‘স্যরি ম্যাডাম। আপনাকে মুখ খুলতেই হবে, আমাদের প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে। দরকার হলে আপনাকে আমরা থানায় নেব। আপনার পেছনে যে মহিলারা দাড়িয়ে আছেন, তারা পোশাকে সিভিলিয়ান বটে, কিন্তু তারা দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার। বাড়িটাও চারিদিক থেকে পুলিশে ঘেরা।’ বলল আহমদ মুসা।
আয়েশা আজীমা মাথা নিচু করে বসেছিল। তার মুখে কিন্তু ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আহমদ মুসা শান্ত কণ্ঠের কঠোর কথাগুলো আয়েশা আজীমার চেহারায় সামান্য চাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি করল না।
আহমদ মুসার ডান পাশের সোফায় বসেছিল তাহির তারিক, বাম পাশের আরেক সোফায় বসেছিল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
আয়েশা আজীমা বসে ছিল সামনে একটু দূরের একটা সোফায়। মাঝখানে লাল কার্পেটে মোড়া বর্গাকৃতির ছোট্ট একটা চত্বর। তাতে শুধু একটা ‘টী’ টেবিল।
তার পরনে পাজামা ও ফুলহাতা কামিজ। কামিজের উপর একটা কুকিং অ্যাপ্রন।
আয়েশা আজীমা রান্নাঘরে ছিল। সেখানে সে যেভাবে ছিল মহিলা পুলিশ অফিসারেরা তাকে সেভাবেই ধরে নিয়ে এসেছে।
তার মাথায় একটা রুমাল বাঁধা।
বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিছাত্রী ও সেরা সুন্দরী ছিল আয়েশা আজীমা। সৌদি ছাত্র শেখ বাজের মেধা ও বিত্তই সম্ভবত শেখ আয়েশা আজীমাকে আকৃষ্ট করে। আকর্ষণ শেষে প্রেম ও বিবাহে পরিণতি লাভ করে।
আয়েশা আজীমা আহমদ মুসার কথার কোন জবাব না দেয়াতে আহমদ মুসা জেনারেল তারিক ও জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের দিকে একবার তাকাল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে আয়েশা আজীমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘দেখুন, চুপ থেকে লাভ নেই। ড. শেখ বাজ হাতে-নাতে ধরা পড়েছেন। তার কাছ থেকে কোটপিনের আকারে এই শক্তিশালী ট্রান্সমিটার পাওয়া গেছে। তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছেন, তার কোটপিনে যে ট্রান্সমিটার তা তিনি জানেন না। কিন্তু আইন তার এ কথা মানবে না। ধরা পড়ার পর সব অপরাধীই এমন কথা বলে। এখন আমরা জানতে চাই আপনার এ ব্যাপারে বক্তব্য কি? কারণ তিনি বলেছেন, কোটপিন আপনার সংগ্রহ করা।’
থামল আহমদ মুসা।
আয়েশা আজীমা একবার মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে চাইল। কোন কথা নেই তার মুখে। তবে প্রথমবারের মত তার চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠতে দেখা গেল।
আহমদ মুসা মুখ একটু নিচু করে ভাবল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক সূক্ষ্ণ হাসি। বলল সে, ‘তাহলে বুঝা গেল মিসেস বাজ, আপনি কিছুই জানেন না। ড. শেখ বাজই মিথ্যা কথা বলেছেন। সত্য তাহলে তার কাছেই পাওয়া যাবে। তার কাছ থেকেই সত্য এবার বের করতে হবে। সত্য বের করার কৌশল পুলিশের জানা আছে। বাবা ডেকে সব সত্য কথা বলে দেবেন তিনি। আমরা উঠছি। যতদিন না বিষয়টির সুরাহা হয় ততদিন আপনি পুলিশের কাস্টডিতে…।’
কথা শেষ করতে পারল না আহমদ মুসা। চিৎকার করা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল আয়েশা আজীমা, ‘না, আমি সব বলব। ওর কোন দোষ নেই। ওঁর মত ভাল মানুষ কোন অপরাধ করতে পারেন না। তার কোন ক্ষতি করবেন না, তাকে আপনারা ছেড়ে দিন।’
কথাগুলো বলে থামল আয়েশা আজীমা। দু’হাতে মুখ ঢেকে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।
‘ওঁর কোন দোষ নেই দোষটা তাহলে কার, এটাই তো আমরা জানতে চাচ্ছি। সব বলুন আপনি আমাদের।’ বলল আহমদ মুসা।
আয়েশা আজীমা হাতের রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘আমি একটা স্টেটমেন্ট করব, আপনি লিখুন।’
আহমদ মুসা তাকাল তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের দিকে।
বুঝতে পেরে জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল ইশারা করে আয়েশা আজীমার পেছনে দাঁড়ানো তিন মহিলা পুলিশ অফিসারের একজনকে ডেকে বলল, ‘মিসেস বেরিল ডেডেগ্লু, আপনি ওঁর স্টেটমেন্টটা লিখুন।’
মিসেস বেরিল ডেডেগ্লু এই এলাকার একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত অফিসার।
মিসেস ডেডেগ্লু পকেট থেকে নোটশিট ও কলম বের করে আয়েশা আজীমার পাশের সোফায় বসে পড়ল। বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাডাম, বলুন।’
আয়েশা আজীমা মিসেস ডেডেগ্লুর কাছ থেকে নোটশীট ও কলম নিয়ে নিল এবং কয়েকটি নোটশীটের শেষ প্রান্তে নিজের নাম দস্তখত করে ওগুলো মিসেস ডেডেগ্লুর হাতে ফেরত দিল।
স্টেটমেন্ট করার আগেই স্টেটমেন্টশীটে সত্যয়নকারী দস্তখত করায় অবাকই হল আহমদ মুসা। বেরিল ডেডেগ্লুও। তার চোখেও বিস্ময়।
‘লিখুন’, বলতে শুরু করল আয়েশা আজীমা, ‘আমি আয়েশা আজীমা ওরফে আলিশা দানিয়েল স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে এই স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছি যে, ‘আমি ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট (থ্রি জিরো) নামক সংস্থার দেয়া অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে তাদের সরবরাহ করা ‘কোটপিন’ আকারের শক্তিশালী ট্রান্সমিটার আমার স্বামীর কোটে নিয়মিত লাগিয়ে রাখার মাধ্যমে রিসার্চ সেন্টারের যাবতীয় কথোপকথন পাচার করেছি। আমার স্বামীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা ব্যবহার করা তাঁর অজ্ঞাতে তাঁদেরই বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্র করতে আমি বাধ্য হয়েছি। কেন এভাবে আমি বাধ্য হলাম, কেন আমার প্রিয়তম স্বামী ও তার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র করতে বাধ্য হলাম, তার পেছনে আছে আমার এক অসহায়ত্ব। সে অসহায়ত্ব হলো আমার স্বামীকে রক্ষার এক নিরুপায় ব্যবস্থা। আমি ওদের ষড়যন্ত্রের সাথী না হলে ওরা আমার স্বামীকে হত্যা করত। আমি জানি আমার স্বামীকে কেউ-ই ওদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারত না। শুধু ‘থ্রি জিরো’ই তখন আমার শত্রু হতো না, তুরস্কের পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে আমার মত ছদ্মবেশী অনেকে আছে যারা ‘থ্রি জিরো’ অর্থাৎ ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট-এর পক্ষে কাজ করছে তারাও আমার স্বামীর হন্তায় পরিণত হতো। আমার অন্যায় হয়েছে, আমার ছদ্মবেশ সম্পর্কে আমার স্বামীকে না বলা, এমন ছদ্মবেশ নিয়ে তার মত একজন ভালো ও জাতিপ্রেমিক মানুষকে বিয়ে করাও আমার অন্যায় হয়েছিল। কিন্তু তার প্রতি আমার প্রেম আমাকে অন্ধ করেছিল। তাঁকে বিয়ে না করেও পারিনি, তাঁকে হারাবার ভয়ে আমার ছদ্মবেশ সম্পর্কেও তাঁকে বলতে আমি সাহস পাইনি।
আমি স্বীকার করছি। আমার ছদ্মবেশ ছিল পরিকল্পিত। হাজারো ইহুদী তরুণী যেভাবে তাদের নাম পরিচয় পাল্টে মুসলিম ও খ্রিস্টান সমাজে ঢুকে পড়েছে, আমি তাদেরই একজন। লেবাননের বেকা অঞ্চলের এক ইহুদী পরিবারে আমার জন্ম। স্কুল সার্টিফিকেট পর্যায় পর্যন্ত আমি ইসরাইলের তেলআবিবে পড়ি। তারপর বেকায় ফিরে আসি। বেকায়ই আমার পরিবারের পরিচিত আয়েশা আজীমার নাম পরিচয় আমাকে গ্রহণ করতে বলা হয়। তার সমস্ত শিক্ষা ডকুমেন্টও আমাকে দেওয়া হয়। এই সব ডকুমেন্টের জোরে আমি আয়েশা আজীমা রূপে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাই। আমি পুরোপুরি আয়েশা আজীমা হয়ে যাই। পরে শুনেছি, স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পাশের পর আয়েশা আজীমা নিহত হয়। কেউ আমাকে বলেনি, তবে এখনও আমি বিশ্বাস করি আমাকে আয়েশা আজীমা বানাবার জন্যেই তাঁকে হত্যা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে হঠাৎই কৃতি ছাত্র শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজের সাথে আমার পরিচয় হয়। ভালো লেগে যায়। শুধু কৃতি ছাত্র বলে নয়, তার চরিত্রের দৃঢ়তা ও মেয়েদের প্রতি নির্মোহ ভাব আমাকে আকৃষ্ট করে বেশি। তার মত ঠাণ্ডা ছেলেকে উত্তপ্ত করতে আমার অনেক সময় লেগেছে। জার্মানিতে পিএইচডি করার সময় তার কাছ থেকে বিয়ের ইতিবাচক সাড়া আমি পাই। ইতিমধ্যে ‘থ্রি জিরো’-এর সাথে আমার পরিচয় হয়ে গেছে। পরে জেনেছি তারাই জার্মানিতে পড়ার জন্য আমার স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছে। বৈরুতে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচও আমার বাবা-মায়ের মাধ্যমে তারাই দেয় বলে জানতে পারি। শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজের সাথে আমার সম্পর্কে ‘থ্রি জিরো’ আমাকে দারুণভাবে কনগ্রাচুলেট করে এবং বলে যে, সৌদি আরবের এমন পরিবারের ছেলে সে সৌদি আরবের বড় কোন এক দায়িত্বে যাবেই। শেখ বাজের উপর তাদের চোখ রাখাকে আমি ভাল চোখে দেখিনি, কারণ এটা আমার একান্তই প্রাইভেট ব্যাপার। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। কেউ আমাকে না বলে দিলেও আমি জানতাম, আমাদের জাতীয় এই সংগঠনের কথা আমাকে মানতে হবে। পিএইচডি করার পর জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ বাজের চাকরি হয়ে গেল। ‘থ্রি জিরো’র লোকরা এসে আমার সাথে দেখা করল। সংবাদপত্রের বিজ্ঞপ্তির একটা কাটিং আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ বাজের চাকরি করা যাবে না। যে কোনভাবে এই বিজ্ঞপ্তির চাকরিই যোগাড় করতে বলো। আমি বিজ্ঞপ্তি পড়ে দেখলাম, সেটা ইস্তাম্বুলের ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি সংস্থায় ‘ডাইরেক্টর অব ম্যানেজমেন্ট’ পদে নিয়োগের একটা বিজ্ঞপ্তি। আমি ওদের বললাম, এটা একটা ম্যানেজারিয়াল পদ, কিন্তু শেখ বাজের পছন্দ একাডেমিক কাজ। তারা চাপ দিয়ে বলল, না এই চাকরিই তাঁকে যোগাড় করতে হবে। তারা যুক্তি হিসেবে বলল, ওআইসির গোপন অর্থ ও তত্ত্বাবধানে এই ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছে। এটাকে ঘিরে নিশ্চয়ই ওআইসির এক বড় পরিকল্পনা আছে। সেখানে কি হয় এটা আমাদের জানা দরকার। সুতরাং শেখ বাজকে সেখানে ঢুকাতেই হবে। আমি পছন্দ করি বা না করি, এটা আমাকে মেনে নিতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি ইস্তাম্বুলে এবং রিসার্চ ও টেকনোলজির সাথে জড়িত বলে এই চাকরি নেওয়ার জন্য শেখ বাজ আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যায়। বরং আমি তার কাছ থেকে ধন্যবাদই পাই যে এমন একটা বিজ্ঞাপনের দিকে আমার নজর গেছে। ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজি (আইআরটি)-তে তার চাকরি হয়ে যায়। এই পদের জন্য তার মত যোগ্য লোকই তারা খুঁজছিল। তার চাকরি হওয়ার পরই নতুন সঙ্কট আমার সামনে স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়। ‘থ্রি জিরো’ অনেকগুলো ‘আল্লাহ’ শব্দ অঙ্কিত অন্ধকারেও জ্বলে এমন দামি পাথরের তৈরি দেওয়াল ‘শো পিচ’ আমাকে দিয়ে বলে আইআরটির তিন ফ্লোরেই দেওয়ালের দর্শনীয় স্থানে শেখ আব্দুল্লাহর দ্বারা এগুলো লাগিয়ে দিতে। তাদের প্রস্তাবে আমি চমকে যাই। বুঝতে পারি ‘শো পিচ’ এর কভারে এগুলো নিশ্চয়ই গোয়েন্দা যন্ত্র, গোপন ক্যামেরা বা গোপন ট্রান্সমিটার হতে পারে। আমি ওদের বললাম, এটা সেট করাকে শেখ বাজ নিজেও সন্দেহের চোখে দেখতে পারে অথবা কারও সন্দেহের শিকার হতে পারে। সেসহ আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। আমার যাই হোক, আমার স্বামীর কোন ক্ষতি আমি করতে পারবো না। তাদের প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপরই তারা আনে ‘কোটপিন’-এর প্রস্তাব। এটাও ঝুঁকিপূর্ণ বলে আমি এই ব্যাপারে সহযোগিতা করতে অপারগতা প্রকাশ করি। এরপরই তারা আবির্ভূত হয় স্বমূর্তিতে। বলে যে, ‘আমি যদি প্রতিদিন স্বামীর কোটে তাদের দেওয়া কোটপিন রাখার ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করি, তাহলে যে স্বামীকে রক্ষার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না, সেই স্বামীকেই আমাকে হারাতে হবে। আমি অস্বীকার করার পর একদিনও তাঁকে বাচতে দেয়া হবে না। আর আমি যদি তাদের এসব কথা আমার স্বামী, পুলিশ বা কাউকে বলি, তাহলে স্বামীর সাথে আমার মেয়েকেও শেষ করে ফেলবে ওরা। আমি নিরুপায় হয়ে যাই। আমি স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাই না, কিন্তু তার চেয়েও বড় হল, আমি কিছুতেই তাঁকে হারাতে চাই না, এই পর্যায়ে এসেই আমার জন্য কম ক্ষতিকর হিসেবে তাদের ‘কোটপিন’-এর প্রস্তাব গ্রহণ করি। প্রাণপ্রিয় স্বামীর সাথে এই বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য প্রতিপল, প্রতিক্ষণ আমি দগ্ধ হয়ে এসেছি। একটা সান্ত্বনা আমার ছিল, সেটা হল স্বামীর সাথে এই বিশ্বাসঘাতকতা করে আমি আমার স্বামীকে রক্ষা করেছি। আমার স্বামীকে দয়া করে আপনারা রক্ষা করবেন। আমিই আমার স্বামীর জন্য মুসিবত। আমি চাই এই মুসিবত থেকেও উনি মুক্তি পান। আর আমিও চাই দুঃসহ, দুর্বহ ব্ল্যাকমেইলের হাত থেকে মুক্তি।’
কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে থামল আয়েশা আজীমা।
সংগে সংগেই আহমদ মুসার প্রশ্ন, ‘ম্যাডাম, এই দুঃসহ, দুর্বহ ব্ল্যাকমেইল যারা করতো, যারা এখানে আপনার সাথে যোগাযোগ করতো, তাদের পরিচয় সম্পর্কে দয়া করে বলুন।’
‘আমার স্টেটমেন্ট শেষ জনাব। আমার স্বামীকে দয়া করে দেখবেন।’
বলেই আয়েশা আজীমা তার বাম হাতের অনামিকার আংটির নিল পাথরটাকে কামরে ধরল।
আয়েশা আজীমাকে তার হাতের আংটি মুখে নিতে দেখেই আহমদ মুসা উঠে দাড়িয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাতটাকে ধরে ফেলার জন্যে। কিন্তু হাতটা ধরে ফেলার আগেই হাতের আংটি কামড়ে ধরেছিল আয়েশা আজীমা।
আহমদ মুসা দ্রুত হাতটা টেনে নিল আয়েশা আজীমার মুখ থেকে।
আয়েশা আজীমার মুখে এক টুকরো নির্দোষ হাসি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু মুহূর্তেই তা কোথায় মিলিয়ে গেল। সোফার উপর এলিয়ে পড়ল আয়েশা আজীমার দেহ।
পেছনে নির্বাক দাঁড়ানো দুই পুলিশ অফিসার ও আয়েশার স্টেটমেন্ট লেখা পুলিশ অফিসারগণ। এই তিন পুলিশ অফিসার গিয়ে ধরল আয়েশা আজীমাকে। তাদের একজন বলল, ‘আমরা বুঝতেই পারিনি ইনি কি করতে যাচ্ছেন। তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।’
হতাশ আহমদ মুসা ধপ করে সোফায় বসে বলল, ‘কোন লাভ নেই পুলিশ অফিসারগণ। পটাসিয়াম সাইনাইড কাউকে এন্টিডোজ নেয়ার সুযোগ দেয় না।’
উঠে দাঁড়িয়েছিল জেনারেল তাহির এবং জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালও। তারাও বসল।
আয়েশা আজীমাকে সোফায় শুইয়ে দিতে দিতে বলল মিসেস বেরিল ডেডেগ্লু, ‘স্যার, সংগে সংগেই কি করে নিশ্চিত হলেন, উনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়েছেন?’ প্রশ্নের লক্ষ্য আহমদ মুসা।
‘সেদিন ‘থ্রি জিরো’র ইরগুন ইবানও আমার হাত ফসকে এভাবেই মরেছে পটাসিয়াম সাইনাইড খেয়ে। সেদিন তাকে বাঁচানো যেমন জরুরি ছিল, একে বাঁচানোও তেমন জরুরি ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তবুও এর কাছ থেকে কিছু জানা গেল।’ বলল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
‘শুধু নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ষড়যন্ত্র সম্পর্কে একজনের নাম প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই বলেননি। আমরা জানি ডঃ বাজ নির্দোষ। আয়েশা আজীমা তাকে নির্দোষ প্রমাণ করায় আমাদের কোন লাভ হয়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তবে ডঃ বাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে, আপনি এই চাল না চাললে আমার মনে হয় আয়েশা আজীমা এটুকুও বলতেন না। আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল জেনারেল তারিক।
‘ঠিক বলেছেন জনাব। স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় কোন খাদ ছিল না তার। স্বামীকে বাঁচানোর জন্যেই এই স্টেটমেন্ট তিনি দিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ইস্তাম্বুলের ষড়যন্ত্রের যারা হোতা, যারা তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে তাদের সম্বন্ধে না বলায় কি প্রমাণ হয় যে তিনি ‘থ্রি জিরো’র প্রতিও বিশ্বস্ত ছিলেন।’ পুলিশ অফিসার বেরিল ডেডেগ্লু বলল।
‘হ্যাঁ, বলা হয় দ্বৈত আনুগত্য আয়েশা আজীমার মধ্যে ছিল। একদিকে তিনি স্বামীকে ভালোবাসতেন বলে স্বামীর সমাজ ও জাতির প্রতিও তার একটা ভালোবাসা ছিল। আবার যারা পেছন থেকে সহযোগিতা দিয়ে তাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, তাদের প্রতিও একটা আনুগত্য তার ছিল। তবে আয়েশা আজীমার স্টেটমেন্টের শেষ কথা প্রমাণ করে তিনি তাদের জাতির ওই লোকদের ভয় করতেন, ভালোবাসতেন না। তাদের হাত থেকে স্বামীকে মুক্ত করা ও নিজে মুক্ত হবার জন্যেই তার এই মৃত্যু।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অনেক ইহুদিই কিন্তু ওদের ষড়যন্ত্রের সাথে নেই।’ জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল।
‘অনেক’ বলছেন কেন, আমার জানা মতে নব্বই ভাগ ইহুদিই ওদের সাথে নেই। তারা ধার্মিক, শান্তি ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী। মাত্র জায়নিস্ট বা ইহুদীবাদী বলে পরিচিত মুষ্টিমেয়রাই পৃথিবীব্যাপী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তাদের চাঁদাবাজি ও হুমকি-ধমকিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ইহুদীরা অতিষ্ঠ ও অসহায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছেন জনাব খালেদ খাকান। এই সাধারণ শান্তিবাদী ইহুদীরা ঐক্যবদ্ধ না থাকা এবং অসংগঠিত হওয়ার কারণেই এদের কণ্ঠ শ্রুত হয় না, এদের কণ্ঠ কোন শক্তি নয়।’
বলেই একটু থেমে আবার বলে উঠল, ‘করনীয় কাজের কথায় আমরা ফিরে আসতে পারি। প্রথমে ডঃ শেখ বাজকে ডাকা দরকার। তিনি এলেই আমরা লাশ নেবার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজ করতে পারি।’
‘ধন্যবাদ জনাব। আমি ডাকছি ড. শেখ বাজকে। আপনি অন্য বিষয় নিয়ে ভাবুন প্লিজ।’ জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালকে লক্ষ্য করে বলল জেনারেল তাহির।
‘ঠিক আছে, আপনারা এসব করুন। আমাকে এখনি উঠতে হবে। আয়েশা আজীমার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ হবার আগেই আমি আরেক ঘাঁটিতে হানা দিতে চাই। সেখানে থাকেন আয়েশা আজীমা বা সেদিনের ইরগুন ইবানের চেয়ে বড় কেউ। তাকে আমাদের হাতে পেতেই হবে। ‘থ্রি জিরো’র ভেতরে ঢোকার প্রত্যক্ষ এই একটা দরজাই আমাদের সামনে খোলা আছে।’
বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘আল্লাহ আপনাকে সফল করুন খালেদ খাকান। কিন্তু একা যাবেন না। অগ্রবাহিনী কিংবা পশ্চাৎবাহিনী যেভাবেই হোক আপনার পছন্দনীয় একদল পুলিশ আপনি নিন।’ বলল জেনারেল তাহির আহমদ মুসাকে।
জেনারেল তাহির থামতেই জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘আমি পুলিশ প্রধানকে বলে দিচ্ছি এবং মোবাইল নাম্বারও দিচ্ছি। তিনি আপনার সাথে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। কোথায় যাচ্ছেন, কি কাজ- এ সম্পর্কে তিনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, আপনিও তাকে কিছু বলবেন না।’
‘ধন্যবাদ আপনাদের। আমি আসি। আমি যাচ্ছি গোল্ডেন হর্নের ওপারে। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে আহদ মুসা বেরুবার জন্যে দরজার দিকে পা বাড়াল।
ডঃ শেখ বাজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি নিয়ে ছুটল বসফরাস ব্রীজ অর্থাৎ কামাল আতাতুর্ক ব্রীজের দিকে। ওই ব্রীজ দিয়ে বসফরাস উপকুলের হাইওয়ে ধরে গোল্ডেন হর্নের গালাটা ব্রীজ পার হয়ে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব তাড়াতাড়ি পৌছা যাবে।
আহমদ মুসার গাড়ি বসফরাস ব্রিজে ওঠার পরই গাড়ির রিয়ারভিউতে দেখল ৪টা গাড়ি সারি বেঁধে একই গতিতে তার পেছনে ছুটে আসছে।
ব্রীজের মাঝামাঝি এসে দেখল ব্রীজের ওপাশ থেকে আরও চারটা গাড়ি হঠাৎ রং সাইড এ এসে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে দাঁড়াল। গোটা রাস্তা জুড়ে তারা দাড়িয়ে। কোনভাবেই তাদের পাশ কাটানো সম্ভব নয়।
আহমদ মুসা ডান দিকে ব্রীজে ওপাশে রিটার্ন লেনের দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে কতকগুলো গাড়ি দাড়িয়ে ডানদিকটাও ব্লক করে ফেলেছে।
আশ্চর্যের বিষয়, সবগুলো গাড়িই, ওয়াগন মিনিট্রাক। আর আহমদ মুসার গাড়ি ১৩০০ সিসির আমেরিকান কার। ওদের তুলনায় বাচ্চা।
তিন দিক থেকেই অবরুদ্ধ আহমদ মুসা। হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি দাড় করায় আহমদ মুসা। বাঁ দিকে দেখেছে আহমদ মুসা ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালের সমান্তরাল প্যানেলবার গাড়ির সমান্তরালে।
আহমদ মুসার গাড়ি দাড়িয়ে পড়তেই তিন পাশের গাড়িগুলোও দাঁড়িয়ে পড়েছে।
তিন দিকে উঁচু গাড়ির দেয়ালের মাঝখানে আহমদ মুসার গাড়ি।
গাড়িগুলো থামতেই নেমে এল একদল মানুষ। প্রত্যেকের হাতে স্টেনগান।
আহমদ মুসা বুঝে গেছে সব। নিশ্চয় ‘থ্রি জিরো’র লোকরাই আগাম পরিকল্পনার মাধ্যমে তাকে সব দিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। ঘেরাও করে ফেলা এতগুলো স্টেনগানের বিরুদ্ধে তার এক রিভলবার কোন কাজেই আসবে না। বরং তাদের গুলী এড়াতে হলে তাকে রিভলবার বের করা চলবে না। মাত্র খোলা থাকা বসফরাসের দিকসহ চারিদিকে একবার চেয়ে মুহূর্তের জন্য করনীয়টা ঠিক করে নিয়ে আহমদ মুসা বসফরাসের দিকে মানে বাম দিকের দরজা খুলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির ছাদে উঠে দু’হাত তুলে দাঁড়াল।
সংগে সংগেই ডান পাশ থেকে একজন চিৎকার করে বলল, ‘কেউ গুলী করবে না। ওকে মৃত পেলেও আমাদের চলবে, কিন্তু জীবন্তই বেশি দরকার। একটা গুলিতে তার আরামের মৃত্যু হলে তার কাছে আমাদের পাওনা শোধ হবে না। তোমরা কয়েকজন গিয়ে তাকে বেঁধে গাড়িতে তোল।’ নির্দেশের সাথে সাথেই তিন দিক থেকে চার পাঁচজন ছুটল আহমদ মুসার দিকে।
‘তোমরা কারা? আমার দোষটা কি? তোমরা এসব কথা বলছ কেন?’
চিৎকার করে এসব কথা বলতে বলতে আহমদ মুসা ইঞ্চি ইঞ্চি করে পেছনে হটে গাড়ির বাম প্রান্তের দিকে এগোচ্ছিল। সে জানে ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালের প্যানেলবার থেকে দু’শ ফুটেরও বেশি নিচে বসফরাসের পানি। ওদিকেও মৃত্যুর হাতছানি তবু তার রক্তের জন্যে হন্যে হয়ে থাকা ‘থ্রি জিরো’র কশাইদের হাতে পড়ার চেয়ে বসফরাসের পানিতে ঝাঁপ দেওয়া অনেক ভালো।
আহমদ মুসার গাড়ির ছাদ থেকে ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালের প্যানেলবারের ব্যবধান দেড় ফুটের বেশি নয়।
আহমদ মুসার দিকে ছুটে আসা লোকগুলো তার গাড়ির পাশে এসে গেছে। ওরা উঠে আসছে গাড়ির ছাদে।
আহমদ মুসা তখন গাড়ির ছাদের বাম পাশের শেষ প্রান্তে।
লোকগুলো উঠে এসেছে গাড়ির ছাদে। তাদের চোখে-মুখে ক্রুর হাসি। যেন কাঁটা-ছেঁড়ার জন্যে একটা অসহায় গিনিপিগ তারা পেয়ে গেছে।
লোকগুলো এগুচ্ছে আহমদ মুসার দিকে। তাদের কয়েকজনের দেহ আহমদ মুসা ও স্টেনগানধারীদের মাঝখানে একটা দেয়াল সৃষ্টি করেছে।
লোকগুলো আরও ক্লোজ হয়েছে আহমদ মুসার।
হঠাৎ আহমদ মুসা এবাউট টার্ন করে লাফ দিয়ে ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালবারে উঠে দেহে একটা ঝাঁকি দিয়ে দক্ষ সাঁতারুর মত শূন্যে সামনে দু’হাত বাড়িয়ে ড্রাইভ দিয়ে বাতাস কেটে ছুটল বসফরাসের নিল জলরাশির দিকে। পেছনের লোকগুলো তখন চিৎকার করে উঠে সবাই কাঁধের স্টেনগান হাতে নিয়ে গুলী করতে শুরু করেছে উড়ন্ত দেহ লক্ষ্যে।
মেজর জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের বাম পাশ থেকে টেলিফোন বেজে উঠল।
বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে।
তার সামনে একটা ফাইল খোলা। ছড়িয়ে আছে অনেক কাগজপত্র। সে ও জেনারেল তাহির তারিক দু’জনে কাগজগুলো পরীক্ষা করছিল। এ কাগজগুলো এনেছে তারা আয়েশা আজীমার ব্যক্তিগত ফাইল থেকে। নোটবুকগুলোও তার আনা হয়েছে। ডঃ শেখ বাজ তাদেরকে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সহযোগিতা করেছে। তার চোখে অশ্রু ছিল, কিন্তু মৃতা স্ত্রীর কোন কিছুই সে তাদের কাছে গোপন রাখেনি। সে চেয়েছে তার স্ত্রীকে যারা ব্ল্যাকমেইল করেছে, ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কাজে ব্যবহার করেছে, তাদের স্বরূপটি উদঘাটিত হোক। তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পাক তাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান এবং পৃথিবীর শান্তিকামী মানবতার আশার প্রদীপ ‘আইআরটি’ (ইনিস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি)। তার স্ত্রীর শেষ পরিচয়টা তাকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। ডঃ বাজ জেনারেল তাহির তারিকদের কাছ থেকে শুনেছে, তার স্ত্রী তাকে সব সন্দেহ থেকে বাঁচাবার জন্যেই নিজের সব কথা সে বলেছে এবং সব অপরাধের স্বীকৃতি দিয়েছে। তার স্ত্রী নিজের দায়ভার নিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে, কিন্তু চেয়েছে স্বামীর গায়ে যেন কোন কালো দাগ না লাগে। ইহুদী কন্যা হিসেবে ষড়যন্ত্রে শামিল থাকলেও স্বামীকে সে ভালবেসেছে প্রাণ দিয়ে। স্ত্রী আয়েশা আজীমা তাকে ঠকিয়েছে তার পরিচয় গোপন করে, জঘন্য অপরাধ করেছে তাকেও ষড়যন্ত্রের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু সে সমগ্র অন্তর দিয়ে অনুভব করছে তার ভালোবাসায় সামান্য কোন খাদ ছিল না। ডঃ শেখ বাজের চোখে অবিরল অশ্রু শুধু এ কারণেই।
একরাশ বিরক্তি নিয়েই জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল তাকাল টেলিফোনের সাইড টেবিলের দিকে। লাল, নীল, সাদা ও কালো অনেকগুলো টেলিফোন সেখানে। পিএবিএক্স ও প্রাইভেট কালো ও সাদা টেলিফোন দুটোই তাকে বিরক্ত করে বেশি।
কিন্তু নীল টেলিফোনটা বাজতে দেখে মুখের বিরক্তি ভাবটা কেটে গেল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের। এ টেলিফোনটা গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের।
টেলিফোন তুলে নিয়ে নিস্পৃহভাবে ওপারের কথা শুনল, দু’একটা নির্দেশও দিল।
টেলিফোন রেখে ঘুরে বসে কাগজ-পত্রে মনোযোগ দেবার আগে বলল, ‘জেনারেল তাহির, বসফরাস ব্রীজে কি যেন একটা ঘটনা ঘটেছে। প্রচুর গোলা-গুলি হয়েছে। কিন্তু প্রাণহানির ঘটনা নেই। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ভয়ানক যানজট ছিল। বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট এখনও পুরো পাওয়া যায়নি।’
বসফরাস ব্রীজ, আর গোলা-গুলির কথা শুনে আগ্রহের সাথে মুখ তুলল জেনারেল তাহির তারিক। বলল, ‘ঘটনা ঘটেছে ক’টায়?’
‘পৌনে একটায়।’ বলল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো জেনারেল তাহির তারিকের। বলল, ‘মিঃ খালেদ খাকান ড. বাজের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল বারটা তিরিশ মিনিটে। গোল্ডেন হর্নে যাবার জন্যে তিনি যদি বসফরাস ব্রীজ ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে কতকটা এই সময়েই তো তার ব্রীজ অতিক্রম করার কথা।’
‘আপনি মিঃ খালেদ খাকানের বিষয়টা এর মধ্যে আনছেন কেন? আপনি কিছু ভাবছেন?’ বলল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
‘ঠিক তেমন নয়, তবে এই সময় মিঃ খালেদ খাকান ঐ এলাকায় থাকার কথা, যদি তিনি বসফরাস ব্রীজ ব্যবহার করে থাকেন, এটাই বলছি।’ জেনারেল তাহির তারিক বলল।
সংগে সংগে কথা বলল না জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল। ভাবান্তর ঘটেছে তার চোখে-মুখে। ছোট হয়ে এসেছে তার দুই চোখ। সিরিয়াসলিই ভাবছে সে।
কয়েক মুহূর্ত চিন্তার পর ঘুরল টেলিফোনের দিকে। তুলে নিল নীল টেলিফোন। একটা কল করল।
ওপার থেকে সাড়া পেতেই বলল, ‘ওয়া আলাইকুম সালাম। হ্যাঁ, বসফরাস ইষ্ট পুলিশ স্টেশন! তোমরাই তো দেখেছ বসফরাসের ঘটনাটা?’
ওপারের উত্তর শুনে নিয়ে জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘হ্যাঁ, বল, ওখানে কি ঘটেছে? হত্যা, কিডন্যাপের চেষ্টা? ব্রীজ থেকে একজন বসফরাসে লাফিয়ে পড়েছে? জানা গেছে সে কে? গ্রেফতার হয়েছে কেউ?’ জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের চোখে বিস্ময় ও উদ্বেগ দুইয়ের মিশ্রণ।
ওপ্রান্তের উত্তর শোনার পর জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘আক্রান্ত বলে যে কারটিকে তোমরা সন্দেহ করছ, তার নাম্বার কত?’
ওপার থেকে উত্তর পেল। উত্তর পাওয়ার সাথে সাথেই তার চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রকাশ ঘটল। দ্রুত কণ্ঠে সে বলল, ‘স্পটে কে আছে?’
উত্তর শুনে নিয়ে বলল, ‘আমরা যাচ্ছি সেখানে, জানিয়ে দাও ওদের।’
বলেই টেলিফোন রেখে ঘুরল জেনারেল তাহির তারিকের দিকে।
জেনারেল তাহিরের চোখে-মুখে প্রশ্ন, তার সাথে আশঙ্কার কালো ছায়া।
ঘুরে বসেই জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘সর্বনাশ হয়েছে, আক্রান্ত গাড়িটা খালেদ খাকানের। তার মানে তিনি ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়েছেন।’ শুষ্ক, উদ্বেগাকুল গলা জেনারেল মোস্তফা কামালের।
মুখের আলো যেন দপ করে নিভে গেল জেনারেল তাহিরের। চোখে –মুখে তার এক বোবা আতঙ্ক। কয়েক মুহূর্ত তার বাক স্ফূরণ হলো না। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘তার পরের খবর কি, মানে খালেদ খাকানের খবর কি?’ কম্পিত কণ্ঠ জেনারেল তাহির তারিকের।
‘বসফরাসে অনুসন্ধান চলছে। পুলিশ, গোয়েন্দা ও নৌবাহিনীর কয়েকটা ইউনিট কাজে নেমেছে। চলুন আমরা যাই। যেতে যেতেই প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টা জানাব।’
বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল তাহিরও।
উঠেই আবার বসে পড়ল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল। বলল, ‘জেনারেল মিঃ তাহির, আপনি গাড়ির দিকে যান। জরুরি আরও কয়েকটা কল সেরে আমি আসছি।’
‘আসুন’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জেনারেল তাহির তারিক।
ঘর থেকে বেরিয়ে লিফট হয়ে নেমে এল আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরের একদম গাড়ি বারান্দায়। এ বিশেষ গাড়ি বারান্দায় লিফটের সামনেই তার ও জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। একটু দুরেই এটেনশন অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল দু’জন কমান্ডো। তারা গাড়ির সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করছিল।
তারা জেনারেল তাহিরকে দেখে স্যালুট দিয়ে আবার স্থির দাঁড়িয়ে গেল।
নানা আশংকা জেনারেল তাহিরকে ঘিরে ধরেছে। আহমদ মুসা দু’শ দশ ফিট উঁচু বসফরাস ব্রীজ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছে, এ কথা মনে হতেই বুক কেপে উঠছে জেনারেল তাহিরের। কোন মানুষ কি এমন সাহস করতে পারে। আহমদ মুসাই হয়ত পারে। কিন্তু তারপর কি ঘটেছে? আর ভাবতে পারছে না জেনারেল তাহির। গোটা সত্ত্বা তার একসঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠছে, আহমদ মুসার মহান জীবনের পরিসমাপ্তি আল্লাহ এভাবে করবেন না। চোখের কোণ ভারী হয়ে উঠল জেনারেল তাহির তারিকের। সমগ্র অন্তর থেকে একটা প্রার্থনা তার উচ্চারিত হলো, ‘আল্লাহ তোমার সৈনিককে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার।’
লিফট থেকে বেরিয়ে এল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
দু’চোখের কোণ মুছে ফেলল জেনারেল তাহির তারিক।
লিফট থেকে বেরিয়েই জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘জেনারেল তাহির, প্রধানমন্ত্রীকেও খবরটা দিলাম। সামরিক গোয়েন্দা সূত্রে তিনি ইতিমধ্যেই খবর পেয়ে গেছেন। তিনি প্রেসিডেন্টকেও এ খবর জানিয়েছেন। তারা খুবই উদ্বিগ্ন। বসফরাস জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ছয় ঘণ্টার জন্যে বিদেশি এবং যেকোন নৌযানের বসফরাসে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং যেসব নৌযান বসফরাস ও মর্মর সাগরে আছে, সেগুলোর বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্যাপক সন্ধান শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওখানে যাচ্ছেন। চলুন, আমরা চলি।’
বলেই নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল। জেনারেল তাহির তারিক কোন কথা বলল না। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জেনারেল মোস্তফার পেছন পেছন চলল।
ব্রীজের গোড়ায় পৌঁছেই জেনারেল মোস্তফা কামালরা ব্রীজের ঠিক গোড়ার আইল্যান্ডে পুলিশের একটা জটলা দেখল। জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘ঠিক এখানকার মত ব্রীজের ওপ্রান্তেও পুলিশ অস্থায়ী অফিস বসিয়েছেন। চলুন আমরা স্পটটা দেখে আসি।’
স্পটে দুজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসার পরিত্যক্ত কারটিও ব্রীজের দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল।
জেনারেল তাহিররা গাড়ি থেকে নামল।
দু’জন পুলিশ অফিসার স্যালুট করে এগিয়ে এসে বলল জেনারেল মোস্তফাকে, ‘স্যার, গাড়িটা এখানেই পাওয়া গেছে, একটুকুও সরানো হয়নি।’
‘থ্যাংকস অফিসার।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘চলুন গাড়িটাকে আগে দেখা যাক।’ বলে জেনারেল তাহির তারিক গাড়ির দিকে এগোলো।
গাড়ির ভেতর-বাহির পরীক্ষা করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল জেনারেল তাহির তারিক, ‘এটা খালেদ খাকানেরই গাড়ি, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু গাড়িতে কোন কিছুই রেখে যাননি। তার মোবাইল, রিভলবার ও আইডি কার্ড তার পকেটেই ছিল।’
উদ্বেগ-আতঙ্কে ভরা জেনারেল মোস্তফা কামালের চেহারা। বলল, ‘ড্যাশবোর্ডের ভয়েস রেকর্ডার শূন্য। কিছুই বলে যাননি। বলবেন বা কি। আমি বুঝতে পারছি না, ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়ার অসম্ভব সিদ্ধান্তটা কেন নিলেন!’
‘সঙ্কটের চরম মুহূর্তে তার মনে যে কাজকে অগ্রাধিকার দেন সেটাকেই তিনি গ্রহণ করেন। যে কোন সঙ্কটে তার মনটা স্থির থাকে।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক। তার কণ্ঠ শুষ্ক।
দু’জনেই গিয়ে দাঁড়াল ব্রীজের ফেন্স ওয়ালের সম্ভাব্য যে স্থান থেকে তিনি লাফিয়ে পড়েছেন সেখানে। নিচে বসফরাসের পানির দিকে তাকিয়ে জেনারেল তাহির বলল, ‘তিনি বসফরাসের নিচে ঠিক লম্বভাবে গিয়ে পড়েছেন। এখানে দাড়িয়েই যদি ওরা ব্রাশ ফায়ার করে থাকে, তাহলে গুলির মুখে পড়ার তার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি না ততক্ষণে রেঞ্জের বাইরে গিয়ে থাকেন। যতই তার দেহটা নিচের দিকে নেমেছে, ততই তা ব্রীজের ইনওয়ার্ডের দিকে বাক নিয়েছে, আর ওদের ব্রাশ ফায়ারের গুলির গতি ব্রীজ থেকে আউটওয়ার্ড হওয়াই স্বাভাবিক।’
‘কিন্তু গুলী থেকে বাঁচলেও এত বড় দূরত্ব থেকে আছড়ে পড়ার আঘাত থেকে তিনি বাচবেন কি করে?’ কম্পিত কণ্ঠ জেনারেল মোস্তফা কামালের।
বেদনায় মুখটা আরও চুপসে গেল জেনারেল তাহির তারিকের। বলল, ‘কিন্তু তার জীবনের ইতি এভাবে ঘটতে পারে না, অবশ্যই পারে না। আসুন আমরা আর কিছু না ভাবি।’
‘ভাবনাকে দেয়াল দিয়ে আটকানো যায় না। সুতরাং এ প্রসঙ্গ থাক। চলুন আমরা নিচের পুলিশের অপারেশন অফিসে যাই। অনুসন্ধান কতদূর এগিয়েছে চলুন দেখি।’
বলে গাড়ির দিকে এগোলো জেনারেল মোস্তফা কামাল।
জেনারেল তাহিরও গিয়ে গাড়িতে উঠল।
নীচে পৌছতেই পুলিশ অফিসাররা স্বাগত জানিয়ে জেনারেল মোস্তফা কামালদের নিয়ে গেল তাঁবু খাটিয়ে তৈরি করা অস্থায়ী অফিসে।
‘নতুন কোন খবর আছে? প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া গেছে?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘স্যার, অনুসন্ধান চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধানও চলছে। এ এলাকায় অনেককেই পাওয়া যাচ্ছে, যারা সেসময় এখানে হাজির ছিল। আকস্মিক ঘটনা তাই অনেকেরই নজরে পড়েনি। অনেকের নজর গেছে ব্রীজ থেকে আসা ব্রাশ ফায়ারের দিকে। পানিতে পড়ার দৃশ্য দেখেছে এমন কাউকে পাওয়া যাইনি এখনও।’ ঘটনার মনিটররত পুলিশ অফিসার বলল।
‘সিসিটিভি’র মনিটর থেকে তো এ দৃশ্য পাবার কথা। সেখানে কি দেখা গেছে?’ বলল দ্রুত কণ্ঠে জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘স্যার, এই মাত্র প্রিন্টগুলো এসেছে। দেখুন ছবিতে একব্যক্তিকে ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বসফরাসের পানি থেকে পঞ্চাশ ফিট লেবেলের পর তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। দু’দিক থেকে আসা দুই সারি জাহাজের আড়ালে চলে যান তিনি। সে সময় একটা জাহাজ বহরের দুই কলাম বসফরাস ব্রীজ অতিক্রম করছিল। জাহাজের দুই কলাম CCTV-র ফোকাসকে আংশিকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।’ বলল দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার।
জেনারেল মোস্তফা ও জেনারেল তাহির পুলিশ অফিসারের কথা শুনছিল, সেই ছবিগুলোও দেখছিল। তারা দেখল, পুলিশ অফিসার যা বলল ঘটনা তাই। আহমদ মুসার ডাইভ দেয়া দু’হাত সামনে ছড়িয়ে রেখে নিপুণ ডাইভারের মত ছুটে আসা দেহ বসফরাসের পানির কিছু উপরে এসে বিশাল জাহাজের আড়ালে চলে গেছে।
ছবিগুলোর দিকে নজর রেখেই জেনারেল তাহির তারিক বলল, ‘জাহাজের দুই কলামের মাঝ বরাবর ফাঁকা থাকার কথা, না কোন নৌযান চলছিল?’
‘চলার কথা না, ধরে নেয়া যায় চলছিল।’ বলল পুলিশ অফিসার।
তাহলে জাহাজের দুই কলাম ছাড়াও আরও ছোট-খাট নৌযানকে প্রত্যক্ষদর্শীর তালিকায় রাখতে হবে।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘স্যার, সেটাকেও আমরা হিসেবে রেখেছি। সেসব নৌযানকে লোকেট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ পুলিশ অফিসার বলল।
‘ধন্যবাদ।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘জাহাজ বহরটা কোন দেশের ছিল? ওদের বক্তব্য কি?’ জেনারেল তাহির বলল।
‘ওটা ছিল সোভিয়েত যুদ্ধ জাহাজের একটা বহর। যাচ্ছিল ওরা ভূমধ্যসাগরের এক মহড়ায় অংশ নিতে। প্রাথমিক যোগাযোগ ওদের সাথে হয়ে গেছে। তাৎক্ষনিক তারা বলেছে, ব্রীজ থেকে বসফরাসে পড়তে কাউকে তারা দেখেছে কিংবা এরকম কেউ তাদের জাহাজে পড়েছে অথবা উদ্ধার করেছে তারা কাউকে, এমন কোন খবর তাদের কাছে নেই। তবে তারা আরও চেক করে দেখবে।’ বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘ধন্যবাদ অফিসার!’ বলে জেনারেল তাহির তাকাল জেনারেল মোস্তফা কামালের দিকে। বলল, ‘আমার মনে হয় আমরা ঘুরে-ফিরে একটু দেখতে পারি। আপনি কি আসবেন?’
‘অবশ্যই, চলুন।’ বলে উঠে দাঁড়াল মোস্তফা কামাল।
পুলিশ ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে জেনারেল তাহির বলল, ‘আসুন আমরা গাড়ি না নিয়ে বসফরাসের তীর ধরে হাটি। করনীয় তো আমাদের কিছু নেই।’
‘চলুন। তবে আমি আশাবাদী কিছু একটা সংবাদ খুব তাড়া তাড়াতাড়িই আমরা পাব। নৌবাহিনীর ওয়াটার স্ক্যানিং কাজ শুরু করে দিয়েছে দেখছি। পানির যে কোন গভীরে হিউম্যান বডিকে ওয়াটার স্ক্যানার লকেট করতে পারে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেল জেনারেল তাহির তারিকের। তার চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া আরও গভীর হলো। বলল, ‘আমরা তাঁর বডি নয়, তাঁকে চাই আমরা। এই বসফরাসে এসে তিনি শেষ হয়ে যাবেন, তা হয় না, হতে পারে না।’ শুষ্ক কণ্ঠ জেনারেল তাহিরের।
‘এটা আমাদের সবারই চাওয়া। আল্লাহ আমাদের এই চাওয়াকে মঞ্জুর করুন।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
বসফরাসের প্রায় পানি ঘেঁষে প্রান্ত বরাবর আপ-ডাউন হাইওয়ে। তার পাশ দিয়ে সুদৃশ্য ফুটপাত। এই রাস্তাগুলো নীল বসফরাসের গলায় যেন হীরকের হার। বসফরাসের তীরে মাঝে মাঝে রয়েছে ফেরী ঘাট। ঘাটগুলো বোট, ফেরি ও মানুষের ভীড়ে ব্যস্ত থাকে। ছোট বোটগুলো ঘাটে ছাড়াও তীরে ভিড়ে থাকে, কিন্তু তা ব্যতিক্রম।
ব্রীজের নিচে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করেছে সকলেই।
ব্রীজের নিচে বিরাট এক ফেরি ঘাট।
ঘাটে বেশ কিছু ফেরি ও বোট দাড়িয়ে আছে। এসব ঘাটে ফেরি ও বড় বড় বোট ছাড়াও ছোট ছোট বোটও ভাড়ায় পাওয়া যায়।
ফুটপাত দিয়ে হেঁটে ফেরিঘাট অতিক্রম করছিল জেনারেল তাহিররা।
‘ঘিয়ে ভাজা কোন কিছুর গন্ধ পাচ্ছি জেনারেল তারিক।’
বলে ডান দিকের পাহাড়ের ঢালের দিকে তাকাল।
বসফরাসের তীর এখানে হাইওয়ে ও ফুটপাতের পর ঢালু হয়ে ক্রমশ উপরে পাহাড়ে উঠে গেছে। এই ঢালে গড়ে উঠেছে মনোরম সব রেস্টুরেন্ট, ক্লাব ও ঘর-বাড়ি।
জেনারেল তাহিরও তাকাল পাহাড়ের ঢালের দিকে।
‘জেনারেল তাহির, আমরা কিন্তু খেয়াল করিনি, লাঞ্চের সময় অনেক আগে পার হয়ে গেছে। বেশি উপরে নয়, এই ঢালেই সুন্দর রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা কি যেতে পারি?’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
খেয়ে সময় নষ্ট করতে মন চাইছিল না জেনারেল তাহিরের। তার কাছে এখন আহমদ মুসার সন্ধান করার চেয়ে বড় কিছু নেই। তবে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে, এ কথাও ঠিক। হয়ত জেনারেল মোস্তফা কামাল বোধ হয় বেশি কষ্ট পাচ্ছে ক্ষুধায়। জেনারেল তাহির সায় দিল জেনারেল মোস্তফা কামালের কথায়। বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা রেস্টুরেন্টে যেতে পারি জেনারেল মোস্তফা।’
লাঞ্চের পিক আওয়ার শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তবে মাঝে মাঝে টেবিল এ দু’চারজন লোক আছে। কেউ কেউ খাচ্ছে, কেউ কেউ বসে গাল-গল্প করছে। গল্পের প্রধান সাবজেক্ট হলো বসফরাস ব্রীজের ঘটনা।
গল্পের সাবজেক্ট শুনে খুশি জেনারেল তাহির তারিক। রেস্টুরেন্টের ঠিক নিচেই দুর্ঘটনার বাঁ ঘটনার স্থান।
মাঝখানের এক ফাঁকা টেবিল দেখে বসেছে জেনারেল তাহিররা।
খেতে শুরু করেছে তারা।
নানারকম কথা তাদের কানে আসছে বিভিন্ন দিক থেকে। ব্রীজে গোলা-গুলি কারা করল, কেন করল-তা নিয়ে নানা রকম ধারনার কথা। ব্রীজ থেকে যে লাফ দিয়ে পড়েছে, সে পাগল না হয়ে যায় না। কেউ বলছে জীবন বাঁচাবার জন্যেই ওটা করেছে। আবার কেউ বলছে, জীবন বাঁচাবার জন্যে কেউ মৃত্যুমুখে ঝাপ দেয় না। বেঘোরে মারা গেল লোকটা।
জেনারেল তাহিরদের পেছনের টেবিলে তিনজন লোক এসেছে সব শেষে। এই মাত্র তাঁর খাওয়া শুরু করেছে। তাদেরই একজন বলল, ‘কিছু না জেনেই বলা হচ্ছে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে লোকটা। আসলে লোকটা মরেনি বলেই মনে হয়। একটা মোটর বোট তাঁকে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে গেছে।’
তাঁর কথা শেষ হতেই তাঁর টেবিলের একজন বলল, ‘দেখেছ তুমি? তখন কোথায় ছিলে?’
‘আমিও একটা বোটে এই ঘাটের দিকে আসছিলাম। গোলা-গুলির মুখে সামনের ঐ বোটটি সামনের দিকে ছুটে পালায়, আমি পিছনের দিকে সরে যাই।’ বলল দ্বিতীয় লোকটি।
খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে জেনারেল তাহির ও জেনারেল মোস্তফা কামাল দু’জনেরই।
শিরদাঁড়া সোজা করে বসেছে তারা। তাদের সমস্ত মনোযোগ এখন ওদের কথার দিকে।
ঐ টেবিলের তৃতীয় লোকটি বলল, ‘সোয়া দু’শ ফিট উপর থেকে পড়লে কারও কিন্তু বাচার কথা নয়।’
‘কিন্তু লোকটা যখন পানিতে ডুবে যাবার পর ভেসে উঠতে পেরেছে, তখন বলতে পার নিজ চেষ্টায় সে ভেসে উঠেছে। তার অর্থ সে মরেনি।’ বলল প্রথম লোকটি।
জেনারেল তাহির ও জেনারেল মোস্তফা কামাল দু’জনেরই দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল চট করে পেছন ফিরে লোকটাকে একবার দেখে নিল। তারপর সে জেনারেল তাহিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘লোকটার কাছে আরও কিছু জানার আছে।’
‘ওদের খাওয়া শেষ হলেই ভাল হয়।’ বলল জেনারেল তাহির।
‘না, এক মিনিট নষ্ট করা যায় না জেনারেল তাহির।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘তা ঠিক।’ বলল জেনারেল তাহির।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
গেল পেছনের টেবিলে।
‘এক্সকিউজ মিঃ জনাব’ বলে পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে লোকটার সামনে ধরে বলল, ‘আমি টার্কিশ ইন্টারনাল সিকিউরিটি সার্ভিস (TISS)-এর ডিজি জেনারেল মোস্তফা কামাল। আমি আপনাদের কথা সামনের টেবিল থেকে শুনেছি। যে লোকটা প্রাণ বাঁচানোর জন্যে বসফরাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তুরস্কের সম্মানিত মেহমান তিনি। ঘটনার সাথে তুরস্কের মর্যাদা জড়িত হয়ে পড়েছে। যে বোটটি তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে তাঁর কোন হদিস কি দয়া করে দিতে পারেন?’
জেনারেল মোস্তফার পরিচয় জানার পর খাওয়া বন্ধ করে তিনজনই উঠে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের বহুল পরিচিত গোয়েন্দা সংস্থা TISS-এর স্বয়ং ডিজিকে তাদের সামনে দেখে তারা মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রথম লোকটি বলল, ‘সিওর স্যার, আমি বলছি।’
বলে একটু থামল লোকটি। স্মরণ করছে সে।
‘আপনারা বসুন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওকে স্যার। ঠিক আছে। বলছি আমি।’
একটু থেমেই বলা শুরু করল, ‘বোটটির পেছনের দু’পাশেই নাম্বার সাইনের উপরে কনকর্ডের ছবি আঁকা ছিল। বোটে ‘কনকর্ড’ মনোগ্রাম ব্যবহার করা একটা আনকমন ব্যাপার। এ কারণেই ‘কনকর্ড’ সাইনটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাঁর সাথে নাম্বার সাইনটিও। নাম্বার সাইনটিও ছিল মজার। মনে পড়ছে নাম্বার সাইনটি ছিল- ‘এমভি’ ড্যাশ ‘বি’ ড্যাশ টি নাইনটি ট্রিপল নাইন (T90999)।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল পকেট থেকে কলম ও নোটপ্যাড বের করে দ্রুত নাম্বার লিখে নিল। তারপর সেখানে দাড়িয়েই পকেট থেকে অয়ারলেস বের করে একটা জরুরি মেসেজ ট্রান্সমিট করলঃ ‘রেড এলার্ট ফর অল সিকিউরিটি সার্ভিস অ্যান্ড পুলিশ। ‘এমভি ড্যাশ বি ড্যাশ টি নাইনটি থাওজ্যান্ড নাইন হান্ড্রেড নাইনটি নাইন’ নাম্বারের মোটর বোট যেখানে যে অবস্থায় পাওয়া যাবে আটকান এবং আমাকে খবর দিন। বোটের বাড়তি চিহ্ন ‘কনকর্ড’ মনোগ্রাম। ওভার।’
মেসেজ শেষ করে জেনারেল মোস্তফা কামাল দাঁড়ানো লোকটিকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি তুরস্কের সীমাহীন উপকার করেছেন। এমন একটা ক্লুর জন্যে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এবং পুলিশ হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখুন।’ বলল লোকটি। তাঁর কণ্ঠও আবেগঘন।
‘আমিন। আমরা সবাই এটা চাই।’ বলে জেনারেল মোস্তফা কামাল আবারো তাদের ধন্যবাদ দিয়ে তার খাবার টেবিলে ফিরে এল।
টেবিলে বসতে বসতে বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কি করার আছে জেনারেল তাহির?’
‘চলুন, আমরা বোট নিয়ে আমরা বসফরাসের দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাই। ও বোটটাতো ওদিকেই গেছে। বোট ডিটেক্ট হবার পর ও দিক থেকেই খবর আসবে। আমরা যতটা সামনে যাব ততটাই আমরা এগিয়ে থাকব।’
‘ঠিক বলেছেন, চলুন, উঠি।’
বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুবার জেনারেল মোস্তফা কামাল একটা পুলিশ বোট কল করল।
রেস্টুরেন্টের বিল চুকিয়ে ঘাটে নেমে এসে দেখল, একটা পুলিশ বোট অপেক্ষা করছে।
একজন পুলিশ অফিসার তীরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।
জেনারেল মোস্তফা কামালরা ওয়াক ওভার ব্রীজ দিয়ে পৌছতেই অফিসার দ্রুত এসে স্যালুট করে বলল, ‘স্যার, বোট রেডি।’
‘এস।’ বলে জেনারেল মোস্তফা কামাল বোটে উঠল। তার পেছনে জেনারেল তাহির। সবশেষে পুলিশ অফিসার।
বোটটা ছোট। দুই রোতে চারটি সিট।
জেনারেল তাহির ও জেনারেল মোস্তফা কামাল সামনের দুই সিটে বসল। পেছনের দুই সিটের একটিতে পুলিশ অফিসার।
ড্রাইভিং সিটে ছিল আরেকটি পুলিশ অফিসার।
‘বোটটি ধীরে ধীরে হর্ন ও মর্মরের সংযোগস্থলের দিকে এগিয়ে নাও। ওখানে গিয়ে আবার ভাবব।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে।
ধীর গতিতে চলেছে বোটটি।
বসফরাসের কামাল আতাতুর্ক থেকে বসফরাস-হর্ন-মর্মর সাগরের সন্ধিস্থল খুব বেশি দূরে নয়। প্রায় এসে পড়েছে বোট সেখানে।
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও জেনারেল তাহির তারিকের অপেক্ষারও অবসান হলো।
ওয়ারলেস বিপ করতে শুরু করল।
শসব্যস্তে কল ওপেন করল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
কথা বলে উঠল ওয়ারলেস।
‘আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ আইদিন গোল্ডেন হর্নের আয়ুব সুলতান ব্রীজ থেকে। ব্রীজের ঘাটে টি ৯০৯৯৯ বোটটি পাওয়া গেছে। বোট ও বোটের লোকজনদের আটকানো হয়েছে। কোন নির্দেশ, স্যার। ওভার।’ ওপ্রান্ত থেকে বলল পুলিশ ইন্সপেক্টর আইদিন।
‘বোটে কোন যাত্রী আছে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফা কামালের।
‘নেই স্যার, তিনজন ক্রু ও মালিক ছাড়া আর কেউ নেই।’ পুলিশ ইন্সপেক্টর বলল।
‘তুমি ওদেরকে আটকে রাখ, আমরা আসছি কয়েক মিনিটের মধ্যে। আমরা এখন হর্নের মুখে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
ওয়ারলেস কল অফ করতেই উদগ্রীব কণ্ঠে জেনারেল তারিক বলল, ‘জিজ্ঞেস করলেন না বসফরাস থেকে উদ্ধার করা লোকটি কোথায়?’
‘বিষয়টা ওদের অজানাই থাক। বোটটা শত্রু পক্ষের কিনা কে জানে! আগে জানলে ওরা সাবধান হতে পারে, কিংবা কিছু ঘটেও যেতে পারে ওখানে। আমরা ক’মিনিটের মধ্যেই ওখানে পৌছাচ্ছি।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ঠিক আছে।’ জেনারেল তাহির বলল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল কোন কথা বলল না। তার দৃষ্টি সামনে হর্নের দিকে।
বোট ইতোমধ্যেই টার্ন নিয়ে দ্রুত গতিতে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করেছে।
২
তোপকাপি ভিআইপি গোল্ড রিসোর্টের ভিআইপি ক্লিনিক।
সংজ্ঞা ফেরেনি তখনও আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার মাথার কাছে একটা চেয়ারে বসে আছে ডোনা জোসেফাইন।
কয়েকজন নার্স কক্ষটিতে। যে কোন নির্দেশের অপেক্ষায়।
কক্ষে প্রবেশ করল কয়েকজন ডাক্তার।
প্রধান ডাক্তার মানে ক্লিনিকের চীফ ডাঃ মোস্তফা সাইদ দ্রুত এগিয়ে এল ডোনা জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘ম্যাডাম সমস্ত পরীক্ষা শেষ। সব কিছু ওকে আছে। বুকে প্রচন্ড চাপের কারণে ফুসফুসে চাপ পড়ে ফলে অক্সিজেন শূন্য হয়ে যায় ফুসফুস। তার ফলেই সংজ্ঞা হারান তিনি। হার্ট, ব্রেন সব ঠিকমত কাজ করছে এখন। স্বাভাবিক হয়ে আসছেন তিনি।’
বলেই ডাঃ মোস্তফা সাইদ এগিয়ে গিয়ে আহমদ মুসার পালস দেখল। বলল, ‘আমি মনে করি, আর ক’মিনিটের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফিরে আসবে।’
আহমদ মুসার হাতটা আস্তে আস্তে বেদে রেখে বলল, ‘ম্যাডাম, আমরা অফিসে আছি। কোন দরকার হলে নার্সকে বলবেন।’
ডাক্তার বেরিয়ে গেল। নার্সরাও। শুধু দু’জন নার্স থাকল।
ডাক্তাররা সান্ত্বনা দিলেও উদ্বেগের কালো মেঘ জোসেফাইনের মুখ থেকে কাটেনি। তবে আগের সেই অস্থিরতা এখন নেই।
ডাক্তাররা বেরিয়ে যেতেই জোসেফাইনের পারসোনাল সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান নার্স দু’জনকে বলল, ‘সিস্টার, তোমরা বাইরে তোমাদের টেবিলে গিয়ে বস।’
‘ইয়েস ম্যাডাম।’ বলে নার্স দু’জন বেরিয়ে গেল।
কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে জেতেই লতিফা আরবাকান বলল, ‘ম্যাডাম, শয়তানদের কয়েকজন স্যারের বন্ধুর পরিচয় দিয়ে গোল্ড রিসোর্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। গোল্ড রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে তারা আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেছিল যে, ‘আমরা মিস্টার খালেদ খাকানের কর্মস্থল আইআরটিতে তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু। আমরা খালেদ খাকানকে দেখতে এসেছি।’ পুলিশ আমার সাথে যোগাযোগ করলে, আমি তাদের নাম জানতে চেয়েছিলাম। যে পাঁচটি নাম তারা বলল, তাদের চারজনের নাম আইআরটির স্টাফদের সাথে মিলে গেল। একটি নামই শুধু নতুন। ইনি নাকি অফিসের নতুন রিক্রুট। যাদের নাম মিলে যায়, তাদের মধ্যে ডঃ শেখ বাজের নাম ছিল। ডঃ শেখ বাজের সাথে বছরখানেক আগে আমার ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হয়েছিল। আমি তাঁর সাথে কথা বলতে চাইলাম। কথা বলে দেখলাম সে নকল লোক। আরবী ধাঁচে ইংরেজি বলার চেষ্টা করলেও আমার জানা কোনো তথ্যই সে ঠিক মত বলতে পারেনি। পুলিশ ওদের গ্রেফতার করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা গোলা-গুলি চালিয়ে কয়েকজন পুলিশকে আহত করে পালিয়েছে। আপনার মনের উপর নতুন করে প্রেসার সৃষ্টি না হোক, এজন্যেই খবরটা আগে আপনাকে দেইনি।’
‘ধন্যবাদ লতিফা। তুমি একটা বড় বিপদ থেকে আমাদের বাঁচিয়েছ। তুমি এতোটা সতর্ক না হলে বড় একটা কিছু ঘটতে পারতো। কিন্তু ওরা তো শক্তি বৃদ্ধি করে আবার ফিরে আসতে পারে।’ বলল জোসেফাইন।
‘সে সম্ভাবনা নেই। তোপকাপি প্রাসাদ ও সংলগ্ন গোটা এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। গোল্ড রিসোর্টকে সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছে পুলিশ।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল জোসেফাইন।
এ সময় আহমদ মুসার দুই হাত নড়ে উঠল আর নড়তে লাগল তাঁর চোখের দুই পাতা।
মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল জোসেফাইনের। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ওর সংজ্ঞা ফিরে আসছে। যাও লতিফা তুমি আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে এস।’
লতিফা আরবাকান দ্রুত দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করেও ফিরে দাঁড়াল। বলল, ‘ছোট সাহেবের ঘুম যদি না ভেঙ্গে থাকে?’
‘আস্তে আস্তে সুড়সুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিও। তার আব্বার কথা শুনলে দেখবে ঘুমের সব জড়তা তার চলে যাবে।’ জোসেফাইন বলল।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লতিফা আরবাকান।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা।
প্রথমেই তার দু’হাত নরম বেডের উপর বুলাল। তার খোলা চোখ কক্ষের ও জোসেফাইনের মুখে এসে নিবদ্ধ হতে রাজ্যের বিস্ময় নামল আহমদ মুসার চোখে। বলল, ‘জোসেফাইন তুমি! আমি কোথায়?’
জোসেফাইন ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশে বসে তার চুলে হাত ধুঁকিয়ে বলল, ‘তুমি গোল্ড রিসোর্টের ক্লিনিকে।’
‘আমি ছিলাম বসফরাসের পানিতে। এখানে এলাম কিভাবে? আর কাউকে দেখছি না, তুমি জানলে কিভাবে?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘বলছি। আল্লাহর হাজার শোকর। সোয়া দু’শ ফুট উঁচু থেকে কেউ লাফিয়ে পড়ার কথা ভাবতে পারে! আল্লাহ বাঁচিয়েছেন।’ বলল জোসেফাইন।
‘আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমি এখানে কি করে এলাম, এত দূরে, একেবারে তোমার এখানে!’ আহমদ মুসা বলল।
‘সব পরে জানাব। বসফরাস থেকে একটা বোট তোমাকে তুলে নিয়ে আয়ুব সুলতান ব্রীজের ঘাটে পৌঁছে। জটলা দেখে সেখানে হাজির হওয়া আমার বান্ধবী জেফি জিনা তোমাকে দেখে চিনতে পেরে তোমাকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে।’
‘মিস জেফি জিনা ওখানে? আমাকে উদ্ধার করার অর্থ কি? আমাকে কেউ কি বন্দী করেছিল?’ বল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘সব আমি শুনিনি। তোমাকে নিয়ে সবাই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে এটা লতিফা আমাকে বলেছে, তোমাকে এখানে আনার কিছুক্ষণ পরই চার পাঁচজন তোমার অফিস সহকর্মীর পরিচয় দিয়ে গোল্ড রিসোর্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। লতিফা ওদের নাম শোনার পর ওদের ভুয়া পরিচয়ের কথা জেনে গোল্ড রিসোর্টে ঢুকতে দিতে নিষেধ করে। তখন পুলিশকে ওরা আক্রমণ করে। তিনজন পুলিশ আহত হলেও সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’
একটু থামল জোসেফাইন। পরে বলল, ‘থাক এসব কথা। এসব নিয়ে তুমি এই মুহূর্তে ভেব না।’
‘ভাবছি না, অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছি। বুঝতে পারছি, নদীতেও ওদের পাহারা ছিল। ওরাই……।’
জোসেফাইন আহমদ মুসার ঠোঁটের উপর হাত চাপা দিয়ে বলল, ‘প্লিজ, এসব বিষয় এখন থাক। আমাকে একটু সময় দাও। তোমাকে সংজ্ঞাহীন দেখে আমাদের দম বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল।’ ভারী কণ্ঠ জোসেফাইনের। তার দুই চোখের কোনে অশ্রু চিক চিক করে উঠেছিল।
আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে। গভীর, অন্তরঙ্গ দৃষ্টি।
জোসেফাইনের একটা হাত ছিল আহমদ মুসার মাথায়, অন্য হাতটা ছিল বেডের উপর।
আহমদ মুসা বেডের উপর থেকে জোসেফাইনের হাত তুলে নিয়ে টানল জোসেফাইনকে নিজের দিকে।
জোসেফাইন বেডের উপর অনেকটা আলতোভাবে বসে ছিল। সে খসে পড়ল আহমদ মুসার বুকের উপর।
আহমদ মুসার দু’হাত তাঁকে আঁকড়ে ধরতে যাচ্ছিল।
জোসেফাইন আহমদ মুসার বুক থেকে তার মুখ তুলে তার হাতের বাঁধন থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, ‘দরজায় নার্সরা বসে আছে, আহমদ আব্দুল্লাহও এখনি এসে পড়বে।’
জোসেফাইন উঠে বসেছে এই সময় দরজায় নক হলো।
জোসেফাইন উঠে পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘হ্যাঁ, ভেতরে আসুন।’
প্রবেশ করল একজন নার্স। তার হাতে কর্ডলেস টেলিফোন। বলল, ‘এক্সকিউজ মি ম্যাডাম, আপনার একটা কল এসেছে, জরুরি।’
‘কার কল’ জিজ্ঞেস করল জোসেফাইন।
‘জেনারেল মোস্তফা কামাল ও জেনারেল তারিক।’ বলল নার্স।
জোসেফাইন আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে নার্সকে বলল, ‘নিয়ে এস টেলিফোন।’
জোসেফাইন টেলিফোন কানের কাছে তুলে নিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। আমি জোসেফাইন মানে মিসেস খালেদ খাকান।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আমি জেনারেল মোস্তফা কামাল। মিঃ খালেদ খাকান কোথায়? আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘উনি গোল্ড রিসোর্টের ক্লিনিকে। জ্ঞান ফিরেছে। ভালো আছেন জনাব। টেলিফোন তাঁকে দিচ্ছি।’ জোসেফাইন বলল।
‘থাক, আমরা এখনি আসছি। আল্লাহ তাঁকে দ্রুত সুস্থ করে তুলুন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আসুন জনাব।’
‘ওকে। আসসালামু আলাইকুম।’ বলল ওপার থেকে।
জোসেফাইনও টেলিফোন রেখে দিল।
ডাক্তাররা ভেতরে ঢুকল।
ডাক্তাররা আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে কিছু জরুরি জিজ্ঞাসাবাদ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করল।
জোসেফাইন ঘরের একপাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বিস্মিত হয়েছে। ডাক্তারদের কাউকে চিনতে পারছে না সে।
হঠাৎ জোরে দরজা ঠেলে একজন ঘরে প্রবেশ করল। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘সব ক্লিয়ার, তাড়াতাড়ি।’
তার কথা শেষ হতেই একজন ডাক্তারের হাতে রিভলবার উঠে এল। তাক করল আহমদ মুসাকে এবং চিৎকার করে বলল, ‘হারাজাদাকে ক্লোরোফরম করে বাঁধ।’
ডাক্তারবেশী তিনজন এগুলো আহমদ মুসার দিকে। তাদের একজনের হাতে ক্লোরোফরমের শিশি।
ঘটনার আকস্মিকতায় জোসেফাইন প্রথমে বিমূড় হয়ে পড়েছিল। আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তাক হতে দেখেই জোসেফাইন সম্বিত ফিরে পেল। দ্রুত ওড়নার আড়ালে হাত দিয়ে কাঁধে ঝুলন্ত ছোট ব্যাগের পকেট থেকে ছোট্ট একটা রিভলবার বের করে আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তাক করে থাকা ডাক্তারকে লক্ষ্য করে প্রথম গুলী ছুঁড়ল সে। প্রথমেই আহমদ মুসাকে বেকায়দা অবস্থা থেকে মুক্ত করা তার লক্ষ্য।
ডাক্তারটির মাথা গুড়িয়ে দিল জোসেফাইনের গুলী।
গুলীর শব্দে অবশিষ্ট তিনজন ফিরে তাকিয়েছে জোসেফাইনের দিকে।
যে লোকটি পরে ঘরে ঢুকেছিল, তারই চোখ প্রথম পড়েছিল জোসেফাইনের উপর। সংগে সংগে রিভলবার তুলে নিয়েছিল সে। জোসেফাইনও তার দিকে তাকিয়েছিল। সে নিশ্চিত ছিল আহমদ মুসাকে বাঁধতে ও ক্লোরোফরম করতে এগিয়ে যাওয়া তিনজনকে আহত মুসাই ম্যানেজ করতে পারবে।
জোসেফাইনের রিভলবারই প্রথমে টার্গেট করেছিল লোকটিকে। সুতরাং জোসেফাইনের রিভলবারের বুলেটই প্রথমে আঘাত করল লোকটিকে। বুলেটটি বিদ্ধ হয়েছিল তার বুকে। তার রিভলবারেরও ট্রিগার টেপা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বুলেটটি বিদ্ধ হবার পর মর্মান্তিক ঝাঁকুনি তার হাতকে কাপিয়ে দিয়েছিল। গুলীটি লক্ষভ্রষ্ট হয়ে জোসেফাইনের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
ওদিকে আহমদ মুসা ওরা তিনজন একশন এ যাবার আগেই দু’পায়ের স্নেক নক ব্যবহার করে ওদের তিনজনকেই মাটিতে ধরাশায়ী করেছে এবং সংগে সংগেই উঠে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াবার সংগে সংগেই জোসেফাইন তার দিকে রিভলবার ছুড়ে দিয়েছিল।
আহমদ মুসা ওদের দিকে রিভলবার তাক করে বলল, ‘যে যেভাবে আছ, সেভাবে থাক। নড়বার চেষ্টা করো না। তিনজনকে মারতে আমার তিন সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না।’
এই সময় বাইরে অনেকগুলো পায়ের ছুটে আসার ভারী শব্দ পাওয়া গেল।
পরক্ষনেই দরজা ঠেলে ছুটে এসে ঘরে প্রবেশ করল জেনারেল মোস্তফা কামাল, জেনারেল তারিকসহ কয়েকজন পুলিশ।
ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনি ঠিক আছেন তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। পুলিশকে বলুন এ তিনজনকে এরেস্ট করতে, মিঃ জেনারেল মোস্তফা কামাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, এরেস্ট কর তিনজনকে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
ওরা তিনজন তাকাল আহমদ মুসা, জেনারেল মোস্তফা, জেনারেল তাহির ও চারজন পুলিশসহ সবার দিকে। সবার হাতের রিভলবার, স্টেনগান তাদের দিকে তাক করা।
তিনজন পুলিশ ওদের দিকে এগোচ্ছিল।
চতুর্থজন পুলিশ অফিসার। সে বলল ঐ তিনজনকে লক্ষ্য করে, তোমরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।
পুলিশ অফিসারটির কর্কশ নির্দেশের সাথে সাথেই ওরা শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে এবং তার সাথে সাথেই দেখা গেল তাদের অনামিকা আঙ্গুল তাদের মুখে চলে গেছে।
চমকে উঠে আহমদ মুসা লাফ দিয়ে ওদের সামনে গিয়ে পড়ল। একজনের আঙ্গুল টেনে বের করল তার মুখ থেকে। কিন্তু দেখল সব শেষ হয়ে গেছে। নীল হয়ে উঠেছে তার মুখ।
‘দুর্ভাগ্য, হাতে পেয়েও এদের জীবিত ধরা যাচ্ছে না।’ স্বগত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘ওদের হাতের রিং এ পটাসিয়াম সায়ানাইডের মত কিছু ছিল নিশ্চয়!’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘হ্যাঁ, মিঃ জেনারেল। আগের ঘটনাগুলোতে এধরনের বিষয়ই ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রথম দু’জন দেখছি গুলীতে মরেছে। ওরা দু’জন নিশ্চয় আক্রমণে এসেছিল। এরা তিনজন আক্রমণে আসেনি?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘আসলে ওরা সকলেই এসেছিল ডাক্তারের ছদ্মবেশে আমার কাছে আসার সুযোগ নিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করতে। এরা তিনজন এসেছিল আমাকে বাঁধতে এবং ওরা দু’জন রিভলবার নিয়ে আমাকে পাহারা দিচ্ছিল। আমি নিরস্ত তখন। আমি বাঁধাই পড়ে যেতাম যদি জোসেফাইন ওদের দুজনকে গুলী করে না মারতো। ওরা দু’জন মারা পড়ার পর আমি আক্রমণে যেতে সুযোগ পাই। আর তার রিভলবারও আমার দিকে ছুড়ে দেয়। সেটা দিয়েই ওদের নিষ্ক্রিয় করেছিলাম। তখনই আপনারা এসেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
ঘরের একপাশে দাঁড়ান জোসেফাইনের দিকে না তাকিয়েই জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘তাঁকে মোবারকবাদ। কৃতজ্ঞ আমরা তার প্রতি। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যা পারেনি, সেটা তিনিই করেছেন।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল থামতেই জেনারেল তারিক বলে উঠল, ‘শুধু তাই নয়, বেগম খালেদ খাকান যে বুদ্ধিমত্তা ও দৃঢ়তার সাথে সংজ্ঞাহীন জনাব খালেদ খাকানকে হর্নের আইয়ুব সুলতান ফেরিঘাট থেকে উদ্ধার করে এনেছেন, সেটা বিস্ময়কর। যারা বসফরাস থেকে উদ্ধার করে খালেদ খাকানকে আইয়ুব সুলতান ফেরিঘাট এ নিয়ে এসেছিল, তাদের হাত থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা মিঃ খালেদ খাকানকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু বেগম খালেদ খাকান সেখানে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হন এবং নিজেকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আপনাকে উদ্ধার করে আনতে সমর্থ হন।’
বিস্ময় ফুটে উঠেছে আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা কারা? মানে আমার আইআরটির শত্রুরা। ওরাই যদি হয়, তাহলে একা জোসেফাইন আমাকে ছাড়িয়ে আনল কি করে? কি ঘটনা বলুন তো? আমি কিছু শুনেছি! পুরোটা বলুন।’
‘যারা আপনাকে বসফরাস থেকে তুলে নিয়েছিল, তাদের খোজ পাওয়ার পরই আমরা হর্নের আইয়ুব ফেরিঘাটে চলে আসি। ওদেরকে আমরা পেয়ে যাই। জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা সব কিছু জেনে নেই আপনাকে যাতে দ্রুত খুঁজে পেতে পারি। তারা বলেছে, আপনাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ওখানে ওরা পৌছার পাঁচ মিনিটের মধ্যে দু’জন লোক এসে হাজির হয়। ওরা মনে হয় জেনেই এসেছিল। এসেই আপনাকে দাবি করল যে, আপনি ওদের লোক বসফরাস ব্রীজ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। তারা যখন ওদের সাথে কথা বলছিল এই সময় আপনার স্ত্রী জোসেফাইন ম্যাডাম পাশ দিয়ে ঘাট এ নেমে যাবার পথে ওখানে দাড়িয়ে যান। তিনি আপনাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসেন। তখন উদ্ধারকারীদের সাথে আলাপ চলছিল ওদের। ম্যাডাম জোসেফাইন দ্রুত এগিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘এঁর এ অবস্থা কেন? কি হয়েছে ওঁর?’ উদ্ধারকারীদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করেন এঁকে আপনি চেনেন?
ম্যাডাম জোসেফাইন কথা বলায় আগের যারা মিঃ খালেদকে আগে থেকেই দাবি করছিল, তারা তেড়ে উঠে। একজন বলে, মিথ্যা বলছে এই বিদেশী মহিলা। নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে। ইতিমধ্যেই দু’জন পুলিশ এসে দাড়িয়েছিল। তারাও শুনছিল কথা। লোকটার কথা শেষ হতেই ম্যাডাম জোসেফাইন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমার নাম মারিয়া জোসেফাইন। ইনি আমার স্বামী। নাম মিঃ খালেদ খাকান।’
সংগে সংগেই ওরা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওঁর নাম খালেদ খাকান। ইনি ইনিস্টিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজিতে চাকরি করেন। উনি মিথ্যা পরিচয় দিয়েছেন। দেখুন ইনি ইউরোপীয় আর মিঃ খাকান এশিয়ান।’
পুলিশের একজন এগিয়ে এসে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসার পকেট সার্চ করে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখল। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, উনি ইনিস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজিতে চাকরি করেন। বলেই পুলিশটি জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জোসেফাইনকে, ‘উনি সত্যিই স্বামী হলে বলুন, উনি যে প্রতিষ্ঠান এ চাকরি করেন তার পুরো নাম কি?’ ম্যাডাম সঠিক জবাব দেন। পুলিশ ওদের জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করে, ‘বল, উনি কোন পদে চাকরি করেন?’ ওরা উত্তর দিতে পারে না। পুলিশ ম্যাডামকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। ম্যাডাম সঠিক উত্তর দেন। এরপর আপনার উচ্চতা ও আইডি মার্ক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। ওরা উত্তর দিতে পারে না। ম্যাডাম ঠিক জবাব দেন। পুলিশ ওদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনাকে ম্যাডামের গাড়িতে তুলে দেয়। ম্যাডাম নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে পুলিশকে অনুরোধ করে তাদের পৌঁছে দিতে। পুলিশ আপনাকে কাছের ক্লিনিকে ভর্তি করতে বললে, ম্যাডাম বলেন, তোপকাপি এলাকায় আমাদের গোল্ড রিসোর্টে নিজস্ব ক্লিনিক রয়েছে, তাঁকে ওখানেই নিতে চাই।’ পুলিশের গাড়ি ম্যাডামের গাড়ির পেছন পেছনে এসে এই গোল্ড রিসোর্টে পৌঁছে দিয়ে যায়।’
কথা শেষ করল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসার চোখেমুখে অপার বিস্ময়। সে অবাক হয়, জোসেফাইনের একজন নতুন বান্ধবী জেফি জিনা তার জন্য এতটা করেছে! নিজেকে ভিন্ন একজনে মানুষের স্ত্রী বলেও পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু জেফি জিনা আমার নাম, আমার প্রতিষ্ঠানের নাম, আমার পদের নাম জানতে পারে, কিন্তু আমার উচ্চতা ও আইডি মার্ক জানল কি করে! এ জিজ্ঞাসার কোন উত্তর পেল না আহমদ মুসা। বরং বিস্ময় বাড়লই তার।
আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা।
এই বিস্ময় জোসেফাইনেরও চোখে-মুখে। জেফি জিনা সেখানে আমার নামে পরিচয় দিয়েছে! হ্যাঁ, সে পরিচয় না দিলে তো সে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে পারতো না। জেফি জিনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল জোসেফাইনের মন। অকল্পনীয় ও দুঃসাহসিক এক উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে সে। ভাগ্যিস জেফি জিনার দেওয়া তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়নি। ভুল প্রমাণ হলে সেও বিপদে পড়তো। কিন্তু জেফি জিনা আহমদ মুসার এসব তথ্য জানল কি করে। এসব ভাবনা তার বিস্ময় আরও বাড়িয়েই দিল।
জেনারেল মিঃ মোস্তফা কামাল বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, ক্লিনিকের ভিন্ন একঘরে আপনাকে নিতে হবে।’
জেনারেল মোস্তফার এ কথার দিকে কোন মনোযোগ নেই আহমদ মুসার। বলল, ‘কি ঘটল বলুন তো। শুরুতেই তো এরা একবার এ ক্লিনিকে হানা দিয়েছিল। কিন্তু তার পরে তো সতর্ক পাহারাই থাকার কথা ছিল।’
পুলিশ অফিসারের চোখে সঙ্কুচিত ভাব ফুটে উঠল। সে একটু এগিয়ে সামনে পড়ে থাকা একটি লাশের গা থেকে ডাক্তারের অ্যাপ্রন সরিয়ে বলল, ‘স্যার, এই দেখুন এরা সুপার সিকিউরিটি ফোর্স (SSF) এর ইউনিফরম এরা এসেছিল। এক গাড়িতে ওরা ১৫জন এসেছিল। ওরা এসে প্রথমেই গোল্ড রিসোর্ট চেকপোস্টের দখল নিয়েছিল। এজন্য পুলিশ দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। ওদের বাধা দিতে গেলে সংঘর্ষে যেতে হয়, এ সাহস তারা পায়নি। ওদের কয়েকজন চেকপোস্ট দখল করে পুলিশদের নিরস্ত্র করে সেখানকার পুলিশদের হত্যা করে সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার দিয়ে। ভুয়া SSF-এর অবশিষ্ট কয়েকজন অন্য পুলিশদের দিকে ছুটে যায়। বাকিরা ছুটে আসে ক্লিনিকের দিকে। ডাক্তাররা বলেছে, ‘সশস্ত্র লোকরা ভেতরের ডাক্তারদের পোশাক খুলে নেয়।’
থামল পুলিশ অফিসারটি।
সংগে সংগেই জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘SSF-এর একটা ইউনিট আসছিল তোপকাপি প্রাসাদে। তাদের গাড়ি নির্জন এপ্রোচ গার্ডেনে প্রবেশের সংগে সংগেই একটা গ্যাস বোমা এসে পড়ে গাড়িতে। মুহূর্তে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে সবাই। ঐ SSF-দের ইউনিফরম ও গাড়ি নিয়ে সন্ত্রাসীরা গোল্ড রিসোর্টে হামলা চালায়। এক মাত্র ড্রাইভার শেষ মুহূর্তে বাঁচবার চেষ্টা করেও আংশিক আক্রান্ত হয়। সে তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে পেয়ে টেলিফোন করে SSF হেডকোয়ার্টারে। আমরা জানতে পারি তার পরেই। এসএসএফ উদ্ধার ইউনিট ছুটে আসে, আমরাও ছুটে আসি। পুলিশও খবর পেয়ে পৌঁছে যায়।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল থামতেই আহমদ মুসা মুখ খুলেছিল কিছু বলার জন্যে।
তখন তিনজন ডাক্তার প্রবেশ করল ঘরে। তাদের কারও ডাক্তারের অ্যাপ্রন নেই। অন্যান্য স্টাফদের সাথে এ তিনজন ডাক্তারকেও আটকে রেখেছিল সন্ত্রাসী ‘থ্রী-জিরো’র লোকরা।
ঘরে প্রবেশ করল এ সময় জোসেফাইনের পার্সোনাল সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে। তার চোখে মুখে বিস্ময় ও আতঙ্ক।
সে ছুটে এল ঘরের একপাশে দাঁড়ানো জোসেফাইনের কাছে।
‘ডাক্তার, আপনারা মিঃ খালেদ খাকানকে ভিন্ন ঘরে নিয়ে যান। তাকে ভাল করে দেখুন। জ্ঞান ফেরার পরই তার উপর দিয়ে বিরাট ধকল গেছে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল একজন ডাক্তারকে লক্ষ্য করে।
‘প্লিজ জেনারেল মোস্তফা, আপনারা আপত্তি না করলে ওকে এখন অন্য ঘরে নয়, আমি বাসায় নিয়ে যেতে চাই।’ বলল জোসেফাইন।
জেনারেল মোস্তফা কামাল জোসেফাইনের দিকে চকিতে একবার মুখ তুলল, মুখ নামিয়ে নিল সংগে সংগেই। বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাডাম। আমাদের আপত্তি নাই।’
তারপর ডাক্তারের উদ্দেশ্য করে জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘আপনারা জনাব খালেদ খাকানকে দেখুন। তারপর ওকে গোল্ড রিসোর্ট কটেজে রেখে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে আসুন।’
ডাক্তারদের দিক থেকে ফিরে জেনারেল মোস্তফা কামাল পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘এখন থেকে গোল্ড রিসোর্টের নিরাপত্তায় পুলিশের সাথে সাথে এসএসএফও থাকবে।’
বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল, তার সাথে সাথে জেনারেল তাহিরও।
‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা পরে কথা বলব। এখন চলি।’ আহমদ মুসার দিকে দিকে ফিরে বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আসুন। আয়েশা আজীমা মানে ডঃ বাজের ওখান থেকে কিছু পাওয়া গেছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তেমন কিছু নয়। তবে ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি। আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। এক সাথে সব পরীক্ষা করা যাবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আর একটা কথা। ওরা এখন মরিয়া হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তার দিকে বেশি নজর দিতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দোয়া করুন মিঃ খালেদ খাকান। আর আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। আল্লাহ আপনাকে যেভাবে বাঁচিয়েছেন, সেভাবেই আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। আসি। আসসালামু আলাইকুম।’
ওরা বেরিয়ে গেল।
‘স্যার, পাশের রুম এ চলুন। আমরা আপনার ব্লাডপ্রেসার ও হার্টবিটটা একটু দেখতে চাই।’ বলল একজন ডাক্তার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ আবদুল্লাহ গিয়ে গাঁট হয়ে বসেছিল আহমদ মুসার কোলে। তার চোখে-মুখে কিন্তু আনন্দের চেয়ে বিস্ময়ই বেশি। সে বারবারই তাকাচ্ছে ছড়ানো রক্ত আর পরে থাকা লোকগুলোর দিকে।
জোসেফাইন এগিয়ে গিয়ে আহমদ আব্দুল্লাহকে আহমদ মুসার কোল থেকে নিয়ে বলল, ‘ও আমার কাছে থাক। এসো পাশের রুমে।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
লতিফা আরবাকান গিয়ে জোসেফাইনের কোল থেকে আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি স্যারকে পাশের রুম এ নিয়ে যান।’
আহমদ আবদুল্লাহ লতিফা আরবাকানের কোলে উঠেই তার মাথায় বাঁধা রুমাল নিয়া টানাটানি আরম্ভ করল।’
‘হ্যালো স্যার জুনিয়র, একি করছ তুমি। তোমার তো কাজ হবে মানুষের নেকাব রক্ষা করা, বেনেকাব করা নয়।’ বলল লতিফা আরবাকান। তার মুখে আনন্দের হাসি।
হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘বল বেটা আহমদ, এটা আমার অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। মায়ের কোল থেকে কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদ।’
আহমদ মুসার ঠোটে হাসি।
চোখ তার নিচু।
হাঁটতে শুরু করেছে সে দরজার দিকে।
জোসেফাইনও তার পাশে হাঁটছে।
লতিফা আরবাকান আহমদ আব্দুল্লাহর বিদ্রোহের সাথে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে আর ওদের পেছনে পেছনে হাঁটছে।
সবশেষে বেরিয়ে এল ডাক্তাররা।
দরজার বাইরে পুলিশ, এসএসএফ-এর লোকরা ও দু’জন ক্লিনার দাড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুতেই পুলিশ ও এসএসএফ-এর লোকরা তাকে স্যালুট করল।
একজন পুলিশ এগিয়ে এসে আহমদ মুসাকে পাশের ঘরের দিকে নিয়ে চলল।
বিস্ময়কর এক স্থানে তোপকাপি প্রাসাদের গোল্ড রিসোর্ট অতিথিশালা।
অতিথিশালার ডুপ্লেক্স কটেজের দু’তলার পূর্ব দিকের একটা ইজি চেয়ারে আধ-শোয়া অবস্থায় আহমদ মুসা। তার স্থির দৃষ্টি সামনে, এক খণ্ড সাগরের বুকে। মর্মর সাগর, বসফরাস ও গোল্ডেন হর্নের মিলিত স্থান এটা। এই সাগর শুধু পানির নয়, স্মৃতিরও এক সমুদ্র, তোপকাপি প্রাসাদের মত গৌরবেরও সাগর এটা। ইউরোপ বিজয়ী মুসলিম সেনাবাহিনীর কলতানে মুখরিত ছিল এই সাগর। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ, সুলতান সুলায়মান, সুলতান বায়েজিদের মত জগত বিখ্যাত দিগ্বিজয়ী মুসলিম রাষ্ট্রনায়করা হর্ন-বসফরাস-মর্মরকে হয়তো এভাবেই দেখেছেন।
নিজেকে স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে ফেলেছিল আহমদ মুসা।
একটি ট্রেতে করে দুই গ্লাস ফলের রস ও একটি বাটিতে বাদাম নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করল জোসেফাইন।
আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে ট্রেটা দুই ইজি চেয়ারের মাঝখানের টি-টেবিলে রেখে পাশের ইজি চেয়ার এ বসল জোসেফাইন।
সালামের জবাব দিয়ে আহমদ মুসা ইজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আহমদ আবদুল্লাহ কোথায়?’
‘লতিফার সাথে পেছনের বাগানে।’ বলল জোসেফাইন।
‘লতিফার সাথে ভাব হয়েছে কেমন? কিছুক্ষণ আগে আমার কোলে উঠে তো বিদ্রোহ করল।’
‘ওটা বিদ্রোহ ছিল না, ছিল তোমার কোলে থাকার ওঁর আকাঙ্ক্ষা। তোমাকে সব সময় পায় না, পেলে আর ছাড়তে চায় না।’ বলল জোসেফাইন।
‘তোমাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি, এখন আবার বাচ্চাকেও কষ্ট……।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হলো না। জোসেফাইন আহমদ মুসার মুখে হাত চাপা দিল। বলল, ‘এ প্রসঙ্গ থাক। জেফি জিনার তখন শেষ হয়নি। কিছু ভাবলে?’
‘জেফি জিনা নিজেকে আহমদ মুসার স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছেন, এটা সে সময়ের জন্যে খুব স্বাভাবিক ছিল। স্ত্রী পরিচয় না দিলে তিনি আমাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারতেন না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে সময়ের জন্যে ওটা খুব স্বাভাবিক ছিল অবশ্যই। কিন্তু একজন মেয়ে নিজেকে অন্য কারও হৃদয় অত্যন্ত বড় না হলে, অসম্ভব আন্তরিক না হলে বান্ধবীর স্বামীকে ঐ অবস্থায়ও নিজের স্বামী বলে পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। আর তার সাথে আমার পরিচয়ও তেমন নয়। আসলে তার মত এমন কাউকে আমি জীবনে দেখিনি, তিনি এসেই যে আমাকে জয় করে নিয়েছেন। আমি তাকে কতোটা ভালবেসেছি জানি না, কারণ তার পরীক্ষা কখনও হয়নি। কিন্তু তিনি আমাকে অসম্ভব রকম আপন করে নিয়েছেন।’ জোসেফাইন বলল।
‘তুমি ঠিক বলেছ জোসেফাইন। তিনি সত্যিই অসাধারণ একজন। কিন্তু আমার সাথে তার দেখা হলো না। তিনি কি বান্ধবীর স্বামীকে এড়িয়ে চলছেন? সংজ্ঞাহীন একজনকে নিয়ে এসে, তার সংজ্ঞা না ফিরে আসতেই চলে যাওয়ার অর্থ এটাই।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইনকে একটু বিব্রত দেখালো। এই চলে যাওয়াটা তার কাছেও স্বাভাবিক মনে হয়নি। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘জেফি জিনা একজন শ্বেতাঙ্গীনি হলেও ইসলামের বিধি-বিধান আন্তরিকভাবে মেনে চলেন। হতে পারে বিনা প্রয়োজনে বান্ধবীর স্বামীর মুখোমুখি হওয়াকে ঠিক মনে করেন না।’
‘হতে পারে। কিন্তু বলত, আমার উচ্চতা, ওজন, আইডি মার্ক, ইত্যাদি তথ্য তিনি কিভাবে জানলেন? এতো সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি গণক এমন দাবি নিশ্চয়ই করবেন না।’
‘এ বিস্ময় তো আমারও। জেফি জিনা টেলিফোন করলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এ কথা। সে হেসে বলেছল, ‘এটা আল্লাহরই একটা সাহায্য। এ সাহায্য এমনভাবে ওঁর জন্যে আসবে, এটা আল্লাহর তরফ থেকেই ব্যবস্থা হয়েছিল।’ বলল জোসেফাইন।
‘এটা জবাব বটে, কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হয় না।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইন উত্তর দেবার আগেই টি-টেবিলে রাখা আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে নিল আহমদ মুসা। কল অন ও লাউডস্পিকার অন করে দিয়ে বলল, ‘হ্যালো।’
ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল কণ্ঠ, ‘আসসালামু আলাইকুম। থ্যাংকস গড, আপনাকে পেয়েছি স্যার। আমি খুব বিপদে।’
‘বলো সাবাতিনি। কি ঘটেছে, কি বিপদ?’ আহমদ মুসা বলল। হাতের চায়ের কাপটি টি-টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা।
ওপ্রান্ত থেকে সাবাতিনির কণ্ঠ, ‘আজকেই আমাকে রোমেলী দুর্গে যেতে হবে সেই কাজের জন্যে।’
‘হ্যাঁ, আজ প্রধান বিজ্ঞানী আন্দালুসির সাপ্তাহিক অবকাশে বাসায় যাবার কথা। কিন্তু তুমি বিপদ ভাবছো কেন?’
‘বিপদ নয় কেন? ধরা পড়ে গেলে হয় জেলে যেতে হবে, নয়তো গুলী খেয়ে মরতে হবে। আর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ওরাও ছাড়বে না।’
‘ছাড়বে না বলছো কেন? ওরা কি তোমাকে কোন থ্রেট করেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘থ্রেট ওইভাবে করেনি তবে বলেছে, সহজ কাজটা তোমাকে পারতেই হবে। মনে রেখ, আমাদের কোন প্রোগ্রামে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই কিন্তু। এই কথা থ্রেট ছাড়া আর কি!’
থামল সাবাতিনি মুহূর্তের জন্যে। বলে উঠল আবার, ‘স্যার, শখের বশে গোয়েন্দা হতে চেয়েছিলাম। এমনটা হবে ভাবিনি। মনে হচ্ছে আমাকে তারা তাদের কর্মী মনে করছে। তাদের লোকদের মতই আমাকে ডিল করছে। কিন্তু আমি ওদের লোক নই, ওদের কোন পয়সা আমি নেই না। আমার খুব ভয় করছে স্যার।’ কান্নাভেজা কণ্ঠ সাবাতিনির।
‘কোন ভয় নেই। তুমি ঠিক সময়ে রোমেলী দুর্গে যাও, সাহসের সাথে কাজটা করবে। যাই ঘটুক আমি দেখব। তোমার কোন ক্ষতি হবে না।’ আহমদ মুসা বলল সান্ত্বনার সুরে।
‘কিন্তু আপনি কোথায়? কিভাবে আমাকে দেখবেন। তাহলে আপনি রোমেলী দুর্গে আসুন।’ আকুল অনুরোধ ঝরে পড়ল সাবাতিনির কণ্ঠে।
‘আমার উপর আস্থা আছে?’
‘আছে স্যার। একশ ভাগের বেশি।’
‘তাহলে যাই ঘটুক, মনে করবে আমি তোমার পাশে আছি। শোন, তোমার প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচ এখন কোথায়?’
‘মানে এখন বর্তমানে?’
‘হ্যাঁ ’
‘তিনি ছুটিতে যাচ্ছেন। আজই ছুটি নিয়েছেন। টিচার্স কোয়ার্টার থেকেও বেরিয়ে এসেছেন। তিনি তার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন বসফরাসের ওপারে ফাতিহ পাশা পার্ক এলাকায় একটা বাড়িতে।’
একটু চিন্তা করল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কাজের জন্যে সে রিভলবারটা তিনি তোমায় দিয়ে দিয়েছেন?’
‘না দেননি। আমি এখন সেখানে যাচ্ছি। ওটা দেবার জন্যে তিনি ডেকেছেন।’
‘কিভাবে যাবে, চিনবে কি করে?’
‘ঠিকানা দিয়েছেন স্যার এইমাত্র।’
‘কি ঠিকানা?’
‘ফাতিহ পাশা পার্কের পূর্ব-দক্ষিণ পাশ বরাবর রাস্তার ওধারে ২৯৫ নাম্বার বাড়ি। আমাকে বলা হয়েছে, বাড়িটির গেটের শীর্ষ ফলাগুলোর মধ্যে ডান থেকে নাম্বার শিষ ফলা স্পর্শ করে গেটবক্সের সামনে গিয়ে দাড়াতে হবে, মিনিট খানেকের মাঝেই একজন বেরিয়ে এসে একটা গিফটবক্স দিয়ে যাবে।’
‘আর কোন পরামর্শ দিয়েছেন তিনি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। যদি ধরা পড়ে যাই আমি। তিনি বলেছিলেন, আমাদের কোন লোক ধরা পড়ে না। যদি বোঝ তুমি ধরা পড়ছ তাহলে তোমার রিভলবারের ট্রিগার-রিং এর মাথার উপরে একটা লাল বোতাম আছে, তাতে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে জোরে চাপ দেবে। সংগে সংগে খবর আমাদের কাছে পৌঁছে যাবে। রোমেলী দুর্গ থেকে তোমাকে আমরা সংগে সংগেই উদ্ধার করে ফেলব।’ থামল সাবাতিনি।
লাল বোতামের কথা শুনতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। সাবাতিনি থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘সাবাতিনি খবরদার, ভুলেও লাল বোতামে চাপ দেবে না।’
‘কেন?’ প্রশ্ন সাবাতিনির। তার কণ্ঠে ভয়।
‘ওতে ‘পয়জন পিস’ আসে।চাপ দেবার সংগে সংগেই তোমার মৃত্যু হবে। ভয় করো না, লাল বোতামে চাপ না দিলে তোমার কোন ক্ষতি হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
সাবতিনি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। পরে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। আমাকে বাঁচালেন। স্যার, আমার বাসায় এমন মৃত্যু দেখেছি। মনে পড়ছে আমার। ওরা এতবড় বিশ্বাসঘাতক, এতবড় খুনি স্যার। আমি তার অনুরোধে শখের বসে কাজ করছি, কোন বিনিময় তো ওদের কাছে নেইনি।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়া সাবাতিনির কণ্ঠ।
আহমদ মুসা কিছু বলবার আগেই সাবাতিনির কণ্ঠ আবার শোনা গেল, ‘আমি যদি ওদের এই কাজ না করি, করবো না আমি।’
‘ওদের এই কাজ না করেও তুমি বাঁচতে পারবে না। তোমার আব্বা-আম্মার উপরও বিপদ নেমে আসবে। ওদের নিষ্ঠুরতার কোন সীমা নেই। তার চেয়ে শোন, ওরা যেভাবে বলছে কাজটা করে দাও, শুধু লাল বোতামে চাপ দেয়া ছাড়া। কাজটা ঠিকভাবে করেছ, সেটা ওদের খুবই দরকার আর এটা তোমার বাঁচার জন্যে দরকার। আমাদের জন্যেও খুব দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আগের দুটো বুঝলাম, আপনাদের কেন দরকার সেটা বুঝলাম না স্যার।’ সাবাতিনি বলল।
‘ওরা হেলিকপ্টার ফলো করবে এবং বিজ্ঞানীর বাড়ি যাবে। ওদেরকে এভাবে আমরা দিনের আলোতে আনতে চাই।’
‘বুঝেছি স্যার। ব্যাপারটা চোরের উপর বাটপারি।’ বলল সাবাতিনি। তার কণ্ঠ এবার হালকা।
থেমেই আবার বলে উঠল সাবাতিনি, ‘ওদের নয় স্যার, আপনার নির্দেশেই আমি এ কাজ করবো।’
‘ওয়েলকাম সাবাতিনি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক। ওখানে তোমার ধরা পড়ার কোন ভয় নেই, ওদিক থেকে তোমার ক্ষতি হবে না। আমার উপর নির্ভর করতে পার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমার পরিচিত দুনিয়ার মধ্যে আমি সবচেয়ে আপনার উপরই নির্ভর করি। আপনি বললে আমি বোধহয় আস্থার সংগে আগুনেও ঝাপ দিতে পারি।’
‘এমন অন্ধ নির্ভরতা ঠিক নয় সাবাতিনি। আল্লাহর পরে নিজের বিবেককেই মনে করতে হবে সবচেয়ে বড়। যাক, শোন, প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচের কোন আইডি মার্ক আছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তার মাথায় একটা চুলও নেই। তাই তিনি সবসময় লাল তুর্কি টুপি পড়ে থাকেন। চোখ দুটো তার তীরের মত তীক্ষ্ণ। খুব অস্বস্থিকর চোখের দৃষ্টি। বোধহয় এটা আড়াল করার জন্যে গোল্ডেন কালারের ডীপ সানগ্লাস পরেন। তার বাঁ কানের নিচে একটা ক্ষতচিহ্ন আছে। ফেস মেকআপ দিয়ে ওটাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। আর……।’
সাবাতিনিকে আর এগুতে দিল না আহমদ মুসা। তার কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর দরকার নেই সাবাতিনি। তোমাকে ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি ওখানে যাত্রা করছি স্যার। ওখান থেকেই রোমেলী দুর্গে আসবো। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওকে সাবাতিনি। ওয়া আলাইকুম সালাম। আল্লাহ তোমার সহায় হোন।’
বলে আহমদ মুসা কল অফ করে মোবাইল রেখে দিল।
মোবাইল রাখতেই জোসেফাইন বলল, ‘তুমি তাকে আশ্বাস দিলে, কিন্তু মেয়েটি উভয় সঙ্কটে। একদিকে মৃত্যু, অন্যদিকে পুলিশে ধরা পড়ার ভয়। কেন তুমি তাকে এমন বিপদের মুখে ঠেলে দিলে?’
‘তুমি জান, মেয়েটি আগেই ওদের ট্রাপে পড়েছে। ওদের ইচ্ছে মত না চললে, তাকে ওরা বাঁচতে দেবে না।
আমি তাকে ও তার পরিবারকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।’
‘কিভাবে?’
‘সাবাতিনি ওদের দেয়া দায়িত্ব পালন করবে, তাতে সে ও তার পরিবার বাঁচবে। মনে করেছিলাম, ওকে গ্রেফতার করাব। কিন্তু তা করলে শত্রুরা তাদের বর্তমান প্রোগ্রাম পাল্টে ফেলবে। আমরা ওদের ফাঁদে ফেলার সুযোগ হারাব। অন্যদিকে সাবাতিনিকে ওরা কোন সন্দেহ করতে পারবে না। তার ও তার পরিবারের কোন ক্ষতি হবে না। সে বাইরে থাকলে আরেকটা উপকার হবে, শত্রুদের সম্পর্কে জানার সে একটা মাধ্যম হবে।’
‘কিন্তু মেয়েটিকে এই বিপদজনক কাজে ব্যবহার করা তোমাদের ঠিক হবে না। তোমার উপর মেয়েটির সীমাহীন আস্থা।’
‘আমি জানি জোসেফাইন। আমার বা আমার মিশনের জন্যে তাকে ব্যবহার করিনি। আমি তা করি না। আমার ভার আমিই বহন করি। আজ তাকে আমি চাপ দিয়ে রোমেলী দুর্গে যে পাঠালাম, সেটা তার ও তার পরিবারের ভালোর জন্যেই। প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচের ঠিকানা ও আইডি জানায় আমার উপকার হয়েছে, কিন্তু তাতে তার ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন একটু এগিয়ে এসে আহমদ মুসার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমার গর্ব যে, তোমার এই সুবিচারবোধ অন্য যে কারো চেয়ে বেশি।’
আহমদ মুসা কাঁধ থেকে জোসেফাইনের হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আল্লাহর বান্দাদের তো উচিত নিজের সুবিধার চেয়ে অন্যের অসুবিধাকে অগ্রাধিকার দেয়া। সুন্দর ও শান্তির সমাজ, যা আল্লাহ চান, এভাবেই গড়ে উঠতে পারে।’
বলেই আহমদ মুসা এক হাত দিয়ে মোবাইলটা আবার তুলে নিল।
‘জেনারেল মোস্তফাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেই!’ বলে আহমদ মুসা একটা কল করল।
ওপারে জেনারেল মোস্তফার কণ্ঠ পেয়ে সালাম দিয়ে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, সাবাতিনি রোমেলী দুর্গে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী মিঃ আন্দালুসির হেলিকপ্টারের টেকঅফ ক’টায়?’
‘এখন থেকে দুঘণ্টা পর ঠিক বেলা দশটায়। এই মাত্র আমি সব খোঁজ নিলাম সব ঠিক আছে। আপনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই কাজ হবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘প্রোগ্রামের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে জেনারেল মোস্তফা। সাবাতিনিকে তার কাজ শেষ করে নীরবে চলে যেতে দিতে হবে। আচ্ছা বলুন তো, অভিজাত সিজলি বা বিয়েগ্ল এলাকায় কোন ভিআইপির বাড়ি কি খালি আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
জেনারেল মোস্তফা একটু চিন্তা করে বলল, ‘হ্যাঁ, সুইচ কনসুলেটের একটা ভাড়া নেয়া বাড়ি খালি হয়েছে। সুইচ কনসাল আঙ্কারায় বদলী হয়ে গেছেন। নতুন কেউ সহসা আসছেন না সম্ভবত। ওরা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িটির নাম ‘ওয়েসিস’।’
‘তাহলে ব্যবস্থা করুন, হেলিকপ্টার ঐ বাড়িতেই ল্যান্ড করবে। বাড়িতে জনাব আন্দালুসির একটা নেমপ্লেট লাগিয়ে দিন।’
‘বুঝেছি মিঃ খালেদ খাকান। বাড়িটাকে আন্দালুসির বাড়িতে পরিণত করতে হবে। চাকর-বাকর, কুক, ড্রাইভার সবাই হবেন গোয়েন্দা, এই তো। সাবাতিনিকে গ্রেফতার করতে নিষেধ করছেন কেন? ওদিক থেকে তার কোন ভয় নেই? কিংবা ওদিকের সাথে এই দরজা আরও খোলা রাখতে চান?’
‘দু’টোই। আয়েশা আজীমার মৃত্যুর পর সাবাতিনি ছাড়া আর কোন মাধ্যম আমাদের হাতে নেই। আরেকটা কথা জেনারেল, আজ দুপুর বারটার দিকে আমি ফাতিহ পাশা পার্ক এলাকায় একটা বাড়িতে যাব। পার্কের পূর্ব-দক্ষিন এলাকায় হবে বাড়িটা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি যখন যাবেন, তখন সেটা নিশ্চয়ই ছোট ব্যাপার নয়?’
‘টার্গেটটা বড়। ধরতে পারলে ভালো। এ জন্যে বিষয়টা আপনাকে জানালাম। ঐ এলাকায় আপনার কিছু লোক থাকতে পারে।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু অতবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল আপনার উপর দিয়ে। আজকেই কি আপনার বের হওয়া উচিত?’
‘কিন্তু দেরি করা যাবেনা। সে ইতিমধ্যেই জায়গা চেঞ্জ করেছে। কর্মস্থল থেকে সে ছুটিও নিয়েছে। সে আবারও জায়গা বদলাতে পারে। আর আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে। আমাদের লোকরা পার্কের ঐ এলাকায় থাকবে। যদি দরকার হয়, তাহলে আমাদের সিকিউরিটির প্রথম নাম্বারটায়, যা আপনার মোবাইলে আছে, টেলিফোন করে জিরো নাইন জিরোতে কল করবেন, তাহলে পার্ক এলাকার টিম লিডারকে পেয়ে যাবেন।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল।’
‘ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।’ ওপার থেকে টেলিফোন রেখে দিল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখতেই জোসেফাইন বলে উঠল, ‘তোমাকে যেতে বাধা দেব না, কিন্তু বসফরাস ব্রীজ হয়ে ওপারে যাও আমার মন তা মেনে নিতে পারছে না। তুমি বোট নিয়ে ওপারে যাও।’
‘ওয়াটার ওয়েকে তুমি নিরাপদ মনে করছ কেন?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘ওরা জানে তুমি এখানে আছো। নিঃসন্দেহে বলা যায় ওরা সম্ভাব্য সকল সড়কপথের উপর চোখ রাখছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘এ ভয় যদি তুমি কর, তাহলে সব রুটেই ভয় আছে। কারণ আমি গোল্ড রিসোর্টের তোপকাপি প্রাসাদ এলাকা থেকে বের হলেই ওরা খবর জানতে পারবে। এর ফলে সড়ক পথ কিংবা পানি পথ যে পথেই যাই ওরা খবর পেয়ে যাবে। সেদিন যে আমি বসফরাস ব্রীজে আক্রান্ত হলাম, সেটা তারা আয়েশা আজীমার বাড়ি থেকে বের হবার পরই জানতে পারে। তবে সেদিন ওরা যে সুযোগ পেয়েছিল, আজ তা পাবে না। সেদিন আমি শুধু অসতর্ক নয়, সামনের দৃষ্টিটা থাকলেও আমি নিজেকে নিজের মাঝে হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এমন তো তোমার হয় না। কি ভাবছিলে তুমি।’
‘আয়েশা আজীমার কাহিনী ও ডঃ বাজের জন্যে তার অকপট স্বীকারোক্তি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আয়েশা আজীমা শুধু নিজেকেই কুরবানী দেয়নি, তার স্বজাতির ষড়যন্ত্রকেও খানিকটা প্রকাশ করে দিয়েছে। এভাবে আচ্ছন্ন থাকার কারণেই আয়েশা আজীমার বাড়ির ড্রাইভার, দারোয়ান ও কাজের লোকদের কেউ যে বাড়ির ঘটনা বাইরে সংগে সংগেই পাচার করতে পারে, সে কথা তখন মনেই আসেনি আমার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আসলে তোমার মনটা খুব সেনসিটিভ, খুব নরম। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর ‘রাহমান’, ‘রহিম’ পরিচয়টাই সৃষ্টি জগতের জন্যে সবচেয়ে বড়। মহান আল্লাহ নিজেই তার সম্পর্কে কুরআন শরীফে বলেছেন, ‘দয়াকে তোমার প্রভু তার জন্যে কর্তব্য হিসেবে ঠিক করেছেন।’ মানুষের মধ্যেও দয়া দেখাতে আল্লাহ বেশ ভালোবাসেন। আর তোমার মধ্যে দয়ার প্রকাশ আমাকে বেশি গর্বিত করে। যাক, আরেক……।’
কথা শেষ করতে পারল না জোসেফাইন। তার কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলল, ‘তাহলে আমার কঠোরতা নিশ্চয়ই তোমাকে দুঃখিত করে?’
গম্ভীর হলো জোসেফাইন। বলল, ‘তোমার কঠোরতা আইনের পক্ষে, নীতির পক্ষে, একেই বলে সুবিচার। মজলুমের পক্ষে দাড়িয়ে, সুবিচারের পক্ষে দাড়িয়ে যে কঠোরতা, তা মানবতা ও দয়া থেকেই উৎসারিত। এটা দয়ার উন্নততর রূপ। ইসলামের শান্তি আইনের কঠোরতা মানুষ ও মানবতার প্রতি অপার ভালোবাসা থেকেই নির্ধারিত।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। তুমি কিন্তু দার্শনিক হয়ে যাচ্ছ। যাক, বল, তুমি কি যেন বলতে যাচ্ছিলে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও আচ্ছা, আমার একটা কৌতূহল, বসফরাসের অস্বাভাবিক ঐ উচ্চতা থেকে কিভাবে লাফিয়ে পড়েছিলে। আমি অবাক হচ্ছি, তোমার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলে কিভাবে।’ বলল জোসেফাইন।
‘পানির কাছাকাছি পৌঁছেও আমি ডাইভিং-এর নিয়ম অনুযায়ী দুই হাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে দুই বড় জাহাজের মাঝ দিয়ে পড়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, সরাসরি পানি যেন আমি পেয়ে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শেষ মুহূর্তে একটা কার্গো ফেরির প্রান্ত ঘেঁষে ছিটকে পড়ে আরেকটা বোটের পেটে বাড়ি খেয়ে পড়ি পানিতে। সৌভাগ্য হলো, কার্গোতে নরম কিছু বোঝাই ছিল এবং আরেকটা সৌভাগ্য হলো, অতবড় উচ্চতা থেকে নিচে পড়বার যে বেগ তা কার্গো বোট ও অন্য যে বোটের পেটে ধাক্কা খেয়েছিলাম সেই বোট এবং বসফরাসের পানি এই তিনের মধ্যে বণ্টন হওয়ায় আমি বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে যাই। কার্গোর নরম লাগেজে ধাক্কা খেয়ে পেছনে পড়ার আঘাত দু’হাত দিয়ে সামলে নেই, কিন্তু ছিটকে পড়া পাঁজরটা বোটের পেটে সরাসরি ধাক্কা খেয়ে যায়। হয়তো এই আঘাতেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। তবে সংজ্ঞা হারাবার আগে সর্বশক্তি দিয়ে পানিতে ভেসে উঠতে সমর্থ হই। সম্ভবত পেছনের বোটের লোকেরা এই অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করে।’
থামল আহমদ মুসা।
মাথার পাশেই দাঁড়িয়েছিল জোসেফাইন। আহমদ মুসার মাথা বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘যা ঘটেছে সেটা মিরাকল। আল্লাহ তোমাকে নিজ হাতে বাঁচিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।’ আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে জোসেফাইনের কণ্ঠ।
‘অবশ্যই জোসেফাইন, আল্লাহই রক্ষা করেছেন। কি ঘটেছে আমি বর্ণনা দিয়েছি। কিন্তু কিভাবে ঘটেছে, তা আমি জানি না। আমার নিজের উপর কিংবা কোন কিছুর উপরই আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সব কিছুর নিয়ন্ত্রক যিনি তিনিই সব নিয়ন্ত্রণ করেছেন।’
থামল আহমদ মুসা। পরক্ষনেই আবার বলল, ‘তুমি ওয়াটারওয়ে ব্যবহার করতে বলেছ। ভালো পরামর্শ তোমার। ফাতিহ পাশা পার্কের এলাকাতেই রয়েছে একটা ফেরিঘাট। একটাই অসুবিধা হবে গাড়ি থাকবে না, গাড়ি ভাড়া করতে হবে।’
‘অসুবিধা নেই। ফেরিঘাটে একটা গাড়ি রাখতে বলতে পার।’ বলল জোসেফাইন।
‘তাহলে যে আবার ফিরতে হবে ব্রীজ হয়ে।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘অসুবিধা হবে না। গাড়িটা আবার কোন ঘাটে রেখে আসবে।’ বলল জোসেফাইন। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘রিভলবার চালাবার মত বুদ্ধিতেও তুমি একদম গোয়েন্দা হয়ে পড়েছ। ধন্যবাদ জোসেফাইন।’
‘বেশি প্রশংসা কিন্তু বিপরীত অর্থও বুঝায়’ বলে আহমদ মুসার পিঠে একটা কিল দিয়ে জোসেফাইন চায়ের কাপ নিয়ে দ্রুত চলে গেল ঘরের দিকে।
৩
ফাতিহ পাশা পার্কের পূর্ব-দক্ষিন পাশের রাস্তার ওধারে সম্ভাব্য সবগুলো এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে ৩৯৫ নং বাড়ি। অবশেষে ৩৯৫ নাম্বার একটা বাড়ি সে পেয়েছে, তা পার্কের প্রায় দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে এবং বাড়িটাও একটা পুলিশ ফাঁড়ি।
ক্লান্ত আহমদ মুসা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল। পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের বাড়িগুলো থেকে শুরু করে পশ্চিম-উত্তরের এই প্রান্ত পর্যন্ত বাড়িগুলোর নাম্বার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ফাতিহ পাশা পার্কের সত্যিকার দক্ষিণ পশ্চিম যাকে বলে, সেখানে বাড়ি রয়েছে মাত্র বিশটি। বাড়িগুলোর নাম্বার ৩৪৬ থেকে ৩৬৫ পর্যন্ত। তারপর ৩৯৭ পর্যন্ত অবশিষ্ট বাড়িগুলো রয়েছে পার্কের দক্ষিণ এবং দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের প্রান্ত পর্যন্ত। সাবাতিনি কি তাকে ভুয়া নাম্বার দিয়েছে? না সে নিজে প্রতারিত হয়েছে? এ দুটোর কোনটিই সম্ভব নয়। সাবাতিনি তাকে ভুয়া নাম্বার দিতে পারে না। অন্যদিকে সাবাতিনি প্রতারিত হলে প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচ নির্দেশিত বাড়িতে সে পৌঁছাবে কি করে? সাবাতিনির ওখানে পৌছা বেগভিচদের জন্যেই প্রয়োজনীয়। তাহলে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল প্রফেসর বেগভিচরা যে বাড়ির নাম্বারে সাবাতিনিকে ডেকেছিল, সাবাতিনি আসার পর তার নাম্বার আবার পাল্টে ফেলেছে। এটাই ঘটেছে নিশ্চয়। কিন্তু কোন নাম্বারকে ৩৯৫ বানাল? যে কোন নাম্বারকেই পাল্টাতে পারে।
আবার চিন্তায় বুঁদ হয়ে গেল আহমদ মুসা।
তার মনে প্রশ্ন জাগল, নাম্বার ৩৯৫ বানাল কেন? যে নাম্বারটিকে সে চেঞ্জ করেছে সে নাম্বারের সাথে ৩৯৫ নাম্বারের কি মিল আছে? মিল থাকাটাই স্বাভাবিক। ধাঁধার সাইকোলজি এটাই যে অঙ্কগুলো ঠিক থাকে, চেঞ্জ হয় অঙ্কের বিন্যাস। এখানে যদি তাই করা হয়ে থাকে, তাহলে তিনটি অঙ্ক দিয়ে ছয় সেট সংখ্যা তৈরি করা যায়। সেগুলো হলো ৩৯৫,৩৫৯,৯৫৩,৯৩৫,৫৯৩ এবং ৫৩৯। এই ছয় সেট সংখ্যার যেকোন একটি হবে আসল সংখ্যা। ভাবলও অনেকক্ষণ আহমদ মুসা। ঠিকানার একটি প্রধান বিষয় ছিল বাড়িটা ফাতিহ পাশা পার্কের পূর্ব-দক্ষিন কোনে। এই দিক নির্দেশনাকে প্রধান ধরলে এই ছয় সেট চারটিই অর্থাৎ ৯৫৩, ৯৩৫, ৫৯৩ এবং ৫৩৯ বাদ হয়ে যায়। কারণ সংখ্যাগুলো ফাতিহ পাশা পার্কের রাস্তার বিপরীত দিকের কোন পাশেরই সংখ্যা নয়। ৩৯৫ যে আসল সংখ্যা নয় তা এ থেকে প্রমাণ হয়েছে। তাহলে একমাত্র ৩৫৯ সংখ্যাটিই বাকি থাকে। সুতরাং এই সংখ্যাটিই হতে পারে আসল ঠিকানা।
আহমদ মুসার মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। তার মনে হলো তার হিসেবে কোন ভুল নেই, ৩৫৯-ই হবে সেই বাঞ্ছিত নাম্বার।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। গাড়িতে উঠে ছুটল ৩৫৯ নাম্বার বাড়ির দিকে।
দক্ষিণ দিক থেকে যাচ্ছে বলে ৩৫৯ নাম্বার বাড়িটা রাইট লেনে পড়েছে, সে যাচ্ছে লেফট লেন ধরে। সুতরাং তাকে আরও উত্তরে টার্ন ঘুরে বাড়িটার দিকে ফিরে আসতে হবে।
টার্নটা ৩৫৯ নাম্বার বাড়ির দু তিনটি বাড়ির উত্তরেই। আহমদ মুসা টার্ন ঘুরে দ্বিধাহীনভাবে গাড়ি চালিয়ে এসে ৩৫৯ নাম্বার বাড়ির সামনে দাড় করাল। বাড়িটা চারতলা।
আহমদ মুসা ঠিক করেই এসেছে, একজন ট্যাক্স গোয়েন্দার পরিচয় নিয়ে সে বাড়িতে ঢুকবে, বাড়িটার ভাড়া সংঙ্ক্রান্ত সব কাগজপত্র সার্চ করার পরোয়ানা নেবে। গোয়েন্দার আইডেন্টিটি কার্ড তার পকেট এ রয়েছে। তুরস্কের মত দেশে কোন বাড়িতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এর চেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা আর নেই। পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতি জানলে বাড়ির অনেকেই সরতে পারে। যার ফলে শিকার ভাগতে পারার সম্ভাবনা থাকে। ট্যাক্স-গোয়েন্দাকে মানুষ বাড়িতে ঢুকতে দেখলে অসন্তুষ্ট হয়, উদ্বিগ্ন হয়, কিন্তু পালায় না কেউ।
আহমদ মুসা তার গাড়ি গেটের সামনে দাড় করিয়ে নামল গাড়ি থেকে। বাম পাশেই গেটবক্স।
আহমদ মুসা গেটবক্সের দিকে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে, ঠিক সে সময়েই গেটের বিশাল দরজাটা দ্রুত ডান দিকে সরে গিয়ে উন্মুক্ত করে দিল গেট।
কিছুটা বিস্মিত আহমদ মুসা পকেটে হাত পুরেই উন্মুক্ত দরজা দিয়ে ভেতরে তাকাল। চোখ পড়ল সরাসরি লাল তুর্কি টুপিধারি একজন লোকের উপর। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের সানগ্লাস। তার স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। তার ডান হাতের রিভলবার আহমদ মুসার দিকে উঠে আসছে।
চোখ পড়তেই আহমদ মুসা তাকে চিনতে পেরেছিল। রিভলবার উঠে আসা দেখেই বুঝেছিল কি ঘটতে যাচ্ছে।
বাম দিকে দেহটাকে ছুড়ে দিয়েছিল আহমদ মুসা। প্রায় তার সাথে সাথেই গুলিরও শব্দ হয়েছিল।
আহমদ মুসার কোটের ডান হাতার একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গুলিটা চলে গেল।
বাম দিকে ছিটকে যাবার সময় আহমদ মুসাও রিভলবার ধরা বাম হাত পকেট থেকে বের করে এনেছিল। আঙ্গুলটাও ছিল ট্রিগারে।
মাটিতে পড়ার আগেই ট্রিগার টিপেছিল আহমদ মুসা। গেটের সামনের জায়গা নিচু ও ঢালু। গুলীটা কিছুটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। ডান হাতকে টার্গেট করা গুলীটা গিয়ে বিদ্ধ হলো প্রফেসর বেগভিচের হাঁটুতে।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়ে স্থির হবার আগেই ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ভেসে এল। এক ঝাঁক গুলী ছুটে এল সেই সাথেই।
আহমদ মুসা নিরাপদেই দ্রুত গড়িয়ে গেটবক্সের দিকে সরে গেল।
ব্রাশ ফায়ার থামলো না। গেটের সামে দাঁড়ানো আহমদ মুসার গাড়ি ঝাঁঝরা হয়ে গেল। গুলীবৃষ্টি এসে গেটবক্স ঘিরে ধরল।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, গুলির আওয়াজটা ক্রমশ নিচে আসছে। গুলী শুরু হয়েছিল দু’তলা থেকে। মনে হয় ওরা ক্রমশ নিচে নেমে আসছে।
আহমদ মুসা গেটবক্সকে সামনে রেখে উঠে দাঁড়াল। এগোলো গেটবক্সের দিকে। গেটবক্সের দরজায় চাপ দিতেই তা খুলে গেল। গেটবক্সের আরেকটা দরজার দিকে আর গেটবক্সের ভেতর ও বাহির দু’দিকেই পর্যবেক্ষণ জানালা।
ভেতরের পর্যবেক্ষণ জানালা দিয়ে আহমদ মুসা উঁকি দিল বাইরে। প্রথমেই চোখ পড়ল সিঁড়ি ঘরের দিকে। সিঁড়ি ঘরটা জানালা থেকে সামনে সোজা সামনে একটা ছোট চত্বরের ওপারে। দক্ষিণ দিকে ঘুরেই দেখতে পেল হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ প্রফেসর বেগভিচ ডান পাটা টেনে নিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিট এ উঠে বসেছে।
আহমদ মুসা বুঝল সে পালাচ্ছে।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা রিভলবার তাক করল প্রফেসর বেগভিচের গাড়ির সামনের চাকা। নির্ভুল নিশানা। একটা গুলী গিয়ে বিদ্ধ হলো সামনের চাকার পেটে। শব্দ তুলে চাকাটা দেবে গেল।
প্রফেসর বেগভিচ তাকাল গেটবক্সের দিকে। তার রিভলবার থেকে কয়েকটা গুলী ছুটে এল গেটবক্স লক্ষ্যে।
ওদিকে সিঁড়িঘরের দিক থেকেও ছুটে এল গুলীর ঝাঁক। সম্ভবত গুলীর শব্দ থেকে তারা আহমদ মুসার অবস্থান আঁচ করে নিয়েছে।
আহমদ মুসা আড়াল থেকে ব্রাশ ফায়ারের উৎস সিঁড়ি ঘরের দিকে নজর রেখে এক হাতে রিভলবার ধরে অন্য হাতে দ্রুত মোবাইলে একটা কল করল পার্কে অপেক্ষমাণ গোয়েন্দাদের। তাদেরকে বাড়ির নাম্বার দিয়ে এদিকে আসতে বলল।
গেটবক্সের জানালা লক্ষ্যে গুলীবৃষ্টি অব্যাহতভাবে চলছে।
আহমদ মুসা বুঝতে পারছে, ওরা গুলীর দেয়াল সৃষ্টি করে এদিকে অগ্রসর হতে চাচ্ছে।
অব্যাহত গুলীর কারণে সিঁড়িঘরের দিকে নজর রাখতে পারছে না আহমদ মুসা। আড়ালে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে এমন জায়গায় চোখ রেখেছে তার মানে ওরা সামনে মুভ করতে চাইলে সে জায়গা তাদের অতিক্রম করতেই হবে।
তবে আহমদ মুসার দিক থেকে গুলীর শব্দ না পেয়ে ওরা সম্ভবত বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে যে, আহমদ মুসা পালাল কিনা। এরকমটা তারা ভাবলে এমন কিছু করে বসবে যা তাকে সুযোগ করে দেবে।
ওদিকে ব্রাশ ফায়ার হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। আহমদ মুসা তার দিক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল না। ওরা কিছু করবে বলে যা ভেবেছিল আহমদ মুসা, সেটাই ঘটছে মনে করল সে। ট্রিগারে আঙুল চেপে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করল আহমদ মুসা।
হঠাৎ ব্রাশ ফায়ার আবার শুরু হলো। এবার গুলীর লক্ষ্য শুধু জানালা নয়, গুলী এখন গেটকেই কভার করেছে। দু’একটা গুলী জানালা লক্ষ্য করে আসছে।
এই গুলীর আড়ালে ষ্টেনগান বাগিয়ে গুঁড়ি মেরে মেরে দু’জন দৌড় দিয়েছে সিঁড়িঘর থেকে গেটের দিকে। এমন সুযোগের জন্যেই ওঁৎপেতে ছিল আহমদ মুসা। তার রিভলবার দু’বার অগ্নিবৃষ্টি করল। চত্বরটার মাঝখানে ওদের দু’টি লাশ ঢলে পড়ল।
এর জবাব এল ওদিক থেকে। দুই ষ্টেনগান থেকে বৃষ্টির মত গুলী ছুটে এল জানালা লক্ষ্যে।
এই সময় গেটবক্সের বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত মাথা নিচু করে গেটবক্স থেকে বাইরে এল। বেরিয়েই দেখতে পেল সাদা পোশাকের সাতজন গোয়েন্দা পুলিশ।
আহমদ মুসা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘ভেতরে চারজন ষ্টেনগানধারী ছিল। দু’জন মারা গেছে। দু’জন সিঁড়ি ঘরে লুকিয়ে থেকে গুলী করছে। আসল শিকার প্রফেসর বেগভিচ আহত অবস্থায় চত্বরের গাড়িতে বসে আছে। তাকে পালাতে দেয়া যাবে না।‘
‘ধন্যবাদ স্যার, ওয়েল ডান স্যার। আমরা দেখছি। আমাদের সাথে বুলেটপ্রুফ গাড়ি আছে।‘
বলে সে সাথীদের দিকে ফিরল। বলল, ‘রেডি।’
তারা এগোলো গাড়ির দিকে।
গুলী-গোলার শব্দ শুনে পুলিশের দু’টো গাড়িওঁ এসে দাঁড়িয়েছিল।
গোয়েন্দা অফিসার একটু এগিয়ে গিয়ে তাদেরকেও কিছু নির্দেশ দিল।
নির্দেশের সংগে সংগেই, পুলিশের দু’টি গাড়ি বাড়ির দু’পাশের দু’দিকে এগোলো। তাদের দৃষ্টি বাড়িটার পেছন দিকে।
গোয়েন্দা পুলিশরাও তাদের গাড়িতে উঠে বসেছে। পুলিশরা দু’দিক থেকে বাড়ির পেছন দিকে এগিয়ে যাবার পর গোয়েন্দা পুলিশের গাড়ি গেট পার হয়ে ছুটল সিঁড়ি ঘরের দিকে। তাদের গাড়িতে ফিট করা গান থেকেও গুলীবৃষ্টি হচ্ছে।
ওদিক থেকে গুলী বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা ছুটল গাড়ির দিকে। ওদের গুলীর কভার নিয়ে আহত প্রফেসর বেগভিচ পালাতেও পারে, এ আশংকা আছে।
গেট পার হতেই গাড়ির ভেতরটা চোখে পড়ল আহমদ মুসার। প্রফেসর বেগভিচকে দেখা পেল না। তাহলে কি প্রফেসর বেগভিচ সত্যিই পালাল! মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার।
তবুও দ্রুত গিয়ে আহমদ মুসা দাঁড়াল গাড়ির পাশে। গাড়ির ভেতরে চোখ যেতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল গাড়ির সিটে ঢলে পড়ে আছে প্রফেসর বেগভিচের দেহ।
এবার নতুন আশংকা আহমদ মুসার মনে, পটাশিয়াম সাইনাইড কি প্রফেসর বেগভিচকেও কেড়ে নিল তাদের হাত থেকে! প্রফেসর বেগভিচের নীল হয়ে যাওয়া মুখের উপর ভালো করে নজর পড়তেই নিশ্চিত হলো তার আশংকাই ঠিক।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে ফেলল।
প্রফেসর বেগভিচকে সার্চ করতে চায় সে। প্রফেসর বেগভিচ কোথায় বেরুচ্ছিল গাড়ি নিয়ে। বেরুবার মুখেই সে আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়েছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় সে ধরা পড়েছে। সুতরাং তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কিছু পাওয়া অসম্ভব নয়।
প্রফেসর বেগভিচের প্যান্টের পকেটে একটা রুমাল এবং একগোছা চাবি সমেত একটা রিং পেল। কোটের দুই সাইড পকেটের একটিতে একটি সিগারেট লাইটার পেল, অন্য পকেটে পাসপোর্ট এবং এয়ার লাইন্সের একটি টিকিট পাওয়া গেল। আহমদ মুসা দেখল, টিকিটটা ইস্তাম্বুল-তেলআবিব (ইসরাইল) রুটের। তার মানে, প্রফেসর বেগভিচ ইসরাইল যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, ভাবল আহমদ মুসা। সিগারেট লাইটার একই সাথে মিনি বন্দুক ও ক্যামেরাও। এই সিগারেট লাইটারের পিনাকৃতির বুলেট ৬ ফিটের মধ্যে যে কোন শিকারকে তাৎক্ষণিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। পিনাকৃতি বুলেটের মাথায় বিশেষভাবে মাখানো থাকে পটাশিয়াম সাইনাইড।
সিগারেট লাইটার পকেটে পুরল আহমদ মুসা।
কোটের ভেতরের দুই পকেটের একটিতে পেল একটি মানিব্যাগ, অন্যটিতে চামড়ার কভারের মধ্যে পেল একটা ‘মাইক্রো ভিসিডি’।‘
দারুণ খুশি হলো আহমদ মুসা। এই মাইক্রো ভিসিডিও ‘মাইক্রো চিপস’-এর মতই এক একটা মেমোরি সাগর। মাইক্রো ভিসিডিটাও পকেটে পুরল আহমদ মুসা।
মানিব্যাগে পেল ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা আইডি কার্ড এবং এক হাজার ডলারের অনেকগুলো নোট।
টাকা ও আইডি কার্ড সমেতই মানি ব্যাগটা আহমদ মুসা প্রফেসর বেগভিচের পকেটেই আবার রেখে দিল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
গোয়েন্দা পুলিশের গাড়ি সিঁড়ি ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা বুঝল, বন্দুকধারীদের অনুসরণ করে গোয়েন্দারা বাড়িতে ঢুকে গেছে।
আহমদ মুসা মোবাইল বের করে কল করল জেনারেল মোস্তফা কামালকে। প্রফেসর বেগভিচের পরিণতিসহ এখানকার সব কথা জানিয়ে বলল, ‘প্রফেসর বেগভিচ ইসরাইল যাবার জন্যে বেরুচ্ছিলেন। তাঁর পকেটে যা পাওয়া গেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো একটা মাইক্রো ভিসিডি। আমার মনে হয় এটা কাজে লাগতে পারে।‘
ওপ্রান্ত থেকে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনি চলে আসুন। আমি গোয়েন্দা অফিসারকে বলে দিচ্ছি তারা কয়েকজন পুলিশকে পাহারায় রেখে অবশিষ্ট পুলিশ দিয়ে লাশগুলো নিয়ে এখানে চলে আসবে। আর এদিকের খবর ভালো। সাবাতিনিকে নিরাপদে তার দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার হাত কেঁপে যাবার ফলে ‘ট্রান্সমিশন চিপস বুলেট’টা হেলিকপ্টারের পেটে পেষ্ট না হয়ে টপে পেষ্ট হয়েছে।‘
‘ঠিক আছে, সে সন্দেহের শিকার না হলেই হয়। ট্রিপল জিরোর লোক বা লোকরা উপস্থিত থেকে নিশ্চয় সবকিছু অবজারভ করেছে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘না, সন্দেহ করার মত কিছুই ঘটেনি। হেলিকপ্টার দর্শকের ষ্টাইলে সে রিভলবার কোটের আড়ালে রেখেই গুলী ছুঁড়তে পেরেছে। কিন্তু আমি ভাবছি খালেদ খাকান, প্রফেসর বেগভিচ মারা যাবার পর তার এই নতুন ঠিকানার খোঁজ জানার ব্যাপারে সন্দেহের তীর সাবাতিনির দিকে নিক্ষিপ্ত হতে পারে।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘তার সম্ভাবনা আছে। আবার নেইও বলা যেতে পারে। গেটে আকস্মিক দেখা হয়েছে, এটাই তাদের মনে হতে পারে। তাছাড়া হেলিকপ্টারে ‘ট্রান্সমিশন চিপ’ স্থাপনের তার দায়িত্ব সে ঠিক ঠিক পালন করেছে। তবু তার উপর নজর রাখার ব্যবস্থা করুন। সাবাতিনির মাধ্যমে তাদের কাজ যদি শেষ হয়ে থাকে, তাহলে সাবাতিনিকে পথের কাঁটাও ভাবতে পারে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি ঠিক বলেছেন। আমি এখনি ব্যবস্থা করছি। দু’জন গোয়েন্দা তার উপর সার্বক্ষনিক নজর রাখবে। ঠিক আছে, আপনি চলুন প্লিজ।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওকে। আসছি আমি। আসসালামু আলাইকুম।‘
আহমদ মুসা রেখে দিল মোবাইল।
গোয়েন্দা কয়েকজনও এসে পৌঁছল। অফিসার আহমদ মুসার সামনে এসে বলল, ওদের ধরা গেল না স্যার। বাড়িতে একটা সুড়ঙ্গ পথ আছে। সে পথেই ওরা পালিয়েছে। সুড়ঙ্গ পথটা একটা ষ্ট্ররস সোয়ারেজে গিয়ে মিলেছে। প্রফেসর বেগভিচের খবর কি স্যার ?’
‘সে নেই। ধরা পড়ার চাইতে পটাশিয়াম বিষ নেয়া সে বেশি পছন্দ করেছে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ও গড! তাহলে আমাদের মিশনটাই ব্যর্থ।‘ বলল গোয়েন্দা অফিসারটি।
‘না, আমাদের মিশন ব্যর্থ হয়নি। শুনুন অফিসার, আপনারা পুলিশের সাথে লাশগুলো নিয়ে আসুন। আমি জেনারেল মোস্তফার ওখানে যাচ্ছি। আপনারা আসুন।‘ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল গেটের দিকে। দেখল, জেনারেল মোস্তফার পাঠানো গাড়িটাও এসে পৌঁছেছে।
আহমদ মুসা গাড়িতে গিয়ে উঠল।
গাড়ি ষ্টার্ট নিল।
গাড়ি তখন বসফরাস ব্রীজের গোড়ায় পৌঁছেছে। মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল ধরতেই ওপার থেকে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘দুঃসংবাদ খালেদ খাকান, আমাদের লোকরা এই মাত্র খবর দিল যে, সাবাতিনি পাহাড় থেকে পড়ে মাথা ফেটে মারা গেছে।‘
‘ইন্নালিল্লাহি…।‘ আহা, সরল, সোজা, রহস্যপ্রিয় মেয়েটা! আমরা তাকে বাঁচাতে পারলাম না।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি খালেদ খাকান। ও যে এত তাড়াতাড়ি সন্দেহের শিকার হবে তা বোঝা যায়নি।‘ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘কিন্তু জেনারেল, সে সন্দেহের শিকার নাকি তার প্রয়োজন ওদের শেষ হয়ে যাওয়ায় ওরা পথ পরিষ্কার করেছে, তা বলা মুস্কিল। আমি আসছি। জেনারেল, সিজলির ‘ওয়েসিস’ বাড়িটায় সার্বক্ষনিক পাহারায় যেন ঘাটতি না হয় দেখবেন প্লিজ।‘
‘সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। ওয়েসিসে যাবার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যতগুলো পথ আছে, সবগুলোর উপরে গোপনে চোখ রাখা হয়েছে। ওরা তাদের চোখ এড়াতে পারবে না।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ধন্যবাদ জেনারেল। আর কোন কথা ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘না, ধন্যবাদ। আসুন।‘
‘ওকে জেনারেল। আসসালামু আলাইকুম।‘ মোবাইল রাখল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা কামাল তার অফিসে তার চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘ভিসিডিতে কি আছে তা জানতে সত্যিই আমার তর সইছে না। ভিসিডিটা দিন মি. খালেদ খাকান।‘
টেবিলের এপাশে বসেছিল আহমদ মুসা, জেনারেল তারিক ও প্রধানমন্ত্রীর সিকিউরিটি এডভাইজার ড. মোহাম্মদ আইদিন।
আহমদ মুসা পকেট থেকে ভিসিডিটা বের করে জেনারেল মোস্তফার হাতে দিল।
জেনারেল মোস্তফা আগ্রহের সাথে ভিসিডিটা হাতে নিয়ে কম্পিউটারে সেট করে প্লে অপশনে ক্লিক করে বলল, ‘প্রফেসর বেগভিচ দেশ থেকে বেরুবার সময় ভিসিডিটা পকেটে রেখেছিল, তখন এটা শূন্য নয় নিশ্চয়।‘
কম্পিউটার স্ক্রীন সচল হলো।
মুহুর্তের জন্য ধোঁয়াটে হয়ে উঠল কম্পিউটার স্ক্রীন। একটু পর ধোঁয়া কেটে গিয়ে বেরিয়ে এলো বসফরাস। স্ক্রীনের সেন্ট্রাল পয়েন্টে এসে গেল বসফরাস তীরের রোমেলী দুর্গ।
হঠাৎ আবার ধোঁয়ায় ঢেকে গেল স্ক্রীনটা। এই ধোঁয়ার মধ্যেই যেন একটা সুড়ঙ্গ নেমে এল। সুড়ঙ্গটা গোটা কম্পিউটার স্ক্রীন জুড়ে বিস্তৃত হলো। সুড়ঙ্গটা দ্রুত উপরে উঠে আসতে লাগল, তার সাথে দৃষ্টিটা ছুটল সুড়ঙ্গের বটমের দিকে। উধাও হয়ে গেল সুড়ঙ্গ। ফুটে উঠল একটা কক্ষের দৃশ্য। কক্ষটি নানারকম জটিল কলকব্জা ও কম্পিউটারে ঠাসা।
চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছে জেনারেল তাহির তারিকের। চিৎকার করে বলল, ‘এ যে আমাদের প্রধান বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির ল্যাব। এই ছবি এ সিডিতে কি করে এল!’
‘সর্বনাশ। বাইরের আমরা দু’একজন ছাড়া তো এই ল্যাব আর কেউ দেখেনি। কোন ধরণের ক্যামেরা ভেতরে যাবার প্রশ্নই নেই। এ ছবি উঠল কি করে।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসার চোখে বিস্ময় নয়, উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। তার স্থির দৃষ্টি ছিল ছবির এংগেলের দিকে।
কক্ষের দৃশ্যটা স্থির ছিল না। একেকটা যন্ত্র-যন্ত্রাংশের উপর একেক সময় স্থির হচ্ছিল। মূল ফোকাসের সময় যন্ত্র-যন্ত্রাংশের ছবিগুলো এতই বড় হচ্ছিল যে, সূচের ডগা পরিমাণ বিন্দুও মার্বেলের মত বড় মনে হচ্ছিল।
হঠাৎ দৃশ্যপট পাল্টে গেল। উবে গেল ল্যাব-কক্ষের দৃশ্য। স্ক্রীনে এল বিরাট একটা হলঘরের ছবি। ঘরটা ভর্তি নানারকম, নানা আকারের দুর্বোধ্য সব যন্ত্রপাতি, ক্রুজ মিসাইল ধরণের ও রকেটলাঞ্চার আকারের দ্রব্যে ভর্তি। হলঘরটা যেমন একটা ক্রিকেট মাঠের মত বিস্তৃত, তেমনি জাম্বোজেটের মত উঁচু।
এই ঘরের দৃশ্যের উপর চোখ পড়তেই জেনারেল তাহির তারিক এবং জেনারেল মোস্তফা কামাল দু’জনেই এক সাথে চিৎকার করে উঠল, ‘সর্বনাশ, কি দেখছি আমরা। এযে আমাদের আইআরটির টপ সিক্রেট রিসার্চ-ট্রেজার এবং গ্রাউন্ডের দৃশ্য!’
আর কারো মুখ থেকেই কোন কথা উচ্চারিত হলো না। সকলের পলকহীন দৃষ্টি কম্পিউটার স্ক্রীনে ফুটে উঠা দৃশ্যের দিকে।
কম্পিউটার স্ক্রীনে ছবির ফোকাস একেকটা যন্ত্র বা আইটেমের উপর গিয়ে পড়ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার যন্ত্র বা আইটেমের সূক্ষ্ম খাঁজসহ একমাত্র বটম ছাড়া সব দিকের দৃশ্যই পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এমন মাল্টি ডাইমেনশনাল ছবি কি করে সম্ভব! এ প্রশ্নও বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখগুলোতে।
ছবির ফোকাস এক এক করে সবগুলো জটিল যন্ত্রপাতি, ক্রুজ মিসাইল ও রকেটলাঞ্চার ধরণের জিনিস এবং ছোট-খাট সব দ্রব্যাদির উপর দিয়ে ঘুরল প্রায় স্থির গতিতে।
আধা ঘন্টা সময় তখন পার হয়ে গেছে।
হঠাৎই ঘরের দৃশ্য উবে গেল।
অন্ধকার নেমে এল স্ক্রীনে।
ভিডিও’র দৃশ্য স্ক্রীন থেকে চলে গেলেও দর্শকদের চোখগুলো যেন আঠার মত লেগে আছে স্ক্রীনে।
অনেকক্ষণ কথা বলল না কেউ। জেনারেল মোস্তফা কামাল, জেনারেল তাহির তারিক, প্রধানমন্ত্রীর সিকিউরিটি এডভাইজার ড. মোহাম্মদ আইদিনদের চোখে-মুখে ভয় ও উদ্বেগের চিহ্ন। আহমদ মুসার মুখে কিন্তু স্বস্তির চিহ্ন। আইআরটির তথ্যাদি সম্বলিত মহাগুরুত্বপুর্ণ এ ভিডিও চিত্র বাইরে পাচারের উদ্যেগ আল্লাহ্ ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
জমাট নিরবতার মধ্যে প্রথম কথা বলে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল। বলল, ‘আল্লাহ্ রক্ষা করুন, আমাদের আইআরটি’র কিছুই তো ওদের অজানা নেই। কিন্তু এ ছবি তারা তুলল কি করে। ভেতরে ক্যামেরা প্রবেশ করার ব্যাপারটা অসম্ভব।‘
‘ঠিক বলেছেন জেনারেল মোস্তফা। এমন ছবি তোলা অসম্ভব। যাদের ল্যাব, টেষ্টিং গ্রাউন্ড ও রিসার্চ ট্রেজারে প্রবেশের অনুমতি আছে, তারা ছাড়া ঐ সব স্থানে প্রবেশ করা যে কোন কারও পক্ষে অসম্ভব।‘
‘ঠিক বলেছেন জেনারেল মোস্তফা। এমন ছবি তোলা অসম্ভব। যাদের ল্যাব, টেষ্টিং গ্রাউন্ড ও রিসার্চ ট্রেজারে প্রবেশের অনুমতি আছে, তারা ছাড়া ঐ সব স্থানে প্রবেশ করা যে কোন কারও পক্ষে অসম্ভব। আর যাদের প্রবেশ করার অনুমতি আছে, তাদের বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত। তাহলে এটা ঘটল কি করে ?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘আমার মনে হয় উপগ্রহের বিশেষ ক্যামেরা থেকে এসব ছবি উঠেছে। উপগ্রহ থেকে ভু-অভ্যন্তরের বিভিন্ন রকমের ছবি তোলা এখন একটা সাধারণ ব্যাপার। আইআরটি’র গোপন তথ্য যোগাড়ে তারা ভূ-উপগ্রহ ব্যবহার করেছে দেখা যাচ্ছে।‘ প্রধানমন্ত্রীর সিকিউরিটি এডভাইজার ড. মোহাম্মদ আইদিন বলল।
আহমদ মুসা চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘ভিডিও চিত্র আকাশ থেকে কিংবা উপগ্রহের ক্যামেরা থেকে তোলা নয়। ছবির ফোকাসগুলো উপর থেকে নয়, বিভিন্ন কৌণিক এঙ্গেলে এসেছে। এমন এংগেল ভূ-পৃষ্ঠের বাইরে হতে পারে না। কোন পাহাড়, বা ব্রীজের উপর থেকেও তোলা হতে পারে ভিডিও চিত্রগুলো।‘
বিস্মিত জেনারেল মোস্তফা কামাল, আপনার ব্যাখ্যাই বেশি যুক্তিসংগত। কিন্তু এ ধরণের ক্যামেরা কি আছে ?’
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষ্ট্রাটেজিক রিসার্চ সম্প্রতি এ ধরণের ক্যামেরা তৈরি করেছে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকেই এ ক্যামেরা ভূ-অভ্যন্তরের মাল্টি ডাইমেনশনাল ছবি তুলতে পারে। এ ক্যামেরার ফোকাস কৌণিকভাবে ভূগর্ভে প্রবেশ করলেও টার্গেটের উপর ফোকাসের ক্ষেত্রে কখনও তা ভার্টিকাল এবং বিভিন্ন উচ্চতায় সমান্তরাল হতে পারে। তার ফলে টার্গেটের একমাত্র তলদেশ ছাড়া সব পাশের সব এংগেলের ছবি তুলতে পারে। আমার মনে হচ্ছে সর্বাধুনিক এ ক্যামেরাই এখানে ব্যবহৃত হয়েছে।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আবিষ্কৃত হলেও এ ক্যামেরা তো মার্কেটে আসেনি। উইপনসের সবগুলো লেটেষ্ট মার্কেট রিপোর্ট আমার কাছে আছে। তাহলে ষড়যন্ত্রকারীরা এ ক্যামেরা পেল কি করে বুঝতে পারছি না।‘ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা ও মার্কিন ষ্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবের মালিকরা যদি কাছাকাছি হয়, তাহলে তো ঐ ক্যামেরা কেনার জন্য মার্কেটের প্রয়োজন হয় না!’
‘আপনি কি তাই মনে করেন মি. খালেদ খাকান ?’ জিজ্ঞাসা ড. মোহাম্মদ আইদিনের।
‘এটা মনে করার কথা নয়, চোখেই দেখা যাচ্ছে ড. আইদিন। এই ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে প্রফেসর বেগভিচ যাচ্ছিলেন ইসরাইলে। ইসরাইল আর মার্কিন বর্তমান শাসকদের একটি মহলের ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থ একই। অতএব মার্কিন ষ্ট্রাটেজিক ল্যাব থেকে ইসরাইল ষ্ট্রাটেজিক ক্যামেরা পেতেই পারে। আর ইসরাইল ও ষড়যন্ত্রকারী ‘থ্রি জিরো’ হতে পারে একই স্বার্থের দুই নাম।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘সর্বনাশ, আমাদের আইআরটি তাহলে এক মহাষড়যন্ত্রের মুখে। কিন্তু একটা কথা, ইসরাইলের সাথে আমাদের তুরস্কের সম্পর্ক তো খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। তার পরেও কি তারা আমাদের সাথে এতবড় একটা ষড়যন্ত্রের কাজ করতে পারে ?’ বলল ড. আইদিনই।
হাসল আহমদ মুসা। কিন্তু আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই উত্তরটা এল জেনারেল তাহিরের কাছ থেকে। বলল, ‘তুরস্ককে নিজের স্বার্থে সে বন্ধু মনে করে এবং ইসরাইল নিজের স্বার্থেই ওআইসির গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআরটিকে তুরস্কে স্থান দেয়ার সিদ্ধান্তকে বৈরিতার চোখে দেখছে।‘
ড. আইদিন তাকাল জেনারেল তাহিরের দিকে। বলল, ‘ঠিক বলেছেন। এটাই কারণ। ওরা তুরস্কের বন্ধু, কিন্তু সেটা যখন ওদের জন্য লাভজনক।‘
একটু থামল ড. আইদিন। বলল সংগে সংগেই আবার, ‘ওদের ক্যামেরা আমাদের গবেষণাগারের সর্বত্র পৌছেছে। আমাদের অত্যন্ত স্পর্শকাতর গবেষণাগার আইআরটির কোন গোপনীয়তা আর অবশিষ্ট নেই। এখন আমাদের করণীয় কি ?’
‘ভিসিডিটা এখনও ওদের হাতে পৌঁছেনি। ভিসিডিটা আগে যদি কোনওভাবে পাঠিয়ে দিত, তবে আজ এতটা ঝুঁকি নিয়ে প্রফেসর বেগভিচ এটা সাথে নিত না। তবে ভিসিডির কপি আরও কারো কাছে থাকতে পারে, তবে নাও থাকতে পারে। হতে পারে, প্রফেসর বেগভিচ নিজেই ব্রীজ থেকে ছবি নিয়েছিলেন আইআরটি গবেষনাগারের। তিনি ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত প্রফেসর বলে তার মাধ্যমে ছবি নেয়াই ছিল নিরাপদ। আমার মনে হয়, সেটাই করা হয়েছে। মনে হয় ফাতিহ পাশা পার্ক সংলগ্ন ঐ বাড়িটা এবং প্রফেসরের বিস্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার খোঁজ করলে ক্যামেরার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। আর…।‘
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। কথার মাঝখানেই বলে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, আমি এখনই নির্দেশ দিচ্ছি অনুসন্ধান করে দেখার জন্যে।‘
‘ধন্যবাদ জেনারেল। আমি যে কথা বলছিলাম। আমাদের করণীয় বিষয় নির্ভর করে ‘থ্রি জিরো’ কি করতে চায় তার উপর। আইআরটি গবেষণাগারের যে বিস্তারিত ছবি তারা সংগ্রহ করেছে, তা তারা তাদের অনেক কাজেই লাগাতে পারে। তবে তারা আইআরটির থিয়োরিটিক্যাল গবেষণা ও প্র্যাকটিক্যাল অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায়। এই জানার জন্যে তারা কি করছে, এটাই আমাদের দেখার বিষয়, সেই সাথে প্রতিরোধ-প্রতিকারের বিষয়ও।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। এটাই এখন প্রধান বিষয়।‘
একটু থামল জেনারেল মোস্তফা কামাল। বলল আবার, ‘আমাকে উঠতে হচ্ছে। খালেদ খাকান যা বলেছেন, সে বিষয়ে এখনি কয়েকটা মেসেজ পাঠাতে হবে। আসছি আমি।‘
জেনারেল মোস্তফা কামাল উঠতেই ড. আইদিন বলল, ‘আমাকে উঠতে হবে এখন। বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টকে এখনি জানাতে চাই।‘
ড. আইদিনও উঠে দাঁড়াল।
সালাম দিয়ে সে পা বাড়াল বাইরের দিকে।
বেরুতে গিয়ে জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনারা বসুন। আরও কিছু কথা আছে। আপনাদের চা দিতে বলছি।‘
বেরিয়ে গেল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘থ্রি জিরোর নিকটে যাবার একটা ছাড়া সব পথ আপাতত হাতছাড়া। এখন…।‘
‘একটা কোনটা ?’ আহমদ মুসার কথার মাঝখানে বলে উঠল জেনারেল তাহির তারিক।
‘সিজলিতে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির নতুন বাড়ি। এই বাড়িটা এখন থ্রি জিরোর টার্গেট। ড. আন্দালুসিকে ঘিরে তাদের যে টার্গেট, তা অর্জন করতে তাদের ঐ বাড়িতে আসতে হবে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘এই কনট্যাক্ট পয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণও।‘ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘হ্যাঁ, জেনারেল তারিক। বিজ্ঞানী আন্দালুসিই তাদের আসল উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, মি. খালেদ খাকান, আপনি ঠিক বলেছেন।‘ বলল জেনারেল তারিক।
‘বাড়িটার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নতুন করে রিভিও করা দরকার।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন। আজ সকালেও আমি ও জেনারেল মোস্তফা কামাল সেখানে গিয়েছিলাম। নিরাপত্তার বিষয়টা আমরা পর্যালোচনা করেছি। কুক, পরিচারক-পরিচারিকা ও বয়-বেয়ারার ছদ্মবেশে মোট ৮ জন মহিলা-পুরুষ গোয়েন্দা বাড়ির ভেতরে নিয়োজিত আছেন। এছাড়া বাড়ির সকল এপ্রোস রোডসহ চারদিকে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা নতুন করে নিশ্চিত করা হয়েছে।‘ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘ধন্যবাদ। প্রশ্ন হলো, ওরা কোন পথে অগ্রসর হতে চায়। উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তারা কোন কৌশল গ্রহণ করতে চাচ্ছে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি আগেই এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন। এটাই এখনকার বড় প্রশ্ন। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এখন তাদের মতলবটা কি। আপনি নিশ্চয় কিছু ধারণা করছেন ?’ জেনারেল তাহির তারিক বলল।
‘ওদের সামনে মাত্র একটা অপশন নিশ্চয় নেই। তবে তাদের টার্গেট যে ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ফর্মুলার জন্যেই তাদের প্রয়োজন বিজ্ঞানীকে। কিন্তু সোর্ড-এর ফর্মুলার জন্য তারা এতটা মরিয়া কেন ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কারণ, তাদের উড়ন্ত ধরণের সকল অফেনসিভ অস্ত্র অচল হয়ে পড়ছে। এতে করে তাদের দাঁত ও থাবা ভোতা হয়ে পড়বে।‘ বলল জেনারেল তারিক।
‘কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। ওদের দাঁত বা থাবা রক্ষা বা অস্ত্রগুলোকে সচল রাখাই একমাত্র টার্গেট হলে ওরা খুব সহজেই বিজ্ঞানীদের সমেত আইআরটিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে। ওদের উপগ্রহের নিস্পলক চোখ আইআরটির উপর নিবদ্ধ আছে। ওদের হাতে এমন অস্ত্র আছে যা রোমেলী দূর্গের ঐ অংশসহ ১০০ ফুট গভীর পর্যন্ত দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতে পারে। তা না করে ফর্মুলা হাত করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন ? নিছক আত্মরক্ষা নয়, ফর্মুলাই ওদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু ‘সোর্ড’-এর টেকনোলজি হাত করার জন্যে কিনা ? ওরা তো এমনিতেই নিরাপদ। রকেট ও রকেট জাতীয় অস্ত্র ধ্বংসের প্রতিরক্ষা শিল্ড (ষ্ট্রাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ-SDI) তো আছেই! তাহলে সোর্ড-এর ফর্মুলার জন্য এতটা পাগল হয়ে উঠবে কেন ? আমি মনে করি এ প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ।‘ থামল আহমদ মুসা।
‘মি. আহমদ মুসা, আপনি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। এভাবে আমি বিষয়টাকে দেখিনি। ধন্যবাদ আহমদ মুসা। কিন্তু কি হতে পারে বিষয়টা ?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
এ সময় চা-নাস্তার ট্রলি ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল বেয়ারা।
ট্রলিতে দুই কাপ চা, দুই হাফ প্লেটে কাবাব সাজানো। তার পাশে সসের বাটি। যেন কাবাব দিয়ে ধোঁয়া উঠছে, এমন মনে হচ্ছে দেখতে।
জেনারেল তাহির সাগ্রহে বলল, ‘যাক তুমি আসতে বেশ দেরি করলেও ভালো নাস্তা এনেছো হে।‘ জেনারেল তাহিরের লক্ষ্য নাস্তার দিকে।
কিন্তু আহমদ মুসার লক্ষ্য বেয়ারার পায়ের দিকে। বেয়ারার পায়ে পুলিশের কমব্যাট বুট দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। তুরস্কে পুলিশ ও অফিসের বেয়ারারাও কি ওদের লোক! তারা তো কমব্যাট বুট পরে না এবং তারা ইউনিফরম পরে বটে, কিন্তু কমব্যাট ইউনিফরম নয়! বেয়ারার পরনে ননকমব্যাট ইউনিফরম ঠিক আছে, কিন্তু ইউনিফরমটা তার দেহের চেয়ে অনেক বড়। বুটের মত এটাও বিদঘুটে দেখাচ্ছে।
হঠাৎ মনে একটা চিন্তার উদয় হওয়ায় চমকে উঠল আহমদ মুসা।
চেয়ারে সোজা হলো তার দেহ। তীক্ষ্ণ হলো তার দৃষ্টি।
বেয়ারা টেবিলে চা, নাস্তা সাজিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। স্যালুট দিয়ে জেনারেল তাহিরকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনারেল স্যার ভিসিডিটা আমাকে এখুনি নিয়ে যেতে বলল। ড. আইদিনকে ওটা দেবেন তিনি।‘
জেনারেল তাহির কাবাবের প্লেটটা টেনে নিচ্ছিল। বলল, ‘ও, প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের সাথে তিনি বোধ হয় কথা বলেছেন। ঠিক আছে বেয়ারা, ওটা বের করে নাও।‘
জেনারেল তাহির তারিকের নির্দেশ দেবার আগেই বলা যায় বেয়ারা হাঁটা শুরু করেছিল।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে তখন চিন্তার ঝড়। হঠাৎ যেন তার মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল, ‘দাঁড়াও বেয়ারা, আমি জেনারেল মোস্তফার সাথে কথা বলে নিই।‘
একথা বলার সাথে সাথেই পকেটে হাত পুরেছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার নির্দেশ শুনেই বেয়ারা বোঁ করে এদিকে ঘুরল। সেই সাথে তার হাতে উঠে এসেছে রিভলবার।
আহমদ মুসার হাত পকেটে ঢুকলেও তার চোখ দু’টি আঠার মত লেগেছিল বেয়ারার উপর।
বেয়ারাকে পকেট থেকে রিভলবার বের করে ঘুরতে দেখে মোবাইল ছেড়ে রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল আহমদ মুসার হাত।
আর রিভলবার সমেত হাত বেরিয়ে আসার সাথে সাথে আহমদ মুসা টেবিল-লেবেলের উপরে বেড়ে থাকা তার দেহকে টেবিলের সমান্তরালে বাঁদিকে নিয়েছিল। তার রিভলবার থেকে গুলীও বেরিয়ে গিয়েছিল প্রায় সংগে সংগেই।
বেয়ারা ও আহমদ মুসা দু’জনের রিভলবার থেকে প্রায় একই সময়ে গুলী বেরিয়ে ছিল।
বেয়ারার গুলী আহমদ মুসার ডান কাঁধের বাহু সন্ধিতে একটা ছোবল মেরে কিছু গোসত তুলে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। দেহটা তার বাঁ দিকে সরে না গেলে বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যেত বেয়ারার গুলীতে।
আহমদ মুসার মত সাবধান হতে পারেনি বেয়ারা। তার ফলেই আহমদ মুসার নিক্ষিপ্ত বুলেট বেয়ারার বাম বুক একেবারে বিধ্বস্ত করে দেয়।
বেয়ারার দেহ একবার টলে উঠে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল টেবিলের পাশে।
আহমদ মুসার দেহটা সোজা হলো চেয়ারে।
বিস্ময়-বিস্ফোরিত চোখ দু’টি জেনারেল তাহিরের। মুহূর্তের জন্যে বাকহারা হয়ে গিয়েছিল সে। আহমদ মুসার গুলীটা ছিল জবাবী বা আত্মরক্ষামূলক, এটা বোঝা গেছে। কিন্তু বেয়ারা আহমদ মুসার কথা শুনে ক্ষেপে উঠে আহমদ মুসাকে গুলী করে বসল কেন ? তাহলে কি …!
জেনারেল তাহিরের চিন্তায় ছেদ নামল।
ছুটে এসে ঘরে প্রবেশ করল জেনারেল মোস্তফা কামাল এবং তার সাথে কয়েকজন পুলিশ।
জেনারেল মোস্তফা কামালের চোখ প্রথমেই পড়ল বেয়ারার রক্তাক্ত লাশের উপর। তারপর দেখতে পেল আহমদ মুসাকে বাঁ হাত দিয়ে ডান বাহুসন্ধি চেপে ধরে বসে থাকতে। আহমদ মুসার হাত ছাপিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আহত স্থান থেকে।
জেনারেল মোস্তফার চোখ গিয়ে পড়ল জেনারেল তাহির তারিকের উপর।
জেনারেল তাহির তারিক ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। দ্রুত, সংক্ষেপে সব কথা বলে শেষ করল এই বলে যে, মি. খালেদ খাকান তার দেহটা ঠিক সময়ে সরিয়ে নিতে না পারলে বেয়ারার আগে তিনি লাশ হতেন। আর যদি ব্যাপারটা আঁচ করতে না পারতেন এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে মোবাইলের বদলে রিভলবার বের না করতেন, তাহলে আগে উনি, তারপর আমাকেও লাশ হতে হতো এবং ভিসিডিটা চলে বেয়ারার হাতে।‘
বিস্ময় বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে জেনারেল মোস্তফা কামালের দুই চোখ।
সে দ্রুত ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে, ‘মি. খালেদ খাকান, আঘাতটা কেমন ? বুলেট ভেতরে আছে কিনা ? চলুন, পাশেই আমাদের পুলিশ হাসপাতালের ভিআইপি উইং।‘
আহমদ মুসাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তুলতে যাচ্ছিল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
একজন পুলিশ বলল, ‘স্যার, আমরা ষ্ট্রেচার নিয়ে আসছি।‘ বলে দৌড় দিল পুলিশটি।
আহমদ মুসা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে বলল, ‘আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আমার আঘাত তেমন নয়। গুলীটা বেরিয়ে গেছে। আপনি বরং দেখুন আসল বেয়ারা কোথায় ? মনে হচ্ছে তাকে কোথাও আটকে রেখে বেয়ারার পোশাকধারী এই লোক এসেছিল ভিসিডিটা হাত করতে। থ্রি-জিরোর এজেন্ট জাতীয় কেউ এ হতে পারে।‘
বেয়ারাকে পর্যবেক্ষন করছিল যে পুলিশ অফিসারটি, সে বলে উঠল, ‘স্যার এ আমাদের পুলিশের র্যাপিড কমব্যাট ব্যাটেলিয়নের লোক। নাম জোসেফ সেদ্দিক। সিকিউরিটি হেডকোয়ার্টারে আজ তার কোন ডিউটি ছিল না।‘
‘ধন্যবাদ অফিসার। তুমি যাও, এর ব্যাপারে সব তথ্য আমরা চাই। এর সংগী-সাথীদের হদিস আমাদের প্রয়োজন। এর ব্যাপারটা জানাজানির আগেই এ কাজ করতে হবে।‘
কথা শেষ করে অন্য একজন অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অপারেশনের ফুল ব্যবস্থাসহ ডাক্তারকে তুমি আসতে বল হাসপাতাল থেকে। আর লাশ নিয়ে যা করা দরকার তার ব্যবস্থা কর। ঘরটা পরিস্কারের ব্যবস্থা কর।‘
পুলিশের দু’জন অফিসার বেরিয়ে গেল।
দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই ডাক্তাররা এসে গেল। সাথে একটা ট্রলি। ট্রলিটাই একটা অপারেশন বেডে পরিণত হলো। বেডের নিচের লেয়ারে অপারেশনের সব সরঞ্জাম।
ডাক্তারদের সব নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, ডাক্তাররা তাদের কাজ সারুন। আমি আসছি। জেনারেল তাহির এখানে থাকছেন।‘
বেরিয়ে গেল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
পাকা দশ মিনিট পর ফিরে এল জেনারেল মোস্তফা কামাল। তখন আহমদ মুসার ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ।
আহমদ মুসা হাসপাতালের ঢিলাঢালা পোশাক পরে সোফায় এসে বসেছে।
ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে ডাক্তাররাও বেরিয়ে গেল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল এসে তার চেয়ারে বসল। তার মুখ মলিন। বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, এই ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো ছাড়া আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। তারা ঠিকই বলেছেন। তাদের ভিসিডিটা আমরা হাত করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেটা উদ্ধারের জন্যে আমাদের সিকিউরিটি হেডকোয়ার্টারে ওরা অভিযান চালাতে পারল কি করে, এর কোন জবাব নেই। মি. খালেদ খাকানের অস্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার কারণে আপনারা বেঁচে গেছেন, ভিসিডিটা যে রক্ষা পেয়েছে সেটা ভিন্ন খাত। তাদের অভিযানকে সফলই বলতে হবে। অনেক প্রশ্ন সামনে এসে গেছে। ভিসিডিটা যে এখানে, সেটা তারা জানলো কি করে ? জানার পর উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা এত দ্রুত কিভাবে হলো এবং তার বাস্তবায়নই বা এত দ্রুত, এত নিখুঁতভাবে কেমন করে হতে পারল ?’
থামল জেনারেল মোস্তফা। তার কন্ঠে হতাশার সুর।
‘জেনারেল মোস্তফা’, বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘তারা এত দ্রুত জানতে পারা এবং সফল অভিযান করায় বিস্ময়ের কিছু নেই। আমি নিশ্চিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার সর্বত্র তাদের লোক আছে। এরা ঠিক আয়েশা আজীমার মত। এরা তুর্কি প্রজাতন্ত্রের চাকরি করে, টাকা নেয়, কিন্তু আনুগত্য করে বিশেষ ষড়যন্ত্রের। নির্দেশ পেলেই এরা সক্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমান ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আর …।‘
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই জেনারেল মোস্তফা বলে উঠল, ‘আপনি ঠিক বলেছেন মি. খালেদ খাকান। ঘটনাটা ঠিক আয়েশা আজীমার মতই। বেয়ারাটা আসলে একজন পুলিশ অফিসার। আসল নাম তার জোসেফ সেদ্দিক নয়, তার প্রকৃত নাম ডেভিড বেনইয়ামিন। তুরস্কের এক ইহুদী পরিবারে জন্ম। স্কুল ফাইনালের আগে নাম পাল্টিয়ে খৃষ্টান নাম জোসেফ সেদ্দিক গ্রহণ করে। ইতিমধ্যেই আমাদের র্যাপিড কমব্যাট ব্যাটেলিয়নে এ ধরণের তিনটি নাম পাওয়া গেছে। তাদের কাউকেই এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার এখন মনে হচ্ছে, এরা সকলেই আয়েশা আজীমার মত ইচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে ‘থ্রি জিরো’র পক্ষে কাজ করে। বিষয়টা আমি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে চাই।‘
‘কিন্তু জেনারেল মোস্তফা, অপরাধকে জাতিগত কালার দেয়া ঠিক হবে না। পৃথিবীর বহু দেশের বহু ঘটনায় আমি ইহুদীদের দেশপ্রেমিক দেখেছি, ইহুদীদের নাম ভাঙ্গিয়ে গোষ্ঠী বিশেষের ষড়যন্ত্রের ঘোর বিরোধী দেখেছি তাদেরকে। তুরস্কেও এমন লোক প্রচুর আছে। যেমন ইস্তাম্বুলের ইয়াসার পরিবার।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। আমিও এমনটাই মনে করি। তবু আমার এখন মনে হচ্ছে, তাদের উপর চোখ রাখা দরকার। ভালো-মন্দের পার্থক্যটা হওয়া দরকার। অনেক ভালো লোকও জাতিগত ক্রিমিনালদের চাপে, ভয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। যদি চোখ রাখা হয়, তাহলে এই ভালো লোকদের সাহায্য করা, রক্ষা করা যাবে।‘ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘হ্যাঁ, এই সতর্কতা প্রয়োজন। কিন্তু একজনও যাতে অহেতুক সন্দেহের শিকার না হয়, তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান। এদিকে তো নজর রাখতেই হবে। যাক এ প্রসংগ, এখন বলুন, আমরা আমাদের আসল কাজে কিভাবে এগোব। ওরা দেখা যাচ্ছে সাংঘাতিক একশনে।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ওরা একশনে থাকলেই আমাদের লাভ। আর ওদের এখন একশনে থাকতেই হবে। টার্গেটে পৌঁছতে ওরা এখন আর বেশি সময় নিতে চায় না। আমার মনে হয় ওদের সবটা মনোযোগ বিজ্ঞানীদের উপর। সুতরাং সিজলি এলাকায় বিজ্ঞানীদের বাড়ি এখন আমাদেরও মনোযোগের কেন্দ্র।‘ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি এখন উঠতে চাই।‘
‘অবশ্যই মি. খালেদ খাকান। আপনার রেষ্ট প্রয়োজন। আপনি কোথায় যেতে চান, রোমেলী দুর্গে, না গোল্ড রিজর্টে ?’
‘প্রথমে গোল্ড রিজর্টে।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘হেড কোয়ার্টারের লনে আপনার জন্যে হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে। ওরা রেডি।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘হেলিকপ্টার কেন ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর এটাই নির্দেশ। আপনাকে নিয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। এই হেলিকপ্টার আপনার ডিসপোজালে থাকবে। আপনি স্বাধীনভাবে একে ব্যবহার করবেন।‘ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘ধন্যবাদ। তবে আকাশ নয়, মাটিকেই আমি পছন্দ করি। শত্রুরা মাটিতে তাই আমাকেও মাটিতেই থাকতে হবে।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘বিষয়টা আপনার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কখন কি ব্যবহার করবেন, সেটা আপনিই দেখবেন। তবে তারা বলেছেন, আপনার নিরাপত্তা আমাদের নাম্বার ওয়ান প্রায়োরিটি।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘ধন্যবাদ জেনারেল মোস্তফা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন কিন্তু আপনাকে হেলিকপ্টারেই যেতে হবে। আপনি এখানে আছেন, এখান থেকে বেরুবেন, এটা শত্রুরা সবাই জানে। কোন ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ধন্যবাদ, আমি বুঝেছি আপনাদের কথা।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘একটা কথা মনে পড়ে গেছে মি. খালেদ খাকান। খুব আগ্রহ আমার তা জানার। আপনি কি করে বুঝলেন যে বেয়ারা নকল?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘প্রথমত তার পায়ে ছিল পুলিশের কমব্যাট বুট, যা বেয়ারারা পরে না। দ্বিতীয় হলো, বেয়ারার ইউনিফরম তাঁর গয়ে ফিট ছিল না। সংগে সংগেই আমার মনে এ কথা এসেছিল যে, সে নকল বেয়ারা। আসল বেয়ারাকে সে কোথাও আটকে রেখে এসেছে। আর তার সাথে আমার মনে হয়েছিল, তার টার্গেট ভিসিডি।’
‘ধন্যবাদ খালেক খাকান। আল্লাহ আপনাকে আরও বেশি বেশি সাহায্য করুন। আমার মনে হয় আল্লাহ আপনার মনে ইলহাম করেন।’ বলল জেনারেল তাহির।
‘অসহায় বান্দার বিপদে আল্লাহ বান্দার মনে বাণী পাঠান। বান্দার প্রতি আল্লাহর ‘রহমান’ নামের এ এক অসীম দয়া।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সব মানুষই কি আল্লাহর এ বাণী শুনতে পান?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল তাহিরের।
‘অবশ্যই পান। অনেক সময় এটা বিবেকের রায় আকারে আসে। আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদরা বরং আরও অগ্রসর হয়ে বলেছেন, মহান লেখকদের যত মহৎ লেখা এবং বিজ্ঞানের যত আবিষ্কার, সবই স্রষ্টার দান। স্রষ্টার কাছ থেকে এটা প্রথমে মানুষের অবচেতন মনে আসে। তারপর অবচেতন থেকে চেতনায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আধুনিক চিন্তাবিদরা সত্যিই এমন কথা বলতে পেরেছেন?’ বলল জেনারেল মোস্তফা। তার চোখে মুখে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, জেনারেল মোস্তফা। আর্নল্ড টয়েনবি ও দাইমাকু ইকেদার মত আধুনিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ বিবেকরাই এ কথা বলেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। আরও একটা বড় বিষয়ে আপনি আমার শিক্ষক হলেন।’ বলল জেনারেল তাহির।
‘আমারও।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে উঠে দাঁড়াল দুই জেনারেলও। বলল,‘চলুন, আমরা আপনাকে হেলিকপ্টারে দিয়ে আসি।’
সবাই হাঁটতে লাগল ঘরের দরজার দিকে।
৪
অল্পক্ষণ হলো মিটিং শুরু হয়েছে। একটা বড় টেবিল ঘিরে চারজন মানুষ।
প্রধান বা সভাপতির আসনে বসেছে ‘থ্রি জিরো’র ইউরোপীয় প্রধান আইজ্যাক বেগিন। তার পাশেই ইসরাইলী রাস্ট্রদূত বসেছে। তাদের সামনে টেবিলের ওপ্রান্তে বসেছে ‘থ্রি জিরো’র ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের প্রধান প্রফেসর ডক্টর ডেভিড ইয়াহুদ। তার পাশেই ‘স্মার্থা’। স্মার্থা ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের নতুন অপারেশন চীফ। ইরগুন ইবান নিহত হবার পর তার দায়িত্ব এসে পড়েছে স্মার্থার উপর।
প্রফেসর ডক্টর ইয়াহুদ তাদের ইস্তাম্বুল প্রজেক্ট সম্প্রতি মারাত্মক যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, তার উপর পূর্ণাঙ্গ ব্রিফিং শেষ করল।
‘থ্রি জিরো’র ইউরোপীয় প্রধান আইজ্যাক বেগিনের মুখ আষাঢ়ে মেঘের মত ভারি।
মাথা নিচু করে সে ডক্টর ডেভিড ইয়াহুদের কথা শুনছিল।
ডক্টর ইয়াহুদের কথা শেষ হলে ধীরে ধীরে মুখ তুলল আইজ্যাক বেগিন। চোখে-মুখে তার অনেক প্রশ্ন। মুখ ফাঁক করেছে প্রশ্ন করার জন্যে।
এই সময় ইন্টারকমে কথা বলে উঠল আইজ্যাক বেগিনের পিএস।
‘বল রবিন। জরুরি কিছু?’ জিজ্ঞাসা আইজ্যাক বেগিনের।
‘স্যার, বেঞ্জামিন এসেছে। ভেতরে পাঠাব?’ বলল রবিন।
‘বেঞ্জামিন? লরেন্স কোথায়? আমি তো লরেন্সের টেলিফোনের অপেক্ষা করছি। পাঠাও তাকে।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘লরেন্স তো এভাবে আমাদের দূতাবাসে আসার কথা নয়। তার উপর পুলিশের নজর আছে বলে আমরা জানি।’ বলল তুরস্কে কার্যরত ইসরাইলি রাষ্টদূত।
‘আমি সে কথাই ভাবছি। টেলিফোনে মেসেজ আসবে লরেন্সের কাছ থেকে। কিন্তু সেই মেসেজের বদলে বেঞ্জামিন আসছে কেন? লরেন্সের মোবাইল ঘন্টা খানেক আগে থেকে বন্ধ।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘লরেন্সের সাথে গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারেই যেহেতু ডিউটি ছিল, তাই জরুরি কোন কথা তার থাকতে পারে।’ বলল ড.ইয়াহুদ।
দরজায় নক হলো।
‘এস রবিন।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
রবিন লরেন্সকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
রবিন লরেন্সকে ভেতরে ঢুকিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
নির্দেশ মত স্মার্থার পাশে একটা খালি চেয়ারে বসল বেঞ্জামিন।
বেঞ্জামিন পুলিশের গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারে একজন সিভিলিয়ান কেমিষ্ট অফিসার।
সবার চোখ বেঞ্জামিনের দিকে নিবদ্ধ।
মুখ খুলল বেঞ্জামিন। একবার ড. ইয়াহুদের দিকে তাকিয়ে চোখ নিবদ্ধ করল আইজ্যাক বেগিনের দিকে। তার চোখ-মুখ ভীত ও ফ্যাকাসে। বলল, ‘স্যার, লরেন্স নিহত হয়েছেন।’
‘কখন, কিভাবে? সে তার কাজ করতে পারেনি?’ জিজ্ঞাসা আইজ্যাক বেগিনের।
‘সে বেয়ারার ছদ্মবেশে নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। জেনারেল মোস্তফা তখন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খালেদ খাকান তাকে গুলী করে মেরেছে।’
‘খালেদ খাকান কি করে তাকে সন্দেহ করল? লরেন্স অত্যন্ত চালাক লোক। একাধিক অপশন দেয়া হয়েছিল। যে কোন মূল্যে আজকেই ভিসিডি উদ্ধার করতে হবে। সুযোগ পেলে চায়ে বিষ মিশিয়ে ওদের হত্যা করে ভিসিডির কাছে পৌঁছতে হবে। এ সুযোগ না পেলে ঘরে বিষাক্ত গ্যাস ছুঁড়ে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এই দুই ক্ষেত্রে সন্দেহ হবার আগেই তো কাজ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সে খালেদ খাকানের সন্দেহের শিকার হলো কি করে? জেনারেল মোস্তফা সন্দেহ করলে একটা কথা ছিল যে, সে লরেন্সকে চিনতে পেরেছে।’
বেঞ্জামিন বলল, ‘আমি বলাবলি করতে শুনেছি যে, লরেন্স ঘরে প্রবেশ করার আগেই জেনারেল মোস্তফা বেরিয়ে এসেছিল এবং তাঁর নির্দেশেই লরেন্স নাস্তা নিয়ে যান ঐ ঘরে। তিনি জেনারেল মোস্তফার বরাত দিয়ে ভিসিডিটি কম্পিউটার থেকে নিয়ে আসার চেষ্টাও করেন। সেই সময় খালেদ খাকান বাধা দিলে লরেন্স তাকে গুলী করেন। কাঁধে গুলীবিদ্ধ হয়েও খালেদ খাকান গুলী করে হত্যা করে লরেন্সকে।’
‘তাই হবে। ওতো খালেদ খাকান নয়, আমাদের চিরশত্রু, আমাদের সীমাহীন সর্বনাশের হোতা সেই আহমদ মুসা। নিখুঁত মেকআপে তার চেহারা অনেক খানি পরিবর্তন করেছিল। দেরি হয়েছে তাকে চিনতে। সব ব্যাপার আমরা জেনেছি। তার নাম পাল্টিয়ে তুর্কি সরকার ও ওআইসি তাকে নিয়ে এসেছে তাদের আইআরটি রক্ষার জন্যে।’ থামল আইজ্যাক বেগিন।
ড. ডেভিড ইয়াহুদ, স্মার্থা সকালের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত। অবচেতন মনে শিউরেও উঠেছে তারা। তারা সবাই জানে, সব যুদ্ধেই অবশেষে তারা আহমদ মুসার কাছে হেরেছে। সাধারণ ঐ লোকটি একেবারেই অসাধারণ। যেমন সে ক্ষীপ্র, তেমনি ধুর্ত, তার সাহসেরও পরিমাপ নেই।
তাদের মুখে কোন কথা নেই।
কথা বলে উঠল আইজ্যাক বেগিন। বলল বেঞ্জামিনকে লক্ষ্য করে, ‘তুমি এবার এস।’
‘ইয়েস স্যার।’ বলে বেঞ্জামিন উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বেঞ্জামিন বেরিয়ে যেতেই আইজ্যাক বেগিন বলল, ‘এখন দুই টার্গেট, ‘সোর্ড’-এর ফর্মুলা হাত করা এবং আহমদ মুসাকে হত্যা করা। দেখামাত্র তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত আমাদের আগে থেকেই আছে। সেটাই কার্যকারী করতেই হবে।’
‘সে সাংঘাতিক ধড়িবাজ। তার ফাইল আমি মোসাদ-এর ওয়েবসাইটে পড়লাম। তাকে ধরার জন্যে, তাকে শেষ করার জন্যে হাজারো ফাঁদ পাতা হয়েছে, হাজারো সুযোগ আমাদের হাতে এসেছে, কিন্তু সবই আমাদের ব্যর্থ হয়েছে। ইস্তাম্বুলে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাও এ কথাই বলছে যে, তার সাথে লড়াই নয় ধ্বংস করতে হবে তাকে। আমি মনে করি স্যার, আইআরটি সমেত তাকে ও বিজ্ঞানীদের ধ্বংস করা হোক। তাতে আহমদ মুসাসহ ওদের সোর্ড ও গবেষণা কার্যক্রম শেষ হয়ে যাবে।’ বলল স্মার্থা।
গম্ভীর হলো আইজ্যাক বেগিন এবং ড. ডেভিড ইয়াহুদের মুখ। ড. ইয়াহুদ তাকাল আইজ্যাক বেগিনের দিকে।
আইজ্যাক বেগিন সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। বলল, ‘স্মার্থা, তুমি আমাদের অপারেশন স্কোয়াডের একটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তোমার জানা দরকার যে, সোর্ড, সোর্ডের বিজ্ঞানী বা আইআরটি ধ্বংস করা আমাদের মিশন নয়। আমরা ‘সোর্ড’-এর ফর্মুলা চাই, আমরা চাই সোর্ডের ডিজাইন।’
‘কিন্তু স্যার, আমি বুঝতে পারছি না, ‘সোর্ড’ এবং এর ডিজাইনে এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কেন? আমি জানি, মার্কিন ইহুদী কণাবিজ্ঞানী ইলাম ইমামুয়েল আলোক কণা ফোটন নিয়ে ‘সোর্ড’-এর অনুরূপ গবেষণায় সফল হয়েছেন। এর অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সোর্ড’ জাতীয় ডিফেনসিভ শিল্ডের মালিক হওয়ার সাথে সাথে গোপনে ইসরাইলও এর মালিক হয়ে গেছে। অতএব সোর্ড কিংবা সোর্ডের ফর্মূলার দরকার ইসরাইলের নেই। এরপরও স্যার, আইআরটির সোর্ড ও সোর্ডের ফর্মূলা পাওয়ার জন্যে অহেতুক আমরা এত ক্ষতি স্বীকার করছি কেন? সব সমতে আইআরটি ধ্বংস করলেই তো আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায়। সোর্ড ওদের হাতে না থাকলেই আমরা বেঁচে যাই।’ বলল স্মার্থা।
‘তুমি যে তথ্য দিয়েছ তা ঠিক। কিন্তু সব তথ্য তুমি দিতে পারনি। আমাদের কণাবিজ্ঞানী ইলাম ইমামুয়েল আলোক-কণার ‘ফোটন’- শিল্ড আবিষ্কার করেছেন, যার ফাংশন ডিফেন্সিভ অস্ত্র হিসেবে ওদের সোর্ড এর মতই। কিন্তু ওদের ‘সোর্ড’- এর ভয়াবহ অফেনসিভ ক্যারেক্টার রয়েছে, যা আমাদের ফোটন শিল্ডে নেই।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘বুঝলাম না, স্যার?’ স্মার্থা বলল।
‘বলছি শোন, ইস্তাম্বুলের ‘আইআরটি’ গবেষণাগার ‘সোর্ড’ নামের যে ‘ফোটন-শিল্ড তৈরি করেছে তা যেমন ডিফেনসিভ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তেমনি অফেনসিভ অন্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। আইআরটির প্রধান বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বহু আগের লেখা ‘টেকনোলজিক্যাল ইউজ অব ফোটনস’ নামের একটা নিবন্ধ তার গোপন ওয়েব সাইট থেকে আমাদের বিজ্ঞানীরা উদ্ধার করেছেন। তাতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে তিনি গামা-ফোটনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম নতুন উপাদান ‘আল-সালাম’- এর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন এই ‘আল-সালাম’- এর প্রযুক্তিগত ব্যবহার ফোটন-নেটকে ভয়ংকর মারণাস্ত্রে রূপ দিতে পারে, যা পাল্টে দিতে পারে দুনিয়াকে। তার মতে ‘আল-সালাম’- এর প্রযুক্তি রূপকে যদি ফোটন-নেটের সাথে যুক্ত করা হয়, তাহলে এমন একটা অস্ত্র তৈরি হবে যা আলোর গতিতে দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে পৌছে যে কোন দুর্ভেদ্য সাইলোতে ঢুকে পড়ে মেটালিক-ননমেটালিক সব অস্ত্রকে সম্পূর্ণ হাওয়া করে দিতে পারে। আজ আইআরটিতে বসে ড. আন্দালুসি যে ‘সোর্ড’ তৈরি করেছেন, তাতে এই অফেনসিভ ক্যারেক্টার যুক্ত রয়েছে। ‘সোর্ড’- এর যে অর্থ তার মধ্যেও এর ইংগিত আছে। ‘সোর্ড’ -কে সেভিয়ার অব ওয়ার্ল্ড র্যাশনাল ডোমেইন বলা যায়। সংক্ষেপে এর অর্থ ‘মানব-ধর্মের ত্রাতা’। মানব ধর্ম বলতে ওরা বুঝাচ্ছে ‘শান্তি’ (rational domain)। আর বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি ফোটনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম- এর নতুন উপাদানের নাম রেখেছেন ‘আল-সালাম’ মানে শান্তি। এর অর্থ তারা বুঝাচ্ছেন, আমরা মনে করছি, দুনিয়ার সব অস্ত্রকে তার নিজ নিজ সাইলোতে ধ্বংস করে দিয়ে তারা দুনিয়াতে যুদ্ধহীন শান্তি নিয়ে আসবেন। এটাই আমাদের আতংকের বিষয়। আমরা চাই আমাদের সাইলোগুলোতে আমাদের অন্ত্র অটুট রেখে দুনিয়ার সব অস্ত্র ধ্বংস করতে। এজন্যেই আমরা মরিয়া ওদের ‘সোর্ড’ এবং তার ফর্মুলা হাত করতে।’
থামল আইজ্যাক বেগিন।
স্মার্থার ঠোঁট শুকনো। তার চোখে অসহায় দৃষ্টি।
তার ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কথা বেরুলো না। কথা যেন গলায় আটকে গেছে।
স্মার্থা সামনের গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে এক গ্লাস পানি সবটাই খেয়ে নিল।
গ্লাসটা টেবিলে রেখে সে বলল, ‘স্যার আমাদের বিজ্ঞানী গামাফোটনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম-এর আল-সালাম উপাদান খোঁজার চেষ্টা করছে না?’
চেয়ারে গা এলিয়ে দিল আইজ্যাক বেগিন। তার চোখে-মুখে দারুণ হতাশার ছাপ। বলল, ইউরোপ-আমেরিকার কার্যরত আমাদের সকল কণাবিজ্ঞানী অবিরাম চেষ্টা করেও এই ব্যাপারে এক ধাপ এগোতে পারেনি। এমনকি কোন সম্ভাবনাও তারা সৃষ্টি করতে পারেনি।’
স্মার্থারও চোখে-মুখে ভীতি-মিশ্রিত হতাশার সুর। বলল, ‘দক্ষিণ স্পেনের প্রায় পরিত্যক্ত শহর গ্রানাডার দরিদ্র মরিসকো পরিবারের সন্তান ড. আমির আবদুল্লাহ আন্দালুসি যা পারলো, আমাদের হাজারো বিজ্ঞানীরা তা পারল না?’
‘তিনি দরিদ্র মরিসকো ঘরের সন্তান বটে, কিন্তু তার বাল্য-কৈশোরের গোটা সময় কেটেছে মালাগা, গ্রানাডা, কার্ডোভার ভাঙা লাইব্রেরীগুলোতে। সে যেন কোন হারানো জিনিস অবিরাম খুঁজে ফিরেছে। কিছু পেয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু অনুসন্ধিতসু কিশোর মাদ্রিদের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কণা-পদার্থ বিজ্ঞানে সর্বকালের সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে পাস করেছে। আর বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ‘ক্যারেক্টার’ অব ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের যে গবেষণাপত্র তিনি তৈরি করেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মান লাভ করে। সুতরাং তিনি সামান্য থেকে উঠে আসা হলেও একজন অসামান্য মানুষ। তাকে ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগারগুলো যে কোন মূল্যে কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি নামমাত্র বেতনে সৌদি আরবের মদিনা বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখান থেকেই তিনি এসেছেন ওআইসির আইআরটি প্রজেক্টে।’
থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
কথা বলে উঠল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘ড. আন্দালুসি যা পেরেছেন, তা আমাদের বিজ্ঞানীরা না পারাটা বিস্ময়ের নয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিউটন আবিষ্কার করেন, আর কোন বিজ্ঞানী পারেননি। আইনস্টাইন আবিষ্কার করেন, আপেক্ষিক তত্ব। অন্য কোন বিজ্ঞানীর পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানের জগতে এটাই ঘটে।’
‘স্যার, এখন তাহলে আমাদের করনীয়? আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দুনিয়ার এখন প্রথম এবং একমাত্র কাজই হবে, যে কোন মূল্যে সোর্ডের ফর্মুলা হস্তগত করা এবং বিজ্ঞানীদের সমেত আইআরটিকে ধ্বংস করা।’ বলল স্মার্থা।
‘সেটাই তো আমরা চাচ্ছি। কিন্তু হচ্ছে কই। আমাদের চলার পথ তো ধীরে ধীরে সংকুচিতই হয়ে পড়ছে। স্মার্থা, তুমি যা বলেছ আমরা সেটাই চিন্তু করছি। যে কোন মূলেই আমরা সোর্ডের ফর্মুলা হাত করব এবং আইআরটিকে অবশ্যই আমরা চলতে দেব না।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘আমাদের অনেক ক্ষতি হলেও আমরা একটা বড় সাফল্য পেয়েছি। প্রফেসর বেগভিচের আত্মা শান্তি পাক। তার চেষ্টাতেই আমরা আইআরটির প্রধান বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাসার সন্ধান পেয়েছি। এখন আমরা কার্যকরী কিছু ভালো পদক্ষেপের দিকে এগোতে পারব।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘সেই পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে কি চিন্তা করেছেন? আমাদের কিন্তু দ্রুত এগোতে হবে। অনেক সময় আমাদের নষ্ট হয়েছে ইতিমধ্যেই।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘ড. আন্দালুসিকে ভয় দেখিয়ে আমরা কাজ আদায় করব। সেটা ব্যর্থ হলে আমরা তাকে কিডন্যাপ করে ফর্মুলা আদায়ের ব্যবস্থা করব। কিন্তু অনেক বিবেচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, তাকে ভয় দেখিয়ে কিংবা কিডন্যাপ, নির্যাতন করে কিংবা হত্যার ভয় দেখিয়েও তার কাছ থেকে কিছু আদায় করা যাবে না। তিনি তার জীবনের চেয়ে আইআরটি’র স্বার্থ, জাতির স্বার্থকে অনেক বড় বলে মনে করেন। সুতরাং আমরা ভাবছি যে, তিনি তার জীবনের চেয়ে যাকে বেশি ভালোবাসেন, যার ক্ষতি তিনি সহ্য করতে পারবেন না, এমন কিছুর উপর আমাদের হাত দিতে হবে। এই লক্ষ্যে আমরা তার পারিবারিক তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি। শীঘ্রই আমরা এ বিষয়ে একটা কমপ্লিট চিত্র পেয়ে যাব। আমরা এখন তারই অপেক্ষা করছি।
‘ধন্যবাদ ড. ডেভিড ইয়াহুদ। আপনারা ঠিক পথে এগোচ্ছেন। ড. আন্দালুসির মত আদর্শনিষ্ঠ ও জাতিগত- প্রাণ লোকদের শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে বা ক্ষতি করে দূর্বল করা যায় না। আঘাত দিতে হয় এদের মনে। এরা নীতিনিষ্ঠ, আদর্শবাদী বলে তাদের মনটা স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। তাই তাদের মনে উপযুক্ত আঘাত পড়লে তাদের আদর্শিক ও মানসিক প্রতিরোধ ধ্বসে পড়ে। সুতরাং ড. আন্দালুসির ব্যাপারে আপনারা সঠিক পথ বেছে নিয়েছেন।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘কিন্তু আহমদ মুসাকে পথ থেকে সরাতে না পারলে এই কাজ নিরাপদ হবে না বলে আমি মনে করি। এই ইস্তাম্বুলেই সে আমাদের অনেকগুলো উদ্যোগ র্ব্যথ করে দিয়েছে।’ ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত বলল।
‘আহমদ মুসা ও সোর্ড- এর ফর্মূলা দু’টিই আমাদের নাম্বার ওয়ান প্রায়োরিটি। এ ব্যাপারে উপর থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আহমদ মুসার একদিন বেঁচে থাকা মানে আমাদের হায়াত একদিন কমে যাওয়া। আমাদের দুর্ভাগ্য বসফরাস ব্রীজ থেকে পড়েও সে বেঁচে গেল। বারবার গুলীর মুখ থেকে বেঁচে গেছে। তার আমরা কোন ক্ষতি করতে পারিনে, তার হাতে আমাদের ক্ষতি আকাশ স্পর্শ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল আমাদের জন্যে স্বর্গভূমি, সেখান থেকে আমরা উৎখাত হয়েছি। আমাদের কিছু বিজ্ঞানী ও আমলা নাম ভাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকে আছে বলেই কিছু সুবিধা আমরা পাচ্ছি। যেখানেই আমাদের প্রজেষ্ট সেখানেই আহমদ মুসা। এই আহমদ মুসা তুরস্কেও এসেছে। একথা ঠিক, সে থাকবে আর আমরা সফল হবো, এটা অসম্ভব। বিজ্ঞানী ও আহমদ মুসাকে এক সাথেই ধরতে হবে।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘আহমদ মুসা এক জায়গায় থাকে না, সর্বশেষ তথ্য হলো সে এখন হেলিকপ্টার ব্যবহার করে।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আইজ্যাক বেগিনের। বলল, ‘আহমদ মুসাকে তুর্কি সরকার এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে!’
‘ওআইসি নিশ্চয় এর পেছনে রয়েছে। কারন আইআরটি তো ওআইসির একটি প্রতিষ্ঠান। ওআইসি গুরুত্ব দিলে তুর্কি সরকার অবশ্যই গুরুত্ব দিতে বাধ্য। তাছাড়া আমি শুনেছি, খালেদ খাকান ওরফে আহমদ মুসা খোদ তুর্কি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মেহমান হিসেবে এখানে এসেছে।’ ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত বলল হতাশ কন্ঠে।
‘স্বাভাবিক। স্বপ্ন তারা দেখতেই পারে। অটোম্যানদেরই উত্তরসূরী তো তারা! কিন্তু স্বপ্নটা তারা বেশি দেখে ফেলেছে। এই স্বপ্ন শীঘ্রই মুখ থুবড়ে পড়বে। অটোম্যানদের সেই দিন আর ফিরে…।’
কথায় ছেদ পড়ল আইজ্যাক বেগিনের।
পকেটের মোবাইল বেজে উঠেছে তার।
কথা বন্ধ করে মোবাইল তুলল আইজ্যাক বেগিন।
মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে একনজর তাকিয়েই মুখের কাছে নিয়ে বলল, ‘বল অ্যালিয়াস, কোন-খবর?’
অ্যালিয়াস সিজলি এলাকায় বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির নতুন বাড়ির আশে-পাশে মোতায়েন ‘থ্রি জিরো’র লোকদের একজন।
‘স্যার, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি চলে যাচ্ছেন। তিনি হেলিকপ্টারে উঠছেন। তার বাড়ির লনেই হেলিকপ্টারটা রয়েছে।’ বলল অ্যালিয়াস।
‘যেতে পারেন। হয়তো ইনস্টিটিউট থেকে ডাক পড়েছে। উইকএন্ডটা গোটা দিন বাসায় থাকতে পারলেন না। তুমি হেলিকপ্টারের পাশে মানে বিজ্ঞানীকে বিদায় দিতে আসা কাউকে দেখছ?’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘দেখছি স্যার। একজন সুবেশধারী মহিলাকে দেখছি। তার পেছনে পরিচারিকা ধরনের আরও দু’জন মহিলা এবং আরও দুতিন জন লোক। পেছনের এরা সবাই কাজের মানুষ বলে মনে হচ্ছে।’ বলল অ্যালিয়াস।
‘সুবেশধারী তাঁর স্ত্রী হতে পারেন। বয়স কত মনে হচ্ছে?’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘স্যার তিরিশের মত বয়স হবে।’ বলল অ্যালিয়াস।
‘বয়সের পার্থক্য ঠিক আছে। মুসলমানদের আইডিয়েল পরিবারগুলোতে ৫ থেকে ১০ বছরের পার্থক্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে থাকে। নিশ্চিত উনি ম্যাডাম আন্দালুসি।’
থামল আইজ্যাক বেগিন।
‘কোন নির্দেশ স্যার?’
‘হ্যাঁ, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি চলে যাচ্ছেন। তোমাদের কাজ বেড়ে যাচ্ছে। তোমরা বিজ্ঞানীর পরিবার সম্পর্কে আরও খোঁজ খবর নাও। বাড়িতে কে কখন আসা-যাওয়া করে তার তালিকা রাখ। অন্যান্য খোঁজ আমরা নিচ্ছি। আবার কোন দিন বিজ্ঞানী আসছেন সে খোঁজ নাও। বিজ্ঞানীর সাথে আমরা একবার কথা বলব, তারপর যা করার তা আমরা করব। বাড়ির চাকর-বাকর, লোকেরা যারা বাইরে বের হয়, তাদের সাথে সম্পর্ক কর এবং বাড়ির নিয়ম-কানুন, রুটিন সম্পর্কে জান। কিন্তু সাবধান, কোনোভাবেই ওদের মনে যেন তোমাদের সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক না হয়।’
‘আপনাদের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন হবে স্যার।’
‘ধন্যবাদ অ্যালিয়াস।’
মোবাইল রেখে দিল আইজ্যাক বেগিন। তাকাল ড. ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘ড. ইয়াহুদ, বিজ্ঞানীর বাড়িটার একটা নক্সা আপনার কাছে দেখেছি, সেটা রুম-অ্যারেঞ্জমেন্টর ডিজাইন। আমাদের প্রয়োজন ডিটেইল লে-আউট।’
‘আমরা সেটার সন্ধান করেছি। বাড়িটার নির্মাতা ইস্তাম্বুলের পূর্ব বিভাগ। পূর্ব বিভাগে বাড়ির লে-আউট থাকার কথা। কিন্তু সেখানে পাওয়া যায়নি।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ড. ইয়াহুদ, আপনি সুইচ দূতাবাসে যোগাযোগ করুন। ওখানে জোসেফ জাকারিয়া আছে ডাইরেক্টর এ্যাডমিনিস্ট্রেশন হিসেবে। তার কাছে সাহায্য পাবেন। ওরা ভাড়া নেবার সময় বাড়ির লে-আউট নিশ্চয় নিয়েছিল, কিংবা তারা একটা লে-আউট তৈরি করেছিল। যা হোক, আমরা যা চাই, ওদের কাছ থেকে তা পাওয়া যাবে।’
ড.ডেভিড ইয়াহুদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা দিক আপনি সামনে নিয়ে এসেছেন। বিষয়টা আমার মনেই হয়নি। ধন্যবাদ মি. বেগিন। আমরা অবশ্যই…।’
ডেভিড ইয়াহুদের কথা শেষ না হতেই উঠে দাঁড়াল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘ধন্যবাদ ডেভিড ইয়াহুদ। আমি উঠছি। জরুরি কাজ আছে।’
ড. ডেভিড ইয়াহুদও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন আমিও বেরুবো।’ বেরিয়ে এল তারা সবাই ঘর থেকে।
ড. ডেভিড ইয়াহুদ তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জেমস জোসেফ, তোমার হাতে মাত্র এক ঘন্টা সময় আছে। তোমার এ্যাপয়েনমেন্টা রাত ঠিক আটটায়। রেড়ি হয়ে নাও।’
জেমস জোসেফও ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘ঠিক আছে স্যার। আমি যাচ্ছি’
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে জেমস জোসেফ ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
জেমস জোসেফ বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়িতে অভিযানের নতুন সদস্য। সে ইস্তাম্বুলের ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মেকানিক্যাল স্পেস সাইন্সের ছাত্র। সেই সাথে সে জায়নবাদী আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় কর্মী।
জেমস জোসেফ বেরিয়ে যেতেই বাইরে গাড়ি দাঁড়াবার শব্দ হলো। কয়েক মুহূর্ত পরে ঘরে ঢুকল আইজ্যাক বেগিন।
ঘরে ঢুকেই বলল, জেমস জোসেফকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। সব রেডি তো। ওরা তো বেরুচ্ছে ঠিক সময়ে?’
‘হ্যাঁ, ঠিক সময়ে বেরুচ্ছে। স্মার্থা এবার নেতৃত্বে আছে। আপনি সব ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ডেলিগেশনের সাথে স্মার্থা বেমানান।
‘স্মার্থা শিক্ষকতা করলেও সে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কণাবিজ্ঞানের একটা বিষয়ের উপর পিএইচডি করছে। সুতরাং বেমানান হওয়ার কথা নয়।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ধন্যবাদ ডক্টর। আমি খুব উদ্বিগ্ন। ক’দিন আমি ছিলাম না। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। বিস্তারিত একটু বলুন ডক্টর।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘সত্যিই অনেক কিছু ঘটে গেছে।’
বলে একটু থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। বলল, ‘বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়ি আমরা যতটা প্রটেকটেড মনে করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক সুরক্ষিত বাড়িটা। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, বিজ্ঞানীর বাড়ির কাজের লোকগুলো অবশ্যই পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের লোক। মোতায়েনকৃত আমাদের লোকেরা তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করতে গিয়ে বিপদে পড়ার মুখোমুখি হয়েছে। প্রয়োজনীয় কোন কথা আদায় করতে পারেনি। যে কথাগুলো তারা আদায় করতে পেরেছে তা উল্টা-পাল্টা বা ফাঁদ জাতীয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে।’
‘পরীক্ষামূলকভাবে হকার-ফেরিওয়ালা পাঠাবার যে কথা হয়েছিল, সেটার কিছু করা গেছে?’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘ও পরীক্ষাও হয়ে গেছে। ফেরিওয়ালা, নিউজপেপার হকার ও হোম সার্ভিসের লোকদের পাঠিয়েছিলাম। ওরা গেট পর্যন্তও পৌঁছতে পারেনি। তার আগেই তাদের ধরে ফেলা হয়েছে। অবশ্য পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ওরা আমাদের লোক, কিন্তু সেই সাথে ওরা প্রকৌশলীও। সুতরাং কোন অসুবিধা হয়নি। তবে পরিষ্কার হয়েছে, বিনা বাধায় বিজ্ঞানীর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারা যাবে না। জোর করে যাওয়ার চেষ্টা করলে লড়াই করতে হবে নিঃসন্দেহে।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘জেমস জোসেফদের দ্বারা যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন, সেটার ব্যাপারে আপনি কতটা নিশ্চিত?’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘হ্যাঁ। অনেক চিন্তা করে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ছেলেরা যদি বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাথে দেখা করার একটা অফিসিয়াল উদ্যোগ নেয় তাহলে তারা সে অনুমতি পেতে পারে। এমন ভাবনা থেকেই জেমস জোসেফকে দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এক গ্রুপ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রকে উৎসাহিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রদের রিসার্চ ফোরাম আছে। তারা বিজ্ঞান-টেকনোলজির অত্যাধুনিক টপিক্সের উপর মাঝে মাঝেই সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল ও গ্রুপ জিসকাশনের আয়োজন করে। বড় বড় বিজ্ঞানী ও শিক্ষকদের এসব অনুষ্ঠানে আনা এবং তাদের সাথে গ্রুপ করে দেখা করা তাদের নিয়মিত প্রোগ্রামের অংশ। তাদের এসব প্রোগ্রাম ও পরিচয়ের নানারকম পেপারস-ব্রসিয়ারস আছে। জেমস জোসেফ এই ফোরামের একজন সদস্য, অবশ্য মূল বডিতে সে নেই। তবে তার প্রস্তাবকে তারা গ্রহণ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আইআরটির টেলিফোন নাম্বার যোগাড় করে ফোরামের প্রেসিডেন্ট বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে টেলিফোন করে। ফোরামের একটা গ্রুপ তার সাথে দেখা করতে চাইলে বিজ্ঞানী তার অপরাগতার কথা প্রকাশ করেন। এই অবস্থায় ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির কণাবিজ্ঞান বিভাগের ডীন ড. ফাতিমা বাদরুমা ফোরামকে পরামর্শ দেন তাদের ‘হিস্ট্রি এন্ড মেথডলজি অব স্ট্রাটেজিক রির্সাচ’ বিষয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ড. সারার সাহায্য নিতে। তিনি জানান, কিছুদিন আগে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সায়েন্স এন্ড ইমান বিল গায়ে’-এর উপর সাড়া জাগানো যে আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়, তাতে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি ও ড. সারা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। আমি তখন দেখেছি মার্কিন স্ট্রাটেজিক রিসার্চেও ড. সারাকে ড. আন্দালুসি খুব রেসপেক্ট করেন। তিনি যদি ফোরামের পক্ষে ড. আন্দালুসিকে অনুরোধ করেন, তাহলে ড. আন্দালুসি নিশ্চত রাজি হবেন। ড. ফাতিমা বাদরুমার পরামর্শ অনুসারে ফোরাম প্রতিনিধিরা ড. সারার সাথে দেখা করে তাঁকে অনুরোধ করেন। প্রতিনিধি দলে জেমস জোসেফও ছিল। সেই ফোরামের পক্ষ থেকে একটা ফোল্ডার তৈরি করে ড. সারাকে দেয়া হয়। ড. সারা অনেক আলোচনা ও জিজ্ঞাসাবাদের পর ফোরামের পক্ষে ড. আন্দালুসিকে অনুরোধ করতে রাজি হন। তার অনুরোধেই ড. আন্দালুসি রাজি হন ফোরামকে সাক্ষাৎকার দিতে। আমরা চেয়েছিলাম ড. আন্দালুসি যেন তাঁর বাড়িতে সাক্ষাৎ দিতে রাজি হন। এ জন্যেই সিজলি এলাকায় তার বাড়ির কাছের ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ফোরামকে আমরা ব্যবহার করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সাক্ষাৎ দিতে রাজি হওয়ার পর ড. আন্দালুসি বলেন, অফিসে আমি কাউকে সাক্ষাৎ দেই না। তার উপর আগামী শুক্রবার সিজলিতে আমার বাসাতেই থাকব। বিশ্ববিদ্যালয়ও ঐ এলাকাতেই। সুতরাং সাক্ষাৎটা আমার বাসাতেই হবে।’ থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
খুশিতে উঠে দাঁড়িয়েছে আইজ্যাক বেগিন। সে হাত বাড়িয়ে ড. ইয়াহুদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ইশ্বর আমাদের সাহায্য করছেন। না হলে এতবড় সুযোগ আমরা এভাবে পেয়ে যাই! এখন বলুন, অপারেশন টিমটা আপনার কেমন হয়েছে। তারা পরিকল্পনা অনুসারে ড. আন্দালুসিকে তার স্ত্রী সমেত ওখান থেকে বের করতে পারবে তো?’
‘অবশ্যই বিজ্ঞানীর বাসার মূল অপারেশনে নেতৃত্ব দেবে স্মার্থা। তার সাতে আমাদের আটজন চৌকশ কমান্ডো। জেমস জোসেফ এদের সাথে থাকবে। কারণ যেখানে ওদের আটকে রাখা হবে, সেটা জেমস জোসেফেরই জানা। অন্যদিকে বিজ্ঞানীর বাসায় যাওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিনিধিদলকে কিডন্যাপ করবে অন্য একটা কমান্ডো দল। এরও নিরাপদ পরিকল্পনা করা হয়েছে। আটকে রাখার জায়াগাও ঠিক করা আছে। আমাদের লোকদের প্রত্যেকের ডুপ্লিকেট আইডি কার্ড তৈরি করা হয়েছে। এই আই ডি কার্ডগুলো নিয়ে ছাত্র সেজে আমাদের স্মার্থা বাহিনী বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়িতে প্রবেশ করবে। ছাত্র প্রতিনিধি দলের যে নাম পরিচয় বিজ্ঞানীকে আগেই সরবরাহ করা হয়েছে, তাতে কারও ছবি নেই, ছবি তারা চায়ওনি। সুতরাং কোন দিক দিয়ে কোন অসুবিধা হবে না।’
খুশিতে আইজ্যাক বেগিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনি বললেন, বিজ্ঞানীর বাড়িতে চাকর-বাকর যারা আছে, তারা হয় পুলিশের না হয় গোয়েন্দা বিভাগের লোক। বাড়িতে তাদের সংখ্যা কত হতে পারি এ ব্যাপারে কিছু জেনেছেন?’
‘বিজ্ঞানীর বাড়ির উপর আমাদের যারা চোখে রেখেছে, তাদের মতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে যারা বাইরে এসেছে, তাদের সংখ্যা পাঁচ-ছয় জনের বেশি নয়।’
‘তার মানে বিজ্ঞানীর বাড়িতে ঐ ধরনের লোক সাত আটজনের বেশি হবে না। আর তোমার স্মার্থা বাহিনীতে থাকছে ১০ জন। তুমি কি মনে করছ? সাফল্যের ব্যাপারে কিন্তু কোন ঝুঁকি থাকা চলবে না।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘কোন চিন্তু নেই। আমার লোকরা প্রস্তুত অবস্থায় প্রথম আঘাত করবে। ওরা থাকবে অপ্রস্তুত। স্মার্থার পরিকল্পনা হলো, প্রথম আঘাতেই ওদের অধিকাংশ লোককে টার্গেটে নিয়ে আসা। এজন্যে কথা হয়েছে, সাক্ষাতের এক পর্যায়ে আমাদের লোকরা চোখের পলকে গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়বে এবং একযোগে আক্রমণ করবে। ওদেরকে প্রস্তুতির কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। শুধু বিজ্ঞানী ও তার স্ত্রীকে কোন আঘাত করতে নিষেধ করা হয়েছে। ওদের ধরে নিয়ে যেতে হবে।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘কেন, বিজ্ঞানীর বাচ্চাদের বাদ দিচ্ছেন কেন? ওদের ধরে নিয়ে যেতে হবে। স্ত্রীর সাথে ওরাও হবে বিজ্ঞানীকে কথা বলাবার অব্যর্থ টোপ।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘না, বিজ্ঞানীর ছেলে-মেয়েরা এখন এখানে নেই। এই তথ্য আমরা নিশ্চিতই জানতে পেরেছি।’
বলেই দ্রুত ঘড়ির দিকে তাকাল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। বলল, ‘এখন ১০টা বিশ মিনিট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেলিগেটদের কিডন্যাপের অপারেশন এখন নিশ্চয় শেষ হয়েছে। স্মার্থা বাহিনী যাচ্ছে এখন বিজ্ঞানীর বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ডেলিগেশনের ছদ্মবেশে। কিন্তু এতক্ষনেও টেলিফোন আসছে না কেন? প্রথম অপারেশনের পরেই তার খবর জানানোর কথা ছিল।’
থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
তাকাল আবার ঘড়ির দিকে।
সংগে সংগেই বেজে উঠল তার মোবাইল।
দ্রুত মোবাইল মুখের কাছে তুলে ধরল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। ওপারের কন্ঠ শুনেই বলল, ‘বল জেমস জোসেফ, সুখবর?’
‘জি স্যার। অপারেশন সাকসেসফুল। দু’টি ক্লোরোফরম টাইম বোমার স্বয়ংক্রিয় বিস্ফোরণে দুই গাড়ির সবাই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। পরে আমাদের ড্রাইভার গাড়ি দু’টিকে ড্রাইভ করে সিজলি পাহাড়ে নিয়ে যায়। একটা ঝোঁপে তাদের সংজ্ঞাহীন দেহ লুকিয়ে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে আসে। ম্যাডাম স্মার্থার নেতৃত্বে আমরা নতুন ছাত্র ডেলিগেটরা এখন যাচ্ছি বিজ্ঞানীর বাড়ির দিকে।’
‘ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাদের। টেলিফোনটা স্মার্থাকে দাও।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা।
ওপার থেকে স্মার্থার গলা পেতেই ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল, ‘এখন আর কোন কথা নয়। গড ব্লেস ইউ স্মার্থা। এটাই আমাদের সর্বোচ্চ সুযোগ। লক্ষ্য অর্জনের জন্য আশা করি সব কিছুই করবে। গড ব্লেস ইউ। গুড বাই।’
মোবাইল রেখে দিল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। বলল আইজ্যাক বেগিনের দিকে তাকিয়ে, ‘ওরা বিজ্ঞানীর বাড়িতে যাত্রা করেছে মি. আইজ্যাক বেগিন। ঈশ্বরকে ডাকুন।’
‘গড হেলপ আস।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘সামনে আধ ঘন্টা সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসুন আমরা সুখবরের জন্য অপেক্ষা করি।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘ঠিক আছে। কিন্তু সুড়ঙ্গ পথ সম্পর্কে ওদের সুস্পষ্ট ধারণা আছে তো। ঠিকভাবে বুঝতে না পারলে বিজ্ঞানী ও তার স্ত্রীকে নিয়ে পালানোর সব আয়োজন পন্ড হয়ে যাবে।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘সে রকম কোন অসুবিধা হবে না। অপারেশন টীমে যারা আছে, তারা প্রত্যেককেই বাড়ির নকশা, ঘরগুলোর নকশা, সুড়ঙ্গের মুখ এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়া হয়েছে।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
আইজ্যাক বেগিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ।’
বলে সোফায় গা এলিয়ে দিল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল, ‘মাফ করবেন ড. ইয়াহুদ, একটা জরুরি টেলিফোন সেরে নেই।’
‘অবশ্যই।’ বলল ড. ইয়াহুদ।
আইআরটি-তে রোববারের সকাল।
ফরমাল অফিস নেই। তবু নাস্তার পর ড. শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজ এবং আইটি ইঞ্জিনিয়ার ইসমত কামাল বেশ অনেকক্ষণ আগে অফিসে এসেছে।
অফিসের লাউঞ্জে বসে আহমদ মুসা তাদের সাথে আলাপ করছিল।
বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দক্ষিণহস্ত তরুণ আলোক বিজ্ঞানী ড. ইবনুল আব্বাস আবদুল্লাহ সেসুসি লাউঞ্জে ঢুকল।
সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে এক জনের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন দশটা বিশ মি. খালেদ খাকান। মাত্র বিশ মিনিট লেট। ছুটির দিনে এই লেট নিশ্চয় কাউন্টেবল নয়।’ ড. সেসুসির মুখে হাসি।
সকাল ৯টায় আহমদ মুসা অফিসে এসেছে। সকাল সাড়ে ৮ টায় ড. সেসুসি টেলিফোন করেছিল আহমদ মুসাকে। বলেছিল, আপনি যখন এসেছেন, তখন আমিও ১০টার দিকে লাউঞ্জে আসছি।
‘ওয়েলকাম ড. সেসুসি। ছুটির দিন না হলেও বিজ্ঞানীদের লেট দোষনীয় নয়। বিজ্ঞানীরা অংকে একেবারে অ্যাকুরেট বলেই ব্যক্তি জীবনের কাজ-কর্মে অনেক খানি বেহিসেবী। সুতরাং বিশ মিনিট লেট আমরা সানন্দে গ্রহন করলাম।’ হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। তবে মি. খালেদ খাকান বিজ্ঞানীদের এই বেহিসেবী হবার কথা তাদের পরিবারের কাছে না বলা উচিত। তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’ বলল ড. সেসুসি মুখ টিপে হেসে।
‘পরিস্থিতি আরও খারাপ না করার কথা বলছেন। তার মানে পরিস্থিতি এখন খারাপ। তাই কি ড. সেসুসি?’ বলল ড. আবদুল্লাহ বাজ। তার ঠোঁটে হাসি।
হাসল ড. সেসুসি। বলল, ‘সবে তো আমাদের সাথে আসলেন। আমাকে এখনো বুঝে সারেননি হয়তো। কিন্তু গত তিন মাসে আমাদের চার বিজ্ঞানীর বাড়িতে কয়েকবার গেছি। সেখানে ভাবীদের কাছে মজার মজার কথা শুনেছি। আল্লাহ নাকি বিজ্ঞানীদের মাথায় বস্তুবিজ্ঞানের জ্ঞান ও তার প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং সেই সাথে মগজ থেকে সংসার বুদ্ধির জ্ঞান কেটে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আন্দালুসি ভাবীর কাছে এ অভিযোগ শুনেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘বিয়ের পর গত ২৫ বছরে তোমার স্যার একদিনের জন্যেও কোন অবকাশ সফরে নিয়ে যাবার সময় পাননি। আমার স্ত্রীর সামনে এ কথা বলায় আমি বিপদেই পড়েছিলাম।’
হেসে উঠল আহমদ মুসা ও ড. বাজ দু’জনেই। ড. বাজ বলল, ‘বিপদে পড়েছিলেন কেন, আপনার তো শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়েছে।’
‘ঠিক বলেছেন। পরের উইক এন্ডেই আমি উইক এন্ডের সাথে আরও দু’দিন যোগ করে স্ত্রীকে নিয়ে ‘লেক ভ্যান’-এ গিয়েছিলাম তিনদিনের অবকাশ যাপনে। নূহ আ.- এর কিস্তির মাউন্ট আরারা দেখা আমার স্ত্রীর একটা বড় শখ ছিল।’ বলল ড. সেসুসি। তার মুখে হাসি।
‘তাহলে আল্লাহ নিশ্চয় বিশেষ আনুকুল্য দেখিয়ে আপনার মগজের সংসার-বুদ্ধির সবটুকু অংশ কেটে রাখেননি।’ বলল আহমদ মুসা মিষ্টি হেসে।
‘আল হামদুলিল্লাহ। দোয়া করুন, দয়া করে আর যেন না কাটেন। ঘরের বিপদের মত বড় বিপদ আর নেই। গত উইক এন্ডেও ড. আন্দালুসি বাসায় যাননি। এ উইক এন্ডেও যেতে পারলেন না।’ ড. সেসুসি বলল। তার মুখেও মিষ্টি হাসি।
আহমদ মুসা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘তা ঠিক। কিন্তু ড. আন্দালুসি মিসেস আন্দালুসির অনুমতি নিয়েছেন। মিসেস আন্দালুসি শুধু অনমুতিই দেননি, বলেছেন, ‘দেশ, ধর্ম, জাতি, সর্বোপরি মানুষের প্রয়োজনে ড. আন্দালুসি যা করেন তার সাথে তিনি আছেন।’
গম্ভীর হয়ে উঠল ড. সেসুসির মুখও। বলল, ‘ম্যাডাম রসিকতা করে অনেক সময় অনেক কথা বলেন। কিন্তু তিনি একজন মডেল বিজ্ঞানীর মডেল স্ত্রী। তিনি একদিন হাসতে হাসতে আমাকে বলেছেন, ‘বেটা! বিজ্ঞানীদের স্ত্রীরা কিন্তু স্বভাবগতভাবে বিজ্ঞানের সতীন। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের ও তাদের স্ত্রীদের কিন্তু সচেতন থাকা দরকার। স্ত্রীরা অবশ্যই ত্যাগ স্বীকার করবে, কিন্তু স্বামীদের তার স্বীকৃতি দেয়া উচিত, ঠিক যেমন তোমার স্যার দিয়ে থাকেন।’
ড. সেসুসি কথা শেষ করে একটু থেমে আবার বলে উঠল, ‘ম্যাডামের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে।’
ড. সেসুসি কথা শেষ করতেই আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা মোবাইল বের করে স্ক্রীনের দিকে চেয়ে জোসেফাইনের নাম দেখেই বলল, ‘মাফ করবেন, আমি কলটা রিসিভ করছি।’
বলে আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠে ঘরের একটা প্রান্তে সরে গেল।
‘হ্যালো, জোসেফাইন। আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আমরা ভাল আছি। এইমাত্র আমার সেই বান্ধবী জেফি জিনা একটা খবর দিল। মনে হয় খবরটা খুব খারাপ।’ বলল জোসেফাইন।
‘খবরটা খুব খারাপ?’ দ্রুত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘আজ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির একটা ছাত্র প্রতিনিধিদলের সাথে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাক্ষাতকার ছিল বিজ্ঞানীর সিজলির বাড়িতে। এই উপলক্ষে জেফি জিনাকেও চায়ের আমন্ত্রণের কথা বলেছিলেন বিজ্ঞানী। জেফি জিনা……….।’
জোসেফাইনের কথায় বাধা দিয়ে আহমদ মুসা মাঝখানেই বলে উঠল, ‘সেখানে কিছু ঘটেছে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘সেখানে কিছু ঘটার কথা নয়, একটা সন্দেহজনক ঘটনার খবর দিয়েছে জেফি জিনা।’
মুহূর্তের জন্যে থামল জোসেফাইন, তারপর বলে উঠল, ‘জেফি জিনা বিজ্ঞানীর বাড়ি যাচ্ছিলেন তার গাড়িতে করে। তিনি ছাত্র প্রতিনিধি দলের দু’টি মাইক্রো দেখেছিলেন তার সামনে। তিনি দেখেন, মাইক্রো দু’টি ডানদিকে শেষ একজিট রোড পার হয়ে বিজ্ঞানীর বাড়ির দিকে কয়েক গজ এগিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। থামাটা এত আকস্মিক ছিল যে, পেছনের মাইক্রোটা সামনের মাইক্রোকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পরক্ষণেই রাস্তার পাশ থেকে দু’জন লোক হঠাৎ বেরিয়ে এসে দুই মাইক্রোর ড্রাইভিং সিটে উঠে যায়। তার পরেই মাইক্রো দু’টি দ্রুত ঘুরে সেই ডানের একজিট রোড ধরে ডান দিকে চলে যায়। জেফি জিনা ততক্ষণে ডানর একজিট রোডটার কাছে এসে পড়েছিল। যখন মাইক্রো দু’টি ঘুরে দাঁড়িয়ে ডানের রোড ধরে চলছিল, তখন জেফি জিনা সেই দু’জন ড্রাইভারের পাশে বসা একজনকে দেখেন যাকে ছাত্র বলে তিনি চিনতে পারেন। সে ছাড়া মাত্র প্রতিনিধিদলের কাউকে গাড়ির সিটে বসা দেখতে পাননি। বিস্মিত হন জেফি জিনা। তিনি রাস্তা থেকে একটু সরে গাড়িটা দাঁড় করান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিফোন করে ছাত্র প্রতিনিধিদলের যে কারও টেলিফোন যোগাড়ের চেষ্টা করেন। টেলিফোন নাম্বার পেতে দেরি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কণাবিজ্ঞান বিভাগের ডীনের অফিস থেকে প্রতিনিধিদলের নেতা ছাত্রটির টেলিফোন নাম্বার পেয়ে যান। কিন্তু তিনি টেলিফোন করার চেষ্টা করাকালেই মাইক্রো দু’টিকে দ্রুত ফিরে আসতে দেখেন। তিনি মোবাইল রেখে ড্যাশ বোর্ড থেকে তার দুরবিনটা নিয়ে তাকান মাইক্রোর দিকে। পরে দুই মাইক্রোতে ওঠা দু’জন লোককেই ড্রাইভ করতে দেখেন। কিন্তু সিটগুলোতে বসা যাদের দেখলেন, তাদেরকে তার ছাত্র বলে মনে হয়নি। জেফি জিনার বিস্ময় সন্দেহে পরিণত হয়। তিনি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া প্রতিনিধি দলের নেতা ঐ ছাত্রের নাম্বারে টেলিফোন করেন। কিন্তু বারবার টেলিফোন করেও কোন উত্তর পাননি তিনি। বারবারই নো-রিপ্লাই হয়। ততক্ষণে মাইক্রো দু’টি চলে গেছে। বিজ্ঞানীর বাড়ি সেখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু প্রবল দ্বিধায় পড়েন তিনি। তার নিশ্চিত মনে হয়, ঐ দুই মাইক্রোতে যারা গেছে তারা ছাত্র-প্রতিনিধি দল নয়। প্রবল ……..।’
‘ইন্নালিল্লাহ…। স্যরি জোসেফাইন, তুমি একটু হোল্ড কর। তোমার সাথে আরও কথা বলতে হবে। আমি একটা টেলিফোন করে নেই।’
বলেই কল হোল্ড করে আহমদ মুসা দ্রুত ওয়ান টাস ডায়ালে জেনারেল মোস্তফা কামালকে টেলিফোন করল। ওপার থেকে তার কণ্ঠ পেতেই সালাম দিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘জেনারেল, এখনি আপনি সিজলি এলাকার পুলিশ ষ্টেশনগুলোকে দ্রুত বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়িতে পৌছার জন্যে মুভ করতে বলুন। আর আপনি বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে টেলিফোন করুন। জরুরি।’
‘বুঝতে পারছি কিছু ঘটেছে। কি ঘটেছে? বাড়িতে তো আমাদের শক্তিশালী গোয়েন্দা টিম রয়েছে।’ দ্রুত, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ছাত্র-প্রতিনিধিদলের সাথে ড. আন্দালুসির একটা সাক্ষাতকার ছিল আজ সকালে। যা খবর পেলাম, তাতে মনে হচ্ছে ছাত্র প্রতিনিধিদলকে কিডন্যাপ করে শত্রু পক্ষের কেউ সেখানে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও গড! বুঝেছি। আমি পুলিশ ষ্টেশনগুলোতে টেলিফোন করছি। আমরা যাচ্ছি সেখানে, আপনি প্লিজ আসুন মি. খালেদ খাকান।’
বলেই ‘আসসালাম’ কথাটি কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করে কল লাইন কেটে দিল।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের হোল্ড লাইনটা অন করে বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘মনে হয় সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে সেখানে। তোমার বান্ধবী জেফি জিনা শেষ পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?’
‘প্রবল দ্বিধা নিয়ে অবশেষে তিনি বিজ্ঞানীর বাড়ির দিকেই এগোন। কিন্তু বিজ্ঞানীর বাড়ির রাস্তায় যাবার আগেই দু’জন লোক এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। বলে, বিজ্ঞানী স্যারের বাড়ি যেতে হলে পাশ লাগবে। পাশ আছে কিনা। তখন জেফি জিনা জানান, তার দাওয়াত আছে সেখানে। কিন্তু সেই লোক দুজন বলে, ছাত্র প্রতিনিধি দলের পাশ ছিল, তাঁরা গেছে। পাশ না থাকলে আপনাকে যেতে দিতে পারি না। তখন জেফি জিনা তাদেরকে বলে, তোমরা যদি সরকারি কিংবা সিকিউরিটির লোক হও, তাহলে এখনি পুলিশকে খবর দিয়ে বিজ্ঞানী স্যারের বাড়িতে যাও। তার বিপদের আশংকা করছি আমি। সেই দু’জন লোক জানায়। ভয় নেই, বাড়িতে তাঁর নিরাপত্তার জন্যে ব্যবস্থা আছে। তার পরেই জেফি জিনা আমাকে টেলিফোন করে তোমাকে সব জানাবার অনুরোধ করে তিনি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেছেন।’
থামল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবীকে ধন্যবাদ জোসেফাইন। দোয়া করো, বিজ্ঞানী স্যারের যেন কোন বিপদ না হয়। যে উদ্দেশ্যে আমি এখানে এসেছিলাম জোসেফাইন, তা সম্পাদনে বোধ হয় ব্যর্থ হলাম। রাখি। দেখি ওদিকে কি অবস্থা।’ গম্ভীর অথচ ভাঙা কণ্ঠস্বর আহমদ মুসার।
‘তুমি তো ভেঙে পড়ার জন্যে নও। আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন। ইনশাআল্লাহ তুমি সফল হবে। আমি রাখছি, আসসালামু আলাইকুম।’ গভীর মমতা মাখানো কণ্ঠ জোসেফাইনের।
আহমদ মুসা মোবাইল রাখল পকেটে।
ড. বাজ ও ড. সেসুসি চোখ-মুখ ভরা উদ্বেগ নিয়ে আহমদ মুসার দিকে অপলক দৃষ্টি রেখে পাথরের মত স্থির হয়ে বসে আছে।
আহমদ মুসা তাকাল তাদের দিকে। বলল, ‘শুনেছেন তো সব। খবর সত্য হলে, ধরেই নিতে হবে ড. আন্দালুসি বিপদে পড়েছেন।’ গম্ভীর ও শান্ত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘আমি কয়েকবার স্যারের মোবাইলে টেলিফোন করলাম। রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ এ্যাটেন্ড করছে না। এই মোবাইল সব সময় তিনি কাছে রাখেন।’ বলল ড. সেসুসি। কান্না ভেজা তার কণ্ঠ।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল ড. বাজ। আহমদ মুসা দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল তার আগেই, ‘আমি সিজলিতে যাচ্ছি। আপনারা অফিসে থাকুন।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
ড. বাজ ও ড. সেসুসি উঠে দাঁড়াল।
‘স্যার, আমাদের জন্যে আর কোন নির্দেশ?’ বলল ড. বাজ।
‘আপনাদেরকেও সাবধান থাকতে হবে। ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে গেছে। আসি। আসসালামু আলাইকুম।’
সালাম নিয়ে ড. বাজ সংগে সংগেই বলে উঠল, ‘স্যার, আপনার নিরাপত্তা আমাদের জন্যে বেশি প্রয়োজনীয়। হেলিকপ্টার ওয়ার্কশপে, আসতে বলি?’
‘না ড. বাজ। তাতে আরও দেরি হয়ে যাবে। আমাকে এখনই বেরুতে হবে। আর সিজলি তো বেশি দূরে নয়।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।
সিজলিতে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়ির সামনে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতেই জেনারেল মোস্তফা হেলিকপ্টার থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছুটল ড. আন্দালুসির বাড়ির দিকে। পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের টেলিফোনে আগেই জেনেছেন ড. আন্দালুসির বাড়িতে ৭টি লাশ ছাড়া কিছু নেই। পুলিশ প্রধানের হেলিকপ্টারটিকেও একটু দূরে দাঁড়ানো দেখল।
সিকিউরিটি কর্মীদের স্যালুটের মধ্যে দিয়ে জেনারেল মোস্তফা কামাল বিজ্ঞানী আন্দালুসির বাড়িতে ঢুকে গেল।
পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন জেনারেল মোস্তফা কামালকে স্বাগত জানাল। বলল, ‘বেজমেন্টসহ গোটা বাড়ি সার্চ করা হয়ে গেছে স্যার। যে সাতটি লাশ পাওয়া গেছে, তার সবই আমাদের গোয়েন্দাদের।’
‘ওদের লাশ পড়লেও তা তারা রেখে যায়নি নিশ্চয়?’ গম্ভীর কণ্ঠ জেনারেল মোস্তফা কামালের।
‘অবশ্যই।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘চলুন, আমি একটু দেখতে চাই, বাড়িটাই আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দাদের যারা বাইরে পাহারায় ছিল, তাদের বক্তব্য কি?’
‘কোন গোলা-গুলীর শব্দ তারা পায়নি। মনে করা হচ্ছে, তাদের রিভলবার, ষ্টেনগান সবকিছুতেই সাইলেন্সার লাগানো ছিল।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘কিন্তু আমাদের লোকরা তাদের চলে যেতে দেখলো না কেন? তারা কিভাবে হাওয়া হয়ে গেল বুঝতে পারছেন কিছু?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘মাইক্রো দু’টি বাইরে পড়ে আছে। আমাদের লোকেরা তাদের কাউকে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখেনি। এটা ঠিক হলে দু’টি বিকল্প থাকে, এক. তারা বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে আছে এবং দুই. তারা বাড়ি থেকে কোন বিকল্প পথে পালিয়েছে।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘বিকল্প পথটা কি?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘সুড়ঙ্গ পথ হতে পারে। কিন্তু আমরা বাড়ির একতলা ও বেজমেন্ট ইঞ্চি ইঞ্চি করে খতিয়ে দেখেছি। সুড়ঙ্গের কোন অস্তিত্ব আমরা পাইনি। আরেকটা কথা, আমরা এমনভাবে খুঁজেও কোন সুড়ঙ্গ পেলাম না, কিন্তু বাইরের লোকরা এসে তাড়াহুড়োর মধ্যে তা পেয়ে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। সুতরাং তাদের অন্তর্ধান একটা বড় রহস্য!’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘আসুন, আরেকবার আমরা দেখি বাড়িটা।’
বলে পা বাড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল। তার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনসহ আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার।
আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ সব ফ্লোর ও ঘর দেখে জেনারেল মোস্তফা পুলিশ প্রধানসহ আবার ফিরে এল ড্রইংরুমে।
বসল দু’জনেই সোফায়। দু’জনের চোখে-মুখে উদ্বেগ।
পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন সোফায় সোজা হয়ে বসে মনে হয় কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করল। তারপর বলল, ‘স্যার, কোন সুড়ঙ্গ পথ যদি না থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে পেছনের দরজা দিয়েই তারা পালিয়েছে। পেছনের পনের গজ দূরে বাউন্ডারি ওয়াল। ওয়ালের বাইরে একটা প্রাইভেট রোড আছে। সেখানে গাড়ি রেখে এসে থাকলে এ দিক দিয়ে পালিয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়।’
সোফায় মাথা রেখে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বসেছিল জেনারেল মোস্তফা কামাল। সেও সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘দু’জন লোককে কিডন্যাপ করে ডজন খানেক লোক পেছনের বাউন্ডারি ওয়াল ডিঙিয়ে চলে যাবে, বাইরে মোতায়েন করা আমাদের কোন লোকের নজরে পড়বে না, এটা স্বাভাবিক নয় মি. নাজিম এরকেন।’
‘এ যুক্তিও ঠিক স্যার, কিন্তু বাড়ির তিনদিকে বাগান থাকলেও বাড়ির পেছনে গাছ-গাছড়াটা একটু বেশি। এছাড়া আমাদের লোকদের নজর কিন্ত বাড়ির সামনের গেট ও বাড়ির এ্যাপ্রোস রোডের উপর বেশি ছিল। বাড়ির ঠিক পেছনে সরাসরি কোন পাহারা ছিল না। ওয়ালের বাইরে প্রাইভেট রোডটার উপর চোখ রাখার ব্যবস্থা ছিল। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তাদের চোখ ছিল রাস্তাটির দু’প্রান্তের মুখে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না।’
পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকল একজন পুলিশ অফিসার। বলল, ‘জনাব খালেদ খাকান সাহেব এসেছেন।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন দু’জনেই চমক ভাঙার মত নড়ে-চড়ে বসল। যেন প্রাণ পেল তারা!
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে এস। আমরা ওনার জন্য অপেক্ষা করছি।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে।
পুলিশ অফিসার চলে গেল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই আহমদ মুসা ঘরে ঢুকল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন দু’জনই উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে। হাসি নয়, তার মুখে বেদনা যেন উথলে উঠছে! জেনারেল মোস্তফা জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আমরা বিস্মিত, বিপর্যস্ত মি. খালেদ খাকান। আপনার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল আহমদ মুসাকে ধরে নিয়ে পাশের সোফায় বসাল। তারপর নিজের আসনে ফিরে গিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘ভূতুড়ে ঘটনা ঘটেছে মি. খালেদ খাকান! বাড়ির চারদিকে পুলিশ পাহারায় ছিল। তাছাড়া বাড়ির ভেতরে কাজের লোক ও পরিবারের সদস্যের ছদ্মবেশে ছয়জন মহিলা ও দু’জন পুরুষ গোয়েন্দা অফিসারসহ সর্বমোট আটজন গোয়েন্দা কর্মী পাহারায় ছিল, অথচ দশজনের একটা দল বাড়িতে প্রাবেশ করে সাতজন গোয়েন্দা কর্মীকে খুন করে বিজ্ঞানী ও একজন গোয়েন্দা মহিলা কর্মীকে কিডন্যাপ করে হাওয়া হয়ে গেল। তারা কিভাবে পালাল তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘মহিলা গোয়েন্দা অফিসারকেও হয়তো তারা বিজ্ঞানীর সাথে গ্রেফতার করেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই মনে হচ্ছে। কারণ তার লাশও নেই, পালাতেও পারেনি। কিন্তু অন্যদের খুন করে তাকে নিয়ে যাবে কেন?’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তাকে ভুল করে নিয়ে গেছে।’
‘ভুল করে কিভাবে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফা কামালের।
‘মহিলা গোয়েন্দা অফিসারকে ওরা বিজ্ঞানীর স্ত্রী মনে করেছে এবং খুশি হয়ে তাকে তাদের প্রয়োজনের বড় অস্ত্র হিসেবে সাথে করে নিয়ে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
বেদনার সাথে সাথে বিস্ময় নামল জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন দু’জনের চোখে-মুখেই। দ্রুত কথা বলে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল। বলল, ‘বুঝেছি, স্ত্রী মনে করে নিয়ে গেছে। কারণ, বিজ্ঞানী কথা না বললে, কথা মত কাজ না করলে স্ত্রীকে লাঞ্জিত করে, তার উপর নির্যাতন চালিয়ে বিজ্ঞানীকে ওদের কথা মতো চলতে বাধ্য করবে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় মি. খালেদ খাকান।’
‘অবশ্যই উদ্বেগের খবর জনাব! কিন্তু এর মধ্যেও আনন্দের বিষয় হলো, মহিলাটি আমাদের বিজ্ঞানীর স্ত্রী নন।’
‘খবরটা আনন্দের কেন? স্ত্রী না হলেও মেয়েটিকে লাঞ্জিত করতে পারে, সে নির্যাতিতা হতে পারে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আনন্দের এই কারণে যে, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি মেয়েটি তার স্ত্রী নয় বলার পর মেয়েটিকে গিনিপিগ বানাতে পারবে না। অন্যদিকে বিজ্ঞানীকে তাদের ইচ্ছামত কাজ করাতে ও কথা বলাতে বাড়তি কোন সুযোগ তারা পাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন দু’জনের মুখেই কিছু উজ্জ্বলতা ফিরে এল। বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। এখন চলুন, ঘটনার সব জায়গা আপনিও একটু দেখুন। কোন দিক দিয়ে পালাল সেটা উদ্ধার হলে আমাদেরও সামনে এগোবার একটা পথ হয়।’
‘চলুন দেখি’ বলে উঠে আহমদ মুসা পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনকে জিজ্ঞেস করল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কি যোগাযোগ হয়েছে, আটকে রাখা ছাত্র প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মুক্ত হয়েছে, তদন্তে ওরা আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারে?’
‘পুলিশ ছাত্র প্রতিনিধিদলকে সিজলি পাহাড় এলাকা থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করেছে। ওরা এখন হাসপাতালে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। তারাও তদন্ত শুরু করেছে। সব রকম সহযোগিতা তারা আমাদের করবে।’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
আহমদ মুসা একবার জেফি জিনার কথা বলতে চাইল যে, সে মূল্যবান সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা বলল না, চেপে গেল। কারণ আহমদ মুসা ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছে। বাইদিবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে জেফি জিনা নামে কোন শিক্ষিকা বা গবেষক আছেন কিনা জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু এ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ নেই বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে জানান। বিষয়টা আহমদ মুসার কাছে কিছুটা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাথে তিনি পরিচিত হলেন কি করে? আর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি কেউ না হলে তিনি ছাত্রদের সাথে চায়ের দাওয়াত পেলেন কি করে? সুতরাং বিষয়টার কূল কিনারা করতে না পেরে আহমদ মুসা জেফি জিনা সম্পর্কে পুলিশ প্রধানকে কিছু বলল না। শুধু বলল, ‘মি. নাজিম এরকেন ছাত্র প্রতিনিধি দলের ছদ্মবেশে শত্রুদের যারা বিজ্ঞানীর বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেছিল, তাদের মধ্যে সাইন্স এন্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও ছিল।’
উজ্জ্বল হয়ে উঠল পুলিশ প্রধানের চোখ দু’টি। বলল, ‘স্যার, এটা তো অতি মূল্যবান ও সুনির্দিষ্ট ইনফরমেশন। তার নামটা জানা যাবে স্যার?’
‘এখনও জানা যায়নি। আমি চেষ্টা করব জানার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার পুলিশ বাহিনী, আপনার গোয়েন্দা বিভাগ নেই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় তথ্য আপনার কাছেই আসছে। আমরা কৃতজ্ঞ।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘একটা প্রবাদ আছে, ঝড়ে বক পড়ে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে। ব্যাপারটা এই রকমই। অকল্পনীয় সব সোর্স থেকে তথ্য আসে। এটা মনে করি আল্লাহর খাস সাহায্য। আমার কোন কেরামতি নেই।’
হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছিল আহমদ মুসা।
আগে আগে হাঁটছিল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
চলছিল উপর তলায় উঠার সিঁড়ির দিকে।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘নিহত সব লাশ এক তলায়।’ তাহলে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্যে নিচে ড্রইংরুমে নেমেছিলেন নিশ্চয়! সুতরাং সবাই নিচে ছিলেন। সব ঘটনা এক তলায় ঘটেছে, উপর তলায় নয়। তারা পালিয়েছে হয় একতলা হয়ে না হয় আন্ডার গ্রাউন্ড কোন পথ দিয়ে। সুতরাং নিচের তলা ও আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরটাই শুধু দেখতে চাই।’
একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘চলুন, পেছনের দরজা পর্যন্ত যাওয়া যাক।’
চলল সবাই। এবার আহমদ মুসা সকলের আগে।
ওপরে ওঠার সিঁড়ির ডান পাশ ঘেঁষে একটা করিডোর সামনে চলে গেছে। এ করিডোরটাই কয়েকটা বাঁক নেবার পর পেছনের দরজায় গিয়ে ঠেকেছে।
হাঁটছে আহমদ মুসা।
তার দৃষ্টি দু’পাশের দেয়াল ও মাটির দিকে। তার বিশ্বাস এ পক্ষের ৭ জন লোক নিহত। এরা একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল, সুতরাং প্রস্তুত ও পরিকল্পিত অবস্থায় আক্রমণের সুযোগ তারা পেয়েছে। কিন্তু তাই বলে ওপক্ষ আহত-নিহত হওয়ার কোন ব্যাপার ঘটবেই না, এটা স্বাভাবিক নয়। আর যেহেতু দু’জনকে বন্দী করে তাড়াহুড়ো করে পালাতে হয়েছে, তাই তারা কিছু চিহ্ন রেখে যাবেই। তার মধ্যে রক্তের দাগ একটি।
কিন্তু আহমদ মুসা পেছনের দরজা পর্যন্ত হেঁটেও কোন চিহ্ন বা অস্বাভাবিক কিছু পেল না। দরজা খুলে বাগানটাও দেখল। কিছুই পেল না।
ফিরে এল আবার সিঁড়ির গোড়ায়।
সিঁড়ির বাম পাশ ঘেঁষে আর একটা করিডোর সামনে চলে গেছে। এ করিডোরের ডান পাশ দিয়ে বরাবর একটা দেয়াল। আর বাম পাশ দিয়ে যে দেয়াল তার মাঝ বরাবর বড় একটা দরজা।
ঐ দরজার দিকে ইংগিত করে জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘ওটাই আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামার দরজা মি. খালেদ খাকান।’
করিডোরের মেঝে ও দু’ধারের দেয়ালও পাথরের। বর্গাকৃতি পাথরের জোড়াগুলোও ধবধবে সাদা।
করিডোর ও দুই দেয়ালের উপর সূঁচ খোঁজার মত তীক্ষ দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে চলছে আহমদ মুসা। দরজা পর্যন্ত যেতে বার দুয়েক দাঁড়াল।
দরজার সামনে এসে আবার দাঁড়াল আহমদ মুসা।
দরজা কালো রং করা ষ্টিলের স্লাইডিং ডোর। ডিজিটাল, ম্যানুয়াল দু’ভাবেই খোলা যায়। তবে ম্যানুয়াল সিষ্টেম অফ করে ডিজিটাল সিষ্টেম চালু করতে হয়। আবার ডিজিটাল সিষ্টেম অফ করে ম্যানুয়াল সিষ্টেম চালু করা যায়।
পুলিশ প্রধান এগিয়ে এসে দরজাটা খুলে দিল। সরে গেল ষ্টিলের স্লাইডিং ডোরটা দেয়ালের ভেতরে।
দরজার পরেই সিঁড়ির কাছে বড় একটা ষ্ট্যান্ডিং। ষ্ট্যান্ডিং-এর ডান ও বাম পাশ দিয়ে দু’পাশের দেয়াল ঘেঁষে দু’টি প্রশস্ত সিঁড়ি দু’দিকে নেমে গেছে।
ষ্ট্যান্ডিং-এর সামনেটা রেলিং ঘেরা। রেলিং ষ্ট্যান্ডিং-এর সামনেটা ঘুরে এসে দু’পাশে সিঁড়ির সাইড রেলিং হয়ে নিচের ফ্লোর পর্যন্ত নেমে গেছে। সিঁড়ি ও রেলিং দু’টোই ব্ল্যাক ষ্টিলের।
আহমদ মুসারা ষ্ট্যান্ডিং-এ এসে দাঁড়াল।
নীচে বড় একটা হলঘর।
সিঁড়ি বরাবর অংশটুকু ছাড়া গোটা হলঘর লাল কার্পেটে ঢাকা। চারদিক ঘিরে সোফার সারি। মাঝখানটা ফাঁকা।
গোটা হলঘরটা উজ্জ্বল আলোয় প্লাবিত। ষ্ট্যান্ডিং এর উপরে দেয়ালে দু’পাশে দু’টি লাইট। সে আলোতে কালো সিঁড়িতে সাদা প্রতিফলনের সৃষ্টি করেছে।
আহমদ মুসা সিঁড়ি দু’টোকে একবার তীক্ষ দৃষ্টিতে দেখল। ডানদিকে সিঁড়ির দ্বিতীয় ষ্টেপের রেলিং সংলগ্ন একটা জায়গায় একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘আসুন, আমরা ডান পাশের এ সিঁড়ি দিয়ে নামি।’
সবাই নেমে এল নিচে।
সিঁড়ি থেকে নেমে হলঘরে ঢোকার মত প্রশস্ত একটা জায়গা দু’প্রান্তে বাদ রেখে সোফা সাজানো। সিঁড়ি প্রান্তের সোফার সারিটা সিঁড়ি যতটা প্রশস্ত তার চেয়ে কিছু বেশি জায়গা রেখে সাজানো হয়েছে।
‘শত্রুরা বিজ্ঞানীকে কিডন্যাপ করে আন্ডার গ্রাউন্ড এই ঘরে নেমে এসেছিল। নিশ্চয়ই এই ঘর বা এই আন্ডার ফ্লোরের কোন স্থান দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ আছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল জেনারেল মোস্তফার দিকে। বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা ও জেনারেল তাহির তারিককে এই বাড়ির ইন্টারনাল, এক্সটারনাল ডিজাইন, লে-আউট, নকশা যোগাড় করতে বলেছিলাম। সেটা পেলে সহজেই বের হতো সিঁড়ি পথটা কোথায়।’
‘জেনারেল তাহির আমাকে বলেছিলেন, সেসব যোগাড় হয়েছে। আমার অফিসে এই বাড়ি সংক্রান্ত ফাইলে সব আছে। বলব কি সে ফাইল আনতে?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ঠিক আছে। আমরা আর একটু দেখি। না হলে ফাইলের সাহায্য নেয়া যাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মি. খালেদ খাকান, আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন কিডন্যাপটা এই আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এসে তারপর হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘কিডন্যাপারদের এক বা একাধিক লোক আহত হয়েছে। কিডন্যাপ করে পালাবার সময় পথে আহতদের থেকে রক্তের ফোটা পড়েছে। কেউ যাতে তাদের অনুসরণ করার সুযোগ না পায়, এজন্যে তারা রক্তের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। এর পরও করিডোরে দুই জায়গায় এবং সিঁড়িতে এক জায়গায় সামান্য পরিমাণে হলেও শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ আমি দেখেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এবার নিয়ে তিনবার এ পথে এলাম, আমার কিন্তু তা চোখে পড়েনি। ধন্যবাদ আপনার চোখের দৃষ্টিকে।’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
‘চোখের খুব বেশি কৃতিত্ব নেই। আমি আগেই ধরে নিয়েছিলাম এ পক্ষের ৭ জনকে হত্যা করতে ওদের কাউকে না কাউকে নিশ্চয় অন্তত আহত হতেই হবে। আহতদের নিয়ে তাড়াহুড়ো করে পালাবার সময় পথে তাদের পালানোর চিহ্ন হিসেবে রক্তের দাগ ফেলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এই ক্লুটা খোঁজার চেষ্টার ফলেই তা পেয়ে গেছি।’
‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। আপনি ঠিক চিন্তা করেছেন। দুর্ঘটনার সাইক্লোনের মধ্যেও আপনার মাথা ঠান্ডা থাকে। আপনি একটা দৃষ্টান্ত।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসার নজর তখন সিঁড়ির গোড়ার দিকে। জেনারেল মোস্তফার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘জেনারেল দেখুন দু’পাশের সিঁড়ির লেভেল থেকে সোফায় সারির দূরত্ব একটু বেশি মনে হচ্ছে না?’
‘হ্যাঁ, এতটা দূরত্ব না রাখলেও হতো। সিঁড়ি থেকে নেমে হলরুমে প্রবেশের জন্যে যথেষ্ট জায়গা রাখার পরও এতটা জায়গা শূন্য রেখে দেয়া ‘অডলুকিং’ মনে হচ্ছে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘অডলুকিং লাগছে আরও এই কারণে যে এই ফাঁকা জায়গা কার্পেটে ঢেকে না দেয়ার মধ্যে কোন যুক্তি নেই। ঘরের সৌন্দর্য নষ্ট করে এটা কেন করা হয়েছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।’ পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন বলল।
‘এই সৌন্দর্যহানির কারণ আছে। আমার সন্দেহ সত্য হলে আন্ডার গ্রাউন্ড স্পেসটা এখানেই আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
চমকে উঠল জেনারেল মোস্তফা, পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনসহ উপস্থিত পুলিশ অফিসাররাও। চোখ বড় বড় করে জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন এক সাথেই দু’জনে বলে উঠল, ‘এখানে সুড়ঙ্গ রয়েছে?’
‘হ্যাঁ, এখানেই রয়েছে এবং আমরা এই যে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, আমি মনে করছি এখানেই রয়েছে সুড়ঙ্গের মুখ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মি. খালেদ খাকান আপনি – ভবিষ্যত বক্তার মত কথা বলছেন। এখানে সুড়ঙ্গের মুখ আছে, কোনো চিহ্ন দেখে নিশ্চয় এ কথা বলছেন, সেটা কি?’
‘আমি নিশ্চিত নই, তবে বিভিন্ন অসঙ্গতি, অস্বাভাবিকতা ও নানা কার্যকরণ থেকে এ ধারণা করছি। আপনারা দেখুন ওপাশের সিঁড়ির গোড়ায় শেষ পিলার একটাই, কিন্তু এ পাশের প্রান্তে জোড়া পিলার। মূল পিলারের সাথে আরেকটা পিলার। দ্বিতীয় পিলারটার মাথা হাতল আকারের এবং সাইড রেলিং-এর টপ বরাবর আসা ষ্টিল বার থেকে বিচ্ছিন্ন। দ্বিতীয় পিলারটার গোড়া দেখুন গাড়ির গিয়ারের মত রাবারের কভার। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠে যে এর একটা ফাংশন আছে। কি সেই ফাংশন? এ প্রশ্নের উত্তরেই আমার সিদ্ধান্ত, গোপন সুড়ঙ্গের মুখ এখানেই।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা দুই ধাপ এগিয়ে গিয়ে শেষ দ্বিতীয় পিলারের শীর্ষ হাতল দু’হাতে ধরে জোরের সংগে নিচের দিকে টানল।
সংগে সংগে সিঁড়ির গোড়া থেকে পাশের মেঝের সোফার সারির পাশ ঘেঁষে একটা আয়তাকার অংশ সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল আলোকজ্জল একটা সিঁড়ি মুখ।
‘ও গড! আলহামদুলিল্লাহ।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল ও নাজিম এরকেন এক সাথেই বলে উঠল।
‘আসুন, নামি।’
বলে সুড়ঙ্গের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল আহমদ মুসা।
‘গ্যাস মাস্ক তো লাগবে না আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘না মি. জেনারেল। আমার মনে হয় সুড়ঙ্গ স্বল্প দীর্ঘই হবে এবং সুড়ঙ্গে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘চলুন মি. খালেদ খাকান।’
বলে তাকাল জেনারেল মোস্তফা পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের দিকে।
পুলিশ প্রধান তার পাশেই দাঁড়ানো সিজলি এলাকার পুলিশ কমিশনারকে তাদের সাথে যেতে বলল। আর সবাইকে সব ফরমালিটি শেষ করে লাশগুলো নিয়ে যেতে বলল। আর কয়েকজন পুলিশকে থাকতে হবে এই বাড়ির পাহারায় এ নির্দেশও দিল।
পুলিশ কমিশনার পাশের পুলিশ অফিসারদের সব নির্দেশ দিয়ে সুড়ঙ্গে নামার জন্যে সবার সাথে পা বাড়াল।
সিঁড়ি দিয়ে প্রায় পনের ফিট নামার পর একটা প্রশস্ত ল্যান্ডিং পাওয়া গেল যেখানে চার পাঁচ জন লোক এক সাথে দাঁড়ানো যায়। এখান থেকে সুড়ঙ্গের শুরু। সিঁড়িটা অন্ধকার। ল্যান্ডিং দেয়ালে রয়েছে একটা সুইচ বোর্ড। তাতে চারটি সুইচ। প্রথম সুইচের নিচে দু’টি এ্যারো চিহ্ন মুখোমুখি আর দ্বিতীয় সুইচের নিচে দু’টি এ্যারো চিহ্ন বিপরীতমুখী। তৃতীয় সুইচের নিচে একটা মশালের ছবি আর চতুর্থ সুইচের নিচে আঁকা একটা ছোট্ট হাতপাখা। জেনারেল মোস্তফারাও দেখছিল সুইচ বোর্ড।
জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘এ্যারো চিহ্নিত সুইচ দু’টি সুড়ঙ্গের সিঁড়ির মূখ বন্ধ করা ও খোলার জন্য, মশাল চিহ্নিত সুইচটা চেপে সুড়ঙ্গে আলো জ্বালাতে হবে, আর বাতাসের জন্যে চাপতে হবে পাখার সুইচ।’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘সুইচ চাপুন জনাব।’
জেনারেল মোস্তফা একে একে তিনটি সুইচই চাপল। কিন্তু সিঁড়ির মুখ যেমন বন্ধ হলো না, তেমনি সুড়ঙ্গে আলো জ্বললো না, বাতাসও এল না।
জেনারেল মোস্তফা কামাল তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘সুইচগুলো ওয়ার্ক করছে না মি. খালেদ খাকান।’
‘সুইচগুলোর মধ্যে নির্মাতারা একটা ধাঁধাঁ তৈরি করে রেখেছে জেনারেল মোস্তফা। এবার আপনি বিপরীত এ্যারো চিহ্নিত সুইচ টিপুন এবং মশাল ও পাখা চিহ্নিত সুইচ এক সাথে চাপুন এবং মশাল ও পাখার সুইচ আগে চাপতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
তাই করল জেনারেল মোস্তফা।
এবার সুড়ঙ্গে আলো জ্বললো, বাতাস এল এবং সিঁড়ি মুখ বন্ধ হয়ে গেল।
বিস্মিত জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনি এই ধাঁধাঁটি কি করে ধরলেন?’
‘সুইচ বোর্ডটার সবটা বিষয় আপনি ভালোভাবে দেখে বুঝার চেষ্টা করলে আপনিও ধরতে পারতেন। দেখুন, এ্যারো আঁকা সুইচ দু’টোর উপরে দু’টো সুইচের স্থান কভার করে লম্বা দু’টো এ্যারো আঁকা। বোর্ডের মত একই কালারের হওয়ার কারণে এ তীর দু’টো খুব তাড়াতাড়ি চোখে পড়ছে না। এর অর্থ, এই তীর দু’টির একটির শুরু প্রথম সুইচ থেকে, কিন্তু মাথাটা দ্বিতীয় সুইচে, আর দ্বিতীয় তীরটির শুরু দ্বিতীয় সুইচ থেকে, মাথাটা প্রথম সুইচে। এর অর্থ হলো, প্রথম সুইচটির কাজ পাওয়া যাবে দ্বিতীয় সুইচ থেকে। মশাল ও পাখা আঁকা সুইচের মাথার উপরে দেখুন বোর্ডের মত একই কালারে দু’টি সমান্তরাল সরল রেখা সুইচ দু’টোকে যুক্ত করেছে। এটার ইংগিত হলো, এ সুইচ দু’টির ফাংশন এক সাথে, সুতরাং এদের অফ, অন একই সময়ে করতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মশাল ও পাখার সুইচ দু’টি কেন আগে চাপতে হবে, সে কথা কিন্তু বলেননি।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘মশাল ও পাখার সুইচ আগে অন না করে সিঁড়ি বন্ধের সুইচ অফ করলে সিঁড়ি মুখের দরজা বন্ধ হতো না। নির্মাতারা এটাই চেয়েছেন। কারণ সিঁড়ি মুখের দরজা আগে বন্ধ হলে সিঁড়ি মুখ থেকে আসা আলো-বাতাস বন্ধ হয়ে যেত। তাতে সুড়ঙ্গ অন্ধকারে ডুবে যেত, বাতাসও বন্ধ হতো। এই সংকট যাতে না হয়, এ জন্যে মশাল ও পাখার সুইচ দু’টি আগে অন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা কামাল একদিকে কথা শুনছিল, অন্যদিকে তার চোখ দু’টি আঠার মত লেগেছিল সুইচ বোর্ডের উপর। আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই জেনারেল মোস্তফা বলে উঠল, ‘পেয়েছি মি. খালেদ খাকান, আগে-পরের ক্লুটা পেয়ে গেছি। এই দেখুন, মশাল ও পাখার দুই সুইচের পাশেই বোর্ডের কালো অংশে ‘২’ লেখা ও এ্যারো চিহ্নিত দুই সুইচের পাশে একইভাবে ‘১’ লেখা।
‘ধন্যবাদ জেনারেল মোস্তফা। এবার আসুন, আমরা সামনে অগ্রসর হই।’
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল।
সবাই হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসার পেছনে পেছনে।
হাঁটা শুরু করে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনি গোয়েন্দা ট্রেনিং-এর অদ্বিতীয় এক শিক্ষক হতে পারেন।’
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার কথার দিকে কান না দিয়ে বলল, ‘জেনারেল, ওদের পালানোর পথ তো পেয়ে গেলাম, ওদের ধরার পথ এখন আমাদের দরকার। আইআরটি কিংবা বিজ্ঞানী কারও কোন ক্ষতি হতে দিতে আমরা পারি না। এজন্যে ওদের কোন সময় দেয়া যাবে না।’
‘ঠিক মি. খালেদ খাকান। ওরা সময় পেয়ে আমাদের দারুণ ক্ষতি হবে। কিন্তু সামনে আমি অন্ধকার দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ না কেউ এই গ্যাং মানে ‘থ্রি জিরো’র সাথে জড়িত। আমি মনে করি এদের খুঁজে বের করাকে আমাদের প্রথম গুরুত্ব দিতে হবে। সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘এ পর্যন্ত আমি যা জানতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছেলে তাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে পালানোর সময়ও ছেলেটি তাদের সাথে ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটা তো স্পেসেফিক ইনফরমেশন। তাকে লোকেট করতে পারলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘তবে তার নামটা আমি এখনও জানতে পারিনি। চেষ্টা করছি।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলতে বলতে হাঁটছে তারা।
একশ’ গজও তখন পার হয়নি তারা। সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে গেল, তারা একটা সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ এসে হাজির হলো।
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আমার অনুমান ভুল না হলে আমরা বাড়ির উত্তর প্রান্তের সীমানা দেয়ালের কাছে এসে গেছি। এ দেয়ালের বাইরে রয়েছে ওয়াটার সাপ্লাই প্ল্যান্ট, তার সাথে বেশ ফাঁকা জায়গাও রয়েছে।’
‘তার মানে ওরা এখানে পালাবার জন্যে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করেছিল। চলুন উপরে ওঠা যাক।’
‘সিঁড়ির গোড়ায় ল্যান্ডিং এর দেয়ালে আগের মত সুইচ বোর্ড এবং সুইচ বোর্ডের চারটি সুইচ পাওয়া গেল। এখানেও ধাঁধাঁ সেই একই রকমের।
আহমদ মুসারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
সিঁড়ি মুখ যেখানে শেষ হয়েছে, সেটা ভাঙা, পরিত্যক্ত সামগ্রী ফেলার একটা ঘর। সুড়ঙ্গ মুখ জুড়ে রয়েছে এই ঘরটির মেঝেরই একাংশ।
আর ঘরটির উত্তর দেয়ালটাই আসলে সীমান্ত দেয়াল।
আহমদ মুসা ঘরে উঠে চারদিকে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলতেই দেখতে পেল, ঘরের উত্তর দিকের অর্থাৎ সীমান্ত দেয়ালের গায়ে দেয়াল রংয়ের একটা ষ্টিলের দরজা। এখানেও দেখল দরজার গায়ে দু’টি দেয়াল রংয়ের বোতাম। দুই বোতামের নিচে আঁকা এ্যারো চিহ্নের সেই ধাঁধাঁ।
আহমদ মুসারা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে গাড়ির চাকার দাগও তাদের খুব সহজেই চোখে পড়ল।
‘আমাদের দুর্ভাগ্য, কিডন্যাপারদের এই সাফল্যের কারণ তাদের সফল পরিকল্পনা। তারা বাড়ির নকশা হাত করতে সফল হয়েছে। জেনারেল মোস্তফা, আপনারা দেখুন বাড়ির নকশা কারা বের করল, কিভাবে বের করল।’
‘অবশ্যই দেখছি। কিন্তু বলুন আমরা এগোবো কোন পথে? তাড়াতাড়ি কিছু করতে না পারলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। তুরষ্কও বেকায়দায় পড়েছে ওআইসি’র অন্যান্য সদস্যের কাছে।
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘এই বিপর্যয়ের ভার আমার উপরই বর্তায় বেশি।’
‘না মি. খালেদ খাকান। আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। আপনি যদি বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে এখানে আনার ব্যবস্থা না করতেন, বাড়িতেই যদি তাঁকে রাখা হতো, তাহলে তার স্ত্রী ও বাচ্চারাও আজ তার সাথে বন্দী হতো। সেটা হতো অত্যন্ত ভয়াবহ। তাতে বিজ্ঞানী তাদের সব কথা মানতে বাধ্য হয়ে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হতে পারতেন। সবকিছু আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেত। বিজ্ঞানী কিডন্যাপ হলেও এই মহাদুর্যোগ থেকে আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে তখন গভীর চিন্তার ছাপ। যেন কোন গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা থামলেও আহমদ মুসা কোন কথা বলেনি।
জেনারেল মোস্তফাই আবার কথা বলল, ‘কি ভাবছেন মি. খালেদ খাকান?’
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে মুখ তুলে জেনারেল মোস্তফার দিকে তাকাল। বলল, ‘আমাকে এখুনি যেতে হবে। চলুন ফিরে যাই, গাড়ি তো ওখানে।’
‘চলুন। কিন্তু আপনি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কি ভাবছেন, আমাদের আপনার কিছু বলার আছে কিনা? সময় নষ্ট করা যাবে না কিছুতেই।’
সীমানা ওয়ালের দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে সবাই হাঁটা শুরু করেছে গাড়ির কাছে আসতে।
হাঁটতে হাঁটতে বলল আহমদ মুসা, ‘জেনারেল মোস্তফা, জনাব নাজিম এরকেন, আপনারা একটু চেষ্টা করুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জ্ঞান ফিরে এলে তাদের কাছ থেকে জানুন কিডন্যাপকারীদের কাউকে তারা চেনে কিনা। নিশ্চয় তাদের সাথেরই কেউ কিডন্যাপারদের একজন বা কিডন্যাপারদের লোক। বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করলে কোন ক্লু পাওয়া যাবেই। বাড়ির নকশা কারা পূর্ত দফতর থেকে যোগাড় করেছে, তাদের চিহ্নিত করতে পারলেও কিডন্যাপারদের কাছে পৌছা সম্ভব হবে। তাদের গাড়ি দু’টির ষ্টিয়ারিং হুইলে দু’জন ড্রাইভারের ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া যাবে, তাও সাহায্যে আসতে পারে। আর আমিও একটা ক্লু সামনে রেখে বেরুচ্ছি। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কিছুই করতে পারবো না।’
‘নিশ্চয় আল্লাহ সাহায্য করবেন। আমরা ভয়ংকর এক বিপদের মধ্যে আছি। আল্লাহ আমাদের একমাত্র ভরসা।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
তারা পৌছে গেছে গাড়ির সামনে।
আহমদ মুসা এগোল গাড়ির দিকে।
জেনারেল মোস্তফা ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘আপনি হেলিকপ্টারে যেতে পারেন মি. খালেদ খাকান।’
‘দরকার নেই জেনারেল। আমার নামে বরাদ্দ হেলিকপ্টার তো অফিসে আছে। দরকার হলে নিয়ে নেব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পায়ের তলায় মাটি দরকার।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেনও হেসে ফেলেছে। জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘দুঃখের মধ্যেও আপনি হাসতে পারেন, হাসাতেও পারেন মি. খালেদ খাকান। আমরা এখন হেলিকপ্টারে উঠব বটে, কিন্তু আমাদের পায়ের তলাতেও মাটি দরকার।’
‘পায়ের তলায় মাটি না থাকলে হেলিকপ্টার আকাশে উড়বে কি করে! হেলিকপ্টার আকাশে উড়ার জন্যে যেমন মাটি দরকার, তেমনি ল্যান্ড করার জন্যেও মাটি প্রয়োজন।’ হেসেই বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’
‘ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো।
‘ওয়া আলাইকুম সালাম।’ বলল জেনারেল মোস্তফা। সেও ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।
৫
ষ্টার্টারের চাবিতে হাত দিয়েছে আহমদ মুসা। চাবিটা ঘুরাবার আগেই বেজে উঠল আহমদ মুসার মোবাইল।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকাল। দেখল জোসেফাইনের নাম্বার। মনে হঠাৎ যেন আনন্দের বন্যা নামল আহমদ মুসার। তার সমগ্র অন্তর যেন জোসেফাইনের টেলিফোনেরই অপেক্ষা করছিল।
টেলিফোনটা মুখের কাছে নিয়ে সালাম দিয়েই বলল, ‘জোসেফাইন, তোমার টেলিফোন সাংঘাতিকভাবে আশা করছিলাম। ধন্যবাদ তোমাকে টেলিফোনের জন্যে।’
‘যার বেশি দরকার সেই কিন্তু টেলিফোন করে, তুমি কিন্তু টেলিফোন করনি।’
‘এই মুহূর্তে তোমার টেলিফোন যে আমি সাংঘাতিকভাবে আশা করছিলাম, সেটা বুঝলাম তোমার টেলিফোন পাওয়ার পর।’
‘এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বল?’ হাসতে হাসতে বলল জোসেফাইন।
‘তোমাকে বিশ্বাস করতে বলব কি, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। অবচেতন মনের চাওয়া চেতন মন সব সময় জানতে পারে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘রাখ দর্শনের কথা, বল তুমি কি বলবে, না ওটাও অবচেতন মনে আছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘জোসেফাইন, তোমার বান্ধবী ঠিকই সন্দেহ করেছিল, খবর ঠিক দিয়েছিল। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে রক্ষা করতে পারিনি। যথাসময়ে আমরা পৌছতে পারিনি, বিজ্ঞানীকে ওরা কিডন্যাপ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ইন্নালিল্লাহ! ভয়ানক দুঃসংবাদ। তুমি এখন কোথায়?’ বলল জোসেফাইন।
‘বিজ্ঞানীর বাড়ির সামনে গাড়িতে উঠে বসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি কোথাও যাচ্ছ? তোমার সাথে কথা বলে ঠিক এটাই ভেবেছি। তোমার জন্যে আমার কাছেও জরুরি তথ্য আছে। কয়েক মিনিট আগে জেফি জিনা আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। বিজ্ঞানী কিডন্যাপ হওয়ার বিষয় সেও নিশ্চয় জেনেছেন।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। ওঁকেই আমার এখন খুব বেশি দরকার। বলতো কি ইনফরমেশন দিয়েছেন। নিশ্চয় আগের মতই জরুরি কিছু হবে।’
‘একটা ঠিকানা দিয়েছেন এবং বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা প্রতিনিধিদল তাদের রিসার্চ ফোরামের পক্ষ থেকে তার সাথে দেখা করে ড. আন্দালুসির সাথে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করেছিল। সে সময় ছাত্রদের একজন জেমস জোসেফ তাকে ষ্টুডেন্ট রিসার্চ ফোরামের একটা ফোল্ডার দিয়েছিল। ফোল্ডারে রিসার্চ ফোরামের কাগজ-পত্রের মধ্যে একটা চিরকুট ছিল। তাতে জনৈক ডিওয়াই লিখেছিল, জেমস জোসেফ, তুমি প্রতিনিধি দলে অবশ্যই থাকবে। যে কোন মূল্যে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতেই হবে। আর নতুন ঠিকানা ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাস সড়কের ৯৯ নম্বর বাড়িটা ভালো করে দেখে আসবে। ঠিকানাটা তোমার চিনে নেয়ার দরকার হবে। এই চিরকুটটা সে সময় গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, এখন এটা তোমার কাছে অমূল্য হতে পারে, জেফি জিনা বলেছেন।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেই সাথে তার মনে দারুণ এক বিস্ময়ও। কে এই জেফি জিনা? ছাত্র প্রতিনিধি দল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার জন্যে তারা জেফি জিনার কাছে কেন গিয়েছিল? আর বিজ্ঞানী ড. আন্দালূসিই বা কোন কারণে জেফি জিনাকে দাওয়াত করেছিল ছাত্রদের সাথে? তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন গুণী অধ্যাপক হলে একটা অর্থ পাওয়া যেত। কিন্তু ঐখানে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কোন অধ্যাপক নেই। তাহলে কে তিনি?
ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসা। জোসেফাইনের কথা শেষ হলেও উত্তরে আহমদ মুসা কিছু বলেনি।
জোসেফাইন আবার কথা বলে উঠল, ‘কি ভাবছ? কি হলো তোমার? কথা বলছ না যে?’
‘হ্যাঁ, জোসেফাইন তোমার বান্ধবী যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেটা সত্যিই অমূল্য। যে ছেলেটা জেফি জিনাকে ফোল্ডারটা দিয়েছিল, তারই নাম জেমস জোসেফ এবং অনুমান সত্য হলে বিজ্ঞানীর বাড়িতে হামলাকারী গ্রুপের সাথে তিনি তাকে দেখেছিলেন। সুতরাং এই ঠিকানা বিজ্ঞানীর উদ্ধার অভিযানের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমি ভাবছিল জোসেফাইন, তোমার এই বান্ধবীটি কে? ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অত্যন্ত পরিচিত কেউ অথবা প্রভাবশালী ও গুণী একজন অধ্যাপক হবেন। কিন্তু জেফি জিনা নামে কোন অধ্যাপক ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তাহলে জেফি জিনা নামটা কি নকল? আমরা কিছু বুঝতে পারছি না জোসেফাইন।’
থামল আহমদ মুসা।
‘আমার কাছে তার নাম বদলাবার দরকার কি? নামটা নকল বলে আমার মনে হচ্ছে না। কিন্তু তোমার কথা ঠিক যে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় কেউ না হলে এসব ঘটনার সাথে তাকে জড়িত দেখা যাচ্ছে কেন?’ বলল জোসেফাইন।
‘কিন্তু ঐ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ নেই, এটাও তো সত্য! আমার আরেকটা বিষয় বিস্ময়কর বলে মনে হচ্ছে, বিজ্ঞানীর বাড়িতে হামলা হচ্ছে, এই খবরটা তিনি পুলিশকে না দিয়ে তোমাকে দিলেন কেন! আবার এখন এই যে, গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ও ঠিকানার খবর কেন তোমাকে দিলেন! পুলিশকে সরাসরি দিতে পারতেন। কিন্তু ভায়া-মিডিয়া দেয়ার মত সময় খরচ অযথা করলেন কেন? সত্যি আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি সব বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কি কিছু মনে করবেন উনি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি জিজ্ঞেস করব?’ জোসেফাইন বলল।
‘যেমন তিনি এখন কোথায়? তার সাথে আমি কথা বলতে পারি কিনা? তাঁর আরও সহযোগিতা আমাদের দরকার। তিনি যদি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকেন, তাহলে আমি তো কাছেই আছি। আমি গিয়েও তার সাথে দেখা করতে পারি। ইত্যাদি বিষয় তাঁর কাছে তুলতে পার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু এসব প্রশ্ন করে, এসব বিষয় তুলে তার নাম ও পেশার পরিচয় পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’ বলল জোসেফাইন।
‘একবার তার ঠিকানা জানলে তার সব পরিচয়ই আমরা বের করতে পারব। তার নাম, পেশা নিয়ে আজ এ সময় হঠাৎ প্রশ্ন তুলতে গেলে আমরা তাকে সন্দেহ করছি ভাবতে পারেন।’
‘ঠিক বলেছ জোসেফাইন। কোনোভাবে তাঁকে হিট করা ঠিক হবে না। শুরু থেকেই তিনি আমাদের যে সহযোগিতা দিয়ে আসছেন, তা অমূল্য। হতে পারে আমাদের সন্দেহ ঠিক নয়। নাম হয়তো তার ঠিক আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হয়েও তার অবস্থান এমন গুরুত্বপূর্ণ যে সব জায়গায় তিনি আছেন। অথবা তিনি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ হতে পারেন। ঠিক আছে, আসলে যা আমরা চাই, সে তথ্য তিনি তো দিয়েছেনই। আবার টেলিফোন করলে বাই দি বাই কিছু আলোচনা করতে পার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে, যতটা পারি করব। তোমার এখন কি প্রোগ্রাম?’ বলল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবী জেফি জিনা যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেটাই এখন আমাদের টার্গেট। সে বিষয়টা জেনারেল মোস্তফাদের সাথে আলোচনা করছি।’
‘ঠিক আছে, সময় আর নষ্ট করব না। আমি রাখছি। ফি আমানিল্লাহ। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম।’
মোবাইল পকেটে রেখে তাকাল আহমদ মুসা বাইরের গাড়ি ও হেলিকপ্টারের দিকে। দেখল বাড়ির সামনে জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ মুসা বুঝল, আমি কেন দেরি করছি, কেন আমি দাঁড়িয়ে আছি, এ নিয়ে তাদের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে বলেই তারা এদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সংগে সংগে জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনও ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার কাছাকাছি এসেই জেনারেল মোস্তফা জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার মি. খালেদ খাকান। নতুন কোন খবর অথবা কিছু ঘটেছে?’
জেনারেল মোস্তফারা আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ‘ফাতিহ সুলতান মোহাম্মাদ বাইপাস রোডের ৯৯ নম্বর বাড়িটার চারদিকে সাদা পোশাকের পুলিশ দিয়ে পাহারা বসাতে হবে এখনই। লক্ষ্য রাখতে হবে ঐ বাড়ির অথবা সেখানকার অন্য কেউ যাতে সন্দেহ না করে যে, চারদিক থেকে বাড়িটার উপর চোখ রাখা হচ্ছে। দ্বিতীয় কথা হলো, বাড়িটাতে কেউ যাক ক্ষতি নেই, কিন্তু বাড়ি থেকে কেউ বেরুলে সবার অলক্ষ্যে তাকে আটকাতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেনের চোখে বিস্ময় এবং অনেক প্রশ্ন। কিন্তু আহমদ মুসা কাউকে কোন প্রশ্ন না করতে দিয়ে পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনকে বলল, ‘মি. এরকেন, এখনি আপনার পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে দিন।’
‘ঠিক আছে স্যার। আমি নির্দেশ দিচ্ছি।’ বলে মোবাইল তুলে নিল হাতে। একটু সময় নিয়ে বিষদ নির্দেশ দিল।
কথা শেষ করে মোবাইল অফ করে দিয়ে নাজিম এরকেন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কিন্তু কাকে রক্ষার জন্যে কিংবা কাকে ধরার জন্যে আমরা বাড়িটার উপর চোখ রাখব স্যার?’
‘সন্দেহ করা হচ্ছে, কিডন্যাপাররা বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে নিয়ে ঐ বাড়িতে উঠেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় ও আনন্দে পাল্টে গেল জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেনের চেহারা। মুহূর্ত কয়েক যেন তারা কথা বলতে পারল না।
প্রথম মুখ খুলল জেনারেল মোস্তফা। বলল সে, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনার কথা আমার কাছে মহাআনন্দের আর স্বপ্নের মত লাগছে। আপনি ঠিক বলছেন তো! সত্যিই আপনি এত তাড়াতাড়ি এতদূর পর্যন্ত এগোতে পেরেছেন?’
‘আমার স্ত্রী টেলিফোন করেছিলেন। আমাদের অত্যন্ত সচেতন একজন শুভাকাংক্ষী এই তথ্য আমাদের দিয়েছেন। তাঁর দেয়া তথ্য আগেও সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমরা কোন প্রশ্ন তুলছি না মি. খালেদ খাকান। আমাদের বিস্ময় লাগছে, সোনার হরিণটা এত তাড়াতাড়ি হাতের মুঠোয় আসবে। এখন বলুন, আপনার পরিকল্পনা কি?’
‘এখন সেখানে রওয়ানা হতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরাও! যদি আপনি ঠিক মনে করেন।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘এ অভিযান তো আপনাদের। আমি সহযোগিতা করছি মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই বলল, ‘এ অভিযানটা আমাদের হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা বিপদ বুঝলে বিজ্ঞানীকে হত্যাও করতে পারে। আমাদের এ ধরনের অবস্থার শিকার হওয়া চলবে না।’
‘ঠিক মি. খালেদ খাকান! প্ল্যানটা কি হবে একটু ভাবা প্রয়োজন।’ পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন বলল।
‘বলুন, কি করা যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলল পুলিশ প্রধানই আবার। বলল, ‘দিনের বেলায় বাড়িটা গোপনে ঘিরেই রাখতে হবে, যেভাবে আপনি বলেছেন। গভীর রাতে গোপনে বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে, যাতে ওদের এড়ানো এবং বিজ্ঞানীকে নিরাপদে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা যায়।’
‘রাতে হলেও প্রথমে দল বেঁধে বা একাধিক লোক বাড়িতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। বাড়িতে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা নিশ্চয় তারা রেখেছে। ওরা টের পেয়ে গেলে দু’টি ঘটনা ঘটবে। এক. বিজ্ঞানীর জীবনের তারা ক্ষতি করবে অথবা দুই. বিজ্ঞানীকে নিয়ে পালিয়ে যাবার সুযোগ তারা নেবে। এ বাড়িতেও সুড়ঙ্গ পথের ব্যবস্থা নেই তা বলা যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক মি. খালেদ খাকান! এ ধরনের কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না। আপনার পরামর্শ কি? আমরা তাহলে কিভাবে এগোবো?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, ‘চলুন ওখানে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। তবে আমি মনে করছি, দিনে কিংবা রাতে, যখনই সম্ভব হয় আমি গোপনে বাড়িটাতে প্রথম প্রবেশ করব। আমি মোবাইলে মিসকল দেব, তখন অবস্থা বুঝে আপনারা প্রবেশ করবেন।’
‘কিন্তু মি. খালেদ খাকান, ওরা খুব বিপজ্জনক লোক। ওরা কত লোক ভেতরে আছে, তাও জানা নেই। আপনি যদি বিপদে পড়েন?’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘নিরাপদে বাড়িটিতে প্রবেশ করে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে নিরাপদ করা এখনকার জন্যে সবচেয়ে বড় কাজ এবং এটা আমাদের করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই মি. খালেদ খাকান। ঠিক আছে, আমরা যাত্রা করতে পারি।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘আমার মনে হয়, আমরা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে যাচ্ছি। সাদা পোশাকে আরও কিছু পুলিশ। তারাও এক গাড়িতে দু’জনের বেশি যাবে না। বাড়িটার উত্তর পাশেই একটা হোটেল আছে। আর বাড়ির পেছনে, মানে পশ্চিম দিকে একটা বড় মসিজদ রয়েছে। আর দক্ষিণ পাশে একটা কম্যুনিটি হাসপাতাল। আমাদের লোকরা রাস্তার পাশে অবস্থান নেয়া ছাড়াও এই তিনটি স্থানকে কেন্দ্র করা হোক। আমরাও সেখানে অবস্থান নিতে পারি।
‘আশ্রয়ের একটা জায়গা থাকা দরকার। সেই হিসেবেও কেন্দ্রগুলো ঠিকই হয়েছে। কিন্তু আপনার লোকদের বলে দিন যেন সব রাস্তার উপর নিচ্ছিদ্র অবরোধ থাকে। আর কেউ যেন পালাতে না পারে।’ কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আসুন, আমরা যাত্রা করি।’
বলে সালাম দিয়ে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে এগোলো।
‘ঠিক আছে মি. খালেদ খাকান, আমি বিষয়টা আবার আমাদের লোকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।’ নাজিম এরকেন বলল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল সালাম নিয়ে ‘গুডলাক মি. খালেদ খাকান’ বলে তার গাড়ির দিকে এগোলো।
এগোলো পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনও।
‘না, থামবেন না ড. আন্দালুসি। আরও একটু বিস্তারিত বলুন, সোর্ড নামে যে অস্ত্র তৈরি করেছেন, সেটা কিভাবে ফাংশন করে?’
কথাগুলো বলছিল ডেভিড ইয়াহুদ।
সে একটা চেয়ারে বসে। তার পাশের চেয়ারেই বসেছিল আইজ্যাক বেগিন।
তাদের সামনে আরেকটা কাঠের চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছেন বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। ড. আন্দালুসির পাশেই আরেকটা কাঠের চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় আছে বিজ্ঞানীর সাথে ধরে আনা মহিলা গোয়েন্দা অফিসার।
আর তাদের সকলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ ছয়জন ষ্টেনগানধারী অস্ত্র বাগিয়ে এ্যাটেনশন অবস্থায়।
ঘরটা আন্ডার গ্রাউন্ড একটা কক্ষ। বেশ বড়।
এটা ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ রোডের ৯৯নং বাড়িটির একটা কক্ষ।
বাড়িটা চারদিক থেকে প্রাচীর ঘেরা।
প্রাচীর ঘেরা জায়গার মাঝখানে বাড়িটা।
বাড়ির সম্মুখ ভাগের প্রাচীর রাস্তা থেকে কয়েক গজ ভেতরে। রাস্তা থেকে প্রাচীর গেট পর্যন্ত রাস্তা পাথর বিছানো। গেটে গ্রীলের দরজা। গেট থেকে একটা পাথর বিছানো পথ গাড়ি বারান্দায় গেছে। গাড়ি বারান্দা থেকে তিন ধাপের একটা সিঁড়ি পেরোলে বারান্দা। বারান্দায় সোজা এগোলেই বাড়িতে প্রবেশের মূল দরজা। ভেতরে প্রবেশ করলেই বিশাল একটা লাউঞ্জ। লাউঞ্জের চারদিকে বিভিন্ন করিডোর। লাউঞ্জের ডান দিকের দু’প্রান্ত দিয়ে দুটি সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সিঁড়িগুলো দেয়ালের সাথে যুক্ত হয়ে উপরে উঠে গেছে। ওপাশের সিঁড়ির গোড়ার পাশে দেয়ালে রয়েছে একটা দরজা। দরজা থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
আন্ডার গ্রাউন্ডে অনেকগুলো কক্ষ।
কক্ষগুলো ষ্টোর এবং শেল্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যবাহী সাম্রাজ্যের কেন্দ্র হিসেবে তুরষ্ক সব যুদ্ধ অথবা যুদ্ধ-ঝুঁকির মধ্যে ছিল। একমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া ঠান্ডাযুদ্ধ পর্যন্ত সকল যুদ্ধের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ এক পক্ষ ছিল তুরষ্ক। এজন্যে তুরষ্কে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের বাড়িতে আন্ডার গ্রাউন্ড শেল্টার রয়েছে।
আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরটির একটা বড় ও বিশেষ কক্ষে ড. আন্দালুসিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ডেভিড ইয়াহুদের প্রশ্নের জবাবে ড. আন্দালুসি বলল, ‘আমি বলেছি, ‘সোর্ড’ কোন অস্ত্র নয়, এটা আত্মরক্ষার একটা মেকানিজম। এটা কারো বিরুদ্ধে নয়, অন্যের হিংসার হাত থেকে নিজেকে রক্ষার একটা মাধ্যম মাত্র।’
‘তবু এটা অস্ত্র। অস্ত্রকে যা ব্যর্থ, নিষ্ক্রিয় করে, কিংবা ধ্বংস করে, সেটা অস্ত্রের চেয়েও বড় অস্ত্র। ‘সোর্ড’ এ ধরনেরই একটা ভয়াবহ অস্ত্র। যাই হোক, বলুন কিভাবে এটা ফাংশন করে? এর বেসিক কনসেপ্ট কি?’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘নিয়ন্ত্রিত আলোক কণার একটা দেয়াল উড়ন্ত ও অগ্রসরমান যে কোন কিছুর গতিরোধ করে এবং একে পৃথিবীর আবহাওয়ার বাইরে নিয়ে ধ্বংস করে। এটাই এর কনসেপ্ট যে, ইন্টিগ্রেটেড আলোক কণার শক্তিকৃত চৌম্বকত্ব ও সর্বভেদী ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে উড়ন্ত অগ্রসরমান সকল মেটালিক, নন-মেটালিক বস্তুকে আকাশেই অবরুদ্ধ এবং তার বিলয় ঘটাতে পারে।’ বলল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি।
‘তার মানে আকাশপথের আক্রমণকারী সব অস্ত্রকেই সোর্ড ধ্বংস করতে পারবে। এর অর্থ সোর্ড মানব কল্যাণের বড় অস্ত্র। তাই নয় কি?’ ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘অবশ্যই। আমি তো বলেছি এটা আক্রমণ করার কোন অস্ত্র নয়, আত্মরক্ষার মাধ্যম।’ বলল ড. আন্দালুসি।
‘তাহলে বলুন, কল্যাণের মাধ্যম যে জিনিসটা, তার উপর সকলের অধিকার আছে কিনা?’ ড. ডেভিড বলল।
ড. আন্দালুসি তাকাল পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। তার দু’চোখে অন্ধকার। সে পরিষ্কার বুঝতে পারল, ডেভিড ইয়াহুদের কথা কোন দিকে যাচ্ছে।
ভাবতে গিয়ে ডেভিড ইয়াহুদের কথার জবাব দিতে পারল না ড. আন্দালুসি।
ডেভিড ইয়াহুদই কথা বলে উঠল আবার। বলল, ‘মঙ্গলজনক আবিষ্কার কারও একার নয়। সকলেরই অধিকার আছে তা থেকে উপকার নেয়ার। সুতরাং ড. আন্দালুসি, ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা আমরা চাই।’
বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং মুখের ভাব শক্ত হয়ে উঠেছে। বলল, ‘আমাকে কি এজন্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে?’
‘ধন্যবাদ ড. আন্দালুসি, আমাদের মনের কথা আপনিই বলে দিয়েছেন। হ্যাঁ, ড. আন্দালুসি, আপনার ঐ মহামঙ্গলের আবিষ্কারের প্রতিই আমাদের লোভ। ফর্মূলা আদায়ের জন্যেই আমরা আপনাকে তুলে নিয়ে এসেছি।’
‘বৃথাই কষ্ট করেছেন। এই ফর্মূলা আপনারা কেন, দুনিয়ার অন্য আর কাউকেই দেয়া হবে না।’ বলল ড. আন্দালুসি। শক্ত কণ্ঠ তার।
‘সাধারণভাবে সকলের জন্যে কল্যাণকর কোন কিছু যদি কেউ কুক্ষিগত করে রাখতে চায়, সেটা অন্যায়। আমরা এ অন্যায় বরদাশত করব না। আমরা কল্যাণের মহৎ লক্ষ্যেই তা ছিনিয়ে নেব। এজন্যেই আপনাকে এখানে আনা হয়েছে।’
হাসল বিজ্ঞানী আন্দালুসি। বলল, ‘আপনারা কল্যাণের লক্ষ্যে নয়, মানুষের অকল্যাণের লক্ষ্যেই এই আবিষ্কারকে হাত করতে চান। আমরা এটা হতে দেব না।’
‘দেবেন আপনারা, তা জানি বলেই তো আমরা সোর্ড-এর পিতাকে নিয়ে এসেছি। দেবেন না কেন? কল্যাণের আবিষ্কার, যেমন ধরুন কোন ওষুধ, গোটা মানব জাতির সম্পদ। এ ধরনের কল্যাণের আবিষ্কার ‘সোর্ড’ কুক্ষিগত করে রাখা দুরভিসন্ধিমূলক।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ কঠোর কণ্ঠে।
‘উল্টো কথা বলছেন। ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা আপনাদের হাত করতে চাওয়াই দুরভিসন্ধিমূলক। একটা জঘন্য উদ্দেশ্য নিয়েই আপনারা ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলাকে হাত করতে চাচ্ছেন।’
আইজ্যাক বেগিন এতক্ষণ কথা বলেনি। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। বাজের মত হিংস্র শিকারীর দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে ড. আন্দালুসির দিকে। বলল, ‘দুরভিসন্ধিটা কি ড. আন্দালুসি?’
‘সোর্ড-এর যে ফর্মূলা, তা দিয়ে শুধু সোর্ডের মত আত্মরক্ষার অস্ত্র নয়, আক্রমণের অস্ত্রও তৈরি হতে পারে। এই আক্রমণাত্মক অস্ত্র হবে আত্মরক্ষার অস্ত্র ‘সোর্ড’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত ও ভয়াবহ। সমন্বিত ও শক্তিকৃত ফোটনের স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বউৎক্ষিপ্ত ফোটন-এ্যারো পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকে যে কোন স্থানের বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র মাইলো এবং অস্ত্র গুদাম নিজেই খুঁজে নিয়ে চোখের পলকে সেগুলোকে নিস্ক্রিয় ও নিরস্থিত করে দিতে পারে। আপনাদের দুরভিসন্ধি হলো সোর্ডের ফর্মূলা হাত করে এই অস্ত্র তৈরি করে গোটা পৃথিবী দখল করে নেয়া।’
আইজ্যাক বেগিন এবং ডেভিড ইয়াহুদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যেন আকাশের চাঁদ তারা হাতে পেয়ে গেছে।
তারা এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে, তৎক্ষণাত কোন কথা তারা বলতে পারেনি।
নিরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘ধন্যবাদ ডক্টর, আমরা যা জেনেছি, আপনি তা নিশ্চিত করলেন। এখন আসুন, আমরা একটা ডিল করি। আমরা সোর্ডের ফর্মূলা চাই, বিনিময়ে যা চাইবেন দিতে রাজি আছি। টাকার যে অংক বলবেন, সেই অংকই আমরা দেব। বলুন ডক্টর।’
হাসল ডক্টর আন্দালুসি। বলল, ‘আমি একজন বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী নই। তাছাড়া আমার গবেষণা মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বত হিমালয়। ঐ হিমালয় পরিমাণ অর্থ দিলেও আমি মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করব না, ফর্মূলাটি আমরা দেব না।’
গম্ভীর হয়ে উঠল আইজ্যাক বেগিন ও ডেভিড ইয়াহুদের মুখ। তাদের চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠেছে। দু’জন দু’জনের দিকে একবার তাকাল। তারপর আইজ্যাক বেগিন চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ড. আন্দালুসির দিকে। মুহূর্তের জন্যে একবার চোখ বুজল। তারপর চোখ খুলে বলল, ‘ডক্টর, নিশ্চয় এটা আপনার শেষ কথা নয়। শেষ কথার আগে আরও অনেক কিছুই বাকি আছে। হ্যাঁ বলুন ডক্টর, আমাদের কথায় রাজি হয়ে যান, রাজি না হয়ে আপনার অন্য কোন উপায়ও নেই।’
‘না, আমার শেষ কথাই বলে দিয়েছি।’ বলল ডক্টর আন্দালুসি।
চোখ দু’টি জ্বলে উঠল আইজ্যাক বেগিনের। তাকাল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘আপনার মিশন শুরু করুন মি. ডেভিড। নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।’
ডেভিড ইয়াহুদ তাকাল ড. আন্দালুসির দিকে। কাঠের চেয়ারটিতে হাত, পাসহ গোটা দেহ শক্ত করে বাঁধা ড. আন্দালুসির। একমাত্র মাথা ছাড়া দেহের কোন অংশ একটু নড়াবার উপায় নেই। চেয়ারের তলা থেকে একটা বৈদ্যুতিক তার বেরিয়ে কার্পেটের তলায় ঢুকে গেছে।
পাশের চেয়ারে ড. আন্দালুসির সাথে কিডন্যাপ করে আনা মহিলা গোয়েন্দা অফিসার সাইমি ইসমাইলকে চেয়ারের সাথে একইভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার চেয়ারের তলা থেকেও একটা বৈদ্যুতিক তার কার্পেটের তলায় ঢুকে গেছে।
ডেভিড ইয়াহুদ চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকাল সাইমি ইসমাইলের দিকে। বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার স্বামীকে বুঝান। এটা তার গবেষণাগার কিংবা ড্রইংরুম নয়। এখানে ওঁকে সংবর্ধনা দেবার জন্যে আনা হয়নি। আনা হয়েছে ফর্মূলা আদায়ের জন্যে! এ লক্ষে যা করা দরকার আমরা তাই করব। আপনি তাঁকে বুঝান।’
গোয়েন্দা অফিসার সাইমি ইসমাইলের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। বলল, ‘আপনাদের ভুল হচ্ছে। আমরা স্বামী-স্ত্রী নই, আমি তাঁর একজন কর্মচারী, সিকিউরিটির দিকটা আমি দেখি।’
‘আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আমাদের বোকা সাজাতে চাইছেন। বিজ্ঞানীর সাথে তাঁর স্ত্রীকে ধরে এনেছি, সেটা বুঝেই পরিচয় গোপন করতে চাইছেন। মিথ্যা কথা বলে লাভ হবে না।’
বলেই ডেভিড ইয়াহুদ চেয়ারের একটা হুক থেকে রিমোটটা টেনে নিয়ে বলল, ‘ড. আন্দালুসি, কেউ কথা না শুনলে তাকে কথা শোনাবার ফর্মূলা আমাদের আছে। সে রকম একটা ফর্মূলাই আমরা এখন প্রয়োগ করছি। রেডি স্যার।’
ডেভিড ইয়াহুদের তর্জনি রিমোর্ট কন্ট্রোলের একটা লাল বোতামে চেপে বসল।
সংগে সংগে ঝাঁকি দিয়ে উঠল ড. আন্দালুসির দেহ। অসহনীয় যন্ত্রণাকাতর একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল ডক্টর আন্দালুসির কণ্ঠ থেকে। ড. আন্দালুসির হাত, পা যেন সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করছিল। শক্ত করে বাঁধা সিল্কের কর্ড দেহে কামড়ে বসেছিল। সেই কামড়ে পাতলা চামড়ার ওপরের অংশ কেটে দু’ভাগ হয়ে গেল। দু’হাত ও দু’পায়ের বাঁধনের স্থান থেকে ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল। তার দু’চোখ বিস্ফোরিত হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো। যতক্ষণ ডেভিড ইয়াহুদের তর্জনি লাল বোতাম চেপেছিল, ততক্ষণ ড. আন্দালুসির আর্ত চিৎকার থামেনি।
বোতাম থেকে তর্জনি উঠল।
চিৎকার ধীরে ধীরে থেমে গেল।
তার মাথাটা চেয়ারের আশ্রয়ে ঢলে পড়ল। চোখ দু’টি তার বুজে গেছে।
আইজ্যাক বেগিন ও ডেভিড ইয়াহুদের মুখে প্রশান্তি। সাইমি ইসমাইলের চোখে মুখে আতংক। সে ভাবছে, ফর্মূলা না পেলে তারা বিজ্ঞানীকে মেরে ফেলতে পারে। অন্যদিকে ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা সম্পর্কে সে যা জেনেছে, তাতে এই ফর্মূলা কিছুতেই এদের হাতে দেবেন না বিজ্ঞানী। তাহলে? প্রশ্নের উত্তর ভাবতে গিয়ে কেঁপে উঠল সাইমি ইসমাইল।
‘ড. আন্দালুসি কথা বলুন। কি ভাবছেন আমাদের প্রস্তাব সম্পর্কে।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
ড. আন্দালুসি স্থির, নিরব। কথা বলল না, চোখও খুলল না।
আইজ্যাক বেগিনের চোখে আবার আগুন দেখা গেল। তাকাল সে ডেভিড ইয়াহুদের দিকে।
ড. ইয়াহুদের হাতের রিমোর্ট কনট্রোল আবার নড়ে উঠল। তার তর্জনি আবার সক্রিয় হলো। চেপে বসল সেই লাল বোতামে।
শক্ত বাঁধনের মধ্যেও বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দেহ লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করল। আর মুখ থেকে বেরিয়ে এল বুক ফাটা চিৎকার।
হাত পায়ের বাঁধন থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। যন্ত্রণার অসহনীয় তীব্রতায় বড় হয়ে বের হয়ে আসা চোখ দু’টি তার যেন ফেটে যাচ্ছে।
সুইচ থেকে ডেভিড ইয়াহুদ তার তর্জনি না তোলা পর্যন্ত ড. আন্দালুসির বুকফাটা চিৎকার থামল না।
পাশের চেয়ারে বাধা সাইমি ইসমাইল চিৎকার করে উঠল, ‘আপনারা এটা কি করছেন! উনি একজন বিজ্ঞানী। দয়া করে এই অমানুষিক কাজ বন্ধ করুন।’
সুইচ থেকে তর্জনি উঠল ইয়াহুদের।
চিৎকার থামলো ডক্টর আন্দালুসির। তার মাথাটা নেতিয়ে পড়ল চেয়ারে। চোখ বুজে গেছে তার। চেয়ারের হাতলে বাধা দু’হাত তার কাঁপছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চেয়ারের হাতা দিয়ে।
‘ম্যাডাম, আমরা তো এই খারাপ পথে যেতে চাইনি। উনি বাধ্য করেছেন। আপনি তাকে বলুন, ফর্মূলা উনি আমাদের দিয়ে দিতে রাজি হোন।’ সাইমি ইসমাইলের দিকে চেয়ে বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
সাইমি ইসমাইল কিছু বলার আগেই ক্লান্ত, কাঁপা স্বরে ডক্টর আন্দালুসি বলল, ‘ম্যাডাম সাইমি ইসমাইল, আপনি ওদের বলে দিন, কোন নির্যাতন করেই তারা যা চায় তা পাবে না। আর আমাকে ওরা মেরে ফেলতে পারবে না। কারণ তাতে তাদের সোনার ডিম তারা চিরতরে হারাবে।’
হো হো করে হেসে উঠল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘আপনি অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী। আমাদের উদ্দেশ্য ঠিক বুঝেছেন। কিন্তু এটা বুঝেননি যে, আমরা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি। যারা দৈনিক শত নির্যাতন হজম করতে পারে, তারা কিন্তু মানসিক চাপে মোমের মত গলে যায়।’
একটু থামল আইজ্যাক বেগিন।
পাশের টিপয়ের গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক পানি খেল। তারপর একটা হাসল। বলল, ‘ড. আন্দালুসি, আপনার উপর আঘাত আপনি সহ্য করেছেন, কিন্তু সাইমি ইসমাইলের উপর এ ধরনের আঘাত আপনি কতক্ষণ সহ্য করবেন? এখানেই শেষ নয়। অস্ত্র আমাদের আরও আছে। আপনার চোখের সামনে বিবস্ত্র সাইমি ইসমাইল মানুষ-হায়েনার দ্বারা লুণ্ঠিত হবে, তারপরও আপনি কতক্ষণ চুপ করে থাকবেন।’
কথা শেষ করে আইজ্যাক বেগিন তাকাল আবার ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘এবার সাইমিকে কিছুটা নাচান মি. ইয়াহুদ। তারও কিছু গান আমরা শুনি।’
চমকে উঠে চোখ খুলল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ, যে উদ্বেগ তার চোখে-মুখে কঠিন নির্যাতনেও ফুটে উঠতে দেখা যায়নি। চেয়ারে এলিয়ে পড়া মাথা তুলে সে বলল, ‘সাইমি ইসমাইল আমার স্ত্রী নন। তিনি একজন নির্দোষ মহিলা। তাঁকে আপনারা ছেড়ে দিন। দাবি আপনাদের আমার কাছে। আমাকে নিয়ে আপনারা যা ইচ্ছা তাই করুন।’
আইজ্যাক বেগিনের আবার সেই অট্টহাসি। বলল, ‘আমরা ঠিক সিলেকশন করেছি। এ ওষুধেই কাজ দেবে। আগাও ডেভিড ইয়াহুদ।’
ডেভিড ইয়াহুদ রিমোর্টটা হাতে তুলে নিল আবার।
ঠিক এই সময় দরজায় নক হলো। দ্রুত নক হলো পরপর তিনবার। এর অর্থ কেউ জরুরি সাক্ষাৎ চায়।
আইজ্যাক বেগিন তাকাল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। ডেভিড ইয়াহুদ উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে ঘুর দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভেতরে এস।’
ভেতরে প্রবেশ করল জেমস জোসেফ। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
‘কি ব্যাপার জেমস, তোমাকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে! কোন খবর?’ জিজ্ঞাসা ডেভিড ইয়াহুদের।
‘স্যার, বাড়িটার চারদিকে নতুন কিছু লোকের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। আমাদের ইনফরমাররা বলছে, লোকগুলো সাদা পোশাকে পুলিশ হতে পারে।’
ডেভিড ইয়াহুদের চেহারায় কেউ যেন এক রাশ কালি ঢেলে দিল। বলল, ‘খবরটা কি ঠিক? এটা কি করে সম্ভব? বাড়িটাতো আমরা নিয়েছি মাত্র সাত দিন হলো। আমাদের লোকরাও জানে না। আমাদের লোকরা যারা আজ এখানে এসেছে, তারাও এই বাড়িটা প্রথম দেখল। কিভাবে এটা বাইরের কেউ জানতে পারে? লোকজন যে পুলিশের তা কি করে জানা গেল?’
আমাদের লোকরা তাদের সাথে মেলা-মেশার ফলে তাদের কথাবার্তা শুনে এবং বাড়িটার উপর চোখ রাখা দেখে তাদের সন্দেহ হয়েছে। সবশেষ এইমাত্র খবর পেলাম ঐ লোকদের একজন মোবাইলে কাউকে বলছেন, একজন বিখ্যাত লোককে কিডন্যাপ করার ঘটনা ঘটেছে। উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের থাকতে হবে। এই কথার পর এখন আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।’ বলল জেমস জোসেফ।
উঠে দাঁড়াল আইজ্যাক বেগিনও।
সেও এসে দাঁড়াল ডেভিড ইয়াহুদের পাশে জেমস জোসেফের কাছে। তাদের সকলের মুখ পাণ্ডুর, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। বলল আইজ্যাক বেগিন, ‘ধন্যবাদ জেমস, খবরটা পেতে যে আরও দেরি হয়নি এজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওরা কমব্যাট ষ্টেজে এখনও আসেনি। নিশ্চয় ওরা কোন কিছুর অপেক্ষা করছে। এরই সুযোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।’
একটু থামল আইজ্যাক বেগিন।
চোখ তুলল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘মি. ডেভিড ইয়াহুদ, আন্ডার গ্রাউন্ড গ্যারেজে কয়টি গাড়ি আছে?’
‘দু’টি বুলেটপ্রুফ গাড়িসহ সাতটি গাড়ি আছে।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘লোকদের ডাক। এদের দু’জনকে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তোল। এ গাড়িতে আমি উঠব এবং জেমসসহ উঠবে আরও তিনজন। অন্য বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুমি উঠবে কয়জনকে নিয়ে বাকি ৫ টি গাড়িতে অবশিষ্ট জনশক্তি উঠবে। সাতটি গাড়ি দু’গ্রুপে ভাগ হবে। একটা গ্রুপ আপনার নেতৃত্বে যাবে দক্ষিণের পথ ধরে। আর অন্য গ্রুপ নিয়ে আমি যাব উত্তর দিকে। এতে ওরা বিভ্রান্তিতে পড়বে এবং ওদের জনশক্তি ভাগ হয়ে যাবে। এর জন্যে তাদের গাড়িও লাগবে। তাদের এই অপ্রস্তুতি হবে আমাদের জন্যে বড় সুযোগ।’
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডেভিড ইয়াহুদের। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. বেগিন। এ সময়ের জন্যে এর চেয়ে ভালো পরিকল্পনা আর হয় না। কিন্তু বেরুবার মুখেই যদি আমরা আক্রমণের মুখে পড়ি!’
‘সে ধরনের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেবার জন্যেই সাতটি গাড়ি এক সাথে বের হতে হবে। তাদের তাৎক্ষণিক ঐ আক্রমণ সাতটি গাড়িকে মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট হবে না। তারা বাড়তি প্রস্তুতি নেবার আগেই আমরা তাদের আওতার বাইরে চলে যাব।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘রাস্তার দু’ধারেও ওদের লোক মোতায়েন আছে বলে মনে করা হচ্ছে।’ জেমস জোসেফ বলল।
‘ওসব বাধা ধর্তব্য নয় জেমস। কোন গাড়ির দৃঢ় সংকল্প গতিকে আকস্মিক চেষ্টায় মোকাবিলা সহজ নয়। ও বিষয়ে চিন্তা করার কিছু নেই।’
কথা শেষ করেই তাকাল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘আমি তৈরি হয়ে উপরে যাচ্ছি মি. ডেভিড ইয়াহুদ। এদের এখনি গাড়িতে নিন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সবগুলো গাড়ি এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, আমি এটাই চাই।’
বলেই আইজ্যাক বেগিন উপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে চলল। অন্যদিকে ডেভিড ইয়াহুদ রিমোর্ট কনট্রোলের ‘কল’ বোতামে চাপ দিয়ে রিমোর্ট কনট্রোলকে মুখের কাছে নিয়ে বলল, ‘সাতটি গাড়িই রেডি কর। তিন চার মিনিটের মধ্যেই আমরা বেরুবো। ইট ইজ অ্যান ইমারজেন্সি। ওভার।’
রিমোর্টটা মুখ থেকে সরিয়েই চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা স্টেনগানধারীদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমাদের দু’জন এস। এদের বাঁধন খুলে দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেল। মুখে ভালো করে টেপ পেস্ট করে দাও। তারপর নিয়ে চল গ্যারেজে। আর জেমস জোসেফ, ওদিকে দেখ গাড়ি ঠিক ঠাক রেডি হচ্ছে কিনা।’
ডেভিড ইয়াহুদের কথা শেষ হবার সংগে সংগে ‘ইয়েস স্যার’ বলে জেমস জোসেফ ছুটল গ্যারেজের দিকে।
দু’জন স্টেনগানধারী ড. আন্দালুসি ও সাইমি ইসমাইলের বাঁধন খোলা শুরু করেছে।
ডেভিড ইয়াহুদ পকেট থেকে তার মোবাইল তুলে নিল। তার তর্জনি অস্থির হলো মোবাইলের ‘কী’গুলোর উপর একটা কল করার জন্যে।
৬
গোল্ডেন হর্নের একদম পশ্চিম প্রান্ত এলাকার ফ্লাইওভার-৩ জংশন দিয়ে ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাস রোডে প্রবেশ করেছিল।
বাইপাস রোড ধরে তীরের গতিতে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
ড্যাশ বোর্ডে রাখা মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল কলটা জেনারেল মোস্তফার কাছ থেকে এসেছে। আহমদ মুসা দ্রুত মোবাইলটা কানের কাছে তুলে নিল। এ সময় জেনারেল মোস্তফার ফোন নিশ্চয় কোন ছোট কারণে নয়। তারাও এই বাইপাস রোডের বিপরীত রোড ধরে আসছে। জেনারেল মোস্তফার ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাস সড়কে প্রবেশ করেছে গোল্ডেন হর্ন এলাকার জংশন নং ৫ দিয়ে। তাদের গাড়ি ছুটে আসছে পশ্চিম দিকে। তাদের গাড়ি বাইপাস রোড ধরে ৯৯ নাম্বার বাড়ির দিকে আসছে। আসছে আহমদ মুসারাও।
মোবাইল তুলে নিয়ে সালাম দিতেই ওপ্রান্ত থেকে জেনারেল মোস্তফার দ্রুত কণ্ঠ শুনতে পেল আহমদ মুসা। বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, এই মাত্র ৯৯ নাম্বার বাড়ির এলাকা থেকে আমাদের জানাল, বাড়িটা থেকে কয়েকটি গাড়ি বেরিয়ে এসেছে। তারা পালাচ্ছে।’ জেনারেল মোস্তফার উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত কণ্ঠ।
‘ওরা কোন দিকে পালাচ্ছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘জানা যায়নি। ও কথা শেষ করতে পারেনি, তার আগেই সে গোলা-গুলীর মধ্যে পড়ে যায়। সম্ভবত তার মোবাইল পড়ে যায়, কিন্তু মোবাইল বন্ধ হয়নি। আমি তার মোবাইলেও কিছুক্ষণ গোলা-গুলীর শব্দ পেয়েছি।’
‘ওদের পালাবার সম্ভাব্য রুট কি হতে পারে জেনারেল?’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিরানব্বই নাম্বার বাড়ির সামনে একটা টার্ন নেবার পাস-পয়েন্ট আছে। সুতরাং বাইপাস রোডের পূর্ব- পশ্চিম যে কোন দিকে তারা যেতে পারে।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘ঠিক আছে, আমার মনে হয় মোতায়েনরত পুলিশ ওদের গাড়িগুলোর গতিরোধ করতে চেষ্টা করেছিল এবং পুলিশ পাল্টা আক্রমণের শিকার হয়। পুলিশের ক্ষতিও হয়েছে বলে মনে হয়। এই কারণেই ওদিক থেকে ইনফরমেশন আসা বন্ধ হয়েছে।’
আহমদ মুসা কথা বলছিল এবং ইস্তাম্বুলের সিটি ম্যাপের উপরও চোখ বুলাচ্ছিল। বাইপাস রোডের ৯৯ নাম্বার বাড়ির অবস্থানটা দেখে নিয়ে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, আমার মনে হয় যদি ওরা পূর্ব দিকে গিয়ে থাকে, তাহলে এখনি ওদের সাক্ষাত আপনারা পেয়ে যাবেন।’
‘ইউ আর রাইট খালেদ খাকান। আমি দেখতে পাচ্ছি ডানের ফেরার রাস্তা দিয়ে ৪টা গাড়ি জোটবদ্ধ হয়ে ছুটে আসছে। তাদের মধ্যে একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি। সামনেই ওদিকের রাস্তায় যাবার টার্ন-পয়েন্ট। আমরা ওদের গতিরোধ করব। ওকে খালেদ খাকান।’
জেনারেল মোস্তফার মোবাইল অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা মোবাইলটা ড্যাশ বোর্ডে রেখে দুরবিনটা তুলে নিয়ে সামনের রাস্তার উপর চোখ বুলান। আহমদ মুসার এখান থেকে ৯৯ নাম্বার বাড়িটা জেনারেল মোস্তফাদের অবস্থানের তুলনায় দ্বিগুণ দূরে। আর বাইপাসের এই দিকটা গোল্ডেন হর্নের এলাকা অতিক্রম করে শহরের পশ্চিম প্রান্তের পার্বত্য উপকণ্ঠ ঘুরে উত্তরের পার্বত্য ভূমির দিকে এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল না পলাতকরা অপেক্ষাকৃত এই নিরাপদ রুট বাদ দিয়ে পূর্ব দিকে জংশন ৫-এর দিকে গেল কেন! ওদিকটার তো দক্ষিণে গোল্ডেন হর্ন ও পূর্বে বসফরাস দ্বারা ক্লোজ হয়ে গেছে। ওরা এই সময়ে গোল্ডেন হর্ন কিংবা বসফরাসের ব্রীজে উঠার ঝুঁকি নেবে, এটায় সায় দিচ্ছে না তার মন কিছুতেই।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো ওরা ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় নেয়নি তো। পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্যে তারা দু’ভাগ হয়ে দু’রুটকেই ব্যবহার করতে পারে। এতে পুলিশের প্রতিরোধ শক্তি দু’ভাগ হয়ে যাবে এবং দু’ভাগের কোনভাগে বিজ্ঞানীরা আছেন, এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়বে পুলিশরা। আরেকটা কৌশলও তারা করতে পারে। সেটা হলো, দু’রুটে যাওয়া দু’ভাগের যেভাগে বিজ্ঞানীরা থাকবেন না, সেভাগে গাড়ির সংখ্যা বেশি রেখে নিরাপত্তার বেশি ব্যবস্থা করে পুলিশের দৃষ্টি সেদিকে বেশি আকৃষ্ট রেখে অন্য ভাগে বিজ্ঞানীদের নিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এটা ভাবতে গিয়ে জেনারেল মোস্তফাদের দিকে যাওয়া ৪টি গাড়ির জোটবদ্ধ যাত্রাকে কিছুটা প্রদর্শনী বলে মনে হলো আহমদ মুসার কাছে। আহমদ মুসার এই ভাবনা ঠিক হওয়ার অর্থ এই বাইপাসের পশ্চিমমুখী রুট ধরে ওদের কোন গাড়ি কি এগিয়ে আসছে!
এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। ডান পাশে ফেরার রোডটিতে যাওয়ার জন্য সামনে এসে পড়া পাস-পয়েন্টে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।
রং সাইড দিয়েই মাঝারি গতিতে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার গাড়ি।
বাইপাস খুব ব্যস্ত নয়, কিন্তু গাড়ি চলাচল করছে খুব কমও নয়। এই গাড়ি চলাচলের মধ্যেই আহমদ মুসার গাড়ি ঠিক রাস্তার মাঝখান দিয়ে দ্বিধাহীন গতিতে এগিয়ে চলছে। সামনে থেকে আসা গাড়িগুলোই বরং আহমদ মুসার গাড়ির বেপরোয়া গতি দেখে তাদের গতি ঠিক করে নিচ্ছে।
এভাবে চলার তিরিশ সেকেন্ডও পার হয়নি। বাইপাস সড়কের ডানদিকের একটা সংযোগ রাস্তার থেকে একটা মোটর সাইকেল দ্রুত বেরিয়ে এল।
মোটর সাইকেলে একজন পুলিশ অফিসার। মাথায় হ্যাট, শোল্ডার ব্যান্ডে লাল রংয়ের ডবল ক্রিসেন্ট থেকে বুঝা যাচ্ছে ফাস্ট গ্রেডের একজন পুলিশ অফিসার সে।
পুলিশ অফিসারের মোটর সাইকেলটি বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ির রাস্তা ব্লক করে দাঁড়াল।
তার মোটর সাইকেলের সামনে পর্যন্ত গিয়ে হার্ড ব্রেক কষল আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার মোটর সাইকেল থেকে নেমে পড়েছে।
গাড়ি দাঁড় করিয়েই আহমদ মুসাও গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আহমদ মুসা ঝামেলায় পড়তে চায় না। আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলে ওদের সাথে দেখা হওয়ার খুব বেশি দেরি নেই।
গাড়ি থেকে দু’তিন ধাপ এগিয়ে পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি হলো।
আহমদ মুসা দেখল, পুলিশ অফিসারটি পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক তরুণী।
‘ম্যাডাম, আমি দুঃখিত। ইচ্ছা করেই এবং বাধ্য হয়েই আমাকে এই বেআইনি কাজটি করতে হয়েছে। আমার মনে হয় আমি বড় ধরনের একটা ঘটনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। আমি আপনার সহযোগিতা চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার মেয়েটি মাথা থেকে হ্যাট খুলল। বলল, ‘আপনি অনেকগুলো কথা বলেছেন, কিন্তু কোন কথাই আপনার আইন ভাঙার পক্ষে যুক্তি নয়। আপনি দয়া করে রাস্তায় ফিরে যান।’ পুলিশ অফিসার মেয়েটির কণ্ঠ শক্ত।
‘আপনি আইনের কথা বলেছেন ম্যাডাম, ধন্যবাদ! কিন্তু শুরুতেই ইচ্ছে করে এবং বাধ্য হয়েই আমাকে আইন ভাঙতে হয়েছে। এখনও আমি আপনার কথা মানতে পারবো না। অনেক ইমারজেন্সি আছে, যখন আইন ব্রেক করা অপরিহার্য হয়ে যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
পুলিশ অফিসার মেয়েটি তীক্ষ্ণ, গভীর দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার মুখটি সহজ হয়ে উঠল। বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি, ‘আমি বুঝতে পারছি, আপনার সব কথাই সত্য, কিন্তু আইন ভাঙা কেন অপরিহার্য তা আমি বুঝিনি। প্রতিদিন রাস্তার মানুষ ও যাত্রীদের অনেকে হাজারো অপরিহার্য সিচুয়েশনে পড়ে, কিন্তু ট্রাফিক আইন ভাঙার অনুমতি কেউ পায় না।’
‘ঠিক বলেছেন ম্যাডাম, কিন্তু আমার বিষয়টা ন্যাশনাল ইমারজেন্সির সাথে জড়িত।’
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে পুলিশ অফিসার মেয়েটির সামনে তুলে ধরল।
কার্ডের দিকে তাকিয়েই পুলিশ অফিসার মেয়েটি চমকে উঠল। দেখল, তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল মোস্তফার দস্তখতসহ প্রধানমন্ত্রীর কাউন্টার সাইন করা স্পেশাল গ্রেডের সিকিউরিটি কার্ড। এই কার্ড যার হাতে থাকে সে যা প্রয়োজন তা করার স্বাধীনতা পায় এবং সব দায় থেকে মুক্ত থাকে।
কার্ডের উপর চোখ বুলিয়েই পুলিশ অফিসার মেয়েটি এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল আহমদ মুসাকে বলল, ‘স্যরি স্যার। আপনি এখন স্বাধীন।’
‘ধন্যবাদ ম্যাডাম। নরম মনের মেয়েরাও যে কত কঠোর হতে পারে নিছক আইন রক্ষায়, তার একটা দৃষ্টান্ত আজ দেখলাম।’
আহমদ মুসা কথাটা বলে মেয়েটির দিকে মুখ তুলতেই তার চোখ মেয়েটির পেছনে সামনের রাস্তার উপরে পড়ে গেল। দেখতে পেল, তিনটি গাড়ি একই সমান্তরালে এগিয়ে আসছে। মাঝের গাড়িটি যে বুলেটপ্রুফ তা দেখেই বুঝল আহমদ মুসা। সংগে সংগে মনে পড়ল, জেনারেল মোস্তফা যে চারটি গাড়ির কথা বললেন তারও একটি বুলেটপ্রুফ ছিল। এর অর্থ এরা নিশ্চিতই কিডন্যাপারদের একটা অংশ। হতে পারে এদের সাথেই আছেন বিজ্ঞানীরা।
ওরা এসে পড়েছে।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
আহমদ মুসা দ্রুত নিজের কোট খুলে পুলিশ অফিসার মেয়েটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি পুলিশের টুপিটা খুলে ফেলুন। ইউনিফরমের উপর কোটটা পরে নিন। প্লিজ কারণ জিজ্ঞেস করবেন না।’
বলেই আহমদ মুসা প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে মেশিন রিভলবারটার স্পর্শ একবার নিয়ে দ্রুত একটু সরে গেল সড়কের উত্তর পাশের দিকে।
আহমদ মুসার কার ও পুলিশ অফিসার মেয়েটির মোটর সাইকেল সড়কের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ঐ তিনটি গাড়িও পাশাপাশি সড়কের মাঝখান দিয়ে আসছিল। অনেকটা দূরে থাকতেই তারা এটা লক্ষ্য করেই সম্ভবত গাড়ি তিনটি সমান্তরালে সারিবদ্ধভাবেই মাঝপথ এড়িয়ে সড়কের ডানপাশে মানে উত্তর পাশের দিকে সরে গেছে।
আহমদ মুসা সড়কের উত্তর পাশের দিকে একটু সরে ছুটে আসা তিনটি গাড়ির বরাবর দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে গাড়ি তিনটি থামানোর চেষ্টা করতে লাগল। আহমদ মুসার ভাবখানা এই রকম যে, তার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, এজন্যে গাড়িগুলোর সে সাহায্য চাইছে। গাড়িগুলো সাধারণ হলে এই অবস্থায় তারা অবশ্যই দাঁড়াবে। আর যদি গাড়িগুলো ডেভিড ইয়াহুদের ‘থ্রি জিরো’র হয় এবং বিজ্ঞানীকে যদি সাথে নিয়ে থাকে, তাহলে আহমদ মুসাকে পিষে ফেলে হলেও তারা সামনে এগোবে।
গাড়িগুলো তীরবেগে ছুটে আসছে। হাত তোলার পর ওদের গাড়ির গতি আরও বেড়েছে বলে মনে হলো আহমদ মুসার কাছে।
তখন গাড়ি ৫০ গজ দূরেও নয়।
আহমদ মুসা ভাবল, বুলেটপ্রুফ গাড়িটাকে বড় কোন ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে তার গতি ব্লক করে বিজ্ঞানীকে অক্ষত উদ্ধার করতে হবে।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে বিদ্যুৎ বেগে মেশিন রিভলবার বের করে আনল।
ট্রিগারে আঙুল চেপেই আহমদ মুসা রিভলবার বের করে এনেছিল। বের করেই ট্রিগার চেপে রিভলবার ঘুরিয়ে আনল ডান পাশের গাড়ির বাম চাকা এবং বাম পাশের গাড়ির ডান চাকার উপর।
গুলী করেই আহমদ মুসা নিজের দেহটাকে ছুঁড়ে দিয়ে দক্ষ এক্রব্যাটের মত নিজের দেহকে হাতের উপর কয়েকবার ঘুরিয়ে নিল। কয়েকগজ ডানে গিয়ে তার দেহ মাটির উপর পড়ে স্থির হলো।
আহমদ মুসার হাতে রিভলবার উঠতে দেখে তিন গাড়ি থেকেই তাকে উদ্দেশ্য করে গুলী করা হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষনে আহমদ মুসার দেহ তিন গাড়ির মধ্য অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল এবং দু’পাশের ব্রাশ ফায়ারের প্রবল শব্দে গতি পরিবর্তন করেছিল। তার ফলে তাদের গুলীও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়।
অন্যদিকে টায়ার বিস্ফোরণের পর দু’গাড়িই একটি বাম দিকে, অন্যটি ডান দিকে টার্ন নিয়ে একটা আরেকটার উপর আছড়ে পড়ে। মাঝের বুলেটপ্রুফ গাড়িও তাদের সাথে সামান্য ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। সম্ভবত ড্রাইভার পাশের দু’গাড়ির গতি দেখে শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষতে পেরেছিল।
আহমদ মুসার দেহ মাটিতে পড়বার সংগে সংগেই সে আবার উঠে দাঁড়াল। জাম্প করার সময় সে মেশিন রিভলবারটা ছুঁড়ে দিয়েছিল এদিকে। সেটাও পাশে পড়েছিল। উঠে দাঁড়াবার সময় রিভলবারটাও কুঁড়িয়ে নিয়েছে সে।
আহমদ মুসা পুলিশ অফিসার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি এই গাড়ির আরোহীদের একটু দেখুন, এরা যাতে আক্রমণে আসতে না পারে।’
বলেই আহমদ মুসা ছুটল বুলেটপ্রুফ গাড়িটার দিকে।
বুলেটপ্রুফ গাড়িটার ওপাশ দিয়ে দু’টি মাথা উপরে উঠতে দেখা গেল। কার মাথা স্পষ্ট হলো না আহমদ মুসার কাছে, কারণ ঐ গাড়িতে বিজ্ঞানী ডঃ আন্দালুসি এবং সাইমি ইসমাইলেরও থাকার কথা। সুতরাং রিভলবার তুলেও গুলী করতে পারলো না।
কিন্তু পরমুহূর্তেই গাড়ির উপর দিয়ে স্টেনগানের ব্যারেল দেখা গেল এবং সেই সাথে ছুটে এল গুলীবৃষ্টি।
আহমদ মুসা সংগে সংগেই বসে পড়েছিল মাটিতে এবং দু’হাঁটু বুকের সাথে গুটিয়ে নিয়ে দ্রুত ফুটবলের মত গড়িয়ে বুলেটপ্রুফ গাড়ির এপাশে চলে এল। যেহেতু ওরা গাড়ির ভিতর দিয়ে গুলী করছিল, তাই সবগুলো গুলী আহমদ মুসার মাথার অনেক উপর দিয়ে চলে যায়। আর ওরা মাথা লুকিয়ে গুলী শুরু করার কারণে আহমদ মুসার ফুটবলের মত গড়িয়ে আসাটা দেখতে পায়নি।
বুলেটপ্রুফ গাড়ির আড়াল থেকে গুলী শুরু হলে পুলিশ অফিসার মেয়েটি ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির আড়াল নিয়ে গুলী করা শুরু করেছে। এই গাড়িটাই ওদের গুলী বর্ষণের টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা বুলেটপ্রুফ গাড়ির এপাশে আশ্রয় নেয়ার পর ধীরে ধীরে এগিয়ে গাড়ির পেছন ঘুরে এসে গাড়ির ওপাশটাকে সামনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে এগোচ্ছিল।
আহমদ মুসা তখন গাড়ির পেছন দিকে টার্ন নিচ্ছিল। টার্ন নেবার সময় পেছন দিকে দৃষ্টি গিয়েছিল এমনিতেই। তাকিয়েই দেখতে পেল, দু’জন আহত লোক টায়ার ফেটে যাওয়ায় এক্সিডেন্টের মুখে পড়া এ পাশের গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। মাথা থেকে নেমে আসা রক্তে তাদের মুখ ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের হাতে রিভলবার। রিভলবার তুলছে তারা আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তার দেহটা গাড়ির পেছনে আড়াল করেই বাম হাতে মেশিন রিভলবার থেকে গুলীবৃষ্টি করল।
ওরাও গুলী করেছিল। কিন্তু আহমদ মুসার দেহ ততক্ষনে বুলেটপ্রুফ গাড়ির পেছনে আশ্রয় নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ওদের কাছে তখন আড়াল নেয়ার কিছু ছিল না। ফলে ওরা আহমদ মুসার গুলী বর্ষণের অসহায় শিকারে পরিণত হয়।
গুলী বন্ধ করেই আহমদ মুসা পেছন দিক একবার দেখে নিশ্চিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং বিড়ালের মত চলতে শুরু করল।
গাড়ির উপর দিয়ে এদের যে গুলীবর্ষণ চলছে, তাতে কিছু পরিবর্তন বুঝতে পারলো আহমদ মুসা। এখন দু’টি নয়, একটি স্টেনগান থেকে গুলী বর্ষণ চলছে। একজনের স্টেনগান থামল কেন?
সংগে সংগেই আহমদ মুসার মন বলে উঠল, আহমদ মুসার পাল্টা গুলী বর্ষণের শব্দ থেকে ওরা ধরে নিয়েছে বুলেটপ্রুফ গাড়ির এপাশে নিশ্চয় শত্রু এসে গেছে। তাই একজনকে গুলী বর্ষণে রেখে আরেকজন নিশ্চয় এদিকে আসছে।
আহমদ মুসা মেশিন রিভলবারটা ডান হাতে নিয়ে অদৃশ্য টার্গেটের দিকে স্থির করে বিড়ালের মত নিঃশব্দে দ্রুত গাড়ির পেছনটা ঘুরে গাড়ির ওপাশে টার্ন নেবার আগে গাড়ির কোণাটায় মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ট্রিগারের উপরে তর্জনীটাকে শক্ত করে এক ঝটকায় গাড়ির ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল।
ওপাশে ঘুরতেই চোখ পড়ল একজন শ্বেতাংগ চেহারার লোকের উপর। একেবারে মুখোমুখি তারা শ্বেতাংগ লোকটির হাতে উদ্ধত রিভলবার। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এরই সুযোগ গ্রহণ করল আহমদ মুসার রিভলবার। আহমদ মুসার তর্জনি ট্রিগারে চেপে বসেছে। এক পশলা গুলি গিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল শ্বেতাংগ লোকটির বুক।
গুলী করেই আহমদ মুসা তাক করল দ্বিতীয় লোকটিকে। সে গাড়ির উপর দিয়ে অদৃশ্য শত্রু লক্ষ্যে গুলী করছিল। এদিকে গুলীর শব্দ শুনে সে গুলী বন্ধ করে তার স্টেনগানটা মূহুর্তে ঘুরিযে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। আহমদ মুসার রিভলবার তখন তার দিকে হাঁ করে আছে।
আহমদ মুসা দেখল, স্টেনগানধারী লোকটি একজন তরুন। আহমদ মুসার হঠাত মনে পড়ল, কিডন্যাপারদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রকে জেফি জিনা দেখেছিল এবং ডেলিগেটদের সাথে যে ছেলেটি জেফি জিনাকে একটি ফোল্ডার দিয়েছিল যার মধ্যে ৯৯নং বাসার ঠিকানা ছিল, এই কি সেই ছাত্র।
এই চিন্তা করেই আহমদ মুসা তরুণকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি শত্রুতামূলক আচরণ না করলে আমি তোমাকে গুলী করব না। তুমি তোমার স্টেনগান ফেলে দাও। আত্নসমর্পন না কররে তোমার বাঁচার কোন সম্ভাবনা …।‘
পুলিশ অফিসার মেয়েটি আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এদিক থেকে তার লক্ষ্যে গুলী বন্ধ হওয়ায় এবং এদিকে গুলীর শব্দ শুনেই সে ছুটে এসেছিল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই তরুণটির স্টেনগানের ব্যারেল বেপরোয়াভাবে উঠে এল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসার মুখের কথা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল তার তর্জনি। চেপে ধরেছিল মেশিন রিভলবারের ট্রিগারকে। এক পশলা গুলী গিয়ে আছড়ে পড়ল তরুণটির বুকে। স্টেনগানটি হাতে ধরেই সে টলে উঠে আছড়ে পড়ল মাটিতে।
‘ধন্যবাদ মি…..’ বলল পুলিশ মেয়েটি।
‘খালেদ খাকান।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান।‘ বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি।
‘ধন্যবাদ নয়, আমি তরুণটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমি মনে করি, টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে তরূণটি।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘না, আমি এজন্যে ধন্যবাদ দেইনি। ধন্যবাদ দিয়েছি অবিশ্বাস্য ধরনের এই সফল অপারেশন দেখে।‘ বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি।
আহমদ মুসা পুলিশ মেয়েটির এই সব কথা যেন শুনতেই পায়নি।
বলল, ‘ম্যাডাম অফিসার …।‘
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই পুলিশ অফিসার মেয়েটি বলে উঠল, ‘আমার নাম আয়েশা আরবাকার।‘
নাম শুনে একটু চমকে উঠে তাকাল পুলিশ অফিসার মেয়েটির দিকে আহমদ মুসা। মেয়েটির নাম শুনে জোসেফাইনের পিএস লতিফা আরবাকানের কথা মনে পড়েছে। তার সাথে এ মেয়েটির চেহারারও মিল আছে। বলল আহমদ মুসা, ‘আপনার কি লতিফা আরবাকান নামে কোন বোন আছে?’
পুলিশ অফিসার মেয়েটি চমকে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ আছে। আপনি কি তাকে চেনেন?’
বলে এক মুহূর্ত থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তাহলে কি আপনি ম্যাডাম মারিয়া জোসেফাইনের স্বামী সেই খালেদ খাকান?’ বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। সে ম্যাডাম মারিয়া জোসেফাইন ও তাঁর স্বামী খালেদ খাকান সম্পর্কে লতিফা আরবাকানের কাছে অনেক কথা শুনেছে এবং প্রতিদিনই শুনছে। সেই খালেদ খাকান ইনি!
তার চিন্তা বেশি দূর এগোতে পারলনা। তার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘ মিস, মিসেস আয়েশা আরবাকান..।‘
এবারও পুলিশ অফিসার মেয়েটি আহমদ মুসার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘ মিস আয়েশা আরবাকান।‘ তার মুখে হাসি।
‘হ্যাঁ মিস আযেশা আরবাকান। চলুন গাড়ির ভেতরটা দেখি। সেখানে দু’জন বন্দী থাকার কথা।‘
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করেছে।
পাশাপাশি আয়েশা আরবাকানও হাঁটতে শুরু করেছে। বলল, ‘বন্দীর কথা বললেন, কারা এই বন্দী? এই বন্দী উদ্ধারের জন্যেই কি আপনার এই অভিযান?’
‘বন্দীর একজন বিজ্ঞানী এবং আরেকজন আপনাদের লোক সাইমি ইসমাইল।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘বিজ্ঞানী মানে, ড. আন্দালুসি?’ জিজ্ঞাসা আয়েশা আরবাকানের।
‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘আমি লতিফার কাছে শুনেছি উনি কিডন্যাপ হয়েছেন। সরকার অবশ্যই ঘটনা গোপন রাখায় কেউ জানতে পারেনি। গোয়েন্দা অফিসার সাইমি মিসিং হবার কথাটা বিভাগীয় সূত্রেই জানি।‘ আয়শা আরবাকান বলল।
গাড়ির দরজা খোলাই ছিল।
প্রবেশ করল দু’জনই।
গাড়ির পেছনের সিটে হাত-পা বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসী এবং সাইমি ইসমাইলকে। দু’জনের মুখই চওড়া টেপ পেস্ট করে বন্ধ রাখা হয়েছে।
ড. আন্দলুসির চেহারা বিধ্বস্ত।
দু’জনেই দেখতে পেল তাদেরকে।
আহমদ মুসার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে সামনের সিটের উপরে উঠে আহমদ মুসা ড. আন্দালুসির মুখের টেপ খুলে দিল ও হাত-পায়ের বাঁধন কেটে ফেলল। আয়েশা আরবাকানও মুক্ত করল গোয়েন্দা অফিসার সাইমি ইসমাইলকে।
মুক্ত হয়েই সাইমি ইসমাইল বলল দ্রুত কণ্ঠে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আমার ভুল না হয়ে থাকলে আপনি মি. খালেদ খাকান। আপনি তাড়াতাড়ি আন্দালুসির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। উনি অসুস্থ।‘
আহমদ মুসা বলল, ‘মিস আয়েশা আরবাকান, মিস সাইমি ইসমাইল আপনারা ড. আন্দালুসিকে সিটে শুইয়ে দিন। প্রচুর ঠান্ডা পানি খাওয়ান তাকেঁ, তাঁকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছে বুঝতে পারছি। গাড়ির দরজা বন্ধ করে এয়ারকন্ডিশনকে ফ্রিজিং পয়েন্টে নিয়ে যান। আমি জেনারেল মোস্তফা এবং নাজিম এরকেনকে ডাকছি। ওরা কাছেই আছেন।‘
বলে আহমদ মুসা ড. আন্দালুসিকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা বেরিয়ে আসার সময় ড. আন্দালুসি বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে মি. খালেদ খাকান। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না্ ওরা আমার দেহকে কষ্ট দিলেও, মন আমার আগের চেয়ে হাজার গুন বেশি তাজা ও শক্তিশালী হয়েছে।‘
আহমদ মুসার মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠেছিল। ড. আন্দালুসিকে আবার ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিল, ‘একজন মুমিনের চরিত্র এরকমই হয়ে থাকে স্যার।‘
আহমদ মুসা বেরিয়ে যেতেই সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকান দু’জনে আহমদ মুসার নির্দেশ পালনে কাজে লেগে গেল।
ড. আন্দালুসিকে শুইয়ে দিয়ে গাড়ির রেফ্রিজারেটর বক্স থেকে পানির প্লাস্টিক বতলের ৫০০ মিলিমিটারের পানি সবটুকু খাইয়ে দিল।
তাঁর বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।
পানি খাওয়ার পর ড. আন্দালুসি বলল, ‘মনে হচ্ছিল এক সাগর পানিতেও আমার তৃষ্ণা মিটবেনা। কিন্তু তোমাদের এক বোতল ঠান্ডা পানিতেই আমার তৃষ্ণা মিটে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ।‘
গাড়ির এয়ারকন্ডিশন আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিয়ে এল।
কাজ শেষ করে সাইমি ইসমাইল সিটে বসতে বসতে বলল, ‘মিস আয়শা আরবাকান ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার সৌভাগ্য যে, আপনি এই রকম একটি অপারেশনে খালেদ খাকানের সহযোগী হতে পেরেছেন।‘
হাসল আযেশা আরবাকান। বলল, ‘খালেদ খাকান সাহেব রং সাইডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাকেঁ পাকড়াও করার জন্যে মোটর সাইকেল নিয়ে রাস্তায় প্রবেশ করেছিলাম।‘
তারপর কি কি ঘটেছিল তার সব বিবরণ দিযে বলল, ‘এই অপারেশনে একটাই কাজ করেছি, সেটা হোল আপনার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে আপনাকে মুক্ত করেছি। তবে আমি সৌভাগ্যবান। তিনটি বেপরোয়া গাড়ির বিরুদ্ধে একজন মানুষের অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য এক অপারেশনের দৃশ্য দেখলাম। তীর বেগে ছুটে আসা তিনটি গাড়ির মাত্র ৫০ গজ সামনে দাঁড়িয়ে গুলী করে দু’পাশের দু’গাড়ির মধ্যে সংঘাত ঘটিয়ে রাস্তা ব্লক করা একটা শিল্পকর্মের মত নিখুঁত ও সুন্দর কারুকাজ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আমি না দেখলে এমন ঘটতে পারে তা বিশ্বাস করতামনা।‘
‘আমিও তার সম্পর্কে এমন সব কথাই শুনেছি। তবে তোমার মত কোন সৌভাগ্যের মুখোমুখি হইনি।
‘এখন বারবার আমার একটা কথাই মনে জাগছে, সেটা হলো, আসল পরিচয় তাঁর কি? আমার বোন মিসেস খালেদ খাকানের পার্সোনাল সেক্রেটারী। আমার বোন বলেছে, মিসেস খালেদ খাকান ফরাসি এবং ফ্রান্সের রাজবংশের একজন রাজকুমারী। ফ্রান্সের রাজকুমারীকে যে বিয়ে করে সে ফ্রান্সের রাজকুমার না হলেও সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে তার চেয়ে বড় কেউ নিশ্চয় হবেন। তার সিকিউরিটি কার্ডে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর এবং তার স্ত্রী প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর রাস্ট্রীয় মেহমান হিসেবে তোপকাপিতে রয়েছেন। ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট তার নিজের পিএসকে মিসেস খালেদ খাকানের পিএস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সুতরাং খালেদ খাকানের অতুলনীয় কাজের মতই তার অতুলনীয় কোন পরিচয় আছে।‘
চোখ বুজে শুয়েছিলেন বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন তিনি। বললেন, ‘তোমাদের কথা সত্য বলেই হয়তো মি. খালেদ খাকান ভিন্ন ধরনের মানুষ। উনি প্রশংসা পছন্দ করেন না। যাক, এখান থেকে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন। তোমরা দেখ, মি. খালেদ খাকান একা বাইরে গিয়ে কি করছেন।‘
‘ঠিক আছে স্যার। আমরা দেখছি ওদিকে।
বলেই দু’জন গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরিয়েই টেলিফোন করেছিল জেনারেল মোস্তফাকে। তাকে খবরটা মানে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির উদ্ধারের খবর দিলে জেনারেল মোস্তফা কয়েক মুহূর্ত বিস্ময় ও আনন্দে কথা বলতে পারেনি। তারা আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে, ‘এখানে বড় ঘটনা ঘটেছে। এসে বলব। আমরা আসছি। আপনারা সাবধান থাকবেন।‘
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার সাথে কথা বলার পর প্রথমেই এল আইজ্যাক বেগিনের লাশের কাছে। আহমদ মুসা তাকে ‘থ্রি জিরো’র ইউরোপীয় প্রধান হিসেবে চেনেন না। নামও জানে না। কিন্তু ইউরোপীয় চেহারা ও বিজ্ঞানীর বহনকারী গাড়ির প্রধান হিসেবে দেখে নিশ্চিত হয়েছে একজন খুব বড় নেতা হবেন।
আহমদ মুসা তাকে সার্চ করল। পকেট থেকে পেল মোবাইল ও একটি মানিব্যাগ। মানিব্যাগে কিছু ডলার ও টার্কিশ লিরা পেল। তার সাথে মানিব্যাগের কয়েন কেবিনে একটি সীম এবং মাইক্রো চিপ পেল আহমদ মুসা। সীম ও চিট পকেটে রেখে মোবাইলটা হাতে নিল। মেনু বাটনে চাপ দেবার জন্যে আঙুল তুলেছিল আহমদ মুসা। আঙুল মেনু বাটন স্পর্শ করার আগেই মোবাইল নতুন মেসেজের সংকেত দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসার আঙুল থেমে গেল।
মেসেজের সংকেত শেষ হবার পর আহমদ মুসা মেসেজটা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল। এই সময় আসা মেসেজ নিশ্চয় জরুরি ও গুরুত্বপূণ হবে। যিনি মেসেজ পাঠিয়েছেন, তিনি জানেন না এখানে কি ঘটেছে।
মেসেজটি ওপেন করল আহমদ মুসা। মাত্র কয়েকটি শব্দের একটি মেসেজ: Change Direction to 101 Barbaros Boulevard ম্যাসেসের শেষে প্রেরকের নাম Dy লেখা। চট করেই আহমদ মুসার মনে পড়ল Dy বর্ন দুটির অর্থ David, Yahood, এই ডেভিড ইয়াহুদ তুরস্কে ‘থ্রি জিরো’র প্রধান। তিনি একে মেসেজ পাঠিয়েছেন যে, গতি পরিবর্তন করে ১০১ বারবারোজ বুলেভার্ডে যাও। মানে বন্দী বিজ্ঞানীকে অন্য কোন ঠিকানায় যাবার কথা ছিল, শেষ মুহুর্তে কোন কারণে গন্তব্য চেঞ্জ করে নতুন ঠিকানা ১০১ বারবারোজ বুলেভার্ডে যেতে বলা হয়েছে।
গাড়ির শব্দ পেল আহমদ মুসা। মোবাইলটা অফ করে পকেটে রেখে দিল। ফিরে দাঁড়িয়ে দেখল কয়েকটি পুলিশের গাড়িসহ দু’টি কার এসে দাঁড়িয়েছে। দু’টি কারের একটি থেকে নামছে জেনারেল মোস্তফা, অন্যটি থেকে পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
আহমদ মুসা এক ধাপ, দু’ধাপ করে তাদের দিকে এগোলো। আর তারা দু’জন ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে। তারা দু’জন এক সাথেই জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘খালেদ খাকান, আপনি আমাদের সকলের গর্ব। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।‘ আর পুলিশ প্রধান বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে সবচেয়ে ভালোবাসেন, কারন আপনি সব বান্দাকে ভালোবাসেন। এজন্য বিজয় সব সময় আপনার হাতেই ধরা দেয়।‘ পুলিশ প্রধানের কণ্ঠ আবেগে ভারি হয়ে উঠেছে।
‘চলুন দেখবেন বিজ্ঞানী ড. আন্দলুসিকে।‘ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকান। তাদের উপর চোখ পড়তেই পুলিশ প্রধান সাইমি ইসমাইলকে স্বাগত জানিয়ে আয়েশা আরবাকানকে বলল, ‘তুমি এখানে কি করে?’
আয়েশা কিছু বলার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘উনি এই অপারেশনে আমার সাথী।‘
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল পুলিশ প্রধান।
আয়েশা প্রতিবাদে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘চলুন বিজ্ঞানী একা আছেন।‘
‘চলুন।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক ধাপ সামনে এগোতেই দেখতে পেল আইজ্যাক বেগিনকে। তাকে দেখেই চমকে উঠল তারা। বলল, ‘ইনি তো আইজ্যাক বেগিন। ইনি ইহুদীবাদী একটি গোপন আন্দোলনের ইউরোপীয় নেতা। কি আশ্চর্য! ইনি এস্তাম্বুলে এসেছেন এবং কিডন্যাপের সাথে ইনিও জড়িত!’
‘যে গাড়িতে বিজ্ঞানী ও সাইমি ইসমাইলকে পাওয়া গেছে, সেই গাড়িতে ইনি এবং ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজির একজন ছাত্র ছিল। এ দেখুন তার লাশ।‘ সামনের একটা লাশের দিকে ইংগিত করে বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন সামনে এগিয়ে ছাত্রটিকেও দেখল। পুলিশ প্রধান বলল, ‘চিনতে পেরেছি। এর ছবি আমাদের ছাত্র অপরাধী ফাইলে রয়েছে। এর বিরুদ্ধে রহস্যজনক গতিবিধির অভিযোগ রয়েছে।‘
‘এখানে কতজন মারা গেছে মি. খালেদ খাকান?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘গুলীতে চারজন। অন্য ছয় জন গাড়ির একসিডেন্টএ?।‘
বিজ্ঞান ড. আন্দলুসি যে গাড়িতে আছেন, সে গাড়ির পাশে সবাই এসে পৌছেছে।
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, কথা আদায়ের জন্যেই নিশ্চয় বিজ্ঞানীকে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছিল। তিনি অসুস্থ। তাকে একটু ঠান্ডায় রাখা হয়েছে। আসুন তাঁর সাথে কথা বলুন।‘
বলে গাড়ির দরজা খুলল আহমদ মুসা।
দরজা খুলতেই বিজ্ঞানী ড. আন্দলুসি উঠে বসছিলেন।
‘স্যার, আপনি শুয়ে থাকুন তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল মোস্তফা এবং পুলিশ প্রধান জনাব নাজিম এরকেন এসেছেন। তারা একটু দেখা করবেন আপনার সাথে।‘
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন গাড়ির ভেতর দিকে এগোলো। আহমদ মুসা সরে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য বসার জায়গা করে দিয়ে বলল, ‘আপনারা তার সাথে বসুন। আমি আসছি।‘
বলে আহমদ মুসা সরে এল।
একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকান। আহমদ মুসা ওদের লক্ষ্য করে বলল, ‘পুলিশ এখনি লাশগুলোকে নিয়ে যাবে। আপনার আইজ্যাক বেগিন বাদে অন্য নিহতদের পকেটগুলো সার্চ করে দেখুন। পকেটের কাগজপত্র ও মোবাইলগুলো কাজে লাগতে পারে।‘
‘ঠিক স্যার। ধন্যবাদ, আমরা দেখছি।‘
বলে ওরা দু’জন কাজে লেগে গেল।
আহমদ মুসা দাঁড়াল গাড়ি ঠেস দিয়ে। তার মাথায় একটা চিন্তা অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো, তাদের অপারেশনের একটা মধ্যবর্তী সময় তারা গন্তব্য পরিবর্তন করল কেন? হঠাত তার মনে হলো, ডেভিড ইয়াহুদের ওখানে কি ঘটেছে তার মধ্যে এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত থাকতে পারে, কারণ ডেভিড ইয়াহুদই গন্তব্য চেঞ্জ করেছেন।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন এল এ সময়। আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, আপনি টেলিফোনে বলছিলেন যে, ওখানে কি একটা নাকি ঘটেছে?’
‘হ্যাঁ, সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে খালেদ খাকান। এখনি ছুটতে হবে প্রধানমন্ত্রীর ব্রিফিং-এ। আমাদের অসুস্থ প্রধান বিচারপতি মিলিটারি এ্যাম্বুলেন্সে সামরিক হাসপাতালে যাচ্ছিলেন, ওরা পালানোর পথে এই এ্যাম্বুলেন্স কিডন্যাপ করেছে। দু’তিন মিনিট পরেই ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাশ সড়কের ওপ্রান্তের জংশন এলাকা থেকে খবর এল, সেখানে রাস্তার পাশে মিলিটারী এ্যাম্বুলেন্সকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ‘ওরা মানে এই আইজ্যাক বেগিনের কিডন্যাপাররা?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘হ্যাঁ ওদের চারটি গাড়ির তিনটিই আমাদের পুলিশের হাতে পড়ে। ধরা পড়া নিশ্চিত যেনে ওরাই ওদের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং সবাই মারা পড়ে। কিন্তু বুলেটপ্রূফ গাড়িটা আমাদের তিনজন পুলিশের লাশের উপর দিযে পালাতে সক্ষম হয়। ওরাই কিডন্যাপ করে এ্যাম্বুলেন্সটিকে।‘ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘এ্যাম্বুলেন্সকে কিডন্যাপ করল কেন? ওরা কি জানত যে, এ্যাম্বুলেন্সে প্রধান বিচারপতি আছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, ওরা বুলেটপ্রুফ গাড়ি ছেড়ে দিয়ে এ্যাম্বুলেন্স নিয়েছিল। জংশন-৬ এলাকা নিরাপদে পার হবার জন্যেই তারা এ্যাম্বুলেন্সের কভার নিয়েছিল।‘ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘বুঝলাম, প্রধান বিচারপতির পরিচয় পাবার পর তারা তাকেঁ কিডন্যাপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তাঁকে দিয়ে কি করবে ওরা? ড. আন্দালুসীকে কিডন্যাপ করার সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। তাঁর ক্ষেত্রে তো এরকম কোন কারণ নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘তাদের পরিত্যাক্ত মিলিটারী এ্যাম্বুলেন্সে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টা অবিলম্বে পরিত্যাগ করতে হবে। তার প্রমাণ হিসেবে অবিলম্বে খালেদ খাকানকে তুরস্ক থেকে বহিস্কার করতে হবে। এ দু’টি নির্দেশ মানা না হলে প্রধান বিচারপতিকে হত্যা করা হবে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখন তাহলে কি? বিজ্ঞানী তো উদ্ধার হয়ে গেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এখন ভয় হলো, ক্রুদ্ধ হয়ে তারা যেন প্রধান বিচারপতিকে হত্যা না করে বসে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা। চোখে-মুখে তার উদ্বেগ।
আহমদ মুসা কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। এ সময়েই বেজে উঠল জেনারেল মোস্তফার টেলিফোন।
‘এক্সকিউজ মি!’ বলে জেনোরেল মোস্তফা মোবাইল তুলে নিল। মোবাইল স্ক্রীনে প্রধানমন্ত্রীর নাম্বার দেকে চমকে উঠে মুখের কাছে মোবাইল এনে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার, আমি মোস্তফা কামাল। কিছু আদেশ স্যার?’
ওপার থেকে প্রধানমন্ত্রী কথা বলল। ওপারের কথা শুনে বলল, ‘স্যার, ড. আন্দালুসি এখন ভালো আছেন।’
ওপার থেকে প্রধানমন্ত্রী আবার কথা বলল। তার কথা শুনে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘স্যার, এখনি তাঁকে বলছি। জি স্যার, ব্রিফিং-এ আমি তাঁকেও নিয়ে আসব। তিনি আমার পাশেই আছেন স্যার।’
‘জি স্যার, তাকে মোবাইল দিচ্ছি।’ বলল ওপারের কথা শুনে জেনারেল মোস্তফা।
জেনারেল মোস্তফা মোবাইলটি আহমদ মুসার দিকে তুরে ধরে বলল, ‘জনাব খালেদ খাকান, মহামান্য প্রধানমন্ত্রী।’
আহমদ মুসা মোবাইলটি হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দিয়ে বলল, ‘আপনি ভালো আছেন স্যার?’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি যা করেছি, আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে সেও নিশ্চয় তা পারতো।’ বলল আহমদ মুসা ওপারের কথা শুনে।
‘এক্সকউজ মি স্যার, আমি মনে করি ওদের ফলো করাই এখন প্রথম কাজ। আমি একটা পরিকল্পনা অলরেডি করে ফেলেছি।’ ওপারের কথা শুনে বলল আহমদ মুসা আবার।
‘ধন্যবাদ স্যার, মহামান্য প্রেসিডেন্টকে আমার সালাম দেবেন। নিশ্চয় দু’একদিনের মধ্যেই আমি আপনাদের সাথে দেখা করব।’ বলল আহমদ মুসা আবার।
‘দোয়া করুন স্যার, আমি যা ধারণা করেছি তা যেন ঠিক হয়। আমি জনাব জেনারেল মোস্তফাকে টেলিফোন দিচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম।’
আহমদ মুসা মোবাইলটা আবার জেনারেল মোস্তফাকে দিল।
জেনারেল মোস্তফা টেলিফোন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে ‘জি’ ‘জি’ করে অবশেষে বলল, ‘স্যার, মি. খালেদ খাকান অবশ্যই সব ব্যাপারে স্বাধীন স্যার। আমরা তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। তাঁর সাথে পরামর্শ করেই আমরা আসছি স্যার।’
সালাম দিয়ে মোবাইল রেখে দিল জেনারেল মোস্তফা। মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘প্রধান বিচারপতির কিডন্যাপের বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন, সে বিষয়ে সহযোগিতা করাকেই আমাদের প্রধান কাজ বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলুন মি. আহমদ মুসা আমরা কি করতে পারি?’
‘ঘটনার পর আইজ্যাক বেগিনের মোবাইল নিয়ে আমি যখন ‘মেনু’ উইনডো ওপেন করতে যাচ্ছিলাম, তখন একটা মেসেজ আসে তার মোবাইলে। মেসেজে একটা নতুন ঠিকানা দেয়া হয়েছে। সব কার্যকারণ বিচার করে আমার মনে বলছে, এই ঠিকানায় আমরা প্রধান বিচারপতিকে পাব। এই ঠিকানাকেই আমি এখন টার্গেট করতে চাচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনসহ সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল পুলিশ প্রধান,‘ঠিকানাটা কি?’
‘১০১ বার্বারোস বুলেভার্ডে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার মুখে ঠিকানাটা উচ্চারিত হতেই সাইমি ইসমাইলের চোখে-মুখে চাঞ্চল্য দেখা দিল। সে বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে,‘স্যার এ সম্পর্কে আমিও একটা তথ্য দিতে পারি।’
সবাই তাকাল সাইমি ইসমাইলের দিকে।
‘ওয়েলকাম মিস সাইমি ইসমাইল, বলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমাদেরকে আজ যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, তখন আইজ্যাক বেগিনের মোবাইলে একটা কল আসে। তিনি কলটি রিসিভ করে এ কথাগুলো বলেছিলেন, ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ড রেডি? ধন্যবাদ। আমাদের লক্ষ্য এখন পিয়েল পাশা বুলেভার্ড। এটা কাছে।’ সাইমি ইসমাইল বলল।
‘ধন্যবাদ সাইমি ইসমাইল। আপনার এই তথ্য ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ডকে কনফার্ম করল। আসলে শুরুতে গন্তব্য পিয়েল পাশা বুলেভার্ড ছিল। কিন্তু সম্ভবত তাদের গাড়ি বহর আক্রান্ত হওয়া এবং প্রধানবিচারপতিকে কিডন্যাপ করায় পিয়েল পাশা বুলেভার্ড কাছে বলেই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়, অথবা সেখানে অন্য কোন অসুবিধা দেখা দেয়, তার ফলেই তারা গন্তব্যস্থান হিসেবে ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ডকে ঠিক করে।’ থামল আহমদ মুসা।
সংগে সংগেই পুলিশ প্রধান প্রধান নাজিম এরকেন বলে উঠল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ঠিকানা সম্পর্কে আপনার কথা ঠিক। এখন আমাদের কি করণীয় স্যার?’
‘দয়া করে ১০১ বার্বারোস ঠিকানাটার চারপাশে আপনাদের লোকদের সাদা পোশাকে এমনভাবে অবস্থান নিতে বলুন, যাতে কারও মনে সামান্য সন্দেহের উদ্রেকও না হয়। এ ঠিকানায় ঢুকতে কাউকে তারা বাধা দেব না। কিন্তু কেউ বেরুলে তাকে ফলো করবে এবং নিরাপদ জায়গায় তাকে আটক করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অল রাইট’ বলে পুলিশ প্রধান একটু সরে দাঁড়িয়ে তার পকেট থেকে মিনি অয়্যারলেস বের করে নির্দেশ দিতে শুরু করল।
‘এরপর করণীয় কি মি. খালেদ খাকান?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘আমাদের লক্ষ্য হলো, প্রধান বিচারপতিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল, তারপর বলল, ‘বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি ওদের হাত ছাড়া হওয়া এবং আইজ্যাক বেগিনের পরিণতির কথা জানতে পারলে ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হবে। রাগের মাথায় ওরা প্রধান বিচারপতির ক্ষতি করতে পারে। এই সম্ভাবনা রোধের জন্যে অবিলম্বে তাকে উদ্ধারের পদক্ষেপ নিতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
‘আপনি কি উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে কিছু ভেবেছেন?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের।
‘উদ্ধার অভিযান এমন হবে যা শেষ মুহূর্তের আগে ওরা টের পাবে না। টের পেলে ওরা মরিয়া হয়ে প্রধান বিচারপতিকে হত্যাও করে ফেলতে পারে। উদ্ধার অভিযানের বিষয় যখন তারা টের পাবে, তখন তাদের করার কিছুই থাকবে না, এই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।’ আহমদ মুসা আহমদ মুসা বলল।
‘সে ব্যবস্থার কথাই ভাবুন মি. খালেদ খাকান।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
চোখ বন্ধ করেছিল আহমদ মুসা। ভাবছিল সে।
জেনারেল মোস্তফা থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, দু’একজনকে ঐ বাড়িতে ওদের অলক্ষ্যে প্রবেশ করতে হবে। তাদের কাজ হবে প্রধান বিচারপতিকে সাহায্য করা, নিরাপদ করা। তারা সংকেত দিলে, তারপর ঐ ঠিকানায় সর্বাত্মক অভিযান পরিচালিত হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
সবাই নিরব।
ভাবছে সবাই।
সব শেষে সবাই তাকাল আহমদ মুসার দিকেই। জেনারেল মোস্তফা বলল,‘এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চয় কিছু ভাবছেন মি. খালেদ খাকান?’
‘আমাকে ওরা তুরস্ক ছাড়া করতে চাচ্ছে, আমিই আগে দেখা করতে চাই ওদের সাথে।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখভরা হাসি।
কিন্তু হাসতে পারল না আর কউ। বলল জেনারেল মোস্তফা,‘আপনি একা?’
‘ওদের নজর এড়াবার জন্যে একাই সবচেয়ে ভালো। তাছাড়া এই মুহূর্তে দ্বিতীয় জনের সিলেকশন মুস্কিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জেনারেল তাহির তারিক আংকারা থেকে ফিরেছেন, তাঁর সাথে কি একটু কথা বলবেন?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘সময় কম। এই সময়ে তার উদ্বেগ বাড়িয়ে লাভ নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি খুব সামান্য একজন কমান্ডো। আমি ও আমার সাথীরা সেদিন বিজ্ঞানী স্যারের কিডন্যাপ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছি। এরপরও আমি কি আমার সহযোগিতা অফার করতে পারি?’ বলল সাইমি ইসমাইল।
‘বোন ভাইকে এমন সহযোগিতা অফার করাটাই স্বাভাবিক। সেদিন তোমরা ব্যর্থ হওনি বোন। তুমি ছাড়া সবাই তো সেদিন জীবন দিয়েছে। বিজ্ঞানীর স্ত্রী মনে না করলে তোমাকেও ওরা মেরে ফেলত। সেদিন দিনটা ওদের ছিল, পরিকল্পনাও ছিল ওদের। তাই বিজয়ও ওদের হয়েছে। কিন্তু তোমরা সেদিন ব্যর্থ হওনি।’আহমদ মুসা বলল।
আবেগে মুখ ভারি হয়ে উঠেছিল সাইমি ইসমাইলের। তার দুধে-আলতা রংয়ের গালে স্ফটিকের মত দু’ফোটা অশ্রুও নেমে এসেছিল।
বলল, ‘তাহলে কি ভাইয়ের সাথী হতে পারব আমি?’ আবেগরূদ্ধ কণ্ঠ সাইমি ইসমাইলের।
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘আমাদের ঐতিহ্য হলো, এ ধরনের লড়াই-এ বোনরা শুরুতেই শামিল হয় না। বিবি খাওলাদের ডাক পড়ে যুদ্ধের পরিনতি পর্বে। জেনারেল মোস্তফা ও জনাব নাজিম এরকেনের সাথে আজকে তুমিও থাকবে যুদ্ধের সমাপ্তি টানার অভিযানে।’
‘ধন্যবাদ। কষ্ট হলেও ভাইদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া বোনদেরও ঐতিহ্য।’ বলল সাইমি ইসমাইল চোখ মুছতে মুছতে।
‘আরেক বোনের তো কথা বলা হচ্ছে না! বোনরা সবসময় আবদার করেই কি অধিকার আদায় করবে?’ বলল আয়েশা আরবাকান।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তুমি তো আমার সাথেই আছ। তোমার দুই রিভলবারের সবগুলো গুলিই তুমি খরচ করেছ এই অভিযানে। আমি মোস্তফা ও জনাব নাজিম এরকেনের কাছে তোমার নামও রিকমেন্ড করব এই অভিযানে শামিল করার জন্য।’
‘জনাব খালেদ খাকান, আয়েশা আরবাকানও আমাদের মহিলা কমান্ডো ইউনিটের একজন চৌকশ সদস্য। তাকে আমরা ওয়েলকাম করব এই অভিযানে।’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
‘ধন্যবাদ মি. নাজিম এরকেন।’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল জেনারেল মোস্তফার দিকে। বলল, ‘আমার গাড়ি ওরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন। আমি এখনি বের হতে চাই।’
‘চলুন, আমরা ড. আন্দালুসিকে নিয়ে মিলিটারী হাসপাতাল পর্যন্ত একসাথে যাই। ওখানেই একটা ভাল গাড়ি আপনার জন্য থাকবে। প্রয়োজনীয় কমব্যাট ব্যাগও পাবেন তাতে।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই জেনারেল মোস্তফা আবার বলল, ‘আমি ভাবছি, আপনি ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ড ঠিকানায় পৌঁছে আমাদেরকে একটা সঙ্কেত দেবেন। আপনার সঙ্কেত পাওয়ার পর আমরা ওদিকে মুভ করব। যাতে আপনি বাড়িতে প্রবেশের বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে আমরা সেখানে পৌঁছতে পারি।’
‘ধন্যবাদ, ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চলুন আমরা মুভ করি হাসপাতালের দিকে।’
‘চলুন। মি. খালেদ খাকান আপনি সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকানকে নিয়ে ড. আন্দালুসির সাথে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে বসুন। সাইমি ইসমাইলই গাড়িটা ড্রাইভ করবে।’
বলে জেনারেল মোস্তফা তার গাড়ির দিকে এগোলো। অন্যেরাও এগোলো তাদের গাড়ি লক্ষ্যে।
স্টার্ট নিল সবগুলো গাড়ি।
জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের গাড়ি সবার আগে। তারপরে বিজ্ঞানীকে নিয়ে আহমদ মুসাদের বুলেটপ্রুফ গাড়ি। সবার পেছনে পুলিশের দুটি গাড়ি।
গাড়ির ছোট্ট বহরটি এগিয়ে চলল মিলিটারী হাসপাতালের দিকে।
৭
একশ’ এক বার্বারোস বুলেভার্ড-এর ৪ তলা বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের একটা প্রশস্ত কক্ষে বসে আছে ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
মাথার চুল তার উস্কো-খুস্কো। মুখ শুকনো। চোখদুটি লাল। ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ডাক্তার এসে একবার চেক করে গেছে।
দু’ঘন্টা ধরে বসে আছে এই চেয়ারে। তেলআবিব, ইউরোপের কয়েকটি রাজধানী ও ওয়াশিংটনে অনেকগুলো টেলিফোন করেছে এই দু’ঘন্টায়। জানিয়েছে সে ‘থ্রি জিরো’র মহাবিপর্যয়ের কথা। বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে কিডন্যাপ করতে পারার তাদের সাফল্যের কথা। একদিন আগে আইজ্যাক বেগিনও এভাবেই তেলআবিব, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি রাজধানীর গুরুত্বপুর্ণ মহলকে এ কথাগুলো জানিয়েছিল। তারা অভিনন্দন জানিয়েছিল আইজ্যাক বেগিন ও ড. ডেভিড ইয়াহুদকে এবং আশা করেছিল যে, সোর্ড-এর ফর্মুলা হস্তগত করা সম্ভব হবে, যা তাদেরকে গোটা দুনিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অকল্পনীয় এক সুযোগ এনে দেবে। আইজ্যাক বেগিন ও ড. ডেভিড ইয়াহুদ তাদের নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিল, তার স্ত্রীকেও যখন আমরা আটক করতে পেরেছি, তখন সাফল্য সম্পর্কে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। একদিন, দুদিন, তিনদিন, কয়দিন সে নির্যাতন সহ্য করবে। নিজে সহ্য করত্রে পারলেও তার চোখের সামনে স্ত্রী লাঞ্ছিত হবার বিভৎস দৃশ্য সে কয়দিন সহ্য করবে! সে মুখ খুলবে, খুলতেই হবে। শুধু তাই নয় তাকে আমাদের ল্যাবরেটরীতে বশংবদের মত কাজ করতে বাধ্য করা হবে। এধরনের কত আশার কথাই না ড. ডেভিড ইয়াহুদ তেলআবিব, ইউরোপ ও আমেরিকার তাদের মুরুব্বীদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু সবই ভণ্ডুল হয়ে গেল। খোদ আইজ্যাক বেগিন নিহত হলেন এবং বিজ্ঞানীকে তারা উদ্ধার করে নিয়ে গেল। সব আশায় গুঁড়েবালি পড়ে গেল! কেন এমনটি হল? আমাদের গোপন ঠিকানার সন্ধান ওরা কি করে পেল? আর উদ্ধার করার ব্যাপারটা এক অসম্ভব কাহিনী। ৬ জন লোক নিজেদের গাড়ির মধ্যকার দুর্ঘটনায় মারা গেছে, ৪ জন গুলিতে। যে রিপোর্ট সংগ্রহ হয়েছে, তাতে মাত্র একজন লোক এই সর্বনাশটা করেছে। কে এই লোক আমরা জানি। ওরা পরিচয় ভাড়িয়ে বলে খালেদ খাকান, আমরাও বলি। বলি এই কারণে যে, খালেদ খাকান নামেই যদি তাকে শেষ করে দেয়া যায়, সেটাই ভালো। তাছাড়া ‘আহমদ মুসা’ নামটা প্রকাশ পেলে ওই পক্ষের ও সাধারণ মানুষের সাহস আরও বাড়বে। আর আমাদের হতাশা তাতে বাড়বে।
এই খালেদ খাকান ব্যাটা আমাদের লোকদের খবর, আমাদের ঘাঁটির ঠিকানা একের পর এক পেয়ে যাচ্ছে কি করে? এ পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে সে যত অভিযান করেছে, সবগুলোই ছিল সুনির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে। কোথা থেকে পাচ্ছে এই খবরগুলো সে।
দুঃখের মধ্যেও ড. ডেভিড ইয়াহুদের সান্তনা হলো, তেলআবিব, ইউরোপ, আমেরিকা তাকে সাহস দিয়েছে। যে কোন মূল্যে সোর্ড-এর ফর্মুলা হাত করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে বিজ্ঞানীদের সমেত রোমেলী দূর্গ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। সে ব্যবস্থাও তারা করেছে। ড. ডেভিড ইয়াহুদরা গ্রীন সিগন্যাল দিলেই তারা কাজ শুরু করবে। তার জন্য আরেকটা আশার কথা হল এনজিও’র পরিচয়ে ইউরোপ থেকে কিছু চৌকশ জনশক্তি পাঠানো হয়েছে তাকে সাহায্য করার জন্য। এটা তার জন্য খুব বড় একটা সুখবর। আহমদ মুসা আসার পর তার হাতে ‘থ্রী জিরো’র মূল্যবান জনশক্তি নষ্ট হয়েছে, যার সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে।
শেষের চিন্তাগুলো উজ্জ্বীবিত করল ড. ডেভিড ইয়াহুদকে।
এসময় ঘরে প্রবেশ করল শীর্ষ গোয়েন্দা স্মার্থা ও নতুন অপারেশন চীফ সোলেমান স্যামসন।
তারা ঘরে ঢুকতেই ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল, ‘প্রধান বিচারপতির খবর কি?’
‘এই গ্রাউন্ডফ্লোরের এক সেলে তাকে রাখা হয়েছে। সেলে গ্রীলের গেট। দু’জন স্টেনগানধারীকে সেখানে পাহারায় রাখা হয়েছে। আর গ্রাউন্ডফ্লোর থেকে আন্ডারগ্রাউন্ডের সিঁড়িমুখেও দু’জন পাহারায় রাখা হয়েছে।’ বলল সোলেমান স্যামসন।
‘বাড়ির বাইরে কি অবস্থা?’ জিজ্ঞাসা ড. ডেভিড ইয়াহুদের।
‘বাড়ির গেটবক্সে পাহারায় থাকবে দু’জন স্টেনগানধারী। আর ৪ জন ছদ্মবেশে বাড়ির চারিদিকে নজর রাখবে। বাড়ির সামনে যেখান থেকে প্রাইভেট রাস্তা বাড়ির গেট পর্যন্ত এসেছে, সেখানে বড় রাস্তার বার্বারোস বুলেভার্ডের একটি তেমাথা। এখানে বিপরীত দিক থেকে আরেকটি রাস্তা এই বুলেভার্ডের সাথে মিশেছে। এই তেমাথায় একটা কক্ষ ভাড়া নিয়ে একটা ইনফরমেশন সেন্টার খুলে স্মার্থা বসছে। সেখানে বসে বুলেভার্ডসহ বাড়ির তিনদিকে সে নজর রাখতে পারবে।’ বলল সোলেমান স্যামসন।
‘ধন্যবাদ। প্রধান গেট ছাড়া ডুপ্লেক্সে ঢোকার কি আর কোন পথ আছে?’
‘না স্যার, এই ডুপ্লেক্সে প্রাইভেট কোন এক্সিট নেই।’
‘ঠিক আছে, চল আমরা প্রধান বিচারপতির ওখানে যাই। চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। প্রধান বিচারপতির কিডন্যাপকে কাজে লাগাতে হবে। বিজ্ঞানী আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। এখন খালেদ খাকানকে তুরস্ক থেকে তাড়াতে হবে। প্রধান বিচারপতিকে এই দাবি আদায়ের পণবন্দি বানাতে চাই। প্রধান বিচারপতির এই মর্মে বিবৃতি আদায় করতে হবে যে, জনৈক খালেদ খাকানকে তুরস্ক থেকে না তাড়ালে আমার মুক্তির সম্ভাবনা নেই। প্রধান বিচারপতির এই বিবৃতি সরকারের কাছে এবং সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে পাঠাতে হবে। জনগণের পক্ষ থেকেও দাবি উঠাতে হবে যে, একজন খালেদ খাকানের জন্যে প্রধান বিচারপতির এই অবস্থা চলতে দেয়া যেতে পারে না। তাদের তরফ থেকে দাবি উঠাতে হবে, খালেদ খাকানকে বহিষ্কার করে প্রধান বিচারপতিকে মুক্ত করা হোক।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ধন্যবাদ স্যার। চমৎকার একটা কৌশল বের করেছেন। এভাবে চাপ সৃষ্টি করে, গণদাবি তুলে যদি তুরস্ক থেকে খালেদ খাকানকে বহিষ্কার করা যায়, তাহলে বিরাট লাভ হবে আমাদের। আমাদের লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়ে যাবে।’
‘চল যাই।’ বলে উঠে দাঁড়াল ডেভিড ইয়াহুদ।
উঠে দাঁড়াল সোলেমান স্যামসন ও স্মার্থা।
বেরিয়ে এল তারা ঘর থেকে।
আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের যে সেলে প্রধান বিচারপতি বন্দী আছে, সে সেলের পেছনে এসে দাড়াল তিনজন। সেলের দেয়ালের হাংগার থেকে তিনজনই আপাদমস্তক কাল পোশাক পরল এবং মুখে পরল মুখোশ।
সেলের পাহারায় থাকা দু’জন গার্ড আগেই দেখতে পেয়েছিল তাদের তিনজনকে। ওরা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই সেলের দরজা তারা খুলে দিল।
সেলে প্রবেশ করল তিনজন।
প্রধান বিচারপতি খাটিয়ায় শুয়ে ছিল। মুখোশ পরা তিনজন ঘরে ঢুকতেই প্রধান বিচারপতি উঠে বসলো।
প্রধান বিচারপতি ঋজু গড়নের হাল্কা-পাতলা মানুষ, কিন্তু লম্বা হবেন প্রায় ৬ ফুটের মত। সহজ-সরল চেহারার ভদ্রলোক মানুষ।
জল্লাদের পোশাক পরে তিনজনকে ঘরে ঢুকতে দেখে ভীতির একটা ছাপ তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে।
বেডের সামনে একটাই চেয়ার। ড. ডেভিড ইয়াহুদ চেয়ারটিতে বসতে বসতে বলল, ‘অনুমতি ছাড়াই বসলাম স্যার, আপনি তো এখন প্রধান বিচারপতি নন।’
একটু থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। তারপর পকেট থেকে রিভলবার বের করেই প্রধান বিচারপতির দিকে পরপর দু’টি গুলী করল। একটা গুলী প্রধান বিচারপতির মাথার ডান পাশে, দ্বিতীয় গুলী মাথার বাম পাশের চুল ছুঁয়ে চলে গেল।
ভীষণভাবে চমকে উঠেছে প্রধান বিচারপতি। কেঁপে উঠেছে তাঁর দেহ। প্রবল আতঙ্ক চোখে-মুখে।
ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল, ‘স্যার, গুলী দু’টি ভেতরদিকে আর আধা ইঞ্চি করে সরে এলে আপনার মাথা গুঁড়ো হয়ে যেত এবং আপনি লাশ হয়ে যেতেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, মৃত্যুটা আপনার কত কাছাকাছি। আপনি যদি আমাদের সহযোগীতা না করেন, তাহলে পরের গুলী মাত্র আধা ইঞ্চি মাথার দিকে সরে আসবে।’
থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘কি সহযোগীতা?’ শুকনো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল প্রধান বিচারপতি।
‘একজন লোককে তুরস্ক থেকে বহিষ্কারে সাহায্য করতে হবে।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘কে সেই লোক?’
‘লোকটির নাম মি. খালেদ খাকান।’
‘কে সে?’
‘সে তুরস্কের লোক নয়।’
‘আমি তাকে চিনি না। আমাকে কি করতে হবে?’
‘আমরা তাকে চিনি। আমাদের জন্য সে সাংঘাতিক ক্ষতিকর। তার বহিষ্কারের উপর আপনার মুক্তি নির্ভর করছে। অতএব, সরকারের কাছে আপনি একটা আবেদন জানাবেন যে, তাকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে আমাদের দাবি সরকার যেন মেনে নেন।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘তাকে বহিষ্কার করা হবে কেন? সে কি বৈধভাবে তুরস্কে নেই? আমি একটা অন্যায় দাবি কিভাবে করতে পারি?’ বলল প্রধান বিচারপতি।
‘আপনি বাঁচার জন্য করতে পারেন। আপনি সরকারকে বলুন, তাকে বহিষ্কার করার উপর আপনার প্রাণে বাঁচা ও নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে বাঁচা নির্ভর করছে। আপনাকে এই আপিল করতে হবে করুণ সুরে, যেন আপনি অপরিসীম নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্যে এই বিবৃতি দিচ্ছেন।’
বলেই ড. ডেভিড ইয়াহুদ পেছনে দাঁড়ানো সাথীদের একজনকে লক্ষ করে বলল, ‘স্যামসন, রেকর্ডার বের করে তাঁর বক্তব্য রেকর্ড কর।’
সঙ্গে সঙ্গেই স্যামসন কাল আলখেল্লার ভেতর থেকে রেকর্ডারসহ হাত বের করে এগোলো প্রধান বিচারপতির খাটিয়ার দিকে। সে প্রধান বিচারপতির সামনে খাটিয়ায় বসল। রেকর্ডার অন করে তা তুলে ধরল প্রধান বিচারপতির মুখের কাছে।
প্রধান বিচারপতির হাত দিয়ে রেকর্ডারটি পাশের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘আমি একজন বিচারপতি। নিছক প্রাণ বাঁচাবার জন্যে একজন নির্দোষ লোক সম্পর্কে এমন দাবি আমি করতে পারি না।’
চেয়ারে বসা লোকটির হাতের রিভলবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে এল প্রধান বিচারপতির লক্ষ্যে। তার সাথে সাথে একটা গুলীও বর্ষিত হল। এবার ফাঁকা গুলী নয়। প্রধান বিচারপতির বাম হাতের কাঁধ-সন্ধিস্থলের এক খাবলা গোশত তুলে নিয়ে গুলীটা বেরিয়ে গেল।
প্রধান বিচারপতি আর্তনাদ করে উঠে ডান হাত দিয়ে বাম কাঁধ চেপে ধরল।
‘এই গুলীটা নমুনা গুলী ছিল। এরপর বুক ভেদ করে গুলী চলে যাবে। এবার বক্তব্যটা দিন। যে আর্তস্বরে চিৎকার করলেন, সেই আর্তস্বরেই একটা বক্তব্য দিন।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘কিন্তু আমি প্রাণভয়ে একজন নির্দোষ মানুষের ক্ষতি করতে পারব না।’ বলল প্রধান বিচারপতি। বেদনার্ত তার কণ্ঠ।
‘সামসন, রেকর্ডারটি স্মার্থাকে দিয়ে চাবুকটা নিয়ে এস। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না।’ নির্দেশ দিল চেয়ারে বসা লোকটি।
চাবুক নিয়ে এল স্যামসন।
‘চাবুক চালাতে থাক, যতক্ষণ না বক্তব্য রেকর্ড করতে রাজী হয়।’
বলে চেয়ার নিয়ে দরজার কাছে সরে বসল ডেভিড ইয়াহুদ। স্মার্থাও।
চাবুক চলল প্রধান বিচারপতির পিঠে, বুকে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানে। প্রথম কয়েক ঘা মুখ বুজে সহ্য করল। কিন্তু তারপরেই তার মুখ থেকে বুক ফাটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসতে লাগল।
চাবুক কিন্তু থামল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই দেহটা ঝিমিয়ে পড়ল প্রধান বিচারপতির। চিৎকারের শক্তিও আর থাকল না।
চেয়ারে বসা ড. ডেভিড ইয়াহুদ স্যামসনকে থামতে নির্দেশ দিল। তারপর চেয়ার নিয়ে এগিয়ে এল ডেভিড ইয়াহুদ প্রধান বিচারপতির নেতিয়ে পড়া দেহের কাছে। বলল, ‘স্যরি, আমরা এই খারাপ কাজটা করতে চাইনি। আপনিই বাধ্য করেছেন স্যার। বক্তব্যটি দিয়ে দিন। বক্তব্যটি দিলে কয়েকদিনের মধ্যেই আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন।’
প্রধান বিচারপতি চোখ খুলল। বলল, ‘বলেছি তো, আমি একজন বিচারপতি। নির্যাতনের ভয়ে, মৃত্যু-ভয়ে এধরনের বক্তব্য আমি দিতে পারি না। পারব না।’
‘প্রধান বিচারপতি মহোদেয়! মৃত্যুর চেয়েও বড় শাস্তি আমরা দিতে পারি। আমরা কি সে ব্যবস্থাই করব?’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না, যে মৃত্যুকে ভয় করেনা, তাকে আর কি দিয়ে ভয় দেখাবে?’ প্রধান বিচারপতি বলল।
‘আছে। আপনার স্ত্রী-কন্যাকে ধরে আনা হচ্ছে। সহ্য করতে পারবেন, আপনার চোখের সামনে তাদের লাঞ্চনা?’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
চোখ খুলল প্রধান বিচারপতি। তার চোখে মুখে আতঙ্ক। বলল, ‘তারা নির্দোষ, নিরীহ, আমার দোষ তাদের ঘাড়ে চাপাবেন কেন? না, এটা তোমরা পার না।’ উদ্বেগ-আতঙ্কে ভেঙ্গে পড়া কণ্ঠ প্রধান বিচারপতির।
ডেভিড ইয়াহুদ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি যাচ্ছি আপনার স্ত্রী-কন্যাকে আনার ব্যবস্থা করতে।’
বলে ডেভিড ইয়াহুদ তাকাল স্যামসনের দিকে। বলল, ‘তাঁকে দশ মিনিট সময় দাও। এ সময়ের মধ্যে তিনি যদি বক্তব্য দিতে রাজী হন, তাহলে আমাকে টেলিফোন করবে। আমি তাহলে তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে ধরে আনার ব্যবস্থা নিয়ে এগোবো না। তোমার টেলিফোন না পেলে বুঝবো উনি রাজী হন নি।’
স্যামসনকে এই নির্দেশগুলো দিয়ে ড. ডেভিড ইয়াহুদ আবার তাকাল প্রধান বিচারপতির দিকে। বলল, ‘প্রধান বিচারপতি মহোদয়! দশ মিনিটের মধ্যে রাজী না হলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে আপনার স্ত্রী-কন্যাকে আপনি এখানে দেখতে পাবেন।’
বলেই কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে ডেভিড ইয়াহুদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দশ মিনিট শেষ হতে আর মাত্র এক মিনিট বাকি।
স্যামসন ও স্মার্থা প্রধান বিচারপতির সেলে প্রবেশ করল। স্যামসন বলল, ‘স্যার, দশ মিনিটের আর মাত্র এক মিনিট বাকি। আপনি রাজী হয়েছেন,এই টেলিফোন তাহলে আমি স্যারকে করছি না।’
প্রধান বিচারপতির রক্তাক্ত দেহ বিছানার উপর নেতিয়ে পড়েছিল। চোখ বন্ধ ছিল তার। বলল সে, ‘আমাকে কি বলতে হবে, তোমরা লিখে দাও।’ ক্ষীণ কণ্ঠ প্রধান বিচারপতির। চোখ বন্ধ রেখেই কথাগুলো সে বলল।
‘ধন্যবাদ বিচারপতি মহোদয়! আপনার শুভবুদ্ধির জন্য।’
বলেই স্যামসন স্মার্থার দিকে তাকাল।
স্মার্থা কাল আলখেল্লার ভেতর থেকে এক খণ্ড কাগজ বের করে প্রধান বিচারপতির দিকে তা এগিয়ে দিল।
ঠিক এসময়েই ব্রাশফায়ারের শব্দ হল। চমকে উঠে স্যামসন ও স্মার্থা সেলের দরজার দিকে তাকাল। দেখল, সেলের গেটে দাঁড়ানো দু’জন স্টেনগানধারী প্রহরীকে। তারা স্টেনগান বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের স্টেনগানের ব্যারেল থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। স্যামসন ও স্মার্থা দ্রুত তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল সামনে কেউ নেই। সিঁড়ি পর্যন্ত ফাঁকা।
‘কী ব্যাপার? গুলী করলে কাকে?’ জিজ্ঞাসা স্যামসনের।
‘একটা ঢিল ধরনের কিছু গায়ে এসে পড়েছে। তাই সাথে সাথে গুলী চালিয়েছি।’ বলল একজন প্রহরী।
‘কোথায় ঢিল?’ বলল স্যামসন।
প্রহরীর খুঁজতে লাগল ঢিল। পেল না।
‘থাক। চল চারদিকটা খুঁজে দেখি।’ স্যামসন বলল। ঘরটা তালাশ করতে বেরুল চারজনই। তাদের হাতে উদ্যত স্টেনগান ও রিভলবার।
আয়েশা আজীমা মাথা নিচু করে বসেছিল। তার মুখে কিন্তু ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আহমদ মুসা শান্ত কণ্ঠের কঠোর কথাগুলো আয়েশা আজীমার চেহারায় সামান্য চাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি করল না।
আহমদ মুসার ডান পাশের সোফায় বসেছিল তাহির তারিক, বাম পাশের আরেক সোফায় বসেছিল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
আয়েশা আজীমা বসে ছিল সামনে একটু দূরের একটা সোফায়। মাঝখানে লাল কার্পেটে মোড়া বর্গাকৃতির ছোট্ট একটা চত্বর। তাতে শুধু একটা ‘টী’ টেবিল।
তার পরনে পাজামা ও ফুলহাতা কামিজ। কামিজের উপর একটা কুকিং অ্যাপ্রন।
আয়েশা আজীমা রান্নাঘরে ছিল। সেখানে সে যেভাবে ছিল মহিলা পুলিশ অফিসারেরা তাকে সেভাবেই ধরে নিয়ে এসেছে।
তার মাথায় একটা রুমাল বাঁধা।
বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিছাত্রী ও সেরা সুন্দরী ছিল আয়েশা আজীমা। সৌদি ছাত্র শেখ বাজের মেধা ও বিত্তই সম্ভবত শেখ আয়েশা আজীমাকে আকৃষ্ট করে। আকর্ষণ শেষে প্রেম ও বিবাহে পরিণতি লাভ করে।
আয়েশা আজীমা আহমদ মুসার কথার কোন জবাব না দেয়াতে আহমদ মুসা জেনারেল তারিক ও জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের দিকে একবার তাকাল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে আয়েশা আজীমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘দেখুন, চুপ থেকে লাভ নেই। ড. শেখ বাজ হাতে-নাতে ধরা পড়েছেন। তার কাছ থেকে কোটপিনের আকারে এই শক্তিশালী ট্রান্সমিটার পাওয়া গেছে। তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছেন, তার কোটপিনে যে ট্রান্সমিটার তা তিনি জানেন না। কিন্তু আইন তার এ কথা মানবে না। ধরা পড়ার পর সব অপরাধীই এমন কথা বলে। এখন আমরা জানতে চাই আপনার এ ব্যাপারে বক্তব্য কি? কারণ তিনি বলেছেন, কোটপিন আপনার সংগ্রহ করা।’
থামল আহমদ মুসা।
আয়েশা আজীমা একবার মুখ তুলে আহমদ মুসার দিকে চাইল। কোন কথা নেই তার মুখে। তবে প্রথমবারের মত তার চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠতে দেখা গেল।
আহমদ মুসা মুখ একটু নিচু করে ভাবল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক সূক্ষ্ণ হাসি। বলল সে, ‘তাহলে বুঝা গেল মিসেস বাজ, আপনি কিছুই জানেন না। ড. শেখ বাজই মিথ্যা কথা বলেছেন। সত্য তাহলে তার কাছেই পাওয়া যাবে। তার কাছ থেকেই সত্য এবার বের করতে হবে। সত্য বের করার কৌশল পুলিশের জানা আছে। বাবা ডেকে সব সত্য কথা বলে দেবেন তিনি। আমরা উঠছি। যতদিন না বিষয়টির সুরাহা হয় ততদিন আপনি পুলিশের কাস্টডিতে…।’
কথা শেষ করতে পারল না আহমদ মুসা। চিৎকার করা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল আয়েশা আজীমা, ‘না, আমি সব বলব। ওর কোন দোষ নেই। ওঁর মত ভাল মানুষ কোন অপরাধ করতে পারেন না। তার কোন ক্ষতি করবেন না, তাকে আপনারা ছেড়ে দিন।’
কথাগুলো বলে থামল আয়েশা আজীমা। দু’হাতে মুখ ঢেকে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।
‘ওঁর কোন দোষ নেই দোষটা তাহলে কার, এটাই তো আমরা জানতে চাচ্ছি। সব বলুন আপনি আমাদের।’ বলল আহমদ মুসা।
আয়েশা আজীমা হাতের রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘আমি একটা স্টেটমেন্ট করব, আপনি লিখুন।’
আহমদ মুসা তাকাল তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের দিকে।
বুঝতে পেরে জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল ইশারা করে আয়েশা আজীমার পেছনে দাঁড়ানো তিন মহিলা পুলিশ অফিসারের একজনকে ডেকে বলল, ‘মিসেস বেরিল ডেডেগ্লু, আপনি ওঁর স্টেটমেন্টটা লিখুন।’
মিসেস বেরিল ডেডেগ্লু এই এলাকার একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত অফিসার।
মিসেস ডেডেগ্লু পকেট থেকে নোটশিট ও কলম বের করে আয়েশা আজীমার পাশের সোফায় বসে পড়ল। বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাডাম, বলুন।’
আয়েশা আজীমা মিসেস ডেডেগ্লুর কাছ থেকে নোটশীট ও কলম নিয়ে নিল এবং কয়েকটি নোটশীটের শেষ প্রান্তে নিজের নাম দস্তখত করে ওগুলো মিসেস ডেডেগ্লুর হাতে ফেরত দিল।
স্টেটমেন্ট করার আগেই স্টেটমেন্টশীটে সত্যয়নকারী দস্তখত করায় অবাকই হল আহমদ মুসা। বেরিল ডেডেগ্লুও। তার চোখেও বিস্ময়।
‘লিখুন’, বলতে শুরু করল আয়েশা আজীমা, ‘আমি আয়েশা আজীমা ওরফে আলিশা দানিয়েল স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে এই স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছি যে, ‘আমি ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট (থ্রি জিরো) নামক সংস্থার দেয়া অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে তাদের সরবরাহ করা ‘কোটপিন’ আকারের শক্তিশালী ট্রান্সমিটার আমার স্বামীর কোটে নিয়মিত লাগিয়ে রাখার মাধ্যমে রিসার্চ সেন্টারের যাবতীয় কথোপকথন পাচার করেছি। আমার স্বামীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা ব্যবহার করা তাঁর অজ্ঞাতে তাঁদেরই বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্র করতে আমি বাধ্য হয়েছি। কেন এভাবে আমি বাধ্য হলাম, কেন আমার প্রিয়তম স্বামী ও তার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র করতে বাধ্য হলাম, তার পেছনে আছে আমার এক অসহায়ত্ব। সে অসহায়ত্ব হলো আমার স্বামীকে রক্ষার এক নিরুপায় ব্যবস্থা। আমি ওদের ষড়যন্ত্রের সাথী না হলে ওরা আমার স্বামীকে হত্যা করত। আমি জানি আমার স্বামীকে কেউ-ই ওদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারত না। শুধু ‘থ্রি জিরো’ই তখন আমার শত্রু হতো না, তুরস্কের পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে আমার মত ছদ্মবেশী অনেকে আছে যারা ‘থ্রি জিরো’ অর্থাৎ ওয়ান ওয়ার্ল্ড অরবিট-এর পক্ষে কাজ করছে তারাও আমার স্বামীর হন্তায় পরিণত হতো। আমার অন্যায় হয়েছে, আমার ছদ্মবেশ সম্পর্কে আমার স্বামীকে না বলা, এমন ছদ্মবেশ নিয়ে তার মত একজন ভালো ও জাতিপ্রেমিক মানুষকে বিয়ে করাও আমার অন্যায় হয়েছিল। কিন্তু তার প্রতি আমার প্রেম আমাকে অন্ধ করেছিল। তাঁকে বিয়ে না করেও পারিনি, তাঁকে হারাবার ভয়ে আমার ছদ্মবেশ সম্পর্কেও তাঁকে বলতে আমি সাহস পাইনি।
আমি স্বীকার করছি। আমার ছদ্মবেশ ছিল পরিকল্পিত। হাজারো ইহুদী তরুণী যেভাবে তাদের নাম পরিচয় পাল্টে মুসলিম ও খ্রিস্টান সমাজে ঢুকে পড়েছে, আমি তাদেরই একজন। লেবাননের বেকা অঞ্চলের এক ইহুদী পরিবারে আমার জন্ম। স্কুল সার্টিফিকেট পর্যায় পর্যন্ত আমি ইসরাইলের তেলআবিবে পড়ি। তারপর বেকায় ফিরে আসি। বেকায়ই আমার পরিবারের পরিচিত আয়েশা আজীমার নাম পরিচয় আমাকে গ্রহণ করতে বলা হয়। তার সমস্ত শিক্ষা ডকুমেন্টও আমাকে দেওয়া হয়। এই সব ডকুমেন্টের জোরে আমি আয়েশা আজীমা রূপে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাই। আমি পুরোপুরি আয়েশা আজীমা হয়ে যাই। পরে শুনেছি, স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পাশের পর আয়েশা আজীমা নিহত হয়। কেউ আমাকে বলেনি, তবে এখনও আমি বিশ্বাস করি আমাকে আয়েশা আজীমা বানাবার জন্যেই তাঁকে হত্যা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে হঠাৎই কৃতি ছাত্র শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজের সাথে আমার পরিচয় হয়। ভালো লেগে যায়। শুধু কৃতি ছাত্র বলে নয়, তার চরিত্রের দৃঢ়তা ও মেয়েদের প্রতি নির্মোহ ভাব আমাকে আকৃষ্ট করে বেশি। তার মত ঠাণ্ডা ছেলেকে উত্তপ্ত করতে আমার অনেক সময় লেগেছে। জার্মানিতে পিএইচডি করার সময় তার কাছ থেকে বিয়ের ইতিবাচক সাড়া আমি পাই। ইতিমধ্যে ‘থ্রি জিরো’-এর সাথে আমার পরিচয় হয়ে গেছে। পরে জেনেছি তারাই জার্মানিতে পড়ার জন্য আমার স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছে। বৈরুতে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচও আমার বাবা-মায়ের মাধ্যমে তারাই দেয় বলে জানতে পারি। শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজের সাথে আমার সম্পর্কে ‘থ্রি জিরো’ আমাকে দারুণভাবে কনগ্রাচুলেট করে এবং বলে যে, সৌদি আরবের এমন পরিবারের ছেলে সে সৌদি আরবের বড় কোন এক দায়িত্বে যাবেই। শেখ বাজের উপর তাদের চোখ রাখাকে আমি ভাল চোখে দেখিনি, কারণ এটা আমার একান্তই প্রাইভেট ব্যাপার। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। কেউ আমাকে না বলে দিলেও আমি জানতাম, আমাদের জাতীয় এই সংগঠনের কথা আমাকে মানতে হবে। পিএইচডি করার পর জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ বাজের চাকরি হয়ে গেল। ‘থ্রি জিরো’র লোকরা এসে আমার সাথে দেখা করল। সংবাদপত্রের বিজ্ঞপ্তির একটা কাটিং আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ বাজের চাকরি করা যাবে না। যে কোনভাবে এই বিজ্ঞপ্তির চাকরিই যোগাড় করতে বলো। আমি বিজ্ঞপ্তি পড়ে দেখলাম, সেটা ইস্তাম্বুলের ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি সংস্থায় ‘ডাইরেক্টর অব ম্যানেজমেন্ট’ পদে নিয়োগের একটা বিজ্ঞপ্তি। আমি ওদের বললাম, এটা একটা ম্যানেজারিয়াল পদ, কিন্তু শেখ বাজের পছন্দ একাডেমিক কাজ। তারা চাপ দিয়ে বলল, না এই চাকরিই তাঁকে যোগাড় করতে হবে। তারা যুক্তি হিসেবে বলল, ওআইসির গোপন অর্থ ও তত্ত্বাবধানে এই ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছে। এটাকে ঘিরে নিশ্চয়ই ওআইসির এক বড় পরিকল্পনা আছে। সেখানে কি হয় এটা আমাদের জানা দরকার। সুতরাং শেখ বাজকে সেখানে ঢুকাতেই হবে। আমি পছন্দ করি বা না করি, এটা আমাকে মেনে নিতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি ইস্তাম্বুলে এবং রিসার্চ ও টেকনোলজির সাথে জড়িত বলে এই চাকরি নেওয়ার জন্য শেখ বাজ আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যায়। বরং আমি তার কাছ থেকে ধন্যবাদই পাই যে এমন একটা বিজ্ঞাপনের দিকে আমার নজর গেছে। ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজি (আইআরটি)-তে তার চাকরি হয়ে যায়। এই পদের জন্য তার মত যোগ্য লোকই তারা খুঁজছিল। তার চাকরি হওয়ার পরই নতুন সঙ্কট আমার সামনে স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়। ‘থ্রি জিরো’ অনেকগুলো ‘আল্লাহ’ শব্দ অঙ্কিত অন্ধকারেও জ্বলে এমন দামি পাথরের তৈরি দেওয়াল ‘শো পিচ’ আমাকে দিয়ে বলে আইআরটির তিন ফ্লোরেই দেওয়ালের দর্শনীয় স্থানে শেখ আব্দুল্লাহর দ্বারা এগুলো লাগিয়ে দিতে। তাদের প্রস্তাবে আমি চমকে যাই। বুঝতে পারি ‘শো পিচ’ এর কভারে এগুলো নিশ্চয়ই গোয়েন্দা যন্ত্র, গোপন ক্যামেরা বা গোপন ট্রান্সমিটার হতে পারে। আমি ওদের বললাম, এটা সেট করাকে শেখ বাজ নিজেও সন্দেহের চোখে দেখতে পারে অথবা কারও সন্দেহের শিকার হতে পারে। সেসহ আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। আমার যাই হোক, আমার স্বামীর কোন ক্ষতি আমি করতে পারবো না। তাদের প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপরই তারা আনে ‘কোটপিন’-এর প্রস্তাব। এটাও ঝুঁকিপূর্ণ বলে আমি এই ব্যাপারে সহযোগিতা করতে অপারগতা প্রকাশ করি। এরপরই তারা আবির্ভূত হয় স্বমূর্তিতে। বলে যে, ‘আমি যদি প্রতিদিন স্বামীর কোটে তাদের দেওয়া কোটপিন রাখার ব্যবস্থা করতে অস্বীকার করি, তাহলে যে স্বামীকে রক্ষার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না, সেই স্বামীকেই আমাকে হারাতে হবে। আমি অস্বীকার করার পর একদিনও তাঁকে বাচতে দেয়া হবে না। আর আমি যদি তাদের এসব কথা আমার স্বামী, পুলিশ বা কাউকে বলি, তাহলে স্বামীর সাথে আমার মেয়েকেও শেষ করে ফেলবে ওরা। আমি নিরুপায় হয়ে যাই। আমি স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাই না, কিন্তু তার চেয়েও বড় হল, আমি কিছুতেই তাঁকে হারাতে চাই না, এই পর্যায়ে এসেই আমার জন্য কম ক্ষতিকর হিসেবে তাদের ‘কোটপিন’-এর প্রস্তাব গ্রহণ করি। প্রাণপ্রিয় স্বামীর সাথে এই বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য প্রতিপল, প্রতিক্ষণ আমি দগ্ধ হয়ে এসেছি। একটা সান্ত্বনা আমার ছিল, সেটা হল স্বামীর সাথে এই বিশ্বাসঘাতকতা করে আমি আমার স্বামীকে রক্ষা করেছি। আমার স্বামীকে দয়া করে আপনারা রক্ষা করবেন। আমিই আমার স্বামীর জন্য মুসিবত। আমি চাই এই মুসিবত থেকেও উনি মুক্তি পান। আর আমিও চাই দুঃসহ, দুর্বহ ব্ল্যাকমেইলের হাত থেকে মুক্তি।’
কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে থামল আয়েশা আজীমা।
সংগে সংগেই আহমদ মুসার প্রশ্ন, ‘ম্যাডাম, এই দুঃসহ, দুর্বহ ব্ল্যাকমেইল যারা করতো, যারা এখানে আপনার সাথে যোগাযোগ করতো, তাদের পরিচয় সম্পর্কে দয়া করে বলুন।’
‘আমার স্টেটমেন্ট শেষ জনাব। আমার স্বামীকে দয়া করে দেখবেন।’
বলেই আয়েশা আজীমা তার বাম হাতের অনামিকার আংটির নিল পাথরটাকে কামরে ধরল।
আয়েশা আজীমাকে তার হাতের আংটি মুখে নিতে দেখেই আহমদ মুসা উঠে দাড়িয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাতটাকে ধরে ফেলার জন্যে। কিন্তু হাতটা ধরে ফেলার আগেই হাতের আংটি কামড়ে ধরেছিল আয়েশা আজীমা।
আহমদ মুসা দ্রুত হাতটা টেনে নিল আয়েশা আজীমার মুখ থেকে।
আয়েশা আজীমার মুখে এক টুকরো নির্দোষ হাসি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু মুহূর্তেই তা কোথায় মিলিয়ে গেল। সোফার উপর এলিয়ে পড়ল আয়েশা আজীমার দেহ।
পেছনে নির্বাক দাঁড়ানো দুই পুলিশ অফিসার ও আয়েশার স্টেটমেন্ট লেখা পুলিশ অফিসারগণ। এই তিন পুলিশ অফিসার গিয়ে ধরল আয়েশা আজীমাকে। তাদের একজন বলল, ‘আমরা বুঝতেই পারিনি ইনি কি করতে যাচ্ছেন। তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।’
হতাশ আহমদ মুসা ধপ করে সোফায় বসে বলল, ‘কোন লাভ নেই পুলিশ অফিসারগণ। পটাসিয়াম সাইনাইড কাউকে এন্টিডোজ নেয়ার সুযোগ দেয় না।’
উঠে দাঁড়িয়েছিল জেনারেল তাহির এবং জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালও। তারাও বসল।
আয়েশা আজীমাকে সোফায় শুইয়ে দিতে দিতে বলল মিসেস বেরিল ডেডেগ্লু, ‘স্যার, সংগে সংগেই কি করে নিশ্চিত হলেন, উনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়েছেন?’ প্রশ্নের লক্ষ্য আহমদ মুসা।
‘সেদিন ‘থ্রি জিরো’র ইরগুন ইবানও আমার হাত ফসকে এভাবেই মরেছে পটাসিয়াম সাইনাইড খেয়ে। সেদিন তাকে বাঁচানো যেমন জরুরি ছিল, একে বাঁচানোও তেমন জরুরি ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তবুও এর কাছ থেকে কিছু জানা গেল।’ বলল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
‘শুধু নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ষড়যন্ত্র সম্পর্কে একজনের নাম প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই বলেননি। আমরা জানি ডঃ বাজ নির্দোষ। আয়েশা আজীমা তাকে নির্দোষ প্রমাণ করায় আমাদের কোন লাভ হয়নি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তবে ডঃ বাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে, আপনি এই চাল না চাললে আমার মনে হয় আয়েশা আজীমা এটুকুও বলতেন না। আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল জেনারেল তারিক।
‘ঠিক বলেছেন জনাব। স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় কোন খাদ ছিল না তার। স্বামীকে বাঁচানোর জন্যেই এই স্টেটমেন্ট তিনি দিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ইস্তাম্বুলের ষড়যন্ত্রের যারা হোতা, যারা তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে তাদের সম্বন্ধে না বলায় কি প্রমাণ হয় যে তিনি ‘থ্রি জিরো’র প্রতিও বিশ্বস্ত ছিলেন।’ পুলিশ অফিসার বেরিল ডেডেগ্লু বলল।
‘হ্যাঁ, বলা হয় দ্বৈত আনুগত্য আয়েশা আজীমার মধ্যে ছিল। একদিকে তিনি স্বামীকে ভালোবাসতেন বলে স্বামীর সমাজ ও জাতির প্রতিও তার একটা ভালোবাসা ছিল। আবার যারা পেছন থেকে সহযোগিতা দিয়ে তাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, তাদের প্রতিও একটা আনুগত্য তার ছিল। তবে আয়েশা আজীমার স্টেটমেন্টের শেষ কথা প্রমাণ করে তিনি তাদের জাতির ওই লোকদের ভয় করতেন, ভালোবাসতেন না। তাদের হাত থেকে স্বামীকে মুক্ত করা ও নিজে মুক্ত হবার জন্যেই তার এই মৃত্যু।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অনেক ইহুদিই কিন্তু ওদের ষড়যন্ত্রের সাথে নেই।’ জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল।
‘অনেক’ বলছেন কেন, আমার জানা মতে নব্বই ভাগ ইহুদিই ওদের সাথে নেই। তারা ধার্মিক, শান্তি ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী। মাত্র জায়নিস্ট বা ইহুদীবাদী বলে পরিচিত মুষ্টিমেয়রাই পৃথিবীব্যাপী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তাদের চাঁদাবাজি ও হুমকি-ধমকিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ইহুদীরা অতিষ্ঠ ও অসহায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক বলেছেন জনাব খালেদ খাকান। এই সাধারণ শান্তিবাদী ইহুদীরা ঐক্যবদ্ধ না থাকা এবং অসংগঠিত হওয়ার কারণেই এদের কণ্ঠ শ্রুত হয় না, এদের কণ্ঠ কোন শক্তি নয়।’
বলেই একটু থেমে আবার বলে উঠল, ‘করনীয় কাজের কথায় আমরা ফিরে আসতে পারি। প্রথমে ডঃ শেখ বাজকে ডাকা দরকার। তিনি এলেই আমরা লাশ নেবার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজ করতে পারি।’
‘ধন্যবাদ জনাব। আমি ডাকছি ড. শেখ বাজকে। আপনি অন্য বিষয় নিয়ে ভাবুন প্লিজ।’ জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালকে লক্ষ্য করে বলল জেনারেল তাহির।
‘ঠিক আছে, আপনারা এসব করুন। আমাকে এখনি উঠতে হবে। আয়েশা আজীমার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ হবার আগেই আমি আরেক ঘাঁটিতে হানা দিতে চাই। সেখানে থাকেন আয়েশা আজীমা বা সেদিনের ইরগুন ইবানের চেয়ে বড় কেউ। তাকে আমাদের হাতে পেতেই হবে। ‘থ্রি জিরো’র ভেতরে ঢোকার প্রত্যক্ষ এই একটা দরজাই আমাদের সামনে খোলা আছে।’
বলেই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
‘আল্লাহ আপনাকে সফল করুন খালেদ খাকান। কিন্তু একা যাবেন না। অগ্রবাহিনী কিংবা পশ্চাৎবাহিনী যেভাবেই হোক আপনার পছন্দনীয় একদল পুলিশ আপনি নিন।’ বলল জেনারেল তাহির আহমদ মুসাকে।
জেনারেল তাহির থামতেই জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘আমি পুলিশ প্রধানকে বলে দিচ্ছি এবং মোবাইল নাম্বারও দিচ্ছি। তিনি আপনার সাথে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। কোথায় যাচ্ছেন, কি কাজ- এ সম্পর্কে তিনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, আপনিও তাকে কিছু বলবেন না।’
‘ধন্যবাদ আপনাদের। আমি আসি। আমি যাচ্ছি গোল্ডেন হর্নের ওপারে। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে আহদ মুসা বেরুবার জন্যে দরজার দিকে পা বাড়াল।
ডঃ শেখ বাজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসা গাড়ি নিয়ে ছুটল বসফরাস ব্রীজ অর্থাৎ কামাল আতাতুর্ক ব্রীজের দিকে। ওই ব্রীজ দিয়ে বসফরাস উপকুলের হাইওয়ে ধরে গোল্ডেন হর্নের গালাটা ব্রীজ পার হয়ে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব তাড়াতাড়ি পৌছা যাবে।
আহমদ মুসার গাড়ি বসফরাস ব্রিজে ওঠার পরই গাড়ির রিয়ারভিউতে দেখল ৪টা গাড়ি সারি বেঁধে একই গতিতে তার পেছনে ছুটে আসছে।
ব্রীজের মাঝামাঝি এসে দেখল ব্রীজের ওপাশ থেকে আরও চারটা গাড়ি হঠাৎ রং সাইড এ এসে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে দাঁড়াল। গোটা রাস্তা জুড়ে তারা দাড়িয়ে। কোনভাবেই তাদের পাশ কাটানো সম্ভব নয়।
আহমদ মুসা ডান দিকে ব্রীজে ওপাশে রিটার্ন লেনের দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে কতকগুলো গাড়ি দাড়িয়ে ডানদিকটাও ব্লক করে ফেলেছে।
আশ্চর্যের বিষয়, সবগুলো গাড়িই, ওয়াগন মিনিট্রাক। আর আহমদ মুসার গাড়ি ১৩০০ সিসির আমেরিকান কার। ওদের তুলনায় বাচ্চা।
তিন দিক থেকেই অবরুদ্ধ আহমদ মুসা। হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি দাড় করায় আহমদ মুসা। বাঁ দিকে দেখেছে আহমদ মুসা ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালের সমান্তরাল প্যানেলবার গাড়ির সমান্তরালে।
আহমদ মুসার গাড়ি দাড়িয়ে পড়তেই তিন পাশের গাড়িগুলোও দাঁড়িয়ে পড়েছে।
তিন দিকে উঁচু গাড়ির দেয়ালের মাঝখানে আহমদ মুসার গাড়ি।
গাড়িগুলো থামতেই নেমে এল একদল মানুষ। প্রত্যেকের হাতে স্টেনগান।
আহমদ মুসা বুঝে গেছে সব। নিশ্চয় ‘থ্রি জিরো’র লোকরাই আগাম পরিকল্পনার মাধ্যমে তাকে সব দিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। ঘেরাও করে ফেলা এতগুলো স্টেনগানের বিরুদ্ধে তার এক রিভলবার কোন কাজেই আসবে না। বরং তাদের গুলী এড়াতে হলে তাকে রিভলবার বের করা চলবে না। মাত্র খোলা থাকা বসফরাসের দিকসহ চারিদিকে একবার চেয়ে মুহূর্তের জন্য করনীয়টা ঠিক করে নিয়ে আহমদ মুসা বসফরাসের দিকে মানে বাম দিকের দরজা খুলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির ছাদে উঠে দু’হাত তুলে দাঁড়াল।
সংগে সংগেই ডান পাশ থেকে একজন চিৎকার করে বলল, ‘কেউ গুলী করবে না। ওকে মৃত পেলেও আমাদের চলবে, কিন্তু জীবন্তই বেশি দরকার। একটা গুলিতে তার আরামের মৃত্যু হলে তার কাছে আমাদের পাওনা শোধ হবে না। তোমরা কয়েকজন গিয়ে তাকে বেঁধে গাড়িতে তোল।’ নির্দেশের সাথে সাথেই তিন দিক থেকে চার পাঁচজন ছুটল আহমদ মুসার দিকে।
‘তোমরা কারা? আমার দোষটা কি? তোমরা এসব কথা বলছ কেন?’
চিৎকার করে এসব কথা বলতে বলতে আহমদ মুসা ইঞ্চি ইঞ্চি করে পেছনে হটে গাড়ির বাম প্রান্তের দিকে এগোচ্ছিল। সে জানে ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালের প্যানেলবার থেকে দু’শ ফুটেরও বেশি নিচে বসফরাসের পানি। ওদিকেও মৃত্যুর হাতছানি তবু তার রক্তের জন্যে হন্যে হয়ে থাকা ‘থ্রি জিরো’র কশাইদের হাতে পড়ার চেয়ে বসফরাসের পানিতে ঝাঁপ দেওয়া অনেক ভালো।
আহমদ মুসার গাড়ির ছাদ থেকে ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালের প্যানেলবারের ব্যবধান দেড় ফুটের বেশি নয়।
আহমদ মুসার দিকে ছুটে আসা লোকগুলো তার গাড়ির পাশে এসে গেছে। ওরা উঠে আসছে গাড়ির ছাদে।
আহমদ মুসা তখন গাড়ির ছাদের বাম পাশের শেষ প্রান্তে।
লোকগুলো উঠে এসেছে গাড়ির ছাদে। তাদের চোখে-মুখে ক্রুর হাসি। যেন কাঁটা-ছেঁড়ার জন্যে একটা অসহায় গিনিপিগ তারা পেয়ে গেছে।
লোকগুলো এগুচ্ছে আহমদ মুসার দিকে। তাদের কয়েকজনের দেহ আহমদ মুসা ও স্টেনগানধারীদের মাঝখানে একটা দেয়াল সৃষ্টি করেছে।
লোকগুলো আরও ক্লোজ হয়েছে আহমদ মুসার।
হঠাৎ আহমদ মুসা এবাউট টার্ন করে লাফ দিয়ে ব্রীজের ফেঞ্চ-ওয়ালবারে উঠে দেহে একটা ঝাঁকি দিয়ে দক্ষ সাঁতারুর মত শূন্যে সামনে দু’হাত বাড়িয়ে ড্রাইভ দিয়ে বাতাস কেটে ছুটল বসফরাসের নিল জলরাশির দিকে। পেছনের লোকগুলো তখন চিৎকার করে উঠে সবাই কাঁধের স্টেনগান হাতে নিয়ে গুলী করতে শুরু করেছে উড়ন্ত দেহ লক্ষ্যে।
মেজর জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের বাম পাশ থেকে টেলিফোন বেজে উঠল।
বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে।
তার সামনে একটা ফাইল খোলা। ছড়িয়ে আছে অনেক কাগজপত্র। সে ও জেনারেল তাহির তারিক দু’জনে কাগজগুলো পরীক্ষা করছিল। এ কাগজগুলো এনেছে তারা আয়েশা আজীমার ব্যক্তিগত ফাইল থেকে। নোটবুকগুলোও তার আনা হয়েছে। ডঃ শেখ বাজ তাদেরকে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সহযোগিতা করেছে। তার চোখে অশ্রু ছিল, কিন্তু মৃতা স্ত্রীর কোন কিছুই সে তাদের কাছে গোপন রাখেনি। সে চেয়েছে তার স্ত্রীকে যারা ব্ল্যাকমেইল করেছে, ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কাজে ব্যবহার করেছে, তাদের স্বরূপটি উদঘাটিত হোক। তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পাক তাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান এবং পৃথিবীর শান্তিকামী মানবতার আশার প্রদীপ ‘আইআরটি’ (ইনিস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি)। তার স্ত্রীর শেষ পরিচয়টা তাকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। ডঃ বাজ জেনারেল তাহির তারিকদের কাছ থেকে শুনেছে, তার স্ত্রী তাকে সব সন্দেহ থেকে বাঁচাবার জন্যেই নিজের সব কথা সে বলেছে এবং সব অপরাধের স্বীকৃতি দিয়েছে। তার স্ত্রী নিজের দায়ভার নিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে, কিন্তু চেয়েছে স্বামীর গায়ে যেন কোন কালো দাগ না লাগে। ইহুদী কন্যা হিসেবে ষড়যন্ত্রে শামিল থাকলেও স্বামীকে সে ভালবেসেছে প্রাণ দিয়ে। স্ত্রী আয়েশা আজীমা তাকে ঠকিয়েছে তার পরিচয় গোপন করে, জঘন্য অপরাধ করেছে তাকেও ষড়যন্ত্রের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু সে সমগ্র অন্তর দিয়ে অনুভব করছে তার ভালোবাসায় সামান্য কোন খাদ ছিল না। ডঃ শেখ বাজের চোখে অবিরল অশ্রু শুধু এ কারণেই।
একরাশ বিরক্তি নিয়েই জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল তাকাল টেলিফোনের সাইড টেবিলের দিকে। লাল, নীল, সাদা ও কালো অনেকগুলো টেলিফোন সেখানে। পিএবিএক্স ও প্রাইভেট কালো ও সাদা টেলিফোন দুটোই তাকে বিরক্ত করে বেশি।
কিন্তু নীল টেলিফোনটা বাজতে দেখে মুখের বিরক্তি ভাবটা কেটে গেল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের। এ টেলিফোনটা গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের।
টেলিফোন তুলে নিয়ে নিস্পৃহভাবে ওপারের কথা শুনল, দু’একটা নির্দেশও দিল।
টেলিফোন রেখে ঘুরে বসে কাগজ-পত্রে মনোযোগ দেবার আগে বলল, ‘জেনারেল তাহির, বসফরাস ব্রীজে কি যেন একটা ঘটনা ঘটেছে। প্রচুর গোলা-গুলি হয়েছে। কিন্তু প্রাণহানির ঘটনা নেই। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ভয়ানক যানজট ছিল। বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট এখনও পুরো পাওয়া যায়নি।’
বসফরাস ব্রীজ, আর গোলা-গুলির কথা শুনে আগ্রহের সাথে মুখ তুলল জেনারেল তাহির তারিক। বলল, ‘ঘটনা ঘটেছে ক’টায়?’
‘পৌনে একটায়।’ বলল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো জেনারেল তাহির তারিকের। বলল, ‘মিঃ খালেদ খাকান ড. বাজের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল বারটা তিরিশ মিনিটে। গোল্ডেন হর্নে যাবার জন্যে তিনি যদি বসফরাস ব্রীজ ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে কতকটা এই সময়েই তো তার ব্রীজ অতিক্রম করার কথা।’
‘আপনি মিঃ খালেদ খাকানের বিষয়টা এর মধ্যে আনছেন কেন? আপনি কিছু ভাবছেন?’ বলল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
‘ঠিক তেমন নয়, তবে এই সময় মিঃ খালেদ খাকান ঐ এলাকায় থাকার কথা, যদি তিনি বসফরাস ব্রীজ ব্যবহার করে থাকেন, এটাই বলছি।’ জেনারেল তাহির তারিক বলল।
সংগে সংগে কথা বলল না জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল। ভাবান্তর ঘটেছে তার চোখে-মুখে। ছোট হয়ে এসেছে তার দুই চোখ। সিরিয়াসলিই ভাবছে সে।
কয়েক মুহূর্ত চিন্তার পর ঘুরল টেলিফোনের দিকে। তুলে নিল নীল টেলিফোন। একটা কল করল।
ওপার থেকে সাড়া পেতেই বলল, ‘ওয়া আলাইকুম সালাম। হ্যাঁ, বসফরাস ইষ্ট পুলিশ স্টেশন! তোমরাই তো দেখেছ বসফরাসের ঘটনাটা?’
ওপারের উত্তর শুনে নিয়ে জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘হ্যাঁ, বল, ওখানে কি ঘটেছে? হত্যা, কিডন্যাপের চেষ্টা? ব্রীজ থেকে একজন বসফরাসে লাফিয়ে পড়েছে? জানা গেছে সে কে? গ্রেফতার হয়েছে কেউ?’ জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের চোখে বিস্ময় ও উদ্বেগ দুইয়ের মিশ্রণ।
ওপ্রান্তের উত্তর শোনার পর জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘আক্রান্ত বলে যে কারটিকে তোমরা সন্দেহ করছ, তার নাম্বার কত?’
ওপার থেকে উত্তর পেল। উত্তর পাওয়ার সাথে সাথেই তার চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রকাশ ঘটল। দ্রুত কণ্ঠে সে বলল, ‘স্পটে কে আছে?’
উত্তর শুনে নিয়ে বলল, ‘আমরা যাচ্ছি সেখানে, জানিয়ে দাও ওদের।’
বলেই টেলিফোন রেখে ঘুরল জেনারেল তাহির তারিকের দিকে।
জেনারেল তাহিরের চোখে-মুখে প্রশ্ন, তার সাথে আশঙ্কার কালো ছায়া।
ঘুরে বসেই জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল বলল, ‘সর্বনাশ হয়েছে, আক্রান্ত গাড়িটা খালেদ খাকানের। তার মানে তিনি ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়েছেন।’ শুষ্ক, উদ্বেগাকুল গলা জেনারেল মোস্তফা কামালের।
মুখের আলো যেন দপ করে নিভে গেল জেনারেল তাহিরের। চোখে –মুখে তার এক বোবা আতঙ্ক। কয়েক মুহূর্ত তার বাক স্ফূরণ হলো না। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘তার পরের খবর কি, মানে খালেদ খাকানের খবর কি?’ কম্পিত কণ্ঠ জেনারেল তাহির তারিকের।
‘বসফরাসে অনুসন্ধান চলছে। পুলিশ, গোয়েন্দা ও নৌবাহিনীর কয়েকটা ইউনিট কাজে নেমেছে। চলুন আমরা যাই। যেতে যেতেই প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টা জানাব।’
বলে উঠে দাঁড়াল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল তাহিরও।
উঠেই আবার বসে পড়ল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল। বলল, ‘জেনারেল মিঃ তাহির, আপনি গাড়ির দিকে যান। জরুরি আরও কয়েকটা কল সেরে আমি আসছি।’
‘আসুন’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জেনারেল তাহির তারিক।
ঘর থেকে বেরিয়ে লিফট হয়ে নেমে এল আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরের একদম গাড়ি বারান্দায়। এ বিশেষ গাড়ি বারান্দায় লিফটের সামনেই তার ও জেনারেল হাজী মোস্তফা কামালের গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। একটু দুরেই এটেনশন অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল দু’জন কমান্ডো। তারা গাড়ির সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করছিল।
তারা জেনারেল তাহিরকে দেখে স্যালুট দিয়ে আবার স্থির দাঁড়িয়ে গেল।
নানা আশংকা জেনারেল তাহিরকে ঘিরে ধরেছে। আহমদ মুসা দু’শ দশ ফিট উঁচু বসফরাস ব্রীজ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছে, এ কথা মনে হতেই বুক কেপে উঠছে জেনারেল তাহিরের। কোন মানুষ কি এমন সাহস করতে পারে। আহমদ মুসাই হয়ত পারে। কিন্তু তারপর কি ঘটেছে? আর ভাবতে পারছে না জেনারেল তাহির। গোটা সত্ত্বা তার একসঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠছে, আহমদ মুসার মহান জীবনের পরিসমাপ্তি আল্লাহ এভাবে করবেন না। চোখের কোণ ভারী হয়ে উঠল জেনারেল তাহির তারিকের। সমগ্র অন্তর থেকে একটা প্রার্থনা তার উচ্চারিত হলো, ‘আল্লাহ তোমার সৈনিককে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার।’
লিফট থেকে বেরিয়ে এল জেনারেল হাজী মোস্তফা কামাল।
দু’চোখের কোণ মুছে ফেলল জেনারেল তাহির তারিক।
লিফট থেকে বেরিয়েই জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘জেনারেল তাহির, প্রধানমন্ত্রীকেও খবরটা দিলাম। সামরিক গোয়েন্দা সূত্রে তিনি ইতিমধ্যেই খবর পেয়ে গেছেন। তিনি প্রেসিডেন্টকেও এ খবর জানিয়েছেন। তারা খুবই উদ্বিগ্ন। বসফরাস জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ছয় ঘণ্টার জন্যে বিদেশি এবং যেকোন নৌযানের বসফরাসে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং যেসব নৌযান বসফরাস ও মর্মর সাগরে আছে, সেগুলোর বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্যাপক সন্ধান শুরু হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওখানে যাচ্ছেন। চলুন, আমরা চলি।’
বলেই নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল। জেনারেল তাহির তারিক কোন কথা বলল না। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জেনারেল মোস্তফার পেছন পেছন চলল।
ব্রীজের গোড়ায় পৌঁছেই জেনারেল মোস্তফা কামালরা ব্রীজের ঠিক গোড়ার আইল্যান্ডে পুলিশের একটা জটলা দেখল। জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘ঠিক এখানকার মত ব্রীজের ওপ্রান্তেও পুলিশ অস্থায়ী অফিস বসিয়েছেন। চলুন আমরা স্পটটা দেখে আসি।’
স্পটে দুজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়েছিল।
আহমদ মুসার পরিত্যক্ত কারটিও ব্রীজের দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল।
জেনারেল তাহিররা গাড়ি থেকে নামল।
দু’জন পুলিশ অফিসার স্যালুট করে এগিয়ে এসে বলল জেনারেল মোস্তফাকে, ‘স্যার, গাড়িটা এখানেই পাওয়া গেছে, একটুকুও সরানো হয়নি।’
‘থ্যাংকস অফিসার।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘চলুন গাড়িটাকে আগে দেখা যাক।’ বলে জেনারেল তাহির তারিক গাড়ির দিকে এগোলো।
গাড়ির ভেতর-বাহির পরীক্ষা করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল জেনারেল তাহির তারিক, ‘এটা খালেদ খাকানেরই গাড়ি, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু গাড়িতে কোন কিছুই রেখে যাননি। তার মোবাইল, রিভলবার ও আইডি কার্ড তার পকেটেই ছিল।’
উদ্বেগ-আতঙ্কে ভরা জেনারেল মোস্তফা কামালের চেহারা। বলল, ‘ড্যাশবোর্ডের ভয়েস রেকর্ডার শূন্য। কিছুই বলে যাননি। বলবেন বা কি। আমি বুঝতে পারছি না, ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়ার অসম্ভব সিদ্ধান্তটা কেন নিলেন!’
‘সঙ্কটের চরম মুহূর্তে তার মনে যে কাজকে অগ্রাধিকার দেন সেটাকেই তিনি গ্রহণ করেন। যে কোন সঙ্কটে তার মনটা স্থির থাকে।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক। তার কণ্ঠ শুষ্ক।
দু’জনেই গিয়ে দাঁড়াল ব্রীজের ফেন্স ওয়ালের সম্ভাব্য যে স্থান থেকে তিনি লাফিয়ে পড়েছেন সেখানে। নিচে বসফরাসের পানির দিকে তাকিয়ে জেনারেল তাহির বলল, ‘তিনি বসফরাসের নিচে ঠিক লম্বভাবে গিয়ে পড়েছেন। এখানে দাড়িয়েই যদি ওরা ব্রাশ ফায়ার করে থাকে, তাহলে গুলির মুখে পড়ার তার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি না ততক্ষণে রেঞ্জের বাইরে গিয়ে থাকেন। যতই তার দেহটা নিচের দিকে নেমেছে, ততই তা ব্রীজের ইনওয়ার্ডের দিকে বাক নিয়েছে, আর ওদের ব্রাশ ফায়ারের গুলির গতি ব্রীজ থেকে আউটওয়ার্ড হওয়াই স্বাভাবিক।’
‘কিন্তু গুলী থেকে বাঁচলেও এত বড় দূরত্ব থেকে আছড়ে পড়ার আঘাত থেকে তিনি বাচবেন কি করে?’ কম্পিত কণ্ঠ জেনারেল মোস্তফা কামালের।
বেদনায় মুখটা আরও চুপসে গেল জেনারেল তাহির তারিকের। বলল, ‘কিন্তু তার জীবনের ইতি এভাবে ঘটতে পারে না, অবশ্যই পারে না। আসুন আমরা আর কিছু না ভাবি।’
‘ভাবনাকে দেয়াল দিয়ে আটকানো যায় না। সুতরাং এ প্রসঙ্গ থাক। চলুন আমরা নিচের পুলিশের অপারেশন অফিসে যাই। অনুসন্ধান কতদূর এগিয়েছে চলুন দেখি।’
বলে গাড়ির দিকে এগোলো জেনারেল মোস্তফা কামাল।
জেনারেল তাহিরও গিয়ে গাড়িতে উঠল।
নীচে পৌছতেই পুলিশ অফিসাররা স্বাগত জানিয়ে জেনারেল মোস্তফা কামালদের নিয়ে গেল তাঁবু খাটিয়ে তৈরি করা অস্থায়ী অফিসে।
‘নতুন কোন খবর আছে? প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া গেছে?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘স্যার, অনুসন্ধান চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধানও চলছে। এ এলাকায় অনেককেই পাওয়া যাচ্ছে, যারা সেসময় এখানে হাজির ছিল। আকস্মিক ঘটনা তাই অনেকেরই নজরে পড়েনি। অনেকের নজর গেছে ব্রীজ থেকে আসা ব্রাশ ফায়ারের দিকে। পানিতে পড়ার দৃশ্য দেখেছে এমন কাউকে পাওয়া যাইনি এখনও।’ ঘটনার মনিটররত পুলিশ অফিসার বলল।
‘সিসিটিভি’র মনিটর থেকে তো এ দৃশ্য পাবার কথা। সেখানে কি দেখা গেছে?’ বলল দ্রুত কণ্ঠে জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘স্যার, এই মাত্র প্রিন্টগুলো এসেছে। দেখুন ছবিতে একব্যক্তিকে ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বসফরাসের পানি থেকে পঞ্চাশ ফিট লেবেলের পর তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। দু’দিক থেকে আসা দুই সারি জাহাজের আড়ালে চলে যান তিনি। সে সময় একটা জাহাজ বহরের দুই কলাম বসফরাস ব্রীজ অতিক্রম করছিল। জাহাজের দুই কলাম CCTV-র ফোকাসকে আংশিকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।’ বলল দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার।
জেনারেল মোস্তফা ও জেনারেল তাহির পুলিশ অফিসারের কথা শুনছিল, সেই ছবিগুলোও দেখছিল। তারা দেখল, পুলিশ অফিসার যা বলল ঘটনা তাই। আহমদ মুসার ডাইভ দেয়া দু’হাত সামনে ছড়িয়ে রেখে নিপুণ ডাইভারের মত ছুটে আসা দেহ বসফরাসের পানির কিছু উপরে এসে বিশাল জাহাজের আড়ালে চলে গেছে।
ছবিগুলোর দিকে নজর রেখেই জেনারেল তাহির তারিক বলল, ‘জাহাজের দুই কলামের মাঝ বরাবর ফাঁকা থাকার কথা, না কোন নৌযান চলছিল?’
‘চলার কথা না, ধরে নেয়া যায় চলছিল।’ বলল পুলিশ অফিসার।
তাহলে জাহাজের দুই কলাম ছাড়াও আরও ছোট-খাট নৌযানকে প্রত্যক্ষদর্শীর তালিকায় রাখতে হবে।’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘স্যার, সেটাকেও আমরা হিসেবে রেখেছি। সেসব নৌযানকে লোকেট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ পুলিশ অফিসার বলল।
‘ধন্যবাদ।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘জাহাজ বহরটা কোন দেশের ছিল? ওদের বক্তব্য কি?’ জেনারেল তাহির বলল।
‘ওটা ছিল সোভিয়েত যুদ্ধ জাহাজের একটা বহর। যাচ্ছিল ওরা ভূমধ্যসাগরের এক মহড়ায় অংশ নিতে। প্রাথমিক যোগাযোগ ওদের সাথে হয়ে গেছে। তাৎক্ষনিক তারা বলেছে, ব্রীজ থেকে বসফরাসে পড়তে কাউকে তারা দেখেছে কিংবা এরকম কেউ তাদের জাহাজে পড়েছে অথবা উদ্ধার করেছে তারা কাউকে, এমন কোন খবর তাদের কাছে নেই। তবে তারা আরও চেক করে দেখবে।’ বলল পুলিশ অফিসারটি।
‘ধন্যবাদ অফিসার!’ বলে জেনারেল তাহির তাকাল জেনারেল মোস্তফা কামালের দিকে। বলল, ‘আমার মনে হয় আমরা ঘুরে-ফিরে একটু দেখতে পারি। আপনি কি আসবেন?’
‘অবশ্যই, চলুন।’ বলে উঠে দাঁড়াল মোস্তফা কামাল।
পুলিশ ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে জেনারেল তাহির বলল, ‘আসুন আমরা গাড়ি না নিয়ে বসফরাসের তীর ধরে হাটি। করনীয় তো আমাদের কিছু নেই।’
‘চলুন। তবে আমি আশাবাদী কিছু একটা সংবাদ খুব তাড়া তাড়াতাড়িই আমরা পাব। নৌবাহিনীর ওয়াটার স্ক্যানিং কাজ শুরু করে দিয়েছে দেখছি। পানির যে কোন গভীরে হিউম্যান বডিকে ওয়াটার স্ক্যানার লকেট করতে পারে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেল জেনারেল তাহির তারিকের। তার চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া আরও গভীর হলো। বলল, ‘আমরা তাঁর বডি নয়, তাঁকে চাই আমরা। এই বসফরাসে এসে তিনি শেষ হয়ে যাবেন, তা হয় না, হতে পারে না।’ শুষ্ক কণ্ঠ জেনারেল তাহিরের।
‘এটা আমাদের সবারই চাওয়া। আল্লাহ আমাদের এই চাওয়াকে মঞ্জুর করুন।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
বসফরাসের প্রায় পানি ঘেঁষে প্রান্ত বরাবর আপ-ডাউন হাইওয়ে। তার পাশ দিয়ে সুদৃশ্য ফুটপাত। এই রাস্তাগুলো নীল বসফরাসের গলায় যেন হীরকের হার। বসফরাসের তীরে মাঝে মাঝে রয়েছে ফেরী ঘাট। ঘাটগুলো বোট, ফেরি ও মানুষের ভীড়ে ব্যস্ত থাকে। ছোট বোটগুলো ঘাটে ছাড়াও তীরে ভিড়ে থাকে, কিন্তু তা ব্যতিক্রম।
ব্রীজের নিচে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করেছে সকলেই।
ব্রীজের নিচে বিরাট এক ফেরি ঘাট।
ঘাটে বেশ কিছু ফেরি ও বোট দাড়িয়ে আছে। এসব ঘাটে ফেরি ও বড় বড় বোট ছাড়াও ছোট ছোট বোটও ভাড়ায় পাওয়া যায়।
ফুটপাত দিয়ে হেঁটে ফেরিঘাট অতিক্রম করছিল জেনারেল তাহিররা।
‘ঘিয়ে ভাজা কোন কিছুর গন্ধ পাচ্ছি জেনারেল তারিক।’
বলে ডান দিকের পাহাড়ের ঢালের দিকে তাকাল।
বসফরাসের তীর এখানে হাইওয়ে ও ফুটপাতের পর ঢালু হয়ে ক্রমশ উপরে পাহাড়ে উঠে গেছে। এই ঢালে গড়ে উঠেছে মনোরম সব রেস্টুরেন্ট, ক্লাব ও ঘর-বাড়ি।
জেনারেল তাহিরও তাকাল পাহাড়ের ঢালের দিকে।
‘জেনারেল তাহির, আমরা কিন্তু খেয়াল করিনি, লাঞ্চের সময় অনেক আগে পার হয়ে গেছে। বেশি উপরে নয়, এই ঢালেই সুন্দর রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা কি যেতে পারি?’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
খেয়ে সময় নষ্ট করতে মন চাইছিল না জেনারেল তাহিরের। তার কাছে এখন আহমদ মুসার সন্ধান করার চেয়ে বড় কিছু নেই। তবে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে, এ কথাও ঠিক। হয়ত জেনারেল মোস্তফা কামাল বোধ হয় বেশি কষ্ট পাচ্ছে ক্ষুধায়। জেনারেল তাহির সায় দিল জেনারেল মোস্তফা কামালের কথায়। বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা রেস্টুরেন্টে যেতে পারি জেনারেল মোস্তফা।’
লাঞ্চের পিক আওয়ার শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তবে মাঝে মাঝে টেবিল এ দু’চারজন লোক আছে। কেউ কেউ খাচ্ছে, কেউ কেউ বসে গাল-গল্প করছে। গল্পের প্রধান সাবজেক্ট হলো বসফরাস ব্রীজের ঘটনা।
গল্পের সাবজেক্ট শুনে খুশি জেনারেল তাহির তারিক। রেস্টুরেন্টের ঠিক নিচেই দুর্ঘটনার বাঁ ঘটনার স্থান।
মাঝখানের এক ফাঁকা টেবিল দেখে বসেছে জেনারেল তাহিররা।
খেতে শুরু করেছে তারা।
নানারকম কথা তাদের কানে আসছে বিভিন্ন দিক থেকে। ব্রীজে গোলা-গুলি কারা করল, কেন করল-তা নিয়ে নানা রকম ধারনার কথা। ব্রীজ থেকে যে লাফ দিয়ে পড়েছে, সে পাগল না হয়ে যায় না। কেউ বলছে জীবন বাঁচাবার জন্যেই ওটা করেছে। আবার কেউ বলছে, জীবন বাঁচাবার জন্যে কেউ মৃত্যুমুখে ঝাপ দেয় না। বেঘোরে মারা গেল লোকটা।
জেনারেল তাহিরদের পেছনের টেবিলে তিনজন লোক এসেছে সব শেষে। এই মাত্র তাঁর খাওয়া শুরু করেছে। তাদেরই একজন বলল, ‘কিছু না জেনেই বলা হচ্ছে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে লোকটা। আসলে লোকটা মরেনি বলেই মনে হয়। একটা মোটর বোট তাঁকে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে গেছে।’
তাঁর কথা শেষ হতেই তাঁর টেবিলের একজন বলল, ‘দেখেছ তুমি? তখন কোথায় ছিলে?’
‘আমিও একটা বোটে এই ঘাটের দিকে আসছিলাম। গোলা-গুলির মুখে সামনের ঐ বোটটি সামনের দিকে ছুটে পালায়, আমি পিছনের দিকে সরে যাই।’ বলল দ্বিতীয় লোকটি।
খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে জেনারেল তাহির ও জেনারেল মোস্তফা কামাল দু’জনেরই।
শিরদাঁড়া সোজা করে বসেছে তারা। তাদের সমস্ত মনোযোগ এখন ওদের কথার দিকে।
ঐ টেবিলের তৃতীয় লোকটি বলল, ‘সোয়া দু’শ ফিট উপর থেকে পড়লে কারও কিন্তু বাচার কথা নয়।’
‘কিন্তু লোকটা যখন পানিতে ডুবে যাবার পর ভেসে উঠতে পেরেছে, তখন বলতে পার নিজ চেষ্টায় সে ভেসে উঠেছে। তার অর্থ সে মরেনি।’ বলল প্রথম লোকটি।
জেনারেল তাহির ও জেনারেল মোস্তফা কামাল দু’জনেরই দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল চট করে পেছন ফিরে লোকটাকে একবার দেখে নিল। তারপর সে জেনারেল তাহিরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘লোকটার কাছে আরও কিছু জানার আছে।’
‘ওদের খাওয়া শেষ হলেই ভাল হয়।’ বলল জেনারেল তাহির।
‘না, এক মিনিট নষ্ট করা যায় না জেনারেল তাহির।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘তা ঠিক।’ বলল জেনারেল তাহির।
উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
গেল পেছনের টেবিলে।
‘এক্সকিউজ মিঃ জনাব’ বলে পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে লোকটার সামনে ধরে বলল, ‘আমি টার্কিশ ইন্টারনাল সিকিউরিটি সার্ভিস (TISS)-এর ডিজি জেনারেল মোস্তফা কামাল। আমি আপনাদের কথা সামনের টেবিল থেকে শুনেছি। যে লোকটা প্রাণ বাঁচানোর জন্যে বসফরাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তুরস্কের সম্মানিত মেহমান তিনি। ঘটনার সাথে তুরস্কের মর্যাদা জড়িত হয়ে পড়েছে। যে বোটটি তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে তাঁর কোন হদিস কি দয়া করে দিতে পারেন?’
জেনারেল মোস্তফার পরিচয় জানার পর খাওয়া বন্ধ করে তিনজনই উঠে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের বহুল পরিচিত গোয়েন্দা সংস্থা TISS-এর স্বয়ং ডিজিকে তাদের সামনে দেখে তারা মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রথম লোকটি বলল, ‘সিওর স্যার, আমি বলছি।’
বলে একটু থামল লোকটি। স্মরণ করছে সে।
‘আপনারা বসুন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওকে স্যার। ঠিক আছে। বলছি আমি।’
একটু থেমেই বলা শুরু করল, ‘বোটটির পেছনের দু’পাশেই নাম্বার সাইনের উপরে কনকর্ডের ছবি আঁকা ছিল। বোটে ‘কনকর্ড’ মনোগ্রাম ব্যবহার করা একটা আনকমন ব্যাপার। এ কারণেই ‘কনকর্ড’ সাইনটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাঁর সাথে নাম্বার সাইনটিও। নাম্বার সাইনটিও ছিল মজার। মনে পড়ছে নাম্বার সাইনটি ছিল- ‘এমভি’ ড্যাশ ‘বি’ ড্যাশ টি নাইনটি ট্রিপল নাইন (T90999)।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল পকেট থেকে কলম ও নোটপ্যাড বের করে দ্রুত নাম্বার লিখে নিল। তারপর সেখানে দাড়িয়েই পকেট থেকে অয়ারলেস বের করে একটা জরুরি মেসেজ ট্রান্সমিট করলঃ ‘রেড এলার্ট ফর অল সিকিউরিটি সার্ভিস অ্যান্ড পুলিশ। ‘এমভি ড্যাশ বি ড্যাশ টি নাইনটি থাওজ্যান্ড নাইন হান্ড্রেড নাইনটি নাইন’ নাম্বারের মোটর বোট যেখানে যে অবস্থায় পাওয়া যাবে আটকান এবং আমাকে খবর দিন। বোটের বাড়তি চিহ্ন ‘কনকর্ড’ মনোগ্রাম। ওভার।’
মেসেজ শেষ করে জেনারেল মোস্তফা কামাল দাঁড়ানো লোকটিকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি তুরস্কের সীমাহীন উপকার করেছেন। এমন একটা ক্লুর জন্যে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এবং পুলিশ হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখুন।’ বলল লোকটি। তাঁর কণ্ঠও আবেগঘন।
‘আমিন। আমরা সবাই এটা চাই।’ বলে জেনারেল মোস্তফা কামাল আবারো তাদের ধন্যবাদ দিয়ে তার খাবার টেবিলে ফিরে এল।
টেবিলে বসতে বসতে বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কি করার আছে জেনারেল তাহির?’
‘চলুন, আমরা বোট নিয়ে আমরা বসফরাসের দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাই। ও বোটটাতো ওদিকেই গেছে। বোট ডিটেক্ট হবার পর ও দিক থেকেই খবর আসবে। আমরা যতটা সামনে যাব ততটাই আমরা এগিয়ে থাকব।’
‘ঠিক বলেছেন, চলুন, উঠি।’
বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুবার জেনারেল মোস্তফা কামাল একটা পুলিশ বোট কল করল।
রেস্টুরেন্টের বিল চুকিয়ে ঘাটে নেমে এসে দেখল, একটা পুলিশ বোট অপেক্ষা করছে।
একজন পুলিশ অফিসার তীরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।
জেনারেল মোস্তফা কামালরা ওয়াক ওভার ব্রীজ দিয়ে পৌছতেই অফিসার দ্রুত এসে স্যালুট করে বলল, ‘স্যার, বোট রেডি।’
‘এস।’ বলে জেনারেল মোস্তফা কামাল বোটে উঠল। তার পেছনে জেনারেল তাহির। সবশেষে পুলিশ অফিসার।
বোটটা ছোট। দুই রোতে চারটি সিট।
জেনারেল তাহির ও জেনারেল মোস্তফা কামাল সামনের দুই সিটে বসল। পেছনের দুই সিটের একটিতে পুলিশ অফিসার।
ড্রাইভিং সিটে ছিল আরেকটি পুলিশ অফিসার।
‘বোটটি ধীরে ধীরে হর্ন ও মর্মরের সংযোগস্থলের দিকে এগিয়ে নাও। ওখানে গিয়ে আবার ভাবব।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে।
ধীর গতিতে চলেছে বোটটি।
বসফরাসের কামাল আতাতুর্ক থেকে বসফরাস-হর্ন-মর্মর সাগরের সন্ধিস্থল খুব বেশি দূরে নয়। প্রায় এসে পড়েছে বোট সেখানে।
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও জেনারেল তাহির তারিকের অপেক্ষারও অবসান হলো।
ওয়ারলেস বিপ করতে শুরু করল।
শসব্যস্তে কল ওপেন করল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
কথা বলে উঠল ওয়ারলেস।
‘আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ আইদিন গোল্ডেন হর্নের আয়ুব সুলতান ব্রীজ থেকে। ব্রীজের ঘাটে টি ৯০৯৯৯ বোটটি পাওয়া গেছে। বোট ও বোটের লোকজনদের আটকানো হয়েছে। কোন নির্দেশ, স্যার। ওভার।’ ওপ্রান্ত থেকে বলল পুলিশ ইন্সপেক্টর আইদিন।
‘বোটে কোন যাত্রী আছে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফা কামালের।
‘নেই স্যার, তিনজন ক্রু ও মালিক ছাড়া আর কেউ নেই।’ পুলিশ ইন্সপেক্টর বলল।
‘তুমি ওদেরকে আটকে রাখ, আমরা আসছি কয়েক মিনিটের মধ্যে। আমরা এখন হর্নের মুখে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
ওয়ারলেস কল অফ করতেই উদগ্রীব কণ্ঠে জেনারেল তারিক বলল, ‘জিজ্ঞেস করলেন না বসফরাস থেকে উদ্ধার করা লোকটি কোথায়?’
‘বিষয়টা ওদের অজানাই থাক। বোটটা শত্রু পক্ষের কিনা কে জানে! আগে জানলে ওরা সাবধান হতে পারে, কিংবা কিছু ঘটেও যেতে পারে ওখানে। আমরা ক’মিনিটের মধ্যেই ওখানে পৌছাচ্ছি।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ঠিক আছে।’ জেনারেল তাহির বলল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল কোন কথা বলল না। তার দৃষ্টি সামনে হর্নের দিকে।
বোট ইতোমধ্যেই টার্ন নিয়ে দ্রুত গতিতে গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করেছে।
২
তোপকাপি ভিআইপি গোল্ড রিসোর্টের ভিআইপি ক্লিনিক।
সংজ্ঞা ফেরেনি তখনও আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার মাথার কাছে একটা চেয়ারে বসে আছে ডোনা জোসেফাইন।
কয়েকজন নার্স কক্ষটিতে। যে কোন নির্দেশের অপেক্ষায়।
কক্ষে প্রবেশ করল কয়েকজন ডাক্তার।
প্রধান ডাক্তার মানে ক্লিনিকের চীফ ডাঃ মোস্তফা সাইদ দ্রুত এগিয়ে এল ডোনা জোসেফাইনের দিকে। বলল, ‘ম্যাডাম সমস্ত পরীক্ষা শেষ। সব কিছু ওকে আছে। বুকে প্রচন্ড চাপের কারণে ফুসফুসে চাপ পড়ে ফলে অক্সিজেন শূন্য হয়ে যায় ফুসফুস। তার ফলেই সংজ্ঞা হারান তিনি। হার্ট, ব্রেন সব ঠিকমত কাজ করছে এখন। স্বাভাবিক হয়ে আসছেন তিনি।’
বলেই ডাঃ মোস্তফা সাইদ এগিয়ে গিয়ে আহমদ মুসার পালস দেখল। বলল, ‘আমি মনে করি, আর ক’মিনিটের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফিরে আসবে।’
আহমদ মুসার হাতটা আস্তে আস্তে বেদে রেখে বলল, ‘ম্যাডাম, আমরা অফিসে আছি। কোন দরকার হলে নার্সকে বলবেন।’
ডাক্তার বেরিয়ে গেল। নার্সরাও। শুধু দু’জন নার্স থাকল।
ডাক্তাররা সান্ত্বনা দিলেও উদ্বেগের কালো মেঘ জোসেফাইনের মুখ থেকে কাটেনি। তবে আগের সেই অস্থিরতা এখন নেই।
ডাক্তাররা বেরিয়ে যেতেই জোসেফাইনের পারসোনাল সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান নার্স দু’জনকে বলল, ‘সিস্টার, তোমরা বাইরে তোমাদের টেবিলে গিয়ে বস।’
‘ইয়েস ম্যাডাম।’ বলে নার্স দু’জন বেরিয়ে গেল।
কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে জেতেই লতিফা আরবাকান বলল, ‘ম্যাডাম, শয়তানদের কয়েকজন স্যারের বন্ধুর পরিচয় দিয়ে গোল্ড রিসোর্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। গোল্ড রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে তারা আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেছিল যে, ‘আমরা মিস্টার খালেদ খাকানের কর্মস্থল আইআরটিতে তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু। আমরা খালেদ খাকানকে দেখতে এসেছি।’ পুলিশ আমার সাথে যোগাযোগ করলে, আমি তাদের নাম জানতে চেয়েছিলাম। যে পাঁচটি নাম তারা বলল, তাদের চারজনের নাম আইআরটির স্টাফদের সাথে মিলে গেল। একটি নামই শুধু নতুন। ইনি নাকি অফিসের নতুন রিক্রুট। যাদের নাম মিলে যায়, তাদের মধ্যে ডঃ শেখ বাজের নাম ছিল। ডঃ শেখ বাজের সাথে বছরখানেক আগে আমার ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হয়েছিল। আমি তাঁর সাথে কথা বলতে চাইলাম। কথা বলে দেখলাম সে নকল লোক। আরবী ধাঁচে ইংরেজি বলার চেষ্টা করলেও আমার জানা কোনো তথ্যই সে ঠিক মত বলতে পারেনি। পুলিশ ওদের গ্রেফতার করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা গোলা-গুলি চালিয়ে কয়েকজন পুলিশকে আহত করে পালিয়েছে। আপনার মনের উপর নতুন করে প্রেসার সৃষ্টি না হোক, এজন্যেই খবরটা আগে আপনাকে দেইনি।’
‘ধন্যবাদ লতিফা। তুমি একটা বড় বিপদ থেকে আমাদের বাঁচিয়েছ। তুমি এতোটা সতর্ক না হলে বড় একটা কিছু ঘটতে পারতো। কিন্তু ওরা তো শক্তি বৃদ্ধি করে আবার ফিরে আসতে পারে।’ বলল জোসেফাইন।
‘সে সম্ভাবনা নেই। তোপকাপি প্রাসাদ ও সংলগ্ন গোটা এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। গোল্ড রিসোর্টকে সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছে পুলিশ।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল জোসেফাইন।
এ সময় আহমদ মুসার দুই হাত নড়ে উঠল আর নড়তে লাগল তাঁর চোখের দুই পাতা।
মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল জোসেফাইনের। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ওর সংজ্ঞা ফিরে আসছে। যাও লতিফা তুমি আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে এস।’
লতিফা আরবাকান দ্রুত দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করেও ফিরে দাঁড়াল। বলল, ‘ছোট সাহেবের ঘুম যদি না ভেঙ্গে থাকে?’
‘আস্তে আস্তে সুড়সুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে নিও। তার আব্বার কথা শুনলে দেখবে ঘুমের সব জড়তা তার চলে যাবে।’ জোসেফাইন বলল।
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লতিফা আরবাকান।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা।
প্রথমেই তার দু’হাত নরম বেডের উপর বুলাল। তার খোলা চোখ কক্ষের ও জোসেফাইনের মুখে এসে নিবদ্ধ হতে রাজ্যের বিস্ময় নামল আহমদ মুসার চোখে। বলল, ‘জোসেফাইন তুমি! আমি কোথায়?’
জোসেফাইন ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশে বসে তার চুলে হাত ধুঁকিয়ে বলল, ‘তুমি গোল্ড রিসোর্টের ক্লিনিকে।’
‘আমি ছিলাম বসফরাসের পানিতে। এখানে এলাম কিভাবে? আর কাউকে দেখছি না, তুমি জানলে কিভাবে?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘বলছি। আল্লাহর হাজার শোকর। সোয়া দু’শ ফুট উঁচু থেকে কেউ লাফিয়ে পড়ার কথা ভাবতে পারে! আল্লাহ বাঁচিয়েছেন।’ বলল জোসেফাইন।
‘আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমি এখানে কি করে এলাম, এত দূরে, একেবারে তোমার এখানে!’ আহমদ মুসা বলল।
‘সব পরে জানাব। বসফরাস থেকে একটা বোট তোমাকে তুলে নিয়ে আয়ুব সুলতান ব্রীজের ঘাটে পৌঁছে। জটলা দেখে সেখানে হাজির হওয়া আমার বান্ধবী জেফি জিনা তোমাকে দেখে চিনতে পেরে তোমাকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে।’
‘মিস জেফি জিনা ওখানে? আমাকে উদ্ধার করার অর্থ কি? আমাকে কেউ কি বন্দী করেছিল?’ বল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘সব আমি শুনিনি। তোমাকে নিয়ে সবাই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে এটা লতিফা আমাকে বলেছে, তোমাকে এখানে আনার কিছুক্ষণ পরই চার পাঁচজন তোমার অফিস সহকর্মীর পরিচয় দিয়ে গোল্ড রিসোর্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। লতিফা ওদের নাম শোনার পর ওদের ভুয়া পরিচয়ের কথা জেনে গোল্ড রিসোর্টে ঢুকতে দিতে নিষেধ করে। তখন পুলিশকে ওরা আক্রমণ করে। তিনজন পুলিশ আহত হলেও সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’
একটু থামল জোসেফাইন। পরে বলল, ‘থাক এসব কথা। এসব নিয়ে তুমি এই মুহূর্তে ভেব না।’
‘ভাবছি না, অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছি। বুঝতে পারছি, নদীতেও ওদের পাহারা ছিল। ওরাই……।’
জোসেফাইন আহমদ মুসার ঠোঁটের উপর হাত চাপা দিয়ে বলল, ‘প্লিজ, এসব বিষয় এখন থাক। আমাকে একটু সময় দাও। তোমাকে সংজ্ঞাহীন দেখে আমাদের দম বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল।’ ভারী কণ্ঠ জোসেফাইনের। তার দুই চোখের কোনে অশ্রু চিক চিক করে উঠেছিল।
আহমদ মুসা তাকাল জোসেফাইনের দিকে। গভীর, অন্তরঙ্গ দৃষ্টি।
জোসেফাইনের একটা হাত ছিল আহমদ মুসার মাথায়, অন্য হাতটা ছিল বেডের উপর।
আহমদ মুসা বেডের উপর থেকে জোসেফাইনের হাত তুলে নিয়ে টানল জোসেফাইনকে নিজের দিকে।
জোসেফাইন বেডের উপর অনেকটা আলতোভাবে বসে ছিল। সে খসে পড়ল আহমদ মুসার বুকের উপর।
আহমদ মুসার দু’হাত তাঁকে আঁকড়ে ধরতে যাচ্ছিল।
জোসেফাইন আহমদ মুসার বুক থেকে তার মুখ তুলে তার হাতের বাঁধন থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, ‘দরজায় নার্সরা বসে আছে, আহমদ আব্দুল্লাহও এখনি এসে পড়বে।’
জোসেফাইন উঠে বসেছে এই সময় দরজায় নক হলো।
জোসেফাইন উঠে পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘হ্যাঁ, ভেতরে আসুন।’
প্রবেশ করল একজন নার্স। তার হাতে কর্ডলেস টেলিফোন। বলল, ‘এক্সকিউজ মি ম্যাডাম, আপনার একটা কল এসেছে, জরুরি।’
‘কার কল’ জিজ্ঞেস করল জোসেফাইন।
‘জেনারেল মোস্তফা কামাল ও জেনারেল তারিক।’ বলল নার্স।
জোসেফাইন আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে নার্সকে বলল, ‘নিয়ে এস টেলিফোন।’
জোসেফাইন টেলিফোন কানের কাছে তুলে নিয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। আমি জোসেফাইন মানে মিসেস খালেদ খাকান।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আমি জেনারেল মোস্তফা কামাল। মিঃ খালেদ খাকান কোথায়? আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘উনি গোল্ড রিসোর্টের ক্লিনিকে। জ্ঞান ফিরেছে। ভালো আছেন জনাব। টেলিফোন তাঁকে দিচ্ছি।’ জোসেফাইন বলল।
‘থাক, আমরা এখনি আসছি। আল্লাহ তাঁকে দ্রুত সুস্থ করে তুলুন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আসুন জনাব।’
‘ওকে। আসসালামু আলাইকুম।’ বলল ওপার থেকে।
জোসেফাইনও টেলিফোন রেখে দিল।
ডাক্তাররা ভেতরে ঢুকল।
ডাক্তাররা আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়ে কিছু জরুরি জিজ্ঞাসাবাদ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করল।
জোসেফাইন ঘরের একপাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বিস্মিত হয়েছে। ডাক্তারদের কাউকে চিনতে পারছে না সে।
হঠাৎ জোরে দরজা ঠেলে একজন ঘরে প্রবেশ করল। দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘সব ক্লিয়ার, তাড়াতাড়ি।’
তার কথা শেষ হতেই একজন ডাক্তারের হাতে রিভলবার উঠে এল। তাক করল আহমদ মুসাকে এবং চিৎকার করে বলল, ‘হারাজাদাকে ক্লোরোফরম করে বাঁধ।’
ডাক্তারবেশী তিনজন এগুলো আহমদ মুসার দিকে। তাদের একজনের হাতে ক্লোরোফরমের শিশি।
ঘটনার আকস্মিকতায় জোসেফাইন প্রথমে বিমূড় হয়ে পড়েছিল। আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তাক হতে দেখেই জোসেফাইন সম্বিত ফিরে পেল। দ্রুত ওড়নার আড়ালে হাত দিয়ে কাঁধে ঝুলন্ত ছোট ব্যাগের পকেট থেকে ছোট্ট একটা রিভলবার বের করে আহমদ মুসার দিকে রিভলবার তাক করে থাকা ডাক্তারকে লক্ষ্য করে প্রথম গুলী ছুঁড়ল সে। প্রথমেই আহমদ মুসাকে বেকায়দা অবস্থা থেকে মুক্ত করা তার লক্ষ্য।
ডাক্তারটির মাথা গুড়িয়ে দিল জোসেফাইনের গুলী।
গুলীর শব্দে অবশিষ্ট তিনজন ফিরে তাকিয়েছে জোসেফাইনের দিকে।
যে লোকটি পরে ঘরে ঢুকেছিল, তারই চোখ প্রথম পড়েছিল জোসেফাইনের উপর। সংগে সংগে রিভলবার তুলে নিয়েছিল সে। জোসেফাইনও তার দিকে তাকিয়েছিল। সে নিশ্চিত ছিল আহমদ মুসাকে বাঁধতে ও ক্লোরোফরম করতে এগিয়ে যাওয়া তিনজনকে আহত মুসাই ম্যানেজ করতে পারবে।
জোসেফাইনের রিভলবারই প্রথমে টার্গেট করেছিল লোকটিকে। সুতরাং জোসেফাইনের রিভলবারের বুলেটই প্রথমে আঘাত করল লোকটিকে। বুলেটটি বিদ্ধ হয়েছিল তার বুকে। তার রিভলবারেরও ট্রিগার টেপা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বুলেটটি বিদ্ধ হবার পর মর্মান্তিক ঝাঁকুনি তার হাতকে কাপিয়ে দিয়েছিল। গুলীটি লক্ষভ্রষ্ট হয়ে জোসেফাইনের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
ওদিকে আহমদ মুসা ওরা তিনজন একশন এ যাবার আগেই দু’পায়ের স্নেক নক ব্যবহার করে ওদের তিনজনকেই মাটিতে ধরাশায়ী করেছে এবং সংগে সংগেই উঠে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াবার সংগে সংগেই জোসেফাইন তার দিকে রিভলবার ছুড়ে দিয়েছিল।
আহমদ মুসা ওদের দিকে রিভলবার তাক করে বলল, ‘যে যেভাবে আছ, সেভাবে থাক। নড়বার চেষ্টা করো না। তিনজনকে মারতে আমার তিন সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না।’
এই সময় বাইরে অনেকগুলো পায়ের ছুটে আসার ভারী শব্দ পাওয়া গেল।
পরক্ষনেই দরজা ঠেলে ছুটে এসে ঘরে প্রবেশ করল জেনারেল মোস্তফা কামাল, জেনারেল তারিকসহ কয়েকজন পুলিশ।
ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনি ঠিক আছেন তো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। পুলিশকে বলুন এ তিনজনকে এরেস্ট করতে, মিঃ জেনারেল মোস্তফা কামাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হ্যাঁ, এরেস্ট কর তিনজনকে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
ওরা তিনজন তাকাল আহমদ মুসা, জেনারেল মোস্তফা, জেনারেল তাহির ও চারজন পুলিশসহ সবার দিকে। সবার হাতের রিভলবার, স্টেনগান তাদের দিকে তাক করা।
তিনজন পুলিশ ওদের দিকে এগোচ্ছিল।
চতুর্থজন পুলিশ অফিসার। সে বলল ঐ তিনজনকে লক্ষ্য করে, তোমরা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।
পুলিশ অফিসারটির কর্কশ নির্দেশের সাথে সাথেই ওরা শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে এবং তার সাথে সাথেই দেখা গেল তাদের অনামিকা আঙ্গুল তাদের মুখে চলে গেছে।
চমকে উঠে আহমদ মুসা লাফ দিয়ে ওদের সামনে গিয়ে পড়ল। একজনের আঙ্গুল টেনে বের করল তার মুখ থেকে। কিন্তু দেখল সব শেষ হয়ে গেছে। নীল হয়ে উঠেছে তার মুখ।
‘দুর্ভাগ্য, হাতে পেয়েও এদের জীবিত ধরা যাচ্ছে না।’ স্বগত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘ওদের হাতের রিং এ পটাসিয়াম সায়ানাইডের মত কিছু ছিল নিশ্চয়!’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘হ্যাঁ, মিঃ জেনারেল। আগের ঘটনাগুলোতে এধরনের বিষয়ই ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রথম দু’জন দেখছি গুলীতে মরেছে। ওরা দু’জন নিশ্চয় আক্রমণে এসেছিল। এরা তিনজন আক্রমণে আসেনি?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘আসলে ওরা সকলেই এসেছিল ডাক্তারের ছদ্মবেশে আমার কাছে আসার সুযোগ নিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করতে। এরা তিনজন এসেছিল আমাকে বাঁধতে এবং ওরা দু’জন রিভলবার নিয়ে আমাকে পাহারা দিচ্ছিল। আমি নিরস্ত তখন। আমি বাঁধাই পড়ে যেতাম যদি জোসেফাইন ওদের দুজনকে গুলী করে না মারতো। ওরা দু’জন মারা পড়ার পর আমি আক্রমণে যেতে সুযোগ পাই। আর তার রিভলবারও আমার দিকে ছুড়ে দেয়। সেটা দিয়েই ওদের নিষ্ক্রিয় করেছিলাম। তখনই আপনারা এসেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
ঘরের একপাশে দাঁড়ান জোসেফাইনের দিকে না তাকিয়েই জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘তাঁকে মোবারকবাদ। কৃতজ্ঞ আমরা তার প্রতি। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যা পারেনি, সেটা তিনিই করেছেন।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল থামতেই জেনারেল তারিক বলে উঠল, ‘শুধু তাই নয়, বেগম খালেদ খাকান যে বুদ্ধিমত্তা ও দৃঢ়তার সাথে সংজ্ঞাহীন জনাব খালেদ খাকানকে হর্নের আইয়ুব সুলতান ফেরিঘাট থেকে উদ্ধার করে এনেছেন, সেটা বিস্ময়কর। যারা বসফরাস থেকে উদ্ধার করে খালেদ খাকানকে আইয়ুব সুলতান ফেরিঘাট এ নিয়ে এসেছিল, তাদের হাত থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা মিঃ খালেদ খাকানকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু বেগম খালেদ খাকান সেখানে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হন এবং নিজেকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আপনাকে উদ্ধার করে আনতে সমর্থ হন।’
বিস্ময় ফুটে উঠেছে আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা কারা? মানে আমার আইআরটির শত্রুরা। ওরাই যদি হয়, তাহলে একা জোসেফাইন আমাকে ছাড়িয়ে আনল কি করে? কি ঘটনা বলুন তো? আমি কিছু শুনেছি! পুরোটা বলুন।’
‘যারা আপনাকে বসফরাস থেকে তুলে নিয়েছিল, তাদের খোজ পাওয়ার পরই আমরা হর্নের আইয়ুব ফেরিঘাটে চলে আসি। ওদেরকে আমরা পেয়ে যাই। জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা সব কিছু জেনে নেই আপনাকে যাতে দ্রুত খুঁজে পেতে পারি। তারা বলেছে, আপনাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ওখানে ওরা পৌছার পাঁচ মিনিটের মধ্যে দু’জন লোক এসে হাজির হয়। ওরা মনে হয় জেনেই এসেছিল। এসেই আপনাকে দাবি করল যে, আপনি ওদের লোক বসফরাস ব্রীজ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। তারা যখন ওদের সাথে কথা বলছিল এই সময় আপনার স্ত্রী জোসেফাইন ম্যাডাম পাশ দিয়ে ঘাট এ নেমে যাবার পথে ওখানে দাড়িয়ে যান। তিনি আপনাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসেন। তখন উদ্ধারকারীদের সাথে আলাপ চলছিল ওদের। ম্যাডাম জোসেফাইন দ্রুত এগিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘এঁর এ অবস্থা কেন? কি হয়েছে ওঁর?’ উদ্ধারকারীদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করেন এঁকে আপনি চেনেন?
ম্যাডাম জোসেফাইন কথা বলায় আগের যারা মিঃ খালেদকে আগে থেকেই দাবি করছিল, তারা তেড়ে উঠে। একজন বলে, মিথ্যা বলছে এই বিদেশী মহিলা। নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে। ইতিমধ্যেই দু’জন পুলিশ এসে দাড়িয়েছিল। তারাও শুনছিল কথা। লোকটার কথা শেষ হতেই ম্যাডাম জোসেফাইন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমার নাম মারিয়া জোসেফাইন। ইনি আমার স্বামী। নাম মিঃ খালেদ খাকান।’
সংগে সংগেই ওরা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওঁর নাম খালেদ খাকান। ইনি ইনিস্টিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজিতে চাকরি করেন। উনি মিথ্যা পরিচয় দিয়েছেন। দেখুন ইনি ইউরোপীয় আর মিঃ খাকান এশিয়ান।’
পুলিশের একজন এগিয়ে এসে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসার পকেট সার্চ করে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখল। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, উনি ইনিস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড টেকনোলজিতে চাকরি করেন। বলেই পুলিশটি জিজ্ঞেস করল ম্যাডাম জোসেফাইনকে, ‘উনি সত্যিই স্বামী হলে বলুন, উনি যে প্রতিষ্ঠান এ চাকরি করেন তার পুরো নাম কি?’ ম্যাডাম সঠিক জবাব দেন। পুলিশ ওদের জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করে, ‘বল, উনি কোন পদে চাকরি করেন?’ ওরা উত্তর দিতে পারে না। পুলিশ ম্যাডামকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। ম্যাডাম সঠিক উত্তর দেন। এরপর আপনার উচ্চতা ও আইডি মার্ক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। ওরা উত্তর দিতে পারে না। ম্যাডাম ঠিক জবাব দেন। পুলিশ ওদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনাকে ম্যাডামের গাড়িতে তুলে দেয়। ম্যাডাম নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে পুলিশকে অনুরোধ করে তাদের পৌঁছে দিতে। পুলিশ আপনাকে কাছের ক্লিনিকে ভর্তি করতে বললে, ম্যাডাম বলেন, তোপকাপি এলাকায় আমাদের গোল্ড রিসোর্টে নিজস্ব ক্লিনিক রয়েছে, তাঁকে ওখানেই নিতে চাই।’ পুলিশের গাড়ি ম্যাডামের গাড়ির পেছন পেছনে এসে এই গোল্ড রিসোর্টে পৌঁছে দিয়ে যায়।’
কথা শেষ করল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসার চোখেমুখে অপার বিস্ময়। সে অবাক হয়, জোসেফাইনের একজন নতুন বান্ধবী জেফি জিনা তার জন্য এতটা করেছে! নিজেকে ভিন্ন একজনে মানুষের স্ত্রী বলেও পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু জেফি জিনা আমার নাম, আমার প্রতিষ্ঠানের নাম, আমার পদের নাম জানতে পারে, কিন্তু আমার উচ্চতা ও আইডি মার্ক জানল কি করে! এ জিজ্ঞাসার কোন উত্তর পেল না আহমদ মুসা। বরং বিস্ময় বাড়লই তার।
আনমনা হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা।
এই বিস্ময় জোসেফাইনেরও চোখে-মুখে। জেফি জিনা সেখানে আমার নামে পরিচয় দিয়েছে! হ্যাঁ, সে পরিচয় না দিলে তো সে সংজ্ঞাহীন আহমদ মুসাকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে পারতো না। জেফি জিনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল জোসেফাইনের মন। অকল্পনীয় ও দুঃসাহসিক এক উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে সে। ভাগ্যিস জেফি জিনার দেওয়া তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়নি। ভুল প্রমাণ হলে সেও বিপদে পড়তো। কিন্তু জেফি জিনা আহমদ মুসার এসব তথ্য জানল কি করে। এসব ভাবনা তার বিস্ময় আরও বাড়িয়েই দিল।
জেনারেল মিঃ মোস্তফা কামাল বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, ক্লিনিকের ভিন্ন একঘরে আপনাকে নিতে হবে।’
জেনারেল মোস্তফার এ কথার দিকে কোন মনোযোগ নেই আহমদ মুসার। বলল, ‘কি ঘটল বলুন তো। শুরুতেই তো এরা একবার এ ক্লিনিকে হানা দিয়েছিল। কিন্তু তার পরে তো সতর্ক পাহারাই থাকার কথা ছিল।’
পুলিশ অফিসারের চোখে সঙ্কুচিত ভাব ফুটে উঠল। সে একটু এগিয়ে সামনে পড়ে থাকা একটি লাশের গা থেকে ডাক্তারের অ্যাপ্রন সরিয়ে বলল, ‘স্যার, এই দেখুন এরা সুপার সিকিউরিটি ফোর্স (SSF) এর ইউনিফরম এরা এসেছিল। এক গাড়িতে ওরা ১৫জন এসেছিল। ওরা এসে প্রথমেই গোল্ড রিসোর্ট চেকপোস্টের দখল নিয়েছিল। এজন্য পুলিশ দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। ওদের বাধা দিতে গেলে সংঘর্ষে যেতে হয়, এ সাহস তারা পায়নি। ওদের কয়েকজন চেকপোস্ট দখল করে পুলিশদের নিরস্ত্র করে সেখানকার পুলিশদের হত্যা করে সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার দিয়ে। ভুয়া SSF-এর অবশিষ্ট কয়েকজন অন্য পুলিশদের দিকে ছুটে যায়। বাকিরা ছুটে আসে ক্লিনিকের দিকে। ডাক্তাররা বলেছে, ‘সশস্ত্র লোকরা ভেতরের ডাক্তারদের পোশাক খুলে নেয়।’
থামল পুলিশ অফিসারটি।
সংগে সংগেই জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘SSF-এর একটা ইউনিট আসছিল তোপকাপি প্রাসাদে। তাদের গাড়ি নির্জন এপ্রোচ গার্ডেনে প্রবেশের সংগে সংগেই একটা গ্যাস বোমা এসে পড়ে গাড়িতে। মুহূর্তে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে সবাই। ঐ SSF-দের ইউনিফরম ও গাড়ি নিয়ে সন্ত্রাসীরা গোল্ড রিসোর্টে হামলা চালায়। এক মাত্র ড্রাইভার শেষ মুহূর্তে বাঁচবার চেষ্টা করেও আংশিক আক্রান্ত হয়। সে তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে পেয়ে টেলিফোন করে SSF হেডকোয়ার্টারে। আমরা জানতে পারি তার পরেই। এসএসএফ উদ্ধার ইউনিট ছুটে আসে, আমরাও ছুটে আসি। পুলিশও খবর পেয়ে পৌঁছে যায়।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল থামতেই আহমদ মুসা মুখ খুলেছিল কিছু বলার জন্যে।
তখন তিনজন ডাক্তার প্রবেশ করল ঘরে। তাদের কারও ডাক্তারের অ্যাপ্রন নেই। অন্যান্য স্টাফদের সাথে এ তিনজন ডাক্তারকেও আটকে রেখেছিল সন্ত্রাসী ‘থ্রী-জিরো’র লোকরা।
ঘরে প্রবেশ করল এ সময় জোসেফাইনের পার্সোনাল সেক্রেটারি লতিফা আরবাকান আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে। তার চোখে মুখে বিস্ময় ও আতঙ্ক।
সে ছুটে এল ঘরের একপাশে দাঁড়ানো জোসেফাইনের কাছে।
‘ডাক্তার, আপনারা মিঃ খালেদ খাকানকে ভিন্ন ঘরে নিয়ে যান। তাকে ভাল করে দেখুন। জ্ঞান ফেরার পরই তার উপর দিয়ে বিরাট ধকল গেছে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল একজন ডাক্তারকে লক্ষ্য করে।
‘প্লিজ জেনারেল মোস্তফা, আপনারা আপত্তি না করলে ওকে এখন অন্য ঘরে নয়, আমি বাসায় নিয়ে যেতে চাই।’ বলল জোসেফাইন।
জেনারেল মোস্তফা কামাল জোসেফাইনের দিকে চকিতে একবার মুখ তুলল, মুখ নামিয়ে নিল সংগে সংগেই। বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাডাম। আমাদের আপত্তি নাই।’
তারপর ডাক্তারের উদ্দেশ্য করে জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘আপনারা জনাব খালেদ খাকানকে দেখুন। তারপর ওকে গোল্ড রিসোর্ট কটেজে রেখে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে আসুন।’
ডাক্তারদের দিক থেকে ফিরে জেনারেল মোস্তফা কামাল পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘এখন থেকে গোল্ড রিসোর্টের নিরাপত্তায় পুলিশের সাথে সাথে এসএসএফও থাকবে।’
বলেই উঠে দাঁড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল, তার সাথে সাথে জেনারেল তাহিরও।
‘মিঃ খালেদ খাকান, আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা পরে কথা বলব। এখন চলি।’ আহমদ মুসার দিকে দিকে ফিরে বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আসুন। আয়েশা আজীমা মানে ডঃ বাজের ওখান থেকে কিছু পাওয়া গেছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তেমন কিছু নয়। তবে ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি। আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। এক সাথে সব পরীক্ষা করা যাবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আর একটা কথা। ওরা এখন মরিয়া হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তার দিকে বেশি নজর দিতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দোয়া করুন মিঃ খালেদ খাকান। আর আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। আল্লাহ আপনাকে যেভাবে বাঁচিয়েছেন, সেভাবেই আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। আসি। আসসালামু আলাইকুম।’
ওরা বেরিয়ে গেল।
‘স্যার, পাশের রুম এ চলুন। আমরা আপনার ব্লাডপ্রেসার ও হার্টবিটটা একটু দেখতে চাই।’ বলল একজন ডাক্তার আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ আবদুল্লাহ গিয়ে গাঁট হয়ে বসেছিল আহমদ মুসার কোলে। তার চোখে-মুখে কিন্তু আনন্দের চেয়ে বিস্ময়ই বেশি। সে বারবারই তাকাচ্ছে ছড়ানো রক্ত আর পরে থাকা লোকগুলোর দিকে।
জোসেফাইন এগিয়ে গিয়ে আহমদ আব্দুল্লাহকে আহমদ মুসার কোল থেকে নিয়ে বলল, ‘ও আমার কাছে থাক। এসো পাশের রুমে।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
লতিফা আরবাকান গিয়ে জোসেফাইনের কোল থেকে আহমদ আব্দুল্লাহকে নিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি স্যারকে পাশের রুম এ নিয়ে যান।’
আহমদ আবদুল্লাহ লতিফা আরবাকানের কোলে উঠেই তার মাথায় বাঁধা রুমাল নিয়া টানাটানি আরম্ভ করল।’
‘হ্যালো স্যার জুনিয়র, একি করছ তুমি। তোমার তো কাজ হবে মানুষের নেকাব রক্ষা করা, বেনেকাব করা নয়।’ বলল লতিফা আরবাকান। তার মুখে আনন্দের হাসি।
হাসল জোসেফাইন। বলল, ‘বল বেটা আহমদ, এটা আমার অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। মায়ের কোল থেকে কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদ।’
আহমদ মুসার ঠোটে হাসি।
চোখ তার নিচু।
হাঁটতে শুরু করেছে সে দরজার দিকে।
জোসেফাইনও তার পাশে হাঁটছে।
লতিফা আরবাকান আহমদ আব্দুল্লাহর বিদ্রোহের সাথে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে আর ওদের পেছনে পেছনে হাঁটছে।
সবশেষে বেরিয়ে এল ডাক্তাররা।
দরজার বাইরে পুলিশ, এসএসএফ-এর লোকরা ও দু’জন ক্লিনার দাড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুতেই পুলিশ ও এসএসএফ-এর লোকরা তাকে স্যালুট করল।
একজন পুলিশ এগিয়ে এসে আহমদ মুসাকে পাশের ঘরের দিকে নিয়ে চলল।
বিস্ময়কর এক স্থানে তোপকাপি প্রাসাদের গোল্ড রিসোর্ট অতিথিশালা।
অতিথিশালার ডুপ্লেক্স কটেজের দু’তলার পূর্ব দিকের একটা ইজি চেয়ারে আধ-শোয়া অবস্থায় আহমদ মুসা। তার স্থির দৃষ্টি সামনে, এক খণ্ড সাগরের বুকে। মর্মর সাগর, বসফরাস ও গোল্ডেন হর্নের মিলিত স্থান এটা। এই সাগর শুধু পানির নয়, স্মৃতিরও এক সমুদ্র, তোপকাপি প্রাসাদের মত গৌরবেরও সাগর এটা। ইউরোপ বিজয়ী মুসলিম সেনাবাহিনীর কলতানে মুখরিত ছিল এই সাগর। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ, সুলতান সুলায়মান, সুলতান বায়েজিদের মত জগত বিখ্যাত দিগ্বিজয়ী মুসলিম রাষ্ট্রনায়করা হর্ন-বসফরাস-মর্মরকে হয়তো এভাবেই দেখেছেন।
নিজেকে স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে ফেলেছিল আহমদ মুসা।
একটি ট্রেতে করে দুই গ্লাস ফলের রস ও একটি বাটিতে বাদাম নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করল জোসেফাইন।
আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে ট্রেটা দুই ইজি চেয়ারের মাঝখানের টি-টেবিলে রেখে পাশের ইজি চেয়ার এ বসল জোসেফাইন।
সালামের জবাব দিয়ে আহমদ মুসা ইজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আহমদ আবদুল্লাহ কোথায়?’
‘লতিফার সাথে পেছনের বাগানে।’ বলল জোসেফাইন।
‘লতিফার সাথে ভাব হয়েছে কেমন? কিছুক্ষণ আগে আমার কোলে উঠে তো বিদ্রোহ করল।’
‘ওটা বিদ্রোহ ছিল না, ছিল তোমার কোলে থাকার ওঁর আকাঙ্ক্ষা। তোমাকে সব সময় পায় না, পেলে আর ছাড়তে চায় না।’ বলল জোসেফাইন।
‘তোমাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি, এখন আবার বাচ্চাকেও কষ্ট……।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হলো না। জোসেফাইন আহমদ মুসার মুখে হাত চাপা দিল। বলল, ‘এ প্রসঙ্গ থাক। জেফি জিনার তখন শেষ হয়নি। কিছু ভাবলে?’
‘জেফি জিনা নিজেকে আহমদ মুসার স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছেন, এটা সে সময়ের জন্যে খুব স্বাভাবিক ছিল। স্ত্রী পরিচয় না দিলে তিনি আমাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারতেন না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে সময়ের জন্যে ওটা খুব স্বাভাবিক ছিল অবশ্যই। কিন্তু একজন মেয়ে নিজেকে অন্য কারও হৃদয় অত্যন্ত বড় না হলে, অসম্ভব আন্তরিক না হলে বান্ধবীর স্বামীকে ঐ অবস্থায়ও নিজের স্বামী বলে পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। আর তার সাথে আমার পরিচয়ও তেমন নয়। আসলে তার মত এমন কাউকে আমি জীবনে দেখিনি, তিনি এসেই যে আমাকে জয় করে নিয়েছেন। আমি তাকে কতোটা ভালবেসেছি জানি না, কারণ তার পরীক্ষা কখনও হয়নি। কিন্তু তিনি আমাকে অসম্ভব রকম আপন করে নিয়েছেন।’ জোসেফাইন বলল।
‘তুমি ঠিক বলেছ জোসেফাইন। তিনি সত্যিই অসাধারণ একজন। কিন্তু আমার সাথে তার দেখা হলো না। তিনি কি বান্ধবীর স্বামীকে এড়িয়ে চলছেন? সংজ্ঞাহীন একজনকে নিয়ে এসে, তার সংজ্ঞা না ফিরে আসতেই চলে যাওয়ার অর্থ এটাই।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইনকে একটু বিব্রত দেখালো। এই চলে যাওয়াটা তার কাছেও স্বাভাবিক মনে হয়নি। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘জেফি জিনা একজন শ্বেতাঙ্গীনি হলেও ইসলামের বিধি-বিধান আন্তরিকভাবে মেনে চলেন। হতে পারে বিনা প্রয়োজনে বান্ধবীর স্বামীর মুখোমুখি হওয়াকে ঠিক মনে করেন না।’
‘হতে পারে। কিন্তু বলত, আমার উচ্চতা, ওজন, আইডি মার্ক, ইত্যাদি তথ্য তিনি কিভাবে জানলেন? এতো সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি গণক এমন দাবি নিশ্চয়ই করবেন না।’
‘এ বিস্ময় তো আমারও। জেফি জিনা টেলিফোন করলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এ কথা। সে হেসে বলেছল, ‘এটা আল্লাহরই একটা সাহায্য। এ সাহায্য এমনভাবে ওঁর জন্যে আসবে, এটা আল্লাহর তরফ থেকেই ব্যবস্থা হয়েছিল।’ বলল জোসেফাইন।
‘এটা জবাব বটে, কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হয় না।’ আহমদ মুসা বলল।
জোসেফাইন উত্তর দেবার আগেই টি-টেবিলে রাখা আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে নিল আহমদ মুসা। কল অন ও লাউডস্পিকার অন করে দিয়ে বলল, ‘হ্যালো।’
ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল কণ্ঠ, ‘আসসালামু আলাইকুম। থ্যাংকস গড, আপনাকে পেয়েছি স্যার। আমি খুব বিপদে।’
‘বলো সাবাতিনি। কি ঘটেছে, কি বিপদ?’ আহমদ মুসা বলল। হাতের চায়ের কাপটি টি-টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা।
ওপ্রান্ত থেকে সাবাতিনির কণ্ঠ, ‘আজকেই আমাকে রোমেলী দুর্গে যেতে হবে সেই কাজের জন্যে।’
‘হ্যাঁ, আজ প্রধান বিজ্ঞানী আন্দালুসির সাপ্তাহিক অবকাশে বাসায় যাবার কথা। কিন্তু তুমি বিপদ ভাবছো কেন?’
‘বিপদ নয় কেন? ধরা পড়ে গেলে হয় জেলে যেতে হবে, নয়তো গুলী খেয়ে মরতে হবে। আর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ওরাও ছাড়বে না।’
‘ছাড়বে না বলছো কেন? ওরা কি তোমাকে কোন থ্রেট করেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘থ্রেট ওইভাবে করেনি তবে বলেছে, সহজ কাজটা তোমাকে পারতেই হবে। মনে রেখ, আমাদের কোন প্রোগ্রামে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই কিন্তু। এই কথা থ্রেট ছাড়া আর কি!’
থামল সাবাতিনি মুহূর্তের জন্যে। বলে উঠল আবার, ‘স্যার, শখের বশে গোয়েন্দা হতে চেয়েছিলাম। এমনটা হবে ভাবিনি। মনে হচ্ছে আমাকে তারা তাদের কর্মী মনে করছে। তাদের লোকদের মতই আমাকে ডিল করছে। কিন্তু আমি ওদের লোক নই, ওদের কোন পয়সা আমি নেই না। আমার খুব ভয় করছে স্যার।’ কান্নাভেজা কণ্ঠ সাবাতিনির।
‘কোন ভয় নেই। তুমি ঠিক সময়ে রোমেলী দুর্গে যাও, সাহসের সাথে কাজটা করবে। যাই ঘটুক আমি দেখব। তোমার কোন ক্ষতি হবে না।’ আহমদ মুসা বলল সান্ত্বনার সুরে।
‘কিন্তু আপনি কোথায়? কিভাবে আমাকে দেখবেন। তাহলে আপনি রোমেলী দুর্গে আসুন।’ আকুল অনুরোধ ঝরে পড়ল সাবাতিনির কণ্ঠে।
‘আমার উপর আস্থা আছে?’
‘আছে স্যার। একশ ভাগের বেশি।’
‘তাহলে যাই ঘটুক, মনে করবে আমি তোমার পাশে আছি। শোন, তোমার প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচ এখন কোথায়?’
‘মানে এখন বর্তমানে?’
‘হ্যাঁ ’
‘তিনি ছুটিতে যাচ্ছেন। আজই ছুটি নিয়েছেন। টিচার্স কোয়ার্টার থেকেও বেরিয়ে এসেছেন। তিনি তার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন বসফরাসের ওপারে ফাতিহ পাশা পার্ক এলাকায় একটা বাড়িতে।’
একটু চিন্তা করল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কাজের জন্যে সে রিভলবারটা তিনি তোমায় দিয়ে দিয়েছেন?’
‘না দেননি। আমি এখন সেখানে যাচ্ছি। ওটা দেবার জন্যে তিনি ডেকেছেন।’
‘কিভাবে যাবে, চিনবে কি করে?’
‘ঠিকানা দিয়েছেন স্যার এইমাত্র।’
‘কি ঠিকানা?’
‘ফাতিহ পাশা পার্কের পূর্ব-দক্ষিণ পাশ বরাবর রাস্তার ওধারে ২৯৫ নাম্বার বাড়ি। আমাকে বলা হয়েছে, বাড়িটির গেটের শীর্ষ ফলাগুলোর মধ্যে ডান থেকে নাম্বার শিষ ফলা স্পর্শ করে গেটবক্সের সামনে গিয়ে দাড়াতে হবে, মিনিট খানেকের মাঝেই একজন বেরিয়ে এসে একটা গিফটবক্স দিয়ে যাবে।’
‘আর কোন পরামর্শ দিয়েছেন তিনি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। যদি ধরা পড়ে যাই আমি। তিনি বলেছিলেন, আমাদের কোন লোক ধরা পড়ে না। যদি বোঝ তুমি ধরা পড়ছ তাহলে তোমার রিভলবারের ট্রিগার-রিং এর মাথার উপরে একটা লাল বোতাম আছে, তাতে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে জোরে চাপ দেবে। সংগে সংগে খবর আমাদের কাছে পৌঁছে যাবে। রোমেলী দুর্গ থেকে তোমাকে আমরা সংগে সংগেই উদ্ধার করে ফেলব।’ থামল সাবাতিনি।
লাল বোতামের কথা শুনতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। সাবাতিনি থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘সাবাতিনি খবরদার, ভুলেও লাল বোতামে চাপ দেবে না।’
‘কেন?’ প্রশ্ন সাবাতিনির। তার কণ্ঠে ভয়।
‘ওতে ‘পয়জন পিস’ আসে।চাপ দেবার সংগে সংগেই তোমার মৃত্যু হবে। ভয় করো না, লাল বোতামে চাপ না দিলে তোমার কোন ক্ষতি হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
সাবতিনি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। পরে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। আমাকে বাঁচালেন। স্যার, আমার বাসায় এমন মৃত্যু দেখেছি। মনে পড়ছে আমার। ওরা এতবড় বিশ্বাসঘাতক, এতবড় খুনি স্যার। আমি তার অনুরোধে শখের বসে কাজ করছি, কোন বিনিময় তো ওদের কাছে নেইনি।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়া সাবাতিনির কণ্ঠ।
আহমদ মুসা কিছু বলবার আগেই সাবাতিনির কণ্ঠ আবার শোনা গেল, ‘আমি যদি ওদের এই কাজ না করি, করবো না আমি।’
‘ওদের এই কাজ না করেও তুমি বাঁচতে পারবে না। তোমার আব্বা-আম্মার উপরও বিপদ নেমে আসবে। ওদের নিষ্ঠুরতার কোন সীমা নেই। তার চেয়ে শোন, ওরা যেভাবে বলছে কাজটা করে দাও, শুধু লাল বোতামে চাপ দেয়া ছাড়া। কাজটা ঠিকভাবে করেছ, সেটা ওদের খুবই দরকার আর এটা তোমার বাঁচার জন্যে দরকার। আমাদের জন্যেও খুব দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আগের দুটো বুঝলাম, আপনাদের কেন দরকার সেটা বুঝলাম না স্যার।’ সাবাতিনি বলল।
‘ওরা হেলিকপ্টার ফলো করবে এবং বিজ্ঞানীর বাড়ি যাবে। ওদেরকে এভাবে আমরা দিনের আলোতে আনতে চাই।’
‘বুঝেছি স্যার। ব্যাপারটা চোরের উপর বাটপারি।’ বলল সাবাতিনি। তার কণ্ঠ এবার হালকা।
থেমেই আবার বলে উঠল সাবাতিনি, ‘ওদের নয় স্যার, আপনার নির্দেশেই আমি এ কাজ করবো।’
‘ওয়েলকাম সাবাতিনি। তুমি নিশ্চিন্ত থাক। ওখানে তোমার ধরা পড়ার কোন ভয় নেই, ওদিক থেকে তোমার ক্ষতি হবে না। আমার উপর নির্ভর করতে পার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমার পরিচিত দুনিয়ার মধ্যে আমি সবচেয়ে আপনার উপরই নির্ভর করি। আপনি বললে আমি বোধহয় আস্থার সংগে আগুনেও ঝাপ দিতে পারি।’
‘এমন অন্ধ নির্ভরতা ঠিক নয় সাবাতিনি। আল্লাহর পরে নিজের বিবেককেই মনে করতে হবে সবচেয়ে বড়। যাক, শোন, প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচের কোন আইডি মার্ক আছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তার মাথায় একটা চুলও নেই। তাই তিনি সবসময় লাল তুর্কি টুপি পড়ে থাকেন। চোখ দুটো তার তীরের মত তীক্ষ্ণ। খুব অস্বস্থিকর চোখের দৃষ্টি। বোধহয় এটা আড়াল করার জন্যে গোল্ডেন কালারের ডীপ সানগ্লাস পরেন। তার বাঁ কানের নিচে একটা ক্ষতচিহ্ন আছে। ফেস মেকআপ দিয়ে ওটাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। আর……।’
সাবাতিনিকে আর এগুতে দিল না আহমদ মুসা। তার কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর দরকার নেই সাবাতিনি। তোমাকে ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি ওখানে যাত্রা করছি স্যার। ওখান থেকেই রোমেলী দুর্গে আসবো। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওকে সাবাতিনি। ওয়া আলাইকুম সালাম। আল্লাহ তোমার সহায় হোন।’
বলে আহমদ মুসা কল অফ করে মোবাইল রেখে দিল।
মোবাইল রাখতেই জোসেফাইন বলল, ‘তুমি তাকে আশ্বাস দিলে, কিন্তু মেয়েটি উভয় সঙ্কটে। একদিকে মৃত্যু, অন্যদিকে পুলিশে ধরা পড়ার ভয়। কেন তুমি তাকে এমন বিপদের মুখে ঠেলে দিলে?’
‘তুমি জান, মেয়েটি আগেই ওদের ট্রাপে পড়েছে। ওদের ইচ্ছে মত না চললে, তাকে ওরা বাঁচতে দেবে না।
আমি তাকে ও তার পরিবারকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।’
‘কিভাবে?’
‘সাবাতিনি ওদের দেয়া দায়িত্ব পালন করবে, তাতে সে ও তার পরিবার বাঁচবে। মনে করেছিলাম, ওকে গ্রেফতার করাব। কিন্তু তা করলে শত্রুরা তাদের বর্তমান প্রোগ্রাম পাল্টে ফেলবে। আমরা ওদের ফাঁদে ফেলার সুযোগ হারাব। অন্যদিকে সাবাতিনিকে ওরা কোন সন্দেহ করতে পারবে না। তার ও তার পরিবারের কোন ক্ষতি হবে না। সে বাইরে থাকলে আরেকটা উপকার হবে, শত্রুদের সম্পর্কে জানার সে একটা মাধ্যম হবে।’
‘কিন্তু মেয়েটিকে এই বিপদজনক কাজে ব্যবহার করা তোমাদের ঠিক হবে না। তোমার উপর মেয়েটির সীমাহীন আস্থা।’
‘আমি জানি জোসেফাইন। আমার বা আমার মিশনের জন্যে তাকে ব্যবহার করিনি। আমি তা করি না। আমার ভার আমিই বহন করি। আজ তাকে আমি চাপ দিয়ে রোমেলী দুর্গে যে পাঠালাম, সেটা তার ও তার পরিবারের ভালোর জন্যেই। প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচের ঠিকানা ও আইডি জানায় আমার উপকার হয়েছে, কিন্তু তাতে তার ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
জোসেফাইন একটু এগিয়ে এসে আহমদ মুসার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আমার গর্ব যে, তোমার এই সুবিচারবোধ অন্য যে কারো চেয়ে বেশি।’
আহমদ মুসা কাঁধ থেকে জোসেফাইনের হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আল্লাহর বান্দাদের তো উচিত নিজের সুবিধার চেয়ে অন্যের অসুবিধাকে অগ্রাধিকার দেয়া। সুন্দর ও শান্তির সমাজ, যা আল্লাহ চান, এভাবেই গড়ে উঠতে পারে।’
বলেই আহমদ মুসা এক হাত দিয়ে মোবাইলটা আবার তুলে নিল।
‘জেনারেল মোস্তফাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেই!’ বলে আহমদ মুসা একটা কল করল।
ওপারে জেনারেল মোস্তফার কণ্ঠ পেয়ে সালাম দিয়ে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, সাবাতিনি রোমেলী দুর্গে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী মিঃ আন্দালুসির হেলিকপ্টারের টেকঅফ ক’টায়?’
‘এখন থেকে দুঘণ্টা পর ঠিক বেলা দশটায়। এই মাত্র আমি সব খোঁজ নিলাম সব ঠিক আছে। আপনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই কাজ হবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘প্রোগ্রামের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে জেনারেল মোস্তফা। সাবাতিনিকে তার কাজ শেষ করে নীরবে চলে যেতে দিতে হবে। আচ্ছা বলুন তো, অভিজাত সিজলি বা বিয়েগ্ল এলাকায় কোন ভিআইপির বাড়ি কি খালি আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
জেনারেল মোস্তফা একটু চিন্তা করে বলল, ‘হ্যাঁ, সুইচ কনসুলেটের একটা ভাড়া নেয়া বাড়ি খালি হয়েছে। সুইচ কনসাল আঙ্কারায় বদলী হয়ে গেছেন। নতুন কেউ সহসা আসছেন না সম্ভবত। ওরা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িটির নাম ‘ওয়েসিস’।’
‘তাহলে ব্যবস্থা করুন, হেলিকপ্টার ঐ বাড়িতেই ল্যান্ড করবে। বাড়িতে জনাব আন্দালুসির একটা নেমপ্লেট লাগিয়ে দিন।’
‘বুঝেছি মিঃ খালেদ খাকান। বাড়িটাকে আন্দালুসির বাড়িতে পরিণত করতে হবে। চাকর-বাকর, কুক, ড্রাইভার সবাই হবেন গোয়েন্দা, এই তো। সাবাতিনিকে গ্রেফতার করতে নিষেধ করছেন কেন? ওদিক থেকে তার কোন ভয় নেই? কিংবা ওদিকের সাথে এই দরজা আরও খোলা রাখতে চান?’
‘দু’টোই। আয়েশা আজীমার মৃত্যুর পর সাবাতিনি ছাড়া আর কোন মাধ্যম আমাদের হাতে নেই। আরেকটা কথা জেনারেল, আজ দুপুর বারটার দিকে আমি ফাতিহ পাশা পার্ক এলাকায় একটা বাড়িতে যাব। পার্কের পূর্ব-দক্ষিন এলাকায় হবে বাড়িটা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি যখন যাবেন, তখন সেটা নিশ্চয়ই ছোট ব্যাপার নয়?’
‘টার্গেটটা বড়। ধরতে পারলে ভালো। এ জন্যে বিষয়টা আপনাকে জানালাম। ঐ এলাকায় আপনার কিছু লোক থাকতে পারে।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু অতবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল আপনার উপর দিয়ে। আজকেই কি আপনার বের হওয়া উচিত?’
‘কিন্তু দেরি করা যাবেনা। সে ইতিমধ্যেই জায়গা চেঞ্জ করেছে। কর্মস্থল থেকে সে ছুটিও নিয়েছে। সে আবারও জায়গা বদলাতে পারে। আর আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে। আমাদের লোকরা পার্কের ঐ এলাকায় থাকবে। যদি দরকার হয়, তাহলে আমাদের সিকিউরিটির প্রথম নাম্বারটায়, যা আপনার মোবাইলে আছে, টেলিফোন করে জিরো নাইন জিরোতে কল করবেন, তাহলে পার্ক এলাকার টিম লিডারকে পেয়ে যাবেন।’
‘ধন্যবাদ জেনারেল।’
‘ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।’ ওপার থেকে টেলিফোন রেখে দিল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখতেই জোসেফাইন বলে উঠল, ‘তোমাকে যেতে বাধা দেব না, কিন্তু বসফরাস ব্রীজ হয়ে ওপারে যাও আমার মন তা মেনে নিতে পারছে না। তুমি বোট নিয়ে ওপারে যাও।’
‘ওয়াটার ওয়েকে তুমি নিরাপদ মনে করছ কেন?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘ওরা জানে তুমি এখানে আছো। নিঃসন্দেহে বলা যায় ওরা সম্ভাব্য সকল সড়কপথের উপর চোখ রাখছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘এ ভয় যদি তুমি কর, তাহলে সব রুটেই ভয় আছে। কারণ আমি গোল্ড রিসোর্টের তোপকাপি প্রাসাদ এলাকা থেকে বের হলেই ওরা খবর জানতে পারবে। এর ফলে সড়ক পথ কিংবা পানি পথ যে পথেই যাই ওরা খবর পেয়ে যাবে। সেদিন যে আমি বসফরাস ব্রীজে আক্রান্ত হলাম, সেটা তারা আয়েশা আজীমার বাড়ি থেকে বের হবার পরই জানতে পারে। তবে সেদিন ওরা যে সুযোগ পেয়েছিল, আজ তা পাবে না। সেদিন আমি শুধু অসতর্ক নয়, সামনের দৃষ্টিটা থাকলেও আমি নিজেকে নিজের মাঝে হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এমন তো তোমার হয় না। কি ভাবছিলে তুমি।’
‘আয়েশা আজীমার কাহিনী ও ডঃ বাজের জন্যে তার অকপট স্বীকারোক্তি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আয়েশা আজীমা শুধু নিজেকেই কুরবানী দেয়নি, তার স্বজাতির ষড়যন্ত্রকেও খানিকটা প্রকাশ করে দিয়েছে। এভাবে আচ্ছন্ন থাকার কারণেই আয়েশা আজীমার বাড়ির ড্রাইভার, দারোয়ান ও কাজের লোকদের কেউ যে বাড়ির ঘটনা বাইরে সংগে সংগেই পাচার করতে পারে, সে কথা তখন মনেই আসেনি আমার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আসলে তোমার মনটা খুব সেনসিটিভ, খুব নরম। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর ‘রাহমান’, ‘রহিম’ পরিচয়টাই সৃষ্টি জগতের জন্যে সবচেয়ে বড়। মহান আল্লাহ নিজেই তার সম্পর্কে কুরআন শরীফে বলেছেন, ‘দয়াকে তোমার প্রভু তার জন্যে কর্তব্য হিসেবে ঠিক করেছেন।’ মানুষের মধ্যেও দয়া দেখাতে আল্লাহ বেশ ভালোবাসেন। আর তোমার মধ্যে দয়ার প্রকাশ আমাকে বেশি গর্বিত করে। যাক, আরেক……।’
কথা শেষ করতে পারল না জোসেফাইন। তার কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলল, ‘তাহলে আমার কঠোরতা নিশ্চয়ই তোমাকে দুঃখিত করে?’
গম্ভীর হলো জোসেফাইন। বলল, ‘তোমার কঠোরতা আইনের পক্ষে, নীতির পক্ষে, একেই বলে সুবিচার। মজলুমের পক্ষে দাড়িয়ে, সুবিচারের পক্ষে দাড়িয়ে যে কঠোরতা, তা মানবতা ও দয়া থেকেই উৎসারিত। এটা দয়ার উন্নততর রূপ। ইসলামের শান্তি আইনের কঠোরতা মানুষ ও মানবতার প্রতি অপার ভালোবাসা থেকেই নির্ধারিত।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। তুমি কিন্তু দার্শনিক হয়ে যাচ্ছ। যাক, বল, তুমি কি যেন বলতে যাচ্ছিলে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও আচ্ছা, আমার একটা কৌতূহল, বসফরাসের অস্বাভাবিক ঐ উচ্চতা থেকে কিভাবে লাফিয়ে পড়েছিলে। আমি অবাক হচ্ছি, তোমার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলে কিভাবে।’ বলল জোসেফাইন।
‘পানির কাছাকাছি পৌঁছেও আমি ডাইভিং-এর নিয়ম অনুযায়ী দুই হাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে দুই বড় জাহাজের মাঝ দিয়ে পড়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, সরাসরি পানি যেন আমি পেয়ে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শেষ মুহূর্তে একটা কার্গো ফেরির প্রান্ত ঘেঁষে ছিটকে পড়ে আরেকটা বোটের পেটে বাড়ি খেয়ে পড়ি পানিতে। সৌভাগ্য হলো, কার্গোতে নরম কিছু বোঝাই ছিল এবং আরেকটা সৌভাগ্য হলো, অতবড় উচ্চতা থেকে নিচে পড়বার যে বেগ তা কার্গো বোট ও অন্য যে বোটের পেটে ধাক্কা খেয়েছিলাম সেই বোট এবং বসফরাসের পানি এই তিনের মধ্যে বণ্টন হওয়ায় আমি বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে যাই। কার্গোর নরম লাগেজে ধাক্কা খেয়ে পেছনে পড়ার আঘাত দু’হাত দিয়ে সামলে নেই, কিন্তু ছিটকে পড়া পাঁজরটা বোটের পেটে সরাসরি ধাক্কা খেয়ে যায়। হয়তো এই আঘাতেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। তবে সংজ্ঞা হারাবার আগে সর্বশক্তি দিয়ে পানিতে ভেসে উঠতে সমর্থ হই। সম্ভবত পেছনের বোটের লোকেরা এই অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করে।’
থামল আহমদ মুসা।
মাথার পাশেই দাঁড়িয়েছিল জোসেফাইন। আহমদ মুসার মাথা বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘যা ঘটেছে সেটা মিরাকল। আল্লাহ তোমাকে নিজ হাতে বাঁচিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।’ আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে জোসেফাইনের কণ্ঠ।
‘অবশ্যই জোসেফাইন, আল্লাহই রক্ষা করেছেন। কি ঘটেছে আমি বর্ণনা দিয়েছি। কিন্তু কিভাবে ঘটেছে, তা আমি জানি না। আমার নিজের উপর কিংবা কোন কিছুর উপরই আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সব কিছুর নিয়ন্ত্রক যিনি তিনিই সব নিয়ন্ত্রণ করেছেন।’
থামল আহমদ মুসা। পরক্ষনেই আবার বলল, ‘তুমি ওয়াটারওয়ে ব্যবহার করতে বলেছ। ভালো পরামর্শ তোমার। ফাতিহ পাশা পার্কের এলাকাতেই রয়েছে একটা ফেরিঘাট। একটাই অসুবিধা হবে গাড়ি থাকবে না, গাড়ি ভাড়া করতে হবে।’
‘অসুবিধা নেই। ফেরিঘাটে একটা গাড়ি রাখতে বলতে পার।’ বলল জোসেফাইন।
‘তাহলে যে আবার ফিরতে হবে ব্রীজ হয়ে।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘অসুবিধা হবে না। গাড়িটা আবার কোন ঘাটে রেখে আসবে।’ বলল জোসেফাইন। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘রিভলবার চালাবার মত বুদ্ধিতেও তুমি একদম গোয়েন্দা হয়ে পড়েছ। ধন্যবাদ জোসেফাইন।’
‘বেশি প্রশংসা কিন্তু বিপরীত অর্থও বুঝায়’ বলে আহমদ মুসার পিঠে একটা কিল দিয়ে জোসেফাইন চায়ের কাপ নিয়ে দ্রুত চলে গেল ঘরের দিকে।
৩
ফাতিহ পাশা পার্কের পূর্ব-দক্ষিন পাশের রাস্তার ওধারে সম্ভাব্য সবগুলো এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে ৩৯৫ নং বাড়ি। অবশেষে ৩৯৫ নাম্বার একটা বাড়ি সে পেয়েছে, তা পার্কের প্রায় দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে এবং বাড়িটাও একটা পুলিশ ফাঁড়ি।
ক্লান্ত আহমদ মুসা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল। পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের বাড়িগুলো থেকে শুরু করে পশ্চিম-উত্তরের এই প্রান্ত পর্যন্ত বাড়িগুলোর নাম্বার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ফাতিহ পাশা পার্কের সত্যিকার দক্ষিণ পশ্চিম যাকে বলে, সেখানে বাড়ি রয়েছে মাত্র বিশটি। বাড়িগুলোর নাম্বার ৩৪৬ থেকে ৩৬৫ পর্যন্ত। তারপর ৩৯৭ পর্যন্ত অবশিষ্ট বাড়িগুলো রয়েছে পার্কের দক্ষিণ এবং দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের প্রান্ত পর্যন্ত। সাবাতিনি কি তাকে ভুয়া নাম্বার দিয়েছে? না সে নিজে প্রতারিত হয়েছে? এ দুটোর কোনটিই সম্ভব নয়। সাবাতিনি তাকে ভুয়া নাম্বার দিতে পারে না। অন্যদিকে সাবাতিনি প্রতারিত হলে প্রফেসর আলী আহসান বেগভিচ নির্দেশিত বাড়িতে সে পৌঁছাবে কি করে? সাবাতিনির ওখানে পৌছা বেগভিচদের জন্যেই প্রয়োজনীয়। তাহলে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল প্রফেসর বেগভিচরা যে বাড়ির নাম্বারে সাবাতিনিকে ডেকেছিল, সাবাতিনি আসার পর তার নাম্বার আবার পাল্টে ফেলেছে। এটাই ঘটেছে নিশ্চয়। কিন্তু কোন নাম্বারকে ৩৯৫ বানাল? যে কোন নাম্বারকেই পাল্টাতে পারে।
আবার চিন্তায় বুঁদ হয়ে গেল আহমদ মুসা।
তার মনে প্রশ্ন জাগল, নাম্বার ৩৯৫ বানাল কেন? যে নাম্বারটিকে সে চেঞ্জ করেছে সে নাম্বারের সাথে ৩৯৫ নাম্বারের কি মিল আছে? মিল থাকাটাই স্বাভাবিক। ধাঁধার সাইকোলজি এটাই যে অঙ্কগুলো ঠিক থাকে, চেঞ্জ হয় অঙ্কের বিন্যাস। এখানে যদি তাই করা হয়ে থাকে, তাহলে তিনটি অঙ্ক দিয়ে ছয় সেট সংখ্যা তৈরি করা যায়। সেগুলো হলো ৩৯৫,৩৫৯,৯৫৩,৯৩৫,৫৯৩ এবং ৫৩৯। এই ছয় সেট সংখ্যার যেকোন একটি হবে আসল সংখ্যা। ভাবলও অনেকক্ষণ আহমদ মুসা। ঠিকানার একটি প্রধান বিষয় ছিল বাড়িটা ফাতিহ পাশা পার্কের পূর্ব-দক্ষিন কোনে। এই দিক নির্দেশনাকে প্রধান ধরলে এই ছয় সেট চারটিই অর্থাৎ ৯৫৩, ৯৩৫, ৫৯৩ এবং ৫৩৯ বাদ হয়ে যায়। কারণ সংখ্যাগুলো ফাতিহ পাশা পার্কের রাস্তার বিপরীত দিকের কোন পাশেরই সংখ্যা নয়। ৩৯৫ যে আসল সংখ্যা নয় তা এ থেকে প্রমাণ হয়েছে। তাহলে একমাত্র ৩৫৯ সংখ্যাটিই বাকি থাকে। সুতরাং এই সংখ্যাটিই হতে পারে আসল ঠিকানা।
আহমদ মুসার মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। তার মনে হলো তার হিসেবে কোন ভুল নেই, ৩৫৯-ই হবে সেই বাঞ্ছিত নাম্বার।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। গাড়িতে উঠে ছুটল ৩৫৯ নাম্বার বাড়ির দিকে।
দক্ষিণ দিক থেকে যাচ্ছে বলে ৩৫৯ নাম্বার বাড়িটা রাইট লেনে পড়েছে, সে যাচ্ছে লেফট লেন ধরে। সুতরাং তাকে আরও উত্তরে টার্ন ঘুরে বাড়িটার দিকে ফিরে আসতে হবে।
টার্নটা ৩৫৯ নাম্বার বাড়ির দু তিনটি বাড়ির উত্তরেই। আহমদ মুসা টার্ন ঘুরে দ্বিধাহীনভাবে গাড়ি চালিয়ে এসে ৩৫৯ নাম্বার বাড়ির সামনে দাড় করাল। বাড়িটা চারতলা।
আহমদ মুসা ঠিক করেই এসেছে, একজন ট্যাক্স গোয়েন্দার পরিচয় নিয়ে সে বাড়িতে ঢুকবে, বাড়িটার ভাড়া সংঙ্ক্রান্ত সব কাগজপত্র সার্চ করার পরোয়ানা নেবে। গোয়েন্দার আইডেন্টিটি কার্ড তার পকেট এ রয়েছে। তুরস্কের মত দেশে কোন বাড়িতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এর চেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা আর নেই। পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতি জানলে বাড়ির অনেকেই সরতে পারে। যার ফলে শিকার ভাগতে পারার সম্ভাবনা থাকে। ট্যাক্স-গোয়েন্দাকে মানুষ বাড়িতে ঢুকতে দেখলে অসন্তুষ্ট হয়, উদ্বিগ্ন হয়, কিন্তু পালায় না কেউ।
আহমদ মুসা তার গাড়ি গেটের সামনে দাড় করিয়ে নামল গাড়ি থেকে। বাম পাশেই গেটবক্স।
আহমদ মুসা গেটবক্সের দিকে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে, ঠিক সে সময়েই গেটের বিশাল দরজাটা দ্রুত ডান দিকে সরে গিয়ে উন্মুক্ত করে দিল গেট।
কিছুটা বিস্মিত আহমদ মুসা পকেটে হাত পুরেই উন্মুক্ত দরজা দিয়ে ভেতরে তাকাল। চোখ পড়ল সরাসরি লাল তুর্কি টুপিধারি একজন লোকের উপর। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের সানগ্লাস। তার স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। তার ডান হাতের রিভলবার আহমদ মুসার দিকে উঠে আসছে।
চোখ পড়তেই আহমদ মুসা তাকে চিনতে পেরেছিল। রিভলবার উঠে আসা দেখেই বুঝেছিল কি ঘটতে যাচ্ছে।
বাম দিকে দেহটাকে ছুড়ে দিয়েছিল আহমদ মুসা। প্রায় তার সাথে সাথেই গুলিরও শব্দ হয়েছিল।
আহমদ মুসার কোটের ডান হাতার একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গুলিটা চলে গেল।
বাম দিকে ছিটকে যাবার সময় আহমদ মুসাও রিভলবার ধরা বাম হাত পকেট থেকে বের করে এনেছিল। আঙ্গুলটাও ছিল ট্রিগারে।
মাটিতে পড়ার আগেই ট্রিগার টিপেছিল আহমদ মুসা। গেটের সামনের জায়গা নিচু ও ঢালু। গুলীটা কিছুটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। ডান হাতকে টার্গেট করা গুলীটা গিয়ে বিদ্ধ হলো প্রফেসর বেগভিচের হাঁটুতে।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়ে স্থির হবার আগেই ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ভেসে এল। এক ঝাঁক গুলী ছুটে এল সেই সাথেই।
আহমদ মুসা নিরাপদেই দ্রুত গড়িয়ে গেটবক্সের দিকে সরে গেল।
ব্রাশ ফায়ার থামলো না। গেটের সামে দাঁড়ানো আহমদ মুসার গাড়ি ঝাঁঝরা হয়ে গেল। গুলীবৃষ্টি এসে গেটবক্স ঘিরে ধরল।
আহমদ মুসা লক্ষ্য করল, গুলির আওয়াজটা ক্রমশ নিচে আসছে। গুলী শুরু হয়েছিল দু’তলা থেকে। মনে হয় ওরা ক্রমশ নিচে নেমে আসছে।
আহমদ মুসা গেটবক্সকে সামনে রেখে উঠে দাঁড়াল। এগোলো গেটবক্সের দিকে। গেটবক্সের দরজায় চাপ দিতেই তা খুলে গেল। গেটবক্সের আরেকটা দরজার দিকে আর গেটবক্সের ভেতর ও বাহির দু’দিকেই পর্যবেক্ষণ জানালা।
ভেতরের পর্যবেক্ষণ জানালা দিয়ে আহমদ মুসা উঁকি দিল বাইরে। প্রথমেই চোখ পড়ল সিঁড়ি ঘরের দিকে। সিঁড়ি ঘরটা জানালা থেকে সামনে সোজা সামনে একটা ছোট চত্বরের ওপারে। দক্ষিণ দিকে ঘুরেই দেখতে পেল হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ প্রফেসর বেগভিচ ডান পাটা টেনে নিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিট এ উঠে বসেছে।
আহমদ মুসা বুঝল সে পালাচ্ছে।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা রিভলবার তাক করল প্রফেসর বেগভিচের গাড়ির সামনের চাকা। নির্ভুল নিশানা। একটা গুলী গিয়ে বিদ্ধ হলো সামনের চাকার পেটে। শব্দ তুলে চাকাটা দেবে গেল।
প্রফেসর বেগভিচ তাকাল গেটবক্সের দিকে। তার রিভলবার থেকে কয়েকটা গুলী ছুটে এল গেটবক্স লক্ষ্যে।
ওদিকে সিঁড়িঘরের দিক থেকেও ছুটে এল গুলীর ঝাঁক। সম্ভবত গুলীর শব্দ থেকে তারা আহমদ মুসার অবস্থান আঁচ করে নিয়েছে।
আহমদ মুসা আড়াল থেকে ব্রাশ ফায়ারের উৎস সিঁড়ি ঘরের দিকে নজর রেখে এক হাতে রিভলবার ধরে অন্য হাতে দ্রুত মোবাইলে একটা কল করল পার্কে অপেক্ষমাণ গোয়েন্দাদের। তাদেরকে বাড়ির নাম্বার দিয়ে এদিকে আসতে বলল।
গেটবক্সের জানালা লক্ষ্যে গুলীবৃষ্টি অব্যাহতভাবে চলছে।
আহমদ মুসা বুঝতে পারছে, ওরা গুলীর দেয়াল সৃষ্টি করে এদিকে অগ্রসর হতে চাচ্ছে।
অব্যাহত গুলীর কারণে সিঁড়িঘরের দিকে নজর রাখতে পারছে না আহমদ মুসা। আড়ালে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে এমন জায়গায় চোখ রেখেছে তার মানে ওরা সামনে মুভ করতে চাইলে সে জায়গা তাদের অতিক্রম করতেই হবে।
তবে আহমদ মুসার দিক থেকে গুলীর শব্দ না পেয়ে ওরা সম্ভবত বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে যে, আহমদ মুসা পালাল কিনা। এরকমটা তারা ভাবলে এমন কিছু করে বসবে যা তাকে সুযোগ করে দেবে।
ওদিকে ব্রাশ ফায়ার হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। আহমদ মুসা তার দিক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল না। ওরা কিছু করবে বলে যা ভেবেছিল আহমদ মুসা, সেটাই ঘটছে মনে করল সে। ট্রিগারে আঙুল চেপে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করল আহমদ মুসা।
হঠাৎ ব্রাশ ফায়ার আবার শুরু হলো। এবার গুলীর লক্ষ্য শুধু জানালা নয়, গুলী এখন গেটকেই কভার করেছে। দু’একটা গুলী জানালা লক্ষ্য করে আসছে।
এই গুলীর আড়ালে ষ্টেনগান বাগিয়ে গুঁড়ি মেরে মেরে দু’জন দৌড় দিয়েছে সিঁড়িঘর থেকে গেটের দিকে। এমন সুযোগের জন্যেই ওঁৎপেতে ছিল আহমদ মুসা। তার রিভলবার দু’বার অগ্নিবৃষ্টি করল। চত্বরটার মাঝখানে ওদের দু’টি লাশ ঢলে পড়ল।
এর জবাব এল ওদিক থেকে। দুই ষ্টেনগান থেকে বৃষ্টির মত গুলী ছুটে এল জানালা লক্ষ্যে।
এই সময় গেটবক্সের বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত মাথা নিচু করে গেটবক্স থেকে বাইরে এল। বেরিয়েই দেখতে পেল সাদা পোশাকের সাতজন গোয়েন্দা পুলিশ।
আহমদ মুসা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘ভেতরে চারজন ষ্টেনগানধারী ছিল। দু’জন মারা গেছে। দু’জন সিঁড়ি ঘরে লুকিয়ে থেকে গুলী করছে। আসল শিকার প্রফেসর বেগভিচ আহত অবস্থায় চত্বরের গাড়িতে বসে আছে। তাকে পালাতে দেয়া যাবে না।‘
‘ধন্যবাদ স্যার, ওয়েল ডান স্যার। আমরা দেখছি। আমাদের সাথে বুলেটপ্রুফ গাড়ি আছে।‘
বলে সে সাথীদের দিকে ফিরল। বলল, ‘রেডি।’
তারা এগোলো গাড়ির দিকে।
গুলী-গোলার শব্দ শুনে পুলিশের দু’টো গাড়িওঁ এসে দাঁড়িয়েছিল।
গোয়েন্দা অফিসার একটু এগিয়ে গিয়ে তাদেরকেও কিছু নির্দেশ দিল।
নির্দেশের সংগে সংগেই, পুলিশের দু’টি গাড়ি বাড়ির দু’পাশের দু’দিকে এগোলো। তাদের দৃষ্টি বাড়িটার পেছন দিকে।
গোয়েন্দা পুলিশরাও তাদের গাড়িতে উঠে বসেছে। পুলিশরা দু’দিক থেকে বাড়ির পেছন দিকে এগিয়ে যাবার পর গোয়েন্দা পুলিশের গাড়ি গেট পার হয়ে ছুটল সিঁড়ি ঘরের দিকে। তাদের গাড়িতে ফিট করা গান থেকেও গুলীবৃষ্টি হচ্ছে।
ওদিক থেকে গুলী বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা ছুটল গাড়ির দিকে। ওদের গুলীর কভার নিয়ে আহত প্রফেসর বেগভিচ পালাতেও পারে, এ আশংকা আছে।
গেট পার হতেই গাড়ির ভেতরটা চোখে পড়ল আহমদ মুসার। প্রফেসর বেগভিচকে দেখা পেল না। তাহলে কি প্রফেসর বেগভিচ সত্যিই পালাল! মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার।
তবুও দ্রুত গিয়ে আহমদ মুসা দাঁড়াল গাড়ির পাশে। গাড়ির ভেতরে চোখ যেতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল গাড়ির সিটে ঢলে পড়ে আছে প্রফেসর বেগভিচের দেহ।
এবার নতুন আশংকা আহমদ মুসার মনে, পটাশিয়াম সাইনাইড কি প্রফেসর বেগভিচকেও কেড়ে নিল তাদের হাত থেকে! প্রফেসর বেগভিচের নীল হয়ে যাওয়া মুখের উপর ভালো করে নজর পড়তেই নিশ্চিত হলো তার আশংকাই ঠিক।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে ফেলল।
প্রফেসর বেগভিচকে সার্চ করতে চায় সে। প্রফেসর বেগভিচ কোথায় বেরুচ্ছিল গাড়ি নিয়ে। বেরুবার মুখেই সে আহমদ মুসার মুখোমুখি হয়েছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় সে ধরা পড়েছে। সুতরাং তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কিছু পাওয়া অসম্ভব নয়।
প্রফেসর বেগভিচের প্যান্টের পকেটে একটা রুমাল এবং একগোছা চাবি সমেত একটা রিং পেল। কোটের দুই সাইড পকেটের একটিতে একটি সিগারেট লাইটার পেল, অন্য পকেটে পাসপোর্ট এবং এয়ার লাইন্সের একটি টিকিট পাওয়া গেল। আহমদ মুসা দেখল, টিকিটটা ইস্তাম্বুল-তেলআবিব (ইসরাইল) রুটের। তার মানে, প্রফেসর বেগভিচ ইসরাইল যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, ভাবল আহমদ মুসা। সিগারেট লাইটার একই সাথে মিনি বন্দুক ও ক্যামেরাও। এই সিগারেট লাইটারের পিনাকৃতির বুলেট ৬ ফিটের মধ্যে যে কোন শিকারকে তাৎক্ষণিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। পিনাকৃতি বুলেটের মাথায় বিশেষভাবে মাখানো থাকে পটাশিয়াম সাইনাইড।
সিগারেট লাইটার পকেটে পুরল আহমদ মুসা।
কোটের ভেতরের দুই পকেটের একটিতে পেল একটি মানিব্যাগ, অন্যটিতে চামড়ার কভারের মধ্যে পেল একটা ‘মাইক্রো ভিসিডি’।‘
দারুণ খুশি হলো আহমদ মুসা। এই মাইক্রো ভিসিডিও ‘মাইক্রো চিপস’-এর মতই এক একটা মেমোরি সাগর। মাইক্রো ভিসিডিটাও পকেটে পুরল আহমদ মুসা।
মানিব্যাগে পেল ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা আইডি কার্ড এবং এক হাজার ডলারের অনেকগুলো নোট।
টাকা ও আইডি কার্ড সমেতই মানি ব্যাগটা আহমদ মুসা প্রফেসর বেগভিচের পকেটেই আবার রেখে দিল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
গোয়েন্দা পুলিশের গাড়ি সিঁড়ি ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা বুঝল, বন্দুকধারীদের অনুসরণ করে গোয়েন্দারা বাড়িতে ঢুকে গেছে।
আহমদ মুসা মোবাইল বের করে কল করল জেনারেল মোস্তফা কামালকে। প্রফেসর বেগভিচের পরিণতিসহ এখানকার সব কথা জানিয়ে বলল, ‘প্রফেসর বেগভিচ ইসরাইল যাবার জন্যে বেরুচ্ছিলেন। তাঁর পকেটে যা পাওয়া গেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো একটা মাইক্রো ভিসিডি। আমার মনে হয় এটা কাজে লাগতে পারে।‘
ওপ্রান্ত থেকে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনি চলে আসুন। আমি গোয়েন্দা অফিসারকে বলে দিচ্ছি তারা কয়েকজন পুলিশকে পাহারায় রেখে অবশিষ্ট পুলিশ দিয়ে লাশগুলো নিয়ে এখানে চলে আসবে। আর এদিকের খবর ভালো। সাবাতিনিকে নিরাপদে তার দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার হাত কেঁপে যাবার ফলে ‘ট্রান্সমিশন চিপস বুলেট’টা হেলিকপ্টারের পেটে পেষ্ট না হয়ে টপে পেষ্ট হয়েছে।‘
‘ঠিক আছে, সে সন্দেহের শিকার না হলেই হয়। ট্রিপল জিরোর লোক বা লোকরা উপস্থিত থেকে নিশ্চয় সবকিছু অবজারভ করেছে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘না, সন্দেহ করার মত কিছুই ঘটেনি। হেলিকপ্টার দর্শকের ষ্টাইলে সে রিভলবার কোটের আড়ালে রেখেই গুলী ছুঁড়তে পেরেছে। কিন্তু আমি ভাবছি খালেদ খাকান, প্রফেসর বেগভিচ মারা যাবার পর তার এই নতুন ঠিকানার খোঁজ জানার ব্যাপারে সন্দেহের তীর সাবাতিনির দিকে নিক্ষিপ্ত হতে পারে।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘তার সম্ভাবনা আছে। আবার নেইও বলা যেতে পারে। গেটে আকস্মিক দেখা হয়েছে, এটাই তাদের মনে হতে পারে। তাছাড়া হেলিকপ্টারে ‘ট্রান্সমিশন চিপ’ স্থাপনের তার দায়িত্ব সে ঠিক ঠিক পালন করেছে। তবু তার উপর নজর রাখার ব্যবস্থা করুন। সাবাতিনির মাধ্যমে তাদের কাজ যদি শেষ হয়ে থাকে, তাহলে সাবাতিনিকে পথের কাঁটাও ভাবতে পারে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি ঠিক বলেছেন। আমি এখনি ব্যবস্থা করছি। দু’জন গোয়েন্দা তার উপর সার্বক্ষনিক নজর রাখবে। ঠিক আছে, আপনি চলুন প্লিজ।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ওকে। আসছি আমি। আসসালামু আলাইকুম।‘
আহমদ মুসা রেখে দিল মোবাইল।
গোয়েন্দা কয়েকজনও এসে পৌঁছল। অফিসার আহমদ মুসার সামনে এসে বলল, ওদের ধরা গেল না স্যার। বাড়িতে একটা সুড়ঙ্গ পথ আছে। সে পথেই ওরা পালিয়েছে। সুড়ঙ্গ পথটা একটা ষ্ট্ররস সোয়ারেজে গিয়ে মিলেছে। প্রফেসর বেগভিচের খবর কি স্যার ?’
‘সে নেই। ধরা পড়ার চাইতে পটাশিয়াম বিষ নেয়া সে বেশি পছন্দ করেছে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ও গড! তাহলে আমাদের মিশনটাই ব্যর্থ।‘ বলল গোয়েন্দা অফিসারটি।
‘না, আমাদের মিশন ব্যর্থ হয়নি। শুনুন অফিসার, আপনারা পুলিশের সাথে লাশগুলো নিয়ে আসুন। আমি জেনারেল মোস্তফার ওখানে যাচ্ছি। আপনারা আসুন।‘ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল গেটের দিকে। দেখল, জেনারেল মোস্তফার পাঠানো গাড়িটাও এসে পৌঁছেছে।
আহমদ মুসা গাড়িতে গিয়ে উঠল।
গাড়ি ষ্টার্ট নিল।
গাড়ি তখন বসফরাস ব্রীজের গোড়ায় পৌঁছেছে। মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল ধরতেই ওপার থেকে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘দুঃসংবাদ খালেদ খাকান, আমাদের লোকরা এই মাত্র খবর দিল যে, সাবাতিনি পাহাড় থেকে পড়ে মাথা ফেটে মারা গেছে।‘
‘ইন্নালিল্লাহি…।‘ আহা, সরল, সোজা, রহস্যপ্রিয় মেয়েটা! আমরা তাকে বাঁচাতে পারলাম না।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি খালেদ খাকান। ও যে এত তাড়াতাড়ি সন্দেহের শিকার হবে তা বোঝা যায়নি।‘ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘কিন্তু জেনারেল, সে সন্দেহের শিকার নাকি তার প্রয়োজন ওদের শেষ হয়ে যাওয়ায় ওরা পথ পরিষ্কার করেছে, তা বলা মুস্কিল। আমি আসছি। জেনারেল, সিজলির ‘ওয়েসিস’ বাড়িটায় সার্বক্ষনিক পাহারায় যেন ঘাটতি না হয় দেখবেন প্লিজ।‘
‘সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। ওয়েসিসে যাবার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যতগুলো পথ আছে, সবগুলোর উপরে গোপনে চোখ রাখা হয়েছে। ওরা তাদের চোখ এড়াতে পারবে না।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘ধন্যবাদ জেনারেল। আর কোন কথা ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘না, ধন্যবাদ। আসুন।‘
‘ওকে জেনারেল। আসসালামু আলাইকুম।‘ মোবাইল রাখল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা কামাল তার অফিসে তার চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘ভিসিডিতে কি আছে তা জানতে সত্যিই আমার তর সইছে না। ভিসিডিটা দিন মি. খালেদ খাকান।‘
টেবিলের এপাশে বসেছিল আহমদ মুসা, জেনারেল তারিক ও প্রধানমন্ত্রীর সিকিউরিটি এডভাইজার ড. মোহাম্মদ আইদিন।
আহমদ মুসা পকেট থেকে ভিসিডিটা বের করে জেনারেল মোস্তফার হাতে দিল।
জেনারেল মোস্তফা আগ্রহের সাথে ভিসিডিটা হাতে নিয়ে কম্পিউটারে সেট করে প্লে অপশনে ক্লিক করে বলল, ‘প্রফেসর বেগভিচ দেশ থেকে বেরুবার সময় ভিসিডিটা পকেটে রেখেছিল, তখন এটা শূন্য নয় নিশ্চয়।‘
কম্পিউটার স্ক্রীন সচল হলো।
মুহুর্তের জন্য ধোঁয়াটে হয়ে উঠল কম্পিউটার স্ক্রীন। একটু পর ধোঁয়া কেটে গিয়ে বেরিয়ে এলো বসফরাস। স্ক্রীনের সেন্ট্রাল পয়েন্টে এসে গেল বসফরাস তীরের রোমেলী দুর্গ।
হঠাৎ আবার ধোঁয়ায় ঢেকে গেল স্ক্রীনটা। এই ধোঁয়ার মধ্যেই যেন একটা সুড়ঙ্গ নেমে এল। সুড়ঙ্গটা গোটা কম্পিউটার স্ক্রীন জুড়ে বিস্তৃত হলো। সুড়ঙ্গটা দ্রুত উপরে উঠে আসতে লাগল, তার সাথে দৃষ্টিটা ছুটল সুড়ঙ্গের বটমের দিকে। উধাও হয়ে গেল সুড়ঙ্গ। ফুটে উঠল একটা কক্ষের দৃশ্য। কক্ষটি নানারকম জটিল কলকব্জা ও কম্পিউটারে ঠাসা।
চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠেছে জেনারেল তাহির তারিকের। চিৎকার করে বলল, ‘এ যে আমাদের প্রধান বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির ল্যাব। এই ছবি এ সিডিতে কি করে এল!’
‘সর্বনাশ। বাইরের আমরা দু’একজন ছাড়া তো এই ল্যাব আর কেউ দেখেনি। কোন ধরণের ক্যামেরা ভেতরে যাবার প্রশ্নই নেই। এ ছবি উঠল কি করে।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসার চোখে বিস্ময় নয়, উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। তার স্থির দৃষ্টি ছিল ছবির এংগেলের দিকে।
কক্ষের দৃশ্যটা স্থির ছিল না। একেকটা যন্ত্র-যন্ত্রাংশের উপর একেক সময় স্থির হচ্ছিল। মূল ফোকাসের সময় যন্ত্র-যন্ত্রাংশের ছবিগুলো এতই বড় হচ্ছিল যে, সূচের ডগা পরিমাণ বিন্দুও মার্বেলের মত বড় মনে হচ্ছিল।
হঠাৎ দৃশ্যপট পাল্টে গেল। উবে গেল ল্যাব-কক্ষের দৃশ্য। স্ক্রীনে এল বিরাট একটা হলঘরের ছবি। ঘরটা ভর্তি নানারকম, নানা আকারের দুর্বোধ্য সব যন্ত্রপাতি, ক্রুজ মিসাইল ধরণের ও রকেটলাঞ্চার আকারের দ্রব্যে ভর্তি। হলঘরটা যেমন একটা ক্রিকেট মাঠের মত বিস্তৃত, তেমনি জাম্বোজেটের মত উঁচু।
এই ঘরের দৃশ্যের উপর চোখ পড়তেই জেনারেল তাহির তারিক এবং জেনারেল মোস্তফা কামাল দু’জনেই এক সাথে চিৎকার করে উঠল, ‘সর্বনাশ, কি দেখছি আমরা। এযে আমাদের আইআরটির টপ সিক্রেট রিসার্চ-ট্রেজার এবং গ্রাউন্ডের দৃশ্য!’
আর কারো মুখ থেকেই কোন কথা উচ্চারিত হলো না। সকলের পলকহীন দৃষ্টি কম্পিউটার স্ক্রীনে ফুটে উঠা দৃশ্যের দিকে।
কম্পিউটার স্ক্রীনে ছবির ফোকাস একেকটা যন্ত্র বা আইটেমের উপর গিয়ে পড়ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার যন্ত্র বা আইটেমের সূক্ষ্ম খাঁজসহ একমাত্র বটম ছাড়া সব দিকের দৃশ্যই পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এমন মাল্টি ডাইমেনশনাল ছবি কি করে সম্ভব! এ প্রশ্নও বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখগুলোতে।
ছবির ফোকাস এক এক করে সবগুলো জটিল যন্ত্রপাতি, ক্রুজ মিসাইল ও রকেটলাঞ্চার ধরণের জিনিস এবং ছোট-খাট সব দ্রব্যাদির উপর দিয়ে ঘুরল প্রায় স্থির গতিতে।
আধা ঘন্টা সময় তখন পার হয়ে গেছে।
হঠাৎই ঘরের দৃশ্য উবে গেল।
অন্ধকার নেমে এল স্ক্রীনে।
ভিডিও’র দৃশ্য স্ক্রীন থেকে চলে গেলেও দর্শকদের চোখগুলো যেন আঠার মত লেগে আছে স্ক্রীনে।
অনেকক্ষণ কথা বলল না কেউ। জেনারেল মোস্তফা কামাল, জেনারেল তাহির তারিক, প্রধানমন্ত্রীর সিকিউরিটি এডভাইজার ড. মোহাম্মদ আইদিনদের চোখে-মুখে ভয় ও উদ্বেগের চিহ্ন। আহমদ মুসার মুখে কিন্তু স্বস্তির চিহ্ন। আইআরটির তথ্যাদি সম্বলিত মহাগুরুত্বপুর্ণ এ ভিডিও চিত্র বাইরে পাচারের উদ্যেগ আল্লাহ্ ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
জমাট নিরবতার মধ্যে প্রথম কথা বলে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল। বলল, ‘আল্লাহ্ রক্ষা করুন, আমাদের আইআরটি’র কিছুই তো ওদের অজানা নেই। কিন্তু এ ছবি তারা তুলল কি করে। ভেতরে ক্যামেরা প্রবেশ করার ব্যাপারটা অসম্ভব।‘
‘ঠিক বলেছেন জেনারেল মোস্তফা। এমন ছবি তোলা অসম্ভব। যাদের ল্যাব, টেষ্টিং গ্রাউন্ড ও রিসার্চ ট্রেজারে প্রবেশের অনুমতি আছে, তারা ছাড়া ঐ সব স্থানে প্রবেশ করা যে কোন কারও পক্ষে অসম্ভব।‘
‘ঠিক বলেছেন জেনারেল মোস্তফা। এমন ছবি তোলা অসম্ভব। যাদের ল্যাব, টেষ্টিং গ্রাউন্ড ও রিসার্চ ট্রেজারে প্রবেশের অনুমতি আছে, তারা ছাড়া ঐ সব স্থানে প্রবেশ করা যে কোন কারও পক্ষে অসম্ভব। আর যাদের প্রবেশ করার অনুমতি আছে, তাদের বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত। তাহলে এটা ঘটল কি করে ?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘আমার মনে হয় উপগ্রহের বিশেষ ক্যামেরা থেকে এসব ছবি উঠেছে। উপগ্রহ থেকে ভু-অভ্যন্তরের বিভিন্ন রকমের ছবি তোলা এখন একটা সাধারণ ব্যাপার। আইআরটি’র গোপন তথ্য যোগাড়ে তারা ভূ-উপগ্রহ ব্যবহার করেছে দেখা যাচ্ছে।‘ প্রধানমন্ত্রীর সিকিউরিটি এডভাইজার ড. মোহাম্মদ আইদিন বলল।
আহমদ মুসা চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘ভিডিও চিত্র আকাশ থেকে কিংবা উপগ্রহের ক্যামেরা থেকে তোলা নয়। ছবির ফোকাসগুলো উপর থেকে নয়, বিভিন্ন কৌণিক এঙ্গেলে এসেছে। এমন এংগেল ভূ-পৃষ্ঠের বাইরে হতে পারে না। কোন পাহাড়, বা ব্রীজের উপর থেকেও তোলা হতে পারে ভিডিও চিত্রগুলো।‘
বিস্মিত জেনারেল মোস্তফা কামাল, আপনার ব্যাখ্যাই বেশি যুক্তিসংগত। কিন্তু এ ধরণের ক্যামেরা কি আছে ?’
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষ্ট্রাটেজিক রিসার্চ সম্প্রতি এ ধরণের ক্যামেরা তৈরি করেছে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকেই এ ক্যামেরা ভূ-অভ্যন্তরের মাল্টি ডাইমেনশনাল ছবি তুলতে পারে। এ ক্যামেরার ফোকাস কৌণিকভাবে ভূগর্ভে প্রবেশ করলেও টার্গেটের উপর ফোকাসের ক্ষেত্রে কখনও তা ভার্টিকাল এবং বিভিন্ন উচ্চতায় সমান্তরাল হতে পারে। তার ফলে টার্গেটের একমাত্র তলদেশ ছাড়া সব পাশের সব এংগেলের ছবি তুলতে পারে। আমার মনে হচ্ছে সর্বাধুনিক এ ক্যামেরাই এখানে ব্যবহৃত হয়েছে।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আবিষ্কৃত হলেও এ ক্যামেরা তো মার্কেটে আসেনি। উইপনসের সবগুলো লেটেষ্ট মার্কেট রিপোর্ট আমার কাছে আছে। তাহলে ষড়যন্ত্রকারীরা এ ক্যামেরা পেল কি করে বুঝতে পারছি না।‘ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা ও মার্কিন ষ্ট্রাটেজিক রিসার্চ ল্যাবের মালিকরা যদি কাছাকাছি হয়, তাহলে তো ঐ ক্যামেরা কেনার জন্য মার্কেটের প্রয়োজন হয় না!’
‘আপনি কি তাই মনে করেন মি. খালেদ খাকান ?’ জিজ্ঞাসা ড. মোহাম্মদ আইদিনের।
‘এটা মনে করার কথা নয়, চোখেই দেখা যাচ্ছে ড. আইদিন। এই ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে প্রফেসর বেগভিচ যাচ্ছিলেন ইসরাইলে। ইসরাইল আর মার্কিন বর্তমান শাসকদের একটি মহলের ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থ একই। অতএব মার্কিন ষ্ট্রাটেজিক ল্যাব থেকে ইসরাইল ষ্ট্রাটেজিক ক্যামেরা পেতেই পারে। আর ইসরাইল ও ষড়যন্ত্রকারী ‘থ্রি জিরো’ হতে পারে একই স্বার্থের দুই নাম।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘সর্বনাশ, আমাদের আইআরটি তাহলে এক মহাষড়যন্ত্রের মুখে। কিন্তু একটা কথা, ইসরাইলের সাথে আমাদের তুরস্কের সম্পর্ক তো খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। তার পরেও কি তারা আমাদের সাথে এতবড় একটা ষড়যন্ত্রের কাজ করতে পারে ?’ বলল ড. আইদিনই।
হাসল আহমদ মুসা। কিন্তু আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই উত্তরটা এল জেনারেল তাহিরের কাছ থেকে। বলল, ‘তুরস্ককে নিজের স্বার্থে সে বন্ধু মনে করে এবং ইসরাইল নিজের স্বার্থেই ওআইসির গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআরটিকে তুরস্কে স্থান দেয়ার সিদ্ধান্তকে বৈরিতার চোখে দেখছে।‘
ড. আইদিন তাকাল জেনারেল তাহিরের দিকে। বলল, ‘ঠিক বলেছেন। এটাই কারণ। ওরা তুরস্কের বন্ধু, কিন্তু সেটা যখন ওদের জন্য লাভজনক।‘
একটু থামল ড. আইদিন। বলল সংগে সংগেই আবার, ‘ওদের ক্যামেরা আমাদের গবেষণাগারের সর্বত্র পৌছেছে। আমাদের অত্যন্ত স্পর্শকাতর গবেষণাগার আইআরটির কোন গোপনীয়তা আর অবশিষ্ট নেই। এখন আমাদের করণীয় কি ?’
‘ভিসিডিটা এখনও ওদের হাতে পৌঁছেনি। ভিসিডিটা আগে যদি কোনওভাবে পাঠিয়ে দিত, তবে আজ এতটা ঝুঁকি নিয়ে প্রফেসর বেগভিচ এটা সাথে নিত না। তবে ভিসিডির কপি আরও কারো কাছে থাকতে পারে, তবে নাও থাকতে পারে। হতে পারে, প্রফেসর বেগভিচ নিজেই ব্রীজ থেকে ছবি নিয়েছিলেন আইআরটি গবেষনাগারের। তিনি ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত প্রফেসর বলে তার মাধ্যমে ছবি নেয়াই ছিল নিরাপদ। আমার মনে হয়, সেটাই করা হয়েছে। মনে হয় ফাতিহ পাশা পার্ক সংলগ্ন ঐ বাড়িটা এবং প্রফেসরের বিস্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার খোঁজ করলে ক্যামেরার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। আর…।‘
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। কথার মাঝখানেই বলে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, আমি এখনই নির্দেশ দিচ্ছি অনুসন্ধান করে দেখার জন্যে।‘
‘ধন্যবাদ জেনারেল। আমি যে কথা বলছিলাম। আমাদের করণীয় বিষয় নির্ভর করে ‘থ্রি জিরো’ কি করতে চায় তার উপর। আইআরটি গবেষণাগারের যে বিস্তারিত ছবি তারা সংগ্রহ করেছে, তা তারা তাদের অনেক কাজেই লাগাতে পারে। তবে তারা আইআরটির থিয়োরিটিক্যাল গবেষণা ও প্র্যাকটিক্যাল অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায়। এই জানার জন্যে তারা কি করছে, এটাই আমাদের দেখার বিষয়, সেই সাথে প্রতিরোধ-প্রতিকারের বিষয়ও।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। এটাই এখন প্রধান বিষয়।‘
একটু থামল জেনারেল মোস্তফা কামাল। বলল আবার, ‘আমাকে উঠতে হচ্ছে। খালেদ খাকান যা বলেছেন, সে বিষয়ে এখনি কয়েকটা মেসেজ পাঠাতে হবে। আসছি আমি।‘
জেনারেল মোস্তফা কামাল উঠতেই ড. আইদিন বলল, ‘আমাকে উঠতে হবে এখন। বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টকে এখনি জানাতে চাই।‘
ড. আইদিনও উঠে দাঁড়াল।
সালাম দিয়ে সে পা বাড়াল বাইরের দিকে।
বেরুতে গিয়ে জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনারা বসুন। আরও কিছু কথা আছে। আপনাদের চা দিতে বলছি।‘
বেরিয়ে গেল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘থ্রি জিরোর নিকটে যাবার একটা ছাড়া সব পথ আপাতত হাতছাড়া। এখন…।‘
‘একটা কোনটা ?’ আহমদ মুসার কথার মাঝখানে বলে উঠল জেনারেল তাহির তারিক।
‘সিজলিতে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির নতুন বাড়ি। এই বাড়িটা এখন থ্রি জিরোর টার্গেট। ড. আন্দালুসিকে ঘিরে তাদের যে টার্গেট, তা অর্জন করতে তাদের ঐ বাড়িতে আসতে হবে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘এই কনট্যাক্ট পয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণও।‘ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘হ্যাঁ, জেনারেল তারিক। বিজ্ঞানী আন্দালুসিই তাদের আসল উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, মি. খালেদ খাকান, আপনি ঠিক বলেছেন।‘ বলল জেনারেল তারিক।
‘বাড়িটার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নতুন করে রিভিও করা দরকার।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন। আজ সকালেও আমি ও জেনারেল মোস্তফা কামাল সেখানে গিয়েছিলাম। নিরাপত্তার বিষয়টা আমরা পর্যালোচনা করেছি। কুক, পরিচারক-পরিচারিকা ও বয়-বেয়ারার ছদ্মবেশে মোট ৮ জন মহিলা-পুরুষ গোয়েন্দা বাড়ির ভেতরে নিয়োজিত আছেন। এছাড়া বাড়ির সকল এপ্রোস রোডসহ চারদিকে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা নতুন করে নিশ্চিত করা হয়েছে।‘ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
‘ধন্যবাদ। প্রশ্ন হলো, ওরা কোন পথে অগ্রসর হতে চায়। উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তারা কোন কৌশল গ্রহণ করতে চাচ্ছে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি আগেই এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন। এটাই এখনকার বড় প্রশ্ন। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এখন তাদের মতলবটা কি। আপনি নিশ্চয় কিছু ধারণা করছেন ?’ জেনারেল তাহির তারিক বলল।
‘ওদের সামনে মাত্র একটা অপশন নিশ্চয় নেই। তবে তাদের টার্গেট যে ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ফর্মুলার জন্যেই তাদের প্রয়োজন বিজ্ঞানীকে। কিন্তু সোর্ড-এর ফর্মুলার জন্য তারা এতটা মরিয়া কেন ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কারণ, তাদের উড়ন্ত ধরণের সকল অফেনসিভ অস্ত্র অচল হয়ে পড়ছে। এতে করে তাদের দাঁত ও থাবা ভোতা হয়ে পড়বে।‘ বলল জেনারেল তারিক।
‘কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। ওদের দাঁত বা থাবা রক্ষা বা অস্ত্রগুলোকে সচল রাখাই একমাত্র টার্গেট হলে ওরা খুব সহজেই বিজ্ঞানীদের সমেত আইআরটিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে। ওদের উপগ্রহের নিস্পলক চোখ আইআরটির উপর নিবদ্ধ আছে। ওদের হাতে এমন অস্ত্র আছে যা রোমেলী দূর্গের ঐ অংশসহ ১০০ ফুট গভীর পর্যন্ত দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতে পারে। তা না করে ফর্মুলা হাত করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন ? নিছক আত্মরক্ষা নয়, ফর্মুলাই ওদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু ‘সোর্ড’-এর টেকনোলজি হাত করার জন্যে কিনা ? ওরা তো এমনিতেই নিরাপদ। রকেট ও রকেট জাতীয় অস্ত্র ধ্বংসের প্রতিরক্ষা শিল্ড (ষ্ট্রাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ-SDI) তো আছেই! তাহলে সোর্ড-এর ফর্মুলার জন্য এতটা পাগল হয়ে উঠবে কেন ? আমি মনে করি এ প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ।‘ থামল আহমদ মুসা।
‘মি. আহমদ মুসা, আপনি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। এভাবে আমি বিষয়টাকে দেখিনি। ধন্যবাদ আহমদ মুসা। কিন্তু কি হতে পারে বিষয়টা ?’ বলল জেনারেল তাহির তারিক।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে ভাবনার চিহ্ন।
এ সময় চা-নাস্তার ট্রলি ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল বেয়ারা।
ট্রলিতে দুই কাপ চা, দুই হাফ প্লেটে কাবাব সাজানো। তার পাশে সসের বাটি। যেন কাবাব দিয়ে ধোঁয়া উঠছে, এমন মনে হচ্ছে দেখতে।
জেনারেল তাহির সাগ্রহে বলল, ‘যাক তুমি আসতে বেশ দেরি করলেও ভালো নাস্তা এনেছো হে।‘ জেনারেল তাহিরের লক্ষ্য নাস্তার দিকে।
কিন্তু আহমদ মুসার লক্ষ্য বেয়ারার পায়ের দিকে। বেয়ারার পায়ে পুলিশের কমব্যাট বুট দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। তুরস্কে পুলিশ ও অফিসের বেয়ারারাও কি ওদের লোক! তারা তো কমব্যাট বুট পরে না এবং তারা ইউনিফরম পরে বটে, কিন্তু কমব্যাট ইউনিফরম নয়! বেয়ারার পরনে ননকমব্যাট ইউনিফরম ঠিক আছে, কিন্তু ইউনিফরমটা তার দেহের চেয়ে অনেক বড়। বুটের মত এটাও বিদঘুটে দেখাচ্ছে।
হঠাৎ মনে একটা চিন্তার উদয় হওয়ায় চমকে উঠল আহমদ মুসা।
চেয়ারে সোজা হলো তার দেহ। তীক্ষ্ণ হলো তার দৃষ্টি।
বেয়ারা টেবিলে চা, নাস্তা সাজিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। স্যালুট দিয়ে জেনারেল তাহিরকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনারেল স্যার ভিসিডিটা আমাকে এখুনি নিয়ে যেতে বলল। ড. আইদিনকে ওটা দেবেন তিনি।‘
জেনারেল তাহির কাবাবের প্লেটটা টেনে নিচ্ছিল। বলল, ‘ও, প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের সাথে তিনি বোধ হয় কথা বলেছেন। ঠিক আছে বেয়ারা, ওটা বের করে নাও।‘
জেনারেল তাহির তারিকের নির্দেশ দেবার আগেই বলা যায় বেয়ারা হাঁটা শুরু করেছিল।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে তখন চিন্তার ঝড়। হঠাৎ যেন তার মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল, ‘দাঁড়াও বেয়ারা, আমি জেনারেল মোস্তফার সাথে কথা বলে নিই।‘
একথা বলার সাথে সাথেই পকেটে হাত পুরেছে আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার নির্দেশ শুনেই বেয়ারা বোঁ করে এদিকে ঘুরল। সেই সাথে তার হাতে উঠে এসেছে রিভলবার।
আহমদ মুসার হাত পকেটে ঢুকলেও তার চোখ দু’টি আঠার মত লেগেছিল বেয়ারার উপর।
বেয়ারাকে পকেট থেকে রিভলবার বের করে ঘুরতে দেখে মোবাইল ছেড়ে রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল আহমদ মুসার হাত।
আর রিভলবার সমেত হাত বেরিয়ে আসার সাথে সাথে আহমদ মুসা টেবিল-লেবেলের উপরে বেড়ে থাকা তার দেহকে টেবিলের সমান্তরালে বাঁদিকে নিয়েছিল। তার রিভলবার থেকে গুলীও বেরিয়ে গিয়েছিল প্রায় সংগে সংগেই।
বেয়ারা ও আহমদ মুসা দু’জনের রিভলবার থেকে প্রায় একই সময়ে গুলী বেরিয়ে ছিল।
বেয়ারার গুলী আহমদ মুসার ডান কাঁধের বাহু সন্ধিতে একটা ছোবল মেরে কিছু গোসত তুলে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। দেহটা তার বাঁ দিকে সরে না গেলে বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যেত বেয়ারার গুলীতে।
আহমদ মুসার মত সাবধান হতে পারেনি বেয়ারা। তার ফলেই আহমদ মুসার নিক্ষিপ্ত বুলেট বেয়ারার বাম বুক একেবারে বিধ্বস্ত করে দেয়।
বেয়ারার দেহ একবার টলে উঠে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল টেবিলের পাশে।
আহমদ মুসার দেহটা সোজা হলো চেয়ারে।
বিস্ময়-বিস্ফোরিত চোখ দু’টি জেনারেল তাহিরের। মুহূর্তের জন্যে বাকহারা হয়ে গিয়েছিল সে। আহমদ মুসার গুলীটা ছিল জবাবী বা আত্মরক্ষামূলক, এটা বোঝা গেছে। কিন্তু বেয়ারা আহমদ মুসার কথা শুনে ক্ষেপে উঠে আহমদ মুসাকে গুলী করে বসল কেন ? তাহলে কি …!
জেনারেল তাহিরের চিন্তায় ছেদ নামল।
ছুটে এসে ঘরে প্রবেশ করল জেনারেল মোস্তফা কামাল এবং তার সাথে কয়েকজন পুলিশ।
জেনারেল মোস্তফা কামালের চোখ প্রথমেই পড়ল বেয়ারার রক্তাক্ত লাশের উপর। তারপর দেখতে পেল আহমদ মুসাকে বাঁ হাত দিয়ে ডান বাহুসন্ধি চেপে ধরে বসে থাকতে। আহমদ মুসার হাত ছাপিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আহত স্থান থেকে।
জেনারেল মোস্তফার চোখ গিয়ে পড়ল জেনারেল তাহির তারিকের উপর।
জেনারেল তাহির তারিক ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। দ্রুত, সংক্ষেপে সব কথা বলে শেষ করল এই বলে যে, মি. খালেদ খাকান তার দেহটা ঠিক সময়ে সরিয়ে নিতে না পারলে বেয়ারার আগে তিনি লাশ হতেন। আর যদি ব্যাপারটা আঁচ করতে না পারতেন এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে মোবাইলের বদলে রিভলবার বের না করতেন, তাহলে আগে উনি, তারপর আমাকেও লাশ হতে হতো এবং ভিসিডিটা চলে বেয়ারার হাতে।‘
বিস্ময় বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে জেনারেল মোস্তফা কামালের দুই চোখ।
সে দ্রুত ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে, ‘মি. খালেদ খাকান, আঘাতটা কেমন ? বুলেট ভেতরে আছে কিনা ? চলুন, পাশেই আমাদের পুলিশ হাসপাতালের ভিআইপি উইং।‘
আহমদ মুসাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তুলতে যাচ্ছিল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
একজন পুলিশ বলল, ‘স্যার, আমরা ষ্ট্রেচার নিয়ে আসছি।‘ বলে দৌড় দিল পুলিশটি।
আহমদ মুসা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে বলল, ‘আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আমার আঘাত তেমন নয়। গুলীটা বেরিয়ে গেছে। আপনি বরং দেখুন আসল বেয়ারা কোথায় ? মনে হচ্ছে তাকে কোথাও আটকে রেখে বেয়ারার পোশাকধারী এই লোক এসেছিল ভিসিডিটা হাত করতে। থ্রি-জিরোর এজেন্ট জাতীয় কেউ এ হতে পারে।‘
বেয়ারাকে পর্যবেক্ষন করছিল যে পুলিশ অফিসারটি, সে বলে উঠল, ‘স্যার এ আমাদের পুলিশের র্যাপিড কমব্যাট ব্যাটেলিয়নের লোক। নাম জোসেফ সেদ্দিক। সিকিউরিটি হেডকোয়ার্টারে আজ তার কোন ডিউটি ছিল না।‘
‘ধন্যবাদ অফিসার। তুমি যাও, এর ব্যাপারে সব তথ্য আমরা চাই। এর সংগী-সাথীদের হদিস আমাদের প্রয়োজন। এর ব্যাপারটা জানাজানির আগেই এ কাজ করতে হবে।‘
কথা শেষ করে অন্য একজন অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অপারেশনের ফুল ব্যবস্থাসহ ডাক্তারকে তুমি আসতে বল হাসপাতাল থেকে। আর লাশ নিয়ে যা করা দরকার তার ব্যবস্থা কর। ঘরটা পরিস্কারের ব্যবস্থা কর।‘
পুলিশের দু’জন অফিসার বেরিয়ে গেল।
দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই ডাক্তাররা এসে গেল। সাথে একটা ট্রলি। ট্রলিটাই একটা অপারেশন বেডে পরিণত হলো। বেডের নিচের লেয়ারে অপারেশনের সব সরঞ্জাম।
ডাক্তারদের সব নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, ডাক্তাররা তাদের কাজ সারুন। আমি আসছি। জেনারেল তাহির এখানে থাকছেন।‘
বেরিয়ে গেল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
পাকা দশ মিনিট পর ফিরে এল জেনারেল মোস্তফা কামাল। তখন আহমদ মুসার ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ।
আহমদ মুসা হাসপাতালের ঢিলাঢালা পোশাক পরে সোফায় এসে বসেছে।
ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে ডাক্তাররাও বেরিয়ে গেল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল এসে তার চেয়ারে বসল। তার মুখ মলিন। বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, এই ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো ছাড়া আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। তারা ঠিকই বলেছেন। তাদের ভিসিডিটা আমরা হাত করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেটা উদ্ধারের জন্যে আমাদের সিকিউরিটি হেডকোয়ার্টারে ওরা অভিযান চালাতে পারল কি করে, এর কোন জবাব নেই। মি. খালেদ খাকানের অস্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার কারণে আপনারা বেঁচে গেছেন, ভিসিডিটা যে রক্ষা পেয়েছে সেটা ভিন্ন খাত। তাদের অভিযানকে সফলই বলতে হবে। অনেক প্রশ্ন সামনে এসে গেছে। ভিসিডিটা যে এখানে, সেটা তারা জানলো কি করে ? জানার পর উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা এত দ্রুত কিভাবে হলো এবং তার বাস্তবায়নই বা এত দ্রুত, এত নিখুঁতভাবে কেমন করে হতে পারল ?’
থামল জেনারেল মোস্তফা। তার কন্ঠে হতাশার সুর।
‘জেনারেল মোস্তফা’, বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, ‘তারা এত দ্রুত জানতে পারা এবং সফল অভিযান করায় বিস্ময়ের কিছু নেই। আমি নিশ্চিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার সর্বত্র তাদের লোক আছে। এরা ঠিক আয়েশা আজীমার মত। এরা তুর্কি প্রজাতন্ত্রের চাকরি করে, টাকা নেয়, কিন্তু আনুগত্য করে বিশেষ ষড়যন্ত্রের। নির্দেশ পেলেই এরা সক্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমান ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আর …।‘
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই জেনারেল মোস্তফা বলে উঠল, ‘আপনি ঠিক বলেছেন মি. খালেদ খাকান। ঘটনাটা ঠিক আয়েশা আজীমার মতই। বেয়ারাটা আসলে একজন পুলিশ অফিসার। আসল নাম তার জোসেফ সেদ্দিক নয়, তার প্রকৃত নাম ডেভিড বেনইয়ামিন। তুরস্কের এক ইহুদী পরিবারে জন্ম। স্কুল ফাইনালের আগে নাম পাল্টিয়ে খৃষ্টান নাম জোসেফ সেদ্দিক গ্রহণ করে। ইতিমধ্যেই আমাদের র্যাপিড কমব্যাট ব্যাটেলিয়নে এ ধরণের তিনটি নাম পাওয়া গেছে। তাদের কাউকেই এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার এখন মনে হচ্ছে, এরা সকলেই আয়েশা আজীমার মত ইচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে ‘থ্রি জিরো’র পক্ষে কাজ করে। বিষয়টা আমি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে চাই।‘
‘কিন্তু জেনারেল মোস্তফা, অপরাধকে জাতিগত কালার দেয়া ঠিক হবে না। পৃথিবীর বহু দেশের বহু ঘটনায় আমি ইহুদীদের দেশপ্রেমিক দেখেছি, ইহুদীদের নাম ভাঙ্গিয়ে গোষ্ঠী বিশেষের ষড়যন্ত্রের ঘোর বিরোধী দেখেছি তাদেরকে। তুরস্কেও এমন লোক প্রচুর আছে। যেমন ইস্তাম্বুলের ইয়াসার পরিবার।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। আমিও এমনটাই মনে করি। তবু আমার এখন মনে হচ্ছে, তাদের উপর চোখ রাখা দরকার। ভালো-মন্দের পার্থক্যটা হওয়া দরকার। অনেক ভালো লোকও জাতিগত ক্রিমিনালদের চাপে, ভয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। যদি চোখ রাখা হয়, তাহলে এই ভালো লোকদের সাহায্য করা, রক্ষা করা যাবে।‘ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘হ্যাঁ, এই সতর্কতা প্রয়োজন। কিন্তু একজনও যাতে অহেতুক সন্দেহের শিকার না হয়, তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান। এদিকে তো নজর রাখতেই হবে। যাক এ প্রসংগ, এখন বলুন, আমরা আমাদের আসল কাজে কিভাবে এগোব। ওরা দেখা যাচ্ছে সাংঘাতিক একশনে।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ওরা একশনে থাকলেই আমাদের লাভ। আর ওদের এখন একশনে থাকতেই হবে। টার্গেটে পৌঁছতে ওরা এখন আর বেশি সময় নিতে চায় না। আমার মনে হয় ওদের সবটা মনোযোগ বিজ্ঞানীদের উপর। সুতরাং সিজলি এলাকায় বিজ্ঞানীদের বাড়ি এখন আমাদেরও মনোযোগের কেন্দ্র।‘ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আমি এখন উঠতে চাই।‘
‘অবশ্যই মি. খালেদ খাকান। আপনার রেষ্ট প্রয়োজন। আপনি কোথায় যেতে চান, রোমেলী দুর্গে, না গোল্ড রিজর্টে ?’
‘প্রথমে গোল্ড রিজর্টে।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘হেড কোয়ার্টারের লনে আপনার জন্যে হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে। ওরা রেডি।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘হেলিকপ্টার কেন ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর এটাই নির্দেশ। আপনাকে নিয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। এই হেলিকপ্টার আপনার ডিসপোজালে থাকবে। আপনি স্বাধীনভাবে একে ব্যবহার করবেন।‘ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘ধন্যবাদ। তবে আকাশ নয়, মাটিকেই আমি পছন্দ করি। শত্রুরা মাটিতে তাই আমাকেও মাটিতেই থাকতে হবে।‘ বলল আহমদ মুসা।
‘বিষয়টা আপনার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কখন কি ব্যবহার করবেন, সেটা আপনিই দেখবেন। তবে তারা বলেছেন, আপনার নিরাপত্তা আমাদের নাম্বার ওয়ান প্রায়োরিটি।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল।
‘ধন্যবাদ জেনারেল মোস্তফা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন কিন্তু আপনাকে হেলিকপ্টারেই যেতে হবে। আপনি এখানে আছেন, এখান থেকে বেরুবেন, এটা শত্রুরা সবাই জানে। কোন ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ধন্যবাদ, আমি বুঝেছি আপনাদের কথা।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘একটা কথা মনে পড়ে গেছে মি. খালেদ খাকান। খুব আগ্রহ আমার তা জানার। আপনি কি করে বুঝলেন যে বেয়ারা নকল?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘প্রথমত তার পায়ে ছিল পুলিশের কমব্যাট বুট, যা বেয়ারারা পরে না। দ্বিতীয় হলো, বেয়ারার ইউনিফরম তাঁর গয়ে ফিট ছিল না। সংগে সংগেই আমার মনে এ কথা এসেছিল যে, সে নকল বেয়ারা। আসল বেয়ারাকে সে কোথাও আটকে রেখে এসেছে। আর তার সাথে আমার মনে হয়েছিল, তার টার্গেট ভিসিডি।’
‘ধন্যবাদ খালেক খাকান। আল্লাহ আপনাকে আরও বেশি বেশি সাহায্য করুন। আমার মনে হয় আল্লাহ আপনার মনে ইলহাম করেন।’ বলল জেনারেল তাহির।
‘অসহায় বান্দার বিপদে আল্লাহ বান্দার মনে বাণী পাঠান। বান্দার প্রতি আল্লাহর ‘রহমান’ নামের এ এক অসীম দয়া।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সব মানুষই কি আল্লাহর এ বাণী শুনতে পান?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল তাহিরের।
‘অবশ্যই পান। অনেক সময় এটা বিবেকের রায় আকারে আসে। আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদরা বরং আরও অগ্রসর হয়ে বলেছেন, মহান লেখকদের যত মহৎ লেখা এবং বিজ্ঞানের যত আবিষ্কার, সবই স্রষ্টার দান। স্রষ্টার কাছ থেকে এটা প্রথমে মানুষের অবচেতন মনে আসে। তারপর অবচেতন থেকে চেতনায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আধুনিক চিন্তাবিদরা সত্যিই এমন কথা বলতে পেরেছেন?’ বলল জেনারেল মোস্তফা। তার চোখে মুখে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ, জেনারেল মোস্তফা। আর্নল্ড টয়েনবি ও দাইমাকু ইকেদার মত আধুনিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ বিবেকরাই এ কথা বলেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। আরও একটা বড় বিষয়ে আপনি আমার শিক্ষক হলেন।’ বলল জেনারেল তাহির।
‘আমারও।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে উঠে দাঁড়াল দুই জেনারেলও। বলল,‘চলুন, আমরা আপনাকে হেলিকপ্টারে দিয়ে আসি।’
সবাই হাঁটতে লাগল ঘরের দরজার দিকে।
৪
অল্পক্ষণ হলো মিটিং শুরু হয়েছে। একটা বড় টেবিল ঘিরে চারজন মানুষ।
প্রধান বা সভাপতির আসনে বসেছে ‘থ্রি জিরো’র ইউরোপীয় প্রধান আইজ্যাক বেগিন। তার পাশেই ইসরাইলী রাস্ট্রদূত বসেছে। তাদের সামনে টেবিলের ওপ্রান্তে বসেছে ‘থ্রি জিরো’র ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের প্রধান প্রফেসর ডক্টর ডেভিড ইয়াহুদ। তার পাশেই ‘স্মার্থা’। স্মার্থা ইস্তাম্বুল প্রজেক্টের নতুন অপারেশন চীফ। ইরগুন ইবান নিহত হবার পর তার দায়িত্ব এসে পড়েছে স্মার্থার উপর।
প্রফেসর ডক্টর ইয়াহুদ তাদের ইস্তাম্বুল প্রজেক্ট সম্প্রতি মারাত্মক যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, তার উপর পূর্ণাঙ্গ ব্রিফিং শেষ করল।
‘থ্রি জিরো’র ইউরোপীয় প্রধান আইজ্যাক বেগিনের মুখ আষাঢ়ে মেঘের মত ভারি।
মাথা নিচু করে সে ডক্টর ডেভিড ইয়াহুদের কথা শুনছিল।
ডক্টর ইয়াহুদের কথা শেষ হলে ধীরে ধীরে মুখ তুলল আইজ্যাক বেগিন। চোখে-মুখে তার অনেক প্রশ্ন। মুখ ফাঁক করেছে প্রশ্ন করার জন্যে।
এই সময় ইন্টারকমে কথা বলে উঠল আইজ্যাক বেগিনের পিএস।
‘বল রবিন। জরুরি কিছু?’ জিজ্ঞাসা আইজ্যাক বেগিনের।
‘স্যার, বেঞ্জামিন এসেছে। ভেতরে পাঠাব?’ বলল রবিন।
‘বেঞ্জামিন? লরেন্স কোথায়? আমি তো লরেন্সের টেলিফোনের অপেক্ষা করছি। পাঠাও তাকে।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘লরেন্স তো এভাবে আমাদের দূতাবাসে আসার কথা নয়। তার উপর পুলিশের নজর আছে বলে আমরা জানি।’ বলল তুরস্কে কার্যরত ইসরাইলি রাষ্টদূত।
‘আমি সে কথাই ভাবছি। টেলিফোনে মেসেজ আসবে লরেন্সের কাছ থেকে। কিন্তু সেই মেসেজের বদলে বেঞ্জামিন আসছে কেন? লরেন্সের মোবাইল ঘন্টা খানেক আগে থেকে বন্ধ।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘লরেন্সের সাথে গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারেই যেহেতু ডিউটি ছিল, তাই জরুরি কোন কথা তার থাকতে পারে।’ বলল ড.ইয়াহুদ।
দরজায় নক হলো।
‘এস রবিন।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
রবিন লরেন্সকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
রবিন লরেন্সকে ভেতরে ঢুকিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
নির্দেশ মত স্মার্থার পাশে একটা খালি চেয়ারে বসল বেঞ্জামিন।
বেঞ্জামিন পুলিশের গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারে একজন সিভিলিয়ান কেমিষ্ট অফিসার।
সবার চোখ বেঞ্জামিনের দিকে নিবদ্ধ।
মুখ খুলল বেঞ্জামিন। একবার ড. ইয়াহুদের দিকে তাকিয়ে চোখ নিবদ্ধ করল আইজ্যাক বেগিনের দিকে। তার চোখ-মুখ ভীত ও ফ্যাকাসে। বলল, ‘স্যার, লরেন্স নিহত হয়েছেন।’
‘কখন, কিভাবে? সে তার কাজ করতে পারেনি?’ জিজ্ঞাসা আইজ্যাক বেগিনের।
‘সে বেয়ারার ছদ্মবেশে নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। জেনারেল মোস্তফা তখন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খালেদ খাকান তাকে গুলী করে মেরেছে।’
‘খালেদ খাকান কি করে তাকে সন্দেহ করল? লরেন্স অত্যন্ত চালাক লোক। একাধিক অপশন দেয়া হয়েছিল। যে কোন মূল্যে আজকেই ভিসিডি উদ্ধার করতে হবে। সুযোগ পেলে চায়ে বিষ মিশিয়ে ওদের হত্যা করে ভিসিডির কাছে পৌঁছতে হবে। এ সুযোগ না পেলে ঘরে বিষাক্ত গ্যাস ছুঁড়ে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এই দুই ক্ষেত্রে সন্দেহ হবার আগেই তো কাজ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সে খালেদ খাকানের সন্দেহের শিকার হলো কি করে? জেনারেল মোস্তফা সন্দেহ করলে একটা কথা ছিল যে, সে লরেন্সকে চিনতে পেরেছে।’
বেঞ্জামিন বলল, ‘আমি বলাবলি করতে শুনেছি যে, লরেন্স ঘরে প্রবেশ করার আগেই জেনারেল মোস্তফা বেরিয়ে এসেছিল এবং তাঁর নির্দেশেই লরেন্স নাস্তা নিয়ে যান ঐ ঘরে। তিনি জেনারেল মোস্তফার বরাত দিয়ে ভিসিডিটি কম্পিউটার থেকে নিয়ে আসার চেষ্টাও করেন। সেই সময় খালেদ খাকান বাধা দিলে লরেন্স তাকে গুলী করেন। কাঁধে গুলীবিদ্ধ হয়েও খালেদ খাকান গুলী করে হত্যা করে লরেন্সকে।’
‘তাই হবে। ওতো খালেদ খাকান নয়, আমাদের চিরশত্রু, আমাদের সীমাহীন সর্বনাশের হোতা সেই আহমদ মুসা। নিখুঁত মেকআপে তার চেহারা অনেক খানি পরিবর্তন করেছিল। দেরি হয়েছে তাকে চিনতে। সব ব্যাপার আমরা জেনেছি। তার নাম পাল্টিয়ে তুর্কি সরকার ও ওআইসি তাকে নিয়ে এসেছে তাদের আইআরটি রক্ষার জন্যে।’ থামল আইজ্যাক বেগিন।
ড. ডেভিড ইয়াহুদ, স্মার্থা সকালের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত। অবচেতন মনে শিউরেও উঠেছে তারা। তারা সবাই জানে, সব যুদ্ধেই অবশেষে তারা আহমদ মুসার কাছে হেরেছে। সাধারণ ঐ লোকটি একেবারেই অসাধারণ। যেমন সে ক্ষীপ্র, তেমনি ধুর্ত, তার সাহসেরও পরিমাপ নেই।
তাদের মুখে কোন কথা নেই।
কথা বলে উঠল আইজ্যাক বেগিন। বলল বেঞ্জামিনকে লক্ষ্য করে, ‘তুমি এবার এস।’
‘ইয়েস স্যার।’ বলে বেঞ্জামিন উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বেঞ্জামিন বেরিয়ে যেতেই আইজ্যাক বেগিন বলল, ‘এখন দুই টার্গেট, ‘সোর্ড’-এর ফর্মুলা হাত করা এবং আহমদ মুসাকে হত্যা করা। দেখামাত্র তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত আমাদের আগে থেকেই আছে। সেটাই কার্যকারী করতেই হবে।’
‘সে সাংঘাতিক ধড়িবাজ। তার ফাইল আমি মোসাদ-এর ওয়েবসাইটে পড়লাম। তাকে ধরার জন্যে, তাকে শেষ করার জন্যে হাজারো ফাঁদ পাতা হয়েছে, হাজারো সুযোগ আমাদের হাতে এসেছে, কিন্তু সবই আমাদের ব্যর্থ হয়েছে। ইস্তাম্বুলে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাও এ কথাই বলছে যে, তার সাথে লড়াই নয় ধ্বংস করতে হবে তাকে। আমি মনে করি স্যার, আইআরটি সমেত তাকে ও বিজ্ঞানীদের ধ্বংস করা হোক। তাতে আহমদ মুসাসহ ওদের সোর্ড ও গবেষণা কার্যক্রম শেষ হয়ে যাবে।’ বলল স্মার্থা।
গম্ভীর হলো আইজ্যাক বেগিন এবং ড. ডেভিড ইয়াহুদের মুখ। ড. ইয়াহুদ তাকাল আইজ্যাক বেগিনের দিকে।
আইজ্যাক বেগিন সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। বলল, ‘স্মার্থা, তুমি আমাদের অপারেশন স্কোয়াডের একটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তোমার জানা দরকার যে, সোর্ড, সোর্ডের বিজ্ঞানী বা আইআরটি ধ্বংস করা আমাদের মিশন নয়। আমরা ‘সোর্ড’-এর ফর্মুলা চাই, আমরা চাই সোর্ডের ডিজাইন।’
‘কিন্তু স্যার, আমি বুঝতে পারছি না, ‘সোর্ড’ এবং এর ডিজাইনে এত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কেন? আমি জানি, মার্কিন ইহুদী কণাবিজ্ঞানী ইলাম ইমামুয়েল আলোক কণা ফোটন নিয়ে ‘সোর্ড’-এর অনুরূপ গবেষণায় সফল হয়েছেন। এর অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সোর্ড’ জাতীয় ডিফেনসিভ শিল্ডের মালিক হওয়ার সাথে সাথে গোপনে ইসরাইলও এর মালিক হয়ে গেছে। অতএব সোর্ড কিংবা সোর্ডের ফর্মূলার দরকার ইসরাইলের নেই। এরপরও স্যার, আইআরটির সোর্ড ও সোর্ডের ফর্মূলা পাওয়ার জন্যে অহেতুক আমরা এত ক্ষতি স্বীকার করছি কেন? সব সমতে আইআরটি ধ্বংস করলেই তো আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায়। সোর্ড ওদের হাতে না থাকলেই আমরা বেঁচে যাই।’ বলল স্মার্থা।
‘তুমি যে তথ্য দিয়েছ তা ঠিক। কিন্তু সব তথ্য তুমি দিতে পারনি। আমাদের কণাবিজ্ঞানী ইলাম ইমামুয়েল আলোক-কণার ‘ফোটন’- শিল্ড আবিষ্কার করেছেন, যার ফাংশন ডিফেন্সিভ অস্ত্র হিসেবে ওদের সোর্ড এর মতই। কিন্তু ওদের ‘সোর্ড’- এর ভয়াবহ অফেনসিভ ক্যারেক্টার রয়েছে, যা আমাদের ফোটন শিল্ডে নেই।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘বুঝলাম না, স্যার?’ স্মার্থা বলল।
‘বলছি শোন, ইস্তাম্বুলের ‘আইআরটি’ গবেষণাগার ‘সোর্ড’ নামের যে ‘ফোটন-শিল্ড তৈরি করেছে তা যেমন ডিফেনসিভ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তেমনি অফেনসিভ অন্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। আইআরটির প্রধান বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বহু আগের লেখা ‘টেকনোলজিক্যাল ইউজ অব ফোটনস’ নামের একটা নিবন্ধ তার গোপন ওয়েব সাইট থেকে আমাদের বিজ্ঞানীরা উদ্ধার করেছেন। তাতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে তিনি গামা-ফোটনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম নতুন উপাদান ‘আল-সালাম’- এর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন এই ‘আল-সালাম’- এর প্রযুক্তিগত ব্যবহার ফোটন-নেটকে ভয়ংকর মারণাস্ত্রে রূপ দিতে পারে, যা পাল্টে দিতে পারে দুনিয়াকে। তার মতে ‘আল-সালাম’- এর প্রযুক্তি রূপকে যদি ফোটন-নেটের সাথে যুক্ত করা হয়, তাহলে এমন একটা অস্ত্র তৈরি হবে যা আলোর গতিতে দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে পৌছে যে কোন দুর্ভেদ্য সাইলোতে ঢুকে পড়ে মেটালিক-ননমেটালিক সব অস্ত্রকে সম্পূর্ণ হাওয়া করে দিতে পারে। আজ আইআরটিতে বসে ড. আন্দালুসি যে ‘সোর্ড’ তৈরি করেছেন, তাতে এই অফেনসিভ ক্যারেক্টার যুক্ত রয়েছে। ‘সোর্ড’- এর যে অর্থ তার মধ্যেও এর ইংগিত আছে। ‘সোর্ড’ -কে সেভিয়ার অব ওয়ার্ল্ড র্যাশনাল ডোমেইন বলা যায়। সংক্ষেপে এর অর্থ ‘মানব-ধর্মের ত্রাতা’। মানব ধর্ম বলতে ওরা বুঝাচ্ছে ‘শান্তি’ (rational domain)। আর বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি ফোটনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম- এর নতুন উপাদানের নাম রেখেছেন ‘আল-সালাম’ মানে শান্তি। এর অর্থ তারা বুঝাচ্ছেন, আমরা মনে করছি, দুনিয়ার সব অস্ত্রকে তার নিজ নিজ সাইলোতে ধ্বংস করে দিয়ে তারা দুনিয়াতে যুদ্ধহীন শান্তি নিয়ে আসবেন। এটাই আমাদের আতংকের বিষয়। আমরা চাই আমাদের সাইলোগুলোতে আমাদের অন্ত্র অটুট রেখে দুনিয়ার সব অস্ত্র ধ্বংস করতে। এজন্যেই আমরা মরিয়া ওদের ‘সোর্ড’ এবং তার ফর্মুলা হাত করতে।’
থামল আইজ্যাক বেগিন।
স্মার্থার ঠোঁট শুকনো। তার চোখে অসহায় দৃষ্টি।
তার ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কথা বেরুলো না। কথা যেন গলায় আটকে গেছে।
স্মার্থা সামনের গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে এক গ্লাস পানি সবটাই খেয়ে নিল।
গ্লাসটা টেবিলে রেখে সে বলল, ‘স্যার আমাদের বিজ্ঞানী গামাফোটনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম-এর আল-সালাম উপাদান খোঁজার চেষ্টা করছে না?’
চেয়ারে গা এলিয়ে দিল আইজ্যাক বেগিন। তার চোখে-মুখে দারুণ হতাশার ছাপ। বলল, ইউরোপ-আমেরিকার কার্যরত আমাদের সকল কণাবিজ্ঞানী অবিরাম চেষ্টা করেও এই ব্যাপারে এক ধাপ এগোতে পারেনি। এমনকি কোন সম্ভাবনাও তারা সৃষ্টি করতে পারেনি।’
স্মার্থারও চোখে-মুখে ভীতি-মিশ্রিত হতাশার সুর। বলল, ‘দক্ষিণ স্পেনের প্রায় পরিত্যক্ত শহর গ্রানাডার দরিদ্র মরিসকো পরিবারের সন্তান ড. আমির আবদুল্লাহ আন্দালুসি যা পারলো, আমাদের হাজারো বিজ্ঞানীরা তা পারল না?’
‘তিনি দরিদ্র মরিসকো ঘরের সন্তান বটে, কিন্তু তার বাল্য-কৈশোরের গোটা সময় কেটেছে মালাগা, গ্রানাডা, কার্ডোভার ভাঙা লাইব্রেরীগুলোতে। সে যেন কোন হারানো জিনিস অবিরাম খুঁজে ফিরেছে। কিছু পেয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু অনুসন্ধিতসু কিশোর মাদ্রিদের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কণা-পদার্থ বিজ্ঞানে সর্বকালের সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে পাস করেছে। আর বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ‘ক্যারেক্টার’ অব ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের যে গবেষণাপত্র তিনি তৈরি করেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মান লাভ করে। সুতরাং তিনি সামান্য থেকে উঠে আসা হলেও একজন অসামান্য মানুষ। তাকে ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগারগুলো যে কোন মূল্যে কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি নামমাত্র বেতনে সৌদি আরবের মদিনা বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখান থেকেই তিনি এসেছেন ওআইসির আইআরটি প্রজেক্টে।’
থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
কথা বলে উঠল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘ড. আন্দালুসি যা পেরেছেন, তা আমাদের বিজ্ঞানীরা না পারাটা বিস্ময়ের নয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিউটন আবিষ্কার করেন, আর কোন বিজ্ঞানী পারেননি। আইনস্টাইন আবিষ্কার করেন, আপেক্ষিক তত্ব। অন্য কোন বিজ্ঞানীর পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানের জগতে এটাই ঘটে।’
‘স্যার, এখন তাহলে আমাদের করনীয়? আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দুনিয়ার এখন প্রথম এবং একমাত্র কাজই হবে, যে কোন মূল্যে সোর্ডের ফর্মুলা হস্তগত করা এবং বিজ্ঞানীদের সমেত আইআরটিকে ধ্বংস করা।’ বলল স্মার্থা।
‘সেটাই তো আমরা চাচ্ছি। কিন্তু হচ্ছে কই। আমাদের চলার পথ তো ধীরে ধীরে সংকুচিতই হয়ে পড়ছে। স্মার্থা, তুমি যা বলেছ আমরা সেটাই চিন্তু করছি। যে কোন মূলেই আমরা সোর্ডের ফর্মুলা হাত করব এবং আইআরটিকে অবশ্যই আমরা চলতে দেব না।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘আমাদের অনেক ক্ষতি হলেও আমরা একটা বড় সাফল্য পেয়েছি। প্রফেসর বেগভিচের আত্মা শান্তি পাক। তার চেষ্টাতেই আমরা আইআরটির প্রধান বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাসার সন্ধান পেয়েছি। এখন আমরা কার্যকরী কিছু ভালো পদক্ষেপের দিকে এগোতে পারব।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘সেই পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে কি চিন্তা করেছেন? আমাদের কিন্তু দ্রুত এগোতে হবে। অনেক সময় আমাদের নষ্ট হয়েছে ইতিমধ্যেই।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘ড. আন্দালুসিকে ভয় দেখিয়ে আমরা কাজ আদায় করব। সেটা ব্যর্থ হলে আমরা তাকে কিডন্যাপ করে ফর্মুলা আদায়ের ব্যবস্থা করব। কিন্তু অনেক বিবেচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, তাকে ভয় দেখিয়ে কিংবা কিডন্যাপ, নির্যাতন করে কিংবা হত্যার ভয় দেখিয়েও তার কাছ থেকে কিছু আদায় করা যাবে না। তিনি তার জীবনের চেয়ে আইআরটি’র স্বার্থ, জাতির স্বার্থকে অনেক বড় বলে মনে করেন। সুতরাং আমরা ভাবছি যে, তিনি তার জীবনের চেয়ে যাকে বেশি ভালোবাসেন, যার ক্ষতি তিনি সহ্য করতে পারবেন না, এমন কিছুর উপর আমাদের হাত দিতে হবে। এই লক্ষ্যে আমরা তার পারিবারিক তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি। শীঘ্রই আমরা এ বিষয়ে একটা কমপ্লিট চিত্র পেয়ে যাব। আমরা এখন তারই অপেক্ষা করছি।
‘ধন্যবাদ ড. ডেভিড ইয়াহুদ। আপনারা ঠিক পথে এগোচ্ছেন। ড. আন্দালুসির মত আদর্শনিষ্ঠ ও জাতিগত- প্রাণ লোকদের শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে বা ক্ষতি করে দূর্বল করা যায় না। আঘাত দিতে হয় এদের মনে। এরা নীতিনিষ্ঠ, আদর্শবাদী বলে তাদের মনটা স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। তাই তাদের মনে উপযুক্ত আঘাত পড়লে তাদের আদর্শিক ও মানসিক প্রতিরোধ ধ্বসে পড়ে। সুতরাং ড. আন্দালুসির ব্যাপারে আপনারা সঠিক পথ বেছে নিয়েছেন।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘কিন্তু আহমদ মুসাকে পথ থেকে সরাতে না পারলে এই কাজ নিরাপদ হবে না বলে আমি মনে করি। এই ইস্তাম্বুলেই সে আমাদের অনেকগুলো উদ্যোগ র্ব্যথ করে দিয়েছে।’ ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত বলল।
‘আহমদ মুসা ও সোর্ড- এর ফর্মূলা দু’টিই আমাদের নাম্বার ওয়ান প্রায়োরিটি। এ ব্যাপারে উপর থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আহমদ মুসার একদিন বেঁচে থাকা মানে আমাদের হায়াত একদিন কমে যাওয়া। আমাদের দুর্ভাগ্য বসফরাস ব্রীজ থেকে পড়েও সে বেঁচে গেল। বারবার গুলীর মুখ থেকে বেঁচে গেছে। তার আমরা কোন ক্ষতি করতে পারিনে, তার হাতে আমাদের ক্ষতি আকাশ স্পর্শ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল আমাদের জন্যে স্বর্গভূমি, সেখান থেকে আমরা উৎখাত হয়েছি। আমাদের কিছু বিজ্ঞানী ও আমলা নাম ভাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকে আছে বলেই কিছু সুবিধা আমরা পাচ্ছি। যেখানেই আমাদের প্রজেষ্ট সেখানেই আহমদ মুসা। এই আহমদ মুসা তুরস্কেও এসেছে। একথা ঠিক, সে থাকবে আর আমরা সফল হবো, এটা অসম্ভব। বিজ্ঞানী ও আহমদ মুসাকে এক সাথেই ধরতে হবে।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘আহমদ মুসা এক জায়গায় থাকে না, সর্বশেষ তথ্য হলো সে এখন হেলিকপ্টার ব্যবহার করে।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আইজ্যাক বেগিনের। বলল, ‘আহমদ মুসাকে তুর্কি সরকার এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে!’
‘ওআইসি নিশ্চয় এর পেছনে রয়েছে। কারন আইআরটি তো ওআইসির একটি প্রতিষ্ঠান। ওআইসি গুরুত্ব দিলে তুর্কি সরকার অবশ্যই গুরুত্ব দিতে বাধ্য। তাছাড়া আমি শুনেছি, খালেদ খাকান ওরফে আহমদ মুসা খোদ তুর্কি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মেহমান হিসেবে এখানে এসেছে।’ ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত বলল হতাশ কন্ঠে।
‘স্বাভাবিক। স্বপ্ন তারা দেখতেই পারে। অটোম্যানদেরই উত্তরসূরী তো তারা! কিন্তু স্বপ্নটা তারা বেশি দেখে ফেলেছে। এই স্বপ্ন শীঘ্রই মুখ থুবড়ে পড়বে। অটোম্যানদের সেই দিন আর ফিরে…।’
কথায় ছেদ পড়ল আইজ্যাক বেগিনের।
পকেটের মোবাইল বেজে উঠেছে তার।
কথা বন্ধ করে মোবাইল তুলল আইজ্যাক বেগিন।
মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে একনজর তাকিয়েই মুখের কাছে নিয়ে বলল, ‘বল অ্যালিয়াস, কোন-খবর?’
অ্যালিয়াস সিজলি এলাকায় বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির নতুন বাড়ির আশে-পাশে মোতায়েন ‘থ্রি জিরো’র লোকদের একজন।
‘স্যার, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি চলে যাচ্ছেন। তিনি হেলিকপ্টারে উঠছেন। তার বাড়ির লনেই হেলিকপ্টারটা রয়েছে।’ বলল অ্যালিয়াস।
‘যেতে পারেন। হয়তো ইনস্টিটিউট থেকে ডাক পড়েছে। উইকএন্ডটা গোটা দিন বাসায় থাকতে পারলেন না। তুমি হেলিকপ্টারের পাশে মানে বিজ্ঞানীকে বিদায় দিতে আসা কাউকে দেখছ?’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘দেখছি স্যার। একজন সুবেশধারী মহিলাকে দেখছি। তার পেছনে পরিচারিকা ধরনের আরও দু’জন মহিলা এবং আরও দুতিন জন লোক। পেছনের এরা সবাই কাজের মানুষ বলে মনে হচ্ছে।’ বলল অ্যালিয়াস।
‘সুবেশধারী তাঁর স্ত্রী হতে পারেন। বয়স কত মনে হচ্ছে?’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘স্যার তিরিশের মত বয়স হবে।’ বলল অ্যালিয়াস।
‘বয়সের পার্থক্য ঠিক আছে। মুসলমানদের আইডিয়েল পরিবারগুলোতে ৫ থেকে ১০ বছরের পার্থক্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে থাকে। নিশ্চিত উনি ম্যাডাম আন্দালুসি।’
থামল আইজ্যাক বেগিন।
‘কোন নির্দেশ স্যার?’
‘হ্যাঁ, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি চলে যাচ্ছেন। তোমাদের কাজ বেড়ে যাচ্ছে। তোমরা বিজ্ঞানীর পরিবার সম্পর্কে আরও খোঁজ খবর নাও। বাড়িতে কে কখন আসা-যাওয়া করে তার তালিকা রাখ। অন্যান্য খোঁজ আমরা নিচ্ছি। আবার কোন দিন বিজ্ঞানী আসছেন সে খোঁজ নাও। বিজ্ঞানীর সাথে আমরা একবার কথা বলব, তারপর যা করার তা আমরা করব। বাড়ির চাকর-বাকর, লোকেরা যারা বাইরে বের হয়, তাদের সাথে সম্পর্ক কর এবং বাড়ির নিয়ম-কানুন, রুটিন সম্পর্কে জান। কিন্তু সাবধান, কোনোভাবেই ওদের মনে যেন তোমাদের সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক না হয়।’
‘আপনাদের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন হবে স্যার।’
‘ধন্যবাদ অ্যালিয়াস।’
মোবাইল রেখে দিল আইজ্যাক বেগিন। তাকাল ড. ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘ড. ইয়াহুদ, বিজ্ঞানীর বাড়িটার একটা নক্সা আপনার কাছে দেখেছি, সেটা রুম-অ্যারেঞ্জমেন্টর ডিজাইন। আমাদের প্রয়োজন ডিটেইল লে-আউট।’
‘আমরা সেটার সন্ধান করেছি। বাড়িটার নির্মাতা ইস্তাম্বুলের পূর্ব বিভাগ। পূর্ব বিভাগে বাড়ির লে-আউট থাকার কথা। কিন্তু সেখানে পাওয়া যায়নি।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ড. ইয়াহুদ, আপনি সুইচ দূতাবাসে যোগাযোগ করুন। ওখানে জোসেফ জাকারিয়া আছে ডাইরেক্টর এ্যাডমিনিস্ট্রেশন হিসেবে। তার কাছে সাহায্য পাবেন। ওরা ভাড়া নেবার সময় বাড়ির লে-আউট নিশ্চয় নিয়েছিল, কিংবা তারা একটা লে-আউট তৈরি করেছিল। যা হোক, আমরা যা চাই, ওদের কাছ থেকে তা পাওয়া যাবে।’
ড.ডেভিড ইয়াহুদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা দিক আপনি সামনে নিয়ে এসেছেন। বিষয়টা আমার মনেই হয়নি। ধন্যবাদ মি. বেগিন। আমরা অবশ্যই…।’
ডেভিড ইয়াহুদের কথা শেষ না হতেই উঠে দাঁড়াল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘ধন্যবাদ ডেভিড ইয়াহুদ। আমি উঠছি। জরুরি কাজ আছে।’
ড. ডেভিড ইয়াহুদও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন আমিও বেরুবো।’ বেরিয়ে এল তারা সবাই ঘর থেকে।
ড. ডেভিড ইয়াহুদ তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জেমস জোসেফ, তোমার হাতে মাত্র এক ঘন্টা সময় আছে। তোমার এ্যাপয়েনমেন্টা রাত ঠিক আটটায়। রেড়ি হয়ে নাও।’
জেমস জোসেফও ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘ঠিক আছে স্যার। আমি যাচ্ছি’
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে জেমস জোসেফ ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
জেমস জোসেফ বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়িতে অভিযানের নতুন সদস্য। সে ইস্তাম্বুলের ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মেকানিক্যাল স্পেস সাইন্সের ছাত্র। সেই সাথে সে জায়নবাদী আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় কর্মী।
জেমস জোসেফ বেরিয়ে যেতেই বাইরে গাড়ি দাঁড়াবার শব্দ হলো। কয়েক মুহূর্ত পরে ঘরে ঢুকল আইজ্যাক বেগিন।
ঘরে ঢুকেই বলল, জেমস জোসেফকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। সব রেডি তো। ওরা তো বেরুচ্ছে ঠিক সময়ে?’
‘হ্যাঁ, ঠিক সময়ে বেরুচ্ছে। স্মার্থা এবার নেতৃত্বে আছে। আপনি সব ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ডেলিগেশনের সাথে স্মার্থা বেমানান।
‘স্মার্থা শিক্ষকতা করলেও সে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কণাবিজ্ঞানের একটা বিষয়ের উপর পিএইচডি করছে। সুতরাং বেমানান হওয়ার কথা নয়।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ধন্যবাদ ডক্টর। আমি খুব উদ্বিগ্ন। ক’দিন আমি ছিলাম না। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। বিস্তারিত একটু বলুন ডক্টর।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘সত্যিই অনেক কিছু ঘটে গেছে।’
বলে একটু থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। বলল, ‘বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়ি আমরা যতটা প্রটেকটেড মনে করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক সুরক্ষিত বাড়িটা। আমরা নিশ্চিত হয়েছি, বিজ্ঞানীর বাড়ির কাজের লোকগুলো অবশ্যই পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের লোক। মোতায়েনকৃত আমাদের লোকেরা তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করতে গিয়ে বিপদে পড়ার মুখোমুখি হয়েছে। প্রয়োজনীয় কোন কথা আদায় করতে পারেনি। যে কথাগুলো তারা আদায় করতে পেরেছে তা উল্টা-পাল্টা বা ফাঁদ জাতীয় বলেই আমাদের মনে হয়েছে।’
‘পরীক্ষামূলকভাবে হকার-ফেরিওয়ালা পাঠাবার যে কথা হয়েছিল, সেটার কিছু করা গেছে?’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘ও পরীক্ষাও হয়ে গেছে। ফেরিওয়ালা, নিউজপেপার হকার ও হোম সার্ভিসের লোকদের পাঠিয়েছিলাম। ওরা গেট পর্যন্তও পৌঁছতে পারেনি। তার আগেই তাদের ধরে ফেলা হয়েছে। অবশ্য পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ওরা আমাদের লোক, কিন্তু সেই সাথে ওরা প্রকৌশলীও। সুতরাং কোন অসুবিধা হয়নি। তবে পরিষ্কার হয়েছে, বিনা বাধায় বিজ্ঞানীর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারা যাবে না। জোর করে যাওয়ার চেষ্টা করলে লড়াই করতে হবে নিঃসন্দেহে।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘জেমস জোসেফদের দ্বারা যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন, সেটার ব্যাপারে আপনি কতটা নিশ্চিত?’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘হ্যাঁ। অনেক চিন্তা করে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ছেলেরা যদি বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাথে দেখা করার একটা অফিসিয়াল উদ্যোগ নেয় তাহলে তারা সে অনুমতি পেতে পারে। এমন ভাবনা থেকেই জেমস জোসেফকে দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এক গ্রুপ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রকে উৎসাহিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রদের রিসার্চ ফোরাম আছে। তারা বিজ্ঞান-টেকনোলজির অত্যাধুনিক টপিক্সের উপর মাঝে মাঝেই সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল ও গ্রুপ জিসকাশনের আয়োজন করে। বড় বড় বিজ্ঞানী ও শিক্ষকদের এসব অনুষ্ঠানে আনা এবং তাদের সাথে গ্রুপ করে দেখা করা তাদের নিয়মিত প্রোগ্রামের অংশ। তাদের এসব প্রোগ্রাম ও পরিচয়ের নানারকম পেপারস-ব্রসিয়ারস আছে। জেমস জোসেফ এই ফোরামের একজন সদস্য, অবশ্য মূল বডিতে সে নেই। তবে তার প্রস্তাবকে তারা গ্রহণ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আইআরটির টেলিফোন নাম্বার যোগাড় করে ফোরামের প্রেসিডেন্ট বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে টেলিফোন করে। ফোরামের একটা গ্রুপ তার সাথে দেখা করতে চাইলে বিজ্ঞানী তার অপরাগতার কথা প্রকাশ করেন। এই অবস্থায় ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির কণাবিজ্ঞান বিভাগের ডীন ড. ফাতিমা বাদরুমা ফোরামকে পরামর্শ দেন তাদের ‘হিস্ট্রি এন্ড মেথডলজি অব স্ট্রাটেজিক রির্সাচ’ বিষয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ড. সারার সাহায্য নিতে। তিনি জানান, কিছুদিন আগে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সায়েন্স এন্ড ইমান বিল গায়ে’-এর উপর সাড়া জাগানো যে আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়, তাতে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি ও ড. সারা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। আমি তখন দেখেছি মার্কিন স্ট্রাটেজিক রিসার্চেও ড. সারাকে ড. আন্দালুসি খুব রেসপেক্ট করেন। তিনি যদি ফোরামের পক্ষে ড. আন্দালুসিকে অনুরোধ করেন, তাহলে ড. আন্দালুসি নিশ্চত রাজি হবেন। ড. ফাতিমা বাদরুমার পরামর্শ অনুসারে ফোরাম প্রতিনিধিরা ড. সারার সাথে দেখা করে তাঁকে অনুরোধ করেন। প্রতিনিধি দলে জেমস জোসেফও ছিল। সেই ফোরামের পক্ষ থেকে একটা ফোল্ডার তৈরি করে ড. সারাকে দেয়া হয়। ড. সারা অনেক আলোচনা ও জিজ্ঞাসাবাদের পর ফোরামের পক্ষে ড. আন্দালুসিকে অনুরোধ করতে রাজি হন। তার অনুরোধেই ড. আন্দালুসি রাজি হন ফোরামকে সাক্ষাৎকার দিতে। আমরা চেয়েছিলাম ড. আন্দালুসি যেন তাঁর বাড়িতে সাক্ষাৎ দিতে রাজি হন। এ জন্যেই সিজলি এলাকায় তার বাড়ির কাছের ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ফোরামকে আমরা ব্যবহার করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সাক্ষাৎ দিতে রাজি হওয়ার পর ড. আন্দালুসি বলেন, অফিসে আমি কাউকে সাক্ষাৎ দেই না। তার উপর আগামী শুক্রবার সিজলিতে আমার বাসাতেই থাকব। বিশ্ববিদ্যালয়ও ঐ এলাকাতেই। সুতরাং সাক্ষাৎটা আমার বাসাতেই হবে।’ থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
খুশিতে উঠে দাঁড়িয়েছে আইজ্যাক বেগিন। সে হাত বাড়িয়ে ড. ইয়াহুদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ইশ্বর আমাদের সাহায্য করছেন। না হলে এতবড় সুযোগ আমরা এভাবে পেয়ে যাই! এখন বলুন, অপারেশন টিমটা আপনার কেমন হয়েছে। তারা পরিকল্পনা অনুসারে ড. আন্দালুসিকে তার স্ত্রী সমেত ওখান থেকে বের করতে পারবে তো?’
‘অবশ্যই বিজ্ঞানীর বাসার মূল অপারেশনে নেতৃত্ব দেবে স্মার্থা। তার সাতে আমাদের আটজন চৌকশ কমান্ডো। জেমস জোসেফ এদের সাথে থাকবে। কারণ যেখানে ওদের আটকে রাখা হবে, সেটা জেমস জোসেফেরই জানা। অন্যদিকে বিজ্ঞানীর বাসায় যাওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিনিধিদলকে কিডন্যাপ করবে অন্য একটা কমান্ডো দল। এরও নিরাপদ পরিকল্পনা করা হয়েছে। আটকে রাখার জায়াগাও ঠিক করা আছে। আমাদের লোকদের প্রত্যেকের ডুপ্লিকেট আইডি কার্ড তৈরি করা হয়েছে। এই আই ডি কার্ডগুলো নিয়ে ছাত্র সেজে আমাদের স্মার্থা বাহিনী বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়িতে প্রবেশ করবে। ছাত্র প্রতিনিধি দলের যে নাম পরিচয় বিজ্ঞানীকে আগেই সরবরাহ করা হয়েছে, তাতে কারও ছবি নেই, ছবি তারা চায়ওনি। সুতরাং কোন দিক দিয়ে কোন অসুবিধা হবে না।’
খুশিতে আইজ্যাক বেগিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনি বললেন, বিজ্ঞানীর বাড়িতে চাকর-বাকর যারা আছে, তারা হয় পুলিশের না হয় গোয়েন্দা বিভাগের লোক। বাড়িতে তাদের সংখ্যা কত হতে পারি এ ব্যাপারে কিছু জেনেছেন?’
‘বিজ্ঞানীর বাড়ির উপর আমাদের যারা চোখে রেখেছে, তাদের মতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে যারা বাইরে এসেছে, তাদের সংখ্যা পাঁচ-ছয় জনের বেশি নয়।’
‘তার মানে বিজ্ঞানীর বাড়িতে ঐ ধরনের লোক সাত আটজনের বেশি হবে না। আর তোমার স্মার্থা বাহিনীতে থাকছে ১০ জন। তুমি কি মনে করছ? সাফল্যের ব্যাপারে কিন্তু কোন ঝুঁকি থাকা চলবে না।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘কোন চিন্তু নেই। আমার লোকরা প্রস্তুত অবস্থায় প্রথম আঘাত করবে। ওরা থাকবে অপ্রস্তুত। স্মার্থার পরিকল্পনা হলো, প্রথম আঘাতেই ওদের অধিকাংশ লোককে টার্গেটে নিয়ে আসা। এজন্যে কথা হয়েছে, সাক্ষাতের এক পর্যায়ে আমাদের লোকরা চোখের পলকে গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়বে এবং একযোগে আক্রমণ করবে। ওদেরকে প্রস্তুতির কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। শুধু বিজ্ঞানী ও তার স্ত্রীকে কোন আঘাত করতে নিষেধ করা হয়েছে। ওদের ধরে নিয়ে যেতে হবে।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘কেন, বিজ্ঞানীর বাচ্চাদের বাদ দিচ্ছেন কেন? ওদের ধরে নিয়ে যেতে হবে। স্ত্রীর সাথে ওরাও হবে বিজ্ঞানীকে কথা বলাবার অব্যর্থ টোপ।’ আইজ্যাক বেগিন বলল।
‘না, বিজ্ঞানীর ছেলে-মেয়েরা এখন এখানে নেই। এই তথ্য আমরা নিশ্চিতই জানতে পেরেছি।’
বলেই দ্রুত ঘড়ির দিকে তাকাল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। বলল, ‘এখন ১০টা বিশ মিনিট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেলিগেটদের কিডন্যাপের অপারেশন এখন নিশ্চয় শেষ হয়েছে। স্মার্থা বাহিনী যাচ্ছে এখন বিজ্ঞানীর বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ডেলিগেশনের ছদ্মবেশে। কিন্তু এতক্ষনেও টেলিফোন আসছে না কেন? প্রথম অপারেশনের পরেই তার খবর জানানোর কথা ছিল।’
থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
তাকাল আবার ঘড়ির দিকে।
সংগে সংগেই বেজে উঠল তার মোবাইল।
দ্রুত মোবাইল মুখের কাছে তুলে ধরল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। ওপারের কন্ঠ শুনেই বলল, ‘বল জেমস জোসেফ, সুখবর?’
‘জি স্যার। অপারেশন সাকসেসফুল। দু’টি ক্লোরোফরম টাইম বোমার স্বয়ংক্রিয় বিস্ফোরণে দুই গাড়ির সবাই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। পরে আমাদের ড্রাইভার গাড়ি দু’টিকে ড্রাইভ করে সিজলি পাহাড়ে নিয়ে যায়। একটা ঝোঁপে তাদের সংজ্ঞাহীন দেহ লুকিয়ে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে আসে। ম্যাডাম স্মার্থার নেতৃত্বে আমরা নতুন ছাত্র ডেলিগেটরা এখন যাচ্ছি বিজ্ঞানীর বাড়ির দিকে।’
‘ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাদের। টেলিফোনটা স্মার্থাকে দাও।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা।
ওপার থেকে স্মার্থার গলা পেতেই ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল, ‘এখন আর কোন কথা নয়। গড ব্লেস ইউ স্মার্থা। এটাই আমাদের সর্বোচ্চ সুযোগ। লক্ষ্য অর্জনের জন্য আশা করি সব কিছুই করবে। গড ব্লেস ইউ। গুড বাই।’
মোবাইল রেখে দিল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। বলল আইজ্যাক বেগিনের দিকে তাকিয়ে, ‘ওরা বিজ্ঞানীর বাড়িতে যাত্রা করেছে মি. আইজ্যাক বেগিন। ঈশ্বরকে ডাকুন।’
‘গড হেলপ আস।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘সামনে আধ ঘন্টা সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসুন আমরা সুখবরের জন্য অপেক্ষা করি।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘ঠিক আছে। কিন্তু সুড়ঙ্গ পথ সম্পর্কে ওদের সুস্পষ্ট ধারণা আছে তো। ঠিকভাবে বুঝতে না পারলে বিজ্ঞানী ও তার স্ত্রীকে নিয়ে পালানোর সব আয়োজন পন্ড হয়ে যাবে।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘সে রকম কোন অসুবিধা হবে না। অপারেশন টীমে যারা আছে, তারা প্রত্যেককেই বাড়ির নকশা, ঘরগুলোর নকশা, সুড়ঙ্গের মুখ এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়া হয়েছে।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
আইজ্যাক বেগিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ।’
বলে সোফায় গা এলিয়ে দিল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল, ‘মাফ করবেন ড. ইয়াহুদ, একটা জরুরি টেলিফোন সেরে নেই।’
‘অবশ্যই।’ বলল ড. ইয়াহুদ।
আইআরটি-তে রোববারের সকাল।
ফরমাল অফিস নেই। তবু নাস্তার পর ড. শেখ আবদুল্লাহ বিন বাজ এবং আইটি ইঞ্জিনিয়ার ইসমত কামাল বেশ অনেকক্ষণ আগে অফিসে এসেছে।
অফিসের লাউঞ্জে বসে আহমদ মুসা তাদের সাথে আলাপ করছিল।
বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দক্ষিণহস্ত তরুণ আলোক বিজ্ঞানী ড. ইবনুল আব্বাস আবদুল্লাহ সেসুসি লাউঞ্জে ঢুকল।
সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে এক জনের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখন দশটা বিশ মি. খালেদ খাকান। মাত্র বিশ মিনিট লেট। ছুটির দিনে এই লেট নিশ্চয় কাউন্টেবল নয়।’ ড. সেসুসির মুখে হাসি।
সকাল ৯টায় আহমদ মুসা অফিসে এসেছে। সকাল সাড়ে ৮ টায় ড. সেসুসি টেলিফোন করেছিল আহমদ মুসাকে। বলেছিল, আপনি যখন এসেছেন, তখন আমিও ১০টার দিকে লাউঞ্জে আসছি।
‘ওয়েলকাম ড. সেসুসি। ছুটির দিন না হলেও বিজ্ঞানীদের লেট দোষনীয় নয়। বিজ্ঞানীরা অংকে একেবারে অ্যাকুরেট বলেই ব্যক্তি জীবনের কাজ-কর্মে অনেক খানি বেহিসেবী। সুতরাং বিশ মিনিট লেট আমরা সানন্দে গ্রহন করলাম।’ হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ। তবে মি. খালেদ খাকান বিজ্ঞানীদের এই বেহিসেবী হবার কথা তাদের পরিবারের কাছে না বলা উচিত। তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’ বলল ড. সেসুসি মুখ টিপে হেসে।
‘পরিস্থিতি আরও খারাপ না করার কথা বলছেন। তার মানে পরিস্থিতি এখন খারাপ। তাই কি ড. সেসুসি?’ বলল ড. আবদুল্লাহ বাজ। তার ঠোঁটে হাসি।
হাসল ড. সেসুসি। বলল, ‘সবে তো আমাদের সাথে আসলেন। আমাকে এখনো বুঝে সারেননি হয়তো। কিন্তু গত তিন মাসে আমাদের চার বিজ্ঞানীর বাড়িতে কয়েকবার গেছি। সেখানে ভাবীদের কাছে মজার মজার কথা শুনেছি। আল্লাহ নাকি বিজ্ঞানীদের মাথায় বস্তুবিজ্ঞানের জ্ঞান ও তার প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং সেই সাথে মগজ থেকে সংসার বুদ্ধির জ্ঞান কেটে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আন্দালুসি ভাবীর কাছে এ অভিযোগ শুনেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘বিয়ের পর গত ২৫ বছরে তোমার স্যার একদিনের জন্যেও কোন অবকাশ সফরে নিয়ে যাবার সময় পাননি। আমার স্ত্রীর সামনে এ কথা বলায় আমি বিপদেই পড়েছিলাম।’
হেসে উঠল আহমদ মুসা ও ড. বাজ দু’জনেই। ড. বাজ বলল, ‘বিপদে পড়েছিলেন কেন, আপনার তো শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়েছে।’
‘ঠিক বলেছেন। পরের উইক এন্ডেই আমি উইক এন্ডের সাথে আরও দু’দিন যোগ করে স্ত্রীকে নিয়ে ‘লেক ভ্যান’-এ গিয়েছিলাম তিনদিনের অবকাশ যাপনে। নূহ আ.- এর কিস্তির মাউন্ট আরারা দেখা আমার স্ত্রীর একটা বড় শখ ছিল।’ বলল ড. সেসুসি। তার মুখে হাসি।
‘তাহলে আল্লাহ নিশ্চয় বিশেষ আনুকুল্য দেখিয়ে আপনার মগজের সংসার-বুদ্ধির সবটুকু অংশ কেটে রাখেননি।’ বলল আহমদ মুসা মিষ্টি হেসে।
‘আল হামদুলিল্লাহ। দোয়া করুন, দয়া করে আর যেন না কাটেন। ঘরের বিপদের মত বড় বিপদ আর নেই। গত উইক এন্ডেও ড. আন্দালুসি বাসায় যাননি। এ উইক এন্ডেও যেতে পারলেন না।’ ড. সেসুসি বলল। তার মুখেও মিষ্টি হাসি।
আহমদ মুসা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘তা ঠিক। কিন্তু ড. আন্দালুসি মিসেস আন্দালুসির অনুমতি নিয়েছেন। মিসেস আন্দালুসি শুধু অনমুতিই দেননি, বলেছেন, ‘দেশ, ধর্ম, জাতি, সর্বোপরি মানুষের প্রয়োজনে ড. আন্দালুসি যা করেন তার সাথে তিনি আছেন।’
গম্ভীর হয়ে উঠল ড. সেসুসির মুখও। বলল, ‘ম্যাডাম রসিকতা করে অনেক সময় অনেক কথা বলেন। কিন্তু তিনি একজন মডেল বিজ্ঞানীর মডেল স্ত্রী। তিনি একদিন হাসতে হাসতে আমাকে বলেছেন, ‘বেটা! বিজ্ঞানীদের স্ত্রীরা কিন্তু স্বভাবগতভাবে বিজ্ঞানের সতীন। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের ও তাদের স্ত্রীদের কিন্তু সচেতন থাকা দরকার। স্ত্রীরা অবশ্যই ত্যাগ স্বীকার করবে, কিন্তু স্বামীদের তার স্বীকৃতি দেয়া উচিত, ঠিক যেমন তোমার স্যার দিয়ে থাকেন।’
ড. সেসুসি কথা শেষ করে একটু থেমে আবার বলে উঠল, ‘ম্যাডামের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে।’
ড. সেসুসি কথা শেষ করতেই আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল।
আহমদ মুসা মোবাইল বের করে স্ক্রীনের দিকে চেয়ে জোসেফাইনের নাম দেখেই বলল, ‘মাফ করবেন, আমি কলটা রিসিভ করছি।’
বলে আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠে ঘরের একটা প্রান্তে সরে গেল।
‘হ্যালো, জোসেফাইন। আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওয়া আলাইকুম সালাম। আমরা ভাল আছি। এইমাত্র আমার সেই বান্ধবী জেফি জিনা একটা খবর দিল। মনে হয় খবরটা খুব খারাপ।’ বলল জোসেফাইন।
‘খবরটা খুব খারাপ?’ দ্রুত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘আজ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির একটা ছাত্র প্রতিনিধিদলের সাথে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাক্ষাতকার ছিল বিজ্ঞানীর সিজলির বাড়িতে। এই উপলক্ষে জেফি জিনাকেও চায়ের আমন্ত্রণের কথা বলেছিলেন বিজ্ঞানী। জেফি জিনা……….।’
জোসেফাইনের কথায় বাধা দিয়ে আহমদ মুসা মাঝখানেই বলে উঠল, ‘সেখানে কিছু ঘটেছে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘সেখানে কিছু ঘটার কথা নয়, একটা সন্দেহজনক ঘটনার খবর দিয়েছে জেফি জিনা।’
মুহূর্তের জন্যে থামল জোসেফাইন, তারপর বলে উঠল, ‘জেফি জিনা বিজ্ঞানীর বাড়ি যাচ্ছিলেন তার গাড়িতে করে। তিনি ছাত্র প্রতিনিধি দলের দু’টি মাইক্রো দেখেছিলেন তার সামনে। তিনি দেখেন, মাইক্রো দু’টি ডানদিকে শেষ একজিট রোড পার হয়ে বিজ্ঞানীর বাড়ির দিকে কয়েক গজ এগিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। থামাটা এত আকস্মিক ছিল যে, পেছনের মাইক্রোটা সামনের মাইক্রোকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পরক্ষণেই রাস্তার পাশ থেকে দু’জন লোক হঠাৎ বেরিয়ে এসে দুই মাইক্রোর ড্রাইভিং সিটে উঠে যায়। তার পরেই মাইক্রো দু’টি দ্রুত ঘুরে সেই ডানের একজিট রোড ধরে ডান দিকে চলে যায়। জেফি জিনা ততক্ষণে ডানর একজিট রোডটার কাছে এসে পড়েছিল। যখন মাইক্রো দু’টি ঘুরে দাঁড়িয়ে ডানের রোড ধরে চলছিল, তখন জেফি জিনা সেই দু’জন ড্রাইভারের পাশে বসা একজনকে দেখেন যাকে ছাত্র বলে তিনি চিনতে পারেন। সে ছাড়া মাত্র প্রতিনিধিদলের কাউকে গাড়ির সিটে বসা দেখতে পাননি। বিস্মিত হন জেফি জিনা। তিনি রাস্তা থেকে একটু সরে গাড়িটা দাঁড় করান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিফোন করে ছাত্র প্রতিনিধিদলের যে কারও টেলিফোন যোগাড়ের চেষ্টা করেন। টেলিফোন নাম্বার পেতে দেরি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কণাবিজ্ঞান বিভাগের ডীনের অফিস থেকে প্রতিনিধিদলের নেতা ছাত্রটির টেলিফোন নাম্বার পেয়ে যান। কিন্তু তিনি টেলিফোন করার চেষ্টা করাকালেই মাইক্রো দু’টিকে দ্রুত ফিরে আসতে দেখেন। তিনি মোবাইল রেখে ড্যাশ বোর্ড থেকে তার দুরবিনটা নিয়ে তাকান মাইক্রোর দিকে। পরে দুই মাইক্রোতে ওঠা দু’জন লোককেই ড্রাইভ করতে দেখেন। কিন্তু সিটগুলোতে বসা যাদের দেখলেন, তাদেরকে তার ছাত্র বলে মনে হয়নি। জেফি জিনার বিস্ময় সন্দেহে পরিণত হয়। তিনি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া প্রতিনিধি দলের নেতা ঐ ছাত্রের নাম্বারে টেলিফোন করেন। কিন্তু বারবার টেলিফোন করেও কোন উত্তর পাননি তিনি। বারবারই নো-রিপ্লাই হয়। ততক্ষণে মাইক্রো দু’টি চলে গেছে। বিজ্ঞানীর বাড়ি সেখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু প্রবল দ্বিধায় পড়েন তিনি। তার নিশ্চিত মনে হয়, ঐ দুই মাইক্রোতে যারা গেছে তারা ছাত্র-প্রতিনিধি দল নয়। প্রবল ……..।’
‘ইন্নালিল্লাহ…। স্যরি জোসেফাইন, তুমি একটু হোল্ড কর। তোমার সাথে আরও কথা বলতে হবে। আমি একটা টেলিফোন করে নেই।’
বলেই কল হোল্ড করে আহমদ মুসা দ্রুত ওয়ান টাস ডায়ালে জেনারেল মোস্তফা কামালকে টেলিফোন করল। ওপার থেকে তার কণ্ঠ পেতেই সালাম দিয়ে দ্রুত কণ্ঠে বলল, ‘জেনারেল, এখনি আপনি সিজলি এলাকার পুলিশ ষ্টেশনগুলোকে দ্রুত বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়িতে পৌছার জন্যে মুভ করতে বলুন। আর আপনি বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে টেলিফোন করুন। জরুরি।’
‘বুঝতে পারছি কিছু ঘটেছে। কি ঘটেছে? বাড়িতে তো আমাদের শক্তিশালী গোয়েন্দা টিম রয়েছে।’ দ্রুত, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ছাত্র-প্রতিনিধিদলের সাথে ড. আন্দালুসির একটা সাক্ষাতকার ছিল আজ সকালে। যা খবর পেলাম, তাতে মনে হচ্ছে ছাত্র প্রতিনিধিদলকে কিডন্যাপ করে শত্রু পক্ষের কেউ সেখানে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ও গড! বুঝেছি। আমি পুলিশ ষ্টেশনগুলোতে টেলিফোন করছি। আমরা যাচ্ছি সেখানে, আপনি প্লিজ আসুন মি. খালেদ খাকান।’
বলেই ‘আসসালাম’ কথাটি কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করে কল লাইন কেটে দিল।
আহমদ মুসা জোসেফাইনের হোল্ড লাইনটা অন করে বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘মনে হয় সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে সেখানে। তোমার বান্ধবী জেফি জিনা শেষ পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?’
‘প্রবল দ্বিধা নিয়ে অবশেষে তিনি বিজ্ঞানীর বাড়ির দিকেই এগোন। কিন্তু বিজ্ঞানীর বাড়ির রাস্তায় যাবার আগেই দু’জন লোক এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। বলে, বিজ্ঞানী স্যারের বাড়ি যেতে হলে পাশ লাগবে। পাশ আছে কিনা। তখন জেফি জিনা জানান, তার দাওয়াত আছে সেখানে। কিন্তু সেই লোক দুজন বলে, ছাত্র প্রতিনিধি দলের পাশ ছিল, তাঁরা গেছে। পাশ না থাকলে আপনাকে যেতে দিতে পারি না। তখন জেফি জিনা তাদেরকে বলে, তোমরা যদি সরকারি কিংবা সিকিউরিটির লোক হও, তাহলে এখনি পুলিশকে খবর দিয়ে বিজ্ঞানী স্যারের বাড়িতে যাও। তার বিপদের আশংকা করছি আমি। সেই দু’জন লোক জানায়। ভয় নেই, বাড়িতে তাঁর নিরাপত্তার জন্যে ব্যবস্থা আছে। তার পরেই জেফি জিনা আমাকে টেলিফোন করে তোমাকে সব জানাবার অনুরোধ করে তিনি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেছেন।’
থামল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবীকে ধন্যবাদ জোসেফাইন। দোয়া করো, বিজ্ঞানী স্যারের যেন কোন বিপদ না হয়। যে উদ্দেশ্যে আমি এখানে এসেছিলাম জোসেফাইন, তা সম্পাদনে বোধ হয় ব্যর্থ হলাম। রাখি। দেখি ওদিকে কি অবস্থা।’ গম্ভীর অথচ ভাঙা কণ্ঠস্বর আহমদ মুসার।
‘তুমি তো ভেঙে পড়ার জন্যে নও। আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন। ইনশাআল্লাহ তুমি সফল হবে। আমি রাখছি, আসসালামু আলাইকুম।’ গভীর মমতা মাখানো কণ্ঠ জোসেফাইনের।
আহমদ মুসা মোবাইল রাখল পকেটে।
ড. বাজ ও ড. সেসুসি চোখ-মুখ ভরা উদ্বেগ নিয়ে আহমদ মুসার দিকে অপলক দৃষ্টি রেখে পাথরের মত স্থির হয়ে বসে আছে।
আহমদ মুসা তাকাল তাদের দিকে। বলল, ‘শুনেছেন তো সব। খবর সত্য হলে, ধরেই নিতে হবে ড. আন্দালুসি বিপদে পড়েছেন।’ গম্ভীর ও শান্ত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘আমি কয়েকবার স্যারের মোবাইলে টেলিফোন করলাম। রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ এ্যাটেন্ড করছে না। এই মোবাইল সব সময় তিনি কাছে রাখেন।’ বলল ড. সেসুসি। কান্না ভেজা তার কণ্ঠ।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল ড. বাজ। আহমদ মুসা দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল তার আগেই, ‘আমি সিজলিতে যাচ্ছি। আপনারা অফিসে থাকুন।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
ড. বাজ ও ড. সেসুসি উঠে দাঁড়াল।
‘স্যার, আমাদের জন্যে আর কোন নির্দেশ?’ বলল ড. বাজ।
‘আপনাদেরকেও সাবধান থাকতে হবে। ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে গেছে। আসি। আসসালামু আলাইকুম।’
সালাম নিয়ে ড. বাজ সংগে সংগেই বলে উঠল, ‘স্যার, আপনার নিরাপত্তা আমাদের জন্যে বেশি প্রয়োজনীয়। হেলিকপ্টার ওয়ার্কশপে, আসতে বলি?’
‘না ড. বাজ। তাতে আরও দেরি হয়ে যাবে। আমাকে এখনই বেরুতে হবে। আর সিজলি তো বেশি দূরে নয়।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।
সিজলিতে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির বাড়ির সামনে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতেই জেনারেল মোস্তফা হেলিকপ্টার থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছুটল ড. আন্দালুসির বাড়ির দিকে। পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের টেলিফোনে আগেই জেনেছেন ড. আন্দালুসির বাড়িতে ৭টি লাশ ছাড়া কিছু নেই। পুলিশ প্রধানের হেলিকপ্টারটিকেও একটু দূরে দাঁড়ানো দেখল।
সিকিউরিটি কর্মীদের স্যালুটের মধ্যে দিয়ে জেনারেল মোস্তফা কামাল বিজ্ঞানী আন্দালুসির বাড়িতে ঢুকে গেল।
পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন জেনারেল মোস্তফা কামালকে স্বাগত জানাল। বলল, ‘বেজমেন্টসহ গোটা বাড়ি সার্চ করা হয়ে গেছে স্যার। যে সাতটি লাশ পাওয়া গেছে, তার সবই আমাদের গোয়েন্দাদের।’
‘ওদের লাশ পড়লেও তা তারা রেখে যায়নি নিশ্চয়?’ গম্ভীর কণ্ঠ জেনারেল মোস্তফা কামালের।
‘অবশ্যই।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘চলুন, আমি একটু দেখতে চাই, বাড়িটাই আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দাদের যারা বাইরে পাহারায় ছিল, তাদের বক্তব্য কি?’
‘কোন গোলা-গুলীর শব্দ তারা পায়নি। মনে করা হচ্ছে, তাদের রিভলবার, ষ্টেনগান সবকিছুতেই সাইলেন্সার লাগানো ছিল।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘কিন্তু আমাদের লোকরা তাদের চলে যেতে দেখলো না কেন? তারা কিভাবে হাওয়া হয়ে গেল বুঝতে পারছেন কিছু?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘মাইক্রো দু’টি বাইরে পড়ে আছে। আমাদের লোকেরা তাদের কাউকে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখেনি। এটা ঠিক হলে দু’টি বিকল্প থাকে, এক. তারা বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে আছে এবং দুই. তারা বাড়ি থেকে কোন বিকল্প পথে পালিয়েছে।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘বিকল্প পথটা কি?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘সুড়ঙ্গ পথ হতে পারে। কিন্তু আমরা বাড়ির একতলা ও বেজমেন্ট ইঞ্চি ইঞ্চি করে খতিয়ে দেখেছি। সুড়ঙ্গের কোন অস্তিত্ব আমরা পাইনি। আরেকটা কথা, আমরা এমনভাবে খুঁজেও কোন সুড়ঙ্গ পেলাম না, কিন্তু বাইরের লোকরা এসে তাড়াহুড়োর মধ্যে তা পেয়ে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। সুতরাং তাদের অন্তর্ধান একটা বড় রহস্য!’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘আসুন, আরেকবার আমরা দেখি বাড়িটা।’
বলে পা বাড়াল জেনারেল মোস্তফা কামাল। তার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনসহ আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার।
আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ সব ফ্লোর ও ঘর দেখে জেনারেল মোস্তফা পুলিশ প্রধানসহ আবার ফিরে এল ড্রইংরুমে।
বসল দু’জনেই সোফায়। দু’জনের চোখে-মুখে উদ্বেগ।
পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন সোফায় সোজা হয়ে বসে মনে হয় কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করল। তারপর বলল, ‘স্যার, কোন সুড়ঙ্গ পথ যদি না থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে পেছনের দরজা দিয়েই তারা পালিয়েছে। পেছনের পনের গজ দূরে বাউন্ডারি ওয়াল। ওয়ালের বাইরে একটা প্রাইভেট রোড আছে। সেখানে গাড়ি রেখে এসে থাকলে এ দিক দিয়ে পালিয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়।’
সোফায় মাথা রেখে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বসেছিল জেনারেল মোস্তফা কামাল। সেও সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘দু’জন লোককে কিডন্যাপ করে ডজন খানেক লোক পেছনের বাউন্ডারি ওয়াল ডিঙিয়ে চলে যাবে, বাইরে মোতায়েন করা আমাদের কোন লোকের নজরে পড়বে না, এটা স্বাভাবিক নয় মি. নাজিম এরকেন।’
‘এ যুক্তিও ঠিক স্যার, কিন্তু বাড়ির তিনদিকে বাগান থাকলেও বাড়ির পেছনে গাছ-গাছড়াটা একটু বেশি। এছাড়া আমাদের লোকদের নজর কিন্ত বাড়ির সামনের গেট ও বাড়ির এ্যাপ্রোস রোডের উপর বেশি ছিল। বাড়ির ঠিক পেছনে সরাসরি কোন পাহারা ছিল না। ওয়ালের বাইরে প্রাইভেট রোডটার উপর চোখ রাখার ব্যবস্থা ছিল। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তাদের চোখ ছিল রাস্তাটির দু’প্রান্তের মুখে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না।’
পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকল একজন পুলিশ অফিসার। বলল, ‘জনাব খালেদ খাকান সাহেব এসেছেন।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন দু’জনেই চমক ভাঙার মত নড়ে-চড়ে বসল। যেন প্রাণ পেল তারা!
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে এস। আমরা ওনার জন্য অপেক্ষা করছি।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে।
পুলিশ অফিসার চলে গেল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই আহমদ মুসা ঘরে ঢুকল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন দু’জনই উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাকে। হাসি নয়, তার মুখে বেদনা যেন উথলে উঠছে! জেনারেল মোস্তফা জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, ‘আমরা বিস্মিত, বিপর্যস্ত মি. খালেদ খাকান। আপনার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি।’
জেনারেল মোস্তফা কামাল আহমদ মুসাকে ধরে নিয়ে পাশের সোফায় বসাল। তারপর নিজের আসনে ফিরে গিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘ভূতুড়ে ঘটনা ঘটেছে মি. খালেদ খাকান! বাড়ির চারদিকে পুলিশ পাহারায় ছিল। তাছাড়া বাড়ির ভেতরে কাজের লোক ও পরিবারের সদস্যের ছদ্মবেশে ছয়জন মহিলা ও দু’জন পুরুষ গোয়েন্দা অফিসারসহ সর্বমোট আটজন গোয়েন্দা কর্মী পাহারায় ছিল, অথচ দশজনের একটা দল বাড়িতে প্রাবেশ করে সাতজন গোয়েন্দা কর্মীকে খুন করে বিজ্ঞানী ও একজন গোয়েন্দা মহিলা কর্মীকে কিডন্যাপ করে হাওয়া হয়ে গেল। তারা কিভাবে পালাল তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘মহিলা গোয়েন্দা অফিসারকেও হয়তো তারা বিজ্ঞানীর সাথে গ্রেফতার করেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই মনে হচ্ছে। কারণ তার লাশও নেই, পালাতেও পারেনি। কিন্তু অন্যদের খুন করে তাকে নিয়ে যাবে কেন?’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তাকে ভুল করে নিয়ে গেছে।’
‘ভুল করে কিভাবে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফা কামালের।
‘মহিলা গোয়েন্দা অফিসারকে ওরা বিজ্ঞানীর স্ত্রী মনে করেছে এবং খুশি হয়ে তাকে তাদের প্রয়োজনের বড় অস্ত্র হিসেবে সাথে করে নিয়ে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
বেদনার সাথে সাথে বিস্ময় নামল জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন দু’জনের চোখে-মুখেই। দ্রুত কথা বলে উঠল জেনারেল মোস্তফা কামাল। বলল, ‘বুঝেছি, স্ত্রী মনে করে নিয়ে গেছে। কারণ, বিজ্ঞানী কথা না বললে, কথা মত কাজ না করলে স্ত্রীকে লাঞ্জিত করে, তার উপর নির্যাতন চালিয়ে বিজ্ঞানীকে ওদের কথা মতো চলতে বাধ্য করবে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় মি. খালেদ খাকান।’
‘অবশ্যই উদ্বেগের খবর জনাব! কিন্তু এর মধ্যেও আনন্দের বিষয় হলো, মহিলাটি আমাদের বিজ্ঞানীর স্ত্রী নন।’
‘খবরটা আনন্দের কেন? স্ত্রী না হলেও মেয়েটিকে লাঞ্জিত করতে পারে, সে নির্যাতিতা হতে পারে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘আনন্দের এই কারণে যে, বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি মেয়েটি তার স্ত্রী নয় বলার পর মেয়েটিকে গিনিপিগ বানাতে পারবে না। অন্যদিকে বিজ্ঞানীকে তাদের ইচ্ছামত কাজ করাতে ও কথা বলাতে বাড়তি কোন সুযোগ তারা পাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন দু’জনের মুখেই কিছু উজ্জ্বলতা ফিরে এল। বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল, ‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। এখন চলুন, ঘটনার সব জায়গা আপনিও একটু দেখুন। কোন দিক দিয়ে পালাল সেটা উদ্ধার হলে আমাদেরও সামনে এগোবার একটা পথ হয়।’
‘চলুন দেখি’ বলে উঠে আহমদ মুসা পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনকে জিজ্ঞেস করল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কি যোগাযোগ হয়েছে, আটকে রাখা ছাত্র প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মুক্ত হয়েছে, তদন্তে ওরা আমাদের কিছু সাহায্য করতে পারে?’
‘পুলিশ ছাত্র প্রতিনিধিদলকে সিজলি পাহাড় এলাকা থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করেছে। ওরা এখন হাসপাতালে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। তারাও তদন্ত শুরু করেছে। সব রকম সহযোগিতা তারা আমাদের করবে।’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
আহমদ মুসা একবার জেফি জিনার কথা বলতে চাইল যে, সে মূল্যবান সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা বলল না, চেপে গেল। কারণ আহমদ মুসা ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছে। বাইদিবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে জেফি জিনা নামে কোন শিক্ষিকা বা গবেষক আছেন কিনা জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু এ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ নেই বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে জানান। বিষয়টা আহমদ মুসার কাছে কিছুটা জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাথে তিনি পরিচিত হলেন কি করে? আর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি কেউ না হলে তিনি ছাত্রদের সাথে চায়ের দাওয়াত পেলেন কি করে? সুতরাং বিষয়টার কূল কিনারা করতে না পেরে আহমদ মুসা জেফি জিনা সম্পর্কে পুলিশ প্রধানকে কিছু বলল না। শুধু বলল, ‘মি. নাজিম এরকেন ছাত্র প্রতিনিধি দলের ছদ্মবেশে শত্রুদের যারা বিজ্ঞানীর বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেছিল, তাদের মধ্যে সাইন্স এন্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও ছিল।’
উজ্জ্বল হয়ে উঠল পুলিশ প্রধানের চোখ দু’টি। বলল, ‘স্যার, এটা তো অতি মূল্যবান ও সুনির্দিষ্ট ইনফরমেশন। তার নামটা জানা যাবে স্যার?’
‘এখনও জানা যায়নি। আমি চেষ্টা করব জানার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার পুলিশ বাহিনী, আপনার গোয়েন্দা বিভাগ নেই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় তথ্য আপনার কাছেই আসছে। আমরা কৃতজ্ঞ।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘একটা প্রবাদ আছে, ঝড়ে বক পড়ে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে। ব্যাপারটা এই রকমই। অকল্পনীয় সব সোর্স থেকে তথ্য আসে। এটা মনে করি আল্লাহর খাস সাহায্য। আমার কোন কেরামতি নেই।’
হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছিল আহমদ মুসা।
আগে আগে হাঁটছিল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
চলছিল উপর তলায় উঠার সিঁড়ির দিকে।
আহমদ মুসা দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘নিহত সব লাশ এক তলায়।’ তাহলে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্যে নিচে ড্রইংরুমে নেমেছিলেন নিশ্চয়! সুতরাং সবাই নিচে ছিলেন। সব ঘটনা এক তলায় ঘটেছে, উপর তলায় নয়। তারা পালিয়েছে হয় একতলা হয়ে না হয় আন্ডার গ্রাউন্ড কোন পথ দিয়ে। সুতরাং নিচের তলা ও আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরটাই শুধু দেখতে চাই।’
একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘চলুন, পেছনের দরজা পর্যন্ত যাওয়া যাক।’
চলল সবাই। এবার আহমদ মুসা সকলের আগে।
ওপরে ওঠার সিঁড়ির ডান পাশ ঘেঁষে একটা করিডোর সামনে চলে গেছে। এ করিডোরটাই কয়েকটা বাঁক নেবার পর পেছনের দরজায় গিয়ে ঠেকেছে।
হাঁটছে আহমদ মুসা।
তার দৃষ্টি দু’পাশের দেয়াল ও মাটির দিকে। তার বিশ্বাস এ পক্ষের ৭ জন লোক নিহত। এরা একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল, সুতরাং প্রস্তুত ও পরিকল্পিত অবস্থায় আক্রমণের সুযোগ তারা পেয়েছে। কিন্তু তাই বলে ওপক্ষ আহত-নিহত হওয়ার কোন ব্যাপার ঘটবেই না, এটা স্বাভাবিক নয়। আর যেহেতু দু’জনকে বন্দী করে তাড়াহুড়ো করে পালাতে হয়েছে, তাই তারা কিছু চিহ্ন রেখে যাবেই। তার মধ্যে রক্তের দাগ একটি।
কিন্তু আহমদ মুসা পেছনের দরজা পর্যন্ত হেঁটেও কোন চিহ্ন বা অস্বাভাবিক কিছু পেল না। দরজা খুলে বাগানটাও দেখল। কিছুই পেল না।
ফিরে এল আবার সিঁড়ির গোড়ায়।
সিঁড়ির বাম পাশ ঘেঁষে আর একটা করিডোর সামনে চলে গেছে। এ করিডোরের ডান পাশ দিয়ে বরাবর একটা দেয়াল। আর বাম পাশ দিয়ে যে দেয়াল তার মাঝ বরাবর বড় একটা দরজা।
ঐ দরজার দিকে ইংগিত করে জেনারেল মোস্তফা কামাল বলল, ‘ওটাই আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামার দরজা মি. খালেদ খাকান।’
করিডোরের মেঝে ও দু’ধারের দেয়ালও পাথরের। বর্গাকৃতি পাথরের জোড়াগুলোও ধবধবে সাদা।
করিডোর ও দুই দেয়ালের উপর সূঁচ খোঁজার মত তীক্ষ দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে চলছে আহমদ মুসা। দরজা পর্যন্ত যেতে বার দুয়েক দাঁড়াল।
দরজার সামনে এসে আবার দাঁড়াল আহমদ মুসা।
দরজা কালো রং করা ষ্টিলের স্লাইডিং ডোর। ডিজিটাল, ম্যানুয়াল দু’ভাবেই খোলা যায়। তবে ম্যানুয়াল সিষ্টেম অফ করে ডিজিটাল সিষ্টেম চালু করতে হয়। আবার ডিজিটাল সিষ্টেম অফ করে ম্যানুয়াল সিষ্টেম চালু করা যায়।
পুলিশ প্রধান এগিয়ে এসে দরজাটা খুলে দিল। সরে গেল ষ্টিলের স্লাইডিং ডোরটা দেয়ালের ভেতরে।
দরজার পরেই সিঁড়ির কাছে বড় একটা ষ্ট্যান্ডিং। ষ্ট্যান্ডিং-এর ডান ও বাম পাশ দিয়ে দু’পাশের দেয়াল ঘেঁষে দু’টি প্রশস্ত সিঁড়ি দু’দিকে নেমে গেছে।
ষ্ট্যান্ডিং-এর সামনেটা রেলিং ঘেরা। রেলিং ষ্ট্যান্ডিং-এর সামনেটা ঘুরে এসে দু’পাশে সিঁড়ির সাইড রেলিং হয়ে নিচের ফ্লোর পর্যন্ত নেমে গেছে। সিঁড়ি ও রেলিং দু’টোই ব্ল্যাক ষ্টিলের।
আহমদ মুসারা ষ্ট্যান্ডিং-এ এসে দাঁড়াল।
নীচে বড় একটা হলঘর।
সিঁড়ি বরাবর অংশটুকু ছাড়া গোটা হলঘর লাল কার্পেটে ঢাকা। চারদিক ঘিরে সোফার সারি। মাঝখানটা ফাঁকা।
গোটা হলঘরটা উজ্জ্বল আলোয় প্লাবিত। ষ্ট্যান্ডিং এর উপরে দেয়ালে দু’পাশে দু’টি লাইট। সে আলোতে কালো সিঁড়িতে সাদা প্রতিফলনের সৃষ্টি করেছে।
আহমদ মুসা সিঁড়ি দু’টোকে একবার তীক্ষ দৃষ্টিতে দেখল। ডানদিকে সিঁড়ির দ্বিতীয় ষ্টেপের রেলিং সংলগ্ন একটা জায়গায় একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘আসুন, আমরা ডান পাশের এ সিঁড়ি দিয়ে নামি।’
সবাই নেমে এল নিচে।
সিঁড়ি থেকে নেমে হলঘরে ঢোকার মত প্রশস্ত একটা জায়গা দু’প্রান্তে বাদ রেখে সোফা সাজানো। সিঁড়ি প্রান্তের সোফার সারিটা সিঁড়ি যতটা প্রশস্ত তার চেয়ে কিছু বেশি জায়গা রেখে সাজানো হয়েছে।
‘শত্রুরা বিজ্ঞানীকে কিডন্যাপ করে আন্ডার গ্রাউন্ড এই ঘরে নেমে এসেছিল। নিশ্চয়ই এই ঘর বা এই আন্ডার ফ্লোরের কোন স্থান দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ আছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল জেনারেল মোস্তফার দিকে। বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা ও জেনারেল তাহির তারিককে এই বাড়ির ইন্টারনাল, এক্সটারনাল ডিজাইন, লে-আউট, নকশা যোগাড় করতে বলেছিলাম। সেটা পেলে সহজেই বের হতো সিঁড়ি পথটা কোথায়।’
‘জেনারেল তাহির আমাকে বলেছিলেন, সেসব যোগাড় হয়েছে। আমার অফিসে এই বাড়ি সংক্রান্ত ফাইলে সব আছে। বলব কি সে ফাইল আনতে?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘ঠিক আছে। আমরা আর একটু দেখি। না হলে ফাইলের সাহায্য নেয়া যাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘মি. খালেদ খাকান, আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন কিডন্যাপটা এই আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এসে তারপর হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘কিডন্যাপারদের এক বা একাধিক লোক আহত হয়েছে। কিডন্যাপ করে পালাবার সময় পথে আহতদের থেকে রক্তের ফোটা পড়েছে। কেউ যাতে তাদের অনুসরণ করার সুযোগ না পায়, এজন্যে তারা রক্তের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। এর পরও করিডোরে দুই জায়গায় এবং সিঁড়িতে এক জায়গায় সামান্য পরিমাণে হলেও শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ আমি দেখেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এবার নিয়ে তিনবার এ পথে এলাম, আমার কিন্তু তা চোখে পড়েনি। ধন্যবাদ আপনার চোখের দৃষ্টিকে।’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
‘চোখের খুব বেশি কৃতিত্ব নেই। আমি আগেই ধরে নিয়েছিলাম এ পক্ষের ৭ জনকে হত্যা করতে ওদের কাউকে না কাউকে নিশ্চয় অন্তত আহত হতেই হবে। আহতদের নিয়ে তাড়াহুড়ো করে পালাবার সময় পথে তাদের পালানোর চিহ্ন হিসেবে রক্তের দাগ ফেলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এই ক্লুটা খোঁজার চেষ্টার ফলেই তা পেয়ে গেছি।’
‘ধন্যবাদ খালেদ খাকান। আপনি ঠিক চিন্তা করেছেন। দুর্ঘটনার সাইক্লোনের মধ্যেও আপনার মাথা ঠান্ডা থাকে। আপনি একটা দৃষ্টান্ত।’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আহমদ মুসার নজর তখন সিঁড়ির গোড়ার দিকে। জেনারেল মোস্তফার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘জেনারেল দেখুন দু’পাশের সিঁড়ির লেভেল থেকে সোফায় সারির দূরত্ব একটু বেশি মনে হচ্ছে না?’
‘হ্যাঁ, এতটা দূরত্ব না রাখলেও হতো। সিঁড়ি থেকে নেমে হলরুমে প্রবেশের জন্যে যথেষ্ট জায়গা রাখার পরও এতটা জায়গা শূন্য রেখে দেয়া ‘অডলুকিং’ মনে হচ্ছে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘অডলুকিং লাগছে আরও এই কারণে যে এই ফাঁকা জায়গা কার্পেটে ঢেকে না দেয়ার মধ্যে কোন যুক্তি নেই। ঘরের সৌন্দর্য নষ্ট করে এটা কেন করা হয়েছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।’ পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন বলল।
‘এই সৌন্দর্যহানির কারণ আছে। আমার সন্দেহ সত্য হলে আন্ডার গ্রাউন্ড স্পেসটা এখানেই আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
চমকে উঠল জেনারেল মোস্তফা, পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনসহ উপস্থিত পুলিশ অফিসাররাও। চোখ বড় বড় করে জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন এক সাথেই দু’জনে বলে উঠল, ‘এখানে সুড়ঙ্গ রয়েছে?’
‘হ্যাঁ, এখানেই রয়েছে এবং আমরা এই যে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, আমি মনে করছি এখানেই রয়েছে সুড়ঙ্গের মুখ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মি. খালেদ খাকান আপনি – ভবিষ্যত বক্তার মত কথা বলছেন। এখানে সুড়ঙ্গের মুখ আছে, কোনো চিহ্ন দেখে নিশ্চয় এ কথা বলছেন, সেটা কি?’
‘আমি নিশ্চিত নই, তবে বিভিন্ন অসঙ্গতি, অস্বাভাবিকতা ও নানা কার্যকরণ থেকে এ ধারণা করছি। আপনারা দেখুন ওপাশের সিঁড়ির গোড়ায় শেষ পিলার একটাই, কিন্তু এ পাশের প্রান্তে জোড়া পিলার। মূল পিলারের সাথে আরেকটা পিলার। দ্বিতীয় পিলারটার মাথা হাতল আকারের এবং সাইড রেলিং-এর টপ বরাবর আসা ষ্টিল বার থেকে বিচ্ছিন্ন। দ্বিতীয় পিলারটার গোড়া দেখুন গাড়ির গিয়ারের মত রাবারের কভার। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠে যে এর একটা ফাংশন আছে। কি সেই ফাংশন? এ প্রশ্নের উত্তরেই আমার সিদ্ধান্ত, গোপন সুড়ঙ্গের মুখ এখানেই।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা দুই ধাপ এগিয়ে গিয়ে শেষ দ্বিতীয় পিলারের শীর্ষ হাতল দু’হাতে ধরে জোরের সংগে নিচের দিকে টানল।
সংগে সংগে সিঁড়ির গোড়া থেকে পাশের মেঝের সোফার সারির পাশ ঘেঁষে একটা আয়তাকার অংশ সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল আলোকজ্জল একটা সিঁড়ি মুখ।
‘ও গড! আলহামদুলিল্লাহ।’ জেনারেল মোস্তফা কামাল ও নাজিম এরকেন এক সাথেই বলে উঠল।
‘আসুন, নামি।’
বলে সুড়ঙ্গের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল আহমদ মুসা।
‘গ্যাস মাস্ক তো লাগবে না আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘না মি. জেনারেল। আমার মনে হয় সুড়ঙ্গ স্বল্প দীর্ঘই হবে এবং সুড়ঙ্গে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘চলুন মি. খালেদ খাকান।’
বলে তাকাল জেনারেল মোস্তফা পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের দিকে।
পুলিশ প্রধান তার পাশেই দাঁড়ানো সিজলি এলাকার পুলিশ কমিশনারকে তাদের সাথে যেতে বলল। আর সবাইকে সব ফরমালিটি শেষ করে লাশগুলো নিয়ে যেতে বলল। আর কয়েকজন পুলিশকে থাকতে হবে এই বাড়ির পাহারায় এ নির্দেশও দিল।
পুলিশ কমিশনার পাশের পুলিশ অফিসারদের সব নির্দেশ দিয়ে সুড়ঙ্গে নামার জন্যে সবার সাথে পা বাড়াল।
সিঁড়ি দিয়ে প্রায় পনের ফিট নামার পর একটা প্রশস্ত ল্যান্ডিং পাওয়া গেল যেখানে চার পাঁচ জন লোক এক সাথে দাঁড়ানো যায়। এখান থেকে সুড়ঙ্গের শুরু। সিঁড়িটা অন্ধকার। ল্যান্ডিং দেয়ালে রয়েছে একটা সুইচ বোর্ড। তাতে চারটি সুইচ। প্রথম সুইচের নিচে দু’টি এ্যারো চিহ্ন মুখোমুখি আর দ্বিতীয় সুইচের নিচে দু’টি এ্যারো চিহ্ন বিপরীতমুখী। তৃতীয় সুইচের নিচে একটা মশালের ছবি আর চতুর্থ সুইচের নিচে আঁকা একটা ছোট্ট হাতপাখা। জেনারেল মোস্তফারাও দেখছিল সুইচ বোর্ড।
জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘এ্যারো চিহ্নিত সুইচ দু’টি সুড়ঙ্গের সিঁড়ির মূখ বন্ধ করা ও খোলার জন্য, মশাল চিহ্নিত সুইচটা চেপে সুড়ঙ্গে আলো জ্বালাতে হবে, আর বাতাসের জন্যে চাপতে হবে পাখার সুইচ।’
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘সুইচ চাপুন জনাব।’
জেনারেল মোস্তফা একে একে তিনটি সুইচই চাপল। কিন্তু সিঁড়ির মুখ যেমন বন্ধ হলো না, তেমনি সুড়ঙ্গে আলো জ্বললো না, বাতাসও এল না।
জেনারেল মোস্তফা কামাল তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘সুইচগুলো ওয়ার্ক করছে না মি. খালেদ খাকান।’
‘সুইচগুলোর মধ্যে নির্মাতারা একটা ধাঁধাঁ তৈরি করে রেখেছে জেনারেল মোস্তফা। এবার আপনি বিপরীত এ্যারো চিহ্নিত সুইচ টিপুন এবং মশাল ও পাখা চিহ্নিত সুইচ এক সাথে চাপুন এবং মশাল ও পাখার সুইচ আগে চাপতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
তাই করল জেনারেল মোস্তফা।
এবার সুড়ঙ্গে আলো জ্বললো, বাতাস এল এবং সিঁড়ি মুখ বন্ধ হয়ে গেল।
বিস্মিত জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনি এই ধাঁধাঁটি কি করে ধরলেন?’
‘সুইচ বোর্ডটার সবটা বিষয় আপনি ভালোভাবে দেখে বুঝার চেষ্টা করলে আপনিও ধরতে পারতেন। দেখুন, এ্যারো আঁকা সুইচ দু’টোর উপরে দু’টো সুইচের স্থান কভার করে লম্বা দু’টো এ্যারো আঁকা। বোর্ডের মত একই কালারের হওয়ার কারণে এ তীর দু’টো খুব তাড়াতাড়ি চোখে পড়ছে না। এর অর্থ, এই তীর দু’টির একটির শুরু প্রথম সুইচ থেকে, কিন্তু মাথাটা দ্বিতীয় সুইচে, আর দ্বিতীয় তীরটির শুরু দ্বিতীয় সুইচ থেকে, মাথাটা প্রথম সুইচে। এর অর্থ হলো, প্রথম সুইচটির কাজ পাওয়া যাবে দ্বিতীয় সুইচ থেকে। মশাল ও পাখা আঁকা সুইচের মাথার উপরে দেখুন বোর্ডের মত একই কালারে দু’টি সমান্তরাল সরল রেখা সুইচ দু’টোকে যুক্ত করেছে। এটার ইংগিত হলো, এ সুইচ দু’টির ফাংশন এক সাথে, সুতরাং এদের অফ, অন একই সময়ে করতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মশাল ও পাখার সুইচ দু’টি কেন আগে চাপতে হবে, সে কথা কিন্তু বলেননি।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘মশাল ও পাখার সুইচ আগে অন না করে সিঁড়ি বন্ধের সুইচ অফ করলে সিঁড়ি মুখের দরজা বন্ধ হতো না। নির্মাতারা এটাই চেয়েছেন। কারণ সিঁড়ি মুখের দরজা আগে বন্ধ হলে সিঁড়ি মুখ থেকে আসা আলো-বাতাস বন্ধ হয়ে যেত। তাতে সুড়ঙ্গ অন্ধকারে ডুবে যেত, বাতাসও বন্ধ হতো। এই সংকট যাতে না হয়, এ জন্যে মশাল ও পাখার সুইচ দু’টি আগে অন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা কামাল একদিকে কথা শুনছিল, অন্যদিকে তার চোখ দু’টি আঠার মত লেগেছিল সুইচ বোর্ডের উপর। আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই জেনারেল মোস্তফা বলে উঠল, ‘পেয়েছি মি. খালেদ খাকান, আগে-পরের ক্লুটা পেয়ে গেছি। এই দেখুন, মশাল ও পাখার দুই সুইচের পাশেই বোর্ডের কালো অংশে ‘২’ লেখা ও এ্যারো চিহ্নিত দুই সুইচের পাশে একইভাবে ‘১’ লেখা।
‘ধন্যবাদ জেনারেল মোস্তফা। এবার আসুন, আমরা সামনে অগ্রসর হই।’
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করল।
সবাই হাঁটতে শুরু করল আহমদ মুসার পেছনে পেছনে।
হাঁটা শুরু করে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনি গোয়েন্দা ট্রেনিং-এর অদ্বিতীয় এক শিক্ষক হতে পারেন।’
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার কথার দিকে কান না দিয়ে বলল, ‘জেনারেল, ওদের পালানোর পথ তো পেয়ে গেলাম, ওদের ধরার পথ এখন আমাদের দরকার। আইআরটি কিংবা বিজ্ঞানী কারও কোন ক্ষতি হতে দিতে আমরা পারি না। এজন্যে ওদের কোন সময় দেয়া যাবে না।’
‘ঠিক মি. খালেদ খাকান। ওরা সময় পেয়ে আমাদের দারুণ ক্ষতি হবে। কিন্তু সামনে আমি অন্ধকার দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ না কেউ এই গ্যাং মানে ‘থ্রি জিরো’র সাথে জড়িত। আমি মনে করি এদের খুঁজে বের করাকে আমাদের প্রথম গুরুত্ব দিতে হবে। সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘এ পর্যন্ত আমি যা জানতে পেরেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছেলে তাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে পালানোর সময়ও ছেলেটি তাদের সাথে ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটা তো স্পেসেফিক ইনফরমেশন। তাকে লোকেট করতে পারলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘তবে তার নামটা আমি এখনও জানতে পারিনি। চেষ্টা করছি।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলতে বলতে হাঁটছে তারা।
একশ’ গজও তখন পার হয়নি তারা। সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে গেল, তারা একটা সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ এসে হাজির হলো।
আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আমার অনুমান ভুল না হলে আমরা বাড়ির উত্তর প্রান্তের সীমানা দেয়ালের কাছে এসে গেছি। এ দেয়ালের বাইরে রয়েছে ওয়াটার সাপ্লাই প্ল্যান্ট, তার সাথে বেশ ফাঁকা জায়গাও রয়েছে।’
‘তার মানে ওরা এখানে পালাবার জন্যে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করেছিল। চলুন উপরে ওঠা যাক।’
‘সিঁড়ির গোড়ায় ল্যান্ডিং এর দেয়ালে আগের মত সুইচ বোর্ড এবং সুইচ বোর্ডের চারটি সুইচ পাওয়া গেল। এখানেও ধাঁধাঁ সেই একই রকমের।
আহমদ মুসারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
সিঁড়ি মুখ যেখানে শেষ হয়েছে, সেটা ভাঙা, পরিত্যক্ত সামগ্রী ফেলার একটা ঘর। সুড়ঙ্গ মুখ জুড়ে রয়েছে এই ঘরটির মেঝেরই একাংশ।
আর ঘরটির উত্তর দেয়ালটাই আসলে সীমান্ত দেয়াল।
আহমদ মুসা ঘরে উঠে চারদিকে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলতেই দেখতে পেল, ঘরের উত্তর দিকের অর্থাৎ সীমান্ত দেয়ালের গায়ে দেয়াল রংয়ের একটা ষ্টিলের দরজা। এখানেও দেখল দরজার গায়ে দু’টি দেয়াল রংয়ের বোতাম। দুই বোতামের নিচে আঁকা এ্যারো চিহ্নের সেই ধাঁধাঁ।
আহমদ মুসারা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে গাড়ির চাকার দাগও তাদের খুব সহজেই চোখে পড়ল।
‘আমাদের দুর্ভাগ্য, কিডন্যাপারদের এই সাফল্যের কারণ তাদের সফল পরিকল্পনা। তারা বাড়ির নকশা হাত করতে সফল হয়েছে। জেনারেল মোস্তফা, আপনারা দেখুন বাড়ির নকশা কারা বের করল, কিভাবে বের করল।’
‘অবশ্যই দেখছি। কিন্তু বলুন আমরা এগোবো কোন পথে? তাড়াতাড়ি কিছু করতে না পারলে ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। তুরষ্কও বেকায়দায় পড়েছে ওআইসি’র অন্যান্য সদস্যের কাছে।
গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। বলল, ‘এই বিপর্যয়ের ভার আমার উপরই বর্তায় বেশি।’
‘না মি. খালেদ খাকান। আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। আপনি যদি বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে এখানে আনার ব্যবস্থা না করতেন, বাড়িতেই যদি তাঁকে রাখা হতো, তাহলে তার স্ত্রী ও বাচ্চারাও আজ তার সাথে বন্দী হতো। সেটা হতো অত্যন্ত ভয়াবহ। তাতে বিজ্ঞানী তাদের সব কথা মানতে বাধ্য হয়ে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হতে পারতেন। সবকিছু আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেত। বিজ্ঞানী কিডন্যাপ হলেও এই মহাদুর্যোগ থেকে আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে তখন গভীর চিন্তার ছাপ। যেন কোন গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা থামলেও আহমদ মুসা কোন কথা বলেনি।
জেনারেল মোস্তফাই আবার কথা বলল, ‘কি ভাবছেন মি. খালেদ খাকান?’
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে মুখ তুলে জেনারেল মোস্তফার দিকে তাকাল। বলল, ‘আমাকে এখুনি যেতে হবে। চলুন ফিরে যাই, গাড়ি তো ওখানে।’
‘চলুন। কিন্তু আপনি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কি ভাবছেন, আমাদের আপনার কিছু বলার আছে কিনা? সময় নষ্ট করা যাবে না কিছুতেই।’
সীমানা ওয়ালের দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে সবাই হাঁটা শুরু করেছে গাড়ির কাছে আসতে।
হাঁটতে হাঁটতে বলল আহমদ মুসা, ‘জেনারেল মোস্তফা, জনাব নাজিম এরকেন, আপনারা একটু চেষ্টা করুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জ্ঞান ফিরে এলে তাদের কাছ থেকে জানুন কিডন্যাপকারীদের কাউকে তারা চেনে কিনা। নিশ্চয় তাদের সাথেরই কেউ কিডন্যাপারদের একজন বা কিডন্যাপারদের লোক। বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করলে কোন ক্লু পাওয়া যাবেই। বাড়ির নকশা কারা পূর্ত দফতর থেকে যোগাড় করেছে, তাদের চিহ্নিত করতে পারলেও কিডন্যাপারদের কাছে পৌছা সম্ভব হবে। তাদের গাড়ি দু’টির ষ্টিয়ারিং হুইলে দু’জন ড্রাইভারের ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া যাবে, তাও সাহায্যে আসতে পারে। আর আমিও একটা ক্লু সামনে রেখে বেরুচ্ছি। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কিছুই করতে পারবো না।’
‘নিশ্চয় আল্লাহ সাহায্য করবেন। আমরা ভয়ংকর এক বিপদের মধ্যে আছি। আল্লাহ আমাদের একমাত্র ভরসা।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘অবশ্যই।’ বলল আহমদ মুসা।
তারা পৌছে গেছে গাড়ির সামনে।
আহমদ মুসা এগোল গাড়ির দিকে।
জেনারেল মোস্তফা ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘আপনি হেলিকপ্টারে যেতে পারেন মি. খালেদ খাকান।’
‘দরকার নেই জেনারেল। আমার নামে বরাদ্দ হেলিকপ্টার তো অফিসে আছে। দরকার হলে নিয়ে নেব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পায়ের তলায় মাটি দরকার।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেনও হেসে ফেলেছে। জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘দুঃখের মধ্যেও আপনি হাসতে পারেন, হাসাতেও পারেন মি. খালেদ খাকান। আমরা এখন হেলিকপ্টারে উঠব বটে, কিন্তু আমাদের পায়ের তলাতেও মাটি দরকার।’
‘পায়ের তলায় মাটি না থাকলে হেলিকপ্টার আকাশে উড়বে কি করে! হেলিকপ্টার আকাশে উড়ার জন্যে যেমন মাটি দরকার, তেমনি ল্যান্ড করার জন্যেও মাটি প্রয়োজন।’ হেসেই বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন।’
‘ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো।
‘ওয়া আলাইকুম সালাম।’ বলল জেনারেল মোস্তফা। সেও ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।
৫
ষ্টার্টারের চাবিতে হাত দিয়েছে আহমদ মুসা। চাবিটা ঘুরাবার আগেই বেজে উঠল আহমদ মুসার মোবাইল।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকাল। দেখল জোসেফাইনের নাম্বার। মনে হঠাৎ যেন আনন্দের বন্যা নামল আহমদ মুসার। তার সমগ্র অন্তর যেন জোসেফাইনের টেলিফোনেরই অপেক্ষা করছিল।
টেলিফোনটা মুখের কাছে নিয়ে সালাম দিয়েই বলল, ‘জোসেফাইন, তোমার টেলিফোন সাংঘাতিকভাবে আশা করছিলাম। ধন্যবাদ তোমাকে টেলিফোনের জন্যে।’
‘যার বেশি দরকার সেই কিন্তু টেলিফোন করে, তুমি কিন্তু টেলিফোন করনি।’
‘এই মুহূর্তে তোমার টেলিফোন যে আমি সাংঘাতিকভাবে আশা করছিলাম, সেটা বুঝলাম তোমার টেলিফোন পাওয়ার পর।’
‘এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বল?’ হাসতে হাসতে বলল জোসেফাইন।
‘তোমাকে বিশ্বাস করতে বলব কি, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। অবচেতন মনের চাওয়া চেতন মন সব সময় জানতে পারে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘রাখ দর্শনের কথা, বল তুমি কি বলবে, না ওটাও অবচেতন মনে আছে।’ বলল জোসেফাইন।
‘জোসেফাইন, তোমার বান্ধবী ঠিকই সন্দেহ করেছিল, খবর ঠিক দিয়েছিল। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে রক্ষা করতে পারিনি। যথাসময়ে আমরা পৌছতে পারিনি, বিজ্ঞানীকে ওরা কিডন্যাপ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ইন্নালিল্লাহ! ভয়ানক দুঃসংবাদ। তুমি এখন কোথায়?’ বলল জোসেফাইন।
‘বিজ্ঞানীর বাড়ির সামনে গাড়িতে উঠে বসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তুমি কোথাও যাচ্ছ? তোমার সাথে কথা বলে ঠিক এটাই ভেবেছি। তোমার জন্যে আমার কাছেও জরুরি তথ্য আছে। কয়েক মিনিট আগে জেফি জিনা আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। বিজ্ঞানী কিডন্যাপ হওয়ার বিষয় সেও নিশ্চয় জেনেছেন।’
‘ধন্যবাদ জোসেফাইন। ওঁকেই আমার এখন খুব বেশি দরকার। বলতো কি ইনফরমেশন দিয়েছেন। নিশ্চয় আগের মতই জরুরি কিছু হবে।’
‘একটা ঠিকানা দিয়েছেন এবং বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা প্রতিনিধিদল তাদের রিসার্চ ফোরামের পক্ষ থেকে তার সাথে দেখা করে ড. আন্দালুসির সাথে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে অনুরোধ করেছিল। সে সময় ছাত্রদের একজন জেমস জোসেফ তাকে ষ্টুডেন্ট রিসার্চ ফোরামের একটা ফোল্ডার দিয়েছিল। ফোল্ডারে রিসার্চ ফোরামের কাগজ-পত্রের মধ্যে একটা চিরকুট ছিল। তাতে জনৈক ডিওয়াই লিখেছিল, জেমস জোসেফ, তুমি প্রতিনিধি দলে অবশ্যই থাকবে। যে কোন মূল্যে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতেই হবে। আর নতুন ঠিকানা ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাস সড়কের ৯৯ নম্বর বাড়িটা ভালো করে দেখে আসবে। ঠিকানাটা তোমার চিনে নেয়ার দরকার হবে। এই চিরকুটটা সে সময় গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, এখন এটা তোমার কাছে অমূল্য হতে পারে, জেফি জিনা বলেছেন।’
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেই সাথে তার মনে দারুণ এক বিস্ময়ও। কে এই জেফি জিনা? ছাত্র প্রতিনিধি দল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার জন্যে তারা জেফি জিনার কাছে কেন গিয়েছিল? আর বিজ্ঞানী ড. আন্দালূসিই বা কোন কারণে জেফি জিনাকে দাওয়াত করেছিল ছাত্রদের সাথে? তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন গুণী অধ্যাপক হলে একটা অর্থ পাওয়া যেত। কিন্তু ঐখানে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কোন অধ্যাপক নেই। তাহলে কে তিনি?
ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল আহমদ মুসা। জোসেফাইনের কথা শেষ হলেও উত্তরে আহমদ মুসা কিছু বলেনি।
জোসেফাইন আবার কথা বলে উঠল, ‘কি ভাবছ? কি হলো তোমার? কথা বলছ না যে?’
‘হ্যাঁ, জোসেফাইন তোমার বান্ধবী যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেটা সত্যিই অমূল্য। যে ছেলেটা জেফি জিনাকে ফোল্ডারটা দিয়েছিল, তারই নাম জেমস জোসেফ এবং অনুমান সত্য হলে বিজ্ঞানীর বাড়িতে হামলাকারী গ্রুপের সাথে তিনি তাকে দেখেছিলেন। সুতরাং এই ঠিকানা বিজ্ঞানীর উদ্ধার অভিযানের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমি ভাবছিল জোসেফাইন, তোমার এই বান্ধবীটি কে? ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির অত্যন্ত পরিচিত কেউ অথবা প্রভাবশালী ও গুণী একজন অধ্যাপক হবেন। কিন্তু জেফি জিনা নামে কোন অধ্যাপক ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তাহলে জেফি জিনা নামটা কি নকল? আমরা কিছু বুঝতে পারছি না জোসেফাইন।’
থামল আহমদ মুসা।
‘আমার কাছে তার নাম বদলাবার দরকার কি? নামটা নকল বলে আমার মনে হচ্ছে না। কিন্তু তোমার কথা ঠিক যে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় কেউ না হলে এসব ঘটনার সাথে তাকে জড়িত দেখা যাচ্ছে কেন?’ বলল জোসেফাইন।
‘কিন্তু ঐ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ নেই, এটাও তো সত্য! আমার আরেকটা বিষয় বিস্ময়কর বলে মনে হচ্ছে, বিজ্ঞানীর বাড়িতে হামলা হচ্ছে, এই খবরটা তিনি পুলিশকে না দিয়ে তোমাকে দিলেন কেন! আবার এখন এই যে, গুরুত্বপূর্ণ চিঠি ও ঠিকানার খবর কেন তোমাকে দিলেন! পুলিশকে সরাসরি দিতে পারতেন। কিন্তু ভায়া-মিডিয়া দেয়ার মত সময় খরচ অযথা করলেন কেন? সত্যি আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি সব বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কি কিছু মনে করবেন উনি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি জিজ্ঞেস করব?’ জোসেফাইন বলল।
‘যেমন তিনি এখন কোথায়? তার সাথে আমি কথা বলতে পারি কিনা? তাঁর আরও সহযোগিতা আমাদের দরকার। তিনি যদি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকেন, তাহলে আমি তো কাছেই আছি। আমি গিয়েও তার সাথে দেখা করতে পারি। ইত্যাদি বিষয় তাঁর কাছে তুলতে পার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু এসব প্রশ্ন করে, এসব বিষয় তুলে তার নাম ও পেশার পরিচয় পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’ বলল জোসেফাইন।
‘একবার তার ঠিকানা জানলে তার সব পরিচয়ই আমরা বের করতে পারব। তার নাম, পেশা নিয়ে আজ এ সময় হঠাৎ প্রশ্ন তুলতে গেলে আমরা তাকে সন্দেহ করছি ভাবতে পারেন।’
‘ঠিক বলেছ জোসেফাইন। কোনোভাবে তাঁকে হিট করা ঠিক হবে না। শুরু থেকেই তিনি আমাদের যে সহযোগিতা দিয়ে আসছেন, তা অমূল্য। হতে পারে আমাদের সন্দেহ ঠিক নয়। নাম হয়তো তার ঠিক আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হয়েও তার অবস্থান এমন গুরুত্বপূর্ণ যে সব জায়গায় তিনি আছেন। অথবা তিনি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ হতে পারেন। ঠিক আছে, আসলে যা আমরা চাই, সে তথ্য তিনি তো দিয়েছেনই। আবার টেলিফোন করলে বাই দি বাই কিছু আলোচনা করতে পার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে, যতটা পারি করব। তোমার এখন কি প্রোগ্রাম?’ বলল জোসেফাইন।
‘তোমার বান্ধবী জেফি জিনা যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেটাই এখন আমাদের টার্গেট। সে বিষয়টা জেনারেল মোস্তফাদের সাথে আলোচনা করছি।’
‘ঠিক আছে, সময় আর নষ্ট করব না। আমি রাখছি। ফি আমানিল্লাহ। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুম সালাম।’
মোবাইল পকেটে রেখে তাকাল আহমদ মুসা বাইরের গাড়ি ও হেলিকপ্টারের দিকে। দেখল বাড়ির সামনে জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ মুসা বুঝল, আমি কেন দেরি করছি, কেন আমি দাঁড়িয়ে আছি, এ নিয়ে তাদের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে বলেই তারা এদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সংগে সংগে জেনারেল মোস্তফা কামাল ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনও ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসার কাছাকাছি এসেই জেনারেল মোস্তফা জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার মি. খালেদ খাকান। নতুন কোন খবর অথবা কিছু ঘটেছে?’
জেনারেল মোস্তফারা আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ‘ফাতিহ সুলতান মোহাম্মাদ বাইপাস রোডের ৯৯ নম্বর বাড়িটার চারদিকে সাদা পোশাকের পুলিশ দিয়ে পাহারা বসাতে হবে এখনই। লক্ষ্য রাখতে হবে ঐ বাড়ির অথবা সেখানকার অন্য কেউ যাতে সন্দেহ না করে যে, চারদিক থেকে বাড়িটার উপর চোখ রাখা হচ্ছে। দ্বিতীয় কথা হলো, বাড়িটাতে কেউ যাক ক্ষতি নেই, কিন্তু বাড়ি থেকে কেউ বেরুলে সবার অলক্ষ্যে তাকে আটকাতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেনের চোখে বিস্ময় এবং অনেক প্রশ্ন। কিন্তু আহমদ মুসা কাউকে কোন প্রশ্ন না করতে দিয়ে পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনকে বলল, ‘মি. এরকেন, এখনি আপনার পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে দিন।’
‘ঠিক আছে স্যার। আমি নির্দেশ দিচ্ছি।’ বলে মোবাইল তুলে নিল হাতে। একটু সময় নিয়ে বিষদ নির্দেশ দিল।
কথা শেষ করে মোবাইল অফ করে দিয়ে নাজিম এরকেন আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কিন্তু কাকে রক্ষার জন্যে কিংবা কাকে ধরার জন্যে আমরা বাড়িটার উপর চোখ রাখব স্যার?’
‘সন্দেহ করা হচ্ছে, কিডন্যাপাররা বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে নিয়ে ঐ বাড়িতে উঠেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় ও আনন্দে পাল্টে গেল জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেনের চেহারা। মুহূর্ত কয়েক যেন তারা কথা বলতে পারল না।
প্রথম মুখ খুলল জেনারেল মোস্তফা। বলল সে, ‘মি. খালেদ খাকান, আপনার কথা আমার কাছে মহাআনন্দের আর স্বপ্নের মত লাগছে। আপনি ঠিক বলছেন তো! সত্যিই আপনি এত তাড়াতাড়ি এতদূর পর্যন্ত এগোতে পেরেছেন?’
‘আমার স্ত্রী টেলিফোন করেছিলেন। আমাদের অত্যন্ত সচেতন একজন শুভাকাংক্ষী এই তথ্য আমাদের দিয়েছেন। তাঁর দেয়া তথ্য আগেও সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমরা কোন প্রশ্ন তুলছি না মি. খালেদ খাকান। আমাদের বিস্ময় লাগছে, সোনার হরিণটা এত তাড়াতাড়ি হাতের মুঠোয় আসবে। এখন বলুন, আপনার পরিকল্পনা কি?’
‘এখন সেখানে রওয়ানা হতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরাও! যদি আপনি ঠিক মনে করেন।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘এ অভিযান তো আপনাদের। আমি সহযোগিতা করছি মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই বলল, ‘এ অভিযানটা আমাদের হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা বিপদ বুঝলে বিজ্ঞানীকে হত্যাও করতে পারে। আমাদের এ ধরনের অবস্থার শিকার হওয়া চলবে না।’
‘ঠিক মি. খালেদ খাকান! প্ল্যানটা কি হবে একটু ভাবা প্রয়োজন।’ পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন বলল।
‘বলুন, কি করা যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলল পুলিশ প্রধানই আবার। বলল, ‘দিনের বেলায় বাড়িটা গোপনে ঘিরেই রাখতে হবে, যেভাবে আপনি বলেছেন। গভীর রাতে গোপনে বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে, যাতে ওদের এড়ানো এবং বিজ্ঞানীকে নিরাপদে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা যায়।’
‘রাতে হলেও প্রথমে দল বেঁধে বা একাধিক লোক বাড়িতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। বাড়িতে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা নিশ্চয় তারা রেখেছে। ওরা টের পেয়ে গেলে দু’টি ঘটনা ঘটবে। এক. বিজ্ঞানীর জীবনের তারা ক্ষতি করবে অথবা দুই. বিজ্ঞানীকে নিয়ে পালিয়ে যাবার সুযোগ তারা নেবে। এ বাড়িতেও সুড়ঙ্গ পথের ব্যবস্থা নেই তা বলা যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক মি. খালেদ খাকান! এ ধরনের কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না। আপনার পরামর্শ কি? আমরা তাহলে কিভাবে এগোবো?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
আহমদ মুসা ভাবছিল। বলল, ‘চলুন ওখানে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। তবে আমি মনে করছি, দিনে কিংবা রাতে, যখনই সম্ভব হয় আমি গোপনে বাড়িটাতে প্রথম প্রবেশ করব। আমি মোবাইলে মিসকল দেব, তখন অবস্থা বুঝে আপনারা প্রবেশ করবেন।’
‘কিন্তু মি. খালেদ খাকান, ওরা খুব বিপজ্জনক লোক। ওরা কত লোক ভেতরে আছে, তাও জানা নেই। আপনি যদি বিপদে পড়েন?’ বলল জেনারেল মোস্তফা কামাল।
‘নিরাপদে বাড়িটিতে প্রবেশ করে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে নিরাপদ করা এখনকার জন্যে সবচেয়ে বড় কাজ এবং এটা আমাদের করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই মি. খালেদ খাকান। ঠিক আছে, আমরা যাত্রা করতে পারি।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘আমার মনে হয়, আমরা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে যাচ্ছি। সাদা পোশাকে আরও কিছু পুলিশ। তারাও এক গাড়িতে দু’জনের বেশি যাবে না। বাড়িটার উত্তর পাশেই একটা হোটেল আছে। আর বাড়ির পেছনে, মানে পশ্চিম দিকে একটা বড় মসিজদ রয়েছে। আর দক্ষিণ পাশে একটা কম্যুনিটি হাসপাতাল। আমাদের লোকরা রাস্তার পাশে অবস্থান নেয়া ছাড়াও এই তিনটি স্থানকে কেন্দ্র করা হোক। আমরাও সেখানে অবস্থান নিতে পারি।
‘আশ্রয়ের একটা জায়গা থাকা দরকার। সেই হিসেবেও কেন্দ্রগুলো ঠিকই হয়েছে। কিন্তু আপনার লোকদের বলে দিন যেন সব রাস্তার উপর নিচ্ছিদ্র অবরোধ থাকে। আর কেউ যেন পালাতে না পারে।’ কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, ‘আসুন, আমরা যাত্রা করি।’
বলে সালাম দিয়ে আহমদ মুসা গাড়ির দিকে এগোলো।
‘ঠিক আছে মি. খালেদ খাকান, আমি বিষয়টা আবার আমাদের লোকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।’ নাজিম এরকেন বলল।
জেনারেল মোস্তফা কামাল সালাম নিয়ে ‘গুডলাক মি. খালেদ খাকান’ বলে তার গাড়ির দিকে এগোলো।
এগোলো পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনও।
‘না, থামবেন না ড. আন্দালুসি। আরও একটু বিস্তারিত বলুন, সোর্ড নামে যে অস্ত্র তৈরি করেছেন, সেটা কিভাবে ফাংশন করে?’
কথাগুলো বলছিল ডেভিড ইয়াহুদ।
সে একটা চেয়ারে বসে। তার পাশের চেয়ারেই বসেছিল আইজ্যাক বেগিন।
তাদের সামনে আরেকটা কাঠের চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছেন বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। ড. আন্দালুসির পাশেই আরেকটা কাঠের চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় আছে বিজ্ঞানীর সাথে ধরে আনা মহিলা গোয়েন্দা অফিসার।
আর তাদের সকলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ ছয়জন ষ্টেনগানধারী অস্ত্র বাগিয়ে এ্যাটেনশন অবস্থায়।
ঘরটা আন্ডার গ্রাউন্ড একটা কক্ষ। বেশ বড়।
এটা ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ রোডের ৯৯নং বাড়িটির একটা কক্ষ।
বাড়িটা চারদিক থেকে প্রাচীর ঘেরা।
প্রাচীর ঘেরা জায়গার মাঝখানে বাড়িটা।
বাড়ির সম্মুখ ভাগের প্রাচীর রাস্তা থেকে কয়েক গজ ভেতরে। রাস্তা থেকে প্রাচীর গেট পর্যন্ত রাস্তা পাথর বিছানো। গেটে গ্রীলের দরজা। গেট থেকে একটা পাথর বিছানো পথ গাড়ি বারান্দায় গেছে। গাড়ি বারান্দা থেকে তিন ধাপের একটা সিঁড়ি পেরোলে বারান্দা। বারান্দায় সোজা এগোলেই বাড়িতে প্রবেশের মূল দরজা। ভেতরে প্রবেশ করলেই বিশাল একটা লাউঞ্জ। লাউঞ্জের চারদিকে বিভিন্ন করিডোর। লাউঞ্জের ডান দিকের দু’প্রান্ত দিয়ে দুটি সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সিঁড়িগুলো দেয়ালের সাথে যুক্ত হয়ে উপরে উঠে গেছে। ওপাশের সিঁড়ির গোড়ার পাশে দেয়ালে রয়েছে একটা দরজা। দরজা থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে।
আন্ডার গ্রাউন্ডে অনেকগুলো কক্ষ।
কক্ষগুলো ষ্টোর এবং শেল্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যবাহী সাম্রাজ্যের কেন্দ্র হিসেবে তুরষ্ক সব যুদ্ধ অথবা যুদ্ধ-ঝুঁকির মধ্যে ছিল। একমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া ঠান্ডাযুদ্ধ পর্যন্ত সকল যুদ্ধের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ এক পক্ষ ছিল তুরষ্ক। এজন্যে তুরষ্কে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের বাড়িতে আন্ডার গ্রাউন্ড শেল্টার রয়েছে।
আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরটির একটা বড় ও বিশেষ কক্ষে ড. আন্দালুসিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ডেভিড ইয়াহুদের প্রশ্নের জবাবে ড. আন্দালুসি বলল, ‘আমি বলেছি, ‘সোর্ড’ কোন অস্ত্র নয়, এটা আত্মরক্ষার একটা মেকানিজম। এটা কারো বিরুদ্ধে নয়, অন্যের হিংসার হাত থেকে নিজেকে রক্ষার একটা মাধ্যম মাত্র।’
‘তবু এটা অস্ত্র। অস্ত্রকে যা ব্যর্থ, নিষ্ক্রিয় করে, কিংবা ধ্বংস করে, সেটা অস্ত্রের চেয়েও বড় অস্ত্র। ‘সোর্ড’ এ ধরনেরই একটা ভয়াবহ অস্ত্র। যাই হোক, বলুন কিভাবে এটা ফাংশন করে? এর বেসিক কনসেপ্ট কি?’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘নিয়ন্ত্রিত আলোক কণার একটা দেয়াল উড়ন্ত ও অগ্রসরমান যে কোন কিছুর গতিরোধ করে এবং একে পৃথিবীর আবহাওয়ার বাইরে নিয়ে ধ্বংস করে। এটাই এর কনসেপ্ট যে, ইন্টিগ্রেটেড আলোক কণার শক্তিকৃত চৌম্বকত্ব ও সর্বভেদী ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে উড়ন্ত অগ্রসরমান সকল মেটালিক, নন-মেটালিক বস্তুকে আকাশেই অবরুদ্ধ এবং তার বিলয় ঘটাতে পারে।’ বলল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি।
‘তার মানে আকাশপথের আক্রমণকারী সব অস্ত্রকেই সোর্ড ধ্বংস করতে পারবে। এর অর্থ সোর্ড মানব কল্যাণের বড় অস্ত্র। তাই নয় কি?’ ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘অবশ্যই। আমি তো বলেছি এটা আক্রমণ করার কোন অস্ত্র নয়, আত্মরক্ষার মাধ্যম।’ বলল ড. আন্দালুসি।
‘তাহলে বলুন, কল্যাণের মাধ্যম যে জিনিসটা, তার উপর সকলের অধিকার আছে কিনা?’ ড. ডেভিড বলল।
ড. আন্দালুসি তাকাল পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। তার দু’চোখে অন্ধকার। সে পরিষ্কার বুঝতে পারল, ডেভিড ইয়াহুদের কথা কোন দিকে যাচ্ছে।
ভাবতে গিয়ে ডেভিড ইয়াহুদের কথার জবাব দিতে পারল না ড. আন্দালুসি।
ডেভিড ইয়াহুদই কথা বলে উঠল আবার। বলল, ‘মঙ্গলজনক আবিষ্কার কারও একার নয়। সকলেরই অধিকার আছে তা থেকে উপকার নেয়ার। সুতরাং ড. আন্দালুসি, ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা আমরা চাই।’
বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং মুখের ভাব শক্ত হয়ে উঠেছে। বলল, ‘আমাকে কি এজন্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে?’
‘ধন্যবাদ ড. আন্দালুসি, আমাদের মনের কথা আপনিই বলে দিয়েছেন। হ্যাঁ, ড. আন্দালুসি, আপনার ঐ মহামঙ্গলের আবিষ্কারের প্রতিই আমাদের লোভ। ফর্মূলা আদায়ের জন্যেই আমরা আপনাকে তুলে নিয়ে এসেছি।’
‘বৃথাই কষ্ট করেছেন। এই ফর্মূলা আপনারা কেন, দুনিয়ার অন্য আর কাউকেই দেয়া হবে না।’ বলল ড. আন্দালুসি। শক্ত কণ্ঠ তার।
‘সাধারণভাবে সকলের জন্যে কল্যাণকর কোন কিছু যদি কেউ কুক্ষিগত করে রাখতে চায়, সেটা অন্যায়। আমরা এ অন্যায় বরদাশত করব না। আমরা কল্যাণের মহৎ লক্ষ্যেই তা ছিনিয়ে নেব। এজন্যেই আপনাকে এখানে আনা হয়েছে।’
হাসল বিজ্ঞানী আন্দালুসি। বলল, ‘আপনারা কল্যাণের লক্ষ্যে নয়, মানুষের অকল্যাণের লক্ষ্যেই এই আবিষ্কারকে হাত করতে চান। আমরা এটা হতে দেব না।’
‘দেবেন আপনারা, তা জানি বলেই তো আমরা সোর্ড-এর পিতাকে নিয়ে এসেছি। দেবেন না কেন? কল্যাণের আবিষ্কার, যেমন ধরুন কোন ওষুধ, গোটা মানব জাতির সম্পদ। এ ধরনের কল্যাণের আবিষ্কার ‘সোর্ড’ কুক্ষিগত করে রাখা দুরভিসন্ধিমূলক।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ কঠোর কণ্ঠে।
‘উল্টো কথা বলছেন। ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা আপনাদের হাত করতে চাওয়াই দুরভিসন্ধিমূলক। একটা জঘন্য উদ্দেশ্য নিয়েই আপনারা ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলাকে হাত করতে চাচ্ছেন।’
আইজ্যাক বেগিন এতক্ষণ কথা বলেনি। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। বাজের মত হিংস্র শিকারীর দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে ড. আন্দালুসির দিকে। বলল, ‘দুরভিসন্ধিটা কি ড. আন্দালুসি?’
‘সোর্ড-এর যে ফর্মূলা, তা দিয়ে শুধু সোর্ডের মত আত্মরক্ষার অস্ত্র নয়, আক্রমণের অস্ত্রও তৈরি হতে পারে। এই আক্রমণাত্মক অস্ত্র হবে আত্মরক্ষার অস্ত্র ‘সোর্ড’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত ও ভয়াবহ। সমন্বিত ও শক্তিকৃত ফোটনের স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বউৎক্ষিপ্ত ফোটন-এ্যারো পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকে যে কোন স্থানের বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র মাইলো এবং অস্ত্র গুদাম নিজেই খুঁজে নিয়ে চোখের পলকে সেগুলোকে নিস্ক্রিয় ও নিরস্থিত করে দিতে পারে। আপনাদের দুরভিসন্ধি হলো সোর্ডের ফর্মূলা হাত করে এই অস্ত্র তৈরি করে গোটা পৃথিবী দখল করে নেয়া।’
আইজ্যাক বেগিন এবং ডেভিড ইয়াহুদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যেন আকাশের চাঁদ তারা হাতে পেয়ে গেছে।
তারা এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে, তৎক্ষণাত কোন কথা তারা বলতে পারেনি।
নিরবতা ভেঙে প্রথম কথা বলল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘ধন্যবাদ ডক্টর, আমরা যা জেনেছি, আপনি তা নিশ্চিত করলেন। এখন আসুন, আমরা একটা ডিল করি। আমরা সোর্ডের ফর্মূলা চাই, বিনিময়ে যা চাইবেন দিতে রাজি আছি। টাকার যে অংক বলবেন, সেই অংকই আমরা দেব। বলুন ডক্টর।’
হাসল ডক্টর আন্দালুসি। বলল, ‘আমি একজন বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী নই। তাছাড়া আমার গবেষণা মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বত হিমালয়। ঐ হিমালয় পরিমাণ অর্থ দিলেও আমি মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করব না, ফর্মূলাটি আমরা দেব না।’
গম্ভীর হয়ে উঠল আইজ্যাক বেগিন ও ডেভিড ইয়াহুদের মুখ। তাদের চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠেছে। দু’জন দু’জনের দিকে একবার তাকাল। তারপর আইজ্যাক বেগিন চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ড. আন্দালুসির দিকে। মুহূর্তের জন্যে একবার চোখ বুজল। তারপর চোখ খুলে বলল, ‘ডক্টর, নিশ্চয় এটা আপনার শেষ কথা নয়। শেষ কথার আগে আরও অনেক কিছুই বাকি আছে। হ্যাঁ বলুন ডক্টর, আমাদের কথায় রাজি হয়ে যান, রাজি না হয়ে আপনার অন্য কোন উপায়ও নেই।’
‘না, আমার শেষ কথাই বলে দিয়েছি।’ বলল ডক্টর আন্দালুসি।
চোখ দু’টি জ্বলে উঠল আইজ্যাক বেগিনের। তাকাল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘আপনার মিশন শুরু করুন মি. ডেভিড। নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।’
ডেভিড ইয়াহুদ তাকাল ড. আন্দালুসির দিকে। কাঠের চেয়ারটিতে হাত, পাসহ গোটা দেহ শক্ত করে বাঁধা ড. আন্দালুসির। একমাত্র মাথা ছাড়া দেহের কোন অংশ একটু নড়াবার উপায় নেই। চেয়ারের তলা থেকে একটা বৈদ্যুতিক তার বেরিয়ে কার্পেটের তলায় ঢুকে গেছে।
পাশের চেয়ারে ড. আন্দালুসির সাথে কিডন্যাপ করে আনা মহিলা গোয়েন্দা অফিসার সাইমি ইসমাইলকে চেয়ারের সাথে একইভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার চেয়ারের তলা থেকেও একটা বৈদ্যুতিক তার কার্পেটের তলায় ঢুকে গেছে।
ডেভিড ইয়াহুদ চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকাল সাইমি ইসমাইলের দিকে। বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার স্বামীকে বুঝান। এটা তার গবেষণাগার কিংবা ড্রইংরুম নয়। এখানে ওঁকে সংবর্ধনা দেবার জন্যে আনা হয়নি। আনা হয়েছে ফর্মূলা আদায়ের জন্যে! এ লক্ষে যা করা দরকার আমরা তাই করব। আপনি তাঁকে বুঝান।’
গোয়েন্দা অফিসার সাইমি ইসমাইলের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। বলল, ‘আপনাদের ভুল হচ্ছে। আমরা স্বামী-স্ত্রী নই, আমি তাঁর একজন কর্মচারী, সিকিউরিটির দিকটা আমি দেখি।’
‘আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আমাদের বোকা সাজাতে চাইছেন। বিজ্ঞানীর সাথে তাঁর স্ত্রীকে ধরে এনেছি, সেটা বুঝেই পরিচয় গোপন করতে চাইছেন। মিথ্যা কথা বলে লাভ হবে না।’
বলেই ডেভিড ইয়াহুদ চেয়ারের একটা হুক থেকে রিমোটটা টেনে নিয়ে বলল, ‘ড. আন্দালুসি, কেউ কথা না শুনলে তাকে কথা শোনাবার ফর্মূলা আমাদের আছে। সে রকম একটা ফর্মূলাই আমরা এখন প্রয়োগ করছি। রেডি স্যার।’
ডেভিড ইয়াহুদের তর্জনি রিমোর্ট কন্ট্রোলের একটা লাল বোতামে চেপে বসল।
সংগে সংগে ঝাঁকি দিয়ে উঠল ড. আন্দালুসির দেহ। অসহনীয় যন্ত্রণাকাতর একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল ডক্টর আন্দালুসির কণ্ঠ থেকে। ড. আন্দালুসির হাত, পা যেন সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করছিল। শক্ত করে বাঁধা সিল্কের কর্ড দেহে কামড়ে বসেছিল। সেই কামড়ে পাতলা চামড়ার ওপরের অংশ কেটে দু’ভাগ হয়ে গেল। দু’হাত ও দু’পায়ের বাঁধনের স্থান থেকে ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এল। তার দু’চোখ বিস্ফোরিত হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো। যতক্ষণ ডেভিড ইয়াহুদের তর্জনি লাল বোতাম চেপেছিল, ততক্ষণ ড. আন্দালুসির আর্ত চিৎকার থামেনি।
বোতাম থেকে তর্জনি উঠল।
চিৎকার ধীরে ধীরে থেমে গেল।
তার মাথাটা চেয়ারের আশ্রয়ে ঢলে পড়ল। চোখ দু’টি তার বুজে গেছে।
আইজ্যাক বেগিন ও ডেভিড ইয়াহুদের মুখে প্রশান্তি। সাইমি ইসমাইলের চোখে মুখে আতংক। সে ভাবছে, ফর্মূলা না পেলে তারা বিজ্ঞানীকে মেরে ফেলতে পারে। অন্যদিকে ‘সোর্ড’-এর ফর্মূলা সম্পর্কে সে যা জেনেছে, তাতে এই ফর্মূলা কিছুতেই এদের হাতে দেবেন না বিজ্ঞানী। তাহলে? প্রশ্নের উত্তর ভাবতে গিয়ে কেঁপে উঠল সাইমি ইসমাইল।
‘ড. আন্দালুসি কথা বলুন। কি ভাবছেন আমাদের প্রস্তাব সম্পর্কে।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
ড. আন্দালুসি স্থির, নিরব। কথা বলল না, চোখও খুলল না।
আইজ্যাক বেগিনের চোখে আবার আগুন দেখা গেল। তাকাল সে ডেভিড ইয়াহুদের দিকে।
ড. ইয়াহুদের হাতের রিমোর্ট কনট্রোল আবার নড়ে উঠল। তার তর্জনি আবার সক্রিয় হলো। চেপে বসল সেই লাল বোতামে।
শক্ত বাঁধনের মধ্যেও বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির দেহ লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করল। আর মুখ থেকে বেরিয়ে এল বুক ফাটা চিৎকার।
হাত পায়ের বাঁধন থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। যন্ত্রণার অসহনীয় তীব্রতায় বড় হয়ে বের হয়ে আসা চোখ দু’টি তার যেন ফেটে যাচ্ছে।
সুইচ থেকে ডেভিড ইয়াহুদ তার তর্জনি না তোলা পর্যন্ত ড. আন্দালুসির বুকফাটা চিৎকার থামল না।
পাশের চেয়ারে বাধা সাইমি ইসমাইল চিৎকার করে উঠল, ‘আপনারা এটা কি করছেন! উনি একজন বিজ্ঞানী। দয়া করে এই অমানুষিক কাজ বন্ধ করুন।’
সুইচ থেকে তর্জনি উঠল ইয়াহুদের।
চিৎকার থামলো ডক্টর আন্দালুসির। তার মাথাটা নেতিয়ে পড়ল চেয়ারে। চোখ বুজে গেছে তার। চেয়ারের হাতলে বাধা দু’হাত তার কাঁপছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চেয়ারের হাতা দিয়ে।
‘ম্যাডাম, আমরা তো এই খারাপ পথে যেতে চাইনি। উনি বাধ্য করেছেন। আপনি তাকে বলুন, ফর্মূলা উনি আমাদের দিয়ে দিতে রাজি হোন।’ সাইমি ইসমাইলের দিকে চেয়ে বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
সাইমি ইসমাইল কিছু বলার আগেই ক্লান্ত, কাঁপা স্বরে ডক্টর আন্দালুসি বলল, ‘ম্যাডাম সাইমি ইসমাইল, আপনি ওদের বলে দিন, কোন নির্যাতন করেই তারা যা চায় তা পাবে না। আর আমাকে ওরা মেরে ফেলতে পারবে না। কারণ তাতে তাদের সোনার ডিম তারা চিরতরে হারাবে।’
হো হো করে হেসে উঠল আইজ্যাক বেগিন। বলল, ‘আপনি অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী। আমাদের উদ্দেশ্য ঠিক বুঝেছেন। কিন্তু এটা বুঝেননি যে, আমরা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি। যারা দৈনিক শত নির্যাতন হজম করতে পারে, তারা কিন্তু মানসিক চাপে মোমের মত গলে যায়।’
একটু থামল আইজ্যাক বেগিন।
পাশের টিপয়ের গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক পানি খেল। তারপর একটা হাসল। বলল, ‘ড. আন্দালুসি, আপনার উপর আঘাত আপনি সহ্য করেছেন, কিন্তু সাইমি ইসমাইলের উপর এ ধরনের আঘাত আপনি কতক্ষণ সহ্য করবেন? এখানেই শেষ নয়। অস্ত্র আমাদের আরও আছে। আপনার চোখের সামনে বিবস্ত্র সাইমি ইসমাইল মানুষ-হায়েনার দ্বারা লুণ্ঠিত হবে, তারপরও আপনি কতক্ষণ চুপ করে থাকবেন।’
কথা শেষ করে আইজ্যাক বেগিন তাকাল আবার ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘এবার সাইমিকে কিছুটা নাচান মি. ইয়াহুদ। তারও কিছু গান আমরা শুনি।’
চমকে উঠে চোখ খুলল বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ, যে উদ্বেগ তার চোখে-মুখে কঠিন নির্যাতনেও ফুটে উঠতে দেখা যায়নি। চেয়ারে এলিয়ে পড়া মাথা তুলে সে বলল, ‘সাইমি ইসমাইল আমার স্ত্রী নন। তিনি একজন নির্দোষ মহিলা। তাঁকে আপনারা ছেড়ে দিন। দাবি আপনাদের আমার কাছে। আমাকে নিয়ে আপনারা যা ইচ্ছা তাই করুন।’
আইজ্যাক বেগিনের আবার সেই অট্টহাসি। বলল, ‘আমরা ঠিক সিলেকশন করেছি। এ ওষুধেই কাজ দেবে। আগাও ডেভিড ইয়াহুদ।’
ডেভিড ইয়াহুদ রিমোর্টটা হাতে তুলে নিল আবার।
ঠিক এই সময় দরজায় নক হলো। দ্রুত নক হলো পরপর তিনবার। এর অর্থ কেউ জরুরি সাক্ষাৎ চায়।
আইজ্যাক বেগিন তাকাল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। ডেভিড ইয়াহুদ উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে ঘুর দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভেতরে এস।’
ভেতরে প্রবেশ করল জেমস জোসেফ। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
‘কি ব্যাপার জেমস, তোমাকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে! কোন খবর?’ জিজ্ঞাসা ডেভিড ইয়াহুদের।
‘স্যার, বাড়িটার চারদিকে নতুন কিছু লোকের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। আমাদের ইনফরমাররা বলছে, লোকগুলো সাদা পোশাকে পুলিশ হতে পারে।’
ডেভিড ইয়াহুদের চেহারায় কেউ যেন এক রাশ কালি ঢেলে দিল। বলল, ‘খবরটা কি ঠিক? এটা কি করে সম্ভব? বাড়িটাতো আমরা নিয়েছি মাত্র সাত দিন হলো। আমাদের লোকরাও জানে না। আমাদের লোকরা যারা আজ এখানে এসেছে, তারাও এই বাড়িটা প্রথম দেখল। কিভাবে এটা বাইরের কেউ জানতে পারে? লোকজন যে পুলিশের তা কি করে জানা গেল?’
আমাদের লোকরা তাদের সাথে মেলা-মেশার ফলে তাদের কথাবার্তা শুনে এবং বাড়িটার উপর চোখ রাখা দেখে তাদের সন্দেহ হয়েছে। সবশেষ এইমাত্র খবর পেলাম ঐ লোকদের একজন মোবাইলে কাউকে বলছেন, একজন বিখ্যাত লোককে কিডন্যাপ করার ঘটনা ঘটেছে। উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের থাকতে হবে। এই কথার পর এখন আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।’ বলল জেমস জোসেফ।
উঠে দাঁড়াল আইজ্যাক বেগিনও।
সেও এসে দাঁড়াল ডেভিড ইয়াহুদের পাশে জেমস জোসেফের কাছে। তাদের সকলের মুখ পাণ্ডুর, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। বলল আইজ্যাক বেগিন, ‘ধন্যবাদ জেমস, খবরটা পেতে যে আরও দেরি হয়নি এজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওরা কমব্যাট ষ্টেজে এখনও আসেনি। নিশ্চয় ওরা কোন কিছুর অপেক্ষা করছে। এরই সুযোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।’
একটু থামল আইজ্যাক বেগিন।
চোখ তুলল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘মি. ডেভিড ইয়াহুদ, আন্ডার গ্রাউন্ড গ্যারেজে কয়টি গাড়ি আছে?’
‘দু’টি বুলেটপ্রুফ গাড়িসহ সাতটি গাড়ি আছে।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘লোকদের ডাক। এদের দু’জনকে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তোল। এ গাড়িতে আমি উঠব এবং জেমসসহ উঠবে আরও তিনজন। অন্য বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুমি উঠবে কয়জনকে নিয়ে বাকি ৫ টি গাড়িতে অবশিষ্ট জনশক্তি উঠবে। সাতটি গাড়ি দু’গ্রুপে ভাগ হবে। একটা গ্রুপ আপনার নেতৃত্বে যাবে দক্ষিণের পথ ধরে। আর অন্য গ্রুপ নিয়ে আমি যাব উত্তর দিকে। এতে ওরা বিভ্রান্তিতে পড়বে এবং ওদের জনশক্তি ভাগ হয়ে যাবে। এর জন্যে তাদের গাড়িও লাগবে। তাদের এই অপ্রস্তুতি হবে আমাদের জন্যে বড় সুযোগ।’
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডেভিড ইয়াহুদের। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. বেগিন। এ সময়ের জন্যে এর চেয়ে ভালো পরিকল্পনা আর হয় না। কিন্তু বেরুবার মুখেই যদি আমরা আক্রমণের মুখে পড়ি!’
‘সে ধরনের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেবার জন্যেই সাতটি গাড়ি এক সাথে বের হতে হবে। তাদের তাৎক্ষণিক ঐ আক্রমণ সাতটি গাড়িকে মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট হবে না। তারা বাড়তি প্রস্তুতি নেবার আগেই আমরা তাদের আওতার বাইরে চলে যাব।’ বলল আইজ্যাক বেগিন।
‘রাস্তার দু’ধারেও ওদের লোক মোতায়েন আছে বলে মনে করা হচ্ছে।’ জেমস জোসেফ বলল।
‘ওসব বাধা ধর্তব্য নয় জেমস। কোন গাড়ির দৃঢ় সংকল্প গতিকে আকস্মিক চেষ্টায় মোকাবিলা সহজ নয়। ও বিষয়ে চিন্তা করার কিছু নেই।’
কথা শেষ করেই তাকাল ডেভিড ইয়াহুদের দিকে। বলল, ‘আমি তৈরি হয়ে উপরে যাচ্ছি মি. ডেভিড ইয়াহুদ। এদের এখনি গাড়িতে নিন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সবগুলো গাড়ি এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, আমি এটাই চাই।’
বলেই আইজ্যাক বেগিন উপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে চলল। অন্যদিকে ডেভিড ইয়াহুদ রিমোর্ট কনট্রোলের ‘কল’ বোতামে চাপ দিয়ে রিমোর্ট কনট্রোলকে মুখের কাছে নিয়ে বলল, ‘সাতটি গাড়িই রেডি কর। তিন চার মিনিটের মধ্যেই আমরা বেরুবো। ইট ইজ অ্যান ইমারজেন্সি। ওভার।’
রিমোর্টটা মুখ থেকে সরিয়েই চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা স্টেনগানধারীদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমাদের দু’জন এস। এদের বাঁধন খুলে দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেল। মুখে ভালো করে টেপ পেস্ট করে দাও। তারপর নিয়ে চল গ্যারেজে। আর জেমস জোসেফ, ওদিকে দেখ গাড়ি ঠিক ঠাক রেডি হচ্ছে কিনা।’
ডেভিড ইয়াহুদের কথা শেষ হবার সংগে সংগে ‘ইয়েস স্যার’ বলে জেমস জোসেফ ছুটল গ্যারেজের দিকে।
দু’জন স্টেনগানধারী ড. আন্দালুসি ও সাইমি ইসমাইলের বাঁধন খোলা শুরু করেছে।
ডেভিড ইয়াহুদ পকেট থেকে তার মোবাইল তুলে নিল। তার তর্জনি অস্থির হলো মোবাইলের ‘কী’গুলোর উপর একটা কল করার জন্যে।
৬
গোল্ডেন হর্নের একদম পশ্চিম প্রান্ত এলাকার ফ্লাইওভার-৩ জংশন দিয়ে ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাস রোডে প্রবেশ করেছিল।
বাইপাস রোড ধরে তীরের গতিতে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ি।
ড্যাশ বোর্ডে রাখা মোবাইল বেজে উঠল আহমদ মুসার।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল কলটা জেনারেল মোস্তফার কাছ থেকে এসেছে। আহমদ মুসা দ্রুত মোবাইলটা কানের কাছে তুলে নিল। এ সময় জেনারেল মোস্তফার ফোন নিশ্চয় কোন ছোট কারণে নয়। তারাও এই বাইপাস রোডের বিপরীত রোড ধরে আসছে। জেনারেল মোস্তফার ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাস সড়কে প্রবেশ করেছে গোল্ডেন হর্ন এলাকার জংশন নং ৫ দিয়ে। তাদের গাড়ি ছুটে আসছে পশ্চিম দিকে। তাদের গাড়ি বাইপাস রোড ধরে ৯৯ নাম্বার বাড়ির দিকে আসছে। আসছে আহমদ মুসারাও।
মোবাইল তুলে নিয়ে সালাম দিতেই ওপ্রান্ত থেকে জেনারেল মোস্তফার দ্রুত কণ্ঠ শুনতে পেল আহমদ মুসা। বলল, ‘মি. খালেদ খাকান, এই মাত্র ৯৯ নাম্বার বাড়ির এলাকা থেকে আমাদের জানাল, বাড়িটা থেকে কয়েকটি গাড়ি বেরিয়ে এসেছে। তারা পালাচ্ছে।’ জেনারেল মোস্তফার উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত কণ্ঠ।
‘ওরা কোন দিকে পালাচ্ছে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘জানা যায়নি। ও কথা শেষ করতে পারেনি, তার আগেই সে গোলা-গুলীর মধ্যে পড়ে যায়। সম্ভবত তার মোবাইল পড়ে যায়, কিন্তু মোবাইল বন্ধ হয়নি। আমি তার মোবাইলেও কিছুক্ষণ গোলা-গুলীর শব্দ পেয়েছি।’
‘ওদের পালাবার সম্ভাব্য রুট কি হতে পারে জেনারেল?’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিরানব্বই নাম্বার বাড়ির সামনে একটা টার্ন নেবার পাস-পয়েন্ট আছে। সুতরাং বাইপাস রোডের পূর্ব- পশ্চিম যে কোন দিকে তারা যেতে পারে।’ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘ঠিক আছে, আমার মনে হয় মোতায়েনরত পুলিশ ওদের গাড়িগুলোর গতিরোধ করতে চেষ্টা করেছিল এবং পুলিশ পাল্টা আক্রমণের শিকার হয়। পুলিশের ক্ষতিও হয়েছে বলে মনে হয়। এই কারণেই ওদিক থেকে ইনফরমেশন আসা বন্ধ হয়েছে।’
আহমদ মুসা কথা বলছিল এবং ইস্তাম্বুলের সিটি ম্যাপের উপরও চোখ বুলাচ্ছিল। বাইপাস রোডের ৯৯ নাম্বার বাড়ির অবস্থানটা দেখে নিয়ে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, আমার মনে হয় যদি ওরা পূর্ব দিকে গিয়ে থাকে, তাহলে এখনি ওদের সাক্ষাত আপনারা পেয়ে যাবেন।’
‘ইউ আর রাইট খালেদ খাকান। আমি দেখতে পাচ্ছি ডানের ফেরার রাস্তা দিয়ে ৪টা গাড়ি জোটবদ্ধ হয়ে ছুটে আসছে। তাদের মধ্যে একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি। সামনেই ওদিকের রাস্তায় যাবার টার্ন-পয়েন্ট। আমরা ওদের গতিরোধ করব। ওকে খালেদ খাকান।’
জেনারেল মোস্তফার মোবাইল অফ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা মোবাইলটা ড্যাশ বোর্ডে রেখে দুরবিনটা তুলে নিয়ে সামনের রাস্তার উপর চোখ বুলান। আহমদ মুসার এখান থেকে ৯৯ নাম্বার বাড়িটা জেনারেল মোস্তফাদের অবস্থানের তুলনায় দ্বিগুণ দূরে। আর বাইপাসের এই দিকটা গোল্ডেন হর্নের এলাকা অতিক্রম করে শহরের পশ্চিম প্রান্তের পার্বত্য উপকণ্ঠ ঘুরে উত্তরের পার্বত্য ভূমির দিকে এগিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল না পলাতকরা অপেক্ষাকৃত এই নিরাপদ রুট বাদ দিয়ে পূর্ব দিকে জংশন ৫-এর দিকে গেল কেন! ওদিকটার তো দক্ষিণে গোল্ডেন হর্ন ও পূর্বে বসফরাস দ্বারা ক্লোজ হয়ে গেছে। ওরা এই সময়ে গোল্ডেন হর্ন কিংবা বসফরাসের ব্রীজে উঠার ঝুঁকি নেবে, এটায় সায় দিচ্ছে না তার মন কিছুতেই।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো ওরা ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় নেয়নি তো। পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্যে তারা দু’ভাগ হয়ে দু’রুটকেই ব্যবহার করতে পারে। এতে পুলিশের প্রতিরোধ শক্তি দু’ভাগ হয়ে যাবে এবং দু’ভাগের কোনভাগে বিজ্ঞানীরা আছেন, এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়বে পুলিশরা। আরেকটা কৌশলও তারা করতে পারে। সেটা হলো, দু’রুটে যাওয়া দু’ভাগের যেভাগে বিজ্ঞানীরা থাকবেন না, সেভাগে গাড়ির সংখ্যা বেশি রেখে নিরাপত্তার বেশি ব্যবস্থা করে পুলিশের দৃষ্টি সেদিকে বেশি আকৃষ্ট রেখে অন্য ভাগে বিজ্ঞানীদের নিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এটা ভাবতে গিয়ে জেনারেল মোস্তফাদের দিকে যাওয়া ৪টি গাড়ির জোটবদ্ধ যাত্রাকে কিছুটা প্রদর্শনী বলে মনে হলো আহমদ মুসার কাছে। আহমদ মুসার এই ভাবনা ঠিক হওয়ার অর্থ এই বাইপাসের পশ্চিমমুখী রুট ধরে ওদের কোন গাড়ি কি এগিয়ে আসছে!
এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। ডান পাশে ফেরার রোডটিতে যাওয়ার জন্য সামনে এসে পড়া পাস-পয়েন্টে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল।
রং সাইড দিয়েই মাঝারি গতিতে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার গাড়ি।
বাইপাস খুব ব্যস্ত নয়, কিন্তু গাড়ি চলাচল করছে খুব কমও নয়। এই গাড়ি চলাচলের মধ্যেই আহমদ মুসার গাড়ি ঠিক রাস্তার মাঝখান দিয়ে দ্বিধাহীন গতিতে এগিয়ে চলছে। সামনে থেকে আসা গাড়িগুলোই বরং আহমদ মুসার গাড়ির বেপরোয়া গতি দেখে তাদের গতি ঠিক করে নিচ্ছে।
এভাবে চলার তিরিশ সেকেন্ডও পার হয়নি। বাইপাস সড়কের ডানদিকের একটা সংযোগ রাস্তার থেকে একটা মোটর সাইকেল দ্রুত বেরিয়ে এল।
মোটর সাইকেলে একজন পুলিশ অফিসার। মাথায় হ্যাট, শোল্ডার ব্যান্ডে লাল রংয়ের ডবল ক্রিসেন্ট থেকে বুঝা যাচ্ছে ফাস্ট গ্রেডের একজন পুলিশ অফিসার সে।
পুলিশ অফিসারের মোটর সাইকেলটি বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ির রাস্তা ব্লক করে দাঁড়াল।
তার মোটর সাইকেলের সামনে পর্যন্ত গিয়ে হার্ড ব্রেক কষল আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার মোটর সাইকেল থেকে নেমে পড়েছে।
গাড়ি দাঁড় করিয়েই আহমদ মুসাও গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আহমদ মুসা ঝামেলায় পড়তে চায় না। আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলে ওদের সাথে দেখা হওয়ার খুব বেশি দেরি নেই।
গাড়ি থেকে দু’তিন ধাপ এগিয়ে পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি হলো।
আহমদ মুসা দেখল, পুলিশ অফিসারটি পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক তরুণী।
‘ম্যাডাম, আমি দুঃখিত। ইচ্ছা করেই এবং বাধ্য হয়েই আমাকে এই বেআইনি কাজটি করতে হয়েছে। আমার মনে হয় আমি বড় ধরনের একটা ঘটনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। আমি আপনার সহযোগিতা চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার মেয়েটি মাথা থেকে হ্যাট খুলল। বলল, ‘আপনি অনেকগুলো কথা বলেছেন, কিন্তু কোন কথাই আপনার আইন ভাঙার পক্ষে যুক্তি নয়। আপনি দয়া করে রাস্তায় ফিরে যান।’ পুলিশ অফিসার মেয়েটির কণ্ঠ শক্ত।
‘আপনি আইনের কথা বলেছেন ম্যাডাম, ধন্যবাদ! কিন্তু শুরুতেই ইচ্ছে করে এবং বাধ্য হয়েই আমাকে আইন ভাঙতে হয়েছে। এখনও আমি আপনার কথা মানতে পারবো না। অনেক ইমারজেন্সি আছে, যখন আইন ব্রেক করা অপরিহার্য হয়ে যায়।’ আহমদ মুসা বলল।
পুলিশ অফিসার মেয়েটি তীক্ষ্ণ, গভীর দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার মুখটি সহজ হয়ে উঠল। বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি, ‘আমি বুঝতে পারছি, আপনার সব কথাই সত্য, কিন্তু আইন ভাঙা কেন অপরিহার্য তা আমি বুঝিনি। প্রতিদিন রাস্তার মানুষ ও যাত্রীদের অনেকে হাজারো অপরিহার্য সিচুয়েশনে পড়ে, কিন্তু ট্রাফিক আইন ভাঙার অনুমতি কেউ পায় না।’
‘ঠিক বলেছেন ম্যাডাম, কিন্তু আমার বিষয়টা ন্যাশনাল ইমারজেন্সির সাথে জড়িত।’
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে পুলিশ অফিসার মেয়েটির সামনে তুলে ধরল।
কার্ডের দিকে তাকিয়েই পুলিশ অফিসার মেয়েটি চমকে উঠল। দেখল, তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল মোস্তফার দস্তখতসহ প্রধানমন্ত্রীর কাউন্টার সাইন করা স্পেশাল গ্রেডের সিকিউরিটি কার্ড। এই কার্ড যার হাতে থাকে সে যা প্রয়োজন তা করার স্বাধীনতা পায় এবং সব দায় থেকে মুক্ত থাকে।
কার্ডের উপর চোখ বুলিয়েই পুলিশ অফিসার মেয়েটি এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল আহমদ মুসাকে বলল, ‘স্যরি স্যার। আপনি এখন স্বাধীন।’
‘ধন্যবাদ ম্যাডাম। নরম মনের মেয়েরাও যে কত কঠোর হতে পারে নিছক আইন রক্ষায়, তার একটা দৃষ্টান্ত আজ দেখলাম।’
আহমদ মুসা কথাটা বলে মেয়েটির দিকে মুখ তুলতেই তার চোখ মেয়েটির পেছনে সামনের রাস্তার উপরে পড়ে গেল। দেখতে পেল, তিনটি গাড়ি একই সমান্তরালে এগিয়ে আসছে। মাঝের গাড়িটি যে বুলেটপ্রুফ তা দেখেই বুঝল আহমদ মুসা। সংগে সংগে মনে পড়ল, জেনারেল মোস্তফা যে চারটি গাড়ির কথা বললেন তারও একটি বুলেটপ্রুফ ছিল। এর অর্থ এরা নিশ্চিতই কিডন্যাপারদের একটা অংশ। হতে পারে এদের সাথেই আছেন বিজ্ঞানীরা।
ওরা এসে পড়েছে।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
আহমদ মুসা দ্রুত নিজের কোট খুলে পুলিশ অফিসার মেয়েটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি পুলিশের টুপিটা খুলে ফেলুন। ইউনিফরমের উপর কোটটা পরে নিন। প্লিজ কারণ জিজ্ঞেস করবেন না।’
বলেই আহমদ মুসা প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে মেশিন রিভলবারটার স্পর্শ একবার নিয়ে দ্রুত একটু সরে গেল সড়কের উত্তর পাশের দিকে।
আহমদ মুসার কার ও পুলিশ অফিসার মেয়েটির মোটর সাইকেল সড়কের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ঐ তিনটি গাড়িও পাশাপাশি সড়কের মাঝখান দিয়ে আসছিল। অনেকটা দূরে থাকতেই তারা এটা লক্ষ্য করেই সম্ভবত গাড়ি তিনটি সমান্তরালে সারিবদ্ধভাবেই মাঝপথ এড়িয়ে সড়কের ডানপাশে মানে উত্তর পাশের দিকে সরে গেছে।
আহমদ মুসা সড়কের উত্তর পাশের দিকে একটু সরে ছুটে আসা তিনটি গাড়ির বরাবর দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে গাড়ি তিনটি থামানোর চেষ্টা করতে লাগল। আহমদ মুসার ভাবখানা এই রকম যে, তার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, এজন্যে গাড়িগুলোর সে সাহায্য চাইছে। গাড়িগুলো সাধারণ হলে এই অবস্থায় তারা অবশ্যই দাঁড়াবে। আর যদি গাড়িগুলো ডেভিড ইয়াহুদের ‘থ্রি জিরো’র হয় এবং বিজ্ঞানীকে যদি সাথে নিয়ে থাকে, তাহলে আহমদ মুসাকে পিষে ফেলে হলেও তারা সামনে এগোবে।
গাড়িগুলো তীরবেগে ছুটে আসছে। হাত তোলার পর ওদের গাড়ির গতি আরও বেড়েছে বলে মনে হলো আহমদ মুসার কাছে।
তখন গাড়ি ৫০ গজ দূরেও নয়।
আহমদ মুসা ভাবল, বুলেটপ্রুফ গাড়িটাকে বড় কোন ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে তার গতি ব্লক করে বিজ্ঞানীকে অক্ষত উদ্ধার করতে হবে।
আহমদ মুসা ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে বিদ্যুৎ বেগে মেশিন রিভলবার বের করে আনল।
ট্রিগারে আঙুল চেপেই আহমদ মুসা রিভলবার বের করে এনেছিল। বের করেই ট্রিগার চেপে রিভলবার ঘুরিয়ে আনল ডান পাশের গাড়ির বাম চাকা এবং বাম পাশের গাড়ির ডান চাকার উপর।
গুলী করেই আহমদ মুসা নিজের দেহটাকে ছুঁড়ে দিয়ে দক্ষ এক্রব্যাটের মত নিজের দেহকে হাতের উপর কয়েকবার ঘুরিয়ে নিল। কয়েকগজ ডানে গিয়ে তার দেহ মাটির উপর পড়ে স্থির হলো।
আহমদ মুসার হাতে রিভলবার উঠতে দেখে তিন গাড়ি থেকেই তাকে উদ্দেশ্য করে গুলী করা হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষনে আহমদ মুসার দেহ তিন গাড়ির মধ্য অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল এবং দু’পাশের ব্রাশ ফায়ারের প্রবল শব্দে গতি পরিবর্তন করেছিল। তার ফলে তাদের গুলীও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়।
অন্যদিকে টায়ার বিস্ফোরণের পর দু’গাড়িই একটি বাম দিকে, অন্যটি ডান দিকে টার্ন নিয়ে একটা আরেকটার উপর আছড়ে পড়ে। মাঝের বুলেটপ্রুফ গাড়িও তাদের সাথে সামান্য ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। সম্ভবত ড্রাইভার পাশের দু’গাড়ির গতি দেখে শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষতে পেরেছিল।
আহমদ মুসার দেহ মাটিতে পড়বার সংগে সংগেই সে আবার উঠে দাঁড়াল। জাম্প করার সময় সে মেশিন রিভলবারটা ছুঁড়ে দিয়েছিল এদিকে। সেটাও পাশে পড়েছিল। উঠে দাঁড়াবার সময় রিভলবারটাও কুঁড়িয়ে নিয়েছে সে।
আহমদ মুসা পুলিশ অফিসার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি এই গাড়ির আরোহীদের একটু দেখুন, এরা যাতে আক্রমণে আসতে না পারে।’
বলেই আহমদ মুসা ছুটল বুলেটপ্রুফ গাড়িটার দিকে।
বুলেটপ্রুফ গাড়িটার ওপাশ দিয়ে দু’টি মাথা উপরে উঠতে দেখা গেল। কার মাথা স্পষ্ট হলো না আহমদ মুসার কাছে, কারণ ঐ গাড়িতে বিজ্ঞানী ডঃ আন্দালুসি এবং সাইমি ইসমাইলেরও থাকার কথা। সুতরাং রিভলবার তুলেও গুলী করতে পারলো না।
কিন্তু পরমুহূর্তেই গাড়ির উপর দিয়ে স্টেনগানের ব্যারেল দেখা গেল এবং সেই সাথে ছুটে এল গুলীবৃষ্টি।
আহমদ মুসা সংগে সংগেই বসে পড়েছিল মাটিতে এবং দু’হাঁটু বুকের সাথে গুটিয়ে নিয়ে দ্রুত ফুটবলের মত গড়িয়ে বুলেটপ্রুফ গাড়ির এপাশে চলে এল। যেহেতু ওরা গাড়ির ভিতর দিয়ে গুলী করছিল, তাই সবগুলো গুলী আহমদ মুসার মাথার অনেক উপর দিয়ে চলে যায়। আর ওরা মাথা লুকিয়ে গুলী শুরু করার কারণে আহমদ মুসার ফুটবলের মত গড়িয়ে আসাটা দেখতে পায়নি।
বুলেটপ্রুফ গাড়ির আড়াল থেকে গুলী শুরু হলে পুলিশ অফিসার মেয়েটি ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার গাড়ির আড়াল নিয়ে গুলী করা শুরু করেছে। এই গাড়িটাই ওদের গুলী বর্ষণের টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা বুলেটপ্রুফ গাড়ির এপাশে আশ্রয় নেয়ার পর ধীরে ধীরে এগিয়ে গাড়ির পেছন ঘুরে এসে গাড়ির ওপাশটাকে সামনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে এগোচ্ছিল।
আহমদ মুসা তখন গাড়ির পেছন দিকে টার্ন নিচ্ছিল। টার্ন নেবার সময় পেছন দিকে দৃষ্টি গিয়েছিল এমনিতেই। তাকিয়েই দেখতে পেল, দু’জন আহত লোক টায়ার ফেটে যাওয়ায় এক্সিডেন্টের মুখে পড়া এ পাশের গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। মাথা থেকে নেমে আসা রক্তে তাদের মুখ ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের হাতে রিভলবার। রিভলবার তুলছে তারা আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তার দেহটা গাড়ির পেছনে আড়াল করেই বাম হাতে মেশিন রিভলবার থেকে গুলীবৃষ্টি করল।
ওরাও গুলী করেছিল। কিন্তু আহমদ মুসার দেহ ততক্ষনে বুলেটপ্রুফ গাড়ির পেছনে আশ্রয় নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ওদের কাছে তখন আড়াল নেয়ার কিছু ছিল না। ফলে ওরা আহমদ মুসার গুলী বর্ষণের অসহায় শিকারে পরিণত হয়।
গুলী বন্ধ করেই আহমদ মুসা পেছন দিক একবার দেখে নিশ্চিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং বিড়ালের মত চলতে শুরু করল।
গাড়ির উপর দিয়ে এদের যে গুলীবর্ষণ চলছে, তাতে কিছু পরিবর্তন বুঝতে পারলো আহমদ মুসা। এখন দু’টি নয়, একটি স্টেনগান থেকে গুলী বর্ষণ চলছে। একজনের স্টেনগান থামল কেন?
সংগে সংগেই আহমদ মুসার মন বলে উঠল, আহমদ মুসার পাল্টা গুলী বর্ষণের শব্দ থেকে ওরা ধরে নিয়েছে বুলেটপ্রুফ গাড়ির এপাশে নিশ্চয় শত্রু এসে গেছে। তাই একজনকে গুলী বর্ষণে রেখে আরেকজন নিশ্চয় এদিকে আসছে।
আহমদ মুসা মেশিন রিভলবারটা ডান হাতে নিয়ে অদৃশ্য টার্গেটের দিকে স্থির করে বিড়ালের মত নিঃশব্দে দ্রুত গাড়ির পেছনটা ঘুরে গাড়ির ওপাশে টার্ন নেবার আগে গাড়ির কোণাটায় মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ট্রিগারের উপরে তর্জনীটাকে শক্ত করে এক ঝটকায় গাড়ির ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল।
ওপাশে ঘুরতেই চোখ পড়ল একজন শ্বেতাংগ চেহারার লোকের উপর। একেবারে মুখোমুখি তারা শ্বেতাংগ লোকটির হাতে উদ্ধত রিভলবার। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এরই সুযোগ গ্রহণ করল আহমদ মুসার রিভলবার। আহমদ মুসার তর্জনি ট্রিগারে চেপে বসেছে। এক পশলা গুলি গিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল শ্বেতাংগ লোকটির বুক।
গুলী করেই আহমদ মুসা তাক করল দ্বিতীয় লোকটিকে। সে গাড়ির উপর দিয়ে অদৃশ্য শত্রু লক্ষ্যে গুলী করছিল। এদিকে গুলীর শব্দ শুনে সে গুলী বন্ধ করে তার স্টেনগানটা মূহুর্তে ঘুরিযে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়েছিল। আহমদ মুসার রিভলবার তখন তার দিকে হাঁ করে আছে।
আহমদ মুসা দেখল, স্টেনগানধারী লোকটি একজন তরুন। আহমদ মুসার হঠাত মনে পড়ল, কিডন্যাপারদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রকে জেফি জিনা দেখেছিল এবং ডেলিগেটদের সাথে যে ছেলেটি জেফি জিনাকে একটি ফোল্ডার দিয়েছিল যার মধ্যে ৯৯নং বাসার ঠিকানা ছিল, এই কি সেই ছাত্র।
এই চিন্তা করেই আহমদ মুসা তরুণকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি শত্রুতামূলক আচরণ না করলে আমি তোমাকে গুলী করব না। তুমি তোমার স্টেনগান ফেলে দাও। আত্নসমর্পন না কররে তোমার বাঁচার কোন সম্ভাবনা …।‘
পুলিশ অফিসার মেয়েটি আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এদিক থেকে তার লক্ষ্যে গুলী বন্ধ হওয়ায় এবং এদিকে গুলীর শব্দ শুনেই সে ছুটে এসেছিল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই তরুণটির স্টেনগানের ব্যারেল বেপরোয়াভাবে উঠে এল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
আহমদ মুসার মুখের কথা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল তার তর্জনি। চেপে ধরেছিল মেশিন রিভলবারের ট্রিগারকে। এক পশলা গুলী গিয়ে আছড়ে পড়ল তরুণটির বুকে। স্টেনগানটি হাতে ধরেই সে টলে উঠে আছড়ে পড়ল মাটিতে।
‘ধন্যবাদ মি…..’ বলল পুলিশ মেয়েটি।
‘খালেদ খাকান।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ মি. খালেদ খাকান।‘ বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি।
‘ধন্যবাদ নয়, আমি তরুণটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমি মনে করি, টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে তরূণটি।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘না, আমি এজন্যে ধন্যবাদ দেইনি। ধন্যবাদ দিয়েছি অবিশ্বাস্য ধরনের এই সফল অপারেশন দেখে।‘ বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি।
আহমদ মুসা পুলিশ মেয়েটির এই সব কথা যেন শুনতেই পায়নি।
বলল, ‘ম্যাডাম অফিসার …।‘
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই পুলিশ অফিসার মেয়েটি বলে উঠল, ‘আমার নাম আয়েশা আরবাকার।‘
নাম শুনে একটু চমকে উঠে তাকাল পুলিশ অফিসার মেয়েটির দিকে আহমদ মুসা। মেয়েটির নাম শুনে জোসেফাইনের পিএস লতিফা আরবাকানের কথা মনে পড়েছে। তার সাথে এ মেয়েটির চেহারারও মিল আছে। বলল আহমদ মুসা, ‘আপনার কি লতিফা আরবাকান নামে কোন বোন আছে?’
পুলিশ অফিসার মেয়েটি চমকে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ আছে। আপনি কি তাকে চেনেন?’
বলে এক মুহূর্ত থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তাহলে কি আপনি ম্যাডাম মারিয়া জোসেফাইনের স্বামী সেই খালেদ খাকান?’ বলল পুলিশ অফিসার মেয়েটি। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। সে ম্যাডাম মারিয়া জোসেফাইন ও তাঁর স্বামী খালেদ খাকান সম্পর্কে লতিফা আরবাকানের কাছে অনেক কথা শুনেছে এবং প্রতিদিনই শুনছে। সেই খালেদ খাকান ইনি!
তার চিন্তা বেশি দূর এগোতে পারলনা। তার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘ মিস, মিসেস আয়েশা আরবাকান..।‘
এবারও পুলিশ অফিসার মেয়েটি আহমদ মুসার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘ মিস আয়েশা আরবাকান।‘ তার মুখে হাসি।
‘হ্যাঁ মিস আযেশা আরবাকান। চলুন গাড়ির ভেতরটা দেখি। সেখানে দু’জন বন্দী থাকার কথা।‘
বলে আহমদ মুসা হাঁটতে শুরু করেছে।
পাশাপাশি আয়েশা আরবাকানও হাঁটতে শুরু করেছে। বলল, ‘বন্দীর কথা বললেন, কারা এই বন্দী? এই বন্দী উদ্ধারের জন্যেই কি আপনার এই অভিযান?’
‘বন্দীর একজন বিজ্ঞানী এবং আরেকজন আপনাদের লোক সাইমি ইসমাইল।‘ আহমদ মুসা বলল।
‘বিজ্ঞানী মানে, ড. আন্দালুসি?’ জিজ্ঞাসা আয়েশা আরবাকানের।
‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘আমি লতিফার কাছে শুনেছি উনি কিডন্যাপ হয়েছেন। সরকার অবশ্যই ঘটনা গোপন রাখায় কেউ জানতে পারেনি। গোয়েন্দা অফিসার সাইমি মিসিং হবার কথাটা বিভাগীয় সূত্রেই জানি।‘ আয়শা আরবাকান বলল।
গাড়ির দরজা খোলাই ছিল।
প্রবেশ করল দু’জনই।
গাড়ির পেছনের সিটে হাত-পা বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসী এবং সাইমি ইসমাইলকে। দু’জনের মুখই চওড়া টেপ পেস্ট করে বন্ধ রাখা হয়েছে।
ড. আন্দলুসির চেহারা বিধ্বস্ত।
দু’জনেই দেখতে পেল তাদেরকে।
আহমদ মুসার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে সামনের সিটের উপরে উঠে আহমদ মুসা ড. আন্দালুসির মুখের টেপ খুলে দিল ও হাত-পায়ের বাঁধন কেটে ফেলল। আয়েশা আরবাকানও মুক্ত করল গোয়েন্দা অফিসার সাইমি ইসমাইলকে।
মুক্ত হয়েই সাইমি ইসমাইল বলল দ্রুত কণ্ঠে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘আমার ভুল না হয়ে থাকলে আপনি মি. খালেদ খাকান। আপনি তাড়াতাড়ি আন্দালুসির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। উনি অসুস্থ।‘
আহমদ মুসা বলল, ‘মিস আয়েশা আরবাকান, মিস সাইমি ইসমাইল আপনারা ড. আন্দালুসিকে সিটে শুইয়ে দিন। প্রচুর ঠান্ডা পানি খাওয়ান তাকেঁ, তাঁকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছে বুঝতে পারছি। গাড়ির দরজা বন্ধ করে এয়ারকন্ডিশনকে ফ্রিজিং পয়েন্টে নিয়ে যান। আমি জেনারেল মোস্তফা এবং নাজিম এরকেনকে ডাকছি। ওরা কাছেই আছেন।‘
বলে আহমদ মুসা ড. আন্দালুসিকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা বেরিয়ে আসার সময় ড. আন্দালুসি বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে মি. খালেদ খাকান। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না্ ওরা আমার দেহকে কষ্ট দিলেও, মন আমার আগের চেয়ে হাজার গুন বেশি তাজা ও শক্তিশালী হয়েছে।‘
আহমদ মুসার মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠেছিল। ড. আন্দালুসিকে আবার ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিল, ‘একজন মুমিনের চরিত্র এরকমই হয়ে থাকে স্যার।‘
আহমদ মুসা বেরিয়ে যেতেই সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকান দু’জনে আহমদ মুসার নির্দেশ পালনে কাজে লেগে গেল।
ড. আন্দালুসিকে শুইয়ে দিয়ে গাড়ির রেফ্রিজারেটর বক্স থেকে পানির প্লাস্টিক বতলের ৫০০ মিলিমিটারের পানি সবটুকু খাইয়ে দিল।
তাঁর বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।
পানি খাওয়ার পর ড. আন্দালুসি বলল, ‘মনে হচ্ছিল এক সাগর পানিতেও আমার তৃষ্ণা মিটবেনা। কিন্তু তোমাদের এক বোতল ঠান্ডা পানিতেই আমার তৃষ্ণা মিটে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ।‘
গাড়ির এয়ারকন্ডিশন আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিয়ে এল।
কাজ শেষ করে সাইমি ইসমাইল সিটে বসতে বসতে বলল, ‘মিস আয়শা আরবাকান ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার সৌভাগ্য যে, আপনি এই রকম একটি অপারেশনে খালেদ খাকানের সহযোগী হতে পেরেছেন।‘
হাসল আযেশা আরবাকান। বলল, ‘খালেদ খাকান সাহেব রং সাইডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাকেঁ পাকড়াও করার জন্যে মোটর সাইকেল নিয়ে রাস্তায় প্রবেশ করেছিলাম।‘
তারপর কি কি ঘটেছিল তার সব বিবরণ দিযে বলল, ‘এই অপারেশনে একটাই কাজ করেছি, সেটা হোল আপনার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে আপনাকে মুক্ত করেছি। তবে আমি সৌভাগ্যবান। তিনটি বেপরোয়া গাড়ির বিরুদ্ধে একজন মানুষের অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য এক অপারেশনের দৃশ্য দেখলাম। তীর বেগে ছুটে আসা তিনটি গাড়ির মাত্র ৫০ গজ সামনে দাঁড়িয়ে গুলী করে দু’পাশের দু’গাড়ির মধ্যে সংঘাত ঘটিয়ে রাস্তা ব্লক করা একটা শিল্পকর্মের মত নিখুঁত ও সুন্দর কারুকাজ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আমি না দেখলে এমন ঘটতে পারে তা বিশ্বাস করতামনা।‘
‘আমিও তার সম্পর্কে এমন সব কথাই শুনেছি। তবে তোমার মত কোন সৌভাগ্যের মুখোমুখি হইনি।
‘এখন বারবার আমার একটা কথাই মনে জাগছে, সেটা হলো, আসল পরিচয় তাঁর কি? আমার বোন মিসেস খালেদ খাকানের পার্সোনাল সেক্রেটারী। আমার বোন বলেছে, মিসেস খালেদ খাকান ফরাসি এবং ফ্রান্সের রাজবংশের একজন রাজকুমারী। ফ্রান্সের রাজকুমারীকে যে বিয়ে করে সে ফ্রান্সের রাজকুমার না হলেও সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে তার চেয়ে বড় কেউ নিশ্চয় হবেন। তার সিকিউরিটি কার্ডে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর এবং তার স্ত্রী প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর রাস্ট্রীয় মেহমান হিসেবে তোপকাপিতে রয়েছেন। ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট তার নিজের পিএসকে মিসেস খালেদ খাকানের পিএস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সুতরাং খালেদ খাকানের অতুলনীয় কাজের মতই তার অতুলনীয় কোন পরিচয় আছে।‘
চোখ বুজে শুয়েছিলেন বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন তিনি। বললেন, ‘তোমাদের কথা সত্য বলেই হয়তো মি. খালেদ খাকান ভিন্ন ধরনের মানুষ। উনি প্রশংসা পছন্দ করেন না। যাক, এখান থেকে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন। তোমরা দেখ, মি. খালেদ খাকান একা বাইরে গিয়ে কি করছেন।‘
‘ঠিক আছে স্যার। আমরা দেখছি ওদিকে।
বলেই দু’জন গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরিয়েই টেলিফোন করেছিল জেনারেল মোস্তফাকে। তাকে খবরটা মানে বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসির উদ্ধারের খবর দিলে জেনারেল মোস্তফা কয়েক মুহূর্ত বিস্ময় ও আনন্দে কথা বলতে পারেনি। তারা আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে, ‘এখানে বড় ঘটনা ঘটেছে। এসে বলব। আমরা আসছি। আপনারা সাবধান থাকবেন।‘
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফার সাথে কথা বলার পর প্রথমেই এল আইজ্যাক বেগিনের লাশের কাছে। আহমদ মুসা তাকে ‘থ্রি জিরো’র ইউরোপীয় প্রধান হিসেবে চেনেন না। নামও জানে না। কিন্তু ইউরোপীয় চেহারা ও বিজ্ঞানীর বহনকারী গাড়ির প্রধান হিসেবে দেখে নিশ্চিত হয়েছে একজন খুব বড় নেতা হবেন।
আহমদ মুসা তাকে সার্চ করল। পকেট থেকে পেল মোবাইল ও একটি মানিব্যাগ। মানিব্যাগে কিছু ডলার ও টার্কিশ লিরা পেল। তার সাথে মানিব্যাগের কয়েন কেবিনে একটি সীম এবং মাইক্রো চিপ পেল আহমদ মুসা। সীম ও চিট পকেটে রেখে মোবাইলটা হাতে নিল। মেনু বাটনে চাপ দেবার জন্যে আঙুল তুলেছিল আহমদ মুসা। আঙুল মেনু বাটন স্পর্শ করার আগেই মোবাইল নতুন মেসেজের সংকেত দিয়ে উঠল।
আহমদ মুসার আঙুল থেমে গেল।
মেসেজের সংকেত শেষ হবার পর আহমদ মুসা মেসেজটা দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল। এই সময় আসা মেসেজ নিশ্চয় জরুরি ও গুরুত্বপূণ হবে। যিনি মেসেজ পাঠিয়েছেন, তিনি জানেন না এখানে কি ঘটেছে।
মেসেজটি ওপেন করল আহমদ মুসা। মাত্র কয়েকটি শব্দের একটি মেসেজ: Change Direction to 101 Barbaros Boulevard ম্যাসেসের শেষে প্রেরকের নাম Dy লেখা। চট করেই আহমদ মুসার মনে পড়ল Dy বর্ন দুটির অর্থ David, Yahood, এই ডেভিড ইয়াহুদ তুরস্কে ‘থ্রি জিরো’র প্রধান। তিনি একে মেসেজ পাঠিয়েছেন যে, গতি পরিবর্তন করে ১০১ বারবারোজ বুলেভার্ডে যাও। মানে বন্দী বিজ্ঞানীকে অন্য কোন ঠিকানায় যাবার কথা ছিল, শেষ মুহুর্তে কোন কারণে গন্তব্য চেঞ্জ করে নতুন ঠিকানা ১০১ বারবারোজ বুলেভার্ডে যেতে বলা হয়েছে।
গাড়ির শব্দ পেল আহমদ মুসা। মোবাইলটা অফ করে পকেটে রেখে দিল। ফিরে দাঁড়িয়ে দেখল কয়েকটি পুলিশের গাড়িসহ দু’টি কার এসে দাঁড়িয়েছে। দু’টি কারের একটি থেকে নামছে জেনারেল মোস্তফা, অন্যটি থেকে পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
আহমদ মুসা এক ধাপ, দু’ধাপ করে তাদের দিকে এগোলো। আর তারা দু’জন ছুটে এল আহমদ মুসার দিকে। তারা দু’জন এক সাথেই জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘খালেদ খাকান, আপনি আমাদের সকলের গর্ব। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।‘ আর পুলিশ প্রধান বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে সবচেয়ে ভালোবাসেন, কারন আপনি সব বান্দাকে ভালোবাসেন। এজন্য বিজয় সব সময় আপনার হাতেই ধরা দেয়।‘ পুলিশ প্রধানের কণ্ঠ আবেগে ভারি হয়ে উঠেছে।
‘চলুন দেখবেন বিজ্ঞানী ড. আন্দলুসিকে।‘ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকান। তাদের উপর চোখ পড়তেই পুলিশ প্রধান সাইমি ইসমাইলকে স্বাগত জানিয়ে আয়েশা আরবাকানকে বলল, ‘তুমি এখানে কি করে?’
আয়েশা কিছু বলার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘উনি এই অপারেশনে আমার সাথী।‘
বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল পুলিশ প্রধান।
আয়েশা প্রতিবাদে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আহমদ মুসা বলল, ‘চলুন বিজ্ঞানী একা আছেন।‘
‘চলুন।‘ বলল জেনারেল মোস্তফা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক ধাপ সামনে এগোতেই দেখতে পেল আইজ্যাক বেগিনকে। তাকে দেখেই চমকে উঠল তারা। বলল, ‘ইনি তো আইজ্যাক বেগিন। ইনি ইহুদীবাদী একটি গোপন আন্দোলনের ইউরোপীয় নেতা। কি আশ্চর্য! ইনি এস্তাম্বুলে এসেছেন এবং কিডন্যাপের সাথে ইনিও জড়িত!’
‘যে গাড়িতে বিজ্ঞানী ও সাইমি ইসমাইলকে পাওয়া গেছে, সেই গাড়িতে ইনি এবং ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজির একজন ছাত্র ছিল। এ দেখুন তার লাশ।‘ সামনের একটা লাশের দিকে ইংগিত করে বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন সামনে এগিয়ে ছাত্রটিকেও দেখল। পুলিশ প্রধান বলল, ‘চিনতে পেরেছি। এর ছবি আমাদের ছাত্র অপরাধী ফাইলে রয়েছে। এর বিরুদ্ধে রহস্যজনক গতিবিধির অভিযোগ রয়েছে।‘
‘এখানে কতজন মারা গেছে মি. খালেদ খাকান?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘গুলীতে চারজন। অন্য ছয় জন গাড়ির একসিডেন্টএ?।‘
বিজ্ঞান ড. আন্দলুসি যে গাড়িতে আছেন, সে গাড়ির পাশে সবাই এসে পৌছেছে।
আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, কথা আদায়ের জন্যেই নিশ্চয় বিজ্ঞানীকে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছিল। তিনি অসুস্থ। তাকে একটু ঠান্ডায় রাখা হয়েছে। আসুন তাঁর সাথে কথা বলুন।‘
বলে গাড়ির দরজা খুলল আহমদ মুসা।
দরজা খুলতেই বিজ্ঞানী ড. আন্দলুসি উঠে বসছিলেন।
‘স্যার, আপনি শুয়ে থাকুন তুরস্কের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান জেনারেল মোস্তফা এবং পুলিশ প্রধান জনাব নাজিম এরকেন এসেছেন। তারা একটু দেখা করবেন আপনার সাথে।‘
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন গাড়ির ভেতর দিকে এগোলো। আহমদ মুসা সরে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য বসার জায়গা করে দিয়ে বলল, ‘আপনারা তার সাথে বসুন। আমি আসছি।‘
বলে আহমদ মুসা সরে এল।
একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকান। আহমদ মুসা ওদের লক্ষ্য করে বলল, ‘পুলিশ এখনি লাশগুলোকে নিয়ে যাবে। আপনার আইজ্যাক বেগিন বাদে অন্য নিহতদের পকেটগুলো সার্চ করে দেখুন। পকেটের কাগজপত্র ও মোবাইলগুলো কাজে লাগতে পারে।‘
‘ঠিক স্যার। ধন্যবাদ, আমরা দেখছি।‘
বলে ওরা দু’জন কাজে লেগে গেল।
আহমদ মুসা দাঁড়াল গাড়ি ঠেস দিয়ে। তার মাথায় একটা চিন্তা অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো, তাদের অপারেশনের একটা মধ্যবর্তী সময় তারা গন্তব্য পরিবর্তন করল কেন? হঠাত তার মনে হলো, ডেভিড ইয়াহুদের ওখানে কি ঘটেছে তার মধ্যে এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত থাকতে পারে, কারণ ডেভিড ইয়াহুদই গন্তব্য চেঞ্জ করেছেন।
জেনারেল মোস্তফা ও নাজিম এরকেন এল এ সময়। আহমদ মুসা জেনারেল মোস্তফাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জেনারেল মোস্তফা, আপনি টেলিফোনে বলছিলেন যে, ওখানে কি একটা নাকি ঘটেছে?’
‘হ্যাঁ, সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে খালেদ খাকান। এখনি ছুটতে হবে প্রধানমন্ত্রীর ব্রিফিং-এ। আমাদের অসুস্থ প্রধান বিচারপতি মিলিটারি এ্যাম্বুলেন্সে সামরিক হাসপাতালে যাচ্ছিলেন, ওরা পালানোর পথে এই এ্যাম্বুলেন্স কিডন্যাপ করেছে। দু’তিন মিনিট পরেই ফাতিহ সুলতান মোহাম্মদ বাইপাশ সড়কের ওপ্রান্তের জংশন এলাকা থেকে খবর এল, সেখানে রাস্তার পাশে মিলিটারী এ্যাম্বুলেন্সকে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ‘ওরা মানে এই আইজ্যাক বেগিনের কিডন্যাপাররা?’ আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
‘হ্যাঁ ওদের চারটি গাড়ির তিনটিই আমাদের পুলিশের হাতে পড়ে। ধরা পড়া নিশ্চিত যেনে ওরাই ওদের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয় এবং সবাই মারা পড়ে। কিন্তু বুলেটপ্রূফ গাড়িটা আমাদের তিনজন পুলিশের লাশের উপর দিযে পালাতে সক্ষম হয়। ওরাই কিডন্যাপ করে এ্যাম্বুলেন্সটিকে।‘ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘এ্যাম্বুলেন্সকে কিডন্যাপ করল কেন? ওরা কি জানত যে, এ্যাম্বুলেন্সে প্রধান বিচারপতি আছেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না, ওরা বুলেটপ্রুফ গাড়ি ছেড়ে দিয়ে এ্যাম্বুলেন্স নিয়েছিল। জংশন-৬ এলাকা নিরাপদে পার হবার জন্যেই তারা এ্যাম্বুলেন্সের কভার নিয়েছিল।‘ জেনারেল মোস্তফা বলল।
‘বুঝলাম, প্রধান বিচারপতির পরিচয় পাবার পর তারা তাকেঁ কিডন্যাপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তাঁকে দিয়ে কি করবে ওরা? ড. আন্দালুসীকে কিডন্যাপ করার সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। তাঁর ক্ষেত্রে তো এরকম কোন কারণ নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘তাদের পরিত্যাক্ত মিলিটারী এ্যাম্বুলেন্সে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। তাতে লেখা হয়েছে, ‘বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টা অবিলম্বে পরিত্যাগ করতে হবে। তার প্রমাণ হিসেবে অবিলম্বে খালেদ খাকানকে তুরস্ক থেকে বহিস্কার করতে হবে। এ দু’টি নির্দেশ মানা না হলে প্রধান বিচারপতিকে হত্যা করা হবে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘এখন তাহলে কি? বিজ্ঞানী তো উদ্ধার হয়ে গেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এখন ভয় হলো, ক্রুদ্ধ হয়ে তারা যেন প্রধান বিচারপতিকে হত্যা না করে বসে।’ বলল জেনারেল মোস্তফা। চোখে-মুখে তার উদ্বেগ।
আহমদ মুসা কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। এ সময়েই বেজে উঠল জেনারেল মোস্তফার টেলিফোন।
‘এক্সকিউজ মি!’ বলে জেনোরেল মোস্তফা মোবাইল তুলে নিল। মোবাইল স্ক্রীনে প্রধানমন্ত্রীর নাম্বার দেকে চমকে উঠে মুখের কাছে মোবাইল এনে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার, আমি মোস্তফা কামাল। কিছু আদেশ স্যার?’
ওপার থেকে প্রধানমন্ত্রী কথা বলল। ওপারের কথা শুনে বলল, ‘স্যার, ড. আন্দালুসি এখন ভালো আছেন।’
ওপার থেকে প্রধানমন্ত্রী আবার কথা বলল। তার কথা শুনে জেনারেল মোস্তফা বলল, ‘স্যার, এখনি তাঁকে বলছি। জি স্যার, ব্রিফিং-এ আমি তাঁকেও নিয়ে আসব। তিনি আমার পাশেই আছেন স্যার।’
‘জি স্যার, তাকে মোবাইল দিচ্ছি।’ বলল ওপারের কথা শুনে জেনারেল মোস্তফা।
জেনারেল মোস্তফা মোবাইলটি আহমদ মুসার দিকে তুরে ধরে বলল, ‘জনাব খালেদ খাকান, মহামান্য প্রধানমন্ত্রী।’
আহমদ মুসা মোবাইলটি হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দিয়ে বলল, ‘আপনি ভালো আছেন স্যার?’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমি যা করেছি, আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে সেও নিশ্চয় তা পারতো।’ বলল আহমদ মুসা ওপারের কথা শুনে।
‘এক্সকউজ মি স্যার, আমি মনে করি ওদের ফলো করাই এখন প্রথম কাজ। আমি একটা পরিকল্পনা অলরেডি করে ফেলেছি।’ ওপারের কথা শুনে বলল আহমদ মুসা আবার।
‘ধন্যবাদ স্যার, মহামান্য প্রেসিডেন্টকে আমার সালাম দেবেন। নিশ্চয় দু’একদিনের মধ্যেই আমি আপনাদের সাথে দেখা করব।’ বলল আহমদ মুসা আবার।
‘দোয়া করুন স্যার, আমি যা ধারণা করেছি তা যেন ঠিক হয়। আমি জনাব জেনারেল মোস্তফাকে টেলিফোন দিচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম।’
আহমদ মুসা মোবাইলটা আবার জেনারেল মোস্তফাকে দিল।
জেনারেল মোস্তফা টেলিফোন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে ‘জি’ ‘জি’ করে অবশেষে বলল, ‘স্যার, মি. খালেদ খাকান অবশ্যই সব ব্যাপারে স্বাধীন স্যার। আমরা তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। তাঁর সাথে পরামর্শ করেই আমরা আসছি স্যার।’
সালাম দিয়ে মোবাইল রেখে দিল জেনারেল মোস্তফা। মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘প্রধান বিচারপতির কিডন্যাপের বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন, সে বিষয়ে সহযোগিতা করাকেই আমাদের প্রধান কাজ বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলুন মি. আহমদ মুসা আমরা কি করতে পারি?’
‘ঘটনার পর আইজ্যাক বেগিনের মোবাইল নিয়ে আমি যখন ‘মেনু’ উইনডো ওপেন করতে যাচ্ছিলাম, তখন একটা মেসেজ আসে তার মোবাইলে। মেসেজে একটা নতুন ঠিকানা দেয়া হয়েছে। সব কার্যকারণ বিচার করে আমার মনে বলছে, এই ঠিকানায় আমরা প্রধান বিচারপতিকে পাব। এই ঠিকানাকেই আমি এখন টার্গেট করতে চাচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।
জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনসহ সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল পুলিশ প্রধান,‘ঠিকানাটা কি?’
‘১০১ বার্বারোস বুলেভার্ডে।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার মুখে ঠিকানাটা উচ্চারিত হতেই সাইমি ইসমাইলের চোখে-মুখে চাঞ্চল্য দেখা দিল। সে বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে,‘স্যার এ সম্পর্কে আমিও একটা তথ্য দিতে পারি।’
সবাই তাকাল সাইমি ইসমাইলের দিকে।
‘ওয়েলকাম মিস সাইমি ইসমাইল, বলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আমাদেরকে আজ যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, তখন আইজ্যাক বেগিনের মোবাইলে একটা কল আসে। তিনি কলটি রিসিভ করে এ কথাগুলো বলেছিলেন, ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ড রেডি? ধন্যবাদ। আমাদের লক্ষ্য এখন পিয়েল পাশা বুলেভার্ড। এটা কাছে।’ সাইমি ইসমাইল বলল।
‘ধন্যবাদ সাইমি ইসমাইল। আপনার এই তথ্য ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ডকে কনফার্ম করল। আসলে শুরুতে গন্তব্য পিয়েল পাশা বুলেভার্ড ছিল। কিন্তু সম্ভবত তাদের গাড়ি বহর আক্রান্ত হওয়া এবং প্রধানবিচারপতিকে কিডন্যাপ করায় পিয়েল পাশা বুলেভার্ড কাছে বলেই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়, অথবা সেখানে অন্য কোন অসুবিধা দেখা দেয়, তার ফলেই তারা গন্তব্যস্থান হিসেবে ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ডকে ঠিক করে।’ থামল আহমদ মুসা।
সংগে সংগেই পুলিশ প্রধান প্রধান নাজিম এরকেন বলে উঠল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ঠিকানা সম্পর্কে আপনার কথা ঠিক। এখন আমাদের কি করণীয় স্যার?’
‘দয়া করে ১০১ বার্বারোস ঠিকানাটার চারপাশে আপনাদের লোকদের সাদা পোশাকে এমনভাবে অবস্থান নিতে বলুন, যাতে কারও মনে সামান্য সন্দেহের উদ্রেকও না হয়। এ ঠিকানায় ঢুকতে কাউকে তারা বাধা দেব না। কিন্তু কেউ বেরুলে তাকে ফলো করবে এবং নিরাপদ জায়গায় তাকে আটক করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অল রাইট’ বলে পুলিশ প্রধান একটু সরে দাঁড়িয়ে তার পকেট থেকে মিনি অয়্যারলেস বের করে নির্দেশ দিতে শুরু করল।
‘এরপর করণীয় কি মি. খালেদ খাকান?’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
‘আমাদের লক্ষ্য হলো, প্রধান বিচারপতিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটু ভাবল, তারপর বলল, ‘বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসি ওদের হাত ছাড়া হওয়া এবং আইজ্যাক বেগিনের পরিণতির কথা জানতে পারলে ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হবে। রাগের মাথায় ওরা প্রধান বিচারপতির ক্ষতি করতে পারে। এই সম্ভাবনা রোধের জন্যে অবিলম্বে তাকে উদ্ধারের পদক্ষেপ নিতে হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
‘আপনি কি উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে কিছু ভেবেছেন?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের।
‘উদ্ধার অভিযান এমন হবে যা শেষ মুহূর্তের আগে ওরা টের পাবে না। টের পেলে ওরা মরিয়া হয়ে প্রধান বিচারপতিকে হত্যাও করে ফেলতে পারে। উদ্ধার অভিযানের বিষয় যখন তারা টের পাবে, তখন তাদের করার কিছুই থাকবে না, এই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।’ আহমদ মুসা আহমদ মুসা বলল।
‘সে ব্যবস্থার কথাই ভাবুন মি. খালেদ খাকান।’ বলল জেনারেল মোস্তফা।
চোখ বন্ধ করেছিল আহমদ মুসা। ভাবছিল সে।
জেনারেল মোস্তফা থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, দু’একজনকে ঐ বাড়িতে ওদের অলক্ষ্যে প্রবেশ করতে হবে। তাদের কাজ হবে প্রধান বিচারপতিকে সাহায্য করা, নিরাপদ করা। তারা সংকেত দিলে, তারপর ঐ ঠিকানায় সর্বাত্মক অভিযান পরিচালিত হবে।’
থামল আহমদ মুসা।
সবাই নিরব।
ভাবছে সবাই।
সব শেষে সবাই তাকাল আহমদ মুসার দিকেই। জেনারেল মোস্তফা বলল,‘এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চয় কিছু ভাবছেন মি. খালেদ খাকান?’
‘আমাকে ওরা তুরস্ক ছাড়া করতে চাচ্ছে, আমিই আগে দেখা করতে চাই ওদের সাথে।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখভরা হাসি।
কিন্তু হাসতে পারল না আর কউ। বলল জেনারেল মোস্তফা,‘আপনি একা?’
‘ওদের নজর এড়াবার জন্যে একাই সবচেয়ে ভালো। তাছাড়া এই মুহূর্তে দ্বিতীয় জনের সিলেকশন মুস্কিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জেনারেল তাহির তারিক আংকারা থেকে ফিরেছেন, তাঁর সাথে কি একটু কথা বলবেন?’ জিজ্ঞাসা জেনারেল মোস্তফার।
‘সময় কম। এই সময়ে তার উদ্বেগ বাড়িয়ে লাভ নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি খুব সামান্য একজন কমান্ডো। আমি ও আমার সাথীরা সেদিন বিজ্ঞানী স্যারের কিডন্যাপ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছি। এরপরও আমি কি আমার সহযোগিতা অফার করতে পারি?’ বলল সাইমি ইসমাইল।
‘বোন ভাইকে এমন সহযোগিতা অফার করাটাই স্বাভাবিক। সেদিন তোমরা ব্যর্থ হওনি বোন। তুমি ছাড়া সবাই তো সেদিন জীবন দিয়েছে। বিজ্ঞানীর স্ত্রী মনে না করলে তোমাকেও ওরা মেরে ফেলত। সেদিন দিনটা ওদের ছিল, পরিকল্পনাও ছিল ওদের। তাই বিজয়ও ওদের হয়েছে। কিন্তু তোমরা সেদিন ব্যর্থ হওনি।’আহমদ মুসা বলল।
আবেগে মুখ ভারি হয়ে উঠেছিল সাইমি ইসমাইলের। তার দুধে-আলতা রংয়ের গালে স্ফটিকের মত দু’ফোটা অশ্রুও নেমে এসেছিল।
বলল, ‘তাহলে কি ভাইয়ের সাথী হতে পারব আমি?’ আবেগরূদ্ধ কণ্ঠ সাইমি ইসমাইলের।
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘আমাদের ঐতিহ্য হলো, এ ধরনের লড়াই-এ বোনরা শুরুতেই শামিল হয় না। বিবি খাওলাদের ডাক পড়ে যুদ্ধের পরিনতি পর্বে। জেনারেল মোস্তফা ও জনাব নাজিম এরকেনের সাথে আজকে তুমিও থাকবে যুদ্ধের সমাপ্তি টানার অভিযানে।’
‘ধন্যবাদ। কষ্ট হলেও ভাইদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া বোনদেরও ঐতিহ্য।’ বলল সাইমি ইসমাইল চোখ মুছতে মুছতে।
‘আরেক বোনের তো কথা বলা হচ্ছে না! বোনরা সবসময় আবদার করেই কি অধিকার আদায় করবে?’ বলল আয়েশা আরবাকান।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তুমি তো আমার সাথেই আছ। তোমার দুই রিভলবারের সবগুলো গুলিই তুমি খরচ করেছ এই অভিযানে। আমি মোস্তফা ও জনাব নাজিম এরকেনের কাছে তোমার নামও রিকমেন্ড করব এই অভিযানে শামিল করার জন্য।’
‘জনাব খালেদ খাকান, আয়েশা আরবাকানও আমাদের মহিলা কমান্ডো ইউনিটের একজন চৌকশ সদস্য। তাকে আমরা ওয়েলকাম করব এই অভিযানে।’ বলল পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেন।
‘ধন্যবাদ মি. নাজিম এরকেন।’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল জেনারেল মোস্তফার দিকে। বলল, ‘আমার গাড়ি ওরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন। আমি এখনি বের হতে চাই।’
‘চলুন, আমরা ড. আন্দালুসিকে নিয়ে মিলিটারী হাসপাতাল পর্যন্ত একসাথে যাই। ওখানেই একটা ভাল গাড়ি আপনার জন্য থাকবে। প্রয়োজনীয় কমব্যাট ব্যাগও পাবেন তাতে।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই জেনারেল মোস্তফা আবার বলল, ‘আমি ভাবছি, আপনি ১০১ বার্বারোস বুলেভার্ড ঠিকানায় পৌঁছে আমাদেরকে একটা সঙ্কেত দেবেন। আপনার সঙ্কেত পাওয়ার পর আমরা ওদিকে মুভ করব। যাতে আপনি বাড়িতে প্রবেশের বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে আমরা সেখানে পৌঁছতে পারি।’
‘ধন্যবাদ, ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চলুন আমরা মুভ করি হাসপাতালের দিকে।’
‘চলুন। মি. খালেদ খাকান আপনি সাইমি ইসমাইল ও আয়েশা আরবাকানকে নিয়ে ড. আন্দালুসির সাথে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে বসুন। সাইমি ইসমাইলই গাড়িটা ড্রাইভ করবে।’
বলে জেনারেল মোস্তফা তার গাড়ির দিকে এগোলো। অন্যেরাও এগোলো তাদের গাড়ি লক্ষ্যে।
স্টার্ট নিল সবগুলো গাড়ি।
জেনারেল মোস্তফা ও পুলিশ প্রধান নাজিম এরকেনের গাড়ি সবার আগে। তারপরে বিজ্ঞানীকে নিয়ে আহমদ মুসাদের বুলেটপ্রুফ গাড়ি। সবার পেছনে পুলিশের দুটি গাড়ি।
গাড়ির ছোট্ট বহরটি এগিয়ে চলল মিলিটারী হাসপাতালের দিকে।
৭
একশ’ এক বার্বারোস বুলেভার্ড-এর ৪ তলা বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের একটা প্রশস্ত কক্ষে বসে আছে ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
মাথার চুল তার উস্কো-খুস্কো। মুখ শুকনো। চোখদুটি লাল। ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ডাক্তার এসে একবার চেক করে গেছে।
দু’ঘন্টা ধরে বসে আছে এই চেয়ারে। তেলআবিব, ইউরোপের কয়েকটি রাজধানী ও ওয়াশিংটনে অনেকগুলো টেলিফোন করেছে এই দু’ঘন্টায়। জানিয়েছে সে ‘থ্রি জিরো’র মহাবিপর্যয়ের কথা। বিজ্ঞানী ড. আন্দালুসিকে কিডন্যাপ করতে পারার তাদের সাফল্যের কথা। একদিন আগে আইজ্যাক বেগিনও এভাবেই তেলআবিব, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি রাজধানীর গুরুত্বপুর্ণ মহলকে এ কথাগুলো জানিয়েছিল। তারা অভিনন্দন জানিয়েছিল আইজ্যাক বেগিন ও ড. ডেভিড ইয়াহুদকে এবং আশা করেছিল যে, সোর্ড-এর ফর্মুলা হস্তগত করা সম্ভব হবে, যা তাদেরকে গোটা দুনিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অকল্পনীয় এক সুযোগ এনে দেবে। আইজ্যাক বেগিন ও ড. ডেভিড ইয়াহুদ তাদের নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিল, তার স্ত্রীকেও যখন আমরা আটক করতে পেরেছি, তখন সাফল্য সম্পর্কে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। একদিন, দুদিন, তিনদিন, কয়দিন সে নির্যাতন সহ্য করবে। নিজে সহ্য করত্রে পারলেও তার চোখের সামনে স্ত্রী লাঞ্ছিত হবার বিভৎস দৃশ্য সে কয়দিন সহ্য করবে! সে মুখ খুলবে, খুলতেই হবে। শুধু তাই নয় তাকে আমাদের ল্যাবরেটরীতে বশংবদের মত কাজ করতে বাধ্য করা হবে। এধরনের কত আশার কথাই না ড. ডেভিড ইয়াহুদ তেলআবিব, ইউরোপ ও আমেরিকার তাদের মুরুব্বীদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু সবই ভণ্ডুল হয়ে গেল। খোদ আইজ্যাক বেগিন নিহত হলেন এবং বিজ্ঞানীকে তারা উদ্ধার করে নিয়ে গেল। সব আশায় গুঁড়েবালি পড়ে গেল! কেন এমনটি হল? আমাদের গোপন ঠিকানার সন্ধান ওরা কি করে পেল? আর উদ্ধার করার ব্যাপারটা এক অসম্ভব কাহিনী। ৬ জন লোক নিজেদের গাড়ির মধ্যকার দুর্ঘটনায় মারা গেছে, ৪ জন গুলিতে। যে রিপোর্ট সংগ্রহ হয়েছে, তাতে মাত্র একজন লোক এই সর্বনাশটা করেছে। কে এই লোক আমরা জানি। ওরা পরিচয় ভাড়িয়ে বলে খালেদ খাকান, আমরাও বলি। বলি এই কারণে যে, খালেদ খাকান নামেই যদি তাকে শেষ করে দেয়া যায়, সেটাই ভালো। তাছাড়া ‘আহমদ মুসা’ নামটা প্রকাশ পেলে ওই পক্ষের ও সাধারণ মানুষের সাহস আরও বাড়বে। আর আমাদের হতাশা তাতে বাড়বে।
এই খালেদ খাকান ব্যাটা আমাদের লোকদের খবর, আমাদের ঘাঁটির ঠিকানা একের পর এক পেয়ে যাচ্ছে কি করে? এ পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে সে যত অভিযান করেছে, সবগুলোই ছিল সুনির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে। কোথা থেকে পাচ্ছে এই খবরগুলো সে।
দুঃখের মধ্যেও ড. ডেভিড ইয়াহুদের সান্তনা হলো, তেলআবিব, ইউরোপ, আমেরিকা তাকে সাহস দিয়েছে। যে কোন মূল্যে সোর্ড-এর ফর্মুলা হাত করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে বিজ্ঞানীদের সমেত রোমেলী দূর্গ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। সে ব্যবস্থাও তারা করেছে। ড. ডেভিড ইয়াহুদরা গ্রীন সিগন্যাল দিলেই তারা কাজ শুরু করবে। তার জন্য আরেকটা আশার কথা হল এনজিও’র পরিচয়ে ইউরোপ থেকে কিছু চৌকশ জনশক্তি পাঠানো হয়েছে তাকে সাহায্য করার জন্য। এটা তার জন্য খুব বড় একটা সুখবর। আহমদ মুসা আসার পর তার হাতে ‘থ্রী জিরো’র মূল্যবান জনশক্তি নষ্ট হয়েছে, যার সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে।
শেষের চিন্তাগুলো উজ্জ্বীবিত করল ড. ডেভিড ইয়াহুদকে।
এসময় ঘরে প্রবেশ করল শীর্ষ গোয়েন্দা স্মার্থা ও নতুন অপারেশন চীফ সোলেমান স্যামসন।
তারা ঘরে ঢুকতেই ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল, ‘প্রধান বিচারপতির খবর কি?’
‘এই গ্রাউন্ডফ্লোরের এক সেলে তাকে রাখা হয়েছে। সেলে গ্রীলের গেট। দু’জন স্টেনগানধারীকে সেখানে পাহারায় রাখা হয়েছে। আর গ্রাউন্ডফ্লোর থেকে আন্ডারগ্রাউন্ডের সিঁড়িমুখেও দু’জন পাহারায় রাখা হয়েছে।’ বলল সোলেমান স্যামসন।
‘বাড়ির বাইরে কি অবস্থা?’ জিজ্ঞাসা ড. ডেভিড ইয়াহুদের।
‘বাড়ির গেটবক্সে পাহারায় থাকবে দু’জন স্টেনগানধারী। আর ৪ জন ছদ্মবেশে বাড়ির চারিদিকে নজর রাখবে। বাড়ির সামনে যেখান থেকে প্রাইভেট রাস্তা বাড়ির গেট পর্যন্ত এসেছে, সেখানে বড় রাস্তার বার্বারোস বুলেভার্ডের একটি তেমাথা। এখানে বিপরীত দিক থেকে আরেকটি রাস্তা এই বুলেভার্ডের সাথে মিশেছে। এই তেমাথায় একটা কক্ষ ভাড়া নিয়ে একটা ইনফরমেশন সেন্টার খুলে স্মার্থা বসছে। সেখানে বসে বুলেভার্ডসহ বাড়ির তিনদিকে সে নজর রাখতে পারবে।’ বলল সোলেমান স্যামসন।
‘ধন্যবাদ। প্রধান গেট ছাড়া ডুপ্লেক্সে ঢোকার কি আর কোন পথ আছে?’
‘না স্যার, এই ডুপ্লেক্সে প্রাইভেট কোন এক্সিট নেই।’
‘ঠিক আছে, চল আমরা প্রধান বিচারপতির ওখানে যাই। চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। প্রধান বিচারপতির কিডন্যাপকে কাজে লাগাতে হবে। বিজ্ঞানী আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। এখন খালেদ খাকানকে তুরস্ক থেকে তাড়াতে হবে। প্রধান বিচারপতিকে এই দাবি আদায়ের পণবন্দি বানাতে চাই। প্রধান বিচারপতির এই মর্মে বিবৃতি আদায় করতে হবে যে, জনৈক খালেদ খাকানকে তুরস্ক থেকে না তাড়ালে আমার মুক্তির সম্ভাবনা নেই। প্রধান বিচারপতির এই বিবৃতি সরকারের কাছে এবং সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে পাঠাতে হবে। জনগণের পক্ষ থেকেও দাবি উঠাতে হবে যে, একজন খালেদ খাকানের জন্যে প্রধান বিচারপতির এই অবস্থা চলতে দেয়া যেতে পারে না। তাদের তরফ থেকে দাবি উঠাতে হবে, খালেদ খাকানকে বহিষ্কার করে প্রধান বিচারপতিকে মুক্ত করা হোক।’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ধন্যবাদ স্যার। চমৎকার একটা কৌশল বের করেছেন। এভাবে চাপ সৃষ্টি করে, গণদাবি তুলে যদি তুরস্ক থেকে খালেদ খাকানকে বহিষ্কার করা যায়, তাহলে বিরাট লাভ হবে আমাদের। আমাদের লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়ে যাবে।’
‘চল যাই।’ বলে উঠে দাঁড়াল ডেভিড ইয়াহুদ।
উঠে দাঁড়াল সোলেমান স্যামসন ও স্মার্থা।
বেরিয়ে এল তারা ঘর থেকে।
আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের যে সেলে প্রধান বিচারপতি বন্দী আছে, সে সেলের পেছনে এসে দাড়াল তিনজন। সেলের দেয়ালের হাংগার থেকে তিনজনই আপাদমস্তক কাল পোশাক পরল এবং মুখে পরল মুখোশ।
সেলের পাহারায় থাকা দু’জন গার্ড আগেই দেখতে পেয়েছিল তাদের তিনজনকে। ওরা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই সেলের দরজা তারা খুলে দিল।
সেলে প্রবেশ করল তিনজন।
প্রধান বিচারপতি খাটিয়ায় শুয়ে ছিল। মুখোশ পরা তিনজন ঘরে ঢুকতেই প্রধান বিচারপতি উঠে বসলো।
প্রধান বিচারপতি ঋজু গড়নের হাল্কা-পাতলা মানুষ, কিন্তু লম্বা হবেন প্রায় ৬ ফুটের মত। সহজ-সরল চেহারার ভদ্রলোক মানুষ।
জল্লাদের পোশাক পরে তিনজনকে ঘরে ঢুকতে দেখে ভীতির একটা ছাপ তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে।
বেডের সামনে একটাই চেয়ার। ড. ডেভিড ইয়াহুদ চেয়ারটিতে বসতে বসতে বলল, ‘অনুমতি ছাড়াই বসলাম স্যার, আপনি তো এখন প্রধান বিচারপতি নন।’
একটু থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ। তারপর পকেট থেকে রিভলবার বের করেই প্রধান বিচারপতির দিকে পরপর দু’টি গুলী করল। একটা গুলী প্রধান বিচারপতির মাথার ডান পাশে, দ্বিতীয় গুলী মাথার বাম পাশের চুল ছুঁয়ে চলে গেল।
ভীষণভাবে চমকে উঠেছে প্রধান বিচারপতি। কেঁপে উঠেছে তাঁর দেহ। প্রবল আতঙ্ক চোখে-মুখে।
ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল, ‘স্যার, গুলী দু’টি ভেতরদিকে আর আধা ইঞ্চি করে সরে এলে আপনার মাথা গুঁড়ো হয়ে যেত এবং আপনি লাশ হয়ে যেতেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, মৃত্যুটা আপনার কত কাছাকাছি। আপনি যদি আমাদের সহযোগীতা না করেন, তাহলে পরের গুলী মাত্র আধা ইঞ্চি মাথার দিকে সরে আসবে।’
থামল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘কি সহযোগীতা?’ শুকনো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল প্রধান বিচারপতি।
‘একজন লোককে তুরস্ক থেকে বহিষ্কারে সাহায্য করতে হবে।’ বলল ড. ডেভিড ইয়াহুদ।
‘কে সেই লোক?’
‘লোকটির নাম মি. খালেদ খাকান।’
‘কে সে?’
‘সে তুরস্কের লোক নয়।’
‘আমি তাকে চিনি না। আমাকে কি করতে হবে?’
‘আমরা তাকে চিনি। আমাদের জন্য সে সাংঘাতিক ক্ষতিকর। তার বহিষ্কারের উপর আপনার মুক্তি নির্ভর করছে। অতএব, সরকারের কাছে আপনি একটা আবেদন জানাবেন যে, তাকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে আমাদের দাবি সরকার যেন মেনে নেন।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘তাকে বহিষ্কার করা হবে কেন? সে কি বৈধভাবে তুরস্কে নেই? আমি একটা অন্যায় দাবি কিভাবে করতে পারি?’ বলল প্রধান বিচারপতি।
‘আপনি বাঁচার জন্য করতে পারেন। আপনি সরকারকে বলুন, তাকে বহিষ্কার করার উপর আপনার প্রাণে বাঁচা ও নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে বাঁচা নির্ভর করছে। আপনাকে এই আপিল করতে হবে করুণ সুরে, যেন আপনি অপরিসীম নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্যে এই বিবৃতি দিচ্ছেন।’
বলেই ড. ডেভিড ইয়াহুদ পেছনে দাঁড়ানো সাথীদের একজনকে লক্ষ করে বলল, ‘স্যামসন, রেকর্ডার বের করে তাঁর বক্তব্য রেকর্ড কর।’
সঙ্গে সঙ্গেই স্যামসন কাল আলখেল্লার ভেতর থেকে রেকর্ডারসহ হাত বের করে এগোলো প্রধান বিচারপতির খাটিয়ার দিকে। সে প্রধান বিচারপতির সামনে খাটিয়ায় বসল। রেকর্ডার অন করে তা তুলে ধরল প্রধান বিচারপতির মুখের কাছে।
প্রধান বিচারপতির হাত দিয়ে রেকর্ডারটি পাশের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘আমি একজন বিচারপতি। নিছক প্রাণ বাঁচাবার জন্যে একজন নির্দোষ লোক সম্পর্কে এমন দাবি আমি করতে পারি না।’
চেয়ারে বসা লোকটির হাতের রিভলবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে এল প্রধান বিচারপতির লক্ষ্যে। তার সাথে সাথে একটা গুলীও বর্ষিত হল। এবার ফাঁকা গুলী নয়। প্রধান বিচারপতির বাম হাতের কাঁধ-সন্ধিস্থলের এক খাবলা গোশত তুলে নিয়ে গুলীটা বেরিয়ে গেল।
প্রধান বিচারপতি আর্তনাদ করে উঠে ডান হাত দিয়ে বাম কাঁধ চেপে ধরল।
‘এই গুলীটা নমুনা গুলী ছিল। এরপর বুক ভেদ করে গুলী চলে যাবে। এবার বক্তব্যটা দিন। যে আর্তস্বরে চিৎকার করলেন, সেই আর্তস্বরেই একটা বক্তব্য দিন।’ ড. ডেভিড ইয়াহুদ বলল।
‘কিন্তু আমি প্রাণভয়ে একজন নির্দোষ মানুষের ক্ষতি করতে পারব না।’ বলল প্রধান বিচারপতি। বেদনার্ত তার কণ্ঠ।
‘সামসন, রেকর্ডারটি স্মার্থাকে দিয়ে চাবুকটা নিয়ে এস। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না।’ নির্দেশ দিল চেয়ারে বসা লোকটি।
চাবুক নিয়ে এল স্যামসন।
‘চাবুক চালাতে থাক, যতক্ষণ না বক্তব্য রেকর্ড করতে রাজী হয়।’
বলে চেয়ার নিয়ে দরজার কাছে সরে বসল ডেভিড ইয়াহুদ। স্মার্থাও।
চাবুক চলল প্রধান বিচারপতির পিঠে, বুকে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানে। প্রথম কয়েক ঘা মুখ বুজে সহ্য করল। কিন্তু তারপরেই তার মুখ থেকে বুক ফাটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসতে লাগল।
চাবুক কিন্তু থামল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই দেহটা ঝিমিয়ে পড়ল প্রধান বিচারপতির। চিৎকারের শক্তিও আর থাকল না।
চেয়ারে বসা ড. ডেভিড ইয়াহুদ স্যামসনকে থামতে নির্দেশ দিল। তারপর চেয়ার নিয়ে এগিয়ে এল ডেভিড ইয়াহুদ প্রধান বিচারপতির নেতিয়ে পড়া দেহের কাছে। বলল, ‘স্যরি, আমরা এই খারাপ কাজটা করতে চাইনি। আপনিই বাধ্য করেছেন স্যার। বক্তব্যটি দিয়ে দিন। বক্তব্যটি দিলে কয়েকদিনের মধ্যেই আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন।’
প্রধান বিচারপতি চোখ খুলল। বলল, ‘বলেছি তো, আমি একজন বিচারপতি। নির্যাতনের ভয়ে, মৃত্যু-ভয়ে এধরনের বক্তব্য আমি দিতে পারি না। পারব না।’
‘প্রধান বিচারপতি মহোদেয়! মৃত্যুর চেয়েও বড় শাস্তি আমরা দিতে পারি। আমরা কি সে ব্যবস্থাই করব?’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
‘ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না, যে মৃত্যুকে ভয় করেনা, তাকে আর কি দিয়ে ভয় দেখাবে?’ প্রধান বিচারপতি বলল।
‘আছে। আপনার স্ত্রী-কন্যাকে ধরে আনা হচ্ছে। সহ্য করতে পারবেন, আপনার চোখের সামনে তাদের লাঞ্চনা?’ বলল ডেভিড ইয়াহুদ।
চোখ খুলল প্রধান বিচারপতি। তার চোখে মুখে আতঙ্ক। বলল, ‘তারা নির্দোষ, নিরীহ, আমার দোষ তাদের ঘাড়ে চাপাবেন কেন? না, এটা তোমরা পার না।’ উদ্বেগ-আতঙ্কে ভেঙ্গে পড়া কণ্ঠ প্রধান বিচারপতির।
ডেভিড ইয়াহুদ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি যাচ্ছি আপনার স্ত্রী-কন্যাকে আনার ব্যবস্থা করতে।’
বলে ডেভিড ইয়াহুদ তাকাল স্যামসনের দিকে। বলল, ‘তাঁকে দশ মিনিট সময় দাও। এ সময়ের মধ্যে তিনি যদি বক্তব্য দিতে রাজী হন, তাহলে আমাকে টেলিফোন করবে। আমি তাহলে তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে ধরে আনার ব্যবস্থা নিয়ে এগোবো না। তোমার টেলিফোন না পেলে বুঝবো উনি রাজী হন নি।’
স্যামসনকে এই নির্দেশগুলো দিয়ে ড. ডেভিড ইয়াহুদ আবার তাকাল প্রধান বিচারপতির দিকে। বলল, ‘প্রধান বিচারপতি মহোদয়! দশ মিনিটের মধ্যে রাজী না হলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে আপনার স্ত্রী-কন্যাকে আপনি এখানে দেখতে পাবেন।’
বলেই কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে ডেভিড ইয়াহুদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দশ মিনিট শেষ হতে আর মাত্র এক মিনিট বাকি।
স্যামসন ও স্মার্থা প্রধান বিচারপতির সেলে প্রবেশ করল। স্যামসন বলল, ‘স্যার, দশ মিনিটের আর মাত্র এক মিনিট বাকি। আপনি রাজী হয়েছেন,এই টেলিফোন তাহলে আমি স্যারকে করছি না।’
প্রধান বিচারপতির রক্তাক্ত দেহ বিছানার উপর নেতিয়ে পড়েছিল। চোখ বন্ধ ছিল তার। বলল সে, ‘আমাকে কি বলতে হবে, তোমরা লিখে দাও।’ ক্ষীণ কণ্ঠ প্রধান বিচারপতির। চোখ বন্ধ রেখেই কথাগুলো সে বলল।
‘ধন্যবাদ বিচারপতি মহোদয়! আপনার শুভবুদ্ধির জন্য।’
বলেই স্যামসন স্মার্থার দিকে তাকাল।
স্মার্থা কাল আলখেল্লার ভেতর থেকে এক খণ্ড কাগজ বের করে প্রধান বিচারপতির দিকে তা এগিয়ে দিল।
ঠিক এসময়েই ব্রাশফায়ারের শব্দ হল। চমকে উঠে স্যামসন ও স্মার্থা সেলের দরজার দিকে তাকাল। দেখল, সেলের গেটে দাঁড়ানো দু’জন স্টেনগানধারী প্রহরীকে। তারা স্টেনগান বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের স্টেনগানের ব্যারেল থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। স্যামসন ও স্মার্থা দ্রুত তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল সামনে কেউ নেই। সিঁড়ি পর্যন্ত ফাঁকা।
‘কী ব্যাপার? গুলী করলে কাকে?’ জিজ্ঞাসা স্যামসনের।
‘একটা ঢিল ধরনের কিছু গায়ে এসে পড়েছে। তাই সাথে সাথে গুলী চালিয়েছি।’ বলল একজন প্রহরী।
‘কোথায় ঢিল?’ বলল স্যামসন।
প্রহরীর খুঁজতে লাগল ঢিল। পেল না।
‘থাক। চল চারদিকটা খুঁজে দেখি।’ স্যামসন বলল। ঘরটা তালাশ করতে বেরুল চারজনই। তাদের হাতে উদ্যত স্টেনগান ও রিভলবার।
Leave a Reply