে।
বলেই চোখ খুলে তাকাল সারা জেফারসন জোসেফাইনের দিকে। বলল, স্যরি আপা, ওভাবে ওকে ধরতে যাওয়া ঠিক হয়নি। দুষ্টু যে এখান থেকে লাফ দিতে পারে, বুঝতে পারিনি।
তুমি এ নিয়ে ভেবো না সারা। ওর কিছু হয়নি। পাটা একটু বাঁকা হয়ে পড়ায় একটু ব্যথা পেয়েছে। তা সঙ্গে সঙ্গেই সেরে গেছে। তবে তোমার ওভাবে উঠে পড়া ঠিক হয়নি। জোসেফাইন বলল।
কখন যে এভাবে উঠেছি, বুঝতে পারিনি আপা। সারা জেফারসন বলল। তার মুখে ম্লান হাসি।
জোসেফাইন আহমদ আব্দুল্লাহকে কোল থেকে নামিয়ে বলল, চল এখন গোসলে যেতে হবে।
জোসেফাইন সারার কাছে গিয়ে তার মাথার স্কার্ফ ঠিক করে দিয়ে ওড়নাও ভালো করে মাথায় টেনে দিল। বলল, কম্বলটাও কি আরেকটু টেনে দেব গায়ে?
দাও আপা। সারা জেফারসন বলল।
কম্বল সারার কোমর পর্যন্ত টেনে দিল। জোসেফাইন গেল আহমদ মুসার কাছে। বলল, আমি আহমদ আব্দুল্লাহকে গোসল করিয়ে খাইয়ে আসছি। তুমি একটু বস এখানে। নার্সও পাশেই তার কেবিনে আছে।
আচ্ছা এস। বলল আহমদ মুসা।
যাবার জন্যে পা বাড়িয়েও ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, টেবিলে সারার মোবাইলটা আছে। ওদিকেও একটু দেখো। মাঝে মাঝে টেলিফোন আসে।
টেলিফোন এলে কি স্যরি বলব, না মিস সারাকে দিতে হবে? বলল আহমদ মুসা।
হাসল জোসেফাইন। বলল, সারার কাছে কোন অপ্রয়োজনীয় টেলিফোন আসে না। স্যরি বলবে কেন?
কি নিয়ম তোমাদের, আমি কি টেলিফোন ধরে মিস সারাকে দেব, না রিং অবস্থায় দেব। বলল আহমদ মুসা নিচু কণ্ঠে।
হাসল জোসেফাইন। বলল, আমাকে দেরি করানোর চেষ্টা করছ।
একটু থামল জোসেফাইন। বলল, পারসোনাল সেক্রেটারি বলে কাকে জান তো? এখন সেই সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করতে হবে তোমাকে।
তথাস্তু! বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন আহমদ আব্দুল্লাহর হাত ধরে চলে গেল।
আহমদ মুসা গিয়ে সোফায় বসল।
সেন্টার টেবিলের নিচের তাক থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল।
এমন সময় দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা উঠে দরজায় গেল। দেখল মেজর ম্যাক আর্থার দাঁড়িয়ে। তার সাথে মেজর নেলসন ও আরেকজন এশীয়।
মেজর নেলসন আহমদ মুসাকে স্যালুট দিয়ে বলল, স্যার, ইনি সৌদি দূতাবাস থেকে এসেছেন। আপনার জন্য একটা মেসেজ আছে।
মেজর নেলসন সারা জেফারসনের এই হসপিটাল স্যুটের নিরাপত্তার দায়িত্বে।
মেজর নেলসনের কথা শেষ হতেই সৌদি দূতাবাসের লোকটি বলল, আস্সালামু আলায়কুম। স্যর, আমি ব্রিগেডিয়ার আমর আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ। ওআইসির নিরাপত্তা কমিটির চেয়ারম্যান এবং রাবেতা আলম আল ইসলামীর সংখ্যালঘু কমিটির সভাপতির একটা যৌথ বার্তা নিয়ে এসেছি।
ব্রিগেডিয়ার আমর বার্তাটি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা বার্তাটি হাতে নিয়ে ইনভেলাপের উপরের লেখাটা পড়ল। তাতে লেখা রয়েছে ব্রাদার আহমদ মুসা, প্রযত্নে: সারা জেফারসন, জেফারসন ভিলা, ওয়াশিংটন।
ব্রিগেডিয়ার আমরই আবার কথা বলল। বলল, স্যার, অনুমতি দিলে আমি আসতে পারি।
কিন্তু ব্রিগেডিয়ার, মেহমানদারীর কি হবে? হেসে বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। আমি হাসপাতালে এসেছি। এটা মেহমানদারীর জায়গা নয় স্যার। বলল ব্রিগেডিয়ার আমর।
আচ্ছা ব্রিগেডিয়ার আবার দেখা হবে। বলল আহমদ মুসা।
সালাম দিয়ে ব্রিগেডিয়ার আমর মেজর নেলসনের সাথে চলে গেল।
সারা জেফারসনের কক্ষে ফিরে এল আহমদ মুসা।
সোফায় বসল এসে।
মনে হলো কেউ এসেছিলেন। না বসেই চলে গেলেন? জিজ্ঞাসা করল সারা জেফারসন আহমদ মুসার দিকে না তাকিয়েই।
হ্যাঁ মিস সারা, সৌদি আরব দূতাবাস থেকে ব্রিগেডিয়ার আমর এসেছিলেন ওআইসি ও রাবেতার একটা বার্তা নিয়ে। চলে গেছেন তিনি। বলল আহমদ মুসা।
বার্তা? কি বার্তা? বলল সারা জেফারসন। তার কণ্ঠে একটা চমকে ওঠার ভাব।
বার্তাটা বন্ধ ইনভেলাপে এখনও খুলি নাই। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা ইনভেলাপ তুলে নিয়ে খুলতে গেল।
বেজে উঠল টেবিলের উপর রাখা সারা জেফারসনের টেলিফোন।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে মোবাইল তুলে নিয়ে কল অন করে সারা। জেফারসনের কাছে নিয়ে গেল।
মোবাইল বেজে উঠলে সারা জেফারসন এদিকে তাকিয়ে ছিল। ষে, তার ডান হাত বাড়িয়ে আহমদ মুসার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিল। বলল, ধন্যবাদ।
ভালো। আপনি খুব ফরমাল হয়ে গেছেন। মোবাইল সারা জেফারসনের হাতে দিয়ে বলল আহমদ মুসা।
মুহূর্তের জন্যে সারা জেফারসন একটু থমকে গিয়েছিল। কিছু বলল। মোবাইলে অনুচ্চস্বরে কিছু কথা বলল। কথা শেষ করে মোবাইলটা টেবিলে ফেরত দেয়ার জন্যে মোবাইলসহ হাত বাড়িয়ে বলল, প্লিজ…।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে সারা জেফারসনের হাত থেকে মোবাইলটা নিল। আহমদ মুসা ফিরছিল-সোফায়।
আমি বেশি ফরমাল হয়ে গেছি। তার সাথে সাথে আমি আপনি এবং মিসও তত হয়েছি।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। বলল, ও এই কথা! অনেক দিন পর দেখা তো। অনেক কিছু ভুলে গেছি।
সারা জেফারসন আহমদ মুসার এ কথার জবাব দিতে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। বলল, একটা কথা বলতে পারি? গম্ভীর কণ্ঠ সারা জেফারসনের।
অবশ্যই। বল। বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গেই কথা বলল না সারা জেফারসন। একটা বিব্রত অবস্থা তার চোখে-মুখে। প্রবল একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ছায়া তার চেহারায়। নীরবতা ভেঙে সে বলল অবশেষে, জোসেফাইন আপার অসম্ভব চিন্তার বিষয়টা আপনি? জানেন? সারা জেফারসনের কথাগুলো বাধো বাধো ও কিছুটা ভাঙা কণ্ঠ। _ প্রশ্ন শুনে আহমদ মুসার চোখে-মুখেও গাম্ভীর্য নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গেই এর উত্তর তার কাছ থেকে এল না। একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ সারা জেফারসন, আমি হাসপাতাল থেকে ফেরার পর জোসেফাইন তার চিন্তার কথা আমাকে বলেছে।
একটু থামল আহমদ মুসা। শুরু করল আবার, জোসেফাইনের চিন্তাকে অসম্ভব বলেছো সারা! জোসেফাইন যখন আমাকেও তার এই চিন্তাটার কথা বলেছিল তখন আমিও তার চিন্তাকে অস্বাভাবিক, অন্যায় ও অপ্রয়োজনীয় বলেছিলাম। কিন্তু এখন তা মনে করছি না।
কেন? সারা জেফারসন বলল।
আমি যেটা শুনেছি, দেখেছি এবং আজ যা দেখলাম, তাতে এটা নিশ্চিত আহমদ আব্দুল্লাহর মাম্মি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছেন। আহমদ আব্দুল্লাহ তার মাম্মিকে ছাড়তে পারবে না এবং তার। মাম্মিও আহমদ আব্দুল্লাহকে কষ্ট দিতে পারবেন না। সুতরাং জোসেফাইনের চিন্তা আর অসম্ভব, অস্বাভাবিক নেই। বলল আহমদ মুসা। তার গম্ভীর কণ্ঠ।
সারা জেফারসনও উত্তর দিতে দেরি করল। বলল ধীর কণ্ঠে, আহমদ আব্দুল্লাহ অবুঝ ছেলে। তার কথা, তার কাজ আর অন্যের সিদ্ধান্ত এক হতে পারে না। সে পরিবারের অংশ, কেন্দ্র নয়। সারা জেফারসন বলল।
পরিবারের কেন্দ্রই এটা বলছে সারা জেফারসন। বলল আহমদ মুসা।
এই বলাটা একটা অবুঝ শিশুর মন-নির্ভর, তার ভালো লাগা নির্ভর। সারা জেফারসন বলল।
না সারা। এই বলাটা ঐ শিশুর মাম্মির মন-নির্ভর, তার মাম্মির ভালো লাগা নির্ভর, তার মাম্মির জীবন-নির্ভরও। বলল আহমদ মুসা।
সারা জেফারসনের মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। অশ্রুতে ভারি হয়ে উঠেছে। তার দুই চোখ। আহমদ মুসার কথার কোন জবাব দিতে পারল না সারা জেফারসন। একথা সে বলতে পারছে না আহমদ মুসার ঐ বলাটা মন নির্ভর নয়, ভালো লাগা নির্ভর নয়, তার জীবন-নির্ভর নয়। বলবে কি করে
এর চেয়ে বড় সত্য তার জীবনে কি আছে?
ঘরে প্রবেশ করল জোসেফাইন। ধন্যবাদ আহমদ মুসা, ধন্যবাদ সারা। আমি তোমাদের শেষের দিকের সব কথা শুনেছি। বলতে বলতে এগিয়ে এল জোসেফাইন। বসল সে এসে আহমদ মুসার সামনে কার্পেটের উপর। আহমদ মুসার দুই হাত টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ আহমদ মুসা। একজন লাভিং স্বামী হিসাবে, অন্যায়ের প্রতিরোধ ও সত্যের সংগ্রামের একজন দায়ী হিসাবে এবং একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসাবে যা এই মুহূর্তে করা দরকার তা তুমি করেছ। আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল জোসেফাইনের কণ্ঠ।
বলেই জোসেফাইন উঠে দাঁড়াল। ছুটে গেল সারা জেফারসনের কাছে। তার মাথার কাছে বসে তার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, আল্লাহর ইচ্ছা যে কি সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে সারা। না হলে সাত সাগর তের নদী পার হয়ে আমি ছুটে আসব কেন তোমার কাছে। আর ওঁর মতো লোককে বুঝাবার ক্ষমতা কি আমাদের আছে? তিনি আমার চিন্তা শোনার পরে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাতে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। দেখ, সেই তিনিও যুক্তির কাছে, বাস্তবতার কাছে এবং নিশ্চয় আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। এটা আল্লাহর রহমত সারা, তুমি ওঁর শেষ কথাটার জবাব দাওনি? তোমার কথাটা বল সারা।
সারার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। বলল অরুদ্ধ কণ্ঠে, আল্লাহর কি ইচ্ছা আমি বুঝতে পারছি না। হয়তো তুমি যা বলছ সেটাই। কিন্তু
তোমাকে বলেছি আপা, তুমি যা বলবে আর উনি যা বলবেন, তার বাইরে কী আমি যেতে পারি না, পারব না।
জোসেফাইন সারার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ধন্যবাদ সারা। তুমি আমাদের ইচ্ছার সাথে একমত হয়েছ। কিন্তু তোমার মত কি তা জানা গেল না?
আমাকে আর কিছু বলতে বলল না আপা। সারার কোন কথাটা তোমার অজানা আছে? বলল সারা খুব নিচু গলায়, প্রায় ফিসফিস করে।
ধন্যবাদ সারা। আমার বুক থেকে পাথর নেমে গেল। আল হামদুলিল্লাহ।
বলে মুখ ফিরাল জোসেফাইন আহমদ মুসাকে কিছু বলার জন্যে। দেখল আহমদ মুসা নেই, কোন ফাঁকে চলে গেছে। হাসল জোসেফাইন। মনে মনে বলল, আমি খুব খুশি আহমদ মুসা। তুমি আমার অনুরোধ রেখেছ। তুমি সারাকে এভাবে না বললে, সারার মনে কোথাও একটা অন্ধকার, অস্পষ্টতা থেকেই যেত। সারার যেটুকু জানার বিষয় ছিল, জেনে গেছে। সে এখন দ্বিধাহীন। আল হামদুলিল্লাহ।
আহমদ মুসা সরে পড়েছে সারা। বলল জোসেফাইন হাসতে হাসতে।
জোসেফাইন উঠতে যাচ্ছিল। সারা জেফারসন তার হাত ধরে টেনে রাখল।
জোসেফাইন ফিরে বসল। বলল, কি হলো সারা? তুমি একটু বস আপা। আমার খুব খারাপ লাগছে। উনি বললেন বটে আমি তোমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছি। কিন্তু আমার শুধুই মনে। হচ্ছে, একটা সুন্দর সাজানো পরিবেশ যেন লণ্ডভণ্ড করে দিলাম আমি। মনে হচ্ছে সবাই যেন অবাক-বিস্ময় নিয়ে আমাকে দেখছে। একটা অন্যায় বোধ আমাকে কুঁকড়ে দিচ্ছে। সারা জেফারসন বলল। তার কণ্ঠ ভারি।
জোসেফাইন সারা জেফারসনের আরও ক্লোজ হয়ে বসে সারার মাথায়। হাত রাখল। বলল, তোমার এই বোধটা শুধুই তোমার নয়, আমেরিকার একটি সংস্কার। শুধু আমেরিকার নয়, গোটা দুনিয়া জুড়ে নারী অধিকার ও নারী আন্দোলন সামনে আসা এবং বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রচারের পর একটা কুসংস্কার মানুষের মনে দানা বেঁধে বসেছে। সেই কুসংস্কারই অন্যায় বোধ-এর রূপ নিয়ে তোমাকে পীড়া দিচ্ছে।
আপা তুমি এই বোধকে একদম কুসংস্কারই বলে ফেললে? সারা জেফারসন বলল।
যা স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে, যা মানবিকতার বিরুদ্ধে, সুস্থ জীবনধারার বিরুদ্ধে তা অবশ্যই কুসংস্কার। বলল জোসেফাইন।
তুমি অনেক ভারি কথা বলেছ আপা। সে ভারি কথাটা আবার চলমান বিশ্বাস-ব্যবস্থার বিপরীত। একাধিক বিয়ের ব্যবস্থাকে তুমি বলছ স্বাভাবিক, মানবিক ও সুস্থ জীবনধারার অংশ। অথচ আজকের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত হলো একাধিক বিয়েই বরং নারীর মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এবং সেহেতু মানবাধিকারেরও বিরোধী একটা স্বেচ্ছাচার। সারা জেফারসন বলল।
হাসল জোসেফাইন। বলল, একাধিক বিয়ে ব্যবস্থা সম্পর্কে ওদের প্রথম ভুল হলো এটাকে সার্বিক সাধারণ সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে দেখা। অথচ এটা তা নয়, এটা সাধারণ সামাজিক বিয়ে ব্যবস্থার একটি ব্যতিক্রমী বিধান। এই বিধান দেয়া হয়েছে মূলত সামাজিক সমস্যা মোকাবিলার জন্যে। ইয়াতিমের মতো অসহায় মেয়েদের সমস্যা সমাধান উপলক্ষেই এই বিধান দেয়া হয়েছে। তুমি কুরআন শরিফের সূরা নিসার ৩ নাম্বার আয়াতে দেখ আছে, তোমরা যদি আশংকা কর যে, ইয়াতিম মেয়েদের প্রতি সুবিচার (শ্লীলতা, পবিত্রতা রক্ষা) করতে পারবে না, তাহলে তাদের মধ্যে যাদের পছন্দ তাদের বিয়ে কর দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশংকা কর যে সুবিচার (সমান ব্যবহার) করতে পারবে না, তাহলে একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে। এতে পক্ষপাতিত্ব না করার অধিকতর সম্ভাবনা। সূরা নিসার আরও সামনে এগুলে তুমি ১২৯ ও ১৩০ নাম্বার আয়াতে দেখতে পাবে, আল্লাহ বলছেন, আর তোমরা যতই ইচ্ছা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সমান ব্যবহার করতে কখনই পারবে না। তবে তোমরা কোন একজনের দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়ো না এবং অপরকে ঝুলানো অবস্থায় রেখ না। যদি তোমরা নিজেদের সংশোধন কর ও সাবধান হও তবে আল্লাহ নিশ্চয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যদি তারা পৃথক হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাদের প্রাচুর্য দ্বারা তাদের প্রত্যেককে অভাবমুক্ত করবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও প্রজ্ঞাময়। সূরা নিসার এই তিন আয়াতের তুমি যদি সারাংশ কর তাহলে দেখবে- এক. সমস্যা মোকাবিলা, ব্যভিচার ও অবৈধ-অসামাজিক সম্পর্ক রোধ করার জন্যে পছন্দের নারীদের চারজন পর্যন্ত বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। দুই.। স্ত্রীদের প্রতি সুবিচার ও সমান ব্যবহার যদি করতে না পারে, তাহলে এই চারজন পর্যন্ত বিয়ের অধিকার কেড়ে নিয়ে এক-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে মাত্র ক্রীতদাসীদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। বিয়ে না করলেও ক্রীতদাসীরা মালিকের সম্পত্তি হিসেবে মালিকের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। এটা বন্ধ করা ও ক্রীতদাসীদের সম্মান দেয়ার জন্যেই তাদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর আরও কারণ হলো, এতে নতুন কোন পক্ষপাতিত্বের ভয় নেই। তিন. একাধিক স্ত্রীর প্রতি সমান ব্যবহার সম্ভব নয় এ ঘোষণা করে একাধিক বিয়ের পথ কার্যত বন্ধ করা হয়েছে এবং যদি বিয়ে হয়েও যায়, তাহলে অবিচার না করে, ঝুলিয়ে না রেখে পরম্পরকে বিচ্ছিন্ন হবার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে আল্লাহ উভয়ের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন ও সাহায্য করবেন। আমি যে তিনটি পয়েন্ট তুলে ধরলাম, যা আল্লাহ রাব্বল আলামিন বলেছেন, তার সারমর্ম হলো, মানবিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা পবিত্রতার লক্ষ্যে চার পর্যন্ত বিয়ের পথ খুলে রাখা হয়েছে, কিন্তু এই অনুমতিকে সাংঘাতিকভাবে শর্তসাপেক্ষ করে একাধিক বিয়ের পথ কার্যত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যারা একাধিক বিয়েকে খারাপ চোখে দেখেন এবং একাধিক বিয়ের অনুমতি দেয়ায় ইসলামের সমালোচনা করেন, তারা ইসলামী বিধানের বাস্তবতা অনুধাবন করলে তারা তাদের সমালোচনার জন্যে লজ্জিত হবেন এবং এই বিধানকে গ্রহণ করবেন সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা মোকাবিলার জন্যে। দেখ সারা, প্রত্যেকটা আইন বা কঠোর আইনের এক বা একাধিক একসেপশন বা ব্যতিক্রম থাকে। বিয়ের ক্ষেত্রেও ইসলাম একটা ব্যতিক্রম রেখেছে। এটাই মানবিক এবং সামাজিক। থামল জোসেফাইন।
সারা জেফারসনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ধন্যবাদ আপা। আমার কি মনে হচ্ছে জান, আমাদের আমেরিকান খৃস্টান সমাজে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে ও বাড়ছে তাকে উদাহরণ হিসাবে সামনে এনে ইসলামের এই বিধানের উপকারিতা তুলে ধরে আমি দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে পিরবো। সূরা নিসা আমি পড়েছি আপা, কিন্তু এই কথাগুলো এভাবে আমার মাথায় আসেনি। ধন্যবাদ তোমাকে।
একটু থেমেই জেফারসন আবার বলল, আমাদের আমেরিকান সমাজ কি এই বাস্তবতা কোন দিন বুঝবে আপা?
যত দিন না বুঝবে তত দিন তাকে অনেক পারিবারিক, সামাজিক সমস্যায় ভুগতে হবে। বুঝলে এই শর্তযুক্ত ব্যতিক্রমকে মানুষ একটা বড় কল্যাণ হিসেবেই গ্রহণ করবে। বলল জোসেফাইন।
শর্তের কথা উনি নিশ্চয় জানেন। আল্লাহ যেখানে নিজে বলছেন, সমান ব্যবহার তোমরা কিছুতেই করতে পারবে না। সেই সমান ব্যবহার উনি কিভাবে করবেন? সারা জেফারসন বলল। তার ঠোঁটে হাসি।
বিয়ের পর তুমিই জিজ্ঞেস করো তাকে। তবে ওর প্রতি আমার আস্থা আছে। তিনি কোন অন্যায় করতে পারেন না। আর আমি-তুমি, আমরা তো কোন প্রতিযোগী নই সারা। বলল জোসেফাইন।
সারা জেফারসনের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, প্রতিযোগিতা কেন আপা। আমি তো তোমার পাশে বসার ভয় নিয়েই মরছি। মনকে বুঝাতে পারছি না, যা তোমার, একান্তই তোমার, তাতে আমি হাত লাগাব কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি আপা?
বলতে বলতে কান্নারুদ্ধ হয়ে গেল সারা জেফারসনের কণ্ঠ। চোখ থেকে ঝরঝর করে নেমে এল অশ্রু।
আবেগে ভারি হয়ে উঠেছে জোসেফাইনের চেহারা। সে সারা জেফারসনের কপালে চুমু খেয়ে বলল, আমিও তোমাকে ভালোবাসি সারা। তোমার সেই চিঠি পড়েই আমার এই ভালোবাসার শুরু। তারপর যখন তোমার সাথে দেখা হলো, তখন দেখলাম চিঠির সারার চেয়ে বাস্তবের সারা আরও বেশি সুন্দর, আরও বেশি মিষ্টি, আরও বড় হৃদয়ের। জোসেফাইনেরও দুচোখ ভরে উঠল আবেগের অশ্রুতে। সারা জেফারসন জোসেফাইনের গলা জড়িয়ে ধরে আরও কাছে টেনে নিল। জোসেফাইনও জড়িয়ে ধরল সারা জেফারসনকে। দুই দেহের মতো দুজনের অশ্রুও এক হয়ে গেল।
.
২.
নাস্তার পর সকলে এসে বসেছে ফ্যামিলি লাউঞ্জের সোফায়। জোসেফাইন, জিনা জেফারসন, সারা জেফারসন, আহমদ আব্দুল্লাহ, সকলেই। আহমদ মুসা যাচ্ছিল তার কক্ষের দিকে।
আহমদ আব্দুল্লাহ, যাও তোমার বাবাকে এখানে নিয়ে এস। বলল জোসেফাইন আহমদ আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে।
আহমদ আব্দুল্লাহ বসেছিল সারা জেফারসনের পাশে। মায়ের নির্দেশ পেয়ে সে ছুটল তার বাবার দিকে।
আহমদ আব্দুল্লাহ গিয়ে জড়িয়ে ধরল তার বাবাকে। বলল, বাবা আম্মি আপনাকে লাউঞ্জে ডাকছেন। চলুন।
আহমদ মুসা তাকাল লাউঞ্জের দিকে এবং ঘুরে দাঁড়াল। হাঁটতে লাগল লাউঞ্জের দিকে।
আহমদ আব্দুল্লাহ ছাড়েনি তার বাবাকে। সেই যে জ্যাকেটের একটা প্রান্ত জাপটে ধরেছে আর ছেড়ে দেয়নি। নিয়ে এসে বসাল একটা সোফায় এবং নিজে বসল বাবার পাশে।
জোসেফাইন, তোমার সোলজার খুব যোগ্য। দেখ বাবাকে কিভাবে ধরে আনল। জিনা জেফারসন বলল।
হাসল জোসেফাইন। বলল, বাবার উত্তরাধিকার পেতে হবে তো?
কথাটা শেষ করেই জোসেফাইন আহমদ মুসাকে বলল, তোমার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ওঁরা কবে করছেন?
এ সপ্তাহেই। ওটা ঠিক সংবর্ধনা নয়। গেট টুগেদারের মতো ব্যাপার। বলল আহমদ মুসা।
ওরা যেভাবে বক্তৃতার ব্যবস্থা করছে তাতে সংবর্ধনাই হয়ে যাবে। জোসেফাইন বলল।
দুএকজন ব্যবস্থাপনার পক্ষ থেকে কিছু বলতে পারেন। বলল আহমদ মুসা।
না, ঘটনা তা নয়। ওঁদের পক্ষ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে কিছু বলার জন্যে ঐ অনুষ্ঠানে। জোসেফাইন বলল।
তোমার সাথেও যোগাযোগ করা হয়েছে? তুমি কি উত্তর দিয়েছ? বলল আহমদ মুসা।
আমি রিগ্রেট করে মাফ চেয়েছি। বলেছি যে, তুমি এটা পছন্দ করবে না। জোসেফাইন বলল।
ধন্যবাদ জোসেফাইন। তুমি ঠিক করেছ। বলল আহমদ মুসা।
কিছু বললে কি আর হতো বাছা? জিনা জেফারসন বলল।
না মা, ওখানে জোসেফাইনের বলার কিছু নেই। বললে বলতে হবে। আমার সম্পর্কে। স্বামীর সামনে স্বামী সম্পর্কে স্ত্রীকে দিয়ে বলানো আমার কাছে শোভন মনে হয় না। বলল আহমদ মুসা।
তুমি আবার প্রশংসা পছন্দ কর না। সিদ্ধান্ত ঠিক হয়েছে। জিনা। জেফারসন বলল।
ধন্যবাদ মা।
বলে জোসেফাইন আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, তোমার কাছে কি একটা মেসেজ এসেছে ওআইসি ও রাবেতার কাছ থেকে?
হাসল আহমদ মুসা। পকেট থেকে একটা ইনভেলাপ বের করে আহমদ মুসা বলল, এই ইনভেলাপের মধ্যেই সে মেসেজটা আছে। নাস্তার আগে এই মেসেজটাই আর একবার পড়ছিলাম। তুমি পড়ে দেখ জোসেফাইন।
খুলল ইনভেলাপটি জোসেফাইন।
দুপাতার একটা মেসেজ, ইংরেজিতে টাইপ করা। পড়তে লাগল। জোসেফাইন।
ওআইসি ও রাবেতার পক্ষ থেকে ভাই আহমদ মুসার প্রতি :
আসোলামু আলায়কুম।
আল্লাহ রাব্বল আলামিনের সমস্ত প্রশংসা। আল্লাহর রাসূল মোহাম্মদ (স.)-এর প্রতি অসংখ্য দরূদ ও সালাম। আপনার সব খবর আমরা রাখছি। আমরা সব সময় আপনার জন্যে দোয়া করেছি। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন, এজন্যে আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি।
আপনাকে খুব জরুরি একটা বিষয় জানাবার জন্যে আমরা ওআইসির সংখ্যালঘু নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি এবং রাবেতায়ে আলম আল ইসলামীর মুসলিম সংখ্যালঘু সেল থেকে এই চিঠি লিখছি। জানি আমরা আপনি একটা বড় ও কঠিন অভিযান থেকে ফিরেছেন। আপনার অনেক বিশ্রাম প্রয়োজন। নিরবচ্ছিন্ন স্বস্তি। প্রয়োজন। তবু এ বিষয়টা আমরা আপনাকে জানাতে বাধ্য হচ্ছি। অনেক বিকল্প আমরা চিন্তা করেছি, আমরা কিছু করার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু কোন বিকল্পই কাজ দেয়নি, কোন চেষ্টাই সফল হয়নি। শুধু আমরা নই, জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘের সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সংস্থা ইউনিসেফও সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোন সূত্র খুঁজে পায়নি, কোন প্রতিকারও খুঁজে পায়নি। বাধ্য হয়ে সবাই আপনার কথা বলছে। সৌদি সরকার থেকেও আমাদের এই পরামর্শই দেয়া হয়েছে। সবার সর্বশেষ চিন্তার ফল এই চিঠি।
সংকটটা হলো আর্মেনিয়ার দক্ষিণ সীমান্তের একটি জনপদ নিয়ে। স্থানটা আর্মেনিয়ার দক্ষিণ সীমান্তের আরাস নদীর খুব কাছে দিভিন। উপত্যকা। এখানে বাস করে গাজী সালাহউদ্দীন বংশের সরাসরি একটা শাখা, বলা যায় একমাত্র অবশিষ্ট শাখা। এদের মোট জনসংখ্যা এখন প্রায় পঁচিশ হাজার। পরিবারের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। মজার ব্যাপার হলো এরা যে গাজী সালাহউদ্দীনের উত্তরসূরি এটা তারা জানে না। আর্মেনিয়ারও কেউ এটা জানে না। ওআইসির সংখ্যালঘু নিরাপত্তা শাখা ও রাবেতার মুসলিম সংখ্যালঘু শাখার যৌথ অনুসন্ধানে এই পরিচয়টি আবিষ্কৃত হয়েছে। যখন কেউই এটা জানে না, তখন আমরাও কাউকে এটা জানানো ঠিক মনে করিনি। অনুসন্ধানে যে তথ্য আমরা পেয়েছি, তাতে আমরা জেনেছি, ১১৯৩ সালে সুলতান গাজী সালাহউদ্দীনের মৃত্যুর পর তার সন্তানরা ও ভাইদের মধ্যে যে সংঘাত শুরু হয়, সেই সময় সুলতান। সালাহউদ্দীনের সপ্তম পুত্রের পরিবার সংঘাতের এলাকা থেকে পূর্ব। আনাতোলিয়ার হিসন কেইফায় হিজরত করে। ১২৩২ সালে এখানেও সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ১২৬০ সালে হিসন কেইফা মোঙ্গল আক্রমণের মুখে পড়ে। পরে মোঙ্গলরা চলে গেলে এখানে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বংশের শাসন আবার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এক সময় এই শাসন ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেও গোটা পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় ছিল। কিন্তু মোঙ্গল আক্রমণের সময়ই সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সপ্তম পুত্রের ঐ পরিবার হিসন কেইফা থেকে হিজরত করে আর্মেনিয়ার প্রাচীন নগরী দিভিনে চলে যায়। এর সাড়ে পাঁচশ বছর পরে সোভিয়েতের কম্যুনিস্ট শাসনের শুরুতেই এই বংশের বিশাল জনপদকে দিভিন থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। তারা আশ্রয় নেয় আর্মেনিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত সংলগ্ন একটা উপত্যকায়। তারা উপত্যকাটির নাম দেয় দিভিন, তাদের হারানো জনপদের নাম অনুসারে। এই দিভিন উপত্যকাতেই তারা এখন বাস করছে।
পেছনের এই ইতিহাসটা আপনাকে এই জন্যেই জানালাম যে, আপনি যাতে নিশ্চিত হতে পারেন দিভিনের পরিবারটি সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি। সাধারণভাবে দিভিন উপত্যকার এই পরিবার, এই জনপদকে কুর্দিদের বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন অংশ বলে মনে করা হয়। কিন্তু এরা কুর্দিদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না, কুর্দিরাও রাজনৈতিকভাবে এদের হিসেবে ধরে না। দিভিনের এই আইয়ুবী পরিবারের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা আধুনিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়, কিন্তু ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চা এদের মধ্যে খুব বেশি। প্রাচীন নগরী দিভিনে এরা গড়ে তুলেছিল ইসলামী শিক্ষার কয়েকটি বিশাল কেন্দ্র। এর মধ্যে ছিল কুরআন, তাফসির ও হাদিস শাস্ত্র অধ্যয়নের বিশ্ববিদ্যালয় ধরনের উচ্চতর শিক্ষালয়। এর সাথে ছিল ইসলামের ইতিহাস গবেষণা, অনুসন্ধান ও সংগ্রহের উচ্চতর একাডেমি ধরনের প্রতিষ্ঠান। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রভৃতি সব বিষয়েই এই গবেষণা, অনুসন্ধান ও সংগ্রহের মধ্যে শামিল ছিল। গোটা ককেশাস, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল থেকে জ্ঞান অনুসন্ধানী ও ছাত্ররাও এখানে আসত। কম্যুনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন আর্মেনিয়া দখলে নেয়ার পর সবকিছুই ধ্বংস করে দেয় এবং আইয়ুবী পরিবারকেও উচ্ছেদ করে। দিভিনে নতুন বসতি গড়ার পর দিভিন নগরী থেকে তারা যা রক্ষা করে আনতে পেরেছিল, তাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও একাডেমিগুলোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। মানের দিক দিয়ে, কার্যকারিতার দিক দিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন গোটা ককেশাস; তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে অনন্য। এখানে যেমন বিশ্বমানের আলেম তৈরি হচ্ছে, তেমনি এরা এদের একাংশকে উচ্চতর শিক্ষার জন্যে বিদেশে বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিজ্ঞানীও তৈরি করছে। এই দিভিন উপত্যকার তৈরি আলেম ও বিজ্ঞানীরা ককেশাস, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছে। বিশেষ করে এখানে তৈরি বিশ্বমানের আলেমরা অমূল্য সেবা দিয়ে চলেছে গোটা মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায়। আর এসব তারা করছে নীরবে, কোন প্রচার ছাড়াই। কুর্দিদের যে বহুমুখী রাজনীতি, তার কোনটির সাথেই তারা যুক্ত নয়। দেশীয় রাজনীতিতেও তারা কোন পক্ষ নয়, আর্মেনিয়ার বড় দলগুলোকে তারা ভোট দেয়। এরপরও তারা আজ বিপদগ্রস্ত। তারা বহুমুখী নীরব ও ভয়ংকর আক্রমণের শিকার। সে আক্রমণগুলো সম্পূর্ণ নির্মূল প্রক্রিয়ার অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। সে আক্রমণ বা অন্তর্ঘাতমূলক কাজগুলো নিম্নরূপ :
এক. প্রতিভাবান ও প্রভাবশালী লোকদের মধ্য থেকে মাত্র গত এক বছরে দুশ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি নিহত হয়েছে এবং প্রায় একশর মতো কিডন্যাপড হয়েছে। এদের মধ্যে গণ্যমান্য নারী ও পুরুষ ব্যক্তিত্ব রয়েছে।
দুই. দিভিন উপত্যকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গ্রন্থাগারে রহস্যময় আগুন লাগছে। গত এক বছরে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দুটি গ্রন্থাগার রহস্যময় আগুনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
তিন. আর্মেনিয়ার অন্যান্য উপত্যকার মতো দিভিন উপত্যকার মানুষরাও বলতে গেলে পাথরের বুক চিরে ফসল ফলায়। এই ফসল স্বর্ণখণ্ডের চেয়েও মূল্যবান। যা বেঁচে থাকার জন্যে অপরিহার্য। গত এক দেড় বছর ধরে কোন অদৃশ্য কারণে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে। যাচ্ছে। একটা দানাও ক্ষেত থেকে আনা যাচ্ছে না। ক্ষেতের মাটি, পাথর, ফসলের ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করা হয়েছে ল্যাববেটরিতে। বলা হয়েছে, বিষাক্ত বা সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। নতুন কোন প্রাকৃতিক কারণেই ঐভাবে ফসল বিনষ্ট হয়েছে। দিভিনের অধিবাসীরা এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারছে না। ফসল ধ্বংসের ফলে দিভিন উপত্যকার অবস্থা মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি ও বাইরের খাদ্য সাহায্যে তারা বেঁচে আছে। এই উপত্যকা থেকে তারা প্রাকৃতিকভাবেই উচ্ছেদ হবার পথে।
চার. প্রায় গত এক বছর ধরে দিভিন উপত্যকায় যে ঔষধগুলো আসছে বা আনা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই নকল, বিষাক্ত কিংবা কোনওভাবে ক্ষতিকর। দিভিনের ঔষধ ব্যবসায়ীরা আর্মেনিয়ার সবাই যেখান থেকে ঔষধ আনে, সেখান থেকেই ঔষধ আনছে। দোষ দেয়া হচ্ছে দিভিনের ঔষধ-ব্যবসায়ীদের। দিভিনের সব ঔষধের দোকান বন্ধ হবার পথে। অনেক ব্যবসায়ীর জেল হয়েছে, কারও মামলা বিচারাধীন রয়েছে, কেউ গ্রেফতার হয়ে মামলার অপেক্ষা করছে। দিভিনে জীবন রক্ষাকারী ঔষধ সংকট চরমে। পার্শ্ববর্তী উপত্যকাও বেশ দূরে। সেখানে গেলেও অধিকাংশ সময়। ঔষধ মিলছে না।
পাঁচ. হত্যা, অপহরণ বন্ধে, রহস্যময় অগ্নিকাণ্ড তদন্তে, ফসল নষ্ট হওয়ার প্রতিবিধানে, নকল ও বিষাক্ত ঔষধের অনুসন্ধানে আর্মেনীয় সরকার সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছে, কিন্তু কোনই লাভ। হয়নি। কোন কিছুরই প্রতিকার-প্রতিবিধান হয়নি। মাঝখানে এই সব তদন্তের সাথে যুক্ত চারজন দক্ষ ও পেশাদার গোয়েন্দা অফিসার নিহত হয়েছেন। দিভিনবাসীদের পক্ষে এই সব তদন্তকারী ও দিভিবাসীদের সহযোগিতাকারী ইউনিসেফ, ওআইসি ও রাবেতার পাঁচজন স্বেচ্ছাসেবী অফিসার নিহত হয়েছেন আর্মেনিয়ায়। এর ফলে একটা ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে তদন্তকারী ও স্বেচ্ছাসেবী অফিসারদের মধ্যে। প্রতিকারের জন্যে এখন যা হচ্ছে নামকাওয়াস্তে।
ছয়. আমরা, এমনকি আর্মেনিয়ার পুলিশ আর গোয়েন্দাদেরও অনেকে মনে করেন এ সবের পেছনে বড় কোন ষড়যন্ত্র জড়িত রয়েছে। মনে করলেও এর পক্ষে কোন প্রমাণ কেউ যোগাড় করতে পারেনি। পুলিশ, গোয়েন্দা ও দিভিনের লোকরা যারা নিহত হয়েছে, সেসব হত্যাকাণ্ডের তদন্তও কোন ক্লু-এর অভাবে এক ইঞ্চিও এগোতে পারেনি।
সাত. এই অবস্থায় আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। তার চেয়েও অসহায় ও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দিভিন উপত্যকার পঁচিশ হাজার ভালো মানুষ, ভালো মুসলিম এবং ইসলামের সেবক ও ঐতিহাসিক এক মহান শাসকের বংশধারার অবশিষ্ট একমাত্র শাখা। এই অবস্থায় কোন পথ না পেয়ে আমরা আপনাকেই স্মরণ করছি। এই স্মরণ করাটাকে আমরা মনে করছি আল্লাহরই ইচ্ছা। আল্লাহ আপনাকে অশেষ নেয়ামত দিয়েছেন। আমাদের মতো দিভিন উপত্যকার পঁচিশ হাজার অসহায় মানুষ আপনার মতো অজানা কোন এক ত্রাণকর্তার দিকেই তাকিয়ে আছে, আল্লাহর সাহায্য হিসেবে যিনি আসবেন তাদের কাছে অভয় আর মুক্তির আশ্রয় হিসাবে। আমরা আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসার উত্তরের অপেক্ষা করব।
মেসেজটা নীরবে পড়ছিল জোসেফাইন। শেষদিকে এসে অশ্রুতে তার দুচোখ সিক্ত হয়ে গেল। শেষে তার দুগণ্ড বেয়ে নেমে এল নীরব অশ্রুর ধারা।
পড়া শেষ হয়ে গেলেও একইভাবে পাথরের মতো বসে থাকল জোসেফাইন। যেন সে সম্বিত হারিয়ে ফেলেছে।
এ সময় তার হাত থেকে মেসেজের কাগজটা পড়ে গেল তার কোলের উপরে।
সবাই তাকিয়েছিল জোসেফাইনের দিকে। পাশেই বসেছিল সারা জেফারসন।
বিস্ময় তার চোখে-মুখে! বলল, কি হলো আপা? তোমার চোখে পানি কেন? কি আছে মেসেজে?
জোসেফাইন নীরবে তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। কোল থেকে। মেসেজের কাগজটা নিয়ে তুলে দিল সারা জেফারসনকে।
সারা জেফারসনও পড়ল মেসেজটা।
পড়তে পড়তে ভারি হয়ে উঠেছিল তার মন। যখন পড়া শেষ করল, তখন বিষাদে ঢেকে গেল তার মুখ। দিভিনের অধিবাসীদের মর্মান্তিক অবস্থায় তার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সেই সাথে আহমদ মুসার প্রতি আহ্বানের বিষয়টায় তার মন কেঁপে উঠেছিল! একি আহমদ মুসার নতুন অভিযানের ডাক!
সারা জেফারসন তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল, আপা উনি কি তাহলে…।
কথাটা শেষ করতে পারল না সারা জেফারসন। গলায় আটকে গেল।
জোসেফাইন সারা জেফারসনকে বলল, হ্যাঁ সারা, তুমি ঠিকই ধরেছ।
বলে জোসেফাইন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, আজকের এমন আলোকিত যুগেও যখন মানবাধিকার নিয়ে চারদিকে অশ্রুপাত হচ্ছে, তখন দিভিনের মতো অসহায় জনপদও আছে! মানুষের জীবন নিয়ে এমন মর্মান্তিক খেলা চলতে পারছে! এ ভিটে-মাটিও দেখছি ওদের ছাড়তে হবে? তাতেই কি তারা রক্ষা পাবে? মনে হয় না। ওদের অস্তিত্বই তো ওদের মূল টার্গেট! কি ভাবছ তুমি ওদের নিয়ে?
তুমি ঠিক বলেছ জোসেফাইন। ওদের অস্তিত্বই ষড়যন্ত্রকারীদের টার্গেট। বলল আহমদ মুসা।
কি ভাবছ এখন তুমি? জোসেফাইন বলল।
ভাবনার কিছু নেই জোসেফাইন। আজকেই ওদের মেসেজের জবাব দিয়ে দেব। বলল আহমদ মুসা।
কি জবাব হবে আমি জানি, কিন্তু সময় নির্দিষ্ট করো না। জোসেফাইন বলল।
কিন্তু আপা উনি তো সুস্থ হননি। আহত স্থানের পূরণ ও নিরাময় সব কথা নয়, দেহ ও মনেরও একটা ক্ষয় আছে। উপযুক্ত বিশ্রামেই তা পূরণ হয়। বলল সারা জেফারসন। তার মুখ জুড়ে সংকোচ ও সলজ্জভাব।
বলেই মুখ নিচু করেছিল সারা জেফারসন।
সারা জেফারসনই প্রশ্ন তুলেছে। উত্তর দাও। আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল জোসেফাইন।
ধন্যবাদ। সারার কথার মধ্যে ডাক্তারিবিদ্যার ছাপ আছে। সুতরাং কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। যাক, সময় নির্দিষ্ট করতে না করলে তুমি! আমি সময় এখনও ঠিক করিনি। বলল আহমদ মুসা।
বিষয়টা খুবই ইমারজেন্সি ধরনের! ওদের দুশ লোক নিহত, একশ লোক গুম হয়েছে! মাঠে ফসল নেই! চিকিৎসার ঔষধ নেই! যাদের হাতে রিমেডি, সেই পুলিশেরও চারজন গোয়েন্দা নিহত! তাদের সাথে ইউনেস্কো, ওআইসি ও রাবেতার আরও পাঁচজন নিহত! ভয়াবহ অবস্থা! জানি না, সেখানকার অসহায় মানুষগুলো এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কিভাবে বাস করছে!
বলে একটু থামল জোসেফাইন। তার চোখে শূন্য দৃষ্টি। কণ্ঠও ভারি হয়ে উঠেছে জোসেফাইনের। শূন্য দৃষ্টি ঘুরিয়ে সে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, সময় নির্দিষ্ট না করলেও সময় নির্দিষ্ট তোমাকে করতে হবে। কিন্তু মনে রেখ, তার আগে তোমার একটা বড় কাজ আছে। তার জন্যে উপযুক্ত সময় তোমাকে রাখতে হবে। থামল জোসেফাইন।
আহমদ মুসা তাকিয়েছে জোসেফাইনের দিকে। তার চোখে-মুখে একটা বিব্রত ভাব।
সারা জেফারসনের নিচু মুখটা আরও নিচু হয়ে পড়েছে।
জোসেফাইন, সামনে আরও একটা কাজ আছে, গেট টুগেদার। এত সময় কি হাতে আছে আমার? তুমি তো ওখানার গোটা বিষয় উপলব্ধি করছ। বলল আহমদ মুসা।
আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত। আমাদের চেষ্টা করার নিয়ত থাকতে হবে, চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ চেষ্টা করতে বলেছেন। জোসেফাইন বলল।
আর এ চেষ্টাটা অগ্রাধিকার পাওয়াই উচিত। গেট টুগেদারটা কার্যত ওদের জন্যে, কিন্তু এ কাজটা নিজেদের জন্যে। বলল জিনা জেফারসন।
সারা জেফারসন জোসেফাইনের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল, আপা, আমি আসছি।
বলে জোসেফাইন কিছু বলার আগেই দ্রুত চলে গেল সারা লাউঞ্জ থেকে। জোসেফাইনের ঠোঁটে এক টুকরো মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, সারা হঠাৎ চলে যাওয়ায় কেউ কিছু মনে করবেন না। এই লজ্জা আমাদের মেয়েদের ভূষণ, অলংকার। এটা মেয়েদের আরও সুন্দর ও মহীয়ান করে।
মা জোসেফাইন। তোমাদের এই ভালোবাসা, পারস্পরিক এই শ্রদ্ধা ইহকাল-পরকালে আল্লাহ অটুট রাখুন। এক বৃন্তে দুটি ফুল হিসাবে এই জগতে এবং বেহেশতে তোমাদের পাশাপাশি অবস্থান অক্ষয় হোক। বলল। জিনা জেফারসন।
না মা, এক বৃন্তে দুটি নয়, তিনটি ফুলকে এই জগতে ও বেহেশতে অক্ষয় হবার জন্যে দোয়া করুন। জোসেফাইন বলল।
আমিন! বলল জিনা জেফারসন।
আমিন! বলল জোসেফাইনও।
আমিন, বলা শেষ করেই জোসেফাইন আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, আমিন বললে না তুমি?
আহমদ মুসার গম্ভীর মুখে স্বচ্ছ এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, আমিন!
আল হামদুলিল্লাহ! বলল জোসেফাইন।
.
গেট টুগেদার ডিনার। ক্যাপিটাল হিল।
সিনেটের একটা বড় কমিটি কক্ষ। পাশেই ডিনার লাউঞ্জ। অনুষ্ঠান চলছে।
সিনেট স্পিকার ক্যাথারিন এলিজাবেথ সভাপতির চেয়ারে। প্রধান অতিথি প্রেসিডেন্ট। গেস্ট অব অনার আহমদ মুসা।
ঠিক সময়ে প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। শেষের দিকে এখন প্রোগ্রাম। গেট টুগেদার এই বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছে সরকারের মন্ত্রীরা, সিনেট ও কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ, সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ অফিসারবৃন্দ, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, শীর্ষ আমলা ও বিশিষ্ট নাগরিকগণ। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা অ্যাডভাইজারের স্বাগত বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হয়।
এরপর আহমদ মুসাকে অভিনন্দিত করে একে একে বক্তব্য রেখেছে মন্ত্রী, সিনেট-কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট নাগরিকসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে আসা ব্যক্তিবর্গ। আশা করা হয়েছিল, জনা চার-পাঁচেকের বেশি বক্তা হবে না। কিন্তু সংখ্যা হয়ে গেল ডাবল। আগ্রহী ব্যক্তিবর্গের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের সময় দিতে হয়েছে।
শেষ পর্বে নির্দিষ্ট ছিল আহমদ মুসার কাছ থেকে কিছু শোনা। তারপর প্রধান অতিথি প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন। শেষে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন অনুষ্ঠানের সভাপতি।
আহমদ মুসার এবার কথা বলার পালা।
তার ডাক পড়ল কিছু বলার জন্যে। মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হলো, যার জন্যে আজকে আমাদের অনুষ্ঠান, যার বিষয়ে এতক্ষণ সবাই কথা বলেছেন, যিনি আমেরিকান না হয়েও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের আমেরিকার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, এই সেদিন যিনি সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ হুমকির মুখে আমেরিকার পাশে ছিলেন, সেই আহমদ মুসাকে আমরা অনুরোধ করছি কিছু বলার জন্যে। এখন কথা বলছেন জনাব আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা দাঁড়াল। প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুল (স.), আহলে বায়েত ও সাহাবীদের এবং হযরত ঈসা ও মুসা (আ.)-সহ অন্য নবী রাসুলদের প্রতি সালাম পেশের পর প্রেসিডেন্টসহ উপস্থিত নেতৃবৃন্দকে সম্বোধন শেষে বলল, এতক্ষণ আমার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তার কোনটারই কৃতিত্ব আমার নয়। ভালো-মন্দের সংঘাত চলে আসছে এবং চলতেই থাকবে। ডেথ ভ্যালিতে সেদিন যা ঘটেছে, সেখানে আমার ভূমিকা আল্লাহই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। যে বুদ্ধি, সাহস দিয়ে আমি ওদের মোকাবিলা করেছি, তা আল্লাহরই দেয়া। সুতরাং উল্লেখ করার মতো আমার নিজস্ব কৃতিত্ব কিছুই ছিল না।
আমি খুশি হয়েছি, গৌরব বোধ করছি যে, জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকনদের আমেরিকার জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়েছি। তাদের মাধ্যমে এই আমেরিকা অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে (১৭৮৭) গণতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের জন্যে তাদের মৌলিক অধিকার বিধিবদ্ধ করার মাধ্যমে। সন্দেহ নেই, আজ থেকে প্রায় পনেরশ বছর আগে আমাদের নবী আল্লাহর শেষ বার্তাবাহক মুহাম্মাদ (স:) এবং তার উপর নাজিলকৃত কুরআন মানুষের বাঁচার অধিকার, তার মত প্রকাশের অধিকার, তার শিক্ষার অধিকার, তার খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। সব মানুষকে আদম-সন্তান হিসাবে অভিহিত করে আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে সব বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠতে বলেছিলেন। কিন্তু সেই বিধান ও আহ্বান আজও মজুদ থাকলেও বিধিবদ্ধ আকারে সব মানুষের কাছে তা পৌঁছেনি। আমেরিকার মহান ফাউন্ডার-ফাদারসগণ বিশ্বব্যাপী শক্তিমানদের স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্যের ঘোর অন্ধকারে, মানুষের অধিকার পদে পদে লাঞ্ছিত হবার সংকটজনক এক পরিস্থিতিতে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছিল, বিধিবদ্ধ করেছিল। আমেরিকান সংবিধানের এই আইন ও অধিকার শুধু মার্কিন জনগণকে নয়, বিশ্বের সব মানুষকে সম্মানিত করেছিল, মানুষকে আশান্বিত করেছিল এবং গণতন্ত্রের নতুন ঐতিহাসিক যাত্রার উদ্বোধন করেছিল।
জর্জ ওয়াশিংটনের আমেরিকা, টমাস জেফারসনের আমেরিকা, আব্রাহাম লিংকনের আমেরিকা আজ বিশ্বের সুপার পাওয়ার। আমেরিকার ফাউন্ডার ফাদারসগণ মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকারের যে নৈতিক দণ্ড জনগণের হাতে তুলে দিয়েছিল, সে দণ্ড এখন আমেরিকান জনগণের সরকার ধারণ করছেন। নিজেদের পাওয়ার ও পজিশন ব্যবহার করে তারা মানুষের জন্যে অনেক কিছুই করতে পারেন। বিশেষ করে বিশ্বের নিরাপত্তা ও মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে।
যুদ্ধ আজ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিপদ। যুদ্ধে এক পক্ষ জয়ী হয়, আরেক পক্ষ পরাজিত হয়। পরাজিত পক্ষে শুধু সরকারই থাকে না, পরাজয়ের দায়ভার জনগণের উপরই বেশি চাপে। দুটি বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে। এর তিন-চতুর্থাংশই হবে সাধারণ মানুষ, নির পরাধ মানুষ, নিরস্ত্র মানুষ। বিশ্বযুদ্ধের জন্যে এদের কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু যুদ্ধের খেসারত তাদেরকেই দিতে হয়েছে বেশি। কোথাও। স্বাধীনতা হারিয়ে, কোথায় মানবিক অধিকার হারিয়ে, কোথাও জীবনসহ সর্বস্ব খুইয়ে। আমেরিকার ফাউন্ডার ফাদারসগণ তাদের জনগণের সাথে এই মানুষদের কথাও ভেবেছিলেন। জাতিসংঘ সনদে সই করে এই দায়িত্ব। আমেরিকার আজ আরও বেড়েছে। এই দায়িত্ব আমেরিকা পালন করবে, এটা শুধু মানুষের ইচ্ছা নয়, স্রষ্টারও ইচ্ছা নিশ্চয় এটা। আমেরিকা আজ যে শক্তি, সুযোগ ও সুবিধার মালিক, তা স্রষ্টার ইচ্ছাতেই পাওয়া, এটা মানতে হবে। সুতরাং সবদিকের বিচারে যতটা সম্ভব আমেরিকাকে মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে কাজ করা উচিত।
আমি এই প্রসঙ্গে একটা কথা রাখতে চাই। আশা করি একজন সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে নিছক একটা প্রত্যাশা হিসেবেই একে দেখা। হবে।
ফোম-এর এইচ থ্রি সন্ত্রাসীরা ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ নামের যে বিপর্যয়কর অস্ত্র তৈরি করেছিল, সেটা এখন আমেরিকান সরকারের হাতে। তার সাথে রয়েছে ম্যাগনেটিভ ডেথ ওয়েভ। এ অস্ত্র দুটি একদিক দিয়ে ডিফেনসিভ, অন্যদিক দিয়ে ভয়াবহ অফেনসিভও। দেশের পর দেশের স্বাধীনতা, তার নাগরিকদের অধিকার হরণ করা যেতে পারে এই দুটি অস্ত্র দিয়ে। এমনকি গোটা দুনিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তার করা যেতে এই অস্ত্র। ব্যবহার করে। আমেরিকার সংবিধান ও আমেরিকার ফাউন্ডার ফাদারসদের যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, তার পরিপন্থী এই অস্ত্র। এই অস্ত্রের অস্তিত্ব নিরাপদও নয়। এই অস্ত্র অনুরূপ অস্ত্রের আবিষ্কার ডেকে আনতে পারে, যেমনটা সন্ত্রাসীরা করেছিল। নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ এ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। এই অবস্থায় নতুন অস্ত্র, নতুন বিতর্ক, নতুন প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করতে পারে। আমেরিকা এর নিমিত্ত না হওয়াই। ভালো। এটাই আমার প্রত্যাশা।
আমাকে কেন্দ্র করে এই আয়োজনের জন্যে আমি মহামান্য প্রেসিডেন্ট, তার মন্ত্রীসভা, তার সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়ার জন্যে আয়োজকদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সকলকে ধন্যবাদ।
আহমদ মুসা ডায়াস থেকে সরে ফিরে গেল তার জায়গায়।
এবার কথা বলার পালা প্রেসিডেন্টের। প্রেসিডেন্ট এলেন ডায়াসে।
প্রেসিডেন্ট সম্বোধন শেষে আয়োজকদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলা যায় দীর্ঘ বক্তৃতাই করলেন। আহমদ মুসা সম্পর্কে তিনি বললেন, আমার জানা। গোটা পরিমণ্ডলে আহমদ মুসা এক অনন্য মানুষ। তিনি মানুষের জন্যে কাজ করেন নিজ উদ্যোগে, কোন প্রকার বিনিময়ের প্রত্যাশা না করে। আমার মনে যে প্রশ্ন ছিল তার জবাব তার কাছ থেকে আজ পেয়েছি। তিনি স্রষ্টার জন্যে স্রষ্টার ইচ্ছাতেই কাজ করেন। গভীর ধর্মবিশ্বাস ও স্রষ্টার প্রতি সীমাহীন আস্থা ও ভালোবাসা না থাকলে কেউ এমন নিঃস্বার্থ অবস্থানে পৌঁছতে পারেন না। মানুষকে ভালোবাসলে, অন্যায়কে ঘৃণা করলে এবং অন্যায়ের মূলোৎপাটন সর্বান্তকরণে চাইলেই একজন মানুষ পরার্থে নিজের জীবন বাজি রাখতে পারে। আহমদ মুসা আমার কাছে এ ধরনেরই একজন। মানুষ। তাকে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ স্রষ্টাকে।
আহমদ মুসা যুদ্ধমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন দেখেন, মানবাধিকারের ঘোর সমর্থক হিসাবে আমি তাকে দেখছি, তার ধর্ম ইসলাম যে মানবাধিকার ও সুবিচারের ক্ষেত্রে এতটা সুস্পষ্ট, এমন বিস্তারিত, তা আমি এভাবে জানতাম না। দুনিয়ার মানুষ ও আমাদের এই অনন্য প্ল্যানেটের জন্যে এটা একটা সুসংবাদ। আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ যে তিনি আমেরিকাকে আমেরিকানদের মতোই বুঝেছেন। তিনি আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসদের স্বপ্ন ও সাধনার কথা বলেছেন। আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসগণ এবং আমাদের আমেরিকা মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার। পক্ষে। অন্যের কলোনি থাকার অভিজ্ঞতা আমেরিকার রয়েছে, কিন্তু আমেরিকা কাউকে কলোনি বানায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপকে কলোনাইজ করেছিল, কিন্তু আমেরিকা পশ্চিম। ইউরোপ, পশ্চিম জার্মানী, জাপানকে কলোনি, বানায়নি। আজও আমেরিকার কোন কলোনি নেই। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হাওয়াই, আলাস্কা কলোনি নয়, আমেরিকান রাষ্ট্রের গর্বিত অংশীদার। আজো আমেরিকা মানুষের অধিকার ও মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। ভুলের উর্ধে কোন মানুষই নয়, কোন দেশও নয়। কোল্ড ওয়ারের সময় (১৯৪৫-১৯৯০) কম্যুনিজমকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে কিছু যুদ্ধ, সংঘাত এবং কিছু নির্মম সিদ্ধান্তের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এখানে অনেক ভুল হলেও তা ছিল ক্যুনিজম প্রতিরোধের অংশ। ইরাক-আফগানিস্তানেও ভুল হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষা করতে গিয়ে মানুষের অধিকার সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে গিয়ে অন্যায় করা হয়েছে। এই রকম ভুল আমাদের আরও হয়েছে আমি স্বীকার করছি। আঞ্চলিক রাজনীতি ও বিশ্বরাজনীতির জটিল আবর্তে জড়িয়ে পড়ার কারণেই এসব ঘটেছে। ওয়ার অন টেরর অন্যের উপর, বিশেষ করে মুসলমানদের উপর যেমন চেপেছে, তেমনি তা আমেরিকার উপরও চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কিভাবে চাপল, কে চাপালো, একজন আমেরিকান হিসাবেই আমি বলছি, তার নিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ অনুসন্ধান প্রয়োজন। গোপন অস্ত্র ব্যবহার করে আজ যারা আমেরিকার সামরিক শক্তিকে, আমেরিকার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে যারা উদ্যত হয়েছিল, সে রকম বন্ধুরূপী শত্রুর হাত ওয়ার অন টেরর-এর পেছনে ছিল কিনা তা দেখার সময় আজ এসেছে। গোপন অস্ত্রের ষড়যন্ত্রকে কেন্দ্র করে সার্বিক তদন্ত শুরু হয়েছে। এই তদন্ত সব ষড়যন্ত্র, সব ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মূল করে আমেরিকার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে নিরাপদ ও নিশ্চিত করার একটি উদ্যোগ। কাউকেই আমরা ছাড় দেব না।
যে ভুল-ভ্রান্তির আমি উল্লেখ করলাম, তা একটি ব্যতিক্রম। আমেরিকার নিজস্ব রূপ এটা নয়। আমেরিকা তার ফাউন্ডার ফাদারসদের বিধিবদ্ধকৃত মানুষের অধিকার, মানুষের স্বাধীনতার আদর্শের উপরই দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের স্বার্থে মানবাধিকারের স্বার্থে আহমদ মুসা যুদ্ধ সংঘাত চান না। যুদ্ধ-সংঘাত আমরা আমেরিকানরাও চাই না। আমি বলেছি, কাউকে কলোনি করার যুদ্ধ আমরা কখনও করিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমরা অংশ নেইনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও আমরা অনেক দেরিতে যুদ্ধে নেমেছি দুনিয়া গ্রাসকামী এক অপশক্তিকে ধ্বংস করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোল্ড ওয়ারের সময় নিরস্ত্রীকরণ উদ্যোগের ক্ষেত্রে আমাদেরই আগ্রহ ছিল বেশি। এই আগ্রহ আমাদের এখনও আছে। গোপন দুটি অস্ত্রের ব্যাপারে আহমদ মুসা যে প্রত্যাশা করেছেন, তার জন্যে তাকে ধন্যবাদ। এই অস্ত্রের কোন ব্যাপারেই কোন চিন্তা আমরা এখনো করিনি। যে ষড়যন্ত্র আমাদের ঘিরে ধরেছিল, সে ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটনই এখন আমাদের আশু করণীয়। আহমদ মুসার প্রত্যাশা নতুন একটা চিন্তা হিসাবে আমাদের কাছে এসেছে। আমরা এর সম্মান করব। তার সম্মানে আমি এই প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, আমরা অবিলম্বে অনুসন্ধান শুরু করব, বিশ্বের আর কোন পক্ষ বা দেশের কাছে এই অস্ত্র আছে কিনা। না থাকলে অস্ত্র দুটিকে আমরা ডিসম্যান্টল করব। তারপর এই অস্ত্রের গবেষণা কোথাও কেউ করছে না, তা পুরোপুরি নিশ্চিত হবার পর আমরা এই অস্ত্র ধ্বংস করব। শুধু থাকবে এর ল্যাবরেটরি ভার্সন, কোন কালে আমেকিার কোন সংকট মোকাবিলার শেষ একটি অবলম্বন হিসাবে। আমরা এসব কাজে তিন মাসের বেশি সময় নেব না আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণায় উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে উঠলেন, আহমদ মুসাও।
প্রেসিডেন্ট তার বক্তৃতা শেষ করলেন এই বলে যে, আহমদ মুসা আমাদের এই আয়োজনে অংশ নিতে সম্মত হওয়ায় আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলছি, আমেরিকা আহমদ মুসার আরও ঘনিষ্ঠ হতে চায়, আত্মীয়তার বন্ধনে তাঁকে বাঁধতে চায়, আহমদ মুসা সে সুযোগ আমেরিকাকে দেবেন আশা করছি। সবাইকে ধন্যবাদ। গড় ব্লেস আস। অল।
প্রেসিডেন্টের এই শেষ কথা শোনার সাথে সাথে সারা জেফারসনের চোখে-মুখে বিব্রতকর ভাব ফুটে উঠল। মুখ নিচু করল সে। পাশে বসা জোসেফাইন মিষ্টি হেসে সারা জেফারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টও ঘটকালি করলেন সারা।
আহমদ মুসা প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে তার বক্তৃতা শুনছিল। তার চোখে-মুখে কোন ভাবান্তর নেই। মাত্র একটু গম্ভীর হয়ে উঠেছিল মুখটা।
.
সারা জেফারসনদের ড্রইং রুম।
একটা সোফায় বসেছে জর্জ আব্রাহাম জনসন ও তার নাতি। তার ডান পাশের সোফায় আহমদ মুসা ও বাম পাশের সোফায় জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা।
সামনের বড় সোফাটিতে মিসেস জর্জ আব্রাহাম জনসন। তার এক, পাশে জোসেফাইন, অন্য পাশে সারা জেফারসন। সারা জেফারসনের কোলে আহমদ আব্দুল্লাহ।
কথা বলছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন, অনেক কথা হলো, কিন্তু আমি যে জন্যে এসেছি, সেই কথায় আমরা আসতেই পারিনি। থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
একটু নড়ে-চড়ে বসল সে। মুখটাও তার গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, আমি যে বিষয়ে কথা বলতে চাই, সে বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সবার সাথে আলোচনা করেছি গত কয়েকদিনে। আজ আমি আনুষ্ঠানিকভাবে কথাটা পাড়তে চাই। আপনারা সবাই জানেন আমাদের প্রেসিডেন্ট একটা আশা প্রকাশ করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমি কথা বলতে চাই।
থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন আবার। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, আহমদ মুসা, আমি প্রেসিডেন্টের পক্ষে কথা বললেও নিজেকে কি তোমারও অভিভাবক ভাবতে পারি?
জি, অবশ্যই আংকেল। এদেশে আপনার চেয়ে বড় মুরুব্বি আর কে আছেন? বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা।
বলেই জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল, মা জোসেফাইন, আমার কথাগুলো কি তোমার পক্ষ থেকেও মনে করব?
জি বাবা, আপনি যা বলবেন বলে ভাবছি, সেটা অবশ্যই আমার পক্ষ থেকেও হবে। আমি সর্বান্তকরণে এমনটা চেয়েছি ও চাচ্ছি। জোসেফাইন বলল।
ধন্যবাদ মা জোসেফাইন।
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, মা সারা, আমি তোমার ব্যাপারে তোমার মার সাথে কথা বলতে চাই। তোমার অনুমতি নিশ্চয় পাব?
সারা জেফারসনের মুখ নিচু। মুখ তুলল সে।
তার চোখে-মুখে চরম বিব্রত ভাব। তার সাথে আছে লজ্জার আড়ষ্টতা।
মুখ তুলে কারও দিকে না তাকিয়েই বলল, আংকেল, আমার অভিভাবক মা এখানে উপস্থিত আছে, আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই। অংকেল, আমি কি আসতে পারি?
না মা সারা, আহমদ মুসা আছে, সবাই আছেন। তোমাকেও বসতে হবে মা। সবাইকে নিয়েই কথা বলতে চাই। বলল জর্জ আব্রাহাম। জনসন।
উঠে দাঁড়িয়েছিল সারা জেফারসন।
মুখ নিচু করে আবার বসে পড়ল সে।
জর্জ আব্রাহাম জনসন সোফায় সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসে বলল। জিনা জেফারসনকে লক্ষ্য করে, ম্যাডাম জেফারসন, আপনি আহমদ মুসাকে চেনেন আর সারা জেফারসন আপনার মেয়ে। তার সম্পর্কেও সবকিছু জানেন। সব বিষয়ে সবার সাথে আলোচনার পর আমি আপনার। কাছে এসেছি। আমি আমার সন্তানতুল্য আহমদ মুসার সাথে আমার স্নেহের মা সারা জেফারসনের বিয়ের প্রস্তাব করছি। থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
সারা জেফারসন মাথা নিচু করেই বসেছিল।
আহমদ মুসারও আনত দৃষ্টি।
আর জোসেফাইন তাকিয়ে আছে জিনা জেফারসনের দিকে।
জিনা জেফারসনের মুখ গম্ভীর।
মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজেছিল জিনা জেফারসন। যেন শেষবারের মতো ভাবছে।
নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসল জিনা জেফারসন। তার গম্ভীর মুখটা আরও ভারি হয়ে উঠেছে। একটা অশ্রুসিক্ত আবেগের প্রকাশ তার চোখে মুখে। বলল আস্তে আস্তে সে, সারার বাবা, যিনি সারার পক্ষে কথা বলার সবচেয়ে উপযুক্ত ছিলেন, তিনি আজ নেই। জেফারসন পরিবারেও এখন কোন বড় মুরুব্বি নেই, যিনি সারার পক্ষে দাঁড়াতে পারেন। সুতরাং এ দায়টা আমার উপর বর্তেছে। থামল জিনা জেফারসন। তার কণ্ঠ নরম ও অশ্রুসিক্ত।
একটু থেমে আবার শুরু করল জিনা জেফারসন। বলল, সত্য হলো, আমিও এমন একটা দিনের অপেক্ষা করছিলাম। পিতা-মাতাকে সবচেয়ে আনন্দ দেয় যা, তার মধ্যে ছেলে-মেয়ের বিয়ে একটি। এ দিনটা মর্মান্তিক বিদায়ের, তবু আনন্দের। কারণ পিতা-মাতা দেখতে চায় ছেলে-মেয়েদের সংসার। আমিও এটাই চাই মা হিসেবে।
শেষের কথাগুলো জিনা জেফারসনের কান্নায় ভেঙে পড়ল। থামল জিনা জেফারসন।
সারা জেফারসনের নত মুখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।
আহমদ আব্দুল্লাহ বসেছিল সারা জেফারসনের পাশে, তার গা ঘেষে। সে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সারা জেফারসনের অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে। সে এক সময় বলে উঠল, মাম্মি, তুমি কাঁদছ কেন?
জোসেফাইনের চোখ দিয়েও অশ্রু গড়াচ্ছিল। সে উঠল। উঠে গিয়ে আহমদ আব্দুল্লাহকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, মাম্মিকে বিরক্ত করো না বেটা। চল।
না আম্মা, আমি বিরক্ত করব না। ছেড়ে দাও আমাকে। বলল আহমদ আব্দুল্লাহ। জোসেফাইন তাকে ঠিক আছে বেটা বলে ছেড়ে দিয়ে বলল, চুপচাপ বসে থাকবে। কথা বলবে না, কেমন।
আহমদ আব্দুল্লাহ ছুটে গিয়ে সারা জেফারসনের পাশে বসল। সারা জেফারসন তাকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখল।
জিনা জেফারসন তার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চোখ মুছে সামনে ফিরে আবার শুরু করল, মি. জর্জ আব্রাহাম জনসন, আপনি যে প্রস্তাব করেছেন, সেটা আমার কথা। আমি অনেক দিন ধরে অনেক চিন্তার পর এ সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছি, আমার সারাকে একটা সংসার দেবার, এ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু আমার এ চিন্তাকে ভাষা দিতে পারিনি। মা জোসেফাইন একে ভাষা দিয়েছে। জোসেফাইন মা শুধু একে ভাষা দেয়নি, এর পক্ষে সে সবকিছুই করেছে। আজকের এই দিন হয়তো আসতো না মা জোসেফাইন। যদি এর মধ্যে এসে না দাঁড়াতো। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনাকে ধন্যবাদ মি. জর্জ জনসন সবার আকাক্ষিত এই প্রস্তাবের জন্যে। আপনি এ দায়িত্ব না নিলে কিভাবে আমরা সামনে এগোতাম, তা জানা নেই।
আল হামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ ম্যাডাম জেফারসন। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
একটু হাসল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, আমি মহামান্য প্রেসিডেন্টের কাছে কৃতজ্ঞ। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার মতো এই কাজের দায়িত্ব তিনিই আমাকে দিয়েছেন। আল হামদুলিল্লাহ। দায়িত্ব আমি পালন করেছি।
থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন। তাকাল সারা জেফারসনের দিকে। বলল, মা সারা, তুমি আমাকে একটু সাহায্য কর। তোমার গেটকিপারকে বল আমার গাড়িতে একটা প্যাকেট আছে, ওটা নিয়ে আসতে।
হ্যাঁ আংকেল, আমি বলছি।
বলে সারা জেফারসন ইন্টারকম-কানেকটর হাতে তুলে নিয়ে বোতাম টিপে গেটকিপারকে নির্দেশ দিল জর্জ আব্রাহাম জনসনের গাড়ি থেকে প্যাকেটটা নিয়ে আসতে।
সারা জেফারসনের কথা শেষ হলে জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল জিনা জেফারসনের দিকে। বলল, ম্যাডাম জেফারসন, আমি জেনেছি, আহমদ মুসা আগামী শুক্রবার রাত দশটার ফ্লাইটে যাচ্ছে ইউরোপ, যাবে আর্মেনিয়ায়। হাতে মাত্র ৫ দিন সময় আছে। এর মধ্যেই আমরা শুভ কাজটা সেরে ফেলতে চাই। সে দিনটা কবে হবে?
জিনা জেফারসন তাকাল সারা জেফারসন ও আহমদ মুসার দিকে। শেষে তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল, বল মা জোসেফাইন, এ প্রশ্নের কি জবাব দেব আমি?
জিনা জেফারসনের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে নত মুখে সারা জেফারসন বলল, এতো তাড়াহুড়া কেন? উনি আর্মেনিয়া থেকে ঘুরে আসুন।
জোসেফাইনের ঠোঁটে এক টুকরো হাসি। বলল, সারার কথার মধ্যে যুক্তি আছে এক দিক থেকে। কিন্তু আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে শুভ কাজ। সেরে ফেলার মধ্যে অসুবিধার কিছু নেই।
আমিও তাই মনে করছি। সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন বলল।
তাহলে এই সিদ্ধান্ত হয়ে যেতে পারে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কথা শেষ করেই সে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, তোমার যাবার ডেট কি এদিক সেদিক হতে পারে আহমদ মুসা?
এটা সম্ভব নয় আংকেল। ওঁদের মেসেজ আসার পর পনের দিন পার হয়ে গেছে। ওঁরা আমাকে আরও আগে আশা করেছিলেন। বলল আহমদ মুসা। _ তাহলে এই পাঁচ দিনের মধ্যেই একটা, ডেট হয়ে যাওয়া দরকার। ডেটটা কবে হতে পারে? জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
সবাই নীরব। কেউ কথা বলছে না।
পল পল করে সময় বয়ে যাচ্ছে। মুখ তুলল সারা জেফারসন। বিব্রত অবস্থা সারার। তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, এই পাঁচ দিনই যদি চূড়ান্ত হয়, তাহলে আমাদের মুসলমানদের পবিত্র দিন হলো শুক্রবার। আগামী শুক্রবার বিকেলে এই অনুষ্ঠান হতে পারে।
বিস্ময় ফুটে উঠেছে জর্জ আব্রাহাম জনসন, জিনা জেফারসন ও জোসেফাইনের মুখে।
নির্বাক তারা সকলেই।
জর্জ আব্রাহাম জনসনই নীরবতা ভাঙল। বলল, কিন্তু ঐ দিনই তো আহমদ মুসার বাইরে যাবার দিন, ফ্লাইট রাত দশটায়। ঐ দিন কি করে বিয়ে হয়!
জোসেফাইনের মুখ থেকে বিস্ময়ভাব ধীরে ধীরে কেটে গেল। ঠোঁটে তার স্নেহময় মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। মনে মনে বলল, লজ্জামিশ্রিত এক প্রচণ্ড জড়তায় ভুগছে সারা জেফারসন। এই লজ্জা ও জড়তা হলো আহমদ মুসার সাথে স্বামী-স্ত্রীর জীবন শুরুর ক্ষণ নিয়ে। এই ক্ষেত্রে সে সহজ হতে পারছে না এবং এটা স্বাভাবিক। ভাবল সে, সারাকে তার সাহায্য করা। দরকার।
কিছু বলার জন্যে মুখ তুলেছিল জোসেফাইন।
কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল আহমদ মুসা। বলল, আমি মনে করি সারা জেফারসন ঠিক বলেছে। শুক্রবার আমাদের পবিত্র দিন। এই দিন বিকেলে বা সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান হতে পারে।
খুশি হলো জোসেফাইন। সেও এই কথাটাই বলতে চেয়েছিল। বলল, সারা জেফারসন ও আহমদ মুসা দিন ও সময়ের ব্যাপারে যে কথা বলেছে, সেটাই আমাদের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।
জর্জ আব্রাহাম জনসনের বিস্মিত মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, আহমদ মুসা বিস্ময়কর মানুষ, সারা জেফারসনও বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব ও ধারাল চেতনার মানুষ! তাদের সিদ্ধান্তও বিস্ময়কর! আমরা মেনে নিলাম। তাদের এ সিদ্ধান্ত।
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকাল গাড়ি থেকে নিয়ে এসে রাখা বক্সটার দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাল স্ত্রী মিসেস জনসনের দিকে। বলল, এবার তুমি সকলকে মিষ্টি মুখ করাও। বক্সটা খুলে দেখ মিষ্টির প্যাকেট। আছে। ওগুলো দিয়ে দাও সকলকে। মিসেস জনসন উঠল।
আমি খালা আম্মাকে সাহায্য করি? বলল জোসেফাইন জর্জ আব্রাহাম জনসনকে লক্ষ্য করে।
জর্জ আব্রাহাম জনসন কথা বলার আগেই মিসেস জনসন বলে উঠল, পুত্রবধূর সাহায্য শাশুড়ির জন্যে খুবই মধুর। এস মা।
জোসেফাইন বক্সটা খুলে ফেলল।
মিষ্টির ছোট ছোট প্যাকেটে ভরা বক্সটা।
ছোট প্যাকেটে মিষ্টি ও চামচ আছে।
বক্সে বেশ কয়েকটা ট্রেও রয়েছে।
মিসেস জনসন ট্রেতে মিষ্টির প্যাকেটগুলো সাজিয়ে দিল। আর জোসেফাইন সেগুলো সবাইকে পরিবেশন করল।
সারা জেফারসন ও আহমদ আব্দুল্লাহর সামনে মিষ্টির একটা ট্রে রেখে সারা জেফারসনের পাশে বসল। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, দুষ্টু বোন, সন্ধ্যায় বিয়ে, আর দশটায় ফ্লাইট হলে ৮ টায় উনি চলে যাবেন। এটা ঠিক হলো? এখনো পালিয়ে থাকতে চাও কেন? ফিসফিসে কণ্ঠ জোসেফাইনের।
অস্বস্তির একটা কালো ছায়া নামল সারা জেফারসনের চোখে-মুখে। ভারি হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, অন্তত তুমি আমাকে ভুল বুঝ না আপা। আমার এটা পালানো নয়। আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারছি না। সারা জেফারসনের গলার স্বর কাঁপা।
আমি বুঝতে পারছি সারা। কিন্তু দৃশ্যটার কথা একবার চিন্তা করো তো! একটা কথাও তোমার সাথে হলো না, উনি চলে গেলেন। তোমার ভালো লাগবে? তুমি সহ্য করতে পারবে? পরে তো কাঁদবে! বলল জোসেফাইন ফিসফিসে কণ্ঠে।
কোন উত্তর দিল না সারা জেফারসন। মুখটা তার আরও নিচু হয়ে গেল।
জোসেফাইনই আবার কথা বলল, বিয়েটা বাদ জুমআ নিয়ে আসতে চাই। তাতেই অনুষ্ঠান শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তোমাদের অন্তত সালাম বিনিময়ের একটা সুযোগ হওয়া দরকার। তুমি কি ভাব?
আমি কিছুই ভাবতে পারছি না আপা। তুমি যা নির্দেশ করবে আমি। তাই করব। সারা জেফারসন বলল।
ধন্যবাদ, আমার ভালো বোন। বলে জোসেফাইন সারা জেফারসনের পিঠে আদরের একটা ছোট্ট থাপ্পড় দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
বক্সে পানিরও অনেকগুলো প্যাক ছিল। জোসেফাইন পানির প্যাকগুলো সবাইকে পরিবেশন করল।
সবার মিষ্টি খাওয়া হয়ে গেলে জোসেফাইন জর্জ আব্রাহাম জনসনকে বলল, আংকেল আমি একটা কথা বলতে চাই সবার উদ্দেশ্যে।
হ্যাঁ মা, অবশ্যই। বল। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জোসেফাইন উঠে দাঁড়াল। বলল, আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি যে, একটা শুভ সিদ্ধান্ত নেয়ার তৌফিক আল্লাহ রাব্বল আলামিন। আমাদের দিয়েছেন। মহামান্য প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি ও আমেরিকার আহমদ মুসা পরিবারের অভিভাবক জনাব জর্জ আব্রাহাম জনসন এই শুভ সিদ্ধান্ত উদ্যাপনের জন্য আমাদের সকলকে মিষ্টিমুখ করিয়েছেন। তাঁর প্রতিও আমরা সকলে কৃতজ্ঞ। শুভ কাজ সম্পন্ন করার সব করণীয় জর্জ আব্রাহাম জনসনের তত্ত্বাবধানে এই দুই পরিবার করবে। আজ আর একটা কাজই বাকি আছে, তা হলো দোয়া। আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করব, আজ যে শুভ সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করলাম, তাতে আল্লাহ যেন বরকত দেন। এবং আমরা তা সাফল্যের সাথে যেন সম্পন্ন করতে পারি।
একটু থামল জোসেফাইন। চিন্তা করল। বলল, আমি বুঝতে পারছি না দোয়া করার জন্যে কাকে আহ্বান করব। জনাব আহমদ মুসা কি এ সিলেকশনে আমাকে সহযোগিতা করবেন? প্লিজ।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলে উঠল, বয়সে সবার বড় হিসেবে আমি মা জোসেফাইনকে সাহায্য করতে চাই।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল জর্জ আব্রাহাম জনসন, আমরা যারা এখানে উপস্থিত আছি, তাদের মধ্যে সব বিচারে আহমদ মুসা দোয়া করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। আমাদের জানাটা এখনও এবিসিডির বেশি নয়। আমি অনুরোধ করছি আহমদ মুসাকে দোয়া করার জন্যে।
আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল, জোসেফাইন, তুমি দোয়াটা কর। এই অনুষ্ঠানের জন্য এটাই যথাযথ হবে।
জোসেফাইন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ভাবল আহমদ মুসা ঠিকই বলেছে।
ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা।
বলে জোসেফাইন তাকাল সবার দিকে। বলল, আমি প্রথমে একবার। সূরা ফাতিহা, একবার সূরা এখলাস, তারপর তিনবার দরূদ শরিফ পড়ব। আপনারাও মনে মনে আমার সাথে পড়ন। তারপর দোয়া।
জোসেফাইন সুরা ফাতিহা ও সূরা এখলাস তেলাওয়াত করল। তিনবার দরূদ পড়ল। সবার মুখ নিচু। ঠোঁট নড়ছে সবার। সবাই পড়ছে জোসেফাইনের সাথে।
পড়া শেষে জোসেফাইন হাত তুলল মোনাজাতের জন্যে। আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুলের প্রতি সালাম ও শান্তি কামনা করে অবশেষে উপস্থিত সকলের জন্যে দোয়া করল, বিশ্বের সব মুসলমান, সব মানুষের কল্যাণ কামনা করল। সবশেষে এল শুভ সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গে। আবেগপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তার কণ্ঠ। বিনীতভাবে আল্লাহর বরকত ও রহমত কামনা করল। অবশেষে কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে প্রার্থনা করল, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের পরিবারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পরিবারের আদর্শ এনে দিন। আমার ও সারার মধ্যে উম্মুল মুমেনিন খাদিজা (রা.)-সহ উম্মেহাতুল মুমেনিনদের মন-মানসিকতা সৃষ্টি করে দিন, তাদের চরিত্র, নিষ্ঠা ও ধর্মভীরুতা আমাদের মধ্যে দান করুন এবং আমাদের সকলকে জান্নাতের পথে অটলভাবে চলার তৌফিক দিন।
সকলে বলল, আমিন!
দরূদ পড়ার মাধ্যমে মোনাজাত শেষ করল জোসেফাইন।
মোনজাত শেষ হতেই উঠে দাঁড়াল জিনা জেফারসন ও মিসেস জনসন। তারা এসে জড়িয়ে ধরল জোসেফাইনকে বলল, তোমার এই প্রার্থনা, প্রার্থনার চেয়ে অনেক বড় কিছু। অনেক ধন্যবাদ।
মা জোসেফাইন, তোমার তেলাওয়াত এত মিষ্টি, এত সুন্দর! আমার কাছে কুরআন শরিফ তেলাওয়াতের অনেক অডিও ভিডিও আছে। আমি ওগুলো শুনি। কিন্তু তোমার তেলাওয়াতে মনোমুগ্ধকর এক নতুনত্ব পেলাম। তোমাকে ধন্যবাদ। ভাবছি, তুমি যদি আমাদের পরিবারকে সাহায্য করতে! বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জোসেফাইন কিছু বলার আগেই আহমদ মুসা বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন জনাব। জোসেফাইনের তেলাওয়াত মনোমুগ্ধকর মিষ্টি ও অনন্য। এক আবেগে জড়ানো। ওর তেলাওয়াত মদিনাতেও প্রশংসা পেয়েছে।
যিনি এই কথাগুলো বললেন, তিনিই আমার তেলাওয়াতের শিক্ষক। আমি তাকেই অনুসরণ করি। আহমদ মুসার দিকে ইংগিত করে বলল। জোসেফাইন।
কিন্তু তোমার মতো মিষ্টি মমতার কণ্ঠ আমি পাব কোথায় জোসেফাইন? আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে জেসেফাইন বলল, থাক এ প্রসংগ, মা কিছু বলবেন।
ধন্যবাদ মা জোসেফাইন।
বলে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, খানা টেবিলে রেডি। সবাইকে আমার দাওয়াত। চলুন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন হাসল। বলল, আমি ও আমরা এমন ঘোষণাই এখন আশা করছিলাম।
সবাই হেসে উঠল।
.
৩.
কোন সাজ-সজ্জা, কোন বাড়তি হৈ চৈ ছাড়াই বিয়ের দিনটা পার হয়ে গেছে। সারা জেফারসনের দেয়া শর্তানুসারে ঘনিষ্ঠ পারিবারিক লোকজন ছাড়া কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সারার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের বাইরে এসেছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন, প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস ও সিনেটের কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিকের পরিবার। আর আহমদ মুসার তরফের দাওয়াতের মেহমান হচ্ছে ওয়াশিংটনের কয়েকটি মুসলিম দূতাবাসের। কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার এবং ওয়াশিংটনের ইসলামিক সেন্টারের কয়েকজন মুসলিম নেতা। আর এসেছিল আহমদ মুসার ভক্ত। ক্যারিবিয়ানের টার্ক দ্বীপপুঞ্জ থেকে লায়লা জেনিফার ও জর্জ, বাহামা থেকে শিলা সুসান, নিউ মেক্সিকো থেকে সান্তা আনা ও সান ঘানেম, ডা, আশরাফ, ফায়জা হক, মেয়ে সারা সাদীয়া, মিসিসিপির কাহোকিয়া থেকে রেড ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী প্রফেসর আরাপাহো আরিকায়া, জিভায়ো ও ওগলালা, ওয়াশিংটন এলাকা থেকে সারা বেনগুরিয়ান, বরিস ও ন্যান্সি ময়নিহান, ইহুদি মেয়ে নোয়ান নাবিলা ও তার স্বামী, ইহুদি ডাক্তার মি. বেগিন বারাক, হিন্দু মেয়ে সাগরিকা সেন, তার ভাই শশাংক এবং রেডইন্ডিয়ান তরুণ বিজ্ঞানী সান ওয়াকার ও মেরী রোজ।
আহমদ মুসার ভক্ত-অনুরক্ত এই মেহমানরাই বিয়ে-অনুষ্ঠানে ভারি ভারি লোকদের গাম্ভীর্যের মধ্যে হাসি-আনন্দের একটা টেউ এনেছিল।
মারিয়া জোসেফাইন তাদের কাছে আকাশের চাঁদের মতো। লায়লা জেনিফার, শিলা সুসান, সান্তা আনা, সারা সাদীয়া, সারা বেনগুরিয়ান, ন্যান্সি ময়নিহান, নোয়ান নাবিলা, সাগরিকা সেন, মেরী রোজ, ওগলালারা প্রায় সারাক্ষণ তাকে ঘিরে রেখেছিল এবং মাঝে মাঝেই তাকে নিয়ে আসর জমিয়েছে। সে আসরে কনে সারা জেফারসনকেও ধরে এনে বসিয়েছে। তাদের অন্তহীন প্রশ্নের মুখে পড়ল মারিয়া জোসেফাইন।
ভাবি বহুজনের টার্গেট থেকে আহমদ মুসাকে আপনি কিভাবে শিকার করেছিলেন? প্রশ্ন করল টার্কস দ্বীপপুঞ্জের লায়লা জেনিফার।
তোমরা আমাকে নিয়ে পড়লে কেন? সারাকে আজ প্রশ্ন করার দিন। বলল জোসেফাইন মুখ ভরা হাসি নিয়ে।
সারা জেফারসন আমাদের নেত্রী। তিনি আমেরিকান। তাকে আমরা জানি। আরও জানব। কিন্তু আজ ভাগ্যগুণে আপনাকে আমরা কাছে পেয়েছি। তাই পাশ কাটিয়ে যেতে দেব না আপনাকে আমরা। জবাব চাই লায়লার প্রশ্নের। বলল ইহুদি মেয়ে নোয়ান নাবিলা।
হাসল জোসেফাইন। বলল, দেখ, তোমরা আমাকে দোষ দিও না। তিনি আর কারো টার্গেট ছিলেন জানতাম না, জানলে এগোতে সাহস পেতাম না। শিকার করাও হতো না।
প্রশ্নের উত্তর হলো না। কি করে শিকার করলেন সবার স্বপ্নের এই মানুষকে। সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছিল বাহামার মেয়ে শিলা সুসান।
সবার স্বপ্নের মানুষ তা আমি জানতাম না। শুধু আমার স্বপ্নের মানুষ। বলেই ভাবতাম। বলল জোসেফাইন মিষ্টি হেসে।
তারপর? বলল শিলা সুসানই।
তারপর কি? হেসে বলল জোসেফাইন।
অসাধ্য সাধনটা কি করে হলো? মেরী রোজ বলল।
অসাধ্য কেন? আহমদ মুসার মনটা জানো কাদামাটির চেয়েও নরম। কারও অশ্রু, কারও দুঃখ তিনি সইতে পারেন না। অই তাকে জয় করেছে। বলল জোসেফাইন। এবার তার কণ্ঠ কিছুটা ভারি।
সব তো জানি না। কিন্তু একজনকে তিনি অনেক কাঁদিয়েছেন। তাহলে…? সাগরিকা সেন বলল।
সারার কথা বলছ? কিন্তু ওর অঞ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দেখতে পায়নি। তাছাড়া একটা সমস্যাও ছিল। মাঝখানে ছিল একটা হৃদয়, সে হৃদয়কে ওঁরা কেউ ভাঙতে চাননি। বলল প্রসন্ন মুখে জোসেফাইন।
কিন্তু এখন? সে হৃদয় তো এখনও আছে? বলল ওগলালা, মিসিসিপির মেয়ে।
সে হৃদয় ভাঙেনি। বরং সে হৃদয়ই এগিয়ে এসেছে দুই হৃদয়কে জোড়া লাগাতে বলল জোসেফাইন হাসি মুখে।
সে হৃদয় ভাঙেনি দেখতে পাচ্ছি। কেন ভাঙেনি? শিলা সুসান বলল।
যে হৃদয় শুধুই তার নিজের জন্যে, সে হৃদয় ভাঙতে পারে। কিন্তু যে হৃদয় আল্লাহর জন্যে, সে হৃদয় এমন ঘটনায় ভাঙে না। বলল জোসেফাইন গম্ভীর কণ্ঠে।
আল্লাহর জন্যে কথাটার অর্থ বুঝলাম না। মেরী রোজ বলল।
যে হৃদয় আল্লাহর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়। আল্লাহর ইচ্ছাকেই নিজের ইচ্ছা বলে গ্রহণ করে, যে হৃদয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই সবকিছু করে, এমন হৃদয়কেই বলা হয় আল্লাহর জন্যে। জোসেফাইন বলল।
যে ঘটনার দিকে ইংগিত করেছেন, তার সাথে আল্লাহর ইচ্ছা অনিচ্ছার সম্পর্ক বুঝিয়ে বলুন প্লিজ। ফায়জা আশরাফ বলল।
বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষাপটে ও প্রয়োজনে ব্যতিক্রমি ব্যবস্থা হিসাবে একাধিক বিয়ের অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন, যাতে সামাজিক ও পারিবারিক সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা বজায় থাকে। যে হৃদয় এর সাথে একমত হয়, সে হৃদয় আল্লাহর জন্যে। আমার হৃদয় আল্লাহর ইচ্ছার সাথে একমত বলেই আমার হৃদয় ভাঙেনি শুধু নয়, আমি আনন্দিত, পরিতৃপ্ত এবং গর্বিত একটি ভাঙা হৃদয়কে জোড়া লাগাতে পেরে, সুস্থতা, স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনতে পেরে। বলল জোসেফাইন। এক উজ্জ্বলতায় আলোকিত হয়ে উঠল জোসেফাইনের মুখ।
জোসেফাইনকে ঘিরে থাকা চারদিকের মুখগুলোতে নেমে এসেছিল। বিস্ময়! এমন নতুন কথা, বিস্ময়কর কথা তারা এর আগে শোনেনি। স্বামীকে ভাগ করা! কোনো মেয়ে এটা কল্পনাও করতে পারে না! মুসলিমরাও তো এটা এখন আর মানছে না। কিন্তু জোসেফাইন বিষয়টাকে এমন বিস্ময়করভাবে তুলে ধরল, যাতে মনে হলো খুবই সংহত ও স্বাভাবিক বিষয়টা।
কিন্তু সব স্বামীর ইচ্ছা যদি হয় একাধিক বিয়ে, আর অবস্থা যদি এমন সৃষ্টি হয়, একাধিক বিয়ে সাধারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাহলে কি হবে? শিলা সুসান বলল।
একাধিক বিয়ের অনুমতি এসেছে কঠিন শর্ত সাপেক্ষে। তার একটি হলো, পারিবারিক ও সামাজিক অসুস্থতা নিরাময়, অন্যটি সব স্ত্রীকে সমানভাবে দেখা। এই অসুস্থতা যদি না থাকে এবং স্বামী সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখতে যদি অসমর্থ হয়, তাহলে অনুমতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এমনকি বিয়ে হলেও কষ্টের মধ্যে না রেখে বিচ্ছেদ ঘটাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর এ বিধান যদি মানা হয়, তাহলে কোটিজনেও একটি একাধিক বিয়ে সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ। আল্লাহর দেয়া অনুমতিকে সাধারণ আইনের শর্ত সাপেক্ষ একটা ব্যতিক্রম হিসাবে দেখতে হবে। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। জোসেফাইন বলল আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে।
চারদিকের সব মুখই আনন্দে ভরে গিয়েছিল। মেরী রোজ বলল, সত্যি ইসলাম ডিনামিক ধর্ম। এর বিধান ও দৃষ্টিভঙ্গি একান্তভাবেই প্রকৃতির মতোই অমোঘ নিয়মে বাঁধা, প্রাকৃতিক। এখন আমার মনে হচ্ছে। বিয়ের ক্ষেত্রে এমন একটা একসেপশন না থাকাটাই অপ্রাকৃতিক, এক ধরনের সামাজিক অন্ধত্ব। এই সামাজিক অন্ধত্বকে ভাঙতে আমাদের নেত্রী সাহসের সাথে এগিয়ে এসেছেন, সেজন্যে তাকে অসংখ্য মোবারকবাদ।
আমরা কি ম্যাডাম সারা জেফারসনের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছু শুনতে পারি? বলল সান্তা আনা।
আমার জানা-শোনা, আমার ঈমান কোনটাই জোসেফাইন আপার মতো নয়। এতদিন একান্তভাবেই ভেবেছি, আমি আমার এক বোনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করব কেন? করছি কেন? এটা আমার দুর্বলতা। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। ভারি কণ্ঠে বলল সারা জেফারসন।
আল হামদুলিল্লাহ। আমাদের বোন সারা এখন সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছেন। আমরা সকলে তার জন্যে দোয়া করছি। জোসেফাইন বলল।
কিন্তু এটা কেন হলো, আজ দশটার মধ্যে জনাব আহমদ মুসা চলে যাচ্ছেন। এটা আটকাতে হবে। বলল লায়লা জেনিফার।
এটা আমাদের হাতে নেই। আল্লাহর ইচ্ছার উপর আমরা ভরসা রাখি। দেখা যাক আল্লাহ কি করেন। জোসেফাইন বলল।
জোসেফাইনের কথার মধ্যে কিছুটা রহস্যের আঁচ ছিল। ত্বরিত দৃষ্টিতে তাকাল সারা জেফারসন জোসেফাইনের দিকে। তার চোখে একটা আশার আলো। যেন সে চাচ্ছে অন্যথা কিছু ঘটুক।
এ ধরনের আলোচনার আসর কখনও ছোট, কখনও লম্বা আর ঘুরে ফিরে সারা দিন ধরেই চলেছে।
এরই মধ্যে বাদ-আসর ওয়াশিংটন ইসলামিক সেন্টার মসজিদের ইমামের পরিচালনায় ইসলামী বিধান অনুসারে বিয়ে পড়ানোর কাজ সম্পন্ন হয়।
বিয়ের সম্মতি বাক্য উচ্চারণ করার পরেই সারা জেফারসন পাশে বসা জোসেফাইনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাকে গভীর মমতায় সান্ত্বনা দেয় জোসেফাইন।
.
রাত তখন সাড়ে ৮টা। খাওয়ার পর সারার ঘরেই সবাই বসেছিল। সারার পাশেই বসেছিল জোসেফাইন।
কিন্তু অনেকক্ষণ ধরেই সারা জেফারসন অনেকটাই আনমনা। তার চোখ-মুখে চঞ্চলতার ভাব সবার অলক্ষ্যে মাঝে মাঝেই নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল সারা।
বিষয়টা লক্ষ্য করেছিল জোসেফাইন। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।
ঘড়িতে সাড়ে ৮টা বাজতে দেখে সত্যিই তার চোখে-মুখে অস্থিরতার ভাব ফুটে উঠল। একবার সে জোসেফাইনের দিকে তাকাল।
কিছু বলবে সারা? জিজ্ঞাসা করল জোসেফাইন।
সারা দ্রুত তার মুখ জোসেফাইনের কানের কাছে নিয়ে বলল, উনি কোথায়? উনি কি যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছেন? দশটায় ফ্লাইট হলে এখনি তো উনি চলে যাবেন!,
জোসেফাইন সারা জেফারসনের চোখে চোখ রাখল। একটু অপেক্ষা করল। বলল, তাই চাও তুমি?
চোখ বন্ধ করল সারা জেফারসন।
কোন উত্তর এল না তার কাছ থেকে।
হঠাৎ সে জোসেফাইনের কাঁধে মুখ খুঁজল। বলল প্রায় অস্ফুট কণ্ঠে, সেদিন কথাটা আমি খুব ভেবে বলিনি। তার কণ্ঠ অঞরুদ্ধ।
তাহলে এখন কি হবে? বলল জোসেফাইন। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।
জানি না। নিশ্চয় তোমরা সবাই আমাকে ভুল বুঝেছ। কথার সাথে সাথে কান্না অশ্রু হয়ে বেরিয়ে এল সারা জেফারসনের চোখ থেকে।
কি হচ্ছে ভাবি? নতুন ভাবির চোখে অশ্রু কেন? বলল লায়লা জেনিফার।
তোমরা সব ছোট। সব অশ্রুর অর্থ জানতে নেই।
বলে সারা জেফারসনের অশ্রু মুছে দিল জোসেফাইন।
জোসেফাইনের কথার ঢংয়ে সবাই হেসে উঠেছিল।
সেই ফাঁকে জোসেফাইন সারা জেফারসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, কি চাও তুমি বল তো?
আপনারা কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না। সারা জেফারসন বলল।
আপনারা মানে উনি? বলল জোসেফাইন। তার ঠোঁটে হাসি।
সারা জেফারসন একটু নীরব থেকে বলল, হ্যাঁ।
জোসেফাইন সারা জেফারসনের পিঠে হাত রেখে বলল, কষ্ট পেয়ো না। তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে। এখন বলব না।
কিছু বলতে যাচ্ছিল সারা জেফারসন। হলো না বলা।
আড্ডার আসরে প্রবেশ করল জিনা জেফারসন। এল জোসেফাইনের কাছে। বলল, মা জোসেফাইন মি. জর্জরা যেতে চান। তোমরা এস।
জিনা জেফারসনের কথা শেষ হতেই জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের চারদিকে ঘিরে বসে থাকা লায়লা জেনিফাররা বলে উঠল, আমাদেরও এখন উঠতে হবে। নির
বলে লায়লা জেনিফার উঠে দাঁড়াল। তার সাথে অন্যরাও।
উঠে দাঁড়াল জোসেফাইন ও সারা জেফারসন। জোসেফাইন সবাইকে লক্ষ্য করে বলল, এখনি উঠবে তোমরা? কেন, থেকে গেলে কি ক্ষতি হবে?
কাল আবার আসব। আমাদের কোন অসুবিধা হবে না। বলল মেরী রোজ ও শিলা সুসান।
অন্য অতিথিরা একে একে সবাই চলে গেছে। লায়লা জেনিফার, মেরী রোজ, শীলা সুসানরাও চলে গেল।
জোসেফাইন, সারা জেফারসন, আহমদ মুসা, জিনা জেফারসনরা প্রেসিডেন্টের পরিবার এবং জর্জ আব্রাহাম জনসনের পরিবারকেও বিদায় দিয়ে ফিরে এল।
জোসেফাইন সবাইকে নিয়ে গিয়ে বসল সারা জেফারসনের কক্ষে।
সারা জেফারসন বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তার ঘরের চারদিকে চাইল। তার ঘর নতুন সাজ দেখে সে অবাক। বিয়ে উপলক্ষে সব ঘরের মতো তার ঘরকেও সাজানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে এমন ফুলের সমারোহ ছিল না। সে মাত্র চার পাঁচ ঘন্টা তার ঘরে আসেনি। এর মধ্যে এভাবে ঘর সাজালো
সারা জেফারসন তাকাল জোসেফাইনের দিকে। ইশারা করল ঘরের সাজের দিকে।
জোসেফাইন হাসল। বলল, কোন কিছুই অর্থহীন নয়।
কিছু বলতে যাচ্ছিল সারা জেফারসন।
কিন্তু তার আগেই তার মা জিনা জেফারসন বলল, আহমদ মুসা কি তার ঘরে গেল মা জোসেফাইন?
জি মা। ওঁর একটু রেষ্ট নেয়া দরকার। বলল জোসেফাইন।
ওখানে কি কেউ আছে তাকে অ্যাটেন্ড করার? জিনা জেফারসন বলল।
দরকার নেই মা। উনি একটু নিরিবিলি থাকুন। বলল জোসেফাইন।
এভাবে কথা চলতেই থাকল তাদের মধ্যে।
এক সময় সারা জেফারসন বলল, আপা, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার জন্যে তোমার কি যেন একটা সারপ্রাইজ আছে? আর শুনলাম, ওঁর প্লেন ডিলেড হয়েছে? বল না আপা, কতটা ডিলেড হয়েছে?
তোমার দুই প্রশ্নের জবাব একটাই। সশরীরে ওঁর কাছেই জবাব পাবে। তবে একটা বিষয় বলে রাখি, আমাদের জর্জ আংকেল বিষয়টা কাউকে না জানিয়ে একটা ভালো কাজ করেছেন। বলল জোসেফাইন।
তার মানে? সারা জেফারসন বলল।
তুমি মানে খুঁজতে থাক। আমরা যাই। বলে উঠে দাঁড়াল জোসেফাইন।
জিনা জেফারসন আগেই চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে সারা জেফারসনের মাথায় হাত রেখে গড ব্লেস ইউ বলে চলে যায়।
ধন্যবাদ বলে তার মা চলে যাবার পরেই সারা জেফারসন জোসেফাইনকে ঐ প্রশ্ন করেছিল।
জোসেফাইন উঠে দাঁড়ালে সারা জেফারসন বলল, আপা, আহমদ আব্দুল্লাহ কোথায়? জেগে থাকলে তাকে পাঠাও, না হলে আমি তাকে নিয়ে আসছি।
আহমদ আব্দুল্লাহ আজ এখানে শোবে না। বেডে দেখ না দ্বিতীয় বালিশটা বড়। বলল জোসেফাইন। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।
বসা থেকে প্রিং-এর মতো উঠে দাঁড়াল সারা। দুধাপ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল জোসেফাইনকে। বলল, এটাই তোমার সারপ্রাইজ আপা? আমি তো…।
জোসেফাইনের আঙুল সারা জেফারসনের ঠোঁটে চেপে বসল। বলল জোসেফাইন, আর কোন কথা নয় সারা বোন।
বলে সারা জেফারসনের কপালে একটা চুমু খেল। তারপর আসছি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সারা জেফারসন, ধপ করে তার বিছানায় বসে পড়ল। এক সাগর। লজ্জা ও সংকোচে তার বোধশক্তি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
কতক্ষণ এভাবে সে ছিল সেও জানে না। দরজায় নক হলো।
তারপর দরজাটা খুলে গেল।
ছুটে গেল সারা জেফারসনের দুই চোখ সে দিকে। তিনি আসছেন।
সারা জেফারসনের গোটা চেতনায় অপরিচিত এক শিহরণ খেলে গেল।
সমগ্র চেতনাকে তা অবশ করে দিল। আবার দেখল সারা, উনি আসছেন।
উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন। দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল সে।
.
গভীর অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে দিভিন উপত্যকা। দুপাশের উঁচু পাহাড় দিভিন উপত্যকার অন্ধকারকে আরও জমাট করে তুলেছে।
এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা উপত্যকার গ্যাস-লাইটের বাতিগুলোকে তারার আলোর মতো মনে হচ্ছে। দিভিন উপত্যকায় বিজলী বাতি ছিল, কিন্তু সম্প্রতি কয়েকটি ট্রান্সফরমারে শর্ট-সার্কিট বিস্ফোরণের কারণে বিদ্যুতের সাপ্লাই এখন নেই।
উপত্যকার মাঝামাঝি বরাবর প্রবাহিত ছোট্ট জল-স্রোতের বেশ কিছুটা উপরে টিলার মাথায় বড়সড় একটা বাড়ি। বাড়ি থেকে পাথর-বাঁধানো একটা সিঁড়ি ধাপে ধাপে জলের স্রোতধারা পর্যন্ত নেমে গেছে।
ছোট্ট এই পানির ধারাটা একটু বেশি বৃষ্টি হলে কিংবা বর্ষা কালে বড়সড় নদীর রূপ নেয়।
বাড়িটার উঠানে একটা বড় আকারের গ্যাস লাইট জ্বলছে। ক্ষুদ্র একটা গ্যাস সিলিন্ডার থেকে লাইটটা জ্বালানি পাচ্ছে। বাড়িটার একটা ঘরে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা লাশ। লাশের পাশে একজন তরুণী অঝোর ধারায় কাঁদছে আর কুরআন শরিফ তেলাওয়াত করছে। একটু দূরে ঘরের খোলা দরজার সামনে চেয়ারে বসে আছে এক বৃদ্ধ। তার নাম মুহাম্মাদ আসতি আওয়াত। সে দিভিন উপত্যকার সমাজপতি।
উঠানে অনেক লোক। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে।
উঠানের গেট ঠেলে প্রবেশ করল দুজন তরুণ।
উঠানে অনেক লোক দেখে এবং ভেতর থেকে কান্নার শব্দ পেয়ে। মুহূর্তেই তরুণ দুজনের মুখ দুঃসহ বেদনার ভারে পার হয়ে গেল।
তারা খোলা দরজার বারান্দায় বসে থাকা বৃদ্ধের কাছে গিয়ে দাঁড়াল মাথা নিচু করে। তাদের মধ্যে একজনের চোখ থেকে নামছিল অবিরল ধারায় অশ্রু। এই তরুণটি আসতি আওয়াত-এর ছোট ছেলে। নাম এরদেলান। আর যে তরুণীটি কুরআন শরিফ পড়ছে তার মায়ের লাশের পাশে বসে সে আসতি আওয়াতের মেয়ে শেপল। মেডিকেল কলেজে পড়ত। এখন লেখা-পড়া বন্ধ নিরাপত্তার কারণে।
বাবা, ঔষধ নিয়ে আসতে আমাদের দেরি হয়ে গেছে। আগারাক অঞ্চলের দোকানগুলোও এখন আমাদের দিভিন উপত্যকার কারও কাছে ঔষধ বিক্রি করছে না। অবশেষে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বন্ধুকে দিয়ে ঔষধ কিনেছি। এসব করতে গিয়েই ৬ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছতে পারি নি। বলল এরদেলান। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছিল ৬ ঘন্টার মধ্যে ঔষধ খাওয়াতে না পারলে অসুস্থ আসতি আওয়াতের স্ত্রীর জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা আছে।
সঙ্গে সঙ্গেই এরদেলান ও পাশের বাড়ির মেডিকেলের ছাত্র শেপলের ক্লাসমেট আহমদ নেবেজকে পাঠানো হয় আরও বড় সমৃদ্ধ এলাকা আগারাক অঞ্চলে। দিভিন উপত্যকায় বেশ কয়েকটি ঔষধের দোকান ছিল। নকল ঔষধ বিক্রির অপরাধে সেসব দোকান এখন বন্ধ। কিন্তু ইয়েরেভেনের হোলসেলের যেসব ঔষধ হাউজ এই নকল ঔষধ সরবরাহ করেছে, তাদের কিছু হয়নি। রহস্যজনকভাবে সব তদন্ত চাপা পড়ে আছে। কষ্ট ভোগ করছে দিভিন উপত্যকার মানুষ। এ উপত্যকায় ঔষধের দোকান বন্ধ হওয়ার পর পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ঔষধ আনাতেও সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আইডি কার্ডে দিভিন উপত্যকার নাম দেখলে তার কাছে আর ঔষধ বিক্রি করছে না দোকানদাররা।
কেঁদো না বেটা! অবস্থার উপর তোমার আমার কারোরই হাত নেই। পেছনের কথা ভুলে সামনের দিকে তাকাতে হবে। বলল এরদেলান ও শেপলের পিতা।
ঠিক বলেছেন আংকেল, আমাদের পেছনে নয়, সামনে তাকাতে হবে। কিন্তু কিভাবে? সামনে এগোবার রাস্তা ধীরে ধীরে ক্লোজ হয়ে যাচ্ছে। বলল আহমদ নেবেজ।
আহমদ নেবেজ-এর আরেকটা পরিচয় হলো সে দিভিন উপত্যকার যুব সংগঠন হিলফুল-ফজলের সভাপতি এবং ইয়েরেভেন মেডিকেল কলেজের। ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক।
নেবেজ, তুমি শেষে যে উপসংহার টেনেছ, তা খুবই পুরাতন কথা। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তুমি এই দৃশ্য দেখবে। নবী-রাসূল (স:)-দের জীবন কি বলে? কি অবস্থায় মুসলমানদের আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে হয়েছিল? আমাদের রাসূল (সঃ) মদিনায় হিজরত করেছিলেন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থাতেই। এর পরেও এমন ঘটনার সাক্ষাত পাবে বার বার। বলল মুহাম্মাদ আসতি আওয়াত।
আংকেল, আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু যে কথাটা আমরা বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো, আমরা তো কোন পথ বের করতে পারছি না। আহমদ নেবের্জ বলল।
পথ বের হয়ে থাকে না। পথ তৈরি করতে হয়। এটাও ইতিহাস। বলল আসতি আওয়াত।
শেপল কুরআন শরিফ পড়া বন্ধ করেছিল। এবার কুরআন হাতে নিয়েই উঠে এল। তার গায়ের বড় চাদরটা তার মাথার উপর দিয়ে কপাল পর্যন্ত নেমে এসেছে।
সে এসে পিতার সামনে দাঁড়াল। বলল, বাবা পথ তো আমরা এ পর্যন্ত বের করতে পারিনি। বরং আমাদের সংকটের পরিধি বাড়ছে। তদন্তকারী চারজন পুলিশ অফিসার নিহত হয়েছেন, ওআইসি, রাবেতা ও ইউনেস্কোর পাঁচজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও নিহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে আমরা তো এক ইঞ্চিও এগোতে পারিনি। খোদ পুলিশও এখন আমাদের সাহায্য করতে ভয় করছে।
হ্যাঁ মা, দৃশ্যত দেখা যাচ্ছে সামনে এগোবার পথ আমাদের বন্ধ। কিন্তু এর অর্থ পথ নেই, এটা নয়। মা, তুমি ও নেবেজ দুজনেই মেডিকেলের ছাত্র। বল তো, কোন একটি রোগকে একজন ডাক্তার অসাধ্য বললে, তখন অন্য ডাক্তার তা সাধ্য বলতে কি পারে না? পারে। সুতরাং হতাশ। হলে চলবে না।
কথা শেষ করে একটু থেমেই মুহাম্মাদ আসতি আওয়াত বলল, বাইরে আমাদের দিভিন উপত্যকার গণ্যমান্য সবাই এসেছে। ওদের সাথে কথা বলতে হবে। তারপর দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। কাল সকালে মাইয়েতের দাফন করতে হবে। এরদেলান মুহাম্মাদ তুমি শেপলের সাথে ঘরে তোমার মায়ের কাছে থাক। নেবেজ আমার সাথে এস।
বাবা অনেক বিষয়েই সেখানে কথা হতে পারে। লোকজন সবাই হতাশ ও ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছে একের পর এক ঘটনায়। আমিও কি তোমার সাথে আসতে পারি বাবা? বলল শেপল।
আসতে চাও? এস।
বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল আসতি আওয়াত।
পেছনে শেপল এবং নেবেজ।
দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। দুজনেরই মুখ নিচু।
এক সময় শেপল মুখ না তুলেই বলল, তুমি তো কলেজে গিয়েছিলে। কাল কি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে?
গিয়েছিলাম এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। পরীক্ষার খোঁজ নেইনি। নেবেজ বলল।
কেন পরীক্ষা দিচ্ছ না? জিজ্ঞাসা শেপলের।
তুমি পরীক্ষা দিচ্ছ না। আমি দেব কি করে ভাবলে? নেবেজ বলল। তোমার এ সিদ্ধান্ত ঠিক নয় নেবেজ। তুমি জান, আমাদের সহপাঠি মুসলিম ছাত্রী ত্রিফা অপহৃত হওয়ার পর সবার সিদ্ধান্তেই আমাকে মেডিকেল কলেজ ছাড়তে হয়েছে। বলল শেপল।
তুমি সবার সিদ্ধান্তে ছেড়েছ। আর আমি নিজের সিদ্ধান্তে ছেড়েছি। নেবেজ বলল।
না, তুমি নিজের সিদ্ধান্তে নয়, আমি পরীক্ষা দিচ্ছি না বলে তুমিও দিচ্ছ না। তুমি আমার বিষয় নয়, জাতির স্বার্থ দেখবে। বলল শেপল।
তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি সে মন হারিয়ে ফেলেছি। আমি পরীক্ষা দিতে পারবো না। নেবেজ বলল।
একজনের জন্যে মন হারিয়ে যাবে, তোমার জন্যে এটা শোভন নয়। তুমি অনেক সংস্থা-সংগঠনের নেতা হয়েছ। এই মন নিয়ে তুমি নেতৃত্ব দেবে কি করে? বলল শেপল।
সামাজিক জীবনের বাইরে আমার একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে, মনও আছে। আমার ব্যক্তিগত এ জীবন প্রাইভেট, সামাজিক জীবন পাবলিক। সেখানে আমার ব্যক্তিগত জীবনের ছোঁয়া লাগে না শেপল। নেবেজ বলল।
কথা বলতে বলতে ওরা নিজেদের অজান্তেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
কথা বলছিল ওরা।
দুজনেরই মুখ নিচু।
মুখ তুলে সামনে তাকিয়েই লজ্জা পেল শেপল। না তাকিয়েই নেবেজকে বলল, চল, বাবা পৌঁছে গেছেন।
তারা দুজনেই দ্রুত হাঁটতে লাগল।
.
বিশাল উঠানের অনেকটা জায়গা জুড়ে ম্যাট বিছিয়ে তার উপর চাদর বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। সবাই বসেছে। মুহাম্মাদ আসতি আওয়াত সকলের সামনে তার জন্যে রাখা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসেছে।
শেপল গিয়ে পিতার কাছে বসল। আর নেবেজ গিয়ে সবার সাথে আসতি আওয়াতের সামনের দিকে গিয়ে বসল।
মুহাম্মাদ আসতি আওয়াত বসেই সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দুঃখিত, সবাই অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন।
বলে একটু থেমেই বলল, সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী কাল ৮টায় তাঁর নামাজে জানাযা হবে এবং তারপরেই দাফন হবে তার ঘরের বাইরের পাশটায়।
আসতি আওয়াতের কথা শেষ হতেই সামনে থেকে একজন যুবক উঠে দাঁড়াল। বলল, সরদার, আপনি যেভাবে বলেছেন জানাযা, দাফন সেভাবেই হবে। কিন্তু তাঁকে যারা হত্যা করল, তাদের ব্যাপারে কি হবে? একটা কেসও তো হয়নি। আমরা আর কত সহ্য করব? এভাবে বাঁচার কোন অর্থ হয় না!
আসতি আওয়াতের স্ত্রী রাস্তায় একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। দুর্ঘটনার পূর্ব মুহূর্তে ড্রাইভার গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে সে অক্ষত থাকে। একটা ট্রাকের ধাক্কায় আসতি আওয়াতের স্ত্রীর ট্যাক্সি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বুকে আঘাত পায় আসতি আওয়াতের স্ত্রী। আগে থেকেই হার্টের প্রব্লেম ছিল। বুকের আঘাত সেই সমস্যাকে মারাত্মক করে তোলে। জরুরি যে ঔষধের প্রয়োজন ছিল তা সংগ্রহ করতে পারার আগেই সে ইন্তেকাল করে। মনে করা হচ্ছে হত্যা করার জন্যে সুপরিকল্পিতভাবে ট্রাকটি ট্যাক্সিকে আঘাত করেছিল। আসতি আওয়াতের স্ত্রী রায়হানা খুব সুপরিচিত মহিলা ছিল। দিভিন উপত্যকার নারী শক্তি আন্দোলনের সে সভানেত্রী ছিল।
যুবকটির কথা শেষ হলেও সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না আসতি আওয়াত। গম্ভীর হয়ে উঠেছিল তার চোখ মুখ। একটু সময় নিয়ে বলল, মামলা এখনও করা যায়। কিন্তু কি হবে? পুলিশ তো এসে আমাদের এখানেই ঘুরঘুর করবে। কাজের কাজ কিছুই করবে না। যা হোক, তবু মামলা আমাদের করা উচিত। এভাবে বাঁচার অর্থ হয় না, ঠিকই বলেছ। কিন্তু ভালোভাবে বাঁচার জন্যে আমরা কি করব? অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে তো লড়াই করা যায় না। পুলিশও তাদের চিহ্নিত করতে পারেনি। আমাদের শুভেচ্ছাকামী রাবেতা, ওআইসি, ইউনেস্কো আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে। তারা ক্রিমিনালদের হদিস করতে পারেনি। তাদের ও পুলিশের নয়টি মূল্যবান জীবনের হানি হয়েছে। তাদেরকেই বা আমরা কি বলতে পারি!
কিছুই করার নেই। তাহলে কি আমরা বসে বসে মার খাব? বলল অন্য একজন যুবক।
যুবকটি বসতেই আরেকজন প্রধান লোক উঠে দাঁড়াল লাঠির উপর ভর দিয়ে। বলল, শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। আমাদের শস্য ক্ষেত নেই। আমাদের ব্যবসায় বাণিজ্যের পথ প্রায় বন্ধ। আমাদের পানির উৎস ছোট্ট নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত। শোনা যাচ্ছে, সংগোপনে এর গতি পাল্টে দেয়ার কাজ চলছে। হত্যা, কিডন্যাপ অব্যাহত আছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও বাড়ছে। আমাদের ঔষধ নেই, চিকিৎসা নেই। আমাদের মুহতারেমা রায়হানা, আওয়াত হামলার শিখার হলেন, বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। এমন ঘটনা সামনে আরও বাড়বে। সবদিক দিয়েই আমরা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে। এটা হিজরতের সময় কিনা?
তোমার এই শেষ প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো জ্ঞান আমার নেই। তবে একটা কথা, হিজরত আমরা করব কোথায়? ইরান আমাদের জন্যে উপযুক্ত জায়গা নয়। সেখানে আমাদের ভাইয়েরা খুব ভালো নেই। সেখানে আমরা উপদ্রুপ হয়ে দাঁড়াতে পারি। আজারবাইজানেও আমরা আন্তরিক অভ্যর্থনা পাব না। শিয়া-সুন্নী বিভাজন দুঃখজনকভাবে সামনে আসার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। শত্রুরা যে বিভাজন উস্কে দিয়ে মুসলমানদের সংহতি সংহার করতে চেয়েছিল, তাদের সে চাওয়া সফল হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের মধ্যে একমাত্র তুরস্কই আমাদের আশ্রয় হতে পারে। কিন্তু আমাদের দিভিন। উপত্যকা থেকে সেখানে যাওয়ার পথ খুবই বিপদ সংকুল! ওদিকে গেলে ধরা পড়তে হবে। রাতারাতি সেখানে যাওয়া যাবে না। সুতরাং হিজরত আমাদের জন্য কোন সহজ বিষয় নয়। বলল আসতি আওয়াত।
সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল আসতি আওয়াতের মেয়ে শেপল। বলল, হিজরতের প্রশ্ন আসছে কি করে? আমাদের পূর্বপুরুষরা দিভিন থেকে হিজরত করে এখানে এসেছিল। এ জায়গারও নাম দিয়েছিল দিভিন। এখান থেকে আবার হিজরত করব, যেখানে যাব সেটা কি আমাদের ভূমি হবে? হবে না। তাহলে সেখান থেকেও কি হিজরত করব? হিজরতের শিক্ষা মনে হয় এমনটা নয়। আল্লাহর রাসূল (স.) মদিনায় হিজরত করার পর আর হিজরত করেননি। সেখানে থেকেই সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আমরা হিজরত করেই এখানে এসেছি। কেন আমরা এখান থেকেই সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করব না?
শেপলের কথা শেষ হতেই নেবেজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শেপল ঠিকই বলেছে। আমরা যদি পেছনে হটতেই থাকি, পৃথিবীতে কোথাও আমাদের জায়গা হবে না। সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার পথ আমাদের বের করতেই হবে।
এই সময় উত্তর দিক থেকে হৈ চৈ-এর শব্দ ভেসে এল।
সবাই উঠে দাঁড়াল। তাকাল উত্তর দিকে। উত্তর দিগন্তে উজ্জ্বল আলোর ঝলক দেখা গেল।
কোথাও আগুন লেগেছে? সবার মনে এই একই প্রশ্ন।
সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। সবার দৃষ্টি উত্তর দিগন্তে। হন্তদন্ত হয়ে একজন লোক উঠে এল বাড়িতে।
বাড়িতে ঢুকেই সে চিৎকার করে উঠল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাদের কুটির শিল্প কেন্দ্র এবং কম্যুনিটি সেন্টারে আগুন লেগেছে।
শান্ত হও বাহুজ। বল, কখন আগুন লাগল, কিভাবে লাগল? বলল মুহাম্মাদ আসতি আওয়াত।
এই তো কয়েক মিনিট আগে। কিভাবে লেগেছে কেউ বলতে পারছে না। আমাদের কুটির শিল্প কেন্দ্র ও কম্যুনিটি সেন্টার একসাথে জ্বলে উঠেছে। বাহুজ নামের লোকটি বলল।
তার কথা শেষ হতেই উপস্থিত সকলেই প্রায় এক সাথে বলে উঠল, সরদার আমরা যাচ্ছি। ফিরে এসে কথা হবে।
বলে সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটল সেই অগ্নিকাণ্ডের দিকে।
ট্রেনটি আর্মেনিয়া সীমান্ত অতিক্রম করেছে বেশ আগে। সামনে সানাহিন শহর।
ট্রেনটি আসছে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে। ইউক্রাইনের খারকভ, ডোনেটস্ক, রাশিয়ার রোস্তভ, জর্জিয়ার তিবলিসি হয়ে ট্রেনটি যাচ্ছে আর্মেনিয়ার ইয়েরেভেন। দূর পাল্লার ট্রেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ শহরসহ এই রুটে রাজধানী টু রাজধানী যাতায়াত করে এই ট্রেনটি।
এ ট্রেনে বিশেষ স্লিপিং কম্পার্টমেন্ট আছে। এ ধরনের কম্পার্টমেন্ট চার, আট ও বারো সিটের হয়ে থাকে। সিটগুলোকে স্লিপিং বেড বানানো। যায়।
একটা স্লিপিং কম্পার্টমেন্ট। বারো সিটের।
কম্পার্টমেন্টের এক প্রান্তের কোণায় আহমদ মুসা শুয়ে আছে। তার মাথার সামনের জানালা অন্যান্য জানালার মতোই টাইট করে বন্ধ।
আহমদ মুসা আসছে কিয়েভ থেকে। ওয়াশিংটন থেকে লন্ডন, বন হয়ে। সে ইউক্রাইনের কিয়েভে এসেছে। কিয়েভ থেকে সে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভেনে আসার জন্যে রেলপথ বেছে নিয়েছে। তুরস্ক, আজারবাইজান ও ইরান হয়ে আর্মেনিয়ায় যাওয়ার পথে নানা বিধি-নিষেধ সৃষ্টি করা হয়েছে। যেহেতু আমেরিকান নাগরিক হিসাবে সে আসছে, তাই ইউরোপ হয়ে আসা তার জন্যে স্বাভাবিক।
জর্জিয়া থেকে আর্মেনিয়ায় ঢোকার সময় তার পাসপোর্টই শুধু দেখেছে, আমেরিকান পাসপোর্ট দেখে তাকে আর কোন প্রশ্ন করেনি।
আমেরিকান পরিচয় ছাড়াও তার আর একটা পরিচয় আছে। সেটা হলো, সে মার্কিন এফবিআই-এর একজন কর্মকর্তা। কিন্তু এই পরিচয় সে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া প্রকাশ করতে চায় না। এফবিআই কর্মকর্তার এই। কার্ড জর্জ আব্রাহাম জনসন তাকে দিয়েছে, যাতে করে কাজে আহমদ মুসার কিছুটা সুবিধা হয়। তার কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে মানবাধিকার রক্ষামূলক কাজের বিশেষ মিশন নিয়ে সে ককেশাস অঞ্চলে এসেছে। আহমদ মুসা ইয়েরেভেনে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের বিশেষ উইংকে টপ সিক্রেট বিষয় হিসাবে এটা জানিয়ে রাখবে।
রাত আড়াইটায় ট্রেনটি আর্মেনিয়া সীমান্ত অতিক্রম করেছে।
সীমান্তের ফর্মালিটি শেষ হলে আবার ঘুমাতে চেষ্টা করছিল আহমদ মুসা।
সবে চোখটা ধরে এসেছিল। হঠাৎ বেসুরা এক কণ্ঠে তা ভেঙে গেল।
কে যেন বলছিল, …কথা ছাড়ুন। উঠে বসুন। আমাদের বসতে দিন।
উঠে বসতে আপত্তি নেই। বসতে দিতেও আপত্তি নেই। কিন্তু এটা তো এভাবে বসার জায়গা নয়। সিটে শুয়ে থাকা যুবকটি উঠে বসে বলল।
আগন্তুকরা ছিল চারজন।
একশবার বসার জায়গা। বলে ওদের চারজনের একজন সাথীদের দিকে চেয়ে বলল, তোরা তিনজন এখানে বস। আমি পাশের বেঞ্চটায় যাই। ওখানে একজন নিঃসঙ্গ সুন্দরী রয়েছে।
লোকটি পাশের সিটের দিকে পা বাড়াল। সেখানে একজন মেয়ে শুয়েছিল, সে উঠে বসেছে। মেয়েটার আর্মেনীয় চেহারা। এক দৃষ্টিতেই দেখে মনে হবে, আর্মেনিয়ার শ্রেষ্ঠা সুন্দরীদের একজন।
এদিকের সিটে যে যুবকটি বসেছিল, সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, উনি আমার স্ত্রী। আপনারা চারজন আমার সিটেই বসুন। আমি স্ত্রীর সিটে যাচ্ছি।
যে লোকটি মেয়েটার সিটের দিকে যাচ্ছিল থমকে দাঁড়িয়ে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, স্ত্রী হলো তো কি হয়েছে? পাশে বসব ক্ষতি কি?
লোকটি গিয়ে যুবকটির স্ত্রীর পাশে ধপাস করে বসল। বলল, ম্যাডাম, দেশের জন্যে তো কাজ করি। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। দেখুন। খুঁজলে গায়ে রক্তের ছিটা-টিটা পেয়ে যাবেন।
লোকটির কথার মধ্যে মাতলামির টান আছে।
ওদের সবার মধ্যে মাতলামির লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠল। ভয় পেয়ে মেয়েটি তার সিট থেকে উঠে তার স্বামী যুবকটির পাশে এসে দাঁড়াল।
যে লোকটি মেয়েটির পাশে গিয়ে বসেছিল, সে যেন এতে অপমানিত বোধ করল। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল সে। মাতলামি তার কেটে গেল। স্প্রিং-এর মতো সে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। ছুটে এসে সে মেয়েটাকে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে দিল সিটের উপর। বলল, পাশে বসলেই জাত যায় না? এবার ভালো করে জাত যাওয়াচ্ছি। বলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটার উপর।
এ সময় একজন পুলিশ প্রবেশ করেছিল। সেও শুনতে পেয়েছিল। লোকটির কথা। পুলিশটি ছুটে এল।
মেয়েটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়া লোকটিকে ধরতে গেল। লোকটিও পেছনে তাকয়েছিল। মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সে গায়ের জ্যাকেটের কলার টেনে কিছু দেখাল পুলিশকে।
পুলিশটি চমকে উঠে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তার পরেই শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, তুমি যেই হও আইনের চেয়ে বড় নও।
পুলিশ লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল, তোমরা চলে এস আমার সাথে এই স্লিপিং কম্পার্টমেন্ট থেকে। বৈধ যাত্রীদের তোমরা ডিস্টার্ব করো না।
ব্যাটা পুলিশ, তুমি কে? তোমার বাবারা আমাদের সালাম করে। যাও তুমি। না হলে…। কথা শেষ না করেই থেমে গেল লোকটি।
দেখ, তোমরা এ কম্পার্টমেন্ট না ছাড়লে তোমাদের আমি গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবো।
কয় টাকার পুলিশ কি বলেরে! আমাদের নাকি প্রেপ্তার করবে?
বলেই সেই লোকটি জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলবার বের করে পর পর তিনটি গুলি ছুড়ল পুলিশটির মাথা লক্ষ্য করে।
পুলিশটি আছাড় খেয়ে পড়ল গাড়ির মেঝের উপর।
গুলি করেই লোকটি ছুটে গিয়ে যুবকটির পাশ থেকে মেয়েটিকে ধরে এগোতে লাগল কম্পার্টমেন্ট থেকে বের হওয়ার জন্যে। যুবকটি ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল।
লোকটি ঘুরে দাঁড়িয়ে তার রিভলবারের বাঁট দিয়ে আঘাত করল যুবকটির মাথায়। ফেটে গেল যুবকটির কপাল। কপাল থেকে ঝর ঝর করে নেমে এল রক্ত। লোকদের দুজন যুবকটিকে ধরে আছড়ে ফেলল মেঝেতে।
মেয়েটিকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। বাঁচাও, বাঁচাও! চিৎকার করছে মেয়েটি।
কম্পার্টমেন্টের সব লোকই উঠে বসেছে। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়েছে। সবার মুখে উদ্বেগ-আতংক। কিন্তু কেউ কিছু করার সাহস পাচ্ছে না।
আহমদ মুসা আধা শোয়া অবস্থায় ছিল। শুরু থেকেই দেখছিল ঘটনা। আর্মেনিয়াতে ঢুকেই এ ধরনের ঘটনায় জড়িত হওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না। ভেবেও ছিল যে, পুলিশ মিটমাট করতে পারবে। তার মনে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হলো। লোকটি তার জ্যাকেট খুলে কি দেখাল পুলিশকে। পুলিশ প্রথমটায়। চমকে উঠেছিল কেন? ওরা যখন পুলিশের মাথায় তিনটে গুলি করল, তখন উঠে বসল আহমদ মুসা। উন্মাদ অথবা ক্ষমতার অতি দম্ভ ছাড়া একজনকে মারার জন্যে তার মাথায় তিনটে গুলি কেউ করে না। তারপর যখন ওরা চারজন যুবকটিকে আহত করে তার স্ত্রীকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে শুরু করল এবং মেয়েটি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে লাগল, তখন আহমদ মুসা স্থান-কাল সব ভুলে গেল এবং মেয়েটিকে বাঁচানো আর অপরাধীকে শাস্তি দেয়াই তার কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
নীরবে নিঃশব্দে দ্রুত এগিয়ে গেল ওদের দিকে।
সেই সর্দার গোছের লোকটাই মেয়েটার দুই হাত ধরে তাকে টেনে। নিয়ে যাচ্ছিল। পেছনে তিনজন সহযোগিতা করছিল। তাদের সবার হাতে রিভলবার।
ওদের লক্ষ্য সম্ভবত মেয়েটাকে কম্পার্টমেন্টের দরজার ওপারের সার্ভিস রুমেনিয়ে যাওয়া। ওখানেই গাড়ি স্টপ করাবার ইন্টারকম ব্যবস্থা আছে।
ওদের পাশাপাশি পৌঁছে আহমদ মুসা এক লাফে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একেবারে মেয়েটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যে তোক তার মুখোমুখি। দেয়ালের মতো স্থির দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল, ছেড়ে দাও মেয়েটাকে।
আহমদ মুসার কণ্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু পাথরের মতো শক্ত।
চমকে উঠে লোকটি দাঁড়িয়ে গেছে। আহমদ মুসাকে দেয়ালের মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটির হাতও ছেড়ে দিয়েছে লোকটি।
পড়ে গিয়েছিল মেয়েটি। না উঠেই ওদের অলক্ষ্যে হামাগুড়ি দিয়ে স্বামীর দিকে ছুটেছে সে।
লোকটি আহমদ মুসার পাথরের মতো চেহারার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্যে থমকে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই তার রিভলবার ধরা ডান হাত চোখের পলকে উঠে এল আহমদ মুসার বুক লক্ষ্যে। লোকটি আগের মতোই হো হো করে হেসে উঠে বলল, তুই কে হে পুঁচকে, আমার শিকারে বাগড়া দিলি? পুলিশ পুঁচকের মাথায় তিনটে গুলি ঢুকিয়েছি, বাকি তিনটে তাহলে তোর…।
কথা শেষ করতে পারল না লোকটি। আহমদ মুসার বাম হাত বিদ্যুৎ বেগে উপরে উঠে আঘাত করল লোকটির রিভলবার ধরা ডান হাতে। রিভলবারটি ছিটকে লোকটির হাত থেকে উপরে উঠে গেল।
আহমদ মুসা ডান হাত বাড়িয়ে রিভলবারটা ধরে নিয়েই একধাপ পাশে সরে পেছনের তিনজন রিভলবারধারীকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি গুলি করল। গুলি ওদের তিনজনের রিভলবার ধরা হাত বিদ্ধ করল। হাত থেকে রিভলবার ওদের পড়ে গেছে।
সামনের চতুর্থ লোকটি নিজেকে সামলে নিয়ে আহমদ মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। আহমদ মুসা চোখের পলকে সরে দাঁড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করল।
লোকটি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে আছড়ে পড়ল ট্রেনের মেঝের উপর। মুখ থুবড়ে পড়েছে সে। এরপরও সঙ্গে সঙ্গেই সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। আহমদ মুসা রিভলবারের বাট দিয়ে তার কানের পেছনটায় আঘাত করল। ধনন্তরী সে আঘাত। লোকটি সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।
আহমদ মুসা আহত তিন জনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সকলেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়। কোন চালাকির চেষ্টা করলে এবার মাথা গুঁড়িয়ে দেব।
কম্পার্টমেন্টের কেউ ওঠে দাঁড়িয়েছিল, কেউ বসেছিল। সেই যুবক ও মেয়েটিসহ সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। ভোজবাজির মতো ঘটনা তাদের হতবাক করে দিয়েছে। যা তারা কল্পনাও করতে পারেনি, তাই ঘটে গেল তাদের চোখের সামনে। বিশেষ করে যুবক ও তার স্ত্রী-মেয়েটি যতটা বিস্মিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কৃতজ্ঞতা ও স্বস্তিতে ভাসছে তারা! মেয়েটি মনে করছে সে নতুন জীবন পেয়েছে এবং সে জীবন ঐ লোকটির হাত ধরেই এসেছে! অপার বিস্ময়ের ব্যাপার! লোকটি খালি হাতে রিভলবারধারী চারজনের বিরুদ্ধে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ওদের গুলিতে পুলিশের নির্মম মৃত্যু দেখার পরও তার মনে বিন্দুমাত্র ভয়ের সৃষ্টি হয়নি! অন্যের জন্যে এভাবে মৃত্যুর মুখে মানুষ দাঁড়াতে পারে, তা তাদের ভাবনার মধ্যেও ছিল না। অকল্পনীয় তার শক্তি সাহস ও কৌশল! গুলির মুখে দাঁড়িয়ে সে শত্রুর রিভলবার দখল করে তিনজন রিভলবারধারীসহ সবাইকে অদ্ভুত ক্ষীপ্রতায় পরাভূত করল। ফিল্মেই সে এমনটা দেখেছে, বাস্তবে ঘটতে পারে, তা কখনও সে মনে। করেনি।
সন্ত্রাসীদের শুইয়ে দেবার ব্যবস্থা করে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল, আপনারা কেউ একজন প্লীজ, ট্রেনটা থামিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন এবং পারলে পুলিশকে খবর দিন। এদের চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন এবং পুলিশকেই এদের দায়িত্ব নিতে হবে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই যুবকের স্ত্রী-মেয়েটি বলল, আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি। বলে সে মোবাইল বের করল এবং কল করল।
আরেকজন মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে এল। বলল, আমি ট্রেন থামাবার ব্যবস্থা করছি। ওপাশেই সে ব্যবস্থা আছে।
লোকটি এগোল দরজা সংলগ্ন সেই কক্ষটার দিকে।
অন্য একজন এই সময় বলে উঠল, এ কক্ষে সিসি ক্যামেরাসহ মাইক্রোফোন আছে। নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি উচ্চতায় বিশেষ ধরনের শব্দ হলে ওগুলো আপনাতেই চালু হয়ে যায়। নিশ্চয় তা হয়েছে।
যুবকটির কথা শেষ না হতেই দেখা গেল ট্রেনের গতি স্লো হয়ে গেছে। থেমে যাচ্ছে ট্রেন। থেমে গেল ট্রেন।
ট্রেন থেমে যাবার সাথে সাথে কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে গেল।
কম্পার্টমেন্টে প্রবেশ করল চারজন পুলিশ রিভলবার বাগিয়ে।
গোটা কম্পার্টমেন্টে তাদের চোখ দৌড়ে ফিরছে। তারা দেখল গুলিতে নিহত পুলিশের লাশ। দেখল উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা হাতে গুলিবিদ্ধ তিনজন ও সংজ্ঞাহীন একজনকে। তারা তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
রিভলবার হাতে দাঁড়ানো আহমদ মুসা স্থির, স্বাভাবিক।
পুলিশ কিছু বলার আগেই এবং আহমদ মুসাও পুলিশকে কিছু বলার আগেই সেই মেয়েটি পুলিশকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, উনিই আমাকে কিডন্যাপ ও লাঞ্ছিত হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। একজন পুলিশকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে মেরেছে, আমার স্বামীকেও সন্ত্রাসীরা আহত করেছে।
আমরা সিসিটিভিতে ঘটনাটা দেখেছি ম্যাডাম।
বলেই পুলিশ অফিসারটি ফিরল আহমদ মুসার দিকে। বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমাদের সকলকে হতবাক করেছেন। একজন চৌকশ কমান্ডোর কাছেই মাত্র এমনটা আশা করা যায়। কিন্তু আমার পুলিশী জীবনে আমি এমনটা দেখিনি। আপনি কি কোন…!
পুলিশ অফিসারটি কথা শেষ করতে পারলো না। তার অয়্যারলেসটি রেড সিগন্যালের সাথে সাথে বিফ বিফ করে উঠেছে।
নিশ্চয় বিভাগীয় কোন কল, চিন্তা করেই পুলিশ অফিসারটি অয়্যারলেস কানের কাছে তুলে নিল। ওপ্রান্ত থেকে যে কণ্ঠ ভেসে এল, সেটা উত্তর আর্মেনিয়া জোনের পুলিশ প্রধানের। পুলিশ অফিসারটি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আদেশ করুন স্যার।
ওপ্রান্ত থেকে বলল, তোমার ট্রেনের একটা স্লিপিং কম্পার্টমেন্টে নিহত-আহত হওয়ার বড় একটা ঘটনা ঘটেছে। জান?
স্যার, আমি এখন সে কম্পার্টমেন্টেই স্যার। পুলিশ অফিসারটি বলল।
যে মেয়েটিকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করা হয়েছিল সে আমাদের পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক স্যারের মেয়ে আন্না এলিনা। আহত যুবকটি তার স্বামী। তারা ভালো আছে তো? কোন অসুবিধা নেই তো? বলল উত্তর আর্মেনিয়া জোনের পুলিশ প্রধান।
ওরা ভালো আছেন স্যার। এখন আর কোন সমস্যা নেই স্যার। পুলিশ অফিসারটি বলল।
যে ছেলেটি ওদের বাঁচাল, সন্ত্রাসীদের কাবু করল, সে কে জেনেছ? বলল উত্তরাঞ্চলের পুলিশ প্রধান।
স্যার, তার সাথে এখনও কথা হয়নি। বলব স্যার। পুলিশ অফিসারটি বলল।
চলন্ত একটা ট্রেনে এত বড় ঘটনা ঘটাতে পারে ওরা কারা? বলল উত্তরাঞ্চলের পুলিশ প্রধান।
ওরা চারজনই যুবক বয়সের। ওদের চেহারা ও স্যুট বুট প্রফেশনাল ক্রিমিনালদের সাথে মেলে না। আমার মনে হয় স্যার, ওরা প্রফেশনাল না হয়ে অপ্রফেশনাল ক্রিমিনাল গ্রুপের মতো বড় কিছু হতে পারে। ওদের। ঘটানো এই ঘটনা আমার মনে হয় টার্গেটেড নয়, হঠাৎ করেই ওরা ঘটিয়েছে। এ থেকে এটা প্রমাণ হয় এরা আত্মবিশ্বাসী ও বেপরোয়া কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের অংশ হতে পারে, যারা কোন বিরোধিতা বা বাধা বরদাশত করে না। স্যার, বিশেষ লক্ষ্যে গঠিত কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক সন্ত্রাসীদের চরিত্র এমন হয়ে থাকে। পুলিশ অফিসারটি বলল।
ধন্যবাদ অফিসার। ঠিক বলেছ। ওদের ছেড় না, সাবধানে ডিল করো। অফিসার, তুমি টেলিফোনটা আন্না এলিনাকে দাও। বলল উত্তরাঞ্চলের পুলিশ প্রধান।
আন্না এলিনার সাথে কথা শেষ হলো।
সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা বলে উঠল, অফিসার, আপনি রাজনৈতিক ও সামাজিক সন্ত্রাসী গ্রুপের কথা বলেছেন। এদেরকে কি পরীক্ষা করে দেখবেন?
পুলিশ অফিসার গভীর দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ঋজু দেহ, পেটা স্বাস্থ্য, পবিত্র দৃষ্টি, চেহারায় ক্ষীপ্রতা ও প্রতিভা যেন ঠিকরে পড়ছে যুবকটি থেকে! মুগ্ধ পুলিশ অফিসার বলল, আপনি কে? আপনার পরিচয় কি? কোন প্রফেশনাল নিশ্চয়?
না, কোন প্রফেশনাল নই। সৌখিন অ্যামেচার বলতে পারেন। আমেরিকান। যাচ্ছি ইয়েরেভেনে। বলল আহমদ মুসা।
একটু যেন ভাবল পুলিশ অফিসার। বলল, কি পরীক্ষা করব বলুন তো?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, একজন পুলিশ অফিসারের মুখে এমন প্রশ্ন মানায় না।
আপনি যে জন্যে পরীক্ষার কথা বলেছেন তাও সাধারণ অ্যামেচারের কণ্ঠে মানায় না।
বলে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই পুলিশ অফিসার সংজ্ঞাহীন লোকটির দিকে তাকাল। সে চিৎ হয়ে পড়েছিল।
পুলিশ অফিসার প্রথমে লোকটির পকেট সার্চ করল। জ্যাকেট ও প্যান্টের গোটা আষ্টেক পকেটে একটা মানিব্যাগ, মানিব্যাগে কিছু টাকা ছাড়া আর কিছুই পেল না। তার দুই হাত কাধ পর্যন্ত পরীক্ষা করল। জ্যাকেটের কলার ও চেষ্ট ব্যান্ডসহ সম্ভাব্য সবকিছুই চেক করল, সন্দেহ করার মতো কিছুই পেল না। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে।
ওর জ্যাকেট ও শার্টের ব্রান্ড-ট্যাগটাও দেখুন অফিসার। বলল আহমদ মুসা।
অফিসার একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আবার বসে পড়ল সংজ্ঞাহীন লোকটার মাথার কাছে। ঘাড়ের কাছের জ্যাকেট ও শার্টের অংশটা টেনে একটু আলগা করে দুটো ব্রান্ড-ট্যাগই সামনে নিয়ে এল। দেখতে লাগল।
আহমদ মুসাও পুলিশ অফিসারটির পাশে বসল।
জ্যাকেটের ব্রান্ড-ট্যাগে বিশেষ স্টাইলে কোল্ড ওয়্যার লেখা। তার নিচে কোম্পানির মনোগ্রাম- শিকারের উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভংগিতে ব্ল্যাক টাইগারের ছবি। তার নিচে কিছু লেখা। আর শার্টের ব্রান্ড-ট্যাগও সেই একই কোল্ড ওয়্যার কোম্পানির। এখানেও কোম্পানির নামের নিচে সেই ব্ল্যাক টাইগার একই ভঙ্গিতে আঁকা।
আহমদ মুসাও ব্রান্ড-ট্যাগ দুটো দেখছিল।
ব্রান্ড-ট্যাগ ভালো করে দেখে পুলিশ অফিসার আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, দুটিই মেকারস-এর ট্যাগ। কিছু তো নেই এখানে।
অফিসার, আমার যতটুকু মনে পড়ে কোল্ড ওয়্যার কোম্পানির ব্রান্ড ট্যাগে ব্ল্যাক টাইগার আছে ঠিকই, কিন্তু তা ঘুমানো অবস্থায়। আর এখানে। ব্ল্যাক টাইগার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বলল আহমদ মুসা।
বলতে বলতে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
পুলিশ অফিসারের বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে! সেও উঠে দাঁড়াল। বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। এখন আমার মনে হচ্ছে কোল্ড ওয়্যার কোম্পানি ব্রান্ড-ট্যাগের ব্ল্যাক টাইগার শোয়া অবস্থায় ও ঘুমন্ত। কিন্তু আপনি এত তাড়াতাড়ি ধরলেন কি করে? আমেরিকায় কি কোল্ড ওয়্যার কোম্পানির পোশাক পাওয়া যায়?
আমি দেখিনি। কোম্পানির কোল্ড ওয়্যার পোশাক দেখলাম প্রথম কিয়েভে এসে। একটা পেষাকের দোকানে ঢুকেছিলাম। সেখানেই দেখেছি। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু তাতেই মনে আছে? আপনার চোখ এত ডিটেইল দেখে এবং আপনার মেমরি তা মনে রাখে! আমি কোল্ড ওয়্যার-এর কাপড় ব্যবহার করেছি। কিন্তু আপনি বলার আগে বিষয়টা আমার মনে পড়েনি। পুলিশ অফিসার বলল।
এ রকম হতে পারে। যাক। একটা কথা মি, অফিসার, ব্ল্যাক টাইগার নামে কোন গ্রুপ বা দল এদেশে আছে? পুলিশ অফিসারের কথার দিকে কান না দিয়ে নতুন প্রসঙ্গে আসল আহমদ মুসা।
একটু ভাবল পুলিশ অফিসার। বলল, এ রকম, কোন সক্রিয় দল বা গ্রুপের কথা আমাদের জানা নেই। তবে বেশ কিছু দিন নামহীন একটা গ্রুপ অত্যন্ত গোপনে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। কে তারা তার কোন চিহ্ন তারা রেখে যায় না। পুলিশের হাতে ওদের দুজন মারা পড়েছে। কিন্তু তাদের দেহ, কাপড়-চোপড় সার্চ করে কোন কু পাওয়া যায়নি।
তাদের ইথনিক পরিচয়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
কেন, আর্মেনিয়ানই হবে। আমার মনে হয় এটা পরীক্ষা করা হয়নি। এদের সম্পর্কে আপনি কি মনে করছেন? পুলিশ অফিসার বলল।
এদের মধ্যে সংজ্ঞাহীন লোকটি রাশিয়ান বলে আমি মনে করি। বলল আহমদ মুসা।
বিস্মিত পুলিশ অফিসারটি বলল, কি করে বুঝলেন এত তাড়াতাড়ি। ওদের চারজনের চেহারা একই রকম। আর আর্মেনিয়ায় বহু রাশিয়ান আছে, যারা আর্মেনিয়ান, রাশিয়ান নয়।
আর্মেনিয়ার রাশিয়ানরা কি রাশিয়ার সম্রাট আইভান-এর আনুগত্য করে? বলল আহমদ মুসা।
কখনও না। সম্রাট আইভান দি টেরিবল-এর রাশিয়া আর্মেনিয়ার শত্রু, আর্মেনিয়ার মানুষের শত্রু। তার অত্যাচারের দাগ আর্মেনিয়ার ঘাড়েও আছে। আমাদের চার্চ, আমাদের বিশ্বাসেরও গলা টিপে ধরেছিল ওরা। আমেনিয়ানরা আইভান-এর মতো কোন রাশিয়ান শাসককেই ভালো চোখে দেখে না। পুলিশ অফিসার বলল।
কিন্তু দেখুন, সংজ্ঞাহীন লোকটির ডান কাঁধের উল্কিতে আইভান দি টেরিবল-এর মূর্তি আঁকা। তার মানে এই লোকটি আর্মেনিয়ান নয়, রাশিয়ান। বলল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ অফিসারটি ঝুঁকে পড়ে লোকটির কাঁধ দেখল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক উল্কিতে আইভান দি টেরিবল। কি অদ্ভুত আপনার দৃষ্টি। আমিও কাঁধটা দেখেছি। উল্কিটাও চোখে পড়েছিল। তবে এর বেশি কিছু দেখিনি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, হঠাৎই হয়তো আমার চোখে পড়েছিল। যাক, এদের সম্পর্কে কি ধারণা করছেন?
এরা কি কোন মাল্টি ন্যাশনাল গ্যাঙ? তাই মনে করছেন আপনি? পুলিশ অফিসার বলল।
তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা জিজ্ঞাসা, এমন মাল্টি ন্যাশনাল গ্যাঙ কোন একটা লক্ষ্য সামনে নিয়েই তৈরি হয়। কিন্তু আপনি বলছেন এদের নাম আগে শোনা যায়নি। এদের কোন কাজও দেখা যায়নি। বরং সক্রিয় দেখা যাচ্ছে একটা নামহীন সংস্থার। এটা কেন? বলল আহমদ মুসা।
এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। অনুসন্ধান করতে হবে। এই মূল্যবান দিকটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। কমিনিটের সাক্ষাতে আপনার কাছে অনেক কিছুই শিখলাম স্যার। আবারো ধন্যবাদ।
বলেই পুলিশ অফিসার ঘুরে দাঁড়িয়ে পুলিশদের দিকে তাকাল। বলল, এদের সবাইকে হাতকড়া পরাও। সামনেই সানাহিন শহরের স্টপেজে পুলিশ অফিসারের লাশসহ এদের নামিয়ে দিতে হবে।
পুলিশদের এ নির্দেশ দিয়ে পুলিশ অফিসার ঘুরে দাঁড়াল। আন্না, এলিনার দিকে চেয়ে বলল, ম্যাডাম, সন্ত্রাসীরা এই কম্পার্টমেন্টে যা করেছে, যা ঘটেছে, যা আপনি দেখেছেন শুরু থেকে বলুন প্লিজ, আমি লিখে নিচ্ছি। এতে আপনি স্বাক্ষর করবেন, আরও কয়েকজনের স্বাক্ষর নেব সাক্ষী হিসাবে। এটাই হবে এফআইআর।
বলে পুলিশ অফিসার পকেট থেকে কাগজ কলম বের করল।
অফিসার, তিনজনের আহত হাত থেকে রক্ত ঝরছে, আমি রক্ত বন্ধের ব্যবস্থা করতে পারি? বলল আহমদ মুসা।
সন্ত্রাসীদের শক্তি কিছু কমুক, শাস্তি কিছু পাক। তবে আপনি ওদের জন্যে কিছু করতে চাইলে করতে পারেন। পুলিশ অফিসারটি বলল। তার মুখে হাসি।
ধন্যবাদ অফিসার! বলে আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে ব্যান্ডেজ, তুলা ইত্যাদি বের করল।
যাত্রীদের মধ্যে একজজন বলে উঠল, স্যার, ও শয়তানরা একজন। পুলিশকে হত্যা করেছে। এদের আরও কষ্ট পাওয়াই উচিত।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, শত্রু বন্দী হবার পর তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায় আটককারীদের উপর বর্তায়। মানুষ হিসাবে সে দায়িত্ব পালন করা দরকার। তারা যে অপরাধ করেছে, তার শাস্তি দেবে। আদালত।
আন্না এলিনা ও পুলিশ অফিসার দুজনেই মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বিস্ময় তাদের চোখে-মুখে!
আহমদ মুসা মনোযোগ দিয়েছে ব্যান্ডেজের কাজে।
.
৪.
কাজ মোটেই দ্রুত এগোচ্ছে না লেভন! শক্ত কণ্ঠে বলল সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল, আর্মেনিয়ার ব্ল্যাক টাইগারের সুপ্রীম নেতা।
সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেলের পরনে খৃস্টান ফাদারের পোশাক। তার গলায় ঝুলছে বড় আকারের সুবর্ণ ক্রস। তার আরেকটা বড় পরিচয়। হলো সে দিভিনের অস্তিত্বহীন সেন্ট গ্রেগরী চার্চের ফাদার। চিরকুমার ফাদার সেমভেল থাকেন চার্চ সংলগ্ন তার জন্যে তৈরি বাড়িতেই। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ প্রোগ্রামের মাধ্যমে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে খনন করে দিভিনের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। অনুমতি নিয়েই তৃতীয় শতকের সেন্ট গ্রেগরী চার্চের স্বকল্পিত ফাদার সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল সেন্ট গ্রেগরী চার্চের একটা রেপ্লিকা তৈরি করেছে। তার সাথে অতীতের আদলেই রয়েছে ফাদার ও চার্চ স্টাফদের বাসস্থান। নকল সেন্ট গ্রেগরী চার্চ দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। খুবই পবিত্র জ্ঞান করা হয় একে। মনে করা হয়, খৃস্টের ইচ্ছাতেই প্রাচীন সেন্ট গ্রেগরীর পুনরাবির্ভাব ঘটেছে।
এই সেন্ট গ্রেগরী চার্চ ও ফাদারের বাসস্থানের মধ্যে একটা সংযোগ টানেল রয়েছে। টানেলটা ঠিক টানেল নয়, এক বিশাল প্রসাদের প্রশস্ত সংযোগ পথ। তা দুর্গের মতো সুরক্ষিত একটা বাড়ি। এটাই ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার (BAT)-এর হেড কোয়ার্টার।
দুর্গ-সদৃশ এই বাড়িরই একটা কক্ষে ফাদার সেন্ট সেমভেল আলোচনায় বসেছে।
ফাদার সেন্ট সেমভেলের কথা শেষ হলেও টাইগার আর্মি (TA)-এর প্রধান জেনারেল গ্যাগিক লেভন কিছু বলল না। একবার মাথা তুলে তাকিয়ে চুপ করে থাকল। সে জানে ফাদার সেন্ট সেমভেল কথা শুরু করেছেন, শেষ করেননি।
জেনারেল গ্যাগিক লেভন আর্মেনীয় হলেও এই সেদিন পর্যন্ত রুশ আর্মির একজন দুর্ধর্ষ জেনারেল ছিল। অতি ক্যাথলিক গোঁড়ামি ও বেপরোয়া স্বভাবের জন্যে তাকে সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ার করে দেয়া। হয়। ক্রুদ্ধ লেভন আর্মেনিয়া চলে আসার পর ফাদার সেন্ট সেমভেল তাকে দলে টানে।
লেভন যা ভেবেছ ঠিক তাই! ফাদার সেন্ট সেমভেলই আবার কথা শুরু করল। বলল, পরিকল্পনা ছিল, নীরবেই খুব দ্রুত ওদের সীমান্তের। ওপারে ঠেলে দেব। আয়োজন সেই মতোই করা হয়েছে। ওদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। কিন্তু মাটি কামড়ে যেন পড়ে আছে ওরা। এই দিভিন থেকে ১৯২৫ সালে ওদের উচ্ছেদের সময় বেশি বেগ পেতে হয়নি। সোভিয়েত আর্মি ওদের প্রতিষ্ঠান ও জনপদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, পলায়নপরদের উপর গুলি চালিয়েছিল। একদিনের এই এক ঘটনাতেই ওরা দিভিন ছেড়ে দক্ষিণ আর্মেনিয়া সীমান্তে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো ঐ রকম কিছু করা যাচ্ছে না। তবে যা করা হয়েছে, তাও একটা জনপদকে উচ্ছেদের জন্যে যথেষ্ট। তাদের উঠে যাওয়ার কিন্তু নাম নেই। আমি বুঝতে পারছি না কেন যে ইউনেস্কো ও জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা এদের সাথে যুক্ত হলো! ওআইসি, রাবেতা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, এর একটা অর্থ আছে। কিন্তু ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট হওয়া আমাকে বিস্মিত করেছে। সব মিলিয়ে আমি উদ্বিগ্ন আমাদের এই পরিকল্পনা নিয়ে। এখনি ওদের উচ্ছেদ করতে না পারলে ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে যাবে। থামল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
গ্যাগিক লেভন মনোযোগ দিয়ে ফাদার সেন্ট সেমভেলের কথা শুনছিল। ফাদার সেন্ট সেমভেলের কথা শেষ হলে সে বলল, ইয়োর হোলি হাইনেস, আমার নিছক একটা কৌতূহল, এই কুর্দি গ্রুপটাকে আমরা বিশেষ টার্গেট করেছি কেন? আর্মেনিয়ায় তো আরও শক্তিশালী কুর্দি কিংবা অন্যান্য মুসলিম জনপদ আছে।
হাসল ফাদার সেন্ট সেমভেল। বলল, তুমি তো নতুন আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছ, তাই তুমি জান না। তোমাকে জানানোও হয়নি। বিষয়টা খুব গোপন। তোমার অবশ্যই জানা দরকার।
একটু থামল ফাদার সেন্ট সেমভেল। রাজাসনের মতো চেয়ারটায় একটু গা এলিয়ে দিল। বলতে শুরু করল আবার, এরা সাধারণ কোন কুর্দি কবিলা নয়। তুমি শুনলে চমকে উঠবে, আমাদের ক্রুসেডের বিজয়াভিযান যার কাছে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল, যার বীরত্ব, মহত্ত্ব আমাদের চিরন্তন মনোবেদনার কারণ, সেই সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বংশধারার এরা সরাসরি এবং জীবিত একমাত্র শাখা এই কবিলা। এরা একদিনও আর্মেনিয়ায় থাকুক, তা আমার কাম্য নয়।
সত্যি চমকে উঠেছিল জেনারেল গ্যাগিক লেভন। সঙ্গে সঙ্গেই কথা বলল না। ধীরে ধীরে তার চোখে বিস্ময়ের সাথে ভাবনারও একটা চিহ্ন ফুটে উঠল। বলল, মাফ করবেন ইয়োর হোলি হাইনেস, শুধু বিস্ময় নয়, একটা ভাবনাও আমার কাছে বড় হয়ে উঠছে। আমরা ভুল করছি না তো! ভুল করে এত মূল্য তাদের দিচ্ছি না তো! প্রায় হাজার বছর পর একটা বংশের সরাসরি ও সঠিক ধারাবাহিকতা খুঁজে বের করা অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে!
জেনারেল লেভন, তোমার কথা বেঠিক নয়। তোমার জায়গায় হলে আমিও এ কথাই বলতাম, কিন্তু আজ বলছি না। তুমি কি সেন্ট রাফায়েল রাজিক-এর নাম শুনেছ? বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
ইয়েস, ইয়োর হোলি হাইনেস। তিনি ছিলেন আর্মেনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘজীবী ধর্মনেতা। জেনারেল লেভন বলল।
ঠিক বলেছ। তখন আমি ছিলাম খৃস্টান যুবসংগঠনের একজন চৌকস নেতা এবং চার্চের একজন কর্মী হিসেবেও সবে আমার হাতেখড়ি হয়েছে। সেই সময় একদিন ফাদার সেন্ট রাফায়েল রাজিক আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি বিস্মিত হলাম, আমাকে তিনি ডেকে পাঠাবেন কেন? কোন কি অপরাধ হয়েছে আমার? ভয়ে ভয়ে গেলাম। সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ বাও করে শ্রদ্ধা জানালাম। তিনি ইজি চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। আমাকে তার পাশে একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বস ইয়ংম্যান। আমি বসলাম। ফাদার শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়েছিলেন। আমার দিকে না তাকিয়েই তিনি বললেন, বৎস, সেদিন যুব সম্মেলনে দেয়া তোমার বক্তৃতার ভিডিওটা দেখলাম। শক্তি শান্তির পূর্বশর্ত। তার চেয়ে বড় পূর্বশর্ত হলো ভবিষ্যতের শত্রুকে চিনতে পারা এবং শত্রুমুক্ত ভবিষ্যত গড়া তোমার এই কথাটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। তোমার কথার সাথে আমি একমত। কিন্তু কথাটা তুমি কেন বলেছ?
আর্মেনিয়া কোন সময়ই শক্তির উপযুক্ত চর্চা করেনি এবং শত্রুকেও কোন সময় আগাম চিনতে পারেনি। ইয়োর হোলি হাইনেস, এই দিকটা সামনে রেখেই আমি ঐ কথা বলেছিলাম। আমার এ কথার পর ফাদার সেন্ট রাফায়েল রাজিক কিছু বলেননি। চুপ করে ছিলেন। তার মুখ ভাবলেশহীন ছিল।
অল্প কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, ঠিক বলেছ ইয়ং ম্যান। আমি খুব খুশি যে তোমাদের মতো ইয়ং ম্যানরা আজ এটা বুঝেছ।
একটু থামেন ফাদার। তারপর একটু হাসেন। বলেন, আমি আশাবাদী, আর্মেনিয়ার ভবিষ্যত তোমাদের মতো তরুণরাই গড়বে। এই গড়ার ক্ষেত্রে ছোট-বড় কোন কিছুই বিবেচনার বাইরে থাকা উচিত নয়। আজকের বীজ কালকে মহীরুহ হয়ে উঠে। যেমন আমাদের দিভিনের ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রাসাদ এলাকার কুর্দি কবিলার কথাই ভাব। এমনকি দিভিনের লোকসংখ্যার অনুপাতেও সিন্ধুর কাছে বিন্দুর চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু জান এই বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু। লুকিয়ে আছে। ওরা সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর নির্ভেজাল রক্ত। এই রক্তবীজ থেকে একদিন সিংহ বেরিয়ে আসতে পারে। সুতরাং দেশ গড়া, জাতি রক্ষার জন্যে বিপদের ছোট বড় সব অপশনই বিবেচনায় রাখতে হয়। ফাদার খৃস্টের ইচ্ছা, তোমরা তা রাখবে। যাও বস।
বলেই ফাদার সেন্ট রাফায়েল রাজিক চোখ বুজলেন। ঘুমিয়ে পড়লেন যেন।
আমি আর কথা না বলে চলে আসি। জেনারেল লেভন এই ফাদার সেন্ট রাফায়েল রাজিকের কাছেই প্রথম সুলতান সালাহউদ্দীনের রক্ত এই কবিলার কথা জানতে পারি। এর আরও অনেক পরে দিভিনের যাদুঘরের ঐতিহাসিক দলিল বিভাগ, থেকে আকস্মিকভাবেই আরও ডিটেইল জানতে পারি। আর্মেনিয়ার সম্রাট হিম-১-এর শাসন আমলে ১২৬০ সালের দিকে সুলতান সালাহউদ্দীনের সপ্তম পুত্রের এই পরিবার দিভিনে মাইগ্রেট করে। মাইগ্রেট করার আগে দিভিনের এই পরিবার হিসন কেইফা থেকে দিভিনে আসার অনুমতি চায়। তখন হিসন কেইফায় মোঙ্গল হামলা উত্তর বিশৃঙ্খলা চলছিল। সেই অবস্থার প্রেক্ষিতেই সুলতান সালাহউদ্দীনের পরিবার আর্মেনিয়ার দিভিনে মাইগ্রেট করতে চায়। তাদের আবেদনের কপিও দলিলটির সাথে ছিল। তাতে বলা হয়েছিল তাদের পূর্বপুরুষরা এক সময় দিভিনের বাসিন্দা ছিল। ৮৯৩ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় আর্মেনিয়ায়। দিভিন এলাকার ৭০ হাজার লোক ভূমিকম্পে মারা যায়। বিধ্বস্ত হয় দিভিন। অন্যান্যের মতো তারাও দিভিন ছাড়ে। তারা চলে আসে আজকের ইরাক এলাকায়। এরাই সুলতান সালাহউদ্দীনের উত্তরসূরি। এই দলিল থেকে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে যাই কুর্দি কবিলা হলেও এরা আসলে, সুলতান সালাহউদ্দীনের রক্ত, তার প্রত্যক্ষ বংশধর।
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ফাদার সেন্ট আর্থার আলেক্স সেমভেল।
জেনারেল লেভনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ইয়োর হোলি হাইনেস ফাদার, ওরা যে সুলতান সালাহউদ্দীনের সত্যিই প্রত্যক্ষ বংশধর, সে বিষয়ে আমার এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
তাহলেই বুঝেছ, আমরা কেন কুর্দি বলে পরিচিত ঐ কবিতা নিয়ে এতটা আগ্রহী, ওদের দেশ ছাড়া করতে আমরা এতটা ব্যস্ত কেন? বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
বুঝলাম ইয়োর হোলি হাইনেস। বলে জেনারেল লেভন চুপ করে গেল। একটু ভাবল। পরে বলল, ইয়োর হোলি হাইনেস, আমি একটা কথা বলব, যদি আমাকে অনুমতি দেন।
অনুমতির দরকার এমন কি কথা জেনারেল লেভন। হ্যাঁ, বল, কি বলবে।
ইয়োর হোলি হাইনেস, সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ঐ বংশধররা যদি বিপজ্জনকই হয়, তাহলে দেশ থেকে ওদের তাড়াতে চাচ্ছেন কেন? ওরা আমাদের হাতের মুঠোর বাইরে যাবে কেন? জেনারেল লেভন বলল।
তার মানে, কি বলতে চাচ্ছ তুমি? বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল। ওদের যখন বিপজ্জনক ভাবছি, তখন দেশ থেকে ওদের তাড়িয়ে বড় শত্রু বানাচ্ছি কেন, শত্রুতা করার সুযোগ দিচ্ছি কেন? জেনারেল লেভন বলল।
তাহলে শত্রুকে কি আমাদের দেশে রাখতে বলছ? দেশে রেখে কি আমরা বিপদ বাড়াব? বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
না, ইয়োর হোলি হাইনেস, আমি বরং উল্টো কথাই বলছি। আমি চাচ্ছি, বিপদের এই উৎসকে চিরতরে নির্মূল করা হোক। জেনারেল লেভন বলল।
ফাদার মাথা ঘুরিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল জেনারেল লেভনের দিকে। বলল, মানে, তুমি ওদেরকে দেশে রেখেই টোটাল এলিমিনেট করার কথা বলছ?
হ্যাঁ, ইয়োর হোলি হাইনেস। তাদের মতো শক্রদের শেষ রাখতে নেই।
মুহর্তের জন্যে চোখ বুজল ফাদার সেন্ট সেমভেল। চোখ খুলল একটু পর।
তার চোখে উজ্জ্বল দৃষ্টি। বলল, জেনারেল লেভন, তুমি ঠিক বলেছ। এটাই স্থায়ী সমাধান।
মুহূৰ্তৰ্কয়েক চুপ থেকে বলল, কিন্তু জেনারেল লেভন, আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক। পৃথিবীও আজ ছোট হয়ে গেছে। এপ্রান্তের খবর ওপ্রান্তে যেতে মুহূর্তও সময় লাগে না। তার উপর রয়েছে আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা। একজন, দুজনের ব্যাপার নয়, একটা গোষ্ঠীকে এভাবে এলিমিনেট করা। এখনকার পরিবেশে সম্ভব নয়।
ইয়োর হোলি হাইনেস, আমি রুশ বাহিনীর এনেমি এলিমিনেশন ইউনিটে (EEU) কাজ করেছি। সব ঘাট আমার জানা আছে। আমি গণতন্ত্র-ফনতন্ত্রে বিশ্বাস করি না। স্বার্থের কাছে নীতি-নৈতিকতার কোন মূল্য নেই। ভাববেন না ইয়োর হোলি হাইনেস। জেনারেল লেভন বলল।
ভাববেন না বললেই তো ভাবনা চলে যাবে না। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে তুমি যেমনটা ভালো মনে কর তার একটা ডিটেইল প্ল্যান আমার কাছে পেশ কর। তাড়াতাড়ি চাই এটা। যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। আরও দেরি হোক তা চাই না। বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
কথা শেষ করতেই ফাদারের টেলিফোন বেজে উঠল।
অয়্যারলেস বেজে উঠায় চমকে উঠল ফাদার সেন্ট সেমভেল। সরাসারি তার অয়্যারলেসে তো কল আসার কথা নয়। তার সব কলই আসে পিএ বা পিএস-দের কাছে। একমাত্র বিশেষ জরুরি অবস্থায় তার সরাসরি অয়্যারলেসে কল আসতে পারে। তাহলে সে রকমই কি কিছু ঘটেছে?।
তাড়াতাড়ি অয়্যারলেস তুলে নিল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
অয়্যারলেস ওপেন করতেই ওপ্রান্ত থেকে সোনা সোসানার কণ্ঠ ভেসে এল। বলল, ইয়োর হোলি হাইনেস, বিশেষ জরুরি, আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে পারি? আমি নিচের লনে, গাড়িতে।
সোনা সোসানা ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার-এর শীর্ষ গোয়েন্দা অপারেটর এবং ফাদার সেন্ট সেমভেলের গোপন পার্সোনাল অপারেশন টিম-এর সম্মানিত সদস্য। সেও রুশ আর্মির সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্নেল র্যাংকের একজন অফিসার ছিল। তার পোস্টিং ছিল আর্মেনিয়ায়। আর্মেনীয় পলিসি নিয়ে রুশ সামরিক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের সাথে মতানৈক্য হওয়ার পর সে পদত্যাগ করে এবং আর্মেনিয়ায় আশ্রয় নেয়। রুশ গোয়েন্দা হিসাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়ই ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার (BAT) ও এর প্রধানের সাথে তার পরিচয় ঘটে। রুশ-আর্মি থেকে পদত্যাগের পরই ব্যাট-এ যোগদান করে। তার আরেকটি বড় পরিচয় হলো সে জেনারেল লেভন-এর ছোট বোন। জেনারেল লেভন-এর ব্যাট-এ যোগদানের পিছনেও বোন সোনা সোনার প্রভাব ছিল।
সোনা সোসানা ফাদার সেমভেল-এর পার্সোনাল অপারেশন টিম (POT)-এর সদস্য বলেই সঙ্গে সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেয়ে গেল। ফাদার সেন্ট সেমভেল বলল, হ্যাঁ, এস সোনা সোসানা। এখানে জেনারেল লেভনও আছে।
দুমিনিটের মধ্যেই নক হলো দরজায়। ফাদার সেন্ট সেমভেলের সামনে টেবিল-গ্লাসে একটা আয়তাকার স্ক্রিনে ভেসে উঠল সোনা সোসানার দরজার সামনে দাঁড়ানো গোটা ছবি।
ফাদার সেন্ট সেমভেল টেবিলের নিচে একটা বিশেষ পা-দানির উপর রাখা ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিল প্ল্যাটফরমের একটা অংশের উপর।
দরজা খুলে গেল।
দরজায় সোনা সোসানা। পরনে তার সাদা স্কার্ট। তার উপর গায়ে কালো ফুলহাতা জাম্পার ধরনের কিছু। চোখে গগলস। মাথায় ববকাট চুল। তীরের মতো ঋজু শরীর, স্পোর্টিং ফিগার। বলা যায় আর্মেনিয়ান এক অপ্সরী। রুশ-গোয়েন্দা বিভাগ এ ধরনের মেয়েদের রিক্রুট করে।
সোনা সোনার দিকে না তাকিয়েই ফাদার সেন্ট সেমভেল বলল, এস সোসানা।
সোসানা গিয়ে দাঁড়াল টেবিলের সামনে। অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে। দৃষ্টি নিচু। ভাইয়ের দিকেও চাইল না।
বস। মুখ না তুলেই বলল ফাদার সেমভেল।
বসল সোসানা।
বল। বলল এবার সরাসরি তাকিয়ে ফাদার সেমভেল।
সানাহিন থেকে টেলিফোন পেয়েছি অল্প আগে। আমাদের …।
চারজন লোক গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে, এই তো? বলল ফাদার সেমভেল সোসানার কথার মাঝখানেই।
ইয়েস, ইয়োর হোলি হাইনেস। আমাদের লোক জীবিত অবস্থায় এবং এত সংখ্যায় ধরা পড়া এই প্রথম। বলল সোসানা।
ফাদার সেন্ট সেমভেল তাকাল জেনারেল লেভনের দিকে। বলল, আমি সোসানার জন্য অপেক্ষা করছিলাম যে, সেও খবর নিয়ে আসবে। দুজনকেই আমার দরকার। এখন বল তুমি কি ভাবছ?
ইয়োর হোলি হাইনেস, প্রথম কাজ আমাদের লোকদের মুক্ত করা, ইনটেরগেশনের আগেই। দ্বিতীয় কাজ প্রতিশোধ নেয়া। বলল জেনারেল লেভন।
ঠিক চিন্তা করেছ। ওদের থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। আমি দেখতে চাই রাতের মধ্যেই ওরা মুক্ত হয়েছে। বলল ফাদার সেমভেল।
ইয়োর হোলি হাইনেস, ধরুন ওরা মুক্ত হয়েছে। আমি কাজ শুরু করছি। জেনারেল লেভন বলল।
আর প্রতিশোধ? বলল ফাদার সেমভেল।
জবাব দেয়ার আগে একটু ভাবল জেনারেল লেভন। বলল, পুলিশের শাস্তি অবশ্যই দেব। যারা সেদিন ট্রেনে ছিল, তারা হয় সানাহিনে নেমেছে, নয়তো ট্রেনে ইয়েরেভেন আসছে। আমরা হয় সানাহিনে ওদের ধরব, না হয় রাস্তায় কিংবা ইয়েরেভেনে। ওরা বাঁচবে না ইয়োর হোলি হাইনেস।
জেনারেল লেভন, পুলিশ আমাদের টার্গেট নয়। আমাদের চার কমান্ডোকে গুলি করে আহত করেছে এবং পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। একজন যুবক। সুতরাং টার্গেট সেই যুবক। বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
ইয়োর হোলি হাইনেস, যুবকটি সাহিনে নেমেছে? জেনারেল লেভন বলল।
না সানাহিনে নামেনি। ইয়েরেভেনেই আসছে। পথে ট্রেন কোথাও থামবে না, তাই তার পথে নেমে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
ধন্যবাদ ইয়োর হোলি হাইনেস। সে আমার টার্গেট। ইয়েরেভেনে ঢোকা তার ভাগ্যে হবে না। জেনারেল লেভন বলল।
জেনারেল লেভন, আত্মবিশ্বাস অবশ্যই থাকতে হবে। তবে অতি আত্মবিশ্বাস ভালো নয়। ধন্যবাদ। বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
ফাদার সেমভেলের আলোচনা শেষে ধন্যবাদ বলা মানে চলে যাবার ইংগিত।
জেনারেল লেভন ফাদার সেমভেলের দিকে চোখ তুলে একবার তাকিয়েই উঠে দাঁড়াল।
জেনারেল সেমভেল বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।
সোসানা, জেনারেল লেভনকে তোমার ফলো করতে হবে। তুমি রেডি? জেনারেল লেভন বেরিয়ে গেলে ফাদার সেন্ট সেমভেল বলল।
ইয়োর হোলি হাইনেস, আপনি কি বিষয়টা নিয়ে কোন কিছু ভাবছেন? বলল সোনা সোসানা।
কোন কিছুকেই ছোট করে দেখা উচিত নয়। কয়েক বছর আগে এই আর্মেনিয়াতেই আমাদের উত্তরসূরিদের বড় একটা উদ্যোগের অপমৃত্যু ঘটে। তুমি জান, মাইকেল পিটারের হোয়াইট ওলফ সফল হতে পারেনি। তিনিসহ টপ সব নেতাই মারা পড়েন। বাইরে থেকে এসে একজন যুবক মাত্র এই বিপর্যয় ঘটিয়েছিল। আমি জানতে পেরেছি, এই ঘটনাতেও একজন যুবকই খালি হাতে প্রতিবাদ জানাতে এগিয়ে এসেছিল। সে আমাদের লোকদের রিভলবারেই আমাদের চারজনকে আহত করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। ট্রেনের ঐ কামরার একজন যাত্রীর বরাত দিয়ে আমাকে পুলিশেরই একটা সোর্স এটা জানিয়েছে। তার কাজ দেখে। পুলিশও বিস্মিত হয়েছে। এমনকি পুলিশ অফিসারও তাকে স্যার বলে সম্বোধন করেছে। খবরটা আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে।
বলে থামল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
ইয়োর হোলি হাইনেস, আমার প্রতি আপনার নির্দেশ? সোনা সোনা বলল।
বলেছি, তুমি জেনারেল লেভনকে ফলো করবে। এরপর তোমার কাজ হলো যুবকটিকে ফলো করা, তার পরিচয় জানা এবং তাকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়া চিরতরে। বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
ঈশ্বর করুন, এত কিছুর দরকার না হোক। ইয়েরেভেনে ঢাকাই যেন তার ভাগ্যে না জোটে। সোনা সোসানা বলল।
সব সময় পরিকল্পনা হওয়া উচিত পরিপূর্ণ। আগে সাফল্য এসে গেলে ভালো। আমি চাই এই অভিযানে তুমি সফল হও। সফল হলে একটা বড় পুরস্কার তোমাকে দেব। বলল ফাদার সেন্ট সেমভেল।
সোনা সোসানা খুশি হলো। কৌতূহলী চোখে তাকাল ফাদার সেমভেলের দিকে।
ফাদার সেমভেল হাসল। বলল, অফিসিয়াল কথা শেষ। এবার ইনফরমাল হতে পার। বলল ফাদার সেমভেল।
ধন্যবাদ, ইয়োর হোলি হাইনেস। সোনা সোসানা বলল।
না, ইয়োর হোলি হাইনেস, অফিসিয়াল অ্যাড্রেস। ইনফরমাল অবস্থায় ফরমাল সম্বোধন নয়। বলল ফাদার সেমভেল।
এটা অফিস, ইয়োর হোলি হাইনেস। সোনা সোনা বলল।
এটাকে বলতে পার আমার বাড়ির বৈঠকখানার এক্সটেনশন। বাড়ির চেয়ে অফিসকেই আমি প্রেফার করি। বাড়িটা মৃত। গৃহকর্মীরা ছাড়া কেউ নেই। তোমরা যখন যাও, বাড়িটা হেসে উঠে। বলল ফাদার সেমভেল।
পলকের জন্যে মুখটা ম্লান হয়ে উঠেছিল সোনা সোনার। পরবর্তী পলকেই মুখটা তার আবার হেসে উঠেছিল। বলল, সেটা আমাদের। সৌভাগ্য।
সৌভাগ্য আমারও। বলল ফাদার সেমভেল। তার চোখে পরিতৃপ্তি বোধের একটা স্ফুরণ।
.
সানাহিন থেকে ট্রেন ছাড়ার পর নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। চোখ বুজলেও ঘুম আসছিল না তার। ঘটনার প্রতিক্রিয়া এখনও শেষ হয়ে। যায়নি। ব্ল্যাক টাইগার কারা? খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, লুটেরাদের দল? ঘটনা ও ধরা পড়া লোকদের পরীক্ষা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়নি।
পেছনে বাম পাশের সিটের দিক থেকে একটা ক্যামেরা ক্লিক করার শব্দ হলো।
চোখ খুলল আহমদ মুসা। তার চোখ ছুটে গেল শব্দ লক্ষ্যে। দেখল সে, সিটে বসা একজনের ডান হাত তার জ্যাকেটের মধ্যে ঢুকল। তার চোখের দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার বুঝতে অসুবিধা হলো না, লোকটি ক্যামেরা পকেটে লুকালো। সে যে তারই ফটো তুলেছে তাও পরিষ্কার তার অপ্রস্তুত অবস্থা থেকে।
তাকে কিছু কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল আহমদ মুসা। এখন এ বিষয়ে কোন কথা নয়। তাকে বুঝতে দেয়া যাবে না যে, তাকে আমি সন্দেহ করেছি, তার কাজ আমি দেখেছি। লোকটি সানাহিন থেকে ট্রেনে উঠেছে। হতে পারে লোকটা গ্রেফতার হওয়া লোকদের দলেরই কেউ। সুতরাং তাকে জানতে না দিয়ে তাকে অবজারভ করতে হবে, জানতে হবে। কি উদ্দেশ্যে আমার পিছু নিয়েছে সে।
আহমদ মুসা এদিক সেদিক তাকিয়ে সিটের বিছানাটা ঠিক করে নিয়ে। শুয়ে পড়ল। কম্বলটা বুক পর্যন্ত তুলে নিয়ে বুক ও মাথা মুড়ল একটা পাতলা চাদরে। তার পাতলা চাদরের উপরের প্রান্তে বড় একটা ফুটো আছে। সেটা দিয়েই আলোকোজ্জ্বল কক্ষটির মোটামুটি সবকিছুই দেখা। যাচ্ছে। লোকটির দিকে চোখ রাখার ক্ষেত্রে এটুকুই যথেষ্ট হবে।
ট্রেন চলছিল তীরবেগে।
ডানাড়জোর শহর পেরিয়ে স্পাইটাক শহর অতিক্রম করতে যাচ্ছিল। ট্রেনটা। ট্রেনের সবাই তখন ঘুমে। কিন্তু আহমদ মুসার চোখে ঘুম নেই। সে দেখতে পেল লোকটি উঠে বসেছে। চারদিকে দেখছে। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করল। আরও একটা কি যেন বের করল। ভাঁজ করা রুমালে কিছু ঢালতে দেখা গেল। বসে থেকেই লোকটা তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
উঠে দাঁড়াল লোকটি। চারদিকে তাকাল সে। আবার তার চোখ ঘুরে এল আহমদ মুসার দিকে।
লোকটি একপা দুপা করে বিড়ালের মতো এগোতে লাগল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার কাছাকাছি এসেই লোকটি ডান হাতে পকেট থেকে রিভলবার বের করে নিল। তার বাম হাতে সেই রুমাল।
আহমদ মুসা বুঝতে পেরেছে, লোকটি আহমদ মুসাকে ক্লোরোফরম করে সংজ্ঞাহীন করতে চায়। কেন? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। আহমদ মুসাকে সংজ্ঞাহীন করে লোকটি কি করবে? আর ঘন্টা খানেকও লাগবে না ইয়েরেভেনে যেতে। লোকটি কি আহমদ মুসাকে অসুস্থ দেখিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিতে চায়? কিন্তু আহমদ মুসা ইতিমধ্যেই এখানে পরিচিত হয়ে গেছে, অন্তত সেই মেয়ে ও যুবকটি তাকে নতুন আগন্তুকের হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিজেরাই নিয়ে যেতে চাইবে। হতে পারে লোকটার আরও লোক ইয়েরেভেনে ওয়েট করছে। তারা হঠাৎ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।
লোকটি আহমদ মুসার মাথার কাছে এসে গেছে।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, লোকটাকে বাধা দেবে না। শ্বাস বন্ধ। রেখে নিজেকে সংজ্ঞা হারানো থেকে রক্ষা করবে। সংজ্ঞাহীন করার জন্যে এমন সব লিকুইড স্প্রে বেরিয়েছে, যা নাকে ধরা বা স্প্রে করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মানুষ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। আগের মতো নিশ্চিত হবার জন্যে আধা মিনিট এক মিনিট নাকে ধরে রাখার প্রয়োজন হয় না।
লোকটি আহমদ মুসার মাথার কাছে বসে পড়ল। একটা গ্যাস মাস্ক পরে নিল সে।
আহমদ মুসা বুঝল সংজ্ঞালোপকারী লিকুইড ভেজানো রুমাল তার নাকে চাপতে হবে না, শুধু নাকের সামনে ধরবে মাত্র। কয়েকটা শ্বাসের সাথে লিকুইডের গ্যাস ভেতরে ঢুকলেই কাজ শেষ।
আহমদ মুসা সিটের বাইরের দিকে পাশ ফিরে শুয়েছিল। এতে লোকটির সুবিধা হলো।
লোকটির রুমাল ধরা বাম হাত এগিয়ে এল আহমদ মুসার নাকের দিকে। আর তার ডান হাতের রিভলবার আহমদ মুসার কপাল লক্ষ্যে স্থির। হলো। লোকটার হাতের রুমাল আহমদ মুসার নাকের মাথার কাছে এসে। স্থির হলো।
আহমদ মুসা শ্বাস বন্ধ করে নিয়েছিল।
দশ পনের সেকেন্ড রুমালটি নাকের সামনে রেখে সরিয়ে নিল। মাথার কাছে বসে সে অপেক্ষা করল আরও দশ পনের সেকেন্ড।
লোকটি নড়ে-চড়ে বসে সহজ হলো। চাদরের ভেতর থেকে আহমদ। মুসার একটা হাত বের করে উপরে তুলে ছেড়ে দিয়ে দেখল হাতটা আছড়ে পড়ে গেল।
লোকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লোকটি এবার আহমদ মুসার মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে মুখ এদিক ওদিক করে দেখল কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
লোকটি খুশি মনে উঠে দাঁড়াল। চলে গেল তার সিটে।
আহমদ মুসা চোখ খুলে তাকাল লোকটির দিকে।
লোকটি সিটে বসেই মোবাইল বের করল। কল করল কোথাও।
ওপারের কানেকশন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে বলে উঠল, স্যার, একটা ভালো খবর আছে, ব্যবসায়ে ভালো প্রফিট করেছি। এখন নির্দেশ বলুন স্যার।
ওপারের কথা শুনে আবার বলল, স্যার, ধন্যবাদ স্যার। হিজ হোলি হাইনেসকে আমার ব্যাপারে একটু বলবেন। বলুন স্যার, নির্দেশ বলুন।
ওপারের নির্দেশ সে শুনল বেশ কয়েক মিনিট ধরে। ওপারের কথা শেষ হলে সে বলল। তাহলে স্যার, স্পাইটাকেই ট্রেন থামছে। ওরাই আসবে, সবকিছু করবে। খবর পেয়ে একজন অসুস্থ আত্মীয়কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এই তো? ঠিক আছে। ট্রেন স্পাইটাক শহরের টানেলে প্রবেশ করেছে।
ওকে স্যার! বলে অয়্যারলেসের কল অফ করল লোকটি।
কল অফ করেই লোকটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে মুখে বিজয়ের আনন্দ!
লোকটি আস্তে আস্তে কথা বললেও আহমদ মুসা তার সব কথাই শুনেছে। আহমদ মুসা বুঝতে পারল, স্পাইটাক স্টপেজে ট্রেন থামার কথা না থাকলেও ওরা আত্মীয়ের অসুস্থতার অজুহাত তুলে ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা করেছে। অকে অসুস্থ দেখিয়েই ওরা তাকে কিডন্যাপ করবে। অতি সুন্দর নিরাপদ ব্যবস্থা ওদের। বুঝা যাচ্ছে, উপরে তাদের শক্তিশালী লবী আছে। তাছাড়া দলটা করিতকর্মা অবশ্যই। রাতে ট্রেনে ঘটনা ঘটল আর সাথে সাথেই সানাহিনে তারা ট্রেনে লোক তুলে দিল প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে। তাদের এই ক্ষীপ্রতাই প্রমাণ করে ওদের কনট্যাক্ট বহুমুখী।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন থামবে। আহমদ মুসা মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। পার হলো আরও কয়েক মিনিট।
ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট মাইক্রোফোনে একটা ঘোষণা ভেসে এল, ন্দ্র মহিলা ও ন্দ্র মহোদয়গণ, একজন অসুস্থ, সংজ্ঞাহীন মানুষকে সরিয়ে নেবার জন্যে স্পাইটাকে ট্রেন থামাতে হচ্ছে। আপনাদের অসুবিধার জন্যে আমরা দুঃখিত।
মিনিটখানেকের মধ্যে গাড়ি থেমে গেল।
কম্পার্টমেন্টের কেউ জেগে উঠেছিল, কেউ ঘুমে। যারা জেগে উঠেছিল তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়, এমন ঘটনা তো আগে কখনও ঘটেনি! ট্রেনেই তো ডাক্তার আছে, এমনকি অল্পপরিসরে হলেও একটা ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট আছে! আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তো ইয়েরেভেন ট্রেন থামবে। তাহলে অযৌক্তিকভাবে এই অ্যারেঞ্জমেন্ট কেন করা হলো!
জেগে উঠেছিল পুলিশ প্রধানের মেয়ে এবং তার জামাই যুবকটিও। তাদের চোখেও বিস্ময় ও বিরক্তি।
ট্রেন থামতেই আহমদ মুসাদের কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে গেল। প্রবেশ করল দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ চেহারার একজন। তার ঋজু পদক্ষেপ। মিলিটারি মার্চ করার মতোই তার হাঁটা। তার পেছনে পেছনে প্রবেশ করল। স্ট্রেচার নিয়ে চারজন লোক। ট্রেনের দরজার মুখে লাগানো আছে অ্যাম্বুলেন্স।
লোকটিকে প্রবেশ করতে দেখেই আগের সেই লোকটি উঠে দাঁড়ালো। সে আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল, এই আমাদের সেই আত্মীয়। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন। দ্রুত করুন স্যার।
ধন্যবাদ, আমি দ্রুত করার জন্যেই এসেছি। বলেই মিলিটারি চেহারার লোকটি কম্পার্টমেন্টের সবাইকে লক্ষ্য করে বলল, স্যরি আপনাদের ডিস্টার্ব করলাম। আপনাদের সহযাত্রী আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে নিতে এসেছি।
লোকটার কথা শেষ হতেই বিস্মিত আন্না এলিনা অর্থাৎ পুলিশ প্রধানের মেয়ে বলল, এই তো কিছুক্ষণ আগেও তিনি সুস্থ সবল মানুষ ছিলেন। আমাদের সাথেই বলা যায়, উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। অসুস্থ হলেন। কখন? আর ওনার অসুস্থতার খবরটা কি করে জানলেন আপনারা?
আহমদ মুসাকে ক্লোরোফরম করা সেই লোকটা বলল, আমিই খবর দিয়েছি। ওনাকে সংগ দেবার জন্যে আমি সানাহিনে ট্রেনে উঠেছিলাম।
আন্না এলিনা একবার আহমদ মুসার দিকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলার। আর কোন কথা খুঁজে পেল না।
দ্রুত হেঁটে মিলিটারি চেহারার লোকটি আহমদ মুসার মাথার কাছে। গিয়ে দাঁড়াল। একটানে তার উপর থেকে চাদর সরিয়ে দিল। দেখল আহমদ মুসার নিঃসাড় দেহ।
লোকটি পেছনে তাকিয়ে তাড়া দিল, তোমরা তাড়িতাড়ি একে তুলে নাও।
স্ট্রেচার নিয়ে চারজন দ্রুত এল। রাখল আহমদ মুসার সিটের পাশে।
সেই মিলিটারি চেহারার লোকটি আহমদ মুসার মাথার কাছ থেকে সরে গিয়ে স্ট্রেচারের পাশে দাঁড়াল।
মিলিটারি চেহারার লোকটা যখন কম্পার্টমেন্টের লোকদের সাথে কথা বলছিল, সবার চোখ তখন লোকটার দিকে ছিল, তখন আহমদ মুসা এক পলক দেখে নিয়েছে লোকটাকে। আর্মি ছাট চুল। আর্মি কমান্ডারদের কথার মতো তার কথার ধরন। সুস্থতা ও শক্তি তার দেহ থেকে ঠিকরে পড়ছে। তার বুদ্ধিটা তার শক্তির মতো শার্প নয়। আর্মির মতোই তার কোমরে ঝুলানো রিভলবার। নিশ্চয় লাইসেন্স করা।
চাদর, কম্বল সব আহমদ মুসার উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তিনজন ধরাধরি করে আহমদ মুসাকে স্ট্রেচারে নামিয়ে নিল। আহমদ মুসাকে ভালো করে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে চারজন স্ট্রেচারটি তুলে নিল।
এমন একটা সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মাথা থেকে মিলিটারি লোকটার দূরত্ব দুই ফুটের বেশি নয়।
মিলিটারি চেহারার লোকটা স্ট্রেচার নিয়ে চলার নির্দেশ দিল। সে সামনে তাকিয়েছিল। বলল, প্লিজ, আপনারা সিটে বসে স্ট্রেচারটা ভালো করে নিয়ে যাবার সুযোগ দিন।
লোকটা ডানে ঘোরায় তার বাম কানের নিচে ঘাড়ের সেনসেটিভ জায়গাটা উন্মুক্ত ছিল।
আহমদ মুসার ডান হাতের কারাত হাতুড়ির মতো গিয়ে আঘাত করল লোকটার কানের নিচে।
লোকটা মাথা তুলে চাইবারও সুযোগ পেল না। তার শরীরটা একবার দুবার পাক খেয়ে পড়ে গেল ট্রেনের মেঝেতে।
আঘাত করেই আহমদ মুসা লাফ দিয়ে নিচে নেমে মিলিটারি লোকটার কোমর থেকে রিভলবার তুলে নিল।
নেতা লোকটাকে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যেতে দেখে বিস্মিত ভীত বিহব্বল চারজনের হাত থেকে স্ট্রেচার পড়ে গেল। হাত থেকে স্ট্রেচার পড়ে যাওয়ার পর ওরা মুহূর্তের মধ্যে ভীতি-বিহ্বলতা কাটিয়ে পকেটে হাত দিল রিভলবার বের করার জন্যে। সে সুযোগ তারা পেল না। আহমদ মুসার রিভলবার পলকের মধ্যে ঘুরে এল ওদের চারজনের উপর দিয়ে।
ওদের চারজনই উরুতে গুলিবিদ্ধ হলো। ওরা সকলেই চিৎকার করে বসে পড়ল।
আহমদ মুসার সংজ্ঞা লোপের চেষ্টাকারী লোকটি পালাচ্ছিল। আহমদ মুসা তারও পায়ে গুলি করল। সে পড়ে গেল মেঝের উপর।
পুলিশ এসে ঝড়ের মতো প্রবেশ করল কম্পার্টমেন্টটিতে। ট্রেনের নিরাপত্তায় মোতায়েন করা সেই পুলিশ অফিসার তার ফোর্স নিয়ে এল।
এসে সবকিছুর দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, এবার পাঁচজন গুলিবিদ্ধ?
আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, আপনার হাতে রিভলবার? আপনিই গুলি করেছেন?
হ্যাঁ অফিসার, আমিই ওদের গুলি করেছি। বলল আহমদ মুসা।
আমাদের কাছে ইনফরমেশন আছে, ওরা ওদের অসুস্থ ও সংজ্ঞাহীন আত্মীয়কে নিতে এসেছিল। কি ঘটে গেল এর মধ্যে?
আমিই বোধ হয় তাদের সেই আত্মীয়। দেখুন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ, সংজ্ঞাহীনও নই। আহমদ মুসা বলল।
তাই তো দেখছি। তাহলে ঘটনাটা কি স্যার? বলল পুলিশ অফিসার।
ঘটনা হলো, যে লোকটা পালাচ্ছিল, যার পায়ে গুলি করলাম, সে সানাহিন থেকে কম্পার্টমেন্টে উঠেছিল। তারা পরিকল্পনা করেছিল, এই লোকটি সুযোগ মতো আমাকে ক্লোরোফরম করে সংজ্ঞাহীন করবে। অতঃপর তাদের আত্মীয় অসুস্থ ও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে, এই অজুহাতে তারা স্পাইটাকে ট্রেন থামিয়ে ট্রেন থেকে আমাকে নামিয়ে নেবে। আহমদ মুসা বলল।
মানে কিডন্যাপ করবে! কেন? বলল পুলিশ অফিসার। তার চোখে বিস্ময়।
সানাহিনের আগে ট্রেনে যে ঘটনা ঘটেছিল, যে ঘটনায় আমি ওদের চারজনকে গুলিবিদ্ধ করেছিলাম, তার প্রতিশোধ নেবার জন্যে আমাকে ওরা কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল। আহমদ মুসা বলল।
ও গড! তার মানে এরা-ওরা সব একই গ্যাং-এর সদস্য? বলেই অফিসারটি ঝুঁকে পড়ে ওদের ছয়জনের জামা-জ্যাকেটের কলার-ব্যান্ড পরীক্ষা করল। দেখল সেই একই মনোগ্রাম, একটা ব্ল্যাক টাইগার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে রয়েছে।
ঠিক স্যার, এরা-ওরা একই গ্যাং-এর সদস্য।
বলেই অন্য পুলিশের দিকে ফিরল পুলিশ অফিসারটি। বলল, সুরত হাল, ছবি এ সব কাজই তোমাদের শেষ নয়। সাথে এই পাঁচজনকে এই অ্যাম্বুলেন্সেই তুলে নাও। দেখ বাইরে আরও পুলিশ এসেছে, ওদের হাওলা করে দাও অ্যাম্বুলেন্সকে। ওদের কাছ থেকে একটা লিখিত রিসিট রাখ। আমি গিয়ে অন্যান্য বিষয় ঠিক করব।
পুলিশরা ওদের ছয়জনকে নিয়ে চলে গেল।
পুলিশ অফিসার আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, স্যার, আপনি একটা স্টেটমেন্ট লিখে দিন। সেটাকেই আমরা এফআইআর হিসেবে দেখব। বলে পুলিশ অফিসার কাগজ ও কলম আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা সিটে বসে তার স্টেটমেন্ট লিখে ফেলল।
স্বাক্ষর করে স্টেটমেন্টটা তুলে দিল পুলিশ অফিসারের হাতে।
স্টেটমেন্টের উপর একবার নজর বুলিয়ে অফিসার বলল, স্যার, আপনার নাম আছে, কিন্তু অ্যাড্রেস দেয়া নেই। প্লিজ, অ্যাড্রেসটা। দিন স্যার।
আমি ইয়েরেভেনে যাচ্ছি, কোথায় উঠব এখনো ঠিক করিনি। অ্যাড্রেস দিই কিভাবে? আহমদ মুসা বলল।
আর্মেনিয়ার পুলিশ প্রধানের মেয়ে আন্না এলিনা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, এক্সকিউজ মি স্যার, ইয়েরেভেনে আমাদের অ্যাড্রেস ব্যবহার করতে পারেন।
কিন্তু তাতে কি লাভ? ওখানে আমাকে এরা তো পাবেন না। আহমদ মুসা বলল।
আপনি আমাদের মেহমান হতে পারেন। এতে আপত্তি থাকলে আপনি ইয়েরেভেনে গিয়ে অ্যাড্রেস সংশোধন করতে পারবেন। আমাদেরকে জানালেই সংশোধন করিয়ে নেব, কথা দিচ্ছি। বলল। আন্না এলিনা।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। নানা দিক নিয়ে চিন্তা করল। বলল, ঠিক আছে অফিসার ওর ঠিকানাই লিখে নেন।
ঠিক আছে, ওদের ঠিকানা আমার জানা আছে। লিখে নিচ্ছি।
অ্যাড্রেস লিখে নিয়ে পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়াল।
কাগজটি ভাঁজ করে সহকারির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, মি. আবু আহমদ আব্দুল্লাহ, আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে চাই। ওরা আপনাকে সংজ্ঞাহীন করতে ব্যর্থ হলো কেন? কিভাবে ওদের আপনি বোকা বানালেন?
ও কিছু না। লোকটাকে আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। সে ক্লোরোফরম করতে আসছে, সেটাও আমি টের পেয়েছিলাম। ক্লোরোফরম করেছিল সে আমাকে। আমি যে সংজ্ঞা হারিয়েছি, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই সে ফিরে গিয়েছিল তার সিটে। আমি…।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই পুলিশ অফিসারটি বলে উঠল, বুঝা যাচ্ছে ওরা সংজ্ঞাহীন করেছিল আপনাকে। কিন্তু আপনি সংজ্ঞা হারাননি। সেটা কিভাবে?
খুব সিম্পল। ও যতক্ষণ ক্লোরোফরম আমার নাকে ধরে রেখেছিল, ততক্ষণ আমি শ্বাস বন্ধ করে রেখেছিলাম। বর্তমানে যে ধরনের সংজ্ঞা লোপকারী লিকুইড পাওয়া যাচ্ছে তা দশ পনের সেকেন্ডের বেশি নাকে রাখার দরকার হয় না। তাছাড়া এক দেড় মিনিট শ্বাস বন্ধ করে রাখতে সকলেই পারে। বলল আহমদ মুসা।
আশ্চর্য লোক আপনি! লোকটিকে সন্দেহ করার পর তাকে স্বাধীনভাবে অপরাধ করার সুযোগ দিলেন! সে যদি ক্লোরোফরম ২ মিনিট কিংবা তারও বেশি সময় আপনার নাকে ধরে রাখতো! পুলিশ অফিসারটি বলল।
যেখানে দশ পনের সেকেন্ডে একজন মানুষ সংজ্ঞাহীন হয়, সেখানে ক্লোরোফরম দুই মিনিট কিংবা তারও বেশি সময় নাকে ধরে রাখা সাধারণ হিউম্যান সাইকোলজি নয়। আমি এরই সুযোগ গ্রহণ করেছি। বলল আহমদ মুসা।
আশ্চর্য মানুষ আপনি! এই চরম সিচুয়েশনে মানুষের সাইকোলজিকেও বিবেচনায় আনেন! সাধারণত একজন প্রোফেশনালই এমন করতে পারেন। প্লিজ স্যার, আসলে আপনি…।
পুলিশ অফিসারের কথার মাঝেই আহমদ মুসা বলল, মি. অফিসার, মানুষকে, আল্লাহ অসীম ক্ষমতার আকর বানিয়েছেন। একজন মানুষ চেষ্টা করলে সবই পারে। ধরে নিন, সব পারার একজন সৌখিন চর্চাকারী আমি। প্লিজ অফিসার, এখানেই আলোচনা শেষ হোক। আপনারও ফিরবার সময় হলো।
হাসল পুলিশ অফিসার। বলল, স্যার, আমার মন যেন সব জবাব পেল না।
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, ভবিষ্যতের জন্যেও কিছু রাখুন অফিসার।
আবার দেখা হবে? বলল পুলিশ অফিসার।
পৃথিবীটা গোল, দেখা হবারই কথা। আর আর্মেনিয়াও খুব একটা বড় দেশ নয়। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার, আসি।
বলে পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করল অফিসার কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরুবার জন্যে। কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল পুলিশ অফিসার।
আহমদ মুসা ফিরছিল তার সিটের দিকে।
কম্পার্টমেন্টের মাঝ থেকে একজন তরুণ বলে উঠল, স্যার, প্লিজ যাবেন না, আমাদের মাঝামাঝি আর একটু বসুন। আমরা তো কিছু বলতে পারিনি, বলতে চাই। প্লিজ।
অন্য সকলে সমস্বরে তাকে সমর্থন করল।
স্যার, আমাদের এখানে বসুন। আমি আমার স্বামীর সিটে যাচ্ছি। প্লিজ আসুন। বলল সেই মেয়েটি।
আসুন স্যার। ফিল্মে আমরা যা দেখি, তা সাজানো বলে বিশ্বাসের প্রশ্ন আসে না। কিন্তু আজ যা ঘটল, যা দেখলাম, সারা জীবনের তা সঞ্চয়। বলল মেয়েটির স্বামী।
আহমদ মুসা মেয়েটির সিটে বসতে বসতে বলল, বসছি, কিন্তু সব আমি করেছি তা আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত নয়। মানুষ বিপদে পড়লে, বিপদ দেখলে জীবন বাঁচানোর জন্যে অনেক কিছুই করে, সেগুলো তার কৃতিত্ব নয়, সবই আল্লাহর সাহায্য। সুতরাং এ নিয়ে আলোচনা চলে না।
গড বা আল্লাহর প্রতি আস্থা-বিশ্বাস আপনার দেখছি অ্যাবসলিউট! বলল আন্না এলিনার স্বামী যুবকটি।
যখন বিশ্বাস করা হবে, তখন সেটা অ্যাবসলিউট বা সম্পূর্ণই করা উচিত। বলল আহমদ মুসা।
স্যার, একটা প্রশ্ন করি। এই জন্যেই কি মুসলমানদের ধর্মান্ধ বলা হয়? মুসলমানরা অন্ধভাবে ধর্মের আনুগত্য করে। কোন যুক্তির স্থান তাদের কাছে নেই। আন্না এলিনা বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, একনিষ্ঠ বিশ্বাসী হওয়ার মানে ধর্মান্ধতা নয়। মিসেস এলিনা, আপনাদের দুজনের কথাই ধরি, স্ত্রীকে কিছু অ্যাসাইন্ড করা স্বামীর দায়িত্ব, অনুরূপভাবে স্বামীকে কিছু বিষয়ে অ্যাসাইন্ড করার দায়িত্বও স্ত্রীর আছে। স্ত্রী যদি তার কাজ ঠিক মতো সম্পাদন করে আর স্বামীও যদি তার দায়িত্ব যথারীতি সম্পাদন করে, তাহলে কি তাদের এই দায়িত্ব পালনকে অন্ধতা বলা যাবে?
আন্না এলিনা একটু চিন্তা করল। তার মুখে কিছুটা চমৎকৃত হবার প্রকাশ। আহমদ মুসার আনত মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, স্যার, স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের দায়িত্বের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান হতেই হবে। এটাকে কোনভাবেই অন্ধত্ব বলা যাবে না। এই নিষ্ঠার অব্যাহত লংঘন এককে অপরের প্রতি অবিশ্বাসী করে তুলবে, যা তাদের জীবনে বিপর্যয় ঘটাতে পারে, ভেঙেও যেতে পারে সংসার।
মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ মানুষের কাছে তার বিধানের প্রতি এই নিষ্ঠাই চায়। বলল আহমদ মুসা।
আরেকজন মধ্যবয়সী মহিলা বলে উঠল, স্যার আবু আহমদ আব্দুল্লাহ, স্বামী-স্ত্রীর দায়-দায়িত্ব তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং এটা তাদের সংসারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নিষ্ঠার সাথে তাদের দায় দায়িত্ব পালনের মধ্যে ধর্মান্ধতার তো কোন ব্যাপার নেই?
আপনি ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ। বলল আন্না এলিনা।
আহমদ মুসা আবার হাসল। বলল, আল্লাহ মানুষের কাছে কি চায়? এই চাওয়া মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও তাদের সামাজিক জীবনের জন্যই প্রয়োজনীয় কি না?
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর আবার বলল, দেখুন মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সৃষ্টিজগতে মানুষের অবস্থান সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলতে চাই। বিরক্ত হবেন না তো?
অবশ্যই না, বরং যে বিষয়ে আপনি কথা বলতে চাচ্ছেন, সেটা আরও ইন্টারেস্টিং। আপনি বলতে শুরু করুন। আন্না এলিনা বলল।
ধন্যবাদ আপনাকে এবং সকলকে।
বলে একটু থেমে বলা শুরু করল আহমদ মুসা, ইউনিভার্সের। লক্ষ-কোটি স্পেসিসের মধ্যে মানুষ একটি। কিন্তু সমগ্র ইউনিভার্সে। মানুষের স্থান অনন্য। সমগ্র সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, পৃথিবী ও সৌরজগতের সব স্পেসিস, সব ব্যবস্থা মানুষের সেবায় তৎপর। আপনি আপনাদের চারপাশের সব স্পেসিস- পশু-পাখি, তৃণলতা, গাছ-পালা, মাটি, নদী-নালা, সূর্যের আলো, চাঁদের কিরণ- সবকিছু মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করছে। এমনকি সৌরজগতের সব ব্যবস্থাও পৃথিবী ও মানুষের স্বার্থে কাজ করছে। আমাদের সৌরজগত যে গ্যালাক্সির অংশ, সেই মিল্কিওয়ে গ্যালক্সি ও অন্যান্য হাজারো গ্যালাক্সি গোটা ইউনিভার্সের গতি ও ভারসাম্য রক্ষা করছে। যার ফলে আমাদের সৌরজগত এবং আমাদের গ্রহ নিরাপদ থাকতে পারছে এবং তার ফলে মানুষের জীবন ও বংশধারা রক্ষা হচ্ছে। আর…।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। মাঝখান থেকে কথা বলে উঠল মধ্যবয়সী একজন লোক, ধন্যবাদ স্যার, আপানি ইতিমধ্যেই যা বলেছেন, তা একটু হজম হতে দিন। আপনি যা বললেন তার সারাংশ কি এই যে, পৃথিবী, সৌরজগত ও ইউনিভার্স এবং এর মধ্যের সবকিছু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের জন্য কাজ করছে?
হ্যাঁ, আমি এটাই বলেছি। আর আমি এটা বলেছি আমাদের ধর্মগ্রন্থের শিক্ষা থেকে। আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। এজন্যেই আল্লাহ মানুষকে উপাধি দিয়েছেন খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। বলল আহমদ মুসা।
এর দ্বারা আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন স্যার? বলল সেই মেয়ে। আন্না এলিনা।
আল্লাহ মানুষের কাছে কি চান, এই চাওয়া নিষ্ঠার সাথে পূরণ করা, যাকে অনেকে মানুষের অন্ধত্ব বলেন, এটা প্রয়োজনীয় কিনা এ ব্যাপারে আমার যে বক্তব্য, এটা তার ভূমিকার একাংশ।
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলা শুরু করল, আমি যা বললাম তার মূল কথা সমস্ত জগত মানুষের জন্যে কাজ করছে, মানুষের কাজে লাগছে। অন্য কথায় সমস্ত সৃষ্টি ও সৃষ্টিজগতকে মানুষের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের কাজ মানুষের সেবা করা। এটাই তাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এবং এই নির্দেশ নিখুঁতভাবে। পালন করাই তাদের কাজ। এর অন্যথা করার কোন সুযোগ, সামর্থ্য, ইচ্ছা কোনটাই তাদের নেই। কিন্তু মানুষের…!
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। মাঝখান থেকে কথা বলে উঠল আন্না এলিনা। বলল, ওদের শক্তি, সামর্থ্য, সুযোগ থাকতে না পারে, কিন্তু ইচ্ছা থাকবে না কেন?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, বলুন তো এলিনা, সূর্য কি বলবে আমি আলো দেব না কিংবা একই অবস্থানে এভাবে থাকবো না? বাতাসের কি ইচ্ছা করবে মানুষকে অক্সিজেন ও গাছপালাকে হাইড্রোজেন না দেবার কিংবা সে কি বলবে আমি আর বইব না? আমাদের প্ল্যানেট কি বলবে মানুষকে আশ্রয় দেব না, তাদের জন্য ফসল, নদী-নালা, পানি-খনিজ দ্রব্য আমি ধরে রাখবো না? না, বলবে না, বলার ইচ্ছাও করবে না।
ঠিক, ইচ্ছা করবে না, বলবে না। কারণ ঐ কাজগুলোই তো ওদের প্রকৃতি। আন্না এলিনা বলল।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এ প্রাকৃতিক কমান্ডটাই তো আল্লাহ বা স্রষ্টার আদেশ। সমস্ত সৃষ্টি এই আদেশের অধীন, একমাত্র মানুষ ছাড়া। তবে মানুষের দৈহিক ফাংশন সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর নির্দেশের। অধীন। আল্লাহর আদেশের অনুসরণ ছাড়া তাদের নিজস্ব কোন ইচ্ছা নেই। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক স্যার। কিন্তু এই যে বললেন, একমাত্র মানুষ ছাড়া গোটা সৃষ্টি আল্লাহরা স্থির আদেশের অধীন, এমনকি মানুষের দৈহিক ফাংশনও। তাহলে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা থাকল কি করে? আন্না এলিনা বলল।
অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের পার্থক্য হলো, মানুষের ইচ্ছাশক্তি আছে এবং মানুষ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মানুষের সব চিন্তা, পরিকল্পনা, কাজ, সিদ্ধান্ত আসে মানুষের এই ইচ্ছাশক্তি থেকে। মানুষের এই ইচ্ছাশক্তিও আল্লাহর দান। বলল আহমদ মুসা।
আপনার সব কথা বুঝলাম। কিন্তু মানুষের এই স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন কাজ, স্বাধীন সিদ্ধান্তের সাথে মানুষের ধর্মান্ধতা ও ধর্মনিষ্ঠার সম্পর্ক কোথায়? বলল সেই মাঝবয়সী মহিলাটি।
ধন্যবাদ ম্যাডাম, আমি সেই কথাতেই আসছি। দেখা গেল, সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর আদেশের অধীন, এমনকি মানুষের বডি ফাংশনও। কিন্তু মানুষের ইচ্ছা, কাজ, চিন্তা ও সিদ্ধান্তের উপর আল্লাহ তার অনড় আদেশ আরোপ করেননি। আদেশ তিনি আরোপ করেননি বটে, কিন্তু আদেশ তিনি দিয়েছেন। যাতে মানুষের চিন্তা, কাজ ও সিদ্ধান্ত ব্যক্তি ও সমাজের শান্তি, সুস্থতা ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত হয়। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও কেউ কথা বলল না। সকলেরই চোখে মুখে একটা বিস্ময়!
অবশেষে নীরবতা ভাঙল সেই মধ্যবয়সী মহিলাই। বলল, জনাব, আপনার শেষ কথাটা বুঝলাম না। মানুষের চিন্তা, কর্মের উপর গড তার আদেশ বা আইনকে বাধ্যতামূলক করেননি, এটা পরিষ্কার। মানুষ তার ইচ্ছামতোই চিন্তা, কাজ করতে পারে। অন্যদিকে গড় মানুষের চিন্তা ও কাজের উপর আদেশ আরোপ করেননি বটে, কিন্তু আদেশ তিনি দিয়েছেন! এই কথার অর্থ বুঝলাম না।
মানুষের জীবনের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, আল্লাহ তাকে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন, কিন্তু সেই সাথে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন পরিচালনার জন্যে আদেশ-নিষেধও দিয়েছেন। শুরু থেকেই বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধর্মীয় বিধানের আকারে এটা। মানুষের কাছে এসেছে। বলল আহমদ মুসা।
গড-এর আদেশ-নিষেধ এসেছে ধর্মের বিধান আকারে! কেন? সৃষ্টিজগতের অন্য ক্ষেত্রে তো গড-এর আদেশ এসেছে জীবনের অঙ্গীভূত হয়ে, যা অলংঘনীয়। কিন্তু মানুষের চিন্তা ও কাজের ক্ষেত্রে গড-এর আদেশ-নিষেধ ধর্মের বিধান আকারে যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্নভাবে আসবে কেন? এর কি কারণ? বলল সেই মাঝবয়সী মহিলা।
মানুষের চিন্তা ও কাজের ক্ষেত্রে আদেশ যদি জীবন-প্রকৃতির অঙ্গীভূত ও অলংঘনীয় হতো, তাহলে মানুষ অন্যান্য সৃষ্টির মতো রোবট হয়ে যেত। আদেশ পালনের যন্ত্রে পরিণত হতো। আল্লাহর ইচ্ছা তাতে পূরণ হতো না, এই বিশ্বজগত সৃষ্টির লক্ষ্য তাঁর সাধিত হতো না। আল্লাহ তা চাননি বলেই মানুষকে তিনি যেমন সমগ্র সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন এবং দিয়েছেন জ্ঞান, বিচার বুদ্ধি ও সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলো। কিন্তু ওপক্ষের কেউ কথা বলল না। সবাই বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
অবশেষে দাঁড়াল এক ষাটোর্ধ সাদা চুলের একজন লোক। বলল সে, বৎস, আমি সাবাজ গ্যারিক, ইয়েরেভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের একজন অধ্যাপক। তোমার কথাগুলো আমাকে চমৎকৃত করেছে। তোমার বয়সের ছেলেরা এমন সব তত্ত্বের কথা বলে না। তোমাকে ধন্যবাদ। এখন বল, মানুষ সৃষ্টির পেছনে গড বা স্রষ্টার উদ্দেশ্য আর লক্ষ্য কি? এ ব্যাপারে দর্শন, বিজ্ঞান অনেক কথা বলে, কিন্তু তুমি কি বল?
আমার কথা নয় স্যার, সেটা গড-এর কথা। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে বল। প্রবীণ লোকটি বলল।
আল্লাহ তার প্রেরিত বাণী কুরআন শরীফে বলেছেন, আমি জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছি এটা দেখার জন্যে যে, কারা সৎ ও মহৎ কাজ করে এবং কারা মন্দ ও খারাপ কাজ করে, খারাপ পথে চলে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামল। আবার সেই নীরবতা।
সকলের চোখে-মুখেই অস্বস্তি ও জিজ্ঞাসা।
কথা বলল সেই প্রবীণ অধ্যাপকই। বলল, তার মানে এটা একটা পরীক্ষা। কিন্তু কেন?
কারণ এই সেরা সৃষ্টিকে আল্লাহ পুরস্কৃত করতে চান, আরও উন্নত ও উচ্চতম স্থানে প্রমোট করতে চান। আর পরীক্ষায় ফেল করলে শাস্তি দিতে চান। বলল আহমদ মুসা।
তুমি কি পুরস্কারের জন্য হেভেন ও শাস্তির জন্য হেল-এর কথা বলছ? প্রবীণ অধ্যাপক বলল।
আমি বেহেশত ও দোজখ মাত্র এই শব্দ দুটির কথা বলছি না, বলছি মানুষের জন্যে তার মৃত্যু পরবর্তী নতুন জগতের কথা। সব মানুষকেই জন্ম-মৃত্যুর এই গতির জগৎ ছেড়ে চির-স্থিতির এক চিরন্তন জগতে যেতে হবে। সেখানে মানুষের ভাগ্যে জুটবে চিরন্তন পুরস্কার অথবা চিরন্তন শাস্তি। আমাদের এটা আজকের বীজ বপনের জগৎ আর চিরন্তন স্থিতির ঐ জগৎ হলো ফল লাভের জগত। ভালো কাজের ফল হবে ভালো, মন্দ কাজের ফল মন্দ হবে। আমরা ভালো ফল লাভের সেই জগতকে হেভেন বলতে পারি এবং মন্দ ফল লাভের সেই জগতকে হেল বলতে পারি। আহমদ মুসা থামল।
আবার নীরবতা। এবার নীরবতাটা আগের চেয়েও গভীর।
প্রথমে মুখ খুলল এবার আন্না এলিনা।
বলল, যে গড় মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ করলেন, কাজের যে স্বাধীনতা অন্য সৃষ্টিকুলকে দেননি, সে স্বাধীনতা ও মর্যাদা মানুষকে তিনি দিয়েছেন, সেই মানুষকে চিরন্তন শাস্তির মধ্যে ঠেলে দেবেন। কেন?
ম্যাডাম এলিনা, যাকে যত বড় উচ্চ স্থান দেয়া হয়, যাকে যত বেশি শক্তি, মর্যাদা, সুবিধা দেয়া হয়, যার যত বেশি দায়িত্ব হয়ে থাকে, তার ব্যর্থতা, বিচ্যুতি, বিদ্রোহের শাস্তি তত বেশি কঠিন হয়ে। থাকে। দেখুন সৃষ্টিকুলের মধ্যে প্রাণীকুল ও অন্যান্য সৃষ্টির কোন বিচার নেই, তাদের শাস্তিও নেই। কারণ এসব তাদের নিজের জন্যে কিছুই করেনি, বরং তাদের জীবন তারা বিলিয়ে দিয়েছে মানুষের জন্যে। অন্যদিকে মানুষ শুধু নিজের জন্যেই কাজ করেছে, অন্য কোন সৃষ্টির কাজে আসেনি। মানুষ শুধু ভোগ করেই গেছে। বলল আহমদ মুসা।
এবারও আহমদ মুসা থামার পর কেউ কথা বলল না। তারা যেন আহমদ মুসার কথাগুলো গিলছিল। তারপর দেখা গেল সবার চোখে-মুখে প্রবল ভাবান্তর।
মুখ খুলল সেই মধ্যবয়সী মহিলা। বলল, স্যার, আপনি মনে ভয় ধরিয়ে দিলেন কিন্তু মানুষের চিরন্তন এই শাস্তি যে কারণে, সে কারণ কিন্তু স্পষ্ট হলো না। তার ব্যর্থতা, বিচ্যুতি, বিদ্রোহ, দায়িত্বহীনতা কোথায়, কতখানে, কিভাবে? আপনি বলেছেন, মানুষের চিন্তা, কাজ ও জীবন পরিচালনার জন্যে গড়-এর আদেশ রয়েছে। সে আদেশ পালন না করার শাস্তি এত বড় হবে কেন? তিনি তো এ আদেশ বাধ্যতামূলক করে দেননি!
হাসল আহমদ মুসা। বলল, আল্লাহ বাধ্যতামূলক করেননি, কিন্তু তিনি বলে দিয়েছেন, আমি জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি করেছি এটা দেখার জন্যে যে, কে ভালো কাজ করে আর ভালো পথে চলে এবং কে মন্দ কাজ করে আর মন্দ পথে চলে। তিনি আরও বলেছেন, ভালো কাজের জন্যে চিরন্তন পুরস্কার রয়েছে, যে মন্দ কাজ করবে। তার জন্যে রয়েছে চিরন্তন শাস্তি। এক কথায় জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ মানলে পুরস্কার, না মানলে শাস্তি।
এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মানুষেরই তো এটা জানা দরকার। কিন্তু পৃথিবীর কয়জন মানুষ এটা জানে? আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধর্ম অর্থাৎ গড-এর এই আদেশ এসেছে প্রফেটদের মাধ্যমে। সব প্রফেটদের মাধ্যমে আসা আদেশ নিষেধ এক ধরনের নয়। তাহলে কোন্ প্রফেটের মাধ্যমে আসা আদেশ-নিষেধ মানুষ অনুসরণ করবে? বলল মাঝবয়সী মহিলাটি।
ম্যাডাম, আপনার শেষের প্রশ্নের জবাব আমি পরে দেব। আল্লাহর আদেশ-নিষেধের বিষয়টা সব মানুষ জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি মনে করি ধর্মের আদেশ-নিষেধ ও স্রষ্টা সম্পর্কে জানা এবং জানার যাদের সুযোগ আছে, তেমন লোকের সংখ্যা দুনিয়াতে অনেক। ইসলাম, খৃস্টধর্ম ও ইহুদি ধর্ম এই তিন একত্ববাদী ধর্মের অনুসারী এবং এই তিন ধর্মের সাথে পরিচিত মানুষের মোট সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি হবে। তারা মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হলে দুনিয়ার সব মানুষের কাছে আল্লাহর পরিচয় পৌঁছানো কঠিন নয়। বলল আহমদ মুসা।
আমরা খৃস্টান, নিয়মিত চার্চে যাই, কিন্তু আমরাই তো জানি না। গড-এর আদেশ-নিষেধ কি? আমি মনে করি সব খৃস্টানের এই একই কথা হবে। তাহলে আদশে-নিষেধটা কোথায় আছে, কোথায় পাওয়া যাবে। বলল মাঝবয়সী মহিলাটি।
যুক্তিসঙ্গত কথা বলেছেন ম্যাডাম। সত্যিই ইহুদি ও খৃস্টধর্মে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবন পরিচালনার মতো বিস্তারিত আদেশ-নিষেধ নেই। কারণ, ধর্ম দুটি ইতিহাসের যে পরিবেশে প্রচারিত হয়, তখন মানুষের জীবন-জটিলতা ছিল কম, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক প্রয়োজনও ছিল কম। তার উপর প্রফেটের মাধ্যমে আসা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ রেকর্ড ও সংরক্ষণের সুযোগও ছিল না। সে কারণেই কিছু আদেশ-নিষেধ মিসিং হতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই হেসে উঠল আন্না এলিনা। বলল, এইবার আপনি আপনার ধর্মের দিকে ইংগিত করলেন। আপনার ধর্ম একত্ববাদী তো বটেই, পৃথিবীর সব উল্লেখযোগ্য ধর্মের মূধ্যে আপনাদের ধর্ম সর্বকনিষ্ঠ এবং বলা হয়, গড-এর কাছ থেকে আসা বাণী আপনার ধর্মগ্রন্থ কুরআনে এবং প্রফেটের উপদেশ নির্দেশ অটুট অবস্থায় আছে।
আমি আমার ধর্মের দিকে ইংগিত করতে চাচ্ছি না। আমি শুধু স্রষ্টা মানুষের জন্যে যে জীবন পরিচালনা পদ্ধতি দিয়েছেন, তার সম্পর্কেই কিছু বলছিলাম। আপনি সর্বকনিষ্ঠ ধর্ম ইসলামের কথা বলেছেন। সৌভাগ্যক্রমে সেটা আমার ধর্ম বটে। কিন্তু আল্লাহর আদেশ-নিষেধের বাহন ধর্মের ধারাবাহিকতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ইসলামের কথা আসতই। ধর্মের ধারাবাহিকতায় ইসলাম সর্বশেষ ও সর্বকনিষ্ঠ এবং প্রফেটদের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ প্রফেট হযরত মোহাম্মাদ সা.। আর সত্য কথা হলো, মানুষের জন্যে ধর্ম পাঠানো এবং প্রফেট পাঠানোর যে মিশন তা এই শেষ ধর্ম ও শেষ প্রফেটে এসে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আহমদ মুসা বলল।
প্রবাদের সেই কথার মতো কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে। যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটল দেখছি। কোথায় আলোচনার বিষয় ছিল ধর্মান্ধতা, ধর্মের বিধি-বিধানের অন্ধ আনুগত্য, সেখানে আমরা স্রষ্টা, সৃষ্টিজগৎ, পরকাল, ধর্ম ও প্রফেট সব নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু এ থেকে আমরা উপকৃত হয়েছি। স্যারকে ধন্যবাদ, চিন্তার এক দিগন্ত আমাদের কাছে খুলে গেছে। এ বিষয়টাও আমাদের। কাছে পরিষ্কার হয়েছে, আমরা মানি আর না মানি, স্রষ্টার আদেশ নিষেধ সর্বকনিষ্ঠ ধর্ম ইসলামে ইনট্যাক্ট থাকাটাই দেখা যাচ্ছে। যুক্তিসঙ্গত। গড-এর আদেশ-নিষেধের সন্ধানে ইসলামের কাছেই যেতে হবে। অবশ্যই এটা পার্সোনাল সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমরা। আমাদের জিজ্ঞাসায় ফিরে আসছি। গড-এর আদেশ একনিষ্ঠ অনুসরণকে অন্ধত্ব বা ধর্মান্ধতা বলা যাবে কি না? বলল সেই মাঝ বয়সী মহিলাটি।
স্যার যে আলোচনা করলেন তাতে দেখা গেল, গোটা সৃষ্টি। জগৎ, মানুষের বডি ফাংশনসহ সবকিছু গড-এর আদেশের অনড় অনুসরণ করে থাকে। চিন্তা ও কর্মে মানুষকে গড যে স্বাধীনতা দিয়েছেন, তার জন্যেও রেখেছেন আদেশ-নিষেধ যা মানুষ গ্রহণ করতেও পারে, আবার নাও করতে পারে। তবে অনুসরণ না করলে সে পথভ্রষ্ট হবে এবং এর জন্যে পরকালে শাস্তি পাবে অর্থাৎ চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ পালন করা মানুষের শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্যেই প্রয়োজন। এই গোটা বিষয় সামনে রাখলে ধর্মনিষ্ঠা বা ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসরণ ভারচু অর্থাৎ পুণ্য হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মান্ধতা খারাপ অর্থে ব্যবহৃত একটা শব্দ। না বুঝে, না শুনে, না জেনে একটা খারাপ কিছুকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা বুঝানো হয় এই শব্দ দ্বারা। ধর্মের নিষ্ঠাপূর্ণ অনুসরণ অন্ধত্বও নয়, ধর্মান্ধতাও নয়। বলল আন্না এলিনা।
ধন্যবাদ ম্যাডাম এলিনা। আপনি সুন্দর বলেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে। যে প্রশ্ন উঠেছিল তার জবাব আপনি দিয়ে দিলেন। বলল আহমদ মুসা।
একটা জবাব হয়তো হলো, কিন্তু প্রশ্ন আরও আছে। সিনেমার হিরোর চেয়ে বড় হিরো হিসাবে আমরা যে আপনাকে দেখলাম, সেটা আপনার আসল পরিচয়, না এই যে সেন্ট-এর মতো কথা। বললেন, সেটা আপনার আসল পরিচয়? আন্না এলিনা বলল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই সময় কম্পার্টমেন্টের দেয়ালে সেট করা টিভি অন হয়ে গেল। টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা লেখা : ব্রেকিং নিউজ।
রেলগাড়ির কম্পার্টমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ ও ঘোষণা শোনার জন্য টিভি সার্ভিস রয়েছে। যখন প্রয়োজন হয় তখন টিভিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হবার ব্যবস্থা রয়েছে।
সবার দৃষ্টি ছুটে গেল টিভি স্ক্রিনের দিকে।
টিভি স্ক্রিনে ভেসে এল একজন সংবাদ পাঠকের ছবি। শোনা গল তার কণ্ঠে ব্রেকিং নিউজটা :
আর্মেনীয় পুলিশ আজ দুই ঘটনায় আটজন সন্ত্রাসীকে আটক করেছিল, পুলিশ কাস্টোডি থেকে তাদের ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া। হয়েছে। আটজন সন্ত্রাসীর মধ্যে চারজনকে সানাহিন শহরের অদূরে চলন্ত ট্রেনে এক সন্ত্রাসী ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়। অন্য চারজনকে স্পাইটাক-এর কাছে ট্রেনেই অনুরূপ ঘটনায় আটক করা হয়েছিল। ওদের প্রায় সবাই গুলিতে আহত ছিল।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসার জন্যে চারজনকে সানাহিন হাসপাতালে, অন্য চারজনকে স্পাইটাক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। উভয় ক্ষেত্রেই আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত একদল বেপরোয়া সন্ত্রাসী হাসপাতালে। হামলা চালিয়ে দুই ঘটনায় চারজন পুলিশ ও দশজন হাসপাতাল। সিকিউরিটিকে হত্যা করে আসামীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনা এতটাই আকস্মিক ও দ্রুত ঘটে যায় যে, মাত্র দুশ গজ দূরে পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও তারা কোন সাহায্যে আসতে পারেনি।
হাসপাতাল সূত্রে প্রকাশ, উভয় ঘটনায় হামলাকারী সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের সম্মুখ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে, কিন্তু আহত সন্ত্রাসীদের নিয়ে পালিয়ে যায় হাসপাতালের পেছন দরজা দিয়ে। জানা গেছে, পেছন দরজার সামনে দুটি গাড়ি তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। হাসপাতাল সূত্রের মতে সন্ত্রাসীরা যেভাবে হাসপাতালে ঢুকেছে, যে দ্রুততার সাথে হাসপাতালের বেড থেকে তাদের সাথীদের তুলে নিয়ে যেভাবে পালিয়েছে, তাতে এটা পরিষ্কার হাসপাতালের সবকিছু তাদের নখদর্পণে ছিল, তারা জানত যে তাদের সাথীরা কে কোন্ বেডে আছে, পালাবার সবচেয়ে সহজ পথ কোটা হতে পারে। এই চিন্তা থেকে একটা সূত্র বলছে, হাসপাতাল থেকে, এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকেও কারও কারও সাহায্য তারা পেয়েছে। অবশ্য পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সম্ভাবনার কথা অস্বীকার করেছেন।
ঘটনা দুটি সর্বমহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। পুলিশ প্রধানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে।
ব্রেকিং নিউজ বন্ধ হয়ে গেল। ট্রেনের দেয়ালের টিভি স্ক্রিনের আলো নিভে গেল।
কম্পার্টমেন্টের সবাই উদ্বেগের সাথে নিউজ শুনছিল।
নিউজ শেষ হবার সাথে সাথেই তাদের চোখে-মুখে বিষাদ নেমে এল। তারা সকলেই সন্ত্রাসীদের দেখেছে। তাদের নৃশংসতা ও সন্ত্রাসী চেহারা দেখেছে। দেখেছে সবাই, কিভাবে তাদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আটক করা হয়েছে।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে কোন ভাবান্তর নেই। সে বিস্মিত হয়নি, বরং নিশ্চিত হয়েছে যে, ওরা বড় ও খুব করিতকর্মা একটি গ্রুপ। প্রশাসন ও সমাজ-জীবনের নানা স্তরে ওদের প্রভাব রয়েছে। আর্মেনিয়ায় পা দিয়েই এমন একটা গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেল, এটা ভেবে খুশি হলো আহমদ মুসা।
কম্পার্টমেন্টের বিস্মিত সকলের দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখের উপর এসে নিবদ্ধ হলো। সবচেয়ে বিব্রত অবস্থা আন্না এলিনার। তার বাবা পুলিশ প্রধান, আর পুলিশের ব্যর্থতার কারণেই সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে পারল। অনেকটাই শুকনো কণ্ঠে বলল, স্যরি স্যার, আপনি কষ্ট করে যাদের ধরলেন, পুলিশ তাদের ধরে রাখতে পারল না। বিষয়টাকে খুব স্বাভাবিক হিসাবেই দেখা উচিত। ঘটনাটা এতই আকস্মিক ছিল যে, কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই তা শেষ হয়ে। গেছে। পুলিশ কিংবা সিকিউরিটি কারও কিছুই করার ছিল না।
আপনি এই কথা বলছেন? ঐ দুই ঘটনাস্থলে আপনার মতো। কেউ থাকলে কি ঘটত বলুন তো? আকস্মিকতার অজুহাত নিশ্চয় উঠত না? আন্না এলিনা বলল।
কি ঘটত আমি জানি না। কিন্তু যারা বা যে গ্রুপটি হামলা করেছিল, তারা ভয়ংকর এবং খুবই দক্ষ। তারা আটঘাট বেঁধে অভিযান চালিয়েছিল। দুই ঘটনায় যা ঘটেছে তার জন্যে কারও দোষ আমি দেখছি না ম্যাডাম। বলল আহমদ মুসা।
হতে পারে। কিন্তু আমি ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত! এই সন্ত্রাসীদের যে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, সেখানে দুই দুই করে চারজন মাত্র পুলিশ রাখা হবে তা মেনে নেয়া যায় না। বলল সেই মাঝবয়সী মহিলাটি।
এ প্রসঙ্গ থাক ম্যাডাম। আমরা সামনের সময় নিয়ে আলোচনা। করতে পারি। বলল আহমদ মুসা।
সামনের সময় কেন? বুঝলাম না স্যার। বলল আন্না এলিনা।
আমার অনুমান মিথ্যা না হলে ওরা আরেকটা হামলা চালাবে। বলল আহমদ মুসা।
ওরা মানে সন্ত্রাসীরা? কোথায় হামলা চালাবে? কেন? আন্না এলিনাই আবার বলল।
এবার টার্গেট প্রধানত আমি। বলল আহমদ মুসা।
প্রধান টার্গেট আপনি? আর অপ্রধান টার্গেট? আন্না এলিনা বলল।
আমি নিশ্চিত নই। সুতরাং না বলাই ভালো। বলল আহমদ মুসা।
কি করে বুঝলেন আবার ওরা হামলা চালাতে পারে? আন্না এলিনাই বলল।
যতটা ওদের বুঝেছি, ওরা পরাজয় বা ব্যর্থতা মেনে নিতে রাজী নয়। আমাকে ধরে নেয়া বা মেরে ফেলার তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা মুছে ফেলার জন্যে আবার আক্রমণে তারা আসবে। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু আপনাকে দেখে তো কিছুই মনে হচ্ছে না। এই অবস্থায় মানুষের উদ্বেগ-আতংক থাকা স্বাভাবিক। সেই ভাব তো আপনার মধ্যে দেখছি না। আন্না এলিনার স্বামী এরিক অ্যালেন বলল।
এরিক অ্যালেনের কথা শেষ হতেই আন্না এলিনা আহমদ মুসাকে বলল, ইনি আমার স্বামী তা আগেই জেনেছেন। এর নাম এরিক অ্যালেন। ইয়েরেভেন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির (EUST) অধ্যাপক।
আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। বলে আহমদ মুসা। হ্যান্ডশেকের জন্যে এরিক অ্যালেনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনি ইয়েরেভেন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির অধ্যাপক সেটা আগেই বুঝেছিলাম।
কিভাবে?এরিক অ্যালেন বলল।
কোট পিন-এর মনোগ্রাম দেখে। বলল আহমদ মুসা।
এতো ছোট জিনিসও আপনার নজরে পড়েছে? কোট পিনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অংকিত মনোগ্রাম দেখেই বুঝেছেন আমি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তা কি করে বুঝলেন? এরিক অ্যালেন বলল।
বিশ্ববিদ্যালয়টির এই কোট পিন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করতে পারেন না। বলল আহমদ মুসা।
এ তথ্যও আপনি জানেন? বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল এরিক অ্যালেন।
সত্যিই অবাক ব্যাপার! আন্না এলিনাও বলল।
দেখুন, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অনেক সময় হঠাৎ করেই এমন তথ্য জানা হয়ে যায়। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু স্যার, এর আগে সন্ত্রাসীদের জ্যাকেট-শার্টে মেকার কোম্পানির মনোগ্রাম সামান্য পাল্টিয়ে লাগানো হয়েছে, এটাও আপনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এটাও নিশ্চয় হঠাৎ জানার ফল নয়? আন্না এলিনা বলল।
প্লিজ ম্যাডাম, এসব এখন থাক। আর মিনিট দশেকের মধ্যেই কিন্তু আমরা ইয়েরেভেন পৌঁছে যাব।
গম্ভীর হলো আন্না এলিনা। তাকাল স্বামী এরিক অ্যালেনের দিকে। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, আপনি কি ভাবছেন? আপনার আশংকার কথা পুলিশকে জানানো উচিত নয় কি? আপনি বললে আমি বাবাকে বলতে পারি।
না তার দরকার হবে না। তবে আপনি আপনার বাবাকে বলতে পারেন, স্টেশন প্ল্যাট ফরমের যে জায়গাটায় এই কম্পার্টমেন্ট দাঁড়াবে, সে জায়গায় যেন পুলিশ মোতায়েন থাকে, যাতে আপনাদের ট্রেন থেকে নামা নিরাপদ হয় এবং স্টেশন থেকে চলে যাওয়াও আপনাদের নিরাপদ হয়। বলল আহমদ মুসা।
আপনার কথা ভাবছেন না কেন? আপনিই না ওদের টার্গেট? এরিক অ্যালেন বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছার মধ্যে কি হয় বলতে পারছি না।
তার মানে? মুখ শুকনো করে বলল আন্না এলিনা।
আমার মন ও যুক্তি দুটোই বলছে স্টেশন পৌঁছা পর্যন্ত ওরা সময় দেবে না।
বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল দ্রুত কণ্ঠে এরিক অ্যালেনকে, ট্রেনটা যান্ত্রিক কারণে থেমেছিল কতক্ষণ আগে?
এরিক অ্যালেন হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার মনে হয় এখন থেকে পনের মিনিট আগে।
এরিক অ্যালেনের কথার রেশ বাতাসে মিশবার আগেই ঠিক মাথার উপরেই ট্রেনের ছাদে ছোট্ট একটা শব্দ হলো। তার সাথে সাথেই একটা কিছু ট্রেনের মেঝেতে পড়েই তা বিস্ফোরিত হলো।
বিস্ফোরিত হবার মুহূর্তেই আহমদ মুসা চিৎকার করে উঠল, নিশ্বাস বন্ধ করে সবাই শুয়ে পড়ুন।
আহমদ মুসাও শ্বাস বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। সে শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে। ট্রেনের ছাদের যেখান থেকে বম্ব জাতীয় কিছু পড়েছিল সে স্থানটা ছিল তার চোখের সামনে।
মেঝেতে পড়েই আহমদ মুসা আরেকটা কাজ করল। সেটা হলো ওদের কাছ থেকে কুড়িয়ে রাখা রিভলবারটা জ্যাকেটের পকেট থেকে নিয়ে ঘাড়ের সাথে কলারের নিচে রাখল।
ট্রেনের কম্পার্টমেন্টটাতে ভয়ংকর গ্যাস বোমা বা ডেথ বম্ব-এর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। মাত্র দুতিন সেকেন্ড সময়ও গ্যাস যদি কারও নাক বা মুখ দিয়ে নিশ্বাসের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে তাহলে সেটাই একজনের মৃত্যুর জন্যে যথেষ্ট। তবে ভয়াবহ এ বিষের কার্যকারিতা এক মিনিটের বেশি থাকে না। গ্যাসীয় বিষের ঘনত্ব। কমে গেলেই বাতাসের অক্সিজেন হাইড্রোজেন বিষের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। সন্ত্রাসীরা ট্রেনের ছাদ কেটে প্রথমে নিচে গ্যাস বোমা বা ডেথ বম্ব ফেলেছিল। মহাক্রুদ্ধ সন্ত্রাসীরা চেয়েছিল টার্গেট আহমদ মুসাসহ কম্পার্টমেন্টের সবাইকে হত্যা করতে, যাতে পুলিশ কখনও তাদের লোকদের গ্রেপ্তার করতে আর সাহস না করে।
আহমদ মুসা গ্যাস বোমাটিকে ক্লোরোফরম বোমা বলে মনে করেছিল। কিন্তু শরীরের চামড়ায় যখন গ্যাসের স্পর্শ পেল, তখন আঁৎকে উঠল সে। বুঝল, ওটা মৃত্যু বোমা। সঙ্গে সঙ্গে আতংকিত হয়ে উঠল এই ভেবে যে, অন্যদের অবস্থা কি? তারা কি সাবধান হতে পেরেছে? না মৃত্যু…! আর ভাবতে পারল না আহমদ মুসা। চোখ বন্ধ করে সংজ্ঞাহীনের মতো পড়ে রইল।
পলপল করে সময় বয়ে গেল।
মিনিট দুয়েক পরেই আস্তে আস্তে নিশ্বাস নিতে শুরু করেছে। আহমদ মুসা।
কারও কোন সাড়া-শব্দ নেই। নিশ্চয় সবাই মারা পড়েছে।
উপর থেকে এই কথা ভেসে এল। আহমদ মুসা পলকের জন্যে চোখ খুলে দেখল, ছাদের সেই কাটা অংশ থেকে কথা ভেসে আসছে।
উপর থেকে আসা কণ্ঠটি থামলে আরেকটি কণ্ঠ ভেসে এল। বলল, চল, তাহলে আমরা সবাই নিচে নেমে যাই, শুধু একজন উপরে থাকবে নাইলনের মইটি ঠিকমত আটকে থাকছে কিনা তা পাহারা দেবার জন্যে।
আমাদের টার্গেট লোকটাকে আমরা কি করে চিনব। মৃত হলেও তাকে তো ধরে নিয়ে যাবার কথা। বলল আরেকজন।
অসুবিধা হবে না। ভুলে গেলে তোমরা, কম্পার্টমেন্টে মাত্র একজনই অশ্বেতাংগ এশিয়ান আছে। সেই আমাদের টার্গেট। বলল দ্বিতীয় জন।
কথা শেষ করেই সে আবার বলে উঠল, সময় হাতে আছে মাত্র সাত মিনিট। ইয়েরেভেন টানেলে ঢোকার আগে ট্রেন স্লো হবে, ওখানেই আমাদের নেমে যাবার কথা। এস সবাই নেমে পড়ি।
উপরের কথা বন্ধ হয়ে গেল।
সবাই নামছে নাইলনের মই বেয়ে একসাথে।
আহমদ মুসা একেই মহাসুযোগ হিসেবে দেখল। কম্পার্টমেন্টের কেউ জীবিত আছে কিনা, তার জানা নেই। এতগুলো লোককে ওরা নৃশংসভাবে মেরেছে। ওদের কোন সুযোগ দেয়া যায় না।
ওরা মাঝ পথ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ইচ্ছা করলে ওরা এখন মেঝেতে লাফিয়েও পড়তে পারে।
আহমদ মুসা দ্রুত রিভলবার নিয়ে শুয়ে থেকেই পরপর পাঁচটা গুলি করল।
পাঁচজনই ছাদ থেকে ইট পড়ার মতো পড়ে গেল মেঝেতে।
আহমদ মুসা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। বিড়ালের মতো আস্তে আস্তে এগোলো। তার দৃষ্টি উপরে ছাদের দিকে। তার হাতে উদ্যত রিভলবার।
ট্রেনের ছাদের কাটা অংশ সোজাসুজি তার নজরে এল। কম্পার্টমেন্টের উজ্জ্বল আলো অনেকটাই টর্চের আলোর মতো কাটা অংশ দিয়ে রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করছে।
হঠাৎ সেই কাটা অংশের উপর অন্ধকার নেমে এল, যেন একটা ঢাকনা কাটা অংশের উপর এসে বসল।
একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল আহমদ মুসার মনে। সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসার রিভলবার উপরে উঠল। ছুটে গেল একটা গুলি রিভলবার থেকে।
আঁ… করে একটা শব্দ উঠল উপর থেকে। তার সাথে সাথেই একজন মানুষের দেহ আছড়ে পড়ল নিচে।
আহমদ মুসা দেখল গুলি লেগেছে একদম তার বুকে।
আহমদ মুসা তাকাল অন্য পাঁচজনের দিকে।
ওদের চারজনের নিশ্চল দেহ। ওদের প্রত্যেকেরই বুকে গুলি লেগেছে। মাত্র একজন কাতরাচ্ছে। তার পাঁজরে গুলি লেগেছে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াল।
বিষ বোমার ফলে এদিকে কি ঘটেছে, এখনও সে জানে না।
দুধাপ এগিয়ে আন্না এলিনাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ডাকল, মি. অ্যালেন, ম্যাডাম এলিনা।
দুজনেই ধীরে ধীরে উঠে বসল। ভীত, উদ্বিগ্ন বিধ্বস্ত তাদের চেহারা। উঠে বসেই আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আন্না এলিনা বলল, স্যার, আপনি সুস্থ আছেন, আপনি ভালো আছেন?
আল্লাহর হাজার শোকর আপনারা বেঁচে আছেন। প্লিজ, একটু দেখুন অন্যদের কি অবস্থা। বলল আহমদ মুসা।
এই সময় অধ্যাপক সারজি গ্যারিক ও মাঝবয়সী সেই মহিলা উঠে দাঁড়াল। তারা প্রায় একসাথেই বলে উঠল, আপনি বলার সাথে সাথেই আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিলাম। ওটা কি গ্যাস বোমা ছিল? নাকি ক্লোরোফরম?
আহমদ মুসা কিছু বলার আগে আন্না এলিনারা বলল, আমরাও আদেশের সাথে সাথেই শ্বাস বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিলাম।
আল্লাহ আপনাদের বাঁচিয়েছেন। অন্যদের অবস্থা কি চলুন দেখি। বলল আহমদ মুসা।
আন্না এলিনারা দেখা শুরু করেছিল।
সবাই মিলে সব যাত্রীকেই পরীক্ষা করল। তাদের সামনে এল, ভয়াবহ এক দৃশ্য। আহমদ মুসার ৫ জন ছাড়া সব যাত্রীই বিষ বোমায় মৃত্যু বরণ করেছে।
ও গড! বলে ধপ করে সিটে বসে পড়ল এরিক অ্যালেন। বলল, তার মানে আমরাও নিশ্বাস বন্ধ না করলে ওদের মতো লাশ হয়ে যেতাম?
ওদিকে অধ্যাপক সারজি গ্যারিক ছুটে এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল, ভয়াবহ এক মৃত্যুর হাত থেকে আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। গড় ব্লেস ইউ।
স্যার, আপনি কি করে বুঝেছিলেন যে ওটা ডেথ বোমা? কি করতে হবে এর মোকাবিলায়? কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বলল আন্না এলিনা। আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
বোমার সাইজ ও বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনে বুঝেছিলাম। আমি প্রথমে ওকে ক্লোরোফরম বোমা বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু পরে বিস্ফোদিত গ্যাসের স্পর্শ যখন পেলাম, তখন বুঝলাম ওটা ডেথ বোমা, ক্লোরোফরম বোমা নয়।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবার বলে উঠল, ম্যাডাম এলিনা, রেলপুলিশ নিশ্চয় এখনি আসবে, তবু আপনি ঘটনাটি আপনার বাবাকে জানিয়ে স্টেশনে আপনাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাটা করুন।
ঠিক আছে স্যার, আমি এখনি টেলিফোন করছি। কিন্তু শর্ত হলো, আপনি আমাদের সাথে নামবেন এবং আমাদের সাথে যাবেন। আন্না এলিনা বলল।
হ্যাঁ স্যার, এলিনা ঠিক বলেছে। আপনি আমাদের সাথে যাবেন। বিপদ আমাদের চেয়ে আপনার বেশি। আমরা আপনাকে ছাড়তে পারি না। এই ঘটনার পর ওরা পাঁচজন লোক হারিয়ে ভয়ানক হিংস্র হয়ে উঠবে আপনার উপর। আপনি আমাদের সাথে চলুন। তারপর পরামর্শ করে যা হয় করা যাবে। এরিক অ্যালেন বলল।
ধন্যবাদ মি. অ্যালেন। ইয়েরেভেনে গিয়ে কোথাও না কোথাও আমাকে উঠতে হতো। আপনাদের মেহমান হতে আমার আপত্তি নেই। তবে শর্ত একটাই, আমার পরিচয় সম্পর্কে কোন কথা প্রচার করা যাবে না। বলল আহমদ মুসা।
আমি রাজি এ শর্তে। এরিক অ্যালেন বলল।
যিনি পরিচয় গোপন রাখতে চান, তার পরিচয় গোপন থাকাই দরকার। আমিও রাজি স্যার। আন্না এলিনা তার মোবাইলে কল, তৈরি করছিল।
আন্না এলিনা মোবাইলে পেয়ে গেল তার বাবা আর্মেনিয়ার পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিককে। সে তার বাবাকে তার কম্পার্টমেন্টে এই মাত্র যা ঘটে গেছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ জানাল। জানাল ট্রেনের ছাদ কেটে সন্ত্রাসীদের অভিযান ও কম্পার্টমেন্টে ডেথ বোমা নিক্ষেপ সম্পর্কে। প্রায় এক ডজনের বেশি লোকের ভয়ংকর মৃত্যু ও তারা পাঁচজন বেঁচে যাওয়ার কাহিনী সম্পর্কে সে বাবাকে বলল। নাইলনের ল্যাডারে ৫ জন সন্ত্রাসীর কম্পার্টমেন্টে প্রবেশের চেষ্টা। এবং তারা ৫ জনসহ ৬ জন সন্ত্রাসীর মৃত্যুর ঘটনা জানাল সে। স্টেশনে নিরাপত্তার জন্যে আহমদ মুসা যে পরামর্শ দিয়েছে, সে কথাও সে তার বাবাকে জানাল। সব শেষে বলল, বাবা মিরাকল এই ইনি দুইবার আমার জীবন বাঁচালেন।
ভয়ংকর এক কাহিনী শোনালে আমাকে এলি। বোমার আকার ও শব্দ শুনে যুবকটি কি করে পেল বোমার পরিচয়? ছয়জনকে সে গুলি করে মেরেছে? তাকে মোবাইলটা দাও তো, একটু কথা বলি। বলল আন্না এলিনার বাবা আর্মেনিয়ার পুলিশ প্রধান অ্যারাম। আড্রানিক।
মুখের কাছ থেকে মোবাইল সরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, বাবা আপনার সাথে কথা বলবেন।
বলে আন্না এলিনা মোবাইলটা আহমদ মুসার হাতে দিল।
মোবাইল হাতে নিয়ে কল স্টার্ট করে আহমদ মুসা বলল, ওয়েলকাম স্যার, আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত।
ধন্যবাদ ইয়ংম্যান। আমি আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনাকে। এক যাত্রায় দুদুবার, আপনি আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছেন। দ্বিতীয়বার আমার জামাতাসহ আরও চারজনকে বাঁচিয়েছেন। বলল আন্না এলিনার বাবা পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক।
স্যার, এ কৃতিত্ব ঈশ্বরের। আমি নিমিত্ত মাত্র ছিলাম। আপনার শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ। আহমদ মুসা বলল।
এ ধরনের অসাধারণ কাজ যারা করে, তারা প্রশংসা পেতেও ভালোবাসে। কিন্তু দেখছি আপনি তাদের থেকে ভিন্ন। প্রশংসার। মতো বিনিময়েরও আপনি প্রত্যাশী নন। আমি সত্যি খুশি হয়েছি। এলি বলল, আপনি আমাদের মেহমান হতে রাজি হয়েছেন। আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। বলল আন্না এলিনার বাবা।
স্যার, আপনি ম্যাডাম আন্না এলিনার পিতা। আমি বয়সে আপনার সন্তানের মতোই হবে। আমাকে আপনি বলে লজ্জা দেবেন না প্লিজ। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ ইয়ংম্যান এই শুভেচ্ছার জন্যে। ঈশ্বর তোমর সহায়। হোন, তুমি দীর্ঘজীবী হও। ধন্যবাদ। রাখছি। বাই।
বাই! বলে আহমদ মুসা মোবাইলটি আন্না এলিনার হাতে ফেরত দিল।
মোবাইল নিতে নিতে আন্না এলিনা বলল, নিমন্ত্রণ কিন্তু এবার পাকাপোক্ত হলো। বাবাও বলেছেন আপনাকে। স্যার, আপনাকে পেয়ে আর একজনও খুব খুশি হবে।
কেন? কে? আহমদ মুসার কৌতূহলী প্রশ্ন।
আমার বড় বোন ইভা নারিন। সে ডাকসাইটে গোয়েন্দা অফিসার। কুফু-কারাতে ব্ল্যাক বেল্টধারী। অপরাধীদের যম সে। প্রফেশন ছাড়া কোন দিকে তার চোখ নেই। বিয়ের জন্যেও সে এ পর্যন্ত সময় দেয়নি। আপনার সব কাহিনী হয় সে জেনেছে, নয় তো বাবা তাকে বলেছে। তার সাক্ষাতের জন্যে আমি উন্মুখ হয়ে আছি স্যার। এবার তাকে বলতে পারব, তুমি যার কাছে শিশু এমন লোকও দুনিয়াতে আছে। খুশিতে মুখ রাঙিয়ে বলল আন্না এলিনা।
না ম্যাডাম, আর্মেনীয় পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সম্পর্কে অনেক ভালো কথা আমি পড়েছি। সোভিয়েট গোয়েন্দাদের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা জিতেছে। বলল আহমদ মুসা।
ট্রেন স্লো হয়ে থেমে গেল।
কম্পার্টমেন্টে প্রবেশ করল সেই পুলিশ অফিসার তার কয়েকজন সাথীকে নিয়ে।
ঢুকেই সামনে গুলিবিদ্ধ স্তূপীকৃত লাশ দেখে মাথার হ্যাট খুলে হাতে নিল।
লাশের দিক থেকে চোখ তুলে আহমদ মুসাকে দেখেই বলল, স্যরি স্যার, আপনার ধরিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের আমরা ধরে রাখতে পারিনি। তারই হয়তো ফল এই ঘটনা।
একটু থেমেই পুলিশ অফিসারটি আবার বলল, স্যার, কম্পার্টমেন্টের অবশিষ্ট লোকরা কি সংজ্ঞাহীন?
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই আন্না এলিনা বলল, আমরা পাঁচজন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এই কম্পার্টমেন্টে। আমরাও বেঁচে থাকতাম না, যদি স্যার আমাদের নিশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে পড়তে না বলতেন।
বোমার শব্দ আমরা পেয়েছি। ওটা তাহলে পয়জন বম্ব ছিল? বলল পুলিশ অফিসার।
স্যার তো তাই বললেন। বলল আন্না এলিনা।
ও গড! কি নিষ্ঠুরতা! কি ভয়াবহ ঘটনা!
বলেই আহমদ মুসার দিকে তাকাল পুলিশ অফিসার। বলল, আপনার কাছে আমরা, আমাদের গোটা দেশ কৃতজ্ঞ থাকবে। স্যার।
কথা শেষ করেই সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে বলল, কাজ শুরু করে দাও তোমরা।
পুলিশ অফিসারও একটা কল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
এ সময় আন্না এলিনার মোবাইল বেজে উঠল।
কলটা ধরেই মুখ একটু সরিয়ে নিয়ে বলল, আপার টেলিফোন।
কথা বলার জন্যে আন্না এলিনা একটু দূরে সরে গেল।
.
৫.
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে একটুক্ষণ পায়চারি করে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা।
ফ্লাওয়ার ভাসে একগুচ্ছ গোলাপ রেখে একজন অ্যাটেনডেন্ট বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে।
আহমদ মুসা ডাকল তাকে।
লোকটি সামনে এসে একটা ছোট্ট বাও করে আর্মেনীয় ভাষায় বলল, কোন আদেশ স্যার?
মোটামুটি আর্মেনীয় ভাষা বলতে পারে আহমদ মুসা। বলল, আদেশ নয়, জিজ্ঞাসা আছে। এত টাটকা ফুল কোথায় পেলে?
এ বাড়ির নিজস্ব বাগানের ফুল। বলল অ্যাটেনডেন্ট লোকটি।
বাড়িতে ফুল বাগান আছে? তাহলে তো বড় বাড়ি, অনেক জায়গা নিয়ে। রাতে এসেছি তো বুঝতে পারিনি। আহমদ মুসা বলল।
অনেক বড় বাড়ি স্যার। বাড়ির তিন দিকেই বলা যায় বাগান। একটা ফুল বাগান, একটা ফল বাগান এবং একটা লেকের মতো আছে, লেকের চার পাশেও গাছ-গাছালি আছে। লেকে মাছও আছে প্রচুর। এটা সরকারি নয় স্যার, এটা স্যারের নিজস্ব বাড়ি।
তোমার স্যার মানে অ্যারাম আড্রানিক সাহেবের পরিবার কি অনেক বড়? আহমদ মুসা বলল।
বড় নয় স্যার। স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে তাঁর পরিবার। তবে আমাদেরকে তিনি পরিবারের সদস্য হিসেবেই দেখেন। সরকারি স্টাফ বাদ দিলে আমাদের সংখ্যাই হবে ডজনের বেশি। বলল অ্যাটেনডেন্ট লোকটি।
অ্যারাম আভ্রানিক সাহেবের সরকারি মুখপাত্র, পিএস, অ্যাটেনডেন্টরা কি এই বাসাতেও বসেন? আহমদ মুসা বলল।
ওদের শিফটিং ডিউটি। রাতেও ওদের থাকতে হয়। তাছাড়া ম্যাডামেরও পিএ, এপিএস আছেন। বলল লোকটি।
ম্যাডাম মানে অ্যারাম আড্রানিকের স্ত্রী? আহমদ মুসা বলল।
না স্যার। স্যারের বড় মেয়ে নারিন ম্যাডাম। উনিও পুলিশের বড় অফিসার। খুব নাম তাঁর। বলল অ্যাটেনডেন্ট লোকটি।
কেমন নাম? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
অনেক সমস্যার তিনি সমাধান করেছেন। বড় বড় ক্রিমিনালদের তিনি ধরেছেন। বলল অ্যাটেনডেন্ট লোকটি।
কিন্তু ওর বোন তো ট্রেনে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তোমরা এটা শুনেছ তো? আহমদ মুসা বলল। তার ঠোঁটে হাসি।
শুনেছি স্যার। আপনি ছোট ম্যাডামকে দুবার বাঁচিয়েছেন, তার জীবন রক্ষা করেছেন। আপনার সম্পর্কে নারিন ম্যাডাম কি বলেছেন জানেন? ট্রেনের ঘটনার পর ছোট ম্যাডামের খবরটা যখন এল, নারিন ম্যাডাম তখন কেঁদে ফেলেছিলেন এবং বড় সাহেবকে বলেছিলেন, বাবা, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও, এক অসাধারণ লোক ঈশ্বর ঐ কম্পার্টমেন্টে রেখেছিলেন। ট্রেনের তিনটি ঘটনার পর সবকিছুর পর্যালোচনা থেকে আমি নিশ্চিত বাবা, আমাদের কেউই আমরা ঘটনাগুলো ঐভাবে মোকাবিলা করতে পারতাম না। তবে বাবা, একটা কথা, ওর বাঁচা কঠিন হবে। বলল অ্যাটেনডেন্ট লোকটি।
তাহলে তো উনি আমার জন্যে বিপদের কথা বলেছেন! বলল আহমদ মুসা।
স্যার, ম্যাডাম নিশ্চয় ওটা কথার কথা বলেছেন।
মনে মনে হাসল আহমদ মুসা। বলল মনে মনেই নিশ্চয় কথার কথা বলার লোক তিনি নন!
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। তার আগেই অ্যাটেনডেন্ট লোকটি বলে উঠল, ছোট ম্যাডামরা এদিকে আসছেন। আমি যাই। চলে গেল লোকটি।
লোকটির বড় ম্যাডাম নারিনের চিন্তা কিন্তু আহমদ মুসার মাথা থেকে গেল না। মনে পড়ল আহমদ মুসার, গত রাতে রেল স্টেশনে ইভা নারিনের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার সময় তাকে কিছুটা চমকে উঠতে দেখেছে সে। ইভা নারিনের চোখে বিস্ময় ছিল, কিন্তু সেই সাথে ছিল একটা শংকার প্রতিফলন। কিশোর শংকা? তারপর আহমদ মুসার সাথে কথা বলার সময়ও তার মুখের সেই শংকার ছায়াটা দূর হয়নি। আবার বাড়িতে আসার পর বাড়ির চীফ স্টাফ আহমদ মুসার ব্যাগ নিয়ে রেখেছিল গ্রাউন্ড ফ্লোরের গেস্ট রুমে। বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়িটায় আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরসহ তিনটি ফ্লোর। সাধারণত গেস্ট যারা আসেন তাদের থাকার স্থান একতলা মানে গ্রাউন্ড ফ্লোরেই হয়। কিন্তু ইভা নারিন এটা জানার সঙ্গে সঙ্গেই তার বাবাকে বলল, মেহমানকে দুতলার খাস মেহমানখানায় রাখা দরকার। তাঁর বিষয়ে সতর্কতার প্রয়োজন আছে। বড় ঘটনা উনি ঘটিয়েছেন বাবা। তার বাবা পুলিশ প্রধান, অ্যারাম আড্রানিক বলেছিলেন, তুমি যখন এটাই ভাবছ, তখন ঠিক আছে। তাই কর। আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে এই কথা শুনেছিল। আহমদ মুসা রেল স্টেশনে ম্যাডাম নারিনের মুখে যে প্রচ্ছন্ন শংকা দেখেছিল, বাড়িতে তার থাকার রুম সিলেকশনের সময় তার মধ্যে যে শংকা ও সতর্কতার প্রকাশ ঘটেছিল, সেই কথাই নতুন করে বলে গেল অ্যাটেনডেন্ট লোকটি। কিন্তু আন্না এলিনার বোন, পুলিশ প্রধানের বড় মেয়ে, আর্মেনিয়ার ডাকসাইটে গোয়েন্দা অফিসারের মনে এই শংকা কিসের? ট্রেনে যে তিনটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তাতে অতি অসাধারণত্ব কিছু নেই। পুলিশ কাস্টোডি থেকে আসামী পালিয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কোন অভিযানের সময় অ্যাকশনে পাঁচ ছয়জন সন্ত্রাসী নিহত হওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। এগুলো অবশ্যই ম্যাডাম নারিনের শংকা ও সাবধানতার কারণ হতে পারে না। তাহলে কারণটা কি?
আহমদ মুসার চিন্তা আর এগোলো না। ঘরে ঢুকল আন্না এলিনা ও তার স্বামী এরিক অ্যালেন।
স্যার রাতভর টেনশন ও মারামারির পর অসময়ের ঘুম আপনার কেমন হলো? ঘরে ঢুকেই হাসতে হাসতে বলল আন্না এলিনা।
নিশ্চিন্ত পরিবেশে সুন্দর ঘুম হয়েছে ম্যাডাম। বলল আহমদ মুসা।
দেখুন ম্যাডাম ট্যাডাম বলবেন না। আমি বয়সে আপনার বেশ ছোট। তাছাড়া গত রাতে দুবার আমার প্রাণ বাঁচিয়ে কমপক্ষে বড় ভাইয়ের মতো কাজ করেছেন। সুতরাং নাম ধরে ডাকলে আমি খুশি হবো। এখন বলুন তো নিশ্চিন্ত পরিবেশ কেন বললেন? আন্না এলিনা বলল।
হত্যা, মারামারি, টেনশনের পর পুলিশ প্রধানের বাড়ির চেয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয় আর কোথায় পাওয়া যাবে? বলল আহমদ মুসা।
হাসল আন্না এলিনা। বলল, অবাক ব্যাপার। আপনি বলছেন পুলিশ প্রধানের বাড়ি নিশ্চিন্ত আশ্রয়, অন্যদিকে আমার ডাকসাইটে গোয়েন্দা অফিসার আপা আপনাকে নিয়ে মহাটেনশনে ছিলেন সারা রাত।
কথা শেষ করেই আন্না এলিনা বলল, চলুন, নাস্তা রেডি। সকলে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। এক ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে নাস্তার সময় অবস্থার কারণে। চলুন।
সকলকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছেন? আশ্চর্য! চলুন। বলল আহমদ মুসা।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে এল, নাস্তার টেবিলে নিশ্চয় সবাই থাকবে। কথা প্রসঙ্গে অবশ্যই ওখানে তার নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হবে। কি উত্তর দেবে সে? মিথ্যা বলবে সে? আবার ভাবল, পাসপোর্টে যে নাম-পরিচয় আছে, সেটাই বলতে হবে। এটা আংশিক মিথ্যা হলেও এর মধ্যেই কল্যাণ আছে। তার লক্ষ্য একটা বিপন্ন জনগোষ্ঠিকে বাঁচানো। প্রথমেই তার নাম পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে সে উদ্দেশ্য সাধন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
আহমদ মুসা নাস্তার টেবিলের সামনে পৌঁছতেই নাস্তার টেবিলে বসা সকলে উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করল। উত্তরে আহমদ মুসা বাউ না করে সকলকে উদ্দেশ্য করে সালাম বলল।
নাস্তার টেবিলটা ওভাল সাইজের। ছয়টা চেয়ার।
ওভাল টেবিলের লম্বালম্বি দুই প্রান্তে দুই চেয়ার এবং টেবিলের অন্য দুই পাশে দুটি করে চারটি চেয়ার।
টেবিলের পাঁচটি আসনই পূর্ণ। টেবিলের লম্বালম্বি এক প্রান্তের একটা চেয়ার খালি। অপর প্রান্তে বসেছেন বয়স্ক রাশভারি একজন মানুষ। আহমদ মুসা দেখেই বুঝল উনিই আর্মেনিয়ার পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক।
অ্যারাম আড্রানিকই এগিয়ে এসে আহমদ মুসাকে শূন্য চেয়ারে নিয়ে বসাল।
অ্যারাম আড্রানিক নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়েই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আহমদ মুসাকে। প্রথমে নিজেয় পরিচয়, পরে ডান পাশে স্ত্রী, তার পাশে বড় মেয়ে ইভা নারিনের পরিচয় দিল। শেষে বাম পাশে তার ছোট মেয়ে আন্না এলিনা ও তার স্বামী এরিক অ্যালেনের পরিচয়।
অ্যারাম আভ্রানিক সবার পরিচয় দেয়া শেষ করলে আহমদ মুসা বলল, আর আমি আবু আহাম্মদ আব্দুল্লাহ। আমেরিকান। সৌখিন টুরিস্ট।
সবাই আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু ইভা নারিন প্রথমে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। আর তাকায়নি। তার মুখ ছিল গম্ভীর। তার সুন্দর মুখের এই গাম্ভীর্য তাকে আরও বেশি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন করে তুলেছে। তার ছোট বোনও খুবই সুন্দরী, কিন্তু সে তার চেয়েও বেশি সুন্দরী। হয়তো এ কারণেই পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের জন্যে তাকে পছন্দ করা হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে গোয়েন্দা বিভাগে সৌন্দর্যকে মূল্যবান ও বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে মনে করা হয়।
কিন্তু বাবা, তুমি এ দেশে এসে শুরুতেই গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়লে আমাদের মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে। আমরা দুঃখিত। বলল অ্যারাম আড্রানিকের স্ত্রী মেরি মারগারিটা।
আমাকে ছেলের মতো সম্বোধন করার পর এভাবে দুঃখিত হওয়া বোধ হয় ঠিক নয়। আর মানুষ হয়ে মানুষকে সাহায্য করাটা কোন খবর হওয়ার মতোও গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা আমি মনে করি। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ বাবা তোমাকে। কিন্তু সাহায্য করার খবর গুরুত্বপূর্ণ না হতে পারে, সাহায্য করাটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা করতে গিয়েই তোমার বিপদ হয়েছে। আমি এলিনার কাছে শুনেছি- দ্বিতীয় ও তৃতীয় হামলার উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে হত্যা করা। আমার দুঃখ, এখানেই বাবা। বলল পুলিশ প্রধানের স্ত্রী এলিনাদের মা মেরি মারগারিটা।
তুমি ঠিক বলেছ মারগারিটা। ঘটনাটা খুবই দুঃখের অবশ্যই। এ নিয়ে আরও কথা আমরা বলব। এখন এস সকলে নাস্তার দিকে মনোযোগ দেই। নাস্তার সময় এমনিতেই পার হয়ে গেছে। বলল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক।
হ্যাঁ, এস সবাই শুরু করি।
একটু থামল মেরি মারগারিটা। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, বাবা, তুমি নিশ্চিন্তে খাও। কোন আইটেমেই তোমার জন্য হারাম কিছু নেই।
কিন্তু মা, কেমন করে জানলেন আমি মুসলিম? এটা তো আমি আন্না এলিনাকেও বলিনি! আহমদ মুসা বলল।
হাসল মেরি মারগারিটা। বলল, দেখ বাবা, এটা শুধু পুলিশ প্রধানের বাড়ি নয়, এটা একটা বড় গোয়েন্দা অফিসারেরও বাড়ি। সে মানে আমার বড় মেয়ে ইভা নারিন, তুমি ভোরে প্রার্থনা করেছ তা জেনেছে। শুধু তাই নয়, তোমার ধর্মগ্রন্থের পাঠও সে শুনেছে। তার পরেই আমাকে বলেছে মুসলিমরা কি ধরনের খাদ্যকে হারাম মনে করে। সেই নির্দেশ দিয়েছে স্টাফদের, কি রান্না করতে কিভাবে।
না, আমি গোয়েন্দাগিরি করিনি। আমি খুব ভোরে প্রতিদিনের মতোই আমাদের জিমনেশিয়ামে যাচ্ছিলাম। ওনার ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় মিষ্টি একটা আবৃত্তি শুনতে পেলাম। কৌতূহলী হয়ে আমি গরাদ খোলা জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতে পাই উনি প্রার্থনা করছেন এবং বুঝতে পারি তিনি কুরআনের ভার্স আবৃত্তি করছেন। আমি আর্মেনিয়াতেও মুসলমানদের মসজিদে প্রার্থনা দেখেছি। তাছাড়া তিন দিনের এক নিরাপত্তা সম্মেলনে তুরস্কে গিয়ে মুসলমানদের প্রার্থনা আমি নিকট থেকে দেখেছি। বলল ইভা নারিন। সে অনেকটাই বিব্রত। সুন্দর মুখটা তার একটু মলিন হয়ে গেল।
তুমি অনেক উপকার করেছ মা। নাস্তার অনেক আইটেমে আমরা পর্কওয়েল ও এমনকি গোশত ব্যবহার করি, যা হয়তো আজও করতাম, যা ওঁদের দৃষ্টিতে হালাল নয়। সেটা হয়নি তুমি আগাম জানার ফলে। নারিনদের মা মেরি মারগারিটা বলল।
আমার একটা কথা স্যার, গরু, ছাগল, ভেড়া শূকর সবই পণ্ড, শূকরকে হারাম করা হলো কেন? বলল আন্না এলিনা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
স্যরি এলিনা, যাকে খাওয়া তোমরা বৈধ মনে কর, সে সম্পর্কে আমি কোন বিরূপ মন্তব্য করব না। এটা খোলামেলাভাবে আমাদের প্রথম সাক্ষাত। বৈসাদৃশ্যের কথা না বলে সাদৃশ্যের বিষয় সামনে আসা ভালো। খেতে খেতে আহমদ মুসা বলল। তার মুখে হাসি।
এটা করে কি সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের দ্বন্দ্ব, নীতি-আদর্শ আর পার্থক্যের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলা যাবে? মুখ তুলে আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল ইভা নারিন। তার মুখ গম্ভীর। খাচ্ছিল সেও।
যাবে না। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ উন্মুক্ত করা যাবে। বলল আহমদ মুসা। তারও মুখ গম্ভীর।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লক্ষ্য হওয়া উচিত, না নীতি আদর্শের বিজয়? ইভা নারিন বলল।
আহমদ মুসা মুখ তুলে তাকাল ইভা নারিনের দিকে। তার চোখে একটা গভীর জিজ্ঞাসা। বলল, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যেও নীতি আদর্শের বিজয় হতে পারে। একাধিক আদর্শ সহাবস্থানের পরিবেশে প্রচারিত হতে পারে। স্বাধীন বিচার বুদ্ধি এ থেকে গ্রহণ বর্জন করতে পারে। এভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অধিকতর গ্রহণযোগ্য নীতি-আদর্শের বিজয় হতে পারে। আসলে নীতি আদর্শের বিজয়ের অর্থ মানুষের স্বাধীন বিচারবুদ্ধির বিজয়।
ইভা নারিন তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে ঔজ্জ্বল্য, তার সাথে শংকাও। বলল, আপনি আইডিয়াল সমাজের কথা বলেছেন, আইডিয়াল এক মানবগোষ্ঠির কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের সমাজ তা নয়, আজকের বৃহত্তর মানবগোষ্ঠিও তা নয়। আমরা দেখব, যে নীতি-আদর্শ পিছিয়ে পড়ছে বা অগ্রহণযোগ্য। হচ্ছে, তা রুখে দাঁড়াচ্ছে, অশান্তি ও সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই অবস্থায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কি করে চলবে?
চালাবার চেষ্টা করতে হবে। অধিকতর গ্রহণযোগ্য যে আদর্শ, বিষয়-বুদ্ধিসম্মত যে আদর্শ, তাকে সংঘাতের বদলে ধৈর্যের, আক্রমণের বদলে আত্মরক্ষায় পথ অনুসরণ করতে হবে। উদারতা দিয়ে সংকীর্ণতাকে, ভালোবাসা দিয়ে হিংসাকে জয় করতে হবে। এই পথ কষ্টের এবং দীর্ঘ। কিন্তু এই পথেই দেখা যাবে বিবেক ও বিচার বুদ্ধি সমর্থিত নয় এমন নীতি-আদর্শের শক্তি সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর মানুষের বিচার-বুদ্ধি যে নীতি আদর্শকে গ্রহণ করেছে তা বিজয়ী হচ্ছে এবং গড়ে উঠছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সমাজও। আহমদ মুসা বলল।
ইভা-নারিন চোখ সরায়নি আহমদ মুসার মুখ থেকে। তার চোখ দুটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটিতে তার নির্মল অস্পষ্ট হাসির রেখা। কিন্তু চাঁদের কলংকের মতো তার মুখ জুড়ে শংকার ছায়া। বলল একটু সময় নিয়ে, ধন্যবাদ জনাব। আমার আসল প্রশ্নের আগে ছোট একটা প্রশ্ন, আপনি বললেন বিচার বুদ্ধিসম্মত গ্রহণযোগ্য আদর্শের বিজয় হবে, সেই সাথে গড়ে উঠবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সমাজও। কিন্তু গ্রহণযোগ্য আদর্শের বিজয়ে তো একক আদর্শের সমাজ গড়ে উঠবে, সহাবস্থানের প্রশ্ন থাকছে না সেখানে? সহাবস্থানের মানে হলো একাধিক আদর্শের অবস্থান।
মানুষের বিচার-বুদ্ধিসম্মত আদর্শের বিজয় মানে সব আদর্শের বিলুপ্তি হওয়া নয়। সংখ্যা, শক্তি যাই হোক তারা থাকবে, এটাই বাস্তবতা। মানুষের গ্রহণযোগ্যতা হারানোর ফলে সহাবস্থান নষ্ট করার মতো শক্তি, সুযোগ তাদের থাকবে না, এটা ধরে নেয়া হয়েছে। আহমদ মুসা বলল।
বুঝলাম। কিন্তু এটা তো স্বপ্নের কথা। বলল ইভা নারিন।
একে মানুষের লক্ষ্যও বলতে পারেন। লক্ষ্য স্বপ্ন তো মানুষের থাকতেই হবে। লক্ষ্য, স্বপ্নই মানুষকে, তার সমাজকে পারফেকশনের দিকে নিয়ে যাবে। আহমদ মুসা বলল।
খাওয়ার জন্যে চোখ ফিরানো ছাড়া ইভা নারিনের চোখ আঠার মতো লেগেছিল আহমদ মুসার মুখের উপর। তার চোখ-মুখের ঔজ্জ্বল্য মুগ্ধতায় রূপান্তরিত হয়েছে। সেই সাথে একটা বিস্ময়ও তার চোখে-মুখে। বলল সে, এই উত্তরের জন্যে ধন্যবাদ। আরেকটা বিষয় হলো, ধৈর্য, ভালোবাসা, আত্মরক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে বিচার বুদ্ধিসম্মত গ্রহণযোগ্য আদর্শের বিজয়ের যে কথা বলেছেন, সে রকম বাস্তব কোন দৃষ্টান্ত কি দুনিয়াতে আছে? না এটা শুধুই পারফেকশন মুখী একটা স্বপ্নযাত্রা?
ম্যাডাম নারিন, খুবই পরিচিত একটা দৃষ্টান্ত আছে। দৃষ্টান্তটি ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রচার ও বিজয়ের কথা। তাঁর ৬৩ বছর জীবনের ৪০তম বছরে আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তিনি ইসলামের প্রচার শুরু করেন। তার ২৩ বছর ইসলাম, প্রচারের সময় এক দিনও তিনি ইসলামের প্রচার বন্ধ করেননি। ইসলাম প্রচারের এই জীবনকালে তিনি ও তাঁর সাথীরা নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে অত্যচারিত হয়েও সামনে চলার কাহিনী আছে, এক পর্যায়ে তাঁর ও তাঁর সাথীদের আত্মরক্ষার কাহিনী আছে, তাদের ভালোবাসা। দিয়ে হিংসা ও বিরোধিতাকে জয় করার কাহিনী আছে, কাহিনী আছে তার আদর্শের নিরংকুশ বিজয়ের। তিনি যে সমাজ, রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন, সেখানে খৃস্টান, ইহুদি ও পৌত্তলিক সবাই ছিলেন। তারপরও ছিল সে সমাজে সুবিচার, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা। নবী মুহাম্মদ (স:) বলেন, অন্য ধর্মের কেউ কোনোভাবে অত্যাচারিত হলে, শেষ বিচারের দিন অত্যাচারিতের পক্ষ নিয়ে স্বয়ং তিনি আল্লাহর কাছে বিচার চাইবেন। শান্তি ও সহাবস্থানের পূর্ণ পরিবেশ ছিল বলেই পার্শ্ববর্তী খৃস্টান দেশ থেকে খৃস্টানরা মুসলিম দেশে চলে আসতো। এটা। ইতিহাস। এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। থামল আহমদ মুসা।
এটা একটা দৃষ্টান্ত বটে। কিন্তু যাকে বলা হয় গোল্ডেন পিরিয়ড তা কিন্তু বেশি দিন টেকেনি। বলল ইভা নারিন।
এই সময়ের মধ্যে যা প্রমাণিত হবার তা কিন্তু হয়ে গেছে। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামতেই আন্না এলিনা বলল, স্যার, আপনি ও আমার বুদ্ধিজীবী গোয়েন্দা আপা যে আলোচনা করছেন, তা আপনাদের জন্যে খুবই উপযোগী। কিন্তু আমরা ভেতরে ঢুকতে পারছি না।
এলিনা, অর্থহীন কথা বলো না। বলল ইভা নারিন শাসনের সুরে।
আচ্ছা তোমরা দুবোন থাম। আমি এই আলোচনা শুধু উপভোগ করছিলাম না, শিক্ষাও নিচ্ছিলাম। আমাদের মেহমান আবু আব্দুল্লাহ এবং নারিন দুজনকেই ধন্যবাদ। বিশেষ করে ধন্যবাদ দিচ্ছি মেহমান আবু আব্দুল্লাহকে। তার কথায় নতুন দিকনির্দেশনা আছে, যা নারিনও অস্বীকার করেনি। আমি আশাবাদী যে, তোমরা নতুন প্রজন্ম সহাবস্থান ও সহযোগিতার নতুন বিশ্ব গড়ায় এগিয়ে যাবে, যে বিশ্বে থাকবে শান্তির সহাবস্থান, তার সাথে থাকবে আদর্শবাদেরও বিজয়। থামল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিক।
থেমেই আবার মুখ খুলল। আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার কথা শুনে মনে হলো, মানুষের জীবন, মানুষের ধর্ম, মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে তুমি গভীরভাবে চিন্তা কর। কিন্তু গত রাতের তোমার যে রূপ বিভিন্ন রিপোর্টে এসেছে আর এলিনার কাছে যা শুনেছি, তাতে তুমি একজন সফল সেনা কমান্ডোও। দুইয়ে তো মিলে না!
স্যার, মানুষের ভাবনা চিন্তার জন্যে মাথা ও মন আছে, তার সাথে আছে সংসারে লড়াইয়ের জন্যে হাত-পা। মাথা-মন ও হাত পা দুইয়ে মিলেই কিন্তু পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আহমদ মুসা বলল।
হো হো করে হেসে উঠল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক। হেসে নিয়ে বলল, চমৎকার! চমৎকার বলেছ আবু আব্দুল্লাহ। তোমার কথা ও কথার পক্ষে তোমার চমৎকার উদাহরণ আমার চিরদিন মনে থাকবে।
থাক আর নয়। ছেলেটা শুধু এই কথা নয়, মনে রাখার মতো। আরও অনেক কথা বলেছে। কিন্তু তোমরা দুই বাপ-বেটি মিলে ছেলেটাকে খেতে দিলে না। বলল অ্যারাম আড্রানিকের স্ত্রী মেরি মারগারিটা।
না মা। ক্ষুধাও লেগেছিল। যথেষ্ট খেয়েছি। আহমদ মুসা বলল।
সবাইকে ধন্যবাদ। আজকের দিনটা সবার জন্যে শুভ হোক! বলে উঠে দাঁড়াল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক।
যেতে শুরু করে ফিরে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, আমি বসার ঘরে বসছি, তুমি কি একটু আসবে? মা নারিন, এলিনা ও তোমরা সকলেই এস।
আসছি স্যার! বলে আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল। পরে ইভা নারিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি রুমে যাচ্ছি। আমি আসছি।
ইভা নারিনও উঠে দাঁড়িয়েছে। সে আহমদ মুসার উত্তরে কিছু বলল না। উজ্জ্বল চোখ তুলে তাকাল শুধু আহমদ মুসার দিকে। তার চোখ ভারিও।
স্যার, নিচ তলার বসার ঘরে আপনি আগে বসেছেন, কিন্তু এই ফ্লোরের বসার ঘর তো আপনি দেখেননি। একে ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি আসছি, আপনাকে নিয়ে আসব। বলল হাসি। মুখে আন্না এলিনা।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকে ঘুরে প্রথম বাকে পুব দিকে ঘুরলে প্রথম দক্ষিণমুখী দরজাটা তো?
কি করে চিনলেন? আপনি তো ওদিকে যাননি! বলল এলিনা।
ও কিছুই না। একটা সাধারণ অনুমান। গত রাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় ওদিকে নজর গিয়েছিল। দেখলাম দরজাটার পুব পাশের দেয়ালের হ্যাংগারে একটা হ্যাট টাঙানো আছে। ঐ হ্যাট ও হ্যাংগার দেখেই আমি অনুমান করেছি, ওটা বসার ঘর হবে। আরেকটা দিক আমার নজরে এসেছে, দরজাটা অপেক্ষাকৃত বড় ও দেয়ালটাও মোভেবল।
আন্না, এনিনা কথা বলল না। বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গেছে।
ইভা নারিনেরও বিস্ময়জড়িত দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আসছি! বলে আহমদ মুসা পা বাড়াল তার ঘরের দিকে।
আন্না এলিনার চোখ ঘুরে গেল তার বড় বোন ইভা নারিনের দিকে। বলল, কি বুঝলে আপা তুমি? আমরা তো সিঁড়ি দিয়ে সব সময় উঠি, আমাদের চোখ তো ঐভাবে কখনো দেখেনি! আমি ট্রেনেও দেখেছি, পুলিশ যা বুঝতে পারেনি, তিনিই তা ধরিয়ে দিয়েছেন।
ইভা নারিনের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠল ছোট্ট একটা উত্তর দিল, ঈশ্বর বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন যোগ্যতা দেন।
তুমি বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছ আপা। বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন যোগ্যতা দেয়ার বিষয় এটা নয়। ওনাকে তো ঈশ্বর সব যোগ্যতাই দিয়েছেন। বাবা দেখলে না তার কেমন প্রশংসা করলেন? বলল আন্না এলিনা।
ইভা নারিনের গম্ভীর মুখটা আরও গম্ভীর হলো। বলল, চল, বাবা ডেকেছেন।
বলেই ইভা নারিন হাঁটা শুরু করল।
বিস্ময় এসে ঘিরে ধরল আন্না এলিনাকে। তার আপা তো এমন বিস্ময়কর আচরণ আগে কখনো করেনি। আপার মুখটা ছিল বেশ গম্ভীর! অথচ এমন ক্ষেত্রে সে উচ্ছল হয়ে উঠে। রহস্যের গন্ধ পেলে আর কথা ছাড়ে না। নাস্তার টেবিলে সে অনেক কথা বলেছে স্যারের সাথে। তার চোখে ঔজ্জ্বল্য ছিল, মুগ্ধতা ছিল বটে, তার সাথে কেমন যেন বিষণ্ণতাও ছিল। আপার কি হয়েছে? কোন সমস্যায় পড়েছে?
চিন্তা তার আর এগোল না। ইভা নারিনকে পেছন ফিরে তার। দিকে তাকাতে দেখেই সে ছুটল।
ড্রইংরুমে সবাই বসেছে।
পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিকের সামনের সোফায় বসানো হয়েছে আহমদ মুসাকে। মাঝখানে সেন্টার টেবিল। অ্যারাম আড্রানিকের স্ত্রী মেরি মারগারিটা বসেছে স্বামীর পাশে। তাদের বাম। দিকে সেন্টার টেবিলের বাম পাশের সোফায় বসেছে আন্না এলিনা ও তার স্বামী এরিক অ্যালেন। আর সেন্টার টেবিলের দক্ষিণ পাশে বসেছে ইভা নারিন।
সেন্টার টেবিলের উপর সেদিনের কয়েকটা দৈনিক।
প্রত্যেক দৈনিকেই গত রাতে ট্রেনে সংঘটিত তিনটি ঘটনা ফলাও করে ছাপা হয়েছে।
আহমদ মুসা যখন এসেছে, তখনও সবাই এসে পৌঁছায়নি। সেই সুযোগে অনুমতি নিয়ে কে কি লিখেছে তার উপর নজর বুলিয়েছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা খুশি হলো যে, তার পরিচয় নিয়ে পত্রিকাগুলো তেমন কিছু লেখেনি।
সবাই বসার পর পুলিশ প্রধান বলল, বলতে পার এটা আমাদের নাস্তা-উত্তর চায়ের আসর। এই সুযোগে আবু আব্দুল্লাহর সাথে কিছু আলাপ করতে চাই।
পুলিশ প্রধান তাকাল তার বড় মেয়ে গোয়েন্দা অফিসার ইভা নারিনের দিকে। বলল, মা, তুমি গত রাতের ঘটনা সম্পর্কে জেনেছ তো?
ইভা নারিন তার বাবার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, হ্যাঁ বাবা, বিভাগীয় রিপোর্ট আমি পেয়েছি। এলিনার কাছেও শুনেছি। সকালের সবগুলো কাগজেও দেখেছি।
বেশ। এ তিনটা সোর্স আমিও ব্যবহার করেছি। আমি আবু আব্দুল্লাহর কাছ থেকেও কিছু জানতে চাই। সে খুবই বুদ্ধিমান। তার মতামত আমাদের জন্যে মূল্যবান হবে। বলল পুলিশ প্রধান। অ্যারাম আড্রানিক।
পুলিশ প্রধান মুখ ফেরাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাও তখন কাগজ থেকে মুখ তুলেছে।
গত রাতে ট্রেনের তিনটি ঘটনার একটি ব্যাপারে আমি একদম। অন্ধকারে। সেটা হলো, কারা এই ঘটনা ঘটাল। প্রমাণ হয়েছে, যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা দুঃসাহসিক, দুর্ধর্ষ, সাংঘাতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং তারা যাকে টার্গেট করে, কিংবা যারা তাদের পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদের তারা বাঁচিয়ে রাখে না। আমার জানামতে, আর্মেনিয়ার বর্তমান সন্ত্রাসী কোন গ্রুপের সাথে এদের এই চরিত্র মেলে না। তুমি কি বল মা নারিন?
ইভা নারিন মুখ নত করে ছিল। মুখ তুলল সে। বলল সে, আমিও তাই মনে করি বাবা।
ম্লান হেসে কথাটা বলল ইভা নারিন।
কিন্তু তার হাসির মধ্যে হাসির চেয়ে বিষণ্ণতা বেশি ছিল। আহমদ মুসার চোখকে তা ফাঁকি দিতে পারলো না। তার চোখেও ভয় ও বিষণ্ণতার একটা প্রচ্ছন্ন ছায়া। আবারও অবাক হলো আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ মা! বলে মেয়েকে ধন্যবাদ দিয়ে পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিক আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আবু আব্দুল্লাহ, তুমি কি এ ব্যাপারে আমাকে কোন সাহায্য করতে পার?
পুলিশ রিপোর্টে কি ঐ সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম বলা হয়নি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
না বলা হয়নি। বলল পুলিশ প্রধান।
তারা হয়তো জেনেছে, কিন্তু রিপোর্টে তারা নিশ্চিত না হয়ে উল্লেখ করেনি, এমন কি হতে পারে? আহমদ বলল।
কখনও না, এমন হতে পারে না। সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম তো রিপোর্টের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। যতটুকু পাবে, জানবে ততটুকু জানাতে হবে। বলল পুলিশ প্রধান।
কিন্তু এটাই হয়েছে স্যার, যে তারা জানায়নি। সন্ত্রাসীদের জামা-জ্যাকেটের ব্রান্ড ট্যাগে এমন কিছু পাওয়া গেছে, তাতে ওদের সংগঠনের নাম ব্ল্যাক টাইগার বলে ধরে নেয়া যায়।
ব্ল্যাক টাইগার? বিস্ময় বিজড়িত কণ্ঠে স্বগতোক্তির মতোই উচ্চারণ করল পুলিশ প্রধান।
আর সে সময় চমকে উঠে মুখ তুলেছিল ইভা নারিন।
স্বগতোক্তির পরেই পুলিশ প্রধান বলল, তাহলে ওরা কি তথ্যটা হাইড করল? তার কণ্ঠে এবার বিস্ময় নয়, কঠোরতা ঝরে পড়ল।
গোপন করার ব্যাপারটা নাও ঘটতে পারে। সন্ত্রাসীদের জামা জ্যাকেটার ব্রান্ড ট্যাগের ঐ অর্থটা বা নামটা আমি অনুমান করেছিলাম এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে বলেছিলাম। সে এটা বিশ্বাস নাও করতে পারে। হয়তো সেই কারণে তারা রিপোর্টে উল্লেখ করেনি। আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ বাবা, উনিই বিষয়টা পুলিশকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বলল আন্না এলিনা।
কেন তুমি ঐ নামটা তাদের, সেটা মনে করেছিলে? পুলিশ প্রধান বলল।
পুলিশ প্রধানের ঐ প্রশ্নের সাথে সাথে ইভা নারিন তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। তার চোখে মুহূর্তের জন্যে একটা গভীর আতংকের ভাব ফুটে উঠেছিল।
ওদের জামা-জ্যাকেটের ব্রান্ড যে মেকার-কোম্পানির ছিল, সে কোম্পানির ব্রান্ডের সাথে জামা-জ্যাকেটের ব্রান্ডের মধ্যে কিছুটা অমিল ছিল। আসল কোম্পানির ব্রান্ড ট্যাগে একটা ব্ল্যাক টাইগার শুয়েছিল, কিন্তু ওদের জামা-জ্যাকেটের ব্রান্ড ট্যাগে ব্ল্যাক টাইগার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অবস্থায় ছিল। কোম্পানির ব্রান্ডে ওদের নিজস্ব চেঞ্জ থেকেই আমার মনে হয়েছিল ওদের একটা সংগঠন নিশ্চয় আছে এবং তার নাম ব্ল্যাক টাইগার বা তার আগে পিছে আরও কিছু থাকতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গিয়েছিল পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিকের। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ঠিক ধরেছ আহমদ আব্দুল্লাহ।
তোমার চিন্তায় কোন ভুল নেই। কিন্তু তুমি সুদূর আমেরিকার একজন হয়েও আর্মেনিয়া অঞ্চলের একটা কোম্পানির মেকারস ব্রান্ড ট্যাগ-এর এই চেঞ্জ ধরতে পারলে কি করে? এবং তা থেকে একটা নামও বের করে ফেললে! অসাধারণ! তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আবু আব্দুল্লাহ।
ইভা নারিনের চোখে-মুখে বিস্ময়, উদ্বেগ-মুগ্ধতা মিলে এক অদ্ভুত চেহারার প্রকাশ ঘটেছিল। সে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার। দিকে। চোখ সরিয়ে নিতে যেন সে ভুলে গিয়েছিল।
বিষয়টা আমার নজরে পড়ে গিয়েছিল। পুলিশেরও নজরে পড়তে পারতো। বড় কিছু নয় স্যার এটা। বলল আহমদ মুসা। তার চেহারায় ছিল লজ্জিত ভাব।
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা আবার বলল, আরেকটা বিষয় আমার মনে হচ্ছে স্যার, কোন না কোন ফর্মে পুলিশ বা ভেতর থেকে কেউ সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা করেছে।
পুলিশ প্রধানের কপাল কুঞ্চিত হলো। বলল, কেন এটা মনে করছ?
দুই হাসপাতালেই পুলিশ পাহারা উপযুক্ত ছিল না। সন্ত্রাসীদের কেবিন এলাকায় পাহারা তো ছিলই না। তাছাড়া ট্রেনে ওদের তৃতীয়। আক্রমণের আগে এক জায়গায় ট্রেন থেমেছিল অল্পক্ষণের জন্যে। এই থামাটা বোধ হয় স্বাভাবিক নয়। হতে পারে ওখানেই সন্ত্রাসীরা ট্রেনে উঠে। বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ প্রধান বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও কথা বলল না পুলিশ প্রধান।
অন্য সবার চোখেও বিস্ময় বিমুগ্ধতা। শুধু ইভা নারিনের চোখে বিস্ময় বিমুগ্ধতার পাশে দুশ্চিন্তার একটা কালো ছায়া।
ধন্যবাদ আবু আব্দুল্লাহ! তুমি আমাদের মূল্যবান সাহায্য করেছ। আমাদের বিভাগ এভাবে চিন্তা করেনি। তদন্তে হয়তো অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। তোমার দিকনির্দেশনা আমাদের। সাহায্য করবে। বলল পুলিশ প্রধান।
তাহলে আমি উঠতে পারি স্যার? আহমদ মুসা বলল। একটু বস। তোমাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি? বলল পুলিশ প্রধান।
অবশ্যই স্যার। আহমদ মুসা বলল।
তোমার অ্যাকশন, অ্যানালেসিস, চিন্তা সবই বিস্ময়কর! আসলে তুমি কি কর? বলল পুলিশ প্রধান।
তা বলার মতো কিছু নয় স্যার। সোশ্যাল কনসালট্যান্সির মতো কিছু করি আর সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই। আহমদ মুসা বলল।
ওকে, ইয়ংম্যান। যাও, বিশ্রাম নাও। অনেক ধকল গেছে। যদি ওষুধ পত্রের দরকার হয়, তাহলে এলিনাকে বলবে।
কথাটা শেষ করে পুলিশ প্রধান তাকাল ইভা নারিনের দিকে। বলল, মা তুমি মেহমানের খোঁজ-খবর রেখ। তোমার চিন্তা-কাজের সাথে তার অনেক মিল আছে।
ইভা নারিনের মুখটা মুহূর্তের জন্যে কিছুটা রাঙা হয়ে উঠল। বলল, আচ্ছা বাবা।
আহমদ মুসা উঠে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার কক্ষের দিকে পা বাড়াল।
আন্না উঠে দাঁড়িয়ে তার স্বামীকে বলল, চল, ওকে তার কক্ষে পৌঁছে দিয়ে আসি।
বলে তারা দুজনে চলল আহমদ মুসার সাথে সাথে।
তাদের পেছন থেকে ইভা নারিন একটু উঁচু কণ্ঠে বলে উঠল, এলিনা, ওঁকে বলো উনি যেন বাড়ির বাইরে না যান।
উনি যদি কারণ জিজ্ঞাসা করেন? বলল এলিনা পেছনে তাকিয়ে।
বলো যে, কারণ জানি না, বাবার এটা অনুরোধ। ইভা নারিন বলল।
বাবা তো অনুরোধ করেননি। মিথ্যা বলব কেন? বলল এলিনা।
না, বলবে। ইভা নারিন বলল।
আর কিছু না বলে হেসে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল এলিনা ও এরিক অ্যালেন।
ওরা চলে যেতেই পুলিশ প্রধানের স্ত্রী মেরি মারগারিটা বলল, সত্যিই খুব ভালো ছেলে আবু আব্দুল্লাহ। দেখেছ, ওর চেহারায় একটা পবিত্রতা আছে। দৃষ্টি কত সংযত! কথা, চলাফেরায় আমিত্বের লেশ মাত্র নেই।
হাসল পুলিশ প্রধান। বলল, মারগারিটা, ছেলেটাকে প্রথম দর্শনেই এই সার্টিফিকেটটা তুমি দিলে! কিন্তু…
বল, কোন্ কথাটা আমি বেঠিক বলেছি? বলল মেরি মারগারিটা।
না, তুমি ঠিক বলেছ। আমি একমত।
বলে পুলিশ প্রধান তাকাল বড় মেয়ে ইভা নারিনের দিকে। বলল, আবু আব্দুল্লাহ সম্পর্কে তোমার মূল্যায়ন কি মা?
তার সম্পর্কে মন্তব্য করতে আরও সময় লাগবে বাবা। অ্যাকশান, অ্যানালেসিস ও চিন্তায় সে বিস্ময়কর বলে তুমি যে মন্তব্য করেছ, তা ঠিক বাবা। আমার সার্ভিস লাইফে বহুমুখী অনেক প্রতিভার সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে, কিন্তু এমন ভালো মানুষ কাউকে আমি দেখিনি। তবে তার সম্পর্কে আরও জানার আগে চূড়ান্ত কথা বলা যাবে না। বলল ইভা নারিন। তার মুখ গম্ভীর।
তুমি একজন গোয়েন্দা অফিসারের মতোই কথা বলেছ মা। দেখ, খোঁজ নিয়ে আর কি জানতে পার। আমাদের কারণেই সে। বিপদে জড়িয়েছে। তার পাশে আমাদের দাঁড়ানোও দরকার। পুলিশ প্রধান বলল।
অবশ্যই বাবা। কিন্তু আমাদের সাধ্য অসীম নয়। তিনি তাঁর ইচ্ছামতো এখানে সেখানে যাবেন, তাঁকে কিভাবে পাহারা দিয়ে রাখা যাবে? দুচারজন পুলিশ সাথে দিলেও তাদের সামর্থ্য কতটুকু হবে! বলল ইভা নারিন।
তুমি কি বলতে চাও নারিন? পুলিশ প্রধান বলল। তার ভ্রূ কুঞ্চিত।
তাকে এ মুহূর্তেই এদেশ থেকে চলে যাওয়া দরকার বাবা। বলল নারিন।
তুমি একটু বেশি শংকিত মনে হয়? পুলিশ প্রধান বলল।
ইভা নারিনের মুখ আবেগে রাঙা হয়ে উঠল। বলল, বাবা, তুমিও বলেছ, আমিও বলেছি অ্যাকশন, অ্যানালিসিসে তিনি অনন্য এক প্রতিভা। আমি এলিনার মুখে শুনেছি, ট্রেনে দ্বিতীয়বার অ্যাটাকের পর যখনই তিনি সন্ত্রাসীরা পুলিশ কাস্টোডি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা শুনেছেন তখনই সাথে সাথে তিনি বলেছেন, ট্রেনে আমাদের উপর আবার অ্যাটাক হবে। তার কয়েক মিনিট পরেই অ্যাটাক হয়েছে। ছাদ কেটে উপর থেকে সন্ত্রাসীরা যখন ভেতরে বোমা ছুঁড়েছে, তৎক্ষণাৎ নিশ্বাস বন্ধ করে সবাই শুয়ে পড়ুন বলে চিৎকার দিয়ে তিনি নিজেও শুয়ে পড়েছেন। তাঁর এই সিক্সথ সেনস-এর কাজ অনন্য, অসাধারণ বাবা। তার সাথে তিনি আদর্শবাদী ও ভালো মানুষ বাবা। তাঁকে সব ক্ষতি থেকে বাঁচানো দরকার।
পুলিশ প্রধানের চিন্তাক্লিষ্ট চোখে প্রশ্নের ছাপ। বলল, তুমি এই সন্ত্রাসীদের এত শক্তিশালী মনে করছ কেন মা?
ট্রেনের তিনটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে বাবা! একবার কাউকে টার্গেট করলে তাকে ছাড়ছে না ওরা। শেষ ঘটনার কথা চিন্তা কর বাবা, তারা ট্রেন থামার ব্যবস্থা করে ট্রেনে উঠতে পেরেছে, ট্রেনের ছাদ কেটে তার ভেতরে আক্রমণ করেছে। এ থেকে প্রমাণ হচ্ছে, তারা খুবই কৌশলী ও শক্তিশালী। তাছাড়া মেহমান বললেন, সরকার ও প্রশাসনে তাদের প্রভাব রয়েছে। আমাদের সামনে যে ঘটনাগুলো রয়েছে তা যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব তাঁর কথা সত্য, এটা স্বীকার করে নিতেই হবে। বলল ইভা নারিন।
কিন্তু তারা সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নিশ্চয় নয়। ভয় করছ কেন তুমি? পুলিশ প্রধান বলল।
আমি ভয় করছি মেহমানকে নিয়ে। তিনি তো সরকার নন। ইভা নারিন বলল।
ঠিক বলেছ মা। যিনি বিদেশী, যিনি হোটেল-মোটেলে থাকবেন, যিনি ঘুরে বেড়াবেন এখানে-সেখানে, তাকে নিরাপত্তা দেয়া অবশ্যই কঠিন। তাহলে কি করা যায় বল? তার জন্য আমাদের উপর একটা দায়িত্ব বর্তেছে। বলল পুলিশ প্রধান।
বলেছি বাবা, এখনি আর্মেনিয়া থেকে চলে যাওয়ার মধ্যেই তার জন্যে কল্যাণ আছে। ইভা নারিন বলল।
তাহলে মা তুমি তার সাথে কথা বল। আমার কথা বলা ভালো দেখায় না। তুমি বন্ধু হিসাবে এ ধরনের রিকুয়েস্ট করতে পার। তোমাদের মধ্যে কথা-বার্তায় বোঝা যায় উনি তোমাকে সম্মান করেন, মর্যাদা দেন। বলল পুলিশ প্রধান।
দেখছ না বাবা, এ ধরনের সম্মান-মর্যাদা তিনি সকলকেই দেন। ইভা নারিন বলল।
এটা তার সুরুচি বোধ। ঠিক আছে মা, তাহলে একথাই থাকল। তুমি তাকে রাজি করাও। বলল পুলিশ প্রধান।
আমি চেষ্টা করব বাবা। ইভা নারিন বলল।
ওর স্বার্থেই তোমাকে সব ধরনের চেষ্টা করতে হবে। বলল পুলিশ প্রধান।
.
মনটাকে একটু শান্ত করার জন্যে এবং একটু বিশ্রামের আশায় বিছানার আশ্রয় নিল ইভা নারিন। কিন্তু বিছানায় গা এলিয়ে দেবার পর মনটা তার আরও অস্থির হয়ে উঠল। মনটা তার এত দুর্বল হয়ে পড়ছে কেন! মেহমানকে বাঁচানোর জন্যে তার মন এত অস্থির হয়ে উঠছে কেন? সেকি তার বোনকে বাঁচিয়েছে বলে? মন তাও বলছে না। তার ক্ষতি হবে, সে ওদের মতো ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের হাতে পড়বে, তার অস্তিত্ব মুছে যাবে! এটা ভাবতেই তার হৃদয়ে একটা বেদনা তীব্র হয়ে উঠছে। এই মেহমান যেন অনেক দিনের চেনা, গভীর পরিচয় যেন তার সাথে! সেই গভীর পরিচয় নিয়ে কখন যেন সে তার আত্মার আত্মীয় হয়ে গেছে। অথচ গত রাতেই সে জেনেছে। বিদেশী এই যুবক ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার (BAT)-এর সাত আটজনকে গুলিবিদ্ধ করেছে, পাঁচজনকে হত্যা করেছে। তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে ব্যাট (BAT)-এর পক্ষ থেকে। যে কোন মূল্যে তাকে হত্যা করতে হবে, এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তারপর ভোর রাতেই তাকে জানানো হয় সেই বিদেশী যুবককে আমাদের বাড়িতে আনা হয়েছে। সে যেন হঠাৎ চলে না যায়। তাকে যেন আমি চোখে চোখে রাখি। সবকিছু জানার পরেও তার মন এমন করছে কেন? প্রথম দেখাতেই কেন মনে হলো সারা জীবন এমন লোককেই আমি দেখতে চেয়েছি, অপেক্ষা করে আছি এমন লোকের জন্যেই। হাজার বছরের চাওয়া যেন এক নজরেই দেখা হয়ে গেছে। কেন এমন হলো? এমন অস্বাভাবিক ঘটনা কেন তার জীবনে ঘটল? তার এই ২৬ বছরের জীবনে এমন আলোড়ন তো তার জীবনে আর কখনো আসেনি! কাউকে তো সে এভাবে আগে, দেখেনি। কেন তার মনে হচ্ছে সব শক্তি দিয়ে সব বিপদ থেকে তাকে আড়ালে রাখতে হবে?
ইভা নারিনের ব্যক্তিগত অয়্যারলেস বেজে উঠল।
ভ্রূ কুঞ্চিত হলো ইভা নারিনের।
ভীতি-মিশ্রিত বিরক্তির একটা ছাপ ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে।
উঠে বসল ইভা নারিন। মনকে শাসন করল। মনে মনে বলল প্রিয় সংগঠনের প্রতি তার মন এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠল কেন?
তাড়াতাড়ি উঠে কলটা ধরল সে।
হ্যালো, আমি ইভা নারিন। বলল ইভা নারিন।
ম্যাডাম নারিন, আমি সোসানা। ওদিকের সব ভালো? ও প্রান্ত থেকে সোনা সোসানা বলল। BAT-এর গোয়েন্দা প্রধান সে।
হ্যাঁ ম্যাডাম সোসানা, সব ভালো? বলল ইভা নারিন।
খুনীটা কোথায় এখন, তার ঘরে তো? সোনা সোসানা বলল।
হ্যাঁ! ছোট্ট জবাব দিল ইভা নারিন।
শুনুন এই মাত্র স্পেশাল নির্দেশ এসেছে। কালকে সকালের সূর্য তার দেখা চলবে না। রাতের মধ্যেই তাকে শেষ করতে হবে। আমি আপনাদের বাড়ির কাছাকাছি জায়গায় আছি। আমাদের লোকজনও চারদিকে মোতায়েন করা আছে। কিন্তু আসল কাজটা আপনাকে করতে হবে। বলল সোনা সোসানা।
কি করতে হবে? ইভা নারিন বলল। অনেক কষ্টে সে গলার কম্পন আড়াল করল।
তাকে হত্যা করতে হবে। কিভাবে, সেটা আপনাকেই ঠিক, করতে হবে। সে পরামর্শ আমরা দিতে পারবো না। তবে হ্যাঁ, আপনার কাছে সর্বাধুনিক স্পাই রিং আছে। সে রিং-এর গোপন নিডল-এ এমন একটা ব্যাকটেরিয়া আছে, সে ব্যাকটেরিয়া কারও দেহে অণুপরিমাণ প্রবেশ করলে মুহূর্তেই তার হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হবে। তাকে হত্যার জন্যে আপনি এই স্পাই রিং ব্যবহার করতে পারেন। আর আপনার মতো অসাধারণ সুন্দরীর জন্যে এটা খুবই সহজ। বলল সোনা সোনা।
গোটা দেহ ভীষণভাবে কেঁপে উঠল ইভা নারিনের। প্রবল একটা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত গোটা দেহে। কথা বলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলল সে।
সোনা সোসানাই আবার কথা বলে উঠল, ঠিক আছে ম্যাডাম। আমি শেষ করতে পারি?
একটা কথা ম্যাডাম। তিনি আমাদের মেহমান এবং আমাদের বাসায় তিনি…
কথা শেষ না করেই থেমে গেল ইভা নারিন। রুদ্ধ হয়ে আসছিল তার কণ্ঠ।
ম্যাডাম, আপনার কথা আমি বুঝেছি। কিছুই করার নেই। আমাদের উপর, আপনার উপর নির্দেশ এটাই। আর আতিথ্য পরায়ণতা, সৌজন্যবোধ ইত্যাদির চেয়ে অনেক বড় দায়িত্ব আপনার উপর বর্তেছে। কোন আবেগ, অজুহাত দিয়ে এই দায়িত্ব এড়ানো যাবে না, এটা আপনি জানেন। সে আমাদের পাঁচজন লোককে মেরেছে, সাত আটজন লোককে গুলিবিদ্ধ করেছে। তাকে হত্যা না করা পর্যন্ত সব কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। টপ টু বটম সবাই উন্মুখ হয়ে আছে আপনার সফল হওয়ার খবর শোনার জন্যে। ব্যর্থতার কোন সুযোগ এখানে নেই। আমি কল অফ করলাম ম্যাডাম। গুড লাক, বাই।
ওপার থেকে অয়্যারলেস বন্ধ করার শব্দ হলো।
দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ইভা নারিন।
ধপ করে বসে পড়ল সে বেড়ে।
গতার গোটা দেহ যেন কাঁপছিল অপমানসহ কি এক যন্ত্রণায়। তার সৌন্দর্যের কথা এনে এক অশ্লীল ইংগিত দিয়েছে সোসানা। পুলিশ প্রধানের মেয়ের জীবনরক্ষাকারী একজন মেহমানকে পুলিশ প্রধানের বাড়িতেই হত্যা করা হবে, এটা তার পরিবারের শুধু অপমানই নয়, বিশ্বাসঘাতকতা! এসব চিন্তা এক অসহনীয় যন্ত্রণা হয়ে তাকে আচ্ছন্ন করে তুলল। তার উপর এই মেহমান তার কাছে। শুধু একজন মেহমান, এলিনাদের প্রাণরক্ষাকারী মাত্র নন। তিনি তার ছাব্বিশ বছরের জীবনে একজন বিস্ময়কর আগন্তুক! প্রথম দর্শনেই যাকে মনে হয়েছে শত বছরের চেনা। আমি যেন ঘুমিয়ে ছিলাম। তাই বোধ হয় জীবনে আমি কাউকে পাত্তা দেইনি। কাছে পাওয়ার উপযুক্ত মনে করিনি কাউকেই। কিন্তু সে যেন আমাকে সোনার কাঠির স্পর্শে জাগিয়ে দিয়েছে। জেগে ওঠার প্রথম দৃষ্টিতেই তাকে দেখতে পেয়েছি। কিন্তু পরিণাম আমি জানি না! আমার পাওয়াটা ধুমকেতুর মতোই অন্ধকারে আবার হারিয়ে যেতে পারে! তবু এই পাওয়াটাই আমার কাছে বড়। এই পাওয়াকে আমি হত্যা করতে পারি না। যন্ত্রণা এবার অশ্রু হয়ে তার দুগণ্ড বেয়ে নেমে এল। শুয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুজল সে। দুচোখ থেকে অশ্রুর দুই ধারা আরও বেগবান হলো।
বিপর্যস্ত, ক্লান্ত ইভা নারিন এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
ধড়মড় করে এক সময় ঘুম থেকে উঠে বসল ইভা নারিন। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল, রাত একটা! আর দেরি করা চলে না। যেতে হবে তাকে জীবনের কঠিনতম এক অভিযানে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে।
ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে ইভা নারিন পোশাক পাল্টাল। একজন সম্মানিত ঊর্ধ্বতনের কাছে যেতে যে রকম শালীন পোশাক সাধারণত সে পরে, সে ধরনের রাত্রিকালীন পোশাক সে পরল। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা ফুলহাতা সাদা গাউন, মাথায় তুলার সাদা হেড ওয়্যার। গলায় পেচানো রুমাল বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল, মুসলিম আবু আব্দুল্লাহ নিশ্চয় এই পোশাকে তাকে দেখে বিরক্ত হবে না।
প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হলে ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে গাউনের নিচে তার ছোট্ট রিভলবারটির অস্তিত্ব একবার দেখে নিল। তাকাল হাতের ভয়ংকর আংটিটার দিকে। রাতের এমন অভিযানের জন্যে যেমন সাজার কথা তেমনি সেজেছে সে।
ইভা নারিন নক করল আহমদ মুসার দরজায়।
তিনবার নক করতেই আহমদ মুসার ঘরের দরজা খুলে গেল।
দরজার সামনে আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে। তার হাত খালি।
নিঃসংকোচ চেহারা।
কোন বিস্ময় নেই চোখে-মুখে। কিছুটা বিস্মিত হলো ইভা নারিন, নক শুনেই দরজা খুললেন! সাবধানতা নেই, শংকা নেই, বিস্ময় নেই! কি ধরনের নার্ভের মানুষ ইনি!
আমি ভেতরে আসতে পারি? বলল ইভা নারিন।
আসুন। বলে আহমদ মুসা সরে দাঁড়াল এবং সোফা দেখিয়ে দিল ইভা নারিনকে বসার জন্যে।
ইভা নারিন বসল।
আহমদ মুসা ইভা নারিনের সামনের সোফায় না বসে বেডের উপর গিয়ে বসল।
এক্সকিউজ মি, দরজাটা বন্ধ করে আসি। বলে উঠে দাঁড়াল ইভা নারিন।
স্যরি ম্যাডাম নারিন, দরজাটা খোলাই থাকুক। বলল আহমদ মুসা।
কেন? বলল ইভা নারিন।
আমাদের ধর্মের বিধান, স্বামী-স্ত্রী নয় এমন নারী পুরুষ কোন ঘরে যদি একা থাকে, তাহলে দরজা দেয়া যাবে না। আহমদ মুসা বলল।
ইভা নারিনের মুখে একটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। বসে পড়ল। সে। বলল, বুঝেছি মি. আবু আব্দুল্লাহ। পারস্পরিক আস্থা বলে কি কোন জিনিস নেই?
আছে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে যে আস্থা রাখা যাবে, তা ঠিক নয়। তাছাড়া তৃতীয় পক্ষের আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা হলো বন্ধ ঘরে দুজনের মাঝখানে থাকে শয়তান। পাপ, অন্যায়, অবিচার সব খারাবির নিমিত্ত এই শয়তান। আহমদ মুসা বলল।
অন্য কেউ বললে আমি হাসতাম। আপনি যখন বলেছেন, তখন এটা ভাবার বিষয়। পরে ভাবব।
বলে একটু থামল ইভা নারিন। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, রাত একটায় আমি আপনার ঘরে এলাম, আপনি বিস্মিত হননি?
না ম্যাডাম নারিন, আমি বিস্মিত হইনি। আমি জানতাম আপনি আসবেন। বলল আহমদ মুসা।
জানতেন? কিভাবে? ইভা নারিন বলল। তার চোখে-মুখে প্রবল বিস্ময়।
আপনার কাছ থেকে জেনেছি। বলল আহমদ মুসা।
আমার কাছ থেকে? কিভাবে? ইভা নারিন বলল।
আজ সকালে আমি যখন আপনার বাবার সাথে কথা বলছিলাম, তখন আপনি অধিকাংশ সময়ই চুপ ছিলেন। কিন্তু আপনার হাত চুপ ছিল না। খবরের কাগজের সাদা অংশে আপনি কলম চালিয়েছেন। সেই আঁচড়ের অধিকাংশেরই কোন অর্থ ছিল। কিন্তু কিছু কিছুর অর্থ ছিল না। আপনি একাধিকবার কয়েক জায়গায় BAT, BAT, লিখেছেন এবং এ ধরনের আরও কিছু লিখেছেন। BAT শব্দটা আমার কাছে অর্থবহ হয়ে ওঠে। আপনি যা লিখেছেন তার ইলাস্ট্রেশন আমি করেছি ব্ল্যাক আর্মেনিয়াম টাইগার। ট্রেনের তিন ঘটনায় আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে শক্তিশালী, প্রভাবশালী এই গ্রুপটার নাম ব্ল্যাক টাইগার, বা ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার। এই নামটাই যখন আপনার হাতে। সংক্ষিপ্ত আকারে আসল, তখনই আমি স্থির ধরে নিয়েছি আপনি ব্যাট-এর সদস্য কিংবা কেউ হবেন। তখনই ভাবলাম আপনি অবশ্যই হানা দেবেন আমার কক্ষে। আমি ধরে নিয়েছিলাম আপনার হাতে ভয়ংকর কোন অস্ত্র থাকবে। কিন্তু তা না দেখে আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। তিনবার ওরা ব্যর্থ হবার পর দেখামাত্র আমাকে হত্যা করবে, এটাই স্বাভাবিক। বলল আহমদ মুসা।
শুনছিল ইভা নারিন আহমদ মুসার কথা। প্রথমে সে বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছিল তার ব্যাট শব্দটি লেখার বিষয় ধরা পড়া এবং তার পূর্ণ অর্থ শুনে। কারণ BAT শব্দ সে কখন লিখেছে, তারই মনে নেই। পরে তার চোখ-মুখ গোটা দেহে তীব্র একটা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছিল এই কথা শুনে যে, ইভা নারিন তাকে হত্যা করতে পারে।
দ্রুত নিজেকে সামলে নিল ইভা নারিন। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল সে। বলল, শুধু ব্যাট শব্দটা দেখে আমাকে এত বড় সন্দেহ করলেন! ব্যাট-এর তো আরও অর্থ আছে!
হ্যাঁ, তা আছে ম্যাডাম। কিন্তু আপনার সাথে প্রথম সাক্ষাত থেকে আমি দেখে আসছি আপনার চোখে-মুখে আনন্দের পাশে বিষাদ আছে, হাসির সাথে বিষণ্ণতা আছে। এর অর্থ আমি বুঝেছি আপনার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলছে। দ্বন্দ্বটা কি বুঝিনি। কিন্তু আপনার হাতে লেখা ব্যাট শব্দটা পেয়ে আমার কাছে পরিষ্কার। হয়েছে, আপনার নিজের ভালো লাগা না লাগা, পছন্দ-অপছন্দের সাথে ব্ল্যাক টাইগারের স্বার্থের দ্বন্দ্বে ভুগছেন আপনি। আপনি জানেন ট্রেনের তিনটি ঘটনাই ব্ল্যাক টাইগারের কাজ এবং আমি এখন ব্ল্যাক টাইগারের টপমোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে ইভা নারিন তার কথা শুনছিল। ধীরে ধীরে তার মুখ নিচু হয়ে গেল। এক অব্যাক্ত আবেগে তার চোখ-মুখ ভারি হয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা থামলে সে মুখ না তুলেই বলল, আপনি, সব জানেন, আমি ডেডলি কোন অস্ত্র নিয়ে আপনার সামনে আসবো এটাও ধরে নিয়েছিলেন। তাহলে আপনি নিরুদ্বেগে খালি হাতে দরজা খুললেন কেন? ইভা নারিনের কণ্ঠ অনেকটাই বাধো বাধো।
আমি আপনার উপর আস্থা হারাতে চাইনি। আমার এই চাওয়া সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আপনি অস্ত্র হাতে আমার মুখোমুখি হননি।
ইভা নারিনের দুই চোখ সিক্ত হয়ে উঠেছিল। উনি তাহলে আমার উপর আস্থা রাখেন, বিশ্বাস করেন যে আমি তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারি না! অশ্রুর দুই স্রোত নামল ইভা নারিনের দুই গণ্ড বেয়ে।
মুখ তুলল সে। তাকাল আহমদ মুসার দিকে অশ্রু প্লাবিত চোখে। বলল, কেন আপনি আস্থা হারাননি। এর মধ্যেই তো আপনি বুঝেছেন BAT-এর সদস্যরা কত জুয়েল, কত প্রতিশোধকামী, হতে পারে!
ইভা নারিনের মতো শক্ত মেয়ের এমন ব্যাকুল কান্না দেখে বিব্রত হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা ইভা নারিনের মধ্যে তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব দেখেই বুঝেছিল, তার প্রিয় ছোট বোনের প্রাণ রক্ষাকারী আহমদ মুসার প্রতি সে কৃতজ্ঞ। কিন্তু ইভা নারিনের এই। অঝোর ধারার কান্না নিছক কৃতজ্ঞ হওয়ার সাথে মিলে না। তাহলে? এই তাহলের কোন উত্তর খুঁজে পেল না আহমদ মুসা।
ম্যাডাম নারিন, আপনাকে দেখে ও আপনার সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছিল আমাকে আপনি অমন শক্রর দৃষ্টিতে দেখেন না, যার আপনি ক্ষতি করতে পারেন, হত্যা করতে পারেন। বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিনের চোখে অশ্রুর ধারা আরও বেগবান হলো। বলল সে, তাহলে কি দৃষ্টিতে আমি আপনাকে দেখি? কেন এত দ্বন্দ্ব, এত যন্ত্রণা আমার মধ্যে?
বলে ইভা নারিন দুহাতে তার মুখ ঢাকল। কান্না রোধের চেষ্টা করতে লাগল।
বিব্রত আহমদ মুসা ফেসিয়াল টিস্যর বক্সটা ইভা নারিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, প্লিজ ম্যাডাম নারিন, আমি জানি, খুবই বাস্তববাদী আপনি। ওরা আপনাকে কি দায়িত্ব দিয়েছে বলুন। আমি কিছু করতে পারি কিনা আপনার জন্যে?
বলল বটে আহমদ মুসা কথাগুলো প্রসঙ্গটা পাল্টে দেবার জন্যে। কিন্তু আহমদ মুসা এই অঞ চেনে। এমন অশ্রুর মুখোমুখি সে বহুবার হয়েছে। এই অশ্রুর পুরানো পরিচয় সে মনে করতে চায় না, মনে মনেও অশ্রুর নাম উচ্চারণ করতে ভীত আহমদ মুসা।
ইভা নারিন চোখ মুছে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, পারবেন আমার জন্যে কিছু করতে? শুনবেন আমার অনুরোধ?
সব মানুষের সব সাধ্য থাকে না। আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই করব। বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিন ছুটে এসে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসল। বলল, আপনাকে এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, প্লিজ ম্যাডাম নারিন, আপনি উঠুন।
বলে হাত ধরে তাকে টেনে তুলে সোফায় বসাল। নিজেও বসল তার সামনের সোফায়। আবার বলল আহমদ মুসা, কেন আমাকে এখনি এভাবে চলে যেতে বলছেন? প্লিজ, সব কথা আমাকে খুলে বলুন।
কিছু শোনার, জানার আপনার দরকার নেই। আপনি চলে যান প্লিজ। বলল ইভা নারিন। তার কণ্ঠে আকুল অনুরোধ।
ওরা নিশ্চয় আপনাকে আমাকে হত্যার দায়িত্ব দিয়েছে এই রাতেই। সব আমাকে বলুন। না হলে আপনার কথা আমি শুনতে পারব না। আহমদ মুসা বলল।
ইভা নারিন একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন, আজ রাতেই আপনাকে হত্যার নির্দেশ আমার উপর হয়েছে
ম্যাডাম নারিন, নিশ্চয় আপনি জানেন এই নির্দেশের অর্থ কি? ব্ল্যাক টাইগারকে যতটুকু বুঝেছি, ওরা ব্যর্থতা মানতে রাজি নয়, অনুরূপভাবে ব্যর্থ কাউকে ওরা বরদাশত করে না। এর অর্থ কি আপনি জানেন। বলল আহমদ মুসা।
জানি আমি। ইভা নারিন বলল। তার কণ্ঠ ভারি।
আমাকে পালিয়ে চলে যেতে দিয়ে আপনার ব্যর্থতার কি কারণ। ওদের কাছে বলবেন? বলল আহমদ মুসা।
বলব আমি আপনার কক্ষে পৌঁছার আগেই আপনি পালিয়ে গেছেন। ইভা নারিন বলল।
আপনার কথা ওরা বিশ্বাস করবে না। কারণ তারা জানে, হাতের মুঠোয় থাকা শত্রু হাতছাড়া করে দেবার মতো গোয়েন্দা, অফিসার আপনি নন। আপনি মোস্ট ওয়ান্টেড শত্রুকে পালিয়ে যেতে দিয়েছেন, ওরা এটাই নিশ্চিত ধরে নিবে। এর পরিণাম কি আপনি জানেন? বলল আহমদ মুসা।
জানি, অবধারিত মৃত্যু। কিন্তু সেটা পরের কথা। আমি এসব নিয়ে এখন ভাবছি না। আপনি নিরাপদ হবার পর এসব বিষয় আমি ভেবে দেখব। ইভা নারিন বলল।
কিন্তু আমি কোথাও যাচ্ছি না। একজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আরেকজনের সরে যাওয়া, এটা মানব সমাজের কাজ নয়, ম্যাডাম ইভা নারিন। বলল আহমদ মুসা।
ম্লান হাসি ইভা নারিনের মুখে। বলল, আপনি না গেলেই আমি মৃত্যু থেকে বেঁচে যাচ্ছি না। আমার ব্যর্থতা তো থাকছেই।
তাকাল আহমদ মুসা ইভা নারিনের দিকে। একটু ভাবল। বলল, বুঝেছি ম্যাডাম নারিন, তাহলে আপনার সামনে এখন দুটি পথ। খোলা। এক. আমাকে হত্যা করা এবং দুই. ব্ল্যাক টাইগারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া।
ইভা নারিনের ম্লান মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, দুই পথের কোনটাই আমার জন্যে নয়। আপনাকে হত্যা করার ইচ্ছা, সাধ্য কোনটাই আমার নেই। আর ব্ল্যাক টাইগারের মোকাবিলা করতে পারার প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে কি করবেন? বলল আহমদ মুসা।
আমার ভুল, পাপের খেসারত হয়তো আমাকে আমার জীবন। দিয়ে করতে হতে পারে। ইভা নারিন বলল। কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠেছে তার।
এটা তো একটা চ্যালেঞ্জের কাছে আত্মসমর্পণের কথা। আপনার বিবেক কি বলে ম্যাডাম নারিন? বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না ইভা নারিন। কয়েক মুহূর্ত যেন ভাবল। বলল, বিবেকের তাকিদেই তো আমি ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার এর সদস্য হয়েছিলাম।
আপনার তখনকার অভিজ্ঞতা আর এখনকার অভিজ্ঞতা এক নয়। আর ট্রেনের এই ঘটনা আপনি এর আগে দেখেননি। এখন আপনার বিবেক কি বলে?
বিবেকের কথা শোনা ছেড়ে দিয়েছি। কি শুনব বিবেকের কথা। ইভা নারিন বলল গম্ভীর কণ্ঠে।
ম্যাডাম নারিন, ব্ল্যাক টাইগার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, নাম ছাড়া। আপনি ব্ল্যাক টাইগারের কোন কাজে ক্ষুব্ধ বলে মনে হচ্ছে। অসুবিধা না থাকলে বলতে পারেন। বলল আহমদ মুসা।
আপনি ব্ল্যাক টাইগারকে যতটুকু জানেন, তার কিঞ্চিত বেশি আমি জানি। কিন্তু তাকে জানা বলে না। এক অন্ধকার থেকে আসা নির্দেশ আমি পালন করে যাচ্ছি। অন্ধকারে কি আছে, কারা আছে, কেন আছে তার কিছুই আমি জানি না। ইভা নারিন বলল। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
কি ধরনের নির্দেশ পালন করতে হয়েছে, তা থেকে আপনি বুঝেননি কিছু? বলল আহমদ মুসা।
তৎক্ষণাৎ উত্তর এল না ইভা নারিনের কাছ থেকে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, বিশেষ বিশেষ সংস্থা, সংগঠন, ব্যক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন রকম তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া। ফরমায়েশ অনুসারে হত্যা ও হত্যায় সহায়তা করার ঘটনাও আছে।
সাংঘাতিক ব্যাপার! আচ্ছা, এসব থেকে এদের পরিচয় ও কাজ সম্পর্কে কিছু আঁচ করতে পারেননি? বলল আহমদ মুসা।
ঐ সব সংস্থা, সংগঠন ও ব্যক্তির অধিকাংশই জাতিগত সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এ থেকে আমি বিশেষ কিছু ধারণা করতে পারিনি। ইভা নারিন বলল।
মাফ করবেন, ওদের কোন্ জিনিসটি আপনাকে আকৃষ্ট করেছিল যে জন্যে ওদের সদস্য পদ নিয়েছিলেন? বলল আহমদ মুসা।
সেটা একটা আবেগের ব্যাপার। গির্জার বিশেষ এক আয়োজনে আমি একজন ফাদারের বক্তৃতা শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পর্কে চাষ্ট্রে নীরব থাকা, নির্বিকার থাকা আমাদের জাতির অপরিসীম ক্ষতি করেছে। ইতিহাসের অধিকাংশ সময়ই জাতি দেশি বিদেশিদের দ্বারা শাসিত-শোষিত হয়েছে। তাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদির আড়ালে তারা সে শোষণ অব্যাহত রেখেছে। এই শোষণ বন্ধ করতে হবে যে কোন মূল্যে। এই বক্তৃতা আমার তরুণ মনকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তরুণ এক গোয়েন্দা অফিসার আমি তখন। হঠাৎ একদিন ঐ ফাদারের সাথে আমার দেখা হয়। তখন সেই বক্তৃতার কথা তুলে ধরে আমি বলেছিলাম, শোষণ কিভাবে বন্ধ করা যাবে। তিনি আমার সব পরিচয় জেনে নিয়ে পরে একদিন আমাকে ব্ল্যাক আর্মেনিয়ান টাইগার-এর সদস্য করে নিলেন ইভা নারিন বলল।
তাদের দেয়া কাজ থেকে তাদের সম্পর্কে নিশ্চয় আপনার একটা ইমপ্রেশন হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
যারা জেনে শুনে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যা করে, তারা খুনি ছাড়া আর কিছু নয়। ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি যারা বিদ্বেষ পোষণ করে, তারা সুস্থ নয়, অমানুষ হবার মতো অসুস্থ। ওদের যতটুকু আমি জেনেছি, তাতে এটাই আমার ধারণা ওদের সম্পর্কে। ইভা নারিন বলল।
এমন ধারণা আপনার যে সংগঠন সম্পর্কে, অন্তত আত্মরক্ষার জন্যে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না কেন? বলল আহমদ মুসা।
আত্মরক্ষা করা আর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক জিনিস নয় জনাব। ইভা নারিন বলল।
এক জিনিস নয় ঠিক। কিন্তু ঐ ধরনের সংগঠনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই শুধু আত্মরক্ষা করা যায়। বলল আহমদ মুসা।
আপনার পরামর্শ কি জনাব আমার জন্যে? ইভা নারিন বলল।
পরামর্শ বোধ হয় আমি দিতে পারি না, আমার মত বলতে পারি। বলল আহমদ মুসা।
হাসল ইভা নারিন। মিষ্টি হাসি। বলল, একজন পরামর্শ চাওয়ার পর এমন কথা বলা যায় না। তাহলে তার মনের উপর অবিচার করা হয়।
স্যরি ম্যাডাম নারিন, আমার পরামর্শ ও আমার মত একই কথা। বলল আহমদ মুসা।
আমার মনে হয় আজকের রাতের ঘটনার ব্যাপারে সত্য কথা ওদের বলা দরকার। বলবেন ওদেরকে যে, তাকে হত্যার জন্যে তার ঘরে আমি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম উনি আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। উনি আমাকে আগেই সন্দেহ করেছিলেন। সুতরাং আমার কাজের আমি সুযোগ পাইনি। আর আজই কোন এক সময় উনি চলে যাবেন। তাকে হত্যার কোন সুযোগ আমার আর হবে না। বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ধন্যবাদ জনাব। বাঁচালেন আমাকে। খুঁজেই পাচ্ছিলাম কি বলব ওদের। কোন্ কথাটা যৌক্তিক হবে, যা বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে ওরা। ওরা যে আবার আমাকে দায়িত্ব দেবে, শেষ কথাটায় তারও সুযোগ বন্ধ হবে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বলে একটু থামলো ইভা নারিন।
মুহূর্ত কয়েক পরে আবার বলে উঠল, এর পর কি হবে? ওদের জাল থেকে বের হবো কিভাবে? আপনি তো থাকছেন না, পরামর্শ পাব কোথায়?
প্লিজ, হাসাবেন না! আপনি পুলিশ প্রধানের মেয়ে। আপনি দেশের একজন শীর্ষ গোয়েন্দা অফিসার। আমি তাৎক্ষণিক দুএকটা মত বা পরামর্শ দিলাম বটে, কিন্তু বাইরে তাকাবার প্রয়োজন পরামর্শের জন্যে। তবু বলছি, যেটা আগেই বলেছি, আত্মরক্ষার জন্যে আপনাকে অফেনসিভে যেতে হবে। ট্রেনের তিন ঘটনার পর একটা সুযোগ তো এসেছে ওদের বিরুদ্ধে অল আউট অফেনসিভে যাওয়ার। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করুন। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। এই বিষয়টা আমার মনেই ছিল না। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু জনাব, আপনার সহযোগিতার বিকল্প এটা নয়। বলল ইভা নারিন।
একটু থেমেই আবার বলল ইভা নারিন, আপনার সাথে দেখা হবে, যোগাযোগ হবে, এটা আমি আশা করছি।
ট্যুরিস্টরা তো ভেসে বেড়ায়। আপনাকে আমি কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। আপনার ঠিকানা তো জানাই থাকলো। আস্থা থাকলে আপনার টেলিফোন নাম্বার দিতে পারেন। বলল আহমদ মুসা।
আপনি শেষ কথাটা একজনের মনকে আহত করার জন্যেই বলেছেন। ইভা নারিন বলল।
না ম্যাডাম নারিন, একজন গোয়েন্দা অফিসারের প্রাইভেট নাম্বার সাধারণত কাউকে দেয়া হয় না, এটা জানি। বলল আহমদ মুসা।
আপনি কি সাধারণ? আমি কি তাই মনে করতে পারি আপনাকে? আবারও আপনি এ কথাটা বললেন একটা মনকে আহত করার জন্যে। ইভা নারিন বলল। তার কণ্ঠ ভারি।
আমি একটা নীতির কথা বলেছি। স্যরি। বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিন কথা বলল না। মুহূর্ত কয়েক চুপ থাকার পর বলল, আমার সব কথা আমি বলেছি। আপনার সম্পর্কে আমি কিন্তু কিছুই জানি না। তবে এটুকু জানি, আপনি শুধুই ট্যুরিস্ট নন।
আপনার এই সন্দেহের কারণ? বলল আহমদ মুসা।
তেমন কোন প্রমাণ আমার কাছে নেই। তবে আমি জানি, আপনার মতো অতি অসাধারণ লোকরা কোন উদ্দেশ্য ছাড়া কোন টুরেও যান না, বিশেষ করে যখন একাকী যান। ইভা নারিন বলল।
ইভা নারিনের কথাটা আহমদ মুসার মনে ভাবান্তর সৃষ্টি করল। সে কি ইভা নারিনকে মিথ্যা কথা বলবে, সত্যটা কিংবা সত্যের। কাছাকাছি কিছু বলবে। তার কাজে ইভা নারিনের মতো গোয়েন্দা অফিসারের দরকার হতে পারে। তার পিতার প্রয়োজন তো হতেই পারে।
এসব ভাবতে ভাবতে উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ইভা নারিন।।
আহমদ মুসার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল, ম্যাডাম নারিন, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি একটা ছোট কাজ নিয়ে আর্মেনিয়ায় এসেছি।
আপনি কি কাজ নিয়ে এসেছেন সেটা জিজ্ঞাসা করা হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু বলতে পারি, কাজটা কিন্তু ছোট নয়। আপনার মতো। লোকরা যখন এভাবে কোথাও যায়, বড় কাজ নিয়েই যায়।
আহমদ মুসার মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, এক আলোচনায় সব জানা যায় না।
ধন্যবাদ। আমি তাহলে আরও আলোচনার সুযোগ পাব! অনেক ধন্যবাদ। ইভা নারিন বলল। তার চোখে আনন্দের ঔজ্জ্বল্য।
সমস্যায় পড়লে আপনাদের দ্বারস্থ আমাকে হয়তো হতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
আগাম ওয়েলকাম। দ্বারস্থ নয়, নির্দেশের অপেক্ষা করব। ইভা নারিন বলল।
আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল আহমদ মুসা।
অবশ্যই। প্রবল আগ্রহ নিয়ে বলল ইভা নারিন।
ব্ল্যাক টাইগারের সাথে সম্পর্ক কাট করার পর আপনাকে কিন্তু আপনার কলিগদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ভ্রূ কুঞ্চিত হলো ইভা নারিনের। ভাবল সে একটু। বলল, ঠিক বলেছেন। ঘনিষ্ঠ লোক কিংবা কলিগদের দিয়েই আমাকে ফাঁদে ফেলা ও হত্যার চেষ্টা করতে পারে। ধন্যবাদ আপনাকে।
ওয়েলকাম। গুড নাইট। বলল আহমদ মুসা।
আমাকে এভাবেই কক্ষ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন? বলল ইভা নারিন।
না, গুড বাই দিতে চাচ্ছি। আর তো কোন কথা দেখছি না। বলল আহমদ মুসা।
আমি যাচ্ছি। আপনার ঘুম আর নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু শেষ। একটা প্রশ্ন আছে। ইভা নারিন বলল।
বলুন। বলল আহমদ মুসা।
আপনি দরজা খোলার সাথে সাথে যদি আমি গুলি করতাম। তাহলে আপনি কিভাবে আত্মরক্ষা করতেন? আপনার হাত খালি ছিল। যতদূর জানি আপনার কাছে কোন রিভলবারও নেই। শক্রদের কাছ থেকে নেয়া যে রিভলবার ছিল, সেটা ট্রেন থেকে নামার সময় পুলিশকে দিয়ে এসেছেন। ইভা নারিন বলল।
আপনি ঘাড়ের পেছন থেকে রিভলবার নিয়ে গুলি করার আগেই আপনি মাটিতে পড়ে যেতেন। তখন আপনার রিভলবার আমার হাতে চলে আসত। বলল আহমদ মুসা।
আপনি কি করে জানলেন আমার ঘাড়ের পেছনে রিভলবার আছে? ইভা নারিনের প্রশ্ন।
আপনার গাউনের কলারটা অস্বাভাবিক উঁচু হয়ে আছে, রিভলবার রাখলে যেমনটা হতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিনের চোখে বিস্ময়!
একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আলোচনার সুযোগ নিয়েও তো আমি আপনাকে অন্য কোনভাবে হত্যা করতে পারতাম?
জানি সে রকম অস্ত্র আপনার কাছে আছে। কিন্তু সে অস্ত্র ব্যবহারের জন্যে দৈহিকভাবে ঘনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন হয়। সে সুযোগ আপনি পাননি। বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিনের চোখের বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। বলল, কি অস্ত্র সেটা?
আহমদ মুসা ইভা নারিনের ডান হাতের একটা আংটি দেখিয়ে বলল, এই স্পাই রিংটা।
আহমদ মুসার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা ইভা নারিন স্তম্ভিত হয়ে গেল। কোন কথা বলল না।
সম্মোহিতের মতো কিছুক্ষণ আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কি করে বুঝলেন এটা স্পাই রিং। এমন ডিজাইনের গোল্ড রিং খুবই সাধারণ!
ডিজাইনে একটু পার্থক্য আছে ম্যাডাম নারিন। সাধারণ গোল্ড রিংগুলো আঙুলে ঘোরানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু এই রিং-এর উপরের অংশ আঙুলের নিচের দিকে আপনাতেই ঘুরে যাবে না। এটা এই রিং বহনকারীর নিরাপত্তার জন্যে করা হয়েছে। উপরের অংশ যদি আঙুলের নিচে যায়, তাহলে হাত মুঠো করলে বা অন্য কোনওভাবে চাপ লাগলে বিষাক্ত পিন বহনকারীকেই আঘাত করতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়াবিষ্ট ইভা নারিন হা করে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে যেন তার। এক সময় ধীরে ধীরে সে মাথা নিচু করল। আবার মাথা তুলল ধীরে ধীরে। আহমদ মুসার দিকে কিছুক্ষণ পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল ইভা নারিন, আপনি আসলে কে? আপনি আবু আহাম্মদ আব্দুল্লাহ অবশ্যই নন! আপনার মতো এমন মানুষ পৃথিবীতে দুএকজনের বেশি থাকেন না এবং তাঁকে সারা দুনিয়া চেনে, আমরাও চেনার কথা। গভীর আবেগ-অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে আসা কথাগুলো নিস্তব্ধ শান্ত সাগরের মতো গভীর।; এই আবেগ-অনুভূতি আহমদ মুসার মনকেও স্পর্শ করল। আহমদ মুসার মুখও গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, দুঃখিত ম্যাডাম নারিন, আমার কাজের পরিচয় যেমন উহ্য থাকল, আমার পরিচয়টাও আজ উহ্য থাক।
চোখ দুটি আপনাতেই বন্ধ হয়ে গেল নারিনের।
যখন চোখ দুটি তার খুলে গেল, তখন অশ্রুতে দুচোখ তার পূর্ণ। বলল শান্ত কণ্ঠে, হ্যাঁ, এমন অবস্থায় আমি পড়লে আমিও হয়তো কাউকে বিশ্বাস করতে পারতাম না।
তার দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
সে উঠে দাঁড়াল।
ভাঙা কণ্ঠে গুড নাইট! বলে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
.
৬.
পুলিশ প্রধান অ্যারাম আড্রানিকের বাড়ি থেকে পর পর তিনটি গাড়ি বেরিয়ে এল। বাড়ির গেট থেকে ১০০ গজ এগোবার পর তিনটি গাড়ির একটি পশ্চিম দিকে, একটি পূর্ব দিকে এবং তৃতীয়টি দক্ষিণের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল।
সবগুলো গাড়িই হাইল্যান্ডার জীপ।
দক্ষিণমুখী গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসেছিল আহমদ মুসা। তার পাশের সিটে ইভা নারিন। আর পেছনের সিটে দুজন পুলিশ অফিসার।
এই ব্যবস্থা স্বয়ং পুলিশ প্রধান অ্যারাম আভ্রানিকের। তিনি চেয়েছিলেন আরও কয়েকদিন আহমদ মুসাকে তাদের বাসায়। রাখতে, অবস্থা নরমাল হওয়া পর্যন্ত। আহমদ মুসাকে ধরা বা হত্যার জন্যে তাদের বাসা ঘিরে যে অনেক ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে, তা সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ প্রধান এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আহমদ মুসা বাধা দিয়েছে। কারণ এসব করতে গেলে সংবাদ পত্রে নিউজ হতে পারে। আহমদ মুসার প্রসংগ কোনওভাবে তাতে এসে পড়তে পারে। আহমদ মুসা তা চায়নি। পুলিশ প্রধান কিছুই জানেন না, বিষয়টা এই ভাবেই রাখতে চেয়েছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা তাদের বাড়ি থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলে, তখন পুলিশ প্রধান তার জন্যে এই ব্যবস্থা করেন। তার সাথে দেন ইভা নারিন এবং দুজন পুলিশ অফিসারকে। তিনটি গাড়ির ব্যবস্থা এই জন্যে পুলিশ প্রধান করেছেন যে, তিন গাড়িকেই যদি ওরা ফলো। করতে চায়, তাহলে ওদের উপস্থিত শক্তিকে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। এমনও হতে পারে, শত্রুপক্ষ করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে। নিতে তিনটি গাড়িই ওদের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।
আহমদ মুসা তাকে পৌঁছে দেবার জন্যে এক ড্রাইভার ছাড়া আর কাউকেই নিতে চায়নি। বিশেষ করে ইভা নারিনকে সাথে দেবার তীব্র বিরোধিতা করেছে সে। কিন্তু পুলিশ প্রধান হেসে বলেছে, তোমাকে নিরাপদে পৌঁছানো আমার দায়িত্ব। ইভা নারিনকে সাথে না দিলে আমার মন নিশ্চিত হতে পারছে না। আর ইভা নারিন ওদিকেই যাবে। তোমাকে রেখে পর সে তার অ্যাসাইনমেন্টে যেতে পারবে। ইভা নারিনকে আহমদ মুসার সাথে দেবার জন্যে সবচেয়ে উৎসাহী ছিল আন্না এলিনা। অবশেষে সে-ই জয়ী হয়।
গাড়ি ড্রাইভ করার কথা ছিল একজন পুলিশ অফিসারের। পেছনের সিটে বসার কথা ছিল আহমদ মুসা ও ইভা নারিনের। কিন্তু গাড়িতে ওঠার সময় আহমদ মুসা সোজা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। ইভা নারিন আপত্তি করে বলে পাহাড়ি পথ, আপনি নতুন। উত্তরে আহমদ মুসা বলেছিল, এখন স্যাটেলাইট মানচিত্র দেখে সব রাস্তাঘাট মুখস্থ রাখা যায়, চিন্তা করবেন না।
আহমদ মুসার পাশের সিটে উঠে বসার সময় ইভা নারিন বলেছিল, বাবাকে ধন্যবাদ।
আমার কিন্তু দুঃখ হচ্ছে, তিনি জানেন না আমার মতো তাঁর মেয়ের মাথার উপরও মহাবিপদের খাড়া ঝুলছে। জানলে তিনি এই কাজ করতেন না। বলেছিল আহমদ মুসা।
সেজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ইভা নারিন বলেছিল। তার ঠোঁটে এক টুকরো দুষ্টুমির হাসি।
সামনের দুটি গাড়ি স্টার্ট নেবার পর তৃতীয় গাড়ি হিসেবে আহমদ মুসার গাড়ি রাস্তায় নেমে আসে।
মাঝারি গতিতে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসার হাইল্যান্ডার জীপ।
পুলিশ প্রধানের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে আসা দক্ষিণমুখী এই সড়কটি কিছু দূর এসে পশ্চিমে বাঁক নিয়ে মূল ইয়েরেভেন শহরকে বামে রেখে সোজা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসার হাইল্যান্ডার জীপ এই পথ ধরেই এগিয়ে চলছে।
জনাব সিটি সেন্টার হয়ে সোজা পথেই তো আমাদের নগরী থেকে বেরিয়ে যাবার কথা। আপনি কোন্ দিকে এগোচ্ছেন? বলল ইভা নারিন। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
আমি ঠিকই যাচ্ছি ম্যাডাম। ওয়েস্ট সার্কুলার রোড হয়ে আন্তাপ হয়েই আমরা সিটি থেকে বেরিয়ে যাব। আহমদ মুসা বলল।
আন্তাপ দিয়েই যদি আমরা সিটি থেকে বের হই, তাহলে আমরা এতটা পথ ঘুরছি কেন? বলল ইভা নারিন।
সন্ধ্যায় এ রাস্তাটা অনেকটাই ফ্রি থাকে। কেউ আমাদের ফলো করছে কিনা, সেটা দেখা সহজ হবে। আহমদ মুসা বলল।
ইভা নারিন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। মনে মনে বলল, অবাক ব্যাপার। আমার শহর, অথচ আমি এ দিকটা বিবেচনা করতে পারিনি। অদ্ভুত মানুষ। যতই দেখছি ততই সম্মোহিত হচ্ছি। তিনি মডেস্ট, মডারেট ও খুব সংবেদনশীল হৃদয়ের একজন। মানুষ। চরিত্রের দিক দিয়ে যেন একজন এ্যানজেল, ফেরিশতা। প্রয়োজন ছাড়া দৃষ্টি সে নত রাখে। বিশ্বে সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত এমন সম্প্রদায়ে আমার জন্ম। সবাই আমাকে খুবই সুন্দরী বলে। মিস আর্মেনিয়া কনটেস্টে যোগ দেবার জন্যে আমার কাছে প্রস্তাব এসেছিল। আমি সৌন্দর্যকে প্রদর্শনী ও ব্যবসায়ের বস্তু বানাতে চাইনি বলে যাইনি। সেই আমি অনেকবার তার সামনে দাঁড়িয়েছি, কথা বলেছি। কিন্তু তার চোখে কোন ভাবান্তর, কোন চাঞ্চল্য, বাড়তি কোন উৎসাহ, আবেগ কিংবা মুগ্ধতা কিছুই আমি দেখিনি। যেন পাথর, কোন কিছুই তার বুকে স্পন্দন তোলে না। আমার সৌন্দর্যের অহংকার তার পায়ে লুটোপুটি খায়। এই দুদিনেও তার নাম পরিচয় পর্যন্ত জানালেন না উনি। বলেছেন, জানার সময় হলেই জানতে পারবেন। বাবা তাকে এ বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞাসা করেননি। তিনি তার কাছ থেকে যা শুনেছেন তাই বিশ্বাস করেছেন।
ইভা নারিন গভীর চিন্তার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন।
আহমদ মুসার গাড়ি পূর্ব দিকে এল টার্ন নিয়ে আন্তাপের দিকে ছুটে চলছে। এই এলাকাটা অনেকটাই পাহাড়ীধাচের। দুপাশটা এবড়ো-থেবড়ো এবং ছোট বড় টিলায় ভরা। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া খুবই কম। তবে রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।
আহমদ মুসার গাড়ি আগের চেয়ে দ্রুত এগিয়ে চলছে।
পেছন ও সামনে থেকে চার চার করে আটটা হেডলাইট ছুটে আসছে তাদের দিকে।
শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে অপলক চোখে আহমদ মুসা তাকিয়ে আছে রিয়ারভিউ-এর দিকে। তার আগেই সন্দেহ হয়েছিল, চারটা গাড়ির হেডলাইট দুটি সামনে থেকে ও দুটি পেছন থেকে একই লেন ধরে এগিয়ে আসছে। কিন্তু কোন লেন ধরে আসছে এই বিষয়টি তার কাছে স্পষ্ট ছিল না। গাড়ি চারটি আরও কাছে আসার পর একদম সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, চারটা গাড়িই তার লেন ধরেই সামনে ও পেছন থেকে এগিয়ে আসছে। ডিস্ট্যান্স ইনডিকেটরে দেখল তার গাড়ি থেকে দুপাশের গাড়ির দূরত্ব কাটায় কাটায় সমান। এবং গতিও সমান।
ওদের মতলব বুঝে ফেলেছে আহমদ মুসা। তারা তার জন্যে ফাঁদ পেতেছে এমন জায়গায়, যেখানে এক্সিট নেবার কোন সুযোগ নেই। এমনকি রাস্তার পাশটা এতটায় এবড়ো-থেবড়ো যে দুএকগজও এগোবার মতো নয়।
আহমদ মুসা সিন্ধান্ত নিয়ে নিল। শেষ অপশন হিসেবে চওড়া রাস্তার সুযোগটা সে গ্রহণ করবে। দুদিকের চারটি গাড়িই রোড ডিভাইডারের পাশের দুই লেন ধরে এগিয়ে আসছে। আর আহমদ মুসার গাড়ি চলছে এই দুই লেনের মাঝ বরাবর।
দুদিকের চারটি গাড়িই একশ গজের মধ্যে চলে এসেছে।
ইভা নারিন তার চিন্তার মধ্যে একবারেই ডুবে গিয়েছিল।
কি কারণে হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে সামনে-পিছনে চোখ ফেলেই চিৎকার করে উঠল, মি. আব্দুল্লাহ সর্বনাশ, ওরা তো আমাদের, পিষে ফেলবে।
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। তার সমস্ত মনোযোগ। সামনের গাড়ি ও রিয়ারভিউ-এর দিকে।
আহমদ মুসার গাড়ির রাইট গ্রীন সিগন্যাল অব্যাহতভাবে সংকেত দিয়ে যাচ্ছে।
আতংকিত ইভা নারিন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার মুখ ভাবলেশহীন। তার দুই চোখ পথরের মতো স্থির রিয়ারভিউ ও সামনের গাড়ির দিকে। তার এক হাত শক্তভাবে ধরে আছে গিয়ার, আর এক হাত স্টেয়ারিং হুইলে। কোন দিকে কোন ভ্রূক্ষেপ, তার নেই। যেন দুনিয়ার সবকিছু থেকে সে বিচ্ছিন্ন। ভয়ংকর কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে তার কোন প্রতিফলন তার চোখে মুখে নেই।
দুদিক থেকে ছুটে আসা চারটি গাড়ির দূরত্ব যখন চল্লিশ গজের মতো, তখন শিউরে উঠল ইভা নারিন। কথা তার মুখে জোগাল না। তাকিয়ে রইল সে আহমদ মুসার দিকে বোবা দৃষ্টিতে। পাথরের মতো স্থির নির্বিকার চেহারা আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল ডিস্ট্যান্স ইনডিকেটরের দিকে। ইনডিকেটরে তখন ১৫ গজের দূরত্ব।
আহমদ মুসা মুখ তুলে তাকাল দুই দিকের অবস্থানের উপর। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ম্যাডাম নারিন, আপনারা দুহাতে মাথা জড়িয়ে ধরে হাঁটুতে মুখ গুজুন।
পরক্ষণেই আহমদ মুসার গাড়ি প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এল অ্যাংগলে বাম দিকে ঘুরে গেল। গাড়ি স্থির হবার আগেই সেকেন্ডের ব্যবধানে গাড়ি আরেকটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে এল অ্যাংগলে ডানদিকে বাঁক নিয়ে সামনে এগোলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। গাড়ির সবাই প্রচণ্ড সংঘর্ষের আওয়াজ শুনল। তারপরেই পর পর কয়েকটা বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা গেল।
গাড়ি থেমে গেল আহমদ মুসার।
হাটুর আশ্রয় থেকে মুখ তুলল ইভা নারিন।
আহমদ মুসা ব্রেক কষেই দুহাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে সিটে গা এলিয়ে দিল। চোখ বুজল সে। আল্লাহর সাহায্য ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার হৃদয় বিগলিত। অজস্র শুকরিয়া আদায় করল সে আল্লাহর।
ইভা নারিন মাথা তুলেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসাকে সিটে গা এলিয়ে থাকা ও চোখ বুজা অবস্থায় দেখে উদ্বিগ্ন। ইভা নারিন আহমদ মুসার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, আপনি ঠিক আছেন তো মি. আব্দুল্লাহ?
আহমদ মুসা চোখ খুলেই দ্রুত সোজা হয়ে বসল। ইভা নারিনের দিকে তাকিয়ে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলল, ঠিক আছেন তো ম্যাডাম নারিন? উত্তরের অপেক্ষা না করেই আহমদ মুসা তাকায় দুই পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, আপনারা ঠিক আছেন তো?
সবে পুলিশ দুজন ঠিক হয়ে বসেছে। তাদের চোখে মুখে আতংকের ছায়া তখনও আছে। তাদের একজন বলল, আমরা ভাল আছি স্যার।
আহমদ মুসা মুখ ফিরাল ইভা নারিনের দিকে। তার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যরি, এই ঝুঁকি নেয়া ছাড়া আর কোন অপশন ছিল না।
স্যরি কেন? বিস্ময়কর এক কৌশলে আপনি আমাদের জীবন। বাঁচিয়েছেন। ঝুঁকিটা সাংঘাতিক বিপজ্জনক ছিল, কিন্তু আপনি যে অবিশ্বাস্যভাবে তা ডিল করেছেন তাতে ঝুঁকিটা এখন বড় কোন বিষয় ছিল বলে মনে হচ্ছে না অবশ্যই। কিন্তু আসলেই তা ছিল ভয়ংকর একটা ব্যাপার। আপনাকে ধ্যনবাদ দেবার কোন ভাষা আমার জানা নেই। বলল ইভা নারিন।
কোন জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা জানালা দিয়ে জ্বলন্ত গাড়িগুলোর দিকে তাকাল। গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে দ্রুত কণ্ঠে বলল, আপনারা আসুন, দেখি লোকগুলোর কি হলো। কোন সাহায্য করা যায় কিনা?
দরজা খুলে আহমদ মুসা ছুটল সেদিকে।
ইভা নারিন ও দুইজন পুলিশ অফিসারও গাড়ি থেকে বের হয়ে তার পিছু নিল।
চারটি ট্রাকেরই হেড টু হেড সংঘর্ষ হয়েছে। চারটি গাড়িরই সামনের অংশ ভেঙে, দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। তার উপর চারটি ইঞ্জিনই বিস্ফোরিত হয়েছে। আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সামনের অংশসহ সর্বত্র।
আহমদ মুসা ঘুরে দেখছিল শেষ মুহূর্তে ড্রাইভার কিংবা কেউ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পড়েছে কিনা। আহত হলেও তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এমন কাউকেই দেখতে পেল না সে।
দাঁড়িয়ে পড়েছে আহমদ মুসা।
তার পাশে এসে দাঁড়াল ইভা নারিন।
পেছনে দুজন পুলিশ অফিসার।
কেউ বেঁচে নেই মনে হচ্ছে। বলল ইভা নারিন।
ওদের একটা বৈশিষ্ট হলো, ওরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করে, মৃত্যুর মুখ থেকে পালায় না। আজও তাই হয়েছে। প্রাণ বাঁচাবার জন্যে কেউ গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়েনি। আহমদ মুসা বলল।
ওরা যে ফাঁদ পেতেছিল, সেই ফাঁদে পড়ে তারাই জীবন দিল। বলল ইভা নারিন।
যারা মারা পড়ল, আসলে ফাঁদ কিন্তু তারা পাতেনি। যারা ফাঁদ তৈরি করেছে, তারা কিন্তু বহাল তবিয়তে আরাম কেদারায় বসে তাদের তৈরি করা ফাঁদের সাফল্যের কথা ভাবছে। কিন্তু যখন এই ধ্বংসের খবর তাদের কাছে পৌঁছবে তখন ব্যর্থতার জন্যে এই মৃত্যুবরণকারী লোকদের প্রতিই তারা ক্রুদ্ধ হবে। তাদের আত্মবিসর্জনের কথা, এদের পরিবারের কথা কিছুই তারা ভাববে না। এরা যেমন মারা গেল, এদের পরিবারও তেমনি হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে। আহমদ মুসা বলল। তার শেষের কথাগুলো আবেগে ভারি হয়ে উঠেছিল।
বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে ইভা নারিন তাকাল আহমদ মুসার দিকে। যারা মারতে এসেছিল, তাদের মৃত্যুতে আহমদ মুসার এই ভাবাবেগ দেখে অবাক হলো সে। যারা জীবন-মৃত্যুর খেলায় জড়িত তাদের তো এমন ভাবাবেগ থাকে না! অদ্ভুত তো এই মানুষটা!
বলল ইভা নারিন, জনাব, ওরা না মরলে আমাদের মরতে হতো। জীবন-মৃত্যুর এই খেলায় কোন ভাবাবেগের কি সুযোগ আছে?
এটা ভাবাবেগ নয়, মানবিকতা। আসলে ওরা আমাদের শত্রু নয়, শত্রুরা ওদের ব্যবহার করেছে। সুতরাং মানবিক সহানুভূতি তারা পেতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
সব দেশের সৈনিকরা বেতন ভুক। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তারা প্রতিপক্ষ, শত্রু। ইভা নারিন বলল।
হ্যাঁ, তারা প্রতিপক্ষ ও শত্ৰু। কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় যখন তারা নিহত হয়, আহত হয়, বন্দী হয়, তখন মানবিক বিবেচনায় তাদের দেখার কথা।
ধন্যবাদ! বলে ইভা নারিন মোবাইল সামনে নিল এবং পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সাথে কথা বলল। জানিয়ে দিল এই ইনসিডেন্টের খবর।
মোবাইল অফ করে বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, চলুন আমরা যাই। অল্পক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে যাবে।
গাড়িতে উঠে ইভা নারিন বলল, চারটি ট্রাক নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণের আয়োজন তারা কখন করল? ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না!
আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, আমার মনে হয় তারা আমাদের গাড়িকে আগেই সন্দেহ করেছে। তাহলেই শুধু এ ঘটনা ঘটা সম্ভব। বলল আহমদ মুসা।
তিন গাড়ির মধ্যে আমাদের গাড়িকে তারা সন্দেহ করবে কেন, কিভাবে? ইভা নারিন বলল।
আপনাদের বাড়ি থেকে কেউ তাদের বিষয়টা জানিয়ে দিলে এই ঘটনা সম্ভব হতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
অসম্ভব! আমাদের বাড়িতে অমন কেউ নেই। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ইভা নারিন বলল।
নিশ্চয় ওরা কোনোভাবে জানতে পেরেছে। থাক এ প্রসংগ। আমরা আন্তাপ-এ এসে গেছি। আস্তাপেই তো আমি নেমে যাব। বলল আহমদ মুসা।
আপনি কোথায় যাবেন? ইভা নারিন বলল।
আহমদ মুসা তাকাল ইভা নারিনের দিকে। একটু চিন্তা করল। বলল, আমি গোরিসে যাব।
গোরিস দক্ষিণ-পূর্ব আর্মেনিয়ার একটা সীমান্ত শহর। এখান থেকে আজারবাইজান খুব কাছে। আবার এখান থেকে আর্মেনিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত পথও আছে।
গোরিসের নাম শুনে ইভা নারিনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। বলল, সেখান থেকে আপনি কি কাঁপান যাবেন?
কাপান আরও পশ্চিম-দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর।
আহমদ মুসা তাকাল ইভা নারিনের দিকে। বলল, এ প্রশ্ন কেন?
কারণ, গোরিস থেকে আজারবাইজান যাবার রাস্তা আছে, আরেকটা রাস্তা আছে কাঁপান হয়ে আরও দক্ষিণে যাবার। আপনি তো আজারবাইজান যাবেন না। সুতরাং বাকি থাকে কাঁপান। বলল ইভা নারিন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ঠিক ধরেছেন, আমি কাঁপান যাব।
আবার ভ্রু কুঞ্চিত হলো ইভা নারিনের। মাথা নিচু করে একটু ভাবল সে। তারপর মুখ তুলে সে বলল, আপনি আসলে দিভিন উপত্যকায় যেতে চাচ্ছেন।
ইভা নারিনের এ কথা আহমদ মুসাকে বিস্মিত করল না। কাঁপান যাওয়ার কথা যখন জেনেছে, তখন দিভিন যাওয়া আমার লক্ষ্য হতে পারে, তা ধরে নেয়া স্বাভাবিক তার মতো গোয়েন্দা অফিসারের জন্যে।
হ্যাঁ ম্যাডাম নারিন, আমি দিভিন যাব। বলল আহমদ মুসা।
আমি আর প্রশ্ন করে আপনাকে বিব্রত করবো না। তবে আমাকে বিশ্বাস করলে বলতে পারেন। যাক, আমি আপনাকে কাঁপান নামিয়ে আসতে পারি, যদি আপনি আপত্তি না করেন। আমি যাব আগারাক। গত পরশু আমাদের একজন গোয়েন্দা অফিসার সেখানে নিহত হয়েছেন। বলল ইভা নারিন। তার কণ্ঠ গম্ভীর।
আহমদ মুসা একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ম্যাডাম নারিন, আমার নাম পরিচয় আমি আপনার, আপনাদের কাছে লুকিয়েছি ঠিক, কিন্তু সেটা অবিশ্বাস করে নয়। গোপনীয়তার একটা ধর্ম আছে। যেমন আপনি ব্যাট-এর সাথে যোগাযোগ রাখতেন, আপনার বাবা এটা জানতেন না। এটা আপনার বাবাকে আপনি অবিশ্বাস করার কারণে নয়।
একটু থামল আহমদ মুসা। আবার শুরু করল, আমি দিভিন যাবার জন্যেই আর্মেনিয়া এসেছি ম্যাডাম নারিন। সেখানে…।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই ইভা নারিন বলল, প্লিজ, আত্মাকে ম্যাডাম বলবেন না। আমরা কাছাকাছি বয়সের হবো, বড় নিশ্চয় হবো না? আমাকে নাম ধরে ডাকলে আমি খুশি হবো। খুব খারাপ লাগে ম্যাডাম সম্বোধন শুনতে আপনার কাছ থেকে। মনে হয় যেন একটা দেয়াল তুলে দিচ্ছেন আপনি আমাদের মাঝখানে। অন্তত বন্ধুও কি হতে পারি না! ভারি কণ্ঠ ইভা নারিনের।
নারিন, আমরা আন্তাপ পৌঁছে গেছি। এখানে থামার কথা বলেছিলেন। বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিন মুখ নিচু করে ছিল। মুখ তুলল সে। বলল, হ্যাঁ, প্লিজ থামুন এখানে।
হাতের টিস্যু দিয়ে মুখ মুছল নারিন। তাকাল পেছনের দিকে। বলল, অফিসার, আপনারা তো এখানে নামবেন। ইয়েবুনিতে পৌঁছেই হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করবেন। ওখান থেকে নির্দেশ পাবেন। ও.কে অফিসার। গুডলাক।
থ্যাংক ইউ ম্যাডাম! বলে দুজন অফিসার গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
ইভা নারিনও গাড়ি থেকে নামল।
পুলিশ অফিসার দুজন ইভা নারিনকে স্যালুট দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
গাড়িতে তার সিটে ফিরে এল ইভা নারিন।
আমি মনে করেছিলাম ওরা আপনার এ্যাসাইনমেন্টের সংগী। বলল আহমদ মুসা।
ওদের কাজ ইয়েবুনিতে। ওরা ভিন্ন গাড়িতে আসত। কিন্তু বাবা বললেন, তুমি যখন আত্তাপ হয়ে যাচ্ছ, তখন ওরাও তোমাদের সাথে যাক। একটা বাড়তি সিকিউরিটির ব্যবস্থা হবে। ইভা নারিন বলল।
কথা শেষ করেই আবার বলল সে, আপনি যা বলতে শুরু করেছিলেন, আপনার সে কথাটা শেষ করতে পারেন।
দিভিন উপত্যকায় কি ঘটছে, তার সবকিছু নিশ্চয় আপনি জানেন। বিষয়টা আমিও একটু দেখতে চাই। সেজন্যেই আমি এসেছি। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় ফুটে উঠল ইভা নারিনের চোখে-মুখে। সুদূর আমেরিকা। থেকে উনি এসেছেন বিষয়টা শুধুই কি দেখার জন্যে! কি দেখবেন তিনি?
দিভিনের সব ঘটনা আপনি জানেন? ইভা নারিন বলল।
সব হয়তো আমি জানি না, কিছু জানি। আমি সব জানতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
তারপর? ইভা নারিন বলল।
তারপরের চিন্তা সবকিছু জানার পরেই। বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।
আপনি দিভিন জনপদের মানুষকে সাহায্য করতে চান। আপনার কাছ থেকে মানুষ এটাই আশা করতে পারে। তাই তো? ইভা নারিন বলল।
এ দায়িত্ব তো আপনাদের, আপনাদের প্রশাসনের। বলল আহমদ মুসা।
এ দায়িত্ব আমাদের প্রশাসন পালন করতে চেষ্টা করছে। আমাদের যে গোয়েন্দা অফিসার আগারাক-এ নিহত হয়েছেন, তিনি দিভিন উপত্যকার ঘটনা নিয়ে তদন্ত করছিলেন। ইভা নারিন বলল।
এর আগেও এই তদন্তে জড়িত আরও চারজন গোয়েন্দা অফিসার আপনারা হারিয়েছেন। বলল আহমদ মুসা।
আপনি সেখবরও জানেন? ইভা নারিন বলল।
রাবেতা, ইউনেস্কো ও ওআইসির আরও পাঁচ জন কর্মকর্তা দিভিন উপত্যকার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। বলল আহমদ মুসা।
প্রবল বিস্ময় ইভা নারিনের চোখে-মুখে। বলল, এ তথ্যও আপনি জেনেছেন! দিভিন উপত্যকার সমস্যার বিষয়ে আর কি জানেন আপনি?
রাবেতা ও ওআইসির চিঠিতে আহমদ মুসা দিভিন সম্পর্কে যা জেনেছিল, তা থেকে দিভিনের লোকদের বংশ পরিচয়টা গোপন রেখে তাদের সমস্যা-সংকটের বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরে সে বলল, নীরব-নির্মূলের এই ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে, কেন ঘটাচ্ছে। সেটা জানতেই আমি এসেছি।
ধন্যবাদ মি. আবু আব্দুল্লাহ। কিন্তু আপনি সবই তো জানেন। আপনি যে উদ্দেশ্যে এসেছেন, সে উদ্দেশ্যে আমরাও কাজ করছি। কিন্তু আমরা যেখানে হিমশিম খাচ্ছি, রাবেতা, ওআইসি, ইউনেস্কোর উদ্যোগও যেখানে ফেল করেছে, সেখানে আপনি একজন ব্যক্তি কি করবেন? ইভা নারিন বলল।
কি করতে পারবো জানি না, কিন্তু করার চেষ্টা করব। চেষ্টা করাই তো মানুষের কাজ, ফল দেয়ার ক্ষমতা আল্লাহর। বলল আহমদ মুসা।
দিভিন উপত্যকার তদন্তে এ পর্যন্ত পাঁচজন গোয়েন্দা অফিসারসহ দশজন তদন্তকারী মারা গেছেন। এ থেকেই এ সমস্যার জটিলতা, ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। একজন ব্যক্তিমাত্র হিসাবে এমন অন্ধকার ভয়াবহতার মধ্যে পা দিতে আপনার ভয় করছে না? ইভা নারিন বলল।
যে বা যারা আমার প্রতিপক্ষ তারা মানুষ, আমি ভয় করব কেন? সুযোগ পেলে, সমর্থ হলে কোন মানুষ আমাকে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু তাকে আমি ভয় করি না। বলল আহমদ মুসা।
মৃত্যু আপনার কাছে এত তুচ্ছ বিষয়? মৃত্যু মানে তো এ সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায়! অতএব মৃত্যু তো ভয়ের, আতংকের বিষয়! ইভা নারিন বলল।
মানুষের জন্যে মৃত্যু অবধারিত করেছেন আল্লাহ, মৃত্যুর দিন ক্ষণ সবই সুনির্দিষ্ট আছে। এর কোন হেরফের আল্লাহ করবেন না। তাই কোন কাজে মৃত্যু ভয়ের এ বিষয়টি ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। নির্ধারিত দিন ক্ষণ ছাড়া মৃত্যু হবে না, এটা শক্তির একটা প্রবল উৎস। বিপজ্জনক কাজে এই শক্তির খুব বেশি প্রয়োজন।
ইভা নারিন বিস্ময় ভরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। তার মনে হচ্ছে, কথাগুলো এক পরম অভয়বাণী হিসেবে তার হৃদয়ে প্রবেশ করছে। খুশিতে ভরে উঠল ইভা নারিনের মন। অনন্তকাল ধরে এমন মানুষের সঙ্গি হওয়া যায়। বলল সে, ধন্যবাদ, আপনার এ কথাগুলো যেন মহৎ এক উপদেশবাণী। মনে হচ্ছে বার বার শুনি। সত্যিই মি. আব্দুল্লাহ আমার মধ্যে যেন নতুন এক ইভা নারিনকে দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমার শক্তি সাহস বেড়ে গেছে।
ধন্যবাদ! বলে আহমদ মুসা প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল, এদিকের পাহাড়ি রাস্তা তো মজার। আঁকা-বাঁকা যাকে বলে তার অপূর্ব নির্দশন এই রাস্তা। বাঁক পার হয়ে স্থির হবার আগেই আরেক বাঁক।
কিন্তু এর পরেও আপনি যে স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছেন, তার অর্ধেক স্পিডেও আমি চালাতে পারবো না। আপনি এ রাস্তায় আগে আসেননি নিশ্চয়। ইভা নারিন বলল।
না আসিনি। রাস্তার এ হাল আর কতদূর পর্যন্ত চলবে? বলল আহমদ মুসা।
রাস্তার এ হাল সামনে আরও বেহাল হবে। জিগ-জ্যাগের সাথে যোগ হবে আরোহন, অবরোহন। ইভা নারিন বলল। তার মুখে হাসি।
এ রকম রাস্তায় গাড়ি চালাতে আমার ভালই লাগে। আপনাদের গাড়ি আপত্তি না করলেই হয়। বলল আহমদ মুসা।
দেখছি, সব কঠিন কাজ আপনার ভাল লাগে। চার ট্রাকের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে স্যান্ডউইচ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেও দেখেছি আপনার নির্বিকার ভাব, যেন কিছু ঘটছে না। ইভা নারিন বলল।
নারিন, এটা কঠিন কাজকে, কঠিন অবস্থাকে ভাল লাগা নয়, ভালবাসা নয়, বরং কোন কঠিন কাজকেই ভয় করা। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু মি. আব্দুল্লাহ এই ভয় করা কঠিন কাজ, কঠিন। অবস্থার চেয়েও কঠিন। ইভা নারিন বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, পুরনো কথাই বলতে হয় নারিন। আপনি যদি ক্ষতির ভয়, মৃত্যু ভয় জয় করতে পারেন, তাহলে কোন ভয়ই আপনার কাছে ভয় থাকবে না।
মি, আব্দুল্লাহ আমি আপনাকে যতই দেখছি….!
আহমদ মুসা ইভা নারিনের কথার মাঝখানে বলে উঠল, ইভা। নারিন সামনে চেয়ে দেখুন।
ইভা নারিন সামনে তাকিয়ে দেখল, সামনের রাস্তাটা ব্লক করে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ছয় জন মানুষ গাড়ির সামনে অস্ত্র বাগিয়ে অবস্থান নিয়েছে।
সংগে সংগেই ব্যাপারটা আঁচ করল ইভা নারিন। বলল সে, মি, আব্দুল্লাহ আমি বুঝেছি। আরেক ফাঁদ পাতা হয়েছে আমাদের জন্যে। ইভা নারিনের কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসা পেছন দিকসহ আশপাশটা দেখছিল।
আহমদ মুসা ইভা নারিনের কথার কোন জবাব না দিয়ে বলল, বাম দিকে ফাঁকা জায়গাটার ওপারে গাছ-গাছড়ার মধ্যে দেখা যাচ্ছে ওটা কি কোন বাড়ি?
ওটা একটা রেস্ট হাউজ। সাথে তেলের একটা পাম্প আছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটা শপও আছে। ইভা নারিন বলল।
আমরা তো একটা উপত্যকা থেকে একটা চড়াই বেয়ে এই টিলায় উঠে এলাম। সামনের রাস্তাটা কেমন? দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।, সামনের লোকগুলো ও গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার পরেই রাস্তার অবরোহন শুরু। ইভা নারিন বলল।
তার পরেই মানে কত ফুট পরে হতে পারে? বলল আহমদ মুসা।
চার পাঁচ ফুটের বেশি হবে না। একেবারে উত্রাই-এর মুখেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ইভা নারিন বলল।
কথা শেষ করেই ইভা নারিন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠল, মি. আব্দুল্লাহ দেখুন রেস্ট হাউজের দিক থেকে পাঁচ-ছয় জন গোটা চত্বর কভার করে অস্ত্র বাগিয়ে এগিয়ে আসছে।
পেছন থেকেও গাড়ি চড়াই বেয়ে উপরে উঠে আসছে। গাড়ির হেড লাইটের খুব স্পষ্ট আলো দেখা যাচ্ছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা এসে পৌঁছবে আমাদের পেছনটা ব্লক করার জন্যে। বলল আহমদ মুসা। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামনে।
আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিয়েছিল।
সামনের গাড়ি ও লোকদের ৩০ ফিটের মতো দূরে এসে আহমদ মুসা হর্ন দিতে দিতে থেমে গেল। থেমেও হর্ন দিতে থাকল।
আপনি এটা কি করছেন মি. আব্দুল্লাহ? হর্ন দিয়ে কি লাভ? ওরা তো…।
ইভা নারিনের কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলল, আমরা নিরীহ শান্তিকামী নাগরিক। আমরা ওদেরকে আমাদের পথ ছেড়ে দিতে বলছি। আমি চাই ওরা আমাদের বোকা ঠাওরাক।
হঠাৎ আহমদ মুসা হর্ন বন্ধ করে দিয়ে গাড়ি দ্রুত পিছাতে শুরু করল। বলল, নারিন, মাথা নিচু করে শক্ত হয়ে বসুন।
আহমদ মুসাকে পিছাতে দেখে সামনের লোকগুলো কেউ তাদের উদ্যত স্টেনগান নামিয়ে আবার কেউ উপরে তুলে সানন্দে সামনে এগোচ্ছে। তাদের গাড়িটাও স্টার্ট নেবার শব্দ হল।
আহমদ মুসার গাড়ি হঠাৎ ঝড়ের বেগে সামনে এগোতে লাগল।
সামনে থেকে আসা লোকগুলো কি ঘটছে তা বোঝার চেষ্টা করছিল। যখন বুঝে ফেলল, তখন আহমদ মুসার গাড়ি প্রায় তাদের ঘাড়ের উপর। তারা এদিক ওদিক দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করল।
আহমদ মুসার গাড়ি সবে স্টার্ট নেয়া সামনের গাড়িটার পেটে গিয়ে আঘাত করল প্রচণ্ড বেগে। আঘাত করেই আহমদ মুসা নিজের গাড়ি সামলে নিয়ে রাস্তা বরাবর আনার জন্যে স্টিয়ারিং ডান দিকে কিছুটা ঘুরিয়ে নিল। স্পিডটাও সেই সাথে কিছুটা কমিয়ে এনেছিল। তার গাড়িটা উত্রাই বেয়ে তীর বেগে এগিয়ে যেতে লাগল।
আর রাস্তা ব্লক করা স্টার্ট নেয়া গাড়িটা এক পাশে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ছিটকে নিচে গড়িয়ে পড়ল।
আহমদ মুসার গাড়ি তীর বেগে উত্রাই পেরিয়ে সমতল রাস্তায় নেমে এল।
আগেই ইভা নারিন মাথা তুলে সোজা হয়ে বসেছিল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা। শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে। তার দুই চোখ সামনের দিকে পাথরের মতো স্থির। কিন্তু মুখ ভাবলেশহীন। বিপজ্জনক এ্যাকশনের সময় আহমদ মুসাকে আরও একবার সে দেখেছে। এমন এ্যাকশনের সময় আহমদ মুসার এই অবয়ব দেখতে অপূর্ব। ইভা নারিন পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকল আহমদ মুসার দিকে। তার হৃদয় জুড়ে তখন তোলপাড়। চরম বিপদও যেন তার কাছে ছেলেখেলা! কিন্তু কি অসীম সাহস, কি বিদ্যুতগতির ক্ষীপ্রতা, কি অদ্ভুত কৌশল! সামনে কি ঘটবে সে ব্যাপারে সামান্য চিন্তাও তার মধ্যে নেই! আগের ঘটনায় সে দেখেছে চার ট্রাকের কবল থেকে অসম্ভবরকম টার্ন নিয়ে বেরুতে, সামান্য বিলম্ব হলেই গাড়ি শুদ্ধ তারা পিষে যেত। আর এই ঘটনায় দেখল উদ্যত স্টেনগানধারী আধডজন মানুষের ব্যারিকেড সরিয়ে ওদের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে পথ করে বেরিয়ে আসার অবিশ্বাস্য ঘটনা। এসব ঘটনার কথা মনে হলে এখনো। তার বুকের স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। কে এই রূপকথার রাজপুত্র, যিনি সব পারেন!
গাড়ি সমভূমিতে নেমে আসার পর আহমদ মুসা রিয়ারভিউ এর দিকে একবার তাকিয়ে সিটে হেলান দিয়ে বলল, নারিন, যখন কোন পথ আর থাকে না, তখন আল্লাহ পথ করে দেন। যখন সবটুকু ভরসা আল্লাহর উপর ন্যাস্ত করা হয়, তখন আল্লাহ সহায় হন। আর আল্লাহ সহায় হলে আর ভয় থাকে না।
পরপর দুটি ভয়ংকর ঘটনা দেখার পর আপনি যা বলবেন, তাই বিশ্বাস করবো। তবু একটা প্রশ্ন, আগের ঘটনায়, এখনকার ঘটনায় যে দুঃসাহসিক পদক্ষেপ আপনি নিলেন, এই পদক্ষেপের অসম্ভব সিন্ধান্তটা আপনার মাথায় এল কি করে? এ নিয়ে আমিও ভেবেছি, কিন্তু কোন পথ দেখতে পাইনি। ইভা নারিন বলল।
বিপদ আসা যেমন বাস্তবতা, বিপদ থেকে বাঁচার একটা পথ থাকা বা যতই আটঘাট বাঁধা হোক তার দুর্বল একটা দিক থাকাও তেমনি বাস্তবতা। ওদের ফাঁদের দুর্বল পথটাই আমি বেছে নিয়েছিলাম। আল্লাহ সাহায্য করেছেন। বলল আহমদ মুসা।
ইভা নারিন কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা বলে উঠল, একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইভা নারিন, এই অল্প সময়ের মধ্যে আটঘাট বেঁধে এই আক্রমণের সুযোগ ওরা পেল কি করে? আন্তাপ থেকে এ পর্যন্ত আসার পথে আমাদের কেউ ফলো করেনি, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তাহলে ওরা জানল কি করে যে, আমরা কোন পথে যাচ্ছি, কোথায় আমাদের আটকাতে হবে! আন্তাপ থেকে এ পর্যন্ত ডানে-বামে অনেক পথ আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। ওগুলোর যে কোন পথে আমরা যেতে পারতাম। এই পথেই আমরা আসছি, সেটা তাদের জানার কথা নয়। জানলো কি করে ওরা!
ইভা নারিন বিস্ময় ভরা চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ঠিক বলেছেন, মি. আব্দুল্লাহ, ওদের জানতে পারার কোন সুযোগ আমি দেখছি না। জানল কি করে তাহলে? ইভা নারিনের চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
নারিন, আপনাদের এই গাড়িটা গত দুদিনের মধ্যে গ্যারেজে পাঠানো হয়েছে? বলল আহমদ মুসা।
না পাঠানো হয়নি। এ গাড়িটা আমার। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। ইভা নারিন বলল।
আপনার দেহে এমন কিছু কি আছে, যার সাথে ব্ল্যাক টাইগার এর সম্পর্ক আছে, বিশেষ করে যে জিনিসটা সব সময় আপনার কাছে থাকে। বলল আহমদ মুসা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো ইভা নারিনের। সে তার ডান অনামিকার সোনার আংটিটি দেখিয়ে বলল, ব্ল্যাক টাইগারের সদস্য পদ পাওয়ার পর আমার প্রাপ্য হিসেবে এই আংটিটা আমি তাদের থেকে পেয়েছি। রিংটা আমাকে দেয়ার আগে একটা লটারি হয়। নতুন সদস্য হলে তার জন্যে একটা লটারি হয়। লটারিতে তার জন্যে যা উঠে, তা সব সময় তাকে কাছে রাখতে হয়। সেই কারণে এই গোল্ড রিংটা আমি আঙুলে রেখেছি।
এই রিংটা যদি আমি এখন বাইরে ছুঁড়ে দিতে বলি, ছুঁড়ে ফেলে দেবেন? বলল আহমদ মুসা।
হাসল ইভা নারিন। বলল, চলন্ত গাড়ি থেকে আমাকেও যদি ঝাঁপ দিতে বলেন, তাও পারব, আর একটা গোল্ড রিং-এর তো কথাই নেই। তবু জানার জন্যে জিজ্ঞাসা করছি, রিংটা ফেলে দিতে হবে কেন?
এই রিং-এ নিশ্চয় ট্রান্সমিটার চিফ সেট করা আছে। ঐ ট্রান্সমিটারই অবিরাম আমাদের অবস্থান জানাচ্ছে। সেই খবর থেকেই তারা আমাদের লোকেশন ঠিক করছে। বলল, আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল ইভা নারিনের। বলল, ও গড, গোয়েন্দার উপর গোয়েন্দাগিরী। বলে ইভা নারিন আঙুল থেকে গোল্ড রিংটি খুলে বাইরে ছুঁড়ে দিল। তারপর সিটে বসেই মাথা নুইয়ে আহমদ মুসাকে বাও করল। বলল, আমার আমিত্বের সব কিছু নিয়ে আপনার কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা, প্রশংসা নিবেদনের কোন ভাষা আমার জানা নেই। কণ্ঠ ভারি ইভা নারিনের।
একটু থামল নারিন। নিজেকে একটু সামলে নিল। বলল, আমি এতদিন ওদের ট্রান্সমিটার বইয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি! আমার প্রতিটি পদক্ষেপ তারা মনিটর করেছে! আজ বুঝতে পারছি, হঠাৎ আমাকে তারা ঐভাবে অ্যাসাইনমেন্ট দিত কিভাবে। ওরা বলতো, আপনি তো অমুক জায়গায় আছেন, এই কাজটা আপনি করুন। আমি অবাক হলেও ভাবতাম আমাদের সংগঠনের নেটওয়ার্ক সব জায়গায় আছে। এ বিষয়টা নিয়ে আমি কোন দিনই গভীরভাবে ভাবিনি। সত্যি গোয়েন্দা হিসাবে এটা আমার বড় ব্যর্থতা।
আপনি কোনোভাবে ওদের সন্দেহ করলে আপনার চোখে। নিশ্চয় বিষয়টা ধরা পড়তো। থাক, এ প্রসংগ। গোরিসে কিন্তু ওরা ইতিমধ্যে খবর পাঠিয়েছে। গোরিসে কোন ঝামেলা তারা করতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
একটা সুবিধা আমাদের হয়েছে। এখন হয়তো ওরা আমাকে আর মনিটর করতে পারছে না। ওরা মনে করতে পারে এই উপত্যকাতেই, যেখানে রিংটি পড়ে আছে, সেখানই আমাদের গাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো আমাদের গাড়ি খারাপ হয়েছে, ভাবতে পারে। বলল ইভা নারিন।
ধন্যবাদ। ঠিক বলেছেন নারিন। এটাই ঘটবে। তবু তারা গোরিসে ওদের লোকদের অ্যালার্ট করতে পারে। আমি ভাবছিলাম, গোরিসে না গিয়ে কাঁপান যাবার কোন বিকল্প পথ আছে কি না। বলল আহমদ মুসা।
প্লিজ, তাহলে গাড়ি থামান মি, আব্দুল্লাহ। একটা সুযোগ আমাদের হাতে আছে। যখন গোরিস-কাঁপান রোড তৈরি হচ্ছিল, তখন সোজা পথে উপকরণ সরবাহের জন্য গোরিস-কাঁপানের মধ্যবর্তী স্থান পর্যন্ত একটা ট্র্যাক তৈরি করা হয়। এই রাস্তাটা তেমন ব্যবহার হয় না। হেভি গাড়ির জন্যে তৈরি রাস্তাটায় ছোট গাড়ির পক্ষে চলা খুব কষ্টকর। ইভা নারিন বলল।
ধন্যবাদ নারিন। ভালো খবর। কষ্টকর হোক, ঐ পথেই যাব, যদি আপনি রাজি থাকেন। বলল আহমদ মুসা।
আপনি যে পথে যাবেন, সে পথ আগুন বিছানো হলেও আমার জন্যে তা.আনন্দদায়ক হবে। অতএব যাত্রা শুরু করুন। একটু সামনে গিয়েই দক্ষিণ-পূর্বমুখী ট্রাকটা আমরা পাব।
আহমদ মুসার গাড়ি আবার স্টার্ট নিল। গাড়ি ঘুরিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে আহমদ মুসা দেখতে পেল ট্র্যাকটা।
সামনে ওটাই সেই ট্র্যাক। ইভা নারিন বলল।
চলতে লাগল গাড়ি গোরিস-কাঁপান রোডের উদ্দেশ্যে।
আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি সামনে।
ইভা নারিনের দৃষ্টি সামনের দিক থেকে ঘুরে এসে স্থির হলো আহমদ মুসার মুখে। অন্ধকার রাতের এমন নীরব-নিঝুম যাত্রায় তাঁর মতো নিরাপদ ও নির্ভর করার মতো এমন সাথীর কথা ভাবেনি সে কোন দিন। কে এই বিস্ময়কর মানুষ! এঁর মতো, কাউকে যেন খুঁজেছে সে সারা জীবন। সেই প্রতীক্ষা যেন পূর্ণ হয়েছে এঁকে দেখার পর। চোখ দুটি তার আবার ঘুরে গাড়ির হেডলাইট পেরিয়ে সামনের অন্ধকারে নিবদ্ধ হলো। ঐ অন্ধকারের মতোই তার জীবন। সেখানে আলো নেই, আশা নেই, আছে হৃদয়হীন এক পেশা। আজ খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে তাকে। মাথা খুঁজতে মন চাচ্ছে কোন নিরাপদ আশ্রয়ে।
.
৭.
রাত তখন সাড়ে ৯টা।
আহমদ মুসার গাড়ি কিমাতে পৌঁছল।
কিমা কাঁপান থেকে আরও বিশ-পঁচিশ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে। কেফানেই আহমদ মুসার নামার কথা ছিল এবং কথা ছিল ইভা নারিন আহমদ মুসাকে কেফানে নামিয়ে দিয়ে কাদঝারান, লিচক, মেগ্রি হয়ে আগারাকে যাবে। কিন্তু কেফানে এসে ইভা নারিন আহমদ মুসাকে বলে, কেফান থেকে দিভিন যাওয়ার পথ খুব দুর্গম। রাস্তা একটা আছে বটে, কিন্তু গাড়ি পাওয়া যাবে না রাতে। এ যুক্তি দেখানোর পর পরামর্শ দিয়ে বলে, তার চেয়ে যদি কিমাতে যাওয়া যায়, তাহলে দিভিন উপত্যকায় যাওয়া আপনার জন্যে সহজ হবে এবং দিভিন কাছেও হবে। মানচিত্র দেখে আহমদ মুসা খুশি হয়েই বলে, ঠিক বলেছেন। কিমাত থেকে যে আঁকাবাঁকা পথটা দিভিনের দিকে আরও পশ্চিমে গেছে, সেটা থেকে আর একটা রাস্তা দিভিনের উত্তর প্রান্ত দিয়ে ঢুকে দিভিনের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ সীমান্ত ঘেঁষে বয়ে চলা আরাশ নদীর সমান্তরাল হাইওয়েতে পড়েছে। খুব সহজেই আহমদ মুসা রাজি হয়ে যায় ইভা নারিনের প্রস্তাবে।
কিমাতে এসে দিভিন উপত্যকার দিকে যাওয়ার রাস্তার মুখে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার।
স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসে একবার তাকল আহমদ মুসা ইভা নারিনের দিকে। বলল, ধন্যবাদ ইভা নারিন, আমাকে বিশাল একটা লিফট দিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমার পথ এবার ভিন্ন দিকে। আমি নামছি।
ভিন্ন দিকে কেন? ঐ পথ আমারও হতে পারে। দিভিনের ভেতর দিয়ে যে রাস্তা আরাশ হাইওয়েতে উঠেছে, সে রাস্তা ধরে গিয়ে আমি সহজেই আগারাকে পৌঁছতে পারি। ইভা নারিন বলল। তার ঠোঁটে হাসি।
আহমদ মুসার মুখ গম্ভীর হলো। বলল, সত্যি বলুন তো ইভা নারিন, আমাকে পৌঁছে দেয়া উদ্দেশ্য, না আমি কোথায় যাচ্ছি, সেটা দেখাই আপনার উদ্দেশ্য?
গাম্ভীর্যের একটা ছায়া নামল ইভা নারিনের মুখে। বলল, আমি আগারাকে যাব ঐ তদন্তে, একথা সত্য। তার সাথে এটাও সত্য যে, বাবার নির্দেশ আমার উপর আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া। আপনাকে পথে ছেড়ে দিতে তিনি নিষেধ। করেছেন। আমি সেটাই করতে চাই। শুরুতেই আপনাকে বলিনি, কারণ আপনি এত লম্বা লিফট নিতে কিছুতেই রাজি হতেন না। ইতিমধ্যে আবার আপনার সাথে দিভিন যাওয়ার প্রবল আগ্রহ আমার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। আমি যে তদন্তভার নিয়ে আগারাক৷ যাচ্ছি, দিভিনে গেলে সে বিষয়ে আমি সাহায্য পেতে পারি বলে। আমার মনে হয়। সুতরাং এ দিক থেকে দিভিন যাওয়াটা আমার জন্যে প্রয়োজন।
ধন্যবাদ নারিন। আপনার প্রয়োজন যদি থাকে, আমার কোন আপত্তি নেই। আমার কথা বিশেষভাবে ভাবার জন্যে আপনার পিতার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বলে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল দিভিনের সড়কে আহমদ মুসা।
.
দিভিনে প্রবেশ করেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
উপত্যকার মাঝ বরাবর একটা ক্ষীণকায় নদী। তার দুই পারে ক্ষেত, বাগান, গাছ পালা ও বসতি। দুই পারের পাহাড়ের ছায়ায় শুয়ে থাকা উপত্যকা জমাট অন্ধকারে ঢাকা। মাঝে মাঝে আকাশের তারার মতো জ্বলছে গ্যাস বাতিগুলো। চারদিকে এক নিঝুম নীরবতা।
উপত্যকার পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে মোটামুটি প্রশস্ত একটা সড়ক। এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে দক্ষিণে সীমান্ত নদী আরাশের দিকে।
এই সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
হঠাৎ ডান দিকে টিলার দিক থেকে হৈ চৈ ও আগুন আগুন বলে চিৎকার শুনতে পেল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা ব্রেক কষল, গাড়িতে। তাকাল ইভা নারিনের দিকে। ইভা নারিনও তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
চলুন দেখা যাক। ইভা নারিন বলল। ধন্যবাদ নারিন! বলে গাড়ি ঘুরিয়ে চলল টিলাটির দিকে আহমদ মুসা।
[পরবর্তী বই আতংকের দিভিন উপত্যকা]
Leave a Reply