ইবু সলোমানের রত্নভাণ্ডার
বিকেল বিকেল সময়ে পোর্তো বন্দর থেকে ফ্রান্সিসদের জাহাজ ছাড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য পশ্চিমদিগন্তে সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছে নেমে এল। লাল রং ছড়িয়ে পড়ল প্রায় মধ্য আকাশ পর্যন্ত। মারিয়া জাহাজের রেলিঙ ধরে বরাবরের মতো সূর্যাস্ত দেখছিল। ওর মনে আজ খুব আনন্দ। কতদিন পরে য়ুরোপে এসেছে ওরা। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের পাশের দেশগুলিতে তো য়ুরোপের দেশগুলির মতো অত বাড়ি-ঘর নেই, উঁচু উঁচু গির্জার চুড়োও দেখা যেত না। লোক জনও পরিচিত পোশাক পরা নয়। মালবাহী যাত্রীবাহী জাহাজগুলির চলাচলও কম। এখানে তো মাঝে মাঝেই তেমনি জাহাজের দেখা পাচ্ছে। জাহাজগুলোর মাথায় মাস্তুলের উপরে উড়ছে পতপত করে নানা য়ুরোপীয় দেশের পতাকা-স্পেনের, ফ্রান্সের, জার্মানির এমনকি দূরের দেশ ফিনল্যাণ্ডের পতাকাও দু’একটা দেখেছে। হ্যারি অনেক দেশের খবর জানে, পতাকাও চেনে। জলদস্যুদের ক্যারাভেলের (ছোট দ্রুতগামী জাহাজ) সাক্ষাৎ এখনও পায়নি। তবে ওরাও কম বুদ্ধিমান নয়। ওদের ক্যারাভেল জাহাজে নানা দেশের পতাকা ওড়ায়। কিন্তু কাছাকাছি এসে লুঠপাটের মতলব থাকলে হঠাৎ দুটো ঢ্যাঁড়া-দেওয়া সাদা হাড় আর নরকঙ্কালের মাথা আঁকা কালো পতাকা উড়িয়ে। দিয়ে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়ে যাত্রীজাহাজে নয়তো মালবাহী জাহাজের ওপর। অবাধে লুঠপাট চালিয়ে সবকিছু নিয়ে অন্য কোনও দেশের পতাকা উড়িয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। অবশ্য এটা য়ুরোপের এলাকা। বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ইংল্যাণ্ডের নজরদারি জাহাজ ঘুরে বেড়ায়। জলদস্যুদের মতলব বুঝতে পারলে সেই জাহাজ কয়েকশো মাইল তাড়া করে ধরে ফেলে। নিরীহ যাত্রীদের গভীর সমুদ্রে অসহায় অবস্থায় পেয়ে সর্বস্ব লুঠ করা, হত্যা করা কোনও সভ্য দেশই সহ্য করে না। বন্দী করে দেশে নিয়ে যায়। ক্যাপটেন তো বটেই সঙ্গী জলদস্যুরাও রেহাই পায় না। প্রকাশ্য স্থানে জনসমক্ষে ফাঁসিকাঠে দেয়। তাই এই অঞ্চলে জলদস্যুদের ভয় অনেক কম।
চারদিক অন্ধকার করে সন্ধ্যা নেমে এল। আকাশে বাঁকা চাঁদের আলো উজ্জ্বল হল। ভাইকিংরা রাতের খাওয়া সেরে জাহাজের ডেকে অনেকেই এসে জড়ো হল। বসে যায় নাচগানের আসর। সিনেত্ৰা সুরেলা গলায় দেশের গানও গায়। নিজের তৈরি গানও গায়। ফ্রান্সিস ওকে খুব উৎসাহ দেয়। সবাই খুশি। স্বদেশ আর বেশি দূরে নয়।
দুদিন পরে সেদিন রাতে আর আসর বসেনি। সবাই কেবিন ঘরে, ডেক-এ হালের কাছে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জোরে হাওয়ার আরামে ঘুমোচ্ছে সবাই। নজরদার পেড্রোও মাস্তুলের মাথায় ওর ছোট্ট জায়গাটায় গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
গভীর রাত তখন। আবছা চাঁদের আলোয় একটা ছোটো জাহাজ বেশ দ্রুত? দুলতে দুলতে এসে ফ্রান্সিসদের জাহাজে ধাক্কা দিয়ে থেমে গেল। দশ-বারো জন য়ুরোপীয় নিঃশব্দে লাফিয়ে লাফিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে আসতে লাগল। সকলের হাতেই খোলা তরোয়াল। সমুদ্রে ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজে দুলুনিতো আছেই। জাহাজটায় গায়ে জোর ধাক্কা লাগলেও ফ্রান্সিসদের কারো ঘুম ভাঙল না। হালের কাছেই ঘুমিয়ে থাকা শাঙ্কোর সামনে একজন তরোয়াল হাতে দ্রুত এসে জোরে তরোয়ালের খোঁচা দিল। শাঙ্কো উঃ শব্দ করেই উঠে বসল। অবাক চোখে দেখল অল্প দাড়িগোঁফওয়ালা একজন য়ুরোপীয় লোক ওর দিকে তাকিয়ে মুখে আঙুল চেপে চুপ করে থাকার ইঙ্গিত করল। লোকটার দশাসই চেহারা। গায়ে য়ুরোপীয় পোশাক। বেশ দামি। মাথায় লালচে লম্বা চুল সমুদ্রের হাওয়ায় এলোমেলো। কোমরে চামড়ার ফেট্টি। জলদস্যু নয় বোঝাই যাচ্ছে। তবে এ কে? ওদিকে বাকি কয়েকজনের গায়ে সাধারণ পোশাক। বোঝাই যাচ্ছে দামি পোশাক পড়া লোকটাই দলপতি। অন্য ভাইকিং বন্ধুদের সঙ্গীরা তরোয়ালের খোঁচা দিয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছিল। সবাই উঠে বসতে লাগল।
শাঙ্কো জিগ্যেস করল–তোমরা কারা?
ফিনল্যাণ্ডের অধিবাসী। তোমরা নোর্স। তাই না? লোকটা মৃদুস্বরে বলল। লোকটা ফিনদের ভাষায় বলল। ফিনল্যাণ্ড শাঙ্কোদের দেশ থেকে উত্তরে। খুব একটা দূরে নয়। শাঙ্কো মোটামুটি বুঝল। বলল হ্যাঁ, আমরা ভাইকিং। য়ুরোপে আমরা নোর্স বলেও পরিচিত। কিন্তু হঠাৎ তরোয়াল উঁচিয়ে ভয় দেখাচ্ছ কেন?
পাশেই আমাদের জাহাজ। নিশ্চয়ই আমাদের জাহাজে খাবার জন্যে তোমাদের নিমন্ত্রণ করতে আসিনি। লোকটি দাঁত বের করে হাসল।
–তা তো ওরকম তরোয়ালের খোঁচা খেয়েই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের জ্বালাতে এলে কেন? শাঙ্কো বলল।
-খুব সহজ। তোমাদের জাহাজে দামি কিছু জিনিস মানে সোনা রূপো হীরে মুক্তো নিশ্চয়ই আছে। জলদস্যু হিসেবে তোমরাও জাহাজ লুঠ কর। আমরা সেসব লুঠ করতে এসেছি। বলে না, চোরের ধন চুরি করা। লোকটা, আবার সেঁতো হাসি হাসল।
-আর কিছু?
–সেটা পরে মানে শ্বেতাঙ্গ লোকদের ধরে বন্দী করে আরবীয় বনিকদের কাছে বিক্রিও করি। আশাতীত স্বর্ণমুদ্রা পাই। আবার সেঁতে হাসি।
শাঙ্কো চুপ করে রইল। নিরস্ত্র অবস্থায় এদের সঙ্গে লড়াই করতে যাওয়া বোকামি। যা বলে শুনে যাও। যা করে দেখে যাও। এরা লুঠেরার দল। ও শুধু। বলল–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
—এটা উত্তর পোর্তুগাল। কাছেই সিনহো শহর বন্দর। তারই শহরতলিতেই আমরা আস্তানা গেড়েছি। এখানে অনেক জায়গায় আমরা দলবদ্ধভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আস্তানা করেছি।
তাহলে সিনহো বন্দর নগরটা লুঠ করলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত।
উঁহু। এই অঞ্চলের শাসক মুর। মুরদের রাজত্ব এখানে। শাসকের নাম ইবু গ্যাব্রিওল। সাংঘাতিক লোক, হিংস্র প্রকৃতির। সব সময় সন্দেহ। অবশ্য আমাদের ব্যবসায়ী বলে জানে। পশুর লোম, চামড়া, হাতে বোনা সুন্দর কাপড়টাপড়, কার্পেট এসব ধনী আরবীয় বণিকদের কাছে কেনা বেচা করি। থাকগে ওসব। তোমরা কতজন জাহাজে আছ? লোকটা জানতে চাইল।
–বেশি না। জনা পাঁচ-ছয়।
–তাহলে তো কেল্লা ফতে। একটু গলা চড়িয়ে সঙ্গীদের বলল–অ্যাই, তোরা পাঁচজন নীচে কেবিন ঘরটাতে তল্লাশি চালা। নিশ্চয়ই এদের লুঠ করা দামি সম্পত্তি পাবি।
দলনেতার কথা শেষ হতেই সিনাত্রা সুরেলা গলায় গেয়ে উঠল–চলো হে বন্ধুরা–পাহাড়ের উপত্যকায় বসন্ত এসেছে–এ-এ। শাঙ্কো সাঙ্গে সঙ্গে কাঠের ডেক-এ জুতো ঠুকে থপ থপ্ নাচ শুরু করে দিল। দলপতি সঙ্গে সঙ্গে থাম, বলে জোরে চেঁচিয়ে উঠেই সিনাত্রার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তরোয়াল চালাল সঙ্গে সঙ্গে। সিনাত্রার কাঁধের কাছে পোশাক কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। তবে খুব বেশি গভীর ক্ষত হল না। কারণ শাঙ্কো দ্রুত এক ধাক্কায় সিনাত্রাকে সরিয়ে দিয়েছিল।
ওদিকে ডেক-এ অনেকের চলাফেরার শব্দে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুমের মধ্যেও সতর্ক থাকা ফ্রান্সিসদের চিরদিনের অভ্যেস হয়ে গেছে। পরক্ষণেই সিনাত্রার গান আর শাঙ্কোর নাচের শব্দে ফ্রান্সিস দ্রুত বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল। মারিয়াও ঘুম ভেঙে দেখল ফ্রান্সিস বিছানার তলা থেকে এক ঝটকায় তবোয়ালটা বের করে ফেলেছে।
–কী হল? মারিয়া ভীতস্বরে বলে উঠল। ফ্রান্সিস ঠোঁটে আঙুল রেখে চাপাস্বরে বলে উঠল–ওপরের ডেক-এ নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। নইলে এত গভীর রাতে সিনাত্রা কক্ষনো গান গায় না, শাঙ্কোও নাচ জুড়ে দেয় না। ফ্রান্সিস সিঁড়ির দিকে ছুটল। কিন্তু ওপরে উঠল না। সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওপরে কী ঘটছে আর এক্ষুনি ওপরে উঠবে কিনা, শাঙ্কোরা কোনও সঙ্কেত দেয় কিনা তার জন্যে কান পেতে রইল।
ওপরের ডেক-এ এবার দলপতি নিঃশব্দে তরোয়াল উঁচিয়ে সিঁড়িঘর দেখাল। তারপর নিজেই সিঁড়িঘরের প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে পেছন ফিরে সঙ্গীদের নামতে ইঙ্গি ত করল। পাঁচজন সঙ্গী খোলা তরোয়াল হাতে দলপতির পেছনে এসে দাঁড়াল। অন্যেরা ঘুরে ঘুরে শাঙ্কোদের পাহারা দিতে লাগল। বিনোলা এই সুযোগের জন্যে তক্কে তকে ছিল শেষ সঙ্গীটির ওঁচানো তরোয়ালের ডগাটা সিঁড়িঘরের মাথায় লেগে গেল। ও টাল খেয়ে মাথা নিচু করতেই বিনোলা বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে মাথার কাছে ঝুলন্ত কাঁচ ঢাকা আলোটা এক থাবড়ায় নিভিয়ে দিয়েই শেষ সঙ্গীটির ওপর প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই ধাক্কায় অন্ধকারে শেষ সঙ্গীটি ছিটকে পড়ল সামনের সঙ্গীদের ওপর, সবাই মিলে অন্ধকারে টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ল সবার সামনে দলপতির এ উপর। সেই প্রচণ্ড ধাক্কায় দলপতি মুখ থুবড়ে পড়ল সিঁড়ি থেকে ছিটকে নীচের কাঠের মেঝেয়। দলপতির হাত থেকে অন্ধকারে কোথায় ছিটকে পড়ল তরোয়ালটা। ওর নাক ভেঙে গেল। ঠোঁট ফেটে গেল। সারা মুখে রক্ত ছুটল। পেছনের সঙ্গীদেরও কয়েকজনের কপাল ফেটে গেল, কারো হাঁটু ভাঙল, কারো হাত। তাদের হাতের তরোয়ালও ছিটতে গেল। শুধু দুজন সবার ওপরে ছিল। তাদের হাতেধরা তরোয়াল হাতেই রইল। সকলের ওপর পড়ল বিনোলা, অক্ষত। ওর ওপরে তো কেউ ছিটকে পড়েনি। সিঁড়িঘরের অন্ধকারে আঞ্জাদ, গোঙানি, শুরু হল। বিনোলা ততক্ষণে ডিগবাজি খেয়ে কয়েক হাত দূরে ফ্রান্সিসের পায়ের কাছে পড়েছে। ফ্রান্সিস বিনোলাকে তুলে পেছনে ঠেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল–কেউ লড়তে এসো না, নির্ঘাৎ মারা যাবে। যে দুজনের হাতে তরোয়াল ছিল তারা উঠে দাঁড়াল ঠিকই, কিন্তু বাকি সবাই তখন ভাঙা কনুই, -পা, ফাটা কপাল নিয়ে গোঙাতে শুরু করেছে। অন্ধকারে সিঁড়িঘরে আর্তনাদ, গোঙানি চলল। তরোয়াল হাতে দুই সঙ্গী অন্ধকারে ফ্রান্সিসকে দেখতেই পেল না। ফ্রান্সিস এক ঝটকায় এগিয়ে এসে সামনের সঙ্গীটির গলায় তরোয়ালের ডগা চেপে বলল–তরোয়াল ফেলে দাও। ও কিছু না বুঝে থমকে গেল। ফ্রান্সিস তরোয়ালের ডগা আরো জোরে চেপে ধরল। কেটে গেল গলা। অন্যজন তখন ভয়ে তরোয়াল ফেলে দিয়েছে। ফ্রান্সিস সিঁড়িঘর দিয়ে আসা নিস্তেজ আলোয় ভালো করে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। গলা চড়িয়ে বলল–মারিয়া, মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে এসো। কোনও ভয় নেই।
একটু পরেই মারিয়া মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে এল। মোমবাতিটা বিনোলা হাতে নিয়ে তুলে ধরল। মোমবাতির আলোয় দেখা গেল, সামনেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে, দলপতি। পরনে দামি পোশাক ও কোমরের চওড়া চামড়ার কোমরবন্ধনী সোনার কাজ করা। নাক-চোখ মুখ রক্তে মাখামাখি। ফ্রান্সিস সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল বিনোলা এটাই গুণ্ডা দলের সর্দার, তাই না?
–হ্যাঁ, বিনোলা বলল।
–যা দেখছি মাসখানেক বিছানা থেকে উঠতে পারবে না। কিন্তু এই গুণ্ডার দল এখানে এল কী করে?
–একটা ছোটো জাহাজ চড়ে। এরা ফিনল্যাণ্ডের লোক। এখানে উত্তর পোর্তুগা ডেরা বেঁধেছে। নিজেদের সাধারণ ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয়। আসলে দাস ব্যবসায়ী। তবে খুব উঁচু দরের। শুধু শ্বেতাঙ্গদের ধরে। তারপরে প্রচুর আরবীয় স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বড়লোক আরবীয় বণিকদের কাছে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে। বিনোলা বলল।
–ব্বাঃ! তাহলে তো শুধু মুখ-হাত-পা ভাঙলে চলবে না, সবকটাকে নিকেশ করতে হবে। কথাটা বলে ফ্রান্সিস তরোয়াল উঁচিয়ে ধরল।
আহত সঙ্গীরা তখন কেউ ভাঙা পা চেপে ধরে, হাতে কনুই চেপে ধরে উঠে দাঁড়াতে শুরু করল। সকলেই মুখচোখ বিকৃত করে ব্যথাবেদনা সহ্য করছে। মৃদু গোঙাচ্ছেও। যে সঙ্গীটি তরোয়াল ফেলে দিলেছিল সে এবার করুণ স্বরে বলে উঠল–আমাদের মেরো না। সর্দারের নির্দেশেই আমরা এই জঘন্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছি।
-ঠিক আছে তোমাদের জাহাজে চলে যাও। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করো–বরং উপোস করে মরবো কিন্তু এরকম দস্যুতা আর ক্রীতদাস ব্যবসায়ে জড়াবে না।
দুজনই একসঙ্গে বলে উঠল–আমরা প্রতিজ্ঞা করছি। ফ্রান্সিস আহতদের দিকে তাকিয়ে বলল–সবাই ওপরের ডেক-এ যাও। কেউ নিজেদের জাহাজে গিয়ে উঠতে পারবে না। চলো, আমরাও যাচ্ছি। আহতরা হাত-পা চেপে ব্যাথায় গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল।
ওদিকে ওপরে যে কজন দলপতির সঙ্গী ছিল তারা বিনোলাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখল। দলপতি আর সঙ্গীদের হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ার জোর শব্দ শুনল। বুঝল ওরা পরস্পর জড়াজড়ি করে গড়িয়ে পড়ল। তারপরই আর্ত চিৎকার। ওরা হকচকিয়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। শাঙ্কো এই সুযোগটা কাজে লাগাল। দেশীয় ভাষায় গলা চড়িয়ে বলল– সবাই এদিকে-ওদিকে ছুটোছুটি করতে থাকো। সবাই সারি ভেঙে হালের দিকে, সামনের দিকে, সিঁড়িঘরের দিকে ছুটোছুটি শুরু করল। কিন্তু সব কজনকে সামলাবে কী করে? ওরা অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে পরে হাঁপাতে লাগল। এবার শাঙ্কো আবার গলা চড়িয়ে বলল–ওদের ওপর ঝড়িয়ে পড়ো। তরোয়াল কেড়ে নাও। সঙ্গে সঙ্গে ভাইকিং বন্ধুরা বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এসে ক্লান্ত সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এসব লড়াই শাঙ্কোরা অনেক বার লড়েছে। দুজন সঙ্গীর হাতের তরোয়াল ছিটকে গেল। শাঙ্কোরা কয়েকজন ছুটে গিয়ে তরোয়াল দুটো তুলে নিয়ে রুখে দাঁড়াল। সঙ্গীরা এত দ্রুত আক্রমণের আশঙ্কা করেনি। হতবাক হয়ে শাঙ্কোদের দিকে তাকিয়ে রইল। তরোয়াল হাতেই রইল। শাঙ্কো জোর গলায় বলে উঠল–তরোয়াল ফেলে দে। লড়তে এলে কেউ বাঁচবি না। বাকিরা তবু তরোয়াল ফেলল না। তখনই আহত সঙ্গীরা গোঙাতে গোঙাতে ডেক-এ উঠতে লাগল। সবাই উঠে এল। নীচে দলপতির তখনও জ্ঞান ফেরেনি। অসাড় পড়ে আছে।
ততক্ষণে সূর্য উঠেছে। চারদিকে ভোরের নরম রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিস বিনোলা-মারিয়াও এবার ডেক-এ উঠে এল। তিনজনের হাতে তরোয়াল দেখে ফ্রান্সিস তরোয়াল উঁচিয়ে ছুটে এল। ফ্রান্সিদের সেই রুদ্রমূর্তি দেখে ওরা পিছু হটে গেল। শাঙ্কো আর এক বন্ধু তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসের পেছনে পেছনে ছুটে এস। সঙ্গীরা এবার ভয়ে হাতের তরোয়াল ডেক-এর ওপর ফেলে দিল।
ফ্রান্সিস দলপতির ছোট জাহাজটার কাছে এসে দাঁড়াল। দেখল দলপতির পাঁচ সাতজন সঙ্গী খোলা তরোয়াল হাতে ডেক-এর ওপর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–তোদের মারাত্মক জখম সঙ্গীদের তো দেখতেই পেলি। তোদের দলপতি অজ্ঞান হয়ে নিচে পড়ে আছে। ওরা ওকে নিয়ে আসছে। তোরা গোপনে ক্রীতদাস ব্যবসা করিস। এই জঘন্য নির্মম কাজের জন্যে তোদের সভ্য সমাজে স্থান নেই। লড়তে এলে সব কটাকে আহত নয়, একেবারে নিকেশ করে, দেব।
ওদিকে দলপতিসহ তার সঙ্গীদের সিঁড়ি দিয়ে ছিটকে গড়িয়ে পড়ার জোর শব্দে অন্য ঘুমন্ত ভাইকিংদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। হ্যারিও ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠে। পড়েছিল। তিলমাত্র দেরি না করে অস্ত্রঘরের দিকে ছুটে যেতে যেতে চিৎকার করে বলে উঠল, ভাইসব, তরোয়াল নিয়ে ডেক-এ উঠে আসো। ওরাও উঠে পড়ে দ্রুত অস্ত্রঘরের দিকে যেতে লাগল। তরোয়াল নিয়ে ওরা সিঁড়ির দিকে ছুটল। আবছা আলোয় কেউ দেখল সিঁড়ির নিচে কে কনুই চেপে ভর করে দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। অন্যরকম পোশাক। কেউ দলপতিকে ডিঙিয়ে ছুটল। কেউ ওর কাঁধ, হাত মাড়িয়ে দিয়ে গেল। দলপতি আবার সটান শুয়ে পড়ল। কয়েকজন ওর মুখ বুক মাড়িয়ে দিয়ে ছুটে গেল। দলপতি আবার অজ্ঞান হয়ে গেল।
দু-তিনজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এসে দাঁড়াল। বাকিরা কাছে এসে দাঁড়াল। বাকিরা আহত ও অন্য সঙ্গীদের ঘিরে দাঁড়াল।
সিঁড়িতে নীচে কে পড়ে আছে? হ্যারি জিগ্যেস করল।
–এই জাহাজের দলপতি। ওর সঙ্গীদের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছ। কথাটা বলে ফ্রান্সিস গায়ে লাগা ছোট জাহাজের সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল–সবার আগে একটা কাজ করতে হবে। তোদের জাহাজে নিশ্চয়ই কিছু শ্বেতাঙ্গকে ক্রীতদাস হিসেবে আরবীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করবি বলে বন্দী করে রেখেছিস। এক্ষুনি সবাইকে আমাদের জাহাজে তুলে দে। তোদের দলপতি আর সঙ্গীদের তখন তোদের জাহাজে তুলে দেব। তার আগে নয়।
সঙ্গীরা দলপতিকে না দেখে আর সঙ্গীদের ঐ অবস্থা দেখে বুঝেছিল একটা কিছু, হয়েছে। দু’তিনজন তরোয়াল ফেলে দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে সাতজন শ্বেতাঙ্গ বন্দীকে ডেক-এ নিয়ে এল। শতচ্ছিন্ন পোশাক। মাথার চুলে জট পাকানো। তবে সুস্থ সবাই। ক্রীতদাসের ব্যবসাতে সুস্থদেহী যুবকই বেশি দাম দিয়ে কেনা হয়। শেষের জনকে দু তিনজন সঙ্গী ধরে ধরে নিয়ে এল। বয়স্ক। মাথার চুল দাড়ি গোঁফ সাদা। বেশ দুর্বলও। পরনে শতচ্ছিন্ন পোর্তুগীজ পোশাক। হ্যারি বলে উঠল-আশ্চর্য। এই বৃদ্ধকে তো একটা রুপোর মুদ্রা দিয়েও কেউ কিনবে না। একে বন্দী করে রেখেছিস কেন?
–নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। ফ্রান্সিস বলল। সুস্থরা সবাই সহজেই দুলনির মধ্যেও ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে এল। কিন্তু বৃদ্ধকে কাঁধে চাপিয়ে সঙ্গীরা আর কয়েকজন ভাইকিং মিলে এই জাহাজে নিয়ে এল।
–এর পরেও এই জঘন্য ব্যবসায়ীদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত? ফ্রান্সিস দাঁত চাপাস্বরে বলে উঠল। হ্যারি শান্তস্বরে বলল–ফ্রান্সিস, ভুলে যেও না এরা সভ্যদেশের মানুষ। সভ্যজগতেই ওরা মানুষ হয়েছে। কাজই সভ্যভদ্র নীতিবাদী মানুষদের তো ওরা দেখেছে। দেখো না এদের সভ্য, সৎ ও ভদ্র জীবন কাটাবার জন্যে একটা সুযোগ দিয়ে। ভুল বুঝতে পেরে অন্যায় অমানবিক কাজ ছেড়ে হয়তো ভালো হতে পারে। যারা পারবে না তারা উচ্ছন্নে যাক।
ঠিক আছে। তোমার কথাই মেনে নিলাম। সেই বৃদ্ধকে তখন শাঙ্কোরা ধরে ধরে সিঁড়িঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ঐ বৃদ্ধকে আমার কেবিন ঘরে নিয়ে যাও। ওকে প্রথমে ভালো করে স্নান করাবে। নতুন পোশাক পরাবে। ভেনকে ডেকে আনবে। ভেন যেমন বলে করবে। তারপর ওকে মারিয়ার জিম্মায় রেখে চলে আসবে। শাঙ্কোরা বৃদ্ধকে কাঁধে নিয়ে সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। মারিয়াও ওদের পেছনে পেছনে চলল। এবার ফ্রান্সিস সুস্থ দুই সঙ্গীকে বলল–তোমরা সিঁড়ির নীচে যাও। তোমাদের সর্দারের জ্ঞান ফিরুক বা না ফিরুক তুলে নিয়ে ডেক-এ এসো।
ওরা দুজনেই ছুটল সিঁড়িঘরের দিকে। একটু পরেই ওরা অনেক কষ্টে দলপতিকে এনে ডেক-এ শুইয়ে দিল। দলপতির তখন জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু নড়াচড়া নেই। কোনোরকমে চোখ খুলে পিটপিট করল। মুখ দিয়ে শব্দও করতে পারছিল না। আহত সঙ্গীরা ডেক-এর এক পাশে শুয়ে-বসে ছিল। অল্পস্বল্প কাতরাচ্ছে নয়তো গোঙাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–সবাই যেভাবে পারো তোমাদের জাহাজে গিয়ে ওঠো। তারপর ডেক-এ সবাই এসে দাঁড়াবে।
–ওরা একা একা গিয়ে জাহাজে উঠতে গেলে বেলা হয়ে যাবে। তার চেয়ে আমরা একটু সাহায্য করলে ওদের তাড়াতাড়ি বিদেয় করতে পারব। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল।
হ্যারি বিনোলাকে ডেকে ঐ আহতদের ওদের জাহাজে উঠতে সাহায্য করতে বলল। সুস্থ দুই সঙ্গী আর কয়েকজন ভাইকিং বন্ধুকে নিয়ে বিনোলা ওদের অনেক কষ্টে ঐ দুলুনির মধ্যে ওদের জাহাজে তুলে দিল। দলপতিকে ওরা তখন কেবিন ঘরে নামিয়ে নিয়ে গেলে বাকিরা এসে ওদের ডেক-এ সার দিয়ে দাঁড়াল। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে না পরে বসে পড়ল।
ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে গলা চড়িয়ে বলতে শুরু করল–ভালো করে শোনো। আমরা তোমাদের চেয়ে সংখ্যা বেশি। তোমাদের সবকটাকে নিকেশ করার ক্ষমতা আমাদের আছে। যারা আহত হবে তাদের ছুঁড়ে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া এমন কিছু কঠিন নয়। ক্ষুর্ধাত হাঙরের পাল তাহলে খুশিতে লাফালাফি করবে। কিন্তু আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধুর অনুরোধে তোমাদের মুক্তি দিলাম। ফ্রান্সিস থামল। দলপতির সঙ্গীরা ততক্ষণে ফ্রান্সিসের ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখে বুঝে গেছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল ওরা। ফ্রান্সিস আবার বলতে লাগল–কিন্তু একটা শর্ত আছে। কেউ আর দাস-ব্যবসার মতো জঘন্য কাজে জড়াবে না। সোজা তোমাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাবে। যারা আবার এখান থেকে ডেরা বৈধে ঐ ব্যবসায় সাহায্য করবে তারা নরকে। যাক। ব্যস্-আর কিছু বলার নেই। এক্ষুনি জাহাজ ছেড়ে দাও। এক্ষুনি–যাও।
সঙ্গীদের মধ্যে নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরে যাবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। রাতের আবছা অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে নিঃশব্দে যে কাছিটা ওরা ফ্রান্সিসদের জাহাজের কাছির সঙ্গে বেঁধেছিল, শাঙ্কো ছুটে গিয়ে সেই কাছিটা তরোয়াল দিয়ে কয়েকবার পেঁচিয়ে কেটে ফেলল। ওদের জাহাজটা যেন জোরে ধাক্কা খেয়ে দুলতে দুলতে বেশ দূরে চলে গেল। তিনটে পাল নামানো ছিল। দ্রুত সেই তিনটে পাল খুলে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই দস্যু ও দাস-ব্যবসায়ীদের জাহাজ অনেক দূরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিস্তৃত প সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। হ্যারিকে নিয়ে ফ্রান্সিস নিজেদের কেবিন ঘরে এল। দেখল সেই বৃদ্ধটি বিছানার একপাশে বসে আস্তে আস্তে খাচ্ছে। সামনে মারিয়া দাঁড়িয়ে থেকে বৃদ্ধের খাওয়া দেখাশুনো করবে। বৃদ্ধের পরনে নতুন পোশাক। বোঝ যাচ্ছে সযত্নে বৃদ্ধকে স্নান করানো হয়েছে। মাথার পাকা চুলও অনেকটা বিন্যস্ত। ফ্রান্সিসরা ঢুকতে বৃদ্ধ তৃপ্তির হাসি হেসে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিসও হেসে বলল–কী? এখন ভালো লাগছে তো? পোর্তুগীজ ভাষাতেই জিগ্যেস করল।
বৃদ্ধ কোনও কথা না বলে মাথা কাত করল। তারপর আস্তে আস্তে খেতে লাগল। ফ্রান্সিস বুঝল বৃদ্ধ পোর্তুগীজ। ও বলল–আপনার নাম কী?
–আলফানসো। খাওয়া থামিয়ে বৃদ্ধ মৃদুস্বরে বলল।
–আপনি পোর্তুগীজ?
–হ্যাঁ, দক্ষিণ পোর্তুগালে সমুদ্রের ধারে একটা গ্রামে আমার জন্ম।
–তবে এখানে এলেন কেন?
বৃদ্ধ ফোকলামুখে হেসে বলল–আমি আপনাদের দেশে স্ক্যান্ডানেভিয়াতেও গেছি। আপনাদের দেশের ভাষা, শুধু বুঝিই না বলতেও পারি। ফরাসি জার্মান আরবী ফার্সি মিলিয়ে পাঁচ-ছটা ভাষা আমি আমার মাতৃভাষার মতোই বলতে পারি।
ফ্রান্সিস অবাক হয়ে হ্যারির দিকে তাকাল। হ্যারিও অবাক। বলল এত দেশ ঘুরেছেন কেন?
–জ্ঞানসংগ্রহের জন্যে। একটা সত্য জেনেছি প্রত্যেক জাতিই তার মাতৃভাষাকে নিজের মায়ের মতো ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।
ফ্রান্সিস বলল–আপনার এই অবস্থা দেখে বুঝতেই পারছি বেশ অত্যাচার হয়েছে আপনার ওপর। দেশ-দেশান্তরে গেছেন, ঘুরেছেন। শরীরটা আপনার তাই ভেঙেও পড়েছে। আপনার কাছে সবকিছু জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমাদের। কিন্তু এখন নয়। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে নিন। রাতের খাওয়ার পরে আপনার সঙ্গে আমরা কথা বলব। ততক্ষণে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করুন। ওদিকে বাকি সাত শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাসদের জন্য একই ব্যবস্থা হল।
রাতের খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিসরা নিজেদের ঘরে এসে বসল। আলফানসোকে অনেক তরতাজা মনে হল।
–আপনি এখন ভালো আছেন তো? ফ্রান্সিস একপাশে বসে আলফানসোকে জিজ্ঞেস করল। আলফানসো হেসে মাথা কাত করল। তারপর বলল-শুনলাম তোমরা ভাইকিং। তোমার নাম ফ্রান্সিস। অনেক গুপ্তধন নাকি বুদ্ধি খাটিয়ে খুঁজে বের করেছ।
-ওসব থাক। আপনার কথা বলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–সে তো এক ইতিহাস। গপপো লেখা যায়। তবে সব সত্যি, গপপো না। থেমে বলল-শোনো তোমাদের বিরকা নগরেও আমি কিছুদিন ছিলাম। একটা সত্যিই আমি বুঝেছি তোমরা দুঃসাহসী বীরের জাত। অন্যায় তোমরা সহ্য কর না।
–আবার জলদস্যু হিসেবে আমাদের দুর্নামও আছে। হ্যারি হেসে বলল।
–হ্যাঁ তাও শুনেছি। দেখো, সবাই যদি নীতিবাদী সত্যবাদী হত, সব মানুষকে ভালোবাসতে পারত তাহলে তো স্বৰ্গই হত এই পৃথিবী। যাক গে–সে সব কথা। অতি সংক্ষেপে প্রথম থেকেই বলি। একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে যে। ফোকলা মুখে হেসে আলফানসো বলল।
–নিশ্চয়ই শুনব। আপনি জ্ঞানীগুণী মানুষ এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই এমন একজন মানুষের এইরকম দুরবস্থা হল কেন সেটাই বুঝতে চাইছি। ফ্রান্সিস বলল।
ছোটবেলা কেটেছে দক্ষিণ বন্দর এলাকায়। অভাবী ঘরের সন্তান। দুবেলা খেতেই পেতাম না। পড়াশুনা করার কথা তো স্বপ্নেও ভাবতাম না। দিনরাতের অনেকটা সময় সমুদ্রতীরেই কাটাতাম। আর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম সীমাহীন সমুদ্রের দিকে। কত কথা ভাবতাম। সমুদ্রের সঙ্গে সেই আমার বন্ধুত্বের শুরু। সবে যুবক তখন। এক মালবাহী জাহাজে এক আবছা অন্ধকার সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়লাম। নামেই নাবিক। ডেক মোছা থেকে শুরু করে রান্নার সাহায্য করা সবই করতে হত। স্পেনের এক বন্দরে একরাতে নেমে পড়লাম। কাজ করে যে অর্থ রোজগার করেছিলাম তাই নিয়ে এক সস্তা সরাইখানায় আশ্রয় নিলাম। থেমে একটু দম নিল আলফানসো।
ঠিক আছে। এখন ঘুমোন। পরে না হয়–হ্যারি বলল।
আলফানসো মৃদু হেসে ওর পাকা চুলভর্তি মাথা নাড়ল। বলল–দেখো, স্মৃতি– তা যত সুখেরই হোক বা যত দুঃখের, যত বেদনারই হোক–অনেকটা কবিতা বা গানের মতো মনে করতে বসলে ডুবে যেতে হয়। বলতে ভালো লাগে। নিজেকে যেন নতুন করে বার বার চেনা যায়। যা হোক-একটা দুঃখ কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই আমার ছিল। অভাব দারিদ্র্য নয়–অশিক্ষার নিরক্ষরতার দুঃখ। এই দুঃখ দূর করব শিক্ষিত হব এই সংকল্পটা আমার বরাবরই ছিল। তাই যেখানে গেছি, সেই দেশের ভাষা তো বটেই, সাহিত্য, ইতিহাস জানার সুযোগ নিয়েছি। সেই দেশে পৌঁছেই। খোঁজ করেছি শিক্ষার জায়গার। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা নেব সে সাধ্য তোতা ছিল না।
শিক্ষাদানের স্থানে কাকুতি-মিনতি করে শিক্ষার্থীদের সবার পেছনে জায়গা জুটিয়েছি। আশ্চর্য কি জান তারা কিন্তু কেউ আমাকে বিমুখ করেননি। উপোসী থেকেও সেসব জায়গায় গেছি। পাঠ শুনেছি। কোনও কোনও রাত কোনও কোনও দিন আমার অনাহারে কেটেছে। একটা সত্য আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি–যদি সতোর সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণের জ্ঞান সংগ্রহের চেষ্টা কর–কোনও বাধাই বাধা নয়। কথাটা বলে আলফানসো পোশাকের হাতা দিয়ে চোখ মুছল। ফ্রান্সিসরা কেউ কোনও কথা বলল না।
–যাক ওসব কথা। সবশেষে উত্তরের অত ঠান্ডা সহ্য করতে পারলাম না। চেয়ে চিন্তে ছেঁড়া পোশাক পরে থাকা–বেশ অসুস্থ হয়ে ফিরে এলাম ফরাসিদের দেশে। জান তো ফরাসিরা ভীষণ কবিতা ভালোবাসে। কত জায়গায় কবিতার আসর বসে। সময় পেলে শরীর সুস্থ থাকলে সেইসব আসরে যেতাম। মানুষ, পোশাক নিয়ে ওখানে কারো কোনও কৌতূহল নেই। কিছুদিনের মধ্যে ফরাসি ভাষা আয়ত্ত করে ফেললাম। এবার আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম। সমুদ্র আজও আমার কাছে বিস্ময়। প্রকৃতির বিচিত্র রূপও দেশে দেশে দেখেছি। কবিতা লিখতে লাগলাম। কিছু কিছু আসরে কবিতা পাঠও করতে লাগলাম। আমার মাতৃ ভাষা ফরাসি নয়। কাজেই অনেক কবির সঙ্গে এইজন্যেই আমার বন্ধুত্ব হল। এবার অভিজাত শ্রেণীর আসরেও আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হল। অর্থ ও খাদ্য যথেষ্ট পেলাম। আমি যেন নতুন জীবন পেলাম। এমনি এক আসরে পরিচয় হল এক বিখ্যাত কবির সঙ্গে। তিনি অযাচিতভাবে আমার কবিতার খুব প্রশংসা করলেন। কয়েকদিন মেলামেশার পর বললেন–আপনি বিদেশি। কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভালোবেশে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লিখেছেন। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তাই আপনি নতুন একটা ধারা আনতে পেরেছেন। এটা কম কথা নয়। তবু আমি অনুরোধ করছি–দেশে ফিরে যান। নিজের মাতৃভাষায় কাব্যসাহিত্য রচনা করে স্বদেশের ভাষাকে সমৃদ্ধ করুন। একেই বলে মাতৃঋণ শোধ করা। আন্তরিক চেষ্টা করুন। আলফানসো থামল। কয়েবার জোরে শ্বাস নিল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
–ফ্রান্সিস ওঁকে বিশ্রাম করতে দাও। ঘুমিয়ে পড়ুক। মারিয়া একটু ভয়-মেশানো সুরে বলল।
আলফানসো মৃদু হেসে হাত তুলে অভয় দিল। তারপর বলতে লাগল–সেই রাতে সরাইখানার শুয়ে খুব গভীরভাবে ভাবতে লাগলাম সেই কবির কথাগুলো। তারপর প্রায় শেষ রাতে স্থির করলাম–আর বিদেশে-বিভুঁইয়ে নয়। দেশে এই সিনহো বন্দর নগরে ফিরে এলাম। দেখলাম–স্বদেশের চেহারা পাল্টে গেছে। দুর্ধর্ষ মুরজাতি স্বদেশের অনেক অংশ দখল করে নিয়েছে। এখানেও যিনি শাসক তিনিও মুর। ইবু সালোমান। দুর্ধর্ষ সাহসী যোদ্ধা ওরা। তবে মুররা ছিল পরধর্ম-অসহিঞ্চু। দোষ কী দেব বলো? জীবনকে যে যেমনভাবে দেখে। কিন্তু আশ্চর্য কি জান এই ইবু সালোমান একেবারে অন্য ধাতুতে তৈরি। নিজের ধর্মের প্রতি যেমন পরধর্মের প্রতিও তেমনি শ্রদ্ধা। শুধু তাই নয়–নিজে যথার্থ কবি। মুওয়া মু মুহাম মানে আরবী ভাষায় মুখে মুখে কবিতা বানিয়ে বলা মানে
–হ্যাঁ। জানি–জিগেল। সুর করে বলা হয়। হ্যারি বলল।
–তোমরা জান? আলফানসো একটু আশ্চর্য হল।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই প্রকৃতির এক মুর শাসকের পরিচয় আমরাও পেয়েছি। ফ্রান্সিস বলল।
–সত্য অদ্ভুত মানুষ এই ইবু সালোমান। তার কথা বলে শেষ করতে পারব না। যাক-কী করে তার সংস্পর্শে এলাম, কী করে তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু হয়ে গেলাম সে অনেক কথা। বিরাট তাঁর বাড়ির একটি ঘর নির্দিষ্টই ছিল। জিগেলের আসর বসত সেখানে। সেই ঘরের পাশেই একটি শয়নকক্ষের পালঙ্কে তিনি মাঝে মাঝেই আমাকে ডাকতেন। কত রাত আমরা কাব্যর্চচা করেছি। আরবী ভাষা জানাই ছিল। ভাষা শিক্ষার সূত্র আমার আয়ত্তে ছিল। অল্প দিনের মধ্যেই আমি আমার পুরোনো কবিতাগুলি আরবী ভাষায় অনুবাদ করে তাকে শোনাতে লাগলাম। তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। আমি তো খোদ কবিতার দেশেই সুনাম অর্জন করেছিলাম। কাজেই আমার কবিতার গভীরতা তিনি সহজেই বুঝতেন। আলফানসো থামল। তারপর বলতে লাগল তিনি কিন্তু আরবীয় ধনী বণিকদের সঙ্গে ব্যবসা সূত্রেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। আর প্রচুর কুফি বা আরবীয় স্বর্ণমুদ্রা জমিয়েছিলাম। সব রাখতেন একটা সোনার গিকিরা লম্বাটে সিন্দুকে। আমি সেটা দেখেছিলাম। তাঁর কড়া হুকুম ছিল কেউ যেন সেটা স্পর্শ না করে। কিন্তু সেই সিন্দুক ভর্তি স্বর্ণমুদ্রাই তার কাল হল। জ্যেষ্ঠ পুত্র ইবু গ্যাব্রিওল ছিল পিতার ঠিক উল্টো প্রকৃতির। দুর্বিনীত, হিংস্র প্রকৃতির, চূড়ান্ত স্বার্থপর। কিছু অসৎ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে হয়ে উঠেছিল অত্যাচারী নিষ্ঠুর। মাঝে মাঝেই ও অসৎ সঙ্গীদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে মজা করতে যেত। কোনও কারণে রেগে গেলে প্রজাদের বাড়িঘর, ক্ষেত-খামারে আগুন লাগিয়ে দিত। এই জায়গায় ইবু সলোমন ছিলেন ভীষণ দুর্বল। পুত্রস্নেহে অন্ধ। কারণ, ঐ একটি মাত্র সন্তানই তার বেঁচেছিল। অসৎ বন্ধুদের পরামর্শে সে ক্রমে ক্রমে যোদ্ধাদের প্রচুর অর্থের বিনিময়ে নিজের কজায় নিয়ে এল। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। কারণ, যোদ্ধারা জানত ইবু সালোমনকে প্রজারা দেবতার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। তাদের বাগ মানানো খুব কঠিন। বন্ধুরা পরামর্শ দিল–পিতাকে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিতে না পারলে শাসকের আসন পাওয়া যাবে না। ইবু সালোমন সবই জেনেছিলেন। এক রাতে মাত্র কয়েকজন বিশ্বস্ত বলশালী প্রহরীকে নিয়ে যে কোথায় চলে গেলেন কেউ জানতেই পারল না। জানল কয়েকদিন পরে ফিরে না আসার জন্যে। তিনি ফিরেছিলেন একা। বিশ্বস্ত প্রহরীর কথা জিগ্যেস করাতে তিনি বলেছিলেন–তারা প্রচুর অর্থ নিয়ে স্পেনে চলে গেছে। তার হঠাৎ অন্তর্ধানের পরেই জানা গেল পালঙ্কের নীচে রাখা স্বর্ণমুদ্রা বোঝাই সেই সিন্দুটাও উধাও। কিন্তু সিন্দুকটা নিয়ে কেউ কিছু জিগ্যেস করতে সাহস করল না। এমনকি প্রধান পরামর্শদাতাও না। আলফানসো থামল। ফ্রান্সিস বেশ আয়েসি ভঙ্গি তে বসে শুনছিল। এবার দ্রুত উঠে বসল। হ্যারি তাই দেখে সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বলে উঠল–ঠিক আছে। এখন থাক। আপনি বিশ্রাম করুন। পরে শুনব সব। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল হ্যারি একমাত্র তুমিই আমার চিন্তাভাবনা, মনোভাব সঠিক বুঝতে পার। মারিয়াও বুঝতে ভুল করে। যাক গে–আলফানসো, আপনি আরামে ঘুমিয়ে পড়ন। পরে আমার কিছু জানার আছে।
আলফানসো এতক্ষণ একটানা কথা বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আর কোনও কথা না বলে পাশ ফিরে ঘুমের উদ্যোগে করল।
পরের সারাদিন এ বিষয়ে আর কথা হল না। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আবার সবাই বসল।
এবার আপনার কথা সংক্ষেপে বলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–ইবু সালোমন কবি ছিলেন সত্যি। সেই সঙ্গে অত্যন্ত বুদ্ধিমানও ছিলেন। কে কেমন মানুষ, কী তার উদ্দেশ্য, বিশ্বাসযোগ্য কিনা সহজেই বুঝি নিতেন। একমাত্র পুত্র যে অত স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সহ্য করবে না সেটা তিনি খুবই সহজেই বুঝে ফেলেছিলেন। কিন্তু ঐ যে বললাম অন্ধ পুত্রস্নেহ। তিনি কাউকে কিছু বললেন না। ছেলেকে তো নয়ই। নিঃশব্দে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। সেই সময়ে যে জিগেলগুলো রচনা করেছিলেন তা মৃত্যুর জন্যে প্রতীক্ষারত নির্ভীক এক মানুষের মর্মকথা। অপূর্ব জিগেল সে সব। কথাগুলো বলার সময় আলফানুসোর গলা কান্নার বুজে এল। বলতে লাগলেন-সেই রাতটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেই শয়নকক্ষে অনেক রাত অব্দি পরস্পরকে জিগেল শোনাচ্ছিলাম। রাত গভীর হল। দুজনেই বিশ্রাম নিলাম। ওঁর একটাই পছন্দের জিনিস ছিল–ক্লান্তিবোধ হলে একটা সুদৃশ্য কাঁচের বড় লম্বাটে নলওয়ালা পাত্রে আঙুরের রস রাখতেন। সেখান থেকে নিজেই পাশে রাখা একটা গ্লাসে ঢেলে খেতেন। আমাকেও দিতেন। সেই ঘরে অন্য কারো প্রবেশের অধিকার ছিল না। একে যদি বিলাসিতা বল তো বলতে পার। কিন্তু আলবোলার নল মুখে তামাক খেতে তাকে কোনোদিন দেখিনি। যাক গে– হঠাৎ তিনি গ্লাসে অর্ধেকটা নিয়ে তাড়াতাড়ি রেখে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন–কোন রকম শব্দ শুনলেন? শব্দটা আমিও শুনেছিলাম। গভীর রাতের স্তব্ধতায় এরকম শব্দ শোনা যায়। উনি বলে উঠলেন–একটা জিগেল বলছি। লিখে ফেলুন তো। সুন্দর চামড়া মেশানো কাগজ ওখানে বরাবরই থাকত। বাজপাখির পাখা থেকে তৈরি কলমও। আমিও গ্লাস রেখে লিখতে লাগলাম। এক পংক্তি লিখেই বুঝলাম এটা তার পূর্বেই ভেবে নেওয়া কবিতা। আমি দ্রুত লিখতে লাগলাম। তাড়াতাড়িই শেষ হল কবিতাটা। উনি ম্লান হেসে বললেন, এটাই আমার শেষ কবিতা। জিগেল না কিন্তু। আমার সব লেখা কবিতা আপনি রেখে দিয়েছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ। যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আমি বললাম। আপনি রাজি হলেই সব বাঁধিয়ে রাখব।
তাই রাখুন। অনেক সুখ দুঃখ বেদনার স্মৃতি তো জড়িয়ে আছে ঐ কবিতাগুলোর সঙ্গে। তবে এই শেষ কবিতাটা শুধু আলাদা করে আপনার কাছে রেখে দিন। একমাত্র আপনার মতো একজন যথার্থ উচ্চমানের কবিই এই কবিতাটার অর্থ বুঝবেন। অন্যের কাছে এটা দুর্বোধ্য মনে হবে। অবশ্য সেই অর্থের বাইরেও একটা অন্য অর্থও আছে। এখন নয়–পরে–অর্থাৎ আমাব অবর্তমানে–মানে
আমি বাধা দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে যাব তখনই বাইরের দিককার দরজায় মৃদু টকটক শব্দ শোনা গেল। ইবু সালেমান আস্তে বললেন–দয়া করে দরজাটা খুলে দিন। গভীর রাতের নৈঃশব্দ্যের মধ্যে শব্দটা বেশ জোরেই শোনা গেল। আমি তো হতবাক। একে তার এই কক্ষে কারো প্রবেশের হুকুম নেই। তার ওপর এত রাতে কে এল? তার অন্দরমহল থেকে কি কেউ এল? কিন্তু বাইরের দরজা দিয়ে তারা আসবেন কেন? এলে ভেতরের দরজা দিয়েই তো আসবেন। আবার টোকা দেওয়ার শব্দ। এবার একটু জোরে।
–যান। খুলে দিন দরজা। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন যেন আপন মনে –নিঃশব্দ মৃত্যু। এর অপেক্ষাতই ছিলাম। আমি চমকে উঠলাম। একথার অর্থ কী? আবার টোকা দেওয়ার শব্দ। উনি নিঃশব্দে আঙুল তুলে দরজাটা দেখালেন। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিলাম। ঘরের মৃদু আলোয় দেখলাম তার জ্যেষ্ঠপুত্র ইবু গ্যাব্রিওল দাঁড়িয়ে। তার পেছনে তার দুজন বিশ্বস্ত দেহরক্ষী। কঠিন মুখ তাদের। গ্যাব্রিওল একটু হেসে বলল–বাড়ি যান। অনেক রাত হয়েছে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। এক ঝলক পেছনে তাকিয়ে দেখি ইবু সালোমন দু’চোখ বন্ধ করে নিথর বসে আছেন। ঠোঁট দুটো অল্প অল্প নড়ছে। বোধ হয় কিছু প্রার্থনা করছেন।
যান। ইবু গ্যাব্রিওল প্রায় চাপা ধমকের সুরে বলল। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম নিঃশব্দ মৃত্যুর অর্থ কি? আমি দ্রুত বাইরে চলে এলাম। বুকে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে। কী করে সরাইখানায় ফিরে এলাম বলতে পারব না। একটু থেমে ভগ্নস্বরে বৃদ্ধ আলফানসো বলল–ওটাই তার শেষ কবিতা। কথাটা বলে আলফানসো দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
উত্তেজনায় তখন ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সংযত করল। বসে পড়ল আবার। আলফানসো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল একটু পরে শান্ত হল। ফ্রান্সিসরা তিনজনেই ততক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। হ্যারি আস্তে আস্তে চলে গেল। ফ্রান্সিস নিঃশব্দে কম্বলটা টেনে নিয়ে মেঝেয় পেতে শুয়ে পড়ল। মারিয়া হাত বাড়িয়ে আলফানসোকে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিল।
পরেরদিনও খাবার খেতে খেতে আলফানসোকে ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল,
এখন আপনার শরীর কেমন?
আলফানসো খুশির হাসি হেসে বলল–বুকে জমে থাকা এত কথা তোমাদের বলতে পেরে আমি যেন হালকা বোধ করছি। তোমাদের ধন্যবাদ।
ফ্রান্সিস তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল–আমরা এরকমই। তবে ইবু সালোমনের শেষ কবিতার প্রসঙ্গটা অন্তত আমার মনে একটা প্রশ্ন তুলেছে। সেই কবিতাটা এখন কোথায়? ..
–সে তো আর এক ইতিহাস। আলফানসো বলল।
–সে সব আমার জানা। শুনুন অতি সংক্ষেপে বলছি–ইবু গ্যাব্রিওল দেশটায় অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। সর্বপ্রথমে সে আপনাকেই বন্দী করেছিল। ইবু গ্যাব্রিওল অত্যন্ত ধুরন্ধরের মতো পরিকল্পনা করে এগিয়েছিল। অবশ্য তার অসৎ বন্ধুরাও তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিল। ফ্রান্সিস বলল–তাই কিনা?
–ঠিক তাহলেই বুঝতেই পারছ যে অমানুষটা নিজের দেবতুল্য পিতাকে হত্যা করতে পারে, সে আমার ওপর কী রকম অত্যাচার করতে পারে! ওই অমানুষটাকে আমি কতবার বলেছি–ইবু সালোমান তার স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার সম্বন্ধে একটি কথাও আমাকে বলেননি। সেটা ও বিশ্বাসই করতে চাইল না। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ইবু সালোমনের শেষ কবিতাটা লুকিয়ে রাখার জন্যে। কিন্তু অতটুকু কয়েদঘরে কোথায় লুকোব। সব পোশাক কেটেকুটে খোলার সময় কাগজটা মেঝেয় পড়ে গেল। ঘামে জলে লেখাগুলো প্রায় মুছে গেছে তখন। ওটা এক লাফে তুলে নিয়ে ও পড়ল। মুখ বেঁকিয়ে বলল–ও! উদ্ভট পাগলের প্রলাপ। এ পড়ে কী হবে?
কবিতা ওরকমই হয়। আমি মৃদুস্বরে বলেছিলাম।
জাহান্নামে যাক সব। কথাটা বলে ও কবিতা লেখা কাগজটা একটা টানে দু ফালি A করে ফেলল। হাত বাড়িয়ে বললাম ঐ পাগলের প্রলাপটা একেবারে ছিঁড়ে ফেল না। আমাকে দাও। ও কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল। কী যে দুঃখ হল আমার, কী বলবো!
কবিতাটা মনে আছে আপনার? ফ্রান্সিস সাগ্রহে জিগ্যেস করল।
–আমিই তো লিখেছিলাম। কতবার পড়েছি। আলফানসো বলল।
–মারিয়া। কাগজ কলম বের করো। লিখে ফেলো তো। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া ওর চামড়ার সুদৃশ্য ব্যাগ থেকে কাগজ আর পাখার কলম বের করে তৈরি হল। আলফানসো আস্তে আস্তে বলতে লাগলো–
চির উদাসীন লোভাত বয়ে চলেছে।
কোথাও প্রচণ্ড ঘূর্ণির আবর্ত।
হিংসা দ্বেষ স্বর্ণতৃষা।
হানাহানি রক্তপাত অমোঘ মৃত্যু।
জেনো অতল তলে।
গভীর অবঞ্চল প্রশান্তির সম্পদ।
যারা আজীবন কাঁদে
একটু শান্তির জন্যে
তাদের সেই প্রশান্তির সম্পদ।
বিলিয়ে দাও।
সার্থক হোক তোমার মনুষ্যজীবন।
লেখা শেষ হলে ফ্রান্সিস কাগজটা হ্যারিকে দিল। হ্যারি কয়েকবার পড়ে বলল—
সত্যি অপূর্ব! একজন প্রকৃত মানবপ্রেমীর অন্তরের ডাক।
–সত্যি তাই। এই শেষ কবিতাটার গুরুত্ব অপরিসীম। এই কবিতাটায় একটা রহস্যময় নির্দেশ আছে। আলফানসো বলল।
একটু ভেবে নিয়ে হ্যারি বলল হতে পারে। অসম্ভব নয়।
ফ্রান্সিস আলফানসোর দিকে তাকাল। বলল–লোভাত কী?
–একটা নদী, উত্তরের দিকে।
–কত দূরে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–সিনহো থেকে একদিনের পথ। আলফানসো বলল।
–খুব বড় নদী? ফ্রান্সিস বলল।
শীতকালে নয়। কিন্তু বর্ষাকালে আর সমুদ্রে জোয়ারের সময় দু’পাশের বসতি ভাসিয়ে দিয়ে বন্যা হয়।
দু’পাশের বসতি কি খুব ঘন?
–না না। ছাড়া ছাড়া কয়েকটা গ্রাম মতো। আলফানসো বলল।
–আমাদের জাহাজ ঢুকবে? হ্যারি জিগ্যেস করল।
–উঁহু। অত গভীর নয়। আলফানসো মাথা এপাশ-ওপাশ করল।
–ইবু সালোমান কি মাঝে মাঝেই ঐ নদীর দিকে যেতেন? ফ্রান্সিস বলল।
–জানি না। তবে আমি বার দুয়েক দেখেছিলাম তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষী কে এতামকে সঙ্গে নিতে।
–হুঁ। তিনি ঐ নদী দেখতে যেতেন। তাই না? হ্যারি বলল।
–মনে হয় উনি নগরের হইহট্টোগোল থেকে কিছুদিনের জন্যে প্রকৃতির কোলে যেতে ভালোবাসতেন। একটা ছোট্ট কবিতায় লিখেছিলেন–
নগরবাসী বন্ধু
সে ও হে প্রকৃতির মায়ের কোলে
অনেক সান্ত্বনা পাবে।
–সন্দেহ নেই তিনি সত্যিকারের কবি ছিলেন। আলফানসো, আমাদের জাহাজেও আছে একজন ভালো গায়ক বন্ধু। তাকে পেলে আপনি খুশি হবেন। হ্যারি বলল।
আর কোনও কথা হল না। আলফানসো শুয়ে পড়ল। মারিয়া মেঝেয় কম্বল পাততে পাততে বলল–আমি এখানে শোব আজ।
–কী যে বলো। ঐ কাঠের মেঝেয় তোমার কষ্ট হবে। ফ্রান্সিস আপত্তি করল।
–পারব। মারিয়া শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসও শুয়ে পড়ল। আলফানসো ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।
পরের দিন সকালে ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে জাহাজচালক ফ্লেজারের কাছে এল। বলল–ফ্লেজার আমাদের জাহাজ উত্তর পোর্তুগালের বন্দর নগর সিনহোর কাছে এসেছে। আমরা ঐ বন্দরনগরে যাব না। এবার অন্যভাবে ছক কষেছি। ঐ অঞ্চলের শাসক ভীষণ হিংস্র প্রকৃতির। নিজের পিতাকে সকলের অগোচরে ধুরন্ধর খুনির মতো ছক কষে হত্যা করেছে। ওকে বিশ্বাস নেই। তুমি উত্তরের দিকে দিক ঠিক রেখে চালাও। যেতে যেতে ডানদিকে একটা নদী–লোভাতের মুখ পাবে। ঐ নদীতে আমাদের যেতে হবে। জাহাজ ঢুকবে না। নৌকো নিতে হবে। যতটা দ্রুত পার চলো। আমরা আর বিনা কারণে এক মুহূর্তও দেরি করব না।
–ঠিক আছে। হুইল ঘুরিয়ে ফ্লেজার বলল।
দুজনে সরে এসে রেলিঙ ধরে দাঁড়াল। শাঙ্কোও এসে দাঁড়াল।
কী ঠিক করলে, ফ্রান্সিস? হ্যারি জানতে চাইল।
–আমরা সিনহো নগরে যাব না। ইবু গ্যাব্রিওলের থাবা এড়িয়ে লোভাত নদী এলাকায় যাব। শুধু তুমি, শাঙ্কো আর আমি নৌকা নিয়ে সমুদ্রের মুখ থেকে নদীতে ঢুকব। আগে নদীটা ঘুরে ভালো করে দেখব।
–তবে কি ঐ নদীতেই ইবু সালোমনের আরবী স্বর্ণভাণ্ডার গোপনে রাখা আছে? হ্যারি জিগ্যেস করল।
–অবশ্যই কোনও সন্দেহ নেই।
–কিন্তু কোথায়? লোভাত নদী কত লম্বা তা তো জানি না। হ্যারি সংশয় প্রকাশ করল।
–উজিয়ে গিয়ে দেখতে হবে। খোঁজাখুঁজি করতে হবে। হয়তো কাছাকাছি কোথাও সূত্র পেয়ে যাব। উৎস পর্যন্ত যেতে হবে। ইবু সালোমন খুব বেশি দূর যাননি বলেই আমার বিশ্বাস। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু সঠিক জায়গাটা খুঁজে পেতে তো অনেকদিন লাগবে। শাঙ্কো বলল।
সেটা তো সব খোঁজখবর না নিয়ে এখনই বলতে পারব না। একটা সমস্যা তো আছেই–মাঝে মাঝে আকাশে মেঘ জমছে। কখনও কখনও বৃষ্টিও হচ্ছে। পুরো বর্ষা আসতে খুব একটা দেরি নেই। তার আগেই সবরকম খোঁজাখুঁজি চালাতে হবে। গোপনে রাখা কুফির মানে আরবী স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার উদ্ধার করতে হবে। এক মুহূর্ত দেরি করা চলবে না।
জাহাজের গতি বাড়ানো হয়েছে। মনে হয় দু একদিনের মধ্যেই লোভাত নদীর মুখে পৌঁছতে পারব। তারপর কাজে নামতে হবে। তাও ভাটার সময়। নদীর জল তখন সমুদ্রমুখী বইবে। নদীটা কত বড়, স্রোত কেমন, উজানে নৌকো চালাতে হলে অনেককিছু জানার আছে, বোঝার আছে।
শাঙ্কো বা হ্যারি কেউ কোনও কথা বলল না। ওরা জানে ফ্রান্সিস অনেক ভেবেচিন্তে ছক কষে।
এও তো হতে পারে–শাঙ্কো বলতে গেল।
ফ্রান্সিস ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল–জানি তুমি কী বলবে। হ্যাঁ, তাও হতে পারে। হয়তো গোপন স্বর্ণ ভাণ্ডার সেখানে নেই। কিন্তু আছে কিনা তুমি বা আমি কেউ এক্ষুনি বলতে পারব না। দেখাই যাক না।
আর কোনও কথা হল না। ফ্রান্সিস পুবদিকের একটু মেঘলা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বললশাঙ্কো, নজরদার পেড্রোকে গিয়ে বলল আজ রাতে ওর বিশ্রাম নেই। সারারাত পুবদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। শাঙ্কো বাধ্যর মতো সঙ্গে সঙ্গে পেড্রোর খোঁজে চলল।
–হ্যারি, আমরাও আজ রাতে ঘুমোত পারব না। তৈরি থাকতে হবে। লোভাত নদীর মুখ নজরে পড়বেই। কারণ, এখন সারারাত চাঁদের উজ্জ্বল আলো থাকবে। নদীমুখ চিনতে আমরা অভ্যস্ত। চলো, এখন বিশ্রাম করে নিই।
রাতের খাওয়া সেরে ফ্রান্সিস সেই যে ডেক-এ এসে ঐ রেলিঙ ধরে দাঁড়াল, আর নামল না। হ্যারি মাঝে মাঝে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসই বলল–হ্যারি, তোমার শরীর কিন্তু আমাদের মতো শক্তপোক্ত নয়। তুমি শুয়ে পড়ো গে।
রাত গভীর হতে লাগল। একটানা সমুদ্রের শোঁ শোঁ শব্দের বিরাম নেই। মাস্তুলের ওপরে নজরদার পেড্রো তো নজরদারির ব্যাপারে চির অভ্যস্ত। চারদিকে উজ্জ্বল চাঁদের আলো। আকাশে কালচে মেঘের আনাগোনা চলছে। কখনও চাঁদের মুখ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। মেঘ সরে যেতেই আবার চারদিকে জ্যোত্সর বন্যা। ঢেউ ভেঙ্গে জাহাজ দ্রুত চলেছে।
রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মাস্তুলের ওপর নজরদার পেড্রোর হাঁক শোনা। গেল–ডানদিকে–নদীর মুখ। তখন হ্যারিও ফ্রান্সিসের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আকাশে চাঁদ তখন উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে। মাথার ওপরে আকাশ সাদাটে হয়ে এসেছে। সূর্য উঠতে দেরি নেই। অস্পষ্ট হলেও দুজনে লোভাত নদীর মুখ দেখল। জাহাজ আরো কাছে এল। সূর্য উঠল। ভোরের নরম রোদে দেখা গেল নদীর জল সমুদ্রের জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। বেশ ঘোলাটে জল। নদীটা মোটামুটি দেখে নিয়ে বুঝল জাহাজ ঢোকার মতো বড় নদী নয়। অভিজ্ঞ চোখে বুঝল খুব গভীর নয় লোভাত নদীর জল। এখন ভাটার টান চলেছে।
খাঁড়ি নয়। জলের গভীরতাও তেমন নয়। কী বলো? হ্যারি বলল।
–হুঁ। এখানেই তীরে কোথাও জাহাজ নোঙর বাঁধতে হবে। নদী ধরে এগোতে গেলে নৌকা ছাড়া গতি নেই। তাও ভাটা চলছে। নৌকো স্রোতের বিপরীতে চালাতে হবে। ফ্রান্সিস ভাবতে ভাবতে বলল।
ততক্ষণে শাঙ্কোরা কয়েকজনও এসে দাঁড়িয়েছে। শাঙ্কো বলল–কিন্তু কতদূর যেতে হবে তাও তো বুঝতে পারছি না।
-বাঃ শাঙ্কো! এটা একটা কথা হল? আমরা তো নদীতে এখনও ঢুকতেই পারিনি। তার আগেই বুঝে যাব কোথায় কতদূর যেতে হবে! ফ্রান্সিস বলল।
না না, তা কেন? একটু থতমত খেয়ে শাঙ্কো বলল।
–তাহলে ঐ ভাবনা ছাড়ো। যাও–তিনটে নৌকার ব্যবস্থা করো। দাঁড় বেশি সংখ্যায় নাও। কয়েকজন সকালের খাবার খেয়েই লোভাত নদীতে ঢুকব। ফ্রান্সিস বলল!
শাঙ্কোরা কয়েকজন তিনটে নৌকোয় নেমে এল। নৌকোর সব কিছু খুঁটিয়ে দেখল। পরীক্ষা করল কোথাও ফুটো রয়েছে কিনাকাঠ ফেটেছে কিনা। একটায় দেখা গেল মাঝামাঝি একটু জল জমেছে। জলটা ছেচে ফেলে কাঠের টুকরো জুড়ে জায়গাটা শক্ত করা হল।
— ফ্রান্সিসের কেবিন ঘরে রাঁধুনি বন্ধু খাবার দিয়ে গেল। খেতে খেতে ফ্রান্সিস বলল–আলফানসো, ইবু সালোমনের শেষ কবিতাটা তো আপনার মুখস্থ। আচ্ছা, কবিতাটার ঠিক অর্থটা কি?
–তেমন কঠিন অর্থ কিছু না। সমুদ্রে বা নদীর জলে যে প্রবল ঘূর্ণি এখানে সেখানে দেখা যায়, মানুষের জীবনেও তেমনি সেই ঘুর্ণি আছে। হিংসা হানাহানি রক্তের ঘূর্ণি।
স্বাথপর নির্মম হৃদয়ের মানুষদের জীবন ঐ ঘূর্ণির মতো। কিন্তু সেই সব ঘূর্ণির নিচে যে জলভাগ সেখানকার জল কিন্তু শান্ত অচঞ্চল। স্থিতধী মহান মানুষেরাও তেমনি। সুন্দর অর্থ তারা ঘূর্ণিপাকের নীচে অচঞ্চল থাকেন।
–দেখুন, আমি কাঠখোট্টো মানুষ। কবিতা-টবিতা তেমন বুঝি না। কথাটা বলে ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল–হ্যারি, তুমি কিছু বলল।
হ্যারি একটু চুপ করে থেকে বলল–আমারও তাই মনে হয়েছে। কিন্তু তবু আমার মনে খটকা যাচ্ছে না মনে হয় কবিতাটা আলফানসোকে লক্ষ্য করেই যেন লেখা। নইলে বিলিয়ে দাও কথাটা আসত না। আবার দেখো প্রশান্তি সম্পদ। প্রশান্তি নিশ্চয়ই মানুষের মনের সম্পদ। এটাই সঠিক বুঝতে পারছি না।
একপাশে বসে মারিয়া ওদের কথা শুনছিল। বলল-মনের সম্পদ কি বিলিয়ে দেওয়া যায়? সোনা হীরে মুক্তা এসব বিলোনো যায়। তারপর খাদ্যটাদ্যও। কিন্তু মনের সম্পদ? সেটা কি বিলোতে পারে?
আলফানসো, আপনি কী বলেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
আলফানসো কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। দুজনের ব্যাখ্যা ভাবল। তারপর চোখ পিটপিট করে তাকাল। বলল–ফ্রান্সিস, তোমার বন্ধু সত্যিই জ্ঞানী। শব্দের গভীর অর্থ বোঝে। রাজকুমারীও কম যান না। উনি কবিতা লেখেন কিনা জানি না। তবে কবিতার অর্থ উদ্ধারে নিঃসন্দেহে দক্ষ। একটু থেমে বলল–এভাবেও অর্থটা করা যায়। সত্যি কথাটা হল–কবিতার দু’এক পংক্তি মনে হতেই আমি আর শেষটুকু মনে করার কথা ভাবতামই না। চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেত। তাই খুব গভীরে বোঝবার চেষ্টাও করিনি কোনোদিন। তোমরা দুজন যেভাবে পংক্তিগুলির অর্থ উদ্ধার করেছ, একজন সামান্য কবি হিসেবে আমি তোমাদের ভূয়সী প্রশংসা করছি। হ্যাঁ, এইবার আমি সত্যিই বুঝতে পারছি উনি শেষ কবিতাটার মধ্যে দিয়ে আমাকেই কিছু একটা নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। সাগ্রহে বলে উঠল–হ্যারি, তোমরা তৈরি হও। আমার চিন্তায় যেটুকু ধোঁয়াশা ছিল তা কেটে গেছে। দেরি করা চলবে না। সকালের খাবার খেয়ে ইবু গ্যাব্রিওল কিছু আঁচ করার আগেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব।
ফ্রান্সিস অবশ্য দুটো নৌকা নিল। নৌকো দুটো তৈরিই ছিল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে একটা নৌকোয় হ্যারি বিনোলা আর সিনাত্রাকে নিয়ে দড়ির সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। অন্যটায় ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো বসল। দুটো নৌকোই ছেড়ে দেওয়া হল। খুব উঁচু ঢেউ উঠছে না। নদীমুখে আসতেই দেখা গেল মুখটায় নদীর ঘোলা জল এসে মিশে যাচ্ছে। স্রোত খুব তীব্র নয়। সামনে রইল ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোর নৌকো। দুজনেই দাঁড় বাইতে লাগল। গতি বাড়াতে হবে। পেছনেরটায় হ্যারি বিনোলা আর সিনাত্রা। নদীর ঢেউয়ে দোল খেতে খেতে বেশ দ্রুতই চলল নৌকো দুটো। ফ্রান্সিস দু’ধারে তাকিয়ে দেখল–বাঁদিকে টানা উঁচু-নিচু পাহাড়। ডানদিকে কিন্তু বনভূমি। বড় বড় গাছগাছালি ঝোঁপঝাড়। নৌকো দুটো চলল। কিন্তু দু’পাড়ে কোনও জনবসতি নেই। তবে বাঁদিকে পাহাড়ি এলাকা কমে গিয়ে গাছগাছালি দেখা গেল।
মাথার ওপর সূর্যের তেজ তেমন নেই। মাঝে মাঝে হালকা মেঘে সূর্য ঢাকাও পড়ছিল। তাই দুপুর হয়ে এলেও দাঁড় টানতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না। একটা ছোটো বাঁক আসতেই দেখা গেল জনবসতি শুরু হয়েছে ডানদিকে। কাঠ-পাথরের বাড়ি। গাছের ডাল ফালা করে জানালা-দরজা তৈরি করা হয়েছে। নদীর পাড়ে বেশ কিছু দেশীয় মাছধরা নৌকো। তীরে খুঁটিতে জাল শুকোচ্ছে। বোঝা গেল জেলেপাড়া। এদের মাছ ধরাই প্রধান পেশা। তবে খাটো ছোট ফসলি জমিও দেখা যায়। শাঙ্কোই প্রথম একটু অধীর হয়ে হ্যারির দিকে তাকাল। বলল হ্যারি, আমরা কোথায় যাচ্ছি, কখন থামব কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
অধৈর্য হয়ো না। বলবার সময় এলে ফ্রান্সিস নিজেই সব বলবে। হ্যারি শান্তস্বরে বলল।
–আমরা কি কোনও গুপ্তধন উদ্ধার করতে যাচ্ছি? বিনোলা বলল।
–অবশ্যই। নইলে কি হাওয়া খেতে এসেছি? সমুদ্রে কি হাওয়া কিছু কম? হ্যারি বলল।
তখনই ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–এভাবে হবে না। হ্যারি, নৌকো ভেড়াতে বলো।
দুটো নৌকো তীরে ভেড়ানো হল। দেখা গেল তীরে বেশ কয়েকটা দেশীয় জেলে নৌকো বাঁধা। তীরের এখানে ওখানে ছড়িয়ে কয়েকটা পাথরখণ্ড। তার উপর বসে কয়েকজন জেলে জাল বুনছে। পরনে গ্রামের জেলেদের সাধারণ পোশাক। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন পোশাক। সবচেয়ে সামনে একটা পাথরের কাছে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে ছিল। কোমরে হাত দিয়ে জেলেরা কেউ কেউ ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ফ্রান্সিসদের নৌকোও দেখছিল। অন্যরকম নৌকো। বোঝাই যাচ্ছে এরা বিদেশি।
নৌকো থেকে ফ্রান্সিস সেই বৃদ্ধের কাছে এল। সঙ্গে হ্যারিও এল। ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল–এই গ্রামটার নাম কি?
ইরেকাস। বৃদ্ধ ফোকলা মুখে হেসে বলল–আপনারা কারা?
আমরা বিদেশি। আমাদের জাহাজ এই লোভাত নদীর মুখেই নোঙর করা আছে। এই নদীতে জাহাজ তো ঢোকে না। তাই নৌকোতে চড়ে এসেছি। সমুদ্রে ঘূর্ণিটুর্নি দেখেছি। শুনলাম এই লোভাত নদীতেও নাকি একটা বেশ বড় ঘূর্ণি আছে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ।
–সেটা কোথায়?
আঙুল বেশ দূরের একটা ছোট পাহাড় দেখিয়ে বৃদ্ধ বলল–ঐ খানে। বেশ দূরে। ওখানে নদীটা বাঁক খেয়েছে। ওখানেই আছে ঘূর্ণিটা বর্ষাকালে তো সে ভয়ংকর চেহারা নেয়। এখনও কম নয়। কত নৌকো যে ঐ ঘূর্ণির কাছাকাছি যেতেই, ডুবে গেছে তার হিসেব নেই। আমরা ভুলেও ওদিকে মাছ ধরতে যাই না।
তাহলে তো এখন ওটার কাছে যাওয়াই যাবে না। হ্যারি বলল।
–বলেন কী! ঘূর্ণির প্রচণ্ড টানে নৌকাসুদ্ধ তলিয়ে যাবেন। একজন জেলে বলে উঠল।
–তাহলে কী করবে? হ্যারি ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল।
–নৌকো দুটো এখানেই থাক। আমরা নদীতীর দিয়ে হেঁটে ঐ ঘূর্ণির কাছে যাব। চলো এসো সবাই।
সবাই নৌকো থেকে নেমে এল।
শাঙ্কোরা যখন নৌকো দুটোকে খুঁটির সঙ্গে বাঁধছে তখন সিনাত্রা বলল–ফ্রান্সিস, সেই সকালে খেয়েছি। তারপর এই দুপুরে হতে চলল। ফ্রান্সিস হেসে ডান হাতের চেটো দেখিয়ে বলল–র্গিজার পাদরিদেরও খেতে হয়। ব্যবস্থা হচ্ছে। ফ্রান্সিস জেলেদের কাছে গেল। একজন বয়স্ক জেলেকে বলল–আপনি তো আমার পিতৃতুল্য। আপনি গররাজি হলেও আমি মোটেই দুঃখিত হব না। বয়স্ক জেলে হাঁ করে ফ্রান্সিসদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। হেসে ফ্রান্সিস বলল–লোভাত নদীর সেই মুখ থেকে নৌকো চালিয়ে আসছি। কিছু পেটে পড়েনি। যদি আমাদের জন্যে সামান্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেন তাহলে আমরা নতুন উদ্যমে কাজে নামতে পারি।
–সেকি কথা? আপনারা তো আমাদের অতিথি! দেখছি কী করা যায়।
বৃদ্ধ জাল বুনছিল। জাল বোনা বন্ধ রেখে চলে গেল ঘরগুলোর দিকে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল–আপনাদের খেতে দেবার মতো খাবার হয়ে গেছে।
একটা মোটামুটি বড় বাড়ির উঠোনে একধরনের লম্বাটে শুকনো পাতায় ওদের খাবার দেওয়া হল। ফ্রান্সিসরা বসে পড়ে খেতে লাগল। মাছের ঝোল মতো আর রুটি দুটো করে। খাওয়া শেষ করে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল
এখন বিশ্রাম-টিশ্রাম চলবে না। আমার সঙ্গে চলো।
নদীতীরের বালিমাটি অনেক দূর টানা চলে গেছে। সেই ভেজা ভেজা বালিমাটির এলাকা ধরে ফ্রান্সিস হাঁটতে শুরু করল দূরে নদীর বাঁকের দিকে। আগে-পাছে হেঁটে চলল সবাই। কিছুদূর যেতেই বালিমাটি এলাকা শেষ। পাথুরে মাটি শুরু হল। মাঝে মাঝে ছোটো বড়ো পাথুরে চাই। সেখানে উঠে চলা শুরু হল। চলার গতি অনেক কমে গেল। এবড়ো খেবড়ো পাথুরে মাটি ছোটো ছোটো চাইয়ে উঠে পাশ কাটিয়ে গাছগাছালির গুঁড়ি এড়িয়ে বাঁকের কাছ আসাতে দেখা গেল নদীটা এখানে অনেকটা বাঁক নিয়েছে। দুপাশের পাথুরে মাটির ঢাল নেমে এসেছে। দুপাশের দূরত্ব এখানে অনেক কম। দুপাশের ঢালে ধাক্কা খেয়ে তীব্র স্রোতের জলে একটা বড় আকারের ঘূর্ণি তৈরি হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস, তুমি কি এই ঘূর্ণির কথাই ভাবছিলে?
-হ্যাঁ। লক্ষ করেছো নদীর দুই তীরের দূরত্ব এখানে অনেক কম। এপারে উঁচু উঁচু গাছ আর ঝোঁপঝাড় টানা চলে গেছে। ওপারে অবশ্য মাত্র একটা চেস্টনাট গাছ দেখছি।
–তাহলে কি ইবু সালোমন এখানেই এসেছিলেন। হ্যারি বলল।
–অবশ্যই। ভুলে যেও না তিনি সঙ্গে ছসাতজন বলশালী দুঃসাহী দেহরক্ষী এনেছিলেন।
–কিন্তু তারা তো কেউ ফিরে আসেনি?
–এখানেই প্রশ্ন। উত্তর সহজ–সেই দুঃসাহসী দেহরক্ষীদের সাহায্যে তিনি এখানেই কোথাও আরবী স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার লুকিয়ে রেখেছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে অন্য সব রাজা-শাসকরা যা করে তিনিও তাই করেছেন। তাদের ছলেবলে কৌশলে হত্যা করেছেন। হ্যারি বলল।
এতো তোমার অনুমান। হ্যারি বলল।
–দেখি আমার অনুমান সত্যি কিনা। এবার চলো, ঘূর্ণিটার যত কাছে সম্ভব যাব। ফ্রান্সিস বলল।
বড় বড় গাছ-ঝোঁপঝাড় তীরের কাছ পর্যন্ত নেমে গেছে। তারপর নদীর জল বয়ে চলেছে। ঘূর্ণি বরাবর শেষ দুটো গাছের একটা কাণ্ড ধরে ফ্রান্সিস ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘূর্ণির্টার দিকে তাকিয়ে রইল। পাশে দাঁড়ানো শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস, এই ঘূর্ণির যা পাক দেখছি নৌকো তো নৌকো, জাহাজ ও ডুবে যেতে পারে।
–হ্যাঁ, সমুদ্রেও কোথাও কোথাও ডুবো পাহাড়ের ধাক্কায় এরকম প্রচণ্ড ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়। জাহাজও পাক খেতে খেতে ডুবে যায়। এই ঘূর্ণিটা তেমন বড় কিছু না। তবে জেলে নৌকো ডুবে যাবে। তাই জেলেরা এদিকে নৌকোয় চড়ে মাছ ধরতে আসে না।
–আলফানসো বলেছিল ইবু সালোমনের পালঙ্কের নীচে নাকি একটা লম্বাটে সিন্দুকে স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার সযত্নে রাখা ছিল। তাহলে ইবু সালোমান তাঁর দেহরক্ষীদের দিয়ে এই ঘূর্ণির মধ্যেই ফেলে দিয়েছিলেন সেই স্বর্ণভাণ্ডার? হ্যারি ভাবতে ভাবতে বলল।
–মনে হয় সেটাই হয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু তাহলে তো এই সিন্দুক উদ্ধারই করা যাবে না। হ্যারি হতাশ ভঙ্গিতে বলল।
–এইটাই সবচেয়ে জটিল ধাঁধা। তিনি কি সব জেনেও ঐ সিন্দুকটা এখানে ফেলে দিয়ে গেছেন? ফ্রান্সিস বলল।
তাহলে তো ওটা চিরকালের জন্যে মানুষের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। হ্যারি বলল।
–না। সিন্দুকটা এখানেই ফেলা হয়েছিল। কীভাবে ফেলা হয়েছিল এটা জানতে পারলেই বোঝা যাবে তিনি কি সিন্দুকটা চিরদিনের জন্য লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চেয়েছিলেন? তারপর একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল-হ্যারি, সেই ছেলেবেলায় তুমি তো জানো কতদিন সমুদ্রের সামনে বসে থেকেছি আমি। কত জাহাজ কত দূর দূর দেশ থেকে আসত। নাবিকদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি আমি। এক বৃদ্ধ নারিক আমায় বলেছিল–এক সামুদ্রিক ঘূর্ণির কথা। প্রচণ্ড ঘূর্ণিতে পড়ে পাক খেতে খেতে সে অত্যন্ত দ্রুতবেগে তলিয়ে গিয়েছিল। আশ্চার্য! গভীরে জল ছিল অনেক শান্ত। ঘূর্ণির পাক কতদূর পৌঁছোয়নি। এত দ্রুত তলিয়ে গিয়েছিল যে তখনও তর দম ফুরোয়নি। সে শান্ত জলে দুপায়ের তলায় পাথর বালিতে ধাক্কা দিয়ে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় শান্ত এলাকা। দিয়ে ওপরে উঠে এসেছিল। বেঁচে গিয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল।
-হ্যাঁ। কাজেই এই ঘূর্ণির প্রবল মোচড় ওপরেই। একেবারে তলায় জল কিন্তু শান্ত। আসলে অগভীর এই লোভাত নদী। তা নইলে সহজেই দু-তীর বন্যায় ভেসে যেত না। মনে হয় ইবু সলোমন সেই সিন্দুক তুলে আনার জন্যে একটা ব্যবস্থা রেখেছিলেন।
-কেন? হ্যারি বলে উঠল।
–হয় তো তিনি তখনও পুত্রের ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস হারাননি। কত দূরাচারী নিমর্ম নরঘাতকও তো পরে সাধুপুরুষ হয়েছেন। তাই তার শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস ছিল হয়তো পুত্র ইবু গ্যাব্রিওলের মানসিক পরিবর্তন হবে। সে শুধরে যাবে। তখন এই স্বর্ণভাণ্ডার তুলে এনে পুত্রকে দিয়ে যাবেন।
হ্যারি চুপ করে ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল–হ্যাঁ ফ্রান্সিস, তোমার অনুমান ঠিক। মানুষের এরকম পরিবর্তনের অনেক কাহিনি আছে।
-তাই-সেই শয়নকক্ষের বাইরে পুত্রের মৃদু পদশব্দ শুনেই বুঝেছিলেন–নিঃশব্দে মৃত্যু হবে তাঁর পুত্র তাকে হত্যা করতে আসছে। তাই তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় ও সৎ আলফানসোকে গুপ্ত স্বর্ণভাণ্ডারের হদিস তার শেষ কবিতায় জানিয়ে দিয়ে গেছেন। কীভাবে সেই স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করতে হবে, তারপর কীভাবে হতভাগ্য সর্বহারাদের মধ্যে তা বিলিয়ে দিতে হবে তার ইঙ্গিতও দিয়ে গেছেন।
কথাটা শুনে হ্যারি চোখ বুজে ভাবল। তারপর তাকিয়ে বলল-সাবাস ফ্রান্সিস! তুমি কবি না হয়েও শেষ কবিতাটার অর্থ সঠিক উদ্ধার করতে পেরেছ। তাহলে উদ্ধারের একটা উপায় নিশ্চয়ই আছে।
–অবশ্যই আছে। এবার এই ঘূর্ণির দু’পাশের গাছের সারি, ঝোঁপজঙ্গল সব তন্ন তন্ন করে খুঁজতে হবে। দেখা যাক কোনও সূত্র পাওয়া যায় কিনা। কারণ, নৌকোয় চড়ে গিয়ে সিন্দুক ঐ ঘূর্ণিতে ফেলে দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু ঐ ঘূর্ণির মধ্যে সিন্দুক ফেলতে গেলে তো যেতেই হবে। কীভাবে দুঃসাহসী দেহরক্ষীরা ওখানে গিয়েছিল? উড়ে উড়ে তো যায়নি। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে কীভাবে গিয়েছিল? হ্যারি বলল।
–সেই সূত্রটাই পেতে হবে। আজ তো বিকেল হয়ে এসেছে। চলো, ঐ জেলেদের গ্রামে ফিরে যাই। আজকের রাতটা ঐ গ্রামে কাটিয়ে কাল তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে এখানে চলে আসব। মোটেই দেরি করা চলবে না। ইবু গ্যাব্রিওল কিন্তু ভীষণ ধুরন্ধর। তাছাড়া এসব লোকেরা অত্যন্ত সন্দেহবাতিক হয়। যে নিজের পিতাকে নিঃশব্দে হত্যা করতে পারে, সে সব পারে। তার শাসনের বিরুদ্ধে কেউ কোথাও তলে তলে লোক ক্ষ্যাপাচ্ছে কিনা তা জানতেও ইতিমধ্যে সারা রাজ্যে গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছে। গুপ্তচরদের পোশাকে তো আর তাদের আসল পরিচয় লেখা থাকে না। সে ভালো করেই জানে ইবু সালোমন মাঝে মাঝেই এই লোভাত নদী এলাকায় প্রকৃতির কোলে কিছুদিন কাটিয়ে যেতেন। সুতরাং এমনটা হতেই পারে যে স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার লুকিয়ে রাখতে তিনি এই নদী এলাকাটাই বেছে নিয়েছিলেন। কাজেই লোভাত নদীর তীর বরাবর সব জায়গা ওপরই নজর রাখতে ইতিমধ্যেই গুপ্তচর পাঠিয়েছে। ইরেকাস গ্রামে আমরা এসে ডেরা বেঁধেছি এ খবর খুব সহজেই পাবে ওরা। কারণ, আমরা বিদেশি। এখানকার মানুষ নই। আমাদের শনাক্ত করা সহজ।
–তুমি ঠিকই বলেছ, ফ্রান্সিস। হ্যারি মাথা ওঠানামা করে বলল।
ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল–শাঙ্কো, বিনোলা, তাড়াতাড়ি ফিরে চলো। নদীর তীর কিন্তু চলার পক্ষে ভালো রাস্তা নয়। বেশ সময় লাগবে ফিরে যেতে। সন্ধের মধ্যেই ইরেকাস গ্রামে পৌঁছাতে হবে।
সবাই ফিরে চলল। এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথ ভেঙে ঝোঁপজঙ্গল পেরিয়ে ওরা যখন ঐ গ্রামে ফিরে এল তখন সন্ধে নেমেছে। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে সঙ্গে নিয়ে সেই বৃদ্ধের বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল। দেখল বৃদ্ধটি চুপ করে উঠোনের একপাশে একটা গাছের কাটা গুঁড়িতে বসে আছে। ফ্রান্সিস কাছে এসে বলল কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলছি। বৃদ্ধ কিছু বুঝতে না পেরে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
-দেখুন, আমরা এখানে এসেছি ঐ ঘূর্ণিটা দেখতে। তবে সন্ধে হয়ে এল, ভালো করে দেখাই হল না। কালকে একটু সকাল সকাল গিয়ে ভালো করে দেখব। মুশকিল হল সেই সমুদ্রমুখে আমাদের জাহাজ নোঙর করা আছে। জাহাজে ফিরে আবার কাল সকালেই আসা অসম্ভব। কাজই আমাদের আজকের রাতটা এখানে থাকতে হবে। আমাদের এই ক’জনকে খেতে দিতে। আপনাদের তো খরচ হবে। তাই অনুরোধ করছি–ধারে-কাছে গম, চিনি এসবের দোকান টোকান আছে?
–আছে একটু দূরে। সেখান থেকেই এসব কিনি আমরা। বৃদ্ধ বলল।
–তাহলে আমরা আপনাকে দুটো স্বর্ণমুদ্রা দিচ্ছি। আপনারা কিনে আনুন। এই দামটা আপনাকে নিতেই হবে। ফ্রান্সিস অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল।
–আপনি সত্যিই বিবেচক। এতজনকে খাওয়ানো
বৃদ্ধকে থামিয়ে দিয়ে ফ্রান্সিস বলল–সেটা বুঝি বলেই এই মূল্য ধরে দিচ্ছি। আপত্তি করবেন না।
–ঠিক আছে। দিন। বৃদ্ধ বলল।
–শাঙ্কো, দুটো স্বর্ণমুদ্রা দাও।
-শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে তিনটি স্বর্ণমুদ্রা বের করে দিল। বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতে হেসে বলল-দুটো হলেই হবে।
–তিনটেই রাখুন। শাঙ্কো হেসে বলল।
বৃদ্ধ আর আপত্তি করল না। মুদ্রা তিনটি নিয়ে নিচু দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
ক্লান্ত ফ্রান্সিসরা উঠোনের এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে বসল। শাঙ্কো ঘরের দরজার, কাছে গেল। ডাকাডাকি শুরু করল। এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। শাঙ্কো তেষ্টার কথা বলে একটা মাটির বড় পাত্রে খাবার জল নিয়ে এল। বলল–মেপে খাও সবাই। রাতে খাওয়ার পর জলে যেন কম না পড়ে। সবাই মুখের কাছে পাত্রটা ধরে অল্প অল্প জল খেল। বেশি খেতে ভরসা পেল না। এবার ওরা শুয়ে বসে। বিশ্রাম করতে লাগল।
একটু রাতে ঐ উঠোনেই দুপুরের মতোই খেতে দেওয়া হল। বৃদ্ধের ছেলে মাঝখানে একটা জ্বলন্ত মশাল একটা গর্তে ঢুকিয়ে রাখল। সেই লম্বাটে শুকনো পাতা। পাঁচটা করে রুটি দেওয়া হল প্রত্যেকের পাতে। ভাজা, ঝোল মতো মিলিয়ে প্রত্যেককে চারটে করে মাছ দেওয়া হল। সঙ্গে আনাজের ঝোল। সবাই ক্ষুধার্ত। অল্পক্ষণের মধ্যেই পাত ফাঁকা। ফ্রান্সিস মাছভাজা চিবুতে চিবুতে একটু জোরে বলল–আর চেও না। পেট ভরে খেতে গেলে হয়তো এদের খাবারে টান পড়ে যাবে।
খাওয়ার পর উঠোনেই সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে পড়ল। নদীর দিক থেকে বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল। ক্লান্ত ভাইকিংরা প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। ও তাকিয়ে রইল নদীর ওপারের গাছগাছালি আর উঁচু পাহাড়টার দিকে। জ্যোৎস্না-ধোওয়া রাত। চাঁদ পাহাড়ের মাথায়। নিস্তব্ধ রাত। নদীর জলে গাছগাছালি আর পাহাড়ের উপর উজ্জ্বল জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ল। বড় সুন্দর দৃশ্য। সেই সঙ্গে নদীর ঢেউয়ের মৃদু শব্দ। ফ্রান্সিস মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে চেয়ে রইল। এবার সহজেই বুঝল কেন ইবু সালোমন মাঝে মাঝেই এই লোভাত নদী দেখতে আসতেন। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল ফ্রান্সিস।
সকালে বাসি রুটি আর ঝোল খেয়ে আবার যাত্রা শুরু হল। গতকালের মতো একই জায়গায় নৌকোগুলো তীরে পুঁতে রাখা খুঁটিতে দড়ি দিয়ে বেঁধে হাঁটতে লাগল সবাই। আজকে সূর্যের তেজটা কম। মাঝে মাঝে কালচে মেঘে সূর্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল। তবে রাস্তা বলে তো কিছু নেই। তাই একটু মন্থর গতিতে হাঁটতে হচ্ছিল। ঘূর্ণির কাছাকাছি পৌঁছে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–বিশ্রাম নেওয়া চলবে না। ঘূর্ণি বরাবর তীরের দিকে ঝুঁকেপড়া গাছগুলোর কান্ড খুব খুঁটিয়ে দেখতে থাকো। গাছের কাণ্ডের কোথাও কুড়ুলের কোপের দাগ বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক চিহ্ন মানে মানুষের হাতে তৈরি কোনও কিছু নজরে পড়লেই আমাকে ডাকবে। ছড়িয়ে পড়ল সবাই। ঝুঁকে পড়া ডাল সরিয়ে বা উঁচু ঝোঁপগাছের ডালপালা সরিয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু করল।
ঝোঁপঝাড় ভাঙার শব্দ শোনা যেতে লাগল। খোঁজাখুঁজি চলছে। হঠাৎ শাঙ্কোর চড়া গলা শোনা গেল–ফ্রান্সিস, এদিকে এসো তো। ফ্রান্সিস খোঁজা বন্ধ রেখে ঝোঁপঝাড় ঠেলে শাঙ্কোর কাছে ছুটে এল। শাঙ্কো বিরাট উঁচু গাছের নীচে ঝোঁপঝাড় ভাঙছে তখন। ফ্রান্সিসকে গাছটার প্রায় পনেরো হাত ওপরে কাণ্ডটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল–ঐ দেখো।
ফ্রান্সিস মুখ উঁচু করে দেখলে ওখানুটার কাছাকাছি সব ডালগুলো কাটা। তার মানে কেউ ওখান পর্যন্ত উঠেছিল গাছ বেয়ে। ওখানে একটা মোটা কাছির অংশ পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধা। আশ্চর্য! কাছিটা কাটা। হাত দুয়েক কাটা কাছি ঝুলছে। ফ্রান্সিস জোর গলায় ডাকল–হ্যারি, দেখে যাও।
ওদের জোর গলায় ডাকাডাকি শুনে হ্যারি ছুটে এল। খোঁজাখুঁজি রেখে বিনোলাও ছুটে এল। হ্যারি কাছে এলে কাটা কাছিটা দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলল–দেখো, আমার অনুমান সত্যি কিনা।
হ্যারি প্রথমে ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। সে চুপ করে ভাবছে তখন ফ্রান্সিস বলল–বুঝিয়ে দিচ্ছি। লক্ষ করো, এখানে ওপারের পাহাড়ি ঢাল অনেকটা নদীর বুকে নেমে এসেছে। তাতে নদীর দুই তীরের দূরত্ব অনেক কমে গেছে। ওপারের ঢালের পরেই মাত্র একটা বিরাট চেস্টানাট গাছ দাঁড়িয়ে আছে।
হ্যারি ওপারের চেস্টনাট গাছের সঙ্গে এপারের এই উঁচু গাছটার দূরত্ব আন্দাজ করে বললহা, দুটো গাছের দূরত্ব অনেক কম।
-ওপারে না গিয়েও আমি বলে দিচ্ছি–ওপারের চেস্টনাট গাছটার দশ পনেরো হাত ওপরের কাণ্ডে ঠিক এমনি একটা মোটা কাছি বাঁধা আছে। সেটাও এ কেটে ফেলা হয়েছে।
তার অর্থ দাঁড়াল-ইবু সালোমনের নির্দেশে তার দুঃসাহসী যোদ্ধারা দু’পারের দুটো গাছে ঐ উচ্চতায় একটা মোটা কাছি শক্ত করে বেঁধেছিল। এবার কল্পনা করো ঐ কাছিটা ঠিক ঘূর্ণির ওপর দিয়ে গেছে কিনা। হ্যারি ঘূর্ণিটার দিকে তাকাল। হিসেবে করল। হ্যাঁ, সত্যিই তাই। কাছিটা টানা হলে ঠিক ঘূর্ণিটার ওপর দিয়েই যাবে। ও বলে উঠল–সাবাস ফ্রান্সিস। এবার সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। একজন বা দুজন দেহরক্ষী
–দুজন। অত ভারী সিন্দুকটা একজনের পক্ষে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। টানা কাছিটায় একটা মোটা দড়ির ফাঁস পরানো হয়েছিল। সেই ফাঁসে সোনার মুদ্রাভর্তি সিন্দুকের দু’পাশের কড়া দুটোয় দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তারপর ঝুলিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঐ ঘূর্ণিটার ঠিক ওপরে। দড়ির নানারকম গিঠ বাঁধা ফাস দড়িতে ঝুলিয়ে মালপত্র এ জাহাজ থেকে ঐ জাহাজে নিয়ে যাওয়া এসব রীতিতে আমরা অভ্যস্ত। দেহরক্ষীরা সেটাই করেছিল।
–তারপর ওপর থেকে দড়ি কেটে সিন্দুকটা ঐ ঘূর্ণির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এই তো? হ্যারি বলল।
–ঠিক তাই। এ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাটা ভেবে নিয়েছি।
–তাহলে তো যে কথাটা আমি আগে বলেছিলাম সেটাই বলি ইবু সালোমন কি ঐ সম্পত্তি চিরদিনের জন্য মানুষের নাগালের বাইরেই রেখে দিতে চেয়েছিলেন? হ্যারি বলল।
–এই জায়গায়টাতেই আসল রহস্য। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
তোমার কী মনে হয়? হ্যারি জানতে চাইল।
–না। উনি প্রয়োজনের সময় এই গোপনে ফেলে দেওয়া সিন্দুকটা উদ্ধারের উপায় রেখেছিলেন। ফ্রান্সিস বলল। কবিতাটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। শেষের দিকের পংক্তি তাদের সেই প্রশান্তির সম্পদ বিলিয়ে দাও। তাহলে তো সহজেই বোঝা যাচ্ছে সেই সম্পদ উদারতা ভালোবাসা বা ওরকম কিছু না–এমন কিছু যা অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া যায় অর্থাৎ স্বর্ণ সম্পদ–তাই কিনা? ফ্রান্সিস হেসে বলল।
ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রেখে হ্যারি বলে উঠল–আবার বলছি সাবাস ফ্রান্সিস।
–এখনও কিন্তু সেই সিন্দুক উদ্ধার করতে পারিনি। কথাটা বলে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব, একটা সূত্র পেয়েছি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্রটি এখনও খুঁজে পাইনি। আজ আর খোঁজাখুজি নয়। এখন আমরা ঐ ইরেকাস গ্রামে ফিরে যাব। চলো সব।
আবার ইরেকাস গ্রামের দিকে চলা শুরু হল। সেই পাথর-পাথুরে মাটি গাছ ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে। দুপুর পেরিয়ে গেল। ফ্রান্সিস একটু চিন্তিত স্বরে বলল–হ্যারি, দুপুরে খাওয়ার কথা কিছু তো বলে যাইনি। হ্যারি হেসে বলল–তুমি যখন নিজের ভাবনা-চিন্তা নিয়ে চুপ করে থাক তখন অন্য দিকগুলো তো আমাকেই ভাবতে হয়। চিন্তা নেই-শাঙ্কোর কাছ থেকে আরো দুটো স্বর্ণমুদ্রা বৃদ্ধকে দিয়ে বলে রেখেছি–আরো দু’একদিন আমরা এখানে থাকব। আপনি আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা রাখবেন। এই জন্যেই হ্যারি, তোমাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্তও চলে না। এমনকি–মারিয়াও মাঝে মাঝে আমার মন বোঝে না। স্বাভাবিক রাজকুমারী তো সেদিনের।
–তা ঠিক, হ্যারি, ফ্রান্সিসের কথার উত্তর দিল।
রান্না হয়ে গিয়েছিল। পরিশ্রান্ত ক্ষুধার্ত ভাইকিংরা আর দেরি করল না। নিজেরাই উঠোনের একপাশে জত্ব করে রাখা লম্বাটে শুকনো পাতা নিয়ে এসে খেতে বসে .. গেল। খেতে খেতে পাশে বসা শাঙ্কোকে ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো একটা খুব দরকারি কাজ তোমাকে করতে হবে। একা। শাঙ্কো ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকাল। তুমি কাল দুপুরে খেয়ে একটা নৌকো নিয়ে বেরিয়ে যাবে। জাহাজে উঠে যত লম্বা পাও একটা শক্ত কাছি আর মোটামুটি হাতকুড়ি শক্ত দড়ি নিয়ে আসবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
–এটা এমন কিছু কাজ নয়। সমস্যা হল-এখন ভাটার টান চলছে। নৌকো গুলো নিয়ে যেতে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু ফেরার সময় জোয়ারের টান না পেলে উজান বেয়ে আসতে বেশ কষ্ট হবে।
–তাহলে একটা নৌকোতে না হয় বিনোলা যাবে। তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। ফ্রান্সিস বলল।
ঠিক আছে। কাছিটা পাকিয়ে রাখতে একটা নৌকোর জায়গায় না হয় দুটো নৌকোয় ছড়িয়ে রাখব। আর একটা নৌকো নিয়ে আসব।
–যেমন সুবিধে বুঝবে। তবে ঐ নৌকোটায় আমার নামের আদ্যক্ষর এফ আমি খোদাই করে রেখেছি। ওটা চেপেই ডুবো পাহাড়ের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলে সোনার ঘন্টার দ্বীপে গিয়েছিলাম। আমি মারা গেলে ঐ নৌকোটা রাজার যাদুঘরে সোনার, .. ঘন্টাটার পাশে রেখে দিও।
–ফ্রান্সিস, মৃত্যুচিন্তা মনকে দুর্বল করে দেয়। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল।
–হ্যারি, ফ্রান্সিস হেসে বলল–আমার ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা। বেঁচে থাকতে আমাকে উজ্জীবিত করে। মৃত্যু তো অমোঘ সত্য। আমি কক্ষনো ভুলি না–যে কোনো মুহূর্তে আমার মৃত্যু হতে পারে। কাপুরুষের কলঙ্কিত মৃত্যু নয়:-বীরের মৃত্যু।
–এজন্যেই সত্যি বলছি, মাঝে মাঝে আমার বড় ভয় করে। হ্যারি আবার মৃদুস্বরে বলল। তারপর বলল–এই যে তুমি দু’ধারের গাছে কাছি বেঁধে দুরন্ত ঘূর্ণির ঠিক ওপরে কাছি বেয়ে বেয়ে যাবে বলে স্থির করেছ–জান এটা কতবড় মারাত্মক ঝুঁকি!
–সে তো হাত ফসকে ঘূর্ণিতে পড়ে গেলে। শোনো একটা সূত্র পাওয়া বাকি। সেটা পেলে নির্বিঘ্নে ঐ সিন্দুক ঘূর্ণির মধ্যে থেকে তুলে আনতে পারব। ফ্রান্সিস বলল।
–পারবে? নির্বিঘ্নে? জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে?
–আলবাৎ পাড়ব। কিন্তু হ্যারি, আমার মন বলছে অত সহজে সিন্দুকটা উদ্ধার করা যাবে না। ফ্রান্সিস বলল।
রাতে উঠোনেই খাওয়ার-দাওয়া চলছে। দুপুরের মতো বৃদ্ধ এদিক ওদিক ঘুরে তদারকি করছে। হ্যারি হেসে বলল– আপনি ঘরে যান। বিশ্রাম করুন। বৃদ্ধ আর : কোনও কথা না বলে চলে গেল।
রাতে আগের মতোই উঠোনে এখান-সেখানে শুয়ে পড়ল সবাই। নদীর দিকে থেকে সারাদিনের গরমের পর ঠান্ডা বাতাস ছুটে আসছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সবাই। শুধু ফ্রান্সিস মাথার পেছনে দুহাতের চেটো রেখে চোখ বুজে শুয়ে আছে। হাতে সময় নেই। শাঙ্কোদের ফিরতে দেরি হয়ে গেলে সমস্যা বাড়বে। সবাইকে নিয়ে ঐ বাঁকে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সন্ধের অন্ধকারের আগে কতক্ষণ আর সময় পাওয়া যাবে। ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুলল। আকাশে জ্যোৎস্নার ঢল নেমেছে যেন। আগণন তারা জ্বলছে। হালকা সাদা মেঘ উড়ছে। আঃ পৃথিবী কী সুন্দর! এই চোখে দেখা আকাশই তো শেষ সীমা নয়। সহপাঠী হ্যারির সঙ্গে এক পাকা দাড়ি-গোঁফওয়ালা বৃদ্ধর পাথরের ঘুপচি ঘরে ওরা জনা দশবারো ছাত্র পড়ত। বৃদ্ধের নাম মনে নেই। মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথা বলত বৃদ্ধই। তোমরা যে আকাশটা দেখ সেটা ছাড়িয়ে এই যে শূন্যতা তার কোনও সীমা পরিসীমা নেই। এরকমই কী যেন। ফ্রান্সিস মনে মনে ভাবছিল–হ্যারির ঘুম ভেঙে গেল তখনই। দেখল ফ্রান্সিস আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
–ঠিক জানি। ঘুমোওনি। হ্যারি বিড়বিড় করে বলল। হ্যারি, ছেলেবেলাটা সত্যি বড় সুন্দর তাই না?
–কী এমন নতুন কথাটা বললে আঁ?
–শাঙ্কোরা যে কখন ফিরতে পারবে তাই ভাবছি। ফ্রান্সিস একই চিন্তিত স্বরে বলল।
–ভেবে কী করবে? যখন আসার আসবে। কিন্তু রাত জাগলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। হ্যারি বলল।
–ও আমার অভ্যেস আছে তা জান। ফ্রান্সিস পাশ ফিরতে ফিরতে বলল।
পরেরদিন সকালে ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল বৃদ্ধকে গিয়ে বলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন দুজনের মতো খাবার এক্ষুনি বেঁধে দেবার ব্যবস্থা করেন। বেশি কিছু না। শুধু রুটি মাছের ঝোলমতো। হ্যারি সেই বৃদ্ধকে দেখল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যারি কাছে গিয়ে বলল দেখুন বাধ্য হয়ে আপনাকে একটু বিরক্ত করছি। বৃদ্ধ কোমল মুখে হেসে বলল বলুন কী ব্যাপার। রান্না ভালোই হচ্ছে না?
-না, না। এত সুস্বাদু মাছ আমরা কোনদিন খাই নি। আচ্ছা এই মাছগুলোর নাম কী?
–লিতানি। এই নদীতে প্রচুর পাওয়া যায়। বর্ষার সময় তো হাজারে হাজারে মাছ। কাছাকাছি গ্রাম থেকে ব্যবসায়ী আসে। নৌকো ভর্তি করে মাছ কিনে নিয়ে যায়। সেই সব মরশুমে আমাদের আয় যথেষ্ট হয়। বলতে পারেন ঐ আয়ের ওপরেই আমরা বেঁচে আছি।
–শুনে ভাবতে লাগল। এখন যা বলছিলাম আমাদের দুই বন্ধু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গিয়ে আমাদের নোঙ্গর করা জাহাজে যাবে। খুব দরকারি কিছু জিনিস নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। কাজেই এই দুজনের জন্যে–
–বুঝেছি।
-যদি বলেন রান্নার ব্যাপার আমরা সাহায্য করতে পারি।
–সে কি! আপনারা আমাদের অতিথি। আপনাদের নিজেদের রান্না করা খেতে দিলে আমাদের গ্রামের অমঙ্গল হবে। নিশ্চিন্ত থাকুন। বাড়ির মেয়েদের বলছি– অল্পক্ষণের মধ্যেই রান্না করে দিতে।
হ্যারি শাঙ্কোকে গিয়ে তাড়া লাগাল। বলল তোমাদের দুজনের জন্যে যা হোক রেধে দেওয়া হচ্ছে। দেরি না করে খাওয়া শেষ করেই যাত্রা শুরু করবে। আর হ্যাঁ। পেট পুরে খাবে। তোমাদের বেশি খেলে আমাদের খাবার কম পড়ে যাবে কিনা এসব একেবারে ভাববে না। যাও–শুয়ে পড়ে বিশ্রাম যতটা পার করে নাও।
শাঙ্কো বিনোলাকে ডেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সারল। তারপর তৈরি হয়ে নদীর ধারে চলে এল। দুটো নৌকোয় উঠল দুজনে। নদীর জলের ভাটার টানে নৌকো ছেড়ে দিল। দুপুরের রোদের তেজ কম। এদিক ওদিক আকাশ ছাড়া ছাড়া মেঘ রোদের তেজ চাপা পড়ে গেছে।
নদীর মুখের কাছাকাছি এসেছে আজ শাঙ্কো আর বিনোলা। শাঙ্কো হিসেব করে বুঝল ভাটার টানে বেশ তাড়াতাড়িই এসেছে। পশ্চিমের তারাজ্বলা আকাশে বাঁকা চাঁদ। খুব উজ্জ্বল চাঁদের আলো নেই। এর অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় চারিদিক মোটামুটি দেখে বোঝা যাচ্ছে একপাশে গাছগাছালি অন্য পাশে উঁচুনিচু পাহাড়ি এলাকা।
দূর থেকে শাঙ্কো অস্পষ্ট দেখল ওদের জাহাজটা বাঁদিকের তীরে নোঙ্গর করা হয়েছে। ঢেউয়ের ধাক্কায় আস্তে আস্তে দুলছে। শাঙ্কোদের রাত তো চাঁদের আলো না থাকলে অন্ধকারেই কাটে। কাজেই অন্ধকারে ওরা বেশ আন্দাজে সব বুঝে নেয়। অন্তত জাহাজ বন্দর সহজেই বুঝতে পারে।
ওদের জাহাজের কাছে এসে দেখল জাহাজের সব আলো নেভানো এমনকি সিঁড়ির ঘরের আলোও। শাঙ্কোর কেমন খটকা লাগলো। ওরা সাধারণত রাতে সিঁড়িঘরের আলোটা জ্বেলে রাখে যাতে জাহাজে রাতের অন্ধকারে জলদস্যুরা জাহাজে উঠলে দেখা যায়। কয়েকজন বন্ধু জাহাজের উপর ঘুমোয়। ওদের তো ডাকতে হয়। শাঙ্কোরা আসবে এটা তো ওরা জানে না। জাহাজের গায়ের কাছে এসে শাঙ্কো হাতের চেটো গোল করে চেঁচিয়ে ডাকল–ভাইসব একটু সজাগ থাকো। এভাবে মড়ার মতো ঘুমিও না। কিন্তু কারও কোন সাড়া পেল না। অবাক কাণ্ড! কেউ কি তাহলে উপরে শোয়নি। যাক গে জাহাজে উঠে দেখা যাবে। নৌকো দুটো জাহাজের গায়ে লাগল। দড়ির মইটা নামানো নেই। অবশ্য বন্ধুদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ওরা যে এত তাড়াতাড়ি মাত্র দুজন আসবে এটা তো ওদের জানা নেই। হালের কাছে গোটানো দড়ি ধরে ধরে শাঙ্কো জাহাজের অন্য পাশে চলে এলো। তখনই অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখল নদীর মুখের ওপাশে একটা জাহাজ দেখল। চলন্ত জাহাজ নয়। নোঙ্গর করা জাহাজ। শাঙ্কো দড়ি ধরে উঠতে উঠতে ভাবল–এই জাহাজেটা বোধ হয় ওদের পর এখানে এসেছে। কিন্তু জাহাজে চড়ে এখানে কারা এল? যাক গে দুজনে পরপর অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় জাহাজের উপর উঠে এল। সামনে তাকিয়েই? শাঙ্কো দেখল-রাজকুমারী চুপ করে সিঁড়িঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শাঙ্কো রাজকুমারীর দিকে যেতে যেতে বলল–রাত জাগবেন না। যান ঘুমিয়ে পড়ুন। ফ্রান্সিসরা সবাই সুস্থ। ভালো আছে। রাজকুমারীর কাছে এসে শাঙ্কো সেই স্বল্প আলোয় দেখল-রাজকুমারী কেমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ শুকনো। মাথার চুল এলোমেলো। কেমন রোগার্তা রাজকুমারী–আপনার শরীর ভালো আছে তো? আপনি অসুস্থ শুনলে ফ্রান্সিস কিন্তু কথটা শাঙ্কো শেষ করতে পারল না। দেখল সিঁড়ি দিয়ে দুতিনজন মূর যোদ্ধা খোলা তরোয়াল হাতে দ্রুত উঠে এল। বিদ্যুৎ চমকের মতো ওর মনে পড়ল একটা জাহাজ ও আগে দেখে এসেছে। তাহলে মুর যোদ্ধারা ওদের জাহাজ দখল করেছে। রাজকুমারীসহ সবাই তাহলে বন্দী। শাঙ্কো ত্বড়িৎ গতিতে রেলিঙ্গের দিকে ছুটতে ছুটতে চেঁচিয়ে বললো–বিনোলা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ো। পালাও। কথাটা বলতে বলতেই শাঙ্কো লাফ দিয়ে রেলিঙ টপকে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপরেই একটু ডুবে ওদের একটা নৌকার কাছে ভেসে উঠল। ভেজা শরীর নিয়ে এক ঝটকায় একটা নৌকায় উঠে পড়েই এক হাঁচকা টানে দড়িটা ছিঁড়ে নৌকাটা নিয়েই দাঁড় তুলে বাইতে লাগল। জোরে দাঁড় বেয়ে অনেকটা দূরে চলে এল। মাথা তুলে এক নজর দেখল–রেলিঙ ধরে মূর যোদ্ধারা তাকিয়ে আছে। শাঙ্কো জোরে শ্বাস ফেলল। একটু হাঁপাতে হাঁপাতে প্রাণপণ দাঁড় বাইতে লাগল। জোয়ার তখন শুরু হয়ে গেছে। বেশ কষ্ট করেই নৌকাবাইতে লাগল। জোয়ারের টান বাড়ল। নৌকো দ্রুত চলল।
ততক্ষণে মুর যোদ্ধারা বিনোলাকে ধরে সিঁড়িঘরের দিকে নিয়ে চলেছে। রাজকুমারী দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। এই বন্দী জীবনে একটাই সান্ত্বনা ফ্রান্সিসরা সকলেই সুস্থ আছে, ভালো আছে। অবশ্য কবে সবাই ফিরবে সেটা আর আতর্কিতে আক্রান্ত শাঙ্কো বলতে পারে নি।
শাঙ্কো দাঁড় বাওয়া একেবারে বন্ধ করতে সাহস পেল না। প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগল। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল খুব অস্পষ্ট ওদের জাহাজটা তখন বেশ দূরে। চাঁদের আবছা আলো চারদিকে। আস্তে আস্তে জোয়ারের টান আরও বাড়ল। সেই টানে নৌকো বেশ তাড়াতাড়িই ভেসে চলল। এতক্ষণে শাঙ্কো বুঝতে পারল ও কতটা ক্লান্ত। একটু আস্তে আস্তে দাঁড় বাইতে লাগল। নদীর জলে চাঁদের নিস্তেজ আলো পড়েছে। নদীর দুপাশে এবার কালো কালো গাছগাছালি শুরু হল। আস্তে আস্তে চারদিক একবারে অন্ধকার হয়ে গেল। শাঙ্কো আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল কালচে মেঘ জমেছে আকাশে। হঠাৎই জলে ছড় ছড় শব্দ তুলে বৃষ্টি নামল। কেমন ধূসর হয়ে গেল আকাশটা। ঝাপসা হয়ে গেল চারদিক। এক তো সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে গায়ের পোশাক ভিজে গিয়েছিল এখন বৃষ্টির জলে পোশাক সপসপে হয়ে গেল। মেঘ উড়ে গিয়ে বৃষ্টি থেমে গেল। আকাশ সাদাটে হয়ে গেল। বোঝা গেল ভোর হতে দেরি নেই।
তখন সবে সূর্য উঠেছে। চারিদিক ভোরের রোদ ছড়িয়ে পড়ল। দূরে ইরেকাস গ্রামের ঘাট দেখা গেল। শাঙ্কো আস্তে আস্তে ঘাটে নৌকো দুটো ভেড়াল। নৌকো চালিয়ে এত দূরে যাওয়া আসা। শাঙ্কো ক্লান্তিতে অবসাদে তখন প্রায় নড়তেই পারছে না। ঘাটে বন্ধুরা কেউ দাঁড়িয়ে নেই। শাঙ্কো শরীরের সমস্ত জোর এক করে প্রাণপণে ডাকল–ফ্রান্সিস। কিন্তু সেই ডাক খুবই মৃদু শোনাল। শাঙ্কো বুঝল তীরে উঠে না ডাকলে কেউ শুনতে পাবে না। ও ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না গা ছেড়ে দিয়ে নৌকায় জমা বৃষ্টির জলের মধ্যে চোখ বুজে পড়ে রইল। নৌকটা ভাসতে ভাসতে তীরের কাছে এসেছে তখন। ফ্রান্সিস দুহাতের মধ্যে মাথা গুঁজে বসেছিল। শাঙ্কোরা ফিরবে বলে। কাজেই সারারাত প্রায় জেগেই কেটেছে। শাঙ্কোর ডাক খুব অস্পষ্ট ওর সতর্ক কানে পৌঁছলে ও এক লাফে উঠে দাঁড়িয়েই তীরভূমির দিকে ছুটলো। ফ্রান্সিসকে ছুটতে দেখে হ্যারিও পেছনে পেছনে ছুটল।
তীরের কাছে নৌকো ভাসছে। তখন ফ্রান্সিস জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নৌকার কাছে এসে ফ্রান্সিস দেখল নৌকোর মধ্যে শাঙ্কো একা অসাড় পড়ে আছে। হাতে দাঁড়টা ধরা আছে। ও তাড়াতাড়ি ছুটে এসে শাঙ্কোকে টেনে তুলল। তখনই হ্যারি আর দুই বন্ধুও এসে হাত লাগাল। ওরা শাঙ্কোর অসাড় দেহটা তুলে এনে পাথুরে শুকনো মাটির উপরে শুইয়ে দিল। এতক্ষণ শাঙ্কো চোখ বুজে ছিল। এবার চোখ মেলে ফ্রান্সিসদের দেখল। ফ্রান্সিস পাশের বন্ধুটিকে বলল–শিগগির শাঙ্কোর জন্যে শুকনো কাপড় নিয়ে এস। বন্ধুটি ছুটে গেল। হ্যারি শাঙ্কোর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল শাঙ্কো তুমি সুস্থ আছো তো? শাঙ্কো ম্লান হেসে মাথা কাত করল।
–শাঙ্কো-বিনোলা কোথায়? ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল। শাঙ্কো হাতের চেটোতুলে। ইঙ্গিত করল–পরে বলবে। ফ্রান্সিস আর কোন কথা জিজ্ঞেস করল না। তখনই বন্ধুটি শাঙ্কোর জন্য শুকনো পোশাক নিয়ে এল। সবাই মিলে শাঙ্কোকেদাঁড় করাল। তারপর ভিজে পোশাক খুলে শুকনো পোশাক আস্তে আস্তে পরিয়ে দিল। শুকনো পোশাক পরে শাঙ্কোর শরীর যেন সাড় এল।
হেঁটে যেতে পারবে? হ্যারি জানতে চাইল। শাঙ্কো মাথা কাত করল। দুতিন জন শাঙ্কোকে ধরে ধরে বাড়ির উঠোনে নিয়ে এল। যে মোটা কাপড় পেতে ওরা কয়েক জন রাতে শুয়ে ছিল সেখানে শাঙ্কোকে আস্তে করে শুইয়ে দিল।
–সিনাত্রা দেখে তো কারো বাড়িতে দুধ পাও কি না ফ্রান্সিস বলল, সিনাত্রা চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বড় গ্লাসে করে দুধ নিয়ে এলো। গ্লাসটা হাতে নিয়ে ফ্রান্সিস বুঝল বেশ গরম দুধ। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর মাথা তুলে ধরল। হ্যারি আস্তে আস্তে শাঙ্কোকে দুধ টুকু খাইয়ে দিল।
ছাগলের দুধ। সিনাত্রা বলল।
–গরম হলেই হল। ফ্রান্সিস বলল। অল্পক্ষণের মধ্যেই এত ক্ষণ ভিজে পোশাকে– থাকা শাঙ্কো শরীরের উষ্ণতা অনুভব করল। ও আস্তে আস্তে উঠে বসল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি ওর পাশে বসল।
–এখন ভালো লাগছে তো? হ্যারি বলল।
শাঙ্কো মাথা কাত করে দুর্বল স্বরে বলল। হ্যাঁ।
শাঙ্কো আমার মনের আশঙ্কা যাচ্ছে না জাহাজের সবাই ভালো আছে তো? ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল।
মনে হয় ভালো আছে। তবে সবাই বন্দী হয়ে আছে জাহাজে। রাজকুমারী শরীর খারাপ হয়ে গেছে। তবে অসুস্থ নয়। তারপর শাঙ্কো থেমে থেমে আস্তে আস্তে সব ঘটনা খুলে বলল। ফ্রান্সিস হ্যারি দুজনেই চুপ চাপ রইল। ততক্ষণে বন্ধুরাও এসে ওদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সব শুনে ফ্রান্সিস বলল–এখন সবই পরিষ্কার বুঝতে পারছি ইবু গ্যাব্রিওল জাহাজ ভর্তি যোদ্ধা নিয়ে আমাদের হন্য হয়ে খুঁজে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য ইবু সালোমনের স্বর্ণভাণ্ডারের উদ্ধারের জন্যে আমরা চেষ্টা করছি কিনা। ও ভালো করেই জানে ঐ স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করার বুদ্ধি ওর নেই। ওর বন্ধুদেরও নেই। খুব ধুরন্ধর তো ঠিক আন্দাজ করেছে আলফানসো আমাদের জাহাজেই আশ্রয় নিয়েছে আর আমরা স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করতে নেমেছি। আমরা সেই স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারলে নিশ্চয়ই সেটা নিয়ে জাহাজে ফিরবো। তাই ও বুদ্ধি খাটিয়ে জাহাজ দখল করে বন্ধুদের বন্দী করছে। অপেক্ষা করছে কখন আমরা আসব তার জন্যই।
–তাহলে এখন কী করবে? হ্যারি জানতে চাইল।
বন্ধুদের আগে মুক্ত করবো। ফ্রান্সিস ভাবতে ভাবতে বলল।
–তাহলে তো আমাদের জাহাজে ফিরে যেতে হবে। আর একেবারে নিরস্ত্র অবস্থায়। ঐ দুর্ধর্ষ মুর যোদ্ধাদের সঙ্গে তো লড়াইয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। হ্যারি বলল।
-হ্যারি কব্জির জোরের চেয়ে বুদ্ধির জোর বেশি। আজকের দিনটা থাক। শাঙ্কোর যা অবস্থা। একদিন বিশ্রাম পেলে শাঙ্কো অনেকটা সুস্থ হবে। ওকে এই অবস্থায় সাথে নেওয়া যাবে না। আবার ওকে এখানে একা রেখেও যাওয়া যাবে না। একটা দিন তো হাতে আছে। ঠিক একটা ছক কষতে পারবো।
–কিন্তু ইবু গ্যাব্রিয়েল শুধু ধুরন্দর নয় ভীষণ হিংস্র প্রকৃতির। নিজের অমন, নিরীহ পিতাকে যেভাবে নিঃশব্দে হত্যা করেছে। ফ্রান্সিস হাত তুলে হ্যারিকে থামিয়ে দিয়ে বলল–অনেক দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষেরই কোন না কোন দুর্বলতা থাকে। ইবু গ্যাব্রিয়েল সম্পদ পিশাচ। এটাই ওর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। সেই ফাঁদেই ওকে ফেলতে হবে।
–তাহলে তো সেই স্বর্ণসম্পদ উদ্ধার করতে পারলে
হ্যাঁ। ওকেই দিয়ে দেব। হাজার হোক ও তো ইবু সালোমানের পুত্র। পিতার সম্পদের অধিকারী তো ইবু গ্যাব্রিয়েলই। প্রচুর ধনসম্পদ সংগ্রহ করবো ধনী হবো সেই উদ্দেশ্য নিয়ে তো আমরা গুপ্তধনভাণ্ডার উদ্ধার করি না। ফ্রান্সিস বলল।
–তা ঠিক। কিন্তু ওর মতো নরপশুকে কি বিশ্বাস করা যায়?
–ভাবতে হবে। একটা পুরো দিন তো পাচ্ছি। দেখি সবদিক ভেবে। কথাটা বলে ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি তুমি এই বৃদ্ধকে বল–তাড়াতাড়ি যা হোক বেঁধে দিতে। শাঙ্কোকে সুস্থ করাই এখন আমার প্রাথমিক কাজ। শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল শাঙ্কো–এখন শুয়ে বিশ্রাম কর রান্না হলেই পেট পুরে খাবে। সারা দুপুর শুয়ে ঘুমিয়ে বিশ্রাম করবে। রাতেও বিশ্রাম ঘুম হলে কাল সকালেই তুমি সুস্থ বোধ করবে। আর কথা নয়। এবার বিশ্রাম কর। ফ্রান্সিস উঠে এল। শাঙ্কোর জন্য রান্না হল কি না সেই খোঁজে চলল। বন্ধুরা কয়েকজন এসে শাঙ্কোর কাছে বসল। শাঙ্কো মৃদুস্বরে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগল। কিন্তু মাঝে মাঝেই উন্মানা হয়ে যেতে লাগল। রাজকুমারী ও বন্ধুরা বন্দী হয়ে আছে। এই কথা ভেবে। ফ্রান্সিস কী ভাবে ওদের মুক্ত করবে সেই চিন্তাই করছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই শাঙ্কোকে বাসি পাঁচ-ছটা রুটি গরম করে সঙ্গে বেশ কয়েকটা মাছের ঝোল দেওয়া হল। শাঙ্কো খেতে লাগল।
রাতে খাওয়ার সময় হ্যারি বলল–তাহলে কখন যাব আমরা?
–দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়েই বেরিয়ে পড়বো ফ্রান্সিস বলল।
দুপুরের খাওয়া ফ্রান্সিসরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। শুধু রুটি আর মাছের ঝোল। অন্য কোন পদ নয়।
পেট পুরে খাও। রুটি খাওয়া নাও জুটতে পারে। ফ্রান্সিস যেমন বরাবর বলে তাই গলা বাড়িয়ে বলল। পরদিন বিশ্রাম করে ঘুমিয়ে শাঙ্কো আবার গায়ে জোর পেল। তারপর তৈরি হয়ে নদীর ধারে চলে এল। দুটো নৌকোয় উঠল সবাই। নদীর জলের ভাটার টানে নৌকো ছেড়ে দিল।
কেউ কোন কথা বলছিল না। ফ্রান্সিস অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবল। একটাই সমস্যা। আবু গ্যাব্রিয়েল নিজে ঐ জাহাজে আছে কিনা। শাঙ্কো বলতে পারেনি।
কারণ ও তরোয়াল হাতে কয়েকজন মূর যোদ্ধাকেই দেখেছে শুধু। ইবু গ্যাব্রিয়েল থাকলে যে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। দলপতি সেটা পারলেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাবে। ওরা ইবু গ্যাব্রিয়েলকে যমের মতো ভয় করে। এটাই স্বাভাবিক।
সন্ধ্যের কাছাকাছি সময়ে ফ্রান্সিসদের নৌকোদুটো নদীর মূখের কাছাকাছি এল। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় দেখা গেল দুটো জাহাজই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস আশান্বিত হল নিশ্চয়ই ইবু গ্যাব্রিয়েল এসেছে সরেজমিনে সব দেখতে।
জাহাজ দুটোর কাছাকাছি আসতে ফ্রান্সিসরা দেখল খোলা তরোয়াল হাতে বেশ কয়েকজন যোদ্ধা জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। সিনাত্রা হ্যারির কাছে এসে বলল–ওরা তো আমাদের মেরে ফেলবে।
–এখনই ঠিক বলতে পারছি না। তবে ফ্রান্সিস খুব ভেবেচিন্তে পা ফেলে। কাজেই প্রাণের ভয় নেই। হ্যারি বলল।
নৌকো দুটো জাহাজের গায়ে এসে লাগল। ফ্রান্সিস নৌকোয় উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে গলা তুলে বলল–ভাই, আমরা নিরস্ত্র। আমরা লড়াই করতে আসিনি একথা আগেই বলেছি। আমরা বন্ধুদের খোঁজ নিতে এসেছি। তখন যোদ্ধাদের মধ্যে একজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে আস্তে আস্তে, পা ফেলে এগিয়ে এল। বেশ গর্বোদ্ধত ভঙ্গি অন্য যোদ্ধাদের মতো পোশাক হলেও মাথায় একটা কালো কাপড়ের পাগড়ির মতো। তরোয়ালের বাঁটে সোনারূপোর কাজ করা। বেশ বলশালী চেহারা। গলায় বুটিমতো সোনার হার ঝুলছে। ফ্রান্সিসদের বুঝতে অসুবিধে হল না এই লোকটিই দলপতি। কাছে আসতে বলল। গায়ের আটোসাটো কালো পোশাকটা দামি কাপড়ের। হয় তো এই যোদ্ধার হাতেই ইবু সালোমানের মৃত্যু হয়েছে। মনে একটা বিতৃষ্ণার ভাব এলেও নিজেকে সংযত করল।
তোমার বন্ধুরা আমাদের জাহাজে বন্দী হয়ে আছে। দলপতি বলল।
কেন?
–তোমরা ইবু সালোমনের কুফির ভাণ্ডার উদ্ধার করে এই জাহজেই আসবে। যাতে তোমরা আমাদের স্বর্ণমুদ্রার সিন্দুক নিয়ে পালাতেনা পার আগাম সেই ব্যবস্থা করে রাখতে। বেশ গম্ভীর গলায় দলপতি বলল।
তাকিয়ে দেখুন আমাদের দুটো নৌকোয় কয়েকটা দাঁড় আর কিছু পোশাক পড়ে আছে।
–ও তাহলে তোমরা সেই সোনার ভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারো নি? দলপতি যেন একটু হতাশ হল।
–তার আগে একটা কথা জানতে চাই বর্তমান শাসক ইবু গ্যাব্রিয়েল কি এই জাহাজে আছেন?
–হ্যাঁ উনি দুপুরের সব ব্যবস্থা দেখতে এসেছেন।
তার সঙ্গে কিছু কথা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
আমাকে বলতে পারো। আমি রব্বানি। সেনাপতি।
–না। আমি তার সঙ্গেই কথা বলতে চাই। বোঝা গেল সেনাপতি রব্বানি বেশ মন ক্ষুণ্ণ হল। তবে আর কোন কথা না বলে বলল-দাঁড়াও। ইবু গ্যাব্রিয়েলকে সংবাদ পাঠাচ্ছি। একজন যোদ্ধাকে এসে ইঙ্গিত করল যোদ্ধাটি দ্রুত চলে গেল।
একটু পরে ইবু গ্যাব্রিয়েল সিঁড়িঘর দিয়ে ডেক-এ উঠে এল। জেনারেল পোষাক পরনে। মাথায় পাগড়ির সামনে একটা বড় মুক্তো বসানো। বলল–
–তোমরা তো ভাইকিং? বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল।
–হ্যাঁ ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল।
–তোমাদের দলনেতা কে? ইবু গ্যাব্রিয়েল জিজ্ঞেস করল।
–আমি। ফ্রান্সিস বলল–আমার নাম ফ্রান্সিস।
–হুঁ। আমি সব খবর রাখি। আলফানসোকে তোমরা আশ্রয় দিয়েছে। লোকটা আমার হাত ফসকে পালিয়েছিল। যাকগে–আমাদের পৈতৃক সম্পদ-সিন্দুক ভর্তি কুফি তোমরা উদ্ধার করতে পেরেছো! বেশ সাগ্রহে ইবু গ্যাব্রিয়েল বলল।
না। তবে অনুমান করছি। সেই অনুমান কতটা সত্যি তা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। ফ্রান্সিস বলল।
-বলো কি? ইবু গ্যাব্রিয়েল প্রায় লাফিয়ে উঠল। এইবার ভুরু কুঁচকে ফ্রান্সিসের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর চোখ পিট পিট করতে করতে বলতে লাগল-এই নিখোঁজ সোনার মুদ্রাভর্তি সিন্দুক্টা একমাত্র আমিই দেখেছিলাম। আর আলফানসো বুড়োটা হয়তো দেখেছে। তুমি বুড়োটার সুযোগ বুঝে পালিয়েছে। ইবু গ্যাব্রিয়েলের চোখ পিটপিটানি দেখে ফ্রান্সিস বুঝল নোকটা শুধু নরপশুই নয় ধুর্ত। সাবধানে কথা বলতে হবে।
কিন্তু অনুমানটা করলেন কি করে? ইবু গ্যাব্রিয়েল জানতে চাইল।
ইবু সালোমান একজন সত্যিকারের কবি ছিলেন তবে একইসঙ্গে বুদ্ধিমানও ছিলেন। নইলে আরবীর বণিকদের সঙ্গে ব্যবসা করে অত ধনসম্পদ বাঁচাতে পারতেন না।
–ও সব শুনে লাভ কী। আসল কথা বল। ইবু গ্যাব্রিয়েল তাড়া লাগাল।
–তাঁর শেষ কবিতা থেকে। ফ্রান্সিস বলল।
–ও। ওটা তো পাগলের প্রলাপ। ইবু গ্যাব্রিয়েল দেঁতো হাসি বলল।
–না। ওটা গিজেল না বেশ ভেবেচিন্তে লেখা। কবিতা।
–কিন্তু আমি ঐ কবিতা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছি।
–কবিতাটা আলফানসোর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল।
–ও। বৃদ্ধটা তো আভাসেও একথা বলেনি।
–কারণ উনি একটা মর্মন্তুদ ঘটনা আন্দাজ করে ঐ কবিতাটা দু এক পংক্তি মনে করতেই তাঁর চোখে জল আসতো অর্থটা আর ভাবতে পারেন নি। আমরা সেই অর্থটা বুঝতে পেরেছি। তার সাহায্যেই এগিয়েছি। তবে এখনও নিশ্চিন্তই কবিতার মধ্যে দিয়ে ইবু সালোমান যা বলতে চেয়ে ছিলেন তার সত্যতা এখনও যাচাই করতে পারিনি। ফ্রান্সিস বলল।
–যদি তোমার অনুমান সত্যি হয় তবে ঐ স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারবে? ইবু গ্যাব্রিয়েল আবার চোখ পিট পিট করতে লাগল।
–এখনই বলতে পারছি না। ফ্রান্সিস মাথা এপাশ ওপাশ করল।
–যদি উদ্ধার করতে পারো তহলে আমাদের ফাঁকি দিয়ে ঐ ধনসম্পদ নিয়ে গোপনে পালাবে। এটাই তো তোমাদের মতলব।
–একটা স্বর্ণমুদ্রাও নেব না। ফ্রান্সিস আস্তে বলল।
–অবাক কাণ্ড। তোমাদের এই জাহাজটা তো একটা সিন্দুকে দামি দামি গয়না সোনার চাকতি পেয়েছি। সে সব কি কেউ তোমাদের বিলিয়ে দিয়েছে? ইবু গ্যাব্রিয়েল ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলল।
–সেই সম্পদের সঙ্গে বহু মানুষের রক্ত চোখে জল মিশে আছে। এই সম্পদ অভিশপ্ত সম্পদ। ফ্রান্সিস বলল।
–এখন ভাল ভাল কথা বলো হয়তো। অত স্বর্ণমুদ্রা খুঁজে পেলে তখন অন্য চেহারা ধরবে। তোমরা তো লুঠেরার দল।
–এই অভিযোগ এই সন্দেহের চেহারা আমরা আগে দেখেছি। কিন্তু যখন তারা দেখেছে আমরা একটা সোনার আংটিও চাই নি তখন আমাদের বিশ্বাস করেছে। ইবু গ্যাব্রিয়েল, আমরা অন্য ধরনের মানুষ। যদি সোনা ভর্তি সিন্দুক উদ্ধার করতে পারি ইবু সালোমানের যর্থাথ দাবিদার আপনাকেই সব দিয়ে যাবো। বললাম তো একটা স্বর্ণমুদ্রাও নেব না।
–আমাকে বোকা বুঝিয়ে পালিয়েও যেতে পারবে না।
–আমরা আমাদের বন্ধুদের বন্দী অবস্থায় রেখে হাজার প্রলোভনেও এক পা যাবো না। ফ্রান্সিস দৃঢ়স্বরে বলল।
–বিশ্বাস কি! আবার ইবু গ্যাব্রিয়েল চোখ পিট পিট করতে লাগল।
–বেশ। আপনার সেনাপতি রব্বানি নিশ্চয়ই খুব বিশ্বস্ত। তার সঙ্গে আপনার কিছু দুধর্ষ যোদ্ধা আমাদের সঙ্গে চলুক। তাহলে তো আপনার বিশ্বাস হবে আমার কথা? ওদের হুকুম দিয়ে রাখবেন আমরা কেউ পালাতে গেলে তারা যেন তাকে হত্যা করে। আমরা তো নিরস্ত্র। ইবু গ্যাব্রিয়েল একবার রব্বানির দিকে তাকাল। তারপর বলল–বেশ। তোমাদের ওপর নজর রাখতে ওরা তোমাদের সঙ্গে যাবে। ফ্রান্সিস এটাই চাইছিল। ও নিশ্চিন্ত হল।
কবে কোথায় যাবে তোমরা? ইবু গ্যাব্রিয়েল জানতে চাইল।
–সেটা রব্বানি দেখতেই পাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশি না। এখানে তোমরা যে কজন আছো- শুধু তারা যাবে। তার বাইরে আর কেউ যাবে না। ইবু গ্যাব্রিয়েল বলল।
–কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে?
–কি শর্ত?
–গুপ্তধন উদ্ধার করে যখনই আপনাকে দেব তখনই আমাদের সবাইকে মুক্তি দিতে হবে। ফ্রান্সিস কথাটা বেশ জোর দিয়ে বলল।
–সে তখন দেখা যাবে। ডান হাত শূন্যে ঘুরিয়ে গ্যাব্রিয়েল বলল।
–উঁহু। আগে এই শর্তটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। ফ্রান্সিস জোর দিয়ে বলল।
ইবু গ্যব্রিয়েল একবার চোখ পিট পিট করে রব্বানির দিকে তাকাল। রব্বানি– বলল মান্যবর শর্ত মেনে নিন। ওরা ঐ স্বর্ণসিন্দুক কোনদিন উদ্ধারই করতে পারবে না। তখন ওদের বন্দি করে জাহাজ সুষ্ঠু রাজধানী ফিরে যাবো আমরা।
–হুঁ। বেশ তোমার শত মেনে নিলাম। তোমরা কখন যাবে? ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে গ্যাব্রিয়েল বলল।
–আজ রাতের খাওয়া শেষ করে। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু যাবে যে থাকবে কোথায়? খাবে কী?
–ইরেকাশ নামে একটা গ্রাম আছে। ওখানেই আমরা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–ব্বাঃ! বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। ঠাট্টা করে গ্যাব্রিয়েল বলল।
-বুদ্ধিমানরা তাই করে। অবশ্য জঘন্য চরিত্রের মানুষেরাও তাই করে থাকে। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল।
–হুঁ। রব্বানিরা আমাদের নৌকোয় যাবে।
তাহলে তো ভালই হয়। কারণ–কিছু লম্বা কাছি আর দড়ি নিয়ে যেতে হবে আমাদের। নৌকো দরকার।
–ব্বাঃ! বেশ অনুমান মাত্র করেছে। এর মধ্যেই–
–হ্যাঁ। আমি ভেবেচিন্তে বুদ্ধি খাটিয়ে এর আগেও বেশকিছু গুপ্ত ধনভাণ্ডার ও উদ্ধার করেছি। অবশ্য বন্ধুদের সাহায্যও পেয়েছি।
–ভালভাল। ইবু গ্যাব্রিয়েল পিছু ফিরে হালের দিকে চলল। বোধ হয় নিজের : জাহাজের দিকে যাবে বলে।
সিঁড়িঘরের কাছে এখন মারিয়া দাঁড়িয়ে ছিল। তখন অস্পষ্টই জ্যোৎস্না মারিয়াকে দেখে ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি মারিয়ার কাছে এল। স্বল্প আলোয় মারিয়ার মুখচোখ দেখেই বুঝল-পেট ভরে খায় নি মারিয়া চিন্তায়। রাতও জেগেছে। ফ্রান্সিস কাছে এসে বলল মারিয়া–তোমার চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের বিপদ বাড়বে। তুমি সুস্থ থাকার চেষ্টা কর। কিছু ভেবো না। ঐ স্বর্ণভাণ্ডার আমরা উদ্ধার ঠিক করতে পারবো। সবাই মুক্তি পাবো। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে জাহাজ দেশের দিকে চালাবো। একেবারে দুশ্চিন্তা করো না। শুধু আমার উপরে বিশ্বাস রেখো। মারিয়া মৃদু হাসল।
–যাও–গিয়ে শুয়ে পড়ো। বিশ্রাম করো। গুপ্ত স্বর্ণভাণ্ডার খোঁজ করে ফ্রান্সিসরা কতটা সফল হয়েছে সেটা আর জিজ্ঞেস করল না। আস্তে আস্তে নিঃশব্দে মারিয়া নেমে গেল। রব্বানি এগিয়ে ফ্রান্সিসকে একসঙ্গে বসতে নির্দেশ দিল। দুজন যোদ্ধা খোলা তরোয়াল হাতে ওদের পাহারা দিতে লাগল। ফ্রান্সিসরা কজন চুপচাপ ডেকএ বসে রইল। সেনাপতি রব্বানি ফ্রান্সিসের কাছে এল।
বলল–বন্ধুদের দেখবে না?
-কি হবে দেখে? ওদের মুক্ত তো করতে পারবো না বরং ওদের কষ্ট বাড়িয়ে দেবো। তবে একটু অনুরোধ একটা খবর ওদের দিলে উপকার হয়। খবর দেবেন যে আমরা সবাই সুস্থ আছি আর আজ রাতেই স্বর্ণভাণ্ডার অনুসন্ধানে যাচ্ছি। আমার প্রতিজ্ঞা বন্দী বন্ধুদের মুক্ত করবোই।
বেশ। খবর দেওয়া যাবে। তবে তুমি বড্ড বেশি এগিয়ে ভাবছো। ঐ স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধারের জন্যে মাননীয় শাসক ইবু গ্যাব্রিয়েল কম চেষ্টা করেন নি।
–দেখা যাক। আমরা যে বেশি বুদ্ধিমান সেই প্রমাণ করতে পারি কি না। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
ফ্রান্সিসরা রাতের খাওয়া ঐ ডেক এ মশালের আলোয় বসে খেয়ে নিল।
–চলো সব। দেরি করবো না। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে বলল।
কাছি দড়ি জোগাড় করে নৌকোয় উঠতে উঠতে একটু দেরিই হল। ফ্রান্সিসরা দেখল ইবু গ্যাব্রিয়েল জাহাজের দিক থেকে বেশ একটা শক্তপোক্ত নৌকোয় চড়ে চারজন বলশালী সশস্ত্র যোদ্ধাকে নিয়ে রব্বানি আসছে। রব্বানিদের নৌকো ওদের নৌকোর পিছনে পিছনে এসে দাঁড়াল।
–নৌকো ছাড়া। ফ্রান্সিসের হুকুম শোনা গেল সব নৌকো পরপর যাত্রা শুরু করল। অস্পষ্ট স্রোতের মধ্যে দিয়ে নৌকোগুলি চলল নদীর ওপর দিয়ে ভেসে।
–জোয়ারের টান এসেছে। শাঙ্কো দাঁড় বাইতে বাইতে গলা চড়িয়ে বলল।
–তবু-দাঁড় বাওয়া বন্ধ করল না। ভোর ইরেকাবা গ্রামে পৌঁছতেই হবে। ফ্রান্সিসও গলা চড়িয়ে বলল। কাছি দড়ি বোঝাই নৌকোয় শুধু সিনাত্রা একা দাঁড় বাইতে লাগল।
সারা নদীপথে ফ্রান্সিসরা কেউ প্রায় কোন কথা বলল না। হ্যারি ভেবে চলল ফ্রান্সিস কি সত্যিই স্বর্ণভাণ্ডার হদিশ বের করতে পারবে? ফ্রান্সিস নদীর জলধারার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল। হ্যারি একবার ভাবল ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু চিন্তান্বিত ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা বলল না।
এক সময় ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল। যদি নৌকোর মধ্যে ঘুমুতে চাও ঘুমিয়ে নাও। কালকে অনেক কাজ করতে হবে। হ্যারি আর দুই বন্ধু নৌকার মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নৌকোগুলো বেশ দ্রুতই চলল। রব্বানির নৌকোটা ফ্রান্সিসদের শেষ নৌকোটার সঙ্গে বাঁধা ছিল। ওদের তো আর কোন তাড়া নেই। চিন্তাও নেই। শুধু নিরস্ত্র ফ্রান্সিসদের ওপর নজর রাখা। কেউ পালাতে গেলে তরোয়াল চালিয়ে হত্যা করা।
তখন ভোর হয় হয়। চারটে নৌকোই ইরেকাবা গ্রামের নদীতীরে বাঁধা হল। নামল সবাই। গ্রামের লোকেরা আর সবাই ঘুম ভেঙ্গে উঠেছে। সবার আগে হ্যারি সেই বৃদ্ধের বাড়ীতে এল। দরজায় ধাক্কা দিতে বৃদ্ধ বেরিয়ে এল।
–শুনুন আমরা আমাদের জাহাজ থেকে দড়ি কাছি এসব দরকারি জিনিস আনতে গিয়েছিলাম এই মাত্র এসেছি আমাদের সময় কম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের জন্যে যাহোক কিছু খাবার তৈরি করতে বলুন। সঙ্গে আমাদের আরো। কয়েকজন এসেছে। সকলের জন্যে অন্তত দুটি করে রুটি আর মাছের ঝোল ব্যবস্থা। করুন। শাঙ্কো তখনই এসে হ্যারির পাশে দাঁড়াল। শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে হ্যারি বলল শাঙ্কো তোমার পট্টি থেকে চারটে সোনার চাকতি বের করে দিও।
–এই দামটা রাখুন আরও দরকার পড়লে দেব। কিন্তু রান্নাটা তাড়াতাড়ি হতে হবে। আমাদের দুই বন্ধু আশপাশের সাহায্য করবে। বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বলল–না না। আপনারা আমাদের অতিথি। আপনাদের রান্নার কাজ করতে দিলে গ্রামের অমঙ্গ ল হবে। আপনারা নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করুন। গ্রামের মহিলাদের মধ্যে ভালো রাঁধুনি এসে আপনাদের খাবার তৈরি করে দিচ্ছে।
হ্যারি ফিরে এসে ফ্রান্সিসকে সব বলল। তারপর বলল–কাল সারা রাত কারো তেমন ঘুম হয়নি। এই অবস্থায়–
উপায় নেই হ্যারি। সব কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারতে হবে। ঐ নরপশুর উপর আমার বিন্দু মাত্র বিশ্বাস নেই। যত তাড়াতাড়ি স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করে ওর জাহাজে পাঠিয়ে মুক্তি নিতে হবে। বেশি দেরি হলে ইবু গ্যাব্রিয়েল বিগড়ে যেতে পারে। ঐ লোকটা কাউকে বিশ্বাস করে না। নিজেকেও না।
–বেশ। তাহলে খাওয়া সেরেই যাত্রা শুরু করবো। হ্যারি মাথা নাড়িয়ে বলল।
বন্ধুরা সিনাত্রার নৌকোয় কাছি দড়ি নিয়ে বৃদ্ধের বাড়ির উঠোনে এসে এখানে ওখানে শুয়ে পড়ল। রব্বানি সঙ্গী সহ একপাশে একটা গাছের ছায়ায় বসল। রব্বানি। তীক্ষ্ণ নজর রাখল ভাইকিংদের দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল–রান্না হয়ে গেছে। আপনারা খেতে বসুন। সবাই একপাশে জড়ো করা শুকনো পাতা নিয়ে উঠোনে বসে গেল। হ্যারি রব্বানির কাছে এসে বলল–আপনারাও খেতে চলুন।
–এই লোনা উঠোনে? রব্বানি বেশ অবাক হয়ে বলল।
–কী করা যাবে। এদের ঘরের জায়গা খুবই কম। আসুন। হ্যারি বলল।
সকলেরই খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিসের কণ্ঠ উচ্চস্বরে শোনা গেল।
–বিশ্রাম টিশ্রাম হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ ঘূর্ণির কাছে যেতে হবে। চলো সব।
ভাইকিংরা একে একে নৌকাতে উঠল। রব্বানি তখনও ভেবে পাচ্ছে না–এরা কাছি দড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? মরুক গে। দেখাই যাক না ওদের কাজ তো ভাইকিংদের উপর কড়া নজর রাখা যাতে কেউ পালাতে না পারে। রব্বানিও ওদের নৌকোয় উঠল। নৌকোয় বাঁধা দড়ি। কাজেই রব্বানিদের নৌকো চালাতে হচ্ছিল না। ফ্রান্সিস ভালো করেই বুঝল রব্বানিরা বিশ্রামের সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু ফ্রান্সিস এই চিন্তাটাকে আমল দিল না। একসময় রব্বানি গলা চড়িয়ে বলল-কেউ চালাকি করতে যাবে না। করতে গেলে খতম হয়ে যাবে। ভাইকিংরা চুপ করে রইল।
যে ঘাটে নেমে ওরা তীর ভূমির পাথর ছড়ানো পাথুরে জমি ঝোঁপ জঙ্গল গাছপালার মধ্যেই দিয়ে আগে গিয়েছিল নৌকো থেকে নেমে সবাই চলল। রব্বানিরা সব পিছনে পিছনে চলল।
বেশকিছুক্ষণ পর সেই কাণ্ডে কাটাদড়ি বাঁধা গাছটার নিচে এল সবাই। হ্যারি রব্বানির কাছে গিয়ে বলল–আপনারা এখানে গাছের নিচে পাথরে বসুন বিশ্রাম করুন। আমরা কাজে নামছি। রব্বানি কিন্তু হাঁ করে দেখছিল ফ্রান্সিসদের। এরা কাছি দড়ি এনেছে কেন কি করবে ওসব দিয়ে তাই জিজ্ঞেস করল–এসব কাছি দড়ি দিয়ে কী করবেন? এখন কি ঠিক বুঝবেন না দেখতে থাকুন পরে বুঝবেন। রব্বানি যোদ্ধাদের বলল ওরা ওদের মত যা করছে করুক। আমাদের শুধু কড়া নজর রাখা। কাজই যে যেখানে পারো বসে পড়। কিন্তু চোখের বাইরে কাউকে যেতে দেবে না।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোরা ততক্ষণ নৌকো থেকে কাছি দড়ি এনে সেই গাছটার নিচে জড় করে ফেলেছে। দ্রুত কাজ করছে সবাই। রব্বানি নদীর ঘুর্ণিটা এখন কাছ থেকে স্পষ্ট দেখাও গেল। লোকমুখে এতদিন শুনেছে সমুদ্রে নদীতে প্রচণ্ড ঘূর্ণিতে জাহাজে প্রচণ্ড পাক খেতে খেতে ডুবে যায়। নদীর ঘূর্ণির টানে আরোহী সুদ্ধ নৌকো ডুবে যায়। ঘূর্ণির প্রচণ্ড টান জাহাজ নৌকো মানুষ তো বটেই কোন কিছুর সাধ্য নেই সেই টান থেকে উদ্ধার পাওয়ার।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ডেকে বল–আর এক মুহূর্তেও দেরি নয়। কাছির একদিকের মাথা নিয়ে গাছটায় ওঠ। কাটা দড়ির কাছে গিয়ে কাণ্ডটায় শক্ত করে ধরো। বিনালা নেই। সিনাত্রা তোমার পেছনে পেছনে উঠবে। কাটা দড়িটা এত দিনের রোদে বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই আর তেমন শক্ত নেই। ওটা ছিঁড়তে গেলে সময় নষ্ট হবে। ওটার ওপরেই কাছিটা যত শক্ত করে পারো বাঁধবে দুজন মিলে। যাও। পারবে তো?
–কিছছু ভেব না। শাঙ্কো দড়ির মাথাটা আলগা ফঁস দিল। কাঁধে ঝুলিয়ে গাছটা বেয়ে উঠতে লাগল। এখানে ওখানে ডাল ধরে ধরে। সিনাত্রাও ওর দেখাদেখি সেইভাবে উঠতে লাগল। জাহাজে জাহাজেই তো জীবন কেটেছে এতদিন। শক্ত বাঁধনের কৌশল ওরা ভালভাবেই জানে। অল্প সময়ের মধ্যেই বাঁধা শেষ করে নেমে এল।
এবার কাছিটা নিয়ে গিয়ে কিছু দূরে নদীতীরে আমাদের নৌকোটা বাঁধা আছে সেই নৌকোয় চড়ে ও পারে চলে যাও। এখন ভাটার টান চলছে। কাজেই নৌকো স্রোতের টানে ঘূর্ণির দিকে যাবে না। ওপারে পৌঁছে দু’জন কাছিটা নিয়ে ঐ চেস্টনাট গাছের নিচে যাবে। কাছির থোকা কোমরে আগা করে বেঁধে চেস্টানাট গাছটায় উঠবে। এপারের গাছটার প্রায় সমান উচ্চতায় কাছিটা শক্ত করে বাঁধবে। তারপর নেমে আসবে। তখন নদীর ঐ ঘূর্ণিটার ওপর দিয়ে কাছিটা টান টান হয়ে থাকবে। যাও দেরি করো না। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল।
দুজনে ঝোঁপঝাড় পার হয়ে নৌকার কাছে এল। দুজনের হাতে তখন কাছিটা ধরা। নৌকা বাঁধার দড়িগুলি খুলে দুজন নৌকা ভাসিয়ে দিল। কিছুদূর ঘূর্ণিটা দেখা গেল। কিন্তু ভাটার টানে নৌকো ওদিকে গেল না। ওপারে নৌকা পৌঁছল। শাঙ্কো কাছিটা নিয়ে বসল। সিনাত্রা ওকে পেছনে কাছি ধরতে সাহায্য করল। দুজন কাছি নিয়ে চেস্টনাট গাছটায় কাণ্ড বেয়ে বেয়ে উঠল। দেখল–ফ্রান্সিসের অনুমান সত্য। একই উপায়ে কাটা কাছি বাঁধা। দুজনে কাণ্ড পেঁচিয়ে কাটা দড়ির ওপরে খুব শক্ত করে কাছিটা বাঁধল। দু’জন নেমে এল। দেখল এপারে মাত্র একটাই চেস্টনাট গাছ। ওপারের তুলনায় এ পারটা অনেক সমতল। সবুজ ঘাসে ঢাকা। এবার নদীর দিকে তাকিয়ে দেখল ঘূর্ণিটার ওপর দিয়ে কাছিটা টানা টান বাঁধা হয়ে গেছে।
এ পারে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলল ইবু সালোমদের দেহরক্ষীরা এভাবেই দু’ধারের গাছদুটিতে বেঁধেছিল। কাজেই নিচে ঘূর্ণির ভয় ছিল না। আমরাও দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে ঘুর্ণির ওপর দিয়ে ওপারে চলে যেতে পারবো। নিরাপদে।
–তাহলে তো হাত ফসকে নিচের ঘুণীর জলে পড়তে হবে না।
–ঠিক তাই। প্রথমে ঝুলে ঝুলে আমিই যাব। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি চমকে উঠে বলল পাগল হয়েছে? ঘূর্ণির ওপর দিয়ে এভাবে যাওয়া? হাত ফসকে গেলে তো। ওকে থামিয়ে দিয়ে ফ্রান্সিস বলল–আমার অভ্যাস আছে এটা তো তুমি জানো। কাছি দড়ির রকমসকম ও বহন ক্ষমতা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। উপায় নেই। এভাবে না গিয়ে। এ পারটা তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়ে গেছে। বাকি রয়েছে ওপারটা। শাঙ্কো সিনাত্রা ওপারে আছে। আমরাও পর পর কাছি তে ঝুল ঝুল করে ওপারে যাব। তুমি পারবে না। তুমি কাউকে নিয়ে নৌকায় চড়ে ওপারে যাও। কাজে নেমে পড়ো। কিন্তু সবাই পার হ’ল না হয়–ফ্রান্সিস বলে উঠল–হ্যারি–এখনও শেষ রহস্যের সমাধানটা বাকি। ইবু সালোমন নিশ্চয়ই কোন না কোন ব্যবস্থা রেখেছিল যাতে প্রয়োজন হলে স্বর্ণভাণ্ডার ভরা সিন্দুকটা তুলে আনা যায় সহজে। সেই সুত্রটাই খুঁজে বের করতে হবে। কথাটা শেষ করেই ফ্রান্সিস গাছটায় উঠতে শুরু করল। কাটা গাছটার কাছে উঠে ঝোলানো কাছিটা ধরে দু’তিনবার খুব জোরে হ্যাঁচকা টান দিল। বুঝল কাছিটা বেশ শক্ত করেই বাঁধা হয়েছে। এবার দুলতে-থাকা কাছিটা ধরে– ফ্রান্সিস ঝুলে পড়ল। নিপুণভাবে হাত দুটো পর পর ছেড়ে ধরে দুলতে দুলতে ওপারে দিকে চলল। ঘূর্ণির ওপরটায় আসতেই বুঝল নিচ থেকে যেন একটা হাওয়া ওপরের ও দিকে উঠে আসছে। ফ্রান্সিস কাছিটা শক্ত হাতে ধরে জায়গাটা আস্তে আস্তে সাবধানে পার হল। বেশ হাঁপানো গলায় চিৎকার করে বলল-ঘূর্ণির ঠিক ওপর দিয়ে সাবধানে পার হবে। এখানকার পাক-খাওয়া হাওয়াটা বিপজ্জনক।
আস্তে আস্তে একসময় ও পারে চলে এল। গাছের কাণ্ডটা দু হাতে জড়িয়ে ধরে একটুক্ষণ দম নিল। তারপর কাণ্ড ডাল ধরে নিচে মাটিতে নেমে এল। দেখল গাছটার গোড়ায় প্রায় হাতখানেক উঁচু পাথরের টুকরোর স্তূপ। বড় টুকরোও আছে। যেন কেউ সাজিয়ে রেখেছে। এটা প্রকৃতির খেয়াল হয়ে নি। ও ভুরু কুঁচকে ভাবল–এরকম ছোট বড় পাথরের টুকরো কারণ কি? কোন বাচ্চা ছেলেমেয়ের কাণ্ড এটা নয়। এভাবে পাথরের টুকরো সাজিয়ে রাখার কারণ কি? ততক্ষণে শাঙ্কো আর সিনাত্রা ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একটুক্ষণ ঘাসের ওপর বসে বিশ্রাম নিয়ে ফ্রান্সিস বলল-কেমন এই চেস্টনাট গাছের তলাটা আর চারপাশ খুঁটিয়ে দেখতে হবে। একটাই গাছ, ঝোঁপজঙ্গলও বেশি নেই। খোঁজা শুরু কর। ইবু সালোমনের দেহরক্ষীরা এপারে নিশ্চয়ই এসেছিল আর চুপ করে বসে থাকে নি। এখানেও ওরা কিছু করেছে। কী করেছে সেটা খুঁজে দেখতে হবে। সমস্ত জায়গাই তন্ন তন্ন করে খোঁজো। বেলা বাড়ছে।
ওপারে একটা পাথরের ওপর বসে রব্বানি দূর থেকে ফ্রান্সিসদের কাণ্ডকারখানা দেখছিল। ওরা ওপারে কী করছে বোঝা যাচ্ছে না। ওপারে ওর কোন যোদ্ধাও। নেই। রব্বানি দ্রুত উঠে বসল। ও সজাগ হল। যদি ঐ তিনজন ভাইকিং সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায় ইবু গ্যাব্রিয়েল ওদের গর্দান নেবে। ও তাড়াতাড়ি হ্যারির কাছে এল। রব্বানি বলল–ওপারে আমাদের কোন যোদ্ধা এ যাবৎ যায় নি। তোমাদের বিশ্বাস নেই। আমি দুজন যোদ্ধাকে নিয়ে ওপারে যাবো।
বেশ। চলুন নৌকোয় চড়ে আমিও একসঙ্গে যাবো।
রব্বানি দু’জন যোদ্ধাকে ইশারায় ডাকল। ওরা কাছে এলে বলল
–চলো ওপারে যাবো। তোমরা কাছিতে ঝুলে ঝুলে যাবে।
–ওভাবে কি যাওয়া যাবে? একজন যোদ্ধা বলল।
–ঐ ভাইকিংটা গেল কী করে?
–ওর বোধহয় জীবনের ওপর কোন মায়া দয়া নেই। যোদ্ধাটি বলল।
–মরুক গে। চলো নৌকোয় চড়েই যাবে। রব্বানি বলল। হ্যারি আর রব্বানিরা ঝোঁপঝাড় ভেঙে পাথরের চাঁইয়ের গাছের মোটা মোটা শেকল এড়িয়ে নৌকাগুলির দিকে চলল।
–কিন্তু কী খুঁজব? শাঙ্কো ঠিক বুঝতে না পেরে বলল।
–এমন কিছু যা প্রকৃতির সৃষ্টি নয়। মানুষের হাতে গড়া। গাছটার গোড়ায় পাথর-টুকরো কেমন যেন মানুষের হাতে সাজিয়ে রাখা। অবশ্য এলোমেলোভাবে। নাওখোঁজা শুরু করো।
তিনজনে চারপাশ মাথা নিচু করে খুঁজতে লাগল। ততক্ষণে আরো কয়েকজন ভাইকিংও কাছি ঝুলে ঝুলে এপারে চলে এসেছে। সবাই মিলে খোঁজা শুরু হল। তারপরই হ্যারি এল। সঙ্গে রব্বানির দুজন যোদ্ধা সবাই মিলে খোঁজা শুরু হল। ঝোঁপঝাড় টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হল। হঠাৎ শাঙ্কো নদীর জলের কাছাকাছি দেখল ওখানেও টানা পাথরের ছোটো-বড়ো টুকরো যেন একটানা এই গাছটার দিকে এসে শেষ হয়ে গেছে। ও গলা চড়িয়ে ডেকে বলল–ফ্রান্সিস, এদিকে দেখো তো। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে এল। দেখল পাথরের সারি যেখানে এসে শেষ হয়েছে সেখানে বালি-মেশানো মাটি কেমন যেন চেপে বসানো। ফ্রান্সিস বলে। উঠল–সবাই হাত লাগাও। পাথরের খণ্ডগুলো সরিয়ে ফেলো। দেখা যাক নীচে কী। আছে। ততক্ষণে হ্যারিও এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই ছুটে এসে হাত লাগাল। অল্পক্ষণের মধ্যেই পাথরখণ্ডগুলো সরিয়ে ফেলতেই দেখা গেল টানা গর্তমতো। গর্তের ওপরকার বালি মেশানো মাটি তুলে ফেলতেই দেখা গেল একটা মোটা কাছি। ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল–হ্যারি, রহস্য আর রহস্য নেই। এই কাছি দিয়ে সিন্দুকটা বেঁধে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ঐ ঘূর্ণির মধ্যে। পরে প্রয়োজনে যাতে সিন্দুকটা টেনে তুলে আনা যায়।
–বলো কী? শাঙ্কো প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।
–তাহলে তো এই দড়ি ধরে টানলেই ঐ সাংঘাতিক ঘূর্ণি থেকে সিন্দুকটা উঠে আসবে। হ্যারি বলল।
–অবশ্যই। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
তবে তো যে কেউ এসে এই কাছি টেনে সিন্দুকটা তুলে আনতে পারত। শাঙ্কো বলল।
–পারত যদি সে বুঝতে পারত এভাবে পাথরখণ্ড মানুষই সাজিয়েছে, প্রকৃতি নয়। এটা বুঝতে গেলে তাকে অন্তত আমার মতো বুদ্ধিমান হতে হবে। যাক গে, দেরি নয়। সবাই মিলে কাছিটা টেনে তুলে ফেলল।
সবাই কাছি টেনে তুলে ফেলল সবটা তুলতে দেখা গেল কাছির মাথাটা চেস্টনাট গাছের গোড়া পর্যন্ত গেছে। আর অনুমান নয়। চেস্টনাট গাছটার ঠিক গোড়ায় কাছিটা বেঁধে রাখা হয়েছে। তাই ওখানে পাথরখণ্ড দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল।
–তাহলে তো এখন সব পরিষ্কার হয়ে গেল। নিশ্চয়ই ঐ সিন্দুকের হাতল দুটোয় এই কাছিটা বেঁধে ওরা টানা কাছিতে ঝুলিয়ে এনে ঐ ঘূর্ণির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। ওরা সত্যিই দুঃসাহসী ছিল। কোনও সন্দেহ নেই। হ্যারি বলল। কাছি টানতেই বোঝা গেল ওটার সঙ্গে খুব ভারী কিছু বাঁধা আছে।
শাঙ্কোরা বারকয়েক টানতেই বুঝল, যে ভারী জিনিসটা বাঁধা আছে সেটা উঠে আসছে। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে কাছি ছেড়ে দিয়ে দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল–ফ্রান্সিস, কাছিটার সঙ্গেই সিন্দুকটা বাঁধা আছে। মারো টান।
হ্যারি হেসে বলল–ফ্রান্সিস, এত সহজে সিন্দুকটা উদ্ধার হবে ভাবিনি।
ফ্রান্সিস কিন্তু হাসল না। বলল–হ্যারি, সিন্দুকটা জলের তলা থেকে এখনও কিন্তু পারে নিয়ে আসতে পারোনি। পারলে বুঝব সফল হলাম। ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতে না হতেই কাছিটা ছিঁড়ে গেল। শাঙ্কোরা ভারসাম্য হারিয়ে এ ওর গায়ে গড়িয়ে গেল। ছেঁড়া কাছিটা জল থেকে উঠে এল। সবাই হতবাক।
-যাঃ। বিনোলা মুখে হতাশার শব্দ করে ঘাসে ঢাকা বালির ওপর বসে পড়ল। ছেঁড়া কাছিটা হাতে নিয়ে ভাইকিংরা এ ওর মুখের দিকে হতাশার ভঙ্গিতে তাকাল। হ্যারি ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–ফ্রান্সিস, এটা কী হল? এত মোটা কাছিটা–
-হ্যাঁ ছিঁড়ে গেল। কিন্তু কেন? কথাটা বলেই ফ্রান্সিস কাছির ছেঁড়া জায়গাটা মাটি থেকে তুলে খুঁটিয়ে দেখে বলল–বোঝাই যাচ্ছে কাছিটার এই জায়গাটা দীর্ঘদিন অত্যন্ত ধারালো কিছুর সঙ্গে ঘষা খেয়ে খেয়ে ছিবড়ে মতো বেরিয়ে গেছে। জোরে টান পড়তে একেবারে ছিঁড়ে গেছে।
জলের নীচে এমন কী ধারালো জিনিস থাকতে পারে? হ্যারি বলল।
–অনেক কিছু! বড় শামুকের ভাঙা খোল, কাঁচ বা পাথরের চাইয়ের ধারালো মাথা। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো আর স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধারের কোনও আশাই রইল না। শাঙ্কো বলে উঠল।
উঁহু। হাল ছাড়তে আমি রাজি নই। একটু সময় চাই। ছক কষতে হবে। কথাটা বলে ফ্রান্সিস ঘাসে-ঢাকা বালির ওপর বসে পড়ল। বন্ধুরা সব একজন দুজন করে এসে ফ্রান্সিসকে ঘিরে দাঁড়াল। হতাশায় ম্লানমুখ সকলেরই। এত কষ্ট করে এতদূর এগিয়ে এসে হার স্বীকার করতে হবে? ফ্রান্সিস দু’হাত হাঁটুতে রেখে মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নিস্তব্ধ চারিদিক। শুধু পাখপাখালির ডাক আর ঘূর্ণিরত পাক খাওয়ায় জলের শব্দ শোনা যেতে লাগল।
হঠাৎ ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল–দড়ির কুণ্ডলীটা নিয়ে এসো। শাঙ্কো আর সিনাত্রা কাঁধে দড়ির কুণ্ডলীটা নিয়ে ফিরে এল।
–দড়ি দিয়ে কী করবে? শাঙ্কো কিছু বুঝতে না পেরে বলল।
ঐ ঘূর্ণিতে নামতে হবে। ফ্রান্সিস দড়ির মুখটা বের করতে করতে বলল।
–সর্বনাশ! ফ্রান্সিস, এ তো আত্মহত্যা। হ্যারি ভীতস্বরে চেঁচিয়ে বলল।
–না হ্যারি। কাপুরুষ আত্মহত্যা করে। বীরপুরুষ লড়াই করে বেঁচে থাকে। এটা জীবনের ঝুঁকি। বলা যায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষা। এই ঝুঁকি নিতেই হবে। নইলে হার মেনে মাথা নিচু করে চলে যেতে হবে। সেই বৃদ্ধ অভিজ্ঞ নাবিক বলেছিল–ঘূর্ণির একেবারে নীচে ওপরের চক্করের দাপট থাকে না। সেখানে জল অনেক শান্ত থাকে। আজকে সেটা হাতেকলমে পরীক্ষার সময় এসেছে।
ফ্রান্সিস লম্বা দড়িটার একটা মাথা কোমরে দুটো প্যাঁচ দিয়ে বাঁধল। তারপর বলল–আমি দড়ির মাথাটা নিয়ে কাছিতে ঝুলে ঘূর্ণির ঠিক ওপরে যাব। ওখান থেকে ঘূর্ণির মধ্যে নামব। তারপর ঘূর্ণির পাকই আমাকে দ্রুত টেনে নিচে নামাবে। একেবারে নীচে অনেকটা শান্ত জলস্তর পাব। কোমর থেকে দড়ির মাথাটা বের করে ছেঁড়া কাছিটায় শক্ত করে বেঁধেই দড়িতে জোরে দুটো হ্যাঁচকা টান দেব। সঙ্গে সঙ্গে দড়ির অন্য মুখটা ধরে তোমরা সবাই মিলে আমাকে টেনে তুলবে। খুব সাবধান। এতটুকু দেরি করা চলবে না। জলের নীচে সাধারণ মানুষের চেয়ে আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারি। দেশের ডুবুরিদের কাছ থেকে এই কৌশলটা আমার শেখা আছে। আমার নিরাপত্তার কথা একেবারে ভাববে না। তাতে সময় নষ্ট হবে। তৈরি হও সবাই।
কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় ফ্রান্সিস চেস্টনাট গাছটায় উঠে পড়ল। তারপর কাছিটা ধরে ঝুলে পড়ল। হাত দুটো দিয়ে কাছি ধরে দুলতে দুলতে চলে এল ঠিক ঘূর্ণির ওপর। একটুক্ষণ দম নিল। তারপর দু’হাত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত হাঁটু দুটো দু’হাত দিয়ে বুকে চেপে ধরে মাথা নিচু করে ঘূর্ণির মাঝখানে পড়ল। মুহূর্তে প্রচণ্ড পাক খেয়ে মাথাটা ঘুরে উঠল। জোর পাক খেতে খেতে নীচে তলিয়ে গেল। হাত-পা খোলা থাকলে বোধহয় ছিঁড়ে বেরিয়ে যেত ঘূর্ণির প্রচণ্ড পাকে। ওর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। আশ্চর্য! নীচে জলের সেই প্রচণ্ড পাক নেই বললেই চলে। ফ্রান্সিস একটা বড় পাথরের মাথায় পা রাখল। জলের নীচেটা কিন্তু পুরোপুরি অন্ধকার নয়। ঘোলা জলের মধ্যে দিয়েও সূর্যের অল্প একটু আলো জলতল অবধি পৌঁছচ্ছে। সেই স্নান আলোয় ফ্রান্সিস দেখল ছেঁড়া কাছিটা ঐ পাথরের চাঁইয়ের মাথার কাছে পড়ে আছে। পাশেই একটা অন্ধকার গভীর খাদে কাছিটা নেমে গেছে। এই গহরের জন্যেই এখানে এরকম প্রচণ্ড ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়েছে। কোমর থেকে দড়ির মাথাটা বের করতে করতে দেখল পাথরের চাইয়ের মাথাটা উঁচিয়ে আছে। ভীষণ ধারালো। এখানে ঘষা খেয়ে খেয়েই কাছিটার ছিবড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাই জোর টান পড়তেই ছিঁড়ে গেছে। অভিজ্ঞ হাতে দ্রুত কাছিটার ছেঁড়া মাথায় দড়িটা শক্ত করে বেঁধে পাথরের ছুঁচোলা মাথা থেকে এক ঝটকায় দড়িটা সরিয়ে দিয়ে পরপর দুটো হ্যাঁচকা টান মারল ফ্রান্সিস। ওপরে দড়ি ধরে দাঁড়ানো শাঙ্কোরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠে দড়ি টানতে শুরু করল।
ফ্রান্সিস প্রাণপণে দড়িটা হাতে-পায়ে জোরে চেপে ধরে রইল। ঘূর্ণির মুখ থেকে অনেকটা সরে এসেছে বলে ঘূর্ণির প্রচণ্ডতা এখানে কম। এর পাক খাওয়া জলের টান চোখ বুজে সামলাতে লাগল। চোখের সামনে একটা কালচে ভাব বাড়তে লাগল। মাথা ঘোরা বেড়ে গেল। কিন্তু ফ্রান্সিস প্রাণপণে দড়ি চেপে ধরে রইল। এখন এই দড়িই একমাত্র ভরসা। ঘূর্ণির পাক তখনও ওকে নীচে টানছে।
দম ফুরিয়ে আসছে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। তবু ফ্রান্সিস ভয় পেল না। চোখ বুজে দড়ি চেপে ধরে রইল। মুঠি আলগা করল না। প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ফ্রান্সিস জলের ওপর ভুস করে মাথা তুলল। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল। ফ্রান্সিসকে জলের উপরে মাথা তুলতে দেখেই শাঙ্কোরা কয়েকটা জোর টান দিয়ে ফ্রান্সিসকে তীরের বালুর ওপর টেনে আনল। কোমরের ওপরটা তীরের বালিতে কোমর থেকে পা জলের মধ্যে। হ্যারি দ্রুত ছুটে এসে ফ্রান্সিসের মাথার কাছে বসল। মাথাটা আস্তে কোলে তুলে নিয়ে উৎকণ্ঠার সুরে বলে উঠল– ফ্রান্সিস, ফ্রান্সিস, ভালো আছ তো? ফ্রান্সিস চোখ খুলল। দেখল বন্ধুদের ঝুঁকে পড়া মুখগুলো কেমন নড়ছে। মাথা ঘুরছে তখনও। ও চোখ বুজল।
–ফ্রান্সিস, শরীর ঠিক আছে? হ্যারি ব্যাকুলকণ্ঠে জিগ্যেস করল।
ফ্রান্সিস চোখ বোজা অবস্থায় আস্তে ডান হাত তুলে মাথায় ছুঁইয়ে আঙুল ঘোরাল। তার মানে ওর মাথা ঘুরছে।
–এক্ষুনি মাথা ঘোরা কমবে। তুমি চোখ বুজে বিশ্রাম করো। ভেন তো নেই। ভেন থাকলে ওষুধ দিতে পারত। হ্যারি বলল।
কারো মুখে কথা নেই বালি ঘাসের মধ্যে কেউ কেউ বসে আছে, কেউ কেউ শুয়ে পড়েছে। শুধু শাঙ্কো ফ্রান্সিসের শিয়রের কাছে একঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পারে তুলে আনা কাছিটার কাছে কেউ গেল না। কাছিটা দিয়ে ফ্রান্সিস সিন্দুকটা বাঁধতে পেরেছে কিনা এই নিয়ে কেউ ভাবলই না। কতক্ষণে ফ্রান্সিস সুস্থ হবে–এই একটাই দুশ্চিন্তা সবার।
ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুলল। হ্যারি ঝুঁকে পড়ে জিগ্যেস করল– মাথা ঘোরাটা কমেছে? ফ্রান্সিস দুর্বল ভঙ্গিতে আস্তে মাথাটা কাত করল। হ্যারি বলে উঠল–শাঙ্কো, ফ্রান্সিসের মাথা-মুখ আস্তে আস্তে মুছে দাও। এতক্ষণ জলে ছিল।
শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে নিজের জামাটা খুলে ফেলল। হাঁটু গেড়ে বসে ফ্রান্সিসের মুখ কপাল মাথায় আস্তে আস্তে একটু চাপ দিয়ে মুছে দিতে লাগল। মোছা শেষ হলে ফ্রান্সিসের বোধহয় একটু ভালো লাগল। ম্লান হাসল। শাঙ্কো তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে। ডাকল–সিনাত্রা, এখানে এসো। ফ্রান্সিসকে জল থেকে তুলে আনব। তুমি ধরো।
তারপর দুজনে আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসকে টেনে বালি ঘাসের ওপর তুলে আনল। এবার শাঙ্কো আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের জামাটা টেনে বুকের কাছে তুলে দিল। তারপর বুক-পেট মুছিয়ে দিতে লাগল। জলে ভিজে শরীর কেমন সাদাটে হয়ে গেছে। তারপর পা মুছিয়ে দিল। বেশ আরাম হল ফ্রান্সিসের। ও হাত দিয়ে ছেঁড়া কাছিতে বাঁধা দড়িটার দিকে ইঙ্গিত করল। হ্যারি বুঝল সেটা বলল-জাহান্নামে যাক ঐ সিন্দুক। আগে তুমি সুস্থ হও। ফ্রান্সিস চোখ বুজল!
মাথার ওপরে সূর্য তখন পশ্চিম আকাশের দিকে অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে। সারাদিন এত খাটুনি গেছে। সবাই উপোসী। কিন্তু কেউ এই নিয়ে একটি কথাও বলল না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ফ্রান্সিস নড়েচড়ে উঠল। আস্তে ডাকল–হ্যরি!
হ্যারি তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ল।
–কাছিতে বাঁধা–দড়িটা-টানো। ফ্রান্সিস থেমে থেমে বলল।
–আগে তুমি সুস্থ হও তো তারপর। হ্যারি প্রায় ধমকের সুরে বলল।
উঁহু, হাতে একদম সময় নেই। ইবু গ্যাব্রিওল মোটেই ভালো মানুষ নয়। ফ্রান্সিস দম নিয়ে নিয়ে নিম্নস্বরে বলল।
হ্যারি শাঙ্কোর দিকে তাকাল। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল-ভাইসব, এসো। দড়ি টেনে সিন্দুকটা তুলতে হবে। হাত লাগাও। কিন্তু খুব আস্তে আস্তে টানতে হবে। আবার না দড়ি ছিঁড়ে যায়।
শুয়ে-বসে থাকা ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে এল। কাছিতে বাঁধা দড়িটা আস্তে আস্তে টানতে লাগল। নীচের ধারালো মাথাওয়ালা পাথরের চাইটা এড়িয়ে ফ্রান্সিস কাছিটা সরিয়ে রেখে এসেছিল। দড়ির ঘষা খাওয়ার আশঙ্কা ছিল না। ছিঁড়ে যাবার আশঙ্কাও ছিল না। আস্তে আস্তে সিন্দুকটা টেনে এনে তীরে তোলা হল। ফ্রান্সিসের অনুমান ঠিক। চারপাশে এখানে-ওখানে সোনার গিল্টি করা সিন্দুকটার ওপরেও একটা মোটা লোহার হাতল। দু’পাশের লোহার হাতল দুটোও বেশ মোটা। হ্যারি বুঝল ইবু সালোমন বেশ ভেবেচিন্তেই এসব করেছিলেন। এই লোভাত নদীর তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে তিনি মাঝে মাঝে আসতেন। হয়তো তখনই এই পরিকল্পনা করেছিলেন। অসৎ দুরাচারী পুত্রকে তিনি অনেকদিন আগেই চিনেছিলেন।
সিন্দুকটার কাছে গিয়ে সবাই ভিড় জমিয়েছে। সামনের কড়ায় একটা বড় তালা জ্বলছে। শাঙ্কো তালাটা ধরে টানাটানি করল। কিন্তু তালা খুলল না। তখন ও কোমর থেকে বড় ছোরাটা বের করল। তালা লাগানো কড়াটায় ছোরাটা ঢুকিয়ে প্রাণপণে চাড় দিতে লাগল। চাড় দিতে দিতে জলে ভেজা জংধরা কড়াটা বেশ খানিকটা আলগা হল। এবার কড়ার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে জোরে হ্যাঁচকা টান। কড়াটা আরো আলগা হল। হাঁপাতে হাঁপাতে শাঙ্কো বলল–তোমরা একে একে কড়াটা টানতে থাকো। একজন একজন করে বন্ধুরা কড়া ধরে টান মারতে লাগল। একসময় কড়াটা সশব্দ খুলে এল। শাঙ্কো ডালার ওপরের কড়া ধরে টান দিল। ডালা খুলল না। শাঙ্কো আবার টান দিল। আবার–আবার। শেষ পর্যন্ত ডালা খুলে গেল। বিকেলের নিস্তেজ আলোতেও ঝিকিয়ে উঠল আরবী স্বর্ণমুদ্রাগুলি। বেশ কিছু হিরে বসানো স্বর্ণালঙ্কার ও চুনি-পান্না একপাশে রয়েছে দেখা গেল। ভাইকিং বন্ধুরা উল্লাস ধ্বনি তুলল–ও হো হে।
ততক্ষণে ফ্রান্সিসকে উঠে বসতে দেখে ওরা ছুটে গিয়ে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল।
–দেরি নয়। এখনই ফিরব। ফ্রান্সিস ঝোলা সিন্দুকটার দিকে একবার তাকিয়ে নিল। এরকম বহুমূল্য গুপ্তধন ওর কাছে তো নতুন কিছু নয়।
রব্বানিরা তখন ছুটে এল। ভিড়ের মধ্যে এসে ওরাও অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ঝিকিয়ে ওঠা কুফি অলঙ্কারের দিকে। রব্বানি জীবনের কোনদিন এত সোনার ভাণ্ডার অলঙ্কার দেখেনি। হঠাৎ রব্বানি হাসলেন উল্লাস দু’হাত ওপরে তুলে নাচতে লগাল। ভাইকিংরা আনন্দে ধ্বনি তুললও হো হো। ওরা অবশ্য ফ্রান্সিসের উদ্ধার করা এরকম স্বর্ণভাণ্ডার আগেও দেখেছে। কাজেই ওরা খুব আশ্চর্য হল না। ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরাও বুঝল ফ্রান্সিস স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করেছে। ওরাও ও-হো-হো হো ধ্বনি তুলল। রব্বানি তখনও নেচেচলেছে। কাছে এসে মৃদু হেসে হ্যারি বলল ঐ সিন্দুকের একটা কুফিও কিন্তু আপনি পাবেন না। রব্বানি নাচা থামাল। সত্যই তো এবারই তো গ্যাব্রিয়েল নিয়ে নেবে দয়া করে দু’চারটে স্বর্ণমুদ্রা দিতে পারে। এবার ও ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল- তোমরা কিন্তু একটা কুফিও পাবে না।
–তা তো বটেই। ফ্রান্সিস হেসে বলল–আবার আপনারাও কেই পাবেন না। এত স্বর্ণসম্পদ দেখে ইবু গ্যাব্রিয়েল সম্পদের অংশ যে দাবি করবে সেই মরবে।
–এই সিন্দুক আমরা আমাদের নৌকায় তুলে নিয়ে যাবো। বেশ গম্ভীর গলায় রব্বানি বলল। –বেশ। আপনারা খুশি হলে আমরাও খুশি। রব্বানি গলা চড়িয়ে বলল–অ্যাই–হাতলাগা। এই সিন্দুক আমাদের নৌকায় তোল।
উল্লাসে যোদ্ধা কজন এক লাফে এসে। সিন্দুকটা ধরল। তারপর আস্তে আস্তে কাঁধে তুলে ওদের নৌকোর দিকে চলল। উৎসাহের চোটে রব্বানিও নিজের পদমর্যাদা ভুলে গিয়ে কাঁধ লাগল।
–চলো হ্যারি ওপারে যাই। আমাদের কাজ শেষ। ফ্রান্সিস ওদের নৌকা যেখানে ভেড়ানো রয়েছে সেদিকে চলল। সিনাত্রা শাঙ্কো এগিয়ে এল। এত ভেবে চিন্তে এত কষ্ট করে ওরা এই সম্পদ তুলল সেটা ওদের চোখের সামনে দিয়ে বিন্দুমাত্র পরিশ্রম না করে রব্বানিরা নিয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস ওদের মুখ দেখেই বুঝল ওরা কি বলতে চায়। সেটাকে আমলে না দিয়ে ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো–যে বাড়তি কাছি দড়ি পড়ে আছে সে সব নিয়ে এসো। এবার নৌকোয় চড়েই ওপারে যাবো। ওসব কখন কি কাজে লাগে। যাও। শাঙ্কো আর সিনাত্রা গিয়ে কাটা কাছি দড়ি নিয়ে এল।
–নৌকায় চলো বিকেল হয়ে এসেছে। কাল রাতে আমাদের কারও ভালো ঘুম হয় নি। ভীষণ ক্লান্ত আমরা। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই নৌকোর দিকে চলল। যেতে যেতে এবার হ্যারি বলল–এত স্বর্ণমুদ্রা ঐ পিতৃহন্তাকে দিয়ে দেবে ফ্রান্সিস?
–কী করবে বলল হ্যারি? এই ভাণ্ডার নিয়ে না গেলে আমাদের জীবন বিপন্ন হবে। রব্বানি আমাদের সহজে পালাতে দেবে না। পিছু ধাওয়া করবে। এত স্বর্ণসম্পদ দেখে ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো আমাদের পিছু নেবে। ধরা পড়বই। ভুলে যেওনা ওরা সশস্ত্র। আমাদের অস্ত্র একমাত্র শাঙ্কোর ছোরা। এমনি ওদের মানিয়ে চললে আমরা প্রাণে রক্ষা পাবো। কিন্তু পালাতে গিয়ে ধরা পড়তেই হবে। রব্বানি ঠিক আমাদের হত্যা করবে। আর একটা কথাও তো মানতে হবে। মারিয়া আর বন্দী বন্ধুদের কী অবস্থা হবে তা এই নরপশুর হাতে। হ্যারি হাঁটতে হাঁটতে ভাবল সত্যি এছাড়া কোন উপায় নেই। ভেবে দেখ–আমরা তো এই স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করতে আসি নি। স্বর্ণভাণ্ডার তো একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে ইবু গ্যাব্রিয়েলরই। ওরই তো অধিকার এই সম্পদে। আমাদের তো এই সম্পদের ওপর কোন অধিকারই নেই।
নৌকোয় চড়ে সবাই ওপরে এল। সব ভাইকিং বন্ধুরা নিঃশব্দে নৌকোয় উঠল। সিন্দুক নিয়ে সামনে রইল রব্বানির নৌকা। আজ শেষ বিকেল। নৌকোগুলো চলল ইতেরাস গ্রামের দিকে।
ইরেকাবা গ্রামের ঘাটে গিয়ে সব নৌকো ভিড়ল। সেই সকালে আধপেটা খেয়ে গিয়েছিল। এখন ক্ষুধাতৃষ্ণায় সবাই কাতর ভীষণ ক্লান্তও। সিন্দুকটা রব্বানি দুজন যোদ্ধার জিম্মায় রেখে গ্রামের দিকে চলল। গ্রামে ঢুকে ক্লান্তিতে ফ্রান্সিসও শুয়ে পড়ল। পাশে বসা হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস এখন কী করবে?
এখন বিশ্রাম অবশ্য প্রয়োজন। রাতের খাওয়া সেরেই নৌকো ভাসিয়ে দেব। ফ্রান্সিস ক্লান্ত স্বরে বলল।
–কিন্তু রব্বানিরা যদি রাতটা এখানেই থাকতে চায়।
-থাকবে। আমরা কোনমতেই থাকবো না। একটা কাজ কর-বৃদ্ধকে দুটো স্বর্ণমুদ্রা দাও আর বলল যে বেশি করে যেন রুটি তৈরি করে। সবাই ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত। পেট পুরে খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেই বেশ তরতাজা হয়ে যাবো। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি চলে গেল বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলতে। একটু রাত হতেই সবাই শুনো পাতা উঠনে পেতে খেতে বসল। যথেষ্ট রুটি করা হয়েছে। মাছের তো অভাবই নেই।
খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–সবাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নাও। তারপর আমরা নৌকা ভাসাবো। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবো না। রব্বানি এসে হ্যারিকে বলল–আমরাও আপনাদের সঙ্গে একসঙ্গে ফিরবো বেশ। চলুন। হারি বলল।
নৌকাগুলো ছেড়ে দেওয়া হল। আজ আকাশ–জ্যোৎস্না উজ্জ্বল। ফ্রান্সিসের ক্লান্তি অনেকটা কেটেছে। ও নৌকায় গুটিয়ে শুয়ে রইল। তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। এই একই আকাশ তো ওদের দেশেও। তবে ওদের দেশের আকাশের জ্যোত্সা এত উজ্জ্বল হয়। শীতের দেশ। কিন্তু এই চিন্তার মধ্যে একটা চিন্তা কিছুতেই ওর পিছু ছাড়ছিল না। বেশ কষ্ট করেই তো স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার হল। এই পরিশ্রম ও বিশেষ গায়ে মাখে না। কিন্তু চিন্তাটা হ’ল ইবু গ্যাব্রিয়েল তো স্বর্ণভাণ্ডার পেলেই ওদের সম্বন্ধে আর কোন আগ্রহই থাকবে না। ঐ লোকটাকে বিশ্বাস নেই। বহু আকাঙিক্ষত স্বর্ণভাণ্ডার পেলে ওর মতো লোভী নীচ মানুষ কী চেহারা ধরবে সেটা ভেবেই ফ্রান্সিসের মন ভীষণ উদ্বেগকাতর হল। পাশেই বসেছিল হ্যারি। ও তো ভালো করেই চেনে ফ্রান্সিসকে। সহজেই বুঝে নিল–ফ্রান্সিস জেগে আছে বটে কিন্তু গভীরভাবে কিছু ভাবছে। তাই ডাকল– ফ্রান্সিস?
–হুঁ।
–নিশ্চয়ই খুব চিন্তায় পড়েছ।
–স্বাভাবিক। স্বর্ণভাণ্ডার পেয়ে যদি ইবু গ্যাব্রিয়েল আমাদের শর্ত অস্বীকার করে।
–অসম্ভব নয়। তবে এতদিন ধরে যে গোপন স্বর্ণভাণ্ডারের চিন্তায় উদ্ধার করে নিজের হাতে পাবার জন্যে চেষ্টা করেছে নিজের পিতাকে হত্যা করেছে তা পেয়ে হয়তো লোকটা উদার হয়ত হতেই পারে। হয়তো আমরা বাঁচলাম কি মরলাম তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাববে না। হয়তো আমরা আজ ওর কাছে বাতিল হয়ে যাবো।
–সেটা হলেই মঙ্গল। একটু ভেবে ফ্রান্সিস বলল
–আমি স্থির করেছি–তুমি আর আমি রব্বানীর সঙ্গে প্রথমে ইবু গ্যাব্রিয়েলের জাহাজে যাবো। কথা বলবো। ওর মনোভাবটা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারবো। যদি বুঝি ও শর্ত মানবে না তাহলে পালাবার ছক কষবো।
–দেখা যাক। তোমার অনেক খাটুনি গেছে। অনেক চিন্তাভাবনা গেছেই। আপাতত বিশ্রাম করো। পারো তো ঘুমাও।
অসম্ভব। বন্ধুরা মুক্তি পেলে তবেই আমি নিশ্চিন্তে ঘুমুবো। নিজেদের জাহাজ। বন্ধুদের মধ্যে পরিচিত পরিবেশের মধ্যে।
নিজেদের জাহাজের সঙ্গে বাঁধাইবু গ্যাব্রিয়েলের জাহাজের কাছে যখন নৌকোগুলো পৌঁছল তখন সকাল হয়ে গেছে। চারদিক রোদে চনমন করছে। কাছাকাছি আসতে দেখল জাহাজের রেলিঙ ধরে মারিয়া আর বয়স্ক ভেন দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–শাঙ্কো তোমরা আমাদের জাহাজে গিয়ে ওঠো। প্রথমেই মারিয়াকে গিয়ে বলবে আমরা সবাই সুস্থ। স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার হয়েছে। আমাদের কাজ শেষ করে আমি আর হ্যারি ইবু গ্যাব্রিয়েলের জাহাজে উঠবো। তাড়াতাড়িই নিজেদের জাহাজে ফিরে আসব। মরিয়া যেন কোনরকম দুশ্চিন্তা না করে।
রব্বানিদের নৌকোর পেছনে পেছনে ফ্রান্সিস আর হ্যারির নৌকো নিয়ে চলল। ইবু গ্যাব্রিয়েলে দেখা গেল জাহাজের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি আসতে রব্বানি নৌকায় উঠে দাঁড়িয়ে সিন্দুকটা দেখিয়ে বার বার গলা জড়িয়ে বলতে লাগল–মাজার–স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করে এনেছি। এতক্ষণে ইবু গ্যাব্রিয়েলের উদ্বিগ্ন মুখে হাসি ফুটল। জাহাজের যোদ্ধারাও আনন্দে চিৎকার করে উঠল। শূন্যে ভোলা তরোয়াল ঘোরাতে লাগল।
এবার নৌকো থেকে সিন্দুক তোলার জোড়জোর শুরু হল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি যখন দড়ির সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে উঠল সিন্দুকের সামনে তখন ইবু গ্যাব্রিয়েল প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে সিন্দুকটার দিকে তাকিয়ে আছে। যোদ্ধারাও চারপাশে এসে জড়ো হয়েছে। সবাই খুশিতে আটখানা।
রব্বানি এগিয়ে গিয়ে সিন্দুকের ডালা এক হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল। হাজার হাজার স্বর্ণমুদ্রা সোনা হীরে মুক্তো বসানো গয়নাটা উজ্জ্বল রোদ পড়তে বিজিয়ে উঠল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। হ্যারি গলা নামিয়ে ডাকল ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস ওর দিকে তাকাল। এখন কথা বলতে যেও না। ইবু গ্রাবি ফেলের কানেই যাবে না কোন কথা। ওর প্যান্ড। খুশির জোয়ার ভাটা পড়তে দাও। দুজনই চুপ করে দাঁড়িয়ে যোদ্ধাদের আনন্দাশ্লাশ দেখতে লাগল। ইবু গ্যাব্রিয়েল হাসিমুখে চারদিকে তাকাতে লাগল।
-রব্বানি–কী করে উদ্ধার করলে? হাসিমুখে ইবু গ্যাব্রিয়েল বলল।
–এই লোকটা। ভীষণ দুঃসাহসী। ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে রব্বানি বলল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে বলল–মান্যবর-কয়েকটা কথা ছিল। ইবু গ্যাব্রিয়েল হাত নেড়ে বলে উঠল।
পরে এমন সর রব্বানির দিকে তাকিয়ে বলল–সিন্দুক আমরা ঘরে নিয়ে রাখো একটা বুফিও যেন কেউ না নেয়। আর কাল একা তুমি ছাড়া আর কেউ আজ্ঞে না জানিয়ে আগে ঘরে ঢুকবে না।
–মান্যবর এটা তো আপনার বরাবরের হুকুম। রব্বানী ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে ইবু গ্যাব্রিয়েল বলল–তোমরা কিন্তু একটা কুফিও চাইবে না।
–এ কথা তো আমি আগেই বলেছি। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল।
–তাহলে কী বলতে এসেছো?
–আপনার সঙ্গে একটা শর্ত ছিল। ইবু গ্যাব্রিয়েল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে।
–ফ্রান্সিসের শর্ত? কী শর্ত?
–এই শর্ত যে স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারলে আর আপনাকে দিলে আপনি আমার বন্ধুদের মুক্তি দেবেন।
–ও। তাই নাকি? ঠিক আছে। এই নিয়ে পরে কথা হবে।
–পরে না। এক্ষুনি। ফ্রান্সিস দৃঢ়স্বরে বলল। ইবু গ্যাব্রিয়েল কড়া চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।
–ঠিক আছে। স্বর্ণভাণ্ডার তো পেয়ে গেছি। বিদেয় হও সব। রব্বানিকে বলল–যাও ঐ ভিখিরিগুলোকে ছেড়ে দাও।
রব্বানি চলল সিঁড়িঘরের দিকে।
–হ্যারি-তুমি যাও। কয়েদঘরের ঐ জঘন্য পরিবেশে বন্ধুদের দেখলে আমার সহ্য হয় না।
–বেশ। হ্যারি চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরেই মুক্ত বন্দীরা ডেকে উঠে আসতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল সবারই চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। পরনের পোশাক নোংরা হয়ে গেছে। কয়েকজনের পোশাক ছিঁড়ে গেছে। ওরা কয়েকজন ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–আর এখানে না। আমাদের জাহাজে চলো। ওরা কেউ আর নৌকায় নেমে যাওয়ার আগ্রহ দেখাল না। ছুটে গেল হালের দিকে বাঁধা দাড়িতে ঝুল খেয়ে নিজেদের জাহাজের ডেকএ গিয়ে উঠল। হ্যারি বরাবরই দুর্বল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে নৌকোয় চড়ে নিজেদের জাহাজের ডেক উঠে এল। মারিয়া হাসতে হাসতে ছুটে এল। সত্যি মারিয়ার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেছে। চোখমুখ শুকনো মাথার চুল উড়ে উড়ো। অশান্ত মন শান্ত হল। মারিয়া এসে ওর হাত চেপে ধরল। ফ্রান্সিস হেসে বলল–মারিয়া–এক কাজ কর। বন্ধুদের অবস্থাতো দেখছ। শিগগির ওদের স্নান করার ব্যবস্থা করো। তারপর ভাল পোশাক পরে নিতে বললো। রাঁধুনি বন্ধুদের তাড়াতাড়ি রান্নার ব্যবস্থা করতে বলো। বন্ধুরা তখন শাঙ্কো আর সিনিত্রার কাছে গুপ্তধন উদ্ধারের কথা শুনছে। মারিয়া কাছে এসে বলল
–গল্প পরে হবে। আগে স্নান করে নতুন পোশাক পরে নাও। এসো সবাই।
–ভাইসব তোমাদের শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেছে, হ্যারি বলল।
অসুখেই ভুগেছে অনেকে। তবে ভেন দু’বেলা ঐ জাহাজে গিয়ে ওষধু দিয়েছে। রাজকুমারীও আমাদের সেবা শুশ্রূষা করেছেন। এক ভাইকিং বন্ধু বলল।
শাঙ্কো ছোরা বের করে পোঁচ দিয়ে দিয়ে ইবু গ্যাব্রিয়েলের জাহাজের বাঁধা দড়ি কেটে দিল। একটা ঝাঁকুনি খেয়ে জাহাজ সরে এল। বিলোনো ততক্ষণে শেকল তুলে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ বেশ দূরে চলে এল। চলল মাঝ সমুদ্রের দিকে। চারদিকে ঝলসানো রোদ। সমুদ্রের ঢেউও আনেকটা শন্ত। সব পাল খুলে দেওয়া। হল। ফ্লেজার জাহাজ চলল দ্রুত বেগে। স্বদেশের দিকে।
Anik
দেশে যাওয়ার কাহিনি টা পড়তে পারলে ভালো লাগতো।