লিসবনের হোটেল ভাস্কোদাগামা।
পাশাপাশি দুটি কক্ষ।
৭১১ নং কক্ষে থাকে রবীন সিং রাফায়েল ওরফে আহমদ মুসা এবং ৭১২ নং কক্ষে থাকে লছমন লিওনার্দো ওরফে হাসান তারিক।
দুজন দুকক্ষে থাকলেও দুজনেই এখন আহমদ মুসার কক্ষে দুচেয়ারে বসে।
তাদের সামনে টেবিলে উচ্ছিষ্ট খাবার, কয়েক মিনিট আগে তারা খাবার শেষ করেছে।
দশটায় তাদের এয়ারপোর্টে পৌছতে হবে বলে খাবার খাওয়া তারা আগেই সেরে নিয়েছে। বেয়ারা এসে এখনো উচ্ছিষ্টগুলো নিয়ে যায়নি।
বেয়ারা এসে গেল।
উচ্ছিষ্ট খাবার আর বাসনপত্র গোছাতে গোছাতে বলল, ‘স্যার, আপনাদের পরিচিত কে একজন এসেছিল। আপনারা কক্ষে আছেন কিনা জিজ্ঞেস করল। কিন্তু আমি ‘আছেন’ বলার পর তারা ঘরে প্রবেশ না করে তাড়াতাড়ি চলে গেল।’
‘এটা তুমি কখনকার ঘটনা বলছ?’ জিজ্ঞেস করল রবীন সিং রাফায়েল ওরফে আহমদ মুসা।
‘এই তো স্যার ৫ মিনিটও হয়নি।’ বলল বেয়ারা।
‘কি রকম চেহারা বলত?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘বলা যায় পর্তুগীজ চেহারাই। তবে মুখ অপেক্ষাকৃত লাল। মোটামুটি লম্বা-চওড়া।’ বলল বেয়ারা।
আহমদ মুসা বেয়ারাকে বখশিশ দিয়ে বলল, ‘একটু দেখবে, তাকে দেখা যায় কিনা। পেলে নিয়ে আসবে।’
বেয়ারা চলে গেল।
বেয়ারা চলে যেতেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘আমি নিশ্চিত ভাইয়া, শত্রুরা আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে।’
‘তাইতো মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে?’
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার মনে হয় ওরা লবীতে অপেক্ষা করছে। এমনও হতে পারে ওরা হোটেলের চারদিকেই পাহারায় আছে।’
‘দুজন মুসলমান আমরা, একথা তারা নিশ্চিত জানেন। তাই আমার মনে হয় মাত্র দুজন মুসলমানকে ধরার জন্যে ওদের এতকিছু করা স্বাভাবিক নয়।’ বলল হাসান তারিক।
‘তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে খারাপটার কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন তাহলে আমাদের কি করণীয়?’ বলল হাসান তারিক।
‘আমাদের করণীয় হলো আজোরস দ্বীপপুঞ্জে পৌছে যাওয়া। তার আগে কোন সংঘাতে জড়িয়ে না পড়া, যা আমাদের আজোরস যাত্রায় কোন বিঘ্ন ঘটাতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু সংঘাত আসন্ন মনে হচ্ছে ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘দেখা যাক। তুমি রেডি তো এয়ারপোর্ট যাত্রার জন্যে?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া। ব্যাগটা রেডি করে রেখেছি।’
‘ধন্যবাদ, তবে শুধু এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্যে রেডি নয়, লড়াইয়ের জন্যেও রেডি হবে। যাও, ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এস। হোটেলের বিল পরিশোধ করে এসেছি। চেক আউটও হয়ে গেছে। আমি বেরুচ্ছি।’
হাসান তারিক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আসুন, আমিও বের হচ্ছি।’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই করিডোরে বেরিয়ে এল। দুজনের হাতে দুটি ব্যাগ।
‘আমরা কি সোজা লবি হয়ে বের হবো ভাইয়া?’ হাসান তারিক বলল।
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’ বলে লিফট রুমের দিকে হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকও তার পেছনে হাঁটা শুরু করল।
তারা দুজন যখন লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল, ঠিক তখনি লিফট থেকে বেরিয়ে এল বেয়ারা সেই দুজন লোককে সাথে নিয়ে।
আহমদ মুসা অপরিচিত দুজনের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারল, বেয়ারা ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির দুজন লোককে তাদেরই ঘরে নিয়ে আসছে।
বেয়ারার সাথে ছফুটের মত লম্বা ও জিমন্যাষ্টের মত স্বাস্থ্যের অধিকারী যে লোকটি আহমদ মুসার সন্ধানে হোটেলে ছুটে এসেছে তার নাম মারিও জোসেফ। আর তার সাথের লোকটি হলো, তার দক্ষিণ হস্ত, সেই সিলভা।
যাদেরকে আহমদ মুসা এড়াতে চাচ্ছে, তাদের একদম মুখোমুখি হয়েও আহমদ মুসার চোখে-মুখে চাঞ্চল্যের সামান্য ছায়াও পড়ল না।
হাসিমুখে সে বলল, ‘বেয়ারা, আমাদের খোঁজ করছিলেন যারা তাদেরকে কি পেলে?’
‘স্যার, এরাই তো তাঁরা, আপনাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম।’ বলল বেয়ারা খুশি হয়ে দ্রুত কণ্ঠে।
বেয়ারার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা হ্যান্ডশেকের জন্যে নেতা গোছের লম্বা-চওড়াজন অর্থাৎ মারিও জোসেফের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম, আমি রবীন সিং রাফায়েল এবং আমার সাথি লছমন লিওনার্দো। আপনারা নাকি আমাদের খোঁজ করছিলেন?’
‘আপনারা কি আজ রাত ১২টার প্লেনে আজোরাস যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করল মারিও জোসেফ।
আহমদ মুসা একটুও ভ্রু কুচকালো না, মুখে সামান্য ভাঁজও পড়ল না। প্রশ্নের সংগে সংগেই সহজ ও সরল কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ যাচ্ছি তো?’
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারিও জোসেফের। বলল, ‘আপনাদের দুজনকে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে।’
‘কোথায়?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে কৃত্রিম বিস্ময়ের সুর।
‘আমাদের অফিসে।’ বলল মারিও জোসেফ।
‘আপনাদের পরিচয় কিন্তু দেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি এ্যান্টেনিও। লিসবনের এই অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত অফিসার আমি।’ বলল মারিও জোসেফ।
এক কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার মুখে। বলল, ‘এমন ক্ষেত্রে আপনার আইডেনটিটি কার্ড দেখিয়ে এ ধরনের কথা বলা উচিত। তা আপনি দেখাননি।’
‘মাফ করবেন। আপনি সে ধরনের কেউকেটা নন বলেই দেখানো হয়নি। চলুন আপনারা।’ বলল মারিও জোসেফ।
‘যদি বলি যাব না আমরা। এক ঘন্টার মধ্যে আমাদের এয়ারপোর্টে পৌছতে হবে। আপনারা চাচ্ছেন প্লেনটা আমাদের ফেল হোক।’ আহমদ মুসা বলল।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারিও জোসেফের মুখ। বলল, ‘ধন্যবাদ। আমাদের সন্দেহকে আপনারা সত্য প্রমাণ করেছেন। আপনারা যাবেন না আমরা জানতাম। এজন্যে নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থাই করে এসেছি। হোটেল কর্তৃপক্ষও আমাদের সহযোগিতা করবেন। সুতরাং না গিয়ে আপনাদের উপায় নেই।’ বলল কঠোর কণ্ঠে মারিও জোসেফ।
‘সব বুঝলাম। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের কেন যেতে হবে? আমরা কি কোন অপরাধ করেছি?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে কৃত্রিম ক্ষুদ্ধতার সুর।
‘এটা হোটেল। এখানে আমরা সব কথার আসর বসাতে পারি না। অফিসে চলুন, সবই জানতে পারবেন।’ বলল এ্যান্টেনিও ছদ্মনামের মারিও জোসেফ।
আহমদ মুসা ভাবছিল। লোকটি যা বলেছে সব সত্যি। ওরা আট-ঘাট বেঁধেই এসেছে। আর এই হোটেলে ওদের সাথে লড়াইয়ে নামার মধ্যে কোন মংগল নেই। তাতে পর্তুগাল হয়ে আজোরাস যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পর্তুগালের পাসপোর্টে পর্তুগাল হয়ে আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার অনেক সুবিধা। এ সুবিধা আহমদ মুসা হাতছাড়া করতে চায় না। সুতরাং এই আজোরস যাওয়ার পথ যতটা নিরুপদ্রব হয় সে ধরনের ব্যবস্থাই করতে হবে। আহমদ মুসা এটাও ভাবল যে, আজোরস যাওয়ার পথে শুরুতেই ওদের হাতে বন্দী হবার মধ্যেও ঝুঁকি আছে। আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়াই যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে তো আসল কাজই পন্ড হয়ে যাবে। অবশেষে আহমদ মুসা ভাবল, ওদের হাতে বন্দীও হওয়া যাবে না, কিন্তু এই মুহূর্তে কোন ঘটনাও ঘটানো যাবে না, এই উভয় সংকটে আহমদ মুসা ধৈর্য্য ও অপেক্ষারই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।
মারিও জোসেফ থামলে আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। মুখে একটু হাসি টেনে বলল, ‘লছমন কি বল, এদের সাথে যাওয়ার জন্যে রেডি?’
হাসান তারিকের ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘রেডি, তবে ঠিক সময়ে প্লেন আমাদের ধরতে হবে।’
‘শুনেছেন তো মি. এ্যান্টেনিও? আমাদের প্লেন ছাড়ার আর মাত্র ৪০ মিনিট বাকি। চলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক আগে আগে চলল। তাদের পেছনে মারিও জোসেফরা।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এল তারা।
গাড়ি বারান্দায় একটা পাজেরো জীপ এবং একটা মাইক্রো দাঁড়িয়েছিল।
দুগাড়ি ঘিরে লোকরা দাঁড়িয়েছিল।
মারিও জোসেফ সেখানে পৌছেই লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘দুজনকে দুগাড়িতে তুলে তোমরা ওঠ গাড়িতে।’ বলে মারিও জোসেফ নিজে গিয়ে জীপের ড্রাইভিং সিটে উঠল।
লোকরা আহমদ মুসাকে জীপে এবং হাসান তারিককে মাইক্রোতে তুলতে গেল।
আহমদ মুসার হাতে ছিল একটা হ্যান্ড ব্যাগ, হাসান তারিকের হাতেও একটা।
আহমদ মুসা জীপে ওঠার আগে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। বলল হাসান তারিককে লক্ষ্য করে, ‘লছমন, আমার ব্যাগটাও তোমার কাছে থাক।’
বলে আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে তার হাতের ব্যাগ হাসান তারিকের হাতে তুলে দিল। তারপর পেছন ফিরে জীপের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়ে মুখ পেছন দিকে ঘুরিয়ে হাসান তারিককে লক্ষ্য করে বলল, ‘লছমন, ব্যাগটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি। তুমি বন্ধ করো।’
‘ঠিক আছে। বুঝেছি।’ ওদিক থেকে বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল।
গাড়িতে উঠে বসেছে আহমদ মুসা।
দুটি গাড়ি ছুটে চলেছে শহরতলীর দিকে।
গাড়ি ষ্টার্ট দিতেই ওরা সব সিগারেট ধরিয়েছে। দুদিকের দুটি জানালা খুলে দেয়ার পরও গাড়ি ভরে গেছে সিগারেটের ধোঁয়ায়।
আহমদ মুসা প্রতিবাদ করল। বলল, ‘আপনারা গাড়িকে গ্যাস চেম্বার বানিয়ে ফেললেন, এটা কোন ভদ্রতা?’
আহমদ মুসার এ কথা নিয়ে ওদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা শুরু হলো। প্রথমেই মারিও জোসেফ বলল, ‘তাহলে বুঝুন হিটলার কতটা ভদ্র ছিল এবং তার গ্যাস চেম্বারগুলো কেমন ছিল!’
‘বস, সিগারেটের ধোঁয়াকে যে গ্যাস বলে তার পক্ষে হিটলারী গ্যাস সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব নয়।’ একজন বলে উঠল।
সে থামতেই আরেকজন বলল, ‘সিগারেটের ধোঁয়া যার কাছে গ্যাসের মত অসহ্য সে মুসলমান না হয়ে পারে না। আপনি ঠিকই সন্দেহ করেছেন বস।’
এই কণ্ঠ থামতেই আরেকজন বলে উঠল, ‘বস, একে আসল গ্যাস চেম্বারের স্বাদ পাইয়ে দিতে হবে।’
‘মনে হচ্ছে ঈশ্বর তোমাদের আশা পূরণ করবেন।’ বলল মারিও জোসেফ।
এইভাবে তাদের আলোচনা চলতেই থাকল।
আহমদ মুসার ঠোঁটে ফুটে উঠল আগের সেই হাসি। হাসিটা ধীরে ধীরে কঠিন এক সিদ্ধান্তে পরিণত হলো।
ঘড়ি দেখল আহমদ মুসা। দশ মিনিট গাড়ি চলেছে। তার মানে বিমান বন্দরে রিপোর্ট করার আর মাত্র ৩০ মিনিট বাকি।
আহমদ মুসা পকেট থেকে ‘মাউথ-নোজ গ্যাস কভার’ বের করল। এটা ক্ষুদ্রাকারের এক ধরনের গ্যাসমাস্ক। এর কার্যকারিতা পাঁচ দশ মিনিটের বেশি থাকে না।
রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা এবং বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আকস্মিক কোন গন্ধময় পরিবেশের সৃষ্টি হলে এটা ব্যবহার করা হয়।
আহমদ মুসা গ্যাসমাস্কটি পরে নিল।
হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল গাড়িতে।
মারিও জোসেফ বলে উঠল, ‘হেসো না, ফাঁসির আসামীও মুক্তির স্বপ্ন দেখে।’
গ্যাসমাস্কের সাথেই মার্বেলের মত কালো রংয়ের গ্যাসের ডিনামাইট বের করেছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার গ্যাসমাস্ক নিয়ে হাসি ঠাট্টারত কেউই এটা খেয়াল করেনি।
গ্যাস-ডিনামাইটের কালো শরীরের এক জায়গায় জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল একটা লাল বিন্দু। এটাই গ্যাস-ডিনামাইটের ট্রিগার পিন। পিনটি খুলে নিলেই গ্যাস-ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ ঘটে মানে গ্যাস-ডিনামাইটটি তার ভয়ংকর গ্যাস নিঃসরণ শুরু করে। এ গ্যাস-ডিনামাইট আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইটের মত সবকিছু ধ্বংস করে না, কিন্তু ছয় বর্গগজের মধ্যে কোন জীবনের অস্তিত্ব রাখে না। এ কারণেই জীবন ধ্বংসের এ নিরব-অস্ত্রকে ডিনামাইট নাম দেয়া হয়েছে।
হাতের মুঠোর মধ্যে লুকানো জীবন ধ্বংসী এ মারণাস্ত্রের ট্রিগার পিন খুলতে গিয়ে কেঁপে উঠল আহমদ মুসা। হৈ হুল্লোড়, হাসি ঠাট্টায় ব্যস্ত এ জীবন্ত মানুষগুলোর জীবন কি এতই সস্তা যে, আগামী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা ধ্বংস হয়ে যেতে পারবে! ওদের সুন্দর পৃথিবী, মমতায় গড়া ওদের পরিবার থেকে ওরা চিরতরে একেবারে বিনা নোটিশে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কেন! পরক্ষণেই আহমদ মুসার মন থেকে কে যেন বলে উঠল, পৃথিবীর মানব বাগান যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই ‘মহা তিনি’ই সৃষ্টির সাথে ধ্বংসকে একই সাথে জুড়ে দিয়েছেন। ভূমিকম্প, বন্যা, জলোচ্ছাস, ঝড়-সাইক্লোন-হ্যারিকেন, মহামারি এই ধ্বংসেরই এক একটি মহা অস্ত্র। আগাম নোটিশ দিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে এরা আসে না। আবার মন থেকেই আরেকজন বলে উঠল, হত্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধ্বংস তো এক জিনিস নয়। মন থেকে এরও উত্তর এল সংগে সংগেই। বলা হলো, গাছকে রক্ষার জন্যে আগাছা তো মানুষই ধ্বংস করে। না করলে আগাছাই গাছকে শেষ করে দেয়। মানব সমাজেও রয়েছে এ ধরনের অসংখ্য আগাছা। যারা আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এরা ষড়যন্ত্রকারী এবং সন্ত্রাসী নামের আগাছা, এদের হত্যা করতে না পারলে এরাই হত্যা করবে আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে। ওরা আহমদ মুসাকে আসল গ্যাস চেম্বারের স্বাদ পাইয়ে দিতে চায়। ওদের সুযোগ দিলে ওরা এটাই করবে। আর এ জালেমরা জুলুমের জিন্দানখানা সাও তোরাহ দ্বীপে যাবার পথে বাধা। এই আগাছাদের বিনাশ না হলে এক ইঞ্চিও আহমদ মুসা এগুতে পারবে না। শুধু তাই নয়, জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হবে অন্যায় দুর্বলতার।
আহমদ মুসা জেগে উঠল মুহূর্তের ভাবাবেগ থেকে। কঠোর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ।
ঠিক এই সময়েই মারিও জোসেফ বলে উঠল, ‘ডন সিলভাকে বলে দাও, আমরা অফিসে যাচ্ছি না। এসব ঝামেলা অফিসে নিয়ে লাভ নেই। সামনে পাইনের পার্কটায় যেতে বল। আর বলে দাও কথাবার্তায় সময় খরচ করার প্রয়োজন নেই। কাপড় খুলে দেখবে খাতনা আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে সোজা বুকে কয়েকটা গুলী ঢুকিয়ে দেবে। ব্যস।’ থামল মারিও জোসেফ।
তার থামার সাথে সাথেই জীপটা হঠাৎ বাঁক নিয়ে আরেকটা রাস্তায় প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা বুঝল তাদেরকে পাইনের পার্কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কঠিন একটা হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। গ্যাস- ডিনামাইট দুহাতের মুঠোতে নিয়ে খুলে ফেলল লাল পিনটা। তারপর সামনের সিটের নিচ দিয়ে কাল বলটা গড়িয়ে দিল সামনে।
এক সেকেন্ড, দুসেকেন্ড করে গড়িয়ে চলল সময়, ঠিক দশ সেকেন্ডের মাথায় গাড়ির ষ্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। ড্রাইভিং সিট থেকে মারিও জোসেফ দূর্বল তন্দ্রালূ কণ্ঠে বলল, ‘ডন, তুমি ড্রাইভিং সিটে এস, হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল শরীর।’
‘হঠাৎ এ রকম হলো কেন? মনে হচ্ছে আমার শরীর তোমার চেয়েও খারাপ। উঠে দাঁড়াবার শক্তি আমার নেই।’ টেনে টেনে দুর্বল কণ্ঠে বলল ডন।
‘কি বললে?’ তড়াক করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে চিৎকার করে বলে উঠল মারিও জোসেফ, ‘গুলী কর, খুন কর এই লোককে।’
বলে মারিও জোসেফ নিজেই পকেট থেকে রিভলবার বের করার চেষ্টা করল।
কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা পাশের ঝিমুনি আক্রান্ত লোকটির হাত থেকে ষ্টেনগান কেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যে যেখানে যেভাবে আছ বসে থাক। একটু বেয়াদবী করলে মরবে গুলী খেয়ে।’
বলে আহমদ মুসা পিছু হটে গাড়ি থেকে নেমে এল। বন্ধ করে দিল গাড়ির দরজা।
পেছনের গাড়িটা প্রায় এসে পড়েছে। আহমদ মুসা তার ষ্টেনগান তুলল গাড়িটাকে লক্ষ্য করে।
সংগে সংগে গাড়ি থেকে চিৎকার শোনা গেল, ‘ভাইয়া, গুলী করবেন না। আমি গাড়ি চালাচ্ছি।’
আহমদ মুসা ষ্টেনগানের ব্যারেল নিচে নামিয়ে ট্রিগার থেকে তর্জনি সরিয়ে নিল। বলল সেই সাথে চিৎকার করে, ‘ভেতরের খবর কি?’
‘সবাই ঘুমিয়েছে কিংবা…………।’ হাসান তারিক কথা শেষ না করেই থেমে গেল।
গাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি নেমে ছুটে এল হাসান তারিক। ফিসফিস করে বলল, ‘ভাইয়া, খোলা ব্যাগের মাধ্যমে আপনি যে মেসেজ দিয়েছিলেন, তা সংগে সংগেই আমি বাস্তবায়ন করেছি।’
‘ধন্যবাদ হাসান তারিক। আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম যে, তুমি বিষয়টা তাড়াতাড়ি ধরে ফেলতে পারবে কিনা। আলহামদুলিল্লাহ।’
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত জীপের কাছে এল। নিজের মুখের গ্যাসমাস্ক ভালোভাবে মুখে-নাকে সেট হয়ে আছে কিনা দেখে জীপের দরজা খুলে ফেলল। এগুলো লাশের দিকে। পাশে এসে দাঁড়াল হাসান তারিক। দুজনে লাশগুলো রাস্তায় নামিয়ে ফেলল।
‘হাসান তারিক, ব্যাগগুলো নিয়ে এস তোমার মাইক্রো থেকে।’ বলে আহমদ মুসা এগুলো জীপের ড্রাইভিং সিটের দিকে।
হাসান তারিক মাইক্রো থেকে দুটি হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে এসে আহমদ মুসার পাশের সিটে উঠে বসল।
আহমদ মুসা গাড়ি ষ্টার্ট দিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করার আর মাত্র ২৫ মিনিট বাকি হাসান তারিক।’
‘ইনশাআল্লাহ আমরা ঠিক পৌছে যাব ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘কিন্তু সামনে গিয়ে এ গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে কোন ট্যাক্সি-ম্যাক্সি নিতে হবে হাসান তারিক। এ গাড়িটা পুলিশের পরিচিত হবে নিশ্চয়। সুতরাং এ গাড়ি এয়ারপোর্টে নেয়া যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া। এয়ারপোর্টে কি কোন ঝামেলা হতে পারে? কি ভাবছেন আপনি?’ বলল হাসান তারিক।
‘মুসলমানদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়া বন্ধ। কোনভাবে ওরা সন্দেহ করেছে আমরা মুসলমান, ওরা নিশ্চিত হবার জন্যেই আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা আহমদ মুসা ও হাসান তারিক এটা ওরা জানে না। সুতরাং এয়ারপোর্টে নতুন কোন ঝামেলা হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া যে নাম আমরা এ্যান্টোনিওদের বলেছি, সে নামে আমাদের টিকেট নয়। টিকেটে আমাদের পর্তুগীজ-স্পেনীয় নাম রয়েছে। আর পর্তুগীজ পড়তে না পারলেও পর্তুগীজ ভাল বলতে পারি আমরা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার কথা সত্য হোক ভাইয়া। আমাদের যাত্রার অবশিষ্ট সময় আল্লাহ নিরুপদ্রব করুন।’ বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসার গাড়ি সেই রোডে উঠে আসার পর কিছু দূর এগিয়ে একটি ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ড দেখে জীপটি রাস্তার পাশে ছেড়ে দিয়ে আহমদ মুসারা নেমে পড়ল।
তারপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটল লিসবন এয়ারপোর্টে।
আজোরস দ্বীপপুঞ্জের টেরসিয়েরা দ্বীপের ‘লিজে’ এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কাউন্টার।
কাউন্টারে আহমদ মুসা এবং তার পেছনে হাসান তারিক দাঁড়িয়ে।
ইমিগ্রেশন অফিসার আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের পাসপোর্ট নাড়াচাড়া করে বলল, ‘আপনাদের টিকেট দেখি।’
আহমদ মুসা তার হাতে দুটি টিকেট তুলে দিল।
লোকটি টিকেটের পাতা উল্টিয়ে দেখল। তারপর বলল, আপনাদের কার নাম রুইজর্জ এবং কার নাম পেড্রো পোর্টিট?
‘আমি রুইজর্জ, আর ও পেড্রো পোর্টিট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাদের নাম পর্তুগীজ, কিন্তু আপনারা তো এশিয়ান?’ অফিসার লোকটি বলল।
‘পর্তুগালে আফ্রিকান, রাশিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের লোক বাস করে। তাদের সাথে অনেক এশিয়ানও।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘তা ঠিক।’ অনেকটা বিব্রত কণ্ঠেই বলল অফিসার লোকটি।
একটা দম নেবার পরই সে আবার বলে উঠল, ‘আচ্ছা আপনারা রবিন সিং রাফায়েল ও লছমন লিওনার্দো নামের দুএশিয়ানকে চেনেন?’
আহমদ মুসা মনে মনে আঁৎকে উঠল এই ভেবে যে, ‘লিসবনের তাদের সব খবরই তাহলে আজোরস-এ পৌছে গেছে।’
কিন্তু আহমদ মুসার এই আঁৎকে উঠা ভাব মুখের চেহারায় সামান্যও প্রকাশ পেল না। অফিসার লোকটি থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘না, এমন নামের কাউকে আমরা চিনি না। ওরা এই বিমানে যাবে কিনা সেটা যাত্রীদের তালিকা দেখলেই তো জানা যায়।’
‘ওরা খুব সাংঘাতিক লোক এবং মুসলমান। যাত্রী তালিকায় ঐ দুজনের নামে কোন যাত্রী নেই। নিশ্চয় ওরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে ছদ্মনাম ব্যবহার করছে। কোন ছদ্মনাম নিয়েই ওরা প্লেনে উঠেছে।’ বলল অফিসার লোকটি।
থেমেই আবার বলে উঠল লোকটি আহমদ মুসাদের পাসপোর্ট ও টিকিট ফেরত দিতে দিতে, ‘যাই হোক। সন্দেহ করে তো আমরা সব লোককে হেনস্তা করতে পারি না। আপনারা যান। ধন্যবাদ।’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাসপোর্ট ও টিকিট নিয়ে ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে লাগেজ লাউঞ্জে প্রবেশ করল।
হাসান তারিক আহমদ মুসাকে ফিসফিস করে বলল, ‘ইমিগ্রেশন অফিসারটি নেহায়েত ভদ্রলোক। আমি তো ভাবছিলাম, উনি বলে বসবেন যে, আপনাদের নাম পরিচয় যে ঠিক তা প্রমাণের জন্যে আসুন আপনাদের ফিজিক্যাল টেষ্ট দিতে হবে। প্রমাণ করতে হবে আপনারা মুসলমান নন।’
‘দেখলে না লোকটার চেহারা? সে খাঁটি পর্তুগীজ নয়। ‘আজোরী’ সে। মানে আজোরসের মানুষ সে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজোরী’রাও পর্তুগীজ?’ বলল হাসান তারিক।
‘পর্তুগীজ নয়, মিক্সড পর্তুগীজ। পর্তুগীজরা যখন এই বিজন দ্বীপপুঞ্জ দখল ও বসতি গড়ে, তখন তারা প্রচুর স্প্যানিশকে এখানে নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে নর্থ আমেরিকান আদিবাসি এবং এস্কিমোরাও বেশ সংখ্যায় নানাভাবে এখানে এসে ছিটকে পড়ে। সব মিলিয়ে ‘আজোরী’রা একটি মিশ্র জাতি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই হবে। কিন্তু ভাইয়া, এই যে ফাঁড়াটা কাটল, এটাই শেষ ফাঁড়া নয় বলে মনে হচ্ছে।’ বলল হাসান তারিক।
‘কোন সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে হাসান তারিক। ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি (WFA) নিশ্চিত যে, হোটেলে আমাদের ধরতে যাওয়া দুগাড়ির লোকদের হত্যা করে আমরা বিমানে উঠেছি লিসবন থেকে আজোরসের ‘লিজে’ আসার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে তো প্রকৃত বিপদ আমাদের জন্যে বাইরে অপেক্ষা করছে!’ বলল হাসান তারিক।
‘ঠিক অনুমান করেছ হাসান তারিক!’ আহমদ মুসা বলল।
হাসান তারিক থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘বেরুবার আগে তো কিছু তাহলে ভাবতে হয়। আসুন একটু দাঁড়ানো যাক।’
আহমদ মুসাও দাঁড়িয়ে পড়ল।
মুখোমুখি হলো দু’জন।
‘ঠিক বলেছ হাসান তারিক। একটু ভাবা প্রয়োজন। তবে বিকল্প কিছু করার সুযোগ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না।’
‘কেন?’ বলল হাসান তারিক।
‘বিমান বন্দর থেকে বেরুবার একটাই পথ এবং সে পথটাই যদি ওরা আগলে থাকে!’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে শুরুতেই তো সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হবে!’ বলল হাসান তারিক।
‘কিন্তু আমরা সহজেই চিহ্নিত হয়ে যাব, এমন সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে আমাদের মিশনের ক্ষতি হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও তাই ভাবছি ভাইয়া। কিন্তু বিকল্প নেই আপনিই তো বললেন।’ বলল হাসান তারিক।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘হয়তো আমরা বেশি বেশিই ভাবছি। হয়তো কেউ আমাদের পথ আগলে নেই।’
‘যদি থাকে তাহলে কি হবে, সেটাই তো আলোচনার বিষয়।’ হাসান তারিক বলল।
‘যে বিষয়ের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, এসব বিষয় নিয়ে আর ভেবে কি হবে। রণাঙ্গনই বলে দিবে সৈনিকের ভূমিকা কি হবে। এস, অন্য বিষয়ে একটু ভাবি।’ বলে আহমদ মুসা লাউঞ্জের একটা চেয়ারে গিয়ে বসল।
হাসান তারিক গিয়ে বসল তার পাশে।
আহমদ মুসা ব্যাগের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। কাগজটা একটা মানচিত্র। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের একটা মানচিত্র।
মানচিত্রটি আহমদ মুসা সামনে মেলে ধরল। হাসান তারিকও তার উপর চোখ রাখল।
মানচিত্রের উপরের অংশে একটা দ্বীপের উপর আঙুল রেখে বলল, ফ্লোরেস দ্বীপের উত্তরে এটা করভো দ্বীপ। প্রফেসর জ্যাক সাইমনের বক্তব্য অনুসারে এই দ্বীপের কয়েক মাইল দূরে সাও তোরাহ দ্বীপ। করভোর উত্তরে যে সাদা বিন্দুটা দেখা যাচ্ছে, এটা সাও তোরাহ হতে পারে। এই দ্বীপের সবচেয়ে কাছের শহর হলো ফ্লোরেস দ্বীপের ‘সান্তাক্রুজ’। আমার মনে হয় সাও তোরাহ দ্বীপের সবচেয়ে কাছের শহর হিসেবে এর উপর WFA এর খুব বেশি দৃষ্টি থাকবে এখন। সুতরাং এখানে সাও তোরাহ দ্বীপ নিয়ে আলোচনা করা নিরাপদ হবে না। এই কারণে আমি মনে করি, সাও তোরাহ দ্বীপের পরবর্তী নিকটতম শহর হলো সান্তাক্রুজ। সান্তাক্রুজের সোয়াশ’ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে পিকো দ্বীপের ‘হারতা’ শহর। এই হারতা শহরকেই আমরা আপাতত বেজ করতে পারি। এখান থেকে সব খবরাখবর নিয়ে প্রস্তুত হয়ে পরবর্তী বেজ হিসাবে আমরা সান্তাক্রুজে যেতে পারি।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘হারতা এবং সান্তাক্রুজ সম্পর্কেও তো আমাদের কিছু জানা প্রয়োজন।’
‘হ্যাঁ, হাসান তারিক। সেটা করতে হবে। পর্তুগীজ ইয়ারবুক থেকে কিছু জানা গেছে। ওটা তুমি একটু দেখে নিও। ‘লিজে’ থেকে আমরা কিছু ট্যুরিষ্ট লিটারেচার যোগাড় করতে পারব। সেখান থেকেও কিছু জানা যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার সে বলে উঠল, ‘আমরা আপাতত একটা টাইম সিডিউল এ ধরনের করতে পারি যে, খোঁজ-খবরের জন্যে ‘লিজে’তে তিন দিন কাটিয়ে ৪র্থ দিনে আমরা ‘হারতা’তে পৌছব এবং হারতা গিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা করব।’
‘হারতা গিয়ে কোথায় উঠব, এ সম্পর্কে আমরা কোন চিন্তা করব কিনা। ছোট শহরের হোটেলগুলো আমার মতে নিরাপদ নয়।’ বলল হাসান তারিক।
‘তুমি ঠিকই বলেছ হাসান তারিক। ফাইনালী কি হবে আমি জানি না। তবে আপাতত চিন্তা করেছি, হারতার ক্যাথলিক গীর্জার অতিথিশালায় উঠব। আমি ইয়ারবুকে দেখেছি, ‘হারতা সেন্টপল’ গীর্জার বিশাল অতিথিশালা সবার জন্যেই উন্মুক্ত।’ আহমদ মুসা বলল।
খুশি হলো হাসান তারিক। বলল, ‘ক্যামোফ্লেজটা ভালোই হবে ভাইয়া।’
‘এস এবার উঠি।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকও উঠল।
চলল তারা ডিপারচার লাউঞ্জের দিকে।
লাউঞ্জ থেকে বের হবার দরজার পাশে একটা সুদৃশ্য কাউন্টার। কাউন্টারের এক প্রান্তে বিলবোর্ডে একটি বিজ্ঞপ্তি। বলা হয়েছে, এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। যৌক্তিক ভাড়া ও বিশ্বস্ততার প্রতীক আজোরস ন্যাশনাল কোম্পানী।’
বিলবোর্ডটি পড়ে আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বর্তমান অবস্থায় বিশ্বস্ত গাড়ি পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আহমদ মুসা হাসান তারিককে কানে কানে বলল, ‘কাউন্টারে যাও। এদের থেকেই গাড়ি ভাড়া কর। বাইরে গিয়ে গাড়ি ভাড়া করার ঝুঁকি নেয়া যাবে না।’
হাসান তারিক কাউন্টারে গেল। গাড়ি ভাড়া হয়ে গেল। তাদের নিজস্ব কমিউনিকেশন নেট ওয়ার্কের মাধ্যমে বলে দেয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভার লাউঞ্জে ঢুকল এবং আহমদ মুসাদের ‘ওয়েলকাম’ করে গাড়িতে নিয়ে গেল।
প্লেন থেকে নামার পর থেকেই আহমদ মুসার দুচোখ সতর্ক ছিল। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেই গাড়িতে উঠে বসল।
‘স্যার কোথায়?’ ড্রাইভিং সিটে বসে ষ্টিয়ারিং-এ হাত রেখে বলল ড্রাইভার।
আহমদ মুসার চিন্তা করাই ছিল। বলল, ‘গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে চল।’
‘লিজে’ এয়ারপোর্টের বিপরীত দিকে শহরের সাগর প্রান্তে একটা ছোট পাহাড়ের উপর এই হোটেলটি। লিজে এয়ারপোর্ট থেকে দীর্ঘ সরল এক পথ পেরিয়ে ‘লিজে’ শহরে প্রবেশ করতে হয়। তারপর শহর পেরিয়ে ছোট একটা পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড় শীর্ষের ‘গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল’ হোটেলে পৌছতে হয়। বেশ দীর্ঘ পথ। খুশিই হলো ড্রাইভার। তার মুখ দেখা গেল প্রসন্ন।
গাড়ি ষ্টার্ট নিয়েছে। চলছে গাড়ি।
গাড়ি তখন বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
হাসান তারিক আহমদ মুসার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘যাত্রার শুরুটা বোধ হয় ভালোই হলো ভাইয়া।’
‘তোমার কথা সত্য হলে ভালো। কিন্তু আমার অন্য রকম মনে হচ্ছে। ডিপারচার লাউঞ্জে একজন ক্রিমিনাল চেহারার লোক সর্বক্ষণ আমাদের উপর চোখ রেখেছে। আমরা বের হয়ে এলে সেও বেরিয়ে একটা সাদা গাড়িতে চড়েছে। এছাড়া কার-পার্কেও আরেকটা সাদা গাড়ির আরেকজন লোকের দুচোখ আঠার মত গেঁথে ছিল আমাদের উপর। আমাদের গাড়ি ষ্টার্ট নিলে সেই গাড়িকেও ষ্টার্ট হতে দেখেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকের মুখ ম্লান হয়ে গেল। তাকাল সে পেছন দিকে। বোধ হয় সেই দুটি সাদা গাড়ি পিছু নিয়েছে কিনা তা দেখার জন্যে। কিন্তু পেছনে গাড়ির সারি। অধিকাংশই সাদা গাড়ি। হতাশ হয়ে চোখ দুটি ফিরে এল হাসান তারিকের।
কিন্তু শহর পেরিয়ে পার্বত্য পথে প্রবেশের পর সন্দেহ আর থাকলো না। দুটো সাদা গাড়িকে দেখা গেল আহমদ মুসার গাড়ির সমান গতিতে ছুটে আসছে। আহমদ মুসা ড্রাইভারকে বলে গাড়ির গতি বাড়িয়ে কমিয়ে নিশ্চিত হলো যে, গাড়ি দুটো তাদেরকেই অনুসরণ করছে।
আহমদ মুসা পরিস্থিতিটা ড্রাইভারকে জানানো ও তার মনোভাব জেনে নেয়ার জন্যে বলল, ‘ড্রাইভার, দুটো গাড়ি দেখছি আমাদের ফলো করছে।’
‘স্যার, আপনাদের কোন শত্রু আছে?’ বলল ড্রাইভার। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘এদেশে আমরা বেড়াতে এসেছি। থাকতে পারে। কিন্তু ওরা সরকারের কেউ কিংবা ডাকাত-টাকাত নয়তো?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, সরকারী নয়। সরকারের কোন ব্যাপার হলে সেটা বিমান বন্দরেই ঘটত। আর এ ধরনের ডাকাতও আমাদের আজোরসে নেই। স্যার, হতে পারে আপনাদের কোন শত্রু পর্তুগাল থেকেই আপনাদের অনুসরণ করছে।’ বলল ড্রাইভার।
‘তাহলে এখন কি করা যায় ড্রাইভার?’ আহমদ মুসা বলল।
‘চিন্তা নেই স্যার। গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল হোটেল। ওখানে শক্তিশালী পুলিশ ষ্টেশন আছে। আমরা ঠিক হোটেলে পৌছে যাব, ওরা আমাদের ধরতেই পারবে না।’ বলল ড্রাইভার।
পার্বত্য পথে আরও কিছুটা এগুলো আহমদ মুসাদের গাড়ি।
ঝোপে ঢাকা টিলার একটা বাঁক ঘুরতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল দুশ গজের মত দূরে একটা মাইক্রো ও একটা জীপ তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে তাকাল সে। দেখল পেছনে ছুটে আসা দুটি গাড়ির সাথে আরেকটি গাড়ি যোগ হয়েছে।
ড্রাইভার বিষয়টা খেয়াল করেছে। গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে সে। তার চোখে ভয়ের ছাপ। বলল সে, ‘সর্বনাশ স্যার! ওরা দুদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।’
আহমদ মুসাদের গাড়ির সামনেই রাস্তার একটা ত্রিমোহনী। হোটেলগামী রোড থেকে আরেকটা রাস্তা বেরিয়ে পার্বত্য এলাকার মধ্যে দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে।
রাস্তাটির দিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসা ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘পশ্চিম এ রাস্তাটা কোথায় গেছে ড্রাইভার?’
‘স্যার, পার্বত্য এলাকা ছাড়িয়ে রাস্তাটা আমাদের এ দ্বীপের একমাত্র বীচ পর্যন্ত গেছে। সেখানে মনোরম একটা ট্যুরিষ্ট স্পট আছে।’
‘ড্রাইভার গাড়িটা পশ্চিমের ঐ রাস্তায় নাও।’ নির্দেশের স্বরে বলল আহমদ মুসা।
‘ওদিকে তো কোন আশ্রয় নেই স্যার। মাত্র ট্যুরিষ্ট স্পটে একটা পুলিশ ষ্টেশন আছে। সে তো অনেক দূরে?’
‘ভয় করো না ড্রাইভার, তোমার এবং তোমার কোম্পানীর কোন ক্ষতি হবে না। তুমি গাড়ি ঘুরিয়ে নাও।’ এবার দৃঢ় কণ্ঠে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে পশ্চিমের রাস্তায় চলতে শুরু করল।
একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে, ‘শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করার চাইতে শত্রুর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করাই উচিত নয় কি ড্রাইভার?’
‘অবশ্যই স্যার। কিন্তু শত্রুদেরকে খুব প্রবল দেখছি। স্যার, ওরা কারা আন্দাজ করতে পারেন?’ ড্রাইভার বলল।
‘বন্দী কিছু লোককে আমরা উদ্ধার করতে চাই। হতে পারে আটককারী দলের ওরা কেউ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বন্দীরা কে স্যার?’ বলল ড্রাইভার।
‘নিরপরাধ লোক। ওদের মুখ বন্ধ করার জন্যে ওদের অপহরণ করা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বন্দীরা কি আপনাদের আত্মীয়?’ ড্রাইভার বলল।
‘না। অন্যায়ের প্রতিবিধান করতেই আমরা ওদের সাহায্য করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
ড্রাইভারের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কপাল তার কুঞ্চিত।
আর কোন কথা বলল না সে।
আহমদ মুসা তখন অন্য কাজে মনোযোগ দিয়েছে। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে চাবি বের করে লাগেজে করে আনা ব্যাগটা টেনে নিয়ে খুলে ফেলল। বের করল প্লাষ্টিক কনটেইনার থেকে তার এম-১০ মেশিন রিভলবার।
প্লাষ্টিক কনটেইনারটি বিশেষভাবে তৈরি। ‘এক্সরে’ বা কোন ‘রে’ ফেললে এর ভেতরকার কিছু দেখা যায় না। ‘রে’ ফেললেই কনটেইনারটি আয়নার মত স্বচ্ছ একটা ছবি উপহার দেয়। এই কনটেইনারে করেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তাদের অস্ত্র নিয়ে এসেছে।
হাসান তারিকও তার অস্ত্র বের করে নিয়েছে।
এক জায়গায় এসে হঠাৎ ড্রাইভার হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাল।
‘কি হলো ড্রাইভার?’ বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘স্যার, ইঞ্জিন ট্রাবল দিচ্ছে। দেখছি আমি।’ বলে ড্রাইভার দ্রুত ষ্টার্টার থেকে চাবির রিং খুলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করে ইঞ্জিনের দিকে এগুলো। তারপর ইঞ্জিনের টপটা খুলে ফেলে দাঁড় করিয়ে দিল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তখন ব্যস্ত পেছনটা দেখতে।
পেছনে ছুটে আসা গাড়ি ৫টি কত দূরে আছে সেটা আন্দাজ করতে চেষ্টা করছিল।
বেশ সময় পার হয়ে গেল।
ইঞ্জিনের দিক থেকে কোন শব্দ না পেয়ে আহমদ মুসা সামনে তাকাল। কিন্তু ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করার কোন শব্দ সে শুনতে পেল না। তাছাড়া ড্রাইভারকেও দেখতে পেল না।
গাড়ির জানালা খুলে দেখার চেষ্টা করল আহমদ মুসা। কিন্তু গাড়ির জানালা খোলা গেল না। লক করা। দরজা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু দেখল দরজাও লক করা।
চমকে উঠল আহমদ মুসা।
দ্রুত সে এগিয়ে ড্রাইভারের দরজায় নব ঘুরাতে চেষ্টা করল। ঘুরল না।
‘হাসান তারিক, ড্রাইভার পালিয়েছে এবং সেই সাথে সে আমাদেরকে বন্দী করে রেখে গেছে।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
বিদ্যুতস্পৃষ্টের মত ঘুরল হাসান তারিক। বলল, ‘এ জন্যেই সে চাবি নিয়ে নেমে গেছে।’
আহমদ মুসা পেছনটা দেখে জানালার কোণা দিয়ে সামনের দিকটা দেখার চেষ্টা করে বলল, ‘হাসান তারিক, সামনে থেকেও দুটি গাড়ি আসছে। দুতিনশ গজের বেশি দূরে নয় ওরা। পেছনের পাঁচটা গাড়িও দুএকমিনিটের মধ্যে এসে পড়বে।’
‘তার মানে লক করা গাড়িতে আমরা বন্দী হয়ে পড়েছি।’ বলেই হাসান তারিক তার মেশিন রিভলবারটা তাক করল জানালা গুড়ো করে দেবার জন্যে।
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে দ্রুত বলল, ‘গুলী নয়, বাট দিয়ে ভেঙে ফেল। গুলীর শব্দ করে আমাদের অবস্থা ওদের জানাতে চাই না।’
হাসান তারিক মেশিন রিভলবারের বাঁট দিয়ে ভেঙে ফেলল জানালা।
ভাঙা জানালা দিয়ে ব্যাগগুলো আগে বাইরে ফেলে দিয়ে হাসান তারিক ও আহমদ মুসা বাইরে বেরিয়ে এল।
বের হয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘যতদূর ধারণা করি উত্তর দিকে কিছু দূরেই সাগর আর দক্ষিণে পার্বত্য এলাকা পার হলে পাওয়া যাবে বনাঞ্চল, তারপর লোকালয়। কোন দিকটা আমরা বেছে নেব হাসান তারিক?’
‘আমার মতে দক্ষিণ দিক ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক গাড়ি ঘুরে গাড়ির দক্ষিন পাশে এসে দ্রুত রাস্তা থেকে নেমে একটা টিলার আড়াল নিয়ে দক্ষিন দিকে এগুলো।
দুদিক থেকে গাড়িগুলো তখন এসে পড়েছে।
আহমদ মুসাদের গাড়ির সামনে ও পিছনে দাঁড়াল ৭টি গাড়ির একটি বহর।
৭টি গাড়ি থেকে নামল ৪০ জনের একটি বিরাট দল। তাদের সাথে দুটি শিকারী কুকুর।
জীপ থেকে নেমে আসা দীর্ঘদেহী ঋজু শরীরের এবং উত্তেজিত চেহারার একজন লোক আহমদ মুসাদের গাড়ির ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে ভাঙা জানালা দেখে সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, ‘কোন দিকে গেছে দেখ। শয়তানদের কিছুতেই পালাতে দেয়া যাবে না।’
দুটি কুকুর ধরে রাখা দুজন লোক তাদের হাতের ইনভেলাপ থেকে দুখন্ড কাপড় বের করে কুকুর দুটিকে দিয়ে তা শুকিয়ে নিল এবং কুকুর দুটিকে বেঁধে রাখা দড়ির শেষ প্রান্ত ধরে রেখে পুরো দড়ি ছেড়ে দিল।
সংগে সংগেই কুকুর দুটি গাড়ি ঘুরে উত্তর পাশ থেকে দক্ষিণ পাশে গিয়ে ছুটতে শুরু করল দক্ষিণ দিকে। কুকুরের দড়ি ধরে রাখা লোক দু’জনও ছুটল তার সাথে। অবশিষ্ট আটত্রিশজনও তাদের পিছনে চলতে লাগল।
সেই লম্বা লোকটির নেতৃত্বে ওরা চলছে অস্ত্র বাগিয়ে জংগল যুদ্ধের ফরমেশন নিয়ে।
পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে পথহীন পার্বত্য ভূমির উপর দিয়ে আহমদ মুসারাও চলছিল।
পার্বত্য ভূমি চড়াই-উৎরাই, পাহাড়ের টিলা, খাড়া ও গভীর উপত্যকা এবং গাছ ও ঝোপ-জংগলে ভরা। পথ চলা খুব কঠিন। কিন্তু খুশি হলো আহমদ মুসা। এই পরিবেশে WFA-এর লোকরা তাদের খুঁজে পাবে না। আহমদ মুসা চিন্তা করল, তারা জংগলের দিকে না গিয়ে পুবে ‘লিজে’ শহরের দিকে হাঁটা শুরু করতে পারে। কিন্তু আবার ভাবল, শত্রুদের গতিবিধি সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে শহরমূখী হওয়া তাদের ঠিক হবে না।
প্রায় ১ ঘন্টা চলার পর একটা উচ্চভূমির উপর বসল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক।
উচ্চ ভূমিটা সমতল। ঝোপ ও বড় বড় গাছ-গাছড়ায় ভরা। বিশাল উচ্চ ভূমিটা পুরাকীর্তির কোন গড়ের মত। এই গড়টারই উত্তর প্রান্তে এসে বসেছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক। এখানে বসে পেছনে ফেলে আসা পার্বত্য অঞ্চলটার উপর চোখ রাখা যাচ্ছে। ওরা ফলো করছে না ফিরে গেছে এটা খুব জানা দরকার।
আহমদ মুসার এ চিন্তায় ছেদ পড়ল হাসান তারিকের কথায়। সে বলছিল, ‘ভাইয়া, আমরা কাক ডাকা ভোরে খালি পেটে বেরিয়েছি। খাবার বিষয়টাও আমাদের ভাবনায় রাখা যায়।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ হাসান তারিক। আমিও পেটকে বুঝাতে পারছি না। কিন্তু কি খাবে? ব্যাগের পকেটে আছে বিমান থেকে পাওয়া মাত্র কয়েকটা চকলেট।’
বলে আহমদ মুসা চকলেটগুলো বের করে হাসান তারিককে দিল, নিজেও নিল।
চকলেট মুখে দিয়ে হাসান তারিক বলল, ‘ভাইয়া বুঝতে পারছি না, সাত গাড়ি লোক গেল কোথায়! আমাদের ফলো না করে ওরা ফিরে যাবে এটা কি স্বাভাবিক?’
‘না, স্বাভাবিক নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ হতেই আহমদ মুসার কানে এল একটা অপ্রত্যাশিত শব্দ। একটা কুকুরের কণ্ঠ শব্দ তুলতে গিয়েও আকস্মিকভাবে রুদ্ধ হয়ে গেল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা।
হঠাৎ একটা চিন্তা তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। ওরা কি কুকুর নিয়ে এগুচ্ছে? ওরা কি আহমদ মুসাদের দেখতে পেয়েছে? উৎসাহী কুকুরকে সামলাবার জন্যেই কি ঐভাবে তার মুখ চেপে ধরতে হয়েছে?
এই চিন্তা তার মাথায় আসার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘হাসান তারিক, তাড়াতাড়ি আড়াল নাও। সম্ভবত আমরা শত্রুর চোখে পড়ে গেছি।’
বলে আহমদ মুসা নিজেও দ্রুত গড়িয়ে উচ্চভূমির প্রান্ত থেকে একটু ভেতরে সরে এল।
হাসান তারিকও গড়িয়ে একটা ঝোপের আড়ালে চলে এসেছে।
আড়ালে এসেই হাসান তারিক ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘কি ব্যাপার ভাইয়া?’
‘আমি একটা কুকুরের অসমাপ্ত চিৎকার কানে শুনেছি। কেউ কুকুরের চিৎকারকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমাদের শত্রুরা কুকুরের দিক-নির্দেশনায় নিঃশব্দে আমাদের খুব কাছে এসে পৌছেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দুঃখিত, কুকুরের চিৎকারটা আমি খেয়াল করিনি। শব্দ কোন দিক থেকে এসেছে ভাইয়া?’ হাসান তারিক বলল।
‘উত্তর দিক। একদম এই সামনে থেকে। আমার মনে হয়, এই উচ্চভূমি যেখান থেকে উঠে এসেছে সে পর্যন্ত ওরা পৌছে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে ওরা এখন এই হাইল্যান্ডে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ হাসান তারিক বলল।
‘আমার মনে হয় কুকুরকে অনুসরণ করে আমাদের হাতের মুঠোয় পাওয়া পর্যন্ত ওরা নিরবে এগুবে এবং তারপর আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা কি করব এখন? আমরা কি আরও সামনে সরে যাব?’ হাসান তারিক বলল।
‘ওরা চায় আমাদেরকে ওদের টার্গেটের মধ্যে নিতে। আর আমরা চাইব ওদেরকে আমাদের টার্গেটের মধ্যে আনতে। এদিক থেকে আমরা যেখানে রয়েছি, সেটা আমাদের জন্যে ভালো জায়গা। আমাদের এ উচ্চভূমি থেকে যে ঢাল ওদের দিকে নেমে গেছে তা খুব ফ্ল্যাট এবং উন্মুক্ত। ছোট দুচারটা গাছ-গাছড়া ও ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। এই ঢালে তারা আত্মগোপনের কোন সুযোগ পাবে না এবং এই ঢাল দিয়েই তাদের উঠে আসতে হবে। পূর্ব দিকে উচ্চভূমির সাথে পাহাড় যুক্ত হয়েছে। ওদিক দিয়ে আসতে পারছে না। ঢাল ঘুরে পশ্চিম দিক হয়ে তাদের আসার কোন যুক্তি নেই। কারণ আমরা তাদের সম্বন্ধে জানতে পেরেছি এটা তারা জানে না এবং স্বাভাবিকভাবে কুকুর তাদের এই পথেই নিয়ে আসবে।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসান তারিক হাসল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাদের উপযুক্ত জায়গায় এনে ওদের মুখোমুখি করেছেন।’
আহমদ মুসা ঢালের প্রান্ত বরাবর এলাকা পর্যবেক্ষণ করে মাঝামাঝি জায়গায় একটা উঁচু স্থান দেখতে পেল। উঁচু জায়গাটা ঢালের একদম প্রান্তে বেদীর মত দেখতে এবং ওটা পরিকল্পিতভাবে তৈরি মনে হলো তার কাছে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক ক্রলিং করে গিয়ে উঠল সেই বেদিতে। আহমদ মুসারা বেদিতে উঠতেই বিরাট আকারের দুটি বড় সাপ বেদি থেকে নেমে গেল।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, বেদির মেঝেটা পাথরের। পাথরের জোড়াগুলো দিয়ে গাছ-গাছড়া উঠে পাথরগুলো ঢেকে দিয়েছে। বেদির উপর দুটি পাথরের বাটি। বাটিগুলো ভেজা দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। চারদিকে চাইল।
বেদির উত্তর প্রান্তে অবস্থান নিল আহমদ মুসারা। তারা খুশি হলো যে, গোটা ঢালটাই তাদের নজরে আসছে। অবশ্য ঢালের পশ্চিম প্রান্ত দক্ষিণ দিকে বেঁকে গেছে বলে শেষটা দেখা যাচ্ছে না।
বেশিক্ষণ বসতে হলো না আহমদ মুসাদের। দেখা গেল, ঠিক তাদের সোজাসুজি জংগলের ভেতর থেকে ঢালের গোড়ায় উঠে এল দুজন লোক। তাদের সামনে দুটি কুকুর। কুকুর দুটির দড়ি তাদের হাতে। কুকুর দুটি ডবলমার্চের ভংগিতে দৌড়াচ্ছে।
কুকুর স্কোয়াডের পরই বেরিয়ে এল মূল বাহিনী। হাতে ষ্টেনগান, কোমরে পিস্তল সজ্জিত বিরাট একটা দল। সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০এর মধ্যে হবে বলে অনুমান করল আহমদ মুসা। রীতিমত যুদ্ধের আয়োজন। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মেশিন রিভলবার প্রস্তুত।
আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘ওরা ঢালের মাঝ বরাবর আসার আগে আমরা গুলী করব না।’
ওরা ঢালের মাঝ বরাবর এসে গেছে।
আহমদ মুসা তার এম-১০ মেশিন রিভলবার ডান হাতে রেখে বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে আরও একটা রিভলবার বের করে ওদের মাথার উপর দিয়ে গুলী করল। সংগে সংগেই ওদের কয়েক ডজন ষ্টেনগান ও রিভলবার এক সাথে গর্জন করে উঠল আহমদ মুসার রিভলবারের শব্দ লক্ষ্যে। কিন্তু তাদের গুলীগুলো প্রায় ৪০ ডিগ্রী কোণে মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
ওদের গুলীর প্রথম ধাপ আহমদ মুসাদের অতিক্রম করার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মেশিন রিভলবার গর্জন করে উঠল এবং ঘুরতে লাগল দলটির উপর দিয়ে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। দলটির সবাই ভূমি শয্যা নিল।
কয়েকটি দেহ ঢাল বেয়ে গড়িয়ে জংগলে ঢুকে গেল।
অন্যগুলো নির্জীব পড়ে থাকল ঢালের উপর।
ঢাল থেকে দেহগুলো জংগলে গড়িয়ে যাবার পর পরই ওদিক থেকে আহমদ মুসাদের উচ্চভূমি লক্ষ্যে অনিয়মিত ব্যবধানে গুলী আসতে লাগল।
আহমদ মুসারা গুলী খরচ না করে অপেক্ষা করার নীতি অনুসরণ করল। ওখানে বসে গুলী করে ওদের লাভ নেই। সামনে এগুতেই হবে ওদের। সেই সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।
পল পল করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ওপার থেকে সেই অনিয়মিত গুলী একটানা চলছেই।
বিরক্তি ও বিস্ময় কিছুটা আচ্ছন্ন করেছে আহমদ মুসাকে। অর্থহীন ও অব্যাহত এই গুলীর অর্থ কি? এমন কি নিহত-আহতদের নিয়ে যাবারও ওরা চেষ্টা করছে না!
এ সময় আহমদ মুসাদের ঠিক পেছনে অনেকখানি উপরে শূন্য থেকে দুটি কারবাইন হ্যান্ড মেশিনগান গর্জন করে উঠল।
আকাশ থেকে পড়ার মত প্রবল শক খেয়ে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই পেছন ফিরে তাকাল।
২
বেদিতে উঠতে উঠতে ভ্যানিসা গনজালো বলল, ‘ভাইয়া, গত মাসে আমরা আসতে পারিনি। তাতেই দেখো মনে হচ্ছে বেদিটা জংগলে ভরে গেছে। এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না।’
সার্গিও গনজালোও বেদিতে উঠছিল ভেনিসার সাথে। বলল, ‘ভিয়েনীরা এসেছিল তো। মনে হয় ওরা বেদিটা পরিষ্কার করে যায়নি।’
‘তাই হবে। আজ আমাদের সংগ্রামের শক্তিরা দুধ খেয়ে যাবার পর আমরা বেদিটা পরিষ্কার করব ভাইয়া’। বলল ভ্যানিসা গনজালো।
‘আমিও তাই ভাবছি।’ বলল সার্গিও গনজালো।
দুজনেই উঠল বেদিতে।
দুজনের হাতেই দুটা কারবাইন শ্রেণীর ক্ষুদ্র সাবমেশিনগান। দুজনেই হাতের সাবমেশিনগান কাঁধে ঝুলিয়ে কাঁধের থলে থেকে বের করল প্লাষ্টিকের একটা পট। পটের মুখ খুলতে খুলতে ওরা দুজনে গেল বেদির মাঝখানে রাখা দুটো পাথরের বড় বাটির দিকে। পটের মুখ খুলে ওরা দুজন পাথরের দুই বাটিতে পটের সবটুকু দুধ ঢেলে দিল।
পটের মুখ বন্ধ করে কাঁধের ঝুলানো ব্যাগে রেখে দুজনেই কাঁধ থেকে সাবমেশিনগান হাতে নিল এবং দুজনেই সাবমেশিনগানের ব্যারেল বাটির দুধে ডোবাল। তারপর আবার সাবমেশিনগান কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত নেমে এল বেদি থেকে।
দুজনেরই পরনে ফুল সামরিক পোশাক। কাঁধের সাবমেশিনগান ছাড়াও ওদের কোমরে একদিকে ঝুলানো রিভলবার, অন্যদিকে খাপবদ্ধ ছুরি।
দুজনের মাথায় সামরিক টুপি।
দুজনে ওরা ভাই বোন। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা। এ কারণেই পতুর্গীজ আইনে গনজালো বংশ বিদ্রোহী পরিবার। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের পর্তুগীজ আইন ও পুলিশ এই পরিবারের সন্ধানে সর্বক্ষণ পই পই করে ঘুরছে।
বেদি থেকে নেমে সার্গিও এগোচ্ছিল দক্ষিণ দিকে।
ভ্যানিসা গনজালো বলল, ‘ভাইয়া, বেদিটা গাছ-গাছড়ায় ছেয়ে গেছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে বেদিতে আমাদের অতিথিদের আসা-যাওয়া দেখি, সেখান থেকে আজ বেদির কিছুই দেখা যাবে না।’
‘তাহলে।’ থমকে দাঁড়িয়ে বলল সার্গিও গনজালো।
‘চল এই গাছটায় উঠে যাই। ওখান থেকে ভালো করে দেখতে পাব।’ বলল ভ্যানিসা গনজালো।
‘ঠিক, ভ্যানিসা গাছে ওঠা যায়। সব ভালো করে দেখা যাবে। কিন্তু তুমি গাছে উঠতে পারবে তো?’ সার্গিও গনজালো বলল।
‘কি বলছ ভাইয়া। তুমি কি নতুন হলে নাকি?’ বলল ভ্যানিসা গনজালো।
‘ঠিক আছে। চলো।’ বলে সার্গিও গনজালো গাছের দিকে এগোলো।
বেদির পুবপাশে একটা উঁচু গাছে তারা উঠে বসল। ওখান থেকে উচ্চভূমির বিরাট এলাকাসহ উত্তর দিকে নেমে যাওয়া ঢালকেও পরিষ্কার দেখা যায়।
ওরা বেদিকে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী হয়ে বসল।
তারা গাছে উঠে বসার পর দশ মিনিটও গেল না। পূব দিক থেকে এক জোড়া দীর্ঘ সাপ এক সাথে এসে বেদিতে উঠল। এগুলো তারা দুধ ভর্তি পাথরের বাটির দিকে। সাপ দুটি দুবাটি থেকে দুধ খাওয়া শুরু করল।
গাছে বসে দুভাইবোন সার্গিও ও ভ্যানিসা আনন্দের সাথে দেখছিল এই দৃশ্য। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে সার্গিও গনজালো বলে উঠল, ‘আমাদের চার পুরুষ সাপেরও চার পুরুষ ধরে এই দৃশ্য এভাবেই দেখে হয়ে আসছে। এই সাপরা আমাদের শক্তি ছাড়া, সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের প্রতীক।’
‘কিন্তু ভাইয়া, সাপের অব্যর্থ ছোবলের মত আমরা শত্রুর উপর অব্যর্থ আঘাত হানতে পারছি কই? আমরা এগুতে পারছি না কেন?’ বলল ভ্যানিসা।
সার্গিও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ভ্যানিসার চোখ ঢালের উপর পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠে সার্গিওর মুখ চেপে ধরে বলল, ‘ঢালের দিকে দেখ ভাইয়া।’
সংগে সংগেই সার্গিও চোখ ফেরালো ঢালের দিকে।
দেখলো দুজন লোক পাশাপাশি ঢাল বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো সার্গিও গনজালোর। ফিস ফিস করে বলল ভ্যানিসাকে, ‘দুজনের কেউ এদেশের নয়, ইউরোপেরও নয়।’
‘তাহলে কোথাকার?’
‘এশিয়ান মনে হচ্ছে ভ্যানিসা আমার কাছে।’
‘তাহলে ওরা আমাদের শত্রু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ভাইয়া দুজনের হাতেই তো মেশিন রিভলবার?’
‘আসলেই এশিয়ানরা আমাদের শত্রু হবার কথা নয়। কিন্তু ওরা যেহেতু অস্ত্রধারী সেহেতু শত্রু হতেও পারে। আর ওদের চলার ভংগি দেখে মনে হচ্ছে অস্ত্র তারা কারো না কারো বিরুদ্ধেই বহন করছে। তাদের সেই শত্রু কে? আমরাও হতে পারি। আর আমাদেরই রাজ্যের মধ্যে এখন ওরা।’ বলল সার্গিও।
লোক দু’জন তখন উচ্চভূমির প্রান্তে উঠে এসেছে। বসল তারা। কিন্তু উন্মুক্ত জায়গায় না বসে ছোট গাছ-গাছড়ার মধ্যে বসল।
নিচু কণ্ঠে তারা কথা বলছিল। মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছিল ঢালের দিকে। হঠাৎ এক সময় তারা নিচের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দ্রুত গড়িয়ে উচ্চভূমির প্রান্ত থেকে কিছুটা ভেতরে গাছ-গাছড়ার আরও আড়ালে সরে এল।
উৎকর্ণ হয়ে উঠল সার্গিও। বলল ফিসফিস করে, ‘নিচে উপত্যকায় মনে হয় কুকুরের চিৎকার শুনলাম। মনে হয় ওরা দুজনও শুনতে পেয়েছে কুকুরের চিৎকার। এ জন্যেই গড়িয়ে ওরা আরও আড়ালে সরে এল। নিশ্চয় ওরা কারো তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসছে এবং তাড়াকারীরা নিচের উপত্যকায় পৌছে গেছে।’
‘কিন্তু ভাইয়া এদের চোখে-মুখে তো পলাতকদের মত ভয় ও উদ্বেগ নেই!’ বলল ভ্যানিসা।
‘তা ঠিক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তারা পলাতক নয়।’ সার্গিও বলল।
ওরা এ সময় দেখল, লোক দু’জন বেদির দিকে এগুচ্ছে।
আঁৎকে উঠল ভ্যানিসা। ফিসফিস করে বলল, ‘ভাইয়া, আমাদের মেহমান সর্পরাজরা তো এখনও বেদিতে!’
‘আমরা দর্শক, যা ঘটবে তা ঘটতে দাও। পাপ করলে পাপের সাজা ওদের পেতে হবে।’ বলল সার্গিও।
লোক দুজন তখন বেদিতে উঠছিল।
সার্গিও ও ভ্যানিসা বিস্ময়ের সাথে দেখল, সাপ দুটি বেদির দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে সারি বেধে নেমে চলে গেল।
তাদের বিস্ময়ের বড় কারণ হলো, প্রতিদিন সাপ দুটো দুধ খাওয়ার জন্য যেমন বেদিতে উঠে আসে পূর্ব প্রান্ত দিয়ে দুধ খাওয়ার পর নেমেও যায় তেমনি পূর্ব প্রান্ত দিয়ে। কিন্তু আজ প্রথমবার ওরা নামল দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে।
তার মানে তাদের মেহমান সাপ দুটো আপোশ করল লোক দুজনের সাথে, ভাবল সার্গিও। লোক দুজন বেদিতে উঠার আগেই যেমন সাপ দুটো চলে গেল, তেমনি ভিন্ন রাস্তা দিয়ে গেল একই রাস্তা ব্যবহারের সংঘাত এড়িয়ে।
‘ভাইয়া, কি বুঝলে?’ বলল ভ্যানিসা।
‘বুঝলাম, এ দুজন আমাদের শত্রু নয়, বা আমাদের জন্যে ক্ষতিকর নয়।’ বলল সার্গিও।
‘আমারও তাই মত। আর ওদের দুজনের চেহারা কোনও ভাবেই ক্রিমিনালের মত নয়। নিরীহ, নিষ্পাপ ভদ্রলোক বলেই ওদের মনে হয়।’ বলল ভ্যানিসা।
কথা শেষ করেই ভ্যানিসা আবার চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া দেখ, ওরা দুজন ওদের মেশিন রিভলবার বাগিয়ে যুদ্ধের পজিশন নিয়ে বসে আছে।’
সাপ দুটো ঠিক পথে গেল কিনা দেখছিল সার্গিও। ভ্যানিসার কথায় সে মুখ ফিরাল, দেখল, লোক দুজন বেদির উত্তর প্রান্তে গাছ-গাছড়ার আড়াল নিয়ে ঢালের দিকে তাদের রিভলবার তাক করে বসে আছে।
এক মিনিটও পার হলো না।
নিচের উপত্যকার জংগল থেকে দুটি কুকুর নিয়ে ষ্টেনগানধারী দুজন লোক বেরিয়ে এল। তারা উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।
তাদের পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ জনের বিশাল বাহিনী। প্রত্যেকের হাতেই উদ্যত ষ্টেনগান। মনে হচ্ছে একদল যোদ্ধা এগুচ্ছে যুদ্ধের জন্যে।
‘তাহলে ওরাই তাড়া করে নিয়ে আসছে এ দুজনকে?’ বলল ভ্যানিসা ফিসফিস করে সার্গিওর উদ্দেশ্যে।
‘ভাবছি, এ দুজন বিদেশী। কিন্তু ওরা কারা? কি নিয়ে এই লড়াই?’ ধীরে ধীরে চাপা কণ্ঠে বলল ভ্যানিসা।
‘দূর থেকে দেখে যতটা বুঝা যাচ্ছে, তাতে সবাইকেই তো এদেশী বলে মনে হচ্ছে।’ বলল সার্গিও।
লোক দুজন রিভলবার বাগিয়ে বসে আছে। আর ওরা ঢাল বেয়ে উঠে আসছে।
‘দুই রিভলবার দিয়ে ওদের সাথে কিভাবে এরা লড়াই করবে, এরা এতদূর পালিয়ে এল, কিন্তু এখন আবার রুখে দাঁড়াল কেন?’ ভ্যানিসা বলল।
‘এদের ষ্ট্রাটেজিক জ্ঞান খুব টনটনে ভ্যানিসা। এরা খুবই সুবিধাজনক অবস্থান বেছে নিয়েছে। এ রকম জায়গা এদের সামনেও ছিল না, পেছনেও নেই।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু এরা এভাবে বসে কেন? ওদের এগুতে দিচ্ছে কেন?’ চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ভ্যানিসা।
ওরা তখন ঢালের মাঝামাঝি জায়গায় বসে আছে।
ওদের দিকে তাক করে বসা এদের একজন এ সময় ওদের দিকে একটা ফাঁকা গুলী করল সাধারণ রিভলবার থেকে। উত্তরে ওরা সংগে সংগে একসাথে গুলী বৃষ্টি শুরু করল বেদি লক্ষ্যে। এরাও বেদির উপর শুয়ে পড়ে তাদের দুই মেশিন রিভলবারের ট্রিগার টিপে ওদের উপর ঘুরিয়ে নিতে লাগল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ওদিক থেকে গুলী ছোড়া বন্ধ হয়ে গেল। ঢালে আর কাউকেই দাঁড়ানো দেখা গেল না।
ওদিকের গুলী বন্ধ হলে এরাও গুলী ছোড়া বন্ধ করে দিল এবং উঠে বসল বেদির উপর।
‘কি আশ্চর্য, ওরা কি সবাই মরে গেল?’ প্রশ্ন তুলল ভ্যানিসা।
‘বলেছিলাম না ভ্যানিসা। এরা খুব কুশলী। উপযুক্ত জায়গা বেছে নিয়েছে। আবার ওদের নিয়েও এসেছে ঢালের মাঝখানে, তারপর আক্রমণ করেছে। যাতে পালাতে না পারে।’ সার্গিও বলল।
‘না ভাইয়া, এরা প্রথম আক্রমণ করেনি। ঢাল থেকে ওরাই প্রথম আক্রমণ করেছিল। কিন্তু ভাইয়া, এরা ঐ একটা ফাঁকা গুলী কেন করেছিল?’
‘ঠিক জানি না। হতে পারে ওদেরকে প্রথমে আক্রমণে আনা অথবা হটিয়ে দেয়ার জন্যে।’
‘ওদেরকে এরা আক্রমণে আনতে চাইবে কেন?’ আবার জিজ্ঞাসা ভ্যানিসার।
‘আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না ভ্যানিসা।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু এরা এখন কিসের অপেক্ষা করছে। ঢালে তো এখন নেমে যেতে পারে। যুদ্ধ জয় তো হয়েই গেছে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘বোধ হয় এরা আশংকা করছে, উপত্যকায় ওদের শত্রু পক্ষের লোক আরও আছে।’ সার্গিও বলল।
কিছু বলতে গিয়েও তার মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না। সে দেখল, পশ্চিম দিক থেকে দুজন ষ্টেনগানধারী বেদির পেছন পর্যন্ত এসে পৌছেছে।
ভ্যানিসা চাপা কণ্ঠে দ্রুত বলল, ‘ভাইয়া, বেদির পেছনে।’
সার্গিও তাকিয়েছিল ঢালের দিকে। সে তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরাল বেদির পেছনে। দেখতে পেল দুজন ষ্টেনগানধারীকে। তাদের ষ্টেনগানের ব্যারেল তখন লোক দুটিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে।
দেখেই চাপা কণ্ঠে ‘ভ্যানিসা……..’ বলতে বলতেই সার্গিও তার কারবাইনের ট্রিগার চেপে ধরল ঐ দুজন ষ্টেনগাধারীর লক্ষ্যে।
ভ্যানিসাও আগেই তার কারবাইন ঘুরিয়ে নিয়েছিল। সার্গিওর সাথে তারও কারবাইন গর্জন করে উঠেছিল।
দুজন ষ্টেনগানধারীর ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ ঝরে পড়ল মাটিতে।
সার্গিও ও ভ্যানিসা দেখল সেই লোক দুজন প্রথমেই গাছে চড়ে থাকা তাদের দিকেই ফিরে তাকিয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে তাদের দৃষ্টি ঘুরে গেল বেদির পেছনে পড়ে থাকা লাশ দুটির দিকে। তারা বেদির দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে লাশ দুটিকে দেখল। আবার তাদের চোখ উঠে এসে নিবদ্ধ হলো সার্গিওদের উপর।
লোক দুজনের একজন আহমদ মুসা, সার্গিওদের উদ্দেশ্যে পর্তুগীজ ভাষায় বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনারা দুজনকে হত্যা করে আমাদের দুজনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। অথচ আপনারা ওদের কিংবা আমাদের কাউকেই চেনেন না।’
সার্গিওরা নেমে এল। সার্গিও বলল আহমদ মুসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ‘আমরা ওদেরকে বা আপনাদেরকে চিনি না বটে। কিন্তু আক্রমণকারী কে আর আক্রান্ত কে তা আমরা দেখেছি। আমরা আক্রান্তকে সাহায্য করেছি।’
‘অপরাধী আক্রমণকারীরা হয়, কিন্তু আক্রান্তরাও হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা হতে পারে। তবে আমাদের সে ভুল হয়নি, আপনার কথায় নিশ্চিত হলাম।’ বলল সার্গিও।
‘ধন্যবাদ। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল আপনারা যেন স্বর্গের দূত। আমাদের রক্ষার জন্যে দয়া করে ঈশ্বর আপনাদের পাঠিয়েছেন। আমার বিস্ময় এখনও যায়নি। এখানে আপনারা এলেন কি করে? দয়া করে আপনাদের পরিচয় দেবেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি সার্গিও গনজালো।’ বলল সার্গিও। তারপর ভ্যানিসাকে দেখিয়ে বলল, ‘এ আমার সহোদরা ছোট বোন ভ্যানিসা গনজালো। আমরা এ এলাকার। এর বেশি কিছু বলার আগে আপনারা কে তা আমাদের জানা প্রয়োজন।’
‘আমরা বিদেশী। লিজে বিমান বন্দরে নামার পর যাচ্ছিলাম ‘গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে’ থাকার জন্যে।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর হোটেলের পথে তাদের কিডন্যাপ এবং হত্যা প্রচেষ্টাসহ গাড়ির জানালা ভেঙে তাদের পলায়নের সব কথা খুলে বলল।
‘আপনারা বিদেশী। আপনাদের সাথে ওদের শত্রুতা কেন? ওরা কারা?’ বলল ভ্যানিসা।
‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’ (WFA) এর সাথে আপনাদের পরিচয় আছে?’ আহমদ মুসা সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
উত্তরে সার্গিও বলল, ‘পরিচয় নেই, তবে জানি আমরা ঐ সংগঠনকে। সংগঠনটা চরম ইহুদীবাদী। গোটা দুনিয়া দখলের দুঃস্বপ্ন ওদের। আজর ওয়াইজম্যান ওদের নেতা।’
‘ধন্যবাদ মি. সার্গিও। আপনারাতো দেখছি ওদের অনেক কিছুই জানেন। ওদের…….।’ আহমদ মুসার কথা সমাপ্ত হতে পারলো না।
আহমদ মুসাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সার্গিও আবার বলে উঠল, ‘আজোরসের পর্তুগীজ গভর্নর ‘পেড্রো’র স্ত্রী ‘ক্রিষ্টিন করণিকা’ ইহুদী। এই সুবাদে WFA এখানে ব্যাপক সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু আপনাদের সাথে WFA এর শত্রুতা কিসের? আপনাদের পরিচয় কিন্তু বলেননি।’
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর মুখ তুলল সার্গিওর দিকে। গভীর দৃষ্টিতে একবার সে দেখল সার্গিওকে।
উত্তর দিতে কিছু দেরি হলো আহমদ মুসার।
হাসল সার্গিও। বলল, ‘বুঝেছি, বিশ্বাস করতে পারছেন না আমাদের।’
আহমদ মুসা সলজ্জ হাসল। বলল, ‘স্যরি, এটা অবিশ্বাস নয়, সতর্কতা। বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা সবাইকেই করতে হয়। যেমন আপনারাও আপনাদের সবটা পরিচয় আমাদের কাছে দিতে পারেননি।’
আবার হাসল সার্গিও। বলল, ‘কিছু পরিচয় আমরা গোপন রেখেছি বলে কি আপনি মনে করেন?’
ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার। বলল, ‘আপনারা ব্যক্তি পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু দলীয় বা সাংগঠনিক একটা পরিচয় আপনাদের আছে সেটা দেননি।’
‘কি করে বুঝলেন আমাদের একটা সাংগঠনিক পরিচয়ও আছে?’ গম্ভীর কণ্ঠস্বর সার্গিওর।
‘আপনাদের ইউনিফরম ব্যক্তিগত নয়, নিশ্চয় কোন দল বা সংগঠনের। বিশেষ করে আপনাদের ইউনিফরমের বুকে উদীয়মান সূর্যের আলোকস্নাত আজোরস দ্বীপপুঞ্জের যে ইনসিগনিয়া সেটা ব্যক্তিগত নয় অবশ্যই। আপনাদের কারবাইনেও ঐ একই ইনসিগনিয়া আমি দেখতে পেয়েছি। এর অর্থ এই অস্ত্রগুলোও আপনাদের ব্যক্তিগত নয়।’
সার্গিও ও ভ্যানিসার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। তাদের দুজনেরই গভীর বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। বলে উঠল সার্গিও গম্ভীর কণ্ঠে, ‘আপনাদের পরিচয়ের ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু এখন আপনার পরিচয় জানার কৌতূহল দমন করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। এ রকম সুক্ষ ও সার্বিক দৃষ্টিওয়ালা লোককে আমি শার্লক হোমস-এর বইতে দেখেছি, আর আজ আপনাকে জীবন্ত দেখলাম। অতএব এখন আপনার পরিচয় জানতেই হবে। তার আগে আমাদের ছোট্ট পরিচয়টা বলছি।’
বলে একটু থামল সার্গিও। একটু মাথা নিচু করল। মাথা তুলল পরক্ষণেই এবং বলা শুরু করল, ‘ইনসিগনিয়ার উদীয়মান সূর্যটা স্বাধীনতার সূর্য। আমরা চাই আমাদের গোটা আজোরস স্বাধীনতা সূর্যের সোনালী আলোক ধারায় সণাত হোক। আমাদের সংগঠেনর নাম……….’
সার্গিও’র মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আজোরস ইনডিপেনডেন্ট পিপল’ (AIP)।
হাসল সার্গিও। বলল, ‘আমি বিস্মিত হলাম না। কারণ আপনি নতুন এক শার্লক হোমস। অতএব আজোরস দ্বীপপুঞ্জের স্বাধীনতা সংগ্রামের নাম জানা আপনার জন্যে বড় কথা নয়।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘আজোরস ইনডিপেনডেন্ট পিপল (AIP) -কে নেতৃত্ব দিচ্ছে আজোরস দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কারক এবং এখানে প্রথম বসতিস্থাপনকারী গনজালো পরিবার। আমরা সেই ‘গনজালো’ পরিবারের সদস্য। আমার বড়ভাই রিকার্ডো এখানকার পর্তুগীজ সরকারের হাতে বন্দী হবার পর আমি আন্দোলনকে দেখাশূনা করার দায়িত্ব পালন করছি।’ থামল সার্গিও।
থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আমাদের সব কথা বলেছি। এবার আপনাদের কথা বলুন।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাদের কথা খুব বেশি নয়। WFA কিছু লোককে এই দ্বীপপুঞ্জের কোন এক দ্বীপে বন্দী করে রেখেছে। আমরা এসেছি তাদের উদ্ধার করতে।’
‘বন্দী করেছে তারা কারা?’ জিজ্ঞাসা ভ্যানিসার।
‘ওরা কয়েকজন একটি গোয়েন্দা ফার্মের কর্মকর্তা। ওদের গোয়েন্দা ফার্ম WFA ধ্বংস করে দিয়েছে এবং তার ৭ জন কর্মকর্তাকে কিডন্যাপ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেই ফার্ম কি ফ্রান্সের ষ্ট্রাসবার্গের স্পুটনিক?’ বলল ত্বরিত কণ্ঠে ভ্যানিসা।
‘হ্যাঁ, তুমি জানলে কেমন করে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি ঐ সময় ফ্রান্সে ছিলাম। লা-মন্ডেতে ঐ নিউজ আমি পড়েছি। স্পুটনিকের গোয়েন্দারা দেড় যুগ আগের নিউইয়র্কের টুইন-টাওয়ার ধ্বংসের কার্যকরণ অনুসন্ধান করছিল।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিন্তু WFA এই গোয়েন্দাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও গোয়েন্দাদের কিডন্যাপ করল কেন?’ ভ্যানিসা থামতেই বলে উঠল সার্গিও।
‘আপনার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে, ‘ঠাকুর ঘরে কেরে, আমি কলা খাইনি’ এই প্রবাদ প্রযোজ্য।’
বিস্ময় ফুটে উঠল সার্গিওর চোখে-মুখে। বলল, ‘তার মানে WFA টুইন টাওয়ার ধ্বংসের তদন্ত বানচাল করার জন্যে স্পুটনিক ধ্বংস করেছে এবং তার ৭ গোয়েন্দাকে কিডন্যাপ করেছে?’
‘ওদের ভূমিকা তো তাই প্রমাণ করছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরও একটা মজার খবর আছে, যেদিন স্পুটনিক ধ্বংস হয়, তার একদিন পর ইসরাইল রেডিওর দেশরক্ষা বিভাগের একটা সমীক্ষায় মন্তব্য করা হয় যে, ‘স্পুটনিকের সব কাজের মধ্যে একটা সাম্প্রদায়িক লক্ষ্য আছে। দেড় যুগেরও বেশি পর তারা টুইন টাওয়ার ধ্বংস নিয়ে যে কাজ করছে, তাও সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের ভীষণ একগুয়েমি এবং বর্তমান মার্কিন সরকারের প্রশ্রয়েই টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মত ডেড ইস্যু নিয়ে স্পুটনিক কাজ করার সুযোগ পেয়েছে।’ মার্কিন সরকারও স্পুটনিকের যোগসাজসে পরিচালিত এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেককে রুখে দাঁড়াবার জন্যে আহবান জানায়।’ বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ, ইসরাইল সরকারের এই প্রতিক্রিয়াও প্রমাণ করছে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের বিষয়ে কোন কার্যকর তদন্ত হোক তা তারা চায় না। এই না চাওয়ার অর্থ এই ধরা যায় যে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সাথে সংশিস্নষ্ট কোন সত্য তারা গোপন করতে চায়।’ সার্গিও বলল।
‘হ্যাঁ, স্পুটনিক ধ্বংস হওয়া এবং তার গোয়েন্দারা কিডন্যাপ হওয়ার এটাই কারণ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনারা কি স্পুটনিকের লোক?’ জিজ্ঞাসা সার্গিওর।
‘না, আমরা স্পুটনিকের লোক নই। আমরা স্পুটনিকের শুভাকাংখী। এতবড় অন্যায়ের প্রতিবিধান হওয়া উচিত বলেই আমরা কাজে নেমেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার তাহলে কে?’ জিজ্ঞেস করল ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা একটু হাসল। হাসান তারিককে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি ফিলিস্তিন বিপ্লবের একজন নেতা। এখন ফিলিস্তিন সরকারের একজন উপদেষ্টা। নাম হাসান তারিক।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। থেমেই আবার বলল, ‘আর আমার নাম আহমদ মুসা। হাসান তারিকের মত আমার বিশেষ কোন পরিচয় নেই।’
‘আহমদ মুসা’ নাম শুনে সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেরই কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠল। চোখে-মুখে ফুটে উঠল প্রবল জিজ্ঞাসা। ভ্যানিসাই প্রথম কথা বলে উঠল, ‘কোন আহমদ মুসা? এই ক’দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুরিনামে যাকে নিয়ে মহা হৈ চৈ হয়ে গেল সেই আহমদ মুসা?’ ভ্যানিসার কণ্ঠস্বর দ্রুত। যেন এক মুহূর্তেই সব কথা বলে ফেলতে চায়।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠল হাসান তারিক। বলল, ‘হ্যাঁ, উনি সেই আহমদ মুসা। তবে হৈ চৈ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও সুরিনামে নয়, চীন, রাশিয়া, ককেশাস, ফ্রান্স, ফিলিস্তিন সব জায়গাতেই একটা করে ভূমিকম্প ঘটিয়েছেন তিনি।’
হাসান তারিক থামতেই সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেই কোমর বাঁকিয়ে সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে আহমদ মুসাকে বাউ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা চালু ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল।
থেমে গেল সার্গিও ও ভ্যানিসা। উৎকর্ণ হয়ে উঠল তারা।
আহমদ মুসাও উৎকর্ণ হয়ে উঠেছিল। মুহূর্ত কয়েক কান পেতেই সে বলে উঠল, ‘দুটি হেলিকপ্টার আসছে এদিকে। আমার ধারণা মিথ্যা না হলে ওরা এখানেই ল্যান্ড করবে।’
বিস্ময় ফুটে উঠেছে সার্গিও ও ভ্যানিসার চোখে-মুখে। বলল সার্গিও, ‘কেন আসবে হেলিকপ্টার, কার হেলিকপ্টার? আমি তো জানি WFA-এর কোন হেলিকপ্টার নেই।’
‘ঠিক করে বলা মুষ্কিল। তবে আমি আন্দাজ করছি, WFA হেলিকপ্টার ভাড়া করেছে তার প্রেরিত বাহিনীর খোঁজ নেবার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হেলিকপ্টারগুলো পুলিশের বলে মনে করছেন না কেন? WFA পুলিশকে বলে পুলিশের সাহায্য নিতে পারে। আমার মনে হয়, যে দু’জন লোক পেছন থেকে আক্রমণ করার জন্যে উপরে উঠে এসেছিল, তারাই মোবাইলে জানিয়ে দিয়েছিল তাদের বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবার কথা।’ বলল সার্গিও।
‘আমি WFA-কে যতটা জানি তাতে বলতে পারি, তারা এক্ষেত্রে পুলিশের সাহায্য নেবে না। এমনকি এতবড় ম্যাসাকারের কথা তারা পুলিশের কাছ থেকে গোপন করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন?’ বলল সার্গিও।
‘প্রথম কারণ, WFA তার এতবড় বিপর্যয় ও দুর্বলতার কথা পুলিশকে জানাতে চাইবে না। দ্বিতীয় কারণ, এ ধরনের বড় খুন-খারাবির কথা জানতে পারলে আইন-শৃঙ্খলার কারণেই পুলিশ WFA-এর কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে বা তাদের উপর চোখ রাখতে পারে, এমন আশংকা করতে পারে WFA’রা।’ আহমদ মুসা বলল।
সার্গিও ও ভ্যানিসা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। ধীরে ধীরে তাদের চোখে ফুটে উঠল মুগ্ধ দৃষ্টি। বলল সার্গিও, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনার চিন্তাই ঠিক।’
বাক্যটা শেষ করেই মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘এখন করণীয় কি, ঠিক করা দরকার। আমি মনে করি, হেলিকপ্টারগুলো যদি WFA-এরই হয়ে থাকে, তাহলে ওগুলো ল্যান্ড করার আগেই ধ্বংস করে দিতে পারি।’
‘না মি. সার্গিও, আমরা যা বলছি সবই অনুমান। নিশ্চিত না হয়ে এতবড় পদক্ষেপে যাওয়া ঠিক হবে না। এমনও তো হতে পারে, পুলিশে ইনফরমেশন দিয়ে তাদের জ্ঞাতসারে এই হেলিকপ্টার দুটি পাঠাচ্ছে WFA, অথবা এই হেলিকপ্টারে দুএকজন পুলিশকেও তারা পাঠাচ্ছে। আমরা যদি হেলিকপ্টার ধ্বংস করি, আর যে দুটি বিকল্পের কথা আমি বললাম, তার যে কোন একটি যদি সত্য হয়, তাহলে পুলিশের সাথে সংঘাত আমাদের অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। আমরা এই সংঘাত এখন এড়াতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল সার্গিও। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। আহমদ মুসার কথার পর আর কোন কথা চলে না। এখন বলুন আমাদের কি করণীয়। হেলিকপ্টারগুলো এসে পড়ল বলে।’
‘এই উচ্চভূমির পাশে এমন কোথাও আমাদের আত্মগোপন করে অপেক্ষা করতে হবে, যেখান থেকে এই উচ্চ ভূমিটা দেখা যায়। ওদের এ ধারণা দিতে হবে যে, সংঘাতের পরেই এ স্থান ছেড়ে আমরা অন্য কোথাও চলে গেছি।’
‘এর দ্বারা আমরা কি অর্জন করতে চাচ্ছি?’ জিজ্ঞাসা সার্গিওর।
‘নিরর্থক এই সংঘাত এড়ানোর চেষ্টা করা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিরর্থক কেন?’ ভ্যানিসা জিজ্ঞেস করল।
‘এ সংঘাতে আমাদের জড়ানোর মধ্যে ওদের লক্ষ্য হলো আমাদের ক্ষতি করা, ধ্বংস করা। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ওদের ধ্বংস করা নয়, আমাদের বন্দী লোকদের উদ্ধার করা। আমরা এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে আমাদের লক্ষ্য অর্জন জটিলতর হবে। দ্বিতীয়ত, আমি চাই না এ সংঘাতে আপনারা আমাদের সাথে আছেন এটা কোনওভাবে তাদের জানার সুযোগ হোক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন চান না?’ ভ্যানিসাই আবার জিজ্ঞেস করল।
‘নতুন শত্রু সৃষ্টি করা আপনাদের ঠিক হবে না। আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য WFA এখন কোন প্রত্যক্ষ শত্রু নয়, কিন্তু আমাদের হয়ে ওদের সাথে সংঘাতে নামলে আপনারাও শত্রু হয়ে যাবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় ফুটে উঠেছে সার্গিও ও ভ্যানিসার চোখে-মুখে। বলল সার্গিও, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আপনি এর মধ্যেই এতটা ভাবছেন! যে লাভ-ক্ষতির কথা আমাদের মাথায় আসেনি, সেটাও আপনার ভাবনার বিষয়!’
বলে একটু হাসল সার্গিও। হাসিটার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠল তার হৃদয়ের একরাশ বিমুগ্ধতা। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘পরকে আপনি এত আপন করে ভাবতে পারেন বলেই আপনি এত বড়, আপনার এত সাফল্য আহমদ মুসা। এমন মানুষের কাছেই মানুষ তার সবকিছু হারিয়ে বসতে পারে।’ আবেগ-কম্পিত কণ্ঠ ভ্যানিসার।
ভ্যানিসা থামতেই আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে বলে উঠল, ‘ওরা আরও কাছে এসে গেছে, আমাদের এখনি সরতে হবে।’
কিন্তু সার্গিও আহমদ মুসার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে ধীরে ধীরে বলে উঠল, ‘এতদিন আমরা ভেবে এসেছি, যত পার শত্রুকে মার, তাতেই লাভ। কিন্তু আজ আপনার কাছে শিখলাম, লক্ষ্যকেই বড় করে দেখতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয় না বা লক্ষ্য অর্জনকে জটিল করে তোলে এমন সংঘাত, হত্যাকান্ড অনর্থক, তাকে অবশ্যই এড়াতে হবে। এটা যে কত বড় শিক্ষা! ধন্যবাদ আপনাকে মি. আহমদ মুসা।’
‘লক্ষ্যকে বড় করে দেখার অর্থ কিন্তু আবার এই নয় যে, লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে। লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক নয় এমন অনর্থক কিংবা ক্ষতিকর সংঘাত সংঘর্ষ যেমন পরিত্যাজ্য, তেমনি নিছক লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে হলেও অযৌক্তিক ও অন্যায় হয় এমন কোন কাজ বা ঘটনাও ঘটানো যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আপনাদের WFA এবং আমাদের ক্ষেত্রে পর্তুগীজ সরকার কি এই নীতিবোধ মানছে?’ জিজ্ঞেস করল সার্গিও।
‘তাদের লক্ষ্যই যেখানে অবৈধ, সেখানে তাদের পন্থার বৈধতা নিয়ে আলোচনা চলে না। কিন্তু আমার আপনার লক্ষ্য মহৎ, কোন অবৈধ পথ ও পন্থার ক্লেদ দিয়ে একে কলুষিত করা যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা নড়ে উঠল। বলল, ‘চলুন মি. সার্গিও, কোন দিকে যেতে হবে।’
সম্বিত ফিরে পাওয়ার মত নড়ে উঠল সার্গিও। চলতে শুরু করে বলল, ‘আসুন, আপনি যেমন বলেছেন, তেমন ভালো শেল্টার আছে। ওখান থেকে সরে পড়ারও ভালো পথ আছে।’
সবার সাথে ভ্যানিসাও চলতে শুরু করেছে। হাঁটছে সে আহমদ মুসার পাশাপাশি। তার মুখ গম্ভীর। চলতে চলতে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল সে, ‘লক্ষ্য অর্জনে যে পন্থার দিকে সবশেষে আপনি ইংগিত করেছেন, সেটা গ্রহণ করলে তো আমাদের সবাইকে ‘সেন্ট’ অন্য কথায় সাধু-সন্ত হতে হবে। অস্ত্র ধরা যাবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের তাহলে কি হবে?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জন, বন্দুক ধরা তোমার লক্ষ্য নয়। লক্ষ্যকে রক্ষার জন্যেই যখন বন্দুক ধরা প্রয়োজন তখন অবশ্যই বন্দুক ধরতে হবে। সাধু-সন্ত হলেও ধরতে হবে।’
হাসল ভ্যানিসা। বলল, ‘বুঝেছি। লক্ষ্য অর্জনে আপোশহীন হতে হবে, লক্ষ্য রক্ষার জন্যেই লড়াই করতে হবে।’
থামল ভ্যানিসা। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘ইতিহাস সাক্ষী, আপনি মাঠের একজন বিপ্লবী। কিন্তু আবার মনে হচ্ছে আপনি নীতিবাগিশ দার্শনিক একজন সেইন্ট। এটা কি বৈপরিত্য নয়?’
‘আমরা মুসলমান। একজন মুসলিম একই সাথে গৃহী, পুলিশ এবং সৈনিক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি মুসলিম! ও, তাইতো আহমদ মুসা তো মুসলমানই।’ বলল ভ্যানিসা।
‘মন খারাপ হলো তোমার?’ বলল আহমদ মুসা ভ্যানিসাকে লক্ষ্য করে।
‘মন খারাপ হবে কেন? বরং একটু ভালই লাগছে। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের পর্তুগীজ সরকার আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভেদ সৃষ্টি ও এই সংগ্রামে গনজালেস পরিবারের নেতৃত্ব নষ্ট করে একে দুর্বল করার জন্যে অপপ্রচার করে বেড়ায় যে, গনজালো পরিবার নাকি আদিতে মুসলিম ছিল। অপপ্রচার হলেও মুসলমানদের প্রতি কিছুটা আকর্ষণ তো আমাদের থাকবেই।’ ভ্যানিসা বলল।
‘অবাক খবর দিলে তুমি। আসল সত্যটা কি সার্গিও?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। অপপ্রচার নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করিনি আমরা কোন সময়।’ সার্গিও বলল।
হেলিকপ্টার দুটো এসে পড়েছে। দুএক মিনিটের মধ্যেই ওরা এই উচ্চভূমির আকাশে এসে পৌছবে।
উচ্চভূমির পূর্ব-দক্ষিণ পাশে পাহাড়ের গোড়ায় এসে গেছে আহমদ মুসারা।
একটা সংকীর্ণ গিরিপথে ঢুকতে ঢুকতে সার্গিও বলল, ‘এসে গেছি আমরা। সাত আট ফিট উপরে উঠলেই একটা দীর্ঘ গিরিপথের মুখে শেল্টারটা। তার উপর পাহাড়ের ছাদ। সামনে উচ্চভূমির দিকটা উন্মুক্ত, কিন্তু গাছ-গাছড়ায় ঢাকা।’
সবাই সংকীর্ণ গিরিপথ বেয়ে উঠতে লাগল শেল্টারের দিকে।
হেলিকপ্টার দুটি ল্যান্ড করল আহমদ মুসাদের গুহা মুখের ঠিক নিচেই।
উচ্চভূমির গোটা এলাকা গাছ-পালায় ঢাকা। উচ্চভূমির উত্তর দিকে ঢালু স্লোপ, পশ্চিম দিকেও তাই। এই দুই ঢালে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করা সম্ভব নয়।
উচ্চভূমির দক্ষিণ দিকটা দুর্গম। দিকটা অসংখ্য পাহাড় টিলা, সংকীর্ণ উপত্যকা ও গাছপালায় আচ্ছাদিত। ওদিকে হেলিকপ্টার ল্যান্ডের কোন সুযোগ নেই। উচ্চভূমির মাঝখানে সমতল পাথুরে একটা চত্বর আছে। এই চত্বরেই ল্যান্ড করেছে হেলিকপ্টার দুটি।
হেলিকপ্টার দুটি পূবমুখী হয়ে পাশাপাশি ল্যান্ড করেছে। এদের বিশাল পাখার ব্লেডগুলো আহমদ মুসাদের গুহামুখের মাত্র সাত আট ফুট দূর দিয়ে ঘুরছে।
হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং এর জন্যে এই স্থানটি বেছে নেয়ায় আহমদ মুসা দারুন খুশি। ওদের ওঠানামা এবং কথাবার্তারও অনেক কিছুই তারা শুনতে পাবে।
ল্যান্ড করার মিনিট পাঁচেক পর হেলিকপ্টার দুটির দরজা একই সাথে খুলে গেল। দরজা খোলার সাথে সাথেই দুটি হেলিকপ্টার থেকে ৩জন করে ছয়জন লোক লাফ দিয়ে নামল। তাদের সকলের হাতেই উদ্যত ষ্টেনগান।
নেমেই তারা হেলিকপ্টারকে পেছনে রেখে সামনে ছুটে গিয়ে পজিশন নিল। পরক্ষণেই ছয়টি ষ্টেনগান থেকে গুলী শুরু হলো। উচ্চভূমির সব দিক লক্ষ্য করেই তারা গুলী ছুড়ছে।
মিনিট পাঁচেক একটানা গুলীর পর তাদের ছয়টি ষ্টেনগানই থেমে গেল।
আহমদ মুসা বুঝল, শত্রুকে আতংকিত করা কিংবা শত্রুর উপস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া যাচাই করার জন্যে ফাঁকাগুলীর এ মহড়া চলছে।
আরও মিনিট পাঁচেক পার হলো।
হেলিকপ্টার থেকে আরও দুজন নেমে এল। তাদের কাঁধেও ষ্টেনগান ঝুলানো এবং দুজনের হাতেই একটি করে ফোল্ডিং চেয়ার।
হেলিকপ্টার দুটির মাঝখানে তারা চেয়ার দুটি সামনা সামনি করে পাতল।
কাঁচা পাকা চুলের দুজন রাশভারী লোক নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে। বসল তারা চেয়ার দুটিতে।
দুজনের কাউকেই চিনতে পারল না আহমদ মুসা। দুজন নিশ্চয় বড় নেতা গোছের কেউ হবে। তবে সে নিশ্চিত যে এদের মধ্যে WFA-এর প্রধান আজর ওয়াইজম্যান নেই।
বসেই দুজনের একজন মুখ তুলে পজিশন নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা ছয়জনের একজনকে লক্ষ্য করে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, ‘রিকার্ডো’ দুজনকে পাহারায় রেখে তোমরা চারজন ওদিকে যাও। কেউ বেঁচে আছে কিনা দেখ। চল্লিশটি লাশই গুণে আসবে। দেখলাম অস্ত্রগুলো পড়ে আছে। ওগুলো নিয়ে আসবে। সবার কাছেই মোবাইল থাকার কথা। ভালো করে সার্চ করে দেখে ওগুলো অবশ্যই নিয়ে আসবে। মনে রেখ, মোবাইলগুলো অস্ত্রের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।’
কথাগুলো আহমদ মুসারাও শুনতে পেল। শুনে মনটা খচখচ করে উঠল আহমদ মুসার। মোবাইল ওদের কাছে আছে, এ কথা মনেই করেনি আহমদ মুসারা। মোবাইলগুলো শুধু টেলিফোন ইনডেক্সই নয়, কার সাথে কখন যোগাযোগ হয়েছে তারও একটা বর্তমান নির্ঘণ্ট। আর আপসোস করে লাভ নেই, ওগুলো এখন ওদের হাতেই পড়ে গেল, ভাবল আহমদ মুসা।
ওদিকে রিকার্ডো নামক লোকটি তিনজনকে সাথে করে নিয়ে চলে গেল উচ্চভূমির উত্তর ঢালের দিকে।
ওরা চলে গেলে চেয়ারে বসা নেতা গোছের সেই রাশভারী লোকটি সামনের চেয়ারে বসা দ্বিতীয় লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মি. ডেভিড ডায়ার, খবর পাওয়ার পনের মিনিটের মধ্যে আমরা পৌছে গেছি। ওরা সরে পড়ার জন্যে খুব বেশি হলেও সাত আট মিনিট সময় পেয়েছে। এই সময় ওরা এক মাইল পথও যেতে পারেনি। সুতরাং ওদের আশে পাশেই পেয়ে যাব।’
‘মি. এডাম এরিয়েল, আমারও তাই মত। কিন্তু ওদের আশে-পাশে পেতে হলে এখনই আমাদের কাজ শুরু করা দরকার।’
‘হ্যাঁ সেটাই হবে মি. ডায়ার।’ বলে এডাম এরিয়েল পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। মেলে ধরল কাগজটি সামনে।
কাগজটি টেরসিয়েরা দ্বীপের একটা মানচিত্র।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনের চোখেই দূরবীন। এডাম এরিয়েলরা আট নয় ফিট নিচে ৪০ ডিগ্রী কোণে আছে বলে দূরবীনের ফোকাস সহজেই মানচিত্রের উপরও ফেলা যাচ্ছে।
মানচিত্র দেখতে গিয়ে ওরা নিচু স্বরে কথা বলা শুরু করেছে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি পিঠের ব্যাগ থেকে সাউন্ড সেন্সর রেডিও বের করে নিল।
যন্ত্রটি একটা পকেট রেডিওর মত। তাতে দুফিট লম্বা একটা এন্টেনা। এই এন্টেনাটা দুশ বর্গগজের মধ্যেকার সব শব্দ মনিটর করে আলাদা আলাদা করে ক্লাসিফাইড রেকর্ডের পর তা প্রচার করতে পারে।
আহমদ মুসা এন্টেনা তুলে ‘হিউম্যান ভয়েস’ ‘কি’তে চাপ দিয়ে যন্ত্রটিকে সবার মধ্যখানে রেখে দিল।
আহমদ মুসা দূরবীন দিয়ে মানচিত্রের যতটা পারা যায় দেখতে লাগল এবং শুনতে লাগল ওদের কথা রেডিও রিলে থেকে।
যে কণ্ঠ তখন রিলে হচ্ছিল, সেটা এডাম এরিয়েলের কণ্ঠ। শুনেই তা বুঝতে পারল আহমদ মুসা।
বলছিল এডাম এরিয়েল, ‘উচ্চভূমির চারদিকের অবস্থা বুঝলেন তো! এখন দেখুন, আহমদ মুসার যাবার এলাকা একমাত্র দক্ষিণ দিকটাই। উত্তর দিক থেকে সে পালিয়ে এসেছে, অতএব ওদিকে সে এই মুহূর্তে যাবে না। পশ্চিম দিকে ছোটভূমির পরেই বিশাল জলাভূমি। ওদিকে আহমদ মুসার কোন আশ্রয় নেই এবং সামনে এগুবার তার কোন পথ নেই। আর পূব দিকে পাহাড়। এই পাহাড়ের পথে কোন গন্তব্যে পৌছা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য আত্মগোপনের জায়গা এ পাহাড়ে থাকতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা আত্মগোপনের কথা ভাবছে না। তার লক্ষ্য কোন শহর বন্দরে পৌছা। সুতরাং দক্ষিণই তার যাবার একমাত্র পথ। দক্ষিণের পাহাড়-উপত্যকার পথ কষ্টকর হলেও এ পথে কিছুদূর সামনে এগুলে সে পাবে একটা ট্রাইবাল এরিয়া। এস্কিমো, রেড ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুত কিছু লোক এবং পলাতক এক শ্রেণীর অপরাধীদের উত্তর পুরুষ এই এলাকায় বাস করে। এখান থেকে দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূলের কয়েকটি বন্দরে ও দক্ষিণের হেরোইমা শহরে যাবার পাহাড়ী পথ আছে। সুতরাং আহমদ মুসা এই আশ্রয়ের সন্ধানেই এগোবে।’
হাসল ডেভিড ডায়ার। বলল, ‘আহমদ মুসা উচ্চভূমির চারদিকের এত কিছু জানলেই না আশ্রয়ের সন্ধানে দক্ষিণে অগ্রসর হবে। তার এতসব জানার কথা নয়। সে আজ রাতে দ্বীপের বিমান বন্দরে ল্যান্ড করেছে এবং সংগে সংগেই তাড়া খেয়ে সে পালিয়ে এসেছে। আমার ধারণা এত কিছু ভেবে সে এগুতে পারবে না।’
এডাম এরিয়েলও হাসল। বলল, ‘আসলে আপনি আহমদ মুসাকে চেনেন না। সে যে দেশে বা যেখানে পা দেয় তার সবকিছুই সে আগে জেনে নেয়। আমার বিশ্বাস এই দ্বীপের কোন কিছুই তার অজানা নয়।’
‘কিন্তু আপনি কি করে ধরে নিচ্ছেন যে, সে-ই আহমদ মুসা। আমি তো শুনলাম আজর ওয়াইজম্যানও এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি।’ বলল ডেভিড ডায়ার।
‘আগে তিনি নিশ্চিত না হলেও এখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। এখানকার বিপর্যয়ের খবর যে মোবাইলে দিয়েছিল, সে জানায়, তারা আগে আক্রান্ত হয়নি। একটা ফাঁকা গুলী তার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। এই ফাঁকা গুলীর পর তারা আক্রমণ করলে পাল্টা গুলী বর্ষণ শুরু হয় আহমদ মুসার দিক থেকে। এটাই আহমদ মুসার যুদ্ধের সাধারণ কৌশল। সে শত্রুকে কোনওভাবে এলার্ট না করে আক্রমণ সাধারণত করে না। এই ঘটনা যেহেতু এখানে ঘটেছে তাই এখন নিসন্দেহে বলা যায়, এই ম্যাসাকার আহমদ মুসার দ্বারাই হয়েছে।’
‘শত্রুকে আক্রমণের আগে এলার্ট করার আহমদ মুসার এই কৌশল কেন? কেন করে সে এটা?’ বলল ডেভিড ডায়ার।
‘সম্ভবত যুদ্ধ শুরুর দায় আহমদ মুসা তার ঘাড়ে নিতে চায় না, চাপাতে চায় শত্রুর কাঁধে। শত্রুকে এলার্ট করে সে শত্রুকে আক্রমণে নিয়ে আসে, তারপর সে তার জবাব দেয়।’ বলল এডাম এরিয়েল।
‘যুদ্ধে নেমে যুদ্ধের দায় সে নিতে চায় না কেন?’ ডেভিড ডায়ার বলল।
‘সে নিজেকে শান্তিবাদী হিসেবে দেখাতে চায়। সে দেখাতে চায় যে, সে জুলুমের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াই করে।’ বলল এডাম এরিয়েল।
হাসল ডেভিড ডায়ার। বলল, ‘ভূতের মুখে রাম-নাম।’
হাসল এডাম এরিয়েলও। বলল, ‘থাক, এখন যা করার দ্রুত করতে হবে। আমাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত আহমদ মুসাকে আর বাঁচতে দেয়া যাবে না।’
‘বলুন, কি করতে চান? শেষ একটা অস্ত্র তো আমরা সাথে এনে……….।’
ডেভিড ডায়ারের কথা শেষ হলো না। হন্তদন্ত হয়ে একজন নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে এডাম এরিয়েলকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, আমরা আমাদের সাউন্ড রেকর্ড থেকে রিলে গ্রহণ করতে গিয়ে দেখছি, আপনাদের কথা ডাবল রিলে হচ্ছে। তার মানে আপনাদের কথা আরও কোন জায়গা থেকে রেকর্ড ও রিলে হচ্ছে।’
শুনেই এডাম এরিয়েল ও ডেভিড ডায়ার বিদ্যুতপৃষ্টের মত চমকে উঠে সোজা হয়ে বসল। এডাম এরিয়েল চিৎকার করে উঠল, ‘ডাইরেকশন আইডেনটিফাই করেছ?’
হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা লোকটি বলল, ‘জি স্যার। পাহাড়ের দিক মানে পূব দিক থেকে আসছে।’
‘তার মানে আহমদ মুসা পাহাড়েরই কোথাও লুকিয়ে আছে।’ বলল আবার চিৎকার করে এডাম এরিয়েল।
‘স্যার, আপনার একথাগুলোও ওরা শুনতে পাচ্ছে।’ কিছুটা নিচু স্বরে বলল লোকটি।
কিছুটা বিব্রত কণ্ঠে এডাম এরিয়েল বলল, ‘স্যরি। ধন্যবাদ তোমাকে।’
কথাটা বলেই এডাম এরিয়েল উঠে দ্রুত ডেভিড ডায়ারের কাছে গেল। তাকে কানে কানে কি যেন বলল।
ডেভিড ডায়ার সায় দিল এডাম এরিয়েলের কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে।
এরপর এডাম এরিয়েল কানে কানে কিছু বলল হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা লোকটিকে।
শুনেই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে লোকটি দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠল।
ওদিকে ডেভিড ডায়ারও হেলিকপ্টারে উঠে গেল।
এডাম এরিয়েল হাত ইশারা করে ডাকল পাহারায় দাঁড়ানো লোক দুজনকে।
ওরা এলে ওদের দুজনকেই কানে কানে কিছু বলল এডাম এরিয়েল। ওরাও সায় দিল এডাম এরিয়েলের কথায় মাথা নেড়ে।
ওদের সাথে কথা শেষ করেই এডাম এরিয়েল উঠে গেল হেলিকপ্টারে।
হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করল।
গর্জন শুরু করেছে হেলিকপ্টার দুটির ইঞ্জিন।
হেলিকপ্টার থেকে নামল আরও দুজন ষ্টেনগানধারী। তাদের দুজনেরই কাঁধে ঝুলানো ষ্টেনগান এবং কোমরে রিভলবার। শুধু একজনের হাতে বাড়তি বড় একটি ব্যাগ।
আগের দুজনসহ চারজন ষ্টেনগানধারী দৌড়ে হেলিকপ্টারের নিচ থেকে একটু দূরে সরে গেল।
হেলিকপ্টার উঠে গেল আকাশে।
রুদ্ধশ্বাসে দেখছিল আহমদ মুসারা এই দৃশ্য। আহমদ মুসারা জেনেছে, তাদের মনিটরিং ধরে ফেলার সাথে সাথে আহমদ মুসাদের অবস্থানের এলাকাও তারা চিহ্নিত করেছে। এখন কি ওরা আক্রমণে আসবে? কিন্তু ষ্টেনগানধারীদের রেখে হেলিকপ্টার দুটো আকাশে উড়ল কেন? ষ্টেনগানধারীদের পাহারায় রেখে ওরা বিশেষ কোন প্রস্তুতির জন্যে উপরে উঠেছে। তাহলে কি হেলিকপ্টার নিয়ে ওরা আহমদ মুসাদের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্যে বেরুল?
এসব চিন্তা আহমদ মুসার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
হেলিকপ্টার দুটো তখন আকাশে উঠে গেছে এবং পূবমুখী হয়ে উড়তে শুরু করেছে।
নিচের চারজন ষ্টেনগানধারীদের একজন হেলিকপ্টার থেকে নামানো বড় ব্যাগটা খুলে ফেলল। তার ভেতর থেকে এক এক করে বের করে আনল অনেকগুলো গ্যাসমাস্ক।
গ্যাসমাস্কগুলোর দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। পাশের সাউন্ড সেন্সরটা গুটিয়ে ব্যাগের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘হাসান তারিক, ওরা হেলিকপ্টার থেকে গ্যাস ফেলবে এখনি। তোমরা আমার সাথে এস।’
বলে আহমদ মুসা যে পথ দিয়ে উঠেছিল সেই পথে নামা শুরু করল। বলল, ‘ভয় নেই এস, ওদের গ্যাসমাস্ক আমাদের দখল করতে হবে।’
‘ভাইয়া, আমাদের কাছে তো দু’টো গ্যাসমাস্ক আছে। ও দুটো মি. সার্গিও ও মিস ভ্যানিসাকে পরিয়ে দেই?’ চলতে চলতেই বলল হাসান তারিক।
হাসান তারিক, সার্গিও ও ভ্যানিসা আহমদ মুসার পেছনে পেছনে তখন দৌড়াতে শুরু করেছে।
হাসান তারিকের কথার জবাবে আহমদ মুসা দৌড়রত অবস্থায় বলল, ‘ও গ্যাসমাস্কগুলো কার্যকরী থাকে মাত্র দু’এক মিনিট মাত্র। তবুও দিতে পার।’
আহমদ মুসারা সবাই ছুটছে। কিন্তু এগুবার জন্যে যতটা কসরত হচ্ছে, ততটা এগুনো যাচ্ছে না। খাড়া পাহাড়ে ওঠা যতটা কঠিন, নামা তার চেয়েও কঠিন। তার উপর অনেকটা পথ ঘুরে তাদের আসতে হবে হেলিকপ্টার যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই চত্বরটায়।
সার্গিও ও ভ্যানিসার মুখ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আচ্ছন্ন।
আহমদ মুসা এক ঝলক পেছনে তাকিয়ে ওদের লক্ষ্য করে বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই। হেলিকপ্টারগুলো পাহাড়ের পুব অঞ্চলে গ্যাস স্প্রে করতে করতে আসছে, যাতে এর মধ্যে তাদের সব লোকরা গ্যাসমাস্ক পরে নিতে পারে।’
‘ওরা এতবড় অমানুষ! এ গ্যাস প্রয়োগে তো অন্যান্য নিরপরাধসহ পশু-পাখিও মারা পরবে।’ বলে উঠল সার্গিও।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মানুষ যখন অমানুষ হয়, তখন সে পশুর চেয়েও খারাপ হয়ে যায়।’
‘ভাইয়া, আপনি এই সময়েও এমন নির্মল হাসতে পারলেন? আপনার মুখে তো কোন উদ্বেগ দেখছি না।’ আহমদ মুসাক লক্ষ্য করে বলল ভ্যানিসা।
‘আল্লাহ যা ঘটাবেন তাই ঘটবে, চিন্তা করে লাভ কি বোন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে তো আমাদের চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।’ ভ্যানিসা বলল।
‘আমরা যে চেষ্টা করছি, সর্বশক্তি দিয়েই করছি, সেটাও আল্লাহই ঘটাচ্ছেন। কিন্তু উদ্বেগ-আতংক আল্লাহ ঘটান না, কারণ ওটা কোন কাজ নয়।’
হাসল ভ্যানিসা। বলল, ‘অবিস্মরণীয় এক শিক্ষার কথা বলেছেন ভাইয়া।’
পূর্ব দিক থেকে হেলিকপ্টারের গর্জন ভেসে আসছে। দ্রুত ছুটে আসছে ওরা।
আহমদ মুসা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনে পড়ল, তাদের একথাগুলো তো হেলিকপ্টার থেকে ওরা মনিটর করছে এবং এর মাধ্যমে সহজেই ওরা আহমদ মুসাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারবে। অলরেডি ওরা তা হয়তো করেছেও।
ভ্যানিসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘নো মোর টক। ওরা আমাদের অবস্থান ধরে ফেলবে।’
আরেক ঝলক উদ্বেগ নেমে এল সার্গিও এবং ভ্যানিসার চোখে-মুখে।
চত্বরের কাছাকাছি পৌছে গেছে আহমদ মুসারা। চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ওরা পূব দিক থেকে যে গ্যাস স্প্রে করতে করতে আসছে, তার প্রভাব এখানকার বাতাসেও ছড়িয়ে পড়েছে।
আরও দ্রুত পা চালালো আহমদ মুসা। সে আরও একটা বিষয় ভেবে উদ্বিগ্ন হলো। গ্যাসমাস্ক ওয়ালারা চারজনই যদি গ্যাসমাস্কগুলো উচ্চভূমির ঢালে তাদের সহকর্মীদের কাছে নিয়ে গিয়ে থাকে! সে ক্ষেত্রে মুস্কিলে পড়বে তারা। গ্যাসমাস্ক সংগ্রহ তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।
আশা-নিরাশার দোলায় দুলে আহমদ মুসা ষ্টেনগান সামনের দিকে তাক করে গিরিপথের আড়াল থেকে মুখ বাড়াল। দেখল তিনজন ষ্টেনগানধারী রয়েছে। চতুর্থজন সঙ্গীদের গ্যাসমাস্ক সরবরাহ করতে গেছে ঢালে, বুঝল আহমদ মুসা। গ্যাসমাস্কের ব্যাগটাও পড়ে আছে চত্বরে।
‘পশ্চিমমুখী হয়ে পজিশন নিয়ে বসে থাকা গ্যাসমাস্ক পরা ষ্টেনগানধারীদের অলক্ষ্যে তাদের পেছন থেকে গ্যাসমাস্কের ব্যাগ নিয়ে আসবে কিনা, ইত্যাদি নিয়ে আহমদ মুসা কোন সিদ্ধান্তে পৌছার আগেই পেছন থেকে প্রচন্ড হাঁচি দিয়ে উঠল ভ্যানিসা।
বাতাস কিছুটা দুষিত হয়ে পড়ার কারণেই এটার কোন এলার্জিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
হাঁচির সাথে সাথেই তিনজন ষ্টেনগানধারী চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়াল। তাদের ষ্টেনগানও উঠে আসছিল।
আহমদ মুসা সংঘর্ষে যাওয়া ছাড়া গ্যাসমাস্ক দখলের আর কোন উপায় দেখল না।
আহমদ মুসার ষ্টেনগান তাক করাই ছিল। শুধু ট্রিগার চেপে ধরল সে।
ওরা আর গুলী করার সুযোগ পেল না। গুলী খেয়ে পড়ে গেল তিনটি দেহই।
আহমদ মুসা ষ্টেনগান বাগিয়ে ধরে ছুটল ব্যাগের দিকে। তার পেছনে পেছনে ছুটল হাসান তারিক ও ভ্যানিসারাও।
ব্যাগেই গ্যাসমাস্ক পাওয়া গেল।
দ্রুত গ্যাসমাস্ক পরে নিল সবাই।
হেলিকপ্টার এসে গেছে। নিশ্চয় হেলিকপ্টারে ওরা ষ্টেনগানের শব্দ শুনেছে। ওদের দূরবীনে আহমদ মুসারা ধরাও পড়ে যেতে পারে।
‘সবাই এস, জংগলের আড়ালে যেতে হবে।’ খুব নিচু স্বরে কথাগুলো বলে আহমদ মুসা ছুটল জংগলের দিকে। তার সাথে সবাই।
হেলিকপ্টার আসছিল গ্যাস স্প্রে করতে করতে। হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান দাগাও শুরু হলো।
‘হেলিকপ্টার নিশ্চয় ষ্টেনগানের শব্দ শুনেছে, এখন দেখতে পেয়েছে তাদের লোকদের লাশও। আমরা উচ্চভূমির জংগলে আশ্রয় নিয়েছি, এটাও নিশ্চয় ওরা দেখতে পেয়েছে। এস, আমরা উত্তর দিকের ঢালের দিকে আগাই। ওদিকে তাদের লোক আছে। ওদিকে মেশিনগানের ফায়ার কম হতে পারে।’
নিচু চাপা কণ্ঠে কথাগুলো বলার সাথে সাথে আহমদ মুসা উত্তর দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে। তার ষ্টেনগানের নল সামনে উদ্যত। আঙুল ষ্টেনগানের ট্রিগারে। তার পেছনে অন্য সবাই।
পথের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ঘন ঝোপের পাশ কাটিয়ে সামনে এগুতেই আহমদ মুসা ৫জন ষ্টেনগানধারীর একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেল। ওরাও দৌড়ে আসছিল, সম্ভবত এদিকে ষ্টেনগানের আওয়াজ শুনেই।
ঘটনার আকস্মিকতা উভয় পক্ষকেই বিমূঢ় করে দিয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসা এ ধরণের অবস্থার জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তার ষ্টেনগানও হাতে বাগিয়ে ধরা ছিল, হাতের আঙুলও ছিল ট্রিগারে। সুতরাং জিতে গেল আহমদ মুসাই। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে ট্রিগারে চেপে ধরল আঙুল।
ওরাও বিমূঢ়তার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। নড়ে উঠেছিল তাদের ষ্টেনগানও।
কিন্তু তারা এ্যাকশনে যাবার আগেই সে সুযোগ তাদের শেষ হয়ে গেল। পাঁচজনই ষ্টেনগানের গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে ভূমি শয্যা নিল।
আহমদ মুসা একবার পেছনে তাকিয়ে ‘এস তোমরা’ বলে আবার দৌড়াতে শুরু করল।
সবাই এসে পৌছল উত্তর ঢালের মুখে। আহমদ মুসা সবাইকে বড় গাছের গোড়ায় আশ্রয় নিতে বলল।
কিন্তু হেলিকপ্টারের গুলী জংগলের মাঝামাঝি অতিক্রম করার পর বন্ধ হয়ে গেল।
হেলিকপ্টার চলে এল ঢালের ওপর।
‘ওরা ঢালে পাঠানো ওদের লোকদের খুঁজছে।’ বলে একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল নিচু স্বরে আবার, ‘ঢালে ওদের লোকদের পাচ্ছে না। সুতরাং এখন নিশ্চয় ওরা ভাবছে, তাদের লোকরা ঢালের কাজ সেরে উচ্চভূমির জংগলে উঠে এসেছে। এই ষ্টেনগানের ফায়ারও তাদের কানে গেছে। অতএব এখন তারা ভাবতে বাধ্য হবে, জংগলে তাদের লোকদের সাথে আমাদের লোকদের সংঘর্ষ চলছে। ফলে এখন তাদের মেশিনগান ও গ্যাস আক্রমণ দুটোই অকেজো।’
‘কি করে?’ বলল ভ্যানিসা খুব আসেত্ম। তার বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে সপ্রশংস দৃষ্টি।
‘গ্যাসমাস্ক আমরা দখল করেছি, এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত। সুতরাং গ্যাস আক্রমণ কোন কাজ দেবে না। আর যেহেতু ওরা ধরে নিতে বাধ্য হয়েছে, ওদের লোকরাও এখন উচ্চভূমিতে, তাই হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান আক্রমণও তারা চালাতে পারছে না।’ আহমদ মুসা বলল প্রায় ফিসফিস করে।
কথাটা বলেই আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। দ্রুত চাপা কণ্ঠে নির্দেশ দিল, ‘হাসান তারিক, তুমি যাও এখনি যে লাশগুলো পড়ল ওদের কাছে। ওরা ওদের সহকর্মীদের মোবাইলগুলো সংগ্রহের কথা বলেছিল। সবাইকে সার্চ করে মোবাইলগুলো নিয়ে এস।’
‘আমি যেতে পারি মি. তারিকের সাথে। তাকে সহযোগিতা করব।’ বলল সার্গিও যথাসাধ্য তার দরাজ কণ্ঠকে নিচু রেখে।
‘না মি. সার্গিও, আপনি ভ্যানিসার কাছে থাকুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি তো আছেনই।’ বলল সার্গিও।
‘না আমি থাকছি না। এখনি গাছে উঠব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘গাছে কেন?’
‘ওখান থেকে হেলিকপ্টারকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। ওদের কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’ বলেই আহমদ মুসা এগুলো সামনের সবচেয়ে বড় গাছটার দিকে।
গাছে উঠল আহমদ মুসা।
গাছের এমন এক জায়গায় উঠে সে বসল যাতে চারদিকের আকাশটাকে ভালোভাবে দেখা যায়। মাথার উপরটাতেই গাছের ডাল-পালার আড়াল। হেলিকপ্টার সরাসরি উপর থেকে তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু সে হেলিকপ্টারকে টার্গেট করতে পারবে। কিন্তু অসুবিধা যেটা হবে সেটা হলো, একমাত্র উপর ছাড়া চারপাশ থেকে হেলিকপ্টার তাকে দেখতে পাবে, যদি তারা বিশেষভাবে এদিকটার দিকে তাকায়।
উচ্চভূমির গোটা আকাশটাই চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার দুটি। তবে এক সাথে নয়, আলাদাভাবে এবং বেশ দূরত্ব রেখে।
আহমদ মুসা গাছের ডালে যুতসইভাবে বসে তখনও তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। এই সময় দেখতে পেল, একটি হেলিকপ্টার পূবদিকে কিছু দূরে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। আহমদ মুসার মনে হলো, হেলিকপ্টারটি তাকে দেখতে পেয়েছে। হেলিকপ্টারের খোলা দরজা এদিকে হা করে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয় দূরবীনের দুটি চোখ এ দিকে স্থিরভাবে নিবদ্ধ, ভাবল আহমদ মুসা।
দক্ষিণ দিকের দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটি উড়ে আসছিল পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে। সে হেলিকপ্টারটিও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, দেখল আহমদ মুসা। সেই সাথে দেখতে পেল, হেলিকপ্টারটির মাথা বোঁ করে উত্তরমুখী হয়ে ঘুরে গেল। দ্রুত আহমদ মুসা তাকাল পূবের হেলিকপ্টারটির দিকে। দেখল, পূবের হেলিকপ্টারটির মাথাও পশ্চিম দিকে ঘুরে গেছে। আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না দক্ষিণ দিকের হেলিকপ্টারটি, পূবের হেলিকপ্টারকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। এখন দুটি হেলিকপ্টারই তাকে আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুত।
আহমদ মুসার এই চিন্তা শেষ হবার আগেই দেখল, হেলিকপ্টার দুটি তার দিকে দৌড় শুরু করেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত ভাবল, সে ঝুলানো দড়ি বেয়ে নিচে নেমে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু তার ফলে হেলিকপ্টার দুটি বেপরোয়া আক্রমণের সুযোগ পেয়ে যাবে উচ্চভূমির উপরে। কারণ তারা এখন নিশ্চিত মনে করবে, তাদের লোকেরা উচ্চভূমিতে জীবিত থাকলে তাদের শত্রুরা এভাবে গাছে উঠতে পারতো না। সুতরাং হেলিকপ্টার দুটোকে সে সুযোগ দেয়া যাবে না।
এ চিন্তার সাথে সাথে আহমদ মুসা চারদিকে তাকাল। তার চার দিকেই গাছ আছে তবে বেশ দূরে দূরে। কোন কোনটির দূরত্ব পনের-বিশফুট হবে।
দক্ষিণ পূর্ব কোণের দিকে একটা গাছকে টার্গেট করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে এসে আশে-পাশের কয়েকটা ছোট ডাল ভেঙে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুঁজে দিয়ে বাদুড়ের মত খুব সহজভাবে এগুলো দক্ষিণ পূবমুখী একটা মোটা ডাল বেয়ে।
ডালের প্রান্তের দিকে রশির মাথা শক্ত করে বেঁধে আহমদ মুসা ফিরে এল তার আগের জায়গায় রশির শেষ প্রান্তটা হাতে ধরে। তার পর দ্রুত কিছুটা নেমে এসে দুহাতে রশির দুপ্রান্ত জড়িয়ে দুপায়ে গাছটিকে প্রচন্ড শক্তিতে পেছনে ঠেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসা। মুহূর্তেই লম্বা রশির ঝুলন্ত গতিবেগ ক্ষেপণাস্ত্রের মত আহমদ মুসাকে পৌছে দিল দক্ষিণ-পুবের সেই গাছটির একটা ডালের সান্নিধ্যে। আহমদ মুসা এক হাতে ডালটি ধরে ফেলে রশি ছেড়ে দিয়ে দুহাতে ডালটি আঁকড়ে উঠে গেল গাছে।
দুটি হেলিকপ্টারের শব্দও অনেক কাছে এসে গেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত গাছের উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। পাতায় জড়ানো অনেকগুলো ডালের এক গ্রন্থিতে আশ্রয় নিল আহমদ মুসা।
হেলিকপ্টার দুটি এসে গেছে। তাদের টার্গেট সবচেয়ে লম্বা ঐ গাছটি।
প্রবল এক পশলা গুলী বর্ষণ করল গাছটির উপর।
গাছের উপর আকাশে ইতস্তত ঘুরতে লাগল হেলিকপ্টার দুটি।
গাছটিতে কোন লোক নেই এবং সে যে নিচে নেমে গেছে তা তারা বুঝে ফেলেছে।
এ সময় একটা বোমা বিস্ফোরিত হলো গাছের নিচে।
ওরা বোমা ফেলেছে, বুঝল আহমদ মুসা। গ্যাস বোমা নয়, আগুনে বোমা। তবু আহমদ মুসা তার গ্যাস মুখোশটাকে ভালো করে টেনে-টুনে ঠিক করে নিল।
ধুঁয়া ধেয়ে আসছে নিচ থেকে উপর দিকে।
আহমদ মুসা খুশি হলো এই ভেবে যে, ধুঁয়া তাকে ঢেকে ফেলবে এবং হেলিকপ্টার থেকে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু এই সাথে ভাবল ধুঁয়ায় আচ্ছন্ন হলে হেলিকপ্টার দুটোকে টার্গেট করা তার জন্যে কঠিন হয়ে পড়বে। তার উপর হেলিকপ্টার দুটি যদি এই অবস্থায় অন্যদিকে সরে যায়, তাহলে তার গাছে উঠাই বেকার যাবে।
এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা দুহাতে তার দুটি ষ্টেনগানকে তৈরি করে নিয়েছে।
তখন ধোঁয়া উঠে আসেনি এবং তখনও হেলিকপ্টার দুটো গাছটির আকাশে চক্কর দিচ্ছে। গতি তাদের খুব স্লো।
ডালের গ্রন্থিতে পা রেখে আহমদ মুসা গাছের কান্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ষ্টেনগান দুটির ব্যারেল অধীরভাবে অপেক্ষা করছে হেলিকপ্টার দুটি তার নাগালের মধ্যে আসার।
আহমদ মুসা জানে, তার প্রথম আক্রমণই শেষ আক্রমণ হবে। প্রথম আক্রমণ থেকে যদি ওরা বেঁচে যায়, তাহলে ওদের পাল্টা আক্রমণের মুখে আহমদ মুসা দ্বিতীয় আক্রমণের সুযোগ পাবে না।
এজন্যেই আহমদ মুসার ষ্টেনগান দুটি খুব সতর্ক।
এক সময় উত্তর ও দক্ষিণ গামী হেলিকপ্টার দুটি আহমদ মুসার মাথার উপরে প্রায় ২০ ডিগ্রী কোণে পাশাপাশি চলে এল। দক্ষিণমুখি হেলিকপ্টারটি পুবপাশে, আর উত্তরমুখিটি পশ্চিম পাশে। দুটি ফুয়েল ট্যাংকার ষ্টেনগানের নাগালের মধ্যে এসেছে।
গর্জে উঠল আহমদ মুসার দুহাতের দুটি ষ্টেনগান। অবিরাম গুলীর ঝাঁক ছুটে চলল হেলিকপ্টার দুটিকে লক্ষ্য করে।
আক্রান্ত হয়েই হেলিকপ্টার দুটি দ্রুত সরে যেতে লাগল এবং অবিরাম গুলীবৃষ্টি তারাও শুরু করল ভূমির দিকে।
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। হেলিকপ্টার দুটি সরে গিয়ে গুলীবৃষ্টি শুরু না করলে আহমদ মুসা পূব পাশের হেলিকপ্টারের গুলীতে এতক্ষণ ঝাঁঝরা হয়ে গোশতের স্তুপে পরিণত হয়ে যেত।
হেলিকপ্টার দুটি দুদিকে চলে গেল, আর ফিরে এল না।
আহমদ মুসার এ গাছটা অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সেও গাছের শীর্ষ থেকে অনেকখানি নিচে, তাই আকাশটা আর তার চোখে পড়ছে না।
আহমদ মুসা একটু অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিল।
একটু পরেই নিচ থেকে সার্গিও চিৎকার করে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা, একটি হেলিকপ্টারে আগুন ধরে গেছে, অন্যটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দ্রুত ফিরে যাচ্ছে।’
সার্গিও’র কথা শেষ না হতেই প্রচন্ড বিস্ফোরনের শব্দ শোনা গেল পুব দিক থেকে।
‘হেলিকপ্টারটি ধ্বংস হয়ে গেছে মি. আহমদ মুসা।’ নিচ থেকে আনন্দে চিৎকার করে উঠল সার্গিও’র কণ্ঠ।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে আহমদ মুসা গাছ থেকে নামা শুরু করল।
গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল হাসান তারিক, সার্গিও এবং ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা গাছ থেকে নামতেই সার্গিও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘অভিনন্দন মি. আহমদ মুসা। আমাদের টেরসিয়েরা দ্বীপ অবিস্মরণীয় এক যুদ্ধ দেখল। সেই সাথে দেখল আহমদ ………।’
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘আর দেরি নয় মি. সার্গিও, এখনি এখান থেকে সরতে হবে। আমাদেরকে অহেতুক যুদ্ধ এড়াতে হবে।’
‘অহেতুক কেন? এ যুদ্ধে শত্রুরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দূর্বল হয়েছে।’
‘এটুকুই লাভ মি. সার্গিও। কিন্তু এই লাভ করতে গিয়ে শত্রুদের যে পরিমাণ উস্কে দিয়েছি তাতে উদ্দেশ্য হাসিলের পথে এগুবার বদলে আত্মরক্ষার লড়াই-এ ব্যস্ত থাকতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সার্গিও ও ভ্যানিসা স্থির দৃষ্টি তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। আহমদ মুসা থামার একটু পরে সার্গিও বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনি যেভাবে ভেবেছেন, ওটা আমাদের মাথাতেই আসেনি। আপনি ঠিকই বলেছেন।’
সার্গিও একটু থেমেই পরক্ষণে আবার বলল, ‘ওদের নতুন আক্রমণের আশংকা করছেন আপনি?’
‘এই পরিস্থিতিতে ওরা বড় ধরনের আক্রমণে না এসেই পারে না। আমি হলে তো সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করতাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে চলুন আমরা এখন থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়ি।’ বলল সার্গিও।
‘অস্ত্রগুলো কাজে লাগবে, কিন্তু এতগুলো অস্ত্র নেয়া হবে কি করে মি. সার্গিও?’
‘অসুবিধা হবে না, আমরা সবাই ভাগ করে নেব। একটু এগুলেই আমরা দুটি ঘোড়া পেয়ে যাব।’ বলল সার্গিও।
‘আপনারা ঘোড়ায় এসেছিলেন? সামনে তাহলে ঘোড়া চলার মত ভালো রাস্তা আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘দক্ষিণের পাহাড়-উপত্যকার খাড়া চড়াই-উৎরাইটা খুব বেশি নয়। তারপরেই ঘোড়া চলতে পারে।’ বলল সার্গিও।
তৈরি হয়ে চলতে শুরু করল তারা।
যে গিরিপথ দিয়ে তারা পাহাড়ে উঠেছিল লুকাবার জন্যে, সে গিরিপথ দিয়েই তাদের চলা শুরু হলো।
‘আমাদের এ যাত্রা কোথায়? আপনাদের বাড়িতে? কোথায় আপনাদের বাড়ি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা সার্গিওকে।
‘এই উচ্চ ভূমিটাই ছিল আমাদের আদি বাড়ি। ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেলে আরও দক্ষিণে সরে একটা বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। যখন নিরিবিলি সময় কাটাতে চাই, তখন এ বাড়িতেই আমরা আসি।’ বলল সার্গিও।
‘এই উচ্চভূমিটা কি করে বাড়ি হয়? না সমুদ্রের তীর, না নদীর ধার এটা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটাই ছিল তখন সমুদ্র তীর। এই উচ্চভূমিটা একটা দূর্গ। দূর্গটা তৈরি হয়েছিল সমুদ্র তীরে। এর উত্তরের অঞ্চলটা ভূমিকম্পের ফলে জেগে উঠেছে।’
‘এই দুর্গটা আপনাদের পরিবারের বাড়ি হলে ধরে নিতে হবে যে আপনারাই এ দ্বীপের আদি শাসক পরিবার?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘এ দ্বীপের নয় এ দ্বীপপুঞ্জের। আমাদের গনজালো পরিবারই এ দ্বীপের আদি শাসক।’ বলল সার্গিও।
পূর্বমুখী গিরিপথ কিছুটা গিয়ে একেবারে এবাউট টার্ণ করে পশ্চিমমুখী হয়ে একটা সমতল উপত্যকায় প্রবেশ করল। চারদিকের পাহাড়ের দেয়াল ঘেরা উপত্যকাটা বেশ বড়। সারি সারি কবর সে উপত্যকায়। প্রতিটি কবরের শিয়রে ক্রুস শোভা পাচ্ছে।
‘এটা আমাদের আদি পারিবারিক কবরস্থান। ভূমিকম্প আমাদের দূর্গ ধ্বংস করেছে। কিন্তু এ কবরস্থানটা অক্ষত আছে।’ বলল সার্গিও।
উপত্যকার মাঝ বরাবর দিয়ে তারা পশ্চিমে এগিয়ে চলল। দুধারে কবরের সারি।
সামনে চলছিল হাসান তারিক। তারপর ভ্যানিসা। ভ্যানিসার পরে সার্গিও। সবশেষে আহমদ মুসা।
উপত্যকার পশ্চিম প্রান্তে তারা এসে গেছে।
হঠাৎ হাসান তারিক থমকে দাঁড়িয়েছে।
‘একি দেখছি আহমদ মুসা ভাই?’ বলল হাসান তারিক।
‘কি হল? কি দেখছেন?’ বলল সার্গিও ও ভ্যানিসা এক সাথে। তাদের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা।
দ্রুত আহমদ মুসা সামনে চলতে চলতে বলল, ‘কি হয়েছে, কি দেখছ?’
হাসান তারিক মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে ইংগিত করল সামনের কবরের দিকে।
তাকাল আহমদ মুসা। কবরগুলো চোখে পড়ল তার। তাঁর ভ্রুও কুঞ্চিত হয়ে উঠল। উপত্যকার পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত অনেকগুলো কবরের শিয়রে ক্রস রাখা নেই। এই কবরগুলোর সবগুলোর উপরের কাঠামো ভেঙে লন্ড-ভন্ড করা। কিন্তু তারপরও কবরের বুনিয়াদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এই কবরগুলো দক্ষিণ উত্তরমুখী করে তৈরী। অথচ এর পরের সবগুলো কবরই পূব-পশ্চিম মুখী এবং এদের প্রত্যেকটির শিয়রে ক্রস স্থাপিত আছে।
আহমদ মুসাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
পেছন থেকে সার্গিও সামনে এসে আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মাঝখানে দাঁড়াল। সামনে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলে উঠল, ‘ও এই কবরগুলো ভাঙা কেন! অবাক হয়েছেন আপনারা?’ বলে একটু থামল সার্গিও।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক কিছু বলল না।
সার্গিওই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘সব কথা জানি না। তবে শুনেছি, প্রায় একশ বছর আগে আমাদের এক পূর্ব পুরুষ আমাদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জের আজকের আধুনিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গোমেজ গনজালো এই কবরগুলো ভেঙে ফেলেন। সেই সময় ইউরোপের এক সংবাদপত্রে আমাদের পরিবারের দুর্নাম রটাবার জন্যে কি যেন লেখা হয়, তারপরেই তিনি এই কবরগুলো ভেঙে ফেলেন। শুধু তাই নয়, ভেংগে প্রথম কবরটার পাশে পারিবারিক একটা বাক্সও সমাধিস্থ করেন এবং কবরস্থানকে বিদেশীদের জন্যে নিষিদ্ধ করে দেন। একশ বছরের মধ্যে আপনারাই প্রথম বিদেশী এই কবরস্থানে প্রবেশ করেছেন।’
‘বাক্সটা কেন সমাধিস্থ হলো, কিছু জানেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমি জানি না। তবে অনুমান করি, কবরগুলো যে কারণে ভাঙা হয়েছে, সেই একই কারণে বাক্সটাকেও সমাধিস্থ করা হয়েছে।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু ঐ কবরের কাছে কেন? যে কোন জায়গায় করলেই তো হতো!’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমারও সেই প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর জানি না।’ সার্গিও বলল।
সার্গিও থামতেই ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘মনে হয় পরিত্যাজ্য গোপন কিছু সমাধিস্থ করা হয়েছে।’
‘ধন্যবাদ ভ্যানিসা। আমারও তাই মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কবরগুলো ভাঙা হলো কেন, এই ব্যাপারে আপনার কি মনে হয় ভাইয়া?’
‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। কিন্তু বলবো না। তোমাদের একশ বছর আগের পূর্ব পুরুষ যেমন তা সহ্য করতে পারেনি, তেমনি হয়তো তোমরাও পারবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পারবো ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা।
‘ঠিক আছে বলব। আজ নয়। ঐ বাক্সটা যেদিন উদ্ধার করব, সেদিন বলব। এমনও হতে পারে আমাকে কিছুই বলতে হবে না। বাক্সটাই বলে দেবে সব।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় ফুটে উঠল সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেরই চোখে-মুখে। বলে উঠল সার্গিও, ‘বাক্সে কি আছে কেমন করে অনুমান করতে পারছেন? আর ঐ বাক্স আপনি পাবেনই বা কি করে?’
‘অনুমান কিভাবে তার উত্তর ভ্যানিসাই দিয়েছে। যে কারণে কবরগুলো ভাঙা সেই একই কারণে বাক্সটিকেও সমাধিস্থ করা হয়েছে। এদিক থেকে বাক্সে কি থাকতে পারে অনুমান করছি। আর বাক্স পাব কি করে? মাটি খুঁড়ে বের করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাক্সটাকে আপনি এত জরুরী মনে করেন?’ সার্গিও বলল।
‘হ্যাঁ মি. সার্গিও। আপনারা রাজী হলে এখনি খুঁড়ে ওটা বের করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না মি. আহমদ মুসা। আজ নয়। আর একদিন আসব আমরা এদিকে। আর এ ব্যাপারে আম্মাকেও আমার রাজি করতে হবে। কারণ ওটা ছিল পারিবারিক এক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’ সার্গিও বলল।
‘আমার আপত্তি নেই মি. সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আবার যাত্রা শুরু হোক।’ সার্গিও বলল।
যাত্রা আবার শুরু হলো আগের মতই।
হাঁটা শুরু করে ভ্যানিসা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কবর ভাঙার রহস্য জানার ব্যাপারটা তো দেখছি অনির্দিষ্ট সময় চেপে রাখতে হবে, কিন্তু আমি তো এক মুহূর্তও তা পারছি না।’
‘বেশি প্রত্যাশার জিনিস হলে বেশি ভালো লাগবে ভ্যানিসা।’ বলল আহমদ মুসা একটু রসিকতার সুরে।
‘কিন্তু মি. আহমদ মুসা, প্রত্যাশা ও না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে চলছে ভ্যানিসা। তার উপর আরও লোড চাপানো আরও দুঃখজনক হবে।’ সার্গিও বলল।
‘কি সে তিক্ত অভিজ্ঞতা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
সার্গিও মুখ খুলতে যাচ্ছিল।
ভ্যানিসা চিৎকার করে তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আমি কিন্তু এখানে বসে পড়ব।’ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে তার মুখ।
‘ঠিক আছে বলব না।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বলার দরকার নেই। আমার বুঝা হয়ে গেছে। আমার জিজ্ঞাসা মি. সার্গিও, উনি কি এখন রাজবন্দী, না বিদেশে?’
বিস্ময় ফুটে উঠল ভ্যানিসা ও সার্গিও দুজনের চোখে মুখে। পরক্ষণেই বিস্ময়ের স্থান দখল করে নিল বেদনা। বলল সার্গিও ধীরে ধীরে, ‘রাজবন্দী নয়, তবে নজরবন্দী।’
‘ঘটনা কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ঘটনাটা বেদনার। ভ্যানিসা বিদ্রোহী গনজালো পরিবারের মেয়ে, আর সে আজোরসের পর্তুগীজ গভর্ণর পেড্রো পাওলেটা’র ছেলে। দুজনেই লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি ছিল। পাশ করে এসেছে। এখন লুই জুগো রাজধানী পন্ট ডেলগাডারের বাইরে বেরুতে পারে না। আর ভ্যানিসার জন্যে রাজধানীতে ঢোকা কঠিন।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এসব কোন ব্যাপারই নয়। আমি আগের কথাই একটু ঘুরিয়ে বলব, ভালো লাগার বস্তু পাওয়া একটু কঠিন হওয়া বাজার অর্থনীতির জন্যেও স্বাভাবিক।’
সার্গিও মুখ টিপে হাসল।
আরও রক্তিম হয়ে উঠল ভ্যানিসার মুখ।
কিছু বলল না কেউ।
৩
‘চিন্তার কিছু নেই স্যার। ভাল খবরই আমরা আশা করছি।’ বলল জ্যাক শামির আজর ওয়াইজম্যানকে উদ্দেশ্য করে।
‘জ্যাক শামির WFA-এর একজন নেতা এবং আজোরস দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী ‘পন্ট ডেলগাডা’র ষ্টেশন চীফ হিসেবে কাজ করছে বর্তমানে।
‘পাঁচ ঘন্টার জন্যে ওরা হেলিকপ্টার ভাড়া করেছিল। কিন্তু এখন পার হয়ে গেছে ৬ ঘন্টা। তারা অবশ্যই ফেরার কথা। কিন্তু তারা কিছু জানাচ্ছে না, আবার তাদের মোবাইলও বন্ধ। কারণটা তাহলে কি?’ বলল আজর ওয়াইজম্যান সামনে বসা জ্যাক শামিরকে লক্ষ্য করে।
আজর ওয়াইজম্যান কথা বলছে জ্যাক শামিরকে লক্ষ্য করে, কিন্তু তার চোখ জানালা পেরিয়ে আজোরস সাগরের উপর নিবদ্ধ।
আজোরস সাগরকে তার যতটা সুন্দর লাগতো, আজ ততটা সুন্দর লাগছে না। সুন্দরের পাশে সেখানে ভয়ংকর একটা রূপও সে দেখছে। মাত্র দুজন লোকে তার চল্লিশজন লোক শেষ করে দিল, এই ভয়ংকর চিন্তা যেমন তার সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করেছে, তেমনি গ্রাস করছে যেন সামনের সাগরটাকেও।
জ্যাক শামির বলছিল, ‘এদিকটা ভাববার বিষয়ই বটে। তবে স্যার এটা ঘটতে পারে যেহেতু তারা পাঁচ ঘন্টার মধ্যে ফিরতে পারেনি।’
আজর ওয়াইজম্যান মুখ ফিরিয়ে নিল সাগরের দিক থেকে। তাকাল জ্যাক শামিরের দিকে। তার কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বলল, ‘কি যেন বললেন, পুলিশ প্রধান আসবেন, না আমাকে যেতে হবে?’
‘পুলিশ প্রধান মি. বারবোসা পোর্টে কি এক মিটিং-এ যাচ্ছেন, এদিক দিয়ে ফিরবেন, সে সময় এখানে উঠবেন।’
আবার আজর ওয়াইজম্যান সাগরের দিকে ফিরে তাকাল। কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময় বেজে উঠল তার টেলিফোন।
ঘুরল আজর ওয়াইজম্যান মোবাইলের দিকে। তুলে নিল টেলিফোনটা।
ওপার থেকে বলে উঠল, ‘ডেভিড ডায়ার বলছি।’
‘তোমাদের কি খবর? আমাদের ওখানকার চীফ এডাম এরিয়েল কোথায়? এত দেরিতে টেলিফোন করছ কেন?’ এক সাথে প্রশ্নগুলো করে চুপ করল আজর ওয়াইজম্যান।
তারপর ওপারের কথা শুনতে লাগল আজর ওয়াইজম্যান। শুনতে গিয়ে মুখের ভাব পাল্টে যেতে লাগল তার। শেষে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে রাগে-দুঃখে যেন কাঁপতে লাগল তার ঠোঁট।
সব শুনে শেষে ছোট্ট করে সে বলল, ‘ও দুজনকে ঐ তেরসিয়েরা দ্বীপ থেকে বের হতে দেয়া যাবে না। তোমরা অপেক্ষা কর। আমি ব্যবস্থা করছি।’
বলে টেলিফোন রেখে দিল আজর ওয়াইজম্যান।
শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় অপেক্ষা করছিল জ্যাক শামির। আজর ওয়াইজম্যান টেলিফোন রাখতেই বলল, ‘ওখানকার কি খবর স্যার।’
টেলিফোন রাখার পর মুহূর্তকাল সোজা হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকল চেয়ারে। বলল, ধীরে ধীরে, ‘আমাদের হেলিকপ্টার অভিযান ধ্বংস হয়েছে। গ্রাউন্ডে নামানো দশজন কমান্ডোই নিহত। একটি হেলিকপ্টার ধ্বংস হওয়ার ফলে একজন ক্রুসহ এডাম এরিয়েল নিহত হয়েছে। আরেকটা হেলিকপ্টারও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ডেভিড ডায়ার আহত। ঐ হেলিকপ্টারের একজন ক্রু মাত্র অক্ষত আছে।’
বিস্ময় ও বেদনার ধাক্কার সংগে সংগে কথা বলতে পারল না জ্যাক শামির। নিজেকে সামলে নিয়ে একটু পর বলল, ‘এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা আবারও ঘটতে পারল কি করে? ওদের সাথে আর কেউ কি যোগ দিয়েছে?’
‘তার কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। প্রথম অভিযানের প্রথম আক্রমণের পর যে দুজন বেঁচে গিয়েছিল, তারা স্বচক্ষে দুজনকেই মাত্র দেখেছে। মোবাইল করার পর ওরাও সম্ভবত নিহত হয়।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
জ্যাক শামির কিছু বলবে এমন সময় এটেনড্যান্ট ঘরে প্রবেশ করে জ্যাক শামিরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘স্যার, পুলিশ প্রধান মি. বারবোসা এসেছে।’
সংগে সংগে উঠে দাঁড়াল জ্যাক শামির ও আজর ওয়াইজম্যান।
তারা ঘরের বাইরে গিয়ে স্বাগত জানাল আজোরস দ্বীপপুঞ্জের পুলিশ প্রধান বারবোসাকে।
তিনজনই ঘরে এসে তিন সোফায় মুখোমুখি বসল।
পুলিশ প্রধান বারবোসা বসতে বসতেই বলে উঠল, ‘মি. ওয়াইজম্যান আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। ব্যাপার কি?’
আজর ওয়াইজম্যান ম্লান হাসল। বলল, ‘দুজন সন্ত্রাসী মুসলমান আমাদের সাংঘাতিক কষ্ট দিচ্ছে মি. বারবোসা।’
‘কোথায় তারা? কোন কেস করেছেন?’ জিজ্ঞেস করল পুলিশ প্রধান।
‘সবে গত রাতে তারা ‘লিজে’ এয়ারপোর্টে নেমে তেরসিয়েরা দ্বীপে প্রবেশ করেছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আজোরস দ্বীপপুঞ্জে মুসলমানদের একটা সন্ত্রাসী দলের প্রবেশ করার পরিকল্পনা আছে, আপনাদের এই ইনফরমেশনের ভিত্তিতে সরকার তো আজোরস দ্বীপপুঞ্জে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তারা প্রবেশ করল কিভাবে?’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘ওরা ছদ্মনাম নিয়ে প্রবেশ করেছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘তাদের ছদ্মনাম জানেন কি না?’
‘হ্যাঁ। একজনের নাম ‘রুই জর্জ’, অন্যজনের নাম ‘পেড্রো পেট্রিট।’
‘পুলিশকে আগে জানাননি কেন?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ প্রধানের।
‘ওরা এয়ারপোর্টে নামার পর সন্দেহ হওয়ায় ওদের ফলো করতে গিয়ে আমরা এটা জানতে পেরেছি।’ উত্তর দিল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কেন আপনারা সন্দেহ করলেন? আমাদের পুলিশ তো সন্দেহ করতে পারেনি।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘এয়ারপোর্টের বাইরে ওদের কথাবার্তা শুনে আমাদের লোকদের সন্দেহ হয়। পরে খোঁজ নিয়ে এই তথ্য জানা গেছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘এখন বলুন ওরা কি কষ্ট দিচ্ছে, আমরা কি করতে পারি? আর একটা উপকার করুন, আপনারা যেহেতু প্রথম জেনেছেন তাই আপনারা ওদের দুজনের বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করুন যে, তারা নাম ভাঁড়িয়ে অবৈধভাবে এখানে প্রবেশ করেছে।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘আমাদের লোকরা ওদের তাড়া করলে ওরা আশ্রয় নেয় গনজালো উচ্চভূমিতে। আমাদের দুটি হেলিকপ্টার ওদের তাড়া করেছিল। ওদের ধরতে চেষ্টা করতে গেলে ওরা আমাদের একটা হেলিকপ্টার ধ্বংস করে এবং দশজন লোককে হত্যা করে। অন্য হেলিকপ্টারও আমাদের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান। কণ্ঠে সে অসহায় সুর ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করল।
ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠেছে পুলিশ প্রধানের। বলল, ‘সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। পুলিশকে না জানিয়ে আপনারা এভাবে গেলেন কেন? সন্ত্রাসীদের বাগে আনা কি আপনাদের কাজ?’
‘পুলিশকে জানানোর আমরা সুযোগ পাইনি। ওরা পালিয়ে যাবে এই আশংকায় আমাদের লোকরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের অনুসরণ করে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘একটা কথা বলুন মি. ওয়াইজম্যান, যে কাজ পুলিশের সে কাজ আপনারা কাঁধে তুলে নিতে গিয়েছিলেন কেন? ওদের সাথে আপনাদের কি কোন বিশেষ শত্রুতা আছে?’ বলল পুলিশ প্রধান।
একটু বিব্রত দেখাল আজর ওয়াইজম্যানকে। একটু চুপ করে থাকল, তারপর বলল ধীর কণ্ঠে, ‘মুসলিম সন্ত্রাসীরা আমাদের ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরোধী ছিল, আমাদের অস্তিত্বেরও ওরা বিরোধী। আমাদের অবস্থান যেখানে ওদের সন্ত্রাসও সেখানে। বিশ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, কিন্তু যুদ্ধটা তারা শেষ করেনি। বরং মার্কিনীরা এখন ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠছে মুসলমানদের বন্ধু। এর ফলে ওদের সন্ত্রাসের প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়েছি আমরা। এই আজোরস দ্বীপপুঞ্জেও ওরা আমাদের শান্তিতে থাকতে দিতে চায় না।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান। শেষ দিকে তার কণ্ঠ হতাশ ও করুণ হয়ে পড়েছিল।
সহানুভূতি ফুটে উঠল পুলিশ প্রধান বারবোসার চোখে-মুখে। বলল, ‘মি. ওয়াইজম্যান চিন্তা করবেন না। আমাদের এই দ্বীপপুঞ্জ শান্তির দেশ। এখানে কোন সন্ত্রাসীর জায়গা হবে না। আপনি দয়া করে একটা অভিযোগ দায়ের করুন। আমরা দেখছি ব্যাপারটা?’
‘কিন্তু স্যার ব্যাপারটা খুব জরুরী। এই মুহূর্তে ওদের যদি পাকড়াও করা না যায়, তাহলে আরও খুনোখুনি তারা করবে। আর একবার নাগালের বাইরে চলে গেলে ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ওরা কোথায় এখন?’ জিজ্ঞেস করল পুলিশ প্রধান।
‘আমরা মনে করছি, গনজালো উচ্চভূমি থেকে দক্ষিণ দিকে সরে ট্রাইবাল এরিয়া সিলভার ভ্যালি’তে তারা প্রবেশ করেছে। এখান থেকে তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক দ্বীপপুঞ্জের অন্য কোথাও যাওয়া তাদের জন্যে সহজ হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ঠিক আছে মি. ওয়াইজম্যান, আমি তেরসিয়েরা দ্বীপের পুলিশ প্রধানকে নির্দেশ দিচ্ছি তিনি যেন সিলভার ভ্যালি’ থেকে বেরুবার পথগুলোর উপর নজর রাখেন এবং এই ঘটনার তদন্ত যেন তিনি শুরু করেন।’ বলল পুলিশ প্রধান।
একটু থেমেই আবার সে বলে উঠল, ‘আমাকে এখন উঠতে হয় মি. ওয়াইজম্যান।’
আজর ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার অফিসে আপনার এই পদধুলির জন্যে আমি কৃতজ্ঞ মি. বারবোসা। আরও ধন্যবাদ সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছি তার জন্যে।’
বলে আজর ওয়াইজম্যান হাত বাড়ালো পুলিশ প্রধানের দিকে।
‘ধন্যবাদ। বাই।’ বলে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে গেল পুলিশ প্রধান।
গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত পুলিশ প্রধানকে পৌছে দিয়ে ফিরে এল আজর ওয়াইজম্যান ও জ্যাক শামির।
বসল তারা আবার মুখোমুখি সোফায়।
সোফায় গা এলিয়ে ক্রুব্ধ কণ্ঠে আজর ওয়াইজম্যান বলল, ‘এই বেটা পুলিশ প্রধান জার্মান অরিজিন। নাজিদের রক্ত আছে এর শরীরে। ইহুদীরা যেন ওর কাছে কিছুই নয়। বলে তদন্ত করব। গোল্লায় যাক তোর তদন্ত। তেরসিয়েরার পুলিশ প্রধান তোর চেয়ে হাজার গুণ ভাল তার সাথে অলরেডি যোগাযোগ হয়েছে। ডলার একটু বেশি চেয়েছে। তা হোক, আমাদের আজকের প্রয়োজনের চেয়ে এটা বড় কিছু নয়।’
‘তাহলে তো মি. বারবোসাকে এসব বলে ভুল হলো। তিনি যদি এখন তেরসিয়েরা দ্বীপের পুলিশ প্রধানের কাজে হস্তক্ষেপ করেন।’ বলল জ্যাক শামির।
‘তুমি এসব নিয়ে ভেব না। এখন তুমি বল, আজোরস এর শীর্ষ সন্ত্রাসী নেতা ‘ফিগো’কে খবর দিয়েছ?’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
জ্যাক শামির ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘খবর দিয়েছি। এখনি এসে পড়বে।’
‘ঠিকই বলেছ তুমি, পুলিশ প্রধান মি. বারবোসাকে এসব কথা না বললেই ভাল ছিল। এদিকটা ভেবেই কিন্তু আমি তোমাকে ফিগোকে খবর দিতে বলেছিলাম। মাঝখানে আবার বলে ফেললাম পুলিশ প্রধানকে। থাক, একদিক দিয়ে ভালই হলো। ওনাকে তো জানিয়েই দিলাম, ত্বরিৎ কিছু না করলে ওরা খুনোখুনির সুযোগ পেয়ে যাবে। এখন এই দ্বীপে বিশেষ করে সিলভার ভ্যালি অঞ্চলে যা কিছুই ঘটুক এর জন্যে দায়ী হবে আহমদ মুসা। এটা ভালই হলো আমাদের জন্যে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল জ্যাক শামির। দরজায় নক করে ঘরে ঢুকল এ্যাটেনডেন্ট। বলল জ্যাক শামিরকে, ‘স্যার মি. ফিগো নামে একজন লোক এসেছেন।’
শুনেই উঠে দাঁড়াল জ্যাক শামির। ‘স্যার আপনি বসুন। আমি ওঁকে নিয়ে আসছি।’ বলে বেরিয়ে গেল জ্যাক শামির।
মিনিট খানেক পরেই বিরাট বপু একজনকে নিয়ে ঘরে ঢুকল জ্যাক শামির।
সাদাকালো ষ্ট্রাইফের টিসার্ট গায়ে। পরনে সাদা প্যান্ট। মাথায় সাদা হ্যাট।
এরই নাম আলফ্রেড ফিগো।
একেবারে খাঁটি পর্তুগীজ চেহারা। দেখেই মনে হয় সিউর এক জলদস্যু। তবে ফিগো জলে দস্যুতা করে না। সে আজোরস দ্বীপপুঞ্জের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেতা। তার বাহিনী এই দ্বীপপুঞ্জে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ফিগো ঘরে ঢুকতেই আজর ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়াল। কয়েক ধাপ এগিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘ওয়েলকাম ওয়েলকাম, আমি আপনারই অপেক্ষা করছি।’
‘গুড ইভনিং স্যার’ বলে বসতে বসতে আবার বলে উঠল, ‘মনে হলো পুলিশ প্রধান এখান থেকে বেরিয়ে গেল?’
‘হ্যাঁ, এসেছিলেন। পোর্ট থেকে ফেরার পথে একটু ঢুঁ মেরে গেলেন। অনেক দিন থেকে জানাশোনা তো!’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘বলুন স্যার। আমাকে ডেকেছেন কেন? আমরা আপনার কোন কাজে লাগতে পারি?’ বলল ফিগো। একদম নিরস কণ্ঠ তার।
‘মি. ফিগো, আমরা আপনার সাহায্য চাই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কি কাজ? কোন ধরনের কাজ?’ বলল ফিগো।
‘আমাদের বিদেশী দুজন শত্রু প্রবেশ করেছে তেরসিয়েরা দ্বীপে। গত রাতেই ‘লিজে’ এয়ারপোর্ট হয়ে এসেছে ওরা। আমাদের লোকরা তাদের তাড়া করেছিল। কিন্তু আমাদের লোকদের হত্যা করে ওরা পালিয়েছে। এ দুজনকে জীবন্ত অথবা মৃত আমরা চাই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ওরা কোথায়, মানে কোন অঞ্চলে এখন?’ জিজ্ঞেস করল ফিগো।
‘দুপুরে পাওয়া তথ্য অনুসারে ওরা সিলভার ভ্যালিতে প্রবেশ করেছে। দুএকদিন সময় পেলে ওরা অন্য দ্বীপে পালাবে। আমরা চাই তেরসিয়েরা দ্বীপেই যাতে ওদের জীবনের ইতি ঘটে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘সিলভার ভ্যালি হলো গনজালোদের এলাকা। ওখানে তো কোন বিদেশী আশ্রয় পাবার কথা নয়।’ ফিগো বলল।
‘আশ্রয় হয়তো পাবে না। ওদিক দিয়ে হয়তো তারা পালাবার চেষ্টা করবে। আমরা চাই তারা পালাতে না পারুক। আমরা চাই তারা মরুক, অথবা ধরা পড়ুক।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘বলুন আমাদের কি করতে হবে।’ বলল ফিগো।
‘ওরা ঐ অঞ্চল থেকে পালাবার আগেই ওদের ধরতে হবে, না হয় মারতে হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আমরা কি পাব?’ বলল ফিগো।
‘বলুন কি চান?’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কম করে হলেও মিলিয়ন ডলারের নিচে আমরা এসব কাজে হাত দেই না।’ বলল ফিগো।
‘আমরা রাজী। কিন্তু অর্ধেকটা এখন পাবেন, বাকি অর্ধেকটা পাবেন কাজ শেষ হওয়ার পর।’
‘ঠিক আছে। তাই হবে। আর কোন কথা আছে?’ বলল ফিগো।
‘আমরা দ্রুত কাজ চাই। আগামী তিন দিনের মধ্যে সবকিছুর ইতি ঘটাতে হবে। প্রথম সুযোগেই তারা দ্বীপ ছেড়ে পালাবে। সেটা হোক আমরা তা চাই না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘সেই দুজন লোকের ফটো আমাদের দিন এবং টাকাও।’ বলে ফিগো উঠে দাঁড়াল।
আজর ওয়াইজম্যান ইশারা করল জ্যাক শামিরকে।
শামির চলে গেল। মিনিট খানেক পরেই প্রবেশ করল বড় একটা ব্রীফকেস নিয়ে।
আজর ওয়াইজম্যান ব্রীফকেস খুলে ফিগোর দিকে মেলে ধরে বলল, ‘আমরা টাকা নিয়ে দর কষাকষি করিনি। আশা করি, কাজের ক্ষেত্রেও আমাদের কোন ওজর শুনতে হবে না। গুণে নিন টাকাগুলো।’
ফিগো ব্রীফকেস হাতে নিয়ে তা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘আমি কোন সময়ই টাকা গুণে নেই না। আমরা বিশ্বাসের উপর বিজনেস করি।’
‘গুডবাই’ বলে ঘর থেকে গট গট করে চলে গেল ফিগো।
স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠল আজর ওয়াইজম্যানের চোখে-মুখে।
‘বিরাট একটা কাজ হলো স্যার।’ ফিগো চলে যাওয়ার পর বলল জ্যাক শামির।
‘কাজ হলো নয়, কাজ দেয়া হলো মাত্র। ঈশ্বর সাহায্য করুন।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ফিগোদের অসাধ্য কিছু নেই স্যার। পুলিশও তাদের হাতের মুঠোয়।’ জ্যাক শামির বলল।
‘তোমার কথা সত্য হোক শামির।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘আমিন।’ বলে উঠল জ্যাক শামির।
আহমদ মুসা মাগরিবের নামাজ পড়ে হোটেলের কক্ষ থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে।
হোটেলটি দোতলা। বারান্দাটা হোটেলের দক্ষিণের ব্যালকনি।
ব্যালকনির নিচেই রাস্তা। রাস্তাটা সিলভার ভ্যালির গভীর থেকে এসে পুবে কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণ উপকূলের সবচেয়ে বড় শহর আংগ্রা ডে হেরেমা বন্দর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। এই রাস্তারই আরেকটা শাখা দ্বীপের পূব উপকূলের একটা অখ্যাত বন্দরে সাও সিভালায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
রাস্তাটাকে ঠিক রাস্তা বলা যায় না। বলা যায় রাস্তার একটা চিহ্ন এটা। ঘোড়া ও মানুষের যাতায়াত এই পথ-চিহ্নের সৃষ্টি করেছে।
রাস্তার পরেই নিউ টাগুস নদী। রাস্তাটা নদীকে অনুসরণ করেই এগিয়ে গেছে আংগ্রা ডে হেরেমা পর্যন্ত। পাহাড় ও চড়াই-উৎরাই বাধার কারণে রাস্তাটা সব সময় নদীর তীর বেয়ে এগুতে পারেনি।
নদীটা খুবই খরস্রোতা। সিলভার ভ্যালিতেই শুধু এটা কিছুটা নাব্য, তারপর গোটাটাই অনাব্য।
হোটেলটা সিলভার ভ্যালির পূব মুখের উপর দারোয়ানের মত দাঁড়িয়ে।
হোটেলটা উত্তর থেকে এগিয়ে আসা একটা পাহাড়-শ্রেণীর দক্ষিণ প্রান্তের শেষ টিলার উপরে। হোটেলের পরেই রাস্তা, রাস্তার পর নদী এবং নদীর পরেই পাহাড়-শ্রেণীটা প্রথমে দক্ষিণে কিছু দূর এগিয়ে দুভাগ হয়ে একটা দক্ষিণে, অন্যটি পশ্চিমে এগিয়ে গেছে।
পুব দিক থেকে সিলভার ভ্যালিতে প্রবেশের পথ এই একটাই। এই প্রবেশ পথেরই দ্বাররক্ষী যেন হোটেলটা।
হোটেলটাও আবার ঠিক হোটেল নয়। অনেকটাই সরাইখানার মত। সিলভার ভ্যালিতে উৎপাদিত শস্য, ফল-মুল কেনার জন্যে যে ব্যাপারী, পাইকার ও যেসব ফড়িয়ারা উপত্যকায় আসেন, তারাই এই সরাইখানায় উঠে থাকেন। হোটেল বা সরাইখানায় নিয়মিত রান্নার কোন ব্যবস্থা নেই। অতিথি কেউ আসলে তার জন্যে রান্না হয়। এই হোটেলের মালিক ও তার পরিবার থাকেন পাশেই পাহাড়ের এক গুহাকে কেন্দ্র করে তৈরি বাড়িতে।
হোটেলের মালিক নব্বই বছর বয়সের এক বৃদ্ধ। নাম নুনো কাপুচো। আফ্রিকান, রেড ইন্ডিয়ান ও এস্কিমো সবারই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার চেহারা। তার ভাষাও এই ধরনের মিশ্র। গত দেড় দিনে আহমদ মুসার সাথে তার বেশ ভাব হয়ে গেছে। কাপুচো ইতিমধ্যেই আহমদ মুসাকে গর্বের সাথে জানিয়েছে, তারাই দ্বীপপুঞ্জের আদি বাসিন্দা, তাদের ভাষাই দ্বীপপুঞ্জের নিজস্ব ভাষা। বিদেশীদের একদিন এই দ্বীপপুঞ্জ ত্যাগ করতেই হবে। তবে আহমদ মুসাকে সে বিদেশী বলে না, বলে মেহমান।
আহমদ মুসা ইজি চেয়ারে বসে ছিল। তার মুখ পশ্চিমে সিলভার ভ্যালির দিকে। জোৎস্না-স্নাত ভ্যালির বুকে তার চোখ দুটি নিবদ্ধ। গত দেড়টা দিন সে ভ্যালিতে ঘুরে বেড়িয়েছে। উপত্যকাটার নাম সিলভার ভ্যালি। নামটা স্বার্থক। সিলভার ভ্যালির চারদিকেই পাহাড়। পাহাড় থেকে ভ্যালিতে নেমে এসেছে অনেক সফেদ ঝর্ণা। এই ঝর্ণাগুলো সমৃদ্ধ ও বেগবান করেছে উপত্যকার একমাত্র নদী নিউ টাগুসকে। এই পাহাড়ী টাগুসের জন্ম আরও পশ্চিমের উঁচু পাহাড়ে। সফেদ ঝর্ণা, রূপালী নদী, সবুজ সোনালী শস্যক্ষিত এবং ফলের অজস্র বাগান ও সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়ের দেয়াল অপরূপ করে তুলেছে সিলভার ভ্যালিকে। সন্ধ্যার হালকা আঁধারের ওপর রূপালী জ্যোৎস্নার বিচ্ছুরণ এক মায়াময় দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে উপত্যকাটিকে ঘিরে। আহমদ মুসা এই দৃশ্যই উপভোগ করছে।
উপত্যকার গভীরে তারার মত একটা আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আহমদ মুসা নিশ্চিত ওটা সার্গিও ভ্যানিসাদের বাড়ির আলো।
সার্গিও ভ্যানিসাদের বাড়ি সিলভার উপত্যকার মাঝখানে একটা পাহাড়ের উপর। পাহাড়ের গোড়া দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নিউ টাগুস নদী।
চারদিকের সবুজের মাঝখানে ওদের সাদা পাথরের সফেদ বাড়িটা ছবির মত সুন্দর।
কিন্তু আহমদ মুসা তাদের বাড়িতে উঠতে রাজী হয়নি। আহমদ মুসা ওদের বাড়িতে উঠতে অস্বীকার করলে কেঁদে ফেলেছিল ভ্যানিসা। সার্গিও কাঁদেনি বটে, কিন্তু দুঃখ পেয়েছিল, কিছুটা অপমানিতও বোধ করেছিল। আহমদ মুসা ওদের বুঝাতে চেষ্টা করলে সার্গিও বলেছিল, ‘আপনি সিলভার ভ্যালিতে এলেন, অথচ আমাদের বাড়িতে না উঠে গিয়ে থাকবেন চাল-চুলোহীন একটা সরাইখানায়, এটা আমাদের জন্যে চরম দুঃখের এবং অপমানেরও।’ ভারী হয়ে উঠেছিল সার্গিওর কণ্ঠস্বর।
গম্ভীর হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসা। ধীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘তোমাদের ওখানে উঠতে পারলে তোমাদের চেয়ে আমিই খুশি হতাম বেশি। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে আমি এই খুশিকে কুরবানী দিতে চাই।’
‘সে স্বার্থটা কি?’ ত্বরিত কণ্ঠে বলে উঠেছিল ভ্যানিসা।
‘তোমরা কঠিন ও মহান এক দায়িত্ব পালন করছ তোমাদের জনগনের পক্ষে। আমি চাই, কোনভাবেই যেন আমার দ্বারা তোমাদের এ আন্দোলনের কোন ক্ষতি না হয়।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘এ প্রশ্ন উঠছে কেন? আপনি যাচ্ছেন আমাদের বাড়িতে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষতির প্রশ্ন এখানে ওঠে কি করে?’ বলেছিল ভ্যানিসা।
‘তোমাদের বাড়িতে যাওয়া বড় কথা নয়। এই যাওয়ার মাধ্যমে তোমাদের সাথে আমার পরিচয় ও সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা সবাই জানবে, এটা বড় কথা। এই বিষয়টাকে তোমাদের শত্রুরা, তোমাদের সরকার তোমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘কিভাবে?’ বলেছিল ভ্যানিসা।
‘বলবে, এটা ওদের স্বাধীনতা আন্দোলন নয়, বরং দেশ বিক্রি করার একটা ষড়যন্ত্র। ওরা দেশকে বিদেশ, বিধর্মী ও মৌলবাদের চারণক্ষেত্র বানাতে চায়। সম্প্রতি সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী নেতা আহমদ মুসা নাম ভাড়িয়ে এদেশে প্রবেশ করে ওদের বাড়িতে গোপনে অবস্থান করেছে। সুতরাং গনজালো পরিবার বিদ্রোহী, ষড়যন্ত্রকারী ও বিদেশীদের এজেন্ট। ব্যস, কেল্লাফতে। তোমরা তো বলতে পারবে না আমি আসিনি, আমি তোমাদের সাথে থাকিনি।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
সংগে সংগে কথা বলেনি সার্গিও ও ভ্যানিসা। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে ভাবনার চিহ্ন।
একটু পরে ম্লান হেসেছিল সার্গিও। বলেছিল, ‘ঠিক বলেছেন ভাই, এই কথা তারা বলতে পারে।’
‘বলতে পারে নয় মি. সার্গিও, তারা বলবে। আরও একটা কথা মি. সার্গিও। আমার আশংকা যদি সত্য হয়, তাহলে নিশ্চিত জানবেন ওরা আমাদের সন্ধানে আসছে। ওরা এসে পড়ার আগেই যদি আমি সিলভার ভ্যালি ত্যাগ করতে না পারি, তাহলে সংঘাত বাধতে পারে। সেই সংঘাতে গনজালো পরিবার জড়িয়ে পড়লে মহাক্ষতি হবে আপনাদের পরিবারের এবং আপনাদের মহান আন্দোলনের। আমি যদি এই ভ্যালিতেই আলাদা থাকি, তাহলে সংঘাত বাধলেও সেটা হবে আমার ও ওদের মধ্যে। মনে করা হবে, আমি ভ্যালিতে এসে লুকিয়েছিলাম। ভ্যালির কারো সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
ম্লান হাসি ফুটে উঠেছিল ভ্যানিসার মুখেও। বলেছিল আহমদ মুসা থামতেই, ‘আপনার কথা সত্য ভাইয়া, কিন্তু এখন আপনার নিজের কথা ভাবার কথা, আমাদের কথা ভাবছেন কেন?’
‘কৌশল নির্ধারণ করতে হলে সবটা বিষয়ই এক সাথে ভাবতে হবে ভ্যানিসা।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
গম্ভীর হয়ে উঠেছিল ভ্যানিসার মুখ। বলেছিল, ‘জনাব আহমদ মুসার সাথে যুক্তি বুদ্ধি কোন দিক দিয়েই পারবো না। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি আমাদেরকে অমন তৃতীয় শ্রেণীর সরাইখানায় রাখতে পারতেন?’
আবেগে রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল ভ্যানিসার কণ্ঠ। ছলছলে হয়ে উঠেছিল তার চোখ।
ম্লান হাসি ফুটে উঠেছিল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলেছিল সান্তনা দেওয়ার সুরে, ‘তুমি ঠিক বলেছ ভ্যানিসা। আমিও পারতাম না তোমাদেরকে তৃতীয় শ্রেণীর সরাইখানায় রাখতে। কিন্তু আমাদের তো এখন সেই শান্তির সময় নয়। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে এখন। থাকা, খাওয়া, ঘুম ইত্যাদির যুদ্ধকালিন অবস্থা শান্তির সময় থেকে একদমই আলাদা। তুমি যদি এদিকটা ভাব ভ্যানিসা তাহলে আর খারাপ লাগবে না।’
চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে হেসে উঠেছিল ভ্যানিসা। বলেছিল, ‘আপনি কেন বন্দুক হাতে নিতে গেলেন ভাইয়া। এক শান্তির নীড়ে, এক স্নেহময় ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি আপনি। মাত্র কয়েক ঘন্টার পরিচয় আপনার সাথে। তবু আমি ভাবছি, আপনার জাতীয় ও সামাজিক রূপের চাইতে আপনার পারিবারিক রূপটাই হবে মনোমুগ্ধকর বেশি।’
একটু থামল ভ্যানিসা। কিন্তু আহমদ মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুহূতর্কালের মধ্যেই আবার বলে উঠেছিল, ‘আপনার প্রস্তাবে এক শর্তে রাজী।’
‘কি সেই শর্ত?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘সরাইখানার বিছানা ব্যবহার করতে পারবেন না, খাবার খেতেও আপনি পারবেন না। বিছানা আমাদের বাসা থেকে ওখানে যাবে, খাবারও যাবে নিয়মিত সেখানে।’ ভ্যানিসা বলেছিল।
‘আমি তোমার প্রস্তাবে রাজী, তবে একটা শর্তে।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘কি শর্ত?’ জানতে চেয়েছিল ভ্যানিসা।
‘বিছানা, খাবার তোমাদের বাসা থেকে আসতে পারবে, আমরা তাতে পরম আনন্দও বোধ করব, তবে শর্ত হলো এ বিষয়টা কাকপক্ষীরও জানা চলবে না।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘আমি রাজী এ শর্তে।’ ভ্যানিসা বলেছিল আনন্দিত কণ্ঠে।
‘কিন্তু ভ্যানিসা, কাকপক্ষী না জানার শর্ত পূরণ করে কিভাবে তুমি নিয়মিত খাবার পাঠাবে?’ বলেছিল সার্গিও।
হেসেছিল ভ্যানিসা। বলেছিল, ‘আমাদের ভেড়া-ছাগল-গরুর পালটা এখন উপত্যকার পুব-মুখ ঘেঁষেই অবস্থান করছে। পালের সাথে চার পাঁচজন রাখাল রয়েছে। তাদের যাতায়াত আছে সরাইখানায়। ওরাই খাবার পৌছাবে।’
খুশি হয়েছিল সার্গিও। ভ্যানিসাকে ধন্যবাদ দিয়ে সে বলেছিল, ‘এ চিন্তা তোমার মাথায় এল কি করে? যতই চিন্তা করি এ বিষয়টা আমার মাথায় আসতো না।’
আহমদ মুসাও ধন্যবাদ দিয়েছিল ভ্যানিসাকে।
সত্যি ভ্যানিসা তার কথা অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করেছে। রাখালরাই তিন বেলা তার খাবার নিয়ে আসে। হোটেল মালিক নুনো কাপুচোর কাছ থেকেও খাবার আসে। ওগুলো রাখালরা নিয়ে যায় নিজেরা ভোজ করার জন্যে।
আহমদ মুসা শুকরিয়া আদায় করল যে, এখন পর্যন্ত কোন দিক থেকে কিছু ঘটেনি। ভালই যাচ্ছে সময়। মনে মনে আহমদ মুসা কৃতজ্ঞতা জানাল সার্গিও ও ভ্যানিসাদের।
আহমদ মুসা তার চোখ ফিরিয়ে আনল ভ্যানিসাদের বাড়ির দিক থেকে।
পেছনে পায়ের শব্দ পেয়েছে আহমদ মুসা।
দৃষ্টিটা ফিরিয়ে তাকাল আহমদ মুসা পেছন দিকে। দেখল হাসান তারিক ও হোটেলের মালিক নুনো কাপুচো ব্যালকনিতে প্রবেশ করেছে।
এই অসময়ে হোটেল মালিক নুনো কাপুচোকে আসতে দেখে কিছুটা বিস্মিতই হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে একটা চেয়ার টেনে সামনে এনে বসতে বলল নুনো কাপুচোকে।
আহমদ মুসার পাশের চেয়ারে বসল হাসান তারিক।
বসেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘ভাইয়া, মি. কাপুচো বলছেন কিছু লোক নাকি ভ্যালীতে বিদেশীদের খোঁজ করছে।’
ভ্রুকুচকালো আহমদ মুসা। চেয়ারে নড়ে-চড়ে বসল। বলল, ‘মি. কাপুচো, ঘটনা কি?’
‘হ্যাঁ, হঠাৎ যেন সবাই আজ বিদেশী খোঁজ করতে লেগে গেছে। আজ বাজারে আমাদের তিনজন কাবিলা প্রধান আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আমাদের সিলভার ভ্যালিতে আমি দুজন বিদেশীকে দেখেছি কিনা। আজ দুপুরের পর দুজন বাইরের লোক এসেছিল হোটেলে। জিজ্ঞেস করেছিল, হোটেলে কোন বিদেশী এসেছে কিনা, এসেছিল কিনা। আমি বুঝতে পারছি না ঘটনা কি!’ বলল নুনো কাপুচো।
‘বাইরে থেকে এসেছিল ওরা কারা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। তার চোখে-মুখে ভাবনার ছাপ।
‘ওরা ফল ব্যবসায়ীর লোক। মাঝে মাঝেই ওরা আসে ফল মূলের পাইকারী মার্কেটে।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘ওরা কাকে খুঁজছে, কেন খুঁজছে বলেছে কিছু?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সে রকম সুনির্দিষ্টি করে কিছু বলেনি। বলেছে, দুজন বিদেশী হারিয়ে গেছে, তাদেরকেই ওরা খুঁজছে। ওরা নাকি গনজালো প্যালেসেও খোঁজ করেছে। সেখানেও কোন বিদেশী নেই।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘দেখা যাচ্ছে, অনেক লোক লেগেছে খোঁজ করতে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ অনেক লোক। ভ্যালিরও অনেক লোক লেগেছে। কয়েকজন কবিলা প্রধানও। যে কোন মূল্যে বিদেশীদের নাকি ওদের খুঁজে বের করা চাই।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘আমরাও তো বিদেশী। কেউ তো আমাদের খোঁজ করেনি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি তো বিদেশী বলিনি। আমি বলেছি আমার দুজন মেহমান আছে, আর কেউ নেই আমার হোটেলে।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘আপনার কথা ওরা বিশ্বাস করেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তারা বিশ্বাস করা বা না করার সাথে আমার কিছু এসে যায় না। তারা নিজেরাও খোঁজ নিতে পারে। তাছাড়া তারা শুধু তো আমাকে নয়, আরও অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করছে।’ বলল নুনো কাপুচো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ঠিকই বলেছেন আপনি।’
নুনো কাপুচো উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘উঠি আমি এখন, বাইরে কাজ আছে।’
‘দুয়ে দুয়ে চার যেমন সত্য, এটাও তেমনি সত্য হাসান তারিক। ওরা আসবে এটা অবধারিত ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ব্যালকনিতে প্রবেশ করল যুটো, সার্গিওদের হেড রাখাল।
‘কি ব্যাপার যুটো? তুমি এ সময়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘স্যার, কিছুটা সামনে ভ্যালির বাইরে দুটি ট্রাক ও একটি মাইক্রো বোঝাই লোক এসেছে। তার সাথে এসেছে একটা জীপ। আমি কথাবার্তায় শুনেছি, তারা এই হোটেল রেড করবে। দুজন বিদেশীকে তারা ধরবে। আমি খবরটা নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের স্যারের কাছে। তিনি আপনাকে এই চিঠি দিয়েছেন।’
বলে যুটো একটা চিঠি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলল।
পড়লঃ
‘ভাই সাহেব,
আপনাদের অবস্থান শত্রুদের কাছে ধরা পড়ে গেছে। যুটো আপনাকে বলবে। আমি ও ভ্যানিসা গোপন একটা গিরিপথে চারটা ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছি। যুটোর সাথে আপনারা চলে আসুন। শত্রুকে কাঁচকলা দেখিয়ে আমরা উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাব। সংঘাত এড়ানোর আপনার কৌশল সামনে রেখেই আমি এই ব্যবস্থা করেছি।’’
আপনার ভাই,
‘সার্গিও’
চিঠিটা আহমদ মুসা পড়ে হাসান তারিকের হাতে তুলে দিল পড়ার জন্যে।
তারপর তাকাল যুটোর দিকে। বলল, ‘উপত্যকার মুখে ওরা কখন এসেছে?’
‘এক ঘন্টা আগে।’ বলল যুটো।
‘কিন্তু ওরা বাইরে অপেক্ষায় কেন? ঢুকছে না কেন ভেতরে?’ বলল আহমদ মুসা।
আড়াল থেকে ওদের কথা যতটুকু শুনেছি তাতে ধারণা হয়েছে ওরা লোক পাঠিয়েছে ওদের পরিচিত কয়েকজন কাবিলা প্রধানের কাছে উপত্যকায় ঢোকার অনুমতির জন্যে। অনুমতি পেলে মনে হয় ওরা ঢুকবে।
‘কাবিলা প্রধানরা অনুমতি দেবে?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘সরাসরি দেবে না। আমাদের স্যার উপত্যকা কমিটির প্রধান। তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। সে অনুমতি ওরা পাচ্ছে না। কারণ আমাদের স্যার ইতিমধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন।’ বলল যুটো।
‘তাহলে অনুমতি ওরা পাচ্ছে না। অনুমতি না নিয়ে কি ওরা ঢুকবে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘উপত্যকাবাসীদের সাথে লড়াই-এ ওরা নামতে চাইবে না। গাড়ি বোঝাই হয়ে না ঢুকে এমনি দু’চারজন ঢুকতে পারে।’ চিঠি পড়া হয়ে গিয়েছিল হাসান তারিকের। বলল, ‘ভাইয়া কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?’
‘সার্গিও ঠিকই বলেছে। চল আমরা বের হই।’ আহমদ মুসা বলল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা তৈরী হয়ে দুতলার সিঁড়ির মুখে এসে মিলিত হলো।
তাকাল আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তোমার মেশিন রিভলবারটা কোথায়?’
‘আমার ব্যাগে।’ বলল হাসান তারিক।
‘না, ওটা শোল্ডার হোলষ্টারে নাও। কোটের বোতাম খুলে রাখ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে ভাইয়া।’ বলে হাসান তারিক ব্যাগ থেকে রিভলবার শোল্ডার হোলষ্টারে পুরল।
সিঁড়ি দিয়ে নামল আহমদ মুসারা।
হোটেলের কাউন্টারের সামনে আসতেই বিভিন্ন দিক থেকে বেরিয়ে এসে জনাছয়েক লোক আহমদ মুসাদের ঘিরে ধরল। কাপড়ের ভেতর থেকে তারা বের করল রিভলবার। এক সাথে ছয়টা রিভলবার তাক করা আহমদ মুসাদের দিকে।
ছয় দিক থেকে ছয়টা রিভলবারকে হা করে উঠতে দেখে আর্তনাদ করে উঠল যুটো।
আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তুমি যুটোর মত চিৎকার করো না। না জেনে-শুনে এরা নিশ্চয় গুলী করবে না। নিশ্চয় কোথাও ভুল হয়েছে এদের।’
বলে আহমদ মুসা রিভলবারধারী ছয়জনের দিকেই একবার করে তাকাল। তারপর এক জনের দিকে চোখ স্থির করে বলল, ‘আপনিই নিশ্চয় এদের চীফ। এখন বলুন ঘটনা কি?’
‘ঘটনা কিছুই নয়, আমাদের সাথে চলুন। একটু জিজ্ঞাসাবাদ আছে।’ বলল লোকটি।
‘কোথায় যেতে হবে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এই একটু সামনে।’ বলল লোকটি।
‘জিজ্ঞাসা কেন বলুন তো? কোন কেস-টেস আছে নাকি আমাদের বিরুদ্ধে।’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সবই জানতে পারবেন।’ বলল লোকটি।
‘না জেনে যেতে যদি না চাই?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার নাম ফিগো। আমি পাখির মত মানুষ মারতে পারি। দ্বিতীয়বার আমি আর আদেশ করব না। এই মুহূর্তে যাবার জন্যে পা না তুললে গুলী করবে আমার লোকরা।’ বলল ফিগো লোকটা।
কৃত্রিম ভয় ফুটিয়ে তুলল আহমদ মুসা তার চোখে-মুখে। বলল, ‘গুলীর দরকার নেই। আমরা যাব, এবং আপনাদের কি জিজ্ঞাসাবাদ আছে শুনব।’
একটু থামল। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘মি. ফিগো, হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে কি আমরা বেরোবো?’
বিস্ময় ফুটে উঠল ফিগোর চোখে-মুখে। বলল, ‘বিল নিয়ে এখন আপনি ভাবছেন? ঠিক আছে বিল মিটিয়ে দিন।’
আহমদ মুসা হোটেলের কাউন্টারের দিকে এগুলো। কাউন্টারে একজন অল্প বয়সি বয় কাঠ হয়ে বসেছিল, যেন ফাঁসির আসামী। আহমদ মুসা তার সামনে একটা পাঁচশ ডলারে নোট রেখে বলল, ‘বিল কত হয়েছে তুমি তো বলতে পারবে না। মি. কাপুচোকে এই টাকাটা দিয়ে দিয়ো। যদি কিছু বাকি থাকে পরে শোধ করব।’
আহমদ মুসা কাউন্টার থেকে সরে এল। তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘চল, না গিয়ে তো বাঁচা যাচ্ছে না।’
বলে আগে আগে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। তার পেছনে হাসান তারিক শুরু করল হাঁটা। তাদের পেছনে ঐ ছয়জন। তাদের রিভলবারগুলো এখন আগের মত আহমদ মুসাদের দিকে তাক করা নয় এবং ট্রিগার পয়েন্টেও নয়।
রাস্তায় নামার পরেই শুরু হলো অন্ধকারে পথ চলা।
হোটেল থেকে পুবে দুশ’গজ পরে পাহাড় ও নদীর মাঝের প্যাসেজটা সবচেয়ে সংকীর্ণ। কোন রকমে দুটি গাড়ি এই প্যাসেজ দিয়ে পাশাপাশি চলতে পারে। এটাই সিলভার উপত্যকায় প্রবেশের গেট।
কিন্তু গেটে কোন দরজা নেই।
গেট পার হয়ে ওপারে পৌছে গেল সবাই।
ওপারে পৌছতেই পেছন থেকে ফিগোর কণ্ঠ শোনা গেল। বলে উঠছে সে, ‘যে যেভাবে আছ সেভাবে দাঁড়াও।’
ফিগোর কণ্ঠ চাপা বজ্রের মত শোনাল।
সবাই দাঁড়িয়ে গেল।
আবার ধ্বনিত হলো ফিগোর কণ্ঠ। বলল তার দুজন সাথীকে লক্ষ্য করে, ‘জেভি ও কষ্টা, তোমরা শয়তান দুটোকে বেঁধে ফেল।’
আহমদ মুসা দাঁড়াবার আদেশ পেতেই হাসান তারিকও তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসান তারিক পাশে দাঁড়াতেই আহমদ মুসা ফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওরা দ্রুত কিছু ঘটাতে পারে। প্রস্তুত।’
ফিগোর নির্দেশ পাবার পর জেভি ও কষ্টা নামের দুই ব্যক্তি এগুলো আহমদ মুসাদের দিকে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পুবমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জেভি ও কষ্টা পেছন থেকে এগুচ্ছে ওদের দিকে। চারদিকের নিশ্ছিদ্র নিরবতার মাঝে তাদের পায়ের কেডস পাথুরে রাস্তার বুকে শব্দ তুলছে। আহমদ মুসার কান দুটি উৎকর্ণ সেই শব্দের দিকে। প্রতিটি পদক্ষিপ যেন গুণছে।
পায়ের শব্দটি আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়াবার সাথে সাথে আহমদ মুসা একদিকে তার ডান হাতকে এগিয়ে দিল শোল্ডার হোলষ্টারে রাখা তার এম-১০ মেশিন রিভলবারের দিকে। অন্যদিকে বোঁ করে এবাউট টার্ণে তার বাঁ হাতকে ছুঁড়ে দিল পেছনে দাঁড়ানো লোকটির গলার দিকে। হাতটি অক্টোপাশের মত লোকটির গলা পেঁচিয়ে তাকে যখন টেনে নিয়ে আসছিল আহমদ মুসার দিকে, তখন আহমদ মুসার ডান হাতে উঠে আসা এম-১০ বুলেট বৃষ্টি শুরু করেছিল সামনে দাঁড়ানো লোকদের দিকে।
ভোজবাজীর মত এ ঘটনা বুঝে ওঠার আগে তাদের রিভলবারের ট্রিগার টেপার সময় পেছনের লোকরা পেল না। শুধু রিভলবারের ট্রিগার টেপার সময় পেয়েছিল ফিগো। দুটো গুলীও ছুঁড়েছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু গুলী দুটো আহমদ মুসার বক্ষ ভেদ না করে তার বুকে চেপে ধরা ফিগোর সাথীরই পিঠ ফুটো করে দিল। তৃতীয় গুলী ছোঁড়ার সুযোগ ফিগো আর পায়নি। আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের গুলীবৃষ্টি তাকেও ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল।
আহমদ মুসা গুলী বর্ষণ শুরু করার সাথে সাথে হাসান তারিক হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল। সেই সাথে তার হাতে আসা মেশিন রিভলবার প্রথমেই গুলী করেছিল তাকে বাঁধতে আসা লোকটিকে এবং তারপর সামনের দিকে ব্রাশ-ফায়ার করেছিল অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের রিভলবার যখন নিরব হলো, তখন অন্ধকারেই দেখা গেল সামনে কেউ দাড়িয়ে নেই। তবে অন্ধকারের কারণে বুঝার উপায় নেই কার কি অবস্থা।
‘নিশ্চয় কেউ বেঁচে নেই।’ প্রথম কথা বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ তাই। বেঁচে থাকলে গুলী করার এই সুযোগ তারা নিত।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই তারা শুনতে পেল তাদের পেছনে ইঞ্জিনের গর্জন।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই পেছন ফিরে পুব দিকে তাকাল। দেখতে পেল অল্প সামনে তিনটি গাড়ির ছয়টি হেডলাইট জ্বলে উঠেছে। এগিয়ে আসছে গাড়িগুলো।
‘গুলীর শব্দ শুনে কি ঘটেছে তা দেখার জন্যই নিশ্চয় ওরা আসছে।’ বলল হাসান তারিক।
‘এবং তারা মনে করছে, যে গুলীর শব্দ তারা শুনেছে তা তাদের লোকদেরই।’ হাসান তারিক থামতেই বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘তাহলে এখন আমরা কি করব?’ হাসান তারিক বলল।
‘আমরা কিছু করব না, ওরা কি করে সেটা দেখতে চাই।’
কথাটা বলে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘চল, আমরা সিলভার ভ্যালির দিকে হেঁটে গিয়ে ভ্যালির মুখের ওপাশে দাঁড়াই। ওরা এস সাথীদের লাশ দেখুক। তারপর কি করে দেখা যাক।’
বলে আহমদ মুসা সিলভার ভ্যালির দিকে হাঁটা শুরু করল।
হাঁটতে লাগল হাসান তারিক আহমদ মুসার পেছনে।
তিন গাড়ির বহরটি লাশগুলোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সামনের গাড়ির হেডলাইটের আলো ছড়িয়ে পড়ল লাশগুলোর উপর।
তিনটি গাড়ির হেডলাইটই জ্বলছে।
হেডলাইটের আলোতে গাড়িগুলোও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সবার সামনে মাইক্রো। মাইক্রোর ছাদে বিশাল সাইজের একটা মেশিনগান ফিট করা।
গাড়ি তিনটি লাশের সামনে থামার সাথে সাথে মাইক্রোর পেছনের জীপ থেকে দুজন দ্রুত নেমে এল।
তারা মাইক্রোর আড়াল থেকে লাশগুলো দেখে আবার দ্রুত ফিরে গেল জীপে। তারা জীপে ফিরে যেতেই মাইক্রোর ছাদে ফিট করা মেশিনগান গর্জন করে উঠল। গুলীর বৃষ্টি প্রবেশ করল সংকীর্ণ পথ দিয়ে উপত্যকরা ভেতরে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাহাড়ের আড়ালে না থাকলে তাদের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
গুলীবৃষ্টির মধ্যে মাইক্রো থেকে মানুষ নামল। তারা এক এক করে লাশগুলো নিয়ে গাড়িতে তুলতে লাগল।
আহমদ মুসা ফিসফিস করে বলল, ‘তারিক, ওরা আক্রমণে আসছে না। ওদের মেশিনগানের গুলী ওদের লাশ সরিয়ে নেবার ঢাল মাত্র।’
‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ওরা রণে ভংগ দেবে?’ বলল হাসান তারিক। তার চোখে বিস্ময়।
‘একটি কারণে হতে পারে। সেটা হলো যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে তাদের সর্দার রয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ ভাইয়া, ঠিক বলেছেন। ওদের লিডার যে ছিল সে কোন বড় নেতাই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাদের লাশ নিয়ে যাবার এই গরজ কেন?’ বলল হাসান তারিক।
‘লাশ পড়ে থাকলে লাশের মাধ্যমে তাদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে, হয়তো এটা ওরা চায় না।’ আহমদ মুসা বলল।
অব্যাহত গুলীর আড়ালে তারা সবগুলো লাশ তুলে নিল গাড়িতে। গুলী তাদের বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু গাড়িগুলো নড়ল না। নিজেদের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে উপত্যকার সংকীর্ণ মুখটায় এসে দাঁড়াল।
‘ওরা দাঁড়িয়ে কেন। সামনেও এগুচ্ছে না, পেছনেও সরছে না। কারণ কি?’
ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার।
বোঁ করে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরা অবস্থায় আহমদ মুসা তার এম-১০ এর ব্যারেল তুলে নিচ্ছিল।
কিন্তু আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে স্থির হবার আগেই একই সাথে দুটি গুলী এসে আঘাত করল তার এম-১০ মেশিন রিভলবারটিকে। আঘাতে তার তর্জনীও আহত হলো।
রিভলবার পড়ে গেল তার হাত থেকে।
আহমদ মুসার চেয়েও অবস্থা খারাপ হাসান তারিকের। তার দিকে গুলী এসেছিল সেকেন্ড খানেক পরে। হাসান তারিক রিভলবার তুলেছিল গুলী করার জন্যে। কিন্তু তার ট্রিগার টেপার আগেই গুলী এসে বিদ্ধ করেছে তার ডান বাহুকে। ছিটকে পড়ে গেছে তার হাত থেকে রিভলবার।
সামনে থেকে অট্টহাসি ভেসে এল।
আহমদ মুসা তাদের সামনে তিনজন লোককে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারে তাদের অবয়ব পরিষ্কার ছিল না। আহমদ মুসা বুঝতে পারছিল না ওরা কারা? উপত্যকার ভেতরের লোক ওরা, না ওদের সাথে আসা একটা অংশ। লাশ তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ওদের সময় ক্ষেপণের কৌশল এবং লাশ তুলে নেয়ার পরও দাঁড়িয়ে থাকা দেখেই আহমদ মুসার শেষ মুহূর্তে মনে হয়েছিল, লাশ তোলা নাটকের দৃশ্যের দিকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে আক্রমণের ভিন্ন কৌশল তারা গ্রহণ করেছে এবং সেটা তাদের পেছন দিক থেকেই হওয়া স্বাভাবিক। এ ভাবনার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে।
অট্টহাসিটা শুনেই কিন্তু আহমদ মুসা চিনতে পারল ওটা আজর ওয়াইজম্যানের গলা।
অট্টহাসি থামল এবং সেই সাথে ভেসে এলো আজর ওয়াইজম্যানের কন্ঠ। বলল আহমদ মুসা, এবার আমরা ভুল করিনি। অধ্যাপক দানিয়েলের বাড়িতে যে ভুল আমরা করেছিলাম, সেটা আর হবেনা। তোমাকে কাউন্টার আক্রমনের আর সুযোগ আমরা দেবনা।
আজর ওয়াইজম্যানের কথা শেষ হতেই তার পাশের ছায়ামূর্তিটির লম্বা ও মোটা ব্যারেলের বন্দুক চোখের পলকে উপরে উঠল। গর্জন করে উঠল ক্ষিপণাস্ত্রের মত। পর মুহূর্তেই দেখা গেল একটা জাল গিয়ে জড়িয়ে ফেলেছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে।
জালটা অদ্ভুত ইলাষ্টিক ধরনের।
বেশ প্রশস্ত জালটি আহমদ মুসাদের জড়িয়ে ফেলার পর সংকুচিত হয়ে একেবারে লাগেজ ব্যাগে পরিণত হয়েছে। হাত-পা নড়ানো ও মুখ এদিক-ওদিক করার সামান্যতম সুযোগও নেই।
আজর ওয়াইজম্যান আবার হেসে উঠল হো হো করে। হাসির পর বলে উঠল আবার, ‘আহমদ মুসা, আমি তোমাকে হত্যা করতে পারতাম। হত্যা করতে চেয়েছিলামও। কিন্তু হত্যা করিনি। তুমি মৌলবাদী ও মিলিট্যান্টদের ব্যাপারে যা জান, দুনিয়ার কেউ তা জানে না। আজকের মুসলিম রেনেসাপন্থীদের তুমি এক অনন্য অভিধান। তোমাকে হত্যা করলে এই অমূল্য অভিধান চিরতরে হারিয়ে যাবে। আমরা তোমাকে এক্সরে করে ধীরে ধীরে সব তথ্য বের করে নিতে চাই। তবে তুমি বেয়াড়া হলে হত্যা করতে এক সেকেন্ডও দেরি করা হবে না।’
কথা শেষ করেই পকেট থেকে মোবাইল বের করল। টেলিফোন করল কাউকে। মোবাইলটা কানে ধরে ওপার থেকে সাড়া পেয়েই বলে উঠল, ‘সুসংবাদ নাও, দুজনকেই জালে আটকেছি। ওদিকের খবর কি?’
ওপারের কথা শুনে আবার বলে উঠল, ‘আহ বেচারা আলফ্রেড ফিগো! আমি এটাইতো আশংকা করেছিলাম। বিরাট ক্ষতি হলো আমাদের। তোমরা চিন্তা করো না। ফিগোর কাছে কমিট করা পুরো অংকই তোমরা পেয়ে যাবে। আবার চাইলে তোমরা আমার সাথেও কাজ করতে পারবে। যাক, এখন জলদি গাড়ি নিয়ে এস।’
কথা শেষ করেই মোবাইল বন্ধ করল আজর ওয়াইজম্যান। সংগে সংগেই সে তার বাম পাশের দুই সাথীসহ অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে পেছনে ফিরছে। বিস্মিত হয়ে আজর ওয়াইজম্যান পেছন ফিরল। ফিরেই গুলীর মুখোমুখি হলো সে। তার চোখে পড়ল অল্প দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে দুটি ছায়ামূর্তি। তাদের হাতে উদ্যত রিভলবার। আরও চোখে পড়ল, তার পাশের দুই সাথী গুলী বিদ্ধ হয়ে ভূমিশয্যা নিল।
উরুতে গুলীবিদ্ধ হয়েছে আজর ওয়াইজম্যান।
সে দাড়িয়েছিল নদীর তীর ঘেষেই।
তার জামা-কাপড় দিয়ে তখনও পানি ঝরছে। পরিকল্পনা করে নদীর উজান বেয়ে সামনে এসেই তারা পেছন থেকে আক্রমণ করেছিল আহমদ মুসাদেরকে।
পাল্টা আক্রমণের সুযোগ দেখল না আজর ওয়াইজম্যান। ডান হাতের রিভলবার তুলতে গেলেই ওদের গুলীতে ঝাঁঝরা হতে হবে।
মুহূর্তেই তার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল।
তার দেহটা ছিটকে দক্ষিণ দিকে পড়ে গেল। তারপর আরেকটা গড়া দিয়েই নদীতে গিয়ে পড়ল। ছায়ামূর্তি দুটি এবার দ্রুত এগিয়ে এল জালে জড়ানো লাগেজে পরিণত হওয়া আহমদ মুসাদের কাছে।
দুটি ছায়ামূর্তির একজন সার্গিও গনজালো, অন্যজন ভ্যানিসা।
সার্গিও গনজালো তাড়াতাড়ি তার মোজার মধ্যে গুজে রাখা একটা চাকু বের করে জালটা কেটে ফেলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক উঠে দাঁড়াল।
‘ধন্যবাদ মি. সার্গিও, আপনি ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলেন।’
‘ভাই সাহেব, ধন্যবাদটা জুটোর প্রাপ্য। আপনি ও মি. হাসান তারিক আকস্মিকভাবে বন্দী হলে সে ওদের চোখ এড়িয়ে পালায় এবং ছুটে যায় আমাদের কাছে। তা না হলে ওখানে আমরা আপনাদের জন্যে কতক্ষণ দাঁড়াতাম কে জানে!’ বলল সার্গিও।
‘আল্লাহর শুকরিয়া যে, জুটোকে তারা আমাদের সাথে ধরেনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আপনার কৌশল কাজে লেগেছে। উপত্যকার কেউ আপনার সাথে নেই, আপনারা পালিয়ে এসে উপত্যকার হোটেলে উঠেছেন, এটাই তারা সম্ভবত মনে করেছে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিন্তু আপনারা ওদের মেরে আমাদের উদ্ধার করেছেন, এ থেকে ওরা কি ভাববে সেটা এখন চিন্তার বিষয়।’ হাসান তারিক বলল।
হাসান তারিকের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা দ্রুত লাশ দুটির দিকে এগুলো।
ওদের একবার দেখে বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘হ্যাঁ মি. সার্গিও, তৃতীয়জন মানে আজর ওয়াইজম্যান কোথায়?’
‘আহত হবার পর যিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। উনি কি আজর ওয়াইজম্যান ছিলেন? ও গড! উনিই তো প্রথম শিকার হওয়া উচিত ছিল।’ বলল সার্গিও গনজালো।
আপনি কি করবেন মি. সার্গিও, আল্লাহ ওকে আরেকটু সময় দিয়েছেন তার পাপের ভারটা পূর্ণ করার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই হবে ভাই সাহেব।’ বলে একটু থামল সার্গিও। পরক্ষণেই আবার বলে উঠল, ‘আমরা আসার পথে প্রচন্ড গুলী-গোলার শব্দ শুনেছিলাম। আর আজর ওয়াইজম্যানের টেলিফোন টকে বুঝলাম, আলফ্রেড ফিগো নামে নেতা গোছের কেউ মারা গেছে। ঘটনা কি ভাই সাহেব?’
আহমদ মুসা সংক্ষেপে তাদের বন্দী করে নিয়ে আসা, ওদের ছয়জনকে হত্যা করে তাদের মুক্ত হওয়া, মেশিনগানের অব্যাহতগুলীর আড়ালে ওদের লাশ তুলে নিয়ে যাওয়া এবং পেছন থেকে আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে তাদের বন্দী হওয়ার কাহিনী বলল।
‘তাহলে ঐ ছয়জনের একজনই ফিগো হবে। তাকেই আজর ওয়াইজম্যান ভাড়া করেছিল আপনাদের হত্যা অথবা বন্দী…………….।’
সার্গিও’র কথা শেষ হলো না।
পেছন থেকে তিনটি ইঞ্জিন প্রচন্ড গর্জন করে উঠলে আহমদ মুসা ও সার্গিওসহ সকলে পুব দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, তিনটি গাড়ি উপত্যকার দিকে আসছে।
সার্গিও দ্রুতকণ্ঠে বলে উঠল, ‘ভাই সাহেব, বন্দী হিসেবে আপনাকে নিয়ে যেতে আসছে। আজর ওয়াইজম্যান ওদের আসার নির্দেশ দিয়েছিল।’
‘আজর ওয়াইজম্যানের এই ইচ্ছাও পূরণ হলো না। কিন্তু আমরা রক্তপাত এড়াতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
সবাই ছুটে আসা গাড়ির দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়েছিল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল হাসান তারিক। কিন্তু থেমে গেল।
সবাই দেখল, উপত্যকার মুখে পৌছার আগেই থেমে গেল গাড়িগুলো।
‘থেমে গেল কেন গাড়িগুলো? আজর ওয়াইজম্যানের নির্দেশ মোতাবেক গাড়িগুলো দ্রুত এখানে চলে আসার কথা।’ বলল সার্গিও বিস্মিতকণ্ঠে।
ভাবছিল আহমদ মুসা।
হঠাৎ তার মুখে নেমে এল প্রসন্নতা। বলল, ‘যিনি ওদের আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনিই ওদের থামিয়ে দিয়েছেন মি. সার্গিও।’
‘তার মানে আহত আজর ওয়াইজম্যান নদী থেকে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।’ হাসান তারিক বলল।
‘হ্যাঁ তাই হাসান তারিক। এ ছাড়া গাড়িগুলো থেমে যাবার আর কোন যুক্তি নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
হঠাৎ ভ্যানিসা চাপাকণ্ঠে আর্তচিৎকার করে উঠল, ‘সার্গিও ভাইয়া, ওরা তো আহত। দেখ, আহমদ মুসা ভাইয়ার ডান হাতে এবং হাসান তারিক ভাইয়ার ডান বাহুতে রক্ত।’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, ‘চিন্তার কারণ নেই ভ্যানিসা, বুড়ো আঙুলের গোড়াটা গুলীর ধাক্কায় একটু ছিঁড়ে গেছে। আজর ওয়াইজম্যানের গুলী আমার পিস্তলকে আঘাত করেছিল।’
হাসান তারিকও বলে উঠল, ‘আমার বাহুটাও ছিঁড়ে গেছে। গুলী অল্প একটু জায়গা ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে, এখন রক্ত খুব অল্পই বের হচ্ছে।’
ভ্যানিসা তাড়াতাড়ি তার ব্যাগের চেইনটা খুলে গলায় বাঁধা একটা স্কার্ফ বের করল। তাড়াতাড়ি তা ছিঁড়ে একটা অংশ দিয়ে হাসান তারিকের বাহু ও আহমদ মুসার আঙুল বেঁধে দিল। তার বাঁধার ষ্টাইল দেখে হাসান তারিক বলল, ‘আপনি ডাক্তার নাকি?’
‘ডাক্তার নয়, নার্স বলতে পারেন। আমাদের গনজালো পরিবার এবং আমাদের পাহাড়ী ও যাযাবর সব উপজাতির মহিলাদেরই এই ট্রেনিং আছে। আমরা দীর্ঘ এক যুদ্ধে জড়িত। আমাদের মহিলাদেরকেই ডাক্তার ও নার্সের কাজ বেশি করতে হয়।’ বলল ভ্যানিসা।
‘ধন্যবাদ বোন।’ আহমদ মুসা বলল।
ভ্যানিসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু থেমে গেল। ইঞ্জিনের শব্দে তারা সামনে ফিরে তাকাল। দেখতে পেল সামনের গাড়িটা আবার এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।
ওদিকে চোখ রেখে আহমদ মুসা ধীরে ধীরে বলল, ‘আজর ওয়াইজম্যান কি আবার নতুন করে আক্রমণে আসতে চায়? কিন্তু এই রক্তপাত আমাদের জন্যে অপ্রয়োজনীয় এবং সিলভার ভ্যালির জন্যে ক্ষতিকর। এই অবস্থায় আমাদের কি করণীয়।’
আহমদ মুসা থামল।
আহমদ মুসা থামার সাথে সাথে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দও থেমে গেল।
গাড়িটা উপত্যকার প্রবেশ পথের মুখে থেমে গেছ। দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের দেয়ালের ঠিক গা ঘেঁষে। পর মুহূর্তে পেছনের গাড়িটাও এসে তার পাশে দাঁড়াল।
উপত্যকার প্রবেশ মুখে গাড়ি দুটি এমনভাবে দাঁড়াল যে, তৃতীয় কোন গাড়ি যাওয়া আসার পথ বন্ধ হয়ে গেল। এখন গাড়ি দুটির দুপাশ দিয়ে শুধু পায়ে হাঁটা লোকই চলাচল করতে পারবে।
গাড়ি দুটির হেডলাইট উপত্যকার মুখসহ অনেকখানি এলাকা আলোকজ্জ্বল করে তুলেছে। এখন উপত্যকার বাইরে যেই যেতে চাইবে, গাড়ির পড়ে যাবে।
দুটি গাড়ির ছাদের উপর মেশিনগান সাজানো। মেশিনগানের ব্যারেল হা করে আছে উপত্যকার দিকে।
আহমদ মুসার কপাল কুঞ্চিত।
ভাবছিল সে।
বলল একটু পর, ‘মি. সার্গিও ওরা উপত্যকা অবরোধ করে বসল।’
‘অবরোধ? অবরোধ করে কি করবে?’ বলল সার্গিও।
‘আমাকে ও হাসান তারিককে ধরবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিভাবে? অবরোধ করে বসে থাকলেই কি ধরা যাবে? কয়দিন ওভাবে বসে থাকবে তারা?’ বলল সার্গিও।
‘উপত্যকার মুখে ওরা এভাবে বেশি সময় বসে থাকবে না। আমার ধারণা তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করবে এবং পুলিশেরও সাহায্য চাইবে বিশ্বাসযোগ্য কোন কাহিনী ফেঁদে। উপত্যকার ভেতরের কারও সাথে যোগাযোগ করবে। সবশেষে প্রবেশ করবে উপত্যকায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আর আমরা এ সময় উপত্যকায় বসে হাওয়া খাব তাই না? আপনারা যে পথে এসেছেন, সেই পথেই আবার বেরিয়ে যেতে পারেন, এটা কি তারা জানে না?’ সার্গিও বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘সে দিকের ব্যবস্থাও তারা নিশ্চয় করছে।’
‘তার মানে তারা ঐ পথ অবরোধেরও ব্যবস্থা নেবে?’ বলল সার্গিও।
‘শুধু অবরোধ নয়, ঐ পথে এ উপত্যকায় তারা অভিযানেরও ব্যবস্থা করতে পারে। তাদের ক্ষতি কম হয়নি। তারা নিশ্চয় মনে করছে এ সব আহমদ মুসার কাজ। আহমদ মুসাকে ধরার এটুকু ব্যবস্থা তারা করবেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আমাদের এখন কি করণীয় ভাই সাহেব?’ বলল সার্গিও।
‘আমরা যেভাবে নিরবে উপত্যকায় এসেছিলাম, সেভাবেই বেরিয়ে যাব অর্থাৎ যে পথে এসেছিলাম সে পথেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি যে বললেন ঐ পথেও ওরা অবরোধ বসাচ্ছে বা অভিযানে আসছে?’ বলল সার্গিও।
‘পাহাড়ে ওদের চোখ এড়ানো সম্ভব হবে। সাউন্ড মনিটরিং আমাদের সাহায্য করতে পারে ওদের আগমন চিহ্নিত করার কাজে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু এরপরও সংঘাত বাধতে পারে। কিন্তু আপনি চাচ্ছেন সংঘাত এড়াতে।’ বলল সার্গিও।
‘সংঘাত সব সময় এড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। তবে কেউ ঘাড়ে এসে পড়লে জবাব দিতেই হয়। সে যাক। আমাদের এখন যাত্রা করা উচিত মি. সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু তার আগে আমাদের বাসায় যেতে হবে, এটা আপনার ওয়াদা ছিল।’ বলল ভ্যানিসা।
একটু থামল আহমদ মুসা। বলল, ‘এই উপত্যকার প্রতি একটা মমতার সৃষ্টি হয়েছে। এই মমতা আর বাড়াতে চাই না। আর সময়ও নেই তোমাদের বাড়িতে যাবার।’
‘আপনার কোন কথা শুনব না। যেতে হবে আমাদের বাড়িতে।’ বলে ভ্যানিসা তাকাল সার্গিও গনজালোর দিকে। বলল, ‘ভাইয়া’ এস ওদের নিয়ে।’
কথা শেষ করে হাঁটতে লাগল ভ্যানিসা।
সার্গিও আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘চলুন, উপায় নেই।’
৪
আহমদ মুসা ডাইনিং থেকে ড্রইংরুমে প্রবেশ করে শোফায় বসতে বসতে বলল, ‘হাসান তারিক, মি. সার্গিও, ভ্যানিসা এস আমরা একটু বসি। গন্তব্য নিয়ে একটা আলোচনা সেরে নেই।’
ড্রইং রুমের চারদিকে চোখ বুলাচ্ছিল হাসান তারিক। সে বসতে বসতে বলল, ‘ভাইয়া, যাত্রা শুরুর আগে এ কাজটা অবশ্যই আমাদের সারতে হবে। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলি ভাইয়া, মি. সার্গিওদের গোটা ড্রইং রুমটাই যেন একটা বিরাট এ্যানটিকস। বিশাল শোকেসটার এ্যানটিকসগুলোর মত সোফা, কার্পেট, ওয়ালম্যাট, ছবি সবকিছুই দেখার মত এ্যানটিক্স।’
‘হাসান তারিক ভাইয়া ঠিকই বলেছেন। এগুলো সবই আমাদের পুরানো বাড়ি থেকে আনা সম্পদ; আমাদের জীবন্ত অতীত।’
‘তার মানে এগুলোর কোন কোনটির বয়স পাঁচশ’ ছ’শ বছরও হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার কণ্ঠে।
‘অবশ্যই ভাইয়া। আপনি শোকেসের বড় যে তরবারিটা দেখছেন ওটা এই দ্বীপে আমাদের আদি পূর্ব পুরুষ মি. গনজালোর। প্রত্যেকটা এ্যানটিকসের সাথেই তার বয়স ও পরিচয় সম্পর্কে একটা নোট আছে।’
‘বেশ মজার তো! দেখতে তো হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখবেন? আসুন, খুব খুশি হবো।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
সবাই উঠল।
সত্যিই দেখার মত অনেক জিনিস।
আহমদ মুসা এটা ওটা দেখে হাতে তুলে নিল একটা স্বর্ণমুদ্রা। মুদ্রার আরবী বর্ণমালা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। চোখের সামনে তুলে ধরল সে মুদ্রাটা। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। ক্যালিগ্রাফিক আরবী বর্ণমালায় মুদ্রার উপর অংশের প্রান্ত ঘেঁষে অর্ধচন্দ্রাকারে লেখা ‘আব্দুর রহমান আল নাসির লি দ্বীনিল্লাহ’। আর নিচের অংশে ‘৩১১ হিজরী’। টাকাটা দ্রুত উল্টাল আহমদ মুসা। দেখল টাকার গোটা বুক জুড়ে কাবার ছবি। কাবার ছবি ঘিরে টাকার প্রান্ত ঘেঁষে বৃত্তাকারে লেখা, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’
আহমদ মুসা বুঝল মুদ্রাটি স্পেনের। স্পেনের সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমান এ মুদ্রা চালু করেছিলেন হিজরী ৩১১ সালে। তাঁর উপাধি ছিল ‘আল নাসির লি দ্বীনিল্লাহ’। তিনি স্পেনের সিংহাসনে আরোহণ করেন ৩০০ হিজরীতে। তিনি দীর্ঘ ৬৬ বছর স্পেন শাসন করেন। ইংরেজী সাল হিসেবে ৯১২ খৃষ্টাব্দ থেকে ৯৭৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তার শাসনকাল বিস্তৃত ছিল। তিনি তার সিংহাসনে আরোহণের একাদশ বছরে এই স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন। তার শাসকাল স্পেনে মুসলিম শাসনের স্বর্ণযুগ।
সেই সোনালী দৃশ্যটা স্বর্ণমুদ্রার মধ্যে দিয়ে যেন দেখতে পেল আহমদ মুসা। অপ্রতিরোধ্য এক আবেগে হৃদয়টা তার মোচড় দিয়ে উঠল। হাতের মুদ্রাটা যেন মুদ্রা নয়, একটা সোনালী ইতিহাস। হাতসহ মুদ্রাটা উঠে এল ঠোঁটে। আহমদ মুসা একটা চুম্বন এঁকে দিল মুদ্রার বুকে।
আহমদ মুসার দুচোখের কোণায় অশ্রু টলমল করে উঠেছে।
ভ্যানিসা লক্ষ্য করছিল আহমদ মুসাকে। বিস্ময় ও কৌতুহল ফুটে উঠেছে ভ্যানিসার চোখে-মুখে। বলল, ‘ভাইয়া আপনার চোখে অশ্রু কেন? মুদ্রায় আপনি চুমু খেলেন। মুদ্রাটা কি ভাইয়া?’
সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা। ফিরে এল ইতিহাসের জগত থেকে বাস্তবে। তাড়াতাড়ি রুমাল দিয়ে চোখ মুছে ফেলে ম্লান হেসে বলল, ‘স্যরি। মুদ্রাটা আমাকে এক সোনালী অতীতে নিয়ে গিয়েছিল। মুদ্রাকে আমি চুমু খাইনি, মুদ্রার মাধ্যমে আমি চুমু খেয়েছি সেই ইতিহাসকে।’
‘মুদ্রাটা আমরা সব সময় দেখে আসছি। ওর দুর্বোধ্য লেখা আমরা পড়তে পারিনি। আমরা শুনেছি স্বর্ণমুদ্রাটা এই দ্বীপে আসা আমাদের আদি পুরুষ সাথে করে এনেছিলেন। মুদ্রাটা তিনি যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে এসেছেন। আমরাও তাই করি। না বুঝেই করি। কিন্তু আপনি কি বুঝলেন যে চুমু খেলেন? ভ্যানিসার মত আমারও এটা জিজ্ঞাসা।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসার ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। বলল, ‘এই দ্বীপে আসা আপনাদের প্রথম পূর্ব পুরুষ এই মুদ্রাকে যত্ন করতেন? কিন্তু কেন?’
‘আপনি যত্নের চেয়ে বেশি কিছু করেছেন। চুমু খেয়েছেন। কিন্তু কেন? এ ‘কেন’র জবাব পেলে ঐ ‘কেন’-রও জবাব হয়তো পাওয়া যাবে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘পাওয়া যাবে কি?’ বলে আহমদ মুসা একটু থামল। হাতের মুদ্রাটা হাসান তারিকের হাতে দিল। তারপর আবার কথা বলে উঠল, ‘মুদ্রার উপর স্পেনের মুসলিম সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের নাম ‘আবদুর রহমান আল নাসির লি দ্বীনিল্লাহ’ লেখা রয়েছে। তিনি ৩১১ হিজরী অব্দে এই মুদ্রা চালু করেন। মুদ্রার আরেক পাশে রয়েছে আমাদের পবিত্র তীর্থ কেন্দ্র ‘কাবা শরীফে’র ছবি। সেই সাথে তার পাশে রয়েছে আমাদের কালেমা উৎকীর্ণ। এই মুদ্রার মধ্যে আকস্মিক আমাদের সোনালী ইতিহাসের মুখোমুখি হয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।’
‘বুঝেছি ভাইয়া। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আপনার মতো লোকের হৃদয় এত নরম, এত সংবেদনশীল কিভাবে?’ বলল ভ্যানিসা।
‘কেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করবে, তাদের মন থাকতে নেই নাকি? তোমরাও তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছ। তোমাদের মন নেই?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আছে ভাইয়া। কিন্তু আমাদের অতীত আমাকে কাঁদায়নি, এভাবে আমাকে অভিভূত করেনি কোনদিনই।’ বলল ভ্যানিসা।
কথাটা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘মুদ্রাটা দেখছি আপনাদের ইতিহাস-আবেগের সাথে জড়িত। তাহলে আমাদের সেই মহান পূর্বপুরুষ এই মুদ্রাকে ওভাবে যত্ন করতেন কেন? যক্ষের ধনের মত অমন করে আগলে রেখে দিলেন কেন?’
‘হতে পারে এই মুদ্রার সাথে তাঁর কোন কাহিনী বা স্মৃতি জড়িত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটা হতে পারে।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসা কিছু বলল না। তার চোখে মুখে ভাবনার ছায়া। মনোযোগ দিল সে শোকেসের অন্যান্য এ্যানটিকসের দিকে। হাত বাড়িয়ে সে হাতে তুলে নিল খাপবদ্ধ একটা লম্বা তরবারি।
তরবারি হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তরবারির এই পুরু ও সুন্দর চামড়ার খাপটাও কি সেই সময়ের মি. সার্গিও।’
‘না ভাইসাহেব, তরবারিটার সংরক্ষণের জন্যে খাপটা পরবর্তীকালে তৈরি।’ সার্গিও বলল।
‘খাপটা খুলতে পারি সার্গিও?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই। ’ বলল সার্গিও।
তরবারির খাপ খুলে ফেলল আহমদ মুসা।
দীর্ঘ ও মজবুত তরবারিটাও।
তরবারির সেই আগের রং নেই। কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে ঔজ্জ্বল্য। কিন্তু মরিচা স্পর্শ করেনি তরবারিকে।
তরবারির মেটালটা ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করতে গিয়ে বাঁটের পরেই তরবারির গোড়ার উপর নজর পড়তেই আবার ভ্রু কুঁচকে গেল আহমদ মুসার। আবার সেই আরবী বর্ণমালা। তরবারির গোড়ায় খোদাই করে লেখা পড়ল আহমদ মুসাঃ ‘গাজী আলী বিন জামাল।’ নিশ্চয় মালিকের নাম, ভাবল আহমদ মুসা।
তরবারি থেকে মুখ তুলল আহমদ মুসা। তাকাল সার্গিওর দিকে। বলল, ‘এ তরবারিটার মালিক কে সার্গিও?’
‘কেন, এ দ্বীপে আমাদের পরিবারের প্রথম মানুষ ‘গনজালো গাব্রালা।’ সার্গিও বলল।
‘কিন্তু তরবারিতে লেখা তো ভিন্ন নাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি নাম?’ সার্গিও বলল।
‘গাজী আলী বিন জামাল এবং এ নামটাও আরবীতে লেখা।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেছে সার্গিও এবং ভ্যানিসা দুজনেরই।
কিছুক্ষণ তারা কথা বলতেই পারল না।
পরে ধীরে ধীরে বলল সার্গিও, ‘কিন্তু ভাই সাহেব, এই তরবারি আমাদের পূর্ব পুরুষ গনজালোর, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। শত শত বছর ধরে আমাদের পরিবার এই কথা বলে আসছে এবং একে সংরক্ষণ করে আসছে। ভিন্ন লোকের একটা জিনিসকে, তা যতই মূল্যবান হোক, আমাদের পরিবার নিজের বলে দাবী করবে কেন?’
‘আপনার কথা ঠিক মি. সার্গিও। ব্যাপারটা এ রকমও হতে পারে। আপনার পূর্বপুরুষ গনজালো গাব্রালা স্পেনের স্বর্ণমুদ্রাকে যে কারণে সংরক্ষণ করেছেন, তেমন কোন কারণেই হয়তো তিনি এই তরবারিকেও সংরক্ষণ করেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘টাকা বিনিময়ের মাধ্যম মাত্র। আর তরবারি ব্যবহারের জিনিস। দুটোর মালিকানা এক রকমের নয়। সুতরাং তরবারির সাথে টাকার বিষয়ের কোন তুলনা হয় না ভাই সাহেব।’ সার্গিও বলল।
‘তা ঠিক। কিন্তু তাহলে এর ব্যাখ্যা কি হতে পারে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘হতে পারে তিনি তরবারিটা তার মালিকের কাছ থেকে কিনেছেন বা পেয়েছেন।’ সার্গিও বলল।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না।
ভাবছিল সে।
একটু পরেই বলল, ‘আরেকটা রহস্যেরও কিনারা করতে পারছি না সার্গিও। সিলভার ভ্যালির প্রধান নদী নিউ টাগুস। কিন্তু টাগুস নামে একটা নদী আছে স্পেনেও। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের দক্ষিণে স্পেনের ঐতিহাসিক শহর টলেডো। এই টলেডো শহরের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব-বিখ্যাত ছিল। টলেডো শহরটি টাগুস নদীর তীরে অবস্থিত। আমার মনে হচ্ছে এই ‘নিউ টাগুস’ নদীর নাম টলেডোর ‘টাগুস’ নদীর নাম অনুসারেই রাখা হয়েছে। এটাও একটা রহস্য।’
আহমদ মুসা থামতেই ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘আপনি বলতে পারেন ব্যাপারটা ‘নিউইয়র্ক’ ‘নিউজার্সি’ ‘নিউ অরলিন্স’ ‘নিউ হ্যাম্পশায়ার’ ইত্যাদির মত। ‘ইংল্যান্ডের ইয়র্ক’ ‘অরলিন্স’ ‘হ্যাম্পশায়ারের’ লোকরা আমেরিকায় গিয়ে তাদের এসব নামের আগে ‘নিউ’, যোগ করে তাদের নতুন বসতি এলাকার নামকরণ করেছে।’
‘হ্যাঁ ভানিসা, এ রকমই মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
হেসে উঠল ভ্যানিসা। বলল, ‘ভাইয়া, আপনি আসার সাথে সাথে আমাদের একমাত্র স্বর্ণমুদ্রাটা মুসলমানদের হয়ে গেল, আমাদের পারিবারিক গর্বের বস্তু তরবারিটাও মুসলমানদের হয়ে গেল, আমাদের প্রধান নদীর নামটাও এক সময়ের মুসলিম দেশ স্পেনের হয়ে গেল, শুধু আমরাই এখন মুসলমান হওয়ার বাকি।’
বলে আবার হাসতে লাগল ভ্যানিসা।
‘কেন, আমাদের উপর এ ইলজাম পর্তুগীজ সরকার বহুদিন থেকেই করছে।’ বলল সার্গিও। তারও মুখে হাসি।
কিন্তু আহমদ মুসার মুখে হাসি নেই। সে ভাবছিল। এক সময় সে বলে উঠল, ‘মি. সার্গিও, তোমাদের কবরস্তানের উত্তর-দক্ষিণমুখী কবরগুলো ভাঙা কেন, প্রথম কবরটির পাশে তোমাদের কি সব জিনিস সমাধিস্থ করা হয়েছে তা কি অনুসন্ধান করে আমি দেখতে পারি?’
‘হ্যাঁ ভাইসাহেব। এ কথা আগেই আপনি আমাকে বলেছিলেন। আমি আম্মার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি অনুমতি দিয়েছেন একটা শর্তে। সেটা হলো, দেখার পর জিনিসগুলো আবার ওখানেই রেখে দিতে হবে।’ বলল সার্গিও।
‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার আম্মার কাছে আমি কৃতজ্ঞ মি. সার্গিও। তাঁকে নিশ্চয়তা দিবেন একটা জিনিসও নষ্ট করা হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামতেই সার্গিও বলে উঠল, ‘কাজ তাহলে আমাদের বাড়ল ভাইসাহেব। সমাধীক্ষিত্রের খোড়াখুড়িতে বেশ সময় যাবে। আসুন, ম্যাপটা পরীক্ষা করে আমাদের গন্তব্য ও রুট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।’
বলে সার্গিও সোফায় টেবিলের কাছে ফিরে এল।
আহমদ মুসারাও।
সার্গিও সোফায় ফিরে গিয়ে টেবিলে রাখা ‘তেরসিয়েরা’ দ্বীপের মানচিত্রটা কাছে টেনে নিল।
আহমদ মুসা গিয়ে সার্গিওর পাশে বসল।
সার্গিওর সাথে আহমদ মুসাও মানচিত্রের উপর ঝুঁকে পড়ল।
কিন্তু মানচিত্রটা পর্তুগীজ ভাষায়।
হোঁচট খেল আহমদ মুসার চোখ।
বলল আহমদ মুসা, ‘আমি পর্তুগীজ ভাষা বুঝতে পারি, পড়তে পারি না।’
বলেই হঠাৎ আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। আনন্দ প্রকাশ পেল তার চোখে-মুখে। বলে উঠল, ‘মাফ চাচ্ছি মি. সার্গিও। ভুলে যাব, কথাটা বলে ফেলি। পর্তুগীজ ভাষার একটা চিঠি উদ্ধার করেছি WFA-এর একজন মৃতলোকের পকেট থেকে। চিঠিটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু কাউকে দিয়ে চিঠিটা পড়িয়ে নেবার সুযোগ করতে পারিনি এখন।’
‘চিঠিটা এখন আপনার কাছে আছে?’ বলল সার্গিও।
‘হ্যাঁ আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে দিন চিঠিটা। এখনি পড়ে ফেলি। না হলে আবার ভুলে যেতে পারি আমরা।’
‘ধন্যবাদ মি. সার্গিও।’ বলে আহমদ মুসা মানিব্যাগের পকেট থেকে চিঠিটা বের করে সার্গিওর হাতে দিল।
সার্গিও চিঠিটা একবার উল্টেপাল্টে দেখল। বলল, ‘চিঠিটা লিখেছে একজন মা সাও জর্জ দ্বীপের ‘হারতা’ থেকে তার ছেলে ‘এ্যান্টেনিও সোরেস’কে। মা থাকেন ‘হারতা’র ১১নং গনজালো রোডে। কিন্তু ছেলের কোন ঠিকানা চিঠিতে নেই। নিশ্চয় ইনভেলাপে চিঠিটা এসেছে। ঠিকানাটা ইনভেলাপেই ছিল।
‘যাক, হারতার অন্তত একটা ঠিকানা পাওয়া গেল। এবার পড়ুন চিঠিটা মি. সার্গিও।’ সার্গিও পড়তে শুরু করলঃ
‘‘বেটা এ্যান্টেনিও সোরেস,
আশা করি ইশ্বরের কৃপায় তুমি ভাল আছ। এক মাস হলো তুমি চাকুরী নিয়ে পর্তুগাল গেছ। কিন্তু মনে হচ্ছে এক যুগ পার হয়ে গেছে। হয়তো এমন হতো না বেটা, কিন্তু অবস্থার কারণেই তোমাকে খুব বেশি মনে পড়ছে।
যাদের সাথে তুমি পরিচয় করে দিয়ে গেছ, যারা তোমাকে চাকুরী দিয়েছে তারা লোক ভালো নয় সোরেস। তারা দুর্বিণীত, দুঃশ্চরিত্র এবং তাদের প্রতিটি আচরণই সন্দেহজনক। ওরা মনে হয় মানুষ পাচারকারী ধরনের কেউ হবে। কিংবা সন্ত্রাসী কোন দলও হতে পারে। ওরা ওদের সাংঘাতিক সব অস্ত্রশস্ত্র রেখে ঢেকে রাখারও প্রয়োজন বোধ করে না। কদিন আগে একজন লোককে আনল। এশিয়ান হবে। অসুস্থ। তার উপর খুব অত্যাচার হয়েছে মনে হলো। একদিন পরেই তাকে সাও তোরাহ দ্বীপে নিয়ে যায়। এই সাও তোরাহ দ্বীপের কথা ওদের মুখে প্রায় শুনি। দ্বীপটি কোথায়? ওদের কথা-বার্তা শুনে মনে হয় সাও তোরায় বড় কোন ব্যাপার আছে।
আমার এসব ভাল লাগছে না বেটা। তুমি তাড়াতাড়ি এস। দরকার হলে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে এস। ওদের হাত থেকে আমাদের বাঁচাও, তোমার বোনকে বাঁচাও। তোমার চিঠি নয়, তোমার আসার অপেক্ষায় রইলাম।’’
তোমার ‘মা’
চিঠি পড়া শেষ হলো।
মুখ ম্লান হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার। বেদনার একটা চাদর যেন তার চোখ-মুখ ঢেকে দিয়েছে। বলল, ‘স্যরি। মা ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকবে, বিপদগ্রস্ত বোনের অস্থির দু’টি চোখ ভাইয়ের অপেক্ষা করবে। কিন্তু পরিবারের যিনি হাল ধরবেন, সেই ভাই আর কোন দিনই বাড়িতে পৌছবে না। বেচারা নিহত হয়েছে।’
থামল আহমদ মুসা।
তার কণ্ঠ কান্নার মত ভারী।
‘দুঃখের এদিকটা বাদ দিলে চিঠিটা খুবই মূল্যবান ভাইয়া। জানা গেল, সাও তোরাহতে তাদের লোক পাচার অব্যাহত আছে। সাও তোরাহ থেকে ওরা সরে পড়বে, এ ভয় মনে হয় নেই। আমাদের অভিযান দ্রুত করতে হবে ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল ভাইসাহেব। থাক, আসুন ম্যাপটা দেখি।’ বলে সার্গিও আবার ম্যাপের উপর ঝুঁকে পড়ল।
আহমদ মুসাও।
কিন্তু মুখ তার আগের মতই বেদনার্ত।
হাতের পেন্সিলের ডগা দিয়ে মানচিত্রের স্থান বিশেষ স্পর্শ করে বলল সার্গিও, ‘আমরা উত্তরের পার্বত্য পথে উপত্যকা থেকে বের হচ্ছি। তারপর দ্বীপ থেকে বের হবার আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা থাকবে। একটা হলো আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটা পর্যন্ত যে পথ দিয়ে আপনারা এসেছিলেন সেই পথে। অন্যটি আমাদের পারিবারিক সমাধীক্ষিত্র থেকে সোজা পশ্চিম দিকে জলা ভূমিটাকে ডাইনে রেখে দ্বীপের উপকূল পর্যন্ত এগুনো। সে উপকূলে আমাদের একটা ঘাঁটি আছে, মোটর বোটেরও ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই পথটা অপেক্ষাকৃত দুর্গম। এই ট্রাকটা আমরা ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করে না এবং এর সন্ধানও কেউ জানে না। এখন………..।’
সার্গিওর কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘পশ্চিমের এই দূর্গম পথটাই আমাদের জন্যে নিরাপদ। চোখ বন্ধ করে আমরা এ পথ বাছাই করতে পারি।’
‘ধন্যবাদ ভাইসাহেব। এখন বলুন গন্তব্য কোথায় হবে। সেই অনুসারে আমাদের ঘাঁটিকে ইনষ্ট্রাকশন দিতে হবে আয়োজন করার।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসা মানচিত্র থেকে মুখ তুলল। বলল, ‘সেটাও চোখ বন্ধ করে বলা যায়। আমরা সাও জর্জ দ্বীপের ‘হারতা’ যাচ্ছি।’
সার্গিও মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ফ্লোরেস দ্বীপের সান্তক্রুজ কেন নয় ভাইসাহেব। ওখান থেকে সাও তোরাহ যাওয়া সহজ হবে।’
‘এমনিতেই আগে থেকে আমরা হারতাকে প্রথম বেজ ক্যাম্প হিসেবে বাছাই করেছিলাম সাও তোরাহ সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্যে। এখন সেখানে যাওয়া ফরজ হয়ে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ফরজ কি?’ জিজ্ঞাসা সার্গিওর।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ফরজ অর্থ হলো, অবশ্য কর্তব্য।’
‘হারতা যাওয়া অবশ্য কর্তব্য হলো কেন?’ জিজ্ঞেস করল সার্গিও।
‘আমি এ্যান্টেনিও সোরেসের বাড়ি যেতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ্যান্টেনিও সোরেসের বাড়ি কেন?’ সার্গিও বলল।
‘এ্যান্টেনিও সোরেসের মা-বোনদের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখ গম্ভীর।
সবাই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না।
সবাই নিরব।
একটু পর সার্গিও বলল, ‘সিদ্ধান্ত এটাই হলো। তাহলে ওঠা যাক। তৈরি হয়ে তো এখনই যাত্রা করতে হবে।
সবাই উঠল।
উঠতে উঠতে ভ্যানিসা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমার খুবই ইচ্ছা হচ্ছে হারতা যাবার।’
‘না বোন, তুমি এবং সার্গিও কাউকেই এখন এই কাজে জড়াব না। তোমরা যে পবিত্র সংগ্রাম করছ তাকে সব আনন্দিত উপসর্গ থেকে নিরাপদ রাখতে হবে। তোমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে যদি কোনওভাবে মুসলমান তথা মৌলবাদ তথা সন্ত্রাসীদের সাথে যুক্ত করতে পারে, তাহলে তোমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এই ক্ষতি তোমরা আমরা কেউই চাই না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যুক্তি আপনার ঠিক। কিন্তু মনকে মানাবার মত নয়।’ বলল সার্গিও।
‘তবু মনকে মানাতেই হবে ভাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার নির্দেশ অবশ্যই শিরোধার্য।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু একটা শর্তে।’ বলে উঠল ভ্যানিসা।
‘কি শর্ত?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনারা ভালো থাকলে সেটা আমাদের জানার দরকার নেই। কিন্তু বিপদে পড়লে সেটা যেন আমরা জানতে পারি।’ ভ্যানিসা বলল। তার মুখ ম্লান, কণ্ঠ ভারী।
‘চেষ্টা করবো ভ্যানিসা তোমার শর্ত মানতে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইসাহেব। চলুন।’ সার্গিও বলল।
সবাই আবার হাঁটতে শুরু করল।
হঠাৎ ধাতব চিৎকার উঠল শাবলের আঘাতটা মাটির গভীরে গিয়ে আছড়ে পড়তেই।
ধাতব চিৎকার উঠার সাথে সাথেই আনন্দে হুররা দিয়ে উঠল সার্গিও।
শাবল চালাচ্ছিল আহমদ মুসা।
ঘেমে সে একাকার হয়ে গেছে।
প্রায় সাতফুট মাটির নিচে গিয়ে এই প্রথম ধাতব শব্দ পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা, হাসান তারিক ও সার্গিও পর্যায়ক্রমে খননের কাজ করছিল।
অন্ধকারে চাঁদের আলোটুকুকে সম্বল করে মাটি খুঁড়তে হচ্ছিল।
বাইরের আলো জ্বালানো যাচ্ছে না।
তারা আসার পথে আজর ওয়াইজম্যানের বাহিনীর মুখে পড়ে গিয়েছিল। সমাধীক্ষিত্রের এক বাঁক দক্ষিণে একটা প্রশস্ত চড়াইয়ে যখন আহমদ মুসারা উঠছিল সেই সময় দুটি হেলিকপ্টার বোঝাই সশস্ত্র লোক ওখানে ল্যান্ড করতে আসে। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ওরা হেলিকপ্টারের ফ্লাশ ও ধরা পড়া থেকে নিজেদের রক্ষা করে। সশস্ত্র লোকরা চড়াই-এ নামার পর আহমদ মুসাদের পাশ দিয়েই দক্ষিণে চলে যায়। দুটি হেলিকপ্টারের একটি ওদের কাভার দিয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়, অন্যটি গিরিপথের ট্রাক ধরে উত্তরে চলতে শুরু করে। দুটি হেলিকপ্টারই গোটা এই পথের উপর টহল দিয়ে ফিরছে। আলো দেখলেই ওরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাই খননের কাজটা তাদেরকে অন্ধকারের মধ্যেই করতে হচ্ছে।
কোথায় খুঁড়বে এ নিয়েও তারা বিপদে পড়েছিল। এ ব্যাপারে মা-দাদীও খুব বেশী সাহায্য করতে পারেনি। শুধু বলেছিল, জিনিসগুলো প্রথম কবরের পাশে পুঁতে রাখা হয়েছে। সমস্যায় পড়তে হয় প্রথম কবর কোথায় তা নিয়ে। উত্তর-দক্ষিণ কবর যখন, তখন তা মুসলমানের হওয়ার সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা সামনে রেখে আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নেয় পশ্চিম প্রান্তের সর্ব উত্তর থেকে কবর শুরু হয়েছে। সুতরাং সর্ব উত্তরেরটাই প্রথম কবর।
তারপর সমস্যা দেখা দেয় কবরের কোন পাশে জিনিসগুলো পুঁতে রাখা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় কবরের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নেয় এই দু কবরের মাঝখানে যে স্পেস তাতে তেমন কোন বড় জিনিস পুতে রাখার মত নয়। সুতরাং অবশেষে সে পশ্চিম ও উত্তর পাশেই অবস্থান বিচারে ধরে কবরের সিথানের দিকেই জিনিসগুলো পুঁতে রাখা হয়েছে।
সিথানের দিকে সাত ফিট খননের পর শাবলের আঘাত থেকে ধাতব শব্দ উঠায় পুঁতে রাখা ষ্টিলের বাক্স পাওয়া গেছে বলে সবাই খুশি হয়ে উঠল।
‘কবরের লেভেল থেকেও অনেক নিচে পুঁতে রেখেছে বাক্সটা। অথচ মৃতদের সাথে সংশিস্নষ্ট কোন জিনিস কবরে বা কবরের লেভেলেই রাখা হয়।’ বলল গর্তের ভেতর থেকে শাবল চালাতে চালাতেই।
‘যারা এটা রেখেছেন তারা চাননি যে, এটা কেউ খুঁজে পাক।’ হাসান তারিক বলল।
‘আজ ভাইয়া না থাকলে আমাদের শত চেষ্টা ব্যর্থ হতো। আমরা এই বাক্সটা খুঁজে পেতাম না।’ বলল ভ্যানিসা।
ভ্যানিসার কথা শেষ হতেই গর্ত থেকে আহমদ মুসা বলল, ‘এবার এস হাসান তারিক। আলগা হয়েছে বাক্সটা। এখন তোলা যাবে।’
হাসান তারিক লাফ দিয়ে নামল নিচে।
সার্গিও এগিয়ে গেল।
বাক্সটা উপরে উঠে এল।
৬ বর্গফুটের বিশাল বাক্সটা।
বাক্সটা টেনে তার পাশেই পাহাড়ের এক গুহায় নিয়ে গেল।
পুরু পলিথিনে মোড়া বাক্সটা।
‘মি. সার্গিও, যারা বাক্সটাকে কবর দিয়েছিল, তারা বাক্সটাকে কেউ খুঁজে পাক তা চাননি। কিন্তু বাক্সটাকেও তারা নষ্ট করতে চাননি। এয়ারটাইট পলিথিনের মোড়ক একেবারে অক্ষত রেখেছে বাক্সটাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে আমাদের পূর্ব পুরুষরা পারিবারিক এই সম্পদকে লুকিয়ে রেখেছেন, চিরতরে কবরস্থ করেননি!’ সার্গিও বলল।
‘অর্থাৎ তারা চেয়েছিলেন কোন এক সময় পরিবারের কেউ এটা খুঁজে পাক?’ ভ্যানিসা বলল।
‘তাই মনে হয়।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু আজকে কি সেই ‘কোন এক সময়’ বলা যায়?’ ভ্যানিসা বলল।
‘স্বয়ং আহমদ মুসা বাক্সটাকে মাটির নিচ থেকে তুলেছেন। আমি মনে করি এর চেয়ে বড় ঐতিহাসিক সময় ভবিষ্যতে আর আসবে না।’ বলল সার্গিও।
ভ্যানিসার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘আমিও তাই মনে করছি। আমাদের পরিবারের জন্যে এটা সৌভাগ্য।’
বাক্স লক করা ছিল না।
ডালা খোলা হলো বাক্সের। আহমদ মুসাই খুলল।
তিনদিকে বন্ধ বৈদ্যুতিক লন্ঠন জ্বালানো হয়েছিল। যাতে বাইরে আলো দেখা না যায়।
বাক্সের ডালা খোলা হলো। আলোকসম্পাতে বাক্সের অভ্যন্তরে দেখা গেল, একটা কাল কাপড়ে বাক্সের ভেতরটা ঢাকা। কাল কাপড়ের উপরে পড়ে আছে একটা ইনভেলাপ।
‘ইনভেলাপটা তুলে নিয়ে আহমদ মুসা সার্গিওর হাতে দিয়ে বলল, ‘সবার উপর যখন এই ইনভেলাপটা, তখন এই বাক্স সম্পর্কেই এই ইনভেলাপে কিছু লেখা আছে। পরিবারে পক্ষ থেকে এটা পড়ার হক তোমার।’
ইনভেলাপটা হাতে নিল সার্গিও।
শত বছরের পুরানো ইনভেলাপ। শক্ত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ইনভেলাপটা খুলে তার ভেতর থেকে চিঠি বের করল সার্গিও।
ধীরে ধীরে চিঠির ভাঁজ খুলল।
সময়ের তুলনায় চিঠির কাগজের অবস্থা অনেক ভালো। এয়ারটাইট অবস্থায় থাকার কারণেই ক্ষতি হয়নি কাগজের। চিঠির ভাঁজ খুললেও কাগজের কোন ক্ষতি হলো না। চিঠি পড়তে লাগল সার্গিওঃ
‘‘পরিবারের মহান সদস্যদের প্রতি,
আমার দৃঢ় বিশ্বাস মাটির তলা থেকে বাক্সবন্দী এই সম্পদ আমাদের বংশধরেরাই একদিন উত্তোলন করবে। এই বিশ্বাস থেকেই এই সম্বোধন করলাম।
পরিবারের একটি ইতিহাস, একটি পরিচয় আজ বাক্সবন্দী হয়ে আমার হাতে মাটি চাপা পড়ল। পরিবারের এক সময়ের পরিচয়ের চেয়ে পরিবারের অস্তিত্ব বড়। আবার একটি পরিবারের অস্তিত্বের চেয়ে দেশের অস্তিত্ব অনেক বড়। এই বিবেচনাতেই পরিবারের একটি পরিচয় সমাধিস্থ করলাম।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন আজ সংকটে। পর্তুগীজ সরকার সুস্পষ্ট অভিযোগ তুলেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী গনজালো পরিবার এবং স্বয়ং গনজালো মুসলমান ছিলেন। গনজালো পরিবারের খৃষ্টান পরিচয় একটা ছদ্মবেশ মাত্র। এই ছদ্মবেশ নিয়ে আজোরস দ্বীপপুঞ্জকে তারা কুক্ষিগত করতে চায়, মৌলবাদী একটি দেশে পরিণত করতে চায়। পর্তুগীজ সরকারের এই প্রচার আমাদের উপর বজ্রাঘাত হানে। এর উপযুক্ত উত্তর না দিলে প্রিয় মাতৃভূমি আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু পর্তুগীজ সরকারের অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই। আমরা কি জবাব দেব? পরিবারের পুরানো কাগজপত্র ও এ্যানটিকসগুলো পরীক্ষা করতে লাগলাম। পুরানো পোশাকাদি ও দলিলপত্র এবং প্রাপ্ত একটা ডাইরী থেকে নিশ্চিত প্রমাণিত হলো সম্মানিত পুর্বপুরুষ গনজালোসহ আমাদের পুর্ব পুরুষরা মুসলমান ছিলেন। এটা জানার পর পরিবারের স্বার্থে দেশের স্বার্থে প্রথম প্রয়োজন হয়ে পড়ল পারিবারিক এই অতীত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করা এবং তারপর পর্তুগীজ সরকারের জবাবে বলা যে, গনজালো পরিবার পর্তুগীজ সরকারের দুরভিসন্ধিমূলক অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করছে। গনজালোরা আজোরস দ্বীপপুঞ্জে সবচেয়ে পুরানো এবং ঐতিহ্যবাহী খৃষ্টান পরিবার। অজানা ও অপ্রমাণিত কোন অতীত সম্পর্কে তারা কিছু জানতে চায় না, তার প্রয়োজনও নেই। মহান যিশুর রাজ্য হিসেবেই আজোরস তার স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করছে। পর্তুগীজ সরকার মিথ্যা কোন অভিযোগ এনে বা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এই আন্দোলন বানচাল করতে পারবে না।
এই বক্তব্য দেয়ার জন্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো পূর্বপুরুষ মুসলমান হওয়ার সব প্রমাণ নষ্ট করে ফেলা হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে এক এক করে বাছাই করে স্তুপিকৃত করা হলো পুড়িয়ে ফেলার জন্যে। কিন্তু পুড়ানো গেল না। আম্মা, দাদী কান্না শুরু করলেন। আমিও পারলাম না আগুন দিতে। মনে হচ্ছিল, পূর্ব পুরুষদের গায়েই যেন আগুন দিতে যাচ্ছি। অবশেষে ঠিক হলো আজোরসে আমাদের প্রথম পুরুষের কবরের পাশে এগুলো সমাধিস্থ করা হবে। সমাধিস্থ করতে গিয়ে দেখা গেল, প্রথম দিকের সব কবরই উত্তর-দক্ষিণ। অর্থাৎ তারা মুসলমান ছিলেন। অতীতে বহুবার এই সমাধীক্ষিত্রে গেছি, কিন্তু বিষয়টা কেউ আমরা খেয়াল করিনি। এই দৃশ্য আমাদের আতংকিত করে তুলল। এই দৃশ্যের ছবি যদি পর্তুগীজ সরকারের হাতে যায়, আর একবার যদি তা পত্র-পত্রিকায় আসে, তাহলে কথা বলারও আর মুখ থাকবে না। গনজালো পরিবার আকাশ থেকে একেবারে ধুলায় পড়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো প্রথম দিকের সব কবর নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার। সেই দিনই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করা হলো।
এভাবেই গনজালো পরিবার তার অতীতকে মুছে ফেলল এক অপরিহার্য প্রয়োজনে।
আর এ কথাগুলো আমরা রেখে গেলাম ভবিষ্যতের এক প্রয়োজনকে সামনে রেখে।’
-গনজালোর ইতিহাস।’’
পড়া শেষ করল সার্গিও।
সবাই মূর্তির মত স্থির বসে পড়া শুনছিল। পড়া শেষ হলেও তারা তেমনি স্থির বসে রইল। নড়তেও তারা যেন ভুলে গেছে।
কারো মুখেই কোন কথা নেই।
পড়ার পর সার্গিও নিজেও বাকহীন।
অনেকক্ষণ পর নিরবতা ভাঙল ভ্যানিসা। বলল, ‘বলেছিলাম না, ভাইয়ার আগমনে স্বর্ণমুদ্রা, তরবারি, সিলভার উপত্যকার নদীও মুসলমান হয়ে গেছে, এখন আমরাই শুধু মুসলমান হতে বাকি। সেই বাকিটাও এখন জানা হয়ে গেল, আমরা মুসলমানদের বংশধর। মুসলমানদের রক্ত আমাদের ধমনীতে, মানে আমরাও মুসলমান।’
‘এভাবে কথা বলো না ভ্যানিসা। এক সময় হয়তো আমাদের পরিবার মুসলমান ছিল, কিন্তু এখন খৃষ্টান। এটাই আজকের বাস্তবতা।’ বলল সার্গিও।
‘জানি ভাইয়া। এই বাস্তবতাই তো বাস্তব এক অতীতকে কবরস্থ করেছে।’ ভ্যানিসা বলল।
‘তোমাদের ভাইবোনের বিরোধ এখন থাক। আমরা একটা মৃতলাশের পোষ্টমর্টেম করছি মাত্র। এর শুধুই ঐতিহাসিক মূল্য আছে। অতীতের ঘাঁটাঘাঁটি যদি বিরোধের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আর অগ্রসর না হওয়াই ভাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি ভাইসাহেব। আমি ভ্যানিসার আবেগকে একটু থামিয়ে দিতে চেয়েছি। আর কিছু নয়। আমাদের পরিবারের এই ইতিহাস উদ্ধার আমার জন্যেই বরাদ্দ ছিল, এটা আমি মনে করি এবং এর জন্যে আমি গর্বিত। এই তো আমার এক পুর্বপুরুষের বক্তব্য পড়লাম, পারিবারিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে ইতিহাস বিসর্জন দিতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি, ইতিহাস পরিত্যাগ করে পরিবার, জাতি কিছুই বাঁচতে পারে না। ইতিহাস বেঁচে থাকলে সে ইতিহাস নতুন করে জাতি, পরিবার গড়তে পারে। আমার জাতির সদ্য উদ্ধারকৃত ইতিহাস আমাকে নতুন শক্তি দিয়েছে ভাইসাহেব।’ সার্গিও বলল। তার কণ্ঠ আবেগে ভারী।
সার্গিও থামতেই ভ্যানিসা বলল, ‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমার কথাই বললেন আপনি। তবে যে আমাকে বকলেন!’
হাসল সার্গিও। বলল, ‘সব কথা সব সময় বলার প্রয়োজন হয় না।’
‘কিন্তু আপনি বললেন ভাইয়া।’
‘আমি প্রয়োজনে বলেছি ভ্যানিসা।’ হাসতে হাসতে বলল সার্গিও।
‘তাহলে মি. সার্গিও, একটু দেখুন বাক্সে কি আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সার্গিও অনুসন্ধান শুরু করল।
এক এক করে সার্গিও বাক্সের জিনিসগুলো বের করতে লাগল।
বেরুতে লাগল নানা ধরনের সাধারণ ও সামরিক পোশাক, যা স্পেনের সাধারণ মুসলিম মুর এবং সৈনিক ও শাসকরা পরত। আরবী টারবানও পাওয়া গেল। পাওয়া গেল নানা ধরনের মুসলিম শিরস্ত্রাণসহ একটা তুর্কি টুপি। কয়েকটা আরবী ক্যালিওগ্রাফি, কিছু ওয়াল হ্যাং, কিছু আরবী গ্রন্থসহ কোরআন শরীফ, মক্কা শরীফ ও মদিনা শরীফের বাঁধানো ফটো এবং আরও কিছু টুকিটাকিসহ একটি ডাইরীও পাওয়া গেল।
সব জিনিস বের করার পর সার্গিও বলল, ‘সব দেখলেন ভাইসাহেব। আমি যতটা বুঝেছি, সবটা জিনিসই মুসলিম কালচারের স্মারক। অবশ্য বইগুলো ও ডাইরীতে কি আছে আমি জানি না। এখন বলুন, আরও বেশি জানার কি সাহায্য আমাদের করতে পারেন।’
‘বইগুলোর মধ্যে একটি হলো কোরআন শরীফ। অন্যগুলো আরবীতে লেখা ইতিহাস ও হাদিসগ্রন্থ। আমার মতে আরও বেশি জানার ক্ষেত্রে ডাইরীটাই আমাদের সাহায্য করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
সার্গিও ডাইরীটা হাতে নিয়ে তা খুলল। ভেতরটা একবার দেখেই বলে উঠল, ‘আমার অপরিচিত ভাষা ভাইসাহেব। আপনি দেখুন।’
আহমদ মুসা ডাইরীটা হাতে নিয়ে বলল, ‘ডাইরীটাও আরবী ভাষায় লেখা। তবে একটা ভূমিকা আছে, সেটা লেখক স্পেনীয় ভাষায় লিখেছেন।’
‘পড়ুন ভাইসাহেব।’ সার্গিও বলল।
‘ডাইরীটা পড়তে সময় লাগবে। অতটা সময় আমরা এখন দিতে পারবো না। ওদের হেলিকপ্টার এদিকে একটু ঘন ঘনই আসছে। মনে হয় ওরা জানতে পেরেছে আমরা সিলভার উপত্যকায় নেই। সুতরাং রাতের আঁধারেই যতটা সম্ভব পশ্চিমে সরে পড়া দরকার।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর ডাইরীটা লণ্ঠনের আলোর দিকে একটু সরিয়ে বলল, ‘আমি শুরু থেকে পড়ছি।’
বলে পড়তে শুরু করল আহমদ মুসাঃ
‘‘আমি গাজী আলী জামাল। আমাদের বাড়ি স্পেনের টলেডো শহরে। আমাদের সুন্দর বাড়িটা ছিল টাগুস নদীর তীরে। শুরু থেকেই আমরা সামরিক পরিবার। স্পেনের সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের সময়ে আমাদের পরিবারের একজন স্পেনের নৌবাহিনীতে চাকুরী নেয়। সুলতান হাজিব আল মনসুরের সময়ে আমাদের পরিবারের একজন একটি রণতরীর কমান্ডার পদে উন্নীত হন। পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে আমিও স্পেনের নৌবাহিনীতে যোগদান করি। কিন্তু স্পেনের নৌবাহিনী তখন কংকালে পরিণত হয়েছে। স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্য গ্রানাডার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লে স্পেনের নৌবাহিনী ভেঙে পড়ে। ১৪২৩ সালে সুলতান তৃতীয় ইউসুফের মৃত্যু হলে স্পেনের নৌবাহিনীর কংকালটাও শেষ হয়ে যায়। ভারাক্রান্ত মনে আমি এর আগেই সৈনিক হিসেবে মাতৃভূমির সেবার আর কোন সুযোগ না দেখে তুরষ্কের সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের নৌবাহিনীতে যোগদান করি। তুরষ্কের সামরিক শক্তি তখন উদীয়মান। ইউরোপের সার্বিয়া, আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রীস তখন তুর্কিবাহিনীর পদভারে কম্পিত। তুর্কি নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। ১৪২২ সালে তুর্কি বাহিনী কর্তৃক কনষ্ট্যান্টিনোপল অবরোধের ঐতিহাসিক ঘটনাতেও আমি অংশগ্রহণ করি। কিন্তু শীঘ্রই আমি তুর্কি নৌবাহিনীতে চাকুরীর ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি। একটি ঘটনা থেকে এর সূত্রপাত ঘটে। সময়টা হবে ১৪২৩ সালের শেষের দিকে। তুরষ্কের, সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের সিংহাসন আরোহনের তৃতীয় বছর এবং সুলতান তৃতীয় ইউসুফের মৃত্যু-পরবর্তী স্পেনীয় গ্রানাডা রাজ্যের বিপর্যয়ের কাল। সেই সময় তুর্কি নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজের একটা বহর আসছিল মরক্কোর ক্যাসাবস্নাংকা থেকে। আমরা ভূমধ্যসাগরের মেজরকা দ্বীপ থেকে ৫০ মাইল দূরে অবস্থান করছি। আমরা দেখলাম, স্পেনের মুসলিম রাজ্য গ্রানাডার পতাকাবাহী একটা বাণিজ্য জাহাজকে ঘিরে ফেললো ক্ষুদ্র দুটি রণতরী। একটি ফ্রান্সের মারসাই, অপরটিতে স্পেনের খৃষ্টান রাজা বারসেলোনার পতাকা। আমি আমাদের নৌবহরের কমান্ডার ইশমত পাশাকে অনুরোধ করলাম গ্রানাডার জাহাজটিকে বাঁচাবার জন্যে। কমান্ডার বললেন, গ্রানাডাকে সাহায্য করার কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আমাদের নেই। আমি বললাম, এটা গ্রানাডাকে সাহায্য করার ব্যাপার নয়, বিষয়টা রাজনৈতিক দস্যুদের হাত থেকে একটা বাণিজ্য জাহাজকে রক্ষা করার। কমান্ডার বলল, বাণিজ্য জাহাজটি গ্রানাডার উমাইয়াদের। উমাইয়াদের কোন সাহায্য করা হবে না। আমাদের তিনটি রণতরীর সামনেই গ্রানাডার বাণিজ্যতরীটি ফ্রান্সের মারসাই ও বারসেলোনার দুটি ক্ষুদ্র রণতরী লুণ্ঠন করল এবং বাণিজ্য জাহাজের সব লোকদের হত্যা করল। আমিও স্পেনের একজন আরব মুসলমান। আমার চোখের সামনেই আমার স্বজনদের হত্যা করল খৃষ্টান দুটি রণতরীর লোকরা। এই আক্রমণে স্পেনের বারসেলোনো ও ফ্রান্সের মারসাই-এর খৃষ্টান সৈন্য এক হতে পারল, কিন্তু তুর্কি সুলতানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনটি যুদ্ধজাহাজ গ্রানাডার অসহায় এক মুসলিম বাণিজ্য জাহাজকে সাহায্য করতে পারল না। অনেক কাঁদলাম আমি। মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। তুর্কি জাহাজে একদিন, এক মিনিট, এক সেকেন্ড অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে উঠল। সবার অলক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তুর্কি রণতরী থেকে ভূমধ্যসাগরে। এক ঘণ্টা সাঁতরে গিয়ে উঠলাম গ্রানাডার লুণ্ঠিত জাহাজে। লুণ্ঠিত জাহাজে লাশ ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। তবু মনে সান্তনা পেলাম এই ভেবে যে, আমি মজলুমদের সাথে আছি। দীর্ঘ ৭ দিন একা জাহাজ চালিয়ে স্পেনের মালাগা বন্দরে এসে পৌছলাম। মালাগা বন্দরের শূন্য জেটিগুলো দেখে মনটা কেঁদে উঠল। একদিন নৌবাহিনীর জাহাজে ভর্তি থাকত মালাগা বন্দর। আজ একটিও নেই। অন্যদের সাথে নিয়ে লাশগুলো দাফন করার পর আমি পর্তুগালের এক জাহাজে চড়ে স্পেনও ছাড়লাম। চলে এলাম পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে। পর্তুগালের তখন সমুদ্র-অভিযানের প্রাথমিককাল। সমুদ্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ নেভিগেটর যোদ্ধাদের সেখানে দারুণ কদর। চাকরী পেয়ে গেলাম লিসবনের বড় একটা কোম্পানীর নৌবহরে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নেভিগেটর থেকে একটা কমান্ডিং জাহাজের কমান্ডার পদে উন্নীত হলাম পরিশ্রম ও প্রতিভাগুণে এবং আল্লাহর সাহায্যে। ১৪৩১ সালের জুলাই মাস। আমার জাহাজটি উত্তর আটলান্টিকের দিক থেকে মধ্য আটলান্টিকের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ধীর গতিতে। সে দিন জুলাই-এর এগার তারিখ। আমি জাহাজের ডেকে বসেছিলাম। চোখে দূরবীন। আমি জানি পশ্চিমে কানাডার উপকূল আর পূর্বে ইউরো আফ্রিকান উপকূলের মাঝখানে কোন দ্বীপের অস্তিত্ত্ব নেই। তবু আমার অভ্যস্ত চোখের কোন ক্লান্তি নেই। দূরবীনের সাধ্যের শেষ পর্যন্ত চষে ফিরছিল আমার দুটি চোখ। হঠাৎ আমার চোখ দুটি আটকে গেল সবুজ পাহাড়ের চূড়ায়। চোখ দুটিকে আমার বিশ্বাস হলো না। চোখ থেকে দূরবীন সরিয়ে চোখ দুটি মুছে নিলাম। আবার দেখলাম। না, আমার চোখ ভুল দেখেনি। সত্যই ওটা একটা বড় সবুজ দ্বীপ। তার মানে আমি একটা নতুন ভূখন্ড আবিষ্কার করেছি। আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। চিৎকার করে নির্দেশ দিলাম জাহাজের গতি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঘুরিয়ে নেবার। চার ঘন্টা চলার পর দ্বীপটার নিকটবর্তী হলাম। ততক্ষণে দ্বীপটার পশ্চিমে আরো তিনটা দ্বীপের সবুজ দিগন্ত আমার চোখে ধরা পড়ে গেছে। আনন্দে আবারও চিৎকার করে উঠলাম, একটা দ্বীপপুঞ্জ আবিস্কার করেছি। এগারই জুলাই (১৪৩১) বেলা ১টার সময় আমাদের জাহাজ প্রথম দ্বীপে নোঙর ফেলল। এর আধঘন্টা পরে আমি জংগল আচ্ছাদিত তীরে পা রাখলাম। আনন্দে উদ্বেলিত জাহাজের সকলেই নেমেছিল দ্বীপে। তখন যোহর নামাজের সময়। সবাই যখন এদিক-ওদিক ঘুরতে ব্যস্ত তখন আমি যোহর নামাজটা পড়ে নিলাম। বেলা ২টায় আমরা সবাই খাওয়ার জন্যে একত্রিত হলাম। খাওয়ার পর দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ ও পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। ঠিক যোহর নামাজের সময় দ্বীপপুঞ্জে পা রেখেছি বলে আমি প্রস্তাব করলাম দ্বীপপুঞ্জের নাম হবে ‘আয- যোহর।’ সবাই হাততালি দিয়ে সমর্থন জানাল। পরে সবার পক্ষ থেকে আয-যোহর দ্বীপপুঞ্জে পর্তুগালের পতাকা উত্তোলণ করলাম। আমরা দ্বীপে পনের দিন অবস্থান করলাম। দ্বীপে কোন মানুষ ছিল না। উপকূলের কাছেই একটা উচ্চভূমিতে একটা বাড়ি তৈরি করলাম। এই বাড়িটাকেই পরে আমি দূর্গে রূপ দিয়েছিলাম। নাম রেখেছিলাম ‘গাজী আলী জামাল’ দূর্গ। পরে পতুর্গাল থেকে পরিবার-পরিজন আনার পর এই দূর্গই আমার স্থায়ী নিবাসে পরিণত হয়। পতুর্গাল সরকার আমাকে দ্বীপপুঞ্জের গভর্ণরের দায়িত্ব দেন। দ্বীপপুঞ্জের গভর্ণর হিসেবে সবগুলো দ্বীপে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। এই সুযোগকে আমি আল্লাহর দেয়া বড় একটা রহমত হিসেবে গ্রহণ করি। স্পেনের ভাগ্যাহত মুসলমানদের এই দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়ে আমি স্পেনের মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগের উদ্যোগ নিলাম। একবার পর্তুগাল সফরকালে এই উদ্দেশ্যে আমি গোপনে গ্রানাডা গেলাম।
আমি………….।’
‘ভাইয়া খুব কাছেই হেলিকপ্টারের শব্দ। মনে হয় একটা হেলিকপ্টার নেমে আসছে।’ আহমদ মুসার পড়ার মাঝখানে চাপা-উত্তেজিত কণ্ঠে বলল হাসান তারিক। সে বসেছিল একদ গুহার মুখেই।
আহমদ মুসার ডাইরী পড়া বন্ধ হয়ে গেল।
সবাই উৎকর্ণ হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা ডাইরীটা সার্গিও’র হাতে দিয়ে দ্রুত সরে এল গুহার মুখে হাসান তারিকের পাশে।
মুক্ত আকাশের দিকে কান পেতে একটু শোনার চেষ্টা করেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আমাদের মাথার উপরে হেলিকপ্টার। মনে হচ্ছে আলো না জ্বালিয়ে খুব নিচু দিয়ে ওরা এসেছে।’
বলেই আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে থামল। পরমুহূর্তেই আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে মুখোশ বের করে একটা নিজে নিয়ে অন্যগুলো সকলের সামনে ছুড়ে দিয়ে চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোমরা সকলে তাড়াতাড়ি গ্যাস মুখোশ পড়ে নাও। নিশ্চয় শব্দ মনিটরিং করে আমাদের অবস্থান পিন পয়েন্ট করার পর তারা এসেছে। অন্ধকারে নিশ্চয় তারা নামতে সাহস পাবে না। গ্যাস বোমাই তাদের টার্গেট।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই চারদিক থেকে ছোট ছোট বেলুন ফাটলে যেমন শব্দ হয় সেরকম শব্দ উঠতে শুরু করেছিল।
সবাই গ্যাস মুখোশ পরে নিয়েছিল। আহমদ মুসাও তাড়াতাড়ি গ্যাস মুখোশ পরে নিল।
ভ্যানিসা ও সার্গিও’র মুখে আতংক। ভ্যানিসা বলল, ‘ভাইয়া…….।’
ভ্যানিসা মুখ খুলতেই আহমদ মুসা ঠোঁটে আঙুল চেপে তাকে কথা বলতে নিষেধ করল।
‘ভাইয়া’ শব্দ বের হওয়ার পরই ভ্যানিসার মুখ বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা ফিসফিস কণ্ঠে বলল, ‘হেলিকপ্টারে ওদের শক্তিশালী শব্দগ্রাহক যন্ত্র আছে। আর কোন কথা নয়। ওদের বুঝাতে হবে যে, ওদের প্রাণঘাতি গ্যাস বোমায় আমরা সবাই মারা গেছি। এ বিশ্বাস যদি ওদের হয় তাহলে ওরা নিশ্চিন্তে চলে যাবে, অথবা আরও নিশ্চিত হবার জন্যে নিশ্চংকচিত্তে এই গুহার সামনে ল্যান্ড করবে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা গুহামুখের দিকে একটু সরে গিয়ে বসল।
তারপর অখন্ড নিরবতা। আকাশে হেলিকপ্টারের চাপা হালকা যান্ত্রিক গর্জন, নিচে আশে-পাশে মাঝে মাঝে গ্যাসবোমা ফাটার ফটফট শব্দ।
দীর্ঘ এক ঘন্টা নিরবতার পর সবাই অনুভব করল হেলিকপ্টারের শব্দ আরও নিকটতর হচ্ছে। বুঝল সবাই নামছে হেলিকপ্টার থেকে।
আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, ‘ওরা সম্ভবত দেখতে নামছে যে আমরা বেঁচে আছি কিনা। ওরা গুহামুখের দিকে আসবে, সাবধানে থেকো। আমি ওদের পেছন দিকে যাবার চেষ্টা করছি।’
বলে আহমদ মুসা গুহা থেকে বেরিয়ে গেল। তার মুখে গ্যাস মুখোশ এবং হাতে এম-১০ মেশিন রিভলবার।
হেলিকপ্টার ল্যান্ড করল গুহার একটু সামনে সমাধীক্ষেত্রের উপর।
আহমদ মুসা তখন ক্রলিং করে গুহামুখ থেকে অনেকখানি সরে গেছে।
আকাশটা মেঘে ঢেকে যাওয়ায় অন্ধকার এখন নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠেছে। হেলিকপ্টারটিকে অন্ধকারের বুকে আরও অন্ধকার একটা পিন্ড বলে মনে হচ্ছে। চোখের সামনে আর সবকিছুই অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে একটা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ উঠল এবং তা অব্যাহতভাবে চলল।
আহমদ মুসা বুঝল, ব্রাশফায়ারের কেন্দ্রবিন্দু হলো গুহামুখ। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, ওরা গুহার দিকে যাবে। এই ব্রাশফায়ার তারই পূর্ব প্রস্তুতি। তারা দেখতে চায় গুলীর কোন জবাব আসে কিনা। কেউ জীবিত থাকলে নিশ্চয় আত্মরক্ষার জন্যে জবাব দেবে।
হাসান তারিক ব্রাশফায়ারের কোন জবাব দিল না।
খুশি হলো আহমদ মুসা, হাসান তারিক ওদের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। শক্তিশালী শত্রুকে বাইরে গুহা বা ঘরের ভেতর থেকে সমর্থক গুলী চালিয়ে শত্রুর কাছে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়া ঠিক নয়। কারণ তাতে বোমা বা গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থাকে। গুহা বা ঘর থেকে বাইরের প্রবল শক্তির প্রতি আক্রমণটা পিনপয়েন্টেড ও চূড়ান্ত হতে হয়।
আহমদ মুসা এসব ভাবছিল আর হেলিকপ্টারের পেছন দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
আহমদ মুসা পাঁচ মিনিটের মত ক্রলিং করে চলার পর হেলিকপ্টারের পেছনে গিয়ে পৌছল।
ধীরে ধীরে উঠে বসল আহমদ মুসা।
উঠে বসার পর মাথাটা স্থির হবার সাথে সাথেই একটা কঠিন বস্তু এসে মাথায় চেপে বসল। সংগে সংগেই ভারী একটা কণ্ঠ, ‘আমার চোখে ইনফ্রারেড গগলস আছে। তোমার সবকিছুই আমি দেখতে পাচ্ছি। চালাকি করার চেষ্টা করলে মাথার খুলি উড়ে যাবে।’ রুক্ষ ও কঠোর কণ্ঠ লোকটির।
আহমদ মুসার হাতে এম-১০, কিন্তু হাত যেমন ছিল তেমনি কোলের উপর রাখল। আক্রমণকারীর চোখে ইনফ্রারেড গগলস আছে তা আহমদ মুসা বিশ্বাস করেছে। এই গগলসটা থাকার কারণেই সে আহমদ মুসাকে দেখে ফলো করেছে।
আক্রমণকারী লোকটি একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘বেন্টো, ওর হাতের ভয়ংকর এম-১০টা নিয়ে নাও।’
সংগে সংগেই একজন লোক আহমদ মুসার পাশে এসে আহমদ মুসার হাত থেকে এম-১০টা নিয়ে নিল।
পরক্ষণেই পেছনের রিভলবারধারী লোকটি তার রিভলবারের নল দিয়ে আহমদ মুসার মাথাকে একটু সামনে ঠেলে দিয়ে বলে উঠল, ‘উঠে দাঁড়াও।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালে সে বলল, ‘সামনে আগাও হেলিকপ্টারের দরজার দিকে।’
হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা।
পেছনে রিভলবারধারী লোকটির রিভলবার আহমদ মুসার মাথা থেকে তিল পরিমাণও নড়েনি।
হেলিকপ্টারের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
রিভলবারধারী পেছন থেকে বলল, ‘বেন্টো, ওর দুহাতে পেছনে এনে বেঁধে ফেল।’
বেন্টো নামক লোকটিকে আহমদ মুসার পেছনে জায়গা করে দেবার জন্যে রিভলবারধারী আহমদ মুসার পাশে সরে আসছিল। তার রিভলবারের নলটিও আহমদ মুসার মাথা থেকে আলগা হয়ে গিয়েছিল।
মুহূর্তের এই ফাঁকেই ঘটে গেল ঘটনাটা।
হঠাৎ আহমদ মুসার মাথা তীর বেগে নিমণমুখী হলো, আর তার দুই পা ঈষৎ ফাঁক হয়ে ক্ষেপণাস্ত্রের মত উৎক্ষিপ্ত হলো উপর দিকে এবং ধনুকের মত তা বেঁকে একটা আঘাত করল রিভলবারধারীর চোখে-মুখে, অন্য পা টি হাতুড়ীর মত গিয়ে পড়ল আহমদ মুসাকে বাঁধার জন্যে এগিয়ে আসা দ্বিতীয় লোকটির বুকে।
দুজনেই পড়ে গিয়েছিল।
রিভলবারধারীর অবস্থাই বেশি খারাপ হয়েছিল। আহমদ মুসার পায়ের আঘাতে লোকটির ইনফ্রারেড গগলস ভেঙে চোখে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু হাতের রিভলবার তার হাত থেকে ছুটে যায়নি। সে পড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ রেখেই এলোপাথাড়ি গুলী করা শুরু করে দিয়েছিল।
আহমদ মুসাও পড়ে গিয়েছিল।
শুয়ে থেকেই রিভলবারধারীর রিভলবার ধরা হাত সে চিহ্নিত করতে পারল গুলী বর্ষণ দেখে।
আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পড়ে দুহাত দিয়ে তার রিভলবার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করল।
লোকটিও তার দুহাত দিয়ে রিভলবার আঁকড়ে ধরে গুলী করছিল।
রিভলবার নিয়ে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল দুজনের মধ্যে।
লোকটি তার সর্বশক্তি দিয়ে রিভলবারের নল আহমদ মুসার দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করছিল এবং আহমদ মুসাও।
আহমদ মুসাই শেষে জিতে গেল। লোকটির রিভলবারের গুলী তার নিজেরই থুথনির নিচ দিয়ে ঢুকে মস্তক বিদ্ধ করল।
রিভলবারটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা পাশের লোকটির দিকে এগুলো। সে মাটিতে পড়েছিল। আহমদ মুসা ভাবল, লোকটি এলোপাথাড়ী গুলীর মধ্যে মাটিতে পড়ে থেকে আত্মরক্ষা করছে।
অন্ধকারেই আন্দাজ করে আহমদ মুসা তার রিভলবার লোকটির মাথায় চেপে ধরল এবং বলল, ‘দুহাত একটু নড়াতে চেষ্টা করলে মাথা ছাতু করে দেব।’
বলে আহমদ মুসা তার বাম হাত দিয়ে লোকটির ডান কব্জি চেপে ধরল। কিন্তু হাতটি নিসাড়। আহমদ মুসা তার বাম হাতটি আরও সামনে সরিয়ে নিতেই অনুভব করল লোকটির হাত খোলা, তার শিথিল হাতের পাশেই আহমদ মুসা পেয়ে গেল তার এম-১০ মেশিন রিভলবার।
লোকটি কি জ্ঞান হারিয়েছে? – এই চিন্তা করেই আহমদ মুসা তার ডান হাত লোকটির মুখের উপর নিয়ে এল।
গরম তরল কিছুতে আহমদ মুসার ডান হাতটা ডুবে গেল। ‘রক্ত নিশ্চয়’- ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার হাত লোকটির মাথায় নিয়ে এল।
মাথায় রক্তের বন্যা। আহমদ মুসা বুঝল লোকটি মাথায় গুলী খেয়ে মরেছে। এটা রিভলবারধারী লোকটির এলোপাথাড়ী গুলীরই ফল। মাথায় গুলী খাওয়ায় চিৎকারেরও অবসর পায়নি।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
এই সময় তার পেছনে গুহামুখ থেকে সাব-মেশিনগানের একটানা গর্জন ভেসে এল।
আহমদ মুসা গুলীর একটানা ষ্টাইল দেখেই বুঝল এ সাব মেশিনগান হাসান তারিকের।
খুশি হলো আহমদ মুসা যে, হাসান তারিক প্রথম গুলী ছুড়েছে এবং টার্গেট পিনপয়েন্ট করেই গুলী ছুড়ছে। এদের পাল্টা আক্রমণের আর অবসর হবে না।
তাই হলো।
হাসান তারিকের সাব মেশিনগান থেমে গেল। কিন্তু এ পক্ষের পাল্টা আক্রমণ আর হলো না। কিছুক্ষণ নিরবতা।
শত্রুপক্ষের কেউ আর অবশিষ্ট নেই, নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা।
গুহা মুখের দিকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘হাসান তারিক, তোমরা বেরিয়ে এস, গেম ইজ ওভার।’
বৈদ্যুতিক লণ্ঠন সাথে করে বেরিয়ে এল হাসান তারিকরা।
চলে এল ওরা হেলিকপ্টারের কাছে।
‘ওদিকের কি খবর হাসান তারিক?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ওরা পাঁচজন গিয়েছিল। পাঁচজনই মারা পড়েছে ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল।
‘এদিকে ঐযে দুজনের লাশ দেখ, ওরাই শুধু ছিল।’ বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘তার মানে হেলিকপ্টারটি এখন আমাদের।’ আনন্দে বলে উঠল ভ্যানিসা।
‘হ্যাঁ, যুদ্ধ-লব্ধ মাল। নিজের অবশ্যই বলতে পার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন হেলিকপ্টারে উঠে তো আলো জ্বালানো যায়।’ বলল ভ্যানিসা।
‘হ্যাঁ যায়।’ বলেই আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে দক্ষিণ দিকে তাকাল।
হঠাৎ আহমদ মুসাকে এভাবে উৎকর্ণ হয়ে উঠতে দেখে সবাই তাকাল দক্ষিণ দিকে।
সবাই শুনতে পেয়েছে দক্ষিণ দিক থেকে একটা হেলিকপ্টারের শব্দ ভেসে আসছে।
সবাই তাকিয়ে থাকল ওদিকে।
শব্দটি কাছে চলে এসেছে।
খুব নিচু দিয়ে উড়ে আসছে হেলিকপ্টারটি আলো নিভিয়ে। তাই খুব কাছে এসে গেলেও হেলিকপ্টারটি দেখা যাচ্ছে না।
আহমদ মুসা দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠে গেল। মিনিটখানেকের মধ্যেই নেমে এল এ্যান্টি-এয়ারক্রাপ্ট ধরনের হালকা গান নিয়ে। এ গানগুলো লোফ্লাইং বিমান, হেলিকপ্টার কিংবা মাটিতে থাকা যে কোন হালকা ধরনের স্থাপনা ধ্বংসে বংবহার করা যায়। এয়ার থেকে এয়ার, এয়ার থেকে গ্রাউন্ড সব রকমেই এগুলো ব্যবহার করা যায়।
চারটি গানের একটা নিজে রেখে অন্য তিনটি হাসান তারিক, সার্গিও ও ভ্যানিসাকে দিয়ে বলল, ‘প্রথম হেলিকপ্টারটি আমাদের দখলে। দ্বিতীয় শত্রু হেলিকপ্টারটি আসছে হয় প্রথমটির খোঁজ নিতে, অথবা প্রথমটির আমন্ত্রণ পেয়ে। শত্রু হেলিকপ্টারটি নিকট আকাশে আসার পর আমাদের চারজনের একযোগে প্রথম আঘাতেই তাকে ধ্বংস করতে হবে। বোমা ফেলার সুযোগ তাকে দেয়া যাবে না।’
থামল আহমদ মুসা।
ওরা তিনজন একসাথেই বলে উঠল, ‘আমরা বুঝেছি ভাইয়া।’
ল্যান্ড করা হেলিকপ্টারটির দক্ষিণপূর্ব কোণ বরাবর সমাধীক্ষেত্রের মাঝখানে পজিশন নিয়ে সবাই বসল আহমদ মুসার নির্দেশে।
লম্বালম্বি এক লাইনে প্রথমে আহমদ মুসা, তারপরে সার্গিও, পরে ভ্যানিসা এবং সবশেষে হাসান তারিক।
রাতের কালো আঁধার কেটে ততোধিক কালো হেলিকপ্টারটি যমদূতের মত আসছে খুব চাপা একটা গর্জন তুলে।
সমাধীক্ষেত্রের আকাশে ঢুকে পড়েছে হেলিকপ্টারটি।
গতি তার ধীর হয়েছে।
অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত গতি।
মনে হয় অয়্যারলেসের যোগাযোগে প্রথম হেলিকপ্টার থেকে সাড়া পাচ্ছে না। হঠাৎ সমাধীক্ষেত্রের মাঝখানের আকাশে এসে স্থির হয়ে থাকা হেলিকপ্টার থেকে সার্চ লাইটের একটা তীব্র আলো গিয়ে পড়ল মাটিতে ল্যান্ড করা হেলিকপ্টারটির উপর।
সেই আলোতে হেলিকপ্টারের দক্ষিণ পাশে পড়ে থাকা দুটি লাশের দৃশ্যও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
‘ফায়ার। ওটা এখন বিটালিয়েশনে আসবে।’ চাপা কণ্ঠে গর্জন করে উঠল আহমদ মুসা।
সংগে সংগেই চারটি এ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট গান গর্জন করে উঠল।
চারটি গান থেকে আটটি আগুনের বুলেট ছুটে গেল হেলিকপ্টারের দিকে।
আকাশে দাঁড়ানো হেলিকপ্টারকে তাক করে ধীরে সুস্থে ছোঁড়া আটটি বুলেটই গিয়ে আঘাত করল হেলিকপ্টারটিকে।
ভীষণভাবে কেঁপে উঠল হেলিকপ্টারটি। পরক্ষণেই মাথা নিচু করে একটা ড্রাইভ দিয়ে উত্তর দিক হয়ে পূর্ব দিকে ঘুরল। সেই সাথে একাধারে মেশিনগানের গুলী ও বোমা পড়তে শুরু করেছে হেলিকপ্টার থেকে।
হেলিকপ্টারটি একটু পূর্ব দিকে গিয়ে আবার পশ্চিম দিকে ফেরার চেষ্টা করে আবার পূর্বমুখী হয়ে ছুটতে শুরু করল। আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন থেকে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হেলিকপ্টারটি পাহাড়ের আড়ালে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
অল্পক্ষণ পরেই পূর্ব দিকে ভয়ানক বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল।
‘হেলিকপ্টারটি ধ্বংস হয়ে গেল, ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে বসা পজিশন থেকে। কিন্তু আহমদ মুসা ওঠেনি।
‘ভাইয়া আসুন। আমরা গুহামুখের দিকে একটু সরে যাই। বোমার আগুন এদিকে আসছে।’ বলল হাসান তারিক আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
হাসান তারিকের কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘হেলিকপ্টার বিস্ফোরণে যে বনি আদমরা মারা গেল, তার জন্য আমরা কতটুকু দায়ী হাসান তারিক?’ ধীর, ব্যথিত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘আমরা দায়ী নই ভাইয়া। আমরা আত্মরক্ষার জন্যেই গুলী করেছি হেলিকপ্টারকে। ওরা বুঝতে পেরেছিল ওদের হেলিকপ্টারের সব লোক মারা গেছে। ওরা এর প্রতিশোধ নিতে বোমা ও গুলীর সয়লাব বইয়ে দিত এই সমাধীক্ষেত্রে। ওদের হেলিকপ্টারকে না মারলে আমাদেরকেই মরতে হতো।’ বলল হাসান তারিক।
হাসান তারিক থামতেই সার্গিও বলে উঠল, ‘এ প্রশ্ন আপনি তুলছেন কি করে ভাই? এটা যুদ্ধের ময়দান। মারার জন্যেই তারা এসেছিল, তারা না মরলে আমাদের মরতে হতো।’
ম্লান হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনাদের যুক্তিগুলো আমারও জানা। কিন্তু অনেক সময় অনেক ঘটনায় নিজের দিয়ে নিজেকে জানানো যায় না। নিঃসন্দেহে এই হত্যাগুলো প্রয়োজনের। আল্লাহর বিধান একে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু তবু মনে হয় তাঁর বান্দাহদের প্রতি আল্লাহ অপরিসীম মেহেরবান। আল্লাহ ব্যাথা পান তার বান্দাহদের এইসব মৃত্যুতে।’
‘না ভাইয়া, আল্লাহ ব্যাথা পান বান্দাহদের পথভ্রষ্টতায়। বান্দাহদের পথ ভ্রষ্টতাই তো এইসব করুণ পরিণতির জন্য দায়ী।’ বলল হাসান তারিক।
‘তুমি ঠিক বলেছ হাসান তারিক। বান্দাহদের পথভ্রষ্টতাই মূল কথা। এই পথভ্রষ্টতা সব হানাহানি, জুলূম-নির্যাতন এবং হতাহতের জন্য দায়ী। শান্তির জন্যই এই পথভ্রষ্টতার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাঁচাবার এই সংগ্রামই তো ইসলাম করছে। কিন্তু কল্যাণের এই সংগ্রামকেই উৎখাত করার জন্য এগিয়ে এসেছে পথভ্রষ্টরা। চলার পথ থেকে পথভ্রষ্টদের সরাতে না পারলে মানবতার শান্তির সংগ্রাম, মানবতার মুক্তির সংগ্রাম থেমে যাবে, শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং মানুষের শান্তি ও মুক্তির জন্যই তো সংগ্রাম প্রয়োজন পথভ্রষ্টদের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রামে আজকের হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার মত আরও অসংখ্য ঘটনা ঘটতেই পারে।’ বলল হাসান তারিক।
‘ধন্যবাদ মি. হাসান তারিক। আজ আপনাদের কথা খুব আপন বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে মুসলিম ও ইসলাম গৌরবের বস্তু। কিন্তু এতদিন একে অপমানজনক মনে করে এসেছি।’ সার্গিও বলল।
‘শুধু অপমানজনক নয়, আমরা নিষ্ঠুরভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষের কবর ভেঙে ফেলেছি এবং পরিবারের ইতিহাসকে সমাধিস্থ করেছি।’ বলল ভ্যানিসা।
‘যারা কবর ভেঙেছেন, যারা ইতিহাস কবরস্থ করেছেন তাদের সৌভাগ্য হয়নি ডাইরীটা পড়ার, যা আজ আহমদ মুসা ভাই আমাদের পড়ে শোনালেন।’ সার্গিও বলল।
‘ডাইরী পড়া তো শেষ হয়নি ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা।
ভ্যানিসা থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘সব আলোচনা এখন বন্ধ। এখন কাজ। প্রথম কথা হলো, বাক্সটা গর্তে নামিয়ে আগের অবস্থায় রেখে দেয়া। আর………….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই সার্গিও বলে উঠল, ‘বাক্সটিকে আর মাটির তলায় পাঠানো হবে না ভাইয়া। দেখছেন তো, পরিবারের ইতিহাসকে সমাধিস্থ করা নিয়ে ভ্যানিসা কি রকম ক্রিটিক্যাল কথাবার্তা বলছে শুরু থেকেই।’
‘না ভাইয়া, আমার মত আছে। বাক্সটাকে মাটির তলায় যেখানে ছিল সেখানে পাঠিয়ে দিন।’ বলে হাসতে লাগল ভ্যানিসা। হাসতে হাসতেই আবার বলে উঠল, ‘জানি ভাইয়া, আপনি পারবেন না আর বাক্সটাকে সমাধিস্থ করতে। দাদু গাজী আল জামাল এক মুহূর্তেই আমাদের মাথাকে আকাশস্পর্শী করেছেন। আমরা কি পারি এই মাথাকে আবার লুটিয়ে দিতে!’ আবেগ কম্পিত কণ্ঠ ভ্যানিসার কান্নায় ভরে গেল। মুখের হাসি নিভে গেল চোখের পানিতে।
ম্লান হাসল সার্গিও। আবেগ উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে তার মুখও। বলল, ‘ঠিক বলেছ বোন, ঐ বাক্সটা গনজালো পরিবারকে নতুন জীবন দান করল। ওকে কবর নয়, আমাদের মাথায় রাখতে হবে।’
‘কিন্তু আম্মার তো শর্ত ছিল, বাক্স আবার মাটির তলায় রাখতে হবে।’ দ্রুতকণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আম্মা যা বলেছেন, আম্মাই তা আর মানবেন না। সুতরাং সে চিন্তা নেই।’ সার্গিও বলল।
‘তাছাড়া আমাদের পূর্ব পুরুষ যিনি এই ইতিহাসকে সমাধিস্থ করেছিলেন, তাঁর চিঠিওতো শুনলাম। তিনিও আশা করেছিলেন তারই উত্তর পুরুষের কেউ এই ইতিহাস উদ্ধার করবেন। আজ তাঁর আশাই পূর্ণ হলো। সুতরাং আগের অবস্থায় ফিরে যাবার কোন প্রশ্ন নেই।’ বলল ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা হাসল। স্বস্তির হাসি। বলল সার্গিওকে উদ্দেশ্য করে, ‘তাহলে এখন করণীয় বলুন।’
‘এখন আমরা হেলিকপ্টার নিয়ে যাত্রা করব।’ বলল সার্গিও।
‘কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।
‘পশ্চিম উপকূলে আমাদের ঘাঁটিতে, যার কথা আমি আগেও বলেছিলাম।’ বলল সার্গিও।
‘হেলিকপ্টার নিলে অসুবিধা হবে না? কেউ দেখে ফেলবে না? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমাদের ঘাঁটিটা হলো পশ্চিম উপকূলীয় শহর ‘সিরেটা ও দজ রিবেরা’র মাঝখানে এক পার্বত্য উপত্যকায়। ঐ ঘাঁটিতে কোন বাড়ি-ঘর নেই। পাহাড়ের বিভিন্ন গুহাকে বাড়িতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সুতরাং ও ঘাঁটি কারও নজরে পড়ার মত নয়। হেলিকপ্টারটি জংগলের আড়াল করে চালিয়ে নিয়ে যাব। আর ওখানে নিয়ে গিয়েই হেলিকপ্টারে নতুন রং দিয়ে ওটা পাল্টে ফেলব আমরা। এ হেলিকপ্টারেই আমরা কেকো দ্বীপের হারতা পৌছতে পারি।’ বলল সার্গিও।
‘এখানে হেলিকপ্টারের রেজিষ্ট্রেশন নেই?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আছে কমার্শিয়াল হেলিকপ্টারগুলোর। পার্সোনাল হেলিকপ্টারের নেই।’ বলল সার্গিও।
মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বলল, ‘চলুন বাক্সটা হেলিকপ্টারে তুলে যাত্রার জন্য তৈরি হই।’
বলে আহমদ মুসা গুহা লক্ষ্যে হাঁটতে শুরু করল।
ভ্যানিসা হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘হেলিকপ্টার জিন্দাবাদ।’
‘হেলিকপ্টার জিন্দাবাদ কেন?’ পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘হেলিকপ্টারই আমাকে ও সার্গিও ভাইয়াকে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বাদই পড়ে গিয়েছিলাম।’ বলল ভ্যানিসা আদুরে শিশুর ভংগিতে।
সবাই হেসে উঠল।
হেলিকপ্টার উড়ে চলেছে তেরসিয়েরা দ্বীপের পশ্চিম উপকূলের দিকে।
হেলিকপ্টার চালাচ্ছে হাসান তারিক।
তার পেছনেই তিনটি সিটে বসে আছে আহমদ মুসা, সার্গিও ও ভ্যানিসা।
কথা বলছিল সার্গিও, ‘আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি আহমদ মুসা ভাই, ‘গাজী আলী জামাল’ হয়ে গেল ‘গনজালো’। আমাদের পরিবারও টের পেল না এই বিকৃতি।’
শুধু ‘গাজী আলী জামাল’ নাম কেন, দ্বীপপুঞ্জের নামও তো বিকৃত হয়েছে। কোথায় নামটা ছিল ‘আয-যোহর’ সেটা হয়ে গেল ‘আজোরস’। এ রকমই হয়। সময়ের পরিবর্তনে যখন কোন ভাষার চর্চা কমে যায়, কিংবা আদৌ থাকে না, তখন সে ভাষার শব্দগুলো বিকৃত হয়ে যায়। অন্যভাষার লেখকরা এই বিকৃতিকে ত্বরান্বিত করে। যেমন স্পেনের ‘জাবালুত তারিক’ হয়েছে ‘জিব্রালটার’। বলল আহমদ মুসা।
আমার মনে হয় দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন নামের মত মানুষের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি যেটা আগে ছিল, সেটারও ব্যাপক বিকৃতি ঘটেছে।’ ভ্যানিসা বলল।
এ সময় আহমদ মুসা একটু নড়ে-চড়ে বসল। তার চোখে-মুখে হঠাৎ প্রশ্ন ভেসে উঠল। কোন কথা যেন হঠাৎ তার মনে পড়ে গেছে। সে দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘একটা কথা মনে পড়েছে ভ্যানিসা। সেই উচ্চ ভূমিটায়, যেখানে তোমাদের আদি বাড়ি ছিল বলেছিলে, যে বেদিটা আছে সেখানে আমি পাথরের বাটি দেখেছি। বেদিও পাথরের ছিল। সেখান থেকে দুটো বিশাল সাপকে নেমে যেতে দেখেছি। এখন আমার মনে পড়ছে সাপ দুটো বাটিতে কিছু খেয়েছে। আবার তোমরা দুজন বেদির পাশেই গাছের উপর ছিলে। তোমরা সব দেখার কথা। কি দেখেছ? তোমরা ওখানে গাছেই বা কেন ছিলে? এসব প্রশ্ন আমার রয়েছে। জবাব খুঁজে পাইনি।’
আহমদ মুসা থামতেই ভ্যানিসা সার্গিওর দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া, তুমিই উত্তরটা দাও।’
গম্ভীর হয়ে উঠেছে সার্গিও। একটু ভাবল।
একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। বলল, ‘সাপ দুটোকে আমাদের পরিবারের সদস্য মনে করা হয়। পনের দিন বা এক মাস পর পর বেদির ঐ পাথর বাটিটায় দুধ দেয়া হয়। সাপ দুটো তা খেয়ে যায়। এই নিয়ম চলে আসছে কত যুগযুগ ধরে তা আমরা জানি না। আমাদের পূর্ব পুরুষরা এটা করেছে, সাপ দুটোর পিতা-দাদারাও এভাবে একই নিয়মে দুধ খেয়ে এসেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এক সাথে দুটোর বেশি সাপ দুধ খেতে আসে না। আমাদের পারিবারিক বিশ্বাস হলো, সাপ দুটো আমাদের সৌভাগ্যের প্রতীক। আদি ভিটা আমরা ছেড়েছি, কিন্তু তারা ছাড়েনি। তারা আদি বাস্তুভিটাকে ধরে রেখেছে লড়াইয়ে জয়ী হয়ে। আমাদের পরিবারের বিশ্বাস হলো, আমরা অতীতের শক্তি, সম্পদ সব একদিন ফিরে পাব। দ্বীপপুঞ্জে একদিন আবার গনজালো পরিবারের পতাকা উড়বে। সাপ দুটো আমাদের ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্যের পাদপিঠকে আঁকড়ে থাকা তারই একটা প্রমাণ।’
একটু থামল সার্গিও।
সার্গিও থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘লড়াইয়ে জয়ী হয়ে’ কথাটার অর্থ বুঝলাম না। আর আপনাদের সাপের ইতিহাস কার থেকে শুরু? নিশ্চয় শুরু থেকে নয়।’
‘অবশ্যই শুরু থেকে নয়’, বলতে শুরু করল সার্গিও, ‘আমাদের পারিবারিক এক মহাবিপর্যয়ের সময় থেকে সাপের ইতিহাস শুরু বলে আমি শুনেছি। ইতিহাসটা হলোঃ গনজালো পরিবার তখনও দ্বীপের শাসক। সেই সময়ের কোন একদিন আমাদের পারিবারিক বাড়ি ও শাসনকেন্দ্র দুর্গটি আক্রান্ত হয় উত্তর আটলান্টিকের সবচেয়ে বড় জলদস্যুর নৌবাহিনী দ্বারা। রাতের বেলা আক্রমণটা এতই আকস্মিক ছিল যে, আত্মরক্ষার কোন উদ্যোগ নেয়াই সম্ভব হয়নি। দূর্গের সৈন্য ও প্রহরীরা সবাই মর্মান্তিক গণহত্যার শিকার হয়। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বেশির ভাগই মারা যায়। কিন্তু আমাদের পরিবারের শীর্ষ ও দ্বীপপুঞ্জের শাসকপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিটি তার অবশিষ্ট পরিবার-পরিজন নিয়ে দক্ষিণে সিলভার উপত্যকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
জলদস্যু রেডরিংগর বাহিনী আমাদের দূর্গ দখলের ঐ রাতেই ভোরে আমাদের দ্বীপে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্র যেন ছিল আমাদের দূর্গটি। দূর্গ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেল। সেই সাথে ধ্বংস হয়ে গেল জলদস্যু রেডরিংগসহ তার বাহিনী। পরদিন দূর্গের শাসক আমাদের পূর্বপুরুষ দেখতে এসেছিলেন দুর্গের অবস্থা। আর দুর্গের আশে-পাশের লোকদের সাহায্যের জন্যে এনেছিলেন দুধ, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি। তিনি এসে দেখেন পাড়া-প্রতিবেশীদের তেমন ক্ষতি হয়নি। শুধু ধ্বংস হয়েছে দুর্গটাই। সবচেয়ে বিস্ময়কর যে ঘটনা দেখেন সেটা হলো, জলদস্যু সর্দার রেডরিংগ ও তার স্ত্রী দুর্গের গেটের বাইরে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। জানা যায় সর্প দংশনে তাদের মৃত্যু হয়েছে। আর যে সাপ দুটো তাদের কামড়েছিল সে দুটো সাপ তাদের পাশেই বসেছিল। মানুষের ভীড় সে দৃশ্য অবলোকন করেছে। দ্বীপপুঞ্জের শাসক আমাদের পুর্বপুরুষ সেখানে পৌছতেই সাপ দুটো চলে যেতে থাকে। যেন সাপ দুটো লাশ দুটিকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল দ্বীপের শাসকের আগমনের অপেক্ষায়। উপস্থিত প্রবীণদের কেউ কেউ আমাদের পূর্বপুরুষকে বলে, ‘ও দুটো আপনাদের বাস্তু সাপ। ওরা প্রতিশোধ নিয়েছে রিংগর উপরে, যেমন প্রতিশোধ নেয় ঈশ্বর ভূমিকম্পের মাধ্যমে। আপনাদের সাপের দুধ খেতে দিন। সংগে সংগেই আমাদের পূর্বপুরুষটি তার একজন লোকের হাত থেকে দুধের একটা বালতি নিয়ে কিছু দূরে রেখে দেন। সাপ দুটো ফিরে এসে দুধ খেয়ে চলে যায়। সেই থেকেই ওখানে নির্দিষ্ট সময় পরপর দুধ রাখার নিয়ম মেনে আসা হচ্ছে। দুটি সাপও সেই থেকে দুধ খেয়ে যাওয়ার নিয়ম মেনে চলছে।’
একটু থামল সার্গিও। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কাহিনী আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, বিজ্ঞানও বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আপনি তো দেখেছেন দুটো সাপকে দুধ খেয়ে যেতে।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এক ধরনের সাপ কোথাও দুধের সন্ধান পেলে নির্দিষ্ট নিয়মেই সেখানে বার বার আসে। ভূমিকম্পের সন্ধান প্রাণীকূল আগেই পেয়ে থাকে। সেদিন ভূমিকম্পের আগে নিশ্চয় সেখানকার সাপগুলো মাটির তলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ভূমিকম্প শুরু হলে মানুষ পালাচ্ছিল, সাপও পালাচ্ছিল। এই সময় রেডরিংগরা ভীত-সন্ত্রস্ত সাপের আক্রমণের শিকার হয়। এরপরও সাপের একটা নিজস্ব জগৎ আছে, সেই সাথে আল্লাহরও ইচ্ছা আছে। সুতরাং কিছু ঘটনা অলৌকিক পর্যায়ে পড়তেই পারে। আমি সাপকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে বলবো না। তবে সাপকে ভালোমন্দের নিয়ামক ভাবা চলবে না।’
ম্লান হাসল সার্গিও। বলল, ‘আপনার ব্যাখ্যাটি ঠিক। তবু যে বিশ্বাস আশা যোগায়, শক্তি যোগায় এবং তা যদি ক্ষতিকর না হয়, তাহলে সে বিশ্বাস রাখলে ক্ষতি কি!’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘গাজী আলী জামাল ওরফে গনজালো পরিবার আবার ঐশ্বর্য ঐতিহ্য ফিরে পাবে, এ বিশ্বাসের জন্যে সাপকে অবলম্বন করার দরকার নেই। আপনাদের সংগ্রামই তা প্রমাণ করে দেবে, সে শুভ দিন আপনাদের অবশ্যই আসবে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা ভাই। কিন্তু এ ধরনের বিশ্বাস ধর্মনীতির পরিপন্থী?’ বলল সার্গিও।
‘হ্যাঁ, আমাদের ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী। ইসলামের বক্তব্য হলো, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা, প্রতিপালক, প্রত্যাবর্তনস্থল। সব ভালো-মন্দ তারই হাতে। পৃথিবীর কোন পরাক্রমশালী শাসককেই ভালো-মন্দের মালিক বলা যাবে না। বেআইনীভাবে তার কাছে মাথাও নোয়ানো যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, স্রষ্টা মানে আল্লাহ যদি মন্দেরও মালিক হন, তাহলে মন্দের জন্যে তো তিনিই দায়ী হন। তাহলে মন্দের বিচার তিনি করবেন কেমন করে?’ বলল ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমল বা আচরণ মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার জন্যে নির্ধারিত। কিন্তু এর ফলটা হয় খোদায়ী বিধান অনুসারে। ফলাফলের এ অংশটা আল্লাহর এখতিয়ারে। কিন্তু এই ফলাফল আসে আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে, তবে মানুষের আমল ও আচরণের ভিত্তিতে। সুতরাং মন্দের জন্য আচরণকারী মানুষই দায়ী।’
‘ভাইয়া আসুন, আমরা উদ্ভুত অবস্থার আলোচনায় আসি।’ বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘পারিবারিক ইতিহাস ও পূর্ব পুরুষের পরিচয় পাওয়ার পর সবকিছুই উলট-পালট হয়ে গেল। আমাদের পরিচয় এখন কি হবে সেটাই ভাবছি।’ বলল সার্গিও।
‘তোমরা যে পরিচয় চাও, সেটাই হবে সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই, একটি মুসলিম পরিবার কিভাবে খৃষ্টান পরিবারে রূপান্তরিত হলো?’ বলল সার্গিও।
‘অস্বাভাবিক নয় সার্গিও। শত শত বছর খৃষ্টান পরিবেশে যদি একটি বা কয়েকটি মুসলিম পরিবার থাকে এবং সেই সাথে যদি তাদের শিক্ষা-দীক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে জীবনাচরণ তাদের পরিবর্তিত হয়ে যায়, সেই সাথে হারিয়ে যায় তাদের বিশ্বাসও। এক সময় চারদিকের চলমান ধর্মই তাদের ধর্ম হয়ে যায়। এভাবেই গাজী আলী জামাল পরিবার আমূল বদলে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পূর্ব-পরিচয়ের এই আবিস্কার বিস্ময়কর। কিন্তু পরিচয়টা আমার জন্যে গৌরবের। আমার পূর্ব পুরুষরা স্পেনের নৌবাহিনীতে ছিল, অটোমান নৌবাহিনীতে ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গৌরবের মনে হচ্ছে আধুনিক যুগ ও অনন্য সভ্যতার নির্মাতা আরব মুসলমানরা আমাদের পূর্ব পুরুষ। নিজেকে মুসলমান ভাবতে গৌরবই বোধ করছি।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিন্তু তোমাদের মুসলিম পরিচয় প্রকাশ হলে আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া গনজালো পরিবারের জন্যে অসুবিধা হবে না?’ আহমদ মুসা বলল।
জবাব দিল সার্গিও। বলল, ‘আমাদের পূর্ব পুরুষরা পতুর্গাল সরকারের প্রপাগান্ডাকে যতটা ভয় করেছিল, ততটা ভয়ের কোন কারণ নেই। পতুর্গালের প্রপাগান্ডায় কোন কাজ হয়নি। গনজালো পরিবারের ধর্ম আজোরসবাসীদের কাছে কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। গনজালো পরিবারের নেতৃত্ব তাদের ইতিহাসের কারণে। গনজালো পরিবার মুসলিম হলে সে ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যাবে না।’
‘কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে তো বিশ্বব্যাপী একটা খারাপ প্রপাগান্ডা চলছে। গনজালো পরিবারের মুসলিম পরিচয় আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে প্রপাগান্ডার ধার অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। এ প্রপাগান্ডার মূলে তো ছিল, ইহুদীরা। সে ইহুদীদের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদীরা এখন প্রধান আসামীর কাঠগড়ায় দন্ডায়মান এবং একজন মুসলমান আপনিই এই ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। সুতরাং মুসলমানদেরই সুদিন ফিরে আসছে। তারপরও যদি আমাদের পরিবারের মুসলিম পরিচয় আমাদের নেতৃত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আমরা নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে কর্মীর কাতারে দাঁড়াতে একটুও দ্বিধা করবো না। নেতৃত্ব ছাড়ব, কিন্তু ইতিহাস আর ছাড়ব না, আদর্শ ছাড়ব না।’ বলল সার্গিও।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমারও মত এটাই।’ আনন্দে চিৎকার করে উঠল ভ্যানিসা।
‘কনগ্রাচুলেশন। তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি ভ্যানিসা, সার্গিও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম ভাইয়া। খুবই খুশি লাগছে আপনার সাথে এক হতে পেরে। আরও খুশি লাগতো যদি আপনার অভিযানে শরীক হতে পারতাম।’ ভ্যানিসা বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এও হতে পারে, বাধ্য হয়েই তোমাদের অভিযানে যোগ দিতে হচ্ছে। আমরা হারতা যাচ্ছি মূল অভিযানের প্রস্তুতির জন্য। ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। শত্রুর শক্তি এবং সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কেও নয়। হতে পারে যে, অভিযানে তোমাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অতএব হতাশ হয়ো না। বরং প্রস্তুত থেকো।’
‘অবশ্যই ভাইয়া। হারতা কবে যাত্রা করছেন?’ ভ্যানিসা বলল।
‘পশ্চিম উপকূলে তোমাদের ঘাঁটিতে যাবার পর তোমাদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হেলিকপ্টারেই যাবেন?’ ভ্যানিসা বলল।
‘সেটাও ঠিক হবে ওখানে যাবার পর। হেলিকপ্টার নিলে হেলিকপ্টারটি ফিরিয়ে আনার জন্য তোমাদের, মানে অন্তত সার্গিওর যেতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে হেলিকপ্টার নেন ভাইয়া।’ ভ্যানিসা বলল।
আহমদ মুসা হাসল।
অন্য সকলেই হেসে উঠল ভ্যানিসার বাচ্চাসুলভ আবদারে।
হাসি থামলেও কেউ কোন কথা তৎক্ষণাৎ বলল না।
নেমে এল নিরবতা।
এই নিরবতার মধ্যে হেলিকপ্টারের চাপা গর্জনটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
সকলের দৃষ্টিই সামনে।
লক্ষক্ষ্যর পথে যেন প্রাণপণে উড়ে চলেছে হেলিকপ্টার।
৫
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক রেষ্টুরেন্ট থেকে এক পিস করে ডিমের ফ্রাই ও চা খেয়ে রাস্তায় নামল। হাঁটতে শুরু করল ফুটপাত ধরে।
আজ সকাল ছ’টায় তারা গনজালো রোডের মুখে এসে নেমেছে। আর হারতায় এসেছে তারা একদিন আগে। সার্গিও ও ভ্যানিসা তাদেরকে হেলিকপ্টারে করে পৌছে দিয়ে গেছে তারও একদিন আগে। হেলিকপ্টার নিয়ে তারা নামে হারতা থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ উপকূলের ছোট শহর ‘ফেটেরা’র সমুদ্র তটে।
ফেটেরা আজোরস দ্বীপপুঞ্জের এ দ্বীপটির কোষ্টাল হাইওয়ে নেটওয়ার্কের উপর তৈরি একটা ব্যস্ত শহর। শহর থেকে উপকূলটা দুমাইল দূরে। আহমদ মুসাদের হেলিকপ্টার এখানেই অবতরণ করে।
দ্বীপের চারদিকে বৃত্তাকারে বেষ্টিত কোষ্টাল হাইওয়ের শহরগুলো নিয়মিত কমার্শিয়াল বাসলাইনের দ্বারা যুক্ত। একটা দিন আহমদ মুসারা ফেটেরা শহরে অবস্থান করে হারতা সম্পর্কে মোটামুটি জেনে নিয়ে ভোরের বাসে হারতা আসে। হোটেলে উঠে একটা দিন হারতা শহর ও এই দ্বীপ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে তারা কাটায়। পরদিন সকালে এসে তারা প্রবেশ করেছে গনজালো রোডে।
সকাল ছ’টায় গনজালো রোডে নেমে পায়ে হেঁটে রোডের দুপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছে। গনজালো ১১ নং বাড়িটাও তারা দেখেছে। খুবই সাধারণ দুতলা বাড়িটায় দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট।
রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে আহমদ মুসারা পায়চারী করার মত হেঁটে ১১ নং বাড়িটার দিকেই এগুচ্ছিল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনের মুখেই ছোট করে ছাঁটা মুখভরা দাড়ি। পরণে ট্যুরিষ্টের পোশাক। চুলে সোনালী রং করা। দাড়িও সোনালী। মুখেও আছে হাল্কা মেকআপ। তাদেরকে এশীয় বলে চেনার কোন উপায় নেই। মনে হবে ইউরোপের কোন দেশ থেকে আজোরস সফরে এসেছে।
ফুটপাত ধরে তারা হাঁটছিল।
দুজন পাশাপাশি কথা বলতে বলতে হাঁটছিল। একজন প্রৌঢ়া তাদের সামনে পড়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়েছিল প্রৌঢ়া।
আহমদ মুসারা গল্পের তালেই দুজন দুদিকে সরে গিয়ে প্রৌঢ়াকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগুলো।
প্রৌঢ়া কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল। ভাবছিল সে। সে হঠাৎ পেছন ফিরে আহমদ মুসাদের দিকে দৌড় দিল।
পেছন থেকে পর্তুগীজ ভাষায় ‘হ্যাল্লো’ আহবান করল। আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই এক সাথে পেছন ফিরল। দেখল যাকে পাশ কাটিয়ে এসেছে সেই প্রৌঢ়া।
এবার প্রৌঢ়া মহিলাটির দিকে ভালো করে তাকাল আহমদ মুসা। প্রৌঢ়া এ মহিলাকে কোথাও দেখেছে বলে মনে হলো আহমদ মুসার। দ্রুত মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। প্রৌঢ়া মহিলাটি ততক্ষণে সামনে এসে পৌছেছে। বলল প্রৌঢ়া মহিলাট উচ্ছসিত কণ্ঠে, ‘তোমরা বাছা তারা না? আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। ‘ফেটেরা’ থেকে আসার পথে বাসে আমাকে ও আমার মেয়েকে বসতে দিয়ে সারাটা পথ তোমরা দাঁড়িয়েছিলে। তা তোমরা বাছা এখানে কোথায়?’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিকও প্রৌঢ়া মহিলাকে চিনতে পেরেছে। ঠিক, ফেটেরা থেকে আসার পথে বাসে এই মহিলার সাথে তাদের দেখা হয়েছিল। এই মহিলা ও তার সাথের একটি মেয়েকে তাদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে সারা পথ তারা দাঁড়িয়ে এসেছে।
সেদিন ভোরে যাত্রী ছিল প্রচুর। বাসের সব টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ওই প্রৌঢ়া মহিলা ও তার সাথের মেয়ে এসে টিকিট পায়নি কিন্তু তাদের আসতেই হবে হারতায় সকালে। নাছোড়বান্দা হয়ে দাঁড়িয়ে যাবার শর্তে তারা বাসে ওঠে। আহমদ মুসা ও হাসান তারিক নিজেদের জায়গায় প্রৌঢ়া মহিলা ও তার সাথের মেয়েকে বসিয়ে নিজেরা দাঁড়িয়ে আসে। মহিলারা বসতে কিছুতেই রাজী হয়নি। কিন্তু যখন আহমদ মুসারা বলে যে, মায়ের মত গুরুজনকে দাঁড় করিয়ে রেখে তারা বসে থাকতে পারবে না, তারাও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবে, তখন প্রৌঢ়া ও তার মেয়ে সিটে বসে। বসতে বসতে মহিলাটি বলে, ঈশ্বর তোমাদের ভাল করুন বাছা, সত্যিই আমার ছেলের কাজ করেছ।’
প্রৌঢ়ার কথার উত্তরে আহমদ মুসা বলল, ‘স্যরি বুড়িমা, প্রথমে চিনতে পারিনি। এখন ঠিক চিনতে পারছি। ভাল আছেন আপনি?’
‘ভাল আছি বাছা। তবে আমাকে মা বলো না। মা ডাক শুনলে আমার ছেলের কথা মনে পড়বে। কান্না পাবে। তার চেয়ে ‘আন্টি’ বলো।’
প্রৌঢ়া একটু থামল। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ? কোথায় উঠেছ? ও বুঝতে পেরেছি মেইন ল্যান্ড থেকে তোমরা বেড়াতে এসেছ।’
আহমদ মুসা ভাবছিল। প্রৌঢ়া মহিলা থামতেই বলে উঠল, ‘হ্যাঁ আন্টি, আমরা বেড়াতে এসেছি। আশে-পাশে একটা বাসা খুঁজছি ভাড়া নেবার জন্যে।’
শুনেই প্রৌঢ়া মহিলাটি আহমদ মুসাদের দিকে চোখ তুলে পরিপূর্ণভাবে একবার তাকাল। তার চোখে-মুখে আকস্মিক ভাবনার একটা ছায়া। মুহূর্তেই চোখ আবার নামিয়ে নিল সে। ‘আমার বাসায় কি তোমরা উঠবে বাছা? পছন্দ হবে কি? আমরা দুতলায় থাকি। নিচ তলাটা খালিই থাকে। মাঝে মাঝে অবশ্য মেহমান আসে। কিন্তু নিচে চারটি শোবার ঘর আছে। তোমরা দুটোয় থাকলেও দুটো খালি থাকবে।’
‘কোন অসুবিধা নেই। আপনার কাছে দুটো ঘর ভাড়া পেলে আমরা খুবই খুশি হবো আন্টি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সত্যিই তোমরা ভাড়া নেবে? অন্য আর কোন অসুবিধা নেই। ঐ একটু মেহমানের জ্বালাতন। তোমরা উঠলে সে জ্বালাতন কমাবারও একটা পথ হবে। আমি খুব খুশি হবো বাছা তোমরা এলে।’ বলল প্রৌঢ়া মহিলা।
একটু থামল। আবার বলে উঠল প্রৌঢ়া, ‘তাহলে বাছা কেনা-কাটায় এখন যাচ্ছি না। চল তোমরা বাড়িটা দেখবে। এস।’
বলে প্রৌঢ়া ফিরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাশাপাশি হেঁটে মহিলাটির পেছনে চলছিল।
প্রৌঢ়া মহিলাটি এসে নক করল এগার নম্বর বাড়িতে।
‘এটা আপনার বাড়ি আন্টি?’ প্রবল আনন্দ ও বিস্ময় চেপে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকের চোখে-মুখেও উপচে পড়া আনন্দ।
‘হ্যাঁ, আমার বাড়ি। কেমন মনে হচ্ছে বাছা?’ পেছন ফিরে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল প্রৌঢ়া মহিলা।
‘আন্টির বাড়ি কি কখনও খারাপ হতে পারে?’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা। কিন্তু মনে মনে বলল, ‘আল্লাহর অসীম রহমত যে, তিনি তাদেরকে এই বাড়িতে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই বাড়িটার লক্ষ্যেই তো তারা তেরসিয়েরা দ্বীপ থেকে এখানে ছুটে এসেছে।
দরজা খুলে গেল।
দরজায় দেখা গেল প্যান্ট-সার্ট পরা একজন সুন্দরী তরুণীকে। তরুণীটি দরজা খুলে মাকে দেখেই কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু একটু পেছনে দাঁড়ানো আহমদ মুসাদের উপর নজর পড়তেই থেমে গেল তরুণীটি। দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল, ‘এস মা।’
প্রৌঢ়া পেছন ফিরে আহমদ মুসাদের দিকে তাকিয়ে ‘এস বাছা’ বলে ভেতরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসারাও প্রবেশ করল।
মেয়েটি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ‘গুড মর্নিং’ বলে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাদের।
ভেতরে ঢুকেই ঘুরে দাঁড়াল এবং মেয়েটিকে দেখিয়ে আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘চিনতে পারছ? আমার মেয়ে ‘পলা জোনস।’ তারপর মেয়েকে বলল, ‘চিনতে পারছিস পলা? ফেটেরার বাসে দেখেছিলি। মনে পড়ছে?’
মেয়েটি হাসল। বলল, ‘এখন পুরোপুরি মনে পড়ছে মা।’ বলে মেয়েটি আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে সহাস্যে সপ্রতিভ কণ্ঠে বলল, ‘ওয়েলকাম, আসুন।’
আহমদ মুসাদের নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে সোফা দেখিয়ে দিল বসার জন্যে।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসারা বসল।
প্রৌঢ়া আহমদ মুসাদের দিকে দুধাপ এগিয়ে এসে বলল, ‘বাছা তোমরা একটু বস। আমি পলাকে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা কাজ বুঝিয়ে দিয়ে একটু বেরুব।’
বলে প্রৌঢ়া দুতলার ওঠার সিঁড়ির পাশ দিয়ে আরেকটা ঘরের দরজার দিকে এগুলো।
মেয়েটি আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনাদের নাস্তা হয়নি নিশ্চয়?’
‘ধন্যবাদ। নাস্তা করেছি।’ সৌজন্যমূলক একটু হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘একটু বসুন’ বলে দুতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে এগুলো। তার মা যে ঘরে গেছে সেদিকে তাকিয়ে একটু কণ্ঠটা বাড়িয়ে বলল, ‘একটু বসুন। আমি এক্ষণি আসছি।’
বলে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে দুতলায় উঠে গেল।
মিনিট দুই পরেই দুহাতে ট্রে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল।
ট্রেতে বিয়ারের দুটি ক্যান। দুটি গ্লাস। একটা পানির বোতল। একটা বাটিতে কিছু বরফ। চিপসের একটা ঠোঙা।
মেয়েটা ট্রে এনে আহমদ মুসাদের সামনে টেবিলে রেখে হেসে বলল, ‘শুধু শুধু বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকুন। আমি মার সাথে কথা বলে আসি।’
বলেই পলা জোনস ধন্যবাদ দেবার মত সময়টুকু না দিয়েই ছুটল তার মায়ের কাছে।
পলা জোনস চলে যাবার পর আহমদ মুসা বলল, ‘মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী, ভদ্র ও দিলখোলা। কিন্তু তার চোখে-মুখে একটা অস্বস্তির ছায়া আছে।’
কথাগুলো অনেকটা স্বগোতক্তির মত বলেই আহমদ মুসা তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে হাসান তারিক ও তার মাঝে রাখল। দ্রুত হাতে খুলে ফেলল ব্যাগের চেন। বের করল রিমোট সাউন্ড মনিটরিং যন্ত্রটা। যন্ত্রটা অন করে দিয়ে স্পিকারের ভলিয়ম কমিয়ে দিল।
‘ওদের ব্যক্তিগত পারিবারিক কথা জানা আমাদের ঠিক হবে ভাইয়া?’ হাসান তারিক বলল।
‘তা নিশ্চয় ঠিক নয়। কিন্তু হাসান তারিক, দশটা ব্যক্তিগত পারিবারিক কথার মধ্যে একটি কথাও WFA (ওয়ার্ল্ড ফ্রিডোম আর্মি) সম্পর্কে যদি থাকে সেটা আমাদের জন্যে মূল্যবান। এই মুহূর্তে আমাদের জানা দরকার চিঠিতে আমরা যেটা পড়েছি, সেটা ঠিক কিনা? WFA -এর লোকরা এখানে আছে কিনা, আসে কিনা?’
‘ঠিক ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল।
আহমদ মুসা আর কথা বাড়াল না। মনিটরের স্পিকার কথা বলতে শুরু করেছে ফিসফিস কণ্ঠে।
শোনা যাচ্ছিল প্রৌঢ়ার কণ্ঠ। বলছিল, ‘বাছারা খুব ভালো। ওরা বাসা খুঁজছিল। আমি নিয়ে এলাম। নিচের তলাটা ওদের দিয়ে দেব।’
‘বুঝেছি মা তুমি কি চাও। কিন্তু ওদের সাথে সংঘাতে যাওয়া কি ভালো হবে?’ বলল মেয়েটি মানে পলা জোনস।
‘সংঘাতে কেন? আমরা চলতে পারছি না। তোমার চাকরীর ব্যবস্থা এখনও হয়নি। বাসা আমাদের ভাড়া দেয়া প্রয়োজন।’ বলল প্রৌঢ়া।
‘কিন্তু ওরা এমনভাবে জেঁকে বসেছে। মনে করছে ওদেরই বাড়ি এটা।’ বলল মেয়েটি।
‘তুমি ওদের প্রশ্রয় দিচ্ছ পলা। তার ফলেই ওরা আরও জেঁকে বসেছে। ওরা লোক ভাল নয়।’ বলল প্রৌঢ়া।
‘আমি ওদের প্রশ্রয় দিচ্ছি না মা। ওদের সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছি। না করে উপায় কি। আমাদের আত্মরক্ষার শক্তি নেই। ওরা যখন ইচ্ছা, যা ইচ্ছা করতে পারে। কৌশল করেই না এখনও বেঁচে আছি।’ বলল পলা জোনস।
‘এই জন্যেই তো নিচতলা ভাড়া দিতে চাচ্ছি। এতে আমাদের একটা নিরাপত্তারও ব্যবস্থা হবে।’ প্রৌঢ়া মহিলা বলল।
‘নিরাপত্তা নয় মা, বরং ঐ নিরীহ দুজন মানুষকে বিপদে ফেলা হবে। ওদের আমি যতটুকু জানি, তুমি ততটুকু জান না। ওরা দিন-দুপুরে আমাদের সকলকে খুন করে চলে যেতে পারে। আমরা সত্যিই সংকটে আছি মা। ভাইয়া নিখোঁজ। ওদের সাথে ঝগড়া করে বাঁচবো না। ভাইয়াকে আমরা ফিরে পেতে পারি তাদের মাধ্যমেই।’ বলল পলা জোনস।
সংগে সংগে প্রৌঢ়া মহিলা, পলার মা কথা বললো না। একটু পর ধীরে ধীরে বলল, ‘ধন্যবাদ পলা। তুমি যতটা ভেবেছ, আমি ততটা ভাবিনি। তারপরও আমার মন বলছে, একটা অবলম্বন আমাদের খুঁজে নেয়া দরকার। আমার মনে হচ্ছে ওদের দুজনকে যখন হাতের কাছে পেয়েছি, তখন এ সুযোগ আমাদের হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আমাদের হারতার লোকরা শান্তি শান্তি করতে গিয়ে মেরুদন্ডহীন হয়ে গেছে। এদের কারও উপর ভরসা করা যাবে না। মেইনল্যান্ড ইউরোপের লোকরা এমন নয়।’
‘তোমার যুক্তি আমি মানছি মা। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন। তবে এদের ভাড়া দিয়েছ, একথা ওদের জানিও না। বলতে হবে, ‘ফেটেরা’তে এদের সাথে পরিচয়। হারতায় এসেছে, কদিন থাকবে।’ পলা জোনস বলল।
‘ধন্যবাদ পলা। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। খাসা বুদ্ধি বের করেছ। কদিন চলুক। দেখা যাক কি হয়।’ বলল পলার মা।
পলার মার কণ্ঠ থেমে যাবার পর আবার তা কথা বলে উঠল, ‘তাহলে পলা, আমি কেনাকাটা সেরে আসি। তুমি বাছাদেরকে এ দিকের দুটো ঘর ঠিক করে দাও।’
‘ঠিক আছে মা।’ বলল পলা।
‘আমার মনে হয় ছেলে দুটো ভালই হবে, কি বলিস। আমাদের আজোরসের কেউ এভাবে জেদ করে জায়গা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো না।’ পলার মা বলল।
‘একটা পার্থক্য ইতিমধ্যে আমার কাছে ধরা পড়েছে মা। কোন সুন্দরী মেয়ে সামনে পেলে সবাই দুচোখ দিয়ে গোগ্রাসে গেলে। কিন্তু এরা এখনও আমার দিকে একবারও পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়নি।’ বলল পলা জোনস।
‘ঈশ্বর বাছাদের ভালো করুন।’ পলার মা বলল।
নিরব হয়ে গেল মনিটরিং যন্ত্র।
‘ওরা তাহলে আসছে’ স্বগতভাবে কথাটা বলার সাথে সাথে দ্রুত যন্ত্রটা আহমদ মুসা ব্যাগে পুরল।
ড্রইংরুমে ঢুকেই পলার মা আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘বাছারা, তোমরা বস। পলা তোমাদের ঘর ঠিক-ঠাক করে দেবে। আমি একটু আসি।’
‘আন্টি, আপনাদের অসুবিধা করছি না তো? আমরা চেষ্টা করলে অন্যত্রও বাসা ঠিক করে নিতে পারব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না বাছা, আমাদের কোন অসুবিধা নেই। ভাবছি, তোমাদের অসুবিধা হবে কিনা। মাঝে মাঝেই নানারকম মেহমান আসে। থাকেও তারা দুচারদিন। অবশ্য নিচে ঘর আছে চারটা। দুটো ঘর মেহমানদের জন্য থাকবে। অসুবিধা হবার কথা নয়।’ বলল পলার মা।
‘এতে আমাদের কোন অসুবিধা নেই আন্টি। আপনাদের মেহমান মানে আমাদেরও মেহমান। আমাদের জন্যে তাদের কোন অসুবিধা হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ বাছা। আমি জানি তোমরা খুব ভালো ছেলে।’
বলে পলার মা বেরিয়ে গেল।
পলার মা বেরিয়ে যাবার পর পলা জোনস বলল, ‘আপনারা একটু বসুন। আমি ঘর দুটো ঠিক করে দিয়ে আসছি।’
বলে পলা দৌড়ে ঘরের দিকে চলে গেল।
দশ মিনিট পরে ফিরে এলো পলা। বলল, ‘আসুন, ঘর দুটো আপনাদের বুঝিয়ে দেই।’
আহমদ মুসারা চলল পলার সাথে। ড্রইং রুম থেকে দুতলায় ওঠার সিঁড়ির পাশ দিয়ে একটা করিডোর বাড়ির দক্ষিণের শেষ দেয়াল পর্যন্ত গেছে। এই করিডোরের দুপাশে দুটি ঘর। দরজা মুখোমুখি।
দুটোই সাধারণভাবে সুসজ্জিত ঘর। শোবার খাট, লেখার টেবিল, পোশাকের জন্যে ওয়াল ক্যাবিনেট, মিনি ফ্রিজার প্রভৃতি সাধারণভাবে প্রয়োজনীয় সবই রয়েছে। তবে একটি ঘরের দক্ষিণ ওয়ালে একটা বাড়তি দরজা রয়েছে। পলা জানাল ওটা একটা ইমারজেন্সী দরজা। নিচের তলা থেকে জরুরী অবস্থায় বের হবার এটা একটা বিকল্প দরজা। দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা সংকীর্ণ পথ দিয়ে উত্তরের রাস্তায় বের হওয়া যায়।’
‘মেহমানরা এলে কোথায় থাকে সাধারণত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ড্রইংরুমের পূর্ব পাশে দুটো ঘর আছে। ঘর দুটো আরও প্রশস্ত। রাস্তার দিকে জানালা আছে। মেহমানরা ও ঘর দুটোই ব্যবহার করে এ জন্যেই এ ঘর দুটো আপনাদের দেয়া হলো।’
আহমদ মুসা বিকল্প দরজাওয়ালা ঘরটাই বেছে নিল।
যাওয়ার আগে পলা বলল আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে, ‘আম্মা বলেননি, কিন্তু একটা কথা আপনাদের বলি, যাদের আমরা মেহমান বলছি, তারা আমাদের আত্মীয় নন। আমার ভাইয়া সূত্রে ওরা আসেন। আমার ভাইয়াকে ওরা একটা ভালো চাকুরী দিয়েছেন।’
‘আপনার ভাইয়া কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। সৌজন্যের খাতিরেই এটা জিজ্ঞাসা করা।
চোখ-মুখ ম্লান হয়ে উঠল পলা জোনসের। বলল, ‘উনি চাকুরী নিয়ে ৪ মাস আগে লিসবনে গেছেন।’
‘বেশি তো দূরে নয়, কাছেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তবু মনে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি দূর।’ পলা জোনস বলল।
‘কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া নিয়মিত টেলিফোনে কথা বলত। ধীরে ধীরে তার টেলিফোনে কথা বলা কমে যাচ্ছে। তার কথাবার্তায় ভয় ও রাখ-ঢাকের ব্যাপার ক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। আম্মা একটা জরুরী চিঠি পাঠিয়েছেন। তার উত্তর পাওয়া যায়নি। আজ ৭ দিন কোন টেলিফোনও তার আসেনি।’
আহমদ মুসার দেহ-মনে যন্ত্রণার একটা স্রোত বয়ে গেল। তার ভাইয়াকে যে চাকুরী দেয়া হয়েছিল সেটা যে চাকুরী নয়, এক সন্ত্রাসী কাজ এবং সে কাজ করতে গিয়েই সে নিহত হয়েছে, একথা জানতে পারলে এ অসহায় পরিবারটির কি অবস্থা দাঁড়াবে! আর এ নিহত হওয়ার ঘটনা যে আহমদ মুসাদের হাতে হয়েছে এটাও আহমদ মুসাদের জন্যে খুবই বিব্রতকর ও বেদনাদায়ক। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, তারা যে এ পরিবারের সাথে এভাবে জড়িয়ে পড়ল, এর পেছনে নিশ্চয় আল্লাহর কোন ইচ্ছা আচ্ছে। এ পরিবারের একটা দায় কি আল্লাহ এভাবে তাদের উপর তুলে দিলেন? চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ায় উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল আহমদ মুসার।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নামল পলা জোন্সের বুক থেকে। বলল, ‘আমাদের দুঃখের কথা আপনাদের জানানোর প্রয়োজন ছিল না। তবু বললাম এ কারণে যে, অনেক কথাই হয়তো আপনারা জানতে পারবেন।’
‘মিস পলা জোন্স, প্রয়োজনটা কার বেশি, সেটা না আমরা জানি আর না আপনি জানেন। আমি বলব প্রয়োজনেই আপনি বলেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
ম্লান হাসল পলা জোন্স। বলল, ‘দার্শনিকের মত কথা বললেন। তবু যা হোক সান্তনা পেলাম। ধন্যবাদ।’
‘দর্শনই হলো অন্তর্নিহিত বাস্তবতা। আমরা আজ এখানে এসে উঠব, তা আপনারা বা আমরা কেউ ভাবিনি। এই অভাবনীয় বিষয়ের একটা দার্শনিক বাস্তবতা নিশ্চয় আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
পলা জোন্স মুখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, ‘দর্শনের কথাটা আমি ‘ফান’ করে বলেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি আপনি সত্যিই দার্শনিক।’
বলে একটু থামল পলা জোন্স। বলল আবার, ‘আপনারা এখানে ওঠার অভাবনীয় ঘটনার মধ্যে কোন দার্শনিক তাৎপর্য আছে বলে মনে করেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জগতে দৃশ্যমান যা ঘটে, অদৃশ্যমানের সংখ্যা তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি। সুতরাং দৃশ্যমান ঘটনার পেছনে অদৃশ্যমান কার্যকরণ থাকবে, এটা একটা বিশ্বাস।’
পলা জোন্সের চোখ-মুখের বিস্ময়টা আরও বাড়ল। তার বিস্ময় দৃষ্টি আবার নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার উপর। সেই সাথে তার চোখে জিজ্ঞাসাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে সে বলল, ‘আপনাদের পরিচয় কিন্তু জানা হয়নি। যারা ট্যুরে যান তারা ট্যুরিষ্ট। কিন্তু ট্যুরিষ্টদের একটা পেশা ও পরিচয় থাকে, আপনাদের সেই পরিচয় আমরা জানি না। তবে আমি নিশ্চিত, আমরা চারদিকে যাদের দেখি, যারা এখানে আসেন, তাদের থেকে আপনারা আলাদা। দেখলাম, আপনারা বিয়ার খাননি।’
এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘আমরা দু’জনেই সুনির্দিষ্ট কোন পেশার সাথে জড়িত নই। সুতরাং সে ধরনের কোন পরিচয় আমাদের নেই। এদিক থেকে হয়তো কিছু আলাদা আমরা অন্যদের থেকে।’
‘পেশা নয়, মন-মানসিকতায় পার্থক্যের কথা আমি বলেছি।’ বলেই হেসে উঠল পলা জোন্স। বলল আবার, ‘অনেক কথা বলেছি। যাই, প্রয়োজন হলে ডাকবেন। যে কোন সময় দু’তলায় আসতে পারেন। পলা বলবেন, মিস বলার প্রয়োজন নেই। অন্তত বয়সে ছোট হিসেবে এ দাবী আমি করতে পারি।’
একথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পলা জোন্স।
রিডিং টেবিলের সাথে একটা মাত্র চেয়ার। আহমদ মুসা চেয়ারটাতে গিয়ে বসল।
হাসান তারিক গিয়ে বসল খাটে। বসেই বলল, ‘এখন কি ভাবছেন ভাইয়া?’
‘মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতী, ভালই হলো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, এপর্যন্ত সবকিছু ভালই যাচ্ছে। কিন্তু আসল পক্ষ তো সিনে এখনও আসেনি।’ বলল হাসান তারিক।
‘দোয়া করো, সিনে তারা যত তাড়াতাড়ি আসে ততই মঙ্গল। আসল কাজে কিন্তু আমরা এখনও এক ইঞ্চিও এগুতে পারিনি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমরা প্রথম বারের মত WFA-এর লোকদের সবচেয়ে নিকটে পৌছতে যাচ্ছি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, প্রতিপদেই আল্লাহ আমাদের সাহায্য করছেন।’
‘আমার ভয় হচ্ছে, আজর ওয়াইজম্যান সাও তোরাহ থেকে সবাইকে নিয়ে ভাগবে না তো?’ বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ, তোমার কথায় যুক্তি আছে। আজর ওয়াইজম্যান আহত এবং তেরসিয়েরা দ্বীপে তার সর্বাত্মক অভিযান চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সাও তোরাহ দ্বীপ তেরসিয়েরা দ্বীপ থেকে অনেক দূরে। আরও একটা ব্যাপারে তারা আশ্বস্ত আছে যে, তেরসিয়েরা দ্বীপে তারা আমাদেরকে ধরতে না পারলেও এবং তাদের অনেক ক্ষতি হলেও তারা আমাদেরকে আমাদের প্লানমত অগ্রসর হতে দেয়নি, আমাদের পরিকল্পিত অগ্রযাত্রাকে তারা ব্যর্থ করে দিয়েছে। এটা তাদের সাফল্য। অতএব সাও তোরাহ দ্বীপে আমরা আমাদের পরিকল্পনা মত পৌছে যেতে পারব, এটা নিশ্চয় আজর ওয়াইজম্যান মনে করছে না। সুতরাং সাও তোরাহ দ্বীপ থেকে তাদের সরার কোন প্রশ্ন নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
হঠাৎ খুশি হয়ে উঠল হাসান তারিক। বলল, ‘আমাদের ভাগ্য যদি ভালো হয়, ওরা যদি এখানে আসে, তাহলে আজর ওয়াইজম্যানের গতিবিধি সম্পর্কে অবশ্যই কিছু জানা যাবে।’
‘এখানে আমাদের আসার একটা বড় উদ্দেশ্য এটাই।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বাইরের দরজায় নক হতে শুরু করল।
উচ্চ ও অসভ্য রকমের নক হচ্ছে দরজায়। কেউ যেন অস্থির হয়ে উঠেছে দরজা খোলার জন্যে।
পলা জোন্স দোতলা থেকে ছুটে নামছিল। সে দোতলার সিঁড়িমুখে পৌছতেই দেখল, আহমদ মুসা গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। সে দোতলার সিঁড়ি মুখেই থমকে দাঁড়াল। দরজা তার নজরে পড়েছে। আহমদ মুসার পাশ দিয়ে তাকিয়ে দরজার ওপাশে দাঁড়ানো লোক দু’জনকে চিনতে পারল পলা। তাদের ঘাড়ে যারা চেপে বসে আছে সেই মেহমানরাই এসেছে। পলা জোন্স নিজেকে সিঁড়ির রেলিং-এর আড়ালে নেবার চেষ্টা করল।
আহমদ মুসা দরজা খুলতেই দরজার বাইরে দু’জনকে দাঁড়ানো দেখল। দু’জনেরই খালি হাত। লম্বা-চওড়া শক্ত-সামর্থ গায়ের গড়ন। চোখে সাপের মত ঠান্ডা দৃষ্টি এবং তাতে শেয়ালের মত ধূর্ততার ছাপ।
আহমদ মুসাকে দেখেই দু’জনের সামনের জন বিরক্তির সাথে বলে উঠল, ‘কে হে তুমি? কোত্থেকে?’
বলে সে আহমদ মুসাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘কে আপনারা? কাকে চাই? কি প্রয়োজন বলুন?’
আহমদ মুসা ওদের নক করার ধরন এবং ওদের দেখেই বুঝতে পেরেছে ওরা কারা, তবু আহমদ মুসা যে প্রশ্নগুলো একান্তই না করলে নয় অপরিচিত লোকদের সে প্রশ্নগুলো করেছে।
লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি কেন? বুড়ি অথবা পলাকে ডাক।’
‘আপনি পলা জোন্স ও তার মাকে যেভাবে সম্বোধন করছেন, তাতে বুঝলাম যে, আপনারা এঁদের আত্মীয়। স্যরি। আপনারা আসুন। ওয়েলকাম।’ হাসি মুখে বলল আহমদ মুসা।
‘আত্মীয় নই, আত্মীয়ের চেয়ে বড়। কিন্তু তোমরা কে? এবার তোমাদের পরিচয় বল।’ ভেতরে ঢুকে বলল লোকটি।
আহমদ মুসা ওদের দু’জনের সাথে ড্রইংরুমের দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘মিস পলা জোন্সের মা মিসেস জোন্সের সাথে পূর্ব পরিচয় আছে। সেই পরিচয়েই এখানে উঠেছি।’
‘বাড়ি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল আহমদ মুসা। কিন্তু পরক্ষণেই বলে উঠল দ্বিধাহীন কণ্ঠে, ‘ক্যাষ্টেলো ব্রাংকো।’
ক্যাষ্টেলো ব্রাংকো এই দ্বীপেরই দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটা শহর। আহমদ মুসা শহরটাকে চোখে দেখেনি।
‘কিন্তু তোমরা তো ওখানকার বাসিন্দা নও। তোমাদের চেহারাতো তা বলেনা।’ বলল লোকটি।
‘চেহারা কি বলে?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘আজোরীদের সাথে মেলে না।’ বলল লোকটি।
‘সেটা আজোরসের দুর্ভাগ্য। আজ আজোরসে আসল আজোরীদের চেয়ে নকল আজোরীদের সংখ্যা বেশি। নকলের সাথে আসল মিলবে না, এটাই স্বাভাবিক এবং এটা অন্যায় নয়।’
‘থাক, থাক। এধরনের জটিল আলোচনা আমার ভাল লাগে না। ঠিক আছে আপনার আসল-নকল সবাই আজোরী। এখন বলুন, আপনারা ক’দিন থাকছেন?’ বলল লোকটি।
‘এ প্রশ্নও আপনি করছেন? প্রশ্নটা মিসেস জোন্সের জন্যে রেখে দিলেই ভালো হয়।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
লোকটি মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, ‘দেখুন এ বাড়িতে আমার কথা ও মিসেস জোন্সের কথা আলাদা নয়।’
‘স্যরি, জানতাম না একথা। এর পর মনে থাকবে।’ মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টেনে বলল আহমদ মুসা।
সোফার কাছে তারা সবাই পৌছে গেছে।
আহমদ মুসা ওদের দু’জনকে বসার আহবান জানিয়ে বলল, ‘আপনারা বসুন। আমি মিস পলা জোন্সকে ডাকছি। মিসেস জোন্স বাসায় নেই।’
‘থাক থাক। আমাকে মেহমান সাজানোর প্রয়োজন নেই। মিস জোন্স এখনি আসবেন। আর আমাদের ঘর আমরা চিনি। কারও দেখিয়ে দেয়ারও প্রয়োজন নেই। এ বাড়িতে আমরা মেহমান নই। মিস জোন্সদের বাড়ি আমাদেরই বাড়ি।’
‘স্যার, তাহলে তো আর কোন কথা নেই। আমরা আসি। বাই।’ বলে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক হাঁটতে লাগলো তাদের ঘরের উদ্দেশ্যে।
সিঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসছিল পলা জোন্স উড়ে এসে জুড়ে বসা মেহমানদের সাথে আহমদ মুসার কথা শুনে।
৬
সন্ধ্যা তখন ৭টা।
বেন্টো ও সসাদের ট্যাক্সি আহমদ মুসাদের অতিক্রম করতেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তাদের ভাড়া করা ট্যাক্সিতে উঠে বলল, ‘ড্রাইভার ঐ ট্যাক্সিটার সাথে চলো। বেন্টো ও সসা মিস পলা জোন্সদের বাড়িতে আসা সেই দুজন লোক। পলা জোন্সের কাছ থেকে এ দুজনের নাম জেনে নিয়েছে আহমদ মুসারা। আলট্রা সেনসেটিভ সাউন্ড মনিটরিং দিয়ে আড়ি পেতে জেনেছে ওদের পরিকল্পনার কথা। তারা এখন যাচ্ছে জনৈক এমানুয়েলের কাছে। কোথায় কি যেন পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা এমানুয়েল তাদের জানাবে এবং করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দেবে। এটা জানার পরই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তার পিছু নিয়েছে। পরিবর্তনের কথায় চিন্তিত হয়ে পড়েছে আহমদ মুসারা। বড় ধরনের কোন পরিবর্তন ঘটছে না তো? তারা সাও তোরাহ থেকে সরে যায়নি তো? এই উদ্বেগের কারণে বেন্টো ও সসাকে অনুসরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অবশ্যই জানতে হবে পরিবর্তনের ব্যাপারটা।
এপথ ওপথ ঘুরে বেন্টোদের গাড়ি কোষ্টাল হাইওয়েতে উঠে ছুটতে লাগল উত্তর দিকে। শহরের প্রান্তে পৌছে গেল গাড়ি।
তবু বেন্টো ও সসাদের গাড়ি একই গতিতে এগিয়ে চলছে।
‘ওরা কি টের পেয়েছে যে আমরা ওদের অনুসরণ করছি? না, এমানুয়েল লোকটা শহরের বাইরেই থাকে।’ স্বগত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া, রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। আমার মনে হয় না তারা আমাদের সন্দেহ করতে পেরেছে।’ হাসান তারিক বলল ধীর কণ্ঠে।
শহরের বাইরে চলে এসেছে গাড়ি। রাস্তার দুধারে ঘর-বাড়ি, দোকান-পাটের বদলে এখন ঝোপ-জংগল আর গাছ দেখা যাচ্ছে। ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছে দুপাশের বনরেখা।
প্রায় ২শ গজ পেছন থেকে আহমদ মুসারা অনুসরণ করছে বেন্টোদের গাড়িটাকে। হঠাৎ বেন্টোদের গাড়িটা ডান দিকে বাঁক নিয়ে জংগলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
নিশ্চয় ডানদিকে যাবার ওখানে রাস্তা আছে। কিন্তু সাগর তো পাশেই। রাস্তাটা কোথায় যাবে! আহমদ মুসার এ ভাবনা শেষ হবার আগেই গাড়িটা বাঁক নেবার জায়গায় আহমদ মুসারা পৌছে গেল।
আহমদ মুসার নির্দেশে গাড়ি থেমে গিয়েছিল। দেখা গেল কোষ্টাল হাইওয়ে থেকে পাথর বিছানো একটা কাঁচা রাস্তা পুব দিকে চলে গেছে। রাস্তার মুখেই একটা সাইনবোর্ড টাঙানো। তাতে লেখা, ‘প্রাইভেট রোড। পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ নিষিদ্ধ।’
‘স্যার এখানে লাল সাহেবের বাড়ি এবং তার অফিস। এই প্রাইভেট রাস্তা দিয়ে শ’দুয়েক গজ এগুলেই তার বাড়ি। এখানে এক টুকরো ভূখন্ড সাগরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে দ্বীপের আকার নিয়েছে। কোষ্টাল হাইওয়ে থেকে দ্বীপ পর্যন্ত জায়গাটা লাল সাহেবের ব্যক্তিগত।’ বলল ড্রাইভার।
‘লাল সাহেব কে, কি করেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা ড্রাইভারের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই।
‘স্যার, লাল সাহেব ‘একবিশ্ব একদেশ একজাতি’ নামক একটা এনজিও-র মালিক। তিনি হারতায় থাকেন না। মাঝে মাঝে আসেন। আসলে এ বাড়িতেই ওঠেন।’ ড্রাইভার বলল।
‘তিনি কোথায় থাকেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘তা জানি না।’ বলল ড্রাইভার,
‘আগের গাড়িটা তো তাহলে লাল সাহেবের বাড়িতেই গেছে। না এদিকে আর কোন বাড়ি আছে ড্রাইভার?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার এই প্রাইভেট রোড লাল সাহেবের। এই রোডে আর কোন বাড়ি নেই।’ বলল ড্রাইভার।
‘তাহলে গাড়ি ঘুরাও ড্রাইভার। চল লাল সাহেবের বাড়ি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি স্যার। অনুমতি ছাড়া প্রাইভেট রোডে গাড়ি ঢুকানো ঠিক হবে না। তার উপর লাল সাহেবের লোকজন ভাল নয় স্যার।’ ড্রাইভার বলল।
‘ভাল নয় বলছ কেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘স্যার একবার ভাড়া নিয়ে ঐ বাড়িতে গিয়েছিলাম। এক ঘন্টা বসিয়ে রেখে ভাড়া দিয়েছিল অর্ধেক। প্রতিবাদ করলে বাড়ির অন্যান্য লোকজন এসে আমাকে গাল মন্দ কর এবং আমার গাড়ির পাম্প ছেড়ে দেয়।’ বলল ড্রাইভার।
‘লাল সাহেবের বাড়ি কেমন, কত বড়?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তিন তলা বাড়ি। নিচের তলায় অফিস। বাড়ির তিন দিকে রোপন করা গাছের বাগান। বাড়ির সামনে ফুল গাছের বাগান। ফুল বাগানের মাঝখান দিয়ে রাস্তা উঠে গেছে গাড়ি বারান্দায়।’ বলল ড্রাইভার।
‘ধন্যবাদ। তাহলে তুমি এখন কি করবে ড্রাইভার?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘যা বলবেন স্যার। আপনারা এখানে অপেক্ষা করতে বললে অপেক্ষা করব। চলে যেতে বললে চলে যাব।’ বলল ড্রাইভার।
‘ঠিক আছে তুমি গাড়ি একটু আড়ালে নিয়ে অপেক্ষা কর।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
হাসান তারিকও।
তারা হাঁটা শুরু করল পাথর বিছানো পথ দিয়ে।
ড্রাইভার দক্ষিণ দিকে সরে গেল তার গাড়ি নিয়ে।
মাত্র দুটি গাড়ি পাশাপাশি যাওয়ার সরু পথ। দুপাশে ঘন বন।
পাশাপাশি হাঁটছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক।
দুমিনিট চলার পর রাস্তার একটা বাঁক ঘুরতেই তারা দেখল সামনে চলার পথ বন্ধ। রাস্তার আড়াআড়ি ৩ ফুট উঁচুতে ষ্টিলের পাইপ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা।
আহমদ মুসারা পাইপের কাছে পৌছতেই পাইপের দক্ষিণ দিকের প্রান্ত থেকে দুজন লোক এগুতে লাগল আহমদ মুসাদের দিকে।
পায়ের শব্দ পেয়ে তাকাল আহমদ মুসা সেদিকে। দেখল লোক দুজনকে। তাদের দুজনের ঘাড়েই ষ্টেনগান ঝুলানো। একজনের হাতে মোবাইল। আরও দেখল, গার্ড রুম, জংগলের সাথে মিশে আছে।
লোক দুজন এসেই চ্যালেঞ্জ করল, ‘কে তোমরা?’
নিরীহ কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল, ‘আমরা হারতার লোক। লাল সাহেবের কাছে এসেছি।’
লোক দুজন জোৎসণার বিপরীতে দাঁড়ানো ছিল। ওদের মুখের ভাব দেখা গেল না। কিছুক্ষণ কথা বলল না তারা। একটু পরেই কর্কশ কণ্ঠে একজন বলে উঠল, ‘মতলববাজ, জোচ্চোর, এখনি পালাও এখান থেকে। না হলে গুলী করব।’
বলে লোকটি সত্যি সত্যিই তার কাঁধ থেকে ষ্টেনগান নামিয়ে নিতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা বুঝে ফেলল, কথায় আর কাজ হবে না। সংগে সংগেই পকেট থেকে তার ডান হাত রিভলবার সমেত বেরিয়ে এল।
রিভলবারটি ওদের দুজনের দিকে তাক করে বলল, ‘হাত তুলে দাঁড়াও, না হলে দুজনের মাথা এখনি গুঁড়ো হয়ে যাবে।’
লোক দুজন প্রথমে দ্বিধা করল। কিন্তু পরক্ষণেই দুজনের হাত উপরে উঠে গেল।
ওদের দুজনের হাত উপরে উঠতেই হাসান তারিক এগিয়ে গিয়ে মোবাইল ও দুটি ষ্টেনগান ওদের কাছ থেকে নিয়ে নিল। ওদের পকেট হাতড়িয়ে আর কোন অস্ত্র পেল না।
আহমদ মুসা হাসান তারিককে লক্ষ্য করে বলল, ‘ধন্যবাদ। তুমি ওদের দুজনকে এবার ঘুম পাড়িয়ে দাও।’
সংগে সংগে হাসান তারিক ষ্টেনগান দুটো কাঁধে ফেলে এবং মোবাইলটি পকেটে রেখে পকেট থেকে ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার বের করল। স্প্রেয়ারের মুখের ক্যাপ খুলে দুজনের নাকেই স্প্রে করল একে একে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লোক দুজন সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক ওদেরকে টেনে গার্ডরুমে নিয়ে এল। তারা ওদের গার্ড-ইউনিফরম খুলে পরে নিল এবং নিজেদের কাপড়গুলো রাস্তার পাশে একটা ঝোপে লুকিয়ে রাখল।
তারপর দুজন দুটি ষ্টেনগান কাঁধে ফেলে পাশাপাশি হেঁটে এগুলো বাড়ির দিকে। ওখান থেকেই জোৎসণার আলোতে বাড়ির সামনের বাগানটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ফুলের বাগানে বেশ কিছু বড় বড় ফুলের গাছও আছে। তাই বাড়িটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।
গাড়ি বারান্দার আলো ছাড়া বাড়ির আর কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। জানালার ভারী পর্দার ফাঁক গলিয়ে কিছু আলোর রেশ চোখে পড়ছে মাত্র তবে বাড়ির তিনতলা ও নিচতলায় কোন আলো জ্বলছে না।
বাড়ির দুতলার দক্ষিণ দিকের জানালাগুলোতে আলো বেশি দেখা যাচ্ছে।
আহমদ মুসারা বাড়ির সামনের বাগানের পাশ কাটিয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকে গিয়ে পৌছল। বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে উপর দিকে তাকিয়ে দেখল, গাছ বেয়ে উঠে ডাল দিয়ে কষ্ট করে তিন তলার ছাদে পৌছা যায়। তারপর তিন তলা থেকে দুতলায় নেমে আসা যাবে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক ডাল বেয়ে তিন তলার ছাদে নামল বটে, কিন্তু আহমদ মুসা নেমেই তিন তলার সিঁড়ির মুখে ঘরের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা একজনের মুখ দেখতে পেল।
আহমদ মুসা নেমেছিল সিঁড়ি ঘরটির পুব পাশে, হাসান তারিক পশ্চিম পাশে। আর লোকটি বসেছিল সিঁড়ি ঘরের পুব পাশের অন্ধকারে।
আহমদ মুসা ডাল থেকে ছাদ লক্ষ্যে লাফ দিয়ে ছাদের প্রাচীর আঁকড়ে ধরেছিল। সেখান থেকে ছাদে নামার সময়ই লুকানো লোকটি ছুটে এসে পেছন থেকে আহমদ মুসার মাথায় পিস্তল চেপে ধরে।
আহমদ মুসার মাথায় পিস্তল ধরে রেখেই বলল, ‘নেমে এস। আচ্ছা তো তোমার সাহস! এই ভর সন্ধ্যায় তুমি চুরি করতে এসেছ।’
আহমদ মুসা আশ্বস্ত হলো যে, তাকে চোর ভাবা হয়েছে। অতএব হুট করে সে গুলী চালানোর প্রয়োজন বোধ করবে না।
আহমদ মুসা সুবোধ বালকের মত তার হুকুম তামিল করল। নেমে এল সে।
আহমদ মুসার মাথায় পিস্তল ধরে রেখেই বলল, ‘চল হাঁটতে থাক। নিচে নামতে হবে। কোন চালাকির চেষ্টা করো না। তুমি যদি অন্যকোন শত্রু না হও, তাহলে তোমার ভয় নেই। আমরা তোমাকে কিছুই করব না। শুধু পুলিশে দেব চুরির চেষ্টার দায়ে।’
আহমদ মুসা একটুও দেরি না করে হাঁটতে লাগল। তাদেরকে তো নিচে নামতেই হবে, তার সাথেই নামা যাক। যাওয়ার পথেই একটা পথ বেরিয়ে যাবে। তাছাড়া হাসান তারিক তো ওপাশে নেমেছে। এ ব্যাপারটা নিশ্চয় তারও চোখে পড়ে যাবে।
ছাদের দরজা দিয়ে আহমদ মুসা সিঁড়ি ঘরে প্রবেশ করেছে।
হঠাৎ ‘কক’ করে একটা শব্দ হলো এবং তার মাথা থেকে রিভলবারের নলটা সরে গেল।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে তাকাল। দেখল, হাসান তারিকের বাম হাত লোকটার নাকে-মুখে একটা রুমাল চেপে ধরে তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে এবং তার ডান হাত দিয়ে হাসান তারিক লোকটার রিভলবার কেড়ে নিয়েছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লোকটি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক ধরাধরি করে লোকটাকে টেনে নিয়ে অন্ধকার সিঁড়ি ঘরের কোণায় রেখে দিল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। হাসান তারিক, শুরুটা আমাদের ভালই হয়েছে। দুক্ষেত্রেই গোলাগুলী ছাড়াই আমরা কাজ সারতে পেরেছি। গোলাগুলী হলে ভেতরে ওরা সাবধান হয়ে যেতো। চল এবার আমরা তিন তলায় নামি।’ বলল আহমদ মুসা।
তিন তলায় নামল আহমদ মুসারা। তিন তলায় অনেকগুলো ঘর। সবগুলোই অন্ধকার এবং বন্ধ।
দুতলায় নামার সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়াল তারা।
‘ভাইয়া আমরা সাউন্ড মনিটর ব্যবহার করতে পারি। বেন্টো ও সসা’দের অবস্থান এর দ্বারা চিহ্নিত করা যাবে। নিশ্চয় কোথাও তাদের কথা হচ্ছে।’ বলল হাসান তারিক।
‘ঠিক বলেছ, হাসান তারিক।’ বলে আহমদ মুসা কাঁধে ঝুলানো ছোট্ট ব্যাগ থেকে আলট্রা সেনসেটিভ সাউন্ড মনিটরিং যন্ত্র বের করল। লোভয়েসে যন্ত্রটি অন করে দিল আহমদ মুসা।
সংগে সংগেই কথা বলে উঠল যন্ত্রটি। প্রথম কণ্ঠটাই বেন্টোর। কিন্তু চারদিকে নানা শব্দ কথাকে অস্পষ্ট করে তুলছিল।
ডাইরেকশন ইন্ডিকেটর ঘুরিয়ে আহমদ মুসা ঠিক করল বেন্টোদের কথা কোন দিক থেকে আসছে। তারপর মনিটরিং যন্ত্রের অন্য সব দিক বন্ধ করে দিল। এবার বেন্টোদের কথা পরিষ্কার হয়েছে। কথা বলছিল তখন একটা অপরিচিত ভারী কণ্ঠ। বলছিল, ‘তেরসিয়েরা দ্বীপের ঘটনা সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। গতকাল আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, সাও তোরাহ দ্বীপে শিকার নিয়ে যাওয়ার প্রোগ্রাম এখন বন্ধ থাকবে। শুধু তাই নয়, ওখানে যাতায়াতও একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
‘তাহলে আগামীকাল হারতায় যে চালান আসার কথা ছিল তা আসছে না?’ বলল বেন্টোর কণ্ঠ।
‘না আসছে না।’ বলল সেই অপরিচিত কণ্ঠ।
‘সাও তোরাহ যাবার জন্যে যে ‘মিনি সাব’ এসেছে, ওটা কি চলে যাবে?’ তৃতীয় কণ্ঠ বলল। কণ্ঠটি সসা’র।
‘ইতিমধ্যে ওটা চলে গেছে।’ বলল সেই অপরিচিত কণ্ঠ।
‘এতবড় পরিবর্তন, তেরসিয়েরাতে এমন কি ঘটেছে?’ বলল বেন্টো।
‘এমন কি ঘটেছে বলছো? আমাদের অর্ধশতের মত লোক সেখানে নিহত হয়েছে। দুটি ভাড়া করা হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে, একটা নিখোঁজ রয়েছে। স্বয়ং আমাদের চীফ আহত।’
‘কাদের সাথে এ সংঘর্ষ হয়েছে?’ সসা’র কণ্ঠ বলল।
‘সেটা আমাদের বলা হয়নি। তবে মনে হয়, একদিন নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার যারা ধ্বংস করেছিল, তাদেরই উত্তরসূরী ওরা বোধ হয়।’ বলল অপরিচিত কণ্ঠ।
চতুর্থ একটি কণ্ঠ কথা বলে উঠল। বলল, ‘কিন্তু নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার যারা ধ্বংস করেছিল, এটা নিয়ে তো এখন ভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট মি. হ্যারিসন খোদ নাকি মনে করেন যে, সেই সময়ের মার্কিন সরকার যে সিদ্ধান্তে পৌছেছিল সেটা ছিল পরিস্থিতি তাড়িত, উপযুক্ত প্রমাণ ভিত্তিক নয়।’
‘হ্যাঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সেদেশের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি দুই-ই পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু তুমি প্রেসিডেন্ট হ্যারিসনের এ কথাটা কার কাছে শুনলে?’ বলল অপরিচিত সেই প্রথম কণ্ঠ।
‘মার্কিন ষ্টেশন ডিপার্টমেন্টের একজন উর্ধ্বতন অফিসার ট্যুরিষ্ট হিসেবে হারতায় এসেছিলেন। তার সাথে পরিচয় হয়। তিনিই একথা আমাকে বলেছিলেন।’ চতুর্থ কণ্ঠটি উত্তরে বলল।
‘যাক এসব উদ্বেগজনক কথা আমাদের না শোনাই ভাল।’ বলে একটু থেমেই প্রথম কণ্ঠটি আবার কথা শুরু করল, ‘সাও তোরাহ শিকার নিয়ে যাবার কর্মসূচী বাতিল হলো, এ নিয়ে অন্যরকম কিছু ভাবার অবকাশ নেই। শিকার ধরা চলছে এবং সাও তোরাহ প্রজেক্ট চলছে এবং চলবে।’
‘তবে আমরা খুশি হতাম যদি সাও তোরাহয় আমরা কতটা কি করতে পারছি তা জানতে পারতাম।’ বলল চতুর্থ কণ্ঠ।
মুহূর্তকাল নিরবতা।
পরে কথা বলে উঠল সেই প্রথম লোকটি। বলল, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। সাও তোরাহ আমি দেখিওনি। তার প্রয়োজনও নেই। যা হবার তাই হচ্ছে সেখানে।’
কণ্ঠটি থামতেই নারী কণ্ঠের কান্না ভেসে এল সাউন্ড মনিটরিং যন্ত্রে।
কান্নারত নারী কণ্ঠ কথা বলে উঠল। বলল কান্নাজড়িত কণ্ঠে, ‘মি. বেন্টো, মি. সসা আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন, কেন নিয়ে এসেছেন?’
নারী কণ্ঠ শুনে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই চমকে উঠল। এতো মিস পলা জোন্সের কণ্ঠ। বেন্টো ও সসা কি ঐ গাড়িতে করে পলা জোন্সকেও নিয়ে এসেছিল?
নারী কণ্ঠ থামতেই অপরিচিত সেই প্রথম কণ্ঠটি বলে উঠল, ‘সুন্দরী তোমার গল্প বেন্টোদের মুখে অনেক শুনেছি। কিন্তু সময় হয়নি সাক্ষাত করার। আজ অনেক দিন পর আমরা অনেকেই এক সাথে বসতে পেরেছি। আমরা চাই তুমি আমাদের এ সম্মেলনকে স্মরণীয় করে রাখ। আমরা আজ সারারাত তোমাকে ঘিরে নাচব, গাইব। আমরা সকলেই খুশি হতে চাই তোমার সঙ্গলাভে।’
লোকটি একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আমি সকলকে নাচে শরিক হবার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আসুন মিস পলা।’
‘না, আমি নাচব না। আমাকে বাড়িতে রেখে আসুন।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রতিবাদ করে উঠল পলা জোন্স।
‘তোমার কান্না তোমার চিৎকার কেউ শুনতে পাবে না সুন্দরী। ইচ্ছায় না হলে, অনিচ্ছাতেই তোমাকে সবকিছুতে রাজী হতে হবে।’
একটু নিরবতা।
তারপরেই পলা জোন্সের কণ্ঠ আর্ত-চিৎকার করে উঠল, ‘ছেড়ে দাও আমাকে, যেতে দাও। ইশ্বরের দোহাই।’
‘হাসান তারিক এস, পলার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ বলে আহমদ মুসা সাউন্ড রেকডিংটা পকেটে ফেলে ষ্টেনগানটা হাতে নিয়ে দ্রুত নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে।
হাসান তারিকও পেছনে ছুটল আহমদ মুসার। তারও হাত ষ্টেনগান।
দৌড়ানো অবস্থায় আহমদ মুসা পকেট থেকে সাউন্ট মনিটরিং যন্ত্রটা বের করে ঘরটার লোকেশন আবার ঠিক করে নিল। তখনও সাউন্ড মনিটরিং-এ পলা জোন্সের চিৎকার ও প্রচন্ড ধস্তাধস্তির শব্দ ভেসে আসছে।
ঘরটির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক। দরজাটা ঠেলে দেখল দরজা লক করা।
‘রেডি হাসান তারিক’ বলে আহমদ মুসা গুলী করল লকারের কী হোলে।
গুলী করেই প্রচন্ড এক লাথি চালাল দরজায়। খুলে গেল দরজা।
ঘরে জনা সাতেক লোক। সবাই দাঁড়ানো।
ঘরের একদম দক্ষিণ প্রান্তে আহত ও অর্দ্ধনগ্ন অবস্থায় পলা জোন্সকে একজন লোক পাঁজাকোলা করে সম্ভবত পাশের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল। পাশেই একটা দরজা খোলা।
দরজা খুলে যেতেই ঘরেরর সবাই তাকিয়ে ছিল দরজার দিকে। সেই সাথে দুজনের হাতে উঠে এসেছিল রিভলবার। যে লোকটি পলা জোন্সকে পাজাকোলা করে নিয়ে যাচ্ছিল, চোখের পলকে সে পলা জোন্সকে ছেড়ে দিয়ে রিভলবার তুলে নিল পকেট থেকে।
আহমদ মুসারা চেয়েছিল পলা জোন্সকে উদ্ধার করতে। এ জন্যেই দরজা খোলার সাথে সাথে তারা গুলী করেনি। কিন্তু মুহূর্ত দেরি করলে তারা গুলীর শিকার হবে।
সে সুযোগ দিল না ওদের আহমদ মুসারা। ওদের হাতের রিভলবার টার্গেটে উঠে আসার আগেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের ষ্টেনগান ঘরের তিন দিক ঘুরে অগ্নিবৃষ্টি করল।
সাতটি দেহই লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। ঝাঁঝরা দেহগুলো ওদের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্থির হয়ে গেল।
আহমদ মুসা ছুটল ঘরের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে।
পলা জোন্সের প্রায় নগ্ন দেহ কুকড়ে পড়ে ছিল। ভয় ও আতংকে তার দুচোখ বিস্ফোরিত। মুখে মৃত্যুর পান্ডুরতা।
আহমদ মুসা পলার জ্যাকেটটি কুড়িয়ে নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘পরে নাও।’
উঠে বসা পলা জোন্স গায়ের ছেঁড়া গেঞ্জি ও সার্টের উপর জ্যাকেট পরে নিল। তারপর স্কার্ট ঠিক করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি পলাকে নিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। আমি এদের সার্চ করে বাইরে আসছি। দুতলা ও এক তলার ঘরগুলোও সার্চ করতে হবে।’
হাসান তারিক পলা জোন্সকে নিয়ে বাইরে গেল।
পলাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুতলার ঘরগুলো সার্চ করল। কাগজপত্র সন্দেহজনক যা পেল কুড়িয়ে নিল। দুতলায় পেল একটিমাত্র কম্পিউটার সেট। ডিস্কগুলো নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
ভয় ও আতংক কিছুটা কমে গেলে পলা জোন্স আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে নিয়ে বিস্ময়ের দোলায় দুলছিল। গার্ডের ইউনিফরম ও কপাল পর্যন্ত নামানো হ্যাট পরা ক্লিনসেভ আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে চিনতে পারছিল না পলা জোন্স। কিন্তু ওদের কথা মাঝে মাঝে তার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছিল। এই অপরিচিত দুজন লোক এই বিরাট হত্যাকান্ড ঘটিয়েও তাকে বাঁচাল কেন এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এরা এখানে কি খুঁজছে সেটাও তার মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পলা জোন্সকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
গাড়ি বারান্দায় এসে গাড়িতে ওঠার সময় পলা জোন্স বলল, ‘মাফ করবেন আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ আমাদের বাড়িতে মা কান্না-কাটি করছেন।’
‘হ্যাঁ, তুমি বাড়িতেই যাবে।’ বলে আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে উঠল। পাশে উঠল হাসান তারিক। পেছনের সিটে তুলল পলা জোন্সকে।
প্রাইভেট রোড থেকে কোষ্টাল হাইওয়েতে উঠে রেখে যাওয়া ট্যাক্সির কাছে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা ডাকল ট্যাক্সিওয়ালাকে। বলল, ‘আরেকটা গাড়ি যোগাড় হয়ে গেছে। অপেক্ষা করার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’ বলে একমুঠো টাকা ট্যাক্সিওয়ালার হাতে তুলে দিল।
টাকার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল ট্যাক্সিওয়ালার। একটা লম্বা ধন্যবাদ দিয়ে ছুটল সে তার ট্যাক্সির দিকে।
গনজালো রোডের মুখে এসে আহমদ মুসা তার গাড়ি ডান পাশের পার্কটার কারপার্কে দাঁড় করাল।
গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক। পলা জোন্সকে গাড়ি থেকে নামতে বলল।
পার্কের দিকে তাকিয়ে পলা জোন্স বলল, ‘আমার বাড়িতো এখানে নয়।’
‘এস। ১১নং গনজালো রোড খুব দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় ফুটে উঠল পলা জোন্সের মুখে। বলল, ‘আমার বাড়ি আপনারা চেনেন?’
‘ওটা তো এখন আমাদেরও বাড়ি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কে আপনারা?’ বলে উঠল পলা জোন্স। তার কণ্ঠে সংশয় সন্দেহ।
উত্তর না দিয়ে আহমদ মুসা ‘এস’ বলে পলা জোন্সের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
‘গাড়ি না নেয়ার অর্থ বুঝলাম না।’ বলল পলা জোন্স।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই অপয়া গাড়িটা বাড়িতে নিলে ওটা সরিয়ে ফেলার জন্যে আবার পরিশ্রম করতে হবে।’
বলে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা।
তার পেছনে হাঁটতে লাগল হাসান তারিক ও পলা জোন্স।
পলা জোন্স হাঁটছে। কিন্তু তার মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ঝড়ের বেগে। আহমদ মুসার শেষ কথা শুনে তার নিশ্চিত মনে হচ্ছে তাদের নতুন মেহমান ভাইয়ার গলা ওটা। কিন্তু ভাইয়াদের সাথে এদের চেহারার মিল নেই। আর এরা অধিকাংশ সময়ই দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলেছে, যা ভাইয়াদের পক্ষে সম্ভব নয়।
পলা জোন্সের বাড়িতে পৌছল তারা।
দরজায় নক করে পলা জোন্সই প্রথমে প্রবেশ করল বাড়িতে।
পলার মা মিসেস জোন্স পলাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার হাট বসিয়ে দিল।
পলাকে উদ্ধার করেছে এই পূন্যের সুবাদে মিসেস জোন্স আহমদ মুসাদেরকেও ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিল।
‘আপনারা বসুন দয়া করে। আমি কাপড় পাল্টে চা নিয়ে আসছি।
চলে গেল পলা উপরে দুতলায়।
‘পলার কি হয়েছিল? বেন্টো ও সসা কোথায় নিয়ে গিয়েছিল পলাকে? তোমরা কে?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস জোন্স।
‘আন্টি, পরিচয় বলছি।’ বলে আহমদ মুসা মাথা থেকে হ্যাট খুলে ব্যাগ থেকে চুল ও দাড়ি পরে নিল। হাসান তারিকও।
মিসেস জোন্সের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল বিস্ময়ে। বলল, ‘বাছা তোমরা? তো……।’
বিস্ময় জড়িত কণ্ঠে কথা জড়িয়ে গেল মিসেস জোন্সের। একটু পর বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না বাছা!’
‘সব বলব আন্টি।’ বলল আহমদ মুসা।
এ সময় চা নিয়ে নেমে এল পলা জোন্স। আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘ভাইয়া আপনারা? হঠাৎ কোত্থেকে?’
বলেই পলা জোন্সের চোখে পড়ল আহমদ মুসাদের পরনের পোশাকের উপরে। সেই গার্ডের ইউনিফরম। সংগে সংগে সব পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ তার যে শিথিল হয়ে পড়ল। তার হাত থেকে খসে পড়ল চায়ের ট্রে। প্রচন্ড শব্দে তা আছড়ে পড়ল মাটিতে।
পলা জোন্সের মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল, ‘ভাইয়া আপনারা।’
চিৎকারের সাথে তার চোখ দুটি স্থির হলো আহমদ মুসাদের উপর।
অবাক বিস্ময় আর অনেক প্রশ্নের অপ্রতিরোধ্য চাপে বিস্ফোরিত তার দুচোখ।
চিৎকার তার থেমে গেল, কিন্তু চোখ দুটি তার যেন পাথর হয়ে গেছে। কথা সরছে না পলা জোন্সের মুখ থেকে।
আহমদ মুসা হাসল পলা জোন্সের দিকে চেয়ে। বলল, ‘তোমাদের এ বিস্ময় স্বাভাবিক। আমাদের সব কথা তোমাদের শুনতে হবে।’
পলা জোন্সের স্থির চোখ একটুও নড়ল না। তার ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল। বলল, ‘সবকথা পরে শুনব। সবার আগে এক কথায় বলুন, ‘আপনারা কে? কি উদ্দেশ্যে আপনারা এসেছেন?’ শুষ্ক কণ্ঠ পলার।
আহমদ মুসা পরিপূর্ণভাবে তাকাল পলা জোন্সের দিকে। তার অনড় চোখের অতল দৃষ্টিতে আহমদ মুসা অন্য রকম এক পলা জোন্সকে দেখল। মনে হলো, এর কাছে মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই। আহমদ মুসা বলল, ‘আমরা দুজনেই মুসলিম। আমরা ফ্রান্স থেকে লিসবন হয়ে এখানে এসেছি। একটা ভয়ংকর চক্র সাও তোরাহ দ্বীপে আমাদের কিছু ভাইকে বন্দী করে রেখেছে। আমরা তাদের উদ্ধার করতে চাই।’
আহমদ মুসা থামলেও পলা জোন্স কথা বলল না। তার অপলক, অনড় দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আহমদ মুসাদের উপর। যেন অনেক কিছু নিয়ে ভাবছে সে। কিছুক্ষণ পর পলা জোন্স ধীর কণ্ঠে বলল, ‘আপনি আপনাদের পরিচয়ের সবটুকু বোধ হয় বলেননি। আর লিসবন হয়ে হারতা আপনারা আসেননি। লিসবন থেকে তেরসিয়েরা হয়ে হারতা এসেছেন।’
এবার বিস্ময় ফুটে উঠল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘তুমি জান এটা? কি করে?’
‘আপনিই তো বললেন।’ বলল পলা জোন্স।
‘কখন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এইতো বললেন যে, ফ্রান্স থেকে লিসবন হয়ে হারতা পৌছেছেন। যে দুজন মুসলমান লিসবন হয়ে আজোরস দ্বীপপুঞ্জে এসেছেন, তারা প্রথমে হারতায় নেমেছেন এবং অনেক ঘটনাও ঘটিয়েছেন।’ বলল পলা জোন্স।
ভ্রু কুঁচকে উঠেছে আহমদ মুসার। বিস্ময় জড়িত চোখের দৃষ্টি তার আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। বলল, ‘মিস পলা জোন্স আপনি কে?’
‘আমি আজোরস এর ‘সেন্ট্রাল কাউন্টার এসপায়োনেজ এজেন্সী’ (CCEA) এর সদস্য।’ দ্বিধাহীন যান্ত্রিক স্বরে বলল পলা জোন্স।
নতুন বিস্ময় নিয়ে তাকাল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পলা জোন্সের দিকে।
বিস্ময়-বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে মিসেস জোন্সের চোখও।
৭
আজর ওয়াইজম্যান সাও তোরাহ দ্বীপে ৪০ ফুট মাটির নিচে তার অফিস টেবিল বসে। জ্বলছে তার চোখ আগুনের মত। যেন তা পুড়িয়ে ফেলবে সামনে বসা তার দক্ষিণ হস্ত দানিয়েল ডেভিডকে।
আজর ওয়াইজম্যানের জ্বলন্ত চোখ নেচে উঠল। মুখ থেকে তার শব্দের শেল বর্ষিত হলো দানিয়েল ডেভিডকে লক্ষ্য করে, ‘২৪ ঘন্টার মধ্যে আমি হারতায় জর্জ এমানুয়েলের বাড়িতে কি ঘটেছে তার সঠিক রিপোর্ট চাই। আমার বিশ্বাস সেখানে আহমদ মুসা আসেনি। সমুদ্র পথের উপর আমাদের কড়া নজর আছে। গত ৭ দিনে তেরসিয়েরা থেকে কোন ছোট নৌকা বা বোট পশ্চিমের কোন দ্বীপে যায়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে ঘরে হত্যা কান্ডটা ঘটেছে, সেখানে ছেড়া সার্ট ও গেঞ্জীর যে টুকরো পাওয়া গেছে তা কোন মেয়ের। লেডিজ ঘড়িও সেখানে পাওয়া গেছে। এ থেকে প্রমাণ হয় কোন মেয়েকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ড ঘটেছে। খোঁজ নাও ভাল করে।’
একটু থামল আজর ওয়াইজম্যান। বলল আবার একটু পরে, ‘সবাইকে খবর পৌছাও সাও তোরাহমুখী জাহাজ, লঞ্চ, হেলিকপ্টার সবকিছুকে যেন বিনা জিজ্ঞাসায় ধ্বংস করে দেয়া হয়। আমাদের নিজস্ব যোগাযোগ ‘মিনি-সাব’ এর মাধ্যমে চলবে। আর মাটির উপরের বন্দীখানাকে ভূগর্ভে ঢুকিয়ে দাও। যেন মাটির উপরে জংগল ও পাহাড় ছাড়া আর কোন কিছুর চিহ্ন না থাকে।’
আবার একটু দম নিল আজর ওয়াইজম্যান। কয়েক মুহূর্ত পরে শুরু করল আবার, ‘টুইন টাওয়ারের ধ্বংস সম্পর্কিত স্পুটনিক এর অনুসন্ধান রিপোর্টের বাড়তি কপি উদ্ধার করা এখনও সম্ভব হলো না। অথচ এর মধ্যেই রয়েছে আমাদের প্রাণ।’
অনেকটা স্বগত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলেই আজর ওয়াইজম্যান পাগলের মত চিৎকার করে উঠল, ‘নতুন বন্দী সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহকে আমার কাছে নিয়ে এস। সে কামাল সুলাইমানের স্ত্রী লতিফা কামাল, বোন ফাতিমা কামাল এবং যায়েদ বিন ফারুকের খোঁজ-খবর জানে। তার কাছ থেকে বের করে নিতে হবে ওদের ঠিকানা। আর স্পুটনিকের ৭ জনের কাছে শেষ চেষ্টা চালাও। বের কর রিপোর্টের কপি কোথায় রেখেছে। সময় আমাদের হাতে নেই। হয় ওরা বলবে না হয় ওদের সবাইকে মরতে হবে। যাও।’
বেরিয়ে গেল দানিয়েল ডেভিড।
পাশাপাশি দুটি কক্ষ।
৭১১ নং কক্ষে থাকে রবীন সিং রাফায়েল ওরফে আহমদ মুসা এবং ৭১২ নং কক্ষে থাকে লছমন লিওনার্দো ওরফে হাসান তারিক।
দুজন দুকক্ষে থাকলেও দুজনেই এখন আহমদ মুসার কক্ষে দুচেয়ারে বসে।
তাদের সামনে টেবিলে উচ্ছিষ্ট খাবার, কয়েক মিনিট আগে তারা খাবার শেষ করেছে।
দশটায় তাদের এয়ারপোর্টে পৌছতে হবে বলে খাবার খাওয়া তারা আগেই সেরে নিয়েছে। বেয়ারা এসে এখনো উচ্ছিষ্টগুলো নিয়ে যায়নি।
বেয়ারা এসে গেল।
উচ্ছিষ্ট খাবার আর বাসনপত্র গোছাতে গোছাতে বলল, ‘স্যার, আপনাদের পরিচিত কে একজন এসেছিল। আপনারা কক্ষে আছেন কিনা জিজ্ঞেস করল। কিন্তু আমি ‘আছেন’ বলার পর তারা ঘরে প্রবেশ না করে তাড়াতাড়ি চলে গেল।’
‘এটা তুমি কখনকার ঘটনা বলছ?’ জিজ্ঞেস করল রবীন সিং রাফায়েল ওরফে আহমদ মুসা।
‘এই তো স্যার ৫ মিনিটও হয়নি।’ বলল বেয়ারা।
‘কি রকম চেহারা বলত?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘বলা যায় পর্তুগীজ চেহারাই। তবে মুখ অপেক্ষাকৃত লাল। মোটামুটি লম্বা-চওড়া।’ বলল বেয়ারা।
আহমদ মুসা বেয়ারাকে বখশিশ দিয়ে বলল, ‘একটু দেখবে, তাকে দেখা যায় কিনা। পেলে নিয়ে আসবে।’
বেয়ারা চলে গেল।
বেয়ারা চলে যেতেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘আমি নিশ্চিত ভাইয়া, শত্রুরা আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে।’
‘তাইতো মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে?’
ভাবছিল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার মনে হয় ওরা লবীতে অপেক্ষা করছে। এমনও হতে পারে ওরা হোটেলের চারদিকেই পাহারায় আছে।’
‘দুজন মুসলমান আমরা, একথা তারা নিশ্চিত জানেন। তাই আমার মনে হয় মাত্র দুজন মুসলমানকে ধরার জন্যে ওদের এতকিছু করা স্বাভাবিক নয়।’ বলল হাসান তারিক।
‘তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে খারাপটার কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন তাহলে আমাদের কি করণীয়?’ বলল হাসান তারিক।
‘আমাদের করণীয় হলো আজোরস দ্বীপপুঞ্জে পৌছে যাওয়া। তার আগে কোন সংঘাতে জড়িয়ে না পড়া, যা আমাদের আজোরস যাত্রায় কোন বিঘ্ন ঘটাতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু সংঘাত আসন্ন মনে হচ্ছে ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘দেখা যাক। তুমি রেডি তো এয়ারপোর্ট যাত্রার জন্যে?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া। ব্যাগটা রেডি করে রেখেছি।’
‘ধন্যবাদ, তবে শুধু এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্যে রেডি নয়, লড়াইয়ের জন্যেও রেডি হবে। যাও, ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এস। হোটেলের বিল পরিশোধ করে এসেছি। চেক আউটও হয়ে গেছে। আমি বেরুচ্ছি।’
হাসান তারিক উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আসুন, আমিও বের হচ্ছি।’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই করিডোরে বেরিয়ে এল। দুজনের হাতে দুটি ব্যাগ।
‘আমরা কি সোজা লবি হয়ে বের হবো ভাইয়া?’ হাসান তারিক বলল।
‘হ্যাঁ অবশ্যই।’ বলে লিফট রুমের দিকে হাঁটা শুরু করল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকও তার পেছনে হাঁটা শুরু করল।
তারা দুজন যখন লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল, ঠিক তখনি লিফট থেকে বেরিয়ে এল বেয়ারা সেই দুজন লোককে সাথে নিয়ে।
আহমদ মুসা অপরিচিত দুজনের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারল, বেয়ারা ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির দুজন লোককে তাদেরই ঘরে নিয়ে আসছে।
বেয়ারার সাথে ছফুটের মত লম্বা ও জিমন্যাষ্টের মত স্বাস্থ্যের অধিকারী যে লোকটি আহমদ মুসার সন্ধানে হোটেলে ছুটে এসেছে তার নাম মারিও জোসেফ। আর তার সাথের লোকটি হলো, তার দক্ষিণ হস্ত, সেই সিলভা।
যাদেরকে আহমদ মুসা এড়াতে চাচ্ছে, তাদের একদম মুখোমুখি হয়েও আহমদ মুসার চোখে-মুখে চাঞ্চল্যের সামান্য ছায়াও পড়ল না।
হাসিমুখে সে বলল, ‘বেয়ারা, আমাদের খোঁজ করছিলেন যারা তাদেরকে কি পেলে?’
‘স্যার, এরাই তো তাঁরা, আপনাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম।’ বলল বেয়ারা খুশি হয়ে দ্রুত কণ্ঠে।
বেয়ারার কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা হ্যান্ডশেকের জন্যে নেতা গোছের লম্বা-চওড়াজন অর্থাৎ মারিও জোসেফের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম, আমি রবীন সিং রাফায়েল এবং আমার সাথি লছমন লিওনার্দো। আপনারা নাকি আমাদের খোঁজ করছিলেন?’
‘আপনারা কি আজ রাত ১২টার প্লেনে আজোরাস যাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করল মারিও জোসেফ।
আহমদ মুসা একটুও ভ্রু কুচকালো না, মুখে সামান্য ভাঁজও পড়ল না। প্রশ্নের সংগে সংগেই সহজ ও সরল কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ যাচ্ছি তো?’
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারিও জোসেফের। বলল, ‘আপনাদের দুজনকে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে।’
‘কোথায়?’ আহমদ মুসার কণ্ঠে কৃত্রিম বিস্ময়ের সুর।
‘আমাদের অফিসে।’ বলল মারিও জোসেফ।
‘আপনাদের পরিচয় কিন্তু দেননি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি এ্যান্টেনিও। লিসবনের এই অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত অফিসার আমি।’ বলল মারিও জোসেফ।
এক কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার মুখে। বলল, ‘এমন ক্ষেত্রে আপনার আইডেনটিটি কার্ড দেখিয়ে এ ধরনের কথা বলা উচিত। তা আপনি দেখাননি।’
‘মাফ করবেন। আপনি সে ধরনের কেউকেটা নন বলেই দেখানো হয়নি। চলুন আপনারা।’ বলল মারিও জোসেফ।
‘যদি বলি যাব না আমরা। এক ঘন্টার মধ্যে আমাদের এয়ারপোর্টে পৌছতে হবে। আপনারা চাচ্ছেন প্লেনটা আমাদের ফেল হোক।’ আহমদ মুসা বলল।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারিও জোসেফের মুখ। বলল, ‘ধন্যবাদ। আমাদের সন্দেহকে আপনারা সত্য প্রমাণ করেছেন। আপনারা যাবেন না আমরা জানতাম। এজন্যে নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থাই করে এসেছি। হোটেল কর্তৃপক্ষও আমাদের সহযোগিতা করবেন। সুতরাং না গিয়ে আপনাদের উপায় নেই।’ বলল কঠোর কণ্ঠে মারিও জোসেফ।
‘সব বুঝলাম। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের কেন যেতে হবে? আমরা কি কোন অপরাধ করেছি?’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে কৃত্রিম ক্ষুদ্ধতার সুর।
‘এটা হোটেল। এখানে আমরা সব কথার আসর বসাতে পারি না। অফিসে চলুন, সবই জানতে পারবেন।’ বলল এ্যান্টেনিও ছদ্মনামের মারিও জোসেফ।
আহমদ মুসা ভাবছিল। লোকটি যা বলেছে সব সত্যি। ওরা আট-ঘাট বেঁধেই এসেছে। আর এই হোটেলে ওদের সাথে লড়াইয়ে নামার মধ্যে কোন মংগল নেই। তাতে পর্তুগাল হয়ে আজোরাস যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পর্তুগালের পাসপোর্টে পর্তুগাল হয়ে আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার অনেক সুবিধা। এ সুবিধা আহমদ মুসা হাতছাড়া করতে চায় না। সুতরাং এই আজোরস যাওয়ার পথ যতটা নিরুপদ্রব হয় সে ধরনের ব্যবস্থাই করতে হবে। আহমদ মুসা এটাও ভাবল যে, আজোরস যাওয়ার পথে শুরুতেই ওদের হাতে বন্দী হবার মধ্যেও ঝুঁকি আছে। আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়াই যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে তো আসল কাজই পন্ড হয়ে যাবে। অবশেষে আহমদ মুসা ভাবল, ওদের হাতে বন্দীও হওয়া যাবে না, কিন্তু এই মুহূর্তে কোন ঘটনাও ঘটানো যাবে না, এই উভয় সংকটে আহমদ মুসা ধৈর্য্য ও অপেক্ষারই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।
মারিও জোসেফ থামলে আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। মুখে একটু হাসি টেনে বলল, ‘লছমন কি বল, এদের সাথে যাওয়ার জন্যে রেডি?’
হাসান তারিকের ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘রেডি, তবে ঠিক সময়ে প্লেন আমাদের ধরতে হবে।’
‘শুনেছেন তো মি. এ্যান্টেনিও? আমাদের প্লেন ছাড়ার আর মাত্র ৪০ মিনিট বাকি। চলুন।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক আগে আগে চলল। তাদের পেছনে মারিও জোসেফরা।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এল তারা।
গাড়ি বারান্দায় একটা পাজেরো জীপ এবং একটা মাইক্রো দাঁড়িয়েছিল।
দুগাড়ি ঘিরে লোকরা দাঁড়িয়েছিল।
মারিও জোসেফ সেখানে পৌছেই লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘দুজনকে দুগাড়িতে তুলে তোমরা ওঠ গাড়িতে।’ বলে মারিও জোসেফ নিজে গিয়ে জীপের ড্রাইভিং সিটে উঠল।
লোকরা আহমদ মুসাকে জীপে এবং হাসান তারিককে মাইক্রোতে তুলতে গেল।
আহমদ মুসার হাতে ছিল একটা হ্যান্ড ব্যাগ, হাসান তারিকের হাতেও একটা।
আহমদ মুসা জীপে ওঠার আগে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। বলল হাসান তারিককে লক্ষ্য করে, ‘লছমন, আমার ব্যাগটাও তোমার কাছে থাক।’
বলে আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে তার হাতের ব্যাগ হাসান তারিকের হাতে তুলে দিল। তারপর পেছন ফিরে জীপের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়ে মুখ পেছন দিকে ঘুরিয়ে হাসান তারিককে লক্ষ্য করে বলল, ‘লছমন, ব্যাগটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি। তুমি বন্ধ করো।’
‘ঠিক আছে। বুঝেছি।’ ওদিক থেকে বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল।
গাড়িতে উঠে বসেছে আহমদ মুসা।
দুটি গাড়ি ছুটে চলেছে শহরতলীর দিকে।
গাড়ি ষ্টার্ট দিতেই ওরা সব সিগারেট ধরিয়েছে। দুদিকের দুটি জানালা খুলে দেয়ার পরও গাড়ি ভরে গেছে সিগারেটের ধোঁয়ায়।
আহমদ মুসা প্রতিবাদ করল। বলল, ‘আপনারা গাড়িকে গ্যাস চেম্বার বানিয়ে ফেললেন, এটা কোন ভদ্রতা?’
আহমদ মুসার এ কথা নিয়ে ওদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা শুরু হলো। প্রথমেই মারিও জোসেফ বলল, ‘তাহলে বুঝুন হিটলার কতটা ভদ্র ছিল এবং তার গ্যাস চেম্বারগুলো কেমন ছিল!’
‘বস, সিগারেটের ধোঁয়াকে যে গ্যাস বলে তার পক্ষে হিটলারী গ্যাস সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব নয়।’ একজন বলে উঠল।
সে থামতেই আরেকজন বলল, ‘সিগারেটের ধোঁয়া যার কাছে গ্যাসের মত অসহ্য সে মুসলমান না হয়ে পারে না। আপনি ঠিকই সন্দেহ করেছেন বস।’
এই কণ্ঠ থামতেই আরেকজন বলে উঠল, ‘বস, একে আসল গ্যাস চেম্বারের স্বাদ পাইয়ে দিতে হবে।’
‘মনে হচ্ছে ঈশ্বর তোমাদের আশা পূরণ করবেন।’ বলল মারিও জোসেফ।
এইভাবে তাদের আলোচনা চলতেই থাকল।
আহমদ মুসার ঠোঁটে ফুটে উঠল আগের সেই হাসি। হাসিটা ধীরে ধীরে কঠিন এক সিদ্ধান্তে পরিণত হলো।
ঘড়ি দেখল আহমদ মুসা। দশ মিনিট গাড়ি চলেছে। তার মানে বিমান বন্দরে রিপোর্ট করার আর মাত্র ৩০ মিনিট বাকি।
আহমদ মুসা পকেট থেকে ‘মাউথ-নোজ গ্যাস কভার’ বের করল। এটা ক্ষুদ্রাকারের এক ধরনের গ্যাসমাস্ক। এর কার্যকারিতা পাঁচ দশ মিনিটের বেশি থাকে না।
রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা এবং বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে আকস্মিক কোন গন্ধময় পরিবেশের সৃষ্টি হলে এটা ব্যবহার করা হয়।
আহমদ মুসা গ্যাসমাস্কটি পরে নিল।
হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল গাড়িতে।
মারিও জোসেফ বলে উঠল, ‘হেসো না, ফাঁসির আসামীও মুক্তির স্বপ্ন দেখে।’
গ্যাসমাস্কের সাথেই মার্বেলের মত কালো রংয়ের গ্যাসের ডিনামাইট বের করেছিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার গ্যাসমাস্ক নিয়ে হাসি ঠাট্টারত কেউই এটা খেয়াল করেনি।
গ্যাস-ডিনামাইটের কালো শরীরের এক জায়গায় জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল একটা লাল বিন্দু। এটাই গ্যাস-ডিনামাইটের ট্রিগার পিন। পিনটি খুলে নিলেই গ্যাস-ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ ঘটে মানে গ্যাস-ডিনামাইটটি তার ভয়ংকর গ্যাস নিঃসরণ শুরু করে। এ গ্যাস-ডিনামাইট আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইটের মত সবকিছু ধ্বংস করে না, কিন্তু ছয় বর্গগজের মধ্যে কোন জীবনের অস্তিত্ব রাখে না। এ কারণেই জীবন ধ্বংসের এ নিরব-অস্ত্রকে ডিনামাইট নাম দেয়া হয়েছে।
হাতের মুঠোর মধ্যে লুকানো জীবন ধ্বংসী এ মারণাস্ত্রের ট্রিগার পিন খুলতে গিয়ে কেঁপে উঠল আহমদ মুসা। হৈ হুল্লোড়, হাসি ঠাট্টায় ব্যস্ত এ জীবন্ত মানুষগুলোর জীবন কি এতই সস্তা যে, আগামী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা ধ্বংস হয়ে যেতে পারবে! ওদের সুন্দর পৃথিবী, মমতায় গড়া ওদের পরিবার থেকে ওরা চিরতরে একেবারে বিনা নোটিশে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কেন! পরক্ষণেই আহমদ মুসার মন থেকে কে যেন বলে উঠল, পৃথিবীর মানব বাগান যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই ‘মহা তিনি’ই সৃষ্টির সাথে ধ্বংসকে একই সাথে জুড়ে দিয়েছেন। ভূমিকম্প, বন্যা, জলোচ্ছাস, ঝড়-সাইক্লোন-হ্যারিকেন, মহামারি এই ধ্বংসেরই এক একটি মহা অস্ত্র। আগাম নোটিশ দিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে এরা আসে না। আবার মন থেকেই আরেকজন বলে উঠল, হত্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধ্বংস তো এক জিনিস নয়। মন থেকে এরও উত্তর এল সংগে সংগেই। বলা হলো, গাছকে রক্ষার জন্যে আগাছা তো মানুষই ধ্বংস করে। না করলে আগাছাই গাছকে শেষ করে দেয়। মানব সমাজেও রয়েছে এ ধরনের অসংখ্য আগাছা। যারা আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এরা ষড়যন্ত্রকারী এবং সন্ত্রাসী নামের আগাছা, এদের হত্যা করতে না পারলে এরাই হত্যা করবে আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে। ওরা আহমদ মুসাকে আসল গ্যাস চেম্বারের স্বাদ পাইয়ে দিতে চায়। ওদের সুযোগ দিলে ওরা এটাই করবে। আর এ জালেমরা জুলুমের জিন্দানখানা সাও তোরাহ দ্বীপে যাবার পথে বাধা। এই আগাছাদের বিনাশ না হলে এক ইঞ্চিও আহমদ মুসা এগুতে পারবে না। শুধু তাই নয়, জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হবে অন্যায় দুর্বলতার।
আহমদ মুসা জেগে উঠল মুহূর্তের ভাবাবেগ থেকে। কঠোর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ।
ঠিক এই সময়েই মারিও জোসেফ বলে উঠল, ‘ডন সিলভাকে বলে দাও, আমরা অফিসে যাচ্ছি না। এসব ঝামেলা অফিসে নিয়ে লাভ নেই। সামনে পাইনের পার্কটায় যেতে বল। আর বলে দাও কথাবার্তায় সময় খরচ করার প্রয়োজন নেই। কাপড় খুলে দেখবে খাতনা আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে সোজা বুকে কয়েকটা গুলী ঢুকিয়ে দেবে। ব্যস।’ থামল মারিও জোসেফ।
তার থামার সাথে সাথেই জীপটা হঠাৎ বাঁক নিয়ে আরেকটা রাস্তায় প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা বুঝল তাদেরকে পাইনের পার্কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কঠিন একটা হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। গ্যাস- ডিনামাইট দুহাতের মুঠোতে নিয়ে খুলে ফেলল লাল পিনটা। তারপর সামনের সিটের নিচ দিয়ে কাল বলটা গড়িয়ে দিল সামনে।
এক সেকেন্ড, দুসেকেন্ড করে গড়িয়ে চলল সময়, ঠিক দশ সেকেন্ডের মাথায় গাড়ির ষ্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। ড্রাইভিং সিট থেকে মারিও জোসেফ দূর্বল তন্দ্রালূ কণ্ঠে বলল, ‘ডন, তুমি ড্রাইভিং সিটে এস, হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল শরীর।’
‘হঠাৎ এ রকম হলো কেন? মনে হচ্ছে আমার শরীর তোমার চেয়েও খারাপ। উঠে দাঁড়াবার শক্তি আমার নেই।’ টেনে টেনে দুর্বল কণ্ঠে বলল ডন।
‘কি বললে?’ তড়াক করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে চিৎকার করে বলে উঠল মারিও জোসেফ, ‘গুলী কর, খুন কর এই লোককে।’
বলে মারিও জোসেফ নিজেই পকেট থেকে রিভলবার বের করার চেষ্টা করল।
কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা পাশের ঝিমুনি আক্রান্ত লোকটির হাত থেকে ষ্টেনগান কেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যে যেখানে যেভাবে আছ বসে থাক। একটু বেয়াদবী করলে মরবে গুলী খেয়ে।’
বলে আহমদ মুসা পিছু হটে গাড়ি থেকে নেমে এল। বন্ধ করে দিল গাড়ির দরজা।
পেছনের গাড়িটা প্রায় এসে পড়েছে। আহমদ মুসা তার ষ্টেনগান তুলল গাড়িটাকে লক্ষ্য করে।
সংগে সংগে গাড়ি থেকে চিৎকার শোনা গেল, ‘ভাইয়া, গুলী করবেন না। আমি গাড়ি চালাচ্ছি।’
আহমদ মুসা ষ্টেনগানের ব্যারেল নিচে নামিয়ে ট্রিগার থেকে তর্জনি সরিয়ে নিল। বলল সেই সাথে চিৎকার করে, ‘ভেতরের খবর কি?’
‘সবাই ঘুমিয়েছে কিংবা…………।’ হাসান তারিক কথা শেষ না করেই থেমে গেল।
গাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি নেমে ছুটে এল হাসান তারিক। ফিসফিস করে বলল, ‘ভাইয়া, খোলা ব্যাগের মাধ্যমে আপনি যে মেসেজ দিয়েছিলেন, তা সংগে সংগেই আমি বাস্তবায়ন করেছি।’
‘ধন্যবাদ হাসান তারিক। আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম যে, তুমি বিষয়টা তাড়াতাড়ি ধরে ফেলতে পারবে কিনা। আলহামদুলিল্লাহ।’
বলে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত জীপের কাছে এল। নিজের মুখের গ্যাসমাস্ক ভালোভাবে মুখে-নাকে সেট হয়ে আছে কিনা দেখে জীপের দরজা খুলে ফেলল। এগুলো লাশের দিকে। পাশে এসে দাঁড়াল হাসান তারিক। দুজনে লাশগুলো রাস্তায় নামিয়ে ফেলল।
‘হাসান তারিক, ব্যাগগুলো নিয়ে এস তোমার মাইক্রো থেকে।’ বলে আহমদ মুসা এগুলো জীপের ড্রাইভিং সিটের দিকে।
হাসান তারিক মাইক্রো থেকে দুটি হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে এসে আহমদ মুসার পাশের সিটে উঠে বসল।
আহমদ মুসা গাড়ি ষ্টার্ট দিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করার আর মাত্র ২৫ মিনিট বাকি হাসান তারিক।’
‘ইনশাআল্লাহ আমরা ঠিক পৌছে যাব ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘কিন্তু সামনে গিয়ে এ গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে কোন ট্যাক্সি-ম্যাক্সি নিতে হবে হাসান তারিক। এ গাড়িটা পুলিশের পরিচিত হবে নিশ্চয়। সুতরাং এ গাড়ি এয়ারপোর্টে নেয়া যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক বলেছেন ভাইয়া। এয়ারপোর্টে কি কোন ঝামেলা হতে পারে? কি ভাবছেন আপনি?’ বলল হাসান তারিক।
‘মুসলমানদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়া বন্ধ। কোনভাবে ওরা সন্দেহ করেছে আমরা মুসলমান, ওরা নিশ্চিত হবার জন্যেই আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা আহমদ মুসা ও হাসান তারিক এটা ওরা জানে না। সুতরাং এয়ারপোর্টে নতুন কোন ঝামেলা হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া যে নাম আমরা এ্যান্টোনিওদের বলেছি, সে নামে আমাদের টিকেট নয়। টিকেটে আমাদের পর্তুগীজ-স্পেনীয় নাম রয়েছে। আর পর্তুগীজ পড়তে না পারলেও পর্তুগীজ ভাল বলতে পারি আমরা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার কথা সত্য হোক ভাইয়া। আমাদের যাত্রার অবশিষ্ট সময় আল্লাহ নিরুপদ্রব করুন।’ বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসার গাড়ি সেই রোডে উঠে আসার পর কিছু দূর এগিয়ে একটি ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ড দেখে জীপটি রাস্তার পাশে ছেড়ে দিয়ে আহমদ মুসারা নেমে পড়ল।
তারপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটল লিসবন এয়ারপোর্টে।
আজোরস দ্বীপপুঞ্জের টেরসিয়েরা দ্বীপের ‘লিজে’ এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কাউন্টার।
কাউন্টারে আহমদ মুসা এবং তার পেছনে হাসান তারিক দাঁড়িয়ে।
ইমিগ্রেশন অফিসার আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের পাসপোর্ট নাড়াচাড়া করে বলল, ‘আপনাদের টিকেট দেখি।’
আহমদ মুসা তার হাতে দুটি টিকেট তুলে দিল।
লোকটি টিকেটের পাতা উল্টিয়ে দেখল। তারপর বলল, আপনাদের কার নাম রুইজর্জ এবং কার নাম পেড্রো পোর্টিট?
‘আমি রুইজর্জ, আর ও পেড্রো পোর্টিট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাদের নাম পর্তুগীজ, কিন্তু আপনারা তো এশিয়ান?’ অফিসার লোকটি বলল।
‘পর্তুগালে আফ্রিকান, রাশিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের লোক বাস করে। তাদের সাথে অনেক এশিয়ানও।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘তা ঠিক।’ অনেকটা বিব্রত কণ্ঠেই বলল অফিসার লোকটি।
একটা দম নেবার পরই সে আবার বলে উঠল, ‘আচ্ছা আপনারা রবিন সিং রাফায়েল ও লছমন লিওনার্দো নামের দুএশিয়ানকে চেনেন?’
আহমদ মুসা মনে মনে আঁৎকে উঠল এই ভেবে যে, ‘লিসবনের তাদের সব খবরই তাহলে আজোরস-এ পৌছে গেছে।’
কিন্তু আহমদ মুসার এই আঁৎকে উঠা ভাব মুখের চেহারায় সামান্যও প্রকাশ পেল না। অফিসার লোকটি থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘না, এমন নামের কাউকে আমরা চিনি না। ওরা এই বিমানে যাবে কিনা সেটা যাত্রীদের তালিকা দেখলেই তো জানা যায়।’
‘ওরা খুব সাংঘাতিক লোক এবং মুসলমান। যাত্রী তালিকায় ঐ দুজনের নামে কোন যাত্রী নেই। নিশ্চয় ওরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে ছদ্মনাম ব্যবহার করছে। কোন ছদ্মনাম নিয়েই ওরা প্লেনে উঠেছে।’ বলল অফিসার লোকটি।
থেমেই আবার বলে উঠল লোকটি আহমদ মুসাদের পাসপোর্ট ও টিকিট ফেরত দিতে দিতে, ‘যাই হোক। সন্দেহ করে তো আমরা সব লোককে হেনস্তা করতে পারি না। আপনারা যান। ধন্যবাদ।’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাসপোর্ট ও টিকিট নিয়ে ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে লাগেজ লাউঞ্জে প্রবেশ করল।
হাসান তারিক আহমদ মুসাকে ফিসফিস করে বলল, ‘ইমিগ্রেশন অফিসারটি নেহায়েত ভদ্রলোক। আমি তো ভাবছিলাম, উনি বলে বসবেন যে, আপনাদের নাম পরিচয় যে ঠিক তা প্রমাণের জন্যে আসুন আপনাদের ফিজিক্যাল টেষ্ট দিতে হবে। প্রমাণ করতে হবে আপনারা মুসলমান নন।’
‘দেখলে না লোকটার চেহারা? সে খাঁটি পর্তুগীজ নয়। ‘আজোরী’ সে। মানে আজোরসের মানুষ সে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজোরী’রাও পর্তুগীজ?’ বলল হাসান তারিক।
‘পর্তুগীজ নয়, মিক্সড পর্তুগীজ। পর্তুগীজরা যখন এই বিজন দ্বীপপুঞ্জ দখল ও বসতি গড়ে, তখন তারা প্রচুর স্প্যানিশকে এখানে নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে নর্থ আমেরিকান আদিবাসি এবং এস্কিমোরাও বেশ সংখ্যায় নানাভাবে এখানে এসে ছিটকে পড়ে। সব মিলিয়ে ‘আজোরী’রা একটি মিশ্র জাতি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই হবে। কিন্তু ভাইয়া, এই যে ফাঁড়াটা কাটল, এটাই শেষ ফাঁড়া নয় বলে মনে হচ্ছে।’ বলল হাসান তারিক।
‘কোন সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে হাসান তারিক। ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি (WFA) নিশ্চিত যে, হোটেলে আমাদের ধরতে যাওয়া দুগাড়ির লোকদের হত্যা করে আমরা বিমানে উঠেছি লিসবন থেকে আজোরসের ‘লিজে’ আসার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে তো প্রকৃত বিপদ আমাদের জন্যে বাইরে অপেক্ষা করছে!’ বলল হাসান তারিক।
‘ঠিক অনুমান করেছ হাসান তারিক!’ আহমদ মুসা বলল।
হাসান তারিক থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘বেরুবার আগে তো কিছু তাহলে ভাবতে হয়। আসুন একটু দাঁড়ানো যাক।’
আহমদ মুসাও দাঁড়িয়ে পড়ল।
মুখোমুখি হলো দু’জন।
‘ঠিক বলেছ হাসান তারিক। একটু ভাবা প্রয়োজন। তবে বিকল্প কিছু করার সুযোগ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না।’
‘কেন?’ বলল হাসান তারিক।
‘বিমান বন্দর থেকে বেরুবার একটাই পথ এবং সে পথটাই যদি ওরা আগলে থাকে!’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে শুরুতেই তো সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হবে!’ বলল হাসান তারিক।
‘কিন্তু আমরা সহজেই চিহ্নিত হয়ে যাব, এমন সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে আমাদের মিশনের ক্ষতি হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও তাই ভাবছি ভাইয়া। কিন্তু বিকল্প নেই আপনিই তো বললেন।’ বলল হাসান তারিক।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘হয়তো আমরা বেশি বেশিই ভাবছি। হয়তো কেউ আমাদের পথ আগলে নেই।’
‘যদি থাকে তাহলে কি হবে, সেটাই তো আলোচনার বিষয়।’ হাসান তারিক বলল।
‘যে বিষয়ের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, এসব বিষয় নিয়ে আর ভেবে কি হবে। রণাঙ্গনই বলে দিবে সৈনিকের ভূমিকা কি হবে। এস, অন্য বিষয়ে একটু ভাবি।’ বলে আহমদ মুসা লাউঞ্জের একটা চেয়ারে গিয়ে বসল।
হাসান তারিক গিয়ে বসল তার পাশে।
আহমদ মুসা ব্যাগের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। কাগজটা একটা মানচিত্র। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের একটা মানচিত্র।
মানচিত্রটি আহমদ মুসা সামনে মেলে ধরল। হাসান তারিকও তার উপর চোখ রাখল।
মানচিত্রের উপরের অংশে একটা দ্বীপের উপর আঙুল রেখে বলল, ফ্লোরেস দ্বীপের উত্তরে এটা করভো দ্বীপ। প্রফেসর জ্যাক সাইমনের বক্তব্য অনুসারে এই দ্বীপের কয়েক মাইল দূরে সাও তোরাহ দ্বীপ। করভোর উত্তরে যে সাদা বিন্দুটা দেখা যাচ্ছে, এটা সাও তোরাহ হতে পারে। এই দ্বীপের সবচেয়ে কাছের শহর হলো ফ্লোরেস দ্বীপের ‘সান্তাক্রুজ’। আমার মনে হয় সাও তোরাহ দ্বীপের সবচেয়ে কাছের শহর হিসেবে এর উপর WFA এর খুব বেশি দৃষ্টি থাকবে এখন। সুতরাং এখানে সাও তোরাহ দ্বীপ নিয়ে আলোচনা করা নিরাপদ হবে না। এই কারণে আমি মনে করি, সাও তোরাহ দ্বীপের পরবর্তী নিকটতম শহর হলো সান্তাক্রুজ। সান্তাক্রুজের সোয়াশ’ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে পিকো দ্বীপের ‘হারতা’ শহর। এই হারতা শহরকেই আমরা আপাতত বেজ করতে পারি। এখান থেকে সব খবরাখবর নিয়ে প্রস্তুত হয়ে পরবর্তী বেজ হিসাবে আমরা সান্তাক্রুজে যেতে পারি।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘হারতা এবং সান্তাক্রুজ সম্পর্কেও তো আমাদের কিছু জানা প্রয়োজন।’
‘হ্যাঁ, হাসান তারিক। সেটা করতে হবে। পর্তুগীজ ইয়ারবুক থেকে কিছু জানা গেছে। ওটা তুমি একটু দেখে নিও। ‘লিজে’ থেকে আমরা কিছু ট্যুরিষ্ট লিটারেচার যোগাড় করতে পারব। সেখান থেকেও কিছু জানা যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
একটু থেমেই আবার সে বলে উঠল, ‘আমরা আপাতত একটা টাইম সিডিউল এ ধরনের করতে পারি যে, খোঁজ-খবরের জন্যে ‘লিজে’তে তিন দিন কাটিয়ে ৪র্থ দিনে আমরা ‘হারতা’তে পৌছব এবং হারতা গিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা করব।’
‘হারতা গিয়ে কোথায় উঠব, এ সম্পর্কে আমরা কোন চিন্তা করব কিনা। ছোট শহরের হোটেলগুলো আমার মতে নিরাপদ নয়।’ বলল হাসান তারিক।
‘তুমি ঠিকই বলেছ হাসান তারিক। ফাইনালী কি হবে আমি জানি না। তবে আপাতত চিন্তা করেছি, হারতার ক্যাথলিক গীর্জার অতিথিশালায় উঠব। আমি ইয়ারবুকে দেখেছি, ‘হারতা সেন্টপল’ গীর্জার বিশাল অতিথিশালা সবার জন্যেই উন্মুক্ত।’ আহমদ মুসা বলল।
খুশি হলো হাসান তারিক। বলল, ‘ক্যামোফ্লেজটা ভালোই হবে ভাইয়া।’
‘এস এবার উঠি।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকও উঠল।
চলল তারা ডিপারচার লাউঞ্জের দিকে।
লাউঞ্জ থেকে বের হবার দরজার পাশে একটা সুদৃশ্য কাউন্টার। কাউন্টারের এক প্রান্তে বিলবোর্ডে একটি বিজ্ঞপ্তি। বলা হয়েছে, এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। যৌক্তিক ভাড়া ও বিশ্বস্ততার প্রতীক আজোরস ন্যাশনাল কোম্পানী।’
বিলবোর্ডটি পড়ে আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বর্তমান অবস্থায় বিশ্বস্ত গাড়ি পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আহমদ মুসা হাসান তারিককে কানে কানে বলল, ‘কাউন্টারে যাও। এদের থেকেই গাড়ি ভাড়া কর। বাইরে গিয়ে গাড়ি ভাড়া করার ঝুঁকি নেয়া যাবে না।’
হাসান তারিক কাউন্টারে গেল। গাড়ি ভাড়া হয়ে গেল। তাদের নিজস্ব কমিউনিকেশন নেট ওয়ার্কের মাধ্যমে বলে দেয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভার লাউঞ্জে ঢুকল এবং আহমদ মুসাদের ‘ওয়েলকাম’ করে গাড়িতে নিয়ে গেল।
প্লেন থেকে নামার পর থেকেই আহমদ মুসার দুচোখ সতর্ক ছিল। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেই গাড়িতে উঠে বসল।
‘স্যার কোথায়?’ ড্রাইভিং সিটে বসে ষ্টিয়ারিং-এ হাত রেখে বলল ড্রাইভার।
আহমদ মুসার চিন্তা করাই ছিল। বলল, ‘গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে চল।’
‘লিজে’ এয়ারপোর্টের বিপরীত দিকে শহরের সাগর প্রান্তে একটা ছোট পাহাড়ের উপর এই হোটেলটি। লিজে এয়ারপোর্ট থেকে দীর্ঘ সরল এক পথ পেরিয়ে ‘লিজে’ শহরে প্রবেশ করতে হয়। তারপর শহর পেরিয়ে ছোট একটা পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড় শীর্ষের ‘গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল’ হোটেলে পৌছতে হয়। বেশ দীর্ঘ পথ। খুশিই হলো ড্রাইভার। তার মুখ দেখা গেল প্রসন্ন।
গাড়ি ষ্টার্ট নিয়েছে। চলছে গাড়ি।
গাড়ি তখন বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
হাসান তারিক আহমদ মুসার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘যাত্রার শুরুটা বোধ হয় ভালোই হলো ভাইয়া।’
‘তোমার কথা সত্য হলে ভালো। কিন্তু আমার অন্য রকম মনে হচ্ছে। ডিপারচার লাউঞ্জে একজন ক্রিমিনাল চেহারার লোক সর্বক্ষণ আমাদের উপর চোখ রেখেছে। আমরা বের হয়ে এলে সেও বেরিয়ে একটা সাদা গাড়িতে চড়েছে। এছাড়া কার-পার্কেও আরেকটা সাদা গাড়ির আরেকজন লোকের দুচোখ আঠার মত গেঁথে ছিল আমাদের উপর। আমাদের গাড়ি ষ্টার্ট নিলে সেই গাড়িকেও ষ্টার্ট হতে দেখেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকের মুখ ম্লান হয়ে গেল। তাকাল সে পেছন দিকে। বোধ হয় সেই দুটি সাদা গাড়ি পিছু নিয়েছে কিনা তা দেখার জন্যে। কিন্তু পেছনে গাড়ির সারি। অধিকাংশই সাদা গাড়ি। হতাশ হয়ে চোখ দুটি ফিরে এল হাসান তারিকের।
কিন্তু শহর পেরিয়ে পার্বত্য পথে প্রবেশের পর সন্দেহ আর থাকলো না। দুটো সাদা গাড়িকে দেখা গেল আহমদ মুসার গাড়ির সমান গতিতে ছুটে আসছে। আহমদ মুসা ড্রাইভারকে বলে গাড়ির গতি বাড়িয়ে কমিয়ে নিশ্চিত হলো যে, গাড়ি দুটো তাদেরকেই অনুসরণ করছে।
আহমদ মুসা পরিস্থিতিটা ড্রাইভারকে জানানো ও তার মনোভাব জেনে নেয়ার জন্যে বলল, ‘ড্রাইভার, দুটো গাড়ি দেখছি আমাদের ফলো করছে।’
‘স্যার, আপনাদের কোন শত্রু আছে?’ বলল ড্রাইভার। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘এদেশে আমরা বেড়াতে এসেছি। থাকতে পারে। কিন্তু ওরা সরকারের কেউ কিংবা ডাকাত-টাকাত নয়তো?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার, সরকারী নয়। সরকারের কোন ব্যাপার হলে সেটা বিমান বন্দরেই ঘটত। আর এ ধরনের ডাকাতও আমাদের আজোরসে নেই। স্যার, হতে পারে আপনাদের কোন শত্রু পর্তুগাল থেকেই আপনাদের অনুসরণ করছে।’ বলল ড্রাইভার।
‘তাহলে এখন কি করা যায় ড্রাইভার?’ আহমদ মুসা বলল।
‘চিন্তা নেই স্যার। গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল হোটেল। ওখানে শক্তিশালী পুলিশ ষ্টেশন আছে। আমরা ঠিক হোটেলে পৌছে যাব, ওরা আমাদের ধরতেই পারবে না।’ বলল ড্রাইভার।
পার্বত্য পথে আরও কিছুটা এগুলো আহমদ মুসাদের গাড়ি।
ঝোপে ঢাকা টিলার একটা বাঁক ঘুরতেই আহমদ মুসা দেখতে পেল দুশ গজের মত দূরে একটা মাইক্রো ও একটা জীপ তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে তাকাল সে। দেখল পেছনে ছুটে আসা দুটি গাড়ির সাথে আরেকটি গাড়ি যোগ হয়েছে।
ড্রাইভার বিষয়টা খেয়াল করেছে। গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে সে। তার চোখে ভয়ের ছাপ। বলল সে, ‘সর্বনাশ স্যার! ওরা দুদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।’
আহমদ মুসাদের গাড়ির সামনেই রাস্তার একটা ত্রিমোহনী। হোটেলগামী রোড থেকে আরেকটা রাস্তা বেরিয়ে পার্বত্য এলাকার মধ্যে দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে।
রাস্তাটির দিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসা ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘পশ্চিম এ রাস্তাটা কোথায় গেছে ড্রাইভার?’
‘স্যার, পার্বত্য এলাকা ছাড়িয়ে রাস্তাটা আমাদের এ দ্বীপের একমাত্র বীচ পর্যন্ত গেছে। সেখানে মনোরম একটা ট্যুরিষ্ট স্পট আছে।’
‘ড্রাইভার গাড়িটা পশ্চিমের ঐ রাস্তায় নাও।’ নির্দেশের স্বরে বলল আহমদ মুসা।
‘ওদিকে তো কোন আশ্রয় নেই স্যার। মাত্র ট্যুরিষ্ট স্পটে একটা পুলিশ ষ্টেশন আছে। সে তো অনেক দূরে?’
‘ভয় করো না ড্রাইভার, তোমার এবং তোমার কোম্পানীর কোন ক্ষতি হবে না। তুমি গাড়ি ঘুরিয়ে নাও।’ এবার দৃঢ় কণ্ঠে নির্দেশ দিল আহমদ মুসা।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে পশ্চিমের রাস্তায় চলতে শুরু করল।
একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে, ‘শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করার চাইতে শত্রুর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করাই উচিত নয় কি ড্রাইভার?’
‘অবশ্যই স্যার। কিন্তু শত্রুদেরকে খুব প্রবল দেখছি। স্যার, ওরা কারা আন্দাজ করতে পারেন?’ ড্রাইভার বলল।
‘বন্দী কিছু লোককে আমরা উদ্ধার করতে চাই। হতে পারে আটককারী দলের ওরা কেউ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বন্দীরা কে স্যার?’ বলল ড্রাইভার।
‘নিরপরাধ লোক। ওদের মুখ বন্ধ করার জন্যে ওদের অপহরণ করা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বন্দীরা কি আপনাদের আত্মীয়?’ ড্রাইভার বলল।
‘না। অন্যায়ের প্রতিবিধান করতেই আমরা ওদের সাহায্য করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
ড্রাইভারের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কপাল তার কুঞ্চিত।
আর কোন কথা বলল না সে।
আহমদ মুসা তখন অন্য কাজে মনোযোগ দিয়েছে। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে চাবি বের করে লাগেজে করে আনা ব্যাগটা টেনে নিয়ে খুলে ফেলল। বের করল প্লাষ্টিক কনটেইনার থেকে তার এম-১০ মেশিন রিভলবার।
প্লাষ্টিক কনটেইনারটি বিশেষভাবে তৈরি। ‘এক্সরে’ বা কোন ‘রে’ ফেললে এর ভেতরকার কিছু দেখা যায় না। ‘রে’ ফেললেই কনটেইনারটি আয়নার মত স্বচ্ছ একটা ছবি উপহার দেয়। এই কনটেইনারে করেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তাদের অস্ত্র নিয়ে এসেছে।
হাসান তারিকও তার অস্ত্র বের করে নিয়েছে।
এক জায়গায় এসে হঠাৎ ড্রাইভার হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাল।
‘কি হলো ড্রাইভার?’ বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘স্যার, ইঞ্জিন ট্রাবল দিচ্ছে। দেখছি আমি।’ বলে ড্রাইভার দ্রুত ষ্টার্টার থেকে চাবির রিং খুলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করে ইঞ্জিনের দিকে এগুলো। তারপর ইঞ্জিনের টপটা খুলে ফেলে দাঁড় করিয়ে দিল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তখন ব্যস্ত পেছনটা দেখতে।
পেছনে ছুটে আসা গাড়ি ৫টি কত দূরে আছে সেটা আন্দাজ করতে চেষ্টা করছিল।
বেশ সময় পার হয়ে গেল।
ইঞ্জিনের দিক থেকে কোন শব্দ না পেয়ে আহমদ মুসা সামনে তাকাল। কিন্তু ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করার কোন শব্দ সে শুনতে পেল না। তাছাড়া ড্রাইভারকেও দেখতে পেল না।
গাড়ির জানালা খুলে দেখার চেষ্টা করল আহমদ মুসা। কিন্তু গাড়ির জানালা খোলা গেল না। লক করা। দরজা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু দেখল দরজাও লক করা।
চমকে উঠল আহমদ মুসা।
দ্রুত সে এগিয়ে ড্রাইভারের দরজায় নব ঘুরাতে চেষ্টা করল। ঘুরল না।
‘হাসান তারিক, ড্রাইভার পালিয়েছে এবং সেই সাথে সে আমাদেরকে বন্দী করে রেখে গেছে।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
বিদ্যুতস্পৃষ্টের মত ঘুরল হাসান তারিক। বলল, ‘এ জন্যেই সে চাবি নিয়ে নেমে গেছে।’
আহমদ মুসা পেছনটা দেখে জানালার কোণা দিয়ে সামনের দিকটা দেখার চেষ্টা করে বলল, ‘হাসান তারিক, সামনে থেকেও দুটি গাড়ি আসছে। দুতিনশ গজের বেশি দূরে নয় ওরা। পেছনের পাঁচটা গাড়িও দুএকমিনিটের মধ্যে এসে পড়বে।’
‘তার মানে লক করা গাড়িতে আমরা বন্দী হয়ে পড়েছি।’ বলেই হাসান তারিক তার মেশিন রিভলবারটা তাক করল জানালা গুড়ো করে দেবার জন্যে।
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে দ্রুত বলল, ‘গুলী নয়, বাট দিয়ে ভেঙে ফেল। গুলীর শব্দ করে আমাদের অবস্থা ওদের জানাতে চাই না।’
হাসান তারিক মেশিন রিভলবারের বাঁট দিয়ে ভেঙে ফেলল জানালা।
ভাঙা জানালা দিয়ে ব্যাগগুলো আগে বাইরে ফেলে দিয়ে হাসান তারিক ও আহমদ মুসা বাইরে বেরিয়ে এল।
বের হয়েই আহমদ মুসা বলল, ‘যতদূর ধারণা করি উত্তর দিকে কিছু দূরেই সাগর আর দক্ষিণে পার্বত্য এলাকা পার হলে পাওয়া যাবে বনাঞ্চল, তারপর লোকালয়। কোন দিকটা আমরা বেছে নেব হাসান তারিক?’
‘আমার মতে দক্ষিণ দিক ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক গাড়ি ঘুরে গাড়ির দক্ষিন পাশে এসে দ্রুত রাস্তা থেকে নেমে একটা টিলার আড়াল নিয়ে দক্ষিন দিকে এগুলো।
দুদিক থেকে গাড়িগুলো তখন এসে পড়েছে।
আহমদ মুসাদের গাড়ির সামনে ও পিছনে দাঁড়াল ৭টি গাড়ির একটি বহর।
৭টি গাড়ি থেকে নামল ৪০ জনের একটি বিরাট দল। তাদের সাথে দুটি শিকারী কুকুর।
জীপ থেকে নেমে আসা দীর্ঘদেহী ঋজু শরীরের এবং উত্তেজিত চেহারার একজন লোক আহমদ মুসাদের গাড়ির ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে ভাঙা জানালা দেখে সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, ‘কোন দিকে গেছে দেখ। শয়তানদের কিছুতেই পালাতে দেয়া যাবে না।’
দুটি কুকুর ধরে রাখা দুজন লোক তাদের হাতের ইনভেলাপ থেকে দুখন্ড কাপড় বের করে কুকুর দুটিকে দিয়ে তা শুকিয়ে নিল এবং কুকুর দুটিকে বেঁধে রাখা দড়ির শেষ প্রান্ত ধরে রেখে পুরো দড়ি ছেড়ে দিল।
সংগে সংগেই কুকুর দুটি গাড়ি ঘুরে উত্তর পাশ থেকে দক্ষিণ পাশে গিয়ে ছুটতে শুরু করল দক্ষিণ দিকে। কুকুরের দড়ি ধরে রাখা লোক দু’জনও ছুটল তার সাথে। অবশিষ্ট আটত্রিশজনও তাদের পিছনে চলতে লাগল।
সেই লম্বা লোকটির নেতৃত্বে ওরা চলছে অস্ত্র বাগিয়ে জংগল যুদ্ধের ফরমেশন নিয়ে।
পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে পথহীন পার্বত্য ভূমির উপর দিয়ে আহমদ মুসারাও চলছিল।
পার্বত্য ভূমি চড়াই-উৎরাই, পাহাড়ের টিলা, খাড়া ও গভীর উপত্যকা এবং গাছ ও ঝোপ-জংগলে ভরা। পথ চলা খুব কঠিন। কিন্তু খুশি হলো আহমদ মুসা। এই পরিবেশে WFA-এর লোকরা তাদের খুঁজে পাবে না। আহমদ মুসা চিন্তা করল, তারা জংগলের দিকে না গিয়ে পুবে ‘লিজে’ শহরের দিকে হাঁটা শুরু করতে পারে। কিন্তু আবার ভাবল, শত্রুদের গতিবিধি সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে শহরমূখী হওয়া তাদের ঠিক হবে না।
প্রায় ১ ঘন্টা চলার পর একটা উচ্চভূমির উপর বসল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক।
উচ্চ ভূমিটা সমতল। ঝোপ ও বড় বড় গাছ-গাছড়ায় ভরা। বিশাল উচ্চ ভূমিটা পুরাকীর্তির কোন গড়ের মত। এই গড়টারই উত্তর প্রান্তে এসে বসেছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক। এখানে বসে পেছনে ফেলে আসা পার্বত্য অঞ্চলটার উপর চোখ রাখা যাচ্ছে। ওরা ফলো করছে না ফিরে গেছে এটা খুব জানা দরকার।
আহমদ মুসার এ চিন্তায় ছেদ পড়ল হাসান তারিকের কথায়। সে বলছিল, ‘ভাইয়া, আমরা কাক ডাকা ভোরে খালি পেটে বেরিয়েছি। খাবার বিষয়টাও আমাদের ভাবনায় রাখা যায়।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ হাসান তারিক। আমিও পেটকে বুঝাতে পারছি না। কিন্তু কি খাবে? ব্যাগের পকেটে আছে বিমান থেকে পাওয়া মাত্র কয়েকটা চকলেট।’
বলে আহমদ মুসা চকলেটগুলো বের করে হাসান তারিককে দিল, নিজেও নিল।
চকলেট মুখে দিয়ে হাসান তারিক বলল, ‘ভাইয়া বুঝতে পারছি না, সাত গাড়ি লোক গেল কোথায়! আমাদের ফলো না করে ওরা ফিরে যাবে এটা কি স্বাভাবিক?’
‘না, স্বাভাবিক নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা শেষ হতেই আহমদ মুসার কানে এল একটা অপ্রত্যাশিত শব্দ। একটা কুকুরের কণ্ঠ শব্দ তুলতে গিয়েও আকস্মিকভাবে রুদ্ধ হয়ে গেল।
চমকে উঠল আহমদ মুসা।
হঠাৎ একটা চিন্তা তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। ওরা কি কুকুর নিয়ে এগুচ্ছে? ওরা কি আহমদ মুসাদের দেখতে পেয়েছে? উৎসাহী কুকুরকে সামলাবার জন্যেই কি ঐভাবে তার মুখ চেপে ধরতে হয়েছে?
এই চিন্তা তার মাথায় আসার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘হাসান তারিক, তাড়াতাড়ি আড়াল নাও। সম্ভবত আমরা শত্রুর চোখে পড়ে গেছি।’
বলে আহমদ মুসা নিজেও দ্রুত গড়িয়ে উচ্চভূমির প্রান্ত থেকে একটু ভেতরে সরে এল।
হাসান তারিকও গড়িয়ে একটা ঝোপের আড়ালে চলে এসেছে।
আড়ালে এসেই হাসান তারিক ছুটে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘কি ব্যাপার ভাইয়া?’
‘আমি একটা কুকুরের অসমাপ্ত চিৎকার কানে শুনেছি। কেউ কুকুরের চিৎকারকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমাদের শত্রুরা কুকুরের দিক-নির্দেশনায় নিঃশব্দে আমাদের খুব কাছে এসে পৌছেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দুঃখিত, কুকুরের চিৎকারটা আমি খেয়াল করিনি। শব্দ কোন দিক থেকে এসেছে ভাইয়া?’ হাসান তারিক বলল।
‘উত্তর দিক। একদম এই সামনে থেকে। আমার মনে হয়, এই উচ্চভূমি যেখান থেকে উঠে এসেছে সে পর্যন্ত ওরা পৌছে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে ওরা এখন এই হাইল্যান্ডে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ হাসান তারিক বলল।
‘আমার মনে হয় কুকুরকে অনুসরণ করে আমাদের হাতের মুঠোয় পাওয়া পর্যন্ত ওরা নিরবে এগুবে এবং তারপর আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা কি করব এখন? আমরা কি আরও সামনে সরে যাব?’ হাসান তারিক বলল।
‘ওরা চায় আমাদেরকে ওদের টার্গেটের মধ্যে নিতে। আর আমরা চাইব ওদেরকে আমাদের টার্গেটের মধ্যে আনতে। এদিক থেকে আমরা যেখানে রয়েছি, সেটা আমাদের জন্যে ভালো জায়গা। আমাদের এ উচ্চভূমি থেকে যে ঢাল ওদের দিকে নেমে গেছে তা খুব ফ্ল্যাট এবং উন্মুক্ত। ছোট দুচারটা গাছ-গাছড়া ও ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। এই ঢালে তারা আত্মগোপনের কোন সুযোগ পাবে না এবং এই ঢাল দিয়েই তাদের উঠে আসতে হবে। পূর্ব দিকে উচ্চভূমির সাথে পাহাড় যুক্ত হয়েছে। ওদিক দিয়ে আসতে পারছে না। ঢাল ঘুরে পশ্চিম দিক হয়ে তাদের আসার কোন যুক্তি নেই। কারণ আমরা তাদের সম্বন্ধে জানতে পেরেছি এটা তারা জানে না এবং স্বাভাবিকভাবে কুকুর তাদের এই পথেই নিয়ে আসবে।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসান তারিক হাসল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাদের উপযুক্ত জায়গায় এনে ওদের মুখোমুখি করেছেন।’
আহমদ মুসা ঢালের প্রান্ত বরাবর এলাকা পর্যবেক্ষণ করে মাঝামাঝি জায়গায় একটা উঁচু স্থান দেখতে পেল। উঁচু জায়গাটা ঢালের একদম প্রান্তে বেদীর মত দেখতে এবং ওটা পরিকল্পিতভাবে তৈরি মনে হলো তার কাছে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক ক্রলিং করে গিয়ে উঠল সেই বেদিতে। আহমদ মুসারা বেদিতে উঠতেই বিরাট আকারের দুটি বড় সাপ বেদি থেকে নেমে গেল।
বিস্মিত হলো আহমদ মুসা, বেদির মেঝেটা পাথরের। পাথরের জোড়াগুলো দিয়ে গাছ-গাছড়া উঠে পাথরগুলো ঢেকে দিয়েছে। বেদির উপর দুটি পাথরের বাটি। বাটিগুলো ভেজা দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। চারদিকে চাইল।
বেদির উত্তর প্রান্তে অবস্থান নিল আহমদ মুসারা। তারা খুশি হলো যে, গোটা ঢালটাই তাদের নজরে আসছে। অবশ্য ঢালের পশ্চিম প্রান্ত দক্ষিণ দিকে বেঁকে গেছে বলে শেষটা দেখা যাচ্ছে না।
বেশিক্ষণ বসতে হলো না আহমদ মুসাদের। দেখা গেল, ঠিক তাদের সোজাসুজি জংগলের ভেতর থেকে ঢালের গোড়ায় উঠে এল দুজন লোক। তাদের সামনে দুটি কুকুর। কুকুর দুটির দড়ি তাদের হাতে। কুকুর দুটি ডবলমার্চের ভংগিতে দৌড়াচ্ছে।
কুকুর স্কোয়াডের পরই বেরিয়ে এল মূল বাহিনী। হাতে ষ্টেনগান, কোমরে পিস্তল সজ্জিত বিরাট একটা দল। সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০এর মধ্যে হবে বলে অনুমান করল আহমদ মুসা। রীতিমত যুদ্ধের আয়োজন। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মেশিন রিভলবার প্রস্তুত।
আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘ওরা ঢালের মাঝ বরাবর আসার আগে আমরা গুলী করব না।’
ওরা ঢালের মাঝ বরাবর এসে গেছে।
আহমদ মুসা তার এম-১০ মেশিন রিভলবার ডান হাতে রেখে বাম হাত দিয়ে পকেট থেকে আরও একটা রিভলবার বের করে ওদের মাথার উপর দিয়ে গুলী করল। সংগে সংগেই ওদের কয়েক ডজন ষ্টেনগান ও রিভলবার এক সাথে গর্জন করে উঠল আহমদ মুসার রিভলবারের শব্দ লক্ষ্যে। কিন্তু তাদের গুলীগুলো প্রায় ৪০ ডিগ্রী কোণে মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
ওদের গুলীর প্রথম ধাপ আহমদ মুসাদের অতিক্রম করার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মেশিন রিভলবার গর্জন করে উঠল এবং ঘুরতে লাগল দলটির উপর দিয়ে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। দলটির সবাই ভূমি শয্যা নিল।
কয়েকটি দেহ ঢাল বেয়ে গড়িয়ে জংগলে ঢুকে গেল।
অন্যগুলো নির্জীব পড়ে থাকল ঢালের উপর।
ঢাল থেকে দেহগুলো জংগলে গড়িয়ে যাবার পর পরই ওদিক থেকে আহমদ মুসাদের উচ্চভূমি লক্ষ্যে অনিয়মিত ব্যবধানে গুলী আসতে লাগল।
আহমদ মুসারা গুলী খরচ না করে অপেক্ষা করার নীতি অনুসরণ করল। ওখানে বসে গুলী করে ওদের লাভ নেই। সামনে এগুতেই হবে ওদের। সেই সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।
পল পল করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ওপার থেকে সেই অনিয়মিত গুলী একটানা চলছেই।
বিরক্তি ও বিস্ময় কিছুটা আচ্ছন্ন করেছে আহমদ মুসাকে। অর্থহীন ও অব্যাহত এই গুলীর অর্থ কি? এমন কি নিহত-আহতদের নিয়ে যাবারও ওরা চেষ্টা করছে না!
এ সময় আহমদ মুসাদের ঠিক পেছনে অনেকখানি উপরে শূন্য থেকে দুটি কারবাইন হ্যান্ড মেশিনগান গর্জন করে উঠল।
আকাশ থেকে পড়ার মত প্রবল শক খেয়ে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই পেছন ফিরে তাকাল।
২
বেদিতে উঠতে উঠতে ভ্যানিসা গনজালো বলল, ‘ভাইয়া, গত মাসে আমরা আসতে পারিনি। তাতেই দেখো মনে হচ্ছে বেদিটা জংগলে ভরে গেছে। এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না।’
সার্গিও গনজালোও বেদিতে উঠছিল ভেনিসার সাথে। বলল, ‘ভিয়েনীরা এসেছিল তো। মনে হয় ওরা বেদিটা পরিষ্কার করে যায়নি।’
‘তাই হবে। আজ আমাদের সংগ্রামের শক্তিরা দুধ খেয়ে যাবার পর আমরা বেদিটা পরিষ্কার করব ভাইয়া’। বলল ভ্যানিসা গনজালো।
‘আমিও তাই ভাবছি।’ বলল সার্গিও গনজালো।
দুজনেই উঠল বেদিতে।
দুজনের হাতেই দুটা কারবাইন শ্রেণীর ক্ষুদ্র সাবমেশিনগান। দুজনেই হাতের সাবমেশিনগান কাঁধে ঝুলিয়ে কাঁধের থলে থেকে বের করল প্লাষ্টিকের একটা পট। পটের মুখ খুলতে খুলতে ওরা দুজনে গেল বেদির মাঝখানে রাখা দুটো পাথরের বড় বাটির দিকে। পটের মুখ খুলে ওরা দুজন পাথরের দুই বাটিতে পটের সবটুকু দুধ ঢেলে দিল।
পটের মুখ বন্ধ করে কাঁধের ঝুলানো ব্যাগে রেখে দুজনেই কাঁধ থেকে সাবমেশিনগান হাতে নিল এবং দুজনেই সাবমেশিনগানের ব্যারেল বাটির দুধে ডোবাল। তারপর আবার সাবমেশিনগান কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত নেমে এল বেদি থেকে।
দুজনেরই পরনে ফুল সামরিক পোশাক। কাঁধের সাবমেশিনগান ছাড়াও ওদের কোমরে একদিকে ঝুলানো রিভলবার, অন্যদিকে খাপবদ্ধ ছুরি।
দুজনের মাথায় সামরিক টুপি।
দুজনে ওরা ভাই বোন। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা। এ কারণেই পতুর্গীজ আইনে গনজালো বংশ বিদ্রোহী পরিবার। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের পর্তুগীজ আইন ও পুলিশ এই পরিবারের সন্ধানে সর্বক্ষণ পই পই করে ঘুরছে।
বেদি থেকে নেমে সার্গিও এগোচ্ছিল দক্ষিণ দিকে।
ভ্যানিসা গনজালো বলল, ‘ভাইয়া, বেদিটা গাছ-গাছড়ায় ছেয়ে গেছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে বেদিতে আমাদের অতিথিদের আসা-যাওয়া দেখি, সেখান থেকে আজ বেদির কিছুই দেখা যাবে না।’
‘তাহলে।’ থমকে দাঁড়িয়ে বলল সার্গিও গনজালো।
‘চল এই গাছটায় উঠে যাই। ওখান থেকে ভালো করে দেখতে পাব।’ বলল ভ্যানিসা গনজালো।
‘ঠিক, ভ্যানিসা গাছে ওঠা যায়। সব ভালো করে দেখা যাবে। কিন্তু তুমি গাছে উঠতে পারবে তো?’ সার্গিও গনজালো বলল।
‘কি বলছ ভাইয়া। তুমি কি নতুন হলে নাকি?’ বলল ভ্যানিসা গনজালো।
‘ঠিক আছে। চলো।’ বলে সার্গিও গনজালো গাছের দিকে এগোলো।
বেদির পুবপাশে একটা উঁচু গাছে তারা উঠে বসল। ওখান থেকে উচ্চভূমির বিরাট এলাকাসহ উত্তর দিকে নেমে যাওয়া ঢালকেও পরিষ্কার দেখা যায়।
ওরা বেদিকে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী হয়ে বসল।
তারা গাছে উঠে বসার পর দশ মিনিটও গেল না। পূব দিক থেকে এক জোড়া দীর্ঘ সাপ এক সাথে এসে বেদিতে উঠল। এগুলো তারা দুধ ভর্তি পাথরের বাটির দিকে। সাপ দুটি দুবাটি থেকে দুধ খাওয়া শুরু করল।
গাছে বসে দুভাইবোন সার্গিও ও ভ্যানিসা আনন্দের সাথে দেখছিল এই দৃশ্য। দৃশ্যটা দেখতে দেখতে সার্গিও গনজালো বলে উঠল, ‘আমাদের চার পুরুষ সাপেরও চার পুরুষ ধরে এই দৃশ্য এভাবেই দেখে হয়ে আসছে। এই সাপরা আমাদের শক্তি ছাড়া, সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের প্রতীক।’
‘কিন্তু ভাইয়া, সাপের অব্যর্থ ছোবলের মত আমরা শত্রুর উপর অব্যর্থ আঘাত হানতে পারছি কই? আমরা এগুতে পারছি না কেন?’ বলল ভ্যানিসা।
সার্গিও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ভ্যানিসার চোখ ঢালের উপর পড়তেই ভূত দেখার মত চমকে উঠে সার্গিওর মুখ চেপে ধরে বলল, ‘ঢালের দিকে দেখ ভাইয়া।’
সংগে সংগেই সার্গিও চোখ ফেরালো ঢালের দিকে।
দেখলো দুজন লোক পাশাপাশি ঢাল বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে।
ভ্রুকুঞ্চিত হলো সার্গিও গনজালোর। ফিস ফিস করে বলল ভ্যানিসাকে, ‘দুজনের কেউ এদেশের নয়, ইউরোপেরও নয়।’
‘তাহলে কোথাকার?’
‘এশিয়ান মনে হচ্ছে ভ্যানিসা আমার কাছে।’
‘তাহলে ওরা আমাদের শত্রু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ভাইয়া দুজনের হাতেই তো মেশিন রিভলবার?’
‘আসলেই এশিয়ানরা আমাদের শত্রু হবার কথা নয়। কিন্তু ওরা যেহেতু অস্ত্রধারী সেহেতু শত্রু হতেও পারে। আর ওদের চলার ভংগি দেখে মনে হচ্ছে অস্ত্র তারা কারো না কারো বিরুদ্ধেই বহন করছে। তাদের সেই শত্রু কে? আমরাও হতে পারি। আর আমাদেরই রাজ্যের মধ্যে এখন ওরা।’ বলল সার্গিও।
লোক দু’জন তখন উচ্চভূমির প্রান্তে উঠে এসেছে। বসল তারা। কিন্তু উন্মুক্ত জায়গায় না বসে ছোট গাছ-গাছড়ার মধ্যে বসল।
নিচু কণ্ঠে তারা কথা বলছিল। মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছিল ঢালের দিকে। হঠাৎ এক সময় তারা নিচের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দ্রুত গড়িয়ে উচ্চভূমির প্রান্ত থেকে কিছুটা ভেতরে গাছ-গাছড়ার আরও আড়ালে সরে এল।
উৎকর্ণ হয়ে উঠল সার্গিও। বলল ফিসফিস করে, ‘নিচে উপত্যকায় মনে হয় কুকুরের চিৎকার শুনলাম। মনে হয় ওরা দুজনও শুনতে পেয়েছে কুকুরের চিৎকার। এ জন্যেই গড়িয়ে ওরা আরও আড়ালে সরে এল। নিশ্চয় ওরা কারো তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসছে এবং তাড়াকারীরা নিচের উপত্যকায় পৌছে গেছে।’
‘কিন্তু ভাইয়া এদের চোখে-মুখে তো পলাতকদের মত ভয় ও উদ্বেগ নেই!’ বলল ভ্যানিসা।
‘তা ঠিক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তারা পলাতক নয়।’ সার্গিও বলল।
ওরা এ সময় দেখল, লোক দু’জন বেদির দিকে এগুচ্ছে।
আঁৎকে উঠল ভ্যানিসা। ফিসফিস করে বলল, ‘ভাইয়া, আমাদের মেহমান সর্পরাজরা তো এখনও বেদিতে!’
‘আমরা দর্শক, যা ঘটবে তা ঘটতে দাও। পাপ করলে পাপের সাজা ওদের পেতে হবে।’ বলল সার্গিও।
লোক দুজন তখন বেদিতে উঠছিল।
সার্গিও ও ভ্যানিসা বিস্ময়ের সাথে দেখল, সাপ দুটি বেদির দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে সারি বেধে নেমে চলে গেল।
তাদের বিস্ময়ের বড় কারণ হলো, প্রতিদিন সাপ দুটো দুধ খাওয়ার জন্য যেমন বেদিতে উঠে আসে পূর্ব প্রান্ত দিয়ে দুধ খাওয়ার পর নেমেও যায় তেমনি পূর্ব প্রান্ত দিয়ে। কিন্তু আজ প্রথমবার ওরা নামল দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে।
তার মানে তাদের মেহমান সাপ দুটো আপোশ করল লোক দুজনের সাথে, ভাবল সার্গিও। লোক দুজন বেদিতে উঠার আগেই যেমন সাপ দুটো চলে গেল, তেমনি ভিন্ন রাস্তা দিয়ে গেল একই রাস্তা ব্যবহারের সংঘাত এড়িয়ে।
‘ভাইয়া, কি বুঝলে?’ বলল ভ্যানিসা।
‘বুঝলাম, এ দুজন আমাদের শত্রু নয়, বা আমাদের জন্যে ক্ষতিকর নয়।’ বলল সার্গিও।
‘আমারও তাই মত। আর ওদের দুজনের চেহারা কোনও ভাবেই ক্রিমিনালের মত নয়। নিরীহ, নিষ্পাপ ভদ্রলোক বলেই ওদের মনে হয়।’ বলল ভ্যানিসা।
কথা শেষ করেই ভ্যানিসা আবার চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া দেখ, ওরা দুজন ওদের মেশিন রিভলবার বাগিয়ে যুদ্ধের পজিশন নিয়ে বসে আছে।’
সাপ দুটো ঠিক পথে গেল কিনা দেখছিল সার্গিও। ভ্যানিসার কথায় সে মুখ ফিরাল, দেখল, লোক দুজন বেদির উত্তর প্রান্তে গাছ-গাছড়ার আড়াল নিয়ে ঢালের দিকে তাদের রিভলবার তাক করে বসে আছে।
এক মিনিটও পার হলো না।
নিচের উপত্যকার জংগল থেকে দুটি কুকুর নিয়ে ষ্টেনগানধারী দুজন লোক বেরিয়ে এল। তারা উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।
তাদের পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ জনের বিশাল বাহিনী। প্রত্যেকের হাতেই উদ্যত ষ্টেনগান। মনে হচ্ছে একদল যোদ্ধা এগুচ্ছে যুদ্ধের জন্যে।
‘তাহলে ওরাই তাড়া করে নিয়ে আসছে এ দুজনকে?’ বলল ভ্যানিসা ফিসফিস করে সার্গিওর উদ্দেশ্যে।
‘ভাবছি, এ দুজন বিদেশী। কিন্তু ওরা কারা? কি নিয়ে এই লড়াই?’ ধীরে ধীরে চাপা কণ্ঠে বলল ভ্যানিসা।
‘দূর থেকে দেখে যতটা বুঝা যাচ্ছে, তাতে সবাইকেই তো এদেশী বলে মনে হচ্ছে।’ বলল সার্গিও।
লোক দুজন রিভলবার বাগিয়ে বসে আছে। আর ওরা ঢাল বেয়ে উঠে আসছে।
‘দুই রিভলবার দিয়ে ওদের সাথে কিভাবে এরা লড়াই করবে, এরা এতদূর পালিয়ে এল, কিন্তু এখন আবার রুখে দাঁড়াল কেন?’ ভ্যানিসা বলল।
‘এদের ষ্ট্রাটেজিক জ্ঞান খুব টনটনে ভ্যানিসা। এরা খুবই সুবিধাজনক অবস্থান বেছে নিয়েছে। এ রকম জায়গা এদের সামনেও ছিল না, পেছনেও নেই।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু এরা এভাবে বসে কেন? ওদের এগুতে দিচ্ছে কেন?’ চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ভ্যানিসা।
ওরা তখন ঢালের মাঝামাঝি জায়গায় বসে আছে।
ওদের দিকে তাক করে বসা এদের একজন এ সময় ওদের দিকে একটা ফাঁকা গুলী করল সাধারণ রিভলবার থেকে। উত্তরে ওরা সংগে সংগে একসাথে গুলী বৃষ্টি শুরু করল বেদি লক্ষ্যে। এরাও বেদির উপর শুয়ে পড়ে তাদের দুই মেশিন রিভলবারের ট্রিগার টিপে ওদের উপর ঘুরিয়ে নিতে লাগল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ওদিক থেকে গুলী ছোড়া বন্ধ হয়ে গেল। ঢালে আর কাউকেই দাঁড়ানো দেখা গেল না।
ওদিকের গুলী বন্ধ হলে এরাও গুলী ছোড়া বন্ধ করে দিল এবং উঠে বসল বেদির উপর।
‘কি আশ্চর্য, ওরা কি সবাই মরে গেল?’ প্রশ্ন তুলল ভ্যানিসা।
‘বলেছিলাম না ভ্যানিসা। এরা খুব কুশলী। উপযুক্ত জায়গা বেছে নিয়েছে। আবার ওদের নিয়েও এসেছে ঢালের মাঝখানে, তারপর আক্রমণ করেছে। যাতে পালাতে না পারে।’ সার্গিও বলল।
‘না ভাইয়া, এরা প্রথম আক্রমণ করেনি। ঢাল থেকে ওরাই প্রথম আক্রমণ করেছিল। কিন্তু ভাইয়া, এরা ঐ একটা ফাঁকা গুলী কেন করেছিল?’
‘ঠিক জানি না। হতে পারে ওদেরকে প্রথমে আক্রমণে আনা অথবা হটিয়ে দেয়ার জন্যে।’
‘ওদেরকে এরা আক্রমণে আনতে চাইবে কেন?’ আবার জিজ্ঞাসা ভ্যানিসার।
‘আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না ভ্যানিসা।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু এরা এখন কিসের অপেক্ষা করছে। ঢালে তো এখন নেমে যেতে পারে। যুদ্ধ জয় তো হয়েই গেছে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘বোধ হয় এরা আশংকা করছে, উপত্যকায় ওদের শত্রু পক্ষের লোক আরও আছে।’ সার্গিও বলল।
কিছু বলতে গিয়েও তার মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না। সে দেখল, পশ্চিম দিক থেকে দুজন ষ্টেনগানধারী বেদির পেছন পর্যন্ত এসে পৌছেছে।
ভ্যানিসা চাপা কণ্ঠে দ্রুত বলল, ‘ভাইয়া, বেদির পেছনে।’
সার্গিও তাকিয়েছিল ঢালের দিকে। সে তাড়াতাড়ি মুখ ঘুরাল বেদির পেছনে। দেখতে পেল দুজন ষ্টেনগানধারীকে। তাদের ষ্টেনগানের ব্যারেল তখন লোক দুটিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে।
দেখেই চাপা কণ্ঠে ‘ভ্যানিসা……..’ বলতে বলতেই সার্গিও তার কারবাইনের ট্রিগার চেপে ধরল ঐ দুজন ষ্টেনগাধারীর লক্ষ্যে।
ভ্যানিসাও আগেই তার কারবাইন ঘুরিয়ে নিয়েছিল। সার্গিওর সাথে তারও কারবাইন গর্জন করে উঠেছিল।
দুজন ষ্টেনগানধারীর ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ ঝরে পড়ল মাটিতে।
সার্গিও ও ভ্যানিসা দেখল সেই লোক দুজন প্রথমেই গাছে চড়ে থাকা তাদের দিকেই ফিরে তাকিয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে তাদের দৃষ্টি ঘুরে গেল বেদির পেছনে পড়ে থাকা লাশ দুটির দিকে। তারা বেদির দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে লাশ দুটিকে দেখল। আবার তাদের চোখ উঠে এসে নিবদ্ধ হলো সার্গিওদের উপর।
লোক দুজনের একজন আহমদ মুসা, সার্গিওদের উদ্দেশ্যে পর্তুগীজ ভাষায় বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনারা দুজনকে হত্যা করে আমাদের দুজনের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। অথচ আপনারা ওদের কিংবা আমাদের কাউকেই চেনেন না।’
সার্গিওরা নেমে এল। সার্গিও বলল আহমদ মুসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ‘আমরা ওদেরকে বা আপনাদেরকে চিনি না বটে। কিন্তু আক্রমণকারী কে আর আক্রান্ত কে তা আমরা দেখেছি। আমরা আক্রান্তকে সাহায্য করেছি।’
‘অপরাধী আক্রমণকারীরা হয়, কিন্তু আক্রান্তরাও হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তা হতে পারে। তবে আমাদের সে ভুল হয়নি, আপনার কথায় নিশ্চিত হলাম।’ বলল সার্গিও।
‘ধন্যবাদ। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল আপনারা যেন স্বর্গের দূত। আমাদের রক্ষার জন্যে দয়া করে ঈশ্বর আপনাদের পাঠিয়েছেন। আমার বিস্ময় এখনও যায়নি। এখানে আপনারা এলেন কি করে? দয়া করে আপনাদের পরিচয় দেবেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি সার্গিও গনজালো।’ বলল সার্গিও। তারপর ভ্যানিসাকে দেখিয়ে বলল, ‘এ আমার সহোদরা ছোট বোন ভ্যানিসা গনজালো। আমরা এ এলাকার। এর বেশি কিছু বলার আগে আপনারা কে তা আমাদের জানা প্রয়োজন।’
‘আমরা বিদেশী। লিজে বিমান বন্দরে নামার পর যাচ্ছিলাম ‘গঞ্জালেস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে’ থাকার জন্যে।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর হোটেলের পথে তাদের কিডন্যাপ এবং হত্যা প্রচেষ্টাসহ গাড়ির জানালা ভেঙে তাদের পলায়নের সব কথা খুলে বলল।
‘আপনারা বিদেশী। আপনাদের সাথে ওদের শত্রুতা কেন? ওরা কারা?’ বলল ভ্যানিসা।
‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’ (WFA) এর সাথে আপনাদের পরিচয় আছে?’ আহমদ মুসা সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
উত্তরে সার্গিও বলল, ‘পরিচয় নেই, তবে জানি আমরা ঐ সংগঠনকে। সংগঠনটা চরম ইহুদীবাদী। গোটা দুনিয়া দখলের দুঃস্বপ্ন ওদের। আজর ওয়াইজম্যান ওদের নেতা।’
‘ধন্যবাদ মি. সার্গিও। আপনারাতো দেখছি ওদের অনেক কিছুই জানেন। ওদের…….।’ আহমদ মুসার কথা সমাপ্ত হতে পারলো না।
আহমদ মুসাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সার্গিও আবার বলে উঠল, ‘আজোরসের পর্তুগীজ গভর্নর ‘পেড্রো’র স্ত্রী ‘ক্রিষ্টিন করণিকা’ ইহুদী। এই সুবাদে WFA এখানে ব্যাপক সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু আপনাদের সাথে WFA এর শত্রুতা কিসের? আপনাদের পরিচয় কিন্তু বলেননি।’
আহমদ মুসা একটু ভাবল। তারপর মুখ তুলল সার্গিওর দিকে। গভীর দৃষ্টিতে একবার সে দেখল সার্গিওকে।
উত্তর দিতে কিছু দেরি হলো আহমদ মুসার।
হাসল সার্গিও। বলল, ‘বুঝেছি, বিশ্বাস করতে পারছেন না আমাদের।’
আহমদ মুসা সলজ্জ হাসল। বলল, ‘স্যরি, এটা অবিশ্বাস নয়, সতর্কতা। বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা সবাইকেই করতে হয়। যেমন আপনারাও আপনাদের সবটা পরিচয় আমাদের কাছে দিতে পারেননি।’
আবার হাসল সার্গিও। বলল, ‘কিছু পরিচয় আমরা গোপন রেখেছি বলে কি আপনি মনে করেন?’
ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার। বলল, ‘আপনারা ব্যক্তি পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু দলীয় বা সাংগঠনিক একটা পরিচয় আপনাদের আছে সেটা দেননি।’
‘কি করে বুঝলেন আমাদের একটা সাংগঠনিক পরিচয়ও আছে?’ গম্ভীর কণ্ঠস্বর সার্গিওর।
‘আপনাদের ইউনিফরম ব্যক্তিগত নয়, নিশ্চয় কোন দল বা সংগঠনের। বিশেষ করে আপনাদের ইউনিফরমের বুকে উদীয়মান সূর্যের আলোকস্নাত আজোরস দ্বীপপুঞ্জের যে ইনসিগনিয়া সেটা ব্যক্তিগত নয় অবশ্যই। আপনাদের কারবাইনেও ঐ একই ইনসিগনিয়া আমি দেখতে পেয়েছি। এর অর্থ এই অস্ত্রগুলোও আপনাদের ব্যক্তিগত নয়।’
সার্গিও ও ভ্যানিসার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। তাদের দুজনেরই গভীর বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। বলে উঠল সার্গিও গম্ভীর কণ্ঠে, ‘আপনাদের পরিচয়ের ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু এখন আপনার পরিচয় জানার কৌতূহল দমন করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। এ রকম সুক্ষ ও সার্বিক দৃষ্টিওয়ালা লোককে আমি শার্লক হোমস-এর বইতে দেখেছি, আর আজ আপনাকে জীবন্ত দেখলাম। অতএব এখন আপনার পরিচয় জানতেই হবে। তার আগে আমাদের ছোট্ট পরিচয়টা বলছি।’
বলে একটু থামল সার্গিও। একটু মাথা নিচু করল। মাথা তুলল পরক্ষণেই এবং বলা শুরু করল, ‘ইনসিগনিয়ার উদীয়মান সূর্যটা স্বাধীনতার সূর্য। আমরা চাই আমাদের গোটা আজোরস স্বাধীনতা সূর্যের সোনালী আলোক ধারায় সণাত হোক। আমাদের সংগঠেনর নাম……….’
সার্গিও’র মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আজোরস ইনডিপেনডেন্ট পিপল’ (AIP)।
হাসল সার্গিও। বলল, ‘আমি বিস্মিত হলাম না। কারণ আপনি নতুন এক শার্লক হোমস। অতএব আজোরস দ্বীপপুঞ্জের স্বাধীনতা সংগ্রামের নাম জানা আপনার জন্যে বড় কথা নয়।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘আজোরস ইনডিপেনডেন্ট পিপল (AIP) -কে নেতৃত্ব দিচ্ছে আজোরস দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কারক এবং এখানে প্রথম বসতিস্থাপনকারী গনজালো পরিবার। আমরা সেই ‘গনজালো’ পরিবারের সদস্য। আমার বড়ভাই রিকার্ডো এখানকার পর্তুগীজ সরকারের হাতে বন্দী হবার পর আমি আন্দোলনকে দেখাশূনা করার দায়িত্ব পালন করছি।’ থামল সার্গিও।
থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আমাদের সব কথা বলেছি। এবার আপনাদের কথা বলুন।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাদের কথা খুব বেশি নয়। WFA কিছু লোককে এই দ্বীপপুঞ্জের কোন এক দ্বীপে বন্দী করে রেখেছে। আমরা এসেছি তাদের উদ্ধার করতে।’
‘বন্দী করেছে তারা কারা?’ জিজ্ঞাসা ভ্যানিসার।
‘ওরা কয়েকজন একটি গোয়েন্দা ফার্মের কর্মকর্তা। ওদের গোয়েন্দা ফার্ম WFA ধ্বংস করে দিয়েছে এবং তার ৭ জন কর্মকর্তাকে কিডন্যাপ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সেই ফার্ম কি ফ্রান্সের ষ্ট্রাসবার্গের স্পুটনিক?’ বলল ত্বরিত কণ্ঠে ভ্যানিসা।
‘হ্যাঁ, তুমি জানলে কেমন করে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘আমি ঐ সময় ফ্রান্সে ছিলাম। লা-মন্ডেতে ঐ নিউজ আমি পড়েছি। স্পুটনিকের গোয়েন্দারা দেড় যুগ আগের নিউইয়র্কের টুইন-টাওয়ার ধ্বংসের কার্যকরণ অনুসন্ধান করছিল।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিন্তু WFA এই গোয়েন্দাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও গোয়েন্দাদের কিডন্যাপ করল কেন?’ ভ্যানিসা থামতেই বলে উঠল সার্গিও।
‘আপনার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে, ‘ঠাকুর ঘরে কেরে, আমি কলা খাইনি’ এই প্রবাদ প্রযোজ্য।’
বিস্ময় ফুটে উঠল সার্গিওর চোখে-মুখে। বলল, ‘তার মানে WFA টুইন টাওয়ার ধ্বংসের তদন্ত বানচাল করার জন্যে স্পুটনিক ধ্বংস করেছে এবং তার ৭ গোয়েন্দাকে কিডন্যাপ করেছে?’
‘ওদের ভূমিকা তো তাই প্রমাণ করছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরও একটা মজার খবর আছে, যেদিন স্পুটনিক ধ্বংস হয়, তার একদিন পর ইসরাইল রেডিওর দেশরক্ষা বিভাগের একটা সমীক্ষায় মন্তব্য করা হয় যে, ‘স্পুটনিকের সব কাজের মধ্যে একটা সাম্প্রদায়িক লক্ষ্য আছে। দেড় যুগেরও বেশি পর তারা টুইন টাওয়ার ধ্বংস নিয়ে যে কাজ করছে, তাও সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের ভীষণ একগুয়েমি এবং বর্তমান মার্কিন সরকারের প্রশ্রয়েই টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মত ডেড ইস্যু নিয়ে স্পুটনিক কাজ করার সুযোগ পেয়েছে।’ মার্কিন সরকারও স্পুটনিকের যোগসাজসে পরিচালিত এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেককে রুখে দাঁড়াবার জন্যে আহবান জানায়।’ বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ, ইসরাইল সরকারের এই প্রতিক্রিয়াও প্রমাণ করছে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের বিষয়ে কোন কার্যকর তদন্ত হোক তা তারা চায় না। এই না চাওয়ার অর্থ এই ধরা যায় যে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সাথে সংশিস্নষ্ট কোন সত্য তারা গোপন করতে চায়।’ সার্গিও বলল।
‘হ্যাঁ, স্পুটনিক ধ্বংস হওয়া এবং তার গোয়েন্দারা কিডন্যাপ হওয়ার এটাই কারণ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনারা কি স্পুটনিকের লোক?’ জিজ্ঞাসা সার্গিওর।
‘না, আমরা স্পুটনিকের লোক নই। আমরা স্পুটনিকের শুভাকাংখী। এতবড় অন্যায়ের প্রতিবিধান হওয়া উচিত বলেই আমরা কাজে নেমেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার তাহলে কে?’ জিজ্ঞেস করল ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা একটু হাসল। হাসান তারিককে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি ফিলিস্তিন বিপ্লবের একজন নেতা। এখন ফিলিস্তিন সরকারের একজন উপদেষ্টা। নাম হাসান তারিক।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। থেমেই আবার বলল, ‘আর আমার নাম আহমদ মুসা। হাসান তারিকের মত আমার বিশেষ কোন পরিচয় নেই।’
‘আহমদ মুসা’ নাম শুনে সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেরই কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠল। চোখে-মুখে ফুটে উঠল প্রবল জিজ্ঞাসা। ভ্যানিসাই প্রথম কথা বলে উঠল, ‘কোন আহমদ মুসা? এই ক’দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুরিনামে যাকে নিয়ে মহা হৈ চৈ হয়ে গেল সেই আহমদ মুসা?’ ভ্যানিসার কণ্ঠস্বর দ্রুত। যেন এক মুহূর্তেই সব কথা বলে ফেলতে চায়।
আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠল হাসান তারিক। বলল, ‘হ্যাঁ, উনি সেই আহমদ মুসা। তবে হৈ চৈ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও সুরিনামে নয়, চীন, রাশিয়া, ককেশাস, ফ্রান্স, ফিলিস্তিন সব জায়গাতেই একটা করে ভূমিকম্প ঘটিয়েছেন তিনি।’
হাসান তারিক থামতেই সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেই কোমর বাঁকিয়ে সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে আহমদ মুসাকে বাউ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা চালু ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল।
থেমে গেল সার্গিও ও ভ্যানিসা। উৎকর্ণ হয়ে উঠল তারা।
আহমদ মুসাও উৎকর্ণ হয়ে উঠেছিল। মুহূর্ত কয়েক কান পেতেই সে বলে উঠল, ‘দুটি হেলিকপ্টার আসছে এদিকে। আমার ধারণা মিথ্যা না হলে ওরা এখানেই ল্যান্ড করবে।’
বিস্ময় ফুটে উঠেছে সার্গিও ও ভ্যানিসার চোখে-মুখে। বলল সার্গিও, ‘কেন আসবে হেলিকপ্টার, কার হেলিকপ্টার? আমি তো জানি WFA-এর কোন হেলিকপ্টার নেই।’
‘ঠিক করে বলা মুষ্কিল। তবে আমি আন্দাজ করছি, WFA হেলিকপ্টার ভাড়া করেছে তার প্রেরিত বাহিনীর খোঁজ নেবার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হেলিকপ্টারগুলো পুলিশের বলে মনে করছেন না কেন? WFA পুলিশকে বলে পুলিশের সাহায্য নিতে পারে। আমার মনে হয়, যে দু’জন লোক পেছন থেকে আক্রমণ করার জন্যে উপরে উঠে এসেছিল, তারাই মোবাইলে জানিয়ে দিয়েছিল তাদের বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবার কথা।’ বলল সার্গিও।
‘আমি WFA-কে যতটা জানি তাতে বলতে পারি, তারা এক্ষেত্রে পুলিশের সাহায্য নেবে না। এমনকি এতবড় ম্যাসাকারের কথা তারা পুলিশের কাছ থেকে গোপন করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন?’ বলল সার্গিও।
‘প্রথম কারণ, WFA তার এতবড় বিপর্যয় ও দুর্বলতার কথা পুলিশকে জানাতে চাইবে না। দ্বিতীয় কারণ, এ ধরনের বড় খুন-খারাবির কথা জানতে পারলে আইন-শৃঙ্খলার কারণেই পুলিশ WFA-এর কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে বা তাদের উপর চোখ রাখতে পারে, এমন আশংকা করতে পারে WFA’রা।’ আহমদ মুসা বলল।
সার্গিও ও ভ্যানিসা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। ধীরে ধীরে তাদের চোখে ফুটে উঠল মুগ্ধ দৃষ্টি। বলল সার্গিও, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনার চিন্তাই ঠিক।’
বাক্যটা শেষ করেই মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘এখন করণীয় কি, ঠিক করা দরকার। আমি মনে করি, হেলিকপ্টারগুলো যদি WFA-এরই হয়ে থাকে, তাহলে ওগুলো ল্যান্ড করার আগেই ধ্বংস করে দিতে পারি।’
‘না মি. সার্গিও, আমরা যা বলছি সবই অনুমান। নিশ্চিত না হয়ে এতবড় পদক্ষেপে যাওয়া ঠিক হবে না। এমনও তো হতে পারে, পুলিশে ইনফরমেশন দিয়ে তাদের জ্ঞাতসারে এই হেলিকপ্টার দুটি পাঠাচ্ছে WFA, অথবা এই হেলিকপ্টারে দুএকজন পুলিশকেও তারা পাঠাচ্ছে। আমরা যদি হেলিকপ্টার ধ্বংস করি, আর যে দুটি বিকল্পের কথা আমি বললাম, তার যে কোন একটি যদি সত্য হয়, তাহলে পুলিশের সাথে সংঘাত আমাদের অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। আমরা এই সংঘাত এখন এড়াতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
হাসল সার্গিও। বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। আহমদ মুসার কথার পর আর কোন কথা চলে না। এখন বলুন আমাদের কি করণীয়। হেলিকপ্টারগুলো এসে পড়ল বলে।’
‘এই উচ্চভূমির পাশে এমন কোথাও আমাদের আত্মগোপন করে অপেক্ষা করতে হবে, যেখান থেকে এই উচ্চ ভূমিটা দেখা যায়। ওদের এ ধারণা দিতে হবে যে, সংঘাতের পরেই এ স্থান ছেড়ে আমরা অন্য কোথাও চলে গেছি।’
‘এর দ্বারা আমরা কি অর্জন করতে চাচ্ছি?’ জিজ্ঞাসা সার্গিওর।
‘নিরর্থক এই সংঘাত এড়ানোর চেষ্টা করা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিরর্থক কেন?’ ভ্যানিসা জিজ্ঞেস করল।
‘এ সংঘাতে আমাদের জড়ানোর মধ্যে ওদের লক্ষ্য হলো আমাদের ক্ষতি করা, ধ্বংস করা। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ওদের ধ্বংস করা নয়, আমাদের বন্দী লোকদের উদ্ধার করা। আমরা এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে আমাদের লক্ষ্য অর্জন জটিলতর হবে। দ্বিতীয়ত, আমি চাই না এ সংঘাতে আপনারা আমাদের সাথে আছেন এটা কোনওভাবে তাদের জানার সুযোগ হোক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন চান না?’ ভ্যানিসাই আবার জিজ্ঞেস করল।
‘নতুন শত্রু সৃষ্টি করা আপনাদের ঠিক হবে না। আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য WFA এখন কোন প্রত্যক্ষ শত্রু নয়, কিন্তু আমাদের হয়ে ওদের সাথে সংঘাতে নামলে আপনারাও শত্রু হয়ে যাবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় ফুটে উঠেছে সার্গিও ও ভ্যানিসার চোখে-মুখে। বলল সার্গিও, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আপনি এর মধ্যেই এতটা ভাবছেন! যে লাভ-ক্ষতির কথা আমাদের মাথায় আসেনি, সেটাও আপনার ভাবনার বিষয়!’
বলে একটু হাসল সার্গিও। হাসিটার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠল তার হৃদয়ের একরাশ বিমুগ্ধতা। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘পরকে আপনি এত আপন করে ভাবতে পারেন বলেই আপনি এত বড়, আপনার এত সাফল্য আহমদ মুসা। এমন মানুষের কাছেই মানুষ তার সবকিছু হারিয়ে বসতে পারে।’ আবেগ-কম্পিত কণ্ঠ ভ্যানিসার।
ভ্যানিসা থামতেই আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে বলে উঠল, ‘ওরা আরও কাছে এসে গেছে, আমাদের এখনি সরতে হবে।’
কিন্তু সার্গিও আহমদ মুসার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে ধীরে ধীরে বলে উঠল, ‘এতদিন আমরা ভেবে এসেছি, যত পার শত্রুকে মার, তাতেই লাভ। কিন্তু আজ আপনার কাছে শিখলাম, লক্ষ্যকেই বড় করে দেখতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয় না বা লক্ষ্য অর্জনকে জটিল করে তোলে এমন সংঘাত, হত্যাকান্ড অনর্থক, তাকে অবশ্যই এড়াতে হবে। এটা যে কত বড় শিক্ষা! ধন্যবাদ আপনাকে মি. আহমদ মুসা।’
‘লক্ষ্যকে বড় করে দেখার অর্থ কিন্তু আবার এই নয় যে, লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে। লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক নয় এমন অনর্থক কিংবা ক্ষতিকর সংঘাত সংঘর্ষ যেমন পরিত্যাজ্য, তেমনি নিছক লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে হলেও অযৌক্তিক ও অন্যায় হয় এমন কোন কাজ বা ঘটনাও ঘটানো যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আপনাদের WFA এবং আমাদের ক্ষেত্রে পর্তুগীজ সরকার কি এই নীতিবোধ মানছে?’ জিজ্ঞেস করল সার্গিও।
‘তাদের লক্ষ্যই যেখানে অবৈধ, সেখানে তাদের পন্থার বৈধতা নিয়ে আলোচনা চলে না। কিন্তু আমার আপনার লক্ষ্য মহৎ, কোন অবৈধ পথ ও পন্থার ক্লেদ দিয়ে একে কলুষিত করা যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা নড়ে উঠল। বলল, ‘চলুন মি. সার্গিও, কোন দিকে যেতে হবে।’
সম্বিত ফিরে পাওয়ার মত নড়ে উঠল সার্গিও। চলতে শুরু করে বলল, ‘আসুন, আপনি যেমন বলেছেন, তেমন ভালো শেল্টার আছে। ওখান থেকে সরে পড়ারও ভালো পথ আছে।’
সবার সাথে ভ্যানিসাও চলতে শুরু করেছে। হাঁটছে সে আহমদ মুসার পাশাপাশি। তার মুখ গম্ভীর। চলতে চলতে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল সে, ‘লক্ষ্য অর্জনে যে পন্থার দিকে সবশেষে আপনি ইংগিত করেছেন, সেটা গ্রহণ করলে তো আমাদের সবাইকে ‘সেন্ট’ অন্য কথায় সাধু-সন্ত হতে হবে। অস্ত্র ধরা যাবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের তাহলে কি হবে?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জন, বন্দুক ধরা তোমার লক্ষ্য নয়। লক্ষ্যকে রক্ষার জন্যেই যখন বন্দুক ধরা প্রয়োজন তখন অবশ্যই বন্দুক ধরতে হবে। সাধু-সন্ত হলেও ধরতে হবে।’
হাসল ভ্যানিসা। বলল, ‘বুঝেছি। লক্ষ্য অর্জনে আপোশহীন হতে হবে, লক্ষ্য রক্ষার জন্যেই লড়াই করতে হবে।’
থামল ভ্যানিসা। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘ইতিহাস সাক্ষী, আপনি মাঠের একজন বিপ্লবী। কিন্তু আবার মনে হচ্ছে আপনি নীতিবাগিশ দার্শনিক একজন সেইন্ট। এটা কি বৈপরিত্য নয়?’
‘আমরা মুসলমান। একজন মুসলিম একই সাথে গৃহী, পুলিশ এবং সৈনিক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি মুসলিম! ও, তাইতো আহমদ মুসা তো মুসলমানই।’ বলল ভ্যানিসা।
‘মন খারাপ হলো তোমার?’ বলল আহমদ মুসা ভ্যানিসাকে লক্ষ্য করে।
‘মন খারাপ হবে কেন? বরং একটু ভালই লাগছে। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের পর্তুগীজ সরকার আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভেদ সৃষ্টি ও এই সংগ্রামে গনজালেস পরিবারের নেতৃত্ব নষ্ট করে একে দুর্বল করার জন্যে অপপ্রচার করে বেড়ায় যে, গনজালো পরিবার নাকি আদিতে মুসলিম ছিল। অপপ্রচার হলেও মুসলমানদের প্রতি কিছুটা আকর্ষণ তো আমাদের থাকবেই।’ ভ্যানিসা বলল।
‘অবাক খবর দিলে তুমি। আসল সত্যটা কি সার্গিও?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। অপপ্রচার নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করিনি আমরা কোন সময়।’ সার্গিও বলল।
হেলিকপ্টার দুটো এসে পড়েছে। দুএক মিনিটের মধ্যেই ওরা এই উচ্চভূমির আকাশে এসে পৌছবে।
উচ্চভূমির পূর্ব-দক্ষিণ পাশে পাহাড়ের গোড়ায় এসে গেছে আহমদ মুসারা।
একটা সংকীর্ণ গিরিপথে ঢুকতে ঢুকতে সার্গিও বলল, ‘এসে গেছি আমরা। সাত আট ফিট উপরে উঠলেই একটা দীর্ঘ গিরিপথের মুখে শেল্টারটা। তার উপর পাহাড়ের ছাদ। সামনে উচ্চভূমির দিকটা উন্মুক্ত, কিন্তু গাছ-গাছড়ায় ঢাকা।’
সবাই সংকীর্ণ গিরিপথ বেয়ে উঠতে লাগল শেল্টারের দিকে।
হেলিকপ্টার দুটি ল্যান্ড করল আহমদ মুসাদের গুহা মুখের ঠিক নিচেই।
উচ্চভূমির গোটা এলাকা গাছ-পালায় ঢাকা। উচ্চভূমির উত্তর দিকে ঢালু স্লোপ, পশ্চিম দিকেও তাই। এই দুই ঢালে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করা সম্ভব নয়।
উচ্চভূমির দক্ষিণ দিকটা দুর্গম। দিকটা অসংখ্য পাহাড় টিলা, সংকীর্ণ উপত্যকা ও গাছপালায় আচ্ছাদিত। ওদিকে হেলিকপ্টার ল্যান্ডের কোন সুযোগ নেই। উচ্চভূমির মাঝখানে সমতল পাথুরে একটা চত্বর আছে। এই চত্বরেই ল্যান্ড করেছে হেলিকপ্টার দুটি।
হেলিকপ্টার দুটি পূবমুখী হয়ে পাশাপাশি ল্যান্ড করেছে। এদের বিশাল পাখার ব্লেডগুলো আহমদ মুসাদের গুহামুখের মাত্র সাত আট ফুট দূর দিয়ে ঘুরছে।
হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং এর জন্যে এই স্থানটি বেছে নেয়ায় আহমদ মুসা দারুন খুশি। ওদের ওঠানামা এবং কথাবার্তারও অনেক কিছুই তারা শুনতে পাবে।
ল্যান্ড করার মিনিট পাঁচেক পর হেলিকপ্টার দুটির দরজা একই সাথে খুলে গেল। দরজা খোলার সাথে সাথেই দুটি হেলিকপ্টার থেকে ৩জন করে ছয়জন লোক লাফ দিয়ে নামল। তাদের সকলের হাতেই উদ্যত ষ্টেনগান।
নেমেই তারা হেলিকপ্টারকে পেছনে রেখে সামনে ছুটে গিয়ে পজিশন নিল। পরক্ষণেই ছয়টি ষ্টেনগান থেকে গুলী শুরু হলো। উচ্চভূমির সব দিক লক্ষ্য করেই তারা গুলী ছুড়ছে।
মিনিট পাঁচেক একটানা গুলীর পর তাদের ছয়টি ষ্টেনগানই থেমে গেল।
আহমদ মুসা বুঝল, শত্রুকে আতংকিত করা কিংবা শত্রুর উপস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া যাচাই করার জন্যে ফাঁকাগুলীর এ মহড়া চলছে।
আরও মিনিট পাঁচেক পার হলো।
হেলিকপ্টার থেকে আরও দুজন নেমে এল। তাদের কাঁধেও ষ্টেনগান ঝুলানো এবং দুজনের হাতেই একটি করে ফোল্ডিং চেয়ার।
হেলিকপ্টার দুটির মাঝখানে তারা চেয়ার দুটি সামনা সামনি করে পাতল।
কাঁচা পাকা চুলের দুজন রাশভারী লোক নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে। বসল তারা চেয়ার দুটিতে।
দুজনের কাউকেই চিনতে পারল না আহমদ মুসা। দুজন নিশ্চয় বড় নেতা গোছের কেউ হবে। তবে সে নিশ্চিত যে এদের মধ্যে WFA-এর প্রধান আজর ওয়াইজম্যান নেই।
বসেই দুজনের একজন মুখ তুলে পজিশন নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা ছয়জনের একজনকে লক্ষ্য করে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, ‘রিকার্ডো’ দুজনকে পাহারায় রেখে তোমরা চারজন ওদিকে যাও। কেউ বেঁচে আছে কিনা দেখ। চল্লিশটি লাশই গুণে আসবে। দেখলাম অস্ত্রগুলো পড়ে আছে। ওগুলো নিয়ে আসবে। সবার কাছেই মোবাইল থাকার কথা। ভালো করে সার্চ করে দেখে ওগুলো অবশ্যই নিয়ে আসবে। মনে রেখ, মোবাইলগুলো অস্ত্রের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।’
কথাগুলো আহমদ মুসারাও শুনতে পেল। শুনে মনটা খচখচ করে উঠল আহমদ মুসার। মোবাইল ওদের কাছে আছে, এ কথা মনেই করেনি আহমদ মুসারা। মোবাইলগুলো শুধু টেলিফোন ইনডেক্সই নয়, কার সাথে কখন যোগাযোগ হয়েছে তারও একটা বর্তমান নির্ঘণ্ট। আর আপসোস করে লাভ নেই, ওগুলো এখন ওদের হাতেই পড়ে গেল, ভাবল আহমদ মুসা।
ওদিকে রিকার্ডো নামক লোকটি তিনজনকে সাথে করে নিয়ে চলে গেল উচ্চভূমির উত্তর ঢালের দিকে।
ওরা চলে গেলে চেয়ারে বসা নেতা গোছের সেই রাশভারী লোকটি সামনের চেয়ারে বসা দ্বিতীয় লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মি. ডেভিড ডায়ার, খবর পাওয়ার পনের মিনিটের মধ্যে আমরা পৌছে গেছি। ওরা সরে পড়ার জন্যে খুব বেশি হলেও সাত আট মিনিট সময় পেয়েছে। এই সময় ওরা এক মাইল পথও যেতে পারেনি। সুতরাং ওদের আশে পাশেই পেয়ে যাব।’
‘মি. এডাম এরিয়েল, আমারও তাই মত। কিন্তু ওদের আশে-পাশে পেতে হলে এখনই আমাদের কাজ শুরু করা দরকার।’
‘হ্যাঁ সেটাই হবে মি. ডায়ার।’ বলে এডাম এরিয়েল পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। মেলে ধরল কাগজটি সামনে।
কাগজটি টেরসিয়েরা দ্বীপের একটা মানচিত্র।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনের চোখেই দূরবীন। এডাম এরিয়েলরা আট নয় ফিট নিচে ৪০ ডিগ্রী কোণে আছে বলে দূরবীনের ফোকাস সহজেই মানচিত্রের উপরও ফেলা যাচ্ছে।
মানচিত্র দেখতে গিয়ে ওরা নিচু স্বরে কথা বলা শুরু করেছে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি পিঠের ব্যাগ থেকে সাউন্ড সেন্সর রেডিও বের করে নিল।
যন্ত্রটি একটা পকেট রেডিওর মত। তাতে দুফিট লম্বা একটা এন্টেনা। এই এন্টেনাটা দুশ বর্গগজের মধ্যেকার সব শব্দ মনিটর করে আলাদা আলাদা করে ক্লাসিফাইড রেকর্ডের পর তা প্রচার করতে পারে।
আহমদ মুসা এন্টেনা তুলে ‘হিউম্যান ভয়েস’ ‘কি’তে চাপ দিয়ে যন্ত্রটিকে সবার মধ্যখানে রেখে দিল।
আহমদ মুসা দূরবীন দিয়ে মানচিত্রের যতটা পারা যায় দেখতে লাগল এবং শুনতে লাগল ওদের কথা রেডিও রিলে থেকে।
যে কণ্ঠ তখন রিলে হচ্ছিল, সেটা এডাম এরিয়েলের কণ্ঠ। শুনেই তা বুঝতে পারল আহমদ মুসা।
বলছিল এডাম এরিয়েল, ‘উচ্চভূমির চারদিকের অবস্থা বুঝলেন তো! এখন দেখুন, আহমদ মুসার যাবার এলাকা একমাত্র দক্ষিণ দিকটাই। উত্তর দিক থেকে সে পালিয়ে এসেছে, অতএব ওদিকে সে এই মুহূর্তে যাবে না। পশ্চিম দিকে ছোটভূমির পরেই বিশাল জলাভূমি। ওদিকে আহমদ মুসার কোন আশ্রয় নেই এবং সামনে এগুবার তার কোন পথ নেই। আর পূব দিকে পাহাড়। এই পাহাড়ের পথে কোন গন্তব্যে পৌছা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য আত্মগোপনের জায়গা এ পাহাড়ে থাকতে পারে। কিন্তু আহমদ মুসা আত্মগোপনের কথা ভাবছে না। তার লক্ষ্য কোন শহর বন্দরে পৌছা। সুতরাং দক্ষিণই তার যাবার একমাত্র পথ। দক্ষিণের পাহাড়-উপত্যকার পথ কষ্টকর হলেও এ পথে কিছুদূর সামনে এগুলে সে পাবে একটা ট্রাইবাল এরিয়া। এস্কিমো, রেড ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভুত কিছু লোক এবং পলাতক এক শ্রেণীর অপরাধীদের উত্তর পুরুষ এই এলাকায় বাস করে। এখান থেকে দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূলের কয়েকটি বন্দরে ও দক্ষিণের হেরোইমা শহরে যাবার পাহাড়ী পথ আছে। সুতরাং আহমদ মুসা এই আশ্রয়ের সন্ধানেই এগোবে।’
হাসল ডেভিড ডায়ার। বলল, ‘আহমদ মুসা উচ্চভূমির চারদিকের এত কিছু জানলেই না আশ্রয়ের সন্ধানে দক্ষিণে অগ্রসর হবে। তার এতসব জানার কথা নয়। সে আজ রাতে দ্বীপের বিমান বন্দরে ল্যান্ড করেছে এবং সংগে সংগেই তাড়া খেয়ে সে পালিয়ে এসেছে। আমার ধারণা এত কিছু ভেবে সে এগুতে পারবে না।’
এডাম এরিয়েলও হাসল। বলল, ‘আসলে আপনি আহমদ মুসাকে চেনেন না। সে যে দেশে বা যেখানে পা দেয় তার সবকিছুই সে আগে জেনে নেয়। আমার বিশ্বাস এই দ্বীপের কোন কিছুই তার অজানা নয়।’
‘কিন্তু আপনি কি করে ধরে নিচ্ছেন যে, সে-ই আহমদ মুসা। আমি তো শুনলাম আজর ওয়াইজম্যানও এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি।’ বলল ডেভিড ডায়ার।
‘আগে তিনি নিশ্চিত না হলেও এখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। এখানকার বিপর্যয়ের খবর যে মোবাইলে দিয়েছিল, সে জানায়, তারা আগে আক্রান্ত হয়নি। একটা ফাঁকা গুলী তার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। এই ফাঁকা গুলীর পর তারা আক্রমণ করলে পাল্টা গুলী বর্ষণ শুরু হয় আহমদ মুসার দিক থেকে। এটাই আহমদ মুসার যুদ্ধের সাধারণ কৌশল। সে শত্রুকে কোনওভাবে এলার্ট না করে আক্রমণ সাধারণত করে না। এই ঘটনা যেহেতু এখানে ঘটেছে তাই এখন নিসন্দেহে বলা যায়, এই ম্যাসাকার আহমদ মুসার দ্বারাই হয়েছে।’
‘শত্রুকে আক্রমণের আগে এলার্ট করার আহমদ মুসার এই কৌশল কেন? কেন করে সে এটা?’ বলল ডেভিড ডায়ার।
‘সম্ভবত যুদ্ধ শুরুর দায় আহমদ মুসা তার ঘাড়ে নিতে চায় না, চাপাতে চায় শত্রুর কাঁধে। শত্রুকে এলার্ট করে সে শত্রুকে আক্রমণে নিয়ে আসে, তারপর সে তার জবাব দেয়।’ বলল এডাম এরিয়েল।
‘যুদ্ধে নেমে যুদ্ধের দায় সে নিতে চায় না কেন?’ ডেভিড ডায়ার বলল।
‘সে নিজেকে শান্তিবাদী হিসেবে দেখাতে চায়। সে দেখাতে চায় যে, সে জুলুমের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার লড়াই করে।’ বলল এডাম এরিয়েল।
হাসল ডেভিড ডায়ার। বলল, ‘ভূতের মুখে রাম-নাম।’
হাসল এডাম এরিয়েলও। বলল, ‘থাক, এখন যা করার দ্রুত করতে হবে। আমাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত আহমদ মুসাকে আর বাঁচতে দেয়া যাবে না।’
‘বলুন, কি করতে চান? শেষ একটা অস্ত্র তো আমরা সাথে এনে……….।’
ডেভিড ডায়ারের কথা শেষ হলো না। হন্তদন্ত হয়ে একজন নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে এডাম এরিয়েলকে লক্ষ্য করে, ‘স্যার, আমরা আমাদের সাউন্ড রেকর্ড থেকে রিলে গ্রহণ করতে গিয়ে দেখছি, আপনাদের কথা ডাবল রিলে হচ্ছে। তার মানে আপনাদের কথা আরও কোন জায়গা থেকে রেকর্ড ও রিলে হচ্ছে।’
শুনেই এডাম এরিয়েল ও ডেভিড ডায়ার বিদ্যুতপৃষ্টের মত চমকে উঠে সোজা হয়ে বসল। এডাম এরিয়েল চিৎকার করে উঠল, ‘ডাইরেকশন আইডেনটিফাই করেছ?’
হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা লোকটি বলল, ‘জি স্যার। পাহাড়ের দিক মানে পূব দিক থেকে আসছে।’
‘তার মানে আহমদ মুসা পাহাড়েরই কোথাও লুকিয়ে আছে।’ বলল আবার চিৎকার করে এডাম এরিয়েল।
‘স্যার, আপনার একথাগুলোও ওরা শুনতে পাচ্ছে।’ কিছুটা নিচু স্বরে বলল লোকটি।
কিছুটা বিব্রত কণ্ঠে এডাম এরিয়েল বলল, ‘স্যরি। ধন্যবাদ তোমাকে।’
কথাটা বলেই এডাম এরিয়েল উঠে দ্রুত ডেভিড ডায়ারের কাছে গেল। তাকে কানে কানে কি যেন বলল।
ডেভিড ডায়ার সায় দিল এডাম এরিয়েলের কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে।
এরপর এডাম এরিয়েল কানে কানে কিছু বলল হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা লোকটিকে।
শুনেই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে লোকটি দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠল।
ওদিকে ডেভিড ডায়ারও হেলিকপ্টারে উঠে গেল।
এডাম এরিয়েল হাত ইশারা করে ডাকল পাহারায় দাঁড়ানো লোক দুজনকে।
ওরা এলে ওদের দুজনকেই কানে কানে কিছু বলল এডাম এরিয়েল। ওরাও সায় দিল এডাম এরিয়েলের কথায় মাথা নেড়ে।
ওদের সাথে কথা শেষ করেই এডাম এরিয়েল উঠে গেল হেলিকপ্টারে।
হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করল।
গর্জন শুরু করেছে হেলিকপ্টার দুটির ইঞ্জিন।
হেলিকপ্টার থেকে নামল আরও দুজন ষ্টেনগানধারী। তাদের দুজনেরই কাঁধে ঝুলানো ষ্টেনগান এবং কোমরে রিভলবার। শুধু একজনের হাতে বাড়তি বড় একটি ব্যাগ।
আগের দুজনসহ চারজন ষ্টেনগানধারী দৌড়ে হেলিকপ্টারের নিচ থেকে একটু দূরে সরে গেল।
হেলিকপ্টার উঠে গেল আকাশে।
রুদ্ধশ্বাসে দেখছিল আহমদ মুসারা এই দৃশ্য। আহমদ মুসারা জেনেছে, তাদের মনিটরিং ধরে ফেলার সাথে সাথে আহমদ মুসাদের অবস্থানের এলাকাও তারা চিহ্নিত করেছে। এখন কি ওরা আক্রমণে আসবে? কিন্তু ষ্টেনগানধারীদের রেখে হেলিকপ্টার দুটো আকাশে উড়ল কেন? ষ্টেনগানধারীদের পাহারায় রেখে ওরা বিশেষ কোন প্রস্তুতির জন্যে উপরে উঠেছে। তাহলে কি হেলিকপ্টার নিয়ে ওরা আহমদ মুসাদের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্যে বেরুল?
এসব চিন্তা আহমদ মুসার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
হেলিকপ্টার দুটো তখন আকাশে উঠে গেছে এবং পূবমুখী হয়ে উড়তে শুরু করেছে।
নিচের চারজন ষ্টেনগানধারীদের একজন হেলিকপ্টার থেকে নামানো বড় ব্যাগটা খুলে ফেলল। তার ভেতর থেকে এক এক করে বের করে আনল অনেকগুলো গ্যাসমাস্ক।
গ্যাসমাস্কগুলোর দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। পাশের সাউন্ড সেন্সরটা গুটিয়ে ব্যাগের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘হাসান তারিক, ওরা হেলিকপ্টার থেকে গ্যাস ফেলবে এখনি। তোমরা আমার সাথে এস।’
বলে আহমদ মুসা যে পথ দিয়ে উঠেছিল সেই পথে নামা শুরু করল। বলল, ‘ভয় নেই এস, ওদের গ্যাসমাস্ক আমাদের দখল করতে হবে।’
‘ভাইয়া, আমাদের কাছে তো দু’টো গ্যাসমাস্ক আছে। ও দুটো মি. সার্গিও ও মিস ভ্যানিসাকে পরিয়ে দেই?’ চলতে চলতেই বলল হাসান তারিক।
হাসান তারিক, সার্গিও ও ভ্যানিসা আহমদ মুসার পেছনে পেছনে তখন দৌড়াতে শুরু করেছে।
হাসান তারিকের কথার জবাবে আহমদ মুসা দৌড়রত অবস্থায় বলল, ‘ও গ্যাসমাস্কগুলো কার্যকরী থাকে মাত্র দু’এক মিনিট মাত্র। তবুও দিতে পার।’
আহমদ মুসারা সবাই ছুটছে। কিন্তু এগুবার জন্যে যতটা কসরত হচ্ছে, ততটা এগুনো যাচ্ছে না। খাড়া পাহাড়ে ওঠা যতটা কঠিন, নামা তার চেয়েও কঠিন। তার উপর অনেকটা পথ ঘুরে তাদের আসতে হবে হেলিকপ্টার যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই চত্বরটায়।
সার্গিও ও ভ্যানিসার মুখ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আচ্ছন্ন।
আহমদ মুসা এক ঝলক পেছনে তাকিয়ে ওদের লক্ষ্য করে বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই। হেলিকপ্টারগুলো পাহাড়ের পুব অঞ্চলে গ্যাস স্প্রে করতে করতে আসছে, যাতে এর মধ্যে তাদের সব লোকরা গ্যাসমাস্ক পরে নিতে পারে।’
‘ওরা এতবড় অমানুষ! এ গ্যাস প্রয়োগে তো অন্যান্য নিরপরাধসহ পশু-পাখিও মারা পরবে।’ বলে উঠল সার্গিও।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘মানুষ যখন অমানুষ হয়, তখন সে পশুর চেয়েও খারাপ হয়ে যায়।’
‘ভাইয়া, আপনি এই সময়েও এমন নির্মল হাসতে পারলেন? আপনার মুখে তো কোন উদ্বেগ দেখছি না।’ আহমদ মুসাক লক্ষ্য করে বলল ভ্যানিসা।
‘আল্লাহ যা ঘটাবেন তাই ঘটবে, চিন্তা করে লাভ কি বোন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে তো আমাদের চেষ্টা করে কোন লাভ নেই।’ ভ্যানিসা বলল।
‘আমরা যে চেষ্টা করছি, সর্বশক্তি দিয়েই করছি, সেটাও আল্লাহই ঘটাচ্ছেন। কিন্তু উদ্বেগ-আতংক আল্লাহ ঘটান না, কারণ ওটা কোন কাজ নয়।’
হাসল ভ্যানিসা। বলল, ‘অবিস্মরণীয় এক শিক্ষার কথা বলেছেন ভাইয়া।’
পূর্ব দিক থেকে হেলিকপ্টারের গর্জন ভেসে আসছে। দ্রুত ছুটে আসছে ওরা।
আহমদ মুসা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনে পড়ল, তাদের একথাগুলো তো হেলিকপ্টার থেকে ওরা মনিটর করছে এবং এর মাধ্যমে সহজেই ওরা আহমদ মুসাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারবে। অলরেডি ওরা তা হয়তো করেছেও।
ভ্যানিসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘নো মোর টক। ওরা আমাদের অবস্থান ধরে ফেলবে।’
আরেক ঝলক উদ্বেগ নেমে এল সার্গিও এবং ভ্যানিসার চোখে-মুখে।
চত্বরের কাছাকাছি পৌছে গেছে আহমদ মুসারা। চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ওরা পূব দিক থেকে যে গ্যাস স্প্রে করতে করতে আসছে, তার প্রভাব এখানকার বাতাসেও ছড়িয়ে পড়েছে।
আরও দ্রুত পা চালালো আহমদ মুসা। সে আরও একটা বিষয় ভেবে উদ্বিগ্ন হলো। গ্যাসমাস্ক ওয়ালারা চারজনই যদি গ্যাসমাস্কগুলো উচ্চভূমির ঢালে তাদের সহকর্মীদের কাছে নিয়ে গিয়ে থাকে! সে ক্ষেত্রে মুস্কিলে পড়বে তারা। গ্যাসমাস্ক সংগ্রহ তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।
আশা-নিরাশার দোলায় দুলে আহমদ মুসা ষ্টেনগান সামনের দিকে তাক করে গিরিপথের আড়াল থেকে মুখ বাড়াল। দেখল তিনজন ষ্টেনগানধারী রয়েছে। চতুর্থজন সঙ্গীদের গ্যাসমাস্ক সরবরাহ করতে গেছে ঢালে, বুঝল আহমদ মুসা। গ্যাসমাস্কের ব্যাগটাও পড়ে আছে চত্বরে।
‘পশ্চিমমুখী হয়ে পজিশন নিয়ে বসে থাকা গ্যাসমাস্ক পরা ষ্টেনগানধারীদের অলক্ষ্যে তাদের পেছন থেকে গ্যাসমাস্কের ব্যাগ নিয়ে আসবে কিনা, ইত্যাদি নিয়ে আহমদ মুসা কোন সিদ্ধান্তে পৌছার আগেই পেছন থেকে প্রচন্ড হাঁচি দিয়ে উঠল ভ্যানিসা।
বাতাস কিছুটা দুষিত হয়ে পড়ার কারণেই এটার কোন এলার্জিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
হাঁচির সাথে সাথেই তিনজন ষ্টেনগানধারী চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়াল। তাদের ষ্টেনগানও উঠে আসছিল।
আহমদ মুসা সংঘর্ষে যাওয়া ছাড়া গ্যাসমাস্ক দখলের আর কোন উপায় দেখল না।
আহমদ মুসার ষ্টেনগান তাক করাই ছিল। শুধু ট্রিগার চেপে ধরল সে।
ওরা আর গুলী করার সুযোগ পেল না। গুলী খেয়ে পড়ে গেল তিনটি দেহই।
আহমদ মুসা ষ্টেনগান বাগিয়ে ধরে ছুটল ব্যাগের দিকে। তার পেছনে পেছনে ছুটল হাসান তারিক ও ভ্যানিসারাও।
ব্যাগেই গ্যাসমাস্ক পাওয়া গেল।
দ্রুত গ্যাসমাস্ক পরে নিল সবাই।
হেলিকপ্টার এসে গেছে। নিশ্চয় হেলিকপ্টারে ওরা ষ্টেনগানের শব্দ শুনেছে। ওদের দূরবীনে আহমদ মুসারা ধরাও পড়ে যেতে পারে।
‘সবাই এস, জংগলের আড়ালে যেতে হবে।’ খুব নিচু স্বরে কথাগুলো বলে আহমদ মুসা ছুটল জংগলের দিকে। তার সাথে সবাই।
হেলিকপ্টার আসছিল গ্যাস স্প্রে করতে করতে। হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান দাগাও শুরু হলো।
‘হেলিকপ্টার নিশ্চয় ষ্টেনগানের শব্দ শুনেছে, এখন দেখতে পেয়েছে তাদের লোকদের লাশও। আমরা উচ্চভূমির জংগলে আশ্রয় নিয়েছি, এটাও নিশ্চয় ওরা দেখতে পেয়েছে। এস, আমরা উত্তর দিকের ঢালের দিকে আগাই। ওদিকে তাদের লোক আছে। ওদিকে মেশিনগানের ফায়ার কম হতে পারে।’
নিচু চাপা কণ্ঠে কথাগুলো বলার সাথে সাথে আহমদ মুসা উত্তর দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে। তার ষ্টেনগানের নল সামনে উদ্যত। আঙুল ষ্টেনগানের ট্রিগারে। তার পেছনে অন্য সবাই।
পথের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ঘন ঝোপের পাশ কাটিয়ে সামনে এগুতেই আহমদ মুসা ৫জন ষ্টেনগানধারীর একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেল। ওরাও দৌড়ে আসছিল, সম্ভবত এদিকে ষ্টেনগানের আওয়াজ শুনেই।
ঘটনার আকস্মিকতা উভয় পক্ষকেই বিমূঢ় করে দিয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসা এ ধরণের অবস্থার জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তার ষ্টেনগানও হাতে বাগিয়ে ধরা ছিল, হাতের আঙুলও ছিল ট্রিগারে। সুতরাং জিতে গেল আহমদ মুসাই। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে ট্রিগারে চেপে ধরল আঙুল।
ওরাও বিমূঢ়তার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। নড়ে উঠেছিল তাদের ষ্টেনগানও।
কিন্তু তারা এ্যাকশনে যাবার আগেই সে সুযোগ তাদের শেষ হয়ে গেল। পাঁচজনই ষ্টেনগানের গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে ভূমি শয্যা নিল।
আহমদ মুসা একবার পেছনে তাকিয়ে ‘এস তোমরা’ বলে আবার দৌড়াতে শুরু করল।
সবাই এসে পৌছল উত্তর ঢালের মুখে। আহমদ মুসা সবাইকে বড় গাছের গোড়ায় আশ্রয় নিতে বলল।
কিন্তু হেলিকপ্টারের গুলী জংগলের মাঝামাঝি অতিক্রম করার পর বন্ধ হয়ে গেল।
হেলিকপ্টার চলে এল ঢালের ওপর।
‘ওরা ঢালে পাঠানো ওদের লোকদের খুঁজছে।’ বলে একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল নিচু স্বরে আবার, ‘ঢালে ওদের লোকদের পাচ্ছে না। সুতরাং এখন নিশ্চয় ওরা ভাবছে, তাদের লোকরা ঢালের কাজ সেরে উচ্চভূমির জংগলে উঠে এসেছে। এই ষ্টেনগানের ফায়ারও তাদের কানে গেছে। অতএব এখন তারা ভাবতে বাধ্য হবে, জংগলে তাদের লোকদের সাথে আমাদের লোকদের সংঘর্ষ চলছে। ফলে এখন তাদের মেশিনগান ও গ্যাস আক্রমণ দুটোই অকেজো।’
‘কি করে?’ বলল ভ্যানিসা খুব আসেত্ম। তার বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে সপ্রশংস দৃষ্টি।
‘গ্যাসমাস্ক আমরা দখল করেছি, এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত। সুতরাং গ্যাস আক্রমণ কোন কাজ দেবে না। আর যেহেতু ওরা ধরে নিতে বাধ্য হয়েছে, ওদের লোকরাও এখন উচ্চভূমিতে, তাই হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগান আক্রমণও তারা চালাতে পারছে না।’ আহমদ মুসা বলল প্রায় ফিসফিস করে।
কথাটা বলেই আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। দ্রুত চাপা কণ্ঠে নির্দেশ দিল, ‘হাসান তারিক, তুমি যাও এখনি যে লাশগুলো পড়ল ওদের কাছে। ওরা ওদের সহকর্মীদের মোবাইলগুলো সংগ্রহের কথা বলেছিল। সবাইকে সার্চ করে মোবাইলগুলো নিয়ে এস।’
‘আমি যেতে পারি মি. তারিকের সাথে। তাকে সহযোগিতা করব।’ বলল সার্গিও যথাসাধ্য তার দরাজ কণ্ঠকে নিচু রেখে।
‘না মি. সার্গিও, আপনি ভ্যানিসার কাছে থাকুন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি তো আছেনই।’ বলল সার্গিও।
‘না আমি থাকছি না। এখনি গাছে উঠব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘গাছে কেন?’
‘ওখান থেকে হেলিকপ্টারকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। ওদের কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’ বলেই আহমদ মুসা এগুলো সামনের সবচেয়ে বড় গাছটার দিকে।
গাছে উঠল আহমদ মুসা।
গাছের এমন এক জায়গায় উঠে সে বসল যাতে চারদিকের আকাশটাকে ভালোভাবে দেখা যায়। মাথার উপরটাতেই গাছের ডাল-পালার আড়াল। হেলিকপ্টার সরাসরি উপর থেকে তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু সে হেলিকপ্টারকে টার্গেট করতে পারবে। কিন্তু অসুবিধা যেটা হবে সেটা হলো, একমাত্র উপর ছাড়া চারপাশ থেকে হেলিকপ্টার তাকে দেখতে পাবে, যদি তারা বিশেষভাবে এদিকটার দিকে তাকায়।
উচ্চভূমির গোটা আকাশটাই চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার দুটি। তবে এক সাথে নয়, আলাদাভাবে এবং বেশ দূরত্ব রেখে।
আহমদ মুসা গাছের ডালে যুতসইভাবে বসে তখনও তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। এই সময় দেখতে পেল, একটি হেলিকপ্টার পূবদিকে কিছু দূরে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। আহমদ মুসার মনে হলো, হেলিকপ্টারটি তাকে দেখতে পেয়েছে। হেলিকপ্টারের খোলা দরজা এদিকে হা করে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয় দূরবীনের দুটি চোখ এ দিকে স্থিরভাবে নিবদ্ধ, ভাবল আহমদ মুসা।
দক্ষিণ দিকের দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটি উড়ে আসছিল পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে। সে হেলিকপ্টারটিও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, দেখল আহমদ মুসা। সেই সাথে দেখতে পেল, হেলিকপ্টারটির মাথা বোঁ করে উত্তরমুখী হয়ে ঘুরে গেল। দ্রুত আহমদ মুসা তাকাল পূবের হেলিকপ্টারটির দিকে। দেখল, পূবের হেলিকপ্টারটির মাথাও পশ্চিম দিকে ঘুরে গেছে। আহমদ মুসার বুঝতে বাকি রইল না দক্ষিণ দিকের হেলিকপ্টারটি, পূবের হেলিকপ্টারকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। এখন দুটি হেলিকপ্টারই তাকে আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুত।
আহমদ মুসার এই চিন্তা শেষ হবার আগেই দেখল, হেলিকপ্টার দুটি তার দিকে দৌড় শুরু করেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত ভাবল, সে ঝুলানো দড়ি বেয়ে নিচে নেমে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু তার ফলে হেলিকপ্টার দুটি বেপরোয়া আক্রমণের সুযোগ পেয়ে যাবে উচ্চভূমির উপরে। কারণ তারা এখন নিশ্চিত মনে করবে, তাদের লোকেরা উচ্চভূমিতে জীবিত থাকলে তাদের শত্রুরা এভাবে গাছে উঠতে পারতো না। সুতরাং হেলিকপ্টার দুটোকে সে সুযোগ দেয়া যাবে না।
এ চিন্তার সাথে সাথে আহমদ মুসা চারদিকে তাকাল। তার চার দিকেই গাছ আছে তবে বেশ দূরে দূরে। কোন কোনটির দূরত্ব পনের-বিশফুট হবে।
দক্ষিণ পূর্ব কোণের দিকে একটা গাছকে টার্গেট করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে এসে আশে-পাশের কয়েকটা ছোট ডাল ভেঙে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুঁজে দিয়ে বাদুড়ের মত খুব সহজভাবে এগুলো দক্ষিণ পূবমুখী একটা মোটা ডাল বেয়ে।
ডালের প্রান্তের দিকে রশির মাথা শক্ত করে বেঁধে আহমদ মুসা ফিরে এল তার আগের জায়গায় রশির শেষ প্রান্তটা হাতে ধরে। তার পর দ্রুত কিছুটা নেমে এসে দুহাতে রশির দুপ্রান্ত জড়িয়ে দুপায়ে গাছটিকে প্রচন্ড শক্তিতে পেছনে ঠেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসা। মুহূর্তেই লম্বা রশির ঝুলন্ত গতিবেগ ক্ষেপণাস্ত্রের মত আহমদ মুসাকে পৌছে দিল দক্ষিণ-পুবের সেই গাছটির একটা ডালের সান্নিধ্যে। আহমদ মুসা এক হাতে ডালটি ধরে ফেলে রশি ছেড়ে দিয়ে দুহাতে ডালটি আঁকড়ে উঠে গেল গাছে।
দুটি হেলিকপ্টারের শব্দও অনেক কাছে এসে গেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত গাছের উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। পাতায় জড়ানো অনেকগুলো ডালের এক গ্রন্থিতে আশ্রয় নিল আহমদ মুসা।
হেলিকপ্টার দুটি এসে গেছে। তাদের টার্গেট সবচেয়ে লম্বা ঐ গাছটি।
প্রবল এক পশলা গুলী বর্ষণ করল গাছটির উপর।
গাছের উপর আকাশে ইতস্তত ঘুরতে লাগল হেলিকপ্টার দুটি।
গাছটিতে কোন লোক নেই এবং সে যে নিচে নেমে গেছে তা তারা বুঝে ফেলেছে।
এ সময় একটা বোমা বিস্ফোরিত হলো গাছের নিচে।
ওরা বোমা ফেলেছে, বুঝল আহমদ মুসা। গ্যাস বোমা নয়, আগুনে বোমা। তবু আহমদ মুসা তার গ্যাস মুখোশটাকে ভালো করে টেনে-টুনে ঠিক করে নিল।
ধুঁয়া ধেয়ে আসছে নিচ থেকে উপর দিকে।
আহমদ মুসা খুশি হলো এই ভেবে যে, ধুঁয়া তাকে ঢেকে ফেলবে এবং হেলিকপ্টার থেকে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু এই সাথে ভাবল ধুঁয়ায় আচ্ছন্ন হলে হেলিকপ্টার দুটোকে টার্গেট করা তার জন্যে কঠিন হয়ে পড়বে। তার উপর হেলিকপ্টার দুটি যদি এই অবস্থায় অন্যদিকে সরে যায়, তাহলে তার গাছে উঠাই বেকার যাবে।
এই চিন্তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা দুহাতে তার দুটি ষ্টেনগানকে তৈরি করে নিয়েছে।
তখন ধোঁয়া উঠে আসেনি এবং তখনও হেলিকপ্টার দুটো গাছটির আকাশে চক্কর দিচ্ছে। গতি তাদের খুব স্লো।
ডালের গ্রন্থিতে পা রেখে আহমদ মুসা গাছের কান্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ষ্টেনগান দুটির ব্যারেল অধীরভাবে অপেক্ষা করছে হেলিকপ্টার দুটি তার নাগালের মধ্যে আসার।
আহমদ মুসা জানে, তার প্রথম আক্রমণই শেষ আক্রমণ হবে। প্রথম আক্রমণ থেকে যদি ওরা বেঁচে যায়, তাহলে ওদের পাল্টা আক্রমণের মুখে আহমদ মুসা দ্বিতীয় আক্রমণের সুযোগ পাবে না।
এজন্যেই আহমদ মুসার ষ্টেনগান দুটি খুব সতর্ক।
এক সময় উত্তর ও দক্ষিণ গামী হেলিকপ্টার দুটি আহমদ মুসার মাথার উপরে প্রায় ২০ ডিগ্রী কোণে পাশাপাশি চলে এল। দক্ষিণমুখি হেলিকপ্টারটি পুবপাশে, আর উত্তরমুখিটি পশ্চিম পাশে। দুটি ফুয়েল ট্যাংকার ষ্টেনগানের নাগালের মধ্যে এসেছে।
গর্জে উঠল আহমদ মুসার দুহাতের দুটি ষ্টেনগান। অবিরাম গুলীর ঝাঁক ছুটে চলল হেলিকপ্টার দুটিকে লক্ষ্য করে।
আক্রান্ত হয়েই হেলিকপ্টার দুটি দ্রুত সরে যেতে লাগল এবং অবিরাম গুলীবৃষ্টি তারাও শুরু করল ভূমির দিকে।
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। হেলিকপ্টার দুটি সরে গিয়ে গুলীবৃষ্টি শুরু না করলে আহমদ মুসা পূব পাশের হেলিকপ্টারের গুলীতে এতক্ষণ ঝাঁঝরা হয়ে গোশতের স্তুপে পরিণত হয়ে যেত।
হেলিকপ্টার দুটি দুদিকে চলে গেল, আর ফিরে এল না।
আহমদ মুসার এ গাছটা অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সেও গাছের শীর্ষ থেকে অনেকখানি নিচে, তাই আকাশটা আর তার চোখে পড়ছে না।
আহমদ মুসা একটু অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিল।
একটু পরেই নিচ থেকে সার্গিও চিৎকার করে উঠল, ‘মি. আহমদ মুসা, একটি হেলিকপ্টারে আগুন ধরে গেছে, অন্যটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দ্রুত ফিরে যাচ্ছে।’
সার্গিও’র কথা শেষ না হতেই প্রচন্ড বিস্ফোরনের শব্দ শোনা গেল পুব দিক থেকে।
‘হেলিকপ্টারটি ধ্বংস হয়ে গেছে মি. আহমদ মুসা।’ নিচ থেকে আনন্দে চিৎকার করে উঠল সার্গিও’র কণ্ঠ।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে আহমদ মুসা গাছ থেকে নামা শুরু করল।
গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল হাসান তারিক, সার্গিও এবং ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা গাছ থেকে নামতেই সার্গিও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘অভিনন্দন মি. আহমদ মুসা। আমাদের টেরসিয়েরা দ্বীপ অবিস্মরণীয় এক যুদ্ধ দেখল। সেই সাথে দেখল আহমদ ………।’
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘আর দেরি নয় মি. সার্গিও, এখনি এখান থেকে সরতে হবে। আমাদেরকে অহেতুক যুদ্ধ এড়াতে হবে।’
‘অহেতুক কেন? এ যুদ্ধে শত্রুরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দূর্বল হয়েছে।’
‘এটুকুই লাভ মি. সার্গিও। কিন্তু এই লাভ করতে গিয়ে শত্রুদের যে পরিমাণ উস্কে দিয়েছি তাতে উদ্দেশ্য হাসিলের পথে এগুবার বদলে আত্মরক্ষার লড়াই-এ ব্যস্ত থাকতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সার্গিও ও ভ্যানিসা স্থির দৃষ্টি তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। আহমদ মুসা থামার একটু পরে সার্গিও বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। আপনি যেভাবে ভেবেছেন, ওটা আমাদের মাথাতেই আসেনি। আপনি ঠিকই বলেছেন।’
সার্গিও একটু থেমেই পরক্ষণে আবার বলল, ‘ওদের নতুন আক্রমণের আশংকা করছেন আপনি?’
‘এই পরিস্থিতিতে ওরা বড় ধরনের আক্রমণে না এসেই পারে না। আমি হলে তো সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করতাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে চলুন আমরা এখন থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়ি।’ বলল সার্গিও।
‘অস্ত্রগুলো কাজে লাগবে, কিন্তু এতগুলো অস্ত্র নেয়া হবে কি করে মি. সার্গিও?’
‘অসুবিধা হবে না, আমরা সবাই ভাগ করে নেব। একটু এগুলেই আমরা দুটি ঘোড়া পেয়ে যাব।’ বলল সার্গিও।
‘আপনারা ঘোড়ায় এসেছিলেন? সামনে তাহলে ঘোড়া চলার মত ভালো রাস্তা আছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘দক্ষিণের পাহাড়-উপত্যকার খাড়া চড়াই-উৎরাইটা খুব বেশি নয়। তারপরেই ঘোড়া চলতে পারে।’ বলল সার্গিও।
তৈরি হয়ে চলতে শুরু করল তারা।
যে গিরিপথ দিয়ে তারা পাহাড়ে উঠেছিল লুকাবার জন্যে, সে গিরিপথ দিয়েই তাদের চলা শুরু হলো।
‘আমাদের এ যাত্রা কোথায়? আপনাদের বাড়িতে? কোথায় আপনাদের বাড়ি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা সার্গিওকে।
‘এই উচ্চ ভূমিটাই ছিল আমাদের আদি বাড়ি। ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেলে আরও দক্ষিণে সরে একটা বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। যখন নিরিবিলি সময় কাটাতে চাই, তখন এ বাড়িতেই আমরা আসি।’ বলল সার্গিও।
‘এই উচ্চভূমিটা কি করে বাড়ি হয়? না সমুদ্রের তীর, না নদীর ধার এটা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এটাই ছিল তখন সমুদ্র তীর। এই উচ্চভূমিটা একটা দূর্গ। দূর্গটা তৈরি হয়েছিল সমুদ্র তীরে। এর উত্তরের অঞ্চলটা ভূমিকম্পের ফলে জেগে উঠেছে।’
‘এই দুর্গটা আপনাদের পরিবারের বাড়ি হলে ধরে নিতে হবে যে আপনারাই এ দ্বীপের আদি শাসক পরিবার?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘এ দ্বীপের নয় এ দ্বীপপুঞ্জের। আমাদের গনজালো পরিবারই এ দ্বীপের আদি শাসক।’ বলল সার্গিও।
পূর্বমুখী গিরিপথ কিছুটা গিয়ে একেবারে এবাউট টার্ণ করে পশ্চিমমুখী হয়ে একটা সমতল উপত্যকায় প্রবেশ করল। চারদিকের পাহাড়ের দেয়াল ঘেরা উপত্যকাটা বেশ বড়। সারি সারি কবর সে উপত্যকায়। প্রতিটি কবরের শিয়রে ক্রুস শোভা পাচ্ছে।
‘এটা আমাদের আদি পারিবারিক কবরস্থান। ভূমিকম্প আমাদের দূর্গ ধ্বংস করেছে। কিন্তু এ কবরস্থানটা অক্ষত আছে।’ বলল সার্গিও।
উপত্যকার মাঝ বরাবর দিয়ে তারা পশ্চিমে এগিয়ে চলল। দুধারে কবরের সারি।
সামনে চলছিল হাসান তারিক। তারপর ভ্যানিসা। ভ্যানিসার পরে সার্গিও। সবশেষে আহমদ মুসা।
উপত্যকার পশ্চিম প্রান্তে তারা এসে গেছে।
হঠাৎ হাসান তারিক থমকে দাঁড়িয়েছে।
‘একি দেখছি আহমদ মুসা ভাই?’ বলল হাসান তারিক।
‘কি হল? কি দেখছেন?’ বলল সার্গিও ও ভ্যানিসা এক সাথে। তাদের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা।
দ্রুত আহমদ মুসা সামনে চলতে চলতে বলল, ‘কি হয়েছে, কি দেখছ?’
হাসান তারিক মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে ইংগিত করল সামনের কবরের দিকে।
তাকাল আহমদ মুসা। কবরগুলো চোখে পড়ল তার। তাঁর ভ্রুও কুঞ্চিত হয়ে উঠল। উপত্যকার পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত অনেকগুলো কবরের শিয়রে ক্রস রাখা নেই। এই কবরগুলোর সবগুলোর উপরের কাঠামো ভেঙে লন্ড-ভন্ড করা। কিন্তু তারপরও কবরের বুনিয়াদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এই কবরগুলো দক্ষিণ উত্তরমুখী করে তৈরী। অথচ এর পরের সবগুলো কবরই পূব-পশ্চিম মুখী এবং এদের প্রত্যেকটির শিয়রে ক্রস স্থাপিত আছে।
আহমদ মুসাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
পেছন থেকে সার্গিও সামনে এসে আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের মাঝখানে দাঁড়াল। সামনে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলে উঠল, ‘ও এই কবরগুলো ভাঙা কেন! অবাক হয়েছেন আপনারা?’ বলে একটু থামল সার্গিও।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক কিছু বলল না।
সার্গিওই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘সব কথা জানি না। তবে শুনেছি, প্রায় একশ বছর আগে আমাদের এক পূর্ব পুরুষ আমাদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জের আজকের আধুনিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গোমেজ গনজালো এই কবরগুলো ভেঙে ফেলেন। সেই সময় ইউরোপের এক সংবাদপত্রে আমাদের পরিবারের দুর্নাম রটাবার জন্যে কি যেন লেখা হয়, তারপরেই তিনি এই কবরগুলো ভেঙে ফেলেন। শুধু তাই নয়, ভেংগে প্রথম কবরটার পাশে পারিবারিক একটা বাক্সও সমাধিস্থ করেন এবং কবরস্থানকে বিদেশীদের জন্যে নিষিদ্ধ করে দেন। একশ বছরের মধ্যে আপনারাই প্রথম বিদেশী এই কবরস্থানে প্রবেশ করেছেন।’
‘বাক্সটা কেন সমাধিস্থ হলো, কিছু জানেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমি জানি না। তবে অনুমান করি, কবরগুলো যে কারণে ভাঙা হয়েছে, সেই একই কারণে বাক্সটাকেও সমাধিস্থ করা হয়েছে।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু ঐ কবরের কাছে কেন? যে কোন জায়গায় করলেই তো হতো!’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমারও সেই প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর জানি না।’ সার্গিও বলল।
সার্গিও থামতেই ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘মনে হয় পরিত্যাজ্য গোপন কিছু সমাধিস্থ করা হয়েছে।’
‘ধন্যবাদ ভ্যানিসা। আমারও তাই মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কবরগুলো ভাঙা হলো কেন, এই ব্যাপারে আপনার কি মনে হয় ভাইয়া?’
‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। কিন্তু বলবো না। তোমাদের একশ বছর আগের পূর্ব পুরুষ যেমন তা সহ্য করতে পারেনি, তেমনি হয়তো তোমরাও পারবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পারবো ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা।
‘ঠিক আছে বলব। আজ নয়। ঐ বাক্সটা যেদিন উদ্ধার করব, সেদিন বলব। এমনও হতে পারে আমাকে কিছুই বলতে হবে না। বাক্সটাই বলে দেবে সব।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় ফুটে উঠল সার্গিও ও ভ্যানিসা দুজনেরই চোখে-মুখে। বলে উঠল সার্গিও, ‘বাক্সে কি আছে কেমন করে অনুমান করতে পারছেন? আর ঐ বাক্স আপনি পাবেনই বা কি করে?’
‘অনুমান কিভাবে তার উত্তর ভ্যানিসাই দিয়েছে। যে কারণে কবরগুলো ভাঙা সেই একই কারণে বাক্সটিকেও সমাধিস্থ করা হয়েছে। এদিক থেকে বাক্সে কি থাকতে পারে অনুমান করছি। আর বাক্স পাব কি করে? মাটি খুঁড়ে বের করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাক্সটাকে আপনি এত জরুরী মনে করেন?’ সার্গিও বলল।
‘হ্যাঁ মি. সার্গিও। আপনারা রাজী হলে এখনি খুঁড়ে ওটা বের করতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না মি. আহমদ মুসা। আজ নয়। আর একদিন আসব আমরা এদিকে। আর এ ব্যাপারে আম্মাকেও আমার রাজি করতে হবে। কারণ ওটা ছিল পারিবারিক এক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।’ সার্গিও বলল।
‘আমার আপত্তি নেই মি. সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আবার যাত্রা শুরু হোক।’ সার্গিও বলল।
যাত্রা আবার শুরু হলো আগের মতই।
হাঁটা শুরু করে ভ্যানিসা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কবর ভাঙার রহস্য জানার ব্যাপারটা তো দেখছি অনির্দিষ্ট সময় চেপে রাখতে হবে, কিন্তু আমি তো এক মুহূর্তও তা পারছি না।’
‘বেশি প্রত্যাশার জিনিস হলে বেশি ভালো লাগবে ভ্যানিসা।’ বলল আহমদ মুসা একটু রসিকতার সুরে।
‘কিন্তু মি. আহমদ মুসা, প্রত্যাশা ও না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে চলছে ভ্যানিসা। তার উপর আরও লোড চাপানো আরও দুঃখজনক হবে।’ সার্গিও বলল।
‘কি সে তিক্ত অভিজ্ঞতা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
সার্গিও মুখ খুলতে যাচ্ছিল।
ভ্যানিসা চিৎকার করে তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আমি কিন্তু এখানে বসে পড়ব।’ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে তার মুখ।
‘ঠিক আছে বলব না।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘বলার দরকার নেই। আমার বুঝা হয়ে গেছে। আমার জিজ্ঞাসা মি. সার্গিও, উনি কি এখন রাজবন্দী, না বিদেশে?’
বিস্ময় ফুটে উঠল ভ্যানিসা ও সার্গিও দুজনের চোখে মুখে। পরক্ষণেই বিস্ময়ের স্থান দখল করে নিল বেদনা। বলল সার্গিও ধীরে ধীরে, ‘রাজবন্দী নয়, তবে নজরবন্দী।’
‘ঘটনা কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ঘটনাটা বেদনার। ভ্যানিসা বিদ্রোহী গনজালো পরিবারের মেয়ে, আর সে আজোরসের পর্তুগীজ গভর্ণর পেড্রো পাওলেটা’র ছেলে। দুজনেই লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠি ছিল। পাশ করে এসেছে। এখন লুই জুগো রাজধানী পন্ট ডেলগাডারের বাইরে বেরুতে পারে না। আর ভ্যানিসার জন্যে রাজধানীতে ঢোকা কঠিন।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এসব কোন ব্যাপারই নয়। আমি আগের কথাই একটু ঘুরিয়ে বলব, ভালো লাগার বস্তু পাওয়া একটু কঠিন হওয়া বাজার অর্থনীতির জন্যেও স্বাভাবিক।’
সার্গিও মুখ টিপে হাসল।
আরও রক্তিম হয়ে উঠল ভ্যানিসার মুখ।
কিছু বলল না কেউ।
৩
‘চিন্তার কিছু নেই স্যার। ভাল খবরই আমরা আশা করছি।’ বলল জ্যাক শামির আজর ওয়াইজম্যানকে উদ্দেশ্য করে।
‘জ্যাক শামির WFA-এর একজন নেতা এবং আজোরস দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী ‘পন্ট ডেলগাডা’র ষ্টেশন চীফ হিসেবে কাজ করছে বর্তমানে।
‘পাঁচ ঘন্টার জন্যে ওরা হেলিকপ্টার ভাড়া করেছিল। কিন্তু এখন পার হয়ে গেছে ৬ ঘন্টা। তারা অবশ্যই ফেরার কথা। কিন্তু তারা কিছু জানাচ্ছে না, আবার তাদের মোবাইলও বন্ধ। কারণটা তাহলে কি?’ বলল আজর ওয়াইজম্যান সামনে বসা জ্যাক শামিরকে লক্ষ্য করে।
আজর ওয়াইজম্যান কথা বলছে জ্যাক শামিরকে লক্ষ্য করে, কিন্তু তার চোখ জানালা পেরিয়ে আজোরস সাগরের উপর নিবদ্ধ।
আজোরস সাগরকে তার যতটা সুন্দর লাগতো, আজ ততটা সুন্দর লাগছে না। সুন্দরের পাশে সেখানে ভয়ংকর একটা রূপও সে দেখছে। মাত্র দুজন লোকে তার চল্লিশজন লোক শেষ করে দিল, এই ভয়ংকর চিন্তা যেমন তার সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করেছে, তেমনি গ্রাস করছে যেন সামনের সাগরটাকেও।
জ্যাক শামির বলছিল, ‘এদিকটা ভাববার বিষয়ই বটে। তবে স্যার এটা ঘটতে পারে যেহেতু তারা পাঁচ ঘন্টার মধ্যে ফিরতে পারেনি।’
আজর ওয়াইজম্যান মুখ ফিরিয়ে নিল সাগরের দিক থেকে। তাকাল জ্যাক শামিরের দিকে। তার কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বলল, ‘কি যেন বললেন, পুলিশ প্রধান আসবেন, না আমাকে যেতে হবে?’
‘পুলিশ প্রধান মি. বারবোসা পোর্টে কি এক মিটিং-এ যাচ্ছেন, এদিক দিয়ে ফিরবেন, সে সময় এখানে উঠবেন।’
আবার আজর ওয়াইজম্যান সাগরের দিকে ফিরে তাকাল। কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময় বেজে উঠল তার টেলিফোন।
ঘুরল আজর ওয়াইজম্যান মোবাইলের দিকে। তুলে নিল টেলিফোনটা।
ওপার থেকে বলে উঠল, ‘ডেভিড ডায়ার বলছি।’
‘তোমাদের কি খবর? আমাদের ওখানকার চীফ এডাম এরিয়েল কোথায়? এত দেরিতে টেলিফোন করছ কেন?’ এক সাথে প্রশ্নগুলো করে চুপ করল আজর ওয়াইজম্যান।
তারপর ওপারের কথা শুনতে লাগল আজর ওয়াইজম্যান। শুনতে গিয়ে মুখের ভাব পাল্টে যেতে লাগল তার। শেষে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে রাগে-দুঃখে যেন কাঁপতে লাগল তার ঠোঁট।
সব শুনে শেষে ছোট্ট করে সে বলল, ‘ও দুজনকে ঐ তেরসিয়েরা দ্বীপ থেকে বের হতে দেয়া যাবে না। তোমরা অপেক্ষা কর। আমি ব্যবস্থা করছি।’
বলে টেলিফোন রেখে দিল আজর ওয়াইজম্যান।
শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় অপেক্ষা করছিল জ্যাক শামির। আজর ওয়াইজম্যান টেলিফোন রাখতেই বলল, ‘ওখানকার কি খবর স্যার।’
টেলিফোন রাখার পর মুহূর্তকাল সোজা হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকল চেয়ারে। বলল, ধীরে ধীরে, ‘আমাদের হেলিকপ্টার অভিযান ধ্বংস হয়েছে। গ্রাউন্ডে নামানো দশজন কমান্ডোই নিহত। একটি হেলিকপ্টার ধ্বংস হওয়ার ফলে একজন ক্রুসহ এডাম এরিয়েল নিহত হয়েছে। আরেকটা হেলিকপ্টারও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ডেভিড ডায়ার আহত। ঐ হেলিকপ্টারের একজন ক্রু মাত্র অক্ষত আছে।’
বিস্ময় ও বেদনার ধাক্কার সংগে সংগে কথা বলতে পারল না জ্যাক শামির। নিজেকে সামলে নিয়ে একটু পর বলল, ‘এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা আবারও ঘটতে পারল কি করে? ওদের সাথে আর কেউ কি যোগ দিয়েছে?’
‘তার কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। প্রথম অভিযানের প্রথম আক্রমণের পর যে দুজন বেঁচে গিয়েছিল, তারা স্বচক্ষে দুজনকেই মাত্র দেখেছে। মোবাইল করার পর ওরাও সম্ভবত নিহত হয়।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
জ্যাক শামির কিছু বলবে এমন সময় এটেনড্যান্ট ঘরে প্রবেশ করে জ্যাক শামিরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘স্যার, পুলিশ প্রধান মি. বারবোসা এসেছে।’
সংগে সংগে উঠে দাঁড়াল জ্যাক শামির ও আজর ওয়াইজম্যান।
তারা ঘরের বাইরে গিয়ে স্বাগত জানাল আজোরস দ্বীপপুঞ্জের পুলিশ প্রধান বারবোসাকে।
তিনজনই ঘরে এসে তিন সোফায় মুখোমুখি বসল।
পুলিশ প্রধান বারবোসা বসতে বসতেই বলে উঠল, ‘মি. ওয়াইজম্যান আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। ব্যাপার কি?’
আজর ওয়াইজম্যান ম্লান হাসল। বলল, ‘দুজন সন্ত্রাসী মুসলমান আমাদের সাংঘাতিক কষ্ট দিচ্ছে মি. বারবোসা।’
‘কোথায় তারা? কোন কেস করেছেন?’ জিজ্ঞেস করল পুলিশ প্রধান।
‘সবে গত রাতে তারা ‘লিজে’ এয়ারপোর্টে নেমে তেরসিয়েরা দ্বীপে প্রবেশ করেছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আজোরস দ্বীপপুঞ্জে মুসলমানদের একটা সন্ত্রাসী দলের প্রবেশ করার পরিকল্পনা আছে, আপনাদের এই ইনফরমেশনের ভিত্তিতে সরকার তো আজোরস দ্বীপপুঞ্জে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। তারা প্রবেশ করল কিভাবে?’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘ওরা ছদ্মনাম নিয়ে প্রবেশ করেছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘তাদের ছদ্মনাম জানেন কি না?’
‘হ্যাঁ। একজনের নাম ‘রুই জর্জ’, অন্যজনের নাম ‘পেড্রো পেট্রিট।’
‘পুলিশকে আগে জানাননি কেন?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ প্রধানের।
‘ওরা এয়ারপোর্টে নামার পর সন্দেহ হওয়ায় ওদের ফলো করতে গিয়ে আমরা এটা জানতে পেরেছি।’ উত্তর দিল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কেন আপনারা সন্দেহ করলেন? আমাদের পুলিশ তো সন্দেহ করতে পারেনি।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘এয়ারপোর্টের বাইরে ওদের কথাবার্তা শুনে আমাদের লোকদের সন্দেহ হয়। পরে খোঁজ নিয়ে এই তথ্য জানা গেছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘এখন বলুন ওরা কি কষ্ট দিচ্ছে, আমরা কি করতে পারি? আর একটা উপকার করুন, আপনারা যেহেতু প্রথম জেনেছেন তাই আপনারা ওদের দুজনের বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করুন যে, তারা নাম ভাঁড়িয়ে অবৈধভাবে এখানে প্রবেশ করেছে।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘আমাদের লোকরা ওদের তাড়া করলে ওরা আশ্রয় নেয় গনজালো উচ্চভূমিতে। আমাদের দুটি হেলিকপ্টার ওদের তাড়া করেছিল। ওদের ধরতে চেষ্টা করতে গেলে ওরা আমাদের একটা হেলিকপ্টার ধ্বংস করে এবং দশজন লোককে হত্যা করে। অন্য হেলিকপ্টারও আমাদের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান। কণ্ঠে সে অসহায় সুর ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করল।
ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠেছে পুলিশ প্রধানের। বলল, ‘সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। পুলিশকে না জানিয়ে আপনারা এভাবে গেলেন কেন? সন্ত্রাসীদের বাগে আনা কি আপনাদের কাজ?’
‘পুলিশকে জানানোর আমরা সুযোগ পাইনি। ওরা পালিয়ে যাবে এই আশংকায় আমাদের লোকরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের অনুসরণ করে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘একটা কথা বলুন মি. ওয়াইজম্যান, যে কাজ পুলিশের সে কাজ আপনারা কাঁধে তুলে নিতে গিয়েছিলেন কেন? ওদের সাথে আপনাদের কি কোন বিশেষ শত্রুতা আছে?’ বলল পুলিশ প্রধান।
একটু বিব্রত দেখাল আজর ওয়াইজম্যানকে। একটু চুপ করে থাকল, তারপর বলল ধীর কণ্ঠে, ‘মুসলিম সন্ত্রাসীরা আমাদের ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরোধী ছিল, আমাদের অস্তিত্বেরও ওরা বিরোধী। আমাদের অবস্থান যেখানে ওদের সন্ত্রাসও সেখানে। বিশ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, কিন্তু যুদ্ধটা তারা শেষ করেনি। বরং মার্কিনীরা এখন ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠছে মুসলমানদের বন্ধু। এর ফলে ওদের সন্ত্রাসের প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়েছি আমরা। এই আজোরস দ্বীপপুঞ্জেও ওরা আমাদের শান্তিতে থাকতে দিতে চায় না।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান। শেষ দিকে তার কণ্ঠ হতাশ ও করুণ হয়ে পড়েছিল।
সহানুভূতি ফুটে উঠল পুলিশ প্রধান বারবোসার চোখে-মুখে। বলল, ‘মি. ওয়াইজম্যান চিন্তা করবেন না। আমাদের এই দ্বীপপুঞ্জ শান্তির দেশ। এখানে কোন সন্ত্রাসীর জায়গা হবে না। আপনি দয়া করে একটা অভিযোগ দায়ের করুন। আমরা দেখছি ব্যাপারটা?’
‘কিন্তু স্যার ব্যাপারটা খুব জরুরী। এই মুহূর্তে ওদের যদি পাকড়াও করা না যায়, তাহলে আরও খুনোখুনি তারা করবে। আর একবার নাগালের বাইরে চলে গেলে ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ওরা কোথায় এখন?’ জিজ্ঞেস করল পুলিশ প্রধান।
‘আমরা মনে করছি, গনজালো উচ্চভূমি থেকে দক্ষিণ দিকে সরে ট্রাইবাল এরিয়া সিলভার ভ্যালি’তে তারা প্রবেশ করেছে। এখান থেকে তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক দ্বীপপুঞ্জের অন্য কোথাও যাওয়া তাদের জন্যে সহজ হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ঠিক আছে মি. ওয়াইজম্যান, আমি তেরসিয়েরা দ্বীপের পুলিশ প্রধানকে নির্দেশ দিচ্ছি তিনি যেন সিলভার ভ্যালি’ থেকে বেরুবার পথগুলোর উপর নজর রাখেন এবং এই ঘটনার তদন্ত যেন তিনি শুরু করেন।’ বলল পুলিশ প্রধান।
একটু থেমেই আবার সে বলে উঠল, ‘আমাকে এখন উঠতে হয় মি. ওয়াইজম্যান।’
আজর ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার অফিসে আপনার এই পদধুলির জন্যে আমি কৃতজ্ঞ মি. বারবোসা। আরও ধন্যবাদ সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছি তার জন্যে।’
বলে আজর ওয়াইজম্যান হাত বাড়ালো পুলিশ প্রধানের দিকে।
‘ধন্যবাদ। বাই।’ বলে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে গেল পুলিশ প্রধান।
গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত পুলিশ প্রধানকে পৌছে দিয়ে ফিরে এল আজর ওয়াইজম্যান ও জ্যাক শামির।
বসল তারা আবার মুখোমুখি সোফায়।
সোফায় গা এলিয়ে ক্রুব্ধ কণ্ঠে আজর ওয়াইজম্যান বলল, ‘এই বেটা পুলিশ প্রধান জার্মান অরিজিন। নাজিদের রক্ত আছে এর শরীরে। ইহুদীরা যেন ওর কাছে কিছুই নয়। বলে তদন্ত করব। গোল্লায় যাক তোর তদন্ত। তেরসিয়েরার পুলিশ প্রধান তোর চেয়ে হাজার গুণ ভাল তার সাথে অলরেডি যোগাযোগ হয়েছে। ডলার একটু বেশি চেয়েছে। তা হোক, আমাদের আজকের প্রয়োজনের চেয়ে এটা বড় কিছু নয়।’
‘তাহলে তো মি. বারবোসাকে এসব বলে ভুল হলো। তিনি যদি এখন তেরসিয়েরা দ্বীপের পুলিশ প্রধানের কাজে হস্তক্ষেপ করেন।’ বলল জ্যাক শামির।
‘তুমি এসব নিয়ে ভেব না। এখন তুমি বল, আজোরস এর শীর্ষ সন্ত্রাসী নেতা ‘ফিগো’কে খবর দিয়েছ?’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
জ্যাক শামির ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘খবর দিয়েছি। এখনি এসে পড়বে।’
‘ঠিকই বলেছ তুমি, পুলিশ প্রধান মি. বারবোসাকে এসব কথা না বললেই ভাল ছিল। এদিকটা ভেবেই কিন্তু আমি তোমাকে ফিগোকে খবর দিতে বলেছিলাম। মাঝখানে আবার বলে ফেললাম পুলিশ প্রধানকে। থাক, একদিক দিয়ে ভালই হলো। ওনাকে তো জানিয়েই দিলাম, ত্বরিৎ কিছু না করলে ওরা খুনোখুনির সুযোগ পেয়ে যাবে। এখন এই দ্বীপে বিশেষ করে সিলভার ভ্যালি অঞ্চলে যা কিছুই ঘটুক এর জন্যে দায়ী হবে আহমদ মুসা। এটা ভালই হলো আমাদের জন্যে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল জ্যাক শামির। দরজায় নক করে ঘরে ঢুকল এ্যাটেনডেন্ট। বলল জ্যাক শামিরকে, ‘স্যার মি. ফিগো নামে একজন লোক এসেছেন।’
শুনেই উঠে দাঁড়াল জ্যাক শামির। ‘স্যার আপনি বসুন। আমি ওঁকে নিয়ে আসছি।’ বলে বেরিয়ে গেল জ্যাক শামির।
মিনিট খানেক পরেই বিরাট বপু একজনকে নিয়ে ঘরে ঢুকল জ্যাক শামির।
সাদাকালো ষ্ট্রাইফের টিসার্ট গায়ে। পরনে সাদা প্যান্ট। মাথায় সাদা হ্যাট।
এরই নাম আলফ্রেড ফিগো।
একেবারে খাঁটি পর্তুগীজ চেহারা। দেখেই মনে হয় সিউর এক জলদস্যু। তবে ফিগো জলে দস্যুতা করে না। সে আজোরস দ্বীপপুঞ্জের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেতা। তার বাহিনী এই দ্বীপপুঞ্জে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ফিগো ঘরে ঢুকতেই আজর ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়াল। কয়েক ধাপ এগিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘ওয়েলকাম ওয়েলকাম, আমি আপনারই অপেক্ষা করছি।’
‘গুড ইভনিং স্যার’ বলে বসতে বসতে আবার বলে উঠল, ‘মনে হলো পুলিশ প্রধান এখান থেকে বেরিয়ে গেল?’
‘হ্যাঁ, এসেছিলেন। পোর্ট থেকে ফেরার পথে একটু ঢুঁ মেরে গেলেন। অনেক দিন থেকে জানাশোনা তো!’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘বলুন স্যার। আমাকে ডেকেছেন কেন? আমরা আপনার কোন কাজে লাগতে পারি?’ বলল ফিগো। একদম নিরস কণ্ঠ তার।
‘মি. ফিগো, আমরা আপনার সাহায্য চাই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কি কাজ? কোন ধরনের কাজ?’ বলল ফিগো।
‘আমাদের বিদেশী দুজন শত্রু প্রবেশ করেছে তেরসিয়েরা দ্বীপে। গত রাতেই ‘লিজে’ এয়ারপোর্ট হয়ে এসেছে ওরা। আমাদের লোকরা তাদের তাড়া করেছিল। কিন্তু আমাদের লোকদের হত্যা করে ওরা পালিয়েছে। এ দুজনকে জীবন্ত অথবা মৃত আমরা চাই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ওরা কোথায়, মানে কোন অঞ্চলে এখন?’ জিজ্ঞেস করল ফিগো।
‘দুপুরে পাওয়া তথ্য অনুসারে ওরা সিলভার ভ্যালিতে প্রবেশ করেছে। দুএকদিন সময় পেলে ওরা অন্য দ্বীপে পালাবে। আমরা চাই তেরসিয়েরা দ্বীপেই যাতে ওদের জীবনের ইতি ঘটে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘সিলভার ভ্যালি হলো গনজালোদের এলাকা। ওখানে তো কোন বিদেশী আশ্রয় পাবার কথা নয়।’ ফিগো বলল।
‘আশ্রয় হয়তো পাবে না। ওদিক দিয়ে হয়তো তারা পালাবার চেষ্টা করবে। আমরা চাই তারা পালাতে না পারুক। আমরা চাই তারা মরুক, অথবা ধরা পড়ুক।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘বলুন আমাদের কি করতে হবে।’ বলল ফিগো।
‘ওরা ঐ অঞ্চল থেকে পালাবার আগেই ওদের ধরতে হবে, না হয় মারতে হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আমরা কি পাব?’ বলল ফিগো।
‘বলুন কি চান?’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কম করে হলেও মিলিয়ন ডলারের নিচে আমরা এসব কাজে হাত দেই না।’ বলল ফিগো।
‘আমরা রাজী। কিন্তু অর্ধেকটা এখন পাবেন, বাকি অর্ধেকটা পাবেন কাজ শেষ হওয়ার পর।’
‘ঠিক আছে। তাই হবে। আর কোন কথা আছে?’ বলল ফিগো।
‘আমরা দ্রুত কাজ চাই। আগামী তিন দিনের মধ্যে সবকিছুর ইতি ঘটাতে হবে। প্রথম সুযোগেই তারা দ্বীপ ছেড়ে পালাবে। সেটা হোক আমরা তা চাই না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘সেই দুজন লোকের ফটো আমাদের দিন এবং টাকাও।’ বলে ফিগো উঠে দাঁড়াল।
আজর ওয়াইজম্যান ইশারা করল জ্যাক শামিরকে।
শামির চলে গেল। মিনিট খানেক পরেই প্রবেশ করল বড় একটা ব্রীফকেস নিয়ে।
আজর ওয়াইজম্যান ব্রীফকেস খুলে ফিগোর দিকে মেলে ধরে বলল, ‘আমরা টাকা নিয়ে দর কষাকষি করিনি। আশা করি, কাজের ক্ষেত্রেও আমাদের কোন ওজর শুনতে হবে না। গুণে নিন টাকাগুলো।’
ফিগো ব্রীফকেস হাতে নিয়ে তা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘আমি কোন সময়ই টাকা গুণে নেই না। আমরা বিশ্বাসের উপর বিজনেস করি।’
‘গুডবাই’ বলে ঘর থেকে গট গট করে চলে গেল ফিগো।
স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠল আজর ওয়াইজম্যানের চোখে-মুখে।
‘বিরাট একটা কাজ হলো স্যার।’ ফিগো চলে যাওয়ার পর বলল জ্যাক শামির।
‘কাজ হলো নয়, কাজ দেয়া হলো মাত্র। ঈশ্বর সাহায্য করুন।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘ফিগোদের অসাধ্য কিছু নেই স্যার। পুলিশও তাদের হাতের মুঠোয়।’ জ্যাক শামির বলল।
‘তোমার কথা সত্য হোক শামির।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘আমিন।’ বলে উঠল জ্যাক শামির।
আহমদ মুসা মাগরিবের নামাজ পড়ে হোটেলের কক্ষ থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে।
হোটেলটি দোতলা। বারান্দাটা হোটেলের দক্ষিণের ব্যালকনি।
ব্যালকনির নিচেই রাস্তা। রাস্তাটা সিলভার ভ্যালির গভীর থেকে এসে পুবে কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণ উপকূলের সবচেয়ে বড় শহর আংগ্রা ডে হেরেমা বন্দর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। এই রাস্তারই আরেকটা শাখা দ্বীপের পূব উপকূলের একটা অখ্যাত বন্দরে সাও সিভালায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
রাস্তাটাকে ঠিক রাস্তা বলা যায় না। বলা যায় রাস্তার একটা চিহ্ন এটা। ঘোড়া ও মানুষের যাতায়াত এই পথ-চিহ্নের সৃষ্টি করেছে।
রাস্তার পরেই নিউ টাগুস নদী। রাস্তাটা নদীকে অনুসরণ করেই এগিয়ে গেছে আংগ্রা ডে হেরেমা পর্যন্ত। পাহাড় ও চড়াই-উৎরাই বাধার কারণে রাস্তাটা সব সময় নদীর তীর বেয়ে এগুতে পারেনি।
নদীটা খুবই খরস্রোতা। সিলভার ভ্যালিতেই শুধু এটা কিছুটা নাব্য, তারপর গোটাটাই অনাব্য।
হোটেলটা সিলভার ভ্যালির পূব মুখের উপর দারোয়ানের মত দাঁড়িয়ে।
হোটেলটা উত্তর থেকে এগিয়ে আসা একটা পাহাড়-শ্রেণীর দক্ষিণ প্রান্তের শেষ টিলার উপরে। হোটেলের পরেই রাস্তা, রাস্তার পর নদী এবং নদীর পরেই পাহাড়-শ্রেণীটা প্রথমে দক্ষিণে কিছু দূর এগিয়ে দুভাগ হয়ে একটা দক্ষিণে, অন্যটি পশ্চিমে এগিয়ে গেছে।
পুব দিক থেকে সিলভার ভ্যালিতে প্রবেশের পথ এই একটাই। এই প্রবেশ পথেরই দ্বাররক্ষী যেন হোটেলটা।
হোটেলটাও আবার ঠিক হোটেল নয়। অনেকটাই সরাইখানার মত। সিলভার ভ্যালিতে উৎপাদিত শস্য, ফল-মুল কেনার জন্যে যে ব্যাপারী, পাইকার ও যেসব ফড়িয়ারা উপত্যকায় আসেন, তারাই এই সরাইখানায় উঠে থাকেন। হোটেল বা সরাইখানায় নিয়মিত রান্নার কোন ব্যবস্থা নেই। অতিথি কেউ আসলে তার জন্যে রান্না হয়। এই হোটেলের মালিক ও তার পরিবার থাকেন পাশেই পাহাড়ের এক গুহাকে কেন্দ্র করে তৈরি বাড়িতে।
হোটেলের মালিক নব্বই বছর বয়সের এক বৃদ্ধ। নাম নুনো কাপুচো। আফ্রিকান, রেড ইন্ডিয়ান ও এস্কিমো সবারই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার চেহারা। তার ভাষাও এই ধরনের মিশ্র। গত দেড় দিনে আহমদ মুসার সাথে তার বেশ ভাব হয়ে গেছে। কাপুচো ইতিমধ্যেই আহমদ মুসাকে গর্বের সাথে জানিয়েছে, তারাই দ্বীপপুঞ্জের আদি বাসিন্দা, তাদের ভাষাই দ্বীপপুঞ্জের নিজস্ব ভাষা। বিদেশীদের একদিন এই দ্বীপপুঞ্জ ত্যাগ করতেই হবে। তবে আহমদ মুসাকে সে বিদেশী বলে না, বলে মেহমান।
আহমদ মুসা ইজি চেয়ারে বসে ছিল। তার মুখ পশ্চিমে সিলভার ভ্যালির দিকে। জোৎস্না-স্নাত ভ্যালির বুকে তার চোখ দুটি নিবদ্ধ। গত দেড়টা দিন সে ভ্যালিতে ঘুরে বেড়িয়েছে। উপত্যকাটার নাম সিলভার ভ্যালি। নামটা স্বার্থক। সিলভার ভ্যালির চারদিকেই পাহাড়। পাহাড় থেকে ভ্যালিতে নেমে এসেছে অনেক সফেদ ঝর্ণা। এই ঝর্ণাগুলো সমৃদ্ধ ও বেগবান করেছে উপত্যকার একমাত্র নদী নিউ টাগুসকে। এই পাহাড়ী টাগুসের জন্ম আরও পশ্চিমের উঁচু পাহাড়ে। সফেদ ঝর্ণা, রূপালী নদী, সবুজ সোনালী শস্যক্ষিত এবং ফলের অজস্র বাগান ও সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়ের দেয়াল অপরূপ করে তুলেছে সিলভার ভ্যালিকে। সন্ধ্যার হালকা আঁধারের ওপর রূপালী জ্যোৎস্নার বিচ্ছুরণ এক মায়াময় দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে উপত্যকাটিকে ঘিরে। আহমদ মুসা এই দৃশ্যই উপভোগ করছে।
উপত্যকার গভীরে তারার মত একটা আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আহমদ মুসা নিশ্চিত ওটা সার্গিও ভ্যানিসাদের বাড়ির আলো।
সার্গিও ভ্যানিসাদের বাড়ি সিলভার উপত্যকার মাঝখানে একটা পাহাড়ের উপর। পাহাড়ের গোড়া দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নিউ টাগুস নদী।
চারদিকের সবুজের মাঝখানে ওদের সাদা পাথরের সফেদ বাড়িটা ছবির মত সুন্দর।
কিন্তু আহমদ মুসা তাদের বাড়িতে উঠতে রাজী হয়নি। আহমদ মুসা ওদের বাড়িতে উঠতে অস্বীকার করলে কেঁদে ফেলেছিল ভ্যানিসা। সার্গিও কাঁদেনি বটে, কিন্তু দুঃখ পেয়েছিল, কিছুটা অপমানিতও বোধ করেছিল। আহমদ মুসা ওদের বুঝাতে চেষ্টা করলে সার্গিও বলেছিল, ‘আপনি সিলভার ভ্যালিতে এলেন, অথচ আমাদের বাড়িতে না উঠে গিয়ে থাকবেন চাল-চুলোহীন একটা সরাইখানায়, এটা আমাদের জন্যে চরম দুঃখের এবং অপমানেরও।’ ভারী হয়ে উঠেছিল সার্গিওর কণ্ঠস্বর।
গম্ভীর হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসা। ধীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘তোমাদের ওখানে উঠতে পারলে তোমাদের চেয়ে আমিই খুশি হতাম বেশি। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে আমি এই খুশিকে কুরবানী দিতে চাই।’
‘সে স্বার্থটা কি?’ ত্বরিত কণ্ঠে বলে উঠেছিল ভ্যানিসা।
‘তোমরা কঠিন ও মহান এক দায়িত্ব পালন করছ তোমাদের জনগনের পক্ষে। আমি চাই, কোনভাবেই যেন আমার দ্বারা তোমাদের এ আন্দোলনের কোন ক্ষতি না হয়।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘এ প্রশ্ন উঠছে কেন? আপনি যাচ্ছেন আমাদের বাড়িতে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষতির প্রশ্ন এখানে ওঠে কি করে?’ বলেছিল ভ্যানিসা।
‘তোমাদের বাড়িতে যাওয়া বড় কথা নয়। এই যাওয়ার মাধ্যমে তোমাদের সাথে আমার পরিচয় ও সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা সবাই জানবে, এটা বড় কথা। এই বিষয়টাকে তোমাদের শত্রুরা, তোমাদের সরকার তোমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘কিভাবে?’ বলেছিল ভ্যানিসা।
‘বলবে, এটা ওদের স্বাধীনতা আন্দোলন নয়, বরং দেশ বিক্রি করার একটা ষড়যন্ত্র। ওরা দেশকে বিদেশ, বিধর্মী ও মৌলবাদের চারণক্ষেত্র বানাতে চায়। সম্প্রতি সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী নেতা আহমদ মুসা নাম ভাড়িয়ে এদেশে প্রবেশ করে ওদের বাড়িতে গোপনে অবস্থান করেছে। সুতরাং গনজালো পরিবার বিদ্রোহী, ষড়যন্ত্রকারী ও বিদেশীদের এজেন্ট। ব্যস, কেল্লাফতে। তোমরা তো বলতে পারবে না আমি আসিনি, আমি তোমাদের সাথে থাকিনি।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
সংগে সংগে কথা বলেনি সার্গিও ও ভ্যানিসা। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে ভাবনার চিহ্ন।
একটু পরে ম্লান হেসেছিল সার্গিও। বলেছিল, ‘ঠিক বলেছেন ভাই, এই কথা তারা বলতে পারে।’
‘বলতে পারে নয় মি. সার্গিও, তারা বলবে। আরও একটা কথা মি. সার্গিও। আমার আশংকা যদি সত্য হয়, তাহলে নিশ্চিত জানবেন ওরা আমাদের সন্ধানে আসছে। ওরা এসে পড়ার আগেই যদি আমি সিলভার ভ্যালি ত্যাগ করতে না পারি, তাহলে সংঘাত বাধতে পারে। সেই সংঘাতে গনজালো পরিবার জড়িয়ে পড়লে মহাক্ষতি হবে আপনাদের পরিবারের এবং আপনাদের মহান আন্দোলনের। আমি যদি এই ভ্যালিতেই আলাদা থাকি, তাহলে সংঘাত বাধলেও সেটা হবে আমার ও ওদের মধ্যে। মনে করা হবে, আমি ভ্যালিতে এসে লুকিয়েছিলাম। ভ্যালির কারো সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
ম্লান হাসি ফুটে উঠেছিল ভ্যানিসার মুখেও। বলেছিল আহমদ মুসা থামতেই, ‘আপনার কথা সত্য ভাইয়া, কিন্তু এখন আপনার নিজের কথা ভাবার কথা, আমাদের কথা ভাবছেন কেন?’
‘কৌশল নির্ধারণ করতে হলে সবটা বিষয়ই এক সাথে ভাবতে হবে ভ্যানিসা।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
গম্ভীর হয়ে উঠেছিল ভ্যানিসার মুখ। বলেছিল, ‘জনাব আহমদ মুসার সাথে যুক্তি বুদ্ধি কোন দিক দিয়েই পারবো না। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি আমাদেরকে অমন তৃতীয় শ্রেণীর সরাইখানায় রাখতে পারতেন?’
আবেগে রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল ভ্যানিসার কণ্ঠ। ছলছলে হয়ে উঠেছিল তার চোখ।
ম্লান হাসি ফুটে উঠেছিল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলেছিল সান্তনা দেওয়ার সুরে, ‘তুমি ঠিক বলেছ ভ্যানিসা। আমিও পারতাম না তোমাদেরকে তৃতীয় শ্রেণীর সরাইখানায় রাখতে। কিন্তু আমাদের তো এখন সেই শান্তির সময় নয়। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে এখন। থাকা, খাওয়া, ঘুম ইত্যাদির যুদ্ধকালিন অবস্থা শান্তির সময় থেকে একদমই আলাদা। তুমি যদি এদিকটা ভাব ভ্যানিসা তাহলে আর খারাপ লাগবে না।’
চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে হেসে উঠেছিল ভ্যানিসা। বলেছিল, ‘আপনি কেন বন্দুক হাতে নিতে গেলেন ভাইয়া। এক শান্তির নীড়ে, এক স্নেহময় ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি আপনি। মাত্র কয়েক ঘন্টার পরিচয় আপনার সাথে। তবু আমি ভাবছি, আপনার জাতীয় ও সামাজিক রূপের চাইতে আপনার পারিবারিক রূপটাই হবে মনোমুগ্ধকর বেশি।’
একটু থামল ভ্যানিসা। কিন্তু আহমদ মুসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুহূতর্কালের মধ্যেই আবার বলে উঠেছিল, ‘আপনার প্রস্তাবে এক শর্তে রাজী।’
‘কি সেই শর্ত?’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘সরাইখানার বিছানা ব্যবহার করতে পারবেন না, খাবার খেতেও আপনি পারবেন না। বিছানা আমাদের বাসা থেকে ওখানে যাবে, খাবারও যাবে নিয়মিত সেখানে।’ ভ্যানিসা বলেছিল।
‘আমি তোমার প্রস্তাবে রাজী, তবে একটা শর্তে।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘কি শর্ত?’ জানতে চেয়েছিল ভ্যানিসা।
‘বিছানা, খাবার তোমাদের বাসা থেকে আসতে পারবে, আমরা তাতে পরম আনন্দও বোধ করব, তবে শর্ত হলো এ বিষয়টা কাকপক্ষীরও জানা চলবে না।’ বলেছিল আহমদ মুসা।
‘আমি রাজী এ শর্তে।’ ভ্যানিসা বলেছিল আনন্দিত কণ্ঠে।
‘কিন্তু ভ্যানিসা, কাকপক্ষী না জানার শর্ত পূরণ করে কিভাবে তুমি নিয়মিত খাবার পাঠাবে?’ বলেছিল সার্গিও।
হেসেছিল ভ্যানিসা। বলেছিল, ‘আমাদের ভেড়া-ছাগল-গরুর পালটা এখন উপত্যকার পুব-মুখ ঘেঁষেই অবস্থান করছে। পালের সাথে চার পাঁচজন রাখাল রয়েছে। তাদের যাতায়াত আছে সরাইখানায়। ওরাই খাবার পৌছাবে।’
খুশি হয়েছিল সার্গিও। ভ্যানিসাকে ধন্যবাদ দিয়ে সে বলেছিল, ‘এ চিন্তা তোমার মাথায় এল কি করে? যতই চিন্তা করি এ বিষয়টা আমার মাথায় আসতো না।’
আহমদ মুসাও ধন্যবাদ দিয়েছিল ভ্যানিসাকে।
সত্যি ভ্যানিসা তার কথা অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করেছে। রাখালরাই তিন বেলা তার খাবার নিয়ে আসে। হোটেল মালিক নুনো কাপুচোর কাছ থেকেও খাবার আসে। ওগুলো রাখালরা নিয়ে যায় নিজেরা ভোজ করার জন্যে।
আহমদ মুসা শুকরিয়া আদায় করল যে, এখন পর্যন্ত কোন দিক থেকে কিছু ঘটেনি। ভালই যাচ্ছে সময়। মনে মনে আহমদ মুসা কৃতজ্ঞতা জানাল সার্গিও ও ভ্যানিসাদের।
আহমদ মুসা তার চোখ ফিরিয়ে আনল ভ্যানিসাদের বাড়ির দিক থেকে।
পেছনে পায়ের শব্দ পেয়েছে আহমদ মুসা।
দৃষ্টিটা ফিরিয়ে তাকাল আহমদ মুসা পেছন দিকে। দেখল হাসান তারিক ও হোটেলের মালিক নুনো কাপুচো ব্যালকনিতে প্রবেশ করেছে।
এই অসময়ে হোটেল মালিক নুনো কাপুচোকে আসতে দেখে কিছুটা বিস্মিতই হলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে একটা চেয়ার টেনে সামনে এনে বসতে বলল নুনো কাপুচোকে।
আহমদ মুসার পাশের চেয়ারে বসল হাসান তারিক।
বসেই হাসান তারিক বলে উঠল, ‘ভাইয়া, মি. কাপুচো বলছেন কিছু লোক নাকি ভ্যালীতে বিদেশীদের খোঁজ করছে।’
ভ্রুকুচকালো আহমদ মুসা। চেয়ারে নড়ে-চড়ে বসল। বলল, ‘মি. কাপুচো, ঘটনা কি?’
‘হ্যাঁ, হঠাৎ যেন সবাই আজ বিদেশী খোঁজ করতে লেগে গেছে। আজ বাজারে আমাদের তিনজন কাবিলা প্রধান আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আমাদের সিলভার ভ্যালিতে আমি দুজন বিদেশীকে দেখেছি কিনা। আজ দুপুরের পর দুজন বাইরের লোক এসেছিল হোটেলে। জিজ্ঞেস করেছিল, হোটেলে কোন বিদেশী এসেছে কিনা, এসেছিল কিনা। আমি বুঝতে পারছি না ঘটনা কি!’ বলল নুনো কাপুচো।
‘বাইরে থেকে এসেছিল ওরা কারা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। তার চোখে-মুখে ভাবনার ছাপ।
‘ওরা ফল ব্যবসায়ীর লোক। মাঝে মাঝেই ওরা আসে ফল মূলের পাইকারী মার্কেটে।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘ওরা কাকে খুঁজছে, কেন খুঁজছে বলেছে কিছু?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সে রকম সুনির্দিষ্টি করে কিছু বলেনি। বলেছে, দুজন বিদেশী হারিয়ে গেছে, তাদেরকেই ওরা খুঁজছে। ওরা নাকি গনজালো প্যালেসেও খোঁজ করেছে। সেখানেও কোন বিদেশী নেই।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘দেখা যাচ্ছে, অনেক লোক লেগেছে খোঁজ করতে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ অনেক লোক। ভ্যালিরও অনেক লোক লেগেছে। কয়েকজন কবিলা প্রধানও। যে কোন মূল্যে বিদেশীদের নাকি ওদের খুঁজে বের করা চাই।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘আমরাও তো বিদেশী। কেউ তো আমাদের খোঁজ করেনি?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি তো বিদেশী বলিনি। আমি বলেছি আমার দুজন মেহমান আছে, আর কেউ নেই আমার হোটেলে।’ বলল নুনো কাপুচো।
‘আপনার কথা ওরা বিশ্বাস করেছে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তারা বিশ্বাস করা বা না করার সাথে আমার কিছু এসে যায় না। তারা নিজেরাও খোঁজ নিতে পারে। তাছাড়া তারা শুধু তো আমাকে নয়, আরও অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করছে।’ বলল নুনো কাপুচো।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ঠিকই বলেছেন আপনি।’
নুনো কাপুচো উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘উঠি আমি এখন, বাইরে কাজ আছে।’
‘দুয়ে দুয়ে চার যেমন সত্য, এটাও তেমনি সত্য হাসান তারিক। ওরা আসবে এটা অবধারিত ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ব্যালকনিতে প্রবেশ করল যুটো, সার্গিওদের হেড রাখাল।
‘কি ব্যাপার যুটো? তুমি এ সময়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘স্যার, কিছুটা সামনে ভ্যালির বাইরে দুটি ট্রাক ও একটি মাইক্রো বোঝাই লোক এসেছে। তার সাথে এসেছে একটা জীপ। আমি কথাবার্তায় শুনেছি, তারা এই হোটেল রেড করবে। দুজন বিদেশীকে তারা ধরবে। আমি খবরটা নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের স্যারের কাছে। তিনি আপনাকে এই চিঠি দিয়েছেন।’
বলে যুটো একটা চিঠি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলল।
পড়লঃ
‘ভাই সাহেব,
আপনাদের অবস্থান শত্রুদের কাছে ধরা পড়ে গেছে। যুটো আপনাকে বলবে। আমি ও ভ্যানিসা গোপন একটা গিরিপথে চারটা ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছি। যুটোর সাথে আপনারা চলে আসুন। শত্রুকে কাঁচকলা দেখিয়ে আমরা উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যাব। সংঘাত এড়ানোর আপনার কৌশল সামনে রেখেই আমি এই ব্যবস্থা করেছি।’’
আপনার ভাই,
‘সার্গিও’
চিঠিটা আহমদ মুসা পড়ে হাসান তারিকের হাতে তুলে দিল পড়ার জন্যে।
তারপর তাকাল যুটোর দিকে। বলল, ‘উপত্যকার মুখে ওরা কখন এসেছে?’
‘এক ঘন্টা আগে।’ বলল যুটো।
‘কিন্তু ওরা বাইরে অপেক্ষায় কেন? ঢুকছে না কেন ভেতরে?’ বলল আহমদ মুসা।
আড়াল থেকে ওদের কথা যতটুকু শুনেছি তাতে ধারণা হয়েছে ওরা লোক পাঠিয়েছে ওদের পরিচিত কয়েকজন কাবিলা প্রধানের কাছে উপত্যকায় ঢোকার অনুমতির জন্যে। অনুমতি পেলে মনে হয় ওরা ঢুকবে।
‘কাবিলা প্রধানরা অনুমতি দেবে?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘সরাসরি দেবে না। আমাদের স্যার উপত্যকা কমিটির প্রধান। তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। সে অনুমতি ওরা পাচ্ছে না। কারণ আমাদের স্যার ইতিমধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন।’ বলল যুটো।
‘তাহলে অনুমতি ওরা পাচ্ছে না। অনুমতি না নিয়ে কি ওরা ঢুকবে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘উপত্যকাবাসীদের সাথে লড়াই-এ ওরা নামতে চাইবে না। গাড়ি বোঝাই হয়ে না ঢুকে এমনি দু’চারজন ঢুকতে পারে।’ চিঠি পড়া হয়ে গিয়েছিল হাসান তারিকের। বলল, ‘ভাইয়া কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?’
‘সার্গিও ঠিকই বলেছে। চল আমরা বের হই।’ আহমদ মুসা বলল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওরা তৈরী হয়ে দুতলার সিঁড়ির মুখে এসে মিলিত হলো।
তাকাল আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তোমার মেশিন রিভলবারটা কোথায়?’
‘আমার ব্যাগে।’ বলল হাসান তারিক।
‘না, ওটা শোল্ডার হোলষ্টারে নাও। কোটের বোতাম খুলে রাখ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে ভাইয়া।’ বলে হাসান তারিক ব্যাগ থেকে রিভলবার শোল্ডার হোলষ্টারে পুরল।
সিঁড়ি দিয়ে নামল আহমদ মুসারা।
হোটেলের কাউন্টারের সামনে আসতেই বিভিন্ন দিক থেকে বেরিয়ে এসে জনাছয়েক লোক আহমদ মুসাদের ঘিরে ধরল। কাপড়ের ভেতর থেকে তারা বের করল রিভলবার। এক সাথে ছয়টা রিভলবার তাক করা আহমদ মুসাদের দিকে।
ছয় দিক থেকে ছয়টা রিভলবারকে হা করে উঠতে দেখে আর্তনাদ করে উঠল যুটো।
আহমদ মুসা তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘তুমি যুটোর মত চিৎকার করো না। না জেনে-শুনে এরা নিশ্চয় গুলী করবে না। নিশ্চয় কোথাও ভুল হয়েছে এদের।’
বলে আহমদ মুসা রিভলবারধারী ছয়জনের দিকেই একবার করে তাকাল। তারপর এক জনের দিকে চোখ স্থির করে বলল, ‘আপনিই নিশ্চয় এদের চীফ। এখন বলুন ঘটনা কি?’
‘ঘটনা কিছুই নয়, আমাদের সাথে চলুন। একটু জিজ্ঞাসাবাদ আছে।’ বলল লোকটি।
‘কোথায় যেতে হবে?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এই একটু সামনে।’ বলল লোকটি।
‘জিজ্ঞাসা কেন বলুন তো? কোন কেস-টেস আছে নাকি আমাদের বিরুদ্ধে।’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘সবই জানতে পারবেন।’ বলল লোকটি।
‘না জেনে যেতে যদি না চাই?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমার নাম ফিগো। আমি পাখির মত মানুষ মারতে পারি। দ্বিতীয়বার আমি আর আদেশ করব না। এই মুহূর্তে যাবার জন্যে পা না তুললে গুলী করবে আমার লোকরা।’ বলল ফিগো লোকটা।
কৃত্রিম ভয় ফুটিয়ে তুলল আহমদ মুসা তার চোখে-মুখে। বলল, ‘গুলীর দরকার নেই। আমরা যাব, এবং আপনাদের কি জিজ্ঞাসাবাদ আছে শুনব।’
একটু থামল। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘মি. ফিগো, হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে কি আমরা বেরোবো?’
বিস্ময় ফুটে উঠল ফিগোর চোখে-মুখে। বলল, ‘বিল নিয়ে এখন আপনি ভাবছেন? ঠিক আছে বিল মিটিয়ে দিন।’
আহমদ মুসা হোটেলের কাউন্টারের দিকে এগুলো। কাউন্টারে একজন অল্প বয়সি বয় কাঠ হয়ে বসেছিল, যেন ফাঁসির আসামী। আহমদ মুসা তার সামনে একটা পাঁচশ ডলারে নোট রেখে বলল, ‘বিল কত হয়েছে তুমি তো বলতে পারবে না। মি. কাপুচোকে এই টাকাটা দিয়ে দিয়ো। যদি কিছু বাকি থাকে পরে শোধ করব।’
আহমদ মুসা কাউন্টার থেকে সরে এল। তাকাল হাসান তারিকের দিকে। বলল, ‘চল, না গিয়ে তো বাঁচা যাচ্ছে না।’
বলে আগে আগে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। তার পেছনে হাসান তারিক শুরু করল হাঁটা। তাদের পেছনে ঐ ছয়জন। তাদের রিভলবারগুলো এখন আগের মত আহমদ মুসাদের দিকে তাক করা নয় এবং ট্রিগার পয়েন্টেও নয়।
রাস্তায় নামার পরেই শুরু হলো অন্ধকারে পথ চলা।
হোটেল থেকে পুবে দুশ’গজ পরে পাহাড় ও নদীর মাঝের প্যাসেজটা সবচেয়ে সংকীর্ণ। কোন রকমে দুটি গাড়ি এই প্যাসেজ দিয়ে পাশাপাশি চলতে পারে। এটাই সিলভার উপত্যকায় প্রবেশের গেট।
কিন্তু গেটে কোন দরজা নেই।
গেট পার হয়ে ওপারে পৌছে গেল সবাই।
ওপারে পৌছতেই পেছন থেকে ফিগোর কণ্ঠ শোনা গেল। বলে উঠছে সে, ‘যে যেভাবে আছ সেভাবে দাঁড়াও।’
ফিগোর কণ্ঠ চাপা বজ্রের মত শোনাল।
সবাই দাঁড়িয়ে গেল।
আবার ধ্বনিত হলো ফিগোর কণ্ঠ। বলল তার দুজন সাথীকে লক্ষ্য করে, ‘জেভি ও কষ্টা, তোমরা শয়তান দুটোকে বেঁধে ফেল।’
আহমদ মুসা দাঁড়াবার আদেশ পেতেই হাসান তারিকও তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসান তারিক পাশে দাঁড়াতেই আহমদ মুসা ফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওরা দ্রুত কিছু ঘটাতে পারে। প্রস্তুত।’
ফিগোর নির্দেশ পাবার পর জেভি ও কষ্টা নামের দুই ব্যক্তি এগুলো আহমদ মুসাদের দিকে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পুবমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জেভি ও কষ্টা পেছন থেকে এগুচ্ছে ওদের দিকে। চারদিকের নিশ্ছিদ্র নিরবতার মাঝে তাদের পায়ের কেডস পাথুরে রাস্তার বুকে শব্দ তুলছে। আহমদ মুসার কান দুটি উৎকর্ণ সেই শব্দের দিকে। প্রতিটি পদক্ষিপ যেন গুণছে।
পায়ের শব্দটি আহমদ মুসার পেছনে এসে দাঁড়াবার সাথে সাথে আহমদ মুসা একদিকে তার ডান হাতকে এগিয়ে দিল শোল্ডার হোলষ্টারে রাখা তার এম-১০ মেশিন রিভলবারের দিকে। অন্যদিকে বোঁ করে এবাউট টার্ণে তার বাঁ হাতকে ছুঁড়ে দিল পেছনে দাঁড়ানো লোকটির গলার দিকে। হাতটি অক্টোপাশের মত লোকটির গলা পেঁচিয়ে তাকে যখন টেনে নিয়ে আসছিল আহমদ মুসার দিকে, তখন আহমদ মুসার ডান হাতে উঠে আসা এম-১০ বুলেট বৃষ্টি শুরু করেছিল সামনে দাঁড়ানো লোকদের দিকে।
ভোজবাজীর মত এ ঘটনা বুঝে ওঠার আগে তাদের রিভলবারের ট্রিগার টেপার সময় পেছনের লোকরা পেল না। শুধু রিভলবারের ট্রিগার টেপার সময় পেয়েছিল ফিগো। দুটো গুলীও ছুঁড়েছিল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু গুলী দুটো আহমদ মুসার বক্ষ ভেদ না করে তার বুকে চেপে ধরা ফিগোর সাথীরই পিঠ ফুটো করে দিল। তৃতীয় গুলী ছোঁড়ার সুযোগ ফিগো আর পায়নি। আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের গুলীবৃষ্টি তাকেও ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল।
আহমদ মুসা গুলী বর্ষণ শুরু করার সাথে সাথে হাসান তারিক হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল। সেই সাথে তার হাতে আসা মেশিন রিভলবার প্রথমেই গুলী করেছিল তাকে বাঁধতে আসা লোকটিকে এবং তারপর সামনের দিকে ব্রাশ-ফায়ার করেছিল অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের রিভলবার যখন নিরব হলো, তখন অন্ধকারেই দেখা গেল সামনে কেউ দাড়িয়ে নেই। তবে অন্ধকারের কারণে বুঝার উপায় নেই কার কি অবস্থা।
‘নিশ্চয় কেউ বেঁচে নেই।’ প্রথম কথা বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ তাই। বেঁচে থাকলে গুলী করার এই সুযোগ তারা নিত।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই তারা শুনতে পেল তাদের পেছনে ইঞ্জিনের গর্জন।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই পেছন ফিরে পুব দিকে তাকাল। দেখতে পেল অল্প সামনে তিনটি গাড়ির ছয়টি হেডলাইট জ্বলে উঠেছে। এগিয়ে আসছে গাড়িগুলো।
‘গুলীর শব্দ শুনে কি ঘটেছে তা দেখার জন্যই নিশ্চয় ওরা আসছে।’ বলল হাসান তারিক।
‘এবং তারা মনে করছে, যে গুলীর শব্দ তারা শুনেছে তা তাদের লোকদেরই।’ হাসান তারিক থামতেই বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘তাহলে এখন আমরা কি করব?’ হাসান তারিক বলল।
‘আমরা কিছু করব না, ওরা কি করে সেটা দেখতে চাই।’
কথাটা বলে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘চল, আমরা সিলভার ভ্যালির দিকে হেঁটে গিয়ে ভ্যালির মুখের ওপাশে দাঁড়াই। ওরা এস সাথীদের লাশ দেখুক। তারপর কি করে দেখা যাক।’
বলে আহমদ মুসা সিলভার ভ্যালির দিকে হাঁটা শুরু করল।
হাঁটতে লাগল হাসান তারিক আহমদ মুসার পেছনে।
তিন গাড়ির বহরটি লাশগুলোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সামনের গাড়ির হেডলাইটের আলো ছড়িয়ে পড়ল লাশগুলোর উপর।
তিনটি গাড়ির হেডলাইটই জ্বলছে।
হেডলাইটের আলোতে গাড়িগুলোও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সবার সামনে মাইক্রো। মাইক্রোর ছাদে বিশাল সাইজের একটা মেশিনগান ফিট করা।
গাড়ি তিনটি লাশের সামনে থামার সাথে সাথে মাইক্রোর পেছনের জীপ থেকে দুজন দ্রুত নেমে এল।
তারা মাইক্রোর আড়াল থেকে লাশগুলো দেখে আবার দ্রুত ফিরে গেল জীপে। তারা জীপে ফিরে যেতেই মাইক্রোর ছাদে ফিট করা মেশিনগান গর্জন করে উঠল। গুলীর বৃষ্টি প্রবেশ করল সংকীর্ণ পথ দিয়ে উপত্যকরা ভেতরে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাহাড়ের আড়ালে না থাকলে তাদের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
গুলীবৃষ্টির মধ্যে মাইক্রো থেকে মানুষ নামল। তারা এক এক করে লাশগুলো নিয়ে গাড়িতে তুলতে লাগল।
আহমদ মুসা ফিসফিস করে বলল, ‘তারিক, ওরা আক্রমণে আসছে না। ওদের মেশিনগানের গুলী ওদের লাশ সরিয়ে নেবার ঢাল মাত্র।’
‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ওরা রণে ভংগ দেবে?’ বলল হাসান তারিক। তার চোখে বিস্ময়।
‘একটি কারণে হতে পারে। সেটা হলো যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে তাদের সর্দার রয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ ভাইয়া, ঠিক বলেছেন। ওদের লিডার যে ছিল সে কোন বড় নেতাই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাদের লাশ নিয়ে যাবার এই গরজ কেন?’ বলল হাসান তারিক।
‘লাশ পড়ে থাকলে লাশের মাধ্যমে তাদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে, হয়তো এটা ওরা চায় না।’ আহমদ মুসা বলল।
অব্যাহত গুলীর আড়ালে তারা সবগুলো লাশ তুলে নিল গাড়িতে। গুলী তাদের বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু গাড়িগুলো নড়ল না। নিজেদের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে উপত্যকার সংকীর্ণ মুখটায় এসে দাঁড়াল।
‘ওরা দাঁড়িয়ে কেন। সামনেও এগুচ্ছে না, পেছনেও সরছে না। কারণ কি?’
ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার।
বোঁ করে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরা অবস্থায় আহমদ মুসা তার এম-১০ এর ব্যারেল তুলে নিচ্ছিল।
কিন্তু আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে স্থির হবার আগেই একই সাথে দুটি গুলী এসে আঘাত করল তার এম-১০ মেশিন রিভলবারটিকে। আঘাতে তার তর্জনীও আহত হলো।
রিভলবার পড়ে গেল তার হাত থেকে।
আহমদ মুসার চেয়েও অবস্থা খারাপ হাসান তারিকের। তার দিকে গুলী এসেছিল সেকেন্ড খানেক পরে। হাসান তারিক রিভলবার তুলেছিল গুলী করার জন্যে। কিন্তু তার ট্রিগার টেপার আগেই গুলী এসে বিদ্ধ করেছে তার ডান বাহুকে। ছিটকে পড়ে গেছে তার হাত থেকে রিভলবার।
সামনে থেকে অট্টহাসি ভেসে এল।
আহমদ মুসা তাদের সামনে তিনজন লোককে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারে তাদের অবয়ব পরিষ্কার ছিল না। আহমদ মুসা বুঝতে পারছিল না ওরা কারা? উপত্যকার ভেতরের লোক ওরা, না ওদের সাথে আসা একটা অংশ। লাশ তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ওদের সময় ক্ষেপণের কৌশল এবং লাশ তুলে নেয়ার পরও দাঁড়িয়ে থাকা দেখেই আহমদ মুসার শেষ মুহূর্তে মনে হয়েছিল, লাশ তোলা নাটকের দৃশ্যের দিকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে আক্রমণের ভিন্ন কৌশল তারা গ্রহণ করেছে এবং সেটা তাদের পেছন দিক থেকেই হওয়া স্বাভাবিক। এ ভাবনার সাথে সাথেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে।
অট্টহাসিটা শুনেই কিন্তু আহমদ মুসা চিনতে পারল ওটা আজর ওয়াইজম্যানের গলা।
অট্টহাসি থামল এবং সেই সাথে ভেসে এলো আজর ওয়াইজম্যানের কন্ঠ। বলল আহমদ মুসা, এবার আমরা ভুল করিনি। অধ্যাপক দানিয়েলের বাড়িতে যে ভুল আমরা করেছিলাম, সেটা আর হবেনা। তোমাকে কাউন্টার আক্রমনের আর সুযোগ আমরা দেবনা।
আজর ওয়াইজম্যানের কথা শেষ হতেই তার পাশের ছায়ামূর্তিটির লম্বা ও মোটা ব্যারেলের বন্দুক চোখের পলকে উপরে উঠল। গর্জন করে উঠল ক্ষিপণাস্ত্রের মত। পর মুহূর্তেই দেখা গেল একটা জাল গিয়ে জড়িয়ে ফেলেছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে।
জালটা অদ্ভুত ইলাষ্টিক ধরনের।
বেশ প্রশস্ত জালটি আহমদ মুসাদের জড়িয়ে ফেলার পর সংকুচিত হয়ে একেবারে লাগেজ ব্যাগে পরিণত হয়েছে। হাত-পা নড়ানো ও মুখ এদিক-ওদিক করার সামান্যতম সুযোগও নেই।
আজর ওয়াইজম্যান আবার হেসে উঠল হো হো করে। হাসির পর বলে উঠল আবার, ‘আহমদ মুসা, আমি তোমাকে হত্যা করতে পারতাম। হত্যা করতে চেয়েছিলামও। কিন্তু হত্যা করিনি। তুমি মৌলবাদী ও মিলিট্যান্টদের ব্যাপারে যা জান, দুনিয়ার কেউ তা জানে না। আজকের মুসলিম রেনেসাপন্থীদের তুমি এক অনন্য অভিধান। তোমাকে হত্যা করলে এই অমূল্য অভিধান চিরতরে হারিয়ে যাবে। আমরা তোমাকে এক্সরে করে ধীরে ধীরে সব তথ্য বের করে নিতে চাই। তবে তুমি বেয়াড়া হলে হত্যা করতে এক সেকেন্ডও দেরি করা হবে না।’
কথা শেষ করেই পকেট থেকে মোবাইল বের করল। টেলিফোন করল কাউকে। মোবাইলটা কানে ধরে ওপার থেকে সাড়া পেয়েই বলে উঠল, ‘সুসংবাদ নাও, দুজনকেই জালে আটকেছি। ওদিকের খবর কি?’
ওপারের কথা শুনে আবার বলে উঠল, ‘আহ বেচারা আলফ্রেড ফিগো! আমি এটাইতো আশংকা করেছিলাম। বিরাট ক্ষতি হলো আমাদের। তোমরা চিন্তা করো না। ফিগোর কাছে কমিট করা পুরো অংকই তোমরা পেয়ে যাবে। আবার চাইলে তোমরা আমার সাথেও কাজ করতে পারবে। যাক, এখন জলদি গাড়ি নিয়ে এস।’
কথা শেষ করেই মোবাইল বন্ধ করল আজর ওয়াইজম্যান। সংগে সংগেই সে তার বাম পাশের দুই সাথীসহ অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে পেছনে ফিরছে। বিস্মিত হয়ে আজর ওয়াইজম্যান পেছন ফিরল। ফিরেই গুলীর মুখোমুখি হলো সে। তার চোখে পড়ল অল্প দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে দুটি ছায়ামূর্তি। তাদের হাতে উদ্যত রিভলবার। আরও চোখে পড়ল, তার পাশের দুই সাথী গুলী বিদ্ধ হয়ে ভূমিশয্যা নিল।
উরুতে গুলীবিদ্ধ হয়েছে আজর ওয়াইজম্যান।
সে দাড়িয়েছিল নদীর তীর ঘেষেই।
তার জামা-কাপড় দিয়ে তখনও পানি ঝরছে। পরিকল্পনা করে নদীর উজান বেয়ে সামনে এসেই তারা পেছন থেকে আক্রমণ করেছিল আহমদ মুসাদেরকে।
পাল্টা আক্রমণের সুযোগ দেখল না আজর ওয়াইজম্যান। ডান হাতের রিভলবার তুলতে গেলেই ওদের গুলীতে ঝাঁঝরা হতে হবে।
মুহূর্তেই তার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল।
তার দেহটা ছিটকে দক্ষিণ দিকে পড়ে গেল। তারপর আরেকটা গড়া দিয়েই নদীতে গিয়ে পড়ল। ছায়ামূর্তি দুটি এবার দ্রুত এগিয়ে এল জালে জড়ানো লাগেজে পরিণত হওয়া আহমদ মুসাদের কাছে।
দুটি ছায়ামূর্তির একজন সার্গিও গনজালো, অন্যজন ভ্যানিসা।
সার্গিও গনজালো তাড়াতাড়ি তার মোজার মধ্যে গুজে রাখা একটা চাকু বের করে জালটা কেটে ফেলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক উঠে দাঁড়াল।
‘ধন্যবাদ মি. সার্গিও, আপনি ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলেন।’
‘ভাই সাহেব, ধন্যবাদটা জুটোর প্রাপ্য। আপনি ও মি. হাসান তারিক আকস্মিকভাবে বন্দী হলে সে ওদের চোখ এড়িয়ে পালায় এবং ছুটে যায় আমাদের কাছে। তা না হলে ওখানে আমরা আপনাদের জন্যে কতক্ষণ দাঁড়াতাম কে জানে!’ বলল সার্গিও।
‘আল্লাহর শুকরিয়া যে, জুটোকে তারা আমাদের সাথে ধরেনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আপনার কৌশল কাজে লেগেছে। উপত্যকার কেউ আপনার সাথে নেই, আপনারা পালিয়ে এসে উপত্যকার হোটেলে উঠেছেন, এটাই তারা সম্ভবত মনে করেছে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিন্তু আপনারা ওদের মেরে আমাদের উদ্ধার করেছেন, এ থেকে ওরা কি ভাববে সেটা এখন চিন্তার বিষয়।’ হাসান তারিক বলল।
হাসান তারিকের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা দ্রুত লাশ দুটির দিকে এগুলো।
ওদের একবার দেখে বলে উঠল আহমদ মুসা, ‘হ্যাঁ মি. সার্গিও, তৃতীয়জন মানে আজর ওয়াইজম্যান কোথায়?’
‘আহত হবার পর যিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। উনি কি আজর ওয়াইজম্যান ছিলেন? ও গড! উনিই তো প্রথম শিকার হওয়া উচিত ছিল।’ বলল সার্গিও গনজালো।
আপনি কি করবেন মি. সার্গিও, আল্লাহ ওকে আরেকটু সময় দিয়েছেন তার পাপের ভারটা পূর্ণ করার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই হবে ভাই সাহেব।’ বলে একটু থামল সার্গিও। পরক্ষণেই আবার বলে উঠল, ‘আমরা আসার পথে প্রচন্ড গুলী-গোলার শব্দ শুনেছিলাম। আর আজর ওয়াইজম্যানের টেলিফোন টকে বুঝলাম, আলফ্রেড ফিগো নামে নেতা গোছের কেউ মারা গেছে। ঘটনা কি ভাই সাহেব?’
আহমদ মুসা সংক্ষেপে তাদের বন্দী করে নিয়ে আসা, ওদের ছয়জনকে হত্যা করে তাদের মুক্ত হওয়া, মেশিনগানের অব্যাহতগুলীর আড়ালে ওদের লাশ তুলে নিয়ে যাওয়া এবং পেছন থেকে আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে তাদের বন্দী হওয়ার কাহিনী বলল।
‘তাহলে ঐ ছয়জনের একজনই ফিগো হবে। তাকেই আজর ওয়াইজম্যান ভাড়া করেছিল আপনাদের হত্যা অথবা বন্দী…………….।’
সার্গিও’র কথা শেষ হলো না।
পেছন থেকে তিনটি ইঞ্জিন প্রচন্ড গর্জন করে উঠলে আহমদ মুসা ও সার্গিওসহ সকলে পুব দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, তিনটি গাড়ি উপত্যকার দিকে আসছে।
সার্গিও দ্রুতকণ্ঠে বলে উঠল, ‘ভাই সাহেব, বন্দী হিসেবে আপনাকে নিয়ে যেতে আসছে। আজর ওয়াইজম্যান ওদের আসার নির্দেশ দিয়েছিল।’
‘আজর ওয়াইজম্যানের এই ইচ্ছাও পূরণ হলো না। কিন্তু আমরা রক্তপাত এড়াতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
সবাই ছুটে আসা গাড়ির দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়েছিল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল হাসান তারিক। কিন্তু থেমে গেল।
সবাই দেখল, উপত্যকার মুখে পৌছার আগেই থেমে গেল গাড়িগুলো।
‘থেমে গেল কেন গাড়িগুলো? আজর ওয়াইজম্যানের নির্দেশ মোতাবেক গাড়িগুলো দ্রুত এখানে চলে আসার কথা।’ বলল সার্গিও বিস্মিতকণ্ঠে।
ভাবছিল আহমদ মুসা।
হঠাৎ তার মুখে নেমে এল প্রসন্নতা। বলল, ‘যিনি ওদের আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনিই ওদের থামিয়ে দিয়েছেন মি. সার্গিও।’
‘তার মানে আহত আজর ওয়াইজম্যান নদী থেকে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।’ হাসান তারিক বলল।
‘হ্যাঁ তাই হাসান তারিক। এ ছাড়া গাড়িগুলো থেমে যাবার আর কোন যুক্তি নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
হঠাৎ ভ্যানিসা চাপাকণ্ঠে আর্তচিৎকার করে উঠল, ‘সার্গিও ভাইয়া, ওরা তো আহত। দেখ, আহমদ মুসা ভাইয়ার ডান হাতে এবং হাসান তারিক ভাইয়ার ডান বাহুতে রক্ত।’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, ‘চিন্তার কারণ নেই ভ্যানিসা, বুড়ো আঙুলের গোড়াটা গুলীর ধাক্কায় একটু ছিঁড়ে গেছে। আজর ওয়াইজম্যানের গুলী আমার পিস্তলকে আঘাত করেছিল।’
হাসান তারিকও বলে উঠল, ‘আমার বাহুটাও ছিঁড়ে গেছে। গুলী অল্প একটু জায়গা ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছে, এখন রক্ত খুব অল্পই বের হচ্ছে।’
ভ্যানিসা তাড়াতাড়ি তার ব্যাগের চেইনটা খুলে গলায় বাঁধা একটা স্কার্ফ বের করল। তাড়াতাড়ি তা ছিঁড়ে একটা অংশ দিয়ে হাসান তারিকের বাহু ও আহমদ মুসার আঙুল বেঁধে দিল। তার বাঁধার ষ্টাইল দেখে হাসান তারিক বলল, ‘আপনি ডাক্তার নাকি?’
‘ডাক্তার নয়, নার্স বলতে পারেন। আমাদের গনজালো পরিবার এবং আমাদের পাহাড়ী ও যাযাবর সব উপজাতির মহিলাদেরই এই ট্রেনিং আছে। আমরা দীর্ঘ এক যুদ্ধে জড়িত। আমাদের মহিলাদেরকেই ডাক্তার ও নার্সের কাজ বেশি করতে হয়।’ বলল ভ্যানিসা।
‘ধন্যবাদ বোন।’ আহমদ মুসা বলল।
ভ্যানিসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু থেমে গেল। ইঞ্জিনের শব্দে তারা সামনে ফিরে তাকাল। দেখতে পেল সামনের গাড়িটা আবার এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।
ওদিকে চোখ রেখে আহমদ মুসা ধীরে ধীরে বলল, ‘আজর ওয়াইজম্যান কি আবার নতুন করে আক্রমণে আসতে চায়? কিন্তু এই রক্তপাত আমাদের জন্যে অপ্রয়োজনীয় এবং সিলভার ভ্যালির জন্যে ক্ষতিকর। এই অবস্থায় আমাদের কি করণীয়।’
আহমদ মুসা থামল।
আহমদ মুসা থামার সাথে সাথে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দও থেমে গেল।
গাড়িটা উপত্যকার প্রবেশ পথের মুখে থেমে গেছ। দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের দেয়ালের ঠিক গা ঘেঁষে। পর মুহূর্তে পেছনের গাড়িটাও এসে তার পাশে দাঁড়াল।
উপত্যকার প্রবেশ মুখে গাড়ি দুটি এমনভাবে দাঁড়াল যে, তৃতীয় কোন গাড়ি যাওয়া আসার পথ বন্ধ হয়ে গেল। এখন গাড়ি দুটির দুপাশ দিয়ে শুধু পায়ে হাঁটা লোকই চলাচল করতে পারবে।
গাড়ি দুটির হেডলাইট উপত্যকার মুখসহ অনেকখানি এলাকা আলোকজ্জ্বল করে তুলেছে। এখন উপত্যকার বাইরে যেই যেতে চাইবে, গাড়ির পড়ে যাবে।
দুটি গাড়ির ছাদের উপর মেশিনগান সাজানো। মেশিনগানের ব্যারেল হা করে আছে উপত্যকার দিকে।
আহমদ মুসার কপাল কুঞ্চিত।
ভাবছিল সে।
বলল একটু পর, ‘মি. সার্গিও ওরা উপত্যকা অবরোধ করে বসল।’
‘অবরোধ? অবরোধ করে কি করবে?’ বলল সার্গিও।
‘আমাকে ও হাসান তারিককে ধরবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিভাবে? অবরোধ করে বসে থাকলেই কি ধরা যাবে? কয়দিন ওভাবে বসে থাকবে তারা?’ বলল সার্গিও।
‘উপত্যকার মুখে ওরা এভাবে বেশি সময় বসে থাকবে না। আমার ধারণা তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করবে এবং পুলিশেরও সাহায্য চাইবে বিশ্বাসযোগ্য কোন কাহিনী ফেঁদে। উপত্যকার ভেতরের কারও সাথে যোগাযোগ করবে। সবশেষে প্রবেশ করবে উপত্যকায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আর আমরা এ সময় উপত্যকায় বসে হাওয়া খাব তাই না? আপনারা যে পথে এসেছেন, সেই পথেই আবার বেরিয়ে যেতে পারেন, এটা কি তারা জানে না?’ সার্গিও বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘সে দিকের ব্যবস্থাও তারা নিশ্চয় করছে।’
‘তার মানে তারা ঐ পথ অবরোধেরও ব্যবস্থা নেবে?’ বলল সার্গিও।
‘শুধু অবরোধ নয়, ঐ পথে এ উপত্যকায় তারা অভিযানেরও ব্যবস্থা করতে পারে। তাদের ক্ষতি কম হয়নি। তারা নিশ্চয় মনে করছে এ সব আহমদ মুসার কাজ। আহমদ মুসাকে ধরার এটুকু ব্যবস্থা তারা করবেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আমাদের এখন কি করণীয় ভাই সাহেব?’ বলল সার্গিও।
‘আমরা যেভাবে নিরবে উপত্যকায় এসেছিলাম, সেভাবেই বেরিয়ে যাব অর্থাৎ যে পথে এসেছিলাম সে পথেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি যে বললেন ঐ পথেও ওরা অবরোধ বসাচ্ছে বা অভিযানে আসছে?’ বলল সার্গিও।
‘পাহাড়ে ওদের চোখ এড়ানো সম্ভব হবে। সাউন্ড মনিটরিং আমাদের সাহায্য করতে পারে ওদের আগমন চিহ্নিত করার কাজে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু এরপরও সংঘাত বাধতে পারে। কিন্তু আপনি চাচ্ছেন সংঘাত এড়াতে।’ বলল সার্গিও।
‘সংঘাত সব সময় এড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। তবে কেউ ঘাড়ে এসে পড়লে জবাব দিতেই হয়। সে যাক। আমাদের এখন যাত্রা করা উচিত মি. সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু তার আগে আমাদের বাসায় যেতে হবে, এটা আপনার ওয়াদা ছিল।’ বলল ভ্যানিসা।
একটু থামল আহমদ মুসা। বলল, ‘এই উপত্যকার প্রতি একটা মমতার সৃষ্টি হয়েছে। এই মমতা আর বাড়াতে চাই না। আর সময়ও নেই তোমাদের বাড়িতে যাবার।’
‘আপনার কোন কথা শুনব না। যেতে হবে আমাদের বাড়িতে।’ বলে ভ্যানিসা তাকাল সার্গিও গনজালোর দিকে। বলল, ‘ভাইয়া’ এস ওদের নিয়ে।’
কথা শেষ করে হাঁটতে লাগল ভ্যানিসা।
সার্গিও আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘চলুন, উপায় নেই।’
৪
আহমদ মুসা ডাইনিং থেকে ড্রইংরুমে প্রবেশ করে শোফায় বসতে বসতে বলল, ‘হাসান তারিক, মি. সার্গিও, ভ্যানিসা এস আমরা একটু বসি। গন্তব্য নিয়ে একটা আলোচনা সেরে নেই।’
ড্রইং রুমের চারদিকে চোখ বুলাচ্ছিল হাসান তারিক। সে বসতে বসতে বলল, ‘ভাইয়া, যাত্রা শুরুর আগে এ কাজটা অবশ্যই আমাদের সারতে হবে। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলি ভাইয়া, মি. সার্গিওদের গোটা ড্রইং রুমটাই যেন একটা বিরাট এ্যানটিকস। বিশাল শোকেসটার এ্যানটিকসগুলোর মত সোফা, কার্পেট, ওয়ালম্যাট, ছবি সবকিছুই দেখার মত এ্যানটিক্স।’
‘হাসান তারিক ভাইয়া ঠিকই বলেছেন। এগুলো সবই আমাদের পুরানো বাড়ি থেকে আনা সম্পদ; আমাদের জীবন্ত অতীত।’
‘তার মানে এগুলোর কোন কোনটির বয়স পাঁচশ’ ছ’শ বছরও হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার কণ্ঠে।
‘অবশ্যই ভাইয়া। আপনি শোকেসের বড় যে তরবারিটা দেখছেন ওটা এই দ্বীপে আমাদের আদি পূর্ব পুরুষ মি. গনজালোর। প্রত্যেকটা এ্যানটিকসের সাথেই তার বয়স ও পরিচয় সম্পর্কে একটা নোট আছে।’
‘বেশ মজার তো! দেখতে তো হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখবেন? আসুন, খুব খুশি হবো।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
সবাই উঠল।
সত্যিই দেখার মত অনেক জিনিস।
আহমদ মুসা এটা ওটা দেখে হাতে তুলে নিল একটা স্বর্ণমুদ্রা। মুদ্রার আরবী বর্ণমালা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। চোখের সামনে তুলে ধরল সে মুদ্রাটা। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। ক্যালিগ্রাফিক আরবী বর্ণমালায় মুদ্রার উপর অংশের প্রান্ত ঘেঁষে অর্ধচন্দ্রাকারে লেখা ‘আব্দুর রহমান আল নাসির লি দ্বীনিল্লাহ’। আর নিচের অংশে ‘৩১১ হিজরী’। টাকাটা দ্রুত উল্টাল আহমদ মুসা। দেখল টাকার গোটা বুক জুড়ে কাবার ছবি। কাবার ছবি ঘিরে টাকার প্রান্ত ঘেঁষে বৃত্তাকারে লেখা, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’
আহমদ মুসা বুঝল মুদ্রাটি স্পেনের। স্পেনের সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমান এ মুদ্রা চালু করেছিলেন হিজরী ৩১১ সালে। তাঁর উপাধি ছিল ‘আল নাসির লি দ্বীনিল্লাহ’। তিনি স্পেনের সিংহাসনে আরোহণ করেন ৩০০ হিজরীতে। তিনি দীর্ঘ ৬৬ বছর স্পেন শাসন করেন। ইংরেজী সাল হিসেবে ৯১২ খৃষ্টাব্দ থেকে ৯৭৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তার শাসনকাল বিস্তৃত ছিল। তিনি তার সিংহাসনে আরোহণের একাদশ বছরে এই স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন। তার শাসকাল স্পেনে মুসলিম শাসনের স্বর্ণযুগ।
সেই সোনালী দৃশ্যটা স্বর্ণমুদ্রার মধ্যে দিয়ে যেন দেখতে পেল আহমদ মুসা। অপ্রতিরোধ্য এক আবেগে হৃদয়টা তার মোচড় দিয়ে উঠল। হাতের মুদ্রাটা যেন মুদ্রা নয়, একটা সোনালী ইতিহাস। হাতসহ মুদ্রাটা উঠে এল ঠোঁটে। আহমদ মুসা একটা চুম্বন এঁকে দিল মুদ্রার বুকে।
আহমদ মুসার দুচোখের কোণায় অশ্রু টলমল করে উঠেছে।
ভ্যানিসা লক্ষ্য করছিল আহমদ মুসাকে। বিস্ময় ও কৌতুহল ফুটে উঠেছে ভ্যানিসার চোখে-মুখে। বলল, ‘ভাইয়া আপনার চোখে অশ্রু কেন? মুদ্রায় আপনি চুমু খেলেন। মুদ্রাটা কি ভাইয়া?’
সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা। ফিরে এল ইতিহাসের জগত থেকে বাস্তবে। তাড়াতাড়ি রুমাল দিয়ে চোখ মুছে ফেলে ম্লান হেসে বলল, ‘স্যরি। মুদ্রাটা আমাকে এক সোনালী অতীতে নিয়ে গিয়েছিল। মুদ্রাকে আমি চুমু খাইনি, মুদ্রার মাধ্যমে আমি চুমু খেয়েছি সেই ইতিহাসকে।’
‘মুদ্রাটা আমরা সব সময় দেখে আসছি। ওর দুর্বোধ্য লেখা আমরা পড়তে পারিনি। আমরা শুনেছি স্বর্ণমুদ্রাটা এই দ্বীপে আসা আমাদের আদি পুরুষ সাথে করে এনেছিলেন। মুদ্রাটা তিনি যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে এসেছেন। আমরাও তাই করি। না বুঝেই করি। কিন্তু আপনি কি বুঝলেন যে চুমু খেলেন? ভ্যানিসার মত আমারও এটা জিজ্ঞাসা।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসার ভ্রু-কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। বলল, ‘এই দ্বীপে আসা আপনাদের প্রথম পূর্ব পুরুষ এই মুদ্রাকে যত্ন করতেন? কিন্তু কেন?’
‘আপনি যত্নের চেয়ে বেশি কিছু করেছেন। চুমু খেয়েছেন। কিন্তু কেন? এ ‘কেন’র জবাব পেলে ঐ ‘কেন’-রও জবাব হয়তো পাওয়া যাবে।’ বলল ভ্যানিসা।
‘পাওয়া যাবে কি?’ বলে আহমদ মুসা একটু থামল। হাতের মুদ্রাটা হাসান তারিকের হাতে দিল। তারপর আবার কথা বলে উঠল, ‘মুদ্রার উপর স্পেনের মুসলিম সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের নাম ‘আবদুর রহমান আল নাসির লি দ্বীনিল্লাহ’ লেখা রয়েছে। তিনি ৩১১ হিজরী অব্দে এই মুদ্রা চালু করেন। মুদ্রার আরেক পাশে রয়েছে আমাদের পবিত্র তীর্থ কেন্দ্র ‘কাবা শরীফে’র ছবি। সেই সাথে তার পাশে রয়েছে আমাদের কালেমা উৎকীর্ণ। এই মুদ্রার মধ্যে আকস্মিক আমাদের সোনালী ইতিহাসের মুখোমুখি হয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।’
‘বুঝেছি ভাইয়া। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আপনার মতো লোকের হৃদয় এত নরম, এত সংবেদনশীল কিভাবে?’ বলল ভ্যানিসা।
‘কেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করবে, তাদের মন থাকতে নেই নাকি? তোমরাও তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছ। তোমাদের মন নেই?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আছে ভাইয়া। কিন্তু আমাদের অতীত আমাকে কাঁদায়নি, এভাবে আমাকে অভিভূত করেনি কোনদিনই।’ বলল ভ্যানিসা।
কথাটা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘মুদ্রাটা দেখছি আপনাদের ইতিহাস-আবেগের সাথে জড়িত। তাহলে আমাদের সেই মহান পূর্বপুরুষ এই মুদ্রাকে ওভাবে যত্ন করতেন কেন? যক্ষের ধনের মত অমন করে আগলে রেখে দিলেন কেন?’
‘হতে পারে এই মুদ্রার সাথে তাঁর কোন কাহিনী বা স্মৃতি জড়িত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটা হতে পারে।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসা কিছু বলল না। তার চোখে মুখে ভাবনার ছায়া। মনোযোগ দিল সে শোকেসের অন্যান্য এ্যানটিকসের দিকে। হাত বাড়িয়ে সে হাতে তুলে নিল খাপবদ্ধ একটা লম্বা তরবারি।
তরবারি হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তরবারির এই পুরু ও সুন্দর চামড়ার খাপটাও কি সেই সময়ের মি. সার্গিও।’
‘না ভাইসাহেব, তরবারিটার সংরক্ষণের জন্যে খাপটা পরবর্তীকালে তৈরি।’ সার্গিও বলল।
‘খাপটা খুলতে পারি সার্গিও?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই। ’ বলল সার্গিও।
তরবারির খাপ খুলে ফেলল আহমদ মুসা।
দীর্ঘ ও মজবুত তরবারিটাও।
তরবারির সেই আগের রং নেই। কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে ঔজ্জ্বল্য। কিন্তু মরিচা স্পর্শ করেনি তরবারিকে।
তরবারির মেটালটা ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করতে গিয়ে বাঁটের পরেই তরবারির গোড়ার উপর নজর পড়তেই আবার ভ্রু কুঁচকে গেল আহমদ মুসার। আবার সেই আরবী বর্ণমালা। তরবারির গোড়ায় খোদাই করে লেখা পড়ল আহমদ মুসাঃ ‘গাজী আলী বিন জামাল।’ নিশ্চয় মালিকের নাম, ভাবল আহমদ মুসা।
তরবারি থেকে মুখ তুলল আহমদ মুসা। তাকাল সার্গিওর দিকে। বলল, ‘এ তরবারিটার মালিক কে সার্গিও?’
‘কেন, এ দ্বীপে আমাদের পরিবারের প্রথম মানুষ ‘গনজালো গাব্রালা।’ সার্গিও বলল।
‘কিন্তু তরবারিতে লেখা তো ভিন্ন নাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি নাম?’ সার্গিও বলল।
‘গাজী আলী বিন জামাল এবং এ নামটাও আরবীতে লেখা।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেছে সার্গিও এবং ভ্যানিসা দুজনেরই।
কিছুক্ষণ তারা কথা বলতেই পারল না।
পরে ধীরে ধীরে বলল সার্গিও, ‘কিন্তু ভাই সাহেব, এই তরবারি আমাদের পূর্ব পুরুষ গনজালোর, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। শত শত বছর ধরে আমাদের পরিবার এই কথা বলে আসছে এবং একে সংরক্ষণ করে আসছে। ভিন্ন লোকের একটা জিনিসকে, তা যতই মূল্যবান হোক, আমাদের পরিবার নিজের বলে দাবী করবে কেন?’
‘আপনার কথা ঠিক মি. সার্গিও। ব্যাপারটা এ রকমও হতে পারে। আপনার পূর্বপুরুষ গনজালো গাব্রালা স্পেনের স্বর্ণমুদ্রাকে যে কারণে সংরক্ষণ করেছেন, তেমন কোন কারণেই হয়তো তিনি এই তরবারিকেও সংরক্ষণ করেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘টাকা বিনিময়ের মাধ্যম মাত্র। আর তরবারি ব্যবহারের জিনিস। দুটোর মালিকানা এক রকমের নয়। সুতরাং তরবারির সাথে টাকার বিষয়ের কোন তুলনা হয় না ভাই সাহেব।’ সার্গিও বলল।
‘তা ঠিক। কিন্তু তাহলে এর ব্যাখ্যা কি হতে পারে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘হতে পারে তিনি তরবারিটা তার মালিকের কাছ থেকে কিনেছেন বা পেয়েছেন।’ সার্গিও বলল।
আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না।
ভাবছিল সে।
একটু পরেই বলল, ‘আরেকটা রহস্যেরও কিনারা করতে পারছি না সার্গিও। সিলভার ভ্যালির প্রধান নদী নিউ টাগুস। কিন্তু টাগুস নামে একটা নদী আছে স্পেনেও। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের দক্ষিণে স্পেনের ঐতিহাসিক শহর টলেডো। এই টলেডো শহরের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব-বিখ্যাত ছিল। টলেডো শহরটি টাগুস নদীর তীরে অবস্থিত। আমার মনে হচ্ছে এই ‘নিউ টাগুস’ নদীর নাম টলেডোর ‘টাগুস’ নদীর নাম অনুসারেই রাখা হয়েছে। এটাও একটা রহস্য।’
আহমদ মুসা থামতেই ভ্যানিসা বলে উঠল, ‘আপনি বলতে পারেন ব্যাপারটা ‘নিউইয়র্ক’ ‘নিউজার্সি’ ‘নিউ অরলিন্স’ ‘নিউ হ্যাম্পশায়ার’ ইত্যাদির মত। ‘ইংল্যান্ডের ইয়র্ক’ ‘অরলিন্স’ ‘হ্যাম্পশায়ারের’ লোকরা আমেরিকায় গিয়ে তাদের এসব নামের আগে ‘নিউ’, যোগ করে তাদের নতুন বসতি এলাকার নামকরণ করেছে।’
‘হ্যাঁ ভানিসা, এ রকমই মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
হেসে উঠল ভ্যানিসা। বলল, ‘ভাইয়া, আপনি আসার সাথে সাথে আমাদের একমাত্র স্বর্ণমুদ্রাটা মুসলমানদের হয়ে গেল, আমাদের পারিবারিক গর্বের বস্তু তরবারিটাও মুসলমানদের হয়ে গেল, আমাদের প্রধান নদীর নামটাও এক সময়ের মুসলিম দেশ স্পেনের হয়ে গেল, শুধু আমরাই এখন মুসলমান হওয়ার বাকি।’
বলে আবার হাসতে লাগল ভ্যানিসা।
‘কেন, আমাদের উপর এ ইলজাম পর্তুগীজ সরকার বহুদিন থেকেই করছে।’ বলল সার্গিও। তারও মুখে হাসি।
কিন্তু আহমদ মুসার মুখে হাসি নেই। সে ভাবছিল। এক সময় সে বলে উঠল, ‘মি. সার্গিও, তোমাদের কবরস্তানের উত্তর-দক্ষিণমুখী কবরগুলো ভাঙা কেন, প্রথম কবরটির পাশে তোমাদের কি সব জিনিস সমাধিস্থ করা হয়েছে তা কি অনুসন্ধান করে আমি দেখতে পারি?’
‘হ্যাঁ ভাইসাহেব। এ কথা আগেই আপনি আমাকে বলেছিলেন। আমি আম্মার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি অনুমতি দিয়েছেন একটা শর্তে। সেটা হলো, দেখার পর জিনিসগুলো আবার ওখানেই রেখে দিতে হবে।’ বলল সার্গিও।
‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার আম্মার কাছে আমি কৃতজ্ঞ মি. সার্গিও। তাঁকে নিশ্চয়তা দিবেন একটা জিনিসও নষ্ট করা হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামতেই সার্গিও বলে উঠল, ‘কাজ তাহলে আমাদের বাড়ল ভাইসাহেব। সমাধীক্ষিত্রের খোড়াখুড়িতে বেশ সময় যাবে। আসুন, ম্যাপটা পরীক্ষা করে আমাদের গন্তব্য ও রুট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।’
বলে সার্গিও সোফায় টেবিলের কাছে ফিরে এল।
আহমদ মুসারাও।
সার্গিও সোফায় ফিরে গিয়ে টেবিলে রাখা ‘তেরসিয়েরা’ দ্বীপের মানচিত্রটা কাছে টেনে নিল।
আহমদ মুসা গিয়ে সার্গিওর পাশে বসল।
সার্গিওর সাথে আহমদ মুসাও মানচিত্রের উপর ঝুঁকে পড়ল।
কিন্তু মানচিত্রটা পর্তুগীজ ভাষায়।
হোঁচট খেল আহমদ মুসার চোখ।
বলল আহমদ মুসা, ‘আমি পর্তুগীজ ভাষা বুঝতে পারি, পড়তে পারি না।’
বলেই হঠাৎ আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। আনন্দ প্রকাশ পেল তার চোখে-মুখে। বলে উঠল, ‘মাফ চাচ্ছি মি. সার্গিও। ভুলে যাব, কথাটা বলে ফেলি। পর্তুগীজ ভাষার একটা চিঠি উদ্ধার করেছি WFA-এর একজন মৃতলোকের পকেট থেকে। চিঠিটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু কাউকে দিয়ে চিঠিটা পড়িয়ে নেবার সুযোগ করতে পারিনি এখন।’
‘চিঠিটা এখন আপনার কাছে আছে?’ বলল সার্গিও।
‘হ্যাঁ আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে দিন চিঠিটা। এখনি পড়ে ফেলি। না হলে আবার ভুলে যেতে পারি আমরা।’
‘ধন্যবাদ মি. সার্গিও।’ বলে আহমদ মুসা মানিব্যাগের পকেট থেকে চিঠিটা বের করে সার্গিওর হাতে দিল।
সার্গিও চিঠিটা একবার উল্টেপাল্টে দেখল। বলল, ‘চিঠিটা লিখেছে একজন মা সাও জর্জ দ্বীপের ‘হারতা’ থেকে তার ছেলে ‘এ্যান্টেনিও সোরেস’কে। মা থাকেন ‘হারতা’র ১১নং গনজালো রোডে। কিন্তু ছেলের কোন ঠিকানা চিঠিতে নেই। নিশ্চয় ইনভেলাপে চিঠিটা এসেছে। ঠিকানাটা ইনভেলাপেই ছিল।
‘যাক, হারতার অন্তত একটা ঠিকানা পাওয়া গেল। এবার পড়ুন চিঠিটা মি. সার্গিও।’ সার্গিও পড়তে শুরু করলঃ
‘‘বেটা এ্যান্টেনিও সোরেস,
আশা করি ইশ্বরের কৃপায় তুমি ভাল আছ। এক মাস হলো তুমি চাকুরী নিয়ে পর্তুগাল গেছ। কিন্তু মনে হচ্ছে এক যুগ পার হয়ে গেছে। হয়তো এমন হতো না বেটা, কিন্তু অবস্থার কারণেই তোমাকে খুব বেশি মনে পড়ছে।
যাদের সাথে তুমি পরিচয় করে দিয়ে গেছ, যারা তোমাকে চাকুরী দিয়েছে তারা লোক ভালো নয় সোরেস। তারা দুর্বিণীত, দুঃশ্চরিত্র এবং তাদের প্রতিটি আচরণই সন্দেহজনক। ওরা মনে হয় মানুষ পাচারকারী ধরনের কেউ হবে। কিংবা সন্ত্রাসী কোন দলও হতে পারে। ওরা ওদের সাংঘাতিক সব অস্ত্রশস্ত্র রেখে ঢেকে রাখারও প্রয়োজন বোধ করে না। কদিন আগে একজন লোককে আনল। এশিয়ান হবে। অসুস্থ। তার উপর খুব অত্যাচার হয়েছে মনে হলো। একদিন পরেই তাকে সাও তোরাহ দ্বীপে নিয়ে যায়। এই সাও তোরাহ দ্বীপের কথা ওদের মুখে প্রায় শুনি। দ্বীপটি কোথায়? ওদের কথা-বার্তা শুনে মনে হয় সাও তোরায় বড় কোন ব্যাপার আছে।
আমার এসব ভাল লাগছে না বেটা। তুমি তাড়াতাড়ি এস। দরকার হলে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে এস। ওদের হাত থেকে আমাদের বাঁচাও, তোমার বোনকে বাঁচাও। তোমার চিঠি নয়, তোমার আসার অপেক্ষায় রইলাম।’’
তোমার ‘মা’
চিঠি পড়া শেষ হলো।
মুখ ম্লান হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার। বেদনার একটা চাদর যেন তার চোখ-মুখ ঢেকে দিয়েছে। বলল, ‘স্যরি। মা ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকবে, বিপদগ্রস্ত বোনের অস্থির দু’টি চোখ ভাইয়ের অপেক্ষা করবে। কিন্তু পরিবারের যিনি হাল ধরবেন, সেই ভাই আর কোন দিনই বাড়িতে পৌছবে না। বেচারা নিহত হয়েছে।’
থামল আহমদ মুসা।
তার কণ্ঠ কান্নার মত ভারী।
‘দুঃখের এদিকটা বাদ দিলে চিঠিটা খুবই মূল্যবান ভাইয়া। জানা গেল, সাও তোরাহতে তাদের লোক পাচার অব্যাহত আছে। সাও তোরাহ থেকে ওরা সরে পড়বে, এ ভয় মনে হয় নেই। আমাদের অভিযান দ্রুত করতে হবে ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল ভাইসাহেব। থাক, আসুন ম্যাপটা দেখি।’ বলে সার্গিও আবার ম্যাপের উপর ঝুঁকে পড়ল।
আহমদ মুসাও।
কিন্তু মুখ তার আগের মতই বেদনার্ত।
হাতের পেন্সিলের ডগা দিয়ে মানচিত্রের স্থান বিশেষ স্পর্শ করে বলল সার্গিও, ‘আমরা উত্তরের পার্বত্য পথে উপত্যকা থেকে বের হচ্ছি। তারপর দ্বীপ থেকে বের হবার আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা থাকবে। একটা হলো আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটা পর্যন্ত যে পথ দিয়ে আপনারা এসেছিলেন সেই পথে। অন্যটি আমাদের পারিবারিক সমাধীক্ষিত্র থেকে সোজা পশ্চিম দিকে জলা ভূমিটাকে ডাইনে রেখে দ্বীপের উপকূল পর্যন্ত এগুনো। সে উপকূলে আমাদের একটা ঘাঁটি আছে, মোটর বোটেরও ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই পথটা অপেক্ষাকৃত দুর্গম। এই ট্রাকটা আমরা ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করে না এবং এর সন্ধানও কেউ জানে না। এখন………..।’
সার্গিওর কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘পশ্চিমের এই দূর্গম পথটাই আমাদের জন্যে নিরাপদ। চোখ বন্ধ করে আমরা এ পথ বাছাই করতে পারি।’
‘ধন্যবাদ ভাইসাহেব। এখন বলুন গন্তব্য কোথায় হবে। সেই অনুসারে আমাদের ঘাঁটিকে ইনষ্ট্রাকশন দিতে হবে আয়োজন করার।’ বলল সার্গিও।
আহমদ মুসা মানচিত্র থেকে মুখ তুলল। বলল, ‘সেটাও চোখ বন্ধ করে বলা যায়। আমরা সাও জর্জ দ্বীপের ‘হারতা’ যাচ্ছি।’
সার্গিও মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ফ্লোরেস দ্বীপের সান্তক্রুজ কেন নয় ভাইসাহেব। ওখান থেকে সাও তোরাহ যাওয়া সহজ হবে।’
‘এমনিতেই আগে থেকে আমরা হারতাকে প্রথম বেজ ক্যাম্প হিসেবে বাছাই করেছিলাম সাও তোরাহ সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্যে। এখন সেখানে যাওয়া ফরজ হয়ে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ফরজ কি?’ জিজ্ঞাসা সার্গিওর।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ফরজ অর্থ হলো, অবশ্য কর্তব্য।’
‘হারতা যাওয়া অবশ্য কর্তব্য হলো কেন?’ জিজ্ঞেস করল সার্গিও।
‘আমি এ্যান্টেনিও সোরেসের বাড়ি যেতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এ্যান্টেনিও সোরেসের বাড়ি কেন?’ সার্গিও বলল।
‘এ্যান্টেনিও সোরেসের মা-বোনদের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখ গম্ভীর।
সবাই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না।
সবাই নিরব।
একটু পর সার্গিও বলল, ‘সিদ্ধান্ত এটাই হলো। তাহলে ওঠা যাক। তৈরি হয়ে তো এখনই যাত্রা করতে হবে।
সবাই উঠল।
উঠতে উঠতে ভ্যানিসা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমার খুবই ইচ্ছা হচ্ছে হারতা যাবার।’
‘না বোন, তুমি এবং সার্গিও কাউকেই এখন এই কাজে জড়াব না। তোমরা যে পবিত্র সংগ্রাম করছ তাকে সব আনন্দিত উপসর্গ থেকে নিরাপদ রাখতে হবে। তোমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে যদি কোনওভাবে মুসলমান তথা মৌলবাদ তথা সন্ত্রাসীদের সাথে যুক্ত করতে পারে, তাহলে তোমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এই ক্ষতি তোমরা আমরা কেউই চাই না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যুক্তি আপনার ঠিক। কিন্তু মনকে মানাবার মত নয়।’ বলল সার্গিও।
‘তবু মনকে মানাতেই হবে ভাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার নির্দেশ অবশ্যই শিরোধার্য।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু একটা শর্তে।’ বলে উঠল ভ্যানিসা।
‘কি শর্ত?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনারা ভালো থাকলে সেটা আমাদের জানার দরকার নেই। কিন্তু বিপদে পড়লে সেটা যেন আমরা জানতে পারি।’ ভ্যানিসা বলল। তার মুখ ম্লান, কণ্ঠ ভারী।
‘চেষ্টা করবো ভ্যানিসা তোমার শর্ত মানতে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইসাহেব। চলুন।’ সার্গিও বলল।
সবাই আবার হাঁটতে শুরু করল।
হঠাৎ ধাতব চিৎকার উঠল শাবলের আঘাতটা মাটির গভীরে গিয়ে আছড়ে পড়তেই।
ধাতব চিৎকার উঠার সাথে সাথেই আনন্দে হুররা দিয়ে উঠল সার্গিও।
শাবল চালাচ্ছিল আহমদ মুসা।
ঘেমে সে একাকার হয়ে গেছে।
প্রায় সাতফুট মাটির নিচে গিয়ে এই প্রথম ধাতব শব্দ পাওয়া গেল।
আহমদ মুসা, হাসান তারিক ও সার্গিও পর্যায়ক্রমে খননের কাজ করছিল।
অন্ধকারে চাঁদের আলোটুকুকে সম্বল করে মাটি খুঁড়তে হচ্ছিল।
বাইরের আলো জ্বালানো যাচ্ছে না।
তারা আসার পথে আজর ওয়াইজম্যানের বাহিনীর মুখে পড়ে গিয়েছিল। সমাধীক্ষিত্রের এক বাঁক দক্ষিণে একটা প্রশস্ত চড়াইয়ে যখন আহমদ মুসারা উঠছিল সেই সময় দুটি হেলিকপ্টার বোঝাই সশস্ত্র লোক ওখানে ল্যান্ড করতে আসে। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ওরা হেলিকপ্টারের ফ্লাশ ও ধরা পড়া থেকে নিজেদের রক্ষা করে। সশস্ত্র লোকরা চড়াই-এ নামার পর আহমদ মুসাদের পাশ দিয়েই দক্ষিণে চলে যায়। দুটি হেলিকপ্টারের একটি ওদের কাভার দিয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হয়, অন্যটি গিরিপথের ট্রাক ধরে উত্তরে চলতে শুরু করে। দুটি হেলিকপ্টারই গোটা এই পথের উপর টহল দিয়ে ফিরছে। আলো দেখলেই ওরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাই খননের কাজটা তাদেরকে অন্ধকারের মধ্যেই করতে হচ্ছে।
কোথায় খুঁড়বে এ নিয়েও তারা বিপদে পড়েছিল। এ ব্যাপারে মা-দাদীও খুব বেশী সাহায্য করতে পারেনি। শুধু বলেছিল, জিনিসগুলো প্রথম কবরের পাশে পুঁতে রাখা হয়েছে। সমস্যায় পড়তে হয় প্রথম কবর কোথায় তা নিয়ে। উত্তর-দক্ষিণ কবর যখন, তখন তা মুসলমানের হওয়ার সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা সামনে রেখে আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নেয় পশ্চিম প্রান্তের সর্ব উত্তর থেকে কবর শুরু হয়েছে। সুতরাং সর্ব উত্তরেরটাই প্রথম কবর।
তারপর সমস্যা দেখা দেয় কবরের কোন পাশে জিনিসগুলো পুঁতে রাখা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় কবরের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নেয় এই দু কবরের মাঝখানে যে স্পেস তাতে তেমন কোন বড় জিনিস পুতে রাখার মত নয়। সুতরাং অবশেষে সে পশ্চিম ও উত্তর পাশেই অবস্থান বিচারে ধরে কবরের সিথানের দিকেই জিনিসগুলো পুঁতে রাখা হয়েছে।
সিথানের দিকে সাত ফিট খননের পর শাবলের আঘাত থেকে ধাতব শব্দ উঠায় পুঁতে রাখা ষ্টিলের বাক্স পাওয়া গেছে বলে সবাই খুশি হয়ে উঠল।
‘কবরের লেভেল থেকেও অনেক নিচে পুঁতে রেখেছে বাক্সটা। অথচ মৃতদের সাথে সংশিস্নষ্ট কোন জিনিস কবরে বা কবরের লেভেলেই রাখা হয়।’ বলল গর্তের ভেতর থেকে শাবল চালাতে চালাতেই।
‘যারা এটা রেখেছেন তারা চাননি যে, এটা কেউ খুঁজে পাক।’ হাসান তারিক বলল।
‘আজ ভাইয়া না থাকলে আমাদের শত চেষ্টা ব্যর্থ হতো। আমরা এই বাক্সটা খুঁজে পেতাম না।’ বলল ভ্যানিসা।
ভ্যানিসার কথা শেষ হতেই গর্ত থেকে আহমদ মুসা বলল, ‘এবার এস হাসান তারিক। আলগা হয়েছে বাক্সটা। এখন তোলা যাবে।’
হাসান তারিক লাফ দিয়ে নামল নিচে।
সার্গিও এগিয়ে গেল।
বাক্সটা উপরে উঠে এল।
৬ বর্গফুটের বিশাল বাক্সটা।
বাক্সটা টেনে তার পাশেই পাহাড়ের এক গুহায় নিয়ে গেল।
পুরু পলিথিনে মোড়া বাক্সটা।
‘মি. সার্গিও, যারা বাক্সটাকে কবর দিয়েছিল, তারা বাক্সটাকে কেউ খুঁজে পাক তা চাননি। কিন্তু বাক্সটাকেও তারা নষ্ট করতে চাননি। এয়ারটাইট পলিথিনের মোড়ক একেবারে অক্ষত রেখেছে বাক্সটাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে আমাদের পূর্ব পুরুষরা পারিবারিক এই সম্পদকে লুকিয়ে রেখেছেন, চিরতরে কবরস্থ করেননি!’ সার্গিও বলল।
‘অর্থাৎ তারা চেয়েছিলেন কোন এক সময় পরিবারের কেউ এটা খুঁজে পাক?’ ভ্যানিসা বলল।
‘তাই মনে হয়।’ বলল সার্গিও।
‘কিন্তু আজকে কি সেই ‘কোন এক সময়’ বলা যায়?’ ভ্যানিসা বলল।
‘স্বয়ং আহমদ মুসা বাক্সটাকে মাটির নিচ থেকে তুলেছেন। আমি মনে করি এর চেয়ে বড় ঐতিহাসিক সময় ভবিষ্যতে আর আসবে না।’ বলল সার্গিও।
ভ্যানিসার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘আমিও তাই মনে করছি। আমাদের পরিবারের জন্যে এটা সৌভাগ্য।’
বাক্স লক করা ছিল না।
ডালা খোলা হলো বাক্সের। আহমদ মুসাই খুলল।
তিনদিকে বন্ধ বৈদ্যুতিক লন্ঠন জ্বালানো হয়েছিল। যাতে বাইরে আলো দেখা না যায়।
বাক্সের ডালা খোলা হলো। আলোকসম্পাতে বাক্সের অভ্যন্তরে দেখা গেল, একটা কাল কাপড়ে বাক্সের ভেতরটা ঢাকা। কাল কাপড়ের উপরে পড়ে আছে একটা ইনভেলাপ।
‘ইনভেলাপটা তুলে নিয়ে আহমদ মুসা সার্গিওর হাতে দিয়ে বলল, ‘সবার উপর যখন এই ইনভেলাপটা, তখন এই বাক্স সম্পর্কেই এই ইনভেলাপে কিছু লেখা আছে। পরিবারে পক্ষ থেকে এটা পড়ার হক তোমার।’
ইনভেলাপটা হাতে নিল সার্গিও।
শত বছরের পুরানো ইনভেলাপ। শক্ত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ইনভেলাপটা খুলে তার ভেতর থেকে চিঠি বের করল সার্গিও।
ধীরে ধীরে চিঠির ভাঁজ খুলল।
সময়ের তুলনায় চিঠির কাগজের অবস্থা অনেক ভালো। এয়ারটাইট অবস্থায় থাকার কারণেই ক্ষতি হয়নি কাগজের। চিঠির ভাঁজ খুললেও কাগজের কোন ক্ষতি হলো না। চিঠি পড়তে লাগল সার্গিওঃ
‘‘পরিবারের মহান সদস্যদের প্রতি,
আমার দৃঢ় বিশ্বাস মাটির তলা থেকে বাক্সবন্দী এই সম্পদ আমাদের বংশধরেরাই একদিন উত্তোলন করবে। এই বিশ্বাস থেকেই এই সম্বোধন করলাম।
পরিবারের একটি ইতিহাস, একটি পরিচয় আজ বাক্সবন্দী হয়ে আমার হাতে মাটি চাপা পড়ল। পরিবারের এক সময়ের পরিচয়ের চেয়ে পরিবারের অস্তিত্ব বড়। আবার একটি পরিবারের অস্তিত্বের চেয়ে দেশের অস্তিত্ব অনেক বড়। এই বিবেচনাতেই পরিবারের একটি পরিচয় সমাধিস্থ করলাম।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন আজ সংকটে। পর্তুগীজ সরকার সুস্পষ্ট অভিযোগ তুলেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী গনজালো পরিবার এবং স্বয়ং গনজালো মুসলমান ছিলেন। গনজালো পরিবারের খৃষ্টান পরিচয় একটা ছদ্মবেশ মাত্র। এই ছদ্মবেশ নিয়ে আজোরস দ্বীপপুঞ্জকে তারা কুক্ষিগত করতে চায়, মৌলবাদী একটি দেশে পরিণত করতে চায়। পর্তুগীজ সরকারের এই প্রচার আমাদের উপর বজ্রাঘাত হানে। এর উপযুক্ত উত্তর না দিলে প্রিয় মাতৃভূমি আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু পর্তুগীজ সরকারের অভিযোগ সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই। আমরা কি জবাব দেব? পরিবারের পুরানো কাগজপত্র ও এ্যানটিকসগুলো পরীক্ষা করতে লাগলাম। পুরানো পোশাকাদি ও দলিলপত্র এবং প্রাপ্ত একটা ডাইরী থেকে নিশ্চিত প্রমাণিত হলো সম্মানিত পুর্বপুরুষ গনজালোসহ আমাদের পুর্ব পুরুষরা মুসলমান ছিলেন। এটা জানার পর পরিবারের স্বার্থে দেশের স্বার্থে প্রথম প্রয়োজন হয়ে পড়ল পারিবারিক এই অতীত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করা এবং তারপর পর্তুগীজ সরকারের জবাবে বলা যে, গনজালো পরিবার পর্তুগীজ সরকারের দুরভিসন্ধিমূলক অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করছে। গনজালোরা আজোরস দ্বীপপুঞ্জে সবচেয়ে পুরানো এবং ঐতিহ্যবাহী খৃষ্টান পরিবার। অজানা ও অপ্রমাণিত কোন অতীত সম্পর্কে তারা কিছু জানতে চায় না, তার প্রয়োজনও নেই। মহান যিশুর রাজ্য হিসেবেই আজোরস তার স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করছে। পর্তুগীজ সরকার মিথ্যা কোন অভিযোগ এনে বা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এই আন্দোলন বানচাল করতে পারবে না।
এই বক্তব্য দেয়ার জন্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো পূর্বপুরুষ মুসলমান হওয়ার সব প্রমাণ নষ্ট করে ফেলা হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে এক এক করে বাছাই করে স্তুপিকৃত করা হলো পুড়িয়ে ফেলার জন্যে। কিন্তু পুড়ানো গেল না। আম্মা, দাদী কান্না শুরু করলেন। আমিও পারলাম না আগুন দিতে। মনে হচ্ছিল, পূর্ব পুরুষদের গায়েই যেন আগুন দিতে যাচ্ছি। অবশেষে ঠিক হলো আজোরসে আমাদের প্রথম পুরুষের কবরের পাশে এগুলো সমাধিস্থ করা হবে। সমাধিস্থ করতে গিয়ে দেখা গেল, প্রথম দিকের সব কবরই উত্তর-দক্ষিণ। অর্থাৎ তারা মুসলমান ছিলেন। অতীতে বহুবার এই সমাধীক্ষিত্রে গেছি, কিন্তু বিষয়টা কেউ আমরা খেয়াল করিনি। এই দৃশ্য আমাদের আতংকিত করে তুলল। এই দৃশ্যের ছবি যদি পর্তুগীজ সরকারের হাতে যায়, আর একবার যদি তা পত্র-পত্রিকায় আসে, তাহলে কথা বলারও আর মুখ থাকবে না। গনজালো পরিবার আকাশ থেকে একেবারে ধুলায় পড়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো প্রথম দিকের সব কবর নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার। সেই দিনই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করা হলো।
এভাবেই গনজালো পরিবার তার অতীতকে মুছে ফেলল এক অপরিহার্য প্রয়োজনে।
আর এ কথাগুলো আমরা রেখে গেলাম ভবিষ্যতের এক প্রয়োজনকে সামনে রেখে।’
-গনজালোর ইতিহাস।’’
পড়া শেষ করল সার্গিও।
সবাই মূর্তির মত স্থির বসে পড়া শুনছিল। পড়া শেষ হলেও তারা তেমনি স্থির বসে রইল। নড়তেও তারা যেন ভুলে গেছে।
কারো মুখেই কোন কথা নেই।
পড়ার পর সার্গিও নিজেও বাকহীন।
অনেকক্ষণ পর নিরবতা ভাঙল ভ্যানিসা। বলল, ‘বলেছিলাম না, ভাইয়ার আগমনে স্বর্ণমুদ্রা, তরবারি, সিলভার উপত্যকার নদীও মুসলমান হয়ে গেছে, এখন আমরাই শুধু মুসলমান হতে বাকি। সেই বাকিটাও এখন জানা হয়ে গেল, আমরা মুসলমানদের বংশধর। মুসলমানদের রক্ত আমাদের ধমনীতে, মানে আমরাও মুসলমান।’
‘এভাবে কথা বলো না ভ্যানিসা। এক সময় হয়তো আমাদের পরিবার মুসলমান ছিল, কিন্তু এখন খৃষ্টান। এটাই আজকের বাস্তবতা।’ বলল সার্গিও।
‘জানি ভাইয়া। এই বাস্তবতাই তো বাস্তব এক অতীতকে কবরস্থ করেছে।’ ভ্যানিসা বলল।
‘তোমাদের ভাইবোনের বিরোধ এখন থাক। আমরা একটা মৃতলাশের পোষ্টমর্টেম করছি মাত্র। এর শুধুই ঐতিহাসিক মূল্য আছে। অতীতের ঘাঁটাঘাঁটি যদি বিরোধের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আর অগ্রসর না হওয়াই ভাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি ভাইসাহেব। আমি ভ্যানিসার আবেগকে একটু থামিয়ে দিতে চেয়েছি। আর কিছু নয়। আমাদের পরিবারের এই ইতিহাস উদ্ধার আমার জন্যেই বরাদ্দ ছিল, এটা আমি মনে করি এবং এর জন্যে আমি গর্বিত। এই তো আমার এক পুর্বপুরুষের বক্তব্য পড়লাম, পারিবারিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে ইতিহাস বিসর্জন দিতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি, ইতিহাস পরিত্যাগ করে পরিবার, জাতি কিছুই বাঁচতে পারে না। ইতিহাস বেঁচে থাকলে সে ইতিহাস নতুন করে জাতি, পরিবার গড়তে পারে। আমার জাতির সদ্য উদ্ধারকৃত ইতিহাস আমাকে নতুন শক্তি দিয়েছে ভাইসাহেব।’ সার্গিও বলল। তার কণ্ঠ আবেগে ভারী।
সার্গিও থামতেই ভ্যানিসা বলল, ‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমার কথাই বললেন আপনি। তবে যে আমাকে বকলেন!’
হাসল সার্গিও। বলল, ‘সব কথা সব সময় বলার প্রয়োজন হয় না।’
‘কিন্তু আপনি বললেন ভাইয়া।’
‘আমি প্রয়োজনে বলেছি ভ্যানিসা।’ হাসতে হাসতে বলল সার্গিও।
‘তাহলে মি. সার্গিও, একটু দেখুন বাক্সে কি আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
সার্গিও অনুসন্ধান শুরু করল।
এক এক করে সার্গিও বাক্সের জিনিসগুলো বের করতে লাগল।
বেরুতে লাগল নানা ধরনের সাধারণ ও সামরিক পোশাক, যা স্পেনের সাধারণ মুসলিম মুর এবং সৈনিক ও শাসকরা পরত। আরবী টারবানও পাওয়া গেল। পাওয়া গেল নানা ধরনের মুসলিম শিরস্ত্রাণসহ একটা তুর্কি টুপি। কয়েকটা আরবী ক্যালিওগ্রাফি, কিছু ওয়াল হ্যাং, কিছু আরবী গ্রন্থসহ কোরআন শরীফ, মক্কা শরীফ ও মদিনা শরীফের বাঁধানো ফটো এবং আরও কিছু টুকিটাকিসহ একটি ডাইরীও পাওয়া গেল।
সব জিনিস বের করার পর সার্গিও বলল, ‘সব দেখলেন ভাইসাহেব। আমি যতটা বুঝেছি, সবটা জিনিসই মুসলিম কালচারের স্মারক। অবশ্য বইগুলো ও ডাইরীতে কি আছে আমি জানি না। এখন বলুন, আরও বেশি জানার কি সাহায্য আমাদের করতে পারেন।’
‘বইগুলোর মধ্যে একটি হলো কোরআন শরীফ। অন্যগুলো আরবীতে লেখা ইতিহাস ও হাদিসগ্রন্থ। আমার মতে আরও বেশি জানার ক্ষেত্রে ডাইরীটাই আমাদের সাহায্য করবে।’ আহমদ মুসা বলল।
সার্গিও ডাইরীটা হাতে নিয়ে তা খুলল। ভেতরটা একবার দেখেই বলে উঠল, ‘আমার অপরিচিত ভাষা ভাইসাহেব। আপনি দেখুন।’
আহমদ মুসা ডাইরীটা হাতে নিয়ে বলল, ‘ডাইরীটাও আরবী ভাষায় লেখা। তবে একটা ভূমিকা আছে, সেটা লেখক স্পেনীয় ভাষায় লিখেছেন।’
‘পড়ুন ভাইসাহেব।’ সার্গিও বলল।
‘ডাইরীটা পড়তে সময় লাগবে। অতটা সময় আমরা এখন দিতে পারবো না। ওদের হেলিকপ্টার এদিকে একটু ঘন ঘনই আসছে। মনে হয় ওরা জানতে পেরেছে আমরা সিলভার উপত্যকায় নেই। সুতরাং রাতের আঁধারেই যতটা সম্ভব পশ্চিমে সরে পড়া দরকার।’ বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর ডাইরীটা লণ্ঠনের আলোর দিকে একটু সরিয়ে বলল, ‘আমি শুরু থেকে পড়ছি।’
বলে পড়তে শুরু করল আহমদ মুসাঃ
‘‘আমি গাজী আলী জামাল। আমাদের বাড়ি স্পেনের টলেডো শহরে। আমাদের সুন্দর বাড়িটা ছিল টাগুস নদীর তীরে। শুরু থেকেই আমরা সামরিক পরিবার। স্পেনের সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের সময়ে আমাদের পরিবারের একজন স্পেনের নৌবাহিনীতে চাকুরী নেয়। সুলতান হাজিব আল মনসুরের সময়ে আমাদের পরিবারের একজন একটি রণতরীর কমান্ডার পদে উন্নীত হন। পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে আমিও স্পেনের নৌবাহিনীতে যোগদান করি। কিন্তু স্পেনের নৌবাহিনী তখন কংকালে পরিণত হয়েছে। স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্য গ্রানাডার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লে স্পেনের নৌবাহিনী ভেঙে পড়ে। ১৪২৩ সালে সুলতান তৃতীয় ইউসুফের মৃত্যু হলে স্পেনের নৌবাহিনীর কংকালটাও শেষ হয়ে যায়। ভারাক্রান্ত মনে আমি এর আগেই সৈনিক হিসেবে মাতৃভূমির সেবার আর কোন সুযোগ না দেখে তুরষ্কের সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের নৌবাহিনীতে যোগদান করি। তুরষ্কের সামরিক শক্তি তখন উদীয়মান। ইউরোপের সার্বিয়া, আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রীস তখন তুর্কিবাহিনীর পদভারে কম্পিত। তুর্কি নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। ১৪২২ সালে তুর্কি বাহিনী কর্তৃক কনষ্ট্যান্টিনোপল অবরোধের ঐতিহাসিক ঘটনাতেও আমি অংশগ্রহণ করি। কিন্তু শীঘ্রই আমি তুর্কি নৌবাহিনীতে চাকুরীর ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি। একটি ঘটনা থেকে এর সূত্রপাত ঘটে। সময়টা হবে ১৪২৩ সালের শেষের দিকে। তুরষ্কের, সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের সিংহাসন আরোহনের তৃতীয় বছর এবং সুলতান তৃতীয় ইউসুফের মৃত্যু-পরবর্তী স্পেনীয় গ্রানাডা রাজ্যের বিপর্যয়ের কাল। সেই সময় তুর্কি নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজের একটা বহর আসছিল মরক্কোর ক্যাসাবস্নাংকা থেকে। আমরা ভূমধ্যসাগরের মেজরকা দ্বীপ থেকে ৫০ মাইল দূরে অবস্থান করছি। আমরা দেখলাম, স্পেনের মুসলিম রাজ্য গ্রানাডার পতাকাবাহী একটা বাণিজ্য জাহাজকে ঘিরে ফেললো ক্ষুদ্র দুটি রণতরী। একটি ফ্রান্সের মারসাই, অপরটিতে স্পেনের খৃষ্টান রাজা বারসেলোনার পতাকা। আমি আমাদের নৌবহরের কমান্ডার ইশমত পাশাকে অনুরোধ করলাম গ্রানাডার জাহাজটিকে বাঁচাবার জন্যে। কমান্ডার বললেন, গ্রানাডাকে সাহায্য করার কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আমাদের নেই। আমি বললাম, এটা গ্রানাডাকে সাহায্য করার ব্যাপার নয়, বিষয়টা রাজনৈতিক দস্যুদের হাত থেকে একটা বাণিজ্য জাহাজকে রক্ষা করার। কমান্ডার বলল, বাণিজ্য জাহাজটি গ্রানাডার উমাইয়াদের। উমাইয়াদের কোন সাহায্য করা হবে না। আমাদের তিনটি রণতরীর সামনেই গ্রানাডার বাণিজ্যতরীটি ফ্রান্সের মারসাই ও বারসেলোনার দুটি ক্ষুদ্র রণতরী লুণ্ঠন করল এবং বাণিজ্য জাহাজের সব লোকদের হত্যা করল। আমিও স্পেনের একজন আরব মুসলমান। আমার চোখের সামনেই আমার স্বজনদের হত্যা করল খৃষ্টান দুটি রণতরীর লোকরা। এই আক্রমণে স্পেনের বারসেলোনো ও ফ্রান্সের মারসাই-এর খৃষ্টান সৈন্য এক হতে পারল, কিন্তু তুর্কি সুলতানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনটি যুদ্ধজাহাজ গ্রানাডার অসহায় এক মুসলিম বাণিজ্য জাহাজকে সাহায্য করতে পারল না। অনেক কাঁদলাম আমি। মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। তুর্কি জাহাজে একদিন, এক মিনিট, এক সেকেন্ড অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে উঠল। সবার অলক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তুর্কি রণতরী থেকে ভূমধ্যসাগরে। এক ঘণ্টা সাঁতরে গিয়ে উঠলাম গ্রানাডার লুণ্ঠিত জাহাজে। লুণ্ঠিত জাহাজে লাশ ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। তবু মনে সান্তনা পেলাম এই ভেবে যে, আমি মজলুমদের সাথে আছি। দীর্ঘ ৭ দিন একা জাহাজ চালিয়ে স্পেনের মালাগা বন্দরে এসে পৌছলাম। মালাগা বন্দরের শূন্য জেটিগুলো দেখে মনটা কেঁদে উঠল। একদিন নৌবাহিনীর জাহাজে ভর্তি থাকত মালাগা বন্দর। আজ একটিও নেই। অন্যদের সাথে নিয়ে লাশগুলো দাফন করার পর আমি পর্তুগালের এক জাহাজে চড়ে স্পেনও ছাড়লাম। চলে এলাম পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে। পর্তুগালের তখন সমুদ্র-অভিযানের প্রাথমিককাল। সমুদ্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ নেভিগেটর যোদ্ধাদের সেখানে দারুণ কদর। চাকরী পেয়ে গেলাম লিসবনের বড় একটা কোম্পানীর নৌবহরে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নেভিগেটর থেকে একটা কমান্ডিং জাহাজের কমান্ডার পদে উন্নীত হলাম পরিশ্রম ও প্রতিভাগুণে এবং আল্লাহর সাহায্যে। ১৪৩১ সালের জুলাই মাস। আমার জাহাজটি উত্তর আটলান্টিকের দিক থেকে মধ্য আটলান্টিকের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ধীর গতিতে। সে দিন জুলাই-এর এগার তারিখ। আমি জাহাজের ডেকে বসেছিলাম। চোখে দূরবীন। আমি জানি পশ্চিমে কানাডার উপকূল আর পূর্বে ইউরো আফ্রিকান উপকূলের মাঝখানে কোন দ্বীপের অস্তিত্ত্ব নেই। তবু আমার অভ্যস্ত চোখের কোন ক্লান্তি নেই। দূরবীনের সাধ্যের শেষ পর্যন্ত চষে ফিরছিল আমার দুটি চোখ। হঠাৎ আমার চোখ দুটি আটকে গেল সবুজ পাহাড়ের চূড়ায়। চোখ দুটিকে আমার বিশ্বাস হলো না। চোখ থেকে দূরবীন সরিয়ে চোখ দুটি মুছে নিলাম। আবার দেখলাম। না, আমার চোখ ভুল দেখেনি। সত্যই ওটা একটা বড় সবুজ দ্বীপ। তার মানে আমি একটা নতুন ভূখন্ড আবিষ্কার করেছি। আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। চিৎকার করে নির্দেশ দিলাম জাহাজের গতি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঘুরিয়ে নেবার। চার ঘন্টা চলার পর দ্বীপটার নিকটবর্তী হলাম। ততক্ষণে দ্বীপটার পশ্চিমে আরো তিনটা দ্বীপের সবুজ দিগন্ত আমার চোখে ধরা পড়ে গেছে। আনন্দে আবারও চিৎকার করে উঠলাম, একটা দ্বীপপুঞ্জ আবিস্কার করেছি। এগারই জুলাই (১৪৩১) বেলা ১টার সময় আমাদের জাহাজ প্রথম দ্বীপে নোঙর ফেলল। এর আধঘন্টা পরে আমি জংগল আচ্ছাদিত তীরে পা রাখলাম। আনন্দে উদ্বেলিত জাহাজের সকলেই নেমেছিল দ্বীপে। তখন যোহর নামাজের সময়। সবাই যখন এদিক-ওদিক ঘুরতে ব্যস্ত তখন আমি যোহর নামাজটা পড়ে নিলাম। বেলা ২টায় আমরা সবাই খাওয়ার জন্যে একত্রিত হলাম। খাওয়ার পর দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ ও পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। ঠিক যোহর নামাজের সময় দ্বীপপুঞ্জে পা রেখেছি বলে আমি প্রস্তাব করলাম দ্বীপপুঞ্জের নাম হবে ‘আয- যোহর।’ সবাই হাততালি দিয়ে সমর্থন জানাল। পরে সবার পক্ষ থেকে আয-যোহর দ্বীপপুঞ্জে পর্তুগালের পতাকা উত্তোলণ করলাম। আমরা দ্বীপে পনের দিন অবস্থান করলাম। দ্বীপে কোন মানুষ ছিল না। উপকূলের কাছেই একটা উচ্চভূমিতে একটা বাড়ি তৈরি করলাম। এই বাড়িটাকেই পরে আমি দূর্গে রূপ দিয়েছিলাম। নাম রেখেছিলাম ‘গাজী আলী জামাল’ দূর্গ। পরে পতুর্গাল থেকে পরিবার-পরিজন আনার পর এই দূর্গই আমার স্থায়ী নিবাসে পরিণত হয়। পতুর্গাল সরকার আমাকে দ্বীপপুঞ্জের গভর্ণরের দায়িত্ব দেন। দ্বীপপুঞ্জের গভর্ণর হিসেবে সবগুলো দ্বীপে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। এই সুযোগকে আমি আল্লাহর দেয়া বড় একটা রহমত হিসেবে গ্রহণ করি। স্পেনের ভাগ্যাহত মুসলমানদের এই দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়ে আমি স্পেনের মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগের উদ্যোগ নিলাম। একবার পর্তুগাল সফরকালে এই উদ্দেশ্যে আমি গোপনে গ্রানাডা গেলাম।
আমি………….।’
‘ভাইয়া খুব কাছেই হেলিকপ্টারের শব্দ। মনে হয় একটা হেলিকপ্টার নেমে আসছে।’ আহমদ মুসার পড়ার মাঝখানে চাপা-উত্তেজিত কণ্ঠে বলল হাসান তারিক। সে বসেছিল একদ গুহার মুখেই।
আহমদ মুসার ডাইরী পড়া বন্ধ হয়ে গেল।
সবাই উৎকর্ণ হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা ডাইরীটা সার্গিও’র হাতে দিয়ে দ্রুত সরে এল গুহার মুখে হাসান তারিকের পাশে।
মুক্ত আকাশের দিকে কান পেতে একটু শোনার চেষ্টা করেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘আমাদের মাথার উপরে হেলিকপ্টার। মনে হচ্ছে আলো না জ্বালিয়ে খুব নিচু দিয়ে ওরা এসেছে।’
বলেই আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে থামল। পরমুহূর্তেই আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে মুখোশ বের করে একটা নিজে নিয়ে অন্যগুলো সকলের সামনে ছুড়ে দিয়ে চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোমরা সকলে তাড়াতাড়ি গ্যাস মুখোশ পড়ে নাও। নিশ্চয় শব্দ মনিটরিং করে আমাদের অবস্থান পিন পয়েন্ট করার পর তারা এসেছে। অন্ধকারে নিশ্চয় তারা নামতে সাহস পাবে না। গ্যাস বোমাই তাদের টার্গেট।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই চারদিক থেকে ছোট ছোট বেলুন ফাটলে যেমন শব্দ হয় সেরকম শব্দ উঠতে শুরু করেছিল।
সবাই গ্যাস মুখোশ পরে নিয়েছিল। আহমদ মুসাও তাড়াতাড়ি গ্যাস মুখোশ পরে নিল।
ভ্যানিসা ও সার্গিও’র মুখে আতংক। ভ্যানিসা বলল, ‘ভাইয়া…….।’
ভ্যানিসা মুখ খুলতেই আহমদ মুসা ঠোঁটে আঙুল চেপে তাকে কথা বলতে নিষেধ করল।
‘ভাইয়া’ শব্দ বের হওয়ার পরই ভ্যানিসার মুখ বন্ধ হয়ে গেল।
আহমদ মুসা ফিসফিস কণ্ঠে বলল, ‘হেলিকপ্টারে ওদের শক্তিশালী শব্দগ্রাহক যন্ত্র আছে। আর কোন কথা নয়। ওদের বুঝাতে হবে যে, ওদের প্রাণঘাতি গ্যাস বোমায় আমরা সবাই মারা গেছি। এ বিশ্বাস যদি ওদের হয় তাহলে ওরা নিশ্চিন্তে চলে যাবে, অথবা আরও নিশ্চিত হবার জন্যে নিশ্চংকচিত্তে এই গুহার সামনে ল্যান্ড করবে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা গুহামুখের দিকে একটু সরে গিয়ে বসল।
তারপর অখন্ড নিরবতা। আকাশে হেলিকপ্টারের চাপা হালকা যান্ত্রিক গর্জন, নিচে আশে-পাশে মাঝে মাঝে গ্যাসবোমা ফাটার ফটফট শব্দ।
দীর্ঘ এক ঘন্টা নিরবতার পর সবাই অনুভব করল হেলিকপ্টারের শব্দ আরও নিকটতর হচ্ছে। বুঝল সবাই নামছে হেলিকপ্টার থেকে।
আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, ‘ওরা সম্ভবত দেখতে নামছে যে আমরা বেঁচে আছি কিনা। ওরা গুহামুখের দিকে আসবে, সাবধানে থেকো। আমি ওদের পেছন দিকে যাবার চেষ্টা করছি।’
বলে আহমদ মুসা গুহা থেকে বেরিয়ে গেল। তার মুখে গ্যাস মুখোশ এবং হাতে এম-১০ মেশিন রিভলবার।
হেলিকপ্টার ল্যান্ড করল গুহার একটু সামনে সমাধীক্ষেত্রের উপর।
আহমদ মুসা তখন ক্রলিং করে গুহামুখ থেকে অনেকখানি সরে গেছে।
আকাশটা মেঘে ঢেকে যাওয়ায় অন্ধকার এখন নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠেছে। হেলিকপ্টারটিকে অন্ধকারের বুকে আরও অন্ধকার একটা পিন্ড বলে মনে হচ্ছে। চোখের সামনে আর সবকিছুই অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে একটা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ উঠল এবং তা অব্যাহতভাবে চলল।
আহমদ মুসা বুঝল, ব্রাশফায়ারের কেন্দ্রবিন্দু হলো গুহামুখ। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, ওরা গুহার দিকে যাবে। এই ব্রাশফায়ার তারই পূর্ব প্রস্তুতি। তারা দেখতে চায় গুলীর কোন জবাব আসে কিনা। কেউ জীবিত থাকলে নিশ্চয় আত্মরক্ষার জন্যে জবাব দেবে।
হাসান তারিক ব্রাশফায়ারের কোন জবাব দিল না।
খুশি হলো আহমদ মুসা, হাসান তারিক ওদের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। শক্তিশালী শত্রুকে বাইরে গুহা বা ঘরের ভেতর থেকে সমর্থক গুলী চালিয়ে শত্রুর কাছে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়া ঠিক নয়। কারণ তাতে বোমা বা গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থাকে। গুহা বা ঘর থেকে বাইরের প্রবল শক্তির প্রতি আক্রমণটা পিনপয়েন্টেড ও চূড়ান্ত হতে হয়।
আহমদ মুসা এসব ভাবছিল আর হেলিকপ্টারের পেছন দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
আহমদ মুসা পাঁচ মিনিটের মত ক্রলিং করে চলার পর হেলিকপ্টারের পেছনে গিয়ে পৌছল।
ধীরে ধীরে উঠে বসল আহমদ মুসা।
উঠে বসার পর মাথাটা স্থির হবার সাথে সাথেই একটা কঠিন বস্তু এসে মাথায় চেপে বসল। সংগে সংগেই ভারী একটা কণ্ঠ, ‘আমার চোখে ইনফ্রারেড গগলস আছে। তোমার সবকিছুই আমি দেখতে পাচ্ছি। চালাকি করার চেষ্টা করলে মাথার খুলি উড়ে যাবে।’ রুক্ষ ও কঠোর কণ্ঠ লোকটির।
আহমদ মুসার হাতে এম-১০, কিন্তু হাত যেমন ছিল তেমনি কোলের উপর রাখল। আক্রমণকারীর চোখে ইনফ্রারেড গগলস আছে তা আহমদ মুসা বিশ্বাস করেছে। এই গগলসটা থাকার কারণেই সে আহমদ মুসাকে দেখে ফলো করেছে।
আক্রমণকারী লোকটি একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘বেন্টো, ওর হাতের ভয়ংকর এম-১০টা নিয়ে নাও।’
সংগে সংগেই একজন লোক আহমদ মুসার পাশে এসে আহমদ মুসার হাত থেকে এম-১০টা নিয়ে নিল।
পরক্ষণেই পেছনের রিভলবারধারী লোকটি তার রিভলবারের নল দিয়ে আহমদ মুসার মাথাকে একটু সামনে ঠেলে দিয়ে বলে উঠল, ‘উঠে দাঁড়াও।’
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালে সে বলল, ‘সামনে আগাও হেলিকপ্টারের দরজার দিকে।’
হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা।
পেছনে রিভলবারধারী লোকটির রিভলবার আহমদ মুসার মাথা থেকে তিল পরিমাণও নড়েনি।
হেলিকপ্টারের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
রিভলবারধারী পেছন থেকে বলল, ‘বেন্টো, ওর দুহাতে পেছনে এনে বেঁধে ফেল।’
বেন্টো নামক লোকটিকে আহমদ মুসার পেছনে জায়গা করে দেবার জন্যে রিভলবারধারী আহমদ মুসার পাশে সরে আসছিল। তার রিভলবারের নলটিও আহমদ মুসার মাথা থেকে আলগা হয়ে গিয়েছিল।
মুহূর্তের এই ফাঁকেই ঘটে গেল ঘটনাটা।
হঠাৎ আহমদ মুসার মাথা তীর বেগে নিমণমুখী হলো, আর তার দুই পা ঈষৎ ফাঁক হয়ে ক্ষেপণাস্ত্রের মত উৎক্ষিপ্ত হলো উপর দিকে এবং ধনুকের মত তা বেঁকে একটা আঘাত করল রিভলবারধারীর চোখে-মুখে, অন্য পা টি হাতুড়ীর মত গিয়ে পড়ল আহমদ মুসাকে বাঁধার জন্যে এগিয়ে আসা দ্বিতীয় লোকটির বুকে।
দুজনেই পড়ে গিয়েছিল।
রিভলবারধারীর অবস্থাই বেশি খারাপ হয়েছিল। আহমদ মুসার পায়ের আঘাতে লোকটির ইনফ্রারেড গগলস ভেঙে চোখে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু হাতের রিভলবার তার হাত থেকে ছুটে যায়নি। সে পড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ রেখেই এলোপাথাড়ি গুলী করা শুরু করে দিয়েছিল।
আহমদ মুসাও পড়ে গিয়েছিল।
শুয়ে থেকেই রিভলবারধারীর রিভলবার ধরা হাত সে চিহ্নিত করতে পারল গুলী বর্ষণ দেখে।
আহমদ মুসা ঝাঁপিয়ে পড়ে দুহাত দিয়ে তার রিভলবার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করল।
লোকটিও তার দুহাত দিয়ে রিভলবার আঁকড়ে ধরে গুলী করছিল।
রিভলবার নিয়ে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল দুজনের মধ্যে।
লোকটি তার সর্বশক্তি দিয়ে রিভলবারের নল আহমদ মুসার দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করছিল এবং আহমদ মুসাও।
আহমদ মুসাই শেষে জিতে গেল। লোকটির রিভলবারের গুলী তার নিজেরই থুথনির নিচ দিয়ে ঢুকে মস্তক বিদ্ধ করল।
রিভলবারটি হাতে নিয়ে আহমদ মুসা পাশের লোকটির দিকে এগুলো। সে মাটিতে পড়েছিল। আহমদ মুসা ভাবল, লোকটি এলোপাথাড়ী গুলীর মধ্যে মাটিতে পড়ে থেকে আত্মরক্ষা করছে।
অন্ধকারেই আন্দাজ করে আহমদ মুসা তার রিভলবার লোকটির মাথায় চেপে ধরল এবং বলল, ‘দুহাত একটু নড়াতে চেষ্টা করলে মাথা ছাতু করে দেব।’
বলে আহমদ মুসা তার বাম হাত দিয়ে লোকটির ডান কব্জি চেপে ধরল। কিন্তু হাতটি নিসাড়। আহমদ মুসা তার বাম হাতটি আরও সামনে সরিয়ে নিতেই অনুভব করল লোকটির হাত খোলা, তার শিথিল হাতের পাশেই আহমদ মুসা পেয়ে গেল তার এম-১০ মেশিন রিভলবার।
লোকটি কি জ্ঞান হারিয়েছে? – এই চিন্তা করেই আহমদ মুসা তার ডান হাত লোকটির মুখের উপর নিয়ে এল।
গরম তরল কিছুতে আহমদ মুসার ডান হাতটা ডুবে গেল। ‘রক্ত নিশ্চয়’- ভাবল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার হাত লোকটির মাথায় নিয়ে এল।
মাথায় রক্তের বন্যা। আহমদ মুসা বুঝল লোকটি মাথায় গুলী খেয়ে মরেছে। এটা রিভলবারধারী লোকটির এলোপাথাড়ী গুলীরই ফল। মাথায় গুলী খাওয়ায় চিৎকারেরও অবসর পায়নি।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
এই সময় তার পেছনে গুহামুখ থেকে সাব-মেশিনগানের একটানা গর্জন ভেসে এল।
আহমদ মুসা গুলীর একটানা ষ্টাইল দেখেই বুঝল এ সাব মেশিনগান হাসান তারিকের।
খুশি হলো আহমদ মুসা যে, হাসান তারিক প্রথম গুলী ছুড়েছে এবং টার্গেট পিনপয়েন্ট করেই গুলী ছুড়ছে। এদের পাল্টা আক্রমণের আর অবসর হবে না।
তাই হলো।
হাসান তারিকের সাব মেশিনগান থেমে গেল। কিন্তু এ পক্ষের পাল্টা আক্রমণ আর হলো না। কিছুক্ষণ নিরবতা।
শত্রুপক্ষের কেউ আর অবশিষ্ট নেই, নিশ্চিত হলো আহমদ মুসা।
গুহা মুখের দিকে লক্ষ্য করে আহমদ মুসা বলল, ‘হাসান তারিক, তোমরা বেরিয়ে এস, গেম ইজ ওভার।’
বৈদ্যুতিক লণ্ঠন সাথে করে বেরিয়ে এল হাসান তারিকরা।
চলে এল ওরা হেলিকপ্টারের কাছে।
‘ওদিকের কি খবর হাসান তারিক?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ওরা পাঁচজন গিয়েছিল। পাঁচজনই মারা পড়েছে ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল।
‘এদিকে ঐযে দুজনের লাশ দেখ, ওরাই শুধু ছিল।’ বলে উঠল আহমদ মুসা।
‘তার মানে হেলিকপ্টারটি এখন আমাদের।’ আনন্দে বলে উঠল ভ্যানিসা।
‘হ্যাঁ, যুদ্ধ-লব্ধ মাল। নিজের অবশ্যই বলতে পার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন হেলিকপ্টারে উঠে তো আলো জ্বালানো যায়।’ বলল ভ্যানিসা।
‘হ্যাঁ যায়।’ বলেই আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে দক্ষিণ দিকে তাকাল।
হঠাৎ আহমদ মুসাকে এভাবে উৎকর্ণ হয়ে উঠতে দেখে সবাই তাকাল দক্ষিণ দিকে।
সবাই শুনতে পেয়েছে দক্ষিণ দিক থেকে একটা হেলিকপ্টারের শব্দ ভেসে আসছে।
সবাই তাকিয়ে থাকল ওদিকে।
শব্দটি কাছে চলে এসেছে।
খুব নিচু দিয়ে উড়ে আসছে হেলিকপ্টারটি আলো নিভিয়ে। তাই খুব কাছে এসে গেলেও হেলিকপ্টারটি দেখা যাচ্ছে না।
আহমদ মুসা দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠে গেল। মিনিটখানেকের মধ্যেই নেমে এল এ্যান্টি-এয়ারক্রাপ্ট ধরনের হালকা গান নিয়ে। এ গানগুলো লোফ্লাইং বিমান, হেলিকপ্টার কিংবা মাটিতে থাকা যে কোন হালকা ধরনের স্থাপনা ধ্বংসে বংবহার করা যায়। এয়ার থেকে এয়ার, এয়ার থেকে গ্রাউন্ড সব রকমেই এগুলো ব্যবহার করা যায়।
চারটি গানের একটা নিজে রেখে অন্য তিনটি হাসান তারিক, সার্গিও ও ভ্যানিসাকে দিয়ে বলল, ‘প্রথম হেলিকপ্টারটি আমাদের দখলে। দ্বিতীয় শত্রু হেলিকপ্টারটি আসছে হয় প্রথমটির খোঁজ নিতে, অথবা প্রথমটির আমন্ত্রণ পেয়ে। শত্রু হেলিকপ্টারটি নিকট আকাশে আসার পর আমাদের চারজনের একযোগে প্রথম আঘাতেই তাকে ধ্বংস করতে হবে। বোমা ফেলার সুযোগ তাকে দেয়া যাবে না।’
থামল আহমদ মুসা।
ওরা তিনজন একসাথেই বলে উঠল, ‘আমরা বুঝেছি ভাইয়া।’
ল্যান্ড করা হেলিকপ্টারটির দক্ষিণপূর্ব কোণ বরাবর সমাধীক্ষেত্রের মাঝখানে পজিশন নিয়ে সবাই বসল আহমদ মুসার নির্দেশে।
লম্বালম্বি এক লাইনে প্রথমে আহমদ মুসা, তারপরে সার্গিও, পরে ভ্যানিসা এবং সবশেষে হাসান তারিক।
রাতের কালো আঁধার কেটে ততোধিক কালো হেলিকপ্টারটি যমদূতের মত আসছে খুব চাপা একটা গর্জন তুলে।
সমাধীক্ষেত্রের আকাশে ঢুকে পড়েছে হেলিকপ্টারটি।
গতি তার ধীর হয়েছে।
অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত গতি।
মনে হয় অয়্যারলেসের যোগাযোগে প্রথম হেলিকপ্টার থেকে সাড়া পাচ্ছে না। হঠাৎ সমাধীক্ষেত্রের মাঝখানের আকাশে এসে স্থির হয়ে থাকা হেলিকপ্টার থেকে সার্চ লাইটের একটা তীব্র আলো গিয়ে পড়ল মাটিতে ল্যান্ড করা হেলিকপ্টারটির উপর।
সেই আলোতে হেলিকপ্টারের দক্ষিণ পাশে পড়ে থাকা দুটি লাশের দৃশ্যও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
‘ফায়ার। ওটা এখন বিটালিয়েশনে আসবে।’ চাপা কণ্ঠে গর্জন করে উঠল আহমদ মুসা।
সংগে সংগেই চারটি এ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট গান গর্জন করে উঠল।
চারটি গান থেকে আটটি আগুনের বুলেট ছুটে গেল হেলিকপ্টারের দিকে।
আকাশে দাঁড়ানো হেলিকপ্টারকে তাক করে ধীরে সুস্থে ছোঁড়া আটটি বুলেটই গিয়ে আঘাত করল হেলিকপ্টারটিকে।
ভীষণভাবে কেঁপে উঠল হেলিকপ্টারটি। পরক্ষণেই মাথা নিচু করে একটা ড্রাইভ দিয়ে উত্তর দিক হয়ে পূর্ব দিকে ঘুরল। সেই সাথে একাধারে মেশিনগানের গুলী ও বোমা পড়তে শুরু করেছে হেলিকপ্টার থেকে।
হেলিকপ্টারটি একটু পূর্ব দিকে গিয়ে আবার পশ্চিম দিকে ফেরার চেষ্টা করে আবার পূর্বমুখী হয়ে ছুটতে শুরু করল। আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন থেকে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হেলিকপ্টারটি পাহাড়ের আড়ালে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
অল্পক্ষণ পরেই পূর্ব দিকে ভয়ানক বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল।
‘হেলিকপ্টারটি ধ্বংস হয়ে গেল, ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে বসা পজিশন থেকে। কিন্তু আহমদ মুসা ওঠেনি।
‘ভাইয়া আসুন। আমরা গুহামুখের দিকে একটু সরে যাই। বোমার আগুন এদিকে আসছে।’ বলল হাসান তারিক আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
হাসান তারিকের কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘হেলিকপ্টার বিস্ফোরণে যে বনি আদমরা মারা গেল, তার জন্য আমরা কতটুকু দায়ী হাসান তারিক?’ ধীর, ব্যথিত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
‘আমরা দায়ী নই ভাইয়া। আমরা আত্মরক্ষার জন্যেই গুলী করেছি হেলিকপ্টারকে। ওরা বুঝতে পেরেছিল ওদের হেলিকপ্টারের সব লোক মারা গেছে। ওরা এর প্রতিশোধ নিতে বোমা ও গুলীর সয়লাব বইয়ে দিত এই সমাধীক্ষেত্রে। ওদের হেলিকপ্টারকে না মারলে আমাদেরকেই মরতে হতো।’ বলল হাসান তারিক।
হাসান তারিক থামতেই সার্গিও বলে উঠল, ‘এ প্রশ্ন আপনি তুলছেন কি করে ভাই? এটা যুদ্ধের ময়দান। মারার জন্যেই তারা এসেছিল, তারা না মরলে আমাদের মরতে হতো।’
ম্লান হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনাদের যুক্তিগুলো আমারও জানা। কিন্তু অনেক সময় অনেক ঘটনায় নিজের দিয়ে নিজেকে জানানো যায় না। নিঃসন্দেহে এই হত্যাগুলো প্রয়োজনের। আল্লাহর বিধান একে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু তবু মনে হয় তাঁর বান্দাহদের প্রতি আল্লাহ অপরিসীম মেহেরবান। আল্লাহ ব্যাথা পান তার বান্দাহদের এইসব মৃত্যুতে।’
‘না ভাইয়া, আল্লাহ ব্যাথা পান বান্দাহদের পথভ্রষ্টতায়। বান্দাহদের পথ ভ্রষ্টতাই তো এইসব করুণ পরিণতির জন্য দায়ী।’ বলল হাসান তারিক।
‘তুমি ঠিক বলেছ হাসান তারিক। বান্দাহদের পথভ্রষ্টতাই মূল কথা। এই পথভ্রষ্টতা সব হানাহানি, জুলূম-নির্যাতন এবং হতাহতের জন্য দায়ী। শান্তির জন্যই এই পথভ্রষ্টতার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাঁচাবার এই সংগ্রামই তো ইসলাম করছে। কিন্তু কল্যাণের এই সংগ্রামকেই উৎখাত করার জন্য এগিয়ে এসেছে পথভ্রষ্টরা। চলার পথ থেকে পথভ্রষ্টদের সরাতে না পারলে মানবতার শান্তির সংগ্রাম, মানবতার মুক্তির সংগ্রাম থেমে যাবে, শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং মানুষের শান্তি ও মুক্তির জন্যই তো সংগ্রাম প্রয়োজন পথভ্রষ্টদের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রামে আজকের হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার মত আরও অসংখ্য ঘটনা ঘটতেই পারে।’ বলল হাসান তারিক।
‘ধন্যবাদ মি. হাসান তারিক। আজ আপনাদের কথা খুব আপন বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে মুসলিম ও ইসলাম গৌরবের বস্তু। কিন্তু এতদিন একে অপমানজনক মনে করে এসেছি।’ সার্গিও বলল।
‘শুধু অপমানজনক নয়, আমরা নিষ্ঠুরভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষের কবর ভেঙে ফেলেছি এবং পরিবারের ইতিহাসকে সমাধিস্থ করেছি।’ বলল ভ্যানিসা।
‘যারা কবর ভেঙেছেন, যারা ইতিহাস কবরস্থ করেছেন তাদের সৌভাগ্য হয়নি ডাইরীটা পড়ার, যা আজ আহমদ মুসা ভাই আমাদের পড়ে শোনালেন।’ সার্গিও বলল।
‘ডাইরী পড়া তো শেষ হয়নি ভাইয়া।’ বলল ভ্যানিসা।
ভ্যানিসা থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘সব আলোচনা এখন বন্ধ। এখন কাজ। প্রথম কথা হলো, বাক্সটা গর্তে নামিয়ে আগের অবস্থায় রেখে দেয়া। আর………….।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই সার্গিও বলে উঠল, ‘বাক্সটিকে আর মাটির তলায় পাঠানো হবে না ভাইয়া। দেখছেন তো, পরিবারের ইতিহাসকে সমাধিস্থ করা নিয়ে ভ্যানিসা কি রকম ক্রিটিক্যাল কথাবার্তা বলছে শুরু থেকেই।’
‘না ভাইয়া, আমার মত আছে। বাক্সটাকে মাটির তলায় যেখানে ছিল সেখানে পাঠিয়ে দিন।’ বলে হাসতে লাগল ভ্যানিসা। হাসতে হাসতেই আবার বলে উঠল, ‘জানি ভাইয়া, আপনি পারবেন না আর বাক্সটাকে সমাধিস্থ করতে। দাদু গাজী আল জামাল এক মুহূর্তেই আমাদের মাথাকে আকাশস্পর্শী করেছেন। আমরা কি পারি এই মাথাকে আবার লুটিয়ে দিতে!’ আবেগ কম্পিত কণ্ঠ ভ্যানিসার কান্নায় ভরে গেল। মুখের হাসি নিভে গেল চোখের পানিতে।
ম্লান হাসল সার্গিও। আবেগ উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে তার মুখও। বলল, ‘ঠিক বলেছ বোন, ঐ বাক্সটা গনজালো পরিবারকে নতুন জীবন দান করল। ওকে কবর নয়, আমাদের মাথায় রাখতে হবে।’
‘কিন্তু আম্মার তো শর্ত ছিল, বাক্স আবার মাটির তলায় রাখতে হবে।’ দ্রুতকণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আম্মা যা বলেছেন, আম্মাই তা আর মানবেন না। সুতরাং সে চিন্তা নেই।’ সার্গিও বলল।
‘তাছাড়া আমাদের পূর্ব পুরুষ যিনি এই ইতিহাসকে সমাধিস্থ করেছিলেন, তাঁর চিঠিওতো শুনলাম। তিনিও আশা করেছিলেন তারই উত্তর পুরুষের কেউ এই ইতিহাস উদ্ধার করবেন। আজ তাঁর আশাই পূর্ণ হলো। সুতরাং আগের অবস্থায় ফিরে যাবার কোন প্রশ্ন নেই।’ বলল ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা হাসল। স্বস্তির হাসি। বলল সার্গিওকে উদ্দেশ্য করে, ‘তাহলে এখন করণীয় বলুন।’
‘এখন আমরা হেলিকপ্টার নিয়ে যাত্রা করব।’ বলল সার্গিও।
‘কোথায়?’ আহমদ মুসা বলল।
‘পশ্চিম উপকূলে আমাদের ঘাঁটিতে, যার কথা আমি আগেও বলেছিলাম।’ বলল সার্গিও।
‘হেলিকপ্টার নিলে অসুবিধা হবে না? কেউ দেখে ফেলবে না? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘আমাদের ঘাঁটিটা হলো পশ্চিম উপকূলীয় শহর ‘সিরেটা ও দজ রিবেরা’র মাঝখানে এক পার্বত্য উপত্যকায়। ঐ ঘাঁটিতে কোন বাড়ি-ঘর নেই। পাহাড়ের বিভিন্ন গুহাকে বাড়িতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সুতরাং ও ঘাঁটি কারও নজরে পড়ার মত নয়। হেলিকপ্টারটি জংগলের আড়াল করে চালিয়ে নিয়ে যাব। আর ওখানে নিয়ে গিয়েই হেলিকপ্টারে নতুন রং দিয়ে ওটা পাল্টে ফেলব আমরা। এ হেলিকপ্টারেই আমরা কেকো দ্বীপের হারতা পৌছতে পারি।’ বলল সার্গিও।
‘এখানে হেলিকপ্টারের রেজিষ্ট্রেশন নেই?’ আহমদ মুসা বলল।
‘আছে কমার্শিয়াল হেলিকপ্টারগুলোর। পার্সোনাল হেলিকপ্টারের নেই।’ বলল সার্গিও।
মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠল আহমদ মুসার। বলল, ‘চলুন বাক্সটা হেলিকপ্টারে তুলে যাত্রার জন্য তৈরি হই।’
বলে আহমদ মুসা গুহা লক্ষ্যে হাঁটতে শুরু করল।
ভ্যানিসা হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘হেলিকপ্টার জিন্দাবাদ।’
‘হেলিকপ্টার জিন্দাবাদ কেন?’ পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘হেলিকপ্টারই আমাকে ও সার্গিও ভাইয়াকে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বাদই পড়ে গিয়েছিলাম।’ বলল ভ্যানিসা আদুরে শিশুর ভংগিতে।
সবাই হেসে উঠল।
হেলিকপ্টার উড়ে চলেছে তেরসিয়েরা দ্বীপের পশ্চিম উপকূলের দিকে।
হেলিকপ্টার চালাচ্ছে হাসান তারিক।
তার পেছনেই তিনটি সিটে বসে আছে আহমদ মুসা, সার্গিও ও ভ্যানিসা।
কথা বলছিল সার্গিও, ‘আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি আহমদ মুসা ভাই, ‘গাজী আলী জামাল’ হয়ে গেল ‘গনজালো’। আমাদের পরিবারও টের পেল না এই বিকৃতি।’
শুধু ‘গাজী আলী জামাল’ নাম কেন, দ্বীপপুঞ্জের নামও তো বিকৃত হয়েছে। কোথায় নামটা ছিল ‘আয-যোহর’ সেটা হয়ে গেল ‘আজোরস’। এ রকমই হয়। সময়ের পরিবর্তনে যখন কোন ভাষার চর্চা কমে যায়, কিংবা আদৌ থাকে না, তখন সে ভাষার শব্দগুলো বিকৃত হয়ে যায়। অন্যভাষার লেখকরা এই বিকৃতিকে ত্বরান্বিত করে। যেমন স্পেনের ‘জাবালুত তারিক’ হয়েছে ‘জিব্রালটার’। বলল আহমদ মুসা।
আমার মনে হয় দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন নামের মত মানুষের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি যেটা আগে ছিল, সেটারও ব্যাপক বিকৃতি ঘটেছে।’ ভ্যানিসা বলল।
এ সময় আহমদ মুসা একটু নড়ে-চড়ে বসল। তার চোখে-মুখে হঠাৎ প্রশ্ন ভেসে উঠল। কোন কথা যেন হঠাৎ তার মনে পড়ে গেছে। সে দ্রুত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘একটা কথা মনে পড়েছে ভ্যানিসা। সেই উচ্চ ভূমিটায়, যেখানে তোমাদের আদি বাড়ি ছিল বলেছিলে, যে বেদিটা আছে সেখানে আমি পাথরের বাটি দেখেছি। বেদিও পাথরের ছিল। সেখান থেকে দুটো বিশাল সাপকে নেমে যেতে দেখেছি। এখন আমার মনে পড়ছে সাপ দুটো বাটিতে কিছু খেয়েছে। আবার তোমরা দুজন বেদির পাশেই গাছের উপর ছিলে। তোমরা সব দেখার কথা। কি দেখেছ? তোমরা ওখানে গাছেই বা কেন ছিলে? এসব প্রশ্ন আমার রয়েছে। জবাব খুঁজে পাইনি।’
আহমদ মুসা থামতেই ভ্যানিসা সার্গিওর দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া, তুমিই উত্তরটা দাও।’
গম্ভীর হয়ে উঠেছে সার্গিও। একটু ভাবল।
একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। বলল, ‘সাপ দুটোকে আমাদের পরিবারের সদস্য মনে করা হয়। পনের দিন বা এক মাস পর পর বেদির ঐ পাথর বাটিটায় দুধ দেয়া হয়। সাপ দুটো তা খেয়ে যায়। এই নিয়ম চলে আসছে কত যুগযুগ ধরে তা আমরা জানি না। আমাদের পূর্ব পুরুষরা এটা করেছে, সাপ দুটোর পিতা-দাদারাও এভাবে একই নিয়মে দুধ খেয়ে এসেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এক সাথে দুটোর বেশি সাপ দুধ খেতে আসে না। আমাদের পারিবারিক বিশ্বাস হলো, সাপ দুটো আমাদের সৌভাগ্যের প্রতীক। আদি ভিটা আমরা ছেড়েছি, কিন্তু তারা ছাড়েনি। তারা আদি বাস্তুভিটাকে ধরে রেখেছে লড়াইয়ে জয়ী হয়ে। আমাদের পরিবারের বিশ্বাস হলো, আমরা অতীতের শক্তি, সম্পদ সব একদিন ফিরে পাব। দ্বীপপুঞ্জে একদিন আবার গনজালো পরিবারের পতাকা উড়বে। সাপ দুটো আমাদের ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্যের পাদপিঠকে আঁকড়ে থাকা তারই একটা প্রমাণ।’
একটু থামল সার্গিও।
সার্গিও থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘লড়াইয়ে জয়ী হয়ে’ কথাটার অর্থ বুঝলাম না। আর আপনাদের সাপের ইতিহাস কার থেকে শুরু? নিশ্চয় শুরু থেকে নয়।’
‘অবশ্যই শুরু থেকে নয়’, বলতে শুরু করল সার্গিও, ‘আমাদের পারিবারিক এক মহাবিপর্যয়ের সময় থেকে সাপের ইতিহাস শুরু বলে আমি শুনেছি। ইতিহাসটা হলোঃ গনজালো পরিবার তখনও দ্বীপের শাসক। সেই সময়ের কোন একদিন আমাদের পারিবারিক বাড়ি ও শাসনকেন্দ্র দুর্গটি আক্রান্ত হয় উত্তর আটলান্টিকের সবচেয়ে বড় জলদস্যুর নৌবাহিনী দ্বারা। রাতের বেলা আক্রমণটা এতই আকস্মিক ছিল যে, আত্মরক্ষার কোন উদ্যোগ নেয়াই সম্ভব হয়নি। দূর্গের সৈন্য ও প্রহরীরা সবাই মর্মান্তিক গণহত্যার শিকার হয়। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বেশির ভাগই মারা যায়। কিন্তু আমাদের পরিবারের শীর্ষ ও দ্বীপপুঞ্জের শাসকপদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিটি তার অবশিষ্ট পরিবার-পরিজন নিয়ে দক্ষিণে সিলভার উপত্যকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
জলদস্যু রেডরিংগর বাহিনী আমাদের দূর্গ দখলের ঐ রাতেই ভোরে আমাদের দ্বীপে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্র যেন ছিল আমাদের দূর্গটি। দূর্গ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেল। সেই সাথে ধ্বংস হয়ে গেল জলদস্যু রেডরিংগসহ তার বাহিনী। পরদিন দূর্গের শাসক আমাদের পূর্বপুরুষ দেখতে এসেছিলেন দুর্গের অবস্থা। আর দুর্গের আশে-পাশের লোকদের সাহায্যের জন্যে এনেছিলেন দুধ, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি। তিনি এসে দেখেন পাড়া-প্রতিবেশীদের তেমন ক্ষতি হয়নি। শুধু ধ্বংস হয়েছে দুর্গটাই। সবচেয়ে বিস্ময়কর যে ঘটনা দেখেন সেটা হলো, জলদস্যু সর্দার রেডরিংগ ও তার স্ত্রী দুর্গের গেটের বাইরে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। জানা যায় সর্প দংশনে তাদের মৃত্যু হয়েছে। আর যে সাপ দুটো তাদের কামড়েছিল সে দুটো সাপ তাদের পাশেই বসেছিল। মানুষের ভীড় সে দৃশ্য অবলোকন করেছে। দ্বীপপুঞ্জের শাসক আমাদের পুর্বপুরুষ সেখানে পৌছতেই সাপ দুটো চলে যেতে থাকে। যেন সাপ দুটো লাশ দুটিকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল দ্বীপের শাসকের আগমনের অপেক্ষায়। উপস্থিত প্রবীণদের কেউ কেউ আমাদের পূর্বপুরুষকে বলে, ‘ও দুটো আপনাদের বাস্তু সাপ। ওরা প্রতিশোধ নিয়েছে রিংগর উপরে, যেমন প্রতিশোধ নেয় ঈশ্বর ভূমিকম্পের মাধ্যমে। আপনাদের সাপের দুধ খেতে দিন। সংগে সংগেই আমাদের পূর্বপুরুষটি তার একজন লোকের হাত থেকে দুধের একটা বালতি নিয়ে কিছু দূরে রেখে দেন। সাপ দুটো ফিরে এসে দুধ খেয়ে চলে যায়। সেই থেকেই ওখানে নির্দিষ্ট সময় পরপর দুধ রাখার নিয়ম মেনে আসা হচ্ছে। দুটি সাপও সেই থেকে দুধ খেয়ে যাওয়ার নিয়ম মেনে চলছে।’
একটু থামল সার্গিও। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কাহিনী আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, বিজ্ঞানও বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আপনি তো দেখেছেন দুটো সাপকে দুধ খেয়ে যেতে।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এক ধরনের সাপ কোথাও দুধের সন্ধান পেলে নির্দিষ্ট নিয়মেই সেখানে বার বার আসে। ভূমিকম্পের সন্ধান প্রাণীকূল আগেই পেয়ে থাকে। সেদিন ভূমিকম্পের আগে নিশ্চয় সেখানকার সাপগুলো মাটির তলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ভূমিকম্প শুরু হলে মানুষ পালাচ্ছিল, সাপও পালাচ্ছিল। এই সময় রেডরিংগরা ভীত-সন্ত্রস্ত সাপের আক্রমণের শিকার হয়। এরপরও সাপের একটা নিজস্ব জগৎ আছে, সেই সাথে আল্লাহরও ইচ্ছা আছে। সুতরাং কিছু ঘটনা অলৌকিক পর্যায়ে পড়তেই পারে। আমি সাপকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে বলবো না। তবে সাপকে ভালোমন্দের নিয়ামক ভাবা চলবে না।’
ম্লান হাসল সার্গিও। বলল, ‘আপনার ব্যাখ্যাটি ঠিক। তবু যে বিশ্বাস আশা যোগায়, শক্তি যোগায় এবং তা যদি ক্ষতিকর না হয়, তাহলে সে বিশ্বাস রাখলে ক্ষতি কি!’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘গাজী আলী জামাল ওরফে গনজালো পরিবার আবার ঐশ্বর্য ঐতিহ্য ফিরে পাবে, এ বিশ্বাসের জন্যে সাপকে অবলম্বন করার দরকার নেই। আপনাদের সংগ্রামই তা প্রমাণ করে দেবে, সে শুভ দিন আপনাদের অবশ্যই আসবে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা ভাই। কিন্তু এ ধরনের বিশ্বাস ধর্মনীতির পরিপন্থী?’ বলল সার্গিও।
‘হ্যাঁ, আমাদের ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী। ইসলামের বক্তব্য হলো, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা, প্রতিপালক, প্রত্যাবর্তনস্থল। সব ভালো-মন্দ তারই হাতে। পৃথিবীর কোন পরাক্রমশালী শাসককেই ভালো-মন্দের মালিক বলা যাবে না। বেআইনীভাবে তার কাছে মাথাও নোয়ানো যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, স্রষ্টা মানে আল্লাহ যদি মন্দেরও মালিক হন, তাহলে মন্দের জন্যে তো তিনিই দায়ী হন। তাহলে মন্দের বিচার তিনি করবেন কেমন করে?’ বলল ভ্যানিসা।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমল বা আচরণ মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার জন্যে নির্ধারিত। কিন্তু এর ফলটা হয় খোদায়ী বিধান অনুসারে। ফলাফলের এ অংশটা আল্লাহর এখতিয়ারে। কিন্তু এই ফলাফল আসে আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে, তবে মানুষের আমল ও আচরণের ভিত্তিতে। সুতরাং মন্দের জন্য আচরণকারী মানুষই দায়ী।’
‘ভাইয়া আসুন, আমরা উদ্ভুত অবস্থার আলোচনায় আসি।’ বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘পারিবারিক ইতিহাস ও পূর্ব পুরুষের পরিচয় পাওয়ার পর সবকিছুই উলট-পালট হয়ে গেল। আমাদের পরিচয় এখন কি হবে সেটাই ভাবছি।’ বলল সার্গিও।
‘তোমরা যে পরিচয় চাও, সেটাই হবে সার্গিও।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি বুঝতে পারছি না আহমদ মুসা ভাই, একটি মুসলিম পরিবার কিভাবে খৃষ্টান পরিবারে রূপান্তরিত হলো?’ বলল সার্গিও।
‘অস্বাভাবিক নয় সার্গিও। শত শত বছর খৃষ্টান পরিবেশে যদি একটি বা কয়েকটি মুসলিম পরিবার থাকে এবং সেই সাথে যদি তাদের শিক্ষা-দীক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে জীবনাচরণ তাদের পরিবর্তিত হয়ে যায়, সেই সাথে হারিয়ে যায় তাদের বিশ্বাসও। এক সময় চারদিকের চলমান ধর্মই তাদের ধর্ম হয়ে যায়। এভাবেই গাজী আলী জামাল পরিবার আমূল বদলে গেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘পূর্ব-পরিচয়ের এই আবিস্কার বিস্ময়কর। কিন্তু পরিচয়টা আমার জন্যে গৌরবের। আমার পূর্ব পুরুষরা স্পেনের নৌবাহিনীতে ছিল, অটোমান নৌবাহিনীতে ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গৌরবের মনে হচ্ছে আধুনিক যুগ ও অনন্য সভ্যতার নির্মাতা আরব মুসলমানরা আমাদের পূর্ব পুরুষ। নিজেকে মুসলমান ভাবতে গৌরবই বোধ করছি।’ বলল ভ্যানিসা।
‘কিন্তু তোমাদের মুসলিম পরিচয় প্রকাশ হলে আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া গনজালো পরিবারের জন্যে অসুবিধা হবে না?’ আহমদ মুসা বলল।
জবাব দিল সার্গিও। বলল, ‘আমাদের পূর্ব পুরুষরা পতুর্গাল সরকারের প্রপাগান্ডাকে যতটা ভয় করেছিল, ততটা ভয়ের কোন কারণ নেই। পতুর্গালের প্রপাগান্ডায় কোন কাজ হয়নি। গনজালো পরিবারের ধর্ম আজোরসবাসীদের কাছে কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। গনজালো পরিবারের নেতৃত্ব তাদের ইতিহাসের কারণে। গনজালো পরিবার মুসলিম হলে সে ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যাবে না।’
‘কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে তো বিশ্বব্যাপী একটা খারাপ প্রপাগান্ডা চলছে। গনজালো পরিবারের মুসলিম পরিচয় আজোরসের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সে প্রপাগান্ডার ধার অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। এ প্রপাগান্ডার মূলে তো ছিল, ইহুদীরা। সে ইহুদীদের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদীরা এখন প্রধান আসামীর কাঠগড়ায় দন্ডায়মান এবং একজন মুসলমান আপনিই এই ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। সুতরাং মুসলমানদেরই সুদিন ফিরে আসছে। তারপরও যদি আমাদের পরিবারের মুসলিম পরিচয় আমাদের নেতৃত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আমরা নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে কর্মীর কাতারে দাঁড়াতে একটুও দ্বিধা করবো না। নেতৃত্ব ছাড়ব, কিন্তু ইতিহাস আর ছাড়ব না, আদর্শ ছাড়ব না।’ বলল সার্গিও।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমারও মত এটাই।’ আনন্দে চিৎকার করে উঠল ভ্যানিসা।
‘কনগ্রাচুলেশন। তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি ভ্যানিসা, সার্গিও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ওয়েলকাম ভাইয়া। খুবই খুশি লাগছে আপনার সাথে এক হতে পেরে। আরও খুশি লাগতো যদি আপনার অভিযানে শরীক হতে পারতাম।’ ভ্যানিসা বলল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এও হতে পারে, বাধ্য হয়েই তোমাদের অভিযানে যোগ দিতে হচ্ছে। আমরা হারতা যাচ্ছি মূল অভিযানের প্রস্তুতির জন্য। ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। শত্রুর শক্তি এবং সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কেও নয়। হতে পারে যে, অভিযানে তোমাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অতএব হতাশ হয়ো না। বরং প্রস্তুত থেকো।’
‘অবশ্যই ভাইয়া। হারতা কবে যাত্রা করছেন?’ ভ্যানিসা বলল।
‘পশ্চিম উপকূলে তোমাদের ঘাঁটিতে যাবার পর তোমাদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘হেলিকপ্টারেই যাবেন?’ ভ্যানিসা বলল।
‘সেটাও ঠিক হবে ওখানে যাবার পর। হেলিকপ্টার নিলে হেলিকপ্টারটি ফিরিয়ে আনার জন্য তোমাদের, মানে অন্তত সার্গিওর যেতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে হেলিকপ্টার নেন ভাইয়া।’ ভ্যানিসা বলল।
আহমদ মুসা হাসল।
অন্য সকলেই হেসে উঠল ভ্যানিসার বাচ্চাসুলভ আবদারে।
হাসি থামলেও কেউ কোন কথা তৎক্ষণাৎ বলল না।
নেমে এল নিরবতা।
এই নিরবতার মধ্যে হেলিকপ্টারের চাপা গর্জনটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
সকলের দৃষ্টিই সামনে।
লক্ষক্ষ্যর পথে যেন প্রাণপণে উড়ে চলেছে হেলিকপ্টার।
৫
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক রেষ্টুরেন্ট থেকে এক পিস করে ডিমের ফ্রাই ও চা খেয়ে রাস্তায় নামল। হাঁটতে শুরু করল ফুটপাত ধরে।
আজ সকাল ছ’টায় তারা গনজালো রোডের মুখে এসে নেমেছে। আর হারতায় এসেছে তারা একদিন আগে। সার্গিও ও ভ্যানিসা তাদেরকে হেলিকপ্টারে করে পৌছে দিয়ে গেছে তারও একদিন আগে। হেলিকপ্টার নিয়ে তারা নামে হারতা থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ উপকূলের ছোট শহর ‘ফেটেরা’র সমুদ্র তটে।
ফেটেরা আজোরস দ্বীপপুঞ্জের এ দ্বীপটির কোষ্টাল হাইওয়ে নেটওয়ার্কের উপর তৈরি একটা ব্যস্ত শহর। শহর থেকে উপকূলটা দুমাইল দূরে। আহমদ মুসাদের হেলিকপ্টার এখানেই অবতরণ করে।
দ্বীপের চারদিকে বৃত্তাকারে বেষ্টিত কোষ্টাল হাইওয়ের শহরগুলো নিয়মিত কমার্শিয়াল বাসলাইনের দ্বারা যুক্ত। একটা দিন আহমদ মুসারা ফেটেরা শহরে অবস্থান করে হারতা সম্পর্কে মোটামুটি জেনে নিয়ে ভোরের বাসে হারতা আসে। হোটেলে উঠে একটা দিন হারতা শহর ও এই দ্বীপ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে তারা কাটায়। পরদিন সকালে এসে তারা প্রবেশ করেছে গনজালো রোডে।
সকাল ছ’টায় গনজালো রোডে নেমে পায়ে হেঁটে রোডের দুপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছে। গনজালো ১১ নং বাড়িটাও তারা দেখেছে। খুবই সাধারণ দুতলা বাড়িটায় দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট।
রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে আহমদ মুসারা পায়চারী করার মত হেঁটে ১১ নং বাড়িটার দিকেই এগুচ্ছিল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনের মুখেই ছোট করে ছাঁটা মুখভরা দাড়ি। পরণে ট্যুরিষ্টের পোশাক। চুলে সোনালী রং করা। দাড়িও সোনালী। মুখেও আছে হাল্কা মেকআপ। তাদেরকে এশীয় বলে চেনার কোন উপায় নেই। মনে হবে ইউরোপের কোন দেশ থেকে আজোরস সফরে এসেছে।
ফুটপাত ধরে তারা হাঁটছিল।
দুজন পাশাপাশি কথা বলতে বলতে হাঁটছিল। একজন প্রৌঢ়া তাদের সামনে পড়ে গেল। থমকে দাঁড়িয়েছিল প্রৌঢ়া।
আহমদ মুসারা গল্পের তালেই দুজন দুদিকে সরে গিয়ে প্রৌঢ়াকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগুলো।
প্রৌঢ়া কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল। ভাবছিল সে। সে হঠাৎ পেছন ফিরে আহমদ মুসাদের দিকে দৌড় দিল।
পেছন থেকে পর্তুগীজ ভাষায় ‘হ্যাল্লো’ আহবান করল। আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই এক সাথে পেছন ফিরল। দেখল যাকে পাশ কাটিয়ে এসেছে সেই প্রৌঢ়া।
এবার প্রৌঢ়া মহিলাটির দিকে ভালো করে তাকাল আহমদ মুসা। প্রৌঢ়া এ মহিলাকে কোথাও দেখেছে বলে মনে হলো আহমদ মুসার। দ্রুত মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। প্রৌঢ়া মহিলাটি ততক্ষণে সামনে এসে পৌছেছে। বলল প্রৌঢ়া মহিলাট উচ্ছসিত কণ্ঠে, ‘তোমরা বাছা তারা না? আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। ‘ফেটেরা’ থেকে আসার পথে বাসে আমাকে ও আমার মেয়েকে বসতে দিয়ে সারাটা পথ তোমরা দাঁড়িয়েছিলে। তা তোমরা বাছা এখানে কোথায়?’
আহমদ মুসা ও হাসান তারিকও প্রৌঢ়া মহিলাকে চিনতে পেরেছে। ঠিক, ফেটেরা থেকে আসার পথে বাসে এই মহিলার সাথে তাদের দেখা হয়েছিল। এই মহিলা ও তার সাথের একটি মেয়েকে তাদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে সারা পথ তারা দাঁড়িয়ে এসেছে।
সেদিন ভোরে যাত্রী ছিল প্রচুর। বাসের সব টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ওই প্রৌঢ়া মহিলা ও তার সাথের মেয়ে এসে টিকিট পায়নি কিন্তু তাদের আসতেই হবে হারতায় সকালে। নাছোড়বান্দা হয়ে দাঁড়িয়ে যাবার শর্তে তারা বাসে ওঠে। আহমদ মুসা ও হাসান তারিক নিজেদের জায়গায় প্রৌঢ়া মহিলা ও তার সাথের মেয়েকে বসিয়ে নিজেরা দাঁড়িয়ে আসে। মহিলারা বসতে কিছুতেই রাজী হয়নি। কিন্তু যখন আহমদ মুসারা বলে যে, মায়ের মত গুরুজনকে দাঁড় করিয়ে রেখে তারা বসে থাকতে পারবে না, তারাও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবে, তখন প্রৌঢ়া ও তার মেয়ে সিটে বসে। বসতে বসতে মহিলাটি বলে, ঈশ্বর তোমাদের ভাল করুন বাছা, সত্যিই আমার ছেলের কাজ করেছ।’
প্রৌঢ়ার কথার উত্তরে আহমদ মুসা বলল, ‘স্যরি বুড়িমা, প্রথমে চিনতে পারিনি। এখন ঠিক চিনতে পারছি। ভাল আছেন আপনি?’
‘ভাল আছি বাছা। তবে আমাকে মা বলো না। মা ডাক শুনলে আমার ছেলের কথা মনে পড়বে। কান্না পাবে। তার চেয়ে ‘আন্টি’ বলো।’
প্রৌঢ়া একটু থামল। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ? কোথায় উঠেছ? ও বুঝতে পেরেছি মেইন ল্যান্ড থেকে তোমরা বেড়াতে এসেছ।’
আহমদ মুসা ভাবছিল। প্রৌঢ়া মহিলা থামতেই বলে উঠল, ‘হ্যাঁ আন্টি, আমরা বেড়াতে এসেছি। আশে-পাশে একটা বাসা খুঁজছি ভাড়া নেবার জন্যে।’
শুনেই প্রৌঢ়া মহিলাটি আহমদ মুসাদের দিকে চোখ তুলে পরিপূর্ণভাবে একবার তাকাল। তার চোখে-মুখে আকস্মিক ভাবনার একটা ছায়া। মুহূর্তেই চোখ আবার নামিয়ে নিল সে। ‘আমার বাসায় কি তোমরা উঠবে বাছা? পছন্দ হবে কি? আমরা দুতলায় থাকি। নিচ তলাটা খালিই থাকে। মাঝে মাঝে অবশ্য মেহমান আসে। কিন্তু নিচে চারটি শোবার ঘর আছে। তোমরা দুটোয় থাকলেও দুটো খালি থাকবে।’
‘কোন অসুবিধা নেই। আপনার কাছে দুটো ঘর ভাড়া পেলে আমরা খুবই খুশি হবো আন্টি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সত্যিই তোমরা ভাড়া নেবে? অন্য আর কোন অসুবিধা নেই। ঐ একটু মেহমানের জ্বালাতন। তোমরা উঠলে সে জ্বালাতন কমাবারও একটা পথ হবে। আমি খুব খুশি হবো বাছা তোমরা এলে।’ বলল প্রৌঢ়া মহিলা।
একটু থামল। আবার বলে উঠল প্রৌঢ়া, ‘তাহলে বাছা কেনা-কাটায় এখন যাচ্ছি না। চল তোমরা বাড়িটা দেখবে। এস।’
বলে প্রৌঢ়া ফিরে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পাশাপাশি হেঁটে মহিলাটির পেছনে চলছিল।
প্রৌঢ়া মহিলাটি এসে নক করল এগার নম্বর বাড়িতে।
‘এটা আপনার বাড়ি আন্টি?’ প্রবল আনন্দ ও বিস্ময় চেপে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
হাসান তারিকের চোখে-মুখেও উপচে পড়া আনন্দ।
‘হ্যাঁ, আমার বাড়ি। কেমন মনে হচ্ছে বাছা?’ পেছন ফিরে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল প্রৌঢ়া মহিলা।
‘আন্টির বাড়ি কি কখনও খারাপ হতে পারে?’ মুখে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা। কিন্তু মনে মনে বলল, ‘আল্লাহর অসীম রহমত যে, তিনি তাদেরকে এই বাড়িতে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই বাড়িটার লক্ষ্যেই তো তারা তেরসিয়েরা দ্বীপ থেকে এখানে ছুটে এসেছে।
দরজা খুলে গেল।
দরজায় দেখা গেল প্যান্ট-সার্ট পরা একজন সুন্দরী তরুণীকে। তরুণীটি দরজা খুলে মাকে দেখেই কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু একটু পেছনে দাঁড়ানো আহমদ মুসাদের উপর নজর পড়তেই থেমে গেল তরুণীটি। দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল, ‘এস মা।’
প্রৌঢ়া পেছন ফিরে আহমদ মুসাদের দিকে তাকিয়ে ‘এস বাছা’ বলে ভেতরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসারাও প্রবেশ করল।
মেয়েটি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ‘গুড মর্নিং’ বলে স্বাগত জানাল আহমদ মুসাদের।
ভেতরে ঢুকেই ঘুরে দাঁড়াল এবং মেয়েটিকে দেখিয়ে আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘চিনতে পারছ? আমার মেয়ে ‘পলা জোনস।’ তারপর মেয়েকে বলল, ‘চিনতে পারছিস পলা? ফেটেরার বাসে দেখেছিলি। মনে পড়ছে?’
মেয়েটি হাসল। বলল, ‘এখন পুরোপুরি মনে পড়ছে মা।’ বলে মেয়েটি আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে সহাস্যে সপ্রতিভ কণ্ঠে বলল, ‘ওয়েলকাম, আসুন।’
আহমদ মুসাদের নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে সোফা দেখিয়ে দিল বসার জন্যে।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসারা বসল।
প্রৌঢ়া আহমদ মুসাদের দিকে দুধাপ এগিয়ে এসে বলল, ‘বাছা তোমরা একটু বস। আমি পলাকে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা কাজ বুঝিয়ে দিয়ে একটু বেরুব।’
বলে প্রৌঢ়া দুতলার ওঠার সিঁড়ির পাশ দিয়ে আরেকটা ঘরের দরজার দিকে এগুলো।
মেয়েটি আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনাদের নাস্তা হয়নি নিশ্চয়?’
‘ধন্যবাদ। নাস্তা করেছি।’ সৌজন্যমূলক একটু হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘একটু বসুন’ বলে দুতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে এগুলো। তার মা যে ঘরে গেছে সেদিকে তাকিয়ে একটু কণ্ঠটা বাড়িয়ে বলল, ‘একটু বসুন। আমি এক্ষণি আসছি।’
বলে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে দুতলায় উঠে গেল।
মিনিট দুই পরেই দুহাতে ট্রে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল।
ট্রেতে বিয়ারের দুটি ক্যান। দুটি গ্লাস। একটা পানির বোতল। একটা বাটিতে কিছু বরফ। চিপসের একটা ঠোঙা।
মেয়েটা ট্রে এনে আহমদ মুসাদের সামনে টেবিলে রেখে হেসে বলল, ‘শুধু শুধু বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকুন। আমি মার সাথে কথা বলে আসি।’
বলেই পলা জোনস ধন্যবাদ দেবার মত সময়টুকু না দিয়েই ছুটল তার মায়ের কাছে।
পলা জোনস চলে যাবার পর আহমদ মুসা বলল, ‘মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী, ভদ্র ও দিলখোলা। কিন্তু তার চোখে-মুখে একটা অস্বস্তির ছায়া আছে।’
কথাগুলো অনেকটা স্বগোতক্তির মত বলেই আহমদ মুসা তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে হাসান তারিক ও তার মাঝে রাখল। দ্রুত হাতে খুলে ফেলল ব্যাগের চেন। বের করল রিমোট সাউন্ড মনিটরিং যন্ত্রটা। যন্ত্রটা অন করে দিয়ে স্পিকারের ভলিয়ম কমিয়ে দিল।
‘ওদের ব্যক্তিগত পারিবারিক কথা জানা আমাদের ঠিক হবে ভাইয়া?’ হাসান তারিক বলল।
‘তা নিশ্চয় ঠিক নয়। কিন্তু হাসান তারিক, দশটা ব্যক্তিগত পারিবারিক কথার মধ্যে একটি কথাও WFA (ওয়ার্ল্ড ফ্রিডোম আর্মি) সম্পর্কে যদি থাকে সেটা আমাদের জন্যে মূল্যবান। এই মুহূর্তে আমাদের জানা দরকার চিঠিতে আমরা যেটা পড়েছি, সেটা ঠিক কিনা? WFA -এর লোকরা এখানে আছে কিনা, আসে কিনা?’
‘ঠিক ভাইয়া।’ হাসান তারিক বলল।
আহমদ মুসা আর কথা বাড়াল না। মনিটরের স্পিকার কথা বলতে শুরু করেছে ফিসফিস কণ্ঠে।
শোনা যাচ্ছিল প্রৌঢ়ার কণ্ঠ। বলছিল, ‘বাছারা খুব ভালো। ওরা বাসা খুঁজছিল। আমি নিয়ে এলাম। নিচের তলাটা ওদের দিয়ে দেব।’
‘বুঝেছি মা তুমি কি চাও। কিন্তু ওদের সাথে সংঘাতে যাওয়া কি ভালো হবে?’ বলল মেয়েটি মানে পলা জোনস।
‘সংঘাতে কেন? আমরা চলতে পারছি না। তোমার চাকরীর ব্যবস্থা এখনও হয়নি। বাসা আমাদের ভাড়া দেয়া প্রয়োজন।’ বলল প্রৌঢ়া।
‘কিন্তু ওরা এমনভাবে জেঁকে বসেছে। মনে করছে ওদেরই বাড়ি এটা।’ বলল মেয়েটি।
‘তুমি ওদের প্রশ্রয় দিচ্ছ পলা। তার ফলেই ওরা আরও জেঁকে বসেছে। ওরা লোক ভাল নয়।’ বলল প্রৌঢ়া।
‘আমি ওদের প্রশ্রয় দিচ্ছি না মা। ওদের সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছি। না করে উপায় কি। আমাদের আত্মরক্ষার শক্তি নেই। ওরা যখন ইচ্ছা, যা ইচ্ছা করতে পারে। কৌশল করেই না এখনও বেঁচে আছি।’ বলল পলা জোনস।
‘এই জন্যেই তো নিচতলা ভাড়া দিতে চাচ্ছি। এতে আমাদের একটা নিরাপত্তারও ব্যবস্থা হবে।’ প্রৌঢ়া মহিলা বলল।
‘নিরাপত্তা নয় মা, বরং ঐ নিরীহ দুজন মানুষকে বিপদে ফেলা হবে। ওদের আমি যতটুকু জানি, তুমি ততটুকু জান না। ওরা দিন-দুপুরে আমাদের সকলকে খুন করে চলে যেতে পারে। আমরা সত্যিই সংকটে আছি মা। ভাইয়া নিখোঁজ। ওদের সাথে ঝগড়া করে বাঁচবো না। ভাইয়াকে আমরা ফিরে পেতে পারি তাদের মাধ্যমেই।’ বলল পলা জোনস।
সংগে সংগে প্রৌঢ়া মহিলা, পলার মা কথা বললো না। একটু পর ধীরে ধীরে বলল, ‘ধন্যবাদ পলা। তুমি যতটা ভেবেছ, আমি ততটা ভাবিনি। তারপরও আমার মন বলছে, একটা অবলম্বন আমাদের খুঁজে নেয়া দরকার। আমার মনে হচ্ছে ওদের দুজনকে যখন হাতের কাছে পেয়েছি, তখন এ সুযোগ আমাদের হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আমাদের হারতার লোকরা শান্তি শান্তি করতে গিয়ে মেরুদন্ডহীন হয়ে গেছে। এদের কারও উপর ভরসা করা যাবে না। মেইনল্যান্ড ইউরোপের লোকরা এমন নয়।’
‘তোমার যুক্তি আমি মানছি মা। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন। তবে এদের ভাড়া দিয়েছ, একথা ওদের জানিও না। বলতে হবে, ‘ফেটেরা’তে এদের সাথে পরিচয়। হারতায় এসেছে, কদিন থাকবে।’ পলা জোনস বলল।
‘ধন্যবাদ পলা। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। খাসা বুদ্ধি বের করেছ। কদিন চলুক। দেখা যাক কি হয়।’ বলল পলার মা।
পলার মার কণ্ঠ থেমে যাবার পর আবার তা কথা বলে উঠল, ‘তাহলে পলা, আমি কেনাকাটা সেরে আসি। তুমি বাছাদেরকে এ দিকের দুটো ঘর ঠিক করে দাও।’
‘ঠিক আছে মা।’ বলল পলা।
‘আমার মনে হয় ছেলে দুটো ভালই হবে, কি বলিস। আমাদের আজোরসের কেউ এভাবে জেদ করে জায়গা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো না।’ পলার মা বলল।
‘একটা পার্থক্য ইতিমধ্যে আমার কাছে ধরা পড়েছে মা। কোন সুন্দরী মেয়ে সামনে পেলে সবাই দুচোখ দিয়ে গোগ্রাসে গেলে। কিন্তু এরা এখনও আমার দিকে একবারও পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়নি।’ বলল পলা জোনস।
‘ঈশ্বর বাছাদের ভালো করুন।’ পলার মা বলল।
নিরব হয়ে গেল মনিটরিং যন্ত্র।
‘ওরা তাহলে আসছে’ স্বগতভাবে কথাটা বলার সাথে সাথে দ্রুত যন্ত্রটা আহমদ মুসা ব্যাগে পুরল।
ড্রইংরুমে ঢুকেই পলার মা আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘বাছারা, তোমরা বস। পলা তোমাদের ঘর ঠিক-ঠাক করে দেবে। আমি একটু আসি।’
‘আন্টি, আপনাদের অসুবিধা করছি না তো? আমরা চেষ্টা করলে অন্যত্রও বাসা ঠিক করে নিতে পারব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না বাছা, আমাদের কোন অসুবিধা নেই। ভাবছি, তোমাদের অসুবিধা হবে কিনা। মাঝে মাঝেই নানারকম মেহমান আসে। থাকেও তারা দুচারদিন। অবশ্য নিচে ঘর আছে চারটা। দুটো ঘর মেহমানদের জন্য থাকবে। অসুবিধা হবার কথা নয়।’ বলল পলার মা।
‘এতে আমাদের কোন অসুবিধা নেই আন্টি। আপনাদের মেহমান মানে আমাদেরও মেহমান। আমাদের জন্যে তাদের কোন অসুবিধা হবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ বাছা। আমি জানি তোমরা খুব ভালো ছেলে।’
বলে পলার মা বেরিয়ে গেল।
পলার মা বেরিয়ে যাবার পর পলা জোনস বলল, ‘আপনারা একটু বসুন। আমি ঘর দুটো ঠিক করে দিয়ে আসছি।’
বলে পলা দৌড়ে ঘরের দিকে চলে গেল।
দশ মিনিট পরে ফিরে এলো পলা। বলল, ‘আসুন, ঘর দুটো আপনাদের বুঝিয়ে দেই।’
আহমদ মুসারা চলল পলার সাথে। ড্রইং রুম থেকে দুতলায় ওঠার সিঁড়ির পাশ দিয়ে একটা করিডোর বাড়ির দক্ষিণের শেষ দেয়াল পর্যন্ত গেছে। এই করিডোরের দুপাশে দুটি ঘর। দরজা মুখোমুখি।
দুটোই সাধারণভাবে সুসজ্জিত ঘর। শোবার খাট, লেখার টেবিল, পোশাকের জন্যে ওয়াল ক্যাবিনেট, মিনি ফ্রিজার প্রভৃতি সাধারণভাবে প্রয়োজনীয় সবই রয়েছে। তবে একটি ঘরের দক্ষিণ ওয়ালে একটা বাড়তি দরজা রয়েছে। পলা জানাল ওটা একটা ইমারজেন্সী দরজা। নিচের তলা থেকে জরুরী অবস্থায় বের হবার এটা একটা বিকল্প দরজা। দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা সংকীর্ণ পথ দিয়ে উত্তরের রাস্তায় বের হওয়া যায়।’
‘মেহমানরা এলে কোথায় থাকে সাধারণত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ড্রইংরুমের পূর্ব পাশে দুটো ঘর আছে। ঘর দুটো আরও প্রশস্ত। রাস্তার দিকে জানালা আছে। মেহমানরা ও ঘর দুটোই ব্যবহার করে এ জন্যেই এ ঘর দুটো আপনাদের দেয়া হলো।’
আহমদ মুসা বিকল্প দরজাওয়ালা ঘরটাই বেছে নিল।
যাওয়ার আগে পলা বলল আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে, ‘আম্মা বলেননি, কিন্তু একটা কথা আপনাদের বলি, যাদের আমরা মেহমান বলছি, তারা আমাদের আত্মীয় নন। আমার ভাইয়া সূত্রে ওরা আসেন। আমার ভাইয়াকে ওরা একটা ভালো চাকুরী দিয়েছেন।’
‘আপনার ভাইয়া কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। সৌজন্যের খাতিরেই এটা জিজ্ঞাসা করা।
চোখ-মুখ ম্লান হয়ে উঠল পলা জোনসের। বলল, ‘উনি চাকুরী নিয়ে ৪ মাস আগে লিসবনে গেছেন।’
‘বেশি তো দূরে নয়, কাছেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তবু মনে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি দূর।’ পলা জোনস বলল।
‘কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া নিয়মিত টেলিফোনে কথা বলত। ধীরে ধীরে তার টেলিফোনে কথা বলা কমে যাচ্ছে। তার কথাবার্তায় ভয় ও রাখ-ঢাকের ব্যাপার ক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। আম্মা একটা জরুরী চিঠি পাঠিয়েছেন। তার উত্তর পাওয়া যায়নি। আজ ৭ দিন কোন টেলিফোনও তার আসেনি।’
আহমদ মুসার দেহ-মনে যন্ত্রণার একটা স্রোত বয়ে গেল। তার ভাইয়াকে যে চাকুরী দেয়া হয়েছিল সেটা যে চাকুরী নয়, এক সন্ত্রাসী কাজ এবং সে কাজ করতে গিয়েই সে নিহত হয়েছে, একথা জানতে পারলে এ অসহায় পরিবারটির কি অবস্থা দাঁড়াবে! আর এ নিহত হওয়ার ঘটনা যে আহমদ মুসাদের হাতে হয়েছে এটাও আহমদ মুসাদের জন্যে খুবই বিব্রতকর ও বেদনাদায়ক। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো, তারা যে এ পরিবারের সাথে এভাবে জড়িয়ে পড়ল, এর পেছনে নিশ্চয় আল্লাহর কোন ইচ্ছা আচ্ছে। এ পরিবারের একটা দায় কি আল্লাহ এভাবে তাদের উপর তুলে দিলেন? চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ায় উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল আহমদ মুসার।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নামল পলা জোন্সের বুক থেকে। বলল, ‘আমাদের দুঃখের কথা আপনাদের জানানোর প্রয়োজন ছিল না। তবু বললাম এ কারণে যে, অনেক কথাই হয়তো আপনারা জানতে পারবেন।’
‘মিস পলা জোন্স, প্রয়োজনটা কার বেশি, সেটা না আমরা জানি আর না আপনি জানেন। আমি বলব প্রয়োজনেই আপনি বলেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
ম্লান হাসল পলা জোন্স। বলল, ‘দার্শনিকের মত কথা বললেন। তবু যা হোক সান্তনা পেলাম। ধন্যবাদ।’
‘দর্শনই হলো অন্তর্নিহিত বাস্তবতা। আমরা আজ এখানে এসে উঠব, তা আপনারা বা আমরা কেউ ভাবিনি। এই অভাবনীয় বিষয়ের একটা দার্শনিক বাস্তবতা নিশ্চয় আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
পলা জোন্স মুখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, ‘দর্শনের কথাটা আমি ‘ফান’ করে বলেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি আপনি সত্যিই দার্শনিক।’
বলে একটু থামল পলা জোন্স। বলল আবার, ‘আপনারা এখানে ওঠার অভাবনীয় ঘটনার মধ্যে কোন দার্শনিক তাৎপর্য আছে বলে মনে করেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জগতে দৃশ্যমান যা ঘটে, অদৃশ্যমানের সংখ্যা তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি। সুতরাং দৃশ্যমান ঘটনার পেছনে অদৃশ্যমান কার্যকরণ থাকবে, এটা একটা বিশ্বাস।’
পলা জোন্সের চোখ-মুখের বিস্ময়টা আরও বাড়ল। তার বিস্ময় দৃষ্টি আবার নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার উপর। সেই সাথে তার চোখে জিজ্ঞাসাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে সে বলল, ‘আপনাদের পরিচয় কিন্তু জানা হয়নি। যারা ট্যুরে যান তারা ট্যুরিষ্ট। কিন্তু ট্যুরিষ্টদের একটা পেশা ও পরিচয় থাকে, আপনাদের সেই পরিচয় আমরা জানি না। তবে আমি নিশ্চিত, আমরা চারদিকে যাদের দেখি, যারা এখানে আসেন, তাদের থেকে আপনারা আলাদা। দেখলাম, আপনারা বিয়ার খাননি।’
এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ‘আমরা দু’জনেই সুনির্দিষ্ট কোন পেশার সাথে জড়িত নই। সুতরাং সে ধরনের কোন পরিচয় আমাদের নেই। এদিক থেকে হয়তো কিছু আলাদা আমরা অন্যদের থেকে।’
‘পেশা নয়, মন-মানসিকতায় পার্থক্যের কথা আমি বলেছি।’ বলেই হেসে উঠল পলা জোন্স। বলল আবার, ‘অনেক কথা বলেছি। যাই, প্রয়োজন হলে ডাকবেন। যে কোন সময় দু’তলায় আসতে পারেন। পলা বলবেন, মিস বলার প্রয়োজন নেই। অন্তত বয়সে ছোট হিসেবে এ দাবী আমি করতে পারি।’
একথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পলা জোন্স।
রিডিং টেবিলের সাথে একটা মাত্র চেয়ার। আহমদ মুসা চেয়ারটাতে গিয়ে বসল।
হাসান তারিক গিয়ে বসল খাটে। বসেই বলল, ‘এখন কি ভাবছেন ভাইয়া?’
‘মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতী, ভালই হলো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ, এপর্যন্ত সবকিছু ভালই যাচ্ছে। কিন্তু আসল পক্ষ তো সিনে এখনও আসেনি।’ বলল হাসান তারিক।
‘দোয়া করো, সিনে তারা যত তাড়াতাড়ি আসে ততই মঙ্গল। আসল কাজে কিন্তু আমরা এখনও এক ইঞ্চিও এগুতে পারিনি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আমরা প্রথম বারের মত WFA-এর লোকদের সবচেয়ে নিকটে পৌছতে যাচ্ছি।’
‘আলহামদুলিল্লাহ, প্রতিপদেই আল্লাহ আমাদের সাহায্য করছেন।’
‘আমার ভয় হচ্ছে, আজর ওয়াইজম্যান সাও তোরাহ থেকে সবাইকে নিয়ে ভাগবে না তো?’ বলল হাসান তারিক।
‘হ্যাঁ, তোমার কথায় যুক্তি আছে। আজর ওয়াইজম্যান আহত এবং তেরসিয়েরা দ্বীপে তার সর্বাত্মক অভিযান চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সাও তোরাহ দ্বীপ তেরসিয়েরা দ্বীপ থেকে অনেক দূরে। আরও একটা ব্যাপারে তারা আশ্বস্ত আছে যে, তেরসিয়েরা দ্বীপে তারা আমাদেরকে ধরতে না পারলেও এবং তাদের অনেক ক্ষতি হলেও তারা আমাদেরকে আমাদের প্লানমত অগ্রসর হতে দেয়নি, আমাদের পরিকল্পিত অগ্রযাত্রাকে তারা ব্যর্থ করে দিয়েছে। এটা তাদের সাফল্য। অতএব সাও তোরাহ দ্বীপে আমরা আমাদের পরিকল্পনা মত পৌছে যেতে পারব, এটা নিশ্চয় আজর ওয়াইজম্যান মনে করছে না। সুতরাং সাও তোরাহ দ্বীপ থেকে তাদের সরার কোন প্রশ্ন নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
হঠাৎ খুশি হয়ে উঠল হাসান তারিক। বলল, ‘আমাদের ভাগ্য যদি ভালো হয়, ওরা যদি এখানে আসে, তাহলে আজর ওয়াইজম্যানের গতিবিধি সম্পর্কে অবশ্যই কিছু জানা যাবে।’
‘এখানে আমাদের আসার একটা বড় উদ্দেশ্য এটাই।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বাইরের দরজায় নক হতে শুরু করল।
উচ্চ ও অসভ্য রকমের নক হচ্ছে দরজায়। কেউ যেন অস্থির হয়ে উঠেছে দরজা খোলার জন্যে।
পলা জোন্স দোতলা থেকে ছুটে নামছিল। সে দোতলার সিঁড়িমুখে পৌছতেই দেখল, আহমদ মুসা গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। সে দোতলার সিঁড়ি মুখেই থমকে দাঁড়াল। দরজা তার নজরে পড়েছে। আহমদ মুসার পাশ দিয়ে তাকিয়ে দরজার ওপাশে দাঁড়ানো লোক দু’জনকে চিনতে পারল পলা। তাদের ঘাড়ে যারা চেপে বসে আছে সেই মেহমানরাই এসেছে। পলা জোন্স নিজেকে সিঁড়ির রেলিং-এর আড়ালে নেবার চেষ্টা করল।
আহমদ মুসা দরজা খুলতেই দরজার বাইরে দু’জনকে দাঁড়ানো দেখল। দু’জনেরই খালি হাত। লম্বা-চওড়া শক্ত-সামর্থ গায়ের গড়ন। চোখে সাপের মত ঠান্ডা দৃষ্টি এবং তাতে শেয়ালের মত ধূর্ততার ছাপ।
আহমদ মুসাকে দেখেই দু’জনের সামনের জন বিরক্তির সাথে বলে উঠল, ‘কে হে তুমি? কোত্থেকে?’
বলে সে আহমদ মুসাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘কে আপনারা? কাকে চাই? কি প্রয়োজন বলুন?’
আহমদ মুসা ওদের নক করার ধরন এবং ওদের দেখেই বুঝতে পেরেছে ওরা কারা, তবু আহমদ মুসা যে প্রশ্নগুলো একান্তই না করলে নয় অপরিচিত লোকদের সে প্রশ্নগুলো করেছে।
লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি কেন? বুড়ি অথবা পলাকে ডাক।’
‘আপনি পলা জোন্স ও তার মাকে যেভাবে সম্বোধন করছেন, তাতে বুঝলাম যে, আপনারা এঁদের আত্মীয়। স্যরি। আপনারা আসুন। ওয়েলকাম।’ হাসি মুখে বলল আহমদ মুসা।
‘আত্মীয় নই, আত্মীয়ের চেয়ে বড়। কিন্তু তোমরা কে? এবার তোমাদের পরিচয় বল।’ ভেতরে ঢুকে বলল লোকটি।
আহমদ মুসা ওদের দু’জনের সাথে ড্রইংরুমের দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘মিস পলা জোন্সের মা মিসেস জোন্সের সাথে পূর্ব পরিচয় আছে। সেই পরিচয়েই এখানে উঠেছি।’
‘বাড়ি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল আহমদ মুসা। কিন্তু পরক্ষণেই বলে উঠল দ্বিধাহীন কণ্ঠে, ‘ক্যাষ্টেলো ব্রাংকো।’
ক্যাষ্টেলো ব্রাংকো এই দ্বীপেরই দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটা শহর। আহমদ মুসা শহরটাকে চোখে দেখেনি।
‘কিন্তু তোমরা তো ওখানকার বাসিন্দা নও। তোমাদের চেহারাতো তা বলেনা।’ বলল লোকটি।
‘চেহারা কি বলে?’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘আজোরীদের সাথে মেলে না।’ বলল লোকটি।
‘সেটা আজোরসের দুর্ভাগ্য। আজ আজোরসে আসল আজোরীদের চেয়ে নকল আজোরীদের সংখ্যা বেশি। নকলের সাথে আসল মিলবে না, এটাই স্বাভাবিক এবং এটা অন্যায় নয়।’
‘থাক, থাক। এধরনের জটিল আলোচনা আমার ভাল লাগে না। ঠিক আছে আপনার আসল-নকল সবাই আজোরী। এখন বলুন, আপনারা ক’দিন থাকছেন?’ বলল লোকটি।
‘এ প্রশ্নও আপনি করছেন? প্রশ্নটা মিসেস জোন্সের জন্যে রেখে দিলেই ভালো হয়।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
লোকটি মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, ‘দেখুন এ বাড়িতে আমার কথা ও মিসেস জোন্সের কথা আলাদা নয়।’
‘স্যরি, জানতাম না একথা। এর পর মনে থাকবে।’ মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টেনে বলল আহমদ মুসা।
সোফার কাছে তারা সবাই পৌছে গেছে।
আহমদ মুসা ওদের দু’জনকে বসার আহবান জানিয়ে বলল, ‘আপনারা বসুন। আমি মিস পলা জোন্সকে ডাকছি। মিসেস জোন্স বাসায় নেই।’
‘থাক থাক। আমাকে মেহমান সাজানোর প্রয়োজন নেই। মিস জোন্স এখনি আসবেন। আর আমাদের ঘর আমরা চিনি। কারও দেখিয়ে দেয়ারও প্রয়োজন নেই। এ বাড়িতে আমরা মেহমান নই। মিস জোন্সদের বাড়ি আমাদেরই বাড়ি।’
‘স্যার, তাহলে তো আর কোন কথা নেই। আমরা আসি। বাই।’ বলে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক হাঁটতে লাগলো তাদের ঘরের উদ্দেশ্যে।
সিঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসছিল পলা জোন্স উড়ে এসে জুড়ে বসা মেহমানদের সাথে আহমদ মুসার কথা শুনে।
৬
সন্ধ্যা তখন ৭টা।
বেন্টো ও সসাদের ট্যাক্সি আহমদ মুসাদের অতিক্রম করতেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তাদের ভাড়া করা ট্যাক্সিতে উঠে বলল, ‘ড্রাইভার ঐ ট্যাক্সিটার সাথে চলো। বেন্টো ও সসা মিস পলা জোন্সদের বাড়িতে আসা সেই দুজন লোক। পলা জোন্সের কাছ থেকে এ দুজনের নাম জেনে নিয়েছে আহমদ মুসারা। আলট্রা সেনসেটিভ সাউন্ড মনিটরিং দিয়ে আড়ি পেতে জেনেছে ওদের পরিকল্পনার কথা। তারা এখন যাচ্ছে জনৈক এমানুয়েলের কাছে। কোথায় কি যেন পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা এমানুয়েল তাদের জানাবে এবং করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দেবে। এটা জানার পরই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক তার পিছু নিয়েছে। পরিবর্তনের কথায় চিন্তিত হয়ে পড়েছে আহমদ মুসারা। বড় ধরনের কোন পরিবর্তন ঘটছে না তো? তারা সাও তোরাহ থেকে সরে যায়নি তো? এই উদ্বেগের কারণে বেন্টো ও সসাকে অনুসরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অবশ্যই জানতে হবে পরিবর্তনের ব্যাপারটা।
এপথ ওপথ ঘুরে বেন্টোদের গাড়ি কোষ্টাল হাইওয়েতে উঠে ছুটতে লাগল উত্তর দিকে। শহরের প্রান্তে পৌছে গেল গাড়ি।
তবু বেন্টো ও সসাদের গাড়ি একই গতিতে এগিয়ে চলছে।
‘ওরা কি টের পেয়েছে যে আমরা ওদের অনুসরণ করছি? না, এমানুয়েল লোকটা শহরের বাইরেই থাকে।’ স্বগত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া, রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। আমার মনে হয় না তারা আমাদের সন্দেহ করতে পেরেছে।’ হাসান তারিক বলল ধীর কণ্ঠে।
শহরের বাইরে চলে এসেছে গাড়ি। রাস্তার দুধারে ঘর-বাড়ি, দোকান-পাটের বদলে এখন ঝোপ-জংগল আর গাছ দেখা যাচ্ছে। ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছে দুপাশের বনরেখা।
প্রায় ২শ গজ পেছন থেকে আহমদ মুসারা অনুসরণ করছে বেন্টোদের গাড়িটাকে। হঠাৎ বেন্টোদের গাড়িটা ডান দিকে বাঁক নিয়ে জংগলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
নিশ্চয় ডানদিকে যাবার ওখানে রাস্তা আছে। কিন্তু সাগর তো পাশেই। রাস্তাটা কোথায় যাবে! আহমদ মুসার এ ভাবনা শেষ হবার আগেই গাড়িটা বাঁক নেবার জায়গায় আহমদ মুসারা পৌছে গেল।
আহমদ মুসার নির্দেশে গাড়ি থেমে গিয়েছিল। দেখা গেল কোষ্টাল হাইওয়ে থেকে পাথর বিছানো একটা কাঁচা রাস্তা পুব দিকে চলে গেছে। রাস্তার মুখেই একটা সাইনবোর্ড টাঙানো। তাতে লেখা, ‘প্রাইভেট রোড। পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ নিষিদ্ধ।’
‘স্যার এখানে লাল সাহেবের বাড়ি এবং তার অফিস। এই প্রাইভেট রাস্তা দিয়ে শ’দুয়েক গজ এগুলেই তার বাড়ি। এখানে এক টুকরো ভূখন্ড সাগরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে দ্বীপের আকার নিয়েছে। কোষ্টাল হাইওয়ে থেকে দ্বীপ পর্যন্ত জায়গাটা লাল সাহেবের ব্যক্তিগত।’ বলল ড্রাইভার।
‘লাল সাহেব কে, কি করেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা ড্রাইভারের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই।
‘স্যার, লাল সাহেব ‘একবিশ্ব একদেশ একজাতি’ নামক একটা এনজিও-র মালিক। তিনি হারতায় থাকেন না। মাঝে মাঝে আসেন। আসলে এ বাড়িতেই ওঠেন।’ ড্রাইভার বলল।
‘তিনি কোথায় থাকেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘তা জানি না।’ বলল ড্রাইভার,
‘আগের গাড়িটা তো তাহলে লাল সাহেবের বাড়িতেই গেছে। না এদিকে আর কোন বাড়ি আছে ড্রাইভার?’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যার এই প্রাইভেট রোড লাল সাহেবের। এই রোডে আর কোন বাড়ি নেই।’ বলল ড্রাইভার।
‘তাহলে গাড়ি ঘুরাও ড্রাইভার। চল লাল সাহেবের বাড়ি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি স্যার। অনুমতি ছাড়া প্রাইভেট রোডে গাড়ি ঢুকানো ঠিক হবে না। তার উপর লাল সাহেবের লোকজন ভাল নয় স্যার।’ ড্রাইভার বলল।
‘ভাল নয় বলছ কেন?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘স্যার একবার ভাড়া নিয়ে ঐ বাড়িতে গিয়েছিলাম। এক ঘন্টা বসিয়ে রেখে ভাড়া দিয়েছিল অর্ধেক। প্রতিবাদ করলে বাড়ির অন্যান্য লোকজন এসে আমাকে গাল মন্দ কর এবং আমার গাড়ির পাম্প ছেড়ে দেয়।’ বলল ড্রাইভার।
‘লাল সাহেবের বাড়ি কেমন, কত বড়?’ আহমদ মুসা বলল।
‘তিন তলা বাড়ি। নিচের তলায় অফিস। বাড়ির তিন দিকে রোপন করা গাছের বাগান। বাড়ির সামনে ফুল গাছের বাগান। ফুল বাগানের মাঝখান দিয়ে রাস্তা উঠে গেছে গাড়ি বারান্দায়।’ বলল ড্রাইভার।
‘ধন্যবাদ। তাহলে তুমি এখন কি করবে ড্রাইভার?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘যা বলবেন স্যার। আপনারা এখানে অপেক্ষা করতে বললে অপেক্ষা করব। চলে যেতে বললে চলে যাব।’ বলল ড্রাইভার।
‘ঠিক আছে তুমি গাড়ি একটু আড়ালে নিয়ে অপেক্ষা কর।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।
হাসান তারিকও।
তারা হাঁটা শুরু করল পাথর বিছানো পথ দিয়ে।
ড্রাইভার দক্ষিণ দিকে সরে গেল তার গাড়ি নিয়ে।
মাত্র দুটি গাড়ি পাশাপাশি যাওয়ার সরু পথ। দুপাশে ঘন বন।
পাশাপাশি হাঁটছে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক।
দুমিনিট চলার পর রাস্তার একটা বাঁক ঘুরতেই তারা দেখল সামনে চলার পথ বন্ধ। রাস্তার আড়াআড়ি ৩ ফুট উঁচুতে ষ্টিলের পাইপ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা।
আহমদ মুসারা পাইপের কাছে পৌছতেই পাইপের দক্ষিণ দিকের প্রান্ত থেকে দুজন লোক এগুতে লাগল আহমদ মুসাদের দিকে।
পায়ের শব্দ পেয়ে তাকাল আহমদ মুসা সেদিকে। দেখল লোক দুজনকে। তাদের দুজনের ঘাড়েই ষ্টেনগান ঝুলানো। একজনের হাতে মোবাইল। আরও দেখল, গার্ড রুম, জংগলের সাথে মিশে আছে।
লোক দুজন এসেই চ্যালেঞ্জ করল, ‘কে তোমরা?’
নিরীহ কণ্ঠে আহমদ মুসা বলল, ‘আমরা হারতার লোক। লাল সাহেবের কাছে এসেছি।’
লোক দুজন জোৎসণার বিপরীতে দাঁড়ানো ছিল। ওদের মুখের ভাব দেখা গেল না। কিছুক্ষণ কথা বলল না তারা। একটু পরেই কর্কশ কণ্ঠে একজন বলে উঠল, ‘মতলববাজ, জোচ্চোর, এখনি পালাও এখান থেকে। না হলে গুলী করব।’
বলে লোকটি সত্যি সত্যিই তার কাঁধ থেকে ষ্টেনগান নামিয়ে নিতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা বুঝে ফেলল, কথায় আর কাজ হবে না। সংগে সংগেই পকেট থেকে তার ডান হাত রিভলবার সমেত বেরিয়ে এল।
রিভলবারটি ওদের দুজনের দিকে তাক করে বলল, ‘হাত তুলে দাঁড়াও, না হলে দুজনের মাথা এখনি গুঁড়ো হয়ে যাবে।’
লোক দুজন প্রথমে দ্বিধা করল। কিন্তু পরক্ষণেই দুজনের হাত উপরে উঠে গেল।
ওদের দুজনের হাত উপরে উঠতেই হাসান তারিক এগিয়ে গিয়ে মোবাইল ও দুটি ষ্টেনগান ওদের কাছ থেকে নিয়ে নিল। ওদের পকেট হাতড়িয়ে আর কোন অস্ত্র পেল না।
আহমদ মুসা হাসান তারিককে লক্ষ্য করে বলল, ‘ধন্যবাদ। তুমি ওদের দুজনকে এবার ঘুম পাড়িয়ে দাও।’
সংগে সংগে হাসান তারিক ষ্টেনগান দুটো কাঁধে ফেলে এবং মোবাইলটি পকেটে রেখে পকেট থেকে ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার বের করল। স্প্রেয়ারের মুখের ক্যাপ খুলে দুজনের নাকেই স্প্রে করল একে একে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লোক দুজন সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক ওদেরকে টেনে গার্ডরুমে নিয়ে এল। তারা ওদের গার্ড-ইউনিফরম খুলে পরে নিল এবং নিজেদের কাপড়গুলো রাস্তার পাশে একটা ঝোপে লুকিয়ে রাখল।
তারপর দুজন দুটি ষ্টেনগান কাঁধে ফেলে পাশাপাশি হেঁটে এগুলো বাড়ির দিকে। ওখান থেকেই জোৎসণার আলোতে বাড়ির সামনের বাগানটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ফুলের বাগানে বেশ কিছু বড় বড় ফুলের গাছও আছে। তাই বাড়িটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।
গাড়ি বারান্দার আলো ছাড়া বাড়ির আর কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। জানালার ভারী পর্দার ফাঁক গলিয়ে কিছু আলোর রেশ চোখে পড়ছে মাত্র তবে বাড়ির তিনতলা ও নিচতলায় কোন আলো জ্বলছে না।
বাড়ির দুতলার দক্ষিণ দিকের জানালাগুলোতে আলো বেশি দেখা যাচ্ছে।
আহমদ মুসারা বাড়ির সামনের বাগানের পাশ কাটিয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকে গিয়ে পৌছল। বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে উপর দিকে তাকিয়ে দেখল, গাছ বেয়ে উঠে ডাল দিয়ে কষ্ট করে তিন তলার ছাদে পৌছা যায়। তারপর তিন তলা থেকে দুতলায় নেমে আসা যাবে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক ডাল বেয়ে তিন তলার ছাদে নামল বটে, কিন্তু আহমদ মুসা নেমেই তিন তলার সিঁড়ির মুখে ঘরের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা একজনের মুখ দেখতে পেল।
আহমদ মুসা নেমেছিল সিঁড়ি ঘরটির পুব পাশে, হাসান তারিক পশ্চিম পাশে। আর লোকটি বসেছিল সিঁড়ি ঘরের পুব পাশের অন্ধকারে।
আহমদ মুসা ডাল থেকে ছাদ লক্ষ্যে লাফ দিয়ে ছাদের প্রাচীর আঁকড়ে ধরেছিল। সেখান থেকে ছাদে নামার সময়ই লুকানো লোকটি ছুটে এসে পেছন থেকে আহমদ মুসার মাথায় পিস্তল চেপে ধরে।
আহমদ মুসার মাথায় পিস্তল ধরে রেখেই বলল, ‘নেমে এস। আচ্ছা তো তোমার সাহস! এই ভর সন্ধ্যায় তুমি চুরি করতে এসেছ।’
আহমদ মুসা আশ্বস্ত হলো যে, তাকে চোর ভাবা হয়েছে। অতএব হুট করে সে গুলী চালানোর প্রয়োজন বোধ করবে না।
আহমদ মুসা সুবোধ বালকের মত তার হুকুম তামিল করল। নেমে এল সে।
আহমদ মুসার মাথায় পিস্তল ধরে রেখেই বলল, ‘চল হাঁটতে থাক। নিচে নামতে হবে। কোন চালাকির চেষ্টা করো না। তুমি যদি অন্যকোন শত্রু না হও, তাহলে তোমার ভয় নেই। আমরা তোমাকে কিছুই করব না। শুধু পুলিশে দেব চুরির চেষ্টার দায়ে।’
আহমদ মুসা একটুও দেরি না করে হাঁটতে লাগল। তাদেরকে তো নিচে নামতেই হবে, তার সাথেই নামা যাক। যাওয়ার পথেই একটা পথ বেরিয়ে যাবে। তাছাড়া হাসান তারিক তো ওপাশে নেমেছে। এ ব্যাপারটা নিশ্চয় তারও চোখে পড়ে যাবে।
ছাদের দরজা দিয়ে আহমদ মুসা সিঁড়ি ঘরে প্রবেশ করেছে।
হঠাৎ ‘কক’ করে একটা শব্দ হলো এবং তার মাথা থেকে রিভলবারের নলটা সরে গেল।
আহমদ মুসা পেছন ফিরে তাকাল। দেখল, হাসান তারিকের বাম হাত লোকটার নাকে-মুখে একটা রুমাল চেপে ধরে তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে এবং তার ডান হাত দিয়ে হাসান তারিক লোকটার রিভলবার কেড়ে নিয়েছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লোকটি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক ধরাধরি করে লোকটাকে টেনে নিয়ে অন্ধকার সিঁড়ি ঘরের কোণায় রেখে দিল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। হাসান তারিক, শুরুটা আমাদের ভালই হয়েছে। দুক্ষেত্রেই গোলাগুলী ছাড়াই আমরা কাজ সারতে পেরেছি। গোলাগুলী হলে ভেতরে ওরা সাবধান হয়ে যেতো। চল এবার আমরা তিন তলায় নামি।’ বলল আহমদ মুসা।
তিন তলায় নামল আহমদ মুসারা। তিন তলায় অনেকগুলো ঘর। সবগুলোই অন্ধকার এবং বন্ধ।
দুতলায় নামার সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়াল তারা।
‘ভাইয়া আমরা সাউন্ড মনিটর ব্যবহার করতে পারি। বেন্টো ও সসা’দের অবস্থান এর দ্বারা চিহ্নিত করা যাবে। নিশ্চয় কোথাও তাদের কথা হচ্ছে।’ বলল হাসান তারিক।
‘ঠিক বলেছ, হাসান তারিক।’ বলে আহমদ মুসা কাঁধে ঝুলানো ছোট্ট ব্যাগ থেকে আলট্রা সেনসেটিভ সাউন্ড মনিটরিং যন্ত্র বের করল। লোভয়েসে যন্ত্রটি অন করে দিল আহমদ মুসা।
সংগে সংগেই কথা বলে উঠল যন্ত্রটি। প্রথম কণ্ঠটাই বেন্টোর। কিন্তু চারদিকে নানা শব্দ কথাকে অস্পষ্ট করে তুলছিল।
ডাইরেকশন ইন্ডিকেটর ঘুরিয়ে আহমদ মুসা ঠিক করল বেন্টোদের কথা কোন দিক থেকে আসছে। তারপর মনিটরিং যন্ত্রের অন্য সব দিক বন্ধ করে দিল। এবার বেন্টোদের কথা পরিষ্কার হয়েছে। কথা বলছিল তখন একটা অপরিচিত ভারী কণ্ঠ। বলছিল, ‘তেরসিয়েরা দ্বীপের ঘটনা সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। গতকাল আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, সাও তোরাহ দ্বীপে শিকার নিয়ে যাওয়ার প্রোগ্রাম এখন বন্ধ থাকবে। শুধু তাই নয়, ওখানে যাতায়াতও একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’
‘তাহলে আগামীকাল হারতায় যে চালান আসার কথা ছিল তা আসছে না?’ বলল বেন্টোর কণ্ঠ।
‘না আসছে না।’ বলল সেই অপরিচিত কণ্ঠ।
‘সাও তোরাহ যাবার জন্যে যে ‘মিনি সাব’ এসেছে, ওটা কি চলে যাবে?’ তৃতীয় কণ্ঠ বলল। কণ্ঠটি সসা’র।
‘ইতিমধ্যে ওটা চলে গেছে।’ বলল সেই অপরিচিত কণ্ঠ।
‘এতবড় পরিবর্তন, তেরসিয়েরাতে এমন কি ঘটেছে?’ বলল বেন্টো।
‘এমন কি ঘটেছে বলছো? আমাদের অর্ধশতের মত লোক সেখানে নিহত হয়েছে। দুটি ভাড়া করা হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে, একটা নিখোঁজ রয়েছে। স্বয়ং আমাদের চীফ আহত।’
‘কাদের সাথে এ সংঘর্ষ হয়েছে?’ সসা’র কণ্ঠ বলল।
‘সেটা আমাদের বলা হয়নি। তবে মনে হয়, একদিন নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার যারা ধ্বংস করেছিল, তাদেরই উত্তরসূরী ওরা বোধ হয়।’ বলল অপরিচিত কণ্ঠ।
চতুর্থ একটি কণ্ঠ কথা বলে উঠল। বলল, ‘কিন্তু নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার যারা ধ্বংস করেছিল, এটা নিয়ে তো এখন ভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট মি. হ্যারিসন খোদ নাকি মনে করেন যে, সেই সময়ের মার্কিন সরকার যে সিদ্ধান্তে পৌছেছিল সেটা ছিল পরিস্থিতি তাড়িত, উপযুক্ত প্রমাণ ভিত্তিক নয়।’
‘হ্যাঁ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সেদেশের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি দুই-ই পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু তুমি প্রেসিডেন্ট হ্যারিসনের এ কথাটা কার কাছে শুনলে?’ বলল অপরিচিত সেই প্রথম কণ্ঠ।
‘মার্কিন ষ্টেশন ডিপার্টমেন্টের একজন উর্ধ্বতন অফিসার ট্যুরিষ্ট হিসেবে হারতায় এসেছিলেন। তার সাথে পরিচয় হয়। তিনিই একথা আমাকে বলেছিলেন।’ চতুর্থ কণ্ঠটি উত্তরে বলল।
‘যাক এসব উদ্বেগজনক কথা আমাদের না শোনাই ভাল।’ বলে একটু থেমেই প্রথম কণ্ঠটি আবার কথা শুরু করল, ‘সাও তোরাহ শিকার নিয়ে যাবার কর্মসূচী বাতিল হলো, এ নিয়ে অন্যরকম কিছু ভাবার অবকাশ নেই। শিকার ধরা চলছে এবং সাও তোরাহ প্রজেক্ট চলছে এবং চলবে।’
‘তবে আমরা খুশি হতাম যদি সাও তোরাহয় আমরা কতটা কি করতে পারছি তা জানতে পারতাম।’ বলল চতুর্থ কণ্ঠ।
মুহূর্তকাল নিরবতা।
পরে কথা বলে উঠল সেই প্রথম লোকটি। বলল, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। সাও তোরাহ আমি দেখিওনি। তার প্রয়োজনও নেই। যা হবার তাই হচ্ছে সেখানে।’
কণ্ঠটি থামতেই নারী কণ্ঠের কান্না ভেসে এল সাউন্ড মনিটরিং যন্ত্রে।
কান্নারত নারী কণ্ঠ কথা বলে উঠল। বলল কান্নাজড়িত কণ্ঠে, ‘মি. বেন্টো, মি. সসা আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন, কেন নিয়ে এসেছেন?’
নারী কণ্ঠ শুনে আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুজনেই চমকে উঠল। এতো মিস পলা জোন্সের কণ্ঠ। বেন্টো ও সসা কি ঐ গাড়িতে করে পলা জোন্সকেও নিয়ে এসেছিল?
নারী কণ্ঠ থামতেই অপরিচিত সেই প্রথম কণ্ঠটি বলে উঠল, ‘সুন্দরী তোমার গল্প বেন্টোদের মুখে অনেক শুনেছি। কিন্তু সময় হয়নি সাক্ষাত করার। আজ অনেক দিন পর আমরা অনেকেই এক সাথে বসতে পেরেছি। আমরা চাই তুমি আমাদের এ সম্মেলনকে স্মরণীয় করে রাখ। আমরা আজ সারারাত তোমাকে ঘিরে নাচব, গাইব। আমরা সকলেই খুশি হতে চাই তোমার সঙ্গলাভে।’
লোকটি একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আমি সকলকে নাচে শরিক হবার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আসুন মিস পলা।’
‘না, আমি নাচব না। আমাকে বাড়িতে রেখে আসুন।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রতিবাদ করে উঠল পলা জোন্স।
‘তোমার কান্না তোমার চিৎকার কেউ শুনতে পাবে না সুন্দরী। ইচ্ছায় না হলে, অনিচ্ছাতেই তোমাকে সবকিছুতে রাজী হতে হবে।’
একটু নিরবতা।
তারপরেই পলা জোন্সের কণ্ঠ আর্ত-চিৎকার করে উঠল, ‘ছেড়ে দাও আমাকে, যেতে দাও। ইশ্বরের দোহাই।’
‘হাসান তারিক এস, পলার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ বলে আহমদ মুসা সাউন্ড রেকডিংটা পকেটে ফেলে ষ্টেনগানটা হাতে নিয়ে দ্রুত নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে।
হাসান তারিকও পেছনে ছুটল আহমদ মুসার। তারও হাত ষ্টেনগান।
দৌড়ানো অবস্থায় আহমদ মুসা পকেট থেকে সাউন্ট মনিটরিং যন্ত্রটা বের করে ঘরটার লোকেশন আবার ঠিক করে নিল। তখনও সাউন্ড মনিটরিং-এ পলা জোন্সের চিৎকার ও প্রচন্ড ধস্তাধস্তির শব্দ ভেসে আসছে।
ঘরটির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক। দরজাটা ঠেলে দেখল দরজা লক করা।
‘রেডি হাসান তারিক’ বলে আহমদ মুসা গুলী করল লকারের কী হোলে।
গুলী করেই প্রচন্ড এক লাথি চালাল দরজায়। খুলে গেল দরজা।
ঘরে জনা সাতেক লোক। সবাই দাঁড়ানো।
ঘরের একদম দক্ষিণ প্রান্তে আহত ও অর্দ্ধনগ্ন অবস্থায় পলা জোন্সকে একজন লোক পাঁজাকোলা করে সম্ভবত পাশের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল। পাশেই একটা দরজা খোলা।
দরজা খুলে যেতেই ঘরেরর সবাই তাকিয়ে ছিল দরজার দিকে। সেই সাথে দুজনের হাতে উঠে এসেছিল রিভলবার। যে লোকটি পলা জোন্সকে পাজাকোলা করে নিয়ে যাচ্ছিল, চোখের পলকে সে পলা জোন্সকে ছেড়ে দিয়ে রিভলবার তুলে নিল পকেট থেকে।
আহমদ মুসারা চেয়েছিল পলা জোন্সকে উদ্ধার করতে। এ জন্যেই দরজা খোলার সাথে সাথে তারা গুলী করেনি। কিন্তু মুহূর্ত দেরি করলে তারা গুলীর শিকার হবে।
সে সুযোগ দিল না ওদের আহমদ মুসারা। ওদের হাতের রিভলবার টার্গেটে উঠে আসার আগেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের ষ্টেনগান ঘরের তিন দিক ঘুরে অগ্নিবৃষ্টি করল।
সাতটি দেহই লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। ঝাঁঝরা দেহগুলো ওদের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্থির হয়ে গেল।
আহমদ মুসা ছুটল ঘরের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে।
পলা জোন্সের প্রায় নগ্ন দেহ কুকড়ে পড়ে ছিল। ভয় ও আতংকে তার দুচোখ বিস্ফোরিত। মুখে মৃত্যুর পান্ডুরতা।
আহমদ মুসা পলার জ্যাকেটটি কুড়িয়ে নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘পরে নাও।’
উঠে বসা পলা জোন্স গায়ের ছেঁড়া গেঞ্জি ও সার্টের উপর জ্যাকেট পরে নিল। তারপর স্কার্ট ঠিক করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি পলাকে নিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। আমি এদের সার্চ করে বাইরে আসছি। দুতলা ও এক তলার ঘরগুলোও সার্চ করতে হবে।’
হাসান তারিক পলা জোন্সকে নিয়ে বাইরে গেল।
পলাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই আহমদ মুসা ও হাসান তারিক দুতলার ঘরগুলো সার্চ করল। কাগজপত্র সন্দেহজনক যা পেল কুড়িয়ে নিল। দুতলায় পেল একটিমাত্র কম্পিউটার সেট। ডিস্কগুলো নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
ভয় ও আতংক কিছুটা কমে গেলে পলা জোন্স আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে নিয়ে বিস্ময়ের দোলায় দুলছিল। গার্ডের ইউনিফরম ও কপাল পর্যন্ত নামানো হ্যাট পরা ক্লিনসেভ আহমদ মুসা ও হাসান তারিককে চিনতে পারছিল না পলা জোন্স। কিন্তু ওদের কথা মাঝে মাঝে তার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছিল। এই অপরিচিত দুজন লোক এই বিরাট হত্যাকান্ড ঘটিয়েও তাকে বাঁচাল কেন এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এরা এখানে কি খুঁজছে সেটাও তার মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পলা জোন্সকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
গাড়ি বারান্দায় এসে গাড়িতে ওঠার সময় পলা জোন্স বলল, ‘মাফ করবেন আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ আমাদের বাড়িতে মা কান্না-কাটি করছেন।’
‘হ্যাঁ, তুমি বাড়িতেই যাবে।’ বলে আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে উঠল। পাশে উঠল হাসান তারিক। পেছনের সিটে তুলল পলা জোন্সকে।
প্রাইভেট রোড থেকে কোষ্টাল হাইওয়েতে উঠে রেখে যাওয়া ট্যাক্সির কাছে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা ডাকল ট্যাক্সিওয়ালাকে। বলল, ‘আরেকটা গাড়ি যোগাড় হয়ে গেছে। অপেক্ষা করার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’ বলে একমুঠো টাকা ট্যাক্সিওয়ালার হাতে তুলে দিল।
টাকার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল ট্যাক্সিওয়ালার। একটা লম্বা ধন্যবাদ দিয়ে ছুটল সে তার ট্যাক্সির দিকে।
গনজালো রোডের মুখে এসে আহমদ মুসা তার গাড়ি ডান পাশের পার্কটার কারপার্কে দাঁড় করাল।
গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক। পলা জোন্সকে গাড়ি থেকে নামতে বলল।
পার্কের দিকে তাকিয়ে পলা জোন্স বলল, ‘আমার বাড়িতো এখানে নয়।’
‘এস। ১১নং গনজালো রোড খুব দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
বিস্ময় ফুটে উঠল পলা জোন্সের মুখে। বলল, ‘আমার বাড়ি আপনারা চেনেন?’
‘ওটা তো এখন আমাদেরও বাড়ি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কে আপনারা?’ বলে উঠল পলা জোন্স। তার কণ্ঠে সংশয় সন্দেহ।
উত্তর না দিয়ে আহমদ মুসা ‘এস’ বলে পলা জোন্সের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
‘গাড়ি না নেয়ার অর্থ বুঝলাম না।’ বলল পলা জোন্স।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই অপয়া গাড়িটা বাড়িতে নিলে ওটা সরিয়ে ফেলার জন্যে আবার পরিশ্রম করতে হবে।’
বলে হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা।
তার পেছনে হাঁটতে লাগল হাসান তারিক ও পলা জোন্স।
পলা জোন্স হাঁটছে। কিন্তু তার মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ঝড়ের বেগে। আহমদ মুসার শেষ কথা শুনে তার নিশ্চিত মনে হচ্ছে তাদের নতুন মেহমান ভাইয়ার গলা ওটা। কিন্তু ভাইয়াদের সাথে এদের চেহারার মিল নেই। আর এরা অধিকাংশ সময়ই দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলেছে, যা ভাইয়াদের পক্ষে সম্ভব নয়।
পলা জোন্সের বাড়িতে পৌছল তারা।
দরজায় নক করে পলা জোন্সই প্রথমে প্রবেশ করল বাড়িতে।
পলার মা মিসেস জোন্স পলাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার হাট বসিয়ে দিল।
পলাকে উদ্ধার করেছে এই পূন্যের সুবাদে মিসেস জোন্স আহমদ মুসাদেরকেও ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিল।
‘আপনারা বসুন দয়া করে। আমি কাপড় পাল্টে চা নিয়ে আসছি।
চলে গেল পলা উপরে দুতলায়।
‘পলার কি হয়েছিল? বেন্টো ও সসা কোথায় নিয়ে গিয়েছিল পলাকে? তোমরা কে?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস জোন্স।
‘আন্টি, পরিচয় বলছি।’ বলে আহমদ মুসা মাথা থেকে হ্যাট খুলে ব্যাগ থেকে চুল ও দাড়ি পরে নিল। হাসান তারিকও।
মিসেস জোন্সের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল বিস্ময়ে। বলল, ‘বাছা তোমরা? তো……।’
বিস্ময় জড়িত কণ্ঠে কথা জড়িয়ে গেল মিসেস জোন্সের। একটু পর বলল, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না বাছা!’
‘সব বলব আন্টি।’ বলল আহমদ মুসা।
এ সময় চা নিয়ে নেমে এল পলা জোন্স। আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে বলল, ‘ভাইয়া আপনারা? হঠাৎ কোত্থেকে?’
বলেই পলা জোন্সের চোখে পড়ল আহমদ মুসাদের পরনের পোশাকের উপরে। সেই গার্ডের ইউনিফরম। সংগে সংগে সব পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ তার যে শিথিল হয়ে পড়ল। তার হাত থেকে খসে পড়ল চায়ের ট্রে। প্রচন্ড শব্দে তা আছড়ে পড়ল মাটিতে।
পলা জোন্সের মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল, ‘ভাইয়া আপনারা।’
চিৎকারের সাথে তার চোখ দুটি স্থির হলো আহমদ মুসাদের উপর।
অবাক বিস্ময় আর অনেক প্রশ্নের অপ্রতিরোধ্য চাপে বিস্ফোরিত তার দুচোখ।
চিৎকার তার থেমে গেল, কিন্তু চোখ দুটি তার যেন পাথর হয়ে গেছে। কথা সরছে না পলা জোন্সের মুখ থেকে।
আহমদ মুসা হাসল পলা জোন্সের দিকে চেয়ে। বলল, ‘তোমাদের এ বিস্ময় স্বাভাবিক। আমাদের সব কথা তোমাদের শুনতে হবে।’
পলা জোন্সের স্থির চোখ একটুও নড়ল না। তার ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল। বলল, ‘সবকথা পরে শুনব। সবার আগে এক কথায় বলুন, ‘আপনারা কে? কি উদ্দেশ্যে আপনারা এসেছেন?’ শুষ্ক কণ্ঠ পলার।
আহমদ মুসা পরিপূর্ণভাবে তাকাল পলা জোন্সের দিকে। তার অনড় চোখের অতল দৃষ্টিতে আহমদ মুসা অন্য রকম এক পলা জোন্সকে দেখল। মনে হলো, এর কাছে মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই। আহমদ মুসা বলল, ‘আমরা দুজনেই মুসলিম। আমরা ফ্রান্স থেকে লিসবন হয়ে এখানে এসেছি। একটা ভয়ংকর চক্র সাও তোরাহ দ্বীপে আমাদের কিছু ভাইকে বন্দী করে রেখেছে। আমরা তাদের উদ্ধার করতে চাই।’
আহমদ মুসা থামলেও পলা জোন্স কথা বলল না। তার অপলক, অনড় দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আহমদ মুসাদের উপর। যেন অনেক কিছু নিয়ে ভাবছে সে। কিছুক্ষণ পর পলা জোন্স ধীর কণ্ঠে বলল, ‘আপনি আপনাদের পরিচয়ের সবটুকু বোধ হয় বলেননি। আর লিসবন হয়ে হারতা আপনারা আসেননি। লিসবন থেকে তেরসিয়েরা হয়ে হারতা এসেছেন।’
এবার বিস্ময় ফুটে উঠল আহমদ মুসার চোখে-মুখে। বলল, ‘তুমি জান এটা? কি করে?’
‘আপনিই তো বললেন।’ বলল পলা জোন্স।
‘কখন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এইতো বললেন যে, ফ্রান্স থেকে লিসবন হয়ে হারতা পৌছেছেন। যে দুজন মুসলমান লিসবন হয়ে আজোরস দ্বীপপুঞ্জে এসেছেন, তারা প্রথমে হারতায় নেমেছেন এবং অনেক ঘটনাও ঘটিয়েছেন।’ বলল পলা জোন্স।
ভ্রু কুঁচকে উঠেছে আহমদ মুসার। বিস্ময় জড়িত চোখের দৃষ্টি তার আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। বলল, ‘মিস পলা জোন্স আপনি কে?’
‘আমি আজোরস এর ‘সেন্ট্রাল কাউন্টার এসপায়োনেজ এজেন্সী’ (CCEA) এর সদস্য।’ দ্বিধাহীন যান্ত্রিক স্বরে বলল পলা জোন্স।
নতুন বিস্ময় নিয়ে তাকাল আহমদ মুসা ও হাসান তারিক পলা জোন্সের দিকে।
বিস্ময়-বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে মিসেস জোন্সের চোখও।
৭
আজর ওয়াইজম্যান সাও তোরাহ দ্বীপে ৪০ ফুট মাটির নিচে তার অফিস টেবিল বসে। জ্বলছে তার চোখ আগুনের মত। যেন তা পুড়িয়ে ফেলবে সামনে বসা তার দক্ষিণ হস্ত দানিয়েল ডেভিডকে।
আজর ওয়াইজম্যানের জ্বলন্ত চোখ নেচে উঠল। মুখ থেকে তার শব্দের শেল বর্ষিত হলো দানিয়েল ডেভিডকে লক্ষ্য করে, ‘২৪ ঘন্টার মধ্যে আমি হারতায় জর্জ এমানুয়েলের বাড়িতে কি ঘটেছে তার সঠিক রিপোর্ট চাই। আমার বিশ্বাস সেখানে আহমদ মুসা আসেনি। সমুদ্র পথের উপর আমাদের কড়া নজর আছে। গত ৭ দিনে তেরসিয়েরা থেকে কোন ছোট নৌকা বা বোট পশ্চিমের কোন দ্বীপে যায়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে ঘরে হত্যা কান্ডটা ঘটেছে, সেখানে ছেড়া সার্ট ও গেঞ্জীর যে টুকরো পাওয়া গেছে তা কোন মেয়ের। লেডিজ ঘড়িও সেখানে পাওয়া গেছে। এ থেকে প্রমাণ হয় কোন মেয়েকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ড ঘটেছে। খোঁজ নাও ভাল করে।’
একটু থামল আজর ওয়াইজম্যান। বলল আবার একটু পরে, ‘সবাইকে খবর পৌছাও সাও তোরাহমুখী জাহাজ, লঞ্চ, হেলিকপ্টার সবকিছুকে যেন বিনা জিজ্ঞাসায় ধ্বংস করে দেয়া হয়। আমাদের নিজস্ব যোগাযোগ ‘মিনি-সাব’ এর মাধ্যমে চলবে। আর মাটির উপরের বন্দীখানাকে ভূগর্ভে ঢুকিয়ে দাও। যেন মাটির উপরে জংগল ও পাহাড় ছাড়া আর কোন কিছুর চিহ্ন না থাকে।’
আবার একটু দম নিল আজর ওয়াইজম্যান। কয়েক মুহূর্ত পরে শুরু করল আবার, ‘টুইন টাওয়ারের ধ্বংস সম্পর্কিত স্পুটনিক এর অনুসন্ধান রিপোর্টের বাড়তি কপি উদ্ধার করা এখনও সম্ভব হলো না। অথচ এর মধ্যেই রয়েছে আমাদের প্রাণ।’
অনেকটা স্বগত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলেই আজর ওয়াইজম্যান পাগলের মত চিৎকার করে উঠল, ‘নতুন বন্দী সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহকে আমার কাছে নিয়ে এস। সে কামাল সুলাইমানের স্ত্রী লতিফা কামাল, বোন ফাতিমা কামাল এবং যায়েদ বিন ফারুকের খোঁজ-খবর জানে। তার কাছ থেকে বের করে নিতে হবে ওদের ঠিকানা। আর স্পুটনিকের ৭ জনের কাছে শেষ চেষ্টা চালাও। বের কর রিপোর্টের কপি কোথায় রেখেছে। সময় আমাদের হাতে নেই। হয় ওরা বলবে না হয় ওদের সবাইকে মরতে হবে। যাও।’
বেরিয়ে গেল দানিয়েল ডেভিড।
Leave a Reply