সাইমুম ৫৫ – ডেথ ভ্যালি – আবুল আসাদ
প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০১৪
এইচ থ্রি’র কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে আহমদ মুসা। এই মুক্তিটাই আবার সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে আমেরিকান সরকার ও আহমদ মুসার জন্য। আহমদ মুসা সব গোপন তথ্য আমেরিকান সরকারকে জানিয়ে দিলে আমেরিকা অ্যাকশনে আসবে এই ভয়ে এইচ থ্রী সন্ত্রাসীরা আমেরিকার উপর ভয়ঙ্কর গোপন অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। এই মহাবিপজ্জনক মুহুর্তে শুধুমাত্র আমেরিকাকে বাঁচাতে পারে আবার আহমদ মুসাকে নিখোঁজ হয়ে যেতে হলো। …. আমেরিকার উপর এ যেন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’। চুপসে গেছে আমেরিকান সরকার। এল আমেরিকার উপর তিন দিনের আল্টিমেটাম- তিন দিনের মধ্যে শর্ত মেনে না নিলে গোপন অস্ত্র প্রয়োগ করবে সন্ত্রাসীরা। শর্ত মেনে নিলে আমেরিকা আবার আমেরিকা থাকে না। অন্যদিকে এই ভয়ঙ্কর গোপন অস্ত্র মোকাবিলা করার ক্ষমতা নেই আমেরিকার। সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ধ্বংস করাই এখন একমাত্র পথ, কিন্তু সময় কোথায়? পথে নামল আহমদ মুসা। কিন্তু কোথায় ওদের অস্ত্র? শুরু হল আহমদ মুসার জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক, ঝুকিপূর্ণ ও ভয়ঙ্কর অভিযান। তিল তিল করে অগ্রসর হতে লাগল সে। আল্টিমেটামের মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি, জীবন- মৃত্যুকে মহান আল্লাহর হাতে সপে দিয়ে একাই সামনে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসা। আমেরিকার উপর মহলে তখন চলছে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! কি করছে আহমদ মুসা? ….. আহমদ মুসা পারবে কি ওদের গোপন অস্ত্র ধ্বংস করতে? পারবে কি আমেরিকাকে বাঁচাতে? এসব প্রশ্নের জবাবসহ শ্বাসরুদ্ধকর এক কাহিনী নিয়ে হাজির হলো ডেথ ভ্যালি।
***
সাইমুম ৫৫ – ডেথ ভ্যালি – আবুল আসাদ
প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০১৪
###
এই বইয়ের কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তি কিংবা কোন ঘটনার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।–লেখক।
###
মারিয়া জোসেফাইন ও সারা জেফারসন পাশাপাশি সোফায় বসে। দুজনেরই মুখ গম্ভীর।
বাম দিকের আরেকটা সোফায় বসেছিল সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসন। তার চোখ-মুখ উদ্বেগে ঠাসা।
গতকালের স্টোরিটাই এতক্ষণ বিস্তারিত বলছিল সারা জেফারসন।
বলা শেষ করেছে সে। তার পরেই নেমে এসেছে গাম্ভীর্য ও উদ্বেগের এক পরিবেশ।
মারিয়া জোসেফাইনের গাম্ভীর্যের আড়ালে অশ্রুর এক বন্যা নেমেছে তার হৃদয় জুড়ে। ধৈর্যের অনড় বাধ ভেঙে চোখ পর্যন্ত গড়াতে পারছে না। বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না এমনই এক ধৈর্যের প্রতিমূর্তি মারিয়া জোসেফাইন। কিন্তু হৃদয়ের প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস রোধ করে কথা বলতে পারছে না সে।
নীরবতা ভাঙল জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা। বলল, সারা, তুমি সব কথাই বললে। কিন্তু আমাদের ছেলে মানে আহমদ মুসা কোথায় আছে, কেমন আছে, সেটাই তো জানা গেল না। কি সেটা জানা যায়নি মা। তবে সবাই আশা করছেন মা, তিনি ভালো আছেন। বলল সারা।
তাহলে তুমি সারারাত ঘুমাতে পারনি কেন? কেন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছ। কেন জোসেফাইন মা, তুমি কথা বললে, হাসার চেষ্টা করলেও তা কান্নার মত হয়ে উঠছে? কেন মনে হচ্ছে অশ্রুর সাগর ডিঙিয়ে তোমার সব কথা বেরিয়ে আসছে? জিনা জেফারসন বলল।
মা, আমাদের মন দুর্বল বলে আমাদের কাছে আশংকার দিকটাই প্রধান হয়ে উঠে। আমারও তাই হয়েছে মা। স্যরি। এর চেয়েও ভয়াবহ বিপদে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন। নিশ্চয় এবারও করবেন। সারা ঠিকই বলেছে। আমারও মন বলছে তিনি ভালো আছেন। বলল মারিয়া জোসেফাইন।
আমিন। তোমার মনের কথাই আল্লাহ যেন সত্য করেন, মা।
এ সময় ইন্টারকমের প্যানেল বোর্ডে নীল আলো সংকেত দিতে লাগল।
নিশ্চয় আমাদের গেট থেকে। আমি দেখছি।
বলে দ্রুত উঠে গিয়ে সারা জেফারসন ইন্টারকম অ্যাটেন্ড করল।
ম্যাডাম, আলাইয়া অ্যানজেলা নামে এক ম্যাডাম…।
ওপারের কথা শেষ হতে না দিয়েই সারা জেফারসন কথার মাঝখানেই বলে উঠল, হ্যাঁ, ওর আসার কথা আছে, পাঠিয়ে দাও।
ঠিক আছে। বলে ওপার থেকে কল অফ করল।
আপা, ওঁকে আমি নিয়ে আসছি। মারিয়া জোসেফাইনকে লক্ষ্য করে এই কথা বলেই সারা ছুটল।
মিনিটখানেকের মধ্যেই আলাইয়া অ্যানজেলাকে নিয়ে এল সারা জেফারসন।
আলাইয়া অ্যানজেলাকে সারা জেফারসন জোসেফাইনের সামনে নিয়ে এল। উঠে দাঁড়াল জোসেফাইনও।
ইনি মারিয়া জোসেফাইন, ফরাসি রাজকন্যা, আহমদ মুসার স্ত্রী। সারা জেফারসন বলল।
অ্যানজেলার মুখে একটা চমকানো ভাব ফুটে উঠল। ফরাসি রীতিতে। একটা বাউ করল অ্যানজেলা। সংগে সংগেই বলে উঠল, এখানে এসে আহমদ মুসার স্ত্রীকে দেখতে পাব, তা কল্পনাও করিনি। আজকের যুগের এক প্রবাদ পুরুষের স্ত্রীকে দেখে খুশি হলাম। তার উপর তিনি ফরাসি রাজকন্যা। অভিনন্দন ম্যাডাম।
রাজকন্যা-টাজকন্যা কিছু নই। সারা আমাকে খুব ভালোবাসেতো, তাই আমার নামের আগে সব সময় বিশেষণ লাগায়। আমি মানুষ, আহমদ মুসার স্ত্রী, তাতেই আমি খুশি। বলল জোসেফাইন।
না অ্যানজেলা। আমি অহেতুক বিশেষণ লাগাইনি। আমার আপা মারিয়া জোসেফাইন ফ্রান্সের বিখ্যাত বুরবন রাজবংশের সরাসরি সব। শেষ বংশধর, তাহলে তো রাজকন্যাই হয়। সারা জেফারসন বলল।
এসব কথা থাক। আসুন সবাই আমরা বসি।
বলে সারা জেফারসন অ্যানজেলাকে সামনের সোফাটায় বসিয়ে ফিরে এসে জোসেফাইনের পাশে বসল।
আমি সারার কাছে সব শুনেছি মিস অ্যানজেলা, আপনি আহমদ মুসার জন্যে অনেক কিছু করেছেন। আপনাদের সাহায্যেই উনি ওদের হাতের বাইরে যেতে পেরেছেন। কৃতজ্ঞ আমি মিস অ্যানজেলা। বলল মারিয়া জোসেফাইন।
অ্যানজেলা উঠে দাঁড়াল। মারিয়া জোসেফাইনকে একটা ছোট্ট বাউ করে বলল, ম্যাডাম আহমদ মুসা, স্যরি, আমাকে কৃতজ্ঞতা কেন? বরং আমি আমরা আপনাকে এবং আহমদ মুসাকে কৃতজ্ঞতা জানাব। আহমদ মুসা আমেরিকানদের জন্যে যে অবর্ণনীয় কষ্টের বোঝা মাথায় তুলে। নিয়েছেন, তা আমরা কোন কিছু দিয়েই শোধ করতে পারব না। আমি ও শ্যালন যে তাঁকে সামান্য সহযোগিতা করতে পেরেছি, তার জন্যে আমরা গর্ব বোধ করছি। চিরদিন কথাটা আমরা সবার কাছে বলতে পারব। আমরা ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি এ সুযোগ আমাদের দিয়েছিলেন।
সিটে আবার বসে পড়ল অ্যানজেলা। বসেই বলল, ম্যাডাম আহমদ মুসা, উপরে ও সব পাশ থেকে ঘেরাও হওয়ার সেই কঠিন অবস্থায় তিনি আমেরিকার সিকিউরিটির বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং যে কোন মূল্যে ওদের হাতে ধরা পড়া যাবে না, চিন্তা করেছেন। এজন্যেই তিনি গাড়িসহ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সেই দৃশ্যের কথা মনে হলে এখনও আমার বুক কাঁপে। এমন পরার্থে জীবন যার, তার প্রতি প্রতিটি আমেরিকান কৃতজ্ঞ থাকবে।
মিস অ্যানজেলা, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা, প্রশংসা নয়, তার জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ রাখেন, সফল করেন। বলল জোসেফাইন।
আমিন। বলল অ্যানজেলা।
আমিন। সারা জেফারসনও বলল।
জর্জ আব্রাহাম আংকেল তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ফল কিছু। হয়েছে? জিজ্ঞাসা করল অ্যানজেলাকে সারা জেফারসন।
অ্যানজেলা সংগে সংগে উত্তর দিল না।
তার মুখটা মলিন হয়ে গিয়েছিল। সাথে সাথে মুখ নিচুও হয়ে। গিয়েছিল তার।
মুখ তুলে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলল, এফবিআই আমাদের বাসা থেকে পরীক্ষার জন্যে কিছু জিনিস নিয়ে এসেছেন, যেমন, সিসিটিভির মনিটরডিস্ক, টেলিফোন টকের রেকোর্ড, আব্বার কয়েকটি কনফিডেনশিয়াল ফাইল, আব্বার পার্সোনাল কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক।
অ্যানজেলা তার বাবার ডাইরি যে এফবিআই প্রধানকে দিয়েছেন, তার কোন উল্লেখ সে করল না।– ঘটনা কি অ্যানজেলা? চাচাজান মানে তোমার আব্বা ওদের সহযোগিতা করেছিল কেন? বলল সারা জেফারসন।
অ্যানজেলা কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল।
এ সময় সারাদের ইন্টারকম কথা বলে উঠল আবার, ম্যাডাম, জর্জ আব্রাহাম জনসন এসেছেন।
হ্যাঁ, তাঁর আসার কথা আছে। আমি আসছি। বলে উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন। সাথে সাথে অ্যানজেলাকে লক্ষ্য করে বলল, অ্যানজেলা, জর্জ আব্রাহাম আংকেল এসেছেন। আগেই
জানিয়েছিলেন। তুমি বস, আমি তাঁকে নিয়ে আসি।
ম্যাডাম, আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ আর কথা তো হয়েই গেছে। আমি এখন উঠি। অ্যানজেলা বলল।
ঠিক আছে, উনি এলে দেখা করে যাও। আর আমার প্রশ্নটার জবাব। দাওনি তুমি। একটু বস, আসছি।
বলে সারা জেফারসন দ্রুত বেরিয়ে গেল। এক-দেড় মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল জর্জ আব্রাহাম জনসনকে নিয়ে।
অ্যানজেলা ও মারিয়া জোসেফাইন উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানাল।
জর্জ আব্রাহাম জনসন বসতে বসতে বলল, মা জোসেফাইন, মা অ্যানজেলা, তোমরা কেমন আছ?
জি আংকেল, আমরা ভালো আছি। দুজনে প্রায় একসাথেই বলে উঠল।
তোমার মা কেমন আছেন? অ্যানজেলাকে জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহামের।
খুব খারাপ নয় আংকেল। অ্যানজেলা বলল।
স্যরি অ্যানজেলা। বলল জর্জ আব্রাহাম।
না আংকেল, আপনারা যা করছেন তা দেশের জন্যে করছেন। আমরাও আপনাদের সাথে আছি। সত্য যতই বেদনাদায়ক হোক, সত্য সত্যই। অ্যানজেলা বলল।
ধন্যবাদ অ্যানজেলা। তোমাদের দেশপ্রেম আমাদের গর্বের বিষয়। বলল জর্জ আব্রাহাম।
ধন্যবাদ আংকেল। আংকেল আমি এখন উঠব। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই দেখা করতে এসেছিলাম।
বলে তাকাল সারা জেফারসনের দিকে তার কাছে বিদায় নেবার জন্যে।
ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে। বলল সারা জেফারসন।
হাসল অ্যানজেলা। বলল, আচ্ছা, বলব ম্যাডাম।
অ্যানজেলা তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। তারপর সারা জেফারসনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ম্যাডাম, আপনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমার আব্বা ওদের সহযোগিতা করলেন কেন? এর জবাবটাই শুনতে চাচ্ছেন তো?
ওটা তো আমারও জানার বিষয়, অ্যানজেলা। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।– মাথা নিচু করে একটুক্ষণ চুপ করে থাকল অ্যানজেলা। তারপর শুরু করল, আমার বাবা সম্পর্কে আমিও জানার চেষ্টা করছি। আমি অনেকটাই বিস্ময়ের মধ্যে রয়েছি। আমার বিস্ময়ের শুরু আমি পাস করে বেরোবার আগের সময় থেকে। পাস করার আগেই বাবা আমাকে বলেছিলেন, তোমার গবেষণার বিষয় আমাদের কোম্পানির কাজে লাগবে। পাস করার পর আমাদের কোম্পানিতে যোগ দেবে। পাস করার পর কয়েকবার বলেছেন তার প্রস্তাবের কথা। আমি সব সময় বলেছি, বাবা, তোমার কোম্পানির কাজ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, কাজের বিষয়টা কি তাও জানি না, আমি কি করে সিদ্ধান্ত নেব? বাবা স্পষ্ট করে কখনই কিছু বলেননি। সর্বশেষ এই ঘটনার দিন সকালে বাবা আমাকে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, সেদিনের মধ্যেই তাকে আমার মত দিতে হবে। সেদিন তিনি আমাকে তার কোম্পানির নাম বলেছিলেন, এইচ কিউব বা এইচগ্রি আর কাজ সম্পর্কে বলেছিলেন কৌশলগত অস্ত্রের গবেষণা। আমি এই কোম্পানির নাম আগে শুনিনি বলে কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। আপনাদের কোম্পানি রেজিস্টার্ড কি না? আর এ ধরনের কোম্পানির তালিকায় আপনাদের এ কোম্পানির কোন নাম আমি দেখিনি। সরকার এই অস্ত্র গবেষণার বিষয় অবহিত কি না? কারণ অস্ত্র বিক্রি-ব্যবসায়ে সরকারের অনুমোদন দরকার হয়। কোম্পানির লোকেশনটা কোন্ শহরে, কোন এলাকায়? প্রশ্নগুলোর উত্তরে বাবা শুধুই বলেছেন, কাজে যোগ দাও, সবই জানতে পারবে। তিনি আরও একটি কথা বলেছিলেন, কম্যুনিটির জন্যে দায়িত্ব পালন খুবই মূল্যবান, আমাদের জন্যে এটা সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। বাবার এসব কথা থেকে আমার মনে হয়েছে বাবা এইচ থ্রি কোম্পানির একজন মূল ব্যক্তি। এ কথা ভাবতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমার যে বাবাকে নিয়ে আমি অরাজনৈতিক নিঃস্বার্থ সমাজসেবী হিসেবে গর্ব করি, আমার সেই বাবা মনে এমন ধারণা পোষণ করেন এবং আইনের চোখে অবৈধ ব্যবসায়কেও তিনি অন্যায় মনে করেন না! অ্যানজেলা বলল। তার কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল।
ধন্যবাদ মা অ্যানজেলা। তুমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছ। তুমি সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিলে তোমার বাবা ও তাদের ব্যবসায় সম্পর্কে আমরা আর কি জানতে পেরেছি। সাংঘাতিক, বিপজ্জনক তথ্য আমরা জানতে পেরেছি। ঘাঁটি থেকে পাওয়া দলিল-পত্র থেকে আমরা যেটা জানতে পেরেছি তা হলো, দুনিয়াতে কারো হাতে নেই, এমন ভয়ংকর অস্ত্র তারা তৈরি করেছে। কিন্তু কেন করেছে, এই বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। বলল জর্জ আব্রাহাম জানসন।
বিস্ময়, আতংক ফুটে উঠেছে অ্যানজেলার চোখে-মুখে। তার মনে পড়ল, তার আব্বা বলেন তার কম্যুনিটি মানে জায়োনিস্ট স্বার্থের কথা।
এটাই তার অগ্রাধিকার, আমেরিকার স্বার্থ তার কাছে বড় নয়। তাহলে }
এ অস্ত্রগুলো কি জায়োনিস্ট স্বার্থের জন্যে? বুক কেঁপে উঠল অ্যানজেলার। ধীর কণ্ঠে বলল, সত্য কি আমি জানি না স্যার, কিন্তু আমার মনে হয়, এই অস্ত্রগুলো জায়োনিস্টদের স্বার্থে তৈরি হয়েছে।
ভ্রূ-কুঞ্চিত হলো জর্জ আব্রাহাম জনসনের। জায়োনিস্টদের স্বার্থ কি? বলল জর্জ আব্রাহাম।
হতে পারে বারগেনিং, ব্ল্যাক মেইলিং আর এর মাধ্যমে তাদের দাবি আদায়। অ্যানজেলা বলল।
কি দাবি? আমাদের ইহুদি নাগরিকদের আলাদা বা বিশেষ দাবি আছে বলে আমি জানি না। বলল আব্রাহাম জনসন।
ইহুদিরা তো জায়োনিস্ট নয়। তারা ধর্মভীরু ও দেশপ্রেমিক নাগরিক। যারা ইসরাইলের স্রষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক, যারা আমার বাবার মত এক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নাগরিক হয়েও স্বদেশ ও স্বদেশের নাগরিকদের বাদ দিয়ে জায়গানিস্টদের স্বার্থ পূরণকে অগ্রাধিকার দেয়, এরা তারা। অ্যানজেলা বলল।
তোমার মতে তারা কোন স্বার্থ দাবি করতে পারে বারগেনিং বা ব্ল্যাক মেইলিং-এর মাধ্যমে? বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আংকেল, সব বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার নয়। বাবার কথায় আমি যা বুঝেছি, আমি সেটা বললাম। অ্যানজেলা বলল।
অ্যানজেলা। তুমি তো ইহুদি ঘরের মেয়ে। তুমি তো জায়োনিস্ট নও। ওরা জায়োনিস্ট হলো কি করে? বলল জর্জ আব্রাহাম।
আংকেল, আমি ইহুদি। আমি নিয়মিত সিনাগগে যাই। আমাদের ধর্মের জন্য প্রফেট মুসা থেকে। কিন্তু জায়গানিস্টদের সৃষ্টি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে। ওদের ধর্ম, ওদের সিনাগগ সবই ইসরাইল রাষ্ট্র। ওরা যে জাতি স্বার্থের বা কম্যুনিটি স্বার্থের কথা বলে, সেটা আসলে ইসরাইলের স্বার্থ, ইহুদিদের স্বার্থ নয়।
ধন্যবাদ মা। তোমরা নিউ জেনারেশন আমাদের ভরসা। তোমরা খৃস্টান, মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য সবাই মিলে সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতির নতুন আমেরিকা গড়ে তুলবে।
বলে একটু থেমে আবার শুরু করল, বিষয়টা নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত মা। তোমার কথায় চিন্তা আরও বাড়ল। তুমি ওদের যে ধরনের জাতীয় সাম্প্রদায়িকতার কথা বললে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। ধর্মের নীতি থাকে, ভৌগোলিক জাতীয়তা বোধেরও একটা নীতি থাকে, কিন্তু যারা ধর্মকে এক্সপ্লয়েট করে, তারা সব নীতি আদর্শকে এক্সপ্লয়েট করে থাকে। এমন লোকরা যখন ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র যোগাড় করে, তখন তা উদ্বেগ-আতংকের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
গড সেভ আস। অ্যানজেলা বলল।
একটু থেমেই আবার বলল, স্যার, শেষ পর্যন্ত আহমদ মুসা সম্পর্কে কি জানা গেল?
অনুসন্ধান চলছে, এটাই এখন আমাদের টপ প্রায়োরিটি। বলল জর্জ আব্রাহাম।
জোসেফাইন ও সারা জেফারসন দুজনেই হতাশ চোখে তাকাল আব্রাহাম জনসনের দিকে।
স্যার, এখন আমি উঠতে চাই।
বলে অ্যানজেলা তাকাল জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের দিকে।
আচ্ছা মা, ঠিক আছে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
অ্যানজেলা উঠে দাঁড়াল। বলল, স্যার, যখন দরকার হবে বলবেন, ডাকবেন। দেশ ও জনগণ আমার কাছে বড় স্যার।
ধন্যবাদ অ্যানজেলা। খুব খুশি হলাম। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
অ্যানজেলার সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়েছিল জোসেফাইন ও সারা জেফারসন।
তারা তিনজনই একসাথে হাঁটতে হাঁটতে এগুলো। জোসেফাইন দরজা থেকে ফিরে এল। আর সারা জেফারসন অ্যানজেলাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে এল।
সারা জেফারসন জোসেফাইনের পাশে বসতে বসতে বলল, আংকেল, আপনি কষ্ট করে এসেছেন। আমাদের ডাকলে আমরা যেতে পারতাম। ওয়েলকাম আংকেল।
ধন্যবাদ সারা। প্রেসিডেন্টের সাথে আমাদের বৈঠক শেষ। হয়েছে অনেক রাতে। অত রাত না হলে রাতেই আসতাম। সকালেই এসেছি। কথাগুলো টেলিফোনে বলার মত নয়। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের চোখে মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। বলল জোসেফাইন, খারাপ কিছু নয় তো আংকেল?
সারা কিছু বলতে গিয়েও পারল না। কথা যেন গলায় আটকে গেল। কি এমন খবর যে, খোদ আব্রাহাম জনসনকে আসতে হলো আমাদের বাড়িতে। কথাটা জিজ্ঞেস করতেও ভয় পাচ্ছিল সারা জেফারসন।
না মা জোসেফাইন, ভালো খবর। গত কাল রাতে আমি আহমদ মুসার সাথে কথা বলেছি। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কথাটা বলার সাথে সাথে জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের বিস্ময় আনন্দ মিশ্রিত বিস্ফারিত দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়ল জর্জ আব্রাহামের উপর। বাকরুদ্ধ অনেকটাই তারা।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা।
নীরবতা ভাঙল সারা জেফারসন। বলল, উনি কোত্থেকে টেলিফোন করেছিলেন?
বিশেষ কারণে সেটা উনি বলেননি। প্রেসিডেন্টের সাথে আমাদের মিটিং চলাকালে তিনি অপরিচিত অয়্যারলেস ওয়েভ ব্যবহার করে আমাকে অয়্যারলেস কল করেছিলেন। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
তিনি কবে আসছেন? কিছু বলেছেন? জিজ্ঞাসা সারা জেফারসনের।
মুহূর্ত কয় চুপ করে থাকল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, তিনি আসতে পারছেন না মা? এমনকি মনিটরিং হবার ভয়ে তার পক্ষে মোবাইল বা কোন টেলিফোনে যোগাযোগ করাও সম্ভব নয়।
আবারও বিস্ময় ফুটে উঠল জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের চোখে-মুখে। বলল জোসেফাইন, তিনি বন্দী নন তো?
হাসল জর্জ আব্রাহাম জনসন। বলল, উনি সম্পূর্ণ মুক্ত, মা।
তাহলে আসতে পারবেন না কেন? যোগাযোগ করতে পারবেন না। কেন? জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
জর্জ আব্রাহাম জনসন একটু চুপ করে থাকল। পরে বলল, দেশ খুব সংকটে, মা। উনি গতরাতে উদ্বেগজনক খবর দিয়েছেন।
বলে একটু থেমে আবার শুরু করল, দেখ, বিষয়টা মাত্র আমি এবং প্রেসিডেন্ট জানি। আর কাউকে জানানো হয়নি। অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। তোমাদের এ বিষয়টা না বললে আহমদ মুসার ব্যাপারটা তোমরা বুঝবে না। বলে আবার একটু থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আবার বিস্ময় ও উদ্বেগে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে জোসেফাইন ও সারা জেফারসেনের মুখ। কি এমন ভয়ানক গোপনীয় খবর যা মাত্র প্রেসিডেন্ট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জর্জ আব্রাহাম জনসন জানেন? কি বিষয় সেটা!
আবার কথা শুরু করল জর্জ আব্রাহাম। বলল, আমাদের সন্ত্রাসী শত্রুপক্ষ ভয়ংকর দুটি অস্ত্র তৈরি করেছে, যাকে প্রতিরোধ করার কোন ব্যবস্থা আমাদের নেই। প্রথমটি তারা সম্পূর্ণ করেছে। দ্বিতীয়টি এখনো সম্পূর্ণ করতে পারেনি। আর এই অস্ত্র তৈরি সম্পূর্ণ করার জন্যেই তারা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করেছিল। তারা চেয়েছিল আহমদ মুসার মগজ ধোলাই করে রোবটে পরিণত করবে। আর ঐ অস্ত্রটি সম্পূর্ণ করার জন্যে তারা আহমদ মুসার মাধ্যমে পেন্টাগন থেকে একটি যন্ত্রাংশ চুরি করার ব্যবস্থা করবে। পেন্টাগন আহমদ মুসাকে চেনে ও বিশ্বাস করে, সেজন্য অন্য কারো চেয়ে পেন্টাগনে ঢোকা আহমদ মুসার জন্যে সহজ। কিন্তু পরিকল্পনা কার্যকর করার আগেই আহমদ মুসা তাদের ভূগর্ভস্থ বন্দীখানা। থেকে পালিয়ে আসে। আহমদ মুসা পালিয়ে আসায় ওরা আতংকিত হয়ে পড়েছে। তার কাছ থেকে আমেরিকান সরকার সব তথ্য জেনে ফেলবে, এই তাদের ভয়। এটা যদি ঘটে তাহলে আমেরিকান সরকার অ্যাকশনে যাবার আগে তারাই অ্যাকশনে যাবে। তারা যদি আগে অ্যাকশনে যায়, তাহলে আমাদের কৌশলগত ও কনভেনশনাল অস্ত্র ভাণ্ডার তারা তাদের হেড কোয়ার্টারে বসেই ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। এরপর যা ঘটবে তা কল্পনাই করা যায় না। এটা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো, তারা যেন বুঝতে পারে যে, আহমদ মুসা আমেরিকান সরকারকে তথ্য দিতে পারেনি, আমেরিকান সরকারের সাথে সে দেখা করেনি, আহমদ মুসাকে সরকার খুঁজে বেড়াচ্ছে, এ সম্পর্কে শত্রুদের নিশ্চিত থাকা দরকার। আহমদ মুসা তার গোপন অবস্থান থেকে এই জন্যেই আসতে পারছে না, এই বিষয়টাই : সে গতকাল অয়্যারলেসে আমাদের জানিয়েছে। তার সাথে এই যোগাযোগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলেই সম্পূর্ণ নতুন এক ওয়েভ লেংথে সে কথা বলেছে।
উদ্বেগ-আতংকে ছেয়ে গেছে জোসেফাইন ও সারা জেফারসনের মুখ। ভয়ংকর একটা সংকটে আমেরিকা এবং আহমদ মুসাও। আহমদ মুসা বেঁচে আছে, এ কথা প্রকাশ হওয়াও বিপজ্জনক। কিন্তু এ সংকটের সমাধান কিসে! এই প্রশ্নই করল সারা জেফারজন জর্জ আব্রাহাম জনসনকে। বলল, আংকেল, এই সংকটে আপনারা কি করবেন ভাবছেন? কেমন করে এ ভয়ংকর সংকটের সমাধান হবে?
সেই পথটাও আমাদের আহমদ মুসাই দেখিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি পরিকল্পনা করছেন ওদের অপারেশন ঘাঁটিতে ঢোকার। তিনি মনে করছেন ওদের অপারেশন ঘাঁটি তিনি চিহ্নিত করতে পেরেছেন। বলল আব্রাহাম জনসন।
তিনি একা, এত বড় সাংঘাতিক মিশন…? মারিয়া জোসেফাইন বলল অনেকটা আতংকের সুরে।
হ্যাঁ মা, তিনি একা। আমরা বলেছিলাম আরও লোক নিয়ে অভিযানের কথা। কিন্তু তিনি বলেছেন, ওদের আক্রমণের শক্তি অচল করে দেবার একটাই পথ, সেটা হলো ওদের সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রের উপর আঘাত হানা, তাকে অচল করে দেয়া। এই অভিযান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা সামান্য পরিমাণেও যদি সন্দেহ করে যে তাদের অপারেশন ঘাঁটি চিহ্নিত হয়েছে এবং তা আক্রান্ত হতে পারে, তাহলে সেই মুহূর্তেই তারা আক্রমণে যেতে পারে। সুতরাং অভিযান অত্যন্ত গোপনে এবং সেই কারণে একক ধরনের হওয়াই উচিত হবে। তার যুক্তি আমরা মেনে নিয়েছি, মা। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আমরাও মেনে নিচ্ছি, আংকেল। তাঁর চিন্তায় সবচেয়ে ভালো যেটা, সবচেয়ে কল্যাণ যা, সেটাই গ্রহণ করেছেন। বাকি আল্লাহ ভরসা। জোসেফাইন বলল।
ধন্যবাদ মা, তুমি ঠিকই বলেছ। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আংকেল, ওর প্রয়োজন জানা, তাকে সাহায্য করার কাজটা তো হওয়া উচিত। সারা জেফারসন বলল।
সেটা আমরাও চিন্তা করেছি। প্রেসিডেন্ট এই নির্দেশই দিয়েছেন। কিন্তু তার সাথে যোগাযোগের পথ তো আমাদের হাতে নেই। তিনি যোগাযোগ করলেই শুধু আমরা কিছু করতে পারি। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন। কথা শেষ করেই জর্জ আব্রাহাম আবার বলল, এস আমরা সকলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। তিনি যেন আহমদ মুসাকে সফল করেন এবং আমেরিকাকে অকল্পনীয় এক বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আমিন। বলল জোসেফাইন ও সারা জেফারসন দুজনেই।
আংকেল, আমার মা কিন্তু টেবিলে চা দিয়েছেন। আপনি এগোলে আমরাও তাড়াতাড়ি খেতে পারি। সারা জেফারসন বলল।
অবশ্যই এগোব মা, চল। আমি এমনটাই আশা করছিলাম।
বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল।
.
খাবার টেবিলে সবাই বসে। দেরিতে টেবিলে এল দাউদ ইব্রাহিম। বুঝাই যাচ্ছে সে মাত্র গোসল করেছে।
ভাইয়ার একটু দেরি হয়েছে, তুমি কিছু মনে করো না, বাবা। সে পাহাড় থেকে নেমেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
কিন্তু জনাব আহমদ মুসা এবং সে একসাথেই তো পাহাড় থেকে নেমেছিল! বলল নূর ইউসুফ।
তা নেমেছিল। কিন্তু আমাদের অতিথি স্যার এসেই ঝর্নায় গিয়েছিলেন গোসল করতে। আর ভাইয়া ঘুমিয়ে পড়েছিল।
বসেই আবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল দাউদ ইব্রাহিম। আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছোট বাউ করে তার পিতার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, পাহাড়ে উঠতে গিয়ে বুঝলাম আমাদের অতিথি স্যার স্টিলের মানুষ এবং আমি নিছকই মাটির মানুষ। থামল দাউদ ইব্রাহিম।
তোমাদের পাহাড়-অভিযানের গল্প শোনার জন্যে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কিন্তু তোমার এ কথার অর্থ কি? বলল নূর ইউসুফ।
বাবা, আমার ছোট বেলা থেকেই পাহাড়ে উঠা আর বেড়ানোর অভ্যেস আছে। কিন্তু আমাদের পাশের পাহাড়ে আমি কখনো উঠিনি। ক্লাইম্বারদের জন্যে এটি বিপজ্জনক পাহাড়। বাবা, পাহাড়ের গা মসৃণ এবং পাথর অত্যন্ত শক্ত। পাহাড়ের গা থেকে কতবার যে পিছলে পড়েছি, শুধু গাছের সাহায্যে বেঁচে গেছি! কিন্তু স্যার ক্লাইম্বিং, গাছে উঠা, গাছ ও পাহাড়ের মাঝে রোপওয়ে তৈরি করা ও ব্যবহারে অসম্ভব দক্ষ। আমার মনে হয়েছে তিনি প্রফেশনাল ক্লাইম্বার। দশ ঘন্টার ক্লাইম্বিং-এর পরও তার মধ্যে কোন ক্লান্তি নেই। এসেই উনি গোসলে গেলেন আর রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে আমাকে ঘুমাতে হলো। বলল দাউদ ইব্রাহিম।
নূর ইউসুফ ও মরিয়ম মারুফা দুজনেই তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
জনাব আহমদ মুসা, আপনার সম্পর্কে যতটা জানি, মাউন্টেনেয়ারিং-এর ধারেকাছেও আপনি নন। কিন্তু দাউদ ইব্রাহিম যা। বলল, সেটা তো সত্য। সেটা কিভাবে সম্ভব? বলল নূর ইউসুফ।
পাহাড়ে উঠা, পাহাড়ে হাঁটা ছোট বেলা থেকেই করেছি। কিন্তু মাউন্টেনিয়ারিং শেখা যাকে বলে, সেটা আমি শিখিনি। আমার বিশ্বাস, আল্লাহর দেয়া জ্ঞান-বুদ্ধি ও কমনসেন্স কাজে লাগিয়ে সম্ভব সবকিছুই করা যায়। আমি সেটাই করেছি জনাব। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক। তবে সবার জন্যে এটা নয়। যা আহমদ মুসার পক্ষে খুবই সম্ভব।
বলে মুহূর্তকাল নূর ইউসুফ চুপ থেকে আবার বলে উঠল, কিন্তু এত কষ্ট করে পাহাড়ে উঠে কি পেলেন? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না আহমদ মুসা। ভাবছিল সে।
আমার প্রথম দেখার বিষয় ছিল, এই পাহাড়ের পথে ডেথ ভ্যালিতে যাওয়া যায় কি না। আর…।
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই নূর ইউসুফ বলল, কি দেখলেন জনাব আহমদ মুসা? আর আপনি কি নিশ্চিত, ওখানে গিয়ে কাজ হবে?
যখন জানার সব পথ বন্ধ হয়, তখন মানুষের মন কথা বলে উঠে। আর মন বা আত্মা যখন পরিপূর্ণভাবে আল্লাহমুখী হয়ে দাঁড়ায়, তখন মনের কথা হয় আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। জনাব, আমি আমার মনের কথাকে মেনে নিয়েছি। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা। আলহামদুলিল্লাহ, আপনার কাছে বহু। বিষয় শেখার আছে। সত্যই মন কথা বলে। তবে আমাদের মত লোকদের মনের কথায় শয়তানি কথার ভেজাল থাকতেও পারে। নূর ইউসুফ বলল।
না জনাব, আসলেই যা মন বা আত্মার কথা, সেখানে শয়তান ঢুকতে পারে না। ওটা আল্লাহর ইচ্ছার জন্যে বরাদ্দ। সেজন্যে দেখা যাবে, চোর যখন চুরি করে, তখনও সে ভাবে সে ভালো কাজ করছে না। কিন্তু জাগতিক নানা যুক্তি তাকে চুরির দিকে ঠেলে দেয়। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ জনাব আহমদ মুসা। ঠিক বলেছেন। সব অপরাধীই অপরাধকে খারাপ মনে করে। মানুষের বিবেক বা আত্মা কোন মন্দ, অন্যায় নির্দেশ দেয় না। মেনে নিলাম শয়তান এখানে ঢুকতে পারে না। নূর ইউসুফ বলল।
ধন্যবাদ জনাব। বলল আহমদ মুসা।
ওয়েলকাম জনাব আহমদ মুসা। ডেথ ভ্যালিতে যাওয়ার কি ঠিক করলেন? নূর ইউসুফ বলল।
যেতে চাই। কিন্তু এ পাহাড়ের পথে যাওয়া অসম্ভব।
আপনার কাছেও অসম্ভব কিছু আছে স্যার? মরিয়ম মারুফা বলল। গাম্ভীর্য নেমে এল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, আমরা যারা মানুষ, তাদের সামর্থ্যের সীমা আছে, আল্লাহই শুধু অসীম। আমাদের চিন্তা-কর্ম, জ্ঞান-বুদ্ধি সবই সসীমতার ঘেরা টোপে আটকানো।
বলে একটা দম নিয়েই আবার বলল, এমন বিপজ্জনক পাহাড় আমি এর আগে কোথাও দেখিনি। পাহাড়ের এ পাশটা কিছুটা স্লেপিং, গাছ গাছড়াও যথেষ্ট আছে। কিন্তু ও পাশটা একদম খাড়া। গাছ-পালা কিছুই নেই। পাহাড়ের গা বেয়ে নামার কোন উপায় নেই। পাহাড়ের মাথা থেকে দড়ি নামিয়ে দিয়ে সেটাকে অবলম্বন করে নিচে নামা সম্ভব। কিন্তু এভাবে নামা নিরাপদ নয়। ডেথ ভ্যালিতে ওদের ঘাঁটি থাকার সন্দেহ যদি সত্যি হয়, তাহলে ওরা সবাই দেখে ফেলতে পারে। তাহলে কিছু করার আগেই ধরা পড়ে যেতে হবে।
তাহলে এখন কি ভাবছেন? ডেথ ভ্যালিতে যাবার উপায় সম্পর্কে কি চিন্তা করছেন? মরিয়ম মারুফা বলল।
এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ডেথ ভ্যালির চারিদিকটা দেখেছি। তাতে আপনাদের কাছ থেকে যেটা শুনেছি, সেটাই ঠিক। ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের একমাত্র গিরিপথ বন্ধ হবার পর এখানে প্রবেশের সত্যিই আর কোন পথ নেই। তবে আগে আমি ইন্টারনেটে দেখেছি, ডেথ ভ্যালির উত্তর সীমানার পাহাড়টা উঠে এসেছে গভীর একটা ক্রিক থেকে। গোড়ার প্রান্তটা ক্রিকের পানিতে নেমে গেছে। ও প্রান্তে যাওয়ার জন্যে ক্রিকের জলপথ দিয়ে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ঐ দিকের পাহাড়ের উচ্চতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। পাহাড়ের পথে ঐ প্রান্তে যাওয়ার পথ পেলেও সেটা ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের কোন বিকল্প নয়। উত্তর প্রান্তের শ্লেপিংটা উপরের দিকে খাড়া হলেও নিচের জংগলাকীর্ণ দিকটা কম খাড়া। ডেথ ভ্যালির ঐ প্রান্তের ভেতরের পাশটা কিছুটা কম খাড়া হলেও উঠা-নামার জন্যে অনুকূল নয়, তবে মন্দের ভালো হিসাবে এ পাশটাকে ধরা যায় ইতিবাচক। সব মিলিয়ে ডেথ ভ্যালির অবশিষ্ট সব দিক ভালো করে দেখতে চাই, তবে উত্তর দিটকা আমার বেশি পছন্দ হয়েছে। থামল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ জনাব। চারদিকের পাহাড়ের যা বিবরণ দিলেন, তা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন। বহু বছর ধরে এখানে আমরা বাস করছি বটে, কিন্তু আমাদের গণ্ডির বাইরে কোথাও যাইনি। যাওয়া কোন সময় সম্ভব নয় বলে আমরা মনে করে আসছি। আপনি পাহাড়ের অবস্থানকে যেভাবে পর্যালোচনা করলেন, তাতে এখন নিশ্চিত যে আপনি ডেথ ভ্যালিতে ঢুকতে চান। কিন্তু এখান থেকে কিভাবে সামনে এগোবেন? বলল নূর ইউসুফ।
হ্যাঁ জনাব, পাহাড়ে উঠেছিলাম চার দিকের পাহাড় সম্পর্কে একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যে। আজকেই বিকেলে আমি ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের জন্যে কাজ শুরু করব। আহমদ মুসা বলল।
কিভাবে? আপনি যে বর্ণনা দিলেন, তাতেই তো পরিষ্কার ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের কোন পথই খোলা নেই। বলল নূর ইউসুফ।
পথ বের করতে হবে। ডেথ ভ্যালি সম্পর্কে আমার সন্দেহ যদি সত্য হয়, তাহলে একটা পথ অবশ্যই আছে। না থাকলে অন্যরা গেল কি করে? আহমদ মুসা বলল।
সন্দেহ সত্যি নাও তো হতে পারে স্যার? বলল মরিয়ম মারুফা।
চেষ্টার পর কোন পথ যদি বের না হয়, তাহলে নিশ্চিত হবো আমার সন্দেহ ঠিক নয়। আর সন্দেহ যদি ঠিক হয়, আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেন। আমি পথ পেয়ে যাব। আহমদ মুসা বলল।
আলহামদুলিল্লাহ। আপনার বিশ্বাসের এ দৃঢ়তা আছে বলে আপনি নিশ্চিন্তে সামনে অগ্রসর হতে পারেন। আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তাকে তিনি এই দুর্লভ শক্তি দেন। বলল নূর ইউসুফ।
এই শক্তি দুর্লভ নয়। আল্লাহ সবার জন্যে এর অর্জনকে উন্মুক্ত রেখেছেন। আল্লাহকে ভালোবাসলে আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু স্যার, এমন ভালোবাসা কঠিন। তাই তাঁর ভালোবাসা পাওয়াও কঠিন। বলল মরিয়ম মারুফা।
এটা ভুল ধারণা মারুফা। তাকে ভালোবাসা কঠিন হবে কেন? তিনি তো কিছু চান না? আল্লাহ স্রষ্টা, প্রতিপালক, মালিক, সবকিছুর নিয়ন্তা এটা মানা কি কঠিন? শেষ রাসূলকে রাসূল হিসাবে মানা কি কঠিন? নামাজ পড়া, রোজা রাখা, জাকাত দেয়া কঠিন কোন দিক দিয়ে? মন্দ পরিহার করা, ভালোকে গ্রহণ করা কতটা কঠিন? এসব যতটা কঠিন, আল্লাহকে ভালোবাসা মাত্র ততটাই কঠিন। আহমদ মুসা বলল।
স্যার, এ কাজ সহজও নয়, আবার কঠিনও নয়। আমি পড়েছি স্যার, ঈমানদারদের জন্যে এসব কাজ খুবই সহজ, অন্যদের জন্যে কঠিন। বলল মরিয়ম মারুফা।
ঠিক বলেছ মারুফা। এই ঈমান বা বিশ্বাসই ভালোবাসার আসল শক্তি। যাক এ প্রসংগ। আমি এখনই একটু বেরুতে চাই।
খাওয়া শেষে হাত পরিষ্কার করতে করতে বলল আহমদ মুসা। সবাই খাওয়া শেষ করে বসল কম্যুনিকেশন রুমটায়। কোথায় বেরুবেন বললেন? দাউদ ইব্রাহিম বলল।
দক্ষিণ পাশের সংকীর্ণ বিলম্বিত স্থানটায় প্রবেশ করব। বলল আহমদ মুসা।– নূর ইউসুফসহ সবাই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। সবারই চোখে মুখে প্রশ্ন। সবাই মুখ খুলেছিল। কিন্তু সবার আগে কথা বলল মরিয়ম মারুফা। বলল, স্যার, ওখানে কি আছে? পাথর, টিলা, জংগলে ভরা একটা সংকীর্ণ প্যাসেজ। কিছু দূর এগিয়েই তো পাহাড়ের খাড়া উঁচু দেয়াল।
আমি ওদিকে যাইনি। কিন্তু পাহাড়ে উঠে ওদিকটা দেখেছি। ঐ প্যাসেজটা জুড়ে বড় গাছ একটাও নেই। পাথরের উপর যে ধুলা-বালি জমেছে, তাতেই জন্মেছে লতা-গুল্মের জংগল। কোন পাথুরে পথের সাধারণ চরিত্র কিন্তু এটাই। তাই অন্য কিছু ভাববার আগে জায়গাটা দেখতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
নূর ইউসুফ হাসল। বলল, জনাব আহমদ মুসা, আল্লাহ বুদ্ধি-জ্ঞান সব আপনাকে ঢেলে দিয়েছেন। আপনি এক দিন একবার সেদিকে তাকিয়ে যা বুঝলেন, আমি প্রায় সারাজীবন ওদিকে ঘুরাঘুরি করেও তা বুঝিনি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, সত্যি জায়গাটা একটু বেশি রকম পাথুরে।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই মরিয়ম মারুফা বলল, কখন যাচ্ছেন আপনি সেখানে?
একটু রেস্ট নিয়েই আমি যাব।
বলেই তাকাল আহমদ মুসা দাউদ ইব্রাহিমের দিকে। বলল, আমার একটা টর্চ দরকার হবে, আছে?
অবশ্যই স্যার, আমাদের সবারই টর্চ আছে। বলল দাউদ ইব্রাহিম। প্রস্তুত থেকো, তুমিও আমার সাথে যাবে। আপত্তি নেই তো? আহমদ মুসা বলল।
আপত্তি থাকবে কেন স্যার? আপনার সাথী হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ কেউ পায়ে ঠেলে? দাউদ ইব্রাহিম বলল। আনন্দ উপচে পড়ছে তার চোখে-মুখে।
জনাব এই সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত থাকব? বলল নূর ইউসুফ।
আমার আপত্তি নেই জনাব। আহমদ মুসা বলল।
আর আমি? বলল মরিয়ম মারুফা।
তুমি একা বাড়ি থাকবে কেন? আর কিছু না হোক বেড়ানোর কাজটা তো আমাদের হবে। নূর ইউসুফ বলল।
বিকেল সাড়ে তিনটায় বেরুল আহমদ মুসারা।
সবার সামনে আহমদ মুসা। তার পেছনে দাউদ ইব্রাহিম, মরিয়ম মারুফা। সবার পেছনে নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা যে জায়গাটায় যেতে চায় সেটা নূর ইউসুফরা যেখানে থাকে তার পাশেই। রক ক্রিক নদী থেকে যে ছড়াটা পশ্চিম দিকে ঢুকেছে, তার শেষ মাথার ডান পাশে মানে উত্তর পাশে থাকে নূর ইউসুফরা। আহমদ মুসা যে জায়গটা দেখতে চায় সেটা নূর ইউসুফদের বাসস্থান থেকে শুরু হয়ে ছড়াটার মাথা হয়ে দক্ষিণ দিকে একশো গজের মত এগিয়ে পাহাড়ের দেয়ালে গিয়ে শেষ হয়েছে। ছড়ার দক্ষিণ ধার ঘেষে মাথা পর্যন্ত এসে পাহাড়ের দেয়ালটা দক্ষিণ দিকে বেঁকে গিয়ে অর্ধবৃত্তাকার প্রায় সমতল একটা পকেট সৃষ্টি করেছে। ছড়ার মাথার সামনে দিয়ে যাওয়া প্যাসেজটা এই কারণেই একশো গজের মত দীর্ঘ হতে পেরেছে। প্যাসেজটার দক্ষিণ মাথাটা ঢুকে গেছে পাহাড়ের ঐ পকেটে। এই পকেটের শেষ মাথাটা পর্যন্ত দেখতে চায় আহমদ মুসা।
ছোটখাটো আগাছা, লতা-গুল্ম মাড়িয়ে চলছে আহমদ মুসারা। পায়ের নিচে শক্ত পাথরের উপরে মাটির পাতলা লেয়ার। পুরু লেয়ার সম্ভবত গড়ে উঠতে পারেনি বৃষ্টির কারণে। বৃষ্টির পানিতে অব্যাহত ভাবেই কিছু কিছু করে মাটি ধুয়ে নিচের ছড়ায় নেমে যায়। মাটির পাতলা লেয়ারেই জন্মেছে ঘাস, গুল্ম জাতীয় আগাছা। পাথরের জোড়াগুলোতে মাটির লেয়ার পুরু। এসব জায়গাতেই জন্মেছে ছোট ছোট গাছ, লতা-পাতার ঝোঁপ। এসব মাড়িয়ে, কখনও পাশ কাটিয়ে সামনে এগোতে হচ্ছে আহমদ মুসাদের।
সামনে এগোবার এ প্যাসেজটা আড়াই থেকে তিন গজের মত প্রশস্ত। পশ্চিম পাশ বরাবর খাড়া পাহাড়ের দেয়াল। পাহাড়ের গা একেবারেই নগ্ন। খাড়া বলেই গায়ে ধুলা-বালি জমতে পারে না, তার উপর রয়েছে বৃষ্টির আঘাত। আর পুব পাশেও পাহাড়ের খাড়া দেয়াল নেমে গেছে। নিচের গভীর খাড়িতে। ভীতিকর এক দৃশ্য। সে দৃশ্য এড়াতেই যেন সবাই হাটছে প্যাসেজের পশ্চিম পাশের পাহাড়ের গা ঘেষে।
আহমদ মুসার সন্ধানী দৃষ্টি পায়ের তলার রাস্তার গঠন, পাশের পাহাড়ের গা, পাথরের রকম ইত্যাদি সব বিষয়েই চোখ বুলাচ্ছিল।
পাহাড়ের সামনের দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছল তারা।
প্যাসেজের মাথা যেখানে শেষ হয়েছে সে দেয়ালটাও খুঁটে খুঁটে দেখল আহমদ মুসা। আনন্দিত হবার মত কিছুই পেল না।
পেছন ফিরে চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা। তার মন বলছে, দিব্য দৃষ্টিতে যেন সে দেখতেও পাচ্ছে, এ যেন চলাচলের একটা পথ।
স্যার, আপনি যেন কিছু খুঁজছেন। বলল মরিয়ম মারুফা।
হ্যাঁ মারুফা, খুঁজতেই তো এসেছি। কিন্তু পাচ্ছি না কিছু। আহমদ মুসা বলল।
কি খুঁজতে এসেছেন স্যার? বলল দাউদ ইব্রাহিম।
কি খুঁজছি আমি নিজেও জানি না। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, এটা চলাচলের একটা পথের মত। আহমদ মুসা বলল।
সবাই আহমদ মুসার দিকে তাকাল। সবার চোখেই বিস্ময় দৃষ্টি। বলল নূর ইউসুফ, একে আপনার চলাচলের পথ মনে হলো কেন? আমরা ছাড়া তো এখানে কেউ বাস করে না। আর সামনেও দেখুন পাহাড়ের দেয়ালে, ঐ দিকের পথটা যে একেবারেই বন্ধ সেটা আপনিও দেখেছেন। এটা চলাচলের পথ হতে পারে কেমন করে?
আহমদ মুসা পশ্চিম পাশের পাহাড়ের দেয়ালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। ঐভাবে থেকেই বলল, এর উত্তর আমিও জানি না। আমার মনে হয়েছে তাই বললাম।
আহমদ মুসার দুচোখের দৃষ্টি হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। আহমদ মুসা এগিয়ে গেল পশ্চিম পাশের পাহাড়ের দেয়ালের দিকে। দাঁড়াল তুলনামূলকভাবে মসৃণ একটা পাথরের সামনে। আরও ভালোভাবে তার চোখে পড়ল, পাথরের গায়ের সমান্তরালে কিছু জায়গা জুড়ে আঁকা-বাঁকা রেখায় পাথরের গায়ে ধুলা-মাটি যেন বেশি জমেছে। আহমদ মুসা পকেট থেকে চাকু বের করে চাকুর আগা দিয়ে আঁকা-বাঁকা গোটা রেখা থেকে ধুলা-মাটি সরিয়ে দিল।
সবাই আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই দেখছে আহমদ মুসার কাজ।
ধুলা-মাটি সরানোর পর রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।
রেখাগুলোর ঢেউ খেলানো রূপ দেখে ভ্রু-কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। চোখ তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
পেছন ফিরে সবার দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, রেখাগুলো দেখে আপনাদের কি মনে হচ্ছে বলুন তো?
সবাই ভালো করে তাকাল।
আপনি কি মনে করছেন রেখাগুলো প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি? বলল নূর ইউসুফ।
আমার তাই মনে হচ্ছে, আপনাদের মত জানতে চাচ্ছি। আহমদ মুসা বলল।
নূর ইউসুফদের সবার চোখে-মুখে বিস্ময়! দ্রুত কথা বলে উঠল মরিয়ম মারুফা, মানুষের তৈরি? মানুষ আসবে কোত্থেকে এখানে? কেনই বা পাথরে আঁকবে ওসব?
কেন আঁকবে এটাই তো খোঁজার বিষয়। তার আগে কি এঁকেছে, এটা জানার বিষয়। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু রেখাগুলোর কোন অর্থ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বলল দাউদ ইব্রাহিম।
দাউদ ইব্রাহিম, মরিয়ম মারুফা, তোমরা ছোটবেলায় এ রকম কিছু এঁকেছ কি না, স্মরণ কর। আহমদ মুসা বলল।
দুজনের চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ভাবছে দুজনেই।
মরিয়ম মারুফাই প্রথম আনন্দে চিৎকার করে উঠল। বলল, মেঘের ছবি আমরা এভাবে আঁকতাম।
ঠিক মারুফা। দাউদ ইব্রাহিম বলল।
হ্যাঁ, তোমরা ঠিকই বলেছ, এটা মেঘের সিম্বলিক ছবি। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু কে আঁকবে? কেন আঁকবে? নূর ইউসুফ বলল।
কেন এঁকেছে, আমি বোধ হয় বুঝেছি জনাব। বলল আহমদ মুসা।
কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এঁকেছে? সেটা কি? বলল নূর ইউসুফই।
আহমদ মুসা শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চাইল। ভাবল একটু। তাকাল আবার সেই আঁকা-বাঁকা রেখাগুলোর দিকে। চোখ নামিয়ে আরও একটু নিচে তাকাল গরুর দুই শিং দিয়ে তৈরি অস্পষ্ট একটা সার্কেলের দিকে। বলল, মেঘের সিম্বল এঁকে উপরের দিকে ইংগিত করা হয়েছে। আর এটা এঁকেছে এই এলাকার পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান ট্রাইব।
পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান ট্রাইব? নূর ইউসুফরা প্রায় একসাথেই বলে উঠল।
হ্যাঁ, পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান ট্রাইব। বলল আহমদ মুসা।
সে তো অনেক আগের কথা। ওরা এখানে আসবে কেন? কেনইবা আঁকবে এই মেঘের সিম্বল? আর এটা বুঝা গেল কি করে যে, ওটা পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের কাজ? বলল নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা রেখাগুলোর নিচে গরুর দুই শিং-এর সার্কেলের দিকে ইংগিত করে বলল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পূর্ব উপকূলের রেড ইন্ডিয়ান, বিশেষ করে পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ানরা এই সিম্বল ব্যবহার করে থাকে।
মুহূর্তের জন্যে থেমেই আবার শুরু করল আহমদ মুসা, পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান পটোম্যাক নদীর তীরসহ রক ক্রিক নদীর এই এলাকাতেই বাস করতো। পিসকাটাওয়ে একটা গ্রামের নাম ছিল। পিসকাটাওয়ে থেকেই পটোম্যাক নদীর নাম হয়েছে। পটোম্যাককে এক সময় বলা হতো পাটাওমেক, সেখান থেকেই পটোম্যাক। পটোম্যাক থেকে, এই রক ক্রিক হয়ে পশ্চিম-উত্তরে ওয়াশিংটন ডিসি ও মেরিল্যান্ডের ওকোমা পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ান ট্রাইবের বাস ছিল। তারা প্রধানত বাস করত নদীর তীর এলাকায়। এই রক ক্রিক নদীর তীর এলাকাতেও। আমার নিশ্চিতই মনে হচ্ছে এই সংকীর্ণ প্যাসেজটা এক সময় সংকীর্ণ ছিল না। চলাচলের একটা প্রশস্ত পথ ছিল। পাহাড়ের দেয়ালে পাথরের গায়ে তাদের সিম্বল ও মেঘের ড্রইং এটাই প্রমাণ করছে।
কিন্তু পথ কোথায়? পাহাড়ের দেয়ালে প্যাসেজটা তো থেমে গেছে? বলল নূর ইউসুফ।
মরিয়ম মারুফাদের চোখে বিস্ময় দৃষ্টি! নূর ইউসুফ থামতেই মরিয়ম মারুফা বলে উঠল, স্যার, আমাদের এলাকা ও এলাকার ইতিহাস সম্পর্কে আপনি যা বললেন তার কিছুই আমরা জানি না। পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ানরা ওয়াশিংটন ডিসি এলাকায় বাস করত, এটুকুই মাত্র জানি।
জানার সময় শেষ হয়ে যায়নি মারুফা। আর মানুষের আবাল্য পরিচয়ের জায়গা সম্পর্কে জানার আগ্রহ কম থাকাটাই স্বাভাবিক। আহমদ মুসা থামল।
আহমদ মুসা থামার সাথে সাথেই নূর: ইউসুফ বলল, আসল কথাই বলেননি মি. আহমদ মুসা। মেঘের সিম্বল দিয়ে উপর দিকে ইংগিত করবার তাৎপর্যটা কি?
আমি জানি না জনাব। জানার জন্যে আমি উপরে উঠতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
ও জানার সত্যিই কি কিছু আছে? কি থাকতে পারে? বলল মরিয়ম মারুফা।
তা আমি জানি না মারুফা। প্যাসেজের ক্লোজিং পয়েন্টে এসে পিসকাটাওয়ে রেড ইন্ডিয়ানরা কেন উপরের দিকে ইংগিত করল সেটা দেখতে চাই। বলে উপরের দিকে তাকাল আহমদ মুসা।
তার সাথে সাথে তাকাল সবাই।
প্রায় ১০ ফিট উপরে নিচের লেভেল থেকে পাহাড়ের দেয়াল ভেতরের দিকে সরে গেছে। ঠিক ভাজের স্থানে বাইরের দিকে পাথর বেরিয়ে এসেছে। ঠিক যেন কার্নিশ।
পাহাড়ের কার্নিশ বা ভাঁজটা সামনে মানে দক্ষিণে এগিয়ে গেছে, যেখানে পাহাড়ের দেয়াল পূর্ব দিকে টার্ন নিয়েছে সে পর্যন্ত। ভাঁজটা উত্তর দিকেও কিছুটা এগিয়ে এক সময় পাহাড়ের গায়ে মিশে গেছে। পাহাড়ের গায়ে এই ভঁজের ফলে জিগজ্যাগ, এবড়োথেবড়ো সংকীর্ণ একটা বারান্দার সৃষ্টি হয়েছে।
আহমদ মুসা তাকাল দাউদ ইব্রাহিমের দিকে। বলল, তোমার ব্যাগ থেকে দড়ির মইটা বের কর। উপরে উঠতে হবে।
কাজে তাহলে লাগলই স্যার। আমি ভেবেছিলাম, এবার আপনার এই আগাম প্রস্তুতি কাজে লাগবে না। হাসতে হাসতে বলল দাউদ ইব্রাহিম।
কাজে এখনও লাগেনি দাউদ ইব্রাহিম, ব্যবহার করছি মাত্র। বলল আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে।
দড়ির মই হাতে নিল আহমদ মুসা।
প্রথমবারের ছোঁড়াতেই নাইলন-দড়ির ফাসটা বেঁধে গেল কার্নিশের বেরিয়ে থাকা পাথরটায়।
দড়ির মইটা কয়েকবার টেনে দেখে পেছনে তাকিয়ে বলল, আমি ওপরটা একটু দেখে আসি।
আমিও উঠতে চাই। দাউদ ইব্রাহিম বলল।
আমিও উঠব। বলল মরিয়ম মারুফা।
অযথা কষ্ট হবে, এর কি প্রয়োজন আছে? আহমদ মুসা বলল।
ক্ষতি তো নেই। আমরাও উপরটা দেখলাম। বলল নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, অপ্রয়োজনে কষ্টের প্রয়োজন নেই মনে করেছিলাম। ঠিক আছে, চলুন উঠি সবাই।
প্রথমে উঠল আহমদ মুসা। একে একে সবাই।
উপরে উঠে হতাশ হলো। পাহাড়ের এবড়োথেবড়ো গা বারান্দার মত এগিয়ে গেছে সামনে, দক্ষিণে পাহাড়ের দেয়াল পর্যন্ত। বারান্দা হয়ে বারান্দার ক্লোজিং পয়েন্টের দেয়াল পর্যন্ত বার দুই যাতায়াত করল। তার সতর্ক দৃষ্টি পাথরের গায়ে সংকেত চিহ্নের সন্ধান করল। কিন্তু পেল না কিছুই। মনে মনে রেড ইন্ডিয়ানদের ব্যবহৃত কোন প্যাসেজের সন্ধান পাওয়ার সে যে আশা করছিল, তা নিরাশায় পরিণত হলো। কিন্তু মন মানছে না, উপরের দিকে উঠার যে সংকেত নিচে পাহাড়ের গায়ে পেয়েছে, তা নিরর্থক অবশ্যই নয়। সবাইকে উদ্দেশ্য করে আহমদ মুসা বলল, আসুন, সবাই আমরা একটু বিশ্রাম নেই। একটু ভাববারও সময় পাব। পরে আর এক দফা খোঁজ করা যাবে। সবাই বসে পড়ল।
আহমদ মুসারা তখন বারান্দা টাইপ পথটার দক্ষিণ প্রান্তে।
মরিয়ম মারুফা বসে পড়েছিল পথ রোধ করে দাঁড়ানো পাহাড়ের দেয়ালে ঠেস দিয়ে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করল মরিয়ম মারুফা পানি পানের জন্য। পানি পানের আগে মুখ পরিষ্কারের জন্যে মুখ বাড়িয়ে পাহাড়ের দেয়ালের গোড়ায় কুলি ফেলল। কুলির সাথে সাথে তার চোখও গিয়ে পড়ল কুলি পড়ার স্থানে, পাহাড়ের গায়ে। চোখ পড়তেই সে চমকে উঠল পাথরের গায়ে আংশিক একটা রেখা দেখে। রেখা ধুলা-ময়লায় ভর্তি হলেও ভিজে যাওয়ার পর তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিস্মিত মরিয়ম মারুফা ঝুঁকে পড়ে বোতল থেকে পানি ছুঁড়ে পাথরের অনেকখানি জায়গা ধুয়ে দিল। এবার কিছুটা আয়তাকার একটা ক্ষেত্র বেষ্টনকারী ঘুরানো রেখা সুন্দরভাবে ফুটে। উঠল। মনে পড়ল তার নিচের পাথরে দেখা মেঘের রেখাচিত্রের কথা।
বিস্মিত, উত্তেজিত মারুফা চিৎকার করে উঠল, স্যার, দেখুন। আয়তাকার ক্ষেত্রের মত একটা কিছু?
সবাই তাকাল মারুফার দিকে।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে এগোলো মারুফার দিকে।
মারুফা দেখাল আহমদ মুসাকে পাথরের গায়ের আয়তাকার রেখাচিত্র।
আহমদ মুসা বসল পাথরের সামনে।
নূর ইউসুফ ও দাউদ ইব্রাহিমও আহমদ মুসার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা ছোট পাথর খণ্ডের তীক্ষ্ণ প্রান্ত দিয়ে আয়তাকার ক্ষেত্রের চারদিকের রেখা পরিষ্কার করে বলে উঠল, এটা একটা পায়ের রেখাচিত্র।
সবাই ভালো করে দেখল। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়! বলল নূর ইউসুফ, তাহলে মানুষ এখানে এসেছে? স্বগত কণ্ঠ তার।
নিচে পাহাড়ের দেয়ালে দেখা গেল মেঘ। তার একটা অর্থ পাওয়া গেছে। পায়ের রেখাচিত্র দিয়ে নিশ্চয় কিছু বুঝানো হয়েছে। সেটা কি? বলল মরিয়ম মারুফা।
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, এর একটা অর্থ হতে পারে, এটা পায়ে চলার পথ। আরেকটা অর্থ হতে পারে, এই পাথরের গায়ে লাথি দিতে হবে। দুই অর্থ একে অন্যের পরিপূরক মনে হচ্ছে। এটা একটা পায়ে চলার রাস্তা। পথের বাধা দূর করতে হলে আমাদের সামনের এই পাথরটা সরাতে হবে। কিভাবে, তার ইংগিত এই পদরেখা। পাথরের গায়ে ধরার মত কিছু নেই, তাই পা দিয়ে পুশ করে পাথর সরাতে হবে। পদচারি রেড ইন্ডিয়ানদের হাতের চেয়ে পা চলত বেশি।
তার মানে এই পাহাড়ের দেয়াল পেরিয়ে ওপারে মানে সাউথে যাওয়া যাবে! বলল মরিয়ম মারুফা।
আমি ঠিক জানি না। তবে এটা ওপারে পৌঁছার পথ হওয়াই স্বাভাবিক।
বলেই আহমদ মুসা পাথরের গায়ের ফুটপ্রিন্টের উপর পা সেট করে জোরে চাপ দিল। কিন্তু পাথরটা চুল পরিমাণও নড়ল না।
আরও কয়েকবার চেষ্টা করল। কোনই ফল হলো না।
অনেব টাই হতাশ হয়ে আহমদ মুসা বসে পড়ল পাথরের। গোড়ায়। সে নিশ্চিত, ফুটপ্রিন্টের ইংগিতের মধ্যে কোন ভুল নেই। তাহলে? তাদের কি কিছু ভুল হচ্ছে?
পাথরটির উপর চোখ বুলাতে লাগল আহমদ মুসা। পাথরের নিচের অংশে সমতলের কাছাকাছির দিকটা অপেক্ষাকৃত বেশি ধুলি-ধূসরিত।
ধুলো-বালি মোছার জন্যে আহমদ মুসা নিচু হবার সময় হঠাৎ নজরে পড়ল পাথরটির বাম প্রান্তে তীরের অস্পষ্ট ফলা।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াল। ধুলো-বালি মুছে ফেললে তীরের ফলাটা আরও স্পষ্ট হলো।
তীরের ফলা সামনে দিকনির্দেশ করছে। আবার রেড ইন্ডিয়ানদের পায়ের চিহ্নও সেটাই নির্দেশ করে। তাহলে? পাশাপাশি দুটি নির্দেশ কেন? পায়ের চিহ্ন পাথরের মধ্যখানে আর তীরের ফলা পাথরের এই প্রান্তে কেন?
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হঠাৎ তার মনে হলো, পাথরের মাঝখানের পায়ের চিহ্নটি নিশ্চয় স্থানটির একটি সাধারণ নির্দেশনা আর তীরের ফলাটি কার্যকরী একটি নির্দেশ। নিশ্চয় পাথরের বাম প্রান্তটাকে সামনে পুশ করতে হবে।
কি ভাবছেন স্যার, সমাধান কিছু পেলেন? বলল মরিয়ম মারুফা। পেয়েছি বলব না, তবে মনে হচ্ছে পেয়েছি। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা পাথরটির বাম প্রান্ত বরাবর সরে গিয়ে বাম প্রান্তের উপর পা সেট করে প্রচণ্ড শক্তিতে পাথরকে পেছন দিকে পুশ করল। সংগে সংগেই পাথরের বাম প্রান্তটি পেছনে সরে গেল এবং ডান প্রান্তটি বাম দিকে ঘুরে এল। গড়িয়ে পড়ে গেল পাথরটি।
একটা ল্যান্ডিং-এর উপর দাঁড়িয়েছিল পাথরটি। ল্যান্ডিংটির পেছনে মাঝ বরাবর পর্যন্ত ডান দিক থেকে পাথরের দেয়াল রয়েছে। বামে অর্ধেক ফাঁকা, গবাক্ষ ধরনের একটা প্যাসেজের মুখ এটা। প্যাসেজটির ফ্লোর এবড়োথেবড়ো, উঁচু-নিচু। তবে কিছুটা নিচু ল্যান্ডিং-এর তুলনায়। পাথরটি প্যাসেজটির উপরই পড়ে গেছে। ল্যান্ডিং গবাক্ষ ও প্যাসেজটাকে প্রাকৃতিক এবং ল্যান্ডিং বা গবাক্ষ মুখের পাথরটার আকার প্রাকৃতিক মনে হলো না আহমদ মুসার। কাছে। গবাক্ষ মুখ বন্ধ রাখার জন্যে এটা তৈরি করা হয়েছে।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে নূর ইউসুফদের উদ্দেশ্যে বলল, আমি ওপারে যেতে চাই। আপনারা যাবেন?
হ্যাঁ, ওপাশটা আমরা দেখতে চাই। খুব আনন্দের কথা যে, যোগাযোগের একটা বিকল্প পথ পাওয়া গেল। বলল নূর ইউসুফ।
আসুন। বলে আহমদ মুসা গবাক্ষ পথে ভেতরে ঢুকে গেল।
সবাই ঢুকে গেল ভেতরে।
গবাক্ষ-সুড়ঙ্গটা খুবই স্বল্প দৈর্ঘ্য। সুড়ঙ্গের বাইরের দিকটা ক্রমশই প্রশস্ত।
আহমদ মুসা গবাক্ষ-সুড়ঙ্গের ওপাশের মুখে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি একটা কঙ্কালের দিকে।
নূর ইউসুফরা আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়াল।
এ তো মানুষের কঙ্কাল! বলল নূর ইউসুফ।
হ্যাঁ জনাব! বেশ অনেক বছরের পুরানো। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা দেখছিল কঙ্কালটিকে খুঁটে খুঁটে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ও। কঙ্কালের পরনের কাপড় টুকরো টুকরো হয়ে শেষ হয়ে গেছে। কংকালটি সুড়ঙ্গের পশ্চিম দেয়ালে গুহার মত জায়গায় বসা অবস্থায় রয়েছে।
কত বছরের পুরানো হবে কংকালটা? নিজেই নিজের মনকে প্রশ্ন করল আহমদ মুসা। সময়টা আহমদ মুসা আন্দাজ করতে পারল না।
কংকালের বয়স নিশ্চয় অনেক হবে। কিন্তু এখানে সে আসল কেন? আবার একা কেন? আর তার খোঁজই বা কেউ করল না কেন? তার কেউ থাকলে নিশ্চয় লাশ এখানে এভাবে কংকাল হতো না। বলল নূর ইউসুফ।
দাউদ ইব্রাহিম ও মরিয়ম দুজনেরই চোখে-মুখে বিস্ময়!
আপনি ঠিক বলেছেন জনাব। সে এখানে এল কেন? তার সাথে কেউ এল না, তাকে কেউ খোঁজ করল না কেন? সত্যি ভাববার বিষয়। বলে আহমদ মুসা থামল। তার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
একটু পর সে মুখ খুলল। বলল, আমার মনে হয় সে একক উদ্যোগে এসেছে। তার স্বজন-সাথীরা কেউ তার এখানে আসার ব্যাপারটা জানত না।
কিন্তু সে ফিরে গেল না কেন? মারা গেল কিভাবে? প্রশ্ন মরিয়ম মারুফার।
হ্যাঁ, এ দুটিও বড় প্রশ্ন। বলে আহমদ মুসা নিজের ব্যাগ থেকে পেন্সিল আকৃতির টর্চ বের করল। এগিয়ে গেল কংকালের দিকে। সুড়ঙ্গের চেয়ে গুহা মত জায়গাটা অন্ধকার।
টর্চ জ্বেলে কংকালের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। এক জায়গায় টর্চের আলো পড়তেই কিছুটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। যে বস্তুর উপর টর্চের আলো পড়ে প্রতিবিম্বিত হলো, আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ে তা তুলে নিল। দেখল বস্তুটা একটা ব্যবহৃত বুলেট।
চমকে উঠে আহমদ মুসা তাকাল কংকালের মাথা ও বুকের দিকে। বুক দেখে কিছু বুঝল না। কিন্তু মাথার দিকে তাকাতেই
কপালের মাঝে বেশ বড় একটা ফুটো দেখতে পেল।
কংকালের লোকটি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
লোকটা গুলিতে মরেছে? তাহলে বিবদমান দুই পক্ষ এখানে এসেছিল? নূর ইউসুফ বলল।
তাই হবে। কিন্তু কারা এরা? শ্বেতাংগ, রেড ইন্ডিয়ান, না কোন উপজাতি? বলল আহমদ মুসা।
কথা বললেও আহমদ মুসা কংকালের উপর থেকে চোখ সরায়নি। হঠাৎ কংকালের দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুখের ভেতর কিছু একটা দেখতে পেল।
আর একটু এগিয়ে টর্চ দিয়ে ভালো করে দেখল ভেতরে কি দেখা যাচ্ছে। বুঝতে পারল না। অবশেষে আহমদ মুসা কংকালের গলার দিকে হাত ঢুকিয়ে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা জিনিসটি বের করে আনল। সরে এল কংকালের কাছ থেকে।
হাতের জিনিসটার দিকে নজর বুলাল আহমদ মুসা। নরম চামড়া জাতীয় কিছু ভাঁজ করা। ভাঁজ খুলে ফেলল আহমদ মুসা। বর্গাকৃতির একটা পাতলা চামড়া। চামড়ার কাগজও বলা যায়। রেড ইন্ডিয়ানদের সময়ে এভাবে চামড়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল। নানা কাজে এর ব্যবহার হতো। কিন্তু এটা কি? কংকালের মুখে কেন এটা? যখন তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, তখন এটা তার মুখে ছিল। কেন?
প্রথম দৃষ্টিতে চামড়ার অমসৃণ, খসখসে কাগজটিতে কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু পেনসিল টর্চের আলো ফেলতেই দেখতে পেল, কালচে চামড়ার কাগজটার বাম অংশে হালকা কালো রঙের কালিতে বর্গাকৃতি স্থানের উপর আঁকা-বাঁকা আঁচড়। একটু মনোযোগ দিয়েই বুঝল ওগুলো পাহাড়ের সিম্বল। এই সাথে আরেকটা জিনিস দেখতে পেল আহমদ মুসা। বৃত্তাকার পাহাড়ের সিম্বলের ডান পাশ দিয়ে একটা ডট রেখা সামনে এগিয়ে গেছে। ডটগুলো পিরামিড আকৃতির। পিরামিডের শীর্ষদিকটা সামনের দিকে।
আহমদ মুসা কাগজ থেকে মুখ তুলে বলল, আসুন, আমরা সুড়ঙ্গটার বাইরে যাই, কাগজটা ভালো করে দেখতে পাব। মনে হচ্ছে। কাগজটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে।
বলে আহমদ মুসা সুড়ঙ্গের বাইরে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
সবাই তাকে অনুসরণ করল। সুড়ঙ্গের বাইরেটা পাথুরে, জংগলাকীর্ণ। আহমদ মুসা একটা পাথরে বসল। সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা চোখ বুলাচ্ছিল চামড়ার সেই কাগজটার উপরই। সে দেখল, বর্গাকৃতি পাহাড়ের যে সিম্বল, তার পূর্ব পাশ দিয়ে পিরামিড-ডটগুলো উত্তরে চলে গেছে। আহমদ মুসারা সুড়ঙ্গপথে যে। পাহাড় পেরিয়ে এল, সে পাহাড়ের দেয়ালে ডটগুলো থেমে গেছে। কিন্তু পাহাড়ের ওপার থেকে আবার সে ডটগুলো সামনে এগিয়েছে। অবশেষে তা গিয়ে শেষ হয়েছে নূর ইউসুফরা যেখানে থাকে সেখানে। ওখানে গিয়ে পিরামিডের উত্তরমুখী শীর্ষদেশটা পশ্চিম দিকে ঘুরে পাহাড়ের মুখোমুখি হয়েছে। সেখানে পাহাড়ের গায়ে দরজা আকৃতির একটা থলে টাঙানো।
অবাক হলো আহমদ মুসা। বুঝল সে, পিরামিড আকৃতির ডটগুলো অবশ্যই রাস্তা নির্দেশক একটা সংকেত। কিন্তু কেন? পাহাড়ের যেখানে গিয়ে সংকেত শেষ হয়েছে, সেটা নূর ইউসুফদের জায়গা। এর আশ-পাশেই ওরা থাকে। কিন্তু সংকেতের লক্ষ ওখানে কেন? কি বুঝাতে চাচ্ছে সংকেত?
আহমদ মুসা মুখ তুলে তাকাল নূর ইউসুফের দিকে। কাগজটা তাকে দেখিয়ে বলল, দেখুন এই রাস্তার সংকেত আপনাদের ওখানে গিয়ে শেষ হয়েছে। একটা কথা জনাব, আপনারা পাহাড়ের যে গুহা
ঘরগুলোতে বাস করছেন, সেগুলো নিশ্চয় আপনাদের তৈরি নয়?
না। আস্ত গুহা-ঘর আমরা পেয়েছি। প্রয়োজনীয় যে জিনিসপত্র সেগুলোই শুধু আমাদের। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন? বলল নূর ইউসুফ।
প্রশ্নটি বোধ হয় আহমদ মুসার কানে পৌঁছেনি। কাগজটির দিকেই তার মনোযোগ আবার নিবিষ্ট হয়েছে। তার ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে।
সংকেতের রাস্তাটা পাহাড়ের গায়ে এসে যেখানে শেষ হয়েছে, যেখানে থলের আকারে দরজার চিহ্ন অংকিত ছিল। সেটার প্রতিই আহমদ মুসার গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ। আহমদ মুসার মনে হল, থলের আকারে দরজার যে চিহ্ন তা একটা কিছুর ইংগিত বহন করে। থলে সব সময়ই সম্পদের প্রতীক। থলে দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে! তাহলে তো এর অর্থ দাঁড়ায় থলেটি কোন গুপ্তধন ভাণ্ডারকে ইংগিত করছে।
কথাটা মনে হওয়ার সংগে সংগে আহমদ মুসার ভাবনায় এল নূর ইউসুফের কোন ঘরে ধনভাণ্ডার ছিল, না ধনভাণ্ডারটি পাশে কোথাও। তাহলে নূর ইউসুফদের গুহা-ঘরগুলো কি, কেন? তাহলে গুপ্তধনের সাথে বা পাহারায় তোক এখানে থাকত? না আরও গুপ্তধন রাখার জন্যেই এ ঘরগুলোও নির্দিষ্ট ছিল।
আহমদ মুসাকে এভাবে হঠাৎ ভাবনায় ডুবে যেতে দেখে বিস্মিত * নূর ইউসুফ বলল, নতুন কিছু ঘটেছে জনাব আহমদ মুসা?
আহমদ মুসা নূর ইউসুফের কথার জবাব না দিয়ে বলল, জনাব। আপনাদের কোন ঘরে কি গুপ্তধন পেয়েছেন?
গুপ্তধন! অনেকটা স্বগতোক্তির মত বেরিয়ে এল নূর ইউসুফের মুখ থেকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়!
গুপ্তধনের কথা শুনে বিস্মিত হয়েছে দাউদ ইব্রাহিম এবং মারুফাও। আমাদের ঘরে গুপ্তধন? বুঝলাম না আমি জনাব। বলল বিস্মিত নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা নকশার সাংকেতিক রাস্তা আবার দেখিয়ে বলল, সাংকেতিক পথের শেষে থলে আকৃতির সংকেতটার অর্থ হলো, এখানে গুপ্তধন রয়েছে।
কোথায়? আমাদের ঘরে?বলল নূর ইউসুফ।
আপনাদের ঘরে না থাকলেও পাশে কোথাও আছে বলে আমার বিশ্বাস। আপনারা যখন আপনাদের ঘরগুলোতে ঢোকেন, তখন সেখানে কি দেখেছিলেন? আহমদ মুসা বলল।
ঘরটা শূন্যই ছিল। আরশোলা, বিভিন্ন কীট-পতঙ্গের বাসা, দীর্ঘ দিন। পরিত্যাক্ত থাকলে যেমনটা হয়। বলল নূর ইউসুফ।
ঘরগুলোকে কিভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন? আশেপাশে কি ওরকম ঘর আছে? আহমদ মুসা বলল।
সেটা অনেকটাই একটা অ্যাকসিডেন্ট। আমরা পাহাড়ের গাকে পেছনের দেয়াল হিসাবে ধরে থাকার মত ঘর তৈরি করছিলাম গাছকে খুঁটি এবং গাছের ডাল-পাতার বেড়া দিয়ে। একদিন গাছের একটা লম্বা খুঁটি বসাতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ের এক স্থানে আঘাত করার সংগে সংগেই একাংশ সরে যায় এবং একটা দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। এভাবে দরজা খুলে যাবার পর এর সংলগ্ন পাহাড়ের গায়ে খোঁজ করাতে আরও দুটি কক্ষ আমরা পেয়ে যাই। আগেই বলেছি কক্ষগুলো শূন্য ছিল। বলল নূর ইউসুফ।
আশেপাশে তো আর খোঁজ করেননি ঐ ধরনের কক্ষ আরও আছে কিন? আহমদ, মুসা বলল।
আমরা খোঁজ করিনি। আপনি তো দেখেছেন, আমাদের তিনটি কক্ষের দুপাশেই পাহাড়ের দেয়াল খুবই এবড়োথেবড়ো। ঐ রকম জায়গায় কক্ষ থাকার প্রশ্নই উঠে না। তবে আমাদের তিন কক্ষের উত্তর পাশে এবড়োথেবড়ো জায়গাটার পাশে পাহাড়ের মসৃণ দেয়াল আছে। তবে আমরা ওদিকে খোঁজ করিনি, প্রয়োজনও ছিল না। বলল নূর ইউসুফ।
আহমদ মুসা তার হাতের নকশার কাগজের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলে উঠল, চিহ্নিত জায়গাটার যে লোকেশন সেটা আমার মনে হচ্ছে আপনাদের কক্ষের উত্তর দিকেই।
আপনি কি মনে করছেন, আমাদের কক্ষের উত্তর দিকে আরও কক্ষ আছে এবং যেখানে ধনভাণ্ডার আছে! বলল নূর ইউসুফ।
আমি নিশ্চিত নই। তবে নকশার নির্দেশনা বলছে, গুপ্তধনভাণ্ডার ঐ রকম স্থানেই থাকতে পারে। আবার ধনভাণ্ডার আপনাদের কক্ষগুলোতে কোথাও থাকতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা মুহূর্তকাল থেমে আবার বলল, আপনারা বাসায় ফিরে, আমার অনুরোধ, একটু খোঁজ করে দেখবেন। আরও কক্ষ সেখানে আছে কি না, কিংবা আপনাদের কক্ষেরই কোথাও ধনভাণ্ডার আছে কি না।
নূর ইউসুফদের বিস্ময়জড়িত চোখে এবার নতুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো।
আমরা বাসায় ফিরব, আপনি ফিরবেন না? বলল মারুফা।
হ্যাঁ, তাই তো। সবাই মিলে আমরা খুঁজব গুপ্ত ধনভাণ্ডারের আলাদা কোন কক্ষ আছে কি না। দাউদ ইব্রাহিম বলল।
না, দাউদ ইব্রাহিম। সময় খুব কম। ডেথ ভ্যালির চারদিকটা তাড়াতাড়ি দেখে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি এখনই যাব ওদিকে।
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল দাউদ ইব্রাহিমকে লক্ষ্য করে, দাউদ ইব্রাহিম, তোমাকে শহরে যেতে হবে।
কোথায়? বলল দাউদ ইব্রাহিম। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
এফবিআই হেড কোয়ার্টারে যেতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
এফবিআই হেড কোয়ার্টারে? কেন? বলল দাউদ ইব্রাহিম।
আমি চিঠি দেব। সেটা এফবিআই চীফ জর্জ আব্রাহাম জনসনকে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি যা বলেন তাই করবে। বলে আবার থামল আহমদ মুসা। বলল পরক্ষণেই, তুমি হবে তার এবং আমার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী। এ ক্ষেত্রে কোন টেলিফোন-মোবাইল ব্যবহার করা যাবে না। সব কাজ তোমাকে অত্যন্ত গোপনে করতে হবে। মনে রেখ, সাবধান না হলে জীবনের উপর ঝুঁকিও আসতে পারে। অবশ্য সিদ্ধান্ত তোমার, তুমি এই অবস্থায় আমাদের সহযোগিতা করবে কি না?
দাউদ ইব্রাহিম আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। তার চোখে-মুখে একটা গৌরব ও খুশির ভাব ফুটে উঠেছিল। কিন্তু আহমদ মুসার শেষ কথায় তার খুশির ভাব উবে গেল, বেদনার ছায়া নামল তার চোখে মুখে। বলল, এটা আপনাদের কাজ, আমাদের নয়? আমরা কি আমেরিকার নাগরিক নই? এই কাজের জন্যে মাত্র ঝুঁকি কেন, জীবন বিসর্জন দিতে পারি, জনাব।
ধন্যবাদ দাউদ ইব্রাহিম। তোমার কাছে আমি এটাই আশা করেছিলাম। আহমদ মুসা বলল। এ জরুরি ও তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ও সিদ্ধান্তের জন্যে বিশেষ অয়্যারলেস ব্যবহার করা যায় না? বলল মরিয়ম মারুফা।
না মারুফা। যে কোন ধরনের ইলেকট্রনিক মেসেজ মনিটর করার ব্যবস্থা ডেথ ভ্যালির শত্রুদের থাকতে পারে। যারা রিমোট কনট্রোলে সব রকম সমরাস্ত্র ধ্বংসের ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে পারে। তাদের এমন মেসেজ মনিটর ব্যবস্থা থাকতেই পারে। আহমদ মুসা বলল।
আমাদের অয়্যারলেস সেট ব্যবহার করা যায়। ওটার ট্রান্সমিশন তো ধরা পড়ে না। বলল মারুফা।
সেটা ঠিক। কিন্তু সেই ট্রান্সমিশন যেখানে রিসিভ করা হবে, সেখানে এটা নানা অফিসিয়াল মনিটরে ধরা পড়তে পারে। সেটা হতে দেয়া যাবে না। আমি বেঁচে আছি কি না, আমার সাথে আমেরিকা-সরকারের যোগাযোগ আছে কি না, তা জানার জন্যে হোয়াইট হাউজসহ সব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চোখ ও কান রাখা হয়েছে। সুতরাং সবদিক দিয়েই ইলেকট্রনিক যোগাযোগ বন্ধ রাখতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
বলে আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে থামল। একটু সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, আর সময় নষ্ট করা যায় না। আপনারা বাসায় ফিরে যান। আমি ডেথ ভ্যালির চারদিকটা একটু ঘুরে দেখব।
আহমদ মুসা থামতেই দাউদ ইব্রাহিম, বলল, আমি কি আপনার সাথে যেতে পারি না?
না, দাউদ ইব্রাহিম। এসব একক কাজ। যত নীরবে করা যায় ততই মঙ্গল। শোন, এখান থেকে দেড়-দুকিলোমিটার দূরে ডেথ ভ্যালির দক্ষিণ প্রান্তের মাঝামাঝি জায়গায় পাহাড়ের গোড়ায় একটা টিলা আছে। ঠিক টিলার মাথায় একটা স্কারলেট ওক গাছ আছে। চারদিকে সবগুলোই হোয়াইট ওক, মাত্র এই একটাই স্কারলেট ওক গাছ। সেই গাছের তলায় তুমি শহর থেকে ফেরার পর প্রতিদিন একবার করে যাবে। আমার কোন নির্দেশ থাকলে সেখানেই পাবে। গাছের তলায় ওক গাছের পশ্চিম পাশে কোন এক পাথরের তলায় একটা চিরকুটে সেটা লেখা থাকবে। পাথরটা অবশ্যই একটু অসাধারণ হবে। আহমদ মুসা বলল। * আপনি কি ওক গাছের ওখানে গেছেন স্যার? জিজ্ঞাসা মারুফার। তার চোখে-মুখে বিস্ময়!
না যাইনি। আহমদ মুসা বলল।
যাননি? তাহলে গাছের এমন প্রত্যক্ষদর্শীয় বর্ণনা কিভাবে দিলেন? বলল মারুফা।
ওটা আমার কৃতিত্ব নয়, গুগলে এসব সম্পর্কে আমি আগে দেখেছি। আহমদ মুসা বলল।
মারুফা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই দাউদ ইব্রাহিম বলল, শহরে আমাকে কখন যেতে হবে জনাব?
হ্যাঁ, এখনি আমি একটা চিরকুট লিখে দিচ্ছি। তুমি বরং এখান থেকেই চলে যাও। এদিক হয়ে নতুন পথটা তোমার চেনাও দরকার।
বলে আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে কাগজ ও কলম নিয়ে লিখতে বসল। আর দাউদ ইব্রাহিমরা সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে সবকিছু আর একবার দেখা শুরু করল। দাউদ, ইব্রাহিম বলল, বাবা, আমাকে এখন তো এ পথেই যাতায়াত করতে হবে।
লেখা হলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
সুড়ঙ্গ থেকে দাউদ ইব্রাহিমরাও ফিরে এসেছে।
আহমদ মুসা চিরকুটটা দাউদ ইব্রাহিমের হাতে তুলে দিয়ে বলল, খুব সাবধান! এই চিঠি এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন ছাড়া তার অফিসের আর কাউকে দেয়া যাবে না। অফিসে তার সাথে দেখা করা বিপজ্জনক হতে পারে। তার বাসায় তার সাথে দেখা করাই ভালো। চিরকুটের সাথে অন্য একটা কাগজে তার বাড়িতে যাওয়ার পথ এঁকে দিয়েছি। পারবে যেতে? জর্জ আব্রাহাম জনসন লাঞ্চের জন্যে উঠেন বেলা সাড়ে এগারোটায়। বাড়ির গেটে পৌঁছেন সোয়া বারোটায়। তুমি তার আগেই সেখানে পৌঁছবে। গার্ডরা ঢুকতে দেবে না। তুমি বলবে, আমি স্যারের সাথে কথা বলতে চাই। আমি যে কোন শর্ত মেনে তার সাথে দেখা করতে রাজী আছি। যাহোক, তোমাকে যেভাবেই হোক দেখা তার সাথে করতেই হবে।
একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল। তারপর বলল, আগামী কাল বেলা দশটায় অথবা তিনটায় স্কারলেট ওক গাছের তলায় যাবে। তারপর ওখানকার সব সংবাদ লিখে পাথর চাপা দিয়ে রাখবে। প্রতিদিন এ সময় তোমাকে ঐ ওক গাছতলায় যেতে হবে। তখন আমার সাথে দেখাও হবে ইনশাআল্লাহ। যদি কখনো তুমি দেখ যে, তোমার রাখা কাগজ আমি পাথরের তলা থেকে নেইনি, তাহলে বুঝবে আমি কিছুতে ব্যস্ত আছি অথবা আমি কোন বিপদে পড়েছি। সে ক্ষেত্রে তুমি প্রতিদিন অন্তত একবার ঠিক সময়ে গাছের তলায় আসবে।
একটু থামল আহমদ মুসা। পরমুহূর্তেই আবার বলল, তোমাকে এখানে আসা-যাওয়ার কাজটা মেষপালকের ছদ্মবেশে করতে হবে। ছোট খাটো একটা মেষের পাল তো তোমাদের রয়েছেই। থামল আহমদ মুসা।
আপনার কি ধরনের বিপদ হতে পারে? সেক্ষেত্রে আমাদের উপর নির্দেশ কি? আহমদ মুসা থামতেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল মরিয়ম মারুফা।
হ্যাঁ জনাব, আমিও এই কথাটাই বলব ভাবছিলাম। নূর ইউসুফ বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, কিছুই করতে হবে না দোয়া ছাড়া। একটা কাজ, দাউদ ইব্রাহিম প্রতিদিন ঐ গাছতলায় একবার যেন যায়।
অবশ্যই তা হবে জনাব। কিন্তু একটা কথা, যদি তেমন কিছু ঘটে, তাহলে আমরা খোঁজ করতে যেতে পারব না? বলল দাউদ ইব্রাহিম।
গিয়ে কিছু লাভ হবে না। শত্রুপক্ষ এতটাই শক্তিশালী যে, তোমাদের বিপদ বাড়ানো ছাড়া আর কোন লাভ হবে না।
এমন শত্রুর মোকাবিলায় আপনি একা যাবেন কেন তাহলে? বলল মরিয়ম মারুফা।
আমি এ শত্রুদের চিনি। তাই তাদের মোকাবিলা করার পথ আমার কিছুটা হলেও জানা আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমার সন্ধানে কেউ বেরিয়েছে এটা জানতে পারলে ওরা এর ভিন্ন অর্থ করতে পারে। তারা ধরে নেবে মার্কিন সরকারের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে এবং তোমরা তাদেরই লোক। সেক্ষেত্রে তারা ভীত হয়ে তাদের ভয়ানক অস্ত্র ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ, মার্কিন অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংসের জন্যে ব্যবহার করে বসতে পারে। এটা আমরা তাদের করতে দিতে পারি না।
ঠিক আছে স্যার, তাই হবে। আমরা বুঝতে পারছি। বলল নূর ইউসুফ, দাউদ ইব্রাহিমের মত তারও চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ।
ধন্যবাদ সকলকে। আমি যাত্রা শুরু করতে চাই। বলে ছোট ব্যাগটা পিঠের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ, আর একটা কথা, সুড়ঙ্গ পথের মুখের পাথরটা খোলাই থাকবে। কারণ ওপার থেকে পাথরটা বন্ধ করা যায় না। আসলে ওপারে পাহাড় খোদাই করে ঘরগুলো তৈরি হয়েছিল ধনভাণ্ডার সংরক্ষণের জন্যে। ওখানে মানুষ থাকত না। যখন ধন-সম্পদ দেখার জন্যে কিংবা রাখার প্রয়োজন হতো তখন একাধিক লোক সেখানে যেত। তাদের কেউ যখন ধনভাণ্ডারে যেত, তখন অন্য কেউ সুড়ঙ্গ মুখ বন্ধ করে এপাশে আড়ালে কোথাও অপেক্ষা করত। এখন দুপাশে লোক রাখা যাচ্ছে না বলে সুড়ঙ্গ মুখ বন্ধ করার দরকার নেই।
একটু থেমে আহমদ মুসা নূর ইউসুফদের লক্ষ্য করে বলল, সবাই সাবধান থাকবেন। আমি আসি, আসোলামু আলাইকুম।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।
নূর ইউসুফদের সবার দৃষ্টি আহমদ মুসার যাত্রাপথের দিকে। সবাই বাকহীন, নীরব।
এক সময় নীরবতা ভেঙে দাউদ ইব্রাহিম বলল, বাবা, আমিও এখন যাত্রা করতে চাই।
হ্যাঁ, আব্রাহাম জনসনের সাথে দেখা করাটা খুবই জরুরি। যাও তুমি। একটা কথা, গুপ্তধনের ব্যাপারটা আমাকে চিন্তিত করছে।
কেন? বলল দাউদ ইব্রাহিম।
যেভাবেই হোক, ওখানে থাকার সুবাদে আমরা গুপ্তধনের পাহারাদার হয়েছি। নূর ইউসুফ বলল।
চিন্তার কিছু নেই বাবা। এ সম্পদের আর কোন ক্ষতির আশংকা নেই। আহমদ মুসা এলে তিনিই বিষয়টা দেখবেন এবং ব্যবস্থাও নেবেন। বলল দাউদ ইব্রাহিম।
আলহামদুলিল্লাহ। আমিও তাই চাই। নূর ইউসুফ বলল।
তাহলে আমি আসি বাবা। তোমরা সাবধানে থেকো। আস্সালামু আলাইকুম।
বলে দাউদ ইব্রাহিম ঘুরে দাঁড়িয়ে বিসমিল্লাহ বলে সামনের দিকে পা বাড়াল।
.
২.
আহমদ মুসা ডেথ ভ্যালির উত্তর পাশের শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল। সামনে আর ইঞ্চি পরিমাণ এগোবার উপায় নেই। ডেথ ভ্যালির পূর্ব পাশ, যেখানে একটা অংশে নুর ইউসুফদের বাসস্থান সেখান থেকে পাহাড়ের একটা দেয়াল উত্তর ও পূর্ব পাশের সন্ধিস্থল থেকে অনেকখানি। উত্তরে বেড়ে গেছে। তার ফলে পূর্ব পাশ থেকে উত্তর পাশে যাবার কোন উপায় নেই, উত্তর পাশ থেকেও একই অবস্থা।
আহমদ মুসা ডেথ ভ্যালির চারদিক দেখে চমৎকৃত হলো। ডেথ ভ্যালির চারদিকে পাহাড়ের দেয়ালের প্রতিটা অংশ নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করেছে সে। কোন স্থান দিয়েই খাড়া পাহাড় ডিঙিয়ে ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশ সম্ভব নয়। এক সময় যে গিরিপথ দিয়ে ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশ করা হতো, ভূমিকম্প তাকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে যে, তার কোন হদিস আহমদ মুসা খুঁজে পায়নি। সব দেখে আহমদ মুসার মনে হয়েছে, ডেথ ভ্যালি সত্যিই অভেদ্য এক প্রাকৃতিক কারাগার।
কিন্তু আহমদ মুসা কিছুতেই বুঝতে পারছে না, ডেথ ভ্যালিতে ওদের যে ঘাঁটি আছে তা সত্য। তাহলে ওরা ঘাঁটিতে যাতায়াত করে কোন্ পথে! কোনো লো-ফ্লাইং হেলিকপ্টারে? তা অসম্ভব! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের একটা অংশে, পেন্টাগন থেকে যার দূরত্ব তেমন একটা নয়, বলা যায় পাশাপাশি। যত লো-ফ্লাইংই হোক পেন্টাগনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এখানে হেলিকপ্টার উঠানামা করা সম্ভব নয়। তাহলে? এই তাহলের জবাব নেই আহমদ মুসার কাছে।
আহমদ মুসা একটা পাথরে বসে ছিল।
উঠে দাঁড়াল ডেথ ভ্যালির এই উত্তরের পাশটা আর একটু ভালো করে দেখার জন্যে। অন্য তিন পাশ থেকে এপাশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, রক ক্রিকের সংকীর্ণ নদীটা এ প্রান্তটার পা ধুইয়ে দিয়ে আরও সামনে মানে পশ্চিমে এগিয়ে গেছে। আর এ প্রান্তের পাহাড়ের দেয়ালটা অপেক্ষাকৃত কম খাড়া। অনেকটা ধাপে ধাপে উঠে গেছে। অবশ্য একটা পর্যায় পর্যন্ত উঠে খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে। উত্তর প্রান্তটায় পাহাড়ের এক পর্যায় পর্যন্ত ওক গাছের সারি। এর পাথুরে জমিতে ঘাস ও লতা পাতার খুব অভাব। এদিকে মেষপালকরা আসেই না।
সেই সাথে ডেথ ভ্যালির উত্তর পাশটা ছোট-বড় আলগা পাথরে ভরা। পাথরগুলো অমসৃণ ও নড়বড়ে। একটু অসাবধান হয়ে কোন আলগা পাথরে পা ফেললেই পাথরের সাথে সাথে তাকেও গড়িয়ে পড়তে হবে নিচে ক্রিক নদীর প্রান্তে।
আহমদ মুসা ডেথ ভ্যালির উত্তর পাশ ধরে পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করল আবার। চারদিকে তার সতর্ক দৃষ্টি কোন কু কোথাও পায় কি না। ডেথ ভ্যালিতে ঢোকার ওদের নিশ্চয় একটা কোন পথ আছে, সেটা খুঁজে বের করাই এখনকার প্রধান কাজ।
সন্তর্পণে হাঁটছে আহমদ মুসা।
চারদিকে নজর রাখছে, আবার দেখে দেখেও পা ফেলছে। আহমদ মুসা পৌঁছে গেছে ডেথ ভ্যালির প্রায় পশ্চিম প্রান্তের কাছাকাছি। আর কয়েক ধাপ গেলেই তাকে দক্ষিণ দিকে মোড় নিতে হবে।
আহমদ মুসা দুধাপ এগিয়ে ভোঁতা মাথার পিরামিড আকৃতির একটা পাথরের মাথায় বাম পা রেখে অন্য একটা বড় পাথরের উপর লাফ দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ বাম পায়ের নিচ থেকে পাথরটি পিছলে সরে গেল। সংগে। সংগে আহমদ মুসা উল্টে পড়ে গেল ঢালুর দিকে। দেহটা কয়েকবার ওলট-পালট খেয়ে পনের-বিশ গজ নিচে একটা বড় পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে একটা গাছের গোড়ায় আটকে গেল। বুক, পিঠ ও মাথায় বেশ আঘাত পেয়েছে আহমদ মুসা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল আহমদ মুসা।
এই ঘটনাস্থল থেকে কিছু দূরে একটা উপত্যকা থেকে মেষের পাল দেখাশোনারত দুই যুবক ঘটনাটা দেখতে পেয়েছিল। তারা ছুটে এল। আহমদ মুসার কাছে।
একজন আহমদ মুসার পাশে বসে, তাকে পরীক্ষা করল। বলল, জনার্দন, লোকটি জ্ঞান হারিয়েছে।
হ্যাঁ বরিস। লোকটা কিন্তু আমেরিকান নন। বিদেশী পর্যটক হতে পারে।
তাই মনে হচ্ছে। চল আমরা একে আমাদের বাসায় আপাতত নিয়ে যাই। দেখা যাচ্ছে, তার কোন আঘাতই তেমন গুরুতর নয়। বলল বরিস নামের লোকটি।
চল, ধরাধরি করে নিয়ে যেতে হবে। বরিস বলল।
বরিস ও জনার্দন দুজন চাচাতো ভাই। এই এলাকার এক পাহাড়ি পরিবারের সন্তান।
তাদের পরিবারটি রেড ইন্ডিয়ান-আমেরিকান।
তারা আহমদ মুসাকে নিয়ে তুলল তাদের বাড়িতে। গ্রামটা ডেথ ভ্যালি থেকে মাইল তিনেক পশ্চিমে। নাম বুশ ভ্যালি। পাহাড় ঘেরা প্রশস্ত এক উপত্যকা ওটা। গোটা গ্রামটাই সবুজে ঢাকা।
গ্রামে ঢোকার মুখেই ঝরনার ধারে একটা বিরাট বাড়ি। গোটাটাই পাথরের তৈরি।
আহমদ মুসাকে ধরাধরি করে বাড়ির উঠানে প্রবেশ করতেই উঠানের একটা গাছের ছায়ায় বসা একজন প্রৌঢ় উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসাকে প্রৌঢ়ের সামনে নিয়ে রাখা হলো।
প্রৌঢ়ের চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল, তোমরা কিছু ঘটিয়েছ নাকি? এ কে?
না বাবা, ইনি পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে আহত হয়েছেন। সম্ভবত কোন পর্যটক হবেন। বলল বরিস।
হ্যাঁ, তেমন কিছু হবে। লোকটা তো দেখছি বিদেশী। ক্রিমিনাল মনে হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি ভেতরে নাও। প্রথমে জ্ঞান ফিরাতে হবে। সেই সাথে আপাতত তার ক্ষত থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু কিছু ক্ষত থেকে এখনো রক্ত বেরুচ্ছে দেখছি।
ঠিক আছে বাবা! বলে বরিস ও জনার্দন দুজনে ধরাধরি করে তাকে ভেতরে নিয়ে গেল।
প্রৌঢ় ব্যক্তির নাম রবার্ট রবিনসন। বরিসের পিতা এবং জনার্দনের বড় চাচা। রবার্ট রবিনসন এই পরিবারের কর্তা। বুশ ভ্যালি গ্রামের গোত্রেরও প্রধান তিনি।
বরিস ও জনার্দন আহমদ মুসাকে নিয়ে যেতে শুরু করলে আরও তিনজন কিশোর, যুবক বেরিয়ে এল।
তারা সবাই মিলে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল আহমদ মুসাকে। নিয়ে তুলল তাকে একটা রুমে।
প্রৌঢ় রবার্ট রবিনসন সাথে সাথে এসেছিল। বলল, সবাই এখানে ভিড় করো না। আমাদের এলিজা ও জুলিয়া দুজনেরই নার্সিং ট্রেনিং আছে। ফাস্ট এইড দেয়ার কাজ ওরাই করতে পারবে।
এলিজা প্রৌঢ় ভদ্রলোক রবার্ট রবিনসনের মেয়ে, বরিসের বোন। আর জুলিয়া বরিসের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী।
বাবা, ওর জ্ঞান আগে ফেরানো দরকার। বলল জুলিয়া।
দুই কাজ এক সংগেই চলতে পারে। আমার ধারণা ক্ষতস্থান পরিষ্কার ও ব্যান্ডেজ বাঁধার সময় শরীরে যে ব্যথা পাবে, তাতেই তার জ্ঞান ফিরে আসবে। বলে এলিজা ও জুলিয়া কাজে লেগে গেল।
তাই হলো। আহত স্থান পরিষ্কার করার শুরুতেই আহমদ মুসা সংজ্ঞা ফিরে পেল। কিন্তু সংগে সংগে চোখ খুলল না। সে কোথায়, কাদের হাতে সেটা তার জানা দরকার। তার মনে পড়ল, একটা পাথরে পা রাখার পর তা সরে যাওয়ায় সে নিচে পড়ে গিয়েছিল। বুক, কাঁধ ও মাথার সামনের আহত স্থানের যন্ত্রণা সে টের পাচ্ছে। কতক্ষণ সে সংজ্ঞা হারিয়ে ছিল। এরা কারা তাকে তুলে এনেছে। নরম বিছানা, সযত্ন শুশ্রূষা প্রমাণ করে কোন শত্রুপক্ষ এরা নয়। তাছাড়া শুশ্রূষার চারটি হাতও মেয়েলি, তাদের দুএকটা কথাও এর প্রমাণ।
এ সময় আহমদ মুসা শুনতে পেল ভারি মেয়েলি কণ্ঠ, আহারে বাছ! জ্ঞান এখনও ফেরেনি! কোথাও কোন বড় ধরনের আঘাত নেই তো! দেখে মনে হচ্ছে খুব ভালো ছেলে। হাসপাতালে নেয়া যায় কি না? বলল রবার্ট রবিনসনের স্ত্রী, বরিস ও এলিজার মা।
হাসপাতালে নেয়ার কথায় আহমদ মুসা চমকে উঠল। কিছুতেই তার হাসপাতালে যাওয়া যাবে না। হাসপাতালে যাওয়া ঠেকাতে হলে তাকে সজ্ঞানে ফিরে আসতে হবে।
সজ্ঞানে আসার লক্ষণ হিসাবে পায়ের আঙুল, হাতের আঙুল নড়াল আহমদ মুসা।
এলিজা ও জুলিয়া একসংগে বলে উঠল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এর জ্ঞান ফিরে আসছে।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা। তাকাল চারদিকে। বলল, আমি কোথায়?
আপনি একটা বাড়িতে। কোন চিন্তা করবেন না। পড়ে গিয়ে আপনার তিনটি ক্ষত হয়েছে। আমরা ঔষধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। আপনার একটু কষ্ট হবে। বলল এলিজা।
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। আমি পাহাড়ে চলার সময় হঠাৎ পড়ে গিয়েছিলাম। আহমদ মুসা বলল,
আমাদের বরিস ও জনার্দন আপনাকে দেখতে পেয়ে নিয়ে এসেছে। বলে এলিজা দেখিয়ে দিল পাশে দাঁড়ানো বরিস ও জনার্দনকে।
আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে তাদের ধন্যবাদ দিল। মেয়ে দুটি তো বটেই, ছেলে দুটিকে দেখে আহমদ মুসার মনে হলো, ওদের সহজ-সরল চোখে-মুখে অন্য কোন মতলব নেই।
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আবার চোখ বুজল।
মাথার ক্ষতটা পরিষ্কার করছিল এলিজা। বলল, ক্ষতের ভেতরে কিছু ক্ষুদ্র পাথরের টুকরো ঢুকেছে। ওগুলো পরিষ্কার করতে হবে। কষ্ট হবে, ধৈর্য ধরতে হবে আপনাকে।
ঠিক আছে। আপনাদের কাজ করুন। বলল আহমদ মুসা।
মাথার ও ঘাড়ের আহত স্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে কেঁপে উঠেছিল এলিজা ও জুলিয়া দুজনেই। কিন্তু আহমদ মুসার কোন ভাবান্তর নেই। নিরুদ্বেগে যেমন মানুষ ঘুমায়, তেমনি নির্বিকারভাবে সে শুয়ে আছে। কষ্টের সামান্য ছাপও পড়েনি মুখে। বিস্মিত হলো এলিজা ও জুলিয়া।
এলিজা ও জুলিয়া ফ্রেশ হবার জন্যে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল।
বরিস ও জনার্দন আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে বলল, স্যার, আপনাকে ভালো বেডে শিফট করা দরকার। আমরা আপনাকে অন্যত্র। নিয়ে যেতে চাই।
ধন্যবাদ। নিয়ে যেতে হবে না। আমি হাঁটতে পারব। বলে আহমদ মুসা উঠে বসল।
স্যার, আপনার জামা-কাপড় সবই রক্তে ভিজে গেছে। পাল্টানো দরকার। এই কাপড় আমরা এনেছি। বলল বরিস।
ধন্যবাদ, তোমার নাম বোধ হয় বরিস। আহমদ মুসা বলল। জি স্যার। আমি বরিস বুবুকি। বলল বরিস।
আর জনার্দন কে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার। বরিস দেখিয়ে দিল জনার্দনকে।
আমি কৃতজ্ঞ জনার্দন। ধন্যবাদ। বলল আহমদ মুসা জনার্দনকে লক্ষ্য করে।
ওয়েলকাম স্যার। সলজ্জ কণ্ঠে বলল জনার্দন।
এলিজা ও জুলিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে সকলের সাথে দাঁড়িয়েছিল।
বরিস সেখানে উপস্থিত বাবা-মাকে দেখিয়ে তাদের সাথে পরিচয়। করিয়ে দিল। এলিজা ও জুলিয়ার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিল বরিস বুবুকি।
বরিস থামতেই বরিসের মা ইম্মা ইমেলি বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, বাছা! তোমার নাম কি? তুমি কোথায় থাক?
প্রশ্নটি আহমদ মুসাকে বিব্রত করে তুলল। সত্যটা তো বলা যাবেই না। কিন্তু একজন মায়ের মত ব্যক্তির কাছে মিথ্যা কথা বলবে কেমন করে?
অবশেষে সত্যের স্বার্থে মিথ্যা বলতেই হলো। কিন্তু আহমদ মুসার মিথ্যা বলতে খারাপ লাগল। বলল, মা, আমি যদি নামটা না বলি, তাহলে কি আপনারা খারাপ ভাববেন?
তার মানে তুমি নাম বলতে চাও না, আবার মিথ্যা নামও বলতে চাও না। এটা তোমার সতোরই লক্ষণ। মেনে নিচ্ছি আমরা নিশ্চয় এমন কোন কারণ আছে, যার জন্যে তুমি নাম বলতে চাও না। ঠিক আছে। বলল ইম্মা ইমেলি, বরিস ও এলিজার মা।
অনেক ধন্যবাদ মা। আমার সমস্যা আপনি বুঝেছেন। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা লাউঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটেই গেস্ট রুমে তার বেড়ে গেল। হাঁটার সময় বরিস ও জনার্দন দুজনেই তার দুপাশে ছিল। আহমদ মুসা বেড রুম পর্যন্ত হেঁটে আসল বটে, কিন্তু অনুভব করল ব্যথায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ঘাড় ও বুকের আঘাতটাও তাকে অনেক দুর্বল করেছে।
বেডে শোবার পর তার ব্যাগটা চেয়ে নিয়ে নূর ইউসুফের কাছ থেকে নিয়ে আসা কয়েকটা ট্যাবলেট খেয়ে নিল।
আহমদ মুসা শুয়ে পড়লে বরিস ও জনার্দন ঘরের দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
ভেতরের লাউঞ্জটিতে তখনও বসে রবার্ট রবিনসন, ইম্মা ইমেলি, এলিজা, জুলিয়া এবং পরিবারের অন্যরা।
কথা বলছিল রবার্ট রবিনসন, …কিন্তু নামটা বলল না কেন? দুই কারণে মানুষ নাম গোপন রাখে। যদি কোন লোক পরিচিত ক্রিমিনাল হয় অথবা কোন লোক যদি তার নাম প্রকাশ হলে বিপদের আশংকা করে। এই লোকটির ক্ষেত্রেও এ দুটির কোন একটি সত্য হবে। যদি তাই হয়, তাহলে আহমদ মুসা সাধারণ ট্যুরিস্ট কেউ নয়।
ছেলেটা কে আমি জানি না। কিন্তু সে ক্রিমিনাল নয় তা নিশ্চিত। কোন লোক ক্রাইম করলে তার চোখে-মুখে তার প্রকাশ থাকে, এই ছেলের চোখ-মুখ একেবারেই নিষ্পাপ বলল ইম্মা ইমেলি, বরিস-এলিজার মা।
লোকটাকে যে দেখবে তার এটাই মনে হবে মা। আর একটা কথা, লোকটা সাধারণ নার্ভের লোক নয়। আহত স্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে তার শরীরে বেশ কাটা-ছেঁড়ার কাজ করতে হয়েছে। সাধারণ কোন লোক হলে তার চিৎকারে কানপাতা দায় হতো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, অমন তীব্র যন্ত্রণায়ও তার মুখভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি। ঠোঁটে সামান্য কম্পনও দেখা যায়নি। এমন নার্ভের মানুষ দেখা যায় না। বললেই চলে। বলল এলিজা।
ঠিক বলেছে এলিজা। আমিও এই কথাটাই বলব ভাবছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে লোকটার নার্ভ পাথরের মত শক্ত। জুলিয়া বলল।
আমি আরেকটা কথা ভাবছি, ডেথ ভ্যালির ঐ অঞ্চলে কোন দিন কোন পর্যটককে দেখিনি। আমরা খেয়াল করেছি সে ডেথ ভ্যালির উত্তর পাশের পূর্বদিকে শেষ পর্যন্ত গিয়েছিল। ফিরে আসার পথে দুর্ঘটনা ঘটেছে। বলল বরিস বুবুকি।
কিছু খুঁজছে কি তাহলে সে? জনার্দন বলল।
কি খুঁজতে পারে? গুপ্তধনের রুট তো ওটা নয় আমি জানি। বলল রবার্ট রবিনসন।
আবার গুপ্তধনের কথা? ওটা কেন ভুলতে পারছ না? এ নিয়ে আমাদের কত বড় ক্ষতি হয়েছে! সংকট এখনও যায়নি। ওদের ধারণা গুপ্তধনের নকশা আমাদের কাছে আছে। এ নিয়ে বিপদের খড়গ ঝুলছে। আমাদের মাথার উপর। বলল ইম্মা ইমেলি।
মনে না করলেই কি রক্ষা পাওয়া যাবে। আমরা এত বলছি, নকশা আমাদের কাছে নেই। চাচা ওটা সাথে করে নিয়ে গেছে, সে তো আর ফেরেনি। কিন্তু তারা বিশ্বাস করছে কই? বলছে, হয় আসলটা, নয় নকল কপি আমাদের কাছে আছেই। তারা হুমকি দিয়েছে, স্বেচ্ছায় না দিলে তারা তা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। তার উপর আমার বিয়ের ঘটনা ওদের আরও উস্কে দিয়েছে। বলল বরিস বুবুকি।
থাক এসব কথা। মেহমানের কিন্তু খাওয়া হয়নি। তার খাবার ব্যবস্থা কর। বলল রবার্ট রবিনসন।
.
খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গেছে। পরদিন রাত তখন ৯টা। আহমদ মুসা খাবার পর বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। আজ অনেকটাই সুস্থ আহমদ মুসা। রবার্ট রবিনসনসহ সবাই কেউ চেয়ারে কেউ সোফায় বসে। উদ্দেশ্যবিহীন বিভিন্ন কথা-বার্তা চলছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ আহমদ মুসা রবার্ট রবিনসনকে লক্ষ্য করে বলল, কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি জনাব।
অবশ্যই জিজ্ঞাসা করুন? উত্তর দিতে পারব কি না সেটা ভিন্ন কথা। বলল রবার্ট রবিনসন।
আপনারা, লাউঞ্জে যখন গল্প করছিলেন তখন গুপ্তধনের কথা উঠেছিল। বিষয়টা কি আমি জানতে পারি? আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার এই কথার সাথে সাথে রবার্ট রবিনসনসহ সবার মুখ মলিন হয়ে গেল। অজান্তেই তারা যেন একে অপরের দিকে তাকাল। কেউ কোন কথা বলল না। তাদের মনে একটা সন্দেহও দানা বেঁধে উঠল। তাহলে লোকটি কি গুপ্তধন সন্ধানী দলের লোক!
এসব নানা কথা নিয়ে তারা চিন্তিত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। তখন আহমদ মুসা বলল, নিশ্চয় আপনারা ভাবছেন গুপ্তধনের সাথে আমার। সম্পর্ক নিয়ে, কেন আমি এ বিষয় নিয়ে আপনাদের জিজ্ঞাসা করছি! আমার সব কথা শুনলে আপনাদের উদ্বেগ-দ্বিধা দূর হয়ে যাবে আশা করি।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর সংক্ষেপে তাদের সব জানালো। সুড়ঙ্গে কিভাবে একজনের কংকাল দেখল, কিভাবে মুখের ভেতর থেকে একটা চামড়ার কাগজ বের করল, কাগজটি পরীক্ষা করে বুঝল এটা গুপ্তধনের স্থান ও রাস্তার নকশা ইত্যাদি বলে আহমদ মুসা থামল।
গুপ্তধনের নকশা কি আপনার কাছে আছে? বলল রবার্ট রবিনসন।
হ্যাঁ, আমার কাছে আছে। আমি নকশাটা পাওয়ার পরই একটা কাজে এদিকে চলে এসেছি। গুপ্তধন যে দিকে সেদিকে যাবার সুযোগ হয়নি।
কংকালটা কেমন দেখেছেন? তার সামনের একটা দাঁত কি ভাঙা? বলল দ্রুত কণ্ঠে রবার্ট রবিনসন।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর বলল, হ্যাঁ, কংকালের সামনের ডান দিকের একটা দাঁত ভাঙা।
শুনেই দুহাতে মাথা চেপে ধরে মুখ নিচু করল রবিনসন। সে কান্না চাপার চেষ্টা করছে।
সবাই বেদনায় পাণ্ডুর। ছলছল করছে সবার চোখ।
কিছুক্ষণ পর মুখ তুলল রবার্ট রবিনসন। সে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ও আমার ছোট ভাই রবার্ট রমন। গুপ্তধনের নকশা পাবার পর থেকেই সে গুপ্তধন উদ্ধারে পাগল ছিল। শেষ পর্যন্ত এ কাজেই সে জীবন দিল।
সে কিভাবে মারা গেছে, অনাহারে না কোন কিছুর আক্রমণে? তা কি কিছু বুঝতে পেরেছেন? বলল রবিনসন।
তাকে গুলি করে মারা হয়েছে। তার মাথার নিচে কপালে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। আহমদ মুসা বলল।
কারা চাচাকে গুলি করে মেরেছে আন্দাজ করতে পারছ বাবা? রবার্ট রবিনসনকে উদ্দেশ্য করে বলল বরিস বুবুকি।
কারা তা বুঝাই যাচ্ছে। যশুয়া গোত্রের লোকরা নিশ্চয় তাকে ফলো করেছিল। তারাই তাকে হত্যা করেছে। বলল রবার্ট রবিনসন।
কিন্তু তারা তাহলে গুপ্তধনের নকশা পেল না কেন? নকশা তো। চাচার সাথেই ছিল। বরিস বুবুকি বলল। এ উত্তরটা আমি দিচ্ছি। বলে আহমদ মুসা বলল, শত্রুপক্ষকে দেখেই সম্ভবত রবার্ট রমন বুঝতে পেরেছিল তারা কি চায়। সে গুপ্তধনের নকশাটা মুখে পুরে রেখেছিল। তাই হত্যার পর তাকে সার্চ করেও নকশাটা যশুয়া গোত্রের লোকরা পায়নি। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু আপনি পেলেন কি করে? জিজ্ঞাসা এলিজার।
আমি কংকালটা পরীক্ষার সময় টর্চ জ্বেলে দাঁতের ফাঁক দিয়ে মুখের ভেতরে কাগজ জাতীয় কিছু দেখতে পাই। তারপর মুখ থেকে সেটা বের করি আমি। আহমদ মুসা বলল।
আপনি কি করে বুঝলেন যে ওটা গুপ্তধনের নকশা? বলল বরিস বুবুকি।
আহমদ হাসল। তারপর পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল।
আপনি সাংঘাতিক বুদ্ধিমান ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন! তাহলে আপনি তো গুপ্তধনের জায়গাটাও দেখেছেন? বলল এলিজা।
শুধু দেখেছি নয়, ওখানে কয়দিন ছিলাম মেহমান হয়ে। সেখানে একটি পরিবার বাস করে। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে গুপ্তধন কি তাদের দখলে বাছা? বলল ইম্মা ইমেলি। এলিজা ও বরিসের মা।
না মা, গুপ্তধনের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। তারা আমার কাছ থেকে মাত্র শুনেছে ঐখানে গুপ্তধন আছে। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে তো ওরা গুপ্তধনের সন্ধান নিশ্চয় করবেন? বলল রবার্ট রবিনসন।
না জনাব, গুপ্তধনের প্রতি তাদের কোন লোভ নেই। আমি ওখানে গেলেই মাত্র বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হবে।
আপনি সুস্থ হলেই নিশ্চয় ওখানে যাবেন? জিজ্ঞাসা এলিজার।
না, তার চেয়েও বড় কাজ আমার আছে, সেটা না সারলে ওখানে যাবার আমার সুযোগ হবে না। আহমদ মুসা বলল।
গুপ্তধন সন্ধানের চেয়েও বড় কাজ! সে কাজটা আবার কি বাছা? বলল ইম্মা ইমেলি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, আমার নামের মত ওটাও এখন না জানা থাক মা। চিন্তা নেই। সবই আপনারা এক সময় জানতে পারবেন।
আহমদ মুসা হাসি মুখে কথা বললেও তা শান্ত অথচ শক্ত ছিল। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়ার মত।
তাহলে আপনার ব্যাপারে আমাদের কিছু জানাবেন না? আমরা বোধ হয় এতটা অবিশ্বস্ত নই। আমাদের পরিবার মিশ্র শ্বেত-রেড ইন্ডিয়ান হলেও রেড ইন্ডিয়ানদের আমানতদারী আমরা জীবন দিয়েও রক্ষা করি। বলল বরিস বুবুকি।
আহমদ মুসার মুখটা একটু মলিন হলো। বলল, আমি দুঃখিত। প্রশ্নগুলোর উত্তর না দেয়া অস্বাভাবিক। তবুও আমি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছি না, এ অবিশ্বাসের কারণে নয়। এমন কিছু সময় আসে, যখন এমন কিছু কথা থাকে যা এমনকি স্ত্রীকেও বলা যায় না, নিজের ভাই কিংবা ছেলেকেও বলা যায় না। তবে আপনারা অবশ্যই জানতে পারবেন। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ বাছা! বুঝতে পেরেছি। তুমি বড় কোন ব্যাপার নিয়ে কাজ করছ। ঈশ্বর করুন তুমি সফল হও। বলল ইম্মা ইমেলি।
ধন্যবাদ মা। আহমদ মুসা বলল।
রাত সাড়ে ১২টায় ঘুম ভেঙে গেল আহমদ মুসার। বাড়ির ভেতরে হৈ চৈ, কান্নাকাটির শব্দ। আহমদ মুসা উঠে বসল।
বিড়ালের মত সন্তর্পণে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল আহমদ মুসা। তার ডানে দুগজ দূরে গেটের পর বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকার প্যাসেজ। আহমদ মুসা একটু এগিয়ে দেখল গেট খোলা। লক ভেঙে ফেলা হয়েছে। অথবা দরজাই ভেঙে ফেলা হয়েছে।
লাউঞ্জের আরও ভেতরে এগিয়ে গেল আহমদ মুসা। এই লাউঞ্জটা বাড়ির কেন্দ্রবিন্দু। ঘরগুলো মোটামুটি এই লাউঞ্জকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে। লাউঞ্জ থেকে চারটি করিডোর চার দিকে গেছে। তার একটার মুখে গেট।
আহমদ মুসা একটু এগিয়ে দেখল, রবার্ট রবিনসন, বরিস বুবুকি, জনার্দন সকলেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায় লাউঞ্জের শেষ মাথার দিকে পড়ে আছে।
চারজন লোক এলিজা ও জুলিয়াকে দুতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনছে। তারা ও সাথে তাদের মা ইম্মা ইমেলি চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে।
কথা বলছিল রবার্ট রবিনসন। বলছিল, তোমাদের মেয়েকে তো আমরা ধরে আনিনি। স্বেচ্ছায় এসেছে। আইন অনুসারে তাদের বিয়েও হয়েছে। যেহেতু তার বয়স ১৮ বছরের বেশি। সেহেতু সে নিজ ইচ্ছায়। বিয়ে করতে পারে। আমরা তো কোন অন্যায় করিনি।
ন্যায়-অন্যায় আমরা বুঝি না। আমাদের মেয়েকে তোরা নষ্ট করেছিস, তোদের মেয়েকেও আমরা নষ্ট করব। জুলিয়া ও এলিজা দুজনকেই আমরা নিয়ে যাচ্ছি। বলল আক্রমণকারী আগন্তুকদের একজন।
দেখ, আমাদের মেয়ের কোন ক্ষতি হলে আমরাও কিন্তু ছাড়ব না, আজ চোরের মত এসে অপ্রস্তুত অবস্থায় যা করতে পারলে, ভবিষ্যতে তা আর পারবে না। আমাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, জনবল তোমাদের চেয়ে কম নয়। এটা মনে রেখ। বলল রবার্ট রবিনসন।
সে দেখা যাবে। আমাদের যশুয়া কবিলা তোদের টিকোমে কবিলাকে কোন দিনই ভয় করে না। আমরাই ন্যায়ের পথে আছি, আর তোরাই একের পর এক অন্যায় করছিস। তোরা আমাদের গুপ্তধনের নকশা চুরি করেছিস। আমাদের মেয়েকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে চুরি করে নিয়ে এসেছিস। তোদের গোত্র ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না। গুপ্তধনের নকশা ফেরত দিলে তবেই তোরা রক্ষা পেতে পারিস।
আর কতবার আমরা বলব যে গুপ্তধনের নকশা আমাদের কাছে। নেই। বলল আর্তকণ্ঠে রবার্ট রবিনসন।
আর বলতে হবে না। বলার সুযোগই দেব না আর তোদের। আজ তোদের শেষ দিন। বলে হামলাকারী যশুয়া গোত্রের লোকটি যে এলিজা ও জুলিয়াকে ধরে এনেছিল, সে কঠোর কণ্ঠে বলল, এ দুজনকে নিয়ে তোমরা গাড়িতে তোল। এরপর আরেকজনকে লক্ষ্য করে বলল, জন। জনসন, তুমি তোমার রিভলবারটা বুডির মানে ইম্মা ইমেলির হাতে দাও। সেই প্রথম গুলি করে মারবে তার স্বামী রবার্টসনকে, তার পর মারবে তার সন্তান বরিস বুলুকিকে। বুড়ি রাজী না হলে প্রথমে তাকেই গুলি করে মেরে ফেল। তারপর ওদুজনকে মারব। বলল যশুয়া গোত্রের সর্দার গোছের লোকটি।
নির্দেশ অনুসারে জন জনসন তার হাতের একটা রিভলবার ইম্মা। ইমেলির হাতে গুঁজে দিল। ইম্মা ইমেলি তখন চিৎকার করে কাঁদছিল।
অন্যদিকে চারজন এলিজা ও জুলিয়াকে টেনে-হেঁচড়ে গেটের দিকে। নিয়ে যাচ্ছিল।
ওরা আরও কাছাকছি আসতেই আহমদ মুসা লাফ দিয়ে ওদের সামনে গিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা জোরের সাথে বলল, ছেড়ে দাও ওদের। পুরুষের বাহাদুরিটা মেয়েদের সাথে মানায় না!
চারজনের মধ্যে তিনজনেরই কোমরের খাপে ছোরা জাতীয় অস্ত্র রাখা। আর সামনে যে লোকটি এলিজাকে টেনে নিয়ে আসছিল তার ডান হাতেই রিভলবার।
আহমদ মুসা কথা কয়টি বলতেই সামনের লোকটি বলল, তুই আবার কে, এখানে কেন মরতে এলি? কথার সাথে সাথেই সে রিভলবার তুলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
নিরস্ত্র আহমদ মুসার বাম পা চোখের পলকে উঠে এল। লোকটি বুঝে উঠার আগেই পা গিয়ে আঘাত করল লোকটির রিভলবার ধরা হাতের কব্জিতে। মুহূর্তেই রিভলবারটি লোকটির হাত থেকে পাক খেয়ে উপরে উঠে গেল। পাক খেয়েই রিভলবারটা আবার নিচে নেমে এল। লুফে নিল আহমদ মুসা রিভলবারটা। রিভলবার হাতে নিয়েই প্রথমে সামনের লোকটিকে গুলি করল, সংগে সংগেই পরপর আরও তিনটি গুলি করল এলিজা ও জুলিয়াকে ধরে আনা লোক তিনজনকে লক্ষ্য করে। লোক তিনজনকে গুলি করার পরপরই আহমদ মুসা রিভলবার তাক করল যশুয়া কবিলার পক্ষে যে কথা বলছি সরদার গোছের সেই লোককে। বলল, তোমার লোকদের সবাইকে অস্ত্র ফেলে দিতে বল, না হলে তোমার মাথা উড়ে যাবে এখনি।
লোকটি আহমদ মুসার কথা শুনল না। হুকুম দিল, সবাই গুলি করে শয়তানটাকে ঝাঁঝরা করে দাও।
সংগে সংগে আহমদ মুসা বলল, এলিজা, জুলিয়া, তোমরা মাটিতে শুয়ে পড় এই মুহূর্তে! বলে আহমদ মুসা নিজেই ঐ চারটি লাশের আড়াল নিয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়েই গুলি করল যশুয়া গোত্রের সরদার গোছের লোকটিকে। আহমদ মুসার গুলি সত্যিই লোকটির মাথা গুঁড়িয়ে দিল।
তখন বৃষ্টির মত গুলি আসছিল আহমদ মুসাদের দিকে। সবাই হাঁটু গেড়ে বসে গুলি করছিল।
আহমদ মুসার রিভলবারে তখন হিসাব মত আর একটা গুলি আছে। জন জনসন নামের লোকটি যে ইম্মা ইমেলিকে রিভলবার তুলে দিয়েছিল রবার্ট রবিনসন ও বরিসকে মারার জন্যে, সেও হাঁটু গেড়ে বসে গুলি চালাচ্ছে। আহমদ মুসা একটা লাশের মাথার দিকে একটু গড়িয়ে গেল। তাঁর কাঁধের আড়ালে লুকিয়ে তার গলার উপর দিয়ে রিভলবারের নল সেট করে শেষ গুলিটা ছুঁড়ল জন জনসনের মাথা লক্ষ্যে। অব্যর্থ টারগেট। জন জনসন গুলি খেয়ে উল্টে পড়ে গেল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা চিৎকার করে বলে উঠল, যারা বেঁচে আছ, তারা যদি বেঁচে থাকতে চাও, তাহলে অস্ত্র ফেলে দিয়ে মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়াও। আমার গুলি কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না, তা তোমরা দেখেছ। আর শোন, এক আদেশ আমি দুবার দেই না। আর নির্দেশ পালন করলে তোমাদের আমরা ছেড়ে দেব।
ওদের গুলি বন্ধ হয়ে গেল। তাকাল ওরা একে অপরের দিকে। তারপর তারা অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত তুলে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা গুলিশূন্য রিভলবার বাগিয়ে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রবার্ট রবিনসন, বরিস ও জনার্দনের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, হাত তুলে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলুন।
সাত জনকেই ওরা বেঁধে ফেলল।
রবার্ট রবিনসন ছুটে এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, আপনি আমাদের পরিবারকে বাঁচিয়েছেন, পরিবারের ইজ্জত-আবরু রক্ষা করেছেন। কোন কিছু দিয়েই এ ঋণের শোধ সম্ভব নয়। কিন্তু আপনি এ মিরাকল ঘটালেন কি করে?
এসব কথা থাক। আমি যা করেছি, তার কৃতিত্ব স্রষ্টার। এখন বলুন, লাশগুলো কি করবেন, বন্দীদের কি করবেন? আহমদ মুসা বলল।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। পুলিশকে জানালে ঝামেলায় জড়াতে হবে। আবার পুলিশকে না জানিয়ে কি করব বুঝতে পারছি না। বলল রবার্ট রবিনসন।
আমার মনে হয় কি পুলিশের ঝামেলায় না গিয়ে বন্দীদেরকে বলা হোক লাশগুলো তারা নিয়ে যাক। না হলে পুলিশে আমরা মামলা দায়ের করব যে, তারা আমাদের বাড়িতে লুটতরাজ ও আমাদের কিডন্যাপ করতে এসেছিল। সবগুলো অস্ত্রে তাদের হাতের ছাপ আছে। তাদের কোন উপায় নেই বাঁচার। লাশগুলো নিয়ে যদি তারা চলে যায় এবং আর এদিকে আসবে না অংগীকার করে, তাহলে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদের নাম ছাড়া থানায় কেস করা হবে। বলল আহমদ মুসা।
রবার্ট রবিনসন খুশি হয়ে সোৎসাহে বলে উঠল, আপনি শক্তিতে যেমন, অস্ত্রবাজিতে যেমন, বুদ্ধিতেও তেমনি। ধন্যবাদ! আপনার পরামর্শ আমার পছন্দ হয়েছে। এছাড়া আর কোন পথ নেই।
সলা-পরামর্শ শেষ হলে আহমদ মুসা রবার্ট রবিনসনকে কথাগুলো বন্দীদের বলার জন্যে অনুরোধ করল।
বন্দীদের একত্রিত করে রবার্ট রবিনসন আহমদ মুসার কথাগুলো বুঝিয়ে বলল। শেষে বলল, এখন ঠিক কর, তোমরা মুক্ত মানুষ হিসেবে থাকবে, না জেলে যাবে?
সাত জনের সবাই একবাক্যে বলল, আমাদের মুক্তি দিন। আমরা জেলে যেতে চাই না। আপনারা যা বলবেন আমরা তাই করব। আমরা লাশ নিয়ে চলে যাচ্ছি। আর আমরা এ মুখো হবো না। আমাদের মুক্তি দিন।
সাত জনের মধ্যে একজন কথা বলার সাথে সাথে আহমদ মুসার দিকে বার বার তাকাচ্ছিল। বিষয়টা আহমদ মুসার দৃষ্টি এড়াল না। ওদের কথা শেষ হলে আহমদ মুসা তাকে ডাকল। বলল, তুমি কি আমাকে কিছু বলবে? বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন?
লোকটি কাঁচুমাচু হয়ে বলল, আমাকে মাফ করবেন স্যার। ফিল্মের হিরোর মত কাজ আপনি করলেন। তাই বিস্ময় নিয়ে বারবার আমি। দেখছিলাম। এত ক্ষিপ্র, এমন অব্যর্থ টার্গেটের কথা আমি গল্পে পড়েছি, দেখিনি। তাই দেখছিলাম।
আহমদ মুসা তার কথা শুনল এবং চলে যেতে বলল বটে, কিন্তু তার কথা বিশ্বাস হলো না। তার কথাগুলো তার মুখ-চোখের ভাষার সাথে। মিলল না। আহমদ মুসার নিশ্চিত মনে হলো, এই লোক নিশ্চয় আমাকে চিনতে পেরেছে। এই চেনা কেমন চেনা! সেটাই সে বুঝতে পারছে না। এই লোক এইচ থ্রি বা ফোম-এর কেউ হবে এটা স্বাভাবিক নয়। তাহলে? ফোম ও এইচ থ্রির লোকরা গোপনে ঘরে ঘরে পোস্টার বিলি করেছে, তাতে কি তার ফটো দেয়া আছে? পুরস্কারের অংকও হয়তো বিরাট! এমন কোন পোস্টার কি লোকটা দেখেছে! এটা হতে পারে।
তাদের সাত জন লোককেই ছেড়ে দেয়া হলো। তারা সকলে চলে গেল। ( যে লোকটা আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল কি এক গভীর ভাবনা তার চোখে-মুখে। তার চোখের চকচকে লোভাতুর দৃষ্টি আহমদ মুসার চোখ এড়ায়নি। বিশেষ করে যাবার সময়ের শেষ দৃষ্টিটা।
ওরা চলে গেলে আহমদ মুসা শোবার ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বলল, প্লিজ, সবাই শুয়ে পড়ুন।
আহমদ মুসা তার শোবার ঘরের দরজায় রবার্ট রবিনসনকে ঈশারায় ডাকল। বলল, ভয়ের কিছু নেই, ওরা এলিজা ও জুলিয়াকে কিডন্যাপ করার জন্যে আসবে না। আসতে পারে অন্য কাজে।
কি কাজ? উদ্বিগ্ন কণ্ঠ রবার্ট রবিনসনের।
কখন, কবে আসবে জানি না। আমার সন্ধানে ওরা অন্য কেউ আসতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
আপনার সন্ধানে আসবে কেন? আপনার হাতে ওরা ছয়জন খুন হয়েছে তাই? বলল রবার্ট রবিনসন।
না, সে কারণে নয়, অন্য কারণে। থাক এ প্রসঙ্গ আজ এখানেই। সবই জানতে পারবেন। চিন্তার কিছু নেই। আমি শুয়ে পড়ছি। আপনারাও গিয়ে শুয়ে পড়ুন।
গুড নাইট! বলে আহমদ মুসা তার ঘরে ঢুকে গেল।
রবার্ট রবিনসনও চলা শুরু করল দোতলার সিঁড়ির দিকে।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে দেখল, দোতলার লাউঞ্জে সবাই বসে আলোচনা করছে। আলোচনার বিষয় আহমদ মুসা।
রবার্ট রবিনসনও গিয়ে বসল। বলল, আর সময় নষ্ট নয়, চল সবাই শুতে যাই।
কিন্তু বাবা, কি দেখলাম আমরা! সিনেমার দৃশ্যও এমন নিখুঁত হয় না। আমরা তো কিডন্যাপ হয়েই গিয়েছিলাম। মা, বাবা, ভাইয়া, ছোট ভাইয়াও তো মরেই গিয়েছিলেন। কিন্তু একজন আসলেন। অদ্ভুত সাহস, অপরিসীম ক্ষিপ্রতা, শত্রুর অস্ত্র কেড়ে নিয়ে শত্রুকে আঘাত করলেন। ৬ জনকে হত্যা, সাত জনকে বন্দী করলেন। বাবা, এমন লোক কি কোন সাধারণ কেউ হতে পারেন?
ঠিক বলেছ মা, ইনি সাধারণ কেউ নন। বলল রবার্ট রবিনসন।
তাহলে কে হতে পারে, বাবা? গোয়েন্দা? সেনাবাহিনীর অফিসার?। পুলিশ অফিসার? কিংবা কোন প্রফেশনাল ক্রিমিনাল? বলল এলিজা।
প্রফেশনাল ক্রিমিনাল সে নয়, এটা নিশ্চিত। এই মাত্র আমার সাথে তার কথা হলো। উনি বললেন এলিজা ও জুলিয়াকে ধরে নিয়ে যাবার জন্যে কেউ আসবে না। আসতে পারে অন্য কাজে। আবার বললেন, তাঁকে খুঁজতেও আসতে পারে। বলল রবার্ট রবিনসন।
অন্য কাজে আসবে? তার খোঁজে আসবে? তার খোঁজে আসবে কেন? আর উনি এসব জানলেন কি করে? এলিজা বলল।
আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি আগের মতই জবাব দিয়ে বললেন, সবই জানবেন, তবে এখন নয়। বলল রবার্ট রবিনসন।
ঠিকই বলেছ বাবা। ক্রিমিনালরা জীবনের ভয় করে। আর নিজের জীবন বিপন্ন করে তারা অন্যের জীবন, ইজ্জত-আবরু বাঁচাতে যায় না। তার উপর আহত, অসুস্থ। এই অবস্থায় একা খালি হাতে যখন এগারো জন দুবৃত্তের বিরুদ্ধে আমাদের বাঁচাবার জন্যে নেমে গেলেন, তখন নিশ্চয় তিনি জীবনের চিন্তা করেননি। এমন মানুষরা মানুষের আদর্শ, বাবা। এলিজা বলল।
সত্যি বলেছ মা। যে অসাধ্য সাধন সে করেছে তার জন্যে প্রশংসা শুনতেও সে রাজী হয়নি। বলল রবার্ট রবিনসন।
আবার হামলা হওয়ার যে কথা উনি বলেছেন, সে বিষয়ে কি ভাবছ। বাবা? উনি আক্রান্ত হবেন কেন? আজকের ঘটনার প্রতিশোধ? বলল এলিজা।
মেহমান ভদ্রলোক এ ব্যাপারে কিছুই জানাননি। বাই দি বাই বলেছেন, সম্ভবত তিনি চান না এ নিয়ে কোন আলোচনা বা কিছু করা হোক। বলল রবার্ট রবিনসন।
অদ্ভুত মানুষ! এত বড় ঘটনা ঘটাল, কিন্তু এটা তার কাছে কিছুই মস। সত্যিই এক ভিন্ন প্রকৃতির ভিন্ন মানুষ ইনি! চল, সবাই ঘুমাতে
এলিজাই বলল।
.
রাত চারটা। আহমদ মুসার চোখে ঘুম নেই। তার মন বলছে, আজকে রাতেই তারা এখানে আসবে এবং ঘটনাটা ঘটাবে। তাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করছিল যে লোকটি তার কথাই ভাবছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা নিশ্চিত যে, লোকটা তাকে চিনেছে। কিন্তু কেমন চেনা! তার চোখে লোভের চকচকে রং দেখা গেছে। লোভটা কেন? কিসের লোভ?
এই চিন্তার মধ্যেই আহমদ মুসার চোখ একটু ধরে এসেছিল। দুএকটা কট কট শব্দে আহমদ মুসার জড়তাটা কেটে গেল।
আহমদ মুসা মুহূর্তেই বুঝতে পারল, ওটা দরজা লুজ হওয়ার শব্দ। তার মানে দরজা কেউ খুলেছে। বিকল্প চাবি বা অন্য কোন টেকনোলজিতে তারা দরজা খুলতে পারে।
দরজার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসা। আলোর ভ্যারিয়েশন দেখে বুঝতে পারল দরজার অনেকখানি খোলা হয়েছে। সেই খোলা পথ দিয়ে চারটি জমাট কালো অবয়ব ভেতরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা এবার নিশ্চিত হলো ঘরে শত্রু প্রবেশ করেছে। সে সতর্ক হলো। রিভলবারটা বালিশের তলা থেকে বের করে ডান পাজরের তলায় রাখল।
চারটি জমাট অন্ধকার ছায়ামূর্তি আহমদ মুসাকে ঘিরে দাঁড়াল। একজন পায়ের কাছে, আরেকজন মাথার কাছে। আর দুপাশে দুজন।
মাথার কাছের জন নিচু হলো। অন্ধকারে তার হাতের সাদা রুমালটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
আহমদ মুসা বুঝল তাকে ক্লোরোফরম করা হবে। আহমদ মুসার। চিন্তার চেয়েও দ্রুত কাজ করল লোকটা।
বিদ্যুৎ বেগে তার রুমাল ধরা হাত নেমে এল এবং আহমদ মুসার নাকটার ওপর চেপে ধরল। আহমদ মুসা এর জন্যে প্রস্তুত ছিল। নিঃশ্বাস বন্ধ করেছিল সে সংগে সংগেই। আহমদ মুসা মুখ এদিক ওদিক করে দুহাত দিয়ে তার ক্লোরোফরমের রুমাল ধরা হাত সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু সফল হলো না। মিনিট দেড়েকের মধ্যে আহমদ মুসার হাত-পা দেহ নিঃসাড় হয়ে গেল।
শালাকে এত তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়াতে পারব তা ভাবিনি। শালা এবার আমাদের হাতের মুঠোয়, মানে ৫ লাখ ডলার আমরা সকালেই পেয়ে যাচিছ।
একজন লোক সোৎসাহে এ কথাগুলো বলে নির্দেশ দিল, হাত-পা এর বেঁধে ফেল। শালাকে বিশ্বাস নেই।
আহমদ মুসা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এদের কেন, কারও হাতেই এ মুহূর্তে বন্দী হওয়া যাবে না। তার সামনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
একজন লোক যে পেছনে দাঁড়িয়েছিল সে আহমদ মুসার পা বাঁধার জন্য উবু হয়ে বসতে যাচ্ছিল। সংগে সংগে আহমদ মুসার ডান পা তীব্র বেগে উপরে উঠল। গিয়ে তা আঘাত করল লোকটির কণ্ঠনালিতে। লোকটির দেহ ঈষৎ শূন্যে ছিটকে উঠে গিয়ে আছড়ে পড়ল দরজার উপর।
পা দিয়ে লাথি মারার সাথে আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে পাঁজরের তলা থেকে রিভলবার বের করে নিয়েই পাশের দুজনকে গুলি করল এবং তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। মাথার পেছনের লোকটি ক্লোরোফরমের রুমাল ফেলে দিয়ে পকেট থেকে রিভলবার বের করেছিল, ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় লোকটি আহমদ মুসাকে নতুনভাবে টার্গেট করার আগেই আহমদ মুসার গুলির শিকার হলো সে। ইতিপূর্বে দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে একজন পড়ে যাওয়ায় দরজা আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
দরজার বাইরে থেকে ধাক্কা দেয়ার শব্দ হলো। সেই সাথে রবার্ট রবিনসনের কণ্ঠ, কি হচ্ছে ভেতরে? আমরা সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে।
আহমদ মুসা গিয়ে দরজা খুলে দিয়েই দরজায় পড়ে যাওয়া লোকটিকে টেনে তুলে তার মাথায় রিভলবার চেপে ধরে বলল, কে তোমরা? কেন আমাকে আক্রমণ করতে এসেছ?
ইতিমধ্যে রবার্ট রবিনসন ভেতরে ঢুকে ঘরের লাইট জ্বেলে দিয়েছে, ঘরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছে অন্যরাও।
সবাই দেখল আহমদ মুসার বেড ঘিরে তিনটি লাশ পড়ে আছে। আর একজনের মাথায় রিভলবার ধরে আছে আহমদ মুসা।
কি ব্যাপার, কি ঘটেছে, জনাব? এসব কি দেখছি? বলল রবার্ট রবিনসন।
এরা আমাকে কিডন্যাপ করতে এসেছিল? কেন?
বলল রবার্ট রবিনসন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, সেটাই তো এই লোকটার কাছ থেকে জানার চেষ্টা করছি, অন্যরা সবাই তো মারা গেছে। আহমদ মুসা বলল।
বলে আহমদ মুসা মনোযোগ দিল মাথায় রিভলবার চেপে রাখা লোকটির দিকে। বলল, শোন, এক আদেশ আমি দুবার দেই না।
লোকটি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল। কিছুই বলল না।
কঠোর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। সে রিভলবারের ব্যারেলটা সরিয়ে নিল। তার তর্জনি ট্রিগারে চাপ দিল। ধোঁয়ার কুণ্ডলি বেরুল তার রিভলবারের নল থেকে। একটা বুলেট ছুটে গিয়ে লোকটির বাম কানের একাংশ ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল। লোকটা আর্ত-চিৎকার করে উঠল।
আহমদ মুসা রিভলবার আবার মাথায় তাক করে বলল, আমার। প্রশ্নের উত্তর পাইনি। এবারের বুলেট কিন্তু তোমার মাথা গুড়ো করে দেবে। চিৎকার করার সময়ও পাবে না।
স্যার, আমাদের কোন দোষ নেই। দশ হাজার ডলার করে দেবে। বলে আমাদের নিয়ে এসেছে। আপনার মাথার কাছে যে দাঁড়িয়ে ছিল, যে আপনাকে ক্লোরোফরম করেছিল, সেই আসল লোক স্যার। সে ৫ লাখ ডলারের লোভে আপনাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল।
পাঁচ লাখ তাকে কে দেবে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
আমি ঠিক জানি না স্যার। তবে আমি শুনেছিলাম, কারা গোপনে। বাড়ি বাড়ি নাকি লিফলেট বিলি করেছে, তাতে আপনার ফটো আছে। তাতে বলা হয়েছে আপনি দেশের সাংঘাতিক শত্রু। আপনাকে একটা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতে পারলে সংগে সংগে পাঁচ লাখ ডলার। আপনি কোথায় আছেন এ খোঁজ দিলেও এক লাখ ডলার বকশিশ দেয়া হবে স্যার। বলল লোকটি।
সে জায়গাটা কোথায় যেখানে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছাতে বলেছে? আহমদ মুসা বলল।
সেটা আমি জানি না স্যার। শুধু ঐ লোকটাই তা জানত। বলল লোকটি।
কেন তুমি পোস্টার বা লিফলেট পড়নি? আহমদ মুসা বলল।
পড়েছি স্যার। কিন্তু পোস্টারে সেটা লেখা নেই। ওকথাটা মুখে। মুখে বলেছে।
বুঝেছি। শোন, আমার কাজ যতদিন শেষ না হয় তোমাকে ততদিন বন্দী থাকতে হবে। যাতে আমার কথা কাউকে বলতে না পার, এজন্যে
এই ব্যবস্থা। আহমদ মুসা বলল।
স্যার, আপনার কথা আমি কাউকে বলব না। আমায় ছেড়ে দিন স্যার। বলল লোকটি।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করলাম, কিন্তু আমার আসল শত্রুকে তো বিশ্বাস করি না। বলল আহমদ মুসা।
ওদের আমি চিনি না স্যার। বলল লোকটি।
তোমার চেনার দরকার নেই। আজকের এই ঘটনার পর তারাই তোমাকে চিনে নেবে। আমি কোথায় আছি না বললে তুমি মরবে তাদের হাতে। তহমদ মুসা বলল।
লোকটি চমকে উঠল। বলল, তাহলে আপনি যা ভালো মনে করেন। তাই করেন স্যার।
আচ্ছা বলত, আমাকে তোমার যে বন্ধু চিনেছে, সে এই কথা কি ওদেরকে জানিয়েছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
না জানায়নি স্যার, দুটো কারণে। এক. খবর জানলে ওরা নিজেরা এসে ধরে নিয়ে যাবে, টাকা থেকে সে বঞ্চিত হবে। দুই. সে ওদেরকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। বলল লোকটি।
ধন্যবাদ। তোমার এ খবরটি খুব মূল্যবান। বলল আহমদ মুসা।
লোকটির সাথে কথা শেষ করে আহমদ মুসা ফিরল রবার্ট রবিনসনের দিকে।
ওরা সবাই আহমদ মুসা ও লোকটির কথা গোগ্রাসে গিলছিল। ভয় ও বিস্ময় উভয়ই তাদের চোখে মুখে।
জনাব, এই লোকটাকে দুএকদিন কোথায় আটকে রাখা যাবে? বলল আহমদ মুসা।
আমাদের বাড়িতেই তো আমরা রাখতে পারি।
সংগে সংগে কিছু বলল না আহমদ মুসা। একটু ভাবল। বলল, আমি ভাবছি জনাব, এই বাসায় আপনাদের থাকা ঠিক হবে কি না। অন্তত কয়েকদিন।
বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল রবার্ট রবিনসনের। অন্যরাও বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে।
কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। কেন আমাদের বাড়ি ছাড়তে হবে সাময়িকভাবে হলেও? বলল রবার্ট রবিনসন।
এটা আমার একটা আশংকার ব্যাপার। সত্য নাও হতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
কি আশংকা? বলল রবার্ট রবিনসন।
আমাকে যে লোকটি চিনেছিল, সে এই কথা কাউকে জানাতেও পারে, আবার মূল শত্রুপক্ষকেও জানাতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে আপনারা আপনাদের বাড়ি ভয়ানক টার্গেটে পরিণত হবে। তাছাড়া জুলিয়া ও এলিজাকে নিয়ে যে রক্তারক্তি হয়ে গেল, তার প্রতিশোধ নিতে আবার তারা আসতেও পারে। আহমদ মুসা বলল।
আপনি ঠিকই চিন্তা করেছেন। আমাদের সরে থাকা দরকার। কিন্তু কত দিন? বলল রবার্ট রবিনসন।
আমার মনে হয় বেশি দিন সরে থাকতে হবে না। সংকটের সমাধান খুব তাড়াতাড়ি হবার কথা আমি মনে করি। আহমদ মুসা বলল।
সংকটটা কি? সেটা কি আপনার নিজের, না আমাদের, না দেশের, সরকারের? জিজ্ঞাসা রবার্ট রবিনসনের।
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। বলল, আপনাদের সব কথা বলতে পারলে আমার খুব ভালো লাগত। কিন্তু বিষয়টা খুবই গুরুতর। আমি বেঁচে আছি, শত্রুপক্ষ এটা জানা মানে দেশকে ভয়ংকর বিপদের দিকে ঠেলে দেয়া।
শত্রুপক্ষ কি আপনার শত্রু, না দেশের শত্রু? বলল রবার্ট রবিনসন।
আসলে ওরা দেশের শত্রু, আবার আমারও শত্রু। আহমদ মুসা বলল।
দেশের শত্রু হলে দেশ তার মোকাবিলা করবে। আপনার বেঁচে থাকা না থাকার সাথে এর সম্পর্ক কি? বলল রবার্ট রবিনসন।
আহমদ মুসা হাতজোড় করে বলল, কথায় কথায় আপনারা অনেকখানি জেনে ফেলেছেন। আর নয়। যখন জানার তখন সবই জানতে পারবেন। আপনাদের কাছে একটা সাহায্য চাই আমি।
কি সাহায্য? জিজ্ঞাসা রবার্ট রবিনসনের।
ডেথ ভ্যালি সম্পর্কে কিছু জানেন কি না? ডেথ ভ্যালির কাছাকাছি যেহেতু আপনারা থাকেন। ডেথ ভ্যালিতে কোন লোক থাকে কি না, কোন লোক এখানে আসে কি না? এমন কিছু আপনারা দেখেছেন কি না? আহমদ মুসা বলল।
ডেথ ভ্যালিতে মানুষ যাওয়া বা থাকার প্রশ্নই উঠে না। আসলে ওটা ডেড উপত্যকা। সে উপত্যকায় একটাই পথ ছিল, সেটা ঈশ্বর ভূমিকম্পের মাধ্যমে বন্ধ করে দিয়েছেন। ঐ ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের কোন স্থলপথ খোলা নেই। যেহেতু সরকারিভাবেই এটা নিষিদ্ধ এবং ডেড উপত্যকা হিসাবে ঘোষিত হয়েছে, তাই আকাশ বা অন্যপথে এতে প্রবেশ করার চেষ্টা করা যাবে না। তবে এর চারদিকে মানুষের আনাগোনা বন্ধ নেই। বিশেষ করে ক্রিকের জলপথে কখনও কখনও মানুষ আসতে দেখা গেছে। বলল রবার্ট রবিনসন।
ক্রিকের জলপথে মানুষ আসতে দেখা গেছে! বিস্ময় ঝরে পড়ল আহমদ মুসার কণ্ঠে।
বিস্ময় প্রকাশের পরই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, জলপথে এসে তারা কি করত?
তেমন কিছু করতে দেখা যায়নি। মনে হয় ওরা পর্যটক হতে পারে। ওদেরকে ডেথ ভ্যালির উত্তর পাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। বলল রবার্ট রবিনসন।
ভ্রূ-কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ওরা কোন সময়ে আসত?
কথা বলল বরিস বুবুকি। বলল, আমি কিছু দিন ক্রিক এলাকায়। বিশেষ ধরনের পাথর সংগ্রহের কাজ করতাম। তখন অনেক সময় সন্ধ্যা। হয়ে যেত। সে সময় পর্যটকদের নৌকা বিকেলে, অনেক সময় সন্ধ্যায়ও আসতে দেখতাম।
নৌকায় কি থাকত? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
একটু চিন্তা করল বরিস বুবুকি। বলল, নৌকায় লোহা-লক্কড়সহ নানা সামগ্রী থাকত। অনেক সময় বড় বাক্স-কার্টুন দেখেছি। তবে ওসবে কখনো তেমন মনোযোগ দেইনি।
আহমদ মুসার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশ্চয় ক্রিকের নদীপথেই ডেথ ভ্যালিতে সামরিক ঘাঁটি তৈরির সরঞ্জাম আনা হয়েছে। এবং এটা নিশ্চিত যে, ডেথ ভ্যালিতেই এইচ থ্রি ও ফোম-এর সামরিক ঘাঁটি তৈরি হয়েছে।
আহমদ মুসা মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়ে বলল, ভোর হয়ে। গেছে। আপনাদের সিদ্ধান্ত বলুন।
ভার্জিনিয়াতে আমার ভাই থাকেন। আমরা কিছুদিন সেখানে গিয়ে থাকব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি কি করবেন? বলল রবার্ট রবিনসন।
ধন্যবাদ জনাব। আমাকে রক ক্রিকেই থাকতে হবে। অসুবিধা হবে। না। আপনারা অবশ্যই শীঘ্র চলে আসবেন। রক ক্রিকের কাজ আমার শেষ হলেই আপনাদেরকে গুপ্তধনের ওখানে নিয়ে যাব।
আমরা যদি ভার্জিনিয়ায় এখন যাত্রা করি, তাহলে আপনি কোথায়। যাবেন? জিজ্ঞাসা রবার্ট রবিনসনের।
আমি রক ক্রিকে ঘুরতে যাব। আহমদ মুসা বলল।
খাবেন কোথায়? বলল এলিজা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, খাওয়া মানে পেট ভরা। সে ব্যবস্থা। হয়ে যাবে। পশু-পাখিদের দেখ না খাদ্যের কোন অভাব হয় না।
স্যার, বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছেন। মানুষ তো পশু-পাখি নয়। বলল এলিজা।
তা ঠিক। তবে চিন্তা করো না বোন, খাওয়ার ব্যবস্থা আমি একটা করে নেব। আহমদ মুসা বলল।
আমার একটা প্রস্তাব জনাব। বলল রবার্ট রবিনসন।
বলুন। আহমদ মুসা বলল।
আমাদের বাড়িটা বলা যায় রক ক্রিকেই। আপনার কাজও রক ক্রিকে। আমরা নিচের কিচেন, স্টোর, খাবার ঘরসহ কয়েকটা ঘরের চাবি আপনাকে দিয়ে যেতে চাই। আপনি প্রয়োজনে আসবেন, থাকবেন। অসুবিধা নেই। আমাদের পেছন দিকের আন্ডারগ্রাউন্ড এক্সিট ব্যবহার করবেন। বাইরের সব গেটই বন্ধ থাকবে, বাড়ি থেকে বেরুবার অন্যান্য দরজাও বন্ধ থাকবে। কেউ এলে দেখবে বাড়ি আমাদের খালি এবং বন্ধ।
ঠিক আছে। এই ব্যবস্থা আপনারা করতে পারেন। আন্ডারগ্রাউন্ড এক্সিট থাকলে অসুবিধা নেই। প্রয়োজন যদি হয়, তাহলে ব্যবহার করা যাবে। ধন্যবাদ। আহমদ মুসা বলল।
আন্ডারগ্রাউন্ড প্যাসেজসহ আপনাকে সব দেখিয়ে দিতে চাই। আসুন।
চলুন। বলে উঠল আহমদ মুসা।
আমিও যাব, বাবা। দুএকবার মাত্র তো দেখেছি। বলল এলিজা।
ঠিক আছে এস। বলল রবার্ট রবিনসন।
সবাই উঠল।
.
৩.
ডেভিড কোহেন, তুমি কি করে এতটা নিশ্চিত যে আহমদ মুসা নেই? জিজ্ঞাসা শ্যামসন শিমন আলেকজান্ডারের।
স্যার, যত জায়গায় খোঁজ নেয়া যায় সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। সে। কোথাও নেই। বলল ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম। এই ক্যানিংহামই এইচ থ্রি ও ফোম-এর প্রধানরূপে কাজ করছে। আর শিমন আলেকজান্ডার এইচ থ্রি ও ফোম-এর আসল নেতা। সে গডফাদার ও চেয়ারম্যান।
যেমন? বলল শিমন আলেকজান্ডার।
যেমন স্যার, আমরা প্রেসিডেন্টের অফিস, প্রেসিডেন্টের টেলিফোন সার্বক্ষণিক মনিটর করছি। আহমদ মুসা আসলে প্রেসিডেন্টের অফিস। অবশ্যই জানবে। বিশেষ করে টেলিফোনে যোগাযোগ অবশ্যই হবে। আহমদ মুসার সাথে প্রেসিডেন্টের। আহমদ মুসার সবচেয়ে যোগাযোগের যেটা নির্ভরযোগ্য জায়গা সেটা এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের বাড়ি এবং অফিস দুই স্থানেই আমরা তোক রেখেছি। তারা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আহমদ মুসার বাসার প্রতি মুহূর্তের খবর আমরা নিচ্ছি। কোথাও আহমদ মুসা যোগাযোগ করেনি। কিংবা এ পক্ষরাও যোগাযোগ করে কোন হদিস পায়নি আহমদ মুসার। আহমদ মুসা ও আব্রাহাম জনসন এই দুই বাড়িতেই বিষাদের ছায়া। এটাও একটা বড় প্রমাণ যে, আহমদ মুসার কোন খবর তারা পায়নি। পেন্টাগনেও আমাদের লোক আছে। সেখানেও কোন খবর নেই। বলল ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম।
বিদেশের, বিশেষ করে মিডল ইস্টের দেশগুলোকে আমেরিকা কি বলছে, সেটা কি যোগাড় করতে পেরেছ? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মিডল ইস্টকে মানে বিশেষ করে সৌদি আরবকে আমাদের সরকার, সত্যিকার খবর না জানিয়ে পারবে না। শিমন আলেকজান্ডার বলল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমাদের লোকেরা প্রতিদিনের খোঁজ নিচ্ছে। এমনকি যেসব মেসেজ সৌদি আরবে মার্কিন সরকার পাঠিয়েছে সেসবের কপি আমরা যোগাড় করেছি। সেসব মেসেজে এক কথাই বার বার বলা হয়েছে যে, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি আহমদ মুসাকে উদ্ধারের জন্যে। তার কোন ক্ষতি হবে না। শীঘ্রই আমরা তাকে পাব আশা করছি।
ব্রাভো! ব্রাভো! তাহলে নিশ্চিত আহমদ মুসাকে তারা পায়নি। পেলে তা সৌদি আরবের কাছে গোপন করত না। এর অর্থ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন সাংঘাতিক চাপের মধ্যে আছে। শিমন আলেকজান্ডার বলল।
আমিও তাই মনে করি স্যার, আহমদ মুসাকে ওরা পায়নি। সাংঘাতিক চাপের মধ্যে ওরা এখন। বলল ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম।
আমাদেরও চাপ দেবার এটাই সময়। আহমদ মুসা নেই, সুতরাং আর কোন চিন্তা নেই। আহমদ মুসাকে দিয়ে যা করতে চেয়েছিলাম তা হলো না। আমাদেরকে এখন অন্য পথ নিতে হবে। সেটা হলো আলটিমেটাম। থামল শিমন আলেকজান্ডার।
শিমন আলেকজান্ডার থামতেই ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম বলল, আলটিমেটাম? কি বিষয়ে আলটিমেটাম?
কেন আমরা এখন আলটিমেটাম দিতে পারি, এটা বিশ্বাস হচ্ছে না? ভালো করে শোন, মার্কিন সরকারকে তিনটি শর্ত দিয়ে আলটিমেটাম দিতে হবে। এক. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ম্যাগনেটিভ ডেথ ওয়েভ তৈরি করেছে, এটা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রকাশ করতে হবে এবং বিশ্বকে জানিয়ে জনসমক্ষে তা ধ্বংস করতে হবে। অথবা দুই. MDw এর সেন্ট্রিফিউজ কিংপিন আমাদের দিতে হবে। অথবা তিন, উক্ত দুটি শর্তের কোন একটিও না মানলে আমরা আমাদের নিজস্ব পথ ধরব। শর্তগুলোর যেকোনো একটি গ্রহণের জন্য তিন দিনের আলটিমেটাম দেয়া হবে। বুঝেছ গোটা বিষয় ডেভিড কোহেন? বলল শিমন আলেকজান্ডার।
বুঝেছি স্যার। খুব চমৎকার। এই আলটিমেটাম ওদের দারুণ বিপদে ফেলে দেবে, যা থেকে বের হবার পথ তারা পাবে না। কিন্তু স্যার, ওরা প্রথম দুটি শর্ত যদি মেনে না নেয় তাহলে আমরা নিজের পথে চলব। বলেছি। তার অর্থ পরোক্ষভাবে আমরা হুমকি দিয়েছি যে, আমরা তাহলে আমাদের কাজ শুরু করব। সেটা কি? ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম বলল।
এটা কি জিজ্ঞাসা করার বিষয়। তিন দিন পার হওয়ার পর মুহূর্তেই আমরা চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমেরিকার সকল অস্ত্রাগার, সকল সাইলোর অস্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। আমেরিকা পরিণত হবে ঢাল-তলোয়া রহীন সরকারে। এই সময় আমাদের লবি সক্রিয় হয়ে উঠবে সরকারে, কংগ্রেসে, সিনেটে, বিভিন্ন স্টেটের গণ-সমিতিগুলোতে। এক দিনের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। আর আমরা তখন ক্ষমতায় আসীন হবো। এরপর গোটা দুনিয়া জয় করতে আমাদের বেগ পেতে হবে না। বলল শিমন আলেকজান্ডার।
ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন। কিন্তু স্যার, হঠাৎ যদি তারা আহমদ মুসাকে পেয়ে যায়? ডেভিড কোহেন কানিংহাম বলল।
খবরদার, এসব অলক্ষুণে কথা বলবে না। এতদিন যখন আহমদ মুসার সন্ধান মেলেনি। আর মিলবেও না।
আহমদ মুসা চুপ করে বসে থাকার লোক নয়। আর আমাদের যে ইনফরমেশন তার কাছে আছে, তাতে আমেরিকান সরকারের সাথে দেখা করতে কালবিলম্ব করার কথা নয় তার। তা যখন করেনি, তখন নিশ্চিত সে আর বেঁচে নেই। আর আজে-বাজে চিন্তা না করে শোন, আলটিমেটাম ড্রাফট করে আমাকে পড়ে শোনাও।
স্যার, ওটা আমি এখনই করছি। আর একটা বিষয় স্যার। আপনি তো বাইরে, তাহলে এদিকের লবি-ওয়ার্ক কিভাবে, কতখানি হচ্ছে, সেটা একটা প্রশ্ন? ডেভিড কোহেন বলল।
রাজনৈতিক ফ্রন্টের কথা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমাদের লবি কাজ শুরু করে দিয়েছে। আলটিমেটামের রেজাল্ট দেখার পর যখন আমাদের MFw অ্যাকশনে আসবে, তখন সেই ঝড়ো মুহূর্তে ঝড়ের মত আমাদের লবির লোকেরা বেরিয়ে আসবে। আমি রাখছি। তুমি আলটিমেটামের ড্রাফট তৈরি কর। রাখলাম। বাই। বলল শিমন আলেকজান্ডার।
.
জর্জ আব্রাহাম জনসন নির্দিষ্ট জায়গায় অসময়ে দাউদ ইব্রাহিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হলো। এ সময় তো তার আসার কথা নয়। কেন আসল। আব্রাহাম জনসন তার বিশ্বস্ত পারসোনাল এ্যাটেনডেন্টকে পাঠাল দাউদ ইব্রাহিমকে ডেকে আনার জন্য।
দাউদ ইব্রাহিম এল।
আব্রাহাম জনসন কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, কি ব্যাপার দাউদ? কোন বিশেষ খবর? আমাদের সব কথা তাকে বলেছ?
স্যার, আহমদ মুসাকে আমি আর পাইনি। তার কথা অনুসারে সেই গাছের তলায় আমার তার সাথে দেখা হবার কথা, কিন্তু সে সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। পাথরের তলায় যে মেসেজ রাখা ছিল, সে মেসেজও ঐভাবেই ছিল। তিনি তা নেননি। তার মানে গতকাল সারাদিন তিনি সেই গাছতলায় আসেননি। কোনও মতে রাত কাটিয়ে সকালেই ওখানে ছুটে গিয়েছি। আসার সময় আবারও দেখেছি সেই গাছের তলায়, সেই পাথরের তলায় রাখা মেসেজটা সেভাবেই রয়ে গেছে। বলল দাউদ ইব্রাহিম।
দাউদের কথা শুনে আব্রাহাম জনসনের মুখের ঔজ্জ্বল্য যেন দপ করে নিভে গেল। রাজ্যের চিন্তা এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার মনে। মুহূর্ত কয়েক কথা বলতে পারল না। পরে বলল, কোথাও গিয়ে কাজে আটকে গেছে হয়তো। এ না হলে কথার খেলাফ সে করত না।
সেটা হলে তো ভালো। বলল দাউদ ইব্রাহিম।
আমরা সকলে সেটাই আশা করি। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
কথা বলল বটে, জর্জ আব্রাহাম জনসন। কিন্তু নিজের কথায় নিজেই ভরসা পেল না। তার আয়ত্তাধীন হলে তো আহমদ মুসা কথার খেলাফ কখনো করার কথা নয়। কি হল তার? শেষ মুহূর্তে শত্রুর হাতে পড়ল না তো! এই কথা ভাবতে গিয়ে মন কেঁপে উঠল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। আলটিমেটামের সময় মাত্র তিন দিন। এর মধ্যে যদি ওদের কিছু না করা যায় তাহলে তো সর্বনাশ হবে। এই সময় আহমদ মুসাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর এ সময়ই সে আবার নিখোঁজ! যে পরিস্থিতি তাতে এই মুহূর্তেই জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহবান করা দরকার। এই খবর সবাইকে জানানো দরকার। চিন্তা করতে গিয়ে আনমনা হয়ে পড়েছিল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
স্যার, এখন আমি কি করব? বলল দাউদ ইব্রাহিম জর্জ আব্রাহাম জনসনের উদ্দেশ্যে।
জর্জ আব্রাহাম জনসন মনোযোগ দিল দাউদ ইব্রাহিমের দিকে। গাম্ভীর্য নেমে এল তার চোখে-মুখে। বলল, দাউদ ইব্রাহিম, আহমদ মুসাকে পেতেই হবে। তুমি চলে যাও। সেই গাছের আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে থাক। দেখ আহমদ মুসা আসে কি না। তাকে পেলেই বলবে আলটিমেটামের কথা। আর তোমাকে একটা যন্ত্র দিচ্ছি। ছোট্ট যন্ত্র। আহমদ মুসার যে দেখা পেয়েছ, সেটা আমাকে সংগে সংগে জানাতে পারবে এই যন্ত্রের মাধ্যমে। এর বোতামে চাপ দিলে ঠিক এই ডেথ ভ্যালির উপর আকাশে আমাদের একটা যোগাযোগের উপগ্রহ আছে সেটাতে সংকেত পৌঁছবে, সে সংকেত উপগ্রহ রিলে করবে আমার কাছে। ঐ সংকেত পেলেই আমি বুঝব আহমদ মুসার দেখা পাওয়া গেছে। বলল জর্জ আব্রহাম জনসন।
কিন্তু স্যার, আহমদ মুসা স্যার বলেছেন ডেথ ভ্যালির এলাকা থেকে কোনই ইলেক্ট্রনিক ওয়েভ বাইরে বেরুতে পারে না। দাউদ ইব্রাহিম বলল।
তাঁর কথা ঠিক। কিন্তু সেটা হোরাইজন্টাল ওয়েভ। কোন হোরাইজন্টাল ওয়েভই ডেথ ভ্যালির অঞ্চলের বাইরে যেতে পারে না। কিন্তু ভার্টিক্যাল ওয়েভের উপর ম্যাগনেটিক শক্তির কোন কার্যকারিতা
নেই। পরীক্ষা করেই আমরা এ ব্যবস্থা করেছি। তোমার কাজ শেষ হলে যন্ত্রটা আহমদ মুসাকে দিয়ে দেবে। আর দেখা হবার পর তাকে ছদ্মবেশে ডেথ ভ্যালির পূর্ব-দক্ষিণ গোড়ায় জংগলে ঢাকা ছোট একটা সাঁকো আছে, সেখানে তাকে নিয়ে আসবে সিগন্যাল পাঠাবার এক ঘন্টার মধ্যে। তোমাকে যে কথাগুলো বললাম, তা মনে রেখ। দেরি করো না, তুমি যাও।
চলে গেল দাউদ ইব্রাহিম।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ফিরে আসতে আসতেই ভাবল জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক এখনি ডাকতে হবে। সব বিষয় ব্রিফ করে সমাধানের পথ বের করা দরকার।
.
বেলা এগারোটা বাজার দুমিনিট আগেই জর্জ আব্রাহাম জনসন আপতকালীন ম্যানেজমেন্ট কক্ষে প্রবেশ করল। ঢুকে দেখল, সেনাবাহিনী প্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান, সেনা গোয়েন্দা প্রধান, সিআইএ প্রধান এবং প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা আগেই এসে গেছে।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ঢুকতেই প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলে উঠল মি. জনসন, মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যে আবার ডাকলেন। মিটিং-এর কথা শোনার পর থেকে আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না।
একই অবস্থা সকলের। মিটিং-এর ডাক শুনেই মনে হয়েছে বড় কিছু। ঘটেছে। বলল সিআইএ প্রধান।
সময় তখন ঠিক ১১টা। সেনাগোয়েন্দা প্রধান কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময় প্রেসিডেন্ট প্যাসেজের দরজা খুলে গেল। দরজায় এসে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট। সবাইকে শুভ সকাল জানিয়ে প্রেসিডেন্ট কক্ষে প্রবেশ করে নিজের চেয়ারে বসল।
সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল। প্রেসিডেন্ট বসার পর তারা বসল।
প্রেসিডেন্ট সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ভদ্র মহোদয়গণ, দেশ আজ ক্রাইসিসে। ১২ ঘণ্টা আগে যে আলটিমেটাম নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, সেটা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
বলে থামল প্রেসিডেন্ট মুহূর্তের জন্যে। তাকাল প্রেসিডেন্ট জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, মি. আব্রাহাম জনসন, নতুন যে ক্রাইসিস সৃষ্টি হয়েছে সে সম্পর্কে সবাইকে ব্রিফ করুন।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট এবং সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ, আলটিমেটাম সম্পর্কিত সব ঘটনা আপনারা জানেন। একটা নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। আহমদ মুসা প্রেরিত লোকের মাধ্যমে আলটিমেটামের একটা কপি পাঠিয়েছিলাম তার কাছে। তার সাথে কিছু জিজ্ঞাসা ও পরামর্শ। কিন্তু এসব কিছুই আহমদ মুসার হাতে পৌঁছেনি। আহমদ মুসার লোকটি মানে দাউদ ইব্রাহিমের সাথে দেখা করা এবং লিখিত কাগজের মাধ্যমে খবর দেয়া-নেয়ার যে ব্যবস্থা আহমদ মুসা করেছিল, সেটা ফেল করেছে। নির্দিষ্ট স্থানটিতেই আহমদ মুসা আর আসেনি। আহমদ মুসার সাথে সংযোগ এভাবে বিচ্ছিন্ন হবার পর আমরা নতুন সংকটে পড়েছি। আহমদ মুসাকে খোঁজার মত সময়ও আমাদের হাতে নেই। আলটিমেটামের একদিন অতিবাহিত হচ্ছে। আমাদের কি করণীয় এজন্যেই এই বৈঠকের আহবান। বলে থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
সবাই তাকিয়েছিল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। সবারই চোখে মুখে চিন্তা ও উদ্বেগের ছাপ। সবাই নীরব।
অনেকের দৃষ্টি প্রেসিডেন্টের দিকে। প্রেসিডেন্টই কথা বলল আব্রাহাম জনসনকে উদ্দেশ্য করে, আপনি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?
আহমদ মুসার সেই লোকটিকে আবার সেই স্থানে ফেরত। পাঠিয়েছি। নিরাপদ কোন স্থানে লুকিয়ে থেকে সেই স্থানটির উপর চোখ রাখতে বলেছি। আহমদ মুসা কোন কারণে গতকাল না আসতে পারলে আজ অবশ্যই আসবে। যদি আসে তাহলে তাকে ছদ্মবেশে ডেথ ভ্যালি পাহাড়ের গোড়ায় একটা নির্দিষ্ট স্থানে আনতে বলেছি। তার সাথে। সরাসরি কথা হওয়া প্রয়োজন। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ধন্যবাদ জর্জ। এই অবস্থায় এটাই বেস্ট সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঈশ্বর করুন আহমদ মুসা যদি আজ আসে তাহলে তার সাথে আপনার সরাসরি সাক্ষাৎ হওযা অবশ্যই প্রয়োজন। তাকে বলার বিষয়ও আছে, তার কাছ থেকে শোনার বিষয়ও আছে। বলল প্রেসিডেন্ট।
ইয়েস এক্সিলেন্সি। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
ঈশ্বর না করুন আহমদ মুসা আজ যদি না আসে, তাহলে আমাদের কর্মপন্থা কি হবে? বলল সিআইএ প্রধান।
আল্টিমেটামকে আমরা কিভাবে ফেস করতে পারি? আগেও বলেছি, প্রথমে আগাম আক্রমণ করে ওদের MFw ধ্বংস করা, দুই. ওদের ঘাঁটি গোটাটাই উড়িয়ে দেয়া, তিন. ওদের দ্বিতীয় দাবি মেনে নিয়ে কিছু সময় হাতে নেয়ার ব্যবস্থা করা। এর মধ্যে প্রথমটি অনিশ্চিত আহমদ মুসাকে
পাওয়া পর্যন্ত। দ্বিতীয়টি আরও অনিশ্চিত। ওদের সব ঘাঁটির সন্ধান আমাদের জানা নেই। অতএব তৃতীয় পন্থাই আমাদের জন্যে একমাত্র গ্রহণীয় অপশন হতে পারে। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলল।
এক্সিলেন্সি, শেষ বক্তব্য সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই। দ্বিতীয় অপশন গ্রহণ করার অর্থ হলো একটি সন্ত্রাসী শক্তির হাতে গোটা দুনিয়াকে ক্রিপলকারী শক্তি তুলে দেয়া। যার শিকার আমেরিকাও হতে পারে। সুতরাং কোনমতেই আমরা শত্রুদের এই শর্ত গ্রহণ করতে পারি না। বলল সেনাপ্রধান।
সেনাপ্রধানের কথা ঠিক। কিন্তু সমস্যা হলো, সন্ত্রাসীদের প্রথম অপশন আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। কারণ আগাম আক্রমণ চালিয়ে ওদের আক্রমণকারী অস্ত্র MFW আমরা ধ্বংস করতে পারছি না। ঐ অস্ত্র যেমন আমাদের নেই, তেমনি ঐ অস্ত্র ধ্বংস করার টেকনোলজিও আমাদের কাছে নেই। আমরা তাহলে কি শেষ অপশন গ্রহণ করে আমাদের আমেরিকাকে ওদের আক্রমণের হাতে তুলে দেব। তা আমরা দিতে পারি না। তবে শেষ অপশনের কোন টাইম লিমিট নেই। এটা আমাদেরকে কিছু সময় দিতে পারে। বলল সিআইএ প্রধান।
টাইম লিমিট না থাকার অর্থ এও হতে পারে যে, আলটিমেটাম শেষ হওয়ার পরবর্তী মুহূর্ত আক্রমণের সময় হতে পারে। মন্দটাই ধরে নেয়া উচিত। বলল প্রেসিডেন্ট।
ঠিক এক্সিলেন্সি। তাহলে এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় কি, এটাই তো ঠিক করা করা যাচ্ছে না। বলল সিআইএ প্রধানই।
সন্ত্রাসীদের তিনটি অপশনের মধ্যে কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। আমেরিকা ওয়ার্ল্ড পাওয়ার। সে যেমন নিজের দেশকে, তেমনি দুনিয়ার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে না। আগাম আক্রমণের কথাই আমাদের ভাবা দরকার। বলল সেনাপ্রধান।
ধন্যবাদ। এটাই গ্রহণীয় অপশন। এটার উপরই আমরা ওয়ার্ক করছি। কিন্তু আহমদ মুসার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আমরা সমস্যায় পড়েছি। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কিন্তু আহমদ মুসাকে পাওয়া না গেলে কি করণীয়। সেটাই এখন আমরা ভাবছি। বলল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
সন্ত্রাসীদের MFW-এর উপর আমাদের কোন অস্ত্রেরই আক্রমণ কার্যকরী নয়। আহমদ মুসার প্ল্যানটাই এ পরিস্থিতির জন্যে উপযুক্ত। অলক্ষ্যে ওদের ঘাঁটিতে প্রবেশ করতে হবে এবং মূল অস্ত্র ধ্বংস করে ওদের MFW-কে অকার্যকর করে দিতে হবে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসাকে যদি না পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের গোয়েন্দাদের কাউকে কিংবা কয়েকজনকে দিয়ে এ কাজ করার উদ্যোগ নেয়া যায় কি না? প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলল।
না, সেটা সম্ভব নয়। ভালো করতে গিয়ে খারাপ হতে পারে। সামান্য সন্দেহ করলেই তারা তাদের ধ্বংসলীলা শুরু করে দিতে পারে। ওদেরকে আহমদ মুসা জানে, সুতরাং একমাত্র আহমদ মুসাই এই ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব নিতে পারে। সিআইএ প্রধান বলল।
কিন্তু তাকেই তো পাওয়া যাচ্ছে না? উত্তরে বলল প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা প্রধান।
একটু সময় আমরা দেখতে পারি। আলটিমেটামের আজ প্রথম দিন। আরও দুদিন বাকি। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করবেন। বলল প্রেসিডেন্ট।
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, মি. জর্জ, আপনি দাউদের বিষয়টার দিকে মনোযোগ দিন। কোন সিগন্যাল…
এক্সকিউজ মি এক্সিলেন্সি, একটা সিগন্যাল এসেছে। এটা বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন হাতঘড়িটা চোখের সামনে নিয়ে এল।
প্রেসিডেন্ট থেমে গিয়েছিল।
হাতঘড়ির উপর চোখ পড়তেই ডেট কেবিনে নীল আলোর সংকেত দেখতে পেল।
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল জর্জ আব্রাহাম জনসনের। বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি, দাউদ ইব্রাহিম আহমদ মুসাকে পেয়েছে। সে সংকেত পাঠিয়েছে।
ধন্যবাদ ঈশ্বরকে। তাহলে মি. জর্জ, আপনাকেই পরবর্তী প্রোগ্রামের জন্য কাজ শুরু করতে হবে। বলল প্রেসিডেন্ট।
ইয়েস এক্সিলেন্সি। আমি সেটাই ভাবছি।
ধন্যবাদ মি. জর্জ।
বলেই প্রেসিডেন্ট সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা সবাই শুনলেন, আহমদ মুসার ওখান থেকে রেসপন্স পাওয়া গেছে। আমরা মনে করছি, আলটিমেটাম সংক্রান্ত আমাদের মেসেজ সে পেয়েছে। তার চিন্তা, তার প্রোগ্রাম আমাদের কাছে অস্পষ্ট। তবে মি. জর্জের সাথে তার দেখা হচ্ছে। মি. জর্জ ফেরার পর আবার আমরা রাতে বসব। এখন আমরা উঠতে পারি।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ মি. এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট। আমরা আশা করছি মি. জর্জের মিশন সফল হোক। আমরা রাতে ভালো খবরের প্রত্যাশা করব। সেনাবাহিনী প্রধান বলল।
ধন্যবাদ সকলকে। ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন।
বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল সকলেই।
প্রেসিডেন্ট চলে গেল।
.
রবার্ট রবিনসনরা চলে যাবার পর আহমদ মুসা বাড়ির সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে ডেথ ভ্যালিতে বেরিয়ে এল।
সুড়ঙ্গ পথটা খুব দীর্ঘ নয়। কিন্তু যে স্থানটিতে এসে সুড়ঙ্গ পথ শেষ হয়েছে, সেই স্থানটা থেকে অল্প গেলেই ডেথ ভ্যালির উত্তর প্রান্তে পৌঁছা। যায়।
আহমদ মুসা পাহাড়ের একটা আড়াল থেকে হেঁটে ডেথ ভ্যালির উত্তর পাশে গিয়ে পৌঁছল।
আহমদ মুসা আজ ডেথ ভ্যালিতে এসেছেই তার অ্যাকসিডেন্টের জায়গাটা দেখার জন্যে। আহমদ মুসা অবাক হয়েছে পাহাড়ের গায়ের পাথর এভাবে স্লিপ কাটে না সাধারণত। বিশেষ করে আহমদ মুসা যে পাথরে পা রেখে সামনের আরেক পাথরে যাবার চেষ্টা করেছিল, সে পাথরটিকে তার নিচের বড় একটি পাথরে শক্তভাবে আটকে আছে দেখেই আহমদ মুসা তার উপর পা রেখেছিল। কিন্তু পাথরটা ওভাবে সরে গেল কেন?
আহমদ মুসা অ্যাকসিডেন্টের স্থানে যখন পৌঁছল, তখন বেলা ৮টা। মার্কিন পরিবেশ অনুযায়ী এটা খুবই সকাল।
সকালটাই বেছে নিয়েছে আহমদ মুসা। কারণ অন্তত এ সময় এ অঞ্চলে কোন মানুষ আসার কথা নয়। প্রথমত এটা ব্রেকফাস্টের সময়। ছাগল ইত্যাদি চরাতে আসার সময় এটা নয়। ডেথ ভ্যালি সংশ্লিষ্ট লোকও এ অঞ্চলে এখন আসবে না। কারণ বরিসদের সাথে আলোচনা করে। আহমদ মুসা বুঝেছে, তারা রাতকেই বেছে নিয়েছে ডেথ ভ্যালিতে তাদের আসা-যাওয়ার জন্যে। তারা ডেথ ভ্যালিতে তাদের ঘাঁটি গড়ার সময়ও রাতের সময়টাকেই তারা ব্যবহার করেছে বেশি। সুতরাং ডেথ ভ্যালির এ অঞ্চলে আসার জন্যে দিন বিশেষ করে সকালের এই সময়টাই উত্তম।
অ্যাকসিডেন্টের জায়গায় এসে দাঁড়াল আহমদ মুসা। যে পাথরটার উপর তার পা দেয়া পাথর দাঁড়িয়েছিল, সে পাথরের উপরটা প্রায় মসৃণ। বলা যায়। ভালো করে দেখে আরও বুঝল যে, এই মসৃণতাটা প্রাকৃতিক নয়, কেউ মসৃণ করেছে।
পাথরটার পাশে বসল আহমদ মুসা। কেউ মসৃণ করেছে কি না সেটাই আহমদ মুসা আরও ভালোভাবে দেখে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল।
বসার পর পাথরের উপরের তলটা আরও পরিষ্কারভাবে নজরে এল আহমদ মুসার।
দেখতে গিয়ে এক জায়গায় হঠাৎ আহমদ মুসার চোখ আটকে গেল। হিব্রু দুটি শব্দের উপর। পাথরের রঙের কালি দিয়ে লেখা। খুব ভালো করে চোখ না ফেললে লেখাটা দেখাই যায় না।
হিব্রু দুটি শব্দ আহমদ মুসাকে বিস্ময় ও আনন্দে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এইচ থ্রি ও FOAM-এর যাদেরকে আহমদ মুসা দেখেছে, চিনেছে তারা সবাই জু অর্থাৎ জায়োনিস্ট। ওরা, এই হিব্রু শব্দ এবং ডেথ ভ্যালি একসাথে মিলে যাচ্ছে। ওদেরই লেখা হবে এই হিব্রু শব্দ। কেন লিখেছে? এবং একটা পাথরের আড়ালে কেন রেখেছে? এর সাথে ডেথ ভ্যালির কি কোন প্রকার সম্পর্ক আছে? শব্দ দুটি কি বলছে?
বেশ কষ্ট করে অনেকটা ক্যালিওগ্রাফির মত প্যাচানো অক্ষরে লেখা শব্দের পাঠোদ্ধার করতে পারল আহমদ মুসা।
উপরের শব্দটার অর্থ রংধনু, নিচের শব্দটার অর্থ হলো টাংগ অব বেল অর্থাৎ বেল বা ঘন্টার ভেতরে ঝুলন্ত ধাতব খণ্ড যা দুলে দুলে ঘণ্টাকে বাজায়।
পাথরের গায়ে এই শব্দ দুটো লেখার তাৎপর্য কি? নিশ্চয় কিছু বলার জন্যে কিংবা কিছু ইংগিত করার জন্যে এই শব্দ দুটি লেখা হয়েছে। কি সেটা? রংধনু ও টাংগ অব বেল দিয়ে কি বুঝাতে চাওয়া হয়েছে?
বিষয় দুটি নিয়ে আহমদ মুসা অনেক চিন্তা করল। রংধনু তো আকাশের প্রাকৃতিক একটা প্রতিচ্ছবি। এখানে রংধনু কোত্থেকে আসবে। আর রংধনুর পরের বিষয় হলো টাংগ অব বেল।
এই পাহাড়ে কিংবা পাহাড়ের এই রংধনু ধরনের কিছু আছে? রংধনু শব্দ দিয়ে তাকেই কি ইংগিত করা হয়েছে? আহমদ মুসা এ পাশের খাড়া। পাহাড়ের গোটাটার উপর নজর বুলাল, না তেমন কিছুই চোখে পড়ল না।
পাহাড়ের এই উত্তর পাশের একটা মজার বৈশিষ্ট্য হলো, বড় বড় পাহাড়-পর্বতের যেমন স্নেলাইন থাকে, তেমনি এই পাহাড়ের ট্রি লাইন আছে। এই লাইনের উপরে কোন গাছ-গাছড়া নেই, একদম নিরেট পাথুরে পাহাড়। আর ট্রি লাইনের নিচে ক্রিকের পানির ধার পর্যন্ত গাছ গাছড়ার বিস্তৃতি।
আহমদ মুসা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পাহাড়ের এই ধারকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। হয় টপ, না হয় বটম থেকে দেখলে আকার যেভাবে নজরে আসে, পাশ থেকে দেখলে তা আসে না। টপে উঠা অসম্ভব, তবে বটমে নামা যেতে পারে।
বটমেই নামল আহমদ মুসা। একটা উঁচু পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা নজর ফেলল পাহাড়ের গোটা এ পাশটার উপর। ভালো করে তাকাতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল রংধনুটা। পাহাড়ের গায়ে ওক গাছের অবস্থান বিক্ষিপ্ত হলেও মূল সারিটার অবস্থা রংধনুর মতই লাগে, কোনভাবে ওক গাছের মূল কনসেনট্রেশন রংধনুর ধনুকের মত বাঁকা হয়ে পাহাড়ের গোটা এ পাশটা কভার করেছে।
রংধনু পাওয়া গেল। কিন্তু টাংগ অব বেল কোথায়? ওটার অর্থ কি? রংধনু যদি ওক গাছের বাকা সারিকে ধরা হয়ে থাকে, তাহলে বেলের টাংগ মানে ঘণ্টা এবং তার ঝুলন্ত দণ্ড বলা হয়েছে কাকে?
ভাবল আহমদ মুসা অনেক। এক সময় তার মনে হলো, রংধনুর নিচেই টাংগ অব বেল শব্দ লিখা হয়েছে কেন? রংধনুর সাথে ঘণ্টা ও ঘণ্টাদণ্ডের কোন সম্পর্ক আছে কি? কি সেই সম্পর্ক? বেল বা ঘণ্টা বৃত্তাকার বা অর্ধবৃত্তাকার কাঠামোতে ঝুলানো থাকে। অর্ধবৃত্তাকার হলেই সেটা রংধনুর আকারের হয়। ওক গাছের যে অর্ধবৃত্তাকার রংধনু দেখা যাচ্ছে, সেখানে কি তাহলে ঘণ্টা ও ঘণ্টাদণ্ড পাওয়া যাবে? সেটা কি? কোথায় পাওয়া যাবে?
নতুন করে তাকাল আহমদ মুসা ওক গাছের বাঁকানো অর্ধবৃত্তের দিকে। ঘণ্টা তো টাঙানো থাকে বৃত্ত বা অর্ধবৃত্তের শীর্ষ পয়েন্ট থেকে। তাহলে ওক গাছের বাঁকানো অর্ধবৃত্তের ঠিক মধ্য-পয়েন্টের নিচে ঘণ্টা। খোঁজ করতে হবে।
রংধনুর তাৎপর্য বুঝা গেল, কিন্তু ঘণ্টাদণ্ড দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে?
আহমদ মুসার হাতঘড়ি বিপবিপ সিগন্যাল দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসা তাকাল ঘড়ির দিকে। সকাল দশটা বাজে। ১০টার সময় তো দাউদের আসার কথা সেই ওক গাছের তলায়। গতকাল যাওয়া হয়নি। মেসেজ ছিল কি না তাও দেখা হয়নি। আজ ঠিক সময়ে সেখানে যাওয়া দরকার। সাক্ষাৎ হওয়া দরকার দাউদ ইব্রাহিমের সাথে। এখনি যাত্রা শুরু করা দরকার।
আহমদ মুসা দ্রুত পাথরটা থেকে নামল। পাহাড় বেয়ে আবার যাত্রা শুরু করল।
.
আহমদ মুসাকে পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে দাউদ ইব্রাহিম।
এ পর্যন্ত তার মনে জমে থাকা সব কথা গড়গড় করে বলে গেল সে। সবশেষে বলল, আপনার উপর ওরা সাংঘাতিকভাবে নির্ভর করেন। এফবিআই প্রধান বললেন যে, আপনার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় খোদ প্রেসিডেন্টও ভেঙে পড়েছেন।– রাখ তোমার এসব কথা, মানুষের সব ভরসা আল্লাহর উপর। মানুষকে তিনি যতটুকু ক্ষমতা দেন, মানুষ ততটুকুই করতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
একটু থামল। ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। আবার কথা বলা শুরু করল আহমদ মুসা, তিন দিনের আলটিমেটামটা খুব সাংঘাতিক। তিন শর্তের কোনটাই মানা যায় না। প্রথম দুটি তো মানার প্রশ্নই উঠে না। আর তৃতীয়টি হলো, শত্রুর গোপন আক্রমণের মুখোমুখি হওয়া, যে আক্রমণ প্রতিরোধের কোন উপায় নেই এবং আক্রমণের যে ধ্বংসলীলা, তা সহ্য করার ক্ষমতা আমেরিকার নেই।
আমেরিকা তো জগতের একটা শ্রেষ্ঠ শক্তি, তাহলে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারবে না কেন? দাউদ ইব্রাহিম বলল।
ঐ গোপন অস্ত্রের প্রতিরোধ করার কোন অস্ত্র আবিষ্কার এখনো দুনিয়াতে হয়নি। এই গোপন অস্ত্রটা সেই অস্ত্র, যার কথা তোমাদের বলেছি। ওটা ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ। এই অস্ত্র মুহূর্তেই সব ধরনের ধাতব অস্ত্র নিমেষে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। এটা ম্যাগনেটিক অশরীরী আগুন। এই আগুন রোধ করার কোন উপায় এখনো আবিষ্কার হয়নি।
কেঁপে উঠল দাউদ ইব্রাহিম। তার উজ্জ্বল সাদা মুখটা পাংশু হয়ে গেল। বলল, ইন্নালিল্লাহ, আমি বুঝতেই পারিনি ব্যাপারটা। আমাদের আমেরিকা মানে বিশ্বশক্তি তাহলে তো আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। এখন কি হবে? কিভাবে গোপন শয়তানী শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে আমেরিকা?
বল আল্লাহু আকবর! আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি কি ফেরাউনকে ধ্বংস করেননি, বাঁচাননি কি মুসা আ.-কে? বাঁচাননি ইব্রাহিম আ.-কে? আল্লাহকে ডাক। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু আল্লাহ তো বাঁচিয়েছেন মহানবী স.-কে, ইব্রাহিম আ.-কে। কিন্তু আমাদের আমেরিকা তো তা নয়। দাউদ ইব্রাহিম বলল।
মনে রেখ, আল্লাহর সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়নি। আল্লাহ যাকে চান, যাদেরকে চান বাঁচান। কে তাকে মানল কিংবা মানল না তা তিনি দেখেন না। এজন্যেই তাঁর এক নাম রহমান।
বলেই আহমদ মুসা একটু থেমে আবার বলল, তুমি বললে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন আমার সাথে দেখা করতে চান। সেটা কখন? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, সময় এসে গেছে। আমি তাঁকে সিগন্যাল পাঠিয়েছি। সিগন্যাল পাঠাবার এক ঘণ্টার মধ্যে মিটিং প্লেসে আমাদের পৌঁছা। দরকার। দাউদ ইব্রাহিম বলল।
জায়গাটা কোথায়? বলল আহমদ মুসা।
ডেথ ভ্যালি পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব গোড়ায় জংগলে ঢাকা একটা সেতু আছে, ঐখানে। দাউদ ইব্রাহিম বলল।
ভালো জায়গা। বলল আহমদ মুসা।
জায়গাটা চিনেন স্যার? দাউদ ইব্রাহিম বলল।
জানি। নিরাপদ জায়গা। চল। বলল আহমদ মুসা।
দাউদ ইব্রাহিম ব্যাগ থেকে কাউবয়ের পোশাক বের করে বলল, এফবিআই প্রধান আপনাকে ছদ্মবেশে যেতে বলেছেন।
আহমদ মুসা হেসে পোশাক নিয়ে নিল।
আহমদ মুসারা সেই স্থানে পৌঁছার আগেই জর্জ আব্রাহাম জনসন সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা একজন কাউবয়ের পোশাকে থাকলেও চিনতে পেরেছে। জর্জ আব্রাহাম জনসন। কয়েক ধাপ এগিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, তুমি আমাদের সাংঘাতিক দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে। কোথায় গিয়েছিলে? কোন বিপদে পড়নি তো?
বলছি জনাব। আহমদ মুসা বলল।
এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে তার পাশে দাঁড়াল।
ঠিক এই সময় একসাথে কয়েকটি রিভলবার গর্জন করে উঠল।
জর্জ আব্রাহাম জনসন মাথা তুলে পেছন দিকে একবার তাকাল। একটু হাসল। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, কি ঘটল আহমদ মুসা?
আহমদ মুসাও হাসল। বলল, এফবিআই-এর চারটি রিভলবার গুলি। ছুঁড়েছে চার টার্গেট লক্ষ্য করে। সম্ভবত ঐ চারজন আপনাকে ফলো করে এখানে এসেছে।
বুঝলে কি করে গুলি এফবিআই-এর লোকদের রিভলবারের? বলল জর্জ জনসন। * এফবিআই লোকরা যখন একসাথে গুলি ছোঁড়ে, তা একসাথে হয় না। গুলি চেইন আকারে চলে। একটা গুলিকে আরেকটা ফলো করে। আহমদ মুসা বলল।
এটাও তোমার জানা আছে দেখছি? আহমদ মুসা তোমাকে ধন্যবাদ।
বলেই পেছন দিকে তাকাল। বলল, ওরা আসছে আহমদ মুসা। এস শুনি, তোমার কথা ঠিক কি না।
আহমদ মুসা একটু সরে দাঁড়াল। এফবিআই-এর একজন জর্জ আব্রাহামকে স্যালুট দিল।
যাদের শিকার করলে ওরা কারা? বলল জর্জ আব্রাহাম।
স্যার, ওরা আপনাকে ফলো করে এসেছে। আমরা লুকিয়ে থেকে আপনাকে ফলো করে আসা লোকদের মার্ক করি। আমরা দেখলাম, যখনই আহমদ মুসা স্যার ওদের নজরে পড়েছে। সংগে সংগেই ওরা চারজনই পকেট থেকে এক ধরনের অয়্যারলেস বের করে প্রথমে কল করতে যাচ্ছিল। সেই সাথে রিভলবারও বের করেছিল। স্যার, কল ঠেকাবার জন্যে ওদের সংগে সংগেই হত্যা করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না। আফিসারটি বলল।
হ্যাঁ, কল ও গুলি একসাথেই ঠেকিয়েছ তোমরা। ধন্যবাদ। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
অফিসার, যারা ফলো করেছিল, তাদের সংখ্যা চারজনই তো? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ওরা চারজনই। ওরা প্রেসিডেন্ট ভবন থেকেই স্যারকে ফলো করেছে। এটা আমরা কনফারম করেছি স্যার। অফিসার বলল।
ধন্যবাদ। ওরা আমাকে দেখার পর কোন কল করতে পারেনি, এটাই তো? বলল আহমদ মুসা।
জি স্যার। ওরা কোন কল সম্পূর্ণ করতে পারেনি।– ধন্যবাদ। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ অফিসার। হ্যাঁ, তোমরা এখন যাও। এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
এফবিআই-এর লোকরা ফিরে গেল তাদের পজিশনে।
এই সেতু এলাকা এফবিআই-এর একটা গোপন আউটপোস্ট। এর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ে এবং ডেথ ভ্যালি পাহাড়ের এ অংশের উপর নজর রাখা হয়।
এফবিআই-এর লোকরা চলে গেলে জর্জ আব্রাহাম জনসন দাউদ ইব্রাহিমকে দেখে নিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
বুঝল আহমদ মুসা। সে দাউদ ইব্রাহিমকে বলল, দাউদ ইব্রাহিম, তুমি উপরে বেজ পয়েন্টটায় অপেক্ষা কর। আমি আসছি। তোমার কাছে কোন রিভলবার নেই তো? বলল আহমদ মুসা
নেই। দাউদ ইব্রাহিম বলল।
ঠিক আছে। রিভলবার কিংবা ধাতব অস্ত্র নিয়ে উপরে উঠা যাবে না। ওদের মনিটরে ধরা পড়ে যেতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
দাউদ ইব্রাহিম সালাম দিয়ে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা একটু হাসল। কিন্তু জর্জ আব্রাহাম জনসনকে সালাম দিতে বলল না ইচ্ছা করেই।
আহমদ মুসা দাউদ ইব্রাহিমদের সংক্ষিপ্ত কাহিনী জর্জ আব্রাহাম জনসনকে জানিয়ে বলল, রিট্রায়াল বা অন্য কোনভাবে এই পরিবারকে বনবাস থেকে উদ্ধার করতে হবে।
ঠিক আছে। আমার মনে থাকবে। আমি আজ জাস্টিস ডিপার্টমেন্টকে এ ব্যাপারে বলব। দাউদ ইব্রাহিম ছেলেটা ভালো। তার
দায়িত্বশীলতায় আমরা খুশি হয়েছি। বলল আব্রাহাম জনসন।
ওর পিতা নূর ইউসুফও একজন দায়িত্বশীল অফিসার ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। আহমদ মুসা বলল।
সৎ, দায়িত্বপরায়ণরাও অনেক সময় ফাঁদে পড়ে। তার কেস আমরা দেখব আহমদ মুসা। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ধন্যবাদ জনাব। আহমদ মুসা বলল।
এস বলে জর্জ আব্রাহাম জনসন সেতুর দিকে হাঁটতে শুরু করল।
সেতুর উপর নেমে এল তারা দুজন।
সেতুটা ছোট একটা পাহাড়ী নদীর উপর। রক ক্রিক এলাকায় এ রকম ঝনাপুষ্ট নদী অনেক রয়েছে। রক ক্রিকের এ ছড়া-নদীটা সেতু এলাকায় এসে কিছুটা ওয়াইড, মনে হয় গভীরও হয়েছে। এখানকার পানিটা শান্ত।
আহমদ মুসারা সেতুর উপর পৌঁছতেই সেতুর পাশে একটা ছোট টিউব সাবমেরিন জেগে উঠল। সে টিউব সাবমেরিন থেকে একটা অটো সিঁড়ি উঠে এল সেতু পর্যন্ত। টিউব সাবমেরিনের পিঠে একটা দরজা খুলে গিয়েছিল। সিঁড়িটা সে দরজা দিয়েই বেরিয়ে এসেছে।
প্রথমে জর্জ আব্রাহাম জনসন, তার পিছে পিছে আহমদ মুসা সেই সিঁড়ি বেয়ে সাবমেরিনের ভেতর নেমে গেল। তারা ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে সিঁড়ি গুটিয়ে গিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সাবমেরিনের দরজাও বন্ধ হয়ে গেল। তারপর ডুবে গেল পানিতে।
একটা টেবিলের দুদিকে পেতে রাখা দুপাশের চেয়ারে বসল দুজন।
এই টিউব সাবমেরিনে তুমি ও আমি ছাড়া আর কোন মানুষ নেই। আমাদের নাস্তা, কফি সরবরাহ করবে রোবট। ওরাই সিঁড়ি দিয়ে আমাদের নিয়ে এসেছে। বলল আব্রাহাম জনসন।
টিউব সাবমেরিনের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাও কি রোবটদের হাতে? আহমদ মুসা বলল।
না, একটা টিম আছে। সাব অপারেশনে থাকার সময় ওরা থাকে। এখন সাবমেরিনকে রেস্টে রাখা হয়েছে। বলল আব্রাহাম জনসন।
টেবিলে নাস্তা ও কফি সরবরাহ করা হলো। রোবট নিখুঁতভাবে কাজটা করল।
নাস্তা খাওয়া শেষ করে কফির কাফে চুমুক দিয়ে জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, প্রেসিডেন্ট সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তোমাকে আহমদ মুসা। প্রেসিডেন্টসহ আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। আমেরিকার ইতিহাসে এমন জটিল সংকট কখনও আসেনি। তুমি তো এদের তিন শর্ত ও আলটিমেটামের কথা জেনেছ। আর যখন তুমি ওদের সব বিষয় জান। তখন বল সমাধান কি, তুমি কি ভাবছ? বলল আব্রাহাম জনসন।
প্রথমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, বড় একটা ক্ষতি থেকে তিনি আমাদের রক্ষা করেছেন। এই মাত্র যারা নিহত হয়েছে তারা টেলিফোন করতে পারলে ওরা জানতে পারত আমি বেঁচে আছি এবং সরকারের সংগে আমার যোগাযোগও রয়েছে। তাহলে এই মুহূর্তেই আগাম এ্যাকশন হিসেবে তারা MFW ব্যবহার করে বসত। ওরা টেলিফোন করতে না পারায় এবং ওরা সবাই নিহত হওয়ায় এটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে, এইচ থ্রি ও ফোমরা আগে যে অন্ধকারে ছিল আমার ব্যাপারে, এখনও তারা সেই অন্ধকারেই থাকবে। আপনার এফবিআই লোকদের ধন্যবাদ যে তারা ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করেছে। আমি বিস্মিত হচ্ছি যে, এই ছদ্মবেশেও তারা আমাকে দেখেই চিনতে পেরেছে। এর অর্থ হলো, তারা তাদের লোকদের আমার ফটো সব ফরমেটে মুখস্থ করিয়েছে। জনাব, আপনারা আলটিমেটাম ও শর্তগুলো সম্পর্কে কি চিন্তা করছেন? শেষ চুমুক দিতে দিতে বলল আহমদ মুসা।
এটা তোমাকে বলার দরকার আছে। প্রথম দুটি শর্তের কোনটিই মানার মত নয়। আর তৃতীয়টা শর্ত নয়, থ্রেট। তাদের আক্রমণের জন্যে আমাদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। প্রথম দুই শর্ত যেমন গ্রহণীয় নয়, তেমনি তাদের হুমকিও আমাদের জন্যে বিপজ্জনক। তাদের আক্রমণ প্রতিরোধের কোন উপায় আমাদের হাতে নেই। আর সময় মাত্র তিন দিন। এখন তাদের উপর পাল্টা আক্রমণই আমাদের কাছে একমাত্র অপশন। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কথার কথা বলছি, একটা রাষ্ট্রের বা দেশের অস্ত্র ধ্বংস করলেই সে দেশ কি দখল করা যায়? একটা দেশের জনগণই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ, আহমদ মুসা তোমাকে এই বিষয়টাও বলা প্রয়োজন। ওরা শুধু আমাদের অস্ত্র ধ্বংস নয়, আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিও ধ্বংস করবে। গোয়েন্দা সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি এইচ থ্রি ও ফোমদের রাজনৈতিক লবি কাজ শুরু করে দিয়েছে। অস্ত্র ধ্বংস করার পরপরই তারা এটাকে ইস্যু বানিয়ে সরকারের ব্যর্থতার দায়ে একদিকে সরকারের পদত্যাগ দাবি করবে, অন্যদিকে দেশে সংঘাত-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। সব অস্ত্র ধ্বংস হওয়ার আকস্মিক ঘটনায় সরকার, প্রশাসন ও জনগণের মধ্যেও একটা বিমূঢ় অবস্থার সৃষ্টি হবে। এই একই সুযোগ গ্রহণ করে ওরা ক্ষমতা দখল করে ফেলতে পারে। বিস্তারিত তথ্য আমরা পাচ্ছি। যা বললাম তাদের পরিকল্পনার এটাই সারাংশ। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ওদের রাজনৈতিক পরিকল্পনাও দেখছি মারাত্মক। ওদের ষড়যন্ত্র দেখছি সুপরিকল্পিত ও সামগ্রিক। আহমদ মুসা বলল।
এখন তোমার কথা বল আহমদ মুসা। ওদের আক্রমণের শক্তি ধ্বংস করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। তুমি এ নিয়ে কি চিন্তা করছ? বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা তার আজকের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে জর্জ আব্রাহাম জনসনকে জানাল। তার অ্যাকসিডেন্ট হওয়া, পাথরে দুটি হিব্রু শব্দ পাওয়া, তার অনুসন্ধান, সবই সংক্ষেপে বলার পর মত প্রকাশ করল, গত দুই দিনের অভিজ্ঞতায় আমি এখন নিশ্চিত, ডেথ ভ্যালিতেই এখন ওদের ঘাঁটি। সম্ভবত সেটা সামরিক ঘাঁটি।
তুমি ঠিক পথেই এগোচ্ছ আহমদ মুসা। রংধনুকে তুমি পেলে ওক গাছের বাঁকা সারিতে। ঘণ্টা ও ঘণ্টাদণ্ডকে কোথায় পাবে? বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
নিশ্চয় এর অর্থ আছে। পাওয়া যাবে অবশ্যই। আমার ধারণা এই সমস্যার সমাধান হলে ঘাটিতে ঢোকার পথ পেয়ে যাব। মজার ব্যাপার ঘণ্টা ও ঘণ্টাদণ্ডের লোকেশন ওক গাছের বাকা সারির যেখানে হবার কথা, সেটা ডেথ ভ্যালির ফ্লোর লেবেল। আহমদ মুসা বলল।
আলহামদুলিল্লাহ। তোমাকে আল্লাহ সাহায্য করুন। তোমার প্রত্যেকটা চিন্তা-ধারণা বাস্তব এবং এটাই সত্য হবে, ইনশাআল্লাহ। এখন তোমার প্রস্তুতি ও প্রয়োজনের কথা বল। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসা সংগে সংগে কথা বলল না। একটু ভাবল। বলল, ভেতরে কি আছে, কারা আছে, কতজন আছে, কিভাবে আছে, কিভাবে প্রবেশ করব, কি করতে হবে, কিছুই জানি না। রিভলবার কিংবা এই জাতীয় ধাতব অস্ত্র সেখানে অচল। যা করতে হবে সেটা হলো, ওদের অস্ত্রেই ওদের সাথে লড়াই করতে হবে। যোগাযোগের জন্যে একটা কিছু দরকার। সম্পূর্ণ ধাতব পদার্থ বর্জিত অয়্যারলেস এই মুহূর্তে পেলে আমার কাজে লাগতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
সেটা আমার কাছে পাবে আহমদ মুসা। আর একটা জিনিস তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। কিছু প্লাস্টিক কোটেড মাইক্রো চিপস। এগুলো ম্যাগনেটিক পাওয়ার নিউট্রাল। এগুলোর অস্তিত্ব কোন ধরনের যন্ত্রে ধরা পড়বে না। তুমি ওদের ঘাঁটির যেখানেই যাবে চিপস ছড়াবে। তোমার পকেটে থাকলেও ওগুলো কাজ করবে। চিপসগুলো সব ঘটনা রিলে করতে পারবে। এই সিস্টেমে শুধু ফটো আসবে না। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ধন্যবাদ। ভালো ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ যেন সব ক্ষেত্রেই সফল করেন। আহমদ মুসা বলল।
আমিন। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
.
৪.
ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম টেলিফোনেই চিৎকার করে উঠল, সোজা কথায় এস। বল, এফবিআই চিফ ওখানে কেন গিয়েছিলেন? আর তাকে অনুসরণকারী আমাদের চারজন লোক মারা পড়ল কেন?
মাই লর্ড, আমি বলছি। খোঁজ নিয়ে যেটা জানতে পেরেছি, ওখানে এফবিআই-এর একটা আউটপোস্ট আছে। সেখানেই গিয়েছিলেন তিনি। আমাদের চারজন লোকের মৃত্যুর ব্যাপারে জানা গেছে, তারা নাকি এফবিআই প্রধানের দিকে রিভলবার তাক করেছিল। পশ্চিম ওয়াশিংটন এলাকার ফোম-এর প্রধান বেঞ্জামিন বেনহাম কথাগুলো বলল।
তুমি কি বিশ্বাস কর এই কথা? তারা এফবিআই প্রধানকে মারতে যাবে কেন? তাদের উপর নির্দেশ ছিল তার উপর নজর রাখার জন্যে। তার সাথে আহমদ মুসার কোন যোগাযোগ হয় কি না, এটাই দেখার দায়িত্ব ছিল তাদের। এফবিআই প্রধানের প্রতি রিভলবার তাক করা, কিংবা তাঁকে মারার চেষ্টা করার কোন প্রশ্নই উঠে না। বলল ডেভিড কোহেন কানিংহাম।
আমাদের চারজন লোক নাকি ধরা পড়তে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায় এফবিআই প্রধানকে মেরে তারা পালাতে চেষ্টা করেছিল। বেঞ্জামিন বেনহাম বলল।
রাবিশ। এই কথার এক বিন্দুও সত্য নয়। ওরা চারজনই যখন আমাকে টেলিফোন করছিল, সেই সময় ওদের গুলি করে মারা হয়। গুলির শব্দ আমি শুনেছি। সিংগল বাটন কল-অপশনে ওরা চারজন একসাথে কল করেছিল। কল ও গুলি কেউ একসাথে করতে পারে না। সুতরাং তোমার খবর সত্য নয়। আমার মনে হয় সত্যটা হলো, গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানাবার চেষ্টা ওরা চারজন করেছিল। কিন্তু সেটা ঠেকাবার জন্যেই তাদের গুলি করে মারা হয়। সেই গুরুত্বপূর্ণ খবরটা কি? বলল ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম।
মাই লর্ড। চেষ্টা করেও ঐ ধরনের কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ঐ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুধু এফবিআই প্রধান ও তার গাড়িই শুধু ওদিকে গিয়েছে এবং এসেছে। বেঞ্জামিন বেনহাম বলল।
যখন এফবিআই প্রধান ফিরে আসেন, তখন তার সাথে আর কেউ কি ছিল? জানতে চাইল ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম।
কেউ তার সাথে ছিল না। একা গিয়েছিলেন, একাই ফিরেছেন। এটা নিশ্চিত খবর মাই লর্ড। বেঞ্জামিন বেনহাম বলল।
এফবিআই প্রধানের মত লোক ওখানে এক ঘন্টা কি করছিলেন? কেন গিয়েছিলেন? আমাদের চারজন এমন কি দেখেছিল, যা চারজন একসাথেই আমাকে জানাতে চেয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা না গেলে বলতে হবে কিছু জানা হলো না। তোমার কথাগুলো যা ওদের সাজানো…।
লাইনটি কেটে গেল ডেভিড কোহেন ক্যানিংহামের। আরেকটি ভিআইপি ফোন কল ঢুকে পড়ল লাইনে। কলটি শিমন আলেকজান্ডারের।
শিমন আলেকজান্ডার সন্ত্রাসবাদী সংস্থা এইচ থ্রি, এবং বিশ্ব জায়নবাদের নতুন গোয়েন্দা সংস্থা FOAM-এর প্রকৃত প্রধান অথবা বলা যায় গডফাদার বা মাস্টারমাইন্ড এবং ফাইনানসিয়ার। প্রকৃত অর্থে ডেভিড কোহেন একজন নির্বাহী প্রধানমাত্র।
আপনি স্যার? ও গড! আপনার কথাই ভাবছিলাম? ডেভিড কোহেন বলল।
কেন? বড় কিছু? বলল শিমন আলেকজান্ডার।
বড় ঘটনা স্যার। আমাদের চারজন লোককে ওরা আজ মেরে ফেলেছে। আমার মনে…।
ডেভিড কোহেনের কথার মাঝখানেই শিমন আলেকজান্ডার বলে উঠল, ঐ ঘটনা আমি শুনেছি। খুব বড় কি ঘটনা এটা?
বড় এজন্যে যে, ওরা চারজনই কিছু জানাবার জন্যে আমাকে টেলিফোন করেছিল। সে মুহূর্তেই তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আমার মনে হচ্ছে, তারা যাতে ইনফরমেশনটা বলতে না পারে এজন্যেই তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। ডেভিড কোহেন বলল।
তুমি মনে করছ যে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল সেটা। বল তো কি তথ্য হতে পারে বলে মনে করছ তুমি? বলল শিমন আলেকজান্ডার।
আহমদ মুসার যদি তারা দেখা পেয়ে থাকে তাহলে তা গোপন রাখার জন্যে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড চালাতে পারে। ডেভিড কোহেন বলল।
তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ তোমার লোকরা জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে আহমদ মুসাকে দেখেছিল। সেই কথাই তারা তোমাকে জানাতে চেয়েছিল। বলল শিমন আলেকজান্ডার।
হ্যাঁ স্যার। আমি এটাই মনে করছি। ডেভিড কোহেন থামল।
কিন্তু এটা নিয়ে তুমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছ কেন? বলল শিমন আলেকজান্ডার।
এই তথ্য পাবার জন্যেই তো ওদের মোতায়েন রেখেছি এবং সব জায়গায় খোঁজ করছি! ডেভিড কোহেন বলল।
সেটা ছিল শর্ত ও আলটিমেটাম দেয়ার আগের পরিস্থিতি। শর্ত ও আলটিমেটাম দেয়ার পর সে অবস্থা আর নেই। আহমদ মুসার ভূমিকা এখন গৌণ হয়ে গেছে। এখন আহমদ মুসা ওদের হাতে থাকলে কোন ক্ষতি নেই। আমরা যে শর্ত দিয়েছি, তা তারা সবাই মিলে মোকাবিলা। করুক আমরা চাই। প্রথম দুটি শর্তের কোনটাই তারা মানতে পারবে না। মানলে ওদের গোপন অস্ত্রের শক্তি আর থাকবে না। ধ্বংস করতে হবে। তখন আমরা হবো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর প্রথম শর্ত দুটি যদি না মানে, তাহলে তৃতীয় শর্তের জন্যে ওদের তৈরি থাকতে হবে। তাহলে তাদের সব অস্ত্রশক্তি ধ্বংস হবে। সুতরাং আমেরিকার সবাই মিলেও এই ধ্বংস এড়াতে পারবে না। আহমদ মুসারও এ ক্ষেত্রে করার কিছু নেই। আহমদ মুসার এখন কানাকড়ি মূল্যও নেই আমাদের কাছে। এ নিয়ে বৃথাই সময় নষ্ট করছ। এখন মনোযোগ দাও আমাদের দেয়া আলটিমেটামের দিকে। বলল শিমন আলেকজান্ডার।
ঠিক বলেছেন স্যার, আলটিমেটাম দেয়ার পর আহমদ মুসা আমাদের জন্যে বিবেচ্য বিষয়ই নয়। গোটা আমেরিকার শক্তিকেই তো। আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আহমদ মুসা তো একজন ব্যক্তি মাত্র। ডেভিড কোহেন বলল।
হ্যাঁ, এবার বুঝেছ কোহেন। এবার তোমার প্রস্তুতি কত দূর? বলল শিমন আলেকজান্ডার।
কোন্ প্রস্তুতি স্যার? ডেভিড কোহেন বলল।
কোন প্রস্তুতি? তুমি ঘুমিয়ে আছ, না জেগে আছ? ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ (MFw)-এর এটাক প্রস্তুতি, এটাই এখন একমাত্র কাজ আমাদের। বলল শিমন আলেকজান্ডার।
সেটা তো দুদিন পরের ব্যাপার, প্রথম ও দ্বিতীয় শর্ত না মানার পর। ডেভিড কোহেন বলল। এ কোহেন, তুমি এ ধরনের অবাস্তব চিন্তা নিয়ে সময় ব্যয় কর কেন? প্রথম দুই শর্তের কথা মাথা থেকে বাদ দাও। শর্তগুলো মানবে না। জেনেই আমরা তা দিয়েছি, তৃতীয় পদক্ষেপ যাতে আমরা নিতে পারি। সুতরাং তৃতীয় পদক্ষেপটির ব্যাপারে আমাদের সবকিছু ফাইনাল করে ফেল। বলল শিমন আলেকজান্ডার।
সে ব্যবস্থা আমরা সম্পূর্ণ করে ফেলেছি স্যার। আলটিমেটামের তিন। দিন শুরু হবার সংগে সংগে আমরা অপারেশন-ঘাঁটিতে সবাইকে নিয়ে ঢুকে গেছি। ধ্বংস শেষ করে আমরা ঘাঁটি থেকে বের হব। MFW-এর সবকিছু প্রস্তুত। আলটিমেটামের সময় শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে আমরা কাউন্টডাউন শুরু করব এবং আলটিমেটাম শেষ হবার প্রথম। মিনিটেই আমাদের ম্যাগনেটিক ফায়ার ওফেভ (MFW)-এর বিস্ফোরণ ঘটবে এবং ধ্বংসলীলা শুরু হয়ে যাবে। ডেভিড কোহেন বলল।
তুমি নিজে উপস্থিত থাকছ তো? বলল শিমন আলেকজান্ডার।
আমি উপস্থিত থাকছি মানে?_MFW বিস্ফোরণের ডেটোনেটিং পাসওয়ার্ড তো আমার কাছে। শেষ মিনিটে আমি ওটা আমাদের অপারেশনের টেকনিক্যাল বাহিনীকে দেব যাতে প্রথম মিনিটেই আক্রমণ শুরু হতে পারে। ডেভিড কোহেন বলল।
আমাদের ঘাঁটি সুরক্ষিত এবং এর সন্ধান কারও কল্পনাতেও নেই, তবু বলছি ঘাঁটি সুরক্ষার কি ব্যবস্থা রেখেছ? বলল শিমন আলেকজান্ডার।
আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। আমাদের সামরিক ঘাঁটি একটা ডেড প্লেসে। এমন প্লেস নিয়ে কেউ ভাবে না, ভাবার প্রশ্নও নেই। তাই এর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার কোন সুযোগ নেই। এর প্রবেশ পথ খুঁজে পাওয়াকে যেভাবে ধাঁধার বাঁধনে বেঁধে রেখেছি, তা আমাদের লোক ছাড়া কারও পক্ষেই ভাঙা সম্ভব নয়। সুতরাং ঘাটির নিরাপত্তার ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকুন। ডেভিড কোহেন বলল।
নিশ্চিত আছি। তবু কথায় আছে না, সাবধানের মার নেই। সুতরাং সাবধান সব সময় থাকতেই হবে। আচ্ছা, তোমার লোক কি খবর নিচ্ছে আমাদের আলটিমেটাম পাওয়ার পর সরকারের অবস্থা কি? করছে কি ওরা? বলল শিমন আলেকজান্ডার।
ও, এই ব্যাপারে আপনাকে কোন খবর জানানো হয়নি। আলটিমেটামকে ওরা সাংঘাতিক গুরুত্ব দিয়েছে। ওটা পাওয়ার সংগে সংগে ওরা প্রশাসনে অঘোষিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। সমস্ত অস্ত্রঘাঁটি এবং সাইলো ও সাইলো সন্নিহিত এলাকায় রেড এলার্ট জারি করেছে। বিজ্ঞানী ও টেকনিক্যাল স্টাফদের সকল ছুটি বাতিল করেছে। দিনে কয়েকবার করে প্রেসিডেন্ট তার নিরাপত্তা কমিটি নিয়ে আলোচনায় বসছে। মিটিং-এ ঢোকার সময় তাদের মুখ যতটা মলিন দেখা যাচ্ছে, মিটিং থেকে বের হবার সময় ওদের মুখ আরও চুপসে গেছে দেখা যাচ্ছে। ডেভিড কোহেন বলল।
হো হো করে হেসে উঠল শিমন আলেকজান্ডার। বলল, আমি এই তো চেয়েছিলাম। দেখবে আলটিমেটামের শেষ সময় যতটা কাছে আসছে, ওদের উদ্বেগ-উত্তেজনা আরও বাড়বে। শেষে পাগল হয়ে যাবে। ওরা, যখন ব্ল্যাক ফায়ার ওদের অস্ত্রাগার ও সাইলোগুলোকে ধ্বংস করবে। জান, আমার মেয়ে আলাইয়া অ্যানজেলা আজ আমার সাথে কথা বলেছে এবং আমাকে অভিযুক্ত করেছে। বলেছে আমাকে, নিজেকে আইনের হাতে তুলে দিতে। আমি হেসেছি আর বলেছি, অপেক্ষা কর মা। দেখবে, তোমার বাবা কোন ছোট কাজ করে না। যাক, শোন। সব কিছুই আমাদের ঠিকঠাক চলছে। বিজয় আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সব সময় যোগাযোগ রেখ। রাখি। গুডডে।
.
যে স্থানে দাউদ ইব্রাহিমের অপেক্ষা করার কথা, সেখানে বসেছিল। সে। ভাবছিল সে আহমদ মুসার কথা, জর্জ আব্রাহাম জনসনের কথা। একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল দাউদ ইব্রাহিম।
হঠাৎ মাথায় একটা শক্ত কিছুর চাপ খেয়ে ঘুরে তাকাল সে। দেখল, তার মাথায় রিভলবার চেপে ধরে বাম পাশে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে হিংস্র দৃষ্টি।
কে তুই, পুলিশ না গোয়েন্দা? বলল রিভলবার ধরা লোকটি।
ভীষণ চমকে গিয়েছিল দাউদ ইব্রাহিম। তার উপর সে কিছুক্ষণ আগে আহমদ মুসারা যেখানে আছে, তার পিছন দিকে চারটি গুলির শব্দ শুনেছে। সেখানে কি ঘটেছে এটা নিয়ে সে আতংকে ছিল। আহমদ মুসাদের কিছু হলো কি না? আর সেদিক থেকেই লোকটি এসেছে কি না? তার ব্যাপারে সব সে জেনে ফেলেছে কি না। ইত্যাদি ভাবছিল সে।
তবু সাহস করে সে বলল, আমি পুলিশ বা গোয়েন্দা কিছুই নই। পাশের গ্রামে আমার বাড়ি। আমার একজন লোককে খুঁজতে খুঁজতে আমি এখানে এসে পড়েছি।
ধরা পড়লে সবাই এরকম কথা বলে। চল, উঠ। বলে লোকটি দাউদ ইব্রাহিমের মাথায় রিভলবারের বাঁট দিয়ে একটা ঠেলা দিল।
কোথায় যাব? বলল দাউদ ইব্রাহিম। তার মনে একটা ভীতি ছড়িয়ে। পড়েছে। আহমদ মুসারা যাদের কথা বলে, এ লোকটি সেই সন্ত্রাসী দলের নয় তো? যদি তাই হয়, তাহলে তো এই লোকটির কাছে অনেক, তথ্য আছে, যা তাদের অনেক উপকারে লাগতে পারে? এই চিন্তার সাথে সাথে দাউদ ইব্রাহিমের মনের ভীতি কিছুটা দূর হয়ে গেল। তার জায়গায় এই ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল যে, এই লোকটিকে ধরতে হবে।
কোথায় যাবে? একদম পরপারে। তার আগে তোমার পেটের কথাগুলো বের করতে হবে। চল।
কথা শেষ করেই লোকটি রিভলবারের নল দিয়ে আবার গুতা দিল দাউদ ইব্রাহিমের মাথায়।
লোকটি রিভলবারের নলের গুতা দিয়ে দাউদ ইব্রাহিমকে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের গোড়ার দিকে নামার জন্যে ইশারা করছিল।
লোকটির ইশারা মত চলতে লাগল দাউদ ইব্রাহিম। চলা শুরু করে চিন্তা করল, একবার যদি লোকটার হাত থেকে রিভলবারটা নিয়ে নেয়া যায় অথবা ফেলে দেয়া যায়, তাহলে লোকটাকে কাবু করা দাউদ ইব্রাহিমের জন্যে মোটেই কঠিন হবে না।
দাউদ ইব্রাহিমের হাতে ছিল আমেরিকা টুডে কাগজের একটা পাতা। এ বিশেষ পাতাটি আজকের আমেরিকা টুডে থেকে ছিঁড়ে নিয়েছিল পড়ার জন্যে। সে বসে বসে ভাবছিল আর মাঝে মাঝে এই কাগজটাই পড়ছিল।
লোকটির রিভলবারের নলের ঠেলা খেয়ে সামনে চলছিল, আর হাতের কাগজটিই টুকরো করছিল দাউদ ইব্রাহিম। ভীত, নিরীহ আজ্ঞাবহ মানুষের মত চলছিল দাউদ ইব্রাহিম এবং মাঝে মাঝে আবেদন করছিল তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে। এক বুড়ো বাপ, আর এক ছোট বোন ছাড়া তার কেউ নেই, একথাও সে বলছিল।
চলা শুরু হলে ভীত, নিরীহ দাউদ ইব্রাহিমের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে লোকটি রিভলবার নামিয়ে নিয়েছিল তার মাথা থেকে।
অনেকটা নেমে পাহাড়ের গোড়ায় তিন দিকে টিলা ঘেরা একটা স্বল্প পরিসর জায়গায় নিয়ে এল দাউদ ইব্রাহিমকে।
দাউদ ইব্রাহিমকে একটা পাথরের উপর বসিয়ে পাশেই আরেকটা উঁচু পাথরের উপর দাঁড়িয়ে লোকটি দাউদ ইব্রাহিমকে লক্ষ্য করে বলল, চুপচাপ বসে থাক এবং ঈশ্বরকে ডাক। তোমার ব্যাপারে কি নির্দেশ হয় জেনে নিচ্ছি এখনি।
বলে লোকটি বাম হাতে রিভলবার নিয়ে ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে মাউথ অরগ্যান-এর মত ছোট্ট একটা জিনিস বের করল।
কি ব্যাপার এখন তুমি মাউথ অরগ্যান বাজাবে? এই না বললে আমার ব্যাপারে কি নির্দেশ আসে তা জানবে। অথচ মোবাইলের বদলে দেখছি মাউথ অরগ্যান বের করছ। ভাই আমাকে ছাড়ার ব্যবস্থা কর। বলল দাউদ ইব্রাহিম অনুনয়ের সুরে।
এখানে সব মোবাইল, টেলিফোন অচল। আমি তো কথা বলার জন্যেই এটা বের করছি। এটা মাউথ অরগ্যানের মত বাজানো যায়, কিন্তু আসলে এটা ম্যাগনেটিক পাওয়ার পরিচালিত বিশেষ ধরনের অয়্যারলেস। বলে লোকটি মাউথ অরগ্যানের তলায় বিশেষ জায়গায় একটা চাপ দিল। সংগে সংগেই মাউথ অরগ্যানটি বিপ বিপ শব্দ করে উঠল। তার সাথে দেখা গেল সবুজ আলোর ফ্লাশ।
লোকটি তার বাম হাতের রিভলবারটি দাউদ ইব্রাহিমের দিকে তাক করে বলল, হ্যালো, মাই লর্ড। আমি ডেথ ভ্যালির দক্ষিণ গোড়া এলাকা থেকে ডেভিড বলছি।
ইয়েস গো-অন। অয়্যারলেসে ওপার থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠল।
ধন্যবাদ মাই লর্ড। ডেথ ভ্যালির এপাশে সন্দেহজনকভাবে ঘুরতে দেখে একজন লোককে আমি আটক করেছি। সে বলছে, পাশের গ্রামে তার বাড়ি। তার একজন লোককে খুঁজতে এদিকে এসেছে সে। চেহারায় ও পোশাকে মেষপালকের মত মনে হচ্ছে। তার ব্যাপারে কি নির্দেশ মাই লর্ড? বলল এ পাশ থেকে লোকটি।
তার নাম কি? ওপারের কণ্ঠ বলল। প্রশ্ন শুনেই লোকটি তাকাল দাউদ ইব্রাহিমের দিকে।
বুঝল দাউদ ইব্রাহিম। বলল, ডেভিড আব্রাহাম।
লোকটি দাউদ ইব্রাহিমের নাম জানাল। শুনে ওপার থেকে বলল, তুমি নিশ্চয় একজন ভুল লোককে ধরেছ। এ সময় এটা ঠিক হয়নি। যখন ধরেছই, তখন আর কিছু করার নেই। ও বেঁচে থাকলে আমাদের ক্ষতি। অতএব যা করার তাই করো। তবে লাশটা যেন কারও চোখে না পড়ে, পুলিশ যেন খুঁজে না পায়। আর শোন, সবার উপর নির্দেশ হলো, ডেথ ভ্যালি এলাকায় ধরাধরি, খুনোখুনি সব বন্ধ করা হয়েছে। আমরা চাই না পুলিশ বা গোয়েন্দাদের নজর এদিকে পড়ুক। ডেথ ভ্যালির বাইরে পাহাড়ে দুচারজন মানুষ সব সময় দেখা গেছে, এখনও দেখা যেতে পারে। এগুলো আমরা এখন এড়িয়ে চলব। ছোটখাট কাজে হাত দিয়ে বড় কাজের আমরা কোন ক্ষতি করতে চাই না। মনে রেখ। ও.কে.। বাই।
ও.কে. মাই লর্ড।
বলে লোকটি অয়্যারলেস বন্ধ করে পকেটে রাখছিল। তার দৃষ্টি দাউদ ইব্রাহিম থেকে সরে গিয়েছিল। রিভলবার ধরা বাম হাতটাও তার অনেকখানি নিচে নেমে গিয়েছিল।
দাউদ ইব্রাহিম এই সুযোগ হাতছাড়া করল না। তার ব্যাপারে নির্দেশ তারও কানে এসেছে। তাকে হত্যা করার হুকুম এসেছে ওপার থেকে।
দাউদ ইব্রাহিম লোকটির রিভলবার ধরা হাতে আঘাত করল ডান হাত দিয়ে। সংগে সংগে রিভলবারটা তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল।
দাউদ ইব্রাহিম রিভলবারের পরিণতি দেখার অপেক্ষা না করে লোকটির হাতে আঘাত করেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
এতে ভালো ফল হলো। লোকটি একদম অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল। একদিকে হাত থেকে রিভলবার পড়ে যাওয়া, অন্যদিকে সংগে সংগেই আক্রান্ত হওয়ায় সে প্রতিরোধ গড়বার কোনই সুযোগ পায়নি।
দাউদ ইব্রাহিম লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে দুজনেই পাথরের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ল নিচে।
নিচে পড়েই দাউদ ইব্রাহিম লোকটিকে জাপটে ধরে তার পিঠের উপর উঠে বসল এবং পাশ থেকে একটা পাথর নিয়ে লোকটির মাথায় আঘাত করল। এর সাথে সাথেই লোকটির দুই হাত টেনে এনে পিছমোড়া করে ধরল। তারপর গা থেকে জামা খুলে ছিঁড়ে বেঁধে ফেলল লোকটির দুহাত।
মাথার আঘাতটা বেশ জোরেই হয়েছিল। সংগে সংগেই ঝিমিয়ে পড়ল লোকটি। রক্ত বেরুচ্ছে আহত জায়গা থেকে। এই কারণেই পিছমোড়া করে বাঁধা দাউদ ইব্রাহিমের জন্য খুব কঠিন হয়নি।
ছিড়ে ফেলা জামার আরেকটি অংশ দিয়ে লোকটির দুই পা বেঁধে ফেলল দাউদ ইব্রাহিম। ঘটনা অসম্ভব রকম দ্রুত ঘটে গেল।
দাউদ ইব্রাহিম শরীর-স্বাস্থ্যে লোকটির চেয়ে ভালো এবং আহমদ মুসার সাথে কয়েকদিন থেকে সাহসও বেড়েছে তার। তার উপর ছিল জীবন বাঁচানোর দায় এবং আহমদ মুসার সাথে তার দেখা হওয়ার তাকিদ। লোকটির হাত-পা বাঁধার পর উঠে দাঁড়াল দাউদ ইব্রাহিম। এরপর প্রথমেই সে ভাবল, তাকে তার জায়গায় ফিরে যাওয়া দরকার। আহমদ মুসা এসে তাকে খুঁজবে এবং না পেলে চিন্তায় পড়ে যাবে। হয়তো তাকে খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট হবে। কিন্তু যাবে কি করে? লোকটিকে এখন সে কি করবে? তার মনে হলো, এই লোকটি সম্পর্কে আহমদ মুসার জানা দরকার। শত্রুপক্ষের এই লোকটি তার কাজেও লাগতে পারে। লোকটিকে কাঁধে করে কিংবা রিভলবারের ভয় দেখিয়ে তাকে যে সেখানে নিয়ে যাবে, এটাও সম্ভব নয়। কেউ কিংবা অনেকেই দেখে ফেলতে পারে এবং ঘটতেও পারে নতুন বিপদ। ইত্যাদি ভাবনায় যখন দাউদ ইব্রাহিম ঘোর অনিশ্চয়তায়, তখন সে আবার মাথার পেছনের দিকটায় রিভলবারের নলের মত ধাতব কিছুর চাপ অনুভব করল।
সংগে সংগেই তড়াক করে ঘুরে দাঁড়াল দাউদ ইব্রাহিম। দেখল, আহমদ মুসা হাসছে।
আহমদ মুসা বলল, তোমাকে না দেখে আমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। যাক অল্পতেই তোমাকে পেয়ে গেছি।
কিন্তু জানলেন কি করে যে আমি এখানে? এলেন কিভাবে ঠিকঠাক মত? বলল দাউদ ইব্রাহিম।
তুমিই তো আমাকে নিয়ে এসেছ। আহমদ মুসা বলল।
কিভাবে? বলল দাউদ ইব্রাহিম। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
তুমি যে কাগজের টুকরো ফেলতে ফেলতে এসেছ ওখান থেকে, সেটা অনুসরণ করেই ঠিকঠাক আমি এখানে পৌঁছে গেছি।
আমি একটা গোয়েন্দা বইতে এই কৌশলের কথা পড়েছিলাম। কিন্তু আমি ভাবিনি যে, এটা কাজে লাগবে। ধন্যবাদ স্যার। বলল দাউদ ইব্রাহিম।
ধন্যবাদ তো আমি তোমাকে দেব এই বুদ্ধি কাজে লাগানোর জন্যে। আচ্ছা যাক, এই যে লোকটাকে বেঁধে ফেলে রেখেছ এই-ই তো তোমাকে ধরে আনে রিভলবারের ভয় দেখিয়ে। তাই তো? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
আপনি ঠিক ধরেছেন স্যার। মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে সে-ই আমাকে এ পর্যন্ত আসতে বাধ্য করে। বলল দাউদ ইব্রাহিম।
তারপর? একে কুপোকাত করলে কিভাবে? আহমদ মুসা বলল।
ঘটনা সংক্ষেপে আহমদ মুসাকে জানিয়ে বলল, আমার ব্যাপারে নির্দেশের জন্য লোকটা একটা টেলিফোন করেছিল। টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে তাদের বসের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। একদিকে এই মৃত্যু থেকে বাঁচা এবং আপনার কাছে পৌঁছা এই দুই ইচ্ছা আমাকে এমন শক্তি যুগিয়েছিল, যার চিন্তা আমি নিজেও কোন দিন করিনি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলছ কেন? এদের পরিচয় সম্পর্কে তুমি কি জেনেছ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
এ আপনাদের মানে আমাদের শত্রুপক্ষের লোক, টেলিফোন থেকে এটা আমি বুঝেছি। টেলিফোনের ওপার থেকে ওরা আমাকে ঐ অঞ্চল থেকে ধরে আনা পছন্দ করেনি। তারা এ এলাকায় এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটতে দিতে চায় না, যাতে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের চোখ এই এলাকার উপর পড়ে। আমি তাদের এ মনোভাবকেই অনিচ্ছাকৃত বলেছি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এ কারণে যে, ধরার পর তারা আমাকে ছেড়ে দিতে চায়নি। বলল দাউদ ইব্রাহিম।
আহমদ মুসা সংগে সংগে কোন কথা বলল না। এই এলাকায় মানে ডেথ ভ্যালি এলাকায় এ সময় কিছু না ঘটুক তা তারা চাচ্ছে। আসল লক্ষ্য হলো, এ অঞ্চলের উপর পুলিশ ও গোয়েন্দাদের চোখ যেন না পড়ে। কেন? কেন তারা এই নজর পড়াকে ভয় করছে?
প্রশ্নগুলো সামনে আসার সাথে সাথে আহমদ মুসা রিভলবারটা কুড়িয়ে নিয়ে এগোলো বেঁধে রাখা লোকটির দিকে। পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় তাকে চিৎ করে শোয়াল আহমদ মুসা। বাঁধা হাত দুটি বেকায়দা অবস্থায় থাকার কারণেই সম্ভবত যন্ত্রণায় সে ঝাঁকিয়ে উঠল।
সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আহমদ মুসা রিভলবারের নল দিয়ে তার। মাথায় একটা খোঁচা দিয়ে বলল, তুমি এক্ষুণি যার সাথে কথা বললে সেই ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম এখন কোথায়?
লোকটি অবাক হয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কিছু বলল না।
আহমদ মুসা রিভলবার তুলল তার মাথা লক্ষ্যে। বলল, দেখ এক আদেশ আমি দুইবার দেই না।
লোকটির চোখে-মুখে ভীতি ফুটে উঠল। কিন্তু মুখ খুলল না সে।
আহমদ মুসার তর্জনি নড়ে উঠল। চেপে বসল তা ট্রিগারের উপর। রিভলবার থেকে বেরিয়ে গেল একটা গুলি। গুলিটা লোকটার কানের উপরে মাথার চামড়ার একটা অংশ তুলে নিয়ে চলে গেল।
লোকটা চিৎকার করে উঠল।
আহমদ মুসা তার রিভলবার লোকটার মাথায় চেপে রেখেই বলল, ঠিক ঠিক জবাব না দিলে দ্বিতীয় গুলি তোমার মাথা গুঁড়িয়ে দেবে।
আমি জানি না, এই মুহূর্তে কোথায়। তবে গতকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত ছিল ডেথ ভ্যালিতে। বলল সে যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে।
আহমদ মুসা এই তথ্যটা শুনে রোমাঞ্চিত হলো। তবু বলল, ডেথ ভ্যালিতে কেন? ওখানে কোথায় আসবে, কিভাবে আসবে?
ডেথ ভ্যালি তো ওদের ঘাঁটি। ওদের সব অস্ত্র তো এখানেই মোতায়েন। ওখানে কিভাবে প্রবেশ করে তা আমি জানি না। তবে এটুকু জানি ঢোকার সহজ পথ তারা তৈরি করেছে। বলল লোকটি।
আহমদ মুসা চাওয়ার চেয়ে বেশি পেয়ে গেল। ডেথ ভ্যালিতে যে। ওদের অস্ত্রাগার বা ঘাঁটি আছে, এটা ছিল বিভিন্ন কার্যকারণ থেকে সৃষ্ট তার ধারণা। এখন সে নিশ্চিত হলো।
ওখানে ওদের কি অস্ত্র আছে? এমন একটা মৃত স্থানকে তারা বেছে নিল কেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
তা জানি না স্যার। তবে কয়েকদিন থেকে বলাবলি হচ্ছে যে, আর তিন দিন পর আমেরিকার সব অস্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর আমেরিকা আমাদের হাতে চলে আসবে। বলল লোকটি।
এদের কি সৈন্যবাহিনী আছে নাকি? কিভাবে দেশ দখলে আসবে? প্রশ্ন আহমদ মুসার।
তা আমরাও বুঝিনি স্যার। তবে সৈন্যবাহিনী নেই। কিছু লোকজন আছে।
কত লোকজন আছে? আহমদ মুসা বলল।
সংখ্যা বলতে পারবো না স্যার। তবে সৈন্যবাহিনীর মত অত বেশি নয়। বলল লোকটি।
তারা কোথায় থাকে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
ঘাঁটি ধ্বংস হবার পর তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে, আমি সবকিছু জানি না স্যার। বলল লোকটি।
ডেথ ভ্যালিতে তো লোকজন আছে। কত লোক আছে এখানে? আহমদ মুসা বলল।
বলতে পারবো না স্যার। এ রকম কোন কথা শুনিনি। খুব বেশি লোক থাকার কথা নয়। বলল লোকটি।
কেন একথা বলছ? প্রশ্ন আহমদ মুসার।
আমাদের একজন স্যার একদিন বলেছিলেন, আমরা সংখ্যার চেয়ে দক্ষতাকে বেশি গুরুত্ব দেই। লোকের ভিড় আমরা পছন্দ করি না। আসলেও তাদের কোথাও লোকের ভিড় দেখা যায় না। বলল লোকটি।
ডেথ ভ্যালির বাইরে তো ওদের কোন পাহারা নেই। কেন? আহমদ মুসা বলল।
ডেথ ভ্যালির বাইরে তো আমরাই আছি। তবে উত্তর পাশে কোন পাহারা নেই। বলল লোকটি।
তোমরা কতজন আছ? আর উত্তর পাশে পাহারা নেই কেন? আহমদ মুসা বলল।
আমরা তিনজন ছিলাম, দুজনকে সকালে ডেকে নেয়া হয়েছে শহর থেকে। আমারও বিকেলে চলে যাবার কথা। বলল লোকটি।
কেন এই পাহারার আর দরকার নেই? আহমদ মুসা বলল।
জানি না স্যার। শহরেই নাকি এখন কাজ বেশি। বলল লোকটি।
উত্তর দিকে পাহারা কোন সময়ই ছিল না? আহমদ মুসা বলল।
আগের কথা জানি না স্যার। তবে এখন নেই। আমাদেরও ওদিকে যাবার অনুমতি নেই। ওদিকে মানুষ যায় না বললেই চলে। ওদিকে কেউ পাহারায় থাকলে নাকি বাইরের মানুষের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হবে। মানুষের সন্দেহ এড়ানোর জন্যেই নাকি এই ব্যবস্থা। বলল লোকটি।
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল আহমদ মুসা। মনে মনে বলল, ঘটিটাকে তারা আপনাতেই সুরক্ষিত মনে করছে। নিশ্চয় ঘাঁটিতে ঢুকা ও বের হবার ব্যবস্থা এমনটাই নিচ্ছিদ্র তারা করতে পেরেছে যে বাড়তি পাহারার তাদের প্রয়োজন নেই। আহমদ মুসা মনে মনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এই অবস্থাকেই আল্লাহ তাদের বড় দুর্বলতায় পরিণত করুন।
তুমি যদি না ফের তাহলে ওরা কি করবে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্যার, আমি যেখানেই থাকি ওরা আমাকে লোকেট করতে পারবে। আমাকে খুঁজে বের করবে। বলল লোকটি।
অর্থাৎ তুমি যেখানে থাকবে, ঠিক সেখানে ওরা পৌঁছে যেতে পারবে? আহমদ মুসা বলল।
জি স্যার, তারা সেখানে পৌঁছতে পারবে। বলল লোকটি।
আহমদ মুসার ঠোঁটে অস্ফুট একটা হাসি ফুটে উঠল। আহমদ মুসা দাউদ ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ এর পকেটে কি কি আছে। সব বের কর।
দাউদ ইব্রাহিম বলল, যে রিভলবার আপনার হাতে সেটা লোকটির।
পকেট সার্চ করে একটা মাউথ অরগ্যান, অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার, একটা ছোট মানিব্যাগ পেল।
তোমাদের সবার কাছেই অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার থাকে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার লোকটিকে।
আমাদের সবার কাছেই এই ট্রান্সমিটার থাকে। আমাদের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ। আর মোবাইলে কাজও হয় না। বলল লোকটি।
এখন তোমাকে ছেড়ে দেয়া হলে তুমি কি করবে? আহমদ মুসা বলল।
আমি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই এলাকায় থেকে তারপর চলে যাব বিকেলে। বলল লোকটি।
তুমি তো আমার সাথীকে হত্যা করতে পারলে না। তোমার বস-এর নির্দেশ পালন তো হলো না। আহমদ মুসা বলল।
লোকটি মুহূর্তকাল চুপ থেকে বলল, আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে। বলতে হবে যে, হত্যা করে লোকটিকে নিরাপদ জায়গায় ফেলে দিয়ে এসেছে।
এত কিছু কাণ্ড ঘটল, এ সবকিছুই বলবে না তাদের? আহমদ মুসা বলল।
এসব বলা আর মৃত্যুকে ডেকে আনা এক কথা। বেঁচে থাকার জন্যেই আমাকে এ সবকিছু গোপন করতে হবে।
আহমদ মুসা দাউদ ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে বলল, এর বাঁধন খুলে দাও।
বাঁধন খুলে দিলে লোকটি উঠে দাঁড়াল। তোমার কানের উপরটায় গুলিতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তার কি ব্যাখ্যা দেবে তুমি? আহমদ মুসা বলল।
বলব যে, লোকটিকে ধরার সময় ধস্তাধস্তিতে একটা ধারাল পাথরের ঘষা খেয়ে ছিঁড়ে গেছে কিছুটা জায়গা। বলল লোকটি।
ওকে তার মানিব্যাগ, রিভলবার ও অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার দিয়ে দাও। আহমদ মুসা বলল দাউদ ইব্রাহিমকে লক্ষ্য করে।
দাউদ ইব্রাহিম জিনিসগুলো দিয়ে দিল লোকটির হাতে।
তুমি চলে যাও। তুমি নিরাপদ থাক। গুডবাই। বলল আহমদ মুসা লোকটিকে।
লোকটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, গুলিভর্তি রিভলবার আমাকে দিয়ে দিলেন! এখন যদি আমি গুলি করি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, এক গুলিতে তুমি দুজনকে মারতে পারবে না। একজনকেও মেরে ফেলতে পারবে তাও নিশ্চিত নয়। অতএব শত্রুতার চিন্তা তুমি করবে না।
ধন্যবাদ স্যার। মানুষকে জয় করবার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে আপনার। চলি স্যার। বাই। বলে চলতে শুরু করল লোকটি। লোকটি চলে গেল।
স্যার, লোকটিকে ছেড়ে দিলেন। আমাদের কথা, আমাদের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ের কথা সে যদি বলে দেয়? বলল দাউদ ইব্রাহিম।
ওকে আটকে রাখলে ওরা সন্দেহ করতো যে, নিশ্চয় ডেথ ভ্যালিকে কেন্দ্র করে তাদের প্রতিপক্ষ কিছু করছে। সেক্ষেত্রে ডেথ ভ্যালির বাইরের নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা তৎপর হতো। তাতে আমাদের এগোনোর ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত কঠিন হতো। দ্বিতীয়ত তার উপর সন্দেহ হওয়া থেকে বাঁচার জন্যে যা ঘটেছে, সেসব কিছুই সে কাউকে বলবে না। আহমদ মুসা বলল।
বলেই আহমদ মুসা উঁকি মেরে দেখল, লোকটি কতদূর গেছে। তারপর সে সরে এসে বলল, চল দাউদ ইব্রাহিম এবার যাই।
কোথায়? বলল দাউদ ইব্রাহিম।
চল দেখবে। কাছেই থাকার জন্যে একটা বিশাল বাড়ি পাওয়া গেছে। আহমদ মুসা বলল।
ইব্রাহিম তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, চলুন।
আহমদ মুসা টিলার ঘের থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করল। তার ও দাউদ ইব্রাহিমের পরনে তখনও মেষপালকের পোশাক।
.
সূর্য উঠেছে। কিন্তু ডেথ ভ্যালির কুয়াশাচ্ছন্ন এ ঢালে এখনও সকাল হয়নি। আহমদ মুসা এসে পৌঁছেছে ডেথ ভ্যালির উত্তর পাশের মাঝ বরাবর। আহমদ মুসার মনে তার স্বভাববিরুদ্ধ একটা ঝড়। এইচ থ্রি তাদের আলটিমেটামের চূড়ান্ত সময় ১২ ঘণ্টা পিছিয়ে এনেছে। তারা বলেছে, যেহেতু তাদের শর্তের ব্যাপারে ইতিবাচক কিংবা কোন সাড়াই দেয়া হয়নি। এতে পরিষ্কার যে, তাদের কোন শর্তই মানা হচ্ছে না। সুতরাং তারা সময় পিছিয়ে এনেছে। আহমদ মুসা সন্ধ্যায় দাউদ ইব্রাহিমকে জর্জ আব্রাহামের কাছে পাঠিয়েছিল। জর্জ আব্রাহাম জনসনই তার মাধ্যমে তাদের আলটিমেটামের খবর পিছিয়ে আনার মেসেজ আহমদ মুসার কাছে পাঠিয়ে জানিয়েছে যে, ওরা ওদের চূড়ান্ত সময় পিছিয়ে নেয়ায় তাদের সবার উদ্বেগ বেড়েছে। যদিও চাপ বাড়াবার জন্যে তারা এটা করেছে, কিন্তু আমাদের হাতের সময় কমে গেল। আহমদ মুসাকে শেষ সময়ের দিকে খেয়াল রাখার জন্য অনুরোধ জানিয়ে ইনভেলাপে বন্ধ করা একটা ছোট চিঠিতে জানিয়েছে, অসহায় বিকল্প হিসেবে শক্রকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা হিসেবে আমরা স্থির করেছি, আলটিমেটামের শেষ ৫ মিনিট আগে ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ (MDw) আমরা ফায়ার করবো। এতে আমাদের সব অস্ত্র ও ধ্বংস হয়ে যাবে বটে, কিন্তু শত্রুকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া সম্ভব হবে। উদ্বেগের বিষয় যে, কোনওভাবে যদি আমাদের প্রতিপক্ষ দেশ এটা জানতে পারে, তাহলে তাদের কাছে আমাদের অসহায় আত্মসমর্পণের কোন বিকল্প থাকবে না। আরও ক্ষতি হবে, সেটা হলো সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। এই ভয়াবহ সব ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র আহমদ মুসার চেষ্টা ও সাফল্য। চরম উদ্বিগ্ন প্রেসিডেন্টসহ আমরা সকলে। তোমার সাফল্য কামনা করছি আমরা।
জর্জ আব্রাহামের কাছ থেকে এই সব খবর পাওয়ার পর আহমদ মুসার মনে যে ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিল, সে ঝড়ের নিবৃত্তি এখনও হয়নি। নিজের বা বিশেষ কয়েকজনের ক্ষতির বিষয় হলে কোন কথা ছিল না। যে ক্ষতির সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, সে ক্ষতি আমেরিকার মত একটা দেশের শক্তি-সামর্থ্য ও নিরাপত্তা, এমনকি স্বাধীনতার ক্ষতি। এই ক্ষতি হওয়া না হওয়া তার অভিযানের সফলতা ও ব্যর্থতার উপর নির্ভর করছে। এই অনুভূতিই তার মনকে কিছুটা অস্থির করে তুলেছে।
আহমদ মুসা ডেথ ভ্যালির উত্তর পাশের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছে। সে উপর দিকে ওক গাছের রংধনুর দিকে তাকাল। রংধনুর মাঝামাঝি শীর্ষপয়েন্ট ঠিক করে তার বরাবর নিচে সরে এল আহমদ মুসা।
কুয়াশার উপর সূর্যের আলোর রিফ্লেকশনে একটা সফেদ আলো ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে আছে একটা পাথরের উপর। ওক গাছের যে রংধনু সে দেখেছিল তার মধ্যবর্তী শীর্ষ বিন্দুর ঠিক নিচ বরাবরই সে। দাঁড়িয়ে আছে।
উপর দিকে তাকাল আহমদ মুসা। সেই শীর্ষপয়েন্টটার দিকে। তার কপালটা ভাবনায় কুঞ্চিত। তার মনে ভাবনায় স্রোত। বৃত্তাকার বা অর্ধবৃত্তাকার কাঠামোর শীর্ষপয়েন্টে ঝুলে থাকে ঘণ্টা। ঘণ্টার ভেতরে থাকে ঘণ্টা বাজানোর ঝুলন্ত দণ্ড। তাকে বলা হয়েছে টাংগ অব বেল। ওক গাছের রংধনু আকারে অর্ধবৃত্তাকার কাঠামো পাওয়া গেছে। এখন পাওয়া দরকার ঘণ্টা এবং ঘণ্টাদণ্ড (টাংগ অব বেল)। কিভাবে পাওয়া যাবে? ওক গাছের আড়ালে আছে রংধনু, ঘণ্টা ও ঘণ্টাদণ্ড আছে কিসের আড়ালে? আশার কথা, ঘণ্টা পেলে তার সাথে ঘণ্টাদণ্ডও পাওয়া যাবে। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে এই ঘণ্টা? ঘণ্টা সব সময় থাকে অর্ধবৃত্তাকার কাঠামোর শীর্ষপয়েন্টের কাছে, ঠিক নিচেই।
বিসমিল্লাহ বলে আহমদ মুসা অর্ধবৃত্তাকার ওক সারির মধ্যবর্তী শীর্ষপয়েন্ট লক্ষ্যে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠা শুরু করল।
পাহাড়ের এ পাশের গাছগুলো ঘন নয়, বেশ পাতলা, বেশ স্পেস নিয়ে এক একটি গাছ আছে। ওক গাছের রংধনুর মধ্যবর্তী শীর্ষপয়েন্টে একটা চিহ্ন করেছিল আহমদ মুসা, সেই চিহ্ন সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে আহমদ মুসা।
পাহাড় বেয়ে উঠতে গিয়ে আহমদ মুসা দেখল, মাঝে মাঝেই পাথরের ফাঁদ। আলগা পাথরকে এমনভাবে পাহাড়ের গায়ে সেট করা আছে। দেখলে মনে হবে এগুলো পাহাড়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু পা রাখলেই পাথরের সাথে গড়িয়ে পড়তে হবে গড়গড় করে। এরকম দুএকটা পাথরে হাত রেখে সাবধান হয়ে গেল আহমদ মুসা। যাচাই না করে কোন পাথরে আর পা রাখছে না আহমদ মুসা। কিন্তু তাতে অসুবিধা হচ্ছে না। উঠতে। মনে হচ্ছে কেউ যেন উঠার পথটাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছে। পাহাড়ে উঠা এমন সহজ ও সুশৃঙ্খল হতে পারে না। আহমদ মুসার মন কিসের সন্ধানে যেন উন্মুখ হয়ে উঠল। হঠাৎ একটা পাথরের পাশে গুটলি পাকানো গুঁড়া জাতীয় কিছু দেখে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। নিচু হয়ে একটা গুটলি তুলে নিল আহমদ মুসা। গুটলিটার উপর চাপ দিতে গিয়ে বিস্মিত হলো এজন্য যে, এটা ছিল সিমেন্ট-বালির। মিশ্রণ। এই সিমেন্ট-বালির মিশ্রণ এখানে কি করে এল? পাথরের পাশটায় বসে পড়ল আহমদ মুসা। বসে মাথা নিচু করে পাথরটার নিচে উঁকি দিল সে। পাথরটার নিচে আরও বালি-সিমেন্ট দেখতে পেল। ভালো করে পাথরের তলাটা দেখতে গিয়ে আবারও বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। পাথরটা সিমেন্টের প্লাস্টার দিয়ে পাহাড়ের গায়ের সাথে আটকানো।
বিস্ময়ে হা হয়ে গেল আহমদ মুসার মুখ। পাথর সিমেন্ট দিয়ে আটকানো! তার মানে এটা ম্যান-মেড একটা ট্রাক। পেছনে যে পাথরগুলো উপরে উঠাকে সুবিধাজনক করেছে সেগুলো সবই তাহলে। এভাবে সেট করা, সিমেন্ট দিয়ে আটকানো? আহমদ মুসা কয়েক ফুট সামনে এই একই ট্রাকে আরেকটা পাথর দেখতে পেল এভাবে সেট করা। আহমদ মুসা লাফ দিয়ে উঠে গেল সেখানে। দেখল পাথরের তলাটা ঠিক ঐভাবে সিমেন্ট দিয়ে আটকানো।
খুশি হলো আহমদ মুসা। শুকরিয়া আদায় করল আল্লাহর। নিশ্চিত যে, এই পথেই ওরা ডেথ ভ্যালিতে যাতায়াত করে। যাতায়াতের জন্য। এই ট্রাকটাতে সহজ। কারণ এই পথে ডেথ ভ্যালিতে ঘাঁটি তৈরির জন্যে নানা ওজনের, নানা আকারের জিনিস আনতে হয়েছে। নিশ্চিন্ত হলো আহমদ মুসা যে, এই ট্রাকই তাকে লক্ষ্যে নিয়ে যাবে।
আবার চলতে শুরু করল আহমদ মুসা। চলার গতি এবার দ্রুত হলো।
আহমদ মুসা পৌঁছে গেল ওক গাছের সেই রংধনুর মধ্যবর্তী যে গাছকে চিহ্ন ধরে আহমদ মুসা উঠে আসছিল, সে গাছের দশ বারো ফুটের মধ্যে। জায়গাটায় সমতল একটা বড় পাথর। পাথরটির উপর দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা।
সকালের কুয়াশা এখানে নেই। সূর্য দেখতে পাওয়ার প্রশ্ন নেই, কিন্তু দিনের আলোয় ঝলমল করছে চারদিকটা।
আহমদ মুসা উপর দিকে চোখ তুলল। পাহাড়ের গা বেয়ে তার চোখ দুটি উঠতে লাগল ওক গাছের অর্ধবৃত্তাকার রংধনুর মধ্যপয়েন্টের দিকে।
সামনেই একটা বড় পাথরের উপর চোখ দুটি আটকে গেল আহমদ মুসার। এবড়োথেবড়ো গায়ের পাথরটি পাঁচ ফিট লম্বা চার ফিট প্রস্থের হবে। পাথরটির আকৃতি ঠিক ঘণ্টা বা বেলের মতই।
হঠাৎ পাওয়ার আনন্দ তাকে এতটাই ঝকানি দিল যে সে মুহূর্ত খানেকের জন্যে বাকহীন হয়ে গেল। এটাই কি সেই ঘণ্টা? এর অবস্থান। অর্ধবৃত্তাকার ওক রংধনুর শীর্ষপয়েন্টের ঠিক নিচেই। পাথরটিকে যদি চেন দিয়ে বেলের মত করে টাঙানো হয়, তাহলে চেন গিয়ে শীর্ষপয়েন্টটিতেই বাঁধা পড়বে।
আহমদ মুসা আরও একটু ঘনিষ্ঠ হলো পাথরটির। এটাই যদি ঘণ্টা হয়, তাহলে ঘণ্টাদণ্ডটা কোথায়?
পাথরের এবড়োথেবড়ো গাটা আরও ভালোভাবে দেখতে লাগল। আহমদ মুসা। পাথরটির উপরের দিকের মাথাটা একটা কয়েনের মত গোলাকার! এই গোলাকার একটা জায়গার উপর আহমদ মুসার চোখ দুটি আটকে গেল। পাথরটির গায়ে সামান্য উঁচু হয়ে থাকা গোলাকার জায়গার উপরটা মোটামুটি মসৃণ। সেখানে ক্ষুদ্রাকৃতির ইংরেজি কয়েকটা সংখ্যা পাথুরে রঙের কালিতে লেখা। সংখ্যাগুলো এক, সেভেন, এক এবং সেভেন। সংখ্যাগুলোর একসংগে মান দাঁড়াল এক হাজার সাতশ সতের বা সতেরশ সতের। সংখ্যাগুলোর তাৎপর্য কি? সংখ্যা সমন্বিত মান-এর কোন অর্থ আছে কি? সতেরশ সতের কি সালের নাম? এই সালের কোন ঘটনার প্রতি কি ইংগিত করা হয়েছে? কিন্তু এই সালের কোন ঘটনার কথা তার মনে পড়ছে না। কিংবা এই সংখ্যাগুলোর কোন আলাদা আলাদা অর্থ আছে কি নাঁ। বিচ্ছিন্নভাবে কিংবা সমন্বিতভাবে সংখ্যাগুলোর কোন অর্থ খুঁজে সে পেল না। তাহলে এ সংখ্যাগুলো কেন? একটু ভাবতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসার মনে ঝড়ের মত প্রবেশ করল একটা চিন্তা। আগের পাথরে লেখা ছিল হিব্রু ভাষায়, এ পাথরে ইংরেজি কেন? আহমদ মুসা আবার তাকাল পাথরের সংখ্যাগুলোর দিকে। সংখ্যাগুলোর উপর আর একবার নজর বুলাতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার। তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, ওগুলো যেমন, ইংরেজি সংখ্যা হতে পারে, তেমনি হতে পারে হিব্রু চারটি বর্ণ। হিব্রু এই চারটি বর্ণ মিলে যে হিব্রু শব্দ হয়, সে শব্দ হলো কেরেন। হিব্রু কেরেন শব্দ মনে আসতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। এমন শব্দের সংকেতই তো খুঁজছে সে। হিব্রু কেরেন শব্দের অর্থ আলোর কিরণ। এই আশার আলোকেই আহমদ মুসা খুঁজছে।
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল আহমদ মুসার বুক থেকে। তাহলে ঘণ্টার ঘণ্টাদণ্ড পাথরের এই ক্ষুদ্র নবটাই, ভাবল আহমদ মুসা। এই নবটার কোন ফাংশন আছে? এটাই যদি ঘণ্টাদণ্ড হয়, তাহলে তো এর ফাংশন থাকতেই হবে। কি সেটা?
আহমদ মুসা পাথরটার আরও ঘনিষ্ঠ হলো। হাত দিয়ে নবটা স্পর্শ করল। পাথরটির ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আহমদ মুসা দেখল, পাথরের গা এবড়োথেবড়ো বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে পাথরের যে মসৃণ গা দেখা যাচ্ছে, সেটার মসৃণতা পাথরের মত নয়, কেমন যেন রঙের প্রলেপের মত দেখতে। বিস্মিত আহমদ মুসা পাথরের একটা মসৃণ জায়গায় আঙুল দিয়ে টোকা দিল জোরে। তাতে যে শব্দ উঠল তা পাথরের ভারি ও সলিড শব্দ নয়, শব্দটা হালকা, এবং খুব সংক্ষিপ্ত হলেও সুরের স্পন্দন রয়েছে তাতে। সংগে সংগেই আহমদ মুসা বুঝল, এটা পাথর নয় স্টিল। স্টিলের উপর পাথুরে রং করা হয়েছে এবং এবড়োথেবড়ো পাথর বসিয়ে স্টিলকে পাথরের রূপ দেয়া হয়েছে।
রোমাঞ্চ দিয়ে উঠল আহমদ মুসার শরীর। এটাই তাহলে ডেথ ভ্যালিতে ঢোকার দরজা। দরজাটাকে সফলভাবে ক্যামোফ্লেজ করা হয়েছে। একেবারে হাত দিয়ে টোকা না দিলে বোঝার উপায় নেই যে, এটা পাহাড়ের গায়ের নিরেট পাথর ছাড়া অন্য কিছু।
দরজা পাওয়ার পর আহমদ মুসার মন তৎপর হয়ে উঠল দরজা কিভাবে ভোলা যাবে সে চিন্তায়। সে ভাবল নবটাকে যদি ঘণ্টাধ্বনি বলা হয়, তাহলে এটাই হবে দরজা খোলার চাবিকাঠি। আর নবের উপর লেখা আলোর কিরণ শব্দ দুটি এরই ইংগিত দিচ্ছে।
নবে চাপ দিল আহমদ মুসা। নব শক্ত, একটুও নড়চড় নেই। এবার আহমদ মুসা নবটাকে আস্তে আস্তে টানতে শুরু করল।
এবার নব নড়ল। উঠে এল ইঞ্চিখানেক। সংগে সংগে দরজা নড়ে উঠল। দরজার উপরের দিকটা আস্তে আস্তে আলগা হয়ে নামতে শুরু করল।
দরজা খুলছে। মেঝের দিকে নেমে যাচ্ছে। তার মাঝে ভেতরে ফাঁকা? সেটা কি সুড়ঙ্গ কিংবা সিঁড়ি হতে পারে? না কোন কক্ষ?
সাবধান হলো আহমদ মুসা। প্রহরীও থাকতে পারে।
আহমদ মুসা পাশে সরে দাঁড়াল, যাতে এই মুহূর্তে দরজা খুলে যাবার আগেই কারও নজরে না পড়ে যায়।
.
৫.
মোবাইলে জর্জ আব্রাহাম জনসনের কণ্ঠ পেয়েই চমকে উঠল সারা জেফারসন। বলল, গুড মর্নিং। সব খবর ভালো তো আংকেল?
গুড মর্নিং। আমি তোমাদের গেটে। আমি আসতে চাই। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
বুকটা কেঁপে উঠল সারা জেফারসনের। আংকেল এই সাত সকালে আমাদের গেটে? কি ঘটেছে যে, আগে টেলিফোন করারও সময় হয়নি? অনেকটা কম্পিত কণ্ঠেই সারা জেফারসন বলল, আমি আসছি আংকেল। বলে মোবাইল রেখে ছুটল সারা জেফারসন গেটের দিকে।
এ সময় মারিয়া জোসেফাইনও সেখানে হাজির।
সারাকে ছুটতে দেখে বলল, কি ব্যাপার সারা? কি হয়েছে? ছুটে কোথায় যাচ্ছ?
সারা জেফারসন মুখ পেছন ফিরিয়ে বলল, জর্জ আংকেল গেটে। ওকে নিয়ে আমি আসছি।
জর্জ আংকেল মানে জর্জ আব্রাহাম জনসন গেটে? তিনি এসেছেন? খবর তো দেননি? হঠাৎ কি ঘটল। বুকটা কেঁপে উঠল জোসেফাইনের। মনে মনেই সে বলল, লা হাওলা ওয়া লা-কুয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আর কোন আশ্রয় ও শক্তি নেই।
জোসেফাইনও এক পা দুপা করে সামনে এগোতে লাগল।
জর্জ আব্রাহাম জনসনকে সাথে করে নিয়ে আসছে সারা জেফারসন। আস্সালামু আলাইকুম। সালাম দিল জোসেফাইন জর্জ আব্রাহামকে।
ওয়াআলাইকুম। মা কেমন আছ? অনেকখানি বিমর্ষ লাগছে তোমাকে। আব্রাহাম জনসন বলল।
হাসার চেষ্টা করে জোসেফাইন বলল, না, তেমন কিছু নয় আংকেল। আপনি আসুন।
হ্যাঁ আংকেল তেমন কিছু নয়। তবে কিছু তো বটেই। আপনাকে কাছে পেলেই কিছু প্রশ্ন তো মনে জাগেই। বলল সারা জেফারসন।
জর্জ আব্রাহাম লাউঞ্জে একটা সোফায় বসতে বসতে বলল, ঠিকই বলেছ সারা। আমি দুঃখিত। তোমরা অনেক কষ্ট পাচ্ছ। জর্জ আব্রাহামের গম্ভীর কণ্ঠ।
না আংকেল, কষ্ট নয়। এক ধরনের টেনসন বলতে পারেন। বলল সারা জেফারসন।
আমি প্রেসিডেন্টের কাছে যাচ্ছি এ পথ হয়ে। তাই আসলাম তোমাদের সাথে কথা বলব বলে। টেলিফোনে তো সব কথা বলা যায় না।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, তোমাদেরও দোয়া চাই আমরা। সকলেরই সম্মিলিত প্রার্থনা দরকার।
মনে মনে চমকে উঠল জোসেফাইন ও সারা জেফারসন দুজনেই। কি ঘটেছে? বড় কিছু ঘটেছে কি? মনে মনে অস্থির হয়ে উঠল দুজনেই।
জর্জ আব্রাহাম জনসনই আবার কথা বলে উঠল, আজকেই আহমদ মুসার ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের কথা। আমি খবর পেয়েছি, আহমদ মুসা ফজরের নামাজের পর একটু রেস্ট নিয়েই ডেথ ভ্যালির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। আমরা…।
মাফ করবেন আংকেল, উনি কি শেষ পর্যন্ত একাই ঢুকছেন ডেথ ভ্যালিতে? জর্জ আব্রাহাম জনসনের কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল সারা জেফারসন।
হ্যাঁ মা। আহমদ মুসার সিদ্ধান্ত আমরাও মেনে নিয়েছি। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
ডেথ ভ্যালিতে ঢোকার পথ কি পাওয়া গেছে আংকেল? জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
না মা, পাওয়া যায়নি। তবে ডেথ ভ্যালির উত্তর-পাহাড়ের গায়ে লুকায়িত একটা পাথরে হিব্রু বর্ণমালায় কয়েকটা সংকেত পেয়েছে। সে সংকেত থেকে কিছু স্থান সে চিহ্নিত করেছে। তার ধারণা পথ সে পেয়ে যাবে। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল। এ কথা শেষ করে নড়ে চড়ে বসে আবার শুরু করল, আমরা খুব দুর্ভাবনায় আছি মা। একদিকে আহমদ মুসার নিরাপত্তার চিন্তা, অন্যদিকে ওদের আলটিমেটামের সময় শেষ হচ্ছে আজ দুপুর ১২টায়। এই সময়ের মধ্যে ওদের গোপন অস্ত্রটি ধ্বংস করতে না পারলে আমেরিকায়। প্রলয়কাণ্ড ঘটে যাবে। আর আমরা যদি এ থেকে বাঁচার জন্যে শেষ কাউন্টার অফেনসিভে যাই, তাহলে আর এক ধরনের প্রলয় ঘটবে, বিপর্যয় আসবে দেশের রাজনীতিতে। অবশ্যম্ভাবী এই দুই প্রলয় থেকে বাঁচার জন্যে আমরা নির্ভর করছি আহমদ মুসার সাফল্যের উপর। থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আহমদ মুসাকে সাহায্যের কোন ব্যবস্থা আপনারা রেখেছেন কি না। বলল জোসেফাইন।
আমাদের কমান্ডো বাহিনী ওখানে ল্যান্ড করার জন্য হেলিকপ্টার নিয়ে প্রস্তুত আছে। আহমদ মুসা সংকেত পাঠাবার পর তারা অ্যাকশনে যাবে। আহমদ মুসা ওদিকটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর সংকেত পাঠাবে। আমরা তারই অপেক্ষা করব। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
আর উনি যদি সংকেত না পাঠাতে পারেন? বলল জোসেফাইন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
অমন পরিস্থিতি যেন আল্লাহ না দেন। আমরা আশা করছি, সে সংকেত পাঠাতে পারবে। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
আমিন। বলল জোসেফাইন ও সারা জেফারসন দুজনেই।
আমিন বলল জর্জ আব্রাহাম জনসনও। সাথে সাথেই জর্জ আব্রাহাম। জনসন আবার বলে উঠল, এই দোয়াই চাইতে এসেছি তোমাদের কাছে।
হ্যাঁ আংকেল, যে ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা আপনি বললেন, তা আমরা জানতাম না। তবু আমরা দোয়া করছি আহমদ মুসার জন্যে, দেশের জন্যেও। আল্লাহ রাব্বল আলামিন আহমদ মুসাকে নিরাপদ করুন, তাকে সফল করুন এবং দেশকেও আল্লাহ নিরাপদ রাখুন। বলল জোসেফাইন।
আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ মা তোমাদের।
বলে একটু থামল। আবার বলল, যখন যে খবর পাই, সংগে সংগে তোমাদেরও জানাবো আমি। আহমদ মুসার পকেটে ট্রান্সমিটার চিপস আছে। ভেতরের কথা ও শব্দ জাতীয় বিষয় অব্যাহতভাবে আমরা জানতে পারবো।
ধন্যবাদ আংকেল। আমরা উদ্বেগে থাকব। আপনার কাছ থেকে খবর পেলে আমরা খুশি হবো। বলল সারা জেফারসন।
অনুমতি দাও মা, আমি উঠি। প্রেসিডেন্টের কাছে আটটার মধ্যে আমাকে পৌঁছতে হবে।
বলতে বলতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জোসেফাইন ও সারা জেফারসন এগিয়ে দিল জর্জ আব্রাহাম জনসনকে গেট পর্যন্ত।
গাড়িতে উঠতে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম জনসন। জোসেফাইনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার জানা মতে এত বড়, এত গুরুত্বপূর্ণ, এতটা বিপজ্জনক, এতটা দায়িত্বপূর্ণ, এতটা প্রয়োজনীয় কোন অভিযানে আহমদ মুসা এভাবে যায়নি। আচ্ছা মা বলতো, আহমদ মুসার এই অভিযান সম্পর্কে তুমি কি ভাবছ?
সংগে সংগেই সারা জেফারসন বলল, এ পরিস্থিতিতে যা করা দরকার তিনি তাই করছেন। আল্লাহর প্রতি তাঁর অসীম ভরসা। আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করবেন।
ধন্যবাদ মা, এই কথাই আমি শুনতে চেয়েছিলাম। আজ এই পরিস্থিতিতে স্বস্তি, শক্তি ও আস্থার অবলম্বন এই একটাই। আসি মা। তোমরা ভালো থেক।
গাড়িতে উঠল জর্জ আব্রাহাম জনসন। সকাল ৮টা ১৫ মিনিট।
প্রেসিডেন্ট ভবনের সিচুয়েশন কক্ষে সংকটকালীন কমিটির বৈঠক। এ বৈঠকে নিয়মিত সদস্য ছাড়াও কংগ্রেস ও সিনেটের সরকারি ও বিরোধী দলীয় ৪জন নেতাসহ সিনেট ও কংগ্রেসের দুই ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মনে করেছে এই সংকটকালে সিনেট ও কংগ্রেস নেতাদের সবকিছু অবহিত থাকা দরকার।
সিচুয়েশন কক্ষে সবাই এসে আসন গ্রহণ করেছে। শুধু বাকি আছে প্রেসিডেন্ট, এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন এবং সিআইএ প্রধান এডমিরাল ওয়াটসন।
ঠিক তটটা পনের মিনিটেই প্রেসিডেন্ট প্রবেশ করল মিটিংরুমে। তার পেছনে পেছনে প্রবেশ করল জর্জ আব্রাহাম জনসন ও এডমিরাল ওয়াটসন।
সবাই উঠে দাঁড়াল। প্রেসিডেন্ট বসল। বসল সবাই।
বসে প্রেসিডেন্ট সবার দিকে চাইল। বলল প্রেসিডেন্ট, সবাইকে গুড মর্নিং।
একটু থামল প্রেসিডেন্ট। ধীরে ধীরে আবার কথা শুরু করল প্রেসিডেন্ট, রাষ্ট্রীয় সংকটকালে আমরা আবার বসেছি। সিনেটের দুই নেতা এবং কংগ্রেসের দুই নেতাকেও আমি এ মিটিং-এ ডেকেছি। তাদের সবকিছু জানা দরকার। থামল প্রেসিডেন্ট।
মি. প্রেসিডেন্ট, কোন্ রাষ্ট্রীয় সংকটের কথা বলছেন? সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা বলল।
হ্যাঁ, আমিও একথাই জানতে চাচ্ছিলাম। বলল কংগ্রেসের বিরোধী দলীয় নেতা।
সিনেট ও কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই নেতাও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে প্রেসিডেন্টের দিকে চাইল।
ধন্যবাদ সিনেট ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, বিষয়টা আমি বলছি।
বলে প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার কিডন্যাপ হওয়া, এইচ থ্রির ঘাঁটি থেকে আহমদ মুসার পালানো, ঘাঁটিটা সরকারি দখলে আসা, নতুন অস্ত্র গবেষণার সন্ধান লাভ, এইচ থ্রির তাড়া খেয়ে আহমদ মুসার গাড়ি সমেত নদীতে পড়ে নিখোঁজ হওয়া, আহমদ মুসার গোপন এক মাধ্যমে আমাদের কাছে খবর পৌঁছানো, যে সন্ত্রাসী সংগঠন এইচ থ্রি ভয়ংকর অস্ত্র তৈরি করেছে যা মিনিটেই আমেরিকার সমস্ত অস্ত্র অকেজো করে দেবার কথা, এইচ থ্রির আলটিমেটাম, তাদের শর্ত না মানলে আজ বেলা ১২টার পর তাদের আক্রমণ চালানোর কথা, জবাব হিসেবে। সরকার কর্তৃক অস্ত্র ব্যবহারের আগেই ওদের অস্ত্র অকেজো করার উদ্যোগ নেয়া ইত্যাদি বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরল প্রেসিডেন্ট।
পিনপতন নীরবতার মধ্যে প্রেসিডেন্ট তার কথা শেষ করল।
প্রেসিডেন্ট কথা শেষ করলেও সবাই নীরব। সিনেট ও কংগ্রেসের চার নেতার চোখ-মুখ উদ্বেগে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। নিজেদের সামলে নিতে তাদের কিছু সময় লেগে গেল।
প্রথমে মুখ খুলল সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা। বলল, আলটিমেটামের বিষয়টা প্রেসনোট আকারে আনা হয়নি কেন, জাতিকে জানানো হয়নি কেন?
ধন্যবাদ। আলটিমেটামের বিষয়টি জানানো হয়নি কারণ, তিনটি শর্ত ফাঁস হলে আমাদের সাংঘাতিক একটি রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়ত। বলল প্রেসিডেন্ট।
সেটা কি মি. প্রেসিডেন্ট? বলল কংগ্রেসের বিরোধী দলীয় নেতা। ১ সপ্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ম্যাগনেটিক ডেথ ওয়েভ (MDw) নামে। একটা অস্ত্র আবিষ্কার করেছে, যা মুহূর্তে ও নিঃশব্দে হাজার হাজার মাইল দূরের মেটালিক সব অস্ত্র অকেজো করে দিতে পারে ৬ থেকে ১২ মাসের জন্যে। অস্ত্রগুলোর ম্যাগনেটিক ও ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন ছাড়া অস্ত্রগুলো আর কার্যকরীই করা যাবে না। এই অস্ত্র আবিষ্কারের কথা একদম গোপন রাখা হয়েছে। বলল প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু সন্ত্রাসী পক্ষ কি এটা জানে? বলল সিনেটে সংখ্যাগুরু দলের নেতা।
শুধু জানে নয়, তারাও এই অস্ত্র তৈরি করেছে। এই অস্ত্রকে ডেটোনেট করার নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিই মাত্র তারা আবিষ্কার করতে পারেনি। বলল প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু মি. প্রেসিডেন্ট, তারা যে অস্ত্র দিয়ে আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত, সেটা কোন অস্ত্র? সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা বলল।
সেটা আরেক ধরনের অস্ত্র। তার নাম ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ (MFW)। এটা ভয়াবহ একটা ধ্বংসকরী অস্ত্র। এর অদৃশ্য শক্তি ব্ল্যাক ফায়ার মেটালিক অস্ত্র এবং মেটালিক সবকিছুকে নিঃশব্দে, নীরবে হাওয়া করে দেয়। বলল প্রেসিডেন্ট।
ও গড! বলে আর্তনাদ করে উঠল সিনেট ও কংগ্রেসের চার নেতা।
কংগ্রেসের বিরোধী দলীয় নেতা প্রায় কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠল, তাহলে আমরা এখন এই অস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে? তার মানে বেলা ১২টার পর যেকোনো সময় তারা এ অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে?
আমরা সেই আশংকা করছি। বলল প্রেসিডেন্ট।
আত্মরক্ষার জন্যে কিংবা আগাম আক্রমণে গিয়ে নিজেদের বাঁচাবার জন্যে আমরা কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি? বলল সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
এই অস্ত্র মোকাবেলা করা কিংবা প্রতিরোধ করার কোন ব্যবস্থা আমাদের হাতে নেই। সন্ত্রাসীরা এই অস্ত্র যে তৈরি করেছে তা আমাদের জানাই ছিল না। আহমদ মুসার মেসেজেই আমরা এটা প্রথম জানতে পারি। বলল প্রেসিডেন্ট।
আমরা জানতে পারলাম না, আহমদ মুসার মত একজন ব্যক্তি এটা জানল কিভাবে? বলল কংগ্রেসের বিরোধী দলীয় নেতা।
আহমদ মুসাকে তারা কিডন্যাপ করে তাকে বাধ্য করতে চেয়েছিল, দরকার হলে তার মগজ ধোলাই করে, আমেরিকান সরকারের গোপন, অস্ত্রের ডেটোনেশন ফর্মুলা হাত করতে চেয়েছিল। এই সময়ই তাদের আবিষ্কৃত অস্ত্র সম্পর্কে জানতে পারে আহমদ মুসা এবং সেটাই সে আমাদের জানায়। বলল প্রেসিডেন্ট।
আলটিমেটাম শেষ হবার আগেই আমরা আগাম এয়ারস্ট্রাইক কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ওদের ঘাঁটি ধ্বংস করে আমাদেরকে নিরাপদ করতে তো পারি? সিনেটের বিরোধী দলীয় প্রধান বলল।
এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো, ওরা ওদের ম্যাগনেটিক পাহারা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই আক্রমণের বিষয় জানার সম্ভাবনা আছে। জানতে পারলে মুহূর্তেই একদিকে তারা আক্রমণকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে, অন্য দিকে তারা অফেনসিভে এসে আমাদের উপর সার্বিক আঘাত হানতে পারে। এজন্যে আক্রমণের ঝুঁকি নেয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া আক্রমণ কোথায়, কয় জায়গায় করা হবে। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে। কোন তথ্য নেই। আহমদ মুসা ডেথ ভ্যালিতে ওদের একটা ঘাটি আছে বলে মনে করছিল। মাত্র গতকাল সন্ধ্যায় সে নিশ্চিত হয়েছে তার অনুমান ঠিক। ডেথ ভ্যালিতে ওদের একটা ঘাঁটি রয়েছে এবং এই ঘাঁটি থেকেই তারা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। বলল প্রেসিডেন্ট।
আমরা আহমদ মুসার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু দেখছি আমরা একদম আহমদ মুসা-নির্ভর হয়ে পড়েছি। আমাদের গোয়েন্দারা কি করছে? বলল সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা।
এর কারণ হলো, ওরা এখনও জানে যে, ওদের গোপন অস্ত্রের কথা আমরা জানি না। যেহেতু আহমদ মুসা ওদের ঘাঁটি থেকে পালাবার পরই নিখোঁজ হয়ে গেছে এবং তার সাথে আমাদের আর দেখা হয়নি, তাই সে এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানাবার সুযোগও পায়নি। তাদের এই চিন্তাকে আমরা ভাঙতে চাই না। কারণ যে মুহূর্তে তারা এটা জানবে সে মুহূর্তেই তারা তাদের আত্মরক্ষার জন্যে আগাম আক্রমণে চলে আসবে। এজন্যেই আমরা আমাদের গোয়েন্দাদের কাজে লাগাচ্ছি না। তারা ধরা পড়লে, তাদের তৎপরতা সম্পর্কে তারা জানতে পারলে, ওরা ধরে নিতে পারে যে, নিশ্চয় আমরা কিছু জেনেছি। আমরা চাচ্ছি, নিখোঁজ আহমদ মুসার সাহায্য নিতে। আহমদ মুসাই তাদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানে। বলল প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট, বিষয়টা আমি বুঝেছি। সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা বলল।
ওয়েলকাম, সম্মানিত সিনেট নেতা। বলল প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট কথা শেষ করলেও আর কোন কথা কেউ বলল না।
সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে প্রেসিডেন্টই আবার বলল, সিনেট ও কংগ্রেসের সম্মানিত নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। এখন আমরা মূল আলোচনায় আসতে পারি। বলে প্রেসিডেন্ট একটু থেমে আবার শুরু করল, এখন সকাল সাড়ে আটটা বাজে। বেলা ১২টায় ওদের আলটিমেটাম শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা ওদের শর্ত মেনে নিতে পারিনি, তা মানা কোনো দিক দিয়েই সম্ভব নয়। কারণ তাতে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কিছুই থাকবে না। তাদের শর্ত মেনে না নেওয়ায় ওদের তৃতীয় বিকল্প সামনে এসে গেছে। বেলা ১২টার পর আমরা ওদের গোপন ও ভয়ংকর আক্রমণের মুখে পড়ব। এর মোকাবিলার জন্য আমরা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি, সেটা হলো তারা যে অস্ত্র নিয়ে আক্রমণে আসার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে, সেই অস্ত্রকেই ধ্বংস অথবা অকেজো করে ফেলা। এ দায়িত্ব গিয়ে বর্তেছে আহমদ মুসার কাঁধে। আমাদের পরিকল্পনার ফল এটা নয়। এ যেন ঈশ্বরের সিলেকশন। এই পদক্ষেপ ব্যর্থ হলে আমাদের শেষ ও নিরুপায় পদক্ষেপ হলো ওদের অস্ত্র ধ্বংস বা নিষ্ক্রিয় করে দেবার জন্যে আমাদের MDW ব্যবহার করা। এতে আমরা ওদের হাতে পড়ার হাত থেকে বাঁচব বটে, কিন্তু আমাদের সব কৌশলগত ও অন্যান্য মারণাস্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। এর সুযোগ গ্রহণ করবে ষড়যন্ত্রকারীরা। তারা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করবে। সুতরাং এই শেষ অপশন আমাদের জনগণ ও দেশের জন্যে বিপজ্জনক। একমাত্র আহমদ মুসার সাফল্যই আমাদের দুই ধ্বংসাত্মক সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। থামল প্রেসিডেন্ট।
সিনেট ও কংগ্রেসের চার নেতার মুখ উদ্বেগ-আতংকে একেবারে পার হয়ে উঠেছে। সংকটকালীন কমিটির সদস্য সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, সেনা গোয়েন্দা প্রধান, প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা, সিআইএ ও এফবিআই প্রধান সকলের মুখ নিচু।
প্রেসিডেন্ট কথা শেষ করে তাকাল এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, মি. জর্জ জনসন সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কমিটিকে বলুন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন আগেই মাথা তুলে সোজা হয়ে বসেছিল। বলল, ইয়েস এক্সিলেন্সি।
বলে একটু থেমে কথা শুরু করল জর্জ আব্রাহাম জনসন, আহমদ মুসা আজ তার ভোরের প্রার্থনা শেষে ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশের জন্যে যাত্রা শুরু করেছে। এ খবর পাওয়ার পর থেকেই আমি ফলো করার চেষ্টা করছি সেখানকার পরিস্থিতিকে। আমরা তার পকেটে কোনভাবেই ডিটেকটেবল নয় এমন আলট্রা সেনসেটিভ চিপস দিয়েছি। তিনি এগুলো ঘাঁটির যেখানেই যাবেন ছড়িয়ে দেবেন। ছড়িয়ে দিতে না পারলেও ক্ষতি নেই। তার পকেটে থাকলেও বেশ দূর পর্যন্ত আশেপাশের সবকিছুই মনিটর করতে পারবে চিপসগুলো। ঘড়ির টিক টিক শব্দ পর্যন্ত এর মনিটরিং-এ আসবে। ভোর থেকে মনিটরিং-এ কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এই মাত্র এক্সিলেন্সি কথা শেষ করার সময় চিপসের মনিটরিং এ একটা ভারি কিছু পতনের শব্দ পাওয়া গেছে। একটা ভারি কিছু যেন নরম কিছুর উপর পড়েছে। একটা যান্ত্রিক শোঁ শোঁ শব্দও এর সাথে ছিল। এ থেকে বুঝা গেছে, ভারি জিনিসের পতনটা নিয়ন্ত্রিত। আমার মনে হয়েছে, একটা ভারি দরজার পাল্লা যেন নিয়ন্ত্রিতভাবে খুলে গিয়ে মাটিতে নরম কিছুর উপর পড়েছে। এটাই নিশ্চিত করে যে আহমদ মুসা ঢুকেছে ওদের ঘাঁটিতে। থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন থামতেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, চিপসের মনিটরিং তো ইফেক্টসহ সাউন্ড স্ক্রিনে আনা যায়।
ইয়েস এক্সিলেন্সি, আনা যায়। সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আপনি অনুমতি দিলে আমরা এটা স্টার্ট করতে পারি।
অবশ্যই করবেন মি. জর্জ জনসন।
বলে প্রেসিডেন্ট সিনেট ও কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দসহ সবার দিকে একবার চেয়ে বলল, ভদ্রমহোদয়গণ, ওদের আলটিমেটাম শেষ হওয়া পর্যন্ত মানে আড়াই ঘণ্টা সময় ধরে আমাদের মিটিং চলবে। ভালোই হলো। আমরা আহমদ মুসার অভিযান কিছুটা হলেও ফলো করতে পারবো এবং তার অভিযানের রেজাল্টও আমরা জানতে পারবো। ঈশ্বর না করুন, আহমদ মুসা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে আমাদের MDW কাজে লাগাবার জন্য নিরুপায় সিদ্ধান্তও আমরা এখানে বসেই গ্রহণ করব। আমাদের পেন্টাগন ও স্ট্রাটেজিক কমান্ড রেডি আছে। স্ট্রাটেজিক কমান্ড চেষ্টা করবে MDw-কে নিয়ন্ত্রিত করে ক্ষতিকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসার।
সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান বলল, এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমরা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাথে বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেছি নিশ্চয়? আর তাদের শর্ত মেনে নিলে তার ক্ষতিটা কত হতো?
ধন্যবাদ সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যানকে। আমরা তাদের দাবি মেনে নিলে আমাদের অস্ত্র অকেজো হয়ে পড়ত। অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের আমাদের উপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণের অস্ত্র ঠিকই থাকতো। এই অবস্থায় ওদের শর্ত মেনে নেবার অর্থ হলো আমেরিকান নেশন ও গণতন্ত্রের আত্মসমর্পণ সন্ত্রাসীদের কাছে। আমরা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাথে এ বিষয় নিয়ে যতটা সম্ভব খোলাখুলি আলোচনা করেছি। MFW বা ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ নামের সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের প্রতিরোধক কোন কিছুই নেই কারও কাছে। তারা সন্ত্রাসী এবং তাদের অস্ত্রের উপর গোপন আক্রমণ ও ধ্বংস করাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। পরিস্থিতি কি দাঁড়ায় সে অনুসারে তারা আমাদের সাহায্য করতেও প্রস্তুত আছে। বলল প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট। আমি বুঝতে পেরেছি। শতাব্দীর এক ভয়ংকর সংকটকে আমরা মোকাবিলা করছি। ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন। বলল সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান।
ওয়েলকাম ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান। বলল প্রেসিডেন্ট।
কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, মনিটরের জন্যে সাউন্ড স্ক্রিন চালু করছেন মি. জর্জ জনসন।
সব ঠিক হয়েছে। এখনি সাউন্ড স্ক্রিন চালু হয়ে যাবে। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সাউন্ড স্ক্রিনের সাথে চিপস মনিটরিং-এর ব্যবস্থা সেট হয়ে গেল। চালু হয়ে গেল সাউন্ড স্ক্রিন।
স্ক্রিন চালু করার সাথে সাথে একটা শক্ত ধাতব বস্তুর উপর পায়ের শব্দ শোনা গেল, তার সাথে দুটি সংক্ষিপ্ত শীষ দেয়ার মত শব্দও উঠল।
এক্সিলেন্সি এই শীষ দুটি বিশেষ ধরনের গ্যাসগানের। বলল সেনা গোয়েন্দা প্রধান প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে।
সংঘর্ষ তাহলে শুরু হয়ে গেছে। আহমদ মুসার কাছে তো গ্যাসগান। নেই। ও গড? অনেকটা স্বগত উক্তির মত বলল প্রেসিডেন্ট।
সবাই প্রেসিডেন্টের কথা শুনতে পেল। সকলের মুখে নেমে এসেছে। উদ্বেগের কালো ছায়া। সকলের চোখ সাউন্ড স্ক্রিনের দিকে নিবদ্ধ।
.
দরজাটি আস্তে আস্তে নেমে নিঃশব্দে মেঝের উপর সেট হয়ে গেল।
আহমদ মুসার মনে হলো মেঝেতে সেট হওয়া এই দরজার উপর দিয়েই নিশ্চয় যাতায়াত ব্যবস্থা।
দরজাটি মেঝেতে স্থির হবার পরেও আহমদ মুসা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকল কেউ বের হয় কি না তা দেখার জন্যে। প্রহরায় কেউ থাকলে অবশ্যই দরজা খুলে যাওয়া দেখে মনে করবে তাদেরই কেউ প্রবেশ করছে। কেউ না ঢুকলে নিশ্চয় তার মনে প্রশ্ন জাগবে, কি হলো, কেউ ঢুকছে না কেন? এই জিজ্ঞাসাই তাকে বের করে নিয়ে আসবে। হলোও তাই।
হাতে গ্যাসগান ধরা ছফুটের মত লম্বা একজন লোক কে বাইরে আছেন, ভেতরে আসুন বলে মুখ বাড়িয়ে বাইরে উঁকি দিল।
এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল আহমদ মুসা। লোকটির সামনে, বাড়ানো মুখের সাথে সাথে উন্মুক্ত ঘাড়টাও বাইরে বেরিয়ে এসেছিল।
উন্মুক্ত ঘাড়টা দেখার সাথে সাথেই আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুৎবেগে উপরে উঠেছিল।
এই সময় আহমদ মুসাও তার নজরে পড়ে গেল।
আহমদ মুসার হাত উপরে উঠতে দেখেই লোকটি ঘটনা কি বুঝতে পেরেছিল এবং ভীত হবার বদলে জ্বলে উঠেছিল তার চোখ। এই পরিস্থিতিতে সে নিজেকে রক্ষা করবে, না আক্রমণে যাবে এই উভয় সংকট তার মধ্যে দেখা দিয়েছিল। সে আক্রমণে যাবারই সিদ্ধান্ত নিল। গ্যাসগানের ট্রিগার ছুঁয়েই ছিল তার আঙুল। চোখের পলকেই তার। গ্যাসগানের ব্যারেলটা আহমদ মুসার লক্ষ্যে উপরে উঠল।
কিন্তু আহমদ মুসার উদ্যত ডান হাত ততক্ষণে তার উন্মুক্ত ঘাড়ে হাতুড়ির মত গিয়ে আঘাত করেছে।
সংগে সংগেই তার হাত থেকে গ্যাসগানটি খসে পড়ল। তার দেহটাও একবার ঘুরে উঠে পড়ে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে তাকে ধরে ফেলল।
লোকটির সংজ্ঞাহীন দেহটাকে আহমদ মুসা পাঁজাকোলা করে নিয়ে সুড়ঙ্গের এক পাশে শুইয়ে রাখল। নিয়ে এল বাইরে গ্যাসগানটা। আহমদ মুসার দ্বিতীয় কাজ হলো বিশেষ ধরনের ক্লোরোফরম দিয়ে লোকটাকে কমপক্ষে অর্ধ দিবসের জন্যে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। তৃতীয় কাজ হলো, পাহাড়ের গায়ের দরজাটাকে বন্ধ করা। কিন্তু বন্ধ করার চিন্তা করতেই তার মনে পড়ে গেল এই দরজাটা খোলা রাখতে হবে, যাতে ডাকলেই জর্জ আব্রাহাম জনসনের কমান্ডোরা সহজেই ডেথ ভ্যালিতে প্রবেশ করতে পারে। সুতরাং দরজা বন্ধ করার চিন্তা ত্যাগ করল আহমদ মুসা। তবে দরজা বন্ধ করার সিস্টেম সন্ধান করে জেনে নিল। দরজার বাইরের যেমন নব ছিল, ভেতরের গায়েও তেমনি নব আছে। নবটা পুশ করলেই দরজা তার জায়গায় ফিরে যাবে।
দরজার পরে যে সুড়ঙ্গ তা বেশ লম্বা। পাহাড়ের গা কেটে এই সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। দরজা দিয়ে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করা যায়। সুড়ঙ্গের মাঝামাঝি ভেতরের মাথায়ও আরেকটা দরজা দেখা যাচ্ছে। সুড়ঙ্গের মাঝামাঝি ভেতরের শেষ পর্যন্ত কয়েকটি বৈদ্যুতিক বাল্ব সুড়ঙ্গটিকে আলোকিত করে রেখেছে। সুড়ঙ্গের বাইরের অংশে আলো অপেক্ষাকৃত কম। আলো যাতে বাইরে থেকে কোনভাবেই দেখা না যায় এজন্যেই বোধ হয় এই ব্যবস্থা।
আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীন লোকটির পকেট হাতড়িয়ে একটা মানিব্যাগ ও একটি বিশেষ ধরনের অয়্যারলেস ট্রান্সমিটার পেল। ট্রান্সমিটারের ওয়েভ প্যানেলটা একবার দেখে নিয়ে পকেটে রেখে দিল। মানিব্যাগে মানি ছাড়া পেল ১২ মাসের একটা ক্যালেন্ডার কার্ড। ক্যালেন্ডারটা আহমদ মুসা মানিব্যাগে রেখে দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সে দেখলো ক্যালেন্ডার কার্ডের কিছু কিছু তারিখে লাল নীল কালিতে মার্ক করা। মার্ক করা কেন?
আবার ক্যালেন্ডার কার্ডটায় নজর বুলাল আহমদ মুসা। ১২ মাসের ১২টা পয়লা তারিখের প্রথমটি রেড, দ্বিতীয়টি বু- এইভাবে সবগুলো পয়লা তারিখ মার্ক করা।
আহমদ মুসা একটু অবাক হলো। পকেটে রেখে দিল ক্যালেন্ডার কার্ডটা।
আহমদ মুসা এগোলো সুড়ঙ্গের ভেতরের বন্ধ দরজাটার দিকে।
সে বুঝল, এই সুড়ঙ্গে কোন সিসিটিভি নেই। থাকলেও অতি আত্মবিশ্বাসী এইচ থ্রির লোকরা তা মনিটর করার প্রয়োজন বোধ করে না। দিনের পর দিন অর্থহীন মনিটরিং করে তারা টায়ার্ডও হয়ে থাকতে পারে। তাদের অতি নিরাপদ ডেথ ভ্যালির আয়োজন কোনোভাবে প্রতিপক্ষের নজরে পড়তে পারে, এমন চিন্তা তাদের মাথায়ও আসছে না। মনে হয় তাদের সমস্ত মনোযোগ বেলা ১২টার পরবর্তী সময়টার দিকে।
আহমদ মুসা সুড়ঙ্গের ভেতরের সামনে এসে পৌঁছেছে। সে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
দরজাটা আগের দরজার মত নয়। প্লেইন স্টিল প্লেটের দরজা এটা। দরজার চারদিকটা দেখে বুঝল, ম্যানুয়ালি খোলা ও বন্ধ করা যায় না এ দরজা। তাহলে নিশ্চয় কী-বোর্ড কোথাও আছে, ভাবল আহমদ মুসা।
দরজা সংলগ্ন সুড়ঙ্গের দেয়াল এবং সুড়ঙ্গের ফ্লোর তন্ন তন্ন করে খুঁজল আহমদ মুসা। না কী-বোর্ড কিংবা কী-বোর্ডের মত কোন কিছু কোথাও নেই। অবশেষে দরজার উপর চোখ বুলাতে গিয়ে দরজার রঙে রং করা একটা টাচ কী-বোর্ড পেয়ে গেল। কী-বোর্ডটাতে সংখ্যা ও বর্ণ দুই ধরনের বিকল্প রয়েছে। এর অর্থ দরজা খোলা ও বন্ধ করার দুই ধরনের সিস্টেম হতে পারে। এর ফলে পাসওয়ার্ড বা কোড-অপশন অনেক বিস্তৃত হয়েছে।
বিরাট একটা বাঁধার সম্মুখীন হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার মন বলল, এ ধরনের পাসওয়ার্ড ব্যবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের ধাঁধা ও সংকেত দেয়া থাকে।
আহমদ মুসা কী-বোর্ডের চারপাশে খোঁজ করতে লাগল। খুঁজতে গিয়ে দুটি নতুন জিনিস পেল। একটা হলো কী-বোর্ডের মাথার ১৩টি ক্ষুদ্র ডট। ডটগুলো প্রত্যেকটি একটি করে ছিদ্র। আর দ্বিতীয়, কী বোর্ডের নিচে এন্ডিং মার্কের মত একটা চিহ্ন। চিহ্নটিতে সংখ্যা ওয়ান ও এ অ্যালফাবেট জড়াজড়ি করে আছে।
এ দুটি জিনিস কি কোন কিছুর ইংগিত করছে? চিহ্ন দুটির দিকে তাকিয়ে ভাবল আহমদ মুসা।
তার মনে হলো, কী-বোর্ডের মাথার উপরের ১৪টি ডটের অর্থ হতে পারে পাসওয়ার্ডটি ১৩ ডিজিটের। আর কী-বোর্ডের নিচের চিহ্নটিতে অ্যালফাবেট ও সংখ্যা জড়াজড়ির অর্থ হতে পারে পাসওয়ার্ডে সংখ্যা ও অ্যালফাবেট দুই-ই এখানে রয়েছে।
পাসওয়ার্ড কি হতে পারে?
এদের সংগঠনের দুই নাম, এদের আবিষ্কৃত অস্ত্রের নাম, এদের নেতাদের কারও নাম, এই স্থানের নাম ইত্যাদি যেকোনো একটি বা একাধিক মিলে পাসওয়ার্ড হতে পারে। কিন্তু সাথের সংখ্যাগুলো?
তাকাল আহমদ মুসা কি বোর্ডের সংখ্যাগুলোর দিকে। এক এক করে দেখল সংখ্যাগুলো। মোট সংখ্যা ১০টি।
সংখ্যাগুলো জলছাপের মত টাচ কিগুলোর উপর ভেসে আছে। আপাতত কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করল না সংখ্যাগুলোর মধ্যে। তবে আগেই তার নজরে পড়েছিল, সংখ্যাগুলো আবছা লাল ও আবছা নীল সার্কেলে ঘেরা। কিন্তু অ্যালফাবেটগুলো এভাবে সার্কেলে ঘেরা নয়। এটা কি কোন সংকেত? সংকেত হলে প্রত্যেক সংখ্যার উপর একই রকমের সার্কেল কেন?
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল সংজ্ঞাহীন গার্ড লোকটির পকেট থেকে পাওয়া ক্যালেন্ডারে লাল নীল মার্কের কথা। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ক্যালেন্ডার কার্ডটা বের করল। দেখল, ক্যালেন্ডার কার্ডের ১২টি এক তারিখের প্রথম মাসের এক তারিখ লাল, দ্বিতীয় মাসের এক তারিখ নীল, তৃতীয় মাসের এক তারিখ লাল- এভাবে অলটারনেটলি লাল নীল রং করা শেষ মাসের প্রথম তারিখ পর্যন্ত।
ক্যালেন্ডার কার্ডের লাল নীলের সাথে কী-বোর্ডের সংখ্যাগুলোর লাল নীল রঙের কি কোন সম্পর্ক আছে, ভাবল আহমদ মুসা। বোর্ডের লাল নীল সার্কেলের ব্যাখ্যা কি ক্যালেন্ডার কার্ডের লাল নীল সঠিক মার্ক? ব্যাখ্যাটা কি বলছে? যেহেতু বার মাসেরই ১ তারিখকে মার্ক করা হয়েছে এবং যেহেতু কী-বোর্ডের সংখ্যায় ১টি মাত্র এক রয়েছে, অতএব সংখ্যা এখানে ধর্তব্য নয়, ধর্তব্য হলো লাল ও নীলের পর্যায়ক্রমিক অবস্থান। লাল ও নীলের পর্যায়ক্রমিক ব্যবহার কি একথা বলছে যে, দরজা বন্ধ ও দরজা খোলার পাসওয়ার্ড সংখ্যাগুলো পর্যায়ক্রমে রয়েছে? যদি তাই হয়, তাহলে কী-বোর্ডের ১ থেকে শূন্য পর্যন্ত সংখ্যাগুলোর ১, ৩, ৫, ৭ ও ৯ সংখ্যাগুলো দরজা বন্ধের এবং ২, ৪, ৬, ৮ ও শূন্য সংখ্যাগুলো দরজা খোলার জন্যে।
কী-বোর্ডের ১০টি সংখ্যার মধ্যে লাল ও নীলের ভাগে ৫টি করে সংখ্যা পড়েছে। ১৩ ডিজিটের পাসওয়ার্ডের সংখ্যার স্থান যদি হয় পাঁচটি, পাসওয়ার্ডে তাহলে বাকি থাকে আরও ৮ ডিজিটের স্থান। এই স্থানগুলো কি অ্যালফাবেট পাসওয়ার্ডের জন্যে?
ক্যালেন্ডার কার্ডটি নাড়াচাড়ার সময় হঠাৎ একটা জায়গা বিদ্যুতের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল। জায়গাটা সে চোখের সামনে নিয়ে এল। দেখল, সাদা কালিতে ক্ষুদ্রাকারে লেখা এইচ। জানুয়ারি মাসের ক্যালেন্ডারের জানুয়ারি নামের পাশে সাদা কালিতে এই এইচ লেখা।
সাদা কালিতে এই এইচটি কেউ পরিকল্পিতভাবে লিখেছে। কেন? অন্য কোন মাসেও কি এভাবে কিছু লেখা রয়েছে?
আহমদ মুসা ফেব্রুয়ারি মাস পরীক্ষা করল। দেখল, ফেব্রুয়ারি মাসের নামের পাশে ঐভাবে সাদা কালিতে একটা সংখ্যা লেখা। সংখ্যাটা ৩। এভাবে আহমদ মুসা একে একে মাসের নামগুলোর পাশটা পরীক্ষা করল। আগস্ট পর্যন্ত মাসের নামের পাশে একটি করে অ্যালফাবেট পেল।
আহমদ মুসা গুণে দেখল, ৮ টি অ্যালফাবেট রয়েছে আগস্ট মাস পর্যন্ত। তারপর পর কোন মাসের নামের সাথে কিছু লেখা নেই।
খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। পাসওয়ার্ডের আটটা অ্যালফাবেট বাকি ছিল। পাঁচটি সংখ্যা আগেই পাওয়া গেছে। আট অ্যালফাবেট ও পাঁচ সংখ্যা মিলে ১৩ ডিজিটের পাসওয়ার্ড পূর্ণ হয়ে। যাচ্ছে।
সংখ্যা ও অ্যালফাবেটগুলোকে একসাথে সাজাল আহমদ মুসা। অনুমিত পাসওয়ার্ডটা দাঁড়াল-২৪৬৮০ H3MFWMDw.– পাসওয়ার্ডটা তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই দরজার কী-বোর্ডে তা টাইপ করল।
টাইপ করেই গ্যাসগানটা হাতে তুলে নিল আহমদ মুসা। দরজার ওপাশে কি আছে, কি হচ্ছে, কি দেখবে কিছুই আঁচ করার নেই। আল্লাহর উপর ভরসা করে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা ছাড়া করার আর কিছুই নেই।
পাসওয়ার্ড টাইপের পর অপেক্ষা করল। কিন্তু দরজা যেমন স্থির ছিল তেমনই থাকল। পাসওয়ার্ড কাজ করল না।
চঞ্চল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মন। হাতঘড়ির দিকে তাকাল। সময় ৯টা। ওদের আলটিমেটাম শেষ হবার জন্য সময় আছে মাত্র তিন ঘণ্টা। এ পাসওয়ার্ডটার দিকে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার মন বলছে, এই পাসওয়ার্ড কাজ করার কথা। এই পাসওয়ার্ডের কিছুই তার কল্পিত নয়। যে ইংগিতগুলো সে পেয়েছে সেই অনুসারে এই পাসওয়ার্ডই দাঁড়ায়।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, সংখ্যা ও বর্ণমালাভিত্তিক যে পাসওয়ার্ড সে সাজিয়েছে তা সাজানো ঠিক হয়েছে। সে সংখ্যা আগে দিয়েছে, তারপর বর্ণমালা। আবার ভাবল, এই সাজানোটা ঠিক হয়েছে কি না? ঠিক নাও হতে পারে। তাহলে পাসওয়ার্ডের বর্ণমালা কি আগে আসবে? হ্যাঁ, এটাও হতে পারে। ইংরেজি নাম্বার ও অ্যালফাবেট শব্দের ক্রম যদি ধরা হয়, তাহলে অ্যালফাবেট A আগে আসে, পরে আসে নাম্বার-এর N।
ডান হাতে গ্যাসগান রেখে বাম হাতের তর্জনি দিয়ে আবার নতুন পাসওয়ার্ডটি টাইপ করল, প্রথমে সিরিয়াললি বর্ণমালাগুলো, পরে নাম্বার।
পাসওয়ার্ডটি টাইপ শেষ হবার সাথে সাথে নিঃশব্দে নড়ে উঠল দরজা। খুলছে দরজাটা।
আহমদ মুসা গ্যাসগানের ট্রিগারে হাত রেখে গানটা বাগিয়ে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দরজাটা ডানদিক থেকে বামদিকের দেয়ালে ঢুকে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা দরজার সাথে সাথে দরজার আড়াল নিয়ে বামদিকে সরতে থাকল। যতদূর সম্ভব অন্যের চোখ থেকে নিজেকে আড়াল করা এবং অন্যরা কে কোথায় আছে তা দেখার চেষ্টা করাই তার লক্ষ্য। কিন্তু বাম দিকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল তবুও কাউকে দেখতে পেল না আহমদ মুসা।
দরজার সম্পূর্ণটাই ঢুকে গেল বাম দিকের দেয়ালে। উন্মুক্ত দরজার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আহমদ মুসা। গুরুত্বপূর্ণ একটা দরজা বাইরে থেকে খুলে গেল, কিন্তু কেউ এল না, পাহারাতেও কেউ নেই! ব্যাপারটাকে অস্বাভাবিক মনে হলো আহমদ মুসার কাছে। আবার ভাবল, সিকিউরিটি ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা নিশ্চিত বলেই তো অহেতুক এ স্থানে কোন পাহারা নেই। আবার তার মনে হলো, হয়তো আছে প্রহরী। তবে কোথাও বসে ঘুমাচ্ছে অথবা খোশগল্প করছে। যেহেতু ঘাঁটিতে বাইরে থেকে আক্রমণ বা অনুপ্রবেশের কোন চিন্তা বা আশংকা তাদের নেই- এজন্যে হতে পারে তাদের পাহারায় গাছাড়া ভাব। উন্মুক্ত দরজা পথে আহমদ মুসা বাড়ির একটা অংশ দেখতে পেল। দেখল উন্মুক্ত দরজার সামনে দিয়ে একটা প্রশস্ত করিডোর পূর্ব ও পশ্চিম দুই দিকেই এগিয়ে গেছে। পূর্ব দিকে কতদূর কোন দিকে এগিয়ে গেছে তা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পশ্চিম দিকে অল্প কিছু দূর এগিয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়েছে। আর দরজার সামনে করিডোরের পাশ দিয়ে উঁচু পাহাড়ের দেয়াল উঠে গেছে। দেয়ালটা করিডোরের সাথে একইভাবে ঘুরে গেছে। দেয়ালের এদিকে নিচের অংশে কোন দরজা জানালা দেখল না আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা আরও কিছু সময় অপেক্ষা করল। কাউকে আসতে না দেখে দরজা থেকে করিডোরে বেরিয়ে এল। সে ঠিক করল পশ্চিম দিক হয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাওয়া করিডোরের পথেই সে সামনে এগোবে।
আহমদ মুসা দুহাতে গ্যাসগানটা বাগিয়ে ধরে এগোতে লাগল। গোটা পরিবেশকে অস্বাভাবিক মনে হলো তার কাছে। প্রহরী চারদিকে গিজ গিজ করার কথা দিনের গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে। তাহলে তারা কি প্রহরী উপরে রেখেছে তাদের মূল্যবান মারণাস্ত্রের নিরাপত্তায়? না তারা ঘাঁটির নিরাপত্তায় ওভারশিউর বলে প্রহরী তেমন রাখেনি?
আহমদ মুসা করিডোরের দক্ষিণমুখী বাঁকে গিয়ে পৌঁছেছিল। ঘুরছিল দক্ষিণ দিকে। এই সময় গ্যাসগুন বাগিয়ে ধরা ডান হাতের উপর প্রচণ্ড একটা আঘাত এসে পড়ল। আহমদ মুসা দরজা থেকে বেরিয়ে সামনে এগোবার পর দরজার দুপাশটা ভালো করে দেখেনি। দরজার দুপাশেই রয়েছে দুটি গার্ডরুম। গাডরুমে দেয়ালের সাথে মেশানো ক্যামোফ্লেজ করা দরজা আছে। আর আছে কাঁচ ঘেরা গবাক্ষ।
এই দুই গার্ডরুমে দুইজন করে চারজন প্রহরী রয়েছে। দরজা খুলে যাওয়া ওরা টের পেয়েছিল। মনে করেছিল বাইরে থেকে তাদেরই কেউ আসছে। কিন্তু আহমদ মুসাকে গ্যাসগান হাতে করিডোরে দেখে তাদের ভুল ভেঙে যায়। দুই গার্ডরুম থেকে চারজন প্রহরী বিড়ালের মত নিঃশব্দে বেরিয়ে তারা আহমদ মুসার পিছু নেয়। করিডোরের দক্ষিণ মুখের বাঁকে তাদের একজন প্রচণ্ড আঘাত করেছে আহমদ মুসার ডান হাতে।
আহমদ মুসার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল গ্যাসগানটা। আহমদ মুসা। স্থির দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে শত্রু, কিন্তু কয়জন? ভাবল আহমদ মুসা।
ভাবনা তার আর বেশি দূর এগোলো না। পেছন থেকে মাথায় ধাতব কিছু এসে ঠেকল। ধাতব স্পর্শ উপলব্ধি করে মনে হলো আহমদ মুসার বস্তুটি নিশ্চয় স্টেনগান ধরনের কিছু।
এরপরেই সামনে এসে দাঁড়াল তিনজন। তাদের একজন দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর স্বরে বলল, কে তুমি শয়তান? সিংহের গুহায় ঢুকলে কেমন করে, কোন্ সাহসে? আমাদের লোকটাকে হত্যা করেছ নাকি? তবে এসেছ যখন দেখবে মজা।
তিনজনের হাতেই বিশেষ ধরনের স্টেনগান। এ ধরনের স্টেনগানে সাইলেন্সর লাগানো থাকে।
এরা চাপা স্বরে কথা বলছে, আবার, স্টেনগানেও সাইলেন্সর লাগানো। এখানে জোরে কথা বলা, শব্দ করা হয়তো নিষিদ্ধ। এখানে বিশ্বের সর্বাধুনিক অস্ত্র গবেষণা, অস্ত্র তৈরি, অস্ত্র ব্যবহার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত বিজ্ঞানী কিংবা অপারেটররা থাকে। হয়তো তাদেরকে সব রকম ভীতি ও ভাবনা থেকে দূরে রাখাই এর উদ্দেশ্য।
মাথায় আহমদ মুসা স্টেনগানের ব্যারেলের গুঁতো খেল। বলল পেছন থেকে, সামনে আগাও শয়তান।
সামনের তিনজনও আহমদ মুসার দিকে স্টেনগান তাক করে তার পেছনে হাঁটছে। আহমদ মুসাও তাদের সাথে হাঁটতে শুরু করেছে। শান্তভাবে একটি কথাও না বলে। একটু সামনেই করিডোরের ডান পাশে। পশ্চিম দিকে একটা দরজা। এরকম দরজা করিডোরের ডান পাশ বরাবর আরও দেখতে পেল আহমদ মুসা। এটা অনেকটাই অফিসঘরের মত।
দরজাটার সামনে গিয়ে একটু দাঁড়িয়েই আগের তিনজন ঘরে প্রবেশ করল এবং বলল, নিয়ে এস শয়তানকে।
ওরা তিনজন ঘরে ঢুকে চোখের আড়াল হতেই আহমদ মুসা গাছ থেকে ফল খসে পড়ার মত বসে পড়ল। লোকটি বুঝে উঠে তার স্টেনগানটি অ্যাডজাস্ট করার আগেই আহমদ মুসা দুহাত বাড়িয়ে লোকটির দুই পা ধরে সামনে হ্যাঁচকা টান দিল। লোকটি চিৎ হয়ে পড়ে গেল।
তার হাতের স্টেনগান আহমদ মুসার কাছেই ছিটকে পড়ে গেল। দ্রুত স্টেনগানটি তুলে নিয়েই আহমদ মুসা ট্রিগার টিপল মাটিতে পড়ে থাকা লোকটির উদ্দেশ্যে। দুপ দুপ শব্দ করে কয়েকটি গুলি বেরিয়ে গেল।
গুলি করেই আহমদ মুসা লাফ দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল স্টেনগানটি বাগিয়ে ধরে। ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল ঘরের ভেতরের তিনজন স্টেনগান বাগিয়ে বেরিয়ে আসছে। ওদের চোখে মুখে জিজ্ঞাসা। আহমদ মুসাকে স্টেনগান হাতে দেখে ওরা চমকে উঠেছে।
আহমদ মুসা সময় নষ্ট করেনি এক মুহূর্তও। ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার উপর চোখ পড়তেই সে স্টেনগানের ট্রিগার চেপে ধরেছিল।
প্রায় নিঃশব্দে এক পশলা গুলি বেরিয়ে গেল আহমদ মুসার স্টেনগান থেকে। দরজার উপরেই ওরা তিনজন আকস্মিকভাবে স্টেনগানের গুলির মধ্যে পড়ে গেল। গুলির অসহায় খোরাকে পরিণত হলো তারা। দরজার ভেতরেই ওদের তিনজনের লাশ মাটিতে পড়ে গেল।
করিডোরের দক্ষিণ দিক থেকে অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। মনে হচ্ছে কিছু লোক ছুটে আসছে এদিকে। তাহলে কি সাইলেন্সর থাকা সত্ত্বেও গুলির শব্দ ওরা শুনতে পেয়েছে! কিংবা সিসিটিভির মনিটরে ওরা সবকিছু দেখতে পেয়েছে!
আহমদ মুসা একলাফে ঘরে ঢুকে গেল। দরজার উপরের লাশগুলো টেনে ভিতরে নিল।
পায়ের শব্দ দরজার কাছাকাছি এসে গেছে। আহমদ মুসা দ্রুত দরজার পাশে দেয়াল সেঁটে দাঁড়াল।
ওরা সংখ্যায় পাঁচজন। দৌড়ে এসে ওরা দরজার পাশ বরাবর থমকে দাঁড়াল। একজন বলল, বাইরে একটা লাশ, ভেতর থেকেও রক্ত গড়িয়ে আসছে। ভেতরেও নিশ্চয় আহত-নিহত হয়েছে।
আরেকজন বলল, শয়তানটা কোন্ দিকে গেল, নিশ্চয় ঘরে নেই? চল একবার ঘরটা দেখি।
উপরে কি জানানো হয়েছে? আরেকজন বলল।
ঘটনাটা কি আগে আমরা একটু জেনে নেই। শয়তানটা ভেতরে না বাইরে সেটাই তো এখনো জানা হয়নি। বলল দ্বিতীয় জন আবার।
হ্যাঁ, সেটিও ঠিক। এ প্রশ্ন তো উপর থেকে অবশ্যই করবেন। চল। আগে ভেতরে দেখা যাক। তৃতীয়জন বলল।
আহমদ মুসা ওদের সব কথাই শুনতে পেয়েছিল। তার মন বলল, আক্রমণে যাবার এটাই সুযোগ। ওরা আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত হলেও আক্রমণের মুডে ওরা এখন নেই। ওরা এখন অনুসন্ধানে নেমেছে।
ওরা পাঁচজন ঘরে ঢোকার জন্যে দরজার দিকে এগোচ্ছিল।
আহমদ মুসা দেয়ালের আড়াল থেকে এক ঝটকায় বের হয়ে। স্টেনগানের ব্যারেল দরজার বাইরে বের করে ট্রিগার চেপে ধরল।
গুলি করার সাথে সাথে আহমদ মুসাও বের হয়ে এসেছিল জার বাইরে। দরজার বাইরের পাঁচজনই আহমদ মুসার গুলির খোরাক হয়ে গেল।
আহমদ মুসা ওদের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের হাতের স্টেনগান ফেলে দিয়ে ওদের তিনটি সাইলেন্সর লাগানো স্টেনগান তুলে নিল। দুটি বাঁধে ফেলে ও একটি হাতে নিয়ে তা সামনে বাগিয়ে ছুটল করিড়োর ধরে দক্ষিণ দিকে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত যে, উপরে উঠার সিঁড়ি কিংবা লিফট নিশ্চয় ওদিকে আছে। সে দৌড়বার সময় দুপাশেই খেয়াল রাখছে।
বেশ কিছুটা দৌড়াল আহমদ মুসা। দক্ষিণমুখী করিডোর যেখানে পুব দিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছতেই সে দেখল পুব দিক থেকে কয়েকজন স্টেনগানধারী ছুটে আসছে।
ঠিক এই সময় পেছন থেকেও অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। সে সবে পুব দিকের করিডোরে প্রবেশ করেছিল।
সে ঝাঁপিয়ে পড়ল করিডোরের মেঝের উপর। তার স্টেনগান সামনের দিকে বাগিয়ে ধরা। আহমদ মুসা গড়িয়ে করিডোরের বাম দিকের কোনায় সরে এল। এর ফলে পুব দিকের করিডোর তার চোখের সামনেই থাকল। কিন্তু দক্ষিণমুখী করিডোের থেকে ছুটে আসা লোকদের চোখ থেকে সে আড়াল হয়ে গেল। তবে ওরা বাঁকের মুখে না আসা পর্যন্ত আহমদ মুসাকে দেখতে পাবে না।
গড়াতে গিয়ে আহমদ মুসা বুঝতে পারল তার উরু ও ডান বাহু আহত হয়েছে। মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়ই এ দুটি গুলি তাকে। আহত করেছে। গুলি দুটি উরু ও বাহুর কিছু অংশ ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে, না ভেতরে আছে তা আহমদ মুসা বুঝতে পারছে না। তবে যন্ত্রণা থেকে বুঝছে ক্ষত দুটি গম্ভীর হতে পারে। কিন্তু এই যন্ত্রণা ও বেদনাকে প্রশ্রয় দেবার মত সময় তার হাতে এখন নেই।
আহমদ মুসা মেঝের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েই পুব দিক থেকে ছুটে আসা লোকদের লক্ষ্যে করিডোরের সমান্তরালে গুলি করা শুরু করেছিল, গড়িয়ে কোনায় সরে গিয়েও গুলি অব্যাহত রেখেছিল আহমদ মুসা।
ওরা পুব দিক থেকে করিডোর ধরে দৌড়ে আসছিল। গুলিও শুরু করেছিল ওরা। কিন্তু করিডোরের বাম পাশে গড়িয়ে যাবার অল্প সময় পরে ওদের গুলি বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা মাথাটা হঠাৎ তুলে দেখল ওরা সবাই করিডোরে শুয়ে আছে। সে ভাবল, ওরা আহত, নিহত, না জীবিত?
ওদের নিয়ে ভাববার আর সময় হলো না আহমদ মুসার। তার পেছনের করিডোরের পায়ের শব্দ আরও কাছে এসে গেছে।
আহমদ মুসা করিডোরের পুবমুখী বাকটার এপাশে শুয়ে থেকে দেহটাকে ঘুরিয়ে নিল।
ওদিকের পায়ের শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। দক্ষিণমুখী করিডোরে উঁকি দেয়ার জন্য আহমদ মুসা ক্রল করে ফুটখানেক সামনে এগোলো।
স্টেনগানের ট্রিগারে হাত রেখে আহমদ মুসা পলকের জন্যে উঁকি দিল করিডোরের দিকে। দেখল, ওরা বেশ কয়েকজন স্টেনগান বাগিয়ে বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে আসছে।
ওরা তো দৌড়িয়ে আসছিল। হঠাৎ ওদের এই পরিবর্তন কেন? এ দিকের গোলাগুলি ওরা কি টের পেয়েছে। নিশ্চয় টের পেয়েছে। এই। বিশেষ প্রহরীদের স্টেনগানে ডাবল সাইলেন্সর লাগানো থাকলেও গুলি বেরুনোর সময় খুব নিচু হলেও দুপ করে শব্দের একটা চেইন বেরিয়ে আসে। কেউ সতর্ক থাকলে এবং এই স্টেনগান থেকে বেরুনো দুপ শব্দের সাথে পরিচিত হলে এটা তাদের কান এড়াবে না। নিশ্চয়। এদেরও কান এড়ায়নি। এদিকে কি ঘটেছে ওরা কিছুই জানে না। সেটাই দেখার জন্যে এগোচ্ছে ওরা। এদিক থেকে ওরা মানসিকভাবে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। এটা আহমদ মুসার জন্যে সুযোগ।
আহমদ মুসা স্টেনগান তিরিশ ডিগ্রি এ্যাংগেলে সেট করে অপেক্ষা করতে লাগল। এখন ওরা ৪৫ ডিগ্রি এ্যাংগেলে।
ওরা নিঃশব্দে দ্রুতই এগোচ্ছিল। এক মিনিটেরও কম সময়ে ওরা এসে গেল। আহমদ মুসা স্টেনগানের ট্রিগারে তর্জনি সেট করে স্টেনগানের নল দিয়ে মেঝেতে আঘাত করল।
শব্দের সাথে সাথেই ওরা চমকে উঠে এদিকে তাকাল। দেখতে পেল আহমদ মুসার মাথা ও স্টেনগানের ব্যারেল। ওরা সবাই তড়িঘড়ি করে স্টেনগানের নল এ কর্নারের দিকে তাক করছিল।
আহমদ মুসা স্টেনগানের ট্রিগার চেপে ধরে ওদের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল। করিডোরের মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল ওদের পাঁচটি দেহ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে পুব দিক থেকে আসা করিডোরের উপর পড়ে থাকা লাশগুলোর দিকে একবার তাকাল। দেখল, ওরা ওখানে পাঁচজন নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছে।
আহমদ মুসা কোন্ দিকে যাবে বুঝতে পারছিল না। সামনেই করিডোরের ডান পাশে দেখল একটা দরজা আধা খোলা অবস্থায়।
আহমদ মুসা ভাবল, ঘরে ঢুকে পরিস্থিতি বুঝার জন্যে একটু সময় নেয়া দরকার। আরও কেউ আসে কি না, কোন্ দিক থেকে আসে।
আহমদ মুসা ঢুকে গেল ঘরে। ঘরটা অফিসঘরের মত সাজানো। ঘরে ঢুকেই সামনে একটু বাম পাশে একটা অফিস টেবিল। টেবিলে এলোমেলোভাবে কিছু কাগজ-পত্র ছড়ানো। একটা কলম খোলা অবস্থায় টেবিলে পড়ে আছে। টেবিলের এক পাশে একটা পানির গ্লাস। গ্লাসে অর্ধেক পানি। রিভলভিং চেয়ারটা একদিকে বেঁকে আছে। মনে হচ্ছে। এইমাত্র কেউ কাজ করতে করতে বেরিয়ে গেছে।
টেবিলের ডান পাশে একটা সাইড টেবিল। টেবিলে মেগাস্ক্রিনের একটা কম্পিউটার। স্ক্রিনটায় ভর্তি অনেকগুলো লাইভ ছবি। স্ক্রিনটার দিকে আহমদ মুসা তাকিয়েই বুঝল, এটা সিসিটিভির মনিটরিং স্ক্রিন।
আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত খুশি হলো আহমদ মুসা। তার চোখ মনিটরিং স্ক্রিনের উপর আঠার মত লেগে গেল। যে করিডোর দিয়ে সে ঢুকেছিল তা দেখতে পেল। দক্ষিণমুখী করিডোরের শুরুর দিকে একটি লাশ, শেষের দিকে আরও পাঁচটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। পুবমুখী করিডোরের লাশগুলোও সে দেখল। করিডোরের পাশের ঘরগুলোও দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে যে ঘরে আহমদ মুসা ঢুকে ছিল, সে ঘরের চারটি লাশও সে দেখল। পুবমুখী যেখানে লাশগুলো পড়ে আছে। তার একটু সামনেই দুতলায় উঠার সিঁড়ি। দুতলার মাত্র দুটি কক্ষ মনিটরিং স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে। একটি কক্ষ অফিসরুমের মত। তার সামনে প্রশস্ত করিডোর বা লাউঞ্জের মত জায়গা। তার পরেই একটা বিশাল কক্ষ। কক্ষের চারদিক কম্পিউটার ও নানা ধরনের যন্ত্রে ঠাসা। কক্ষের উত্তর দিকের দেয়ালের ভেতর দিয়ে পাইপ মোড়া গুচ্ছ গুচ্ছ নানারকম তার প্রবেশ করেছে এই ঘরে। ঘরের ঠিক মাঝখানে স্টিলের উঁচু প্ল্যাটফরম। প্ল্যাটফরমের উপর বিশাল আকারের জটিল সব যন্ত্রপাতি। যন্ত্রপাতির মাঝখানে স্তম্ভ আকারের এ্যান্টেনা জাতীয় কিছু। তার কালো কুচকুচে মাথাটা প্রবল বেগে ঘুরছে। প্ল্যাটফরমের উপর অনেক যন্ত্রপাতি এবং তার পাশে চারটি মেগাস্ক্রিনের সামনে বসে আছে চারজন। স্ক্রিনের উপর দিকে একটি করে লাল শিরোনাম, তা স্পষ্টই পড়া যাচ্ছে। একদম বাম পাশেরটায় লেখা কাউন্টডাউন ফেজ-১, দ্বিতীয়টায় কাউন্টডাউন ফেজ-২, তৃতীয়টায় কাউন্টডাউন ফেজ-৩। তারপরের লোকটার সামনের স্ক্রিনের শিরোনাম ফাইনাল ফেজ ফায়ার। পড়েই চমকে উঠল আহমদ মুসা। সবগুলো শিরোনামই লাইভ। তার মধ্যে শিরোনাম কাউন্টডাউন ফেজ-১ ফ্লাশ করছে। তার মানে অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি তারা শুরু করে দিয়েছে। কাউন্টডাউনের প্রস্তুতি চলছে। আহমদ মুসার মনটা কেঁপে উঠল। কম্পিউটার স্ক্রিনেই দেখল সময় পৌনে দশটা। সময় হাতে আছে মাত্র সোয়া দুই ঘণ্টা। তৎপর হয়ে উঠল আহমদ মুসা।
অপারেশন রুমের মনিটরিং স্ক্রিনের সামনের চারজন ছাড়া আর কাউকে দেখছে না আহমদ মুসা।
অপারেশন রুমের ওরা চারজন অপারেটিং সাইন্টিস্ট হতে পারে, কিন্তু নেতৃস্থানীয়রা কোথায়? দুতলায় নিশ্চয় আরো কক্ষ আছে, তারা নিশ্চয় কোথাও আছে।
আহমদ মুসা মনিটরিং স্ক্রিনের সামনে থেকে সরে এল। সবকিছু মনিটর যে করছিল সে লোকটা কোথায়? কাজ করতে করতে নিশ্চয় সে উঠে গেছে! কোথায় গেল? যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে সে নেই তো? থাকতেও পারে! মনিটর দেখেই সে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রহরীদের দিয়েছে এবং সে কারণেই প্রহরীরা পরিকল্পিভাবেই আক্রমণে এসেছে। কিন্তু সে গেল কোথায়? মনিটরিং অবশ্যই এতক্ষণ আনঅ্যাটেনডেড থাকার কথা নয়। নিশ্চয় সে মারা পড়েছে। হতে পারে, হয়তো সে-ই ছিল নিচের তলার প্রহরীদের পরিচালক ও সমন্বয়কের দায়িত্বে এবং এই একই কারণে সিসিটিভির মনিটরিং-এর দায়িত্বও তার ছিল। অবস্থা দেখে হয়তো সেও প্রহরীদের সাথে অপারেশনে অংশ নেয় এবং মারা পড়ে।
অফিসরুম থেকে বের হলো আহমদ মুসা। সে এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত যে, নিচের তলায় কোন প্রহরী আর অবশিষ্ট নেই। বিশ একুশ জনের মত প্রহরী নিচের তলায় ছিল, আর তারা সবাই মারা পড়েছে।
আহমদ মুসা ডান দেয়ালের গা ঘেঁসে খুব সতর্কতার সাথে এগোতে লাগল। অল্প সামনেই উপরে উঠার সিঁড়ি। আর দুধাপ এগোলেই সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছা যাবে।
আহমদ মুসা কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা সামনের সিঁড়ির উপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসছে।
থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। কারো কথা শুনতে পেল সিঁড়ি থেকে। একজন উঁচুগলায় বলছে, দানিয়েল কোথায় তুমি, ধরবো টেলিফোন? কি ঘটছে জানতে বললাম, কিছুই জানালে না তো?
আহমদ মুসা বুঝতে পারল নিচে কি ঘটেছে উপরের কেউ তা এখনো জানতে পারেনি। যে নিচে নেমে আসছে সে নিশ্চয় কর্মকর্তাদের কেউ একজন হবে। আহমদ মুসা ভাবল, তাকে ঠেকাতে হবে। তাকে কিছুই জানতে দেয়া যাবে না। সে স্টেনগানের ট্রিগারে তর্জনি রেখে এগোলো সিঁড়ির গোড়ায়।
দেয়ালের প্রান্তে আহমদ মুসা একটু দাঁড়াল লোকটা সিঁড়ির শেষ অংশে পৌঁছার অপেক্ষায়। পায়ের শব্দ শুনে বুঝল লোকটা প্রায় সিঁড়ির শেষ অংশে নেমে এসেছে।
আহমদ মুসা সিঁড়ির পাশে দেয়ালের প্রান্তে মুহূর্তের জন্যে একটু দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় বেরিয়ে সিঁড়ির একেবারে গোড়ায় এসে দাঁড়াল এবং উদ্যত স্টেনগানের ব্যারেল লোকটির অবয়ব লক্ষ্যে তাক করেই ট্রিগারে চাপ দিল।
একঝাঁক গুলি গিয়ে জড়িয়ে ধরল লোকটিকে। লোকটির হাতেও একটা স্টেনগান ছিল।
অদ্ভুত ক্ষিপ্র লোকটি। এমন আকস্মিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও সে তার স্টেনগান তুলেছিল। গুলির আঁক গিয়ে তাকে আঘাত করলেও সে তর্জনি চাপল স্টেনগানের ট্রিগারে।
আহমদ মুসাও লোকটির স্টেনগান তাক করা দেখেছিল। তবে সে গুলি করার সময় পাবে আহমদ মুসা তা ভাবেনি। কিন্তু তবুও সে তার দেহটা ডান দিকে একটু ঝুঁকিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু আহমদ মুসা শেষ রক্ষা করতে পারল না। তার ভাবনা মিথ্যা প্রমাণ করে লোকটির স্টেনগান থেকে অনেকগুলো গুলি ছুটে এল। সে তার দেহ ডানদিকে ঝুঁকিয়ে দেয়ার কারণে বাম পাশ দিয়ে অনেকগুলো গুলি ছুটে গেল। তবে একটা গুলি এসে বাম কাঁধে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করল। তীব্র একটা ব্যথা ও ঝাঁকুনি খেয়ে আহমদ মুসা বসে পড়ল। তার হাত থেকে পড়ে গেল স্টেনগান। সে ডান হাত দিয়ে চেপে ধরল বাম কাঁধ। মুহূর্ত কয়েকের জন্য চিন্তা ভোঁতা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসার।
কিন্তু শীঘ্রই নিজেকে সামলে নিল আহমদ মুসা। কাঁধের স্টেনগান দুটি থেকে একটা ফেলে দিয়ে শরীরটাকে টেনে তুলে উঠে দাঁড়াল সে। মনে হচ্ছে তার বাম কাঁধের ওজন যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। সামনে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি, ভাবল আহমদ মুসা। সব ব্যথা বেদনা, আঘাত ভুলে যেতে চেষ্টা করল সে। যতটা দ্রুত পারল সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল।
পৌঁছল গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়া লোকটির কাছে। লোকটির শরীরের নিচের অংশ সিঁড়িতে, মাথা সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ।
তার ডান হাতের স্টেনগানটা হাত থেকে খসে পড়ে গেছে। কিন্তু হাতটা ঝুলে আছে সিঁড়ির একটা ধাপের উপর। তার হাতঘড়ির সাদা। স্ক্রিনটা জ্বলজ্বল করছে।
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়িয়েছিল লাশের পাশে। লোকটার হাতঘড়ির সাদা স্ক্রিনটা তার দৃষ্টিকে টেনে নিয়েছিল। হাতঘড়িটার সাদা স্ক্রিনের উপরের অংশে একটা লাল ডট ফ্লাশ করছিল।
ঘড়ির অস্বাভাবিক এই রেড ডটের ফ্লাশ করার অর্থ কি? আহমদ মুসা ঘড়িটা খুলে নিল লোকটার হাত থেকে।
এ লোকটার হাতে এমন ঘড়ি কেন, লোকটা কে?
এই চিন্তাও মাথায় এল আহমদ মুসার। সে লোকটার উবু হয়ে পড়ে থাকা মুখটা ঘুরিয়ে দিল।
লোকটার মুখের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। এতো দেখছি ডেভিড কোহেন কানিংহাম! এইচ থ্রি এবং ফোম-এর এক্সিকিউটিভ চীফ! বেচারা এভাবে এখানে মারা পড়ল! তাকে তো বাঁচিয়ে রাখা দরকার ছিল।
আহমদ মুসা তার পকেট সার্চ করল। অয়্যারলেস ওয়াকিটকি ছাড়া আর কিছুই পেল না। অয়্যারলেস তার পকেটে রেখে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। ঘড়িটাকে ভালো করে দেখল সে। ঘড়ির সামনের স্ক্রিনে। ফ্লাশিং রেড ডট ছাড়া নতুন বা অস্বাভাবিক কোন কিছু পেল না।
ঘড়ির ব্যাক সাইডে দেখল একটা অস্বচ্ছ পেস্টিং টেপ লাগানো। টেপের উপর কোন কিছু লেখা নেই এবং এ টেপ লাগানোর কোন যৌক্তিকতাও খুঁজে পেল না আহমদ মুসা। কেন তাহলে এই টেপ?
টেপটি গড়ির ব্যাক থেকে তুলতে চেষ্টা করল আহমদ মুসা। সহজেই উঠে গেল টেপটি। টেপটি ফেলে দিতে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ দেখতে পেল, টেপের ভেতরের সাইডে লাল রঙের কিছু লেখা।
টেপের এদিকটা চোখের সামনে নিয়ে এল আহমদ মুসা। লাল রঙের তিনটি লাইন। লাইন তিনটিতে লেখা- কাউন্টডাউন স্টার্ট। এর সাথে কিছু বিদ্ঘুটে সংখ্যা। দ্বিতীয় লাইনে, কাউন্টডাউন স্টপ। এর সাথেও ঐ ধরনের বিদঘুঁটে কিছু সংখ্যা। তৃতীয় লাইনে লেখা, ফাইনাল ফায়ার। এর পাশেও আগের লাইন দুটির মত বিদ্ঘুটে সংখ্যার একটা সারি!
বিস্মিত, আনন্দিত আহমদ মুসা বুঝল, এ সবগুলোই কাউন্টডাউন ও ফাইনাল অপারেশন স্টার্ট-এর পাসওয়ার্ড। আহমদ মুসাদের জন্যে অমূল্য এক প্রাপ্তি এটা।
আহমদ মুসা ঘড়িটা ও টেপটা জ্যাকেটর পকেটে রেখে শরীর টেনে। নিয়ে ছুটল দুতলার অপারেশন রুমের উদ্দেশ্যে। দুতলার সামনে উত্তর দিকে একটা লাউঞ্জ দেখতে পেল। হাতের ডান ও বাম দুপাশেও অনুরূপ লাউঞ্জ সে দেখল। সামনের লাউঞ্জের মাঝ বরাবর একটা বড় দরজা। আহমদ মুসা মনিটরিং স্ক্রিনের অপারেশন রুমে প্রবেশের পথে এ রকম একটা বড় দরজাই দেখেছিল।
আহমদ মুসা দ্রুত দরজার উদ্দেশ্যে এগোলো। দরজায় একটু চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। ঘরে প্রবেশ করল সে।
এ ঘরটাকে বলা যায় অফিস কাম বিশ্রাম কক্ষ। অফিল টেবিল, অফিস আলমিরা, সোফা, ইজিচেয়ার সবকিছু রয়েছে এই ঘরে। এই ঘরের উত্তর দেয়ালে আরেকটা দরজা। আহমদ মুসা গিয়ে দরজা খুলে ফেলল।
ঘরের দিকে একবার তাকিয়েই সে বুঝল এটাই সেই বিশাল অপরেশন কক্ষ যা মনিটরিং স্ক্রিনে সে দেখেছে। ঘরের চারদিক নানা রকম কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতিতে ঠাসা এবং ঘরের মাঝখানে আছে সেই উঁচু প্ল্যাটফরম। প্ল্যাটফরমে ঢাউস সাইজের বিশাল একটা যন্ত্র। সেই যন্ত্রকে সামনে রেখে চারজন লোক চারটি স্ক্রিনের সামনে বসে আছে। সে চারজন লোক সহসা মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার হাতে স্টেনগান এবং তার গোটা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেখে চারজনেরই চোখ ছানাবড়া।…
আহমদ মুসা ঐ চারজন লোক ও তাদের সামনে রাখা স্ক্রিনের দিকে তাকাল। নিচের মনিটরিং স্ক্রিনে সে যা দেখেছে এখানকার স্ক্রিনেও হুবহু তাই দেখা যাচ্ছে। কাউন্টডাউন ফেজ-১, কাউন্টডাউন ফেজ-২, কাউন্টডাউন ফেজ-৩ এবং ফাইনাল ফায়ার ফেজ- সবই দেখা যাচ্ছে চারটা স্ক্রিনে।
চার স্ক্রিনের সামনের চারজন লোক পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা ওদের দিকে স্টেনগান তুলে বলল, অপারেশন কাউন্টডাউন কখন শুরু হয়েছে?
বামদিকের স্ক্রিনের সামনের লোকটা বলল, সকাল ৯টায় অপারেশন কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে।
শেষ হবে কখন? বলল আহমদ মুসা।
কাউন্টডাউনের ফাস্ট ফেজ শেষ হবে বেলা দশটায়, সেকেন্ড ফেজ চলবে সকাল ১১টা পর্যন্ত। দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলবে থার্ড ফেজ। সেই আগের লোকটাই বলল।
কাউন্টডাউন বন্ধ করা যাবে কিভাবে? বলল আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে ওদের কাছ থেকে কোন উত্তর এল না।
আহমদ মুসা স্টেনগানের ব্যারেলটা ওদের উপর দিয়ে একবার ঘুরিয়ে এনে ধমকের সুরে বলল, দেখুন আমি এক প্রশ্ন দুবার করি না।
সংগে সংগেই ওদিক থেকে উত্তর এল, কাউন্টডাউনের দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হওয়া পর্যন্ত কাউন্ট বন্ধ করা যাবে। কিন্তু কাউন্টডাউন একবার ততীয় পর্যায়ে প্রবেশ করলে আর তা বন্ধ করা যাবে না। কাউন্টডাউনের তৃতীয় পর্যায় এবং ফাইনাল ফায়ার কার্যত একই পর্যায়ের।
কাউন্টডাউন তো প্রথম পর্যায়ে চলছে। এটা তো বন্ধ করা যাবে। বলল আহমদ মুসা।
বন্ধ করা যাবে। কিন্তু বন্ধ করার পাসওয়ার্ড আমাদের জানা নেই। চারজনের মধ্যে সেই লোকটাই বলল।
লোকটার মুখ থেকে পাসওয়ার্ডের কথা শুনেই আহমদ মুসার মনে। হাতঘড়ির ব্যাক থেকে পাওয়া পাসওয়ার্ডের কথা ভেসে উঠল। তাহলে এখন সব পাসওয়ার্ড তার কাছেই। ফাইনাল ফায়ারের পাসওয়ার্ড কি ওদের কাছে নেই? জানতে হবে বিষয়টা।
পাসওয়ার্ড না পেলে কি কাউন্টডাউন বন্ধ করা যাবে না? বলল আহমদ মুসা।
না, বন্ধ করা যাবে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কাউন্টডাউন সেকেন্ড ও থার্ড। ফেজ পেরিয়ে ফাইনাল ফায়ারে চলে যাবে। চারজনের একজন বলল।
কিন্তু ফাইনাল ফায়ারের জন্যে পাসওয়ার্ড-এর কি দরকার আছে? বলল আহমদ মুসা।
জি হ্যাঁ, ফাইনাল ফায়ারের জন্য পাসওয়ার্ড দরকার। কিন্তু কাউন্ট শুরু হবার পর তা যদি যথাসময়ে বন্ধ না হয় এবং ফাইনাল ফায়ার স্টেজে পৌঁছে যায়, তারপরে যথাসময়ে ফায়ার-এর জন্যে পাসওয়ার্ড দিতে হবে, যদি ফায়ার পাসওয়ার্ড না দেয়া হয়, তাহলে ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর অটোম্যাটিক ফায়ার হয়ে যাবে। চারজনের সেই আগের জনই বলল।
ফায়ার বন্ধ করা যায় না? বলল আহমদ মুসা।
ফায়ার বন্ধের কোন পাসওয়ার্ড নেই। ফায়ারিং প্রসেসের ম্যানুয়াল ডিসকানেকশন ফায়ার বন্ধের একমাত্র বিকল্প পথ। বলল চারজনের একজন।
সহযোগিতার জন্যে আপনাদের ধন্যবাদ। প্লিজ, এখন চারজনই হাত উপরে তুলে উঠে আসুন এবং আমার সামনে মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। বাম দিক থেকে তিনজন আগে আসুন। বলল আহমদ মুসা নির্দেশের সুরে।
সংগে সংগেই ওরা নির্দেশ পালন করল।
বাম দিক থেকে প্রথম তিনজন এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসার সামনে। চতুর্থ জন দাঁড়িয়ে থাকল।
ঐ দেখুন ঐ প্যাকেট থেকে বেরিয়ে আসা সিল্কের কর্ডের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। আপনি গিয়ে কর্ড নিয়ে এসে এই তিনজনকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলুন। বলল আহমদ মুসা চতুর্থজনকে লক্ষ্য করে।
যাচ্ছি স্যার, আমি কর্ড নিয়ে আসি। কিন্তু একটা কথা বলতে চাই। স্যার মানুষ হিসাবে। আপনি মারাত্মক আহত স্যার। তিনটা গুলির আঘাত দেখতে পাচ্ছি আপনার দেহে। ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে। আপনার এখনই কিছু এইড দরকার। চতুর্থ লোকটি বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ধন্যবাদ আপনাকে মানুষ হিসাবে কথা বলার জন্যে। কিন্তু এসব বলে আমাকে দুর্বল করবেন না। আমি ভালো আছি। যান আপনি তাড়াতাড়ি কাজ করুন।
লোকটি দ্রুত গিয়ে সিল্কের কর্ড নিয়ে এল এবং পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল তিনজনকে।
ধন্যবাদ সুন্দর করে বাঁধার জন্যে। এবার আপনি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ন। আপনাকেও বেঁধে ফেলতে চাই। দুঃখিত, এই মুহূর্তে আপনাকে। বিশ্বাস করতে পারছি না। এই অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কাউকেই বিশ্বাস করা যাবে না, এ নীতিই আমি অনুসরণ করতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
লোকটি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আহমদ মুসা হাতের স্টেনগানটা পাশে রাখল। গুলিবিদ্ধ বাম কাধ ও গুলিবিদ্ধ বাম বাহুর যন্ত্রণায় কাতর কাঁধ ও হাতের সাহায্য নিয়েই আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে বেঁধে ফেলল চতুর্থ লোকটিকে।
বাঁধা শেষ করেই একটা চেয়ার দরজার মুখে টেনে নিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। নিশ্চিত হলো, এখান থেকে ঘরের ভেতর ও বাইরে সমানভাবে নজর রাখা যাবে।
বসেই বুঝতে পারল আহমদ মুসা, যন্ত্রণা ও বেদনায় শরীর অনেক ভারি হয়ে গেছে। কাঁপছে তার শরীরটা।
স্টেনগান কোলের উপর রেখে পকেট থেকে জর্জ আব্রাহামের দেয়া প্লাস্টিকের এক বিশেষ ধরনের অয়্যারলেস বের করল। ওয়েভলেংথ ঠিক করাই ছিল জর্জ আব্রাহাম জনসনের অয়্যারলেসের সাথে। শুধু ট্রান্সমিটিং বাটনটা অন করল আহমদ মুসা। বাটন অন করেই বলল, হ্যালো মি. জর্জ আব্রাহাম, আস্সালামু আলাইকুম।
.
৬.
প্রেসিডেন্ট ভবনের সিচুয়েশন কক্ষ।
বর্ধিত কলেবরে প্রেসিডেন্টের সংকটকালীন কমিটির বৈঠক।
তাদের সামনে বিশাল সাইজের একটা কম্পিউটার স্ক্রিন। আহমদ মুসার অপারেশন মনিটর হচ্ছে এই স্ক্রিনে। আহমদ মুসার পকেটে একটি ট্রান্সমিটার চিপস রয়েছে। সেই চিপসই ট্রান্সমিট করছে সেখানে সৃষ্টি হওয়া সব শব্দ। আর সেই শব্দ থেকেই আঁচ করা হচ্ছে সেখানে কি ঘটছে। এ প্রেসিডেন্টের নির্দেশেই এটা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট এই ব্যবস্থা এ জন্যে। করেছে যে, এর মাধ্যমে তার সরকারের আরও কি করণীয় আছে সে বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করা।
কমিটির সবার চোখ আঠার মত লেগে আছে টিভি স্ক্রিনের উপর। পল পল করে সময় বয়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই সোয়া ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। উদ্বেগ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সময় কাটছে। আহমদ মুসা বন্দী হওয়ার বিষয়টা তারা জেনেছে স্ক্রিনে ভেসে উঠা বিশেষ শব্দ তরঙ্গ দেখে ও কয়েকটি শব্দ শুনে। কিন্তু আহমদ মুসা মুক্ত হতে পেরেছে কি না সেটা তারা নিশ্চিত জানতে পারেনি। তবে তার বন্দী হওয়ার পরপরই সাইলেন্সর লাগানো স্টেনগানের ব্রাশফায়ারের শব্দ তারা শুনতে পেয়েছে। তারপর ঐ কণ্ঠ আর শোনা যায়নি। এই ব্রাশফায়ারের মিনিট দুয়েক পরে আবারও ব্রাশফায়ারের ঘটনা ঘটেছে সে শব্দও তারা পেয়েছে। ব্রাশফায়ারের ঘটনা এর পরেও তিনবার ঘটেছে। তবে কে কাকে মারছে তা তারা জানতে পারছে না। তবে শব্দ শুনে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে, আহমদ মুসা লড়াইয়ে রয়েছে। আহমদ মুসা একাই যেহেতু একটা পক্ষ, লড়াই চলাই এটা প্রমাণ করে যে, সে এখনো লড়াইয়ে রয়েছে। চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে সবার সান্ত্বনার বিষয় ছিল এটাই।
পঞ্চম ব্রাশফায়ারের পর প্রথমে নীরবতা ভাঙল সিআইএ প্রধান। বলল, এক্সকিউজ মি এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, একটা বিষয়ের দিকে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
প্রেসিডেন্ট তাকাল সিআইএ প্রধানের দিকে।
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আহমদ মুসা ঘাঁটিতে ঢোকার পর পাঁচবার সাইলেন্সর লাগানো স্টেনগানের ব্রাশফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিন দফা ব্রাশফায়ার একেবারে একতরফা। সেখানে কাউন্টার কোন ফায়ার ছিল না। অবশিষ্ট দুই দফা ব্রাশফায়ারের মধ্যে তৃতীয় দফা ব্রাশফায়ারের পর দশ পনের সেকেন্ডের মধ্যেই কাউন্টার ফায়ার হয়েছে। অবশিষ্ট সময়ে ছিল একতরফা ফায়ার। পঞ্চম দফা ফায়ারের সময়ও সংক্ষিপ্ত ফায়ারের উত্তরে সংক্ষিপ্ত আকারে কাউন্টার ফায়ার হয়েছে। আমার মনে হয়েছে প্রথম চার দফা ফায়ারে আহমদ মুসা। ডমিনেট করেছে। হয় কাউন্টার ফায়ার হয়নি আর না হয় কাউন্টার টিকতে পারেনি। কিন্তু এ পর্যন্ত শোনা শেষ ব্রাশফায়ারের বিরুদ্ধে কাউন্টার ফায়ার হয়েছে। এখানে ফায়ারের উত্তরে কিভাবে কাউন্টার ফায়ার হতে পারল এটা আমার কাছে উদ্বেগের বিষয়। বলল সিআইএ প্রধান।
আপনি কি মনে করছেন এ ঘটনায় প্রথম ফায়ার আহমদ মুসা করেছে এবং কাউন্টার ফায়ার করেছে তার প্রতিপক্ষ? জিজ্ঞেস করল প্রেসিডেন্ট।
এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে আমার মনে হয়েছে প্রথম ফায়ারটা আহমদ মুসার তরফ থেকেই করা হয়েছে। আর এখানেই আমার উদ্বেগ। সিআইএ প্রধান বলল।
আপনার উদ্বেগ যথার্থ। ঈশ্বর আহমদ মুসার সহায় হোন। বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
উপস্থিত সকলের চোখে মুখে উদ্বেগের চিহ্ন আরও গম্ভীর হলো।
শেষ সংঘর্ষের পর ১০ মিনিট পার হয়ে গেছে। কোন দিক থেকেই আর কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এটা উদ্বেগের বিষয়। এক্সিলেন্সি। এ সংঘর্ষে শত্রুপক্ষ জয়ী হলে তারা আহমদ মুসার কোন ক্ষতি করতে পারলে তারা অবশ্যই কথা বলত এবং একে সেলিব্রেট করত। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
ঠিক মি. জর্জ। এটা একটা বড় প্রমাণ যে, আহমদ মুসার কোন কিছু হয়নি। গড় সেভ হিম। বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠে আবেগ।
অন্য সবাই আমিন বলে উঠল। সাথে মাথে সবার উদ্বিগ্ন চোখে আশার আলো চিকচিক করে উঠল।
প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হওয়ার কয়েক মুহূর্ত পর নীরব স্ক্রিনে আহমদ মুসার কণ্ঠ ভেসে এল। সবাই শুনতে পেল আহমদ মুসার সেই কণ্ঠটি, অপারেশন কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে।
কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে সকাল ৯টায়-কে একজন আহমদ মুসার কথার উত্তরে বলে উঠল।
আহমদ মুসার কথা ও তার উত্তর শুনে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। সবাই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন। মনে হচ্ছে। আহমদ মুসা শত্রুঘাঁটির মূল অপারেশন রুমে প্রবেশ করেছে। প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ আবেগে কাঁপছিল।
প্রেসিডেন্টের সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। সবাই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল। শত্রুর এমএফ ডব্লিউ অস্ত্রের কাউন্টডাউন, পাসওয়ার্ড এবং ভয়ংকর অটোম্যাটিক ফাইনাল ফায়ারে যাওয়া সংক্রান্ত সব কথা। সবাই শুনল। একদিকে সবাই আনন্দিত এজন্যে যে, অপারেশন কক্ষ এখন আহমদ মুসার নিয়ন্ত্রণে, অন্যদিকে নতুন উদ্বেগ ঘিরে ধরল সবাইকে এজন্যে যে, অস্ত্রের কাউন্টডাউন বন্ধ করতে না পারলে তা অটোম্যাটিক ফায়ার ফেজে চলে যাবে নির্দিষ্ট সময়ে, তখন ফায়ারের জন্যে পাসওয়ার্ডের দরকার হবে না।
আহমদ মুসার কথাবার্তা চলছিল কাউন্টডাউনের কুশলীদের সাথে। তা শুনল সবাই। জানল তারা কাউন্টডাউনের কুশলীরা চারজন। তারা। শুনল আহমদ মুসা কিভাবে তাদের চারজনকে বেঁধে ফেলতে চাচ্ছে। এই সময়ই তারা জানল আহমদ মুসার আহত হওয়ার কথা, তার দেহে তিনটি গুলি লাগার কথা এবং তার দেহ থেকে অব্যাহত রক্তক্ষরণের কথা।
ও গড! আহমদ মুসা মারাত্মক আহত! তার তিনটি গুলি লেগেছে। এই অবস্থাতেই সে অপারেশন কক্ষে পৌঁছেছেন এবং যা করণীয় তা সুস্থ মানুষের মত করছেন। তার কথায় তো কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। বলল সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা।
অন্য সবার মুখে বিষাদের ছায়া।
শুধু আহমদ মুসাই এটা করতে পারেন। তিনি নিজের কথা নয়, অন্যের কথা শুধু ভাবেন, সাহায্যও করেন। বলল প্রেসিডেন্ট। গম্ভীর কণ্ঠ তাঁর।
প্রেসিডেন্টের কথা শেষ হতেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে, এক্সিলেন্সি, আহমদ মুসার অয়্যারলেস এসেছে। আমি তার সাথে কথা বলে আসি।
মি. জর্জ, আপনার অয়্যারলেসে ভয়েস লাউড় করার অপশন থাকলে কলটা লাউড করে দিন। আপনি বসুন। আমরা সকলে আহমদ মুসার কথা শুনতে চাই। অপেক্ষা করতে পারবো না আমরা। বলল প্রেসিডেন্ট।
ইয়েস এক্সিলেন্সি, সে অপশন অবশ্যই আছে। ধন্যবাদ আপনাকে, আমি কলটা লাউড করে দিচ্ছি। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
কথা বলে উঠল আহমদ মুসার কণ্ঠ জর্জ আব্রাহাম জনসনের অয়্যারলেস থেকে, হ্যালো মি. জর্জ আব্রাহাম, আসোলামু আলাইকুম।– ওয়াআলাইকুম সালাম। মি. আহমদ মুসা, প্রেসিডেন্টসহ আমরা মিটিং-এ আছি। আমরা সবাই আপনার কলের অপেক্ষায় ছিলাম। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আলহামদুলিল্লাহ। ওদের ডেথ ভ্যালি ঘাঁটিতে ওদের অ্যাকটিভ কেউ বেঁচে আছে বলে মনে হয় না। এইচ থ্রি ও ফোম-এর নির্বাহী প্রধান। ডেভিড কোহেন ক্যানিংহামসহ ওদের একুশ বাইশজন মারা পড়েছে। আপনারা…।
আহমদ মুসার কথার মধ্যেই জর্জ আব্রাহাম জনসন কথা বলে উঠল, ডেভিড কোহেন ক্যানিংহাম মারা গেছে, আপনি নিশ্চিত আহমদ মুসা?
আগে বুঝতে পারিনি, কিন্তু মরে যাবার পর লাশ পরীক্ষা করতে গিয়ে তাকে আমি চিনতে পেরেছি। বন্দী থাকাকালে আমি তাকে ভালো করেই দেখেছি। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা, বলুন। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আপনারা ট্রান্সমিটার চিপস-এর মাধ্যমে কাউন্টডাউনের কিছু কথা অবশ্যই জানতে পেরেছেন। কাউন্টডাউন ফাস্ট ফেজ থেকে সেকেন্ড। ফেজ-এ প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আমাদের হাতে আর মাত্র সময় আছে এক ঘণ্টা। এই সময়ের মধ্যে কাউন্টডাউন বন্ধ করতে হবে। এর পর আর বন্ধ করা যাবে না। এই ব্যাপারে একাধিক প্রফেশনাল পাঠানোর জন্যে অনুরোধ করছি। দ্বিতীয়ত…।
আবারও আহমদ মুসার কথার মাঝখানে কথা বলে উঠল জর্জ আব্রাহাম জনসন, পাসওয়ার্ডের কি হবে আহমদ মুসা? পাসওয়ার্ড ছাড়া। ডিসম্যান্টলের যে প্রসেসের বিষয়, তা সময় সাপেক্ষও হয়ে যেতে পারে। ওরা বললেও সে ম্যানুয়াল অপশন কতটা ওয়ার্কের্বল হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আলহামদুলিল্লাহ। পাসওয়ার্ড আমার কাছে আছে। মি. ডেভিড ক্যানিংহাম কোহেনের হাতঘড়ির ব্যাক থেকে পাসওয়ার্ডগুলো আমি উদ্ধার করেছি। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার শেষ কথাটা শোনার সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট থ্যাংক গড় বলে উঠল। উপস্থিত সকলের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
মুহূর্তকাল থেমে আহমদ মুসাই আবার কথা বলে উঠল, মি. জর্জ আব্রাহাম, অবিলম্বে আপনাদের বাহিনীকে এ ঘাঁটির দখল নিতে হবে। ঘাঁটির বাইরে থেকে এদের সাহায্যের জন্যে কেউ আসবে কি না জানি না। কোন ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না।
হ্যাঁ, বুঝেছি আহমদ মুসা। কমান্ডো হেলিকপ্টার, চিকিৎসকদল, বিজ্ঞানীদের একটা গ্রুপ সবই প্রস্তুত আছে। এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্টসহ সবাই হাজির আছেন এখানে। এখনি সবকিছুর নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
একটু থেমেই জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল, আহমদ মুসা প্লিজ, আপনার কথা বলুন। আমরা উদ্বিগ্ন।
দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে যা ঘটার সেটাই ঘটেছে। খুবই স্বাভাবিক। এটা। আমি কিছুটা আহত। বলল আহমদ মুসা।
কতটা আহত? জিজ্ঞাসা জর্জ আব্রাহামের। বাম বাহু, বাম কাঁধ এবং উরুতে গুলি লেগেছে। তবে আমি ভালো আছি। আহমদ মুসা বলল।
তিনটি গুলি লাগলে কেউ ভালো থাকে! আপনি বুঝতে পারছেন না, আপনার কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। আমিও আসছি আহমদ মুসা, আপনি সেখানেই বিশ্রাম নেন।
আমি দুতলায় অপারেশন কক্ষের দরজায় চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আছি। ভেতর ও বাহির দুদিকেই চোখ রাখছি। দ্রুত আসুন আপনারা। শুনুন, ডেথ ভ্যালির উত্তর পাশের ঠিক মাঝামাঝি পাহাড়ে ট্রি-লাইন থেকে বেশ কয়েক ফুট নিচে ভেতরে প্রবেশের দরজা। বাইরের দরজা দুটোই ভোলা আছে। আপনারা আসুন।
আপনি ভালো থাকুন। আমরা আসছি আহমদ মুসা। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ও.কে। আসোলামু আলাইকুম। আহমদ মুসা বলল।
ওয়াআলাইকুম সালাম। বলে অয়্যারলেস রাখল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন কথা শেষ করতেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, মুহূর্তও আর দেরি নয় মি. জর্জ। আহমদ মুসাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার। কমান্ডোদের হেলিকপ্টারগুলোকে এখনি যাত্রা করতে হবে। বিজ্ঞানীদের গ্রুপসহ আপনারা যান। বিষয়টা ব্রডকাস্টে আসা দরকার, লাইভ ব্রডকাস্ট। জাতিকে সব বিষয় এখনি জানানো দরকার। যে ভায়বহ ষড়যন্ত্রের মুখে আমরা পড়েছিলাম, তা জাতিরও পুরোপুরিই জানা দরকার।
সিনেট ও কংগ্রেসের সরকারি ও বিরোধী দলীয় চার নেতা, তাদের সাথে সবাই প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে সমর্থন করল।
প্রেসিডেন্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাল। বলল, ধন্যবাদ ঈশ্বরকে! তিনি আমেরিকা ও আমেরিকার জনগণকে এক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছেন। আহমদ মুসার প্রতি সবাই আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাদের জন্যে কাজ করেছেন। অতীতেও তিনি আমাদের অশেষ উপকার করেছেন। কোন বিনিময়ের জন্যে তিনি এসব করেননি। আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, একজন মুসলিমের ইমেজ যদি এটা হয়, তাহলে তাদের চেয়ে বড় মানবতাবাদী আর দেখি না। যাক মি. জর্জ আব্রাহাম, আহমদ মুসা হাসপাতালে এলে আমাদের জানিও। বলে উঠে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট।
সবাই উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা, এত বড় ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি দেখার সুযোগ আমরা সকলেই লাভ করতে চাই।
হ্যাঁ, সবাই আপনারা যেতে পারেন। তবে সেটা হতে পারে। কমান্ডোরা সেখানে পৌঁছে গ্রীন সিগন্যাল দেয়ার পর। বলল প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট চলে গেল।
প্রেসিডেন্ট চলে যাবার পর জর্জ আব্রাহাম জনসন সবাইকে লক্ষ্য করে বলল, আপারেশন ডেথ ভ্যালির জন্যে সেনা, নৌ, বিমান সেনা, এফবিআই, সিআইএ ও পুলিশ সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমান্ডোবাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে কর্নেল আইজেন হাওয়ারকে। প্রেসিডেন্টের নির্দেশে তারা মুভ করেছেন। আপনার যাওয়ার বিষয়টাকে সেনাপ্রধানকে কমুনেট করার জন্যে অনুরোধ করছি।
ধন্যবাদ জর্জ আব্রাহাম জনসন। আমি সব ব্যবস্থা করছি। কর্নেল আইজেন হাওয়ার ও.কে. করলেই আমরা যাত্রা করবো। বলল সেনাপ্রধান। * জর্জ আব্রাহাম জনসন সেনাপ্রধানকে ধন্যবাদ এবং সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আহমদ মুসার পরিবারকে বিষয়টা এখনি জানানো দরকার, ভাবল জর্জ আব্রাহাম জনসন। পকেট থেকে অয়্যারলেস বের করতে গিয়েও থেমে গেল জর্জ আব্রাহাম। এই ঘটনা টেলিফোনে বলা কি ঠিক হবে? গিয়ে বলতে পারলে সেটাই সঠিক হতো। কি করবে সে? হাতে সময় নেই। তাকে এখনি যেতে হবে ডেথ ভ্যালিতে। ওদের বাড়িতে গেলে কিছু সময় তো দেরি হবেই। অবশেষে টেলিফোন করার কথাই ঠিক করল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
পকেট থেকে অয়্যারলেস বের করে কল তৈরি করল সারা জেফারসনের জন্যে।
মারিয়া জোসেফাইন কুরআন শরীফ পড়ছিল। একপাশে বসেছিল সারা জেফারসন, অন্যপাশে আহমদ আবদুল্লাহ। সামনের সোফায় বসেছিল জিনা জেফারসন, সারা জেফারসনের মা।
সকলেরই মুখ গম্ভীর। তাতে উদ্বেগের ছায়া। এমনকি আহমদ আবদুল্লাহও আজ কোন দুষ্টুমি করছে না। তাকে বলা হয়েছে তার বাবার জন্যে দোয়া করতে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে। বাবার জন্য আল্লাহর সাহায্য চেয়ে কেন দোয়া করতে হবে? এমন দোয়া তো সে আগে কখনো করেনি। আহমদ আবদুল্লাহর এই জিজ্ঞাসার জবাবে বলা হয়েছে তার বাবা আজ এক বিপজ্জনক কাজে গেছেন। বিষয়টা বুঝেছে আহমদ আবদুল্লাহ। তারপর থেকেই সে শান্ত।
শান্তভাবে কুরআন শরীফ পড়ছে মারিয়া জোসেফাইন। পাশে বসে সারা জেফারসন কুরআন শরীফ শুনছে বটে, কিন্তু চোখে মুখে তার অস্থিরতা। সেই সাথে সে অন্যমনস্কও। সে এতটাই অন্যমনস্ক যে, একবার আহমদ আবদুল্লাহ তার কোলে গিয়ে বসেছিল, এমন ক্ষেত্রে অবশ্যই সারা জেফারসন আহমদ আবদুল্লাহকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, কিন্তু আজ সে তাকে কোলেও জড়িয়ে ধরেনি, আদরও করেনি।
মারিয়া জোসেফাইন এটা খেয়াল করেছিল।
কুরআন শরীফ পড়া বন্ধ করে সে তাকিয়েছিল সারা জেফারসনের দিকে। জেফারসনের পিঠে হাত রেখে বলেছিল, সারা, আল্লাহর উপর ভরসা কর। তিনি যার নেগাহবান, তার ক্ষতি দুনিয়ার কেউ করতে পারে না।
সারা জেফারসন জোসেফাইনের হাত জড়িয়ে ধরে স্যরি আপা, বলে হাসতে চেষ্টা করল। কিন্তু হাসিটা কান্নার মত হয়ে গেল। তার চোখের কোণায় অশ্রু স্পষ্ট হয়ে উঠল।
এ সময় সারা জেফারসনের মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইলের রিং শুনেই সারা জেফারসনের চোখে-মুখে একটা চমকে উঠা ভাব ফুটে উঠল। সে একবার তাকাল মারিয়া জোসেফাইনের দিকে।
আল্লাহ ভরসা, ধর টেলিফোন সারা। বলল জোসেফাইন কুরআন বন্ধ করতে করতে।
অনেকটা কম্পিত হাতেই পাশ থেকে মোবাইল তুলে নিল সারা জেফারসন। মোবাইলকে লাউড অপশনে নিয়ে বলল, হ্যালো, আমি সারা বলছি।
গুড মর্নিং সারা, আমি জর্জ আব্রাহাম। বলল ওপার থেকে।
গুড মর্নিং আংকেল,…। সারা জেফারসন বলল। হঠাৎ করেই থেমে গেল তার কথা। কুশলও জিজ্ঞাসা করতে পারলো না। কম্পিত বুক, মুখে কোন কথা এল না।
ডেথ ভ্যালিতে আমাদের বিজয় হয়েছে। এই মাত্র আহমদ মুসার সাথে আমার কথা হয়েছে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আংকেল আপনার গলা কেমন যেন লাগছে। আপনার কণ্ঠের মধ্যে খুশি নেই কেন? সারা জেফারসন বলল।
মা সারা, আহমদ মুসা আহত। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
জর্জ আব্রাহামের কথাটা কানে যেতেই চোখ-মুখের আলোটুকু দপ করে নিভে গেল সারার। বুকটা কেঁপে উঠল সারার। আংকেলের কথায় উদ্বেগ কেন? কেমন আহত উনি! কিন্তু জিজ্ঞাসা করার শক্তি সারা জেফারসনের নেই।
আংকেল কথা বলুন জোসেফাইন আপার সাথে। বলে কম্পিত হাতে মোবাইল গুঁজে দিল মারিয়া জোসেফাইনের হাতে।
মারিয়া জোসেফাইন সারা জেফারসনের দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে মোবাইলটি হাতে নিল। আব্রাহাম জনসনের কথা সেও শুনছিল।
মারিয়া জোসেফাইন মোবাইল কানের কাছে তুলে বলল, স্যরি আংকেল। আমাদের সারাটার মন খুব নরম। আমি আপনার কথা সব শুনতে পেয়েছি আংকেল। আহমদ মুসা কেমন আহত? কোথায় তিনি?
জোসেফাইন মা, তুমি তো জান আহমদ মুসা নিজের কথা কম বলে। জিজ্ঞাসা করে আমি জানতে পেরেছি, তার দেহে তিনটি গুলি লেগেছে। এতটুকুই জেনেছি। আমি যাচ্ছি সেখানে। ওকে সামরিক হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ফি আমানিল্লাহ। হ্যাঁ, আংকেল, ওর সাথে কথা বলে ওর প্রকৃত অবস্থা আঁচ করা মুশকিল। উনি অসহনীয় যন্ত্রণাতেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন। আল্লাহ ভরসা আংকেল। সারা জেফারসন বলল। তার কণ্ঠ অনেকটাই ভারি।
মা জোসেফাইন, আমার কমান্ডো বাহিনী চলে গেছে ডেথ ভ্যালিতে। ডেথ ভ্যালির গোটা বিষয় লাইভ ব্রডকাস্ট হবে। তোমাদের টিভি নিশ্চয় খোলা আছে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ধন্যবাদ আংকেল। ওকে আমাদের সালাম পৌঁছাবেন। মারিয়া জোসেফাইন বলল।
ও.কে, মা। ওকে হাসপাতালে নেয়ার পর তোমাদের জানানো হবে এবং তোমাদেরও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হবে। তোমরা ভালো থাক মা। দোয়া কর। রাখি মা। বলল আব্রাহাম জনসন।
ও.কে. আংকেল। আস্সালামু আলাইকুম। মারিয়া জোসেফাইন বলল।
ওয়াআলাইকুম সালাম।
বলে কল অফ করে দিল জর্জ আব্রাহাম জনসন। সারা জেফারসন মারিয়া জোসেফাইনের কাঁধে মাথা রেখে বলল, ধন্যবাদ আপা, ধৈর্য ও সহনশীলতার অপরূপ প্রতিমূর্তি তুমি। আহমদ মুসা আকাশ হলে তুমি সাগর। সাগরই শুধু পারে আকাশকে ধারণ করতে।
উঠে দাঁড়াল সারা জেফারসন। মারিয়া জোসেফাইনের হাত ধরে টানতে টানতে বলল, তাড়াতাড়ি টিভি রুমে চল আপা।
মারিয়া জোসেফাইনও উঠে দাঁড়াল।
এক হাতে সারাকে ধরে, অন্য হাতে সারার মা জিনা জেফারসনকে জড়িয়ে ধরে বলল, চলুন মা টিভি রুমে।
আহমদ আবদুল্লাহও সারা জেফারসনের হাত জড়িয়ে ধরে আছে।
.
টিভি রুম। টিভি চলছে। হঠাৎ একটা ফ্লাশ নিউজ সামনে এল।
একজন উপস্থাপক গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘোষণার স্টাইলে বলল, অনারড ভিউয়ার্স, আমেরিকানদের জন্যে এক সোনালি মুহূর্ত এটা, যখন। ব্যর্থ একটা ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের উন্মোচন ঘটছে। আজ বেলা বারটা এক মিনিটে সে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র আমেরিকার মাটিতে ছোবল হানার সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছিল! ষড়যন্ত্রটি সফল হলে বিধ্বংসী এক নীরব ও অদৃশ্য আগুন আমেরিকার কনভেনশনাল, নন-কনভেনশনাল, স্ট্রাটেজিক সব মেটালিক বস্তু ধ্বংস করে ফেলতো। ভয়ংকর সে অদৃশ্য আগুন ফায়ারড হওয়ার দুই ঘণ্টা আগেই তাদের ষড়যন্ত্রের ঘাটি, আমাদের দখলে এসে যায়। সন্ত্রাসী দলের নির্বাহী প্রধান ডেভিড কোহেন ক্যানিংহামসহ ওদের বাইশজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সন্ত্রাসীদের সাথে এই অভিযান ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক। ওদের পরাজিত বা নিষ্ক্রিয় করে ফেলার সামান্য আগেও যদি ওরা তা জানতে পারত, তাহলে তাদের ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করে ফেলতে পারত, তার ফলে ভয়ংকর ধ্বংস ও বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হতে পারত আমাদের আমেরিকা। এজন্যে। ওদের ষড়যন্ত্র বানচাল করার জন্যে বিপজ্জনক এই অভিযান চালান মাত্র একজন ব্যক্তি অত্যন্ত সংগোপনে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি সফল হয়েছেন। ষড়যন্ত্রের নেতা এবং তার সশস্ত্র আর্মড গ্রুপের প্রায় সবাই নিহত হয়েছে, কি ঘটছে তা জানার আগেই। অত্যন্ত স্পর্শকাতর, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, অত্যন্ত ভারি এই একক অভিযান পরিচালনা করেন আমেরিকান জনগণের শুভাকাঙ্ক্ষী আহমদ মুসা। সম্মানিত ভিউয়ার্স, আপনারা অনেকেই আহমদ মুসাকে চেনেন। ইনি এর আগেও আমেরিকার সাহায্যে এসেছেন নিঃস্বার্থ ও স্বত:স্ফুর্তভাবে। ভিউয়ার্স আপনারা ঈশ্বরের কাছে। তার জন্যে প্রার্থনা করুন। তিনি মারাত্মক আহত। তিনটি গুলি, খেয়েও তিনি তাঁর বিজয় সম্পূর্ণ করেছেন। ঈশ্বর তাকে রক্ষা করুন, সুস্থ করুন।
ডিয়ার ভিউয়ার্স, কিছুক্ষণ আগে আহমদ মুসা সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ডেথ। ভ্যালি থেকে ঘাঁটি দখলের সিগন্যাল দেয়ার পর সেখানে আমাদের কমান্ডো বাহিনী মুভ করেছে। সেই সাথে প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেখানে যাচ্ছেন জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ দায়িত্বশীলরা। জানা গেছে, আহমদ মুসার অভিযান চলাকালীন গোটা সময়টা প্রেসিডেন্ট, সিনেট ও কংগ্রেসের নেতারা এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণসহ আপদকালীন জরুরি কমিটির সব সদস্য অভিযানের প্রতি মুহূর্তের ঘটনা মনিটর করেছেন।
ডিয়ার ভিউয়ার্স, কমান্ডো বাহিনীর সাথে আমাদের ফটো সাংবাদিকসহ রিপোর্টাররা রয়েছেন। তাদের পাঠানো রিপোর্ট ও ভিউগুলো আমরা লাইভ টেলিকাস্ট করছি। চলুন ভিউয়ার্স সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ডেথ ভ্যালিতে এখন কি ঘটছে দেখি।
– মারিয়া জোসেফাইন, সারা জেফারসন, জিনা জেফারসন সকলের চোখ আঠার মত লেগেছিল টেলিভিশন স্ক্রিনে। প্রবল একটা চাপা আবেগের বিস্ফোরণ সকলের চোখে মুখে। যখন টিভিতে আহমদ মুসার ভূমিকা ও তার আহত হওয়ার কথা বলছিল, তখন আবেগের অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাস যেন নীরব অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ছিল জোসেফাইন, সারা জেফারসন, জিনা জেফারসন সকলের চোখ দিয়ে।
তাদের চোখ কিন্তু পলকহীনভাবে তাকিয়েছিল টেলিভিশন স্ক্রিনের দিকে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছিল ডেথ ভ্যালির চারদিকের দৃশ্য। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো রিপোর্টার ডেথ ভ্যালির পরিচয় ও ইতিহাস তুলে ধরছিল।
ডেথ ভ্যালি পাহাড়ের উত্তর পাশের মাঝামাঝি জায়গায় ট্রি-লাইনের কয়েক ফুট নিচে পাহাড়ের একটা ছোট্ট গুহায় গিয়ে স্থির হলো ক্যামেরা।
ওটা ঠিক গুহা নয়। ওটা একটা সুড়ঙ্গ পথের দরজা। জানাল লাইভ ন্যারেটর রিপোর্টার।
টিভির স্ক্রিনে সুড়ঙ্গের ভেতরের দৃশ্য ভেসে উঠল, তার সাথে সাথে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের খোলা দরজার দৃশ্যও। দরজার কাছেই সুড়ঙ্গের দেয়ালের পাশে পড়ে আছে একজন মুমূর্ষ লোক। ধারাবিবরণদানকারী রিপোর্টার জানাল লোকটি সম্ভবত দুই দারজার মাঝখানের গার্ড। আহমদ মুসা তাকে সংজ্ঞাহীন করেছেন এবং ডিজিটাল ধাঁধায় আটকানো শেষ দরজাটা খুলে ঘাঁটির ভেতরে ঢুকেছেন।
যেকোনো পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত হয়ে, অস্ত্র বাগিয়ে কমান্ডোরা এক ধরনের কৌণিক ব্যুহ রচনা করে অগ্রসর হচ্ছিল। তার সাথে অগ্রসর হচ্ছিল হাফ ডজনের মত ক্যামেরা। সেই সাথে চলছিল, যা দেখা যাচ্ছে সবকিছুর লাইভ বিবরণী।
এভাবে অগ্রসর হচ্ছিল কমান্ডোরা, অগ্রসর হচ্ছিল ক্যামেরা এবং ধারাবর্ণনাকারীরা।
এক জায়গায় এসে ক্যামেরা স্থির হলো। একটা দরজার বাইরে করিডোরের উপর পাঁচ ছয়টি রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেল। সেই ঘরটির ভেতরে ক্যামেরার ফোকাস প্রবেশ করলে আরও চার পাঁচটি লাশ রক্তে ভাসছে দেখা গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে সামনে অগ্রসর হলো ক্যামেরার ফোকাস। আরও কিছু দূর এগোলে করিডোরটি পুব দিকে বাঁক নেবার সময় আবার সেই লাশের স্তূপ দেখা গেল। এখানেও পাঁচ ছয়টি রক্তাক্ত লাশ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে।
অগ্রসর হয়েই চলেছে ক্যামেরার ফোকাস এবং সাথে ধারাবিবরণী।
আরও কিছু দূর এগোলে আরও কিছু রক্তে ভেজা লাশের মুখোমুখি। হলো ক্যামেরার ফোকাস। এখানে চার পাঁচটি লাশ পড়ে আছে। তাদের সাইলেন্সার লাগানো স্টেনগান তাদের হাতে ধরাই রয়েছে। আগের দৃশ্যগুলোতেও এটাই দেখা গেছে।
একটা সিঁড়িতে উঠতে যাচ্ছে ক্যামেরার ফোকাস।
সিঁড়ির গোড়ায় বেশ রক্ত দেখা গেল। তার উপর ক্যামেরার ফোকাস স্থির হলো। কিন্তু এখানে কোন লাশ নেই। সিঁড়ি দিয়ে আরও উপরে উঠল দৃশ্যপট। দেখা গেল সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ আরও একটি লাশ। তারও হাতে স্টেনগান ধরা। তার রক্ত ল্যান্ডিংসহ সিঁড়ির কয়েকটি ধাপে ছড়িয়ে পড়েছে।
মনে মনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সারা জেফারসন। কমান্ডোরা এত ধীরে এগোচ্ছে কেন? ক্যামেরা এত স্লো চলছে কেন? একজন আহত মানুষ কি অবস্থায় আছে, সেটাই প্রথম জানা দরকার নয় কি? লাশ দেখানোতে এত সময় ব্যয় করছে কেন?
আপা, এরা খুবই স্লো। মারাত্মক আহত আহমদ মুসাকেই কি আগে সন্ধান করা উচিত নয়? বলল সারা জেফারসন।
সেটা ঠিক। কিন্তু সারা শত্রুঘাঁটিতে ঢোকার একটা গ্রামার আছে কমান্ডোদের। সেটা মেনে সব দিক নিশ্চিত হয়েই তাদের অগ্রসর হতে হচ্ছে। আহমদ মুসাসহ সবার নিরাপত্তার জন্যেই এটা প্রয়োজন। বলল মারিয়া জোসেফাইন।
ধন্যবাদ আপা। কিন্তু ওরা আর একটু দ্রুত হতে পারত। সারা জেফারসন বলল।
হাসল সারা জেফারসন। মিষ্টি হাসি। বলল, আল্লাহই মানুষের নেগাহবান সারা। তার উপরই ভরসা কর। দেখবে মনটা শান্ত হয়েছে।
সারা কিছু বলল না। নিজের মাথাটা আস্তে করে জোসেফাইনের কাঁধে ন্যস্ত করল।
টিভির স্ক্রিনে তখন দোতলার একটা ঘরের দরজা দেখা যাচ্ছে। দরজাটা ভোলা। দরজার উপর দেয়ালে ছোট সাদা একটা বোর্ড। তাতে লাল অক্ষরে লেখা- বিপজ্জনক এলাকা। প্রবেশ নিষেধ।
দরজায় পৌঁছার আগেই কমান্ডোরা থমকে দাঁড়িয়েছে।
ক্যামেরার ফোকাসও আর অগ্রসর হলো না।
ধারাভাষ্যকার ঘোষণা করল, কমান্ডোরা ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের জন্যে। অপেক্ষা করছেন। মনে করা হচ্ছে সামনের দরজা পার হলেই অপারেশন এলাকা। এখানে প্রবেশের জন্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এবং প্রফেশনাল বিজ্ঞানীদের ক্লিয়ারেন্স দরকার।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনসহ ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দকে দেখা গেল।
ধারাভাষ্যকার ঘোষণা করল নিরাপত্তা বিভাগের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ এসে গেছেন। তাঁদের সাথে দেখা যাচ্ছে সিনেট ও কংগ্রেসের নেতাদেরকে এবং বিজ্ঞানীদের একটি দল।
ক্যামেরার ফোকাস অগ্রসর হলো বড় দরজার দিকে। সাথে যাচ্ছেন নেতৃবৃন্দ। তাদের ঘিরে অগ্রসর হচ্ছেন কমান্ডোরা।
ক্যামেরার চোখ দরজার উপর গিয়ে মুহূর্তের জন্যে স্থির হলো। তারপরই ছুটে গেল সামনের দিকের একটা ঘর পেরিয়ে আরেকটা বিশাল কক্ষের দরজায় চেয়ারে বসা স্টেনগান হাতে একজন লোকের উপর গিয়ে ক্যামেরার ফোকাস স্থির হলো। রক্তে ভেজা তার জামা কাপড়।
মুখ ঘুরিয়ে লোকটা তাকাল ক্যামেরা ও পেছনের লোকজনদের দিকে। ভাবলেশহীন তার মুখে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল।
আহমদ মুসা! শব্দটি ভেসে এল জর্জ আব্রাহাম জনসনের কণ্ঠ থেকে। তারপরই দেখা গেল জর্জ আব্রাহাম জনসন ছুটে যাচ্ছে চেয়ারে বসা আহমদ মুসার দিকে। ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, হ্যাঁ সম্মানিত ভিউয়ার্স, সামনে চেয়ারে বসা রক্তাক্ত দেহের উনিই আহমদ মুসা। আজকের মহাগুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধজয়ের সেনাবিহীন একক সেনাপতি তিনিই। তাঁর দিকে ছুটে যাচ্ছে এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন। আহমদ মুসা জর্জ আব্রাহামকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার মুখে সেই মিষ্টি হাসি।
আহমদ আবদুল্লাহ তার বাবা আহমদ মুসাকে দেখেই চিৎকার করে উঠল বাবা বাবা বলে।
চিৎকার করেই থেমে গেল সে। একটু থেমেই বলল অনেকটা শান্ত ও বিস্ময় ভরা কণ্ঠে, বাবার গায়ে রং না ওসব কি? হাতে বন্দুক কেন? বাবা ওখানে ওভাবে বসে আছে কেন?
সারা জেফারসন আহমদ আবদুল্লাহকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, খারাপ মানুষদের বিরুদ্ধে ভালো মানুষকে লড়াই করতে হয় দুনিয়াকে ভালো রাখার জন্যে। তোমার বাবা ঐ ধরনের একটা লড়াইয়ে গিয়েছিলেন। তোমার বাবা জয়ী হয়েছেন। তাঁর জন্যে দোয়া করো।
আমার বাবা খুব ভালো। আমিও হবো বাবার মত। বলল আহমদ আবদুল্লাহ।
অবশ্যই বাবার মত হবে। তবে অত ভালো হয়ো না, আমার মত কেউ যাতে কষ্ট না পায়। সারা জেফারসন বলল আহমদ আবদুল্লাহর কানে কানে।
কি বললে মাম্মি? বলল আহমদ আবদুল্লাহ।
থাক ওসব কথা, তোমার বাবাকে দেখ। বলে আহমদ আবদুল্লাহর চোখ টিভি স্ক্রিনের দিকে ঘুরিয়ে দিল সারা জেফারসন।
জর্জ আব্রাহাম জনসন ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, তোমার বড় কোন ক্ষতি তো হয়নি আহমদ মুসা? সরাই উদ্বিগ্ন তোমার জন্যে।
আমাকে নিয়ে ভাববেন না জনাব। আমি ভালো আছি। জরুরি কাজগুলো সারতে হবে। আমার মনে হয়, এসেনসিয়াল লোকদের উইপন রুমে ডাকুন যেখানে ভয়ংকর উইপনের কাউন্টডাউন হচ্ছে। বলল আহমদ মুসা।
এখানে সিনেট কংগ্রেসের কয়েকজন নেতাও থাকবেন। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
অবশ্যই জনাব। আহমদ মুসা বলল।
জর্জ আব্রাহাম জনসন কমান্ডো প্রধানকে ডেকে বলল, তোমার কমান্ডো গ্রুপ এবং মিডিয়া বাইরে থাক। ভেতরে এখন ভয়ংকর সেই ম্যাগনেটিক উইপন ডিসম্যান্টলের কাজ হবে।
ইয়েস স্যার। বলল কমান্ডো প্রধান।
কমান্ডো প্রধানের কথা শেষ হতেই মিডিয়া টিমের প্রধান ন্যাশনাল টিভি নেটওয়ার্কের বার্তা বিভাগীয় প্রধান বলল, স্যার, উইপন রুমের দৃশ্য না নিলে আমাদের স্টোরি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং মানুষের অনেক জিজ্ঞাসার জবাব তারা পাবে না।
মিডিয়া প্রধানের কথা শেষ হতেই সিআইএ প্রধান বলে উঠল, মি. জর্জ, ওরা উইপন কক্ষ ও কাউন্টডাউনের দৃশ্যের ছবি নিতে পারে, কিন্তু কোন কিছুর স্পেসিফিক ছবি নেয়া যাবে না।
ঠিক বলেছেন এডমিরাল।
বলে মিডিয়া প্রধানের দিকে চেয়ে বলল, ঠিক আছে তোমরা ছবি নাও, কিন্তু কোন কিছুর ক্লোজ ও স্পেসিফিক ছবি যেন না নেয়া হয়।
ধারাভাষ্যসহ ছবি নেয়া শেষ হলে মিডিয়া ও সিকিউরিটিরা বেরিয়ে, গেল ঘর থেকে। ঘরে প্রবেশ করল নেতৃবৃন্দ ও বিজ্ঞানীর দল।
আহমদ মুসা ম্যাগনেটিক ফায়ার ওয়েভ (MFW) উইপন এবং এর কাউন্টডাউন, পাসওয়ার্ড ইত্যাদি সব বিষয়ে একটা ব্রিফিং বিজ্ঞানী দলকে দিল। তারপর পকেট থেকে পাসওয়ার্ড চিরকুট বের করে জর্জ আব্রাহাম জনসনের হাতে দিল।
জর্জ আব্রাহম জনসন পাসওয়ার্ডগুলো লেখা বিশেষ চিরকুটটা বিজ্ঞানী দলের প্রধানকে দেখাল।
বিজ্ঞানী দলের প্রধান সংগে সংগেই তাঁর একজন বিজ্ঞানীর সাথে কথা বলে ব্যাগ থেকে ছোট মোবাইল আকারের যন্ত্র বের করে তাতে পাসওয়ার্ডগুলো টাইপ করল এবং অনেকগুলো অপশনে গিয়ে তা টেস্ট করল।
উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিজ্ঞানী প্রধানের মুখ। বলল, স্যার প্রত্যেকটা পাসওয়ার্ড লাইভ। এর অর্থ পাসওয়ার্ডগুলো লাইভ কিছু এ্যাকশনের সাথে জড়িত।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আহমদ মুসা যথার্থই চিন্তা করেছিল। বলল জর্জ আব্রাহাম
সিনেট ও কংগ্রেসের নেতারা এবং সবাই আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ দিল।
প্লিজ, যা আমার প্রাপ্য নয়, তার জন্য ধন্যবাদ পেলে তার ভার আমাকে দুর্বল করে দেয়।
বলে আহমদ মুসা এক্সকিউজ মি বলে চেয়ারে গিয়ে বসল।– জর্জ আব্রাহাম উদ্বিগ্ন হয়ে তার কাছে ছুটে এল। আহমদ মুসার মাথা জড়িয়ে ধরে বলল, আর দেরি নয় আহমদ মুসা। এখনি তোমাকে হাসপাতালে নিতে হবে।
সিনেট ও কংগ্রেস নেতারা, সিআইএ প্রধান ও সেনাপ্রধান ছুটে এসেছিল। সেনাপ্রধান বলল, প্রথমেই ওকে হাসপাতালে নেয়া দরকার ছিল।
আহমদ মুসাকে দেখে কিছুই বুঝা যায়নি, তবে ওর ব্রিফিংও আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
একটু থেমেই আব্রাহাম জনসন যৌথ কমান্ডো বাহিনীর অপারেশনের কো-কমান্ডার এফবিআই-এর হেডকোয়ার্টার কমান্ডো ইউনিটের প্রধান। আহমদ মুসার অন্ধ ভক্ত ম্যাক আর্থারকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি তোমার কয়েকজন কমান্ডোকে নিয়ে তোমাদের একটি হেলিকপ্টারে করে আহমদ মুসাকে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাও এবং আমি না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানে থাকবে। থামল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
সংগে সংগেই কথা বলে উঠল সেনাপ্রধান, স্যার, আমার মনে হয় ওকে সামরিক হাসপাতালের পেন্টাগন ইউনিটে নিলে ভালো হয়। আমি বলে দিচ্ছি স্যার। ওখানেই সুবিধা বেশি হবে।
ধন্যবাদ, এটাই ভালো হবে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কথা শেষ করেই ফিরে তাকাল কমান্ডো বাহিনীর প্রধান কর্নেল লিংকনের দিকে। বলল, ম্যাক আর্থারকে সাথে নিলে তোমাদের তো কোন অসুবিধা নেই কমান্ডার?
অসুবিধা হবে না স্যার। সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই ঘিরে ফেলেছে গোটা ডেথ ভ্যালি। পাল্টা কিছু ঘটার কোন সম্ভাবনা আর দেখা যাচ্ছে না।
ধন্যবাদ কর্নেল। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ম্যাক আর্থারের নির্দেশে আহমদ মুসাকে বহনের জন্য স্ট্রেচার এসে গেছে। চারজন কমান্ডার এগোচ্ছে আহমদ মুসাকে স্ট্রেচারে ভোলার জন্য।
জনাব, বিজ্ঞানীরা সব বুঝে নিয়েছে তো? আর মাত্র চল্লিশ মিনিট বাকি। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জর্জ আব্রাহাম জনসনকে লক্ষ্য করে বলল আহমদ মুসা।
জর্জ আব্রাহাম জনসন আহমদ মুসার পিঠে হাত রেখে বলল, এখনও তুমি নিজের কথা ভাবছ না আহমদ মুসা, ভাবছ আমেরিকার কথা? আমেরিকার প্রতি এই ভালোবাসার জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ তোমার কাছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, আধুনিক যুগের সোবহে সাদিকে জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন, আব্রাহাম লিংকনদের আমেরিকা যে মানবাধিকারকে সমুন্নত করে তুলেছিল, সেটা আমাদের ইসলামেরও বাণী। তাই সেই আমেরিকা ভালোবাসা পাবারই কথা।
বলে আহমদ মুসা এগোলো স্ট্রেচারের দিকে।
স্ট্রেচারটি শোবার বেডের পর্যায়ে উঠে এল। আহমদ মুসা প্রথমে। আহত বাম পাটা স্ট্রেচারে তুলতে গিয়ে পারল না।
কমান্ডোরা এগিয়ে গেল। বলল, প্লিজ স্যার, আমরা আপনাকে শুইয়ে দিচ্ছি।
শুইয়ে দিল তারা আহমদ মুসাকে। স্ট্রেচার ঠেলে নিয়ে চলতে শুরু করল কমান্ডোরা।
উপস্থিত সবাই প্রায় একসাথেই বলে উঠল, গড ব্লেস ইউ স্যার।
জর্জ আব্রাহাম জনসন কিছুই বলল না। এক অবরুদ্ধ আবেগে তার চোখ-মুখ ভারি। চোখের কোণায় তার অশ্রু চিকচিক করছে। সত্যিই জর্জ আব্রাহাম জনসন আহমদ মুসাকে সন্তানের স্নেহ দিয়ে ভালোবাসে।
আহমদ মুসার স্ট্রেচার কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলে সিনেটর বিরোধী দলীয় নেতা বলল, আমাদের আমেরিকাকে ফাউন্ডার ফাদারসদের দৃষ্টিতে দেখতে আমরা প্রায় ভুলে গেছি। ধন্যবাদ আহমদ মুসাকে।
শুধু ভুলে গেছি তাই নয়, কেউ কেউ আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। বলল কংগ্রেসের বিরোধী দলীয় নেতা।
আহমদ মুসাকে বহনকারী স্ট্রেচার কক্ষের বাইরে যাওয়ার সাথে সাথে মিডিয়া ঘিরে ধরল স্ট্রেচারকে। ধারাভাষ্যকারদের মধ্য থেকে অনেকে প্রশ্ন করল, আহমদ মুসাকে স্ট্রেচারে করে কোথায় নেয়া হচ্ছে, কি তার অবস্থা?
কমান্ডোদের পক্ষ থেকে ম্যাক আর্থারই বলল, প্লিজ, আপনারা ভিড় করবেন না। আহমদ মুসাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া দরকার। তার অবস্থা সম্পর্কে ডাক্তাররাই বলবেন। তবে তিনি এখন ভালো আছেন, কথা বলছেন।
মিডিয়াম্যানরা সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। তবে ধারাভাষ্যকারেরা তাদের মাউথ পিচগুলো সামনে এগিয়ে দিল। বলল, ভিউয়ার্সদের জন্যে আহমদ মুসার একটা ছবি নিতে চাই।
সময় বাঁচানোর জন্য কমান্ডোরা কোন বিতর্কে গেল না এবং বাধাও সৃষ্টি করল না।
ধারাভাষ্যকারদের পক্ষ থেকে একজন বলল, আপনার অভিযানের এই সফলতায় আপনি কেমন মনে করছেন?
অভিযানের সব কাজ এখনও শেষ হয়নি। ভয়ংকর অস্ত্রটির ডিসম্যান্টলের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে প্লিজ প্রশ্নটা ওদেরই করবেন। ধন্যবাদ। বলল আহমদ মুসা।
কমান্ডোরা স্ট্রেচার নিয়ে চলতে শুরু করেছে। আর কোন প্রশ্নের সুযোগ তারা দিল না। ধারাভাষ্যকার বলল ডিয়ার ভিউয়ার্স, এতবড় ভয়ংকর অপারেশন যিনি করলেন, যিনি সম্পূর্ণ সফল হলেন, তিনি কিন্তু এই কৃতিত্ব নিতে চাইলেন না, তা দেখলেন আপনারা। অনেক বড় না হলে নিজেকে এভাবে বিনীত করতে কেউ পারেন না। আমরা সবাই দ্রুত তার সুস্থতা কামনা করি। গড় ব্লেস হিম।
আহমদ মুসাকে স্ট্রেচারে দেখে আঁৎকে উঠেছিল সারা জেফারসনরা সবাই। কেউ কথা বলতে পারছিল না। কি হয়েছে, কি হতে পারে, এমন কিছু ভাবতেও আতংক বোধ করছিল তারা।
ধারাভাষ্যকারের প্রশ্নের জবাবে যখন আহমদ মুসা কথা বলল খুব ক্লোজভাবে তার মুখটা যখন দেখা গেল, তখন অনেকখানি আশ্বস্ত হলো সবাই। তার চোখ-মুখের স্বচ্ছতায় কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। তার মুখে লাবণ্যের একটা আলো আছে, সেটাও ম্লান হয়নি।
আলহামদুলিল্লাহ। বলে উঠেছিল জোসেফাইন।
তাকে অনুসরণ করে সবাই বলেছিল আলহামদুলিল্লাহ।
.
ভার্জিনিয়াতে ভাইয়ের বাসায় রবার্ট রবিনসন টিভিতে ন্যাশনাল নেটওয়ার্কের একটা জনপ্রিয় প্রোগ্রাম দেখছিল। তার সাথে ছিল তার এবং তার ভাইয়ের পরিবারের সবাই। শুধু তার ভাই এখনও এসে পৌঁছেনি বাইরে থেকে।
সবাই প্রোগ্রামের মধ্যে বুঁদ হয়ে গিয়েছিল।
হঠাৎই তাদের সামনে টিভি স্ক্রিনে ফুটে উঠল নিউজ ফ্লাশ। নিউজ ফ্লাশে রুদ্ধশ্বাসে শুনল তারা আমেরিকার বিরুদ্ধে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের খবর, নতুন এক ভয়ংকর অস্ত্রের সাহায্যে আজ বারোটার পরেই আমেরিকার সামরিক শক্তি ধ্বংস করার জন্য অদৃশ্য ও নীরব আক্রমণের ভয়ংকর খবর। বিস্ময়ে তারা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল, যখন শুনল ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের আস্তানা তাদের পাশের ডেথ ভ্যালিতে। হঠাৎ তাদের মনে হলো, তাদের মেহমান যার হাতে তারা বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে এসেছে, যে তাদের পরিবারকে রক্ষা করেছে, সে ডেথ ভ্যালির সাথে জড়িত। তাহলে কি সে ষড়যন্ত্রের একজন? আঁৎকে উঠল তারা।
রবার্ট রবিনসন তার পাশে বসা মায়ের দিকে চেয়ে বলল কম্পিত স্বরে, মা আমাদের মেহমান তাহলে কি এ ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত! এ জন্যেই কি সে তার নাম, পরিচয় দিতে রাজি হয়নি আমাদের?
হতে পারে বেটা। কিন্তু আমার মন বলছে, যে পরের জন্যে জীবন বাজি রাখতে পারে অমন করে, সে এ ধরনের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকতে পারে না। তার মুখ ক্রিমিনালদের মত নয়। বলল রবার্ট রবিনসনের মা ইম্মা ইমেলি।
দাদির পাশেই বসেছিল রবার্ট রবিনসনের মেয়ে এলিজা। বাবা ও দাদি ফিস ফিস করে কথা বললেও সবই শুনতে পেয়েছিল। বলল সে, দাদি, তুমি ঠিকই বলেছ। তার প্রত্যেকটি কথা ও কাজ থেকে প্রমাণ হয়েছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এমন লোক কোন ষড়যন্ত্রে শামিল থাকতে পারে না। আর…।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল এলিজা। তার দাদি তার কথায় বাধা দিয়ে বলল, টিভির দিকে দেখ। ডেথ ভ্যালির দৃশ্য দেখান শুরু হয়েছে।
সবার অখণ্ড মনোযোগ আছড়ে পড়ছে টিভি স্ক্রিনের উপর। শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য তারা দেখে চলেছে। একের পর এক লাশের স্তূপ দেখে। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হবার অবস্থা তাদের। ধারাভাষ্যে তারা শুনছে, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মাত্র একজনের অভিযানেই এসব ঘটেছে। মাত্র একজনের হাতে এমন লাশের মিছিল সৃষ্টি হলো! কে এই মিরাকল ঘটানো লোকটি? ধারাভাষ্যকার তার নাম বলেছে আহমদ মুসা। তিনি আমেরিকান নন।
শেষ পর্যায়ে যখন ক্যামেরার ফোকাস আহমদ মুসার উপর পড়ল, যখন ভাষ্যকার বলল ইনিই আজকের যুদ্ধজয়ের সেনাবিহীন একক সেনাপতি, তখনই চিৎকার করে বলে উঠল রবার্ট রবিনসন, ইনিই তো। আমাদের সেই মেহমান! ও গড, আমাদের মেহমানই তাহলে ভয়ংকর এ যুদ্ধজয়ের একক সেনাপতি! ও গড!
রবার্ট রবিসনের মা ইম্মা ইমেলি দুহাত তুলে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলল, ও গড, ধন্যবাদ তাকে বিজয়ী করেছ। ধন্যবাদ, তাকে আমাদের আতিথ্যে দিয়ে আমাদের সৌভাগ্যবান করেছ! বাছা আহত, তিনটি গুলি লেগেছে। কতই না কষ্ট পাচ্ছে! তাকে তুমি রক্ষা কর, সুস্থ কর।
রবার্ট রবিনসন, মেয়ে এলিজা, পুত্রবধূসহ ভাইয়ের পরিবারের সকলে প্রার্থনার সাথে সাথে আমিন বলে উঠল।
প্রার্থনা শেষ করে ইম্মা ইমেলি বলল, বাছা আহমদ মুসা আমাদের বাড়ির ঘটনাতেও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তারপর আজকের ঘটনাতেও তিন তিনটে গুলি লেগেছে। ঈশ্বর এই ভালো মানুষটিকে সাহায্য করুন।
এরপরও দাদি, তার কথা ও মুখ দেখলে তো মনে হয়, মুখ যেমন স্বাভাবিক, কথাও তেমনি স্বাভাবিক। ঈশ্বর সাহায্য না করলে কোন মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব নয়!
এই সব কথা, গল্প চলছিলই। সময়ের হিসাব কারও ছিল না।
এক সময় বাড়ির ভেতরে এল রবার্ট রবিনসনের বড় ভাই রবার্ট রবার্টসন। এসেই বলল, তোমরা কি টিভি দেখেছ?
হ্যাঁ দেখেছি। তুমি ডেথ ভ্যালির ঘটনার কথা বলছ তো? বলল রবার্ট রবিনসন।
হ্যাঁ সেটাই। তোমাদের পাশেরই ঘটনা। তোমরা বাড়ি থাকলে সেনাবাহিনীর ঘেরাও-এর মধ্যেই পড়ে যেতে। রবার্ট রবার্টসন বলল।
তার চেয়েও বড় ঘটনা আছে ভাই। একক অভিযানে ডেথ ভ্যালি দখল করে ষড়যন্ত্র যে বানচাল করেছে, তাকে দেখেছ? বলল রবার্ট রবিনসন।
হ্যাঁ দেখেছি। নিউজ ফ্লাশের গোটা প্রোগ্রাম আমি দেখেছি। রবার্ট রবার্টসন বলল।
আমাদের বাড়ির সেই মেহমানের গল্প করেছি না, যার পরামর্শে আমাদের এখানে চলে আসতে হলো, যে আমাদের পরিবারকে রক্ষা করেছে! সেই মেহমানই আহমদ মুসা, ডেথ ভ্যালি ষড়যন্ত্র বানচালের নায়ক। বলল রবার্ট রবিনসন।
বল কি? নিশ্চিত হয়ে বলছ তো? রবার্ট রবার্টসন বলল।
নিশ্চিত হয়ে বলছি। সবাই তো একসাথে তাকে টিভিতে দেখলাম। বলল রবার্ট রবিনসন।
সাংঘাতিক ঘটনা! তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, তোমাদের বাসা থেকে এসেই ডেথ ভ্যালি অভিযান করেছে সে। তোমরা ভাগ্যবান। তাঁর সাথে তোমাদের দেখা করা দরকার। তিনি তো গুরুতর আহত।
বলে হঠাই রবার্ট রবার্টসন সোজা হয়ে বসল। তার কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। তার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
ব্যাপারটা নজর এড়াল না কারোরই।
কি হলো ভাই, হঠাৎ যেন বড় কোন চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলে? বলল রবার্ট রবিনসন।
হ্যাঁ, গুরুতর একটা চিন্তা করছি। তোমাদের মেহমানের নাম কি বললে, আহমদ মুসা না? রবার্ট রবার্টসন বলল।
হ্যাঁ ভাই, আহমদ মুসা। টিভিতেও তার নাম তাই বলেছে। বলল রবার্ট রবিনসন।
এটা খেয়াল করিনি টেনশনে। আচ্ছা, তাকে তো হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। কোন হাসপাতালে তা তো বলেনি? বলল রবার্ট রবার্টসন।
তা বলেনি। তবে তাকে সামরিক হাসপাতালেই নেবে বলে মনে হয়। বলল রবার্ট রবিনসন।
ওয়াশিংটনেরই কোন সামরিক হাসপাতালে, তাই তো? মনে হয় একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। রবার্ট রবার্টসন বলল।
কি ঘটনা? বলল রবার্ট রবিনসন।
হাসপাতালেই আহমদ মুসাকে খুন করার চেষ্টা হতে পারে। রবার্ট রবার্টসন বলল।
বল কি? কি করে জানলে তুমি? বলল রবার্ট রবিনসন।
সে এক দৈব ব্যাপার বলতে পার। একটা কথা জানত রিমোট হিয়ারিং ডিভাইস (RHD) কুড়িয়ে পাবার পর থেকে আমার একটা ম্যানিয়া হয়েছে। চলার পথে বা কোথাও বসা অবস্থায় যেখানেই জনসমাগম দেখি, সেখানেই এ যন্ত্রটা কাজে লাগানোর জন্য মন উসখুস করে। আজকেও বাসে আসার পথে যন্ত্রটা কানে ছিল। তিন সিটের আমার রোটাতে আমি একাই ছিলাম। আমার পেছনে আমার রোর সাথে লাগানো রোটাতে একজন লোক এসে বসল। তাকে খুব অস্থির লাগল। সে চারদিকে তাকিয়ে আমার পেছনের তিনটি সিট ফাঁকা দেখে সেখানে এসে বসল। বসেই মোবাইল নয়, ক্ষুদ্র একট অয়্যারলেস কানে লাগাল। সে কথা শুরু করল। খুব আস্তে কথা বলছিল সে। আমি শুনতে লাগলাম তার কথা। সে শুরু করল এভাবে, শোন, তুমি এখন হাসপাতালগুলোর দায়িত্বে। বড় বস ব্রাজিল থেকে মেসেজ পাঠিয়েছেন, এখন শুধু প্রতিশোধ নেবার কথা বলেছেন। একমাত্র টার্গেট আহমদ মুসা। সে মারাত্মক আহত। তাকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। সেখানে প্রথম সুযোগেই তাকে হত্যা করতে হবে। এই নির্দেশ পৌঁছাতে হবে হাসপাতালে আমাদের লোকদের কাছে। হাসপাতালগুলোতে অবস্থানরত আমাদের প্রধান ব্যক্তিদের নাম তোমাকে দিচ্ছি। তুমি এই মুহূর্তেই সবার সাথে যোগাযোগ কর। তাকে নেয়া হবে শীর্ষ হাসপাতালের কোন একটিতে। আমি সেগুলোতে আমাদের কীম্যানদের নাম তোমাকে দিচ্ছি। জর্জ ওয়াশিংটন মিলিটারি হসপিটাল: ব্রিগেডিয়ার ডা. নিকোলাস নাথান, চীফ অব সার্জারি, আইজেন হাওয়ার স্পেশালাইজড মিলিটারি হসপিটাল: ডেপুটি চীফ সার্জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা, উইলিয়াম আলেকজান্ডার, পেন্টাগন কমবাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল: চীফ সার্জন উইং মেজর জেনারেল ডা. সোফিয়া এলিজাবেথ গ্রেস, লিংকন স্পেশালাইজড হসপিটাল অব সার্জারি: ডা. সার্জন ব্রান্ডন গেভিন, চীফ অব স্টাফ সার্জন। আমাদের বস জানিয়েছেন আহমদ মুসাকে এই চারটি হাসপাতালের যেকোনো একটিতে তোলা হবে। তুমি এখনই তাদের সাথে দেখা কর এবং মেসেজ পৌঁছাও। দেখা করতে অসুবিধা হবার কথা নয়। তোমার তো জানা আছে দেখা করার জন্যে তুমি যে স্লিপ পাঠাবে বা যে টেলিফোন করবে, তাতে তোমার নামের শেষ বর্ণের উপর বা পাশে একটা কিউব লাগাবে। ও.কে, অফ। গুডলাক। এই ছিল লোকটির অয়্যারলেস মেসেজ। দেখ, আমার কানে এখনও RHD লাগানো রয়েছে। রেকর্ড থেকে রিপ্লে শুনে তোমাকে বললাম। কথা শেষ করল রবার্ট রবার্টসন।
বিস্ময় উদ্বেগ আতংকে রবার্ট রবিনসন এবং সকলের মুখ হা হয়ে গেছে।
সংগে সংগে কথা বলতে পারল না রবার্ট রবিনসন। রবার্টসনই আবার মুখ খুলল। বলল, মেসেজটাকে তোমার কি মনে হচ্ছে?
সাংঘাতিক মেসেজ, সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র। এখন কি করা যায়? বলল অনেকটা স্বগত কণ্ঠে রবার্ট রবিনসন।
কিছু করলে এখনি করতে হবে। রবার্ট রবার্টসন বলল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ পেয়েছি। থ্যাংক গড়। বলল রবার্ট রবিনসন।
কি পেয়েছ? উদগ্রীব কণ্ঠে বলল রবার্ট রবার্টসন।
দাউদ ইব্রাহিমের টেলিফোন পেয়েছিলাম আজ সকালে। বাড়ির চাবিগুলো কোথায় রেখে গেছে তা বলার জন্যেই সে টেলিফোন করেছিল। সে তার পরিবার সমেত ডেথ ভ্যালির বাইরে আছে এখন। তাকে ঐ টেলিফোনে পাওয়া যাবে। থ্যাংকস গড। বলল রবার্ট রবিনসন।
দাউদ ইব্রাহিম কে? জিজ্ঞাসা রবার্ট রবার্টসনের।
ডেথ ভ্যালির পুব পাশে এক জায়গায় এরা থাকত। এদের এখানেও আহমদ মুসা কিছু দিন মেহমান হিসাবে ছিল। আহমদ মুসা এখন দাউদ ইব্রাহিমকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে। বলল রবার্ট রবিনসন।
তাহলে আর দেরি করো না, দেখ তাকে টেলিফোনে পাও কি না। রবার্ট রবার্টসন বলল।
টেলিফোনে পাওয়া গেল তাকে।
খুব জরুরি খবর আছে দাউদ ইব্রাহিম। তোমার সাথে এখনি দেখা হওয়া দরকার। টেলিফোনে বলা যাবে না। বলল রবার্ট রবিনসন।
অন্তত বিষয়টা কি? ডেথ ভ্যালির সব খবর শুনেছেন তো? দাউদ ইব্রাহিম বলল।
আহমদ মুসার ব্যাপারে জরুরি খবর আছে। অন্য সব খবর আমরা শুনেছি। বলল রবার্ট রবিনসন।
উনি তো এখন হাসপাতালে। দাউদ ইব্রাহিম বলল।
হাসপাতালের ব্যাপারেই জরুরি কথা আছে। কোন্ হাসপাতালে উনি? বলল রবার্ট রবিনসন।
কোন মিলিটারি হাসপাতালে হবে। আমি ঠিক জানি না।
খুব জরুরি বিষয়। কোথায় আমরা দেখা করব বল? বলল রবার্ট রবিনসন।
পটোম্যাকের পেন্টাগন ব্রীজের কাছে। পেন্টাগন প্রান্তে আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো। অসুবিধা হবে? দাউদ ইব্রাহিম বলল।
না, কোন অসুবিধা হবে না। আমি আসছি। বলল দ্রুত কণ্ঠে রবার্ট রবিনসন।
মোবাইলে কথা শেষ করে রবার্ট রবিনসন বড় ভাই রবার্ট রবার্টসনকে বলল, তাহলে ভাই আমি এখনি রওয়ানা দেব, তোমার RHD-টা আমাকে দাও 1 নিশ্চিত থাক ফেরত পাবে।
ফেরত পাওয়ার কথা আমি ভাবছি না। যথাসময়ে খবরটা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছবে কি না সেই ভয় করছি। রবার্ট রবার্টসন বলল।
আমি শুনেছি ভাই, আহমদ মুসার বিশ্বস্ত হিসাবে এফবিআই প্রধান। জর্জ আব্রাহাম জনসনের কাছে দাউদ ইব্রাহিমের গুরুত্ব আছে। বলল রবার্ট রবিনসন।
থ্যাংকস গড়। কিন্তু এখন এফবিআই প্রধানকে সে কোথায় পাবে? সে তো ডেথ ভ্যালিতে। রবার্ট রবিনসন বলল।
গড ব্লেস আহমদ মুসা। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করি। বাকিটা ঈশ্বর করবেন। বলল রবার্ট রবিনসন।
তারপর রবার্ট রবার্টসন তার RHD-টি রবার্ট রবিনসনের হাতে তুলে দিল। বলল, চল, আমিও তোমার সাথে যাবো। এসব কাজে একলা চলা ঠিক নয়।
ধন্যবাদ ভাইয়া। মনে মনে আমিও এমনটাই ভাবছিলাম। ধন্যবাদ তোমাকে ভাইয়া। বলল রবার্ট রবিনসন।
এত ধন্যবাদ আমাকে দিও না। যে লোক নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাদের দেশকে রক্ষা করেছে, তার জন্যে কিছু করা ধন্যবাদের নয়, সামান্য ঋণ পরিশোধ করা মাত্র। চল, আর দেরি নয়। রবার্ট রবার্টসন বলল। গাড়ি নিয়ে বেরোল দুই ভাই।
এই বাড়ি থেকে পেন্টাগন ব্রীজটা বেশি দূরে নয়। মাইল দুই এগোলে ওয়েলিংটন জাতীয় সমাধি ক্ষেত্র। তারপর সামান্য এগোলেই। পেন্টাগন ও পটোম্যাক।
প্রায় ফাঁকা রাস্তায় ফুল স্পিডে এগিয়ে চলছিল তাদের গাড়ি।
.
স্যার, আহমদ মুসাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা এবং তার পাহারায় থাকা এফবিআই-এর অফিসার ম্যাক আর্থার প্রতি পদক্ষেপে আমাকে ডিস্টার্ব করছে। অপারেশনে যাবার আগে কিছু করণীয় থাকে, সেসব করতে গেলে সে জানতে চাচ্ছে, কি করছি, কেন করছি? এমনকি সবকিছু দেখতেও চাচ্ছে। তার মনোপুত না হলে সে কাজ আমরা করতে পারছি না। অপারেশনের সময়সূচিকেও সে পিছাতে বলছে অবিলম্বে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। টেলিফোনে বলল মেজর জেনারেল ডা. সোফিয়া এলিজাবেথ গ্রেস, পেন্টাগন কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান। ডা. গ্রেস টেলিফোনে যার কাছে এই অভিযোগ করলেন তিনি সেনাবাহিনী প্রধান।
অভিযোগ শুনে সেনাবাহিনী প্রধানের ভ্রু কুঁচকে গেল। বিস্মিত ও বিরক্তও হলো। চিকিৎসাক্ষেত্রে কারও এই ধরনের হস্তক্ষেপ শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, অপরাধও। বলল সেনাবাহিনী প্রধান ডা. গ্রেসকে, এমন তো হবার কথা নয়। ডাক্তারদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ঠিক আছে, ঘটনা কি আমি দেখছি। তোমাকে এখনই জানাচ্ছি ডাক্তার।
সেনাবাহিনী প্রধান ভাবল, ম্যাক আর্থার এফবিআই-এর একজন দায়িত্বশীল অফিসার এবং জর্জ আব্রাহাম জনসনের খুবই বিশ্বস্ত। তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের সাথে আলোচনা করা ছাড়া।
সেনাবাহিনী প্রধান তার হটলাইন টেলিফোনে হাত দিল জর্জ আব্রাহাম জনসনকে টেলিফোন করার জন্যে। কিন্তু টেলিফোনের ক্র্যাডেলে হাত দেবার আগেই টেলিফোন বেজে উঠল। সোজা হয়ে বসে সেনাবাহিনী প্রধান টেলিফোনের রিসিভার হাতে তুলে নিতেই ওপ্রান্ত থেকে জর্জ আব্রাহাম জনসনের কণ্ঠ শুনতে পেল। বলল, গুড ডে স্যার, আমি আপনাকে টেলিফোন করতে যাচ্ছিলাম।
জরুরি কিছু? হাসপাতালের ঘটনা নয় তো? বলল আব্রাহাম জনসন।
হ্যাঁ স্যার, ডা. সোফিয়া এলিজাবেথ গ্রেসের ঘটনা নিয়ে। ঐ ঘটনা সম্পর্কে জানেন কিছু স্যার?
এ বিষয় নিয়েই আপনাকে টেলিফোন করেছি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ডা. সোফিয়া এলিজাবেথ গ্রেস গত দুঘণ্টার মধ্যে এমন লোকের কাছ থেকে কোন টেলিফোন বা চিরকুট পেয়েছেন কি না যার নামের শেষ বর্ণের সাথে কিউব অর্থাৎ ৩ সংখ্যাটি রয়েছে। এই দুই ঘণ্টার মধ্যে এ লোকের সাথে ডা. গ্রেসের দেখা হয়েছে কি না? অবিলম্বে এটা জানা দরকার। এটা বিস্তারিত না জানা পর্যন্ত ডা. গ্রেসকে আহমদ মুসাকে অপারেট বা ইনজেকশন দেয়ার মত কাজ, ওষুধ খাওয়ানোর মত কাজ করতে দেয়া যাবে না। এক কথায় আপাতত তাকে আহমদ মুসা থেকে দূরে রাখতে পারলেই ভালো হয়। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
তার মানে ডা. গ্রেসকে আমরা সন্দেহ করছি? ঐ লোকটি এইচ থ্রি গ্রুপের কেউ স্যার? সেনাপ্রধান বলল।
হ্যাঁ জেনারেল। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
এর অর্থ কি মেজর জেনারেল ডা. সোফিয়া এলিজাবেথ গ্রেসও এইচ থ্রির লোক আমরা বলব? সেনাপ্রধান বলল।
তার আগে আমাদের জানা দরকার গত দুই ঘণ্টার মধ্যে ঐ রকম টেলিফোন বা চিরকুট উনি পেয়েছেন কি না, ঐ লোকের সাথে তার দেখা হয়েছে কি না? বলল আব্রাহাম জনসন।
বুঝেছি স্যার। স্যার, আপনি ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে। অল্পক্ষণের মধ্যে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর জানবো স্যার।
সাত মিনিটের মধ্যে সেনাপ্রধান টেলিফোন করল জর্জ আব্রাহাম জনসনকে। বলল, ধন্যবাদ স্যার। সবগুলো প্রশ্নের জবাব পজিটিভ। ডা. গ্রেসের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট থেকে চিরকুটটা পাওয়া গেছে। নামের শেষ বর্ণের সাথে কিউব (3) অংকটি পাওয়া গেছে। ঐ লোকের সাথে ডা. গ্রেসের সাক্ষাতও হয়েছে। কিন্তু তাদের কথাবার্তা হয়েছে সিসিক্যামেরার বাইরে একটা নিউট্রাল জোনে।
আপনার উপসংহার কি জেনারেল? বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন। চিরকুটে লেখা নাম, লোকটির সাথে ডা. গ্রেসের সাক্ষাৎ, তার সাথে নিউট্রাল জোনে আলোচনা থেকে আমি নিশ্চিত স্যার, ডা. গ্রেস সন্দেহের তালিকায়। তবে সে অনেক বড় অফিসার তো! তাকে হাতেনাতে ধরতে চাই। সেনাপ্রধান বলল।
তাহলে তার জন্যে ফাঁদ পাততে চান? বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ঠিক স্যার। আপনি ম্যাক আর্থারকে প্রত্যাহার করুন। আমি ডা, গ্রেসকে বলে দেই যে, ম্যাক আর্থারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর অসুবিধা হবে না আপনার। সেনাপ্রধান বলল।
ঠিক আছে। তবে সে তার কাজের জন্যে কোন্ স্টেজকে বেছে নেবে, এটাই সমস্যা। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
সমস্যা হবে না স্যার। সব স্টেজেই তার সাথে, তার টিমে আমাদের লোক থাকবে। তারা তার প্রতিটা কাজের উপর চোখ রাখবে। তাছাড়া বাড়তি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলল সেনাপ্রধান।
ধন্যবাদ জেনারেল। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ওয়েলকাম স্যার। সেনাপ্রধান বলল।। তাদের মধ্যে কথা শেষ হয়ে গেল। এর এক ঘণ্টা পর।
কর্নেল ডা. কলিন কেনেডি পেন্টাগন কমবাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে তার অফিসকক্ষে তার হাতের ছোট্ট একটা টিভির মত যন্ত্রের স্ক্রিনে আহমদ মুসার কক্ষের ভেতরে নজর রাখছিল। গত এক ঘণ্টায় ডা. গ্রেসের সাথে কাজ করা বা কথা বলা অথবা তার সাথে থাকার সময় ছাড়া সব সময়ই এই স্ক্রিনের উপর নজর রাখছে সে। হঠাৎ স্ক্রিনে ভেসে উঠল ডা. গ্রেস আহমদ মুসার কক্ষে প্রবেশ করছে। সাথে সাথে সোজা সে চলে গেল মেডিসিন টেবিলের কাছে। দ্রু কুঁচকে উঠল কর্নেল ডা. কেনেডির। তাড়াতাড়ি সে পকেট থেকে ক্ষুদ্র একটা অয়্যারলেস বের করে মুখের কাছে নিয়ে, মেজর লোগান বি এলার্ট। ডিজি কিন্তু আম-এর কক্ষে।
লোগান আরেকজন গোয়েন্দা কর্মী। সে আহমদ মুসার কক্ষের বারান্দায় সিকিউরিটির ইউনিফরমে কাজ করছে।
বলুন আমার করণীয়। লোগান বলল। বি এলার্ট। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
কর্নেল ডা. কেনেডি দেখল, ডা. গ্রেস পানির বোতলটি হাতে তুলে নিল। বোতলটি উপরে তুলে ধরে পানি পরীক্ষা করল। তারপর পানির বোতলটি কক্ষের একপাশের ওয়েস্টেজ চ্যানেলে রেখে দিল। একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বোতলটিকে নিয়ে গেল কক্ষের বাইরে। ডা. গ্রেস বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে। অল্পক্ষণ পর একজন নার্স আরেকটি বোতল এনে টেবিলে রাখল।
কর্নেল ডা. কেনেডি মনে মনে বলল, নিশ্চয় বোতলটি ডা. গ্রেস। নার্সকে দিয়ে আহমদ মুসার ঘরে পাঠিয়েছে। ডা. গ্রেস এটা করল। কেন? টেবিলের পানি খারাপ মনে হলে নার্সকে পানি পাল্টাতে বলতে পারত। কক্ষের ফ্রিজেও তো পানি ছিল। তাছাড়া পানি কেন খারাপ তার কৈফিয়ত সে চাইতে পারত। কিন্তু কিছুই না করে নিজে পানি ফেলে দিল এবং নার্সকে দিয়ে আবার পানি পাঠাল কেন?
এই চিন্তার সংগে সংগেই কর্নেল ডা. কেনেডি মেজর লোগানকে অয়্যারলেস করল। বলল, শোন তুমি গ্লাভস পরে নাও এবং আহমদ মুসার কক্ষে যাও। তুমি আহমদ মুসার কক্ষের ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি নিয়ে তার টেবিলে রেখে টেবিলের পানির বোতলটি দ্রুত আমাকে দিয়ে যাও।
দুই মিনিটের মধ্যেই মেজর লোগান কাজ সেরে পানির বোতল নিয়ে কর্নেল ডা. কেনেডির কক্ষে প্রবেশ করল।
ধন্যবাদ মেজর লোগান। পানির বোতলটা রেখে তুমি তাড়াতাড়ি চলে যাও তোমার জায়গায়। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
মেজর লোগান ইয়েস স্যার বলে একটা স্যালুট দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কর্নেল ডা. কেনেডি অয়্যারলেস করল পেন্টাগনের কেমিক্যাল ল্যাবরেটরির প্রধান মেজর ইথান অ্যান্থনীকে। বলল তাকে তাড়াতাড়ি তার কাছে চলে আসতে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেজর অ্যান্থনী এসে হাজির হলো কর্নেল ডা. কেনেডির কক্ষে।
তার দিকে তাকিয়ে কর্নেল ডা. কেনেড়ি তাকে দ্রুত গ্লাভস পরে। নেয়ার নির্দেশ দিল। তারপর পানির বোতলটি দেখিয়ে বলল, এটা টেস্টের জন্যে যতটুকু প্রয়োজন তা ঘোট খালি বোতলটিতে ঢেলে নাও। পরীক্ষার রেজাল্ট যতদূর সম্ভব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে চাই। আমি এই রেজাল্টের অপেক্ষায় বসে থাকব। প্রায়োরিটি হলো, এই পানিতে কিছু। থাকলে মানব দেহের জন্যে তার প্রতিক্রিয়া কিংবা কি অবস্থায় এটা মানব দেহের কি ক্ষতি করতে পারে, এটা জানা। যাও। ধন্যবাদ।
মেজর অ্যান্থনী বেরিয়ে যাবার মিনিট পাঁচেক পর কর্নেল ডা. কেনেডি টেলিফোন পেল ডা. গ্রেসের। বলল, আহমদ মুসার ওয়াটার থেরাপি চলছে। আর দশ মিনিটের মধ্যে সে রেডি হয়ে যাবে। তোমার ওটি এবং ওটি টিমের খবর কি?
স্যার, সবগুলো ভিআইপি ওটি অকোপায়েড ছিল। আধা ঘণ্টার মধ্যে ওটি এবং ওটি টিম রেডি হয়ে যাবে স্যার। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি। তার ঠোঁটে হাসি।
ও.কে. কর্নেল। বলল ডা. গ্রেস।
ওপার থেকে টেলিফোন রেখে দিল ডা. গ্রেস।
অপেক্ষা করা খুব কষ্টকর কাজ। হঠাৎ তার মনে হলো বসকে মানে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানকে এ ব্যাপারে ব্রিফ করা হয়নি। তাড়াতাড়ি সে অয়্যারলেস হাতে তুলে নিল। অয়্যারলেস করল বসকে। এ পর্যন্তকার ডা. গ্রেসের ঘটনা ব্রিফ করল বসকে।
বস কথা বলার আগে বলল, তোমার ঘরের সিসিটিভি ও সাউন্ড মনিটরের অবস্থা কি?
ও দুটো ব্লাইন্ড ও বধির করা হয়েছে স্যার আপনার নির্দেশ ক্রমে। কর্নেল ডা. কেনেডি বলল।
ও.কে.। সো ফার ওয়েলডান মাই বয়। পানির রিপোর্ট আসার সংগে সংগে আমাকে জানাবে। বলল সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান।
ইয়েস স্যার। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
ও.কে.। বাই।
বলে ওপার থেকে লাইন কেটে দিল।
বিশ মিনিটের মাথায় ওয়াটার টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে এল মেজর অ্যান্থনী।
খুশি হয়ে কর্নেল ডা. কেনেডি স্বাগত জানাল মেজর অ্যান্থনীকে। হাত বাড়িয়ে নিল রিপোর্টটা। একবার নজর বুলিয়ে উজ্জ্বল মুখে বলল, রিপোর্ট তো পজিটিভ মেজর?
ইয়েস স্যার। মেজর অ্যান্থনী বলল।
ডিটেইলসটা তুমি বলতো মেজর। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
স্যার, পানিতে মেশানো যে কেমিক্যালটা পাওয়া গেছে তা মানবদেহের বড় কোন ক্ষতি করে না। কিন্তু এই কেমিক্যাল যদি মানুষকে আংশিক বা পূর্ণভাবে সংজ্ঞালোপকারী কোন কেমিক্যালের সাথে নির্দিষ্ট মাত্রায় মেশানো হয় বা সংস্পর্শে আসে, তাহলে তা ভয়ানক ডেডলি হয়ে উঠতে পারে। সংজ্ঞালোপকারী কেমিক্যালের যে মাত্রা মানুষের সংজ্ঞালোপ করে তার চেয়ে শতকরা দশ ভাগ বেশি মাত্রায় পুশ করলে সজ্ঞাহীনতা মৃত্যুতে পরিণত হয়।
শেষ কথাটা শুনে কেঁপে উঠল কর্নেল ডা. কেনেডি। বুকে ক্রস এঁকে মুখটা ঊর্ধ্বমুখী করে বলল, ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ! পানির ডেডলি কেমিক্যাল থেকে আহমদ মুসাকে বাঁচানো গেছে।
মেজর অ্যান্থনীর দিকে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ মেজর। অনেক ধন্যবাদ।
মেজর অ্যান্থনী কর্নেল ডা. কেনেডিকে স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
অয়্যারলেস হাতে নিল কর্নেল ডা. কেনেডি। কল করল সামরিক গোয়েন্দা প্রধানকে।
কর্নেল ডা. কেনেডির কণ্ঠ শুনতে পেয়েই বলল, তোমার কলের অপেক্ষা করছি কর্নেল। বল কি খবর? কিন্তু তার আগে বল আহমদ মুসার ঘর থেকে সরে যাওনি তো?
না স্যার। মুহূর্তের জন্যেও সে ঘর থেকে আমার চোখ সরেনি। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
ধন্যবাদ। এবার আসল খবর বল। রেজাল্ট পজিটিভ নিশ্চয়? বলল সামরিক গোয়েন্দা প্রধান।
ইয়েস স্যার, পজিটিভ। কিন্তু যে কেমিক্যালটি পাওয়া গেছে তা মানবদেহের বড় ধরনের কোন ক্ষতি করে না। কিন্তু মানবদেহে সংজ্ঞালোপকারী মেডিসিন যদি দশ ভাগ বাড়িয়ে পুশ করা হয় আর তা যদি এই কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসে তাহলে এই কেমিক্যাল ভয়ংকর হয়ে উঠে এবং তা মানুষের মৃত্যু ঘটায়।
ও গড! কি ভয়ানক ষড়যন্ত্র। বুঝতে পারছ তো কি ঘটতে যাচ্ছে? বলল সামরিক গোয়েন্দা প্রধান।
ইয়েস স্যার। ষড়যন্ত্রের স্টেজ ভালোভাবেই সাজানো হয়েছে। আরেকটি ঘটনা ঘটানো হয়েছে স্যার। এই মাত্র আমাকে জানানো হলো আমাদের ওটি টিমের অ্যানেসথেশিয়ান হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার জায়গায় ডা. গ্রেস অন্য একজনকে নিয়ে এসেছে। কর্নেল ডা. কেনেডি বলল।
এখন বুঝতে পারছ, কি ঘটতে যাচ্ছে? বলল সামরিক গোয়েন্দা প্রধান।
ইয়েস স্যার। নতুন অ্যানেসথেশিয়ান শতকরা দশ ভাগ বাড়িয়ে সংজ্ঞালোপকারী মেডিসিন পুশ করবে। কর্নেল ডা. কেনেডি বলল।
তা হতে দেয়া যাবে না। তোমরা অ্যালার্ট থেক। বলল সামরিক গোয়েন্দা প্রধান।
ইয়েস স্যার। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
ও.কে. কর্নেল। বাই। বলল সামরিক গোয়েন্দা প্রধান।
ওপার থেকে লাইন কেটে গেল।
দশ মিনিট পর। আহমদ মুসাকে ওটির কাপড় পরাতে যাচ্ছিল একজন অপারেশন অ্যাসিস্টেন্ট।
পাশে দাঁড়িয়েছিল কর্নেল ডা. কেনেডি।
হঠাৎ তার এই অপারেশন অ্যাসিস্টেন্টকে তো এখন এখানে থাকার কথা নয়। এই ওটির অ্যাসিস্টেন্ট গেল কোথায়! কর্নেল ডা. কেনেডি ছেলেটিকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি এখানে? এই ওটির অ্যাসিস্টেন্ট ইভান কোথায়?
ছেলেটি থমকে দাঁড়াল। বলল, স্যার, কি প্রয়োজনে যেন ছুটি নিয়েছে। তাই আমাকে ৩নং ওয়ার্ড থেকে ম্যাডাম ডেকে নিয়েছে।
ইভান ছাড়া আরও দুজন আছে। ওরা কোথায়? বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
ওরা তৈরি হয়ে আসছে স্যার। ম্যাডাম এর মধ্যে আমাকে কাপড় পরিয়ে ফেলতে বলেছেন। ছেলেটি বলল।
কর্নেল ডা. কেনেডির মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেল।
ছেলেটি ওটির পোশাক হাতে নিয়ে তৈরি হচ্ছে আহমদ মুসাকে পরাবার জন্যে।
আহমদ মুসাও শুনছিল তার কথাগুলো।
সে দেখল অ্যাসিস্টেন্ট ছেলেটির কথা কর্নেল ডা. কেনেডি ভালোভাবে নিল না। একটা অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখে মুখে।
আহমদ মুসার ভ্রু কুঁচকে গেল।
ছেলেটি আহমদ মুসাকে পোশাক পরাতে শুরু করেছে।
আহমদ মুসা দেখতে পেল ছেলেটির হাতে ব্রাউন রঙের একটা কিউব। তার মাঝখানে একটা গ্রীন ডট। যখন সে তার হাতটা লম্বা করে লুজ ইউনিফরমটা আহমদ মুসাকে পরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, তখনই গ্রীন ডটটা লাল রং ধারণ করল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। ওটা কি পয়জনস পিন ফায়ার বক্স, না বিষাক্ত কেমিক্যাল স্প্রে বক্স?
চমকে উঠল আহমদ মুসা। কিন্তু বেশি চিন্তা করার সময় নেই। সে ডান হাত দিয়ে খপ করে ওটি অ্যাসিস্টেন্ট ছেলেটির হাতটা ধরে ফেলল এবং প্রচণ্ড একটা মোচড় দিল তার হাতে।
তার হাত থেকে ব্রাউন কিউবটি পড়ে গেল।
ছুটে এল কর্নেল ডা. কেনেডি।
দেখুন ডা. কেনেডি ওর হাত থেকে পড়ে গেল ওটা কি? বলল * আহমদ মুসা।
কর্নেল ডা. কেনেডি জিনিসটাকে এক নজর দেখল। তারপর বলল, ওটা কি স্যার?
ওটা হতে পারে পয়জনস পিন ফায়ার ডিভাইস অথবা হতে পারে পয়জনস কেমিক্যাল স্প্রে ডিভাইস। বলল আহমদ মুসা।
ও গড! বলে কর্নেল ডা. কেনেডি দ্রুত বাম হাতে গ্লাভস পরে নিয়ে ব্রাউন কিউবটি তুলে নিল এবং ডান হাত দিয়ে ওটি অ্যাসিস্টেন্ট ছেলেটির কলার চেপে ধরে ডাকল মেজর লোগানকে।
আহমদ মুসা ছেলেটির হাত ধরেই ছিল। এখন ছেড়ে দিল।
মেজর লোগান ছুটে এল বারান্দা থেকে।
মেজর লোগান, সিকিউরিটি সেলে একে নিয়ে যাও। হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত তুমি পাহারায় থাকবে। হাত-পা বেঁধে রাখবে এর। যাও। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
মেজর লোগান ফ্রন্ট দরজা দিয়ে না নিয়ে পাশের দরজা দিয়ে তাকে নিয়ে চলে গেল।
ধন্যবাদ স্যার। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। গোটা বিষয় আমরা গোপন রাখতে চাই। বিশেষ করে ডা. গ্রেস যেন না জানে। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
তিনি কি …। কথা শেষ না করেই থেমে গেল আহমদ মুসা।
বড় স্যার, জর্জ আব্রাহাম জনসন, এমনটাই তথ্য দিয়েছেন। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
এ সময় এই ওটির দুইজন ওটি অ্যাসিস্টেন্ট রেডি হয়ে এসে গেল।
তোমরা স্যারকে ইউনিফরম পরিয়ে দাও। আমি আসছি।
দুজনকে লক্ষ্য করে কর্নেল ডা. কেনেডি কক্ষের বাইরে চলে গেল।
কক্ষের বাইরে বারান্দায় গিয়ে কর্নেল ডা. কেনেডি সামরিক গোয়েন্দা প্রধানকে টেলিফোন করে সর্বশেষ পয়জনস পিন ফায়ার বা পয়জনস কেমিক্যাল স্প্রে ধরা পড়ার বিষয়টি ব্রিফ করল।
ও গড! এমন ভয়াবহ চতুর্মুখী জাল ওদের! আহমদ মুসা সতর্ক না থাকলে তো সর্বনাশ হয়ে যেত। শোন তুমি পেন্টাগনের স্পেশালাইজড ল্যাবে ব্রাউন কিউবটি পাঠিয়ে দাও। আমি ওদের সাথে কথা বলছি। ওকে ধন্যবাদ মাই বয়।
ওপার থেকে লাইন কেটে গেল।
কর্নেল ডা. কেনেডি ফিরে এল আহমদ মুসার ঘরে। পোশাক পরানো হয়ে গেল আহমদ মুসার। মিনিটখানেক পরেই ডা. সোফিয়া এলিজাবেথ গ্রেস এসে ঘরে ঢুকল। বলল, সব রেডি?
ইয়েস স্যার। ওটি রেডি, প্যাশেন্টও রেডি। আপনার নির্দেশ হলে আমরা মুভ করতে পারি। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
ইয়েস মুভ অন। টিমের অন্য সবাই ওখানেই আছে। বলল ডা. গ্রেস।
আহমদ মুসাকে প্যাশেন্ট ট্রলিতে তুলে সবাই চলল।
একজন ওটি অ্যাসিস্টেন্টকে ডাকল ডা. গ্রেস। বলল, তিন নাম্বার ওটির যশুয়া এসেছিল, সে কোথায়?
আমাদের একটু দেরি হয়েছে আসতে। এসে দেখিনি। বলল ওটি অ্যাসিস্টেন্ট ছেলেটি।
ও, তাহলে তাকে হয়তো ওটিতে কেউ ডেকেছে তাই গেছে। অনেকটা স্বগত কণ্ঠে বলল ডা. গ্রেস।
ওটি প্রস্তুত। টিমের সবাই হাজির।
যশুয়াকে তো দেখছি না। গেল কোথায়? বলল ডাক্তার গ্রেস। নিশ্চয় কোথাও থাকবে। কোন অসুবিধা হলো কি না। আচ্ছা, তাকে আমি দেখতে বলছি। বলে দরজার দিকে হাঁটতে লাগল কর্নেল ডা. কেনেডি।
ও.কে সকলে প্রস্তুত? সবাই মাথা নেড়ে জানাল, প্রস্তুত।
ডা. সাবস্টেনিয়ান স্টিভেন আপনার অ্যানেসথেশিয়ার কাজ শুরু করুন।বলল ডা. গ্রেস।
ডা.. সাবস্টেনিয়ান স্টিভেন রোগীর হার্ট, ব্লাড প্রেসার ইত্যাদি রেকর্ডের দিকে একবার তাকাল। তারপর অ্যানেসথেশিয়ার মেডিসিন পুশ করার জন্যে রেডি হলো।
এগিয়ে এল সে আহমদ মুসার দিকে। তার হাতে ক্ষুদ্র একটা সিরিঞ্জ।
ওটি রুমের দরজা ঠেলে প্রবেশ করল একদল মিলিটারি পুলিশ। তাদের কয়েকজন মেজর জেনারেল ডা, সোফিয়া এলিজাবেথ গ্রেসের কাছে, অন্য কয়েকজন গেল ডা. সাবস্টেনিয়ান স্টিভেনের কাছে। যারা ডা. সাবস্টেনিয়ান স্টিভেনের কাছে গেল, তাদের একজনের হাতে গ্লাভস। পরা। সে অ্যানেসথেশিয়া পুশের ক্ষুদ্র সিরিঞ্জটি নিয়ে নিল। অন্য একজন ডা. সাবস্টেনিয়ান স্টিভেনের হাতে হাতকড়া পরাল।
যারা ডা. গ্রেসের কাছে গিয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে একজন ঊধ্বর্তন অফিসার স্যালুট দিল মেজর জেনারেল ডা. গ্রেসকে। ডা. গ্রেসের হাতে এক শিট কাগজ তুলে দিয়ে বলল, স্যার, আপনাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বলে তাকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে কক্ষের বাইরে নিয়ে গেল। তার পেছনে পেছনে ডা, সাবস্টেনিয়ান স্টিভেনকেও নিয়ে যাওয়া হলো।
অপারেশন টিমের উদ্দেশ্যে কর্নেল ডা. কেনেডি বলল, ফেলো মেম্বারস অপারেশন টিম। যা ঘটে গেল, সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। অপারেশন কমিনিট পরে শুরু হবে। আমাদের সার্জারির নতুন। হেড মেজর জেনারেল ডা. টমাস জ্যাকসন আসছেন। আমাদের নিজস্ব অ্যানেসথিশিয়ানও আসছেন।
বিশাল ওটি কক্ষের পাশের ডক্টরস রুমটায় সবাই গিয়ে বসল।
কর্নেল ডা, কেনেডি আহমদ মুসার কাছে গিয়ে নিচু গলায় বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ স্যার। আপনাকে উপলক্ষ করে পেন্টাগনে বহুদিন ধরে জেঁকে বসা বাইরের নেটওয়ার্কটির এবার মূলোচ্ছেদ হবে।
এরা কারা কর্নেল? জেনেও প্রশ্নটা করল আহমদ মুসা। এদের। দৃষ্টিভঙ্গিটা জানাই তার উদ্দেশ্য।
স্যার, এটা বলার জন্যে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ আছে, আমি নই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ইসরাইলের পক্ষে কাজ করা যে ষড়যন্ত্রকে আপনি
সেবার ধরিয়ে দিয়েছেন, তাদের সেই লক্ষ্যেরই অনুসারী কেউ হবে এরা। বলল কর্নেল ডা. কেনেডি।
ধন্যবাদ কর্নেল। এমনটাই হবে হয়তো। আহমদ মুসা বলল।
এ সময় ওটির ইউনিফরম পরা একজন সেখানে প্রবেশ করল।
কর্নেল ডা, কেনেডি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে স্যালুট দিল।
ইনিই মেজর জেনারেল ডা. টমাস জ্যাকসন।
কর্নেল ডা. কেনেডি, সব রেডি? বলল মেজর জেনারেল ডা. টমাস জ্যাকসন।
সব রেডি। শুধু…।
কর্নেল ডা. কেনেডির কথার মাঝখানেই ডা. টমাস জ্যাকসন বলল, অ্যানেসথেশিয়ান ডা, চার্লস এখনি এসে পৌঁছবেন।
বলে ডা. জ্যাকসন এগিয়ে গেল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার মাথায় একটা হাত রেখে বলল, কনগ্রাচুলেশন ইয়ংম্যান। আমরা আপনার জন্যে গর্বিত। অপারেশন একটু ডিলেড হওয়ায় আমরা দুঃখিত স্যার।
ধন্যবাদ ডক্টর। বলল আহমদ মুসা।
ডা. জ্যাকসন ডা, কেনেডির দিকে তাকিয়ে বলল, টিমের সবাইকে ডাকুন কনেল।
.
ওদের নেকওয়ার্ক এত গভীর ও বিস্তৃত! আমাদের টপ। হাসপাতালগুলোর মাথায় বসে গেছে ওরা! বলল প্রেসিডেন্ট। তার মুখ বিষণ্ণ, মুখে বিরক্তি।
এ সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর অ্যালেক্স ব্রায়ান। বলল, মি. প্রেসিডেন্ট সেবার যখন ইসরাইলের পক্ষের ষড়যন্ত্রকারীরা ধরা পড়ল, তখন আমরা ধরা পড়াদেরই শুধু শাস্তি দিয়েছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বিরোধী এ ষড়যন্ত্রের নেটওয়ার্ক ধ্বংসের আমরা চেষ্টা করিনি। এবার নতুন ষড়যন্ত্রকারীরা আরও অনেক বেশি শক্তি নিয়ে। নিশ্চয় সেই পুরাতন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আমাদের রাষ্ট্রশক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছে।
অ্যালেক্স ব্রায়ান থামতেই কংগ্রেসের বিরোধী দলীয় নেতা জেমস জনাথন বলল, সিনেটর অ্যালেক্স ব্রায়ানকে ধন্যবাদ। তিনি সমস্যার মূলে গেছেন। এ ব্যাপারে আমরা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য দাবি করছি।
সব ভুলেরই সংশোধন করা হবে। দেশ যে সংকটে পড়েছিল, তার পর কোন পিছুটান আমাদের থাকবে না। যা করব আমরা সবাইকে নিয়েই করব। এই আলোচনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমরা এখন অন্য আলোচনায় বসেছি।
বলে একটু থেমেই প্রেসিডেন্ট আবার শুরু করল, একটা বিষয় পরিষ্কার হয়নি। ডা. গ্রেস পানিতে যে কেমিক্যাল মিশিয়েছিল, সেটা নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি অ্যানেসথেটিক কেমিক্যালের সাথে মিশলে তা প্যাশেন্টের মৃত্যু ঘটায়, তবে ব্রাউন কিউব যে ধরা পড়ল ওটার টার্গেট কি ছিল?
সেনাপ্রধান তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, এক্সিলেন্সি এটা জর্জ আব্রাহম জনসন ব্রিফ করলে ভালো হয়। আমরা সব তথ্য তাকে দিয়েছি। তিনিই সব বিষয়ের কো-অর্ডিনেট করছেন।
প্রেসিডেন্ট তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে।
ইয়েস এক্সিলেন্সি। ষড়যন্ত্রকারীরা হাসপাতালে আহমদ মুসাকে হত্যার জন্যে সমান্তরাল দুটি ব্যবস্থা করেছিল। একটি হলো পানির সাথে মেশানো কেমিক্যাল ও ওভারডোজ অ্যানেসথেটিক কেমিক্যালের কম্বিনেশনে তৈরি করে তার মাধ্যমে হত্যা। এটা আমরা আগেই জেনেছি। দ্বিতীয় বিকল্পটা হলো চামড়ার উপর পয়জনস কেমিক্যাল প্রের মাধ্যমে হত্যা করা। প্রেটি সাংঘাতিকভাবে এলার্জিক। প্রের মাধ্যমে কেমিক্যাল গায়ের চামড়া স্পর্শ করার পর ধীরে ধীরে তা গিয়ে। তার শ্বাসনালিতে প্রবেশ করবে। ধীর ক্রিয়ার মাধ্যমে শ্বাসনালি তা বন্ধ করে দেবে। মৃত্যু ঘটবে ভিকটিমের। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ও গড! আঁটঘাট বেঁধেই ওরা ষড়যন্ত্রে নেমেছিল। যার মোকাবিলা ছিল থিয়োরিটিক্যালি অসম্ভব। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করেছেন। বলল প্রেসিডেন্ট।
মি. প্রেসিডেন্ট, আহমদ মুসার মত আহমদ মুসার লোকেরাও ভীষণ কাজের। দাউদ ইব্রাহিমসহ ওরাই তো ষড়যন্ত্র উন্মোচনের মূল কাজটা করে দিয়েছে। সেই পথে হেঁটেই টোটাল ষড়যন্ত্রটা বানচাল, করা গেছে। বলল সিনেটের সংখ্যাগুরু নেতা।
ঠিক তাই। ষড়যন্ত্রের নেটওয়ার্কের সাথে আরও তিনজন বিগম্যানের নাম পাওয়া গেছে। তাদের ব্যাপারে আমরা কি করছি? এবার উচিত হবে এই ষড়যন্ত্র শুধু নয়, যে নেটওয়ার্কের এই ষড়যন্ত্র সে নেটওয়ার্ককেও এবার সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে। এটাই আজ আমেরিকানদের দাবি। বলল সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা।
এই সিদ্ধান্ত একটি রাজনৈতিক বিষয়। কারণ এই নেটওয়ার্ক রাজনৈতিক বিবেচনা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যারা পরিচালনা করছে। এই নেটওয়ার্ক, তারা এককালের জায়গানিস্ট গ্রুপের উত্তরসূরি। বলল কংগ্রেসের সংখ্যাগুরু দলের নেতা।
এসব নানা রকম বিবেচনা করতে গিয়ে গতবার আমরা বলতে গেলে নেটওয়ার্কটিকে অক্ষতই থাকতে দিয়েছিলাম। তারই খেসারত দিলাম এবার আমরা। এবার ঐ সবকিছুই ভাবা হবে না। এক কঠিন সংকট উত্তরণের মাধ্যমে আমেরিকার নবজন্ম হয়েছে। অনেক শিক্ষাও লাভ করেছি আমরা। জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন, আব্রাহাম লিংকনের আমেরিকা এবার সুবিচারই প্রাধান্য দেবে, কোন প্রকার রাজনৈতিক তোষণকে নয়। বলল কংগ্রেস ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান কারসন ক্রিস্টোফার।
ইয়েস সিনেটর ক্রিস্টোফার। অতীতের ভুল সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সবই আপনারা জানবেন। আমেরিকার নিরাপত্তা, আমেরিকার জনগণের নিরাপত্তা আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তার সাথে বিশ্বের সব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হোক তাও আমরা চাই। আমাদের ফাউন্ডার ফাদারসরা এটা ভেবেছেন যে, আমেরিকানদের অধিকার এবং সব মানুষের মৌলিক অধিকার একই সমতলের। আমরা সেটাই প্রতিষ্ঠা করব। কোন রাজনৈতিক বিবেচনাতেই রাষ্ট্র ও মানুষের ন্যায্য অধিকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আমরা বরদাশত করব না। বলল প্রেসিডেন্ট।
কথা শেষ করেই তাকাল এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, মিটিং-এ আসার আগে আহমদ মুসার খবর নিয়েছিলাম। আর কোন খবর পেয়েছেন?
একটু আগে খবর নিয়েছি। তাকে আইসিইউতে নেয়ার দরকার হয়নি। তাকে বেডেই নেয়া হয়েছে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ জর্জ। বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল সেনাপ্রধানের দিকে। বলল, ওর নিরাপত্তার কি ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেনারেল?
এক্সিলেন্সি, আহমদ মুসাকে রাখা হয়েছে হাসপাতালের ভিভিআইপি সুটে। কর্নেল ডা. কেনেডি জনাব আহমদ মুসার চিকিৎসা ও খাবারের বিষয়টা দেখবেন এবং এফবিআই-এর অফিসার ম্যাক আর্থারসহ তার কমান্ডো টিম আহমদ মুসার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে। জর্জ আব্রাহাম জনসন স্যারের এটাই পরামর্শ ছিল। আর ভিজিটরস নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আহমদ মুসার নির্দেশ মত।
ধন্যবাদ জেনারেল।
প্রেসিডেন্ট একটু থামল। তারপর বলল, জেনারেল, জর্জ ওয়াশিংটন সামরিক হাসপাতাল, আইজেন হাওয়ার স্পেশালাইজড সামরিক হাসপাতাল ও লিংকন স্পেশালাইজড হাসপাতালের তিনজন শীর্ষ ডাক্তার সম্পর্কে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এ পর্যন্ত?
এক্সিলেন্সি, সামরিক গোয়েন্দা, এফবিআই ও সিআইএ এক সাথে বসে একটা সমন্বিত পদক্ষেপের ব্যবস্থা নেয়া নিয়েছে। তাদের অলক্ষ্যে তাদের প্রতি পদক্ষেপ মনিটর করা হচ্ছে, পেন্টাগন সামরিক হাসপাতালে যা ঘটল, তার প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে কি হয়, সেটাও দেখা হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে হাসপাতালে তাদের নেটওয়ার্কসহ তাদের পাকড়াও করতে। বলল সেনাবাহিনী প্রধান।
আমি বিস্মিত হচ্ছি, এরা সবাই দায়িত্বশীল আমেরিকান হবার পরেও কিভাবে একটা ষড়যন্ত্রের হাতের পুতুল হয়ে দাঁড়াল? বলল প্রেসিডেন্ট। গম্ভীর তার মুখ।
মি. প্রেসিডেন্ট, এরা আমেরিকান হলেও নিজেদের জায়গানিস্ট বলে মনে করে। এই আবেগকেও ব্যবহার করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। আর জায়োনিস্টদের কাছে তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসটাই প্রথম অগ্রাধিকার পায়। সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা বলল।
আমাদের দেশের আশি থেকে নব্বই ভাগ ইহুদিই দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক নাগরিক। ক্ষুদ্র এই জায়গানিস্ট গ্রুপটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সমস্যা। এরা নানাভাবেই আমাদের জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি করে আসছে। সবশেষে এরা আমাদের অস্তিত্বে হাত দিয়েছিল। আর যেন ইসরাইল এদের মাথা থেকে যাচ্ছে না। বলল প্রেসিডেন্ট।
মি. প্রেসিডেন্ট, অনেকে বলেন এটা একটা নতুন ধর্মের রূপ নিয়েছে। সেটা হলো ইসরাইল ধর্ম। এই ধর্মের ঈশ্বর হলো ইসরাইল। ইসরাইল ড্রিমকে বাস্তবায়নের জন্যে যাই করা হোক, সেটা বৈধ। এ এক বিপজ্জনক মানসিকতা। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলল।
আমেরিকার স্বার্থে, আমাদের দায়িত্বশীল নাগরিক ইহুদিদের স্বার্থে আমেরিকা থেকে এই ষড়যন্ত্রের মূলোচ্ছেদ হওয়া দরকার। ঈশ্বর আমাদেরকে এক ভয়াবহ খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন। আমরা যদি এই ষড়যন্ত্রের মূলোচ্ছেদ করতে না পারি, তাহলে ঈশ্বরের ইচ্ছারও বিরুদ্ধাচরণ করা হবে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, কোন রাজনৈতিক বিবেচনা যেন আমাদের দুর্বল না করে ফেলে। বলল সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতা।
সিনেটের বিরোধী দলীয় নেতাকে ধন্যবাদ। আমরাও এটাই চাই। জনগণও এটাই চাচ্ছে। বলল কংগ্রেসের সংখ্যাগুরু দলের নেতা।
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। জনগণ যা চাচ্ছে সেটাই হবে। আপনাদের সকলের সহযোগিতা চাই। এবার আমরা উঠতে পারি। আমরা আহমদ মুসার দ্রুত সুস্থতার জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি। আমাদের গোয়েন্দা কর্মীদের ধন্যবাদ দিচ্ছি। তারা তাদের কাজ সুচারুভাবে করেছেন।
বলে তাকাল জর্জ আব্রাহাম জনসনের দিকে। বলল, আহমদ মুসা এবং তার পরিবার আমাদের সম্মানিত মেহমান। তাদের ও জেফারসন। পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনার। সশস্ত্র বাহিনী প্রধান ও সিআইএ প্রধানদের আপনার পাশে পাবেন। ধন্যবাদ সকলকে। বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল সবাই। প্রেসিডেন্ট চলে গেল।
একে একে সবাই বিদায় নিল।
জর্জ আব্রাহাম জনসন বেরিয়ে আসতে আসতে অয়্যারলেস করল। সারা জেফারসনকে। বলল, মা, জানি তোমরা রেডি হয়ে আছ। কিন্তু আরও সময় লাগবে তোমাদের হাসপাতালে আসতে। হাসপাতালে আহমদ মুসাকে টার্গেট করে যে ঘটনাগুলো ঘটল, সে প্রেক্ষিতে তোমাদের সিকিউরিটি ব্যবস্থা রিকাস্ট করা হচ্ছে। ব্যবস্থাটা সম্পূর্ণ। হলেই তোমরা হাসপাতালে আসবে।
জি, আংকেল। আমরা বুঝতে পেরেছি। আপনি এখন জোসেফাইন। আপার সাথে কথা বলুন।
বলে সারা জেফারসন অয়্যারলেসটা জোসেফাইনকে দিয়ে দিল।
আস্সালামু আলাইকুম আংকেল। আপনি সারাকে যা বলেছেন। আমি শুনেছি। আমরা আপনাদের সাথে একমত। আমরা যাওয়ার জন্যে উদগ্রীব অবশ্যই, কিন্তু কখন কিভাবে যাবো সেটা আপনারা অবশ্যই দেখবেন। বলল জোসেফাইন।
ধন্যবাদ মা, অসংখ্য ধন্যবাদ। আব্রাহাম জনসন বলল।
আংকেল, উনি কেমন আছেন? বলল জোসেফাইন।
আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছেন মা। তাকে অপারেশনের পরে আইসিইউতেও নেয়া হয়নি। তাকে বেড়ে নিয়ে আসা হয়েছে। অপারেশনের সময় তোমরা হাজির থাকতে চেয়েছিলে, সে সুযোগ কেন আমরা দিতে পারিনি, সেটা তাকে বলেছি। জর্জ আব্রাহাম জনসন বলল।
ধন্যবাদ আংকেল। বলল জোসেফাইন। ওয়েলকাম। তোমরা ভালো থেকো। আসি। আস্সালামু আলাইকুম। বলল জর্জ আবাহাম জনসন।
ওয়াআলাইকুম সালাম।
বলে জোসেফাইন কল ক্লোজ করে অয়্যারলেস সারা জেফারসনের হাতে দিয়ে দিল।
এই অয়্যারলেসটি সরকার থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে আহমদ মুসা ও জেফারসন পরিবারকে।
সারা জেফারসন অয়্যারলেসটি হাতে নিয়ে জোসেফাইনের গলা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল সোফায়। বলল, হাসপাতালেও কি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র হয়েছিল ওর বিরুদ্ধে। জায়োনিস্ট এজেন্টরা দেখি, আমাদের প্রশাসন ও জনজীবনের বিভিন্ন বিভাগে দারুণভাবে ছড়িয়ে আছে। আল্লাহ রক্ষা করেছেন দেশকে এবং আহমদ মুসাকে।
একটা ভালো দিক হলো, এবার এসব কোন কিছুই সরকার গোপন করেনি। সবই মিডিয়ায় দিয়ে দিয়েছে, যেমন দিয়েছে ডেথ ভ্যালি ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত ঘটনা। এর ফলে যে জনমত সৃষ্টি হবে, তা দেশ ও সরকারের সাহায্যে আসবে। বলল জোসেফাইন।
গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত আমি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে মানুষের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছি। দুটি প্রধান জিনিস আমি দেখলাম। এক. আহমদ মুসার ভাবমর্যাদা জাতীয় বীরের পর্যায়ে চলে গেছে। আহমদ মুসার ফটো সংগ্রহ করতে মানুষ পাগল হয়ে গেছে। দুই. ষড়যন্ত্রকারী এবং নেটওয়ার্কের মূলোচ্ছেদ করা হোক এটা ঐক্যবদ্ধ গণদাবি হয়ে উঠেছে। সারা জেফারসন বলল।
আল্লাহ আমেরিকাকে বিপদমুক্ত করুন। আচ্ছা, আহমদ মুসা মুসলিম, এটা কি সব মানুষের কাছে পরিষ্কার? বলল জোসেফাইন।
পরিষ্কার মানে! আমি বহু প্ল্যাকার্ড দেখেছি, ব্যানার দেখেছি, যেখানে লেখা রয়েছে মুসলিমস এন্ড আমেরিকানস আর ব্রাদার্স। লং লিভ আহমদ মুসা। সারা জেফারসন বলল।
গম্ভীর হলো জোসেফাইনের মুখ। বলল, আমেরিকানদের এই উপলব্ধিই আহমদ মুসার জন্যে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। তার সব কষ্ট, সব বেদনা সার্থক। কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠেছে জোসেফাইনের। তাঁর দুচোখের কোণায় অশ্রু।
সারা জেফারসন তাকিয়েছে জোসেফাইনের দিকে। ওড়নার প্রান্ত দিয়ে জোসেফাইনের চোখ মুছে দিল সারা জেফারসন। বলল, অশ্রু কেন আপা, এমন বেদনা আর বিপদের সাগর পাড়ি দিয়েই তো সুসংবাদ আসে, সফলতার সোনালি সূর্য উঠে। সারার কণ্ঠও আবেগে ভেঙে পড়ল। তার চোখ ফেটে নেমে এল অশ্রু।
জোসেফাইন ও জেফারসন দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল।
.
৭.
হাসপাতালের স্যুটে আহমদ মুসার কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, আমি ম্যাক আর্থার, ভেতরে আসতে পারি স্যার?
এস ম্যাক আর্থার। বলল আহমদ মুসা।
ম্যাক আর্থার ঘরে ঢুকল।
কি ব্যাপার ম্যাক আর্থার? কোন খবর? বলল আহমদ মুসা।
স্যার, দাউদ ইব্রাহিমের পরিবার এবং তাদের সাথে রবার্ট রবিনসনের পরিবার এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে। দেখা করেই চলে যাবে তারা। ম্যাক আর্থার বলল।
মিষ্টি হাসল আহমদ মুসা। বলল, ওরা আমার বিপদের সময়ের সাথী ছিল। ওদেরকে সম্মানের সাথে নিয়ে এস। তার আগে ওদের বসার ব্যবস্থা কর ম্যাক আর্থার। বলল আহমদ মুসা।
বিশাল কক্ষ। প্রয়োজন মত চেয়ার আনা হলো।
দশ মিনিটের মধ্যে দুই পরিবার আহমদ মুসার কক্ষে প্রবেশ করল। সবার পরনেই স্টেরিলাইজড ইউনিফরম। আহমদ মুসার স্যুটে প্রবেশ করে প্রথমেই সকলকে পোশাক পাল্টাতে হয়েছে।
আহমদ মুসা হেসে সকলকে স্বাগত জানাল। বলল, সবাই আপনারা কেমন আছেন? জনাব রবার্ট রবিনসন, বাড়ি ছাড়তে হওয়ায় আপনাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। দুঃখিত আমি। মরিয়ম মারুফা, এলিজা, জনার্দন– তোমরা সবাই ভালো আছ নিশ্চয়? থামল আহমদ মুসা।
কথা বলে উঠল রবার্ট রবিনসন, আমাদের দুই পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন। আপনি আমেরিকা ও আমেরিকান জনগণের জন্যে যা করেছেন, তার জন্যে আমেরিকান জনগণের সাথে আমরাও. কৃতজ্ঞ। আপনার সাথে আমাদের কিছু মেশার সুযোগ হয়েছিল সেজন্যে আমরা আরও গর্বিত। চিরদিন মনে থাকবে আমাদের সেই দিনগুলোর কথা। কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠল রবার্ট রবিনসনের।
আহমদ মুসার মুখও গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, আমি মানুষ, মানুষের জন্যে কাজ করার যে সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, তার জন্যে আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা স্যার। মানুষকে এইভাবে ভালোবাসার কথা। বলা আমি আগে কারো কাছে শুনিনি, আর শুনবো কি না তাও জানি না। দেশ, জাতীয়তা, ধর্ম, বর্ণের বেড়া ভেঙে মানুষকে আপন করে নেয়ার জন্য চাই খুব বড় হৃদয়। ধন্যবাদ স্যার, আপনাকে। রবার্ট রবিনসন বলল।
জনাব রবার্ট রবিনসন, আমরা এক আদমের সন্তান। গোটা মানব সমাজ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। মানুষকে ভালোবাসা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। মানুষের মুক্তি, কল্যাণের জন্যেই আমাদের ধর্ম ইসলাম। বলল আহমদ মুসা।
হয়তো তাই হবে। আপনিই তার প্রমাণ। রবার্ট রবিনসন বলল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই এলিজা বলে উঠল, স্যার, আমি একটা অভিযোগ নিয়ে এসেছি।
বল। আহমদ মুসা বলল। তার মুখে হাসি।
ডেথ ভ্যালিতে এককভাবে এতবড় অভিযানের দায়িত্ব আপনার উপর থাকার পর আপনি সেদিন আমাদের বাড়িতে ক্রিমিনালদের সাথে সংঘর্ষে যাবার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তখন আপনার বড় কিছু হয়ে গেলে ডেথ ভ্যালি অভিযানের কি হতো? আমেরিকানদের কি হতো? একথা মনে হলেই আমার বুক কেঁপে উঠে। আপনি সেদিন ঐ ঝুঁকি নেয়াতে আপনার মূল দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করা হয়েছিল। কেন আপনি এটা করেছিলেন? বলল এলিজা।
প্রথমে আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল, পরে গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, তোমার অভিযোগ সত্য বোন। মানবিক বিবেচনার দাবি এটাই। কিন্তু এলিজা দুনিয়াতে মানুষই সবকিছু ঘটায় না। যা ঘটবার তা আল্লাহই ঘটান। মানুষের দায়িত্ব হলো, সেই ঘটনায় বুদ্ধি-বিবেকের রায় অনুসারে ভূমিকা পালন করা। আমি সেটাই করেছিলাম। তবে আল্লাহই তা করিয়েছিলেন। সুতরাং আমার কোন দোষ হয়নি। বলল আহমদ মুসা।
এতবড় ভারি কথা বুঝতে আমার সময় লাগবে স্যার। কিন্তু ভাবছি ডেথ ভ্যালির অপারেশনের কথা। এই ব্যাপারে আপনি কিছু বললেন না? এলিজা বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, এই ঘটনাতেও আমি থাকব, এটা আল্লাহরই পরিকল্পনা ছিল। আল্লাহর অন্য পরিকল্পনা থাকলে সে ভাবেই ঘটনা ঘটত।
ধন্যবাদ। বুঝেছি স্যার। আপনি বিবেক অনুসারে কাজ করবেন, যা ঘটাবার তা আল্লাহই ঘটাবেন। আমাদের খৃস্টানদের মধ্যে এমন বিশ্বাস নেই। আর প্র্যাকটিসিং ধর্মও, আমাদের নয়। এলিজা বলল।
আহমদ মুসা কয়েকবার তাকিয়েছিল রবার্ট রবার্টসনের দিকে। এবার জিজ্ঞাসা করল রবার্ট রবিনসনকে, ইনি কে? আপনার বাড়িতে দেখেছি বলে মনে হয় না।
হাসল রবার্ট রবিনসন। বলল, ওকে আপনার সাথে পরিচয়ই করানো হয়নি। ওনি আমার বড় ভাই রবার্ট রবার্টসন। ভার্জিনিয়ায় ওর বাড়িতেই তো আমরা ছিলাম। আর একটা খবর হলো, হাসপাতালে আপনার ওপর যে হামলা হবে এ খবর উনিই দিয়েছিলেন।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল রবার্ট রবার্টসনকে উদ্দেশ্য করে, ধন্যবাদ! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার দেয়া তথ্য অমূল্য উপকার করেছে আমাদের। ওদের ষড়যন্ত্র রোধ করা গেছে। আপনার দেয়া তথ্যেই।
আমার খুবই ভালো লাগছে। আমি আপনার এবং দেশের কাজে লাগতে পেরেছি। বাই দি বাই স্যার, আরেকটা তথ্য আজ পেলাম। জানি না আদৌ সেটা কোন তথ্য কি না। তবে আমার সন্দেহ হচ্ছে একটা সিমিলার শব্দের জন্য। সে শব্দটা হলো বিগ বস। আমার দেয়া আগের তথ্যেও বিগ বসের নির্দেশনার কথা বলা হয়েছিল। এ তথ্যেও সেই বিগ বসের নির্দেশের কথা আছে। বলল রবার্ট রবার্টসন।
আহমদ মুসার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠল। বলল, প্লিজ বলুন তথ্যটা কি?
আজ অফিস থেকে আমি বাজার হয়ে ফিরছিলাম। একটা পাবলিক কল অফিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। পাবলিক কল অফিসটি টপলেস, সাধারণত এমনটা দেখা যায় না। ভেতরে একজন ক্ষুদ্র অয়্যারলেসে কথা বলছিল PCO-এর টেলিফোনে নয়। তার কথার বিগ বস শব্দটি আমার কানে গেল। আমি থমকে দাঁড়ালাম। আগেও একটি বড় ঘটনায়। এই শব্দটি আমি শুনেছি, তখন একথা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। আমি শুনতে লাগলাম তার কথা। কণ্ঠ উচ্চ নয়, কিন্তু অস্পষ্ট শব্দগুলো বুঝার মত ছিল। সে বলছিল, বিগ বস ক্ষেপে গেছেন। ইতিমধ্যেই তিনি হাসপাতালের সব খবর পেয়েছেন। ডুপন্ট সিনাগগের বটম ফ্লোর আজ রাতেই খালি করতে বলেছেন। যেকোনো মূল্যে কাঁচামালগুলো, কম্পিউটারের হার্ডডিস্কগুলো এবং গুরুত্বপূর্ণ টেস্টিং যন্ত্রপাতিগুলো রক্ষা করতে হবে নতুনভাবে কাজ শুরু করার জন্যে। লিখে নাও, যাবে ২৯৯ নাম্বারের বটমে থ্রি নট থ্রির বটম হয়ে। লিখে নিয়েছ। ও.কে. বাই। ও.কে. বাই শুনেই আমি হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলাম। থামল রবার্ট রবার্টসন।
ধন্যবাদ জনাব, আমার মনে হয় আপনার শোনা মেসেজটা খুবই মূল্যবান। ধন্যবাদ আপনাকে।
বলেই আহমদ মুসা ম্যাক আর্থারকে বলল, তোমার কাছে অয়্যারলেস আছে?
ইয়েস স্যার। বলে ম্যাক আর্থার অয়্যারলেসটি আহমদ মুসার কাছে। নিয়ে এল।
জনাব জর্জ আব্রাহামকে কল দাও। বলল আহমদ মুসা।
ম্যাক আর্থার কল করল এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসনকে।
সংযোগ হলেই অয়্যারলেসটি আহমদ মুসার ডান হাতে তুলে দিল।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে বলল, জনাব আগের সেই একই সূত্র থেকে খবর। ডুপন্ট সিনাগগের আন্ডারগ্রাউন্ড কোন ফ্লোরে এইচ থ্রির স্টোর বা ল্যাব থাকতে পারে। আজ রাতেই ওরা এগুলো শিফট করবে। তাদের নতুনভাবে কাজ শুরু করার সবকিছু নাকি ওখানে আছে। এখনকার মত এটুকুই জনাব। আরও একটা তথ্য আছে সেটা আমি ম্যাক আর্থারকে বলছি। সে আপনাকে জানাবে।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। সূত্রকে আমার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাবে। আমার মনে হচ্ছে খুব মূল্যবান ইনফরমেশন। আমি নির্দেশ দিচ্ছি এখনি কাজ শুরু করার। আহমদ মুসা ধন্যবাদ। তোমার শরীর কেমন? তোমাদের বাসা থেকে আমাদের মায়েরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তোমার ওখানে যাচ্ছে। ও.কে. আহমদ মুসা।
কথা শেষ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা তাকাল রবার্ট রবার্টসনের দিকে। বলল, এফবিআই প্রধান জর্জ আব্রাহাম জনসন আপনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। জানিয়েছেন।
বলেই আহমদ মুসা তাকাল মরিয়ম মারুফাদের দিকে। বলল, তোমরা যে কথা বলছ না?
স্যার, কি বলব আমরা? খুশিতে আমরা অনেক কেঁদেছি। এমন দিন আমেরিকার দেখব ভাবিনি। মিডিয়ায় যখন দেখছি আমেরিকানদের স্লোগান, আমেরিকানস এণ্ড মুসলিমস আর ব্রাদার্স, তখন আনন্দের আবেগ আমরা বুকে ধারণ করতে পারছিলাম না। চোখ ফেটে তা নেমে। এসেছে অশ্রু হয়ে। আপনার রক্তের মূল্যে এই দিন আমরা পেয়েছি। মরিয়ম মারুফার শেষ কথাগুলো কান্নায় আটকে যাচ্ছিল।
কথা শেষ করে অশ্রু গোপন করার জন্য মুখ নিচু করল সে।
মরিয়ম মারুফার আবেগ আহমদ মুসাকেও স্পর্শ করেছিল। সংগে সংগে সে কথা বলতে পারল না। একটু সময় নিয়ে বলল, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর বোন। তিনি যা চেয়েছিলেন, সেটাই তিনি করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
আলহামদুলিল্লাহ। বলে উঠল মরিয়ম মারুফা, তার বাবা নূর ইউসুফ ও ভাই দাউদ ইব্রাহিম।
আহমদ মুসা দাউদ ইব্রাহিমের দিকে চেয়ে বলল, দাউদ ইব্রাহিম তো এই ডেথ ভ্যালির ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। আলহামদুলিল্লাহ।
দাউদ ইব্রাহিম লজ্জিত কণ্ঠে বলল, স্যার, আমি মাত্র আপনার আদেশ পালন করেছি।
কথাটা শেষ করেই দাউদ ইব্রাহিম বলল, স্যার, আপনাকে বলা হয়নি, সিটিতে আমরা একটা বাড়ি পেয়েছি। বাবার কেসের রায় স্থগিত হয়েছে এবং রিট্রায়ালের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা শহরে ফিরে এসেছি স্যার।
আলহামদুলিল্লাহ। খুশি হলাম। ওয়াশিংটনে বেড়ানোর আরেকটা জায়গা হলো আমার।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল।
রবার্ট রবিনসন এক সময় বলে উঠল, আমরা অনেক সময় নিয়েছি। এবার আমরা উঠছি। অনুমতি দিন স্যার। আর সেই সাথে একটা অনুরোধ করে রাখি, আমাদের বাড়িটাকে ভুলবেন না। ম্যাডামসহ যদি আপনাকে পাই, তাহলে তার চেয়ে বড় পাওয়া আমাদের আর কিছু হবে না। দাউদ ইব্রাহিমের বাড়ি এবং আমাদের বাড়িকে এক দৃষ্টিতে দেখার জন্যে অনুরোধ করছি। রবার্ট রবিনসন বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, দুই বাড়িকে একসাথে বেঁধেও ফেলতে পারেন?
কিভাবে? রবার্ট রবিনসন বলল। তার কণ্ঠে কিছুটা বিস্ময়!
আমি আর এগোবো না। আপনারা ভেবে দেখবেন। বলল আহমদ মুসা।
ভাবছিল রবার্ট রবিনসন। বলল, কিছুটা বুঝেছি স্যার। আপনার ইচ্ছা আমাদের জন্যে আদেশ। এর বেশি আজ আর কিছু বলছি না স্যার। বলে উঠে দাঁড়াল রবার্ট রবিনসন।
সকলেই উঠে দাঁড়াল। একে একে বিদায় নিল সবাই।
সবাইকে বিদায় দিয়ে এসে ম্যাক আর্থার আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। বলল, স্যার মি. রবার্টসনের দেয়া কিছু তথ্যের বিষয় এফবিআই প্রধান স্যারকে অবহিত করার কথা বলেছিলেন, সে ব্যাপারে আমার করণীয় কি?
ধন্যবাদ ম্যাক আর্থার স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে। মি. রবার্টসনের দেয়া তথ্যের মধ্যে দুটি বাড়ির নাম্বার আছে। একটি ২৯৯, অপরটি ৩০৩। তার দেয়া তথ্য অনুসারে, সিনাগগ থেকে তাদের মূল্যবান মালামাল তারা ২৯৯ নং বাড়ির বটম ফ্লোর থেকে ৩০৩ নং বাড়ির বটম। ফ্লোর হয়ে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে নিয়ে যাবে। এই তথ্যটা আমি এভাবে অত লোকের মধ্যে তাকে জানাতে চাইনি। এখন তুমি তাকে জানিয়ে দাও। বলল আহমদ মুসা।
ইয়েস স্যার। বলে ম্যাক আর্থার কক্ষ থেকে বেরিয়ে সামনের কক্ষে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ম্যাক আর্থার আবার আহমদ মুসার ঘরে ঢুকল।
সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলল, স্যার, অল্পক্ষণের মধ্যেই ম্যাডামরা আসবেন। আমি তার অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে চাই।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, ওরা মিনিট পনেরোর মধ্যেই এসে যাবেন।
ম্যাক আর্থার কক্ষ থেকে চেয়ার সরিয়ে ফেলে ঘরটিতে পাঁচ সিটের সোফার সাথে একটা তিন সিটের সোফা এনে যোগ করল। ফ্লাওয়ার ভাসে টাটকা ফুল এনে বসাল। দুটি সেন্টার টেবিলের ফুলদানিতে বাদাম, আখরোট, কিশমিশ, প্রভৃতি শুকনো তাজা ফল রাখল। সেন্টার টেবিলের নিচের তাকে সফট ড্রিংকসহ কিছু প্রাকৃতিক ঝরনার পানির প্যাক রাখল।
জোসেফাইনরা এসে গেল।
সারা জেফারসনই তার তৈরি প্রটোকলে সবার আগে রেখেছিল জোসেফাইনকে। তাই জোসেফাইনই প্রথমে ঘরে ঢুকবে, সবাই তাকে ফলো করবে।
জোসেফাইন ঘরে ঢুকল।
আহমদ মুসা তাকিয়েছিল দরজার দিকে। জোসেফাইনকে ঢুকতে দেখে উঠতে চেষ্টা করে ব্যথা পেয়ে ধপ করে তার মাথাটা পড়ে গেল বালিশে।
জোসেফাইন ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে। মাথায় হাত রেখে বলল, উঠতে গিয়েছিলে কেন? খুব ব্যথা লেগেছে? উদ্বেগ ও মমতায় মাখানো নরম কণ্ঠ জোসেফাইনের।
জোসেফাইনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আহমদ মুসা বলল, কেমন। আছ জোসেফাইন?
কেমন থাকতে পারি, বল? বলল জোসেফাইন।
আহমদ আবদুল্লাহ কোথায়? আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইন পেছনে তাকাল। দেখল কেউ নেই পেছনে। ওরা আমার পেছনেই আসছিল। গেল কোথায়? বলল জোসেফাইন।
ওরা কারা? আহমদ মুসা বলল।
সারা জেফারসন, আহমদ আবদুল্লাহ এবং মা জিনা জেফারসন।
তাহলে বুঝতে পারনি ওরা কোথায়? আহমদ মুসা বলল।
না, বুঝতে পারছি না। বলল জোসেফাইন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, আমার কাছে তোমাকে একা আসার সুযোগ দেয়ার জন্যে সবাইকে আটকে দিয়েছে সারা জেফারসন।
হাসল জোসেফাইন। বলল, ভীষণ দুষ্টু সারাটা, বুদ্ধির শেষ নেই। দেখছি আমি।
বলে জোসেফাইন দরজার দিকে এগোতে চাইল। আহমদ মুসা খপ করে তার হাত ধরে কাছে টেনে নিল। জোসেফাইন ভারসাম্য হারিয়ে আহমদ মুসার বুকের ডান পাশটায় পড়ে গেল। আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে তাকে আরও কাছে টেনে নিল।
জোসেফাইন একটু ঘুরে আহমদ মুসার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, প্লিজ, ছেড়ে দাও। দুষ্টুদের ধরে আনি।
হাসল আহমদ মুসা। ছেড়ে দিল সে জোসেফাইনের হাত। জোসেফাইন ছুটে চলে গেল বাইরে। সবাইকে সাথে করে নিয়ে এল।
আহমদ আবদুল্লাহ সারার হাত ধরে তার সাথে তাকে টেনে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আহমদ মুসার কাছে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা আহমদ আবদুল্লাহর মুখ থেকে চোখ উপরে তুলে সারা জেফারসনের দিকে একবার তাকিয়ে সালাম দিয়ে আহমদ আবদুল্লাহর দিকে তার ডান হাত বাড়িয়ে দিল। বলল, কেমন আছ বেটা?
আহমদ আবদুল্লাহ ডান হাত দিয়ে সারা জেফারসনকে ধরে রেখেছে। বাম হাত দিয়ে বাবার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি এখন ভালো আছ বাবা। কিন্তু তুমি হাসপাতালে কেন?
আমি ভালো আছি কি করে জানলে বাবা? আহমদ মুসা বলল।
আমি টিভিতে তোমাকে দেখেছিলাম, তোমার গায়ে কি সব ময়লা, রং। তবে এখন ঠিক আছ।
হ্যাঁ বাবা, আমি এখন ঠিক আছি। আহমদ মুসা বলল।
আলহামদুলিল্লাহ। বলেই আহমদ আবদুল্লাহ সারা জেফারসনের হাত একটু টেনে উপরে তুলে বলল, একে তুমি চেন বাবা, আমার মাম্মি।
আহমদ মুসা একটু বিব্রত হলো। জোসেফাইনকে দেখিয়ে বলল, ইনি কে বেটা?
আহমদ আবদুল্লাহ সংগে সংগেই জবাব দিল, আম্মা, আমার আম্মা। আর এ আমার মাম্মি।
আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে।
জোসেফাইন নিজের জোড়া ঠোঁটের তর্জনি লম্ব আকারে লাগিয়ে ইংগিত করল এ নিয়ে কথা না বলতে।
বুঝল আহমদ মুসা। হেসে উঠল। বলল, তোমার মাম্মিকে আমি চিনি বাবা।
বলে একবার সারা জেফারসনের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে চোখ নিচু করে বলল, কেমন আছেন মিস সারা? কতদিন পরে দেখা বলুন তো!
বিব্রত সারা জেফারসনের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। মুখে তার লজ্জার জড়তা।
স্যরি, এ প্রশ্নটা আমারই জিজ্ঞাসা করা উচিত আপনাকে। স্যরি, সালাম দিতেও ভুলে গেছি। বলল সারা জেফারসন অনেকটা কাঁপা কণ্ঠে।
আমিও তো সালাম দিতে ভুলে গেছি সারা। জোসেফাইন বলল।
সালাম একটা দোয়া। তোমরা সালামের চেয়ে অনেক বেশি দোয়া আমার জন্যে করেছ, করছ। আর ভুল তো হতেই পারে। আসলে আমাদের কারও মনই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।
বলে আহমদ মুসা সারা জেফারসনের মা জিনা জেফারসনের দিকে মুখ ফিরাল। বলল, মা, আপনি কেমন আছেন?
এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু ভালো ছিলাম না বাছা! তোমার উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেল, তার কষ্ট আমরাও পেয়েছি। আল্লাহর হাজার শোকর, সব ঝড় থেমে গেছে। তোমার সেরে উঠতে যদিও সময় লাগবে, কিন্তু তোমাকে এমন সুস্থ অবস্থায় দেখে আমাদের খুব আনন্দ লাগছে বাছা! বলল জিনা জেফারসন।
আমার উপর দিয়ে অনেক বিপদের ঝড় বয়ে গেছে সত্য, কিন্তু কষ্ট অনুভব করতে পারিনি। সেই তুলনায় আপনাদের অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। কষ্ট আপনারাই বেশি পেয়েছেন। আহমদ মুসা বলল।
কি বলব বাছা! এই দুজনের দিকে আমি তাকাতে পারিনি। আমার জোসেফাইন মা ধৈর্যের এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি। তবু বুক জোড়া ব্যথার প্রকাশ তো আটকানো যায় না। সে তুলনায় সারা অনেক পাতলা। অল্প চাপেই ভেঙে পড়া তার স্বভাব। বলল জিনা জেফারসন।
মা, জোসেফাইন সম্পর্কে আপনি ঠিক বলেছেন। বিপদ-বিপর্যয়ে সে পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু মিস সারা অতটা পাতলা নয় মা, যেভাবে আপনি বললেন। আমি তো দেখেছি, দুঃখ ও বিপদের সময় সেও সব ভয়ের উর্ধ্বে উঠতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
মা, আমি আহমদ আবদুল্লাহকে স্যুটটা একটু ভালো করে ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনি।
বলেই জোসেফাইনের দিকে তাকিয়ে বলল, যাই আপা। দেখ, আহমদ আবদুল্লাহ কেমন উসখুস করছে।
ঠিক আছে, ঘুরিয়ে নিয়ে এস। বলল জোসেফাইন।
আমাকে নিয়ে চল সারা, আমিও দেখি। ভাইকে একা তুমি সামলাতে পারবে না।
বলে সারার মা জিনা জেফারসনও উঠে দাঁড়াল।
তাহলে আমি বাদ থাকি কেন? বলল জোসেফাইন।
বাছা একা থাকবে। আর একজন কেউ থাকলে তুমিও যেতে। বলল জিনা জেফারসন।
সারা জেফারসনরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
জোসেফাইনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, তোমার মুখ লাল হয়ে উঠল কেন? ওরা তো অন্যায় কিছু করেনি। তোমার জন্যেই তো ওরা এটা করল।
জোসেফাইন আহমদ মুসার মাথার পাশে বসতে বসতে বলল, এই দুষ্টু বুদ্ধি সব সারার।
দুষ্টু বুদ্ধি বলছ কেন, এটা তো ওর শুভ বুদ্ধি। কতদিন পরে আমাদের দেখা হলো বলতো? সেই যে সৌদি সরকারের অনুরোধে প্যাসিফিকে গেলাম। তারপর কত দিন! আহমদ মুসা বলল।
তোমার এসব মনে করবার সময় কখনো হয়েছে! বলল জোসেফাইন। তার কণ্ঠে অভিমান।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের একটা হাত হাতের মুঠোতে নিয়ে বলল, আমার মনটা জেনে বলছ?। এ জোসেফাইন ধীরে ধীরে নিজের মাথাটা আহমদ মুসার মাথার উপর আলতোভাবে রেখে বলল, জানি আমি। জানি বলেই তো নিজের মনটাকে শক্ত রাখার চেষ্টা করি, যাতে তুমি দুর্বল না হয়ে পড়।
জোসেফাইনের চোখের দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার কপালে।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের হাত ছেড়ে দিয়ে কপাল থেকে জোসেফাইনের অশ্রুর সেই ফোঁটা তর্জনিতে নিল। বলল, জান এই অশ্রুটা কি? হৃদয়ের অন্তহীন ভালোবাসার অনন্তরূপের গলিত প্রকাশ। এই অশ্রু যার জন্যে তার চেয়ে ভাগ্যবান দুনিয়াতে কেউ নেই।
জোসেফাইন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, এবার আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। এবার তুমি আমাকে অনেক বেশি সময় দেবে।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের মাথা একটু তুলে ধরে তার চোখে, মুখে, কপালে চুমু এঁকে দিল। বলল, এবার আমি আর অন্যথা করব না। তুমি যা চাও তাই হবে।
জোসেফাইন আহমদ মুসার কপালে আর একটি চুমু দিয়ে উঠে বসে বলল, কথা কিন্তু দিলে।
তোমাকে কথা দিয়ে কথা রাখিনি, এমন ঘটনা মনে হয় ঘটেনি। আহমদ মুসা বলল।
সেই জন্যেই তো স্মরণ করিয়ে দিলাম। বলল জোসেফাইন।
জোসেফাইন আহমদ মুসার মাথার চুলে হাত ঢুকাল। গোটা মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে বলল, বাহ! তোমার চুল তো এখনো সুন্দরই আছে। কিভাবে এটা হলো।
কেন দাউদ ইব্রাহিম ও রবার্ট রবিনসনের বাসায় তো কোন অসুবিধায় ছিলাম না। আহমদ মুসা বলল।
নিয়ে যাবে আমাকে ওদের কাছে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাব। বলল জোসেফাইন।
নিয়ে যেতে হবে না, ওরাই ছুটে আসার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে। তোমরা আসার আগে ওদের দুই পরিবারই এসেছিল দেখা করতে। ওরা আমার এবং দেশের অশেষ উপকার করেছে। আহমদ মুসা বলল।
আল্লাহ ওদের এর উত্তম জাযাহ দিন। বলল জোসেফাইন।
ছাড়, সারারা এতক্ষণ কোথায়? আহমদ আবদুল্লাহ কি করছে দেখি। বলল জোসেফাইন।
আচ্ছা জোসেফাইন, আহমদ আবদুল্লাহ সারাকে মাম্মি বলার ব্যাপারটা কি? হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইনও হেসে উঠল। বলল, সে অনেক কথা। অনেক দৈবের ব্যাপার। আমরা আমেরিকায় এসে যখন এয়ারপোর্টে নামলাম। আংকেল জর্জ আব্রাহামের পরিবার, জেফারসন পরিবার গিয়েছিল আমাদের রিসিভ করতে। এর মধ্যে আহমদ আবদুল্লাহ গিয়ে মাম্মি মাম্মি বলে জড়িয়ে ধরেছিল সারা জেফারসনকে। সবাই অবাক! সারা তো স্তম্ভিত, বিব্রত। সে এতটাই আনমনা হয়ে পড়েছিল যে, তার হাতের ফুলের তোড়া মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আহমদ আবদুল্লাহর সেদিকে কোন হৃক্ষেপ নেই। মাম্মি মাম্মি করে সারার কোলে উঠে তবেই ছেড়েছে। তারপর থেকে তার সারাদিন চলছে সারাকে নিয়ে। রাতেও ঘুমায় তার কাছে।
স্ট্রেঞ্জ। সারা কিংবা মা কিছু মনে করেন না? আহমদ মুসা বলল।
মা বলেন, বাচ্চারা বেহেশতের ফুল। যা চায় ও বলুক। আর সারা ১ কি বলবে, সে মাম্মিই হয়ে গেছে। আগের থেকেই দারুণ ভালোবাসে ও আহমদ আবদুল্লাহকে। বলল জোসেফাইন।
অবাক কাণ্ড। আহমদ মুসা বলল।
আল্লাহর কোন ইচ্ছা হয়তো এই অবাক কাণ্ডের মধ্যে আছে। বলল জোসেফাইন মিষ্টি হেসে।
আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল, কি বলতে চাচ্ছ। তুমি? গম্ভীর কণ্ঠ আহমদ মুসার।
এখন সব কথা নয়। তুমি অসুস্থ। বলল জোসেফাইন।
কেন সব কথা এখন নয় বলছ জোসেফাইন? আহমদ মুসা বলল।
এই তো বললাম আল্লাহর ইচ্ছার কথা। বলল জোসেফাইন।
কি ইচ্ছা? আহমদ মুসা বলল।
এই কথাই তো এখন নয় বলছি। তবে একটা কথা তোমাকে বলি, আমার ইচ্ছায় আমি আমেরিকায় এসেছি কেন বলতো?
আহমদ মুসা একটু ভাবল। হাসল। বলল, বেড়াতে এসেছ, এটাই তো কথা।
শুধু বেড়াতে নয়, সারাকে নিয়ে যাবার একটা মিশন নিয়েও এসেছি। বলল জোসেফাইন। তার কণ্ঠ গম্ভীর।
আহমদ মুসা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল জোসেফাইনের দিকে। বলল, আমি বুঝতে…।
জোসেফাইন আহমদ মুসার ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে বলল, এ বিষয়ে আর একটি কথাও নয়। তোমাকে সব বলব আমি। বলার জন্যে অপেক্ষা করেছি বহুদিন।
আহমদ মুসা আবার গভীর দৃষ্টিতে তাকাল জোসেফাইনের দিকে। মনে তার অনেক কথা জাগল। জোসেফাইন কি বলতে চায়, মন কিছুটা যেন আঁচ করতে পেরেছে। একটা নতুন বিস্ময় এসে তার মনকে আচ্ছন্ন করল। কিন্তু কিছু বলা যাবে না। জোসেফাইনের আঙুল তখনও তার ঠোঁটে চেপে আছে।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের হাত ধরে তার হাতে একটা চুমু খেয়ে বলল, ঠিক আছে আমার জোসেফাইন, তথাস্তু।
.
দিনে দুএকবার ঘরের মধ্যে দুচার মিনিট পায়চারি করার অনুমতি দিয়েছে ডাক্তাররা আহমদ মুসাকে। এখন কক্ষের ব্যালকনিতে চেয়ারে গিয়ে বসতে পারে আহমদ মুসা। সে কক্ষে পায়চারি করছিল।
হঠাৎ তার অয়্যারলেস বিপ বিপ করে উঠল।
আহমদ মুসা অয়্যারলেস তুলে নিয়ে কানে ধরল।
ওপ্রান্ত থেকে শোনা গেল জর্জ আব্রাহাম জনসনের গলা।
আহমদ মুসা সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন জনাব?
ভালো আছি আহমদ মুসা। তোমাকে একটা খবর জানাবার জন্যে কল করেছি। এ মাসের শেষের দিকে তুমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাচ্ছ। আগামি মাসের মাঝামাঝি তোমাকে নিয়ে একটা গেট-টুগেদারের আয়োজন করেছেন প্রেসিডেন্ট। একথাটা প্রেসিডেন্ট তোমাকে আগাম জানিয়ে রাখতে বলেছেন। বলল আব্রাহাম জনসন।
তেমন কিছু হতেই পারে। কিন্তু এত আগে সিদ্ধান্ত! আহমদ মুসা বলল।
প্রেসিডেন্ট থাকবেন তো। তাই এত আগাম চিন্তা। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কারা থাকবেন সে গেট-টুগেদারে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
সিনেট ও কংগ্রেসের স্পীকারসহ নেতৃবৃন্দ, প্রেসিডেন্টের ক্যাবিনেট, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নেতৃবৃন্দ- এই আর কি। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
বিরাট আয়োজন। জানেন তো এমন কিছু আমি এড়িয়ে চলি। আহমদ মুসা বলল।
তুমি আপত্তি করো না। এটা একটা প্রাথমিক ধারণা। লোক কমতেও পারে। আসল ব্যাপার হলো সকলের দাবির প্রেক্ষিতে এটা হচ্ছে। এজন্যে প্রেসিডেন্টও বেকায়দায় আছে। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
ঠিক আছে জনাব। আমি বলছিলাম, গেট-টুগেদার ছোট হলেই মানায় বেশি। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে শুনলাম। প্রেসিডেন্টেরও মাথায় এটা আছে। আচ্ছা, ও.কে. আহমদ মুসা।
ও.কে. জনাব। আস্সালামু আলাইকুম। আহমদ মুসা বলল।
ওয়াআলাইকুম সালাম। বলল জর্জ আব্রাহাম জনসন।
কথা শেষ হয়ে গেল। মনটা যেন খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। বসে পড়ল সোফায়। সামনের টেবিলে আজকের ওয়াশিংটন পোস্ট। মনটা খুশি হয়ে উঠল তার।
পাতার পর পাতা উল্টিয়ে নিউজ হেডলাইনের উপর চোখ বুলাতে লাগল। মেগাজিন সেকশনের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিভাগের একটা শিরোনামে এসে আহমদ মুসার চোখ আটকে গেল। শিরোনামটা হলো : সুলতান গাজী সালাহুদ্দিন আইয়ুবের নিজস্ব বলে কথিত কবিলাটি আজ ধ্বংসের পথে। বিবরণে বলা হয়েছে, গাজী সালাহুদ্দিনের কবিলাটি কোন এক কাল থেকে বাস করছে আর্মেনিয়ার দক্ষিণ সীমান্তের প্রান্ত এলাকায়। এটা আজারবাইজান, ইরান ও তুরস্কের সীমান্ত ঘেষে। উঁচু পাহাড় ঘেরা, দুর্গম উপত্যকা, গভীর বনাঞ্চল নিয়ে তাদের বাস। এই এলাকায় বিভিন্ন দেশের মানুষ যখন বাড়ছে, এই কবিলার লোক তখন জ্যামিতিক হারে কমছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, খুব শীঘ্র এই কবিলার কোন অস্তিত্ব আর থাকবে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ও ইউনেসকো এই বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা কোন রাজনৈতিক বৈরিতা বা কোন নাশকতার শিকার কি না, তারও কোন হদিস করতে পারেনি ইউনেসকো। অনেক বড় ফিচার। সবটাই পড়ল আহমদ মুসা।
মনটা ভালো করার জন্যে পত্রিকা পড়তে বসে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল তার। রেখে দিল পত্রিকা। ধীরে ধীরে উঠে এসে শুয়ে পড়ল।
ঘড়ির দিকে তাকাল। বেলা ১০টা বাজতে যাচ্ছে। মনটা খুশি হয়ে উঠল তার। আহমদ আবদুল্লাহকে নিয়ে জোসেফাইন ও সারা এই হাসপাতালেই এসেছে। হাসপাতালের কাজ সেরে এখানে আসবে ওরা। ওদের আসতে দশটা বাজতে পারে বলে জানিয়েছে।
দশটা বাজার সাথে সাথেই আহমদ মুসার বেডের পাশের ইন্টারকম বেজে উঠল। আহমদ মুসা পাশ ফিরে বোতাম চেপে কল অন করল।
ম্যাক আর্থারের কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, স্যার ম্যাডামরা এসেছেন।
ওদের আসতে বল ম্যাক আর্থার। বলল আহমদ মুসা।
শোয়া থেকে উঠে বসল আহমদ মুসা। অপেক্ষা করতে লাগল জোসেফাইনদের। দরজা খোলার শব্দ হলো। এসে গেছে ওরা।
.
[পরবর্তী বই – আর্মেনিয়া সীমান্তে]
Leave a Reply