ইয়াংম্যান, তুমি যা বলেছ তার সরল অর্থ হলো কোন অ্যাটল দ্বীপে বাইরে থেকে সহজে দেখা যায় না এমন কোন স্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব কি না? এর সরল উত্তর হলো, সম্ভব নয়। কারণটা দেখ, একটা অ্যাটলে কি থাকে? চারদিকের সংকীর্ণ অথবা কিছুটা প্রশস্ত ভূমি সীমানা, এই ভূমি সীমানার মাঝখানে থাকে লেগুন।লেগুনের নিচে থাকে কোরাল লাইমস্টোনের সলিড বেজ। এই বেজটা ধীরে ধীরে এখানে উঠে এসেছে সাগরের ফ্লোর থেকে। পানির নিচে অ্যাটলের এই সলিড বেজের চারিদিকের দেয়াল নানা রকমের হতে পারে। মসৃণ হতে পারে, এবড়ো-থেবড়ো হতে পারে, সূচালো অথবা ভোঁতা কোরালের ঝাড়ে পূর্ণও হতে পারে। এসব নিয়েই একটা অ্যাটল দ্বীপ। এর মধ্যে ইনডিভিজুয়াল স্থাপনা গড়ে উঠার সুযোগ কোথায়?
কথাগুলো বলছিল ইজিচেয়ারে শোয়া শুভ্র কেশ, শুভ্র ভ্রূর একজন বৃদ্ধ। মুখের চামড়াও তার অনেক কুঁচকানো। উজ্জ্বল সোনালী চেহারায় তার চোখ দু’টি খুবই সজীব ও তীক্ষ্ণ।
বৃদ্ধের নাম অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি।
তাহিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসেনিক ল্যান্ড-সাইন্সের সাবেক অধ্যাপক। গোটা প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় এই বিষয়ে সে অদ্বিতীয় বিশেষজ্ঞ। দুনিয়াজোড়া নাম তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার সাথে সাথে সে প্যাসিফিক আইল্যান্ড ইন্সটিটিউটের প্রধাণও ছিল।
অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি মারেভার বাবার শিক্ষক ছিল। আবার তার পারিবারিক বাড়ি “আরু”তে। এই কারণে মারেভাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক আছে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির পরিবারের সাথে।
মারেভাই আহমদ মুসাকে নিয়ে এসেছে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির কাছে। অ্যাটল দ্বীপগুলোর কম্পোজিশন সম্পর্কে আহমদ মুসা জানতে চায়। আর জনতে চায় অ্যাটলগুলোতে কোন গোপন স্থাপনা কিভাবে গড়ে উঠতে পারে।
আহমদ মুসা তার মাল্টিওয়েভ মনিটরে পাওয়া এসএমএস মতুতুংগা দ্বীপ থেকেই এসেছে এটা নিশ্চিত হবার পর ভেবে কুল-কিনারা পাচ্চে না। ছোট এই দ্বীপের কোথা থেকে তার কাছে এসওএস বার্তা এল!চারদিকে ঘুরে সে মতুতুংগা দ্বীপটাকে দেখেছে। তাছাড়া কম্পিউটারে দ্বীপটির স্যাটেলাইট ইমেজ সে পরিক্ষা করেছে। এতে উপরের সারফেস ছাড়াও দ্বীপটির পানির তলের বেজটাকেও সে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। এই অবস্থায় মারেভা তাঁকে নিয়ে এসেছে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির কাছে।
অধ্যাপক তাতিহিতি “আরু”তে তার পৈত্রিক বাড়িতে অবসর জীবনযাপন করছে। সারা জীবন ধরে সমৃদ্ধ করে তোলা পৈত্রিক পাঠাগারে পড়াশুনা, বাড়ির চারদিকের বাগানের টুকিটাকি পরিচর্যা ও বাগানে ঘুরে বেড়িয়েই তার সময় কেটে যায়। আজ খুশি হয়েছে সে আহমদ মুসাদের পেয়ে।
অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, কিন্তু স্যার, আমি নিশ্চিত একটি অ্যাটলে গোপন স্থাপনা আছে এবং সেখানে মানুষও আছে। যদি এটা সত্য হয়, তাহলে গোপন স্থাপনা কিভাবে গড়ে উঠল?
তুমি ‘যদি’ শব্দ ব্যবহার করেছ। কিন্তু এই ‘যদি’টাকে সত্য বলে নিশ্চিত হচ্ছো কেমন করে, ইয়ংম্যান? বলল অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি।
স্যার, আমি ঐ দ্বীপের এক স্থান থেকে একটি এসওএস বার্তা পেয়েছি। আহমদ মুসা বলল।
তুমি কি করে নিশ্চিত হচ্ছো, এসওএস বার্তাটা ঐ অ্যাটল থেকেই এসেছে? বলল অধ্যাপক তাতিহিতি।
আহমদ মুসা তার অংকের বিবরণ দিয়ে বলল, আমার হিসাবে কোন ভুল হয়নি স্যার।
অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি মাথা নেড়ে বলল, ইয়াংম্যান, অংক তোমার ঠিক আছে।কিন্তু অ্যাটলে গোপন স্থাপনা কোত্থেকে আসবে, সে অংক তো মিলছে না!
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, স্যার, অ্যাটলের কোরাল স্টোন বেজ যা সাগরের ফ্লোর থেকে উঠে এসেছে, তা কি সব সময় সলিড হতে বাধ্য? দেয়ালঘেরা ঘরের মত ফাঁপা হয়ে উঠতে পারে না তা? এভাবে তা কি লেগুনের ফ্লোরের নিচে কোন স্থাপনা গড়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে না?
আহমদ মুসার প্রশ্ন শুনে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।সংগে সংগে উত্তর দিল না। তার চোখ বুজে গিয়েছিল। ভাবছিল সে।
এক সময় চোখ খুলল অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি। সোজা হয়ে বসল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ইয়ংম্যান, তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি বুঝেছি। স্রষ্টার সৃষ্টি বড় বিচিত্র।এর কতটুকু আমরা জানি। এখানে সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখাও টানা যায় না। অতএব, তুমি য বলছ থাকতে পারে, আবার নাও পারে। বিজ্ঞানের কথা যদি বল তাহলে বলব কোরাল স্তরের বৈচিত্রময় গঠনের ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক মাপ-জোক থেকে পাওয়া যাবে না। এগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছার সৃষ্টি।তুমি অ্যাটলের বেজে কোরাল স্টোন ওয়ালকে যেমন ফাঁপা হওয়ার কথা বলছ, তা স্রষ্টার ইচ্ছার আওতার বাইরে নয়।
বলে থামল অধ্যাপক তাতিহাতি। হঠাৎ তার মুখে ভাবনার একটা ছাপ ফুটে উঠল। তার সাথে সাথে তার ঠোঁটে দেখা গেল এক টুকরো হাসিও। তাকাল সে মারেভা মাইমিতির দিকে। বলল, মারেভা, তোমার নিশ্চয় মনে আছে জগতেশ্বরী ও প্রথম মানবী হিনা, প্রিন্স হেসানা হোসানা ও সাগর-রূপা জলকন্যা ভাইমিতি শাবানুর কাহিনী। এই কাহিনীতেই আছে প্রিন্স হেসানা হোসানার প্রতি সদয় জগতেশ্বরী হিনা পাগল প্রেমিক প্রিন্সকে তার প্রেমিকা ভাইমিতি শাবানুর সাথে দেখা করিয়েছিল পানির তলে অ্যাটলের এক প্রাসাদে। অ্যাটলের পানির তলে মানে অ্যাটলের বেজ এলাকায় যে প্রাসাদ থাকতে পারে, তাহিতি এলাকার এই কাহিনীতে তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়।
অধ্যাপক তাতিহিতি থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, কাহিনীটা কি স্যার?
রূপকথা যেমন হয়, এ তেমনি এক কাহিনী। এটা পমারে রাজবংশের এক রাজপুত্রের কাহিনী।
বলে একটু থামে অধ্যাপক তাতিহিতি তাকাল মারেভা মাইমিতির দিকে। বলল, মারেভা, তুমি জানলে কাহিনীটা, বল।
মারেভার মুখ লাল হয়ে উঠল। এক ছোপ লজ্জা এসে ঢেকে দিল তার চোখ-মুখ। সে মুখ নিচু করল।
হাসল অধ্যাপক তাতিহিতি। বলল, ঠিক আছে, আমিই বলছি।বলে শুরু করল অধ্যাপক তাতিহিতিঃ অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপিয়দের আগমন শুরু হয় প্রশান্ত মহশাগরীয় অঞ্চলে। কিন্তু তার আগে কয়েক শতাব্দী ধরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে অনেক রাজবংশের উত্থান ঘটে। তাহিতিতেও এমন একটি রাজবংশ কয়েক শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছে। তাহিতির পমাতে রাজবংশ এদেরই উত্তরসূরি। ঐ রাজবংশের নামও এখন জানা নেই।সেই অজানা বংশের এক রাজপুত্র ছিল হেসানা হোসানা, যার অর্থ সুন্দর ও শক্তির রাজমুকুট। এই সুন্দর রাজপুত্রের শখ ছিল সাগরে ঘুরে বেড়ানো। মাঝে মাঝেই তার নিরুদ্দেশ যাত্রা হতো সাগরে। দিন, রাত, সপ্তাহ গড়িয়ে যেত সে বাড়িতে ফিরতো না। এ দ্বীপ থেকে সে দ্বীপে, এ অ্যাটল থেকে সে অ্যাটলে ঘুরে বেড়াত। তার পালতোলা সাগরজ্বয়ী সুদৃশ্য রাজকীয় বোটে একাই ঘুরে বেড়াত সে। একদিন এক জ্যোৎস্না-গলানো সুন্দর রাতে তার বোট নোঙর করা ছিল এক অ্যাটলের তীরে। বোটের ডেগে বসে সে তন্ময় হয়ে উপভোগ করছিল জ্যোৎস্নাপ্লাবিত সাগরের নিরব-নিঝুম সৌন্দর্য। এই সময় পুব সাগরের বুক থেকে উঠে আসে এক খন্ড কালচে রক্তিম মেঘ। শুরু হয় প্রবল ঘুর্ণি। সে ঘুর্ণিতে তলিয়ে যায় তার বোট। সেও ছিটকে পড়ে যেন কোথাও! নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে। নিজেকে আবার ফিরে পেয়ে যখন সে চোখ খুলে, তখন সে দেখে সুসজ্জিত ঘরের অসম্ভব সুন্দর এক নরম বিছানায়। চোখ ঘুরাতে গিয়ে তার চোখ পড়ে পাশেই সুন্দর আসনে বসা নীল বসনা, নীল নয়না এক অপরূপ সুন্দরীর উপর। তার সাগর-নীল রাজকীয় পোষাকের উপর তার সাগর নীল দোপাট্রা মাথা থেকে কপাল পর্জন্ত নেমে এসেছে। চাঁদের মতো মুখটিই শুধু তার খোলা। চাঁদে কলংক আছে, কিন্তু তার দুধ-আলতা মুখে কোন কলংক নেই। রাজপুত্রের চোখ যেন বাঁধা পড়ে গেল তার মুখে! চোখ সরাতে পারল না রাজপূত্র। পল পল করে সময় বয়ে গেল। দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তবু পলক পড়ে না চোখে। নিল-নয়না সুন্দরী তার চোখ সরিয়ে নিল ঠোঁটে এক টুকরো হাসি টেনে। বলল শাহজাদা আপনি এখন সুস্থ। আপনার বোটও ঠিক হয়ে গেছে। সেটাও তৈরি। আপনি ইচ্ছা করলে এখনই উঠতে পারেন।
রাজপুত্র তখনও তার চোখ সরাতে পারেনি। সুন্দরীর কথাগুলো তার কানে যেন অমৃত ঢেলে দিল! তাহিতি ভাষায় এমন শুদ্ধ, মিষ্টি উচ্চারণ আগে সে শোনেনি।
সুন্দরীর চোখ ঘুরে এল আবার রাজপুত্র হেসানা হোসানার মুখের উপর। আবার আটকা পড়ে গেল দুই জোড়া চোখ।
সুন্দরীর চোখে-মুখে ফুটে উঠল সলাজ হাসি। সে মুখ নিচু করল। বলল, তাহলে শাহজাদা, আরও একটু বিশ্রাম করুন।
উঠতে যাচ্ছিল সুন্দরী।রাজপুত্র হেসানা হোসানা বলল, আমি কোথায় রাজকন্যা?
সুন্দরী মিষ্টি হাসল। বলল, আমি রাজকন্যা নই। আমি বলতে পারেন, সাগরকন্যা। আপনি অ্যাটল রাজ্যের এক প্রাসাদে, মানে অ্যাটলের এক নিবাসে।
যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল সুন্দরী। রাজপুত্র হেসানা হোসানা বিছানায় উঠে বসল। বলল, আপনার নাম কি?
সুন্দরী তার নিচু মুখ না তুলেই বলল, আমি ভাইমিতি শাবানু। বলেই সুন্দরী ভাইমিতি শাবানু পা তুলল যাবার জন্যে।
রাজপুত্র নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে মরিয়া হয়েই বলল, আমি যদি না যেতে চাই? আমি যাব না।
পেছনে না তাকিয়েই ভাইমিতি শাবানু সেই মিষ্টি হেসে বলল, অতিথিশালা তো কারো বাড়ি হয় না! এখানে অতিথিরা আসেন চলে যাবার জন্যেই। আপনিও যাবেন।
বলে চলে গিয়েছিল ভাইমিতি শাবানু।
চলেই আসতে হয় রাজপুত্র হেসানা হোসানাকে। দ্বিতীয়বার এসে ভাইমিতি শাবানু যখন রাজপুত্রের চোখে চোখ রেখে বলল, আসুন শাহজাদা। তখন কি এক অমোঘ টানেই রাজপুত্র উঠে দাঁড়াল, যেন এমন মিষ্টি ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য তার নেই।
রাজপুত্র হেসানা হোসানা যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালে ভাইমিতি শাবানু বলল, শাহজাদা, এবার আপনি দুই চোখ বন্ধ করবেন। আমি আপানকে হাত ধরে নিয়ে যাব।
রেশমের নরম গলার এই মিষ্টি আদেশও রাজপুত্র সংগে সংগেই পালন করল।চোখ বন্ধ করল সে।
ধন্যবাদ! বলে ভাইমিতি শাবানু তার হাত ধরে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলল।
ভাইমিতি শাভানুর স্পর্শে রাজপুত্র হেসানা হোসানার দেহের প্রতিটি পরমাণু যেন জেগে উঠল, শিহরিত হলো! কারও স্পর্শ যে এত মিষ্টি, এত মধুর হতে পারে, তা রাজপুত্রের কল্পনারও বাইরে ছিল।
রাজপুত্র হেসানা হোসানাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কিভাবে নিয়ে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে রাজপুত্রের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। অন্য কিছু ভেবেই স্পর্শের অনুভূতি সে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছিল না। তবে সে ক্রমশ উপরে উঠছিল সেটা তার পা-ই বলে দিচ্ছিল।
উপরে উঠা এক সময় শেষ হলো। তারপর আরো একটু পথ চলা।
আবার থমকে দাঁড়ানো।
ভাইমিতি শাবানুর নরম মিষ্টি গলা শুনতে পেল রাজপুত্র। বলল, একটু দাঁড়াতে হবে শাহজাদা। বিশ, ত্রিশ সেকেন্ড পরে একটা শব্দ হবে, তারপর আপনি চোখ খুলবেন।
বলে ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্র হেসানা হোসানার হাত ছেড়ে দিল। মেয়েটি হাত ছেড়ে দেবার সাথে সাথে রাজপুত্রের মনে হলো তার দেহ জুড়ে জ্বলে থাকা উজ্জ্বল বাতি যেন নিভে গেল। সব শক্তি কেউ শুষে নেয়ার মত দেহটা তার দুর্বল হয়ে পড়ল। একটা শব্দ হলো। মিষ্টি একটা শিসের শব্দ।
চোখ খুলল। দ্রুত চোখ বুলাল চারিদেকে। মেয়েটি নেই।কেউ কোথাও নেই। চারিদিকে পানি। সে এক অ্যাটলের সরু তীরে দাঁড়িয়ে আছে। তার একপাশে সাগর, অন্য পাশে অ্যাটলের লেগুন। পাশে দক্ষিনে আর একটা অ্যাটল আছে, সেটা প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে। তার বোটটি হালকা দোল খাচ্ছে সাগরের পানিতে। বোটটি আগের মতোই বাঁধা অ্যাটলের তীরে। কিন্তু মেয়েটি গেল কোথায়? মাত্র বিশ-ত্রিশ সেকেন্ডের ব্যবধান, কোথায় গেল মেয়েটি? রাজপুত্রের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! সব হারানোর হৃদয়-ভাঙ্গা অনুভূতি নিয়ে সে বসে পড়ল অ্যাটলের তীরে।
মিনিট যায়, ঘন্টা যায়, দিন যায়, রাজপুত্র সে অ্যাটলের তীর থেকে ওঠেনি। তার মুখে একটাই কথা বারবার, কোথায় গেল আমার ভাইমিতি শাবানু?
কয়েকদিন পর রাজার একটি সন্ধানী দল গিয়ে তাঁকে অ্যাটলের তীর থেকে মুমূর্ষ অবস্থায় তুলে আনে। তাকে নিয়ে আসে রাজধানী আরুতে। সে সুস্থ হয়, কিন্তু ভাইমিতি শাবানুর নাম তার মুখ থেকে যায় না। ডাক্তার-কবিরাজ ও ভূত-প্রেতের তান্ত্রিকরাও তাঁকে দেখে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। তাঁকে বুঝানো হয় ভাইমিতি অদৃশ্য জগতের সাগরকন্যা, শাবানু হতে পারে তার নাম। সে অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা, অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাঁকে রাজপুত্রের মতো মানুষ পাবে কি করে? কিন্তু কোন বুঝই সে নেয়নি। তার সাগরে ঘুরাঘুরি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। রাত-বিরাত, বৃষ্টি-খরা, কোন কিছুরই তোয়াক্কা নেই, তার বোট ঘুরে বেড়ায় সাগরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, সবখানে। চারিদিকের নিঝুম নিরবতার মাঝে ধ্বনিত তার একটি মাত্র নামের উচ্চারণ-ভাইমিতি শাবানু, আমার ভাইমিতি শাবানু!
জগতেশ্বরী ‘হিনা’ অবশেষে সদয় হন পাগল প্রেমিক রাজপুত্রের প্রতি। আগের মতোই জ্যোৎস্না-গলা এক চাঁদনী রাতে রজপুত্র হেসানা হোসানার বোট নোঙর করা ছিল সেই অ্যাটলের তীরে।জগতেশ্বরী ‘হিনা’ নেমে আসে।আসে সে অ্যাটলের তীরে। ঘুমন্ত রাজপুত্রকে তুলে নিয়ে নেমে যায় অ্যাটলের তীর থেকে। অ্যাটল-তীরের মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যায় ভেতরে। চলে যায় অ্যাটলের সেই রাজপ্রাসাদে। তাঁকে শুইয়ে দেয় দুগ্ধ ফেনায়িত মনোহরা নরম সেই বিছানায়। ঘুম থেকে জেগে উঠলে সেখানেই আবার দেখা হয় ভাইমিতি শাবানুর সাথে।মিলন হয় দুই হৃদয়ের। রাজপুত্র তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, সবাই বলে তুমি অদৃশ্যের সাগরকন্যা, হারিয়ে যাবে না তো আবার। অদৃশ্য থেকে হাসেন জগতেশ্বরী’হিনা’। রাজপুত্রের উদ্দেশ্যে তার কন্ঠ ধ্বনিত হয়ঃ না রাজপুত্র, ভাইমিতি শাবানু মায়া নয়, মানবী, তাইতো তোমাদের মিলন হলো। আমি আনন্দিত, নিমজ্জিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত মহাদেশ ‘মু’-এর এক মহাগুণী, মহাজ্ঞানী বংশধরের সাথে নতুন প্যাসিফিক কন্টিনেন্টের এই প্রথম মিলন। কাহিনীর এখানেই শেষ। তবে আরও কথা প্রচলিত আছে, রাজপুত্র নাকি এরপর গোপনে আসতো রাজধানীতে, ঘুরে বেড়াতো সাগরেও ভাইমিতি শাবানুকে নিয়ে কাহিনীর শেষ অংশ নাকি সেই জানিয়ে গেছে সবাইকে।
থামল অধ্যাপক তাতিহিতি দীর্ঘ কাহিনী বলা শেষ করার পর।
অত্যন্ত মনোযোগের সাথে আহমদ মুসা অধ্যাপক তাতিহিতির কথা শুনছিল। রূপকথা হিসাবেই সে শুনছিল কিন্তু শুনতে গিয়ে মাঝে মাঝেই তার চোখে-মুখে যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হচ্ছিল, তা অবশ্যই রূপকথা শুনে হয় না।
অধ্যাপক তাতিহিতি থামতেই আহমদ মুসা বলল, স্যার, আপনার কাহিনী রুপকথা হলেও বাস্তবতার কিছু উপাদান তার মধ্যে আছে! যা আমার কাছে সত্যিই বিস্ময়কর লাগছে।
যেমন? বলল অধ্যাপক তাতিহিতি।
যেমন এক.যে অ্যাটলের অবস্থানরত অবস্থায় রাজপুত্র ঝড়ের কবলে পড়ে সংজ্ঞা হারিয়ে অ্যাটলের প্রাসাদে গিয়েছিল, সেই অ্যাটল থেকেই আবার তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় সেই অ্যাটল প্রসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই.অ্যাটলের প্রাসাদ থেকে রাজপুত্র ভাইমিতি শাবানুর হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিল ক্রমঊর্ধ্বমুখী এক পথে বা সিঁড়িপথে। তিন. সংজ্ঞা হারিয়ে যে অ্যাটলের যেখান থেকে অ্যাটলের প্রসাদে নীত হয়েছিল, সে অ্যাটলের সেখানেই সে ওঠে। চার. ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্রকে অ্যাটলের তীরে পৌঁছে দিয়ে ফেরার জন্য বিশ-ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছিল, সে সময় রাজপুত্রকে তার চোখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, পাঁচ. জগতেশ্বরী ‘হিনা’ ভাইমিতি শাবানুকে ‘মানবী’ বলেছে এবং ছয়. কাহিনীতে রাজপুত্রের নাম ‘হোসানা’ শব্দ এবং কথিত সাগরকন্যার নামের সাথে ‘শাবানু’ শব্দটি বিস্ময়কর এক বাস্তবতার ইংগিতবহ। বলল আহমদ মুসা।
অধ্যাপক তাতিহিতি ভ্রূ কুঞ্চিত করে খুব অভিনিবেশ সহকারে আহমদ মুসার কথা শুনছিল। আহমদ মুসার কথা শেষ হবার পরও ভাবল। বলল, বৎস, তুমি বলতে চাচ্ছ, কাহিনীটা রূপকথা হলেও বাস্তবতার এই উপাদানগুলো তার মধ্যে আছে। এই উপাদান মানে এই বিষয়গুলোর তুমি কি অর্থ করছ তা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে ইয়ংম্যান।
অবশ্যই স্যার। প্রথমে একই স্থান থেকে প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার অ্যাটল থেকে রাজপুত্রকে নেয়ার কথা বলি। স্থান-কাল-পাত্র সবই রূপকথা হলে এমনটা নাও হতে পারতো। জগতেশ্বরী ‘হিনা’ যে কোন স্থান থেকে রাজপুত্রকে অন্য যে কোন স্থানে সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারতো। তা করা হয়নি। একই স্থান থেকে একই অ্যাটল প্রাসাদে নিয়ে গেছে। এর অর্থ আমি এটা করতে পারি, সেই অ্যাটল প্রাসাদটি সেই অ্যাটলে বা পাশের কোন অ্যাটলেই হবে। দ্বিতীয় বিষয়টির যে অর্থ আমি করতে চাই, তা হলো, কাহিনীটা শুধু রুপকথা হলে ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্রকে ঊর্ধ্বমুখী হাঁটার কষ্ট দিয়ে অ্যাটলের প্রাসাদ থেকে বাইরে নিয়ে আসতো না। উড়াল দিয়ে বা শাঁ করে মাটি ভেদ করে উপরে তুলে আনতো। রূপকথায় এটাই হয়। দ্বিতীয়ত ক্রমঊর্ধ্বমুখী পথ বা সিড়িপথ দিয়ে রাজপুত্র ভাইমিতি শাবানুর হাত ধরে উপরে উঠে এসেছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড কোন স্থান থেকে এমন পথ ধরে উপরে উঠে আসাটাই বাস্থবতা। এর অর্থ এই হতে পারে, অ্যাটলের প্রাসাদ বা নিবাস বাস্তবেই অস্তিত্বমান। মানে এর অস্তিত্ব রয়েছে। তৃতীয় বিষয় অর্থাৎ অ্যাটলের যেখান থেকে ভাইমিতি শাবানু সংজ্ঞাহীন রাজপুত্রকে নিয়ে গিয়েছিল, ঠিক সেই স্থানেই তাকে ফিরিয়ে আনা প্রমান করে ক্রমঊর্ধ্বমুখী বা ক্রমনিম্নমুখী ঐ পথেই ভাইমিতি শাবানু তাকে নিয়ে গিয়েছিল, আবার ঐ পথেই তাকে ফিরিয়ে আনতে হয় রাজপুত্রকে এবং সেটা স্বাভাবিকভাবে একই স্থানে হয়।রূপকথার এমন বাস্তবতার নিয়মে বন্দী থাকে না। এক নিমেষে পাতাল থেকে আকাশে ওঠা রূপকথার চরিত্র। আপনার রূপকথায় এটা হয়নি। এখানে রূপকথার নায়িকা ভাইমিতি শাবানুকে উপরে উঠার জন্যে ক্রমঊর্ধ্বমুখী পথ এবং পা ব্যবহার করতে হয়েছে। আমি মনে করছি, অ্যাটল থেকে উপরে ওঠার পথ ও অ্যাটলের প্রাসাদ দু’য়েরই অস্তিত্ব রয়েছে। চতুর্থ বিষয়টি এ অস্তিত্বের আরও বড় প্রমাণ। ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্রকে প্রাসাদ থেকে অ্যাটলে তীরে পৌঁছিয়ে দিয়ে বলেছিল বিশ-ত্রিশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ রাখতে। বলেছিল একটা শব্দ শোনার পর চোখ খুলতে। কেন বলেছিল এটা ভাইমিতি শাবানু? বলেছিল ভাইমিতি তার চলে যাবার সুযোগ সৃষ্টির জন্যে। এই সময়ের মধ্যে চলেও গিয়েছিল সে। ভাইমিতি শাবানু অশরীরী কোন সাগরকন্যা হলে তার চলে যাবার জন্যে বিশ-তিরিশ সেকেন্ডের প্রয়োজন ছিল না, এক মুহুর্তই যথেষ্ট ছিল।সে অশরীরী কেউ ছিল না বলেই তার সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। অশরীরী কেউ না হলে সে মানবীই হবে বলে আমি মনে করি। দ্বিতীয়ত ভাইমিতি শাবানু তার চলে যাবার জন্যে বিশ-তিরিশ সেকেন্ড সময় নেয়ার অর্থ এই যে, যে পথ দিয়ে অ্যাটলে ঢুকে যাবে, সে পথ সেখান থেকে বিশ-তিরিশ সেকেন্ডের পথ। আরও স্পষ্ট কথা, ভাইমিতি শাবানু ও রাজপুত্র যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে বিশ-তিরিশ সেকেন্ড দূরত্বে অ্যাটলের প্রাসাদে নামার পথ ছিল। পঞ্চম বিষয় হলো, জগতেশ্বরী কাহিনীর নায়িকা ভাইমিতি শাবানুকে ‘মানবী’ বলা। আমি বলতে চাচ্ছি, জগতেশ্বরীর এই সাক্ষ্য থেকেও প্রমানিত হয় ভাইমিতি শাবানু মানবী। ষষ্ট বিষয়, ভাইমিতির নামের ‘শাবানু’ শব্দ ও রাজপুত্রের নামের ‘হোসানা’ শব্দ।এ ‘শব্দ’ দু’টি তাহিতিয়ান নয়, পলিনেশীয়ানও নয়। শব্দ দু’টির ‘হোসানা’ আরবি শব্দ ও ‘শাবানু’ আরবি-ফারসি মেশানো শব্দ। দু’টিই মুসলিম নামের খন্ডিত রূপ। ‘হোসানা’ আসলে হাসান এবং ‘শাবানু’ হলো ‘শাহবানু’। আপনার কাহিনীর এই ভাষাগত ও নামগত উপাদান থেকে মনে করছি, কাহিনীকে শুধু এক নতুন বাস্তবতা নয়, নতুন এক ইতিহাসের দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। সে ইতিহাস নিশ্চয় তাহিতির ইতিহাস, পলিনেশীয়ার ইতিহাস, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলেরও ইতিহাস। থামল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে প্রায় ছানাবড়া অধ্যাপক তাতিহিতির দু’চোখ! বিহবল চেহারা মারেভা মাইমিতির। তার অবাক দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখের ওপর নিবদ্ধ।
ইতিমধ্যে তামাহি মাহিন এসে পড়েছিল। সেও শুনেছে আহমদ মুসার কথা। তারও চোখ-মুখ বিস্ময়ে ভরা!
অধ্যাপক তাতিহিতি তার ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে, অদ্ভুত! অদ্ভুত! তুমি তুমি কি নতুন কোন শার্লক হোমস, না কুশাগ্র বুদ্ধির ব্যারিস্টার! তুমি কাহিনীর যে অদ্ভুত বিশ্লেষণ করেছ, তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য। এসব বিষয় কোন সময় আমাদের ভাবনাতেও আসেনি। কিন্তু বৎস, তুমি রূপকথা থেকে যে বাস্তবতা বের করেছ, তা যে রূপকথার চেয়েও বিস্ময়কর! রূপকথাও বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু তোমার বাস্তবতাকে আমরা কিভাবে বিশ্বাস করবো,কি করে বিশ্বাস করবো অ্যাটলের তলায় রাজপ্রাসাদ আছে, সেখানে ঢোকার ও বের হবার রাস্তা আছে! বিশ্বাস করব কি করে, ভাইমিতি শাবানু মানবী!
স্যার, বিশ্বাস করা, না করা ভিন্ন জিনিস। কিন্তু আমি বলছি, আপনাদের কাহিনীটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমার কথাও সত্য। স্যার, আপনি সাগরের ভূমি গঠন, দ্বীপমালা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ, কিন্তু আপনি কি এর সবটা জানেন? অজানার তুলনায় আমাদের জানা জগতটা তো খুবই নগণ্য! আমরা জানি না বলেই অজানাটা মিথ্যে হয়ে যাবে? বলল আহমদ মুসা।
অধ্যাপক তাতিহিতির মুখে হাসি ফুটে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে সে হাসি মিলিয়ে গিয়ে নেমে এল এক গাম্ভীর্য। বলল ধীরে ধীরে, তুমি কে জানি না, কিন্তু তোমার কথা আর দশজনের মতো নয়, চিন্তার ধারাও একদম ভিন্ন। তুমি যে যুক্তি তুলে ধরেছ, তা সত্যই অকাট্য। বিশ্বাস করা না গেলেও এনিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। তুমি ঠিকই বলেছ, আমরা সৃষ্টি সম্পর্কে খুব অল্পই জানি, আমাদের অজানাই তো সব! চিন্তা-ভাবনা জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমেই অনেক অজানা বিষয় জানার পরিমন্ডলে আসছে। তোমার চিন্তার নিয়েও ভাবতে হবে। বল, তুমি নিজে এ নিয়ে কি ভাবছ?
স্যার, আমি যা বলেছি সেটাই সত্য তা বলছি না। কিন্তু কাহিনীর যে ঘটনা পরম্পরা তাতে আমার মনে হচ্ছে, কোন কোন অ্যাটলে সে প্রাসাদ, যাকে ভাইমিতি শাবানু নিবাস বলেছে, তাতে প্রবেশ ও বের হবার পথও আছে! সে অ্যাটলের চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে আরেকটা অ্যাটলও আছে! বলল আহমদ মুসা।
কোন অ্যাটলে তুমি এ ধরনের কোন স্থাপনা খুঁজছ। সে চিন্তা থেকেই কাহিনীর প্রাসাদের মধ্যে তুমি তোমার বাঞ্চিত স্থাপনা দেখতে চাচ্ছ, এ কথা আমি বলতে পারতাম। কিন্তু বলতে পারছি না এ কারণে, যুক্তি দিয়েই তুমি তোমার কথা প্রমাণ করেছ। এখন আমি মনে করি, অনুসন্ধান করে দেখা দরকার সে ধরনের অ্যাটল কোনটা হতে পারে। সে অ্যাটল যদি পাওয়া যায় তাহলে পরের কাজগুলো সহজ হয়ে যাবে। আর এ ধরনের কিছু যদি পাওয়া যায়, তাহলে কাহিনীটা ভিন্ন রূপ নিয়ে আমাদের কাছে আসবে। তুমি যা বলেছ, তাহিতি নয় শুধু, পলিনেশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপাঞ্চলের ইতিহাস পাল্টে যেতে পারে। আচ্ছা বৎস, তুমি যে দু’টো শব্দের কথা বললে, সেটা কিন্তু ঠিক। এ দু’টো পলিনেশিয় কোন শব্দ নয়। কিন্তু তুমি জানলে কি করে, এ দু’টো আরবি ও ফারসি শব্দ? বলল অধ্যাপক তাতিহিতি।
আমি আরবি, ফারসি ও এ ভাষার নামের সাথে পরিচিত স্যার। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু কাহিনীর চরিত্রে আরবি, ফারসি ভাষার নাম এল কি করে? তাহলে পলিনেশীয়া মানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের ইতিহাসের সাথে মুসলমানদের কোন সম্পর্ক আছে। এখানকার অতীত জন-জীবনের সাথে মুসলমানরা কোনওভাবে জড়িত? তুমি যেটা বলেছ, এটা সত্যি নতুন ইতিহাসের ইংগিত?
বলে একটু থামল বৃদ্ধ অধ্যাপক তাতিহিতি। ইজি চেয়ারে আবার তার দুর্বল দেহটা এলিয়ে দিল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, এই জিজ্ঞাসার জবাবের জন্য অনুসন্ধান দরকার। চলমান ইতিহাসে এর কোন জবাব মিলবে না।পলিনেশিয়ানে ছড়িয়ে আছে ‘মিথ’ আকারে অসংখ্য ‘পুটাটুপুনা’ (putatupuna) অ্যানসেস্ট্রাল স্টোরিজ (Ancestral stories)। সে সবের মধ্যেই খুঁজতে হবে ইতিহাসকে। প্রিয় ইয়ংম্যান, তোমার মধ্যে যে অদ্ভুত বিশ্লেষণ শক্তি দেখছি, তাতে তুমি পারবে এ ইতিহাসের সন্ধান করতে। আমি আশীর্বাদ করছি বৎস।
থামল অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি। কথা শেষ হবার সাথে সাথে তার চোখ দু’টিও বুজে গেল। চোখে-মুখে তার ক্লান্তি।
স্যরি স্যার, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। আমি বলতে চাচ্ছি স্যার, অ্যানসেন্ট্রাল স্টোরি বা পূর্বপুরুষ-কাহিনীর মধ্যে ইতিহাস সন্ধান করা যত সহজ, পূর্বপুরুষের কাহিনী সন্ধান করা ততটা সহজ নয়। আহমদ মুসা বলল।
চোখ খুলল অধ্যাপক তাতিহিতি। বলল, ঠিক বলেছ তুমি। তবে একজন লোক আছে। তাকে মারেভা ও মাহিন দু’জনেই চেনে। তার নাম মাহকোহ মিনালী মিনার। তিনি প্রাচীন পমেরী রাজবংশের বেঁচে থাকা একমাত্র প্রধানতম মানুষ। ইউরিপীয়রা আসার আগে এই রাজবংশ বিভিন্নভাবে শত শত বছর রাজত্ব করেছে তাহিতিসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে। তিনি এই ‘আরু’তেই সেই প্রাচীন রাজবংশের ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রাসাদের এক কোণে অতীতের সাক্ষী হয়ে অবস্থান করছেন। ‘Putatupuna’ অর্থাৎ অ্যানসেস্ট্রাল স্টোরিজের (পূর্বপুরুষ কাহিনীর) বিশাল ভান্ডার আছে তার কাছে। তিনিই তোমাকে সাহায্য করতে পারেন।
ধন্যবাদ স্যার। বলল আহমদ মুসা।
ওয়েলকাম বৎস। অধ্যাপক তাতিহিতি বলল। চোখ দু’টি তার বুজে গেল আবার।
আমরা তাহলে উঠতে পারি স্যার। আপনি বিশ্রাম নিন। বলল মারেভা মাইমিতি।
এস বোন, কিন্তু তোমার মাহকোহ’র কাছে যেও। আমারও খুব আগ্রহ এ কাহিনী জানার। অধ্যাপক তাতিহিতি বলল।
অধ্যাপক তাতিহিতির কাছ থেক বিদায় নিয়ে আহমদ মুসারা বেরিয়ে এল।
বেরিয়েই তামাহি মাহিন বলল, স্যার, আপনি কি ফাদার মাহকোহ’র ওখানে যাবেন?
ফাদার কেন, উনি কি খৃস্টান? আহমদ মুসা বলল।
না স্যার, উনি খৃস্টান নন। আমরা প্রধান শিক্ষক ও ধর্মনেতাদের ফাদারও বলি। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মনেতাদের ‘ফাদার’ বলে। তার অনুসরণেই আমরা এটা বলি আত্মরক্ষার কৌশল হিসাবে। কারণ খৃস্ট ধর্ম ছাড়া এখানে অন্য সব ধর্ম-বিশ্বাস ও গীর্জা ছাড়া অন্য সব উপাসনালয় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সুতরাং খৃস্ট ধর্মের নাম পরিচয়ের আড়ালেই অনেক তাহিতিয়ান নিজেদের ধর্ম পালন করে থাকে। আরু’তেও তাই হয়। বলল মারেভা।
উনি কি ধর্মনেতা? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ধর্মনেতা। কিন্তু প্রচলিত কোন ইশ্বরের উনি পূজা করেন না। উনি ধ্যান করেন, আ-ভুমি মাথা নোয়ান কোন অদৃশ্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে। বলল তামাহি মাহিন।
তিনি কি করতেন, কি করেন? আহমদ মুসা বলল।
তিনি নিজেকে রাজকীয় শিক্ষা একাডেমি, লাইব্রেরী ও উপাসনালয়ের পরিচালক বলে মনে করেন। এসবের ধ্বংসাবশেষের একটা বাড়িতে তিনি থাকেন। তিনি কোথাও যান না। বলল মারেভা।
তিনি যেখানে থাকেন, সেটা ‘আরু’র কোথায়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্যার, আমরা এসেছি ‘আরু’র সাগর তীরবর্তী পুননির্মিত অংশে। এই অংশের দক্ষিণে একটা বিশাল বিরান অঞ্চল পাওয়া যাবে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে সাগর পর্যন্ত বিলম্বিত তিনটি দীর্ঘ উপত্যকা ও তিনটি বিলম্বিত পাহাড় নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত।এটাই প্রাচীন রাজধানী ‘আরু’র মূল অংশ।এই এলাকার শীর্ষ স্থানে ছিল প্রাসাদ। এই প্রসাদেরই একাংশে ছিল শিক্ষা একাডেমী, লাইব্রেরী ও উপাসনালয়ের স্থান। সেখানেই ফাদার মাহকোহ এখনও বাস করেন। বলল মারেভা।
আর কেউ থাকে না ওখানে? প্রশ্ন আহমদ মুসার।
আরও দু’চারটা বসতি আছে। এদের কেউ রাজপরিবারের অধস্তন, কেউ রাজপরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এছাড়াও আশেপাশে কিছু পরিবার আছে যারা পশু পালন করে জীবন নির্বাহ করে। বলল তামাহি মাহিন।
চল মাহিন মারেভা, ফাদার মাহকোহ’র সাথে দেখা করেই আমরা ফিরব। আমাদের সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্যে অ্যাটলের প্রাসাদ রহস্য এবং ভাইমিতি শাবনুর কাহিনী সম্পর্কে আরও জানা প্রয়োজন। আহমদ মুসা বলল।
ভালই হলো, আজ আমার ও মারেভার মা এসেছেন ‘আরু’তে মাহকোহ’র মন্দিরে উপাসনার জন্যে। তাদের সাথেও দেখা হবে। আমরা একসাথে ফিরতে পারবো। বলল তামাহি মাহিন।
তারা প্রার্থনা করতে এখানে আসেন? আহমদ মুসা বলল।
প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবারে তারা আসেন। আজ মাসের প্রথম শুক্রবার। বলল তামাহি মাহিন।
ফাদার ‘মাহকোহ’র মন্দিরে শুক্রবারে প্রার্থনা হয়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
জি স্যার, সপ্তাহের শুক্রবারে এখানে প্রার্থনা হয়। বলল তামাহি মাহিন।
শুক্রবার কেন? আহমদ মুসা বলল।
জানি না স্যার, এটাই ঐতিহ্য। বলল তামাহি মাহিন।
কি প্রার্থনা হয় সেখানে? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
হাঁটু গেড়ে বসে ধ্যান ও প্রার্থনা। মারেভা বলল।
সবাই উঠে বসেছে গাড়িতে। চলতে শুরু করল গাড়ি।
ড্রাইভার তেপাও-এর পাশের সিটে মারেভা। পেছনে আহমদ মুসা ও তামাহি মাহিন। পেছনের সিটে মারেভার পাশে আহমদ মুসা যেমন বসে না, তেমনি তামাহি মাহিনের বসাও সে এলাউ করে না।
পাহড়ী পথে আস্তে আস্তে চলছে গাড়ি।
অধ্যাপক তাতিহিতির সাথে যে সব কথা হয়েছিল এবং আহমদ মুসা যা জানতে চায়, এক এক করে সব বলল ফাদার মাহকোহ মিলানী মিনারকে।
সামনেই ফরাসে হাঁটু মুড়ে বসে ছিল ফাদার মাহকোহ। তার সামনে ফরাসে বসে কথা বলছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার পেছনে আছে মারেভা ও মাহিন। পাশেই একটু তফাতে বসেছিল মারেভা ও মাহিনের মা পাশাপাশি।
এটাই ফাদার মাহকোহ’র অফিস ঘর।
ঘরের বাইরের দেয়াল এবড়ো-থেবড়ো ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের হলেও ভেতরটা অনেকটা ভাল।
ফাদার মাহকোহ’র এই অফিস ঘরের পাশেই উপাসনালয় মানে মন্দির। উপাসনালয়টি নতুন-পুরাতনের মিশ্রণ। আগের কাঠামোর উপর উপাসনালয়টি পুননির্মিত।
আহমদ মুসার এসে যখন উপাসনালয়ে ঢুকেছিল তখন উপাসনা চলছিল উপাসনালয়ে।
বিরাট ঘর। সবাই ফরাসের উপর লাইন করে পশ্চিমমুখী হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে। সবাই ধ্যানস্থ। ধ্যানের সময় শেষ হলে সবাই এক সাথে প্রার্থনা করল।
উপাসনালয়ের পশ্চিম দেয়ালে একটা বড় অর্ধ চন্দ্র।পরে আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল, অর্ধ চন্দ্র, মানে চন্দ্র হলো জগতেশ্বরী ‘হিনা’-এর প্রতীক। পলিনেশীয় বিশ্বাসমতে জগতেশ্বরী ‘হিনা’ চন্দ্ররুপে প্রকাশিত।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও ফাদার মাহকোহ যেমন ছিল, তেমনি বসে রইল। তার মাথা ঈষৎ নোয়ানো। তার চোখ দু’টি দু’জনের মাঝখানে মাটির মেঝের উপর নিবদ্ধ। মাথায় কাপড়ের একটা গোল বন্ধনী, পাগড়ির একটা বেড়ের মত। প্রাচীন রাজবংশের রাজশিরস্ত্রাণের প্রতীক সেটা করা। সে প্রতীকের মাঝখানে অর্ধ চন্দ্র শোভা পাচ্ছে। ফাদার মাহকোহ’র পরনে লম্বা জামা। মুখে সুন্দর শুভ্র দাড়ি। ফাদারের বয়স শুনেছিল একশ’ বছরের বেশি, তার দেহের কাঠামো শিথিল হয়েছে অবশ্যই, কিন্তু মুখে-চোখে তারুণ্যের দ্যুতি।
একসময় মুখ তুলল ফাদার মাহকোহ। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখে তার শান্ত-গভীর দৃষ্টি। বলল, বুঝতে পারছি তুমি একটা মিশন নিয়ে এসেছ। মিশনটা মনে হচ্ছে কোন এক অ্যাটলের তলদেশের স্থাপনার সন্ধান করা। কিন্তু এর বাইরে তুমি এদেশের না হয়েও এদেশের অতীত নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে, জন-কাহিনী নিয়ে যে আগ্রহ প্রকাশ করছ, তার জন্যে আমি মোবারকবাদ দিচ্ছি তোমাকে। আজকের মানুষ, বিশেষ করে আমাদের মত অনুন্নত দেশের মানুষ সভ্যতার ভোগবাদী মোহে পড়ে বর্তমানের সমৃদ্ধি ও ভবিষ্যত গোছানো নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, নিজেদের অতীত নিয়ে ভাববার সময় এদের নেই আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা আমাদের রাজা মাকোয়া তাকাও-এর মত নিজেদের ইতিহাসের সব উপাদান নিজের হাতেই ধ্বংস করছে। তুমি তার ব্যতিক্রম, ধন্যবাদ তোমাকে।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, তুমি অনেক বিষয় সামনে এনেছ।কিন্তু বিষয়গুলোর সারাংশ করলে দু’টি বিষয় মুখ্য হয়ে ওঠে ! এক. কাহিনীর ভাইমিতি’র নামের ‘শাবানু’ ও প্রিন্স হেসানা’র নামের ‘হুসানা’ অংশ আরবি-ফারসি শব্দের অপভ্রংশ। তাদের নামের সাথে আরবি ও ফারসি ভাষার নাম কোত্থেকে এল। এবং দুই. কাহিনীটিতে অ্যাটল-প্রাসাদের যে কথা বলা হয়েছে, তার বাস্তবতা। থামল ফাদার মাহকোহ।
চোখ বন্ধ করে একটু ভাবল। বলল, এই মাত্র আমি বললাম, আমাদের রাজা মাকোয়া তাকাও তাহিতি ও পলীনেশীয় দ্বীপাঞ্চলের শত শত বছর ধরে জমিয়ে তোলা পূর্বপুরুষদের কাহিনী সব ধ্বংস করে দিয়েছে। এর সাথে অনেক ইতিহাসই মুছে গেছে। এটা যে…।
এটা তাহলে সত্যি ঘটনা? আহমদ মুসা বলল।
দুর্ভাগ্যজনক এক সত্য জনাব আহমদ। পলিনেশীয় সভ্যতার একটা বড় বৈশিষ্ট হলো পারিবারিক ইতিহাস স্মৃতিতে ধরে রাখা। এভাবে হাজার বছরের ইতিহাস ছিল তাদের স্মৃতির স্তরে। কিন্তু ইউরিপীয়রা আসার পর তাদের নতুন সভ্যতা বিপর্যয় ঘটায়। স্মৃতির ইতিহাসকে লিখে রাখার বা এর লেখ্য রূপ তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। এরপর ইতিহাসকে একমুখী করার প্রবনতারও সৃষ্টি হয়। এই প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের হাতের পুতুল নতুন রাজাদের মধ্যে। ১৭৫৭ সালের জুনে আসে বৃটিশ ক্যাপ্টেন ওয়ালিস বন্দুক-কামান নিয়ে। নির্দয় পন্থায় দখল হয়ে যায় রাজধানী ‘আরু’সহ তাহিতি এবং পলিনেশীয় দ্বীপাঞ্চল। আর ১৭৬৮ সালে আসে ফারাসিরা আরও বড় শক্তি নিয়ে এবং তারা বৃটিশদের তাড়িয়ে দখল করে নেয় গোটা এলাকা। স্থানীয় রাজারা প্রতিরোধ চালিয়ে যায় অনেক দিন। অবশেষে উচ্ছেদ হয় ঐতিহ্যবাহী পমারী রাজবংশ ও স্থানীয় রাজারা। ১৮১৫ সালে ফরাসিদের পুতুল রাজা দ্বিতীয় পমপাই একমাত্র রাজা হিসাবে ঘোষিত হয়। ধ্বংস হয় রজধানী আরু। ধ্বংস হয় অতীতের সমাজ-সভ্যতা নির্দয়ভাবে। আর সব কিছুর উপর চেপে বসে খৃস্টান রাজা। গীর্জা ছাড়া সব ধরনের উপাসনালয় ধ্বংস করা হয়। এরই ধারাবাহিকতাতেই ১৮৯০-এর দশকে রাজা মাকিয়া তাকাও লিখিত সব পারিবারিক ইতিহাস ধ্বংস করে ফেলে, একমাত্র তার সময়ের ইতিহাস ছাড়া। তার ফলে মাকিয়া তাকাওদের কাহিনী পলিনেশীয়ার একমাত্র ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়। শুধু পলিনেশীয়াতে নয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব দ্বীপাঞ্চলেই এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের উদ্যোগে একক ইতিহাস তৈরির নামে। ধ্বংসের এই ঝড়ে অগণ্য সত্য কাহিনী, ইতিহাসের ঘটনা, ইতিহাসের উপাদান চিরতরে হারিয়ে গেছে। থামল ফাদার মাহকোহ।
বিস্ময়ের বেদনা নিয়ে আহমদ মুসা তাকিয়ে ছিল ফাদার মাহকোহ’র দিকে। ফাদার মাহকোহ থামতেই আহমদ মুসা বলল, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা এই কাজ বহু দেশে করেছে। কিন্তু সবখানে তারা ষোল আনা সফল হয়নি, আপনাদের পলিনেশীয়াতে কি অবস্থা স্যার?
আমাদের পলিনেশীয়তে অন্য সব লিখিত ইতিহাস শুধু ধ্বংস করা হয়েছে তাই নয়, অন্য ইতিহাসের পাঠ, সংরক্ষণ ও নিষিদ্ধ করা হয়। তার ফলে এখানে সেখানে কিছু কাহিনী, কথা, ইতিহাস ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পারলেও সংরক্ষণ ও চর্চার অভাবে সে সব বেশি দিন বাঁচতে পারেনি। বলল ফাদার মাহকোহ।
স্যার, আপনি তো তা বাঁচাতে পেরেছেন! আহমদ মুসা বলল।
কিছু কিছু, এমনকি আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের সবটা সংগ্রহ করতে পারিনি। আমাদের রাজধানী ‘আরু’ ধ্বংসের সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমাদের রজকীয় সংগ্রহশালা ও লাইব্রেরী। আমি ব্যাপক ঘুরে বেড়িয়েছি ইতিহাসের কাহিনীর সন্ধানে। কিছু মানুষের স্মৃতি থেকে, কিছু গোপনে সংরক্ষিত লেখা থেকে আমি সংগ্রহ করেছি। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার। আপনার সংগ্রহ কতদূর অতীত পর্যন্ত যেতে পেরেছে স্যার? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
পেছনের ইতিহাস কত দূর পেছনে গেছে তা আমি জানি না। এ ব্যাপারে এখনও ঐকমত্য হয়নি। আমার কাছে ইতিহাসের যে উপাদান আছে, তাতে অনেক ফাঁক-ফোকর থাকলেও এক নজরে আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার। আমাকে আপনি কিভাবে সাহায্য করতে পারেন? আহমদ মুসা বলল।
তুমি ‘হাসানা’ ও ‘শাবানু’ এই দুই আরবি, ফারসি নামের উৎস খুঁজছ, কিন্তু শুধু এ দু’টি নামই তো নয়, আরও অনেক নামের উৎস তোমাকে খুঁজতে হবে। পলিনেশীয় সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে পুরাতন দ্বীপ ‘তাহিতি’ নাম নিয়ে কি তুমি ভেবেছ? তাহিতিকে বিশ্বের সুন্দরতম দ্বীপ যদি নাও বলি, তাহিতিবিশ্বের সুন্দরতম দ্বীপের একটি অবশ্যই। ইউরপীয়রা এই দ্বীপকে দেখেই বলে উঠেছিল ‘আইল্যান্ড অব লাভ’ ভালবাসার দ্বীপ। ফরাসি বোগেনভিল বলেছিলেন ‘ মিথ অব প্যারাডাইস’ স্বর্গের কল্পলোক। আরেকজন রোশো বলেছিলেন ‘ মহত্তম অসভ্য’। কিন্তু তাদের অনেক আগে তাহিতি তার নামের মাঝে তার পরিচয়কে, রূপকে ধারণ করেছে। ৮৫০ খৃস্টাব্দের দিকে প্রথম মানব যারা তাহিতিতে বসতি গড়তে আসে, তারা তাহিতিকে ‘আমার শ্রদ্ধা’ ‘আমার সালাম’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। ভাই আহমদ, হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা অধ্যয়ন করার কিছু সুযোগ আমার হয়েছিল। ‘তাহিতি’ নিজেই আরবি শব্দ, আরবি মুল ‘তাহিয়াত’ থেকে এসেছে। তাহিতির অর্থ ‘ আমার শ্রদ্ধা’, ‘আমার অভিনন্দন’, ‘আমার সালাম’। প্রথম মানব যারা তাহিতিতে আসেন, তারা শ্রাদ্ধার, ভালবাসার, শান্তি-আকাঙ্ক্ষার মহত্তম নাম দিয়েই দ্বীপটিকে বরণ করেন। কিন্তু এই লোকগুলো কারা, কোত্থেকে কিভাবে এল, এটাই এখানকার প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর পেলে পলিনেশীয় কাহিনীতে মূল আরবি-ফারসি ‘হাসান’ ও ‘সাহবানু’ নাম কোত্থেকে এল তাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। ‘তাহিতি’র মত অনেক আরবি শব্দ আমরা তাহিতি ও পলিনেশীয়ায় পাব। হয়তো এমনি ভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব দ্বীপাঞ্চলেই পাওয়া যাবে। ইউরোপীয়রা আসার আগে যারা রাজার অধীনে বা স্বাধীনভাবে তাহিতির বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করতো, তাদের ‘আরাই’ (Ari’i) বলা হতো। তারা জনগণের ‘প্রদর্শঙ্কারী’ হিসাবে এই উপাধি ব্যবহার করতো। এটা আরবি শব্দ। তাহিতির রজধানী ধ্বংস করে ফেলা আমাদের এ প্রিয় শহরের ‘আরু’ নামটিও আরবি ‘আরাই’-এর অপভ্রংশ। আবারও প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় আঞ্চলিক শাসকদের এই ‘আরাই’ নাম এবং স্বাধীন তাহিতি ও পলিনেশীয়ার গৌরবান্বিত রাজধানীর ‘আরু’ নাম কোত্থেকে এল, কারা রাখল, কেন রাখল? এ প্রশ্নগুলো আহমদ তোমার প্রশ্নের মতই। এই প্রশ্নগুলোর জবাব পেলে তোমার প্রশ্নেরও জবাব হয়ে যাবে। অতীত ইতিহাসের মধ্যেই এর জবাব পাওয়া যাবে।
দীর্ঘ এক বক্তব্য দিয়ে থামল ফাদার মাহকোহ।
কিন্তু স্যার, ইতিহাস তো ধ্বংস করেছে! আহমদ মুসা বলল।
এরপরও এখানে-সেখানে কিছু রক্ষা পেয়ে গেছে। তার কিছুটা আমিও সংগ্রহ করতে পেরেছি। আমাদের নিজেদের পারিবারিক ইতিহাস তো আছেই ! বলল ফাদার মাহকোহ।
এই ইতিহাসের গুড়াটা কত দূর পর্যন্ত গেছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
এ রকম ইতিহাসের কোন সময় নির্ণয় করা মুস্কিল।
তারপর?
তারপরও এভাবেই কাহিনী বর্ণিত ও লিখিত হয়েছে! তাও আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ্যালেগেরিক্যাল প্রতীকের আবরণ দেয়া। রূপকথায় পাত্র-পাত্রীর যেমন হঠাৎ আগমন ঘটে, আগ-পিছের পরিচয় ও যুক্তি-প্রমাণের কোন বালাই থাকে না, কতকটা সেই রকমই অনেক ক্ষেত্রে। যেমন আমাদের বংশ-ইতিহাসের শুরু আমাদের বংশ বা গোত্রপতির মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। সারাংশ এই রকমঃ বংশের সর্দার তাহেনা (শক্তি) ঈশ্বর হিনার কাছে চলে গেছে। তার দেহটাও পাঠাবার ব্যবস্থা চলছে। সারা রাত তার দেহ পাহাড় শীর্ষে রাখা হয়েছিল। ঈশ্বরের কাছে তার দেহ যায়নি। এবার ছোট ভেলায় করে তার দেহ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সাগরে ভাসাবার ব্যবস্থা করা হয়। বংশের তান্ত্রিক ‘রানুই’ (পবিত্র পুরুষ) ভীষণ ব্যস্ত এই প্রস্তুতি নিয়ে। হঠাৎ দেখা গেল পশ্চিমে মুরিয়ার দিক থেকে একটা জাহাজ আসছে উপকূলের দিকে। এতবড় ও এমন জাহাজ আমরা কখনও দেখিনি। জাহাজ অনেক কাছে এসে গেল। জাহাজের সব কিছুই দেখা যাচ্ছে। পাল আগেই নামিয়ে ফেলা হয়েছে। জাহাজের পাল টাঙানো উঁচু মাস্তুলে একটা বড় সবুজ পতাকা। বাতাসের অভাবে উড়ছে না। জাহাজের ডেকে আপাদমস্তক সাদা পোষাকের অনেক মানুষ। উপকূলে আমাদের লোকদের মধ্যে ভয় ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। জাহাজটি আরও কাছে আসে। মৃতের সৎকারের কাজ বাদ দিয়ে আমাদের লোকেরা তীর-ধনুক, বর্শা ও গুলতি নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। জাহাজের লোকজনও ডেকে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ওদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। আমাদের লোকদের এ অভিজ্ঞতা আছে, জলদস্যুরা বিভিন্ন রূপ ধরে আসে, শান্তিবাদী ও ভালো মানুষের ছদ্মবেশও তারা নেয়। সুতরাং আমদের লোকেরা ওদের গতিরোধের জন্যে তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করে আক্রমণ শুরু করল। তীরগুলো মারাত্মক সূচালো পাথরের, বর্শাগুলো ও তাই। জাহাজের কয়েকজন আহত হয়ে পড়ে গেল। কিন্তু ওরা আক্রমণ করলো না। প্রায় সবাই আড়ালে সরে গেল। মাত্র দু’জন নতুন কাপড়ের বান্ডিল ও বস্তা থেকে খাদ্যশস্য আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করলো, আমরা আক্রমণ বা দখলের জন্যে নয়, ব্যবসায়ের জন্যে এসেছি। সরদারের ছেলে নতুন মনোনীত সরদার সবকিছু পর্যবেক্ষন করছিল।সে আমাদের লোকদের ওদের উপর আক্রমণ বন্ধের নির্দেশ দিল। আক্রমণ বন্ধ হলে জাহাজ এসে তীরে ভিড়ল। জাহাজের ওরা সবাই তীরে নামল। লোকেরা সবাই দীর্ঘদেহী, ফর্সা শ্মশ্রুমণ্ডিত। সকলেই প্রশান্ত চেহারার। চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, তাতে কোন হিংসা-কুটিলতার ছায়া নেই। দেখলে মনে ভয় জাগে না, বরং বন্ধু বলে মনে হয়।
সবাই ওরা নিরস্ত্র। তীরে নেমে সবাই ওরা এক সাথে হাত তুলে প্রার্থনা করল। তারপর ওরা উঠে এসে আমাদের সবার সাথে হাত মেলাল। দু’চারটি তাহিতিয়ান শব্দ, দু’চারটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্যান্য ভাষা মেশানো ভাষায় তারা বুঝালো তাহিতিয়ার কেউ তাদের শত্রু নয়, তারাও কারও শত্রু নয়। তারা ব্যবসায়-বানিজ্য করে এবং সাধ্যমত মানুষের উপকার করে। আমাদের লোকেরা তাদের জাহাজে চড়ল। দেখল, জাহাজে কোন অস্ত্র নেই। আছে কাপড়, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কিছু ব্যবসায়ের পণ্য। আমাদের লোকেরা তাদের বিশ্বাস করল। অস্ত্র ছাড়া কেউ আসতে পারে, আত্মরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া কেউ আসতে পারে, এমনটা আমাদের লোকেরা অতীতে দেখেনি। আমাদের আক্রমণে ওদের কয়েকজন আহত হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন মারা গেল। আহতদের তারা চিকিৎসা করল। তাদের চিকিৎসার ধরন উন্নত। আহত স্থান ওষুধ মেশানো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা, ওষুধ লাগানো, কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, এসব বিষয় আমাদের লোকেরা এই প্রথম দেখল। তারা তাদের মৃত লোককে কূলে নামিয়ে তার সৎকার করার অনুমতি চাইল। আমাদের নতুন সরদার পো মিরি (poe Miri) তাদের অনুমতি দিল। জাহাজ থেকে লাশ তারা উপকূলে নামিয়ে লাশকে গোসল করাল এবং সাদা কাপড় কেটে কয়েক টুকরো করে লাশকে পরিয়ে দিল। গোটা লাশকে সাদা কাপড়ে তারা মুড়ে ফেলল। সেই কাপড়ে মোড়া লাশ তারা সামনে রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দু’হাত বুকে বেঁধে কি সব পড়ল! তারপর আয়তাকার সুন্দর একটা গর্ত বানাল। সেই গর্তের ফ্লোরে কাপড়ে মোড়া লাশকে যত্নের সাথে রেখে দিল এবং গর্তের আয়তাকার মুখ তারা সাইজমত কাটা কাঠ, ডাল, লাকড়ি দিয়ে বন্ধ করে দিল। তার উপর বড় আকারের পাতা সাজিয়ে ঢেকে দিয়ে তাতে মাটি চাপা দিল। গর্তের উপরের এই মাটিকেও তারা সমান ও পরিপাটি করে রাখল। সবশেষে তারা সেই গর্তের চারদিকে দাঁড়িয়ে এক সাথে প্রার্থনা করল। এই গোটা বিষয়টি আমাদের লোকেরা বিস্ময়ের সাথে দেখল এবং খুবই ভাল লাগল তাদের এই লাশের সৎকার করা, বিশেষ করে আমাদের সরদার পো মিরি ও আমাদের তান্ত্রিক রানুই খুবই মুগ্ধ হলো মৃতের প্রতি সম্মান, যত্ন, তাকে ঘিরে প্রার্থনা ও লাশ রাখার পদ্ধতি দেখে। আমাদের সর্দার আমাদের তান্ত্রিক ও লোকদের বলল, আমাদের মৃত সর্দারকে আমরা এভাবে রাখতে পারি। এতে সুবিধা হবে আমার মৃত পিতা কোথায় আছেন তা আমি দেখতে পাবো, তার সাথে কথা বলতে পারবো। তান্ত্রিক ও আমাদের লোকেরা এতে খুব খুশি হলো। তান্ত্রিক বলল, পাহাড়ে রেখে লাশ পশু-পাখির পেটে দেয়া কিংবা লাশ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে হারিয়ে ফেলার চাইতে এটা অনেক ভাল। এসব দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আমাদের সর্দারের লাশ ফুল-পাতা দিয়ে ঢেকে না রেখে আগন্তুকদের লাশ যেভাবে জাহাজ থেকে নামিয়ে আদবের সাথে সৎকার করা হলো, সর্দারের লাশ সেভাবেই সৎকার করা হবে। আগন্তুকরাও এভাবে সৎকারের কথা বলল। আগন্তুকরা আনন্দের সাথে রাজি হলো এবং কাজে লেগে গেল। তারা খুব যত্ন ও সম্মানের সাথে মৃত সর্দারকে গোসল করিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে, কাপড়ে মুড়ে আমাদের লোকজনদের সাথে নিয়ে আয়তাকার সেই গর্তে সুন্দর করে রাখল। সবশেষে গর্তের উপর পাটি সাজানোর কাজ সম্পন্ন করার পর আমাদের লোকদের সাথে নিয়ে মৃতের মঙ্গলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল। এমন সুন্দর ও নতুন ব্যবস্থায় আমাদের সর্দার পো মিরি ভীষণ খুশি এবং আমাদের লোকেরাও। এসব কাজে দুপুর হয়ে গেল। সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিমে একটু হেলে পড়েছে। আগন্তুকদের একজন এসে আমাদের সর্দারকে বুঝালো, তাদের প্রার্থনার সময় হয়েছে, তারা তাদের প্রার্থনার অনুমতি চায়। সর্দার সোৎসাহে অনুমতি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কার কাছে তারা প্রার্থনা করবে? অনুমতি নিতে আসা সেই লোক বলল, এই বিশ্ব-জাহান যিনি সৃস্টি করেছেন, যিনি এই বিশ্ব-জাহানসহ আমাদের সকলকে পালন করেন তার কাছে আমরা প্রার্থনা করব।আমাদের সর্দার খুশি হয়ে বলল, খুব ভাল। আমরাও পার্থনা করি ঈশ্বর হিনার। আপনাদের প্রার্থনা দেখি। আগন্তুকদের কয়েকজন পাহাড়ের ঝর্না থেকে পানি এনেছে। দেখা গেল সেই পানি দিয়ে তারা সকলে একই নিয়মে মুখ, হাত, পা ধুয়ে নিল। একজন একটু উঁচুতে দাঁড়িয়ে দুই কানে দুই হাত চাপা দিয়ে উচ্চ স্বরে কয়েকটি বাক্য উচ্চারণ করল। তারপর তারা সকলেই ভিন্ন ভিন্নভাবে দাঁড়িয়ে, কোমর বাকিয়ে হাঁটুর উপর হাত রেখে মাটির উপর মাথা রেখে প্রার্থনা করল। পরে তাদের প্রবীণ একজনকে সামনে রেখে তারা সকলে পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে ব্যক্তিগতভাবে যা যা করেছিল সামস্টিকভাবেও তাই করল। সামনে দাঁড়ানো প্রবীণ ব্যক্তিটি যা করছে, সকলে তাই করছে অদ্ভুত শৃঙ্খলার সাথে! তাদের প্রার্থনা শেষ হলে সর্দার ও তান্ত্রিক তাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের প্রার্থনা দেখলাম, খুব সুন্দর। কিন্তু শুরুতে একজন কানে হাত দিয়ে উচ্চ স্বরে কি বলল, কেন বলল বুঝলাম না। আগন্তুকদের একজন বুঝিয়ে বলল, ওটা প্রার্থনার জন্যে সকলকে আহ্বান। নিয়ম হলো, সকলকে প্রার্থনার জন্যে ডেকে এক সঙ্গে প্রার্থনা করতে হয়। সর্দার ও তান্ত্রিক উভয়েই বলল, সুন্দর নিয়ম। সকলের অংশগ্রহনে সংঘবদ্ধভাবে এমন প্রার্থনার প্রদ্ধতি আমাদের নেই। আমরাও তো এভাবে প্রার্থনা করতে পারি! প্রার্থনার নেতৃত্ব দানকারী প্রধান ব্যক্তি বলল, অবশ্যই পারেন। আমাদের সর্দার আবার জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু প্রার্থনার সময় আপনাদেরকে তো অনেক কিছু পড়তে দেখছি! কোন মন্ত্র এগুলো? আমরা তো তা জানি না। প্রধান ব্যক্তিটি বলল, অনেক কিছু পড়তে হয় প্রার্থনায়। আপনারা চাইলে আপনাদেরও শিখিয়ে দেব। কিন্তু সবার আগে একটা বিষয় আপনাদের জানতে হবে। সেটা হলো, এই বিশ্ব-জাহানের একজন স্রষ্টা আছেন। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের যা প্রয়োজন, সবই আমাদের দিয়েছেন। মৃত্যুর পর আমরা তার কাছে ফিরে যাব। সেখানে তিনি আমাদের পুরস্কার দেবেন অথবা শাস্তি দেবেন। দুনিয়ায় আমরা ভাল কাজ করলে সেখানে পুরস্কার পাব মানে সুখের জীবন পাব, যা হবে চিরন্তন, আর দুনিয়ায় খারাপ কাজ করে গেলে সেখানে আমরা শাস্তি মানে অসীম যন্ত্রনা-যাতনার এক জীবন পাব, যাও হবে চিরন্তন। স্রষ্টা আমাদের ভালবাসেন। তিনি চান আমরা দুনিয়ায় ভাল কআজ করে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে পুরস্কার হিসাবে সুখের জীবন পাই। আল্লাহ বা স্রষ্টার এই ইচ্ছা মানুষকে জানাবার জন্যে এবং ভালো কাজের পথ কোনটা এবং মন্দ কাজের পথ কোনটা তা মানুষকে দেখাবার জন্যে কিছু কাল পরপর আল্লাহ বিশেষ লোকদের তার দূত হিসাবে পাঠান। এ ধরনের একজন সর্বশেষ মহান ব্যক্তি এসেছিলেন, তার কাছ থেকেই আমরা আমাদের প্রার্থনার ও জীবনের অন্য সব বিষয় জেনেছি। এই বিশ্বাসকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করলে প্রার্থনার সব বিষয় আপনাদের কাছে সহজ হয়ে যাবে। এই সব কথা বলতে গিয়ে প্রধান আগন্তুকের চোখ-মুখও যেমন উজ্জ্বল উঠেছিল, তেমনি শুনতে শুনতে আমাদের সর্দার ও তান্ত্রিকের চোখ-মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। প্রধান আগন্তুক থামতেই তারা দুজনেই বলে উঠল, আপনি যা বলেছেন সব কথাই ভালো, সব কথাই আমরা বিশ্বাস করি। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আগন্তুক প্রবীণের মুখ। বলল, দিনে পাঁচবার আমরা প্রার্থনা করি। সবই আপনাদের জানাব, শেখাব। দীর্ঘ কথা বলার পর থেমে গেল ফাদার মাহকোহ।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে শুধু শুনছিল তাই নয়, গোগ্রাসে যেন গিলছিল। ফাদার মাহকোহ’র থামাটায় বিরাট এক ছন্দ পতনের মত ধাক্কা খেল আহমদ মুসা। তাই ফাদার মাহকোহ থামার সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলল, তারপর কি স্যার?
তারপর কি আমিও জানি না। হাতে লেখা একশত পৃষ্ঠার একটা পুড়ে যাওয়া বইয়ের প্রথম বিশ পৃষ্ঠার কাহিনী আমি বললাম। এর পরের পাতা গুলো পুড়ে গেছে, মাঝের চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মানে এই দশ পৃষ্ঠা আবার অক্ষত পাওয়া গেছে। পরের পৃষ্ঠাগুলো পাওয়া যায়নি। নিশ্চয় পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। বলল ফাদার মাহকোজ।
মাঝের দশ পৃষ্ঠায় কি আছে স্যার? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
বলব, বলছি। বলল ফাদার মাহকোহ।
একটু থামল তারপর নড়ে-চড়ে বসে আর একটু সরাসরি আহমদ মুসাদের মুখোমুখি হলো অধ্যাপক মাহকোহ। মুখ খুলল। বলতে শুরু করল আবার, এই দশ পাতায় তাহিতি এলাকার ও তাহিতর জন-জীবনের কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সারাংশটা এই রকমঃ আগন্তুকরা যে জাহাজ নিয়ে এসেছিল, তাতে লোহার ব্যবহার ছিল মুখ্য। কাঠগুলো ছিল লোহার পেরেকে আটকানো, আবার লোহার পাতে মোড়া। জাহজের রেলিং ও সিঁড়ির কাঠামো ছিল লোহার। আগন্তুকরা লোহার ব্যবহার নিয়ে এল তাহিতি এলাকায়। তীর, বর্শার মতো আত্মরক্ষার অস্ত্র তৈরি, ছুরি-কাটারির মত নিত্য ব্যবিহার্য উপকরণ তৈরি হলো লোহা দিয়ে। তৈজসপত্রের মধ্যে লোহার ব্যবহার ঢুকে গেল। হাঁড়ি, বাটি, কড়াইয়ের মতো জিনিষ তৈরি হলো লোহা দিয়ে। ভীষণ খুশি তাহিতির মানুষ। সবচেয়ে বড় খুশির বিষয় ছিল তাহিতি এলাকায় কৃষ্টির প্রচলন, কাপড়ের ব্যাপক আমদানি ও কাগজের ব্যবহার শুরু হওয়ার বিষয়। আগন্তুকদের সাথে ছিল গম, যব ছাড়াও কয়েক ধরনের সবজির বীজ। উপকূলে সমভূমি ও উপত্যকাগুলোতে আগন্তুকারা নিজেরা জংগল কেটে, ঘাস সরিয়ে চাষের কাজে লেগে গেল, হাতে-কলমে ভুমি চাষ শেখাল তাহিতিবাসিদের। মাটিতে গম-যবের গাছ উঠল, তা থেকে গম, যব প্রভৃতি খাদ্যশস্য মানুষ পেল। উপকূল ও উপত্যকার নরম মাটিতে তৈরি হলো নানা সবজির সমারোহ।বিস্ময়কর পরিবর্তন এল তাহিতি অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে। কাপড়ের সরবরাহ এল, তার সাথে এল পোশাকের নতুন ধরন। নগ্নতা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। মেয়েদের মাথা, গা ও পা পর্যন্ত ঢেকে পোশাক পরার রীতি হয়ে গেল। আর ছেলেরা কমপক্ষে নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢাকা পোশাক পরতে লাগল। আগন্তুকদের নিয়ে আসা কাগজ তাহিতিতে নিয়ে এল লেখাপড়া। আগন্তুকরা সামস্টিক প্রার্থনার জন্যে সবাইকে নিয়ে যে প্রার্থনা গৃহ তৈরি করল, তাতে পড়াশুনার আয়োজন করা হলো সকাল ও সন্ধ্যায়। আগন্তুকরা তাহিতি ভাষা শিখল, আর তাহিতিয়ানদের তারা শেখাল তাদের ধর্মগ্রন্থ পড়ার ভাষা। দুই শিক্ষাই একসাথে প্রার্থনা গৃহে হতো। প্রার্থনা গৃহ ছিল পশ্চিম মুখী। পাতার মাদুর ফেলে মেঝেতে সম্মিলিতভাবে পশ্চিমমুখী হয়ে প্রার্থনা হতো। আগন্তুরাই প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছিল এবং মানুষ তা সানন্দে গ্রহণ করেছিল।তাদের ঈশ্বর হিনা তাদের কাছে আল্লাহ হয়ে গেল অথবা আগন্তুকদের ঈশ্বর আল্লাহ তাহিতিদের কাছে ঈশ্বর হিনা’র রূপ নিয়ে এল। তবে ‘হিনা’র প্রতিকৃতি তৈরি বন্ধ হয়ে গেল। বলা হলো, যিনি অদৃশ্য, নিরাকার তাকে আকার দেওয়া ঠিক নয়। তার আকার দিলে তাঁর সম্পর্কে ধারনা ও বিশ্বাস ধীরে ধীরে বিকৃত ও পরিবর্তিত হতে পারে। তাহিতিয়ানদের জীবনে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এল সেটা সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। আগে ছিল পারিবারিক বা বংশীয় সর্দার বা হেডম্যান হওয়ার সিস্টেম। আগন্তুকরা তৈরি করল বহু বংশ মিলে আঞ্চলিক বা ভুখন্ডগত বা সমাজভিত্তিক পরিচালক বা শাসক হওয়ার সিস্টেম। ঠিক হলো, সবচেয়ে বয়স্ক, জ্ঞান ও চরিত্রে সর্বজনমান্য এমন ব্যক্তিই শাসক বা পরিচালক হবে। তিনি অপারগ হলে প্রবীণরা বসে অন্তত বেশীর ভাগ প্রবীণ একমত হয়ে যোগ্য কাউকে পরিচালক বা শাসক বানাবেন। আবার বেশির ভাগ প্রবীণ তাঁর সাথে একমত না হলে শাসক তাঁর পথ থেকে সরেও যাবে। কিন্তু এই ব্যবস্থা পরবর্তী কালে চলতে পারেনি। স্থিতিশীলতা আনয়ন ও বহুধাবিভক্তি নিরসন করার জন্যে বংশীয় শাসন এসে যায়। এভাবেই আমাদের পামরী রাজবংশ ক্ষমতায় আসে।আমাদের পামরী বংশ শুরু থেকেই আগন্তুকদের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। আগন্তুদের প্রায় সবাই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে পামরীদের আরু এলাকায়। আগন্তুকদের কিছু শিক্ষক হিসাবে, ধর্মনেতা হিসাবে, বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টা হিসাবে গোটা তাহিতি, মুরিয়া ও অন্যান্য দ্বীপে ছড়িয়ে পরেছিল। তারা সেসব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। আগন্তুকদের সাথে পামরীদের ব্যাপক বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল। পামরী রাজবংশের প্রথম রাজা আরি আবদালাহ আরিন্যু ছিল আগন্তুকদের প্রথম জাহাজের নেতা ও বিজ্ঞ আধ্যাত্মিক পুরুষ। আবদালাহ বানজাদ’র মেয়ের ঘরের প্রিয় নাতি। আগন্তুকরাই তাহিতির প্রথম আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝেই জাহাজ এসে নোঙর করত আমাদের আরুতে। জাহাজ থেকে বিভিন্ন পন্য নামত, তাহিতির কিছু ফলমূলও তারা নিয়ে যেত। বুঝা যেত তারা আগন্তুকদের পরিচিত বা তাদের সমজেরই কেউ। জাহাজে আসা কেউ কেউ থেকে যেত, আবার তাহিতি থেকেও কেউ কেউ চলে যেত। আমাদের আগন্তুকরা ও জাহাজের লোকরা ছিল একই ধর্মের।প্রার্থনার সময় জাহাজ থেকেও প্রার্থনার আহবান আসত। শোনা যেত জাহাজগুলো আসছে সুমাত্রা, জাম্বোয়াংগ, ফিজি হয়ে, আবার চলে যেত কোনটি পেরু, কোনটি মেক্সিকো, গোয়াতেমালা, পানামার দিকে। এসব দেশসহ বিভিন্ন দেশের কাহিনীও শোনা যেত আমাদের আগন্তুকসহ তাদের কাছে। এভাবে তাহিতিয়ানরা প্রথম জানল পৃথিবীতে বহু উন্নত মানুষ, উন্নত দেশ আছে, রাজ্য আছে, রাজা আছে। তাহিতির সাথে এসব দেশের লেনদেনও শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাহিতির কি দরকার, কি চাই, জানাতে হতো, পরের জাহাজে সেসব পাওয়া যেত। বলা যায়, এভাবে সব দিক থেকে এক সময়ের অন্ধকার তাহিতি আলোময় হয়ে উঠেছিল।
থামল ফাদার মাহকোহ। থেকেই আবার বলে উঠল, অবশিষ্ট দশ পৃষ্ঠার সারাংশ মোটামুটি এটাই।
স্যার, আপনার সংগ্রহে তো আরও কাহিনী আছে! সে সবে নতুন কিছু নিশ্চয় আছে? আহমদ মুসা বলল।
প্রথমে আমি আমার বংশীয় কাহিনী ১০০ পাতার গ্রন্থগুলো শোনানোর চেষ্টা করেছি। কাঠামোগত একটা গ্যাপ পূরণ হয়েছে। কিন্তু কাহিনীর গ্যাপ রয়েই গেছে। সুতরাং এ থেকে তোমার কোন লাভ হবে না। অধ্যাপক মাহকোহ বলল।
অন্য আরও বংশের তো কাহিনী আছে! সে সবও কি আপনি সংগ্রহ করছেন? বলল আহমদ মুসা।
সে সবের অনেক আমি সংগ্রহ করেছি। সেগুলো সবই শ্রুতি ও স্মৃতি থেকে। লিখিত কাহিনীর পরবর্তী পর্যায় এগুলো। পরিবর্তন ও বিকৃতির অনেক হাওয়া বয়ে গেছে এ সবের দিয়ে। তুমি যার সন্ধান করছ তা তুমি পাবে না ওসব থেকে। ফাদার মাহকোহ বলল।
তাহলে তাহিতির ইতিহাস এভাবে হারিয়ে গেল? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
শুধু তাহিতি নয়, গোটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইতিহাসও এভাবে হারিয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে, ইতিহাসের শুরু হয়েছে ইউরিপীয়দের আগমনের আশপাশ থেকে। আমি জানি না, কিভাবে এই ইতিহাসের উদ্ধার সম্ভব এবং কারা এই দায়িত্ব নেবে। বলল ফাদার মাহকোহ একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে।
ইতিহাস কি এভাবে সবটাই মুছে ফেলা যায়? আহমদ মুসা বলল।
এখন যায় না, কিন্তু তখন যেত। তখন এখানকার মত নানাজনে নানাভাবে ইতিহাস লিখত না। ইতিহাসের লিখিত রূপও ছিল না, ইতিহাস থাকতো স্মৃতিতে। পরে ইতিহাস লেখা শুরু হলেও তা ছিল সীমিত। তাহিতি অঞ্চলের দুর্ভাগ্য হল, লিখিত হবার পর তাহিতি অঞ্চলের ইতিহাস নষ্ট হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে লিখিত ইতিহাসগুলো ছিনিয়ে এনে একসাথে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে পরবর্তীকালে নিরপেক্ষ লোকদের গবেষণা ও অনুসন্ধানে অন্ধকার অতীত মাঝে মাঝে কিছুটা ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। যেমন বৃটিশ সমুদ্রচারী ক্যাপ্টেন কুক যিনি তাহিতি এসেছিলেন ১৭৬৯ সালে। তাঁর সহঅভিযাত্রী বিতানী জোসেফ ব্যাংকস বলেছেন পলিনেশীয় ভাষায় উৎপত্তি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া থেকে। তিনি বিভিন্ন তাহিতিয়ান শব্দের উৎস খোঁজ করতে গিয়ে বিলেছেন, তাহিতিয়ান এ ভাষার শেকড় শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, আরও পশ্চিমে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ক্যাপ্টেন কুক ‘তুপাইয়া’ নামে এক তাহিতিয়ান নাবিকের কথা বলেছিলেন। এই নাবিকের সাথে আলোচনা করে তিনি দেখেন এই নাবিক উত্তর-পূর্বে মারকুইজ দ্বীপপুঞ্জ, পুবে তুয়ামতু অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিনে অস্ট্রালী দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত জানে কিন্তু পশ্চিম দিকে তার জ্ঞান দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ান গোত্রভূক্ত প্রমানিত হয়েছে। এভাবে তাহিতিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সবই দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া ও আরও পশ্চিমের সাথে যুক্ত। জনসংখ্যার বিস্তার যেমন ঐদিক থেকে এসেছে, তেমনি ভাষা, সংস্কৃতি সব ঐদিক থেকেই এসেছে। আর অষ্টক শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম আরব বনিক, নাবিক ও মিশনারীরাই আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের মত প্রশান্ত মহাসাগরও চষে ফিরেছে। তারাই তাহিতির মত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপমালার ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের জনক। সমুদ্র, সমুদ্রপথ ও দিক নির্ণয় সম্পর্কে তাহিতিয়ান নাবিকদের যে বিস্ময়কর জ্ঞান ছিল, তা মুসলিম সভ্যতার সমুদ্রচারী আরব নাবিকদের কাছ থেকেই পাওয়া। কিন্তু সে ইতিহাস মুছে গেছে। একজন ইউরোপীয় বিজ্ঞানী বলেছেন, যেদিন নাবিক তুপাইয়াদের সমুদ্রজ্ঞানের উৎস সম্পর্কে জানা যাবে, সেদিনই পরিস্কার হবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের ইতিহাস। এই ইতিহাসের সন্ধান যদি আমরা চাই, তাহলে আমাদের যেতে হবে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে, এভাবে আমাদের যেতে হবে এশিয়ার অভ্যন্তর পর্যন্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই কথা বলা হয়েছিল নাবিক তুপাইয়াদের কথার আলোকে। সেই সময়ের অবস্থা এখন নেই। অনেক ঝড় বয়ে গেছে তারপর। সে ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে সে সময় পর্যন্ত ইতিহাসের সব উপকরণ। ফাদার মাহকোহ দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামল।
কথা শেষ করে ফাদার মাহকোহ তার হাঁটু মুড়ে বসা অবস্থাটা একটু শিতিল করল। হিপটা মেঝের উপর রেখে দু’পা একটু সরিয়ে নল।
গভীর একটা আনন্দের ছায়া আহমদ মুসার চোখে-মুখে। সব মনোযোগ ঢেলে দিয়ে যেন শুনছিল আহমদ মুসা ফাদার মাহকোহ’র কথাগুলো। তার পেছনে বসা মারেভা ও মাহিন এবং পাশে একটু তফাতে বসা মারেভা ও মাহিনের মা। তাদের সবার চোখে দুনিয়ার বিস্ময় ! এসব কোন কথাই তাহিতির কোন ইতিহাস গ্রন্থে লেখা নেই।
ফাদার মাহকোহ থামলে আহমদ মুসা বলল, স্যার, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। তবু স্যার বলছি, আমার প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব মেলেনি।
তোমার প্রশ্নের জবাবের জন্যেই তো এত কথা বললাম। এর মধ্যে তোমার প্রশ্নের জবাব এসে গেছে। তাহিতিতে প্রথম জাহাজ ও পরবর্তী জাহাজগুলো মুসলমানদের। এই মুসলমানদের অনেকেই তাহিতিতে বসতি স্থাপন করে এবং তারাই অন্ধকার তাহিতিকে আলোতে নিয়ে আসে। তারাই নতুন তাহিতির নির্মাতা। তাহিতির পমেরী রাজবংশের প্রথম রাজা আরি আবাদাল্লাহ আরিন্যু’র মায়ের বংশ ও পিতার বংশ তাহিতিয়ান। তার নাম অপভ্রংশ হিসাবে আমাদের কাছে এসেছে। তার নামের আসল উচ্চারণ আর আব্দুল্লাহ আরিন্যু। তাহিতিয়ান ‘আরি’ মুলত আরবি শব্দ। অর্থ পরিচালক, তত্ত্বাবদায়ক, প্রিন্স, সর্দার ইত্যাদি। আরিন্যু তাহিতিয়ান শব্দের অর্থ সমুদ্র তরঙ্গ। আর সমুদ্র তরঙ্গ মানে সাগর-তরঙ্গ অর্থাৎ সর্দার আব্দুল্লাহ। প্রথম রাজার নামের সাথে ‘আরবি’ শব্দ থাকলে সেই বংশের একজন প্রিন্সের নামের সাথে ‘হাসানা’ বা ‘হেসানা’ শব্দ থাকবে না কেন এবং কেন রূপকথার নায়িকা ভাইমিতির সাথে ‘শাবানু’ অর্থাৎ ‘শাহবানু’ থাকবে না ? বলল ফাদার মাহকহ।
তাহলে রাজা, রাজপুত্ররা কি মুসলমান ছিলেন? জিজ্ঞাসা মারেভা মাইমিতির। তার চোখে-মুখে ঠিকরে পড়া বিস্ময়।
আমি জানি না। এর কোন দলিল পাইনি। যা পেয়েছি তা বললাম। তোমরা তরুণ-তরুণীরা এটা অনুসন্ধান করতে পার। তবে এই যে প্রার্থনাগৃহে আমরা প্রার্থনা করি, এটাও তো মুসলমানদের মসজিদের মতই। যেটুকু পার্থক্য রয়েছে, সেটা সময়ের ব্যবধানে সৃষ্টি হয়েছে বলা যায়। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে রাজধানী আরুর আংশিক ধ্বংসের সাথে এই প্রার্থনা ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।তারপর এটা আবার পুননির্মিত হয় বেশ পরে। নতুন নির্মানের সময় আগের অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সেটাই স্বাভাবিক। দেখ, আমার নামটাও বিদঘুটে। আমার নামের মাহকোহ, মিনালী, মিনারী এই তিন শব্দই আরবি শব্দের অপভ্রংশ। এর অর্থ আমার জানা নেই। আমার পিতার সময়েরও অনেক আগে এই আরবি শব্দগুলো বিকৃত হয়ে গেছে, কিন্তু বিকৃত হলেও আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে আমাদের পরিবার কর্তৃক তা অনুসৃত হয়ে এসেছে। এই দেখ,আমাদের প্রার্থনাকক্ষের সামনের দেয়ালে অর্ধ চন্দ্র আঁকা। একে তাহিতিয়ানদের একজন ঈশ্বর ‘হিনা’র সিম্বল বলে মনে করা হয়। আসলে এটাও বিকৃতি। আসলে এই চাঁদ মুসলমানদের বিখ্যাত অর্ধ চন্দ্র (cresent)। মুসলমানদের মসজিদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে এই অর্ধচন্দ্রের ব্যবহার হতো। আমাদের প্রার্থনা ঘরের অর্ধচন্দ্র আমি গভিরভাবে দেখেছি। আমি নিশ্চিত এটা মুসলমানদের অর্ধ চন্দ্রই। বলল ফাদার মাহকোহ।
তার, মানে স্যার, মূলত এই প্রার্থনাগৃহ মুসলিম প্রার্থনাগৃহ মানে মসজিদই ছিল। আহমদ মুসা বলল।
আমার তাই মনে হয়। বলল ফাদার মাহকোহ।
তাহলে স্যার, এসব জানার পরেও আপনি কেন এই প্রার্থনা গৃহকে তার মূল পরিচয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন না, কেন এই ঘরের প্রার্থনা মুসলমানদের নামাজ হয়ে উঠছে না? আহমদ মুসা বলল।
এসব যেমন রূপান্তরিত হয়েছে, ইতিহাস যেমন রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনি মানুষও রূপান্তরিত হয়েছে। আমিও এই রূপান্তরের ফসল। আমার জানা এবং আমি এক নই। এক হতে চাইলেও আমি পারবো না। পরিবর্তনের স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নেবে। স্রোতের টান উপেক্ষা করে মাটিতে শিকড় গাড়ার সাধ্য আমার নেই। বলল ফাদার মাহকোহ।
ঠিক স্যার, প্রয়োজন স্রোতের গতি পাল্টায়। মারেভা মাইমিতি বলল।
হ্যাঁ, প্রয়োজন স্রোতের গতি পাল্টায়। এটা আমার কাজ নয়, মারেভা-মাহিন এ কাজ তোমাদের। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার, মারেভা-মাহিনরা এটা পারবে ইনশাআল্লাহ ! আর একবার মূল আলোচনায় আসতে চাই স্যার। তাহিতির ইতিহাসের রূপান্তর, মানুষের রূপান্তর ও এই প্রার্থনা গৃহের রূপান্তরের মত রাজপুত্র হেসানা হোসানা ও ভাইমিতি শাবানুদের কাহিনীর রূপান্তর কতটুকু ? বলল আহমদ মুসা।
এটা বলা মুস্কিল। তবে আমি মনে করি কাহিনীতে ঈশ্বরী হিসাবে ‘হিনা’র ভুমিকা বাদ দিলে কাহিনীর যা থাকে, তার তার প্রায় সবটুকুই সত্য। কিন্তু কেন এ বিষয়টা জিজ্ঞেস করছ? ফাদার মাহকোহ বলল।
এ কাহিনী সত্য হলে অ্যাটলের কাহিনীও সত্য হবে। আমি সেই অ্যাটলকেই খুঁজছি। স্যার, আপনি কাহিনী থেকে ঈশ্বরী ‘হিনা’র ভুমিকা মাইনাস করছেন। কিন্তু তাহলে অ্যাটলের অভ্যন্তরে রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানু গেলেন কিভাবে? বলল আহমদ মুসা।
এক কথায় এর উত্তর দেয়া যাবে না। প্রশান্ত মহাসাগর নিয়ে কাহিনী চালু আছে। সবটুকুই ‘মিথ’ বলা হয়। যেমন বিজ্ঞানের মাথায় যা ধরে না, তাকেই বিজ্ঞান অবিশ্বাস করে বসে। এটা ঠিক নয়। বিজ্ঞানের বস্তুজগতের বাইরে যে অদৃশ্য জগত সক্রিয় আছে তা বস্তুজগতের চেয়ে অনেক অনেক বড়। তেমনি আটলান্টিক সম্পর্কিত সব কাহিনীকে ‘মিথ’ বা কল্পকথা বলে অস্বীকার করা যাবে না। প্রশান্ত মহাসাগরের নিমজ্জিত মহাদেশ ‘মু’ এর কথাই ধরা যাক। প্রশান্ত মহাসাগরে একটা মহাদেশ ছিল, প্রাকৃতিক কারণে তা নিমজ্জিত হয়ে গেছে, একে ‘মিথ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। আমি এই উড়িয়ে দেয়াকে সমর্থন করি না । কাহিনীর সবটুকু সত্য কিনা আমি বলতে পারবো না। কিন্তু সত্য অবশ্যই আছে। প্রশান্ত মহাসাগরের সাগর তলের ভূ-গঠন এটাই প্রমাণ করে। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-দক্ষিণ মাঝামাঝি বরাবর পশ্চিম অংশের ভু-গঠন ও এর পুর্বাংশের ভু-গঠন একেবারেই আলাদা। পূর্বাংশের মধ্যে আবার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ গভীর খাঁদের মত। এর মাথায় অ্যাটল অধ্যুষিত পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ। প্রশান্ত মহাসাগরেরে এই অংশে একটা কিছু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছিল। পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে সেই বিপর্যয়ের একটা কিছু ধ্বংসাবশেষ থাকা বিচিত্র নয়! হতে পারে সমুদ্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ সমুদ্রচারী রাজপুত্র হেসানা হোসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর নিমজ্জিত এমন শেল্টার ও তার প্রবেশ পথ সম্পর্কে কোনওভাবে জানতেন। দুই প্রেমিক সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সম্ভবত। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার, আমি এমন একটি সম্ভাবনা সম্পর্কেই জানতে চাচ্ছিলাম। স্যার, আমিও মনে করি রাজপুত্রের এ বিষয়টা কোন কল্পকথা নয়, বাস্তবতা আছে এর মধ্যে। ধন্যবাদ স্যার।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা তাকাল মাহিন মারেভার দিকে। বলল, আমরা স্যারকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। এবার বোধহয় আমরা উঠতে পারি।
মারেভারা কিছু বলার আগেই ফাদার মাহকোহ বলল, আর একটু কষ্ট আমাদের দিয়ে যেতে হবে। প্রার্থনা গৃহে যারা আসেন দুপুরের আগ পর্যন্ত তাদের নিয়ে আমরা দুপুরে এক সাথে খাই। অতএব, আরও কিছু কষ্ট না দিয়ে যেতে পারছেন না। ফাদার মাহকোহ’র মুখে স্পষ্ট হাসি।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল ফাদার মাহকোহ। বলল, ইতিহাস তো কিছু শুনলে, চল এবার ভাঙ্গা রাজধানী ‘আরু’টা একবার দেখ। ইতিহাস এখানে তোমাদের সাথে কথা বলবে। আহমদ মুসারাও উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল মারেভা-মহিনের মায়েরা ও।
মারেভার মা আহমদ মুসাকে বলল, চল বেটা, ভাঙ্গা রাজধানী দেখার সময় আমাদের বাড়িও দেখতে পাবে। আমাদের ও মাহিনদের বাড়ি এক রাস্তাতেই, মাত্র রাস্তার এপার-ওপার।
ধন্যবাদ মা। খুব খুশি হবো দেখলে। কেউ থাকেন না এখানে আপনাদের? আহমদ মুসা বলল।
না, তোমাদের ফাদার মাহকোহ আমাদের চাচাজী। তিনিই আমাদের অভিভাবক। তার লোকরাই সব দেখাশুনা করে। আচ্ছা চল, উনি বেরিয়ে গেছেন। বলল মাহিনের মা।আহমদ মুসা ওদের সঙ্গে চলতে শুরু করে মারেভা ও মাহিনের মাকে লক্ষ্য করে বলল, মা, আমি মারেভা ও মাহিনের সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলতে চাই।
এখনি? বলল মাহিনের মা।
এখনি নয়, তবে বিষয়টা জরুরী। বলল আহমদ মুসা।
জরুরী? কেমন বিষয় বেটা, খারাপ কিছু নয় তো ? বলল মারেভার মা। কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে।
খারাপ নয়, সেটা শুভ একটা বিষয়। বলল আহমদ মুসা।
মারেভা ও মাহিন দু’জনেই পরস্পরের দিকে তাকাল, তারপর তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাদের মুখ কিছুটা রাঙা হয়ে উঠেছে। ‘শুভ কাজ’ বলতে তাদের স্যার কি বুঝিয়েছেন, সেটা তারা দু’জনেই বুঝতে পেরেছে। ইদানিং মাঝে মাঝেই তাদের স্যার বলছেন, তোমরা একসাথে যেভাবে চলাচল করছ তা ঠিক নয়, বিশেষ করে আমাদের সাথে থাকতে হলে তোমরা বিচ্ছিন্ন থাকলে চলবে না। তাদের স্যার যথাসম্ভব শীঘ্র তাদের বিয়ের পক্ষপাতি। কিন্তু মারেভাও মাহিন সলজ্জভাবে সযতনে বিষয়টাকে এড়িয়ে গেছে। এবার সেই বিষয়টা তাদের স্যার তাদের মায়ের কাছে পাড়তে যাচ্ছে। তবে ‘এখনি নয়’ বলে বিষয়টাকে আপাততঃ চাপা দেয়ায় তারা লজ্জার হাত থেকে বাঁচল, স্বস্তি পেল।
তারা সবাই বেরিয়ে এল প্রার্থনা গৃহ থেকে। সকলে হাঁটছে ফাদার মাহকোহ’র পেছনে পেছনে।
২
শর্ট রেঞ্জ অপশনে সুপার মাল্টি সাউন্ড মনিটর অবিরাম বিপ বিপ করেই চলেছে।
চার সিংহ মুর্তির উপর সেট করা রাজসিক ডিভানের উপর রাজশয্যায় শুয়ে ছিল আলেক্সি গ্যারিন। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সর্বময় কর্তা এই আলেক্সি গ্যারিন।
ঠিক শুয়ে থাকা নয়, বালিশে ঠেস দিয়ে পার্সোনাল পিসি হাতে নিয়ে কিছু করছিল। এর মধ্যেই তন্দ্রার শিকার হয়ে তার দেহটা বালিশের উপর নেতিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
বিপ বিপ শব্দটা করেই চলেছে মোবাইলে সাইজের মাল্টি সাউন্ড মনিটরটা।
হঠাৎ ঘুমন্ত আলেক্সি গ্যারিনের হাতঘড়ি ক্ষীণ একটা রেড সিগন্যাল দেয়া শুরু করল। সেই সাথে সাউন্ডলেস ভাইব্রেশন শুরু হল।
এবার চমকে উঠে চোখ খুলল আলেক্সি গ্যারিন।
চোখ খুলেই সে তাকাল হাতঘড়ির দিকে। ঘড়ির স্ক্রীনে লাল অক্ষরে নোটিশ ‘অ্যালাইন ভয়েস মনিটোরড’।
শোয়া থেকে ধড়মড় করে উঠে বসল এলাক্সি গ্যারিন। তার চোখ গিয়ে ফিক্সট হলো সুপার মনিটরের উপর। মনিটরের বিপ বিপ সাউন্ড বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু লাল নোটিশ মনিটরের স্ক্রীনে এখনও আছে।
তাড়াতাড়ি মনিটরটা তুলে নিয়ে আলেক্সি গ্যারিন ভিউ বাটনে চাপ দিল। মনিটরের স্ক্রিন থেকে লালা নোটিশ সরে গিয়ে সেখানে একটা রেড লেটার মেসেজ ভেসে উঠলঃ SOS-save our soul. We are seventy six….. (এসওএস, আমাদের বাঁচান। আমরা ছিয়াত্তর)…’ মেসেজটি অসম্পূর্ণভাবে ক্লোজ হয়ে গেল। সেই সাথে ধাতব কিছু আছড়ে পড়ার শব্দ হলো।
স্প্রিং-এর মত ডিভান থেকে লাফ দিয়ে নামল আলেক্সি গ্যারিন। তার মনের ভেতরটায় তখন তোলপাড়। আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার (COP) থেকে কেউ মেসেজ পাঠাচ্ছে! তার মনের এই তোলপাড়ের ছাপ মুখেও এসে পড়েছে। তার মুখের পেশীগুলো লোহার মত শক্ত হয়ে উঠেছে। দু’চোখে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।
আলেক্সি গ্যারিন লোকটি দেখতেও ইস্পাতের এক রোবটের মত। প্রায় ছয় ফুটের একটা স্লিম বড়ি তার। শক্তির প্রাচুর্য আর ফিটনেসের দীপ্তি যেন ঠিকরে পড়ছে তার দেহ থেকে।
আলেক্সি গ্যারিন মেঝের উপর লাফিয়ে পড়ে কোন কিছু করার আগেই হাতঘড়ি আবার নিরব শব্দে ভাইব্রেট করতে শুরু করল।
ঘড়ির স্ক্রীনের দিকে একবার তাকিয়েই বলে উঠল, হ্যাঁ গোরী, কি ঘটেছে? আলেক্সি গ্যারিনের কণ্ঠ দ্রুত ও কঠোর।
ঘড়ি থেকে কণ্ঠ ভেসে এল, মাই লর্ড, আমাদের রোবট-৩৯ তার প্রাকৃতিক চরিত্রের অন্যথা করে বাইরে থেকে এসওএস পাঠাচ্ছিল। তাকে ধরেছি। নির্দেশ বুলুন মাই লর্ড।
তুমি থাক ওখানে আমি আসছি। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
কথা শেষ করেই আলেক্সি গ্যারিন দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল। দরজার কাছাকাছি হতেই দরজা আপনাতেই খুলে গেল।
দরজা পার হয়ে করিডোরে পা রেখে একটু ঘুরল। দরজার দেয়ালে একটা ডিজিটাল কি বোর্ডে তিন ও নয় বাটন চাপল।
সংগে সংগে করিডোর সচল হয়ে উঠল।
করিডোরের লম্বালম্বি দু’টো অংশ একটা লাল, অন্যটি সবুজ। আলেক্সি গ্যারিন দাঁড়িয়েছিল সবুজ অংশে। সবুজ অংশই চলতে শুরু করেছে।
এ করিডোর সে করিডোর ঘুরে মুভিং এলেভেটরটি মনে হলো দু’তলা পরিমাণ নিচে।
প্রবেশ করল আলেক্সি গ্যারিন ৩৯ নাম্বার সেলে।
আলেক্সি গ্যারিন প্রবেশ করতেই সেলের মাঝখানে দাঁড়ানো আলেক্সি গ্যারিনের পার্সোনাল সিকিউরিটি ও পার্সোনাল অপারেশন কমান্ডার গৌরী বাউ করে দু’পা পেছনে সরে গেল। বলল, আসুন মাই লর্ড।
আলেক্সি গ্যারিন দেখল, রোবট-৩৯-এর দু’হাতে হাতকড়া। বসিয়ে রাখা হয়েছে এক চেয়ারে।
রোবট-৩৯ আসলে বিজ্ঞানী কুতাইবা ওয়াং-এর এখানকার সিরিয়াল নাম। সে পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ কণা-বিজ্ঞানী। বাড়ি তার চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে। তিন মাস আগে অপহৃত হয়ে এখানে এসেছে। সে বন্দী জীবনের প্রথম দিন থেকেই মুক্তির চেষ্টা করছে। ওদের বন্দুকের মুখে টিভি ক্যামেরার সামনে ওদের ফরমাইসি গবেষণা করতে হয় ল্যাবরেটরীতে বসে। এই কাজ করার ফাকেঁই প্রতিদিন তিল তিল করে সে মাল্টিওয়েভ ট্রান্সমিটার তৈরী করে। এ ট্রান্সমিটারের ট্রান্সমিশন যে কোন ওয়েভ লেংথে প্রবেশ করতে পারে। ম্যাসেজ প্রেরণের শুরুতেই সে ধরা পড়ে গেছে। সে জানত, এ ধরনের মেসেজ গার্ড দেবার ব্যবস্থা এদের আছে। কিন্তু কুতায়বা ওয়াং বলেছিল মেজেস পাঠানোর পর ধরা পড়লে ক্ষতি নেই। নিজের জীবন দিয়েও যদি ৭৫জন বিজ্ঞানীর অতি মূল্যবান জীবন রক্ষা করা যায়, তাদের প্রতিভার অপব্যবহার থেকে সে প্রতিভাগুলোকে বাঁচানো যায় এবং এদের ষড়যন্ত্র বানচাল করা যায়। তাহলে সেটাই হবে তার জন্যে বেশি আনন্দের। কিন্তু তা সে পারেনি। মেসেজ পাঠানো তার সম্পূর্ণ হয়নি। যেটুকু পাঠিয়েছে, সেটুকু কি কোন কাজে লাগবে?এই চিন্তাই বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। শয়তানদের বড় শযতান আলেক্সি গ্যারিনকে সেলে প্রবেশ করতে দেখে এই চিন্তাই তার মধ্যে আবার তোলপাড় করে উঠল।
আলেক্সি গ্যারিন মোটা গোড়ালির পয়েন্টেড সু পায়ে মাটি কাঁপানো পদক্ষেপে বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুখের চেহারা তার বিস্ফোরণ উন্মুখ। বলল সে বিজ্ঞান কুতায়বা ওয়াংকে লক্ষ্য করে, তোমার সাথে আর কে আছে এই ষড়যন্ত্রে? কথাগুলো তার শান্ত, কিন্তু বুলেটের মত শক্ত।
কুতায়বা ওয়াং কোন জবাব দিল না। আলেক্সি গ্যারিনকে কোন সাহায্য করার কোন প্রশ্নই আসে না।
দাতেঁ দাঁত চাপল যেন আলেক্সি গ্যারিন। তার ডান হাতটা বেরিয়ে এল প্যান্টের পকেট থেকে। তার হাতে ছোট্ট সাদা সর্বাধুনিক ভার্সনের লেজারগান। গানটি টার্গেট করেছে কুতায়বা ওয়াং-এর দুই হাত। পর মুহূর্তেই দেখা গেল, বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর দুই হাত নেই। কবজি থেকে দুই হাত তার উধাও হয়ে গেছে।
যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ার কথা বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর। কিন্তু তার মুখ থেকে একটা শব্দও বেরুল না। চোখ দু’টি তার বিস্ফোরিত। দাঁতে দাঁত চাপার তীব্রতায় মাড়ি ফেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে।
আলেক্সি গ্যারিন ঘুরে দাঁড়াল গৌরীর দিকে। বলল, গৌরী, তুমি ওকে যা করবার কর। তারপর দৃষ্টান্ত হিসাবে একে আমাদের অন্য রোবটদের দেখাও। তারপর আমার কাছে নিয়ে এস। আমি ততক্ষনে ভেতরের বাইরের ভিডিও ফুটেজগুলো নিজে একবার চেক করব।
বলেই আলেক্সি গ্যারিন গট গট করে হেঁটে দরজার দিকে চলল।
গৌরী ‘ইয়েস মাই লর্ড’ বলে একটা বাউ করল।
সেল থেকে বেরিয়ে গেল আলেক্সি গ্যারিন।
গৌরী ঘুরে দাঁড়াল বিজ্ঞানী কুতায়বার দিকে। বলল, ড. ৩৯, তোমাকে আর শাস্তি দেবার দরকার নেই। তোমার দেহের রক্ত যত কমছে, মৃত্যু তোমার তত নিকটবর্তী হচ্ছে। এর চেয়ে বড় শাস্তি তোমার জন্যে আর নেই।
বলেই গৌরী চেয়ারের পেছনে একটা বোতামে চাপ দিল। সংগে সংগে চেয়ারের চার পায়ার তলায় চার চাকা নেমে এল। চেয়ার ইঞ্চি দু’য়েক উপরে উঠল।
গৌরী চেয়ার ঠেলে নিয়ে চলল, সেলগুলোতে তার প্রদর্শনীর জন্যে। সেলগুলো বটমের দু’টি ফ্লোর জুড়ে।
টপ ফ্লোরে ভিআইপি রেসিডেন্টস ও তাদের অফিস। আলেক্সি গ্যারিন ও গৌরীরা যখন ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার (COP) –এ থাকে তখন টপ ফ্লোরেই তাদের আবাস হয়।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কাল্পনিক বা স্বপ্নের রাজধানী হলো এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’। একটা আ্যটলের তলদেশে বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা ক্যাপিটাল অব পাওয়ার।
গৌরী বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর চেয়ার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কাছের সেলটার দিকে। চেয়ারের হাতলের উপর দিয়ে ঝুলে থাকা তার কব্জি পর্যন্ত উড়ে যাওয়া বাহু থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে অবিরাম। কিন্তু কুতায়বার মুখ একেবারেই বাবলেশহীন। যেন আহত হাতটা তার নয়।
কাছের সেলটার একেবারে মুখোমুখি এসে গেছে গৌরী বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াংকে নিয়ে।
সেলগুলো মহাশূন্য ক্যাপসুলের আদলে তৈরি। বাইরের অংশটা ফাইবারিক কাচের তৈরি। বাইরে থেকে ভেতরের সবকিছুই দেখা যায়। ক্যাপসুলের ভেতরে রয়েছে বেড, টয়লেট, লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি। ব্যায়াম করার জন্যে ঝুলন্ত বারসহ রয়েছে নানা উপকরণ।
এই ক্যাপসুল সেলগুলো রয়েছে বৃত্তাকার বিশাল একটা লাউঞ্জের চারদিক ঘিরে। বৃত্তাকার লাইঞ্জের মাঝখানে রয়েছে সেই ফাইবারকি কাচের দীর্ঘ আয়তাকার কক্ষ। তাতে সারিবদ্ধ টেবিল। রোবটের মত লোকরা বসে। সেলগুলোর সাথে অফিসকক্ষের লোকদের ইন্টারকম যোগাযোগ রয়েছে। এই অফিসকক্ষ থেকেই সেলগুলো কাজ-কর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়া পর্যবেক্ষণের জন্যে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সিসি টিভি ক্যামেরা তো রয়েছেই। সেলগুলোর কোন কথা কোন কাজই মনিটর ও পর্যবেক্ষণের বাইরে নয়।
গৌরী বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর চেয়ার ঠেলে সেলটির সামনে দাঁড়াতেই সেলে দরজা আপনাতেই খুলে গেল।
রোবট-৪০ মুক্তির স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা অবস্থা তোমরা দেখ। যে দুই হাত দিয়ে আমাদের আইন ভেঙেছিলে, সেই দু’হাত দেখ নেই। কিছুক্ষণ পর সেও দুনিয়ায় থাকবে না। বলল চিৎকার করে গৌরী।
রোবট-৪০ আরেকজন বিজ্ঞানী। সে ইন্দোনেশিয়ার ‘সী ম্যুনিকেশন সাইনটিস্ট’, নাম ড. সোয়েকার্ন নাসির। সে গৌরীর কথা শুনে চমকে তাকাল ড. কুতায়বা ওয়াং-এর দিকে। তার দু’হাতের দিকে নজর পড়তেই একটা বিষাদের ছায়া খেলে গেল ড. সোয়েকার্ন নাসিরের মুখের উপর দিয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল মুখের বিষাদ ভাব, শক্ত হয়ে উঠল তার মুখ। তাতে ফুটে উঠল কঠিন সিদ্ধান্তের একটা চিহ্ন।
মুখে কিছুই বলল না ড. সোয়েকার্ন নাসির।
গৌরীর কথা শেষ হতেই কথা বলে উঠল ড. কুতায়বা ওয়াং। বলল, প্রিয় ভাই, আপনাকে বলছি, সবাইকে বলব, মুক্তির স্বপ্ন আমাদের সফল হবে। আংশিক হলেও আমি বাইরে মেসেজ পাঠাতে পেরেছি। আমি নিশ্চিত, এই মেসেজ আল্লাহ ঠিক জায়গায় পৌছিয়ে দেবেন। আপনারা এই শয়…।
কথা শেষ করতে পারলো না ড. কুতায়বা ওয়াং। গৌরীর রিভলবারের এক পশলা গুলি ড. কুতায়বা ওয়াং এর মাথা একবারে ছাতু করে দিল। রক্তের স্রোতে পেইন্ট হয়ে গেল ড. কুতায়বা ওয়াং-এর মুখ ও দেহের অর্ধাংশ। অর্ধাংশ উড়ে যাওয়া মাথা বীভৎস রূপ নিয়েছে।
রিভলবার পকেটে রাখতে রাখতে গৌরী বলল ড. সোয়েকার্ন নাসিরকে লক্ষ্য করে, রোবট ফরটি, মেসেজটা সে সবাইকে বলতে চেয়েছিল, বলার ব্যবস্থা করে দিলাম। একদম স্বর্গে গিয়ে বলবে। গৌরীর চোখ-মুখে আগুন।
কষ্টের একটা ভাব ফুটে উঠেছিল ড. সোয়েকার্ন নাসিরের চোখ-মুখে। কিন্তু মুহূর্তেই সে ভাবটা কেটে মুখের সেই শপথ দৃঢ় ভাবটা আবার ফিরে এল। মনে মনে বলল, ড. ওয়াং কি মেসেজ পাঠিয়েছে? কেমন করে সে এই অসাধ্য সাধন করল! মনে মনে স্যালুট দিল সে ড. ওয়াং-এর উদ্দেশ্যে। গৌরী ড. ওয়াং-এর হুইর চেয়ার ঠেলতে শুরু করেই আবার থমকে দাঁড়াল। মুখ ঘুরিযে বলল ড. নাসিরকে রোবট ফরটি, আমাদের বিজ্ঞানী ড. আলেকজান্ডারকে সাথে নিয়ে আমি বিকেলে দিকে তোমার কাছে আসব। সব ঠিক ঠিক রেখ। মনে আছে তো, আ্যন্টিম্যাটার ফুয়েলের আজ ল্যাবরেটরি টেস্ট হবার কথা। টেস্ট টিউব আজ তোমার রেডি রাখার কথা। আজ কিন্তু কোন এক্সকিউজ শোনা হবে না। ইলেকট্রিক চাবুকের কথা মনে আছে নিশ্চয়। তোমার পিঠের আগের ঘাগুলোর উপর ইলেকট্রিক চাবুক কি আরও ভাল ফল দেবে?
বলেই আবার চেয়ার ঠেলতে শুরু করল গৌরী।
একটা সেল থেকে আরেকটা সেলের দূরত্ব আট নয় ফুটের বেশি নয়। এক সেল থেকে অন্য সেলের ভেতরের সব কিছুই দেখা যায়। কিন্তু প্রতিটি সেলই সাউন্ডপ্রুফ। এক একটি সেলে একজন করে বিজ্ঞানী বাস করে এবং সেলের ল্যাবরেটরিতেই তাদের কাজ করানো হয়। আউটডোর পরীক্ষাগুলো বটম ফ্লোরের ওপেন স্পেসে করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় ফ্লোরে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা থাকে এবং তাদের বন্দুকের মুখে কাজ করানো হয সেখানেই। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট কিডন্যাপ করে আনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের দিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে থাকে।
গৌরী একের পর এক সেলে বিজ্ঞানী ওয়াং-এর মুক্তি প্রচেষ্টার পরিণতি দেখিযে চলল। সেকেন্ড ফ্লোরের সব সে কভার করার পর শেষ সেলটা থেকে প্রথম ফ্লোরে নামার মুভিং ইলেভেটারে উঠতে যাচ্ছিল। সেলটির বিজ্ঞানী ও ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের পুতুল হয়ে উঠা ড. স্যামুয়েল মাদারল্যান্ড গৌরীকে লক্ষ করে বলল, ইয়োর হাইনেস ম্যাডাম, একটা কথা বলতে চাই।
বলো রোবট-৬৯। বলল গৌরী।
আমার মনে হয় এই অবস্থায় একজন বিজ্ঞানীকে অন্য বিজ্ঞানীদের দেখানো ঠিক হচ্ছে না। এর দ্বারা তারা ভয় পাবার বদলে ক্ষুব্ধ বেশি হবে। আপনাদের উদ্দেশ্য ওদের থেকে কাজ নেয়া, বিক্ষুব্ধ করা নয়। ড. স্যামুয়েল মাদারল্যান্ড বলল।
থমকে দাঁড়াল গৌরী। বিজ্ঞানী ড. স্যামুয়েলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক মুহুর্ত ভাবল। তারপর মুখে হাসি টেনে বলল, ‘ধন্যবাদ রোবট-৬৯, তোমার পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ।
বলে প্রথম ফ্লোরে নামার জন্যে মুভিং এলিভেটরের দিকে না গিয়ে চেয়ার ঠেলে এগিয়ে চলল টপ ফ্লোরে ওঠার এলিভেটরের দিকে।
উঠে গেল টপ ফ্লোরে।
টপ ফ্লোরে উঠেই বিজ্ঞানী ড: ওয়াং-এর চেয়ার ঠেলে নিয়ে একটা সংকীর্ণ করিডোর হয়ে একটা প্রান্তে চলে গেল। দেয়ালের গায়ে বর্গাকৃতি একটা খাঁজে চেয়ার ঢুকিয়ে হাত উপরে তুলে দেয়ালের সাথে মিশে থাকা একটা টাচ বাটনে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের ভেতর থেকে একটা দরজা এসে খাঁজটা ঢেকে দিল। ভেতর থেকে সূক্ষ্ম যান্ত্রিক একটা শব্দ ভেসে এল এবং একটা পতনের শব্দ।
গুডবাই রোবট-৩৯। বলার সাথে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল গৌরীর মুখে।
দেয়ালের খাঁজটা লাশ ও এ ধরনের বর্জ্য পাতালের সাগর বক্ষে চালান করার একটা ট্র্যাপ।
গৌরী ফিরে এল। গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের কক্ষের সামনে আসতেই অটোমেটিক দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে ভারী কণ্ঠ ধ্বনিত হলো আলেক্সি গ্যারিনের, এস গৌরী। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।
ইয়েস মাই লর্ড! বলে গৌরী ভেতরে প্রবেশ করল।
পেছনে দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
একটা ডিভানে রাজার মত পা ছড়িয়ে বসে ছিল আলেক্সি গ্যারিন। গৌরী ভেতরে প্রবেশ করলে আলেক্সি গ্যারিন সোজা হয়ে বসল। তার পাশে পড়ে আছে রিমোট কনট্রোল সেট।
গৌরী আস্তে আস্তে গিয়ে আলেক্সি গ্যারিনের একটু পাশে পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।
গৌরী, আমাদের রোবট নাম্বার ৩৯ সাংঘাতিক ছিল। সাংঘাতিক মেধাবী আর কুশলী ছিল। কারও সাথে যোগাযোগ ছাড়াই অভূতপূর্ব কায়দায় অবিশ্বাস্য শক্তির মাল্টিওয়েভ ট্রান্সফরমার বানিয়েছিল। চতুর্দিকে দু’শ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল তার এসওএস। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
সর্বনাশ মাই লর্ড! এই বিশাল অঞ্চলের কোন না কোন জাহাজের মনিটরিং-এ তা ধরা পড়তে পারে। গৌরী বলল।
না, ভাগ্য বলে যদি কিছু থাকে তা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সাথে রয়েছে। পাশের অ্যাটলের ট্রানজিট স্টেশনে আমাদের যে এন্টেনা আছে, তার সার্চ পাওয়ার ঐ মেসেজের বিস্তার-রেঞ্জের চেয়ে অনেক বেশি। সেদিনের সে সময়ের সার্চ রিপোর্টের পুরো রিপোর্ট আমি দেখেছি। ঐ সময় রেডিও এ্যান্টেনাওয়ালা কোন যান্ত্রিক যান এই এলাকায় ছিল না। ইঞ্জিনওয়ালা বোট কিছু ছিল। ছবিতে দেখা গেছে সেগুলো নিছকই ফেরিবোট এবং খুবই ছোট পার্সোনাল। কোন ট্যুরিস্ট বোট কোথাও দেখা যায়নি। তবে ফেরি ধরনের একটা লোকাল বোট আমাদের পাশের তাহানিয়া অ্যাটলের আমাদের ট্রানজিট স্টেশনের একদম পাশে উত্তরে নোঙর করা ছিল। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, নির্দিষ্ট সময়টাতে আমাদের এই ক্যাপিটাল থেকে ট্রান্সমিটিং-এ যে ওয়েভ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তার ম্যাপে দেখা যাচ্ছে ওয়েভের একটা ধারা ঐ বোটের উপর ভেঙে পড়ছে। এর কারণ একাধিক হতে পারে। ঐ বোটে মাল্টিওয়েভ মনিটর থাকা তার মধ্যে একটি। সুতরাং আমাদের আশংকা মাত্র ঐ বোটটি ঘিরে। থামল আলেক্সি গ্যারিন। তার দু’চোখে আগুন!
একটা সাধারণ বোটে ঐ ধরনের মাল্টিওয়েভ মনিটর থাকা স্বাভাবিক নয়। ঐ বোটের আরোহী কারা সেটা কি ছবি থেকে জানা গেছে মাই লর্ড?
আরোহী ছিল দু’জন ছেলে, একজন মেয়ে।
একজন ছেলে ও মেয়েটি পলিনেশীয় অঞ্চলের, অন্যজন বিদেশী। কিন্তু ইউরোপীয় নয়। ওদের ফটো-প্রিন্টও পেয়ে গেছি। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, যে সময়টুকুতে মেসেজ প্রচার হতে পেরেছে, সে সময় তারা তিনজনই বোটের ভেতরে ছিল। মেসেজের শুরুতেই প্রথম ভেতরে ঢুকে বিদেশী লোকটি। তারপর অন্যরাও। বলল অ্যালিক্সি গ্যারিন।
তার মানে মাই লর্ড, আপনি কি মনে করেন ওরা মেসেজের কোন সিগন্যাল পেয়েই ভেতর ঢুকেছে মেসেজ রিসিভ করার জন্যে? গৌরী বলল। উদ্বেগ তার চোখে-মুখে।
সেটাই ঘটেছে এটা বলার মত কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু শতভাগ সন্দেহ যে, সেটাই ঘটেছে।
বলে মুহুর্তকাল থেমে আলেক্সি গ্যারিন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল গৌরী, ফাইল রেডি। ফাইলে পাবে বোটের ছবি, বোটের নাম্বারও পাবে বোটে। তিনজন ছেলেমেয়ের ছবি রয়েছে ফাইলে। কাজ শুরু কর। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে চাই ঐ বিদেশীকে আমাদের হাতে। তাকে জীবিত পেতে হবে। প্রথমে দেশী দু’জনকে খুঁজে পেলে পরবর্তী কাজ সহজ হয়ে যাবে।
কথা শেষ করেই আলেক্সি গ্যারিন বলল, কাজ শুরু করার আগে গৌরী কিছু রেস্ট নাও। বলে আলেক্সি দু’ধাপ এগিয়ে বেডে উঠে গেল। গৌরী প্রথমে কিছুটা বিব্রত হলেও পরক্ষনেই তার মুখে রক্তিম হাসি ফুটিয়ে তুলল। সেও বেডে উঠে গেল। সংগে সংগেই বেডটা ঢুকে গেল দেয়ালের মধ্যে।
অদৃশ্য হয়ে গেল বেডটা। দেয়াল ফিরে এল আগের জায়গায়।
গৌরী ও তার কমান্ডোরা গত ২৪ঘণ্টা ধরে ফলো করছিল মাহিন ও মারেভাকে। বোটের মালিকের কাছ থেকে তারা শুনেছিল, যে বিদেশীর জন্যে তারা সেদিন বোট ভাড়া করেছিল, সে বিদেশী যে মাহিন ও মারেভাদের শুধু গাইড নয়, বন্ধুও মনে হয়েছিল। এ থেকেই গৌরী নিশ্চিত হয়েছিল, মাহিন ও মারেভাকে ফলো করলেই সে বিদেশীকে পাওয়া যাবে। মাহিন ও মারেভাকে পাকড়াও করে তাদের কাছ থেকে জানার চেয়ে এটাই নিরাপদ। তাদের পাকড়াও করলে বিদেশী অবশ্যই সেটা জানবে এবং সে আত্মগোপন করতে পারে। মাহিন ও মারেভাকে ফলো করছে গৌরীরা। এই সিদ্ধান্ত থেকেই গৌরীদের সৌভাগ্যবানই বলতে হবে। বোটের নাম্বার ধরে বোটের মালিককে খুজে পাওয়া গৌরীদের জন্যে কঠিন হয়নি। তাহিতি থেকে তাহিতি, মুরিয়া ও তোয়ামতু অ্যাটল আইল্যান্ডে চলাচলকারী সব যান্ত্রিক বোট ও লঞ্চের রেজিস্ট্রেশন করা হয়ে থাকে। এখান থেকেই গৌরীরা বোটটির মালিকের সন্ধান পেয়েছে। আর বোট মালিকের বুকিং রেকর্ড থেকে পেয়েছে মাহিনের ঠিকানা। মাহিনের ঠিকানায় ওৎ পেতে থেকে মাহিনের সাথে মারেভাকেও পেয়েছে। ভিডিও থেকে পাওয়া ছবির সাথে মিলিয়ে তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে গৌরীরা।
গত ২৪ ঘণ্টায় এক মুহুর্তের জন্যে গৌরীরা পিছু ছাড়েনি মাহিন ও মারেভার। দুই গ্রুপকে দু’জনের পেছনে লাগানো হয়েছে। গৌরী দুই গ্রুপের তদারক করছে।
এই ২৪ ঘণ্টায় মাহিন ও মারেভা আলাদা আলাদাভাবে বাজারে গেছে, পর্যটন অফিসে গেছে, একবার একটা হোটেলেও গিয়েছিল। গৌরীরা তাদের ফলো করেছিল। কিন্তু বিদেশী সেই লোকটিকে কোথাও দেখেনি। গৌরী শংকিত হয়ে পড়েছিল বিদেশী লোকটি চলে যায়নি তো কিংবা আলাদাভাবে অন্য কিছু করায় ব্যস্ত নয় তো! তাহলে কি আমরা ভুল করছি? মাহিন ও মারেভাকে ধরে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করাই কি উচিত ছিল?
গৌরী মারেভাদের গেটের অপজিটে রাস্তার ওপাশে একটা গাড়িতে বসে এসব কথা ভাবছিল। তার দু’চোখ এদিক সেদিক ঘুরে বারবার গিয়ে স্থির হচ্ছিল মারেভার সেই গেটে। দূরবীন দিয়ে মারেবার বাড়ির সামনের কিঞ্চিৎ অংশও দেখতে পাচ্ছিল গৌরী।
এক সময় দূরবীনেই ধরা পড়ল মাহিন একটা ট্যাক্সি নিয়ে মারেভাদের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল। অল্প কিছুক্ষণ পর ট্যাক্সি আবার বেরিয়ে এল। এবার ট্যাক্সিতে দু’জন, মাহিন ও মারেভা।
বেরিয়ে তারা পাপেতির মুল শহরের দিকে না গিয়ে পূর্বদিকে চলল। মাহিন-মারেভাদের গাড়ি চলতে শুরু করলে মারেভাদের বাড়ির পাশের পার্কে একটা আড়াল থেকে আরেকটা গাড়ি বেরিয়ে মারেভাদের গাড়ির পিছু নিল।
তখন রাত আটটা। গৌরী তার গাড়িতে বসে সব দেখছিল।
এত রাতে কোথায় বেরুচ্ছে মাহিন ও মারেভা দু’জনে? সেই বিদেশীর কাছে কি? হতেও পারে। গৌরী তার গাড়ি স্টার্ট দিল।
পেছনের মোড় ঘুরে গাড়ি দু’টির পেছনে ছুটে চলল গৌরীর গাড়ি।
গাড়ি পাহাড়ি নদী টাওনার সমান্তরালে উত্তরে এগিয়ে চলেছে। সামনেই সাভাক।
গৌরীর মাথায় চিন্তা, মাহিন-মারেভারা যাচ্ছে কোথায়? টাওনা লেক একেবারেই তো সামনে!
গাড়ি স্লোপিং পথে নিচে নামতে শুরু করেছে।
অনেক দূর থেকে দেখা যায় ‘লা ডায়মন্ড ড্রপ তাহিতি’ নামের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক হোটেলের নিয়ন সাইন।
সাইনবোর্ডটা চোখে পড়তেই গৌরী ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে উঠল। উচ্চ কণ্ঠে বলল, কোন সন্দেহ নেই মাহিন-মারেভারা সেই বিদেশীর কাছেই যাচ্ছে। বড় বড় বিদেশীই এ হোটেলের বাসিন্দা।
মাহিন-মারেভাদের গাড়ি হোটেল লা ডায়মন্ড ড্রপ গাড়ি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। মাহিন ও মারেভা নামলে গাড়ি পার্কিং-এর দিকে চলে গেল।
মাহিন-মারেভারা নামার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনুসরণকারী ব্ল্যাক সান-এর গাড়ি এসে হোটেলটির গাড়ি বারান্দায় দাঁড়াল। তিনজন গাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত হোটেলের ভেতরে চলে গেল। আর একজন গাড়ি পার্কিং-এ রেখে আসার জন্যে ওদিকে গেল।
গৌরী তার গাড়ি পার্কিং-এ দাঁড় করিয়েই মোবাইল করল আগের গাড়ির ব্ল্যাক সান-এর লোকদেরকে। বলল, নাশকা, তোমরা ওদের ফলো করছ তো? ওদের পেছন ছাড়বে না। কোন রুমে ঢোকে কিংবা রেস্টুরেন্টে ঢোকে সেটা দেখ। আমি রিসেপশনে অপেক্ষা করছি। আমাকে জানাবে।
কল অফ করে গৌরী ধীরে-সুস্থে চলল হোটেলের রিসেপশনের দিকে। রিসেপশনে বসার অল্পক্ষণের মধ্যেই কল পেল গৌরী। কল অন করে সাড়া দিতেই ওপার থেকে নাশকার গলা পেল গৌরী। বলল চাপা কণ্ঠে, ম্যাডাম হোটেলের দশ তলার পেছনের দিকে ১০১৫ ডবল ডিল্যাক্স রুমে ওরা প্রবেশ করেছে। গৌরী তাদেরকে নির্দেশ দিল, তোমরা ওদের জন্যে অপেক্ষা কর। কি হচ্ছে জানাবে আমাকে।
মোবাইলটা জ্যাকেটের পকেটে ফেলে উঠে দাঁড়াল গৌরী। চলল বুকিং কাউন্টারের দিকে। মনে মনে বলল, জানতে চাই কক্ষটিতে থাকে ঐ লোকটি কোন দেশের, কি তার নাম।
খাস ইউরোপীয় চেহারার চুম্বকের মত আকর্ষণকারী অসামান্য এক সুন্দরীকে কাউন্টোরের সামনে দাঁড়াতে দেখে ছুটে এল কাউন্টারের যুবক এ্যাটেনড্যান্ট। বলল, ইয়েস, ওয়েলকাম ম্যাডাম। বলুন কি করতে পারি আপনার জন্যে?
নির্বিকার চেহারায় কোন পরিবর্তন এল না গৌরীর। বলল, একটা রুম চাই। ডবল ডিল্যাক্স ১০১৫ রুমটি কি পাওয়া যাবে? কয়েক বছর আগে এসে ঐ রুমেই ছিলাম।
বুকিং কাউন্টারের যুবকটির মুখটি ম্লান হয়ে গেল।
বলল, ম্যাডাম, রুমটি আগে থেকেই বুকড্। আপনি….।
গৌরী তার মধ্যেই বলে উঠল, ঐ কক্ষে কে আছে?
থেমে গিয়েছিল বুকিং কাউন্টারের যুবকটি। তাড়াতাড়ি রেজিস্টার দেখে বলল, বুকিং আছে ‘আবু আব্দুল্লাহ’-এর নামে।
মুসলমান! স্বগত কণ্ঠে বলল গৌরী। ভ্রু দু’টি তার কুঁচকে গেল। বলল সে, কোন দেশের?
সৌদি আরবের নাগরিক। বলল বুকিং কাউন্টারের যুবক।
সৌদি আরবের! ছবিতে তার যে পোষাক দেখেছি তা তো সৌদি আরবের নয়! অবশ্য সৌদিরা বাইরে গেলে ইনফরমাল ক্ষেত্রগুলোতে পশ্চিমা পোষাকই বেশি পরে! আবার স্বগত কণ্ঠ গৌরীর। একটু অস্বস্তি বোধ করল গৌরী। সৌদিদের প্রচুর টাকা। তারা বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেও থাকে প্রচুর। তাহিতিতে তারা আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল লোকটি তো বোটে মাল্টিওয়েভ মনিটর ব্যবহার করেছে। কোথায় পেল এমন বহুমুখী আলট্রা সেনসেটিভ মনিটর! বোটে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। মাহিন ও মারেভার নয়, তাদের পরিচয়, কাজ, তৎপরতা থেকেই তা পরিষ্কার। তাহলে মনিটর তো সেই সৌদি নাগরিকেরই! তীরের মত সেই সন্দেহ ও হিংস্র ক্রোধ এসে তার মনে প্রবেশ করল।
মোবাইল বেজে উঠল গৌরীর।
এক্সকিউজ মি! বলে গৌরী কাউন্টার থেকে অনেকটা সরে গিয়ে বলল, বল নাশকা, কি খবর?
ম্যাডাম ঘর থেকে বেরিয়ে সেই বিদেশীসহ তিনজন লিফটের দিকে যাচ্ছে। আমরা ফলো করছি। নাশকা বলল।
সেই বিদেশী কে? মানে সেই ছবির বিদেশী কিনা? বলল গৌরী।
ইয়েস ম্যাডাম, হুবহু সেই ছবির লোক। নাশকা বলল।
গুড, তোমরা ওদের ফলো করো। আমি নিচে আছি। বলল গৌরী।
গৌরী গিয়ে বসল কাছের এক সোফায়। ভাবতে লাগল, লোকটি কেমন হবে! তারা আলেয়ার পেছনে ছুটছে না তো! টাকাওয়ালা সৌদিদের বিচিত্র রকম শখ আছে। তারা মাল্টিওয়েভ মনিটর শখবশতও কিনে রাখতে পারে।
এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে গৌরী মনে মনে বলল, ঐসব চিন্তার সময় এখন নয়। তাকে ধরতে হবে, বাজিয়ে দেখতে হবে। তারপর অন্য কথা। তবে সৌদি নাগরিক তো বটে! কোন হৈ চৈ হওয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না। নিরাপদ জায়গায় ফাঁদে আটকিয়ে নিরবে কাজ সারতে হবে।
আবার মোবাইল বেজে উঠল গৌরীর। নাশকার কল।
গৌরী বলল, বল নাশকা।
ম্যাডাম, ওরা তিনজন হোটেলের ২১ তলায় এ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। নাশকা বলল।
এ্যাপেক্স রেস্টুরেন্ট? সে তো সাংঘাতিক কস্টলি! এটা তো প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর মত লোকদের বিনোদনের জায়গা। নানা রকম বিনোদন ও অন্যান্য খরচ তারা খাবার দাম থেকেই তুলে নেয়। প্রতিবারের প্রবেশ ফি’ই তো পাঁচশ মার্কিন ডলার! আবার ভাবল গৌরী, অনেক সৌদি নাগরিকের জন্যে টাকা কোন ফ্যাক্টর নয়।
নাশকা তোমরা বাইরেই অপেক্ষা কর। আমি আসছি। বলল গৌরী।
তারা হোটেলের ২১ তলার এ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। পেছন থেকে নাশকা এসে গৌরীর পেছনে দাঁড়াল।
পেছনে না তাকিয়েই গৌরী বলল, নাশকা, তোমরা বাইরে অপেক্ষা কর, আমি ভেতরে ঢুকছি।
বলেই গৌরী গিয়ে রেস্টুরেন্টের গেটে দাঁড়াল।
গেটের রিসেপশন অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে গৌরীর আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ইয়েস ম্যাডাম, ওয়েলকাম।
গৌরী এগিয়ে গিয়ে গেটের পাশের এ্যাডমিশন কি হোলে একটা এক হাজার ডলারের নোট ছেড়ে দিল। সংগে সংগেই বেরিয়ে এল এ্যাডমিশন কার্ড। ভেতরে ঢুকল গৌরী।
বিশাল বহুভূজাকৃতির হলঘর! নরম আলো। নরম মিষ্টি মিউজিক বাজছে।
হলঘরের প্রতিভূজ বা বাহুতে একাধিক বিশ্রাম কক্ষ আছে।
সব মিলিয়ে হল ঘরে স্বপ্নময় একটা পরিবেশ। গানের কথা ও সুর, আলো-আঁধারির রহস্যময়তা, পোষাক-আশাক সবই অভিজাত প্রকৃতির।
গৌরী হলে প্রবেশ করে চারদিকে চোখ বুলাল। এক সময় তার চোখ গিয়ে স্থির হলো নিরিবিলি জায়গার একটা টেবিলে। টেবিলে তিনজন বসে। দু’জন ছেলে ও একজন মেয়ে। সেই বিদেশি, মাহিন ও মারেভা টেবিলটি ঘিরে বসে আছে। ভীষণ খুশি হলো গৌরী। ওরা এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কাউকে সাক্ষী রেখে ওদের গ্রেফতার করা যাবে না। ছোট-বড় কোন ঝামেলাতেই পড়তে চায় না ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট।
মনে মনে একটা ছক দাঁড় করাল গৌরী। একদম নিরাপদ ছকটি। কিন্তু তার জন্যে দরকার রাতের একটা নিরব প্রহর। তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে অনেকটাই। তার আগে ঐ বিদেশীকে ও সবাইকে একবার বাজিয়ে নেয়া যাক। আঁচ করা যাবে বিদেশী সম্পর্কে। এগোলো গৌরী টেবিলের দিকে।
দাঁড়াল টেবিলের শূন্য আসনটির পেছনে। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, আমি শূন্য আসনটায় বসতে পারি। মাফ করবেন, আপনাকে এশিয়ান দেখে কথা বলার লোভে এলাম।
আহমদ মুসা তাকাল গৌরীর দিকে। দীর্ঘাঙ্গী, একহারা অপরূপ সুন্দরী এক ইউরোপীয় যুবতী। তার দেহ থেকে শক্তি ও সুস্থতা যেন ঠিকরে পড়ছে! অত্যন্ত বিরল এ ধরনের সুঠাম দেহ। চোখ দু’টিতে তার হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আছে, তবে চোখ দু’টি তার স্বচ্ছ নয়। দুই বৈপরীত্য যেন এ মুহূর্তে তার মধ্যে সক্রিয়!
আপনি তো ইউরোপীয়, এশীয়দের প্রতি এ পক্ষপাতিত্ব কেন? বলল আহমদ মুসা।
হাসল গৌরী। বলল, এশিয়া হলো ‘মাদার অব আর্থ’। তাকে সত্যি আমি ভালবাসি। ভালবাসি বলে অনেক পড়াশোনা করেছি এশিয়ার উপর। তাই কিছু পক্ষপাতিত্ব হতে পারে।
আহমদ মুসা তাকিয়ে ছিল গৌরীর দিকে। কথাগুলো শুনতে ভালই লাগল। কিন্তু মনে হলো আহমদ মুসার কথাগুলোর গোড়ায় যেন কোন শিকড় নেই!
বলল আহমদ মুসা, প্লিজ বসুন মি….।
মিস গৌরী। আমার নাম গৌরী মি…। গৌরী বলল।
গৌরী’ নামটি শোনার সংগে সংগেই শক পাওয়ার মত বিদ্যুত খেলে গেল আহমদ মুসার গোটা দেহে। তার স্মৃতির আঙিনায় আছড়ে পড়ল একটা নাম ও আরও কিছু কথা। গৌরী তো গ্যালাকটিক সাম্রাজ্যের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার অভিলাষী সন্ত্রাসী শক্তি ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এক সময়ের সর্বোচ্চ শাসক প্রিন্স জিজরের পার্সোনাল সিকউরিটি ও কমান্ডার ছিল! আর এখনকার গোপন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট যেমন ওদের দলের নাম হুবহু নিয়েছে, তেমনি সেই সময়ের নেতা-নেত্রীদের নামও এরা গ্রহণ করেছে। তাহলে এই গৌরী আজকের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কেউ! না, এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা। এশিয়ায়, বিশেষ করে হিমালয় সংলগ্ন উপমহাদেশের হিন্দু সমাজে গৌরী একটা বহুল প্রচলিত নাম। কিন্তু এই গৌরী তো ভারতের নয়, এশিয়ার নয়, হিন্দু সমাজেরও নয়। তাহলে?
প্রশ্নটা ভেতরে রেখেই আহমদ মুসা নিজের নামটা বলল। বলল, আমার নাম আবু আব্দুল্লাহ!
গৌরী ‘আবু আব্দুল্লাহ’ নামটা আগেই শুনেছে বুকিং কাউন্টার থেকে, কিন্তু প্রকাশ করতে চায়নি ধরা পড়ার ভয়ে।
গৌরী হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা হাত না বাড়িয়ে বলল, স্যরি, মিস গৌরী। আমাদের ধর্মে এ ধরনের হ্যান্ডশেক নিষিদ্ধ। প্লিজ বসুন।
গৌরী মারেভা ও মাহিনের সাথে হ্যান্ডশেক করে বসতে বসতে বলল, আপনাদের ধর্ম নিয়ে এটাই সমস্যা মি. আবু আব্দুল্লাহ, আপনারা মেয়েদের ছোট করে দেখেন।
হ্যান্ডশেক না করাটা মেয়েদের ছোট করে দেখার কারণে নয়। মুসলিম মেয়েরাও ছেলেদের সাথে হ্যান্ডশেক করে না, এটা তেমনি ছেলেদের ছোট করে দেখার কারণে নয়। আসলে এর পেছনে রয়েছে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলাজনিত কারণ। বলল আহমদ মুসা।
সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলাজনিত কারণ!
হ্যাঁ, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলাজনিত কারণ।
কি সেটা? ভ্রূ কুঁচকে বলল মিস গৌরী।
বিষয়টা মানুষের মনস্তত্ত্ব ও প্রবণতার সাথে জড়িত মিস গৌরী। অনেক কথা বলতে হয় বিষয়টা পরিষ্কার করতে হলে। সংক্ষেপে কথাটা হলো, স্বামী-স্ত্রী ও ভাই-বোন, মামা-ভাগ্নি’র মত পারিবারিক অতি ঘনিষ্ঠ জন (যাদের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ) ছাড়া অন্য ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা নিষেধ করেছে আমাদের ধর্ম। মেয়েদের নিরাপত্তা ও সমাজকে একটা বড় সমস্যা থেকে মুক্ত রাখার জন্যে। আহমদ মুসা বলল।
কিসের নিরাপত্তা, কেমন নিরাপত্তা? সামাজিক বড় সমস্যাটি কি? বলল গৌরী।
নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। উভয়ে মিলে আসে মানবীয় পূর্ণতা। সেজন্যে দু’জনের মধ্যে রয়েছে একে অপরের প্রতি এক দুর্লংঘ প্রাকৃতিক আকর্ষণ। এই আকর্ষণকে আইন ও শৃঙ্খলার মধ্যে এনে পিতা-মাতা, ছেলে-সন্তানের এক পরিবার সৃষ্টি করা হয়েছে। সুশৃঙ্খল পরিবার সুশৃঙ্খল সমাজের রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। অবাধ মেলামেশা-সৃষ্ট অনাচার পরিবারে বিপর্যয় আনে, শান্তি-শৃঙ্খলায় কুঠারাঘাত করে। পরিবারের এই বিপর্যয় সমাজ শৃঙ্খলা ও শান্তিকেও বিনষ্ট করে। আহমদ মুসা একটু থামল।
আবার শুরু করার আগেই গৌরী দ্রুত বলল, আর নিরাপত্তা বিষয়টা?
অপেক্ষাকৃত সবলের হাত থেকে দুর্বলের নিরাপত্তা। মেয়েরা সাধারণভাবে রক্ষণাত্মক, অন্যদিকে ছেলেরা অ্যাগ্রেসিভ ও আক্রমণাত্মক। নিরাপত্তা বলতে আমি বুঝিয়েছি ছেলেদের অনিয়ন্ত্রিত ও আক্রমণাত্মক ইচ্ছার কবল থেকে মেয়েদের নিরাপত্তার কথা। আহমদ মুসা বলল।
আপনি যেদিকে ইংগিত করেছেন, সেটা তো ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপার। ব্যক্তিগত পর্যায়েই তা রেখে দেয়া উচিত। এটা সমাজের ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত নয়। তেমনি সমাজও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবার কথা নয়। বলল গৌরী।
ব্যক্তির কাজ যখন অপরাধ হিসাবে সংঘটিত হয়, তখন তা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপার থাকে না। পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পবিত্র সম্পর্কের বিষয়টি অবাধ মেলামেশার কারণে অপরাধ হিসাবে, অপরাধের মহামারি হিসাবে সংঘটিত হচ্ছে। পৃথিবীর দেশগুলো, বিশেষ করে অবাধ মেলামেশার দেশের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখুন, সেখানে নারীরা অপরাধের শিকার হওয়া, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা ও ভঙ্গুরতা, নারীকেন্দ্রিক অপরাধ বিকৃতি ও তজ্জনিত মানসিক বিকৃতি ও অসুস্থাবস্থা কেমন বাড়ছে। আহমদ মুসা বলল।
গৌরীর মুখে একটা ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল।
তার মনের এক অতল তল থেকে কে যেন তাকে বলল, গৌরী, তুমি কি নিজেই শক্তিমানের অনাচারের শিকার নও! তোমার কি পরিবার আছে, ঘর আছে! চমকে ওঠে সে। কিন্তু পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল গৌরী। বলল গম্ভীর কণ্ঠে, এসব অপরাধের পেছনে অনেক কার্যকারণ আছে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, স্যরি মিস গৌরী। যে কার্যকারণই থাক, এ কথা ঠিক যে, অবাধ মেলামেশার কারণে সুযোগ সহজলভ্য হওয়ায় নারীর উপর পুরুষের অনাচার বাড়ছে। সুতরাং তাদের নিরাপদ করতে হলে অবাধ মেলামেশা বন্ধ করে সুযোগের সহজলভ্যতা দূর করতে হবে।
কিন্তু বলুন, আমার সাথে হ্যান্ডশেকের ক্ষেত্রে কি সুযোগের সহজলভ্যতা দূর করার প্রশ্ন আসতে পারে? বলল গৌরী।
অপরাধ দমনে পুলিশী পাহারার ব্যবস্থা একটা আইন। অপরাধ যেখানে সংঘটিত হচ্ছে সেখানেও পুলিশ পাহারা থাকে, আবার অপরাধ যেখানে হচ্ছে না সেখানেও পুলিশ পাহারা থাকে। আমি এই নীতিগত কারণেই আপনার সাথে হ্যান্ডশেক করিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি তো সাংঘাতিক মৌলবাদী! আপনি কি করেন?’
‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াই।’ গৌরীকে পরখ করার জন্যেই আহমদ মুসা ইচ্ছা করে এমন ইংগিতমূলক কথা বলল।
‘তার মানে আপনি মানুষের সেবা করে বেড়ান। তা কি ধরনের সেবা?’ বলল গৌরী। সেও চাইল আহমদ মুসা সম্পর্কে তাদের সন্দেহকে নিশ্চিত করতে।
‘ধরুন, মানুষ অভাবে পড়লে দেখা, কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে দাঁড়ানো-এই আর কি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহিতিতে আপনার কাজ? কোন মিশন এখানে?’ বলল গৌরী। তার চোখে-মুখে হাসি থাকলেও তার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠা আহমদ মুসার দৃষ্টি এড়াল না।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তাহিতিতে মানুষ কোন কাজ নিয়ে আসে না। আসে সব কাজ ছেড়ে-ছুঁড়ে তাহিতেকে দেখতে।’ আহমদ মুসা প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেল। আর এগোতে চাইল না প্রসঙ্গটি নিয়ে। গৌরীর টার্গেট তার বুঝা হয়ে গেছে।
‘আপনি কি মতুতুংগা দ্বীপপুঞ্জের অ্যাটলগুলোতে গেছেন? অ্যাটলের রাজ্য না দেখলে তাহিতি দেখা হয় না।’ বলল গৌরী।
‘গেছি অ্যাটল দেখতে। আপনি ঠিকই বলেছেন। অপরূপ সুন্দর অ্যাটলের এ রাজ্য!’ আহমদ মুসা বলল।
‘জনবিরল অ্যাটল দ্বীপমালা শান্তির রাজ্যও বটে। ওখানে আপনি দেখবেন না কোন হিংসা-বিদ্বেষ, শুনবেন না কোন আর্তের আর্তনাদ। এ বিষয়টা আপনি কতটা লক্ষ্য করেছেন?’ বলল গৌরী।
মুখে হাসি ফুটল আহমদ মুসার। কিন্তু ভেতরে তার অন্য চাঞ্চল্য। গৌরীর প্রশ্নে লক্ষ্য সে পরিষ্কারভাবেই বুঝেছে। গৌরী চাচ্ছে অ্যাটলে যে ৭৬ জন বিজ্ঞানী বিপদগ্রস্থ, সেটা আহমদ মুসা জানে কিনা, এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। এর অর্থ বিজ্ঞানীরা যে ‘এসওএস’ পাঠিয়েছে সেটা ধরা পড়ে গেছে। এখন ওরা সন্ধান করছে এসওএস কে বা কারা পেয়েছে। এ সন্ধানেই গৌরী তার কাছে এসেছে। তার মানে ওরা জেনে ফেলেছে, যখন SOS পাঠানো হয়, তখন আহমদ মুসাদের বোট তাহানিয়া অ্যাটলে ছিল। তা কি করে জানল ওরা? তাহলে কি পাহারা দেবার মত কোন গোপন পর্যবেক্ষণ টেকনলজি ওদের আছে!
এসব চিন্তায় একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। উত্তর দিতে একটু দেরী হলো।
গৌরীর দুই চোখের সমস্ত মনোযোগ তখন কিন্তু আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ।
একটু হাসল আহমদ মুসা। ‘ভাবছিলাম মিস গৌরী, আপনার আবেগপূর্ণ প্রশ্ন সম্পর্কে। তোয়ামতু অ্যাটল রাজ্যের সবটা আমি এখনও দেখিনি। তবে সুন্দর ও শান্তি কিন্তু এক জিনিস নয়। শান্তি থাকলে অসুন্দরও সুন্দর হয়ে উঠে, শুধু ‘সুন্দর’ কিন্তু শান্তি নিশ্চিত করে না।’ আহমদ মুসা বলল।
গৌরীর চোখে এক ধরনের আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে নিশ্চিত ধরে নিল, আহমদ মুসা অ্যাটল রাজ্যে অশান্তি আছে এ কথাই বলছে। আর এর দ্বারা SOS মেসেজ পাওয়াটাকেই নিশ্চিত করল। মনের এ কথাগুলোকে লুকিয়ে রেখে গৌরী হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘আপনার জবাবটা সাংঘাতিক মি. আবু আবদুল্লাহ! আপনি দার্শনিকের মত উত্তর দিয়েছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।’
বলতে বলতে গৌরী উঠে দাঁড়িয়েছে। শেষে বলল, ‘আমি চলি মি. আব্দুল্লাহ। খুশি হলাম আপনার সাথে কথা বলে। ধন্যবাদ সবাইকে।’
অন্য টেবিলের দিকে চলে গেল গৌরী।
গৌরী চলে যেতেই মারেভা বলল, ‘মেয়েটি কি করে তাতো বলল না। আমার মনে হচ্ছে সামরিক বাহিনীর মেয়ে। শরীরটা তার ঐ ধরনের তৈরি। কথাবার্তা ওদের মতই চটপটে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, সেনাবাহিনীর লোক হলে তো এমন অযাচিতভাবে কথা বলতে আসার কথা নয়!’
‘তুমি ঠিকই বলেছ মারেভা। উনি সেনাবাহিনীর লোক নন। আমি যাদের সন্ধান করছি, তিনি তাদের একজন।’ আহমদ মুসা বলল।
মারেভা ও মাহিন দু’জনেই চমকে উঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কিন্তু ওরা আপনাকে জানল কি করে স্যার?’
‘সম্ভবত সেই ‘এসওএস’ মেসেজ ধরা পড়েছে। আমাদের বোটে যে মেসেজ মনিটর হয়েছে সেটা। মনে হচ্ছে, বোটের ক্লু ধরেই তারা এ পর্যন্ত পৌঁছেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সর্বনাশ। কিন্তু মতলব কি ওদের স্যার?’ বলল মাহিন।
‘আমি সেটাই ভাবছি। তারা কি চায়, কি করতে চায়, এটা আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ওরা বড় কোন টার্গেট ছাড়া কিছু করে না।’ আহমদ মুসা বলল।
ভয়ের ছায়া নামল মারেভা ও মাহিনের চোখে-মুখে। বলল, ‘তাহলে আপনার মানে আমাদের সকলের সাবধান হওয়া প্রয়োজন।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এখনও সব কিছু স্পষ্ট নয়। তবে সাবধানতা সব সময়ই ভাল।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়াল মারেভা ও মাহিনও।
‘বিল তো এল না স্যার?’ বলল মাহিন।
‘এনট্রান্স ফি’র সাথে ভেতরের সবকিছুই ইনক্লুডেড মারেভা।’ আহমদ মুসা বলল।
হোটেলের লাউঞ্জে নেমে এল আহমদ মুসারা।
‘স্যার, আমরা আসি।’
‘না, আমি তোমাদের পৌঁছে দেব মাহিন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তেপাওকে ট্যাক্সি নিয়ে আসতে বলেছি। সে এসে গেছে।
চল।’ বলেই আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল।
মারেভা ও মাহিনও তার সাথে হাঁটতে শুরু করল।
ট্যাক্সির কাছাকাছি এসে একবার পেছনে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘মারেভা-মাহিন, তোমাদের বিয়ের তারিখ কবে ঠিক হলো?’
মারেভা-মাহিন দু’জনেরই মুখ লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল। বলল মাহিন, ‘আসছে শুক্রবার, স্যার।‘
‘ধন্যবাদ। বিয়ে ছাড়া তোমাদের এভাবে চলা আর উচিত নয়।’
মারেভা ও মাহিন মুখ নত করল।
সবাই এগোলো আবার গাড়ির দিকে।
৩
রাত সাড়ে দশটা।
আহমদ মুসা মারেভা ও মাহিনদের পৌঁছে দিয়ে হোটেলে ফিরছিল।
তেপাও-এর ট্যাক্সি হাইওয়ে থেকে উত্তর দিকে হোটেলের পথে নেবার পর রাস্তা একেবারে শুনশান। দু’একটা গাড়ি আসতে-যেতে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু উপকূলের লেকপাড়ের হোটেল ডায়মন্ড ড্রপ নিকটবর্তী হওয়ার পর রাস্তা একেবারেই নিরব হয়ে গেল।
ঢালু পথে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে নামছিল আহমদ মুসার গাড়ি। সামনেই ছোট একটা বাঁক। বাঁকের রাস্তাটুকু সমান, ঢালু নয়। তারপর আবার শুরু হয়েছে ঢালু রাস্তা। আহমদ মুসার গাড়ি বাঁক নেবার সময় গাড়ির গতি প্রায় ‘জিরো’তে নেমে এসেছিল।
আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তার পাশে সম্প্রতি তৈরি এই রাস্তার স্পার্ক স্তম্ভের দিকে তাকাতে যাচ্ছিল, এমন সময় চমকে উঠল হঠাৎ চোখের সামনে দিয়ে মার্বেল টাইপের সাদা একটা বস্তু গাড়ির ভেতরে ছুটে যেতে দেখে।
মুহূর্তেই সক্রিয় হয়ে উঠল আহমদ মুসার মাথা। বোমা কিংবা এই ধরনের কোন বস্তু হবে। গাড়ি থেকে বেরুবার সময় ছিল না। শ্বাস বন্ধ করে সে গাড়ির সিটে নিজের দেহটাকে ছেড়ে দিল।
পল পল করে সময় বয়ে যেতে লাগল।
না, কোন বিস্ফোরণ ঘটল না। তার মানে ওটা বোমা নয়, কোন ধরনের গ্যাস বোমা। শ্বাস বন্ধ রাখার দিকে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা।
খোলা ছিল আহমদ মুসার চোখ। দেখল, একই সাথে গাড়ির দু’পাশের দরজা খুলে গেল। তার সাথে সাথেই হ্যান্ড মেশিনগানের দুই নল দুই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল এবং গ্যাস-মাস্ক পরা দুই মুখ।
‘ব্যাটা এশিয়ান কুপোকাত! জ্ঞান হারিয়েছে সে।’ বলল দু’জনের একজন।
তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ভেতরে ঢুকে আহমদ মুসাকে দু’পা ধরে টেনে বের করল গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসা গোটা ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। তাকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। পাল্টা আক্রমণের সুযোগ এখন নেই। সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা, এখন সে সংজ্ঞাহীনের ভান করবে। আর একটা বিষয় ভাবল, এদের হাতে পড়লে এদের জানারও একটা সুযোগ হবে। এখন পর্যন্ত চেষ্টা করেও ওদের হেড কোয়ার্টার ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’-এর সন্ধান সে পায়নি। এর ফলে তার সন্ধান পাওয়ারও একটা পথ হতে পারে।
আহমদ মুসাকে গাড়ি থেকে বের করতেই একটা নারী কন্ঠ বলল, ‘ওকে হাত-পা বেঁধে গাড়িতে তোল’।
কন্ঠটি গৌরীর। কথা শুনেই বুঝতে পারল আহমদ মুসা। খুশি হলো আহমদ মুসা, তার সন্দেহ সঠিক হয়েছে। নিশ্চয় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে গৌরী।
একজন বলল, ‘ম্যাডাম, এ এশিয়ান তো সংজ্ঞাহীন, তারপরও বাঁধতে হবে?’
‘কখন জ্ঞান ফিরে পাবে, তোমরা বলতে পার না। সুতরাং কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তাকে বেঁধে ফেল।’
‘শোন, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কোন আইন তোমরা ভাঙবে না।’ বলল গৌরী।
আড়াল থেকে একটা মাইক্রো বেরিয়ে এসেছে। মাইক্রোতে ওঠানো হলো সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে। তার পাশেই উঠল গৌরী। পেছনে আর চারজন। ড্রাইভারের পাশে একজন।
গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই ড্রাইভিং সিটের লোকটি বলল, ‘উপকূলে যাচ্ছি ম্যাডাম।’
‘না, উইরো। এক ‘মতু’তে নেয়া হচ্ছে না। একে দক্ষিণ পাপেতির ঘাঁটিতে নিয়ে চল। একে প্রথম বাজিয়ে দেখতে হবে এ কি জানে, কতটা জানে? তারপর যে সিদ্ধান্ত হয় করা হবে।’ বলল গৌরী।
আহমদ মুসার কানে সব কথাই গেল। তাকে ‘মতু’তে নেয়া হচ্ছে না। তবে বুঝা গেল ‘মতু’ সাগরের মাঝের কোন দ্বীপ হবে। পলিনেশীয় ভাষায় ‘মতু’ মানে দ্বীপ। এই ‘মতু’টা আবার কোথায়? ‘মতু’কি সেই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ না ‘মতু’ বলতে সাধারণভাবে দ্বীপ বুঝানো হয়েছে?
চলতে শুরু করেছে গাড়ি। প্রথমে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে মূল শহরে পৌঁছে দক্ষিণের কোন পথে যেতে হবে দক্ষিণ পাপেতিতে।
ছুটে চলছে গৌরীর গাড়ি।
আহমদ মুসা তখনও ‘মতু’ নিয়ে তার হিসাব-নিকাশ কষেই চলেছে।
পাশেই গৌরীর মোবাইল সিগন্যাল দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসা উৎকর্ণ হলো।
গৌরী তার জ্যাকেটের পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে অন করে চোখ বুলালো স্ক্রীনে। স্ক্রীনে মেসেজটি পড়েই দুই চোখ ছানা-বড়া হয়ে গেল গৌরীর। দ্রুত সে গ্যালারি ওপেন করল। সদ্য প্রেরিত ছবিটা সে দেখল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ঠিক এটাই আবু আহমদ আব্দুল্লাহর ছবি, কোন ভূল নেই তাতে। তাহলে এটাই সেই আহমদ মুসা! গোটা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত খেলে গেল গৌরীর। সেই দুর্ধর্ষ আহমদ মুসা যার মূল্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার! সে এখানে এই তাহিতিতে! কোন মিশনে! দুশ্চিন্তার একটা কালো মেঘ উঁকি দিল গৌরীর মনে। আহমদ মুসার ইতিহাস সে জানে। সে এখনো অজেয়। তার বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি এখনও কেউ। একটা বিমূঢ়তা নেমে এল গৌরীর মনে, অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুনোর মত। কিন্তু পরক্ষণেই বুক ভরে এক প্রবল যন্ত্রণা জেগে উঠল। যন্ত্রণা শীঘ্রই প্রতিহিংসার আগুনে পরিণত হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সে আগুন। আহমদ মুসা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মুখোমুখি হয়নি কখনও। কিন্তু ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের বহু বন্ধু ও মিত্র সংগঠনের সর্বনাশ করেছে সে। সে এখন তাদের হাতের মুঠোয়। সে চিৎকার করে উঠল, ‘সকলে সাবধান, আমরা মশা ভেবে কিন্তু হাতিকে খাঁচায় ভরেছি।’
সামনের সিট থেকে গৌরীর অপারেশন সহকারী সিনথ্রোস চমকে উঠে পেছনে তাকাল এবং বলল, ‘ম্যাডাম, কিছু খবর পেলেন? হাতিটি তাহলে কে?’
‘হ্যাঁ সিনথ্রোস, যাকে আমরা খুব সহজে বন্দী করেছি, সে আজকে সবচেয়ে ওয়ানটেড ও সবচেয়ে বড় শয়তান আহমদ মুসা!’
‘ও গড!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল সিনথ্রোস।
তার সাথে সাথে ফোন বেজে উঠল গৌরীর।
গৌরী মোবাইলের স্ক্রীনে একবার তাকিয়েই তটস্থভাবে মোবাইলটি মুখের কাছে নিয়ে এসে বলল, ‘ইয়েস মাই লর্ড!’
‘এসএমএস ও ফটো দেখেছ?’
মোবাইল ফোনের ওপার থেকে বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘ইয়েস মাই লর্ড!’ গৌরী বলল।
‘তোমার ও তোমার টিমকে ধন্যবাদ, অসাধারণ এক শিকারকে তোমরা জালে আটকিয়েছ। আমাদের অনেক উপকারে আসবে।‘ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘কিভাবে মাই লর্ড? সে তো বিপজ্জনক!’ গৌরী বলল।
‘সবচেয়ে বিপজ্জনক বলেই তো সবচেয়ে বেশি মূল্য আমরা পাচ্ছি।’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘বেশি মূল্য মানে মাই লর্ড?’ বলল গৌরী।
‘হ্যাঁ, ওর লাশ বিক্রি করেছি আমরা ১ বিলিয়ন ডলারে।’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘কিন্তু মাই লর্ড, এই অবিশ্বাস্য মূল্য দিয়ে কারা নেবে ওকে? আর লাশ বলছেন কেন?’ গৌরী বলল।
‘লাশ এজন্যে বলছি সে, একে কখনো আটকে রাখা যায় না বা আটকে রাখা যায়নি কখনো। তাই জীবন্ত বিক্রি করার ঝুঁকি নিতে চাই না। ক্রেতারাও নিশ্চিত হতে চায় যে, সে মরেছে। আর তখনই আমাদেরকে ঐ মূল্যটা দেবে?’
‘ওটা ওকে মারার মূল্য। এমন মূল্য বহুবার ঘোষনা করেও তাকে তারা মারতে পারেনি।’
মুহূর্তের জন্যে থামল। থেমেই আবার বলল, ‘আমরাও তাকে আটকে রাখার ঝুঁকি নিতে চাই না। আর একটি কথা, তার মত বিপজ্জনক লোককে আমাদের রাজধানী ‘মতু’তে নিয়ে আসতে পারি না। আর সে শেষ হয়ে গেলে আমাদের ‘মতু’ থেকে প্রেরিত SOS –এর বিপজ্জনক একজন প্রত্যক্ষ শ্রোতাও শেষ হয়ে যায়। আর দু’জন প্রত্যক্ষ শ্রোতা থাকল। ওদেরকেও বাঁচিয়ে রাখা হবে না। এখন তোমরা তাকে হত্যা করে লাশ নিয়ে এস।’
‘তাকে তাহলে ঘাঁটিতে নেবার তো প্রয়োজন নেই মাই লর্ড।’ গৌরী বলল।
‘না। তাকে শেষ করে দিয়ে তোমরা লেক টাওনায় ফিরে যাও। ওখানকার প্রাইভেট জেটিতে আমাদের উভচর ফেরি যাচ্ছে। ভয় নেই, প্রাইভেট জেটিটি এখন জনমানবশুন্য।’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘মাই লর্ড, শেষ কাজটা কোন ধরনের হবে সে ব্যাপারে আপনার কোন নির্দেশ আছে?’ গৌরী বলল।
লাশটা অনেক দূরে যাবে। কোন রক্তপাত যেন না হয়, দৃশ্যমান কোনও আঘাতও যেন না থাকে!’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘ইয়েস মাই লর্ড, বুঝেছি। এটাই হবে।’ গৌরী বলল।
‘ধন্যবাদ।’ বলে ওপার থেকে কল অফ করে দিল আলেক্সি গ্যারিন।
মোবাইল জ্যাকেটের পকেটে রেখে গৌরী ড্রাইভারকে লক্ষ করে বলল, ‘উইরো, গাড়িটা আবার ঘুরিয়ে সেই লেক টাওনার দিকে নিয়ে চল।’
গাড়ি থেমে গেল।
গাড়ি তখন এক পাহাড়ি পথ দিয়ে চলছিল। রাস্তা ও চারদিকটা জনমানবশুন্য।
‘সিনথ্রোস, কিছু বুঝেছ?’ গৌরী বলল।
‘ইয়েস ম্যাডাম, আপনার কথা তো কানে এসেছে। মাই লর্ডেরও কিছু কথা কানে এসেছে। বুঝেছি, এই এশিয়ানকে এখন মেরে তার লাশ নিয়ে যাবার নির্দেশ হয়েছে।’ বলল সিনথ্রোস।
‘আরও একটা সুখবর আছে সিনথ্রোস, লাশটা বিক্রি হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারে!’ গৌরী বলল।
‘ও মাই গড!লাশের মূল্যের ক্ষেত্রে এটাই বোধ হয় বিশ্বরেকর্ড! তাদের ধন্যবাদ।’ বলল সিনথ্রোস।
‘ধন্যবাদ! আর ধন্যবাদ এজন্যে যে, সেই কাজটা তোমাকেই করতে হবে। আমি তোমার সিটে যাচ্ছি। তুমি এখানে এস। রক্ত ঝরবে না, লাশের গায়ে দাগও পড়বে না, এমন একটি লাশ বানাবার কাজ তোমাকে করতে হবে।’ গৌরী বলল।
বলে গৌরী নেমে এল গাড়ি থেকে।
ওদিক থেকে সিনথ্রোসও নামল।
সিনথ্রোস পেছনের সিটে আসার সময় ড্যাশবোর্ড থেকে একটা কুশন সংগ্রহ করল।
গৌরী সেদিকে তাকিয়ে হাসতে গিয়ে মনের কোথায় যেন একটা খোঁচা খেল। হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, হোটেল লা ডায়মন্ড ড্রপ-এর এ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে আহমুদ মুসার সাথে সাক্ষাতের দৃশ্যগুলো, মনে পড়ল হ্যান্ডশেক প্রসঙ্গ নিয়ে বলা তার কথাগুলো। সাংঘাতিক নীতিবাগীশ ও আদর্শবাদী লোক সে। দৃষ্টিভংগিটাও খুব মানবিক। এ ধরনের লোকরা ক্রিমিনাল হতে পারে না। আহমদ মুসা সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে। তাতে মৌলবাদী এক হিংস্র লোক মনে হয়েছে তাকে। কূটবুদ্ধির চালে মানুষ মারাই হচ্ছে তার কাজ। কিন্তু তার সাথে কথা বলার পর তার ধারণাটা একেবারেই উল্টে গেছে। ভাল মানুষ এবং সুস্থ ও শান্তির সমাজ সে চায়। ঈশ্বর বোধ হয় এজন্যেই সব সময় তাকে সাহায্য করে থাকে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার নিজের কথা মনে হলো, মুক্ত সমাজ ও বাধা-বন্ধনহীন জীবন তাকে কি দিয়েছে। পাখির মত মানুষ মেরেছি, কিডন্যাপের পর কিডন্যাপ করেছি, কিন্তু কি পেয়েছি? পরিবার নেই, আত্মীয়-স্বজনকে ভুলে গেছি। বিধাতার দেয়া সুন্দর দেহকেও আমি রক্ষা করতে পারিনি, পশুদের তা যথেচ্ছ ভোগের শিকার। এ বিষয়ে তার বোধই ছিল না, জীবনের নগদ উপভোগ নিয়ে সে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু আহমদ মুসা তার চোখ খুলে দিয়েছে। এখন জীবনটা তার কাছে উন্মুক্ত একটা পৃষ্ঠার মত হয়ে গেছে। কিন্তু অনেক কাহিনী, অনেক বিজয়ের নায়ক, অপরাজেয় বলে অভিহিত আহমদ মুসা আজ পরাজিত, তার জীবন সাঙ্গ হতে আর কয়েক মুহূর্ত বাকি! কথাগুলোকে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কিন্তু অবিশ্বাস করার সুযোগ নেই। আহমদ মুসার সংজ্ঞাহীন দেহ সিটের উপর পড়ে আছে। সিনথ্রোসের হাতে দেখছি বর্গাকৃতির ছোট কুশন। ঐ কুশনটি আহমদ মুসার নাকে-মুখে চেপে বসার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কি ঘটবে তা পরিষ্কার। রক্ত ঝরবে না, কোথাও দাগও পড়বে না, কিন্তু প্রাণ থাকবে না দেহে। ভাবতে মনে সেই খোঁচাটা লাগল আবার। কোন মৃত্যু তার মনকে এমন চঞ্চল আর করেনি কখনও।
সিনথ্রোস গাড়িতে উঠে আহমদ মুসার মাথার কাছে বসল।
গৌরীও সামনের সিটে উঠে বসল।
আহমদ মুসা গৌরীর টেলিফোনে কথোপকথন থেকে শুরু করে সব কথাই শুনেছে। তার লাশ এক বিলিয়ন ডলারে বিক্রি হচ্ছে, এটাও সে শুনল। মনে মনে হেসেছে আহমদ মুসা। মাথার কাছ থেকে গৌরী নেমে গেলে আহমদ মুসা হাতের বাঁধনটা পরীক্ষা করল। বাঁধনটা সরল। সম্ভবত সংজ্ঞাহীন মানুষকে এর চেয়ে কড়া বাঁধনের প্রয়োজন তারা অনুভব করেনি। দাঁত দিয়ে আহমদ মুসা হাতের বাঁধন ঢিলা করে দিল যাতে পরে সহজেই খুলে ফেলা যায়। তারপর অতি সন্তর্পণে পা এগিয়ে এনে এক হাত দিয়ে পায়ের বাঁধনও খুলে ফেলল, তবে বাঁধনের বাইরের খোলসটা থাকল।
গাড়িতে উঠে সিনথ্রোস প্রথমেই নজর বুলাল আহমদ মুসার দিকে। সিটের উপর গা এলিয়ে মরার মত পড়ে আছে। হাতও পায়ের বাঁধনও তার চোখে পড়ল।
‘ম্যাডাম, আহমদ মুসার হাত-পায়ের বাঁধন কি থাকবে?’ গৌরীকে লক্ষ করে বলল সিনথ্রোস।
‘তুমি মরে করলে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিত পার। বলির পশুকেও তো মুক্ত রেখেই বলি দেয়া হয়।’
‘আমিও সেটাই ভাবছি ম্যাডাম।’
বলে সিনথ্রোস আহমদ মুসার হাতের বাঁধনের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা বুঝল আমার হাতের বাঁধন যে খোলা তা সে এখনি টের পেয়ে যাবে। তখন সঙ্গে সঙ্গেই সিনথ্রোস আক্রমণে আসবে।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, তাকে আগে আক্রমণে যেতে হবে।
ভাবনার সাথে সাথে আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুৎ বেগে উঠে গিয়ে মাথার পেছনে ঘাড়ের সাথে লাগোয়া জ্যাকেটের গোপন পকেট থেকে রিভলবার নিয়ে সিনথ্রোসের বুকের একপাশে গুলি করল।
সিনথ্রোসের চোখে ধরা পড়েছিল আহমদ মুসার ডান হাত ছুটে যাওয়ার দৃশ্য। কিন্তু তা বুঝে ওঠার পর সিটের উপর থেকে রিভলবার তুলে নিয়ে প্রস্তুত হবার আগেই সে গুলি খেল।
আহমদ মুসা গুলি করেই বাম হাত দিয়ে সিটের উপর পড়ে থাকা সিনথ্রোসের রিভলবার তুলে নিয়ে একই সাথে ডান হাত দিয়ে গৌরীর লক্ষ্যে এবং বাম হাত দিয়ে পেছনের লোকদের দিকে গুলি ছুঁড়তে লাগল।
গৌরীর রিভলবার ধরা হাত গুলিবিদ্ধ হলো। ছিটকে পড়লো তার হাত থেকে রিভলবার।
অন্য দিকে পেছনের সিটের লোকরা প্রথমে বুঝতেই পারেনি কি ঘটেছে। রিভলবার নিয়ে আহমদ মুসাকে দাঁড়াতে দেখে তবেই বুঝতে পারল আহমদ মুসা নয়, তাদের সিনথ্রোসই গুলি খেয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে তারা আহমদ মুসার রিভলবারের টার্গেট হয়ে গেছে। তারা কেউ অস্ত্র তোলারও সুযোগ পেল না। গুলিবিদ্ধ হয়ে যেখানে বসেছিল সেখানেই ঢলে পড়ল।
গৌরীর ডান হাত গুলিবিদ্ধ হবার পর বাম হাত দিয়ে সে তার রিভলবার তুলতে যাচ্ছিল।
‘রিভলবার তুলবেন না মিস গৌরী। সে চেষ্টা করলে আমি গুলি চালাতে বাধ্য হবো। দেখছেন তো, আমার কোন গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।’ বলল আহমদ মুসা।
গৌরী রিভলবার তুলে নেয়ার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অন্যদের মত আমাকে গুলি না করে সাবধান করছেন কেন?’
‘দুই কারনে, এক, আপনি আহত, দুই, আপনি মহিলা। তাছাড়া আপনি এশিয়ানদের ভালবাসেন।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা একটু এগিয়ে গৌরীর রিভলবার তুলে নিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। বলল, ‘ড্রাইভিং সিটের লোকটি নিশ্চয় বাইরে গিয়ে পজিশন নিয়েছে?’
বলে আহমদ মুসা রিভলবার ধরা বাম হাত জানালায় ঠেস দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাথা সরিয়ে নিল।
তখনই এক ঝাঁক গুলির কিছু জানালার বাইরে দিয়ে শূন্যে উড়ে গেল আর কিছু জানালায় আঘাত করল। আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে মাথা সরিয়ে নিতে না পারলে তার মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
আহমদ মুসা লোকটিকে দেখেছে। দরজার একটু পেছনেই সে বসে আছে। তার হাতে ধরা স্টেনগানের ব্যারেল ভয়ংকর। স্টেনগান উদ্যত করে সে বসে আছে।
গুলি তার থেমে গেল হঠাৎ।
সে কি পজিশন চেঞ্জ করল? আহমদ মুসা নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল।
ড্রাইভিং সিটের লোকটি দরজা খোলা রেখেই নেমে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা লোকটিকে যেখানে দেখেছিল সেদিকে বাম হাতের রিভলবার উদ্যত করে পা দিয়ে দরজা বাইরের দিকে পুশ করল।
দেখতে পেল লোকটি উঠে দাঁড়াচ্ছে।
আহমদ মুসার চোখ ও রিভলবার এক সঙ্গেই কাজ করল। লোকটি চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিভলবারের ট্রিগার তার আঙুলে চেপে বসেছিল। রিভলবারের একটি বুলেট উপর থেকে ০৫ ডিগ্রি কোণে গিয়ে ঠিক তার কপালে আঘাত করেছে। তার দেহটা ছিটকে পড়ল পেছনে।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে টেনে দরজা বন্ধ করে সোজা হয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। তাকাল গৌরীর দিকে। সে তার বাম হাত দিয়ে ডান হাতের গুলিবিদ্ধ কবজি চেপে ধরে বসে আছে মাথা নিচু করে। গুঁড়িয়ে যাওয়া কবজি থেকে রক্ত তখনও বেরুচ্ছেই।
আহমদ মুসা হাতের রিভলবার সামনের ড্যাশ বোর্ডের উপর রেখে ওপাশের ড্যাশ বোর্ডের নিচের ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স বের করল। বক্স থেকে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বের করে নিল আহমদ মুসা। তারপর গৌরীর ডান হাত টেনে নিয়ে কবজির পেছনে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে আহত স্থানটা ঢেকে দিল। বলল আহমদ মুসা, ‘এতে অন্তত রক্ত ক্ষরণটা বন্ধ হবে মিস গৌরী।’
বলে মুহূর্ত কয়েক থেমেই আবার কথা শুরু করল, ‘মিস গৌরী, প্লিজ, আপনি কি খোঁজ নেবেন, ওরা কেউ বেঁচে আছে কিনা।’
গৌরী অপলক চোখে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়! বলল, ‘কেন, কি দরকার আপনার ওটা জেনে?’
‘ওদের মধ্যে কেউ আহত থাকলে কিছু শুশ্রুষা তার প্রয়োজন হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মানুষ মারার সময় তাদের কথা ভাবা হলো না, এখন আহতের কথা ভাবা হচ্ছে কেন? এটা কি গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মত বিষয় নয়?’ বলল গৌরী।
ওরা যুদ্ধ চলা কালে মরেছে। এ মৃত্যু স্বাভাবিক। যুদ্ধ শেষে আহতরা কারও শত্রু নয়, আমাদের ধর্মের শিক্ষা এটা। যতটা সাধ্য ওদের সহযোগিতা করা উচিত। এই উচিত কাজটাই আমি করছি।’ আহমদ মুসা বলল। গৌরী মাথা একটু নিচু করল।
মুখে কিছু বলল না আহমদ মুসার কথা জবাবে।
মুহূর্ত খানেক পর মুখ তুলে তাকাল গাড়ির পেছনে হত-নিহত তার সাথীদের দিকে। একটু জোরে বলল, ‘নাশকা, তোমাদের খবর কি? তোমরা কে কেমন আছ বল?’
নাশকাই মুখ তুলল। বলল, ‘তিনজন মারা গেছে ম্যাডাম। আমার বাম বাহু ও ডান হাত গুলিবিদ্ধ হয়েছে।’
গৌরী ফার্স্ট এইড বক্স হাতে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘আপনি বসুন মিস গৌরী। এক হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা যায় না।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি লক করে চাবিটা পকেটে পুরে গৌরীর কাছ থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে পেছনের সিটে যাবার জন্যে উঠল।
‘গাড়ি লক করলেন কেন?’ জিজ্ঞাসা গৌরীর।
‘যাতে গাড়িটা আপনি দখল করতে না পারেন সেজন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার দিকে কয়েক মুহূর্ত দৃষ্টি রেখে বলল, ‘আমি তো পালিয়ে যেতেও পারি?’
‘আমি আপনাদের বন্দী করিনি। আমি নিজেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছি মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন, আমাদের কাছ থেকে আপনার কিছু জানার নেই। কেন আমরা আপনাকে কিডন্যাপ করেছিলাম, সেটা আপনি জানতে চান না?’ বলল গৌরী।
‘জানার আগ্রহ থাকলেও জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা আমার নেই। কারণ আপনারাও হয়তো জানেন না। জানলেও আপনাদের তা বলার কথা নয়। যেমন আপনারা কোন এক ‘মতু’তে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি বিস্মিত হয়েছি, ‘মতু’ নামে তো তাহিতি কিংবা এর আশেপাশে কোন জায়গা নেই! আমি যদি এটা জিজ্ঞাসা করি, আপনি নিশ্চয় বলবেন না?’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শুনে হাসল গৌরী।
তাকাল আহমদ মুসার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে। বলল, ‘আহমদ মুসা, আপনি সত্যিই অনন্য! আপনি কিছুই জিজ্ঞাসা করতে চান না, কিন্তু এমন একটা বিষয় জিজ্ঞাসা করেছেন, যা আপনি জানলে আমাদের আপনাকে জানাবার আর কিছু বাকি থাকে না।’
‘এর মানে ‘মতু’ কি, কোথায়? এটা কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল না। আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন, এ প্রসঙ্গে আপনারাই ‘মতু’র নাম বলেছেন। এটা আমার জিজ্ঞাসার বিষয় নয়। কৌতূহল থেকেই আমি ‘মতু’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। আমার আরও কৌতূহল হলো, কেন আপনারা আমাকে অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলার সাথে সাথে গাড়ির পেছনে গিয়ে আহমদ মুসা দুই বাহুতে গুলিবিদ্ধ নাশকার ব্যান্ডেজ বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে।
‘আপনাকে কেন আমরা কিডন্যাপ করতে চাই, সত্যিই কি তা আপনি জানেন না?’ জিজ্ঞাসা গৌরীর।
বিপদে পড়ল আহমদ মুসা। এভাবে জিজ্ঞাসিত হয়ে মিথ্যা বলতে সে পারে না। অবশেষে দায়টা গৌরীর ঘাড়ে চাপানোর জন্যে বলল, ‘মিস গৌরী, প্রশ্ন আমি আগে করেছি। আপনারা কেন আমাকে কিডন্যাপ করতে এলেন?’
‘কিডন্যাপ করতে পারলে বলতাম। এখন তা আর বলা যাবে না।’ বলল গৌরী।
‘কিন্তু আপনারা অপরাধ করেছেন। তাই আপনারা বলতে বাধ্য।’
‘বাধ্য করলে হয়তো জানতেও পারতেন।’ বলল গৌরী।
‘আমি সেটা পারি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু পরাজিত বাদী আহতদের প্রতি তো আপনি নিপীড়ন চালান না।’ গৌরী বলল।
‘কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র আবার সৃষ্টি করা যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
গৌরী কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময় তার মোবাইল বেজে উঠল।
গৌরী মোবাইলটা বের করতে যাচ্ছিল।
‘না মিস গৌরী, আপনাকে টেলিফোন ব্যবহারের অনুমতি আমি দেব না।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির পেছন থেকে সামনের সিটে চলে এল। নাশকার ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গিয়েছিল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসে গৌরীকে বলল, ‘প্লিজ, মোবাইলটা দিন।’
মোবাইলটা তখনও বেজেই চলেছে।
গৌরী নিরবে মোবাইলটা তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা মোবাইলের কল অন করে বলল, ‘বলুন, আমি আহমদ মুসা, যাকে কিডন্যাপ করতে পাঠিয়েছিলেন।’
‘আপনি তাদের হত্যা করে গাড়ি দখল করে বসে আসেন?’ বলল ওপার থেকে।
‘না, গৌরী ও নাশকা আহত। অন্যরা নিহত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনিই আহমদ মুসা, এটা আগে জানলে কিডন্যাপের জন্যে মাত্র একটা গাড়ি পাঠাতাম না। যা ঘটেছে এটা ঘটার কথা ছিল না। এর প্রতিশোধ আমি নেব।’ বলল ওপার থেকে।
‘সেটা আমিও জানি। কিন্তু আপনারা আমার বিরুদ্ধে লাগলেন কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা বাইরের কারো কোন প্রশ্নের জবাব দিই না। আপনার প্রশ্নের উত্তরও আমি দেব না।’ বলল ওপার থেকে।
‘না বললেও আমি জানি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি জানেন?’ ওপার থেকে চমকে ওঠা কন্ঠস্বর।
আমিও কোন প্রশ্নের জবাব দেব না। আহমদ মুসা বলল।
‘বেঁচে থাকলে তো জবাব দেবেনই! তবে দেবার সময় আপনি পাবেন না।’ বলল টেলিফোনের ওপার থেকে।
আহমদ মুসা পেছনে ও সামনে তাকাল। দেখল, দু’দিক থেকে দু’টি করে চারটি হেডলাইট ছুটে আসছে। হেড লাইটের অবস্থান ও ধরন দেখে বুঝল, ও দু’টি জিপ গাড়ি।
‘হ্যাঁ, আপনার পাঠানো দু’টি গাড়ি দুই দিক থেকে আসছে।’ আহমদ মুসা বলল।
টেলিফোনের ওপার থেকে কন্ঠটি হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘আহমদ মুসা, তোমার দখল করা গাড়িতে ট্রান্সমিটার ফিট করা আছে। গোলাগুলি ও গাড়ির সব কথাই আমরা শুনেছি। গাড়ির অবস্থান রিলে করার ব্যবস্থাও ঐ গাড়িতে আছে।’
‘ধন্যবাদ, এ তথ্যগুলো আমার জানা ছিল না। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার ভবিষ্যত এখনও আছে বলে আপনি মনে করছেন?’ বলল ওপার থেকে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আল্লাহর ভূমিকায় বসতে চাইবেন না। মানুষের শক্তি খুবই সীমিত।’
ওপার থেকে হো হো হাসির শব্দ ভেসে এল। বলল, ‘জবাব আমি দেব না, জবাব তুমি পেতে যাচ্ছ আহমদ মুসা। তুমি চারদিক থেকে ঘেরাও। দু’পাশের পাহাড়ে আমাদের হেলিকপ্টার কমান্ডো পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘ধন্যবাদ। তোমার শক্তি আর আমার আল্লাহ ভরসা।’
বলেই আহমদ মুসা চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। মুখ ঘুরিয়ে গৌরীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ মিস গৌরী, আপনি গাড়ি থেকে নেমে যান, আর নাশকাকেও নামিয়ে নিন। তাড়াতাড়ি প্লিজ।’
বিস্ময় গৌরীর চোখে-মুখে। বলল, ‘কেন?’
সামনে ও পেছন থেকে আপনাদের দুই বা ততোধিক গাড়ি আসছে আমাকে টার্গেট করে। আপনারা এখন আমার কাস্টডিতে। কিন্তু একটু পরেই আমি আর আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর্যায়ে থাকবো না। তাই নিরাপদ হওয়ার জন্যে আপনাদের মুক্তি দিচ্ছি। প্লিজ মিস গৌরী! সময় নেই, তাড়াতাড়ি করুন।’ আহমদ মুসা বলল।
স্তম্ভিত গৌরী! সে কোন শত্রুকে দেখছে, না হিংসা-বিদ্বেষের মত মানবিক প্রবণতামুক্ত কোন এনজেলকে দেখছে! বলল সে, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। কিন্তু গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আপনিও তো সরে যেতে পারেন।’
সামনে ও পেছনের মত দু’পাশের পাহাড়ও আমার জন্যে নিরাপদ নয়। অন্ধকারে গুলি খাওয়ার চাইতে সামনা সামনি লড়াই করা ভাল মিস গৌরী।’ আহমদ মুসা আর কিছু বলল না।
গাড়ি থেকে নামল গৌরী। নামিয়ে নিল গুরুতর আহত নাশকাকেও।
গাড়ির দরজা গৌরীই এসে বন্ধ করে দিল। সেই সাথে গাড়ির দরজাও লক করে দিল গৌরী। সেই ফাঁকে ব্যাগ থেকে ছোট একটা বাক্স বের করে নিজের দেহের আড়ালে নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে টুপ করে সেটি সিটের উপর রাখল গৌরী। বিষয়টা খেয়াল করল না কেউ। তার কানে এল সশব্দে দরজা বন্ধ ও লক হওয়ার আওয়াজ। গৌরীর এই অযাচিত সাহায্যের জন্যে মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা নিজের পাশের দরজা খোলা রেখেছে ইমারজেন্সী এক্সিট হিসাবে, কিন্তু ওপাশের দরজা লকড থাকুক এটাই চেয়েছিল আহমদ মুসা।
গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা ওপাশের জানালার দিকে তাকাতে গিয়ে ছোট বাক্সটা তার চোখে পড়ল। চমকে উঠে আহমদ মুসা বাম হাত দিয়ে বাক্সটি আস্তে করে টেনে নিল। বাম হাত দিয়ে বাক্সটি চোখের সামনে তুলতেই চক্ষু স্থির হয়ে গেল আহমদ মুসার। বাক্সের উপর লেখা ‘ম্যাগনেটিক মেশিন জ্যামিং ডিভাইস(MMJD)’।
স্তম্ভিত আহমদ মুসা বাম হাতেই খুলে ফেলল বাক্সটি। ভেতরে ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিন। এই মেশিন সম্পর্কে সে পড়েছে, শুনেছে, কিন্তু দেখেনি। এই মেশিন মার্কেটেও আসেনি। বিজ্ঞানী ও প্রস্তুতকারকদের হাতেই মেশিনটা রয়েছে। এই মেশিন এখানে এল কি করে? সে নিশ্চিত গৌরীই তার ব্যাগ থেকে এটা রেখে গেছে। তার মানে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের হাতে এই জ্যামিং মেশিন রয়েছে।
গৌরীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল আহমদ মুসার মন। তার সাথে অবাক বিস্ময়ও! গৌরী তার দলের সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল কেমন করে! ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের লোকরা মৃত্যুর মুখেও দলের ব্যাপারে মুখ খোলে না। আর গৌরী আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল তার লোকদের পরাজয়, এমনকি ধ্বংসের অস্ত্র।
আহমদ মুসা ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিন (এমএমজেডি) সম্পর্কে বিস্তারিত পড়েছে। অস্ত্রটি ছোট কিন্তু যুদ্ধের জগতে এক বিস্ময়। এই অস্ত্রের ম্যাগনেটিক ফায়ার যে কোন মেটালে তৈরি যন্ত্রকে মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। ট্যাংক থেকে পিস্তল ও স্টিলমিল থেকে খেলনা গাড়ি সবাই এই ক্ষুদ্র অস্ত্রের কাছে অসহায়। অস্ত্রটি মাল্টিডাইমেনশনাল ও সিংগল ডাইমেনশনাল হতে পারে। এর সাহায্যে সাংঘাতিক কার্যকরি ফায়ার ফোকাসকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। টার্গেটের আয়তন যেমন হবে, এর ফায়ার ফোকাসকেও সেরকম করা যায়। তাতে আশেপাশের অনুরূপ কোন কিছু্র ক্ষতি হয় না।
হাসল আহমদ মুসা। গৌরী এক মোক্ষম অস্ত্র আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়েছে। এর মোক্ষম ম্যাগনেটিক ফায়ার শুধু ওদের গাড়িগুলোকে নয়, ওদের সব অস্ত্রকে অকেজো করে দেবে।
তাই হলো। সামনের গাড়ি ১০ গজ দূরে থাকতেই আহমদ মুসা ম্যাগনেটিক ফায়ার করেছিল, নিয়ন্ত্রিত ফায়ার। তারপর গাড়িটি মাত্র দুই গজ এগোতে পেরেছিল। আট গজের মাথায় গাড়িটা থেমে গিয়েছিল। পেছন থেকে আসা গাড়িও এই ভাগ্য বরণ করেছিল। তারা গাড়ি খুলতেও পারেনি। গাড়ির লক জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয় তাদের মোবাইলও কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ সেগুলোও জ্যাম হবার কথা।
আহমদ মুসা নিজের গাড়ি থামিয়ে সামনে ও পেছনে ম্যাগনেটিক ফায়ার করেছিল।
এবার আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট করল। গাড়ি ঘুরিয়ে পেছন দিকে চলতে শুরু করল। মাইল দুয়েক পশ্চিমে এগোলেই তার হোটেলে ফেরার রাস্তা সে পেয়ে যাবে।
পেছনের নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা গাড়িটিকে পাশ কাটিয়ে আহমদ মুসার গাড়ি বেরিয়ে এল।
নিশ্চিন্ত হলো সে। ছুটতে লাগল তার গাড়ি। কিন্তু একশ’ গজও এগোতে পারল না। দু’পাশ থেকে শুরু হলো গুলি বৃষ্টি।
আহমদ মুসার পাশের জানালা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। তার সামনে দিয়েই কয়েকটা গুলি বেরিয়ে গেল। আহমদ মুসার দেহটা রিল্যাক্স মুডে সিটের উপর এলিয়ে পড়ে না থাকলে তার দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
মুহূর্তেই আহমদ মুসার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। পাহাড়ের দু’পাশে যাদের নামানো হয়েছিল তার পালানো পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্যে, তারাই তাদের বিপদগ্রস্থ গাড়ির দিকে ছুটে এসেছে। এদের মধ্যে গৌরী নিশ্চয় রয়েছে। তাদের গাড়িগুলোর কি বিপদ ঘটতে যাচ্ছে তা একমাত্র সেই-ই জানত। সেই-ই দ্রুত তার লোকদের সংগঠিত করার জন্যে এদিকে এসেছে। আহমদ মুসা বুঝল, কিছুটা এগোলেই সে এদের গুলির রেঞ্জের বাইরে যেতে পারবে। ইতিমধ্যেই দু’পাশের জানালা দিয়ে গুলি আসা প্রায় বন্ধ হয়েছে। এবার গুলি আসছে অপেক্ষাকৃত উপর থেকে। আঘাত করছে জানালার লেবেলের উপরে ও ছাদেও।
গুলি বৃষ্টির মধ্যে স্টিয়ারিং থেকে আহমদ মুসার হাত শিথিল হয়নি। সিটের সাথে সেঁটে থেকে হাত দু’টোকে যথাসম্ভব ঠিক রেখে সে স্টিয়ারিং হুইল নিয়ন্ত্রণ করছিল।
গুলি বৃষ্টি এখন আঘাত করছে আহমদ মুসার গাড়ির পেছন দিকে।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ওদের গাড়ির রেঞ্জ থেকে। ওদের পক্ষে আহমদ মুসার গাড়ি ফলো করা সম্ভব নয়।
আহমদ মুসা আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু স্বস্তি তার স্থায়ী হলো না।
তার পকেটে থাকা গৌরীর মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল ধরল আহমদ মুসা।
ওপারের কথা শুনেই আহমদ মুসা বুঝল, ব্ল্যাক সান এই কিছুক্ষণ আগে কথা বলেছে।
লোকটি আহমদ মুসার কন্ঠ পেয়েই বলে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা ধন্যবাদ, আমাদের অস্ত্রে আমাদেরই ঘায়েল করলেন, সত্যিই আপনার নামের মতই আপনি! কিন্তু গৌরীর ব্যাগে যদি জ্যামিং মেশিন (MMJD) না পেতেন, তাহলে কিন্তু আপনার এই বিজয় লাভের সুযোগ ছিল না। গৌরী একটা ভুল করেছে। মেশিনটির সেফটি পিন খুলে নিলেই আপনার বুজরুগি সব হাওয়া হয়ে যেত!’
লোকটি একটু থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘জ্যামিং মেশিন ব্যবহার করেছি এটা আপনাকে কে বলল?’
‘অবান্তর প্রশ্ন। বলেছি তো, আপনার গাড়িতে সুপার সেনসেটিভ সাইট ট্রান্সমিটার আছে। সেটাই আমাকে বলে দিয়েছে। আরও বলে দিয়েছে, আপনি গাড়ি ঘুরিয়ে জ্যাম হয়ে যাওয়া পেছনের গাড়ির পাশ কাটিয়ে পশ্চিম দিকে এগিয়েছেন। দু’দিকের পাহাড় থেকে আমাদের লোকরা আপনাকে আটকাবার চেষ্টা করে। গুলি বৃষ্টির মধ্যেও গাড়ি চালিয়ে আপনি বের হয়ে এসেছেন। এখন আপনি নিরাপদ, তাই না?’
‘তা মনে করারই কথা।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার ওপার থেকে হো হো হাসির শব্দ। বলল ওপারের কন্ঠ, ‘আহমদ মুসা, বিপদ তোমার মাথার উপর পৌঁছতে দু’এক মিনিটের বেশি দেরি হবে না। ‘আরু’র পাশের পাহাড়েই আছে আমাদের ফ্লাইং-লিফটের একটি ঘাঁটি। সেখানে এক আসনের ফ্লায়ার থেকে দশ আসনের মিনি হেলিকপ্টার রয়েছে। ওগুলো দিনের আলোতে বের হয় না। এখন রাত।’
বলেই আবার হো হো করে হেসে উঠল লোকটি। হাসির মধ্যেই ওপারের লাইন অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ করল। চিন্তা করল, আরেকটা বিপদ আসছে। নিশ্চিত হওয়া গেল, পানির তলদেশ দিয়ে চলার জন্যে ওদের যেমন ক্ষুদ্র টিউব সাবমেরিন আছে, মিনি সাবমেরিন আছে, তেমনি আকাশে চলার জন্যে ওরা সম্ভবত ফ্লাইং টিউব, ফ্লাইং মডিউল, মিনি হেলিকপ্টার তৈরি করেছে। এসবের ফাংশন, চরিত্র, শক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুই জানা নেই তার। তার কাছে অস্ত্র আছে বলতে ওদের কাছ থেকে পাওয়া স্টেনগান, গৌরীর ফেলে যাওয়া রিভলবার ও সেই জ্যামিং মেশিন।
চোখ খুলল আহমদ মুসা। তাকাল মাথার উপর গাড়ির ছাদের দিকে। দেখল যা ভেবেছিল তাই। ছাদের এ অংশটা স্লাইডিং।
আহমদ মুসা সুইচ টিপে স্লাইডিং ডোরটা খুলে ফেলল। দুই ফুট চওড়া ও তিন ফুট লম্বা আয়তকার একটা স্পেস বের হয়ে গেল। তাকাল উপরের দিকে। আবার সেই ভাবনা, ফ্লাইং টিউব বা ফ্লাইং মডিউল অথবা মিনি হেলিকপ্টার যাই আসুক, তারা কি করতে চাইবে! বোমা মেরে গাড়ি সমেত তাকে ধ্বংস করবে? কিন্তু তা করলে তার আস্ত লাশ পাবে কি করে? লাশ না পেলে তো এক বিলিয়ন ডলার পাবে না। আকাশ থেকে গুলি বৃষ্টি করে তাকে মারবে! কিন্তু সেজন্যে ফ্লাইং বস্তুটিকে অনেকখানি নিচে নেমে আসতে হবে। সে ঝুঁকি তারা নেবে! কারণ আহমদ মুসার কাছেও স্টেনগানের মত অস্ত্র আছে, তা তারা ধরেই নেবে। অবশ্য বড় রেঞ্জের কোন লাইটগান তাদের হাতে থাকতেই পারে, এটা ভাবল আহমদ মুসা। কিন্তু তারা কি গুলি করবে? তারা অক্ষত মানুষ বা লাশ চায়।
আবার উপর দিকে চাইল আহমদ মুসা।
কোন দিকে থেকে কোন ধরনের শব্দ নেই। হঠাৎ তার মনে এল, ওরা শব্দহীন ফ্লাইং ভেহিকেলস তো তৈরি করতে পারে!
সতর্ক হলো আহমদ মুসা। তার সন্ধানী চোখ ঘুরতে লাগল মাথার উপর আকাশে। তার চোখ ঘুরে আরু’র পুব আকাশে আসতেই অমাবস্যার চাঁদের মত গোলাকার চলন্ত অন্ধকারকে এগিয়ে আসতে দেখল।
চট করে আহমদ মুসার মনে পড়ল, ব্ল্যাক সানের সেই নেতা একটু আগে তাকে মোবাইলে জানালো আরু’র পাশের তাদের ফ্লাইং ঘাঁটি থেকে তাদের ফ্লাইং ভেহিকেল আক্রমণে আসবে। এই চলন্ত অন্ধকারই কি সেই অ্যাটাকিং ফ্লাইং ভেহিকেল!
চলন্ত গোলাকার সেই অন্ধকার যানটি দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল তার গাড়ির দিকে। এগিয়ে আসছে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে। আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পীড সর্বোচ্চ সীমায় তুলল, কিন্তু বিস্ময়ের সাথে দেখল, সেই গোলাকার অন্ধকারটি সঙ্গে সঙ্গেই তার কৌণিক অবস্থান এডজাস্ট করে নিল! আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না, তার গাড়ির ট্রান্সমিটারটিই ঐ ফ্লাইং অন্ধকার বস্তু অর্থাৎ ব্ল্যাক সান-এর ফ্লাইং ভেহিকেলকে গাইড করছে।
তার মানে তার গাড়ির সাউন্ড ট্রান্সমিটার শুধু শব্দই ট্রান্সমিট করে না, নির্দিষ্ট এক ওয়েভ লেংথে তার অবস্থানকেও রিলে করে। সুতরাং তার গাড়ি যেখানেই যাক, ফ্লাইং ভেহিকেলটি তাকে লোকেট করবেই।
ফ্লাইং ভেহিকেলটি আহমদ মুসার গাড়ির চেয়ে কয়েকগুন বেশি বেগে এগিয়ে আসছে। ইতিমধ্যেই ফ্লাইং ভেহিকেলটি ৭০ডিগ্রি কোণে উঠে এসেছে। মাথার উপর আসতে দেরি নেই।
আহমদ মুসা গাড়ি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল।
ফ্লাইং ভেহিকেলকে পিছু ছাড়াবার দেখা যাচ্ছে এটাই একমাত্র পথ।
হার্ড ব্রেক কষে আহমদ মুসা তার গাড়ি থামাল।
জ্যামিং মেশিন, গৌরীর রিভলবার ও একটি স্টেনগান নিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
গাড়ি থেকে নেমেই আহমদ মুসা সামনের দিকে দৌড় দিল। আর শ’গজের মত এগোলেই দু’দিকের পাহাড় অতিক্রম করে অনেকটা সমতল এলাকায় গিয়ে পৌঁছবে। তাতে আশেপাশের তার মুভ করার সুযোগ হবে।
দু’পাশের পাহাড়ের দেয়াল পার হতেই আহমদ মুসার পকেটে থাকা গৌরীর মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইল ধরল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার ‘হ্যালো’ বলে সাড়া দিতেই ওপার থেকে সেই ‘হো হো’ হাসির শব্দ ভেসে এল। হাসি থামলে কন্ঠটি বলল, ‘আহমদ মুসা, তুমি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রক্ষা পাবে না । আমাদের সর্বগুণান্বিত ভেহিকেল জুনিয়র এক্সেকিউটর-১ পাঠিয়েছি। তার চোখ আপনাকে খোঁজে নিবেই। আপনার লাশ আমরা চাই-ই।
একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহ ছাড়া সর্বগুণান্বিত ও সর্বশক্তিমান আর কেউ নেই। সবচেয়ে নিখুঁত বলে আমরা যাকে ভাবি তার মধ্যেই বড় খুঁত রয়ে যায়। নির্ভুল হবার সর্বশক্তিমান হবার অহংকার একমাত্র আল্লাহরই সাজে। তার সৃষ্টির এই দাবি করা মুর্খতা। আহমদ মুসা বলল।
ওপার থেকে আবার সেই হাসি। বলল, আমাদের সবচেয়ে ছোট অস্ত্র ‘জুনিয়র এক্সকিউটর-১’ আমরা পাঠিয়েছি। তার শক্তিটা একবার দেখ।এই কথা শেষ হবার পরে আবার তার সেই হাসি। কেটে গেল ওপার থেকে করা মোবাইলের লাইন।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা ওপরে তাকিয়ে দেখল কথিত সেই জুনিয়র এক্সকিউটর-১ আরও অনেক নিচে নেমে এসেছে। এসে পৌছেছে প্রায় মাথার ওপর। স্টেস ভেহিকেল জুনিয়র এক্সকিউটর-১ এখনও গুলীর রেঞ্জের অনেক ওপরে। তবে নামছে এক্সকিউটর-১।
নেমে এল অনেক নিচে। কোন পথে আক্রমণ আসবে তার অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসা। হঠাৎ ওপর থেকে এক পশলা গুলি বৃষ্টি ছুটে এল নিচে। শব্দ থেকে বুঝল গুলী স্টেনগান থেকেই এসেছে
একটা বড় পাথরের গা ঘেঁষে আহমদ মুসা বসে পড়েছিল। তার চারপাশে গুলীর একটা রিং তৈরী হলো। আহমদ মুসা বুঝল তাকে লক্ষ্য করে গুলী করা হয় নি।
ওপর থেকে গুলী বর্ষণ বন্ধ হতেই আহমদ মুসা তার স্টেনগান তুলে গুলী করল জুনিয়র এক্সকিউটর-১ লক্ষ্য করে। গুলীগুলো, ফিরে এল নিচে। গোটা স্পেস ভেহিকেলটা বুলেট প্রুফ বুঝল আহমদ মুসা। একটা ভাবনা এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে। স্টেনগান অকেজো হয়ে পড়ার পর আত্মরক্ষা ও আক্রমণের আর কি অপশন বাকি থাকল তার কাছে ?
আহমদ মুসার ভাবনা শেষ হতে পারলো না হঠাৎ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল ওপর থেকে আসা ও ফিরে আসা বুলেটগুলো আবার ওপরে উঠে যাচ্ছে। হাতের স্টেনগানেও টান পড়েছে।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। ম্যাগনেটিক পুলিং। কথাটা আহমদ মুসার মাথায় আসার সাথে সাথেই জ্যাকেটের পকেট জুড়ে থাকা ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিন টেনে বের করে দ্রুত পাওয়ার অন করে টপ ফোকাসের চারদিক সীমাবদ্ধ করে ফাংশন অপশন স্টার্ট করল। সংগে সংগে জ্যামিং মেশিনের অদৃশ্য ফায়ার ফোকাস ছুটল এক্সকিউটর-১ লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার মাথার ওপরের আকাশে জুনিয়র এক্সকিটর-১ যেমন স্থির দাঁড়িয়েছিল, তেমনি স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক ফায়ার কোন কাজ করল না বুঝল আহমদ মুসা। এর পর একটা জিনিস লক্ষ্য করল, নিচে গ্রাউন্ড থেকে বুলেটের মত মেটালিক দ্রব্য উপরে উঠে যাচ্ছিল, তা বন্ধ হয়ে গেল। হাতে ধরা স্টেনগান ও জ্যামিং মেশিনও আর উপর থেকে টান অনুভব করল না। তার মানে জুনিয়র এক্সকিউটর-১ এর ম্যাগনেটিক পুলকে তার ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক ফোকাস নিউট্রাল করে দিয়েছে। কিন্তু জুনিয়র এক্সকিউটর-১ এর কোন ক্ষতি করতে পারল না তার জ্যামিং মেশিন। নিশ্চয় ম্যাগনেটিক জ্যামিং প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা এতে আছে। তবে আহমদ মুসা আরেকটা জিনিস ভেবে খুব খুশি হলো, জুনিয়র এক্সকিউটর-১ থেকে গুলী করে তার কোন ক্ষতি করতে ওরা পারবে না। তার ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক ফায়ার বুলেটকেও নিউট্রাল করে দিতে পারে। এটা এক্সকিউটরও নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে।
তাহলে এক্সকিউটর এখন আগাবে কোন পথে ?
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল তার নিজের কিডন্যাপ হওয়ার কথা। ব্ল্যাক সান-এর গৌরিরা তাকে কিডন্যাপ করেছে ক্লোরোফরম কিংবা ঐ জাতীয় চেতনা লোপকারী গ্যাস প্রয়োগ করে। আর কাউকে আস্ত কিডন্যাপ করার এটাই সবচেয়ে সহজ পথ। তাছাড়া তারা লাশ চাইলে জীবনবিনাশী কোন গ্যাসও ব্যবহার করতে পারে।
যতদুর পারা যায় এর আওতা থেকে দূরে সরতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো গাড়ি থেকে নামার পরও জুনিয়র এক্সকিউটর-১ তাকে অনুসরন করছে কিভাবে। ব্ল্যাক সানের লোকেরা বলছে আমি যেখানে যাই, এর হাত থেকে বাঁচতে পারবো না। এক্সকিউটর-১ এর চোখ আমাকে খোঁজে নিবেই। কিন্তু কিভাবে? গৌরীর গাড়িতে সাউন্ড ট্রান্সমিটার ছিল। কিন্তু আমার সাথে তো সাউন্ড ট্রান্সমিটার কিংবা অন্য কোন ট্রান্সমিটার নেই।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের অস্ত্রশস্ত্র সব কিছুর সাথে ট্রান্সমিটার চীপস লাগানো আছে। যেহেতু আমার সাথে গৌরীদের মানে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের একটি রিভলবার, একটি স্টেনগান এবং একটি জ্যামিং মেশিন আছে। এর সবগুলোতেই কিংবা কোন একটিতে ট্রান্সমিটার চীপস লাগনো রয়েছে।
আহমদ মুসা রিভলবার ও স্টেনগান ছুঁড়ে ফেলে দিল। কিন্তু হাতে নিয়েও জ্যামিং মিশিনটি ফেলে দিতে পারলো না । মেশিনটি তার দরকার। ভাবল আহমদ মুসা, জ্যামিং মেশিন নিয়ে সে সরে যাবে। এক্সকিউটর-১ যদি তাকে সেখানেও ফলো করে তাহলে বুঝা যাবে জ্যামিং মেশিনেও ট্রান্সমিটিং চীপস রয়েছে।
এসব চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। আকাশে চাঁদ নেই। চারদিকে অন্ধকার। উচ্চতা ও চারদিক উন্মুক্ত হওয়ার কারণে কিছুটা স্তব্ধতা থাকলেও ভূমি সন্নিহিত স্থানে অন্ধকারটা একেবারে ঘুটঘুটে।
আহমদ মুসা রাস্তা এড়িয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে দ্রুত এগোলো পশ্চিম দিকে। মাইল খানিক এগোবার পর একটা টিলার গোড়ায় গিয়ে বসল। এখান থেকে কয়েক গজ এগোলেই হাইওয়ে থেকে একটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে হোটেলের দিকে। আহমদ মুসার চোখ আকাশের দিকে। ব্ল্যাক সানের জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ তাকে ফলো করছে কি না, এটাই তার দেখার বিষয়।
দু’তিন মিনিটও পার হয় নি। আহমদ মুসা দেখল এক্সিকিউটর-১ মানে সেই গোলাকার জমাট অন্ধকারটি দ্রুত এসে তার মাথার ওপর স্থির হলো। আর সংগে সংগেই এক্সিকিউটর-১ এর তলদেশে একটা নীল আলো জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল।
আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল এক্সিকিউটর-১ এর দিকে। একটা মিষ্টি নীল আলো জ্বলে উঠে নিভে যেতে আহমদ মুসাও দেখল। একটু বিস্মিতই হলো আহমদ মুসা এক্সিকিউটর-১ এর ম্যাগনেটিক পুল থ্রো হওয়ার সময়ও আলো জ্বলেছিল, তবে সেটা ছিল কমলা, কিন্তু এবার নীল আলো কেন? হঠাৎ আহমদ মুসার মাথায় এল, নীল রঙ হচ্ছে বিষের প্রতীক। নীল আলো কি সেই সংকেত দিল ? তার মানে বিষাক্ত কোন অস্ত্র তাক করা হয়েছে ?
সে ধরনের বিষাক্ত গ্যাস যদি কোন প্রকার গান থেকে ফায়ার করে থাকে তাহলে এখন তা থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কারণ উপরের এক্সিকিউটর-১ থেকে ফায়ার করা গ্যাসীয় ওয়েভ মাটিতে পৌছতে পাঁচ দশ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না। এই সময়ের মধ্যের এক্সিকিউটর-১ এর আওতা থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
এই চিন্তার সংগে সংগেই আহমদ মুসা পকেট জ্যামিং মেশিন বের করে এক্সিকিউট-১ কে টার্গেট করল। সে জানেনা ম্যাগনেটেড জ্যামিং ওয়েভ বিষাক্ত গ্যাস ওয়েভের প্রতিরোধে কিছু আসবে কিনা। কিন্তু যেহেতু করার কিছু নেই তাই আল্লাহ ভরসা করা যা হাতে আছে সেটাই কাজে লাগাতে হবে।
বিষাক্ত গ্যাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর হলো বাইরের বিষাক্ত গ্যাস দেহের ভেতরে ঢুকতে না দেয়া। বিষাক্ত গ্যাসের এ্যাকশন দেড় দু’মিনিটের বেশি থাকে না।
আহমদ মুসা পকেটের রুমাল আঁট ভাজ করে নাক ও মুখের উপর রাখল। তারপর মোবাইলের স্ক্রীন লাইট অন রেখে স্ক্রীনের পরিবর্তনের প্রতি নজর রাখল। বিষাক্ত গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারী এবং কিছুটা অস্বচ্ছ। যা স্বচ্ছ স্ক্রীন লাইটের উপর কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। সেটায় দেখবে সাথে সাথে সে নাক, মুখ ও চোখ পুরোপুরি বন্ধ রাখবে। যেহেতু পালিয়ে বাঁচার কোন উপায় নেই, তাই আত্মরক্ষার এটুকু ব্যবস্থা ছাড়া তার করার কিছু নেই।
সমস্ত ইন্দ্রিয়ের সবটুকু মনোযোগ খোলা রেখে আহমদ মুসা অপেক্ষা করছিল। তার দুই চোখ আঠার মত লেগেছিল মোবাইলের স্ক্রীনে। কিন্তু স্ক্রীন সংকেত দেবার আগেই আহমদ মুসা তার শরীর থেকেই সংকেত পেয়ে গেল। হঠাৎই আহমদ মুসার মনে হলো একটা ভারী ঠান্ডা বাতাস যেন তার মাথার উপর চেপে বসল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা মুখ ও শ্বাস বন্ধ করে চোখ বুজল। পল পল করে সময় বয়ে চলল।
আহমদ মুসা অনুভব করছে সেই ঠাণ্ডা ভারী বাতাসের ছোয়া যেন চারদিক থেকে এসে আহমদ মুসাকে চেপে ধরল। বুঝল বিষাক্ত গ্যাসেরই ঠান্ডা ছোবল এটা। হিমশীতল মৃত্যু নিয়ে এলো এই ঠান্ডা ছোবল। কোন ধরনের বিষ এটা? কোন কেমিক্যাল গ্যাস, না সাইনাইডের গ্যাসীয় রূপান্তর এটা। এ প্রশ্নের উত্তর আহমদ মুসার কাছে নেই।
সময় বয়ে চলছে পল পল করে। একের পর এক বিষাক্ত গ্যাসের ওয়েভ আসছে। বয়ে যাচ্ছে তা দেহের উপর দিয়েই।
দেড় মিনিট পার হয়ে গেছে।
আহমদ মুসার ফুসফুস মুক্ত বাতাসের জন্যে আকুলি-বিকুলি শুরু করেছে। আকুলি-বিকুলিটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই বিকুলিটা এক সময় বুক ফেটে যাওয়ার চিৎকারে পরিনত হলো। বিষাক্ত গ্যাসের মৃত্যু ছোবল তখন আহমদ মুসার কাছে গৌণ হয়েছে। অস্থির হয়ে উঠেছে তার শরীর। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। ইচ্ছার ওপর বুদ্ধির নিয়ন্ত্রন যেন শিথিল হয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রন ভেঙে বন্ধ নাক বন্ধ মুখ যেন এখনি মুক্ত বাতাসকে গ্রোগ্রাসে গিলবে।
আহমদ মুসা মুখ ও নাকের রুমালকে নাক ও মুখের উপর আরও ভালভাবে সেঁটে ধরে ধীরে ধীরে রুমালের মধ্য থেকে নিঃশ্বাস ছাড়ল ও গ্রহণ করল খুব ভয়ে ভয়ে। কিন্তু যেটুকু পেল তার কোন প্রতিক্রিয়া সে অনুভব করল না। আরও কিছুক্ষণ পর সে নাকে মুখে চেপে রাখা কাপড়ের ভেতর দিয়ে শ্বাস গ্রহণ করল। না, কোন প্রতিক্রিয়া নেই। হাত ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে চোখ বুলিয়ে দেখল ইতিমধ্যে দেখল আড়াই মিনিট পার হয়েছে। আহমদ মুসা দেখেছে এক্সিকিউটর-১ থেকে সেই ভয়ংকর নীল তিনবার জ্বলেছে। তার মানে জীবনবিনাশী বিষাক্ত গ্যাসের ফায়ার তিনবার হয়েছে। শেষ ফায়ার থেকে দুই মিনিট সময় পার হয়েছে। সুতরাং বিষাক্ত গ্যসের কার্যকরীতা এখন আর নেই। চারদিকের বাতাস এসে বিষাক্ত গ্যাসকে হজম করে ফেলেছে।
আরও কিছুক্ষণ পর আহমদ মুসা রুমাল সরাল তার নাক মুখ থেকে। সত্যি ফ্রেশ বাতাস পেল আহমদ মুসা। উন্মুক্ত নাক দিয়ে বুক ভরে বাতাস নিয়ে আহমদ মুসা এক্সিউকিউটর-১ মাথার ওপর ঠিক দাঁড়িয়ে আছে। কি করণী এখন ভাবছে আহমদ মুসা। সে বেঁচে আছে জানলে এক্সিকিউটর-১ আবার আক্রমনে আসবে। আরও একটু ভেবে আহমদ মুসা উৎসাহিত হয়ে মনে মনে বলল।
আহমদ মুসা বেঁচে নেই এই ম্যাসেজ এক্সিকিউটরকে দেবার সহজ পথ হলো, জ্যামিং মেশিন এখানে রেখে চলে যাওয়া। তার কাছে থাকা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের চীপসটি নিশ্চয় জ্যামিং মেশিনের সাথেই আছে। জ্যামিং মেশিন এখানে রেখে যদি আহমদ মুসা চলে যায়, তাহলে এক্সিকিউটর-১ ভাববে আহমদ মুসা এখানেই আছে এবং মরে গেছে। কারণ বিষাক্ত গ্যাসের হাত থেকে কোন ভাবে বাচলেও এখানে আর আমার কোন ভাবে থাকার কথা নয়, এটাই তার নিশ্চিত ভাবার কথা। সুতরাং জ্যামিং মেশিন এখানে রেখে সে নিরাপদে চলে যেতে পারে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আহমদ মুসা।
জ্যামিং মেশিনটি পাথরের গোড়ায় একটা গর্তের মত জায়গায় লুকিয়ে রাখল যাতে মেশিনটি প্রথম দৃষ্টিতেই খুঁজে না পায়।
আহমদ মুসার কষ্ট লাগল জ্যামিং মেশিনটি এভাবে রেখে যেতে। কিন্তু শেষে ভাবল, সব বিষয় আল্লাহই ভাল জানেন। আল্লাহ ছাড়া আর কারও বা অন্য কিছুর উপর আমি নির্ভরশীল নই।
আহমদ মুসা পাথরটির পেছনে দিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে মাটির সাথে সেঁটে রেখে ক্রলিং করে চলল রাস্তার সামনের মোড়টির দিকে, যেখান থেকে এক রাস্তা চলে গেছে তার হোটেলে। চলতে চলতে আহমদ মুসা ভাবল, এক্সিকিউটর-১-এ যদি নাইট ভিশন আই কিংবা রাতে দেখার মত অন্য কোন ব্যবস্থা থেকেও থাকে, তবু মাটিতে তাকে ক্রলিং অবস্থায় ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়।
ক্রলিং করে আহমদ মুসা রাস্তার মোড় পর্যন্ত পৌঁছল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
তারার আলোতে যেটুকু স্বচ্ছতা, তা মাটি পর্যন্ত পৌঁছেনি।
আহমদ মুসা এক টিলার উপর বসে তাকাল পুব আকাশে। এক্সিকিউটর-১ অস্পষ্ট ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে। তখনও স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়।
ভাবল আহমদ মুসা, এক্সিকিউটর-১-এর দৃষ্টিতে মৃত আহমদ মুসাকে নেবার জন্যে ওটা তো নিচে নামার কথা। কিন্তু এক ইঞ্চিও তো নিচে নামেনি! তাহলে কারও অপেক্ষা করছে কিংবা লাশ নেবার জন্যে তাদের গাড়িগুলোকে কি নির্দেশ দেয়া হয়েছে? শেষেরটাই স্বাভাবিক। কিছু দূরেই তো ওদের গাড়ি ও লোকজন রয়েছে। জ্যাম গাড়িগুলোকে নিশ্চয় এতক্ষণে সচল করা হয়েছে।
সতর্ক হলো আহমদ মুসা। ওরা এসে যদি আহমদ মুসার লাশ না পায়, তাহলে আহমদ মুসার সন্ধানে ছুটবে আবার তারা। সেক্ষেত্রে আহমদ মুসাকে তারা প্রথমেই খুঁজবে হোটেলে তার কক্ষে।
আহমদ মুসাও হোটেলে ফেরারই সিদ্ধান্ত নিল। ওদের গতিবিধি সম্পর্কে আহমদ মুসারও জানা দরকার।
হোটেলের রাস্তা ধরে দ্রুত এগোল আহমদ মুসা।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের দু’টি গাড়ি ও অনেক লোক তন্নতন্ন করে খুঁজল চারদিক কিন্তু আহমদ মুসার লাশ কোথাও পেল না।
সবাই ফিরে এসে মাথা নিচু করে বসে বলল, শয়তানটার লাশ কোথাও নেই ম্যাডাম।
গৌরীর চোখে বিস্ময় ও বিহ্বল ভাব থাকলেও আহমদ মুসার লাশ পাওয়া গেল না এই খবরে গৌরী দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হবার চেয়ে খুশিই হলো যেন বেশি! চমকে উঠল গৌরী। মনকে শাসন করল সে। লোকদের দিকে চেয়ে দ্রুত বলল, সে বেঁচে থাকলে অবশ্যই সাথে করে জ্যামিং মেশিন নিয়ে যেত। নিশ্চয় সে বেঁচে নেই। তোমরা আরও ভাল করে দেখ।
এটা বলল বটে গৌরী। তবে নিজের কথায় নিজেই জোর পেল না।
লোকরা আবার চারদিকে ছুটল।
গৌরী মোবাইল করল ক্রিনিনকে।
বলল, ক্রিনিন আহমদ মুসার লাশ এখনও পাওয়া যায়নি।
ক্রিনিন জুনিয়র এক্সিকিউটর-১-এর কমান্ডার। গৌরীর কথার উত্তরে দুই চোখ কপালে তুলে সে বলল, পাওয়া যাবে না কেন? নিশ্চয় পাওয়া যাবে ম্যাডাম। আমি এক্সিকিউটরের লাইটভিশন টেলিস্কোপে দেখে তাকে টার্গেট করেই ফায়ার করেছি। ফায়ারের আড়াই মিনিটের মাথায় আবার আমি দেখেছি পাথরে তার দেহ ঠেস দিয়ে থাকা। সে বাঁচেনি, বাঁচতে পারে না। তার লাশ পাওয়া যাবে না কেন?
কিন্তু লাশ থাকলে তো জ্যামিং মেশিনের পাশেই থাকার কথা। জ্যামিং মেশিন পাথরের গোড়াতেই পাওয়া গেছে, কিন্তু তাকে তো পাওয়া যাচ্ছে না! ক্রিনিন, তুমি এক্সেলেন্সি লর্ডকে কিছু জানিয়েছ? বলল গৌরী।
জি ম্যাডাম। আমি মাই লর্ডকে জানিয়েছি, ফায়ার সফল। আহমদ মুসাকে টার্গেট করেই ফায়ার হয়েছে।
ফায়ারের পর তার দেহকে একটা পাথরের সাথে দেখা গেছে। ক্রিনিন বলল।
ঠিক আছে ক্রিনিন। আমি দেখছি এদিকে। দেখা যাক, শেষটা কি দাঁড়ায়।
গুড বাই, জানিয়ে কল অফ করে দিল।
কিন্তু মোবাইল পকেটে রাখা আর হলো না।
মোবাইল বেজে উঠল আবার।
গৌরী মোবাইল এগিয়ে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়েই জড়সড় হয়ে গেল।
মোবাইলটা মুখের সামনে নিয়ে বলল, ইয়েস মাই লর্ড, আমি গৌরী।
লাশ ঠিকঠাক আছে? কি করছ তোমরা এখন? বলল ওপার থেকে আলেক্সি গ্যারিন।
মুখ শুকিয়ে গেল গৌরীর। বলল, মাই লর্ড, এখনও লাশ আমরা খুঁজে পাইনি।
কি বলছ, লাশ পাওনি মানে? পাথরটির কাছে লাশ নেই? জিজ্ঞাসা আলেক্সি গ্যারিনের।
মাই লর্ড, পাথরের গোড়ায় আমরা আমাদের জ্যামিং মেশিন পেয়েছি। কিন্তু লাশ আমরা পেলাম না। গৌরী বলল।
তার মানে ক্রিনিন মিথ্যা বলেছে। গৌরী, পাথরের কাছে যখন আহমদ মুসার লাশ পাওয়া যায়নি, তখন সেখানে ক্রিনিনের লাশ থাকবে। অপেক্ষা কর গৌরী। বলে আলেক্সি গ্যারিন কল অফ করে দিল ওপার থেকে।
কেঁপে উঠল গৌরী। সে জানে এরপর কি ঘটবে। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল গৌরী। তিরিশ সেকেন্ডও পার হলো না।
একটা ভারী বস্তু এসে পড়ল গৌরীর কাছেই। আবার কেঁপে উঠল গৌরী। না দেখলেও সে নিশ্চিত যে, ওটা ক্রিনিনের লাশ।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটে ব্যর্থতার এটাই শাস্তি। এখানে বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দিতে বিলম্ব হয় না, বিলম্ব করে না আলেক্সি গ্যারিন। জুনিয়ন এক্সিকিউটর-১-এ যেখানে কমান্ডার ক্রিনিনের আসন ছিল, সেখানে তার মাথা বরাবর পেছনে ইস্পাতের দেয়ালে একটা ফুটো আছে। সেই ফুটোতে ফিট করা রয়েছে দূরনিয়ন্ত্রিত বিশেষ ধরনের রিভলবারের ব্যারেল। রিমোট কনট্রোলের বোতাম চেপে এই গানে ফায়ার করেছে আলেক্সি গ্যারিন। হত্যা করে সিসি টিভি’তে তার ছবি দেখেছে সে। তারপর রিমোট কনট্রোলের আরেকটা বোতাম টিপে ক্রিনিনের সিটের নিচে এক্সিকিউটর-১-এর একটা অংশ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সেই উন্মুক্ত পথে সিট থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে ক্রিনিনের লাশ। এই সব দৃশ্য, এ সব প্রসেস গৌরীর মুখস্ত। সে কারণেই চমকে উঠেছিল তার লর্ড আলেক্সি গ্যারিনের কথা শুনে।
গৌরী গিয়ে ক্রিনিনের লাশ টেনে এনে পাথরের গোড়ায় রাখল।
আবার বেজে উঠল গৌরীর মোবাইলটা। গৌরী মোবাইল ধরল।
পেয়েছ ক্রিনিনের লাশ? ওপার থেকে জিজ্ঞাসা আলেক্সি গ্যারিনের।
ইয়েস মাই লর্ড। ওটা নিয়ে পাথরের গোড়ায় রেখেছি। বলল গৌরী।
শোন, দু’তিনজনকে লাগাও লাশগুলোকে মানুষের চোখের আড়াল করতে। অবশিষ্টরা জিলাস-এর নেতৃত্বে আহমদ মুসাকে ফলো করবে। প্রথমে হোটেলে। তারপরের নির্দেশ আমি দেব। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
স্যরি মাই লর্ড, আমরা যারা তাকে ধরার জন্যে প্রথম অভিযানে এসেছিলাম, তারা তার ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধান হতে পারিনি। স্যরি মাই লর্ড, বলল গৌরী।
ব্যর্থতা তোমাদের নয় গৌরী, সফলতা আহমদ মুসার। সফলতা তার প্রায় অতিমানবিক বুদ্ধি ও ক্ষিপ্রতার। প্রথমটায় আমিও তাকে অবমূল্যায়ন করেছিলাম গৌরী। সে যে আহমদ মুসা, এ বিষয়টাকে আমি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেইনি। আসলে আহমদ মুসা অপরাজিত এক ডেভিল। সে বারবার ফাঁদে পড়েছে, কিন্তু সব সময়ই ফাঁদ কেটে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে বের হয়ে গেছে। বলা যায় গৌরী, আমাদের পশ্চিমা বন্ধুদের সব শক্তি তার কাছে পরাজয় বরণ করেছে। এ জন্যেই এখন তারা বলছে, তাকে ধরা নয়, দেখা মাত্র হত্যা করতে হবে। তারা যে ঠিক বলছে, আজকের রাতের ঘটনা তা প্রমাণ করল।
কিন্তু গৌরী ক্রিনিনকে জীবন দিতে হলো তার একটি ভুলের কারণে। বিষাক্ত গ্যাসে আহমদ মুসার সত্যিই মৃত্যু হয়েছে কিনা, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে তা নিশ্চিত করেনি।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, তুমি ও নাশকা আহত। তোমরা চলে এস। বলে দিয়েছি, জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ ল্যান্ড করছে সেখানে। গুড বাই।
কথা শেষ করেই আলেক্সি গ্যারিন ওপার থেকে কল অফ করে দিল।
কিন্তু গৌরী মোবাইল হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। তার মাথায় কিলবিল করছে অনেক চিন্তা। তার লর্ড আলেক্সি গ্যারিন আহমদ মুসাকে ‘ডেভিল’ বলেছে। এখন পর্যন্ত তাকে হারাতে না পারার কারণেই তাকে ডেভিল বলা হচ্ছে। মনে পড়ল তার ‘লা ডায়মন্ড ড্রপ’ হোটেলের ‘অ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে’ মানব-মানবীর সম্পর্ক বিষয়ে আহমদ মুসার একান্ত মানবিক কথাগুলো। মনে পড়ল তাদের প্রতি আহমদ মুসার বিস্ময়কর আচরণের কথা। এই মানুষ যদি ‘ডেভিল’ হয় তাহলে অ্যাঞ্জেল বলে কোন কিছু সৃষ্টিতে নেই। মানুষ অ্যাঞ্জেল হতে পারে না। মানুষ যদি মানুষ হতে পারে, তাহলে অ্যাঞ্জেলের চেয়ে বড় হয়, এটা পড়েছি। আমার জীবনে আহমদ মুসাকে আমি প্রথম মানুষ দেখলাম যে অ্যাঞ্জেলের চেয়ে বড়। আহত ডান হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকাল গৌরী। এই ব্যান্ডেজ বেঁধেছে আহমদ মুসা। তার হাতের স্পর্শ লেগে আছে এই ব্যান্ডেজে। রোমাঞ্চিত হলো গৌরীর দেহ। বাম হাত দিয়ে ডান হাত তুলে নিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করল ব্যান্ডেজে।
পাশ থেকে শব্দ ওঠায় চমকে উঠে ফিরে তাকাল গৌরী।
জুনিয়ন এক্সিকিউটর-১ ল্যান্ড করেছে।
এক্সিকিউটর-১ থেকে ডেপুটি কমান্ডার (এখন কমান্ডার) নিলাপ্পা।
তাকে দেখেই গৌরী বলল, হ্যাঁ নিলাপ্পা, তুমি ওয়েট কর। আমি এদিকের কাজ সেরে নিই। বলল গৌরী।
ইয়েস ম্যাডাম। বলল নিলাপ্পা।
গৌরী তার মোবাইলে একটা কল তৈরি করতে করতে একটু দূরে সরে গেল।
ক্যাপিটাল অব পাওয়ার।
বিশ্বমিলনায়তন (Hall of World Assembly)।
বিশ্বনির্বাহীদের কাউন্সিল বৈঠক।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এটাই সর্বোচ্চ পরামর্শ সভা। ব্ল্যাক সানের ৫ জন শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা এই কাউন্সিলের সদস্য। ব্ল্যাক সানের সুপ্রিম কমান্ডার ও প্রেসিডেন্ট লর্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড আলেক্সি গ্যারিন এই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
অর্ধ বৃত্তাকার টেবিল ঘিরে বসেছে পাঁচজন শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা।
টেবিলের বিপরীতে বৃত্তাকার প্রান্তের সামনে সূর্যাকার টেবিলের পেছনে কোন চেয়ার নেই।
ঠিক রাত ১২ টা বেজে ১ মিনিট ঘরের ছাদ ফুঁড়ে একটা টিউব লিফট নেমে এল। লিফটটি কালো ছিল। লিফটটি নেমে এল সূর্যাকার টেবিলটির পেছন পাশ ঘেঁষে।
লিফটটি নেমে মুহূর্তকাল স্থির হয়েই আবার উঠে গেল। লিফট উঠে যেতেই দেখা গেল সিংহাসনাকৃতির একটা চেয়ারে দীর্ঘাকৃতির একজন শিরদাঁড়া সোজা করে অ্যাটেনশন অবস্থায় বসে। দেহে তাঁর সামরিক পোশাক। মাথায় কালো সামরিক ক্যাপ। ক্যাপের সামনে ব্ল্যাক সানের একটা মনোগ্রাম। তাঁর দুই কাঁধ ও বুকে সেই একই মনোগ্রামের প্লেট।
কালো মূর্তিসহ নেমে আসা চেয়ারটি মেঝের উপর স্থির হতেই সামনে অর্ধ বৃত্তাকার টেবিলের পাঁচজন উঠে দাড়িয়ে বাউ করল।
এই কালো মূর্তিই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান আলেক্সি গ্যারিন। আলেক্সি গ্যারিন মুখোশ পড়েই সবার সামনে আসে। গৌরীর মত কিছু পার্সোনাল স্টাফ ছাড়া কেউ তাকে চোখে দেখেনি। শীর্ষ এই পাঁচজন কর্মকর্তাও তাঁর পার্সোনাল স্টাফের অন্তর্ভুক্ত।
আলেক্সি গ্যারিন এসে বসার পর পরই তাঁর পেছনে এক সারিতে তিনটি চেয়ার চলে এল। আলেক্সি গ্যারিনের ঠিক পেছনে মাঝের চেয়ারে গৌরী। তাঁর ডান পাশের চেয়ারে চীফ অব অপারেশন ‘জিজর’। সে সম্পর্কে আলেক্সি গ্যারিনের ছোট ভাই। আর গৌরীর বাম পাশে রয়েছে ব্ল্যাক সানের গোয়েন্দাপ্রধান এবং আলেক্সি গ্যারিনের আরেক ছোট ভাই ডারথ ভাদের।
গৌরী তাঁর চেয়ারে বসার আগেই একটা ফাইল নিয়ে রেখে দিল আলেক্সি গ্যারিনের সামনে টেবিলের উপর।
ফাইলের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল আলেক্সি গ্যারিন।
মুখ তুলল ফাইল থেকে। সোজা হয়ে বসল।
একবার সবার উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, শুভ সময় সকলকে। লং লীভ আমাদের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট। অমর হোক আমাদের স্লোগান ‘পাওয়ার ফর পাওয়ার’ অর্থাৎ শক্তির জন্য শক্তি।
বলে একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন। শুরু করল আবার, ব্ল্যাক সানের শীর্ষ নির্বাহীবৃন্দ, আজ এক বিশেষ বৈঠকে আমি তোমাদের ডেকেছি। উদ্দেশ্য, আমাদের এ পর্যন্ত কাজের একটা পর্যলোচনা করা এবং উদ্ভূত একটা পরিস্থিতি সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করা। প্রথমে আমাদের কাজ নিয়ে আলোচনায় আসি। আমাদের ‘শক্তির জন্য শক্তি’ প্রজেক্টের চীফ এক্সিকিউটিভ ‘পালপেটাইন’ তোমার বিভাগের কাজের বিবরন দাও।
‘শক্তির জন্য শক্তি’ প্রজেক্টের নির্বাহী পালপেটাইন নড়েচড়ে বসল। তাঁর সামনে স্পিকার বক্সের সিগন্যাল লাইট জলে উঠেছে। স্পিকার অন হয়ে গেল। বলতে শুরু পালপেটাইন, মাই লর্ড! ‘শক্তির জন্য শক্তি’ আপনার উদ্ভাবিত সবচেয়ে প্রিয় প্রোজেক্ট। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা এই মহান প্রজেক্টের সাথে সামিল হতে পেরেছি। মাই লর্ডের এই মহান প্রজেক্টের লক্ষ্য হলো, শক্তি দিয়ে শক্তি অর্জন, সেই শক্তি দিয়ে গোটা বিশ্ব-চরাচরকে বশ করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রয়োজন গোটা দুনিয়াকে মেধাশুন্য করার মাধ্যমে শক্তি শূন্য করা এবং প্রয়োজন আমাদের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের শক্তির রাজত্ব চিরস্থায়ী করার জন্যে দুনিয়া থেকে সকল নীতি- নৈতিকতার উচ্ছেদ ঘটানো। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে আমরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মেধাগুলো সরিয়ে আনছি দেশ ও জাতি সমুহের কাছ থেকে, বিশেষ করে মুসলিম দেশের মুসলিম মেধাকে সরিয়ে আনাকে প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। আজ দুনিয়াতে মুসলমানদের ইসলামই দুনিয়াকে ধর্মের শিক্ষামুক্ত ও নীতি- নৈতিকতামুক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন অবিকৃত থাকায় মুসলমানদের বিশ্বাস খুবই জীবন্ত এবং মানুষের মধ্যে এর আবেদন খুবই কার্যকরি। এটাই আমাদের জন্যে বিপদ। এজন্যই মুসলিম জাতিকে মেধাশুন্য ও শক্তিশুন্য করার প্রতি প্রথমেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে’ সরিয়ে এনেছি, তাঁদের ৯০ ভাগই মুসলিম। এর মাধ্যমে একদিকে মুসলিম জাতিকে ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্বল করা যাবে। অন্য দিকে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট ও তাঁর ক্যাপিটাল অব পাওয়ার শক্তিশালী হবে। এটা আমাদের সফল প্রোগ্রাম। কয়েকদিন আগে আমরা সৌদি আরবের স্পেস ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ও আলোক বিজ্ঞানের এ যুগের সবচেয়ে সফল বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মক্কীকে সরিয়ে আনতে পেরেছি। এটা আমাদের বর্ণনাতীত বড় একটা সাফল্য। স্পেসশীপ ও সমুদ্রযানে এ্যান্টিম্যাটার ফুয়েল ব্যবহারের টেকনলজি উদ্ভাবনে তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন। এ ব্যাপারে ক্লিনিক্যাল টেস্ট তিনি করেছেন এবং তা সফল হয়েছে। তিনি এ্যান্টিম্যাটার ফুয়েল ব্যবহারের উপযোগী স্পেস মেরিনের ডিজাইন তৈরির কাজও শেষ করেছেন। এখন এই বিজ্ঞানী আমাদের হাতে। তাকে কব্জায় আনার মাধ্যমে একদিকে আমরা মুসলিম জাতির শক্তিকেন্দ্র সৌদি আরবকে এক মহাশক্তির মালিক হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছি, অন্যদিকে এই শক্তির মালিক আমরা হতে যাচ্ছি। আমা….।
পালপেটাইনের কথার মাঝখানেই একমাত্র আলেক্সি গ্যারিন ছাড়া উপস্থিত সকলেই হাততালি দিয়ে উঠল।
থেমে গিয়েছিল পালপেটাইন। আবার শুরু করে বলল, আমাদের মটো ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ প্রোজেক্ট নিয়ে সাফল্যের সাথে এগোচ্ছি। থামল পালপেটাইন।
পিনপতন নিরবতা।
কালো ইউনিফরমে আবৃত কালো মুখোশে ঢাকা আলেক্সি গ্যারিনের মুখ নড়ে উঠল। বলল, টুডে সাইন্স অব টুমরো বাই রোবটস (রোবটস গড়ার আগামীর বিজ্ঞান আজ) আমাদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আমাদের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করবে। এই প্রকল্পটি আমি নিজে তত্তাবধায়ন করি। এই প্রকল্পের দৈনন্দিন দেখা-শুনা আমার পক্ষ থেকে গৌরী করে থাকে। আমি তাকে বলছি, এই প্রকল্পের কাজ কিভাবে এগোচ্ছে ও কতটা এগিয়েছে তাঁর উপর একটা রিপোর্ট পেশ করতে।
কোথা থেকে যেন গৌরীর মনে অপরিচিত একটা বিষণ্ণতা নেমে এল! চমকে উঠল গৌরী। সব সময় তো সে তাঁর লর্ডের কাছ থেকে এই দায়িত্ব পেয়ে গৌরব বোধ করেছে এবং লাভ করেছে সীমাহীন আনন্দ। কিন্তু আজ এই বিষণ্ণতা কেন? সেই আনন্দের কথাগুলো বলতে আজ কষ্ট হবে বলে মনে হচ্ছে কেন?
সব ভাবনা ঝেরে ফেলে উঠে দাঁড়ালো গৌরী। আলেক্সি গ্যারিনকে ইয়েস মাই লর্ড, বলে একটা লম্বা বাউ করে একটা নোটশিট ফাইল থেকে বের করে স্পিকারের সামনে বসল। বলতে শুরু করল, মাই লর্ড ও মাই কলিগস। ‘রোবটস গড়বে আগামীর বিজ্ঞান’-প্রকল্পটি মাই লর্ডের সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী একটা পদক্ষেপ। বিজ্ঞানী গড়ে তাঁর কাছ থেকে থেকে বাঞ্ছিত কাজ পাওয়া অসম্ভব। আমাদের প্রকল্পে বিভিন্ন বিষয়ে গড়া প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের তাঁদের স্থান থেকে সরিয়ে এনে তাঁদের স্ব স্ব বিষয়ে কাজ নেয়া হচ্ছে। এই কাজে তাঁদের রোবটে পরিনত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাঁদের প্রতিভার শেষ বিন্দু বের করে নিয়ে আগামীর বিজ্ঞানী গড়ে তোলা হচ্ছে। কাজটা কঠিন হলেও মাই লর্ডের পরিচালনায় বৈজ্ঞানিক প্রদ্ধতিতে কঠিনকে সহজ করে ফেলা হয়েছে। প্রায় পৌনে একশ’ বিজ্ঞানীর অধিকাংশই আজ আজ্ঞাবহ নিরেট রোবট। যারা রোবট হয়নি তারাও হবে। যারা হবেনা তাঁদের জন্যেও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা।
মূল উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে আমরা বহু দূর এগিয়েছি। সার্বিক কমুনিকেশনের ক্ষেত্রে এ্যান্টিম্যাটার যুগে প্রবেশ ও সামরিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে লেজার-উত্তর যুগে প্রবেশ করে অদ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ও আক্রমনের শক্তি আমরা অর্জন করতে যাচ্ছি। আমাদের বিজ্ঞানীকে দিয়ে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি আমরা আবিষ্কার করেছি। পরিবহন ক্ষেত্রে সে জ্বালানীর সফল ল্যাবরেটরি টেস্টও আমরা করেছিলাম। আমরা এখন এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানীর মালিক। আমাদের হাতের মুঠোয় এখন এ্যান্টিম্যাটার বিজ্ঞান। সৌদি আরব থেকে সরিয়ে আনা বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-মক্কীর সহযোগিতা যদি আমরা আদায় করতে পারি, তাহলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি চালিত স্পেসশীপ, ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান ও সমুদ্রযান আমরা ব্যবহার করতে পারবো। তখন আমরা কয়েক মিনিটে চাঁদে যাতায়াত করতে পারবো। একদিনের মধ্যে আমরা সৌরজগতের শেষ সীমায় গিয়ে ফিরে আসতে পারবো। তখন দুনিয়ার সব পরিবহণ ব্যবস্থা অচল হয়ে যাবে। অন্যদিকে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি তৈরির পাশাপাশি এ্যান্টিম্যাটার পরমাণুর আরও উন্নত রিপ্রসেসিং-এর মাধ্যমে এ্যান্টিম্যাটার বোমা তৈরির ক্ষেত্রেও আমরা বহু দূর এগিয়ে গিয়েছি। আগামী এক মাসের মধ্যে আমরা ল্যাবরেটরি টেস্ট করতে যাচ্ছি। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে আমরা সমুদ্রতলে এর টেস্টের আয়োজন করতে পারবো। আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা এ্যান্টিম্যাটার পরমানু বোমার মালিক হবো। ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ অর্জনের লক্ষ্য ষোল কলায় পূর্ণ হবে। দুনিয়ার সব অস্ত্র অচল হয়ে যাবে। বিশ্বে হবো আমরাই একমাত্র শক্তি। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট হবে দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারক। দুনিয়ার অচল অস্ত্রের মত ঈশ্বরও অচল হয়ে পড়বে। আমাদের লর্ড হবে দুনিয়ার লর্ড, লর্ড অব দ্য ইউনিভার্স। ধন্য….।
হাততালি দিয়ে উঠল সকলে।
হাততালির মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল গৌরীর কথা।
হাততালি শেষ হলে গৌরী বলল, আমার কথা এখানেই শেষ। ধন্যবাদ মাই লর্ড, ধন্যবাদ সকলকে।
আবার পিনপতন নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল আলেক্সি গ্যারিন। বলল, আজকে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সব বিষয়ে আলোচনা করছি না। আজ শেষ আলোচনার বিষয় হল, একজন বিদেশী তাহিতিতে এসে ঝামেলা পাকিয়েছে। বিষয়টি ছোট, কিন্তু আলোচনার দাবী রাখে। কারন ব্যাপারটি অনেক বড়। এ পর্যন্ত সে আমাদের পাঁচজন লোককে খুন করেছে।
একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন।
শীর্ষ নির্বাহীদের একজন হাত তুলল।
বল। কথা বলার অনুমতি দিল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, এটা একটা ব্যক্তির ব্যাপার। আপনি চাইলেও সে ইলিমিনেট হয়ে যায়। বলল সেই শীর্ষ নির্বাহী।
সে একজন ব্যক্তি বটে, কিন্তু সে একাই সহস্রের সমান। সে অপরাজিত এক ডেভিল। নাম তাঁর আহমদ মুসা। আলেক্সি গ্যারিন বলল।
আহমদ মুসার নাম শুনে মাথা খাড়া করল পাঁচ শীর্ষ নির্বাহীর সকলেই। একজন বলল, সে বিপদ এখানে এল কি করে? কেন এসেছে?
কেন এসেছে, সেটাই চিন্তার বিষয়। তোমরা জান, আমাদের একজন রোবট একটা ম্যাসেজ বাইরে পাঠাতে চেষ্টা করেছিল, আংশিক পাঠিয়েছিল। প্রমানিত হয়েছে, যখন সে ম্যাসেজটি পাঠাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা এক বোটে তাহনিয়া দ্বীপের এ প্রান্তে ছিল। তাঁর মনিটরিং-এ এই মেসেজ ধরা পড়েছে আমরা নিশ্চিত। সে এ নিয়ে কি ভাবছে, কি করছে তা আমরা জানিনা। তাঁর আসাটাই সন্দেহজনক। বিনা কারনে সে এক পা ফেলেনা, এটা সবাই জানে । সে নিছক বেড়াতে তাহিতিতে এসেছে এটা ঠিক নয়। সে কথাই আমি তোমাদের বলতে চাচ্ছি। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, আহমদ মুসা খুবই বিপদজনক ব্যক্তি। শুরুতেই তাকে ইলিমিনেট করা দরকার। ঘটনাটিকে এগোতে দেয়া ঠিক নয় মাই লর্ড। বলল শীর্ষ নির্বাহীদের অন্য একজন।
সে ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। গৌরীর নেতৃত্বে একটা দক্ষ টীম পাঠিয়েছিলাম তাকে কিডন্যাপ করার জন্যে। ইতিমধ্যে পশ্চিমের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বন্ধু সংগঠন আমাদের জানাল, তাঁরা আহমদ মুসার লাশ চায়। তাঁরা অনুরোধ করে আহমদ মুসাকে হত্যা করার কোন সুযোগ ছেড়ে না দেয়ার। লাশের মুল্য হিসাবে তাঁরা দিবে ১ বিলিয়ন ডলার। তখন আহমদ মুসাকে আমরা কিডন্যাপ করে ফেলেছি। আমি গৌরীকে নির্দেশ দিলাম আহমদ মুসাকে হত্যা করার। কিন্তু তাকে হত্যা করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। গৌরী ও নাশকা মারাত্নক আহত হয়, মারা যায় আমাদের পাঁচজন। সংগে সংগেই দুই গাড়িতে দু’টি টিম পাঠিয়েছিলাম তাকে ঘিরে ফেলতে। ঘিরে ফেলেও তাঁরা তাকে আটকাতে পারেনি। আমাদের অস্ত্রে আমাদের ঘায়েল করে সে নিরাপদে বেরিয়ে যায়। তাঁর সাথে সাথেই আমি আমাদের জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ পাঠিয়েছিলাম তাকে অনুসরন ও হত্যা করার জন্যে। কিন্তু এক্সিকিউটর-১ তাকে বাগে পেয়েও, সর্বশেষে বিষাক্ত গ্যাস তাঁর উপর প্রয়োগ করেও তাকে হত্যা করা যায়নি। তাঁর সন্ধানও পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর পর থেকে। তাঁর ব্যাপারে আরও সিরিয়াসলি ভাবা প্রয়োজন বলেই কথাটা এই বৈঠকে তুলেছি। আলেক্সি গ্যারিন বলল।
মাই লর্ড, আপনি কি আশংকা করছেন? আমাদের কি করা দরকার? আমাদের প্রতি আপনার কি পরামর্শ? বলল অন্য একজন শীর্ষ নির্বাহী।
আমি ভাবছি ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রজেক্টের নিরাপত্তা নিয়ে। ব্লাক সান সিন্ডিকেটের নিরাপদ স্থান খুজতে আমি গোটা দুনিয়া চষে ফিরেছি। কিন্তু সব দিক নিরাপদ স্থান আমি পাইনি।সবশেষে সভ্যতা থেকে বহু দুরে সবচেয়ে বড় সাগরের মাঝামাঝি ও প্রায় জনশূন্য এই তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলাম। দ্বীপগুলো অ্যাটল দ্বীপ হওয়ায় নতুন জনবসতির সুযোগ এখানকার দু’একটা ছাড়া কোন অ্যাটল দ্বীপেই নেই। আমার খুব ভালো লেগেছিল স্থানটা। অ্যাটল থেকে অ্যাটলে ঘুরে বেরিয়েছি মাসের পর মাস। কিন্তু ব্ল্যাক সান-এর ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ স্থাপিত হতে পারে এমন উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাইনি। তোয়ামতু অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র দ্বীপ ‘মাকাতিয়া’র পুরানো মন্দিরে বিশ্রাম কক্ষে বসেছিলাম। অ্যাটল দ্বীপগুলোতে ঘোরাফেরার পথে প্রায়ই এই বিশ্রামখানায় বসি। পাশের রেস্টুরেন্টে তাজা মাছের ভাজি ও তাজা ফল প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো আমার প্রিয়। সেদিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে আবার এসে বসেছিলাম মন্দিরের বিশ্রামকক্ষে। আমার সামনে বসেছিল বৃদ্ধ একজন সন্ন্যাসী। আর কেউ ছিল না বিশ্রামকক্ষে।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর চোখ সব সময় বন্ধই দেখলাম।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে থাকতে এক সময় চোখ ধরে এসেছিল।
বৎস, তুমি ঘুমালে? এই কথাগুলো কানে যাওয়ায় আমার তন্দ্রা কেটে যায়।
চোখ মেলে দেখি সন্ন্যাসী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাঁর দিকে তাকাতেই বলল, তোমার বাড়ি নিশ্চয় আমাদের অ্যাটল দীপপুঞ্জে নয়?
জি হ্যাঁ। বললাম আমি।
তুমি পর্যটকও নিশ্চয় নও? সন্ন্যাসী বলল।
জি না। আমি বললাম।
গত তিন মাসে তুমি এখানে তিরিশবার এসেছ। সন্ন্যাসী বলল।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম সন্ন্যাসীর দিকে। অনেকবার এসেছি তাহানিয়া দ্বীপের এখানে। কিন্তু তিরিশবার হয়েছে কিনা গুনে দেখিনি। আমি বললাম, বাবা, তিন মাসে আমি এখানে অনেকবার এসেছি, তিরিশবার হয়েছে কিনা আমি জানিনা। নিশ্চয় আপনার গুনা ঠিক বাবা।
তুমি নিশ্চয় কাউকে খুজছ বৎস? বলল সন্ন্যাসী।
কাউকে নয়, কিছু খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন হন্যে হয়ে কি খুজছ বৎস? বলল সন্ন্যাসী।
একটা জায়গা খুজছি বাবা। এই অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জ আমার ভালো লেগেছে। এখানে একটা নিরিবিলি স্থানে আশ্রয় গড়ার জায়গা খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন জায়গা তো প্রচুর! এত খুজছ কেন? সন্ন্যাসি বলল।
একটা বড় জায়গা যা মানুষের চোখের আড়াল হবে, এমন একটা জায়গা খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন জায়গা তো ডাকাতদের আড্ডার জন্য দরকার! তুমি সে রকম কিছু করতে নিশ্চয় চাওনা? সন্ন্যাসী বলল।
আমি হেসেছিলাম। তারপর গম্ভীর হয়ে সিরিয়াসলি বলেছিলাম, ডাকাতির জন্য নয়, আমি জায়গা চাই বিশাল একটা গবেষণা সংস্থা গড়ার জন্যে যা দুনিয়াকে একশ’ বছর এগিয়ে নেবে।
এ্যাটম বোমা বানাবে এবং আমাদের পানিতে তা পরীক্ষা করবে নাকি, যেমন ফ্রান্স কয়েক যুগ ধরে করেছে। যেন আমরা ওদের গিনিপিগ! সন্ন্যাসী বলল।
বাবা, আমাদের গবেষণা ঐ ধরনের নয়। আমাদের গবেষণা আরও বড় বিষয় নিয়ে। লোক চক্ষুর আড়ালে তা হবে। মানুষ ও পরিবেশকে তা ডিস্টার্ব করবে না বাবা। আমি বললাম।
কিন্তু এর জন্যে তো ইন্সিটিটিউট ধরনের বিশাল বাড়ি ও বড় জায়গা দরকার। অ্যাটলের সারফেসে তো এমন জায়গা দেখিনা বৎস। সন্ন্যাসী বলল।
সে জন্যই তো খুজেই ফিরছি বাবা! আমি বললাম।
ভাবছিল সন্ন্যাসী।
আমিও কিছু বললাম না। চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিছুক্ষন পর মুখ তুলল। তাকাল আমার দিকে। বলল, প্রশান্ত মহাসাগরের এই অঞ্চলে ‘মু’ নামে একটা মহাদেশ ছিল, এটা তুমি বিশ্বাস কর?
আমি শুনেছি বাবা। কিন্তু এ নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। তবে আগ্রহ আছে জানার। বললাম আমি।
আজকের তাহিতি দ্বীপ যেমন বাস্তবতা, তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের অস্তিত্ব যেমন বাস্তবতা, তেমনি আজকের মধ্যপ্রশান্ত মহাসাগরের মহাদেশ ‘মু’ একটা বাস্তবতা। এই মহাদেশ ছিল বিশাল ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী। পেরু ও গুয়েতেমালার পুরাকীর্তি এবং মায়া সভ্যতার বিস্ময় ‘মু’ সভ্যতারই খণ্ডাংশ। ‘মু’ মহাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের অন্তঃসার শূন্য গর্ব, ঈশ্বরকে ত্যাগ করা, ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পদের ধ্বংসকারী ব্যবস্থা এবং পরিশেষে ঈশ্বরের শাস্তি ভুমিকম্প ও প্লাবনের আঘাত ধ্বংস করে ‘মু’ মহাদেশকে। অ্যাটল দ্বীপগুলোর কোন কোনটি সেই মহাদেশরই ধ্বংসাবশেষ হিসাবে টিকে আছে। এরকম একটি অ্যাটলের খবর আমি জানি, যার ভিতরে অক্ষত আছে ‘মু’ মহাদেশের রাজন্যবর্গের একটি বহুতল প্রাসাদ। থামল সন্ন্যাসী।
বহুতল প্রাসাদ? আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
হ্যাঁ, বহুতল প্রাসাদ বৎস। সন্ন্যাসী বলল।
অ্যাটলের অভ্যন্তরে? আমার জিজ্ঞাসা।
হ্যাঁ, অ্যাটলের ভিতরে। সন্ন্যাসী বলল।
আপনি সে অ্যাটলকে জানেন? জিজ্ঞাসা করলাম। বিস্ময় ও আনন্দে আমার ভেতরটা তখন কাঁপছে। রুপকথার মত মনে হচ্ছে তাঁর কথাগুলো।
অবশ্যই জানি বৎস। সেই জানাটাও একটা রুপকথার মত।
বলে একটু থামল সন্ন্যাসী। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, তখন আমার বয়স তিরিশ। সন্ন্যাস ব্রত নিয়ে আমি তখন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরি। একদিন এই মন্দিরেই আমার মত নব্বই-ঊর্ধ্ব এক বুড়ো সন্ন্যাসীর সাথে দেখা। ঈশ্বরী ‘হিনার’ বন্দনা চলছিল সেদিন মন্দিরে। বন্দনা শেষ হতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। বন্দনা শেষ হবার পর মন্দিরের এক কক্ষে আমি সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসিকে শুইয়ে দিতে যাই। বিছানা ঠিক করে তাকে শুইয়ে দিয়ে আমি তাকে বাতাস করছিলাম। দীর্ঘ সময় ধরে শোনা বন্দনায় অনেক কথাই মাথায় কিলবিল করছিল। তাঁর মধ্যে কিছু বিষয় আমাকে খুচাচ্ছিল বেশি। আমি গুরুকে বললাম, গুরু, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
গুরু চোখ বন্ধ করে ছিলেন। চোখ খুলে বলেছিলেন, অনুমতি নিয়ে বলতে হবে কেন? বল তোমার কথা।
গুরু বন্দনার মধ্যে শুনলাম, ঈশ্বরী হিনা রাজপুত্র হেসানা হোসানা, সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর একমন একতনু প্রেমসাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে অ্যাটলের এক প্রাসাদে তাঁদের মিলন ঘটিয়েছিলেন এবং প্রাসাদটি তাঁদের উপহার দিয়েছিলেন-এটা কি সত্য ঘটনা? ঈশ্বরী হিনা কি সত্যিই এটা করেছিলেন?
বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
সন্ন্যাসী শোয়া থেকে উঠে বসেছিলেন। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলেছিলেন, তোমার কি সন্দেহ আছে এ কথায়?
সন্দেহ নেই, কৌতূহল আছে। স্বর্গের ঈশ্বরী নেমে এসেছিলেন তাঁদের জন্যে এবং এই ধরনের একটা প্রাসাদ কোন অ্যাটলে আছে? গুরুজি এটা সত্যিই বিস্ময়ের। আমি বলেছিলাম।
স্রষ্টা ঈশর কি তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসবেন না?
সৃষ্টির কান্না কি স্রষ্টার মন গলাবে না? তিনি কি সৃষ্টির অশ্রু মুসাতে আসবেন না? অবশ্যই আসবেন। রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর ক্ষেত্রে তিনি এসেছিলেন। রাজপুত্র হেসানা সাগরকন্যা শাবানুর জন্যে রাজ্য রাজত্ব সবই ছেড়েছিলেন। প্রশান্ত মহাসাগরে এই অ্যাটল রাজ্যে তিনি অবিরাম কেঁদেছেন এবং ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি সব ভুলেছিলেন, ভুলেন নি শুধু সাগরকন্যার প্রেম। স্রষ্টা দেখেছিলেন তাঁর সৃষ্টি এই রাজপুত্র সাগরকন্যাকে না পেলে সাগরেই তাঁর জীবন শেষ করে দিবে। এই অবস্থায় স্রষ্টা ‘হিনা’ তাঁর সৃষ্টির চোখ মুসাতে না এসে পারেন? তাই তিনি এসেছিলেন। তিনি আদর করে তাঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন ‘মু’ মহাদেশের ধ্বংসাবশেষ অ্যাটল দ্বীপের সেই প্রাসাদে। সেখানেই তাঁদের মিলন ঘটেছিল। স্রষ্টা হিনা তাঁর সৃষ্ট দুই মানব-মানবীর পাগলপারা প্রেমে মুগ্ধ হয়ে খুলে দিয়েছিলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত এক মহাদেশের স্মৃতিবাহী সুন্দর প্রাসাদটিকে।আমার অস্তিত্ব যেমন সত্য, তোমার অস্তিত্ব যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই ঘটনা।
কথা শেষ করে সন্ন্যাসী আবার শুয়ে পড়েছিলেন। শুয়ে থেকেই বললেন, তরুন সন্ন্যাসী বেটা, তোমাকে আরও বলি এই অধমকেও স্রষ্টা হিনা দয়া করে সেই প্রাসাদটি দেখিয়েছিলেন। এই চর্ম চোখে আমি তা দেখেছি।
বলে থেমেছিলেন গুরু সন্ন্যাসী মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার শুরু করেছিলেন, তোমার মত আমার মনে প্রাসাদের অস্তিত্ব নিয়ে বিস্ময় ছিলনা বটে, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য এক আকুতি ছিল আমার ঐ প্রাসাদটি দেখার জন্যে। এই আকুলতা নিয়ে আমি অবিরাম ঘুরে ফিরেছি অ্যাটল থেকে অ্যাটলে দিনের পর দিন। একদিন সন্ধ্যায় তাহানিয়া অ্যাটলের পাশ দিয়ে মাকাতিয়া দ্বীপে ফেরার সময় প্রবল ঝড়ের মুখে পড়ল আমার ছোট বোটটি। এ অঞ্চলে ঝড় হয় না। যদি কখনও হয়, তাহলে তাকে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন মনে করে যে যেখানে থাকে সে সেখানেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর ঝড় সম্পূর্ণ থেমে গেলে আবার জীবন-কর্ম শুরু করে। সে অনুসারে আমি তাহানিয়া অ্যাটলে আমার ছোট বোটটি বেধে সেখানেই অপেক্ষা করলাম। অস্থির সাগরের ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখলাম। মঙ্গলময় মমতাময় স্রষ্টা হিনা কিংবা তাঁর পাঠানো কোন স্বর্গীয় অ্যাঞ্জেল আমার কাছে এলেন। আলোয় ঢাকা তাঁর দেহ কিংবা বলা যায় আলোর এক অবয়ব তিনি। আমাকে বললেন, এসো মানব, আমার সাথে এসো। আমি উঠলাম, তাঁর পেছেনে পেছনে চললাম। বোঁট থেকে নেমে তাহানিয়া অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্ত থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর এক যায়গায় দাঁড়ালো জ্যোতির্ময় অবয়ব। তাকাল মাটির দিকে। আমিও তাকালাম। সেখানে দেখলাম সফেদ ফুলের একগুচ্ছ গাছের ছোট্ট ঝোপ। জ্যোতির্ময় অবয়বটি মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছায় ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’ এর ‘সিঁড়িমুখ’ বের হলো। সংগে সংগেই ফুলের গাছের ঝোপটি অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখানে মাটির নিচে কিছু একটা দেখা গেল। গোলাকার সফেদ পাথর। আবার বলল জ্যোতির্ময় অবয়বটি, সর্বশক্তিমানের ইচ্ছায় আমাদের পথ ছাড়ুন। কথার সাথে সাথেই পাশের মাটির ভেতরে হারিয়ে গেল সফেদ পাথরটি। সুন্দর সিঁড়িমুখ বের হয়ে পড়ল। সিঁড়িও সফেদ পাথরের। সেই সিঁড়িপথে ঢুকে গেলাম ভেতরে জ্যোতির্ময় অবয়বের সাথে। আসলেই ওটা প্যালেস। সম্মোহিতের মত আমি দেখেছি প্রাসাদটা। আয়তনে অনেক বড়, ছোট-খাটো একটা দ্বীপের সমান, তেমনি উচুর দিক দিয়ে কয়েক তলা হবে। এখানেই রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি ছিল? বলেছিলাম স্বাগত কণ্ঠে। জ্যোতির্ময় অবয়বের অ্যাঞ্জেল জবাবে বলেছিল, হ্যাঁ, এখানেই তাঁরা ছিল, এটাই ছিল তাঁদের বাড়ি। যতটা সম্ভব মানুষের কল্যান তাঁরা করেছে। কখন আমার প্রাসাদ দেখা শেষ হল আমি জানিনা। যখন আমার ঘুম ভাঙল, দেখলাম ভোর হয়ে গেছে। একটা স্বস্তি যেন আমার দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। মনের মধ্যে একই কথা বার বার ঘুরে ফিরে আসতে লাগল, স্বপ্নটা আমার কি সত্যি। সত্যিই কি অ্যাঞ্জেল এসেছিল আমার কাছে। প্রাসাদ কি আমি দেখেছি তাঁর সাথে গিয়ে, সত্যিই কি তাহলে প্রাসাদ আছে। সকাল হতেই আমি বোঁট থেকে নেমে অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্ত ধরে দক্ষিনে এগোতে থাকলাম। এখানে অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্তটি প্রশস্ত। যতই দক্ষিনে গেছে আরও প্রশস্ত হয়েছে। আমার চোখ সন্ধান করছিল সেই সফেদ ফুলের গাছের ঝোপ। পেয়ে গেলাম সফেদ ফুলের সেই ঝোপ। আমি বিস্মিত ও সম্মোহিতের মত দাড়িয়ে পড়লাম সফেদ ফুলের গাছের সেই ঝোপের পাশে। আমার গোটা শরীর রোমাঞ্চিত হলো। তাহলে স্বপ্ন আমার সত্য, অ্যাঞ্জেল সত্য, প্রাসাদও সত্য। আমি ছুটে গিয়ে বোঁট থেকে শাবল নিয়ে এলাম। সফেদ ফুলের গাছের ঝোপের পাশে গর্ত আকারে খুড়তে লাগলাম। মাটির দু’হাত গভীরে যাবার পর সত্যিই পেলাম স্বপ্নে দেখা সেই সফেদ পাথর। তাঁর মানে পাথর তুললেই সিঁড়ি। সিঁড়ির পড়েই সেই প্রাসাদ। সবই আমি পেয়ে গেলাম। প্রাসাদে ঢুকতে মন চায়নি। চাল-চুলাহীন সন্ন্যাসী, তাঁর তো প্রাসাদ দরকার নেই। যা দেখার সেটা তো অ্যাঞ্জেল আমাকে দেখিয়েছেন। গর্ত মাটি ঢেলে বন্ধ করে চলে এসেছিলাম। আর যাইনি। বলল তরুন সন্ন্যাসী, ‘মু’ মহাদেশের অবশিষ্ট স্মৃতি সেই প্রাসাদ সম্পর্কে আর জিজ্ঞাসা আছে? সৃষ্টির অশ্রু মোছাতে স্রষ্টা যে আসেন কিংবা সৃষ্টির আন্তরিক চাওয়া মেটাবার ব্যবস্থা করেন, সে বিষয়ে কোন বিস্ময় এখনও আছে?
গুরুজি একটি বিষয়, রাজপুত্র হেসানা সম্পর্কে আমার কোন কথা নেই। কারন সে পাপেতি রাজবংশের রাজকুমার আমরা জানি। কিন্তু ‘সাগরকন্যা’ তো বাস্তব নয়। বললাম আমি।
সন্ন্যাসী বলল, জানা গেছে, সে একটা জাহাজ ডুবির ফল। তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জ উত্তর পাশ দিয়ে গুয়েতেমালার দিকে যাবার পথে একটা জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। পরে জানা গেছে, জাহাজটি পশ্চিম এশিয়ার কোন এক আরব দেশের। জাহাজ থেকে আর কেউ বেঁচেছে কিনা জানা যায়নি, তবে একজন শিশুকন্যা বেঁচেছিল। শিশুকন্যাটি একটা ডলফিনের পিঠে ভাসছিল। ডলফিন গিয়ে ভেড়ে পলিনেশীয়ার কোন দ্বীপে। সে দ্বীপেরই বনচারী, সাগরচারী একটা পরিবার শিশুকন্যাকে ডলফিনের পিঠ থেকে নিয়ে নেয়। তারাই তাঁর নাম রাখে ভাইমতি বা সাগরকন্যা। আর তাঁর গলার লকেটে পাওয়া নামের পাঠোদ্ধার করে সেটা এভাবেই এসেছে। শিশু ভাইমতি শাবানু একদিন বড় হয়। বন ও সাগর হয় তাঁর বাধা-বন্ধনহীন বিচরনের ক্ষেত্র। পাখির মতই সে ঘুরে বেড়ায় বনে ও সাগরে। সাগরকন্যা শেষ পর্যন্ত সাগরকন্যাই হয়ে যায়। এই সাগরকন্যার সাথেই একদিন দেখা হয় সাগরচারী রাজপুত্র হেসানা হোসানার সাথে। প্রথম দর্শনেই স্রষ্টার ইচ্ছায় তাঁরা একে অপরের হয়ে যায়। এই কাহিনী আমি শুনেছি পূর্ব তাহিতির এক বৃদ্ধ জেলের কাছে। আমি নিশ্চিত, এই কাহিনির মধ্যে কোন অতিরঞ্জন নেই। বিকল্পও নেই এই কাহিনীর। থামল একটু গুরু সন্ন্যাসী। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, তরুন সন্ন্যাসী বল, আর কোন কথা, আর কোন প্রশ্ন?
আমি বললাম, না, আর কোন প্রশ্ন নেই গুরু সন্ন্যাসী। আমি চলে এসেছিলাম গুরুজির কক্ষ থেকে।
তারপর এক সময় আমিও গিয়েছিলাম তাহানিয়া দ্বীপে সেই সফেদ ফুল গাছের ঝোপের সন্ধানে। সেই ঝোপ পাইনি। ঝোপ না পাওয়ায় আমার আগ্রহ কৌতূহল বেড়ে গিয়েছিল, পাথর ও প্রাসাদ ঐভাবে আছে কিনা তা দেখার জন্যে। অনেক দিনের অনেক খোঁজাখুঁজি, অনেক খোঁড়াখুঁড়ির এক রাতের শুভ ভোঁরে দু’হাত মাটির গভীরে পেয়ে গেলাম সেই গোলাকার সফেদ পাথর। পাথর পাওয়ার সাথে সাথে আমার গুরু সন্ন্যাসীর মত সব পাওয়া হয়ে গেল। সফেদ পাথর সরিয়ে ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ারে’ প্রবেশ করতে মন চায়নি। ঘর-দোর ছাড়া পথের সন্ন্যাসী প্রাসাদ দিয়ে কি করব। যে কৌতূহল ছিল সেই কৌতূহল মিটিয়ে চলে এসেছি। থামল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
আমি গোগ্রাসে যেন গিলছিলাম তাঁর কথা এবং তাঁর গুরু সন্ন্যাসীর কথা। মনে হছিল আমি যেন, স্বর্গের চাবি পেয়ে গেছি। আমি অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জে গত তিন দিন ধরে যা খুজছিলাম, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি যেন পেয়ে গেছি। আনন্দ উত্তেজনায় মনে হল হার্টবিট আমার বেড়ে গেছে!
কথা শেষ করে বৃদ্ধ সন্ন্যাসী পাথরের বেঞ্চির উপর গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখ বুজে গিয়েছে তাঁর।
আমিও কোন কথা বললাম না।
নীরব আমরা। বয়ে চলল সময়। এক সময় চোখ খুলল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
তাকাল আমার দিকে। বলল বৎস ‘প্যালেস অফ ওয়েলফেয়ার’ তোমার কাজে লাগবে। সৃষ্টির উপর গবেষণা ভালো জিনিস। এটা হয় মানুষের মঙ্গলের জন্যেই। অতএব, তুমি প্যালেস অব ওয়েলফেয়ারের সদ্ব্যবহার করতে পারবে। তুমি যেমন চাও প্রাসাদটি সে রকমই। থামল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
স্বর্গ যেন কেউ আমার হাতে তুলে দিল।
আমি উঠে গিয়ে সন্ন্যাসিকে আভূমি প্রণাম করে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পা ছুয়ে বললাম, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার এই দানের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার নেই।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী দু’হাত জোর করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলল, সন্ন্যাসীদের জন্যে কোন কৃতজ্ঞতা নেই। কৃতজ্ঞতা সব ঈশ্বরের জন্যে।
বলে আবার চোখ বুজল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী। চোখ বুজে থেকেই বলল, যাও বৎস, ঈশ্বরের সম্পদ ঈশ্বরের জন্যে ব্যবহার কর। আমাদের হারানো ‘মু’ মহাদেশের রাজন্যদের ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’-এর যথার্থ ব্যবহার কর। ঈশ্বরের মত ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালবাস। তাহলে তাঁর রোষের মুখোমুখি তোমাকে কোনদিন হতে হবেনা।
আরও কোন নসিহত শোনার ভয়ে তাড়াতাড়ি তাকে একটা প্রণাম করে আমি চলে এলাম।
সুদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সুপ্রিম বস আলেক্সি গ্যারিন।
বৈঠকে উপস্থিত পাঁচ শীর্ষ নির্বাহীসহ চীপ অব অপারেশন জিজর, গোয়েন্দা প্রধান ডারথ ভাদের ও গৌরী পিনপতন নিরবতার মধ্যে আনন্দ, বিস্ময় ও কৌতূহলের সাথে আলেক্সি গ্যারিনের কথা শুনছিল। আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হলেও শ্রোতাদের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। বাস্তব ঘটনা যে রুপকথার চেয়েও বিস্ময়কর হতে পারে, এ কাহিনী তারই প্রমান।
আলেক্সি গ্যারিন দীর্ঘ কথা শেষ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। তবে শীঘ্রই সোজা হয়ে বসল। বলল, কাহিনী একটু দীর্ঘ হলেও তা তোমাদের বললাম, কিভাবে এই ঐতিহাসিক রাজকীয় প্যালেস পেলাম আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ প্রতিষ্ঠার জন্যে। ঈশর দিবে আমি বিশ্বাস করিনা। আমাদের প্রাপ্য বলে আমরা এটা পেয়েছি। বলে একটু থামল। মুহূর্ত কয়েক পর আবার শুরু করল, ঐতিহ্য ও নীতি-নৈতিকতায় আমি বিশ্বাস করিনা। সে জন্যই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী যে নীতি- নৈতিকতার উপদেশ আমাকে দিয়েছিলেন তা রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁদের প্রিয় ‘মু’ মহাদেশের রাজকীয় প্রাসাদের অংশ ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’ বলে কথিত প্রাসাদটিই আজ আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’।
ওয়েলফেয়ার কি জন্যে? ওয়েলফেয়ার প্রয়োজন দুর্বলদের। দুর্বলদের জন্যে আমাদের কিছু করার নেই বরং আমরা দুনিয়ার সবাইকে দুর্বল বানাতে চাই। শুধু সবল থাকবে, শক্তিশালী ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট ও সকল ক্ষমতার কেন্দ্র হবে আমাদের এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আলেক্সি গ্যারিন আবার বলল, বহু কষ্টে আমাদের এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ আমরা পেয়েছি। এর নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ প্রাইওরিটি। আহমদ মুসা কোন মিশন নিয়ে এখানে এসেছে আমি জানিনা। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর সাথে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য সে আমাদের চিনেছে, জেনেছে তাঁর কোন প্রমান আমি পাইনি। তবে তাঁর সাথে আমাদের সংঘাত শুরু হওয়ায় ধরে নেয়া যায় তাঁর মত বুদ্ধিমান লোক সবকিছুই জেনে যাবে।এটা অবধারিত ধরে নিয়েই আহমদ মুসাকে শেষ করার জন্যে সর্বান্তক চেষ্টা ও সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। বিপদ সম্পর্কে সবাইকে জানানো ও করনীয় ঠিক করার জন্যেই আজকের বৈঠকের আয়োজন। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
একটু নিরবতা।
নিরবতা ভেঙ্গে বলল একজন শীর্ষ নির্বাহী, মাই লর্ড, আপনি যা বলেছেন সেটাই আমাদের করনীয়। শয়তানটাকে শেষ করার লক্ষ্যে সর্বান্তক চেষ্টা ও সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে চীপ অপারেশন জিজর, গোয়েন্দা প্রধান ডারথ ভাদের ও গৌরীকে নিয়ে তিন সদস্যের একটি অপারেশন টীম গঠন করা হলো। এই টীম যাবতীয় উপায়-উপকরন ব্যবহার করবে এবং আহমদ মুসাকে খুঁজে বের করে, তাকে সার্বক্ষণিক নজরে রেখে যতটা সম্ভব শীঘ্রই তাকে শেষ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে তাঁর লাশও কিন্তু আমাদের পেতে হবে। সুযোগ পেলে কিংবা সুযোগ সৃষ্টি করে দেখামাত্র তাকে হত্যা করার চেষ্টা করতে হবে।
সবাই মাথা নাড়ল। কিন্তু মাথা নাড়তে পারল না গৌরী।
একটা চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
কি দোষ আহমদ মুসার? তাকে আমরা কিডন্যাপ করতে গেছি। সেটা করতে গিয়ে আমাদের পাঁচজন মরেছে। সে তো আত্নরক্ষা করেছে মাত্র! সে তো আমাদের আক্রমন করেনি। তাহলে দেখামাত্র গুলী কেন? তাকে না দেখলে, তাঁর ভেতরটা না জানলে এ প্রশ্ন তাঁর মনে হয়ত আসতো না। লাশ নেবে কেন আর তাঁর লাশ ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট বিক্রিই বা কেন করবে?
এসব নানা কথা, নানা প্রশ্ন গৌরীকে বিমূঢ় করে দিয়েছিল। তাই তাঁর লর্ড আলেক্সি গ্যারিনের কথায় সে সায় দিতে পারেনি।
টিমের কাজ শুরু হবে আজ এই মুহূর্ত থেকে। গুড নাইট সকলকে। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হবার সংগে সংগেই ফ্লোরের ভেতরে থেকে কালো টিউব উঠে এল। আলেক্সি গ্যারিনের চেয়ারের চারদিক ঘিরে দেয়ালের মত উঠে এল টিউবটা। উঠে চলল ছাদ ফুঁড়ে উপরে।
বৈঠকের সবাই উঠে বাউ করে দাঁড়িয়েছিল।
টিউব-লিফট উপরে অদৃশ্য হয়ে গেলে শীর্ষ নির্বাহী পাঁচজনের একজন গৌরীকে লক্ষ্য করে বলল, আমরা উঠতে পারি, ম্যাডাম গৌরী?
গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের পিএ এবং আলেক্সি গ্যারিনের ব্যক্তিগত বাহিনীর কমান্ডার হলেও আলেক্সি গ্যারিনের অনুপস্থিতিতে সেই তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে। আলেক্সি গ্যারিনের পার্সোনাল সেক্রেটারিয়েটও গৌরী দেখে। ফলে উপরের সবার চেয়ে গোপন বিষয় সে বেশি জানে। আরেকটা বিষয়ও সকলে ওপেন সিক্রেট আকারে জানে এবং সেটা হলো, গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের স্ত্রী নয় তবে ডি-ফ্যাকটো স্ত্রী হিসাবে রয়েছে। এই বিষয়টি গৌরীর জন্যে খুবই স্পর্শকাতর। পরোক্ষভাবেও গৌরী কোন সময় এ ধরনের কথার মুখোমুখি হলে খুবই রিঅ্যাক্ট করে। এমন ক্ষেত্রে লুকিয়ে তাকে কাঁদতে দেখা গেছে। কিন্তু ব্ল্যাক সানের শীর্ষ পর্যায়ের সবাই এক সময়ের পূর্ব মার্লিন এলাকার রুশ বংশোদ্ভূত মেয়ে গৌরীকে সমীহ করে চলে। গৌরী যেমন অসম্ভব সুন্দরী, তেমনি সাহসী, বুদ্ধিমতি, ক্ষিপ্র ও দারুন উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। Rise and fall of the dynasties of the world, বিষয়ের উপর পিএইচডি গৌরীর। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধ্যাপনা করার কথা ছিল। কিন্তু গৌরী প্রকৃতিগতভাবে সাহসী ও বেপরোয়া বলেই সাজানো একটা খুনের মামলার আসামী হয়ে তাকে পলাতক হতে হয়। এই অবস্থায় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট তাকে রিক্রুট করে। সাহস, মেধার জোরেই সে ব্ল্যাক সানের শীর্ষ পর্যায়ে উঠেছে।
মাই লর্ড চলে গেছেন। মিটিং শেষ হয়েছে। আপনারা অবশ্যই যেতে পারেন। বলল গৌরী।
এখনই একটা মিটিং সেরে ফেলতে পারি।বলল জিজর।
ঠিক। মাই লর্ড তো এখন থেকেই কাজ শুরু করতে বলেছেন। ডারথ ভাদের বলল।
এ ধরনের মিটিং-এর জন্যে প্রস্তুতি দরকার। তবে একটা প্রাথমিক আলোচনা হতে পারে। বলল গৌরী।
পাশের আরেকটা কক্ষের একটা গোল টেবিল ঘিরে বসে তাঁরা আলোচনা শুরু করল।
মিটিং চলল প্রায় একটা ঘণ্টা।
মিটিং শেষে বেরিয়ে আসার সময় গৌরী হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত ৪টা। হাসল গৌরী। তাঁদের সব কাজ রাতেই। নামটা তাঁদের সার্থক।
গৌরী তাঁর কক্ষে যাবার জন্যে এলিভেটরে উঠতে যাচ্ছিল। তাঁর মোবাইল বেজে উঠল। থমকে দাঁড়ালো গৌরী।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দেখল স্বয়ং তাঁর লর্ডের কল। তাড়াতাড়ি সাড়া দিয়ে বলল, ইয়েস মাই লর্ড, কোন হুকুম?
তুমি এখনই একটু আমার বাংলোতে চলে এস। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
অস্বস্তি, একটা অসহায়ত্ব যেন ছায়া ফেলল গৌরীর চোখে-মুখে। কিন্তু মুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল। বলল, ইয়েস মাই লর্ড, আমি আসছি।
বলে গৌরী অন্য একটি বিশেষ এলিভেটরে উঠল। সংগে সংগেই তা চালু হয়ে গেল। এ এলিভেটর সরাসরি গেছে আলেক্সি গ্যারিনের বেডরুমে। এ এলিভেটর তাঁর ইচ্ছাতেই মাত্র চলে।
৪
হাসপাতালে আহমদ মুসা যখন পৌঁছল তখন দশটা।
ইনফরমেশন ডেস্ক থেকে খোঁজ নিয়ে আহমদ মুসা তিন তোলার ১১ নাম্বার কেবিনে গিয়ে হাজির হল।
আহমদ মুসাকে দেখেই ছুটে এসে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরল তামাহি মাহিন। মারেভা মাইমিতিও আহমদ মুসার কাছে এসে বলল, স্যার, আপনি সুস্থ তো? সারারাত মনে হচ্ছে আপনার ঘুম হয়নি। কালকের পোশাকই তো পড়ে আছেন! এ কি আপনার জ্যাকেটের দুই হাতাতেই যে রক্ত! ঠিক আছেন তো আপনি?
আহমদ মুসা হাসল। বলল, মারেভা, আমি ভেবেছিলাম তোমার প্রশ্ন বোধ হয় শেষ হবে না। ধন্যবাদ শেষ করার জন্যে। এত….।
কথা বলা হল না আহমদ মুসার। তেপাও শোয়া থেকে উঠে বসেছিল। কথা বন্ধ করে আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে বলল, তুমি তো এই প্রথম সংজ্ঞালোপকারী গ্যাসের কবলে পড়েছ, তোমার সুস্থ হতে আরও কিছু সময় লাগবে। আর উঠে কি করবে। অন্তত কয়েক দিন গাড়ি চালাতে তুমি পারবে না।
ডাক্তারও তাই বলেছে। স্যার কি ঘটেছিল? আপনাকে না দেখা পর্যন্ত আমরা দারুন উদ্বেগে ছিলাম। ভোর বেলা আমরা হাসপাতাল থেকে টেলিফোন পাই, তেপাও নামে ট্যাক্সি চালককে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। সংজ্ঞা ফিরে পেয়েছে এই মাত্র। সে অনুরোধ করেছে আপনাদের হাসপাতালে আসার জন্যে। আমি মারেভাকে সংগে সংগেই নিয়েই চলে আসি। মারেভাও চলে আসে। তেপাও আমাদের জানায়, কি এক জিনিষ গাড়ির ভেতরে পড়ার সাথে সাথেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সে আর কিছুই জানে না। হাসপাতালের বেডে সে জ্ঞান ফিরে পায়। আমরা সংকিত হয়ে পড়ি যে, আপনিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং আপনি শত্রুর হাতে পড়েছেন। বলল মাহিন।
স্যার আপনাকেও অসুস্থ মনে হচ্ছে। আপনার জ্যাকেটের দুই আস্তিনে রক্ত। বলুন প্লিজ, কি ঘটেছিল, কি হয়েছিল আপনার?
নিশ্চয় বড় কিছু? বলল মারেভা মাইমিতি।
গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। বলল, সে অনেক কথা মারেভা। কেবিনের দরজা বন্ধ করে দাও বলছি।
মাহিন দৌড়ে গিয়ে কেবিনের দরজা বন্ধ করে ফিরে এলো।
তেপাও জ্ঞান হারিয়েছিল, কিন্তু আমি জ্ঞান হারাইনি। গোল বলটাকে গাড়ির ভিতরে পড়তে দেখেই আমি শ্বাস নেয়া বন্ধ করেছিলাম। কিন্তু অজ্ঞান হবার ভান করেছিলাম।
বলে আহমদ মুসা রাতের গোটা কাহিনী বলল। কিভাবে তাকে সংজ্ঞাহীন মনে করে ওঁরা ওদের গাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল হাত-পা বেঁধে। কিভাবে তাঁদের কাছে আহমদ মুসাকে হত্যার নির্দেশ আসে, কিভাবে আহমদ মুসা দাত দিয়ে হাতের বাঁধন ও পরে পায়ের বাঁধন সে খুলে ও সংজ্ঞাহীনের মত পড়েছিল, কিভাবে তাঁরা গাড়ির সিটেই তাকে হত্যার উদ্যোগ নেয়, কিভাবে সে গাড়ির পাঁচজনকে হত্যা ও দু’জনকে আহত করে নিজেকে রক্ষা করে, কিভাবে আবার সামনে ও পিছন থেকে শত্রুপক্ষের গাড়ি দ্বারা সে আক্রান্ত হয়, কিভাবে সে তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া বিস্ময়কর এক অস্ত্রে তাদেরকেই অকেজো করে দিয়ে ওদের ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর ওদের আকাশযান এক্সিকিউটর-১ ছুটে আসে তাঁকে হত্যার জন্যে, কিভাবে উপর থেকে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করে, কিভাবে সে আল্লাহ্র ইচ্ছায় নিজেকে রক্ষা করে এবং কিভাবে জ্যামিং মেশিন ফেলে দিয়ে এক্সিকিউটর-১ এর কবল থেকে সরে আসতে সক্ষম হয়-সব কথা সংক্ষেপে বলল আহমদ মুসা।
মারেভা, মাহিন ও তেপাও সবার চোখেই আতংক আর বিস্ময়। তাঁদের কারও মুখে কোন কথা নেই। বিস্ময় ও আতংকের ঘোরে নির্বাক হয়ে গেছে যেন তাঁরা!
আহমদ মুসাই নিরবতা ভাঙল। হাসল সে। বলল, কি হলো, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি! ভাবছ এত ঘটনা ঘটল কিভাবে রাতের একটা অংশে!
তা নয়, স্যার। একটা সত্য ঘটনা রূপকথার ভয় ও বিস্ময়কেও ছাড়িয়ে গেছে। আমরা সে ভয় ও বিস্ময়কে কাটাতে পারছি না।
বলে একটা ঢোক গিলেই আবার শুরু করল মারেভা, আপনার লাশ ১ বিলিয়ন ডলারে কিনতে চায় ওঁরা কারা? এবং কেন কিনতে চেয়েছিল?
ওঁরা পশ্চিমের একটি বড় সন্ত্রাসী গ্রুপ। যে কোন মুল্যে ওঁরা আমার মৃত্যু চায়। তাই আমার লাশ হাতে পেয়ে তাঁরা নিশ্চিত হতে চায়, আমি মরেছি। বলল আহমদ মুসা।
ওহ গড! বলে আঁতকে উঠল মারেভা আহমদ মুসার কথা শুনে। হতবাক হয়ে গেছে মাহিন ও তেপাও।
কিন্তু এরা কারা, যারা আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল, হত্যার চেষ্টা করেছিল? বলল মাহিন।
আমি যাদের সন্ধানে এসেছি, এরা তারাই। ওঁরা আমার পরিচয় পেয়ে গেছে। সেদিন অ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে গৌরী নামে যে মেয়েটিকে দেখেছিলে, সে ঐ দলেরই সদস্য। আমার সন্ধানেই সে রেস্টুরেন্টে এসেছিল। সে ও তাঁর লোকজনই আমাকে কিডন্যাপ করে। আহমদ মুসা বলল।
ওহ গড! তাহলে তো ওদের লোক নানাভাবে আমাদের ফলো করছে! বলল মারেভা।
কিন্তু ওঁরা চিনতে পারল কি করে আপনাকে? মাহিন বলল।
আমাকে আহমদ মুসা পরিচয়ে ওঁরা জানতো না আজ রাতের আগে। তোমাদের তাহানিয়া অ্যাটলে একটা sos আমি মনিটর করেছিলাম, মুলত সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যেই আমাকে ওঁরা কিডন্যাপ করেছিল। কিছু ঘটনা ঘটার পর ওঁরা জানতে পারে আমি আহমদ মুসা এবং এটা ওদের জানিয়ে দেয় পশ্চিমের ওদের মিত্র সংঘটনকে। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে ওঁরা এখন আপনাকে নিশ্চয় হন্যে হয়ে খুজছে? বলল মারেভা।
হ্যাঁ, আজ শেষ রাতে ওঁরা হোটেলে আমার রুম পর্যন্ত এসেছিল। ভোর পর্যন্ত ওৎ পেতে ছিল হোটেলের পেছনের রাস্তায়। আমি এটা আঁচ করেই হোটেল রুমে যাইনি। ওদের গতিবিধি দেখার জন্যে আমিও হোটেলের রাস্তায় অপেক্ষা করছিলাম। সকালে ওঁরা চলে গেলে আমি তেপাও-এর সন্ধানে এসেছি। বলল আহমদ মুসা।
তাঁর মানে আপনি সারারাত ও এখন পর্যন্ত বাইরে! আপনার বিশ্রাম নেই, খাওয়াও হয়নি আপনার নিশ্চয়? আপনি নিজে ঠিক না হয়ে এই অবস্থায় আপনি এসেছেন তেপাও-এর খোঁজে! বলল মাহিন।
আমি তেপাও-এর জন্যে উদ্বিগ্ন ছিলাম। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁর কি হলো, তারপর গাড়ি আবার হাইজাকিং-এর পাল্লায় পড়ে কিনা। তাই খোঁজ নিতেই এসেছি। বলল আহমদ মুসা।
তেপাও-এর চোখ ছলছল করে উঠেছে। বলল, স্যার আপনি সারারাত মৃত্যুর সাথে লড়লেন। যে কোন সময় যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারত। আপনারই রেস্ট বেশি দরকার। আর আপনি আমার খোঁজে ছুটে এসেছেন!
আচ্ছা যাক, বল, তুমি কিভাবে হাসপাতালে এলে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
এই হাসপাতালেরই একজন ডাক্তার আমাকে নিয়ে এসে ভর্তি করে দিয়েছে হাসপাতালে। তেপাও বলল।
স্যার, এবার চলুন নাস্তা করবেন। হাসপাতালের ক্যান্টিনে ভালো নাস্তার ব্যবস্থা আছে। বলল মাহিন আহমদ মুসাকে।
না, আগে হোটেলে ফিরে আমাকে ফ্রেশ হতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ঐ হোটেলে ফেরা তো আপনার ঠিক হবে না স্যার! ওঁরা নিশ্চয় পাহারা বসিয়েছে। বলল মাহিন।
না মাহিন, ঐ হোটেলে ফিরছি না। আমি একটা পাবলিক কল অফিস থেকে হোটেলকে জানিয়ে দিয়েছি, আমি মুরিয়া চলে এসেছি কয়েক দিনের জন্যে। শীঘ্রই ফিরব।
আহমদ মুসা একটু থামতেই মারেভা বলল, কিন্তু হোটেলে যেতে চাইছেন যে আপনি?
তবে আমি পাতুতোয়ায় হোটেল প্যাসেফিক ইন্টারন্যাশনালে একটা কক্ষ নিয়ে রেখেছি। সেখানেই যাব আমি। এখান থেকে কাছেও হোটেলটা। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় মারেভাদের চোখে-মুখে। বলল মাহিন, আপনি কি করে বুঝেছিলেন যে, হোটেলটা আপনাকে ছাড়তে হতে পারে?
আমি জেনে তা করিনি। আমাদের রসূল সঃ-এর এ ধরনের উপদেশ আছে, যৌবনে বার্ধক্যের চিন্তা করতে হয়, ভালো সময়ে খারাপ সময়ের কথা ভাবতে হয় ইত্যাদি। আমিও তাই ভালো সময়ে খারাপ সময়ের কথা চিন্তা করে ব্যবস্থা করে রেখেছি। বলল আহমদ মুসা।
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে একটু রেস্ট নেব। তারপর একটু স্বরাষ্ট্র বিভাগে যাবো ফরাসি সেই পুলিশপ্রধানের সাথে আলোচনার জন্যে। এরপর ফিরব হোটেলে। তোমরা সেখানে আসতে পারো। পরামর্শ করা যাবে।
ফরাসি সেই পুলিশ অফিসারের কাছে কেন? ওঁরা কি কিছু বলেছে? কিছু ঘটেছে? জিজ্ঞাসা মারেভার।
না, কিছু ঘটেনি। তাঁর সাথে দেখা করে আজকের ঘটনা ব্রিফ করতে চাই। যা ঘটেছে তাঁর কিছু তো তাঁদের জানা দরকার! যে কোন সময় তাঁদের সাহায্যেরও দরকার হতে পারে। বলল আহমদ মুসা। কথা শেষ করেই ‘আল্লাহ্ হাফেজ’ বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল আহমদ মুসা। ঠিক বেলা তিনটায় মারেভা ও মাহিন পাতুতোয়ার হোটেল প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনালে গিয়ে পৌঁছল।
আহমদ মুসা ঘুম থেকে উঠে তাঁদের স্বাগত জানাল।
স্যরি স্যার, আপনাকে আমরা ঘুম থেকে তুললাম। বলল মাহিন।
তোমরা বরং আমার উপকার করেছ। আমি দিনে ঘুমাই না। কখনও ঘুমালেও এক ঘণ্টার বেশি নয়। তোমরা না এলে দেখছি আমার নিয়ম ভঙ্গ হতো। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা টয়লেট থেকে ওজু করে ফ্রেশ হয়ে এসে বলল, এখন বোধ হয় কফি খেতে আমাদের ভালো লাগবে।
বলে আহমদ মুসা কফি বানানোর সরঞ্জামের দিকে এগোল।
মারেভা উঠে দৌড়ে গেল কফি পটের কাছে। বলল স্যার, ছোট বোনকে আর লজ্জা দিবেন না। আপনি গিয়ে বসুন।
আমি কফি তৈরিতে এক্সপার্ট না হলেও তা না খাওয়ার মত হবে না নিশ্চয়।
ধন্যবাদ। বলে আহমদ মুসা এসে সোফায় বসল। কফি এল।
মারেভা আহমদ মুসা ও মাহিনকে কফি দিয়ে নিজে এক কাপ নিয়ে ভিন্ন সোফায় গিয়ে বসল।
আহমদ মুসা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা মাহিন-মারেভা, আমি যদি বল আমি ‘মতু’তে যেতে চাই, তাহলে তোমরা কি বুঝবে?
মারেভারা একটু ভাবল।
মারেভাই প্রথম মুখ খুলল। বলল, পলিনেশীয় ভাষায় ‘মতু’ অর্থ দ্বীপ। সে অনুসারে আমি বুঝব, আপনি একটা দ্বীপে যেতে চান।
আমার কাছেও এটাই অর্থ স্যার। বলল মাহিন।
কিন্তু এভাবে কেউ কি বলে আমি ‘মতু’ যাব? আহমদ মুসা বলল।
না, তা বলে না স্যার। যে দ্বীপে যাবে, সে দ্বীপের নাম বলবে সেটাই স্বাভাবিক। বলল মারেভা।
কেউ যদি বলে ‘মতু’ যাব, তাহলে কি ধরে নেয়া হবে না যে, সে বিশেষ দ্বীপের নাম বলছে? আহমদ মুসা বলল।
জি স্যার, সেটাই ধরে নিতে হবে। বলল মারেভা ও মাহিন দু’জনেই।
‘মতু’ নামে কি কোন দ্বীপ আছে ফ্রেঞ্চ পলিনেশীয়ার বিশেষ করে মতুতোয়া অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জে?
দু’জনেই ভাবল কিছুক্ষন। বলল মারেভা। না ‘মতু’ নামে কোন দ্বীপ নেই এবং থাকা স্বাভাবিকও নয়। দ্বীপের নাম ‘দ্বীপ’ হতে পারেনা।
আমিও তাই মনে করি স্যার। বলল মাহিনও।
মাহিনের কথা শেষ হতেই মারেভা বলে উঠল, ‘মতু’ সম্পর্কে এত কথা বলছেন কেন স্যার? ‘মতু’ নামে দ্বীপই বা খুজছেন কেন স্যার?
আমি যখন অজ্ঞানের ভান করে ওদের গাড়িতে পড়েছিলাম, তখন তাঁদের আলোচনা থেকে জানলাম, আমাকে ‘মতু’তে নিয়ে যাবার কথা ছিল ওদের। কিন্তু নির্দেশ আসে আমাকে ‘মতু’তে নেয়া যাবে না। তাহিতিতেই তাঁদের কোন এক ঘাটিতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ হয়। গাড়ির গতি পরিবর্তন করে তাহিতির ঘাটির দিকেই চলতে শুরু করে। পড়ে অবশ্য আবার নির্দেশ আসে আমাকে কোথাও নেয়া যাবে না ঐ রাস্তাতেই আমাকে হত্যা করতে হবে। আমি ওদের ‘মতু’ বলা থেকে বুঝেছি, ‘মতু’ অবশ্যই একটা দ্বীপের নাম।
ঠিক বলেছেন স্যার, ‘মতু’ একটা দ্বীপেরই নাম হবে। প্রশ্ন হল, ‘মতু’ দ্বীপটি কথায়?
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। ভাবছিল সে। মনে পড়ল তাঁর এসওএস(SOS) এর কথা। এসওএস (SOS) সত্য এটা প্রমানিত হয়েছে, এবং সে এসওএস ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান ঘাটি ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ থেকেই। একথাও পরিস্কার যে, সেখানেই বন্দী ৭৬ জন বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ এবং সেখানেই বন্দী আছেন সৌদি আরবের বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মক্কী। আহমদ মুসা এসওএস ‘টি পেয়েছিল তাহানিয়া অ্যাটলের দক্ষিন মাথায় অবস্থান কালে। সেখান থেকে এক মাইলের মধ্যে বা আশেপাশে ‘মতু’ নামে কোন অ্যাটল দ্বীপ আছে কিনা! মারেভারা বলল, না এ নামে কোন দ্বীপ নেই। তাহলে কি ব্ল্যাক সানের লোকরা দ্বীপটির এই ছদ্মনাম দিয়েছে কিংবা তাঁরা কি দ্বীপের আংশিক নাম বলেছে?
আহমদ মুসা মাথা তুলে তাকাল মাহিনের দিকে। বলল, মাহিন তোমরা তাহানিয়া অ্যাটলের চারপাশের, বিশেষ করে ১ থেকে ২ মাইলের মধ্যে যে সব অ্যাটল দ্বীপ আছে সেগুলার কি নামের তালিকা দিতে পার?
অবশ্যই পারবো স্যার। হোটেলের মিডিয়া সেন্টারে কম্পিউটার আছে। কম্পিউটারের গোগলের স্যাটেলাইট ভিউতে গেলেই সব দ্বীপ ও তাঁর নাম পেয়ে যাব। বলে উঠে দাঁড়ালো মাহিন।
মারেভা, তুমিও যাও। বুদ্ধি শেয়ার করতে পারবে দু’জনে।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। মারেভা ভাবল, স্যার কি একা থাকতে চান কিছুক্ষন, না একা ঘরে মারেভার থাকা তিনি এড়াতে চাচ্ছেন। শেষটাই বোধ হয় ঠিক। আরও ভাবল, মারেভা ও মাহিনের এক সাথে ঘুরাও তিনি পছন্দ করছেন না। যাক, সত্তর তাঁদের বিয়েটা হিয়ে যাচ্ছে, তখন আর স্যারের কিছু বলার থাকবে না। আরেকটা কথা ভেবে ভালো লাগল মারেভার, ইসলাম ধর্ম মোতাবেক তাঁদের বিয়ে হচ্ছে! তাঁদের দুই পরিবারই ইসলাম গ্রহন করেছে।
চলে গেল মারেভা ও মাহিন।
ফিরে এলো তাঁরা মিনিট দশেকের মধ্যেই।
সিটে বসেই মাহিন বলল, স্যার আমাদের মিশন সফল। আমরা ‘মতু’ দ্বীপ পাইনি বটে, মতুতুংগা নামে একটা দ্বীপ পেয়েছি। ‘মতু’ শব্দসহ আর কোন দ্বীপের নাম মতুতুয়া দ্বীপপুঞ্জে নেই। সুতরাং আমরা মনে করি ‘মতু’ বলতে মতুতুংগা দ্বীপকেই বুঝানো হয়েছে।
কিন্তু ‘মতুতুংগা’ দ্বীপটি কোনটি? তাহানিয়ার দক্ষিনের দ্বীপটি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হ্যাঁ, দক্ষিনের দ্বীপটাই। বলল মারেভা।
কিন্তু, দ্বীপটা তো খুবই ছোট! ওঁর চারদিকের ল্যান্ড-লাইন খুবই সংকীর্ণ। ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’-এর জন্যে ওরকম দ্বীপ আইডিয়াল নয়। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু তাহানিয়ার আশেপাশে কেন গোটা দ্বীপপুঞ্জে ‘মতু’ শব্দসহ হন দ্বীপের নাম নেই। বলল মাহিন।
তা ঠিক। আমাকে দ্বীপটা আবার দেখতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু ঐ জায়গাটা তো আপনার জন্যে নিরাপদ নয়! আপনিই তো বলেছিলেন, ওদের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় আমাদের বোঁট, আমাদের তিনজনের চেহারা ধরা পড়েছিল। সেই ছবি ও বোটের নাম্বার দেখেই ওঁরা আমাদের খোঁজ পায়। তারমানে তাহানিয়া ও আশেপাশের দ্বীপপুঞ্জ ওদের ক্লোজ ক্যামেরার রেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং তাহানিয়া, মুতুতুংগা ও এর আশেপাশে যাওয়া, বিশেষ করে আপনার জন্যে এখন আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বলল মারেভা।
ঠিক মারেভা, কিন্তু ওখানে না গেলে তো সমস্যার জট খুলছে না। ‘মতু’ যদি মতুতুংগাই হয়, তাহলে তাঁর ভিন্নতর কিছু খুঁজে পাওয়া যাবেই। সেটা সাগরের উপরে হতে পারে, সাগর বক্ষেও হতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
একটু থেমেই আবার শুরু করল, আমি এখান থেকে বেরিয়ে যাব তাহিতি সরকারের ‘ওসান ও ওসান রিসোর্সেস ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তিয়ারে হিরেনুর কাছে। আজ গিয়েছিলাম তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান আর সেই পরিচিত মসিয়ে দ্যা গলের কাছে। তিনিই অধ্যাপক তিয়ারে হিরেনুর সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছেন। সাগরে যদি নামতে হয়, তাহলে তাঁর সাহায্য দরকার।
আপমি সাগরে নামবেন? বলল মাহিন।
নামবো না, নামতে যদি হয় তারই আগাম প্রস্তুতি। মতুতংগা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর, তাঁর বাইরেটা দেখার পর এই বিষয়ে চিন্তা করব। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার মোবাইলের স্ক্রিনে কয়েকবার বিপ বিপ শব্দ করে একটা লাল আলো জ্বলে উঠল। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হবার পর তা থেমে গেল।
আহমদ মুসার ভ্রু কুঞ্চিত হল। তাকাল মাহিনদের দিকে। বলল, তেপাও তো নিচে গাড়িতে আছে, না?
জি হ্যাঁ। বলল মাহিন।
তাহলে একটা কল করে বল, গাড়ি পার্ক করে থাকার সময় কেউ তাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করেছে কিনা?
সংগে সংগেই তাঁর সাথে কথা বলল মাহিন। কথা শেষ করে আহমদ মুসাকে বলল, গাড়ি পার্ক করার পাঁচ মিনিট পরে একজন লোক আসে, এবং বলে মাহিন ও মারেভা দু’জনেই আমার বন্ধু। তাঁদের এখানে আসার কথা আপনার গাড়িতেই। ওঁরা কথায় গেল? তেপাও বলেছে, এই হোটেলেই কোন কাজে গেছে। একথা শুনেই তাঁরা হোটেলে ঢুকেছে।
তোমরা রিসেপশনে কিছু বলেছ? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
আপনি রুম নাম্বার আমাদের দিয়ে আসেন নি। আমরা রিসেপশনে আপনার নতুন নাম বলে রুম নাম্বার জিজ্ঞাসা করেছি। বলল মারেভা।
মারেভা থামতেই মাহিন বলে উঠল, কেন এসব বলছেন স্যার, কিছু ঘটেছে?
আমার মনে হচ্ছে, তোমাদের ফলো করে কেউ এসেছে।
বিস্ময় ফুটে উঠল মারেভা ও মাহিন দু’জনের চোখে-মুখে। মারেভা বলল, কারা ফলো করেছে? ওঁরা?
হ্যাঁ ঠিক ধরেছ। বলল আহমদ মুসা।
তাঁর মানে ওঁরা আমাদের ফলো করে আপনার কাছে পৌছতে চায়। বলল মাহিন।
আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু বলা হলো না। তাঁর মোবাইলে কয়েকবার বিপ বিপ শব্দ উঠল, তাঁর সাথে মোবাইলের স্ক্রিনে চারটি লাল আলো ভিন্ন ভিন্নভাবে একই সাথে জ্বলে উঠেছে। সে চমকে উঠল। দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, মারেভা, মাহিন, তোমরা তাড়াতাড়ি এক পাশে সরে যাও। তাড়া……।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতে পারল না। প্রবল ধাক্কায় কক্ষের দরজা ভেঙ্গে পড়ল।
ধাক্কা দেয়া লোকেরা সামনে ঝুকে পড়েছিল। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে রিভলবার।
দরজায় ধাক্কা পড়ার প্রথম শব্দ কানে আসার সাথে সাথেই আহমদ মুসা মাথার পেছনে জ্যাকেটের গোপন পকেট থেকে দ্রুত রিভলবার বের করে তাক করল দরজার দিকে। রিভলবারের ট্রিগারে তাঁর তর্জনী।
দরজার পাল্লা পড়ে যেতেই দরজা ভেঙ্গে লোক দু’জন এসে গেল তাঁর রিভলবারের সামনে। নড়ে উঠল আহমদ মুসার তর্জনী অবিরামভাবে। সামনের দু’জন লোক গুলী খেয়ে পড়ে গেল দরজার উপরে।
গুলী অব্যাহত রেখেই আহমদ মুসা মেঝের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ওদিক থেকেও গুলী আসা শুরু হয়েছে।
আহমদ মুসা মেঝের উপর ঝাপিয়ে পড়ার পর দরজায় দাঁড়ানো অবশিষ্ট দু’জনের, যারা গুলী ছোড়া শুরু করেছে, তাঁদের টার্গেট পরিবর্তন হয়ে গেল। এরই সুযোগ গ্রহন করল আহমদ মুসা মেঝেয় গিয়ে পড়ার সংগে সংগেই। আহমদ মুসার রিভালবার থেকে শেষ দুটি গুলী বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসার গুলী যখন ওদের দু’জনের বুকে বিদ্ধ হল, তখন তাঁদের রিভলবারও আহমদ মুসা লক্ষ্যে সরে এসেছিল। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হবার পর তাঁদের তর্জনীও তাঁদের রিভলবারের ট্রিগারে চেপে বসেছিল বটে, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আহমদ মুসার পেছনের দেয়ালকে গিয়ে বিদ্ধ করল।
আহমদ মুসা গুলী করেই দ্রুত গড়িয়ে সরে গিয়েছিল ওদের গুলী এড়াবার জন্যে। কিন্তু ওদের টার্গেটে আসেনি, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।
একবার দরজার দিকে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। দেখল, মাহিন ও মারেভা মেঝেতে সোফার আড়ালে।
মাহিন, তোমরা ঠিক আছ। জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ভীত ও আতংকগ্রস্থ মাহিন, মারেভা উঠে দাড়াল। কম্পিত কণ্ঠে বলল, মাহিন আমরা ভালো আছি। তাঁদের চোখ গিয়ে নিবদ্ধ হলো চারটি লাশের উপর এবং দেখল আহমদ মুসার রিভলবারটাও।
দরজায় বেশ কিছু ভীত, বিস্মিত ও উৎসুক লোকের ভিড় জমে গেছে। হোটেলের ম্যানেজারও এসে গেছে।
আহমদ মুসা দরজার দিকে এগিয়ে বলল, ম্যানেজার সাহেব, এরা আমার রুমের দরজা ভেঙ্গে আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেছিল। আপনি পুলিশকে খবর দিন।
সংগে সংগেই ম্যানেজার তাঁর মোবাইলে টেলিফোন করল পুলিশকে।
সবাই পুলিশের অপেক্ষায়।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পুলিশ এসে গেল।
পিলিশ অফিসার এই রেঞ্জের প্রধান কর্মকর্তা হিমাতা হিরো হোটেলের ম্যানেজার ও আহমদ মুসার বক্তব্য গ্রহন করল। আহমদ মুসার বক্তব্য গ্রহন করার পর তাকে বলল, আমাদের স্যার মানে পুলিশ প্রধান মিস্টার দ্যাগল আপনার খুব ঘনিষ্ঠ, তাই না?
হা, পরিচিত। কেন? বলল আহমদ মুসা।
আমি তদন্তে আসার আগে এই হোটেলের এই রুমের ঘটনার বিষয়ে তাকে ব্রীফ করেছি। তিনি আপনার কথা আমাকে বলেছেন এবং আপনার নিরাপত্তার বিষয় দেখতে বলেছেন।
হ্যাঁ, তিনি খুব সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ, আপনি আপনার রিভলবারের লাইসেন্সটা আমাকে দেখান। এটা আমাদের রুটিন কাজ। আর আপনার রিভলবার ও লাইসেন্স আমাদের দিবেন। এটা কেসের জন্যে প্রয়োজন। আপনি আরেকটা রিভলবার ও লাইসেন্স এখনি পেয়ে যাবেন।
ধন্যবাদ। বলে আহমদ মুসা তাঁর রিভালবার ও লাইসেন্স পুলিশ অফিসারকে দিল।
পুলিশ কক্ষের দরজা ও নিহতদের বিস্তারিত ফটো গ্রহন করল। তারপর নিহত আক্রমণকারীদের রিভলবারগুলো কাপড় জড়িয়ে সাবধানে সংরক্ষনে নিল। লাশগুলোও নিয়ে গেল পুলিশ।
হোটেল ম্যানেজমেন্ট আহমদ মুসাকে অন্য একটি কক্ষে শিফট করল ঘরটা ঠিক করার জন্যে।
আহমদ মুসার সাথে মারেভা ও মাহিনও নতুন কক্ষে এল। আহমদ মুসা নতুন কক্ষে উঠতে গিয়ে দেখল, কক্ষের সামনের করিডোরে দুই প্রান্তের মুখে দু’জন করে চারজন পুলিশের প্রহরা রয়েছে।
কক্ষে প্রবেশ করেই মারেভা বলল, আমি পুলিশ আসার খবরে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। নিশ্চয় আপনার বন্ধু পুলিশ কর্মকর্তা আপনাকে সাহায্য করেছেন।
হ্যাঁ, সেটা তো অবশ্যই। তাছাড়া আমি তো বেআইনি কিছু করিনি। আত্নরক্ষার অধিকার সকলের আছে। আমি তাঁদের না মারলে তাঁদের হাতে আমাকে মরতে হতো। দেখামাত্র গুলী করার নির্দেশ নিয়েই তারা এসেছিল এবং তারা তাই করেছিল। আমার রিভলবারও বেআইনি ছিল না। আহমদ মুসা বলল।
দরজা ভাঙ্গার পর যা কিছু ঘটল তাকে অবিশ্বাস্য এক রূপকথার মত মনে হচ্ছে! ভয়ে আমার শ্বাসরুদ্ধ হবার মত হয়েছিল। কিন্তু কখন, কিভাবে, কোথেকে আপনি রিভলবার বের করলেন এবং একা চারজনকেই হত্যা করলেন, আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনে হলো আপনি প্রস্তুত ছিলেন। বলল মাহিন।
আমাদের কেউ ফলো করেছে, তা আপনি কি করে বুঝলেন? বলল মারেভা।
আহমদ মুসা তাকাল মারেভাদের দিকে। বলল, আমার দরজার সামনে কার্পেটের ভেতরে পরিকল্পিতভাবে কয়েকটি অ্যাংগেলে আলপিনের গোঁড়ার মত ক্ষুদ্র কয়েকটা আলট্রা সেনসেটিভ ইলেকট্রিক সিগন্যালার পেতে রাখা ছিল। তোমরা আমার রুমে আসার মিনিট সাতেক পর একজন লোক এসে আমার দরজার সামনে এসে দাড়ায়। পনেরো সেকেন্ডের মত দাড়িয়ে চলে যায়। আমার মোবাইলে এর সিগন্যাল আমি পেয়ে যাই। আমার সন্দেহ হয়, তোমাদের ফলো করা হয়েছে এবং তাঁদের একজন আমার রুমটা এসে চিনে গেল। আমি তেপাও-এর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম যে, তোমাদের ফলো করা হয়েছে। আমাদের কথা বলার ফাঁকেই ওঁরা প্রস্তুত হয়ে আমার দরজায় এসে দাড়ায়। চারটি সিগন্যাল পাই আমি আমার মোবাইলে। বুঝতে পারি ওঁরা চারজন এসেছে। এবার কক্ষ দেখার জন্যে নয়, আমাকে হত্যার জন্যে। আমি ভেবেছিলাম, ওঁরা দরজায় নক করবে, আমি খুলতে যাব অবশ্যই, তখনই ওঁরা আমাকে গুলী করবে এক সাথে পয়েন্টেড ব্ল্যাংক। এতে ওদের একজন মরলেও আমাকে ওঁরা মারতে পারবে, এই চিন্তাই তারা করবে। কিন্তু তারা ভুল করে।
কি ভুল করে? জিজ্ঞাসা মারেভার।
ওঁরা দরজায় টোকা দিয়ে আমাকে সতর্ক করে দিতে চায়নি। ওঁরা চেয়েছে, আচমকা দরজা ভেঙ্গে অপ্রস্তুত অবস্থায় আমার উপর ঝাপিয়ে পড়তে। কিন্তু তা হয়নি। আমি সতর্ক ছিলাম। ওরাই দরজা ভাঙতে গিয়ে সামনের দু’জন কিছুটা হলেও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং ওদের সকলেরই রিভালবার আমাকে দেখার পর আমাকে লক্ষ্য করে উঠে আসতে বিলম্ব করে। এরই সুযোগ গ্রহন করে আমার তৈরি থাকা রিভালবার, প্রথমে সামনের দু’জনকে, পড়ে পেছনের দু’জনকে হত্যা করে। আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে শুনছিল মারেভা ও মাহিন আহমদ মুসার কথা। কি অদ্ভুত তাঁর প্রতি সেকেন্ডে প্রতি মুহূর্তের হিসাব! প্রতি মুহূর্তের সুযোগের কি অদ্ভুত সদ্ব্যবহার! দরজা ভাঙতে গিয়ে ওদের প্রস্তুতি ও মনোযোগের সামান্য যে বিচ্ছিন্নতা তাকে ব্যবহার করেই আহমদ মুসা বিজয়ী আর ওঁরা পরাজিত, মৃত।
আহমদ মুসা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে এক ঝাক গুলীর শিকার তিনিই হতেন। জীবন আর মৃত্যু কত কাছাকাছি! ভাবতে গিয়ে বুক কেপে উঠল মারেভার। চোখ দুটি বিস্ফরিত মাহিনের।
আপনি বুঝতে পেরেছেন, ওঁরা এসেছে আপনাকে হত্যা করতে, আপনার ভয় লাগেনি? জিজ্ঞাসা করল মাহিন।
ভয় কি জন্যে? বলল আহমদ মুসা।
কেন। মৃত্যুর? মাহিন বলল।
মৃত্যু আল্লাহ্র নির্দেশ ছাড়া আসে না। সুতরাং মৃত্যু ভয় করার বিষয় নয় এবং কেউ মৃত্যু কামনা করুক আল্লাহ্ তা চান না। সেজন্যই আত্নরক্ষাকে অবশ্য কর্তব্য বলা হয়েছে। আমি সে চেষ্টা করেছি। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার! স্রষ্টা বা আল্লাহ্র পরিচয়, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। ক’দিনে আপনি অনেক কিছু শিখিয়েছেন আমাদের। মারেভা বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, শেখা, মানা ও করা কিন্তু এক জিনিষ নয় মারেভা।
স্যার, আপনি জানেন না, আমরা মানছি এবং করছিও। মারেভা বলল।
আমরা মানে কে? বলল আহমদ মুসা।
আমরা মানে আমাদের দুই পরিবার। আপনি একদিন বাসায় আসুন, বিস্মিত হবেন। আমাদের ড্রয়িং রুমের পাশের ঘরটা এখন নামাজ ঘর। আমার মাথা গায়ে যে ওড়না দেখছেন, তা এখন আমাদের সব মেয়ের মাথায়। মারেভা বলল।
ধন্যবাদ তোমাদের। আহমদ মুসা বলল।
স্যার, এখন আমাদের প্রতি আপনার নির্দেশ কি? বলল মাহিন।
তোমাদেরকে আগামী কয়েকদিন বা কিছুদিন বাড়িতে থাকা চলবে না। আহমদ মুসা বলল।
কেন স্যার, কিছু আশংকা করছেন? বলল মাহিন।
অবশ্যই। তোমরা ওদের নজরদারিতে রয়েছ। তোমাদের মাধ্যমে আমাকে ওঁরা খুঁজে পেতে চায়। না পেলে এমনকি ওঁরা তোমাদের আটকও করতে পারে যাতে আমাকে পাওয়ার ওদের একটা ব্যবস্থা হয়। আহমদ মুসা বলল।
মারেভা ও মাহিনের মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। মারেভা বলল, ঠিক স্যার। ঠিক বলেছেন আপনি। এটা তারা করবে।
আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার, ওঁরা এই চেষ্টা করবে। আজও ওঁরা আমাদেরকে অনুসরন করেই এখানে এসেছে। মাহিন বলল।
স্যার, একটা কথা। আহমদ মুসার দিকে না তাকিয়েই বলল মারেভা।
কি কথা বল? আহমদ মুসা বলল।
মাহিন, তুমিই বল না। মাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল মারেভা। রহস্যময় একটা লজ্জা এসে জড়ো হয়েছে যেন মারেভার মুখে। লাল হয়ে উঠেছে তাঁর মুখ।
মাহিনের মুখেও লজ্জা এসে জুটল। বলল, জড়সড় হয়ে, ও আমাদের বিয়ের কথা বলতে চাচ্ছে স্যার। সেতার কি হবে?
বিয়ে হতেই হবে, কবে যেন হচ্ছে বিয়ে? আহমদ মুসা বলল।
আগামী শুক্রবার, স্যার। তারিখটা তো আপনারই দেয়া স্যার!
হ্যাঁ, দাওয়াতের জন্যে তো কার্ড হচ্ছে না? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
না, হচ্ছে না। আপনি তো নিষেধ করেছেন।
আপনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই শুধু আত্মীয়দের নিয়ে ঘরোয়া অনুষ্ঠান হচ্ছে। মাহিন বলল।
তাই বলে ঘরে হচ্ছে না তো! বলল আহমদ মুসা। আমাদের এলাকার ক্লাব ভাড়া নেয়া হচ্ছে। তবে সেখানে আলোকসজ্জার বাইরে কিছু হবে না। নেম-সাইন বোর্ডও থাকবে না। মাহিন বলল।
ধন্যবাদ। তোমরা কোথায় থাকবে বলে ঠিক করেছ? বলল আহমদ মুসা।
আব্বা-আম্মাদের সাথে পরামর্শ করে আমরা সেটা ঠিক করব। তবে অমনটা হবে না। আমাদের পাড়াতেই আমাদের আন্টিদের বাসা। সেখানেই আমাদের থাকতে হবে। মাহিন বলল।
দুঃখিত, আমার কারনেই তোমরা এই বিপদে পড়লে। বলল আহমদ মুসা।
বিপদ হলেও বিপদটা খুব আনন্দের স্যার। আপনার সাথি হতে পারা এক দুর্লভ গৌরব। স্যার, এই প্রথম বুঝতে পারছি আমাদের জীবনের মুল্য আছে। মারেভা বলল।
জীবনকে বুঝতে পারার জন্যে ধন্যবাদ।
মুহূর্ত কয়েকের জন্যে থামল আহমদ মুসা। আবার বলল, তোমরা সকালে বাড়ি থেকে বেরুবার পর তোমরা কি আর বাড়ি গিয়েছিলে?
না, যাবার সময় হয়নি। বলল মারেভা।
তাহলে তোমাদের বাড়ি যাওয়া দরকার। আহমদ মুসা বলল।
আপনি অনুমতি দিলে আমরা যেতে পারি। কিন্তু আপনি তো একা! তেপাও কি থাকবে এখানে? জিজ্ঞাসা মাহিনের।
অনুমতির প্রশ্ন কেন? তোমরা স্বাধীন ইচ্ছায় এসেছ, স্বাধীন ইচ্ছাতেই যখন ইচ্ছা তখন যাবে। কিন্তু ভাবছি তোমরা যাবে কিভাবে! আহমদ মুসা বলল।
এ নিয়ে ভাবনা কেন স্যার? বলল মাহিন।
তোমাদের যাতায়াতও এখন নিরাপদ নয়। হোটেলের সামনে ওঁরা নিশ্চয় পাহারায় আছে। তোমাদেরকেও ওঁরা ধরে নিয়ে যেতে পারে। আমাকে হাতে পাওয়ার এটা তাঁদের একটা কৌশল হতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে? বলল মারেভা।
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, ঠিক আছে হোটেলের পেছন দিক দিয়ে চলে যাবার ব্যবস্থা করছি। হোটেলের কেউ একজন তোমাদেরকে হোটেলের পেছন দিকের পথ দেখিয়ে দেবে।
বলে একটু থেমে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, একটা কথা, তোমরা এভাবে আমার কাছে আর এসো না। বিপদ তোমাদের এড়িয়ে চলতে হবে। আর আমাকে এখানে কিংবা ঐ হোটেলে নাও পেতে পার। পুলিশ নিষেধ না করলে আমি এখান থেকে অন্য কোন হোটেলে চলে যেতে পারি। টেলিফোন যোগাযোগেও অসুবিধা হতে পারে। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারি। আজকালের মধ্যেই আমি অ্যাটল দ্বীপে যাব।
একা? আমাদের সাথে নেবেন না? জিজ্ঞাসা মাহিনের।
না, মাহিন। আমাকে একাই যেতে হবে, ছদ্মবেশে অথবা সুযোগ হলে ট্যুরিষ্টদের সাথে যেতে পারি। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু স্যার, আপনার সাথে যাওয়ার চাইতে না যাওয়া আমাদের জন্যে বেশি কষ্টকর হবে। বলল মারেভা।
আমার জন্যে এ কষ্ট তোমাদের করতে হবে।
তোমাদের অনেক বিপদে জড়িয়েছি, এখন আর নয়। তবে প্রয়োজন বোধ করলেই তোমাদের ডাকব। আহমদ মসা বলল।
আপনিই ওদের টার্গেন স্যার। আপনি কি করে সেখানে যাবেন? বলল মারেভা। মুখ তার ম্লান। উদ্বেগও তার চোখে-মুখে।
বিপদ তো আছেই! বিপদের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে হবে। ওদের হাতে ৭৫ থেকে ৭৬ জন্য বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ বন্দী আছে। ওদের বিপদ আমার বিপদের চেয়ে বেশি। মাহিন, মারেভা! জীবন বাজী রেখে অগ্রসর না হলে ওদের বাঁচানো যাবে না। বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ নিরব, শান্ত, হৃদয়স্পর্শী।
আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। কিন্তু আমরা উদ্বেগে থাকব। বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল মারেভা।
মাহিনের চোখও অশ্রুশিক্ত।
তাদের অশ্রু আহমদ মুসাকেও স্পর্শ করল। তাহিতির মত দূরতম স্থানে এসেও মারেভা-মাহিনের মত ভাইবোন পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। অজান্তেই তার দুই চোখের কোণ ভিজে উঠেছিল। বলল, মাহিন মারেভা, যুদ্ধক্ষেত্রের জন্যে বড় ভাইকে অশ্রু দিয়ে নয়, হাসি দিয়ে বিদায় দিতে হয়, বিশেষ করে মুসলমানদের এটা একটা ঐতিহ্য।
আমাদের বিশ্বাস, জ্ঞান কোনটাই অমন শক্ত নয়। আমাদের মাফ করুন। বলল মারেভা ও মাহিন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, নিজেকে ছোট মনে করা বড় হওয়ার সিঁড়ি মারেভা। যাক। আমি হোটেলের কাউকে ডেকে বলে দিচ্ছি, সে তোমাদের হোটেলের পেছন দরজা দিয়ে বের করে দেবে। এদিকের সব ঠিকঠাক করে আমিও বের হবো।
বলে আহমদ মুসা টেলিফোনে হোটেলের একজন অফিসারকে কল করল।
টেলিফোন রেখেই আহমদ মুসা মারেভাদের বলল, তোমরা এখন কোথায় যাবে, কোন রুটে যাবে?
আমি মারেভাকে তার বাড়িতে রেখে আমার বাড়িতে যাব। এখান থেকে সোজা গিয়ে হাইওয়েতে উঠব। সেখান থেকে আমার বাড়িতে সোজা পথ একটাই, সেটা আপনি জানেন। রুট সম্পর্কে কি আপনি কিছু বলতে চান স্যার? বলল মাহিন।
না মাহিন…। কথা শেষ হলো না আহমদ মুসার। দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা কথা বন্ধ করে বলল, হোটেলের লোক এসে গেছে। দরজা খুলে দাও।
হোটেলের একজন কর্মচারী ঘরে ঢুকল।
আহমদ মুসা তাকে সব বুঝিয়ে বলল এবং বলল, চল, আমিও এগিয়ে দিয়ে আসব।
আহমদ মুসা পেছনের গেট পর্যন্ত গিয়ে ওদের বিদায় দিয়ে এল।
এসেই সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল জুতাসহ পা খাটের নিচে রেখে।
শুয়েই মনে হলো শরীর বিশ্রাম চায়।
চোখ জুড়ে তার তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে হলো ড্রাইভার তেপাও-এর কথা। সে বেচারা তো কার পার্কে বসেই আছে! তাকে তো যেতে বলা হয়নি!
তাড়াতাড়ি আহমদ মুসা উঠে বসল।
বিছানার উপর থেকে মোবাইল নিয়ে আহমদ মুসা তেপাওকে টেলিফোন করল। বলল, স্যরি, তেপাও তুমি অনেক কষ্ট করলে।
না স্যার, কোন কষ্ট হচ্ছে না। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আর একটা কথা স্যার। তিনজন লোক হোটেল থেকে বের হওয়ার পর গেটের দিকে চোখ রেখে এখানে ঠায় বসেছিল। গল্প করার ছলে জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল, তাদের সাহেব ভেতরে আর তার জন্যে তারা অপেক্ষা করছে। কিন্তু এইমাত্র এসে বলল, তাদের সাহেব চলে যেতে বলেছে। চলে যাচ্ছে তারা। কিন্তু হোটেল থেকে চলে না গিয়ে তারা তড়িঘড়ি হোটেলের পেছন দিকে চলে গেল। ওদের গতিবিধি কিন্তু শুরু থেকেই ভালো লাগেনি।
হোটেলের পেছনে গেছে? ঠিক দেখেছ? দ্রুত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
ঠিক দেখেছি স্যার। বলল তেপাও।
তেপাও, তুমি তাড়াতাড়ি গাড়ি হোটেলের বাইরে নিয়ে একটু দূরে দাঁড় করাও। আমি হোটেলের পেছন দিক দিয়ে আসছি। হোটেলের সামনে ওদের আরও লোক থাকতে পারে। তাড়াতাড়ি কর তেপাও।
বলে আহমদ মুসা কল অফ করে দিয়ে তৈরি হয়ে দ্রুত হোটেলের পেছন দিয়ে বেরিয়ে এল। একটু এসেই গাড়ি পেয়ে গেল। তেপাও অপেক্ষা করছিল। তেপাও সালাম দিল আহমদ মুসাকে।
সালাম নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে আহমদ মুসা বলল, তুমিও ইসলাম গ্রহণ করেছ তেপাও?
কিভাবে গ্রহণ করতে হয় জানি না। মারেভা, মাহিন সাহেবরা যা শিখিয়েছে আমি তা ঠিক ঠিক করি। আর কি করতে হবে বলুন স্যার। তেপাও বলল।
আমাদের ধর্মের কি তোমার ভাল লেগেছে, তেপাও? বলল আহমদ মুসা।
স্রষ্টা এক, এটা আমার খুব ভালো লেগেছে স্যার। আরেকটা বিষয় হলো, স্রষ্টার পূজা-আরাধনা সকলের জন্যে সমান ও সকলে স্বাধীনভাবে এটা করতে পারে। হাটে-মাঠে-ঘাটে-মন্দিরে সর্বত্র এবং এটা প্রতিদিনের বিষয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আপনি। আপনার মধ্যে ধর্মের যে ছবি দেখেছি, সেটা আমরা গ্রহণ না করে পারিনি স্যার। তেপাও বলল।
ধন্যবাদ তেপাও। ইসলাম হলো মানুষের স্বভাব-ধর্ম। মানুষের বিবেক যা বলে, ইসলাম তাই করতে বলে। বিবেক হলো মানব-মন ও মানব-মস্তিষ্কের জন্যে স্রষ্টার দেয়া বিধিবদ্ধ একটা প্রকৃতি। আল্লাহর বাণীবাহক বা মেসেঞ্জাররা দুনিয়াতে আসেন এই মানব প্রকৃতিকে সাহায্য ও শক্তিশালী করা জন্যে। সুতরাং যারা সত্য ধর্ম সঠিকভাবে মেনে চলে তারাই সত্যিকার মানুষ হয়। তেপাও, আমি সেই মানুষ হবার চেষ্টা করি মাত্র। বলল আহমদ মুসা।
সত্যিই আপনি আপনার আচরণের মত সুন্দর কথা বলেন স্যার, যদিও সব কথা বুঝা আমার জন্যে কঠিন হয়। তেপাও বলল।
গাড়ি ষ্টার্ট আগেই দিয়েছিল তেপাও। বলল, কোথায় যাব স্যার?
মারেভা ও মাহিন বাড়ি যাচ্ছে। ওদের ফলো করতে হবে। সোজা দক্ষিণের পথটা ধরে হাইওয়েতে ওঠ। তারপর মারেভা ও মাহিনের বাড়ি। তোমার কথা সত্য হলে শত্রু তাদের ফলো করছে। মারেভারা বিপদে পড়তে পারে। আহমদ মুসা বলল।
বুঝেছি স্যার, মাহিন ও মারেভা ম্যাডাম তাহলে হোটেলের পেছন দরজা দিয়ে বের হয়েছিল। শয়তানরা সামনের মত পেছনেও পাহারায় ছিল এবং সামনের ও পেছনের লোকরা একত্র হয়ে তাদের ফলো করেছে।
হ্যাঁ, তেপাও, এটাই ঘটনা। যতটা সম্ভব জোরে চালাও। ওদের ধরতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
মাহিন সাহেব ও মারেভা ম্যাডামকে টেলিফোন করে সাবধান করে দেয়া যায় না স্যার? ওরা কোথায় এখন তা জানাও যাবে। তেপাও বলল।
ধন্যবাদ তেপাও। বিষয়টা আমার খেয়ালই হয়নি।
বলেই আহমদ মুসা কল করল মাহিনকে।
মাহিন ওপ্রান্ত থেকে বলল, বলুন স্যার, কোন খবর, কোন নির্দেশ?
তোমরা কি তোমাদের পেছন দিকে লক্ষ রেখেছ?
আমি মনে করছি, একটা গাড়ি তোমাদের ফলো করছে। আহমদ মুসা বলল।
এখন থেকে লক্ষ্য রাখছি স্যার। ওরাই কি ফলো করছে? বলল মাহিন।
হ্যাঁ ওরাই। শোন মাহিন, ওরা সংখ্যায় কম পক্ষে চারজন। তার উপর ওদের হাতে অস্ত্র আছে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ওরা এখন পাগল। সুতরাং কোনভাবেই ওদের হাতে পড়া তোমাদের চলবে না। তোমরা….।
আহমদ মুসার কথার মধ্যেই মাহিন বলে উঠল, স্যার, ছোট মাইক্রো ধরনের একটা গাড়ি আমাদের ফলো করছে বলে মনে হচ্ছে। এখনও দেড়শ ২শ’ গজ পেছনে আছে।
মাহিন, তোমরা তো এখনও হাইওয়ে পাওনি! এ রাস্তায় কোন বড় সুপার মার্কেট আছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
জি স্যার, আমরা এখনও দক্ষিণমুখী রাস্তায়। তবে আমাদের সামনেই হাইওয়ে। দু’এক মিনিটের মধ্যেই হাইওয়ের ক্রসিং-এ আমরা পৌঁছে যাব। সেখানে বড় সুপার মার্কেট আছে স্যার। মাহিন বলল।
সুপার মার্কেটটি মোড়ের বামে মানে তোমাদের গাড়ির লাইনে পড়ে কিনা? বলল আহমদ মুসা।
জি স্যার, হাতের বামে। মাহিন বলল।
শোন, তোমরা মোড়ে গিয়ে সুপার মার্কেটের কারপার্কে গাড়ি পার্ক করেই দ্রুত সুপার মার্কেটে ঢুকে যাও। তারপর…।
আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে মাহিন বলে উঠল, ওরাও তো সুপার মার্কেটে ঢুকে যাবে এবং আমাদের ধরে আনতে পারবে।
হ্যাঁ, পারবে। কিন্তু ততক্ষণে সুপার মার্কেটের কারপার্কিং-এ আমরাও পৌঁছে যাব। আমরা এই সময়টুকুই চাই। তোমরা সুপার মার্কেটে ঢুকলে সেই সময় আমরা পেয়ে যাব। আহমদ মুসা বলল।
মারেভাকে নিয়েই চিন্তা স্যার। বলল মাহিন।
ভয় নেই মাহিন। মার্কেটে ঢুকে ওরা তোমাদের ধরে আনবে, এর জন্যে মানসিকভাবে তোমরা প্রস্তুত থাক। কিন্তু ওরা মার্কেটে না ঢুকে কার পার্কিং-এ তোমাদের জন্যে অপেক্ষাও করতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
আচ্ছা স্যার, এখন আর ভয় করছে না। আপনার জন্য অপেক্ষা করব আমরা। বলল মাহিন।
আমরা আসছি। তুমি ড্রাইভারকে গাড়ি জোরে চালাতে বল। ওরা কারপার্কে পৌঁছার আগে অন্তত তোমরা সুপার মার্কেটের গেটে পৌঁছেছ, এটা নিশ্চিত হওয়া চাই। আর একটা কথা, ওরা মার্কেটে ঢুকে যদি তোমাদের কিডন্যাপ করতে চায়, তাহলে কিডন্যাপের সময় হৈ চৈ, চিৎকার করে এ কথা জানান দেবে, ওরা তোমাদের কিডন্যাপ করছে। এটা আমাদের সাহায্যে আসবে। আহমদ মুসা বলল।
ইনশাআল্লাহ স্যার। দোয়া করুন। বলল মাহিন।
আমিন! ‘আল্লাহ হাফেজ!’ বলে আহমদ মুসা কল অফ করে দিল।
৫
আহমদ মুসাদের গাড়ি যখন সে সুপার মার্কেটের কারপার্কিং-এ প্রবেশ করছিল, তখন ওরা তিনজনে ধরে মাহিনকে চ্যাং দোলা করে গাড়িতে তুলছিল।
আহমদ মুসা মাহিনকে গাড়িতে তুলতে দেখল। বুঝল মারেভাকে আগেই গাড়িতে পুরা হয়েছে। মারেভার চিৎকারও শোনা যাচ্ছে।
মারেভা ও মাহিনের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার চারদিকের পরিবেশকে সত্যিই আতংকিত করে তুলেছে। আসলেই তারা অভিনয় করছে না, আতংকগ্রস্ত হয়ে বাঁচার জন্যে চিৎকার করছে। নিখুঁত অভিনয় ও বাস্তব আচরণের মধ্যে আসলেই বোধ হয় কোন পার্থক্য নেই।
তাদের চিৎকারে সুপার মার্কেটের সামনে অনেক লোক জমেছে। মার্কেটের ভেতর থেকেও লোক বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কেউ কিছু করছে না। তাদের দিকে ষ্টেনগান তাক করে আছে কিডন্যাপারদের সহচর একজন। তারা আগে ফাঁকা গুলিও ছুঁড়েছে। তাতেই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সকলে।
গাড়ি থামতেই আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। তার ডান হাতে রিভলবার।
বের হয়েই আহমদ মুসা বিরভলবার তুলল ষ্টেনগানধারীর উদ্দেশ্যে। বলল, ষ্টেনগান ফেলে দাও। আমি এক আদেশ দু’বার দেই না।
ষ্টেনগানধারী চরকির মত বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। তার ষ্টেনগানের নলও ঘুরে এল আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। তারও আঙ্গুল ষ্টেনগানের ট্রিগারে।
আহমদ মুসা আত্মরক্ষার জন্যে মুহূর্তও সময় নষ্ট করেনি। ঠিক সময়েই তার তর্জনি চেপে বসেছে ট্রিগারে। ষ্টেনগানধারীর ষ্টেনগানের নলের গা ঘেঁষে বুলেটটি লোকটির বাঁ বুকে গিয়ে বিদ্ধ হলো।
যারা মাহিনকে গাড়িতে ঢুকাচ্ছিল, তারাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার তাদের গুলিবিদ্ধ সাথীর দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত পকেট থেকে রিভলবার বের করেছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তারা আহমদ মুসার টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
আহমদ মুসা ষ্টেনগানধারীকে গুলি করেই ওদের তিনজনকে টার্গেট করেছে। ওদেরকে রিভলবার বের করতে দেখে আহমদ মুসা বলল, তোমরা রিভলবার ফেলে দাও, তা না হলে তোমাদেরকেও এই সাথীর মত…।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। ওদের রিভলবার তাকে টার্গেট করে উঠে আসছে দেখে আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগার টিপে দিল পর পর তিনবার। কিন্তু সর্ববামের লোকটির ক্ষেত্রে টার্গেট মিস হলো। তার বাম কাঁধে গুলি লাগল। সে গুলি চালাবারও সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু আহমদ মুসার গুলি গিয়ে আঘাত করল আহমদ মুসার বাম বাহুসন্ধির উপরের অংশে। অদ্ভুত ষ্ট্যামিনা লোকটির! নিজের গুলিবিদ্ধ কাঁধের দিকে কোন খেয়াল নেই তার। প্রথম গুলিটা টার্গেটে লাগেনি দেখে রিভলবারসমেত তার ডান হাত উঠে আসছিল আহমদ মুসার লক্ষে।
কিন্তু আহমদ মুসা তা হতে দিল না। তার রিভলবার এই তৃতীয় টার্গেটের দিকে তাক করাই ছিল। শুধু ট্রিগার টেপার বাকি। ট্রিগার টিপে দিল সে। আহমদ মুসার লক্ষ এবার ছিল লোকটির ডান হাত।
ওদের একজনকে জীবন্ত ধরার প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। কিন্তু সে সুযোগ এ পর্যন্ত হয়নি। এবারের সুযোগটিকে সে কাজে লাগাল।
আহমদ মুসার গুলি গিয়ে লোকটির একবারে কবজিতে বিদ্ধ হলো। তার হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল।
লোকটি সাংঘাতিক বেপরোয়া!
রিভলবারটি গুলিবিদ্ধ ডান হাত থেকে খসে পড়ার সাথে সাথে সে বসে পড়ল এবং বাম হাত দিয়ে রিভলবারটি তুলে নিল।
তার গুলিবিদ্ধ ডান কাঁধের অসম্ভব যন্ত্রণা সে উপেক্ষা করে রিভলবার বাম হাতে তুলে নিয়ে আহমদ মুসাকে টার্গেট করার চেষ্টা করল।
তার রিভলবার উঠে আসছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা নিরুপায়। গুলি করে লোকটির বাম হাতটা নিস্ক্রিয় করে দেয়াই আহমদ মুসার বাঁচার উপায়।
আহমদ মুসার রিভলবার লোকটির দিকে তাক করাই ছিল। ট্রিগার টিপল শুধু।
গুলিটি গিয়ে বিদ্ধ করল লোকটির ডান বাহুকে। রিভলবারসমেত তার বাম হাত আছড়ে পড়ল মাটিতে।
লোকটি সম্ভবত তার হতাশা ও ব্যর্থতায় মাটিতে শুয়ে পড়ল।
মাহিন ও মারেভা আগেই গাড়ির ওপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। আতংকগ্রস্ত তাদের চোখ-মুখ। আহমদ মুসার বাম বাহুসন্ধিতে গুলি লাগতে দেখে দু’জনেই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল, যেন গুলিটা তাদের লেগেছে।
গুলি বন্ধ হতেই মাহিন ও মারেভা দু’জন ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে।
ওদিকে সুপার মার্কেটের সামনের লোকরা গুলি শুরু হলে কেউ সুপার মার্কেটের ভেতরে সরে গিয়েছিল, কেউ সুপার মার্কেটের সিঁড়িতে শুয়ে বা বসে ছিল। গুলি বন্ধ হলে তারা সবাই বেরিয়ে এল। সবাই হাততালি দিয়ে কিডন্যাপিং থেকে মাহিন ও মারেভার উদ্ধার পাওয়াকে স্বাগত জানাল।
তেপাও এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছে।
তেপাও, মাহিন, তোমরা এস, লোকটিকে আমাদের গাড়িতে তোল। কুইক।
তেপাও মাহিনকে এ নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসা মারেভাকে বলল, তুমি তোমাদের ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে এস। ট্যাক্সিওয়ালাকে না পেলে টাকা তার ট্যাক্সির উপরে রেখে এস।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা হাততালি দেয়া উৎসুক, অপেক্ষমাণ লোকদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, প্লিজ, আপনারা শুনুন, আহত লোকটির অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তাকে অবিলম্বে হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। কিডন্যাপিং-এর শিকার তরুণ-তরুণীকেও এখানে রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। হতে পারে তাদের বিপদ এখনও কাটেনি। তাই তাদেরকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছি। পুলিশ এসে যাবে। আপনারা যা দেখেছেন, দয়া করে তা পুলিশকে জানাবেন। ধন্যবাদ সকলকে।
উপস্থিত লোকেরা হাততালি দিয়ে আহমদ মুসার কথার জবাব দিল।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল।
তেপাও সামনের বাঁক ঘুরে গাড়ি একটু দাঁড় করাবে। আহমদ মুসা বলল।
গাড়িটা বাঁকে এসে বাঁক ঘুরে একটা সেফ ল্যান্ডিং দেখে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা বন্ধ করে গাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। কল করল তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান ফরাসি পুলিশ সার্ভিসের প্রধান সেই অফিসারকে। মাহিন ও মারেভার কিডন্যাপিং নিয়ে যা যা ঘটল সংক্ষেপে আহমদ মুসা সব জানাল তাকে এবং বলল, আমি আহত লোকটিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা আমার খুব জরুরি। এই প্রথম ওদের একজনকে জীবিত ধরা গেছে। তার কাছ থেকে কিছু কথা নেয়া আমার দরকার। কিন্তু আইন অনুসারে তাকে থানায় দেয়া দরকার অথবা হাসপাতালে নিয়ে পুলিশকে জানানো উচিত। আপনার পরামর্শ চাই স্যার।
মি. আহমদ মুসা, ঘটনাস্থলে কোন পুলিশ ছিল? বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান।
জি না। আহমদ মুসা বলল।
যে গাড়ি ব্যবহার করছেন, তা কোন পুলিশ নিশ্চয় দেখেনি। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান।
দেখেনি। আহমদ মুসা বলল।
ঘটনাস্থলের লোকজন গাড়ির নাম্বার নিশ্চয় দেখেনি বা নেয়নি? জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধানের।
সেটা বলা মুশকিল স্যার। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে জানলেও ক্ষতি নেই। একটা কাজ করুন। আপনা গাড়ি এখন কোথায়? জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধানের।
অ্যাভেনিউ পোমা’তে উঠে পূর্ব দিকে যাচ্ছি। আমরা পাতোতোয়ার হোটেল প্যাসেফিক ইন্টারন্যাশনাল থেকে এসে পোমা সুপার মার্কেটটির পাশ দিয়ে অ্যাভনিউ পোমা’তে উঠেছি। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে। ভালোই হলো। আপনাদের সামনেই মায়েভা থানা। আপনার সাথে আর কয়জন আছে? জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধানের।
আমাদের ড্রাইভার তেপাও, মাহিন ও মারেভা। আহমদ মুসা বলল।
আপনি গাড়িটা ছেড়ে দিন। ওরা আহত লোকটিসহ গাড়ি নিয়ে এগোক ধীরে ধিরে। আর আপনি অন্য একটি গাড়ি নিয়ে সোজা মায়েভা থানায় চলে যান। সেখানে সব ঘটনা খুলে বলুন এবং শেষে বলুন, আপনি গুলিবিদ্ধ আহত লোকটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছু দূর এগোবার পর একটি মাইক্রো আপনার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আপনাকে আহত করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িশুদ্ধ আহত লোকটিকে নিয়ে গেছে। আপনি থানায় গিয়ে এই ডাইরিটি করুন। থানা সন্দেহজনকভাবে আপনাকে কিছু করতে আসবে না। আমিও মিনিট পনের পরে থানায় টেলিফোন করব। থানা থেকে বেরিয়ে তারপর আহত লোকটিকে নিয়ে কোন নিরাপদ স্থানে চলে যান। আপনার প্রয়োজন পূরণে যা ইচ্ছা তাই করুন।
বলে থামল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান। মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে আবার বলল, সেরকম নিরাপদ জায়গা আছে আপনাদের?
সে রকম নেই। তবে ব্যবস্থা একটা করে ফেলব। আহমদ মুসা বলল।
না, তার দরকার নেই। আপনাকে অত কষ্ট করতে হবে না। আপনি আহত লোকটিকে নিয়ে সোজা আমার এখানে চলে আসুন। এখানে আন্ডারগ্রাউন্ডে আমাদের একটা সেল আছে। আপাতত সেটা আপনারা ব্যবহার করবেন। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান।
ধন্যবাদ স্যার। আমরা আসছি। আহমদ মুসা বলল।
ওয়েলকাম। আসুন, কথা আপাতত শেষ। গুড বাই আহমদ মুসা। বলে ওপার থেকে কল অফ করে দিলেন।
কল অফ করে আহমদ মুসা ডাকল মাহিনকে।
মাহিন তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসার কাছে যেতেই সে মাহিনকে নিয়ে গাড়ি থেকে একটু দূরে সরে গেল। তাকে সব কথা বুঝিয়ে বলল। সব কথা শুনে মাহিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, এই সময়ের জন্যে এর চেয়ে ভাল সলিউশন আর হয় না স্যার।
হ্যাঁ মাহিন, তুমি ঠিক বলেছ। ঠিক আছে মাহিন। যেভাবে বলেছি, সেভাবে কাজ করবে।
বলে আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, মারেভা, আমি একটু অন্য জায়গায় যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরব। তোমরা চলতে থাক।
মাহিন উঠে বসেছে গাড়িতে।
গাড়ি তাদের চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসে বলল, সামনে মায়েভা থানায় চল।
জি স্যার, বলে ট্যাক্সি ড্রাইভার তার গাড়িতে ষ্টার্ট দিল।
আহত লোকটির তিনটি ক্ষত স্থানেই ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল আহমদ মুসা খুব যত্নের সাথে। গুলিবিদ্ধ তিন জায়গার কোনটাতেই বুলেট নেই। ঘাড়ের আঘাতটাই বেশি গভীর। কিন্তু সেখানেও বুলেট নেই। ঘাড়ের কিছু গোশত ছিঁড়ে নিয়ে বুলেট বেরিয়ে গেছে।
খুব ভাগ্যবান দেখছি আপনি। ওরা মরেছে, আপনি মরেননি। আর গুলির তিনটি আঘাত বড় হলেও তা মারাত্মক নয়। বুলেট নেই বলে অপারেশনের দরকার হলো না। বলল আহমদ মুসা নরম কণ্ঠে লোকটির দিকে চেয়ে।
লোকটির মধ্যে আগের সেই বেপরোয়া ভাব এখন নেই। আহমদ মুসা ব্যান্ডেজ বাঁধার শুরুতেই লোকটিকে সমবেদনা দেখিয়ে বলেছিল, আমি তোমাদেরকে মারতে বা আহত করতে চাইনি। চেয়েছিলাম তরুণ-তরুণী দু’জনকে উদ্ধার করতে। আমি তোমাদের বলেছিলাম। অস্ত্র ফেলে দিতে, তাহলে আর এই অঘটন ঘটতো না।
লোকটি কোন জবাব দিল না। কিন্তু আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে। এ ধরনের ব্যবহারে সে অবাক হয়েছে! সে বুঝেছে, যে দু’জনকে তারা কিডন্যাপ করেছিল তারা আহমদ মুসার আত্মীয় বা বন্ধু হবে নিশ্চয়ই। এখনও তারা তো উদ্ধারকারী আহমদ মুসার সাথেই আছে। সে দিক থেকে আহমদ মুসা তার প্রতি যতটা মারমুখো হওয়া দরকার ছিল, ততটা নয়, বরং ব্যাপারটা সমব্যথীর মতো। এটাই ছিল লোকটির বিষ্ময়ের কারণ।
আহমদ মুসার কথার উত্তরে এবার লোকটি বলল, আমার এই সৌভাগ্যই আমার জন্যে দুর্ভাগ্যের কারণ হলো।
কেন? বলল আহমদ মুসা।
অনেকের কাছে ব্যর্থতা ক্ষমাহীন অপরাধ। এই সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা নিয়ে বেঁচে যাওয়া দুর্ভাগ্যের। লোকটি বলল।
দুর্ভাগ্যটা কি রকম? বলল আহমদ মুসা।
দুর্ভাগ্যটা মৃত্যু পর্যন্ত গড়াতে পারে। বলল লোকটি।
কথা শেষ করেই লোকটি বলল আবার, কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন?
দুনিয়াতে কত ধরনের লোক আছে, হত ধরনের দল, গ্রুপ আছে, তা জানার একটা কৌতুহল এটা। আচ্ছা, আপনার নাম কি?
লোকটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, নামের কি প্রয়োজন?
প্রয়োজনের প্রশ্ন নয়। মানব সমাজের একটা সাধারণ রীতি হলো কারো সাথে দেখা, লেনদেন বা পরিচয় হলে তার নাম জিজ্ঞাসা করা হয়।
লোকটি আহমদ মুসার দিকে আবার চোখ তুলে তাকাল। আহমদ মুসার মধ্যে শত্রু ধরনের কোন ছবি খুঁজে সে পেল না। আহমদ মুসাকে সহজ, সরল, স্বচ্ছ লোক বলে মনে হলো তার কাছে। আর তার যুক্তি ঠিক। এক্ষেত্রে নাম না বলাটাই বরং বেমানান। লোকটি বলল, আমার নাম মফ ফ্লেরি।
আপনাকে দেখে তো সহজ সরল বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার এই ভাই-বোনকে আপনারা কিডন্যাপ করতে চেয়েছিলেন কেন? আহমদ মুসা খুব নরম কণ্ঠে বলল।
লোকটি কোন উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ওরা দুইজন কি সত্যিই আপনার ভাই-বোন?
শুধু ভাই-বোন নয়, ভাই-বোনের চেয়েও বড়। আহমদ মুসা বলল।
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তাকাল আবার আহমদ মুসার দিকে। ভাবছে সে আহমদ মুসাকে নিয়েই। এই লোক ইচ্ছা করলে আমাকে মেরে ফেলতে পারতো, পুলিশের হাতেও তুলে দিতে পারতো। এসব কিছূ না করে সে আমার ক্ষত স্থান পরিষ্কার করেছে, সেলাই দিয়েছে এবং তাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। নিজের আহত স্বজনের মতই সে আচরণ করছে আমার সাথে।
এসব চিন্তা করেই বলল, তাদের ধরার মধ্যে আমাদের ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ ছিল না। আমরা নির্দেশ পালন করেছি মাত্র।
নির্দেশ কার ছিল? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
আমরা নির্দেশ পেয়েছিলাম, ‘ম্যাডাম গৌরী’ নামে এক কর্মকর্তার কাছ থেকে। লোকটি বলল।
কিসের কর্মকর্তা তিনি? বলল আহমদ মুসা।
লোকটি অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সে সংগঠনের নাম নেয়া তাদের জন্যে নিষেধ। মাফ করুন স্যার আমাকে।
আহমদ মুসা মনে মনে ভাবল, কিসের কর্মকর্তা তা আমরা জানি। তারপর বলল, ঠিক আছে তোমাকে বিপদে ফেলবো না। সংগঠনের নাম শুনতে চাই না। তোমাদের দিয়ে কোথায় কাজ করায়, কি কাজ করায় তারা?
লোকটি বলল, তাহিতি, মুরিয়া, তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি স্থানসহ পলিনেশীয়ার সব জায়গায় কাজ করি। কি কাজ করি আমরা তা বলতে পারবো না স্যার। সেটা বললে আমাদের প্রাণ যাবে।
কি কাজ করো সেটা আমরা জানি। সেটা তুমি না বললেও চলে। ঠিক আছে, যদি ক্ষতি হয় বলবে না। কিন্তু একটা বিষয়ে সাহায্য করতে পার। পলিনেশীয়ার দ্বীপপুঞ্জ ও দ্বীপ সম্পর্কে তোমার অনেক অভিজ্ঞতা। আচ্ছা বল তো ‘মতু’ নামে কোন দ্বীপ আছে? বলল আহমদ মুসা।
কেন, প্রায় সকলেরই জানা, তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের ‘মতুতুংগা’ অ্যাটলকেই সংক্ষেপে ‘মতু বলা হয়।
ধন্যবাদ মি. মফ ফ্লেরি। ‘মতু’ দ্বীপ বা অ্যাটল নিয়ে খুব আগ্রহ আমার।
আহমদ মুসার কথা শুনে লোকটির ভ্রু কুঁচকে গেল মুহূর্তের জন্য। চোখে-মুখে তার নেমে এল উদ্বেগ ও বিষ্ময়। বলল, ‘মতু অ্যাটল নিয়ে আপনার এ আগ্রহ কেন?
সে অনেক কথা। পলিনেশীয় অঞ্চলের একটা রূপকথা শোনার পর থেকেই এই আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
রূপকথা? কি রূপকথা? লোকটি বলল।
রাজকুমার হেসানা হোসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর রূপকথা। ঐ রূপকথায় আছে গডেজ ‘হিনা’ দুই প্রেমিকের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাদের মিলন ঘটিয়েছিলেন মতুতুংগা অ্যাটল দ্বীপে। ঐ অ্যাটল দ্বীপের অভ্যন্তরে একটি প্রাসাদ আছে। সেই প্রাসাদে মিলন হয়েছিল রাজপুত্র ও সাগরকন্যার। যত দিন তারা বেঁচে ছিল ঐ প্রাসাদেই তারা বাস করেছে। আমি মনে করি এই রূপকথা যেমন সত্য ঘটনা, তেমনি প্রাসাদও একটা বাস্তব সত্য। এই কারণেই ‘মতু’ বা ‘মতুতুংগা’ অ্যাটল দ্বীপ আমার স্বপ্নের জায়গা। থামল আহমদ মুসা।
লোকটি মানে মফ ফ্লেরির মুখ থেকে উদ্বেগ ও বিষ্ময়ভাব কেটে গেল। স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল তার মনে। সে বুঝে নিল, তাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে’র খোঁজ এরা জানে না।
আহমদ মুসার কথার উত্তরে কিছু বলল না মফ ফ্লেরি।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, মি. মফ ফ্লেরি, আমার আগ্রহের কথা নিশ্চয় বুঝেছ। এখন বল, আমার আগ্রহটা ঠিক কিনা।
আগ্রহ ঠিক আছে। কিন্তু প্রাসাদের বিষয়টা রূপকথার মতই কল্পনা। মফ ফ্লেরি বলল।
ব্যাপক অনুসন্ধান ছাড়া কোন দাবী বা বিশ্বাসকে অস্বীকার করা যায় না। মতুতুংগা দ্বীপে তোমার কি এই অনুসন্ধান আছে? বলল আহমদ মুসা।
মফ ফ্লেরি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার কণ্ঠে একটা ভিন্ন সুর আঁচ করল সে। তার মনের কোণে একটা ছোট্ট আশংকাও জেগে উঠল। বলল, মতুতুংগাসহ সব দ্বীপ ও অ্যাটলে আমার বিচরণ আছে তাই বলছিলাম, প্রাসাদের বিষয়টা অবাস্তব।
তোমার কথা মানলাম। কিন্তু তোমার এই ‘অবাস্তব তত্ত্ব’ কি করে প্রমাণ করা যায় বল তো? তোমার এই ‘অবাস্তব তত্ত্বে’র প্রমাণ হয়ে গেলে তো আর এ ব্যাপারে কারো মাথা ঘামাতে হতো না। বলল আহমদ মুসা।
একটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠল মফ ফ্লেরির চোখে-মুখে। বলল, আমি কি করে বলতে পারি? কথাগুলো ভাসা ভাসা মনে হলো। যেন কথাগুলো মনের গভীর থেকে উঠে আসেনি, কথাগুলোন শেকড় যেন তার মনে নেই!
আহমদ মুসার কানকে এসব ফাঁকি দিতে পারলো না। বলল, তুমি মতুতুংগা অ্যাটলটাকে ভালভাবে দেখেছ বলেই সেখানে প্রাসাদের অস্তিত্বের বিষয়কে ‘অবাস্তব’ বলতে পেরেছ। সেজন্যেই অবাস্তব প্রমাণ করার উপায়গুলোও তুমিই বলতে পারবে। বল, সেগুলো কি হতে পারে।
সংগে সংগে জবাব দিল না মফ ফ্লেরি। মুহূর্ত কয়েক চুপ থাকার পর বলল, অ্যাটলগুলো হলো ফাঁপা বা সলিড পর্বতপ্রমাণ উঁচু বেজের উপর সংকীর্ণ বা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত পাড় ঘেরা পুকুর বা হ্রদের মত। অ্যাটলগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাছাকাছি হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে একই বেজের উপর অনেক অ্যাটল হতে পারে, যেমন গাছের একই কাণ্ডের উপর অনেক শাখা হয়। এই ধরনের ক্ষেত্রগুলোতে দুই অ্যাটলের মাঝখানের পানি অগভীর হয়ে থাকে। অ্যাটলের এই সব বৈশিষ্ট সামনে রাখলে কোন অ্যাটলের ফাঁপা বেজের মধ্যে প্রাসাদ ধরনের কিছু আছে কিনা পরীক্ষার জন্যে দু’টি উপায় আছে। সহজ উপায়টি হলো, অ্যাটলের পাড় প্রশস্ত হলে সেখান থেকে অথবা পাশের কোন অ্যাটলের প্রশস্ত পাড় থেকে সুড়ঙ্গ কেটে অ্যাটলের ফাঁপা অংশে প্রবেশ করে ভেতরটা দেখা। আরেকটা উপায় আছে। কঠিন এবং তা হলো, পানির নিচে অ্যাটলের বেজের গায়ে কোন যথোপযুক্ত টেনলজির মাধ্যমে সুড়ঙ্গ করে ভেতরে প্রবেশ করা।
আহমদ মুসার ঠোঁটে সূক্ষ্ম একটা হাসির আভা ফুটে উঠল। বলল, ধন্যবাদ মফ ফ্লেরি, তুমি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছ। যেন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা! তাই নয় কি মফ ফ্লেরি?
আবার সেই বিব্রতকর অবস্থা ফুটে উঠল মফ ফ্লেরির মুখে। ব্যাপারটা অনেকখানি চোর ধরা পড়ার মত।
সংগে সংগে উত্তরদ দিতে পারল না মফ ফ্লেরি।
মফ ফ্লেরির এই অবস্থাকে আহমদ মুসা ইতিবাচক মনে করল। এ ধরনের সুড়ঙ্গ তার দেখার মধ্যে না থাকলে তার আচরণ এমন হতো না, মনস্তত্ত্বের দিক থেকে এটাই স্বতসিদ্ধ।
অবশেষে মফ ফ্লেরি বলল, আমি যা বলেছি, তার বেশি কিছু আমি জানি না।
আহমদ মুসা কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল না। আহমদ মুসা নিশ্চিতই বুঝল সে সত্য কথা বলেনি। তবু এ ব্যাপারে চাপ না দিয়ে বলল, তুমি যাদের সাথে বা যে সংগঠনের সাথে আছ, সেটা কত বছর?
তিন বছর। বলল মফ ফ্লেরি।
তোমাকে খুব বুদ্ধিমান ও সচেতন বলে মনে হচ্ছে। তুমি পেশায় আসলে কি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। বলল মফ ফ্লেরি।
সে তো মূল্যবান পেশা! কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে তুমি কিডন্যাপিং পেশায় নেমেছ। আহমদ মুসা বলল।
মফ ফ্লেরি মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে একটা অস্বস্তির ছাপ। বলল, প্রয়োজনে নির্দেশ মত আমাদের সব কাজই করতে হয়। তবে মূলত সংগঠনের মেরিন সাইডটায় আমি কাজ করি।
তাহলে দলের অনেক সারফেস শীপ ও বোট আছে? বলল আহমদ মুসা।
কিছু তো আছেই। মফ ফ্লেরি বলল।
দলের আন্ডারওয়াটার ভেহিকল অর্থাৎ সাবমেরিন জাতীয় ভেহিকেল নেই? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
চমকে উঠল মফ ফ্লেরি। দুই চোখ ছানাবড়া করে তাকাল আহমদ মুসার দিকে!
কথা বলার খেই যেন হারিয়ে ফেলেছে মফ ফ্লেরি! কোন কথা বলল না সে।
আবার মিথ্যা বল। বল যে, সাবমেরিন জাতীয় কোন ভেহিকেল দলের নেই! আহমদ মুসাই আবার বলল। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি।
মফ ফ্লেরি নির্বাক হয়ে গেছে। কোন কথাই সে বলতে পারল না। তার চোখের দৃষ্টির মধ্যে একটা অসহায়ত্ব আছে। তার মনে একটা কথা তোলপাড় করে উঠছে, কে এই লোক! আমাদের সব বিষয় সে জানে কি করে!
আবারও কথা বলল আহমদ মুসাই। বলল, একটা গোপন দলের সাথে তুমি শামিল হলোও তোমাকে সরল, সহজ মনে করেছিলাম। কিন্তু দেখছি তুমি খুব সহজভাবে মিথ্যা কথা বলতে পার। মতুতুংগার সৃড়ঙ্গ সম্পর্কে তুমি জান না, এই মিথ্যা কথা কেন বললে?
লোকটি অনেকখানি মুষড়ে পড়েছে। বলল, গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে আমাদের শপথ করতে হয়। আত্মরক্ষার জন্যেই আমি মিথ্যা বলেছি। শপথ কেউ ভাঙলে তার মৃত্যুদণ্ড হয়, এটা দলের অপরিবর্তনীয় বিধান। আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার বুক থেকে অনিশ্চয়তার একটা পাহাড় যেন নেমে গেল! মতুর প্রাসাদে ঢোকার সুড়ঙ্গ তাহলে সত্য এবং প্রাসাদও সত্য!
আপনি সব জেনেও আমাকে প্রশ্ন করছেন, এর অর্থ আমি বুঝলাম না। বলল মফ ফ্লেরি।
দেখছিলাম যে, তুমি কি বল। অরেকটা জিনিস, মতুতুংগা অ্যাটলের পশ্চিমে কোন অ্যাটল নেই। উত্তরের অ্যাটলটা বেশ দূরে। তাদের মধ্যে কমন সংযোগ নেই। বাকি থাকে পূর্ব ও দক্ষিণ। এই দুই দিকে মতুতুংগার কাছাকাছি চারটি অ্যাটল আছে অর্থাৎ তাহানিয়া, টেপোটো, হিতি ও তোয়ানেকে। এই চারের মধ্যে ‘হিতি’ অ্যাটলের সাথে মতুতুংগার কমন বেজ নেই। অনুরূপভাবে ‘টোপোটো’ ও ‘তোয়ানেকে’ অ্যাটলের সাথেও মতুতুংগার কমন বেজ নেই। এই তিন অ্যাটল ও মতুতুংগার মাঝখানে বরং খাদের উত্তর প্রান্ত ঘুরে মতুতুংগা পর্যন্ত উঁচু ও সংযুক্ত একটা বেজ রয়েছে। কিন্তু টোপোটো অ্যাটলটি এতই ক্ষুদ্র ও ডোবা যে, সেখান থেকে সংযোগ সুড়ঙ্গ মতুতুংগা পর্যন্ত হতে পারে না। বাকি থাকে বড় আকারের তাহানিয়া অ্যাটল। এর পশ্চিম তটরেখার দক্ষিণ প্রান্ত বেশ প্রশস্ত ও উঁচু যেখানে কনষ্ট্রাকশন সম্ভব। এ প্রান্ত থেকে মতুতুংগা পর্যন্ত কিছুটা সংকীর্ণ হলেও উঁচু একক একটি বেজ লাইন চলে গেছে। এখন তুমি বল, সুড়ঙ্গের যে তত্ব দিয়েছ তাতে মতুতুংগার প্রাসাদে ঢোকার সুড়ঙ্গ কোন অ্যাটল থেকে হতে পারে?
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল আহমদ মুসা।
মফ ফ্লেরি হাঁ করে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে দেখছিল আহমদ মুসাকে। সে ভেবে পাচ্ছে না অ্যাটলগুলো সম্পর্কে আহমদ মুসা এত বিস্তারিত তথ্য জানে কি করে! বহুদিন আমি ঘুরছি এ অঞ্চলে, কিন্তু এর সব কথা আমার জানা নেই। আসলে দেখছি সব জানে এই লোকটা। প্রাসাদের ভেতরের কথাও কি সে জানে? কেঁপে উঠল মফ ফ্লেরির বুকটা। আসলে ভেতরে কি আছে, কি ঘটে তার সব কিছু তারাও জানে না। শুধু অচেনা, অজানা লোকদের সেখানে ঢুকতে দেখে, তাদেরকে আর কখনো বের হতে দেখে না। এই লোকটি সে বিষয়েও কি জানে? কিন্তু কিভাবে?
মফ ফ্লেরির নিরব ও বিষ্ময়াবিষ্ট হয়ে হাঁ করে থাকতে দেখে আহমদ মুসা বলল, আমার কথায় অবাক হবার কিছু নেই। সবই তো তুমি জান! তোমার জানা বিষয়টা জানালে আমি উপকৃত হবো। প্লিজ বল।
আপনি সবই জানেন স্যার, এরপরও প্রশ্ন করছেন? আপনি তো অবস্থার পর্যালোচনা করে বলেই দিয়েছেন মতুতুংগা অ্যাটলের সুড়ঙ্গ কোন অ্যাটল থেকে আসতে পারে। আসলেই এর কোন বিকল্প নেই। বলল মফ ফ্লেরি।
হাফ ট্রুথ মানে অষ্পষ্ট সত্য কিন্তু সত্য নয়। তুমি পরিষ্কার করে বল। তুমি যার বিকল্প নেই বললে, সেটা প্রতক্ষদর্শীর কাছে সত্য এটা কিনা?
নিচু করে রাখা মুখ তুলল মফ ফ্লেরি। একটা ভীতি ও অসহায় ভাব তার চোখে-মুখে। বলল, হ্যাঁ তাই স্যার। আপনি সব জানার পরেও কেন এসব কথা বারবার বলছেন স্যার?
আমি তোমার পরীক্ষা নিচ্ছি বলতে পার। আচ্ছা, এতক্ষণ আমি বলেছি, এবার তুমিই বল, সুড়ঙ্গটির মুখ কোথায়?
সেটাও তো আপনিই বলে দিয়েছেন। তাহানিয়া দ্বীপের পশ্চিম তটরেখার দক্ষিণ প্রান্ত এলাকা কনষ্ট্রাকশনের জন্যে উপযুক্ত। উত্তর তো এখানেই আছে স্যার। বলল মফ ফ্লেরি।
খুশি হলো আহমদ মুসা। সে অবশ্যই মিথ্যা বলেনি। সুড়ঙ্গের মুখ তাহানিয়ার পশ্চিম তটরেখার দক্ষিণ প্রান্তেই রয়েছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়াল সে। বলল, মি. মফ ফ্লেরি, আমি আসছি।
বলে পাশের ঘরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
সে ঘরে দরজার পাশেই বসে ছিল মারেভা ও মাহিন।
তারাও ওঠে দাঁড়াল। বলল, ধন্যবাদ স্যার, কথা আদায় করার ক্ষেত্রেও দুনিয়ায় নিশ্চয় আপনার কোন জুড়ি নেই। কোন বকাবকি, হুমকি-ধমকি ও গায়ে হাত তোলা ছাড়াই আপনার যা প্রয়োজন সবই আদায় করে নিলেন অদ্ভুত কৌশলে। আবারও ধন্যবাদ স্যার। বলল মারেভা।
আমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর। ভালোবাসা, মমতার চেয়ে বড় অস্ত্র দুনিয়ায় আর নেই। সে আমাকে শত্রু মনে করেনি এবং আমার কথাবার্তায় সে বিশ্বাস করে নিয়েছে আমি তাদের সব কিছু জানি। আমার জানা বিষয় তাই প্রকাশ করতে সে দ্বিধা করেনি। থাক, এসব কথা। আমি যাচ্ছি স্বরাষ্ট্র সচিব সাহেবের কাছে। বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল। মারেভা ও মাহিনও ঘর থেকে বের হবার জন্যে হাঁটতে শুরু করল।
পিএস গিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিবকে বলল, স্যার, আহমদ মুসা নামে একজন ভদ্রলোক এসেছেন। আপনার সাথে দেখা করতে চান।
শুনেই স্বরাষ্ট্র সচিব উঠে দাঁড়াল। বলল, ভদ্রলোককে নিয়ে আসি।
পিএস বিষ্মিত হয়ে একবার স্বরাষ্ট্র সচিবের দিকে তাকাল। স্যার, নিজে যাবেন তাকে স্বাগত জানাতে? বলল, আপনি বসুন স্যার। আমি তাকে নিয়ে আসছি।
না, সে খুব মূল্যবান মানুষ। ফরাসিদের জামাই। তাছাড়াও তার আরও বড় পরিচয় আছে। বলে স্বরাষ্ট্র সচিব হাঁটতে শুরু করল।
পিএস-এর কক্ষে গিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধান স্বাগত জানালো আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসাকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান তার কক্ষে এসে বসল। আহমদ মুসাকে বসিয়ে নিজে গিয়ে তার আসনে বসল।
বসেই বলল, মি. আহমদ মুসা, আজকের জিজ্ঞাসাবাদের খবর কি, ভাল নিশ্চয়ই।
আল হামদুলিল্লাহ! ভাল স্যার। যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি। বলল আহমদ মুসা।
এত তাড়াতাড়ি মুখ খুলল! স্বরাষ্ট্র সচিব বলল। তার কণ্ঠে বিষ্ময়!
অনেক কথা বলতে হয়েছে স্যার।
আমি তার সমব্যথী ও বন্ধু-এ বিশ্বাস তার মধ্যে জেগেছিল। আমি কোন পক্ষ নই, কোন স্বার্থে আমি এসব জানতে চাচ্ছি না, এটাও সে ধরে নিয়েছিল। আমি নিছক তার ব্যাপারে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করছি, এটাও তাকে বুঝাতে পেরেছিলাম। আর তাদের সম্পর্কে এবং তাদের ঘাঁটি ও তাদের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আমি কথা বলে তার মধ্যে এ বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম যে, তাদের ব্যাপারে আমি সব জানি, নিছক তাকে আমি বাজিয়ে দেখছি মাত্র। এজন্যে কোন তথ্য দেয়াকে সে খারাপ মনে করেনি এবং মিথ্যাও বলেনি এই কারণে যে তার মিথ্যা আমার কাছে ধরা পড়ে যাবে। বলল আহমদ মুসা।
বিষ্ময়মিশ্রিত প্রশংসার একটা ঢেউ খেলে গেল তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধানের চোখে-মুখে। বলল, চমৎকার মি. আহমদ মুসা! চমৎকার আপনার কৌশল। আপনি ধমকি দিয়ে কিংবা গুলি ছুঁড়েও এত কথা উদ্ধার করতে পারতেন না। ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আহমদ মুসা, সব ক্ষেত্রেই এই কৌশল খাটিয়ে ফল পাওয়া যায়?
ভালবাসা, সহমর্মিতার শক্তি অত্যন্ত কঠিন ও কঠোর মানুষকেও দুর্বল করে, তাকে কাছে টানে, তার হৃদয় জয় করে নেয়া যায়। তার মনের কথাগুলোও তখন পাখা মেলে, ওপেন হয়ে যায়। কিন্তু শক্তির প্রয়োগ বা প্রদর্শণী মানুকে ভীত করে। ভয়ে অনেকেই মুখ খোলে। আবার অনেকেই শক্তিকে ভয় করে না, এদের বিরুদ্ধে শক্তি কোন কাজেও আসে না। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক মি. আহমদ মুসা, দুনিয়ার পাষণ্ডতম মানুষও কাঁদে ভালবাসার ছোঁয়ায়, অস্ত্রের আঘাতে নয়। যাক, এখন বলুন আপনি কত দূর পৌঁছলেন? স্বরাষ্ট্র সচিব বলল।
স্যার, পথের সন্ধান পেয়েছি। সে পথে চলে এখন লক্ষে পৌঁছতে হবে। পথ চলে লক্ষে পৌঁছার কঠিন কাজটাই এখন বাকি। বলল আহমদ মুসা।
ঈশ্বর আপনাকে সাহায্য করুন ইয়ংম্যান। লক্ষে আপনি পৌঁছবেনই, এতে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমাদের সাহায্য সব সময় আপনার সাথে থাকবে। বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের নিরাপত্তা ও মুক্তি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। যেন আমাদের ভুলে তাদের বড় কোন ক্ষতি না হয়, এ ব্যাপারে আমরা খুবই সতর্ক। এটা আপনার কেস। আমরা আপনার উপরেই নির্ভর করছি। স্বরাষ্ট্র সচিব বলল।
ধন্যবাদ আপনাদের এই দৃষ্টিভংগির জন্যে। উদ্বেগের বিষয় এটাই স্যার, ওরা সামান্য কিছু টের পেলেই বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। এজন্যে ওদের কার্যকরি শক্তি নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার আগে কিংবা ওদের ‘শক্তির কেন্দ্র’ দখলের আগে ওদের কিছুই জানতে দেয়া যাবে না। বলল আহমদ মুসা।
এ কারণেই এই কাজে বা অভিযানে দলবদ্ধভাবে যাওয়া যাবে না একেবারেই। এই বিপজ্জনক অভিযানে মাত্র দু’একজনকেই অংশ গ্রহণ করতে হবে ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। আমার মনে হচ্ছে বিষয়টা অত্যন্ত ষ্পর্শকাতর এবং অতি বিপজ্জনক বলেই ঈশ্বর আপনাকে পাঠিয়েছেন। আমি আপনার সম্পর্কে অনেক শুনেছি। কিন্তু কয়েক দিন ধরে আপনার কাজ দেখে মনে হচ্ছে আপনার সম্পর্কে যা শুনেছি তার চেয়ে অনেক বড় আপনি। ধন্যবাদ আহমদ মুসা। তাহাতির প্রধান স্বরাষ্ট্র সচিব বলল।
মফ ফ্লেরির বিষয়ে এখন কি করা যায়! সে যেহেতু আমাদের সাহায্য করেছে, এজন্যে সে বিচারের মুখোমুখি হোক, তা আমি চাচ্ছি না স্যার। আপনারা তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখুন আমাদের অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত। আর তার পরিবার-পরিজনকেও আপনাদেরই দেখতে হবে, তাদের ভরণ-পোষণও করতে হবে। আমিও তাকে বলব, এখন সে বাইরে গেলে তার দলই তাকে মেরে ফেলবে এবং তার কোন চিন্তা নেই পরিবার-পরিজন নিয়ে। তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বলল আহমদ মুসা।
আপনি যা বলেছেন। সেটাই হবে মি. আহমদ মুসা। তাকেও আশ্বস্ত করুন, তার পরিবার নিয়ে তার কোন চিন্তা করতে হবে না। স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান বলল।
ধন্যবাদ জনাব। আর আমাকে সাহায্যের বিষয়টা সময় মত আমি আপনাকে জানব। বলল আহমদ মুসা।
আপনার একটা কনট্যাক্ট নাম্বার দিলে প্রয়োজনে আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো। স্বরাষ্ট্র সচিব-পুলিশপ্রধান বলল।
সেটা বিপজ্জনক হতে পারে স্যার। ওরা যেমন ভেতর থেকে পাঠানো মেসেজ মনিটর করতে পারে, তেমনি বাইরে থেকে পাঠানো মেসেজ মনিটরের ব্যবস্থা তার অবশ্যই রেখেছে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক মি. আহমদ মুসা। আপনি ঠিক চিন্তুা করেছেন। ধন্যবাদ!
তাহলে উঠতে পারি স্যার। বলল আহমদ মুসা।
ডিনারের সময় হয়ে আসছে। আমরা কি এক সংগে ডিনার করতে পারি না? ভুলবেন না আপনি কিন্তু আমাদের জামাই, ফরাসিদের জামাই। স্বরাষ্ট্র সচিব-পুলিশপ্রধান বলল।
ধন্যবাদ স্যার। আপনাদের স্নেহের এই অফার আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারিনা। আমার সাথে কিন্তূ দু’জন ছেলেমেয়ে আছে। বলল আহমদ মুসা।
তামাহি মাহিন ও মারেভা মাইমিতি তো! ওদেরও দাওয়াত ডিনারে। আমরা খুব খুশি। ওরা আপনার ভাল সহকারী হয়ে উঠেছে। আমি চিন্তা করছি, ওদের আমি আমাদের গোয়েন্দা বিভাগে নিয়ে নেব। আপনি কি মনে করেন? স্বরাষ্ট্র সচিব-পুলিশ প্রধান বলল।
আমার মনের কথা বলেছেন। আমি আপনাকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করতে চাচ্ছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
মি, আহমদ মুসা, খুশি হলাম আপনার অভিমত পেয়ে। স্বরাষ্ট্র সচিব বলল।
আমি ‘মফ ফ্লেরি’র আর একটু কথা বলব। আমি তা হলে এখন উঠছি স্যার। বলল আহমদ মুসা।
মফ ফ্লেরির সাথে কথা বলার এই সিদ্ধান্ত আহমদ মুসা আরও একটা কারণে নিল। তাহানিয়া অ্যাটল থেকে মতুতুংগার প্রসাদে যাওয়ার সুড়ঙ্গ ও প্রসাদের ব্যাপারে আহমদ মুসা আর একটু কথা বলতে চায়। এ বিষয় যে কোন তথ্য তার কাজে আসবে।
ঠিক আছে আসুন। আমর পিএস ঠিক ১২টায় আপনার ডিনারে আসবে। আমি আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করব। হ্যাঁ, আর একটা কথা বলতে ভূলে গেছি। আমি অ্যাটল ট্যুরিস্টদের ছদ্মবেশে কমান্ডো, পুলিশ, ও গোয়েন্দাদের নিয়োজিত করতে চাই যাতে যাতে কোন সন্দেহ সৃষ্টি না হয় এমনভাবে। স্বরাষ্ট সচিব-পুলিশ প্রধান বলল।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর বলল, করতে পারেন। তবে তাদেরকে পোষাকে-আশাকে, কথাবার্তায় ও আচার-আচরণে একদম টুরিস্ট হতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা। আমি তাদের কাছে মানে তাহিতির সব পুলিশ ও গোয়েন্দার কাছে আপনার ফটো ও মেসেজ দিয়ে রাখতে চাই, যাতে আপনার যে কোন আদেশ তারা শুনতে বাধ্য থাকে। আর অ্যাটল গুলোতে যারা থাকবে তাদের কামান্ডারের কন্ট্যাকট নাম্বার আপনাকে দেব। তাকে আপনি যে কোন আদেশ দিতে পারবেন। স্বরাষ্ট সচিব ও পুলিশ প্রধান বলল।
ধন্যবাদ স্যার। আমি খুব খুশি হলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। স্বরাষ্ট সচিব কাম পুলিশপ্রধানও উঠে দাঁড়াল। আহমদ মুসা তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এল।
৬
ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের সিচুয়েশন রুম।
সিচুয়েশন রুমের এক প্রান্তে সূর্যকার একটি বেদি। বেদির উপর সুন্দর রাজকীয় কার্পেট পাতা।
বেদির সামনে শ্বেত পাথরের মেঝেতে সারিবদ্ধ তিনটি চেয়ার। চেয়ারগুলোও সাদা ধবধবে রঙের।
তিনটি চেয়ারের মাঝের চেয়ারে গৌরী। তার ডানে জিজর, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের অপারেশন চীফ। আর গৌরির বাম পাশে বসেছে ডারথ ভাদের, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের গোয়েন্দাপ্রধান।
তার সবাই উন্মুখভাবে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। তাদের সবারই মুখ বিষণ্ণ।
তাদের অপেক্ষার ইতি হলো।
বেদির পেছনের দেয়াল ফুঁড়েই যেন বেরিয়ে এল রক্তলাল চেয়ারে বসা আলেক্সি গ্যারিন, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সর্বময় কর্তা। তার গায়ে লাল রাজকীয় পোষাক।
ধবধবে সাদা ঘরে লালের আগমন অনেকটাই সূর্যোদয়ের মত।
বেদির মাঝখানে এসে স্থির হলো চেয়ারটি।
বেদির নিচে মেঝেয় চেয়ারে বসা জিজর, গৌরী ও ডারথ ভাদের উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা বাও করে বলল, লং লিভ আওয়ার লর্ড! লং লিভ আওয়ার সিন্ডিকেট!
বসল তারা তিনজন।
আজ আলেক্সি গ্যারিনের মুখে মুখোশ নেই।
চল্লিশ বছেরের মত বয়সের একজন মানুষ সে। পশ্চিমের সে সাদা রঙের মানুষ। শক্ত চোয়াল, কঠিন মুখ, চোখের দৃষ্টিতে কঠোরতা। মুখে লাবণ্য-কমনীয়তা কিছু ছিল কিনা কোনদিন, তা বুঝা যায় না। কঠিন ও কঠোরতার মাঝে হারিয়ে গেছে যেন সুকমার বৃত্তির সব কিছু।
আলেক্সি গ্যারিনের দৃষ্টি সবার উপর দিয়ে ঘুরে এসে স্থির হলো জিজরের মুখের উপর।
জিজর মাথা নত করল।
এ সব কি হচ্ছে জিজর?
মাই লর্ড! বলে চুপ করে থাকল জিজর।
তিনটি কমিটি করে দিয়েছিলাম আহমদ মুসাকে এলিমিনেট করতে, কিন্তূ তোমাদের ৮ সদস্যের এলিট কামান্ডোরা নিজেরাই এলিমেনেট হয়ে গেল। কেন, কিভাবে? বলল আলেক্সি গ্যারিন। কঠোর যান্ত্রিক তার কন্ঠ।
গৌরীদের তিনজনের মুখও মলিন হয়ে গেল পরাজিত সৈনিকের মত।
জিজর উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করে বলল, মাই লর্ড, আমাদের অভিযান ঠিক ভাবে……।
জিজরের কথার মধ্যেই আলেক্সি গ্যারিন বলে উঠল, থাক জিজর। এই কথাগুলো একটু পরে শুনব। আগে শুনতে চাই, আমাদের কোন লোক এ পর্যন্ত শ্ত্রুর হাতে ধরা পড়েনি। ধরা পড়ার অঘটন কিভাবে ঘটল?
মাই লর্ড! আমার কথার মধ্যে এটাও বলব মাই লর্ড। বলল জিজর।
বল। বলল আলেক্সি গ্যারিন কঠোর কন্ঠে।
মাই লর্ড! সেদিন রাতে বড় ঘটনার পর আপনার নির্দেশে তিনজনে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আহমদ মুসাকে প্রস্তূতি ও পরিকল্পনার কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। প্রতিটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাকে একের পর এক আঘাত হানতে হবে। এই লক্ষেই সে রাতের পর আহমদ মুসাকে খুঁজে পাবার জন্যে সকালেই আমরা মারেভা ও মাহিনকে খুঁজে নিই এবং তাদের ফলো করে হাসপাতালে যাই। সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিল আহমদ মুসার ড্রাইভার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আহমদ মুসা হাসপাতালে আসেনি। একজনকে পাহারায় রেখে আমাদের কয়েকজন আহমদ মুসার আগের হোটেলে চলে আসে। জানা যায় সে হোটেলে আহমদ মুসা যায়নি। এটা জেনে আমাদের লোকেরা আবার সেই হাসপাতালে ফিরে আসে। তারা সে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে আহমদ মুসা এসে চলে গেছে। দুর্ভাগ্য, পাহারায় থাকা আমাদের লোক তাকে চিনতে পারেনি। আহমদ মুসা ছদ্মবেশে ছিল বলে মনে হয়। কিন্তূ মাহিন ও মারেভা তখনও হাসপাতালে ছিল। আমাদের লোকেরা তাদের আনুসরন করে নতুন এক হোটেলে গিয়ে আহমদ মুসাকে পায়। তার হোটেল কক্ষে থাকা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারা চারজন প্রথম সুযোগেই তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হোটেলে ও তার আশেপাশে পুলিশ ছিল না। তার লাশ আনার পথে কোন বাধাও ছিল না। পরিকল্পনা হয় প্রথমে দু’জন এক আঘাতেই দরজা ভেঙে ফেলবে। আর প্রস্তূত থাকা দু’জন এক সাথে গুলি করবে আহমদ মুসাকে। একজন এ্যাটেনডেন্টকে টাকা দিয়ে ঐ সময়ে গল্পরত আহমদ মুসা, মারেভা ও মাহিনের মিটিং ডায়াগ্রাম সংগ্রহ করা হয়েছিল।পরিকল্পনা নিখুঁত ছিল। এক আঘাতে দরজাও ভেঙে পড়েছিল। কিন্তূ বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমাদের প্রস্তূত থাকা লোকেরা অপ্রস্তূত আহমদ মুসার আগে গুলি ছুঁড়তে পারেনি। এই অবস্থায় সেখানে আমাদের চারজন নিহত হয় এবং আমাদের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর আহমদ মুসার হোটেলের দু’পাশে পুলিশের পাহারা বসে। এই অবস্থায় আমাদের অবশিষ্ট লোকেরা হোটেলের পেছন দরজা দিয়ে মাহিন ও মারেভাকে চলে যেতে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে, মারেভা ও মাহিনকে তারা পণবন্দী করবে আহমদ মুসাকে হাতের মধ্যে পাওয়ার জন্যে এবং তারা সিদ্ধান্ত অনুসারে মারেভাদের পিছু নেয়। হাইওয়ের যে স্থানকে ওদের কিডন্যাপ করার পরিকল্পনা করে, তার কিছু আগে মারেভা ও মাহিন গাড়ি থামিয়ে একটা সুপার মার্কেটে নেমে পড়ে। আমাদের লোকেরা সিদ্ধান্ত নেয় ওরা মার্কেট থেকে বেরুলেই তাদের ধরে গাড়িতে তুলবে এবং কিছু ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে তারা বেরিয়ে আসবে। কিন্তূ তাদের গাড়ি তোলার সময় কোত্থেকে একটা গাড়ি এসে হাজির হয়। আমাদের তিনজন লোককে হত্যা করে মারেভাদের উদ্ধার করে নিয়ে চলে যাবার সময় তার ছোঁড়া তিনটি গুলিতে সিরিয়াসভাবে আহত আমাদের একজন লোককে তারা ধরে নিয়ে যায়। যাবার সময় চিৎকার করে বলে যায়, আহতকে আমরা হাসপাতালে নিচ্ছি। এর কিছুক্ষন পর আমাদের লোকেরা থানায় যায়। থানা অদ্ভুত কাথা জানায়। বলে, আমাদের আহত ঐ ব্যক্তিকে যা থানায় নিয়ে আসছিল, সে থানায় এসে ডাইরি করে গেছে, আহত আমাদের লোককে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে কয়েকজন লোক। কয়েকটি গাড়ি নিয়ে তার গাড়ি তারা ঘিরে ফেলে আহতকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এরপর আমাদের আহত লোকটির আর কোন খোঁজ আমরা পাইনি। মারেভা ও মাহিন নিখোঁজ রয়েছে। তাদের বাড়িতে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের পরিবারের লোকেরাও উদ্বিগ্ন। থানায় তারা ডাইরিও করেছে।
থামল জিজর। মুহূর্তকাল থেমেই আবার বলল, মাই লর্ড, আমরা পর্যালোচনা করেছি, আমাদের পরিকল্পনায় তেমন কোন ভূল নেই। আহমদ মুসা অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় আমাদের প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রেও অকল্পনীয়ভাবে তারা আক্রমণের শিকার হয়, যখন তারা ব্যস্ত ছিল মারেভা ও মাহিনকে গাড়িতে তোলার জন্যে। অতএব, মাই লর্ড, আমাদের পর্যালোচনায় আমাদের ব্যর্থতার কারণ, সামর্থ্য ও সুযোগের অভাব নয়। মাই লর্ড! আমরা মুখাপেক্ষী আপনার সিদ্ধান্ত ও আদেশের। থামল জিজর।
তোমাদের কাজ ও বক্তব্যের মধ্যে অনেক ফাঁক রয়েছে। সুপার মার্কেটে আমাদের লোকদের মেরে আমাদের বন্দীদের কেড়ে নিল, তারা একজন না কয়জন ছিল? সে বা তারা হঠাৎ সেখানে উদিত হলো কোত্থেকে? তাদের সুপার মার্কেটে ঢোকা পরিকল্পিত কি না? আহতকে কেউ কেড়ে নিয়েছে, থানায় এই খবর দেওয়া সাজানো কিনা? এই সব বিষয়ে তোমাদের অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা হয়নি।
বলে আলেক্সি গ্যারিন মুহূর্তের জন্যে থামল। আবার শুরু করল, আমি নিশ্চিত সুপার মার্কেটে আমাদের লোকদের হত্যা, মারেভাদের উদ্ধার ও আমাদের লোকদের ধরে নিয়ে যাওয়ার কাজ আহমদ মুসা করেছে। সে ছাড়া এভাবে এই কাজ করার লোক পলিনেশীয়ায় আর কেউ নেই। সে কোন ভাবে মারেভাদের বিপদ জেনে বা বুঝতে পেরে তাদের ফলো করে এবং মারেভাদেরকে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দেয়। নির্দেশ অনুসারেই মারেভারা সুপার মার্কেট প্রবেশ করে সময় ক্ষেপণের জন্যে, যাতে সেই সময়ের মধ্যে আহমদ মুসা পৌছতে পারে। এ না হলে যে মারেভারা ভয়ে হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে আসে, তারা সুপার মার্কেটে ঢুকবে মার্কেটিং করার জন্যে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আহতকে ছিনতাইয়ের কাহিনী সেই সাজিয়েছে, যাতে আহতকে হাসপাতালে পৌছাবার দায় থেকে বেঁচে যায়। নিশ্চয় আমাদের আহত লোকটি মরে গেছে অথবা আহমদ মুসা হত্যা করেছে। কারণ গুলিবিদ্ধ সিরিয়াস আহতকে বন্দী রাখা ও চিকিৎসা করার সুযোগ হোটেলে থাকা আহমদ মুসার কাছে নেই।
আলেক্সি গ্যারিন থামতেই জিজর বলল, মাই লর্ড! হতে পারে, গাড়ির মধ্যেই তাড়াহুড়া করে আমাদের আহত লোকটির কাছ থেকে কথা আদায়ের চেষ্টা করেছে এবং কথা আদায় করতে না পেরে আরও নির্যাতন করতে গিয়ে মেরেই ফেলেছে।
গৌরীর মুখে কথা এসেই গিয়েছিল যে, আহমদ মুসা এ ধরনের শত্রু নয়, সে আহত বন্দীকে নির্যাতন বা হত্যা করতে পারে ন। কিন্তূ নিজেকে সামলে নিল গৌরী। নিজেকে এভাবে প্রকাশ করতে চাইল না গৌরী। কিন্তূ আহমদ মুসার প্রতি এই অভিযোগ তার মনে একটা কষ্টের সৃষ্টি হলো।
হ্যাঁ জিজর, এটাই ঘটেছে। আহমদ মুসা বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে বড় টেররিস্ট। এই কাপুরুষটির এই ন্যাক্কারজনক কাজ তার পাপকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা তাকে ছাড়ব না।
মুহূর্ত কয়েকের জন্যে থেমে ডারথ ভাদেরের দিকে চেয়ে বলল, ভাদের এই ঘটনা ও আহমদ মুসা সম্পর্কে নতুন কি তথ্য তোমার কাছে আছে বল? ডারথ ভাদের উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করে বলল, ঘটনা সম্পর্কে নতুন কোন তথ্য নেই। সুপার মার্কেটের লোকদের সাথে কথা বলে আমাদের গোয়েন্দারা লোকটির চেহারা, পোশাক-আশাক, কথার ধরন ইত্যাদি যে তথ্য পেয়েছে, তাতে মাই লর্ডের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়, লোকটি আহমদ মুসাই ছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আহমদ মুসা তাহিতি থেকে হঠাৎ যেন কোথাও উধাও হয়েছে বা পালিয়ে গেছে। কোন হোটেলে বা অন্য প্লেসে কোন সময় তাকে আমাদের গোয়েন্দারা পায়নি।
আহমদ মুসা সম্পর্কে ভাল জানলে একথা বলতে না ডারথ ভাদের। সে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালায় না। সে অত্যন্ত বিপদজ্জনক। এ পর্যন্ত আমাদের কোন চেষ্টাই সফল হয়নি। সবচেয়ে বিস্ময়ের হলো, তাকে কখনও আইনের চোখে অপরাধী বানানো যায় না। সব জায়গায় সে ত্রাতার ভুমিকায় থাকে, আইন ও পুলিশের পক্ষেই তারা কাজ করে। আমি বুঝতে পারছি না, হঠাৎ সে তাহিতিতে এল কেন? কোন মিশনে সে এসেছে। কিন্তূ তার উদ্দেশ্য না জানলেও সে আমাদের জন্যে বিপদজ্জনক। আমাদের পশ্চিমি বন্ধুরা একটা উদ্ধেগজনক তথ্য দিয়েছে। সেটা হলো সৌদি বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাক্কী’র অনুসন্ধানের দায়িত্ব সৌদি সরকার আহমদ মুসাকে দিয়েছে। আরেকটা তথ্য তারা দিয়েছে, আমাদের যারা বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আব্দুল্লাকে কিডন্যাপ করেছিল, তাদের পিছু নিয়ে আহমদ মুসা ওমান পর্যন্ত এসেছিল। অন্য দিকে আমাদের লোকদের তথ্য হলো, ওমানের সাগর তীরের একটি হোটেলে তাদের উপস্থিতি একজনের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল। গ্যাস বোমা ফেলে তাকে সংজ্ঞাহীন করে তড়িঘড়ি করে তারা পালিয়ে এসেছে। এই দুই তথ্য মেলালে দেখা যাচ্ছে, ওমান হোটেলের সেই লোকটি ছিল আহমদ মুসা। সে আহমদ মুসাই এখন তাহিতিতে। সুতরাং সুস্পষ্ট না জানলেও এটা ধরেই নিতে হবে যে, সে বিজ্ঞিনীর সন্ধানেই তাহিতিতে এসেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সে তাহিতিতে আসবে কেন? সে জানবে কি করে এখানেই তাকে পাবে! কিন্তূ আহমদ মুসার অসাধ্য কিছু নেই। সুতরাং আমাদের প্রজেক্ট আজ ঝুঁকির মধ্যে। একে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে দিতে পারি না। সাফল্য যখন আমাদের হাতের মুঠোয়, গোটা দুনিয়াকে অচল করে দিয়ে, সবার উপর আমরা সচল থাকার যে যাদুরকাঠি আমরা হাতে পেতে যাচ্ছি, তখন কাউকেই আমাদের দিকে চোখ তুলে চাইতে দিতে পারি না। আমাদের প্রোজেক্টের স্বার্থে আহমদ মুসাকে অবশ্যই মারতে হবে। তাকে মারার জন্যে একের পর এক প্লান তোমরা বানাও। এক অপশন ব্যর্থ হলে অন্য অপশন সংগে সংগেই তোমরা যেতে পারবে। এ পর্যন্ত যদিও আমরা সফল হইনি, তবে আমাদের পদক্ষেপ সঠিক হয়েছে। এজন্য তোমাদের মোবারকবাদ দিচ্ছি। আহমদ মুসা অত্যন্ত চালাক, অত্যন্ত ক্ষিপ্র ও অতুলনীয় উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী। এই গুণগুলোই তাকে এ পর্যন্ত বাঁচিয়েছে, কিন্তূ সব সময় তাকে বাঁচাবে না। কেউ এভাবে বাঁচেও না। ভূল এক সময় করেই এবং খতম হয়ে যায় সেই একটি ভূলেই।আমাদেরকে তারই অপেক্ষায় একের পর এক ফাঁদ পেতে যেতে হবে শয়তানের বাচ্চাকে ধরার জন্যে। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
আলেক্সি গ্যারিনের কথার মধ্যে মাঝে মাঝেই গৌরীর মনটা খচ খচ করে উঠেছে কিছু বলার জন্যে। আহমদ মুসা শুধু অসম্ভব চালাক, ক্ষিপ্র ও উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারীই নয়, সে মানবিক ও নীতিনিষ্ঠও। তার জীবন দৃষ্টি, আচরণ কোনও অপরাধীর মত নয়। বন্দীদের প্রতি তার দায়িত্ববোধ ও মমতা গৌরীকে বিস্মিত করেছে। মন জয়ও কি করেনি! না হলে জ্যামিং মেশিনটা সে আহমদ মুসাকে দিয়ে এল কেন, যা আহমদ মুসাকে ঐ সংঘর্ষে জয়ী করেছে।
কথা শেষ করে আলেক্সি গ্যারিন তাকাল গৌরীর দিকে। তাকে অন্যমনস্কতায় ডুবে থকতে দেখে বলল, গৌরী, কি ভাবছ তুমি?
চমকে উঠে গৌরী নিজকে সামলে নিল। মাই লর্ড, এসব নিয়েই ভাবছি।
কি ভাবছ তুমি? বলল আলেক্সি গ্যারিন।
গৌরী মাথা নিচু করে একটু ভেবে বলল, মাই লর্ড! সে এখন আড়লে চলে গেছে আমাদের উপর্যুপরি আক্রমণে। তার সাথে মারেভা ও মাহিনও। আমি মনে করি, আমরা কিছুটা চুপ থেকে তাদেরকে আড়াল থেকে বের করে আনা দরকার। তারপর তাকে আঘাতহানার সুযোগ নিতে হবে তার অপ্রস্তূত অবস্থায়, অন্য দিকে আমাদের প্রজেক্টের রক্ষার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত আছে কিনা, সেদিকে নজর দিতে হবে।
আলেক্সি গ্যারিনের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ধন্যবাদ গৌরী। তোমার চিন্তা ও পরামর্শকে স্বাগত জানাচ্ছি। তুমি সঠিক চিন্তা করেছ। ওরা গর্তে ঢুকেছে, গর্ত থেকে বের করে আনতে হবে তাদের। জিজর, এবার তোমার সামনের চিন্তা সম্পর্কে বল।
মাই লর্ড, ম্যাডাম গৌরী ঠিক বলেছেন। তাদেরকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন এ মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনেও যেতে পারবো না। তবে সংগোপনে তাদের সন্ধান অব্যাহত রাখাতে হবে, বিশেষ করে মারেভা ও মাহিনের বাড়ির উপর খুব সাবধানে নজর রাখতে হবে। মাহিনরা নিশ্চয় তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখবে। এই পথেই আহমদ মুসার সন্ধান পাওয়া যাবে। তার সন্ধান পাওয়া ও তাকে শেষ করাকে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিতে হবে। এজন্যে তাহিতি দ্বীপে আমাদের জনশক্তির সর্বোচ্চ মবিলাইজেশন করতে হবে। প্রতিটি স্থানে আমাদের নজরদারি করতে হবে। সর্বত্র সব দিকে থেকে তাকে ঘিরে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে পলিনেশীয়ার বাইরে থেকে এবং আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার থেকেও আমাদের লোকজনকে তাহিতিতে নিতে হবে। আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের বাইরেই আহমদ মুসাকে ধ্বংস করতে হবে। আমি মনে করি ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট এই ঝামেলা এড়াতে পারলে নির্বিঘ্নে তার লক্ষে পৌছে যাবে। জিজর বলল।
আলেক্সি গ্যারিন এবার ডারথ ভাদেরের দিকে তাকাল।
ডারথ ভাদের প্রস্তূত ছিল। বলল সংগে সংগেই, মাই লর্ড, আমি ম্যাডাম গৌরীও মি, জিজরকে সমর্থন করছি। দরকার হলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাহিতিতেই আহমদ মুসাকে ধ্বংস করতে হবে। থামল ডারথ ভাদের।
সবার কথা শেষ হলে আলেক্সি গ্যারিন চোখে নিচে নামিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, তাহলে এটাই ঠিক হলো, মারেভা ও মাহিনের বাড়ির উপর গোপন নজরদারি চলবে, তাদের বাড়ির লোকজনদের গতিবিধির উপরও গোপনে নজর রাখা হবে এবং গোটা তাহিতি দ্বীপে চলবে গোপন চিরুণী অভিযান। এজন্য প্রয়োজনীয় শক্তিকে তাহিতিতে মোবিলাইজ করার প্লানও মঞ্জুর করা হবে। জিজর ও ডারথ ভাদের উপস্থিত থেকে তাহিতির অভিযান পরিচালনা করবে। আর গৌরী ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের দায়িত্বে থাকবে, যেহেতু তার গুলিবিদ্ধ হাত এখনও পুরোপরি সুস্থ নয়। তোমরা এবার প্রস্তূতি গ্রহন করো। ওকে। কথা শেষ করল আলেক্সি গ্যারিন।
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আলেক্সি গ্যারিনের আসন হটে পেছনের দেয়ালের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল, ঠিক যেভাবে এসেছিল। গৌরীরা তিনজনও উঠে দাঁড়াল।
গৌরী কক্ষের বাইরে যেতেই তার মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখল তার বস আলেক্সি গ্যারিন।
কল অন করে, ইয়েস মাই লর্ড! বলতেই ওপার থেকে আলেক্সি গ্যারিন বলল, গৌরী এস, আমি শোবার ঘরে।
সংগে সংগেই মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল গৌরীর। চোখে ফুটে উঠল অপমান ও জ্বালাময় বেদনার একটা ছাপ।
ইয়েস মাই লর্ড! বলল গৌরী। কথা বলতে কষ্ট হলো গৌরীর।
হ্যাঁ, শোন গৌরী। কয়েক দিন তোমাকে সাদা পোষাকে দেখছি। ওটা আমি দু’চোখে দেখতে পারিনা, সাদা হলো মৃত্যুর প্রতীক। তুমি আগের মত লাল পোষাক পরে এস। তুমি লাল তোমার ভেতরটাও লাল। তোমার গায়ের লাল পোষাক তাই মনে আগুন জ্বালায়। এ আগুন আমার সবচেয়ে প্রিয়। এস গৌরী। বলল আলেক্সি ওপার থেকে।
গৌরী ইয়েস মাই লর্ড! বলতেই ওপার থেকে কল অফ হয়ে গেল।
যন্ত্রের মত কল অফ করল গৌরী।
মুখে ইয়েস মাই লর্ড! বললেও গৌরীর চোখে জ্বলে উঠেছে অপমানের আগুন। এতদিন নারীত্বের, ব্যক্তিত্বের এই অপমানের আগুন অবচেতন মনের কোন এক কোণে যেন সে অনুভব করতো! আজ সেই আগুন তার চোখে নেমে এসেছে। আহমদ মুসা তার মনের সুপ্ত আগুনকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেদিন ‘লা ডায়মন্ড ড্রপ’ হোটেলের ‘অ্যাপেক্স’ রেস্টুরেন্টে আহমদ মুসার সাথে কয়েক মিনিট আলোচনা তাকে নতুন জীবন দিয়েছে। তার নারীত্বের মর্যাদার চেতনা এখন আকাশ স্পর্শ করেছে। মোবাইলটা পকেটে রেখে মনে মনে বলল গৌরী, আগুন শুধু মনোরঞ্জনের জন্য নয় মাই লর্ড, ধ্বংসেরও হতে পারে।
এ আগুন যেন অশ্রু হয়ে জমেছে তার চোখের দুই কোণে!
চোখ মুছে গৌরী পা বাড়াল আলেক্সি গ্যারিনের ঘরের দিকে। ওখানেই এক প্রস্থ লাল পোষাক আছে। কোন এক সময় তা সে খুলছিল। আর নিয়ে আসা হয়নি। ওটাই পরা যাবে সেখানে গিয়ে। তার মনের দরজায় আহমদ মুসার পবিত্র, প্রশস্ত, সুন্দর অবয়বটা এসে দাঁড়াল। সে যেন ট্রাফিক পুলিশের মত হাত তুলে গৌরীকে এগোতে নিষেধ করছে! অশ্রুর একটা ঢেউ যেন তার দুই চোখের কোণকে প্লাবিত করল আবার। মনে মনেই বলল, আহমদ মুসা, তোমার কথাগুলো স্বাধীন মানুষের জন্যে, আমি স্বাধীন মানুষ নই!
গৌরী হাঁটছিল। তার হাঁটা থামল না।
আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে বলল তাহিতিসহ পলিনেশীয়া দ্বীপপুঞ্জের স্বরাষ্ট্র সচিব, প্রধান ফারসি আমলা মসিয়ে দ্যাগল, জরুরি বিষয়টা আপনার কি মি.আহমদ মুসা?
ধন্যবাদ স্যার, এই সাক্ষাত দেয়ার জন্যে।
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। সোজা হয়ে বসে বলল, আমি ছদ্মবেশ নিয়ে তোয়ামতো দ্বীপপুঞ্জে গিয়েছিলাম সংশ্লিষ্ট দ্বীপ এলাকায়ও ঘুরেছি। সব বিষয়ে একটা ধারণা নেবার চেষ্টা করেছি। লক্ষ অর্জনের জন্যে কিছু টার্গেটও ঠিক করেছি। সামনে এগোবার জন্যে আপনার সাহায্য আমার প্রয়োজন।
মি. আহমদ মুসা, আপনার উপর আমার একশ’ ভাগেরও বেশী আস্থা আছে। সেদিন আমরা আলোচনায় বুঝেছি, আতগুলো মুল্যবান মানুষের জীবন রক্ষা করতে হলে গোপন অভিযানের কোন বিকল্প নেই এবং এই অভিযান আপনাকে দিয়েই সম্ভব। তবুও বলছি আপনার সামনে এগোনোর ব্যাপারে সব দিক আপনি ভেবেছেন কিনা, সব ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত কিনা? বলল তাহিতিসহ ফ্রেঞ্চ পলিনেশীয়ার স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধান মসিয়ে দ্যাগল।
সংশ্লিষ্ট সব ব্যাপার নিয়েই আমি ভেবিছি। তবে ঝুঁকির প্রশ্ন তো আছেই।
এ ধরনের অভিযানে ঝুকি এড়ানো সম্ভব নয়। তবে ঝুকি যাতে কমানো যায়, এজন্যে আপনার কছে এসেছি সাহায্যের জন্যে। আহমদ মুসা বলল।
অবশ্যই সাহায্য পাবেন। আমারা প্যারিসকে বিষয়টা ব্রিফ দিয়েছি। তারা সব রকম সাহায্যের নির্দেশ দিয়েছেন। দরকার হলে এখানকার সেনা ইউনিট ব্যবহার করা যাবে। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান দ্যাগল।
ধন্যবাদ স্যার। বলল আহমদ মুসা।
আপনার প্রয়োজনের কথা বলুন মি. আহমদ মুসা।
স্যার, এক, আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল দরকার। ছোট, যাতে এই দ্বীপ বা অ্যাটলের কিনারায় পৌছতে পারি। ওদের রাডার বা সিসি ক্যামেরা’কে ফাঁকি দিয়ে ওদের দ্বীপের নির্দিষ্ট টার্গেটে পৌছার জন্যে এটা দরকার। দুই, রাডার ও ক্যামেরার রেজিস্ট্যান্ট পোশাক দরকার। তিন, ইলেক্ট্রন জ্যামিং মেশিন আমার দরকার এবং চার আলট্রা সাইলেন্সর টেকনলজির মিনি মেশিন রিভালবার আমার প্রয়োজন। শর্ত হলো, এই সবই ফেরত দেব, এই টেকনলজি কারও হাতে যাবার ভয় নেই। বলল আহমদ মুসা।
হাসল স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল। বলল, ফেরত দেয়া, টেকনলজি ট্রান্সফার না হওয়ার প্রশ্ন তুলছেন কেন, আহমদ মুসা? আর কি করে জানলেন যে, এই জিনিসগুলো আমাদের কাছে আছে?
স্যার, আমি পৃথিবীর সব মিলিটারির টাইম জার্নাল নিয়মিত দেখি। এসব জিনিস ফরাসিরা কবে আবিস্কার করেছে তাও আমি জানি। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তূ আহমদ মুসা সাবমেরিন ছাড়া আমাদের আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল, যেটা আছে সেটা ডুবুরীদের ক্যাপসুলের মত। তবে আরও উন্নত। এ থেকে কোন বুদ্বুদ বের হয় না। সাবমেরিনের মত এটা চলতে পারে। কম পানিতেও চলে তবে তার গতি বেশী নয়, ম্যাক্সিমাম ছয় ঘন্টার মত এটা পানির তলে থাকতে পারে। এটা বানানো হয়েছে গোয়েন্দাদের ছোট-খাট কাজে ব্যবহারের জন্যে। স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল বলল।
এটাই আমার মিশনের জন্যে এ্যাপ্রেপ্রিয়েট স্যার। বলল আহমদ মুসা।
আপনার সৌভাগ্য মি. আহমদ মুসা। এই আন্ডারওয়াটার ক্যাপসুলটি দুদিন আগে আমাদের সংগ্রহে এসেছে। এর ব্যাবহারের কয়েকটা বিষয় আপনাকে শিখতে হবে। বলল স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল।
ধন্যবাদ স্যার। আপনারা সাহায্য করলে শিখে নেব। অন্য তিনটি বিষয়ে বলুন। বলল আহমদ মুসা।
ওগুলোর ব্যাপারে সমস্যা হবে না। তবে রাডার ও ক্যামেরা রেজিস্ট্যান্ট পোষাকের বিকল্পও আমাদের আছে। স্বয়ংক্রিয় ক্রোকোডাইল ও ডলফিন পোষাক আছে। ওর ভেতরে ঢুকে পানিতে ও স্থলে যে কোন দিকে, যে কোন ডিস্টিনেশনে চালানো যায়। তবে রাডার ও ক্যমেরা রেসিস্ট্যান্ট নয়। অন্যদিকে রাডার ও ক্যামেরা রেসিস্ট্যান্ট পোশাক রাডার ও ক্যামেরার ব্লাইন্ড অ্যারর হিসাবে চিহ্নিত হবে। সুবিধা হলো এ পোশাকে আপনি যত্র-তত্র যেতে পারবেন, কিন্তূ ক্রোকোডাইল ও ডলফিনের পক্ষে তো সব জায়গায় যাওয়া স্বাভাবিক নয়! থামল স্বরাষ্ট সচিব মসিয়ে দ্যাগল।
হ্যাঁ, রাডার, ক্যামেরা রেসিস্ট্যান্ট পোশাকই আমার জন্য ভাল হবে স্যার। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে, মি, আহমদ মুসা। আপনার যা চাহিদা সেটাই পাবেন। স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল বলল।
আমি অ্যাটলে ঢোকার পর কোন লোক অ্যাটলে ঢূকবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্যে সারফেসে পেট্রল বোট ও পানির নীচে সাবমেরিন পাহারায় থাকতে হবে? এবং………।
আহমদ মুসা কথার মাঝখানেই দ্যাগল বলে উঠল, সাবমেরিন কেন? সারফেসে পাহারায় থাকলেই তো হয়।
অ্যাটলের ভেতরে ঢোকার কোন আন্ডারওয়াটার প্যাসেজ আসে কিনা তা জানি না। থাকলে সেদিক দিয়ে লোক ঢুকে যেতে পারে। ওদের বিভিন্ন ধরনের আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল আছে। আমি ওদের টিউব সাবমেরিনও দেখেছি। বলল আহমদ মুসা।
কি বলেছেন আপনি! ওদের সাবমেরিন, এমনটি টিউব সাবমেরিনও আছে? কোথায় থাকে ওসব?
আছে যে আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। কোথায় থাকে তা জানি না। তাহিতির কোস্টাল লেগুন এবং তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের একাধিক লেগুনে থাকতে পারে। শুধু তাই নয়, ওদের হেলিকপ্টার ও এয়ার-ক্যাপসুলও রয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ হয়ে গেল স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগলের মুখ! কোন কথা বলতে পারল না কিছুক্ষণ। বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলল, মি, আহমদ মুসা! এত কথা তো আগে বলেননি। রীতিমত ওরা রাষ্ট শক্তি বনে গেছে। বিপদজ্জনক ওদের প্রস্তূতি। এই অবস্থায় আমি ওদের হেড কোয়ার্টার বা ঘাঁটিতে আপনাকে ঢুকতে দিতে পারি না। আমি প্যারিসে জানাব। ওদের অনুমতি লাগবে।
আপনি ওদের জানান। কিন্তূ এ কারনে আমাদের এ্যাকশনের জন্য দেরি করার প্রয়োজন নেই। বলল আহমদ মুসা।
প্রয়োজন আছে মি, আহমদ মুসা। আমাদের শক্তি বাড়াতে হবে। স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল বলল।
তাদের সাথে যুদ্ধ করার তো প্রয়োজন নেই। শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজন কি? আমি জানি যে শক্তি আপনার হাতে আছে সেটাই যথেষ্ট ওদের পরাজিত করার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
ধরুন, ওদের হেড কোয়ার্টার দখল হয়ে গেল। হেড কোয়ার্টারে যাবার পথ ওরা না পেলে এবং পানি, আকাশ ও আন্ডারওয়াটার পথে ওরা হেড কোয়ার্টারে যেতে না পারলে ওরা বিশৃঙ্খল ও ভীত হয়ে পড়বে। আমি মনে করি এ ধরনের শক্তি আপনার আছে। আপনার দু’টি ডেস্টয়ার ও কামান, মেশিনগান ও এ্যান্টিএয়ারক্রাফটগানসজ্জিত ২০টি বড় ধরনের মিলিটারি পেট্রল বোট রয়েছে। আর সাবমেরিন আছে বলেও আপনার কাছ থেকে শুনেছি। সুতরাং ওদের বাইরের শক্তিকে ক্রাশ করার জন্যে এই আয়োজনই যথেষ্ট। আরেকটি কথা স্যার হেড কোয়ার্টার ও উদ্ধার পর্বে শক্তি কোন কাজে লাগবে না, এখানে বুদ্ধির যুদ্ধে জিততে হবে এবং বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের উদ্ধার করতে হবে। তাদের নিরাপত্তার জন্যে এই নিরব অপারেশনের প্রয়োজন। বলল আহমদ মুসা।
স্বরাষ্ট সচিব অনেক্ষণ চুপ করে থাকলো। ভাবল। তারপর বলল, ধন্যবাদ মি, আহমদ মুসা, আপনি ঠিক পথেই চিন্তা করছেন। কিন্তূ আপনার চূড়ান্ত অভিযানের আগে অ্যাটলটিতে আন্ডারওয়াটার কোন প্যালেস আছে কিনা তা কি জানা দরকার নয়?
তারও কোন প্রয়োজন দেখি না স্যার। বরং তা দেখতে গেলে ওদের সাথে যদি দেখা হয়ে যায়, ওরা যদি আমাদের জেনে ফেলে কিংবা কোন কারণে সংঘাত বাঁধলে বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাবে এবং ওরা আরও সতর্ক হয়ে যেতে পারে। আমাদের এ অপারেশনের কনসেপ্ট হলো স্যার, ওদের সতর্ক হওয়ার আগে নিরবে ওদের ক্ষমতার কেন্দ্রকে অকেজো করে দেয়া এবং বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর পরই দরকার হবে ক্ষমতার প্রদর্শনী, বাইরের বিজয়টা নিশ্চিত করার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
আমি একমত মি. আহমদ মুসা। কিন্তূ ভাবছি হেড কোয়ার্টার দখলে নেয়ার ভয়ংকর কাজটা কিভাবে হবে। এর সাফল্যের উপরই নির্ভর করছে সব কিছু। আপনার কি পরিকল্পনা? আমাকে প্লিজ একটু আশ্বস্ত করুন। স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল বলল।
আমার কোন পরিকল্পনা নেই স্যার। আল্লাহর সাহায্যের উপর ভরসা করে আমি ভেতরে প্রবেশ করব। প্রতিটি সুযোগের যথাযথ ও সময়োচিত সদ্ব্যবহার করব। সন্দেহ নেই অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ভালোকাজ করার জন্যে আমি যাচ্ছি। আল্লাহর নির্দেশ এটা। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেন। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনার অনেক কাহিনী আমি শুনেছি। আজ দেখছি। আপনার জীবনের সাফল্যের শক্তিকেও আজ আমি প্রত্যক্ষ করলাম। স্বার্থ নয়, স্রষ্টার জন্যে যারা কাজ করেন মৃত্যুভয়সহ কোন কিছু হারাবার ভয় তাদের থাকে না। তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
সব কিছুর পিছুটানমুক্ত কেউ যদি হয়, তাহলে সে সব কিছু করতে পারে। পারবেন আহমদ মুসা, আপনিই পারবেন। গড ব্লেস ইউ। স্বরাষ্ট সচিব মসিয়ে দ্যাগল বলল।
মুহূর্তকাল থেমেই আবার বলল, মি. আহমদ মুসা। আপনি যা চেয়েছেন তা পাবেন এবং যা করতে বলেছেন তা আমি সবই করব।
ধন্যবাদ স্যার, অনেক ধন্যবাদ। বলল আহমদ মুসা।
ওয়েলকাম মাই ফেবারিট ইয়ংম্যান। আমি টেলিফোন করে দিচ্ছি আমাদের নৌ-ঘাটিতে। ফরমাল মেসেজও পাঠাচ্ছি। আজ বা কাল যে কোন সময় সেখানে জয়েন করতে হবে। অন্তত ১২ ঘন্টা সময় সেখানে এক্সারসাইজের জন্যে আপনাকে দিতে হবে।
ওকে স্যার। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে কথা আপতত এখানেই শেষ। প্রয়োজন হলে যে কোন সময় আমাকে টেলিফোন করতে পারেন। আমার প্রাইভেট নাম্বার তো আপনার কাছে আছেই। এ সব কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়াল স্বরাষ্ট মি. সচিব দ্যাগল।
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।
হ্যান্ড শেক করে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল। মি. দ্যাগলও অন্য ঘরের দিকে চলে গেল।
স্বরাষ্ট সচিবের কক্ষ থেকে আহমদ মুসা বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই মি. দ্যাগলের পিএস বলল, স্যার, গাড়ি ডাকব?
না, আমি ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিলাম, ছেড়ে দিয়েছি। তবে চিন্তা নেই, আমি আর একটা ট্যাক্সি ডেকে নেব।
স্যার বলেছেন আপনার সাথে গাড়ি না থাকলে আমাদের গাড়ি দিয়ে আপনাকে পৌছে দিতে। বিনীতভাবে মি. দ্যাগলের পিএস বলল।
না, ধন্যবাদ। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা গাড়ি বারান্দার সামনে আসতেই সেখানে অপেক্ষমাণ এক শিখ ড্রাইভার আহমদ মুসাকে সালাম করল। তারপর শিখ ড্রাইভারদের মতই হিন্দি মেশানো তাহিতি ল্যাংগুয়েজে বলল, সাব কি যাবেন? আমার গাড়ি আছে।
বিস্ময় দৃষ্টিতে সালাম দেয়া দেখে আহমদ মুসা তার দিকে তাকিয়েছিল। তবে সে তাকে চিনতে পারলো। শিখ ড্রাইভার যখন কথা বলল, তখন তার দাঁত, মুখ, চোখ দেখে বুঝল, শিখ ড্রাইভারের ছদ্মবেশ সঠিকভাবে হয়নি।
খুশি হলো আহমদ মুসা। ক’দিন আন্ডারগ্রাউন্ড থাকার পর শিখ ড্রাইভারের ছদ্মবেশে তেপাও বের হয়েছে। ভাল। তার উপার্জনও দরকার। কিন্তূ সে তাহিতির স্বরাষ্ট বিভাগের গাড়ি বারান্দায় কেন? আমাকে দেখে সে যে পরিমান বিস্মিত হয়েছে, তাতেই প্রমানিত হয় সে আমাকে এখানে আশা করেনি। তা হলে সে এসেছে কেন?
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগলের পিএস-এর দিকে ফিরে বলল, ধন্যবাদ, আমি গাড়ি পেয়েছি। আমি এর গাড়িতেই যাব।
ইয়েস স্যার। আমি স্বরাষ্ট সচিবকে বলল। বলল সচিবের পিএস।
স্যার, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি কার পার্কিং থেকে গাড়ি নিয়ে আসছি। বলল তেপাও আহমদ মুসাকে।
বলেই সে ছুটল কার পার্কের দিকে।
গাড়ি নিয়ে এল তেপাও। কিন্তূ তার সেই ট্যাক্সি নয়। ভিন্ন নাম্বার ও অপেক্ষাকৃত নতুন ট্যাক্সি।
গাড়িতে উঠে বসল আহমদ মুসা। গাড়ি চলতে শুরু করল।
তেপাও, তুমি কি গাড়ি পাল্টেছ? বলল আহমদ মুসা।
মারেভা ম্যাডাম বলল, আমার গাড়ির নাম্বার ওরা পেয়ে থাকতে পারে। সুতরাং গাড়ি বের করতে চাইলে নতুন গাড়ি বের করতে হবে। তাই আমি গাড়ি পাল্টিয়েছি। ছদ্মবেশও নিয়েছি শত্রুদের থেকে নিজকে আড়াল করার জন্যে। তেপাও বলল।
তুমি এখানে এসেছিলে কেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্বরাষ্ট সচিব মি. দ্যাগলের সাথে দেখা করার জন্যে।
আহমদ মুসার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল! বলল, স্বরাষ্ট সচিবের সাথে দেখা! কেন?
আপনার বিষয়ে খোঁজ খবর নেবার জন্যে। কোথাও খোঁজ না পেয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। সেইজন্যেই আমাকে স্বরাষ্ট সচিবের সাথে দেখা করার জন্যে পাঠানো হয়েছে। আমাদের ধারণা তিনি নিশ্চয় আপনার খবর বলতে পারবেন। বলল তেপাও।
স্বরাষ্ট সচিব যদি দেখা না করতেন? আহমদ মুসা বলল।
অবশ্যই দেখা করতেন। আমি আপনার বিষয়ে জানার আছে, এ কথা বলে দেখা করতে চাইতাম। বলতাম, অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন, তাই আপনার সাথে দেখা করা দরকার। বলল তেপাও।
সত্যিই কি কোন জরুরি প্রয়োজন তেপাও? আহমদ মুসা বলল।
সত্যিই জরুরি প্রয়োজন আমরা মনে করি। প্রয়োজনটা হলো আপনাকে কিছু খবর জানানো। অবশ্য আমরা জানি না, খবরগুলো আপনার কাছে জরুরি কিনা। বলল তেপাও।
কি খবর তেপাও, তাড়াতাড়ি বল। আহমদ মুসা বলল।
স্যার আজ সকালে আমি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে ছিলাম আমার এই নতুন ট্যাক্সি নিয়ে এবং এই ছদ্মবেশে। দু’জন লোক এল স্ট্যান্ডে। তারা একে, ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিল এবং গাড়ির নাম্বারও দেখছিল। আমার গাড়িটা ছিল এক প্রান্তে। অবশেষে তারা আমার কাছে এল এবং বলল, আমি তেপাও নামে কোন ড্রাইভারকে চিনি কিনা। আমি বলাম এ নামে কোন ড্রাইভারকে আমি চিনি না। তার অন্য কোন নামও থাকতে পারে। পরে তারা বলল, আমি হোটেল লা ডায়মন্ড ড্রপ-এ যাব কিনা। আমি যেতে চাইলে তারা আমার গাড়িতে উঠল। চলার পথে তারা যে গল্প করছিল এবং টেলিফোনে তাদের যে কথা হয়েছিল, সেটাই আপনাকে আমার জানাবার বিষয়। বলল তেপাও।
কি কথা শুনেছ তাদের? নিশ্চয় আমার কাজে লাগবে। বলল আহমদ মুসা।
তারা বলছিল, আহমদ মুসা, মাহিন, মারেভারা গেল কোথায়? এ সব বিষয় নিয়েই তারা কথা বলছিল। একজন বলছিল, হোটেল, নিজেদের বাড়ি, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি কোথাও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় যেতে পারে তারা? আমরা তেপাওকেও খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে পেলেও ওদের সন্ধান লাভ সহজ হতো।
অন্যজন বলল, আমরা তাদের সন্ধান করতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করিনি। এই চেষ্টায় তাদের পাওয়া যাবে না। ওরাও এটা বুঝেছে। এবার অন্য ব্যবস্থা হচ্ছে।
কি ব্যবস্থা? বলল প্রথম জন।
আমি সব জানি না। তবে শুনলাম, তাহিতি ও মুরিয়া দ্বীপের প্রতি ইঞ্চি জায়গা খুঁজে হলেও ওদের বের করবে তারা। এজন্যে তাহিতি ও মুরিয়ার বাইরে থেকে, এমনকি হেড কোয়ার্টার ‘মতু’ থেকেও তাদের দরকারী সব লোককে তাহিতি ও মুরিয়াতে আনা হচ্ছে। আমি শুনেছি, তাহিতিতেই আহমদ মুসাকে তারা ধ্বংস করবে। বলল দ্বিতীয় লোক।
দ্বিতীয় লোকের কথা চলাকালেই একটা কল আসলো তার মোবাইলে। সে তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে মোবাইল ধরল। বলল, ইয়েস স্যার, আমি সনি।
অপর পক্ষের কোন কথা শুনা গেল না। এপারের দ্বিতীয় লোকটি শুধু বলে চলল, জি স্যার, ওকে স্যার, ঠিক সিদ্ধান্ত, আমরা প্রস্তুত, মুহূর্তের জন্যেও আমরা কাজ বন্ধ রাখিনি স্যার। কথা শেষ করে ফোন রাখল দ্বিতীয় লোকটি।
কে টেলিফোন করেছিল সান? প্রথম লোকটি বলল।
কে আবার জারা, বস জিজরের দক্ষিন হস্ত।
কি বলল? জিজ্ঞাসা প্রথম লোকটির।
অনেক কথা। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
কি কথা? প্রথম লোকটি আবার বলল।
আমি যা বলছি সেটাই। বাইরে থেকে সব লোককে তাহিতি মুরিয়াতে আনা হচ্ছে। এমনকি আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার মতু থেকেও এখানকার জন্যে দরকারী সব লোককে তাহিতিতে আনা আছে। আজ থেকে লোক আসা শুরু হয়েছে। কালকের মধ্যে সব এসে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের ‘লর্ড’ মানে বসের যে তিনজন সিকিউরিটিপ্রধান রয়েছে তার মধ্যে প্রধান দু’জন চীপ অব অপারেশন জিজর ও গোয়েন্দাপ্রধান ডারথ ভাদের এখানকার অপারেশন পরিচালনার জন্যে গতকালই তাহিতি এসেছেন। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
তাহিতিকে তাহলে কি যুদ্ধক্ষেত্র বানাবে? বলল প্রথম লোকটি।
না, না। লোকটি বলল সবকাজ অত্যন্ত সংগোপনে হবে। গোটা তাহিতি ও মুরিয়া দ্বীপে নিশ্ছিদ্র চিরুনী অভিযান চলবে গোপনে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অলক্ষ্যে। এই অভিযান চলবে তাহিতি ও মুরিয়া দ্বীপে একই সংগে। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
বিশাল পদক্ষেপ। কিন্তূ আহমদ মুসাকে, যে তার জন্যে এই আয়োজন? বলল প্রথম লোকটি।
কি বলছ তুমি। টাকার অংকে ওকে পরিমাপ করা যাবেনা। ওর লাশের মুল্যই নাকি উঠেছে বিলিয়ন ডলার! বলল দ্বিতীয় লোকটি।
অসম্ভব ব্যাপার! বলছেন কি আপনি! প্রথম লোকটি বলল।
কিন্তূ তাহিতি ও মুরিয়াতে এত কিছু হবে কিন্তূ এখানকার পুলিশ বা গোয়েন্দারা টের পাবে না? বলল প্রথম লোকটি।
হাসল প্রথম লোকটি। বলল, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কি টাকার অভাব! কত টাকা লাগে মাট পর্যায়ের পেটি অফিসারদের কিনতে? নিশ্চিত থাকুন সে কেনা হয়ে গেছে। পুলিশও এই সাথে আমাদের সহযোগিতা করবে। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
তাহলে আর কোন চিন্তা নেই। কিন্তূ একটা বিষয়ে আশংকা হয়, বিপদ তো একটা এসেই গেছে। ঈশ্বর না করুক। আহমদ মুসা যদি ধরা না পড়ে, তাহলে আমাদের কোন বিপদ হবে না তো? আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার কতটা সুরক্ষিত? আমাদের ভবিষ্যৎ কিন্তূ এই সাফল্যের উপর নির্ভর করছে। বলল প্রথম লোকটি।
নিশ্চিত থাক। আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার দুনিয়ায় নয়, পাতালে। আমরা ছাড়া যেতে পারে একমাত্র দৈত্য, আর কেউ নয়। বলল দ্বিতীয় লোকটি।
কিন্তূ আমরা যেতে পারলে অন্যেরা যেতে পারবে না কেন? কথায় আছে, এক মানুষ যা পারে অন্য মানুষও তা পারবে। প্রথম লোকটি বলল।
এ তত্ত্ব সব ক্ষেত্রে খাটে না। আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি খাটে না। প্রথমে পাতালে নামার পথ পাওয়ার বিষয়টি একটা অসম্ভব ব্যাপার। তার পরের ধাপে নামার ব্যাপারটা আরও কঠিন, সেখানে ধাঁধা আছে। ইলেকট্রনিক নানা ধাঁধা আছে। দু’দিকের দেয়াল ফুঁড়ে স্বয়ংক্রিয় গুলি অনুপ্রবেশকারীকে পদে পদে ঝাঁঝরা করে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। কেউ রাস্তা পেরিয়ে প্রাসাদের দরজায় পা রাখতে পারলেও দরজা খুলতে পারবেনা। ডিজিটাল লকের কোড ভাঙা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আর ভেতরে তো আরেক গোলক ধাঁধা। চারটি ফ্লোরের এলিভেটর প্রতিটি করিডোরে দ্বিমুখীভাবে চলে। কোনটা কোন দিকে চলছে কেউ জানে না?
শুনেছি, আমাদের সব গোপন কোড, আমাদের সব কিছু শুধু একজনই জানে। যে আমাদের সব কিছু জানে, তাকে এই পরিস্থিতিতে মতু থেকে সরানো দরকার নয় কি?
হাসল দ্বিতীয় লোকটি। বলল, তাকে পাওয়া অত সোজা নয়। সে আমাদের চার তলায় থাকে বটে, কিন্তূ কোথায় থাকে কেউ জানেনা এবং সে এক কক্ষেও সব সময় থাকে না। তার ব্যপারে জানতে পারে শুধু ম্যাডাম গৌরী। তাও কতটা জানে জানি না।
এত কিছু তুমি জান কি করে? ভেতরের তো কিছুই আমরা জানি না। বলল প্রথম লোকটি।
আমি বাইরের অপারেশনের দায়িত্ব পেয়েছি মাত্র কিছু দিন হলো। তার আগে আমি ডিজাইনার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে ভেতরের সব কাজের সাথেই যুক্ত ছিলাম। কক্ষ বিন্যাস, ইলেক্ট্রিক ও এলিভেটর নেটওয়ার্কিং সব কিছুর সাথেই আমি ছিলাম।
কাজটা ছিল খুব জটিল। এটি তৈরি করা প্রাসাদ নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে বা আগের মানুষের আগের চিন্তায় তৈরি করা প্রাসাদ। লিমিটেড এ্যাকোমোডেশন। এখানে নতুনভাবে কোন কিছু সংযোজন করা সহজ নয়। ইলেকট্রিক ওয়ারিং কোন কোন জায়গায় ড্রিল করে কোনভাবে করা হয়েছে। আর চারটি মুভিং ওলিভেটর তৈরিতে কিছু ভাংচুর করতে হয়েছে, কিন্তূ অসুবিধা হয়নি। এ্যাকোমোডেশনও ঠিক মত হয়েছে। তৃতীয় ও দ্বিতীয় তলায় রোবটদের জন্যে সারিবদ্ধ ক্যাপসুল গড়া হয়েছে। দুই ফ্লোরে ওদের এ্যাকোমোডেশন ও অন্য সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। নিচের তলায় তো কিছুই নেই। ওটা একটা টেস্টগ্রাউন্ড ও ল্যাবরেটরি। সব কাজেই আমি ছিলাম।
তা হলে তো তুমি অনেক বেতন পেতে? প্রথম লোকটি বলল।
বেতন আর কি। কাজটা হয়ে গেলেই হয়। আমরা সফল তো আমরাই দুনিয়ার বাদশাহ হবো। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
কেন? পাশেই তো আছে আমেরিকা, ওরা বসে থাকবে? বলল প্রথম লোকটি।
আমাদেরকে তারা তাদের লোকজনই ভাববে। মনে করবে আমরা তাদের কাজই করছি। কিন্তূ শত্রু বলে বুঝবে, তখন আর তাদের করার কিছু থাকবে না বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত সারেন্ডার করা ছাড়া। দ্বিতীয় লোক বলল।
হোটেল ‘লা ডাইমন্ড ড্রপ’ এর গেটে পৌছতেই ওদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নামার সময় ওদের একজন বলল, আহমদ মুসার রুম তো বন্ধ। ঘরের চাবি না পেলে তো আমাদের চলবে না। ঘর থেকে ওর পোষাক কিংবা ব্যবহার্য কিছু চাই। আমাদের কুকুর বাহিনীর জন্যে এটা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন টার্গেটেড হিউম্যান স্পেল ডিটেক্টর ( THSD) –এর জন্যে। মানুষের চোখ যেখানে যাবে না। সেখানেও কুকুর ও স্পেল ডিটেক্টরের চোখ যাবে। রক্ষা নেই আহমদ মুসার। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
চিন্তা নেই ‘কী বোর্ড’ থেকে চুরি করব আমরা চাবিটি। আর তা পেতেই হবে, এটা আমাদের দাবী।
দু’জনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। তারা চলে গেল হোটেলের ভেতরে।
আমি তখন কোথায় আপনাকে পাব এই সন্ধানে ছুটলাম। শহরের সম্ভাব্য সব জায়গা খুঁজে তারপর গেলাম ম্যাডাম মারেভার ওখানে। উনি থাকছেন তার এক বান্ধবীর বাসায়। তিনি আমাকে বললেন, স্যার মাঝে মাঝে মি. দ্যাগলের কাছে যান। আর এই মুহূর্তে স্যার মি, দ্যাগলের সাথে যোগাযোগ রাখবেন এটাই স্বাভাবিক। তুমি গিয়ে মি, দ্যাগলকে একটা জরুরি মেসেজ পৌছানোর চেষ্টা কর। মি, দ্যাগলের সাক্ষাৎ পেলে বলবে, আপনি দয়া করে স্যারের কাছে এই খবরগুলো পৌছানোর ব্যবস্থা করুন। উনি নিশ্চয় ব্যবস্থা করবেন। কিন্তূ মি, দ্যাগলের সাথে আর দেখা করতে হলো না। আল্লাহর অশেষ রহমতে আপনাকেই পেয়ে গেলাম। সব কথা আপনাকেই বলতে পারলাম। খুব হালকা লাগছে এখন আমার।
আহমদ মুসা পিঠ চাপড়ালো তেপাও-এর। বলল, তেপাও, আমার ভাই, তুমি যে ইনফরমেশন আমাকে দিয়েছ, তার চেয়ে বড় ইনফরমেশন আমি তাহিতিতে এসে পাইনি। তোমাকে ধন্যবাদ! অনেক ধন্যবাদ।
আমি কিছু বুঝিনি স্যার। এটুকু বুঝেছিলাম এ কথাগুলো স্যারের উপকারে লাগবে। বলল তেপাও।
তুমি এত মূল্যবান কথা আমাকে বলেছ যা আমার সামনে এগোবার গাইড লাইন। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, তেপাও, গাড়ি ঘুরাও। স্বরাষ্ট্র সচিব মি. দ্যাগলের কাছে আবার ফিরে চল।
গাড়ি ঘুরাল তেপাও।
আহমদ মুসা কল করল স্বরাষ্ট্র সচিব মি. দ্যাগলকে। মি. দ্যাগল আহমদ মুসার গলা টেলিফোনে পেয়েই বলল, কোন খারাপ খবর নয় তো আহমদ মুসা?
না স্যার। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। আমি আসছি। আপনার অসুবিধা নেই তো স্যার? বলল আহমদ মুসা।
অবশ্যই না। এস। আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। স্বরাষ্ট্র সচিব মসিয়ে দ্যাগল বলল।
গাড়ি পৌছল মসিয়ে দ্যাগলের অফিসে।
মসিয়ে দ্যাগল বেরিয়ে এসেছে বারান্দায়।
আহমদ মুসা বারান্দায় উঠে এলে তারা ভেতরে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসতে বসতে মি. মশিয়ে দ্যাগল বলল, কি ব্যাপার মি. আহমদ মুসা, জরুরি কিছু?
অবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে স্যার। বলল আহমদ মুসা।
কি সেটা? স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল বলল।
স্যার, আগামি সন্ধাতেই আমি ওদের হেড কোয়ার্টার অ্যাটলে ঢুকতে চাই।
কেন, এত তাড়াতাড়ি কেন? বলল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল।
আমাদের তেপাও নিশ্চিত খবর জেনেছে, আমাকেসহ মারেভা ও মাহিনের সন্ধানের জন্য ওরা আগামী পরশু থেকে তাহিতি ও মুরিয়া দ্বীপে চিরুণী অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। অভিযান চলবে নিশ্চয় কয়েক দিন। তাদের এই চিরুণী অভিযানের বেল্ট পলিনেশীয়ার বাইরে থেকে। পলিনেশীয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি হেড কোয়ার্টারের দরকারী সব জনশক্তিকে তাহিতিতে আনা হবে। খোদ ওদের চীফ অপারেশন কমান্ডার জিজর ও ওদের গোয়েন্দাপ্রধান ডারথ ভাদের তাহিতিতে আসছে। আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ। কালকেই ওরা সদলবলে আসছে তাহিতি। আমি পরশু দিন রাতে ওদের হেড কোয়ার্টার অ্যাটলে ঢুকতেচাই স্যার। আমি এর মধ্যেই সব প্রস্তুতি সেরে ফেলতে চাই স্যার। বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে উত্তর দিল না স্বরাষ্ট্র সচিব মশিয়ে দ্যাগল। বলল, হ্যাঁ, মি. আহমদ মুসা, তোমার কৌশলটা ঠিক। তারা যখন তাদের হেড কোয়ার্টার অ্যাটল থেকে এখানে তাদের দরকারি লোকগুলো নিয়ে আসবে তখন তাদের হেড কোয়ার্টার প্রতিরক্ষা অবশ্যই দুর্বল হবে। এই সুযোগই আপনি নিতে যাচ্ছেন। চমৎকার সিদ্ধান্ত! চলুন, আমি আপনাকে নেভাল বেজে নিয়া যাব। ওখানে আপনাকে আন্ডারওয়াটার টিউব ভেহিকেল পরিচালনায় ট্রেনিং নিতে হবে। রাডার রেসিট্যান্ট পোষাক, ইলেক্ট্রনিক জ্যামিং মেশিন ও সাইলেন্সার লাগানো মিনি মেশিন রিভলবার ওখানেই পেয়ে যাবেন। আমি মনে করি, সেখানকার আমাদের নেভাল রেস্ট হাউজে কাল সন্ধ্যায় আপনি থাকবেন।
ধন্যবাদ স্যার। মারেভা, মাহিন ও তেপাও-এর নিরাপত্তাও দরকার। চিরুণী অভিজানের সময় তারা ধরা পড়ে যেতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
আপনার চিন্তা নেই। ওদের নিরাপত্তা নিয়ে আমি আগেই চিন্তা করেছি। বলল মশিয়ে দ্যাগল।
ধন্যবাদ স্যার। আহমদ মুসা বলল।
আসুন! বলে হাঁটতে লাগল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান মশিয়ে দ্যাগল।
তার সাথে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসাও।
গাড়িতে আহমদ মুসাকে বসিয়ে গাড়ি ঘুরে নিজের সিটের পাশে যেতেই একজন গোয়েন্দা অফিসার এসে বলল, স্যার, বিভিন্ন ছদ্মবেশে একাধিক লোক আমাদের এই গেটের উপর নজর রেখেছে। আমরা এগোলেই তারা সরে যাচ্ছে, অন্য লোক আসছে তার জায়গায় অন্য ছদ্মবেশে।
ধন্যবাদ, বুঝেছি ব্যাপারটা।
বলে মশিয়ে দ্যাগল গাড়িতে উঠে বসল।
বলেই বলল, আশ্চর্য হচ্ছি মি. আহমদ মুসা! ওরা আমার গেটের উপরও চোখ রাখছে! আপনি এসেছেন নিশ্চয় ওরা তা জানতে পেরেছে।
তবে আমার এখান থেকে যাওয়া ও আসাটাকে তারা ফলো করতে পারেনি। আমার ধারনা, আজ থেকেই ওরা এখানে পাহারা বসিয়েছে। ওদের এটা জানার কথা নয় যে, আমি এখানে এসেছি এবং এসে থাকি। তবে তারা যে বিবেচনাতেই এসে থাকুক, তারা সফল।
মশিয়ে দ্যাগলের গাড়ি স্টার্ট নিল। গাড়ি চলতে শুরু করল।
এই গেটের উপর চোখ রাখার তখন কেউ ছিল না।
আমাদের ফলো করা আমাদের জন্য ভাল হতো না।
স্বরাষ্ট্র সচিবালয় থেকে নৌঘাঁটি অনেকখানি পথ। পাপেতির সার্কুলারে রোডের যেখানে অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি এসে মিশেছে, সেখানেই স্বরাষ্ট্র সচিবালয় অবস্থিত। অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি সোজা পূর্ব দিকে প্রায় ১০ মাইল এগিয়ে মোয়েভা নদী অতিক্রম করে পূর্ব-দক্ষিন দিকে এগিয়েছে। মোয়েভা নদীর ঐ সংযোগ স্থল থেকে একটা পাথুরে প্রশস্ত রাস্তা মোয়েভা নদীর সমান্তরালে কোস্টাল লেগুনের প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। এটা প্রধান নেভাল ঘাঁটি নয়, এটা নেভাল ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিং কেন্দ্র। এই নেভাল ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিং কেন্দ্রেই আন্ডারওয়াটার ক্যাপসুল ভেহিকেলের ওপর আহমদ মুসার ট্রেনিং হবে।
স্বরাষ্ট্র সচিবালয় থেকে অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি রোড ধরে কিছুটা এগোলেই পাপেতির বিখ্যাত পোরতু নদী। পোরতু নদীর ব্রীজে ওঠার সময় পাশ দিয়ে ফিরছিল গভর্নর সচিবালয়ের সেক্রেটারি হোয়ানু। সে গলা চড়িয়ে বলল, স্যার ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন, কখন ফিরবেন?
আমি মোয়েভা ডকে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরব। স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলকেও কথা অনেকটা গলা চড়িয়েই বলতে হলো। পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির দিকেই তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসা। একটা জীপও দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ির পাশে। আহমদ মুসাদের পরে জীপটি এসে দাঁড়ায়। জীপে চারজন আরহী।
নিবিষ্টভাবে ওদের দিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ সে দেখল, তারা যেন গোগ্রাসে স্বরাষ্ট্র সচিব মি. দ্যাগলের কথা শুনছে! দ্যাগল তখন গলা চড়িয়ে মোয়েভা নেভাল ডকে যাওয়ার কথা বলছিল। গাড়ির অন্য সবারই মনোযোগ তখন ঐ গাড়ির দিকে।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। কিন্তু ভাবনার আর সময় হলো না, সবুজ সিগন্যালের সাথে সাথেই জীপটি হাওয়ার মতো ছুটল সামনে।
স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল তখনও কথা বলছিল গভর্নর সচিবালয়ের সচিব হোয়ানুর সাথে।
কথা শেষ হলে স্টার্ট নিল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের গাড়ি।
অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি সড়কটি তীরের মত সোজা পুব দিকে এগিয়ে গেছে।
স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের সাথে টুকটাক কথা চলছে, কিন্তু আহমদ মুসার মনোযোগ বার বার ছেদ পড়ছিল। ঐ জীপটি ভুলতে পারছিল না আহমদ মুসা। ওরা মি. দ্যাগলের মোয়েভা নেভাল ডকে যাওয়ার কথা উদগ্রীব হয়ে শুনছিল কেন? আর ওদের সবার মনোযোগ তাদের প্রতি ছিল কেন? ওদের মধ্যে একজন ছাড়া কাউকেই তাহিতির লোক বলে মনে হয়নি। তাহলে কি ওরা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের লোক? মি. দ্যাগলের অফিস গেটের উপর তো তারাই চোখ রাখছিল। সন্দেহ নেই ওরাই আবার তাদের ফলো করছে। আহমদ মুসাকেও তারা চিনতে পেরেছে নিশ্চয়। তাহলে ওদের ছেড়ে ওরা চলে গেল কেন?
নানা কথা ও নানা চিন্তার মধ্যে দিয়ে গন্তব্যের শেষ প্রান্তে মোয়েভা নদীর কাছে তারা চলে গেল। মোয়েভা নদীতে ব্রীজ আছে। অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি সড়কটি মোয়েভা ব্রীজ হয়ে আরও পূর্ব-দক্ষিণে চলে গেছে।
ব্রীজ পাওয়ার একটু আগে একটা টিলার ধার ঘেঁষে প্রশস্ত পাথুরে রাস্তা চলে গেছে মোয়েভা নেভাল ডক ইয়ার্ড পর্যন্ত। রাস্তার শুরুটা প্রশস্ত হলেও পরবর্তী অংশ এক রকম নয়। কোথায় সংকীর্ণ, কোথাও প্রশস্ত। দু’এক জায়গায় পাহাড়ের মত উঁচু টিলার সারির বুক চিরে অতিক্রম করেছে সড়কটি। সেখানে সংকীর্ণ। দু’টো গাড়িও পাশাপাশি চলতে পারে না।
ব্রীজের গোড়ায় ছোট্ট একটা পুলিশ ফাঁড়ি।
পর্যায়ক্রমে দু’জন করে পুলিশ পাহারায় থাকে।
হঠাৎ আহমেদ মুসা দ্যাগলকে বলল, স্যার, এখানে গাড়িটা একটু দাঁড় করালে ভাল হয়। পুলিশের সাথে একটু কথা বলতে চাই।
গাড়ি নেভাল ডকের দিকে মোড় না নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পাশেই পুলিশ ফাঁড়ি।
গাড়ি দাঁড়াতেই দু’জন পুলিশ ছুটে এল। স্বরাষ্ট্র সচিবকে দেখে চোখ তাদের ছানাবড়া হয়ে গেল। লম্বা স্যালুট করল তারা।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। পুলিশ দু’জনকে কাছে ডেকে বলল আহমদ মুসা, তোমরা গত দশ মিনিটের মধ্যে কোন জীপ বা গাড়িকে মোয়েভা নেভাল ডক ইয়ার্ডের এই সড়ক ধরে যেতে দেখেছ?
দু’জন একটু ভাবল। একজন বলল, ইয়েস স্যার, সাত আট মিনিট আগে একটা জীপ নেভাল ডক ইয়ার্ডের দিকে গেছে।
পুলিশের উদ্দ্যেশ্যে ‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা স্বরাষ্ট্র সচিবকে বলল, স্যার আপনার গাড়িতে বিস্ফোরক ডিটেক্টর আছে?
না, মি. আহমদ মুসা গাড়িতে আলাদা কোন বিস্ফোরক ডিটেক্টর নেই। গাড়ির ইঞ্জিন কেবিনে ডিটেক্টর ফিট করা আছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সব ধরনের বিস্ফোরককে ডিটেক্ট করতে পারে।
ঠিক আছে স্যার। কত দূর থেকে পারে? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
কমপক্ষে দশ গজ। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল।
গুড। তাহলে এদিকে আর কোন চিন্তা নেই স্যার। আহমদ মুসা বলল।
মি. আহমদ মুসা, এসব নিয়ে আপনি ভাবছেন কেন? আপনি সামনের পথটুকুতে কিছু আশংকা করছেন? জিজ্ঞাসা দ্যাগলের।
হ্যাঁ স্যার, আমাদের এখানে দশ মিনিট আগে যে জীপটা এই পথে নেভাল ইয়ার্ডের দিকে গেছে, সে জীপ্টাকে আমি সন্দেহ করছি। বলল আহমদ মুসা।
এরা কারা বলে মনে করছেন? দ্যাগল বলল।
আমি মনে করছি ওরা ব্লাক সান সিন্ডিকেটের লোক। বলল আহমদ মুসা।
ওরা দেখছি একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে! আমাদের ডক ইয়ার্ডকেও সাবধান করতে হবে। নাশকতামূলক কিছু ঘটাতে পারে ওরা। দ্যাগল বলল।
সাবধান থাকা ভাল স্যার। বলল আহমদ মুসা।
স্বরাষ্ট্র সচিবের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। চলছে গাড়ি মাঝারি গতিতে।
আহমদ মুসার মনে একটা অস্বস্তি। তেমন কিছু তো ঘটেনি! পাশে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ভাবল ব্যাগও তো এনেছে! অ্যাটল দ্বীপে তার অভিজান শুরু হবে এই নেভাল ইয়ার্ড থেকেই। মি. দ্যাগল তাকে এই কথায় বলেছে। ব্যাগ কাছে টেনে নিল আহমদ মুসা। একবার চেক করা দরকার সব উঠেছে কিনা। ব্যাগের প্রধান কেবিনে যা তুলেছিল সবই পেল। হঠাৎ তার খেয়াল হলো লেজারগান ও লেজার কাটার কোথায়? আজ সকালেই তো ব্যাগে তুলেছি! ব্যাগের অন্যান্য কেবিন খুঁজতে গিয়ে ব্যাগের বাইরের কেবিনে পেয়ে গেল অস্ত্র দু’টি। মনে পড়ল আহমদ মুসার, তার একটি অভ্যাস হলো অস্ত্র যত গুরুত্বপূর্ণ হয়, ততই সহজ ও নাগালের মধ্যে রাখে সে ঐ অস্ত্র।
বেশ জোরেই চলছিল গাড়ি। রাস্তার এই অংশটা সমতল। এর পরেই পাহাড়ের ছোট বড় টিলা। নেভাল ডকের সমতল পর্যন্ত নেমে গেছে।
গাড়ীটা কি সত্যিই ওদের ছিল মি. আহমদ মুসা? বলল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল।
আমি তাই মনে করি স্যার? আহমদ মুসা বলল।
ওরা কি বোমা বা এ ধরনের কিছু বিস্ফোরক পাতবে বলে মনে করেন? বলল দ্যাগল।
স্যার, এটা আমার ধারণা। আহমদ মুসা বলল।
বোমা বা বিস্ফোরক পাতার উপযোগী স্থানগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি। বলল দ্যাগল।
আল হামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমাদেরকে নিরাপদে পৌছাতে সাহায্য করুন। আহমদ মুসা বলল।
টিলাসংকুল পথে প্রবেশ করেছে গাড়ি।
রাস্তা আঁকাবাঁকা ও সংকীর্ণ।
দু’পাশে টিলা। সামনে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু একটা টিলা। টিলাকে পাশ কাটাবার জন্যে রাস্তা এখানে বাঁক নিয়েছে।
বাঁক নিতে গিয়ে গাড়ি ডেডস্টপ-এর মত হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।
হঠাৎ এভাবে গাড়ি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সবাই ঝাঁকি খেল। ড্রাইভার পুলিশটি বলল, স্যার, গাড়ির স্টার্টার, চাবি, স্টিয়ারিং কিছুই নড়ছে না।
ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন দেখার জন্যে দরজা খুলতে গিয়ে পারল না। সে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, স্যার, গাড়ির দরজা আনলক হচ্ছে না।
আহমদ মুসাও দ্রুত তার পাশের দরজা খুলতে গেল, কিন্তু পারল না।
দ্রুত আহমদ মুসা ফিরল দ্যাগলের দিকে। বলল, স্যার, গোটা গাড়ি জ্যাম হয়ে গেছে। মেটাল জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক স্প্রে আমাদের গোটা অচল করে দিয়েছে।
এটা কি সম্ভব? এমন অস্ত্রের কথা তো শুনিনি। বলল দ্যাগল।
মেটাল জ্যামিং ডিভাইস ওদের আছে স্যার। আহমদ মুসা বলল।
সাংঘাতিক! এখন করণীয়? বলল দ্যাগল। তার কন্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু বলার সুযোগ হলো না। প্রবল গুলিবৃষ্টি শুরু হলো গাড়ির উপর চারদিক থেকে।
পেছনের চারজন পুলিশ, তাদের রাইফেল, ড্রাইভার পুলিশ ও মি. দ্যাগল রিভালবার হাতে নিল।
আমাদের রাইফেল ও রিভলবার কোন কাজ দেবে না স্যার। ওগুলোও জ্যাম হয়ে গেছে। প্লিজ, আপনারা সিটের নিচে শুয়ে পড়ুন। দ্রুত কন্ঠে চিৎকার করে বলল আহমদ মুসা।
তবু দ্যাগল তার রিভলবার একবার পরীক্ষা করল। দেখল ট্রিগারকে সূঁচ পরিমাণ নড়ানো গেল না। চোখ দু’টি ছানাবড়া হয়ে গেল তার অবাক বিস্ময়ে!
সেও সিটের নিচে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসা গাড়ির ফ্লোরে শুয়ে ব্যাগের বাইরের পকেট থেকে লেজারগান বের করল।
লেজারগানের বডি সর্বাধুনিক প্লাস্টিক মেটাল দিয়ে তৈরি। এই প্লাস্টিক মেটাল ইস্পাতের চেয়ে কয়েক গুণ শক্ত। ইস্পাতের অণুগুলোর মধ্যে ফাঁক থাকে, কিন্তু এই প্লাস্টিকের অণুগুলোর মধ্যে কোন ফাঁক থাকে না। মনে করা হয়, এই প্লাস্টিকের ব্যবহার দিয়ে ‘এ্যান্টিম্যাটার এজ’-এর শুরে হচ্ছে।
লেজারগানটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা মাথা তোলার চেষ্টা করল।
দেখল গাড়ির জানালায় কাচের কোন অস্তিত্ব নেই। গাড়ির বডিও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তবে ডাবল লেয়ারের স্টিল বডির জীপ বলে বুলেটের ঝাঁক ভেতরে লিচের অংশের খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি।
চারদিকের চারটা উৎস থেকে গুলি আসছে, এ সম্পর্কে আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছিল। তার মানে ঐ জীপের চারজন লোকই মাত্র এখানে আছে। আত্মরক্ষার জন্যে চারজনকে শামাল দিতে হবে। গুলি তখনও চলছে।
আহমদ মুসা গড়িয়ে সিটের পাশ ঘেঁষে গাড়ির পেছনের প্রান্তে চলে গেল যাতে তিনদিককে সামনে রাখা যায়। পেছনের গুলির রেঞ্জ দেখে বুঝল তারা দাঁড়িয়ে থেকে গুলি করছে।
আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে লেজারগান ডান হাতে নিয়ে ট্রিগারের বাটনে বুড়ো আঙুল রেখে হাতটা গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে যাওয়া উন্মুক্ত স্পেসের বটম লেভেলে রাখল। যে কোন মুহূর্তে হাতে গুলি খাওয়ার ভয় ছিল। কিন্তু এই ঝুঁকি নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
আহমদ মুসা লেজারগানের ট্রিগারের বাটনে বুড়ো আঙুল চেপে গাড়ির গোটা পেছন দিকের উপর ঘুরিয়ে নিল।
লেজার গানের রেডিয়েশনের স্টিমুলেটেড বিচ্ছুরণ যে লেভেল দিয়ে ঘুরে এসেছে, সে লেভেলে কেউ যদি থাকে তাহলে চোখের পলকে সে দু’খন্ড হয়ে পড়বে।
ট্রিগার টেপার পর আহমদ মুসার শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার পালা।
অপেক্ষার ফল তার সফল হলো, গাড়ির পেছন থেকে গুলি বন্ধ হয়ে গেল।
সংগে সংগে আহমদ মুসা গাড়ির সামনের দিকে ফিরে বসে এক পলকের জন্যে সিটের উপর মাথা তুলল। দেখল সামনের লোকটি তার মিনি মেশিনগান বাগিয়ে ছুটে এসে দাঁড়াল গাড়ির সামনে। তারপর সামনে ঝুঁকে পড়ে মিনি মেশিনগান ঘুরিয়ে নিচ্ছে গাড়ির ফ্রন্ট সিটের দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল ড্রাইভার পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের পিএ তার লক্ষ।
আহমদ মুসা দ্বিতীয়বার ট্রিগারের বাটন টিপল সামনের ঐ লোকটির লক্ষে।
লোকটির মাথার পেছনের অর্ধাংশ মুহূর্তেই কোথায় হারিয়ে গেল। লোকটি লাশ হয়ে পড়ে গেল গাড়ির উপর।
পর মুহূর্তে দু’পাশের জানালায় দু’জন লোক এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা আগেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
ওরা দু’জনেই আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছে।
ওদের মিনি মেশিনগানের নল ঘুরে আসছে।
আহমদ মুসার লেজারগান ঘুরেছে বাঁ দিকের কাচের জানালায় দাঁড়ানো লোকটির লক্ষে। লেজারগানের ট্রিগার বাটনে বুড়ো আঙুল চেপেই ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়ির মেঝের উপর। দুই জানালা থেকেই গুলির ঝাঁক ছুটে এসেছিল আহমদ মুসা লক্ষে। বাম দিকের লোকটির গুলি গোটাটাই লক্ষভ্রষ্ট হয়ে গাড়ির ছাদকে আঘাত করেছিল। তাদের ট্রিগার টেপার আগ মুহূর্তেই লেজারগানের রেডিয়েশনের স্টিমুলেটেড বিচ্ছুরণ গিয়ে আঘাত করেছিল। কিন্তু ডানদিকের লোকটির গুলি করতে তাড়াহুড়া করতে হলেও সে নির্বিঘ্নে গুলি করতে পেরেছিল। লেজারগানের ট্রিগার বাটন চাপার সাথে সাথেই মেঝেয় আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারলে তার দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে যেত। যে সিটের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই সিটের একটা কংকালমাত্র আছে শুধু, সিট আর গাড়ির বডিও উধাও! আহমদ মুসার ঘাড়ের এক খাবলা গোশতও তুলে নিয়ে গেল একটা বুলেট।
আহমদ মুসা মেঝেয় শুয়ে পড়ে ডান দিকের লোকটির গুলির হাত থেকে বেঁচে লেজার গানের টার্গেট ডান দিকের লোকটির দিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে চেষ্টা করছিল।
আহমদ মুসা শুয়ে পড়েই তার পাশের সিটের সামনে দিয়ে সোজা পেয়ে গেল জানালায় দাঁড়ানো ডান দিকের লোককে। শুয়ে পড়ার সময়ই সে ঘুরিয়ে নিয়েছিল লেজারগান। লোকটিকে দেখার পর লেজারগানের ট্রিগার বাটনে বুড়ো আঙুল চেপে বসতে সময় লাগলো না। লোকটিও শুয়ে পড়া আহমদ মুসাকে খুঁজে পেয়েছিল। গুলি বর্ষণরত তার মিনি মেশিনগানের নল দ্রুত ঘুরে আসছিল আহমদ মুসার দিকে। ক্ষিপ্রতার প্রতিযোগিতায় জিতে গেছে আহমদ মুসা। তার লেজারগানের প্রাণঘাতী সব বাধা বিলোপকারী রেডিয়েশনের স্টিমুলেটেডের গতি বুলেটের চেয়ে বহু গুণ বেশি। জানালার ঝুঁকে পড়া লোকটার প্রাণহীন দেহ জানালার উপর ঝুলে পড়ল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলও।
সে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা! এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আপনি! অস্ত্রগুলো অকেজো হবার পর বাঁচার বিন্দুমাত্র আশাও আমরা করিনি!
হঠাৎ বিস্ময় ফুটে উঠল দ্যাগলের চোখে-মুখে।
সে আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে আহমদ মুসার পেছন থেকে দু’হাত সরিয়ে সামনে নিয়ে এল। দেখল, রক্তাক্ত তার দুই হাত। বলল দ্যাগল উদ্বিগ্ন কন্ঠে, আপনি আহত মি. আহমদ মুসা? গুলি লেগেছে।
বলেই দ্যাগল আহমদ মুসার পেছনে গেল। দেখল, ঘাড়ের পাশে কাঁধের একটা অংশ থেকে জ্যাকেট উড়ে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা। বলল দ্যাগল, মি.আহমদ মুসা আপনি সাংঘাতিক আহত। তবে রক্ত দেখে মনে হচ্ছে বুলেটটা হোরিজেন্টালি আঘাত করেছিল, ভার্টিকালি নয়। গুলিটা আহত করে বেরিয়ে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
একটু থেমেই দ্যাগল তার পিএ-কে লক্ষ করে বলল, তুমি ফাস্ট এইড বক্স থেকে ইলাস্টিক ব্যান্ডেজটা নিয়ে এস। তাড়াতাড়ি।
এসবের কিছু দরকার নেই স্যার। চলুন আমরা গাড়ি থেকে বের হই। বলল আহমদ মুসা।
পিএ রেডিমেড ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ নিয়ে এসেছে।
দ্যাগল কিছু না বলে ব্যান্ডেজটি আহমদ মুসার আহত জায়গার উপর সেট করে ব্যান্ডেজের ইলাস্টিক স্কচ টেপ চারদিকে লাগিয়ে দিল।
চলুন এবার। কাছেই আমাদের নেভাল ডক ইয়ার্ড। ওখানে ভাল হাসপাতাল আছে। সার্ভিসও ভাল পাওয়া যাবে। বলল দ্যাগল।
জানালা দিয়ে বের হওয়া অসুবিধাজনক। চলুন ভাঙা উইন্ডো স্ক্রীনের ওদিক দিয়ে বের হতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
কেন এখন খুলবে না দরজা? বলল পুলিশ ড্রাইভার।
না, ম্যাগনেটিক এ্যাকশনের একটা মেয়াদ আছে, তার আগে দরজা খুলবে না। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা, এ মেটালিক জ্যামিং অস্ত্র কোত্থেকে এল? আমি তো এর নামও শুনিনি। এতো একটি সেনাবাহিনীর পুরোটাকেই অচল করে দিতে পারে। বলল দ্যাগল। তার কন্ঠে অপার বিস্ময়!
এটা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের নিজস্ব আবিষ্কার। আহমদ মুসা বলল।
সাংঘাতিক ব্যাপার। ওরা তো দেখছি আমাদের তাহিতিকেও দখল করে ফেলতে পারে। বলার সাথে সাথে চোখ দু’টি ছানাবড়া হয়ে গেল মি. দ্যাগলের!
হ্যাঁ স্যার। ওরা তো তাই চায়। শক্তি দিয়ে ওরা দুনিয়ায় শয়তানের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। কিন্তু শয়তানী শক্তি চিরদিন পরাজিত হয়েছে। সব সময় পরাজিতই হবে। আহমদ মুসা বলল।
সবাই একে একে বের হয়ে এল গাড়ি থেকে।
স্বরাষ্ট্র সচিব টেলিফোন করল পুলিশকে। আর নেভাল ডক ইয়ার্ডকে বলল গাড়ি পাঠাতে।
নেভাল ডক ইয়ার্ডের গাড়ি ও পরে পুলিশ গাড়িও এসে পৌছল।
স্বরাষ্ট্র সচিব পুলিশকে তার কাজ বুঝিয়ে দিল।
নেভাল ডক ইয়ার্ডের সবাই উঠে বসেছে।
দ্যাগলও কথা শেষ করে আহমদ মুসার পাশে উঠে বসল।
আবার ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা আপনাকে। ধন্যবাদ, লেজারগান আপনার কাছে ছিল। আপনি কি সব সময় এভাবে সব অবস্থার জন্যে প্রস্তুত থাকেন? বলল দ্যাগল।
না, তা নয়। আমি নেভাল ডক ইয়ার্ডে আসছি তাহিতি থেকে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েই। এ কারণেই আমাকে যথাসম্ভব প্রস্তুত হয়েই আসতে হয়েছে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! যা প্রয়োজন আপনি তাই করেছেন। তবে আমাদের জন্য আপনাকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হলো। যাক, মি. আহমদ মুসা, আপনাকে কয়েক দিন তো হাসপাতালে থাকতে হবে। তারপর আপনার সেই হাতে কলমের কাজ শেখানো হবে। বলল দ্যাগল।
না জনাব, যেজন্যে এখানে এসেছি, সেই কাজের ব্যবস্থাটা আজই করুন। হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট নেয়ার পর আমি ঐ কাজগুলো দেখতে এবং করতেও পারবো। এই কাজে তো একদিন লেগেও যেতে পারে। সুতারাং আজই কাজ শুরু করতে চাই জনাব। বলল আহমদ মুসা।
দ্যাগল আহমদ মুসার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, বুঝেছি মি. আহমদ মুসা, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের ভয়ংকর দ্বীপটা আপনাকে খুব টানছে।
না স্যার, ঠিক দ্বীপের টান নয়, ৭৬ জন বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞের মুক্তির আকুতি আমাকে অস্থির করে তুলেছে। দ্যাগলের কানে কানে বলল আহমদ মুসা।
দ্যাগলের মুখ গম্ভীর হলো। তার দৃষ্টিটা সামনের দিকে সম্প্রসারিত হলো। অনেকটা স্বগত উক্তির মতই সে বলল, আপনার কথা অনেক শুনেছিলাম, আজ দেখলাম, বুঝলাম, চিনলাম আপনাকে। আপনি সত্যিই শান্তির এক কপোত। যেখানেই মানুষ অশান্তি, সমস্যা, বিপদ, সেখানেই উড়ে যান আপনি।
কেউ উত্তর দিল না দ্যাগলের কথার। উত্তর তিনিও চাননি।
চলছে গাড়ি টিলাসংকুল বিপজ্জনক ঢালু পথে, নেভাল ডক ইয়ার্ডের দিকে।
৭
তোমরা বলতে চাও, ‘আহমদ মুসা সুপারম্যান?’ তীব্র কন্ঠ আলেক্সি গ্যারিনের।
আলেক্সি গ্যারিনের সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়েছিল জিজর ও ডারথ ভাদের। আর আলেক্সি গ্যারিনের কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়েছিল গৌরী।
জিজর ও ডারথ ভাদের কোন কথা বলল না।
আলেক্সি গ্যারিনই কথা বলল আবার।
এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, আমাদের চারজন শ্রেষ্ঠ কমান্ডো জনমানবশূন্য এক পরিবেশে মেটালিক জ্যামার দিয়ে ওদের গাড়িটাকে অচল করে দিল, তারপর অচল করে দিল তাদের অস্ত্রশস্ত্রও। এর পরে চারজন চারদিক থেকে গাড়িটার উপর আক্রমণ চালাল, কাচের বডি ভেঙে গিয়ে গাড়ি উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। তারপরেও চারদিক থেকে চারটি মিনি মেশিনগানের ডজন ডজন বুলেট গাড়ির একজনকেও মারতে পারল না। উল্টো গাড়ি থেকে চারদিকের চার লোককে একা আহমদ মুসা আক্রমণ করল, আর মারা গেল আমাদের চারজন শ্রেষ্ঠ কমান্ডো। একে আমাদের আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?
মাই লর্ড, আমরা যাকে হত্যার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছি, সম্পূর্ন হাতের মুঠোয় পেয়েও তাকে হত্যা করতে না পারা, উল্টো আমাদের সবাই তার হাতে নিহত হওয়া এটা অবিশ্বাস্য। আমি মনে করি আমাদের লোকদের অতি আত্মবিশ্বাস ও যে কোন পরিস্থিতির জন্য তৈরী না থাকার কারণেই এই বিপর্যয় ঘটেছে। আহমদ মুসার লেজারগানের অস্ত্র থাকতে পারে এটা আমরা বিবেচনায় আনতে ব্যর্থ হয়েছি। বলল জিজর নত মুখে বিনীত কন্ঠে।
তা নয়, আহমদ মুসাকে চিনতেই তারা পারেনি বারবার বলা সত্ত্বেও। আহমদ মুসার ক্ষিপ্রতা ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। গাড়ির বডির কাচের অংশ ভেঙে গাড়িকে উন্মুক্ত করার পর কোন সময় না দিয়ে চারদিক থেকে চারজন আহমদ মুসার উপে ঝাঁপিয়ে পড়লে সে পাল্টা আক্রমণের সুযোগ নিতে পারত না। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
ইয়েস মাই লর্ড। একই সংগে বলল জিজর ও ডারথ ভাদের।
তোমরা আজ যা করলে, আগামীতেও তাই কি করতে থাকবে? বলল আলেক্সি গ্যারিন। তীব্র কন্ঠ তার।
মাই লর্ড। আমাদের লোকরা যথেষ্ট প্রস্তুত না হয়েই তাদের ফলো করছিল। তাই বিষয়টি তারা কাউকেই জানায়নি। আহমদ মুসাকে যখন তারা পেয়েছে এবং তাকে ফলো করেছে, তখন তা তাহিতির হেড কোয়ার্টারে ও আশেপাশের আমাদের লোকদের জানানো উচিত ছিল। হয়তো তাতে এই বিপর্যয় রোধ করা যেত এবং আহমদ মুসাকে ফাঁদে আটকানো যেত। ভুল আমাদের কমান্ডোরা করেছে মাই লর্ড। এ রকম ভুল আর হবে না। বলল জিজর।
আলেক্সি গ্যারিন তাকাল ডারথ ভাদেরের দিকে। বলল, ঘটনার পর আহমদ মুসা কোথায়, কি করছে? এ বিষয়টা মনিটর করা হচ্ছে কি না?
ইয়েস মাই লর্ড। ঘটনার পর আমাদের লোকরা জেলের ছদ্মবেশে ঘটনাস্থল ও নেভাক ডক ইয়ার্ডে যায়। তারা জানিয়েছে, আহমদ মুসা নেভাল ডক ইয়ার্ডের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। চিকিৎসা নেয়ার পর সে এখন কোথায়, তা জানা যায়নি। তবে…।
ডারথ ভাদেরের কথার মাঝখানেই আলেক্সি গ্যারিন বলল, আচ্ছা, আহমদ মুসা, স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের সাথে নেভাল ডক ইয়ার্ডে গিয়েছিল কেন?
স্বরাষ্ট্র সচিবের সাথে আহমদ মুসার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র সচিব ফ্রান্সের লোক। আর আহমদ মুসার স্ত্রীও ফ্রান্সের রাজকুমারী। তাই স্বরাষ্ট্র সচিব আহমদ মুসাকে সম্মানের চোখে দেখেন বলে জানা গেছে। তিনিই হয়তো আহমদ মুসাকে নেভাল ডক ইয়ার্ড দেখাবার জন্যে নিয়ে যান। ডারথ ভাদের বলল।
তুমি কি বলতে যাচ্ছিলে? বলল আলেক্সি গ্যারিন জিজরকে লক্ষ করে।
ইয়েস মাই লর্ড, আহমদ মুসার বিষয়ে বলতে যাচ্ছিলাম, ঘটনার সন্ধ্যার দিকে একটা হেলিকপ্টার নেভাল ডক ইয়ার্ড থেকে পাপেতি যায়। জানা গেছে স্বরাষ্ট্র সচিব ঐ হেলিকপ্টারে পাপেতি ফিরেছেন। সবারই ধারনা স্বরাষ্ট্র সচিবের সাথে আহমদ মুসাও পাপেতি ফিরেছেন। আহমদ মুসা আহত বলেই তাকে স্বরাষ্ট্র সচিব হেলিকপ্টারে করে পাপেতি নিয়ে গেছেন। বলল জিজর।
আহমদ মুসা আহত হয়েছে নিশ্চয় ঐ ঘটনায়। তাহলে তো আমাদের কমান্ডোরা তাকে আঘাত হানতে পেরেছিল। কি রকম আহত, কতটা আঘাত সে পেয়েছে? খোঁজ নাও। নিশ্চয় পাপেতিরই কোন এক হাসপাতালে সে থাকবে।
হাসপাতালে সে নাও থাকতে পারে মাই লর্ড। কোন বাড়িতে রেখেও তার চিকিৎসা হতে পারে। বলল গৌরী। এই প্রথম কথা বলল সে। তার মনও চাচ্ছিল যে, কোন হাসপাতালে আহমদ মুসা না থাকুক। কারণ পাপেতির হাসপাতালগুলোতে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা কোনটাই নেই। তার মনের এই চাওয়াটাই প্রকাশ হয়ে পড়েছে তার কথায়। মনের এই চাওয়াটায় চমকে উঠল সে। কেন সে আহমদ মুসার নিরাপত্তা চাইবে?
গৌরীর মনের এই বিব্রত অবস্থা বেশি দুর এগোতে পারল না। কথা বলল আলেক্সি গ্যারিন, গৌরী ঠিক বলেছে। শুধু হাসপাতাল খুঁজলে হয়তো তাকে পাওয়া যাবে না। আসলে আহমদ মুসাকে কোন বাড়িতে রাখার সম্ভাবনাই বেশি।
কিন্তু মাই লর্ড। আহমদ মুসা এ পর্যন্ত হোটেলেই থেকেছে। তাহিতি সরকার তাকে কোন বিশেষ মর্যাদা দিলে সরকারি আতিথ্যে রাখতো। হতে পারে স্বরাষ্ট্র সচিবের সাথে তার সম্পর্কটা পারসোনাল। বলল ডারথ ভাদের।
তোমার কথা সত্য হলেও তার কোন বাড়িতে থাকার সম্ভাবনা রদ হয় না। হোটেল নিরাপদ নয় দেখেই তো সে কয়েক দিন বাড়িতেই আত্মগোপন করে থাকছে। অতএব, বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেবে এটাই স্বাভাবিক।
বলে একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন। একটু ভেবে আবার শুরু করল, তাকে খুঁজে পাওয়ার কাজটা একটু কঠিনই হয়ে গেল। হাসপাতালে থাকলে আমাদের কাজ সহজ হতো। যাক, সে আহত এটা আমাদের জন্যে একটা বড় খবর। অবশ্যই সে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই সুযোগকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, তাকে আমরা খুঁজে বের করবই।
শুধু পাপেতি নয়, পাপেতির আশেপাশের বসতিগুলোকেই আমরা টার্গেট করেছি। পাহাড় ও উপকূলের হোটেল-মোটেল, রেষ্ট হাউস, মেস সব আমাদের টার্গেটের ভেতরে। আমরা প্রতি ইঞ্চি মাটি সার্চ করব এবং সেটা একই সাথে শুরু করবো। যে অঞ্চল সার্চ হবে, সেখানে গিয়ে আবার যাতে আশ্রয় নিতে না পারে, এজন্যে সে অঞ্চলকে আমরা পাহারায় রাখব। আর আমরা যে সার্চ করেছি তাকে, সেটা সে বুঝতেই পারবে না। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, হোম সার্ভিস কোম্পানী ইত্যাদির নামে বিভিন্ন প্রয়োজন ও অজুহাতে সার্চ চলবে। এর মধ্যে কারও সন্দেহ করার কিছুই থাকবে না। আমাদের প্রায় সব জনশক্তিকেই তাহিতিতে এই কাজে নিয়োগ করা হবে। আমাদের এই ক্যাপিটাল অব পাওয়ার থেকেও লোক নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারাই নেতৃত্ব দেবে এই সার্চে। যে কয়দিন সার্চ চলবে, সে কয়দিন আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে বিজ্ঞানীদের কাজ বন্ধ থাকবে। তারা তাদের ক্যাপসুলে তালাবদ্ধ থাকবে। ম্যাডাম গৌরীর নেতৃত্বে রুটিন পাহারা ও ডিউটির জন্যে একটা ছোট দল থাকবে মাত্র ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে।
একটু থামল জিজর। থেমেই আবার বলল, মাই লর্ড, মোটামুটিভাবে এটাই আমাদের চিন্তা। প্ল্যানের আরও ডিটেইলডটা আমরা তাহিতিতে বসেই করব।
তোমাদের চিন্তা ঠিক আছে জিজর। ম্যান পাওয়ার প্ল্যানিংটাও ঠিক আছে। এক এলাকায় এক সাথে সার্চ। আবার সার্চ হওয়া এলাকায় পাহারা বসানো। অনেক লোক তো লাগবেই। কিন্তু এই কাজে তোমরা কয়দিন সময় নেবে? বলল আলেক্সি গ্যারিন।
দু’দিনের বেশি নয়, মাই লর্ড। রাত-দিন ২৪ ঘন্টা আমাদের সার্চ চলবে। বলল জিজর।
ও কে। মনে রেখ আর কোন ব্যর্থতা আমি বরদাশত করবো না। কার কি পরিচয় আমি বুঝি না, মানি না। সাফল্যের বাইরে আমার আর কোন বিবেচনা নেই। ওকে। উইশ ইউ গুড লাক।
বলে আলেক্সি গ্যারিন গৌরীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একটু পর এস।
আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই তার চেয়ারটা পিছু হটে পেছনের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে গেল।
জিজর ও ডারথ ভাদেরও গৌরীকে ‘গুড নাইট’ বলে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।
গৌরী তার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ২টা। ক্লান্তির একটা হাই উঠল তার মুখ থেকে। তার শয়নকক্ষের সুন্দর বেড তার ক্লান্ত শরীরকে ডাকছে। কিন্তু উপায় নেই। তার ‘মাই লর্ড’ আলেক্সি গ্যারিন তাকে ডেকেছে।
বিক্ষোভের একটা বিচ্ছুরণ ঘটল গৌরীর চোখে-মুখে। কিন্তু উপায় নেই।
কোন আইন, নীতি-নিয়ম নয়, সে ইচ্ছার দাস। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, সে থ্রীল ও ঝুঁকি পছন্দ করতো। বড় কিছু করার জন্যে, বড় ঝুঁকি নেয়া যাবে, সে এমন ধরনের একটা জীবন চাইতো। কিন্তু এই জীবন তো সে চায়নি, যে জীবনে নারীত্ব, ব্যক্তিত্বের কোন সম্মান থাকবে না, যে জীবন হবে স্বেচ্ছাচারের অধীন। সে আগে কেন দেখা পায়নি আহমদ মুসার মত লোকের। তার জীবনে অনেক, অনেক বড় কাজ আছে, থ্রীল আছে, ঝুঁকি আছে, কিন্তু সেই সাথে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও মনুষ্যত্ব আছে। এমন জীবনই তো সে চেয়েছিল।
গৌরীর এ ভাবনার মধ্যেই তার পা গিয়ে উঠল লাল এলিভেটরে যা তাকে নিয়ে যাবে আলেক্সি গ্যারিনের কাছে।
আহমদ মুসার অনুমান ঠিক প্রমানিত হলো। তাহানিয়া অ্যাটলের পশ্চিম উপকূলের দক্ষিণ প্রান্তে যে সরবরাহ কেন্দ্র, সেটাই হলো ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ মতুতুংগা অ্যাটলের রহস্যের সিংহদ্বার।
আহমদ মুসা তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের সৌজন্যে পাওয়া আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল ‘সীবেড ক্যাপসুল’ চালিয়ে এসে অবস্থান নিয়েছিল তাহানিয়া অ্যাটলের সেই সরবরাহ কেন্দ্রের সামনে উপকূল ঘেঁষে পানির নিচে। তার রাডার ও ক্যামেরা রেসিস্ট্যান্ট পোষাক আপাদমস্তক খোলসের মত পরে নিয়ে পানি থেকে উপকূলে উঠেছিল এবং গড়িয়ে পৌছেছিল গিয়ে সরবরাহ কেন্দ্রের নিচে, একদম দরজার গোড়ায়।
শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা মাথা তুকে দেখেছিল, কোন আলো কোথাও জ্বলছে না, কেউ কোথাও নেই। দৃষ্টি সীমার মধ্যে সমুদ্রেও কোন আলো দেখতে পায়নি। ডান হাতের চেইন খুলে হাতঘড়ি বের করে রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখল হিউম্যান ওয়াচ ইন্ডিকেটর গ্রীন সিগনাল দিয়ে যাচ্ছে। তার মানে এখান থেকে দশ বর্গগজের মধ্যে কোন মানুষ নেই।
সরবরাহ কেন্দ্রের দরজা স্টিলের। ডবল লক করা।
আহমদ মুসা নিশ্চিত ছিল, সরবরাহ কেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে দু’দিকেই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আছে। কিন্তু যেহেতু গায়ে ক্যামেরা রেসিস্ট্যান্ট পোষাক আছে, সেজন্য উঠে দাঁড়িয়ে সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার দিয়ে গুলি করে দু’টি তালাই ভেঙে ফেলল।
সরবরাহ কেন্দ্রটি এয়ারকন্ডিশন করা।
ঘরে সোফার সারি। তার সাথে কয়েকটা ডীপ ফ্রিজ ও কয়েকটা সেলফ। শাক-সবজি থেকে আটা-চাল, মসলাপাতি সবই সাজানো সেলফগুলোতে। ডীপ ফ্রিজগুলোও খুলে দেখল আহমদ মুসা। নানা রকম নাছ-গোশত ও ডেয়ারি দ্রব্যে ভরপুর ডীপ ফ্রিজগুলো। আহমদ মুসা নিঃসন্দেহে স্বীকার করে নিল, ক্যামোফ্লেজ নয়, এটা সত্যিই সরবরাহ কেন্দ্র এবং এটাও বুঝে নিল, এ সঞ্চয়গুলো মতুতুংগা অ্যাটলের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ – এর জন্যই।
কিন্তু রহস্যের দরজা কোথায়?
সরবরাহ কেন্দ্রের বিশাল ঘরটা তন্নতন্ন খুঁজে কিছুই পায় না সে। এক জায়গায় দু’টি রেফ্রিজারেটরের মাঝখানে ফাঁকা দেয়াল দেখতে পায়। অস্বাভাবিক মনে হয় দেয়ালটাকে। হাতের রিভলবার দিয়ে টোকা দেয় স্টিলের পরে। একটা হালকা ধাতব শব্দ হয়। তার মানে ওটা দেয়াল নয়, স্টিলের কিছু, দরজাই হবে হয়তো।
দু’টি রেফ্রিজারেটরের মাঝের স্পেসটা একজন মানুষের সাধারণভাবে চলাচলের জন্য যথেষ্ট নয়।
নিজেকে সংকুচিত করে আহমদ মুসা দেয়ালের নিকটে পৌছে চাপ দেয় দরজা আকারের স্টিলের পাল্লার উপর। সংগে সংগে খুলে যায় পাল্লা। পুরোপুরিই একটা দরজা এটা।
দরজা খুলে গেলে আহমদ মুসা দেখতে পায়, ওপারে আরও বড় একটা ঘর। গোটাটাই একটা কোল্ডস্টোরেজ। সেখানে আলু, টমেটো, বীট, গাজর ইত্যাদির স্তূপ।
কক্ষটি অনেকখানি নিচু। প্রায় পাচ-ছয়টা ধাপ পেরিয়ে কক্ষটিতে নামতে হয়। কক্ষটিতে নামে আহমদ মুসা।
ঘরটিতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিশাল সংগ্রহ দেখে বিস্মিত হয় না আহমদ মুসা। ‘ ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ অর্থাৎ মতুতুংগার প্রাসাদে শুধু বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞই বন্দী আছে ৭৬ জন। এঁরা ছাড়াও তো সেখানে আরও লোক আছে। সুতরাং তাদের জন্য খাবারের এ ধরনের বড় আয়োজন তো থাকবেই হবে।
কিন্তু রহস্যপুরীতে ঢোকার সিংহদ্বারটা কোথায়? খুঁজতে শুরু করে আহমদ মুসা।
ঘরের চারিদিকের দেয়াল ঘেঁষে বড় বড় ডীপ ফ্রিজের সারি। আর মাঝখানে মেঝেতে রাখা আলু, টমেটো ইত্যাদির স্তুপ।
ডীপ ফ্রিজগুলো একের পর এক খুলে ভেতরটা দেখতে থাকে আহমদ মুসা। সেগুলো আগের মতই মাছ, গোশত, ডেয়ারি পণ্যে ঠাসা। দুই ঘরের পার্টিশন ওয়ালের পাশ ঘেঁষে রাখা একটা বড় ডীপ ফ্রিজার খুলে আহমদ মুসা দেখে, ফ্রিজটা অন্যগুলো থেকে একটু ভিন্ন। ডীপ ফ্রিজের মাঝামাঝি বরাবরের মতই কিছু উপরে, কিছু নিচে মানে পুরো আয়তন জোড়া একটা ট্রের উপর টিনজাত খাদ্য সাজানো। ট্রের নিচে গোটা ফ্রিজটাই খালি। ডীপ ফ্রিজের তলা সবচেয়ে বিস্ময়ের ঠেকেছিল আহমদ মুসার কাছে। তলাটা মেটালিক নয়! পুরোটাই যেন একটা শ্বেত পাথর! পাথরটির চার প্রান্তই ডীপ ফ্রিজটির চারদিকের ওয়াল থেকে কিছুটা আলগা অর্থাৎ ডীপ ফ্রিজের আয়তনের তুলনায় সাদা পাথরটি ছোট। তাছাড়া এর উত্তর প্রান্তের মাঝখানে একটা বড় সাদা কাপ উপুর করে রাখা। কাপটা মনে হচ্ছে প্লাস্টিকের।
এই অস্বাভাবিকতা আকর্ষণ করে আহমদ মুসাকে। ট্রেটি তুলে নেয় ডীপ ফ্রিজ থেকে। তারপর ঢুকে যায় ডীপ ফ্রিজের মধ্যে। ঠিক তলাটি সলিড শ্বেত পাথরের। আহমদ মুসা কাপটি তুলে নেয়। অমনি তার নজরে পড়ে কাপের নিচের সাদা রিংটি। রিংটি শ্বেত পাথরের প্লেটটার সাথে আটকানো।
আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে আহমদ মুসার মুখ। এটাই তাহলে সিংহদ্বার!
আহমদ মুসা এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে রিং ধরে টেনে তুলে ফেলে পাথরটাকে।
আনন্দ-বিস্ময়ে চোখ দু’টি বিস্ফারিত হলো আহমদ মুসার। তার সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে একটি সিঁড়ি পথ।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। খুশি হলো। তার অনুমান সত্য তা প্রমাণিত হতে চলেছে। এই সরবরাহ কেন্দ্রের মধ্যেই রয়েছে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ মতুতুংগা অ্যাটলের রহস্যের সিংহদ্বার।
আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে গ্যাস মাস্কটা বের করে মুখে লাগিয়ে সিঁড়িতে নেমে গেল। সিঁড়িটা পরিচ্ছন্ন ও আলোকিতও।
সিঁড়িমুখের পাথর আবার সিঁড়ি মুখে সেট করল আহমদ মুসা।
দেখা যাচ্ছে সিঁড়িটা অনেক দুর পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। সাদা পাথরের সিঁড়িকে শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সিঁড়ি যেখানে শেষ সেখান থেকে রাস্তাটা সমতল হয়ে সামনে এগিয়েছে।
আহমদ মুসা যাত্রা শুরুর আগে ডান হাতের রিস্টওয়াচের হিউম্যান ইন্ডিকেটর, বিস্ফোরক ও মেটাল ইন্ডকেটর সব ঠিক আছে একবার দেখে নিল। মুখের গ্যাস মাস্কও ঠিক আছে কিনা দেখল। কাঁধে ঝুলানো তার সাইলেন্সার মিনি মেশিনগান। ডান হাতে লেজারগান।
নিজেকে প্রস্তুত দেখার পর আহমদ মুসা নজর দিল সিঁড়ি ও দু’পাশের দেয়ালের দিকে।
সিঁড়ি সাদা পাথরের। প্রতিটি সিঁড়িতে রয়েছে তিনটি করে পাথর। তিনটি পাথরই একটি অন্যটি থেকে আলগা। সব ধাপে একই অবস্থা।
সিঁড়ির দু’পাশের দেয়ালেও পাথর বসানো। বিভিন্ন রঙের। দেয়ালের মাঝ বরাবর পাথরগুলো সবই কালো। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, কালো পাথরের মাঝটায় রাউন্ড করা অনেক ফুটো। প্রতিটি কালো পাথরে এই একই রকম ডিজাইন। সিঁড়ির ছাদটার প্লাস্টার সাদা রঙের।
সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে আহমদ মুসা আরও একবার ভেবে নিল, সিঁড়ি পথে নিরাপত্তামূলক কি কি ব্যবস্থা থাকতে পারে। পাহারায় লোক থাকতে পারে। সিঁড়ি পথে বিস্ফোরকও পেতে রাখতে পারে। হয়তো তারা সিঁড়ির নির্দিষ্ট রুটে চলে। এর বাইরে গেলেই বিস্ফোরকের ফাঁদে পড়তে হতে পারে। শত্রুর আগমন টের পেলে ওরা বিষাক্ত গ্যাস বোমাও ছুঁড়তে পারে সিঁড়ি ও সুড়ঙ্গে। এছাড়া আর কি ব্যবস্থা সুরঙ্গ পথের নিরাপত্তার তা জানা নেয় আহমদ মুসার। তবে তাকে এই অবস্থায় হিউম্যান ওয়াচ মনিটর (HWM) ও মেটাল বিস্ফোরক ডিটেক্টরের নির্দেশনা সামনে রেখেই চলা ছাড়া উপায় নেই।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল আহমদ মুসা।
কতকগুলো ধাপ নামার পর অনেকটা নিশ্চিন্তই হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসা।
হঠাৎ বিপ বিপ শব্দ হলো ডান হাতের রিষ্টওয়াচ থেকে। হাত ঘুরিয়ে রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেটাল ও বিস্ফোরক ইন্ডিকেটর লাল সিগন্যাল দিচ্ছে।
সংগে সংগে দাঁড়িয়ে গেল আহমদ মুসা।
এখান থেকে কয়েক গজের মধ্যে কোথাও মেটালিক কিছু বা বিস্ফোরক আছে। ইন্ডিকেটর মেটাল ও বিস্ফোরক দু’য়েরই উপস্থিতির সংকেত দিচ্ছে।
কিন্তু সিঁড়ি, সিঁড়ির দু’পাশের দেয়াল ও সিঁড়ির উপরের ছাদ সবই ত আনেকদুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে পরিস্কার! কিছু কোথাও নেই। তাহলে সিগন্যাল আসছে কেন?
আহমদ মুসা চোখ উপরে তুলল, ছাদের দিকে। বিপ বিপ শব্দ কিঞ্চিত কমে গেল। বুঝল আহমদ মুসা, ইন্ডিকেটরটা বিস্ফোরক বা মেটালের উৎস থেকে একটু দূরে সরে গেছে।
ইন্ডিকেটরের বিপ বিপ শব্দ উৎসের যত কাছে যায় তত বাড়ে, দূরে সরলে কমে।
আহমদ মুসা এবার ডান হাতটা পাশের দেয়ালের দিকে নিল। আওয়াজ বেরে গেল বিপ বিপ শব্দের।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, কাছেই দেয়ালের কোথাও বিস্ফোরক বা এ জাতীয় কিছু লুকানো আছে। লুকানো আছে কেন? এর ব্যবহার তাহলে কিভাবে হবে?
আহমদ মুসা লুকানো জায়গাটাকে সঠিকভাবে লোকেট করার জন্য রিস্টওয়াচ পরা ডান হাত সিঁড়ির দেয়ালের আরও সামনে এগিয়ে নিল। এগিয়ে নিতে গিয়ে তার বাম পাতা সিঁড়িতে রাখার সাথে সাথেই তা দেবে গেল সামান্য। দেহের ভারসাম্য হারিয়ে আছড়ে পড়ার মত উপরের সিঁড়িতে বসে পরল।
ঠিক যে সময় আহমদ মুসার দেহ উপরের সিঁড়িতে বসে পড়ছিল, তখন সিঁড়ির দু’পাশের দেয়াল থেকে এক পশলা গুলির বৃষ্টি সিঁড়ির মাঝের দিকে ছুটে এল। মাঝখানে কোন টার্গেট না পাওয়ায় গুলির পশলা পরস্পর বিপরীত দিকের দেয়ালে গিয়ে আঘাত করল। গুলিগুলো নিঃশব্দে এসেছিল।
বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখল আহমদ মুসা এই দৃশ্য। নিচের ধাপে পা রেখে যদি সে দাঁড়িয়ে যেত ধাপটির উপর, তাহলে বুকের দু’পাশের দুই পাঁজর দিয়ে গুলির ঝাঁক তার বুকে ঢুকে যেত। অদ্ভুত পরিকল্পনা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের।
মুখের গ্যাস মাস্ক ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে সিঁড়ির অবশিষ্ট অংশ ক্রলিং করে নামার সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা।
সিঁড়ির গোঁড়ায় এসে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
সামনের দিকে তাকাল। সুড়ঙ্গের মেঝেটা একই রকমের কংক্রিটের এবং নিট-ফিনিশিং করা। কোন বিশেষ বিশেষত্ব চোখে পড়ল না।
সুড়ঙ্গটা টিউবের মত, শুধু মেঝেটাই সমতল। মেঝে ছাড়া অর্ধ বৃত্তাকার অংশটি প্লাস্টার করা। এখানেও কোন কিছু তেমন আহমদ মুসার নজরে পড়ল না।
বিসমিল্লাহ বলে রিস্টওয়াচের ইনডিকেটরের দিকে নজর রেখে চলতে লাগল আহমদ মুসা।
এক জায়গায় এসে সুড়ঙ্গের একটা ছোট বাঁক। বাঁকে মাথার উপরের বাল্বটা খুবই উজ্জ্বল। বাঁক নেয়ার জন্যেই কি এটা! হতে পারে।
কিন্তু কয়েক ধাপ এগোলেই মেটাল ইনডিকেটর সাংঘাতিকভাবে বিপ বিপ করতে লাগল, অনেকটা চিৎকারের মত।
সংগে সংগে দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসা।
ডান হাতটা সব দিকে ঘুরিয়ে ইনডিকেটর পরীক্ষা করে দেখল, বিপ বিপ- এর তীব্রতা উপর দিকে বেশি, মনে হলো কেন্দ্রটা উজ্জ্বল বাল্বের দিকে। কিন্তু বাল্ব বরাবর গোটা সুড়ঙ্গেই ইনডিকেটর বিপ বিপ সিগন্যাল দিচ্ছে।
আহমদ মুসা বাল্বের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখল বাল্বের হোল্ডারটা স্টিলের। সুড়ঙ্গে এ পর্যন্ত দেখা সব বাল্বের হোল্ডার প্লাস্টিকের।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, বাল্বের হোল্ডারের কারনেই ইনডিকেটরের এই বিপ বিপ। কিন্তু এত বড় স্টিল হোল্ডারে এত বড় বাল্ব কি এই বাঁকের জন্যে দেয়া হয়েছে? এর কোন সদুত্তর সে খুঁজে পেল না।
আহমদ মুসা চলতে শুরু করল।
বাল্বের ঠিক নিচে পৌঁছাতেই বাল্বটার বিস্ফরন ঘটল। সংগে সংগে হালকা এক প্রকার গ্যাসে আহমদ মুসার চারিদিকটা ভরে গেল।
বিস্ফোরণের আকস্মিকতায় চমকে উঠেছিলো আহমদ মুসা। বুঝে নিয়েছিল কি ঘটেছে। সংগে সংগে বাড়তি সতর্কতার জন্যে মুখের গ্যাস মাস্কের ইলাস্টিক বাটন ঠিক আছে কিনা দেখে নিল।
সংগে সংগেই আবার হাটা শুরু করল আহমদ মুসা।
কয়েক গজ হাটার পর দেখল গ্যাস মাস্কের স্ক্রিনে ইয়েলো রঙ আর নেই। আহমদ মুসা বুঝল, প্রাণঘাতী গ্যাস স্পোক শুধু বাল্বের নিচে আসা শত্রুদের মারার জন্যে কয়েক গজের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে।
চলা অব্যাহত রাখল আহমদ মুসা।
ভাবল, দুই ফাঁদ সে পার হয়েছে। আর কি ফাঁদ পাতা আছে সামনে?
আরও ভাবল, সুড়ঙ্গে তারা কোন প্রহরী রাখেনি তো! তারা তাদের পাতা ফাঁদের উপর নির্ভর করেছে। আহমদ মুসা মন মনে সেই সাথে স্বীকার করল, তাদের ফাঁদগুলো বিস্ময়কর ধরনের নতুন, যা থেকে বাঁচা আল্লাহর সাহায্যেই শুধু সম্ভব। প্রথম ফাঁদের ক্রস ফায়ার থেকে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছেন। আর এই বিশেষ গ্যাস মাস্ক তার কাছে ছিলনা, এটা সে পেয়েছে ওপরের সরবরাহ কেন্দ্রে। এটাও আল্লাহর সাক্ষাত সাহায্য।
সুড়ঙ্গ পথ শেষ হল।
এবার সিঁড়ি পথে উপরে উঠতে হবে।
সিঁড়িতে পা দেবার আগে আহমদ মুসা সিঁড়ির দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। এ সিঁড়ি পথটা আগের চেয়ে ভিন্ন। সাদা পাথরের সিঁড়ি। সাদা পাথরের মধ্যে এখানে ওখানে ঘন কালো পাথর বসানো। কালো পাথরগুলো শৃঙ্খলার সাথে বসানো নয়, বিক্ষিপ্ত ও কালো পাথরগুলো আকারেও এক রকম নয়। মোজাইকে এমন পাথর বসানোর নজির আছে। বলা যায়, মোজাইকের ডিজাইনই এখানে অনুসরন করা হয়েছে এবং সন্দেহ নেই তা সৌন্দর্যেরও সৃষ্টি করেছে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল আহমদ মুসা। চারিদিকে বিশেষ করে সিঁড়ির দিকে ভাল করে চোখ রেখেছে আহমদ মুসা।
সিঁড়ির প্রায় অর্ধেকটা পথ উঠেছে।
এখানে একটা ধাপে পা চেপে অন্য পা উপরের ধাপে ওঠাবার জন্যে তুলল আহমদ মুসা। শরীরের পুরো ওজন যখন নিচের পায়ের উপর পড়ল। তখন পা রাখার জায়গাটা অল্প দেবে গেল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা! কিন্তু কিছু করার সময় ছিল না।
পারল শুধু নিচের পায়ের উপর শরীরটাকে রেখে নিচে নামিয়ে নিতে। তাতে নিচের ধাপের উপর পায়ের উপর চাপ আরও বাড়ল।
নিচের ধাপে পায়ের একটা আঘাত টের পেয়েছে সে। আঘাতটা তার জুতার সোলে। তীক্ষ্ণ একটা শব্দও তার কানে এসেছে।
মুহূর্ত কয়েক অপেখা করে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল উপরের ধাপে। নিচের ধাপে রাখা পা তুলে আহমদ মুসা দেখল, স্টিলের একটা স্পোক ঢুকে গেছে জুতার সোলে। স্পোকটার আধা ইঞ্চির মত অংশ বাইরে বেরিয়ে আছে। বুঝল, স্পোকটা জুতার সোলের প্রথেমে রাবার, পরে চামড়ার অংশ ভেদ করে গিয়ে আটকা পড়েছে সোলের স্টিলের অংশে। জুতাটি বিশেষভাবে তৈরি। স্টিলের একটা প্লেট জুতার গোড়ালি থেকে আগা পর্যন্ত জুড়ে দেয়া আছে।
আহমদ মুসা হাতে গ্লাভস লাগিয়ে টেনে বের করল স্পোকটি। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ স্পোকটির আকৃতি দেখেই বুঝল, বিশেষ অস্ত্রের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এটা। স্পোকটি বিষাক্ত হবে নিশ্চয়।
আহমদ মুসা গ্যাস মাস্কের একটা বোতাম টিপে একটা বিশেষ স্ক্রিন চোখের সামনে নিয়ে এলো। এই স্ক্রিনের সামনে এনে স্পোকটি পরীক্ষা করল আহমদ মুসা। নিশ্চিত হলো, স্পোকটি গোটাই বিষাক্ত। জুতার সোলে স্টিলের প্লেট না থাকলে এই স্পোকটি আঘাত করত পায়ের তালুতে। প্রাণঘাতী বিষে সংগে সংগেই মৃত্যু নেমে আসত।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল তাকে জুতাটি প্রেজেন্ট করেছে এই অভিযানের জন্যে। এই জুতার আরও কার্যকারিতা রয়েছে। আহমদ মুসারও এই ধরনের একটা জুতা ছিল। কিন্তু সে জুতাটি সে হারিয়ে ফেলেছে হোটেল লা ডায়মন্ড ড্রপে আসার পর।
নিচের ধাপের যে জায়গা থেকে স্পোকটি বেরিয়ে এসেছে, সেটাও পরীক্ষা করল আহমদ মুসা।
নিচের ধাপের যেখানে পা রেখেছিল, তাও সেট করা একটা কালো পাথরের উপর। এটা কালো পাথরটির মাঝের প্রায় গোটা অংশই জুড়ে রয়েছে। পাথরতিতে দুই সারি ছিদ্র। ছিদ্রগুলোও কালো। কালো পাথরের সূক্ষ্ম কালো ছিদ্রগুলো দাঁড়ানো অবস্থায় সাধারনত চোখে পড়ার মত নয়।
আহমদ মুসা মনে মনে বলল, অদ্ভুত সব ফাঁদ পেতে এঁরা এদের সুড়ঙ্গ পথকে সুরক্ষিত করেছে! মানুষের শক্তিকেও এরা বদলে দিয়েছে যান্ত্রিক কৌশলের ভয়াবহতা দিয়ে। ভেতরের অবস্থা আরও কতটা ভয়াবহ জানি না!
হাঁটা শেষ করে সিঁড়ির স্ট্যান্ডিং-এ উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। মুখোমুখি হলো একটা বড় দরজার। সলিড স্টিলের দরজার দু’পাশটাই দু’পাশের দেয়ালে ঢুকে পড়েছে, , উপর ও নিচের অংশটাও একই রকম।
দরজার চারপাশটা আহমদ মুসা খুটে খুটে দেখল।
দরজা খোলার ক্লু খুঁজছে সে। নিশ্চয় কোথাও সে ক্লু আছে। কোথায় সেটা?
হঠাৎ আহমদ মুসা দেখতে পেল দরজার মাথার সমান উঁচুতে স্টিলের গায়ে স্টিল কালারের মার্বেলের মত গোলাকার টাচ লকের ক্যালকুলেটর বোর্ড। চারদিক খুঁজল, আশেপাশে কিংবা দরজার অন্য কোথাও এ ধরনের কিছু নেই।
নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা, দরজা খোলার লক এটাই।
কিন্তু এর অপারেটিং সিস্টেম কেমন? এ টাচ লকে ক্যাল্কুলেট বা কম্পিউটারের মত ডিলিট, অ্যাড, মাইনাস ইত্যাদির মত কোন অপশন নেই। শুধু রয়েছে এক থেকে শূন্য পর্যন্ত নাম্বার।
এই অবস্থায় ডিজিটাল লক বিপজ্জনক হতে পারে। টাচ করলে যে নাম্বার উঠবে, তা ডিলিট করা সম্ভব হবে না। আর সে নাম্বার বা নাম্বারগুলো যদি সঠিক কোড না হয়, তাহলে দরজা খোলার আর সুযোগ থাকবে না।
এই প্রথম একটা উদ্বেগ এসে আহমদ মুসাকে আচ্ছন্ন করল।
ঘড়ি দেখল আহমদ মুসা। রাত ৮টা। তার সব কাজ রাত ১২টার মধ্যেই শেষ করতে হবে।
রাত ১২টা পর্যন্ত ঘুমায় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এই ক্যাপিটাল অব পাওয়ার। এদের ঘুম শুরু হয় সন্ধ্যা ৬টায়। এসব কথা সে শুনেছে তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মফ ফ্লেরির কাছ থেকে।
উদ্বেগ নিয়ে দরজাকে পাশে রেখে বসে পড়ল আহমদ মুসা। বুঝতে পারল সে, সুড়ঙ্গ ও গেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে এতটাই নিশ্চিত করেছে যে, প্রহরী রাখারও প্রয়োজন হয়নি।
বসেই আহমদ মুসা হাত বাড়াল দরজার গোড়ায় দরজা ও ফ্লোরের মাঝখানে যে সংকীর্ণ ফাঁক রয়েছে সেখানে।
বসার সময়ই সে দেখতে পেয়েছে দরজা ও ফ্লোরের প্রান্তটির মাঝখানের ফাঁকে ঠিক দরজার রঙেরই একটা ভাজ করা কাগজ।
একটা আঙুল দিয়ে কোনমতে তুলে নিল ভাঁজ করা কাগজ খণ্ডটি। দ্রুত কাগজ খণ্ডটির ভাঁজ খুলল আহমদ মুসা।
৮ সেন্টিমিটারের মত বর্গাকৃতির একটা কাগজ। শুরুতেই একদম টপে এক পাশে ছোট একটা বৃত্ত। তাও স্টিল কালারের। তার পাশে সমান্তরালে অনেক ডিজিট। তার নিচে একটা রঙিন ডায়াগ্রাম। ডায়াগ্রামটি শুরু হয়েছে বটম থেকে। লাল ও সবুজ দু’টি রেখা। সবুজ রেখাটি বাম পাশে বেঁকে নিচের দিকে গেছে তারপর শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছে সবুজ রেখাগুলোর মাথায় শৃঙ্খলিত মানুষের রেখাচিত্র। লাল লেখাটি উপরে উঠে গেছে।লাল রেখাটি শেষ হয়েছে একটা রেখাচিত্রের সামনে। রেখাচিত্রটির মাথায় রাজমুকুট। আহমদ মুসার চোখে-মুখে বিস্ময়।
এই বিস্ময় নিয়েই আহমদ মুসা কাগজ খণ্ডটি আর উপরের ডিজিটাল নাম্বারের উপর আবার নজর দিল।
আহমদ মুসার মনে হলো, এই কাগজের সাথে এই দরজার সম্পর্ক আছে। তা না হলে কাগজটি এখানে থাকবে কেন, তার রংও দরজার মতই হবে কেন?
ডিজিটাল নাম্বারের পাশে বৃত্তকে দরজার ডিজিটাল লক এবং পাশের নাম্বারকে লক খোলার ডিজিটাল কোড হিসেবে ধরে নিল।
কিন্তু নিচের ডায়াগ্রামটা?
এরও অর্থ আছে। কি সেই অর্থ?
মানুষের শৃঙ্খলিত রেখচিত্র কি বিপদ্গ্রস্ত মানুষের মানে বিজ্ঞানীদের বুঝানো হয়েছে? কিন্তু রাজমুকুটওয়ালা রেখাচিত্রটি কার? এ কি ক্যাপিটাল অব পাওয়ার, অন্য কথায় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কি সর্বময় কর্তার? আর লাল-সবুজ রেখার তাৎপর্য কি? সবুজ কি শান্তি, আর লাল কি অশান্তি বা অত্যাচারের প্রতীক? এ প্রতীকটা তো মোটামুটি সকলেরই জানা! এটা এখানে দেখাবার অর্থ কি?
আহমদ মুসা অবশেষে ভাবল ভেতরে না ঢুকলে এ সবের অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আহমদ মুসা আবার ফিরে এল ডিজিটাল নাম্বারের কাছে। বৃত্ত ও ডিজিটাল নাম্বারগুলো সম্পর্কে তার ভাবনাটা ঠিক হলে টাচ লকটি একটা ডিজিটাল লক। কোড নাম্বারগুলো টাইপ করলেই দরজা খুলে যাবে।
কিন্তু লক খুলে যাক এটা চাচ্ছে কে? কে তাকে এটা সরবরাহ করল? কেন?
এর কোন উত্তর আহমদ মুসার জানা নেই।
এটা তার জন্যে একটা ফাঁদ কিংবা দরজা খোলা অসম্ভব করে তোলার একটা কৌশল নয় তো?
এরও কোন উত্তর জানা নেই আহমদ মুসার।
কি করার আছে এখন আহমদ মুসার?
ডিজিটাল নাম্বারটির দিকে আবার তাকাল আহমদ মুসা।
১৮ ডিজিটাল নাম্বারটি কিছুটা মজার। ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সিরিয়ালি লেখা হয়েছে। তারপর এ ডিজিটগুলোকেই উল্টোভাবে সাজানো হয়েছে, নাম্বারগুলো আবার ৯ থেকে ১ পর্যন্ত লেখা। এই ১৮ ডিজিটকে এই সিরিয়ালে ১ শুরুতে বা বটমে রেখে ক্লকওয়াইজ সাজালে ক্লকবৃত্তের বটমে থাকে ডবল ১ এবং শীর্ষে থাকে ডবল ৯, সর্বোচ্চ নাম্বারের জোড়া যার যোগফল আঠার এবং বেজোড় সংখ্যা হিসেবে নিরানব্বই। ১৮ আঠারটি ডিজিটের যে কোনটির চেয়ে বড়। আর ৯৯ আঠার ডিজিটের সম্মিলিত যোগফলের চেয়ে বড়। আহমদ মুসা খুশি হলো, ১৮ ডিজিটের সংখ্যাবাচক কনসেপ্টের সাথে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মনোগ্রামের কনসেপ্টের মিল আছে। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মনোগ্রাম ‘সূর্য’টির টপ-এর কিরণটিই সর্বোচ্চ, অন্যগুলো ছোট-বড়, যেমন ডিজিটাল বৃত্তের ১৬টি ডিজিট।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, লক খোলার ডিজিটাল কোড ঠিক আছে।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল ডিজিটাল লক-এর দিকে। হাত তুলল টাচ লকের দিকে। কিন্তু সংগে সংগেই আবার এক পা পিছিয়ে এল।
দরজা খোলার আগে সব ঠিক আছে কি না দেখতে হবে তাকে।
জুতা, মোজার আড়াল, প্যান্টের পকেট, জ্যাকেটের পকেট, কলারের আড়ালটা সব ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে সাইলেন্সারযুক্ত মাইক্রো মেশিনগান বাম হাতে নিল। ডান হাতের কাছে জ্যাকেটের ডান পকেটে লেজারগান রেখেছে।
আহমদ মুসা আবার এগিয়ে গিয়ে ডিজিটাল লকের সামনে দাঁড়াল।
বিসমিল্লাহ্ বলে আহমদ মুসা শাহাদাত আঙুলি দিয়ে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত ‘টাচ কী’গুলো চাপল। তরপর ৯ থেকে ‘টাচ কী’ চেপে ১-এ ফিরে এল।
৯ম টাচ কীতে চাপ দিয়েই আহমদ মুসা ঠিক দরজার মাঝখানে সরে এল। দরজা যেদিকে যাবে সেদিকেই সরে যাবে সে, যাতে গুলির সামনে প্রথমেই পড়ে না যায়। ওরা যদি ভেতরে বেশি সংখ্যাক লোক থাকে, তাহলে ক্রস ফায়ারের সুবিধা ওরা পেয়ে যেতে পারে। মুখোমুখি না পড়ে মুহূর্তকালের জন্যে হলেও ওদের চোখের আড়ালে গিয়ে পাশ থেকে আক্রমন করতে চায় সে।
দরজা বাম দিকে সরছিল। কিন্তু যতটা চোখের পলকে সরবে মনে করেছিল, ততটা বেগে সরল না। ভারি দরজা স্বাভাবিক গতিতে সরছিল।
এসে সুবিধা হলো আহমদ মুসার।
দরজা সরে আসা শুরু হওয়ার সংগে সংগেই লাফ দিয়ে যেয়ে বামে কোণে শুয়ে রিভলবার তাক করল।
আহমদ মুসা দরজার পেছনেই স্টেনগান তাক করে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা একজনকে দেখতে পেয়েছে, সেও দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা গুলি করেছে, সেও গুলি করেছে। আহমদ মুসা শুয়ে থেকেই গুলি করেছে, আর সেও গুলি করেছে হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থায়। কিন্তু দেখতে পাওয়ার এবং গুলি করা মাত্র কয়েক মিলি সেকেন্ডের ব্যবধান, শুয়ে থাকা অবস্থায় গুলি করার কারণে বেশি সুবিধা পাওয়ায় জিতে গেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার মাইক্রো মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি তাকে বিদ্ধ করল, আর লোকটির সব গুলিই লক্ষচ্যুত হয়েছে সে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাতের আঙুল কেঁপে যাওয়ায়।
আহমদ মুসা গুলি শুরু করার পর আর বন্ধ করেনি। ট্রিগারে আঙুল চেপে রেখে তা বামে সরিয়ে নিচ্ছে দরজা সরে যাওয়ার সমান গতিতে।
ওরাও গুলি ছুঁড়ছে। কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগই দরজাকেই আঘাত করছে এবং কিছু দরজার খোলা পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আহমদ মুসার গুলি দরজার আড়াল থেকে হওয়ায় কিছূটা কৌণিক হলেও তার অব্যাহত গুলি কাজে লাগছে দরজা অব্যাহতভাবে সরে যাওয়ার কারণে। ওরা দরজার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বসে ছিল, সারিবদ্ধভাবেই ওদের লাশ পড়ে গেল।
দরজা খোলা শুরু হওয়া থেকে শেষ পর্যন্ডত সময় বেশি নয়, ওরাও গুলি করছিল, আর ওরাও দু’দেয়ালের মাঝখানে সারিবদ্ধ অবস্থায় বসে ছিল, এই সব কারণে তারা আড়াল নেয়নি, নেয়ার সুযোগও ছীল না। তারা ডানে সরে এসে সরাসরি আহমদ মুসাকে আক্রমণ করবে, তা পারেনি আহমদ মুসার অব্যহত গুলির জন্য। আবার ওরা পালায়নি পেছনে গিয়ে আলাদা অবস্থান নেবার জন্যে, কারণ ওরা পালায় না, আহমদ মুসা এটা দেখেছে।
ওদের আটটা লাশ দেখা যাচ্ছে দরজার পেছনে।
ঐ কোনটায় আহমদ মুসা শোয়া অবস্থায় আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করল। কেউ এল না। নিরব চারদিক।
আহমদ মুসা না উঠে ক্রলিং করে ভেতরে ঢুকল।
ভেতরে ঢুকে সামনে তাকাতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। ডায়াগ্রামে দেখা গেল লাল-সবুজের জীবন্ত দৃশ্য সামনে ভাসছে।
ভেতরে ঢুকেই প্রথমে প্রশস্ত স্ট্যান্ডিং। স্ট্যান্ডিং-এর পরেই মুভিং এলিভেটর। এলিভেটরের লাল-সবুজ দু’টি অংশ। দু’টিই চলছে পাশাপাশি বিপরীত দিকে। লালটা উপরে উঠছে এবং সবুজটা নামছে নিচে।
বিস্মিত আহমদ মুসা! একদম মিলে যাচ্ছে ডায়াগ্রামের সাথে। দরজা খোলার কোড নাম্বার দিয়ে এবং ভেতরের গাইডলাইন দিয়ে কে তাকে সাহায্য করল!। কিন্তু আহমদ মুসা আজ এখানে আসছে কে জানত!
আহমদ মুসা নিশ্চিত, ডায়াগ্রামকে অনুসরণ করেই সে লক্ষে পৌঁছতে পারবে। সবুজ এলিভেটর তাকে নিয়ে এল বন্দী বিজ্ঞানীদের কাছে এবং লাল এলিভেটরে সে যেতে পারবে ‘কিং’-এর কাছে। এই ‘কিং’টা কে? ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের হেড? সেটাই হবে।
কোথায় আহমদ মুসা আগে যাবে? বন্দী বিজ্ঞানীদের কাছে, না ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সাথেই বুঝা-পড়া আগে শেষ করবে।
বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের মুক্ত করে নিরাপদে তাদের নিয়ে যেতে হলে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান ও অন্যদের হাত থেকে এই প্রাসাদকেই আগে মুক্ত করতে হবে। এটাই সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তাকাল লাল এলিভেটরের দিকে।
কিন্তু এদের লোকজন কোথায়?
এরা ৮ জন যে রকম প্রস্তুত অবস্থায় ছিল তাতে বুঝা যাচ্ছে, এরা তার জন্যে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষায় ছিল। তাহলে অন্যেরাও তো এটা জানবে! তারাও সাবধান থাকবে, প্রস্তুত থাকবে। তাহলে তারা কোথায়? এল না কেন এত গুলির শব্দ শোনার পরেও!
আহমদ মুসার মাইক্রো মেশিনগান সাইলেন্সারযুক্ত, কিন্তু ওদের গুলির তো শব্দ হয়েছে।
এ জিজ্ঞাসার জবাব পেল না আহমদ মুসা। বুঝতে পারলো না ঘটনা কি! তাহলে কি ওরা অন্য কোথাও অবস্থান নিয়েছে?
সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে নিয়েছিল আহমদ মুসা।
এবার বিসমিল্লাহ্ বলে লাল এলিভেটরের লাল সিনথেটিক কার্পেটে পা রাখল আহমদ মুসা।
ধীরে ধীরে এলিভেটর উঠতে লাগল উপরে।
আহমদ মুসার বাম হাতে ঝুলছে মাইক্রো মেশিনগান আর তার হাতের মুঠোয় রয়েছে লেজারগান।
আহমদ মুসা দেখতে পাচ্ছে এলিভেটর এক লেয়ার থেকে অন্য লেয়ারে উঠছে।
এক সময় দেখল এলিভেটর করিডোর, চত্বর দিয়ে চলছে। দু’পাশে ঘর, লাউঞ্জের সারি। এ সময় এলিভেটর সমতল অবস্থায় চলছিল। হঠাৎ এলিভেটর ৩০ ডিগ্রি কোণে উপরে উঠতে লাগল। এলিভেটরের দু’পাশেই অনেক উচু দেয়াল।অনেক উচুতে আহমদ মুসা এলিভেটরের মতই প্রশস্ত দরজা দেখতে পেল। দরজাটা অত্যন্ত দর্শনীয়। রাজা-বাদশাদের ঘরের দরজার মতই। আধুনিক যুগের এ্যান্টিকের একটা চমৎকার নিদর্শন। আহমদ মুসা ভাবল, এই দরজার ওপাশেই তাহলে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের রাজা থাকেন। দরজাটা ঠিক এলিভেটরের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। এলিভেটর চলার উপযোগী ফাঁকটুকুই মাত্র রয়েছে দরজার নিচে।
প্রথম বুঝল আহমদ মুসা, দরজা বন্ধ। কিন্তু তার নিচ দিয়ে এলিভেটর চলছে। তার মানে তাকে এখনই প্রচণ্ড ধাক্কা দেবে। এর সাথে সাথেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে নিচের ল্যান্ডিং-এ পড়ে যেতে হবে তাকে।
দরজা এসে গেছে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি ডান হাত বের করে সামনে বাড়িয়ে দিল যাতে ধাক্কা থেকে শরীরটাকে রক্ষা করা যায়।
কিন্তু হাত দরজা স্পর্শ করার আগেই দরজা খুলে গেল।
দরজা পার হবার পর এলিভেটরের পথ আবার সমতল হয়ে গেল।
কিন্তু অল্প দূরেই আরেকটা দরজা, ঘরের দরজা। ঘরটির সামনের দেয়ালটিই শুধু দেখা যাচ্ছে। পাথরের দেয়ালটি অদ্ভুত কারুকাজে সাজানো! দরজাটি মনে হয় সোনার অংশ দিয়েই কারুকাজ করা।
দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছতেই এলিভেটর থেমে গেল আপনা-আপনি।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, স্বর্ণদরজার এ ঘরটাই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের রাজা’র বাসস্থান, যার রেখাচিত্র ডায়াগ্রামে আছে। এলিভেটর থেকে আহমদ মুসা দরজার সামনে ল্যান্ডিং-এ উঠে দাঁড়াল।
এখন কি করবে সে? দরজার ওপারে কি আছে?
আহমদ মুসা শাহাদাত আঙুল দিয়ে দরজার উপর চাপ দিল। খুলে গেল দরজা। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। এসব কি কোন যাদু বলে হচ্ছে?
খুলে গেল সম্পূর্ণ দরজা।
দরজার পরেই রাজকীয় কার্পেটে মোড়া করিডোর।
করিডোরের দু’পাশে দু’টি দরজা।
করিডোরের সামনে সুসজ্জিত লাউঞ্জ।
মিষ্টি সাদা আলোতে হাসছে যেন লাউঞ্জটা।
বাম হাতে মাইক্রো মেশিনগানটি বাগিয়ে ধরে ডান হাতে জ্যাকেটের ডান পকেটে রেখে দু’তিন ধাপ এগোলো।
হঠাৎ লাউঞ্জের ওপাশ থেকে কথা বলে উঠল একটা কণ্ঠ।
সংগে সংগে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
কণ্ঠটি বলছিল, আহমদ মুসা, তুমি শুধু সাংঘাতিক ধূর্তই নও, তুমি ভাগ্যবানও। ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে ঢোকার অসম্ভব কাজও তুমি করেছ। আমাদের কোন এক বিশ্বাসঘাতকের বিশ্বাসঘাতকতায় তুমি ভাগ্যবান হয়েছ। আমাদের প্রধান গেটের দরজা ছিল অজেয়, সেটা খোলার কোড তুমি পেয়ে গেছ। এই প্রসাদের ডায়াগ্রামও নিশ্চয় তোমাকে দেয়া হয়েছে। তুমি ভাগ্যবান যে, আমার ঘুমাবার সময়কে তুমি বেছে নিতে পেরেছ তোমার অভিযানের জন্য। তুমি ভাগ্যবান বলেই আমরা ক্যাপিটাল অব পাওয়ারকে খালি করে সবাইকে পাঠিয়েছি তাহিতিতে ডোর টু ডোর খুঁজে তোমাকে বের করে আনতে। ঠিক এই সময় তুমি ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে অভিযানে এসেছ। কোন এক বিশ্বাসঘাতকের সাহায্যই তোমাকে ভাগ্যবান করেছে। আমাকে যখন ঘুম থেকে জাগানো হয, তখন তুমি হার্ড লেয়ার পর্যন্ত এসে গেছ। তার পর আমি তোমাকে এই স্বর্ণপ্রসাদের গেটে আসতে আর বাধা দেইনি। কারণ এই স্বর্ণপ্রসাদ এখনও উদ্বোধণ পর্যন্ত হয়নি। তোমার রক্ত দিয়েই তার উদ্বোধন হবে। স্বরণীয় হয়ে থাকবে এই উদ্বোধন। থেমে গেল কণ্ঠ।
থেমে গেল লাউড স্পীকার।
পল পল করে বয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত।
কি ঘটতে যাচ্ছে, কি করবে আহমদ মুসা, তা ভাবছিল সে।
হঠাৎ আহমদ মুসার পায়ের তলা থেকে কার্পেট কোন এক অদৃশ্য শক্তির হ্যাঁচকা টানে প্রবল বেগে সরে গেল।
একদম চিৎ হয়ে পড়ে গেল আহমদ মুসা।
টানটা এত আকস্মিক ও প্রবল ছিল যে, আহমদ মুসা তার দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই হারিয়ে ফেলেছিল। বাম হাত থেকে মাইক্রো মেশিনগানটি ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডান হাতটি জ্যাকেটের পকেট থেকে ছিটকে বিরিয়ে এলেও বিস্ময়করভাবে লেজারগানটি হাতের মুঠোতেই ছিল।
আহমদ মুসা পড়ে যাবার মুহূর্তেই করিডোরটির সামনে এসে দাঁড়াল ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান অ্যালেক্সি গ্যারিন। তার দুই হাতে দু’টি রিভলবার। তার দুই চোখে আগুন।
সে এসে দাঁড়িয়ে স্থির হবার আগেই তার দুই রিভলবার থেকে দু’টি গুলি বর্ষিত হলো আহমদ মুসার লক্ষ্যে, ঠিক দেখামাত্র গুলি করার মত। আহমদ মুসাকে দেখার পর আর অপেক্ষা করেনি অ্যালেক্সি গ্যারিন।
আহমদ মুসা চিৎ হয়ে পড়ে যাবার পর প্রাথমিক ধাক্কাই সে সামলাতে পারেনি, আক্রমণে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না তার।
আহমদ মুসা দেখতে পেয়েছে, গুলি ছুঁড়ছে অ্যালেক্সি গ্যারিন।
করণীয় কিছু নেই, একটা বিমূঢ় অবস্থা আহমদ মুসার। মৃত্যুর অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই তার করার নেই।
কিন্তু গুলি তাকে স্পর্শ করল না।
এক নারী মূর্তী দু’টি গুলিই তার বুক পেতে দিয়ে গ্রহণ করেছে। সামান্য টলে উঠে ঢলে পড়ছে নারী মূর্তির দেহটি।
অ্যালেক্সি গ্যারিন মেয়েটিকে গুলি খেতে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্যে। তারপরই আবার তার দু’হাতের রিভলবার উঠে এসেছে আহমদ মুসার লক্ষে।
কিন্তু অ্যালেক্সি গ্যারিনকে আর সুযোগ দিল না আহমদ মুসা। সে আগেই উঠে দাঁড়িয়েছি। হাতের লেজারগানও তার তৈরি ছিল। বাটন টিপে ফায়ার করল অ্যালেক্সি গ্যারিনকে। ভয়ংকর আলোর এক স্রোত আলোর গতিতেই ছুটে গিয়ে আঘাত করল অ্যালেক্সি গ্যারিনকে।
গাছ যেমন ভেঙে পরে, তেমনি ভেঙে পড়ল অ্যালেক্সি গ্যারিনের দেহ।
আহমদ মুসা ইতিমধ্যেই চিনতে পেরেছে গৌরীকে। গৌরীই আহমদ মুসাকে বাঁচাবার জন্যে বুক পেতে দিয়েছে গুলির সামনে।
গৌরী পড়ে গেলে করিডোরের কার্পেটের উপর।
আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে গৌরীর পাশে বসে হাঁটুর উপর মাথা তুলে নিল। বলল, মিস গৌরী, আপনি আমাকে বাঁচাবার জন্যে এভাবে. . .।
যন্ত্রণায় অস্থির গৌরীর চেহারা। সে মুখ ফিরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, জীবনে একটিই ভালো কাজ করলাম। জনাব ঈশ্বরকে বলার মত এই একটা কাজই আমার হয়েছে।
গৌরী একটু থেমেই আবার বলল, আমার সময় বেশি নেই, শুনুন। আবার জ্যাকেটের কলারের একটা পকেটে এক খন্ড কাগজ আছে। কোড নাম্বার ছাড়া ক্যাপসুলগুলো খোলার কোন উপায় নেই। ওগুলো বুলেটপ্রুফ, ফায়ারপ্রুফ ও আনব্রোকেবল। যদি ওগুলো জোর করে ভাঙার চেষ্টা করা হয় তাহলে বিজ্ঞানীরা মারা যাবে। এই কাগজ খণ্ডে বিজ্ঞানীদের ক্যাপসুলগুলো খোলার কোড নাম্বার আছে। তৃতীয় তলায় একটা কনট্রোল সেন্টার আছে। সেই সেন্টারে একটা ডিজিটাল কী বোর্ড দেখবেন। সেই কী বোর্ডে এই কোড টাইপ করলে ক্যাপসুলগুলো খুলে যাবে।
আহমদ মুসা গৌরীর জ্যাকেটের কলারের গোপন পকেট থেকে কাগজটি বের করে নিতে নিতে বলল, এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে, সেটা কথায়? আপনার বুকের দুই পাশে গুলি লেগেছে। আপনি সেরে উঠবেন।
সে চেষ্টা করবেন না। আমি বুঝতে পারছি আমার সময় বেশি নেই। জানেন এই মৃত্যুতে আমি খুব তৃপ্ত আমি। একজন ভালো মানুষের কোলে আমি মরতে পারছি, এটা আমার সৌভাগ্য। এতে আমি খুব খুশিও। কারণ আমাকে যে ধ্বংস করেছে, মৃত্যুর আগে তার ধ্বংস আমি দেখলাম। স্রষ্টার কাছে তার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ আছে, জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে কেন আপনার সাথে দেখা হলো? কেন আরো আগে আপনার দেখা পাইনি? আমি উচ্চাভিলাষী ছিলাম। আমি বড় কিছু করতে চাইতাম। কিন্তু তা মনুষ্যত্ব ও আমার মানবিক অধিকারের বিনিময়ে নয়। কিন্তু তাই হয়েছে।
গৌরীর শেষের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে উঠল। ধুঁকছিল সে। চোখটা তার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আপনি প্লিজ বলুন, এখানে কোথায় চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে?
বলে আহমদ মুসা তাকে পাঁজাকোলা করে ওঠাতে যাচ্ছিল।
চোখ খুলল গৌরী। সে মাথা নেড়ে বলল, না, কোন প্রয়োজন নেই। সত্যিই সময় আমার নেই। বলে থামল সে।
আমাকে আপনার কিছু বলার আছে? আত্মীয়-স্বজন কিংবা অন্য কোন ব্যাপারে? বলল আহমদ মুসা।
গৌরী চোখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আছে। আমার জ্যাকেটের পকেটে দেখুন একটা ছোট্ট ডাইরি আছে। ওতে আমি কথাগুলো লিখে রেখেছি। এই রাতে যখন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে আসেন, তখনই আমি তাড়াহুড়া করে লিখেছি।
আমি সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে আসছি, এটা আপনি দেখেছেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হ্যাঁ। বলল গৌরী।
কিভাবে? আহমদ মুসা বলল।
আপনি রাডার ও ক্যামেরাসজ্জিত রেসিস্ট্যান্ট যে পোষাক পরেছিলেন, তা আমাদের ক্যামেরার জন্যে অচল। তাই আমি আপনাকে দেখতে পেয়েছি এবং চিনতেও পেরেছি।
আর কেউ দেখিনি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
না। ক্যাপিটাল অব পাওয়ার-এর নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার উপর ছিল।
তাই আটজন কমান্ড নিয়ে আমি জেগে বসে ছিলাম। বলল গৌরী। ধীরে ধীরে তার কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
প্রধান দরজা খোলার কোড ও ডায়াগ্রাম আপনিই দিয়েছিলেন? আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ। কারন আমি মুক্ত চেয়েছিলাম এবং ওদের ধ্বংসও চেয়েছিলাম।
আল্লাহ আপনাকে এর যাযাহ দিন! আপনি শুধু কিছু বিজ্ঞানীর নয়, গোটা দুনিয়ার আপনি উপকার করেছেন। আল্লাহর অসীম দয়া আপনি পাবেন! আহমদ মুসা বলল।
আল্লাহ্ মানে স্রষ্টার প্রতি আপনার তো খুব বিশ্বাস, তাই না? বলল গৌরী।
কেন? আপনি স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন না? আহমদ মুসা বলল।
আমার বিশ্বাস দিয়ে কি হবে? আমি তাঁর জন্যে মানে আমার বিশ্বাসের পক্ষে কিছূই করিনি। সুতরাং পরজগতেও আমার কোন ভবিষ্যত নেই। বলল অশ্রুরদ্ধ ক্ষীণ কণ্ঠে।
আছে। আপনি এক স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন? আহমদ মুসা বলল।
করি। দৃঢ়ভাবে করি। কারণ পরমাণু থেকে গ্যালাক্সি পর্যন্ত গোটা সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে একক এক বিধান। স্রষ্টা একজন না হলে এটা হতো না। বলল গৌরী নরম ও ক্ষীণ কণ্ঠে। দু’চোখ থেকে তার গড়িয়ে আসছিল অশ্রু।
আপনি কি পৃথিবীতে স্রষ্টার বাণীবাহক অর্থাৎ নবী-রসূলে বিশ্বাস করেন না?
খুব মৃদভাবে চোখ তুলে তাকাল গৌরী আহমদ মুসার দিকে। বলল, জেসাসকে আমি মানি। কিন্তু তাঁর জন্যে কোন কাজ করিনি।
নবী-রসূলদের ধারাবাহিকতায় শেষ নবী মুহাম্মাদ স. এর কথা আপনি জানেন? আহমদ মুসা বলল।
জানি। বলল গৌরী।
আল্লাহ্র পাঠানো নবী-রসূল স.-দের মধ্যে তিনি শেষ নবী, এটা আপনি মানেন?
চোখ বুজে ছিল গৌরী। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলল। বলল, বিশ্বাসের জন্যে যতটা জানা দরকার ততটা জানি না। তবে আপনার উপর আস্থা আমার সীমাহীন। আপনি তাঁকে শেষ নবী বলছেন, আমি তাঁকে শেষ নবী মানলাম।
মিস গৌরীঁ! পরকালে আমার পরিণতি কি হবে আমি জানি না, কিন্তু একটা কথা বলছি, আপনি আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাস করেন এবং আল্লাহর শেষ নবী মোহাম্মাদুর রসূলল্লাহ্ স.-এর উপর আস্থা পোষণ করেন, সুতরাং সৃষ্ট মানুষের প্রতি আল্লাহর যে প্রতিশ্রুতি, সে অনুসারে আল্লাহ্ আপনাকে মাফ করতে পারেন এবং গ্রহণ করতে পারেন তাঁর জান্নাতের জন্যে। আহমদ মুসা বলল।
যন্ত্রণায় কাতর গৌরীর গোটা দেহ। তবে তার চোখ দু’টি উজ্জল।
অশ্রু ঝরছিল সে চোখ দিয়ে চোখ বুজল, যেন ক্লান্তি ও কষ্ট শামলে নেবার চেষ্টা করছে সে!
চোখ খুলল আবার সে। বলল, স্রষ্টা অনুগ্রহ করলে, তাঁর দয়া হলেই সবই সম্ভব। আপনার মত সকলের ন্যায় আমিও তাঁর দয়র মুখাপেক্ষী হলাম। গৌরীর কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। যেন ঘুমিয়ে পড়ছে সে।
একটু থেমেছিল। আবার অস্পষ্ট ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, বিজ্ঞানীদের নিয়ে যাবার জন্যে সুড়ঙ্গকে নিরাপদ করতে হবে। এজন্যে সেন্ট্রাল কন্ট্রোলের সিস্টেম কন্ট্রোল প্যানেলে ‘অ’ চিহ্নিত সুইচটা অফ করে দিলেই সুড়ঙ্গে যে ফাঁদগুলো আছে তা অকেজো হয়ে যাবে। কাঁপা গলায় আস্তে আস্তে বলল কথাগুলো।
গোটা দেহেই তার নিঃসাড় হয়ে পড়েছে যেন!
তার হাত পায়ের কোন চেতনা দেখা যাচ্ছে না।
চোখ বুজেছে আবার সে।
কাঁপছে গৌরীর ঠোঁট দু’টি। যেন নিজের সাথে নিজেই সে লড়াই করছে! চোখ দু’টি তার খুলে গেল আবার।
ঠোঁট দু’টি তার নড়ে উঠল। অস্ফুট ও কাঁপা গলায় বলল, আহমদ মুসা, ডা-য়েরি-তে আ-মি যা আপ-না-কে ব-লে-ছি তা আপ-নাকে জা-নাবার জন্যে? কো-ন দা-য়িত্বের ভাব আ-মি আপ-নাকে জা-নাবার জন্যে? কো-ন-দা-য়িত্বের ভার আ-মি আ-পনাকে দিচ্ছি না। সে অধি-কা-রও আ-মা-র নে-ই।
কণ্ঠ থেমে গেল গৌরীর। চোখ দু’টিও বুজে গেল তার।
নিথর হয়ে গেল তার শরীর।
যেন প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল গৌরী। কিন্তু ঘুম নয়, মৃত্যুর সিংহদ্বার দিয়ে এ এক মহাযাত্রার শুরু।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে গৌরীর মাথাটা কার্পেটে নামিয়ে রাখল।
গৌরীর প্রাণহীন দেহের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল আহমদ মুসা, আল্লাহ তোমার শাহাদাৎ মঞ্জুর করুন। আল্লাহর এক নগণ্য বান্দাকে বাঁচাতে এবং আল্লাহর হাজারো বান্দার উপকারের জন্যে তুমি জীবন দিয়েছে। আল্লাহর কাছে এই সাক্ষ্য আমি দিচ্ছি।
তাহিতির নৌবহর ঘিরে ফেলেছে তাহনিয়া ও মাতুতুংগা অ্যাটল।
আহমদ মুসা বন্দী বিজ্ঞানীদের সুড়ঙ্গ দিয়ে তাহনিয়া অ্যাটলের পাড়ে নিয়ে এসেছে। এক এক করে সব বিজ্ঞানীকে তুলে নেয়া হলো তাহিতি নৌবাহিনীর জাহাজে।
জাহাজে ওঠার আগে সৌদি আরবের মুক্তিপ্রাপ্ত স্পেস মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল মক্বী আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, আল্লাহ আপনাকে উত্তম যাযাহ দিন ও দীর্ঘ জীবন দান করুন। শুধু আমাকে নয়, পৃথিবীর প্রায় পৌঁনে একশ’ শীর্ষ বিজ্ঞানীকে আল্লাহর সাহায্যে নতুন জীবন দিয়েছেন। অনেক সালাম আপনাকে।
এই সময় হেলিকপ্টার ল্যান্ড করল।
হেলিকপ্টার থেকে নেমে এল স্বরাষ্ট্র ও পুলিশ প্রধান দ্যাগল ও তাহিতির গভর্নর ফ্রাঁসোয়া বুরবন।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল তাদে রদিকে। তারাও এগিয়ে এল। দ্যাগল আহমদ মুসাকে কংগ্রাচুলেশন জানিয়ে জড়িয়ে ধরল এবং বলল, জানেন গোটা দুনিয়ার এটাই আজ হট নিউজ! আপনার নাম ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দুনিয়ায়।
দ্যাগল আহমদ মুসাকে পরিচয় করিয়ে দিল গভর্নরের সাথে। গভর্নর আহমদ মুসাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, তোমার জন্যে আমরা গর্বিত। গোটা দুনিয়ায় তাহিতি অসাধ্য সাধন করেছে। এর সব কৃতিত্ব তোমার।
গভর্নরকে ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসা একটু আলগা হতেই দ্যাগল বলল, পেছনে তাকিয়ে দেখ আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা পেছনে তাকাল। দেখল, মাহিত ও মারেভা। ওরা হেলিকপ্টারে দ্যাগলের সাথেই এসেছে।
আহমদ মুসা ওদের দিকে এগোলো।
মাহিন এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, স্যার, আমাদের দারুণ গর্ব হচ্ছে।
মারেভা এসে পাশে দাঁড়াল। বলল, স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, দেখো কেউ আমার এই খোজ নেয়নি, আমার বোন নিয়েছে। বোনদের, মা’দের ধর্ম এটাই!
একটু থামল আহমদ মুসা। আবার বলল মারেভাদের দিকে চেয়ে, হ্যাঁ, ভাল আছি বোন!
ভাইয়া, আমি ও মাহিন চাকুরি পেয়েছি। বলল মারেভা।
কি চাকুরি? আহমদ মুসা বলল।
গোয়েন্দা বিভাগে। প্রথমে আমাদের ট্রেনিং চলবে। তার সাথে পড়ার সুযোগটাও থাকবে। বলল মারেভা।
অভিনন্দন তোমাদের! ভাল চাকুরি। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে পারবে। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা এগোলো গভর্নরের দিকে।
এ সময় মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
কল ধরতেই আহমদ মুসা ওপার থেকে কণ্ঠ পেল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আব্দুল ওয়াহাব আল-নজদীর।
আহমদ মুসা তাকে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়েই সে বলল, অভিনন্দন আহমদ মুসা, শুধু আমাদের বিজ্ঞানী নয়, প্রায় পৌনে একশ’ বিজ্ঞানীকে তুমি মুক্ত করেছ। গোটা দুনিয়া তোমাদের অভিনন্দিত করছে। আমি মহামান্য বাদশাহকে জানিয়েছি। তিনি আপনাকে সালাম দিয়েছেন।
ধন্যবাদ স্যার। আল্লাহর সাহায্যেই সব হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
আবারও ধন্যবাদ তোমাকে। আমরা এখানে সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। ম্যাডামরা সবাই ভাল আছেন। বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আহমদ মুসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সালামের জবাব দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল।
এগিয়ে গেল আহমদ মুসা গভর্নরের দিকে।
তাহানিয়া এ্যাটল থেকে তাহিতি নৌবাহিনীর একটা জাহাজ প্যাসেফিকের বুক চিরে ধীর গতিতে দুলে দুলে চলছে তাহিতির দিকে। জাহাজের একটা কেবিনে শুয়ে আছে আহমদ মুসা। তার হাতে গৌরীর দেয়া সেই ডায়েরিটা। ডায়েরি পড়ার জন্য সে খুলল।
তখনই তার মোবাইলে কল বেজে উঠল। ধরল টেলিফোন আহমদ মুসা।
ওপার থেকে কণ্ঠ তাহিতির গভর্নরের, গুড মর্নিং মি. আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা গুড মর্নিং জানাল।
মি. আহমদ মুসা। একটা খবর আপনাকে না জানিয়ে পারলাম না।
প্যারিস থেকে এই মাত্র প্রধানমন্ত্রী জানালেন, মতুতুংগা অ্যাটলের প্রসাদটিকে ফরাসি সরকার পর্যটকদের জন্যে খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর বার্ষিক আয়ের এক-চতুর্থাংশ শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। অর্ধেকটা পাবে তাহিতি ও পলিনেশীয়া দ্বীপপুঞ্জ। অবশিষ্ট এক-চতুর্থাংশ খরচ করা হবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব ধর্মের শিশুদের ধর্ম শিক্ষার উন্নয়নে। আপনার কাছে এই পরামর্শ ফরাসি সরকার রেখেছেন। আর প্রসাদটির ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার” নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘আহমদ প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’। আর ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের গোপন ঘাটিগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে এবং ওদের মিনি সাবমেরিন, টিউব সাবমেরিন সমৃদ্ধ ওদের যে নৌবহর আছে পানির তলায়, তা খুঁজে বের করা ও পাকড়াও করার কাজ শুরু হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন সরকার আমাদের সাহায্য করছে। বলল গভর্নর।
অন্য সব সিদ্ধান্তের জন্য ফরাসি সরকারকে ধন্যবাদ। কিন্তু স্যার, আমার নাম জড়ানো হলো কেমন প্যালেসের নামের সাথে? আহমদ মুসা বলল।
এ সিদ্ধান্ত ফরাসি ক্যাবিনেটের, আমি কি করে বলব মি. আহমদ মুসা। ভাবল সে, নামটা আমার নয়। ‘আহমদ’ আল্লাহর রসূলের নাম বলেই তো এটা আমার নামেরও একটা অংশ। থাক না অ্যাটল প্রসাদের মত দুনিয়ার এক বিস্ময়ের সাথে আমার রসূল মানে মানুষের রসূলের নাম জড়িয়ে! অ্যাটল দ্বীপের নিচের এই বিস্ময়কর প্রসাদটি তো দুনিয়ার মানুষ ও পর্যটকদের কাছে এক নজর দেখার এক অপার আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠবে।
আহমদ মুসা কিছূ বলার আগে গভর্নর নিজেই আবার বলে উঠল, ঠিক আছে মি. আহমদ মুসা, আপনি তো এখন শীপে। আসুন, আমরা আপনার অপেক্ষা করছি। দেশ-বিদেশের বহু সাংবাদিক এসে পৌঁছেছে। আর মনে আছে তো, আজ রাতে আমার বাড়িতে ডিনার।
মনে আছে স্যার। আর ঠিক সময়েই আমি সংবাদিক সম্মেলনে পৌঁছব স্যার। কিন্তু স্যার, আমি শুধু উপস্থিত থাকবো, আমার পরিচয় দিতে পারবেন না। আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ, একথা আমাকে মি. দ্যাগল জানিয়েছেন কিন্তু পরিচিত হতে, কয়েকটা কথা বলতে দোষ কি মি. আহমদ মুসা? বলল গভর্নর।
স্যার, আমি কোন রাজনীতিক নই, কোন প্রফেশনাল পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কেউ নই। কোন পরিচয় ছাড়াই মানুষের জন্যে কাজ করছি, কাজ করবো। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আপনি সত্যই সকলের জন্যে দৃষ্টান্ত হওয়ার মত একজন। ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন! রাখছি তাহলে টেলিফোন। বলল গভর্নর।
আপনার টেলিফোনের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, আমি আসছি স্যার। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা মোবাইল রেখে গৌরীর ডাইরিতে হাত দিতে যাচ্ছিল।
আবার মোবাইলে কল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল তুলে নিয়ে কল অন করল আহমদ মুসা।
আচ্ছালামু আলাইকুম। ওপার থেকে জোসেফাইনের কণ্ঠ।
ওয়া আলাইকুম সালাম, জোসেফাইন কেমন আছ? তোমাকে কয়েকবার টেলিফোন করে পাইনি। বলল আহমদ মুসা।
তোমার প্রশ্নের জবাব দেবার আগে তোমাকে কংগ্রাচুলেশন দিয়ে নেই। কংগ্রাচু. . .।
জোসেফাইনের কথার মধ্যেই আহমদ মুসা বলে উঠল, না, ম্যাডাম জোসেফাইন, তোমার কংগ্রাচুলেশন নয়, কনসুলেশন চাই তোমার কাছে। তোমাকে ছেড়ে অনেক দিন আমি বাইরে, অনেক কষ্টে আছি।
আমি সব জানি। আমার ননদ সব আমাকে জানিয়েছে। তুমি যে লড়াইয়ে আছো, তাতে আমাকে স্মরণ করার, আমার জন্যে কষ্ট পাবার মত সময় কোথায় তোমার? তুমি গুলিতে আহমত হয়েছে একাধিকবার। সেটাও তো আমাকে জানাওনি! তার পরেও তোমাকে অভিনন্দন! থামল জোসেফাইন।
বেদনায় ভারি কণ্ঠ জোসেফাইনের। শেষ কয়েকটা শব্দ তার গলায় বেঁধে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, জোসেফাইন, তুমি না আমার জোসেফাইন! তুমিতো অনেক শক্ত। তুমি ভেঙে পড়লে আমিও তো ভেঙে পড়ব জোসেফাইন!
স্যরি! মাফ কর আমাকে। কিন্তু তুমি তোমার সব খবর আমাকে জানাবে না কেন? না জানানোর জন্যই এই কষ্ট আমার লেগেছে। বলল জোসেফাইন।
স্যরি, জানানো উচিত ছিল। কিন্তু ঘটনাগুলো একের পর এক এমনভাবে ঘটেছে, যাতে সুস্থির সময় খুব কম পাওয়া গেছে। আর ভয় হয়েছে তুমি ভয়ানক উদ্বেগের মধ্যে পড়বে। ভেবেছি, সমস্যাগুলো ক্লিয়ার হলেই তোমাকে জানাবো। মারেভা তোমাকে টেলিফোনে এসব জানিয়েছে? বলল আহমদ মুসা।
তাহিতিতে যখণ আজ ভোর, তখন সে টেলিফোন করে বিজয়ের কথা জানিয়েছে। সে এর আগেও আরও দু’দিন টেলিফোন করেছে। ও হ্যাঁ, আরও একদিন সে আমাকে টেলিফোন করেছে। ওদের বিয়ের ঠিক পর মুহূর্তেই সে ওদের বিয়ের খবর আমাকে জানিয়েছে। আমি ওকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলাম, তোমার ভাইয়াকে ছাড়া বিয়ে করছ! জবাবে সে বলেছিল, ভাইয়া ডেট ঠিক করে দিয়ে বলেছিলেন, যাই ঘটুক, কেউ না আসুক ঐদিন যেন বিয়ে হয়ে যায়! ঐ দিনের পর তোমরা বিয়ে না হওয়া অবস্থায় আমার কাছে আসতে পারবে না। অতএব, উপায় কি বিয়ে করতেই হলো। খুব ভাল মেয়ে মারেভা। বলল জোসেফাইন।
হ্যাঁ, ওরা দু’জন আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আরেকজনের কথা বলতে হচ্ছে জোসেফাইন সে হলো গৌরী-ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সর্বময় কর্তা আলেক্সি গ্যারিনের পার্সোনাল সেক্রেটারি, তার বডিগার্ড ও গ্যারিনের নিজস্ব বাহিনীর কমান্ডার। আলেক্সি গ্যারিনের যে দু’টি গুলি আমার বুকে বিদ্ধ হবার কথা ছিল, ছুটে এসে সে এই দু’টি গুলি নিজেই বুক পেতে নেয়। এই সুযোগেই আমি লেজার গানের ফায়ার করে আলেক্সি গ্যারিনকে হত্যা করি। গৌরী মারা গেছে জোসেফাইন।আহমদ মুসার অবিচল কণ্ঠও যেন শেষ বাক্যে কেঁপে উঠেছিল!
ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। বলল জোসেফাইন।
ইন্নালিল্লাহ পড়লে যে জোসেফাইন? আহমদ মুসা বলল।
তোমার জন্যে যে জীবন দিতে পারে, তোমাকে যে এতটা চেনে, সে তোমার ধর্মকেও ভালো না বসে পারে না। বলল জোসেফাইন।
হ্যাঁ জোসেফাইন, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে সে এক আল্লাহ ও শেষ নবীর উপর তার বিশ্বাসের ঘোষণা দিয়েছে। আহমদ মুসা বলল।
আল্লাহ্ গৌরীকে কবুল করুন! কিন্তু এত বড় অবস্থানে থেকে কেন সে তোমাকে সাহায্য করল? জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
আহমদ মুসার সাথে অ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে গৌরীর প্রথম দেখা ও কথাবার্তা হয়। গৌরীরা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করার পর সে ওদের গাড়ি দখল করা, ওদের বন্দী করা, মেটাল জ্যামিং মেশিন রেখে গিয়ে আহমদ মুসাকে নিরবে সাহায্য করা, মতুংগা অ্যাটলের তলদেশে ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ প্রসাদে প্রবেশে গৌরীর সাহায্য এবং সর্বেশেষ ঘটনা ও তার কথাবার্তা সব জোসেফাইনকে জানাল।
সত্যিই দুর্ভাগ্য আমাদের গৌরীর। সে বঞ্চনা ও নারীত্বের চরম অপমানের শিকার। এ সব কিছু কিন্তু তার হৃদয়ের মহৎ বৃত্তিকে হত্যা করতে পারেনি। তাই সে তোমাকে অবলম্বন করে নতুন করে জেগে উঠতে চেয়েছে। সে সৌভাগ্যবানও বটে! সে জীবন দিয়ে যা করেছে, তা করার সৌভাঘ্য কচিৎ কারও ভাগ্যে জোটে। আল্লাহ তাকে কবুল করুন এবং উত্তম যাযাহ দান করুন! তার কবর কোথায় হয়েছে? বলল জোসেফাইন।
আমি অনুরোধ করেছি, তাহিতেই তার কবর হবে। আহমদ মুসা বলল।
তুমি তার জানাজা পড়বে। বলল জোসেফাইন।
অবশ্যই পড়বো জোসেফাইন। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ! বলে একটু থামল জোসেফাইন। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, তোমাকে একটা খবর দিতে চাই।
কি খবর? আহমদ মুসা বলল।
আমি ও আহমদ আব্দুল্লাহ আমেরিকা যাচ্ছি।
আমেরিকা যাচ্ছ? আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়!
বিস্মিত হচ্ছ কেন? অনুমতি তো অনেক আগেই দিয়েছ। বলল জোসেফাইন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, অবশ্যই যাবে। কেন যাচ্ছ এটাই বুঝছি না, বেড়াতে গেলে তো আমাকে সাথে নিতে চাইতে! আহমদ মুসা বলল।
তোমার এত ভক্ত সেখানে যে, নিরবে বেড়ানো যেত না। যেখানে যেতাম, সেখানে জনসভা হয়ে যেত। বলল জোসেফাইন।
কবে যাচ্ছ? কোথায় উঠবে? আহমদ মুসা বলল।
আমার হোস্ট হচ্ছেন খালাম্মা, সারা জেফারসনের মা। আমেরিকা যাব শুনেই বললেন, আমার বাড়িতেই উঠতে হবে, গেষ্ট হিসেবে নয়, মেয়ে হিসেবে। আমি তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারিনি। বলল জোসেফাইন।
ধন্যবাদ জোসেফাইন, তোমার আমেরিকা সফর সুন্দর হবে, সফল হবে। খালাম্মা অত্যন্ত স্নেহময়ী এক মা। সারা জেফারসনের সাথে কি তার আগে কথা বলেছ? আহমদ মুসা বলল। সারা নিউমেক্সিকোতে, চাকুরিতে। মাস খানেকের ছুটিতে দু’একদিনের মধ্যেই সে বাড়িতে আসবে। তাকে আমি কিছু বলিনি। খালাম্মাকেও বলতে নিষেধ করেছি। আমি তাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। বলল জোসেফাইন।
কবে যাচ্ছো? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসা।
তোমার এই মিশনের সমাপ্তির অপেক্ষায় ছিলাম। আজ টিকেট করে ফেলব।
সৌদি আরবের সরকারি কর্তৃপক্ষ কি জানে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আমি মার্কিন দূতাবাসকে জানাবার পর রাষ্ট্রদূত ও সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালের ডিজি সাহেব এসেছিলেন। তারা সব জানিয়ে গেছেন, ওয়াশিংটন বিমান রিসিভ করবেন এবং সরকারী নিরাপত্তায় আমাকে সারা জেফারসনের বাসায় পৌঁছে দেবে। নিরাপত্তা নিয়ে আমাকে কিছু ভাবতে হবে না। আমি যেখানে থাকব এবং যেখানেই যাব, আমাদের জন্যে সরকারী নিরাপত্তা থাকবে। বলল জোসেফাইন।
আলহামদুলিল্লাহ! বিদেশ-বিভূয়ে যাবে, কোথায় কি করবে, এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা ছিল। সেটা কাটল। দোয়া করি তোমার সফর আনন্দদায়ক হোক! আহমদ মুসা বলল।
শুধু আনন্দদায়ক নয়, সফল হোক, এই দোয়া কর। বলল জোসেফাইন।
কিন্তু কি চাও তুমি এই সফরে? কিসের সাফল্য চাইবে? আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইন হাসল। বলল, ‘আনন্দদায়ক’ শব্দের পরিপূরক হলো সাফল্য। মানুষ বলে না যে, তোমার সফল সফল ও আনন্দদায়ক হোক? বলল জোসেফাইন।
ঠিক আছে আমিও তাই চাইছি। তোমার সফল সফল ও আনন্দদায়ক হোক? বলল আহমদ মুসা।
আমিন! বলল জোসেফাইন।
কিন্তু আমার কষ্টটা বাড়ল জোসেফাইন। বলল আহমদ মুসা।
কি কষ্ট? গম্ভীর কণ্ঠ জোসেফাইনের।
তোমাকে দেখা পাওয়ার সময়টা আরও দীর্ঘ হলো।
জোসেফাইন হাসল। বলল, এসব ডান-বামের কথা রেখে বল তোমার পরবর্তী ডেস্টিনেশন কি? গৌরীর ডাইরিতে কি আছে? আমি ওতে ‘বিপদ’ মানে ‘রহস্যের গন্ধ’ পাচ্ছি।
আমি ওটা পড়িনি। পড়ব আহমদ মুসা বলল।
পড়ার পর কিন্তু আমাকে জানাবে। বলল জোসেফাইন।
অবশ্যই। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আবার বলল, আহমদ আব্দুল্লাহ কোথায়? এতক্ষণ যে তুমি নিরাপদে কথা বলল।
ও ঘুমিয়ে আছে। বলল জোসেফাইন।
বিদেশে যাবে, দেখ ওকে, চোখে চোখে রেখ। আহমদ মুসা বলল।
সারা ওকে পেলে আমি কতক্ষণ তাকে দেখতে পাব, সেটা বলা মুস্কিল। বলল জোসেফাইন।
তবু সব দায়িত্ব তো তোমারই। আহমদ মুসা বলল।
দোয়া করো। আর কোন কথা? বলল জোসেফাইন।
আরো একটা কথা আছে তবে. . .। আহমদ মুসা বলল।
বুঝেছি, আমি রাখলাম। আহমদ আব্দুল্লাহ উঠলে আবার টেলিফোন করব। আচ্ছালামু আলায়কুম। বলল জোসেফাইন।
অনেকক্ষণ রইলাম। ওয়া আলাইকুম সালাম। আহমদ মুসা বলল।
মোবাইলটা রেখেও আহমদ মুসা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তার চোখে শূণ্য দৃষ্টি। চোখে ভাসছে জোসেফাইনের হাসি মাখা সুন্দর মুখটা। সত্যই হৃদয়ে সে অনুভব করছে জোসেফাইনের দূরত্ব।
অনেকক্ষণ পর বালিশটা টেনে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। পাশ থেকে টেনে নিল গৌরীর ডাইরিটা।
কথাগুলো বলছিল ইজিচেয়ারে শোয়া শুভ্র কেশ, শুভ্র ভ্রূর একজন বৃদ্ধ। মুখের চামড়াও তার অনেক কুঁচকানো। উজ্জ্বল সোনালী চেহারায় তার চোখ দু’টি খুবই সজীব ও তীক্ষ্ণ।
বৃদ্ধের নাম অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি।
তাহিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসেনিক ল্যান্ড-সাইন্সের সাবেক অধ্যাপক। গোটা প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় এই বিষয়ে সে অদ্বিতীয় বিশেষজ্ঞ। দুনিয়াজোড়া নাম তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার সাথে সাথে সে প্যাসিফিক আইল্যান্ড ইন্সটিটিউটের প্রধাণও ছিল।
অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি মারেভার বাবার শিক্ষক ছিল। আবার তার পারিবারিক বাড়ি “আরু”তে। এই কারণে মারেভাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক আছে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির পরিবারের সাথে।
মারেভাই আহমদ মুসাকে নিয়ে এসেছে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির কাছে। অ্যাটল দ্বীপগুলোর কম্পোজিশন সম্পর্কে আহমদ মুসা জানতে চায়। আর জনতে চায় অ্যাটলগুলোতে কোন গোপন স্থাপনা কিভাবে গড়ে উঠতে পারে।
আহমদ মুসা তার মাল্টিওয়েভ মনিটরে পাওয়া এসএমএস মতুতুংগা দ্বীপ থেকেই এসেছে এটা নিশ্চিত হবার পর ভেবে কুল-কিনারা পাচ্চে না। ছোট এই দ্বীপের কোথা থেকে তার কাছে এসওএস বার্তা এল!চারদিকে ঘুরে সে মতুতুংগা দ্বীপটাকে দেখেছে। তাছাড়া কম্পিউটারে দ্বীপটির স্যাটেলাইট ইমেজ সে পরিক্ষা করেছে। এতে উপরের সারফেস ছাড়াও দ্বীপটির পানির তলের বেজটাকেও সে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। এই অবস্থায় মারেভা তাঁকে নিয়ে এসেছে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির কাছে।
অধ্যাপক তাতিহিতি “আরু”তে তার পৈত্রিক বাড়িতে অবসর জীবনযাপন করছে। সারা জীবন ধরে সমৃদ্ধ করে তোলা পৈত্রিক পাঠাগারে পড়াশুনা, বাড়ির চারদিকের বাগানের টুকিটাকি পরিচর্যা ও বাগানে ঘুরে বেড়িয়েই তার সময় কেটে যায়। আজ খুশি হয়েছে সে আহমদ মুসাদের পেয়ে।
অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতির কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, কিন্তু স্যার, আমি নিশ্চিত একটি অ্যাটলে গোপন স্থাপনা আছে এবং সেখানে মানুষও আছে। যদি এটা সত্য হয়, তাহলে গোপন স্থাপনা কিভাবে গড়ে উঠল?
তুমি ‘যদি’ শব্দ ব্যবহার করেছ। কিন্তু এই ‘যদি’টাকে সত্য বলে নিশ্চিত হচ্ছো কেমন করে, ইয়ংম্যান? বলল অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি।
স্যার, আমি ঐ দ্বীপের এক স্থান থেকে একটি এসওএস বার্তা পেয়েছি। আহমদ মুসা বলল।
তুমি কি করে নিশ্চিত হচ্ছো, এসওএস বার্তাটা ঐ অ্যাটল থেকেই এসেছে? বলল অধ্যাপক তাতিহিতি।
আহমদ মুসা তার অংকের বিবরণ দিয়ে বলল, আমার হিসাবে কোন ভুল হয়নি স্যার।
অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি মাথা নেড়ে বলল, ইয়াংম্যান, অংক তোমার ঠিক আছে।কিন্তু অ্যাটলে গোপন স্থাপনা কোত্থেকে আসবে, সে অংক তো মিলছে না!
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, স্যার, অ্যাটলের কোরাল স্টোন বেজ যা সাগরের ফ্লোর থেকে উঠে এসেছে, তা কি সব সময় সলিড হতে বাধ্য? দেয়ালঘেরা ঘরের মত ফাঁপা হয়ে উঠতে পারে না তা? এভাবে তা কি লেগুনের ফ্লোরের নিচে কোন স্থাপনা গড়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে না?
আহমদ মুসার প্রশ্ন শুনে অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।সংগে সংগে উত্তর দিল না। তার চোখ বুজে গিয়েছিল। ভাবছিল সে।
এক সময় চোখ খুলল অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি। সোজা হয়ে বসল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ইয়ংম্যান, তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি বুঝেছি। স্রষ্টার সৃষ্টি বড় বিচিত্র।এর কতটুকু আমরা জানি। এখানে সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখাও টানা যায় না। অতএব, তুমি য বলছ থাকতে পারে, আবার নাও পারে। বিজ্ঞানের কথা যদি বল তাহলে বলব কোরাল স্তরের বৈচিত্রময় গঠনের ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক মাপ-জোক থেকে পাওয়া যাবে না। এগুলো মহান স্রষ্টার ইচ্ছার সৃষ্টি।তুমি অ্যাটলের বেজে কোরাল স্টোন ওয়ালকে যেমন ফাঁপা হওয়ার কথা বলছ, তা স্রষ্টার ইচ্ছার আওতার বাইরে নয়।
বলে থামল অধ্যাপক তাতিহাতি। হঠাৎ তার মুখে ভাবনার একটা ছাপ ফুটে উঠল। তার সাথে সাথে তার ঠোঁটে দেখা গেল এক টুকরো হাসিও। তাকাল সে মারেভা মাইমিতির দিকে। বলল, মারেভা, তোমার নিশ্চয় মনে আছে জগতেশ্বরী ও প্রথম মানবী হিনা, প্রিন্স হেসানা হোসানা ও সাগর-রূপা জলকন্যা ভাইমিতি শাবানুর কাহিনী। এই কাহিনীতেই আছে প্রিন্স হেসানা হোসানার প্রতি সদয় জগতেশ্বরী হিনা পাগল প্রেমিক প্রিন্সকে তার প্রেমিকা ভাইমিতি শাবানুর সাথে দেখা করিয়েছিল পানির তলে অ্যাটলের এক প্রাসাদে। অ্যাটলের পানির তলে মানে অ্যাটলের বেজ এলাকায় যে প্রাসাদ থাকতে পারে, তাহিতি এলাকার এই কাহিনীতে তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়।
অধ্যাপক তাতিহিতি থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, কাহিনীটা কি স্যার?
রূপকথা যেমন হয়, এ তেমনি এক কাহিনী। এটা পমারে রাজবংশের এক রাজপুত্রের কাহিনী।
বলে একটু থামে অধ্যাপক তাতিহিতি তাকাল মারেভা মাইমিতির দিকে। বলল, মারেভা, তুমি জানলে কাহিনীটা, বল।
মারেভার মুখ লাল হয়ে উঠল। এক ছোপ লজ্জা এসে ঢেকে দিল তার চোখ-মুখ। সে মুখ নিচু করল।
হাসল অধ্যাপক তাতিহিতি। বলল, ঠিক আছে, আমিই বলছি।বলে শুরু করল অধ্যাপক তাতিহিতিঃ অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপিয়দের আগমন শুরু হয় প্রশান্ত মহশাগরীয় অঞ্চলে। কিন্তু তার আগে কয়েক শতাব্দী ধরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে অনেক রাজবংশের উত্থান ঘটে। তাহিতিতেও এমন একটি রাজবংশ কয়েক শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছে। তাহিতির পমাতে রাজবংশ এদেরই উত্তরসূরি। ঐ রাজবংশের নামও এখন জানা নেই।সেই অজানা বংশের এক রাজপুত্র ছিল হেসানা হোসানা, যার অর্থ সুন্দর ও শক্তির রাজমুকুট। এই সুন্দর রাজপুত্রের শখ ছিল সাগরে ঘুরে বেড়ানো। মাঝে মাঝেই তার নিরুদ্দেশ যাত্রা হতো সাগরে। দিন, রাত, সপ্তাহ গড়িয়ে যেত সে বাড়িতে ফিরতো না। এ দ্বীপ থেকে সে দ্বীপে, এ অ্যাটল থেকে সে অ্যাটলে ঘুরে বেড়াত। তার পালতোলা সাগরজ্বয়ী সুদৃশ্য রাজকীয় বোটে একাই ঘুরে বেড়াত সে। একদিন এক জ্যোৎস্না-গলানো সুন্দর রাতে তার বোট নোঙর করা ছিল এক অ্যাটলের তীরে। বোটের ডেগে বসে সে তন্ময় হয়ে উপভোগ করছিল জ্যোৎস্নাপ্লাবিত সাগরের নিরব-নিঝুম সৌন্দর্য। এই সময় পুব সাগরের বুক থেকে উঠে আসে এক খন্ড কালচে রক্তিম মেঘ। শুরু হয় প্রবল ঘুর্ণি। সে ঘুর্ণিতে তলিয়ে যায় তার বোট। সেও ছিটকে পড়ে যেন কোথাও! নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে। নিজেকে আবার ফিরে পেয়ে যখন সে চোখ খুলে, তখন সে দেখে সুসজ্জিত ঘরের অসম্ভব সুন্দর এক নরম বিছানায়। চোখ ঘুরাতে গিয়ে তার চোখ পড়ে পাশেই সুন্দর আসনে বসা নীল বসনা, নীল নয়না এক অপরূপ সুন্দরীর উপর। তার সাগর-নীল রাজকীয় পোষাকের উপর তার সাগর নীল দোপাট্রা মাথা থেকে কপাল পর্জন্ত নেমে এসেছে। চাঁদের মতো মুখটিই শুধু তার খোলা। চাঁদে কলংক আছে, কিন্তু তার দুধ-আলতা মুখে কোন কলংক নেই। রাজপুত্রের চোখ যেন বাঁধা পড়ে গেল তার মুখে! চোখ সরাতে পারল না রাজপূত্র। পল পল করে সময় বয়ে গেল। দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তবু পলক পড়ে না চোখে। নিল-নয়না সুন্দরী তার চোখ সরিয়ে নিল ঠোঁটে এক টুকরো হাসি টেনে। বলল শাহজাদা আপনি এখন সুস্থ। আপনার বোটও ঠিক হয়ে গেছে। সেটাও তৈরি। আপনি ইচ্ছা করলে এখনই উঠতে পারেন।
রাজপুত্র তখনও তার চোখ সরাতে পারেনি। সুন্দরীর কথাগুলো তার কানে যেন অমৃত ঢেলে দিল! তাহিতি ভাষায় এমন শুদ্ধ, মিষ্টি উচ্চারণ আগে সে শোনেনি।
সুন্দরীর চোখ ঘুরে এল আবার রাজপুত্র হেসানা হোসানার মুখের উপর। আবার আটকা পড়ে গেল দুই জোড়া চোখ।
সুন্দরীর চোখে-মুখে ফুটে উঠল সলাজ হাসি। সে মুখ নিচু করল। বলল, তাহলে শাহজাদা, আরও একটু বিশ্রাম করুন।
উঠতে যাচ্ছিল সুন্দরী।রাজপুত্র হেসানা হোসানা বলল, আমি কোথায় রাজকন্যা?
সুন্দরী মিষ্টি হাসল। বলল, আমি রাজকন্যা নই। আমি বলতে পারেন, সাগরকন্যা। আপনি অ্যাটল রাজ্যের এক প্রাসাদে, মানে অ্যাটলের এক নিবাসে।
যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল সুন্দরী। রাজপুত্র হেসানা হোসানা বিছানায় উঠে বসল। বলল, আপনার নাম কি?
সুন্দরী তার নিচু মুখ না তুলেই বলল, আমি ভাইমিতি শাবানু। বলেই সুন্দরী ভাইমিতি শাবানু পা তুলল যাবার জন্যে।
রাজপুত্র নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে মরিয়া হয়েই বলল, আমি যদি না যেতে চাই? আমি যাব না।
পেছনে না তাকিয়েই ভাইমিতি শাবানু সেই মিষ্টি হেসে বলল, অতিথিশালা তো কারো বাড়ি হয় না! এখানে অতিথিরা আসেন চলে যাবার জন্যেই। আপনিও যাবেন।
বলে চলে গিয়েছিল ভাইমিতি শাবানু।
চলেই আসতে হয় রাজপুত্র হেসানা হোসানাকে। দ্বিতীয়বার এসে ভাইমিতি শাবানু যখন রাজপুত্রের চোখে চোখ রেখে বলল, আসুন শাহজাদা। তখন কি এক অমোঘ টানেই রাজপুত্র উঠে দাঁড়াল, যেন এমন মিষ্টি ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য তার নেই।
রাজপুত্র হেসানা হোসানা যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালে ভাইমিতি শাবানু বলল, শাহজাদা, এবার আপনি দুই চোখ বন্ধ করবেন। আমি আপানকে হাত ধরে নিয়ে যাব।
রেশমের নরম গলার এই মিষ্টি আদেশও রাজপুত্র সংগে সংগেই পালন করল।চোখ বন্ধ করল সে।
ধন্যবাদ! বলে ভাইমিতি শাবানু তার হাত ধরে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলল।
ভাইমিতি শাভানুর স্পর্শে রাজপুত্র হেসানা হোসানার দেহের প্রতিটি পরমাণু যেন জেগে উঠল, শিহরিত হলো! কারও স্পর্শ যে এত মিষ্টি, এত মধুর হতে পারে, তা রাজপুত্রের কল্পনারও বাইরে ছিল।
রাজপুত্র হেসানা হোসানাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কিভাবে নিয়ে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে রাজপুত্রের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। অন্য কিছু ভেবেই স্পর্শের অনুভূতি সে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছিল না। তবে সে ক্রমশ উপরে উঠছিল সেটা তার পা-ই বলে দিচ্ছিল।
উপরে উঠা এক সময় শেষ হলো। তারপর আরো একটু পথ চলা।
আবার থমকে দাঁড়ানো।
ভাইমিতি শাবানুর নরম মিষ্টি গলা শুনতে পেল রাজপুত্র। বলল, একটু দাঁড়াতে হবে শাহজাদা। বিশ, ত্রিশ সেকেন্ড পরে একটা শব্দ হবে, তারপর আপনি চোখ খুলবেন।
বলে ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্র হেসানা হোসানার হাত ছেড়ে দিল। মেয়েটি হাত ছেড়ে দেবার সাথে সাথে রাজপুত্রের মনে হলো তার দেহ জুড়ে জ্বলে থাকা উজ্জ্বল বাতি যেন নিভে গেল। সব শক্তি কেউ শুষে নেয়ার মত দেহটা তার দুর্বল হয়ে পড়ল। একটা শব্দ হলো। মিষ্টি একটা শিসের শব্দ।
চোখ খুলল। দ্রুত চোখ বুলাল চারিদেকে। মেয়েটি নেই।কেউ কোথাও নেই। চারিদিকে পানি। সে এক অ্যাটলের সরু তীরে দাঁড়িয়ে আছে। তার একপাশে সাগর, অন্য পাশে অ্যাটলের লেগুন। পাশে দক্ষিনে আর একটা অ্যাটল আছে, সেটা প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে। তার বোটটি হালকা দোল খাচ্ছে সাগরের পানিতে। বোটটি আগের মতোই বাঁধা অ্যাটলের তীরে। কিন্তু মেয়েটি গেল কোথায়? মাত্র বিশ-ত্রিশ সেকেন্ডের ব্যবধান, কোথায় গেল মেয়েটি? রাজপুত্রের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! সব হারানোর হৃদয়-ভাঙ্গা অনুভূতি নিয়ে সে বসে পড়ল অ্যাটলের তীরে।
মিনিট যায়, ঘন্টা যায়, দিন যায়, রাজপুত্র সে অ্যাটলের তীর থেকে ওঠেনি। তার মুখে একটাই কথা বারবার, কোথায় গেল আমার ভাইমিতি শাবানু?
কয়েকদিন পর রাজার একটি সন্ধানী দল গিয়ে তাঁকে অ্যাটলের তীর থেকে মুমূর্ষ অবস্থায় তুলে আনে। তাকে নিয়ে আসে রাজধানী আরুতে। সে সুস্থ হয়, কিন্তু ভাইমিতি শাবানুর নাম তার মুখ থেকে যায় না। ডাক্তার-কবিরাজ ও ভূত-প্রেতের তান্ত্রিকরাও তাঁকে দেখে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। তাঁকে বুঝানো হয় ভাইমিতি অদৃশ্য জগতের সাগরকন্যা, শাবানু হতে পারে তার নাম। সে অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা, অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাঁকে রাজপুত্রের মতো মানুষ পাবে কি করে? কিন্তু কোন বুঝই সে নেয়নি। তার সাগরে ঘুরাঘুরি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। রাত-বিরাত, বৃষ্টি-খরা, কোন কিছুরই তোয়াক্কা নেই, তার বোট ঘুরে বেড়ায় সাগরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, সবখানে। চারিদিকের নিঝুম নিরবতার মাঝে ধ্বনিত তার একটি মাত্র নামের উচ্চারণ-ভাইমিতি শাবানু, আমার ভাইমিতি শাবানু!
জগতেশ্বরী ‘হিনা’ অবশেষে সদয় হন পাগল প্রেমিক রাজপুত্রের প্রতি। আগের মতোই জ্যোৎস্না-গলা এক চাঁদনী রাতে রজপুত্র হেসানা হোসানার বোট নোঙর করা ছিল সেই অ্যাটলের তীরে।জগতেশ্বরী ‘হিনা’ নেমে আসে।আসে সে অ্যাটলের তীরে। ঘুমন্ত রাজপুত্রকে তুলে নিয়ে নেমে যায় অ্যাটলের তীর থেকে। অ্যাটল-তীরের মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যায় ভেতরে। চলে যায় অ্যাটলের সেই রাজপ্রাসাদে। তাঁকে শুইয়ে দেয় দুগ্ধ ফেনায়িত মনোহরা নরম সেই বিছানায়। ঘুম থেকে জেগে উঠলে সেখানেই আবার দেখা হয় ভাইমিতি শাবানুর সাথে।মিলন হয় দুই হৃদয়ের। রাজপুত্র তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, সবাই বলে তুমি অদৃশ্যের সাগরকন্যা, হারিয়ে যাবে না তো আবার। অদৃশ্য থেকে হাসেন জগতেশ্বরী’হিনা’। রাজপুত্রের উদ্দেশ্যে তার কন্ঠ ধ্বনিত হয়ঃ না রাজপুত্র, ভাইমিতি শাবানু মায়া নয়, মানবী, তাইতো তোমাদের মিলন হলো। আমি আনন্দিত, নিমজ্জিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত মহাদেশ ‘মু’-এর এক মহাগুণী, মহাজ্ঞানী বংশধরের সাথে নতুন প্যাসিফিক কন্টিনেন্টের এই প্রথম মিলন। কাহিনীর এখানেই শেষ। তবে আরও কথা প্রচলিত আছে, রাজপুত্র নাকি এরপর গোপনে আসতো রাজধানীতে, ঘুরে বেড়াতো সাগরেও ভাইমিতি শাবানুকে নিয়ে কাহিনীর শেষ অংশ নাকি সেই জানিয়ে গেছে সবাইকে।
থামল অধ্যাপক তাতিহিতি দীর্ঘ কাহিনী বলা শেষ করার পর।
অত্যন্ত মনোযোগের সাথে আহমদ মুসা অধ্যাপক তাতিহিতির কথা শুনছিল। রূপকথা হিসাবেই সে শুনছিল কিন্তু শুনতে গিয়ে মাঝে মাঝেই তার চোখে-মুখে যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হচ্ছিল, তা অবশ্যই রূপকথা শুনে হয় না।
অধ্যাপক তাতিহিতি থামতেই আহমদ মুসা বলল, স্যার, আপনার কাহিনী রুপকথা হলেও বাস্তবতার কিছু উপাদান তার মধ্যে আছে! যা আমার কাছে সত্যিই বিস্ময়কর লাগছে।
যেমন? বলল অধ্যাপক তাতিহিতি।
যেমন এক.যে অ্যাটলের অবস্থানরত অবস্থায় রাজপুত্র ঝড়ের কবলে পড়ে সংজ্ঞা হারিয়ে অ্যাটলের প্রাসাদে গিয়েছিল, সেই অ্যাটল থেকেই আবার তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় সেই অ্যাটল প্রসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই.অ্যাটলের প্রাসাদ থেকে রাজপুত্র ভাইমিতি শাবানুর হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিল ক্রমঊর্ধ্বমুখী এক পথে বা সিঁড়িপথে। তিন. সংজ্ঞা হারিয়ে যে অ্যাটলের যেখান থেকে অ্যাটলের প্রসাদে নীত হয়েছিল, সে অ্যাটলের সেখানেই সে ওঠে। চার. ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্রকে অ্যাটলের তীরে পৌঁছে দিয়ে ফেরার জন্য বিশ-ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছিল, সে সময় রাজপুত্রকে তার চোখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, পাঁচ. জগতেশ্বরী ‘হিনা’ ভাইমিতি শাবানুকে ‘মানবী’ বলেছে এবং ছয়. কাহিনীতে রাজপুত্রের নাম ‘হোসানা’ শব্দ এবং কথিত সাগরকন্যার নামের সাথে ‘শাবানু’ শব্দটি বিস্ময়কর এক বাস্তবতার ইংগিতবহ। বলল আহমদ মুসা।
অধ্যাপক তাতিহিতি ভ্রূ কুঞ্চিত করে খুব অভিনিবেশ সহকারে আহমদ মুসার কথা শুনছিল। আহমদ মুসার কথা শেষ হবার পরও ভাবল। বলল, বৎস, তুমি বলতে চাচ্ছ, কাহিনীটা রূপকথা হলেও বাস্তবতার এই উপাদানগুলো তার মধ্যে আছে। এই উপাদান মানে এই বিষয়গুলোর তুমি কি অর্থ করছ তা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে ইয়ংম্যান।
অবশ্যই স্যার। প্রথমে একই স্থান থেকে প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার অ্যাটল থেকে রাজপুত্রকে নেয়ার কথা বলি। স্থান-কাল-পাত্র সবই রূপকথা হলে এমনটা নাও হতে পারতো। জগতেশ্বরী ‘হিনা’ যে কোন স্থান থেকে রাজপুত্রকে অন্য যে কোন স্থানে সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারতো। তা করা হয়নি। একই স্থান থেকে একই অ্যাটল প্রাসাদে নিয়ে গেছে। এর অর্থ আমি এটা করতে পারি, সেই অ্যাটল প্রাসাদটি সেই অ্যাটলে বা পাশের কোন অ্যাটলেই হবে। দ্বিতীয় বিষয়টির যে অর্থ আমি করতে চাই, তা হলো, কাহিনীটা শুধু রুপকথা হলে ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্রকে ঊর্ধ্বমুখী হাঁটার কষ্ট দিয়ে অ্যাটলের প্রাসাদ থেকে বাইরে নিয়ে আসতো না। উড়াল দিয়ে বা শাঁ করে মাটি ভেদ করে উপরে তুলে আনতো। রূপকথায় এটাই হয়। দ্বিতীয়ত ক্রমঊর্ধ্বমুখী পথ বা সিড়িপথ দিয়ে রাজপুত্র ভাইমিতি শাবানুর হাত ধরে উপরে উঠে এসেছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড কোন স্থান থেকে এমন পথ ধরে উপরে উঠে আসাটাই বাস্থবতা। এর অর্থ এই হতে পারে, অ্যাটলের প্রাসাদ বা নিবাস বাস্তবেই অস্তিত্বমান। মানে এর অস্তিত্ব রয়েছে। তৃতীয় বিষয় অর্থাৎ অ্যাটলের যেখান থেকে ভাইমিতি শাবানু সংজ্ঞাহীন রাজপুত্রকে নিয়ে গিয়েছিল, ঠিক সেই স্থানেই তাকে ফিরিয়ে আনা প্রমান করে ক্রমঊর্ধ্বমুখী বা ক্রমনিম্নমুখী ঐ পথেই ভাইমিতি শাবানু তাকে নিয়ে গিয়েছিল, আবার ঐ পথেই তাকে ফিরিয়ে আনতে হয় রাজপুত্রকে এবং সেটা স্বাভাবিকভাবে একই স্থানে হয়।রূপকথার এমন বাস্তবতার নিয়মে বন্দী থাকে না। এক নিমেষে পাতাল থেকে আকাশে ওঠা রূপকথার চরিত্র। আপনার রূপকথায় এটা হয়নি। এখানে রূপকথার নায়িকা ভাইমিতি শাবানুকে উপরে উঠার জন্যে ক্রমঊর্ধ্বমুখী পথ এবং পা ব্যবহার করতে হয়েছে। আমি মনে করছি, অ্যাটল থেকে উপরে ওঠার পথ ও অ্যাটলের প্রাসাদ দু’য়েরই অস্তিত্ব রয়েছে। চতুর্থ বিষয়টি এ অস্তিত্বের আরও বড় প্রমাণ। ভাইমিতি শাবানু রাজপুত্রকে প্রাসাদ থেকে অ্যাটলে তীরে পৌঁছিয়ে দিয়ে বলেছিল বিশ-ত্রিশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ রাখতে। বলেছিল একটা শব্দ শোনার পর চোখ খুলতে। কেন বলেছিল এটা ভাইমিতি শাবানু? বলেছিল ভাইমিতি তার চলে যাবার সুযোগ সৃষ্টির জন্যে। এই সময়ের মধ্যে চলেও গিয়েছিল সে। ভাইমিতি শাবানু অশরীরী কোন সাগরকন্যা হলে তার চলে যাবার জন্যে বিশ-তিরিশ সেকেন্ডের প্রয়োজন ছিল না, এক মুহুর্তই যথেষ্ট ছিল।সে অশরীরী কেউ ছিল না বলেই তার সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। অশরীরী কেউ না হলে সে মানবীই হবে বলে আমি মনে করি। দ্বিতীয়ত ভাইমিতি শাবানু তার চলে যাবার জন্যে বিশ-তিরিশ সেকেন্ড সময় নেয়ার অর্থ এই যে, যে পথ দিয়ে অ্যাটলে ঢুকে যাবে, সে পথ সেখান থেকে বিশ-তিরিশ সেকেন্ডের পথ। আরও স্পষ্ট কথা, ভাইমিতি শাবানু ও রাজপুত্র যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে বিশ-তিরিশ সেকেন্ড দূরত্বে অ্যাটলের প্রাসাদে নামার পথ ছিল। পঞ্চম বিষয় হলো, জগতেশ্বরী কাহিনীর নায়িকা ভাইমিতি শাবানুকে ‘মানবী’ বলা। আমি বলতে চাচ্ছি, জগতেশ্বরীর এই সাক্ষ্য থেকেও প্রমানিত হয় ভাইমিতি শাবানু মানবী। ষষ্ট বিষয়, ভাইমিতির নামের ‘শাবানু’ শব্দ ও রাজপুত্রের নামের ‘হোসানা’ শব্দ।এ ‘শব্দ’ দু’টি তাহিতিয়ান নয়, পলিনেশীয়ানও নয়। শব্দ দু’টির ‘হোসানা’ আরবি শব্দ ও ‘শাবানু’ আরবি-ফারসি মেশানো শব্দ। দু’টিই মুসলিম নামের খন্ডিত রূপ। ‘হোসানা’ আসলে হাসান এবং ‘শাবানু’ হলো ‘শাহবানু’। আপনার কাহিনীর এই ভাষাগত ও নামগত উপাদান থেকে মনে করছি, কাহিনীকে শুধু এক নতুন বাস্তবতা নয়, নতুন এক ইতিহাসের দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। সে ইতিহাস নিশ্চয় তাহিতির ইতিহাস, পলিনেশীয়ার ইতিহাস, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলেরও ইতিহাস। থামল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে প্রায় ছানাবড়া অধ্যাপক তাতিহিতির দু’চোখ! বিহবল চেহারা মারেভা মাইমিতির। তার অবাক দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখের ওপর নিবদ্ধ।
ইতিমধ্যে তামাহি মাহিন এসে পড়েছিল। সেও শুনেছে আহমদ মুসার কথা। তারও চোখ-মুখ বিস্ময়ে ভরা!
অধ্যাপক তাতিহিতি তার ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে, অদ্ভুত! অদ্ভুত! তুমি তুমি কি নতুন কোন শার্লক হোমস, না কুশাগ্র বুদ্ধির ব্যারিস্টার! তুমি কাহিনীর যে অদ্ভুত বিশ্লেষণ করেছ, তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য। এসব বিষয় কোন সময় আমাদের ভাবনাতেও আসেনি। কিন্তু বৎস, তুমি রূপকথা থেকে যে বাস্তবতা বের করেছ, তা যে রূপকথার চেয়েও বিস্ময়কর! রূপকথাও বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু তোমার বাস্তবতাকে আমরা কিভাবে বিশ্বাস করবো,কি করে বিশ্বাস করবো অ্যাটলের তলায় রাজপ্রাসাদ আছে, সেখানে ঢোকার ও বের হবার রাস্তা আছে! বিশ্বাস করব কি করে, ভাইমিতি শাবানু মানবী!
স্যার, বিশ্বাস করা, না করা ভিন্ন জিনিস। কিন্তু আমি বলছি, আপনাদের কাহিনীটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমার কথাও সত্য। স্যার, আপনি সাগরের ভূমি গঠন, দ্বীপমালা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ, কিন্তু আপনি কি এর সবটা জানেন? অজানার তুলনায় আমাদের জানা জগতটা তো খুবই নগণ্য! আমরা জানি না বলেই অজানাটা মিথ্যে হয়ে যাবে? বলল আহমদ মুসা।
অধ্যাপক তাতিহিতির মুখে হাসি ফুটে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে সে হাসি মিলিয়ে গিয়ে নেমে এল এক গাম্ভীর্য। বলল ধীরে ধীরে, তুমি কে জানি না, কিন্তু তোমার কথা আর দশজনের মতো নয়, চিন্তার ধারাও একদম ভিন্ন। তুমি যে যুক্তি তুলে ধরেছ, তা সত্যই অকাট্য। বিশ্বাস করা না গেলেও এনিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। তুমি ঠিকই বলেছ, আমরা সৃষ্টি সম্পর্কে খুব অল্পই জানি, আমাদের অজানাই তো সব! চিন্তা-ভাবনা জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমেই অনেক অজানা বিষয় জানার পরিমন্ডলে আসছে। তোমার চিন্তার নিয়েও ভাবতে হবে। বল, তুমি নিজে এ নিয়ে কি ভাবছ?
স্যার, আমি যা বলেছি সেটাই সত্য তা বলছি না। কিন্তু কাহিনীর যে ঘটনা পরম্পরা তাতে আমার মনে হচ্ছে, কোন কোন অ্যাটলে সে প্রাসাদ, যাকে ভাইমিতি শাবানু নিবাস বলেছে, তাতে প্রবেশ ও বের হবার পথও আছে! সে অ্যাটলের চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে আরেকটা অ্যাটলও আছে! বলল আহমদ মুসা।
কোন অ্যাটলে তুমি এ ধরনের কোন স্থাপনা খুঁজছ। সে চিন্তা থেকেই কাহিনীর প্রাসাদের মধ্যে তুমি তোমার বাঞ্চিত স্থাপনা দেখতে চাচ্ছ, এ কথা আমি বলতে পারতাম। কিন্তু বলতে পারছি না এ কারণে, যুক্তি দিয়েই তুমি তোমার কথা প্রমাণ করেছ। এখন আমি মনে করি, অনুসন্ধান করে দেখা দরকার সে ধরনের অ্যাটল কোনটা হতে পারে। সে অ্যাটল যদি পাওয়া যায় তাহলে পরের কাজগুলো সহজ হয়ে যাবে। আর এ ধরনের কিছু যদি পাওয়া যায়, তাহলে কাহিনীটা ভিন্ন রূপ নিয়ে আমাদের কাছে আসবে। তুমি যা বলেছ, তাহিতি নয় শুধু, পলিনেশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপাঞ্চলের ইতিহাস পাল্টে যেতে পারে। আচ্ছা বৎস, তুমি যে দু’টো শব্দের কথা বললে, সেটা কিন্তু ঠিক। এ দু’টো পলিনেশিয় কোন শব্দ নয়। কিন্তু তুমি জানলে কি করে, এ দু’টো আরবি ও ফারসি শব্দ? বলল অধ্যাপক তাতিহিতি।
আমি আরবি, ফারসি ও এ ভাষার নামের সাথে পরিচিত স্যার। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু কাহিনীর চরিত্রে আরবি, ফারসি ভাষার নাম এল কি করে? তাহলে পলিনেশীয়া মানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের ইতিহাসের সাথে মুসলমানদের কোন সম্পর্ক আছে। এখানকার অতীত জন-জীবনের সাথে মুসলমানরা কোনওভাবে জড়িত? তুমি যেটা বলেছ, এটা সত্যি নতুন ইতিহাসের ইংগিত?
বলে একটু থামল বৃদ্ধ অধ্যাপক তাতিহিতি। ইজি চেয়ারে আবার তার দুর্বল দেহটা এলিয়ে দিল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, এই জিজ্ঞাসার জবাবের জন্য অনুসন্ধান দরকার। চলমান ইতিহাসে এর কোন জবাব মিলবে না।পলিনেশিয়ানে ছড়িয়ে আছে ‘মিথ’ আকারে অসংখ্য ‘পুটাটুপুনা’ (putatupuna) অ্যানসেস্ট্রাল স্টোরিজ (Ancestral stories)। সে সবের মধ্যেই খুঁজতে হবে ইতিহাসকে। প্রিয় ইয়ংম্যান, তোমার মধ্যে যে অদ্ভুত বিশ্লেষণ শক্তি দেখছি, তাতে তুমি পারবে এ ইতিহাসের সন্ধান করতে। আমি আশীর্বাদ করছি বৎস।
থামল অধ্যাপক টেপোয়া তাতিহিতি। কথা শেষ হবার সাথে সাথে তার চোখ দু’টিও বুজে গেল। চোখে-মুখে তার ক্লান্তি।
স্যরি স্যার, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। আমি বলতে চাচ্ছি স্যার, অ্যানসেন্ট্রাল স্টোরি বা পূর্বপুরুষ-কাহিনীর মধ্যে ইতিহাস সন্ধান করা যত সহজ, পূর্বপুরুষের কাহিনী সন্ধান করা ততটা সহজ নয়। আহমদ মুসা বলল।
চোখ খুলল অধ্যাপক তাতিহিতি। বলল, ঠিক বলেছ তুমি। তবে একজন লোক আছে। তাকে মারেভা ও মাহিন দু’জনেই চেনে। তার নাম মাহকোহ মিনালী মিনার। তিনি প্রাচীন পমেরী রাজবংশের বেঁচে থাকা একমাত্র প্রধানতম মানুষ। ইউরিপীয়রা আসার আগে এই রাজবংশ বিভিন্নভাবে শত শত বছর রাজত্ব করেছে তাহিতিসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে। তিনি এই ‘আরু’তেই সেই প্রাচীন রাজবংশের ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রাসাদের এক কোণে অতীতের সাক্ষী হয়ে অবস্থান করছেন। ‘Putatupuna’ অর্থাৎ অ্যানসেস্ট্রাল স্টোরিজের (পূর্বপুরুষ কাহিনীর) বিশাল ভান্ডার আছে তার কাছে। তিনিই তোমাকে সাহায্য করতে পারেন।
ধন্যবাদ স্যার। বলল আহমদ মুসা।
ওয়েলকাম বৎস। অধ্যাপক তাতিহিতি বলল। চোখ দু’টি তার বুজে গেল আবার।
আমরা তাহলে উঠতে পারি স্যার। আপনি বিশ্রাম নিন। বলল মারেভা মাইমিতি।
এস বোন, কিন্তু তোমার মাহকোহ’র কাছে যেও। আমারও খুব আগ্রহ এ কাহিনী জানার। অধ্যাপক তাতিহিতি বলল।
অধ্যাপক তাতিহিতির কাছ থেক বিদায় নিয়ে আহমদ মুসারা বেরিয়ে এল।
বেরিয়েই তামাহি মাহিন বলল, স্যার, আপনি কি ফাদার মাহকোহ’র ওখানে যাবেন?
ফাদার কেন, উনি কি খৃস্টান? আহমদ মুসা বলল।
না স্যার, উনি খৃস্টান নন। আমরা প্রধান শিক্ষক ও ধর্মনেতাদের ফাদারও বলি। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মনেতাদের ‘ফাদার’ বলে। তার অনুসরণেই আমরা এটা বলি আত্মরক্ষার কৌশল হিসাবে। কারণ খৃস্ট ধর্ম ছাড়া এখানে অন্য সব ধর্ম-বিশ্বাস ও গীর্জা ছাড়া অন্য সব উপাসনালয় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সুতরাং খৃস্ট ধর্মের নাম পরিচয়ের আড়ালেই অনেক তাহিতিয়ান নিজেদের ধর্ম পালন করে থাকে। আরু’তেও তাই হয়। বলল মারেভা।
উনি কি ধর্মনেতা? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ধর্মনেতা। কিন্তু প্রচলিত কোন ইশ্বরের উনি পূজা করেন না। উনি ধ্যান করেন, আ-ভুমি মাথা নোয়ান কোন অদৃশ্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে। বলল তামাহি মাহিন।
তিনি কি করতেন, কি করেন? আহমদ মুসা বলল।
তিনি নিজেকে রাজকীয় শিক্ষা একাডেমি, লাইব্রেরী ও উপাসনালয়ের পরিচালক বলে মনে করেন। এসবের ধ্বংসাবশেষের একটা বাড়িতে তিনি থাকেন। তিনি কোথাও যান না। বলল মারেভা।
তিনি যেখানে থাকেন, সেটা ‘আরু’র কোথায়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্যার, আমরা এসেছি ‘আরু’র সাগর তীরবর্তী পুননির্মিত অংশে। এই অংশের দক্ষিণে একটা বিশাল বিরান অঞ্চল পাওয়া যাবে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে সাগর পর্যন্ত বিলম্বিত তিনটি দীর্ঘ উপত্যকা ও তিনটি বিলম্বিত পাহাড় নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত।এটাই প্রাচীন রাজধানী ‘আরু’র মূল অংশ।এই এলাকার শীর্ষ স্থানে ছিল প্রাসাদ। এই প্রসাদেরই একাংশে ছিল শিক্ষা একাডেমী, লাইব্রেরী ও উপাসনালয়ের স্থান। সেখানেই ফাদার মাহকোহ এখনও বাস করেন। বলল মারেভা।
আর কেউ থাকে না ওখানে? প্রশ্ন আহমদ মুসার।
আরও দু’চারটা বসতি আছে। এদের কেউ রাজপরিবারের অধস্তন, কেউ রাজপরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এছাড়াও আশেপাশে কিছু পরিবার আছে যারা পশু পালন করে জীবন নির্বাহ করে। বলল তামাহি মাহিন।
চল মাহিন মারেভা, ফাদার মাহকোহ’র সাথে দেখা করেই আমরা ফিরব। আমাদের সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্যে অ্যাটলের প্রাসাদ রহস্য এবং ভাইমিতি শাবনুর কাহিনী সম্পর্কে আরও জানা প্রয়োজন। আহমদ মুসা বলল।
ভালই হলো, আজ আমার ও মারেভার মা এসেছেন ‘আরু’তে মাহকোহ’র মন্দিরে উপাসনার জন্যে। তাদের সাথেও দেখা হবে। আমরা একসাথে ফিরতে পারবো। বলল তামাহি মাহিন।
তারা প্রার্থনা করতে এখানে আসেন? আহমদ মুসা বলল।
প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবারে তারা আসেন। আজ মাসের প্রথম শুক্রবার। বলল তামাহি মাহিন।
ফাদার ‘মাহকোহ’র মন্দিরে শুক্রবারে প্রার্থনা হয়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
জি স্যার, সপ্তাহের শুক্রবারে এখানে প্রার্থনা হয়। বলল তামাহি মাহিন।
শুক্রবার কেন? আহমদ মুসা বলল।
জানি না স্যার, এটাই ঐতিহ্য। বলল তামাহি মাহিন।
কি প্রার্থনা হয় সেখানে? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
হাঁটু গেড়ে বসে ধ্যান ও প্রার্থনা। মারেভা বলল।
সবাই উঠে বসেছে গাড়িতে। চলতে শুরু করল গাড়ি।
ড্রাইভার তেপাও-এর পাশের সিটে মারেভা। পেছনে আহমদ মুসা ও তামাহি মাহিন। পেছনের সিটে মারেভার পাশে আহমদ মুসা যেমন বসে না, তেমনি তামাহি মাহিনের বসাও সে এলাউ করে না।
পাহড়ী পথে আস্তে আস্তে চলছে গাড়ি।
অধ্যাপক তাতিহিতির সাথে যে সব কথা হয়েছিল এবং আহমদ মুসা যা জানতে চায়, এক এক করে সব বলল ফাদার মাহকোহ মিলানী মিনারকে।
সামনেই ফরাসে হাঁটু মুড়ে বসে ছিল ফাদার মাহকোহ। তার সামনে ফরাসে বসে কথা বলছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার পেছনে আছে মারেভা ও মাহিন। পাশেই একটু তফাতে বসেছিল মারেভা ও মাহিনের মা পাশাপাশি।
এটাই ফাদার মাহকোহ’র অফিস ঘর।
ঘরের বাইরের দেয়াল এবড়ো-থেবড়ো ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের হলেও ভেতরটা অনেকটা ভাল।
ফাদার মাহকোহ’র এই অফিস ঘরের পাশেই উপাসনালয় মানে মন্দির। উপাসনালয়টি নতুন-পুরাতনের মিশ্রণ। আগের কাঠামোর উপর উপাসনালয়টি পুননির্মিত।
আহমদ মুসার এসে যখন উপাসনালয়ে ঢুকেছিল তখন উপাসনা চলছিল উপাসনালয়ে।
বিরাট ঘর। সবাই ফরাসের উপর লাইন করে পশ্চিমমুখী হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে। সবাই ধ্যানস্থ। ধ্যানের সময় শেষ হলে সবাই এক সাথে প্রার্থনা করল।
উপাসনালয়ের পশ্চিম দেয়ালে একটা বড় অর্ধ চন্দ্র।পরে আহমদ মুসা জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল, অর্ধ চন্দ্র, মানে চন্দ্র হলো জগতেশ্বরী ‘হিনা’-এর প্রতীক। পলিনেশীয় বিশ্বাসমতে জগতেশ্বরী ‘হিনা’ চন্দ্ররুপে প্রকাশিত।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও ফাদার মাহকোহ যেমন ছিল, তেমনি বসে রইল। তার মাথা ঈষৎ নোয়ানো। তার চোখ দু’টি দু’জনের মাঝখানে মাটির মেঝের উপর নিবদ্ধ। মাথায় কাপড়ের একটা গোল বন্ধনী, পাগড়ির একটা বেড়ের মত। প্রাচীন রাজবংশের রাজশিরস্ত্রাণের প্রতীক সেটা করা। সে প্রতীকের মাঝখানে অর্ধ চন্দ্র শোভা পাচ্ছে। ফাদার মাহকোহ’র পরনে লম্বা জামা। মুখে সুন্দর শুভ্র দাড়ি। ফাদারের বয়স শুনেছিল একশ’ বছরের বেশি, তার দেহের কাঠামো শিথিল হয়েছে অবশ্যই, কিন্তু মুখে-চোখে তারুণ্যের দ্যুতি।
একসময় মুখ তুলল ফাদার মাহকোহ। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। চোখে তার শান্ত-গভীর দৃষ্টি। বলল, বুঝতে পারছি তুমি একটা মিশন নিয়ে এসেছ। মিশনটা মনে হচ্ছে কোন এক অ্যাটলের তলদেশের স্থাপনার সন্ধান করা। কিন্তু এর বাইরে তুমি এদেশের না হয়েও এদেশের অতীত নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে, জন-কাহিনী নিয়ে যে আগ্রহ প্রকাশ করছ, তার জন্যে আমি মোবারকবাদ দিচ্ছি তোমাকে। আজকের মানুষ, বিশেষ করে আমাদের মত অনুন্নত দেশের মানুষ সভ্যতার ভোগবাদী মোহে পড়ে বর্তমানের সমৃদ্ধি ও ভবিষ্যত গোছানো নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, নিজেদের অতীত নিয়ে ভাববার সময় এদের নেই আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা আমাদের রাজা মাকোয়া তাকাও-এর মত নিজেদের ইতিহাসের সব উপাদান নিজের হাতেই ধ্বংস করছে। তুমি তার ব্যতিক্রম, ধন্যবাদ তোমাকে।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, তুমি অনেক বিষয় সামনে এনেছ।কিন্তু বিষয়গুলোর সারাংশ করলে দু’টি বিষয় মুখ্য হয়ে ওঠে ! এক. কাহিনীর ভাইমিতি’র নামের ‘শাবানু’ ও প্রিন্স হেসানা’র নামের ‘হুসানা’ অংশ আরবি-ফারসি শব্দের অপভ্রংশ। তাদের নামের সাথে আরবি ও ফারসি ভাষার নাম কোত্থেকে এল। এবং দুই. কাহিনীটিতে অ্যাটল-প্রাসাদের যে কথা বলা হয়েছে, তার বাস্তবতা। থামল ফাদার মাহকোহ।
চোখ বন্ধ করে একটু ভাবল। বলল, এই মাত্র আমি বললাম, আমাদের রাজা মাকোয়া তাকাও তাহিতি ও পলীনেশীয় দ্বীপাঞ্চলের শত শত বছর ধরে জমিয়ে তোলা পূর্বপুরুষদের কাহিনী সব ধ্বংস করে দিয়েছে। এর সাথে অনেক ইতিহাসই মুছে গেছে। এটা যে…।
এটা তাহলে সত্যি ঘটনা? আহমদ মুসা বলল।
দুর্ভাগ্যজনক এক সত্য জনাব আহমদ। পলিনেশীয় সভ্যতার একটা বড় বৈশিষ্ট হলো পারিবারিক ইতিহাস স্মৃতিতে ধরে রাখা। এভাবে হাজার বছরের ইতিহাস ছিল তাদের স্মৃতির স্তরে। কিন্তু ইউরিপীয়রা আসার পর তাদের নতুন সভ্যতা বিপর্যয় ঘটায়। স্মৃতির ইতিহাসকে লিখে রাখার বা এর লেখ্য রূপ তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। এরপর ইতিহাসকে একমুখী করার প্রবনতারও সৃষ্টি হয়। এই প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের হাতের পুতুল নতুন রাজাদের মধ্যে। ১৭৫৭ সালের জুনে আসে বৃটিশ ক্যাপ্টেন ওয়ালিস বন্দুক-কামান নিয়ে। নির্দয় পন্থায় দখল হয়ে যায় রাজধানী ‘আরু’সহ তাহিতি এবং পলিনেশীয় দ্বীপাঞ্চল। আর ১৭৬৮ সালে আসে ফারাসিরা আরও বড় শক্তি নিয়ে এবং তারা বৃটিশদের তাড়িয়ে দখল করে নেয় গোটা এলাকা। স্থানীয় রাজারা প্রতিরোধ চালিয়ে যায় অনেক দিন। অবশেষে উচ্ছেদ হয় ঐতিহ্যবাহী পমারী রাজবংশ ও স্থানীয় রাজারা। ১৮১৫ সালে ফরাসিদের পুতুল রাজা দ্বিতীয় পমপাই একমাত্র রাজা হিসাবে ঘোষিত হয়। ধ্বংস হয় রজধানী আরু। ধ্বংস হয় অতীতের সমাজ-সভ্যতা নির্দয়ভাবে। আর সব কিছুর উপর চেপে বসে খৃস্টান রাজা। গীর্জা ছাড়া সব ধরনের উপাসনালয় ধ্বংস করা হয়। এরই ধারাবাহিকতাতেই ১৮৯০-এর দশকে রাজা মাকিয়া তাকাও লিখিত সব পারিবারিক ইতিহাস ধ্বংস করে ফেলে, একমাত্র তার সময়ের ইতিহাস ছাড়া। তার ফলে মাকিয়া তাকাওদের কাহিনী পলিনেশীয়ার একমাত্র ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়। শুধু পলিনেশীয়াতে নয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব দ্বীপাঞ্চলেই এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের উদ্যোগে একক ইতিহাস তৈরির নামে। ধ্বংসের এই ঝড়ে অগণ্য সত্য কাহিনী, ইতিহাসের ঘটনা, ইতিহাসের উপাদান চিরতরে হারিয়ে গেছে। থামল ফাদার মাহকোহ।
বিস্ময়ের বেদনা নিয়ে আহমদ মুসা তাকিয়ে ছিল ফাদার মাহকোহ’র দিকে। ফাদার মাহকোহ থামতেই আহমদ মুসা বলল, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা এই কাজ বহু দেশে করেছে। কিন্তু সবখানে তারা ষোল আনা সফল হয়নি, আপনাদের পলিনেশীয়াতে কি অবস্থা স্যার?
আমাদের পলিনেশীয়তে অন্য সব লিখিত ইতিহাস শুধু ধ্বংস করা হয়েছে তাই নয়, অন্য ইতিহাসের পাঠ, সংরক্ষণ ও নিষিদ্ধ করা হয়। তার ফলে এখানে সেখানে কিছু কাহিনী, কথা, ইতিহাস ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পারলেও সংরক্ষণ ও চর্চার অভাবে সে সব বেশি দিন বাঁচতে পারেনি। বলল ফাদার মাহকোহ।
স্যার, আপনি তো তা বাঁচাতে পেরেছেন! আহমদ মুসা বলল।
কিছু কিছু, এমনকি আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের সবটা সংগ্রহ করতে পারিনি। আমাদের রাজধানী ‘আরু’ ধ্বংসের সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমাদের রজকীয় সংগ্রহশালা ও লাইব্রেরী। আমি ব্যাপক ঘুরে বেড়িয়েছি ইতিহাসের কাহিনীর সন্ধানে। কিছু মানুষের স্মৃতি থেকে, কিছু গোপনে সংরক্ষিত লেখা থেকে আমি সংগ্রহ করেছি। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার। আপনার সংগ্রহ কতদূর অতীত পর্যন্ত যেতে পেরেছে স্যার? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
পেছনের ইতিহাস কত দূর পেছনে গেছে তা আমি জানি না। এ ব্যাপারে এখনও ঐকমত্য হয়নি। আমার কাছে ইতিহাসের যে উপাদান আছে, তাতে অনেক ফাঁক-ফোকর থাকলেও এক নজরে আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার। আমাকে আপনি কিভাবে সাহায্য করতে পারেন? আহমদ মুসা বলল।
তুমি ‘হাসানা’ ও ‘শাবানু’ এই দুই আরবি, ফারসি নামের উৎস খুঁজছ, কিন্তু শুধু এ দু’টি নামই তো নয়, আরও অনেক নামের উৎস তোমাকে খুঁজতে হবে। পলিনেশীয় সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে পুরাতন দ্বীপ ‘তাহিতি’ নাম নিয়ে কি তুমি ভেবেছ? তাহিতিকে বিশ্বের সুন্দরতম দ্বীপ যদি নাও বলি, তাহিতিবিশ্বের সুন্দরতম দ্বীপের একটি অবশ্যই। ইউরপীয়রা এই দ্বীপকে দেখেই বলে উঠেছিল ‘আইল্যান্ড অব লাভ’ ভালবাসার দ্বীপ। ফরাসি বোগেনভিল বলেছিলেন ‘ মিথ অব প্যারাডাইস’ স্বর্গের কল্পলোক। আরেকজন রোশো বলেছিলেন ‘ মহত্তম অসভ্য’। কিন্তু তাদের অনেক আগে তাহিতি তার নামের মাঝে তার পরিচয়কে, রূপকে ধারণ করেছে। ৮৫০ খৃস্টাব্দের দিকে প্রথম মানব যারা তাহিতিতে বসতি গড়তে আসে, তারা তাহিতিকে ‘আমার শ্রদ্ধা’ ‘আমার সালাম’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। ভাই আহমদ, হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা অধ্যয়ন করার কিছু সুযোগ আমার হয়েছিল। ‘তাহিতি’ নিজেই আরবি শব্দ, আরবি মুল ‘তাহিয়াত’ থেকে এসেছে। তাহিতির অর্থ ‘ আমার শ্রদ্ধা’, ‘আমার অভিনন্দন’, ‘আমার সালাম’। প্রথম মানব যারা তাহিতিতে আসেন, তারা শ্রাদ্ধার, ভালবাসার, শান্তি-আকাঙ্ক্ষার মহত্তম নাম দিয়েই দ্বীপটিকে বরণ করেন। কিন্তু এই লোকগুলো কারা, কোত্থেকে কিভাবে এল, এটাই এখানকার প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর পেলে পলিনেশীয় কাহিনীতে মূল আরবি-ফারসি ‘হাসান’ ও ‘সাহবানু’ নাম কোত্থেকে এল তাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। ‘তাহিতি’র মত অনেক আরবি শব্দ আমরা তাহিতি ও পলিনেশীয়ায় পাব। হয়তো এমনি ভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব দ্বীপাঞ্চলেই পাওয়া যাবে। ইউরোপীয়রা আসার আগে যারা রাজার অধীনে বা স্বাধীনভাবে তাহিতির বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করতো, তাদের ‘আরাই’ (Ari’i) বলা হতো। তারা জনগণের ‘প্রদর্শঙ্কারী’ হিসাবে এই উপাধি ব্যবহার করতো। এটা আরবি শব্দ। তাহিতির রজধানী ধ্বংস করে ফেলা আমাদের এ প্রিয় শহরের ‘আরু’ নামটিও আরবি ‘আরাই’-এর অপভ্রংশ। আবারও প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় আঞ্চলিক শাসকদের এই ‘আরাই’ নাম এবং স্বাধীন তাহিতি ও পলিনেশীয়ার গৌরবান্বিত রাজধানীর ‘আরু’ নাম কোত্থেকে এল, কারা রাখল, কেন রাখল? এ প্রশ্নগুলো আহমদ তোমার প্রশ্নের মতই। এই প্রশ্নগুলোর জবাব পেলে তোমার প্রশ্নেরও জবাব হয়ে যাবে। অতীত ইতিহাসের মধ্যেই এর জবাব পাওয়া যাবে।
দীর্ঘ এক বক্তব্য দিয়ে থামল ফাদার মাহকোহ।
কিন্তু স্যার, ইতিহাস তো ধ্বংস করেছে! আহমদ মুসা বলল।
এরপরও এখানে-সেখানে কিছু রক্ষা পেয়ে গেছে। তার কিছুটা আমিও সংগ্রহ করতে পেরেছি। আমাদের নিজেদের পারিবারিক ইতিহাস তো আছেই ! বলল ফাদার মাহকোহ।
এই ইতিহাসের গুড়াটা কত দূর পর্যন্ত গেছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
এ রকম ইতিহাসের কোন সময় নির্ণয় করা মুস্কিল।
তারপর?
তারপরও এভাবেই কাহিনী বর্ণিত ও লিখিত হয়েছে! তাও আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ্যালেগেরিক্যাল প্রতীকের আবরণ দেয়া। রূপকথায় পাত্র-পাত্রীর যেমন হঠাৎ আগমন ঘটে, আগ-পিছের পরিচয় ও যুক্তি-প্রমাণের কোন বালাই থাকে না, কতকটা সেই রকমই অনেক ক্ষেত্রে। যেমন আমাদের বংশ-ইতিহাসের শুরু আমাদের বংশ বা গোত্রপতির মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। সারাংশ এই রকমঃ বংশের সর্দার তাহেনা (শক্তি) ঈশ্বর হিনার কাছে চলে গেছে। তার দেহটাও পাঠাবার ব্যবস্থা চলছে। সারা রাত তার দেহ পাহাড় শীর্ষে রাখা হয়েছিল। ঈশ্বরের কাছে তার দেহ যায়নি। এবার ছোট ভেলায় করে তার দেহ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সাগরে ভাসাবার ব্যবস্থা করা হয়। বংশের তান্ত্রিক ‘রানুই’ (পবিত্র পুরুষ) ভীষণ ব্যস্ত এই প্রস্তুতি নিয়ে। হঠাৎ দেখা গেল পশ্চিমে মুরিয়ার দিক থেকে একটা জাহাজ আসছে উপকূলের দিকে। এতবড় ও এমন জাহাজ আমরা কখনও দেখিনি। জাহাজ অনেক কাছে এসে গেল। জাহাজের সব কিছুই দেখা যাচ্ছে। পাল আগেই নামিয়ে ফেলা হয়েছে। জাহাজের পাল টাঙানো উঁচু মাস্তুলে একটা বড় সবুজ পতাকা। বাতাসের অভাবে উড়ছে না। জাহাজের ডেকে আপাদমস্তক সাদা পোষাকের অনেক মানুষ। উপকূলে আমাদের লোকদের মধ্যে ভয় ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। জাহাজটি আরও কাছে আসে। মৃতের সৎকারের কাজ বাদ দিয়ে আমাদের লোকেরা তীর-ধনুক, বর্শা ও গুলতি নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। জাহাজের লোকজনও ডেকে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ওদের হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। আমাদের লোকদের এ অভিজ্ঞতা আছে, জলদস্যুরা বিভিন্ন রূপ ধরে আসে, শান্তিবাদী ও ভালো মানুষের ছদ্মবেশও তারা নেয়। সুতরাং আমদের লোকেরা ওদের গতিরোধের জন্যে তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করে আক্রমণ শুরু করল। তীরগুলো মারাত্মক সূচালো পাথরের, বর্শাগুলো ও তাই। জাহাজের কয়েকজন আহত হয়ে পড়ে গেল। কিন্তু ওরা আক্রমণ করলো না। প্রায় সবাই আড়ালে সরে গেল। মাত্র দু’জন নতুন কাপড়ের বান্ডিল ও বস্তা থেকে খাদ্যশস্য আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করলো, আমরা আক্রমণ বা দখলের জন্যে নয়, ব্যবসায়ের জন্যে এসেছি। সরদারের ছেলে নতুন মনোনীত সরদার সবকিছু পর্যবেক্ষন করছিল।সে আমাদের লোকদের ওদের উপর আক্রমণ বন্ধের নির্দেশ দিল। আক্রমণ বন্ধ হলে জাহাজ এসে তীরে ভিড়ল। জাহাজের ওরা সবাই তীরে নামল। লোকেরা সবাই দীর্ঘদেহী, ফর্সা শ্মশ্রুমণ্ডিত। সকলেই প্রশান্ত চেহারার। চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, তাতে কোন হিংসা-কুটিলতার ছায়া নেই। দেখলে মনে ভয় জাগে না, বরং বন্ধু বলে মনে হয়।
সবাই ওরা নিরস্ত্র। তীরে নেমে সবাই ওরা এক সাথে হাত তুলে প্রার্থনা করল। তারপর ওরা উঠে এসে আমাদের সবার সাথে হাত মেলাল। দু’চারটি তাহিতিয়ান শব্দ, দু’চারটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্যান্য ভাষা মেশানো ভাষায় তারা বুঝালো তাহিতিয়ার কেউ তাদের শত্রু নয়, তারাও কারও শত্রু নয়। তারা ব্যবসায়-বানিজ্য করে এবং সাধ্যমত মানুষের উপকার করে। আমাদের লোকেরা তাদের জাহাজে চড়ল। দেখল, জাহাজে কোন অস্ত্র নেই। আছে কাপড়, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কিছু ব্যবসায়ের পণ্য। আমাদের লোকেরা তাদের বিশ্বাস করল। অস্ত্র ছাড়া কেউ আসতে পারে, আত্মরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া কেউ আসতে পারে, এমনটা আমাদের লোকেরা অতীতে দেখেনি। আমাদের আক্রমণে ওদের কয়েকজন আহত হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন মারা গেল। আহতদের তারা চিকিৎসা করল। তাদের চিকিৎসার ধরন উন্নত। আহত স্থান ওষুধ মেশানো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা, ওষুধ লাগানো, কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, এসব বিষয় আমাদের লোকেরা এই প্রথম দেখল। তারা তাদের মৃত লোককে কূলে নামিয়ে তার সৎকার করার অনুমতি চাইল। আমাদের নতুন সরদার পো মিরি (poe Miri) তাদের অনুমতি দিল। জাহাজ থেকে লাশ তারা উপকূলে নামিয়ে লাশকে গোসল করাল এবং সাদা কাপড় কেটে কয়েক টুকরো করে লাশকে পরিয়ে দিল। গোটা লাশকে সাদা কাপড়ে তারা মুড়ে ফেলল। সেই কাপড়ে মোড়া লাশ তারা সামনে রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দু’হাত বুকে বেঁধে কি সব পড়ল! তারপর আয়তাকার সুন্দর একটা গর্ত বানাল। সেই গর্তের ফ্লোরে কাপড়ে মোড়া লাশকে যত্নের সাথে রেখে দিল এবং গর্তের আয়তাকার মুখ তারা সাইজমত কাটা কাঠ, ডাল, লাকড়ি দিয়ে বন্ধ করে দিল। তার উপর বড় আকারের পাতা সাজিয়ে ঢেকে দিয়ে তাতে মাটি চাপা দিল। গর্তের উপরের এই মাটিকেও তারা সমান ও পরিপাটি করে রাখল। সবশেষে তারা সেই গর্তের চারদিকে দাঁড়িয়ে এক সাথে প্রার্থনা করল। এই গোটা বিষয়টি আমাদের লোকেরা বিস্ময়ের সাথে দেখল এবং খুবই ভাল লাগল তাদের এই লাশের সৎকার করা, বিশেষ করে আমাদের সরদার পো মিরি ও আমাদের তান্ত্রিক রানুই খুবই মুগ্ধ হলো মৃতের প্রতি সম্মান, যত্ন, তাকে ঘিরে প্রার্থনা ও লাশ রাখার পদ্ধতি দেখে। আমাদের সর্দার আমাদের তান্ত্রিক ও লোকদের বলল, আমাদের মৃত সর্দারকে আমরা এভাবে রাখতে পারি। এতে সুবিধা হবে আমার মৃত পিতা কোথায় আছেন তা আমি দেখতে পাবো, তার সাথে কথা বলতে পারবো। তান্ত্রিক ও আমাদের লোকেরা এতে খুব খুশি হলো। তান্ত্রিক বলল, পাহাড়ে রেখে লাশ পশু-পাখির পেটে দেয়া কিংবা লাশ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে হারিয়ে ফেলার চাইতে এটা অনেক ভাল। এসব দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আমাদের সর্দারের লাশ ফুল-পাতা দিয়ে ঢেকে না রেখে আগন্তুকদের লাশ যেভাবে জাহাজ থেকে নামিয়ে আদবের সাথে সৎকার করা হলো, সর্দারের লাশ সেভাবেই সৎকার করা হবে। আগন্তুকরাও এভাবে সৎকারের কথা বলল। আগন্তুকরা আনন্দের সাথে রাজি হলো এবং কাজে লেগে গেল। তারা খুব যত্ন ও সম্মানের সাথে মৃত সর্দারকে গোসল করিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে, কাপড়ে মুড়ে আমাদের লোকজনদের সাথে নিয়ে আয়তাকার সেই গর্তে সুন্দর করে রাখল। সবশেষে গর্তের উপর পাটি সাজানোর কাজ সম্পন্ন করার পর আমাদের লোকদের সাথে নিয়ে মৃতের মঙ্গলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল। এমন সুন্দর ও নতুন ব্যবস্থায় আমাদের সর্দার পো মিরি ভীষণ খুশি এবং আমাদের লোকেরাও। এসব কাজে দুপুর হয়ে গেল। সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিমে একটু হেলে পড়েছে। আগন্তুকদের একজন এসে আমাদের সর্দারকে বুঝালো, তাদের প্রার্থনার সময় হয়েছে, তারা তাদের প্রার্থনার অনুমতি চায়। সর্দার সোৎসাহে অনুমতি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কার কাছে তারা প্রার্থনা করবে? অনুমতি নিতে আসা সেই লোক বলল, এই বিশ্ব-জাহান যিনি সৃস্টি করেছেন, যিনি এই বিশ্ব-জাহানসহ আমাদের সকলকে পালন করেন তার কাছে আমরা প্রার্থনা করব।আমাদের সর্দার খুশি হয়ে বলল, খুব ভাল। আমরাও পার্থনা করি ঈশ্বর হিনার। আপনাদের প্রার্থনা দেখি। আগন্তুকদের কয়েকজন পাহাড়ের ঝর্না থেকে পানি এনেছে। দেখা গেল সেই পানি দিয়ে তারা সকলে একই নিয়মে মুখ, হাত, পা ধুয়ে নিল। একজন একটু উঁচুতে দাঁড়িয়ে দুই কানে দুই হাত চাপা দিয়ে উচ্চ স্বরে কয়েকটি বাক্য উচ্চারণ করল। তারপর তারা সকলেই ভিন্ন ভিন্নভাবে দাঁড়িয়ে, কোমর বাকিয়ে হাঁটুর উপর হাত রেখে মাটির উপর মাথা রেখে প্রার্থনা করল। পরে তাদের প্রবীণ একজনকে সামনে রেখে তারা সকলে পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে ব্যক্তিগতভাবে যা যা করেছিল সামস্টিকভাবেও তাই করল। সামনে দাঁড়ানো প্রবীণ ব্যক্তিটি যা করছে, সকলে তাই করছে অদ্ভুত শৃঙ্খলার সাথে! তাদের প্রার্থনা শেষ হলে সর্দার ও তান্ত্রিক তাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের প্রার্থনা দেখলাম, খুব সুন্দর। কিন্তু শুরুতে একজন কানে হাত দিয়ে উচ্চ স্বরে কি বলল, কেন বলল বুঝলাম না। আগন্তুকদের একজন বুঝিয়ে বলল, ওটা প্রার্থনার জন্যে সকলকে আহ্বান। নিয়ম হলো, সকলকে প্রার্থনার জন্যে ডেকে এক সঙ্গে প্রার্থনা করতে হয়। সর্দার ও তান্ত্রিক উভয়েই বলল, সুন্দর নিয়ম। সকলের অংশগ্রহনে সংঘবদ্ধভাবে এমন প্রার্থনার প্রদ্ধতি আমাদের নেই। আমরাও তো এভাবে প্রার্থনা করতে পারি! প্রার্থনার নেতৃত্ব দানকারী প্রধান ব্যক্তি বলল, অবশ্যই পারেন। আমাদের সর্দার আবার জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু প্রার্থনার সময় আপনাদেরকে তো অনেক কিছু পড়তে দেখছি! কোন মন্ত্র এগুলো? আমরা তো তা জানি না। প্রধান ব্যক্তিটি বলল, অনেক কিছু পড়তে হয় প্রার্থনায়। আপনারা চাইলে আপনাদেরও শিখিয়ে দেব। কিন্তু সবার আগে একটা বিষয় আপনাদের জানতে হবে। সেটা হলো, এই বিশ্ব-জাহানের একজন স্রষ্টা আছেন। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের যা প্রয়োজন, সবই আমাদের দিয়েছেন। মৃত্যুর পর আমরা তার কাছে ফিরে যাব। সেখানে তিনি আমাদের পুরস্কার দেবেন অথবা শাস্তি দেবেন। দুনিয়ায় আমরা ভাল কাজ করলে সেখানে পুরস্কার পাব মানে সুখের জীবন পাব, যা হবে চিরন্তন, আর দুনিয়ায় খারাপ কাজ করে গেলে সেখানে আমরা শাস্তি মানে অসীম যন্ত্রনা-যাতনার এক জীবন পাব, যাও হবে চিরন্তন। স্রষ্টা আমাদের ভালবাসেন। তিনি চান আমরা দুনিয়ায় ভাল কআজ করে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে পুরস্কার হিসাবে সুখের জীবন পাই। আল্লাহ বা স্রষ্টার এই ইচ্ছা মানুষকে জানাবার জন্যে এবং ভালো কাজের পথ কোনটা এবং মন্দ কাজের পথ কোনটা তা মানুষকে দেখাবার জন্যে কিছু কাল পরপর আল্লাহ বিশেষ লোকদের তার দূত হিসাবে পাঠান। এ ধরনের একজন সর্বশেষ মহান ব্যক্তি এসেছিলেন, তার কাছ থেকেই আমরা আমাদের প্রার্থনার ও জীবনের অন্য সব বিষয় জেনেছি। এই বিশ্বাসকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করলে প্রার্থনার সব বিষয় আপনাদের কাছে সহজ হয়ে যাবে। এই সব কথা বলতে গিয়ে প্রধান আগন্তুকের চোখ-মুখও যেমন উজ্জ্বল উঠেছিল, তেমনি শুনতে শুনতে আমাদের সর্দার ও তান্ত্রিকের চোখ-মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। প্রধান আগন্তুক থামতেই তারা দুজনেই বলে উঠল, আপনি যা বলেছেন সব কথাই ভালো, সব কথাই আমরা বিশ্বাস করি। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আগন্তুক প্রবীণের মুখ। বলল, দিনে পাঁচবার আমরা প্রার্থনা করি। সবই আপনাদের জানাব, শেখাব। দীর্ঘ কথা বলার পর থেমে গেল ফাদার মাহকোহ।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে শুধু শুনছিল তাই নয়, গোগ্রাসে যেন গিলছিল। ফাদার মাহকোহ’র থামাটায় বিরাট এক ছন্দ পতনের মত ধাক্কা খেল আহমদ মুসা। তাই ফাদার মাহকোহ থামার সংগে সংগেই আহমদ মুসা বলল, তারপর কি স্যার?
তারপর কি আমিও জানি না। হাতে লেখা একশত পৃষ্ঠার একটা পুড়ে যাওয়া বইয়ের প্রথম বিশ পৃষ্ঠার কাহিনী আমি বললাম। এর পরের পাতা গুলো পুড়ে গেছে, মাঝের চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মানে এই দশ পৃষ্ঠা আবার অক্ষত পাওয়া গেছে। পরের পৃষ্ঠাগুলো পাওয়া যায়নি। নিশ্চয় পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। বলল ফাদার মাহকোজ।
মাঝের দশ পৃষ্ঠায় কি আছে স্যার? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
বলব, বলছি। বলল ফাদার মাহকোহ।
একটু থামল তারপর নড়ে-চড়ে বসে আর একটু সরাসরি আহমদ মুসাদের মুখোমুখি হলো অধ্যাপক মাহকোহ। মুখ খুলল। বলতে শুরু করল আবার, এই দশ পাতায় তাহিতি এলাকার ও তাহিতর জন-জীবনের কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সারাংশটা এই রকমঃ আগন্তুকরা যে জাহাজ নিয়ে এসেছিল, তাতে লোহার ব্যবহার ছিল মুখ্য। কাঠগুলো ছিল লোহার পেরেকে আটকানো, আবার লোহার পাতে মোড়া। জাহজের রেলিং ও সিঁড়ির কাঠামো ছিল লোহার। আগন্তুকরা লোহার ব্যবহার নিয়ে এল তাহিতি এলাকায়। তীর, বর্শার মতো আত্মরক্ষার অস্ত্র তৈরি, ছুরি-কাটারির মত নিত্য ব্যবিহার্য উপকরণ তৈরি হলো লোহা দিয়ে। তৈজসপত্রের মধ্যে লোহার ব্যবহার ঢুকে গেল। হাঁড়ি, বাটি, কড়াইয়ের মতো জিনিষ তৈরি হলো লোহা দিয়ে। ভীষণ খুশি তাহিতির মানুষ। সবচেয়ে বড় খুশির বিষয় ছিল তাহিতি এলাকায় কৃষ্টির প্রচলন, কাপড়ের ব্যাপক আমদানি ও কাগজের ব্যবহার শুরু হওয়ার বিষয়। আগন্তুকদের সাথে ছিল গম, যব ছাড়াও কয়েক ধরনের সবজির বীজ। উপকূলে সমভূমি ও উপত্যকাগুলোতে আগন্তুকারা নিজেরা জংগল কেটে, ঘাস সরিয়ে চাষের কাজে লেগে গেল, হাতে-কলমে ভুমি চাষ শেখাল তাহিতিবাসিদের। মাটিতে গম-যবের গাছ উঠল, তা থেকে গম, যব প্রভৃতি খাদ্যশস্য মানুষ পেল। উপকূল ও উপত্যকার নরম মাটিতে তৈরি হলো নানা সবজির সমারোহ।বিস্ময়কর পরিবর্তন এল তাহিতি অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে। কাপড়ের সরবরাহ এল, তার সাথে এল পোশাকের নতুন ধরন। নগ্নতা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। মেয়েদের মাথা, গা ও পা পর্যন্ত ঢেকে পোশাক পরার রীতি হয়ে গেল। আর ছেলেরা কমপক্ষে নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢাকা পোশাক পরতে লাগল। আগন্তুকদের নিয়ে আসা কাগজ তাহিতিতে নিয়ে এল লেখাপড়া। আগন্তুকরা সামস্টিক প্রার্থনার জন্যে সবাইকে নিয়ে যে প্রার্থনা গৃহ তৈরি করল, তাতে পড়াশুনার আয়োজন করা হলো সকাল ও সন্ধ্যায়। আগন্তুকরা তাহিতি ভাষা শিখল, আর তাহিতিয়ানদের তারা শেখাল তাদের ধর্মগ্রন্থ পড়ার ভাষা। দুই শিক্ষাই একসাথে প্রার্থনা গৃহে হতো। প্রার্থনা গৃহ ছিল পশ্চিম মুখী। পাতার মাদুর ফেলে মেঝেতে সম্মিলিতভাবে পশ্চিমমুখী হয়ে প্রার্থনা হতো। আগন্তুরাই প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছিল এবং মানুষ তা সানন্দে গ্রহণ করেছিল।তাদের ঈশ্বর হিনা তাদের কাছে আল্লাহ হয়ে গেল অথবা আগন্তুকদের ঈশ্বর আল্লাহ তাহিতিদের কাছে ঈশ্বর হিনা’র রূপ নিয়ে এল। তবে ‘হিনা’র প্রতিকৃতি তৈরি বন্ধ হয়ে গেল। বলা হলো, যিনি অদৃশ্য, নিরাকার তাকে আকার দেওয়া ঠিক নয়। তার আকার দিলে তাঁর সম্পর্কে ধারনা ও বিশ্বাস ধীরে ধীরে বিকৃত ও পরিবর্তিত হতে পারে। তাহিতিয়ানদের জীবনে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এল সেটা সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। আগে ছিল পারিবারিক বা বংশীয় সর্দার বা হেডম্যান হওয়ার সিস্টেম। আগন্তুকরা তৈরি করল বহু বংশ মিলে আঞ্চলিক বা ভুখন্ডগত বা সমাজভিত্তিক পরিচালক বা শাসক হওয়ার সিস্টেম। ঠিক হলো, সবচেয়ে বয়স্ক, জ্ঞান ও চরিত্রে সর্বজনমান্য এমন ব্যক্তিই শাসক বা পরিচালক হবে। তিনি অপারগ হলে প্রবীণরা বসে অন্তত বেশীর ভাগ প্রবীণ একমত হয়ে যোগ্য কাউকে পরিচালক বা শাসক বানাবেন। আবার বেশির ভাগ প্রবীণ তাঁর সাথে একমত না হলে শাসক তাঁর পথ থেকে সরেও যাবে। কিন্তু এই ব্যবস্থা পরবর্তী কালে চলতে পারেনি। স্থিতিশীলতা আনয়ন ও বহুধাবিভক্তি নিরসন করার জন্যে বংশীয় শাসন এসে যায়। এভাবেই আমাদের পামরী রাজবংশ ক্ষমতায় আসে।আমাদের পামরী বংশ শুরু থেকেই আগন্তুকদের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। আগন্তুদের প্রায় সবাই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে পামরীদের আরু এলাকায়। আগন্তুকদের কিছু শিক্ষক হিসাবে, ধর্মনেতা হিসাবে, বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টা হিসাবে গোটা তাহিতি, মুরিয়া ও অন্যান্য দ্বীপে ছড়িয়ে পরেছিল। তারা সেসব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। আগন্তুকদের সাথে পামরীদের ব্যাপক বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল। পামরী রাজবংশের প্রথম রাজা আরি আবদালাহ আরিন্যু ছিল আগন্তুকদের প্রথম জাহাজের নেতা ও বিজ্ঞ আধ্যাত্মিক পুরুষ। আবদালাহ বানজাদ’র মেয়ের ঘরের প্রিয় নাতি। আগন্তুকরাই তাহিতির প্রথম আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝেই জাহাজ এসে নোঙর করত আমাদের আরুতে। জাহাজ থেকে বিভিন্ন পন্য নামত, তাহিতির কিছু ফলমূলও তারা নিয়ে যেত। বুঝা যেত তারা আগন্তুকদের পরিচিত বা তাদের সমজেরই কেউ। জাহাজে আসা কেউ কেউ থেকে যেত, আবার তাহিতি থেকেও কেউ কেউ চলে যেত। আমাদের আগন্তুকরা ও জাহাজের লোকরা ছিল একই ধর্মের।প্রার্থনার সময় জাহাজ থেকেও প্রার্থনার আহবান আসত। শোনা যেত জাহাজগুলো আসছে সুমাত্রা, জাম্বোয়াংগ, ফিজি হয়ে, আবার চলে যেত কোনটি পেরু, কোনটি মেক্সিকো, গোয়াতেমালা, পানামার দিকে। এসব দেশসহ বিভিন্ন দেশের কাহিনীও শোনা যেত আমাদের আগন্তুকসহ তাদের কাছে। এভাবে তাহিতিয়ানরা প্রথম জানল পৃথিবীতে বহু উন্নত মানুষ, উন্নত দেশ আছে, রাজ্য আছে, রাজা আছে। তাহিতির সাথে এসব দেশের লেনদেনও শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাহিতির কি দরকার, কি চাই, জানাতে হতো, পরের জাহাজে সেসব পাওয়া যেত। বলা যায়, এভাবে সব দিক থেকে এক সময়ের অন্ধকার তাহিতি আলোময় হয়ে উঠেছিল।
থামল ফাদার মাহকোহ। থেকেই আবার বলে উঠল, অবশিষ্ট দশ পৃষ্ঠার সারাংশ মোটামুটি এটাই।
স্যার, আপনার সংগ্রহে তো আরও কাহিনী আছে! সে সবে নতুন কিছু নিশ্চয় আছে? আহমদ মুসা বলল।
প্রথমে আমি আমার বংশীয় কাহিনী ১০০ পাতার গ্রন্থগুলো শোনানোর চেষ্টা করেছি। কাঠামোগত একটা গ্যাপ পূরণ হয়েছে। কিন্তু কাহিনীর গ্যাপ রয়েই গেছে। সুতরাং এ থেকে তোমার কোন লাভ হবে না। অধ্যাপক মাহকোহ বলল।
অন্য আরও বংশের তো কাহিনী আছে! সে সবও কি আপনি সংগ্রহ করছেন? বলল আহমদ মুসা।
সে সবের অনেক আমি সংগ্রহ করেছি। সেগুলো সবই শ্রুতি ও স্মৃতি থেকে। লিখিত কাহিনীর পরবর্তী পর্যায় এগুলো। পরিবর্তন ও বিকৃতির অনেক হাওয়া বয়ে গেছে এ সবের দিয়ে। তুমি যার সন্ধান করছ তা তুমি পাবে না ওসব থেকে। ফাদার মাহকোহ বলল।
তাহলে তাহিতির ইতিহাস এভাবে হারিয়ে গেল? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
শুধু তাহিতি নয়, গোটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইতিহাসও এভাবে হারিয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে, ইতিহাসের শুরু হয়েছে ইউরিপীয়দের আগমনের আশপাশ থেকে। আমি জানি না, কিভাবে এই ইতিহাসের উদ্ধার সম্ভব এবং কারা এই দায়িত্ব নেবে। বলল ফাদার মাহকোহ একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে।
ইতিহাস কি এভাবে সবটাই মুছে ফেলা যায়? আহমদ মুসা বলল।
এখন যায় না, কিন্তু তখন যেত। তখন এখানকার মত নানাজনে নানাভাবে ইতিহাস লিখত না। ইতিহাসের লিখিত রূপও ছিল না, ইতিহাস থাকতো স্মৃতিতে। পরে ইতিহাস লেখা শুরু হলেও তা ছিল সীমিত। তাহিতি অঞ্চলের দুর্ভাগ্য হল, লিখিত হবার পর তাহিতি অঞ্চলের ইতিহাস নষ্ট হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে লিখিত ইতিহাসগুলো ছিনিয়ে এনে একসাথে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে পরবর্তীকালে নিরপেক্ষ লোকদের গবেষণা ও অনুসন্ধানে অন্ধকার অতীত মাঝে মাঝে কিছুটা ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। যেমন বৃটিশ সমুদ্রচারী ক্যাপ্টেন কুক যিনি তাহিতি এসেছিলেন ১৭৬৯ সালে। তাঁর সহঅভিযাত্রী বিতানী জোসেফ ব্যাংকস বলেছেন পলিনেশীয় ভাষায় উৎপত্তি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া থেকে। তিনি বিভিন্ন তাহিতিয়ান শব্দের উৎস খোঁজ করতে গিয়ে বিলেছেন, তাহিতিয়ান এ ভাষার শেকড় শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, আরও পশ্চিমে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ক্যাপ্টেন কুক ‘তুপাইয়া’ নামে এক তাহিতিয়ান নাবিকের কথা বলেছিলেন। এই নাবিকের সাথে আলোচনা করে তিনি দেখেন এই নাবিক উত্তর-পূর্বে মারকুইজ দ্বীপপুঞ্জ, পুবে তুয়ামতু অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিনে অস্ট্রালী দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত জানে কিন্তু পশ্চিম দিকে তার জ্ঞান দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ান গোত্রভূক্ত প্রমানিত হয়েছে। এভাবে তাহিতিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সবই দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া ও আরও পশ্চিমের সাথে যুক্ত। জনসংখ্যার বিস্তার যেমন ঐদিক থেকে এসেছে, তেমনি ভাষা, সংস্কৃতি সব ঐদিক থেকেই এসেছে। আর অষ্টক শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম আরব বনিক, নাবিক ও মিশনারীরাই আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের মত প্রশান্ত মহাসাগরও চষে ফিরেছে। তারাই তাহিতির মত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপমালার ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের জনক। সমুদ্র, সমুদ্রপথ ও দিক নির্ণয় সম্পর্কে তাহিতিয়ান নাবিকদের যে বিস্ময়কর জ্ঞান ছিল, তা মুসলিম সভ্যতার সমুদ্রচারী আরব নাবিকদের কাছ থেকেই পাওয়া। কিন্তু সে ইতিহাস মুছে গেছে। একজন ইউরোপীয় বিজ্ঞানী বলেছেন, যেদিন নাবিক তুপাইয়াদের সমুদ্রজ্ঞানের উৎস সম্পর্কে জানা যাবে, সেদিনই পরিস্কার হবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের ইতিহাস। এই ইতিহাসের সন্ধান যদি আমরা চাই, তাহলে আমাদের যেতে হবে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে, এভাবে আমাদের যেতে হবে এশিয়ার অভ্যন্তর পর্যন্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই কথা বলা হয়েছিল নাবিক তুপাইয়াদের কথার আলোকে। সেই সময়ের অবস্থা এখন নেই। অনেক ঝড় বয়ে গেছে তারপর। সে ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে সে সময় পর্যন্ত ইতিহাসের সব উপকরণ। ফাদার মাহকোহ দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামল।
কথা শেষ করে ফাদার মাহকোহ তার হাঁটু মুড়ে বসা অবস্থাটা একটু শিতিল করল। হিপটা মেঝের উপর রেখে দু’পা একটু সরিয়ে নল।
গভীর একটা আনন্দের ছায়া আহমদ মুসার চোখে-মুখে। সব মনোযোগ ঢেলে দিয়ে যেন শুনছিল আহমদ মুসা ফাদার মাহকোহ’র কথাগুলো। তার পেছনে বসা মারেভা ও মাহিন এবং পাশে একটু তফাতে বসা মারেভা ও মাহিনের মা। তাদের সবার চোখে দুনিয়ার বিস্ময় ! এসব কোন কথাই তাহিতির কোন ইতিহাস গ্রন্থে লেখা নেই।
ফাদার মাহকোহ থামলে আহমদ মুসা বলল, স্যার, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। তবু স্যার বলছি, আমার প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব মেলেনি।
তোমার প্রশ্নের জবাবের জন্যেই তো এত কথা বললাম। এর মধ্যে তোমার প্রশ্নের জবাব এসে গেছে। তাহিতিতে প্রথম জাহাজ ও পরবর্তী জাহাজগুলো মুসলমানদের। এই মুসলমানদের অনেকেই তাহিতিতে বসতি স্থাপন করে এবং তারাই অন্ধকার তাহিতিকে আলোতে নিয়ে আসে। তারাই নতুন তাহিতির নির্মাতা। তাহিতির পমেরী রাজবংশের প্রথম রাজা আরি আবাদাল্লাহ আরিন্যু’র মায়ের বংশ ও পিতার বংশ তাহিতিয়ান। তার নাম অপভ্রংশ হিসাবে আমাদের কাছে এসেছে। তার নামের আসল উচ্চারণ আর আব্দুল্লাহ আরিন্যু। তাহিতিয়ান ‘আরি’ মুলত আরবি শব্দ। অর্থ পরিচালক, তত্ত্বাবদায়ক, প্রিন্স, সর্দার ইত্যাদি। আরিন্যু তাহিতিয়ান শব্দের অর্থ সমুদ্র তরঙ্গ। আর সমুদ্র তরঙ্গ মানে সাগর-তরঙ্গ অর্থাৎ সর্দার আব্দুল্লাহ। প্রথম রাজার নামের সাথে ‘আরবি’ শব্দ থাকলে সেই বংশের একজন প্রিন্সের নামের সাথে ‘হাসানা’ বা ‘হেসানা’ শব্দ থাকবে না কেন এবং কেন রূপকথার নায়িকা ভাইমিতির সাথে ‘শাবানু’ অর্থাৎ ‘শাহবানু’ থাকবে না ? বলল ফাদার মাহকহ।
তাহলে রাজা, রাজপুত্ররা কি মুসলমান ছিলেন? জিজ্ঞাসা মারেভা মাইমিতির। তার চোখে-মুখে ঠিকরে পড়া বিস্ময়।
আমি জানি না। এর কোন দলিল পাইনি। যা পেয়েছি তা বললাম। তোমরা তরুণ-তরুণীরা এটা অনুসন্ধান করতে পার। তবে এই যে প্রার্থনাগৃহে আমরা প্রার্থনা করি, এটাও তো মুসলমানদের মসজিদের মতই। যেটুকু পার্থক্য রয়েছে, সেটা সময়ের ব্যবধানে সৃষ্টি হয়েছে বলা যায়। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে রাজধানী আরুর আংশিক ধ্বংসের সাথে এই প্রার্থনা ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।তারপর এটা আবার পুননির্মিত হয় বেশ পরে। নতুন নির্মানের সময় আগের অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সেটাই স্বাভাবিক। দেখ, আমার নামটাও বিদঘুটে। আমার নামের মাহকোহ, মিনালী, মিনারী এই তিন শব্দই আরবি শব্দের অপভ্রংশ। এর অর্থ আমার জানা নেই। আমার পিতার সময়েরও অনেক আগে এই আরবি শব্দগুলো বিকৃত হয়ে গেছে, কিন্তু বিকৃত হলেও আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে আমাদের পরিবার কর্তৃক তা অনুসৃত হয়ে এসেছে। এই দেখ,আমাদের প্রার্থনাকক্ষের সামনের দেয়ালে অর্ধ চন্দ্র আঁকা। একে তাহিতিয়ানদের একজন ঈশ্বর ‘হিনা’র সিম্বল বলে মনে করা হয়। আসলে এটাও বিকৃতি। আসলে এই চাঁদ মুসলমানদের বিখ্যাত অর্ধ চন্দ্র (cresent)। মুসলমানদের মসজিদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে এই অর্ধচন্দ্রের ব্যবহার হতো। আমাদের প্রার্থনা ঘরের অর্ধচন্দ্র আমি গভিরভাবে দেখেছি। আমি নিশ্চিত এটা মুসলমানদের অর্ধ চন্দ্রই। বলল ফাদার মাহকোহ।
তার, মানে স্যার, মূলত এই প্রার্থনাগৃহ মুসলিম প্রার্থনাগৃহ মানে মসজিদই ছিল। আহমদ মুসা বলল।
আমার তাই মনে হয়। বলল ফাদার মাহকোহ।
তাহলে স্যার, এসব জানার পরেও আপনি কেন এই প্রার্থনা গৃহকে তার মূল পরিচয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন না, কেন এই ঘরের প্রার্থনা মুসলমানদের নামাজ হয়ে উঠছে না? আহমদ মুসা বলল।
এসব যেমন রূপান্তরিত হয়েছে, ইতিহাস যেমন রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনি মানুষও রূপান্তরিত হয়েছে। আমিও এই রূপান্তরের ফসল। আমার জানা এবং আমি এক নই। এক হতে চাইলেও আমি পারবো না। পরিবর্তনের স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নেবে। স্রোতের টান উপেক্ষা করে মাটিতে শিকড় গাড়ার সাধ্য আমার নেই। বলল ফাদার মাহকোহ।
ঠিক স্যার, প্রয়োজন স্রোতের গতি পাল্টায়। মারেভা মাইমিতি বলল।
হ্যাঁ, প্রয়োজন স্রোতের গতি পাল্টায়। এটা আমার কাজ নয়, মারেভা-মাহিন এ কাজ তোমাদের। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার, মারেভা-মাহিনরা এটা পারবে ইনশাআল্লাহ ! আর একবার মূল আলোচনায় আসতে চাই স্যার। তাহিতির ইতিহাসের রূপান্তর, মানুষের রূপান্তর ও এই প্রার্থনা গৃহের রূপান্তরের মত রাজপুত্র হেসানা হোসানা ও ভাইমিতি শাবানুদের কাহিনীর রূপান্তর কতটুকু ? বলল আহমদ মুসা।
এটা বলা মুস্কিল। তবে আমি মনে করি কাহিনীতে ঈশ্বরী হিসাবে ‘হিনা’র ভুমিকা বাদ দিলে কাহিনীর যা থাকে, তার তার প্রায় সবটুকুই সত্য। কিন্তু কেন এ বিষয়টা জিজ্ঞেস করছ? ফাদার মাহকোহ বলল।
এ কাহিনী সত্য হলে অ্যাটলের কাহিনীও সত্য হবে। আমি সেই অ্যাটলকেই খুঁজছি। স্যার, আপনি কাহিনী থেকে ঈশ্বরী ‘হিনা’র ভুমিকা মাইনাস করছেন। কিন্তু তাহলে অ্যাটলের অভ্যন্তরে রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানু গেলেন কিভাবে? বলল আহমদ মুসা।
এক কথায় এর উত্তর দেয়া যাবে না। প্রশান্ত মহাসাগর নিয়ে কাহিনী চালু আছে। সবটুকুই ‘মিথ’ বলা হয়। যেমন বিজ্ঞানের মাথায় যা ধরে না, তাকেই বিজ্ঞান অবিশ্বাস করে বসে। এটা ঠিক নয়। বিজ্ঞানের বস্তুজগতের বাইরে যে অদৃশ্য জগত সক্রিয় আছে তা বস্তুজগতের চেয়ে অনেক অনেক বড়। তেমনি আটলান্টিক সম্পর্কিত সব কাহিনীকে ‘মিথ’ বা কল্পকথা বলে অস্বীকার করা যাবে না। প্রশান্ত মহাসাগরের নিমজ্জিত মহাদেশ ‘মু’ এর কথাই ধরা যাক। প্রশান্ত মহাসাগরে একটা মহাদেশ ছিল, প্রাকৃতিক কারণে তা নিমজ্জিত হয়ে গেছে, একে ‘মিথ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। আমি এই উড়িয়ে দেয়াকে সমর্থন করি না । কাহিনীর সবটুকু সত্য কিনা আমি বলতে পারবো না। কিন্তু সত্য অবশ্যই আছে। প্রশান্ত মহাসাগরের সাগর তলের ভূ-গঠন এটাই প্রমাণ করে। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-দক্ষিণ মাঝামাঝি বরাবর পশ্চিম অংশের ভু-গঠন ও এর পুর্বাংশের ভু-গঠন একেবারেই আলাদা। পূর্বাংশের মধ্যে আবার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ গভীর খাঁদের মত। এর মাথায় অ্যাটল অধ্যুষিত পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ। প্রশান্ত মহাসাগরেরে এই অংশে একটা কিছু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছিল। পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে সেই বিপর্যয়ের একটা কিছু ধ্বংসাবশেষ থাকা বিচিত্র নয়! হতে পারে সমুদ্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ সমুদ্রচারী রাজপুত্র হেসানা হোসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর নিমজ্জিত এমন শেল্টার ও তার প্রবেশ পথ সম্পর্কে কোনওভাবে জানতেন। দুই প্রেমিক সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সম্ভবত। বলল ফাদার মাহকোহ।
ধন্যবাদ স্যার, আমি এমন একটি সম্ভাবনা সম্পর্কেই জানতে চাচ্ছিলাম। স্যার, আমিও মনে করি রাজপুত্রের এ বিষয়টা কোন কল্পকথা নয়, বাস্তবতা আছে এর মধ্যে। ধন্যবাদ স্যার।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা তাকাল মাহিন মারেভার দিকে। বলল, আমরা স্যারকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। এবার বোধহয় আমরা উঠতে পারি।
মারেভারা কিছু বলার আগেই ফাদার মাহকোহ বলল, আর একটু কষ্ট আমাদের দিয়ে যেতে হবে। প্রার্থনা গৃহে যারা আসেন দুপুরের আগ পর্যন্ত তাদের নিয়ে আমরা দুপুরে এক সাথে খাই। অতএব, আরও কিছু কষ্ট না দিয়ে যেতে পারছেন না। ফাদার মাহকোহ’র মুখে স্পষ্ট হাসি।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল ফাদার মাহকোহ। বলল, ইতিহাস তো কিছু শুনলে, চল এবার ভাঙ্গা রাজধানী ‘আরু’টা একবার দেখ। ইতিহাস এখানে তোমাদের সাথে কথা বলবে। আহমদ মুসারাও উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল মারেভা-মহিনের মায়েরা ও।
মারেভার মা আহমদ মুসাকে বলল, চল বেটা, ভাঙ্গা রাজধানী দেখার সময় আমাদের বাড়িও দেখতে পাবে। আমাদের ও মাহিনদের বাড়ি এক রাস্তাতেই, মাত্র রাস্তার এপার-ওপার।
ধন্যবাদ মা। খুব খুশি হবো দেখলে। কেউ থাকেন না এখানে আপনাদের? আহমদ মুসা বলল।
না, তোমাদের ফাদার মাহকোহ আমাদের চাচাজী। তিনিই আমাদের অভিভাবক। তার লোকরাই সব দেখাশুনা করে। আচ্ছা চল, উনি বেরিয়ে গেছেন। বলল মাহিনের মা।আহমদ মুসা ওদের সঙ্গে চলতে শুরু করে মারেভা ও মাহিনের মাকে লক্ষ্য করে বলল, মা, আমি মারেভা ও মাহিনের সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলতে চাই।
এখনি? বলল মাহিনের মা।
এখনি নয়, তবে বিষয়টা জরুরী। বলল আহমদ মুসা।
জরুরী? কেমন বিষয় বেটা, খারাপ কিছু নয় তো ? বলল মারেভার মা। কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে।
খারাপ নয়, সেটা শুভ একটা বিষয়। বলল আহমদ মুসা।
মারেভা ও মাহিন দু’জনেই পরস্পরের দিকে তাকাল, তারপর তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাদের মুখ কিছুটা রাঙা হয়ে উঠেছে। ‘শুভ কাজ’ বলতে তাদের স্যার কি বুঝিয়েছেন, সেটা তারা দু’জনেই বুঝতে পেরেছে। ইদানিং মাঝে মাঝেই তাদের স্যার বলছেন, তোমরা একসাথে যেভাবে চলাচল করছ তা ঠিক নয়, বিশেষ করে আমাদের সাথে থাকতে হলে তোমরা বিচ্ছিন্ন থাকলে চলবে না। তাদের স্যার যথাসম্ভব শীঘ্র তাদের বিয়ের পক্ষপাতি। কিন্তু মারেভাও মাহিন সলজ্জভাবে সযতনে বিষয়টাকে এড়িয়ে গেছে। এবার সেই বিষয়টা তাদের স্যার তাদের মায়ের কাছে পাড়তে যাচ্ছে। তবে ‘এখনি নয়’ বলে বিষয়টাকে আপাততঃ চাপা দেয়ায় তারা লজ্জার হাত থেকে বাঁচল, স্বস্তি পেল।
তারা সবাই বেরিয়ে এল প্রার্থনা গৃহ থেকে। সকলে হাঁটছে ফাদার মাহকোহ’র পেছনে পেছনে।
২
শর্ট রেঞ্জ অপশনে সুপার মাল্টি সাউন্ড মনিটর অবিরাম বিপ বিপ করেই চলেছে।
চার সিংহ মুর্তির উপর সেট করা রাজসিক ডিভানের উপর রাজশয্যায় শুয়ে ছিল আলেক্সি গ্যারিন। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সর্বময় কর্তা এই আলেক্সি গ্যারিন।
ঠিক শুয়ে থাকা নয়, বালিশে ঠেস দিয়ে পার্সোনাল পিসি হাতে নিয়ে কিছু করছিল। এর মধ্যেই তন্দ্রার শিকার হয়ে তার দেহটা বালিশের উপর নেতিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
বিপ বিপ শব্দটা করেই চলেছে মোবাইলে সাইজের মাল্টি সাউন্ড মনিটরটা।
হঠাৎ ঘুমন্ত আলেক্সি গ্যারিনের হাতঘড়ি ক্ষীণ একটা রেড সিগন্যাল দেয়া শুরু করল। সেই সাথে সাউন্ডলেস ভাইব্রেশন শুরু হল।
এবার চমকে উঠে চোখ খুলল আলেক্সি গ্যারিন।
চোখ খুলেই সে তাকাল হাতঘড়ির দিকে। ঘড়ির স্ক্রীনে লাল অক্ষরে নোটিশ ‘অ্যালাইন ভয়েস মনিটোরড’।
শোয়া থেকে ধড়মড় করে উঠে বসল এলাক্সি গ্যারিন। তার চোখ গিয়ে ফিক্সট হলো সুপার মনিটরের উপর। মনিটরের বিপ বিপ সাউন্ড বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু লাল নোটিশ মনিটরের স্ক্রীনে এখনও আছে।
তাড়াতাড়ি মনিটরটা তুলে নিয়ে আলেক্সি গ্যারিন ভিউ বাটনে চাপ দিল। মনিটরের স্ক্রিন থেকে লালা নোটিশ সরে গিয়ে সেখানে একটা রেড লেটার মেসেজ ভেসে উঠলঃ SOS-save our soul. We are seventy six….. (এসওএস, আমাদের বাঁচান। আমরা ছিয়াত্তর)…’ মেসেজটি অসম্পূর্ণভাবে ক্লোজ হয়ে গেল। সেই সাথে ধাতব কিছু আছড়ে পড়ার শব্দ হলো।
স্প্রিং-এর মত ডিভান থেকে লাফ দিয়ে নামল আলেক্সি গ্যারিন। তার মনের ভেতরটায় তখন তোলপাড়। আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার (COP) থেকে কেউ মেসেজ পাঠাচ্ছে! তার মনের এই তোলপাড়ের ছাপ মুখেও এসে পড়েছে। তার মুখের পেশীগুলো লোহার মত শক্ত হয়ে উঠেছে। দু’চোখে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।
আলেক্সি গ্যারিন লোকটি দেখতেও ইস্পাতের এক রোবটের মত। প্রায় ছয় ফুটের একটা স্লিম বড়ি তার। শক্তির প্রাচুর্য আর ফিটনেসের দীপ্তি যেন ঠিকরে পড়ছে তার দেহ থেকে।
আলেক্সি গ্যারিন মেঝের উপর লাফিয়ে পড়ে কোন কিছু করার আগেই হাতঘড়ি আবার নিরব শব্দে ভাইব্রেট করতে শুরু করল।
ঘড়ির স্ক্রীনের দিকে একবার তাকিয়েই বলে উঠল, হ্যাঁ গোরী, কি ঘটেছে? আলেক্সি গ্যারিনের কণ্ঠ দ্রুত ও কঠোর।
ঘড়ি থেকে কণ্ঠ ভেসে এল, মাই লর্ড, আমাদের রোবট-৩৯ তার প্রাকৃতিক চরিত্রের অন্যথা করে বাইরে থেকে এসওএস পাঠাচ্ছিল। তাকে ধরেছি। নির্দেশ বুলুন মাই লর্ড।
তুমি থাক ওখানে আমি আসছি। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
কথা শেষ করেই আলেক্সি গ্যারিন দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল। দরজার কাছাকাছি হতেই দরজা আপনাতেই খুলে গেল।
দরজা পার হয়ে করিডোরে পা রেখে একটু ঘুরল। দরজার দেয়ালে একটা ডিজিটাল কি বোর্ডে তিন ও নয় বাটন চাপল।
সংগে সংগে করিডোর সচল হয়ে উঠল।
করিডোরের লম্বালম্বি দু’টো অংশ একটা লাল, অন্যটি সবুজ। আলেক্সি গ্যারিন দাঁড়িয়েছিল সবুজ অংশে। সবুজ অংশই চলতে শুরু করেছে।
এ করিডোর সে করিডোর ঘুরে মুভিং এলেভেটরটি মনে হলো দু’তলা পরিমাণ নিচে।
প্রবেশ করল আলেক্সি গ্যারিন ৩৯ নাম্বার সেলে।
আলেক্সি গ্যারিন প্রবেশ করতেই সেলের মাঝখানে দাঁড়ানো আলেক্সি গ্যারিনের পার্সোনাল সিকিউরিটি ও পার্সোনাল অপারেশন কমান্ডার গৌরী বাউ করে দু’পা পেছনে সরে গেল। বলল, আসুন মাই লর্ড।
আলেক্সি গ্যারিন দেখল, রোবট-৩৯-এর দু’হাতে হাতকড়া। বসিয়ে রাখা হয়েছে এক চেয়ারে।
রোবট-৩৯ আসলে বিজ্ঞানী কুতাইবা ওয়াং-এর এখানকার সিরিয়াল নাম। সে পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ কণা-বিজ্ঞানী। বাড়ি তার চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে। তিন মাস আগে অপহৃত হয়ে এখানে এসেছে। সে বন্দী জীবনের প্রথম দিন থেকেই মুক্তির চেষ্টা করছে। ওদের বন্দুকের মুখে টিভি ক্যামেরার সামনে ওদের ফরমাইসি গবেষণা করতে হয় ল্যাবরেটরীতে বসে। এই কাজ করার ফাকেঁই প্রতিদিন তিল তিল করে সে মাল্টিওয়েভ ট্রান্সমিটার তৈরী করে। এ ট্রান্সমিটারের ট্রান্সমিশন যে কোন ওয়েভ লেংথে প্রবেশ করতে পারে। ম্যাসেজ প্রেরণের শুরুতেই সে ধরা পড়ে গেছে। সে জানত, এ ধরনের মেসেজ গার্ড দেবার ব্যবস্থা এদের আছে। কিন্তু কুতায়বা ওয়াং বলেছিল মেজেস পাঠানোর পর ধরা পড়লে ক্ষতি নেই। নিজের জীবন দিয়েও যদি ৭৫জন বিজ্ঞানীর অতি মূল্যবান জীবন রক্ষা করা যায়, তাদের প্রতিভার অপব্যবহার থেকে সে প্রতিভাগুলোকে বাঁচানো যায় এবং এদের ষড়যন্ত্র বানচাল করা যায়। তাহলে সেটাই হবে তার জন্যে বেশি আনন্দের। কিন্তু তা সে পারেনি। মেসেজ পাঠানো তার সম্পূর্ণ হয়নি। যেটুকু পাঠিয়েছে, সেটুকু কি কোন কাজে লাগবে?এই চিন্তাই বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। শয়তানদের বড় শযতান আলেক্সি গ্যারিনকে সেলে প্রবেশ করতে দেখে এই চিন্তাই তার মধ্যে আবার তোলপাড় করে উঠল।
আলেক্সি গ্যারিন মোটা গোড়ালির পয়েন্টেড সু পায়ে মাটি কাঁপানো পদক্ষেপে বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুখের চেহারা তার বিস্ফোরণ উন্মুখ। বলল সে বিজ্ঞান কুতায়বা ওয়াংকে লক্ষ্য করে, তোমার সাথে আর কে আছে এই ষড়যন্ত্রে? কথাগুলো তার শান্ত, কিন্তু বুলেটের মত শক্ত।
কুতায়বা ওয়াং কোন জবাব দিল না। আলেক্সি গ্যারিনকে কোন সাহায্য করার কোন প্রশ্নই আসে না।
দাতেঁ দাঁত চাপল যেন আলেক্সি গ্যারিন। তার ডান হাতটা বেরিয়ে এল প্যান্টের পকেট থেকে। তার হাতে ছোট্ট সাদা সর্বাধুনিক ভার্সনের লেজারগান। গানটি টার্গেট করেছে কুতায়বা ওয়াং-এর দুই হাত। পর মুহূর্তেই দেখা গেল, বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর দুই হাত নেই। কবজি থেকে দুই হাত তার উধাও হয়ে গেছে।
যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ার কথা বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর। কিন্তু তার মুখ থেকে একটা শব্দও বেরুল না। চোখ দু’টি তার বিস্ফোরিত। দাঁতে দাঁত চাপার তীব্রতায় মাড়ি ফেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে।
আলেক্সি গ্যারিন ঘুরে দাঁড়াল গৌরীর দিকে। বলল, গৌরী, তুমি ওকে যা করবার কর। তারপর দৃষ্টান্ত হিসাবে একে আমাদের অন্য রোবটদের দেখাও। তারপর আমার কাছে নিয়ে এস। আমি ততক্ষনে ভেতরের বাইরের ভিডিও ফুটেজগুলো নিজে একবার চেক করব।
বলেই আলেক্সি গ্যারিন গট গট করে হেঁটে দরজার দিকে চলল।
গৌরী ‘ইয়েস মাই লর্ড’ বলে একটা বাউ করল।
সেল থেকে বেরিয়ে গেল আলেক্সি গ্যারিন।
গৌরী ঘুরে দাঁড়াল বিজ্ঞানী কুতায়বার দিকে। বলল, ড. ৩৯, তোমাকে আর শাস্তি দেবার দরকার নেই। তোমার দেহের রক্ত যত কমছে, মৃত্যু তোমার তত নিকটবর্তী হচ্ছে। এর চেয়ে বড় শাস্তি তোমার জন্যে আর নেই।
বলেই গৌরী চেয়ারের পেছনে একটা বোতামে চাপ দিল। সংগে সংগে চেয়ারের চার পায়ার তলায় চার চাকা নেমে এল। চেয়ার ইঞ্চি দু’য়েক উপরে উঠল।
গৌরী চেয়ার ঠেলে নিয়ে চলল, সেলগুলোতে তার প্রদর্শনীর জন্যে। সেলগুলো বটমের দু’টি ফ্লোর জুড়ে।
টপ ফ্লোরে ভিআইপি রেসিডেন্টস ও তাদের অফিস। আলেক্সি গ্যারিন ও গৌরীরা যখন ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার (COP) –এ থাকে তখন টপ ফ্লোরেই তাদের আবাস হয়।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কাল্পনিক বা স্বপ্নের রাজধানী হলো এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’। একটা আ্যটলের তলদেশে বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা ক্যাপিটাল অব পাওয়ার।
গৌরী বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর চেয়ার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কাছের সেলটার দিকে। চেয়ারের হাতলের উপর দিয়ে ঝুলে থাকা তার কব্জি পর্যন্ত উড়ে যাওয়া বাহু থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে অবিরাম। কিন্তু কুতায়বার মুখ একেবারেই বাবলেশহীন। যেন আহত হাতটা তার নয়।
কাছের সেলটার একেবারে মুখোমুখি এসে গেছে গৌরী বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াংকে নিয়ে।
সেলগুলো মহাশূন্য ক্যাপসুলের আদলে তৈরি। বাইরের অংশটা ফাইবারিক কাচের তৈরি। বাইরে থেকে ভেতরের সবকিছুই দেখা যায়। ক্যাপসুলের ভেতরে রয়েছে বেড, টয়লেট, লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি। ব্যায়াম করার জন্যে ঝুলন্ত বারসহ রয়েছে নানা উপকরণ।
এই ক্যাপসুল সেলগুলো রয়েছে বৃত্তাকার বিশাল একটা লাউঞ্জের চারদিক ঘিরে। বৃত্তাকার লাইঞ্জের মাঝখানে রয়েছে সেই ফাইবারকি কাচের দীর্ঘ আয়তাকার কক্ষ। তাতে সারিবদ্ধ টেবিল। রোবটের মত লোকরা বসে। সেলগুলোর সাথে অফিসকক্ষের লোকদের ইন্টারকম যোগাযোগ রয়েছে। এই অফিসকক্ষ থেকেই সেলগুলো কাজ-কর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়া পর্যবেক্ষণের জন্যে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সিসি টিভি ক্যামেরা তো রয়েছেই। সেলগুলোর কোন কথা কোন কাজই মনিটর ও পর্যবেক্ষণের বাইরে নয়।
গৌরী বিজ্ঞানী কুতায়বা ওয়াং-এর চেয়ার ঠেলে সেলটির সামনে দাঁড়াতেই সেলে দরজা আপনাতেই খুলে গেল।
রোবট-৪০ মুক্তির স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলা অবস্থা তোমরা দেখ। যে দুই হাত দিয়ে আমাদের আইন ভেঙেছিলে, সেই দু’হাত দেখ নেই। কিছুক্ষণ পর সেও দুনিয়ায় থাকবে না। বলল চিৎকার করে গৌরী।
রোবট-৪০ আরেকজন বিজ্ঞানী। সে ইন্দোনেশিয়ার ‘সী ম্যুনিকেশন সাইনটিস্ট’, নাম ড. সোয়েকার্ন নাসির। সে গৌরীর কথা শুনে চমকে তাকাল ড. কুতায়বা ওয়াং-এর দিকে। তার দু’হাতের দিকে নজর পড়তেই একটা বিষাদের ছায়া খেলে গেল ড. সোয়েকার্ন নাসিরের মুখের উপর দিয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল মুখের বিষাদ ভাব, শক্ত হয়ে উঠল তার মুখ। তাতে ফুটে উঠল কঠিন সিদ্ধান্তের একটা চিহ্ন।
মুখে কিছুই বলল না ড. সোয়েকার্ন নাসির।
গৌরীর কথা শেষ হতেই কথা বলে উঠল ড. কুতায়বা ওয়াং। বলল, প্রিয় ভাই, আপনাকে বলছি, সবাইকে বলব, মুক্তির স্বপ্ন আমাদের সফল হবে। আংশিক হলেও আমি বাইরে মেসেজ পাঠাতে পেরেছি। আমি নিশ্চিত, এই মেসেজ আল্লাহ ঠিক জায়গায় পৌছিয়ে দেবেন। আপনারা এই শয়…।
কথা শেষ করতে পারলো না ড. কুতায়বা ওয়াং। গৌরীর রিভলবারের এক পশলা গুলি ড. কুতায়বা ওয়াং এর মাথা একবারে ছাতু করে দিল। রক্তের স্রোতে পেইন্ট হয়ে গেল ড. কুতায়বা ওয়াং-এর মুখ ও দেহের অর্ধাংশ। অর্ধাংশ উড়ে যাওয়া মাথা বীভৎস রূপ নিয়েছে।
রিভলবার পকেটে রাখতে রাখতে গৌরী বলল ড. সোয়েকার্ন নাসিরকে লক্ষ্য করে, রোবট ফরটি, মেসেজটা সে সবাইকে বলতে চেয়েছিল, বলার ব্যবস্থা করে দিলাম। একদম স্বর্গে গিয়ে বলবে। গৌরীর চোখ-মুখে আগুন।
কষ্টের একটা ভাব ফুটে উঠেছিল ড. সোয়েকার্ন নাসিরের চোখ-মুখে। কিন্তু মুহূর্তেই সে ভাবটা কেটে মুখের সেই শপথ দৃঢ় ভাবটা আবার ফিরে এল। মনে মনে বলল, ড. ওয়াং কি মেসেজ পাঠিয়েছে? কেমন করে সে এই অসাধ্য সাধন করল! মনে মনে স্যালুট দিল সে ড. ওয়াং-এর উদ্দেশ্যে। গৌরী ড. ওয়াং-এর হুইর চেয়ার ঠেলতে শুরু করেই আবার থমকে দাঁড়াল। মুখ ঘুরিযে বলল ড. নাসিরকে রোবট ফরটি, আমাদের বিজ্ঞানী ড. আলেকজান্ডারকে সাথে নিয়ে আমি বিকেলে দিকে তোমার কাছে আসব। সব ঠিক ঠিক রেখ। মনে আছে তো, আ্যন্টিম্যাটার ফুয়েলের আজ ল্যাবরেটরি টেস্ট হবার কথা। টেস্ট টিউব আজ তোমার রেডি রাখার কথা। আজ কিন্তু কোন এক্সকিউজ শোনা হবে না। ইলেকট্রিক চাবুকের কথা মনে আছে নিশ্চয়। তোমার পিঠের আগের ঘাগুলোর উপর ইলেকট্রিক চাবুক কি আরও ভাল ফল দেবে?
বলেই আবার চেয়ার ঠেলতে শুরু করল গৌরী।
একটা সেল থেকে আরেকটা সেলের দূরত্ব আট নয় ফুটের বেশি নয়। এক সেল থেকে অন্য সেলের ভেতরের সব কিছুই দেখা যায়। কিন্তু প্রতিটি সেলই সাউন্ডপ্রুফ। এক একটি সেলে একজন করে বিজ্ঞানী বাস করে এবং সেলের ল্যাবরেটরিতেই তাদের কাজ করানো হয়। আউটডোর পরীক্ষাগুলো বটম ফ্লোরের ওপেন স্পেসে করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় ফ্লোরে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা থাকে এবং তাদের বন্দুকের মুখে কাজ করানো হয সেখানেই। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট কিডন্যাপ করে আনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের দিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে থাকে।
গৌরী একের পর এক সেলে বিজ্ঞানী ওয়াং-এর মুক্তি প্রচেষ্টার পরিণতি দেখিযে চলল। সেকেন্ড ফ্লোরের সব সে কভার করার পর শেষ সেলটা থেকে প্রথম ফ্লোরে নামার মুভিং ইলেভেটারে উঠতে যাচ্ছিল। সেলটির বিজ্ঞানী ও ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের পুতুল হয়ে উঠা ড. স্যামুয়েল মাদারল্যান্ড গৌরীকে লক্ষ করে বলল, ইয়োর হাইনেস ম্যাডাম, একটা কথা বলতে চাই।
বলো রোবট-৬৯। বলল গৌরী।
আমার মনে হয় এই অবস্থায় একজন বিজ্ঞানীকে অন্য বিজ্ঞানীদের দেখানো ঠিক হচ্ছে না। এর দ্বারা তারা ভয় পাবার বদলে ক্ষুব্ধ বেশি হবে। আপনাদের উদ্দেশ্য ওদের থেকে কাজ নেয়া, বিক্ষুব্ধ করা নয়। ড. স্যামুয়েল মাদারল্যান্ড বলল।
থমকে দাঁড়াল গৌরী। বিজ্ঞানী ড. স্যামুয়েলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক মুহুর্ত ভাবল। তারপর মুখে হাসি টেনে বলল, ‘ধন্যবাদ রোবট-৬৯, তোমার পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ।
বলে প্রথম ফ্লোরে নামার জন্যে মুভিং এলিভেটরের দিকে না গিয়ে চেয়ার ঠেলে এগিয়ে চলল টপ ফ্লোরে ওঠার এলিভেটরের দিকে।
উঠে গেল টপ ফ্লোরে।
টপ ফ্লোরে উঠেই বিজ্ঞানী ড: ওয়াং-এর চেয়ার ঠেলে নিয়ে একটা সংকীর্ণ করিডোর হয়ে একটা প্রান্তে চলে গেল। দেয়ালের গায়ে বর্গাকৃতি একটা খাঁজে চেয়ার ঢুকিয়ে হাত উপরে তুলে দেয়ালের সাথে মিশে থাকা একটা টাচ বাটনে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের ভেতর থেকে একটা দরজা এসে খাঁজটা ঢেকে দিল। ভেতর থেকে সূক্ষ্ম যান্ত্রিক একটা শব্দ ভেসে এল এবং একটা পতনের শব্দ।
গুডবাই রোবট-৩৯। বলার সাথে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল গৌরীর মুখে।
দেয়ালের খাঁজটা লাশ ও এ ধরনের বর্জ্য পাতালের সাগর বক্ষে চালান করার একটা ট্র্যাপ।
গৌরী ফিরে এল। গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের কক্ষের সামনে আসতেই অটোমেটিক দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে ভারী কণ্ঠ ধ্বনিত হলো আলেক্সি গ্যারিনের, এস গৌরী। তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।
ইয়েস মাই লর্ড! বলে গৌরী ভেতরে প্রবেশ করল।
পেছনে দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
একটা ডিভানে রাজার মত পা ছড়িয়ে বসে ছিল আলেক্সি গ্যারিন। গৌরী ভেতরে প্রবেশ করলে আলেক্সি গ্যারিন সোজা হয়ে বসল। তার পাশে পড়ে আছে রিমোট কনট্রোল সেট।
গৌরী আস্তে আস্তে গিয়ে আলেক্সি গ্যারিনের একটু পাশে পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।
গৌরী, আমাদের রোবট নাম্বার ৩৯ সাংঘাতিক ছিল। সাংঘাতিক মেধাবী আর কুশলী ছিল। কারও সাথে যোগাযোগ ছাড়াই অভূতপূর্ব কায়দায় অবিশ্বাস্য শক্তির মাল্টিওয়েভ ট্রান্সফরমার বানিয়েছিল। চতুর্দিকে দু’শ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল তার এসওএস। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
সর্বনাশ মাই লর্ড! এই বিশাল অঞ্চলের কোন না কোন জাহাজের মনিটরিং-এ তা ধরা পড়তে পারে। গৌরী বলল।
না, ভাগ্য বলে যদি কিছু থাকে তা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সাথে রয়েছে। পাশের অ্যাটলের ট্রানজিট স্টেশনে আমাদের যে এন্টেনা আছে, তার সার্চ পাওয়ার ঐ মেসেজের বিস্তার-রেঞ্জের চেয়ে অনেক বেশি। সেদিনের সে সময়ের সার্চ রিপোর্টের পুরো রিপোর্ট আমি দেখেছি। ঐ সময় রেডিও এ্যান্টেনাওয়ালা কোন যান্ত্রিক যান এই এলাকায় ছিল না। ইঞ্জিনওয়ালা বোট কিছু ছিল। ছবিতে দেখা গেছে সেগুলো নিছকই ফেরিবোট এবং খুবই ছোট পার্সোনাল। কোন ট্যুরিস্ট বোট কোথাও দেখা যায়নি। তবে ফেরি ধরনের একটা লোকাল বোট আমাদের পাশের তাহানিয়া অ্যাটলের আমাদের ট্রানজিট স্টেশনের একদম পাশে উত্তরে নোঙর করা ছিল। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, নির্দিষ্ট সময়টাতে আমাদের এই ক্যাপিটাল থেকে ট্রান্সমিটিং-এ যে ওয়েভ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তার ম্যাপে দেখা যাচ্ছে ওয়েভের একটা ধারা ঐ বোটের উপর ভেঙে পড়ছে। এর কারণ একাধিক হতে পারে। ঐ বোটে মাল্টিওয়েভ মনিটর থাকা তার মধ্যে একটি। সুতরাং আমাদের আশংকা মাত্র ঐ বোটটি ঘিরে। থামল আলেক্সি গ্যারিন। তার দু’চোখে আগুন!
একটা সাধারণ বোটে ঐ ধরনের মাল্টিওয়েভ মনিটর থাকা স্বাভাবিক নয়। ঐ বোটের আরোহী কারা সেটা কি ছবি থেকে জানা গেছে মাই লর্ড?
আরোহী ছিল দু’জন ছেলে, একজন মেয়ে।
একজন ছেলে ও মেয়েটি পলিনেশীয় অঞ্চলের, অন্যজন বিদেশী। কিন্তু ইউরোপীয় নয়। ওদের ফটো-প্রিন্টও পেয়ে গেছি। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, যে সময়টুকুতে মেসেজ প্রচার হতে পেরেছে, সে সময় তারা তিনজনই বোটের ভেতরে ছিল। মেসেজের শুরুতেই প্রথম ভেতরে ঢুকে বিদেশী লোকটি। তারপর অন্যরাও। বলল অ্যালিক্সি গ্যারিন।
তার মানে মাই লর্ড, আপনি কি মনে করেন ওরা মেসেজের কোন সিগন্যাল পেয়েই ভেতর ঢুকেছে মেসেজ রিসিভ করার জন্যে? গৌরী বলল। উদ্বেগ তার চোখে-মুখে।
সেটাই ঘটেছে এটা বলার মত কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু শতভাগ সন্দেহ যে, সেটাই ঘটেছে।
বলে মুহুর্তকাল থেমে আলেক্সি গ্যারিন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল গৌরী, ফাইল রেডি। ফাইলে পাবে বোটের ছবি, বোটের নাম্বারও পাবে বোটে। তিনজন ছেলেমেয়ের ছবি রয়েছে ফাইলে। কাজ শুরু কর। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে চাই ঐ বিদেশীকে আমাদের হাতে। তাকে জীবিত পেতে হবে। প্রথমে দেশী দু’জনকে খুঁজে পেলে পরবর্তী কাজ সহজ হয়ে যাবে।
কথা শেষ করেই আলেক্সি গ্যারিন বলল, কাজ শুরু করার আগে গৌরী কিছু রেস্ট নাও। বলে আলেক্সি দু’ধাপ এগিয়ে বেডে উঠে গেল। গৌরী প্রথমে কিছুটা বিব্রত হলেও পরক্ষনেই তার মুখে রক্তিম হাসি ফুটিয়ে তুলল। সেও বেডে উঠে গেল। সংগে সংগেই বেডটা ঢুকে গেল দেয়ালের মধ্যে।
অদৃশ্য হয়ে গেল বেডটা। দেয়াল ফিরে এল আগের জায়গায়।
গৌরী ও তার কমান্ডোরা গত ২৪ঘণ্টা ধরে ফলো করছিল মাহিন ও মারেভাকে। বোটের মালিকের কাছ থেকে তারা শুনেছিল, যে বিদেশীর জন্যে তারা সেদিন বোট ভাড়া করেছিল, সে বিদেশী যে মাহিন ও মারেভাদের শুধু গাইড নয়, বন্ধুও মনে হয়েছিল। এ থেকেই গৌরী নিশ্চিত হয়েছিল, মাহিন ও মারেভাকে ফলো করলেই সে বিদেশীকে পাওয়া যাবে। মাহিন ও মারেভাকে পাকড়াও করে তাদের কাছ থেকে জানার চেয়ে এটাই নিরাপদ। তাদের পাকড়াও করলে বিদেশী অবশ্যই সেটা জানবে এবং সে আত্মগোপন করতে পারে। মাহিন ও মারেভাকে ফলো করছে গৌরীরা। এই সিদ্ধান্ত থেকেই গৌরীদের সৌভাগ্যবানই বলতে হবে। বোটের নাম্বার ধরে বোটের মালিককে খুজে পাওয়া গৌরীদের জন্যে কঠিন হয়নি। তাহিতি থেকে তাহিতি, মুরিয়া ও তোয়ামতু অ্যাটল আইল্যান্ডে চলাচলকারী সব যান্ত্রিক বোট ও লঞ্চের রেজিস্ট্রেশন করা হয়ে থাকে। এখান থেকেই গৌরীরা বোটটির মালিকের সন্ধান পেয়েছে। আর বোট মালিকের বুকিং রেকর্ড থেকে পেয়েছে মাহিনের ঠিকানা। মাহিনের ঠিকানায় ওৎ পেতে থেকে মাহিনের সাথে মারেভাকেও পেয়েছে। ভিডিও থেকে পাওয়া ছবির সাথে মিলিয়ে তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে গৌরীরা।
গত ২৪ ঘণ্টায় এক মুহুর্তের জন্যে গৌরীরা পিছু ছাড়েনি মাহিন ও মারেভার। দুই গ্রুপকে দু’জনের পেছনে লাগানো হয়েছে। গৌরী দুই গ্রুপের তদারক করছে।
এই ২৪ ঘণ্টায় মাহিন ও মারেভা আলাদা আলাদাভাবে বাজারে গেছে, পর্যটন অফিসে গেছে, একবার একটা হোটেলেও গিয়েছিল। গৌরীরা তাদের ফলো করেছিল। কিন্তু বিদেশী সেই লোকটিকে কোথাও দেখেনি। গৌরী শংকিত হয়ে পড়েছিল বিদেশী লোকটি চলে যায়নি তো কিংবা আলাদাভাবে অন্য কিছু করায় ব্যস্ত নয় তো! তাহলে কি আমরা ভুল করছি? মাহিন ও মারেভাকে ধরে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করাই কি উচিত ছিল?
গৌরী মারেভাদের গেটের অপজিটে রাস্তার ওপাশে একটা গাড়িতে বসে এসব কথা ভাবছিল। তার দু’চোখ এদিক সেদিক ঘুরে বারবার গিয়ে স্থির হচ্ছিল মারেভার সেই গেটে। দূরবীন দিয়ে মারেবার বাড়ির সামনের কিঞ্চিৎ অংশও দেখতে পাচ্ছিল গৌরী।
এক সময় দূরবীনেই ধরা পড়ল মাহিন একটা ট্যাক্সি নিয়ে মারেভাদের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল। অল্প কিছুক্ষণ পর ট্যাক্সি আবার বেরিয়ে এল। এবার ট্যাক্সিতে দু’জন, মাহিন ও মারেভা।
বেরিয়ে তারা পাপেতির মুল শহরের দিকে না গিয়ে পূর্বদিকে চলল। মাহিন-মারেভাদের গাড়ি চলতে শুরু করলে মারেভাদের বাড়ির পাশের পার্কে একটা আড়াল থেকে আরেকটা গাড়ি বেরিয়ে মারেভাদের গাড়ির পিছু নিল।
তখন রাত আটটা। গৌরী তার গাড়িতে বসে সব দেখছিল।
এত রাতে কোথায় বেরুচ্ছে মাহিন ও মারেভা দু’জনে? সেই বিদেশীর কাছে কি? হতেও পারে। গৌরী তার গাড়ি স্টার্ট দিল।
পেছনের মোড় ঘুরে গাড়ি দু’টির পেছনে ছুটে চলল গৌরীর গাড়ি।
গাড়ি পাহাড়ি নদী টাওনার সমান্তরালে উত্তরে এগিয়ে চলেছে। সামনেই সাভাক।
গৌরীর মাথায় চিন্তা, মাহিন-মারেভারা যাচ্ছে কোথায়? টাওনা লেক একেবারেই তো সামনে!
গাড়ি স্লোপিং পথে নিচে নামতে শুরু করেছে।
অনেক দূর থেকে দেখা যায় ‘লা ডায়মন্ড ড্রপ তাহিতি’ নামের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক হোটেলের নিয়ন সাইন।
সাইনবোর্ডটা চোখে পড়তেই গৌরী ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে উঠল। উচ্চ কণ্ঠে বলল, কোন সন্দেহ নেই মাহিন-মারেভারা সেই বিদেশীর কাছেই যাচ্ছে। বড় বড় বিদেশীই এ হোটেলের বাসিন্দা।
মাহিন-মারেভাদের গাড়ি হোটেল লা ডায়মন্ড ড্রপ গাড়ি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। মাহিন ও মারেভা নামলে গাড়ি পার্কিং-এর দিকে চলে গেল।
মাহিন-মারেভারা নামার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনুসরণকারী ব্ল্যাক সান-এর গাড়ি এসে হোটেলটির গাড়ি বারান্দায় দাঁড়াল। তিনজন গাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত হোটেলের ভেতরে চলে গেল। আর একজন গাড়ি পার্কিং-এ রেখে আসার জন্যে ওদিকে গেল।
গৌরী তার গাড়ি পার্কিং-এ দাঁড় করিয়েই মোবাইল করল আগের গাড়ির ব্ল্যাক সান-এর লোকদেরকে। বলল, নাশকা, তোমরা ওদের ফলো করছ তো? ওদের পেছন ছাড়বে না। কোন রুমে ঢোকে কিংবা রেস্টুরেন্টে ঢোকে সেটা দেখ। আমি রিসেপশনে অপেক্ষা করছি। আমাকে জানাবে।
কল অফ করে গৌরী ধীরে-সুস্থে চলল হোটেলের রিসেপশনের দিকে। রিসেপশনে বসার অল্পক্ষণের মধ্যেই কল পেল গৌরী। কল অন করে সাড়া দিতেই ওপার থেকে নাশকার গলা পেল গৌরী। বলল চাপা কণ্ঠে, ম্যাডাম হোটেলের দশ তলার পেছনের দিকে ১০১৫ ডবল ডিল্যাক্স রুমে ওরা প্রবেশ করেছে। গৌরী তাদেরকে নির্দেশ দিল, তোমরা ওদের জন্যে অপেক্ষা কর। কি হচ্ছে জানাবে আমাকে।
মোবাইলটা জ্যাকেটের পকেটে ফেলে উঠে দাঁড়াল গৌরী। চলল বুকিং কাউন্টারের দিকে। মনে মনে বলল, জানতে চাই কক্ষটিতে থাকে ঐ লোকটি কোন দেশের, কি তার নাম।
খাস ইউরোপীয় চেহারার চুম্বকের মত আকর্ষণকারী অসামান্য এক সুন্দরীকে কাউন্টোরের সামনে দাঁড়াতে দেখে ছুটে এল কাউন্টারের যুবক এ্যাটেনড্যান্ট। বলল, ইয়েস, ওয়েলকাম ম্যাডাম। বলুন কি করতে পারি আপনার জন্যে?
নির্বিকার চেহারায় কোন পরিবর্তন এল না গৌরীর। বলল, একটা রুম চাই। ডবল ডিল্যাক্স ১০১৫ রুমটি কি পাওয়া যাবে? কয়েক বছর আগে এসে ঐ রুমেই ছিলাম।
বুকিং কাউন্টারের যুবকটির মুখটি ম্লান হয়ে গেল।
বলল, ম্যাডাম, রুমটি আগে থেকেই বুকড্। আপনি….।
গৌরী তার মধ্যেই বলে উঠল, ঐ কক্ষে কে আছে?
থেমে গিয়েছিল বুকিং কাউন্টারের যুবকটি। তাড়াতাড়ি রেজিস্টার দেখে বলল, বুকিং আছে ‘আবু আব্দুল্লাহ’-এর নামে।
মুসলমান! স্বগত কণ্ঠে বলল গৌরী। ভ্রু দু’টি তার কুঁচকে গেল। বলল সে, কোন দেশের?
সৌদি আরবের নাগরিক। বলল বুকিং কাউন্টারের যুবক।
সৌদি আরবের! ছবিতে তার যে পোষাক দেখেছি তা তো সৌদি আরবের নয়! অবশ্য সৌদিরা বাইরে গেলে ইনফরমাল ক্ষেত্রগুলোতে পশ্চিমা পোষাকই বেশি পরে! আবার স্বগত কণ্ঠ গৌরীর। একটু অস্বস্তি বোধ করল গৌরী। সৌদিদের প্রচুর টাকা। তারা বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেও থাকে প্রচুর। তাহিতিতে তারা আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল লোকটি তো বোটে মাল্টিওয়েভ মনিটর ব্যবহার করেছে। কোথায় পেল এমন বহুমুখী আলট্রা সেনসেটিভ মনিটর! বোটে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। মাহিন ও মারেভার নয়, তাদের পরিচয়, কাজ, তৎপরতা থেকেই তা পরিষ্কার। তাহলে মনিটর তো সেই সৌদি নাগরিকেরই! তীরের মত সেই সন্দেহ ও হিংস্র ক্রোধ এসে তার মনে প্রবেশ করল।
মোবাইল বেজে উঠল গৌরীর।
এক্সকিউজ মি! বলে গৌরী কাউন্টার থেকে অনেকটা সরে গিয়ে বলল, বল নাশকা, কি খবর?
ম্যাডাম ঘর থেকে বেরিয়ে সেই বিদেশীসহ তিনজন লিফটের দিকে যাচ্ছে। আমরা ফলো করছি। নাশকা বলল।
সেই বিদেশী কে? মানে সেই ছবির বিদেশী কিনা? বলল গৌরী।
ইয়েস ম্যাডাম, হুবহু সেই ছবির লোক। নাশকা বলল।
গুড, তোমরা ওদের ফলো করো। আমি নিচে আছি। বলল গৌরী।
গৌরী গিয়ে বসল কাছের এক সোফায়। ভাবতে লাগল, লোকটি কেমন হবে! তারা আলেয়ার পেছনে ছুটছে না তো! টাকাওয়ালা সৌদিদের বিচিত্র রকম শখ আছে। তারা মাল্টিওয়েভ মনিটর শখবশতও কিনে রাখতে পারে।
এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে গৌরী মনে মনে বলল, ঐসব চিন্তার সময় এখন নয়। তাকে ধরতে হবে, বাজিয়ে দেখতে হবে। তারপর অন্য কথা। তবে সৌদি নাগরিক তো বটে! কোন হৈ চৈ হওয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না। নিরাপদ জায়গায় ফাঁদে আটকিয়ে নিরবে কাজ সারতে হবে।
আবার মোবাইল বেজে উঠল গৌরীর। নাশকার কল।
গৌরী বলল, বল নাশকা।
ম্যাডাম, ওরা তিনজন হোটেলের ২১ তলায় এ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। নাশকা বলল।
এ্যাপেক্স রেস্টুরেন্ট? সে তো সাংঘাতিক কস্টলি! এটা তো প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর মত লোকদের বিনোদনের জায়গা। নানা রকম বিনোদন ও অন্যান্য খরচ তারা খাবার দাম থেকেই তুলে নেয়। প্রতিবারের প্রবেশ ফি’ই তো পাঁচশ মার্কিন ডলার! আবার ভাবল গৌরী, অনেক সৌদি নাগরিকের জন্যে টাকা কোন ফ্যাক্টর নয়।
নাশকা তোমরা বাইরেই অপেক্ষা কর। আমি আসছি। বলল গৌরী।
তারা হোটেলের ২১ তলার এ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। পেছন থেকে নাশকা এসে গৌরীর পেছনে দাঁড়াল।
পেছনে না তাকিয়েই গৌরী বলল, নাশকা, তোমরা বাইরে অপেক্ষা কর, আমি ভেতরে ঢুকছি।
বলেই গৌরী গিয়ে রেস্টুরেন্টের গেটে দাঁড়াল।
গেটের রিসেপশন অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে গৌরীর আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ইয়েস ম্যাডাম, ওয়েলকাম।
গৌরী এগিয়ে গিয়ে গেটের পাশের এ্যাডমিশন কি হোলে একটা এক হাজার ডলারের নোট ছেড়ে দিল। সংগে সংগেই বেরিয়ে এল এ্যাডমিশন কার্ড। ভেতরে ঢুকল গৌরী।
বিশাল বহুভূজাকৃতির হলঘর! নরম আলো। নরম মিষ্টি মিউজিক বাজছে।
হলঘরের প্রতিভূজ বা বাহুতে একাধিক বিশ্রাম কক্ষ আছে।
সব মিলিয়ে হল ঘরে স্বপ্নময় একটা পরিবেশ। গানের কথা ও সুর, আলো-আঁধারির রহস্যময়তা, পোষাক-আশাক সবই অভিজাত প্রকৃতির।
গৌরী হলে প্রবেশ করে চারদিকে চোখ বুলাল। এক সময় তার চোখ গিয়ে স্থির হলো নিরিবিলি জায়গার একটা টেবিলে। টেবিলে তিনজন বসে। দু’জন ছেলে ও একজন মেয়ে। সেই বিদেশি, মাহিন ও মারেভা টেবিলটি ঘিরে বসে আছে। ভীষণ খুশি হলো গৌরী। ওরা এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কাউকে সাক্ষী রেখে ওদের গ্রেফতার করা যাবে না। ছোট-বড় কোন ঝামেলাতেই পড়তে চায় না ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট।
মনে মনে একটা ছক দাঁড় করাল গৌরী। একদম নিরাপদ ছকটি। কিন্তু তার জন্যে দরকার রাতের একটা নিরব প্রহর। তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে অনেকটাই। তার আগে ঐ বিদেশীকে ও সবাইকে একবার বাজিয়ে নেয়া যাক। আঁচ করা যাবে বিদেশী সম্পর্কে। এগোলো গৌরী টেবিলের দিকে।
দাঁড়াল টেবিলের শূন্য আসনটির পেছনে। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, আমি শূন্য আসনটায় বসতে পারি। মাফ করবেন, আপনাকে এশিয়ান দেখে কথা বলার লোভে এলাম।
আহমদ মুসা তাকাল গৌরীর দিকে। দীর্ঘাঙ্গী, একহারা অপরূপ সুন্দরী এক ইউরোপীয় যুবতী। তার দেহ থেকে শক্তি ও সুস্থতা যেন ঠিকরে পড়ছে! অত্যন্ত বিরল এ ধরনের সুঠাম দেহ। চোখ দু’টিতে তার হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আছে, তবে চোখ দু’টি তার স্বচ্ছ নয়। দুই বৈপরীত্য যেন এ মুহূর্তে তার মধ্যে সক্রিয়!
আপনি তো ইউরোপীয়, এশীয়দের প্রতি এ পক্ষপাতিত্ব কেন? বলল আহমদ মুসা।
হাসল গৌরী। বলল, এশিয়া হলো ‘মাদার অব আর্থ’। তাকে সত্যি আমি ভালবাসি। ভালবাসি বলে অনেক পড়াশোনা করেছি এশিয়ার উপর। তাই কিছু পক্ষপাতিত্ব হতে পারে।
আহমদ মুসা তাকিয়ে ছিল গৌরীর দিকে। কথাগুলো শুনতে ভালই লাগল। কিন্তু মনে হলো আহমদ মুসার কথাগুলোর গোড়ায় যেন কোন শিকড় নেই!
বলল আহমদ মুসা, প্লিজ বসুন মি….।
মিস গৌরী। আমার নাম গৌরী মি…। গৌরী বলল।
গৌরী’ নামটি শোনার সংগে সংগেই শক পাওয়ার মত বিদ্যুত খেলে গেল আহমদ মুসার গোটা দেহে। তার স্মৃতির আঙিনায় আছড়ে পড়ল একটা নাম ও আরও কিছু কথা। গৌরী তো গ্যালাকটিক সাম্রাজ্যের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার অভিলাষী সন্ত্রাসী শক্তি ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এক সময়ের সর্বোচ্চ শাসক প্রিন্স জিজরের পার্সোনাল সিকউরিটি ও কমান্ডার ছিল! আর এখনকার গোপন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট যেমন ওদের দলের নাম হুবহু নিয়েছে, তেমনি সেই সময়ের নেতা-নেত্রীদের নামও এরা গ্রহণ করেছে। তাহলে এই গৌরী আজকের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কেউ! না, এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা। এশিয়ায়, বিশেষ করে হিমালয় সংলগ্ন উপমহাদেশের হিন্দু সমাজে গৌরী একটা বহুল প্রচলিত নাম। কিন্তু এই গৌরী তো ভারতের নয়, এশিয়ার নয়, হিন্দু সমাজেরও নয়। তাহলে?
প্রশ্নটা ভেতরে রেখেই আহমদ মুসা নিজের নামটা বলল। বলল, আমার নাম আবু আব্দুল্লাহ!
গৌরী ‘আবু আব্দুল্লাহ’ নামটা আগেই শুনেছে বুকিং কাউন্টার থেকে, কিন্তু প্রকাশ করতে চায়নি ধরা পড়ার ভয়ে।
গৌরী হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা হাত না বাড়িয়ে বলল, স্যরি, মিস গৌরী। আমাদের ধর্মে এ ধরনের হ্যান্ডশেক নিষিদ্ধ। প্লিজ বসুন।
গৌরী মারেভা ও মাহিনের সাথে হ্যান্ডশেক করে বসতে বসতে বলল, আপনাদের ধর্ম নিয়ে এটাই সমস্যা মি. আবু আব্দুল্লাহ, আপনারা মেয়েদের ছোট করে দেখেন।
হ্যান্ডশেক না করাটা মেয়েদের ছোট করে দেখার কারণে নয়। মুসলিম মেয়েরাও ছেলেদের সাথে হ্যান্ডশেক করে না, এটা তেমনি ছেলেদের ছোট করে দেখার কারণে নয়। আসলে এর পেছনে রয়েছে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলাজনিত কারণ। বলল আহমদ মুসা।
সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলাজনিত কারণ!
হ্যাঁ, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলাজনিত কারণ।
কি সেটা? ভ্রূ কুঁচকে বলল মিস গৌরী।
বিষয়টা মানুষের মনস্তত্ত্ব ও প্রবণতার সাথে জড়িত মিস গৌরী। অনেক কথা বলতে হয় বিষয়টা পরিষ্কার করতে হলে। সংক্ষেপে কথাটা হলো, স্বামী-স্ত্রী ও ভাই-বোন, মামা-ভাগ্নি’র মত পারিবারিক অতি ঘনিষ্ঠ জন (যাদের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ) ছাড়া অন্য ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা নিষেধ করেছে আমাদের ধর্ম। মেয়েদের নিরাপত্তা ও সমাজকে একটা বড় সমস্যা থেকে মুক্ত রাখার জন্যে। আহমদ মুসা বলল।
কিসের নিরাপত্তা, কেমন নিরাপত্তা? সামাজিক বড় সমস্যাটি কি? বলল গৌরী।
নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। উভয়ে মিলে আসে মানবীয় পূর্ণতা। সেজন্যে দু’জনের মধ্যে রয়েছে একে অপরের প্রতি এক দুর্লংঘ প্রাকৃতিক আকর্ষণ। এই আকর্ষণকে আইন ও শৃঙ্খলার মধ্যে এনে পিতা-মাতা, ছেলে-সন্তানের এক পরিবার সৃষ্টি করা হয়েছে। সুশৃঙ্খল পরিবার সুশৃঙ্খল সমাজের রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। অবাধ মেলামেশা-সৃষ্ট অনাচার পরিবারে বিপর্যয় আনে, শান্তি-শৃঙ্খলায় কুঠারাঘাত করে। পরিবারের এই বিপর্যয় সমাজ শৃঙ্খলা ও শান্তিকেও বিনষ্ট করে। আহমদ মুসা একটু থামল।
আবার শুরু করার আগেই গৌরী দ্রুত বলল, আর নিরাপত্তা বিষয়টা?
অপেক্ষাকৃত সবলের হাত থেকে দুর্বলের নিরাপত্তা। মেয়েরা সাধারণভাবে রক্ষণাত্মক, অন্যদিকে ছেলেরা অ্যাগ্রেসিভ ও আক্রমণাত্মক। নিরাপত্তা বলতে আমি বুঝিয়েছি ছেলেদের অনিয়ন্ত্রিত ও আক্রমণাত্মক ইচ্ছার কবল থেকে মেয়েদের নিরাপত্তার কথা। আহমদ মুসা বলল।
আপনি যেদিকে ইংগিত করেছেন, সেটা তো ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপার। ব্যক্তিগত পর্যায়েই তা রেখে দেয়া উচিত। এটা সমাজের ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত নয়। তেমনি সমাজও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবার কথা নয়। বলল গৌরী।
ব্যক্তির কাজ যখন অপরাধ হিসাবে সংঘটিত হয়, তখন তা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপার থাকে না। পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পবিত্র সম্পর্কের বিষয়টি অবাধ মেলামেশার কারণে অপরাধ হিসাবে, অপরাধের মহামারি হিসাবে সংঘটিত হচ্ছে। পৃথিবীর দেশগুলো, বিশেষ করে অবাধ মেলামেশার দেশের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখুন, সেখানে নারীরা অপরাধের শিকার হওয়া, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা ও ভঙ্গুরতা, নারীকেন্দ্রিক অপরাধ বিকৃতি ও তজ্জনিত মানসিক বিকৃতি ও অসুস্থাবস্থা কেমন বাড়ছে। আহমদ মুসা বলল।
গৌরীর মুখে একটা ভাবনার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল।
তার মনের এক অতল তল থেকে কে যেন তাকে বলল, গৌরী, তুমি কি নিজেই শক্তিমানের অনাচারের শিকার নও! তোমার কি পরিবার আছে, ঘর আছে! চমকে ওঠে সে। কিন্তু পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল গৌরী। বলল গম্ভীর কণ্ঠে, এসব অপরাধের পেছনে অনেক কার্যকারণ আছে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, স্যরি মিস গৌরী। যে কার্যকারণই থাক, এ কথা ঠিক যে, অবাধ মেলামেশার কারণে সুযোগ সহজলভ্য হওয়ায় নারীর উপর পুরুষের অনাচার বাড়ছে। সুতরাং তাদের নিরাপদ করতে হলে অবাধ মেলামেশা বন্ধ করে সুযোগের সহজলভ্যতা দূর করতে হবে।
কিন্তু বলুন, আমার সাথে হ্যান্ডশেকের ক্ষেত্রে কি সুযোগের সহজলভ্যতা দূর করার প্রশ্ন আসতে পারে? বলল গৌরী।
অপরাধ দমনে পুলিশী পাহারার ব্যবস্থা একটা আইন। অপরাধ যেখানে সংঘটিত হচ্ছে সেখানেও পুলিশ পাহারা থাকে, আবার অপরাধ যেখানে হচ্ছে না সেখানেও পুলিশ পাহারা থাকে। আমি এই নীতিগত কারণেই আপনার সাথে হ্যান্ডশেক করিনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি তো সাংঘাতিক মৌলবাদী! আপনি কি করেন?’
‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াই।’ গৌরীকে পরখ করার জন্যেই আহমদ মুসা ইচ্ছা করে এমন ইংগিতমূলক কথা বলল।
‘তার মানে আপনি মানুষের সেবা করে বেড়ান। তা কি ধরনের সেবা?’ বলল গৌরী। সেও চাইল আহমদ মুসা সম্পর্কে তাদের সন্দেহকে নিশ্চিত করতে।
‘ধরুন, মানুষ অভাবে পড়লে দেখা, কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে দাঁড়ানো-এই আর কি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহিতিতে আপনার কাজ? কোন মিশন এখানে?’ বলল গৌরী। তার চোখে-মুখে হাসি থাকলেও তার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠা আহমদ মুসার দৃষ্টি এড়াল না।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তাহিতিতে মানুষ কোন কাজ নিয়ে আসে না। আসে সব কাজ ছেড়ে-ছুঁড়ে তাহিতেকে দেখতে।’ আহমদ মুসা প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেল। আর এগোতে চাইল না প্রসঙ্গটি নিয়ে। গৌরীর টার্গেট তার বুঝা হয়ে গেছে।
‘আপনি কি মতুতুংগা দ্বীপপুঞ্জের অ্যাটলগুলোতে গেছেন? অ্যাটলের রাজ্য না দেখলে তাহিতি দেখা হয় না।’ বলল গৌরী।
‘গেছি অ্যাটল দেখতে। আপনি ঠিকই বলেছেন। অপরূপ সুন্দর অ্যাটলের এ রাজ্য!’ আহমদ মুসা বলল।
‘জনবিরল অ্যাটল দ্বীপমালা শান্তির রাজ্যও বটে। ওখানে আপনি দেখবেন না কোন হিংসা-বিদ্বেষ, শুনবেন না কোন আর্তের আর্তনাদ। এ বিষয়টা আপনি কতটা লক্ষ্য করেছেন?’ বলল গৌরী।
মুখে হাসি ফুটল আহমদ মুসার। কিন্তু ভেতরে তার অন্য চাঞ্চল্য। গৌরীর প্রশ্নে লক্ষ্য সে পরিষ্কারভাবেই বুঝেছে। গৌরী চাচ্ছে অ্যাটলে যে ৭৬ জন বিজ্ঞানী বিপদগ্রস্থ, সেটা আহমদ মুসা জানে কিনা, এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। এর অর্থ বিজ্ঞানীরা যে ‘এসওএস’ পাঠিয়েছে সেটা ধরা পড়ে গেছে। এখন ওরা সন্ধান করছে এসওএস কে বা কারা পেয়েছে। এ সন্ধানেই গৌরী তার কাছে এসেছে। তার মানে ওরা জেনে ফেলেছে, যখন SOS পাঠানো হয়, তখন আহমদ মুসাদের বোট তাহানিয়া অ্যাটলে ছিল। তা কি করে জানল ওরা? তাহলে কি পাহারা দেবার মত কোন গোপন পর্যবেক্ষণ টেকনলজি ওদের আছে!
এসব চিন্তায় একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা। উত্তর দিতে একটু দেরী হলো।
গৌরীর দুই চোখের সমস্ত মনোযোগ তখন কিন্তু আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ।
একটু হাসল আহমদ মুসা। ‘ভাবছিলাম মিস গৌরী, আপনার আবেগপূর্ণ প্রশ্ন সম্পর্কে। তোয়ামতু অ্যাটল রাজ্যের সবটা আমি এখনও দেখিনি। তবে সুন্দর ও শান্তি কিন্তু এক জিনিস নয়। শান্তি থাকলে অসুন্দরও সুন্দর হয়ে উঠে, শুধু ‘সুন্দর’ কিন্তু শান্তি নিশ্চিত করে না।’ আহমদ মুসা বলল।
গৌরীর চোখে এক ধরনের আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে নিশ্চিত ধরে নিল, আহমদ মুসা অ্যাটল রাজ্যে অশান্তি আছে এ কথাই বলছে। আর এর দ্বারা SOS মেসেজ পাওয়াটাকেই নিশ্চিত করল। মনের এ কথাগুলোকে লুকিয়ে রেখে গৌরী হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘আপনার জবাবটা সাংঘাতিক মি. আবু আবদুল্লাহ! আপনি দার্শনিকের মত উত্তর দিয়েছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।’
বলতে বলতে গৌরী উঠে দাঁড়িয়েছে। শেষে বলল, ‘আমি চলি মি. আব্দুল্লাহ। খুশি হলাম আপনার সাথে কথা বলে। ধন্যবাদ সবাইকে।’
অন্য টেবিলের দিকে চলে গেল গৌরী।
গৌরী চলে যেতেই মারেভা বলল, ‘মেয়েটি কি করে তাতো বলল না। আমার মনে হচ্ছে সামরিক বাহিনীর মেয়ে। শরীরটা তার ঐ ধরনের তৈরি। কথাবার্তা ওদের মতই চটপটে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, সেনাবাহিনীর লোক হলে তো এমন অযাচিতভাবে কথা বলতে আসার কথা নয়!’
‘তুমি ঠিকই বলেছ মারেভা। উনি সেনাবাহিনীর লোক নন। আমি যাদের সন্ধান করছি, তিনি তাদের একজন।’ আহমদ মুসা বলল।
মারেভা ও মাহিন দু’জনেই চমকে উঠে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘কিন্তু ওরা আপনাকে জানল কি করে স্যার?’
‘সম্ভবত সেই ‘এসওএস’ মেসেজ ধরা পড়েছে। আমাদের বোটে যে মেসেজ মনিটর হয়েছে সেটা। মনে হচ্ছে, বোটের ক্লু ধরেই তারা এ পর্যন্ত পৌঁছেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সর্বনাশ। কিন্তু মতলব কি ওদের স্যার?’ বলল মাহিন।
‘আমি সেটাই ভাবছি। তারা কি চায়, কি করতে চায়, এটা আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ওরা বড় কোন টার্গেট ছাড়া কিছু করে না।’ আহমদ মুসা বলল।
ভয়ের ছায়া নামল মারেভা ও মাহিনের চোখে-মুখে। বলল, ‘তাহলে আপনার মানে আমাদের সকলের সাবধান হওয়া প্রয়োজন।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এখনও সব কিছু স্পষ্ট নয়। তবে সাবধানতা সব সময়ই ভাল।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়াল মারেভা ও মাহিনও।
‘বিল তো এল না স্যার?’ বলল মাহিন।
‘এনট্রান্স ফি’র সাথে ভেতরের সবকিছুই ইনক্লুডেড মারেভা।’ আহমদ মুসা বলল।
হোটেলের লাউঞ্জে নেমে এল আহমদ মুসারা।
‘স্যার, আমরা আসি।’
‘না, আমি তোমাদের পৌঁছে দেব মাহিন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তেপাওকে ট্যাক্সি নিয়ে আসতে বলেছি। সে এসে গেছে।
চল।’ বলেই আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল।
মারেভা ও মাহিনও তার সাথে হাঁটতে শুরু করল।
ট্যাক্সির কাছাকাছি এসে একবার পেছনে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘মারেভা-মাহিন, তোমাদের বিয়ের তারিখ কবে ঠিক হলো?’
মারেভা-মাহিন দু’জনেরই মুখ লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল। বলল মাহিন, ‘আসছে শুক্রবার, স্যার।‘
‘ধন্যবাদ। বিয়ে ছাড়া তোমাদের এভাবে চলা আর উচিত নয়।’
মারেভা ও মাহিন মুখ নত করল।
সবাই এগোলো আবার গাড়ির দিকে।
৩
রাত সাড়ে দশটা।
আহমদ মুসা মারেভা ও মাহিনদের পৌঁছে দিয়ে হোটেলে ফিরছিল।
তেপাও-এর ট্যাক্সি হাইওয়ে থেকে উত্তর দিকে হোটেলের পথে নেবার পর রাস্তা একেবারে শুনশান। দু’একটা গাড়ি আসতে-যেতে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু উপকূলের লেকপাড়ের হোটেল ডায়মন্ড ড্রপ নিকটবর্তী হওয়ার পর রাস্তা একেবারেই নিরব হয়ে গেল।
ঢালু পথে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে নামছিল আহমদ মুসার গাড়ি। সামনেই ছোট একটা বাঁক। বাঁকের রাস্তাটুকু সমান, ঢালু নয়। তারপর আবার শুরু হয়েছে ঢালু রাস্তা। আহমদ মুসার গাড়ি বাঁক নেবার সময় গাড়ির গতি প্রায় ‘জিরো’তে নেমে এসেছিল।
আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তার পাশে সম্প্রতি তৈরি এই রাস্তার স্পার্ক স্তম্ভের দিকে তাকাতে যাচ্ছিল, এমন সময় চমকে উঠল হঠাৎ চোখের সামনে দিয়ে মার্বেল টাইপের সাদা একটা বস্তু গাড়ির ভেতরে ছুটে যেতে দেখে।
মুহূর্তেই সক্রিয় হয়ে উঠল আহমদ মুসার মাথা। বোমা কিংবা এই ধরনের কোন বস্তু হবে। গাড়ি থেকে বেরুবার সময় ছিল না। শ্বাস বন্ধ করে সে গাড়ির সিটে নিজের দেহটাকে ছেড়ে দিল।
পল পল করে সময় বয়ে যেতে লাগল।
না, কোন বিস্ফোরণ ঘটল না। তার মানে ওটা বোমা নয়, কোন ধরনের গ্যাস বোমা। শ্বাস বন্ধ রাখার দিকে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা।
খোলা ছিল আহমদ মুসার চোখ। দেখল, একই সাথে গাড়ির দু’পাশের দরজা খুলে গেল। তার সাথে সাথেই হ্যান্ড মেশিনগানের দুই নল দুই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল এবং গ্যাস-মাস্ক পরা দুই মুখ।
‘ব্যাটা এশিয়ান কুপোকাত! জ্ঞান হারিয়েছে সে।’ বলল দু’জনের একজন।
তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ভেতরে ঢুকে আহমদ মুসাকে দু’পা ধরে টেনে বের করল গাড়ি থেকে।
আহমদ মুসা গোটা ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। তাকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। পাল্টা আক্রমণের সুযোগ এখন নেই। সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা, এখন সে সংজ্ঞাহীনের ভান করবে। আর একটা বিষয় ভাবল, এদের হাতে পড়লে এদের জানারও একটা সুযোগ হবে। এখন পর্যন্ত চেষ্টা করেও ওদের হেড কোয়ার্টার ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’-এর সন্ধান সে পায়নি। এর ফলে তার সন্ধান পাওয়ারও একটা পথ হতে পারে।
আহমদ মুসাকে গাড়ি থেকে বের করতেই একটা নারী কন্ঠ বলল, ‘ওকে হাত-পা বেঁধে গাড়িতে তোল’।
কন্ঠটি গৌরীর। কথা শুনেই বুঝতে পারল আহমদ মুসা। খুশি হলো আহমদ মুসা, তার সন্দেহ সঠিক হয়েছে। নিশ্চয় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে গৌরী।
একজন বলল, ‘ম্যাডাম, এ এশিয়ান তো সংজ্ঞাহীন, তারপরও বাঁধতে হবে?’
‘কখন জ্ঞান ফিরে পাবে, তোমরা বলতে পার না। সুতরাং কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তাকে বেঁধে ফেল।’
‘শোন, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কোন আইন তোমরা ভাঙবে না।’ বলল গৌরী।
আড়াল থেকে একটা মাইক্রো বেরিয়ে এসেছে। মাইক্রোতে ওঠানো হলো সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে। তার পাশেই উঠল গৌরী। পেছনে আর চারজন। ড্রাইভারের পাশে একজন।
গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই ড্রাইভিং সিটের লোকটি বলল, ‘উপকূলে যাচ্ছি ম্যাডাম।’
‘না, উইরো। এক ‘মতু’তে নেয়া হচ্ছে না। একে দক্ষিণ পাপেতির ঘাঁটিতে নিয়ে চল। একে প্রথম বাজিয়ে দেখতে হবে এ কি জানে, কতটা জানে? তারপর যে সিদ্ধান্ত হয় করা হবে।’ বলল গৌরী।
আহমদ মুসার কানে সব কথাই গেল। তাকে ‘মতু’তে নেয়া হচ্ছে না। তবে বুঝা গেল ‘মতু’ সাগরের মাঝের কোন দ্বীপ হবে। পলিনেশীয় ভাষায় ‘মতু’ মানে দ্বীপ। এই ‘মতু’টা আবার কোথায়? ‘মতু’কি সেই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ না ‘মতু’ বলতে সাধারণভাবে দ্বীপ বুঝানো হয়েছে?
চলতে শুরু করেছে গাড়ি। প্রথমে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে মূল শহরে পৌঁছে দক্ষিণের কোন পথে যেতে হবে দক্ষিণ পাপেতিতে।
ছুটে চলছে গৌরীর গাড়ি।
আহমদ মুসা তখনও ‘মতু’ নিয়ে তার হিসাব-নিকাশ কষেই চলেছে।
পাশেই গৌরীর মোবাইল সিগন্যাল দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসা উৎকর্ণ হলো।
গৌরী তার জ্যাকেটের পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে অন করে চোখ বুলালো স্ক্রীনে। স্ক্রীনে মেসেজটি পড়েই দুই চোখ ছানা-বড়া হয়ে গেল গৌরীর। দ্রুত সে গ্যালারি ওপেন করল। সদ্য প্রেরিত ছবিটা সে দেখল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ঠিক এটাই আবু আহমদ আব্দুল্লাহর ছবি, কোন ভূল নেই তাতে। তাহলে এটাই সেই আহমদ মুসা! গোটা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত খেলে গেল গৌরীর। সেই দুর্ধর্ষ আহমদ মুসা যার মূল্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার! সে এখানে এই তাহিতিতে! কোন মিশনে! দুশ্চিন্তার একটা কালো মেঘ উঁকি দিল গৌরীর মনে। আহমদ মুসার ইতিহাস সে জানে। সে এখনো অজেয়। তার বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি এখনও কেউ। একটা বিমূঢ়তা নেমে এল গৌরীর মনে, অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুনোর মত। কিন্তু পরক্ষণেই বুক ভরে এক প্রবল যন্ত্রণা জেগে উঠল। যন্ত্রণা শীঘ্রই প্রতিহিংসার আগুনে পরিণত হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল সে আগুন। আহমদ মুসা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মুখোমুখি হয়নি কখনও। কিন্তু ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের বহু বন্ধু ও মিত্র সংগঠনের সর্বনাশ করেছে সে। সে এখন তাদের হাতের মুঠোয়। সে চিৎকার করে উঠল, ‘সকলে সাবধান, আমরা মশা ভেবে কিন্তু হাতিকে খাঁচায় ভরেছি।’
সামনের সিট থেকে গৌরীর অপারেশন সহকারী সিনথ্রোস চমকে উঠে পেছনে তাকাল এবং বলল, ‘ম্যাডাম, কিছু খবর পেলেন? হাতিটি তাহলে কে?’
‘হ্যাঁ সিনথ্রোস, যাকে আমরা খুব সহজে বন্দী করেছি, সে আজকে সবচেয়ে ওয়ানটেড ও সবচেয়ে বড় শয়তান আহমদ মুসা!’
‘ও গড!’ বলে আর্তনাদ করে উঠল সিনথ্রোস।
তার সাথে সাথে ফোন বেজে উঠল গৌরীর।
গৌরী মোবাইলের স্ক্রীনে একবার তাকিয়েই তটস্থভাবে মোবাইলটি মুখের কাছে নিয়ে এসে বলল, ‘ইয়েস মাই লর্ড!’
‘এসএমএস ও ফটো দেখেছ?’
মোবাইল ফোনের ওপার থেকে বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘ইয়েস মাই লর্ড!’ গৌরী বলল।
‘তোমার ও তোমার টিমকে ধন্যবাদ, অসাধারণ এক শিকারকে তোমরা জালে আটকিয়েছ। আমাদের অনেক উপকারে আসবে।‘ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘কিভাবে মাই লর্ড? সে তো বিপজ্জনক!’ গৌরী বলল।
‘সবচেয়ে বিপজ্জনক বলেই তো সবচেয়ে বেশি মূল্য আমরা পাচ্ছি।’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘বেশি মূল্য মানে মাই লর্ড?’ বলল গৌরী।
‘হ্যাঁ, ওর লাশ বিক্রি করেছি আমরা ১ বিলিয়ন ডলারে।’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘কিন্তু মাই লর্ড, এই অবিশ্বাস্য মূল্য দিয়ে কারা নেবে ওকে? আর লাশ বলছেন কেন?’ গৌরী বলল।
‘লাশ এজন্যে বলছি সে, একে কখনো আটকে রাখা যায় না বা আটকে রাখা যায়নি কখনো। তাই জীবন্ত বিক্রি করার ঝুঁকি নিতে চাই না। ক্রেতারাও নিশ্চিত হতে চায় যে, সে মরেছে। আর তখনই আমাদেরকে ঐ মূল্যটা দেবে?’
‘ওটা ওকে মারার মূল্য। এমন মূল্য বহুবার ঘোষনা করেও তাকে তারা মারতে পারেনি।’
মুহূর্তের জন্যে থামল। থেমেই আবার বলল, ‘আমরাও তাকে আটকে রাখার ঝুঁকি নিতে চাই না। আর একটি কথা, তার মত বিপজ্জনক লোককে আমাদের রাজধানী ‘মতু’তে নিয়ে আসতে পারি না। আর সে শেষ হয়ে গেলে আমাদের ‘মতু’ থেকে প্রেরিত SOS –এর বিপজ্জনক একজন প্রত্যক্ষ শ্রোতাও শেষ হয়ে যায়। আর দু’জন প্রত্যক্ষ শ্রোতা থাকল। ওদেরকেও বাঁচিয়ে রাখা হবে না। এখন তোমরা তাকে হত্যা করে লাশ নিয়ে এস।’
‘তাকে তাহলে ঘাঁটিতে নেবার তো প্রয়োজন নেই মাই লর্ড।’ গৌরী বলল।
‘না। তাকে শেষ করে দিয়ে তোমরা লেক টাওনায় ফিরে যাও। ওখানকার প্রাইভেট জেটিতে আমাদের উভচর ফেরি যাচ্ছে। ভয় নেই, প্রাইভেট জেটিটি এখন জনমানবশুন্য।’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘মাই লর্ড, শেষ কাজটা কোন ধরনের হবে সে ব্যাপারে আপনার কোন নির্দেশ আছে?’ গৌরী বলল।
লাশটা অনেক দূরে যাবে। কোন রক্তপাত যেন না হয়, দৃশ্যমান কোনও আঘাতও যেন না থাকে!’ বলল আলেক্সি গ্যারিন।
‘ইয়েস মাই লর্ড, বুঝেছি। এটাই হবে।’ গৌরী বলল।
‘ধন্যবাদ।’ বলে ওপার থেকে কল অফ করে দিল আলেক্সি গ্যারিন।
মোবাইল জ্যাকেটের পকেটে রেখে গৌরী ড্রাইভারকে লক্ষ করে বলল, ‘উইরো, গাড়িটা আবার ঘুরিয়ে সেই লেক টাওনার দিকে নিয়ে চল।’
গাড়ি থেমে গেল।
গাড়ি তখন এক পাহাড়ি পথ দিয়ে চলছিল। রাস্তা ও চারদিকটা জনমানবশুন্য।
‘সিনথ্রোস, কিছু বুঝেছ?’ গৌরী বলল।
‘ইয়েস ম্যাডাম, আপনার কথা তো কানে এসেছে। মাই লর্ডেরও কিছু কথা কানে এসেছে। বুঝেছি, এই এশিয়ানকে এখন মেরে তার লাশ নিয়ে যাবার নির্দেশ হয়েছে।’ বলল সিনথ্রোস।
‘আরও একটা সুখবর আছে সিনথ্রোস, লাশটা বিক্রি হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারে!’ গৌরী বলল।
‘ও মাই গড!লাশের মূল্যের ক্ষেত্রে এটাই বোধ হয় বিশ্বরেকর্ড! তাদের ধন্যবাদ।’ বলল সিনথ্রোস।
‘ধন্যবাদ! আর ধন্যবাদ এজন্যে যে, সেই কাজটা তোমাকেই করতে হবে। আমি তোমার সিটে যাচ্ছি। তুমি এখানে এস। রক্ত ঝরবে না, লাশের গায়ে দাগও পড়বে না, এমন একটি লাশ বানাবার কাজ তোমাকে করতে হবে।’ গৌরী বলল।
বলে গৌরী নেমে এল গাড়ি থেকে।
ওদিক থেকে সিনথ্রোসও নামল।
সিনথ্রোস পেছনের সিটে আসার সময় ড্যাশবোর্ড থেকে একটা কুশন সংগ্রহ করল।
গৌরী সেদিকে তাকিয়ে হাসতে গিয়ে মনের কোথায় যেন একটা খোঁচা খেল। হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, হোটেল লা ডায়মন্ড ড্রপ-এর এ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে আহমুদ মুসার সাথে সাক্ষাতের দৃশ্যগুলো, মনে পড়ল হ্যান্ডশেক প্রসঙ্গ নিয়ে বলা তার কথাগুলো। সাংঘাতিক নীতিবাগীশ ও আদর্শবাদী লোক সে। দৃষ্টিভংগিটাও খুব মানবিক। এ ধরনের লোকরা ক্রিমিনাল হতে পারে না। আহমদ মুসা সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে। তাতে মৌলবাদী এক হিংস্র লোক মনে হয়েছে তাকে। কূটবুদ্ধির চালে মানুষ মারাই হচ্ছে তার কাজ। কিন্তু তার সাথে কথা বলার পর তার ধারণাটা একেবারেই উল্টে গেছে। ভাল মানুষ এবং সুস্থ ও শান্তির সমাজ সে চায়। ঈশ্বর বোধ হয় এজন্যেই সব সময় তাকে সাহায্য করে থাকে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার নিজের কথা মনে হলো, মুক্ত সমাজ ও বাধা-বন্ধনহীন জীবন তাকে কি দিয়েছে। পাখির মত মানুষ মেরেছি, কিডন্যাপের পর কিডন্যাপ করেছি, কিন্তু কি পেয়েছি? পরিবার নেই, আত্মীয়-স্বজনকে ভুলে গেছি। বিধাতার দেয়া সুন্দর দেহকেও আমি রক্ষা করতে পারিনি, পশুদের তা যথেচ্ছ ভোগের শিকার। এ বিষয়ে তার বোধই ছিল না, জীবনের নগদ উপভোগ নিয়ে সে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু আহমদ মুসা তার চোখ খুলে দিয়েছে। এখন জীবনটা তার কাছে উন্মুক্ত একটা পৃষ্ঠার মত হয়ে গেছে। কিন্তু অনেক কাহিনী, অনেক বিজয়ের নায়ক, অপরাজেয় বলে অভিহিত আহমদ মুসা আজ পরাজিত, তার জীবন সাঙ্গ হতে আর কয়েক মুহূর্ত বাকি! কথাগুলোকে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কিন্তু অবিশ্বাস করার সুযোগ নেই। আহমদ মুসার সংজ্ঞাহীন দেহ সিটের উপর পড়ে আছে। সিনথ্রোসের হাতে দেখছি বর্গাকৃতির ছোট কুশন। ঐ কুশনটি আহমদ মুসার নাকে-মুখে চেপে বসার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কি ঘটবে তা পরিষ্কার। রক্ত ঝরবে না, কোথাও দাগও পড়বে না, কিন্তু প্রাণ থাকবে না দেহে। ভাবতে মনে সেই খোঁচাটা লাগল আবার। কোন মৃত্যু তার মনকে এমন চঞ্চল আর করেনি কখনও।
সিনথ্রোস গাড়িতে উঠে আহমদ মুসার মাথার কাছে বসল।
গৌরীও সামনের সিটে উঠে বসল।
আহমদ মুসা গৌরীর টেলিফোনে কথোপকথন থেকে শুরু করে সব কথাই শুনেছে। তার লাশ এক বিলিয়ন ডলারে বিক্রি হচ্ছে, এটাও সে শুনল। মনে মনে হেসেছে আহমদ মুসা। মাথার কাছ থেকে গৌরী নেমে গেলে আহমদ মুসা হাতের বাঁধনটা পরীক্ষা করল। বাঁধনটা সরল। সম্ভবত সংজ্ঞাহীন মানুষকে এর চেয়ে কড়া বাঁধনের প্রয়োজন তারা অনুভব করেনি। দাঁত দিয়ে আহমদ মুসা হাতের বাঁধন ঢিলা করে দিল যাতে পরে সহজেই খুলে ফেলা যায়। তারপর অতি সন্তর্পণে পা এগিয়ে এনে এক হাত দিয়ে পায়ের বাঁধনও খুলে ফেলল, তবে বাঁধনের বাইরের খোলসটা থাকল।
গাড়িতে উঠে সিনথ্রোস প্রথমেই নজর বুলাল আহমদ মুসার দিকে। সিটের উপর গা এলিয়ে মরার মত পড়ে আছে। হাতও পায়ের বাঁধনও তার চোখে পড়ল।
‘ম্যাডাম, আহমদ মুসার হাত-পায়ের বাঁধন কি থাকবে?’ গৌরীকে লক্ষ করে বলল সিনথ্রোস।
‘তুমি মরে করলে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিত পার। বলির পশুকেও তো মুক্ত রেখেই বলি দেয়া হয়।’
‘আমিও সেটাই ভাবছি ম্যাডাম।’
বলে সিনথ্রোস আহমদ মুসার হাতের বাঁধনের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিল।
আহমদ মুসা বুঝল আমার হাতের বাঁধন যে খোলা তা সে এখনি টের পেয়ে যাবে। তখন সঙ্গে সঙ্গেই সিনথ্রোস আক্রমণে আসবে।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, তাকে আগে আক্রমণে যেতে হবে।
ভাবনার সাথে সাথে আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুৎ বেগে উঠে গিয়ে মাথার পেছনে ঘাড়ের সাথে লাগোয়া জ্যাকেটের গোপন পকেট থেকে রিভলবার নিয়ে সিনথ্রোসের বুকের একপাশে গুলি করল।
সিনথ্রোসের চোখে ধরা পড়েছিল আহমদ মুসার ডান হাত ছুটে যাওয়ার দৃশ্য। কিন্তু তা বুঝে ওঠার পর সিটের উপর থেকে রিভলবার তুলে নিয়ে প্রস্তুত হবার আগেই সে গুলি খেল।
আহমদ মুসা গুলি করেই বাম হাত দিয়ে সিটের উপর পড়ে থাকা সিনথ্রোসের রিভলবার তুলে নিয়ে একই সাথে ডান হাত দিয়ে গৌরীর লক্ষ্যে এবং বাম হাত দিয়ে পেছনের লোকদের দিকে গুলি ছুঁড়তে লাগল।
গৌরীর রিভলবার ধরা হাত গুলিবিদ্ধ হলো। ছিটকে পড়লো তার হাত থেকে রিভলবার।
অন্য দিকে পেছনের সিটের লোকরা প্রথমে বুঝতেই পারেনি কি ঘটেছে। রিভলবার নিয়ে আহমদ মুসাকে দাঁড়াতে দেখে তবেই বুঝতে পারল আহমদ মুসা নয়, তাদের সিনথ্রোসই গুলি খেয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে তারা আহমদ মুসার রিভলবারের টার্গেট হয়ে গেছে। তারা কেউ অস্ত্র তোলারও সুযোগ পেল না। গুলিবিদ্ধ হয়ে যেখানে বসেছিল সেখানেই ঢলে পড়ল।
গৌরীর ডান হাত গুলিবিদ্ধ হবার পর বাম হাত দিয়ে সে তার রিভলবার তুলতে যাচ্ছিল।
‘রিভলবার তুলবেন না মিস গৌরী। সে চেষ্টা করলে আমি গুলি চালাতে বাধ্য হবো। দেখছেন তো, আমার কোন গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।’ বলল আহমদ মুসা।
গৌরী রিভলবার তুলে নেয়ার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অন্যদের মত আমাকে গুলি না করে সাবধান করছেন কেন?’
‘দুই কারনে, এক, আপনি আহত, দুই, আপনি মহিলা। তাছাড়া আপনি এশিয়ানদের ভালবাসেন।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা একটু এগিয়ে গৌরীর রিভলবার তুলে নিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। বলল, ‘ড্রাইভিং সিটের লোকটি নিশ্চয় বাইরে গিয়ে পজিশন নিয়েছে?’
বলে আহমদ মুসা রিভলবার ধরা বাম হাত জানালায় ঠেস দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাথা সরিয়ে নিল।
তখনই এক ঝাঁক গুলির কিছু জানালার বাইরে দিয়ে শূন্যে উড়ে গেল আর কিছু জানালায় আঘাত করল। আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে মাথা সরিয়ে নিতে না পারলে তার মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
আহমদ মুসা লোকটিকে দেখেছে। দরজার একটু পেছনেই সে বসে আছে। তার হাতে ধরা স্টেনগানের ব্যারেল ভয়ংকর। স্টেনগান উদ্যত করে সে বসে আছে।
গুলি তার থেমে গেল হঠাৎ।
সে কি পজিশন চেঞ্জ করল? আহমদ মুসা নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল।
ড্রাইভিং সিটের লোকটি দরজা খোলা রেখেই নেমে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা লোকটিকে যেখানে দেখেছিল সেদিকে বাম হাতের রিভলবার উদ্যত করে পা দিয়ে দরজা বাইরের দিকে পুশ করল।
দেখতে পেল লোকটি উঠে দাঁড়াচ্ছে।
আহমদ মুসার চোখ ও রিভলবার এক সঙ্গেই কাজ করল। লোকটি চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিভলবারের ট্রিগার তার আঙুলে চেপে বসেছিল। রিভলবারের একটি বুলেট উপর থেকে ০৫ ডিগ্রি কোণে গিয়ে ঠিক তার কপালে আঘাত করেছে। তার দেহটা ছিটকে পড়ল পেছনে।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে টেনে দরজা বন্ধ করে সোজা হয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল। তাকাল গৌরীর দিকে। সে তার বাম হাত দিয়ে ডান হাতের গুলিবিদ্ধ কবজি চেপে ধরে বসে আছে মাথা নিচু করে। গুঁড়িয়ে যাওয়া কবজি থেকে রক্ত তখনও বেরুচ্ছেই।
আহমদ মুসা হাতের রিভলবার সামনের ড্যাশ বোর্ডের উপর রেখে ওপাশের ড্যাশ বোর্ডের নিচের ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স বের করল। বক্স থেকে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বের করে নিল আহমদ মুসা। তারপর গৌরীর ডান হাত টেনে নিয়ে কবজির পেছনে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে আহত স্থানটা ঢেকে দিল। বলল আহমদ মুসা, ‘এতে অন্তত রক্ত ক্ষরণটা বন্ধ হবে মিস গৌরী।’
বলে মুহূর্ত কয়েক থেমেই আবার কথা শুরু করল, ‘মিস গৌরী, প্লিজ, আপনি কি খোঁজ নেবেন, ওরা কেউ বেঁচে আছে কিনা।’
গৌরী অপলক চোখে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়! বলল, ‘কেন, কি দরকার আপনার ওটা জেনে?’
‘ওদের মধ্যে কেউ আহত থাকলে কিছু শুশ্রুষা তার প্রয়োজন হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মানুষ মারার সময় তাদের কথা ভাবা হলো না, এখন আহতের কথা ভাবা হচ্ছে কেন? এটা কি গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মত বিষয় নয়?’ বলল গৌরী।
ওরা যুদ্ধ চলা কালে মরেছে। এ মৃত্যু স্বাভাবিক। যুদ্ধ শেষে আহতরা কারও শত্রু নয়, আমাদের ধর্মের শিক্ষা এটা। যতটা সাধ্য ওদের সহযোগিতা করা উচিত। এই উচিত কাজটাই আমি করছি।’ আহমদ মুসা বলল। গৌরী মাথা একটু নিচু করল।
মুখে কিছু বলল না আহমদ মুসার কথা জবাবে।
মুহূর্ত খানেক পর মুখ তুলে তাকাল গাড়ির পেছনে হত-নিহত তার সাথীদের দিকে। একটু জোরে বলল, ‘নাশকা, তোমাদের খবর কি? তোমরা কে কেমন আছ বল?’
নাশকাই মুখ তুলল। বলল, ‘তিনজন মারা গেছে ম্যাডাম। আমার বাম বাহু ও ডান হাত গুলিবিদ্ধ হয়েছে।’
গৌরী ফার্স্ট এইড বক্স হাতে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বলল, ‘আপনি বসুন মিস গৌরী। এক হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা যায় না।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ি লক করে চাবিটা পকেটে পুরে গৌরীর কাছ থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে পেছনের সিটে যাবার জন্যে উঠল।
‘গাড়ি লক করলেন কেন?’ জিজ্ঞাসা গৌরীর।
‘যাতে গাড়িটা আপনি দখল করতে না পারেন সেজন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার দিকে কয়েক মুহূর্ত দৃষ্টি রেখে বলল, ‘আমি তো পালিয়ে যেতেও পারি?’
‘আমি আপনাদের বন্দী করিনি। আমি নিজেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছি মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন, আমাদের কাছ থেকে আপনার কিছু জানার নেই। কেন আমরা আপনাকে কিডন্যাপ করেছিলাম, সেটা আপনি জানতে চান না?’ বলল গৌরী।
‘জানার আগ্রহ থাকলেও জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা আমার নেই। কারণ আপনারাও হয়তো জানেন না। জানলেও আপনাদের তা বলার কথা নয়। যেমন আপনারা কোন এক ‘মতু’তে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমি বিস্মিত হয়েছি, ‘মতু’ নামে তো তাহিতি কিংবা এর আশেপাশে কোন জায়গা নেই! আমি যদি এটা জিজ্ঞাসা করি, আপনি নিশ্চয় বলবেন না?’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শুনে হাসল গৌরী।
তাকাল আহমদ মুসার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে। বলল, ‘আহমদ মুসা, আপনি সত্যিই অনন্য! আপনি কিছুই জিজ্ঞাসা করতে চান না, কিন্তু এমন একটা বিষয় জিজ্ঞাসা করেছেন, যা আপনি জানলে আমাদের আপনাকে জানাবার আর কিছু বাকি থাকে না।’
‘এর মানে ‘মতু’ কি, কোথায়? এটা কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল না। আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন, এ প্রসঙ্গে আপনারাই ‘মতু’র নাম বলেছেন। এটা আমার জিজ্ঞাসার বিষয় নয়। কৌতূহল থেকেই আমি ‘মতু’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। আমার আরও কৌতূহল হলো, কেন আপনারা আমাকে অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলার সাথে সাথে গাড়ির পেছনে গিয়ে আহমদ মুসা দুই বাহুতে গুলিবিদ্ধ নাশকার ব্যান্ডেজ বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে।
‘আপনাকে কেন আমরা কিডন্যাপ করতে চাই, সত্যিই কি তা আপনি জানেন না?’ জিজ্ঞাসা গৌরীর।
বিপদে পড়ল আহমদ মুসা। এভাবে জিজ্ঞাসিত হয়ে মিথ্যা বলতে সে পারে না। অবশেষে দায়টা গৌরীর ঘাড়ে চাপানোর জন্যে বলল, ‘মিস গৌরী, প্রশ্ন আমি আগে করেছি। আপনারা কেন আমাকে কিডন্যাপ করতে এলেন?’
‘কিডন্যাপ করতে পারলে বলতাম। এখন তা আর বলা যাবে না।’ বলল গৌরী।
‘কিন্তু আপনারা অপরাধ করেছেন। তাই আপনারা বলতে বাধ্য।’
‘বাধ্য করলে হয়তো জানতেও পারতেন।’ বলল গৌরী।
‘আমি সেটা পারি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু পরাজিত বাদী আহতদের প্রতি তো আপনি নিপীড়ন চালান না।’ গৌরী বলল।
‘কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র আবার সৃষ্টি করা যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
গৌরী কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময় তার মোবাইল বেজে উঠল।
গৌরী মোবাইলটা বের করতে যাচ্ছিল।
‘না মিস গৌরী, আপনাকে টেলিফোন ব্যবহারের অনুমতি আমি দেব না।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির পেছন থেকে সামনের সিটে চলে এল। নাশকার ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গিয়েছিল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসে গৌরীকে বলল, ‘প্লিজ, মোবাইলটা দিন।’
মোবাইলটা তখনও বেজেই চলেছে।
গৌরী নিরবে মোবাইলটা তুলে ধরল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা মোবাইলের কল অন করে বলল, ‘বলুন, আমি আহমদ মুসা, যাকে কিডন্যাপ করতে পাঠিয়েছিলেন।’
‘আপনি তাদের হত্যা করে গাড়ি দখল করে বসে আসেন?’ বলল ওপার থেকে।
‘না, গৌরী ও নাশকা আহত। অন্যরা নিহত।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনিই আহমদ মুসা, এটা আগে জানলে কিডন্যাপের জন্যে মাত্র একটা গাড়ি পাঠাতাম না। যা ঘটেছে এটা ঘটার কথা ছিল না। এর প্রতিশোধ আমি নেব।’ বলল ওপার থেকে।
‘সেটা আমিও জানি। কিন্তু আপনারা আমার বিরুদ্ধে লাগলেন কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা বাইরের কারো কোন প্রশ্নের জবাব দিই না। আপনার প্রশ্নের উত্তরও আমি দেব না।’ বলল ওপার থেকে।
‘না বললেও আমি জানি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি জানেন?’ ওপার থেকে চমকে ওঠা কন্ঠস্বর।
আমিও কোন প্রশ্নের জবাব দেব না। আহমদ মুসা বলল।
‘বেঁচে থাকলে তো জবাব দেবেনই! তবে দেবার সময় আপনি পাবেন না।’ বলল টেলিফোনের ওপার থেকে।
আহমদ মুসা পেছনে ও সামনে তাকাল। দেখল, দু’দিক থেকে দু’টি করে চারটি হেডলাইট ছুটে আসছে। হেড লাইটের অবস্থান ও ধরন দেখে বুঝল, ও দু’টি জিপ গাড়ি।
‘হ্যাঁ, আপনার পাঠানো দু’টি গাড়ি দুই দিক থেকে আসছে।’ আহমদ মুসা বলল।
টেলিফোনের ওপার থেকে কন্ঠটি হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘আহমদ মুসা, তোমার দখল করা গাড়িতে ট্রান্সমিটার ফিট করা আছে। গোলাগুলি ও গাড়ির সব কথাই আমরা শুনেছি। গাড়ির অবস্থান রিলে করার ব্যবস্থাও ঐ গাড়িতে আছে।’
‘ধন্যবাদ, এ তথ্যগুলো আমার জানা ছিল না। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার ভবিষ্যত এখনও আছে বলে আপনি মনে করছেন?’ বলল ওপার থেকে।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আল্লাহর ভূমিকায় বসতে চাইবেন না। মানুষের শক্তি খুবই সীমিত।’
ওপার থেকে হো হো হাসির শব্দ ভেসে এল। বলল, ‘জবাব আমি দেব না, জবাব তুমি পেতে যাচ্ছ আহমদ মুসা। তুমি চারদিক থেকে ঘেরাও। দু’পাশের পাহাড়ে আমাদের হেলিকপ্টার কমান্ডো পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘ধন্যবাদ। তোমার শক্তি আর আমার আল্লাহ ভরসা।’
বলেই আহমদ মুসা চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। মুখ ঘুরিয়ে গৌরীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ মিস গৌরী, আপনি গাড়ি থেকে নেমে যান, আর নাশকাকেও নামিয়ে নিন। তাড়াতাড়ি প্লিজ।’
বিস্ময় গৌরীর চোখে-মুখে। বলল, ‘কেন?’
সামনে ও পেছন থেকে আপনাদের দুই বা ততোধিক গাড়ি আসছে আমাকে টার্গেট করে। আপনারা এখন আমার কাস্টডিতে। কিন্তু একটু পরেই আমি আর আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর্যায়ে থাকবো না। তাই নিরাপদ হওয়ার জন্যে আপনাদের মুক্তি দিচ্ছি। প্লিজ মিস গৌরী! সময় নেই, তাড়াতাড়ি করুন।’ আহমদ মুসা বলল।
স্তম্ভিত গৌরী! সে কোন শত্রুকে দেখছে, না হিংসা-বিদ্বেষের মত মানবিক প্রবণতামুক্ত কোন এনজেলকে দেখছে! বলল সে, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। কিন্তু গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আপনিও তো সরে যেতে পারেন।’
সামনে ও পেছনের মত দু’পাশের পাহাড়ও আমার জন্যে নিরাপদ নয়। অন্ধকারে গুলি খাওয়ার চাইতে সামনা সামনি লড়াই করা ভাল মিস গৌরী।’ আহমদ মুসা আর কিছু বলল না।
গাড়ি থেকে নামল গৌরী। নামিয়ে নিল গুরুতর আহত নাশকাকেও।
গাড়ির দরজা গৌরীই এসে বন্ধ করে দিল। সেই সাথে গাড়ির দরজাও লক করে দিল গৌরী। সেই ফাঁকে ব্যাগ থেকে ছোট একটা বাক্স বের করে নিজের দেহের আড়ালে নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে টুপ করে সেটি সিটের উপর রাখল গৌরী। বিষয়টা খেয়াল করল না কেউ। তার কানে এল সশব্দে দরজা বন্ধ ও লক হওয়ার আওয়াজ। গৌরীর এই অযাচিত সাহায্যের জন্যে মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা নিজের পাশের দরজা খোলা রেখেছে ইমারজেন্সী এক্সিট হিসাবে, কিন্তু ওপাশের দরজা লকড থাকুক এটাই চেয়েছিল আহমদ মুসা।
গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা ওপাশের জানালার দিকে তাকাতে গিয়ে ছোট বাক্সটা তার চোখে পড়ল। চমকে উঠে আহমদ মুসা বাম হাত দিয়ে বাক্সটি আস্তে করে টেনে নিল। বাম হাত দিয়ে বাক্সটি চোখের সামনে তুলতেই চক্ষু স্থির হয়ে গেল আহমদ মুসার। বাক্সের উপর লেখা ‘ম্যাগনেটিক মেশিন জ্যামিং ডিভাইস(MMJD)’।
স্তম্ভিত আহমদ মুসা বাম হাতেই খুলে ফেলল বাক্সটি। ভেতরে ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিন। এই মেশিন সম্পর্কে সে পড়েছে, শুনেছে, কিন্তু দেখেনি। এই মেশিন মার্কেটেও আসেনি। বিজ্ঞানী ও প্রস্তুতকারকদের হাতেই মেশিনটা রয়েছে। এই মেশিন এখানে এল কি করে? সে নিশ্চিত গৌরীই তার ব্যাগ থেকে এটা রেখে গেছে। তার মানে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের হাতে এই জ্যামিং মেশিন রয়েছে।
গৌরীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল আহমদ মুসার মন। তার সাথে অবাক বিস্ময়ও! গৌরী তার দলের সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল কেমন করে! ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের লোকরা মৃত্যুর মুখেও দলের ব্যাপারে মুখ খোলে না। আর গৌরী আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল তার লোকদের পরাজয়, এমনকি ধ্বংসের অস্ত্র।
আহমদ মুসা ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিন (এমএমজেডি) সম্পর্কে বিস্তারিত পড়েছে। অস্ত্রটি ছোট কিন্তু যুদ্ধের জগতে এক বিস্ময়। এই অস্ত্রের ম্যাগনেটিক ফায়ার যে কোন মেটালে তৈরি যন্ত্রকে মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। ট্যাংক থেকে পিস্তল ও স্টিলমিল থেকে খেলনা গাড়ি সবাই এই ক্ষুদ্র অস্ত্রের কাছে অসহায়। অস্ত্রটি মাল্টিডাইমেনশনাল ও সিংগল ডাইমেনশনাল হতে পারে। এর সাহায্যে সাংঘাতিক কার্যকরি ফায়ার ফোকাসকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। টার্গেটের আয়তন যেমন হবে, এর ফায়ার ফোকাসকেও সেরকম করা যায়। তাতে আশেপাশের অনুরূপ কোন কিছু্র ক্ষতি হয় না।
হাসল আহমদ মুসা। গৌরী এক মোক্ষম অস্ত্র আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়েছে। এর মোক্ষম ম্যাগনেটিক ফায়ার শুধু ওদের গাড়িগুলোকে নয়, ওদের সব অস্ত্রকে অকেজো করে দেবে।
তাই হলো। সামনের গাড়ি ১০ গজ দূরে থাকতেই আহমদ মুসা ম্যাগনেটিক ফায়ার করেছিল, নিয়ন্ত্রিত ফায়ার। তারপর গাড়িটি মাত্র দুই গজ এগোতে পেরেছিল। আট গজের মাথায় গাড়িটা থেমে গিয়েছিল। পেছন থেকে আসা গাড়িও এই ভাগ্য বরণ করেছিল। তারা গাড়ি খুলতেও পারেনি। গাড়ির লক জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয় তাদের মোবাইলও কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ সেগুলোও জ্যাম হবার কথা।
আহমদ মুসা নিজের গাড়ি থামিয়ে সামনে ও পেছনে ম্যাগনেটিক ফায়ার করেছিল।
এবার আহমদ মুসা গাড়ি স্টার্ট করল। গাড়ি ঘুরিয়ে পেছন দিকে চলতে শুরু করল। মাইল দুয়েক পশ্চিমে এগোলেই তার হোটেলে ফেরার রাস্তা সে পেয়ে যাবে।
পেছনের নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা গাড়িটিকে পাশ কাটিয়ে আহমদ মুসার গাড়ি বেরিয়ে এল।
নিশ্চিন্ত হলো সে। ছুটতে লাগল তার গাড়ি। কিন্তু একশ’ গজও এগোতে পারল না। দু’পাশ থেকে শুরু হলো গুলি বৃষ্টি।
আহমদ মুসার পাশের জানালা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। তার সামনে দিয়েই কয়েকটা গুলি বেরিয়ে গেল। আহমদ মুসার দেহটা রিল্যাক্স মুডে সিটের উপর এলিয়ে পড়ে না থাকলে তার দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
মুহূর্তেই আহমদ মুসার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। পাহাড়ের দু’পাশে যাদের নামানো হয়েছিল তার পালানো পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্যে, তারাই তাদের বিপদগ্রস্থ গাড়ির দিকে ছুটে এসেছে। এদের মধ্যে গৌরী নিশ্চয় রয়েছে। তাদের গাড়িগুলোর কি বিপদ ঘটতে যাচ্ছে তা একমাত্র সেই-ই জানত। সেই-ই দ্রুত তার লোকদের সংগঠিত করার জন্যে এদিকে এসেছে। আহমদ মুসা বুঝল, কিছুটা এগোলেই সে এদের গুলির রেঞ্জের বাইরে যেতে পারবে। ইতিমধ্যেই দু’পাশের জানালা দিয়ে গুলি আসা প্রায় বন্ধ হয়েছে। এবার গুলি আসছে অপেক্ষাকৃত উপর থেকে। আঘাত করছে জানালার লেবেলের উপরে ও ছাদেও।
গুলি বৃষ্টির মধ্যে স্টিয়ারিং থেকে আহমদ মুসার হাত শিথিল হয়নি। সিটের সাথে সেঁটে থেকে হাত দু’টোকে যথাসম্ভব ঠিক রেখে সে স্টিয়ারিং হুইল নিয়ন্ত্রণ করছিল।
গুলি বৃষ্টি এখন আঘাত করছে আহমদ মুসার গাড়ির পেছন দিকে।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল ওদের গাড়ির রেঞ্জ থেকে। ওদের পক্ষে আহমদ মুসার গাড়ি ফলো করা সম্ভব নয়।
আহমদ মুসা আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু স্বস্তি তার স্থায়ী হলো না।
তার পকেটে থাকা গৌরীর মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল ধরল আহমদ মুসা।
ওপারের কথা শুনেই আহমদ মুসা বুঝল, ব্ল্যাক সান এই কিছুক্ষণ আগে কথা বলেছে।
লোকটি আহমদ মুসার কন্ঠ পেয়েই বলে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা ধন্যবাদ, আমাদের অস্ত্রে আমাদেরই ঘায়েল করলেন, সত্যিই আপনার নামের মতই আপনি! কিন্তু গৌরীর ব্যাগে যদি জ্যামিং মেশিন (MMJD) না পেতেন, তাহলে কিন্তু আপনার এই বিজয় লাভের সুযোগ ছিল না। গৌরী একটা ভুল করেছে। মেশিনটির সেফটি পিন খুলে নিলেই আপনার বুজরুগি সব হাওয়া হয়ে যেত!’
লোকটি একটু থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘জ্যামিং মেশিন ব্যবহার করেছি এটা আপনাকে কে বলল?’
‘অবান্তর প্রশ্ন। বলেছি তো, আপনার গাড়িতে সুপার সেনসেটিভ সাইট ট্রান্সমিটার আছে। সেটাই আমাকে বলে দিয়েছে। আরও বলে দিয়েছে, আপনি গাড়ি ঘুরিয়ে জ্যাম হয়ে যাওয়া পেছনের গাড়ির পাশ কাটিয়ে পশ্চিম দিকে এগিয়েছেন। দু’দিকের পাহাড় থেকে আমাদের লোকরা আপনাকে আটকাবার চেষ্টা করে। গুলি বৃষ্টির মধ্যেও গাড়ি চালিয়ে আপনি বের হয়ে এসেছেন। এখন আপনি নিরাপদ, তাই না?’
‘তা মনে করারই কথা।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার ওপার থেকে হো হো হাসির শব্দ। বলল ওপারের কন্ঠ, ‘আহমদ মুসা, বিপদ তোমার মাথার উপর পৌঁছতে দু’এক মিনিটের বেশি দেরি হবে না। ‘আরু’র পাশের পাহাড়েই আছে আমাদের ফ্লাইং-লিফটের একটি ঘাঁটি। সেখানে এক আসনের ফ্লায়ার থেকে দশ আসনের মিনি হেলিকপ্টার রয়েছে। ওগুলো দিনের আলোতে বের হয় না। এখন রাত।’
বলেই আবার হো হো করে হেসে উঠল লোকটি। হাসির মধ্যেই ওপারের লাইন অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ করল। চিন্তা করল, আরেকটা বিপদ আসছে। নিশ্চিত হওয়া গেল, পানির তলদেশ দিয়ে চলার জন্যে ওদের যেমন ক্ষুদ্র টিউব সাবমেরিন আছে, মিনি সাবমেরিন আছে, তেমনি আকাশে চলার জন্যে ওরা সম্ভবত ফ্লাইং টিউব, ফ্লাইং মডিউল, মিনি হেলিকপ্টার তৈরি করেছে। এসবের ফাংশন, চরিত্র, শক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুই জানা নেই তার। তার কাছে অস্ত্র আছে বলতে ওদের কাছ থেকে পাওয়া স্টেনগান, গৌরীর ফেলে যাওয়া রিভলবার ও সেই জ্যামিং মেশিন।
চোখ খুলল আহমদ মুসা। তাকাল মাথার উপর গাড়ির ছাদের দিকে। দেখল যা ভেবেছিল তাই। ছাদের এ অংশটা স্লাইডিং।
আহমদ মুসা সুইচ টিপে স্লাইডিং ডোরটা খুলে ফেলল। দুই ফুট চওড়া ও তিন ফুট লম্বা আয়তকার একটা স্পেস বের হয়ে গেল। তাকাল উপরের দিকে। আবার সেই ভাবনা, ফ্লাইং টিউব বা ফ্লাইং মডিউল অথবা মিনি হেলিকপ্টার যাই আসুক, তারা কি করতে চাইবে! বোমা মেরে গাড়ি সমেত তাকে ধ্বংস করবে? কিন্তু তা করলে তার আস্ত লাশ পাবে কি করে? লাশ না পেলে তো এক বিলিয়ন ডলার পাবে না। আকাশ থেকে গুলি বৃষ্টি করে তাকে মারবে! কিন্তু সেজন্যে ফ্লাইং বস্তুটিকে অনেকখানি নিচে নেমে আসতে হবে। সে ঝুঁকি তারা নেবে! কারণ আহমদ মুসার কাছেও স্টেনগানের মত অস্ত্র আছে, তা তারা ধরেই নেবে। অবশ্য বড় রেঞ্জের কোন লাইটগান তাদের হাতে থাকতেই পারে, এটা ভাবল আহমদ মুসা। কিন্তু তারা কি গুলি করবে? তারা অক্ষত মানুষ বা লাশ চায়।
আবার উপর দিকে চাইল আহমদ মুসা।
কোন দিকে থেকে কোন ধরনের শব্দ নেই। হঠাৎ তার মনে এল, ওরা শব্দহীন ফ্লাইং ভেহিকেলস তো তৈরি করতে পারে!
সতর্ক হলো আহমদ মুসা। তার সন্ধানী চোখ ঘুরতে লাগল মাথার উপর আকাশে। তার চোখ ঘুরে আরু’র পুব আকাশে আসতেই অমাবস্যার চাঁদের মত গোলাকার চলন্ত অন্ধকারকে এগিয়ে আসতে দেখল।
চট করে আহমদ মুসার মনে পড়ল, ব্ল্যাক সানের সেই নেতা একটু আগে তাকে মোবাইলে জানালো আরু’র পাশের তাদের ফ্লাইং ঘাঁটি থেকে তাদের ফ্লাইং ভেহিকেল আক্রমণে আসবে। এই চলন্ত অন্ধকারই কি সেই অ্যাটাকিং ফ্লাইং ভেহিকেল!
চলন্ত গোলাকার সেই অন্ধকার যানটি দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল তার গাড়ির দিকে। এগিয়ে আসছে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে। আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পীড সর্বোচ্চ সীমায় তুলল, কিন্তু বিস্ময়ের সাথে দেখল, সেই গোলাকার অন্ধকারটি সঙ্গে সঙ্গেই তার কৌণিক অবস্থান এডজাস্ট করে নিল! আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না, তার গাড়ির ট্রান্সমিটারটিই ঐ ফ্লাইং অন্ধকার বস্তু অর্থাৎ ব্ল্যাক সান-এর ফ্লাইং ভেহিকেলকে গাইড করছে।
তার মানে তার গাড়ির সাউন্ড ট্রান্সমিটার শুধু শব্দই ট্রান্সমিট করে না, নির্দিষ্ট এক ওয়েভ লেংথে তার অবস্থানকেও রিলে করে। সুতরাং তার গাড়ি যেখানেই যাক, ফ্লাইং ভেহিকেলটি তাকে লোকেট করবেই।
ফ্লাইং ভেহিকেলটি আহমদ মুসার গাড়ির চেয়ে কয়েকগুন বেশি বেগে এগিয়ে আসছে। ইতিমধ্যেই ফ্লাইং ভেহিকেলটি ৭০ডিগ্রি কোণে উঠে এসেছে। মাথার উপর আসতে দেরি নেই।
আহমদ মুসা গাড়ি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল।
ফ্লাইং ভেহিকেলকে পিছু ছাড়াবার দেখা যাচ্ছে এটাই একমাত্র পথ।
হার্ড ব্রেক কষে আহমদ মুসা তার গাড়ি থামাল।
জ্যামিং মেশিন, গৌরীর রিভলবার ও একটি স্টেনগান নিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
গাড়ি থেকে নেমেই আহমদ মুসা সামনের দিকে দৌড় দিল। আর শ’গজের মত এগোলেই দু’দিকের পাহাড় অতিক্রম করে অনেকটা সমতল এলাকায় গিয়ে পৌঁছবে। তাতে আশেপাশের তার মুভ করার সুযোগ হবে।
দু’পাশের পাহাড়ের দেয়াল পার হতেই আহমদ মুসার পকেটে থাকা গৌরীর মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইল ধরল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার ‘হ্যালো’ বলে সাড়া দিতেই ওপার থেকে সেই ‘হো হো’ হাসির শব্দ ভেসে এল। হাসি থামলে কন্ঠটি বলল, ‘আহমদ মুসা, তুমি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রক্ষা পাবে না । আমাদের সর্বগুণান্বিত ভেহিকেল জুনিয়র এক্সেকিউটর-১ পাঠিয়েছি। তার চোখ আপনাকে খোঁজে নিবেই। আপনার লাশ আমরা চাই-ই।
একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহ ছাড়া সর্বগুণান্বিত ও সর্বশক্তিমান আর কেউ নেই। সবচেয়ে নিখুঁত বলে আমরা যাকে ভাবি তার মধ্যেই বড় খুঁত রয়ে যায়। নির্ভুল হবার সর্বশক্তিমান হবার অহংকার একমাত্র আল্লাহরই সাজে। তার সৃষ্টির এই দাবি করা মুর্খতা। আহমদ মুসা বলল।
ওপার থেকে আবার সেই হাসি। বলল, আমাদের সবচেয়ে ছোট অস্ত্র ‘জুনিয়র এক্সকিউটর-১’ আমরা পাঠিয়েছি। তার শক্তিটা একবার দেখ।এই কথা শেষ হবার পরে আবার তার সেই হাসি। কেটে গেল ওপার থেকে করা মোবাইলের লাইন।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা ওপরে তাকিয়ে দেখল কথিত সেই জুনিয়র এক্সকিউটর-১ আরও অনেক নিচে নেমে এসেছে। এসে পৌছেছে প্রায় মাথার ওপর। স্টেস ভেহিকেল জুনিয়র এক্সকিউটর-১ এখনও গুলীর রেঞ্জের অনেক ওপরে। তবে নামছে এক্সকিউটর-১।
নেমে এল অনেক নিচে। কোন পথে আক্রমণ আসবে তার অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসা। হঠাৎ ওপর থেকে এক পশলা গুলি বৃষ্টি ছুটে এল নিচে। শব্দ থেকে বুঝল গুলী স্টেনগান থেকেই এসেছে
একটা বড় পাথরের গা ঘেঁষে আহমদ মুসা বসে পড়েছিল। তার চারপাশে গুলীর একটা রিং তৈরী হলো। আহমদ মুসা বুঝল তাকে লক্ষ্য করে গুলী করা হয় নি।
ওপর থেকে গুলী বর্ষণ বন্ধ হতেই আহমদ মুসা তার স্টেনগান তুলে গুলী করল জুনিয়র এক্সকিউটর-১ লক্ষ্য করে। গুলীগুলো, ফিরে এল নিচে। গোটা স্পেস ভেহিকেলটা বুলেট প্রুফ বুঝল আহমদ মুসা। একটা ভাবনা এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে। স্টেনগান অকেজো হয়ে পড়ার পর আত্মরক্ষা ও আক্রমণের আর কি অপশন বাকি থাকল তার কাছে ?
আহমদ মুসার ভাবনা শেষ হতে পারলো না হঠাৎ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল ওপর থেকে আসা ও ফিরে আসা বুলেটগুলো আবার ওপরে উঠে যাচ্ছে। হাতের স্টেনগানেও টান পড়েছে।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। ম্যাগনেটিক পুলিং। কথাটা আহমদ মুসার মাথায় আসার সাথে সাথেই জ্যাকেটের পকেট জুড়ে থাকা ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিন টেনে বের করে দ্রুত পাওয়ার অন করে টপ ফোকাসের চারদিক সীমাবদ্ধ করে ফাংশন অপশন স্টার্ট করল। সংগে সংগে জ্যামিং মেশিনের অদৃশ্য ফায়ার ফোকাস ছুটল এক্সকিউটর-১ লক্ষ্যে।
আহমদ মুসার মাথার ওপরের আকাশে জুনিয়র এক্সকিটর-১ যেমন স্থির দাঁড়িয়েছিল, তেমনি স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক ফায়ার কোন কাজ করল না বুঝল আহমদ মুসা। এর পর একটা জিনিস লক্ষ্য করল, নিচে গ্রাউন্ড থেকে বুলেটের মত মেটালিক দ্রব্য উপরে উঠে যাচ্ছিল, তা বন্ধ হয়ে গেল। হাতে ধরা স্টেনগান ও জ্যামিং মেশিনও আর উপর থেকে টান অনুভব করল না। তার মানে জুনিয়র এক্সকিউটর-১ এর ম্যাগনেটিক পুলকে তার ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক ফোকাস নিউট্রাল করে দিয়েছে। কিন্তু জুনিয়র এক্সকিউটর-১ এর কোন ক্ষতি করতে পারল না তার জ্যামিং মেশিন। নিশ্চয় ম্যাগনেটিক জ্যামিং প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা এতে আছে। তবে আহমদ মুসা আরেকটা জিনিস ভেবে খুব খুশি হলো, জুনিয়র এক্সকিউটর-১ থেকে গুলী করে তার কোন ক্ষতি করতে ওরা পারবে না। তার ম্যাগনেটিক জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক ফায়ার বুলেটকেও নিউট্রাল করে দিতে পারে। এটা এক্সকিউটরও নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে।
তাহলে এক্সকিউটর এখন আগাবে কোন পথে ?
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল তার নিজের কিডন্যাপ হওয়ার কথা। ব্ল্যাক সান-এর গৌরিরা তাকে কিডন্যাপ করেছে ক্লোরোফরম কিংবা ঐ জাতীয় চেতনা লোপকারী গ্যাস প্রয়োগ করে। আর কাউকে আস্ত কিডন্যাপ করার এটাই সবচেয়ে সহজ পথ। তাছাড়া তারা লাশ চাইলে জীবনবিনাশী কোন গ্যাসও ব্যবহার করতে পারে।
যতদুর পারা যায় এর আওতা থেকে দূরে সরতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো গাড়ি থেকে নামার পরও জুনিয়র এক্সকিউটর-১ তাকে অনুসরন করছে কিভাবে। ব্ল্যাক সানের লোকেরা বলছে আমি যেখানে যাই, এর হাত থেকে বাঁচতে পারবো না। এক্সকিউটর-১ এর চোখ আমাকে খোঁজে নিবেই। কিন্তু কিভাবে? গৌরীর গাড়িতে সাউন্ড ট্রান্সমিটার ছিল। কিন্তু আমার সাথে তো সাউন্ড ট্রান্সমিটার কিংবা অন্য কোন ট্রান্সমিটার নেই।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের অস্ত্রশস্ত্র সব কিছুর সাথে ট্রান্সমিটার চীপস লাগানো আছে। যেহেতু আমার সাথে গৌরীদের মানে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের একটি রিভলবার, একটি স্টেনগান এবং একটি জ্যামিং মেশিন আছে। এর সবগুলোতেই কিংবা কোন একটিতে ট্রান্সমিটার চীপস লাগনো রয়েছে।
আহমদ মুসা রিভলবার ও স্টেনগান ছুঁড়ে ফেলে দিল। কিন্তু হাতে নিয়েও জ্যামিং মিশিনটি ফেলে দিতে পারলো না । মেশিনটি তার দরকার। ভাবল আহমদ মুসা, জ্যামিং মেশিন নিয়ে সে সরে যাবে। এক্সকিউটর-১ যদি তাকে সেখানেও ফলো করে তাহলে বুঝা যাবে জ্যামিং মেশিনেও ট্রান্সমিটিং চীপস রয়েছে।
এসব চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। আকাশে চাঁদ নেই। চারদিকে অন্ধকার। উচ্চতা ও চারদিক উন্মুক্ত হওয়ার কারণে কিছুটা স্তব্ধতা থাকলেও ভূমি সন্নিহিত স্থানে অন্ধকারটা একেবারে ঘুটঘুটে।
আহমদ মুসা রাস্তা এড়িয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে দ্রুত এগোলো পশ্চিম দিকে। মাইল খানিক এগোবার পর একটা টিলার গোড়ায় গিয়ে বসল। এখান থেকে কয়েক গজ এগোলেই হাইওয়ে থেকে একটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে হোটেলের দিকে। আহমদ মুসার চোখ আকাশের দিকে। ব্ল্যাক সানের জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ তাকে ফলো করছে কি না, এটাই তার দেখার বিষয়।
দু’তিন মিনিটও পার হয় নি। আহমদ মুসা দেখল এক্সিকিউটর-১ মানে সেই গোলাকার জমাট অন্ধকারটি দ্রুত এসে তার মাথার ওপর স্থির হলো। আর সংগে সংগেই এক্সিকিউটর-১ এর তলদেশে একটা নীল আলো জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল।
আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল এক্সিকিউটর-১ এর দিকে। একটা মিষ্টি নীল আলো জ্বলে উঠে নিভে যেতে আহমদ মুসাও দেখল। একটু বিস্মিতই হলো আহমদ মুসা এক্সিকিউটর-১ এর ম্যাগনেটিক পুল থ্রো হওয়ার সময়ও আলো জ্বলেছিল, তবে সেটা ছিল কমলা, কিন্তু এবার নীল আলো কেন? হঠাৎ আহমদ মুসার মাথায় এল, নীল রঙ হচ্ছে বিষের প্রতীক। নীল আলো কি সেই সংকেত দিল ? তার মানে বিষাক্ত কোন অস্ত্র তাক করা হয়েছে ?
সে ধরনের বিষাক্ত গ্যাস যদি কোন প্রকার গান থেকে ফায়ার করে থাকে তাহলে এখন তা থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। কারণ উপরের এক্সিকিউটর-১ থেকে ফায়ার করা গ্যাসীয় ওয়েভ মাটিতে পৌছতে পাঁচ দশ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না। এই সময়ের মধ্যের এক্সিকিউটর-১ এর আওতা থেকে বের হওয়া অসম্ভব।
এই চিন্তার সংগে সংগেই আহমদ মুসা পকেট জ্যামিং মেশিন বের করে এক্সিকিউট-১ কে টার্গেট করল। সে জানেনা ম্যাগনেটেড জ্যামিং ওয়েভ বিষাক্ত গ্যাস ওয়েভের প্রতিরোধে কিছু আসবে কিনা। কিন্তু যেহেতু করার কিছু নেই তাই আল্লাহ ভরসা করা যা হাতে আছে সেটাই কাজে লাগাতে হবে।
বিষাক্ত গ্যাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর হলো বাইরের বিষাক্ত গ্যাস দেহের ভেতরে ঢুকতে না দেয়া। বিষাক্ত গ্যাসের এ্যাকশন দেড় দু’মিনিটের বেশি থাকে না।
আহমদ মুসা পকেটের রুমাল আঁট ভাজ করে নাক ও মুখের উপর রাখল। তারপর মোবাইলের স্ক্রীন লাইট অন রেখে স্ক্রীনের পরিবর্তনের প্রতি নজর রাখল। বিষাক্ত গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারী এবং কিছুটা অস্বচ্ছ। যা স্বচ্ছ স্ক্রীন লাইটের উপর কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। সেটায় দেখবে সাথে সাথে সে নাক, মুখ ও চোখ পুরোপুরি বন্ধ রাখবে। যেহেতু পালিয়ে বাঁচার কোন উপায় নেই, তাই আত্মরক্ষার এটুকু ব্যবস্থা ছাড়া তার করার কিছু নেই।
সমস্ত ইন্দ্রিয়ের সবটুকু মনোযোগ খোলা রেখে আহমদ মুসা অপেক্ষা করছিল। তার দুই চোখ আঠার মত লেগেছিল মোবাইলের স্ক্রীনে। কিন্তু স্ক্রীন সংকেত দেবার আগেই আহমদ মুসা তার শরীর থেকেই সংকেত পেয়ে গেল। হঠাৎই আহমদ মুসার মনে হলো একটা ভারী ঠান্ডা বাতাস যেন তার মাথার উপর চেপে বসল।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা মুখ ও শ্বাস বন্ধ করে চোখ বুজল। পল পল করে সময় বয়ে চলল।
আহমদ মুসা অনুভব করছে সেই ঠাণ্ডা ভারী বাতাসের ছোয়া যেন চারদিক থেকে এসে আহমদ মুসাকে চেপে ধরল। বুঝল বিষাক্ত গ্যাসেরই ঠান্ডা ছোবল এটা। হিমশীতল মৃত্যু নিয়ে এলো এই ঠান্ডা ছোবল। কোন ধরনের বিষ এটা? কোন কেমিক্যাল গ্যাস, না সাইনাইডের গ্যাসীয় রূপান্তর এটা। এ প্রশ্নের উত্তর আহমদ মুসার কাছে নেই।
সময় বয়ে চলছে পল পল করে। একের পর এক বিষাক্ত গ্যাসের ওয়েভ আসছে। বয়ে যাচ্ছে তা দেহের উপর দিয়েই।
দেড় মিনিট পার হয়ে গেছে।
আহমদ মুসার ফুসফুস মুক্ত বাতাসের জন্যে আকুলি-বিকুলি শুরু করেছে। আকুলি-বিকুলিটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই বিকুলিটা এক সময় বুক ফেটে যাওয়ার চিৎকারে পরিনত হলো। বিষাক্ত গ্যাসের মৃত্যু ছোবল তখন আহমদ মুসার কাছে গৌণ হয়েছে। অস্থির হয়ে উঠেছে তার শরীর। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। ইচ্ছার ওপর বুদ্ধির নিয়ন্ত্রন যেন শিথিল হয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রন ভেঙে বন্ধ নাক বন্ধ মুখ যেন এখনি মুক্ত বাতাসকে গ্রোগ্রাসে গিলবে।
আহমদ মুসা মুখ ও নাকের রুমালকে নাক ও মুখের উপর আরও ভালভাবে সেঁটে ধরে ধীরে ধীরে রুমালের মধ্য থেকে নিঃশ্বাস ছাড়ল ও গ্রহণ করল খুব ভয়ে ভয়ে। কিন্তু যেটুকু পেল তার কোন প্রতিক্রিয়া সে অনুভব করল না। আরও কিছুক্ষণ পর সে নাকে মুখে চেপে রাখা কাপড়ের ভেতর দিয়ে শ্বাস গ্রহণ করল। না, কোন প্রতিক্রিয়া নেই। হাত ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে চোখ বুলিয়ে দেখল ইতিমধ্যে দেখল আড়াই মিনিট পার হয়েছে। আহমদ মুসা দেখেছে এক্সিকিউটর-১ থেকে সেই ভয়ংকর নীল তিনবার জ্বলেছে। তার মানে জীবনবিনাশী বিষাক্ত গ্যাসের ফায়ার তিনবার হয়েছে। শেষ ফায়ার থেকে দুই মিনিট সময় পার হয়েছে। সুতরাং বিষাক্ত গ্যসের কার্যকরীতা এখন আর নেই। চারদিকের বাতাস এসে বিষাক্ত গ্যাসকে হজম করে ফেলেছে।
আরও কিছুক্ষণ পর আহমদ মুসা রুমাল সরাল তার নাক মুখ থেকে। সত্যি ফ্রেশ বাতাস পেল আহমদ মুসা। উন্মুক্ত নাক দিয়ে বুক ভরে বাতাস নিয়ে আহমদ মুসা এক্সিউকিউটর-১ মাথার ওপর ঠিক দাঁড়িয়ে আছে। কি করণী এখন ভাবছে আহমদ মুসা। সে বেঁচে আছে জানলে এক্সিকিউটর-১ আবার আক্রমনে আসবে। আরও একটু ভেবে আহমদ মুসা উৎসাহিত হয়ে মনে মনে বলল।
আহমদ মুসা বেঁচে নেই এই ম্যাসেজ এক্সিকিউটরকে দেবার সহজ পথ হলো, জ্যামিং মেশিন এখানে রেখে চলে যাওয়া। তার কাছে থাকা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের চীপসটি নিশ্চয় জ্যামিং মেশিনের সাথেই আছে। জ্যামিং মেশিন এখানে রেখে যদি আহমদ মুসা চলে যায়, তাহলে এক্সিকিউটর-১ ভাববে আহমদ মুসা এখানেই আছে এবং মরে গেছে। কারণ বিষাক্ত গ্যাসের হাত থেকে কোন ভাবে বাচলেও এখানে আর আমার কোন ভাবে থাকার কথা নয়, এটাই তার নিশ্চিত ভাবার কথা। সুতরাং জ্যামিং মেশিন এখানে রেখে সে নিরাপদে চলে যেতে পারে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আহমদ মুসা।
জ্যামিং মেশিনটি পাথরের গোড়ায় একটা গর্তের মত জায়গায় লুকিয়ে রাখল যাতে মেশিনটি প্রথম দৃষ্টিতেই খুঁজে না পায়।
আহমদ মুসার কষ্ট লাগল জ্যামিং মেশিনটি এভাবে রেখে যেতে। কিন্তু শেষে ভাবল, সব বিষয় আল্লাহই ভাল জানেন। আল্লাহ ছাড়া আর কারও বা অন্য কিছুর উপর আমি নির্ভরশীল নই।
আহমদ মুসা পাথরটির পেছনে দিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে মাটির সাথে সেঁটে রেখে ক্রলিং করে চলল রাস্তার সামনের মোড়টির দিকে, যেখান থেকে এক রাস্তা চলে গেছে তার হোটেলে। চলতে চলতে আহমদ মুসা ভাবল, এক্সিকিউটর-১-এ যদি নাইট ভিশন আই কিংবা রাতে দেখার মত অন্য কোন ব্যবস্থা থেকেও থাকে, তবু মাটিতে তাকে ক্রলিং অবস্থায় ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়।
ক্রলিং করে আহমদ মুসা রাস্তার মোড় পর্যন্ত পৌঁছল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
তারার আলোতে যেটুকু স্বচ্ছতা, তা মাটি পর্যন্ত পৌঁছেনি।
আহমদ মুসা এক টিলার উপর বসে তাকাল পুব আকাশে। এক্সিকিউটর-১ অস্পষ্ট ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে। তখনও স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়।
ভাবল আহমদ মুসা, এক্সিকিউটর-১-এর দৃষ্টিতে মৃত আহমদ মুসাকে নেবার জন্যে ওটা তো নিচে নামার কথা। কিন্তু এক ইঞ্চিও তো নিচে নামেনি! তাহলে কারও অপেক্ষা করছে কিংবা লাশ নেবার জন্যে তাদের গাড়িগুলোকে কি নির্দেশ দেয়া হয়েছে? শেষেরটাই স্বাভাবিক। কিছু দূরেই তো ওদের গাড়ি ও লোকজন রয়েছে। জ্যাম গাড়িগুলোকে নিশ্চয় এতক্ষণে সচল করা হয়েছে।
সতর্ক হলো আহমদ মুসা। ওরা এসে যদি আহমদ মুসার লাশ না পায়, তাহলে আহমদ মুসার সন্ধানে ছুটবে আবার তারা। সেক্ষেত্রে আহমদ মুসাকে তারা প্রথমেই খুঁজবে হোটেলে তার কক্ষে।
আহমদ মুসাও হোটেলে ফেরারই সিদ্ধান্ত নিল। ওদের গতিবিধি সম্পর্কে আহমদ মুসারও জানা দরকার।
হোটেলের রাস্তা ধরে দ্রুত এগোল আহমদ মুসা।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের দু’টি গাড়ি ও অনেক লোক তন্নতন্ন করে খুঁজল চারদিক কিন্তু আহমদ মুসার লাশ কোথাও পেল না।
সবাই ফিরে এসে মাথা নিচু করে বসে বলল, শয়তানটার লাশ কোথাও নেই ম্যাডাম।
গৌরীর চোখে বিস্ময় ও বিহ্বল ভাব থাকলেও আহমদ মুসার লাশ পাওয়া গেল না এই খবরে গৌরী দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হবার চেয়ে খুশিই হলো যেন বেশি! চমকে উঠল গৌরী। মনকে শাসন করল সে। লোকদের দিকে চেয়ে দ্রুত বলল, সে বেঁচে থাকলে অবশ্যই সাথে করে জ্যামিং মেশিন নিয়ে যেত। নিশ্চয় সে বেঁচে নেই। তোমরা আরও ভাল করে দেখ।
এটা বলল বটে গৌরী। তবে নিজের কথায় নিজেই জোর পেল না।
লোকরা আবার চারদিকে ছুটল।
গৌরী মোবাইল করল ক্রিনিনকে।
বলল, ক্রিনিন আহমদ মুসার লাশ এখনও পাওয়া যায়নি।
ক্রিনিন জুনিয়র এক্সিকিউটর-১-এর কমান্ডার। গৌরীর কথার উত্তরে দুই চোখ কপালে তুলে সে বলল, পাওয়া যাবে না কেন? নিশ্চয় পাওয়া যাবে ম্যাডাম। আমি এক্সিকিউটরের লাইটভিশন টেলিস্কোপে দেখে তাকে টার্গেট করেই ফায়ার করেছি। ফায়ারের আড়াই মিনিটের মাথায় আবার আমি দেখেছি পাথরে তার দেহ ঠেস দিয়ে থাকা। সে বাঁচেনি, বাঁচতে পারে না। তার লাশ পাওয়া যাবে না কেন?
কিন্তু লাশ থাকলে তো জ্যামিং মেশিনের পাশেই থাকার কথা। জ্যামিং মেশিন পাথরের গোড়াতেই পাওয়া গেছে, কিন্তু তাকে তো পাওয়া যাচ্ছে না! ক্রিনিন, তুমি এক্সেলেন্সি লর্ডকে কিছু জানিয়েছ? বলল গৌরী।
জি ম্যাডাম। আমি মাই লর্ডকে জানিয়েছি, ফায়ার সফল। আহমদ মুসাকে টার্গেট করেই ফায়ার হয়েছে।
ফায়ারের পর তার দেহকে একটা পাথরের সাথে দেখা গেছে। ক্রিনিন বলল।
ঠিক আছে ক্রিনিন। আমি দেখছি এদিকে। দেখা যাক, শেষটা কি দাঁড়ায়।
গুড বাই, জানিয়ে কল অফ করে দিল।
কিন্তু মোবাইল পকেটে রাখা আর হলো না।
মোবাইল বেজে উঠল আবার।
গৌরী মোবাইল এগিয়ে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়েই জড়সড় হয়ে গেল।
মোবাইলটা মুখের সামনে নিয়ে বলল, ইয়েস মাই লর্ড, আমি গৌরী।
লাশ ঠিকঠাক আছে? কি করছ তোমরা এখন? বলল ওপার থেকে আলেক্সি গ্যারিন।
মুখ শুকিয়ে গেল গৌরীর। বলল, মাই লর্ড, এখনও লাশ আমরা খুঁজে পাইনি।
কি বলছ, লাশ পাওনি মানে? পাথরটির কাছে লাশ নেই? জিজ্ঞাসা আলেক্সি গ্যারিনের।
মাই লর্ড, পাথরের গোড়ায় আমরা আমাদের জ্যামিং মেশিন পেয়েছি। কিন্তু লাশ আমরা পেলাম না। গৌরী বলল।
তার মানে ক্রিনিন মিথ্যা বলেছে। গৌরী, পাথরের কাছে যখন আহমদ মুসার লাশ পাওয়া যায়নি, তখন সেখানে ক্রিনিনের লাশ থাকবে। অপেক্ষা কর গৌরী। বলে আলেক্সি গ্যারিন কল অফ করে দিল ওপার থেকে।
কেঁপে উঠল গৌরী। সে জানে এরপর কি ঘটবে। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল গৌরী। তিরিশ সেকেন্ডও পার হলো না।
একটা ভারী বস্তু এসে পড়ল গৌরীর কাছেই। আবার কেঁপে উঠল গৌরী। না দেখলেও সে নিশ্চিত যে, ওটা ক্রিনিনের লাশ।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটে ব্যর্থতার এটাই শাস্তি। এখানে বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দিতে বিলম্ব হয় না, বিলম্ব করে না আলেক্সি গ্যারিন। জুনিয়ন এক্সিকিউটর-১-এ যেখানে কমান্ডার ক্রিনিনের আসন ছিল, সেখানে তার মাথা বরাবর পেছনে ইস্পাতের দেয়ালে একটা ফুটো আছে। সেই ফুটোতে ফিট করা রয়েছে দূরনিয়ন্ত্রিত বিশেষ ধরনের রিভলবারের ব্যারেল। রিমোট কনট্রোলের বোতাম চেপে এই গানে ফায়ার করেছে আলেক্সি গ্যারিন। হত্যা করে সিসি টিভি’তে তার ছবি দেখেছে সে। তারপর রিমোট কনট্রোলের আরেকটা বোতাম টিপে ক্রিনিনের সিটের নিচে এক্সিকিউটর-১-এর একটা অংশ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সেই উন্মুক্ত পথে সিট থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে ক্রিনিনের লাশ। এই সব দৃশ্য, এ সব প্রসেস গৌরীর মুখস্ত। সে কারণেই চমকে উঠেছিল তার লর্ড আলেক্সি গ্যারিনের কথা শুনে।
গৌরী গিয়ে ক্রিনিনের লাশ টেনে এনে পাথরের গোড়ায় রাখল।
আবার বেজে উঠল গৌরীর মোবাইলটা। গৌরী মোবাইল ধরল।
পেয়েছ ক্রিনিনের লাশ? ওপার থেকে জিজ্ঞাসা আলেক্সি গ্যারিনের।
ইয়েস মাই লর্ড। ওটা নিয়ে পাথরের গোড়ায় রেখেছি। বলল গৌরী।
শোন, দু’তিনজনকে লাগাও লাশগুলোকে মানুষের চোখের আড়াল করতে। অবশিষ্টরা জিলাস-এর নেতৃত্বে আহমদ মুসাকে ফলো করবে। প্রথমে হোটেলে। তারপরের নির্দেশ আমি দেব। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
স্যরি মাই লর্ড, আমরা যারা তাকে ধরার জন্যে প্রথম অভিযানে এসেছিলাম, তারা তার ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধান হতে পারিনি। স্যরি মাই লর্ড, বলল গৌরী।
ব্যর্থতা তোমাদের নয় গৌরী, সফলতা আহমদ মুসার। সফলতা তার প্রায় অতিমানবিক বুদ্ধি ও ক্ষিপ্রতার। প্রথমটায় আমিও তাকে অবমূল্যায়ন করেছিলাম গৌরী। সে যে আহমদ মুসা, এ বিষয়টাকে আমি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেইনি। আসলে আহমদ মুসা অপরাজিত এক ডেভিল। সে বারবার ফাঁদে পড়েছে, কিন্তু সব সময়ই ফাঁদ কেটে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে বের হয়ে গেছে। বলা যায় গৌরী, আমাদের পশ্চিমা বন্ধুদের সব শক্তি তার কাছে পরাজয় বরণ করেছে। এ জন্যেই এখন তারা বলছে, তাকে ধরা নয়, দেখা মাত্র হত্যা করতে হবে। তারা যে ঠিক বলছে, আজকের রাতের ঘটনা তা প্রমাণ করল।
কিন্তু গৌরী ক্রিনিনকে জীবন দিতে হলো তার একটি ভুলের কারণে। বিষাক্ত গ্যাসে আহমদ মুসার সত্যিই মৃত্যু হয়েছে কিনা, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে তা নিশ্চিত করেনি।
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, তুমি ও নাশকা আহত। তোমরা চলে এস। বলে দিয়েছি, জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ ল্যান্ড করছে সেখানে। গুড বাই।
কথা শেষ করেই আলেক্সি গ্যারিন ওপার থেকে কল অফ করে দিল।
কিন্তু গৌরী মোবাইল হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। তার মাথায় কিলবিল করছে অনেক চিন্তা। তার লর্ড আলেক্সি গ্যারিন আহমদ মুসাকে ‘ডেভিল’ বলেছে। এখন পর্যন্ত তাকে হারাতে না পারার কারণেই তাকে ডেভিল বলা হচ্ছে। মনে পড়ল তার ‘লা ডায়মন্ড ড্রপ’ হোটেলের ‘অ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে’ মানব-মানবীর সম্পর্ক বিষয়ে আহমদ মুসার একান্ত মানবিক কথাগুলো। মনে পড়ল তাদের প্রতি আহমদ মুসার বিস্ময়কর আচরণের কথা। এই মানুষ যদি ‘ডেভিল’ হয় তাহলে অ্যাঞ্জেল বলে কোন কিছু সৃষ্টিতে নেই। মানুষ অ্যাঞ্জেল হতে পারে না। মানুষ যদি মানুষ হতে পারে, তাহলে অ্যাঞ্জেলের চেয়ে বড় হয়, এটা পড়েছি। আমার জীবনে আহমদ মুসাকে আমি প্রথম মানুষ দেখলাম যে অ্যাঞ্জেলের চেয়ে বড়। আহত ডান হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকাল গৌরী। এই ব্যান্ডেজ বেঁধেছে আহমদ মুসা। তার হাতের স্পর্শ লেগে আছে এই ব্যান্ডেজে। রোমাঞ্চিত হলো গৌরীর দেহ। বাম হাত দিয়ে ডান হাত তুলে নিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করল ব্যান্ডেজে।
পাশ থেকে শব্দ ওঠায় চমকে উঠে ফিরে তাকাল গৌরী।
জুনিয়ন এক্সিকিউটর-১ ল্যান্ড করেছে।
এক্সিকিউটর-১ থেকে ডেপুটি কমান্ডার (এখন কমান্ডার) নিলাপ্পা।
তাকে দেখেই গৌরী বলল, হ্যাঁ নিলাপ্পা, তুমি ওয়েট কর। আমি এদিকের কাজ সেরে নিই। বলল গৌরী।
ইয়েস ম্যাডাম। বলল নিলাপ্পা।
গৌরী তার মোবাইলে একটা কল তৈরি করতে করতে একটু দূরে সরে গেল।
ক্যাপিটাল অব পাওয়ার।
বিশ্বমিলনায়তন (Hall of World Assembly)।
বিশ্বনির্বাহীদের কাউন্সিল বৈঠক।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এটাই সর্বোচ্চ পরামর্শ সভা। ব্ল্যাক সানের ৫ জন শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা এই কাউন্সিলের সদস্য। ব্ল্যাক সানের সুপ্রিম কমান্ডার ও প্রেসিডেন্ট লর্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড আলেক্সি গ্যারিন এই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
অর্ধ বৃত্তাকার টেবিল ঘিরে বসেছে পাঁচজন শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা।
টেবিলের বিপরীতে বৃত্তাকার প্রান্তের সামনে সূর্যাকার টেবিলের পেছনে কোন চেয়ার নেই।
ঠিক রাত ১২ টা বেজে ১ মিনিট ঘরের ছাদ ফুঁড়ে একটা টিউব লিফট নেমে এল। লিফটটি কালো ছিল। লিফটটি নেমে এল সূর্যাকার টেবিলটির পেছন পাশ ঘেঁষে।
লিফটটি নেমে মুহূর্তকাল স্থির হয়েই আবার উঠে গেল। লিফট উঠে যেতেই দেখা গেল সিংহাসনাকৃতির একটা চেয়ারে দীর্ঘাকৃতির একজন শিরদাঁড়া সোজা করে অ্যাটেনশন অবস্থায় বসে। দেহে তাঁর সামরিক পোশাক। মাথায় কালো সামরিক ক্যাপ। ক্যাপের সামনে ব্ল্যাক সানের একটা মনোগ্রাম। তাঁর দুই কাঁধ ও বুকে সেই একই মনোগ্রামের প্লেট।
কালো মূর্তিসহ নেমে আসা চেয়ারটি মেঝের উপর স্থির হতেই সামনে অর্ধ বৃত্তাকার টেবিলের পাঁচজন উঠে দাড়িয়ে বাউ করল।
এই কালো মূর্তিই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান আলেক্সি গ্যারিন। আলেক্সি গ্যারিন মুখোশ পড়েই সবার সামনে আসে। গৌরীর মত কিছু পার্সোনাল স্টাফ ছাড়া কেউ তাকে চোখে দেখেনি। শীর্ষ এই পাঁচজন কর্মকর্তাও তাঁর পার্সোনাল স্টাফের অন্তর্ভুক্ত।
আলেক্সি গ্যারিন এসে বসার পর পরই তাঁর পেছনে এক সারিতে তিনটি চেয়ার চলে এল। আলেক্সি গ্যারিনের ঠিক পেছনে মাঝের চেয়ারে গৌরী। তাঁর ডান পাশের চেয়ারে চীফ অব অপারেশন ‘জিজর’। সে সম্পর্কে আলেক্সি গ্যারিনের ছোট ভাই। আর গৌরীর বাম পাশে রয়েছে ব্ল্যাক সানের গোয়েন্দাপ্রধান এবং আলেক্সি গ্যারিনের আরেক ছোট ভাই ডারথ ভাদের।
গৌরী তাঁর চেয়ারে বসার আগেই একটা ফাইল নিয়ে রেখে দিল আলেক্সি গ্যারিনের সামনে টেবিলের উপর।
ফাইলের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল আলেক্সি গ্যারিন।
মুখ তুলল ফাইল থেকে। সোজা হয়ে বসল।
একবার সবার উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, শুভ সময় সকলকে। লং লীভ আমাদের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট। অমর হোক আমাদের স্লোগান ‘পাওয়ার ফর পাওয়ার’ অর্থাৎ শক্তির জন্য শক্তি।
বলে একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন। শুরু করল আবার, ব্ল্যাক সানের শীর্ষ নির্বাহীবৃন্দ, আজ এক বিশেষ বৈঠকে আমি তোমাদের ডেকেছি। উদ্দেশ্য, আমাদের এ পর্যন্ত কাজের একটা পর্যলোচনা করা এবং উদ্ভূত একটা পরিস্থিতি সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করা। প্রথমে আমাদের কাজ নিয়ে আলোচনায় আসি। আমাদের ‘শক্তির জন্য শক্তি’ প্রজেক্টের চীফ এক্সিকিউটিভ ‘পালপেটাইন’ তোমার বিভাগের কাজের বিবরন দাও।
‘শক্তির জন্য শক্তি’ প্রজেক্টের নির্বাহী পালপেটাইন নড়েচড়ে বসল। তাঁর সামনে স্পিকার বক্সের সিগন্যাল লাইট জলে উঠেছে। স্পিকার অন হয়ে গেল। বলতে শুরু পালপেটাইন, মাই লর্ড! ‘শক্তির জন্য শক্তি’ আপনার উদ্ভাবিত সবচেয়ে প্রিয় প্রোজেক্ট। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা এই মহান প্রজেক্টের সাথে সামিল হতে পেরেছি। মাই লর্ডের এই মহান প্রজেক্টের লক্ষ্য হলো, শক্তি দিয়ে শক্তি অর্জন, সেই শক্তি দিয়ে গোটা বিশ্ব-চরাচরকে বশ করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রয়োজন গোটা দুনিয়াকে মেধাশুন্য করার মাধ্যমে শক্তি শূন্য করা এবং প্রয়োজন আমাদের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের শক্তির রাজত্ব চিরস্থায়ী করার জন্যে দুনিয়া থেকে সকল নীতি- নৈতিকতার উচ্ছেদ ঘটানো। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে আমরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মেধাগুলো সরিয়ে আনছি দেশ ও জাতি সমুহের কাছ থেকে, বিশেষ করে মুসলিম দেশের মুসলিম মেধাকে সরিয়ে আনাকে প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। আজ দুনিয়াতে মুসলমানদের ইসলামই দুনিয়াকে ধর্মের শিক্ষামুক্ত ও নীতি- নৈতিকতামুক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন অবিকৃত থাকায় মুসলমানদের বিশ্বাস খুবই জীবন্ত এবং মানুষের মধ্যে এর আবেদন খুবই কার্যকরি। এটাই আমাদের জন্যে বিপদ। এজন্যই মুসলিম জাতিকে মেধাশুন্য ও শক্তিশুন্য করার প্রতি প্রথমেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে’ সরিয়ে এনেছি, তাঁদের ৯০ ভাগই মুসলিম। এর মাধ্যমে একদিকে মুসলিম জাতিকে ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্বল করা যাবে। অন্য দিকে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট ও তাঁর ক্যাপিটাল অব পাওয়ার শক্তিশালী হবে। এটা আমাদের সফল প্রোগ্রাম। কয়েকদিন আগে আমরা সৌদি আরবের স্পেস ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ও আলোক বিজ্ঞানের এ যুগের সবচেয়ে সফল বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মক্কীকে সরিয়ে আনতে পেরেছি। এটা আমাদের বর্ণনাতীত বড় একটা সাফল্য। স্পেসশীপ ও সমুদ্রযানে এ্যান্টিম্যাটার ফুয়েল ব্যবহারের টেকনলজি উদ্ভাবনে তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন। এ ব্যাপারে ক্লিনিক্যাল টেস্ট তিনি করেছেন এবং তা সফল হয়েছে। তিনি এ্যান্টিম্যাটার ফুয়েল ব্যবহারের উপযোগী স্পেস মেরিনের ডিজাইন তৈরির কাজও শেষ করেছেন। এখন এই বিজ্ঞানী আমাদের হাতে। তাকে কব্জায় আনার মাধ্যমে একদিকে আমরা মুসলিম জাতির শক্তিকেন্দ্র সৌদি আরবকে এক মহাশক্তির মালিক হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছি, অন্যদিকে এই শক্তির মালিক আমরা হতে যাচ্ছি। আমা….।
পালপেটাইনের কথার মাঝখানেই একমাত্র আলেক্সি গ্যারিন ছাড়া উপস্থিত সকলেই হাততালি দিয়ে উঠল।
থেমে গিয়েছিল পালপেটাইন। আবার শুরু করে বলল, আমাদের মটো ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ প্রোজেক্ট নিয়ে সাফল্যের সাথে এগোচ্ছি। থামল পালপেটাইন।
পিনপতন নিরবতা।
কালো ইউনিফরমে আবৃত কালো মুখোশে ঢাকা আলেক্সি গ্যারিনের মুখ নড়ে উঠল। বলল, টুডে সাইন্স অব টুমরো বাই রোবটস (রোবটস গড়ার আগামীর বিজ্ঞান আজ) আমাদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আমাদের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করবে। এই প্রকল্পটি আমি নিজে তত্তাবধায়ন করি। এই প্রকল্পের দৈনন্দিন দেখা-শুনা আমার পক্ষ থেকে গৌরী করে থাকে। আমি তাকে বলছি, এই প্রকল্পের কাজ কিভাবে এগোচ্ছে ও কতটা এগিয়েছে তাঁর উপর একটা রিপোর্ট পেশ করতে।
কোথা থেকে যেন গৌরীর মনে অপরিচিত একটা বিষণ্ণতা নেমে এল! চমকে উঠল গৌরী। সব সময় তো সে তাঁর লর্ডের কাছ থেকে এই দায়িত্ব পেয়ে গৌরব বোধ করেছে এবং লাভ করেছে সীমাহীন আনন্দ। কিন্তু আজ এই বিষণ্ণতা কেন? সেই আনন্দের কথাগুলো বলতে আজ কষ্ট হবে বলে মনে হচ্ছে কেন?
সব ভাবনা ঝেরে ফেলে উঠে দাঁড়ালো গৌরী। আলেক্সি গ্যারিনকে ইয়েস মাই লর্ড, বলে একটা লম্বা বাউ করে একটা নোটশিট ফাইল থেকে বের করে স্পিকারের সামনে বসল। বলতে শুরু করল, মাই লর্ড ও মাই কলিগস। ‘রোবটস গড়বে আগামীর বিজ্ঞান’-প্রকল্পটি মাই লর্ডের সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী একটা পদক্ষেপ। বিজ্ঞানী গড়ে তাঁর কাছ থেকে থেকে বাঞ্ছিত কাজ পাওয়া অসম্ভব। আমাদের প্রকল্পে বিভিন্ন বিষয়ে গড়া প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের তাঁদের স্থান থেকে সরিয়ে এনে তাঁদের স্ব স্ব বিষয়ে কাজ নেয়া হচ্ছে। এই কাজে তাঁদের রোবটে পরিনত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাঁদের প্রতিভার শেষ বিন্দু বের করে নিয়ে আগামীর বিজ্ঞানী গড়ে তোলা হচ্ছে। কাজটা কঠিন হলেও মাই লর্ডের পরিচালনায় বৈজ্ঞানিক প্রদ্ধতিতে কঠিনকে সহজ করে ফেলা হয়েছে। প্রায় পৌনে একশ’ বিজ্ঞানীর অধিকাংশই আজ আজ্ঞাবহ নিরেট রোবট। যারা রোবট হয়নি তারাও হবে। যারা হবেনা তাঁদের জন্যেও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা।
মূল উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে আমরা বহু দূর এগিয়েছি। সার্বিক কমুনিকেশনের ক্ষেত্রে এ্যান্টিম্যাটার যুগে প্রবেশ ও সামরিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে লেজার-উত্তর যুগে প্রবেশ করে অদ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ও আক্রমনের শক্তি আমরা অর্জন করতে যাচ্ছি। আমাদের বিজ্ঞানীকে দিয়ে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি আমরা আবিষ্কার করেছি। পরিবহন ক্ষেত্রে সে জ্বালানীর সফল ল্যাবরেটরি টেস্টও আমরা করেছিলাম। আমরা এখন এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানীর মালিক। আমাদের হাতের মুঠোয় এখন এ্যান্টিম্যাটার বিজ্ঞান। সৌদি আরব থেকে সরিয়ে আনা বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-মক্কীর সহযোগিতা যদি আমরা আদায় করতে পারি, তাহলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি চালিত স্পেসশীপ, ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান ও সমুদ্রযান আমরা ব্যবহার করতে পারবো। তখন আমরা কয়েক মিনিটে চাঁদে যাতায়াত করতে পারবো। একদিনের মধ্যে আমরা সৌরজগতের শেষ সীমায় গিয়ে ফিরে আসতে পারবো। তখন দুনিয়ার সব পরিবহণ ব্যবস্থা অচল হয়ে যাবে। অন্যদিকে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি তৈরির পাশাপাশি এ্যান্টিম্যাটার পরমাণুর আরও উন্নত রিপ্রসেসিং-এর মাধ্যমে এ্যান্টিম্যাটার বোমা তৈরির ক্ষেত্রেও আমরা বহু দূর এগিয়ে গিয়েছি। আগামী এক মাসের মধ্যে আমরা ল্যাবরেটরি টেস্ট করতে যাচ্ছি। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে আমরা সমুদ্রতলে এর টেস্টের আয়োজন করতে পারবো। আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা এ্যান্টিম্যাটার পরমানু বোমার মালিক হবো। ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ অর্জনের লক্ষ্য ষোল কলায় পূর্ণ হবে। দুনিয়ার সব অস্ত্র অচল হয়ে যাবে। বিশ্বে হবো আমরাই একমাত্র শক্তি। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট হবে দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারক। দুনিয়ার অচল অস্ত্রের মত ঈশ্বরও অচল হয়ে পড়বে। আমাদের লর্ড হবে দুনিয়ার লর্ড, লর্ড অব দ্য ইউনিভার্স। ধন্য….।
হাততালি দিয়ে উঠল সকলে।
হাততালির মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল গৌরীর কথা।
হাততালি শেষ হলে গৌরী বলল, আমার কথা এখানেই শেষ। ধন্যবাদ মাই লর্ড, ধন্যবাদ সকলকে।
আবার পিনপতন নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল আলেক্সি গ্যারিন। বলল, আজকে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সব বিষয়ে আলোচনা করছি না। আজ শেষ আলোচনার বিষয় হল, একজন বিদেশী তাহিতিতে এসে ঝামেলা পাকিয়েছে। বিষয়টি ছোট, কিন্তু আলোচনার দাবী রাখে। কারন ব্যাপারটি অনেক বড়। এ পর্যন্ত সে আমাদের পাঁচজন লোককে খুন করেছে।
একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন।
শীর্ষ নির্বাহীদের একজন হাত তুলল।
বল। কথা বলার অনুমতি দিল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, এটা একটা ব্যক্তির ব্যাপার। আপনি চাইলেও সে ইলিমিনেট হয়ে যায়। বলল সেই শীর্ষ নির্বাহী।
সে একজন ব্যক্তি বটে, কিন্তু সে একাই সহস্রের সমান। সে অপরাজিত এক ডেভিল। নাম তাঁর আহমদ মুসা। আলেক্সি গ্যারিন বলল।
আহমদ মুসার নাম শুনে মাথা খাড়া করল পাঁচ শীর্ষ নির্বাহীর সকলেই। একজন বলল, সে বিপদ এখানে এল কি করে? কেন এসেছে?
কেন এসেছে, সেটাই চিন্তার বিষয়। তোমরা জান, আমাদের একজন রোবট একটা ম্যাসেজ বাইরে পাঠাতে চেষ্টা করেছিল, আংশিক পাঠিয়েছিল। প্রমানিত হয়েছে, যখন সে ম্যাসেজটি পাঠাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা এক বোটে তাহনিয়া দ্বীপের এ প্রান্তে ছিল। তাঁর মনিটরিং-এ এই মেসেজ ধরা পড়েছে আমরা নিশ্চিত। সে এ নিয়ে কি ভাবছে, কি করছে তা আমরা জানিনা। তাঁর আসাটাই সন্দেহজনক। বিনা কারনে সে এক পা ফেলেনা, এটা সবাই জানে । সে নিছক বেড়াতে তাহিতিতে এসেছে এটা ঠিক নয়। সে কথাই আমি তোমাদের বলতে চাচ্ছি। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, আহমদ মুসা খুবই বিপদজনক ব্যক্তি। শুরুতেই তাকে ইলিমিনেট করা দরকার। ঘটনাটিকে এগোতে দেয়া ঠিক নয় মাই লর্ড। বলল শীর্ষ নির্বাহীদের অন্য একজন।
সে ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। গৌরীর নেতৃত্বে একটা দক্ষ টীম পাঠিয়েছিলাম তাকে কিডন্যাপ করার জন্যে। ইতিমধ্যে পশ্চিমের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বন্ধু সংগঠন আমাদের জানাল, তাঁরা আহমদ মুসার লাশ চায়। তাঁরা অনুরোধ করে আহমদ মুসাকে হত্যা করার কোন সুযোগ ছেড়ে না দেয়ার। লাশের মুল্য হিসাবে তাঁরা দিবে ১ বিলিয়ন ডলার। তখন আহমদ মুসাকে আমরা কিডন্যাপ করে ফেলেছি। আমি গৌরীকে নির্দেশ দিলাম আহমদ মুসাকে হত্যা করার। কিন্তু তাকে হত্যা করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। গৌরী ও নাশকা মারাত্নক আহত হয়, মারা যায় আমাদের পাঁচজন। সংগে সংগেই দুই গাড়িতে দু’টি টিম পাঠিয়েছিলাম তাকে ঘিরে ফেলতে। ঘিরে ফেলেও তাঁরা তাকে আটকাতে পারেনি। আমাদের অস্ত্রে আমাদের ঘায়েল করে সে নিরাপদে বেরিয়ে যায়। তাঁর সাথে সাথেই আমি আমাদের জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ পাঠিয়েছিলাম তাকে অনুসরন ও হত্যা করার জন্যে। কিন্তু এক্সিকিউটর-১ তাকে বাগে পেয়েও, সর্বশেষে বিষাক্ত গ্যাস তাঁর উপর প্রয়োগ করেও তাকে হত্যা করা যায়নি। তাঁর সন্ধানও পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর পর থেকে। তাঁর ব্যাপারে আরও সিরিয়াসলি ভাবা প্রয়োজন বলেই কথাটা এই বৈঠকে তুলেছি। আলেক্সি গ্যারিন বলল।
মাই লর্ড, আপনি কি আশংকা করছেন? আমাদের কি করা দরকার? আমাদের প্রতি আপনার কি পরামর্শ? বলল অন্য একজন শীর্ষ নির্বাহী।
আমি ভাবছি ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রজেক্টের নিরাপত্তা নিয়ে। ব্লাক সান সিন্ডিকেটের নিরাপদ স্থান খুজতে আমি গোটা দুনিয়া চষে ফিরেছি। কিন্তু সব দিক নিরাপদ স্থান আমি পাইনি।সবশেষে সভ্যতা থেকে বহু দুরে সবচেয়ে বড় সাগরের মাঝামাঝি ও প্রায় জনশূন্য এই তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলাম। দ্বীপগুলো অ্যাটল দ্বীপ হওয়ায় নতুন জনবসতির সুযোগ এখানকার দু’একটা ছাড়া কোন অ্যাটল দ্বীপেই নেই। আমার খুব ভালো লেগেছিল স্থানটা। অ্যাটল থেকে অ্যাটলে ঘুরে বেরিয়েছি মাসের পর মাস। কিন্তু ব্ল্যাক সান-এর ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ স্থাপিত হতে পারে এমন উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাইনি। তোয়ামতু অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র দ্বীপ ‘মাকাতিয়া’র পুরানো মন্দিরে বিশ্রাম কক্ষে বসেছিলাম। অ্যাটল দ্বীপগুলোতে ঘোরাফেরার পথে প্রায়ই এই বিশ্রামখানায় বসি। পাশের রেস্টুরেন্টে তাজা মাছের ভাজি ও তাজা ফল প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো আমার প্রিয়। সেদিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে আবার এসে বসেছিলাম মন্দিরের বিশ্রামকক্ষে। আমার সামনে বসেছিল বৃদ্ধ একজন সন্ন্যাসী। আর কেউ ছিল না বিশ্রামকক্ষে।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর চোখ সব সময় বন্ধই দেখলাম।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে থাকতে এক সময় চোখ ধরে এসেছিল।
বৎস, তুমি ঘুমালে? এই কথাগুলো কানে যাওয়ায় আমার তন্দ্রা কেটে যায়।
চোখ মেলে দেখি সন্ন্যাসী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাঁর দিকে তাকাতেই বলল, তোমার বাড়ি নিশ্চয় আমাদের অ্যাটল দীপপুঞ্জে নয়?
জি হ্যাঁ। বললাম আমি।
তুমি পর্যটকও নিশ্চয় নও? সন্ন্যাসী বলল।
জি না। আমি বললাম।
গত তিন মাসে তুমি এখানে তিরিশবার এসেছ। সন্ন্যাসী বলল।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম সন্ন্যাসীর দিকে। অনেকবার এসেছি তাহানিয়া দ্বীপের এখানে। কিন্তু তিরিশবার হয়েছে কিনা গুনে দেখিনি। আমি বললাম, বাবা, তিন মাসে আমি এখানে অনেকবার এসেছি, তিরিশবার হয়েছে কিনা আমি জানিনা। নিশ্চয় আপনার গুনা ঠিক বাবা।
তুমি নিশ্চয় কাউকে খুজছ বৎস? বলল সন্ন্যাসী।
কাউকে নয়, কিছু খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন হন্যে হয়ে কি খুজছ বৎস? বলল সন্ন্যাসী।
একটা জায়গা খুজছি বাবা। এই অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জ আমার ভালো লেগেছে। এখানে একটা নিরিবিলি স্থানে আশ্রয় গড়ার জায়গা খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন জায়গা তো প্রচুর! এত খুজছ কেন? সন্ন্যাসি বলল।
একটা বড় জায়গা যা মানুষের চোখের আড়াল হবে, এমন একটা জায়গা খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন জায়গা তো ডাকাতদের আড্ডার জন্য দরকার! তুমি সে রকম কিছু করতে নিশ্চয় চাওনা? সন্ন্যাসী বলল।
আমি হেসেছিলাম। তারপর গম্ভীর হয়ে সিরিয়াসলি বলেছিলাম, ডাকাতির জন্য নয়, আমি জায়গা চাই বিশাল একটা গবেষণা সংস্থা গড়ার জন্যে যা দুনিয়াকে একশ’ বছর এগিয়ে নেবে।
এ্যাটম বোমা বানাবে এবং আমাদের পানিতে তা পরীক্ষা করবে নাকি, যেমন ফ্রান্স কয়েক যুগ ধরে করেছে। যেন আমরা ওদের গিনিপিগ! সন্ন্যাসী বলল।
বাবা, আমাদের গবেষণা ঐ ধরনের নয়। আমাদের গবেষণা আরও বড় বিষয় নিয়ে। লোক চক্ষুর আড়ালে তা হবে। মানুষ ও পরিবেশকে তা ডিস্টার্ব করবে না বাবা। আমি বললাম।
কিন্তু এর জন্যে তো ইন্সিটিটিউট ধরনের বিশাল বাড়ি ও বড় জায়গা দরকার। অ্যাটলের সারফেসে তো এমন জায়গা দেখিনা বৎস। সন্ন্যাসী বলল।
সে জন্যই তো খুজেই ফিরছি বাবা! আমি বললাম।
ভাবছিল সন্ন্যাসী।
আমিও কিছু বললাম না। চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিছুক্ষন পর মুখ তুলল। তাকাল আমার দিকে। বলল, প্রশান্ত মহাসাগরের এই অঞ্চলে ‘মু’ নামে একটা মহাদেশ ছিল, এটা তুমি বিশ্বাস কর?
আমি শুনেছি বাবা। কিন্তু এ নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। তবে আগ্রহ আছে জানার। বললাম আমি।
আজকের তাহিতি দ্বীপ যেমন বাস্তবতা, তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের অস্তিত্ব যেমন বাস্তবতা, তেমনি আজকের মধ্যপ্রশান্ত মহাসাগরের মহাদেশ ‘মু’ একটা বাস্তবতা। এই মহাদেশ ছিল বিশাল ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী। পেরু ও গুয়েতেমালার পুরাকীর্তি এবং মায়া সভ্যতার বিস্ময় ‘মু’ সভ্যতারই খণ্ডাংশ। ‘মু’ মহাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের অন্তঃসার শূন্য গর্ব, ঈশ্বরকে ত্যাগ করা, ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পদের ধ্বংসকারী ব্যবস্থা এবং পরিশেষে ঈশ্বরের শাস্তি ভুমিকম্প ও প্লাবনের আঘাত ধ্বংস করে ‘মু’ মহাদেশকে। অ্যাটল দ্বীপগুলোর কোন কোনটি সেই মহাদেশরই ধ্বংসাবশেষ হিসাবে টিকে আছে। এরকম একটি অ্যাটলের খবর আমি জানি, যার ভিতরে অক্ষত আছে ‘মু’ মহাদেশের রাজন্যবর্গের একটি বহুতল প্রাসাদ। থামল সন্ন্যাসী।
বহুতল প্রাসাদ? আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
হ্যাঁ, বহুতল প্রাসাদ বৎস। সন্ন্যাসী বলল।
অ্যাটলের অভ্যন্তরে? আমার জিজ্ঞাসা।
হ্যাঁ, অ্যাটলের ভিতরে। সন্ন্যাসী বলল।
আপনি সে অ্যাটলকে জানেন? জিজ্ঞাসা করলাম। বিস্ময় ও আনন্দে আমার ভেতরটা তখন কাঁপছে। রুপকথার মত মনে হচ্ছে তাঁর কথাগুলো।
অবশ্যই জানি বৎস। সেই জানাটাও একটা রুপকথার মত।
বলে একটু থামল সন্ন্যাসী। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, তখন আমার বয়স তিরিশ। সন্ন্যাস ব্রত নিয়ে আমি তখন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরি। একদিন এই মন্দিরেই আমার মত নব্বই-ঊর্ধ্ব এক বুড়ো সন্ন্যাসীর সাথে দেখা। ঈশ্বরী ‘হিনার’ বন্দনা চলছিল সেদিন মন্দিরে। বন্দনা শেষ হতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। বন্দনা শেষ হবার পর মন্দিরের এক কক্ষে আমি সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসিকে শুইয়ে দিতে যাই। বিছানা ঠিক করে তাকে শুইয়ে দিয়ে আমি তাকে বাতাস করছিলাম। দীর্ঘ সময় ধরে শোনা বন্দনায় অনেক কথাই মাথায় কিলবিল করছিল। তাঁর মধ্যে কিছু বিষয় আমাকে খুচাচ্ছিল বেশি। আমি গুরুকে বললাম, গুরু, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
গুরু চোখ বন্ধ করে ছিলেন। চোখ খুলে বলেছিলেন, অনুমতি নিয়ে বলতে হবে কেন? বল তোমার কথা।
গুরু বন্দনার মধ্যে শুনলাম, ঈশ্বরী হিনা রাজপুত্র হেসানা হোসানা, সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর একমন একতনু প্রেমসাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে অ্যাটলের এক প্রাসাদে তাঁদের মিলন ঘটিয়েছিলেন এবং প্রাসাদটি তাঁদের উপহার দিয়েছিলেন-এটা কি সত্য ঘটনা? ঈশ্বরী হিনা কি সত্যিই এটা করেছিলেন?
বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
সন্ন্যাসী শোয়া থেকে উঠে বসেছিলেন। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলেছিলেন, তোমার কি সন্দেহ আছে এ কথায়?
সন্দেহ নেই, কৌতূহল আছে। স্বর্গের ঈশ্বরী নেমে এসেছিলেন তাঁদের জন্যে এবং এই ধরনের একটা প্রাসাদ কোন অ্যাটলে আছে? গুরুজি এটা সত্যিই বিস্ময়ের। আমি বলেছিলাম।
স্রষ্টা ঈশর কি তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসবেন না?
সৃষ্টির কান্না কি স্রষ্টার মন গলাবে না? তিনি কি সৃষ্টির অশ্রু মুসাতে আসবেন না? অবশ্যই আসবেন। রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর ক্ষেত্রে তিনি এসেছিলেন। রাজপুত্র হেসানা সাগরকন্যা শাবানুর জন্যে রাজ্য রাজত্ব সবই ছেড়েছিলেন। প্রশান্ত মহাসাগরে এই অ্যাটল রাজ্যে তিনি অবিরাম কেঁদেছেন এবং ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি সব ভুলেছিলেন, ভুলেন নি শুধু সাগরকন্যার প্রেম। স্রষ্টা দেখেছিলেন তাঁর সৃষ্টি এই রাজপুত্র সাগরকন্যাকে না পেলে সাগরেই তাঁর জীবন শেষ করে দিবে। এই অবস্থায় স্রষ্টা ‘হিনা’ তাঁর সৃষ্টির চোখ মুসাতে না এসে পারেন? তাই তিনি এসেছিলেন। তিনি আদর করে তাঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন ‘মু’ মহাদেশের ধ্বংসাবশেষ অ্যাটল দ্বীপের সেই প্রাসাদে। সেখানেই তাঁদের মিলন ঘটেছিল। স্রষ্টা হিনা তাঁর সৃষ্ট দুই মানব-মানবীর পাগলপারা প্রেমে মুগ্ধ হয়ে খুলে দিয়েছিলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত এক মহাদেশের স্মৃতিবাহী সুন্দর প্রাসাদটিকে।আমার অস্তিত্ব যেমন সত্য, তোমার অস্তিত্ব যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই ঘটনা।
কথা শেষ করে সন্ন্যাসী আবার শুয়ে পড়েছিলেন। শুয়ে থেকেই বললেন, তরুন সন্ন্যাসী বেটা, তোমাকে আরও বলি এই অধমকেও স্রষ্টা হিনা দয়া করে সেই প্রাসাদটি দেখিয়েছিলেন। এই চর্ম চোখে আমি তা দেখেছি।
বলে থেমেছিলেন গুরু সন্ন্যাসী মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার শুরু করেছিলেন, তোমার মত আমার মনে প্রাসাদের অস্তিত্ব নিয়ে বিস্ময় ছিলনা বটে, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য এক আকুতি ছিল আমার ঐ প্রাসাদটি দেখার জন্যে। এই আকুলতা নিয়ে আমি অবিরাম ঘুরে ফিরেছি অ্যাটল থেকে অ্যাটলে দিনের পর দিন। একদিন সন্ধ্যায় তাহানিয়া অ্যাটলের পাশ দিয়ে মাকাতিয়া দ্বীপে ফেরার সময় প্রবল ঝড়ের মুখে পড়ল আমার ছোট বোটটি। এ অঞ্চলে ঝড় হয় না। যদি কখনও হয়, তাহলে তাকে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন মনে করে যে যেখানে থাকে সে সেখানেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর ঝড় সম্পূর্ণ থেমে গেলে আবার জীবন-কর্ম শুরু করে। সে অনুসারে আমি তাহানিয়া অ্যাটলে আমার ছোট বোটটি বেধে সেখানেই অপেক্ষা করলাম। অস্থির সাগরের ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখলাম। মঙ্গলময় মমতাময় স্রষ্টা হিনা কিংবা তাঁর পাঠানো কোন স্বর্গীয় অ্যাঞ্জেল আমার কাছে এলেন। আলোয় ঢাকা তাঁর দেহ কিংবা বলা যায় আলোর এক অবয়ব তিনি। আমাকে বললেন, এসো মানব, আমার সাথে এসো। আমি উঠলাম, তাঁর পেছেনে পেছনে চললাম। বোঁট থেকে নেমে তাহানিয়া অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্ত থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর এক যায়গায় দাঁড়ালো জ্যোতির্ময় অবয়ব। তাকাল মাটির দিকে। আমিও তাকালাম। সেখানে দেখলাম সফেদ ফুলের একগুচ্ছ গাছের ছোট্ট ঝোপ। জ্যোতির্ময় অবয়বটি মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছায় ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’ এর ‘সিঁড়িমুখ’ বের হলো। সংগে সংগেই ফুলের গাছের ঝোপটি অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখানে মাটির নিচে কিছু একটা দেখা গেল। গোলাকার সফেদ পাথর। আবার বলল জ্যোতির্ময় অবয়বটি, সর্বশক্তিমানের ইচ্ছায় আমাদের পথ ছাড়ুন। কথার সাথে সাথেই পাশের মাটির ভেতরে হারিয়ে গেল সফেদ পাথরটি। সুন্দর সিঁড়িমুখ বের হয়ে পড়ল। সিঁড়িও সফেদ পাথরের। সেই সিঁড়িপথে ঢুকে গেলাম ভেতরে জ্যোতির্ময় অবয়বের সাথে। আসলেই ওটা প্যালেস। সম্মোহিতের মত আমি দেখেছি প্রাসাদটা। আয়তনে অনেক বড়, ছোট-খাটো একটা দ্বীপের সমান, তেমনি উচুর দিক দিয়ে কয়েক তলা হবে। এখানেই রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি ছিল? বলেছিলাম স্বাগত কণ্ঠে। জ্যোতির্ময় অবয়বের অ্যাঞ্জেল জবাবে বলেছিল, হ্যাঁ, এখানেই তাঁরা ছিল, এটাই ছিল তাঁদের বাড়ি। যতটা সম্ভব মানুষের কল্যান তাঁরা করেছে। কখন আমার প্রাসাদ দেখা শেষ হল আমি জানিনা। যখন আমার ঘুম ভাঙল, দেখলাম ভোর হয়ে গেছে। একটা স্বস্তি যেন আমার দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। মনের মধ্যে একই কথা বার বার ঘুরে ফিরে আসতে লাগল, স্বপ্নটা আমার কি সত্যি। সত্যিই কি অ্যাঞ্জেল এসেছিল আমার কাছে। প্রাসাদ কি আমি দেখেছি তাঁর সাথে গিয়ে, সত্যিই কি তাহলে প্রাসাদ আছে। সকাল হতেই আমি বোঁট থেকে নেমে অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্ত ধরে দক্ষিনে এগোতে থাকলাম। এখানে অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্তটি প্রশস্ত। যতই দক্ষিনে গেছে আরও প্রশস্ত হয়েছে। আমার চোখ সন্ধান করছিল সেই সফেদ ফুলের গাছের ঝোপ। পেয়ে গেলাম সফেদ ফুলের সেই ঝোপ। আমি বিস্মিত ও সম্মোহিতের মত দাড়িয়ে পড়লাম সফেদ ফুলের গাছের সেই ঝোপের পাশে। আমার গোটা শরীর রোমাঞ্চিত হলো। তাহলে স্বপ্ন আমার সত্য, অ্যাঞ্জেল সত্য, প্রাসাদও সত্য। আমি ছুটে গিয়ে বোঁট থেকে শাবল নিয়ে এলাম। সফেদ ফুলের গাছের ঝোপের পাশে গর্ত আকারে খুড়তে লাগলাম। মাটির দু’হাত গভীরে যাবার পর সত্যিই পেলাম স্বপ্নে দেখা সেই সফেদ পাথর। তাঁর মানে পাথর তুললেই সিঁড়ি। সিঁড়ির পড়েই সেই প্রাসাদ। সবই আমি পেয়ে গেলাম। প্রাসাদে ঢুকতে মন চায়নি। চাল-চুলাহীন সন্ন্যাসী, তাঁর তো প্রাসাদ দরকার নেই। যা দেখার সেটা তো অ্যাঞ্জেল আমাকে দেখিয়েছেন। গর্ত মাটি ঢেলে বন্ধ করে চলে এসেছিলাম। আর যাইনি। বলল তরুন সন্ন্যাসী, ‘মু’ মহাদেশের অবশিষ্ট স্মৃতি সেই প্রাসাদ সম্পর্কে আর জিজ্ঞাসা আছে? সৃষ্টির অশ্রু মোছাতে স্রষ্টা যে আসেন কিংবা সৃষ্টির আন্তরিক চাওয়া মেটাবার ব্যবস্থা করেন, সে বিষয়ে কোন বিস্ময় এখনও আছে?
গুরুজি একটি বিষয়, রাজপুত্র হেসানা সম্পর্কে আমার কোন কথা নেই। কারন সে পাপেতি রাজবংশের রাজকুমার আমরা জানি। কিন্তু ‘সাগরকন্যা’ তো বাস্তব নয়। বললাম আমি।
সন্ন্যাসী বলল, জানা গেছে, সে একটা জাহাজ ডুবির ফল। তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জ উত্তর পাশ দিয়ে গুয়েতেমালার দিকে যাবার পথে একটা জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। পরে জানা গেছে, জাহাজটি পশ্চিম এশিয়ার কোন এক আরব দেশের। জাহাজ থেকে আর কেউ বেঁচেছে কিনা জানা যায়নি, তবে একজন শিশুকন্যা বেঁচেছিল। শিশুকন্যাটি একটা ডলফিনের পিঠে ভাসছিল। ডলফিন গিয়ে ভেড়ে পলিনেশীয়ার কোন দ্বীপে। সে দ্বীপেরই বনচারী, সাগরচারী একটা পরিবার শিশুকন্যাকে ডলফিনের পিঠ থেকে নিয়ে নেয়। তারাই তাঁর নাম রাখে ভাইমতি বা সাগরকন্যা। আর তাঁর গলার লকেটে পাওয়া নামের পাঠোদ্ধার করে সেটা এভাবেই এসেছে। শিশু ভাইমতি শাবানু একদিন বড় হয়। বন ও সাগর হয় তাঁর বাধা-বন্ধনহীন বিচরনের ক্ষেত্র। পাখির মতই সে ঘুরে বেড়ায় বনে ও সাগরে। সাগরকন্যা শেষ পর্যন্ত সাগরকন্যাই হয়ে যায়। এই সাগরকন্যার সাথেই একদিন দেখা হয় সাগরচারী রাজপুত্র হেসানা হোসানার সাথে। প্রথম দর্শনেই স্রষ্টার ইচ্ছায় তাঁরা একে অপরের হয়ে যায়। এই কাহিনী আমি শুনেছি পূর্ব তাহিতির এক বৃদ্ধ জেলের কাছে। আমি নিশ্চিত, এই কাহিনির মধ্যে কোন অতিরঞ্জন নেই। বিকল্পও নেই এই কাহিনীর। থামল একটু গুরু সন্ন্যাসী। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, তরুন সন্ন্যাসী বল, আর কোন কথা, আর কোন প্রশ্ন?
আমি বললাম, না, আর কোন প্রশ্ন নেই গুরু সন্ন্যাসী। আমি চলে এসেছিলাম গুরুজির কক্ষ থেকে।
তারপর এক সময় আমিও গিয়েছিলাম তাহানিয়া দ্বীপে সেই সফেদ ফুল গাছের ঝোপের সন্ধানে। সেই ঝোপ পাইনি। ঝোপ না পাওয়ায় আমার আগ্রহ কৌতূহল বেড়ে গিয়েছিল, পাথর ও প্রাসাদ ঐভাবে আছে কিনা তা দেখার জন্যে। অনেক দিনের অনেক খোঁজাখুঁজি, অনেক খোঁড়াখুঁড়ির এক রাতের শুভ ভোঁরে দু’হাত মাটির গভীরে পেয়ে গেলাম সেই গোলাকার সফেদ পাথর। পাথর পাওয়ার সাথে সাথে আমার গুরু সন্ন্যাসীর মত সব পাওয়া হয়ে গেল। সফেদ পাথর সরিয়ে ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ারে’ প্রবেশ করতে মন চায়নি। ঘর-দোর ছাড়া পথের সন্ন্যাসী প্রাসাদ দিয়ে কি করব। যে কৌতূহল ছিল সেই কৌতূহল মিটিয়ে চলে এসেছি। থামল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
আমি গোগ্রাসে যেন গিলছিলাম তাঁর কথা এবং তাঁর গুরু সন্ন্যাসীর কথা। মনে হছিল আমি যেন, স্বর্গের চাবি পেয়ে গেছি। আমি অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জে গত তিন দিন ধরে যা খুজছিলাম, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি যেন পেয়ে গেছি। আনন্দ উত্তেজনায় মনে হল হার্টবিট আমার বেড়ে গেছে!
কথা শেষ করে বৃদ্ধ সন্ন্যাসী পাথরের বেঞ্চির উপর গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখ বুজে গিয়েছে তাঁর।
আমিও কোন কথা বললাম না।
নীরব আমরা। বয়ে চলল সময়। এক সময় চোখ খুলল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
তাকাল আমার দিকে। বলল বৎস ‘প্যালেস অফ ওয়েলফেয়ার’ তোমার কাজে লাগবে। সৃষ্টির উপর গবেষণা ভালো জিনিস। এটা হয় মানুষের মঙ্গলের জন্যেই। অতএব, তুমি প্যালেস অব ওয়েলফেয়ারের সদ্ব্যবহার করতে পারবে। তুমি যেমন চাও প্রাসাদটি সে রকমই। থামল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
স্বর্গ যেন কেউ আমার হাতে তুলে দিল।
আমি উঠে গিয়ে সন্ন্যাসিকে আভূমি প্রণাম করে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পা ছুয়ে বললাম, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার এই দানের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার নেই।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী দু’হাত জোর করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলল, সন্ন্যাসীদের জন্যে কোন কৃতজ্ঞতা নেই। কৃতজ্ঞতা সব ঈশ্বরের জন্যে।
বলে আবার চোখ বুজল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী। চোখ বুজে থেকেই বলল, যাও বৎস, ঈশ্বরের সম্পদ ঈশ্বরের জন্যে ব্যবহার কর। আমাদের হারানো ‘মু’ মহাদেশের রাজন্যদের ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’-এর যথার্থ ব্যবহার কর। ঈশ্বরের মত ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালবাস। তাহলে তাঁর রোষের মুখোমুখি তোমাকে কোনদিন হতে হবেনা।
আরও কোন নসিহত শোনার ভয়ে তাড়াতাড়ি তাকে একটা প্রণাম করে আমি চলে এলাম।
সুদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সুপ্রিম বস আলেক্সি গ্যারিন।
বৈঠকে উপস্থিত পাঁচ শীর্ষ নির্বাহীসহ চীপ অব অপারেশন জিজর, গোয়েন্দা প্রধান ডারথ ভাদের ও গৌরী পিনপতন নিরবতার মধ্যে আনন্দ, বিস্ময় ও কৌতূহলের সাথে আলেক্সি গ্যারিনের কথা শুনছিল। আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হলেও শ্রোতাদের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। বাস্তব ঘটনা যে রুপকথার চেয়েও বিস্ময়কর হতে পারে, এ কাহিনী তারই প্রমান।
আলেক্সি গ্যারিন দীর্ঘ কথা শেষ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। তবে শীঘ্রই সোজা হয়ে বসল। বলল, কাহিনী একটু দীর্ঘ হলেও তা তোমাদের বললাম, কিভাবে এই ঐতিহাসিক রাজকীয় প্যালেস পেলাম আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ প্রতিষ্ঠার জন্যে। ঈশর দিবে আমি বিশ্বাস করিনা। আমাদের প্রাপ্য বলে আমরা এটা পেয়েছি। বলে একটু থামল। মুহূর্ত কয়েক পর আবার শুরু করল, ঐতিহ্য ও নীতি-নৈতিকতায় আমি বিশ্বাস করিনা। সে জন্যই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী যে নীতি- নৈতিকতার উপদেশ আমাকে দিয়েছিলেন তা রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁদের প্রিয় ‘মু’ মহাদেশের রাজকীয় প্রাসাদের অংশ ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’ বলে কথিত প্রাসাদটিই আজ আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’।
ওয়েলফেয়ার কি জন্যে? ওয়েলফেয়ার প্রয়োজন দুর্বলদের। দুর্বলদের জন্যে আমাদের কিছু করার নেই বরং আমরা দুনিয়ার সবাইকে দুর্বল বানাতে চাই। শুধু সবল থাকবে, শক্তিশালী ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট ও সকল ক্ষমতার কেন্দ্র হবে আমাদের এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আলেক্সি গ্যারিন আবার বলল, বহু কষ্টে আমাদের এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ আমরা পেয়েছি। এর নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ প্রাইওরিটি। আহমদ মুসা কোন মিশন নিয়ে এখানে এসেছে আমি জানিনা। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর সাথে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য সে আমাদের চিনেছে, জেনেছে তাঁর কোন প্রমান আমি পাইনি। তবে তাঁর সাথে আমাদের সংঘাত শুরু হওয়ায় ধরে নেয়া যায় তাঁর মত বুদ্ধিমান লোক সবকিছুই জেনে যাবে।এটা অবধারিত ধরে নিয়েই আহমদ মুসাকে শেষ করার জন্যে সর্বান্তক চেষ্টা ও সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। বিপদ সম্পর্কে সবাইকে জানানো ও করনীয় ঠিক করার জন্যেই আজকের বৈঠকের আয়োজন। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
একটু নিরবতা।
নিরবতা ভেঙ্গে বলল একজন শীর্ষ নির্বাহী, মাই লর্ড, আপনি যা বলেছেন সেটাই আমাদের করনীয়। শয়তানটাকে শেষ করার লক্ষ্যে সর্বান্তক চেষ্টা ও সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে চীপ অপারেশন জিজর, গোয়েন্দা প্রধান ডারথ ভাদের ও গৌরীকে নিয়ে তিন সদস্যের একটি অপারেশন টীম গঠন করা হলো। এই টীম যাবতীয় উপায়-উপকরন ব্যবহার করবে এবং আহমদ মুসাকে খুঁজে বের করে, তাকে সার্বক্ষণিক নজরে রেখে যতটা সম্ভব শীঘ্রই তাকে শেষ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে তাঁর লাশও কিন্তু আমাদের পেতে হবে। সুযোগ পেলে কিংবা সুযোগ সৃষ্টি করে দেখামাত্র তাকে হত্যা করার চেষ্টা করতে হবে।
সবাই মাথা নাড়ল। কিন্তু মাথা নাড়তে পারল না গৌরী।
একটা চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
কি দোষ আহমদ মুসার? তাকে আমরা কিডন্যাপ করতে গেছি। সেটা করতে গিয়ে আমাদের পাঁচজন মরেছে। সে তো আত্নরক্ষা করেছে মাত্র! সে তো আমাদের আক্রমন করেনি। তাহলে দেখামাত্র গুলী কেন? তাকে না দেখলে, তাঁর ভেতরটা না জানলে এ প্রশ্ন তাঁর মনে হয়ত আসতো না। লাশ নেবে কেন আর তাঁর লাশ ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট বিক্রিই বা কেন করবে?
এসব নানা কথা, নানা প্রশ্ন গৌরীকে বিমূঢ় করে দিয়েছিল। তাই তাঁর লর্ড আলেক্সি গ্যারিনের কথায় সে সায় দিতে পারেনি।
টিমের কাজ শুরু হবে আজ এই মুহূর্ত থেকে। গুড নাইট সকলকে। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হবার সংগে সংগেই ফ্লোরের ভেতরে থেকে কালো টিউব উঠে এল। আলেক্সি গ্যারিনের চেয়ারের চারদিক ঘিরে দেয়ালের মত উঠে এল টিউবটা। উঠে চলল ছাদ ফুঁড়ে উপরে।
বৈঠকের সবাই উঠে বাউ করে দাঁড়িয়েছিল।
টিউব-লিফট উপরে অদৃশ্য হয়ে গেলে শীর্ষ নির্বাহী পাঁচজনের একজন গৌরীকে লক্ষ্য করে বলল, আমরা উঠতে পারি, ম্যাডাম গৌরী?
গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের পিএ এবং আলেক্সি গ্যারিনের ব্যক্তিগত বাহিনীর কমান্ডার হলেও আলেক্সি গ্যারিনের অনুপস্থিতিতে সেই তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে। আলেক্সি গ্যারিনের পার্সোনাল সেক্রেটারিয়েটও গৌরী দেখে। ফলে উপরের সবার চেয়ে গোপন বিষয় সে বেশি জানে। আরেকটা বিষয়ও সকলে ওপেন সিক্রেট আকারে জানে এবং সেটা হলো, গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের স্ত্রী নয় তবে ডি-ফ্যাকটো স্ত্রী হিসাবে রয়েছে। এই বিষয়টি গৌরীর জন্যে খুবই স্পর্শকাতর। পরোক্ষভাবেও গৌরী কোন সময় এ ধরনের কথার মুখোমুখি হলে খুবই রিঅ্যাক্ট করে। এমন ক্ষেত্রে লুকিয়ে তাকে কাঁদতে দেখা গেছে। কিন্তু ব্ল্যাক সানের শীর্ষ পর্যায়ের সবাই এক সময়ের পূর্ব মার্লিন এলাকার রুশ বংশোদ্ভূত মেয়ে গৌরীকে সমীহ করে চলে। গৌরী যেমন অসম্ভব সুন্দরী, তেমনি সাহসী, বুদ্ধিমতি, ক্ষিপ্র ও দারুন উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। Rise and fall of the dynasties of the world, বিষয়ের উপর পিএইচডি গৌরীর। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধ্যাপনা করার কথা ছিল। কিন্তু গৌরী প্রকৃতিগতভাবে সাহসী ও বেপরোয়া বলেই সাজানো একটা খুনের মামলার আসামী হয়ে তাকে পলাতক হতে হয়। এই অবস্থায় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট তাকে রিক্রুট করে। সাহস, মেধার জোরেই সে ব্ল্যাক সানের শীর্ষ পর্যায়ে উঠেছে।
মাই লর্ড চলে গেছেন। মিটিং শেষ হয়েছে। আপনারা অবশ্যই যেতে পারেন। বলল গৌরী।
এখনই একটা মিটিং সেরে ফেলতে পারি।বলল জিজর।
ঠিক। মাই লর্ড তো এখন থেকেই কাজ শুরু করতে বলেছেন। ডারথ ভাদের বলল।
এ ধরনের মিটিং-এর জন্যে প্রস্তুতি দরকার। তবে একটা প্রাথমিক আলোচনা হতে পারে। বলল গৌরী।
পাশের আরেকটা কক্ষের একটা গোল টেবিল ঘিরে বসে তাঁরা আলোচনা শুরু করল।
মিটিং চলল প্রায় একটা ঘণ্টা।
মিটিং শেষে বেরিয়ে আসার সময় গৌরী হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত ৪টা। হাসল গৌরী। তাঁদের সব কাজ রাতেই। নামটা তাঁদের সার্থক।
গৌরী তাঁর কক্ষে যাবার জন্যে এলিভেটরে উঠতে যাচ্ছিল। তাঁর মোবাইল বেজে উঠল। থমকে দাঁড়ালো গৌরী।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দেখল স্বয়ং তাঁর লর্ডের কল। তাড়াতাড়ি সাড়া দিয়ে বলল, ইয়েস মাই লর্ড, কোন হুকুম?
তুমি এখনই একটু আমার বাংলোতে চলে এস। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
অস্বস্তি, একটা অসহায়ত্ব যেন ছায়া ফেলল গৌরীর চোখে-মুখে। কিন্তু মুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল। বলল, ইয়েস মাই লর্ড, আমি আসছি।
বলে গৌরী অন্য একটি বিশেষ এলিভেটরে উঠল। সংগে সংগেই তা চালু হয়ে গেল। এ এলিভেটর সরাসরি গেছে আলেক্সি গ্যারিনের বেডরুমে। এ এলিভেটর তাঁর ইচ্ছাতেই মাত্র চলে।
৪
হাসপাতালে আহমদ মুসা যখন পৌঁছল তখন দশটা।
ইনফরমেশন ডেস্ক থেকে খোঁজ নিয়ে আহমদ মুসা তিন তোলার ১১ নাম্বার কেবিনে গিয়ে হাজির হল।
আহমদ মুসাকে দেখেই ছুটে এসে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরল তামাহি মাহিন। মারেভা মাইমিতিও আহমদ মুসার কাছে এসে বলল, স্যার, আপনি সুস্থ তো? সারারাত মনে হচ্ছে আপনার ঘুম হয়নি। কালকের পোশাকই তো পড়ে আছেন! এ কি আপনার জ্যাকেটের দুই হাতাতেই যে রক্ত! ঠিক আছেন তো আপনি?
আহমদ মুসা হাসল। বলল, মারেভা, আমি ভেবেছিলাম তোমার প্রশ্ন বোধ হয় শেষ হবে না। ধন্যবাদ শেষ করার জন্যে। এত….।
কথা বলা হল না আহমদ মুসার। তেপাও শোয়া থেকে উঠে বসেছিল। কথা বন্ধ করে আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে বলল, তুমি তো এই প্রথম সংজ্ঞালোপকারী গ্যাসের কবলে পড়েছ, তোমার সুস্থ হতে আরও কিছু সময় লাগবে। আর উঠে কি করবে। অন্তত কয়েক দিন গাড়ি চালাতে তুমি পারবে না।
ডাক্তারও তাই বলেছে। স্যার কি ঘটেছিল? আপনাকে না দেখা পর্যন্ত আমরা দারুন উদ্বেগে ছিলাম। ভোর বেলা আমরা হাসপাতাল থেকে টেলিফোন পাই, তেপাও নামে ট্যাক্সি চালককে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। সংজ্ঞা ফিরে পেয়েছে এই মাত্র। সে অনুরোধ করেছে আপনাদের হাসপাতালে আসার জন্যে। আমি মারেভাকে সংগে সংগেই নিয়েই চলে আসি। মারেভাও চলে আসে। তেপাও আমাদের জানায়, কি এক জিনিষ গাড়ির ভেতরে পড়ার সাথে সাথেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সে আর কিছুই জানে না। হাসপাতালের বেডে সে জ্ঞান ফিরে পায়। আমরা সংকিত হয়ে পড়ি যে, আপনিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং আপনি শত্রুর হাতে পড়েছেন। বলল মাহিন।
স্যার আপনাকেও অসুস্থ মনে হচ্ছে। আপনার জ্যাকেটের দুই আস্তিনে রক্ত। বলুন প্লিজ, কি ঘটেছিল, কি হয়েছিল আপনার?
নিশ্চয় বড় কিছু? বলল মারেভা মাইমিতি।
গম্ভীর হলো আহমদ মুসা। বলল, সে অনেক কথা মারেভা। কেবিনের দরজা বন্ধ করে দাও বলছি।
মাহিন দৌড়ে গিয়ে কেবিনের দরজা বন্ধ করে ফিরে এলো।
তেপাও জ্ঞান হারিয়েছিল, কিন্তু আমি জ্ঞান হারাইনি। গোল বলটাকে গাড়ির ভিতরে পড়তে দেখেই আমি শ্বাস নেয়া বন্ধ করেছিলাম। কিন্তু অজ্ঞান হবার ভান করেছিলাম।
বলে আহমদ মুসা রাতের গোটা কাহিনী বলল। কিভাবে তাকে সংজ্ঞাহীন মনে করে ওঁরা ওদের গাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল হাত-পা বেঁধে। কিভাবে তাঁদের কাছে আহমদ মুসাকে হত্যার নির্দেশ আসে, কিভাবে আহমদ মুসা দাত দিয়ে হাতের বাঁধন ও পরে পায়ের বাঁধন সে খুলে ও সংজ্ঞাহীনের মত পড়েছিল, কিভাবে তাঁরা গাড়ির সিটেই তাকে হত্যার উদ্যোগ নেয়, কিভাবে সে গাড়ির পাঁচজনকে হত্যা ও দু’জনকে আহত করে নিজেকে রক্ষা করে, কিভাবে আবার সামনে ও পিছন থেকে শত্রুপক্ষের গাড়ি দ্বারা সে আক্রান্ত হয়, কিভাবে সে তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া বিস্ময়কর এক অস্ত্রে তাদেরকেই অকেজো করে দিয়ে ওদের ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর ওদের আকাশযান এক্সিকিউটর-১ ছুটে আসে তাঁকে হত্যার জন্যে, কিভাবে উপর থেকে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করে, কিভাবে সে আল্লাহ্র ইচ্ছায় নিজেকে রক্ষা করে এবং কিভাবে জ্যামিং মেশিন ফেলে দিয়ে এক্সিকিউটর-১ এর কবল থেকে সরে আসতে সক্ষম হয়-সব কথা সংক্ষেপে বলল আহমদ মুসা।
মারেভা, মাহিন ও তেপাও সবার চোখেই আতংক আর বিস্ময়। তাঁদের কারও মুখে কোন কথা নেই। বিস্ময় ও আতংকের ঘোরে নির্বাক হয়ে গেছে যেন তাঁরা!
আহমদ মুসাই নিরবতা ভাঙল। হাসল সে। বলল, কি হলো, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি! ভাবছ এত ঘটনা ঘটল কিভাবে রাতের একটা অংশে!
তা নয়, স্যার। একটা সত্য ঘটনা রূপকথার ভয় ও বিস্ময়কেও ছাড়িয়ে গেছে। আমরা সে ভয় ও বিস্ময়কে কাটাতে পারছি না।
বলে একটা ঢোক গিলেই আবার শুরু করল মারেভা, আপনার লাশ ১ বিলিয়ন ডলারে কিনতে চায় ওঁরা কারা? এবং কেন কিনতে চেয়েছিল?
ওঁরা পশ্চিমের একটি বড় সন্ত্রাসী গ্রুপ। যে কোন মুল্যে ওঁরা আমার মৃত্যু চায়। তাই আমার লাশ হাতে পেয়ে তাঁরা নিশ্চিত হতে চায়, আমি মরেছি। বলল আহমদ মুসা।
ওহ গড! বলে আঁতকে উঠল মারেভা আহমদ মুসার কথা শুনে। হতবাক হয়ে গেছে মাহিন ও তেপাও।
কিন্তু এরা কারা, যারা আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল, হত্যার চেষ্টা করেছিল? বলল মাহিন।
আমি যাদের সন্ধানে এসেছি, এরা তারাই। ওঁরা আমার পরিচয় পেয়ে গেছে। সেদিন অ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে গৌরী নামে যে মেয়েটিকে দেখেছিলে, সে ঐ দলেরই সদস্য। আমার সন্ধানেই সে রেস্টুরেন্টে এসেছিল। সে ও তাঁর লোকজনই আমাকে কিডন্যাপ করে। আহমদ মুসা বলল।
ওহ গড! তাহলে তো ওদের লোক নানাভাবে আমাদের ফলো করছে! বলল মারেভা।
কিন্তু ওঁরা চিনতে পারল কি করে আপনাকে? মাহিন বলল।
আমাকে আহমদ মুসা পরিচয়ে ওঁরা জানতো না আজ রাতের আগে। তোমাদের তাহানিয়া অ্যাটলে একটা sos আমি মনিটর করেছিলাম, মুলত সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যেই আমাকে ওঁরা কিডন্যাপ করেছিল। কিছু ঘটনা ঘটার পর ওঁরা জানতে পারে আমি আহমদ মুসা এবং এটা ওদের জানিয়ে দেয় পশ্চিমের ওদের মিত্র সংঘটনকে। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে ওঁরা এখন আপনাকে নিশ্চয় হন্যে হয়ে খুজছে? বলল মারেভা।
হ্যাঁ, আজ শেষ রাতে ওঁরা হোটেলে আমার রুম পর্যন্ত এসেছিল। ভোর পর্যন্ত ওৎ পেতে ছিল হোটেলের পেছনের রাস্তায়। আমি এটা আঁচ করেই হোটেল রুমে যাইনি। ওদের গতিবিধি দেখার জন্যে আমিও হোটেলের রাস্তায় অপেক্ষা করছিলাম। সকালে ওঁরা চলে গেলে আমি তেপাও-এর সন্ধানে এসেছি। বলল আহমদ মুসা।
তাঁর মানে আপনি সারারাত ও এখন পর্যন্ত বাইরে! আপনার বিশ্রাম নেই, খাওয়াও হয়নি আপনার নিশ্চয়? আপনি নিজে ঠিক না হয়ে এই অবস্থায় আপনি এসেছেন তেপাও-এর খোঁজে! বলল মাহিন।
আমি তেপাও-এর জন্যে উদ্বিগ্ন ছিলাম। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁর কি হলো, তারপর গাড়ি আবার হাইজাকিং-এর পাল্লায় পড়ে কিনা। তাই খোঁজ নিতেই এসেছি। বলল আহমদ মুসা।
তেপাও-এর চোখ ছলছল করে উঠেছে। বলল, স্যার আপনি সারারাত মৃত্যুর সাথে লড়লেন। যে কোন সময় যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারত। আপনারই রেস্ট বেশি দরকার। আর আপনি আমার খোঁজে ছুটে এসেছেন!
আচ্ছা যাক, বল, তুমি কিভাবে হাসপাতালে এলে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
এই হাসপাতালেরই একজন ডাক্তার আমাকে নিয়ে এসে ভর্তি করে দিয়েছে হাসপাতালে। তেপাও বলল।
স্যার, এবার চলুন নাস্তা করবেন। হাসপাতালের ক্যান্টিনে ভালো নাস্তার ব্যবস্থা আছে। বলল মাহিন আহমদ মুসাকে।
না, আগে হোটেলে ফিরে আমাকে ফ্রেশ হতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ঐ হোটেলে ফেরা তো আপনার ঠিক হবে না স্যার! ওঁরা নিশ্চয় পাহারা বসিয়েছে। বলল মাহিন।
না মাহিন, ঐ হোটেলে ফিরছি না। আমি একটা পাবলিক কল অফিস থেকে হোটেলকে জানিয়ে দিয়েছি, আমি মুরিয়া চলে এসেছি কয়েক দিনের জন্যে। শীঘ্রই ফিরব।
আহমদ মুসা একটু থামতেই মারেভা বলল, কিন্তু হোটেলে যেতে চাইছেন যে আপনি?
তবে আমি পাতুতোয়ায় হোটেল প্যাসেফিক ইন্টারন্যাশনালে একটা কক্ষ নিয়ে রেখেছি। সেখানেই যাব আমি। এখান থেকে কাছেও হোটেলটা। বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় মারেভাদের চোখে-মুখে। বলল মাহিন, আপনি কি করে বুঝেছিলেন যে, হোটেলটা আপনাকে ছাড়তে হতে পারে?
আমি জেনে তা করিনি। আমাদের রসূল সঃ-এর এ ধরনের উপদেশ আছে, যৌবনে বার্ধক্যের চিন্তা করতে হয়, ভালো সময়ে খারাপ সময়ের কথা ভাবতে হয় ইত্যাদি। আমিও তাই ভালো সময়ে খারাপ সময়ের কথা চিন্তা করে ব্যবস্থা করে রেখেছি। বলল আহমদ মুসা।
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে একটু রেস্ট নেব। তারপর একটু স্বরাষ্ট্র বিভাগে যাবো ফরাসি সেই পুলিশপ্রধানের সাথে আলোচনার জন্যে। এরপর ফিরব হোটেলে। তোমরা সেখানে আসতে পারো। পরামর্শ করা যাবে।
ফরাসি সেই পুলিশ অফিসারের কাছে কেন? ওঁরা কি কিছু বলেছে? কিছু ঘটেছে? জিজ্ঞাসা মারেভার।
না, কিছু ঘটেনি। তাঁর সাথে দেখা করে আজকের ঘটনা ব্রিফ করতে চাই। যা ঘটেছে তাঁর কিছু তো তাঁদের জানা দরকার! যে কোন সময় তাঁদের সাহায্যেরও দরকার হতে পারে। বলল আহমদ মুসা। কথা শেষ করেই ‘আল্লাহ্ হাফেজ’ বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল আহমদ মুসা। ঠিক বেলা তিনটায় মারেভা ও মাহিন পাতুতোয়ার হোটেল প্যাসিফিক ইন্টারন্যাশনালে গিয়ে পৌঁছল।
আহমদ মুসা ঘুম থেকে উঠে তাঁদের স্বাগত জানাল।
স্যরি স্যার, আপনাকে আমরা ঘুম থেকে তুললাম। বলল মাহিন।
তোমরা বরং আমার উপকার করেছ। আমি দিনে ঘুমাই না। কখনও ঘুমালেও এক ঘণ্টার বেশি নয়। তোমরা না এলে দেখছি আমার নিয়ম ভঙ্গ হতো। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা টয়লেট থেকে ওজু করে ফ্রেশ হয়ে এসে বলল, এখন বোধ হয় কফি খেতে আমাদের ভালো লাগবে।
বলে আহমদ মুসা কফি বানানোর সরঞ্জামের দিকে এগোল।
মারেভা উঠে দৌড়ে গেল কফি পটের কাছে। বলল স্যার, ছোট বোনকে আর লজ্জা দিবেন না। আপনি গিয়ে বসুন।
আমি কফি তৈরিতে এক্সপার্ট না হলেও তা না খাওয়ার মত হবে না নিশ্চয়।
ধন্যবাদ। বলে আহমদ মুসা এসে সোফায় বসল। কফি এল।
মারেভা আহমদ মুসা ও মাহিনকে কফি দিয়ে নিজে এক কাপ নিয়ে ভিন্ন সোফায় গিয়ে বসল।
আহমদ মুসা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা মাহিন-মারেভা, আমি যদি বল আমি ‘মতু’তে যেতে চাই, তাহলে তোমরা কি বুঝবে?
মারেভারা একটু ভাবল।
মারেভাই প্রথম মুখ খুলল। বলল, পলিনেশীয় ভাষায় ‘মতু’ অর্থ দ্বীপ। সে অনুসারে আমি বুঝব, আপনি একটা দ্বীপে যেতে চান।
আমার কাছেও এটাই অর্থ স্যার। বলল মাহিন।
কিন্তু এভাবে কেউ কি বলে আমি ‘মতু’ যাব? আহমদ মুসা বলল।
না, তা বলে না স্যার। যে দ্বীপে যাবে, সে দ্বীপের নাম বলবে সেটাই স্বাভাবিক। বলল মারেভা।
কেউ যদি বলে ‘মতু’ যাব, তাহলে কি ধরে নেয়া হবে না যে, সে বিশেষ দ্বীপের নাম বলছে? আহমদ মুসা বলল।
জি স্যার, সেটাই ধরে নিতে হবে। বলল মারেভা ও মাহিন দু’জনেই।
‘মতু’ নামে কি কোন দ্বীপ আছে ফ্রেঞ্চ পলিনেশীয়ার বিশেষ করে মতুতোয়া অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জে?
দু’জনেই ভাবল কিছুক্ষন। বলল মারেভা। না ‘মতু’ নামে কোন দ্বীপ নেই এবং থাকা স্বাভাবিকও নয়। দ্বীপের নাম ‘দ্বীপ’ হতে পারেনা।
আমিও তাই মনে করি স্যার। বলল মাহিনও।
মাহিনের কথা শেষ হতেই মারেভা বলে উঠল, ‘মতু’ সম্পর্কে এত কথা বলছেন কেন স্যার? ‘মতু’ নামে দ্বীপই বা খুজছেন কেন স্যার?
আমি যখন অজ্ঞানের ভান করে ওদের গাড়িতে পড়েছিলাম, তখন তাঁদের আলোচনা থেকে জানলাম, আমাকে ‘মতু’তে নিয়ে যাবার কথা ছিল ওদের। কিন্তু নির্দেশ আসে আমাকে ‘মতু’তে নেয়া যাবে না। তাহিতিতেই তাঁদের কোন এক ঘাটিতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ হয়। গাড়ির গতি পরিবর্তন করে তাহিতির ঘাটির দিকেই চলতে শুরু করে। পড়ে অবশ্য আবার নির্দেশ আসে আমাকে কোথাও নেয়া যাবে না ঐ রাস্তাতেই আমাকে হত্যা করতে হবে। আমি ওদের ‘মতু’ বলা থেকে বুঝেছি, ‘মতু’ অবশ্যই একটা দ্বীপের নাম।
ঠিক বলেছেন স্যার, ‘মতু’ একটা দ্বীপেরই নাম হবে। প্রশ্ন হল, ‘মতু’ দ্বীপটি কথায়?
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। ভাবছিল সে। মনে পড়ল তাঁর এসওএস(SOS) এর কথা। এসওএস (SOS) সত্য এটা প্রমানিত হয়েছে, এবং সে এসওএস ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান ঘাটি ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ থেকেই। একথাও পরিস্কার যে, সেখানেই বন্দী ৭৬ জন বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ এবং সেখানেই বন্দী আছেন সৌদি আরবের বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মক্কী। আহমদ মুসা এসওএস ‘টি পেয়েছিল তাহানিয়া অ্যাটলের দক্ষিন মাথায় অবস্থান কালে। সেখান থেকে এক মাইলের মধ্যে বা আশেপাশে ‘মতু’ নামে কোন অ্যাটল দ্বীপ আছে কিনা! মারেভারা বলল, না এ নামে কোন দ্বীপ নেই। তাহলে কি ব্ল্যাক সানের লোকরা দ্বীপটির এই ছদ্মনাম দিয়েছে কিংবা তাঁরা কি দ্বীপের আংশিক নাম বলেছে?
আহমদ মুসা মাথা তুলে তাকাল মাহিনের দিকে। বলল, মাহিন তোমরা তাহানিয়া অ্যাটলের চারপাশের, বিশেষ করে ১ থেকে ২ মাইলের মধ্যে যে সব অ্যাটল দ্বীপ আছে সেগুলার কি নামের তালিকা দিতে পার?
অবশ্যই পারবো স্যার। হোটেলের মিডিয়া সেন্টারে কম্পিউটার আছে। কম্পিউটারের গোগলের স্যাটেলাইট ভিউতে গেলেই সব দ্বীপ ও তাঁর নাম পেয়ে যাব। বলে উঠে দাঁড়ালো মাহিন।
মারেভা, তুমিও যাও। বুদ্ধি শেয়ার করতে পারবে দু’জনে।
আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। মারেভা ভাবল, স্যার কি একা থাকতে চান কিছুক্ষন, না একা ঘরে মারেভার থাকা তিনি এড়াতে চাচ্ছেন। শেষটাই বোধ হয় ঠিক। আরও ভাবল, মারেভা ও মাহিনের এক সাথে ঘুরাও তিনি পছন্দ করছেন না। যাক, সত্তর তাঁদের বিয়েটা হিয়ে যাচ্ছে, তখন আর স্যারের কিছু বলার থাকবে না। আরেকটা কথা ভেবে ভালো লাগল মারেভার, ইসলাম ধর্ম মোতাবেক তাঁদের বিয়ে হচ্ছে! তাঁদের দুই পরিবারই ইসলাম গ্রহন করেছে।
চলে গেল মারেভা ও মাহিন।
ফিরে এলো তাঁরা মিনিট দশেকের মধ্যেই।
সিটে বসেই মাহিন বলল, স্যার আমাদের মিশন সফল। আমরা ‘মতু’ দ্বীপ পাইনি বটে, মতুতুংগা নামে একটা দ্বীপ পেয়েছি। ‘মতু’ শব্দসহ আর কোন দ্বীপের নাম মতুতুয়া দ্বীপপুঞ্জে নেই। সুতরাং আমরা মনে করি ‘মতু’ বলতে মতুতুংগা দ্বীপকেই বুঝানো হয়েছে।
কিন্তু ‘মতুতুংগা’ দ্বীপটি কোনটি? তাহানিয়ার দক্ষিনের দ্বীপটি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হ্যাঁ, দক্ষিনের দ্বীপটাই। বলল মারেভা।
কিন্তু, দ্বীপটা তো খুবই ছোট! ওঁর চারদিকের ল্যান্ড-লাইন খুবই সংকীর্ণ। ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’-এর জন্যে ওরকম দ্বীপ আইডিয়াল নয়। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু তাহানিয়ার আশেপাশে কেন গোটা দ্বীপপুঞ্জে ‘মতু’ শব্দসহ হন দ্বীপের নাম নেই। বলল মাহিন।
তা ঠিক। আমাকে দ্বীপটা আবার দেখতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু ঐ জায়গাটা তো আপনার জন্যে নিরাপদ নয়! আপনিই তো বলেছিলেন, ওদের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় আমাদের বোঁট, আমাদের তিনজনের চেহারা ধরা পড়েছিল। সেই ছবি ও বোটের নাম্বার দেখেই ওঁরা আমাদের খোঁজ পায়। তারমানে তাহানিয়া ও আশেপাশের দ্বীপপুঞ্জ ওদের ক্লোজ ক্যামেরার রেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং তাহানিয়া, মুতুতুংগা ও এর আশেপাশে যাওয়া, বিশেষ করে আপনার জন্যে এখন আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বলল মারেভা।
ঠিক মারেভা, কিন্তু ওখানে না গেলে তো সমস্যার জট খুলছে না। ‘মতু’ যদি মতুতুংগাই হয়, তাহলে তাঁর ভিন্নতর কিছু খুঁজে পাওয়া যাবেই। সেটা সাগরের উপরে হতে পারে, সাগর বক্ষেও হতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
একটু থেমেই আবার শুরু করল, আমি এখান থেকে বেরিয়ে যাব তাহিতি সরকারের ‘ওসান ও ওসান রিসোর্সেস ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তিয়ারে হিরেনুর কাছে। আজ গিয়েছিলাম তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান আর সেই পরিচিত মসিয়ে দ্যা গলের কাছে। তিনিই অধ্যাপক তিয়ারে হিরেনুর সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছেন। সাগরে যদি নামতে হয়, তাহলে তাঁর সাহায্য দরকার।
আপমি সাগরে নামবেন? বলল মাহিন।
নামবো না, নামতে যদি হয় তারই আগাম প্রস্তুতি। মতুতংগা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর, তাঁর বাইরেটা দেখার পর এই বিষয়ে চিন্তা করব। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার মোবাইলের স্ক্রিনে কয়েকবার বিপ বিপ শব্দ করে একটা লাল আলো জ্বলে উঠল। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হবার পর তা থেমে গেল।
আহমদ মুসার ভ্রু কুঞ্চিত হল। তাকাল মাহিনদের দিকে। বলল, তেপাও তো নিচে গাড়িতে আছে, না?
জি হ্যাঁ। বলল মাহিন।
তাহলে একটা কল করে বল, গাড়ি পার্ক করে থাকার সময় কেউ তাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করেছে কিনা?
সংগে সংগেই তাঁর সাথে কথা বলল মাহিন। কথা শেষ করে আহমদ মুসাকে বলল, গাড়ি পার্ক করার পাঁচ মিনিট পরে একজন লোক আসে, এবং বলে মাহিন ও মারেভা দু’জনেই আমার বন্ধু। তাঁদের এখানে আসার কথা আপনার গাড়িতেই। ওঁরা কথায় গেল? তেপাও বলেছে, এই হোটেলেই কোন কাজে গেছে। একথা শুনেই তাঁরা হোটেলে ঢুকেছে।
তোমরা রিসেপশনে কিছু বলেছ? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
আপনি রুম নাম্বার আমাদের দিয়ে আসেন নি। আমরা রিসেপশনে আপনার নতুন নাম বলে রুম নাম্বার জিজ্ঞাসা করেছি। বলল মারেভা।
মারেভা থামতেই মাহিন বলে উঠল, কেন এসব বলছেন স্যার, কিছু ঘটেছে?
আমার মনে হচ্ছে, তোমাদের ফলো করে কেউ এসেছে।
বিস্ময় ফুটে উঠল মারেভা ও মাহিন দু’জনের চোখে-মুখে। মারেভা বলল, কারা ফলো করেছে? ওঁরা?
হ্যাঁ ঠিক ধরেছ। বলল আহমদ মুসা।
তাঁর মানে ওঁরা আমাদের ফলো করে আপনার কাছে পৌছতে চায়। বলল মাহিন।
আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু বলা হলো না। তাঁর মোবাইলে কয়েকবার বিপ বিপ শব্দ উঠল, তাঁর সাথে মোবাইলের স্ক্রিনে চারটি লাল আলো ভিন্ন ভিন্নভাবে একই সাথে জ্বলে উঠেছে। সে চমকে উঠল। দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, মারেভা, মাহিন, তোমরা তাড়াতাড়ি এক পাশে সরে যাও। তাড়া……।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতে পারল না। প্রবল ধাক্কায় কক্ষের দরজা ভেঙ্গে পড়ল।
ধাক্কা দেয়া লোকেরা সামনে ঝুকে পড়েছিল। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে রিভলবার।
দরজায় ধাক্কা পড়ার প্রথম শব্দ কানে আসার সাথে সাথেই আহমদ মুসা মাথার পেছনে জ্যাকেটের গোপন পকেট থেকে দ্রুত রিভলবার বের করে তাক করল দরজার দিকে। রিভলবারের ট্রিগারে তাঁর তর্জনী।
দরজার পাল্লা পড়ে যেতেই দরজা ভেঙ্গে লোক দু’জন এসে গেল তাঁর রিভলবারের সামনে। নড়ে উঠল আহমদ মুসার তর্জনী অবিরামভাবে। সামনের দু’জন লোক গুলী খেয়ে পড়ে গেল দরজার উপরে।
গুলী অব্যাহত রেখেই আহমদ মুসা মেঝের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ওদিক থেকেও গুলী আসা শুরু হয়েছে।
আহমদ মুসা মেঝের উপর ঝাপিয়ে পড়ার পর দরজায় দাঁড়ানো অবশিষ্ট দু’জনের, যারা গুলী ছোড়া শুরু করেছে, তাঁদের টার্গেট পরিবর্তন হয়ে গেল। এরই সুযোগ গ্রহন করল আহমদ মুসা মেঝেয় গিয়ে পড়ার সংগে সংগেই। আহমদ মুসার রিভালবার থেকে শেষ দুটি গুলী বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসার গুলী যখন ওদের দু’জনের বুকে বিদ্ধ হল, তখন তাঁদের রিভলবারও আহমদ মুসা লক্ষ্যে সরে এসেছিল। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হবার পর তাঁদের তর্জনীও তাঁদের রিভলবারের ট্রিগারে চেপে বসেছিল বটে, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আহমদ মুসার পেছনের দেয়ালকে গিয়ে বিদ্ধ করল।
আহমদ মুসা গুলী করেই দ্রুত গড়িয়ে সরে গিয়েছিল ওদের গুলী এড়াবার জন্যে। কিন্তু ওদের টার্গেটে আসেনি, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।
একবার দরজার দিকে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। দেখল, মাহিন ও মারেভা মেঝেতে সোফার আড়ালে।
মাহিন, তোমরা ঠিক আছ। জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
ভীত ও আতংকগ্রস্থ মাহিন, মারেভা উঠে দাড়াল। কম্পিত কণ্ঠে বলল, মাহিন আমরা ভালো আছি। তাঁদের চোখ গিয়ে নিবদ্ধ হলো চারটি লাশের উপর এবং দেখল আহমদ মুসার রিভলবারটাও।
দরজায় বেশ কিছু ভীত, বিস্মিত ও উৎসুক লোকের ভিড় জমে গেছে। হোটেলের ম্যানেজারও এসে গেছে।
আহমদ মুসা দরজার দিকে এগিয়ে বলল, ম্যানেজার সাহেব, এরা আমার রুমের দরজা ভেঙ্গে আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেছিল। আপনি পুলিশকে খবর দিন।
সংগে সংগেই ম্যানেজার তাঁর মোবাইলে টেলিফোন করল পুলিশকে।
সবাই পুলিশের অপেক্ষায়।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পুলিশ এসে গেল।
পিলিশ অফিসার এই রেঞ্জের প্রধান কর্মকর্তা হিমাতা হিরো হোটেলের ম্যানেজার ও আহমদ মুসার বক্তব্য গ্রহন করল। আহমদ মুসার বক্তব্য গ্রহন করার পর তাকে বলল, আমাদের স্যার মানে পুলিশ প্রধান মিস্টার দ্যাগল আপনার খুব ঘনিষ্ঠ, তাই না?
হা, পরিচিত। কেন? বলল আহমদ মুসা।
আমি তদন্তে আসার আগে এই হোটেলের এই রুমের ঘটনার বিষয়ে তাকে ব্রীফ করেছি। তিনি আপনার কথা আমাকে বলেছেন এবং আপনার নিরাপত্তার বিষয় দেখতে বলেছেন।
হ্যাঁ, তিনি খুব সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ, আপনি আপনার রিভলবারের লাইসেন্সটা আমাকে দেখান। এটা আমাদের রুটিন কাজ। আর আপনার রিভলবার ও লাইসেন্স আমাদের দিবেন। এটা কেসের জন্যে প্রয়োজন। আপনি আরেকটা রিভলবার ও লাইসেন্স এখনি পেয়ে যাবেন।
ধন্যবাদ। বলে আহমদ মুসা তাঁর রিভালবার ও লাইসেন্স পুলিশ অফিসারকে দিল।
পুলিশ কক্ষের দরজা ও নিহতদের বিস্তারিত ফটো গ্রহন করল। তারপর নিহত আক্রমণকারীদের রিভলবারগুলো কাপড় জড়িয়ে সাবধানে সংরক্ষনে নিল। লাশগুলোও নিয়ে গেল পুলিশ।
হোটেল ম্যানেজমেন্ট আহমদ মুসাকে অন্য একটি কক্ষে শিফট করল ঘরটা ঠিক করার জন্যে।
আহমদ মুসার সাথে মারেভা ও মাহিনও নতুন কক্ষে এল। আহমদ মুসা নতুন কক্ষে উঠতে গিয়ে দেখল, কক্ষের সামনের করিডোরে দুই প্রান্তের মুখে দু’জন করে চারজন পুলিশের প্রহরা রয়েছে।
কক্ষে প্রবেশ করেই মারেভা বলল, আমি পুলিশ আসার খবরে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। নিশ্চয় আপনার বন্ধু পুলিশ কর্মকর্তা আপনাকে সাহায্য করেছেন।
হ্যাঁ, সেটা তো অবশ্যই। তাছাড়া আমি তো বেআইনি কিছু করিনি। আত্নরক্ষার অধিকার সকলের আছে। আমি তাঁদের না মারলে তাঁদের হাতে আমাকে মরতে হতো। দেখামাত্র গুলী করার নির্দেশ নিয়েই তারা এসেছিল এবং তারা তাই করেছিল। আমার রিভলবারও বেআইনি ছিল না। আহমদ মুসা বলল।
দরজা ভাঙ্গার পর যা কিছু ঘটল তাকে অবিশ্বাস্য এক রূপকথার মত মনে হচ্ছে! ভয়ে আমার শ্বাসরুদ্ধ হবার মত হয়েছিল। কিন্তু কখন, কিভাবে, কোথেকে আপনি রিভলবার বের করলেন এবং একা চারজনকেই হত্যা করলেন, আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনে হলো আপনি প্রস্তুত ছিলেন। বলল মাহিন।
আমাদের কেউ ফলো করেছে, তা আপনি কি করে বুঝলেন? বলল মারেভা।
আহমদ মুসা তাকাল মারেভাদের দিকে। বলল, আমার দরজার সামনে কার্পেটের ভেতরে পরিকল্পিতভাবে কয়েকটি অ্যাংগেলে আলপিনের গোঁড়ার মত ক্ষুদ্র কয়েকটা আলট্রা সেনসেটিভ ইলেকট্রিক সিগন্যালার পেতে রাখা ছিল। তোমরা আমার রুমে আসার মিনিট সাতেক পর একজন লোক এসে আমার দরজার সামনে এসে দাড়ায়। পনেরো সেকেন্ডের মত দাড়িয়ে চলে যায়। আমার মোবাইলে এর সিগন্যাল আমি পেয়ে যাই। আমার সন্দেহ হয়, তোমাদের ফলো করা হয়েছে এবং তাঁদের একজন আমার রুমটা এসে চিনে গেল। আমি তেপাও-এর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম যে, তোমাদের ফলো করা হয়েছে। আমাদের কথা বলার ফাঁকেই ওঁরা প্রস্তুত হয়ে আমার দরজায় এসে দাড়ায়। চারটি সিগন্যাল পাই আমি আমার মোবাইলে। বুঝতে পারি ওঁরা চারজন এসেছে। এবার কক্ষ দেখার জন্যে নয়, আমাকে হত্যার জন্যে। আমি ভেবেছিলাম, ওঁরা দরজায় নক করবে, আমি খুলতে যাব অবশ্যই, তখনই ওঁরা আমাকে গুলী করবে এক সাথে পয়েন্টেড ব্ল্যাংক। এতে ওদের একজন মরলেও আমাকে ওঁরা মারতে পারবে, এই চিন্তাই তারা করবে। কিন্তু তারা ভুল করে।
কি ভুল করে? জিজ্ঞাসা মারেভার।
ওঁরা দরজায় টোকা দিয়ে আমাকে সতর্ক করে দিতে চায়নি। ওঁরা চেয়েছে, আচমকা দরজা ভেঙ্গে অপ্রস্তুত অবস্থায় আমার উপর ঝাপিয়ে পড়তে। কিন্তু তা হয়নি। আমি সতর্ক ছিলাম। ওরাই দরজা ভাঙতে গিয়ে সামনের দু’জন কিছুটা হলেও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং ওদের সকলেরই রিভালবার আমাকে দেখার পর আমাকে লক্ষ্য করে উঠে আসতে বিলম্ব করে। এরই সুযোগ গ্রহন করে আমার তৈরি থাকা রিভালবার, প্রথমে সামনের দু’জনকে, পড়ে পেছনের দু’জনকে হত্যা করে। আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে শুনছিল মারেভা ও মাহিন আহমদ মুসার কথা। কি অদ্ভুত তাঁর প্রতি সেকেন্ডে প্রতি মুহূর্তের হিসাব! প্রতি মুহূর্তের সুযোগের কি অদ্ভুত সদ্ব্যবহার! দরজা ভাঙতে গিয়ে ওদের প্রস্তুতি ও মনোযোগের সামান্য যে বিচ্ছিন্নতা তাকে ব্যবহার করেই আহমদ মুসা বিজয়ী আর ওঁরা পরাজিত, মৃত।
আহমদ মুসা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে এক ঝাক গুলীর শিকার তিনিই হতেন। জীবন আর মৃত্যু কত কাছাকাছি! ভাবতে গিয়ে বুক কেপে উঠল মারেভার। চোখ দুটি বিস্ফরিত মাহিনের।
আপনি বুঝতে পেরেছেন, ওঁরা এসেছে আপনাকে হত্যা করতে, আপনার ভয় লাগেনি? জিজ্ঞাসা করল মাহিন।
ভয় কি জন্যে? বলল আহমদ মুসা।
কেন। মৃত্যুর? মাহিন বলল।
মৃত্যু আল্লাহ্র নির্দেশ ছাড়া আসে না। সুতরাং মৃত্যু ভয় করার বিষয় নয় এবং কেউ মৃত্যু কামনা করুক আল্লাহ্ তা চান না। সেজন্যই আত্নরক্ষাকে অবশ্য কর্তব্য বলা হয়েছে। আমি সে চেষ্টা করেছি। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার! স্রষ্টা বা আল্লাহ্র পরিচয়, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। ক’দিনে আপনি অনেক কিছু শিখিয়েছেন আমাদের। মারেভা বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, শেখা, মানা ও করা কিন্তু এক জিনিষ নয় মারেভা।
স্যার, আপনি জানেন না, আমরা মানছি এবং করছিও। মারেভা বলল।
আমরা মানে কে? বলল আহমদ মুসা।
আমরা মানে আমাদের দুই পরিবার। আপনি একদিন বাসায় আসুন, বিস্মিত হবেন। আমাদের ড্রয়িং রুমের পাশের ঘরটা এখন নামাজ ঘর। আমার মাথা গায়ে যে ওড়না দেখছেন, তা এখন আমাদের সব মেয়ের মাথায়। মারেভা বলল।
ধন্যবাদ তোমাদের। আহমদ মুসা বলল।
স্যার, এখন আমাদের প্রতি আপনার নির্দেশ কি? বলল মাহিন।
তোমাদেরকে আগামী কয়েকদিন বা কিছুদিন বাড়িতে থাকা চলবে না। আহমদ মুসা বলল।
কেন স্যার, কিছু আশংকা করছেন? বলল মাহিন।
অবশ্যই। তোমরা ওদের নজরদারিতে রয়েছ। তোমাদের মাধ্যমে আমাকে ওঁরা খুঁজে পেতে চায়। না পেলে এমনকি ওঁরা তোমাদের আটকও করতে পারে যাতে আমাকে পাওয়ার ওদের একটা ব্যবস্থা হয়। আহমদ মুসা বলল।
মারেভা ও মাহিনের মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। মারেভা বলল, ঠিক স্যার। ঠিক বলেছেন আপনি। এটা তারা করবে।
আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার, ওঁরা এই চেষ্টা করবে। আজও ওঁরা আমাদেরকে অনুসরন করেই এখানে এসেছে। মাহিন বলল।
স্যার, একটা কথা। আহমদ মুসার দিকে না তাকিয়েই বলল মারেভা।
কি কথা বল? আহমদ মুসা বলল।
মাহিন, তুমিই বল না। মাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল মারেভা। রহস্যময় একটা লজ্জা এসে জড়ো হয়েছে যেন মারেভার মুখে। লাল হয়ে উঠেছে তাঁর মুখ।
মাহিনের মুখেও লজ্জা এসে জুটল। বলল, জড়সড় হয়ে, ও আমাদের বিয়ের কথা বলতে চাচ্ছে স্যার। সেতার কি হবে?
বিয়ে হতেই হবে, কবে যেন হচ্ছে বিয়ে? আহমদ মুসা বলল।
আগামী শুক্রবার, স্যার। তারিখটা তো আপনারই দেয়া স্যার!
হ্যাঁ, দাওয়াতের জন্যে তো কার্ড হচ্ছে না? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
না, হচ্ছে না। আপনি তো নিষেধ করেছেন।
আপনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই শুধু আত্মীয়দের নিয়ে ঘরোয়া অনুষ্ঠান হচ্ছে। মাহিন বলল।
তাই বলে ঘরে হচ্ছে না তো! বলল আহমদ মুসা। আমাদের এলাকার ক্লাব ভাড়া নেয়া হচ্ছে। তবে সেখানে আলোকসজ্জার বাইরে কিছু হবে না। নেম-সাইন বোর্ডও থাকবে না। মাহিন বলল।
ধন্যবাদ। তোমরা কোথায় থাকবে বলে ঠিক করেছ? বলল আহমদ মুসা।
আব্বা-আম্মাদের সাথে পরামর্শ করে আমরা সেটা ঠিক করব। তবে অমনটা হবে না। আমাদের পাড়াতেই আমাদের আন্টিদের বাসা। সেখানেই আমাদের থাকতে হবে। মাহিন বলল।
দুঃখিত, আমার কারনেই তোমরা এই বিপদে পড়লে। বলল আহমদ মুসা।
বিপদ হলেও বিপদটা খুব আনন্দের স্যার। আপনার সাথি হতে পারা এক দুর্লভ গৌরব। স্যার, এই প্রথম বুঝতে পারছি আমাদের জীবনের মুল্য আছে। মারেভা বলল।
জীবনকে বুঝতে পারার জন্যে ধন্যবাদ।
মুহূর্ত কয়েকের জন্যে থামল আহমদ মুসা। আবার বলল, তোমরা সকালে বাড়ি থেকে বেরুবার পর তোমরা কি আর বাড়ি গিয়েছিলে?
না, যাবার সময় হয়নি। বলল মারেভা।
তাহলে তোমাদের বাড়ি যাওয়া দরকার। আহমদ মুসা বলল।
আপনি অনুমতি দিলে আমরা যেতে পারি। কিন্তু আপনি তো একা! তেপাও কি থাকবে এখানে? জিজ্ঞাসা মাহিনের।
অনুমতির প্রশ্ন কেন? তোমরা স্বাধীন ইচ্ছায় এসেছ, স্বাধীন ইচ্ছাতেই যখন ইচ্ছা তখন যাবে। কিন্তু ভাবছি তোমরা যাবে কিভাবে! আহমদ মুসা বলল।
এ নিয়ে ভাবনা কেন স্যার? বলল মাহিন।
তোমাদের যাতায়াতও এখন নিরাপদ নয়। হোটেলের সামনে ওঁরা নিশ্চয় পাহারায় আছে। তোমাদেরকেও ওঁরা ধরে নিয়ে যেতে পারে। আমাকে হাতে পাওয়ার এটা তাঁদের একটা কৌশল হতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
তাহলে? বলল মারেভা।
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, ঠিক আছে হোটেলের পেছন দিক দিয়ে চলে যাবার ব্যবস্থা করছি। হোটেলের কেউ একজন তোমাদেরকে হোটেলের পেছন দিকের পথ দেখিয়ে দেবে।
বলে একটু থেমে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, একটা কথা, তোমরা এভাবে আমার কাছে আর এসো না। বিপদ তোমাদের এড়িয়ে চলতে হবে। আর আমাকে এখানে কিংবা ঐ হোটেলে নাও পেতে পার। পুলিশ নিষেধ না করলে আমি এখান থেকে অন্য কোন হোটেলে চলে যেতে পারি। টেলিফোন যোগাযোগেও অসুবিধা হতে পারে। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারি। আজকালের মধ্যেই আমি অ্যাটল দ্বীপে যাব।
একা? আমাদের সাথে নেবেন না? জিজ্ঞাসা মাহিনের।
না, মাহিন। আমাকে একাই যেতে হবে, ছদ্মবেশে অথবা সুযোগ হলে ট্যুরিষ্টদের সাথে যেতে পারি। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু স্যার, আপনার সাথে যাওয়ার চাইতে না যাওয়া আমাদের জন্যে বেশি কষ্টকর হবে। বলল মারেভা।
আমার জন্যে এ কষ্ট তোমাদের করতে হবে।
তোমাদের অনেক বিপদে জড়িয়েছি, এখন আর নয়। তবে প্রয়োজন বোধ করলেই তোমাদের ডাকব। আহমদ মসা বলল।
আপনিই ওদের টার্গেন স্যার। আপনি কি করে সেখানে যাবেন? বলল মারেভা। মুখ তার ম্লান। উদ্বেগও তার চোখে-মুখে।
বিপদ তো আছেই! বিপদের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে হবে। ওদের হাতে ৭৫ থেকে ৭৬ জন্য বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ বন্দী আছে। ওদের বিপদ আমার বিপদের চেয়ে বেশি। মাহিন, মারেভা! জীবন বাজী রেখে অগ্রসর না হলে ওদের বাঁচানো যাবে না। বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ নিরব, শান্ত, হৃদয়স্পর্শী।
আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। কিন্তু আমরা উদ্বেগে থাকব। বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল মারেভা।
মাহিনের চোখও অশ্রুশিক্ত।
তাদের অশ্রু আহমদ মুসাকেও স্পর্শ করল। তাহিতির মত দূরতম স্থানে এসেও মারেভা-মাহিনের মত ভাইবোন পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। অজান্তেই তার দুই চোখের কোণ ভিজে উঠেছিল। বলল, মাহিন মারেভা, যুদ্ধক্ষেত্রের জন্যে বড় ভাইকে অশ্রু দিয়ে নয়, হাসি দিয়ে বিদায় দিতে হয়, বিশেষ করে মুসলমানদের এটা একটা ঐতিহ্য।
আমাদের বিশ্বাস, জ্ঞান কোনটাই অমন শক্ত নয়। আমাদের মাফ করুন। বলল মারেভা ও মাহিন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, নিজেকে ছোট মনে করা বড় হওয়ার সিঁড়ি মারেভা। যাক। আমি হোটেলের কাউকে ডেকে বলে দিচ্ছি, সে তোমাদের হোটেলের পেছন দরজা দিয়ে বের করে দেবে। এদিকের সব ঠিকঠাক করে আমিও বের হবো।
বলে আহমদ মুসা টেলিফোনে হোটেলের একজন অফিসারকে কল করল।
টেলিফোন রেখেই আহমদ মুসা মারেভাদের বলল, তোমরা এখন কোথায় যাবে, কোন রুটে যাবে?
আমি মারেভাকে তার বাড়িতে রেখে আমার বাড়িতে যাব। এখান থেকে সোজা গিয়ে হাইওয়েতে উঠব। সেখান থেকে আমার বাড়িতে সোজা পথ একটাই, সেটা আপনি জানেন। রুট সম্পর্কে কি আপনি কিছু বলতে চান স্যার? বলল মাহিন।
না মাহিন…। কথা শেষ হলো না আহমদ মুসার। দরজায় নক হলো।
আহমদ মুসা কথা বন্ধ করে বলল, হোটেলের লোক এসে গেছে। দরজা খুলে দাও।
হোটেলের একজন কর্মচারী ঘরে ঢুকল।
আহমদ মুসা তাকে সব বুঝিয়ে বলল এবং বলল, চল, আমিও এগিয়ে দিয়ে আসব।
আহমদ মুসা পেছনের গেট পর্যন্ত গিয়ে ওদের বিদায় দিয়ে এল।
এসেই সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল জুতাসহ পা খাটের নিচে রেখে।
শুয়েই মনে হলো শরীর বিশ্রাম চায়।
চোখ জুড়ে তার তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে হলো ড্রাইভার তেপাও-এর কথা। সে বেচারা তো কার পার্কে বসেই আছে! তাকে তো যেতে বলা হয়নি!
তাড়াতাড়ি আহমদ মুসা উঠে বসল।
বিছানার উপর থেকে মোবাইল নিয়ে আহমদ মুসা তেপাওকে টেলিফোন করল। বলল, স্যরি, তেপাও তুমি অনেক কষ্ট করলে।
না স্যার, কোন কষ্ট হচ্ছে না। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আর একটা কথা স্যার। তিনজন লোক হোটেল থেকে বের হওয়ার পর গেটের দিকে চোখ রেখে এখানে ঠায় বসেছিল। গল্প করার ছলে জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল, তাদের সাহেব ভেতরে আর তার জন্যে তারা অপেক্ষা করছে। কিন্তু এইমাত্র এসে বলল, তাদের সাহেব চলে যেতে বলেছে। চলে যাচ্ছে তারা। কিন্তু হোটেল থেকে চলে না গিয়ে তারা তড়িঘড়ি হোটেলের পেছন দিকে চলে গেল। ওদের গতিবিধি কিন্তু শুরু থেকেই ভালো লাগেনি।
হোটেলের পেছনে গেছে? ঠিক দেখেছ? দ্রুত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
ঠিক দেখেছি স্যার। বলল তেপাও।
তেপাও, তুমি তাড়াতাড়ি গাড়ি হোটেলের বাইরে নিয়ে একটু দূরে দাঁড় করাও। আমি হোটেলের পেছন দিক দিয়ে আসছি। হোটেলের সামনে ওদের আরও লোক থাকতে পারে। তাড়াতাড়ি কর তেপাও।
বলে আহমদ মুসা কল অফ করে দিয়ে তৈরি হয়ে দ্রুত হোটেলের পেছন দিয়ে বেরিয়ে এল। একটু এসেই গাড়ি পেয়ে গেল। তেপাও অপেক্ষা করছিল। তেপাও সালাম দিল আহমদ মুসাকে।
সালাম নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে আহমদ মুসা বলল, তুমিও ইসলাম গ্রহণ করেছ তেপাও?
কিভাবে গ্রহণ করতে হয় জানি না। মারেভা, মাহিন সাহেবরা যা শিখিয়েছে আমি তা ঠিক ঠিক করি। আর কি করতে হবে বলুন স্যার। তেপাও বলল।
আমাদের ধর্মের কি তোমার ভাল লেগেছে, তেপাও? বলল আহমদ মুসা।
স্রষ্টা এক, এটা আমার খুব ভালো লেগেছে স্যার। আরেকটা বিষয় হলো, স্রষ্টার পূজা-আরাধনা সকলের জন্যে সমান ও সকলে স্বাধীনভাবে এটা করতে পারে। হাটে-মাঠে-ঘাটে-মন্দিরে সর্বত্র এবং এটা প্রতিদিনের বিষয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আপনি। আপনার মধ্যে ধর্মের যে ছবি দেখেছি, সেটা আমরা গ্রহণ না করে পারিনি স্যার। তেপাও বলল।
ধন্যবাদ তেপাও। ইসলাম হলো মানুষের স্বভাব-ধর্ম। মানুষের বিবেক যা বলে, ইসলাম তাই করতে বলে। বিবেক হলো মানব-মন ও মানব-মস্তিষ্কের জন্যে স্রষ্টার দেয়া বিধিবদ্ধ একটা প্রকৃতি। আল্লাহর বাণীবাহক বা মেসেঞ্জাররা দুনিয়াতে আসেন এই মানব প্রকৃতিকে সাহায্য ও শক্তিশালী করা জন্যে। সুতরাং যারা সত্য ধর্ম সঠিকভাবে মেনে চলে তারাই সত্যিকার মানুষ হয়। তেপাও, আমি সেই মানুষ হবার চেষ্টা করি মাত্র। বলল আহমদ মুসা।
সত্যিই আপনি আপনার আচরণের মত সুন্দর কথা বলেন স্যার, যদিও সব কথা বুঝা আমার জন্যে কঠিন হয়। তেপাও বলল।
গাড়ি ষ্টার্ট আগেই দিয়েছিল তেপাও। বলল, কোথায় যাব স্যার?
মারেভা ও মাহিন বাড়ি যাচ্ছে। ওদের ফলো করতে হবে। সোজা দক্ষিণের পথটা ধরে হাইওয়েতে ওঠ। তারপর মারেভা ও মাহিনের বাড়ি। তোমার কথা সত্য হলে শত্রু তাদের ফলো করছে। মারেভারা বিপদে পড়তে পারে। আহমদ মুসা বলল।
বুঝেছি স্যার, মাহিন ও মারেভা ম্যাডাম তাহলে হোটেলের পেছন দরজা দিয়ে বের হয়েছিল। শয়তানরা সামনের মত পেছনেও পাহারায় ছিল এবং সামনের ও পেছনের লোকরা একত্র হয়ে তাদের ফলো করেছে।
হ্যাঁ, তেপাও, এটাই ঘটনা। যতটা সম্ভব জোরে চালাও। ওদের ধরতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
মাহিন সাহেব ও মারেভা ম্যাডামকে টেলিফোন করে সাবধান করে দেয়া যায় না স্যার? ওরা কোথায় এখন তা জানাও যাবে। তেপাও বলল।
ধন্যবাদ তেপাও। বিষয়টা আমার খেয়ালই হয়নি।
বলেই আহমদ মুসা কল করল মাহিনকে।
মাহিন ওপ্রান্ত থেকে বলল, বলুন স্যার, কোন খবর, কোন নির্দেশ?
তোমরা কি তোমাদের পেছন দিকে লক্ষ রেখেছ?
আমি মনে করছি, একটা গাড়ি তোমাদের ফলো করছে। আহমদ মুসা বলল।
এখন থেকে লক্ষ্য রাখছি স্যার। ওরাই কি ফলো করছে? বলল মাহিন।
হ্যাঁ ওরাই। শোন মাহিন, ওরা সংখ্যায় কম পক্ষে চারজন। তার উপর ওদের হাতে অস্ত্র আছে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ওরা এখন পাগল। সুতরাং কোনভাবেই ওদের হাতে পড়া তোমাদের চলবে না। তোমরা….।
আহমদ মুসার কথার মধ্যেই মাহিন বলে উঠল, স্যার, ছোট মাইক্রো ধরনের একটা গাড়ি আমাদের ফলো করছে বলে মনে হচ্ছে। এখনও দেড়শ ২শ’ গজ পেছনে আছে।
মাহিন, তোমরা তো এখনও হাইওয়ে পাওনি! এ রাস্তায় কোন বড় সুপার মার্কেট আছে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
জি স্যার, আমরা এখনও দক্ষিণমুখী রাস্তায়। তবে আমাদের সামনেই হাইওয়ে। দু’এক মিনিটের মধ্যেই হাইওয়ের ক্রসিং-এ আমরা পৌঁছে যাব। সেখানে বড় সুপার মার্কেট আছে স্যার। মাহিন বলল।
সুপার মার্কেটটি মোড়ের বামে মানে তোমাদের গাড়ির লাইনে পড়ে কিনা? বলল আহমদ মুসা।
জি স্যার, হাতের বামে। মাহিন বলল।
শোন, তোমরা মোড়ে গিয়ে সুপার মার্কেটের কারপার্কে গাড়ি পার্ক করেই দ্রুত সুপার মার্কেটে ঢুকে যাও। তারপর…।
আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে মাহিন বলে উঠল, ওরাও তো সুপার মার্কেটে ঢুকে যাবে এবং আমাদের ধরে আনতে পারবে।
হ্যাঁ, পারবে। কিন্তু ততক্ষণে সুপার মার্কেটের কারপার্কিং-এ আমরাও পৌঁছে যাব। আমরা এই সময়টুকুই চাই। তোমরা সুপার মার্কেটে ঢুকলে সেই সময় আমরা পেয়ে যাব। আহমদ মুসা বলল।
মারেভাকে নিয়েই চিন্তা স্যার। বলল মাহিন।
ভয় নেই মাহিন। মার্কেটে ঢুকে ওরা তোমাদের ধরে আনবে, এর জন্যে মানসিকভাবে তোমরা প্রস্তুত থাক। কিন্তু ওরা মার্কেটে না ঢুকে কার পার্কিং-এ তোমাদের জন্যে অপেক্ষাও করতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
আচ্ছা স্যার, এখন আর ভয় করছে না। আপনার জন্য অপেক্ষা করব আমরা। বলল মাহিন।
আমরা আসছি। তুমি ড্রাইভারকে গাড়ি জোরে চালাতে বল। ওরা কারপার্কে পৌঁছার আগে অন্তত তোমরা সুপার মার্কেটের গেটে পৌঁছেছ, এটা নিশ্চিত হওয়া চাই। আর একটা কথা, ওরা মার্কেটে ঢুকে যদি তোমাদের কিডন্যাপ করতে চায়, তাহলে কিডন্যাপের সময় হৈ চৈ, চিৎকার করে এ কথা জানান দেবে, ওরা তোমাদের কিডন্যাপ করছে। এটা আমাদের সাহায্যে আসবে। আহমদ মুসা বলল।
ইনশাআল্লাহ স্যার। দোয়া করুন। বলল মাহিন।
আমিন! ‘আল্লাহ হাফেজ!’ বলে আহমদ মুসা কল অফ করে দিল।
৫
আহমদ মুসাদের গাড়ি যখন সে সুপার মার্কেটের কারপার্কিং-এ প্রবেশ করছিল, তখন ওরা তিনজনে ধরে মাহিনকে চ্যাং দোলা করে গাড়িতে তুলছিল।
আহমদ মুসা মাহিনকে গাড়িতে তুলতে দেখল। বুঝল মারেভাকে আগেই গাড়িতে পুরা হয়েছে। মারেভার চিৎকারও শোনা যাচ্ছে।
মারেভা ও মাহিনের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার চারদিকের পরিবেশকে সত্যিই আতংকিত করে তুলেছে। আসলেই তারা অভিনয় করছে না, আতংকগ্রস্ত হয়ে বাঁচার জন্যে চিৎকার করছে। নিখুঁত অভিনয় ও বাস্তব আচরণের মধ্যে আসলেই বোধ হয় কোন পার্থক্য নেই।
তাদের চিৎকারে সুপার মার্কেটের সামনে অনেক লোক জমেছে। মার্কেটের ভেতর থেকেও লোক বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কেউ কিছু করছে না। তাদের দিকে ষ্টেনগান তাক করে আছে কিডন্যাপারদের সহচর একজন। তারা আগে ফাঁকা গুলিও ছুঁড়েছে। তাতেই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সকলে।
গাড়ি থামতেই আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। তার ডান হাতে রিভলবার।
বের হয়েই আহমদ মুসা বিরভলবার তুলল ষ্টেনগানধারীর উদ্দেশ্যে। বলল, ষ্টেনগান ফেলে দাও। আমি এক আদেশ দু’বার দেই না।
ষ্টেনগানধারী চরকির মত বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। তার ষ্টেনগানের নলও ঘুরে এল আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। তারও আঙ্গুল ষ্টেনগানের ট্রিগারে।
আহমদ মুসা আত্মরক্ষার জন্যে মুহূর্তও সময় নষ্ট করেনি। ঠিক সময়েই তার তর্জনি চেপে বসেছে ট্রিগারে। ষ্টেনগানধারীর ষ্টেনগানের নলের গা ঘেঁষে বুলেটটি লোকটির বাঁ বুকে গিয়ে বিদ্ধ হলো।
যারা মাহিনকে গাড়িতে ঢুকাচ্ছিল, তারাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার তাদের গুলিবিদ্ধ সাথীর দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত পকেট থেকে রিভলবার বের করেছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তারা আহমদ মুসার টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
আহমদ মুসা ষ্টেনগানধারীকে গুলি করেই ওদের তিনজনকে টার্গেট করেছে। ওদেরকে রিভলবার বের করতে দেখে আহমদ মুসা বলল, তোমরা রিভলবার ফেলে দাও, তা না হলে তোমাদেরকেও এই সাথীর মত…।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। ওদের রিভলবার তাকে টার্গেট করে উঠে আসছে দেখে আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগার টিপে দিল পর পর তিনবার। কিন্তু সর্ববামের লোকটির ক্ষেত্রে টার্গেট মিস হলো। তার বাম কাঁধে গুলি লাগল। সে গুলি চালাবারও সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু আহমদ মুসার গুলি গিয়ে আঘাত করল আহমদ মুসার বাম বাহুসন্ধির উপরের অংশে। অদ্ভুত ষ্ট্যামিনা লোকটির! নিজের গুলিবিদ্ধ কাঁধের দিকে কোন খেয়াল নেই তার। প্রথম গুলিটা টার্গেটে লাগেনি দেখে রিভলবারসমেত তার ডান হাত উঠে আসছিল আহমদ মুসার লক্ষে।
কিন্তু আহমদ মুসা তা হতে দিল না। তার রিভলবার এই তৃতীয় টার্গেটের দিকে তাক করাই ছিল। শুধু ট্রিগার টেপার বাকি। ট্রিগার টিপে দিল সে। আহমদ মুসার লক্ষ এবার ছিল লোকটির ডান হাত।
ওদের একজনকে জীবন্ত ধরার প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। কিন্তু সে সুযোগ এ পর্যন্ত হয়নি। এবারের সুযোগটিকে সে কাজে লাগাল।
আহমদ মুসার গুলি গিয়ে লোকটির একবারে কবজিতে বিদ্ধ হলো। তার হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল।
লোকটি সাংঘাতিক বেপরোয়া!
রিভলবারটি গুলিবিদ্ধ ডান হাত থেকে খসে পড়ার সাথে সাথে সে বসে পড়ল এবং বাম হাত দিয়ে রিভলবারটি তুলে নিল।
তার গুলিবিদ্ধ ডান কাঁধের অসম্ভব যন্ত্রণা সে উপেক্ষা করে রিভলবার বাম হাতে তুলে নিয়ে আহমদ মুসাকে টার্গেট করার চেষ্টা করল।
তার রিভলবার উঠে আসছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা নিরুপায়। গুলি করে লোকটির বাম হাতটা নিস্ক্রিয় করে দেয়াই আহমদ মুসার বাঁচার উপায়।
আহমদ মুসার রিভলবার লোকটির দিকে তাক করাই ছিল। ট্রিগার টিপল শুধু।
গুলিটি গিয়ে বিদ্ধ করল লোকটির ডান বাহুকে। রিভলবারসমেত তার বাম হাত আছড়ে পড়ল মাটিতে।
লোকটি সম্ভবত তার হতাশা ও ব্যর্থতায় মাটিতে শুয়ে পড়ল।
মাহিন ও মারেভা আগেই গাড়ির ওপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। আতংকগ্রস্ত তাদের চোখ-মুখ। আহমদ মুসার বাম বাহুসন্ধিতে গুলি লাগতে দেখে দু’জনেই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল, যেন গুলিটা তাদের লেগেছে।
গুলি বন্ধ হতেই মাহিন ও মারেভা দু’জন ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে।
ওদিকে সুপার মার্কেটের সামনের লোকরা গুলি শুরু হলে কেউ সুপার মার্কেটের ভেতরে সরে গিয়েছিল, কেউ সুপার মার্কেটের সিঁড়িতে শুয়ে বা বসে ছিল। গুলি বন্ধ হলে তারা সবাই বেরিয়ে এল। সবাই হাততালি দিয়ে কিডন্যাপিং থেকে মাহিন ও মারেভার উদ্ধার পাওয়াকে স্বাগত জানাল।
তেপাও এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছে।
তেপাও, মাহিন, তোমরা এস, লোকটিকে আমাদের গাড়িতে তোল। কুইক।
তেপাও মাহিনকে এ নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসা মারেভাকে বলল, তুমি তোমাদের ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে এস। ট্যাক্সিওয়ালাকে না পেলে টাকা তার ট্যাক্সির উপরে রেখে এস।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা হাততালি দেয়া উৎসুক, অপেক্ষমাণ লোকদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, প্লিজ, আপনারা শুনুন, আহত লোকটির অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তাকে অবিলম্বে হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। কিডন্যাপিং-এর শিকার তরুণ-তরুণীকেও এখানে রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। হতে পারে তাদের বিপদ এখনও কাটেনি। তাই তাদেরকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছি। পুলিশ এসে যাবে। আপনারা যা দেখেছেন, দয়া করে তা পুলিশকে জানাবেন। ধন্যবাদ সকলকে।
উপস্থিত লোকেরা হাততালি দিয়ে আহমদ মুসার কথার জবাব দিল।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল।
তেপাও সামনের বাঁক ঘুরে গাড়ি একটু দাঁড় করাবে। আহমদ মুসা বলল।
গাড়িটা বাঁকে এসে বাঁক ঘুরে একটা সেফ ল্যান্ডিং দেখে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা বন্ধ করে গাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। কল করল তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান ফরাসি পুলিশ সার্ভিসের প্রধান সেই অফিসারকে। মাহিন ও মারেভার কিডন্যাপিং নিয়ে যা যা ঘটল সংক্ষেপে আহমদ মুসা সব জানাল তাকে এবং বলল, আমি আহত লোকটিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা আমার খুব জরুরি। এই প্রথম ওদের একজনকে জীবিত ধরা গেছে। তার কাছ থেকে কিছু কথা নেয়া আমার দরকার। কিন্তু আইন অনুসারে তাকে থানায় দেয়া দরকার অথবা হাসপাতালে নিয়ে পুলিশকে জানানো উচিত। আপনার পরামর্শ চাই স্যার।
মি. আহমদ মুসা, ঘটনাস্থলে কোন পুলিশ ছিল? বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান।
জি না। আহমদ মুসা বলল।
যে গাড়ি ব্যবহার করছেন, তা কোন পুলিশ নিশ্চয় দেখেনি। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান।
দেখেনি। আহমদ মুসা বলল।
ঘটনাস্থলের লোকজন গাড়ির নাম্বার নিশ্চয় দেখেনি বা নেয়নি? জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধানের।
সেটা বলা মুশকিল স্যার। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে জানলেও ক্ষতি নেই। একটা কাজ করুন। আপনা গাড়ি এখন কোথায়? জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধানের।
অ্যাভেনিউ পোমা’তে উঠে পূর্ব দিকে যাচ্ছি। আমরা পাতোতোয়ার হোটেল প্যাসেফিক ইন্টারন্যাশনাল থেকে এসে পোমা সুপার মার্কেটটির পাশ দিয়ে অ্যাভনিউ পোমা’তে উঠেছি। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে। ভালোই হলো। আপনাদের সামনেই মায়েভা থানা। আপনার সাথে আর কয়জন আছে? জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধানের।
আমাদের ড্রাইভার তেপাও, মাহিন ও মারেভা। আহমদ মুসা বলল।
আপনি গাড়িটা ছেড়ে দিন। ওরা আহত লোকটিসহ গাড়ি নিয়ে এগোক ধীরে ধিরে। আর আপনি অন্য একটি গাড়ি নিয়ে সোজা মায়েভা থানায় চলে যান। সেখানে সব ঘটনা খুলে বলুন এবং শেষে বলুন, আপনি গুলিবিদ্ধ আহত লোকটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছু দূর এগোবার পর একটি মাইক্রো আপনার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আপনাকে আহত করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িশুদ্ধ আহত লোকটিকে নিয়ে গেছে। আপনি থানায় গিয়ে এই ডাইরিটি করুন। থানা সন্দেহজনকভাবে আপনাকে কিছু করতে আসবে না। আমিও মিনিট পনের পরে থানায় টেলিফোন করব। থানা থেকে বেরিয়ে তারপর আহত লোকটিকে নিয়ে কোন নিরাপদ স্থানে চলে যান। আপনার প্রয়োজন পূরণে যা ইচ্ছা তাই করুন।
বলে থামল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান। মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে আবার বলল, সেরকম নিরাপদ জায়গা আছে আপনাদের?
সে রকম নেই। তবে ব্যবস্থা একটা করে ফেলব। আহমদ মুসা বলল।
না, তার দরকার নেই। আপনাকে অত কষ্ট করতে হবে না। আপনি আহত লোকটিকে নিয়ে সোজা আমার এখানে চলে আসুন। এখানে আন্ডারগ্রাউন্ডে আমাদের একটা সেল আছে। আপাতত সেটা আপনারা ব্যবহার করবেন। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান।
ধন্যবাদ স্যার। আমরা আসছি। আহমদ মুসা বলল।
ওয়েলকাম। আসুন, কথা আপাতত শেষ। গুড বাই আহমদ মুসা। বলে ওপার থেকে কল অফ করে দিলেন।
কল অফ করে আহমদ মুসা ডাকল মাহিনকে।
মাহিন তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসার কাছে যেতেই সে মাহিনকে নিয়ে গাড়ি থেকে একটু দূরে সরে গেল। তাকে সব কথা বুঝিয়ে বলল। সব কথা শুনে মাহিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, এই সময়ের জন্যে এর চেয়ে ভাল সলিউশন আর হয় না স্যার।
হ্যাঁ মাহিন, তুমি ঠিক বলেছ। ঠিক আছে মাহিন। যেভাবে বলেছি, সেভাবে কাজ করবে।
বলে আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, মারেভা, আমি একটু অন্য জায়গায় যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরব। তোমরা চলতে থাক।
মাহিন উঠে বসেছে গাড়িতে।
গাড়ি তাদের চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসে বলল, সামনে মায়েভা থানায় চল।
জি স্যার, বলে ট্যাক্সি ড্রাইভার তার গাড়িতে ষ্টার্ট দিল।
আহত লোকটির তিনটি ক্ষত স্থানেই ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল আহমদ মুসা খুব যত্নের সাথে। গুলিবিদ্ধ তিন জায়গার কোনটাতেই বুলেট নেই। ঘাড়ের আঘাতটাই বেশি গভীর। কিন্তু সেখানেও বুলেট নেই। ঘাড়ের কিছু গোশত ছিঁড়ে নিয়ে বুলেট বেরিয়ে গেছে।
খুব ভাগ্যবান দেখছি আপনি। ওরা মরেছে, আপনি মরেননি। আর গুলির তিনটি আঘাত বড় হলেও তা মারাত্মক নয়। বুলেট নেই বলে অপারেশনের দরকার হলো না। বলল আহমদ মুসা নরম কণ্ঠে লোকটির দিকে চেয়ে।
লোকটির মধ্যে আগের সেই বেপরোয়া ভাব এখন নেই। আহমদ মুসা ব্যান্ডেজ বাঁধার শুরুতেই লোকটিকে সমবেদনা দেখিয়ে বলেছিল, আমি তোমাদেরকে মারতে বা আহত করতে চাইনি। চেয়েছিলাম তরুণ-তরুণী দু’জনকে উদ্ধার করতে। আমি তোমাদের বলেছিলাম। অস্ত্র ফেলে দিতে, তাহলে আর এই অঘটন ঘটতো না।
লোকটি কোন জবাব দিল না। কিন্তু আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে। এ ধরনের ব্যবহারে সে অবাক হয়েছে! সে বুঝেছে, যে দু’জনকে তারা কিডন্যাপ করেছিল তারা আহমদ মুসার আত্মীয় বা বন্ধু হবে নিশ্চয়ই। এখনও তারা তো উদ্ধারকারী আহমদ মুসার সাথেই আছে। সে দিক থেকে আহমদ মুসা তার প্রতি যতটা মারমুখো হওয়া দরকার ছিল, ততটা নয়, বরং ব্যাপারটা সমব্যথীর মতো। এটাই ছিল লোকটির বিষ্ময়ের কারণ।
আহমদ মুসার কথার উত্তরে এবার লোকটি বলল, আমার এই সৌভাগ্যই আমার জন্যে দুর্ভাগ্যের কারণ হলো।
কেন? বলল আহমদ মুসা।
অনেকের কাছে ব্যর্থতা ক্ষমাহীন অপরাধ। এই সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা নিয়ে বেঁচে যাওয়া দুর্ভাগ্যের। লোকটি বলল।
দুর্ভাগ্যটা কি রকম? বলল আহমদ মুসা।
দুর্ভাগ্যটা মৃত্যু পর্যন্ত গড়াতে পারে। বলল লোকটি।
কথা শেষ করেই লোকটি বলল আবার, কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন?
দুনিয়াতে কত ধরনের লোক আছে, হত ধরনের দল, গ্রুপ আছে, তা জানার একটা কৌতুহল এটা। আচ্ছা, আপনার নাম কি?
লোকটি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, নামের কি প্রয়োজন?
প্রয়োজনের প্রশ্ন নয়। মানব সমাজের একটা সাধারণ রীতি হলো কারো সাথে দেখা, লেনদেন বা পরিচয় হলে তার নাম জিজ্ঞাসা করা হয়।
লোকটি আহমদ মুসার দিকে আবার চোখ তুলে তাকাল। আহমদ মুসার মধ্যে শত্রু ধরনের কোন ছবি খুঁজে সে পেল না। আহমদ মুসাকে সহজ, সরল, স্বচ্ছ লোক বলে মনে হলো তার কাছে। আর তার যুক্তি ঠিক। এক্ষেত্রে নাম না বলাটাই বরং বেমানান। লোকটি বলল, আমার নাম মফ ফ্লেরি।
আপনাকে দেখে তো সহজ সরল বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার এই ভাই-বোনকে আপনারা কিডন্যাপ করতে চেয়েছিলেন কেন? আহমদ মুসা খুব নরম কণ্ঠে বলল।
লোকটি কোন উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ওরা দুইজন কি সত্যিই আপনার ভাই-বোন?
শুধু ভাই-বোন নয়, ভাই-বোনের চেয়েও বড়। আহমদ মুসা বলল।
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তাকাল আবার আহমদ মুসার দিকে। ভাবছে সে আহমদ মুসাকে নিয়েই। এই লোক ইচ্ছা করলে আমাকে মেরে ফেলতে পারতো, পুলিশের হাতেও তুলে দিতে পারতো। এসব কিছূ না করে সে আমার ক্ষত স্থান পরিষ্কার করেছে, সেলাই দিয়েছে এবং তাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। নিজের আহত স্বজনের মতই সে আচরণ করছে আমার সাথে।
এসব চিন্তা করেই বলল, তাদের ধরার মধ্যে আমাদের ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ ছিল না। আমরা নির্দেশ পালন করেছি মাত্র।
নির্দেশ কার ছিল? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
আমরা নির্দেশ পেয়েছিলাম, ‘ম্যাডাম গৌরী’ নামে এক কর্মকর্তার কাছ থেকে। লোকটি বলল।
কিসের কর্মকর্তা তিনি? বলল আহমদ মুসা।
লোকটি অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সে সংগঠনের নাম নেয়া তাদের জন্যে নিষেধ। মাফ করুন স্যার আমাকে।
আহমদ মুসা মনে মনে ভাবল, কিসের কর্মকর্তা তা আমরা জানি। তারপর বলল, ঠিক আছে তোমাকে বিপদে ফেলবো না। সংগঠনের নাম শুনতে চাই না। তোমাদের দিয়ে কোথায় কাজ করায়, কি কাজ করায় তারা?
লোকটি বলল, তাহিতি, মুরিয়া, তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি স্থানসহ পলিনেশীয়ার সব জায়গায় কাজ করি। কি কাজ করি আমরা তা বলতে পারবো না স্যার। সেটা বললে আমাদের প্রাণ যাবে।
কি কাজ করো সেটা আমরা জানি। সেটা তুমি না বললেও চলে। ঠিক আছে, যদি ক্ষতি হয় বলবে না। কিন্তু একটা বিষয়ে সাহায্য করতে পার। পলিনেশীয়ার দ্বীপপুঞ্জ ও দ্বীপ সম্পর্কে তোমার অনেক অভিজ্ঞতা। আচ্ছা বল তো ‘মতু’ নামে কোন দ্বীপ আছে? বলল আহমদ মুসা।
কেন, প্রায় সকলেরই জানা, তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের ‘মতুতুংগা’ অ্যাটলকেই সংক্ষেপে ‘মতু বলা হয়।
ধন্যবাদ মি. মফ ফ্লেরি। ‘মতু’ দ্বীপ বা অ্যাটল নিয়ে খুব আগ্রহ আমার।
আহমদ মুসার কথা শুনে লোকটির ভ্রু কুঁচকে গেল মুহূর্তের জন্য। চোখে-মুখে তার নেমে এল উদ্বেগ ও বিষ্ময়। বলল, ‘মতু অ্যাটল নিয়ে আপনার এ আগ্রহ কেন?
সে অনেক কথা। পলিনেশীয় অঞ্চলের একটা রূপকথা শোনার পর থেকেই এই আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
রূপকথা? কি রূপকথা? লোকটি বলল।
রাজকুমার হেসানা হোসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর রূপকথা। ঐ রূপকথায় আছে গডেজ ‘হিনা’ দুই প্রেমিকের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাদের মিলন ঘটিয়েছিলেন মতুতুংগা অ্যাটল দ্বীপে। ঐ অ্যাটল দ্বীপের অভ্যন্তরে একটি প্রাসাদ আছে। সেই প্রাসাদে মিলন হয়েছিল রাজপুত্র ও সাগরকন্যার। যত দিন তারা বেঁচে ছিল ঐ প্রাসাদেই তারা বাস করেছে। আমি মনে করি এই রূপকথা যেমন সত্য ঘটনা, তেমনি প্রাসাদও একটা বাস্তব সত্য। এই কারণেই ‘মতু’ বা ‘মতুতুংগা’ অ্যাটল দ্বীপ আমার স্বপ্নের জায়গা। থামল আহমদ মুসা।
লোকটি মানে মফ ফ্লেরির মুখ থেকে উদ্বেগ ও বিষ্ময়ভাব কেটে গেল। স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল তার মনে। সে বুঝে নিল, তাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে’র খোঁজ এরা জানে না।
আহমদ মুসার কথার উত্তরে কিছু বলল না মফ ফ্লেরি।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল, মি. মফ ফ্লেরি, আমার আগ্রহের কথা নিশ্চয় বুঝেছ। এখন বল, আমার আগ্রহটা ঠিক কিনা।
আগ্রহ ঠিক আছে। কিন্তু প্রাসাদের বিষয়টা রূপকথার মতই কল্পনা। মফ ফ্লেরি বলল।
ব্যাপক অনুসন্ধান ছাড়া কোন দাবী বা বিশ্বাসকে অস্বীকার করা যায় না। মতুতুংগা দ্বীপে তোমার কি এই অনুসন্ধান আছে? বলল আহমদ মুসা।
মফ ফ্লেরি তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসার কণ্ঠে একটা ভিন্ন সুর আঁচ করল সে। তার মনের কোণে একটা ছোট্ট আশংকাও জেগে উঠল। বলল, মতুতুংগাসহ সব দ্বীপ ও অ্যাটলে আমার বিচরণ আছে তাই বলছিলাম, প্রাসাদের বিষয়টা অবাস্তব।
তোমার কথা মানলাম। কিন্তু তোমার এই ‘অবাস্তব তত্ত্ব’ কি করে প্রমাণ করা যায় বল তো? তোমার এই ‘অবাস্তব তত্ত্বে’র প্রমাণ হয়ে গেলে তো আর এ ব্যাপারে কারো মাথা ঘামাতে হতো না। বলল আহমদ মুসা।
একটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠল মফ ফ্লেরির চোখে-মুখে। বলল, আমি কি করে বলতে পারি? কথাগুলো ভাসা ভাসা মনে হলো। যেন কথাগুলো মনের গভীর থেকে উঠে আসেনি, কথাগুলোন শেকড় যেন তার মনে নেই!
আহমদ মুসার কানকে এসব ফাঁকি দিতে পারলো না। বলল, তুমি মতুতুংগা অ্যাটলটাকে ভালভাবে দেখেছ বলেই সেখানে প্রাসাদের অস্তিত্বের বিষয়কে ‘অবাস্তব’ বলতে পেরেছ। সেজন্যেই অবাস্তব প্রমাণ করার উপায়গুলোও তুমিই বলতে পারবে। বল, সেগুলো কি হতে পারে।
সংগে সংগে জবাব দিল না মফ ফ্লেরি। মুহূর্ত কয়েক চুপ থাকার পর বলল, অ্যাটলগুলো হলো ফাঁপা বা সলিড পর্বতপ্রমাণ উঁচু বেজের উপর সংকীর্ণ বা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত পাড় ঘেরা পুকুর বা হ্রদের মত। অ্যাটলগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাছাকাছি হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে একই বেজের উপর অনেক অ্যাটল হতে পারে, যেমন গাছের একই কাণ্ডের উপর অনেক শাখা হয়। এই ধরনের ক্ষেত্রগুলোতে দুই অ্যাটলের মাঝখানের পানি অগভীর হয়ে থাকে। অ্যাটলের এই সব বৈশিষ্ট সামনে রাখলে কোন অ্যাটলের ফাঁপা বেজের মধ্যে প্রাসাদ ধরনের কিছু আছে কিনা পরীক্ষার জন্যে দু’টি উপায় আছে। সহজ উপায়টি হলো, অ্যাটলের পাড় প্রশস্ত হলে সেখান থেকে অথবা পাশের কোন অ্যাটলের প্রশস্ত পাড় থেকে সুড়ঙ্গ কেটে অ্যাটলের ফাঁপা অংশে প্রবেশ করে ভেতরটা দেখা। আরেকটা উপায় আছে। কঠিন এবং তা হলো, পানির নিচে অ্যাটলের বেজের গায়ে কোন যথোপযুক্ত টেনলজির মাধ্যমে সুড়ঙ্গ করে ভেতরে প্রবেশ করা।
আহমদ মুসার ঠোঁটে সূক্ষ্ম একটা হাসির আভা ফুটে উঠল। বলল, ধন্যবাদ মফ ফ্লেরি, তুমি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছ। যেন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা! তাই নয় কি মফ ফ্লেরি?
আবার সেই বিব্রতকর অবস্থা ফুটে উঠল মফ ফ্লেরির মুখে। ব্যাপারটা অনেকখানি চোর ধরা পড়ার মত।
সংগে সংগে উত্তরদ দিতে পারল না মফ ফ্লেরি।
মফ ফ্লেরির এই অবস্থাকে আহমদ মুসা ইতিবাচক মনে করল। এ ধরনের সুড়ঙ্গ তার দেখার মধ্যে না থাকলে তার আচরণ এমন হতো না, মনস্তত্ত্বের দিক থেকে এটাই স্বতসিদ্ধ।
অবশেষে মফ ফ্লেরি বলল, আমি যা বলেছি, তার বেশি কিছু আমি জানি না।
আহমদ মুসা কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল না। আহমদ মুসা নিশ্চিতই বুঝল সে সত্য কথা বলেনি। তবু এ ব্যাপারে চাপ না দিয়ে বলল, তুমি যাদের সাথে বা যে সংগঠনের সাথে আছ, সেটা কত বছর?
তিন বছর। বলল মফ ফ্লেরি।
তোমাকে খুব বুদ্ধিমান ও সচেতন বলে মনে হচ্ছে। তুমি পেশায় আসলে কি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। বলল মফ ফ্লেরি।
সে তো মূল্যবান পেশা! কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে তুমি কিডন্যাপিং পেশায় নেমেছ। আহমদ মুসা বলল।
মফ ফ্লেরি মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে একটা অস্বস্তির ছাপ। বলল, প্রয়োজনে নির্দেশ মত আমাদের সব কাজই করতে হয়। তবে মূলত সংগঠনের মেরিন সাইডটায় আমি কাজ করি।
তাহলে দলের অনেক সারফেস শীপ ও বোট আছে? বলল আহমদ মুসা।
কিছু তো আছেই। মফ ফ্লেরি বলল।
দলের আন্ডারওয়াটার ভেহিকল অর্থাৎ সাবমেরিন জাতীয় ভেহিকেল নেই? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
চমকে উঠল মফ ফ্লেরি। দুই চোখ ছানাবড়া করে তাকাল আহমদ মুসার দিকে!
কথা বলার খেই যেন হারিয়ে ফেলেছে মফ ফ্লেরি! কোন কথা বলল না সে।
আবার মিথ্যা বল। বল যে, সাবমেরিন জাতীয় কোন ভেহিকেল দলের নেই! আহমদ মুসাই আবার বলল। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি।
মফ ফ্লেরি নির্বাক হয়ে গেছে। কোন কথাই সে বলতে পারল না। তার চোখের দৃষ্টির মধ্যে একটা অসহায়ত্ব আছে। তার মনে একটা কথা তোলপাড় করে উঠছে, কে এই লোক! আমাদের সব বিষয় সে জানে কি করে!
আবারও কথা বলল আহমদ মুসাই। বলল, একটা গোপন দলের সাথে তুমি শামিল হলোও তোমাকে সরল, সহজ মনে করেছিলাম। কিন্তু দেখছি তুমি খুব সহজভাবে মিথ্যা কথা বলতে পার। মতুতুংগার সৃড়ঙ্গ সম্পর্কে তুমি জান না, এই মিথ্যা কথা কেন বললে?
লোকটি অনেকখানি মুষড়ে পড়েছে। বলল, গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে আমাদের শপথ করতে হয়। আত্মরক্ষার জন্যেই আমি মিথ্যা বলেছি। শপথ কেউ ভাঙলে তার মৃত্যুদণ্ড হয়, এটা দলের অপরিবর্তনীয় বিধান। আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার বুক থেকে অনিশ্চয়তার একটা পাহাড় যেন নেমে গেল! মতুর প্রাসাদে ঢোকার সুড়ঙ্গ তাহলে সত্য এবং প্রাসাদও সত্য!
আপনি সব জেনেও আমাকে প্রশ্ন করছেন, এর অর্থ আমি বুঝলাম না। বলল মফ ফ্লেরি।
দেখছিলাম যে, তুমি কি বল। অরেকটা জিনিস, মতুতুংগা অ্যাটলের পশ্চিমে কোন অ্যাটল নেই। উত্তরের অ্যাটলটা বেশ দূরে। তাদের মধ্যে কমন সংযোগ নেই। বাকি থাকে পূর্ব ও দক্ষিণ। এই দুই দিকে মতুতুংগার কাছাকাছি চারটি অ্যাটল আছে অর্থাৎ তাহানিয়া, টেপোটো, হিতি ও তোয়ানেকে। এই চারের মধ্যে ‘হিতি’ অ্যাটলের সাথে মতুতুংগার কমন বেজ নেই। অনুরূপভাবে ‘টোপোটো’ ও ‘তোয়ানেকে’ অ্যাটলের সাথেও মতুতুংগার কমন বেজ নেই। এই তিন অ্যাটল ও মতুতুংগার মাঝখানে বরং খাদের উত্তর প্রান্ত ঘুরে মতুতুংগা পর্যন্ত উঁচু ও সংযুক্ত একটা বেজ রয়েছে। কিন্তু টোপোটো অ্যাটলটি এতই ক্ষুদ্র ও ডোবা যে, সেখান থেকে সংযোগ সুড়ঙ্গ মতুতুংগা পর্যন্ত হতে পারে না। বাকি থাকে বড় আকারের তাহানিয়া অ্যাটল। এর পশ্চিম তটরেখার দক্ষিণ প্রান্ত বেশ প্রশস্ত ও উঁচু যেখানে কনষ্ট্রাকশন সম্ভব। এ প্রান্ত থেকে মতুতুংগা পর্যন্ত কিছুটা সংকীর্ণ হলেও উঁচু একক একটি বেজ লাইন চলে গেছে। এখন তুমি বল, সুড়ঙ্গের যে তত্ব দিয়েছ তাতে মতুতুংগার প্রাসাদে ঢোকার সুড়ঙ্গ কোন অ্যাটল থেকে হতে পারে?
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল আহমদ মুসা।
মফ ফ্লেরি হাঁ করে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে দেখছিল আহমদ মুসাকে। সে ভেবে পাচ্ছে না অ্যাটলগুলো সম্পর্কে আহমদ মুসা এত বিস্তারিত তথ্য জানে কি করে! বহুদিন আমি ঘুরছি এ অঞ্চলে, কিন্তু এর সব কথা আমার জানা নেই। আসলে দেখছি সব জানে এই লোকটা। প্রাসাদের ভেতরের কথাও কি সে জানে? কেঁপে উঠল মফ ফ্লেরির বুকটা। আসলে ভেতরে কি আছে, কি ঘটে তার সব কিছু তারাও জানে না। শুধু অচেনা, অজানা লোকদের সেখানে ঢুকতে দেখে, তাদেরকে আর কখনো বের হতে দেখে না। এই লোকটি সে বিষয়েও কি জানে? কিন্তু কিভাবে?
মফ ফ্লেরির নিরব ও বিষ্ময়াবিষ্ট হয়ে হাঁ করে থাকতে দেখে আহমদ মুসা বলল, আমার কথায় অবাক হবার কিছু নেই। সবই তো তুমি জান! তোমার জানা বিষয়টা জানালে আমি উপকৃত হবো। প্লিজ বল।
আপনি সবই জানেন স্যার, এরপরও প্রশ্ন করছেন? আপনি তো অবস্থার পর্যালোচনা করে বলেই দিয়েছেন মতুতুংগা অ্যাটলের সুড়ঙ্গ কোন অ্যাটল থেকে আসতে পারে। আসলেই এর কোন বিকল্প নেই। বলল মফ ফ্লেরি।
হাফ ট্রুথ মানে অষ্পষ্ট সত্য কিন্তু সত্য নয়। তুমি পরিষ্কার করে বল। তুমি যার বিকল্প নেই বললে, সেটা প্রতক্ষদর্শীর কাছে সত্য এটা কিনা?
নিচু করে রাখা মুখ তুলল মফ ফ্লেরি। একটা ভীতি ও অসহায় ভাব তার চোখে-মুখে। বলল, হ্যাঁ তাই স্যার। আপনি সব জানার পরেও কেন এসব কথা বারবার বলছেন স্যার?
আমি তোমার পরীক্ষা নিচ্ছি বলতে পার। আচ্ছা, এতক্ষণ আমি বলেছি, এবার তুমিই বল, সুড়ঙ্গটির মুখ কোথায়?
সেটাও তো আপনিই বলে দিয়েছেন। তাহানিয়া দ্বীপের পশ্চিম তটরেখার দক্ষিণ প্রান্ত এলাকা কনষ্ট্রাকশনের জন্যে উপযুক্ত। উত্তর তো এখানেই আছে স্যার। বলল মফ ফ্লেরি।
খুশি হলো আহমদ মুসা। সে অবশ্যই মিথ্যা বলেনি। সুড়ঙ্গের মুখ তাহানিয়ার পশ্চিম তটরেখার দক্ষিণ প্রান্তেই রয়েছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়াল সে। বলল, মি. মফ ফ্লেরি, আমি আসছি।
বলে পাশের ঘরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
সে ঘরে দরজার পাশেই বসে ছিল মারেভা ও মাহিন।
তারাও ওঠে দাঁড়াল। বলল, ধন্যবাদ স্যার, কথা আদায় করার ক্ষেত্রেও দুনিয়ায় নিশ্চয় আপনার কোন জুড়ি নেই। কোন বকাবকি, হুমকি-ধমকি ও গায়ে হাত তোলা ছাড়াই আপনার যা প্রয়োজন সবই আদায় করে নিলেন অদ্ভুত কৌশলে। আবারও ধন্যবাদ স্যার। বলল মারেভা।
আমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর। ভালোবাসা, মমতার চেয়ে বড় অস্ত্র দুনিয়ায় আর নেই। সে আমাকে শত্রু মনে করেনি এবং আমার কথাবার্তায় সে বিশ্বাস করে নিয়েছে আমি তাদের সব কিছু জানি। আমার জানা বিষয় তাই প্রকাশ করতে সে দ্বিধা করেনি। থাক, এসব কথা। আমি যাচ্ছি স্বরাষ্ট্র সচিব সাহেবের কাছে। বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল। মারেভা ও মাহিনও ঘর থেকে বের হবার জন্যে হাঁটতে শুরু করল।
পিএস গিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিবকে বলল, স্যার, আহমদ মুসা নামে একজন ভদ্রলোক এসেছেন। আপনার সাথে দেখা করতে চান।
শুনেই স্বরাষ্ট্র সচিব উঠে দাঁড়াল। বলল, ভদ্রলোককে নিয়ে আসি।
পিএস বিষ্মিত হয়ে একবার স্বরাষ্ট্র সচিবের দিকে তাকাল। স্যার, নিজে যাবেন তাকে স্বাগত জানাতে? বলল, আপনি বসুন স্যার। আমি তাকে নিয়ে আসছি।
না, সে খুব মূল্যবান মানুষ। ফরাসিদের জামাই। তাছাড়াও তার আরও বড় পরিচয় আছে। বলে স্বরাষ্ট্র সচিব হাঁটতে শুরু করল।
পিএস-এর কক্ষে গিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধান স্বাগত জানালো আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসাকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান তার কক্ষে এসে বসল। আহমদ মুসাকে বসিয়ে নিজে গিয়ে তার আসনে বসল।
বসেই বলল, মি. আহমদ মুসা, আজকের জিজ্ঞাসাবাদের খবর কি, ভাল নিশ্চয়ই।
আল হামদুলিল্লাহ! ভাল স্যার। যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি। বলল আহমদ মুসা।
এত তাড়াতাড়ি মুখ খুলল! স্বরাষ্ট্র সচিব বলল। তার কণ্ঠে বিষ্ময়!
অনেক কথা বলতে হয়েছে স্যার।
আমি তার সমব্যথী ও বন্ধু-এ বিশ্বাস তার মধ্যে জেগেছিল। আমি কোন পক্ষ নই, কোন স্বার্থে আমি এসব জানতে চাচ্ছি না, এটাও সে ধরে নিয়েছিল। আমি নিছক তার ব্যাপারে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করছি, এটাও তাকে বুঝাতে পেরেছিলাম। আর তাদের সম্পর্কে এবং তাদের ঘাঁটি ও তাদের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আমি কথা বলে তার মধ্যে এ বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম যে, তাদের ব্যাপারে আমি সব জানি, নিছক তাকে আমি বাজিয়ে দেখছি মাত্র। এজন্যে কোন তথ্য দেয়াকে সে খারাপ মনে করেনি এবং মিথ্যাও বলেনি এই কারণে যে তার মিথ্যা আমার কাছে ধরা পড়ে যাবে। বলল আহমদ মুসা।
বিষ্ময়মিশ্রিত প্রশংসার একটা ঢেউ খেলে গেল তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধানের চোখে-মুখে। বলল, চমৎকার মি. আহমদ মুসা! চমৎকার আপনার কৌশল। আপনি ধমকি দিয়ে কিংবা গুলি ছুঁড়েও এত কথা উদ্ধার করতে পারতেন না। ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আহমদ মুসা, সব ক্ষেত্রেই এই কৌশল খাটিয়ে ফল পাওয়া যায়?
ভালবাসা, সহমর্মিতার শক্তি অত্যন্ত কঠিন ও কঠোর মানুষকেও দুর্বল করে, তাকে কাছে টানে, তার হৃদয় জয় করে নেয়া যায়। তার মনের কথাগুলোও তখন পাখা মেলে, ওপেন হয়ে যায়। কিন্তু শক্তির প্রয়োগ বা প্রদর্শণী মানুকে ভীত করে। ভয়ে অনেকেই মুখ খোলে। আবার অনেকেই শক্তিকে ভয় করে না, এদের বিরুদ্ধে শক্তি কোন কাজেও আসে না। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক মি. আহমদ মুসা, দুনিয়ার পাষণ্ডতম মানুষও কাঁদে ভালবাসার ছোঁয়ায়, অস্ত্রের আঘাতে নয়। যাক, এখন বলুন আপনি কত দূর পৌঁছলেন? স্বরাষ্ট্র সচিব বলল।
স্যার, পথের সন্ধান পেয়েছি। সে পথে চলে এখন লক্ষে পৌঁছতে হবে। পথ চলে লক্ষে পৌঁছার কঠিন কাজটাই এখন বাকি। বলল আহমদ মুসা।
ঈশ্বর আপনাকে সাহায্য করুন ইয়ংম্যান। লক্ষে আপনি পৌঁছবেনই, এতে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমাদের সাহায্য সব সময় আপনার সাথে থাকবে। বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের নিরাপত্তা ও মুক্তি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। যেন আমাদের ভুলে তাদের বড় কোন ক্ষতি না হয়, এ ব্যাপারে আমরা খুবই সতর্ক। এটা আপনার কেস। আমরা আপনার উপরেই নির্ভর করছি। স্বরাষ্ট্র সচিব বলল।
ধন্যবাদ আপনাদের এই দৃষ্টিভংগির জন্যে। উদ্বেগের বিষয় এটাই স্যার, ওরা সামান্য কিছু টের পেলেই বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। এজন্যে ওদের কার্যকরি শক্তি নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার আগে কিংবা ওদের ‘শক্তির কেন্দ্র’ দখলের আগে ওদের কিছুই জানতে দেয়া যাবে না। বলল আহমদ মুসা।
এ কারণেই এই কাজে বা অভিযানে দলবদ্ধভাবে যাওয়া যাবে না একেবারেই। এই বিপজ্জনক অভিযানে মাত্র দু’একজনকেই অংশ গ্রহণ করতে হবে ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। আমার মনে হচ্ছে বিষয়টা অত্যন্ত ষ্পর্শকাতর এবং অতি বিপজ্জনক বলেই ঈশ্বর আপনাকে পাঠিয়েছেন। আমি আপনার সম্পর্কে অনেক শুনেছি। কিন্তু কয়েক দিন ধরে আপনার কাজ দেখে মনে হচ্ছে আপনার সম্পর্কে যা শুনেছি তার চেয়ে অনেক বড় আপনি। ধন্যবাদ আহমদ মুসা। তাহাতির প্রধান স্বরাষ্ট্র সচিব বলল।
মফ ফ্লেরির বিষয়ে এখন কি করা যায়! সে যেহেতু আমাদের সাহায্য করেছে, এজন্যে সে বিচারের মুখোমুখি হোক, তা আমি চাচ্ছি না স্যার। আপনারা তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখুন আমাদের অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত। আর তার পরিবার-পরিজনকেও আপনাদেরই দেখতে হবে, তাদের ভরণ-পোষণও করতে হবে। আমিও তাকে বলব, এখন সে বাইরে গেলে তার দলই তাকে মেরে ফেলবে এবং তার কোন চিন্তা নেই পরিবার-পরিজন নিয়ে। তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বলল আহমদ মুসা।
আপনি যা বলেছেন। সেটাই হবে মি. আহমদ মুসা। তাকেও আশ্বস্ত করুন, তার পরিবার নিয়ে তার কোন চিন্তা করতে হবে না। স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান বলল।
ধন্যবাদ জনাব। আর আমাকে সাহায্যের বিষয়টা সময় মত আমি আপনাকে জানব। বলল আহমদ মুসা।
আপনার একটা কনট্যাক্ট নাম্বার দিলে প্রয়োজনে আমরা আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো। স্বরাষ্ট্র সচিব-পুলিশপ্রধান বলল।
সেটা বিপজ্জনক হতে পারে স্যার। ওরা যেমন ভেতর থেকে পাঠানো মেসেজ মনিটর করতে পারে, তেমনি বাইরে থেকে পাঠানো মেসেজ মনিটরের ব্যবস্থা তার অবশ্যই রেখেছে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক মি. আহমদ মুসা। আপনি ঠিক চিন্তুা করেছেন। ধন্যবাদ!
তাহলে উঠতে পারি স্যার। বলল আহমদ মুসা।
ডিনারের সময় হয়ে আসছে। আমরা কি এক সংগে ডিনার করতে পারি না? ভুলবেন না আপনি কিন্তু আমাদের জামাই, ফরাসিদের জামাই। স্বরাষ্ট্র সচিব-পুলিশপ্রধান বলল।
ধন্যবাদ স্যার। আপনাদের স্নেহের এই অফার আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারিনা। আমার সাথে কিন্তূ দু’জন ছেলেমেয়ে আছে। বলল আহমদ মুসা।
তামাহি মাহিন ও মারেভা মাইমিতি তো! ওদেরও দাওয়াত ডিনারে। আমরা খুব খুশি। ওরা আপনার ভাল সহকারী হয়ে উঠেছে। আমি চিন্তা করছি, ওদের আমি আমাদের গোয়েন্দা বিভাগে নিয়ে নেব। আপনি কি মনে করেন? স্বরাষ্ট্র সচিব-পুলিশ প্রধান বলল।
আমার মনের কথা বলেছেন। আমি আপনাকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করতে চাচ্ছিলাম। বলল আহমদ মুসা।
মি, আহমদ মুসা, খুশি হলাম আপনার অভিমত পেয়ে। স্বরাষ্ট্র সচিব বলল।
আমি ‘মফ ফ্লেরি’র আর একটু কথা বলব। আমি তা হলে এখন উঠছি স্যার। বলল আহমদ মুসা।
মফ ফ্লেরির সাথে কথা বলার এই সিদ্ধান্ত আহমদ মুসা আরও একটা কারণে নিল। তাহানিয়া অ্যাটল থেকে মতুতুংগার প্রসাদে যাওয়ার সুড়ঙ্গ ও প্রসাদের ব্যাপারে আহমদ মুসা আর একটু কথা বলতে চায়। এ বিষয় যে কোন তথ্য তার কাজে আসবে।
ঠিক আছে আসুন। আমর পিএস ঠিক ১২টায় আপনার ডিনারে আসবে। আমি আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করব। হ্যাঁ, আর একটা কথা বলতে ভূলে গেছি। আমি অ্যাটল ট্যুরিস্টদের ছদ্মবেশে কমান্ডো, পুলিশ, ও গোয়েন্দাদের নিয়োজিত করতে চাই যাতে যাতে কোন সন্দেহ সৃষ্টি না হয় এমনভাবে। স্বরাষ্ট সচিব-পুলিশ প্রধান বলল।
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর বলল, করতে পারেন। তবে তাদেরকে পোষাকে-আশাকে, কথাবার্তায় ও আচার-আচরণে একদম টুরিস্ট হতে হবে। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা। আমি তাদের কাছে মানে তাহিতির সব পুলিশ ও গোয়েন্দার কাছে আপনার ফটো ও মেসেজ দিয়ে রাখতে চাই, যাতে আপনার যে কোন আদেশ তারা শুনতে বাধ্য থাকে। আর অ্যাটল গুলোতে যারা থাকবে তাদের কামান্ডারের কন্ট্যাকট নাম্বার আপনাকে দেব। তাকে আপনি যে কোন আদেশ দিতে পারবেন। স্বরাষ্ট সচিব ও পুলিশ প্রধান বলল।
ধন্যবাদ স্যার। আমি খুব খুশি হলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। স্বরাষ্ট সচিব কাম পুলিশপ্রধানও উঠে দাঁড়াল। আহমদ মুসা তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এল।
৬
ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের সিচুয়েশন রুম।
সিচুয়েশন রুমের এক প্রান্তে সূর্যকার একটি বেদি। বেদির উপর সুন্দর রাজকীয় কার্পেট পাতা।
বেদির সামনে শ্বেত পাথরের মেঝেতে সারিবদ্ধ তিনটি চেয়ার। চেয়ারগুলোও সাদা ধবধবে রঙের।
তিনটি চেয়ারের মাঝের চেয়ারে গৌরী। তার ডানে জিজর, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের অপারেশন চীফ। আর গৌরির বাম পাশে বসেছে ডারথ ভাদের, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের গোয়েন্দাপ্রধান।
তার সবাই উন্মুখভাবে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। তাদের সবারই মুখ বিষণ্ণ।
তাদের অপেক্ষার ইতি হলো।
বেদির পেছনের দেয়াল ফুঁড়েই যেন বেরিয়ে এল রক্তলাল চেয়ারে বসা আলেক্সি গ্যারিন, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সর্বময় কর্তা। তার গায়ে লাল রাজকীয় পোষাক।
ধবধবে সাদা ঘরে লালের আগমন অনেকটাই সূর্যোদয়ের মত।
বেদির মাঝখানে এসে স্থির হলো চেয়ারটি।
বেদির নিচে মেঝেয় চেয়ারে বসা জিজর, গৌরী ও ডারথ ভাদের উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা বাও করে বলল, লং লিভ আওয়ার লর্ড! লং লিভ আওয়ার সিন্ডিকেট!
বসল তারা তিনজন।
আজ আলেক্সি গ্যারিনের মুখে মুখোশ নেই।
চল্লিশ বছেরের মত বয়সের একজন মানুষ সে। পশ্চিমের সে সাদা রঙের মানুষ। শক্ত চোয়াল, কঠিন মুখ, চোখের দৃষ্টিতে কঠোরতা। মুখে লাবণ্য-কমনীয়তা কিছু ছিল কিনা কোনদিন, তা বুঝা যায় না। কঠিন ও কঠোরতার মাঝে হারিয়ে গেছে যেন সুকমার বৃত্তির সব কিছু।
আলেক্সি গ্যারিনের দৃষ্টি সবার উপর দিয়ে ঘুরে এসে স্থির হলো জিজরের মুখের উপর।
জিজর মাথা নত করল।
এ সব কি হচ্ছে জিজর?
মাই লর্ড! বলে চুপ করে থাকল জিজর।
তিনটি কমিটি করে দিয়েছিলাম আহমদ মুসাকে এলিমিনেট করতে, কিন্তূ তোমাদের ৮ সদস্যের এলিট কামান্ডোরা নিজেরাই এলিমেনেট হয়ে গেল। কেন, কিভাবে? বলল আলেক্সি গ্যারিন। কঠোর যান্ত্রিক তার কন্ঠ।
গৌরীদের তিনজনের মুখও মলিন হয়ে গেল পরাজিত সৈনিকের মত।
জিজর উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করে বলল, মাই লর্ড, আমাদের অভিযান ঠিক ভাবে……।
জিজরের কথার মধ্যেই আলেক্সি গ্যারিন বলে উঠল, থাক জিজর। এই কথাগুলো একটু পরে শুনব। আগে শুনতে চাই, আমাদের কোন লোক এ পর্যন্ত শ্ত্রুর হাতে ধরা পড়েনি। ধরা পড়ার অঘটন কিভাবে ঘটল?
মাই লর্ড! আমার কথার মধ্যে এটাও বলব মাই লর্ড। বলল জিজর।
বল। বলল আলেক্সি গ্যারিন কঠোর কন্ঠে।
মাই লর্ড! সেদিন রাতে বড় ঘটনার পর আপনার নির্দেশে তিনজনে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আহমদ মুসাকে প্রস্তূতি ও পরিকল্পনার কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। প্রতিটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাকে একের পর এক আঘাত হানতে হবে। এই লক্ষেই সে রাতের পর আহমদ মুসাকে খুঁজে পাবার জন্যে সকালেই আমরা মারেভা ও মাহিনকে খুঁজে নিই এবং তাদের ফলো করে হাসপাতালে যাই। সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিল আহমদ মুসার ড্রাইভার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আহমদ মুসা হাসপাতালে আসেনি। একজনকে পাহারায় রেখে আমাদের কয়েকজন আহমদ মুসার আগের হোটেলে চলে আসে। জানা যায় সে হোটেলে আহমদ মুসা যায়নি। এটা জেনে আমাদের লোকেরা আবার সেই হাসপাতালে ফিরে আসে। তারা সে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে আহমদ মুসা এসে চলে গেছে। দুর্ভাগ্য, পাহারায় থাকা আমাদের লোক তাকে চিনতে পারেনি। আহমদ মুসা ছদ্মবেশে ছিল বলে মনে হয়। কিন্তূ মাহিন ও মারেভা তখনও হাসপাতালে ছিল। আমাদের লোকেরা তাদের আনুসরন করে নতুন এক হোটেলে গিয়ে আহমদ মুসাকে পায়। তার হোটেল কক্ষে থাকা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারা চারজন প্রথম সুযোগেই তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হোটেলে ও তার আশেপাশে পুলিশ ছিল না। তার লাশ আনার পথে কোন বাধাও ছিল না। পরিকল্পনা হয় প্রথমে দু’জন এক আঘাতেই দরজা ভেঙে ফেলবে। আর প্রস্তূত থাকা দু’জন এক সাথে গুলি করবে আহমদ মুসাকে। একজন এ্যাটেনডেন্টকে টাকা দিয়ে ঐ সময়ে গল্পরত আহমদ মুসা, মারেভা ও মাহিনের মিটিং ডায়াগ্রাম সংগ্রহ করা হয়েছিল।পরিকল্পনা নিখুঁত ছিল। এক আঘাতে দরজাও ভেঙে পড়েছিল। কিন্তূ বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমাদের প্রস্তূত থাকা লোকেরা অপ্রস্তূত আহমদ মুসার আগে গুলি ছুঁড়তে পারেনি। এই অবস্থায় সেখানে আমাদের চারজন নিহত হয় এবং আমাদের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর আহমদ মুসার হোটেলের দু’পাশে পুলিশের পাহারা বসে। এই অবস্থায় আমাদের অবশিষ্ট লোকেরা হোটেলের পেছন দরজা দিয়ে মাহিন ও মারেভাকে চলে যেতে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে, মারেভা ও মাহিনকে তারা পণবন্দী করবে আহমদ মুসাকে হাতের মধ্যে পাওয়ার জন্যে এবং তারা সিদ্ধান্ত অনুসারে মারেভাদের পিছু নেয়। হাইওয়ের যে স্থানকে ওদের কিডন্যাপ করার পরিকল্পনা করে, তার কিছু আগে মারেভা ও মাহিন গাড়ি থামিয়ে একটা সুপার মার্কেটে নেমে পড়ে। আমাদের লোকেরা সিদ্ধান্ত নেয় ওরা মার্কেট থেকে বেরুলেই তাদের ধরে গাড়িতে তুলবে এবং কিছু ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে তারা বেরিয়ে আসবে। কিন্তূ তাদের গাড়ি তোলার সময় কোত্থেকে একটা গাড়ি এসে হাজির হয়। আমাদের তিনজন লোককে হত্যা করে মারেভাদের উদ্ধার করে নিয়ে চলে যাবার সময় তার ছোঁড়া তিনটি গুলিতে সিরিয়াসভাবে আহত আমাদের একজন লোককে তারা ধরে নিয়ে যায়। যাবার সময় চিৎকার করে বলে যায়, আহতকে আমরা হাসপাতালে নিচ্ছি। এর কিছুক্ষন পর আমাদের লোকেরা থানায় যায়। থানা অদ্ভুত কাথা জানায়। বলে, আমাদের আহত ঐ ব্যক্তিকে যা থানায় নিয়ে আসছিল, সে থানায় এসে ডাইরি করে গেছে, আহত আমাদের লোককে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে কয়েকজন লোক। কয়েকটি গাড়ি নিয়ে তার গাড়ি তারা ঘিরে ফেলে আহতকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এরপর আমাদের আহত লোকটির আর কোন খোঁজ আমরা পাইনি। মারেভা ও মাহিন নিখোঁজ রয়েছে। তাদের বাড়িতে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের পরিবারের লোকেরাও উদ্বিগ্ন। থানায় তারা ডাইরিও করেছে।
থামল জিজর। মুহূর্তকাল থেমেই আবার বলল, মাই লর্ড, আমরা পর্যালোচনা করেছি, আমাদের পরিকল্পনায় তেমন কোন ভূল নেই। আহমদ মুসা অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় আমাদের প্রথম উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রেও অকল্পনীয়ভাবে তারা আক্রমণের শিকার হয়, যখন তারা ব্যস্ত ছিল মারেভা ও মাহিনকে গাড়িতে তোলার জন্যে। অতএব, মাই লর্ড, আমাদের পর্যালোচনায় আমাদের ব্যর্থতার কারণ, সামর্থ্য ও সুযোগের অভাব নয়। মাই লর্ড! আমরা মুখাপেক্ষী আপনার সিদ্ধান্ত ও আদেশের। থামল জিজর।
তোমাদের কাজ ও বক্তব্যের মধ্যে অনেক ফাঁক রয়েছে। সুপার মার্কেটে আমাদের লোকদের মেরে আমাদের বন্দীদের কেড়ে নিল, তারা একজন না কয়জন ছিল? সে বা তারা হঠাৎ সেখানে উদিত হলো কোত্থেকে? তাদের সুপার মার্কেটে ঢোকা পরিকল্পিত কি না? আহতকে কেউ কেড়ে নিয়েছে, থানায় এই খবর দেওয়া সাজানো কিনা? এই সব বিষয়ে তোমাদের অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা হয়নি।
বলে আলেক্সি গ্যারিন মুহূর্তের জন্যে থামল। আবার শুরু করল, আমি নিশ্চিত সুপার মার্কেটে আমাদের লোকদের হত্যা, মারেভাদের উদ্ধার ও আমাদের লোকদের ধরে নিয়ে যাওয়ার কাজ আহমদ মুসা করেছে। সে ছাড়া এভাবে এই কাজ করার লোক পলিনেশীয়ায় আর কেউ নেই। সে কোন ভাবে মারেভাদের বিপদ জেনে বা বুঝতে পেরে তাদের ফলো করে এবং মারেভাদেরকে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দেয়। নির্দেশ অনুসারেই মারেভারা সুপার মার্কেট প্রবেশ করে সময় ক্ষেপণের জন্যে, যাতে সেই সময়ের মধ্যে আহমদ মুসা পৌছতে পারে। এ না হলে যে মারেভারা ভয়ে হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে আসে, তারা সুপার মার্কেটে ঢুকবে মার্কেটিং করার জন্যে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আহতকে ছিনতাইয়ের কাহিনী সেই সাজিয়েছে, যাতে আহতকে হাসপাতালে পৌছাবার দায় থেকে বেঁচে যায়। নিশ্চয় আমাদের আহত লোকটি মরে গেছে অথবা আহমদ মুসা হত্যা করেছে। কারণ গুলিবিদ্ধ সিরিয়াস আহতকে বন্দী রাখা ও চিকিৎসা করার সুযোগ হোটেলে থাকা আহমদ মুসার কাছে নেই।
আলেক্সি গ্যারিন থামতেই জিজর বলল, মাই লর্ড! হতে পারে, গাড়ির মধ্যেই তাড়াহুড়া করে আমাদের আহত লোকটির কাছ থেকে কথা আদায়ের চেষ্টা করেছে এবং কথা আদায় করতে না পেরে আরও নির্যাতন করতে গিয়ে মেরেই ফেলেছে।
গৌরীর মুখে কথা এসেই গিয়েছিল যে, আহমদ মুসা এ ধরনের শত্রু নয়, সে আহত বন্দীকে নির্যাতন বা হত্যা করতে পারে ন। কিন্তূ নিজেকে সামলে নিল গৌরী। নিজেকে এভাবে প্রকাশ করতে চাইল না গৌরী। কিন্তূ আহমদ মুসার প্রতি এই অভিযোগ তার মনে একটা কষ্টের সৃষ্টি হলো।
হ্যাঁ জিজর, এটাই ঘটেছে। আহমদ মুসা বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে বড় টেররিস্ট। এই কাপুরুষটির এই ন্যাক্কারজনক কাজ তার পাপকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা তাকে ছাড়ব না।
মুহূর্ত কয়েকের জন্যে থেমে ডারথ ভাদেরের দিকে চেয়ে বলল, ভাদের এই ঘটনা ও আহমদ মুসা সম্পর্কে নতুন কি তথ্য তোমার কাছে আছে বল? ডারথ ভাদের উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করে বলল, ঘটনা সম্পর্কে নতুন কোন তথ্য নেই। সুপার মার্কেটের লোকদের সাথে কথা বলে আমাদের গোয়েন্দারা লোকটির চেহারা, পোশাক-আশাক, কথার ধরন ইত্যাদি যে তথ্য পেয়েছে, তাতে মাই লর্ডের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়, লোকটি আহমদ মুসাই ছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আহমদ মুসা তাহিতি থেকে হঠাৎ যেন কোথাও উধাও হয়েছে বা পালিয়ে গেছে। কোন হোটেলে বা অন্য প্লেসে কোন সময় তাকে আমাদের গোয়েন্দারা পায়নি।
আহমদ মুসা সম্পর্কে ভাল জানলে একথা বলতে না ডারথ ভাদের। সে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালায় না। সে অত্যন্ত বিপদজ্জনক। এ পর্যন্ত আমাদের কোন চেষ্টাই সফল হয়নি। সবচেয়ে বিস্ময়ের হলো, তাকে কখনও আইনের চোখে অপরাধী বানানো যায় না। সব জায়গায় সে ত্রাতার ভুমিকায় থাকে, আইন ও পুলিশের পক্ষেই তারা কাজ করে। আমি বুঝতে পারছি না, হঠাৎ সে তাহিতিতে এল কেন? কোন মিশনে সে এসেছে। কিন্তূ তার উদ্দেশ্য না জানলেও সে আমাদের জন্যে বিপদজ্জনক। আমাদের পশ্চিমি বন্ধুরা একটা উদ্ধেগজনক তথ্য দিয়েছে। সেটা হলো সৌদি বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাক্কী’র অনুসন্ধানের দায়িত্ব সৌদি সরকার আহমদ মুসাকে দিয়েছে। আরেকটা তথ্য তারা দিয়েছে, আমাদের যারা বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আব্দুল্লাকে কিডন্যাপ করেছিল, তাদের পিছু নিয়ে আহমদ মুসা ওমান পর্যন্ত এসেছিল। অন্য দিকে আমাদের লোকদের তথ্য হলো, ওমানের সাগর তীরের একটি হোটেলে তাদের উপস্থিতি একজনের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল। গ্যাস বোমা ফেলে তাকে সংজ্ঞাহীন করে তড়িঘড়ি করে তারা পালিয়ে এসেছে। এই দুই তথ্য মেলালে দেখা যাচ্ছে, ওমান হোটেলের সেই লোকটি ছিল আহমদ মুসা। সে আহমদ মুসাই এখন তাহিতিতে। সুতরাং সুস্পষ্ট না জানলেও এটা ধরেই নিতে হবে যে, সে বিজ্ঞিনীর সন্ধানেই তাহিতিতে এসেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সে তাহিতিতে আসবে কেন? সে জানবে কি করে এখানেই তাকে পাবে! কিন্তূ আহমদ মুসার অসাধ্য কিছু নেই। সুতরাং আমাদের প্রজেক্ট আজ ঝুঁকির মধ্যে। একে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে দিতে পারি না। সাফল্য যখন আমাদের হাতের মুঠোয়, গোটা দুনিয়াকে অচল করে দিয়ে, সবার উপর আমরা সচল থাকার যে যাদুরকাঠি আমরা হাতে পেতে যাচ্ছি, তখন কাউকেই আমাদের দিকে চোখ তুলে চাইতে দিতে পারি না। আমাদের প্রোজেক্টের স্বার্থে আহমদ মুসাকে অবশ্যই মারতে হবে। তাকে মারার জন্যে একের পর এক প্লান তোমরা বানাও। এক অপশন ব্যর্থ হলে অন্য অপশন সংগে সংগেই তোমরা যেতে পারবে। এ পর্যন্ত যদিও আমরা সফল হইনি, তবে আমাদের পদক্ষেপ সঠিক হয়েছে। এজন্য তোমাদের মোবারকবাদ দিচ্ছি। আহমদ মুসা অত্যন্ত চালাক, অত্যন্ত ক্ষিপ্র ও অতুলনীয় উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী। এই গুণগুলোই তাকে এ পর্যন্ত বাঁচিয়েছে, কিন্তূ সব সময় তাকে বাঁচাবে না। কেউ এভাবে বাঁচেও না। ভূল এক সময় করেই এবং খতম হয়ে যায় সেই একটি ভূলেই।আমাদেরকে তারই অপেক্ষায় একের পর এক ফাঁদ পেতে যেতে হবে শয়তানের বাচ্চাকে ধরার জন্যে। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
আলেক্সি গ্যারিনের কথার মধ্যে মাঝে মাঝেই গৌরীর মনটা খচ খচ করে উঠেছে কিছু বলার জন্যে। আহমদ মুসা শুধু অসম্ভব চালাক, ক্ষিপ্র ও উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারীই নয়, সে মানবিক ও নীতিনিষ্ঠও। তার জীবন দৃষ্টি, আচরণ কোনও অপরাধীর মত নয়। বন্দীদের প্রতি তার দায়িত্ববোধ ও মমতা গৌরীকে বিস্মিত করেছে। মন জয়ও কি করেনি! না হলে জ্যামিং মেশিনটা সে আহমদ মুসাকে দিয়ে এল কেন, যা আহমদ মুসাকে ঐ সংঘর্ষে জয়ী করেছে।
কথা শেষ করে আলেক্সি গ্যারিন তাকাল গৌরীর দিকে। তাকে অন্যমনস্কতায় ডুবে থকতে দেখে বলল, গৌরী, কি ভাবছ তুমি?
চমকে উঠে গৌরী নিজকে সামলে নিল। মাই লর্ড, এসব নিয়েই ভাবছি।
কি ভাবছ তুমি? বলল আলেক্সি গ্যারিন।
গৌরী মাথা নিচু করে একটু ভেবে বলল, মাই লর্ড! সে এখন আড়লে চলে গেছে আমাদের উপর্যুপরি আক্রমণে। তার সাথে মারেভা ও মাহিনও। আমি মনে করি, আমরা কিছুটা চুপ থেকে তাদেরকে আড়াল থেকে বের করে আনা দরকার। তারপর তাকে আঘাতহানার সুযোগ নিতে হবে তার অপ্রস্তূত অবস্থায়, অন্য দিকে আমাদের প্রজেক্টের রক্ষার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত আছে কিনা, সেদিকে নজর দিতে হবে।
আলেক্সি গ্যারিনের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ধন্যবাদ গৌরী। তোমার চিন্তা ও পরামর্শকে স্বাগত জানাচ্ছি। তুমি সঠিক চিন্তা করেছ। ওরা গর্তে ঢুকেছে, গর্ত থেকে বের করে আনতে হবে তাদের। জিজর, এবার তোমার সামনের চিন্তা সম্পর্কে বল।
মাই লর্ড, ম্যাডাম গৌরী ঠিক বলেছেন। তাদেরকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন এ মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনেও যেতে পারবো না। তবে সংগোপনে তাদের সন্ধান অব্যাহত রাখাতে হবে, বিশেষ করে মারেভা ও মাহিনের বাড়ির উপর খুব সাবধানে নজর রাখতে হবে। মাহিনরা নিশ্চয় তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখবে। এই পথেই আহমদ মুসার সন্ধান পাওয়া যাবে। তার সন্ধান পাওয়া ও তাকে শেষ করাকে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিতে হবে। এজন্যে তাহিতি দ্বীপে আমাদের জনশক্তির সর্বোচ্চ মবিলাইজেশন করতে হবে। প্রতিটি স্থানে আমাদের নজরদারি করতে হবে। সর্বত্র সব দিকে থেকে তাকে ঘিরে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে পলিনেশীয়ার বাইরে থেকে এবং আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার থেকেও আমাদের লোকজনকে তাহিতিতে নিতে হবে। আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের বাইরেই আহমদ মুসাকে ধ্বংস করতে হবে। আমি মনে করি ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট এই ঝামেলা এড়াতে পারলে নির্বিঘ্নে তার লক্ষে পৌছে যাবে। জিজর বলল।
আলেক্সি গ্যারিন এবার ডারথ ভাদেরের দিকে তাকাল।
ডারথ ভাদের প্রস্তূত ছিল। বলল সংগে সংগেই, মাই লর্ড, আমি ম্যাডাম গৌরীও মি, জিজরকে সমর্থন করছি। দরকার হলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাহিতিতেই আহমদ মুসাকে ধ্বংস করতে হবে। থামল ডারথ ভাদের।
সবার কথা শেষ হলে আলেক্সি গ্যারিন চোখে নিচে নামিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, তাহলে এটাই ঠিক হলো, মারেভা ও মাহিনের বাড়ির উপর গোপন নজরদারি চলবে, তাদের বাড়ির লোকজনদের গতিবিধির উপরও গোপনে নজর রাখা হবে এবং গোটা তাহিতি দ্বীপে চলবে গোপন চিরুণী অভিযান। এজন্য প্রয়োজনীয় শক্তিকে তাহিতিতে মোবিলাইজ করার প্লানও মঞ্জুর করা হবে। জিজর ও ডারথ ভাদের উপস্থিত থেকে তাহিতির অভিযান পরিচালনা করবে। আর গৌরী ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের দায়িত্বে থাকবে, যেহেতু তার গুলিবিদ্ধ হাত এখনও পুরোপরি সুস্থ নয়। তোমরা এবার প্রস্তূতি গ্রহন করো। ওকে। কথা শেষ করল আলেক্সি গ্যারিন।
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আলেক্সি গ্যারিনের আসন হটে পেছনের দেয়ালের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল, ঠিক যেভাবে এসেছিল। গৌরীরা তিনজনও উঠে দাঁড়াল।
গৌরী কক্ষের বাইরে যেতেই তার মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখল তার বস আলেক্সি গ্যারিন।
কল অন করে, ইয়েস মাই লর্ড! বলতেই ওপার থেকে আলেক্সি গ্যারিন বলল, গৌরী এস, আমি শোবার ঘরে।
সংগে সংগেই মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল গৌরীর। চোখে ফুটে উঠল অপমান ও জ্বালাময় বেদনার একটা ছাপ।
ইয়েস মাই লর্ড! বলল গৌরী। কথা বলতে কষ্ট হলো গৌরীর।
হ্যাঁ, শোন গৌরী। কয়েক দিন তোমাকে সাদা পোষাকে দেখছি। ওটা আমি দু’চোখে দেখতে পারিনা, সাদা হলো মৃত্যুর প্রতীক। তুমি আগের মত লাল পোষাক পরে এস। তুমি লাল তোমার ভেতরটাও লাল। তোমার গায়ের লাল পোষাক তাই মনে আগুন জ্বালায়। এ আগুন আমার সবচেয়ে প্রিয়। এস গৌরী। বলল আলেক্সি ওপার থেকে।
গৌরী ইয়েস মাই লর্ড! বলতেই ওপার থেকে কল অফ হয়ে গেল।
যন্ত্রের মত কল অফ করল গৌরী।
মুখে ইয়েস মাই লর্ড! বললেও গৌরীর চোখে জ্বলে উঠেছে অপমানের আগুন। এতদিন নারীত্বের, ব্যক্তিত্বের এই অপমানের আগুন অবচেতন মনের কোন এক কোণে যেন সে অনুভব করতো! আজ সেই আগুন তার চোখে নেমে এসেছে। আহমদ মুসা তার মনের সুপ্ত আগুনকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেদিন ‘লা ডায়মন্ড ড্রপ’ হোটেলের ‘অ্যাপেক্স’ রেস্টুরেন্টে আহমদ মুসার সাথে কয়েক মিনিট আলোচনা তাকে নতুন জীবন দিয়েছে। তার নারীত্বের মর্যাদার চেতনা এখন আকাশ স্পর্শ করেছে। মোবাইলটা পকেটে রেখে মনে মনে বলল গৌরী, আগুন শুধু মনোরঞ্জনের জন্য নয় মাই লর্ড, ধ্বংসেরও হতে পারে।
এ আগুন যেন অশ্রু হয়ে জমেছে তার চোখের দুই কোণে!
চোখ মুছে গৌরী পা বাড়াল আলেক্সি গ্যারিনের ঘরের দিকে। ওখানেই এক প্রস্থ লাল পোষাক আছে। কোন এক সময় তা সে খুলছিল। আর নিয়ে আসা হয়নি। ওটাই পরা যাবে সেখানে গিয়ে। তার মনের দরজায় আহমদ মুসার পবিত্র, প্রশস্ত, সুন্দর অবয়বটা এসে দাঁড়াল। সে যেন ট্রাফিক পুলিশের মত হাত তুলে গৌরীকে এগোতে নিষেধ করছে! অশ্রুর একটা ঢেউ যেন তার দুই চোখের কোণকে প্লাবিত করল আবার। মনে মনেই বলল, আহমদ মুসা, তোমার কথাগুলো স্বাধীন মানুষের জন্যে, আমি স্বাধীন মানুষ নই!
গৌরী হাঁটছিল। তার হাঁটা থামল না।
আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে বলল তাহিতিসহ পলিনেশীয়া দ্বীপপুঞ্জের স্বরাষ্ট্র সচিব, প্রধান ফারসি আমলা মসিয়ে দ্যাগল, জরুরি বিষয়টা আপনার কি মি.আহমদ মুসা?
ধন্যবাদ স্যার, এই সাক্ষাত দেয়ার জন্যে।
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। সোজা হয়ে বসে বলল, আমি ছদ্মবেশ নিয়ে তোয়ামতো দ্বীপপুঞ্জে গিয়েছিলাম সংশ্লিষ্ট দ্বীপ এলাকায়ও ঘুরেছি। সব বিষয়ে একটা ধারণা নেবার চেষ্টা করেছি। লক্ষ অর্জনের জন্যে কিছু টার্গেটও ঠিক করেছি। সামনে এগোবার জন্যে আপনার সাহায্য আমার প্রয়োজন।
মি. আহমদ মুসা, আপনার উপর আমার একশ’ ভাগেরও বেশী আস্থা আছে। সেদিন আমরা আলোচনায় বুঝেছি, আতগুলো মুল্যবান মানুষের জীবন রক্ষা করতে হলে গোপন অভিযানের কোন বিকল্প নেই এবং এই অভিযান আপনাকে দিয়েই সম্ভব। তবুও বলছি আপনার সামনে এগোনোর ব্যাপারে সব দিক আপনি ভেবেছেন কিনা, সব ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত কিনা? বলল তাহিতিসহ ফ্রেঞ্চ পলিনেশীয়ার স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধান মসিয়ে দ্যাগল।
সংশ্লিষ্ট সব ব্যাপার নিয়েই আমি ভেবিছি। তবে ঝুঁকির প্রশ্ন তো আছেই।
এ ধরনের অভিযানে ঝুকি এড়ানো সম্ভব নয়। তবে ঝুকি যাতে কমানো যায়, এজন্যে আপনার কছে এসেছি সাহায্যের জন্যে। আহমদ মুসা বলল।
অবশ্যই সাহায্য পাবেন। আমারা প্যারিসকে বিষয়টা ব্রিফ দিয়েছি। তারা সব রকম সাহায্যের নির্দেশ দিয়েছেন। দরকার হলে এখানকার সেনা ইউনিট ব্যবহার করা যাবে। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান দ্যাগল।
ধন্যবাদ স্যার। বলল আহমদ মুসা।
আপনার প্রয়োজনের কথা বলুন মি. আহমদ মুসা।
স্যার, এক, আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল দরকার। ছোট, যাতে এই দ্বীপ বা অ্যাটলের কিনারায় পৌছতে পারি। ওদের রাডার বা সিসি ক্যামেরা’কে ফাঁকি দিয়ে ওদের দ্বীপের নির্দিষ্ট টার্গেটে পৌছার জন্যে এটা দরকার। দুই, রাডার ও ক্যামেরার রেজিস্ট্যান্ট পোশাক দরকার। তিন, ইলেক্ট্রন জ্যামিং মেশিন আমার দরকার এবং চার আলট্রা সাইলেন্সর টেকনলজির মিনি মেশিন রিভালবার আমার প্রয়োজন। শর্ত হলো, এই সবই ফেরত দেব, এই টেকনলজি কারও হাতে যাবার ভয় নেই। বলল আহমদ মুসা।
হাসল স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল। বলল, ফেরত দেয়া, টেকনলজি ট্রান্সফার না হওয়ার প্রশ্ন তুলছেন কেন, আহমদ মুসা? আর কি করে জানলেন যে, এই জিনিসগুলো আমাদের কাছে আছে?
স্যার, আমি পৃথিবীর সব মিলিটারির টাইম জার্নাল নিয়মিত দেখি। এসব জিনিস ফরাসিরা কবে আবিস্কার করেছে তাও আমি জানি। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তূ আহমদ মুসা সাবমেরিন ছাড়া আমাদের আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল, যেটা আছে সেটা ডুবুরীদের ক্যাপসুলের মত। তবে আরও উন্নত। এ থেকে কোন বুদ্বুদ বের হয় না। সাবমেরিনের মত এটা চলতে পারে। কম পানিতেও চলে তবে তার গতি বেশী নয়, ম্যাক্সিমাম ছয় ঘন্টার মত এটা পানির তলে থাকতে পারে। এটা বানানো হয়েছে গোয়েন্দাদের ছোট-খাট কাজে ব্যবহারের জন্যে। স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল বলল।
এটাই আমার মিশনের জন্যে এ্যাপ্রেপ্রিয়েট স্যার। বলল আহমদ মুসা।
আপনার সৌভাগ্য মি. আহমদ মুসা। এই আন্ডারওয়াটার ক্যাপসুলটি দুদিন আগে আমাদের সংগ্রহে এসেছে। এর ব্যাবহারের কয়েকটা বিষয় আপনাকে শিখতে হবে। বলল স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল।
ধন্যবাদ স্যার। আপনারা সাহায্য করলে শিখে নেব। অন্য তিনটি বিষয়ে বলুন। বলল আহমদ মুসা।
ওগুলোর ব্যাপারে সমস্যা হবে না। তবে রাডার ও ক্যামেরা রেজিস্ট্যান্ট পোষাকের বিকল্পও আমাদের আছে। স্বয়ংক্রিয় ক্রোকোডাইল ও ডলফিন পোষাক আছে। ওর ভেতরে ঢুকে পানিতে ও স্থলে যে কোন দিকে, যে কোন ডিস্টিনেশনে চালানো যায়। তবে রাডার ও ক্যমেরা রেসিস্ট্যান্ট নয়। অন্যদিকে রাডার ও ক্যামেরা রেসিস্ট্যান্ট পোশাক রাডার ও ক্যামেরার ব্লাইন্ড অ্যারর হিসাবে চিহ্নিত হবে। সুবিধা হলো এ পোশাকে আপনি যত্র-তত্র যেতে পারবেন, কিন্তূ ক্রোকোডাইল ও ডলফিনের পক্ষে তো সব জায়গায় যাওয়া স্বাভাবিক নয়! থামল স্বরাষ্ট সচিব মসিয়ে দ্যাগল।
হ্যাঁ, রাডার, ক্যামেরা রেসিস্ট্যান্ট পোশাকই আমার জন্য ভাল হবে স্যার। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে, মি, আহমদ মুসা। আপনার যা চাহিদা সেটাই পাবেন। স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল বলল।
আমি অ্যাটলে ঢোকার পর কোন লোক অ্যাটলে ঢূকবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্যে সারফেসে পেট্রল বোট ও পানির নীচে সাবমেরিন পাহারায় থাকতে হবে? এবং………।
আহমদ মুসা কথার মাঝখানেই দ্যাগল বলে উঠল, সাবমেরিন কেন? সারফেসে পাহারায় থাকলেই তো হয়।
অ্যাটলের ভেতরে ঢোকার কোন আন্ডারওয়াটার প্যাসেজ আসে কিনা তা জানি না। থাকলে সেদিক দিয়ে লোক ঢুকে যেতে পারে। ওদের বিভিন্ন ধরনের আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল আছে। আমি ওদের টিউব সাবমেরিনও দেখেছি। বলল আহমদ মুসা।
কি বলেছেন আপনি! ওদের সাবমেরিন, এমনটি টিউব সাবমেরিনও আছে? কোথায় থাকে ওসব?
আছে যে আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। কোথায় থাকে তা জানি না। তাহিতির কোস্টাল লেগুন এবং তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের একাধিক লেগুনে থাকতে পারে। শুধু তাই নয়, ওদের হেলিকপ্টার ও এয়ার-ক্যাপসুলও রয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
হ্যাঁ হয়ে গেল স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগলের মুখ! কোন কথা বলতে পারল না কিছুক্ষণ। বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলল, মি, আহমদ মুসা! এত কথা তো আগে বলেননি। রীতিমত ওরা রাষ্ট শক্তি বনে গেছে। বিপদজ্জনক ওদের প্রস্তূতি। এই অবস্থায় আমি ওদের হেড কোয়ার্টার বা ঘাঁটিতে আপনাকে ঢুকতে দিতে পারি না। আমি প্যারিসে জানাব। ওদের অনুমতি লাগবে।
আপনি ওদের জানান। কিন্তূ এ কারনে আমাদের এ্যাকশনের জন্য দেরি করার প্রয়োজন নেই। বলল আহমদ মুসা।
প্রয়োজন আছে মি, আহমদ মুসা। আমাদের শক্তি বাড়াতে হবে। স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল বলল।
তাদের সাথে যুদ্ধ করার তো প্রয়োজন নেই। শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজন কি? আমি জানি যে শক্তি আপনার হাতে আছে সেটাই যথেষ্ট ওদের পরাজিত করার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
ধরুন, ওদের হেড কোয়ার্টার দখল হয়ে গেল। হেড কোয়ার্টারে যাবার পথ ওরা না পেলে এবং পানি, আকাশ ও আন্ডারওয়াটার পথে ওরা হেড কোয়ার্টারে যেতে না পারলে ওরা বিশৃঙ্খল ও ভীত হয়ে পড়বে। আমি মনে করি এ ধরনের শক্তি আপনার আছে। আপনার দু’টি ডেস্টয়ার ও কামান, মেশিনগান ও এ্যান্টিএয়ারক্রাফটগানসজ্জিত ২০টি বড় ধরনের মিলিটারি পেট্রল বোট রয়েছে। আর সাবমেরিন আছে বলেও আপনার কাছ থেকে শুনেছি। সুতরাং ওদের বাইরের শক্তিকে ক্রাশ করার জন্যে এই আয়োজনই যথেষ্ট। আরেকটি কথা স্যার হেড কোয়ার্টার ও উদ্ধার পর্বে শক্তি কোন কাজে লাগবে না, এখানে বুদ্ধির যুদ্ধে জিততে হবে এবং বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের উদ্ধার করতে হবে। তাদের নিরাপত্তার জন্যে এই নিরব অপারেশনের প্রয়োজন। বলল আহমদ মুসা।
স্বরাষ্ট সচিব অনেক্ষণ চুপ করে থাকলো। ভাবল। তারপর বলল, ধন্যবাদ মি, আহমদ মুসা, আপনি ঠিক পথেই চিন্তা করছেন। কিন্তূ আপনার চূড়ান্ত অভিযানের আগে অ্যাটলটিতে আন্ডারওয়াটার কোন প্যালেস আছে কিনা তা কি জানা দরকার নয়?
তারও কোন প্রয়োজন দেখি না স্যার। বরং তা দেখতে গেলে ওদের সাথে যদি দেখা হয়ে যায়, ওরা যদি আমাদের জেনে ফেলে কিংবা কোন কারণে সংঘাত বাঁধলে বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাবে এবং ওরা আরও সতর্ক হয়ে যেতে পারে। আমাদের এ অপারেশনের কনসেপ্ট হলো স্যার, ওদের সতর্ক হওয়ার আগে নিরবে ওদের ক্ষমতার কেন্দ্রকে অকেজো করে দেয়া এবং বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর পরই দরকার হবে ক্ষমতার প্রদর্শনী, বাইরের বিজয়টা নিশ্চিত করার জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
আমি একমত মি. আহমদ মুসা। কিন্তূ ভাবছি হেড কোয়ার্টার দখলে নেয়ার ভয়ংকর কাজটা কিভাবে হবে। এর সাফল্যের উপরই নির্ভর করছে সব কিছু। আপনার কি পরিকল্পনা? আমাকে প্লিজ একটু আশ্বস্ত করুন। স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগল বলল।
আমার কোন পরিকল্পনা নেই স্যার। আল্লাহর সাহায্যের উপর ভরসা করে আমি ভেতরে প্রবেশ করব। প্রতিটি সুযোগের যথাযথ ও সময়োচিত সদ্ব্যবহার করব। সন্দেহ নেই অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ভালোকাজ করার জন্যে আমি যাচ্ছি। আল্লাহর নির্দেশ এটা। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেন। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনার অনেক কাহিনী আমি শুনেছি। আজ দেখছি। আপনার জীবনের সাফল্যের শক্তিকেও আজ আমি প্রত্যক্ষ করলাম। স্বার্থ নয়, স্রষ্টার জন্যে যারা কাজ করেন মৃত্যুভয়সহ কোন কিছু হারাবার ভয় তাদের থাকে না। তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
সব কিছুর পিছুটানমুক্ত কেউ যদি হয়, তাহলে সে সব কিছু করতে পারে। পারবেন আহমদ মুসা, আপনিই পারবেন। গড ব্লেস ইউ। স্বরাষ্ট সচিব মসিয়ে দ্যাগল বলল।
মুহূর্তকাল থেমেই আবার বলল, মি. আহমদ মুসা। আপনি যা চেয়েছেন তা পাবেন এবং যা করতে বলেছেন তা আমি সবই করব।
ধন্যবাদ স্যার, অনেক ধন্যবাদ। বলল আহমদ মুসা।
ওয়েলকাম মাই ফেবারিট ইয়ংম্যান। আমি টেলিফোন করে দিচ্ছি আমাদের নৌ-ঘাটিতে। ফরমাল মেসেজও পাঠাচ্ছি। আজ বা কাল যে কোন সময় সেখানে জয়েন করতে হবে। অন্তত ১২ ঘন্টা সময় সেখানে এক্সারসাইজের জন্যে আপনাকে দিতে হবে।
ওকে স্যার। বলল আহমদ মুসা।
তাহলে কথা আপতত এখানেই শেষ। প্রয়োজন হলে যে কোন সময় আমাকে টেলিফোন করতে পারেন। আমার প্রাইভেট নাম্বার তো আপনার কাছে আছেই। এ সব কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়াল স্বরাষ্ট মি. সচিব দ্যাগল।
আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল।
হ্যান্ড শেক করে আহমদ মুসা বেরিয়ে এল। মি. দ্যাগলও অন্য ঘরের দিকে চলে গেল।
স্বরাষ্ট সচিবের কক্ষ থেকে আহমদ মুসা বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই মি. দ্যাগলের পিএস বলল, স্যার, গাড়ি ডাকব?
না, আমি ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিলাম, ছেড়ে দিয়েছি। তবে চিন্তা নেই, আমি আর একটা ট্যাক্সি ডেকে নেব।
স্যার বলেছেন আপনার সাথে গাড়ি না থাকলে আমাদের গাড়ি দিয়ে আপনাকে পৌছে দিতে। বিনীতভাবে মি. দ্যাগলের পিএস বলল।
না, ধন্যবাদ। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা গাড়ি বারান্দার সামনে আসতেই সেখানে অপেক্ষমাণ এক শিখ ড্রাইভার আহমদ মুসাকে সালাম করল। তারপর শিখ ড্রাইভারদের মতই হিন্দি মেশানো তাহিতি ল্যাংগুয়েজে বলল, সাব কি যাবেন? আমার গাড়ি আছে।
বিস্ময় দৃষ্টিতে সালাম দেয়া দেখে আহমদ মুসা তার দিকে তাকিয়েছিল। তবে সে তাকে চিনতে পারলো। শিখ ড্রাইভার যখন কথা বলল, তখন তার দাঁত, মুখ, চোখ দেখে বুঝল, শিখ ড্রাইভারের ছদ্মবেশ সঠিকভাবে হয়নি।
খুশি হলো আহমদ মুসা। ক’দিন আন্ডারগ্রাউন্ড থাকার পর শিখ ড্রাইভারের ছদ্মবেশে তেপাও বের হয়েছে। ভাল। তার উপার্জনও দরকার। কিন্তূ সে তাহিতির স্বরাষ্ট বিভাগের গাড়ি বারান্দায় কেন? আমাকে দেখে সে যে পরিমান বিস্মিত হয়েছে, তাতেই প্রমানিত হয় সে আমাকে এখানে আশা করেনি। তা হলে সে এসেছে কেন?
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে স্বরাষ্ট সচিব দ্যাগলের পিএস-এর দিকে ফিরে বলল, ধন্যবাদ, আমি গাড়ি পেয়েছি। আমি এর গাড়িতেই যাব।
ইয়েস স্যার। আমি স্বরাষ্ট সচিবকে বলল। বলল সচিবের পিএস।
স্যার, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি কার পার্কিং থেকে গাড়ি নিয়ে আসছি। বলল তেপাও আহমদ মুসাকে।
বলেই সে ছুটল কার পার্কের দিকে।
গাড়ি নিয়ে এল তেপাও। কিন্তূ তার সেই ট্যাক্সি নয়। ভিন্ন নাম্বার ও অপেক্ষাকৃত নতুন ট্যাক্সি।
গাড়িতে উঠে বসল আহমদ মুসা। গাড়ি চলতে শুরু করল।
তেপাও, তুমি কি গাড়ি পাল্টেছ? বলল আহমদ মুসা।
মারেভা ম্যাডাম বলল, আমার গাড়ির নাম্বার ওরা পেয়ে থাকতে পারে। সুতরাং গাড়ি বের করতে চাইলে নতুন গাড়ি বের করতে হবে। তাই আমি গাড়ি পাল্টিয়েছি। ছদ্মবেশও নিয়েছি শত্রুদের থেকে নিজকে আড়াল করার জন্যে। তেপাও বলল।
তুমি এখানে এসেছিলে কেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্বরাষ্ট সচিব মি. দ্যাগলের সাথে দেখা করার জন্যে।
আহমদ মুসার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল! বলল, স্বরাষ্ট সচিবের সাথে দেখা! কেন?
আপনার বিষয়ে খোঁজ খবর নেবার জন্যে। কোথাও খোঁজ না পেয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। সেইজন্যেই আমাকে স্বরাষ্ট সচিবের সাথে দেখা করার জন্যে পাঠানো হয়েছে। আমাদের ধারণা তিনি নিশ্চয় আপনার খবর বলতে পারবেন। বলল তেপাও।
স্বরাষ্ট সচিব যদি দেখা না করতেন? আহমদ মুসা বলল।
অবশ্যই দেখা করতেন। আমি আপনার বিষয়ে জানার আছে, এ কথা বলে দেখা করতে চাইতাম। বলতাম, অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন, তাই আপনার সাথে দেখা করা দরকার। বলল তেপাও।
সত্যিই কি কোন জরুরি প্রয়োজন তেপাও? আহমদ মুসা বলল।
সত্যিই জরুরি প্রয়োজন আমরা মনে করি। প্রয়োজনটা হলো আপনাকে কিছু খবর জানানো। অবশ্য আমরা জানি না, খবরগুলো আপনার কাছে জরুরি কিনা। বলল তেপাও।
কি খবর তেপাও, তাড়াতাড়ি বল। আহমদ মুসা বলল।
স্যার আজ সকালে আমি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে ছিলাম আমার এই নতুন ট্যাক্সি নিয়ে এবং এই ছদ্মবেশে। দু’জন লোক এল স্ট্যান্ডে। তারা একে, ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিল এবং গাড়ির নাম্বারও দেখছিল। আমার গাড়িটা ছিল এক প্রান্তে। অবশেষে তারা আমার কাছে এল এবং বলল, আমি তেপাও নামে কোন ড্রাইভারকে চিনি কিনা। আমি বলাম এ নামে কোন ড্রাইভারকে আমি চিনি না। তার অন্য কোন নামও থাকতে পারে। পরে তারা বলল, আমি হোটেল লা ডায়মন্ড ড্রপ-এ যাব কিনা। আমি যেতে চাইলে তারা আমার গাড়িতে উঠল। চলার পথে তারা যে গল্প করছিল এবং টেলিফোনে তাদের যে কথা হয়েছিল, সেটাই আপনাকে আমার জানাবার বিষয়। বলল তেপাও।
কি কথা শুনেছ তাদের? নিশ্চয় আমার কাজে লাগবে। বলল আহমদ মুসা।
তারা বলছিল, আহমদ মুসা, মাহিন, মারেভারা গেল কোথায়? এ সব বিষয় নিয়েই তারা কথা বলছিল। একজন বলছিল, হোটেল, নিজেদের বাড়ি, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি কোথাও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় যেতে পারে তারা? আমরা তেপাওকেও খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে পেলেও ওদের সন্ধান লাভ সহজ হতো।
অন্যজন বলল, আমরা তাদের সন্ধান করতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করিনি। এই চেষ্টায় তাদের পাওয়া যাবে না। ওরাও এটা বুঝেছে। এবার অন্য ব্যবস্থা হচ্ছে।
কি ব্যবস্থা? বলল প্রথম জন।
আমি সব জানি না। তবে শুনলাম, তাহিতি ও মুরিয়া দ্বীপের প্রতি ইঞ্চি জায়গা খুঁজে হলেও ওদের বের করবে তারা। এজন্যে তাহিতি ও মুরিয়ার বাইরে থেকে, এমনকি হেড কোয়ার্টার ‘মতু’ থেকেও তাদের দরকারী সব লোককে তাহিতি ও মুরিয়াতে আনা হচ্ছে। আমি শুনেছি, তাহিতিতেই আহমদ মুসাকে তারা ধ্বংস করবে। বলল দ্বিতীয় লোক।
দ্বিতীয় লোকের কথা চলাকালেই একটা কল আসলো তার মোবাইলে। সে তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে মোবাইল ধরল। বলল, ইয়েস স্যার, আমি সনি।
অপর পক্ষের কোন কথা শুনা গেল না। এপারের দ্বিতীয় লোকটি শুধু বলে চলল, জি স্যার, ওকে স্যার, ঠিক সিদ্ধান্ত, আমরা প্রস্তুত, মুহূর্তের জন্যেও আমরা কাজ বন্ধ রাখিনি স্যার। কথা শেষ করে ফোন রাখল দ্বিতীয় লোকটি।
কে টেলিফোন করেছিল সান? প্রথম লোকটি বলল।
কে আবার জারা, বস জিজরের দক্ষিন হস্ত।
কি বলল? জিজ্ঞাসা প্রথম লোকটির।
অনেক কথা। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
কি কথা? প্রথম লোকটি আবার বলল।
আমি যা বলছি সেটাই। বাইরে থেকে সব লোককে তাহিতি মুরিয়াতে আনা হচ্ছে। এমনকি আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার মতু থেকেও এখানকার জন্যে দরকারী সব লোককে তাহিতিতে আনা আছে। আজ থেকে লোক আসা শুরু হয়েছে। কালকের মধ্যে সব এসে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের ‘লর্ড’ মানে বসের যে তিনজন সিকিউরিটিপ্রধান রয়েছে তার মধ্যে প্রধান দু’জন চীপ অব অপারেশন জিজর ও গোয়েন্দাপ্রধান ডারথ ভাদের এখানকার অপারেশন পরিচালনার জন্যে গতকালই তাহিতি এসেছেন। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
তাহিতিকে তাহলে কি যুদ্ধক্ষেত্র বানাবে? বলল প্রথম লোকটি।
না, না। লোকটি বলল সবকাজ অত্যন্ত সংগোপনে হবে। গোটা তাহিতি ও মুরিয়া দ্বীপে নিশ্ছিদ্র চিরুনী অভিযান চলবে গোপনে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অলক্ষ্যে। এই অভিযান চলবে তাহিতি ও মুরিয়া দ্বীপে একই সংগে। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
বিশাল পদক্ষেপ। কিন্তূ আহমদ মুসাকে, যে তার জন্যে এই আয়োজন? বলল প্রথম লোকটি।
কি বলছ তুমি। টাকার অংকে ওকে পরিমাপ করা যাবেনা। ওর লাশের মুল্যই নাকি উঠেছে বিলিয়ন ডলার! বলল দ্বিতীয় লোকটি।
অসম্ভব ব্যাপার! বলছেন কি আপনি! প্রথম লোকটি বলল।
কিন্তূ তাহিতি ও মুরিয়াতে এত কিছু হবে কিন্তূ এখানকার পুলিশ বা গোয়েন্দারা টের পাবে না? বলল প্রথম লোকটি।
হাসল প্রথম লোকটি। বলল, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কি টাকার অভাব! কত টাকা লাগে মাট পর্যায়ের পেটি অফিসারদের কিনতে? নিশ্চিত থাকুন সে কেনা হয়ে গেছে। পুলিশও এই সাথে আমাদের সহযোগিতা করবে। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
তাহলে আর কোন চিন্তা নেই। কিন্তূ একটা বিষয়ে আশংকা হয়, বিপদ তো একটা এসেই গেছে। ঈশ্বর না করুক। আহমদ মুসা যদি ধরা না পড়ে, তাহলে আমাদের কোন বিপদ হবে না তো? আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার কতটা সুরক্ষিত? আমাদের ভবিষ্যৎ কিন্তূ এই সাফল্যের উপর নির্ভর করছে। বলল প্রথম লোকটি।
নিশ্চিত থাক। আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ার দুনিয়ায় নয়, পাতালে। আমরা ছাড়া যেতে পারে একমাত্র দৈত্য, আর কেউ নয়। বলল দ্বিতীয় লোকটি।
কিন্তূ আমরা যেতে পারলে অন্যেরা যেতে পারবে না কেন? কথায় আছে, এক মানুষ যা পারে অন্য মানুষও তা পারবে। প্রথম লোকটি বলল।
এ তত্ত্ব সব ক্ষেত্রে খাটে না। আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ারের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি খাটে না। প্রথমে পাতালে নামার পথ পাওয়ার বিষয়টি একটা অসম্ভব ব্যাপার। তার পরের ধাপে নামার ব্যাপারটা আরও কঠিন, সেখানে ধাঁধা আছে। ইলেকট্রনিক নানা ধাঁধা আছে। দু’দিকের দেয়াল ফুঁড়ে স্বয়ংক্রিয় গুলি অনুপ্রবেশকারীকে পদে পদে ঝাঁঝরা করে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। কেউ রাস্তা পেরিয়ে প্রাসাদের দরজায় পা রাখতে পারলেও দরজা খুলতে পারবেনা। ডিজিটাল লকের কোড ভাঙা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আর ভেতরে তো আরেক গোলক ধাঁধা। চারটি ফ্লোরের এলিভেটর প্রতিটি করিডোরে দ্বিমুখীভাবে চলে। কোনটা কোন দিকে চলছে কেউ জানে না?
শুনেছি, আমাদের সব গোপন কোড, আমাদের সব কিছু শুধু একজনই জানে। যে আমাদের সব কিছু জানে, তাকে এই পরিস্থিতিতে মতু থেকে সরানো দরকার নয় কি?
হাসল দ্বিতীয় লোকটি। বলল, তাকে পাওয়া অত সোজা নয়। সে আমাদের চার তলায় থাকে বটে, কিন্তূ কোথায় থাকে কেউ জানেনা এবং সে এক কক্ষেও সব সময় থাকে না। তার ব্যপারে জানতে পারে শুধু ম্যাডাম গৌরী। তাও কতটা জানে জানি না।
এত কিছু তুমি জান কি করে? ভেতরের তো কিছুই আমরা জানি না। বলল প্রথম লোকটি।
আমি বাইরের অপারেশনের দায়িত্ব পেয়েছি মাত্র কিছু দিন হলো। তার আগে আমি ডিজাইনার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে ভেতরের সব কাজের সাথেই যুক্ত ছিলাম। কক্ষ বিন্যাস, ইলেক্ট্রিক ও এলিভেটর নেটওয়ার্কিং সব কিছুর সাথেই আমি ছিলাম।
কাজটা ছিল খুব জটিল। এটি তৈরি করা প্রাসাদ নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে বা আগের মানুষের আগের চিন্তায় তৈরি করা প্রাসাদ। লিমিটেড এ্যাকোমোডেশন। এখানে নতুনভাবে কোন কিছু সংযোজন করা সহজ নয়। ইলেকট্রিক ওয়ারিং কোন কোন জায়গায় ড্রিল করে কোনভাবে করা হয়েছে। আর চারটি মুভিং ওলিভেটর তৈরিতে কিছু ভাংচুর করতে হয়েছে, কিন্তূ অসুবিধা হয়নি। এ্যাকোমোডেশনও ঠিক মত হয়েছে। তৃতীয় ও দ্বিতীয় তলায় রোবটদের জন্যে সারিবদ্ধ ক্যাপসুল গড়া হয়েছে। দুই ফ্লোরে ওদের এ্যাকোমোডেশন ও অন্য সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। নিচের তলায় তো কিছুই নেই। ওটা একটা টেস্টগ্রাউন্ড ও ল্যাবরেটরি। সব কাজেই আমি ছিলাম।
তা হলে তো তুমি অনেক বেতন পেতে? প্রথম লোকটি বলল।
বেতন আর কি। কাজটা হয়ে গেলেই হয়। আমরা সফল তো আমরাই দুনিয়ার বাদশাহ হবো। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
কেন? পাশেই তো আছে আমেরিকা, ওরা বসে থাকবে? বলল প্রথম লোকটি।
আমাদেরকে তারা তাদের লোকজনই ভাববে। মনে করবে আমরা তাদের কাজই করছি। কিন্তূ শত্রু বলে বুঝবে, তখন আর তাদের করার কিছু থাকবে না বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত সারেন্ডার করা ছাড়া। দ্বিতীয় লোক বলল।
হোটেল ‘লা ডাইমন্ড ড্রপ’ এর গেটে পৌছতেই ওদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নামার সময় ওদের একজন বলল, আহমদ মুসার রুম তো বন্ধ। ঘরের চাবি না পেলে তো আমাদের চলবে না। ঘর থেকে ওর পোষাক কিংবা ব্যবহার্য কিছু চাই। আমাদের কুকুর বাহিনীর জন্যে এটা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন টার্গেটেড হিউম্যান স্পেল ডিটেক্টর ( THSD) –এর জন্যে। মানুষের চোখ যেখানে যাবে না। সেখানেও কুকুর ও স্পেল ডিটেক্টরের চোখ যাবে। রক্ষা নেই আহমদ মুসার। দ্বিতীয় লোকটি বলল।
চিন্তা নেই ‘কী বোর্ড’ থেকে চুরি করব আমরা চাবিটি। আর তা পেতেই হবে, এটা আমাদের দাবী।
দু’জনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। তারা চলে গেল হোটেলের ভেতরে।
আমি তখন কোথায় আপনাকে পাব এই সন্ধানে ছুটলাম। শহরের সম্ভাব্য সব জায়গা খুঁজে তারপর গেলাম ম্যাডাম মারেভার ওখানে। উনি থাকছেন তার এক বান্ধবীর বাসায়। তিনি আমাকে বললেন, স্যার মাঝে মাঝে মি. দ্যাগলের কাছে যান। আর এই মুহূর্তে স্যার মি, দ্যাগলের সাথে যোগাযোগ রাখবেন এটাই স্বাভাবিক। তুমি গিয়ে মি, দ্যাগলকে একটা জরুরি মেসেজ পৌছানোর চেষ্টা কর। মি, দ্যাগলের সাক্ষাৎ পেলে বলবে, আপনি দয়া করে স্যারের কাছে এই খবরগুলো পৌছানোর ব্যবস্থা করুন। উনি নিশ্চয় ব্যবস্থা করবেন। কিন্তূ মি, দ্যাগলের সাথে আর দেখা করতে হলো না। আল্লাহর অশেষ রহমতে আপনাকেই পেয়ে গেলাম। সব কথা আপনাকেই বলতে পারলাম। খুব হালকা লাগছে এখন আমার।
আহমদ মুসা পিঠ চাপড়ালো তেপাও-এর। বলল, তেপাও, আমার ভাই, তুমি যে ইনফরমেশন আমাকে দিয়েছ, তার চেয়ে বড় ইনফরমেশন আমি তাহিতিতে এসে পাইনি। তোমাকে ধন্যবাদ! অনেক ধন্যবাদ।
আমি কিছু বুঝিনি স্যার। এটুকু বুঝেছিলাম এ কথাগুলো স্যারের উপকারে লাগবে। বলল তেপাও।
তুমি এত মূল্যবান কথা আমাকে বলেছ যা আমার সামনে এগোবার গাইড লাইন। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, তেপাও, গাড়ি ঘুরাও। স্বরাষ্ট্র সচিব মি. দ্যাগলের কাছে আবার ফিরে চল।
গাড়ি ঘুরাল তেপাও।
আহমদ মুসা কল করল স্বরাষ্ট্র সচিব মি. দ্যাগলকে। মি. দ্যাগল আহমদ মুসার গলা টেলিফোনে পেয়েই বলল, কোন খারাপ খবর নয় তো আহমদ মুসা?
না স্যার। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। আমি আসছি। আপনার অসুবিধা নেই তো স্যার? বলল আহমদ মুসা।
অবশ্যই না। এস। আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। স্বরাষ্ট্র সচিব মসিয়ে দ্যাগল বলল।
গাড়ি পৌছল মসিয়ে দ্যাগলের অফিসে।
মসিয়ে দ্যাগল বেরিয়ে এসেছে বারান্দায়।
আহমদ মুসা বারান্দায় উঠে এলে তারা ভেতরে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসতে বসতে মি. মশিয়ে দ্যাগল বলল, কি ব্যাপার মি. আহমদ মুসা, জরুরি কিছু?
অবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে স্যার। বলল আহমদ মুসা।
কি সেটা? স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল বলল।
স্যার, আগামি সন্ধাতেই আমি ওদের হেড কোয়ার্টার অ্যাটলে ঢুকতে চাই।
কেন, এত তাড়াতাড়ি কেন? বলল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল।
আমাদের তেপাও নিশ্চিত খবর জেনেছে, আমাকেসহ মারেভা ও মাহিনের সন্ধানের জন্য ওরা আগামী পরশু থেকে তাহিতি ও মুরিয়া দ্বীপে চিরুণী অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। অভিযান চলবে নিশ্চয় কয়েক দিন। তাদের এই চিরুণী অভিযানের বেল্ট পলিনেশীয়ার বাইরে থেকে। পলিনেশীয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি হেড কোয়ার্টারের দরকারী সব জনশক্তিকে তাহিতিতে আনা হবে। খোদ ওদের চীফ অপারেশন কমান্ডার জিজর ও ওদের গোয়েন্দাপ্রধান ডারথ ভাদের তাহিতিতে আসছে। আমি মনে করি এটা আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ। কালকেই ওরা সদলবলে আসছে তাহিতি। আমি পরশু দিন রাতে ওদের হেড কোয়ার্টার অ্যাটলে ঢুকতেচাই স্যার। আমি এর মধ্যেই সব প্রস্তুতি সেরে ফেলতে চাই স্যার। বলল আহমদ মুসা।
সংগে সংগে উত্তর দিল না স্বরাষ্ট্র সচিব মশিয়ে দ্যাগল। বলল, হ্যাঁ, মি. আহমদ মুসা, তোমার কৌশলটা ঠিক। তারা যখন তাদের হেড কোয়ার্টার অ্যাটল থেকে এখানে তাদের দরকারি লোকগুলো নিয়ে আসবে তখন তাদের হেড কোয়ার্টার প্রতিরক্ষা অবশ্যই দুর্বল হবে। এই সুযোগই আপনি নিতে যাচ্ছেন। চমৎকার সিদ্ধান্ত! চলুন, আমি আপনাকে নেভাল বেজে নিয়া যাব। ওখানে আপনাকে আন্ডারওয়াটার টিউব ভেহিকেল পরিচালনায় ট্রেনিং নিতে হবে। রাডার রেসিট্যান্ট পোষাক, ইলেক্ট্রনিক জ্যামিং মেশিন ও সাইলেন্সার লাগানো মিনি মেশিন রিভলবার ওখানেই পেয়ে যাবেন। আমি মনে করি, সেখানকার আমাদের নেভাল রেস্ট হাউজে কাল সন্ধ্যায় আপনি থাকবেন।
ধন্যবাদ স্যার। মারেভা, মাহিন ও তেপাও-এর নিরাপত্তাও দরকার। চিরুণী অভিজানের সময় তারা ধরা পড়ে যেতে পারে। আহমদ মুসা বলল।
আপনার চিন্তা নেই। ওদের নিরাপত্তা নিয়ে আমি আগেই চিন্তা করেছি। বলল মশিয়ে দ্যাগল।
ধন্যবাদ স্যার। আহমদ মুসা বলল।
আসুন! বলে হাঁটতে লাগল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান মশিয়ে দ্যাগল।
তার সাথে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসাও।
গাড়িতে আহমদ মুসাকে বসিয়ে গাড়ি ঘুরে নিজের সিটের পাশে যেতেই একজন গোয়েন্দা অফিসার এসে বলল, স্যার, বিভিন্ন ছদ্মবেশে একাধিক লোক আমাদের এই গেটের উপর নজর রেখেছে। আমরা এগোলেই তারা সরে যাচ্ছে, অন্য লোক আসছে তার জায়গায় অন্য ছদ্মবেশে।
ধন্যবাদ, বুঝেছি ব্যাপারটা।
বলে মশিয়ে দ্যাগল গাড়িতে উঠে বসল।
বলেই বলল, আশ্চর্য হচ্ছি মি. আহমদ মুসা! ওরা আমার গেটের উপরও চোখ রাখছে! আপনি এসেছেন নিশ্চয় ওরা তা জানতে পেরেছে।
তবে আমার এখান থেকে যাওয়া ও আসাটাকে তারা ফলো করতে পারেনি। আমার ধারনা, আজ থেকেই ওরা এখানে পাহারা বসিয়েছে। ওদের এটা জানার কথা নয় যে, আমি এখানে এসেছি এবং এসে থাকি। তবে তারা যে বিবেচনাতেই এসে থাকুক, তারা সফল।
মশিয়ে দ্যাগলের গাড়ি স্টার্ট নিল। গাড়ি চলতে শুরু করল।
এই গেটের উপর চোখ রাখার তখন কেউ ছিল না।
আমাদের ফলো করা আমাদের জন্য ভাল হতো না।
স্বরাষ্ট্র সচিবালয় থেকে নৌঘাঁটি অনেকখানি পথ। পাপেতির সার্কুলারে রোডের যেখানে অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি এসে মিশেছে, সেখানেই স্বরাষ্ট্র সচিবালয় অবস্থিত। অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি সোজা পূর্ব দিকে প্রায় ১০ মাইল এগিয়ে মোয়েভা নদী অতিক্রম করে পূর্ব-দক্ষিন দিকে এগিয়েছে। মোয়েভা নদীর ঐ সংযোগ স্থল থেকে একটা পাথুরে প্রশস্ত রাস্তা মোয়েভা নদীর সমান্তরালে কোস্টাল লেগুনের প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। এটা প্রধান নেভাল ঘাঁটি নয়, এটা নেভাল ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিং কেন্দ্র। এই নেভাল ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিং কেন্দ্রেই আন্ডারওয়াটার ক্যাপসুল ভেহিকেলের ওপর আহমদ মুসার ট্রেনিং হবে।
স্বরাষ্ট্র সচিবালয় থেকে অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি রোড ধরে কিছুটা এগোলেই পাপেতির বিখ্যাত পোরতু নদী। পোরতু নদীর ব্রীজে ওঠার সময় পাশ দিয়ে ফিরছিল গভর্নর সচিবালয়ের সেক্রেটারি হোয়ানু। সে গলা চড়িয়ে বলল, স্যার ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন, কখন ফিরবেন?
আমি মোয়েভা ডকে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরব। স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলকেও কথা অনেকটা গলা চড়িয়েই বলতে হলো। পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির দিকেই তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসা। একটা জীপও দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ির পাশে। আহমদ মুসাদের পরে জীপটি এসে দাঁড়ায়। জীপে চারজন আরহী।
নিবিষ্টভাবে ওদের দিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ সে দেখল, তারা যেন গোগ্রাসে স্বরাষ্ট্র সচিব মি. দ্যাগলের কথা শুনছে! দ্যাগল তখন গলা চড়িয়ে মোয়েভা নেভাল ডকে যাওয়ার কথা বলছিল। গাড়ির অন্য সবারই মনোযোগ তখন ঐ গাড়ির দিকে।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। কিন্তু ভাবনার আর সময় হলো না, সবুজ সিগন্যালের সাথে সাথেই জীপটি হাওয়ার মতো ছুটল সামনে।
স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল তখনও কথা বলছিল গভর্নর সচিবালয়ের সচিব হোয়ানুর সাথে।
কথা শেষ হলে স্টার্ট নিল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের গাড়ি।
অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি সড়কটি তীরের মত সোজা পুব দিকে এগিয়ে গেছে।
স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের সাথে টুকটাক কথা চলছে, কিন্তু আহমদ মুসার মনোযোগ বার বার ছেদ পড়ছিল। ঐ জীপটি ভুলতে পারছিল না আহমদ মুসা। ওরা মি. দ্যাগলের মোয়েভা নেভাল ডকে যাওয়ার কথা উদগ্রীব হয়ে শুনছিল কেন? আর ওদের সবার মনোযোগ তাদের প্রতি ছিল কেন? ওদের মধ্যে একজন ছাড়া কাউকেই তাহিতির লোক বলে মনে হয়নি। তাহলে কি ওরা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের লোক? মি. দ্যাগলের অফিস গেটের উপর তো তারাই চোখ রাখছিল। সন্দেহ নেই ওরাই আবার তাদের ফলো করছে। আহমদ মুসাকেও তারা চিনতে পেরেছে নিশ্চয়। তাহলে ওদের ছেড়ে ওরা চলে গেল কেন?
নানা কথা ও নানা চিন্তার মধ্যে দিয়ে গন্তব্যের শেষ প্রান্তে মোয়েভা নদীর কাছে তারা চলে গেল। মোয়েভা নদীতে ব্রীজ আছে। অ্যাভেনিউ ডু প্রিন্স হিন্দি সড়কটি মোয়েভা ব্রীজ হয়ে আরও পূর্ব-দক্ষিণে চলে গেছে।
ব্রীজ পাওয়ার একটু আগে একটা টিলার ধার ঘেঁষে প্রশস্ত পাথুরে রাস্তা চলে গেছে মোয়েভা নেভাল ডক ইয়ার্ড পর্যন্ত। রাস্তার শুরুটা প্রশস্ত হলেও পরবর্তী অংশ এক রকম নয়। কোথায় সংকীর্ণ, কোথাও প্রশস্ত। দু’এক জায়গায় পাহাড়ের মত উঁচু টিলার সারির বুক চিরে অতিক্রম করেছে সড়কটি। সেখানে সংকীর্ণ। দু’টো গাড়িও পাশাপাশি চলতে পারে না।
ব্রীজের গোড়ায় ছোট্ট একটা পুলিশ ফাঁড়ি।
পর্যায়ক্রমে দু’জন করে পুলিশ পাহারায় থাকে।
হঠাৎ আহমেদ মুসা দ্যাগলকে বলল, স্যার, এখানে গাড়িটা একটু দাঁড় করালে ভাল হয়। পুলিশের সাথে একটু কথা বলতে চাই।
গাড়ি নেভাল ডকের দিকে মোড় না নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পাশেই পুলিশ ফাঁড়ি।
গাড়ি দাঁড়াতেই দু’জন পুলিশ ছুটে এল। স্বরাষ্ট্র সচিবকে দেখে চোখ তাদের ছানাবড়া হয়ে গেল। লম্বা স্যালুট করল তারা।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। পুলিশ দু’জনকে কাছে ডেকে বলল আহমদ মুসা, তোমরা গত দশ মিনিটের মধ্যে কোন জীপ বা গাড়িকে মোয়েভা নেভাল ডক ইয়ার্ডের এই সড়ক ধরে যেতে দেখেছ?
দু’জন একটু ভাবল। একজন বলল, ইয়েস স্যার, সাত আট মিনিট আগে একটা জীপ নেভাল ডক ইয়ার্ডের দিকে গেছে।
পুলিশের উদ্দ্যেশ্যে ‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা স্বরাষ্ট্র সচিবকে বলল, স্যার আপনার গাড়িতে বিস্ফোরক ডিটেক্টর আছে?
না, মি. আহমদ মুসা গাড়িতে আলাদা কোন বিস্ফোরক ডিটেক্টর নেই। গাড়ির ইঞ্জিন কেবিনে ডিটেক্টর ফিট করা আছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সব ধরনের বিস্ফোরককে ডিটেক্ট করতে পারে।
ঠিক আছে স্যার। কত দূর থেকে পারে? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
কমপক্ষে দশ গজ। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল।
গুড। তাহলে এদিকে আর কোন চিন্তা নেই স্যার। আহমদ মুসা বলল।
মি. আহমদ মুসা, এসব নিয়ে আপনি ভাবছেন কেন? আপনি সামনের পথটুকুতে কিছু আশংকা করছেন? জিজ্ঞাসা দ্যাগলের।
হ্যাঁ স্যার, আমাদের এখানে দশ মিনিট আগে যে জীপটা এই পথে নেভাল ইয়ার্ডের দিকে গেছে, সে জীপ্টাকে আমি সন্দেহ করছি। বলল আহমদ মুসা।
এরা কারা বলে মনে করছেন? দ্যাগল বলল।
আমি মনে করছি ওরা ব্লাক সান সিন্ডিকেটের লোক। বলল আহমদ মুসা।
ওরা দেখছি একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছে! আমাদের ডক ইয়ার্ডকেও সাবধান করতে হবে। নাশকতামূলক কিছু ঘটাতে পারে ওরা। দ্যাগল বলল।
সাবধান থাকা ভাল স্যার। বলল আহমদ মুসা।
স্বরাষ্ট্র সচিবের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। চলছে গাড়ি মাঝারি গতিতে।
আহমদ মুসার মনে একটা অস্বস্তি। তেমন কিছু তো ঘটেনি! পাশে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ভাবল ব্যাগও তো এনেছে! অ্যাটল দ্বীপে তার অভিজান শুরু হবে এই নেভাল ইয়ার্ড থেকেই। মি. দ্যাগল তাকে এই কথায় বলেছে। ব্যাগ কাছে টেনে নিল আহমদ মুসা। একবার চেক করা দরকার সব উঠেছে কিনা। ব্যাগের প্রধান কেবিনে যা তুলেছিল সবই পেল। হঠাৎ তার খেয়াল হলো লেজারগান ও লেজার কাটার কোথায়? আজ সকালেই তো ব্যাগে তুলেছি! ব্যাগের অন্যান্য কেবিন খুঁজতে গিয়ে ব্যাগের বাইরের কেবিনে পেয়ে গেল অস্ত্র দু’টি। মনে পড়ল আহমদ মুসার, তার একটি অভ্যাস হলো অস্ত্র যত গুরুত্বপূর্ণ হয়, ততই সহজ ও নাগালের মধ্যে রাখে সে ঐ অস্ত্র।
বেশ জোরেই চলছিল গাড়ি। রাস্তার এই অংশটা সমতল। এর পরেই পাহাড়ের ছোট বড় টিলা। নেভাল ডকের সমতল পর্যন্ত নেমে গেছে।
গাড়ীটা কি সত্যিই ওদের ছিল মি. আহমদ মুসা? বলল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল।
আমি তাই মনে করি স্যার? আহমদ মুসা বলল।
ওরা কি বোমা বা এ ধরনের কিছু বিস্ফোরক পাতবে বলে মনে করেন? বলল দ্যাগল।
স্যার, এটা আমার ধারণা। আহমদ মুসা বলল।
বোমা বা বিস্ফোরক পাতার উপযোগী স্থানগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি। বলল দ্যাগল।
আল হামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমাদেরকে নিরাপদে পৌছাতে সাহায্য করুন। আহমদ মুসা বলল।
টিলাসংকুল পথে প্রবেশ করেছে গাড়ি।
রাস্তা আঁকাবাঁকা ও সংকীর্ণ।
দু’পাশে টিলা। সামনে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু একটা টিলা। টিলাকে পাশ কাটাবার জন্যে রাস্তা এখানে বাঁক নিয়েছে।
বাঁক নিতে গিয়ে গাড়ি ডেডস্টপ-এর মত হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।
হঠাৎ এভাবে গাড়ি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সবাই ঝাঁকি খেল। ড্রাইভার পুলিশটি বলল, স্যার, গাড়ির স্টার্টার, চাবি, স্টিয়ারিং কিছুই নড়ছে না।
ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন দেখার জন্যে দরজা খুলতে গিয়ে পারল না। সে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, স্যার, গাড়ির দরজা আনলক হচ্ছে না।
আহমদ মুসাও দ্রুত তার পাশের দরজা খুলতে গেল, কিন্তু পারল না।
দ্রুত আহমদ মুসা ফিরল দ্যাগলের দিকে। বলল, স্যার, গোটা গাড়ি জ্যাম হয়ে গেছে। মেটাল জ্যামিং মেশিনের ম্যাগনেটিক স্প্রে আমাদের গোটা অচল করে দিয়েছে।
এটা কি সম্ভব? এমন অস্ত্রের কথা তো শুনিনি। বলল দ্যাগল।
মেটাল জ্যামিং ডিভাইস ওদের আছে স্যার। আহমদ মুসা বলল।
সাংঘাতিক! এখন করণীয়? বলল দ্যাগল। তার কন্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু বলার সুযোগ হলো না। প্রবল গুলিবৃষ্টি শুরু হলো গাড়ির উপর চারদিক থেকে।
পেছনের চারজন পুলিশ, তাদের রাইফেল, ড্রাইভার পুলিশ ও মি. দ্যাগল রিভালবার হাতে নিল।
আমাদের রাইফেল ও রিভলবার কোন কাজ দেবে না স্যার। ওগুলোও জ্যাম হয়ে গেছে। প্লিজ, আপনারা সিটের নিচে শুয়ে পড়ুন। দ্রুত কন্ঠে চিৎকার করে বলল আহমদ মুসা।
তবু দ্যাগল তার রিভলবার একবার পরীক্ষা করল। দেখল ট্রিগারকে সূঁচ পরিমাণ নড়ানো গেল না। চোখ দু’টি ছানাবড়া হয়ে গেল তার অবাক বিস্ময়ে!
সেও সিটের নিচে ঢুকে গেল।
আহমদ মুসা গাড়ির ফ্লোরে শুয়ে ব্যাগের বাইরের পকেট থেকে লেজারগান বের করল।
লেজারগানের বডি সর্বাধুনিক প্লাস্টিক মেটাল দিয়ে তৈরি। এই প্লাস্টিক মেটাল ইস্পাতের চেয়ে কয়েক গুণ শক্ত। ইস্পাতের অণুগুলোর মধ্যে ফাঁক থাকে, কিন্তু এই প্লাস্টিকের অণুগুলোর মধ্যে কোন ফাঁক থাকে না। মনে করা হয়, এই প্লাস্টিকের ব্যবহার দিয়ে ‘এ্যান্টিম্যাটার এজ’-এর শুরে হচ্ছে।
লেজারগানটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা মাথা তোলার চেষ্টা করল।
দেখল গাড়ির জানালায় কাচের কোন অস্তিত্ব নেই। গাড়ির বডিও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তবে ডাবল লেয়ারের স্টিল বডির জীপ বলে বুলেটের ঝাঁক ভেতরে লিচের অংশের খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি।
চারদিকের চারটা উৎস থেকে গুলি আসছে, এ সম্পর্কে আহমদ মুসা নিশ্চিত হয়েছিল। তার মানে ঐ জীপের চারজন লোকই মাত্র এখানে আছে। আত্মরক্ষার জন্যে চারজনকে শামাল দিতে হবে। গুলি তখনও চলছে।
আহমদ মুসা গড়িয়ে সিটের পাশ ঘেঁষে গাড়ির পেছনের প্রান্তে চলে গেল যাতে তিনদিককে সামনে রাখা যায়। পেছনের গুলির রেঞ্জ দেখে বুঝল তারা দাঁড়িয়ে থেকে গুলি করছে।
আহমদ মুসা বিসমিল্লাহ বলে লেজারগান ডান হাতে নিয়ে ট্রিগারের বাটনে বুড়ো আঙুল রেখে হাতটা গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে যাওয়া উন্মুক্ত স্পেসের বটম লেভেলে রাখল। যে কোন মুহূর্তে হাতে গুলি খাওয়ার ভয় ছিল। কিন্তু এই ঝুঁকি নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
আহমদ মুসা লেজারগানের ট্রিগারের বাটনে বুড়ো আঙুল চেপে গাড়ির গোটা পেছন দিকের উপর ঘুরিয়ে নিল।
লেজার গানের রেডিয়েশনের স্টিমুলেটেড বিচ্ছুরণ যে লেভেল দিয়ে ঘুরে এসেছে, সে লেভেলে কেউ যদি থাকে তাহলে চোখের পলকে সে দু’খন্ড হয়ে পড়বে।
ট্রিগার টেপার পর আহমদ মুসার শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার পালা।
অপেক্ষার ফল তার সফল হলো, গাড়ির পেছন থেকে গুলি বন্ধ হয়ে গেল।
সংগে সংগে আহমদ মুসা গাড়ির সামনের দিকে ফিরে বসে এক পলকের জন্যে সিটের উপর মাথা তুলল। দেখল সামনের লোকটি তার মিনি মেশিনগান বাগিয়ে ছুটে এসে দাঁড়াল গাড়ির সামনে। তারপর সামনে ঝুঁকে পড়ে মিনি মেশিনগান ঘুরিয়ে নিচ্ছে গাড়ির ফ্রন্ট সিটের দিকে।
আহমদ মুসা বুঝল ড্রাইভার পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের পিএ তার লক্ষ।
আহমদ মুসা দ্বিতীয়বার ট্রিগারের বাটন টিপল সামনের ঐ লোকটির লক্ষে।
লোকটির মাথার পেছনের অর্ধাংশ মুহূর্তেই কোথায় হারিয়ে গেল। লোকটি লাশ হয়ে পড়ে গেল গাড়ির উপর।
পর মুহূর্তে দু’পাশের জানালায় দু’জন লোক এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা আগেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
ওরা দু’জনেই আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েছে।
ওদের মিনি মেশিনগানের নল ঘুরে আসছে।
আহমদ মুসার লেজারগান ঘুরেছে বাঁ দিকের কাচের জানালায় দাঁড়ানো লোকটির লক্ষে। লেজারগানের ট্রিগার বাটনে বুড়ো আঙুল চেপেই ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়ির মেঝের উপর। দুই জানালা থেকেই গুলির ঝাঁক ছুটে এসেছিল আহমদ মুসা লক্ষে। বাম দিকের লোকটির গুলি গোটাটাই লক্ষভ্রষ্ট হয়ে গাড়ির ছাদকে আঘাত করেছিল। তাদের ট্রিগার টেপার আগ মুহূর্তেই লেজারগানের রেডিয়েশনের স্টিমুলেটেড বিচ্ছুরণ গিয়ে আঘাত করেছিল। কিন্তু ডানদিকের লোকটির গুলি করতে তাড়াহুড়া করতে হলেও সে নির্বিঘ্নে গুলি করতে পেরেছিল। লেজারগানের ট্রিগার বাটন চাপার সাথে সাথেই মেঝেয় আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারলে তার দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে যেত। যে সিটের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই সিটের একটা কংকালমাত্র আছে শুধু, সিট আর গাড়ির বডিও উধাও! আহমদ মুসার ঘাড়ের এক খাবলা গোশতও তুলে নিয়ে গেল একটা বুলেট।
আহমদ মুসা মেঝেয় শুয়ে পড়ে ডান দিকের লোকটির গুলির হাত থেকে বেঁচে লেজার গানের টার্গেট ডান দিকের লোকটির দিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে চেষ্টা করছিল।
আহমদ মুসা শুয়ে পড়েই তার পাশের সিটের সামনে দিয়ে সোজা পেয়ে গেল জানালায় দাঁড়ানো ডান দিকের লোককে। শুয়ে পড়ার সময়ই সে ঘুরিয়ে নিয়েছিল লেজারগান। লোকটিকে দেখার পর লেজারগানের ট্রিগার বাটনে বুড়ো আঙুল চেপে বসতে সময় লাগলো না। লোকটিও শুয়ে পড়া আহমদ মুসাকে খুঁজে পেয়েছিল। গুলি বর্ষণরত তার মিনি মেশিনগানের নল দ্রুত ঘুরে আসছিল আহমদ মুসার দিকে। ক্ষিপ্রতার প্রতিযোগিতায় জিতে গেছে আহমদ মুসা। তার লেজারগানের প্রাণঘাতী সব বাধা বিলোপকারী রেডিয়েশনের স্টিমুলেটেডের গতি বুলেটের চেয়ে বহু গুণ বেশি। জানালার ঝুঁকে পড়া লোকটার প্রাণহীন দেহ জানালার উপর ঝুলে পড়ল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলও।
সে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা! এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আপনি! অস্ত্রগুলো অকেজো হবার পর বাঁচার বিন্দুমাত্র আশাও আমরা করিনি!
হঠাৎ বিস্ময় ফুটে উঠল দ্যাগলের চোখে-মুখে।
সে আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে আহমদ মুসার পেছন থেকে দু’হাত সরিয়ে সামনে নিয়ে এল। দেখল, রক্তাক্ত তার দুই হাত। বলল দ্যাগল উদ্বিগ্ন কন্ঠে, আপনি আহত মি. আহমদ মুসা? গুলি লেগেছে।
বলেই দ্যাগল আহমদ মুসার পেছনে গেল। দেখল, ঘাড়ের পাশে কাঁধের একটা অংশ থেকে জ্যাকেট উড়ে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা। বলল দ্যাগল, মি.আহমদ মুসা আপনি সাংঘাতিক আহত। তবে রক্ত দেখে মনে হচ্ছে বুলেটটা হোরিজেন্টালি আঘাত করেছিল, ভার্টিকালি নয়। গুলিটা আহত করে বেরিয়ে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
একটু থেমেই দ্যাগল তার পিএ-কে লক্ষ করে বলল, তুমি ফাস্ট এইড বক্স থেকে ইলাস্টিক ব্যান্ডেজটা নিয়ে এস। তাড়াতাড়ি।
এসবের কিছু দরকার নেই স্যার। চলুন আমরা গাড়ি থেকে বের হই। বলল আহমদ মুসা।
পিএ রেডিমেড ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ নিয়ে এসেছে।
দ্যাগল কিছু না বলে ব্যান্ডেজটি আহমদ মুসার আহত জায়গার উপর সেট করে ব্যান্ডেজের ইলাস্টিক স্কচ টেপ চারদিকে লাগিয়ে দিল।
চলুন এবার। কাছেই আমাদের নেভাল ডক ইয়ার্ড। ওখানে ভাল হাসপাতাল আছে। সার্ভিসও ভাল পাওয়া যাবে। বলল দ্যাগল।
জানালা দিয়ে বের হওয়া অসুবিধাজনক। চলুন ভাঙা উইন্ডো স্ক্রীনের ওদিক দিয়ে বের হতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
কেন এখন খুলবে না দরজা? বলল পুলিশ ড্রাইভার।
না, ম্যাগনেটিক এ্যাকশনের একটা মেয়াদ আছে, তার আগে দরজা খুলবে না। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা, এ মেটালিক জ্যামিং অস্ত্র কোত্থেকে এল? আমি তো এর নামও শুনিনি। এতো একটি সেনাবাহিনীর পুরোটাকেই অচল করে দিতে পারে। বলল দ্যাগল। তার কন্ঠে অপার বিস্ময়!
এটা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের নিজস্ব আবিষ্কার। আহমদ মুসা বলল।
সাংঘাতিক ব্যাপার। ওরা তো দেখছি আমাদের তাহিতিকেও দখল করে ফেলতে পারে। বলার সাথে সাথে চোখ দু’টি ছানাবড়া হয়ে গেল মি. দ্যাগলের!
হ্যাঁ স্যার। ওরা তো তাই চায়। শক্তি দিয়ে ওরা দুনিয়ায় শয়তানের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। কিন্তু শয়তানী শক্তি চিরদিন পরাজিত হয়েছে। সব সময় পরাজিতই হবে। আহমদ মুসা বলল।
সবাই একে একে বের হয়ে এল গাড়ি থেকে।
স্বরাষ্ট্র সচিব টেলিফোন করল পুলিশকে। আর নেভাল ডক ইয়ার্ডকে বলল গাড়ি পাঠাতে।
নেভাল ডক ইয়ার্ডের গাড়ি ও পরে পুলিশ গাড়িও এসে পৌছল।
স্বরাষ্ট্র সচিব পুলিশকে তার কাজ বুঝিয়ে দিল।
নেভাল ডক ইয়ার্ডের সবাই উঠে বসেছে।
দ্যাগলও কথা শেষ করে আহমদ মুসার পাশে উঠে বসল।
আবার ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা আপনাকে। ধন্যবাদ, লেজারগান আপনার কাছে ছিল। আপনি কি সব সময় এভাবে সব অবস্থার জন্যে প্রস্তুত থাকেন? বলল দ্যাগল।
না, তা নয়। আমি নেভাল ডক ইয়ার্ডে আসছি তাহিতি থেকে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েই। এ কারণেই আমাকে যথাসম্ভব প্রস্তুত হয়েই আসতে হয়েছে।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! যা প্রয়োজন আপনি তাই করেছেন। তবে আমাদের জন্য আপনাকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হলো। যাক, মি. আহমদ মুসা, আপনাকে কয়েক দিন তো হাসপাতালে থাকতে হবে। তারপর আপনার সেই হাতে কলমের কাজ শেখানো হবে। বলল দ্যাগল।
না জনাব, যেজন্যে এখানে এসেছি, সেই কাজের ব্যবস্থাটা আজই করুন। হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট নেয়ার পর আমি ঐ কাজগুলো দেখতে এবং করতেও পারবো। এই কাজে তো একদিন লেগেও যেতে পারে। সুতারাং আজই কাজ শুরু করতে চাই জনাব। বলল আহমদ মুসা।
দ্যাগল আহমদ মুসার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, বুঝেছি মি. আহমদ মুসা, ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের ভয়ংকর দ্বীপটা আপনাকে খুব টানছে।
না স্যার, ঠিক দ্বীপের টান নয়, ৭৬ জন বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞের মুক্তির আকুতি আমাকে অস্থির করে তুলেছে। দ্যাগলের কানে কানে বলল আহমদ মুসা।
দ্যাগলের মুখ গম্ভীর হলো। তার দৃষ্টিটা সামনের দিকে সম্প্রসারিত হলো। অনেকটা স্বগত উক্তির মতই সে বলল, আপনার কথা অনেক শুনেছিলাম, আজ দেখলাম, বুঝলাম, চিনলাম আপনাকে। আপনি সত্যিই শান্তির এক কপোত। যেখানেই মানুষ অশান্তি, সমস্যা, বিপদ, সেখানেই উড়ে যান আপনি।
কেউ উত্তর দিল না দ্যাগলের কথার। উত্তর তিনিও চাননি।
চলছে গাড়ি টিলাসংকুল বিপজ্জনক ঢালু পথে, নেভাল ডক ইয়ার্ডের দিকে।
৭
তোমরা বলতে চাও, ‘আহমদ মুসা সুপারম্যান?’ তীব্র কন্ঠ আলেক্সি গ্যারিনের।
আলেক্সি গ্যারিনের সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়েছিল জিজর ও ডারথ ভাদের। আর আলেক্সি গ্যারিনের কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়েছিল গৌরী।
জিজর ও ডারথ ভাদের কোন কথা বলল না।
আলেক্সি গ্যারিনই কথা বলল আবার।
এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, আমাদের চারজন শ্রেষ্ঠ কমান্ডো জনমানবশূন্য এক পরিবেশে মেটালিক জ্যামার দিয়ে ওদের গাড়িটাকে অচল করে দিল, তারপর অচল করে দিল তাদের অস্ত্রশস্ত্রও। এর পরে চারজন চারদিক থেকে গাড়িটার উপর আক্রমণ চালাল, কাচের বডি ভেঙে গিয়ে গাড়ি উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। তারপরেও চারদিক থেকে চারটি মিনি মেশিনগানের ডজন ডজন বুলেট গাড়ির একজনকেও মারতে পারল না। উল্টো গাড়ি থেকে চারদিকের চার লোককে একা আহমদ মুসা আক্রমণ করল, আর মারা গেল আমাদের চারজন শ্রেষ্ঠ কমান্ডো। একে আমাদের আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?
মাই লর্ড, আমরা যাকে হত্যার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছি, সম্পূর্ন হাতের মুঠোয় পেয়েও তাকে হত্যা করতে না পারা, উল্টো আমাদের সবাই তার হাতে নিহত হওয়া এটা অবিশ্বাস্য। আমি মনে করি আমাদের লোকদের অতি আত্মবিশ্বাস ও যে কোন পরিস্থিতির জন্য তৈরী না থাকার কারণেই এই বিপর্যয় ঘটেছে। আহমদ মুসার লেজারগানের অস্ত্র থাকতে পারে এটা আমরা বিবেচনায় আনতে ব্যর্থ হয়েছি। বলল জিজর নত মুখে বিনীত কন্ঠে।
তা নয়, আহমদ মুসাকে চিনতেই তারা পারেনি বারবার বলা সত্ত্বেও। আহমদ মুসার ক্ষিপ্রতা ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। গাড়ির বডির কাচের অংশ ভেঙে গাড়িকে উন্মুক্ত করার পর কোন সময় না দিয়ে চারদিক থেকে চারজন আহমদ মুসার উপে ঝাঁপিয়ে পড়লে সে পাল্টা আক্রমণের সুযোগ নিতে পারত না। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
ইয়েস মাই লর্ড। একই সংগে বলল জিজর ও ডারথ ভাদের।
তোমরা আজ যা করলে, আগামীতেও তাই কি করতে থাকবে? বলল আলেক্সি গ্যারিন। তীব্র কন্ঠ তার।
মাই লর্ড। আমাদের লোকরা যথেষ্ট প্রস্তুত না হয়েই তাদের ফলো করছিল। তাই বিষয়টি তারা কাউকেই জানায়নি। আহমদ মুসাকে যখন তারা পেয়েছে এবং তাকে ফলো করেছে, তখন তা তাহিতির হেড কোয়ার্টারে ও আশেপাশের আমাদের লোকদের জানানো উচিত ছিল। হয়তো তাতে এই বিপর্যয় রোধ করা যেত এবং আহমদ মুসাকে ফাঁদে আটকানো যেত। ভুল আমাদের কমান্ডোরা করেছে মাই লর্ড। এ রকম ভুল আর হবে না। বলল জিজর।
আলেক্সি গ্যারিন তাকাল ডারথ ভাদেরের দিকে। বলল, ঘটনার পর আহমদ মুসা কোথায়, কি করছে? এ বিষয়টা মনিটর করা হচ্ছে কি না?
ইয়েস মাই লর্ড। ঘটনার পর আমাদের লোকরা জেলের ছদ্মবেশে ঘটনাস্থল ও নেভাক ডক ইয়ার্ডে যায়। তারা জানিয়েছে, আহমদ মুসা নেভাল ডক ইয়ার্ডের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। চিকিৎসা নেয়ার পর সে এখন কোথায়, তা জানা যায়নি। তবে…।
ডারথ ভাদেরের কথার মাঝখানেই আলেক্সি গ্যারিন বলল, আচ্ছা, আহমদ মুসা, স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের সাথে নেভাল ডক ইয়ার্ডে গিয়েছিল কেন?
স্বরাষ্ট্র সচিবের সাথে আহমদ মুসার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র সচিব ফ্রান্সের লোক। আর আহমদ মুসার স্ত্রীও ফ্রান্সের রাজকুমারী। তাই স্বরাষ্ট্র সচিব আহমদ মুসাকে সম্মানের চোখে দেখেন বলে জানা গেছে। তিনিই হয়তো আহমদ মুসাকে নেভাল ডক ইয়ার্ড দেখাবার জন্যে নিয়ে যান। ডারথ ভাদের বলল।
তুমি কি বলতে যাচ্ছিলে? বলল আলেক্সি গ্যারিন জিজরকে লক্ষ করে।
ইয়েস মাই লর্ড, আহমদ মুসার বিষয়ে বলতে যাচ্ছিলাম, ঘটনার সন্ধ্যার দিকে একটা হেলিকপ্টার নেভাল ডক ইয়ার্ড থেকে পাপেতি যায়। জানা গেছে স্বরাষ্ট্র সচিব ঐ হেলিকপ্টারে পাপেতি ফিরেছেন। সবারই ধারনা স্বরাষ্ট্র সচিবের সাথে আহমদ মুসাও পাপেতি ফিরেছেন। আহমদ মুসা আহত বলেই তাকে স্বরাষ্ট্র সচিব হেলিকপ্টারে করে পাপেতি নিয়ে গেছেন। বলল জিজর।
আহমদ মুসা আহত হয়েছে নিশ্চয় ঐ ঘটনায়। তাহলে তো আমাদের কমান্ডোরা তাকে আঘাত হানতে পেরেছিল। কি রকম আহত, কতটা আঘাত সে পেয়েছে? খোঁজ নাও। নিশ্চয় পাপেতিরই কোন এক হাসপাতালে সে থাকবে।
হাসপাতালে সে নাও থাকতে পারে মাই লর্ড। কোন বাড়িতে রেখেও তার চিকিৎসা হতে পারে। বলল গৌরী। এই প্রথম কথা বলল সে। তার মনও চাচ্ছিল যে, কোন হাসপাতালে আহমদ মুসা না থাকুক। কারণ পাপেতির হাসপাতালগুলোতে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা কোনটাই নেই। তার মনের এই চাওয়াটাই প্রকাশ হয়ে পড়েছে তার কথায়। মনের এই চাওয়াটায় চমকে উঠল সে। কেন সে আহমদ মুসার নিরাপত্তা চাইবে?
গৌরীর মনের এই বিব্রত অবস্থা বেশি দুর এগোতে পারল না। কথা বলল আলেক্সি গ্যারিন, গৌরী ঠিক বলেছে। শুধু হাসপাতাল খুঁজলে হয়তো তাকে পাওয়া যাবে না। আসলে আহমদ মুসাকে কোন বাড়িতে রাখার সম্ভাবনাই বেশি।
কিন্তু মাই লর্ড। আহমদ মুসা এ পর্যন্ত হোটেলেই থেকেছে। তাহিতি সরকার তাকে কোন বিশেষ মর্যাদা দিলে সরকারি আতিথ্যে রাখতো। হতে পারে স্বরাষ্ট্র সচিবের সাথে তার সম্পর্কটা পারসোনাল। বলল ডারথ ভাদের।
তোমার কথা সত্য হলেও তার কোন বাড়িতে থাকার সম্ভাবনা রদ হয় না। হোটেল নিরাপদ নয় দেখেই তো সে কয়েক দিন বাড়িতেই আত্মগোপন করে থাকছে। অতএব, বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেবে এটাই স্বাভাবিক।
বলে একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন। একটু ভেবে আবার শুরু করল, তাকে খুঁজে পাওয়ার কাজটা একটু কঠিনই হয়ে গেল। হাসপাতালে থাকলে আমাদের কাজ সহজ হতো। যাক, সে আহত এটা আমাদের জন্যে একটা বড় খবর। অবশ্যই সে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই সুযোগকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, তাকে আমরা খুঁজে বের করবই।
শুধু পাপেতি নয়, পাপেতির আশেপাশের বসতিগুলোকেই আমরা টার্গেট করেছি। পাহাড় ও উপকূলের হোটেল-মোটেল, রেষ্ট হাউস, মেস সব আমাদের টার্গেটের ভেতরে। আমরা প্রতি ইঞ্চি মাটি সার্চ করব এবং সেটা একই সাথে শুরু করবো। যে অঞ্চল সার্চ হবে, সেখানে গিয়ে আবার যাতে আশ্রয় নিতে না পারে, এজন্যে সে অঞ্চলকে আমরা পাহারায় রাখব। আর আমরা যে সার্চ করেছি তাকে, সেটা সে বুঝতেই পারবে না। বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, হোম সার্ভিস কোম্পানী ইত্যাদির নামে বিভিন্ন প্রয়োজন ও অজুহাতে সার্চ চলবে। এর মধ্যে কারও সন্দেহ করার কিছুই থাকবে না। আমাদের প্রায় সব জনশক্তিকেই তাহিতিতে এই কাজে নিয়োগ করা হবে। আমাদের এই ক্যাপিটাল অব পাওয়ার থেকেও লোক নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারাই নেতৃত্ব দেবে এই সার্চে। যে কয়দিন সার্চ চলবে, সে কয়দিন আমাদের ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে বিজ্ঞানীদের কাজ বন্ধ থাকবে। তারা তাদের ক্যাপসুলে তালাবদ্ধ থাকবে। ম্যাডাম গৌরীর নেতৃত্বে রুটিন পাহারা ও ডিউটির জন্যে একটা ছোট দল থাকবে মাত্র ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে।
একটু থামল জিজর। থেমেই আবার বলল, মাই লর্ড, মোটামুটিভাবে এটাই আমাদের চিন্তা। প্ল্যানের আরও ডিটেইলডটা আমরা তাহিতিতে বসেই করব।
তোমাদের চিন্তা ঠিক আছে জিজর। ম্যান পাওয়ার প্ল্যানিংটাও ঠিক আছে। এক এলাকায় এক সাথে সার্চ। আবার সার্চ হওয়া এলাকায় পাহারা বসানো। অনেক লোক তো লাগবেই। কিন্তু এই কাজে তোমরা কয়দিন সময় নেবে? বলল আলেক্সি গ্যারিন।
দু’দিনের বেশি নয়, মাই লর্ড। রাত-দিন ২৪ ঘন্টা আমাদের সার্চ চলবে। বলল জিজর।
ও কে। মনে রেখ আর কোন ব্যর্থতা আমি বরদাশত করবো না। কার কি পরিচয় আমি বুঝি না, মানি না। সাফল্যের বাইরে আমার আর কোন বিবেচনা নেই। ওকে। উইশ ইউ গুড লাক।
বলে আলেক্সি গ্যারিন গৌরীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একটু পর এস।
আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই তার চেয়ারটা পিছু হটে পেছনের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে গেল।
জিজর ও ডারথ ভাদেরও গৌরীকে ‘গুড নাইট’ বলে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।
গৌরী তার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ২টা। ক্লান্তির একটা হাই উঠল তার মুখ থেকে। তার শয়নকক্ষের সুন্দর বেড তার ক্লান্ত শরীরকে ডাকছে। কিন্তু উপায় নেই। তার ‘মাই লর্ড’ আলেক্সি গ্যারিন তাকে ডেকেছে।
বিক্ষোভের একটা বিচ্ছুরণ ঘটল গৌরীর চোখে-মুখে। কিন্তু উপায় নেই।
কোন আইন, নীতি-নিয়ম নয়, সে ইচ্ছার দাস। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, সে থ্রীল ও ঝুঁকি পছন্দ করতো। বড় কিছু করার জন্যে, বড় ঝুঁকি নেয়া যাবে, সে এমন ধরনের একটা জীবন চাইতো। কিন্তু এই জীবন তো সে চায়নি, যে জীবনে নারীত্ব, ব্যক্তিত্বের কোন সম্মান থাকবে না, যে জীবন হবে স্বেচ্ছাচারের অধীন। সে আগে কেন দেখা পায়নি আহমদ মুসার মত লোকের। তার জীবনে অনেক, অনেক বড় কাজ আছে, থ্রীল আছে, ঝুঁকি আছে, কিন্তু সেই সাথে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও মনুষ্যত্ব আছে। এমন জীবনই তো সে চেয়েছিল।
গৌরীর এ ভাবনার মধ্যেই তার পা গিয়ে উঠল লাল এলিভেটরে যা তাকে নিয়ে যাবে আলেক্সি গ্যারিনের কাছে।
আহমদ মুসার অনুমান ঠিক প্রমানিত হলো। তাহানিয়া অ্যাটলের পশ্চিম উপকূলের দক্ষিণ প্রান্তে যে সরবরাহ কেন্দ্র, সেটাই হলো ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ মতুতুংগা অ্যাটলের রহস্যের সিংহদ্বার।
আহমদ মুসা তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগলের সৌজন্যে পাওয়া আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল ‘সীবেড ক্যাপসুল’ চালিয়ে এসে অবস্থান নিয়েছিল তাহানিয়া অ্যাটলের সেই সরবরাহ কেন্দ্রের সামনে উপকূল ঘেঁষে পানির নিচে। তার রাডার ও ক্যামেরা রেসিস্ট্যান্ট পোষাক আপাদমস্তক খোলসের মত পরে নিয়ে পানি থেকে উপকূলে উঠেছিল এবং গড়িয়ে পৌছেছিল গিয়ে সরবরাহ কেন্দ্রের নিচে, একদম দরজার গোড়ায়।
শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা মাথা তুকে দেখেছিল, কোন আলো কোথাও জ্বলছে না, কেউ কোথাও নেই। দৃষ্টি সীমার মধ্যে সমুদ্রেও কোন আলো দেখতে পায়নি। ডান হাতের চেইন খুলে হাতঘড়ি বের করে রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখল হিউম্যান ওয়াচ ইন্ডিকেটর গ্রীন সিগনাল দিয়ে যাচ্ছে। তার মানে এখান থেকে দশ বর্গগজের মধ্যে কোন মানুষ নেই।
সরবরাহ কেন্দ্রের দরজা স্টিলের। ডবল লক করা।
আহমদ মুসা নিশ্চিত ছিল, সরবরাহ কেন্দ্রের ভেতরে-বাইরে দু’দিকেই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আছে। কিন্তু যেহেতু গায়ে ক্যামেরা রেসিস্ট্যান্ট পোষাক আছে, সেজন্য উঠে দাঁড়িয়ে সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার দিয়ে গুলি করে দু’টি তালাই ভেঙে ফেলল।
সরবরাহ কেন্দ্রটি এয়ারকন্ডিশন করা।
ঘরে সোফার সারি। তার সাথে কয়েকটা ডীপ ফ্রিজ ও কয়েকটা সেলফ। শাক-সবজি থেকে আটা-চাল, মসলাপাতি সবই সাজানো সেলফগুলোতে। ডীপ ফ্রিজগুলোও খুলে দেখল আহমদ মুসা। নানা রকম নাছ-গোশত ও ডেয়ারি দ্রব্যে ভরপুর ডীপ ফ্রিজগুলো। আহমদ মুসা নিঃসন্দেহে স্বীকার করে নিল, ক্যামোফ্লেজ নয়, এটা সত্যিই সরবরাহ কেন্দ্র এবং এটাও বুঝে নিল, এ সঞ্চয়গুলো মতুতুংগা অ্যাটলের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ – এর জন্যই।
কিন্তু রহস্যের দরজা কোথায়?
সরবরাহ কেন্দ্রের বিশাল ঘরটা তন্নতন্ন খুঁজে কিছুই পায় না সে। এক জায়গায় দু’টি রেফ্রিজারেটরের মাঝখানে ফাঁকা দেয়াল দেখতে পায়। অস্বাভাবিক মনে হয় দেয়ালটাকে। হাতের রিভলবার দিয়ে টোকা দেয় স্টিলের পরে। একটা হালকা ধাতব শব্দ হয়। তার মানে ওটা দেয়াল নয়, স্টিলের কিছু, দরজাই হবে হয়তো।
দু’টি রেফ্রিজারেটরের মাঝের স্পেসটা একজন মানুষের সাধারণভাবে চলাচলের জন্য যথেষ্ট নয়।
নিজেকে সংকুচিত করে আহমদ মুসা দেয়ালের নিকটে পৌছে চাপ দেয় দরজা আকারের স্টিলের পাল্লার উপর। সংগে সংগে খুলে যায় পাল্লা। পুরোপুরিই একটা দরজা এটা।
দরজা খুলে গেলে আহমদ মুসা দেখতে পায়, ওপারে আরও বড় একটা ঘর। গোটাটাই একটা কোল্ডস্টোরেজ। সেখানে আলু, টমেটো, বীট, গাজর ইত্যাদির স্তূপ।
কক্ষটি অনেকখানি নিচু। প্রায় পাচ-ছয়টা ধাপ পেরিয়ে কক্ষটিতে নামতে হয়। কক্ষটিতে নামে আহমদ মুসা।
ঘরটিতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিশাল সংগ্রহ দেখে বিস্মিত হয় না আহমদ মুসা। ‘ ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ অর্থাৎ মতুতুংগার প্রাসাদে শুধু বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞই বন্দী আছে ৭৬ জন। এঁরা ছাড়াও তো সেখানে আরও লোক আছে। সুতরাং তাদের জন্য খাবারের এ ধরনের বড় আয়োজন তো থাকবেই হবে।
কিন্তু রহস্যপুরীতে ঢোকার সিংহদ্বারটা কোথায়? খুঁজতে শুরু করে আহমদ মুসা।
ঘরের চারিদিকের দেয়াল ঘেঁষে বড় বড় ডীপ ফ্রিজের সারি। আর মাঝখানে মেঝেতে রাখা আলু, টমেটো ইত্যাদির স্তুপ।
ডীপ ফ্রিজগুলো একের পর এক খুলে ভেতরটা দেখতে থাকে আহমদ মুসা। সেগুলো আগের মতই মাছ, গোশত, ডেয়ারি পণ্যে ঠাসা। দুই ঘরের পার্টিশন ওয়ালের পাশ ঘেঁষে রাখা একটা বড় ডীপ ফ্রিজার খুলে আহমদ মুসা দেখে, ফ্রিজটা অন্যগুলো থেকে একটু ভিন্ন। ডীপ ফ্রিজের মাঝামাঝি বরাবরের মতই কিছু উপরে, কিছু নিচে মানে পুরো আয়তন জোড়া একটা ট্রের উপর টিনজাত খাদ্য সাজানো। ট্রের নিচে গোটা ফ্রিজটাই খালি। ডীপ ফ্রিজের তলা সবচেয়ে বিস্ময়ের ঠেকেছিল আহমদ মুসার কাছে। তলাটা মেটালিক নয়! পুরোটাই যেন একটা শ্বেত পাথর! পাথরটির চার প্রান্তই ডীপ ফ্রিজটির চারদিকের ওয়াল থেকে কিছুটা আলগা অর্থাৎ ডীপ ফ্রিজের আয়তনের তুলনায় সাদা পাথরটি ছোট। তাছাড়া এর উত্তর প্রান্তের মাঝখানে একটা বড় সাদা কাপ উপুর করে রাখা। কাপটা মনে হচ্ছে প্লাস্টিকের।
এই অস্বাভাবিকতা আকর্ষণ করে আহমদ মুসাকে। ট্রেটি তুলে নেয় ডীপ ফ্রিজ থেকে। তারপর ঢুকে যায় ডীপ ফ্রিজের মধ্যে। ঠিক তলাটি সলিড শ্বেত পাথরের। আহমদ মুসা কাপটি তুলে নেয়। অমনি তার নজরে পড়ে কাপের নিচের সাদা রিংটি। রিংটি শ্বেত পাথরের প্লেটটার সাথে আটকানো।
আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে আহমদ মুসার মুখ। এটাই তাহলে সিংহদ্বার!
আহমদ মুসা এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে রিং ধরে টেনে তুলে ফেলে পাথরটাকে।
আনন্দ-বিস্ময়ে চোখ দু’টি বিস্ফারিত হলো আহমদ মুসার। তার সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে একটি সিঁড়ি পথ।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। খুশি হলো। তার অনুমান সত্য তা প্রমাণিত হতে চলেছে। এই সরবরাহ কেন্দ্রের মধ্যেই রয়েছে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ মতুতুংগা অ্যাটলের রহস্যের সিংহদ্বার।
আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে গ্যাস মাস্কটা বের করে মুখে লাগিয়ে সিঁড়িতে নেমে গেল। সিঁড়িটা পরিচ্ছন্ন ও আলোকিতও।
সিঁড়িমুখের পাথর আবার সিঁড়ি মুখে সেট করল আহমদ মুসা।
দেখা যাচ্ছে সিঁড়িটা অনেক দুর পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। সাদা পাথরের সিঁড়িকে শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সিঁড়ি যেখানে শেষ সেখান থেকে রাস্তাটা সমতল হয়ে সামনে এগিয়েছে।
আহমদ মুসা যাত্রা শুরুর আগে ডান হাতের রিস্টওয়াচের হিউম্যান ইন্ডিকেটর, বিস্ফোরক ও মেটাল ইন্ডকেটর সব ঠিক আছে একবার দেখে নিল। মুখের গ্যাস মাস্কও ঠিক আছে কিনা দেখল। কাঁধে ঝুলানো তার সাইলেন্সার মিনি মেশিনগান। ডান হাতে লেজারগান।
নিজেকে প্রস্তুত দেখার পর আহমদ মুসা নজর দিল সিঁড়ি ও দু’পাশের দেয়ালের দিকে।
সিঁড়ি সাদা পাথরের। প্রতিটি সিঁড়িতে রয়েছে তিনটি করে পাথর। তিনটি পাথরই একটি অন্যটি থেকে আলগা। সব ধাপে একই অবস্থা।
সিঁড়ির দু’পাশের দেয়ালেও পাথর বসানো। বিভিন্ন রঙের। দেয়ালের মাঝ বরাবর পাথরগুলো সবই কালো। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, কালো পাথরের মাঝটায় রাউন্ড করা অনেক ফুটো। প্রতিটি কালো পাথরে এই একই রকম ডিজাইন। সিঁড়ির ছাদটার প্লাস্টার সাদা রঙের।
সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে আহমদ মুসা আরও একবার ভেবে নিল, সিঁড়ি পথে নিরাপত্তামূলক কি কি ব্যবস্থা থাকতে পারে। পাহারায় লোক থাকতে পারে। সিঁড়ি পথে বিস্ফোরকও পেতে রাখতে পারে। হয়তো তারা সিঁড়ির নির্দিষ্ট রুটে চলে। এর বাইরে গেলেই বিস্ফোরকের ফাঁদে পড়তে হতে পারে। শত্রুর আগমন টের পেলে ওরা বিষাক্ত গ্যাস বোমাও ছুঁড়তে পারে সিঁড়ি ও সুড়ঙ্গে। এছাড়া আর কি ব্যবস্থা সুরঙ্গ পথের নিরাপত্তার তা জানা নেয় আহমদ মুসার। তবে তাকে এই অবস্থায় হিউম্যান ওয়াচ মনিটর (HWM) ও মেটাল বিস্ফোরক ডিটেক্টরের নির্দেশনা সামনে রেখেই চলা ছাড়া উপায় নেই।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল আহমদ মুসা।
কতকগুলো ধাপ নামার পর অনেকটা নিশ্চিন্তই হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসা।
হঠাৎ বিপ বিপ শব্দ হলো ডান হাতের রিষ্টওয়াচ থেকে। হাত ঘুরিয়ে রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেটাল ও বিস্ফোরক ইন্ডিকেটর লাল সিগন্যাল দিচ্ছে।
সংগে সংগে দাঁড়িয়ে গেল আহমদ মুসা।
এখান থেকে কয়েক গজের মধ্যে কোথাও মেটালিক কিছু বা বিস্ফোরক আছে। ইন্ডিকেটর মেটাল ও বিস্ফোরক দু’য়েরই উপস্থিতির সংকেত দিচ্ছে।
কিন্তু সিঁড়ি, সিঁড়ির দু’পাশের দেয়াল ও সিঁড়ির উপরের ছাদ সবই ত আনেকদুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে পরিস্কার! কিছু কোথাও নেই। তাহলে সিগন্যাল আসছে কেন?
আহমদ মুসা চোখ উপরে তুলল, ছাদের দিকে। বিপ বিপ শব্দ কিঞ্চিত কমে গেল। বুঝল আহমদ মুসা, ইন্ডিকেটরটা বিস্ফোরক বা মেটালের উৎস থেকে একটু দূরে সরে গেছে।
ইন্ডিকেটরের বিপ বিপ শব্দ উৎসের যত কাছে যায় তত বাড়ে, দূরে সরলে কমে।
আহমদ মুসা এবার ডান হাতটা পাশের দেয়ালের দিকে নিল। আওয়াজ বেরে গেল বিপ বিপ শব্দের।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, কাছেই দেয়ালের কোথাও বিস্ফোরক বা এ জাতীয় কিছু লুকানো আছে। লুকানো আছে কেন? এর ব্যবহার তাহলে কিভাবে হবে?
আহমদ মুসা লুকানো জায়গাটাকে সঠিকভাবে লোকেট করার জন্য রিস্টওয়াচ পরা ডান হাত সিঁড়ির দেয়ালের আরও সামনে এগিয়ে নিল। এগিয়ে নিতে গিয়ে তার বাম পাতা সিঁড়িতে রাখার সাথে সাথেই তা দেবে গেল সামান্য। দেহের ভারসাম্য হারিয়ে আছড়ে পড়ার মত উপরের সিঁড়িতে বসে পরল।
ঠিক যে সময় আহমদ মুসার দেহ উপরের সিঁড়িতে বসে পড়ছিল, তখন সিঁড়ির দু’পাশের দেয়াল থেকে এক পশলা গুলির বৃষ্টি সিঁড়ির মাঝের দিকে ছুটে এল। মাঝখানে কোন টার্গেট না পাওয়ায় গুলির পশলা পরস্পর বিপরীত দিকের দেয়ালে গিয়ে আঘাত করল। গুলিগুলো নিঃশব্দে এসেছিল।
বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখল আহমদ মুসা এই দৃশ্য। নিচের ধাপে পা রেখে যদি সে দাঁড়িয়ে যেত ধাপটির উপর, তাহলে বুকের দু’পাশের দুই পাঁজর দিয়ে গুলির ঝাঁক তার বুকে ঢুকে যেত। অদ্ভুত পরিকল্পনা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের।
মুখের গ্যাস মাস্ক ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে সিঁড়ির অবশিষ্ট অংশ ক্রলিং করে নামার সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা।
সিঁড়ির গোঁড়ায় এসে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
সামনের দিকে তাকাল। সুড়ঙ্গের মেঝেটা একই রকমের কংক্রিটের এবং নিট-ফিনিশিং করা। কোন বিশেষ বিশেষত্ব চোখে পড়ল না।
সুড়ঙ্গটা টিউবের মত, শুধু মেঝেটাই সমতল। মেঝে ছাড়া অর্ধ বৃত্তাকার অংশটি প্লাস্টার করা। এখানেও কোন কিছু তেমন আহমদ মুসার নজরে পড়ল না।
বিসমিল্লাহ বলে রিস্টওয়াচের ইনডিকেটরের দিকে নজর রেখে চলতে লাগল আহমদ মুসা।
এক জায়গায় এসে সুড়ঙ্গের একটা ছোট বাঁক। বাঁকে মাথার উপরের বাল্বটা খুবই উজ্জ্বল। বাঁক নেয়ার জন্যেই কি এটা! হতে পারে।
কিন্তু কয়েক ধাপ এগোলেই মেটাল ইনডিকেটর সাংঘাতিকভাবে বিপ বিপ করতে লাগল, অনেকটা চিৎকারের মত।
সংগে সংগে দাঁড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসা।
ডান হাতটা সব দিকে ঘুরিয়ে ইনডিকেটর পরীক্ষা করে দেখল, বিপ বিপ- এর তীব্রতা উপর দিকে বেশি, মনে হলো কেন্দ্রটা উজ্জ্বল বাল্বের দিকে। কিন্তু বাল্ব বরাবর গোটা সুড়ঙ্গেই ইনডিকেটর বিপ বিপ সিগন্যাল দিচ্ছে।
আহমদ মুসা বাল্বের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখল বাল্বের হোল্ডারটা স্টিলের। সুড়ঙ্গে এ পর্যন্ত দেখা সব বাল্বের হোল্ডার প্লাস্টিকের।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, বাল্বের হোল্ডারের কারনেই ইনডিকেটরের এই বিপ বিপ। কিন্তু এত বড় স্টিল হোল্ডারে এত বড় বাল্ব কি এই বাঁকের জন্যে দেয়া হয়েছে? এর কোন সদুত্তর সে খুঁজে পেল না।
আহমদ মুসা চলতে শুরু করল।
বাল্বের ঠিক নিচে পৌঁছাতেই বাল্বটার বিস্ফরন ঘটল। সংগে সংগে হালকা এক প্রকার গ্যাসে আহমদ মুসার চারিদিকটা ভরে গেল।
বিস্ফোরণের আকস্মিকতায় চমকে উঠেছিলো আহমদ মুসা। বুঝে নিয়েছিল কি ঘটেছে। সংগে সংগে বাড়তি সতর্কতার জন্যে মুখের গ্যাস মাস্কের ইলাস্টিক বাটন ঠিক আছে কিনা দেখে নিল।
সংগে সংগেই আবার হাটা শুরু করল আহমদ মুসা।
কয়েক গজ হাটার পর দেখল গ্যাস মাস্কের স্ক্রিনে ইয়েলো রঙ আর নেই। আহমদ মুসা বুঝল, প্রাণঘাতী গ্যাস স্পোক শুধু বাল্বের নিচে আসা শত্রুদের মারার জন্যে কয়েক গজের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে।
চলা অব্যাহত রাখল আহমদ মুসা।
ভাবল, দুই ফাঁদ সে পার হয়েছে। আর কি ফাঁদ পাতা আছে সামনে?
আরও ভাবল, সুড়ঙ্গে তারা কোন প্রহরী রাখেনি তো! তারা তাদের পাতা ফাঁদের উপর নির্ভর করেছে। আহমদ মুসা মন মনে সেই সাথে স্বীকার করল, তাদের ফাঁদগুলো বিস্ময়কর ধরনের নতুন, যা থেকে বাঁচা আল্লাহর সাহায্যেই শুধু সম্ভব। প্রথম ফাঁদের ক্রস ফায়ার থেকে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছেন। আর এই বিশেষ গ্যাস মাস্ক তার কাছে ছিলনা, এটা সে পেয়েছে ওপরের সরবরাহ কেন্দ্রে। এটাও আল্লাহর সাক্ষাত সাহায্য।
সুড়ঙ্গ পথ শেষ হল।
এবার সিঁড়ি পথে উপরে উঠতে হবে।
সিঁড়িতে পা দেবার আগে আহমদ মুসা সিঁড়ির দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। এ সিঁড়ি পথটা আগের চেয়ে ভিন্ন। সাদা পাথরের সিঁড়ি। সাদা পাথরের মধ্যে এখানে ওখানে ঘন কালো পাথর বসানো। কালো পাথরগুলো শৃঙ্খলার সাথে বসানো নয়, বিক্ষিপ্ত ও কালো পাথরগুলো আকারেও এক রকম নয়। মোজাইকে এমন পাথর বসানোর নজির আছে। বলা যায়, মোজাইকের ডিজাইনই এখানে অনুসরন করা হয়েছে এবং সন্দেহ নেই তা সৌন্দর্যেরও সৃষ্টি করেছে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল আহমদ মুসা। চারিদিকে বিশেষ করে সিঁড়ির দিকে ভাল করে চোখ রেখেছে আহমদ মুসা।
সিঁড়ির প্রায় অর্ধেকটা পথ উঠেছে।
এখানে একটা ধাপে পা চেপে অন্য পা উপরের ধাপে ওঠাবার জন্যে তুলল আহমদ মুসা। শরীরের পুরো ওজন যখন নিচের পায়ের উপর পড়ল। তখন পা রাখার জায়গাটা অল্প দেবে গেল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা! কিন্তু কিছু করার সময় ছিল না।
পারল শুধু নিচের পায়ের উপর শরীরটাকে রেখে নিচে নামিয়ে নিতে। তাতে নিচের ধাপের উপর পায়ের উপর চাপ আরও বাড়ল।
নিচের ধাপে পায়ের একটা আঘাত টের পেয়েছে সে। আঘাতটা তার জুতার সোলে। তীক্ষ্ণ একটা শব্দও তার কানে এসেছে।
মুহূর্ত কয়েক অপেখা করে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল উপরের ধাপে। নিচের ধাপে রাখা পা তুলে আহমদ মুসা দেখল, স্টিলের একটা স্পোক ঢুকে গেছে জুতার সোলে। স্পোকটার আধা ইঞ্চির মত অংশ বাইরে বেরিয়ে আছে। বুঝল, স্পোকটা জুতার সোলের প্রথেমে রাবার, পরে চামড়ার অংশ ভেদ করে গিয়ে আটকা পড়েছে সোলের স্টিলের অংশে। জুতাটি বিশেষভাবে তৈরি। স্টিলের একটা প্লেট জুতার গোড়ালি থেকে আগা পর্যন্ত জুড়ে দেয়া আছে।
আহমদ মুসা হাতে গ্লাভস লাগিয়ে টেনে বের করল স্পোকটি। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ স্পোকটির আকৃতি দেখেই বুঝল, বিশেষ অস্ত্রের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এটা। স্পোকটি বিষাক্ত হবে নিশ্চয়।
আহমদ মুসা গ্যাস মাস্কের একটা বোতাম টিপে একটা বিশেষ স্ক্রিন চোখের সামনে নিয়ে এলো। এই স্ক্রিনের সামনে এনে স্পোকটি পরীক্ষা করল আহমদ মুসা। নিশ্চিত হলো, স্পোকটি গোটাই বিষাক্ত। জুতার সোলে স্টিলের প্লেট না থাকলে এই স্পোকটি আঘাত করত পায়ের তালুতে। প্রাণঘাতী বিষে সংগে সংগেই মৃত্যু নেমে আসত।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা।
তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব দ্যাগল তাকে জুতাটি প্রেজেন্ট করেছে এই অভিযানের জন্যে। এই জুতার আরও কার্যকারিতা রয়েছে। আহমদ মুসারও এই ধরনের একটা জুতা ছিল। কিন্তু সে জুতাটি সে হারিয়ে ফেলেছে হোটেল লা ডায়মন্ড ড্রপে আসার পর।
নিচের ধাপের যে জায়গা থেকে স্পোকটি বেরিয়ে এসেছে, সেটাও পরীক্ষা করল আহমদ মুসা।
নিচের ধাপের যেখানে পা রেখেছিল, তাও সেট করা একটা কালো পাথরের উপর। এটা কালো পাথরটির মাঝের প্রায় গোটা অংশই জুড়ে রয়েছে। পাথরতিতে দুই সারি ছিদ্র। ছিদ্রগুলোও কালো। কালো পাথরের সূক্ষ্ম কালো ছিদ্রগুলো দাঁড়ানো অবস্থায় সাধারনত চোখে পড়ার মত নয়।
আহমদ মুসা মনে মনে বলল, অদ্ভুত সব ফাঁদ পেতে এঁরা এদের সুড়ঙ্গ পথকে সুরক্ষিত করেছে! মানুষের শক্তিকেও এরা বদলে দিয়েছে যান্ত্রিক কৌশলের ভয়াবহতা দিয়ে। ভেতরের অবস্থা আরও কতটা ভয়াবহ জানি না!
হাঁটা শেষ করে সিঁড়ির স্ট্যান্ডিং-এ উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। মুখোমুখি হলো একটা বড় দরজার। সলিড স্টিলের দরজার দু’পাশটাই দু’পাশের দেয়ালে ঢুকে পড়েছে, , উপর ও নিচের অংশটাও একই রকম।
দরজার চারপাশটা আহমদ মুসা খুটে খুটে দেখল।
দরজা খোলার ক্লু খুঁজছে সে। নিশ্চয় কোথাও সে ক্লু আছে। কোথায় সেটা?
হঠাৎ আহমদ মুসা দেখতে পেল দরজার মাথার সমান উঁচুতে স্টিলের গায়ে স্টিল কালারের মার্বেলের মত গোলাকার টাচ লকের ক্যালকুলেটর বোর্ড। চারদিক খুঁজল, আশেপাশে কিংবা দরজার অন্য কোথাও এ ধরনের কিছু নেই।
নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা, দরজা খোলার লক এটাই।
কিন্তু এর অপারেটিং সিস্টেম কেমন? এ টাচ লকে ক্যাল্কুলেট বা কম্পিউটারের মত ডিলিট, অ্যাড, মাইনাস ইত্যাদির মত কোন অপশন নেই। শুধু রয়েছে এক থেকে শূন্য পর্যন্ত নাম্বার।
এই অবস্থায় ডিজিটাল লক বিপজ্জনক হতে পারে। টাচ করলে যে নাম্বার উঠবে, তা ডিলিট করা সম্ভব হবে না। আর সে নাম্বার বা নাম্বারগুলো যদি সঠিক কোড না হয়, তাহলে দরজা খোলার আর সুযোগ থাকবে না।
এই প্রথম একটা উদ্বেগ এসে আহমদ মুসাকে আচ্ছন্ন করল।
ঘড়ি দেখল আহমদ মুসা। রাত ৮টা। তার সব কাজ রাত ১২টার মধ্যেই শেষ করতে হবে।
রাত ১২টা পর্যন্ত ঘুমায় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এই ক্যাপিটাল অব পাওয়ার। এদের ঘুম শুরু হয় সন্ধ্যা ৬টায়। এসব কথা সে শুনেছে তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মফ ফ্লেরির কাছ থেকে।
উদ্বেগ নিয়ে দরজাকে পাশে রেখে বসে পড়ল আহমদ মুসা। বুঝতে পারল সে, সুড়ঙ্গ ও গেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে এতটাই নিশ্চিত করেছে যে, প্রহরী রাখারও প্রয়োজন হয়নি।
বসেই আহমদ মুসা হাত বাড়াল দরজার গোড়ায় দরজা ও ফ্লোরের মাঝখানে যে সংকীর্ণ ফাঁক রয়েছে সেখানে।
বসার সময়ই সে দেখতে পেয়েছে দরজা ও ফ্লোরের প্রান্তটির মাঝখানের ফাঁকে ঠিক দরজার রঙেরই একটা ভাজ করা কাগজ।
একটা আঙুল দিয়ে কোনমতে তুলে নিল ভাঁজ করা কাগজ খণ্ডটি। দ্রুত কাগজ খণ্ডটির ভাঁজ খুলল আহমদ মুসা।
৮ সেন্টিমিটারের মত বর্গাকৃতির একটা কাগজ। শুরুতেই একদম টপে এক পাশে ছোট একটা বৃত্ত। তাও স্টিল কালারের। তার পাশে সমান্তরালে অনেক ডিজিট। তার নিচে একটা রঙিন ডায়াগ্রাম। ডায়াগ্রামটি শুরু হয়েছে বটম থেকে। লাল ও সবুজ দু’টি রেখা। সবুজ রেখাটি বাম পাশে বেঁকে নিচের দিকে গেছে তারপর শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছে সবুজ রেখাগুলোর মাথায় শৃঙ্খলিত মানুষের রেখাচিত্র। লাল লেখাটি উপরে উঠে গেছে।লাল রেখাটি শেষ হয়েছে একটা রেখাচিত্রের সামনে। রেখাচিত্রটির মাথায় রাজমুকুট। আহমদ মুসার চোখে-মুখে বিস্ময়।
এই বিস্ময় নিয়েই আহমদ মুসা কাগজ খণ্ডটি আর উপরের ডিজিটাল নাম্বারের উপর আবার নজর দিল।
আহমদ মুসার মনে হলো, এই কাগজের সাথে এই দরজার সম্পর্ক আছে। তা না হলে কাগজটি এখানে থাকবে কেন, তার রংও দরজার মতই হবে কেন?
ডিজিটাল নাম্বারের পাশে বৃত্তকে দরজার ডিজিটাল লক এবং পাশের নাম্বারকে লক খোলার ডিজিটাল কোড হিসেবে ধরে নিল।
কিন্তু নিচের ডায়াগ্রামটা?
এরও অর্থ আছে। কি সেই অর্থ?
মানুষের শৃঙ্খলিত রেখচিত্র কি বিপদ্গ্রস্ত মানুষের মানে বিজ্ঞানীদের বুঝানো হয়েছে? কিন্তু রাজমুকুটওয়ালা রেখাচিত্রটি কার? এ কি ক্যাপিটাল অব পাওয়ার, অন্য কথায় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের কি সর্বময় কর্তার? আর লাল-সবুজ রেখার তাৎপর্য কি? সবুজ কি শান্তি, আর লাল কি অশান্তি বা অত্যাচারের প্রতীক? এ প্রতীকটা তো মোটামুটি সকলেরই জানা! এটা এখানে দেখাবার অর্থ কি?
আহমদ মুসা অবশেষে ভাবল ভেতরে না ঢুকলে এ সবের অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আহমদ মুসা আবার ফিরে এল ডিজিটাল নাম্বারের কাছে। বৃত্ত ও ডিজিটাল নাম্বারগুলো সম্পর্কে তার ভাবনাটা ঠিক হলে টাচ লকটি একটা ডিজিটাল লক। কোড নাম্বারগুলো টাইপ করলেই দরজা খুলে যাবে।
কিন্তু লক খুলে যাক এটা চাচ্ছে কে? কে তাকে এটা সরবরাহ করল? কেন?
এর কোন উত্তর আহমদ মুসার জানা নেই।
এটা তার জন্যে একটা ফাঁদ কিংবা দরজা খোলা অসম্ভব করে তোলার একটা কৌশল নয় তো?
এরও কোন উত্তর জানা নেই আহমদ মুসার।
কি করার আছে এখন আহমদ মুসার?
ডিজিটাল নাম্বারটির দিকে আবার তাকাল আহমদ মুসা।
১৮ ডিজিটাল নাম্বারটি কিছুটা মজার। ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সিরিয়ালি লেখা হয়েছে। তারপর এ ডিজিটগুলোকেই উল্টোভাবে সাজানো হয়েছে, নাম্বারগুলো আবার ৯ থেকে ১ পর্যন্ত লেখা। এই ১৮ ডিজিটকে এই সিরিয়ালে ১ শুরুতে বা বটমে রেখে ক্লকওয়াইজ সাজালে ক্লকবৃত্তের বটমে থাকে ডবল ১ এবং শীর্ষে থাকে ডবল ৯, সর্বোচ্চ নাম্বারের জোড়া যার যোগফল আঠার এবং বেজোড় সংখ্যা হিসেবে নিরানব্বই। ১৮ আঠারটি ডিজিটের যে কোনটির চেয়ে বড়। আর ৯৯ আঠার ডিজিটের সম্মিলিত যোগফলের চেয়ে বড়। আহমদ মুসা খুশি হলো, ১৮ ডিজিটের সংখ্যাবাচক কনসেপ্টের সাথে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মনোগ্রামের কনসেপ্টের মিল আছে। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের মনোগ্রাম ‘সূর্য’টির টপ-এর কিরণটিই সর্বোচ্চ, অন্যগুলো ছোট-বড়, যেমন ডিজিটাল বৃত্তের ১৬টি ডিজিট।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, লক খোলার ডিজিটাল কোড ঠিক আছে।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল ডিজিটাল লক-এর দিকে। হাত তুলল টাচ লকের দিকে। কিন্তু সংগে সংগেই আবার এক পা পিছিয়ে এল।
দরজা খোলার আগে সব ঠিক আছে কি না দেখতে হবে তাকে।
জুতা, মোজার আড়াল, প্যান্টের পকেট, জ্যাকেটের পকেট, কলারের আড়ালটা সব ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে সাইলেন্সারযুক্ত মাইক্রো মেশিনগান বাম হাতে নিল। ডান হাতের কাছে জ্যাকেটের ডান পকেটে লেজারগান রেখেছে।
আহমদ মুসা আবার এগিয়ে গিয়ে ডিজিটাল লকের সামনে দাঁড়াল।
বিসমিল্লাহ্ বলে আহমদ মুসা শাহাদাত আঙুলি দিয়ে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত ‘টাচ কী’গুলো চাপল। তরপর ৯ থেকে ‘টাচ কী’ চেপে ১-এ ফিরে এল।
৯ম টাচ কীতে চাপ দিয়েই আহমদ মুসা ঠিক দরজার মাঝখানে সরে এল। দরজা যেদিকে যাবে সেদিকেই সরে যাবে সে, যাতে গুলির সামনে প্রথমেই পড়ে না যায়। ওরা যদি ভেতরে বেশি সংখ্যাক লোক থাকে, তাহলে ক্রস ফায়ারের সুবিধা ওরা পেয়ে যেতে পারে। মুখোমুখি না পড়ে মুহূর্তকালের জন্যে হলেও ওদের চোখের আড়ালে গিয়ে পাশ থেকে আক্রমন করতে চায় সে।
দরজা বাম দিকে সরছিল। কিন্তু যতটা চোখের পলকে সরবে মনে করেছিল, ততটা বেগে সরল না। ভারি দরজা স্বাভাবিক গতিতে সরছিল।
এসে সুবিধা হলো আহমদ মুসার।
দরজা সরে আসা শুরু হওয়ার সংগে সংগেই লাফ দিয়ে যেয়ে বামে কোণে শুয়ে রিভলবার তাক করল।
আহমদ মুসা দরজার পেছনেই স্টেনগান তাক করে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা একজনকে দেখতে পেয়েছে, সেও দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা গুলি করেছে, সেও গুলি করেছে। আহমদ মুসা শুয়ে থেকেই গুলি করেছে, আর সেও গুলি করেছে হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থায়। কিন্তু দেখতে পাওয়ার এবং গুলি করা মাত্র কয়েক মিলি সেকেন্ডের ব্যবধান, শুয়ে থাকা অবস্থায় গুলি করার কারণে বেশি সুবিধা পাওয়ায় জিতে গেল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার মাইক্রো মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি তাকে বিদ্ধ করল, আর লোকটির সব গুলিই লক্ষচ্যুত হয়েছে সে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাতের আঙুল কেঁপে যাওয়ায়।
আহমদ মুসা গুলি শুরু করার পর আর বন্ধ করেনি। ট্রিগারে আঙুল চেপে রেখে তা বামে সরিয়ে নিচ্ছে দরজা সরে যাওয়ার সমান গতিতে।
ওরাও গুলি ছুঁড়ছে। কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগই দরজাকেই আঘাত করছে এবং কিছু দরজার খোলা পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আহমদ মুসার গুলি দরজার আড়াল থেকে হওয়ায় কিছূটা কৌণিক হলেও তার অব্যাহত গুলি কাজে লাগছে দরজা অব্যাহতভাবে সরে যাওয়ার কারণে। ওরা দরজার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বসে ছিল, সারিবদ্ধভাবেই ওদের লাশ পড়ে গেল।
দরজা খোলা শুরু হওয়া থেকে শেষ পর্যন্ডত সময় বেশি নয়, ওরাও গুলি করছিল, আর ওরাও দু’দেয়ালের মাঝখানে সারিবদ্ধ অবস্থায় বসে ছিল, এই সব কারণে তারা আড়াল নেয়নি, নেয়ার সুযোগও ছীল না। তারা ডানে সরে এসে সরাসরি আহমদ মুসাকে আক্রমণ করবে, তা পারেনি আহমদ মুসার অব্যহত গুলির জন্য। আবার ওরা পালায়নি পেছনে গিয়ে আলাদা অবস্থান নেবার জন্যে, কারণ ওরা পালায় না, আহমদ মুসা এটা দেখেছে।
ওদের আটটা লাশ দেখা যাচ্ছে দরজার পেছনে।
ঐ কোনটায় আহমদ মুসা শোয়া অবস্থায় আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করল। কেউ এল না। নিরব চারদিক।
আহমদ মুসা না উঠে ক্রলিং করে ভেতরে ঢুকল।
ভেতরে ঢুকে সামনে তাকাতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। ডায়াগ্রামে দেখা গেল লাল-সবুজের জীবন্ত দৃশ্য সামনে ভাসছে।
ভেতরে ঢুকেই প্রথমে প্রশস্ত স্ট্যান্ডিং। স্ট্যান্ডিং-এর পরেই মুভিং এলিভেটর। এলিভেটরের লাল-সবুজ দু’টি অংশ। দু’টিই চলছে পাশাপাশি বিপরীত দিকে। লালটা উপরে উঠছে এবং সবুজটা নামছে নিচে।
বিস্মিত আহমদ মুসা! একদম মিলে যাচ্ছে ডায়াগ্রামের সাথে। দরজা খোলার কোড নাম্বার দিয়ে এবং ভেতরের গাইডলাইন দিয়ে কে তাকে সাহায্য করল!। কিন্তু আহমদ মুসা আজ এখানে আসছে কে জানত!
আহমদ মুসা নিশ্চিত, ডায়াগ্রামকে অনুসরণ করেই সে লক্ষে পৌঁছতে পারবে। সবুজ এলিভেটর তাকে নিয়ে এল বন্দী বিজ্ঞানীদের কাছে এবং লাল এলিভেটরে সে যেতে পারবে ‘কিং’-এর কাছে। এই ‘কিং’টা কে? ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের হেড? সেটাই হবে।
কোথায় আহমদ মুসা আগে যাবে? বন্দী বিজ্ঞানীদের কাছে, না ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সাথেই বুঝা-পড়া আগে শেষ করবে।
বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের মুক্ত করে নিরাপদে তাদের নিয়ে যেতে হলে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান ও অন্যদের হাত থেকে এই প্রাসাদকেই আগে মুক্ত করতে হবে। এটাই সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তাকাল লাল এলিভেটরের দিকে।
কিন্তু এদের লোকজন কোথায়?
এরা ৮ জন যে রকম প্রস্তুত অবস্থায় ছিল তাতে বুঝা যাচ্ছে, এরা তার জন্যে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষায় ছিল। তাহলে অন্যেরাও তো এটা জানবে! তারাও সাবধান থাকবে, প্রস্তুত থাকবে। তাহলে তারা কোথায়? এল না কেন এত গুলির শব্দ শোনার পরেও!
আহমদ মুসার মাইক্রো মেশিনগান সাইলেন্সারযুক্ত, কিন্তু ওদের গুলির তো শব্দ হয়েছে।
এ জিজ্ঞাসার জবাব পেল না আহমদ মুসা। বুঝতে পারলো না ঘটনা কি! তাহলে কি ওরা অন্য কোথাও অবস্থান নিয়েছে?
সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে নিয়েছিল আহমদ মুসা।
এবার বিসমিল্লাহ্ বলে লাল এলিভেটরের লাল সিনথেটিক কার্পেটে পা রাখল আহমদ মুসা।
ধীরে ধীরে এলিভেটর উঠতে লাগল উপরে।
আহমদ মুসার বাম হাতে ঝুলছে মাইক্রো মেশিনগান আর তার হাতের মুঠোয় রয়েছে লেজারগান।
আহমদ মুসা দেখতে পাচ্ছে এলিভেটর এক লেয়ার থেকে অন্য লেয়ারে উঠছে।
এক সময় দেখল এলিভেটর করিডোর, চত্বর দিয়ে চলছে। দু’পাশে ঘর, লাউঞ্জের সারি। এ সময় এলিভেটর সমতল অবস্থায় চলছিল। হঠাৎ এলিভেটর ৩০ ডিগ্রি কোণে উপরে উঠতে লাগল। এলিভেটরের দু’পাশেই অনেক উচু দেয়াল।অনেক উচুতে আহমদ মুসা এলিভেটরের মতই প্রশস্ত দরজা দেখতে পেল। দরজাটা অত্যন্ত দর্শনীয়। রাজা-বাদশাদের ঘরের দরজার মতই। আধুনিক যুগের এ্যান্টিকের একটা চমৎকার নিদর্শন। আহমদ মুসা ভাবল, এই দরজার ওপাশেই তাহলে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের রাজা থাকেন। দরজাটা ঠিক এলিভেটরের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। এলিভেটর চলার উপযোগী ফাঁকটুকুই মাত্র রয়েছে দরজার নিচে।
প্রথম বুঝল আহমদ মুসা, দরজা বন্ধ। কিন্তু তার নিচ দিয়ে এলিভেটর চলছে। তার মানে তাকে এখনই প্রচণ্ড ধাক্কা দেবে। এর সাথে সাথেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে নিচের ল্যান্ডিং-এ পড়ে যেতে হবে তাকে।
দরজা এসে গেছে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি ডান হাত বের করে সামনে বাড়িয়ে দিল যাতে ধাক্কা থেকে শরীরটাকে রক্ষা করা যায়।
কিন্তু হাত দরজা স্পর্শ করার আগেই দরজা খুলে গেল।
দরজা পার হবার পর এলিভেটরের পথ আবার সমতল হয়ে গেল।
কিন্তু অল্প দূরেই আরেকটা দরজা, ঘরের দরজা। ঘরটির সামনের দেয়ালটিই শুধু দেখা যাচ্ছে। পাথরের দেয়ালটি অদ্ভুত কারুকাজে সাজানো! দরজাটি মনে হয় সোনার অংশ দিয়েই কারুকাজ করা।
দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছতেই এলিভেটর থেমে গেল আপনা-আপনি।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, স্বর্ণদরজার এ ঘরটাই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের রাজা’র বাসস্থান, যার রেখাচিত্র ডায়াগ্রামে আছে। এলিভেটর থেকে আহমদ মুসা দরজার সামনে ল্যান্ডিং-এ উঠে দাঁড়াল।
এখন কি করবে সে? দরজার ওপারে কি আছে?
আহমদ মুসা শাহাদাত আঙুল দিয়ে দরজার উপর চাপ দিল। খুলে গেল দরজা। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। এসব কি কোন যাদু বলে হচ্ছে?
খুলে গেল সম্পূর্ণ দরজা।
দরজার পরেই রাজকীয় কার্পেটে মোড়া করিডোর।
করিডোরের দু’পাশে দু’টি দরজা।
করিডোরের সামনে সুসজ্জিত লাউঞ্জ।
মিষ্টি সাদা আলোতে হাসছে যেন লাউঞ্জটা।
বাম হাতে মাইক্রো মেশিনগানটি বাগিয়ে ধরে ডান হাতে জ্যাকেটের ডান পকেটে রেখে দু’তিন ধাপ এগোলো।
হঠাৎ লাউঞ্জের ওপাশ থেকে কথা বলে উঠল একটা কণ্ঠ।
সংগে সংগে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
কণ্ঠটি বলছিল, আহমদ মুসা, তুমি শুধু সাংঘাতিক ধূর্তই নও, তুমি ভাগ্যবানও। ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে ঢোকার অসম্ভব কাজও তুমি করেছ। আমাদের কোন এক বিশ্বাসঘাতকের বিশ্বাসঘাতকতায় তুমি ভাগ্যবান হয়েছ। আমাদের প্রধান গেটের দরজা ছিল অজেয়, সেটা খোলার কোড তুমি পেয়ে গেছ। এই প্রসাদের ডায়াগ্রামও নিশ্চয় তোমাকে দেয়া হয়েছে। তুমি ভাগ্যবান যে, আমার ঘুমাবার সময়কে তুমি বেছে নিতে পেরেছ তোমার অভিযানের জন্য। তুমি ভাগ্যবান বলেই আমরা ক্যাপিটাল অব পাওয়ারকে খালি করে সবাইকে পাঠিয়েছি তাহিতিতে ডোর টু ডোর খুঁজে তোমাকে বের করে আনতে। ঠিক এই সময় তুমি ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে অভিযানে এসেছ। কোন এক বিশ্বাসঘাতকের সাহায্যই তোমাকে ভাগ্যবান করেছে। আমাকে যখন ঘুম থেকে জাগানো হয, তখন তুমি হার্ড লেয়ার পর্যন্ত এসে গেছ। তার পর আমি তোমাকে এই স্বর্ণপ্রসাদের গেটে আসতে আর বাধা দেইনি। কারণ এই স্বর্ণপ্রসাদ এখনও উদ্বোধণ পর্যন্ত হয়নি। তোমার রক্ত দিয়েই তার উদ্বোধন হবে। স্বরণীয় হয়ে থাকবে এই উদ্বোধন। থেমে গেল কণ্ঠ।
থেমে গেল লাউড স্পীকার।
পল পল করে বয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত।
কি ঘটতে যাচ্ছে, কি করবে আহমদ মুসা, তা ভাবছিল সে।
হঠাৎ আহমদ মুসার পায়ের তলা থেকে কার্পেট কোন এক অদৃশ্য শক্তির হ্যাঁচকা টানে প্রবল বেগে সরে গেল।
একদম চিৎ হয়ে পড়ে গেল আহমদ মুসা।
টানটা এত আকস্মিক ও প্রবল ছিল যে, আহমদ মুসা তার দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই হারিয়ে ফেলেছিল। বাম হাত থেকে মাইক্রো মেশিনগানটি ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডান হাতটি জ্যাকেটের পকেট থেকে ছিটকে বিরিয়ে এলেও বিস্ময়করভাবে লেজারগানটি হাতের মুঠোতেই ছিল।
আহমদ মুসা পড়ে যাবার মুহূর্তেই করিডোরটির সামনে এসে দাঁড়াল ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান অ্যালেক্সি গ্যারিন। তার দুই হাতে দু’টি রিভলবার। তার দুই চোখে আগুন।
সে এসে দাঁড়িয়ে স্থির হবার আগেই তার দুই রিভলবার থেকে দু’টি গুলি বর্ষিত হলো আহমদ মুসার লক্ষ্যে, ঠিক দেখামাত্র গুলি করার মত। আহমদ মুসাকে দেখার পর আর অপেক্ষা করেনি অ্যালেক্সি গ্যারিন।
আহমদ মুসা চিৎ হয়ে পড়ে যাবার পর প্রাথমিক ধাক্কাই সে সামলাতে পারেনি, আক্রমণে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না তার।
আহমদ মুসা দেখতে পেয়েছে, গুলি ছুঁড়ছে অ্যালেক্সি গ্যারিন।
করণীয় কিছু নেই, একটা বিমূঢ় অবস্থা আহমদ মুসার। মৃত্যুর অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই তার করার নেই।
কিন্তু গুলি তাকে স্পর্শ করল না।
এক নারী মূর্তী দু’টি গুলিই তার বুক পেতে দিয়ে গ্রহণ করেছে। সামান্য টলে উঠে ঢলে পড়ছে নারী মূর্তির দেহটি।
অ্যালেক্সি গ্যারিন মেয়েটিকে গুলি খেতে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্যে। তারপরই আবার তার দু’হাতের রিভলবার উঠে এসেছে আহমদ মুসার লক্ষে।
কিন্তু অ্যালেক্সি গ্যারিনকে আর সুযোগ দিল না আহমদ মুসা। সে আগেই উঠে দাঁড়িয়েছি। হাতের লেজারগানও তার তৈরি ছিল। বাটন টিপে ফায়ার করল অ্যালেক্সি গ্যারিনকে। ভয়ংকর আলোর এক স্রোত আলোর গতিতেই ছুটে গিয়ে আঘাত করল অ্যালেক্সি গ্যারিনকে।
গাছ যেমন ভেঙে পরে, তেমনি ভেঙে পড়ল অ্যালেক্সি গ্যারিনের দেহ।
আহমদ মুসা ইতিমধ্যেই চিনতে পেরেছে গৌরীকে। গৌরীই আহমদ মুসাকে বাঁচাবার জন্যে বুক পেতে দিয়েছে গুলির সামনে।
গৌরী পড়ে গেলে করিডোরের কার্পেটের উপর।
আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে গৌরীর পাশে বসে হাঁটুর উপর মাথা তুলে নিল। বলল, মিস গৌরী, আপনি আমাকে বাঁচাবার জন্যে এভাবে. . .।
যন্ত্রণায় অস্থির গৌরীর চেহারা। সে মুখ ফিরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, জীবনে একটিই ভালো কাজ করলাম। জনাব ঈশ্বরকে বলার মত এই একটা কাজই আমার হয়েছে।
গৌরী একটু থেমেই আবার বলল, আমার সময় বেশি নেই, শুনুন। আবার জ্যাকেটের কলারের একটা পকেটে এক খন্ড কাগজ আছে। কোড নাম্বার ছাড়া ক্যাপসুলগুলো খোলার কোন উপায় নেই। ওগুলো বুলেটপ্রুফ, ফায়ারপ্রুফ ও আনব্রোকেবল। যদি ওগুলো জোর করে ভাঙার চেষ্টা করা হয় তাহলে বিজ্ঞানীরা মারা যাবে। এই কাগজ খণ্ডে বিজ্ঞানীদের ক্যাপসুলগুলো খোলার কোড নাম্বার আছে। তৃতীয় তলায় একটা কনট্রোল সেন্টার আছে। সেই সেন্টারে একটা ডিজিটাল কী বোর্ড দেখবেন। সেই কী বোর্ডে এই কোড টাইপ করলে ক্যাপসুলগুলো খুলে যাবে।
আহমদ মুসা গৌরীর জ্যাকেটের কলারের গোপন পকেট থেকে কাগজটি বের করে নিতে নিতে বলল, এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে, সেটা কথায়? আপনার বুকের দুই পাশে গুলি লেগেছে। আপনি সেরে উঠবেন।
সে চেষ্টা করবেন না। আমি বুঝতে পারছি আমার সময় বেশি নেই। জানেন এই মৃত্যুতে আমি খুব তৃপ্ত আমি। একজন ভালো মানুষের কোলে আমি মরতে পারছি, এটা আমার সৌভাগ্য। এতে আমি খুব খুশিও। কারণ আমাকে যে ধ্বংস করেছে, মৃত্যুর আগে তার ধ্বংস আমি দেখলাম। স্রষ্টার কাছে তার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ আছে, জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে কেন আপনার সাথে দেখা হলো? কেন আরো আগে আপনার দেখা পাইনি? আমি উচ্চাভিলাষী ছিলাম। আমি বড় কিছু করতে চাইতাম। কিন্তু তা মনুষ্যত্ব ও আমার মানবিক অধিকারের বিনিময়ে নয়। কিন্তু তাই হয়েছে।
গৌরীর শেষের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে উঠল। ধুঁকছিল সে। চোখটা তার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আপনি প্লিজ বলুন, এখানে কোথায় চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে?
বলে আহমদ মুসা তাকে পাঁজাকোলা করে ওঠাতে যাচ্ছিল।
চোখ খুলল গৌরী। সে মাথা নেড়ে বলল, না, কোন প্রয়োজন নেই। সত্যিই সময় আমার নেই। বলে থামল সে।
আমাকে আপনার কিছু বলার আছে? আত্মীয়-স্বজন কিংবা অন্য কোন ব্যাপারে? বলল আহমদ মুসা।
গৌরী চোখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আছে। আমার জ্যাকেটের পকেটে দেখুন একটা ছোট্ট ডাইরি আছে। ওতে আমি কথাগুলো লিখে রেখেছি। এই রাতে যখন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে আসেন, তখনই আমি তাড়াহুড়া করে লিখেছি।
আমি সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে আসছি, এটা আপনি দেখেছেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
হ্যাঁ। বলল গৌরী।
কিভাবে? আহমদ মুসা বলল।
আপনি রাডার ও ক্যামেরাসজ্জিত রেসিস্ট্যান্ট যে পোষাক পরেছিলেন, তা আমাদের ক্যামেরার জন্যে অচল। তাই আমি আপনাকে দেখতে পেয়েছি এবং চিনতেও পেরেছি।
আর কেউ দেখিনি? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
না। ক্যাপিটাল অব পাওয়ার-এর নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার উপর ছিল।
তাই আটজন কমান্ড নিয়ে আমি জেগে বসে ছিলাম। বলল গৌরী। ধীরে ধীরে তার কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
প্রধান দরজা খোলার কোড ও ডায়াগ্রাম আপনিই দিয়েছিলেন? আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ। কারন আমি মুক্ত চেয়েছিলাম এবং ওদের ধ্বংসও চেয়েছিলাম।
আল্লাহ আপনাকে এর যাযাহ দিন! আপনি শুধু কিছু বিজ্ঞানীর নয়, গোটা দুনিয়ার আপনি উপকার করেছেন। আল্লাহর অসীম দয়া আপনি পাবেন! আহমদ মুসা বলল।
আল্লাহ্ মানে স্রষ্টার প্রতি আপনার তো খুব বিশ্বাস, তাই না? বলল গৌরী।
কেন? আপনি স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন না? আহমদ মুসা বলল।
আমার বিশ্বাস দিয়ে কি হবে? আমি তাঁর জন্যে মানে আমার বিশ্বাসের পক্ষে কিছূই করিনি। সুতরাং পরজগতেও আমার কোন ভবিষ্যত নেই। বলল অশ্রুরদ্ধ ক্ষীণ কণ্ঠে।
আছে। আপনি এক স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন? আহমদ মুসা বলল।
করি। দৃঢ়ভাবে করি। কারণ পরমাণু থেকে গ্যালাক্সি পর্যন্ত গোটা সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে একক এক বিধান। স্রষ্টা একজন না হলে এটা হতো না। বলল গৌরী নরম ও ক্ষীণ কণ্ঠে। দু’চোখ থেকে তার গড়িয়ে আসছিল অশ্রু।
আপনি কি পৃথিবীতে স্রষ্টার বাণীবাহক অর্থাৎ নবী-রসূলে বিশ্বাস করেন না?
খুব মৃদভাবে চোখ তুলে তাকাল গৌরী আহমদ মুসার দিকে। বলল, জেসাসকে আমি মানি। কিন্তু তাঁর জন্যে কোন কাজ করিনি।
নবী-রসূলদের ধারাবাহিকতায় শেষ নবী মুহাম্মাদ স. এর কথা আপনি জানেন? আহমদ মুসা বলল।
জানি। বলল গৌরী।
আল্লাহ্র পাঠানো নবী-রসূল স.-দের মধ্যে তিনি শেষ নবী, এটা আপনি মানেন?
চোখ বুজে ছিল গৌরী। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলল। বলল, বিশ্বাসের জন্যে যতটা জানা দরকার ততটা জানি না। তবে আপনার উপর আস্থা আমার সীমাহীন। আপনি তাঁকে শেষ নবী বলছেন, আমি তাঁকে শেষ নবী মানলাম।
মিস গৌরীঁ! পরকালে আমার পরিণতি কি হবে আমি জানি না, কিন্তু একটা কথা বলছি, আপনি আল্লাহ্র একত্বে বিশ্বাস করেন এবং আল্লাহর শেষ নবী মোহাম্মাদুর রসূলল্লাহ্ স.-এর উপর আস্থা পোষণ করেন, সুতরাং সৃষ্ট মানুষের প্রতি আল্লাহর যে প্রতিশ্রুতি, সে অনুসারে আল্লাহ্ আপনাকে মাফ করতে পারেন এবং গ্রহণ করতে পারেন তাঁর জান্নাতের জন্যে। আহমদ মুসা বলল।
যন্ত্রণায় কাতর গৌরীর গোটা দেহ। তবে তার চোখ দু’টি উজ্জল।
অশ্রু ঝরছিল সে চোখ দিয়ে চোখ বুজল, যেন ক্লান্তি ও কষ্ট শামলে নেবার চেষ্টা করছে সে!
চোখ খুলল আবার সে। বলল, স্রষ্টা অনুগ্রহ করলে, তাঁর দয়া হলেই সবই সম্ভব। আপনার মত সকলের ন্যায় আমিও তাঁর দয়র মুখাপেক্ষী হলাম। গৌরীর কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। যেন ঘুমিয়ে পড়ছে সে।
একটু থেমেছিল। আবার অস্পষ্ট ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, বিজ্ঞানীদের নিয়ে যাবার জন্যে সুড়ঙ্গকে নিরাপদ করতে হবে। এজন্যে সেন্ট্রাল কন্ট্রোলের সিস্টেম কন্ট্রোল প্যানেলে ‘অ’ চিহ্নিত সুইচটা অফ করে দিলেই সুড়ঙ্গে যে ফাঁদগুলো আছে তা অকেজো হয়ে যাবে। কাঁপা গলায় আস্তে আস্তে বলল কথাগুলো।
গোটা দেহেই তার নিঃসাড় হয়ে পড়েছে যেন!
তার হাত পায়ের কোন চেতনা দেখা যাচ্ছে না।
চোখ বুজেছে আবার সে।
কাঁপছে গৌরীর ঠোঁট দু’টি। যেন নিজের সাথে নিজেই সে লড়াই করছে! চোখ দু’টি তার খুলে গেল আবার।
ঠোঁট দু’টি তার নড়ে উঠল। অস্ফুট ও কাঁপা গলায় বলল, আহমদ মুসা, ডা-য়েরি-তে আ-মি যা আপ-না-কে ব-লে-ছি তা আপ-নাকে জা-নাবার জন্যে? কো-ন দা-য়িত্বের ভাব আ-মি আপ-নাকে জা-নাবার জন্যে? কো-ন-দা-য়িত্বের ভার আ-মি আ-পনাকে দিচ্ছি না। সে অধি-কা-রও আ-মা-র নে-ই।
কণ্ঠ থেমে গেল গৌরীর। চোখ দু’টিও বুজে গেল তার।
নিথর হয়ে গেল তার শরীর।
যেন প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল গৌরী। কিন্তু ঘুম নয়, মৃত্যুর সিংহদ্বার দিয়ে এ এক মহাযাত্রার শুরু।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে গৌরীর মাথাটা কার্পেটে নামিয়ে রাখল।
গৌরীর প্রাণহীন দেহের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল আহমদ মুসা, আল্লাহ তোমার শাহাদাৎ মঞ্জুর করুন। আল্লাহর এক নগণ্য বান্দাকে বাঁচাতে এবং আল্লাহর হাজারো বান্দার উপকারের জন্যে তুমি জীবন দিয়েছে। আল্লাহর কাছে এই সাক্ষ্য আমি দিচ্ছি।
তাহিতির নৌবহর ঘিরে ফেলেছে তাহনিয়া ও মাতুতুংগা অ্যাটল।
আহমদ মুসা বন্দী বিজ্ঞানীদের সুড়ঙ্গ দিয়ে তাহনিয়া অ্যাটলের পাড়ে নিয়ে এসেছে। এক এক করে সব বিজ্ঞানীকে তুলে নেয়া হলো তাহিতি নৌবাহিনীর জাহাজে।
জাহাজে ওঠার আগে সৌদি আরবের মুক্তিপ্রাপ্ত স্পেস মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল মক্বী আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, আল্লাহ আপনাকে উত্তম যাযাহ দিন ও দীর্ঘ জীবন দান করুন। শুধু আমাকে নয়, পৃথিবীর প্রায় পৌঁনে একশ’ শীর্ষ বিজ্ঞানীকে আল্লাহর সাহায্যে নতুন জীবন দিয়েছেন। অনেক সালাম আপনাকে।
এই সময় হেলিকপ্টার ল্যান্ড করল।
হেলিকপ্টার থেকে নেমে এল স্বরাষ্ট্র ও পুলিশ প্রধান দ্যাগল ও তাহিতির গভর্নর ফ্রাঁসোয়া বুরবন।
আহমদ মুসা এগিয়ে গেল তাদে রদিকে। তারাও এগিয়ে এল। দ্যাগল আহমদ মুসাকে কংগ্রাচুলেশন জানিয়ে জড়িয়ে ধরল এবং বলল, জানেন গোটা দুনিয়ার এটাই আজ হট নিউজ! আপনার নাম ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দুনিয়ায়।
দ্যাগল আহমদ মুসাকে পরিচয় করিয়ে দিল গভর্নরের সাথে। গভর্নর আহমদ মুসাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, তোমার জন্যে আমরা গর্বিত। গোটা দুনিয়ায় তাহিতি অসাধ্য সাধন করেছে। এর সব কৃতিত্ব তোমার।
গভর্নরকে ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসা একটু আলগা হতেই দ্যাগল বলল, পেছনে তাকিয়ে দেখ আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা পেছনে তাকাল। দেখল, মাহিত ও মারেভা। ওরা হেলিকপ্টারে দ্যাগলের সাথেই এসেছে।
আহমদ মুসা ওদের দিকে এগোলো।
মাহিন এসে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, স্যার, আমাদের দারুণ গর্ব হচ্ছে।
মারেভা এসে পাশে দাঁড়াল। বলল, স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?
হাসল আহমদ মুসা। বলল, দেখো কেউ আমার এই খোজ নেয়নি, আমার বোন নিয়েছে। বোনদের, মা’দের ধর্ম এটাই!
একটু থামল আহমদ মুসা। আবার বলল মারেভাদের দিকে চেয়ে, হ্যাঁ, ভাল আছি বোন!
ভাইয়া, আমি ও মাহিন চাকুরি পেয়েছি। বলল মারেভা।
কি চাকুরি? আহমদ মুসা বলল।
গোয়েন্দা বিভাগে। প্রথমে আমাদের ট্রেনিং চলবে। তার সাথে পড়ার সুযোগটাও থাকবে। বলল মারেভা।
অভিনন্দন তোমাদের! ভাল চাকুরি। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে পারবে। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা এগোলো গভর্নরের দিকে।
এ সময় মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
কল ধরতেই আহমদ মুসা ওপার থেকে কণ্ঠ পেল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আব্দুল ওয়াহাব আল-নজদীর।
আহমদ মুসা তাকে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়েই সে বলল, অভিনন্দন আহমদ মুসা, শুধু আমাদের বিজ্ঞানী নয়, প্রায় পৌনে একশ’ বিজ্ঞানীকে তুমি মুক্ত করেছ। গোটা দুনিয়া তোমাদের অভিনন্দিত করছে। আমি মহামান্য বাদশাহকে জানিয়েছি। তিনি আপনাকে সালাম দিয়েছেন।
ধন্যবাদ স্যার। আল্লাহর সাহায্যেই সব হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
আবারও ধন্যবাদ তোমাকে। আমরা এখানে সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। ম্যাডামরা সবাই ভাল আছেন। বলল সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আহমদ মুসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সালামের জবাব দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল।
এগিয়ে গেল আহমদ মুসা গভর্নরের দিকে।
তাহানিয়া এ্যাটল থেকে তাহিতি নৌবাহিনীর একটা জাহাজ প্যাসেফিকের বুক চিরে ধীর গতিতে দুলে দুলে চলছে তাহিতির দিকে। জাহাজের একটা কেবিনে শুয়ে আছে আহমদ মুসা। তার হাতে গৌরীর দেয়া সেই ডায়েরিটা। ডায়েরি পড়ার জন্য সে খুলল।
তখনই তার মোবাইলে কল বেজে উঠল। ধরল টেলিফোন আহমদ মুসা।
ওপার থেকে কণ্ঠ তাহিতির গভর্নরের, গুড মর্নিং মি. আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা গুড মর্নিং জানাল।
মি. আহমদ মুসা। একটা খবর আপনাকে না জানিয়ে পারলাম না।
প্যারিস থেকে এই মাত্র প্রধানমন্ত্রী জানালেন, মতুতুংগা অ্যাটলের প্রসাদটিকে ফরাসি সরকার পর্যটকদের জন্যে খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর বার্ষিক আয়ের এক-চতুর্থাংশ শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। অর্ধেকটা পাবে তাহিতি ও পলিনেশীয়া দ্বীপপুঞ্জ। অবশিষ্ট এক-চতুর্থাংশ খরচ করা হবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সব ধর্মের শিশুদের ধর্ম শিক্ষার উন্নয়নে। আপনার কাছে এই পরামর্শ ফরাসি সরকার রেখেছেন। আর প্রসাদটির ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার” নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘আহমদ প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’। আর ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের গোপন ঘাটিগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে এবং ওদের মিনি সাবমেরিন, টিউব সাবমেরিন সমৃদ্ধ ওদের যে নৌবহর আছে পানির তলায়, তা খুঁজে বের করা ও পাকড়াও করার কাজ শুরু হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন সরকার আমাদের সাহায্য করছে। বলল গভর্নর।
অন্য সব সিদ্ধান্তের জন্য ফরাসি সরকারকে ধন্যবাদ। কিন্তু স্যার, আমার নাম জড়ানো হলো কেমন প্যালেসের নামের সাথে? আহমদ মুসা বলল।
এ সিদ্ধান্ত ফরাসি ক্যাবিনেটের, আমি কি করে বলব মি. আহমদ মুসা। ভাবল সে, নামটা আমার নয়। ‘আহমদ’ আল্লাহর রসূলের নাম বলেই তো এটা আমার নামেরও একটা অংশ। থাক না অ্যাটল প্রসাদের মত দুনিয়ার এক বিস্ময়ের সাথে আমার রসূল মানে মানুষের রসূলের নাম জড়িয়ে! অ্যাটল দ্বীপের নিচের এই বিস্ময়কর প্রসাদটি তো দুনিয়ার মানুষ ও পর্যটকদের কাছে এক নজর দেখার এক অপার আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠবে।
আহমদ মুসা কিছূ বলার আগে গভর্নর নিজেই আবার বলে উঠল, ঠিক আছে মি. আহমদ মুসা, আপনি তো এখন শীপে। আসুন, আমরা আপনার অপেক্ষা করছি। দেশ-বিদেশের বহু সাংবাদিক এসে পৌঁছেছে। আর মনে আছে তো, আজ রাতে আমার বাড়িতে ডিনার।
মনে আছে স্যার। আর ঠিক সময়েই আমি সংবাদিক সম্মেলনে পৌঁছব স্যার। কিন্তু স্যার, আমি শুধু উপস্থিত থাকবো, আমার পরিচয় দিতে পারবেন না। আহমদ মুসা বলল।
হ্যাঁ, একথা আমাকে মি. দ্যাগল জানিয়েছেন কিন্তু পরিচিত হতে, কয়েকটা কথা বলতে দোষ কি মি. আহমদ মুসা? বলল গভর্নর।
স্যার, আমি কোন রাজনীতিক নই, কোন প্রফেশনাল পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কেউ নই। কোন পরিচয় ছাড়াই মানুষের জন্যে কাজ করছি, কাজ করবো। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আপনি সত্যই সকলের জন্যে দৃষ্টান্ত হওয়ার মত একজন। ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন! রাখছি তাহলে টেলিফোন। বলল গভর্নর।
আপনার টেলিফোনের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, আমি আসছি স্যার। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা মোবাইল রেখে গৌরীর ডাইরিতে হাত দিতে যাচ্ছিল।
আবার মোবাইলে কল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল তুলে নিয়ে কল অন করল আহমদ মুসা।
আচ্ছালামু আলাইকুম। ওপার থেকে জোসেফাইনের কণ্ঠ।
ওয়া আলাইকুম সালাম, জোসেফাইন কেমন আছ? তোমাকে কয়েকবার টেলিফোন করে পাইনি। বলল আহমদ মুসা।
তোমার প্রশ্নের জবাব দেবার আগে তোমাকে কংগ্রাচুলেশন দিয়ে নেই। কংগ্রাচু. . .।
জোসেফাইনের কথার মধ্যেই আহমদ মুসা বলে উঠল, না, ম্যাডাম জোসেফাইন, তোমার কংগ্রাচুলেশন নয়, কনসুলেশন চাই তোমার কাছে। তোমাকে ছেড়ে অনেক দিন আমি বাইরে, অনেক কষ্টে আছি।
আমি সব জানি। আমার ননদ সব আমাকে জানিয়েছে। তুমি যে লড়াইয়ে আছো, তাতে আমাকে স্মরণ করার, আমার জন্যে কষ্ট পাবার মত সময় কোথায় তোমার? তুমি গুলিতে আহমত হয়েছে একাধিকবার। সেটাও তো আমাকে জানাওনি! তার পরেও তোমাকে অভিনন্দন! থামল জোসেফাইন।
বেদনায় ভারি কণ্ঠ জোসেফাইনের। শেষ কয়েকটা শব্দ তার গলায় বেঁধে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, জোসেফাইন, তুমি না আমার জোসেফাইন! তুমিতো অনেক শক্ত। তুমি ভেঙে পড়লে আমিও তো ভেঙে পড়ব জোসেফাইন!
স্যরি! মাফ কর আমাকে। কিন্তু তুমি তোমার সব খবর আমাকে জানাবে না কেন? না জানানোর জন্যই এই কষ্ট আমার লেগেছে। বলল জোসেফাইন।
স্যরি, জানানো উচিত ছিল। কিন্তু ঘটনাগুলো একের পর এক এমনভাবে ঘটেছে, যাতে সুস্থির সময় খুব কম পাওয়া গেছে। আর ভয় হয়েছে তুমি ভয়ানক উদ্বেগের মধ্যে পড়বে। ভেবেছি, সমস্যাগুলো ক্লিয়ার হলেই তোমাকে জানাবো। মারেভা তোমাকে টেলিফোনে এসব জানিয়েছে? বলল আহমদ মুসা।
তাহিতিতে যখণ আজ ভোর, তখন সে টেলিফোন করে বিজয়ের কথা জানিয়েছে। সে এর আগেও আরও দু’দিন টেলিফোন করেছে। ও হ্যাঁ, আরও একদিন সে আমাকে টেলিফোন করেছে। ওদের বিয়ের ঠিক পর মুহূর্তেই সে ওদের বিয়ের খবর আমাকে জানিয়েছে। আমি ওকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলাম, তোমার ভাইয়াকে ছাড়া বিয়ে করছ! জবাবে সে বলেছিল, ভাইয়া ডেট ঠিক করে দিয়ে বলেছিলেন, যাই ঘটুক, কেউ না আসুক ঐদিন যেন বিয়ে হয়ে যায়! ঐ দিনের পর তোমরা বিয়ে না হওয়া অবস্থায় আমার কাছে আসতে পারবে না। অতএব, উপায় কি বিয়ে করতেই হলো। খুব ভাল মেয়ে মারেভা। বলল জোসেফাইন।
হ্যাঁ, ওরা দু’জন আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আরেকজনের কথা বলতে হচ্ছে জোসেফাইন সে হলো গৌরী-ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সর্বময় কর্তা আলেক্সি গ্যারিনের পার্সোনাল সেক্রেটারি, তার বডিগার্ড ও গ্যারিনের নিজস্ব বাহিনীর কমান্ডার। আলেক্সি গ্যারিনের যে দু’টি গুলি আমার বুকে বিদ্ধ হবার কথা ছিল, ছুটে এসে সে এই দু’টি গুলি নিজেই বুক পেতে নেয়। এই সুযোগেই আমি লেজার গানের ফায়ার করে আলেক্সি গ্যারিনকে হত্যা করি। গৌরী মারা গেছে জোসেফাইন।আহমদ মুসার অবিচল কণ্ঠও যেন শেষ বাক্যে কেঁপে উঠেছিল!
ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। বলল জোসেফাইন।
ইন্নালিল্লাহ পড়লে যে জোসেফাইন? আহমদ মুসা বলল।
তোমার জন্যে যে জীবন দিতে পারে, তোমাকে যে এতটা চেনে, সে তোমার ধর্মকেও ভালো না বসে পারে না। বলল জোসেফাইন।
হ্যাঁ জোসেফাইন, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে সে এক আল্লাহ ও শেষ নবীর উপর তার বিশ্বাসের ঘোষণা দিয়েছে। আহমদ মুসা বলল।
আল্লাহ্ গৌরীকে কবুল করুন! কিন্তু এত বড় অবস্থানে থেকে কেন সে তোমাকে সাহায্য করল? জিজ্ঞাসা জোসেফাইনের।
আহমদ মুসার সাথে অ্যাপেক্স রেস্টুরেন্টে গৌরীর প্রথম দেখা ও কথাবার্তা হয়। গৌরীরা আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করার পর সে ওদের গাড়ি দখল করা, ওদের বন্দী করা, মেটাল জ্যামিং মেশিন রেখে গিয়ে আহমদ মুসাকে নিরবে সাহায্য করা, মতুংগা অ্যাটলের তলদেশে ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ প্রসাদে প্রবেশে গৌরীর সাহায্য এবং সর্বেশেষ ঘটনা ও তার কথাবার্তা সব জোসেফাইনকে জানাল।
সত্যিই দুর্ভাগ্য আমাদের গৌরীর। সে বঞ্চনা ও নারীত্বের চরম অপমানের শিকার। এ সব কিছু কিন্তু তার হৃদয়ের মহৎ বৃত্তিকে হত্যা করতে পারেনি। তাই সে তোমাকে অবলম্বন করে নতুন করে জেগে উঠতে চেয়েছে। সে সৌভাগ্যবানও বটে! সে জীবন দিয়ে যা করেছে, তা করার সৌভাঘ্য কচিৎ কারও ভাগ্যে জোটে। আল্লাহ তাকে কবুল করুন এবং উত্তম যাযাহ দান করুন! তার কবর কোথায় হয়েছে? বলল জোসেফাইন।
আমি অনুরোধ করেছি, তাহিতেই তার কবর হবে। আহমদ মুসা বলল।
তুমি তার জানাজা পড়বে। বলল জোসেফাইন।
অবশ্যই পড়বো জোসেফাইন। আহমদ মুসা বলল।
ধন্যবাদ! বলে একটু থামল জোসেফাইন। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, তোমাকে একটা খবর দিতে চাই।
কি খবর? আহমদ মুসা বলল।
আমি ও আহমদ আব্দুল্লাহ আমেরিকা যাচ্ছি।
আমেরিকা যাচ্ছ? আহমদ মুসার কণ্ঠে বিস্ময়!
বিস্মিত হচ্ছ কেন? অনুমতি তো অনেক আগেই দিয়েছ। বলল জোসেফাইন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, অবশ্যই যাবে। কেন যাচ্ছ এটাই বুঝছি না, বেড়াতে গেলে তো আমাকে সাথে নিতে চাইতে! আহমদ মুসা বলল।
তোমার এত ভক্ত সেখানে যে, নিরবে বেড়ানো যেত না। যেখানে যেতাম, সেখানে জনসভা হয়ে যেত। বলল জোসেফাইন।
কবে যাচ্ছ? কোথায় উঠবে? আহমদ মুসা বলল।
আমার হোস্ট হচ্ছেন খালাম্মা, সারা জেফারসনের মা। আমেরিকা যাব শুনেই বললেন, আমার বাড়িতেই উঠতে হবে, গেষ্ট হিসেবে নয়, মেয়ে হিসেবে। আমি তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারিনি। বলল জোসেফাইন।
ধন্যবাদ জোসেফাইন, তোমার আমেরিকা সফর সুন্দর হবে, সফল হবে। খালাম্মা অত্যন্ত স্নেহময়ী এক মা। সারা জেফারসনের সাথে কি তার আগে কথা বলেছ? আহমদ মুসা বলল। সারা নিউমেক্সিকোতে, চাকুরিতে। মাস খানেকের ছুটিতে দু’একদিনের মধ্যেই সে বাড়িতে আসবে। তাকে আমি কিছু বলিনি। খালাম্মাকেও বলতে নিষেধ করেছি। আমি তাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। বলল জোসেফাইন।
কবে যাচ্ছো? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসা।
তোমার এই মিশনের সমাপ্তির অপেক্ষায় ছিলাম। আজ টিকেট করে ফেলব।
সৌদি আরবের সরকারি কর্তৃপক্ষ কি জানে? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আমি মার্কিন দূতাবাসকে জানাবার পর রাষ্ট্রদূত ও সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালের ডিজি সাহেব এসেছিলেন। তারা সব জানিয়ে গেছেন, ওয়াশিংটন বিমান রিসিভ করবেন এবং সরকারী নিরাপত্তায় আমাকে সারা জেফারসনের বাসায় পৌঁছে দেবে। নিরাপত্তা নিয়ে আমাকে কিছু ভাবতে হবে না। আমি যেখানে থাকব এবং যেখানেই যাব, আমাদের জন্যে সরকারী নিরাপত্তা থাকবে। বলল জোসেফাইন।
আলহামদুলিল্লাহ! বিদেশ-বিভূয়ে যাবে, কোথায় কি করবে, এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা ছিল। সেটা কাটল। দোয়া করি তোমার সফর আনন্দদায়ক হোক! আহমদ মুসা বলল।
শুধু আনন্দদায়ক নয়, সফল হোক, এই দোয়া কর। বলল জোসেফাইন।
কিন্তু কি চাও তুমি এই সফরে? কিসের সাফল্য চাইবে? আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইন হাসল। বলল, ‘আনন্দদায়ক’ শব্দের পরিপূরক হলো সাফল্য। মানুষ বলে না যে, তোমার সফল সফল ও আনন্দদায়ক হোক? বলল জোসেফাইন।
ঠিক আছে আমিও তাই চাইছি। তোমার সফল সফল ও আনন্দদায়ক হোক? বলল আহমদ মুসা।
আমিন! বলল জোসেফাইন।
কিন্তু আমার কষ্টটা বাড়ল জোসেফাইন। বলল আহমদ মুসা।
কি কষ্ট? গম্ভীর কণ্ঠ জোসেফাইনের।
তোমাকে দেখা পাওয়ার সময়টা আরও দীর্ঘ হলো।
জোসেফাইন হাসল। বলল, এসব ডান-বামের কথা রেখে বল তোমার পরবর্তী ডেস্টিনেশন কি? গৌরীর ডাইরিতে কি আছে? আমি ওতে ‘বিপদ’ মানে ‘রহস্যের গন্ধ’ পাচ্ছি।
আমি ওটা পড়িনি। পড়ব আহমদ মুসা বলল।
পড়ার পর কিন্তু আমাকে জানাবে। বলল জোসেফাইন।
অবশ্যই। আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আবার বলল, আহমদ আব্দুল্লাহ কোথায়? এতক্ষণ যে তুমি নিরাপদে কথা বলল।
ও ঘুমিয়ে আছে। বলল জোসেফাইন।
বিদেশে যাবে, দেখ ওকে, চোখে চোখে রেখ। আহমদ মুসা বলল।
সারা ওকে পেলে আমি কতক্ষণ তাকে দেখতে পাব, সেটা বলা মুস্কিল। বলল জোসেফাইন।
তবু সব দায়িত্ব তো তোমারই। আহমদ মুসা বলল।
দোয়া করো। আর কোন কথা? বলল জোসেফাইন।
আরো একটা কথা আছে তবে. . .। আহমদ মুসা বলল।
বুঝেছি, আমি রাখলাম। আহমদ আব্দুল্লাহ উঠলে আবার টেলিফোন করব। আচ্ছালামু আলায়কুম। বলল জোসেফাইন।
অনেকক্ষণ রইলাম। ওয়া আলাইকুম সালাম। আহমদ মুসা বলল।
মোবাইলটা রেখেও আহমদ মুসা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তার চোখে শূণ্য দৃষ্টি। চোখে ভাসছে জোসেফাইনের হাসি মাখা সুন্দর মুখটা। সত্যই হৃদয়ে সে অনুভব করছে জোসেফাইনের দূরত্ব।
অনেকক্ষণ পর বালিশটা টেনে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। পাশ থেকে টেনে নিল গৌরীর ডাইরিটা।
Leave a Reply