‘তাহলে বলবে না ডকুমেন্টগুলো কোথায় রেখেছ?’ বলল রাগে চোখ মুখ লাল করে এক সারিতে তিনটি চেয়ারে বসা তিনজনের মাঝের জন সামনে হাঁটু ভেঙে দাঁড়ানো তিন বন্দীকে লক্ষ্য করে।
হাঁটু ভেঙে দাঁড়ানো তিন বন্দীর খালি গা। পরনে পাতলা কাপড়ের হাফ ট্রাউজার।
বন্দীদের চেহারা বিপর্যস্ত। শরীরে শত নির্যাতনের চিহ্ন।
তিন বন্দীই কাঁপছিল। পা, হাঁটু তাদের দেহের ভার বইতে পারছিল না। কিন্তু বসার উপায় নেই, নিচে তীক্ষ্ণ পেরেক আঁটা চেয়ার। আবার সোজা হয়ে দাঁড়াবারও সুযোগ নেই, মাথার চার ইঞ্চি উপরেই অনুরূপ তীক্ষ্ণ পেরেক আঁটা ইস্পাতের বোর্ড স্থির হয়ে আছে।
‘এই প্রশ্ন তোমরা শতবার করেছ। এ পর্যন্ত শতবারই জবাব দিয়েছি, তোমরা আমাদের স্পুটনিক অফিস পুড়িয়ে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছ।’ কান্নায় ভেঙে পড়া কন্ঠে বলল তিন বন্দীর মাঝের জন।
‘আমরা বিশ্বাস করি না তোমাদের কথা। তোমরা কম ধড়িবাজ নও। ডকুমেন্টগুলোর শুধু একটি করে কপি তোমাদের কাছে ছিল এটা অবিশ্বাস্য। তোমাদের বলতে হবে ডকুমেন্টগুলোর ডুপ্লিকেট কোথায়।’ বলল চেয়ারে বসা সেই মাঝের জনই।
বন্দীরা তাদের সহ্য ও শক্তির শেষ সীমায় পৌঁছেছিল। তাদের দেহে কম্পন বেড়ে গেছে। শরীর তাদের আঁকা-বাঁকাভাবে দুলতে শুরু করেছে। চোখ তাদের বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ তিনটি দেহ তাদের এক সাথেই খসে পড়ল সারি সারি পেরেক আঁটা চেয়ারের উপর। সঙ্গে সঙ্গে তাদের তিনটি কন্ঠই যন্ত্রনায় বুকফাটা চিৎকার দিয়ে উঠল।
চেয়ারে বসা তিনজন হো হো করে হেসে উঠল। বলল তিনজনের ডান পাশের জন, ‘তোদের ঈমান গেল কোথায়? দাঁড়িয়ে থাকতে পারলি না তো ঈমানের শক্তিতে। তোদের আল্লাহ শক্তি যোগাল না হাঁটুতে এবং পায়ে?’
তিন বন্দীই যন্ত্রনায় আর্তনাদ করছিল। কিন্তু আর উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। কারণ পেরেক আঁটা সেই ইস্পাতের বোর্ড নেমে এসেছে ঠিক আগের মতই মাথার চার ইঞ্চি উপরে।
চারদিক থেকে শত শত যন্ত্রনা-জর্জরিত চোখ দেখছিল তাদের অসহ্য আহাজারি।
স্থানটা বিশাল একটি গোলাকার হলঘর। নিচু ছাদ আট-নয় ফুটের বেশি উচুঁ হবে না।
হলঘরটার চারদিক ঘিরে মোটা লোহার গ্রীল ঘেরা ছোট ছোট ঘর। ঘরগুলোকে খোঁয়ার বলাই ভাল। ঘরগুলোতে দাড়ানো যায় না, পা মেলে শোয়াও যায় না। ঘরের মেঝেগুলো এবড়ো-থেবড়ো কাঠের তৈরী। মাথার উপরের কংক্রিটের ছাদগুলো মুভেবল। সুইচ টিপে সেগুলো সরিয়ে দেয়া যায়, আবার লাগানো যায়। দরকার হলে বন্দীদের রোদে পোড়ানো, আবার বরফ বৃষ্টিতে শাস্তি দেবার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
বিশাল ঘরের ঠিক মাঝখানে প্রায় ২০ বর্গফুট আয়তনের গোলাকার একটা কংক্রিটের বেদী। এই চত্বরের উপরের ছাদটা গম্বুজের মতো উঁচু। বিশেষভাবে নির্মিত এই গম্বুজে এবং বেদীর নিচে নির্যাতনের হাজারো উপকরণ সাজিয়ে রাখা। যখন যেটা তাদের প্রয়োজন সুইচ টিপলেই উপর থেকে নেমে আসে এবং নিচ থেকে উঠে আসে। বন্দীদের একাকী বা দলবদ্ধভাবে এখানে এনে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের যতপ্রকার মারাত্মক পন্থা আছে, সবই তারা পরীক্ষা করেছে এখানে বন্দীদের উপর।
হলঘরের চারপ্রান্তের দু’একটি ছাড়া সবগুলো খোঁয়াড়েই বন্দী রয়েছে। তাদের সংখ্যা দু’শ জনের কম হবে না। তাদেরই বেদনা জর্জরিত চোখ অসহায় দৃষ্টিতে দেখছে তিন বন্দীর উপরে চলমান নির্যাতন। কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে কানে আঙুল দিয়ে চেষ্টা করছে বাঁচতে। কিন্তু মনের কষ্ট তাতে এক বিন্দুও লাঘব হচ্ছে না। কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে প্রার্থনার হাত উপরে তুলে।
তিন বন্দীর অসহায় কাতরানী ছাপিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে চেয়ারে বসা তিনজনের উল্লাস ধ্বনি।
এক ঝাঁক পেরেক বিদ্ধ স্থান থেকে রক্ত ঝরছে তিন বন্দীর। রক্ত চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়ছে বেদিতে।
নির্যাতনকারী টিমের তিনজনের মাঝের জনই টিম লিডার। তার বয়স অন্য দু’জনের চেয়ে কিছু বেশী। তবে কারো বয়স চল্লিশের বেশি নয়। তিনজনের পরনেই ইউরোপিয়ান স্যুট। তবে ইউরোপিয়ানদের মত সাদা নয়। মুখের গড়নও এ্যাভারেজ ইউরোপীয় থেকে আলাদা। যারা ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেগীন, ইয়াহুদ বারাক, এ্যারিয়েল শ্যারনদের দেখেছেন, তারা বলবেন এরা তিনজন ঐ প্রধানমন্ত্রীদের ভাই হবেন কোন না কোন দিক থেকে। এরা যে নিখাদ ইহুদী তা তাদের দিকে একবার তাকিয়েই ওয়াকিফহাল যে কেউ বলে দিতে পারে।
তিন চেয়ারের মাঝের লোকটি তার ডান পাশের লোকটিকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘মি. আইজ্যাক, সুইচে এবার হাত দিন। রক্ত বেশি গেলে আমাদের ক্ষতি।’
হাসল আইজ্যাক শামির। বলল, ‘ঠিক বলেছেন মি. দানিয়েল ডেভিড, ওদের তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের ডকুমেন্টের মতই ওদের রক্ত আমাদের কাছে মুল্যবান। ওরা বাঁচলে ডকুমেন্ট বের হবেই।’
বলে আইজ্যাক শামির তার চেয়ারের পাশেই মেঝের উপর সেট করা একটা বাক্সের ঢাকনা খুলে ফেলল একটা হুক অন করে। ওটা ইলেক্ট্রনিক কনট্রোল বক্স। প্যানেলে সারি সারি অনেক সুইচ। একটা প্যানেলের একটা সুইচকে আইজ্যাক শামির রেড কেবিন থেকে গ্রীন কেবিনে নিয়ে গেল। সংগে সংগেই তিনজন বন্দীর নিচ থেকে পেরেক আঁটা চেয়ার মেঝের ভেতর ঢুকে গেল এবং অনুরূপভাবে মাথার উপর থেকে পেরেক বিছানো ইস্পাতের আয়তাকার বোর্ডটিও চোখের নিমেষে উঠে গম্বুজে ঢুকে গেল।
আহত রক্তাক্ত বন্দী তিনজন আছড়ে পড়ল মাটিতে। বসবার তাদের শক্তি ছিল না, উপায়ও ছিল না। তাদের তিনটি দেহই মেঝেতে শুয়ে পড়ল।
নির্যাতনী টীমের জিজ্ঞাসাবাদকারী তিনজনের নেতা দানিয়েল ডেভিড বলে উঠল সংগে সংগেই, ‘না তোমরা শুতে পারবে না, আরাম তোমাদের কপাল থেকে মুছে গেছে। পরকালে যখন বেহেশত আশা কর, তখন জাহান্নামের শাস্তিটা এখানেই ভোগ করে যাও।’
বলে দানিয়েল ডেভিড চেয়ারের হাতলে তার হাতের নিচেই থাকা একটা সুইচে চাপ দিল। চাপ দেয়ার সাথে সাথেই বেদিটির এক প্রান্ত থেকে ৩ বর্গফুটের মত জায়গার মেঝে একটু নিচে নেমে মেঝের আড়ালে হারিয়ে গেল এবং উঠে এল একটা লিফট। লিফটে একজন মানুষ। লোকটির পরনে সামরিক ইউনিফর্ম। কুস্তিগীরের মত চেহারা।
‘এসটি জিরো ওয়ান, তুমি ওদের আমাদের সামনে সারিবদ্ধ করে বসিয়ে যাও। আর এক পেগ করে ব্রান্ডি দাও ওদের।’ লিফট দিয়ে উঠে আসা ইউনিফরমধারীকে লক্ষ্য করে বলল দানিয়েল ডেভিড।
আদেশ শুনে এসটি জিরো ওয়ান লিফটে করে আবার নিচে নেমে গেল। এক বোতল ব্রান্ডি নিয়ে ফিরে এল আধা মিনিটের মধ্যেই।
জিরো ওয়ান লোকটি তিনটি চেয়ারের সামনে তিনজন বন্দীকে খেলনার মত তুলে এনে বসিয়ে দিল।
বন্দীদের এভাবে বসার ক্ষমতা ছিল না। বসেই তারা কঁকিয়ে উঠল ব্যথায়। ক্লান্তি ও যন্ত্রনায় তারা মাথা সোজা করে বসে থাকতে পারছিল না।
জিরো ওয়ান পেগ ভর্তি ব্রান্ডি ওদের সামনে রেখে বলল, ‘খেয়ে নাও। এ হলো এখনকার জন্যে মেডিসিন। খেলেই দেখবে মাথা সোজা করতে পারছ।’
‘তোমরা এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝেছ, মদ, ব্রান্ডি ধরনের হারাম জিনিস আমাদের খাওয়াতে পারবে না। কিছু দিতে চাইলে আমাদের পানি দাও।’ বলল তিনজনের সারি থেকে মাঝের বন্দী।
‘ব্রান্ডি না খেলে তোমাদের পানি দেওয়া হবে না।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
দানিয়েল ডেভিড ৩ জনের জিজ্ঞাসাবাদকারী দলের নেতা।
বন্দীরা কেউ কোন কথা বলল না।
দানিয়েল ডেভিড তার বাম পাশের লোকের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘মি. হাইম হারজেল তাহলে আপনার জিজ্ঞাসাবাদটা সেরে নিন।’
হাইম হারজেল নড়ে চড়ে বসল।
তাকাল বন্দীদের দিকে।
চোখ তার নির্দিষ্ট করল মাঝের জনের দিকে। বলল, ‘কামাল সুলাইমান, অনেক কথাই বলেছ। এখন বল, মোস্তাফা কামাল আতাতুর্কের বংশধর হবার পরেও তোমার এই পরিবর্তন কেন?’
‘কোন পরিবর্তন?’ হাইম হারজেলের দিকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল কামাল সুলাইমান।
এই কামাল সুলাইমান ৭ জনের গোয়েন্দা সংস্থা স্পুটনিক এর প্রধান। সে কামাল আতাতুর্কের বংশধর, একমাত্র জীবিত বংশধর।
‘তোমাদের মৌলবাদ গ্রহনের কথা বলছি। কামাল আতাতুর্কের যুক্তি ও প্রগতির পথ পরিত্যাগ করে তোমরা মৌলবাদী পথ বেছে নিতে গেলে কেন? যেমন ধর তোমার নামের দুটো অংশ ‘কামাল’ ও ‘সুলাইমান’। কামাল ঠিক আছে, এটা পারিবারিক ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রতি স্বীকৃতি। কিন্তু সুলেমান কেন? ‘সুলেমান’ তো ওসমানীয় খলিফাদের একজনের নাম। কামাল আতাতুর্ক এদের পরিত্যাগ করেছিলেন। এদের একজন তোমার নামের অংশ হলো কি করে?’ বলল হাইম হারজেল।
‘নামটা রেখেছিলেন আমার পিতা। তিনি আমার নাম রাখার সময় পারিবারিক ইতিহাস এবং জাতীয় ঐতিহ্য দুই-ই সামনে রেখেছিলেন’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘জাতীয় ঐতিহ্য কোনটা? সুলেমান নাম?’ জিজ্ঞেস করল হাইম হারজেল।
‘হ্যাঁ, সুলাইমান নাম’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘সুলাইমান জাতীয় ঐতিহ্য হলো কি করে? কামাল আতাতুর্ক তো এই ঐতিহ্য পরিত্যাগ করেছিলেন’। বলল হাইম হারজেল।
‘কামাল আতাতুর্ক যাঁকে এবং যাঁদেরকে পরিত্যাগ করেছিলেন, আমার পিতা নিশ্চয় তাঁদেরকেই গ্রহন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ওসমানীয় খিলাফতের মহান বিজেতা, মহান শাসক এবং ইউরোপের মহাভয়ের ঝান্ডা সুলাইমানকে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে। তার চাওয়ার স্মারক আমার ‘সুলাইমান নাম’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘তার মানে তোমার পিতা তাহলে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, তুর্কিরা শুধুই তুর্কি এবং তুর্কিদের পরিচালনা করবে তুরস্ক ও পাশ্চাত্যের জ্ঞান, ইসলাম নয়-এই মতবাদ পরিত্যাগ করেছিলেন?’ বলল হাইম হারজেল।
‘শুধু আমার পিতা কেন, সাধারণভাবে তুর্কিরা সবাই এই মতবাদ পরিত্যাগ করেছে’। কামাল আতাতুর্ক ১৭ বার সামরিক আইন ব্যবহার করে তুর্কি জনগণকে ধর্মনিরপেক্ষ বানানোর জন্যে বহু আইন করেছেন, কিন্তু এরপরও মসজিদে বসার আসন স্থাপন, মসজিদে জুতা পায়ে নামাজ আদায়, নামাজের ভাষা হিসেবে তুর্কি ভাষা চালু, আরবী বিলোপ, নামাজে সেজদার নিয়ম বাতিল, মসজিদে প্রার্থনাকে সুন্দর করার জন্যে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র চালু ইত্যাদির মত পরিকল্পনা তাকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হতে হয়। সেই তুর্কি জনগণ আজ আরও স্বাধীন এবং শক্তিশালী’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘আচ্ছা তোমার পিতার কথা বাদ দিলাম। তোমার পিতা আংকারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ গ্রাজুয়েট। কিন্তু তুমি তো ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেছ, ইউরোপের সংস্কৃতি-সভ্যতার মধ্যে বড় হয়েছ, কিন্তু তুমি মৌলবাদী হলে কি করে?’ জিজ্ঞেস করল হাইম হারজেল।
‘মৌলবাদ বা মৌলবাদী পরিভাষা পশ্চিমের একশ্রেণীর সংবাদ মাধ্যমের উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি। মুসলিম জাতির ক্ষেত্রে এই পরিভাষা প্রযোজ্য নয়। সুতরাং আমাকে মৌলবাদী নই, বলতে পারেন ধর্মনিরপেক্ষতা পরিহার করে আমি মুসলিম হলাম কি করে’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘ঠিক আছে বল, গোঁড়া মুসলিম হলে কি করে?’ বলল হাইম হারজেল।
‘গোঁড়া বা অগোঁড়া মুসলমান বলে কিছু মুসলিম জাতির মধ্যে নেই’। ‘মুসলিম’ হওয়ার গুণগুলো যার মধ্যে যত বেশি বর্তমান সে তত বেশি পূর্ণাংগ মুসলমান, যার মধ্যে যত কম সে তত অপূর্ণাংগ।’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘আচ্ছা বল, যে কামাল আতাতুর্ক একদিন বলেছিলেন, ‘কেবলমাত্র ইসলামের কর্তৃত্ব নির্মূল করার পরই তুর্কিরা অগ্রগতি লাভ করতে পারে এবং সম্মানিত আধুনিক জাতিতে পরিণত হতে পারে’, সেই কামাল আতাতুর্ক পরিবারের ছেলে হয়ে পূর্ণাংগ মুসলমান হলে কি করে? বলল হাইম হারজেল।
‘এই প্রশ্নের জবাবের সাথে আমার বন্দী হওয়া বা তোমাদের স্বার্থের তো সম্পর্ক দেখছি না?’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘দেখ, তোমাদের ‘স্পুটনিক’ সংস্থা ধ্বংস ও তোমাদের বন্দী করার পেছনে নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাসি ও লিবার্টি টাওয়ার ধ্বংস বিষয়ে তোমাদের তদন্ত বানচাল করা ছিল একটি বড় কারণ মাত্র, সব কারণ নয়। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো, ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মহীনতা, ভোগ-বিলাস আর চরিত্রহীনতার সয়লাবের মধ্যে থেকে তোমরা এবং তোমাদের মত হাজার হাজার যুবক কি করে নিখাঁদ ইসলামে ফিরে এলো!এই ফিরে আসার পথগুলো, কারণগুলো আমরা চিহ্নিত করতে চাই। এ জন্যেই দেখ আমরা তো তোমাদের সাতজনকেই মাত্র ধরিনি। এই বন্দীখানাতেই তোমরা আছ দু’শজনের মত। তোমাদের সাথে আরও যারা এখানে আছে, তারা সবাই তোমাদের মত নেতৃস্থানীয় এবং ‘ডু অর ডাই’ ধরনের সাংঘাতিক এ্যাকটিভিস্ট যুবক। তাদের ধরে তাদের আন্দোলন বানচাল করতে চেয়েছি এটা ঠিক, কিন্তু আসল কারণ এদের আদর্শবাদিতার উৎস সন্ধান করা। এক্সরে করার মত করে সব অজানা রহস্য জেনে নেয়া। এই একই কারণে তোমাকে এই জিজ্ঞাসাবাদ। এখন বল, উত্তর দাও’। বলল হাইম হারজেল। তার দুই চোখে ঠান্ডা সাপের মত ক্রুরতা।
‘এই অজানাকে জানা তোমাদের কোন কাজে লাগবে?’ জিজ্ঞেস করল কামাল সুলাইমান।
ঠান্ডা হাসি হাসল হাইম হারজেল। বলল, ‘রোগ জীবানু কি, কেমন, তার ধর্ম কি জানলেই তো কেবল প্রতিষেধক তৈরী করা যায়। তোমাদের মৌলবাদ কোত্থেকে কিভাবে এল জানলে তবেই তো প্রতিবিধানের পথ বের করা যাবে। আচ্ছা বল, আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
‘তুমি যে প্রশ্ন করেছ, এক কথায় তার কোন জবাব নেই। অনেক কথা বলতে হবে এজন্য’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘ক্ষতি নেই বল। আমরা শুধু তা শুনবই না রেকর্ডও করব।’ বলল হাইম হারজেল।
‘তুমি ঠিকই বলেছ, ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মহীনতা এবং ভোগবাদিতার সয়লাবের মধ্যে আমি মানুষ হয়েছি জার্মানীর এক অভিজাত পল্লীতে। আমার পিতার মধ্যে ঐতিহ্য-প্রীতি প্রবল ছিল। কিন্তু সেটা ছিল তার মনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাইরের কাজ-কর্মে তার কোন প্রকাশ ছিল না। জার্মান-সংস্কৃতির আবহাওয়ায় আর দু’দশজনের মতই আমি মানুষ হয়েছিলাম। চেতনা আমার প্রথম ধাক্কা খেল নূরী এ্যারেন-এর Turkey today and tomorrow বইয়ের কয়েকটা লাইন পড়ে। কামাল আতাতুর্কের অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের মধ্যে ৪৬ জন কুর্দি নেতাকে কামাল এক সাথে ফাঁসি দিয়েছিলেন। ফাঁসির মঞ্চে একজন কুর্দি নেতা শেখ সাইদ হত্যাকারীকে যে কয়টি বলেছিলেন, নূরী এ্যারেন তার বইতে সে কথাগুলো উল্লেখ করেছেন। শেখ সাইদ বলেছিলেন, ‘তোমার প্রতি আমার কোন ঘৃণা নেই। তুমি ও তোমার মনিব কামাল আল্লাহর নিকট ঘৃণিত। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর কাছে আমাদের ফায়সালা হবে।’ শেখ সাইদের এ কথাগুলি প্রথমবারের মত আমার মনে চাবুকের মত আঘাত করে। এই ঘটনার পরপরই আরেকটা বড় ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনা আমার কাছে প্রায় অপরিচিত আমাদের গ্রন্থ আল কোরআন-এর মর্যাদা আমার কাছে আকাশস্পর্শী করে তোলে। ঘটনাটি হলো, একটা ম্যাগাজিনে বৃটিশ রাজনীতিক গ্লাডস্টোন-এর একটা উক্তি পাঠ। উক্তিটি বৃটিশ পার্লামেন্টে গ্লাডস্টোন-এর ভাষণের একটা অংশ। এতে বৃটিশ পার্লামেন্টের ‘সেক্রেটারী ফর কলোনিজ’ মি. গ্লাডস্টোন বলেছিলেন। ‘যতদিন মুসলমানদের আল কোরান থাকবে, আমরা ততদিন তাদেরকে বশ করতে পারবো না। হয় আমাদেরকে তাদের কাছ থেকে এটি কেড়ে নিতে হবে, অথবা তারা যেন এর প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে তার ব্যবস্থা করতে হবে। (So long as the Muslims have the Quran, “we shall be unable to dominate them. We must either take it from them, or make them lose their love of it.”) এই বক্তব্য পাঠ করার সংগে সংগে আমার মনে ঝড়ের বেগে একটি কথা প্রবেশ করল এবং সেটা হলো, ‘আল কোরআনই আমাদের মানে মুসলমানদের স্বাধীনতার শক্তি, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি। আরও মনে হলো, আমার পূর্ব-পুরুষ মোস্তফা কামাল তাহলে হয়তো তার অজান্তেই গ্লাডস্টোনদের পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করেছিলেন। এই চিন্তা হঠাৎ করে আমাকে নতুন মানুষে পরিণত করল। পাল্টে গেল আমার জীবন ধারা। পড়া-শোনার বিষয় আমার পাল্টে গেল। পরিবারের সবাইকে বিস্মিত করে আমি নামাজী বনে গেলাম। এই সময় আমি মোস্তফা কামালের সমসাময়িক তুরস্কের নির্ভীক জননেতা বদিউজ্জামান নূরসীর জীবন ও কর্মের উপর একটা গ্রন্থ পড়লাম যা আমার জীবনকে আমূল পাল্টে দিল। তার অনেক কথা আমার কাছে অথৈ সমুদ্রে পথহারা নাবিকের কাছে ‘বাতি ঘর’ এর মত জীবনদায়িনী মনে হলো । যেমন মোস্তফা কামাল এক ঘটনায় নামাজকে কটাক্ষ করে উক্তি করলে জনাব নুরসী তুরস্কের লৌহ মানবের মুখের উপর বলেছিলেন, ‘পাকা, ঈমানের পর ফরয নামাজই তো ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যারা নামাজ আদায় করে না, তারা বিশ্বাসঘাতক। আর বিশ্বাসঘাতকের অভিমত গ্রহন করা যায় না।’ ইসলামের প্রতি ভালোবাসাও আমি নূরসীর কাছ থেকে শিখেছি। মোস্তফা কামালের শাসনে তুরষ্কে ইউরোপীয় সংস্কৃতির সয়লাব যখন অপ্রতিরুদ্ধ হয়ে উঠল, তখন স্বাস্থ্যগতভাবে নুরসী খুবই ভেঙে পড়লেন, অথচ তার কোন রোগ ছিল না। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার নিজের দুঃখ গুলো সইতে পারি। কিন্তু ইসলামের দুঃখ আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। ইসলামী দুনিয়ার উপর আমি প্রদত্ত প্রতিটি আঘাত আমার অন্তরের উপর হানা দেয়। তাই আমি এমন ভেঙে গেছি। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলের উপর নীতি ও আইনকে স্থান দেয়া, মানুষকে ভালোবাসা, মুসলমানদেরকে ভালোবাসার শিক্ষাও আমি জনাব নুরসীর কাছ থেকে পেয়েছি। মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক জনাব নুরসীর উপর জেল-জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নির্বাসন কতই না করেছেন। কিন্তু যখন মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে অস্ত্র, সৈন্য, গোলা-বারুদ সব প্রস্তুত করে তার কাছে যুদ্ধের অনুমতি চাওয়া হলো, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা কার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান? মোস্তফা কামালের সৈন্য কারা? ওরা এদেশেরই ছেলে। আপনি কাদেরকে হত্যা করবেন? তারা কাকে হত্যা করবে? আপনি কি চান আহমদ মুহাম্মদকে আর হাসান হোসাইনকে হত্যা করুক।’ যে কোন অবস্থায় অস্ত্রের চেয়ে যুক্তিকে, বুদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেবার শিক্ষা আমি নূরসীর কাছ থেকেই পেয়েছি। তিনি সশস্ত্র তৎপরতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। যুক্তি ও বুদ্ধি অস্ত্রকেই তিনি সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর মনে করতেন। আমরা ‘স্পুটনিক’ গড়েছি তা অনেকটা তাঁর এ শিক্ষা থেকেই। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যুক্তি ও বুদ্ধির অস্ত্র দিয়েই আপনাদের এবং সকলের সব ষড়যন্ত্র আমরা নস্যাত করতে পারব।’ থামল কামাল সুলাইমান।
‘যদি বেঁচে থাক।’ বলেই হাইম হারজেল চোখ ফেরাল কামাল সুলাইমানের বামপাশে বসা ওসমান আবদুল হামিদের দিকে। তুরষ্কের ওসমানীয় খিলাফতের শেষ সক্রিয় খলিফা সুলতান আবদুল হামিদের বংশধর। তার দিকে চোখ তুলে ধরে বলল হাইম হারজেল, ‘তোমার পূর্ব পুরুষদের কামাল আতাতুর্ক সুইজারল্যান্ডে নির্বাসন দিয়েছিল। পরবর্তীকালে তোমাদের পরিবার নিরেট একটি ইউরোপীয় পরিবারে পরিণত হয়। আরবী ভাষার চর্চা তাদের মধ্য থেকে উঠে যায়। আরবী ভাষা ভুলে যায় তারা। তুমি কিভাবে মৌলবাদী হলে মানে পূর্ণাংগ মুসলমান হলে সে কাহিনী তোমার কাছ থেকে শুনেছি। শুধু একটা বিষয়ই জানার বাকি আছে সেটা হলো, তুমি আরবী শিখলে কোথায়?’
‘আরবী আমি শিখিনি। আরবী ভাষা আমি জানি না। সবে শিখতে শুরু করেছি।’ বলল ওসমান আবদুল হামিদ।
‘জান না? তাহলে কোরআন ও হাদিস পড় কি করে?’ হাইম হারজেল বলল।
‘ইংরেজী অনুবাদ পড়ি।’ জবাব দিল ওসমান আবদুল হামিদ।
‘ও, আচ্ছা।’ বলে হাইম হারজেল ফারুকের বংশধর এবার আবদুল্লাহ আল ফারুকের দিকে তাকাল। তাকে উদ্দেশ্য করে বলল হাইম হারজেল, ‘সেদিন তোমার কাছ থেকে কিছু জেনেছি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বিষয় জিজ্ঞেস করতে বাকি রয়ে গেছে। বল, তোমার ঘরে ফেরার উপলক্ষ বা কারণটা কি?’
‘ঘরে ফেরা মানে কি ইসলামে ফিরে আসা?’ জিজ্ঞেস করল আবদুল্লাহ আল ফারুক।
‘হ্যাঁ ঠিক, ইসলামে ফেরা।’ বলল হাইম হারজেল।
‘এটা ঠিক ইসলামের চর্চা আমাদের পরিবার থেকে লোপ পেয়েছিল। কিন্তু আমরা মুসলমান এ কথা কেউ আমরা কখনোও ভুলিনি। তারপর নানা কার্যকারণ ও ঘটনায় পূর্ণাংগ ইসলামে আমি ফিরে এসেছি। সে অনেক কথা, কোনটা বলব আমি?’ বলল আবদুল্লাহ আল ফারুক।
‘শুধু বল, কোরআন হাদিস পড়ে, না কিভাবে তোমরা প্রথম চোখ খুলল?’ বলল হাইম হারজেল।
সংগে সংগে উত্তর দিল না আবদুল্লাহ আল ফারুক হারজেলের প্রশ্নের। ভাবছিল সে। একটু পর সে বলল, ‘আমি তখন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একদিন লাইব্রেরীতে বসে নোট তৈরী করছিলাম। নোট শেষে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম আমার হাতের কাছেই ইবনে খালদুনের মুকাদ্দামা পড়ে আছে। এই বিখ্যাত বইটির অনেক নাম শুনেছি। কিন্তু কোন দিন হাতে নিয়ে দেখিনি। কাছে পেয়ে আজ হাতে তুলে নিলাম। সূচীটা দেখে নিলাম। তারপর পাতা উল্টাতে লাগলাম। এক জায়গায় কয়েকটা লাইন সবুজ মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করা দেখলাম। ভাবলাম আমার মতই নোটকারী পাঠকের কাজ। আগ্রহ নিয়ে মার্ক করা লাইন কটি পড়তে লাগলামঃ ‘নবীর আল্লাহ প্রদত্ত বাণী ছাড়া রাজনৈতিক ও স্থায়িত্ব অর্জনে আরবরা অক্ষম। কারণ চারিত্রিক কঠোরতা, গর্ব, বর্বরতা এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে পরস্পরের প্রতিহিংসা তাদের মজ্জাগত। ইচ্ছা ও আকাঙ্খার ঐক্য ছাড়া এগুলো দূরিভূত হওয়া খুবই কষ্টকর। নবীর ধর্মই তাদের রুক্ষতা ও প্রতিহিংসাকে দমন করতে পারে। কারণ এই ধর্মই তাদেরকে বর্বর জাতি থেকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে এ সময় এমন ব্যক্তির আবির্ভাব হওয়া উচিত যিনি তাদেরকে সত্যের দিকে আহ্বান করবেন এবং অসত্য থেকে বিরত রাখবেন তবেই তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে এবং নেতৃত্ব দানে সক্ষম হবে।’ ইবনে খালদুনের এ বক্তব্য একবার দু’বার নয় অনেকবার পড়লাম। কথাগুলো সম্মোহিত করে ফেলল আমাকে। আমার মনে হলো এই লাইন কয়টিতে পৃথিবীর সমাজ বিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুন যা বলেছেন তার চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। এক মুহূর্তেই আরব দেশগুলোর অনৈক্য, দূর্বলতা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বহুমুখিতা, পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদির কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মনে হলো, নবীর শিক্ষা ও আদর্শের শক্তিই আরবদের এবং মুসলমানদের আবার শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করতে পারে। এই চিন্তা আমার সত্ত্বা জুড়ে তড়িত প্রবাহের মত ছড়িয়ে পড়ল। আমি যেন নতুন চিন্তা চেতনায় নতুন মানুষে পরিণত হলাম। তারপর কয়েকদিনে আমি ইবনে খালদুনের এই মুকাদ্দামা পড়ে শেষ করলাম। তখন শুধু আরব জীবন, আরব ইতিহাস নয়, গোটা পৃথিবীর ইতিহাস ও সভ্যতা নতুন পরিচয় নিয়ে আমার সামনে আবির্ভুত হলো। আমার মনে হলো মুসলমানরা ঈমান, কোরআন ও হাদীসের ভূমিকা পরিহার করলে তাদের সংস্কৃতি সভ্যতার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না-আরবতত্ত্ব নয়, জাতিতত্ত্ব নয়, লীন হয়ে যেতে হয় বৈরী সভ্যতা সংস্কৃতি ও জাতিদেহের মধ্যে। সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম শুধু স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিয়ে বাঁচার জন্যে নয়, সুন্দর মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী চিরন্তন শান্তির জন্যে আমাকে ইসলামে ফিরে আসতে হবে। এই হলো আমার ঘরে ফেরার কাহিনী।’ থামল আবদুল্লাহ আল ফারুক।
আবদুল্লাহ আল ফারুক থামতেই দানিয়েল ডেভিড বলে উঠল আবদুল্লাহ আল ফারুকদেরকে লক্ষ্য করে, ‘তোমরা খুব সরল এবং সৎ। কিন্তু স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন তোমাদের ভাগ্যে নেই, সুন্দর মৃত্যুও নয়। পরকালীন শান্তি হয়তো পাবে। কারণ আর যাই হোক আজকের বিশ্ব পরিচালনা তোমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।’
‘হ্যাঁ, জানোয়ারের বিশ্ব যদি হয় তা পরিচলানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু মানুষের বিশ্ব পরিচালনা সম্ভব। আর এ বিশ্ব জানোয়ারদের নয় মানুষের।’ বলল কামাল সুলাইমান।
‘জানো মানুষই সবচেয়ে বড় জানোয়ার?’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘তাদের মানুষ করার জন্যই তো শেষ নবীর শেষ রেসালত।’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘কিন্তু তা করতে পারেনি তোমাদের শেষ নবীর শেষ রেসালত। এই কারণেই তো জানোয়ার বন্দী করতে পারনি, যাদের জানোয়ার বল তারা তোমাদের বন্দী করে এনেছে।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘তোমার কথাই শেষ কথা নয়, দেখো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তোমাদের লীলা-খেলার ইতি ঘটছে, ঘটবে। সেখানে জেনারেল শ্যারনসহ তোমাদের অনেকেই বিচারের সম্মুখিন হচ্ছে।’
চোখ দুটি জ্বলে উঠলো দানিয়েল ডেভিডের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তার শোধ নিচ্ছি আমরা এবং নেব।’
বলে একটু থামল দানিয়েল ডেভিড। একটু পর বলল, ‘তোমাদের আস্ফালন বুদবুদের মত। জানো, মি.হাইম হারজেল তোমাদের কাছ থেকে কি জেনে নিল?’
কামাল সুলাইমানরা এ জিজ্ঞাসার জবাবে কিছুই বলল না। দানিয়েল ডেভিডই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘তোমাদের ঈমান ও শক্তির গভীরতা তিনি যাচাই করলেন। দেখলেন, মূল কোরআন হাদিস থেকে কোন শিক্ষা তোমরা পাওনি। কোরআন হাদিসের গোটা শিক্ষাও তোমরা জান না। কিছু কার্যকারণের মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে একটা জাতীয় আবেগের সৃষ্টি হয়েছে মাত্র এবং এটা পরীক্ষায় টিকবে না। তোমরা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।’
হাসল কামাল সুলাইমান। বলল, ‘ইসলামের প্রথম যুগে যাঁরা মক্কায় শহীদ হয়েছিলেন, বদর প্রান্তরে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, ওহোদ-খন্দকে শহীদ হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা সকলে গোটা কোরআন পড়েছেন-জেনেছেন বলেছেন বলেই শহীদ হননি। বরং ঈমানের জন্যে নয় আমলের জন্যে গোটা কোরআন জানা শর্ত। আর মানুষ জীবন দিতে পারে ঈমানের যুক্তিতেই। সুতরাং তোমাদের ইচ্ছা এতদিন পূরণ হয়নি, কোনদিনই পূরণ হবে না।’
চোখ দু’টি আবার জ্বলে উঠল দানিয়েল ডেভিডের। শক্ত হয়ে উঠল তার চোয়াল। সে তার ডান দিকে বসা আইজ্যাক শামিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কিছু নির্দেশ দিতে যাচ্ছিল এমন সময় একটা শক্তিশালী বীপ বীপ শব্দ ভেসে এল।
সংগে সংগে নিজেকে সামলে নিয়ে লাল চোখে কামাল সুলাইমানের দিকে চেয়ে বলল, ‘বস আসছে। এখন আর সময় নেই। যে মুখে এই অহংকারের কথা বললে, সে মুখ গুঁড়ো করে দেব। তৈরী থেক।’
কথা শেষ করল এবং তার পরেই দু’পাশের দু’জনকে বলল, ‘চল এদের খোঁয়াড়ে রেখে আসি।’
বলেই বন্দী তিনজনকে টেনে নিয়ে ওরা ছুটল খোয়াড়ের দিকে।
ওদের খোয়াড়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে, গ্রীলের দরজায় বিশাল তালা ঝুলিয়ে দ্রুত ফিরে এল নিজ নিজ চেয়ারের কাছে।
বীপ বীপ শব্দ তখনও চলছিল।
কিন্তু তাদের সামনের মেঝের চেহারাটা পাল্টে গেছে। বন্দীদের রক্তে ভেজা মেঝেটা কোথায় সরে গেছে। তার জায়গায় শোভা পাচ্ছে শ্বেত পাথরের সুন্দর মেঝে।
ওরা তিনজন ফিরে এসে চেয়ারে বসল না। তাদের দৃষ্টি শ্বেত পাথরের মেঝের দিকে। অপেক্ষা করছে তারা তাদের বসের।
মাত্র কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা।
তার পরেই শ্বেত পাথরের ওপাশ ঘেঁষে অনেকখানি জায়গায় মেঝে সরে গেল এবং সেখানে চোখের পলকে উঠে এল একটা চেয়ার সমেত একজন মানুষ। চেয়ারে বসা লোকটার তীরের মত ঋজু দেহ। লাল মুখটা পাথরের মত কঠিন। চোখের দৃষ্টিটা শূণ্য। তাতে কোন ভাষা নেই। গায়ে সামরিক পোশাক। হাতে সোনার একটি গ্লোব। গ্লোবের মাঝে জেরুসালেমের প্রোথিত নল আকারের একটা সোনারই দন্ড। তার মাথায় ছয় তারকার একটা পতাকা।
ইনিই আজর ওয়াইজম্যান। ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির’ অবিসংবাদিত নেতা। তার হাতের গ্লোবটি নেতার মনোগ্রাম। নেতার হাতেই শুধু এটা শোভা পায়।
ওরা তিনজন দাঁড়িয়েই ছিল।
আজর ওয়াইজম্যান উঠে এসে স্থির হতেই ওরা তিনজন তাকে সামরিক কায়দায় স্যালুট দিল।
আজর ওয়াইজম্যানও একজন সর্বাধিনায়কের মত সামরিক কায়দায় স্যালুট গ্রহন করল এবং তাদেরকে ‘গুড মর্নিং’ বলে স্বাগত জানিয়ে বসতে বলল।
বসল ওরা তিনজন।
‘মি.দানিয়েল ডেভিড, আপনাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, আপনাদের হাত শূণ্য। কিন্তু আজ তিন সপ্তাহ যাচ্ছে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘আমরা দুঃখিত। আমাদের হাত সত্যিই শূণ্য। অবিশ্বাস্য ব্যাপার স্যার, শারীরিক এধরনের নির্যাতনে হাতিও কথা বলে কিন্তু এই নির্যাতনেও তাদের কথা বলা পারছে না।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘বিস্ময়ের কথা বলছেন কেন? এটা তো জানা কথা। আর হাতির সাথেও তুলনা চলে না। হাতি পশু, মানুষ নয়। সুতরাং মানুষ হাতির চেয়ে শক্ত হবে। আর মানুষের মধ্যে মুসলমানরা শক্তিশালী, একথা বাইরে না বললেও তোমাদের তো মনে রাখা উচিত।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ঠিক বলেছেন স্যার। নির্যাতনের এখানকার সকল প্রক্রিয়াই ব্যর্থ হয়েছে তাদের কথা বলাতে। তারা বলে জাহান্নামের শাস্তি এর চেয়েও ভয়াবহ।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘এটাই তো ওদের শক্তি। মৃত্যুকে যারা সোনালী জগতে প্রবেশের সোনার সিংহদ্বার বলে মনে করে, তারা দুনিয়ার সব ভয়কেই জয় করে। কিন্তু মি.দানিয়েল ডেভিড, তাদের কথা বলাতে হবে। ডকুমেন্টের ডুপ্লিকেট তাদের কাছে অবশ্যই আছে এবং সেগুলো আমাদের অবশ্যই চাই।’ আর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ডুপ্লিকেটগুলো যখন ওদের কাছে আছে, নিশ্চয় তারা কোথাও সেগুলো রেখেছে। স্যার, সেগুলো খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব নয়?’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘তা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা আমরা করেছি। ফল হয়নি। আবার চেষ্টা আমরা শুরু করতে যাচ্ছি। এই সাতজনের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব কাউকেই এই অনুসন্ধান তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে না। এরপর আমরা চিন্তা করেছি, এই সাতজনের যাদের স্ত্রী-সন্তান-সন্ততি আছে তাদের এখানে নিয়ে আসব। তাদের কথা বলাবার এটাই শেষ পথ।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
আজর ওয়াইজম্যানের শেষের কথাগুলো শুনে তিনজনের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল দানিয়েল ডেভিড, ‘স্যার ওদের কথা বলাবার হন্যে ওদের স্ত্রী সন্তান ও মায়েরাই হবে অব্যর্থ অস্ত্র। স্যার, আমার মতে এই সাতজনের আত্মীয় বন্ধুদের সন্ধানে সময় ব্যয় না করে অবিলম্বে এদের পরিবার পরিজনদের এখানে আনলেই কাজ হবে বেশি।’
‘হ্যাঁ, সেটাও আমরা ভাবছি। আমি যাচ্ছি স্ট্রাসবার্গে দু’একদিনের মধ্যে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আপনাকেই যেতে হবে? খুব বড় কাজ তো ওটা নয়। নির্দেশ দিলেই তো ওদের এখানে নিয়ে আসবে।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘ওখানে যেতে হবে। মনে হচ্ছে আমরা নতুন এক বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছি। খবর পাওয়া গেছে, আহমদ মুসা নাকি স্ট্রাসবার্গের উদ্দেশ্যে সুরিনাম ছেড়েছে। আমরা খবরটাকে অবিশ্বাস করছি না। যে মাফিয়া গ্রুপের কাছে থেকে খবর পাওয়া গেছে তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক সুরিনাম সরকারের। তাদের মাধ্যমে আহমদ মুসার টিকিটের বিস্তারিত বিবরণ পেয়ে গেছি। সে সুরিনাম থেকে মদিনায়, মদিনা থেকে আসছে স্ট্রাসবার্গে। এই স্ট্রাসবার্গে আসার দিনক্ষণটাই অনিশ্চিত রয়ে গেছে আমাদের কাছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কেন সে আসছে স্ট্রাসবার্গে?’ জিজ্ঞেস করল দানিয়েল ডেভিডের পাশ থেকে হাইম হারজেল।
‘ইউরোপের একমাত্র কার্যকর মুসলিম গোয়েন্দা সংস্থা স্পুটনিক ধ্বংস হয়েছে, সংস্থার ৭জন পরিচালকের সবাই নিখোঁজ। স্ট্রাসবার্গে এমন সাংঘাতিক ঘটনা ঘটার পর জিজ্ঞাসার প্রয়োজন আছে কি যে আহমদ মুসা সেখানে কেন আসছে!’
‘স্যরি। ঠিক বলেছেন স্যার। কিন্তু আমি ভাবছিলাম, ইউরোপের বাঘা বাঘা গোয়েন্দারা যেখানে স্পুটনিক ঘটনার কোন কুল কিনারা করতে পারেনি, সেখানে আহমদ মুসা এসে কি করবে।’ বলল হাইম হারজেল।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আহমদ মুসা কি ঘটিয়েছে এটা দেখার পরেও আপনি একথা বলছেন? মার্কিন এফবিআই বহু বছরেও যার টিকির নাগাল পায়নি, আহমদ মুসা তার শুধু নাগাল পাওয়া নয়, ইহুদীদের শত বছরের সব আয়োজনই তো সে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইহুদি গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারনের গায়ে কেউ কোন দিন হাত দিতে পারে নি। কিন্তু আহমদ মুসা তাকে মার্কিন কারাগারে নিক্ষেপ করে এমন মামলায় জড়িয়েছে যে জেলের বাইরে আসাই হয়তো তার পক্ষে আর সম্ভব নয়।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
মুখ শুকিয়ে গেছে হাইম হারজেলের। মুখ নিচু করল সে। কথা বলতে পারল না।
মুখ খুলল দানিয়েল ডেভিড। বলল, ‘স্ট্রাসবার্গে আহমদ মুসার আগমন সত্যিই খুব খারাপ খবর। আজ পর্যন্ত দুনিয়ার যে জায়গাতেই সে পা দিয়েছে, সেখানেই ভাগ্যের আনুকুল্য সে পেয়েছে। আর………।’
‘মি.হাইম হারজেল আহমদ মুসাকে জিরো করতে চেয়েছিলেন। আর আপনি তাকে ‘হিরো’ করতে চাচ্ছেন। আমরা যদি তাকে অজেয় হিরোই মনে করি, তাহলে তো আমাদের করার কিছুই থাকে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘স্যরি স্যার।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘ধন্যবাদ মি.দানিয়েল ডেভিড। আসলে কি জানেন, অতীতে আহমদ মুসা সম্পর্কে আমাদের পলিটিক্স ঠিক হয়নি। তাকে বন্দী করে আমরা আর্থিক ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছি। এটা ঠিক হয়নি। তার মত লোককে যে বন্দী রাখা যায় না, এটা বুঝতে আমরা ভুল করেছি। সুতরাং এবার আমাদের সিদ্ধান্ত সুট অন সাইট। দেখা মাত্রই তাকে গুলী করা হবে। তাকে আমাদের দরকার নেই, তার লাশ দরকার।’
‘স্ট্রাসবার্গে আপনি কবে যাবেন স্যার?’ জিজ্ঞেস করল দানিয়েল ডেভিড।
‘আজই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘একটা কথা স্যার।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘কি কথা?’
‘স্পুটনিকের ৭জন ছাড়া আর ২শর মত যারা আছে, তারা কিন্তু এদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। মুখ থেকে মুখে, কান থেকে কানে এই পদ্ধতিতে তারা তথ্য আদান-প্রদান ও শিক্ষা ক্লাস চালু করেছে। এদের এক সাথে এইভাবে রাখা আমাদের লক্ষ্যের পক্ষে কল্যাণকর হচ্ছে না।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
হাসল আজর ওয়াইজম্যান। বলল, ‘মি.ডেভিড, স্পুটনিকের সাতজন ছাড়াও যাদের এখানে রাখা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই তাদের স্ব স্ব অঞ্চলের ইসলামের নেতা। তারা প্রত্যেকেই একটি করে শক্তির জেনারেটর। এখানে তাদের শেখার এবং শেখাবার কিছু নেই মি.ডেভিড।’
বলে একটু থামল আজর ওয়াইজম্যান। শুরু করল আবার, ‘আমাদের এটাকে ‘ক্যাম্প গ্রিনডার’ বলতে পারেন। মানুষকে পেষণ করে তার রস নিংড়ে নেয়াই এই ক্যাম্পের লক্ষ্য। ওদের কাছ থেকে সব তথ্য, সব কথা নিংড়ে নিয়ে ওদের আমরা আটলান্টিকে ডুবিয়ে দেব।’
‘কিন্তু ওদের সন্ত্রাসী সংগঠন ও অস্ত্রপাতি সম্পর্কে তো কিছুই জানা যাচ্ছে না। বলছে না কিছুই ওরা শত নির্যাতনেও।’ বলল তিনজনের একজন আইজ্যাক শামির।
‘থাকলে তো বলবে কিছু ওরা। ওরা সন্ত্রাসী নয়, সন্ত্রাসী কোন সংগঠনও ওদের নেই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কিন্তু আমরা ওদের সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছি সন্ত্রাসী সংগঠন হওয়ার অভিযোগে এবং ওদেরও তো আটক করেছি ভয়ানক সন্ত্রাসী হিসেবে।’ বলল সেই আইজ্যাক শামিরই।
আজর ওয়াইজম্যানের পাথুরে মুখে হাসি ফুটে উঠল বলল, ‘তোমরা জান, ওটা আমাদের প্রোপাগান্ডা, ওদের সংগঠন নিষিদ্ধ করা ও ওদের আটক করার একটা ওজর। আসলে আমরা চাই, ইসলামী পূণর্জাগরনের সব সংস্থা সংগঠন ধ্বংস করতে এবং ওদের পুনর্জাগরণের গোপন কথাগুলো জানতে।’
‘কিন্তু সেরকম কোন তথ্য আমরা বের করতে পারছি কি?’ বলল হাইম হারজেল।
‘প্রচার। এই কিছুক্ষণ আগে কামাল সুলাইমানের কাছ থেকে যে কথাগুলো বের করলেন, তার প্রিন্টের উপর আমি আসার সময় চোখ বুলিয়ে এসেছি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সে দিয়েছে। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো, গত ৫০ বছরে মুসলিম বিশ্বে এমন কি ঘটল যে, মুসলিম তরুণরা, যুবকরা হঠাৎ করে ধর্ম নিরপেক্ষ, এমন কি তাদের অতিপ্রিয় ভাষা ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ ছেড়ে দিয়ে ইসলামের প্রতি অসীম ভালোবাসায় পাগল হয়ে উঠল। এই রহস্য উদঘাটন হচ্ছে। এই তো ক’মিনিট আগে কামাল সুলাইমানদের কাছ থেকে যা শুনলে, তাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান।
সে থামতেই দানিয়েল ডেভিড বলে উঠল, ‘সেটা কি?’
‘এক ধরনের ইতিহাস, এক ধরনের বই-পুস্তক এবং এক ধরনের ঘটনাবলী এমনকি সেকুলার মুসলিম যুবকদেরকেও ইসলামে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রবল শক্তিশালী জেনারেটরের ভূমিকা পালন করছে। কামাল সুলাইমানদের দেয়া তথ্য থেকে এই বিষয়টা সুনির্দিষ্টভাবে জানা গেল।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘এই জানায় লাভ কি?’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘জানায় লাভ হলো, আমরা এখন মুসলিম পাবলিকেশন্স এবং মুসলিম লাইব্রেরীসহ সব পাবলিকেশন্স ও লাইব্রেরীর দিকে নজর দেব। কিছু দিনের মধ্যেই দেখবেন, লাইব্রেরী থেকে ঐ ধরনের বইগুলো উধাও হয়ে গেছে, পুস্তক বিক্রেতাদের দোকান থেকে ঐ ধরনের বই সব রাতারাতি বিক্রি হয়ে গেছে এবং কোন প্রকাশনাই আর ঐ ধরনের বই প্রকাশ করছে না। দু’একটা প্রকাশনা যদি বেয়াড়া হয়, তাহলে স্পুটনিকের মতই সেগুলো জন্মের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে। তাছাড়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অংশ হিসেবে আমরা মুসলিম সরকারগুলোকে বাধ্য করবো যাতে মৌলবাদী, উত্তেজক, প্ররোচক ঐসব বই এর প্রকাশনা শান্তির স্বার্থেই বন্ধ করে দেয়া হয়।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান।
দানিয়েল ডেভিডের চোখ-মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল দানিয়েল ডেভিড, ‘ধন্যবাদ স্যার। আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি। কিন্তু স্যার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার নিয়ে কি করবেন? ওরা আমাদের বিরুদ্ধে তো উঠে পড়ে লেগেছে। জেনারেল শ্যারনকে ওরা মনে হয় ফাঁসি দিয়েই ছাড়বে।’
চিন্তা করছিল আজর ওয়াইজম্যান। দানিয়েল ডেভিড থামার একটু পর বলল, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক দেশ। মার্কিন জনগণ তাদের স্বার্থে আঁচড় লাগাতে দিতেও নারাজ। আমরা ইহুদীবাদীরা এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেইনি। আমরা তাদের পাতের ভাত কেড়ে খেতে শুরু করেছিলাম। কিছু মানুষকে হয়তো চিরদিনই বোকা বানিয়ে রাখা যায়, তবে সব মানুষকে সব সময়ের জন্যে বোকা বানিয়ে রাখা অসম্ভব, আমরা এ সত্যটাকেও আমলে দেইনি। নিউইয়র্কের লিবার্টি টাওয়ার ও ডেমোক্রাসি টাওয়ার ধ্বংসের দায় মুসলমানদের ঘাড়ে সফলভাবে চাপাবার পর যে মহাসুযোগ আমরা পেয়েছিলাম, তা আমাদেরকে বেশি বেপরোয়া করে তুলেছিল। এটা আমাদের ক্ষতি করেছে। আর আহমদ মুসা আমেরিকায় গিয়ে এরই সুযোগ গ্রহন করেছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোটা পরিবেশ আমাদের প্রতিকূলে। নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হবে আমাদের সেখানে। ভয়ের কিছু নেই, আমরা চিন্তা করছি, আগামী নির্বাচনে মার্কিন কংগ্রেসে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল লোকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করার চেষ্টায় আমরা হাত দিয়েছি এবং পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট আমাদের পছন্দনীয় হয় তার জন্যে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের এসব প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে যাবে যদি নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসি টাওয়ার ধ্বংসের আসল রহস্য মার্কিন জনগনের সামনে এসে যায়। এজন্যেই আমরা স্পুটনিক ধ্বংস করেছি, স্পুটনিকের হোতা সাত শয়তানকে আমরা আটক করেছি এবং তাদের সংগ্রহ করা লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসি টাওয়ার ধ্বংসের প্রকৃত প্রমাণাদি আমরা হাত করার চেষ্টা করছি। ঐ সাত শয়তানের কাছ থেকে যে কোন মূল্যে আমাদেরকে ঐ ডকুমেন্ট উদ্ধার করতেই হবে। দরকার হলে ওদের সব আত্মীয় পরিজনকে এখানে নিয়ে আসব এবং সাত শয়তানের মুখ খোলার জন্যে এদের গিনিপিগ বানাব। সুতরাং এই সাও তোরাহ দ্বীপের আমাদের মিশন সফল হওয়ার উপরই নির্ভর করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের ভবিষ্যত। নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসি টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য ফাঁস হয়ে গেলে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা দুনিয়ার কাছে আমরা বিশ্বাসঘাতকে পরিণত হবো।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান।
আজর ওয়াইজম্যানের পাথুরে মুখ ভাবলেশহীন। কিন্তু দানিয়েল ডেভিডের চোখে মুখে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বলল দানিয়েল ডেভিড, ‘স্যার, সাও তোরাহ মিশন ব্যর্থ হবে না স্যার। সাত শয়তানকে অবশেষে কথা বলতেই হবে। তবে আহমদ মুসাকে ঠেকানো দরকার স্যার।’
‘হ্যাঁ, আহমদ মুসার ব্যাপারটা আমরা দেখছি। যে যাতে স্পুটনিকের ঘটনার ব্যাপারে নাক গলাতে না পারে, সে ব্যবস্থা আমরা যে কোন মূল্যেই করব। আমি আজই যাচ্ছি সেখানে।’
কথা শেষ করেই ‘গুড মর্নিং টু অল। উইথ ইউ গুডলাক’ বলে চলে গেল আজর ওয়াইজম্যান।
‘গুড মর্নিং’ বলে দানিয়েল ডেভিডরাও তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল।
ততক্ষনে চেয়ার সমেত আজর ওয়াইজম্যান অদৃশ্য হয়েছে।
তিনজনই আবার বসে পড়ল চেয়ারে। ঘড়ির দিকে তাকাল দানিয়েল ডেভিড। বলল, ‘চলুন আমাদেরও সময় হয়েছে যাবার।’
২
উপর থেকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে স্ট্রাসবার্গ শহরকে। বিমানটি তখন চক্কর দিচ্ছে স্ট্রাসবার্গের আকাশে। সবুজ রাইন উপত্যকা। গাঢ় সবুজ উপত্যকার পশ্চিম বরাবর নেমে আসা পাহাড়ের দেয়াল। ইউরোপের প্রধান ধমনী রাইন নদী বয়ে চলেছে আকাশের রংধনুর মত এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে। উপত্যকার সবুজ শাড়িতে রাইন যেন জীবন্ত এক রূপালী পাড়।
আহমদ মুসার মুগ্ধ চোখ দু’টি রাইন উপত্যকা ঘুরে এসে নিবদ্ধ হলো স্ট্রাসবার্গের উপর।
সবুজের সমুদ্রে লাল-সাদায় মেশানো সুন্দর শহর স্ট্রাসবার্গ। শহরের সবকিছু ছাড়িয়ে সবার উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ‘গথিক গীর্জা’। গথিক গীর্জার উপর নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার উৎসুক দু’টি চোখ। শহরের সবচেয়ে পুরানো অংশ এই ঐতিহাসিক গীর্জার সামনেই ‘দি রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল’। এ হোটেলে সিট বুক করা আছে আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার নজর পড়ল সুন্দর পাহাড়ী নদী ‘রাইনে’র উপর। এই নদীটি ঘিরেই গড়ে উঠেছে স্ট্রাসবার্গ নগরী। ‘রাইন’ থেকে একটা ক্যানেল গিয়ে পড়েছে রাইনে। এর ফলেই স্ট্রাসবার্গ কার্যত সমুদ্র বন্দরে পরিণত হয়েছে।
স্ট্রাসবার্গ এয়ারপোর্টে নামল আহমদ মুসা। স্ট্রাসবার্গ এয়ারপোর্ট থেকে রাস্তাটা তীরের মত সোজা গিয়ে প্রবেশ করেছে স্ট্রাসবার্গে। গাড়ির রিয়ার ভিউতে দীর্ঘ পথ এবং পথে গাড়ির দীর্ঘ সারির গোটাটাই নজরে আসে।
স্ট্রাসবার্গে ঢুকে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। খুবই প্রাচীন শহর, কিন্তু রাস্তাগুলো আধুনিক। এয়ারপোর্ট রোডের মতই রাস্তাগুলো সোজা, ছবির মত সাজানো। গাড়ি থেকে সামনে পেছনে অনেকদূর দেখা যায়। চোখ রাখা যায় অনেক দূর।
ভাড়া করা ট্যাক্সির পয়সা মিটিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা প্রবেশ করল দি রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে।
রিসেপশন কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটা জার্মান মিশ্রিত ফরাসী ভাষায় আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল। আর মেয়েটাকেও পুরো জার্মান মনে হলো না, আবার পুরো ফরাসীও নয়।
ভাষা ও চেহারাগত দিকটা এই রাইন উপত্যকা এবং এর সন্নিহিত এলাকার একটা বৈশিষ্ট্য। কারণ ফ্রান্স ও জার্মান বর্ডারের এই এলাকাটা শত শত বছর ধরে ফ্রান্স-জার্মান সংঘাতের শিকার। এই অঞ্চলটা কখনও ফ্রান্সের অংশ থেকেছে, কখনওবা জার্মানীর অংশ হয়েছে। ১৫০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই এলাকা জার্মানরা শাসন করেছে। তারপর ফরাসীরা এটা দখল করে। জনগণ তাদের উপর ফরাসী পরিচয় চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু এই জনগনই আবার ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের পর ফরাসী হবার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে। ১৮৭১ সালে জার্মানরা যখন এই এলাকা দখলে করে নেয়, তখন এই এলাকার মানুষ জার্মানদের প্রত্যাখ্যান করে ফ্রান্সে হিজরত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফরাসীরা এই এলাকা জার্মানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই জার্মান এ অঞ্চলটা আবার দখল করে নেয়। যুদ্ধের পর ফ্রান্স অঞ্চলটা আবার ফিরে পায়।
রিসেপশনিস্ট মেয়েটা স্বাগত জানালে আহমদ মুসা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘আমি বিদেশী বলেই আমার কৌতূহল। আমি বুঝতে পারছি না আপনি জার্মান না ফরাসী।’
মেয়েটা হাসল। বলল, ‘আপনার কি মনে হয়?’
‘জার্মান ও ফরাসী দুই-ই মনে হয় আমার কাছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি ইউরোপীয়।’ বলে আবার হাসল মেয়েটি। বলল আবার আহমদ মুসাকে কথা বলবার সুযোগ না দিয়েই, ‘এটা বললাম কেন জানেন, স্ট্রাসবার্গ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী, মানে এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড কোয়ার্টার।’
‘জানি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরও কি জানেন, স্ট্রাসবার্গ সম্রাট শার্লেম্যানের স্পিরিচুয়াল ক্যাপিটাল ছিল?’ হেসে বলল মেয়েটি।
‘জানি। কিন্তু শার্লেম্যানের ধর্মরাজ্যের স্পিরিচুয়াল ক্যাপিটালকে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী হিসেবে বেছে নিলেন কেন?’ হাসির সাথে হালকা কন্ঠেই বলল আহমদ মুসা।
প্রায় ৫০ বছর আগে জার্মানী ও ফ্রান্সের দুই রাষ্ট্রপ্রধান এই স্ট্রাসবার্গে বসেই শার্লেম্যানের আদর্শে ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করার নীল নক্সা করেছিলেন বলে বোধ হয়।’
‘শার্লেম্যানের খৃষ্টীয় মৌলবাদী আদর্শে নব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন!’ আহমদ মুসার চোখে মুখে কৃত্রিম বিস্ময়।
‘তা জানি না।’ হেসে উঠে কথাটা বলেই মেয়েটি মুখে সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘ওকে স্যার। এবার নিশ্চিন্ত থাকুন আমি একজন ফরাসী।’
‘আমি আহমদ আবদুল্লাহ। সৌদি আরব থেকে একটা কক্ষ বুক করা আছে। বুকিং নাম্বার ডবল ‘এ’ ডবল ‘জিরো’ ডবল ‘নাইন’।
‘প্লিজ স্যার, বলে মেয়েটি কমপিউটার কী বোর্ডে আঙুল ঘুরিয়ে স্ক্রীনের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বলল, ‘ওকে স্যার। ওয়েলকাম।’
ফরমালিটিজ সেরে আহমদ মুসার হাতে চাবি তুলে দিতে গিয়ে হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় বলে উঠল, ‘মি.আহমদ আবদুল্লাহ, একটা খবর দিতে ভুলে গেছি। আপনার দুজন বন্ধু আপনি এসেছেন কিনা, কবে আসবেন জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নাম বলেননি।’
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘আমার বন্ধু, নাম বলেনি!’
‘স্যার, ব্যাপারটা খুবই অসৌজন্যমূলক এবং অগ্রহনযোগ্য। সেজন্যে বিষয়টার আমরা ফরমাল রেকর্ডও করিনি।’ বলল মেয়েটি।
‘মাফ করুন, বলতে পারেন কন্ঠ দুটি কি জার্মান না ফরাসী ছিল?’
‘ওকে স্যার। জার্মান-ফরাসী কোনটিই নয়। খাঁটি বৃটিশ উচ্চারণ।’ বলল মেয়েটি।
ভাবছিল আহমদ মুসা। এমন কোন বৃটিশ বন্ধু নেই যারা তার এখানে আসার কথা জানে এবং এখানে সিট বুক করার কথা জানতে পারে!আবার ভাবল, ভুলও তো ওদের হতে পারে? আবার এমনও হতে পারে মুসলিম নামে বুকিং দেখে সরকারী কোন এজেন্সী অথবা অন্য কোন মহল পরিচয় চেক করার জন্যেই টেলিফোন করতে পারে। বেদনাদায়ক হলেও এটা সত্য যে, নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে মুসলমানদেরকে ইউরোপ আমেরিকায় সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। কিন্তু সেটা হলে সব মুসলিম বোর্ডারের ব্যাপারেই খোঁজ-খবর নেয়া হবে। সেটা হচ্ছে কি?
এটা চিন্তা করেই আহমদ মুসা রিসেপশনিস্ট মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হোটেলে কি আর কোন মুসলিম বোর্ডার আছেন?’
‘আছেন। দু’জন। একজন জার্মান ছাত্রী ‘ফাতিমা কামাল’, অন্যজন ফরাসী ছাত্র যায়েদ ফারুক। কিন্তু কেন বলুন তো?’
‘তাদের ব্যাপারে কেউ কি টেলিফোনে কিছু জিজ্ঞেস করেছে?’
‘না ।’ ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠেছে মেয়েটির। বলল সে আবার, ‘মি.আহমদ আবদুল্লাহ, আপনি কিছু সন্দেহ করছেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভাবছিলাম। বেনামী টেলিফোন তো!’
‘মি.আহমদ আবদুল্লাহ, আপনি ইচ্ছা করলে পুলিশকে জানাতে পারেন।’
আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপাতত থাক। ধন্যবাদ আপনাকে।’
আহমদ মুসা কক্ষের চাবি নিয়ে চলে গেল তার কক্ষে।
কক্ষ পছন্দ হলো আহমদ মুসার। কক্ষের স্টাইল গথিক গীর্জার মত ট্রেডিশনাল হলেও উপকরণ সবই আধুনিক ।
আহমদ মুসা গোসল সেরে বিশ্রামে যেতে যেতে ভেবে নিল। কাজ শুরু করার আগে শহরটাকে ভালো করে দেখে নেবে । আজ পূর্ণ বিশ্রাম, কাল থেকে শহর দেখে শুরু।
সেদিন আহমদ মুসা ফিরছিল ‘ইউরোপা’ রোড হয়ে । বিখ্যাত এই ইউরোপা রোডেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড কোয়ার্টার। আহমদ মুসা রাস্তার থার্ড লেইন ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল। অভ্যাস বশতই রেয়ারভিউতে চোখ যাচ্ছিল তার।
এক সময় বিস্মিত আহমদ মুসার চোখ দুটি আঠার মত লেগে গেল রেয়ারভিউতে। দেখল, দু’টি গাড়ি, একটা ব্রাউন, অন্যটি এ্যাশকালার, অনেক্ষণ ধরে তার পেছনে আসছে একই গতিতে। গাড়ি দুটি মাঝে মাঝেই সমান্তরালে চলে যাচ্ছে, আবার আগে পিছে চলে আসছে। তাও আবার বাই রোটেশানে একবার ব্রাউনটা আগে আসছে, পরে আবার এ্যাশকালারটা। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল গতকালও গাড়ি দুটিকে সে তার পেছনে দেখেছে এবং এয়ারপোর্ট থেকে আসার সেই প্রথম দিনেও এই গাড়িই তার পেছনে ছিল । হতে পারে অন্যান্য দিনেও গাড়ি দুটি তার পেছনে ছিল, কিন্তু হয়তো তার চোখে পড়েনি।
ভাবল আহমদ মুসা। এটা কি কোন কো-ইন্সিডেন্ট, না কেউ তাকে ফলো করছে? সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা, আগামীকালও সে এ বিষয়টি পরীক্ষা করবে।
হোটেলের পার্কিং প্লেসে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা। গাড়ি থেকে নেমেই গীর্জা ও হোটেলের মাঝের রাস্তার উপর চোখ ফেলল, না গাড়িটা এ রাস্তায় ঢোকেনি। গীর্জার মোড়ে বাঁক নিয়ে তাকে গীর্জার রাস্তায় প্রবেশ করতে হয়েছে। হতে পারে, ওরা বাঁকের আড়ালে দাঁড়িয়ে এদিকে চোখ রাখছে।
আহমদ মুসা ঢুকে গেল হোটেলে।
পরদিন আহমদ মুসা যাচ্ছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্পুটনিক অফিসে। সেদিন এসেই একবার গেছে। কিন্তু আরও ভালো করে দেখা প্রয়োজন।
যা ভেবেছিল তাই। গাড়ি দু’টি আসছে তার পেছনে।
ওরা ফলো করছে তাকে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু ওরা কারা? ওরা কি তাকে নবাগত মুসলিম ব্যক্তিত্ব হিসেবে ফলো করছে, না তাকে আহমদ মুসা হিসেবে ফলো করছে? কিন্তু তাকে আহমদ মুসা হিসেবে চিনবে কি করে? সন্দেহ নেই, তার ফটো ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইরগুন যাই লিউমি’ ও ‘মোসাদে’র কাছে আছে। কিন্তু আহমদ মুসার এই স্বাভাবিক চোহারার ফটো তাদের কাছে নেই। তাছাড়া তাকে আহমদ মুসা হিসেবে যদি চিনেই থাকে, তাহলে তাকে শুধু ফলো করবে কেন? তাকে এ কয়দিনে হত্যা বা বন্দী করার উদ্যোগ নেয়াই স্বাভাবিক ছিল। তাহলে কি ওরা আমাকে ধরার আগে আমার কন্ট্যাক্ট পয়েন্টগুলে চিহ্নিত করতে চায়? যাদেরকে তাদের দরকার হতে পারে? শুধু মুসলিম ব্যক্তিত্ববলে পরিচয় জানা বা কন্ট্যাক্ট পয়েন্টগুলোর সন্ধান করার জন্যে এভাবে কেউ পেছনে লেগে থাকতে পারে? হয়তো পারে। তবে আহমদ মুসার মন বলল, ওরা নিছক একজন মুসলিম ব্যক্তিত্বে সন্ধানে ঘুরছে না। তাহলে? তাহলে কি তারা তাকে আহমদ মুসা হিসেবে চিনতে পেরেছে, না আহমদ মুসা হিসেবে সন্দেহ করছে?
গ্রীন সার্কেলে পৌঁছে গেছে আহমদ মুসা। এই গ্রীন সার্কেলেই স্পুটনিকের অফিস ছিল।
গ্রীন সার্কেলটা বিশাল একটি সার্কুলার মার্কেট। বিশাল সার্কুলার মার্কেটটির মাঝখানে বিরাট গ্রীন সার্কেল, বৃত্তাকার বিরাট বাগান। বাগানটা গাছে ঠাসা। মাঝে মাঝে বসার বেঞ্চি ও বাচ্চাদের দোলনা। বৃত্তাকার বাগানটির মাঝখানে আবার ঘাসে ঢাকা বৃত্তাকারি একটি উন্মুক্ত চত্বর। বৃত্তাকার বাগান ও তার চারপাশ ঘিরে বৃত্তাকার মার্কেটটি, মাঝখান দিয়ে বৃত্তাকার একটি রাস্তা। আবার বৃত্তাকার মার্কেটটির বাইরের চারপাশ ঘিরে একটা প্রশস্ত সার্কুলার রোড।
আহমদ মুসার গাড়ি প্রবেশ করল এই সার্কুলার রোডে। দিনটা রোববার। বিকেল। মার্কেট বন্ধ।
সার্কুলার রোডে গাড়ি ছিল না বললেই চলে।
আহমদ মুসার এক মিনিট পর অনুসরণকারী গাড়ি দুটি প্রবেশ করল সার্কুলার রোডে।
আহমদ মুসা কি করবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। যে লেন দিয়ে স্পুটনিক অফিসে প্রবেশ করতে হয়, সেই লেন দিয়ে আহমদ মুসা ধীর গতিতে প্রবেশ করল মার্কেট ও বৃত্তাকার বাগানের মাঝের ইনার সার্কুলার রোডে।
গাড়ি দুটিও প্রবেশ করল।
বাগানে দু’চার জন লোক দেখা যাচ্ছে। ছুটির দিনে বাগানে যে ভীর হয়, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
আহমদ মুসা তার গাড়ির রিয়ারভিউতে দেখল, গাড়ি দুটো দুরত্ব আগের চেয়ে কমিয়ে দিয়েছে। সার্কুলার রোড হওয়ার কারণে আহমদ মুসার গাড়ি যাতে চোখের আড়ালে না যায়, সেজন্যেই এ দূরত্ব কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
পেছনের গাড়ি দুটি পাশাপাশি ড্রাইভ করে আহমদ মুসার পেছনে পেছনে আসছিল।
আহমদ মুসা এক সময় চোখের পলকে তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তীব্র বেগে এগিয়ে গাড়ি দুটি ব্লক করে তাদের সামনে দাঁড়াল এবং তার সাথে সাথেই গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এল আহমদ মুসা।
গাড়ি দুটিও হার্ড ব্রেক কষে দাড়িয়ে পড়েছিল। প্রথমটায় তারা হচকচিয়ে গিয়েছিল। সে ভাবটা কাটিয়ে উঠে আহমদ মুসাকে সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখেই ওরা গাড়ির দুপাশে দুজন বেরিয়ে এল। তারা দুদিক থেকে দুজন এক পা দু’পা করে এগিয়ে আসতে লাগল। তাদের একজনের হাতে রিভলবার কোটের আড়ালে লুকানো। আরেকজনের হাতে রেশমি ফাঁস। ওরা এত তাড়াতাড়ি এগ্রেসিভ হয়ে উঠবে, আহমদ মুসা তা ভাবে নি। আর আহমদ মুসা এভাবে এখানে রিভলভার ব্যবহার করাকেও ভাল মনে করছে না।
আহমদ মুসা তার ভাবনা শেষ করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই সে দেখল, যার হাতে ফাসি তার ফাঁসিটা আকাশে উড়তে শুরু করেছে।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল এবং এ্যাক্রোব্যাটিক কায়দায় দু’হাত প্রসারিত করে সামনে মাটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পা আকাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে শূন্যেই শরীরটাকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে দু’পায়ের প্রচন্ড লাথি মারল রিভলবার হাতে নিয়ে দাড়াঁনো লোকটির মাথায়।
লোকটি রিভলবার তুলেছিল এবং গুলিও করেছিল আহমদ মুসার লাথি তার মাথায় আঘাত করার সময়। কিন্তু গুলিটা ৭৫ ডিগ্রী কোণ করে আসা আহমদ মুসার দেহের অনেক নিচ দিয়ে চলে গেল।
জোড়া পায়ের লাথি খেয়ে লোকটির দেহ ছিটকে পড়ে গেল গাড়ির পাশে। তার সাথে আহমদ মুসার দেহও ভূপাতিত হলো।
মাটিতে পড়েই উঠে বসল আহমদ মুসা। লোকটির হাত থেকে ছিটকে পড়া রিভলবার কুড়িয়ে নিয়েছে সে।
লোকটি উঠে বেসেছিল। আহমদ মুসা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবারের বাট দিয়ে তার মাথায় প্রচন্ড এক ঘা দিল।
লোকটি সংগা হারিয়ে ফেলল।
আহমদ মুসা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ফাঁসিওয়ালা লোকটি কোথায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
আহমদ মুসা ক্রলিং করে গাড়ির পেছনে ঘুরে গাড়ির ওপাশটায় উকি দিল। কিন্তু কেউ নেই।
‘তাহলে কি ওপাশের গাড়ির ওপারে লুকিয়েছে?’ ভাবল আহমদ মুসা।
ভাবার সংগে সংগেই আহমদ মুসা হাতে রিভলবার বাগিয়ে ধরে কয়েক লাফে ওগাড়ির পেছনে চলে গেল। তার পর মুহূর্তকাল থেমেই গাড়ির ওপাশটায় উঁকি দিল। না কেউ নেই। তাহলে কি পালিয়েছে?
পরক্ষনেই তার মনে হলো, সে তো তাকে বোকা বানায়নি?
সংগে সংগেই স্প্রিং এর মত উঠে দাড়িয়ে পেছন ফিরল আহমদ মুসা। কিন্তু তখন দেরী হয়ে গেছে। তার চোখের সামনে দিয়ে প্রথম গাড়িটা সাঁ করে বেড়িয়ে গেল। দেখল, যাবার সময় দ্বিতীয় লোকটি তার সংগাহীন সাথিকে তুলে নিয়ে গেছে। বুঝল আহমদ মুসা, সে যখন দু’গাড়ির এপাশ ওপাশ দেখছিল, তখন ঐ দ্বিতীয় লোকটি প্রথম গাড়ির সামনের দিকটায় গিয়ে লুকিয়েছিল। তারপর সে দ্বিতীয় গাড়ির দিকে চলে যাওয়ায় তার সুযোগ নিয়ে সাথিকে সহ পালিয়েছে।
বোকার মত কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল আহমদ মুসা। তারপর রিভলবারটা পকেটে ফেলে এগুলো দ্বিতীয় গাড়িটার দিকে। টার্গেট হলো, ওদের খোঁজ পাওয়ার মত কোন কাগজপত্র ওদের গাড়িতে পাওয়া যায় কিনা।
গাড়িতে লাইসেন্স, ব্লুবুক ছাড়া কাগজ জাতীয় আর কিছুই পেল না।
লাইসেন্স ও ব্লুবুকের ঠিকানাগুলো টুকে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
আসরের নামাজের সময় তখন যায় যায় অবস্থা। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি বাগানে প্রবেশ করে একটা গাছের আড়াল খুঁজে নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম অর্থাৎ কাবামুখী হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।
চারটি চোখ আহমদ মুসাকে ফলো করছিল। একজন তরুনীর দুই চোখ এবং একজন তরুনের দুই চোখ। এই চার চোখ আহমদ মুসার সাথে দুই গাড়িওয়ালার সংঘাত –সংঘর্ষটাও দেখেছে। কিভাবে আহমদ মুসার গাড়িটা অনুসরণকারী দু’গাড়ির মুখোমুখি হলো, কিভাবে আহমদ মুসা একজন রিভলবারওয়ালা ও একজন ফাঁসওয়ালার মুখোমুখি হলো, কেমন দক্ষ এ্যাক্রোব্যাটিক কায়দায় আহমদ মুসা একই সাথে ফাঁস থেকে বাচল এবং রিভলবারধারীকে কুপোকাৎ করল, কিভাবে একজন গাড়িওয়ালা সংগাহীন একজন সাথীকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচল, সবই তাদের চার চোখ অবলোকন করেছে বাগানের এক গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসা বাগানে প্রবেশ করার পরও সে তাদের চোখের সামনেই ছিল। তাদের সে বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি যে, একজন শান্তশিষ্ট চেহারার ও সাধারণ মাপের একজন মানুষ কিভাবে দু’জন ষন্ডামার্কা ফরাসীকে নাকে খত দিয়ে ছাড়ল!কিন্তু তারা যখন আহমদ মুসাকে নামাজ পড়তে দেখল তখন তাদের চার চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল। দু’জন এক সাথেই স্বগত কন্ঠে বলে উঠল, ‘লোকটি তাহলে মুসলমান।’
ধীরে ধীরে তাদের দু’জনের চোখমুখের বিস্ময় কেটে গিয়ে সেখানে আনন্দের প্রকাশ ঘটল। আহমদ মুসা মুসলমান একথা জানার পর তাদের মনে আনন্দের অন্ত রইল না। তারা ভেবে খুশি হলো যে, একজন এশিয়ান মুসলিম দু’জন বন্দুকধারী ফরাসীকে অবলীলাক্রমে পরাজিত করতে পারল।
দুজনেই ধীরে ধীরে এগুলো নামাজরত আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তখন মুনাজাত করছে।
আহমদ মুসার পাশে গিয়ে থমকে দাঁড়াল ওরা।
আহমদ মুসাও মুনাজাত এই সময় শেষ করেছিল। ঘাসের উপর পায়ের ক্ষীণ নরম শব্দ আহমদ মুসার কান এড়ায়নি। তাকাল আহমদ মুসা ওদের দিকে।
আহমদ মুসার চোখে ছিল ক্ষীপ্র এক সতর্কতা। চোখ যখন সে ওদের দিকে ঘুরাচ্ছিল, তখন তার হাত চলে গেল গিয়েছিল রিভলবারের বাঁটে।
পাশে এসে দাঁড়ানো তরুণ-তরুণীদেরও এটা চোখে পড়েছিল।
আহমদ মুসার চোখ ওদের উপর পড়তেই তরুণীটি বলে উঠল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘আসসালামু আলাইকুম।’ তরুণটিও বলে উঠল তরুণীটির কন্ঠ থামতেই।
তরুণ তরুণী দু’জনের চেহারাই ইউরোপ-এশিয়ায় মেশানো। চোখ ও চুল ওদের এশিয়ান। কিন্তু গায়ের রং ইউরোপীয়, তবে তার সাথে একটা সোনালী মিশ্রণ আছে যা তাদেরকে অপরূপ করে তুলেছে।
এমন এক জোড়া তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে আকস্মিক সালাম পেয়ে আহমদ মুসা বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেল। সে এ সময় তার শত্রুদেরকেই আশা করেছিল।
আহমদ মুসার মুহূর্তকালের নিরবতার সুযোগে তরুণীটিই আবার বলে উঠল, ‘রিভলবার হাতে রাখার দরকার নেই। আমরা আপনার বন্ধু। আপনার মারামারি আমরা দেখেছি। আপনি মুসলিম দেখে পরিচয়ের জন্যে আমরা এলাম।’ মেয়েটির মুখে মিস্টি হাসি।
আহমদ মুসার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘দু’টি সংশোধনী। আপনারা আমার বন্ধু না হয়ে ভাই বোন হলে খুশি হবো। দ্বিতীয়ত, ঘটনাটা মারামারি ছিল না। ওরা আমাকে মারতে চেয়েছিল, আমি আত্মরক্ষা করেছি।’
তরুণ তরুণী দু’জনেই হাসল। আহমদ মুসার সামনে বসতে বসতে বলল, ‘ওয়েলকাম। আমরা আনন্দের সাথে ভাই-বোন হতে রাজী আছি। তবে শর্ত ‘আপনি’ সম্বোধন ‘তুমি’ তে নিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়টাও আমরা মেনে নিচ্ছি। দু’গাড়িওয়ালারা আসলে, যতদূর বুঝেছি, আপনাকে ওরা ফলো করছিল এবং সেখান থেকেই ঘটনার সৃষ্টি। সুতরাং তারাই আক্রমনকারী।’
‘কিন্তু ভাইয়া, কোন জার্মান-ফরাসীকে আমি কোনদিন এইভাবে এশিয়ানের হাতে কুপোকাত হতে দেখিনি। এই বিজয়ের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ এবং সেই সাথে জানাচ্ছি ওরা কিন্তু আপনাকে ছাড়বে না। আর কি ঘটনা আছে জানি না, কিন্তু ওদের আর্য অহং এ দারুণ ঘা লেগেছে।’ বলল তরুণীটি।
‘বোন, জার্মান ফরাসী ও এশিয়ান এই দৃষ্টিতে বিষয়টিকে না দেখাই ভাল। এটা যেমন ন্যায়-অন্যায়ের একটা দ্বন্দ্ব ছিল, তেমনি যখন কোন সংঘাত বাধে সেটা কোন অন্যায় থেকেই বাধে। কিছু ক্রিমিনাল ছাড়া সব জার্মান ফরাসীই ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’ বলল আহমদ মুসা।
তরুণীটি আহমদ মুসার মুখের শেষ শব্দ সম্পূর্ণ হবার আগেই বলে উঠল, ‘আপনি কে জানি না। আপনার চিন্তা অবশ্যই মহৎ। কিন্তু সাধারণভাবে এটা বাস্তব নয়। পশ্চিমের যারা এশিয়া আফ্রিকা দখল করে একদিন এশিয়া আফ্রিকার মানুষকে যথেষ্ট শাসন শোষনের শিকারে পরিণত করেছিল, তারা এখনও এশিয়া আফ্রিকার মানুষকে সেই একই দৃষ্টিতে দেখে। শাসন শোষনের কৌশল শুধু তারা পাল্টেছে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কথা আমি অস্বীকার করছি না বোন। কিন্তু একে পূব-পশ্চিমের সংঘাত বা পশ্চিমের শোষণ হিসাবে দেখো না। বেদনাদায়ক হলেও যেটা ঘটছে, সেটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেক ব্যক্তির মত প্রতিটি জাতি গোষ্ঠীই তাদের ভাল চিন্তা করবে, স্বার্থ চিন্তা করবে এটাই স্বাভাবিক। পশ্চিম আজ ‘গণতন্ত্রের’ নামে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে যে হস্তক্ষেপ করছে, মুক্ত অর্থনীতির নামে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকে যে কব্জা করছে, মানবাধিকারের শ্লোগান তুলে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের জাতি গঠন ও সংহতিকে যে বাধাগ্রস্থ করছে এবং তথাকথিত ‘সাসটেইনেবল ফেইথ বা ভ্যালুজে’র নামে তারা জাতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের উপর যে ছড়ি ঘুরাতে চাচ্ছে, সেটা পশ্চিমী বিভিন্ন রাষ্ট্র বা জাতির ‘ভাল’ বা ‘স্বার্থ’ চিন্তা করেই। প্রশ্ন হলো তাদের এই ‘ভাল’ বা ‘স্বার্থ’ চিন্তা আমাদের ক্ষতি করছে। আমাদের এই ক্ষতি তারা করতে পারছে তাদের বুদ্ধি ও শক্তির বলে। এর প্রতিকার ভিক্ষা চেয়ে পাওয়া যাবে না, কারণ ভিক্ষুকের আবেদনে তারা কিছু ভিক্ষা দিতে পারে, কিন্তু তাদের ‘ভাল’ বা ‘স্বার্থ’ যাতে, সেখান থেকে সরে দাঁড়াবে না। এর অর্থ হলো আমাদের ‘ভালো’ আমাদের ‘স্বার্থ’ আমাদের দেখতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই তরুনীটি বলে উঠল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি চিন্তার একটা বাস্তব ও বিপ্লবাত্মক দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন। কিন্তু এটা কিভাবে? আপনিই তো বললেন, ওরা শক্তি ও বুদ্ধির জোরে এটা করছে। শক্তি বা বুদ্ধি কোন যুদ্ধেই তো আমরা ওদের সাথে পারবো না।’
‘না পারা পর্যন্ত মার খেতেই হবে। দুর্বলরা এভাবেই মার খায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেচ্ছার কি এখানেই শেষ? কোন পথ তাহলে নেই?’ বলল তরুনীটি।
‘আছে। ইউরোপের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইউরোপ যদি তাদের স্বার্থে একক মুদ্রা, একক অর্থনীতি, একক একটি পার্লামেন্ট গড়তে পারে, তাহলে মুসলিম দেশগুলো অর্থাৎ এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলো নিজস্ব বানিজ্য ব্যবস্থা, নিজস্ব বিনিয়োগ ব্যবস্থা ইত্যাদি গড়তে পারবে না কেন?’ আহমদ মুসা হাসল।
‘আপনার মারামারি দেখে মনে হয়েছিল, আপনি সাংঘাতিক একজন লড়াকু ব্যক্তি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনি একজন সাংঘাতিক পলিটিশিয়ান। আসলে……….।’
তরুণীটি তরুণকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘এই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, আগে বিশ্ব রাজনীতিটা শেষ হোক।’
তরুণীটি মুহূর্তের জন্যে থামল। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, আপনি মুসলিম দেশ ও আফ্রো-এশীয় দেশগুলোকে যা করতে বলেছেন, তার জন্যেও তো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি দরকার।’
‘সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ন্যায়কে ভালোবাসা এবং অন্যায়ের সাথে কোন সমঝোতায় না যাওয়ার শক্তি। এই শক্তি অন্যসব শক্তি সৃষ্টি করে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি এক দূর্লভ শক্তির কথা বললেন, যার দুর্ভিক্ষ এখন সবচেয়ে প্রকট।’ আহমদ মুসা থামতেই দ্রুত কন্ঠে বলে উঠল তরুণটি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এই দুর্ভিক্ষ প্রকট বলেই আমাদের ভোগান্তিও প্রকট।’
‘ধন্যবাদ। রাজনীতির কথা এখন থাক। বলুন, দুই ইউরোপীয় আপনাকে তাড়া করছিল কেন? চেনেন ওদের? বলল তরুণটি।
‘ওদের চিনি না। কিন্তু তাড়া করার কারণ বোধ হয় জানি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি কারণ?’ বলল তরুণীটি।
আহমদ মুসা ওদের দুজনের দিকে তাকাল। বলল, ‘তার আগে তোমাদের পরিচয় জানা দরকার।’
সংগে সংগে তরুণীটি বলে উঠল, ‘আমি ফাতিমা কামাল। জার্মানীর ‘বন’ এ বাড়ি। বনের স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী।’
তরুণীটি কথা শেষ না হতেই তরুণটি বলা শুরু করল, ‘আর আমি যায়েদ ফারুক। প্যারিসে বাড়ি। প্যারিস ইউনিভার্সিটির ছাত্র।’
বিস্ময় ও আনন্দের চিহ্ন আহমদ মুসার চোখে মুখে। তরুনটির কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা কি দি রাইন ইন্ট্যারন্যাশনাল হোটেলে থাক?’
‘হ্যাঁ। কি করে জানলেন?’ এক সাথে বলে উঠল তরুণ-তরুণী দু’জনেই।
‘আমিও ঐ হোটেলেই উঠেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আমাদের কথা জানলেন কি করে?’ বলল তরুণীটি।
‘আমি যেদিন হোটেলে আসি, সেদিনই আমি কাউন্টারে খোঁজ নিয়েছিলাম আর কোন মুসলিম এই হোটেলে আছে কিনা? তারাই আমাকে তোমাদের দু’জনের নাম বলেছিল।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু তোমরা তো দুই প্রান্তের দুইজন, তোমাদের পরিচয় কিভাবে? না বন্ধু ছিলে তোমরা?’
‘না কেউ কাউকে চিনতাম না। আমি যেদিন হোটেলে আসি, সেদিন রিসেপশনে ‘হালাল’ খাবার নিয়ে আলাপ করছিলাম। এ সময় যায়েদ পাশে দাড়িয়ে ছিল। সে অযাযিতভাবেই আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এভাবেই আমাদের পরিচয়।’ বলল তরুণীটি।
‘তোমরা কি হালাল-হারাম মান? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ঠোটে এক টুকরো হাঁসি।
‘না মানলে মুসলমানিত্ব থাকবে কি করে?’ তরুণটি বলল।
আহমদ মুসার ঠোটে আরও স্পষ্ট মিস্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘মুসলমানিত্ব রক্ষার জন্যে আর কি কর? তোমরা দুজন কি আসরের নামাজ পড়েছ?’
তরুণ-তরুণী দুজনের মুখই ম্লান হয়ে গেল। মুখ নিচু হয়ে গেল তাদের। একটু পরেই তরুনীটি মুখ তুলল। বলল, ‘স্যরি ভাইয়া। আমি নামাজ পড়ি। তবে বাইরে বেরুলে অনেক সময় অবস্থার কারণে পড়তে পারি না। কিন্তু কাজা পড়ে নেই।’
যায়েদ ফারুকের মুখ লাল। তরুনীটি মানে ফাতিমা কামাল থামতেই যায়েদ ফারুক বলে উঠল, ‘আমার জবাব দেবার কিছু নেই ভাইয়া। আমাকে কেউ কোনদিন এভাবে বলেনি। নামাজ না পড়ার অপরাধ-বোধ আমার ভেতরে আছে। আমি আজ থেকে নামাজ পড়ব ভাইয়া।’
‘তোমাদের ধন্যবাদ।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘তোমরা জিজ্ঞেস করছিলে ওরা আমাকে তাড়া করার কারণ কি, তাই না? আমি স্ট্রাসবার্গ বিমানবন্দরে নামার পর থেকেই ওরা আমাকে ফলো করছে। আমি যেখানে যাচ্ছি, তারা পিছু পিছু যাচ্ছে। প্রথম দু’দিন আমি বুঝতে পারিনি। আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওদের মুখোমুখি হবো। তাদের মুখোমুখি হতে গিয়েই এই সংঘর্ষ।’ থামল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনের চোখে মুখে বিস্ময়। আহমদ মুসা থামতেই তারা বলল, ‘সাংঘাতিক ঘটনা। কিন্তু এ শত্রুতার কারণ কি?’
‘কারণ কি আমি জানি না। তবে আমি যেটা অনুমান করি, সেটা হলো ব্যাপারটা খুবই বড়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি সেটা?’ বলল ফাতিমা কামাল। তার চোখে শংকা।
আহমদ মুসার চোখে মুখে নেমে এল গাম্ভীর্য। ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার মনে হয় ‘স্পুটনিক’ নামের গোয়েন্দা সংস্থা যারা ধ্বংস করেছে এবং এর গোয়েন্দাদের যারা কিডন্যাপ করেছে, তারা বা তাদের ভাড়া করা লোক এরা।’ আহমদ মুসা থামল।
‘স্পুটনিকে’র নাম শুনেই চমকে উঠেছে যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেই। আহমদ মুসা যখন তার কথা বলা শেষ করল, তখন বিস্ময় শংকায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে তাদের চেহারা।
আহমদ মুসা থামলেও কয়েক মুহূর্ত তারা কথা বলতে পারল না। পরে ফাতিমা কামালই ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনি স্পুটনিকের ঘটনা জানেন? কিন্তু ওরা আপনার পেছনে লাগবে কেন?’
‘জানি। লা-মন্ডে পত্রিকায় পড়েছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আর ওরা আপনার পেছনে কেন? বলল ফাতিমা কামাল।
‘ওরা বোধ হয় ধরে নিয়েছে আমি যখন স্ট্রাসবার্গে এসেছি, তখন স্পুটনিকের ব্যাপার নিয়ে নিশ্চয় আমি কিছু করব। এ জন্যেই তারা আমার গতি বিধির উপর নজর রাখছে।’
যায়েদ ও ফাতিমার বিধ্বস্ত চার চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
এক সময় ফাতিমার ধীর কন্ঠ থেকে বের হয়ে এল, ‘আপনি কে ভাইয়া? আপনার কথা থেকেই প্রমাণ হচ্ছে স্পুটনিক ধ্বংসকারীরা আপনাকে চেনে এবং স্ট্রাসবার্গে এলে আপনি স্পুটনিক ঘটনার অনুসন্ধান করতে পারেন, তাও তারা জানে। কে তাহলে আপনি ভাইয়া?’
ফাতিমা থামতেই যায়েদ বলে উঠল, ‘ঠিক, আমরা এ পর্যন্ত তো আপনার কিছু জানি না। এমনকি আপনার নাম পর্যন্তও না। বলুন ভাই।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাকে আহমদ আবদুল্লাহ বলে ডাকাই যথেস্ট নয় কি?’
‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’ বলল ফাতিমা।
‘সৌদি আরব থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি এখানে এলেই স্পুটনিক ব্যাপারে অনুসন্ধান করবেন এটা তারা ভাবতে গেল কেন? আপনাকে কেমন করে ওরা চেনে?’ জিজ্ঞেস করল যায়েদ ফারুক।
‘আমি গোয়েন্দা কাজে খুব আগ্রহী। বিশেষ করে মুসলমানরা এ ধরনের কোন বিপদে পড়লে আমি সেখানে যাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু মনে হচ্ছে ওরা আপনাকে ভয় করে। সে জন্যে আপনার গতিবিধি ওরা পাহারা দিচ্ছে এবং সুযোগ পেয়েই আপনাকে আটকাবার বা মারার চেষ্টা করেছিল। এটা কেন?’ বলল ফাতিমা।
‘স্পুটনিকের ব্যাপারে কেউ খোঁজখবর নিক, কেউ এর সাথে জড়িয়ে পড়ুক তা নিশ্চয় তারা চায় না। কারণ এটাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরাও তো এই কাজেই এসেছি এবং এ নিয়ে প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থার সাথেও আলাপ করেছি। আমরা তাদের আত্মীয়। আমরা এ ঘটনায় জড়িত হয়ে পড়তেই পারি। কিন্তু আমাদের উপর তাদের চোখ পড়েনি।’ বলল ফাতিমা।
‘তোমরা তাদের আত্মীয়? কে তোমরা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
ফাতিমাই প্রথম কথা বলে উঠল। বলল, ‘আমি স্পুটনিকের নাম্বার ওয়ান গোয়েন্দা পরিচালক কামাল সুলাইমানের ছোট বোন। আমি বনের পারিবারিক বাড়িতে থাকি। স্পুটনিকের ব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্যেই এখানে এসেছি। শত্রু চোখ এড়াবার জন্যেই ভাইয়ার বাড়িতে উঠিনি। আর যায়েদও স্পুটনিকের দ্বিতীয় গোয়েন্দা পরিচালক আবদুল্লাহ ফারুকের ছোট ভাই। সেও একই লক্ষ্যে স্ট্রাসবার্গে এবং আমার মত একই কারণে হোটেলে উঠেছে।’
‘তোমাদের অভিনন্দন। তাহলে আমরা একই উদ্দেশ্যে স্ট্রাসবার্গে এসেছি এবং কাকতালীয়ভাবে একই হোটেলে অবস্থান করছি। শুধু একটাই পার্থক্য। আমি স্পুটনিকের সাতজন ঐতিহাসিক পরিচালকের কারও সাথেই কোনভাবে সম্পর্কিত নই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনাকেও ধন্যবাদ। আমাদের মধ্যে আরেকটা পার্থক্য আছে। সেটা হলো আমরা এসেছি রক্তের টানে, আর আপনি এসেছেন হৃদয়ের টানে। রক্তের টানের চেয়ে হৃদয়ের টানটাই বেশি মূল্যবান।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘এসব কথা থাক বোন। তোমরা এবার কাজের কথায় এস। কিছুক্ষণ আগে যা ঘটল, তাতে শত্রুর লেজে পা পড়েছে। এরা দ্রুত একটা পাল্টা ছোবল মারবে।’ বলল আহমদ মুসা।
যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেরই চোখে মুখে শংকা ফুটে উঠল। যায়েদ বলল, ‘তার মানে ওরা আক্রমন করবে?’
‘আমার তাই বিশ্বাস।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আক্রমনকারী গাড়ি দুটির নাম্বারসহ থানায় একটা ডায়েরী করতে চাই যে, গ্রীন সার্কেলের ইনার সার্কুলার রোডে আমি আক্রান্ত হই। দু’টি গাড়িতে দু’জন লোক আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে। ওদের একটা গাড়ি এবং তোমরা ঘটনার সাক্ষী।’
‘আমরা সাক্ষী হতে রাজি আছি। কিন্তু পুলিশের কাছে বিশেষ কোন সাহায্য মিলবে না।’ বলল যায়েদ।
‘আমি পুলিশের সাহায্য চাই না, আইনকে আমার পক্ষে চাই। এ জন্যেই এই ডায়েরী।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার চিন্তা ঠিক ভাইয়া। গ্রীন সার্কেলের একটু পরেই একটা থানা আছে। যাবার সময় ডায়েরী করা যাবে।’ ফাতিমা বলল।
‘যে গাড়ি ফেলে ওরা পালিয়েছে, সেই গাড়িও পুলিশের হাতে দেওয়া দরকার।’ বলল যায়েদ।
‘সার্কেল পুলিশকে ডেকে বললেই হবে।’ ফাতিমা বলল।
‘যায়েদ-ফাতিমা, ঘটনার ব্যাপারে তোমরা কি পরিমাণ এগিয়েছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না ভাইয়া। আমরা কিছুই এগুতে পারিনি। আমাদের দু’জনের পরিচয় হবার পর আমরা চেষ্টা করছি ভাইয়ারা যে সব করেছেন ও করছেন তার ভিত্তিতে ভাইয়াদের শত্রুদের একটা তালিকা করার।’ ফাতিমা বলল।
‘কিভাবে করছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘অতীতের পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে ও ভাইয়াদের বন্ধু-বান্ধবদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে।’ বলল যায়েদ।
‘আপনার কাজ কতদূর ভাইয়া?’ ফাতিমা বলল।
‘সবে আজ কাজ শুরু হলো। এ কয়দিন আমি শহর দেখে বেড়িয়েছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আজ কিভাবে কাজ শুরু হলো’, ফাতিমা বলল।
‘কিছুক্ষণ আগে গ্রীন সার্কেলে ওদের আক্রমনের মাধ্যমে। শুরুটা খুবই ভাল হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিভাবে?’ যায়েদ বলল।
‘শত্রুরা আক্রমন করা মানে শত্রুর সাথে দেখা হওয়া। তার মাধ্যমে শত্রুদের পরিচয় উদ্ধারের একটা সুযোগ সৃষ্টি হলো। গাড়ি চুরি করা ও গাড়ির লাইসেন্স ও ব্লবুক ভূয়া হতে পারে, কিন্তু ওগুলোতে হাতের যে ছাপ আছে তা ভূয়া নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই সংঘাত আরও সংঘাতের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সুতরাং আমি খুশি যে, আবারও তাদের দেখা পাব।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ও যায়েদের চোখে মুখে বিস্ময়। ফাতিমা বলল, ‘ওরা আবার আক্রমন করবে। আরও সংঘাত হবে। এতে আপনি খুশি। কিন্তু আমাদের তো বুক কাঁপছে।’
‘বুঝলাম, আপনি জাত গোয়েন্দা ভাইয়া। কিন্তু সংঘাতের রেজাল্ট পক্ষে-বিপক্ষে দুই-ই হতে পারে। বিপক্ষে যাবে সে ভয় আপনার নেই?’ বলল যায়েদ।
‘এসব ভাবলে তো এগুনো যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝা গেল, আপনি আমাদের মত সাধারণ কেউ নন এবং এও বুঝা গেল ওরা আপনাকে ভয় করে কেন?’ বলল ফাতিমা।
‘আমরা আনন্দিত ভাইয়া। আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন। আমরা যা করছি, সেটা পুলিশ যা করছে সে রকমই। কিছুই হবে না এতে।’ যায়েদ বলল।
যায়েদ থামতেই ফাতিমা কামাল বলে উঠল, ‘ভাইয়া, আমাদের দু’জনকে কি আপনি সাথে নিতে পারেন?’
ফাতিমার হঠাৎ এই প্রশ্নে আহমদ মুসা মুখ তুলে তাদের দিকে তাকাল। তারপর মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘নিতে পারি। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।’
‘কি সমস্যা?’ বলল ফাতিমা।
‘সমস্যা হলো তোমরা দু’জন বিবাহিত নও।’ আহমদ মুসা বলল।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনের মুখেই বিস্ময় ফুটে উঠল তারপর লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল মুখ।
সংগে সংগে কথা বলতে পারল না তারা। একটু পর ফাতিমা বলল, ‘আপনার কথা বুঝলাম না ভাইয়া। বিয়ের সাথে আমাদের প্রস্তাবের সম্পর্ক কি!’
‘অনধিকার চর্চার জন্যে মাফ করো বোন। আমি তোমাদের দু’জনের মধ্যেকার বিয়ের কথা বলছি। তোমাদের দু’জনের মধ্যে বিয়ে না হয়ে থাকলে কিংবা বিয়ে না হলে তোমরা দু’জনে যেমন একত্রে এভাবে কাজ করতে পার না, তেমনি তোমরা দু’জনে বিবাহিত হলেই শুধু তোমরা একত্রে আমার সাথে কাজ করতে পার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এর কারণ কি ভাইয়া?’ ফাতিমাই বলল আবার।
‘ইসলামের বিধান অনুসারে যাদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ নয়, এমন ছেলে মেয়েরা বিবাহ ছাড়া এভাবে মেলামেশা করতে পারে না। এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে নিভৃতে দু’জনের মধ্যে কিছুক্ষনের জন্যেও দেখা হওয়া নিষিদ্ধ।’
‘নিষিদ্ধ? মানে হারাম?’ বলল ফাতিমা।
‘হ্যাঁ, তাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কারণ?’ বলল ফাতিমা।
‘কারণ শয়তান মানুষকে খারাপ পথে টেনে নেবার জন্যে সদা প্রস্তুত। আর ইসলাম সকল অঘটনের পথ বন্ধ করতে চায়।’
‘বুঝেছি।’ লাজ রাঙা মুখে বলল ফাতিমা।
একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু ভাইয়া আমি ও যায়েদ এমন নিভৃতে অনেক বসেছি, মিশেছি।’
‘কিছু ঘটেনি। কিন্তু ঘটবে না এমন কথা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? আর ব্যতিক্রম তো থাকতেই পারে। কিন্তু আইন হয় সকলের জন্যে। সকলকেই সেই আইন মানতে হয়। ব্যতিক্রম যারা, তাদেরকেও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে তো আমরা এতদিন অপরাধ করেছি ভাইয়া। কিন্তু আমাদের কি দোষ? আমাদের জার্মানীতে মুসলিম পরিবারে এমন মেলামেশা আছে।’ ফাতিমা বলল।
‘আপনি কি ইসলামের সকল বিধিবিধান মেনে চলেন ভাইয়া?’ বলল যায়েদ।
‘পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে অনেক সময়ই পারি না। কিন্তু মানার ইচ্ছা আছে, চেষ্টা আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদেরও তাই করা উচিত। কিন্তু ভাইয়া আপনি যে বিষয়ে প্রস্তাব করেছেন, সেটা নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। যায়েদ ভেবেছে কিনা জানি না।’ বলল ফাতিমা।
যায়েদের মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আমি ভাইয়ার কাছে মিথ্যা বলব না। মিস ফাতিমা আমাকে মাফ করুন, আমি তাঁকে নিয়ে ভেবেছি।’
‘কিন্তু আমার অজ্ঞাতে সেটা, আমাকে কিছু বলনি কখনও।’ বলল ফাতিমা লজ্জায় লাল হয়ে।
‘দুঃখিত, ভাবনাটা কখন যে আমার মনে এসেছে বলতে পারব না। যখন ভাবনাটা আমার জন্যে সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে, তখন বিষয়টা বার বার আমি তোমাকে বলতে চেয়েছি, কিন্তু তুমি একে কিভাবে নেবে তাই বলতে সাহস পাই নি।’
‘তাহলে তুমি আমাকে ভয় কর দেখছি?’ ফাতিমার ঠোঁটে লজ্জা ও হাসির মিশ্রণ।
‘কারণ, সত্যিই তোমার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।’ বলল যায়েদ মুখ নিচু করে।
‘ও, এই কারণেই অপ্রয়োজনেও তোমাকে আমার কক্ষে আসতে দেখেছি।’ বলল ফাতিমা। তার কন্ঠে শাসনের সুর।
‘আমি দুঃখিত ফাতিমা আমার দূর্বলতার জন্যে।’ বলল যায়েদ নরম কন্ঠে।
ফাতিমা হেসে উঠল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘ভাইয়া, আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। আমরা ধরা পড়ে গেছি। আমি বিয়ের কথা ভাবিনি বটে, কিন্তু শুধু যায়েদ নয়, আমিও দেখছি ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমি ওর ঘরে যাইনি বটে, কিন্তু আমি মনে মনে চাইতাম ও আমার ঘরে আরও বেশি আসুক। আমি আরও স্বীকার করছি ভাইয়া। আপনার কথাই ঠিক। কিছু ঘটেনি বটে, কিন্তু সব কিছুই ঘটতে পারতো। আমি আপনার প্রস্তাবে রাজী ভাইয়া। এখন ওর মত জিজ্ঞাসা করুন।’ ফাতিমার শেষের কথাগুলো কান্নাজড়িত আবেগে রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
যায়েদ মুখ তুলে বলল, ‘অন্যায় অবাঞ্চিত গোপন দূর্বলতার জন্যে আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। অবাধ মেলামেশারই এটা স্বাভাবিক পরিণতি ছিল। ভাইয়া, আপনি ঠিকই বলেছেন এই অবস্থা অব্যাহত থাকা আর এক মুহূর্তও উচিত নয়। ফাতিমাকে ধন্যবাদ। ফাতিমা কি ভাববে এজন্যে আমার রাজী থাকার কথা বলতে পারিনি। আমি আনন্দের সাথে আমার মত দিচ্ছি।’
যায়েদ থামতেই ফাতিমা বলে উঠল, ‘আনন্দ শব্দ যোগ করার কোন দরকার ছিল না। ভাইয়া সম্মতির কথা জানতে চেয়েছেন, কোন বিশেষণ নয়।’
‘স্যরি। তবে এটা খারাপ বিশেষণ নয়, ভাল বিশেষণ।’ যায়েদ বলল।
‘প্যারিসের লোকদের ঘরোয়া বুদ্ধি মোটা শুনেছিলাম। আজ প্রমাণ পেলাম। আমাদের ‘বনে’ ব্যক্তির লজ্জাশীলতা এখনও আছে, প্যারিসে তা নেই।’ বলল ফাতিমা।
‘দেখুন ভাইয়া, ফাতিমা প্যারিস তুলে কথা বলছে। বন আর জার্মানীর কথা আমরা কম জানি না।’ কৃত্রিম ক্ষোভ ফুটে উঠল যায়েদের কন্ঠে।
ফাতিমা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে বলল, ‘বিয়েটা বন-প্যারিসের মধ্যে হচ্ছে না, হচ্ছে ফাতিমা ও যায়েদের মধ্যে। তাদের কালচার শুধুই বন ও প্যারিস ভিত্তিক নয়।’
থামল আহমদ মুসা। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তাহলে তোমরা তোমাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলো। শুভ কাজ সত্ত্বরই হয়ে যাওয়া উচিত।’
বলে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। তোমরা যাও অজু করে এস। দু’জনেই আমার সাথে নামাজ পড়বে।’
ওরাও আহমদ মুসার সাথে উঠে দাড়িয়েছে। আনন্দের সাথে ওরা চলল অজু করার জন্যে।
ঘুম ভেঙ্গে গেল আহমদ মুসার।
একটা শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেছে।
কিসের শব্দ?
ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা।
ঘর অন্ধকার। কিন্তু দক্ষিনের দেয়াল জোড়া নীল পর্দার মধ্যে দিয়ে বাইরের নগর রাতের নিস্তব্ধতা এসে ঘরের দক্ষিণ প্রান্তের স্বচ্ছতা কিছুটা ফিঁকে করে ফেলেছে।
আহমদ মুসা চোখ খোলার পর তার চোখ আশপাশটা ঘুরে এসে প্রথমেই সোজা গিয়ে নিবদ্ধ হলো দক্ষিণ দেয়ালের পূব প্রান্তের তার বরাবর পর্দার উপর। চোখ পড়তেই আটকে গেল সেখানে তার চোখ। পর্দা নড়ছে।
কেন নড়ছে? দক্ষিণে গোটাটাই কাঁচের দেয়াল। কোন ফাঁক নেই। বাতাসের প্রবাহ প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। তাহলে নড়বে কেন পর্দা?
নড়ে উঠা পর্দা আবার স্থির হয়েছে।
আহমদ মুসা চোখ সরায়নি পর্দার সেই অংশের উপর থেকে।
মুহূর্তকাল পরেই পর্দা ধীর গতিতে আবার দুলে উঠল এবং সেই সাথে একটা চলন্ত ছায়ামূর্তি পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এল।
ঘরের অন্ধকারে ছায়ামূর্তিটিকে আরও গাঢ় অন্ধকার দেখাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে আহমদ মুসা দেখল ছায়ামূর্তিটির ডান হাত কোমর পর্যন্ত উচুঁতে প্রসারিত। দেহটি সামনের দিকে একটু বেঁকে আসা।
লোকটির ডান হাতে রিভলবার এবং সে আক্রমণাত্মক ভংগিতে পা পা করে অতি সাবধানে তার বেডের দিকে এগিয়ে আসছে।
বুঝল আহমদ মুসা কি ঘটতে যাচ্ছে।
শক্ত হয়ে উঠল আহমদ মুসার দেহ। তার চোখ দু’টি স্থির নিবদ্ধ লোকটির উপর।
আস্তে আস্তে আহমদ মুসা তার ডান হাত বালিশের তলায় নিল। কিন্তু হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল কার রিভলবারটা জ্যাকেটের পকেটেই রয়ে গেছে। গত রাতে বাইরে থেকে ফেরার পর রিভলবারটা রীতি অনুসারে পকেট থেকে বের করে বালিশের তলায় রাখা হয়নি।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। যেদিন প্রয়োজন সেদিনই তার এ ভূলটা হয়ে গেছে।
লোকটি এগিয়ে আসছে।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘুমের ভান করে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আহমদ মুসা। যেহেতু ওর হাতে রিভলবার, তাই সে দূরে থাকতে প্রতিরোধ বা প্রতিআক্রমনের চেষ্টা করে লাভ নেই।
লোকটি খাটের কাছাকাছি পৌঁছে খাট ঘুরে আহমদ মুসার পেছন দিক থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। খাটের পশ্চিম পাশ দিয়ে আহমদ মুসার মাঝ বরাবর আসার পর লোকটি বাম হাত থেকে ডান হাতে রিভলবারটি নিল এবং লোকটির ডান হাত ঢুকে গেল তার পকেটে। বেরিয়ে এল সাদা রঙের কিছু একটা নিয়ে।
আহমদ মুসা বুঝল ওটা একটা সাদা রুমাল। সাদা রুমাল কেন? মনে প্রশ্নটা জাগার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বুঝল, নিশ্চয় ঐ রুমালের ভেতর রাখা আছে ক্লোরোফরম ক্যাপসুল। হাতের চাপে ওটা ভেঙে নিয়ে রুমাল নাকে চাপার সেকেন্ডের মধ্যেই একজন মানুষ সংগা হারিয়ে ফেলে।
লোকটির পরিকল্পনা বুঝে খুশি হলো আহমদ মুসা। এখন আহমদ মুসা নিশ্চিত যে, সে প্রথমেই গুলী করবে না।
লোকটি আহমদ মুসার ডান পাশ ঘুরে তার মাথার পেছনে আসছিল। তার রিভলবার ধরা বাম হাতটি তখন আহমদ মুসার ডান বাহুর উপরে। রিভলবারের নল আহমদ মুসার দেহকে তাক করে নয়, বুকের উপর দিয়ে সমান্তরাল।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল, লোকটি মাথার পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে ক্লোরোফরম করতে চায়। যাতে আহমদ মুসার ঘুম ভাঙলেও হাত দিয়ে আক্রমন করার উপযু্ক্ত সুবিধা না পায়।
তার আগেই তার হাতে যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছে তার সদ্ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিল। এমন একটি নিরাপদ সুযোগেরই সে অপেক্ষা করছিল।
সিদ্ধান্তের সাথে সাথেই কাজ।
আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুত বেগে উঠে এল এবং আঘাত করল লোকটির রিভলবার ধরা বাম হাতে।
রিভলবার তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা তার দেহটাকে একটা পাক দিয়ে মেঝেয় নেমে দাঁড়াল। কিন্তু আহমদ মুসা স্থির হয়ে দাঁড়াবার আগেই লোকটি আহমদ মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা সরে দাঁড়াবার সুযোগ পেল না। সে পড়ে গেল মেঝের উপর এবং তার দেহের উপর এসে পড়ল লোকটি।
লোকটি এসে পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা তাকে কঠিনভাবে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ফেলল, যাতে সে এ্যাকশনে যাবার সুযোগ না পায়। তারপর আহমদ মুসা লোকটির পাল্টা কিছু শুরু করার আগেই নিজের দেহটায় একটা মোচড় দিয়ে লোকটিকে নিচে ফেলল। তারপর তাকে কাবু করার জন্যে আহমদ মুসা তার বুকে উঠে বসার জন্যে দেহটাকে একটু গুটিয়ে নিতে গেল। তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই আহমদ মুসার দেহের চাপ কিছুটা লুজ হয়েছিল মুহূর্তের জন্যে। এই সুযোগই কাজে লাগাল লোকটি। সে দেহটাকে একটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আহমদ মুসাকে ছিটকে ফেলে আবার সে আহমদ মুসার উপর চেপে বসল।
কিন্তু সেও আহমদ মুসাকে সামলাতে পারল না। আহমদ মুসা আবার লোকটিকে ফেলে দিয়ে তার উপর চড়ে বসল।
ঠিক এই সময় অন্ধকারের ভেতর থেকে একজন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসার উপর ঝাপিয়ে পড়া এই লোকটি দক্ষিণ দেয়ালের পশ্চিম পাশ দিয়ে কাঁচ কেটে ভিতরে প্রবেশ করেছিল। আহমদ মুসার নজর শুধু পুব দিকে নিবদ্ধ ছিল বলে পশ্চিম দিক দিয়েও যে আরেকজন ঘরে প্রবেশ করছে সেটা দেখতে পায়নি।
লোকটি এতক্ষন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শত্রু-মিত্র চেনার চেষ্টা করেছে। নিশ্চিত হয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসা ছিটকে পড়ল পাশেই। আকষ্মিক এই আক্রমনের জন্যে প্রস্তুত ছিল না আহমদ মুসা। ঘাড়ে আঘাত পেল সে।
ছিটকে পড়ার পর নিজেকে সামলে নিতে একটু দেরী হলো আহমদ মুসার। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। এ সময় ওরা দু’জন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।
আহমদ মুসা চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ল আবার।
আছড়ে পড়ার পর আহমদ মুসা অনুভব করল তার ডান হাত গিয়ে পড়েছে একটা শক্ত ধাতব জিনিসের উপর। হাত নেড়ে পরীক্ষা করে আনন্দিত হলো আহমদ মুসা ধাতব জিনিসটি একটি রিভলবার। আহমদ মুসার মনে পড়ল এই রিভলবারটিই প্রথম লোকটির হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল।
ওরা দু’জন এসে চেপে বসেছিল আহমদ মুসার উপর। ক্লোরোফরমের গন্ধ আবার পেল আহমদ মুসা। বুঝল, ওরা তাকে সংগাহীন করার চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা তার ডান হাত সক্রিয় করল। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, রিভলবার ব্যবহার না করে উপায় নেই।
ডান হাতটা টেনে এনে আহমদ মুসা প্রথম গুলীটা করল তার উপর চেপে বসা একজনের বুকের পাঁজরে ঠেকিয়ে।
লোকটা বুক ফাটা চিৎকার করে তার বুকের উপর থেকে উল্টে পড়ল তার পাশের লোকটির উপর।
আহমদ মুসা আর ঝুঁকি নেয়া ঠিক মনে করল না। দ্বিতীয় লোকটির হাতে রিভলবার থাকতে পারে। সে এবার রিভলবার ব্যবহারে মরিয়া হয়ে উঠবে।
ইতিমধ্যে পাশের লোকটি চিৎকার করে উঠেছে, ‘কুত্তার বাচ্চা গুলী করেছ। তোমাকেও মরতে…..’
লোকটি কথা শেষ করতে পারল না। আহমদ মুসার রিভলবার শব্দ লক্ষ্যে পর পর দু’বার অগ্নিবৃষ্টি করল।
লোকটি চিৎকার করারও সুযোগ পেল না। নিরব হয়ে গেল।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। কক্ষের আলো জ্বেলে দিয়ে সোজা টেলিফোনের কাছে গেল। টেলিফোন করল হোটেল সিকুরিটিকে। বলল, ‘আমার ঘরে দু’জন লোক ঢুকে আমাকে আক্রমন করেছিল। দু’জনেই নিহত হয়েছে। আপনার আসুন, পুলিশে খবর দিন।’
সংগে সংগেই হোটেল সিকুরিটির লোকেরা এসে গেল। দশ মিনিটের মধ্যেই এসে গেল পুলিশ। এল গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনও।
পুলিশের হাঙ্গামা শেষ হতে সকাল ৮টা বেজে গেল। পারিপার্শ্বিক সব তথ্যাদি পাওয়ার পর পুলিশ আহমদ মুসার বক্তব্য গ্রহন করেছে। প্রথমত, প্রমাণিত হয়েছে লোক দু’জন হোটেলের সম্মুখ দরজা দিয়ে বৈধভাবে প্রবেশের কোন রেকর্ড নেই। দ্বিতীয়ত, প্রমাণিত হয়েছে অসৎ উদ্দেশ্যে তারা লাইলন কর্ড ব্যবহার করে পেছন দেয়াল বেয়ে আহমদ মুসার ঘরে প্রবেশ করেছে। লোক দু’জনের জুতার তলায় হোটেলের দেয়ালের পিংক রং পাওয়া গেছে। তৃতীয়ত, গোয়েন্দা পুলিশের মাইক্রো এক্সরে ক্যামেরায় দক্ষিণ দেয়ালের যে গ্লাস কেটে ওরা দু’জন প্রবেশ করেছিল, তাতে তাদের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। চতুর্থত, ক্লোরোফরম লোক দু’জনই বহন করেছে তার প্রমাণ তাদের পকেট থেকে পাওয়া গেছে। সর্বশেষ আহমদ মুসার হাতে যে রিভলবার আছে তাতে নিহত দু’জনের একজনের হাতের আঙুলের ছাপও পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, আহমদ মুসা নির্দোষ এবং লোক দু’জন আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করতে এসেই নিহত হয়েছে। তাদের মোটিভ হিসেবে রেকর্ড করেছে, স্পুটনিক ঘটনায় অপহৃতদের দু’জন আত্মীয় আহমদ আবদুল্লাহ (আহমদ মুসা)সহ এসেছেন স্ট্রাসবার্গে স্পুটনিকের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এবং স্পুটনিকের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের আক্রমনের এরা শিকার হয়েছে।
পুলিশ এই কেসকে ডাকাতি ও অপহরণ করার চেষ্টার মামলা হিসেবে গ্রহন করে আহমদ মুসাকে সব সন্দেহ ও দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছে এবং পুলিশবাদী কেস হিসেবে একে গ্রহন করা হয়েছে।
আহমদ মুসার কক্ষকে পুলিশ সীল করল। হোটেল কর্তৃপক্ষ আহমদ মুসাকে হোটেলের সর্বোচ্চ তলায় একটা অধিকতর নিরাপদ কক্ষ বরাদ্দ করল।
পুলিশ চলে যেতেই ফাতিমা কামাল আহমদ মুসাকে বলল, ‘ভাইয়া, বেয়ারা আপনার সুটকেস আপনার ঘরে নিয়ে যাক। আপনি এখন আমার ঘরে চলুন। ওখানে যায়েদ অপেক্ষা করছে। অনেক জরুরী কথা আছে।’
বলেই, ফাতিমা কামাল বেয়ারাকে আহমদ মুসার সুটকেস তার কক্ষে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসার হ্যান্ড ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘আসুন ভাইয়া’।
আহমদ মুসা তার সাথে হাঁটতে শুরু করল।
ফাতিমা কামালের ঘরে এসে বসল সবাই।
আহমদ মুসা বসতেই যায়েদ বলে উঠল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর যে, তিনি ভয়ংকর ঘটনা থেকে আপনাকে রক্ষা করেছেন, আমাদেরকেও সাহায্য করেছেন।’
‘আমার কিন্তু এখনও স্বপ্ন মনে হচ্ছে যায়েদ। অন্ধকার রাত। দু’জন লোক টার্গেট করে দেখে শুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু যারা আক্রমন করল তাদেরকে তাদেরই রিভলবার দিয়ে হত্যা করা হলো। এ যেন জগতের শীর্ষ এক গোয়েন্দা কাহিনী।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘তুমি ঠিকই বলেছ ফাতিমা। আশায় আমার বুক ভরে উঠেছে। আমাদের জন্যে যা অসম্ভব, আমাদের জন্যে যা অকল্পনীয়, সেটাই আমাদের এই নতুন ভাইয়ার জন্যে খুবই সাধারণ। আল্লাহ তাঁকে পাঠিয়েছেন আমাদের মহাসংকটে। বুক আমার ভরে উঠেছে আশায়।’ বলল যায়েদ।
‘একজন গোয়েন্দা অফিসার কি মন্তব্য করেছেন জান। বলেছেন, ‘আটঘাট বাধাঁ ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচা অসম্ভব ছিল। মি.আহমদ আবদুল্লাহ নিশ্চয় অসাধারণ লোক।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘এই জন্যেই বিপদ তাঁর উপর এসে চেপে বসেছে। নতুন বিপদও আসন্ন।’ যায়েদ বলল।
‘কি বিপদ?’ সংগে সংগেই প্রশ্ন করে উঠল ফাতিমা কামাল। উদ্বেগে তার দু’চোখ কপালে।
‘ঐ বিপদের কথাই তো তোমাকে বলেছি। ভাইয়াকে এখনই আসতে বলেছিলাম সে কথা বলার জন্যেই।’ বলল যায়েদ।
‘বল তাড়াতাড়ি।’ ফাতিমা কামাল বলল।
‘রাতে ঘটনার খবর পাওয়ার পর থানা কর্মকর্তার সাথে পুলিশের যে বড় অফিসার, সহকারী পুলিশ কমিশনার এসেছিলেন, তিনি আমার পরিচিত। আমার এক বন্ধুর বড় ভাই। ভোর পর্যন্ত তিনি এখানে ছিলেন। তারপর চলে যান। দশ মিনিট আগে আমাকে টেলিফোন করে ভয়াবহ খবর দিলেন। সেটা হলো, পুলিশ কমিশনার হঠাৎ উল্টে গেছেন। তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন সুযোগমত কোন রেকর্ড বা সাক্ষী না রেখে ভাইয়াকে গ্রেপ্তার করতে। তিনি মনে করেন, ভাইয়াকে যারা অপহরণ করতে গিয়েছিল তাদের পেছনে সাংঘাতিক বড় কোন পক্ষ আছে, হতে পারে তারা স্পুটনিক ধ্বংস ও এর ৭জনকে অপহরণ করার সাথে জড়িত। তিনি আশংকা করেন পুলিশ ভাইয়াকে ধরে নিয়ে গিয়ে ঐ পক্ষের হাতে তুলে দিবে।’ থামল যায়েদ।
সংগে সংগেই ফাতিমা কামাল বলে উঠল, ‘কিভাবে পুলিশ গ্রেফতার করবে? পুলিশের স্পট ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টের (SIP) যে কপি ভাইয়াকে পুলিশ দিয়েছে তাতে তাকে সব সন্দেহ থেকে মুক্ত করা হয়েছে।’
‘বললাম তো, পুলিশ তো আইনের মাধ্যমে গ্রেপ্তার দেখাবে না। কোন রেকর্ড বা সাক্ষী না থাকে এমনভাবে কথা বলার জন্যে তাকে তুলে নিয়ে এবং তারপর গায়েব করবে।’ বলল যায়েদ ফারুক।
‘ফরাসী পুলিশের একজন শীর্ষ অফিসারকে এইভাবে মুহূর্তে পাল্টে ফেলল, এই পক্ষটা আসলে কে?’ ফাতিমা কামাল বলল।
যায়েদ ফারুক কিছু বলল না।
আহমদ মুসার ঠোঁটের কোণে কেবল এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘চিন্তা করো না ফাতিমা। নিশ্চয় শীঘ্র তাদের পরিচয় দিনের আলোতে বেরিয়ে আসবে। সে পর্যন্ত ধৈর্য্য ধর।’ বলল আহমদ মুসা শান্ত কন্ঠে।
‘আল্লাহ সেটা করুন, কিন্তু তার আগে তো মহাবিপদ। সব তো শুনলেন ভাইয়া, আমরা এখন কি করব?’ ফাতিমা কামাল বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই। শত্রুরা এসব করে আমাদেরই সাহায্য করছে।’
‘কিভাবে ভাইয়া?’ দু’চোখে কপালে তুলে প্রশ্ন করল যায়েদ ফারুক।
‘শত্রুরা আমাদেরকে চেনে, আমরা তাদের চিনি না। তারা এ্যাকশনে না এলে আমরা এ্যাকশনে যাব কি করে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম। তারা এ্যাকশনে এল। সেই পরিমাণে এ্যাকশনে যাবার ক্ষমতা কি আমাদের আছে? তার উপর দেখছি পুলিশ ওদের সহযোগিতা করবে বলল।’
‘এটা নতুন কিছু নয়। পুলিশের একটা গ্রুপ নিশ্চয় ওদের সহযোগিতা করে আসছে। তা না হলে স্পুটনিক মামলাটা এগুচ্ছে না কেন?’
‘ডবল বিপদ। এখন তাহলে আমাদের কি করণীয়? বুঝা যাচ্ছে, পুলিশ এখন ওঁৎ পাতছে আপনাকে ধরার জন্যে।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল ফাতিমা কামাল।
‘এত উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই বোন। হোটেল কর্তৃপক্ষকে আমি এখনি জানিয়ে দিচ্ছি। হোটেলে কক্ষ আমার ঠিকই থাকবে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে আমি বাইরে থাকব।’ শান্ত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা কোথায় যাবো?’ জিজ্ঞেস করল ফাতিমা কামাল।
‘তোমাদেরকে হোটেল ছেড়ে দিতে হবে। তোমরা তোমাদের আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠবে। অথবা বাড়ি চলে যাও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না ভাইয়া। আত্মীয়রা এমনিতেই বিপদের মধ্যে আছে। তাদের বিপদ বাড়াতে চাই না। আপনাকে সে খবর তো এখনও বলিনি। আমাদের দু’জনের আত্মীয়ের বাসা আজ রাতে তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হয়েছে। অন্যান্য……………’
কথা শেষ করতে পারলো না যায়েদ। আহমদ মুসা তার কথার মাঝখানে বলে উঠল, ‘তোমাদের দু’জন আত্মীয় মানে আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও কামাল সুলাইমানের বাসা?’
‘জি ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘কারা সার্চ করেছে, পুলিশ?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘পুলিশ নয়। অন্য কেউ। বাড়ির সবাইকে ক্লোরোফরম করে অঢেল সময় নিয়ে তারা বাড়িতে কি যেন খুঁজেছে। প্রতিটি সুটকেস, ব্যাগ, কাপবোর্ড, ড্রয়ার, আলমিরাসহ বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা তারা সার্চ করেছে। এমন কি সোফা, চেয়ারের গদিও তারা ফেঁড়ে দেখেছে।’ বলল যায়েদ।
‘অন্য পাঁচজনের বাসা?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘খবর জানতে পারিনি। তবে আরও জানতে পেরেছি, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও কামাল সুলাইমানের বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজন যারা স্ট্রাসবার্গে আছেন, তাদের বাসাও এভাবে সার্চ করা হয়েছে।’ বলল যায়েদ।
‘বল কি?’
বলে আহমদ মুসা অল্প কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘কোন অতিমূল্যবান দলিল বা কোন প্রমাণ তারা হাত করতে চায়। কিন্তু সে দলিল বা প্রমাণ কোথায় আছে তা তারা জানে না। আমার মনে হচ্ছে, অন্য পাঁচজনের বাড়ি ও তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের বাড়িও আজ রাতে সার্চ করা হয়েছে।’
থামল আহমদ মুসা। কিন্তু তার কপাল তখনও কুঞ্চিত। ভাবছে সে। আবার সে বলা শুরু করল, ‘এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার তিনটা জিনিস মনে হচ্ছে-এক, ৭জন যাদের অপহরণ করা হয়েছে তাদের ইন্টেরোগেট করেও কোন এক মূল্যবান দলিলের হদিস বের করতে শত্রুরা পারেনি। অবশেষে নিজেরাই দলিল উদ্ধারে বের হয়েছে। দুই, সবকিছু সমেত স্পুটনিক অফিস পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও কোন অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল বা প্রমাণ এখনও অক্ষত আছে যা স্পুটনিক অফিসের বাইরে কোথাও সরিয়ে রাখা হয়েছিল। তিন, আমার মনে আশা জাগছে, এই দলিল হাত করার পূর্ব পর্যন্ত অপহৃতদের শত্রুরা হত্যা করবে না।’ থামল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ও যায়েদ হা করে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। ফাতিমার দু’চোখের কোনায় অশ্রু চিক চিক করছে।
দু’জনেই কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।
প্রথম তাদের নিরবতা ভাঙল ফাতিমা। বলল, ‘ভাইয়া, আল্লাহ আপনার কথা মঞ্জুর করুন। তারা বেঁচে আছেন, একথা সত্য হোক।’ কান্নায় ভারী হয়ে গেল ফাতিমার কন্ঠ।
‘ভাইয়া, আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আপনার মত সাহসী, শক্তিমান ও তীক্ষ্ণধী সংগ্রামী মানুষের আমাদের প্রয়োজন ছিল। আল্লাহ তা পূরণ করেছেন।’
বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘ভাইয়া, বাড়ি সার্চ করা থেকে আপনি যে তিনটি জিনিস বের করে আনলেন, তার প্রতিটি অক্ষর আমার কাছে সত্য মনে হচ্ছে। ভাইয়া বলুন, এখন আমরা কি করতে যাচ্ছি। আমরা তিনজনেই তো একটা বাড়ি নিতে পারি।’
‘না, তোমরা এক সাথে বাড়ি নিতে পার না। তোমরা………..’
আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মাঝখান থেকে যায়েদ বলে উঠল, ‘ভাইয়া, আমি ও ফাতিমা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। দু’জনের পরিবারকেও জানিয়েছি। এখন আপনার অনুমতি হলেই আমরা বিয়ে করতে পারি।’ লজ্জা সংকোচে বিব্রত কন্ঠ যায়েদের।
লজ্জা এসে ছেয়ে ফেলেছে ফাতিমার মুখে। রাঙা হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল। নত মুখে সেও বলে উঠল, ‘ভাইয়া, ও ঠিকই বলেছে।’
‘আমার অনুমতি কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আপনাকেই আমরা প্রকৃত অভিভাবক মনে করছি। আপনি যেভাবে আমাদের কল্যাণ কামনা করেছেন, যেভাবে আপনি আমাদের ব্যক্তি জীবনের দিকে তাকিয়েছেন, খোলামেলা পরামর্শ দিয়েছেন, সেভাবে আমাদের পরিবার আমাদের দিকে কখনও তাকায়নি।’ বলল যায়েদ।
‘তবু আমি তোমাদের পরিবারের কেউ নই। পরিবারের অনুমতি তোমাদের অবশ্যই নিতে হবে। তোমরা পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু সব মুসলমানই তো ভাই ভাই এবং একটি পরিবারের মত।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘হ্যাঁ, ইসলাম এটা বলেছে। কিন্তু সেই সাথে পারিবারিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে বলেছে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া প্রথম কর্তব্য বলে উল্লেখ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে ভাইয়া। আমরা পরিবারকে জানিয়েছি মানে তাদের অনুমতিও নিয়েছি।’ বলল ফাতিমা।
‘ধন্যবাদ। তাহলে যায়েদ তুমি প্যারিসে তোমার দু’একজন নিকটতম লোকদের নিয়ে জার্মানির বনে ফাতিমার বাড়িতে যাও। সেখানেই বিয়ে অনুষ্ঠিত হোক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, তাহলে আপনাকে যেতে হবে। সবাই খুশি হবে।’ বলল ফাতিমা।
‘পরে যাব। তোমাদের দু’জনের শুধু নয়, স্পুটনিকের ৭জনের পরিবার সম্পর্কে আমার দারুণ আগ্রহ। পরিবারগুলোকে আমি দেখতে চাই, তাদের কথা শুনতে চাই। কি করে এই ঐতিহাসিক ও সেকুলার পরিবারগুলো থেকে স্পুটনিকের জন্ম হলো, তা জানার আমার ইচ্ছা অসীম। এই পরিবারগুলো একদিন মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে, মুসলিম উম্মাহর বর্তমান বিপর্যয়ের জন্যে এই পরিবারগুলো বিরাটভাবে দায়ী। সেই পরিবার থেকেই আবার স্পুটনিকের জন্ম কেমন করে হলো তা আমি জানতে চাই।’ থামল আহমদ মুসা। আবেগে তার কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল।
ফাতিমা ও যায়েদের বিস্ময় ও শ্রদ্ধামিশ্রিত চার চোখ নিবদ্ধ ছিল আহমদ মুসার উপর। বলল, ভাইয়া, চাচাতো ভাই কামাল সুলাইমানের পরিবর্তন কিভাবে হলো সেটা আমাদের কাছে বিস্ময়। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের উত্তর পুরুষ কামাল সুলাইমান কামাল আতাতুর্কের মতই ইসলামের প্রতি ক্রিটিক্যাল ছিল। নিউইয়র্কের টুইন (লিবার্টি ও ডেমোক্রেসি)টাওয়ার ধ্বংসের জন্যে মুসলমানরা যখন অভিযুক্ত হলো, তখন সে ইসলাম ও মৌলবাদী মুসলমানদের গালিগালাজ করার ব্যাপারে অন্যান্যা জার্মানদের চেয়েও অগ্রণী ছিল। তারপর হঠাৎ করে তার পরিবর্তন ঘটল। শুধু তার পরিবর্তন নয়, গোটা পরিবারকেও সে পরিবর্তন করে ছেড়েছে। আমার সাথে দেখা হলেই বলতো, ‘হাসবি কম। মনে রাখবি তুই মজলুম মুসলিম জাতির একজন সদস্য।’ মাঝেই মাঝেই আরও বলত, ‘জানিস মুসলমানদের উপর আজ যে যুলুম চলছে তার জন্যে মুসলমানরা দায়ী নয়, দায়ী একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। যারা মুসলমানদের ঘর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে, যারা তাদের সহায় সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে, তারাই পুলিশ সেজে চুরি ডাকাতির অভিযোগে মুসলমানদের গ্রেফতার করছে এবং নিজেরা চুরি ডাকাতি ও খুন জখম সংঘটিত করে মুসলমানদের ফাঁসিতে লটকাচ্ছে।’ থামল ফাতিমা। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল তার কন্ঠ।
আহমদ মুসা সংগে সংগে কথা বলল না। তারও মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
যায়েদের মুখ নিচু।
আহমদ মুসাই নিরবতা ভাঙল। বলল, ‘আলহামদুল্লিাহ। কামাল সুলাইমান ‘কামাল’ না হয়ে ‘সুলাইমান’ হয়েছেন।’
‘বুঝলাম না ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘অর্থ হলো কামাল সুলাইমান তুরষ্কের মোস্তফা কামাল না হয়ে তুরষ্কের ওসমানীয় খিলাফতের ‘সুলাইমান, দি ম্যাগনিফিসেন্ট’ হয়েছেন। সুলাইমান দি ম্যাগনিফিসেন্ট (১৪৯৪ খৃঃ-১৫৬৬খৃঃ) তুর্কি খিলাফতের সবচেয়ে সফল শাসক। গোটা ভূমধ্যসাগরে তার নৌবাহিনী ছিল অপ্রতিরোধ্য।’
কথা শেষ করে একটু থামতেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘ইতিহাসের এসব কথা থাক। এস, বর্তমান নিয়ে ভাবি।’
ফাতিমা কামাল চোখ মুছে বলল, ‘আপনিও আমাদের সাথে ‘বন’ এ যাবেন, একথা এখনও বলেননি।’
‘না বোন এ সময় নয়। শত্রুরা অনেক কাছাকাছি এসেছে। এ সময় দূরে সরা যাবে না। ওরা আমাদের বাড়িতে ঢুকেছে, এখন আমরা ওদের বাড়িতে ঢুকতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা নরম কন্ঠে।
‘তাহলে ‘বন’ থেকে ওদের আসতে বলি। যায়েদও বলুক তার পরিবারকে আসার জন্যে। বিয়ে স্ট্রাসবার্গেই হবে।’ ফাতিমা বলল দৃঢ় কন্ঠে।
‘ফাতিমা ঠিকই বলেছে। এটাই হবে।’ বলে একটু থামল যায়েদ। একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, ‘তাহলে বাড়ি নেয়ার কি হবে? আজ এ মুহূর্তেই তো আপনার হোটেল থেকে সরা দরকার ভাইয়া।’
‘ঠিক আছে। একটা বাড়ি আজই ঠিক করে ফেল। লোকেশন যাতে নিরিবিলি ও নিরাপদ হয়। বাড়িটার এক অংশে আমি থাকব। অন্য অংশে বিয়ের পর তোমরা থাকবে।’
‘তাহলে ভাইয়া, আমি বাড়ির খোঁজে বের হচ্ছি। উঠব, অনুমতি দিন।’
‘ঠিক আছে, আমিও বের হচ্ছি। চল।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাড়াল।
‘কিন্তু বাইরে তো পুলিশ ওঁৎ পেতে আছে।’ এক সাথে বলে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ। তাদের কন্ঠে প্রতিবাদের সুর।
‘শুধু পুলিশ কেন, ওরাও ওঁৎ পেতে থাকার কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে বেরুবেন কেন?’ দুজনেই আবার বলে উঠল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘পুলিশ এবং ওরা জানে আমি হোটেলে আছি। এই অবস্থায় বাইরে যাওয়া ও ভেতরে থাকা এক কথাই। পুলিশ পক্ষে থাকলে হোটেলের ভেতরটা ওদের জন্যে আরও সুবিধাজনক।’
বলে আহমদ মুসা সোফায় সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘তোমরা চিন্তা করো না। আল্লাহ আছেন।’
উঠে দাড়াল আহমদ মুসা।
যায়েদও উঠে দাড়াল। বলল, ‘আপনি এগোন ভাইয়া, আমি আমার রুম থেকে আসছি।’
যায়েদ সালাম দিয়ে কক্ষ থেকে বেরুবার জন্যে হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসাও।
নিরব ফাতিমা। উদ্বিগ্ন তার দু’চোখ। শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকল ওদের যাত্রা পথের দিকে।
৩
আজর ওয়াইজম্যানের চোখ দু’টি তার সামনে টেবিলে রাখা দু’টি ফটোর উপর স্থিরভাবে নিবদ্ধ।
দু’টি ফটোই আহমদ মুসার বলে কথিত। একটি ফটো ওয়াইজম্যানদের ফটো। আহমদ মুসার ফটো হিসাবে ফাইলে সংরক্ষিত। আরেকটি ফটো স্ট্রাসবার্গ পুলিশের কাছ থেকে সদ্য সংগৃহীত। ফটোটি পুলিশ তুলেছে আহমদ মুসার হোটেল কক্ষে দু’জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর।
আজর ওয়াইজম্যানের হাতে একটা পাওয়ারফুল এ্যামপ্লিফায়ার লেন্স। সেটা দিয়ে খুঁটে খুঁটে সে পরীক্ষা করছে ফটো দু’টিকে।
আজর ওয়াইজম্যান ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির (WFA) প্রধান। সাও তোরাহ দ্বীপ থেকে মাত্র কিছুক্ষণ আগে সে স্ট্রাসবার্গে পৌছেছে।
ফটো দুটি গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করার পর মুখ তুলল আজর ওয়াইজম্যান। হাতের লেন্সটা টেবিলে রেখে সামনে বসা WFA এর স্ট্রাসবার্গ এর স্টেশন চীফ লাইবারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমাদের ফাইল ফটোর সাথে হোটেলের কথিত আহমদ মুসার ফটোর মুখের আদল হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিন্তু চোখ-মুখের মাইক্রো রিডিং মিলছে না। একেবারেই আলাদা। এটা কি করে সম্ভব বুঝতে পারছি না।’
আজর ওয়াইজম্যান থামতেই লাইবারম্যান বলে উঠল, ‘কিন্তু হোটেলের এই লোক আহমদ মুসা হতেই হবে। গ্রীন সার্কেল ও হোটেলের সাংঘাতিক ঘটনা প্রমাণ করছে লোকটি আহমদ মুসা না হয়েই পারে না। হোটেলের ঘটনায় পুলিশ পর্যন্ত বিস্মিত হয়েছে। সাফল্যের সাথে আমাদের লোকেরা হোটেল কক্ষে প্রবেশ করেছিল। পুলিশের মতে তারা প্রথমে আক্রমণ করারও সুযোগ পেয়েছিল। ক্লোরোফরম ভেজা রুমাল খাটের পাশে পাওয়ার অর্থ আহমদ মুসাকে তারা নিদ্রিত অবস্থায় পেয়েছিল এবং তাকে সংগাহীন করার জন্যে ক্লোরোফরমসহ রুমালও তারা বের করেছিল। কিন্তু নিদ্রিত অবস্থায় প্রথমে আক্রমণ করেও দু’জনে আহমদ মুসাকে এঁটে উঠতে পারেনি। আহমদ মুসার মত অসাধারণ কেউ না হলে এটা সম্ভব ছিল না।’
‘আমার কথাও এটাই। মদিনা থেকে স্ট্রাসবার্গে আসা আহমদ মুসার সিডিউলের সাথে এ লোকটির স্টাসবার্গে আসার সিডিউল মিলে যাচ্ছে। চেহারা ও মুখের আদলটাও মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আসল জায়গায় তো মিলছে না’, বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কোন কারণ নিশ্চয় আছে। কিন্তু লোক যে একই এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।’ লাইবারম্যান বলল।
‘সে কারণটা কি হতে পারে?’ জিজ্ঞেস করল আজর ওয়াইজম্যান।
‘হতে পারে দুটি ফটোগ্রাফের কোন একটিতে আহমদ মুসার ছদ্মবেশ আছে।’ বলল লাইবারম্যান।
‘কিন্তু ছদ্মবেশ তো মুখের মাইক্রোরিডিং পাল্টাতে পারে না।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘পারে স্যার। প্লাস্টিক মেকআপ সম্পর্কে আমার বিশেষ পড়াশুনা আছে। আমি জানি, সর্বাধুনিক এমন কিছু প্লাস্টিক মেকআপ আছে যা সব দিক দিয়ে চামড়ার মত। চামড়ার মতই এতে রেখা, লোম ও লোমকূপ আছে। আলট্রা মাইক্রো লেন্সেও চামড়ার সাথে এর কোন ভিন্নতা ধরা পড়ে না।’ বলল লাইবারম্যান।
‘ধন্যবাদ লাইবারম্যান। আপনার এ মত আমি গ্রহন করছি এবং আমরা এখন এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, হোটেলের এই লোকটি আহমদ মুসাই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘অবশ্যই।’ বলল লাইবারম্যান।
‘তাহলে একথাও বলা যায় যে, সে এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘তা আমরা বলতে পারি। হোটেল কক্ষে নিহত হওয়ার ঘটনার পুলিশ রিপোর্টটি আহমদ মুসার পক্ষে গেলেও পুলিশ আমাদেরকে সহযোগিতা করবে তার ব্যবস্থা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার পুলিশের প্রতি কিছু নির্দেশ দিয়েছেন। তারা সুযোগমত আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তার করে আমাদের হাতে তুলে দেবে।’ বলল লাইবারম্যান।
‘পুলিশের সাহায্য একটা বাড়তি বিষয়। তাদের উপর নির্ভর করে বসে থাকা যাবে না।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘না স্যার। আমরা বসে নেই। হোটেলের চারদিকে আমরা ২৪ ঘন্টা পাহারা বসিয়ে রেখেছি। আমরা আহমদ মুসাকে চোখের আড়াল হতে দেব না। সুযোগ পেলে আমরা পুলিশের অপেক্ষা করব না। আমরা নিজেরাই তাকে জালে আটকাব।’ বলল লাইবারম্যান।
‘আমি চাই আহমদ মুসাকে ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপের খাঁচায় পুরতে। তাকে খাঁচায় ভরতে পারলে শুধু বহু তথ্য পাওয়া যাবে তা নয়, গোটা দুনিয়ায় আমাদের মিশন নিরাপদ হয়ে যাবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের এতবড় বিপর্যয় ঘটাতে আহমদ মুসা পারল কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল লাইবারম্যান।
‘আহমদ মুসা শৃগালের মত ধূর্ত, বাঘের মত ক্ষিপ্র, সিংহের মত সাহসী এবং স্যার এ.এইচ. ডুনান্টের চেয়েও মানবিক এবং পোপের চেয়েও দয়ালু। কোন গুণের ঘাটতি তার ভেতর নেই। নিজের জীবন বিপন্ন করে বিপজ্জনক ওহাইও নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে এফবিআই চীফ মি.জর্জের নাতিকে উদ্ধার করে আহমদ মুসা এফবিআই চীফের হৃদয় জয় করে নেয়। সবুজ পাহাড় ও লস আলামাসের মধ্যকার আণবিক ও সামরিক তথ্য পাচারের ইহুদী গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করে তা মার্কিন সরকারের হাতে তুলে দেয়াসহ বহু নিঃস্বার্থ ও উপকারী কাজের মাধ্যমে সে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আস্থা অর্জন করে। অন্যদিকে সে আমাদের বেশ কিছু অপরাধমূলক বড় ধরনের কাজকে হাতে নাতে ধরিয়ে দেয়। এভাবেই সে গত একশ বছরে মার্কিন মাটিতে প্রোথিত আমাদের শেকড়কে আমূল উপড়ে ফেলার ব্যবস্থা করেছে। মার্কিন সরকার, মার্কিন কংগ্রেস ও মার্কিন সমাজে আমাদের শক্তিশালী লবি আজ সম্পূর্ণই অকার্যকর হয়ে পড়েছে এক আহমদ মুসার তৎপরতায়। এই আহমদ মুসাই এসেছে স্ট্রাসবার্গে। স্পুটনিক যে কাজ হাতে নিয়েছিল, সে কাজ করার জনেই সে যদি স্ট্রাসবার্গে এসে থাকে, তাহলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কয়েক বছর আগে সংঘটিত নিউইয়র্কের ‘লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসি’ টাওয়ার ধ্বংস আমরাই করেছি একথা যদি সে প্রমাণ করতে পারে, তাহলে দুনিয়ার কোথাও আমাদের জায়গা হবে না। সুতরাং স্ট্রাসবার্গে এখন আমাদের একমাত্র কাজ সর্বশক্তি দিয়ে আহমদ মুসাকে ধ্বংস করা।’
দীর্ঘ বক্তব্য দেয়ার পর থামল আজর ওয়াইজম্যান। তার চোখে-মুখে সফরের ক্লান্তি এবং কন্ঠে হতাশার সুর।
‘স্যার, আপনি কি নিশ্চিত আহমদ মুসা ‘স্পুটনিক মিশন’ নিয়ে স্টাসবার্গ এসেছে?’ বলল লাইবারম্যান উদ্বিগ্ন কন্ঠে।
‘এছাড়া কোন কাজে সে স্ট্রাসবার্গ আসবে? আহমদ মুসার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এ ধরনের মিশন নিয়ে সে বার বার বিভিন্ন জায়গায় গেছে। আর ‘স্পুটনিক মিশনে’র ব্যাপারটা সফল হয়, তাহলে একদিকে মুসলিম জাতিকে তারা ইতিহাসের জঘণ্য অপরাধের দায় থেকে বাচাঁতে পারবে, অন্যদিকে আমাদের তারা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘স্পুটনিকের সবই তো ধ্বংস হয়ে গেছে। তাছাড়া স্পুটনিকের সাত শয়তানও আমাদের হাতে। আহমদ মুসা যতই করিতকর্মা হোক, আমার বিশ্বাস খুব বেশি সামনে এগুতে পারবে না। আরেকটা বড় বিষয় হলো, স্ট্রাসবার্গ পুলিশের কাছ থেকে সে ভাল সহায়তা পাবে না।’ লাইবারম্যান বলল।
লাইবারম্যানের চোখে-মুখে যতটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠেছিল, ততটাই অস্বস্তি প্রকাশ পাচ্ছিল আজর ওয়াইজম্যানের মুখে। তার কপাল কুঞ্চিত। অস্বস্তিকর ভাবনায় ডুবে যাওয়া তার মুখমন্ডল। লাইবারম্যান থামার পর একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সে বলল, ‘স্পুটনিক অফিসের সবরকমের দলিল দস্তাবেজ আমরা ধ্বংস করেছি। কিন্তু অফিসের দলিল দস্তাবেজই যে সবটুকু এটা কে বলবে। এ সবের কপি তারা অন্যকোন নিরাপদ জায়গায় রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। এগুলো তো আহমদ মুসা পেয়েও যেতে পারে। কারণ, স্পুটনিকের সাথে জড়িত সব পরিবার থেকেই সে সমান সহযোগিতা পাবে।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান।
উদ্বেগে ভরে উঠেছে লাইবারম্যানের চোখ-মুখ। বলল, ‘তাহলে এ দলিলগুলো তো আমাদের যে কোন মূল্যে খুঁজে পেতে হবে। সাও তোরাহে ওদের কাছ থেকে কিছু জানতে পারেননি, বলেনি কিছু তারা?’ লাইবারম্যানের কন্ঠে উত্তেজনা।
‘না কিছুই বলেনি। কোনওভাবেই তাদের মুখ খোলা যায়নি। যে নির্যাতনে হাতিও চিৎকার করবে, সে নির্যাতনও তারা হজম করে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘মানুষ এমন হতে পারে?’ বিস্ময় লাইবারম্যানের কন্ঠে।
‘তারা ভিন্ন মানুষ।’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘কেমন?’
‘মৃত্যুকে ওরা সাফল্যের সিংহদ্বার বলে মনে করে। সেই সাফল্যের তুলনায় এই কষ্টটা নাকি খুবই ছোট।’ ওয়াইজম্যান বলল।
‘তাহলে?’
‘পথ একটাই, আহমদ মুসাকে সরিয়ে দেয়া।’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘সেটা তো এক নাম্বার কাজ। স্পুটনিক পরিবারে কি হানা দেয়া যায় না এই দলিল দস্তাবেজের সন্ধানে?’ লাইবারম্যান বলল।
‘কেন, গত রাতে তো স্পুটনিকের ৭ নেতার বাড়িসহ ওদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়ি আদ্যপান্ত সার্চ করেছ।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘আচ্ছা, তাহলে এসব কাগজই কি খুঁজেছি গত রাতে? কিন্তু কিছুই তো মেলেনি!’ লাইবারম্যান হতাশ কন্ঠে বলল।
‘মিলবে কি এত সহজে! ওদের বৌ-বেটিকেও নিয়ে যেতে হবে সাও তোরাহতে। দেখা যাবে তারপর তাদের মুখ বন্ধ থাকে কতক্ষণ।’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘ঠিক বুদ্ধি। ওদের দেহ যতটা শক্ত, তাদের নৈতিকতা ততটাই স্পর্শকাতর। বৌ বেটির ইজ্জত যেতে দেখলে, স্রোতের মত বেরিয়ে আসবে ওদের মুখ থেকে কথা।’
বলে একটু থেমেই সে আবার বলা শুরু করল, ‘তাহলে এই কাজে আমরা দেরি করছি কেন? নির্দেশ দিন আমরা শুরু করি।’
‘না মি.লাইবারম্যান। আহমদ মুসাকে ধ্বংস করাই প্রথম কাজ। তাকে শেষ করলে, অন্য কাজ ধীরে সুস্থে করায় কোন ক্ষতি হবে না।’
এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল লাইবারম্যানের।
টেলিফোন কানের কাছে তুলে নিল লাইবারম্যান। ওপ্রান্তের কথা শুনে সে বলে উঠল, ‘জরুরী খবর? বল বল।’
ওপারের খবর শুনল। তারপর এক ঝলক তাকাল সে ওয়াইজম্যানের দিকে এবং বলল ওপ্রান্তকে, ‘একটু হোল্ড কর, কথা বলি স্যারের সাথে।’
বলে টেলিফোন এক পাশে সরিয়ে নিয়ে ওয়াইজম্যানকে লক্ষ্য করে দ্রুতকন্ঠে বলল, ‘স্যার, আহমদ মুসা হোটেল থেকে বেরিয়েছে। সে একা একটি ট্যাক্সিতে চড়ে বিষমার্ক রোড ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছে।’ থামল লাইবারম্যান।
লাইবারম্যান থামতেই আজর ওয়াইজম্যান বলে ঊঠল, ‘ওরা যারা আছে সবাইকে পিছু নিতে বল। ঈল পার্কের মোড়ে ওকে চারদিক থেকে আটকাতে হবে। এ অঞ্চলটায় মানুষের যাতায়াত খুবই পাতলা। এখানেই ওর নিপাত ঘটাতে হবে। বলে দাও আমরা আসছি।’
লাইবারম্যান সব কথা ওদের বুঝিয়ে বলে টেলিফোন রাখল।
ওয়াইজম্যান লাইবারম্যানকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আরও যাদের দরকার তাদের বলে দাও সেখানে যেতে। দেখ, আমাদের ব্যর্থ হওয়া চলবে না। আর তৈরী হও এখনি।’
বলে ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়াল।
উৎসাহের সাথে উঠে দাড়াল লাইবারম্যানও।
ওয়াইজম্যান তার কক্ষের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে পাশে ফিরে তাকিয়ে লাইবারম্যানকে বলল, ‘পুলিশ কমিশনারকে কি আমাদের এই মিশনের কথা বলবে?’
‘হ্যাঁ, বলল তাদের সাহায্যও পাওয়া যেতে পারে।’ লাইবারম্যান বলল।
চিন্তা করছিল ওয়াইজম্যান। বলে উঠল, ‘না লাইবারম্যান, পুলিশকে জড়িয়ে লাভ নেই। তাদের কারণে কোন সমস্যারও সৃষ্টি হতে পারে।’
বলে সে পুনরায় চলতে শুরু করল তার কক্ষের দিকে তৈরী হওয়ার জন্যে।
লাইবারম্যানও এগুলো তার কক্ষের দিকে।
ঈল পার্কটি স্ট্রাসবার্গ শহরের মতই পুরাতন।
পার্কটি নদীর সমান্তরালে। বিরাট জায়গা জুড়ে।
পার্কের পাশ দিয়ে রাস্তা। রাস্তার সমান্তরালে নদীর তীর ঘেঁষে মাঝে মাঝে হোটেল ও ট্যুরিস্ট ভিলায় মাঝে মাঝে রয়েছে বাগান। এ বাগানগুলো নদীর পানি পর্যন্ত নেমে গেছে।
শান্ত নিরিবিলি এলাকা। শহরের হৈ-হুল্লোড়ের বিন্দুমাত্রও এখানে নেই।
পার্কের পাশের সড়ক ধরে চলছে আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসার টার্গেট নগরীর মেয়র অফিস। মেয়র অফিসের রেজিস্ট্রেশন বিভাগ থেকে আহমদ মুসা একটা ঠিকানা যোগাড় করতে চায়। গতকাল বিকেলে তাড়া খেয়ে যে গাড়ি ছেড়ে ওরা পালিয়েছিল, সে আমেরিকান গাড়িটার কাগজপত্রে যে নাম ঠিকানা পাওয়া গেছে, তাতে রাস্তার নাম আছে, কিন্তু বাড়ির নাম ও নাম্বার নেই। মেয়র অফিস থেকে এই নাম নাম্বার পাওয়া যায় কিনা, সেটাই সে দেখতে চায়।
আহমদ মুসার গাড়ি চলছিল মধ্যম গতিতে।
সামনেই ঈল পার্কের একটা মোড়। মোড়টা ত্রিরাস্তার একটি সংযোগ স্থল। এই মোড় থেকে একটা রাস্তা ঈল নদীর কিনারা পর্যন্ত নেমে গেছে।
মোড়টাতেও তেমন ভীড় ও গাড়ি ঘোড়ার সমাগম নেই। তবে বেশ কিছু গাড়ি পার্ক করা আছে দেখতে পেল আহমদ মুসা। সবগুলো গাড়িরই মুখ মোড়ের দিকে। হয়তো আরোহীরা নেমে পার্কে ঢুকেছে ভাবল আহমদ মুসা।
মোড়ে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন মোড়ের মাঝামাঝি এসে পৌঁছেছে। হঠাৎ আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে দেখল, সামনে ও বাম দিক থেকে এক জোড়া করে দুই জোড়া গাড়ি তীরবেগে এগিয়ে আসছে। প্রথমে আহমদ মুসা মনে করেছিল মোড় ঘুরে গাড়িগুলো কোন দিকে চলে যাবে। কিন্তু পরক্ষনেই তার বুঝতে বাকি রইল না গাড়িগুলো তার গাড়ি লক্ষ্য করেই পাগলা গতিতে এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ করেই ব্রেক কষেছে আহমদ মুসা তার গাড়ি। সামনে এগুনো যায় না, বামেও না। আর ডাইনে পার্কের দেয়াল। পেছনে হটা ছাড়া পথ নেই।
কিন্তু পেছনে হটতে গিয়ে রিয়ারভিউতে চোখ পড়তেই দেখল, পেছন থেকে আর এক জোড়া গাড়ি সেই একই গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
গাড়িতে আবার ব্রেক কষে গাড়ি থেকে আহমদ মুসা বেরোতে যাবে এমন সময় তিন দিক থেকে বৃষ্টির মত গুলী শুরু হলো।
তিন দিকের গুলির বৃষ্টি এসে ছেঁকে ধরল তার গাড়িকে। গাড়ির সামনে ও পেছনের উইন্ড স্ক্রিন ও সব জানালা মুহূর্তেই উড়ে গেল। ঝাঁঝরা হতে লাগল গাড়ি।
হোটেল থেকে ভাড়ায় আনা গাড়িটার জন্যে কষ্ট লাগল আহমদ মুসার। গাড়ির মেঝেয় শুয়ে নিজের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করল।
পাল্টা আক্রমনের কোন সুযোগ পেল না আহমদ মুসা। তিন দিকের অবিরাম গুলিবৃষ্টির মধ্যে মুহূর্তের জন্যেও মাথা তোলার কোন সুযোগ নেই। আর একটা মাত্র রিভলবার দিয়ে সে সামলাবে কোন দিকে।
হঠাৎ গুলীবর্ষণ তিন দিক থেকেই থেমে গেল। কি ব্যাপার? মুখ ঘুরিয়ে চোখ উপরে তুলল আহমদ মুসা। দেখল, চারদিক থেকেই ছয়টি স্টেনগানের নল প্রবেশ করেছে আহমদ মুসার গাড়ির মধ্যে।
আহমদ মুসা গাড়ির মেঝে থেকে উঠে বসল। শান্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ‘কি ব্যাপার? কে তোমরা? এভাবে কেন আমাকে আক্রমন করেছ, আমার গাড়ি ধ্বংস করেছ?’
‘বাঃ আহমদ মুসা বাঃ! ছয় ছয়টি স্টেনগানের মুখে দাঁড়িয়েও এমন স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলতে পার তুমি?’ বলল সাড়ে ছয় ফুট লম্বা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও নেতা গোছের একজন লোক।
বলেই সে একজনকে নির্দেশ দিল, ‘ওকে বের করে আন।’
তাদের পেছন থেকে আরও দু’তিন জন লোক ছুটে এল। তাদের একজন টান দিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া একটা দরজা খুলে ফেলল।
দু’জনে হিড় হিড় করে টেনে আহমদ মুসাকে গাড়ি থেকে বের করল এবং শুইয়ে দিল রাস্তায়।
সাড়ে ছয় ফুট লম্বা সেই লোকটি এগিয়ে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘ওয়েলকাম আহমদ মুসা। গত দুদিন ছিল তোমার, আজ তৃতীয় দিনটা আমাদের এবং এই তৃতীয় দিনটাই ফাইনাল। তোমাকে হত্যা করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম, তোমার পেটের অনেক কথা তাহলে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাবে। সে কথাগুলো আমাদের খুবই দরকার। এ জন্যেই এখনও তুমি প্রাণে বেঁচে আছ।’
‘আমার সৌভাগ্য।’ বলল আহমদ মুসা লোকটির দিকে তাকিয়ে। এই সাথে ভাবল আহমদ মুসা, এই লোকটিই কি স্পুটনিক ধ্বংসের নেতা? নেতা না হলে নেতা গোছের যে কেউ হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
‘সৌভাগ্য নয়, প্রমাণ হবে এটাই চরম দুর্ভাগ্য, যখন যাবে ‘সাও তোরাহ’তে। আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের ‘গুলাগ’টা কাল্পনিক ছিল, ঈশ্বরের এই ‘গুলাগ’ কিন্তু কাল্পনিক নয়।’
‘ঈশ্বরের কোন ‘গুলাগ’ থাকে না মি.। তাঁর আছে জাহান্নাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ ‘গুলাগ’ না বলে ‘জাহান্নাম’ও একে বলতে পার। কারণ এখানেও লোক ঢোকে, কিন্তু বের হয় না।’ বলল সেই সাড়ে ছয় ফুট লম্বা লোকটা।
‘দুনিয়ার সাজা নকল ঈশ্বরদের জাহান্নাম সম্পর্কে এ দাবী করা যায় না মি.।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা দুনিয়ার ঈশ্বর নই, অধীশ্বর আহমদ মুসা। জাহান্নাম সম্পর্কে ঐ কথা বলছ? ঠিক আছে তোমাকে দিয়েই তার প্রমাণ হবে, তুমি দেখতে পাবে।’
বলেই লোকটি যারা আহমদ মুসাকে টেনে বের করেছিল, তাদের একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একে ক্লোরোফরম লাগাও।’
সংগে সংগেই লোকটি এগিয়ে এল।
আহমদ মুসার কাছে এসে পকেট থেকে বের করল ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার।
আহমদ মুসাও তাকাল ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার কনটেইনারের দিকে। দেখেই চিনল ওটা ভয়ংকর ধরনের একটা ক্লোরোফরম। এ ক্লোরোফরম দিয়ে কাউকে অজ্ঞান করলে দশ বারো ঘন্টার আগে তার জ্ঞান ফেরে না। এর কার্যকারিতাও অত্যন্ত দ্রুত। কারো নাকে স্প্রে করার দুই তিন সেকেন্ডের মধ্যে সে সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আবার এর আরেকটা গুণ হলো, কোথাও এটা স্প্রে করলে তিন চার গজের মধ্যে কেউ থাকলে সেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সুতরাং এটা যে ব্যবহার করে তাকে একটা ছোট গ্যাস মাস্ক পরতে হয়। তবে এর একটা অসুবিধা রয়েছে। সেটা হলো, এর সংজ্ঞাহীন করার কার্যকারিতা স্প্রে করার এক মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না।
লোকটি ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার হাতে নেয়ার সাথে সাথে নাকে গ্যাস মাস্কও পরে নিয়েছে।
গ্যাস মাস্কের ট্রিগারে তার তর্জনি স্থাপন করল লোকটি।
আহমদ মুসাকে ঘিরে রাখা স্টেনগানধারীরা তাদের স্টেনগান আহমদ মুসার দিকে উদ্যত রেখেই ওরা চার পাঁচ গজ দূরে সরে গেল।
আহমদ মুসাকে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছে।
লোকটি স্প্রে করতে লাগল আহমদ মুসার নাকে। প্রায় পাঁচ সেকেন্ড সে স্প্রেটা ধরে রাখল আহমদ মুসার নাকের উপর।
পাঁচ সেকেন্ড স্প্রে করার পর স্প্রে বন্ধ করে সে দু’তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করল। তারপর হঠাৎ আকষ্মিকভাবে সে লোহার স্পাইকওয়ালা জুতার গোড়ালী দিয়ে প্রচন্ড এক ঘা দিল আহমদ মুসার বাম হাতের তালুতে। আহমদ মুসার দেহ নড়ল না, হাতও নয়। শুধু মুখ থেকে অস্ফুট ‘আ….আ’ শব্দ বেরিয়ে এল। তার গলার স্বরটা ঘুমিয়ে পড়ছে এমন মানুষের কন্ঠস্বরের মত শোনাল।
লোকটি আবার সেকেন্ড খানেক সময় নিয়ে আহমদ মুসার নাকে স্প্রে করল।
তারপর সেকেন্ড দেড়েক অপেক্ষ করে আগের মত লোহার স্পাইক দেয়া গোড়ালি দিয়ে আকষ্মিকভাবে প্রচন্ড এক আঘাত করল আহমদ মুসার পায়ের পাতায়।
কিন্তু এবার আর আহমদ মুসার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুল না।
‘ধন্যবাদ জ্যাকব, তোমার কাজ শেষ। এখন তুমি ওকে টেনে নিয়ে লাইবারম্যানের মাইক্রোটার কাছে চল।’ বলল সেই সাড়ে ছয়ফুট লম্বা লোকটি ক্লোরোফরম স্প্রে করা ‘জ্যাকব’ নামক লোকটিকে লক্ষ্য করে।
জ্যাকব আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে এল লাইবারম্যানের মাইক্রোর কাছে।
লোকটি এখানে পৌঁছে তার নাক থেকে গ্যাস মাস্ক খুলে ফেলল।
সবাই সেখানে এল।
সেই সাড়ে ছয়ফুট লম্বা লোকটিও।
সে বলল লাইবারম্যানকে লক্ষ্য করে, ‘লাইবারম্যান, মিশন সফল। পূর্ণ সফল হবে যখন একে ‘সাও তোরাহ’তে নিয়ে খাঁচায় পুরতে পারব। এর জন্যে সেখানে একটা সোনার খাঁচা তৈরী করব। অন্য খাঁচায় একে মানায় না।’
বলে একটু থেমে লাইবারম্যানকে লক্ষ্য করে আবার বলে উঠল, ‘আহমদ মুসাকে নিয়ে তোমার মাইক্রোর মেঝেতে শুইয়ে দাও। আরও চারজন স্টেনগানধারীকে নাও তোমার মাইক্রোতে। সে দশ বারো ঘন্টার আগে জাগবে না। তবু সাবধান থাকবে। নিয়ে গিয়ে হাত পা বেঁধে খাঁচায় ফেলে রাখবে। আমি ‘রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল’ হয়ে ঘাঁটিতে ফিরব।
‘রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে কেন মি.আজর ওয়াইজম্যান?’ বলল লাইবারম্যান।
‘আহমদ মুসার নতুন রুম কোনটি, তার হ্যান্ডব্যাগসহ তার লাগেজ কোথায় সে সব খোঁজ নিয়ে আসব। ওগুলো হাত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যে ডকুমেন্টগুলো আমি খুঁজছি তা আহমদ মুসার কাছে থাকার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। সাত গোয়েন্দার অসমাপ্ত কাজ এর পক্ষেই করা সম্ভব। দেখা যাক, এর কাছে ঐ সব কোন কিছু তথ্য পাওয়া যায় কিনা।’ বলল সাড়ে ছয় ফুট লম্বা আজর ওয়াইজম্যান লোকটি।
‘ঐ ছুঁড়ি-ছোঁড়া দু’জনের কি করা যায়?’ লাইবারম্যান বলল।
‘ওরা জিরো। ওদের গায়ে হাত দিয়ে খামাখা কেন পুলিশের ঝামেলায় পড়তে যাবে?’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘ঠিক আছে স্যার।’ লাইবারম্যান বলল।
কথা শেষ করেই লোকজনের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরা আহমদ মুসাকে আমার মাইক্রোতে তোল। আর স্টেনগানওয়ালা চারজন ওঠ আমার গাড়িতে।’
বলে লাইবারম্যান এগুলো তার গাড়িতে ওঠার জন্যে।
ওয়াইজম্যানও এগুলো তার কারের দিকে।
অল্পক্ষনের মধ্যেই এলাকাটা ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু পড়ে থাকল আহমদ মুসার ভাড়া করে আনা ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়িটা।
চলছে লাইবারম্যানের মাইক্রোবাসটি। গাড়ির মেঝের উপর উপুড় হয়ে আছে আহমদ মুসা।
তার পাশেই গাড়ির সিটে পাশপাশি বসে আছে চারজন লোক।
আর গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে আছে লাইবারম্যান। তার পাশে ড্রাইভিং সিটে আরেকজন ড্রাইভ করছে গাড়ি।
স্টেনগানধারী একজন তার জুতা দিয়ে আহমদ মুসার গায়ে টোকা দিয়ে বলল, ‘ব্যাটা নাকি খুব সাংঘাতিক। কিন্তু আমাদের বুদ্ধির কাছে কুপোকাত!এমন ফাঁদে ফেলা হয়েছে যে, কিছুই করতে পারল না।’
‘আমাদের দু’জন লোক মেরেছে গত রাতে এই লোক। মজা করে শোধ নেয়া যাবে।’ বলল তার পাশের আরেকজন স্টেনগানধারী।
‘কি শোধ নেবে, এতো দেখছি লিকলিকে ছেলে মানুষ। এর সম্পর্কে শোনা কথাগুলো আমার খুব বিশ্বাস হয় না।’ বলল আরেকজন।
‘একে আমার কোথায় নিচ্ছি, শার্লেম্যানের ৫নং বাড়িতে, না বড় বসের ফ্ল্যাটে?’ চতুর্থজন বলে উঠল।
‘কেন বলছ একথা?’ প্রথমজন বলল।
‘শোধ তোলার কথা বলছ তাই। ফ্ল্যাটে নিলে তো সেখানে আমাদের শোধ নেয়া যাবে না।’ চতুর্থজন উত্তর দিল।
‘চিন্তা করো না, তোমাদের সব ইচ্ছা পূরন হবে। তোমরা যেখানে চাচ্ছ সেখানেই নেয়া হবে।’ বলল লাইবারম্যান।
তাদের এই সব গল্প কথা চলতেই থাকল।
আহমদ মুসা সবই শুনছিল। ক্লোরোফরম তাকে সংজ্ঞাহীণ করতে পারে নি। ক্লোরোফরম স্প্রে করার সময় থেকে পাকা দেড় মিনিট সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিল। তাকে গাড়ির দিকে টেনে নেয়ার সময় যখন সে নিঃশ্বাস নিয়েছে, তখন ক্লোরোফরম এর কার্যকারিতা শেষ।
সংজ্ঞাহীন হওয়ার ভান করতে গিয়ে তাকে দারুণ কষ্ট করতে হয়েছে। জুতার লোহার স্পাইকওয়ালা গোড়ালী দিয়ে তার হাতের তালুতে আকষ্মিক এমন আঘাত করেছে যে চুপ করে থাকা অসম্ভব। আহমদ মুসা ধৈর্য্যের সব শক্তি একত্রিত করে চুপ থেকেছে শুধু একটা ক্ষীণ ‘আহ’ শব্দ করার মাধ্যমে। এটুকু শব্দ আহমদ মুসা ইচ্ছা করেই করেছে এটা প্রমাণ করার জন্যে যে, আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে। পায়ের তালুতে দ্বিতীয় আঘাতও তাকে হজম করতে হয়েছে কোন শব্দ না করে।
তাদের গল্পের মাঝে আহমদ মুসা একবার পলকের জন্যে চোখ খুলল। তার ভাগ্য ভাল যে উপুড় অবস্থায় তার মুখ স্টেনগানধারীদের দিকে ফেরানো ছিল। ফলে পলকটুকুতেই দেখতে পেল তার পাশেই গাড়ির সিটে বসা চারজনকে। তাদের পাগুলো আহমদ মুসার গা প্রায় স্পর্শ করে আছে। তাদের একজনের স্টেনগানটা কোলে। অন্য তিনজনের স্টেনগান মাটিতে রেখে ব্যারেল কোলে ঠেসে দেয়া। একজনের স্টেনগানের গোড়া আহমদ মুসার ডান বাহু স্পর্শ করে আছে।
আহমদ মুসা হিসেব কষল, সামনে থেকে লাইবারম্যানের এ্যাকশনে আসতে কতক্ষন সময় নেবে? এর মধ্যে সে কি পেছনটা নিকেশ করতে পারবে? কিন্তু এছাড়া তো উপায় নেই।
মসৃণ রাজপথের উপর দিয়ে মাইক্রোটা চলছিল তীরের বেগে।
চোখ দুটি আহমদ মুসা আবার অর্ধ নির্মিলিতের মত খুলে স্টেনগানের বাটটা আবার দেখে নিল।
তারপর চোখের পলকে আহমদ মুসা বাট ধরে স্টেনগানটা টেনে নিয়েই দেহটা ঘুরিয়ে চিৎ হয়ে গেল।
ওদের চারজনেরই চোখ পড়ে গিয়েছিল আহমদ মুসার উপর। কিন্তু ভুত দেখার মত আৎকে উঠেছিল সবাই। তাদের এই আৎকে ওঠার ভাব তারা কাটিয়ে ওঠার আগেই আহমদ মুসার হাতের স্টেনগান ওদের চারজনের উপর দিয়ে ঘুরে এল।
কি রেজাল্ট হয়েছে না দেখেই শোয়া অবস্থাতেই মুখটা ডানদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে স্টেনগান তাক করলো লাইবারম্যানকে।
চেয়ারের আড়ালে সে। তবু তার চেয়ারের ডানপাশ দিয়ে তার শরীরে ডান পাশের কিছু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আহমদ মুসার হাতে নিখুঁত টার্গেট নেবার সময় ছিল না। সঠিক লক্ষ্যেই আহমদ মুসার স্টেনগান থেকে গুলির ঝাঁক বেরিয়ে গেছে।
গুলি করেই আহমদ মুসা উঠে দাড়াল। গাড়ি কিন্তু ছুটে চলছে তীর বেগেই।
আহমদ মুসার হাতের স্টেনগান তাক করা ড্রাইভারের দিকে। বলল, ‘ড্রাইভার, সামনে গাড়ি দাঁড় করাও। মনে রেখ দ্বিতীয়বার বলব না, গুলী করব।’
বলার সংগে সংগেই ড্রাইভার গাড়ির লেন চেঞ্জ করে রাস্তার কিনারে নিয়ে গেল। কয়েক গজ গিয়েই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা হাতের স্টেনগানটা গাড়ির পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে দরজা খুলে নামতে নামতে বলল, ‘ড্রাইভার, এখনি এদের কোন ক্লিনিকে নিলে এদের কেউ কেউ বেঁচে যেতে পারে।’
কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে ওখানেই দাড়িয়ে থাকল। মাইক্রোটি চোখের আড়ালে চলে যাবার পর একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘হোটেল রাইন ইন্টারন্যাশনাল’।
হোটেল রাইন ইন্টারন্যাশনাল যাওয়ার কথা আহমদ মুসা বলল বটে, কিন্তু পরে চিন্তায় এল, ওদের বড় বস আজর ওয়াইজম্যান তো হোটেল রাইনেই গেছে। সে সেখানে কি করবে, কি বলবে কে জানে!হুট করে হোটেলে যাওয়া তার ঠিক হবে কিনা। কিন্তু হোটেলে না গেলে সে যাবে কোথায়? সে যে লাইবারম্যানদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে একথা আজর ওয়াইজম্যান এখনি জানতে পারবে। জানতে পারার সংগে সংগে সে নিশ্চয় এবার পুলিশকে লেলিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তৎপর হবে। এই সাথে ওয়াইজম্যানরাও আরও মরিয়া হয়ে উঠবে। এই অবস্থায় খোঁজ খবর না নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করা তার জন্যে ঠিক হবে কিনা। তাছাড়া হোটেলের টুরিস্ট সেকশনের যে গাড়ি সে ভাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল, সেটা কোথায় এ প্রশ্নও উঠবে। গাড়ি হারিয়ে গেছে এ কথাও বলা যাবে না, আবার যে হাল হয়েছে গাড়ির সেটাও বলা যাবে না। কারণ তাতে অনেক প্রশ্ন উঠবে, যার জবাব সে দিতে পারবে না।
এসব চিন্তার মধ্যেই আহমদ মুসা পৌঁছে গেল হোটেলের কাছে। সে ঠিক করল হোটেলে না গিয়ে আপাতত সে গীর্জার সামনে নেমে যাবে।
গীর্জার পার্কিং এ নেমে পাশের একটা গাড়ির দিকে তাকাতেই খুশি হয়ে উঠল আহমদ মুসা। দেখল, ফাতিমা ও যায়েদ একটা গাড়িতে বসে।
ওদের দেখে খুশি হওয়ার পরক্ষনেই আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল আহমদ মুসা। ফাতিমারা হোটেলের বদলে গীর্জার পার্কিং এ কেন? হোটেলে কি কিছু ঘটেছে?
আহমদ মুসা এগুলো ওদের দিকে।
ওরাও দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে।
ওরা ছুটে এল আহমদ মুসাকে দেখে।
ওদের মুখে এ সময় যে হাসিটা থাকা স্বাভাবিক সেটা নেই।
ওদের এই অবস্থা দেখে আহমদ মুসাও হাসতে পারল না।
ওরা কাছে আসতেই আহমদ মুসা বলল, ‘কি ব্যাপার, তোমরা এখানে? ভাল আছো তো?’
আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার কোন জবাব না দিয়ে ফাতিমা ও যায়েদ এক সাথে বলে উঠল, ‘আপনি সুস্থ আছেন, আপনি ভাল আছেন তো ভাইয়া?’ তাদের কন্ঠে উদ্বেগ।
‘তোমরা একথা বলছ কেন? উদ্বিগ্ন কেন তোমরা এত?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া আপনাকে ওরা ধরে নিয়ে যায়নি?’ বলল যায়েদ চোখ কপালে তুলে।
‘হ্যাঁ গিয়েছিল। মুক্ত হয়ে আসলাম। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?’
‘এই তো ক’মিনিট আগে আমি আসার সময় ঈল পার্কের মোড়ে আপনার গাড়ি ঝাঁঝরা অবস্থায় দেখলাম। আমি গাড়ির নাম্বার দেখে চিনতে পারি ও গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। জিজ্ঞেস করে সেখানে জড়ো হওয়া লোকদের একজনের কাছে শুনলাম, ছয় সাতটা গাড়ি এ গাড়িটাকে ঘিরে ফেলে বিরামহীন মেশিনগানের গুলী চালিয়ে গাড়ির এ হাল করেছে। এ গাড়ি থেকে একজনকে বের করে ঐ গাড়িওয়ালারা ধরে নিয়ে গেছে। কি ঘটেছিল ভাইয়া, কি করে আপনি মুক্ত হলেন?’ বলল যায়েদ।
আহমদ মুসা সংক্ষেপে ঘটনাটা ওদের বলল। ঘটনা শুনে ওদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বলল ফাতিমা, ‘ভাইয়া মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যে আপনি দ্বিতীয়বার জীবন পেলেন।’
তারপর যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেই হাত উপরে তুলে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। হে আল্লাহ, আমাদের ভাইয়ার বুদ্ধি, শক্তি, সাহস আরও বাড়িয়ে দিন। এ ধরনের সব বিপদেই তিনি যেন জয় করতে পারেন।’
তারা থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা এখানে কি করছ? ঐ শয়তানদের একজন নেতা আজর ওয়াইজম্যান তো হোটেলে আসার কথা আমার রুমের খোঁজ খবর নেবার জন্যে!’
‘সে এসেছিল এবং খোঁজ নিতে আপনার কক্ষেও ঢুকেছিল। সে যখন কাউন্টারে কথা বলছিল, তখন আমি কাউন্টারের পাশে ছিলাম। সব আমি শুনি এবং তাকে ফলো করি। তার ছবিও আমি নিয়েছি। যেভাবে অথরিটির সাথে সে কথা বলছিল এবং কাজ করছিল, তাতে আমার মনে হয়েছে সে ষড়যন্ত্রকারীদের একজন বড় কেউ হবেন। যাই হোক, তার কথা শুনে আমি বুঝে যে, আপনার কোন বিপদ হয়েছে। সেজন্যে হোটেলের লবিতে বসেই আমি যায়েদের অপেক্ষা করি। সে এলে তার কাছে সব শুনে গাড়ি নিয়ে আমরা হোটেল থেকে সরে এসে এখানে অপেক্ষা করি। আমাদের ভয় হচ্ছিল আপনাকে হস্তগত করার পর আমাদের কক্ষেও ওরা হানা দেবে।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘দিতে পারে। কারণ তারা যে জিনিস খুঁজছে তা আমার সুটকেসে পায়নি। আমার হ্যান্ডব্যাগ ও তোমাদের ব্যাগেজ দেখার জন্যে তোমাদের কক্ষেও হানা দিতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি খুঁজছে ভাইয়া ওরা?’ বলল যায়েদ।
‘স্পুটনিকের গোয়েন্দারা নিউইয়র্কের টুইন (লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি) টাওয়ার ধ্বংসের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে যে দলিল দস্তাবেজ যোগাড় করেছিল, সে সবেরই কতকগুলো বা কোনটি সম্ভবত তারা খুঁজছে। লা-মন্ডের রিপোর্টে গোয়েন্দা অপহরণ করার কারণ হিসাবে এ ধরনের কিছুকেই সন্দেহ করা হয়েছিল। আজ আজর ওয়াইজম্যানের মুখেও এ ধরনের কথাই শুনেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আপনি ওদের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পর ওরা নিশ্চয় দারুণ ক্ষেপে গেছে। এই অবস্থায় হোটেল আপনার জন্যে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, আমাদের জন্যেও। কি করা যায় এখন। বাড়ি একটা পেয়েছি। ভাড়া একটু বেশি হলেও আপনি যেমন চেয়েছিলেন, সেরকমই বাড়িটা। বাড়িটাতে কালকে উঠলে ভাল হয়, ‘তবে আজকেও উঠা যায়।’ বলল যায়েদ।
‘আমরা এখনি হোটেল ছেড়ে দেব। আমি ও যায়েদ গিয়ে উঠব ভাড়া করা বাড়িতে। আর ফাতিমা উঠবে আপাতত তার আত্মীয়ের বাড়িতে।’ আহমদ মুসা বলল।
ম্লান হয়ে গেল ফাতিমা কামালের মুখমন্ডল। পরক্ষনেই লজ্জায় ছেয়ে গেল তার মুখ। ফুটে উঠল ঠোঁটে লজ্জা মিশ্রিত হাসি। বলল, ‘ভাইয়া, আপনার জন্যে আরও কিছু খবর আছে। কামাল সুলাইমান ভাইয়ার বাসা থেকে অল্পক্ষন আগে জানিয়েছে, আজ বাদ আসর স্ট্রাসবার্গ মসজিদ কম্যুনিটি হলে দু’পক্ষই বিয়ের আয়োজন করার ব্যাপারে রাজী। আপনার মত পেলেই এটা চূড়ান্ত হবে।’
আহমদ মুসার মুখে ফুটে উঠল মিস্টি হাসি। বলল, ‘ওয়েলকাম বোন। আমার আগের কথা বাতিল। তুমিও আজ যায়েদের সাথে ভাড়াবাড়িতে উঠবে। ওদের বলে দাও। শুভস্য শীঘ্রম।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ মুখ নত করে বলল ফাতিমা কামাল।
আহমদ মুসার মুখে সংকোচ জড়িত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ফাতিমা, যায়েদ, মনে করতে পারো আমি তোমাদের উপর অন্যায় চাপিয়ে দিয়েছি। ভাবতে পার যে, তোমাদের ইনটিগ্রিটিকে আমি সন্দেহ করছি। আমি………’।
আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে ফাতিমা কামাল বলে উঠল, ‘ভাইয়া আপনার কথা ঠিক নয়। আপনি আমাদের সত্যিকার অভিভাবকের কাজ করেছেন। আপনি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, আমরা আমাদের অল্পই জানি, স্রষ্টা জানেন সবটুকুই। সুতরাং আমাদের জন্যে তাঁর নির্দেশই চূড়ান্ত।’ ফাতিমার কন্ঠ আবেগাপ্লুত ও দৃঢ়।
‘ধন্যবাদ বোন’, বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘চল হোটেলের বিল চুকিয়ে আমরা চলে আসি।’
আহমদ মুসাসহ ওরা দু’জন আবার গিয়ে গাড়িতে বসল।
গাড়ি চলতে শুরু করল হোটেলের দিকে।
‘ভাইয়া, আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাচ্ছি?’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘বাদ আসরের অনুষ্ঠান পর্যন্ত তুমি তোমার ভাইয়া কামাল সুলাইমানের বাড়িতে থাকবে। আমি যায়েদকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে উঠব। যায়েদ বাসায় উঠে বাড়ি গুছাবে। আর আমি পরবর্তী অভিযানের জন্যে কিছু খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করব।’
‘কি অভিযান?’ জিজ্ঞেস করল ফাতিমা।
‘ও কথা এখন থাক। পরে বলব।’ বলল আহমদ মুসা।
গাড়ি প্রবেশ করল হোটেলের কার পার্কিং এ।
সত্যিই আহমদ মুসা যেমন চেয়েছিল, সে রকমই বাড়িটা।
আহমদ মুসার কক্ষটি বেশ বড়। এটাচড বাথ। কক্ষ থেকে ফ্ল্যাটের বাইরে বেরুবার ইন্ডিপেনডেন্ট প্যাসেজ। অন্যদিকে দুটি বেডরুম আর একদিকে গেস্টরুম নিয়ে ফাতিমা যায়েদদের অংশ। আহমদ মুসার কক্ষ থেকে ডাইনিং ড্রইং এ প্রবেশের একটা দরজা রয়েছে। এই দরজা বন্ধ থাকলে ফ্ল্যাটের দুই অংশ বলা যায় আলাদাই হয়ে পড়ে। দরজাটা দুই দিক থেকেই বন্ধ করা যায়। সিদ্ধান্ত হয়েছে দরজাটা দুই দিক থেকেই বন্ধ রাখা হবে। দুই পক্ষের কারও প্রয়োজন হলে নক করে দরজা খুলতে হবে। ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বেরুবার জন্য ফাতিমা-যায়েদদের প্যাসেজও আলাদা।
নতুন দম্পতি হিসেবে ফাতিমা ও যায়েদ ফ্লাটে উঠেছে মাগরিবের নামাজের আধা ঘন্টা আগে। স্ট্রাসবার্গ মসজিদ কম্যুনিটি হলে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটি হয়েছে খুবই সুন্দর, কিন্তু সংক্ষিপ্ত। স্ট্রাসবার্গের পনেরটি মুসলিম পরিবার যোগ দিয়েছিল এই বিয়ের অনুষ্ঠানে। বিয়ের পর ফাতিমা ও যায়েদের আত্মীয় স্বজনরা তাদেরকে ফ্ল্যাটে তুলে দিয়ে গেছে।
রাত ১১টা। আহমদ মুসা নক করল ফাতিমা-যায়েদদের অংশে ঢোকার পার্টিশন ডোরে।
খুলে গেল দরজা।
দরজা খুলে দিয়েছে যায়েদ।
আহমদ মুসা সালাম দিল যায়েদ ও ফাতিমা দুজনকে।
ফাতিমা কামাল বসেছিল সোফায়।
আহমদ মুসা দরজায় এসে সালাম দিতেই সালামের জবাব দিয়ে উঠে দাড়াল ফাতিমা। আরও বলল, ‘ওয়েলকাম ভাইয়া।’
বিয়ের পোশাকটা নেই ফাতিমা কামালের পরনে। কিন্তু যে পোশাক পরেছে তাতেও তাকে নববধুই লাগছে। ফুলহাতা কামিজ তার পা পর্যন্ত নেমেছে। মাথার রুমাল কপাল ঢেকে গলা জড়িয়ে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। ফাতিমা কামালের শ্বেতাভ গোলাপী দেহে গোলাপী এই পোশাক তাকে অপরূপ করে তুলেছে।
নত দৃষ্টিতে আহমদ মুসা যায়েদের সাথে গিয়ে সোফায় বসল।
ফাতিমা কামালও বসল।
যায়েদ গিয়ে বসেছে ফাতিমার পাশে। আর আহমদ মুসা তাদের সামনের আরেকটি সোফায়।
ফাতিমার চোখে মুখে লজ্জার ছাপ। লাল হয়ে উঠেছে মুখ।
যায়েদও অনেকটাই বিব্রত।
প্রথম নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসাই। বলল, ‘নতুন সংসার, কোন অসুবিধা নেই তো তোমাদের?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। কোন অসুবিধা নেই ভাইয়া।’ বলল যায়েদ। তার মুখে সলজ্জ হাসি।
‘ভাইয়া, আমরা তো জানি না, আপনি কি বাইরে বেরিয়েছিলেন? ফিরলেন এখন?’ বলল ফাতিমা।
‘না তো, কোথাও বের হইনি? কেন বলছ এ কথা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাইরের পোশাক আপনার পরনে।’ বলল ফাতিমা।
‘ও’ বলে হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বাইরে বের হইনি, বের হবো। সে কথাই তোমাদের বলতে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই রাত ১১টায় বাইরে বেরুবেন? কোথায়?’ বলল ফাতিমা ও যায়েদ একই সাথে। তাদের কন্ঠে বিস্ময়।
‘বলেছিলাম তো এক অভিযানে বেরুতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোথায়?’ বলল যায়েদ।
‘ওদের একটা আস্তানার সন্ধান পেয়েছি। আমি যখন সংজ্ঞাহীন হওয়ার ভান করে ওদের গাড়ির মেঝেতে পড়েছিলাম, তখন ওদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমি ওদের একটা ঘাঁটির ঠিকানা পেয়ে যাই। সেখানেই যাব। দেখি, ওদের পরিচয়, পরিকল্পনা এবং অপহৃত সাতজনকে কোথায় রেখেছে-এসব ব্যাপারে কোন তথ্য উদ্ধার করা যায় কিনা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজই একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। ওরা সাংঘাতিক ক্ষেপে আছে আপনার উপর। এই অবস্থায় এত রাতে আপনার একা তাদের ঘাঁটিতে যাওয়া ঠিক হবে না।’ বলল ফাতিমা দৃঢ় প্রতিবাদের কন্ঠে।
‘না ফাতিমা। শত্রুকে আঘাত করার পর শত্রু পাল্টা আঘাত করার আগেই যদি তাকে আবার আঘাত করা যায়, তাহলে শত্রুকে তাড়াতাড়ি কাবু করা যায়। আজ ওরা যে আঘাত খেয়েছে, তার পাল্টা আঘাতের চিন্তায় ওরা এখন ব্যস্ত। নতুন আঘাত আসতে পারে এটা তারা ভাবছে না এবং আত্মরক্ষারও কোন চিন্তা তাদের মাথায় নেই। সুতরাং এটা একটা বড় সুযোগ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার সাথে যুক্তিতে পারবো না ভাইয়া। আপনার এই যুক্তির জবাবে কি বলতে হবে আমার জানা নেই। কিন্তু আমি যেটা জানি, সেটা হলো আপনার একা ঐ শত্রুপুরীতে যাওয়া ঠিক নয়’।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এসব অভিযান দল বেধে হয় না ফাতিমা। দলবল নিয়ে গেলে শত্রুদের আগাম জেনে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। তাতে লোকক্ষয় হলেও লক্ষ্য অর্জন হয় না। এ জন্যে একা যাওয়াটাই নিরাপদ ও ফলপ্রসু’।
‘কিন্তু একা গিয়ে যদি আপনি বিপদে পড়েন, কোন সাহায্যের যদি আপনার দরকার হয়? না ভাইয়া, আপনার একা যাওয়া হবে না’। বলল ফাতিমা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সবচেয়ে বড় সাহায্যদাতা যিনি, তিনি তো সাথেই আছেন। তিনিই সাহায্য করবেন ফাতিমা। আমাদের তার উপরই নির্ভর করা উচিত’।
‘আল্লাহর কথা বলছেন ভাইয়া? তিনি তো আছেনই। তিনি অবশ্যই সাহায্য করবেন। কিন্তু তিনিই তো শত্রু মোকাবিলায় আমাদের উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কিন্তু আপনি তা করেছেন না ভাইয়া’। বলল ফাতিমাই।
‘আমার সাধ্য যা সেভাবেই আমি প্রস্তুতি নিয়েছি ফাতিমা। বলতে পার, লোক সাথে নেই, একা যাচ্ছি। কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে এমন অনেক কাজ আছে যা একা করতে হয়। আমি সে রকম একটা কাজেই যাচ্ছি। আমি গোপনে তাদের ঘাঁটিতে ঢুকব। অনুসন্ধান করব। তাদের সম্পর্কে তথ্যাদি যোগাড়ের চেষ্টা করব। এমন ধরনের কাজে একা যেতে হয়। আমি সেটাই করছি বোন’। আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝলাম। কিন্তু ভাইয়া, এ ধরনের কাজেও তো সংঘর্ষ হয়। প্রয়োজনীয় সাহায্যের দরকার হয়’। বলল ফাতিমা।
‘দোয়া কর তোমরা বোন। এই সাহায্য যেন আল্লাহ করেন, আমাকে তোমরা বাধা দিওনা। আমি এই কাজ নিয়ে একাই তো এসেছি শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে। সর্বজ্ঞ আল্লাহ এটা জানেন এবং তিনিই আমাকে সাহায্য করবেন’।
ফাতিমা কোন জবাব দিল না। তার অপলক দু’চোখ তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
যায়েদের বিস্ময় বিমুগ্ধ দু’চোখ নিবদ্ধ আহমদ মুসার মুখের উপর।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভাই বোনরা এভাবে তাকিয়ে কেন?’
‘ভাবছি ভাইয়া’। ফাতিমা বলল।
‘কি ভাবছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাবছি, ভাইয়ার পরিচয় জানার ভাগ্য কি আমাদের এখনও হলো না? আমি নিশ্চিত ভাইয়া, আপনার এমন একটা পরিচয় আছে যা এত বড় যে আমরা সামান্য মানুষ হয়ে তা জানা ঠিক নয়’। ফাতিমা বলল।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘ফাতিমা, যায়েদ, গত দু’তিন দিনের পরিচয় থেকে, আমার আচরণ থেকে কি তোমাদের এই বিশ্বাসই হয়েছে?’
‘না ভাইয়া, এ বিশ্বাস নয় বরং উল্টো বিশ্বাসই হয়েছে এবং এ কারণেই মনে কষ্ট লাগছে যে, এত আপন করে যিনি আমাদের নিয়েছেন, স্নেহ ও অভিভাবকত্বের ছত্রছায়া যিনি আমাদের পরম আকাঙ্খিত এক নতুন জীবনে নিয়ে এসেছেন, তার পরিচয় আমরা জানি না, আমাদের জন্যে এটা অবশ্যই বড় কষ্টের ভাইয়া’। বলল ফাতিমা আবেগে ভারী কন্ঠ তার।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কথা বুঝতে পারছি বোন। তোমাদের কাছ থেকে আমার পরিচয় গোপন করার কোন সিদ্ধান্ত আমি নেইনি। আমি এই মিশনে এখানে আসার আগে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার পরিচয় আমি কোথাও প্রকাশ করব না। তাতে আমার কাজ অনেকখানি সহজ হবে এবং শত্রুকে অনেকখানি অসতর্ক ও অপ্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যাবে। কিন্তু শত্রুরা আমার পরিচয় যেভাবেই হোক জেনে ফেলেছে। আমার পরিচয় আগাম জেনেই আজ সকালে ওরা আমাকে ঐভাবে আট-ঘাট বেঁধে বন্দী করতে এসেছিল। শত্রুদের কাছ থেকে আমার পরিচয় গোপন রাখার জন্যেই নিজের পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শত্রুরা সেই পরিচয় যখন জেনেই ফেলেছে, তখন আর পরিচয় গোপনের প্রয়োজন দেখি না’।
বলে আহমদ মুসা সামনের টি টেবিল থেকে স্লিপ পেপারের একটা পাতা ছিড়ে নিয়ে তাতে খস খস করে নিজের নাম লিখল এবং তা স্লিপ প্যাডের নিচে চাপা দিয়ে একটু হেসে বলল, ‘আমি আমার পরিচয় লিখে রাখলাম, পরে পড়ে নিও’।
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে তা যায়েদের হাতে দিয়ে বলল, ‘এতে আমি যেখানে যাচ্ছি তার ঠিকানা লেখা আছে। আমি যদি ভোর পর্যন্ত না ফিরি, তাহলে তোমার পরিচিত পুলিশ অফিসারকে এবং পুলিশ স্টেশনকে এই ঠিকানা জানিয়ে বলবে, স্পুটনিক যারা ধ্বংস করেছে, স্পুটনিকের ৭ গোয়েন্দাকে যারা কিডন্যাপ করেছে, তাদের একটা ঘাঁটির ঠিকানা এটা। ঠিকানাটায় আপনারা এখনি রেড করুন’।
যায়েদ স্লিপটা হাত পেতে নিল। কিন্তু কোন কথা বলল না।
ফাতিমাও কিছু বলল না।
হঠাৎ করে তাদের দু’জনের দু’চোখ ছল ছল করে উঠেছে। উদ্বেগে-আশঙ্কায় তাদের মুখ পান্ডুর।
ফাতিমার দু’চোখের অশ্রু তার দু’গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আহমদ মুসা তাদের অশ্রু দেখে আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘তোমাদের এই মমতার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তোমরা চিন্তা করো না। আল্লাহই আমাদের সহায়’।
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
সালাম দিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে আহমদ মুসা ফ্ল্যাটের গেটের দিকে এগুলো।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই উঠল। তারা আহমদ মুসার পেছন পেছন গেট পর্যন্ত এগুলো। তারপর ‘ফি আমানিল্লাহ, আল্লাহ হাফেজ’ বলে বিদায় জানাল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসাও ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে লিফটের দিকে এগুলো।
লিফট নেমে গেলেও ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই গেটের দু’চৌকাঠে ঠেস দিয়ে সামনে শূণ্য দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে থাকল।
অনেকক্ষন পর ফাতিমা একইভাবে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে বলে উঠল, ‘যায়েদ, ভাইয়া তো আসলেই আমাদের কেউ নন। কিন্তু মন মানছে না কেন? তার বিপদের ভয় এমন করে মনকে পীড়া দিচ্ছে কেন? এ কিসের টান যায়েদ?’
যায়েদও ঐভাবেই স্বগতোক্তির মত জবাব দিল, ‘আমিও জানি না ফাতিমা। তবে এটুকু অনুভব করি, তিনি তার অসীম মমতা দিয়ে আমাদের মন জয় করে নিয়েছেন। বলতে পার ফাতিমা, তার মত এত মমতা এত দায়িত্ববোধ, এত মধুর শাসন আর কারও কাছ থেকে কখনও আমরা পেয়েছি?
‘কিন্তু কেন তিনি এত আদর করেন, কেন তাঁর এই দায়িত্ববোধ, কেন এই মধুর শাসন যায়েদ? আমরা তো তাঁর কেউ নই’। বলল ফাতিমা উদাস কন্ঠে।
‘হতে পারে এটা এক আদর্শের সহমর্মিতা’। যায়েদ বলল।
‘কিন্তু আদর্শিক ভাইদের সাথে তো আমাদের কম দেখা হয়নি। এমন তো দেখিনি কখনও’।
‘হতে পারে খাঁটি আদর্শে গড়া এক মানুষের সন্ধান আমরা এই প্রথম পেলাম’। যায়েদ বলল।
কে তাহলে আমাদের অদেখা, অচেনা অতুলনীয় এই মানুষটি? জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল ফাতিমার কন্ঠে।
‘চল দেখি, তাঁর পরিচয়, তিনি কি লিখে গেছেন’। বলে যায়েদ সোজা হয়ে দাঁড়াল।
সম্বিত ফিরে পাওয়ার মত চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল ফাতিমা। ভেতর দিকে ছুটতে ছুটতে বলল, ‘ধন্যবাদ যায়েদ, তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছ। এস তুমি’।
ফাতিমা ছুটে গিয়ে না বসেই স্লিপ প্যাডের নিচ থেকে আহমদ মুসার রাখা কাগজটা তুলে নিল। কাগজের উপর চোখ বুলাতে বুলাতে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফাতিমা।
স্লিপে লেখা ‘আহমদ মুসা’ নাম পড়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা খেল ফাতিমা। সমস্ত সত্তায় তার যে ধাক্কাটা ব্যঙ্ময় হয়ে উঠল তা হলোঃ ‘আহমদ মুসা। কোন আহমদ মুসা? ক্যারিবিয়ান, আমেরিকা ও সুরিনামের ঘটনায় সদ্য আলোচিত সেই আহমদ মুসা, যিনি ফ্রান্সে, সুইজারল্যান্ড, কংগো, ফিলিস্তিন, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, মিন্দানাওয়ের অসংখ্য সুঘটনার জনক?’
এই সব জিজ্ঞাসার মধ্যে হারিয়ে গেল ফাতিমা। কাগজের স্লিপটা তার হাতে ধরা। তার উপর আঠার মত লেগে আছে ফাতিমার চোখ। মূর্তির মত নিরব-নিশ্চল ফাতিমা।
যায়েদও ফাতিমার কাছে এসে পৌছাল। বলল, ‘কি ফাতিমা, কি দেখলে? কি নাম, কি পরিচয় লিখেছেন তিনি?’
কোন কথা বলল না ফাতিমা।
নির্বাক মূর্তির মত হাতের কাগজটা যায়েদের হাতে তুলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সোফায়।
কাগজটিতে দ্রুত চোখ বুলাল যায়েদ।
‘আহমদ মুসা’র নাম পড়ে চমকে উঠল যায়েদ। কয়েকবার পড়ল নামটা। না তার পড়া ঠিক। এই নামটাই লেখা আছে কাগজে। কাগজ থেকে মাথা তুলে ভাবল একটু আহমদ মুসার কথা। তারপর ‘ও গড’ বলে বসে পড়ল সোফায় ফাতিমার পাশে।
দু’জন পাশাপাশি বসে।
দু’জনেই নিরব।
দু’জনের চোখে-মুখেই বিস্ময় ও বিহবলতার ভাব।
নিরবতা ভাঙল যায়েদ। বলল, ‘আমি ভাবতে পারছি না ফাতিমা। আমরা তিন দিন ধরে আহমদ মুসার সাথে আছি। ভাবলেই আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে যে, ঐ ঘরটিতে বিশ্ব বিখ্যাত আহমদ মুসা থাকেন, আর এইমাত্র তিনি বেরিয়ে গেলেন আমাদের সাথে কথা বলে’।
ধীরে ধীরে ফাতিমা মুখ খুলল। সম্মোহিত কন্ঠে স্বগতোক্তির মত বলল, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না আমারও, আহমদ মুসা এত সহজ, এত সরল, এত সাধারণ। আবার বিশ্বাস হচ্ছে এই কারণে যে, গত তিন দিনে তিনি যা করেছেন সেটা আহমদ মুসারই কাজ। আজকের পাশ্চাত্যের দুর্বিনীত, অহংকারী যোগ্যতাকে এভাবে ধুলায় মিশিয়ে দিতে আহমদ মুসাই পারেন, আর কেউ নয়’। আবেগে কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছে ফাতিমার।
‘আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে যে, আহমদ মুসা স্ট্রাসবার্গে এসেছেন, স্পুটনিক ধ্বংসের কেসটাকে তিনি গ্রহন করেছেন এবং মুসলামানদের এইটুকু বিপদও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে’। আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে যায়েদের কন্ঠও।
ফাতিমার স্বগত কন্ঠ আবার, ‘বড়ত্বের প্রকাশ একটুও তাঁর মধ্যে নেই। কিন্তু স্নেহ-মমতার সিড়ি বেয়ে তিনি কখন যেন আমাদের মাথার উপর উঠে বসেছেন। তিনি যা বলেন তা করা আমাদের জন্য অমোঘ হয়ে যায়। এ ভাবেই বুঝি তিনি নেতা না হয়েও সবার নেতা’।
‘আলহামদুলিল্লাহ ফাতিমা। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। স্ট্রাসবার্গে আহমদ মুসার সাথী হবার জন্যে আল্লাহ আমাদেরকেই বেছে নিয়েছেন’। বলল আবেগ জড়িত কন্ঠে যায়েদ।
ফাতিমা একটু ঘুরে বসে যায়েদের দু’হাত চেপে ধরে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ যায়েদ। এটা আমাদের জন্যে পরম গর্বের’। থামল ফাতিমা।
যায়েদ কিছু বলল না। দু’জনেই নিরব।
একটু পর নিরবতা ভাঙল ফাতিমাই। বলল, ‘কিন্তু আমরা তাকে কোন সহযোগিতা করতে পারছি কই? বিপজ্জনক ও সংঘাতের সব কাজ তিনি একাই করেছেন। আজও তাই গেলেন। আজ সকালের ঘটনায় তিনি বন্দী হয়েছিলেন। ভাবতে পার, যদি তিনি মুক্ত হতে না পারতেন। তার মত এত মূল্যবান মানুষ এতটা নিরাপত্তাহীন থাকা কি ঠিক?’
‘আমরা কি সহযোগিতা করব, আর কি সহযোগিতা তিনি নেবেন। আমরা রিভলবার চালাতে পারা ছাড়া এই লাইনে আর কোন অভিজ্ঞতাই নেই। আচ্ছা বল, এখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমাদের কি করণীয়?’ বলল যায়েদ।
‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে’। বলল ফাতিমা।
‘কি বুদ্ধি?’ জিজ্ঞেস করল যায়েদ।
‘পরে বলছি। বুদ্ধিটা একটু পাকিয়ে নেই’।
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ফাতিমা, ‘তার আগে একটু গড়িয়ে নেব’।
যায়েদও উঠে দাড়িয়েছে। বলল, ‘আমি?’
‘তোমার পথ তুমি দেখ? তোমার বেডরুম ওদিকে’। বলল ফাতিমা। তার ঠোঁটে হাসি।
‘কিন্তু আজ দুই পথ তো এক হয়ে গেছে।’ বলল যায়েদ। তারও মুখে হাসি।
‘তা ঠিক। কিন্তু আমরা তো যুদ্ধক্ষেত্রে।’ ফাতিমা বলল।
হাসল যায়েদ। বলল, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বলতে পার যুদ্ধের তাঁবুতে। এক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের (স.) দৃষ্টান্তই আমাদের পথ দেখাতে পারে’। হাসল যায়েদ।
সলজ্জ হাসিতে রাঙা হয়ে উঠল ফাতিমার মুখ। বলল, ‘মনে থাকে যেন সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর রাসূলের (সঃ) এর দৃষ্টান্ত এভাবে খোঁজ করা হবে’।
‘অবশ্যই’। বলে যায়েদ তার এক হাত বাড়িয়ে দিল ফাতিমার দিকে।
ফাতিমার এক হাত এগিয়ে এসে ধরল যায়েদের হাত।
দু’জনেই এক সাথে পা বাড়াল সামনে।
৪
শার্লেম্যান রোডের ৫ নাম্বার বাড়িটা বেশ বড়। তিনতলা বাড়ি। প্রাচীর ঘেরা।
গেটের উপর বিরাট সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, ‘হিউম্যান রাইটস ইউনিভার্সাল গ্রুপ, স্ট্রাসবার্গ’। সাইনবোর্ডে রাস্তার নামও নেই, বাড়ির নাম্বারও নেই।
আহমদ মুসা বিকেলে এসে দেখে না গেলে এই বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হতো। আশে পাশের লোকদের জিজ্ঞেস করে তবেই আহমদ মুসা ‘হিউম্যান রাইটস ইউনিভার্সাল গ্রপে’র অফিসকে ৫ নাম্বার বাড়ি বলে চিনতে পেরেছিল।
বাড়িটা চেনা আছে বলে আহমদ মুসা খুব নিশ্চিন্তে বাড়ি থেকে বেশ দূরে গাড়ি থেকে নেমে গাড়িটা ছেড়ে দিল।
পথচারীর মত হেঁটে হেঁটে বাড়িটার প্রান্তে এসে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
আর কিছুটা এগুলে গেট। কিন্তু আহমদ মুসা গেট দিয়ে প্রবেশ করতে চায় না।
আহমদ মুসা যেখানে এসে দাড়িয়েছিল, সেখান থেকেই বাড়িটার প্রাচীর শুরু। সেখান থেকে একটা প্রাচীর শার্লেমান সড়কের পাশ ঘেঁষে দক্ষিণে এগিয়ে গেছে। এই প্রাচীরেই বাড়িতে প্রবেশের গেট। আরেকটা প্রাচীর বাড়ির উত্তর সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে গেছে। এই প্রাচীরটাই বাড়ির পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমানা ঘুরে শার্লেম্যান রোডের প্রাচীরের সাথে এসে মিশেছে।
আহমদ মুসা তাঁর হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল, রাত সাড়ে এগারটা বাজে।
সে উত্তরের প্রাচীরের ধার ঘেঁষে পশ্চিম দিকে এগুলো।
আহমদ মুসা ঠিক করেছে প্রাচীর টপকে সে ভেতরে ঢুকবে। এভাবে সবার অলক্ষ্যেই সে ভেতরে ঢুকবে। মারামারি বা শত্রু নিধনে তার কোন লাভ নেই। তার চাই কিছু দলিল-প্রমাণ। যা থেকে জানা যাবে, স্পুটনিকে কি ঘটছে, কেন ঘটছে এবং স্পুটনিকের ৭ গোয়েন্দা কোথায়। এজন্যে গোপনে সে বাড়ি সার্চ করতে চায়। সে নিশ্চিত যে, এভাবেই সে একদিন এখান থেকে বা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় দলিল দস্তাবেজ পেয়েই যাবে।
আহমদ মুসা পশ্চিম প্রাচীরের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাড়াল।
এ প্রাচীরের পর একটা ফলের বাগান। তারপর বাড়িটা। বাড়িটার উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ফুলের বাগান। ফলের বাগান শুধু পশ্চিম দিকেই।
বাড়িটাতে পৌঁছা পর্যন্ত গাছের আড়াল পাওয়া যাবে বলেই আহমদ মুসা এ দিকটা বেছে নিয়েছে। প্রাচীরটা সাত ফুটের মত উঁচু।
কোন কষ্টই হলো না আহমদ মুসার প্রাচীর ডিঙ্গাতে।
একটু দৌড়ে এসে কয়েক ফুট প্রাচীর বেয়ে উঠে গিয়ে প্রাচীরের মাথা ধরে ফেলে খুব সহজেই প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে গেল আহমদ মুসা।
বাগানের গাছগুলো বেশ দূরে দূরে। তার ফলেই গাছগুলো বড় বড়।
আহমদ মুসা বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগোচ্ছে বাড়ির দিকে।
বাড়ির চারদিকে চারটি আলোর ব্যবস্থা আছে। সেই আলোতে বাড়ি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বাগানের জমাট অন্ধকার একটুও দূর হয়নি। অনেকটা অন্ধের মতই হাঁটছে আহমদ মুসা।
চোখে কিছু দেখছে না বলেই কান দু’টি সে বেশি সতর্ক রেখেছে। হঠাৎ তার মনে হলো, নরম ঘাসের উপর তার পায়ের যে শব্দ, সে রকম অনেকগুলো শব্দ তার কানে আসছে। যেন তার ডানে, বামে, পেছনে অনেকগুলো পা তার মত করেই সামনে অগ্রসর হচ্ছে, এই অনুভূতি হওয়ার সাথে সাথেই থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
চারদিকে সতর্ক চোখ বুলাচ্ছে সে।
এই সময় একটা গম্ভীর কন্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘ঠিকই সন্দেহ করেছ আহমদ মুসা। আমরা ঘিরে ফেলেছি তোমাকে চারদিক থেকে। ডজনখানেক স্টেনগান তোমাকে তাক করে আছে। আমাদের প্রত্যেকের চোখে ইনফ্রারেড গগলস। তোমার সবকিছুই আমরা দেখছি। কোন বেয়াদবীর দূর্মতি হলে একেবারে ভর্তা হয়ে যাবে। যেভাবে হাঁটছিলে, সেভাবেই সামনে এগুতে থাক’। কন্ঠটি থেমে গেল।
তার প্রত্যেকটি কথাই আহমদ মুসা বিশ্বাস করল। মনে খুব কষ্ট লাগল আহমদ মুসার, এমন দিনেই সে তার ইনফ্রারেড গগলস নিয়ে আসেনি।
হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। সেই কন্ঠটি অন্ধকারে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আজ গাড়িতে আমাদের একজন লোক বোকার মত এই ৫ নাম্বার বাড়ির কথা উচ্চারণ করেছিল, তুমি পালাবার পর আমরা বুঝেছি তুমি ৫ নাম্বার বাড়িতে আসবে। কিন্তু এত দ্রুত আসবে, আজই আসবে, সেটা আমরা কল্পনাতেও ভাবিনি। কিন্তু আহমদ মুসা তুমি চালাক হয়েও এই বোকামি কেন করলে। প্রকাশ্যে দিবালোকে তুমি বাড়ি দেখতে আসবে, বাড়ি দেখে যাবে, আর তোমাকে কেউ দেখবে না, এটা তুমি ভাবতে পারলে কেমন করে। এটাই ঈশ্বরের মার বুঝলে?’
‘তোমরা ঈশ্বর মান নাকি?’ আহমদ মুসা বলল। তার কন্ঠে বিদ্রুপ।
‘মায়ের কাছে মাসির কথা বল না আহমদ মুসা। তুমিও জান ইহুদীরা মানে বনি ইসরাইলা ঈশ্বরের চিরকালীন বাছাই করা সন্তান’। বলল কন্ঠটি।
‘বাছাই করা ঠিকই, তবে সেটা বেহেশতে যাওয়ার জন্যে নয় নিশ্চয়’। আহমদ মুসা বলল।
বাড়ির পেছনে তখন তারা পৌঁছে গেছে। আলোর মধ্যে সবাই দাড়িয়ে।
আহমদ মুসা দেখল, ঠিকই প্রায় চৌদ্দজন স্টেনগানধারী তাকে ঘিরে আছে।
‘আহাম্মকের কথার কোনো জবাব হয় না আহমদ মুসা’।
আহমদ মুসা দেখল কন্ঠটি ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির স্ট্রাসবার্গের স্টেশন চীফ লাইবারম্যানের।
লাইবারম্যানের বাম হাতে রিভলবার। আর ডান হাতটা গলার সাথে ঝুলিয়ে রাখা। আহমদ মুসা বুঝল, লাইবারম্যান সকালের ঘটনায় শুধু আহতই হয়েছিল।
কথা শেষ করেই লাইবারম্যান ঘুরে দাঁড়াল বাড়ির দিকে। তারপর রিভলবারটা পকেটে রেখে পকেট থেকে বাঁ হাত দিয়ে ক্ষুদ্র মোবাইল সেটের মত একটা কিছু বের করল।
সামনেই ছিল একটা দরজা। বাড়ির পেছনের দরজা এটাই।
লাইবারম্যান তার বাম হাত উঁচু করল দরজাটির সমান্তরালে। সংগে সংগে দরজাটা খুলে গেল। আহমদ মুসা বুঝল লাইবারম্যানের হাতের ওটা রিমোট কনট্রোল।
দরজা খুলে যেতেই একজন লোক বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। তার হাতে একটি হ্যান্ডকাফ।
তাকে দেখেই লাইবারম্যান বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, তুমি আহমদ মুসাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাও। সকালের ভুল আমরা করব না’।
আহমদ মুসাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হলে তাকে নিয়ে সবাই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। সবার আগে লাইবারম্যান। তার পেছনে আহমদ মুসা। অন্য অস্ত্রধারীরা আহমদ মুসার পেছনে।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে আহমদ মুসাকে নিয়ে সবাই এল একটা সিড়ি ঘরে। এখান থেকে সিড়ি উঠে গেছে দু’তলা, তিনতলায়।
সিঁড়ি ঘরে ঢুকেই বৈদ্যুতিক বোর্ডের সুইচের সারি থেকে একটা সুইচে চাপ দিল লাইবারম্যান। সুইচটা অন করার সাথে সাথেই সিড়িঘরের মেঝের একাংশ সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল নিচে নামার সিড়ি।
সিড়ি দিয়ে নামল ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে।
নিচের আন্ডারগ্রাইন্ড ফ্লোরটার মাঝখানে সোফা সজ্জিত একটা লবী ছাড়া গোটাটাই ছোট বড় বিভিন্ন কক্ষে ভরা।
আহমদ মুসাকে নিয়ে ওরা একটি কক্ষে তুলল। কক্ষটি বেশ বড়। কক্ষের একপ্রান্তে সিংগল সাইজের লোহার খাট। খাটটি মেঝের সাথে ফিক্সড করা।
আহমদ মুসাকে কক্ষে ঢুকিয়েই লাইবারম্যান বলল, ‘আহমদ মুসা এটাই তোমার ঘর। তবে বেশিক্ষণ তোমাকে এখানে থাকতে হবে না। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আজর ওয়াইজম্যান আসছেন। তিনি ফিরে এলেই আমরা এখানে আসব। আমরা আসার আগ পর্যন্ত তুমি শুয়ে শুয়ে তোমার জীবনের একটা হিসেব নিকেষও করে নিও। কারণ আমরা আসার পর আর তুমি সুযোগ পাবে না’। থামল লাইবারম্যান।
‘পাব না যদি তুমি ঈশ্বর হও। কিন্তু তুমি ঈশ্বর নও মি.লাইবারম্যান’। বলল আহমদ মুসা।
‘ঈশ্বর হওয়ার প্রয়োজন নেই আহমদ মুসা। ঈশ্বর অনেক স্বাধীনতাই মানুষকে দিয়ে দিয়েছেন’। থামল লাইবারম্যান।
কিন্তু আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না। ভাবল, বেহুদা আলোচনায় কোন লাভ নেই।
লাইবারম্যানই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘আহমদ মুসা আজ সকাল পর্যন্ত তুমি অসংখ্যবার সুযোগ পেয়েছ। কিন্তু সব কিছুরই একটা শেষ আছে আহমদ মুসা। সেই শেষ মাথায় তুমি পৌঁছে গেছ। আর তোমাকে নিয়ে আমরাও ধৈর্য্য সহ্যের শেষ মাথায় পৌঁছেছি। তোমার লাশ পড়ত ঐ অন্ধকার বাগানেই। কিন্তু আজর ওয়াইজম্যান নিজেই তোমার শেষ বিচারটা করতে চান বলেই তুমি কিছুটা সময় পেয়ে গেলে’।
বলেই ঘুরে দাঁড়াল লাইবারম্যান। কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েই আবার ফিরল সে। বলল সে একজনকে লক্ষ্য করে, ‘লেগ চেইনটা আননি?’
‘ইয়েস বস’। বলল লোকটি।
‘লাগাওনি কেন এতক্ষণ?’ ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল লাইবারম্যান।
‘বস আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি’। বলল লোকটি।
কথা শেষ করেই লোকটি তড়িঘড়ি করে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে পড়ল। পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিল আহমদ মুসার এবং সেটা লক করে দিল।
লাইবারম্যান বলে উঠল, ‘তোমার ব্যাপারে আমরা আর কোন ঝুঁকি নিতে চাই না আহমদ মুসা। সকালে তোমার হাত-পায়ে শৃঙ্খল পরালে আমাদের তিনজন লোককে জীবন দিতে হতো না, আমিও আহত হতাম না’।
‘এখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চিন্তই লাইবারম্যান?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বলতে পার। তুমি পালাতে পারছ না, তোমার হাত-পা নিষ্ক্রিয় করা গেছে এব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। সকালের ভুল আমরা শুধরে নিয়েছি’।
বলে ঘুরে দাঁড়াল লাইবারম্যান। বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
তার সাথে সাথে অন্য সকলেও।
লাইবারম্যান তার শেষ কথাটার কোন জবাব পেল না আহমদ মুসার কাছ থেকে। কিন্তু ঘুরে না দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকালে সে দেখতে পেত একটা হাসি। এ হাসি বিদ্রুপ করছে লাইবারম্যানকে।
আহমদ মুসার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
দরজা বন্ধ হতেই বসে পড়ল আহমদ মুসা মেঝেতে।
তার হাতের হ্যান্ডকাফের মতই পায়ের চেইনটা। ছয়সাত ইঞ্চির বেশি লম্বা নয়।
দুই হাঁটু দুই দিকে ছড়িয়ে বসতে পারল না আহমদ মুসা। ঐভাবে বসতে পারলে জুতার গোড়ালী হাতের বেশি কাছে পেত। দুই হাটু একদিকে নিয়ে দুই পা এক সাথে ছড়িয়ে বসল আহমদ মুসা।
পা দু’টি গুটিয়ে যথাসম্ভব কাছে নিয়ে এল সে। তারপর দু’হাত দিয়ে ডান জুতায় হুক দিয়ে আটকানো গোড়ালিটা খুলে ফেলল।
জুতার গোড়ালী হাতে নিয়ে আহমদ মুসা গোড়ালীর ভেতরের পাশের একটা বিশেষ স্থানে চাপ দিতেই গোড়ালীর গোটা সারফেসটাই ক্লিক করে উঠে গেল। বেরিয়ে পড়ল একটা কেবিন। কেবিন থেকে আহমদ মুসা বের করে আনল সিগারেটের চেয়ে সরু এবং আধা সিগারেটের মত লম্বা সুচবিহীন সিরিঞ্জের মত একটা ছোট বস্তু। এটাই ‘মাইক্রো লেসার টর্চ’। এর লেসার বীম দিয়ে যে কোন তালা, সরু সাইজের যে কোন আইরন বার এবং আধা ইঞ্চি পরিমাণ পুরু স্টিলশিট গলিয়ে ফেলা যায়, কেটে ফেলা যায়।
আহমদ মুসা জুতার গোড়ালিটা আবার লাগিয়ে দিয়ে হাত-পায়ের শৃঙ্খল কাটার দিকে মনোযোগ দিল।
লেসার বীম দিয়ে হ্যান্ডকাফের লক এবং পায়ের চেইনের লক গলিয়ে শেষ করে দিতেই হাত পায়ের চেইন খুলে গেল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা লেসার টর্চ পকেটে পুরে হ্যান্ডকাফ ও পায়ের চেইন কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়াল। এগুলো খাটের দিকে।
স্টিলের খাটের উপর রঙিন কাপড়ে মোড়া ফোমের তোষক। পায়ের দিকে একটা কম্বল মুড়িয়ে রাখা। কম্বল দেখে খুশি হলো আহমদ মুসা। কম্বল মুড়ি দিয়ে তার হাত-পাকে সে ওদের চোখের আড়ালে রাখতে পারবে।
আহমদ মুসা হাতের হ্যান্ডকাফ ও পায়ের চেইন তোষকের তলে রেখে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।
ঘুমাবার আগে আহমদ মুসার একটাই অস্বস্তি ছিল যে, তার কাছে কোন অস্ত্র নেই। সার্চ করে সব অস্ত্রই ওরা কেড়ে নিয়েছে। এমনকি ঘড়ি, কলমও। তার ভাগ্য ভাল যে জুতা জোড়া খুলে নেয়নি তারা।
দরজা খোলার শব্দে আহমদ মুসার তন্দ্রা ভাঙল। কিন্তু চোখ খুলল না সে। কিন্তু অনুভব করল ঘরে অনেক লোক প্রবেশ করেছে।
প্রথম কন্ঠ শুনতে পেল সে লাইবারম্যানের। বলছিল সে, ‘ঘুমাচ্ছে আহমদ মুসা’।
‘এই অবস্থায় মানুষের ঘুম আসে। আচ্ছা লোক এই আহমদ মুসা’। একটি ভারী কন্ঠ বলে উঠল। আহমদ মুসা বুঝতে পারল এ কন্ঠ আজর ওয়াইজম্যানের।
‘শেষ ঘুম তো স্যার’। বলল লাইবারম্যান।
বলে একটু থেমেই বলে উঠল সে আবার, ‘এই ঘুমটাই তার শেষ ঘুম হোক স্যার’।
‘না লাইবারম্যান, মৃত্যুটা তাহলে খুব শান্তির হবে তার। সে মরবে খুবই অসহায়ভাবে এবং অসহ্য যন্ত্রনা তাকে পেতে হবে’।
বলে একটা দম নিয়ে হাতের রিভলবারটাকে একবার চেক করে একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি গিয়ে ওকে লাথি মেরে জাগিয়ে দাও। দেখুক সে যম তার শিয়রে’।
আহমদ মুসা অনুভব করল একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটির পায়ের শব্দ যখন প্রায় মাথার পাশ পর্যন্ত এল, তখন আহমদ মুসা চোখ ও মুখকে ঘুম কাতর রেখেই দু’চোখের পাতা সামান্য খুলল। দেখতে পেল, স্টেনগানধারী একজন লোক দু’হাতে স্টেনগান ধরে ব্যারেল উচু করে রেখে তার ডান পা তুলছে আহমদ মুসার বুকে লাথি মারার জন্যে।
তার লাথিটা আহমদ মুসার বুক স্পর্শ করার আগেই চোখের পলকে আহমদ মুসার দু’হাত ছুটে গিয়ে লোকটির স্টেনগান কেড়ে নিল এবং শুয়ে থেকেই তার আগুন ঝরা স্টেনগানকে ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরিয়ে নিতে লাগল।
তার মধ্যেই সে দেখতে পেল একজনকে ঢাল সাজিয়ে তার আড়ালে দাঁড়িয়ে পিছু হটে কে একজন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
ঘরে তখন কেউ দাড়িয়ে নেই। সবার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটানো। রক্তে ভাসছে তারা।
আহমদ মুসা ষ্টেনগান হাতে রেখেই উঠে দাঁড়াল। লাশগুলোর দিকে একবার নজর করল। লাইবারম্যানের লাশ সে দেখতে পেল, কিন্তু আজর ওয়াইজম্যানকে দেখতে পেলনা। বুঝল সে, আজর ওয়াইজম্যানই তাহলে তাদের একজনকে ঢাল সাজিয়ে নিজেকে রক্ষা করে পালিয়ে গেছে। কিন্তু তাকে পেলে তো সব পাওয়া হয়ে যায়।
চিন্তাটা মাথায় আসতেই আহমদ মুসা ছুটল তার পিছু নেবার জন্য।
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে সিঁড়িতে এল।
সিঁড়ি মুখটা বন্ধ।
আহমদ মুসা দেখল সিঁড়ি মুখের কোথাও কোন বোতাম বা কোন সুইচ নেই।
দ্রুত নেমে এলো আহমদ মুসা সিঁড়ি ঘরে। সিঁড়ি ঘরে সে পেয়ে গেল সুইচবোর্ড। দেখল, সব সুইচ অন, শুধু একটাই অফ। অফ সুইচটাকে অন করে দিয়ে আহমদ মুসা সিঁড়ির গোড়ায় ছুটে এল। দেখতে পেল, সিঁড়ির মুখ খুলে গেছে।
আহমদ মুসা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। সিঁড়ি ঘরে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত চোখে পড়ল তার। ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো যে, আজর ওয়াইজম্যান আহত হয়েছে।
রক্তের দাগ অনুসরন করে ছুটল আহমদ মুসা।
বাইরের গেটে যখন এসে দাঁড়াল, দেখতে পেল ছুটন্ত একটা গাড়ির পেছনের লাল আলো।
‘ঐ গাড়িতেই পালাল আজর ওয়াইজম্যান, ভাবল আহমদ মুসা।
এ সময় পাশে একাধিক পায়ের শব্দ শুনে ষ্টেনগান তাক করে তাড়াক করে ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া, আমরা বলে চিৎকার করে উঠল সামনে থেকে।
আহমদ মুসা তার ষ্টেনগানের ব্যারেল সংগে সংগেই নিচু করল।
এক ঝাঁক গুলী গিয়ে মাটিতে বিদ্ধ হলো। আহমদ মুসা ততক্ষনে ষ্টেনগানের ট্রিগার থেকে তার তর্জ্জনি সরিয়ে নিয়েছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে এসে দাঁড়াল যায়েদ এবং ফাতিমা।
প্রচন্ড বিস্ময় ও বিরক্তি আহমদ মুসার চোখে মুখে। ধমকের স্বরে বলল, এ তোমরা কি পাগলামী করেছ, এখনি সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেতে পারতো।
‘আমাদের ভুল হয়েছে ভাইয়া। কথা না বলে এভাবে এগোনো ঠিক হয়নি।’ ভয় মিশ্রিত ভেজা গলায় বলল ফাতিমা।
‘তার চেয়ে বড় ভুল হয়েছে এভাবে তোমাদের আসা।’ বলল
আহমদ মুসা।
‘ফাতিমা প্রস্তাব করল। আমিও ঠিক মনে করলাম। তাই……..।’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল যায়েদ।
যায়েদ থামতেই ফাতিমা বলে উঠল, ‘মাফ করবেন ভাইয়া, আমরা সব জানার পর ঘরে শুয়ে থাকতে পারিনি। বিশেষ করে যখন ভেবেছি আমরা বাসায় রাত যাপন করছি, আর আমাদের এক ভাই আমাদের জন্য মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, তখন ঘরে থাকা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়েছে।’ ফাতিমার আবেগ জড়িত কন্ঠে কান্নার সুর।
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ তোমাদের দায়িত্ববোধের জন্য। আমি হয়তো ঠিক মনে করছি না। কিন্তু তোমরা যা করা উচিত, সেটাই করেছ।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার মন, আপনার বিচারবোধ এবং আপনার স্নেহ এত বড় বলেই আপনি এত বড় এবং আহমদ মুসা। আপনার প্রতি আমাদের অভিনন্দন। আজ আমরা দু’জন আমাদের কে সব চেয়ে ভাগ্যবান মনে করছি।’
‘ওয়েলকাম বোন তোমাদের। তোমাদের কান্ড দেখে আমার স্ত্রী জোসেফাইনের কথা মনে পড়ছে। ঘটনাগুলো বিয়ের আগের। আমি ওকে নির্দেশ দিয়ে আসতাম। কিন্তু আমার অনুপস্থিতির সময় সে তার বিচারবোধ দ্বারা পরিচালিত হতো। বেশ কিছু অভিযানে সে আমার নির্দেশ অমান্য করে আমার পিছু নিয়েছে এবং আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, ভাবীকে এজন্যে কি আপনি বকেছেন?’ বলল ফাতিমা মুখে হাসি টেনে।
‘বকেছি। কিন্তু তার যুক্তিতে তিনি অনড়। আমার অনুপস্থিতিতে তাঁর বিচারবোধ দ্বারা পরিচালিত হবার অধিকার তাঁর রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।’
ফাতিমার মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এ জন্যেই তিনি আমাদের ভাবী এবং আপনার উপযুক্ত সঙ্গিনী।’
ফাতিমা থামতেই যায়েদ তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘ভাইয়া আপনি শুধু আমাদের ভাইয়া নন, আমাদের মানে ফরাসীদের জামাই আপনি। এটা আমাদের একটা বড় গর্ব, যেটা ফাতিমাদের নেই।’ কি রকম? বুঝলাম না। ভাইয়া ফরাসীদের জামাই কি করে? বলল ফাতিমা। তার কন্ঠে বিস্ময়।
‘ও, তুমি জানই না। ভাবী তো মারিয়া জোসেফাইন লুই, ফ্রান্সের সর্বশেষ রাজবংশ বরবুনদের রাজকুমারী। ‘লুই দ্যা গ্রেট’ নামে পরিচিত ফ্রান্সের শক্তিমান সম্রাট চতুর্দশ লুই-এর তিনি সরাসরি বংশধর।’ বলল যায়েদ চোখ–মুখ উজ্জল করে।
‘ও গ্রেট নিউজ আমাদের জন্যে। কিন্তু যায়েদ ফরাসী হিসাবে তোমার যে গর্ব, তার চেয়ে আমার গর্ব বড়, মুসলমান হিসাবে।
আমার একজন ভাই বিয়ে করেছেন তোমাদের রাজকুমারীকে।’
ফাতিমা বলল।
‘সেই হিসাবে তো আমার গর্ব ডবল। ফরাসী হওয়ার পাশা পাশি আমি মুসলমানও।’ চট করে বলল যায়েদ।
ফাতিমা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে বধা দিয়ে বলল, তোমরা ঝগড়াটা বাড়িতে গিয়ে করো। এখন কাজের কথায় এস।
তোমরা এসে ভালই হয়েছে, এত বড় বাড়ি সার্চ করতে হবে, তোমাদের সাহায্য দরকার। চলো ভেতরে। বলে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল।
যায়েদ ও ফাতিমা চলল তার পেছনে পেছনে।
সিঁড়ি রুমে ঢুকে আহমদ মুসা বলল, ‘চলো যাই আগে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ওখানে ডজন খানেক মানুষ মরে পড়ে আছে। ওদের সার্চ করা থেকেই কাজ শুরু করি।’
আহমদ মুসা সুইচ অন করে সিঁড়ি মুখ উন্মুক্ত করে নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। যায়েদ ও ফাতিমা তার পেছনে পেছনে চলল।
তারা পৌছল সেই রক্ত প্লাবিত কক্ষ।
ঘরে রক্তের বন্যা ও লাশের স্তুপ দেখে আঁৎকে উঠল ফাতিমা।
বলল, এত রক্ত এত লাশ।
‘ফাতিমা, এই কক্ষ আমার লাশ পড়ে থাকার কথা ছিল, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় পড়ে আছে তাদের লাশ। আমি এখানে আসব, আগেই ওরা আঁচ করতে পেরেছিল। তার ফলে আমি এসেই ওদের ফাঁদে পড়ে যাই এবং বন্দী হই। হাত পায়ে বেড়ি লাগিয়ে এ ঘরেই ওরা আমাকে বন্দী করে রেখেছিল। আজ রাতেই আমাকে হত্যা করার কথা। সে উদ্দেশ্যেই-অল্প ক’মিনিট আগে ওরা আমার ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। মারতে এসে সবাই ওরা মরেছে শুধু পালাতে পেরেছে ওদের শীর্ষনেতা লোকটি।’ বলে থামল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেরই বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা থামলেও সংগে সংগে কথা বলল না ওরা।
একটু পর যায়েদ বলে উঠল, ‘একজন আহত, রক্তাক্ত লোককে আমরা গাড়ি করে পালাতে দেখলাম। সেই তাহলে নেতা?’
যায়েদ থামতেই ফাতিমা বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনাকে অভিনন্দন ভাইয়া।’ মাত্র দুই দিনে চারটি অভূতপূর্ব বিজয়। আগের অবস্থায় বিস্মিত হতাম, কিন্তু এখান সেই অবস্থা নেই। এসব বিজয় আহমদ মুসার জন্য কিছুই নয়। শুধু বলব, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।
আহমদ মুসা তখন মৃতদের সার্চ শুরু করে দিয়েছে। যায়েদ ও আহমদ মুসাকে সহযোগিতা করতে লাগল। কিন্তু তাদের কাছে কিছুই পাওয়া গেল না।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ওদের পকেটে কোন তথ্য-প্রমাণ না পেলে ও একটা বড় জিনিস পাওয়া গেছে। সেদিন হোটেলে মৃত দু’জনের সার্টের কলারে যে ইনসিগনিয়া পাওয়া গিয়েছিল, এদেরও সার্টের কলারে সেই ইনসিগনিয়াই রয়েছে। তারা যে একই দলের লোক পুলিশ এটা সহজেই বুঝতে পারবে।এটা স্পুটনিক কেসের জন্য ভালই হবে।
‘কিন্তু এই ঘটনায় পুলিশ কি আপনাকে সন্দেহ করবে?’ বলল ফাতিমা।
‘পুলিশ বুঝবে কিনা জানি না, কিন্তু পুলিশকে বুঝানো হবে। আজর ওয়াইজম্যান বেঁচে গেছে। সেই পুলিশের বিশেষ কাউকে জানাতে পারে এবং আমার পিছনে পুলিশকে লেলিয়ে দেয়ার কাজ জোরদার করতে পারে। তবে আইনগতভাবে পুলিশের চিন্তা আজর ওয়াইজম্যানদের বিরুদ্ধেই যাবে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা দরজার দিকে হাঁটা শুরু করল। বলল, ‘এস উপরে সব ফেলার সার্চ করতে হবে, নিশ্চয় কিছু পাওয়া যাবে।’
ফাতিমা ও যায়েদ আহমদ মুসার পিছে পিছে চলল।
নিচের তলায় তারা কিছুই পেল না। দেখে তাদের মনে হলো, নিচের তলাটা এক সময় ষ্টোর ও চাকর বাকরদের বাসস্থান হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। অবশ্য কয়েকটিতে কিছুক্ষন আগেও লোক ছিলো বলে তাদের মনে হলো।
দু’তলাটা সুসজ্জিত। দু’তলার ঘরগুলো প্রায় সবগুলই চেয়ার- টেবিল-সোফায় সাজানো অফিস ও সিটিং কক্ষ। তবে কাগজপত্র নেই কোন টেবিলে। আফিসগুলো পরিত্যক্ত মনে হলো তাদের। টেবিলের ড্রয়ার, আলমারি হাতড়িয়ে কিছু কাগজপত্র ও কয়েকটা টেলিফোন ইনডেক্স যা পেল তা সবই ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের এবং পুরানা।
তিন তলার অধিকাংশ কক্ষই ফাঁকা। দক্ষিন দিকে পেল চারটা বেড রুম একই সারিতে। দেখে মনে হলো, এ বেড রুমগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। চারটি বেড রুমের পাশে একটা কম্পিউটার কক্ষ খুঁজে পেয়ে গেল। ঘরটি একদম তাজা। কিছুক্ষন আগেও ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হলো তাদের। কয়েকটি বাটনে ক্লিক করে আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো যে, কম্পিউটার আজও ব্যবহৃত হয়েছে।
ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা ফাতিমা ও যায়েদের দিকে। বলল, যায়েদ, ফাতিমা এবার তোমাদের বিদ্যার পরীক্ষা হবে। দু’টা কম্পিউটার টার্মিনালের সব ফাইল, সব কিছু তোমাদের খুঁটে খুঁটে সার্চ করতে হবে। আমি ততক্ষণে অন্য কক্ষগুলো দেখে আসি।’
বলে আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুতে যাচ্ছিল। যায়েদ পেছন থেকে বলে উঠল, কম্পিউটারের সিক্রেট ফাইলগুলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেশি। নিশ্চয় ওগুলোর কোড কোথাও রেখে যায় নি। কোন ফাইলে বা কোন প্রোগ্রামে কোড বা কোডগুলোকে ক্যামোফ্লেজ করে রেখে গেলেও তা এত তাড়াতাড়ি বের করা অসম্ভব হতে পারে। ওদের কোড কি হতে পারে, এ ব্যাপারে আপনি কিছু অনুমান করেন কি না।
থমকে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা। তার চেখে মুখে নেমে এল ভাবনার ছাপ। মুখ নিচু হলো তার। চোখ দু’টিও বন্ধ হয়ে গেল মুহুর্তের জন্য। বুঝা গেল গোটা ভাবনাকে সে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছে।
একটু পর চোখ খুলল আহমদ মুসা। মুখ তুলল সে।
যায়েদর মুখে দুই চোখ নিবদ্ধ করে বলল আহমদ মুসা, ‘অত্যন্ত কঠিন, মানে অসম্ভব একটা প্রশ্ন করেছে যায়েদ। তবে আমি যদি ওদের কেউ হতাম, তাহলে যে কোডগুলো আমি ব্যবহার করতাম, সেটা তোমাকে বলতে পারি।’
বলে আহমদ মুসা মুহূর্তকাল চিন্তা করে বলল, ‘তোমাকে অনেকগুলো অপশন নিয়ে ট্রাই করতে হবে। তার প্রথমটি হলো, ‘Harzel’ অথবা ‘H’, দ্বিতীয় ‘Azr Wiseman’ অথবা AW, তৃতীয় ‘World Freedom Army’ অথবা ‘WFA, চতুর্থ ‘HAWWFA’, পঞ্চম ‘HAWFA’ এবং ষষ্ঠ ‘New Gulag’ অথবা ‘NG’, হলো সর্বশেষ।’
আহমদ মুসা থামতেই বিস্মিত কন্ঠে ফাতিমা বলল, ‘World Freedom Army’(WFA) থেকে যে কোড নিয়েছেন তার যুক্তি
বুঝলাম।ওটা ওদের সংগঠনের নাম। সংগঠনের নামে কোড হতে পারে। কিন্তু অন্য কোডগুলোর যুক্তি বুঝছি না। ওগুলো কি আপনার নিছক কল্পনা?
‘কোনটাই কল্পনা নয় ফাতিমা। ইহুদীরা ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রিয়। Hazrel (H) ইহুদীবাদের জনক। Azr Wiseman (AW) এর Wiseman একজন বৃটিশ ইহুদী বিজ্ঞানী, তিনি বলা যায় ইসরাইল রাষ্ট্রের জনক। আর ‘Azr’ হলো ‘World Freedom Army’ (WFA) আন্দোলনের জনক। ‘HAWWFA’ and ‘HAWFA’ উপরোক্ত তিনটি নামের শব্দগুলোর আদ্যাক্ষরের সমাহার। সব শেষ সাবেক সোভিয়েতের ‘New Gulag’ সংস্কৃতির প্রতি ইহুদীদের আকর্ষণ খুব বেশি। সর্ব কনিষ্ঠ হিসাবে সাবেক সোভিয়েতের ‘নির্মূলকরণ’ সংস্কৃতি তারা অনুসরণ করছে। সুতরাং তাদের জন্য ‘New Gulag’ সুন্দর কোড ওয়ার্ড হতে পারে। বলল, আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। কিন্তু একটা কথা। ইহুদীরা ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রিয় হলে তো’ Temple’ ‘Solomon’ ‘Sabat’ ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী শব্দও তো তাদের কোড ওয়ার্ড হতে পারে। কিন্তু এগুলোকে তো আপনি বাদ দিয়েছেন।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ইসরাইল, ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ ‘ইরগুনজাইলিউমি’ ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডোম আর্মি’ প্রভৃতি ধর্মবাদী নয়, ইহুদীবাদী, আধিপত্যবাদী ঐতিহ্যের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি। এ কারণে ওদের ধর্মবাদী ঐতিহ্যের চেয়ে ইহুদীবাদী ঐতিহ্যের প্রতিই নজর দিতে হবে।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
হাসি মুখে এক সাথে বলে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ। পরে যায়েদ আবার বলল, ‘আল্লাহ আপনার চিন্তাকে কবুল করুন এবং আমাদের কামিয়াব করুন।’
বলে যায়েদ কম্পিউটারের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ফাতিমাও।
আহমদ মুসাও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে হাটা শুরু করেছে।
আধা ঘন্টা পরে আহমদ মুসা ফিরে এলো হতাশ হয়ে। তিনতলার অবশিষ্ট ঘরগুলো সার্চ করে কিছুই পাওয়া যায়নি।
আহমদ মুসা কম্পিউটার রুমে ঢুকতেই ফাতিমা চাপা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ইউরেকা, ইউরেকা। আমরা যা খুঁজছিলাম তা বোধ হয় পেয়ে গেছি ভাইয়া। সব আমরা বুঝছি না, আপনি বুঝবেন। আসুন।
আহমদ মুসা গিয়ে যায়েদের পাশে বসল।
কথা শেষ করেই ফাতিমা আবার বলে উঠল, আপনাকে আরও অভিনন্দন ভাইয়া। আপনার অনুমান সত্য। আপনার দেয়া কোড দিয়ে দুই কম্পিউটারের সিক্রেট ফাইলগুলো খোলা গেছে।’
‘কোন দু’টি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘New Gulag এবং Harzel’ উত্তর দিলো ফাতিমা।
আহমদ মুসা আর কোন কথা না বলে মনোযোগ দিল কম্পিউটারের স্ক্রীণের দিকে।
‘ভাইয়া মনে হয় আমরা সাংঘাতিক জিনিস পেয়ে গেছি।’ বলল যায়েদ। তারপর যায়েদ ‘কিবোর্ডে’ একটা বোতাম চাপ দিয়ে স্ক্রীনের একটা জিনিসের দিকে ইংগিত করে বলল, ওটা কি চিনতে পারছেন ভাইয়া।
হ্যাঁ , ওটা ‘স্পুটনিক।’ রাশিয়ার প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ স্পুটনিকের নিচের হেডিংটা পড়ুন। বলল, যায়েদ।
‘এর বিপজ্জনক পরিকল্পরা’-পড়ল শিরোনামটি আহমদ মুসা।
স্ক্রীনের শিরনাম দেয়া পাতাটি যায়েদ ধীরে ধীরে উপরে তুলল। বলল, ‘ভাইয়া, এবার স্পুটনিকের বিপজ্জনক পরিকল্পনাটা, পড়ুন।
পড়তে লাগল আহমদ মুসা। পাতাটি ধীরে ধীরে উপরে উঠছে আর পড়ছে তা আহমদ মুসা।
পড়ার এক পর্যায় এসে আহমদ মুসা আনন্দে যায়েদের পিঠ চাপড়ে চিৎকার করে উঠল, ‘যায়েদ, এ তো আমাদের স্পুটনিকের পরিকল্পনা!
নিউইয়র্কের ‘লিবার্টি’ ও ডেমোক্রাসি’ টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য উন্মোচনে স্পুটনিক তদন্তের যে পরিকল্পনা করেছিল এবং এর যে উদ্দেশ ছিল, এ সবইতো এখানে বলা হয়েছে ! আলহামদুলিল্লাহ। থামল আহমদ মুসা।
কম্পিউটার স্ক্রীনে পাতাটি থেমে গিয়েছিল। আবার তা উপরে উঠতে লাগল। সামনে এসে দাঁড়াল পাতার দ্বিতীয় শিরনাম। যায়েদ বলল, ‘ভাইয়া পড়েন শিরোনামটা।’
‘ষ্টার ওয়ারঃ স্পুটনিককে গুলি করে নামানো’ পড়ল শিরোনামটি আহমদ মুসা। বলল, ‘তার মানে এবার স্পুটনিক ধ্বংসের পরিকল্পনা। আগাও যায়েদ।’
কম্পিউটার স্ক্রীনে পাতা উপরে উঠতে লাগল। উম্মুক্ত হতে লাগল পাতার লেখাগুলো। বলল যায়েদ, ‘ধীরে ধীরে পড়তে থাকুন ভাইয়া’ পড়তে লাগল আহমদ মুসা। তার পড়া যতই এগুলো, তার চোখে-মুখে আনন্দ-বিস্ময়ের খেলা ততই বাড়তে লাগল।
এক সময় পাতাটা কম্পিাউটার স্ক্রীনে স্থির হয়ে গেল। তার মানে দ্বিতীয় শিরোনামের বক্তব্য শেষ।
যায়েদ বলল, ‘কি বুঝলেন ভাইয়া?’
আহমদ মুসা ভাবছিল। তার ভাবনায় ছেদ নামল যায়েদের কথায়।
তাকাল সে যায়েদের দিকে। বলল, একটু ক্যামোফ্লেজ করেছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না। ওদের ‘ষ্টার ওয়ার’ টা হলো নিউইয়র্কের টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য অনুসন্ধানে স্পুটনিকের পরিকল্পনা। ‘ষ্টার ওয়ার’ বর্জন মানে স্পুটনিকের তদন্ত বর্জন করার জন্য তারা স্পুটনিকের পিসফুল ডেথ ঘোষনা করেছে। ষড়যন্ত্রের এই প্রকল্পে আরও দেখা যাচ্ছে ওদের কাছে স্পুটনিকের চেয়ে বড় হলো স্পুটনিকের সাত নির্মাতা। কারণ ‘স্পুটনিক ওয়ান’ হারালে ‘স্পুটনিক টু’ তৈরী করতে পারে। তাই স্পুটনিকের জন্য যে দন্ড সেই দন্ড সাত নির্মাতার জন্যও। তবে তার আগে সাত নির্মাতার এক্সরে প্রয়োজন ‘ষ্টারওয়ার’ অর্থাৎ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য সন্ধানে তারা কতটুকু এগিয়েছে, কাদেরকে আরও তারা জানিয়েছে তা বের করার জন্য।’ থামল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমরা এটাই বুঝেছি। তবে স্পুটনিকের ‘পিসফুল ডেথ’ ব্যাপারটা বুঝিনি।’ বলে উঠল যায়েদ ও ফাতিমা প্রায় এক সংগেই।
‘পিসফুল ডেথ’ মানে উত্তাপ-উত্তেজনাহীন নিরব মৃত্যু। স্পুটনিককে এভাবেই ধ্বংস করা হয়েছে। স্পুটনিকের সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু বিল্ডিং-এর গায়ে কোন আঁচড় লাগেনি, আসবাবপত্রও সব ঠিক আছে। শুধু নেই ফাইল কাগজ-পত্র, ফিল্ম এবং কম্পিউটারের সফটওয়ার ও ডিস্কগুলো। এগুলো নেই, কিন্তু কি হয়েছে এগুলোর সামান্য নির্দশনও কোথাও নেই। মনে হতে পারে, স্পুটনিকের সাত গোয়েন্দা অফিস ছেড়ে দিয়ে ফাইল-পত্র নিয়ে কোথাও উধাও হয়েছে। এটাকে বলা হয়েছে স্পুটনিকের পিসফুল ডেথ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অদ্ভুত এ কৌশল ভাইয়া। ফারাসী গেয়েন্দারা যদি স্পুটনিকের অফিসের কেমিকেল টেষ্ট না করত, তাহলে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে তার কিছুই জানা যেত না, বলল ফাতিমা।
ফাতিমা থামতেই যায়েদ বলে উঠল, আরও মজার জিনিস ভাইয়া, আমরা যার কিছুই বুঝতে পারিনে।’
কথা বলতে বলতেই যায়েদ কস্পিউটারের কীবোর্ডে তার আঙুল চালনা শুরু করেছে। আহমদ মুসা তাকিয়ে আছে কম্পিউটারের স্ক্রীনের দিকে। বলল, মজার জিনিসটা কি যায়েদ?
‘একটা মানচিত্র ভাইয়া।’ বলেই যায়েদ কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে আঙুলি সংকেত করল, দেখুন ভাইয়া তৃতীয় একটা শিরোনাম।’
আহমদ মুসা আবার চোখ ফিরাল কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে। তাকাতেই চোখে পড়ল ‘নিউগুলাগ’ শিরোনামটা। ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
শিরোনামটা উপরে উঠে এল।
তার সাথে সাথে স্ক্রীনে ভেসে উঠল একটা মানচিত্র।
মানচিত্রটা যে একটা দ্বীপের, তা পরিস্কার বুঝা যায় তার চারদিকের রং দেখে। মানচিত্রেও বিভিন্ন বর্নের ল্যান্ড স্কেপ। মানচিত্রের নীচে লেখা ‘নিউ গুলাগ সাও তোরাহ।’
কম্পিউটার স্ক্রীনের উপর ঝুঁকে পড়েছে আহমদ মুসা।
যায়েদ, ফাতিমাও নিরব।
কিছুক্ষন পর মাথা সোজা করে বসল আহমদ মুসা। চোখ বন্ধ তার।
ভাবছে আহমদ মুসা।
মূহূর্ত কয়েকপর চোখ খুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘এটা মজার জিনিস নয় যায়েদ। এটা ভয়ংকর একটা স্থানের মানচিত্র। মানচিত্রের নিচে ফুট নেট আকারে তারকা চিহ্নিত দু’টো প্যারাগ্রাফ পড়েছ যায়েদ?’
‘জ্বি, ভাইয়া।’ যায়েদ বলল।
‘দেখ এক নাম্বার প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে, ধর্মহীন ও ধর্মনিরপেক্ষ ছিল বলে, ‘ওল্ড গুলাগ’ ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ‘নিউ গুলাগে’র ভিত্তি হবে ঈশ্বরের মনোনীত ধর্ম এবং নিউ গুলাগ পরিচালনা করবে ঈশ্বরের সহস্র সহস্র বছরের পরীক্ষিত ও মনোনীত লোকেরা। দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে আছে, নিউ গুলাগ ঈশ্বরের বিশ্ব গড়ার একটা কারখানা এবং ল্যাবরেটরী। পৃথিবীর পথভ্রষ্ট মিলিট্যান্ট-মৌলবাদীদের এখানে এনে এক্সরে করা হবে এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে চিকিৎসা চলবে, গোটা পৃথিবীতে যাতে দ্রুত ইসরাইলের ঈশ্বরের রাজত্ব কায়েম হয়।’
থামল আহমদ মুসা। একটু থেমেই আবার বলল, কি বুঝলে যায়েদ, ফাতিমা।
‘বুঝলাম, ধর্মহীন কম্যুনিষ্টদের গুলাগ ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু ইহুদীদের ধর্মের নিউ গুলাগ সফল হবে। কিন্তু ঝুঝতে পারছিনা এক্সে-রে এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসার ব্যাপারটা।’ বলল, ফাতিমা।
‘ব্যাপারটা আমার কাছেও খুব স্পষ্ট নয়। তবে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে বিষয়টা এই রকম হতে পারে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিউ গুলাগে ধরে নিয়ে যাবে। সেখানে তাদের সব কথা বের করে নেয়া হবে বা জেনে নেয়া হবে যেমন এক্সরে’র মাধ্যমে করা হয়। এর ফলাফলের ভিত্তিতেই অতঃপর গোটা দুনিয়ায় তারা অপারেশন পরিচালনা করবে।’
আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমারও তাই মনে হয়।’ বলল যায়েদ।
‘সবটাই ভয়ংকর ব্যাপার ভাইয়া। ঐ এক্সরের পর নিশ্চয়ই ওখানে
কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না। আর বিশ্বব্যাপী ওদের অপারেশনটা ওল্ড গুলাগের ষ্ট্যালিনের মত।’ বলল ফাতিমা। তার চোখে-মুখে আতংক।
‘ঠিক বলেছ ফাতিমা। তবে ইহুদীবদীরা এটা করবে ধর্ম, মানবতা, মানবাধিকার ও সন্ত্রাস দমনের পোশাক পরে।’ বলে একটা দম নিয়েই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের স্পুটনিকের সাত গোয়েন্দাকে নিউ গুলাগ সাও তোরাহ দ্বীপেই রাখা হয়েছে।’
চমকে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই। তাদের দু’জনের চোখে-মুখেই নেমে এল অন্ধকার। দু’জনে এক সাথে বলে উঠল, ‘কোথায় এই দ্বীপ?’ কান্নার মত ভারী শোনাল তাদের কন্ঠস্বর।
আহমদ মুসা গা এলিয়ে দিল চেয়ারে। বলল, এটাই এখন প্রধান প্রশ্ন।’
সংগে সংগেই আবার সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, ‘যায়েদ সবগুলোর প্রিন্ট নাও। আর চল যাবার আগে পুলিশকে টেলিফোনে সব কিছু বলে যাই।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘যায়েদ তুমি প্রিন্টগুলো তাড়াতাড়ি সেরে ফেল। আমি এখনি আসছি।’
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল পাঁচ মিনিট পরে দ্রুত। বলল, ‘যায়েদ প্রিন্ট শেষ?’
‘জি ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘তাহলে তোমরা দু’জন দ্রুত আমার পেছনে এস।’ বলেই আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুবার জন্য হাঁটা শুরু করল।
ফাতিমা উঠে দাঁড়িয়েছিল সংগে সংগেই। যায়েদও কাজ গুছিয়ে নিয়ে আহমদ মুসার পেছনে হাঁটতে লাগল।
তারা দ্রুত নেমে এল নিচের তলায়।
এসে বাড়ির ভেতরে প্রবেশের গেট থেকে যে করিডোরটা ভেতরে এগিয়ে এসেছে তার মুখে দেয়ালের আড়ালে ওঁৎ পেতে দাঁড়াল তারা। আহমদ মুসা তার হাতে রিভলবার তুলে নিয়েছে।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেরই চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল, যায়েদ ‘কি ব্যাপার ভাইয়া?’ ফিস ফিস কন্ঠ যায়েদের।
‘একটা প্রাইভেট কারকে আমি বাইরের গেটে দাঁড়াতে দেখেছি। দেখেছি দু’জন লোক নামতে। এরা নিশ্চয় WFA-এর লোক। ওদের রিল্যাক্স মুড দেখে মনে হয়েছে ওরা এখানকার ভেতরের খবর জানে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আমরা এগুচ্ছিনা কেন?’ ফাতিমা বলল।
‘সামনে এগিয়ে ওদের মুখোমুখি হয়ে আমি আর লড়াই বাধাতে চাই না। আমি ওদের ধরতে চাই। এ পর্যন্ত ওদের কাউকে আমরা জীবন্ত হাতে পাইনি। ওদের কাউকে জীবন্ত হাতে পেলে ‘নিউ গুলাগ সাও তোরাহ’ দ্বীপ কোথায় জানার চেষ্টা করা যেত।
ফাতিমা ও যায়েদের মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। ফাতিমা বলে উঠল, ‘আপনার এ চিন্তা ঠিক ভাইয়া।’
‘কিন্তু ওরা তো এতক্ষনে ভেতরে প্রবেশ করার কথা। আসছেনা কেন? ঠিক আছে, তোমরা এখানে দাঁড়াও। আমিএকটু ওদিকে…..।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলনা। পেছন থেকে একটা কর্কশ কন্ঠ ধ্বনিত হলো, ‘ও দিকে নয়, এ দিকে তোমার যম আহম …….। তারও কথা শেষ হতে পারল না।
পেছনের দিকে কর্কশ কন্ঠ ধ্বনিত হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে নিজেকে ছুড়ে দিল মেঝেতে এবং সেই সাথেই তার হাতের রিভলবার গর্জন করে উঠল পরপর কয়েকবার।
ওদিকে পেছন থেকে যে কন্ঠ গর্জন করে উঠছিল তারা ছিল দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দু’জনের হাতে উদ্যত রিভলবার। তাদের কন্ঠ থেমে যাবার সাথে সাথে তাদের রিভলবার ও গর্জন করে উঠেছিল।
আহমদ মুসা আগেই মেঝেয় ছিটকে পড়ার ফলে গুলি দু’টি তার উপর দিয়ে চলে যায়। তারা দ্বিতীয় গুলি করার আগেই আহমদ মুসার গুলি তাদের বিদ্ধ করল। বুকে গুলি খেল তারা দু’জনেই। তাদের রক্তাক্ত দেহ লুটোপুটি খাচ্ছিল মেঝেতে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
ভয় ও আকস্মিকতায় কাঠ হয়ে ফাতিমা ও যায়েদ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়েছিল। বাকরোধ হয়ে গেছে যেন তাদের। মৃত্যুকে যেন তারা একদম চোখের উপর নাচতে দেখল। জীবন ও মৃত্যু এত কাছাকাছি!
আহমদ মুসা যদি ঠিক সময়ে মেঝতে নিজেকে ছুঁড়ে দিতে না পারতো, তাহলে ওদের প্রথম গুলিই তার বক্ষ ভেদ করত। তারপর আহমদ মুসা যদি তার গুলিগুলো করতে কয়েক মুহুর্তও বিলম্ব করতো, তাহলে ওদের দ্বিতীয় গুলীর শিকার হতো আহমদ মুসা। তারপর ওদের তৃতীয় গুলি নিশ্চয় ছুটে আসতো যায়েদ ও ফাতিমার লক্ষ্যে। তাদের পকেটে একটি করে রিভলবার আছে, কিন্তু বের করার কথা মনে হয় নি, কখন বের করবে তাও বুঝতে পারেনি। আহমদ মুসা এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন!এত ক্ষিপ্র তিনি !যা ঘটে গেল তা অবিশ্বাস্য এক ঘটনা বলে মনে হচ্ছে তাদের কাছে। তাদের স্থির চোখের শূন্য দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এস যায়েদ এদের একটু চেক করি।’
বলে আহমদ মুসা ওদের দিকে এগুলো।
আহমদ মুসার কথা শুনল যায়েদ। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা তার মধ্যে। যেমন নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।
আহমদ মুসা প্রথমেই ওদের জামার কলার ব্যান্ড পরীক্ষা করল। তারপর তাদের পকেটগুলো সার্চ করল। দু’জনের পকেটে দু’টি মানিব্যাগ ছাড়া আর কিছুই পেলনা। মানিব্যাগে কোন কাগজপত্র পেলনা। এমনকি কোন নেমকার্ডও নয়। শুধু কিছু ইউরো মুদ্রা রয়েছে মানিব্যাগে। মানিব্যাগ দু’টি আবার ওদের পকেটে রেখে দিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল এবং বলল, ‘যায়েদ ফাতিমা এ দু’জনের কলার ব্যান্ডে ঐ একই ইনসিগনিয়া রয়েছে।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলল, চলো আমরা যাই।
আশে-পাশের কোন টেলিফোন বুথ থেকে পুলিশকে এখনি খবরটা জানাতে হবে। যাতে WFA -এর কেউ এখানে আসার আগেই পুলিশ আসতে পারে, সেটাও আমাদের দেখতে হবে।
আহমদ মুসা ‘এসো’ বলে হাঁটতে শুরু করল।
নিশ্চল মূর্তির আবস্থা থেকে ওরা নড়ে উঠল এবং আহমদ মুসার সাথে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে ফাতিমা বলল, ‘এ ধরনের সংঘাতে জীবন-মৃত্যু যে কত কাছাকাছি, তা আজ প্রথম দেখলাম।
আপনার খারাপ লাগেনা ভাইয়া? একটুও চিন্তা হয়না আপনার? আমার বুক এখনোও কাঁপছে। যদি মেঝেয় ছিটকে পড়েগুলী করতে একমুহুর্তও দেরী করতেন তাহলেই তো আপনি আর থাকতেন না। আমি ভাবতেই পারছিনা এ সব কথা।’ কন্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠছিল ফাতিমার।
‘জীবন-মৃত্যু কোন বুলেটের বা কোন অস্ত্রের হাতে নয়। এর ফায়সালা আসে আল্লাহর কাছ থেকে এবং তা আসে যখন তা আসার কথা। সুতরাং এ নিয়ে ভাবনার কিছু নেই।’ তারা গেটে পৌছে গিয়েছিল।
‘ভাইয়া সামনেই রাস্তার পূর্ব পাশে টেলিফোন আছে। আমি আসার আগে দেখেছি।’ বলল, যায়েদ গেটে পৌছেই।
‘যায়েদ চল, টেলিফোনটা করবে তুমি। টেলিফোন করে আমরা পাশেই কোথাও অপেক্ষা করব। এ বাড়িটা পাহাড়া দিতে হবে, যাতে পুলিশ আসার আগে ওরা কেউ আসতে না পারে।’
আহমদ মুসা ‘এস’ বলে আবার হাঁটা শুরু করল।
‘টেলিফোনে কি বলব ভাইয়া?’ বলল যায়েদ।
‘বলবে, ‘অমুক নাম্বার বাড়িতে গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি। বড় কিছু ঘটছে সেখানে। ব্যস আর কিছু নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
টেলিফোন করে আহমদ মুসারা পাশেই অপেক্ষা করল। দশ মিনিটও পার হলো না। পুলিশের দু’টি গাড়ি ছুটে এল তীব্রবেগে এবং তাদের অতিক্রম করে চলে গেল বাড়িটার দিকে।
এবার যায়েদ গাড়ি ষ্টার্ট দিল যাবার জন্যে। গভীর রাতের নিরবতা ভেঙে ছুটে চলছে গাড়ি। যায়েদের পাশে আহমদ মুসা।
পেছনের সিটে ফাতিমা।
চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা।
তিন জনেই নিরব।
নিরবতা ভাঙল যায়েদ। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের স্বরণীয় রাত চির স্বরণীয়ভাবে কাটল ভাইয়া। আমরা খুব খুশি।’
‘তোমাদের অভিনন্দন। কিন্তু মনে রেখ, তোমাদের দু’জনের নতুন জীবন যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এবং সে যুদ্ধটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়েকে প্রতিষ্ঠার জন্য। সুতরাং এটা আমাদের সৌভাগ্য।’ যায়েদ বলল।
‘ধন্যবাদ যায়েদ, তোমাদের মত করে সব মুসলমান যে দিন ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধের সংগ্রাম কে তাদের জন্য সৌভাগ্যের মনে করবে, সেদিন গোটা দুনিয়ার মুসলমানদের জীবন থেকে, অন্ধকারের অমানিশা কেটে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সেদিন কত দূরে ভাইয়া? ফাতিমা বলল।
‘সেটা নির্ভর করছে তোমরা তরুন-তরুনীরা কত দ্রুত সামনে আগাতে পারছো তার ওপর।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা কোন কথার উত্তর দিল না। তার নিরব দৃষ্টি প্রসারিত হলো সামনে।
যায়েদের দৃষ্টিও সামনে প্রসারিত।
আবার আহমদ মুসা তার চোখ বন্ধ করেছে। ভাবছে সে।
এক সময় যায়েদ মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, কি ভাবছেন ভাইয়া?
চোখ খুলল আহমদ মুসা। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘ভাবছি ওদের নিউ গুলাগ ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপের কথা। কেথায় এই ভয়ংকর দ্বীপটা? কিন্তু এই মুহুর্তে তার চেয়েও বেশি ভাবছি আজকের রাতের ঘটনাকে পুলিশ কতটা, কিভাবে ব্যাবহার করবে? তারা প্রেসকে এ চাঞ্চল্যকর বিষয়টা জানতে দিবে কিনা?
বলেই আহমদ মুসা হঠৎ সোজা হয়ে বসল। তার চেখে- মুখে চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। বলল দ্রুত কন্ঠে, যায়েদ ফাতিমা কোন সাংবাদিকের ঠিকানা তোমাদের কাছে আছে?
ফাতিমা, যায়েদ দু’জনেই সোজা হয়ে বসল। যায়েদ বলল, আমার কাছে কোন সাংবাদিকের টেলিফোন নাম্বার নেই। তবে আবদুল্লাহ ভাইয়ের বাসায় সাংবাদিক বুমেদিন বিল্লাহর টেলিফোন নাম্বার থাকতে পারে। কাল ঐ সাংবাদিক ভাইয়ার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ছিলেন।’
‘বুমেদিন বিল্লাহ’ মানে লা-মন্ডের সাংবাদিক যিনি প্রথম নিউজটা করেছিলেন।’
‘হ্যাঁ ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, তাকেই আজ বেশি দরকার। কিন্তু তিনি কি স্ট্রাসবার্গে আছেন?
‘শুনেছিলাম আছেন। তিনি নাকি এই কেসটার ব্যাপারে আগ্রহী।’ যায়েদ বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে যায়েদ মোবাইলে তুমি তোমার ভাইয়ার বাসায় টেলিফোন কর। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহর টেলিফোন নাম্বার নাও।’ দ্রুত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
গাড়ির ষ্টিয়ারিং এ এক হাত রেখে অন্য হাতে মোবাইলে টেলিফোন করল যায়েদ। প্রথমবার ও দ্বিতীয়বারের চেষ্টাতেও টেলিফোন কেউ ধরল না। তৃতীয় বারের চেষ্টায় টেলিফোন রিসিভ করল ওপার থেকে। খুশিতে মুখ উজ্জল হয়ে উঠল যায়েদের। বুমেদীন বিল্লাহর নাম্বার সে নিয়ে নিল।
টেলিফোন অফ করে দিয়ে বলল যায়েদ, ‘আলহামদুলিল্লাহ, নাম্বারটা পেয়েছি ভাইয়া।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। এবার, মিঃ বুমেদীন বিল্লাহকে দেখ। পেলে তাকে বল, ‘শার্লেম্যান রোডের ৫নং বাড়িটা স্পুটনিক ধ্বংসকারী ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরনকারীদের একটা ঘাঁটি। আজ রাতে ওখানে ওদের বার চৌদ্দজন লোক মারা গেছে। ওখানে ওদের ঐ অফিসে কয়েকটা কম্পিউটার রয়েছে। কম্পিউটারে স্পুটনিক ধ্বংস ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরনের ব্যাপারে চাঞ্চলকর তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
ব্যাস, এই টুকুই বললে হয়ে যাবে। এই মাত্র পুলিশ সেখানে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া’ বলে যায়েদ মোবাইল তুলে নিল। টেলিফোন করল। প্রথম বারেই ওপার থেকে সাড়া পেয়ে গেল যায়েদ। আহমদ মুসা যেভাবে বলেছিল সেই ভাবেই সব কথা যায়েদ সাংবাদিক বুমেদিন বিল্লাহকে জানাল। তারপর ওপারের কথা সে শুনল। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল যায়েদের। ধন্যবাদ বলে সে মোবাইলটা অফ করে দিল।
আহমদ মুসা ও ফাতিমা উদগ্রীব হয়ে শুনছিল যায়েদের কথা।
যায়েদ কথা শেষ করতেই ফাতিমা দ্রুত কন্ঠে বলল, কি রেজাল্ট? কি বলল সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ?
‘খুব খুশী হয়েছেন। এখনি যাচ্ছেন উনি ৫নং শার্লেম্যান রোডে। আমাকে অনেক করে ধন্যবাদ দিয়েছেন তিনি।’ বলল যায়েদ।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ যায়েদ তোমার এ সফল মিশনের জন্য। যদি বিষয়টা পত্রিকায় আনা যায় তাহলে তো একটা বিরাট ব্যাপার হবে। ফরাসি পুলিশও তখন চাপে পড়বে।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই যায়েদ বলে উঠল, ‘মিশন আমার কোথায় ভাইয়া! আমি তো মাত্র আপনার প্রক্সি দিলাম।’
‘রাখ এসব কথা। বল, আরও কিছু বলেছেন উনি? বলল আহমদমুসা।
‘একটা প্রশ্ন উনি করেছেন। সেটা হলো, কে তাদের হত্যা করল। প্রশ্ন করে তিনিই আবার তার উত্তর দিয়েছেন। বললেন সেদিন হোটেলে যে ভাবে যে কারনে মরেছে, সে ধরনের ঘটনাই বোধহয় ঘটেছে। দেখলেই বোঝা যাবে। বাড়তি একথা টুকুই তিনি বলেছেন।’ যায়েদ বলল।
‘এ কথাটুকুই অনেক কথা যায়েদ। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ দেখছি খুব বুদ্ধিমান। আমার বিশ্বাস ওখানকার সব কিছুই তার কাছে ধরা পড়ে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাই যেন হয় ভাইয়া।’ বলে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই।
আহমদ মুসা আর কিছু বললনা। গাড়ির চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ফাতিমা ও যায়েদ নিরব। আশায় উজ্জ্বল তাদের চারটি চোখ সামনে নিবদ্ধ।
ছুটে চলছে গাড়ি।
৫
আহমদ মুসা বসে আছে ড্রইংরুমে পুবের জানালার পাশে এক সোফায়।
আহমদ মুসাদের এ ফ্ল্যাটটি আট তলায়। বাড়িটা দাঁড়ানো একেবারে ঈল নদী তীর ঘেঁষে।
আহমদ মুসার দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাইরে নিবদ্ধ। ঈল নদী পেরিয়ে সুন্দর রাইন উপত্যকার অনেকখানিই দেখা যায় এ জানালা দিয়ে। আহমদ মুসা চোখ বুলাচ্ছে রাইন উপত্যকার সবুজ বুকের উপর।
আহমদ মুসার চোখ দুটি রাইন উপত্যকার নরম সবুজের উপর নিবদ্ধ থাকলেও মন তার হারিয়ে গেছে ফেলে আসা এক অতীতের দিকে। তার দু’চোখে ভেসে উঠল রাইনের সবুজের অন্তরালে জমাট রক্তের এক সাগর। পৃথিবীর দুর্ভাগা যতগুলো ভুখন্ড আছে তার মধ্যে সুন্দর সবুজ এই রাইন উপত্যকাও একটি। ফ্রান্স-জার্মান আধিপত্যের লড়াই সবচেয়ে বেশি পীড়িত করেছে এই রাইন উপত্যকাকে। সপ্তম শতাব্দি শেষে এই উপত্যকা সম্রাট শার্লেম্যানের সম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। শার্লেম্যানের উত্তরসুরীদের কাছ থেকে জার্মানি এই উপত্যকা কেড়ে নেয়। ১৫ শতক পর্যন্ত এখানে চলে জার্মানির আধিপত্য। পরে ফ্রান্স কেড়ে নেয় এই উপত্যকা জার্মানির কাছ থেকে এবং শুরু করে এখানে ফরাসীকরণ। বিশেষ করে ফরাসী বিপ্লবের পর এখানকার জনগণ এতটাই ফরাসী হয়ে যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দির শেষভাগে যখন এই উপত্যকা জার্মানি দখল করে নেয় এবং পাল্টা জার্মানিকরণ শুরু করে তখন এখানকার ৫০হাজার মানুষ ফ্রান্সে হিজরত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স রাইন উপত্যকার উপর তার অধিকার ফিরে পায়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই জার্মানি এটা আবার দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই উপত্যকার উপর ফ্রান্সের আধিপত্য পুনঃ প্রতিষ্ঠত হয়। তার পর অর্ধ শতাব্দির বেশি কাল ধরে এখানে চলে ফ্রান্সের শাসন। আবার জার্মানরা এখানে ফিরে আসবে না এ গ্যারান্টি ইতিহাস দিতে পারেনা।
দুই আধিপত্যবাদী শক্তির মাঝে রাইন উপত্যকার মানুষ তৃতীয় শক্তি। কিন্তু তারা দূর্বল। দূর্বল বলেই তাদের স্বাতন্ত্র, স্বাধিকার ও স্ব-মতের কোন মূল্য নেই। এই দূর্বলতার কারণে সুন্দর এই রাইন উপত্যকার মানুষ শুধু নয়, তাদের মত শত শত জাতি-গোষ্ঠি আজ শক্তিমানদের দ্বারা পদদলিত হচ্ছে একইভাবে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, স্বাধীকার, মানবাধিকার সবই শক্তি নির্ভর। যাদের শক্তি আছে তাদের এসব নিশ্চিত থাকবে, আর যাদের তা নেই, এ অধিকার ভোগের অধিকার তাদের পদদলিত হচ্ছে। স্বাধীনতা, স্বাধীকার, মানবাধিকার, সন্ত্রাস এসব কিছুরই সংগা শক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছে। শক্তিমানরা এসবের যে সংগা দেয় সেটাই হয়ে উঠে অনুসরণীয়। বার্মা’র সুচি’র আন্দোলন গনতন্ত্র, কিন্তু আলজিরিয়ার আব্বাস মাদানীর আন্দোলন তা নয়। সূচী পেল নোবেল পুরস্কার, আর আব্বাস মাদানী পেল জেল-দন্ড। পূর্ব তীমুরের আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রাম, কিন্তু কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম অভিহিত হয়েছে সন্ত্রাস হিসেবে। এ সবের সংগায়নের ব্যাপারে জাতিসংঘের কিছু করনীয় নেই। জাতিসংঘ শক্তিমানরা গঠন করেছিল এবং তা শক্তিমানদের কথা শুনতেই বাধ্য। জাতিসংঘ আজ ভারবাহী গাধার মত। সে শুধু ভার বহনকারী, ভার নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণের কোন সুযোগ তার নেই। জাতিসংঘ ত্বরিত গিয়ে পূর্ব তীমুরের ভারটা গ্রহণ করেছিল, কিন্তু কাশ্মীর ও ফিলিস্তিন কিংবা চেচনিয়ার ভার সে গ্রহণ করতে পারেনি। এদিক থেক জাতিসংঘ কিছুটা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়তেও বাধ্য হয়েছে। যেমন ………..।
হঠাৎ আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ এসে পড়ল ফাতিমার কথায়। বলছিল ফাতিমা, ‘রাইন উপত্যকা নিয়ে এত গভীর ভাবে কি ভাবছেন ভাইয়া ?
এর আগেই ফাতিমা ও যায়েদ আহমদ মুসার সামনে এক সোফায় এসে পাশাপাশি বসে পড়েছিল।
দু’জনকেই সুনদর পোশাকে খুব ফ্রেশ লাগছিল। ফাতিমাকে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিপারের একজন গৃহবধু বলে মনে হচ্ছে। তার পরনে পা পর্যন্ত নেমে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ঘাগরা। গায়ে ফুলহাতা ঢিলা কামিজ। মাথার রুমালটা গলা পেঁচিয়ে কাঁধ ও বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে।
আহমদ মুসা ফাতিমার কথা শুনে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকাল। দু’জনের দিকে পলকের জন্য দৃষ্টি দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে উপরের দিকে শুন্য দৃষ্টি তুলে ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, ফাতিমা, আমি রাইন উপত্যকা নিয়েই ভাবছিলাম। তোমরা দু’আসামীই আমার সামনে হাজির। তোমরা জার্মান ও ফরাসীরা সুন্দর সবুজ অতি মনোহর এই রাইন উপত্যকাকে এবং তার মানুষদেরকে ফুটবল বানিয়েছ।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ফাতিমা যায়েদের দিকে ইশারা করল উত্তর দেবার জন্য। কিন্তু যায়েদ ইশারা করল ফাতিমাকে উত্তর দেবার জন্য। ফাতিমা বলল, ভাইয়া আপনি জার্মান-ফরাসীদের দুষছেন কেন! ভূমি নিয়ে এমন লড়াই তো দুনিয়ার সব চেয়ে প্রাচীন ইতিহাস। কোন দেশ, কোন জাতি কি এই দোষ থেকে মুক্ত আছে?’
‘কিন্তু ছোট বিশেষ একটা ভুখন্ড নিয়ে এমন রক্তক্ষয়ী টাগ অব ওয়ার পৃথিবীর আর কোথাও নেই ফাতিমা।’ আহমদমুসা বলল।
‘কোন দুই দেশের সীমান্তে রাইন উপত্যকার মত এমন সুন্দর ও বিশেষ অবস্থানের ল্যান্ডও দুনিয়ার কোথাও নেই ভাইয়া। পাহাড়ের দেয়াল একে বিচ্ছিন্ন করেছে ফ্রান্স থেকে, আবার রাইনের মত
আন্তর্জাতিক নদী একে বিচ্ছিন্ন করেছে জার্মান থেকে। দুই দেশই এই ন্যাচারাল ব্যারিয়ারের অজুহাত তুলে এলাকাটা দখলে রাখতে চায়। নিশ্চয় এ বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনার বিষয় ভাইয়া।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তার মানে সংগত কারনেই আধিপত্ত্যের এ লড়াই চলতেই থাকবে?’
হাসল ফাতিমা। বলল, ‘আমরা তা চাইনা। চাইনা বলেই তো জার্মান এবং ফ্রান্স এক হয়ে গেছি।’
আহমদ মুসা ও যায়েদ দু’জনেই এক সংগে হেসে উঠল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
বাধা দিয়ে ফাতিমা বলে উঠল, ‘এ নিয়ে আর কথা নয়। বলুন, ওদের নতুন গুলাগ ‘সাও তোরাহ’ নিয়ে আর কি ভাবছেন।
আবার সোফায় হেলান দিয়ে বসল আহমদ মুসা। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। সংগে সংগেই কোন উত্তর দিল না। পরে ধীরে ধীরে বলল, ‘ভেবেছি, কিন্তু ভেবে কোন কুল পাইনি। আমরা শুধু দ্বীপটার নামটাই জানতে পেরেছি, আর কিছু নয়। এবং আমি নিশ্চিত এই নামটা আসল নয়।’
‘সর্বনাশ নামটাও যদি নকল হয় তাহলে? বলল ফাতিমা। কন্ঠ তার আর্তনাদের মত শোনাল।
‘দ্বীপটাকে কিভাবে চেনা যাবে, এটাই এখন প্রধান সমস্যা আমাদের কাছে। সে জন্যই আমি চেয়েছিলাম ওদের কাউকে জীবন্ত ধরতে। কিন্তু পারলাম না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চেষ্টা তো সেদিন করেছিলেন। আচ্ছা আপনি যদি ও দু’জনকে গুলি না করতেন, তাহলে কি ঘটত? ওরা কি গুলি করত?
যায়েদ ‘কি ঘটত আমি জানিনা। তবে ওদের প্রথম গুলি করা থেকে বুঝা যায়, ওদের মারতে না পারলে ওদের হাতে আমাদের মরতে হতো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আরেকটা বিকল্প হয়তো ছিল। সেটা হলো অস্ত্র ফেলে দিয়ে ওদের কাছে আত্মসমর্পন করা। যা হতো আমাদের জন্য মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।’ যায়েদ বলল।
হ্যাঁ, এটাও বিকল্প হতে পারতো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন। আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি ভাইয়া, আপনি বুঝলেন কি করে যে, আপনাকে শুয়ে পড়ে গুলী করতে হবে?’ বলল ফাতিমা।
‘ওরা আগেই আমাদের দিকে রিভলবার তাক করেছিল। আমরা রিভলবার ওদের দিকে তুলতে গেলেই ওদের গুলী খেতে হতো। মাটিতে নিজেকে ছিটকে দিয়েছিলাম ওদের চোখের আড়ালে রিভলবার তাক করার সুযোগ নেয়া এবং যদি ওরা গুলী করে বসে তাও এড়াতে পারার জন্য।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার দু’লক্ষ্যই অর্জিত হয়েছিল।’ বলল যায়েদ।
‘আল্লাহ সাহায্য করেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে একটু দম নিয়েই ফাতিমা আবার বলে উঠল, ‘আগের কথায় ফিরে আসি ভাইয়া।’ সাও তোরাহে’র সন্ধান করার জন্য আপনি এখন কি চিন্তা করছেন।
‘চিন্তা করে কোন কিনারায় পৌঁছাতে পারিনি আমি। নানাভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। দ্বীপটার নামের দু’টি শব্দআছে একটি ‘সাও’ অন্যটি ‘তোরাহ’। এর মধ্যে ‘সাও’ ল্যাটিনীয় স্প্যানেশ। আর ‘তোরাহ’ শব্দ ওল্ড টেস্টামেন্টের। শব্দ-প্রকৃতির বিচার থেকে আমি মনে করি, দ্বীপটা মিড-উত্তর আটলান্টিকের পূর্বাংশে অথবা মিড-দক্ষিণ আটলান্টিকের মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ল্যাটিন এলাকার কোথাও হবে।’
ফাতিমা ও যায়েদ তাকিয়েছিল আহমদ মুসার মুখের দিকে।
তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। কিছু বলতে যচ্ছিল যায়েদ। এ সময় দরজায় নক হলো। ওঠে দিয়ে দরজা খুলল যায়েদ।
নিচ থেকে বেয়ারা আজকের কয়েকটি কাগজ নিয়ে এসেছে।
দরজা বন্ধ করতে করতে যায়েদ উপরে যে কাগজটা আছে তার দিকে নজর বুলাচ্ছিল।
নজর বুলিয়েই চিৎকার করে উঠল যায়েদ। বলল, ‘সেদিনের ঘটনাকে লা-মন্ডে লিড আইটেম করেছে ভাইয়া।’
বলে দরজা বন্ধ করে ছুটে এল যায়েদ। কাগজটা আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা কাগজ হাতে নিয়ে তাকাল হেডিংটার উপর। পড়ল হেডিংটাঃ
‘ঘটনার চাঞ্চল্যকর মোর, স্পুটনিক ধ্বংসের সাথে জড়িতদের আরও ১৪ জন নিহত ও কম্পিউটার থেকে পুলিশ কর্তৃক মূল্যবান দলিল উদ্ধার।’
হেডিংটা পড়েই চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। চোখ বুলাল ক্রেডিট লাইনের উপর। দেখল লেখা আছে ‘ষ্ট্রাসবার্গ থেকে বুমেদিন বিল্লাহ।’ আরও খুশি হয়ে উঠল আহমদ মুসা বুমেদিন বিল্লাহর নাম দেখে। সে নাম গোপন করেনি। সাহস আছে তার।
যায়েদ ও ফাতিমা তখন আন্য পত্রিকায় নজর বুলাচ্ছিল। যায়েদ বলে উঠল, প্যারিসের আর মাত্র দু’টি পত্রিকা এবং ষ্ট্রাসবার্গের একটি পত্রিকা সিংগল কলামে নিউজটি দিয়েছে। বলছে, অজ্ঞাতনামা আততায়ীর গুলিতে ১৪ জন অজ্ঞাত নামা নিহত।’
‘লা-মন্ডেই যথেষ্ট যায়েদ। আল্লাহর শুকরিয়া, লা-মন্ডে বিস্ময়কর ভাবে ইহুদী চাপ উপেক্ষা করেছে। আমি………।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই যায়েদ বলে উঠল, ‘এর কারণ আছে ভাইয়া। অতি-সম্প্রতি লা-মন্ডে দ্য গলপন্থীদের হাতে এসেছে।
এর সম্পাদকও নিযুক্ত হয়েছে একজন ন্যাশনালিষ্ট।’
‘ও, কারণ তাহলে এটাই।’ বলে আহমদ মুসা তার হাতের লা-মন্ডেটি যায়েদের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘যায়েদ পড় নিউজটা। কি লিখেছে দেখা যাক।’
যায়েদ হাতে নিল কাগজটা।
সে আবার কাগজটা ফাতিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘পড় না, পড়ায় তুমি খুব ভাল।’
‘তোমাদের ফরাসী তুমিই পড়।’ বলল ফাতিমা।
‘ভাইয়া দেখুন, অল্পক্ষণ আগেও বলছে আমরা জার্মান-ফরাসী এক হয়ে গেছি। আর এখন কি বলছে শুনুন।’ যায়েদ বলল।
ফাতিমা হাসল। যায়েদের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘ভাইয় কথা সে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে। আমি ভাষার কথা বলছি। আর প্রত্যেক জাতির জন্যে তার ভাষা আল্লাহর দান।’
‘আচ্ছা, তোমাদের ঝগড়ার ফয়সালা পরে করব। এবার খবরটা পড়। লা-মন্ডে তোমাদের কাগজ যায়েদ, তুামই এটা পড়বে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও ভাইয়াকে সমর্থন করছি।’ বলল ফাতিমা মুখ টিপে হেসে।
‘ভোট তুমি না দিলেও আমি পড়ছি।’ বলে যায়েদ কাগজ গুছিয়ে নিয়ে সামনে ধরল এবং পড়তে শুরু করলঃ
‘স্ট্রাসবার্গ থেকে বুমেদিন বিল্লাহ্। গত পরশু গভীর রাতে স্ট্রাসবার্গের শার্লেম্যান রোডের ৫নং বাড়ি থেকে পুলিশ স্পুটনিক ধ্বংসের সাথে জড়িত বলে কথিত ১৪ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। সেই বাড়িটির তৃতীয় তলায় তাদের অফিস কম্পিউটার থেকেমূল্যবান দলীল দস্তাবেজ ও উদ্ধার করেছে পুলিশ। এই উদ্ধারের কাজের সময় লা-মন্ডের এই রিপোর্টারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৪ জনের মধ্যে ১২ জনের লাশ পাওয়া যায় ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষ। আর বার জনের মধ্যে ১১ জনের কাছেই একটি করে ষ্টেনগান পাওয়াগেছে, অবশিষ্ট একজনের কাছে পাওয়া গেছে একটি রিভলবার।
কক্ষটিকে বন্দিখানা বলে সন্দেহ করা হয়েছে। ঘরে একটা সিংগেল খাট দেখা গেছে এবং খাটের উপর পাওয়া গেছে একটি হ্যান্ডকাফ। হ্যান্ডকাফের তালা ল্যাসার বীম দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা। পুলিশ মনে করছে একজন লোককে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেই বন্দী হ্যান্ডকাফের তালা গলিয়ে মুক্ত হয় এবং ঘরে প্রবেশকারী ১২ জনকে তাদেরই ষ্টেনগান দিয়ে হত্যা করে পালাতে সমর্থ হয়।
উল্লেখ্য, ক’দিন আগে হোটেল রাইন ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে দু’জনের লাশ পাওয়া যায়। তারাও কক্ষের বাসিন্দাকে হত্যা বা কিডন্যাপ করতে গিয়ে নিহত হয় বলে পুলিশ নিশ্চত হয়েছে। এরা দু’জন এবং উপরোক্ত চৌদ্দজন একই দলের বলে পুলিশ নিশ্চিত ভাবে মনে করছে। তাদের সকলেরই কলার ব্যান্ডে একই ধরনের ইনসিগনিয়া পাওয়া গেছে।
শার্লেম্যান রোডের ৫ নং বাড়িতে অবশিষ্ট ২ জনের লাশ পাওয়া যায় নীচের এক করিডোরে। পুলিশ মনে করছে বন্দী পালাবার সময় এ দু’জনকে হত্যা করে। এ দু’জনের হাতেও একটি করে রিভলবার পাওয়া গেছে।
নিহতদের সব অস্ত্রই লাইসেন্স বিহীন অবৈধ বলে পুলিশ উল্লেখ করেছে।
তিন তলার অফিস কক্ষ কম্পিউটারে যে দলিল দস্তাবেজ পাওয়া গেছে তার মধ্যে স্পুটনিক ধ্বংসের ব্লু- প্রিন্টও রয়েছে। পুলিশ তাদের তদন্তের স্বার্থে এ ব্লু-প্রিন্টের বিবরণ সম্পর্কিত কোন কিছু জানাতে রাজী হয়নি। তবে পুলিশ বলছে, নিছক ঐ ব্লু-প্রিন্ট দিয়ে সংশ্লিষ্ট দল বা ব্যাক্তিকে চিহ্নিত করা মুস্কিল।
নিহতদের সূত্র ধরে ক্রিমিনাল দলটির সন্ধান করা যায় কিনা এ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে পুলিশ বলেছে তারা তা চেষ্টা শুরু করেছে।
ক্রিমিনাল দলটির পরিচয় সম্পর্কে পুলিশ বলতে না পারলেও ইনসিগনিয়ার বৈশিষ্টের প্রতি ইংগিত করে ওয়াকিফহাল মহল বলেনে, কোন ইহুদী সংগঠন স্পুটনিক ধ্বংসের ঘটনার সাথে জড়িত।
ক্রিমিনাল এই ইহুদী সংগঠনটির সাথে কাদের সংঘাত বেধেছে, যাকে সেদিন তারা হেটেলে মারতে বা ধরতে গিয়েছিল তার পরিচয় কি এবং কাকে তারা শার্লেম্যান রোডের ৫ নাম্বার বাড়িতে বন্দী করেছিল, সে সম্পর্কে পুলিশ এবং পর্যবেক্ষক মহল কিছুই বলতে পারছে না। তবে তাদের মতে পুলিশের তদন্ত আগাতে ব্যার্থ হওয়ার পটভুমিতে প্রতিকার ও সাত গোয়েন্দাকে উদ্ধারের জন্যে কোন তৃতীয় পক্ষ এগিয়ে এসেছে কিংবা স্পুটনিক পরিবাররা এই তৃতীয় পক্ষকে নিয়োগ করেছে। অবশ্য কয়েকটি স্পুটনিক পরিবারের সাথে এই প্রশ্ন নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা এধরনের কোন পদক্ষেপের চিন্তাই করেনি বলে জানিয়েছে।
এই তৃতীয় পক্ষের পরিচয় সম্পর্কে হোটেল রাইনে আক্রান্ত ব্যাক্তিটি আসল কথা জানতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লোকটিকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। লোকটি হোটিল থেকে চলে গেছেন এবং গা ঢাকা দিয়েছে। ক্রিমিনাল দলটির ভয়ে এবং তাদের আক্রমন থেকে আত্মরক্ষার জন্যই লোকটা এটা করেছে বলে পুলিশও মনে করেছে। তবে তাকে পুলিশের এখন খুব বেশি প্রয়োজন।
স্পুটনিক ধ্বংস থেকে শুরু করে গত পরশু রাত পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনা দেশের সচেতন ও শান্তিকামী মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। কোন ইহুদী সংগঠন যদি স্পুটনিক ধ্বংস ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরনের সাথে জড়িত থাকে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে এ ইইহুদী সংগঠন স্পুটনিকের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হওয়ার কারণ কি? উল্লেখ্য, সাত গেয়েন্দার স্পুটনিক সংস্থা নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস সম্পর্কে নতুন করে তদন্ত শুরু ও কিছু দলিল হাত করার পরেই তাদের উপর ধ্বংসও বিপর্যয় নেমে আসে।’
পড়া শেষ করেই কাগজটা টি টেবিলে রাখতে রাখতে বলল যায়েদ, ‘ভাইয়া পুলিশ আপনার খোঁজ করছে বন্ধু হিসাবে না শত্রু হিসাবে?
‘আমি কে? ইহুদী সংগঠনটির সাথে যাদের সংঘাত বেঁধেছে, তাদের পরিচয় জানার জন্য আমাকে তাদের প্রয়োজন। শুরুটা ওদের বন্ধুত্বপূর্ন হলেও পরে বন্ধু থাকবে বলে আমি মনে করিনা।’
‘কেন থাকবে না? আপনার দেয়া তথ্য ও আপনার কাজ তো পুলিশের তদন্তে বাড়তি শক্তি যোগাবে।’ বলল, যায়েদ।
‘আমরা হোটেল থেকে কেন তাড়িঘড়ি চলে এলাম, এত তাড়াতাড়ি ভূলে গেছ? পুলিশের একটা গ্রুপ উর্ধ্বতন পুলিশের নির্দেশে আমাকে আন অফিসিয়ালী গ্রেপ্তার করে ঐ ইহুদী সংগঠনের হাতে তুলে দেবে, এটা জানতে পেরেই তো চলে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘পুলিশ যে আন্তরিক নয়, লা-মন্ডের এ রিপোর্ট থেকেও তা বুঝা যাচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি থেকে বুঝা গেল ভাইয়া?’ বলল ফাতিমা।
‘কম্পিউটারে স্পুটনিক ধবংসের যে ব্লু প্রিন্ট ছিল তার কিছুই পুলিশ জানায় নি। উপরন্তু বলেছে, নিছক ঐ ব্লু প্রিন্ট থেকে সংশ্লিষ্ট দল বা ব্যাক্তিকে চিহ্নিত করা যাবে না। এর অর্থ ব্লু প্রিন্টটিকে অকেজ একটা দলিল হিসাবে কোল্ড স্টোরেজে ঠেলে দিতে পারে। সব চেয়ে বড় কথা হলো ক্রিমিনালরা নিজেরাই যাকে নতুন গুলাগ হিসাবে অভিহিত করেছে, সেই ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপের মানচিত্রটি নিউজে নেই। পুলিশরা সাংবাদিকের কাছ থেকে বিষয়টা একদম গোপন করে ফেলেছে। কোন দিনেই হয়তো সাংবাদিকরা বা বাইরের দুনিয়া পুলিশের কাছ থেকে ‘সাও তোরাহে’র কথা আর জানতে পারবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামল ও সংগে সংগে কোন কথা বলল না ফাতিমা ও যায়েদ। তাদের চোখ-মুখে ভাবনা ও হতাশার চিহ্ন।
একটু পরে ফাতিমা হতাশা জড়িত কন্ঠে বলল, ‘আমরা পুলিশের ভুমিকায় এ ব্যাখ্যা করতে পারি যে, ‘পুলিশ তদন্তের স্বার্থেই এটা প্রকাশ করে নি। সাও তোরাহ দ্বীপের মানচিত্র পুলিশের হাতে পড়েছে জানলে ক্রিমিনালরা সাবধান হয়ে যাবে এবং দ্বীপ থেকে সব কিছু তারা অন্যত্র সরিয়ে ফেলবে।’
আহমদ মুসা হাসল।বলল, ‘এ যুক্তি খাটেনা ফাতিমা। কম্পিউটার পুলিশের হাতে পড়ার পর ওরা নিশ্চিত হয়েছে, সাও তোরাহের মানচিত্রও পুলিশ পেয়ে গেছে। বিশেষ করে স্পুটনিক ধ্বংসের ব্লু প্রিন্টটা পুলিশ যখন পেয়েছে, এটা ক্রিমিনালরা বুঝতে মুহুর্তও দেরি হবার কথা নয়।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি ঠিক বলেছেন। তা হলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, পুলিশের কোন সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি না।’ বলল ফাতিমা হতাশ কন্ঠে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, একটা সহযোগিতা আমরা পেলাম।
‘কি সেটা? ত্বড়িত কন্ঠে প্রশ্ন করল যায়েদ।
‘পুলিশ দলিলগুলো প্রকাশ না করায় এবং ক্রিমিনালদের সাথে আঁতাত করায় আমরা এখন নিশ্চিত হতে পারছি যে, ক্রিমিনালদের নতুন গুলাগ ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপেই থাকছে। পুলিশ ক্রিমিনালদের সাথে যোগসাজোশে না গিয়ে মানচিত্রসহ দলিল প্রকাশ করলে, ফাতিমা যেটা বলেছে, ক্রিমিনালরা সাবধান হতো এবং সাও তোরাহ থেকে সব কিছু সরিয়ে নিত। তাতে আমরা যে টুকু এগিয়ে ছিলাম, সে টুকু পিছিয়ে পড়তাম।’ আহমদ মুসা থামল।
আহমদ মুসা থামতেই ফাতিমা ও যায়েদ আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। ফাতিমা বলল, ‘তাহলে আজকের নিউজের এটাই একমাত্র লাভ ভাইয়া।’
‘না, আরও লাভ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরও লাভটা কি?’ জিজ্ঞাসা যায়েদের।
‘এই নিউজটা প্রথম বারের মত এ কথা সামনে নিয়ে এল যে, স্পুটনিক ধ্বংস ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরণের কাজ ইহুদী একটা ক্রিমিনাল সংগঠন করেছে। নিউজটি আরেকটি বড় বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে সেটা হলো, নিউইয়র্কের টুইনটাওয়ার ধ্বংসের সাথে ক্রিমিনাল ইহুদী সংগঠনটি জড়িত থাকতে পারে। তা না হলে টুইন টাওয়ারের ঘটনার উপর নতুন ভাবে তদন্তকারী স্পটনিকের উপর ক্রিমিনাল ইহুদী সংগঠনটি খড়গহস্ত হলো কেন? নিউজটি স্পুটনিকের তদন্ত কাজে পুলিশের ব্যার্থতাকেও তুলে ধরেছে এবং বলেছে যে, প্রতিকার ও সাত গোয়েন্দাকে উদ্ধারের জন্য অবশেষে তৃতীয় একটি পক্ষ কাজে নেমেছে। এই তৃতীয় পক্ষকে ধ্বংসের জন্যও ইহুদী ক্রিমিনাল সংগঠনটি উঠে পড়েলে গেছে এবং এর খেসারত হিসাবে সংগঠনটির এপর্যন্ত কম পক্ষে ষোল জনকে বলী হতে হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু নিউজটা সবচেয়ে বড় খবর তৃতীয় পক্ষ হিসাবে স্বয়ং আহমদ মুসা আবির্ভূত একথা বলতে পারেনি।’ বলল ফাতিমা। তার মুখে আনন্দের হাসি।
‘রিপোর্টারকে এ জন্য ধন্যবাদ ফাতিমা।’ হেসে উঠে বলল যায়েদ।
ফাতিমা হাসিতে যোগ দিল না। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল সে। বলল, ‘স্যরি ভাইয়া। হালকা চিন্তার সময় এটা নয়। পুলিশের সাহায্য আমরা পাচ্ছি না। আপনি কার্যতঃ একা। কি ভাবছেন ভাইয়া?
‘সত্যি নিউজটা আমাদের উপকার করেছে। পুলিশের যোগসাজস অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমাদের ‘শাপেবর’ হয়েছে। বলে আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে দিল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। মুহুর্ত কয়েক নিরব থাকার পর সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, কোন ভাবনার কথা বলব ফাতিমা। শেষ নেই। আমাদের সামনে দীর্ঘ পথ। স্পুটনিকের সাত নেতাকে উদ্ধার করতে হবে, তারপর আসবে
স্পুটনিক মিশন সফল করার কাজ করবে। এই পথের গোটাটাই আজ অন্ধকারে।’
ফাতিমার দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ভাইয়া স্পুটনিকের মিশন’ মানে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের তদন্তের দায়িত্ব আপনি নেবে?
‘দায়িত্ব তো স্পুটনিক নিয়েছে্ স্পুটনিককে সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হবো। আর এটা এমন একটা কাজ যার সাথে বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের স্বার্থ আজ জড়িত আছে। মুসলমানদের মাথা থেকে পুরানো একটা কলংকের বোঝা নামাতে হলে যে সত্য মিথ্যার স্তুপে ঢাকা পড়েছে তাকে উদ্ধার করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এত দিন পর সত্যটা আসলেই উদ্ধার করা যাবে? আপনিও অনেক দিন আমেরিকা ছিলেন, তখন কিছু কি ভেবেছিলেন? জিজ্ঞেস করল যায়েদ।
‘উদ্ধার করা যাবে না কেন? আমি শুনেছি, স্পুটনিক অনেক এগিয়েছিল। তাছাড়া এখন এ ব্যাপারে মার্কিন সরকারের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। তোমরা জান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন দাবার ছক পাল্টে গেছে। ‘ধরাকে সরা’ জ্ঞান কারী জেনারেল শ্যারণ সেখানে আজ বন্দী এবং বিচারের সম্মুখিন।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার বলা শুরু করল, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় ডেমোক্রাসি টাওয়ার’ ও ‘লিবার্টি টাওয়ার’ বিষয় নিয়ে ভাবার আমার সুযোগ হয়নি। আমি আনন্দিত যে, স্পুটনিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটা শুরু করেছে।’
বলতে বলতে আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘স্পুটনিকের সাত নেতা উদ্ধার হলে এ বিষয়ে কাজ করার সময় আসবে, এখন নয়। এখন তাদের উদ্ধারই আমাদের সামনে একমাত্র বিষয়।’
‘ঠিক ভাইয়া, ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপ কোথায়, এ প্রশ্নটাই এখন সব চেয়ে বড়।’ বলল যায়েদ।
‘ভাইয়া আমরা আগামী কাল কামাল সুলাইমান ভাইয়ার বাসায় যাচ্ছি। লতিফা ভাবী কিন্তু একজন ভুগোলবিদ। তার সাথে ‘সাও তোরাহ’ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।’ ফাতিমা বলল।
‘উনি কি কোথাও অধ্যাপনা করেন? জিজ্ঞেস করল আহসদ মুসা।
‘হ্যাঁ উনি স্ট্রসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একজন শিক্ষক।’ বলল ফাতিমা।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, ভালই হলো, দেখা যাক তিনি কোন আলো দেখাতে পারেন কিনা।’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘আপনি কোথাও যাবেন ভাইয়া?’ জিজ্ঞাসা করল যায়েদ।
‘হ্যাঁ, আমি একটু বেরুচ্ছি।’ বলে ওদের সামনে দিয়ে আহমদ মুসা তার কক্ষের দিকে হাঁটা শুরু করল।
‘ভাই সাহেব, আমাদের পরিবারে গত কয়েক জেনারেশনের মধ্যে মোস্তফা কামাল একজনই হয়েছেন। মোস্তফা কামালের জন্ম আর হয়নি। অতএব ইসলাম সম্পর্কে মোস্তফা কামালের বিশেষ দৃষ্টিভংগি আমাদের পরিবারের আর কারও মধ্যেই আর দেখা যায় নি। বরং ইতিহাস হলো, আমাদের পরিবারের তৃতীয় জেনারেশনের যিনি তুরস্ক ছেড়ে জার্মানীতে এসে স্থায়ী বসতি গড়েন, তিনি চেয়ে ছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের স্মৃতি ঘেরা পরিবেশ থেকে দূরে সরে আসতে। তিনি বলতেন, তার পূর্বপুরুষ মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক নিজের মত করে একটি জাতি গড়তে গিয়ে যা করেছেন, সে স্মৃতি একটি সুন্দর ও সুস্থ পরিবারের জন্য দুঃসহ। এই দুঃসহ স্মৃতির হাত থেকে বাঁচার জন্যই তিনি জার্মানীতে হিজরত করেন।’
আহমদ মুসার এক জিজ্ঞাসার জবাবে কথাগুলো বলছিলো লতিফা কামাল। স্পুটনিকের প্রধান গোয়েন্দা ও প্রধান পরিচালক কামাল সুলাইমানের স্ত্রী সে।
আহমদ মুসার সামনের এক সোফায় বসে কথা বলছিলো লতিফা কামাল। মোস্তফা কামাল তুর্কি মহিলাদের ইংরেজী পোশাক পড়িয়ে ছিলেন। মাথা থেকে খুলে ফেলেছিলেন রুমাল এবং নামিয়ে দিয়েছিলেন গা থেকে চাদর। কিন্তু মোস্তফা কামাল পরিবারের সদস্য লতিফা কামালের পরনে তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম গৃহবধুর পোশাক।
লতিফা কামালের পাশে বসেছে ফাতিমা কামাল। আর আহমদ মুসার পাশের সোফায় বসেছে যায়েদ।
এটা লতিফা কামাল ও কামাল সুলাইমানের বাড়ি। স্বামী কামাল সুলাইমান কিডন্যাপ হবার পর লতিফা কামালের বাপ-মা এবং মাঝে মাঝে ভাইরা এসে থাকছে এখানে।
লতিফা থামতেই আহমদ মুসা বলল, বোন মিসেস কামাল, ‘বড় আনন্দের খবর দিলেন আপনি। ধন্যবাদ আপনাকে। এ থেকে আবারও প্রমাণিত হলো, সব কিছু মূলের দিকেই ফেরে।’
‘মোস্তফা কামালের পরিবার মূলের দিকে ফিরেছে। তবে মোস্তফা কামালের দেশ কিন্তু এখনও মূলের দিকে ফিরতে পারেনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অধিকাংশ মানুষ মূলের দিকে ফিরছে, কিন্তু অধিকাংশ নেতা মূলের দিকে ফেরেননি ভাইয়া।’ বলল ফাতিমা।
‘ফাতিমা ঠিক বলেছে ভাই সাহেব।’ লতিফা কামাল বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। ‘হ্যাঁ মিসেস কামাল, ফাতিমা ঠিকই বলেছে। তবে আমার মতে নেতারা বড় বাধা নয়, বাধা সেখানকার কামালীয় সংবিধান। গণতন্ত্রে জনতা জননেতাদের গড়ে নিতে পারে, কিন্তু সেখানকার সংবিধান জনতার ধরা-ছোঁয়ার উর্ধে বলল আহমদ মুসা।
হাসি ফুটে উঠল লতিফা কামালের মুখে। বলল, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনি আহমদ মুসা। ফাতিমা ও আমাদের জানা এবং আপনার জানার মধ্যে যোজন পার্থক্য। আপনি যেটা বলেছেন, সেটাই ঠিক। সংবিধানই আসল বাধা।
বলে একটু থামল লতিফা কামাল। মুহুর্তের জন্যে মাথাটা নীচু করল। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল গাম্ভীর্য। আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলে সে বলল, ‘কামাল সুলাইমান প্রায়ই বলত, , আমাদের দেশ ছাড়া হওয়াটা আমাদের পারিবারিক পাপের একটা প্রায়শ্চিত্ত। মোস্তফা কামাল যে ইউরোপীয় হতে চেয়ে ছিলেন, তার পরিবার আজ সে ইউরোপীয় হয়েছে। কিন্তু এতেই আমাদের প্রয়শ্চিত্ত হয়েছে বলে কামাল সুলাইমান মনে করতেন না। বলতেন, আমাদের পরিবারকে আরও মূল্য দিতে হবে। স্পুটনিকের ঘটনা, তিনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তার কথিত সেই মূল্য কিনা কে জানে।’
থামল লতিফা কামাল। চাঁপা কান্নায় তার কন্ঠ প্রায় রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। হঠাৎই ড্রইংরুমের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। বেদনার ছায়া নেমে এল উপস্থিত সবার মুখে।
নেমে এসেছিল এক নিরবতাও।
নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। বলল, আমি কামাল সুলাইমানের সাথে একমত নই। আল্লাহ একের পাপে অন্যকে শাস্তি দেন না। আর কামাল পরিবারের জার্মানিতে হিজরত আল্লাহর শাস্তি নয় পুরুস্কার। আল্লাহ কামাল পরিবারের কাছ থেকে ইউরোপের মাটিতে ইসলামের পক্ষে খেদমত নিতে চান। সেই খেদমত কামাল পরিবার করছে।
স্পুটনিক তারই একটা অমর দৃষ্টান্ত। স্পুটনিকে যা ঘটেছে, কামাল সুলাইমানের যা ঘটেছে তা আদর্শের সৈনিকের জন্য একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এ ঘটনা প্রমাণ করেছে অন্যান্যদের সাথে কামাল পরিবাকেও আল্লাহ কবুল করেছেন।’
লতিফা কামাল চোখ মুছে বলল, ‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব। আপনার মত বুঝ আল্লাহ আমাদের দান করুন। কামালের দুর্ভাগ্য যে সে আপনার দেখা পেলনা।’
‘দোয়া করুন ভাবী, এ ভাইয়ার সাথে কামাল ভাইয়ার দেখা হবে।
ভাইয়া তো তাঁদের জন্যেই ফ্রান্সে এসেছেন ভাবী।’
‘আল্লাহ সাহায্য করুন। তোমাদের কাছে যেদিন আমি ভাই সাহেবের কথা শুনেছি, সেদিন গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবারের মত বুকটা আমি হাল্কা অনুভব করেছি, বুক ভরে আমি নিঃশ্বাস নিতে পেরেছি। মনে হয়েছে, আল্লাহ তাঁর বিশেষ দয়ার দৃষ্টি আমাদের উপর দিয়েছেন।’ বলল আবেগ–কম্পিত কন্ঠে লতিফা কামাল।
‘ভাবী আপনার একটা সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।’ বলল ফাতিমা।
‘সাহায্যের কথা বলছ কেন? বল কি কাজ আমাকে করতে হবে?’
বলল লতিফা কামাল। তখনও ভারী তার কন্ঠস্বর।
লতিফা থামতেই কথা বলে উঠল আহমদ মুসা। ‘আমরা একটা দ্বীপের সন্ধান করছি, যে দ্বীপে কামাল সুলাইমানরা বন্দী থাকতে পারেন বলে সন্দেহ।’
‘দ্বীপের নাম কি? উদগ্রীব কন্ঠে বলল লতিফা কামাল।
‘সাও তোরাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাও তোরাহ’ নামটি মুখে উচ্চারণ করে ভাবল কিছুক্ষণ লতিফা কামাল। তারপর বলল, ‘এই ধরনের কোন দ্বীপ আছে বলে আমি জানি না। এটা কোন ছদ্মনাম হবে।’
আহমদ মুসা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সেটা লতিফা কামালের দিকে মেলে ধরে বলল, ‘এটা দ্বীপটার আকার। আকার দেখে কোন আন্দাজ করতে পারেন কিনা দেখুন।’
লতিফা কামাল কাগজটি কিছুক্ষণ হাতে দেখে বলল, ‘স্যরি, আমার এবিদ্যা নেই ভাই সাহেব। ‘সমুদ্র পৃষ্ট ও দ্বীপত্তত্ব বিষয়ে যারা পড়া শুনা করেছেন, তাদের পক্ষেই শুধু এব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব।’
এই সময় কলিংবেল বেজে উঠল টেবিলে রাখা কলিং বক্স থেকে।
লতিফা কামাল ‘এক্সকিউজ মি’ বলে কলিং বক্সটা টেনে সামনে নিয়ে একটা সুইচ অন করে বলল, ‘মিসেস কামাল বলছি, কে আপনি দয়া করে বলুন’
ওপারের কথা শুনল লতিফা কামাল। শুনেই প্রবল একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠল তার চোখ মুখে। বলল সে ওপারের লোককে উদ্দেশ্য করে, ‘হোল্ড অন প্লিজ।’
বলে কলিং বক্স নিরব করে দিয়ে বলল, ‘স্যরি ভাই সাহব, একটা কান্ড ঘটে গেছে। আমি লা-মন্ডের রিপোর্টার বুমেদীন বিল্লাহকে সময় দিয়েছিলাম। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম এই এ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা। তিনি এসেছেন। কি করি এখন?
‘বুমেদী বিল্লাহ?’ কোন অসুবিধা নেই মিসেস কামাল। তাঁকে ডাকুন। তাঁর সাথে দেখা হলে আমরাও খুশি হবো। তিনি আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলে আমরা পাশের ঘরে সরে যাবে’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব।’ বলে লতিফা কামাল কলিং বক্স অন করে বলল, ‘স্যরি ফর ট্রাবল, প্লিজ আপনি আসুন।’
লতিফা কামাল কলিং বক্স অফ করতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, মিসেস কামাল, বুমেদীন বিল্লাহর সাথে আমাদের এই দেখা হওয়াকে আমি আল্লাহর এক সাহায্য বলে মনে করছি। মনে মনে তাঁকে আমি চাইছিলাম।
যদি উনি রাজী হন আমরা কথা বললে আপনার আপত্তি নেই তো?
বিষণ্ণতা ফুটে উঠল লতিফা কামালের মুখে। বলল, ‘এভাবে অনাত্মীয়ের মত কথা বলছেন কেন? আমি এবং আপনারা কি আলাদা ভাই সাহেব?
‘ধন্যবাদ বোন লতিফা কামাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যাই উনি এসে পড়বেন’ বলে লতিফা কামাল উঠে গেল দরজার দিকে মেহমানকে রিসিভ করার জন্য।
আধা মিনিটের মধ্যে মেহমানকে রিসিভ করে সাথে নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল লতিফা কামাল।
আহমদ মুসা, ফাতিমা ও যায়েদ উঠে দাঁড়িয়েছে মেহমানকে স্বাগত জানানোর জন্য।
বুমেদীন বিল্লাহকে দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। একেবারে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ‘আহমদ বেন বেল্লা’র চেহারা।
বেন বেল্লাহর যে চেহারা আহমদ মুসার চোখে ভাসছে তার বয়স একটু বেশি, এর বয়স একটু কম।
আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে স্বাগত জানিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনাকে ‘বুমেদীন বিল্লাহ’ না বলে ‘বেন বেল্লাহ’ বললেই মানাত ভাল।’
বুমেদীন বিল্লাহ হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলল, ‘আহমদ বেন বেল্লাহর’ বেল্লাহ’ তো আছেই, আমার মাতৃকূলের ঐতিহাসিক ব্যাক্তি ‘হুয়ারী বুমেদিনে’র ‘বুমেদীন’ বাদ দেবেন কেন। আমার পিতা আমার পিতৃকুল মাতৃকুলকে এক সঙ্গে ধরে রাখার জন্যই দুই ইতিহাসকে যোগ করে আমার নাম রেখেছেন।’
আহমদ মুসা তাকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দুই ইতিহাসের যোগ ফল হয়ে আপনি তাদের চেয়ে বড় ইতিহাস।’
বুমেদীন বিল্লাহ আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি মৃত ইতিহাসের সাক্ষী বটে, কিন্তু আপনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। পুলিশ আপনাকে খুঁজছে, তার চেয়েও বেশি খুঁজছি আমি। আমি কিন্তু আপনাকে ছাড়ছিনা।’
আহমদ মুসা জড়িয়ে ধরা থেকে ছেড়ে দিয়ে তাকে নিয়ে এক সোফায় পাশাপাশি বসতে বসতে বলল, ‘আমিও আপনাকে ছাড়ছি না মিঃ বুমেদীন বিল্লাহ। বিশেষ করে আপনার দ্বিতীয় নিউজ পড়ার পর আপনাকে দারুণভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’
‘চমৎকার, দু’জনকে দু’জনার প্রয়োজন। আসুন তাহলে, আরেকবার হ্যান্ডশেক করি।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘দু’জনে হ্যান্ডশেক করল আবার।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করে বুমেদীন বিল্লাহকে ধরে রেখেই বলল, ‘আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?
‘সেদিন রাতে হোটেল কক্ষে দু’জন লোক নিহত হওয়ার ঘটনার পর পুলিশের সাথে আমিও গিয়েছিলাম। দেখেছি আপনাকে।
আপনার ভোলার কথা নয়। পুলিশ যাই ভাবুক, সেদিন রাতেই কিন্তু আমার মনে হয়েছে পুরো পরিচয় আপনার পাওয়া গেল না।
তারপর সেদিন রাইন পার্কের মোড়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যওয়া যে গাড়ি পাওয়া গেছে তার আরোহী ছিলেন আপনি, সেটা অনুসন্ধানে আমি জানতে পেরেছি। এরপর শার্লেম্যানের ৫ নং বাড়ির ১৪ জনের হত্যার যে ঘটনা সেও আপনিই ঘটিয়েছেন বলে আমি নিশ্চিত।
আপনি সেখানে বন্দী ছিলেন। ওদের হত্যা করে আপনি মুক্ত হয়েছেন। এ সব থেকে আমার নিশ্চিত ধারনা হয়েছে, স্পুটনিকের ঘটনায় আপনি তৃতীয় পক্ষ। এই তৃতীয় পক্ষের কোন পরিচয় আমার জানা নেই। এটা না জানলে আমি ঘটনা নিয়ে আমি আগাতে পারছি না।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘রাইন পার্কের মোড়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়ির আমি আরহী ছিলাম, এটা হোটেল রাইনের গাড়ি রেজিষ্টার থেকে জানা সম্ভব, কিন্তু শার্লেম্যানের ৫ নং বাড়িতে ১৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে আমাকে জড়িত করছেন কিসের ভিত্তিতে? জিজ্ঞেসা করলে আহমদ মুসা।
‘দুই কারণে আমি এটা মনে করছি। এক, হোটেলের নিহত দু’জন এবং শার্লেম্যান ৫ নং বাড়িতে নিহত ১৪ জন একই গ্রুপের। দ্বিতীয়তঃ স্পুটনিক ধ্বংসকারী এই গ্রুপের সাথে আপনি ছাড়া আর কারো সাথে সংঘাত বাধেনি। বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘ঘটনার পেছনে মোটিভ একটা বড় জিনিস। আমাকে আপনি তৃতীয় পক্ষ ধরে নিয়েছেন। কিন্তু এই তৃতীয় পক্ষ আমি হবো কেন? আমার স্বার্থ কি এখানে? আহমদ মুসা বলল।
‘এটা আমারও প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সমাধান আমি করতে পারিনি। এই কারণেই আমি আপনাকে খুঁজছি। আপনার পরিচয় জানতে পারলে মোটিভটা পরিস্কার হতে পারে’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, মিঃ বুমেদীন বিল্লাহ, আমরা কিন্তু মিসেস কামালের প্রতি অবিচার করছি। আপনার এপয়েন্টমেন্ট হয়েছে মিসেস কামালের সাথে। আর এসে কথা বলছেন আপনি আমার সাথে।
এটা ঠিক নয়। এবার আপনি………….।’
কথার মাঝখানে আহমদ মুসাকে থামিয়ে বুমেদীন বিল্লাহ লতিফা কামালের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলে উঠল, ‘ম্যাডাম মিসেস কামাল আমাকে মাফ করুন। আসলে তৃতীয় পক্ষ সম্পর্কে আপনি কি জানেন, কিংবা জানার ব্যাপারে কি সাহায্য করতে পারেন, আপনার আত্মীয় এই ফাতিমা কামালকে কোথায় পাওয়া যাবে, এসব জিজ্ঞাসার জন্যেই আমি আপনার এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলাম। এখন আপনার এখানে এসে দেখি শুধু ফাতিমা কামাল ও যায়েদ নয়, স্বয়ং তৃতীয় পক্ষ এখানে হাজির। সুতরাং তার সাথেই কথা বলছি। আমি আপনার সহযোগিতা চাই।’
হাসল লতিফা কামাল। বলল, আমি এখানে এখন তৃতীয় পক্ষ। আপনাদের দু’পক্ষকেই আমি সমান সহযোগিতা করব।’ দেখুন মিঃ বুমেদীন বিল্লাহ, আপনি আসার প্রায় পূর্ব মুহুর্তে মিসেস লতিফা কামাল আমাকে বলেছেন, তিনি এবং আমরা একপক্ষ। এখন তিনি আলাদা হতে চাচ্ছেন।’ আহমদ মুসা বলল মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টেনে।
হাসল লতিফা কামাল। বলল, ঠিক আছে। আপনার কথা আমি অস্বীকার করছিনা। কিন্তু এক পক্ষের হয়েও অন্য পক্ষকে সহযোগীতা করা যায়, যদি স্বপক্ষের স্বার্থের বিরুদ্ধে না যায়। তাছাড়া হোষ্ট হিসাবে আমার মেহমানদারীরও একটা ভুমিকা আছে।
‘এরপর আর কোন কথা নেই। মেহমানদারীর প্রয়োজনটা আসন্ন হয়ে উঠেছে। সুতরাং মিসেস কামালের প্রস্তাবের প্রতি আমার পূর্ণ সম্মতি আছে।’ বলল আহমদ মুসা হাসতে হাসতে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই বুমেদীন বিল্লাহ বলে উঠল, ‘নিঃস্পত্তি হয়ে গেল। আসুন তাহলে আমরা আমাদের কথায় ফিরে আসি।’
‘অবশ্যই। তবে শুরুটা এবার আমি করব।’ বলল আহমদ মুসা।
বুমেদীন বিল্লাহ থমকে গিয়ে একটু চিন্তা করে বলল, ‘ঠিক আছে মি.আহমদ আবদুল্লাহ। শুরু করুন।’
‘আচ্ছা মি. বুমেদীন বিল্লাহ, সেদিন শার্লেম্যান রোডে ওদের অফিস কম্পিউটারটা কি আপনি দেখে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ দেখেছি। পুলিশ পরীক্ষা ও ডিকোড করার জন্য কম্পিউটার তাদের অফিসে নিয়ে যায়।’
‘কম্পিউটারে পাওয়া দলিল-দস্তাবেজ সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিংকালে পুলিশ কি দলিলগুলো আপনাদের দেখিয়েছিল?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘তাদের নোট থেকে আমাদের বলেছিল।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘নতুন গুলাগ’ সম্পর্কে কিছু বলেছিল? জিজ্ঞেসা করল আহমদ মুসা।
‘নতুন গুলাগ?’ কাদের নতুন গুলাগ? বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল। ‘বলছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে যে, ‘আমাদের এখানকার গোটা আলোচনা ‘অফ দ্যা রেকর্ড।’ এর কোন কিছুই পত্রিকায় দিতে পারবেন না। মনে করুন আপনি আমার সাথে কথা বলছেন বেন বেল্লাহ ও হুয়ারী বুমেদীনদের একজন উত্তরসূরী হিসাবে, সাংবাদিক হিসাবে নয়। বলল আহমদ মুসা শান্ত এবং দৃঢ় কন্ঠে।
‘আপনি মজার কথা বলছেন আহমদ আব্দুল্লাহ। আমার পরিচয়কে এভাবে কেউ কোন দিন তুলে ধরেনি।’ বলেই আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরে বলল, হ্যাঁ আমি কথা দিচ্ছি আহমদ আবদুল্লাহ।’
‘ধন্যবাদ মি. বুমেদীন বিল্লাহ।’ বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলতে শুরু করল, ‘‘আলেকজান্ডার সোলঝে-নিৎসীনের উপন্যাসে ‘গুলাগ দ্বীপপুঞ্জে’র কথা আছে। মানবতার দোজখ অমন ‘গুলাগ’ সোভিয়েত দেশে অনেক ছিল। তবে সে অতীতের কথা। কিন্তু ইহুদী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডমআর্মি’(WFA) সোভিয়েত ও নাজী স্টাইলে ‘নতুন গুলাগ’ স্থাপন করেছে।’
বিস্ময় জেগে উঠল বুমেদীন বিল্লাহর চোখে-মুখে। বলল, কি উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছে? নতুন গুলাগে কারা আছে?
‘তাদের গুলাগ লোক চক্ষুর সামনে এখনো আসেনি। তবে আমি মনে করি, সক্রিয়বাদী মুসলিম ও কামাল সুলাইমানদের মত সত্যসন্ধানীরা আছেন।’
ভ্রু কুচকে গেল বুমেদীন বিল্লাহর। বলল, ‘তার মানে কি আপনি মনে করেন কামাল সুলাইমান সহ স্পুটনিকের সবাইকে ঐ নতুন গুলাগে রাখা হয়েছে?
‘আমি এ চিন্তা করতে চাইনা, কিন্তু এ চিন্তার কোন বিকল্প নেই।’ আহমদ মুসার কন্ঠ শান্ত এবং দৃঢ়।
আহমদ মুসার এ কথা শোনার সাথে সাথে ভয় ও উদ্বেগ ফুটে উঠল লতিফা কামালের চোখে মুখে।
বুমেদীন বিল্লাহর চোখে-মুখেও ভাবান্তর। আহমদ মুসা থামলেও সে কথা বললনা। একটু পর সে বলে উঠল, ‘এই গুলাগের কথা কি শার্লেম্যান রোডে সেদিন ধারা পড়া কম্পিউটারে আছে? ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’ নামটাও কি ঐ কম্পিউটারে আছে?
‘হ্যাঁ আছে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? জিজ্ঞাসা বুমেদীন বিল্লাহর।
‘ওখান থেকে ফেরার আগে আমরা সেদিন তিন তলার অফিস-কম্পিউটারটা চেক করেছিলাম এবং সব দলিল-দস্তাবেজের প্রিন্ট নিয়ে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রবল বিস্ময়ে ছেয়ে গেল বুমেদীন বিল্লাহর মুখ। বলল সে, ‘কোড ভেঙ্গেছিলেন আপনারা? কিন্তু পুলিশ তো পারেনি। অফিসে নিয়ে বিশেষজ্ঞ এনে তবেই কম্পিউটারের গোপন ফাইলগুলো ওপেন করা সম্ভব হয়।’
‘হ্যাঁ কোড ভাঙা সম্ভব হয়েছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমারা যাওয়ার কথা আপনি বললেন। ‘আমরা’- এর মধ্যে আর কে ছিল।’ জিজ্ঞাসা করল বুমেদিন বিল্লাহ।
‘ফাতিমা ও যায়েদ।’ আহমদ মুসা বলল।
বুমেদীন বিল্লাহ বিস্মিত চোখে তাকাল ফাতিমা ও যায়েদের দিকে। বলল, ‘আপনারা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের পড়ার বিষয় কি ছিল?
হাসল যায়েদ। বলল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সাবজেক্ট কম্পিউটার বিজ্ঞান নয়। আমি সেদিন কম্পিউটার অপারেট করেছি বটে, কিন্তু ভাইয়া আমাকে কতগুলো কোড ট্রাই করতে বলেছিল এবং তারই দু’টি দিয়ে দুই কম্পিউটারের লক খুলে গিয়েছিল।’
বুমেদিন বিল্লাহ বিস্মিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
বুমেদিন বিল্লাহর কিছু বলার আগে আহমদ মুসা বলে উঠল, নিশ্চয় আপনি এখন প্রশ্ন করবেন, কম্পিউটারের নতুন গুলাগে কি ছিল?
বুমেদিন বিল্লাহ গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘না’ আমার প্রশ্ন আপনি আসলে কে? শুনেছি, যার হাতে বন্দুক খুব বেশি চলে তার মাথা বেশি চলে না। কিন্তু আপনি দেখছি, বন্দুক চালনা ও মাথা চালনায় সমান দক্ষ। যাক এ প্রশ্ন। আপনি ঐ প্রশ্নের জবাব দিন, বলুন নিউ গুলাগে কি আছে?’ নিউ গুলাগ ফাইলে আছে একটা দ্বীপের স্কেচ এবং নিউ গুলাগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দ্বীপের স্কেচ তার মানে ঐ দ্বীপটাই নিউ গুলাগ? দ্বীপটার নাম কি? দ্রুত ও এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘দ্বীপের নাম ‘সাও তোরাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাও তোরাহ?’ কোথায় এদ্বীপ? বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘এই প্রশ্নেরই জবাব আমি সন্ধান করছি বুমেদীন বিল্লাহ। মিসেস লতিফা কামালের কাছেও এসেছিলাম এই উদ্দেশ্যে। তিনি ভূগোলবিদ, দ্বীপটার সন্ধান নিশ্চয় তিনি দিতে পারবেন, এ আশা নিয়েই আমরা ছুটে এসেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শুনে বুমেদীন বিল্লাহ একবার তাকাল মিসেস কামালের দিকে। তারপর আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘পেয়েছেন দ্বীপের সন্ধান?’
‘দ্বীপের সন্ধান পাইনি, তবে দ্বীপের সন্ধান কার কাছে পাওয়া যেতে পারে সেটা তিনি আমাদের জানিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি কি জানতে পারি দ্বীপের সন্ধানটা কোথায় পাওয়া যাবে?’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘উনি বলেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ ও দ্বীপতত্ত্ব বিশেষজ্ঞের কাছে এর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই লতিফা কামাল বলে উঠল, হ্যাঁ, আমি এটাই বলছি। ‘সমুদ্রপৃষ্ঠ ও দ্বীপতত্ত্ব’ বিশারদরা দ্বীপের সাইজ দেখে সমুদ্র স্রোত নির্ণয় করতে পারেন এবং সমুদ্র স্রোত বিচার করে সমুদ্রের স্থানটাও চিহ্নিত করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়। এছাড়া আরও উপাদান ও উপলক্ষ তাঁদের বিচার্য আছে।
‘ধন্যবাদ মিসেস কামাল। আপনার একথায় আমার মনে আশা জাগছে যে, দ্বীপটার সন্ধান আমরা পাব। আমার মনে হয় তারা দ্বীপের নাম দেখ ও দ্বীপের এলাকা নির্ধারণ করতে পারবেন। যেমন আমি ভাবছি, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ল্যাটিন অঞ্চলের কোথাও অথবা উত্তর আটালান্টিকের স্পেন ও পর্তুগাল বরাবর পশ্চিমে কোথাও এ দ্বীপটা থাকতে পারে।’
‘ভাই সাহেব, এই ভাবনার আপনার ভিত্তি কি? জিজ্ঞেস করল মিসেস কামাল।
‘দ্বীপের নামের দুটি অংশ আছে। তার এক অংশ হিব্রু, অন্য অংশ ল্যটিন। আমি মনে করছি হিব্রু শব্দটা এসেছে ইহুদীদের ঐতিহ্য বোধ থেকে এবং ল্যাটিন অংশটা এসেছে আঞ্চলিক বিবেচনা বা প্রভাব থেকে। আমি যে অঞ্চল গুলোর উল্লেখ করছি সেগুলো ল্যাটিন ভাষা প্রভাবিত।’ আহমদ মুসা বলল।
চমৎকার। আপনার যুক্তি অকাট্য মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ। আমার বিশ্বাস আপনার এ যুক্তি বিশেষজ্ঞদের এই দ্বীপ সন্ধানে সাহায্য করবে।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আপনাকে ধন্যবাদ ভাই সাহেব। আপনি যে চিন্তা করছেন, আমার মাথায় এই চিন্তা কোন দিন আসত কিনা সন্দেহ’ লতিফা কামাল বলল।
‘মিসেস কামাল, দ্বায়িত্ব মানুষকে দ্বায়িত্বশীল বানায়। দ্বায়িত্ব এসে পড়লেই চিন্তা এমনিতেই মাথায় চাপত।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল, তারপর বলে উঠল, মিসেস কামাল, পরামর্শ দিন কার কাছে আমরা যেতে পারি। আমি তো কাউকে চিনি না।
‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ যিনি, তিনি এখন দেশের বাইরে। অন্য কাউকে তো আমি দেখছিনা।’ বলল মিসেস কামাল।
মিসেস কামাল থামতেই বুমেদীন বিল্লাহ বলল, মিঃ আবদুল্লাহ, একজন প্রবীণ আটলান্টিক বিশেষজ্ঞের সাথে আমার পরিচয় আছে। তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমিরিটাস। বাস করেন এই স্ট্রাসবার্গেই।
আটলান্টিক সমুদ্র স্রোত, ভূতত্ব, দ্বীপের গঠন ও প্রকৃতি ইত্যাদি আটলানিটক সংক্রান্ত বিষয়ের উপর তাঁর অনেক বই আছে। আমি মনে করি তার সাথে আপনি কনসাল্ট করতে পারেন। আমি সাথে করে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলুন, আপনি কেন এসব করবেন। আপনার লক্ষ্য কি?
‘আপনি তো আগেই আমাকে তৃতীয় পক্ষ বলে অভিহিত করেছেন। আসলেই আমি তৃতীয় পক্ষ। আমি স্পুটনিকের অপহৃত নেতাদের উদ্ধার করতে চাই। এবং সেটা করতে গিয়ে স্পুটনিক ধ্বংসের আসল লক্ষ্য সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া এবং এ বিষয়ে কিছু করণীয় থাকলে করতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু যত দূর জানি আপনি একা। একাকি করতে পারবেন।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘না একা নই, সাথে আল্লাহ আছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
বুমেদীন বিল্লাহর মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। বলল, আরেকটা কথা, স্পুটনিক নিউইয়র্কের ডেমোক্রাসি ও লিবার্টি টাওয়ার ধ্বংসের উপর তদন্ত করছিল। এ ব্যাপারে আপনার মত কি?
‘আমি মনে করি স্পুটনিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হাতে দিয়েছে। এই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। স্পুটনিক চাইলে আমিও তাদের সাথে থাকব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এবার আমি আমার পুরানা প্রশ্ন করতে চাই মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ।
সেটা হলো, আপনি কে? কেন আপনি তৃতীয় পক্ষ হতে এলেন? বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আমার প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, আপনি এই স্পুটনিক কেসে কেন বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছেন?
কেন আপনি আমাদের সহযোগিতা করতে চাচ্ছেন? ফ্রান্সের সাংবাদিকদের মধ্যে আপনি ব্যাতিক্রম কেন ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার কথা শেষ করার পর সংগে সংগে জবাব দিল না বুমেদীন বিল্লাহ। মুখটা সে একটু নীচু করছে। গম্ভীর হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল।
কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকার পর ধীরে ধীরে বলল, স্পুটনিক ধ্বংসযজ্ঞ আমাকে আহত করেছে। পুলিশের নিস্ক্রিয়তা আমি মেনে নিতে পারিনি, সাংবাদিকদের বৈষম্য দৃষ্টি আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তাই স্পুটনিকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি।’
‘স্পুটনিকের ধ্বংসযজ্ঞ আপনাকে আহত করেছে কেন? সেটা কি শুধু স্পুটনিক একটা ভাল মানবতাবাদী সংস্থা বলেই? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
আবার নিরবতা বুমেদীন বিল্লাহর। একটু পরে সে বলে উঠল, কি আপনি জানতে চাচ্ছেন, আমি বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ, মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ, কিন্তু ফরাসী পুলিশও কিছু ফরাসী সাংবাদিক খৃষ্টান ও ইহুদী হওয়ার কারণে যেমন মুসলিম প্রতিষ্ঠানের সাথে অসহযোগিতা করেছে, তেমনি আমি মুসলিম হিসাবে স্পুটনিককে সহযোগিতা করতে চাচ্ছি।’
বুমেদীন বিল্লাহ থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ধন্যবাদ মিঃ বিল্লাহ। আপনার মত ঐ একই কারণেই আমি স্ট্রসবার্গ ছুটে এসেছি। কারণ আমিও একজন মুসলিম। নিউইয়র্কের ডেমোক্রাসি ও লিবার্টি টাওয়ার ধ্বংসের পুরানো দায়টা আমরা মুসলমানরা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। স্পুটনিক এ দায় থেকে আমাদের মুক্ত করতে চেয়েছিল। তাই স্পুটনিকের উপর ধ্বংসযজ্ঞ আপনার মত আমাকেও আহত করেছে। স্পুটনিকের সাত গোয়েন্দার মহান মিশনকে সহযোগিতা করার জন্য আমি এসেছি।’
‘মি. আহমদ আবদুল্লাহ আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার কাছে আমার দু’টি প্রশ্ন ছিল। দু’টির মধ্যে ‘আপনি কেন এসেছেন’ এ প্রশ্নের জবাব আপনি দিলেন। কিন্তু ‘আপনি কে’ এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু এখনও হয়নি।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, আজই হলো প্রথম সাক্ষাত। প্রথম দিনেই জানা শোনা সব শেষ হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। পরের জন্য কিছু রাখুন।’
বুমেদীন বিল্লাহও হাসল। বলল, আমার আপত্তি নেই। তবে আগ্রহটা আমার আরও বাড়ল।
বুমেদীন বিল্লাহ কথা শেষ করতেই লতিফা কামাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘খাবার টেবিলে নাস্তা এসেছে। আমি সকলকে নাস্তা খাবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
‘খাবার সামনে রেখে নামাজও চলে না, কথা তো চলতেই পারে না। সুতরাং চলুন।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
তার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।
‘শুনলেন তো অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল, আমরা কত বড় শনির দশায় পড়েছি!’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কিন্তু এত বড় বস্নানডার কিভাবে হলো? আমি বুঝলাম, আপনার লোকেরা প্রাণপণ লড়াই করেছে। সবাই মারা গেছে এটাই তার প্রমাণ। কিন্তু লড়াই-এর মত সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল কম্পিউটারের রেকর্ড নষ্ট করে দেয়া। কিন্তু তারা সেটা করেনি।’ অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘আহমদ মুসা বন্দী হবার পর এত বড় বস্নান্ডার ঘটবে, এটা কারও কল্পনাতেও ছিল না। যাক, যখন বিপর্যয় ঘটেছে তখন আমাদের দূর্বলতাতেই ঘটেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখন বলুন শেষ রক্ষার উপায়, স্পুটনিক ধবংসের পরিকল্পনা, ওদের সাত জনকে কিডন্যাপ করার ডকুমেন্ট, সাও তোরহ দ্বীপের মানচিত্র, সবই গিয়ে পড়েছে পুলিশের হাতে। স্ট্রসবার্গের পুলিশ কমিশনারকে অনুরোধ করে কোন রকমে মানচিত্র ও ডকুমেন্টের বিস্তারিত প্রেসে দেয়া আটকাতে পেরেছি। কিন্তু ডকুমেন্টগুলো প্যারিস থেকে চেয়ে পাঠানো হয়েছে। ডকুমেন্টগুলো প্যারিসে গেলেই পত্রিকায় এসে যাবে। পুলিশ প্রধান যে ধরনের লোক, আমি কোন কথা-ই তাকে মানাতে পারবো না। যে টুকু পত্রিকায় এসেছে, তাতেই আমাদের বাইরে বেরুবার উপায় নেই। এর পর ডকুমেন্টের সব কথা যদি পত্রিকায় আসে তাহলে আমরা শেষ হয়ে যাব।’
‘আমর মন কিছুতেই মানছে না মি.ওয়াইজম্যান, একজন লোক একাই এভাবে আপনাদের তুলা ধুনা করল।’ বলল অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল।
‘আমাদের কথা আর কি বলব। আপনি জানেন, বলতে গেলে আহমদ মুসার একার হাতেই ইহুদীবাদের গর্ব জেনারেল শ্যারণ তার দলবল সহ শেষ হয়ে গেল। গোটা ইহুদীবাদই আজ মহা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে অধ্যাপক ডেভিড। যে কোন ভাবে ডকুমেন্টগুলোর প্রেসে যাওয়া আটকাতে হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আমাকে কি করতে হবে বলুন।’ অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘জনাব প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সম্মানিত প্রফেসর এমিরেটাস আপনি। তার উপর প্রেসিডেন্ট আপনার ব্যাক্তিগত বন্ধু। এই সুযোগ আপনাকে কাজে লাগাবার অনুরোধ করছি।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘প্রেসিডেন্টকে আমি কি বলব? অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘ডকুমেন্টগুলো ভূয়া বলে গোটা বিষয়টাই ধামা চাপা দিতে হবে। বলতে হবে যে, মুসলিম মৌলবাদীরা ইহুদীদের ফাঁসাবার জন্য এই ভূয়া ডকুমেন্ট সাজিয়েছে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কিন্তু মি.ওয়াইজম্যান, এটুকু করলেই আপনার বিপদ কেটে যাবে। মূল বিপদ তো বলছেন আহমদ মুসা। তার কি করবেন! এত কিছু পারছেন, ফরাসী পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাকে পথ থেকে সরাতে পারছেন না? অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘সেখানেও এক বিপদ আছে। ফরাসী রাজকুমারীকে আহমদ মুসা বিয়ে করার পর ফরাসী পুলিশের কাছে সে অনেকটা আপন হয়ে গেছে। তার উপর আমেরিকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে ফরাসী পুলিশের কাছে আহমদ মুসার ইমেজ অনেক অনেক বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় ফরাসী পুলিশের কাউকে কাউকে তার বিরুদ্ধে পাওয়া যাবে, সবাইকে পাওয়া যাবে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কিন্তু এই যে বললেন, পুলিশ স্ট্রাসবার্গে কোথাও আহমদ মুসাকে দেখতে পেলে ধরে তাকে আপনাদের হাতে তুলে দেবে। সেটা কিভাবে? অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘স্ট্রাসবার্গের পুলিশের কাছে আহমদ মুসার পরিচয় আহমদ আবদুল্লাহ হিসাবে। তারা আহমদ আবদুল্লাহকে আমাদের হাতে তুলে দেবে, আহমদ মুসাকে নয়।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল কিছু বলতে যাচ্ছিল। আজর ওয়াইজম্যানের মোবাইলটি বেজে উঠল।
থেমে গেল অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল।
‘মাফ করুন’ বলল আজর ওয়াইজম্যান টেলিফোন ধরল।
ওপারের কথা শুনেই ভ্রু কুঁচকে উঠল আজর ওয়াইজম্যানের। বলল দ্রুত কন্ঠে, ‘তোমার দু’জন বাড়ির সামনে পাহারায় থাক আমি লোকজন নিয়ে আসছি।
বলে মোবাইল অফ করে দিয়ে আজর ওয়াইজম্যান অধ্যাপক ডেভিডের উদ্দেশ্যে দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘অধ্যাপক ডেভিড আহমদ মুসার সন্ধান পাওয়া গেছে। একটা বাড়িতে সে আরও দু’জনকে সাথে নিয়ে থাকে। আমাদের দু’জন লোক বাড়িটার সামনে পাহারায় আছে।
লোকজন নিয়ে আমি ওখানেই যাচ্ছি। পরে আবার কথা বলব আপনার সংগে।’ বলে অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল আজর ওয়াইজম্যান।
চারজন লোক নিয়ে ছুটল সে আহমদ মুসার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কিন্তু আজর ওয়াইজম্যান যখন তার লোকজন নিয়ে আহমদ মুসার আটতলায় গিয়ে পৌছল, তার বেশ কিছু আগে আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে নিয়ে আটলান্টিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এমিরিটাস জ্যাক সাইমনের সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে গেছে। আর তখন ফাতিমা এবং যায়েদ ও বাসা থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে এগুচ্ছিল। এই সময় তারা দেখল লিফঠ থেকে বেরিয়ে তাদের ফলাটের দিকে এগুচ্ছে ক’জন লোক। এটা দেখে ফাতিমা এবং যায়েদ দুজনে একটা আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ব্যাপার কি তা দেখার জন্যে। ওরা পাঁচজন যখন ফাতিমাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সে সময় ওদের একজনের মোবাইল বেজে উঠল। লোকটি মোবাইল তুলে নিয়ে চাপা কন্ঠে বলল, ‘ইয়েস, আজর ওয়াইজম্যান।’
লোকটা ওপারের কথা শুনল। শুনেই গা ঝাড়া দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়াল। উত্তেজনা ঠিকরে পড়তে লাগল তার চোখ মুখ থেকে। অনেকটা স্বাগতঃই বলে উঠল লোকটা, ‘আমরা আহমদ মুসার তালাশে এসেছি তার বাড়িতে, আর আহমদ মুসা গিয়ে বসে আছে আমাদের হাতের মুঠোর মধ্য। চল সকলে।
তারা পাঁচজন আবার লিফটে গিয়ে উঠল।
চলে গেল তারা।
আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল ফাতিমা ও যায়েদ।
দু’জনেরই চোখ মুখ শুকনো।
চোখ-মুখে তাদের উদ্বেগ।
আজর ওয়াইজম্যান স্বাগতোক্তিতে যা বলেছে তা শুনতে পেয়েছে ফাতিমা ও যায়েদ দুজনেই।
দু’জন কারো মুখে কোন কথা নেই। অবশেষে নিরবতা ভাঙল ফাতিমা। বলল, ‘আহমদ মুসা ভাইয়ারা আজর ওয়াইজম্যনদের হাতের মুঠোয় যাবেন কি করে? ওরা তো গেলেন অধ্যপক সাইমনের সাথে দেখা করতে। তাহলে কি বুমেদীন বিল্লাহ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?
আহমদ মুসা ভাইকে অন্য কোথাও নিয়ে তুলছে? থামল ফাতিমা।
আতংক ফুটে উঠল যায়েদের চেখে-মুখে। বলল, ‘আমারও এই রকমই সন্দেহ হচ্ছে।
ফাতিমা স্থির দাঁড়িয়েছিল। নড়ে উঠল। চলতে শুরু করল ফ্ল্যাটের দরজার দিকে। বলল, এস যায়েদ, নোট বুকে অধ্যাপক জ্যাক সাইমনের ঠিকানা লেখা আছে।’
যায়েদ ফতিমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘অধ্যপক জ্যাক সাইমনের ঠিকানা দিয়ে কি করবে?
‘কিছু একটা তো করতে হবে আগে জ্যাক সাইমনের ঠিকানা তো দেখি!
দরজা খুলে দু’জনেই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল।
৬
গাড়ি থামল বিশাল এক গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ি থামতেই উর্দীপরা একজন যুবক বারান্দা থেকে দ্রুত নেমে এল। এসে গাড়ির দরজা খুলে সামনে বসা বুমেদীন বিল্লাহকে লক্ষ্য করে বলল, স্যার আপনি নিশ্চয় মিঃ বিল্লাহ। স্যার আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ওয়েলকাম।’
বুমেদীন বিল্লাহ গাড়ি থেকে নেমে ‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
আহমদ মুসাও গাড়ি থেকে নেমেছে।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে বুমেদীন বিল্লাহ ও এ্যাটেনড্যান্টের দিকে চাইতেই গাড়ির বারান্দার উপরে বারান্দায় উঠার সিঁড়ির পাশেই দেয়া সুন্দর একটি নেম প্লেট আহমদ মুসার নজরে পড়ল।
নেমপ্লেটটিতে সাদা পটভুমির উপর সুন্দর সাদাটে নীল কালিতে লেখা প্রফেসর (এমিরিটাস) জ্যাক সাইমন। নেমপ্লেটের সাদা পটভূমির উপর ও নীচের গোটা অংশ সাদাটে নীল।
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরে বুমেদীন বিল্লাহর পাশে এসে একসাথে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
আগে চলছিল এ্যাটেনড্যান্ট।
হাঁটতে হাঁটতে আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে নেমপ্লেটটি দেখিয়ে বলল, ‘নামটা তুলে নিয়ে যদি ওখানে নীল রংয়ের নামের বদলে যদি নীল ছয় কোণা তারকা বসানো যায়, তাহলে ওটা কি হয় বলুন তো?
মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে নেমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করে বল, ‘বলতে পারলাম না। এ রকম কোন জিনিসের কথা আমার মনে পড়ছে না।’
‘ইসরাইল রাষ্ট্রের পতাকা। এখন মিলিয়ে দেখুন।’
মনে করার একটু চেষ্টা করে বুমেদীন বিল্লাহ বলল, ‘পতাকা দেখেছি, কিন্তু এখন স্মৃতিতে আনতে পারছি না। কিন্তু আহমদ আবদুল্লাহ সুদুরের দুই বিষয়কে এভাবে মিলানোর কথা আপনার মনে পড়ল কি করে?
‘কালার এবং তার সেট আপ ও আকার দেখে মনে হলো।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার চলতে শুরু করছে দু’জন।
ভেতরে ঢুকে একটা কক্ষ পেরিয়ে একটা দরজার সামনে এ্যাটেনন্ড্যান্ট থমকে দাঁড়াল। আহমদ মুসারাও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এ্যাটেনন্ড্যান্ট লোকটি বন্ধ দরজায় কয়েকবার নক করল। ভেতর থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এ, ‘ইয়েস’।
এ্যাটেনন্ড্যান্ট বলল, ‘স্যার আপনারা যান।’
দরজা ঠেলে আহমদ মুসা ও বুমেদীন বিল্লাহ ঘরে প্রবেশ করল।
তারা দেখল, প্রৌঢ় দীর্ঘদেহী ভারী চশমাওয়ালা সোনালী সাদা রংয়ের একজন লোক দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
আহমদ মুসারা ঢুকতেই লোকটি উঠে দাঁড়ল এবং কয়েক ধাপ এগিয়ে এল। ‘ওয়েলকাম’ বলে আহমদ মুসার সাথে হাত মেলাল।
বুমেদীন বিল্লাহ নিজের পরিচয় দিয়ে আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল,
‘আমার বন্ধু। নাম আলী আবদুল্লাহ। সমুদ্র ভ্রমনের নেশা। ইদানিং তিনি সমুদ্রের উপর কুইজ তৈরী করছেন।’
আহমদ মুসার এই নাম ও পরিচয় আগেই ঠিক করে রেখেছিল বুমেদীন বিল্লাহ। তার যুক্তি ছিল রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে দু’জন লোক নিহত হওয়ার ঘটনার পর ‘আহমদ আবদুল্লাহ’ নামটি পত্র-পত্রিকায় এসেছে। এ নাম প্রফেসর জ্যাক সাইমন ও পত্র-পত্রিকায় দেখতে পারেন। সুতরাং নামটি কোন বিপত্তির সৃষ্টি করতে পারে। আহমদ মুসা ও বুমেদীন বিল্লাহর এ চিন্তাকে ওয়েলকাম করেছিল।
‘ওয়েলকাম টু বোথ’ বলে প্রফেসর জ্যাক সাইমন বাম পাশের দুটি সোফার দিকে ইংগিত করে বসতে বলল এবং নিজেও ফিরল সোফায় বসার জন্য।
আহমদ মুসা ও বুমেদীন বিল্লাহ সোফায় বসল।
ঘরটি বৃত্তাকার। ঘরের চারদিকে বৃত্তাকার করেই সোফা সাজানো।
বৃত্তের মাঝখানটা ফাঁকা।
বসার পর প্রফেসর জ্যাক সাইমন আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি সমুদ্রকে ভালবাসেন জেনে খুশি হয়েছি। সমুদ্রকে আমিও ভালবাসি। তবে বেশি ভালবাসি আটলান্টিককে।’
‘ধন্যবাদ। বলুন কি করতে পারি আপনার জন্যে।’ প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল।
‘স্যার জার্মানীর এক কুইজ ফার্ম থেকে কিছু কুইজ পেয়েছি, সেগুলো আমি কাজে লাগাতে চাই। কিন্তু একটা আইল্যান্ডের কোন ট্রেস করতে পারছি না। বুমেদীন বিল্লাহ বলল, এর সমাধান শুধু আপনার কাছেই পাওয়া যেতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
‘আইল্যান্ডের ছবি আছে। এর নাম, অবস্থান ও কোন রাষ্ট্রের অংশ, এটা বলে দিতে হবে তো? প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল।
‘জি স্যার।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘দাও ছবিটা। প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল।
‘ছবি নয় আকার বোঝা যায় এমন একটা স্কেচ আছে।’ বলে আহমদ মুসা স্কেচটা প্রফেসর সাইমনের হাতে তুলে দিল।
স্কেচটি হাতে নিল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
চোখের সামনে তুলে ধরল স্কেচটি।
দেখতে লাগল সে দ্বীপটাকে।
ধীরে ধীরে ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠল তার। বিস্ময়, সেই সাথে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল তার চোখ-মুখে। এক সময় এক চোরা দৃষ্টিতে তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। তারপর হঠাৎ সহজ হয়ে উঠে প্রশ্ন করল, ‘দিকের চিহ্নটা কি ঠিক আছে দ্বীপের ?
‘জি হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দ্বীপ সম্পর্কে আপনারা কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন? প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল।
‘না, পারিনি।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলে উঠল, ‘দ্বীপটার সাইজ এ্যাভারেজ ক্যারেক্টরের। এক দৃষ্টিতে চিহ্নিত করা মুস্কিল।
আপনারা একটু বসুন। আমার কম্পিউটারের ইনডেক্স ও ক্যাটালগ একটু কনসাল্ট করে আসি। আপনারা গল্প করুন। চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
বলে উঠে ভেতরে চলে গেল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
প্রফেসর জ্যাক সাইমন চলে যাবার পর বুমেদীন বিল্লাহ আহমদ মুসাকে ফিস ফিস করে বলল, ‘কি মনে করছেন , দ্বীপটাকে উনি কি চিহ্নিত করতে পারবেন?
‘মি. বুমেদীন বিল্লাহ আমার চোখ যদি ভুল না দেখে থাকে তাহলে আমি বলব তিনি দ্বীপটাকে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করেছন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি করে বুঝলেন? জিজ্ঞেস করল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আমার দিকে চেয়ে যখন তিনি কথা বলছিলেন, তখন তার চোখ-মুখের ভাব দেখে আমি এটা বুঝেছি। না চিনতে পারলে যে অবস্থা, যে চেহারা মানুষের হয়, সেটা তাঁর মধ্যে আমি দেখলাম না। যখন তিনি ইনডেক্স ও ক্যটালগ দেখার কথা বললেন, তখনও কথায় অন্তরের কোন স্পর্শ ছিল না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘চিনতে পারলে তা গোপন করবেন কেন? কম্পিউটারে ইনডেক্স ও ক্যাটালগ কনসাল্ট করার কথাইবা বলবেন কেন? বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘আমার কথাটা চুড়ান্ত নয় মিঃ বিল্লাহ। ওটা আমার একটা ধারনা। হতে পারে প্রফেসর জ্যাক সাইমন এমন এক ধরনের মানুষ যার মনের ভাবটা চোখ-মুখে ফুটে উঠতে পারে না এবং চোখ-মুখের ভাব মনের কথা বলে না। এ ধরনের শক্ত মনের ব্যতিক্রমী ব্যাক্তিত্ব দুনিয়াতে অনেক আছে। প্রফেসর জ্যাক সাইমন হতে পারেন তাদেরই একজন। বলল আহমদ মুসা।
চা এসে গিয়েছিল। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল বুমেদীন বিল্লাহ, দ্বীপের সন্ধান পেলে কি করবেন মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ?
‘দ্বীপ সম্পর্কে খোজ খবর নিতে হবে। তার পর প্রয়োজনে দ্বীপে যেতে হবে, যদি স্পুটনিকের লোকেরা সেখানে আটক থাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থ্রিলের প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়েছে। মনে হচ্ছে কি জানেন, এ ধরনের অভিযানে আমি আপনার সংগী হই।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘তাহলে সাংবাদিকতার কি হবে? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এ ধরনের অভিযানে সাংবাদিকতা বাধা হবে কেন? যুদ্ধে কি সাংবাদিকরা শরীক হয় না? বলল বুমেদীন বিল্লাহ। আহমদ মুসা হাসল। বলল ‘আসলে কি জানেন, আপনি আপনাকে চিনতে পারেন নি, দুই ঐতিহাসিক রক্তের ধারা আপনার শরীরে। একটি ধারা এসেছে আলজেরিয়ার বিপ্লবী নেতা আহমদ বেন বেল্লাহর কাছ থেকে। এ সেই মহান বেন বেল্লাহ যিনি ১৯৫৪ সালে ফরাসী ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার জনগণের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়ে ছিলেন। আরেকটি রক্তের ধারা হুয়ারি বুমেদীনের দিক থেকে। তিনিও আলজেরিয়ার একজন স্বাধীন সংগ্রামী এবং আলজেরিয়ার দীর্ঘকালীন প্রেসিডেন্ট। এই দুই রক্ত আপনাকে একটা স্বভাব সংগ্রামী মানসিকতা দিয়েছে। আপনার সাংবাদিকতা আপনার এই স্বভাব সংগ্রামেরই অংশ। এখন আবার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পরিবেশ দেখে আপনার মন তার সাথেও শামিল হতে চাচ্ছে।’ থামল আহমদ মুসা।
বিস্ময় দৃষ্টিতে বুমেদীন বিল্লাহ অপলক তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা থামলে আরও কয়েক মুহুর্ত সময় নিয়ে বুমেদীন বিল্লাহ ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনি কে জানি না। কিন্তু মনে হয় আপনি আর এক আহমদ বেন বেল্লাহ হবেন, যিনি মানুষকে জাগাতে, তাকে সংগ্রামী বানাতে পারেন। এখন সত্যিই আমার নিজেকে নতুন পরিচয়ের নতুন মানুষ মনে হচ্ছে। আমি কখনই বেন বেল্লাহ কিংবা বুমেদীনকে আমার মডেল ভাবতে পারিনি, বরং ঘৃনা করেছি তাদের রাজনীতিকে। অথচ এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে, আহমদ বেন বেল্লাহ ও বুমেদীনের আরেকটা পরিচয় ছিল। সেটা বিপ্লবীর পরিচয়। এই পরিচয় আমার জন্য মডেল হতে পারে এবং এটা সময়েরও প্রয়োজন। আপনাকে…………।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল বুমেদীন বিল্লাহ। কিন্তু এ সময় ড্রয়িং রুমে ফিরে এলেন প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
তার সোফায় বসতে বসতে প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল, ‘স্যরি, অনেক্ষণ আপনাদের বসিয়ে রেখেছি। ‘
‘স্যরি স্যার। আমাদেরই তো দুঃখ প্রকাশ করা দরকার। আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি আমরা।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
আমাদের জন্যে কোন সুখবর আছে স্যার ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই ইয়ংম্যান।’ বলে একটু থামল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
তারপর ধীরে ধীরে আবার শুরু করল, ‘কুইজের উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ দিতে হয় মি. আলী আবদুল্লাহ। এ দ্বীপের সন্ধান তারা পেল কি করে ?
কোন মানচিত্র, এমনকি স্যাটালাইট চিত্রেও এ দ্বীপের কোন আকার স্পষ্ট নয়। কিন্তু আপনার স্কেচে দ্বীপটির নিখুঁত আকার এল কি করে?
কথা শেষ করতেই প্রফেসর জ্যাক সাইমনের মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে নিয়ে প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল, ‘ইয়েস সাইমন স্পিকিং।’
ওপারের কথা শুনে বলল, ‘ইয়েস।’ OK, বলে মোবাইল রেখে দিল।
মোবাইল রেখে দিয়েই প্রফেসর জ্যাক সাইমন তার পূর্ব কথার রেশ ধরে বলে উঠল , হ্যাঁ মি. আলী আবদুল্লাহ , কুইজ উদ্যোক্তারা এ দ্বীপের এই নিখুঁত মাপটা পেল কোথায়?’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। একটু ভাবল আহমদ মুসা। প্রফেসার জ্যাক সাইমনের এ জিজ্ঞাসার মধ্যে বিদ্রুপ ও অভিযুক্ত করার মানসিকতা রয়েছে। তার চোখে-মুখেও একটা অযৌক্তিক কাঠিন্য।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে বলল, ‘কোন অভিযাত্রি, কোন গ্রন্থ অথবা সরকারী কোন সূত্র থেকেও পেতে পারে।’
প্রফেসর জ্যাক সাইমন আহমদ মুসারা যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিল সেই দরজার দিকে তাকিয়েছিল। তার ঠোটে ফুটে উঠেছে এক টুকরো শক্ত হাসি। আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই প্রফেসর বলে উঠল,
‘কেন কোন তিন তলার কম্পিউটার থেকে পেতে পারে না?
প্রফেসর জ্যাক সাইমনের কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা যেন এক ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে উঠল। কখন তার ডান হাত কোটের পকেটে চলে গিয়েছিল। বের হয়ে এল রিভলবার। রিভলবারটি উঠল প্রফেসর জ্যাক সাইমনের মাথা লক্ষ্যে। সেই সাথে আহমদ মুসার কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এল, ‘দেরী হয়ে গেছে, নেম প্লেটটা দেখেই আমার সব কিছু বুঝা উচিত ছিল।’
হঠাৎ হো হো হাসির শব্দ এল ড্রইংরুমের সামনের দরজার দিক থেকে।
তাকাল আহমদ মুসা সেদিকে। দেখল, চারটি ষ্টেনগান ও একটি রিভলবার তাদের দিকে তাক করা। হো হো করা কন্ঠটি আজর ওয়াইজম্যানের। হাসির সাথে সাথেই সে বলে উঠল, ‘সত্যিই দেরী হয়ে গেছে আহমদ মুসা। আর তোমার করার কিছুই নেই।’
বলে সে প্রফেসর জ্যাক সাইমনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘প্রফেসর ডেভিড দানিয়েল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার ঐতিহাসিক টেলিফোনের জন্য। আপনি দয়া করে আহমদ মুসার হাত থেকে রিভলবারটি নিয়ে নিন।’
প্রফেসর জ্যাক সাইমন উঠে এসে আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে রিভলবার কেড়ে নিল।
‘প্রফেসর জ্যাক সাইমন আপনার ইহুদী নাম দেখছি ডেভিড দানিয়েল। নাম কবে পাল্টেছেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘পাল্টাব কেন? ফ্যামিলী নাম হিসাবে এটা সব সময় চালু আছে। পাবলিকলী আমি জ্যাক সাইমন।’
‘মি. জ্যাক সাইমন আপনার মত লোক যে ছব্দবেশী হবেন এটা বিশ্বাস করতে মন চায়নি। তাই রিভলবার বের করতে অনেক দেরী হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন আমাকে সন্দেহ করেছিলে নাকি? জিজ্ঞেস করল জ্যাক সাইমন।
‘অবশ্যই। আপনার নেমপ্লেটটা তো একটা ইসরাইলি পতাকা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাও তুমি ধরে ফেলেছ? তুমি সত্যিই অদ্বিতীয় আহমদ মুসা।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
প্রফেসর জ্যাক সাইমন থামতেই আজর ওয়াইজম্যান বলে উঠল, ‘প্রফেসর ডেভিড দানিয়েল আহমদ মুসার এই কথা বলা কিন্তু একটা কৌশল। শৃগালের মত ধূর্ত, আর সাপের মত বিষাক্ত এই লোক মিঃ প্রফেসর। আপনি দূরে থাকুন।
বলেই আজর ওয়াইজম্যান চোখ ফেরাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘তোমরা দু’জন মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড় আহমদ মুসা। আমি কিন্তু দু’বার নির্দেশ দেব না এবং তোমাকে এক মূহুর্ত বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছাও আমার নেই।
আহমদ মুসা তাকাল বুমেদীন বিল্লাহর দিকে। দেখল বুমেদীন বিল্লাহর চোখ ভরা একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা তার দিকে চাইতে সে বলে উঠল, ‘ওরা যা বলেছে এটাকি ঠিক? আপনি সত্যিই আহমদ মুসা?
‘হ্যাঁ ভাই।’ বলে একটু থামল। তারপর হেসে বলল, ‘আসুন মিঃ ওয়াইজম্যানের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।’
আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠল এবং এগুলো মেঝের মাঝখানটার দিকে।
বুমেদীন বিল্লাহও আহমদ মুসার পেছনে।
আহমদ মুসা পূর্ব দিকে মাথা দিয়ে উপুর হয়ে কার্পেটের উপর শুয়ে পড়ল। বুমেদীন বিল্লাহ আহমদ মুসার বাম পাশে একইভাবে শুয়ে পড়ল।
‘বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান’ বুঝলে আহমদ মুসা। দু’বার তোমার ভাগ্য সহায় হয়েছে, খাঁচা কেটে পালাতে পেরেছ। এবার তোমাকে মরতে হবে, তবে তার আগে তোমাকে একটু নাচাতে চাই।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান আহমদ মুসাকে লক্ষ করে।
কথা শেষ করেই আজর ওয়াইজম্যান একজন ষ্টেনগানধারীর দিকে একটা প্যাকিং টেপের বান্ডিল ছুড়ে দিয়ে নির্দেশ দিল ওদের পিছ মোড়া করে বেঁধে ফেল।
নির্দেশ দিয়ে আজর ওয়াইজম্যান প্রফেসর ডেভিড দানিয়েলকে লক্ষ্য করে বলল, মিঃ ডেভিড দানিয়েল, আসুন পাশের ঘরে একটু কথা বলি।’
আজর ওয়াইজম্যান ও প্রফেসর ডেভিড দানিয়েল পাশের ঘরে চলে গেল।
একজন ষ্টেনগানধারী এক হাতে ষ্টেনগান অন্য হাতে টেপ নিয়ে এগুলো প্রথমে আহমদ মুসার দিকে।
সে আহমদ মুসার পেছন দিক দিয়ে গিয়ে তার উপর চেপে বসে তাকে পিছমোড়া করে বাঁধতে চাইল।
আহমদ মুসা দু’পা এবং দু’হাত ছড়িয়ে শুয়ে ছিল।
ষ্টেনগানধারী লোকটি আহমদ মুসার দু’পায়ের মাঝখান দিয়ে এগুলো তার পিঠের দিকে।
লোকটি যখন আহমদ মুসার নিতম্বের কাছাকাছি এসে পৌছেছে, তখন আহমদ মুসার দুই পা তীব্র বেগে উঠে এসে লোকটির দুই হাঁটুর উপর আঘাত করল। আকস্মিক এই আঘাতে লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল আহমদ মুসার উপর। আর তার ষ্টেনগানটি গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার পাশে একেবারে তার ডান হাতের উপর।
আহমদ মুসা এক মুহুর্তও সময় নষ্ট করেনি। লোকটি আহমদ মুসার উপর পড়ে যাবার আগেই আহমদ মুসা পাশ ফিরে তার বাম হাত ঘুরিয়ে নিয়েছিল ডান হাতের কাছে। ষ্টেনগান ডান হাতের উপর পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার দুই হাত ষ্টেনগান নিয়ে তাক করল তিন ষ্টেনগানধারীকে। শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা ট্রিগার চাপল।
তিনজন ষ্টেনগানধারী ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তার উপর তাদের সহযোগী লোকটি আহমদ মুসার উপর গিয়ে পড়ায় তারা দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল।
ফলে অসহায়ভাবে তারা আহমদ মুসার গুলী বৃাষ্টর শিকার হলো। মূহুর্তেই তিনজনের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ ঝরে পড়ল মেঝের উপর।
এদিকে আহমদ মুসা উপর পড়ে যাওয়া লোকটি প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ঘটনা বুঝে উঠেই সক্রিয় হয়ে উঠল। আহমদ মুসা যখন গুলী করছিল, তখন লোকটির দু’হাত সাঁড়াশীর মত আহমদ মুসার গলা লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা যখন তিনজন ষ্টেনগানধারীকে ভূপাতিত করে তার ষ্টেনগানের ব্যারেল নীচে নামাল, তখন লোকটির দুই হাত সাঁড়াশীর মত চেপে বসেছে আহমদ মুসার গলায়।
প্রতিরক্ষার জন্য আহমদ মুসা ষ্টেনগানকেই ব্যাবহার করল।
দু’হাতে ধরা ষ্টেনগানের বাট দিয়ে প্রচন্ড গুঁতা মারল আহমদ মুসা লোকটির মাথায় এবং সাথে সাথেই আহমদ মুসা মোচড় দিয়ে দেহটাকে ঘুরিয়ে নিল।
মাথায় আঘাত পেয়ে লোকটার দুই হাত আহমদ মুসার গলা থেকে আলগা হয়ে পড়েছিল এবং দেহটাও শিথিল হয়ে পড়েছিল।
আহমদ মুসার দেহের ধাক্কায় সে পাশে গড়িয়ে পড়ল। লোকটি তখন গলা ছেড়ে দিয়ে ষ্টেনগান ধরার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। আহমদ মুসা ততক্ষণে তার ষ্টেনগান ঘুরিয়ে নিয়েছে। আহমদ মুসা ট্রিগার চেপে ধরল ষ্টেনগানের ব্যারেল তার পাঁজরে ঠেকিয়ে।
লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়া এবং আহমদ মুসা ট্রিগার চাপা এক সাথেই হয়েছিল। এক ঝাঁক গুলীর তোড়ে লোকটার দেহ একটা রক্তাক্ত মাংসপিন্ডে পরিনত হলো।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াচ্ছিল। এই সময় চিৎকার করে উঠল বুমেদীন বিল্লাহ, মিঃ আহমদ মুসা গুলী……….।’
ভীত, আতংকিত বুমেদীন বিল্লাহ তখনও গুলী গোলার মধ্যে উঠে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। শুয়ে থেকেই চারদিকটা সে দেখার চেষ্টা করছিল।
বুমেদীন বিল্লাহর চিৎকার করে উঠার সংগে সংগেই আহমদ মুসা নিজের দেহ পেছনের দিকে ছুঁড়ে দিল। তার উপর দিয়ে একটা বুলেট শাঁ করে চলে গিয়ে দেয়ালে বিদ্ধ হলো।
আহমদ মুসা মাটিতে আছড়ে পড়লেও ষ্টেনগান তার হাত থেকে পড়েনি এবং তার আঙুল ট্রিগার থেকে সরেনি।
যে দিক থেকে গুলী এসেছে, তার বিপরিত দিকে পড়েছে আহমদ মুসার মাথা। ফলে সে মেঝেতে শুয়ে পড়লে তার চোখ গিয়ে পড়েছে দরজাটির উপর যেখানে আজর ওয়াইজম্যান গুলী করেছে।
আহমদ মুসা শুয়ে পড়েই ট্রিগার টিপেছে তার ষ্টেনগানের। এক ঝাঁক গুলী ছুটে গেল দরজার উপর।
আজর ওয়াইজম্যান টার্গেট ঠিক করে দ্বিতীয় গুলী করার আর সুযোগ পেল না। আহমদ মুসা দেখতে পেল তার দেহটা একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠে দরজার আড়ালে ছুটে গেল। আহমদ মুসার মনে হলো আহত হয়েছে আজর ওয়াইজম্যান।
শোয়া অবস্থা থেকে আহমদ মুসা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল এবং ছুটল দরজার দিকে।
আহমদ মুসা দরজার ওপারে রক্তের ফোটা ফোটা দাগ দেখতে পেল। রক্তের দাগ অনুসরণ করে ছুটল।
বাইরের বারন্দায় বেরিয়ে দেখল একটা গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে গেট দিয়ে।
আহমদ মুসা ফিরতে যাচ্ছিল এ সময় একটা থামের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এল ফাতিমা ও যায়েদ। বেরিয়েই রক্তে ভেজা আহমদ মুসার দিকে আতংকিত চোখে ফাতিমা বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন ভাইয়া? কাঁধ চেপে ধরে একজন এদিক দিয়ে পালাল।’
‘ভাল আছি। তোমরা এস।’ বলে আহমদ মুসা ছুটল ভেতরে। প্রফেসার জ্যাক সাইমনকে পেতে হবে, ধরতে হবে তাকে।
আহমদ মুসা চারটি লাশ পড়ে থাকা রক্তাক্ত হল রুমটিতে প্রবেশ করতেই সামনের দরজার দিক থেকে, যে দরজা দিয়ে প্রফেসার জ্যাক সাইমন ওরফে ডেভিড দানিয়েল দ্বীপের ইনডেক্স ও ক্যাটালগ দেখার জন্য ভেতরে গিয়েছিল, বুমেদীন বিল্লাহর চিৎকার ভেসে এল মিঃ আহমদ মুসা প্রফেসর জ্যাক সাইমন পালাচ্ছিল ধরে ফেলেছি।’
বলতে বলতে বুমেদীন বিল্লাহ প্রফেসর জ্যাক সাইমনকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে দরজা দিয়ে হল রুমে প্রবেশ করল এবং বলল, ‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে এই প্রফেসরই টেলিফোন করে এই কিলারদের ডেকে এনেছে।’
‘আপনি ঠিক অনুমান করেছেন মি. বিল্লাহ। দ্বীপের ইনন্ডেক্স ও ক্যাটালগ দেখার ভান করে ইনি আজর ওয়াইজম্যানদের টেলিফোন করার জন্যই ভেতরে গিয়েছিলেন। আধা ঘন্টার ও বেশি ভেতরে দেরী করেছিলেন তাদের আসার সুযোগ দেয়ার জন্য। একে পাকড়াও করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ মিঃ বিল্লাহ।’ বলল আহমদ মুসা।
বুমেদীন বিল্লাহ প্রফেসর জ্যাক সাইমনকে সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে আকস্মিকভাবে আহমদ মুসার সামনে ঝুঁকে পড়ে আহমদ মুসার দু’পায়ে দুই হাত দিয়ে বলল, আপনার পদধুলি গ্রহন করলাম দুই আনন্দে। একটি আ্নন্দ হলো কিংবদন্তী নায়ক আহমদ মুসাকে দেখলাম। অন্যটি হলো, তাঁর সাথে একটা অভিযানে শরিক হওয়ার আনন্দ।’
বলতে বলতে উঠে দঁড়িয়ে বিস্ময় বিমূঢ়তায় স্তব্ধ ফাতিমাদের লক্ষ্য করে বলল, মিঃ যায়েদ ও মিসেস ফাতিমা আসুন পদধুলি নিন, জানেন ইনি কে?
‘আগেই পদধুলি নিয়েছি আমরা।’ বলল যায়েদ।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছি বুমেদীন বিল্লাহ। আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, মিঃ বিল্লাহ অনেক কাজ বাকি। প্রফেসর জ্যাক সাইমন আমাদের কতটা সময় নেবে কে জানে!’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল ফাতিমার দিকে। বলল, ‘তোমরা কি বাইরে থেকে গুলীর আওয়াজ পেয়েছ?
‘গুলীর শব্দ বলে বুঝিনি। তবে এক ধরনের শব্দ পেয়েছি। আহত আজর ওয়াইজম্যানকে পালাতে দেখে বুঝলাম ওগুলো গুলীর শব্দ ছিল।’ বলল যায়েদ।
‘ঘরগুলো ভাল শব্দ প্রুফ। নিশ্চয় বাড়ির বাইরে কোন শব্দ যায়নি। ‘আহমদ মুসা বলল। তার মুখে খুশি হওয়ার চিহ্ন।
কথাটা বলেই আহমদ মুসা ফিরল প্রফেসর জ্যাক সাইমনের দিকে।
প্রফেসর জ্যাক সাইমন জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসে ছিল।
আহমদ মুসা তার কাছাকাছি হয়ে বলল, ‘প্রফেসর জ্যাক সাইমন আপনি নাম ভাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করেছে?
‘নাম ভাঁড়িয়ে নয়। আমার সার্টিফিকেট নামই জ্যাক সাইমন।’ শুস্ক কন্ঠে বলল জ্যাক সাইমন।
‘কিন্তু আপনার আসল নাম তো ডেভিড দানিয়েল।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলল না প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘খৃস্টান সেজে সারা জীবন গোপনে ইহুদীদের পক্ষে কাজ করে এসেছেন, এভাবে প্রতারণা করেছেন জনগনের সাথে।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখ খুলল না প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘স্পুটনিক ধ্বংস করা, স্পুটনিকের লোকদের কিডন্যাপ করার সাথে আপনি জড়িত।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার কন্ঠ কঠোর।
মুখ নিচু করে ছিল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। চমকে উঠে মুখ তুলল সে। আর্তকন্ঠে বলে উঠল, ‘না আমি এর সাথে জড়িত নয়। আমি পরে জানতে পেরেছি।’
‘আপনার একথা ঠিক নয়। আপনি জড়িত না থাকলে, পরে জানতে পারলে পুলিশকে আপনি এ বিষয় জানান নি কেন? বলল আহমদ মুসা।
কথা বলল না প্রফেসর জ্যাক সাইমন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে।
‘আমি একজন সাংবাদিক নিয়ে স্পুটনিক ধবংস- ঘটনার অনুসন্ধানের ব্যাপারে একটা তথ্য নিতে আপনার কাছে এসেছিলাম, আপনি আমাদের খুন করার জন্যে টেলিফোন করে ক্রিমিনালদের এনেছেন।
‘খুন করার জন্যে নয়, আমি তাদের খবর দিয়েছিলাম মাত্র।’ আর্তকন্ঠে কম্পিত গলায় বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘খুন করার জন্যে নয় তাহলে বন্দী করার জন্যে? বলল আহমদ মুসা।
‘তাও নয়। এসব ঘটবে আমি ভাবতে পারিনি।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। কান্নাজড়িত কন্ঠ তার।
‘তাহলে ঘটাল কে? আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা এসব ঘটাবে বুঝিনি।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। তাঁর কন্ঠে কান্না মিশ্রিত অনুনয়ের সুর।
‘তাহলে এই কাজ আপনি সমর্থন করেন না? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘না সমর্থন করি না। ‘কন্ঠে শক্তি এনে বলার চেষ্টা করল প্রফেসার জ্যাক সাইমন।
‘আপনি কি স্পুটনিক ধবংস সমর্থন করেন? স্পুটনিকের ৭ জনকে কিডন্যাপ করা সমর্থন করেন? আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘না সমর্থন করি না।’ দৃঢ় কন্ঠে বলল প্রফেসার জ্যাক সাইমন।
‘তাহলে তাদের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য করা আপনার কর্তব্য নয়? আহমদ মুসা বলল।
মাথা নিচু করল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। কোন উত্তর দিল না।
‘তাহলে ওদের অন্যায়কেই সহযোগিতা করবেন? বলল আহমদ মুসা কঠোর কন্ঠে।
‘ওদের সাহায্য না করলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ‘বলে কেঁদে উঠল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। একটু থামল। থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘জানেনা ওরা স্বজাতি হলেও শত্রুর চেয়েও বড় শত্রু। ওরা যে সহযোগিতা চাইবে, সে সহযোগিতা না দেয়ার অর্থ মৃত্যুকে আলিংগন করা। আমি একজন ধর্ম প্রান ইহুদী ছিলাম। ইহুদীবাদীদের সমর্থন করতাম না। কিন্তু প্রাণের ভয়ে বাধ্য হয়েছি তাদের সহযোগিতা করতে এবং যখন যা চায় সেই পরিমাণ অর্থ সাহায্যও করতে হয়। আরও জানেন না, ইহুদীরা আজ ইহুদীবাদীদের কেনা গোলাম। ইসরাইল রাষ্ট্রের নাগরিক না হয়েও ইসরাইলের নাগরিকদের চেয়েও দ্বিগুন ট্যাক্স আমাদের দিতে হয় ইসরাইল রাষ্টকে। আমার সামনের যে নেমপ্লেট ওটা ওদের সরবরাহ করা। আমি টাঙাতে বাধ্য হয়েছি। এ রকম বাধ্য লোকের সংখ্যা ওদের লাখ লাখ।
‘আপনার কথা আমি বিশ্বাস করলাম। আমাদেরকে আপনি সাহায্য করুন। আমরা আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেব।’ বলল আহমদ মুসা।
উদ্বেগ ফুটে উঠল প্রফেসর জ্যাক সাইমনের চোখে- মুখে। বলল, ‘কি সাহায্য ?
‘আপাতত আমরা জানতে চাই, ‘সাও তোরাহ দ্বীপটা কোথায়?
প্রফেসর জ্যাক সাইমন কম্পিত কন্ঠে বলল, ‘আপনারা এ বিষয়টা জানলেই ওরা নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, তথ্যটা আমিই আপনাদের দিয়েছি। তখন দুনিয়ার কোথাও গিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। যেখানে যাব সেখানে গিয়েই ওরা আমাকে হত্যা করবে। আর্তকন্ঠে বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘এ ভয় আপনাকে করতে হবে না। এ বাড়িতে থাকা আপনার ঠিক হবে না। আপনি এখন আজর ওয়াইজম্যানকে টেলিফোন করুন। বলুন যে, বাড়ি থেকে আমি পালিয়ে এসেছি। ফ্রান্সের বাইরে চলে যাচ্ছি, আহমদ মুসাদের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাকে কিছু দিন আত্মগোপনে করতে হবে। এই কথা সে জানার পর আপনাকে দোষ দিতে পারবে না কোন মতেই।’ বলল আহমদ মুসা।
প্রফেসর জ্যাক সাইমনের মুখ উজ্জল হয়ে উঠল আনন্দে। কৌশলটি তার খুব পছন্দ হয়েছে বলে মনে হলো। বলল, ‘কিন্তু আমি থাকব কোথায়?
‘প্যারিসেই থাকবেন। আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব। আপনার নিরাপত্তার দিকটা আমাদের লোকেরাই দেখবে। ‘আহমদ মুসা বলল। ‘ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ যে, আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন। ‘বলে একটু থামল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। তারপর বলল আবার, ‘আমি আপনার অনেক কথা শুনেছি। সাম্প্রতিক আমেরিকার ঘটনাও আমি জানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদীবাদকে নির্মূল করার ব্যাবস্থা আপনি করেছেন। যদি এভাবে গোটা বিশ্বের ইহুদীদেরকে আপনি ইহুদীবাদের অক্টোপাশ থেকে মুক্ত করতে পারতেন, তাহলে তাদের দোয়া আপনি পেতেন।’ আবেগে কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল। প্রফেসর জ্যাক সাইমনের।
‘ধন্যবাদ প্রফেসর জ্যাক সাইমন। ইহুদীবাদের পাপই ইহুদীবাদকে ধবংস করবে। কিন্তু আমার একটা ধারনা ছিল, অধিকাংশ ইহুদী ইসরাইল রাষ্ট্রকে সমর্থন করে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এক সময় করত। যতদিন ইসরাইল শান্তি কামনা করেছে, আরবদের উপর হাত তোলেনি ততদিন সব ইহুদীই ইসরাইলকে সমর্থন করেছে। তারা কামনা করেছে আরবরা এবং অন্য সবাই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে শান্তিতে থাকার ব্যাবস্থা করুক। কিন্তু পরে যখন ইসরাইল শক্তি নির্ভর হয়ে উঠল, অন্যের ভূখন্ড দখল করে নিতে শুরু করল এবং ফিলিস্তিনে ইহুদী বসতি বাড়ানোর অব্যাহত প্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে চলল, তখন থেকেই বিশ্বের শান্তিকামী ইহুদীরা বুঝে নিয়েছে শান্তি ইসরাইল ও ইহুদীবাদীদের লক্ষ্য নয় তারা এক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে যা জ্বালিয়ে রাখবে এক অশান্তির আগুন। ধর্মপ্রাণ ইহুদীরা ইসরাইলকে আজ তাদের জন্যে বিপজ্জনক মনে করছে।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
বলে একটা দম নিল। সোফায় একটু হেলান দিল। তারপর বলল, ‘নতুন গুলাগ বা সাও তোরাহ দ্বীপের কথা আপনি জিজ্ঞেস করেছেন।’ দ্বীপটা কোন মানচিত্রে নেই। পর্তুগাল থেকে ৮০০ মাইল পশ্চিমে ৩৮ ডিগ্রী নর্থ ল্যাটিচুডের উপর আটলান্টিকের ‘আজোরস’ দ্বীপপুঞ্জ। এ দ্বীপপুঞ্জ থেকে সোয়া’শ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ক্ষুদ্র ফ্লোরেস দ্বীপপুঞ্জ। ফ্লোরেস দ্বীপপুঞ্জের মাথার উপর ‘করভো’ নামে একাটা দ্বীপ। করভো দ্বীপের ৫ মাইল সোজা উত্তরে ৩০ ডিগ্রী পশ্চিম ল্যাটিচুডের ৫০ মাইল পশ্চিমে ছোট্ট বেনামা নির্জন একটা দ্বীপ। এটাই ‘নিউ গুলাগ’। নাম রাখা হয়েছে ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপ।’ থামল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
খুশিতে মুখ উজ্জল হয়ে উঠছে আহমদ মুসার মুখ। বলল, ধন্যবাদ প্রফেসর জ্যাক সাইমন। সাও তোরাহ দ্বীপকে আপনি নির্জন বলছেন। ওখানে কোন মানুষই বাস করে না। ‘না’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। ‘তাহলে গোটা দ্বীপে বন্দীরা এবং তাদের পাহারাদাররাই শুধু বাসিন্দা। ‘আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ তাই। আসলে গোটা দ্বীপ পাহাড়ের টিলায় ভর্তি। প্রায় সমগ্র উপুকুল জুড়ে কোথাও খাড়া পাহাড়ের দেয়াল, কিছু কিছু সমতল উপকূল ভূমিও রয়েছে। সব মিলিয়ে দ্বীপটা সাধারণ ভাবে বাসযোগ্য নয়।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘সেখানে কি বন্দীখানা গড়া হয়েছে, না গোটা দ্বীপকেই বন্দীখানা বানানো হয়েছে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘স্যরি। এ সম্পর্কে তারা কোন সময়ই আমার সামনে কোন আলোচনা করেনি এবং আমিও জিজ্ঞাসা করিনি।’ বলল প্রফেসর সাইমন।
ধন্যবাদ প্রফেসর। চলুন আমরা এখন উঠি। এখনি আমাদের চলে যাওয়া উচিত, গাড়িতে শুইয়ে নিয়ে যাব আপনাকে, কেউ টের পাবে না, বাইরে গিয়ে আজর ওয়াইজম্যানকে টেলিফোন করবেন। আজকের মধ্যেই আমরা আপনাকে প্যারিস পৌছাবো।’
‘এ লাশগুলোর কি হবে এবং আমার বাড়ির? জিজ্ঞাসা করল প্রফেসর সাইমন।
‘লাশগুলো গুম করার ব্যাবস্থা আমরা করছি। আর আপনার বাড়িটা আপাতত তালাবদ্ধ থাকবে। আপনার পালিয়ে যাওয়া লোকজন নিশ্চয় ফিরবে না আপনি না ফিরা পর্যন্ত। আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে।’ বলে সায় দিল প্রফেসর সাইমন। সবাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
প্রফেসর সাইমন, ফাতিমা ও যায়েদকে তাদের গাড়িতে তুলে নিল।
গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা মোবাইল বের করল টেলিফোন করার জন্যে। সেদিন ফাতিমা-যায়েদের বিয়েতে গিয়ে মুসলিম সেচ্ছাসেবী একটা গ্রুপের সাথে পরিচিতি হয়েছিল, যাদের সাথে ‘সাইমুমে’র সম্পর্ক আছে বলে তারা জানিয়েছিল। তাদের নাম্বারেই টেলিফোন করতে লাগল আহমদ মুসা।
উত্তেজনায় মিসেস লতিফা কামালের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বলছিল সে, আমার গয়না আছে ব্যাংকের লকারে। সে জন্যই লকার খুলতে গিয়েছিলাম। গত ছয়মাসের মধ্যে লকার খুলিনি। শুধুমাত্র কামাল ও আমিই এই লকার খুলতে পারি। গত ছয়মাসে কামালেই কয়েকবার লকার খুলেছে। আমার যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
বলে একটু দম নিয়ে আবার শুরু করল মিসেস লতিফা কামাল, আজ গিয়ে লকার খুলে গহনা অন্যান্য ফ্যামিলী ডকুমেনেটর সাথে ছোট ও সুদৃশ্য একটা প্লাস্টিক ব্যাগ দেখতে পেলাম। দেখে বিস্মিত হলাম এ ধরনের ব্যাগ আমাদের লকারে ছিল না। তাহলে কি কামাল পরে রেখেছে?
মনে প্রশ্ন জাগায় নতুন ব্যাগটাই প্রথমে খুললাম। খুলে দেখলাম ব্যাগে রয়েছে কতগুলো কাগজ পত্র এবং তার সাথে ডজন খানেকর মত ডিস্ক। আমি একটা কাগজ হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলালাম। দেখলাম, ওটা স্পুটনিকের একটা অনুসন্ধান রিপোর্ট। আরেকটা কাগজেও দেখলাম তাই। বুঝলাম কাগজপত্র ও ডিস্ক সবগুলোই স্পুটনিক সম্পর্কিত। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো, এই ডকুমেন্টগুলোই শয়তানরা খুঁজছে। এগুলোর সন্ধানেই তারা আমাদের বাড়ি এবং আত্মী-স্বজনের বাড়ি পর্যন্ত তছনছ করেছে। ভয়ে আমি কাঁপতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি ব্যাগ বন্ধ করে লকার লক করে আমি চলে এসেছি।’ থামল মিসেস লতিফা কামাল।
লতিফার পাশেই বসে ফাতিমা। তাদের সামনের সোফায় পাশা-পাশি বসে আহমদ মুসা ও যায়েদ।
আহমদ মুসার চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জল হয়ে উঠেছে। বলল আহমদ মুসা দ্রুতকন্ঠে, ‘ওটা কোন ব্যাংকে?
‘আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক।’ মিসেস লতিফা কামাল বলল। ‘গুড। ম্যানেজার কে জানেন? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘জি। মিঃ কার্টার জুনিয়র।’ বলল মিসেস কামাল।
‘মিঃ জন কার্টার জুনিয়র? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘জি, পুরো নাম মি. জন র্কাটার জুনিয়র।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। লোকটা ভাল। এর আগে তিনি একবার প্যারিসে ছিলেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, লকারের খোঁজ কিন্তু ওরা পেয়ে যাবে। সরিয়ে নেয়াই কি নিরাপদ নয়? বলল ফাতিমা।
‘কিন্তু আমি মনে করি, লকারটাই এখন বেশি নিরাপদ। আমেরিকান ব্যাংকের সিস্টেম ভাল। তার উপর ম্যানেজার খুব ভাল লোক। তার উপর ইহুদীদের কোন চাপ পড়বে না। আমাদের কোন বাড়িই এখন নিরাপদ নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ডুপ্লিকেট করে এক সেট অন্য কোথাও রাখলে ভালো হয় না।’ বলল যায়েদ।
‘তা করা যায়। কিন্তু ডকুমেন্ট নিয়ে আমাদের কেউ মুভ করা ঠিক হবে কিনা ভাব বার বিষয়। তবে সুযোগ পেলে ডুপ্লিকিট করা যায়। ঠিক আছে, দেখা যাক অবস্থা কি দাঁড়ায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যাই হোক, ডকুমেন্টগুলো আপনার একবার পড়া প্রয়োজন।’ বলল ফাতিমা।
‘এখন এ দিক চিন্তা করছি না ফাতিমা। এখন প্রথম কাজ গুলাগ অভিযান, কামাল সুলাইমানদের উদ্ধার। এরপর শুরু হবে ইনশাআল্লাহ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য উদ্ধার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে ডকুমেন্টগুলো লকারেই থাকছে? প্রশ্ন করল মিসেস কামাল।
‘হ্যাঁ। ডুপ্লিকেট যদি করা যায়, সেটা বাইরে রাখা যাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে। তাই হবে মি. আহমদ মুসা।’ বলল মিসেস কামাল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময়ে যায়েদ ফিরে এল। সে বারান্দায় উঠে গিয়েছিল। এসে আহমদ মুসাকে বলল, ‘ভাইয়া একটা ট্যাক্সি এদিকে মুখ করে সেই আপনি আসার সময় থেকে দাঁড়িয়ে আছে।
‘ঠিক আছে আমি উঠছি। দেখবো আমি। তোমরা পরে যাবে।
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আসি মিসেস কামাল।’
‘ভাইয়া প্রফেসর সাইমন কি প্যারিসে পৌছেছে?’ বলল ফাতিমা।
‘হ্যাঁ, বুমেদীন বিল্লাহ পৌছে টেলিফোন করেছিল।’
বলে আহমদ মুসা হাতের ব্যাগটা তুলে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।
কিছুক্ষন পরে বেরিয়ে এল কাঁচা-পাকা দাড়ি-চুলওয়ালা প্রৌঢ় সেজে।
পরনে ফুলপ্যান্ট জ্যাকেটের পরিবর্তে লুজ সার্ট ও ট্রাউজার।
যায়েদরা সবাই হেসে উঠল। মিসেস কামাল বলল, আমার আগে জানা না থাকলে আমারই চিৎকার করে ওঠার দশা হত।
‘ধন্যবাদ সকলকে। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ধীরে ধীরে এগুলো ট্যাক্সিটার দিকে।
নিকটবর্তী হলো সে ট্যাক্সিটার।
ট্যাক্সি ড্রাইভার লোকটি গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটকে ইজি চেয়ারে পরিনত করে মিসেস কামালের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বসেছিল। প্রৌঢ় বয়সী আহমদ মুসার দিকে তাকাবার প্রয়োজনই বোধ করেনি লোকটা।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে চলে এসেছে।
হঠাৎ একটা কুকুর লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে প্রচন্ড গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
ঘটনাটি আহমদ মুসার জন্য অকল্পনীয় ছিল।
শেষ মূহুর্তে আহমদ মুসা তার মাথা লক্ষ্যে ছুটে আসা কুকুরকে মাথার কাপড় ধরা দেয়ার জন্যে বাম বাহুকে লাঠির মত শক্ত করে সামনে বাড়িয়ে দিল এবং ডান হাতটি প্রবেশ করল পকেটে রিভলবার বের করার জন্যে।
উড়ে আসা চলন্ত কুকুর হাতের সাথে ধাক্কা খেয়ে হাতটা কামড়ে মাটিতে পড়ে গেল। বাহুর যেটুকু অংশ কুকুরটি কামড়ে ধরেছিল তা ছিঁড়ে নিয়ে গেল।
আহমদ মুসার ডান হাত তখন বেরিয়ে এসেছে রিভলবার নিয়ে।
মাটিতে পড়ে যাওয়ার সংগে সংগেই আবার কুকুরটি উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং নতুন করে আক্রমনের জন্য সামনের দু’পা উপরে তুলে পেছনের দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসার ডান হাতের তর্জনি ট্রিগার টিপতে একটুও দেরী করেনি। বুলেট ছুটে গিয়ে কুকুরটির বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
কুকুরটির দেহটা উল্টে আছড়ে পড়ে গেল মাটিতে।
আহমদ মুসা গুলী করেই তাকাল গাড়ির সিটে বসা লোকটির দিকে। দেখল, লোকটির ডান হাত বেড়িয়ে আসছে কোটের পকেট থেকে। হাতে রিভলবার।
আহমদ মুসা চোখ লোকটির দিকে ঘুরে যাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার হাতের রিভলবারও ঘুরে গিয়েছিল লোকটির দিকে।
আহমদ মসার তর্জনি চেপে বসল রিভলবারের ট্রিগারে। একটা গুলী ছুটে গিয়ে কুকুরটির মতই এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল লোকটি বুক।
গাড়ির দরজা খোলাই ছিল।
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে টেনে সিট থেকে মাটিতে নামিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল আহমদ মুসা।
দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বের করে বাম বাহুর রক্তক্ষরণরত আহত স্থানটা ডান হাত ও দাঁতের সাহায্যে বেঁধে গাড়ি স্টাট দিল।
চারিদিকে চেয়ে দেখল আশে-পাশে কেউ নেই। রাস্তার বাম পাশে দু’তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দু’জন লোক এদিকে তাকিয়ে আছে। আর সামনে রাস্তার ডান পাশে মিসেস লতিফা কামালের বাড়ির ব্যালকনিতে ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
আহমদ মুসা খুশি হলো। অল্পক্ষনের মধ্যেই এখানে পুলিশ আসবে এবং খোজ-খবর নিয়ে জানতে পারবে যে, একজন দাড়িওয়ালা প্রৌঢ় লোককে একটি কুকুর আক্রমন করে কামড়ে ধরেছিলো। লোকটি কুকুর ও কুকুরের মালিক গাড়িওয়ালাকে হত্যা করে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেছে।
আনন্দিত হবার সাথে সাথে চিন্তিতও হলো সে। আহমদ মুসার কোন সন্দেহ নেই যে, কুকুরটিকে শিখিয়ে পড়িয়ে আনা হয়েছিল আহমদ মুসাকে ধরার জন্যেই এবং কুকুর তাকে ঠিকেই চিনেছিল। আজর ওয়াইজম্যানরা যে সাংঘাতিক বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আহমদ মুসাকে ধরার জন্যে কুকুরের ব্যাবহার এরই একটা প্রমাণ। এই ঘটনার তার গায়ে আরও আগুন ধরবে। মিসেস লতিফা কামালের এ বাড়িটা ছেড়ে দেয়া দরকার, ভাবল আহমদ মুসা। হিংসায় অন্ধ হয়ে আজর ওয়াইজম্যানরা কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
এক সময় গাড়ির স্টিয়ারিং হুইললের নীচে তাকাতেই একটা মানিব্যাগ চোখে পড়ল আহমদ মুসার। ভাবল, গুলীতে যে মারা গেছে মানিব্যাগটা সে লোকের হতে পারে। মানিব্যাগটা তুলে নিলো আহমদ মুসা।
মানিব্যাগে দেখল কয়েকশ ডলারের নোট, ২টি নেম কার্ড এবং একটি চিঠি পর্তুগীজ ভাষায়। পর্তুগীজ ভাষা আহমদ মুসা জানে না বিধায় চিঠির সে কিছুই বুঝতে পারল না। কার্ডের দিকে মনোযোগ দিল। চমকে উঠল আহমদ মুসা। কার্ডটিতে ঠিকানার বটমে লেখা রয়েছে ‘আজোরস দ্বীপপুঞ্জ’। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের নাম পড়েই কার্ডের অবশিষ্টটুকু গোগ্রাসে পড়ল আহমদ মুসা। কার্ডের নামটি হলো, ‘এ্যানটিনিও সোরেস।’ পরিচয় হিসাবে লেখা ‘ব্যাবসায়ী ও সমাজকর্মী’। আর ঠিকানা, ‘১১, গনজালো রোড, হরতা, সাও জর্জ, আজোরস। আকাশের চাঁদ হতে পাওয়ার মতই খুশি হলো আহমদ মুসা। ঠিকানা পেয়ে। চিঠি দিয়ে কার্ডটা মুড়িয়ে কার্ডটা পকেটে রেখে দিতে দিতে আহমদ মুসা ভাবল, প্রথম সুযোগেই চিঠিটা কারও কাছ থেকে পড়ে নিতে হবে। এই চিন্তার রেশ ধরেই আহমদ মুসা ভাবতে লাগল, কে এই এ্যনটিনিও? চিঠিটাও তার হবার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু এসব এই সন্ত্রাসীর কাছে কেন? এ্যনটিনিও কি এদের দলের? এমন হাজারো চিন্তা এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে। গাড়ি চলছে আহমদ মুসার। ফোটা ফোটা রক্ত ঝরছে আহমদ মুসার আহত বাম বাহু থেকে।
৭
আন্তর্জাতিক পুলিশ ইন্টারপোলে’র ইউরোপীয় সদর দফতর প্যারিসে ইউরোপীয় ‘ইন্টারপোল’ বৈঠক। এ বৈঠকে ইন্টারপোলের ইউরোপীয় কমিটি ছাড়াও ফ্রান্স সহ কয়েকটি দেশের পুালশ প্রধানও হাজির।
বৈঠকে স্বাগতিক দেশের পুলিশ প্রধান মিঃ মিতেরাঁ তার স্বাগতিক বক্ত্যবে এজেন্ডার উপর ব্রিফিং দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘ইন্টারপোলকে ধন্যবাদ যে, আমাদের আবেদনে বিশেষ এক এজেন্ডার উপর আলোচনা করতে রাজি হয়েছে।’
এজেন্ডার বিষয়ে আমার প্রথমিক বক্তব্য হলো, আপনারাও কিছুটা হলেও স্ট্রাসবার্গের দুটি ঘটনা সম্পর্কে জেনেছেন। এ দুই ঘটনার একটি ঘটনা ঘটে গেছে, আরেকটি ঘটতে চলছে। কিছুদিন আগে ইউরোপের বিখ্যাত একটা অনুসন্ধানী সংস্থা স্পুটনিককে সমূলে ধবংস করা হয়েছে এবং এর ৭ জন কর্মকর্তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতই নিপুন ভাবে কাজটা করা হয়েছে যে, কোন ক্লুই পাওয়া যায়নি সামনে এগুবার। তার ফলেই গত কয়েক মাসে এর তদন্তে কোন অগ্রগতি হয়নি। কিন্তু গত এক পক্ষকালে ঐ স্ট্রাসবার্গেই কিছু ঘটনা ঘটেছে যার সাথে স্পুটনিক ধবংসের ঘটনা সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। স্ট্রাসবার্গের শার্লেম্যান রোডের ৫ নং বাড়ি থেকে ১৪টি লাশ ও দু’টি কম্পিউটার পাওয়া গেছে। এ সম্পকির্ত খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আপনারা দেখেছেন। তবে রিপোর্টে অনেক কিছুই ছাপা হয়নি।
ঐ রিপোর্ট ও আমাদের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’ নামে একটা ইহুদী সংস্থা সুপরিকল্পিতভাবে স্পুটনিক ধ্বংসের ঘটনা ঘটিয়েছে এবং কম্পিউটার থেকে আরও তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।’ থামল ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান।
পুলিশ প্রধান থামতেই ইন্টারপোলের প্রধান জর্জ জ্যাকব বিরক্তির স্বরে বলে উঠল, মিঃ মিতেরাঁ কম্পিউটার থেকে পাওয়া কোন তথ্য দলিল নয়। কম্পিউটারে যে কেউ যে কোন জিনিস ঢুকিয়ে দিতে পারে।
আপনি বলুন, স্ট্রাবার্গে এ পর্যন্ত দেড় ডজনের ও বেশি লোক খুন হয়েছে। এই খুনগুলো কে করলো? যারা এই খুনগুলো করতে পারে, তারা কম্পিউটারে কোন তথ্য ঢুকিয়ে দিতে পারে।’
‘মি.জ্যাকব, যারা খুন হয়েছে তারা সকলেই এক দলের লোক এবং এরা আক্রমনকারী হিসাবে খুন হয়েছে।’ বলল ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান।
‘কাকে এবং কেন তারা আক্রমন করতে গিয়েছিল? যাকে তারা আক্রমন করতে গিয়েছিল সেই কালপ্রিটকে আপনারা বের করার কি চেষ্টা করেছেন? সে কি করছে ফ্রান্সে, তা কি সন্ধান করেছেন? মাফ করবেন, আমার মনে হয় ফ্রান্সের পুলিশের মধ্যে নাজী পন্থী না হলেও এ্যান্টি সেমেটিক প্রবনতার বিস্তার ঘটেছে।’ বলল ইনটারপোলের প্রধান স্পষ্ট ও দৃঢ় কন্ঠে।
ফ্রান্সের পুলিশ প্রধানের মিতেরাঁর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘সব জাতির মধ্যেই ক্রিমিনাল আছে, ক্রিমিনাল গ্রুপ আছে। তেমনি ইহুদীবাদীদের মধ্যেও ক্রিমিনাল গ্রুপ থাকতে পারে। কিন্তু তারা কোন অপরাধে জড়িত হবার ঘটনা ঘটলেই একথা বলা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে যে, এটা এ্যান্টি -সেমেটিকদের ষড়যন্ত্র। আপনাদের সবার কাছে ফাইল দেয়া হয়েছে। ফাইলই সুস্পষ্টভাবে প্রমান করছে, ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি বিরুদ্ধে অভিযোগ এ্যান্টি সেমেটিক কোন ষড়যন্ত্র নয়।’ থামল মিতেরাঁ।
সংগে সংগেই বলে উঠল ইন্টারপোলের প্রধান জ্যাকব, ‘ফাইল দেখেছি। প্রমাণগুলো সবই অবস্থাগত এবং কম্পিউটার রেকর্ড ভিত্তিক। যারা মারা গেছে, তারা সবাই একদলের বলা হচ্ছে এবং রেসিয়াল টেষ্টেও প্রমান করছে তারা সবাই ইহুদী। সবগুলো হত্যাকান্ড ঘটেছে আহমদ মুসার দ্বারা, সেটা যে পরিস্থিতিতেই হোক। প্রতিপক্ষ এখানে আহমদ মুসা। নিছক কম্পিউটারে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্ট্রাসবার্গের সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনাকে স্পুটনিকের সাথে জুড়ে দেয়া ঠিক হবে না। বিষয়টাকে আহমদ মুসার সাথে সংঘাত হিসাবে দেখতে হবে।’
ইন্টারপোল প্রধান জ্যাকব থামতেই বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই এক সাথে বলে উঠল, ‘সন্দেহাতীত আরও প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত মাঝামাঝি এই সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত হবে।’
সংগে সংগেই ফরাসী পুলিশ প্রধান বলে উঠল, ‘আমি দুঃখিত যে, আপনাদের এই মতের সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। ফরাসী পুলিশ মনে করে, স্পুটনিকের ঘটনার সাথে স্ট্রাসবার্গের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো গভীর ভাবে সম্পর্কিত। স্পুটনিকের অপহৃতদের আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকেই আহমদ মুসা স্পুটনিক ধবংসের ঘটনা নিয়ে কাজ করছে। সুতরাং আহমদ মুসার সাথে ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীর সংঘাতকে বিচ্ছিন্ন বলে চলাবার কোন যুক্তি নেই। তাছাড়া আহমদ মুসা কাজ শুরু করার পর স্পুটনিকের ঘটনায় অপহৃত ৭ জনের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সবার বাসা তছনছ হয়েছে। আহমদ মুসার উপর বার বার আক্রমনকারী ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীই যে এই তছনছের কাজ করেছে এতে আমাদের পুলিশের কোন সন্দেহ নেই। স্পুটনিকের সাথে সম্পর্কিত লোকদের বাসাবাড়ির উপর তারা চোখ রাখছে এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। সর্বশেষ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে স্পুটনিকের প্রধান গোয়েন্দা কামাল সুলাইমানের বাড়ির সামনে। প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য অনুসারে কামাল সুলাইমানের বাড়ি থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলে তার উপর আক্রমন চালানো হয়। কিন্তু সংঘর্ষে আক্রমনকারী লোকটি এবং তার কুকুর মারা যায়। যে লোকটি মারা যায় সে ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীর সদস্য। সুতরাং আহমদ মুসাকে এবং স্ট্রাবার্গের সাম্প্রতিক ঘটনাকে স্পুটনিকের ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এই বাস্তবতাকেই যদি ইন্টারপোল অস্বীকার করে তাহলে তাদের সাহায্য আমরা পাব কি করে? আমরা ইন্টারপোলের সাহায্য এই জন্যই চেয়েছিলাম যে, স্পুটনিক যারা ধবংস করেছে এবং এর লোকদের যারা কিডন্যাপ করেছে, তারা ফ্রান্সে সীমাবদ্ধ নয়। আমদের নিশ্চিত বিশ্বাস স্পুটনিকের লোকদের আটকেও রেখেছে ফ্রান্সের বাইরে। এদিক থেকেই ইন্টারপোলের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন ছিলো।’ বলল ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান মিঃ মিতেরাঁ।
ইন্টারপোলের বৃটিশ প্রতিনিধি মিঃ উইলসন বলল, ‘আমি মিঃ মিতেরাঁর যুক্তিকে সমর্থন করছি। স্পুটনিক ও স্ট্রাবার্গের সাম্প্রতিক ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। ফ্রান্সকে এই ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্যও করা উচিত। তবে একটা কথা। ফ্রান্সের জামাই আহমদ মুসার প্রতি ফ্রান্সের দুর্বলতার অর্থ আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু ইহুদীদের প্রতি মিতেরাঁ এত কঠোর হয়ে উঠলেন কেন?
আবার মিতেরাঁ বলে উঠল, ‘স্পুটনিকের মত কোন কিছু ধবংসের ঘটনা যদি ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মী বৃটেনে ঘটাত, তাহলে মিঃ উইলসন আমার চেয়েও কঠোর হতেন আমি হলফ করে বলতে পারি।’
এইভাবে আলোচনা চলল।
দীর্ঘ আলোচনার পর বৈঠক তিনটি সিন্ধান্তে উপনীত হলোঃ এক, বিশ্ব মুক্তি সেনা বা ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীকে (WFA) স্ট্রাসবার্গের ঘটনাবলীর জন্য দায়ী বলে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হলো, তবে এই সংস্থাকে ইহুদী সংগঠন হিসাবে প্রকাশ করা হবে না, দুই, ঘটনার সাথে
‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মী’ (WFA) জড়িত থাকা সম্পর্কে ফ্রান্সকে আরও প্রত্যক্ষ প্রমান সংগ্রহ করতে হবে এবং তিন, ইন্টারপোল ফ্রান্সকে সব রকম সহযোগিতা করবে।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাবার সময় মিতেরাঁ, উইলসান এবং জার্মান পুলিশ প্রধান ভন ক্রয়েগার এক সাথে হাঁটছিল। ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান মিতেরাঁ বলল, ‘ইহুদীবাদীদের এ ধরনের পাপকে আর কতদিন আমরা ঢেকে রাখব? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিশেষ করে বিজ্ঞানী জন জ্যাকব ও জেনারেলে শ্যারণদের অপকীর্তি থেকে কি আমরা শিক্ষা গ্রহন করবো না?
বৃটিশ পুলিশ প্রধান জর্জ উইলসনের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘মিটিং এ অনেক সময়েই পোষাকী কথা বলতে হয়। কিন্তু ফ্যক্ট হলো আমাদের প্রশ্রয় কিন্তু ইহুদীদের আরও ক্রিমিনাল বানাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তাদেরই ক্ষতি করছি আমরা।’
উইলসন থামতেই ভন ক্রয়েগার বলে উঠল, ‘এর পরিনতি হতে পারে ভয়ংকর। ‘নাজী’রা হয়তো কোনদিনই আর ফিরবে না। কিন্তু ‘নাজী’দের ভাইয়েরা তো ফিরতে পারে।’
‘সাংঘাতিক কথা বলছেন মিঃ ক্রয়েগার।’ বলে উঠল জর্জ উইলসন।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ভন ক্রয়েগার। কিন্তু বলা হলো না ইনটারপোল প্রধান মিঃ জন জ্যাকব তাদের মধ্যে এসে পড়ায়।
কথার প্রসংগ পাল্টাল ভন ক্রয়েগার।
হাঁটতে লাগল চারজন।
টেলিফোন ধরে ওপারের কথা শুনেই চমকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফাতিমা। বলল, এক্সেলেন্সি, প্লিজ হোল্ড করুন। উনি আছেন, ওনাকে দিচ্ছি আমি।
বলে ফাতিমা মহাব্যস্ত হয়ে টেলিফোটা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভাইয়া ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের টেলিফোন।’
হাঁ ফাতিমা গলা শুনেই বুঝতে পেরেছি।’ বলে আহমদ মুসা টেলিফোন সেট সামনে টেনে নিল। আহমদ মুসা সালাম দিয়ে কথা বলা শুরু করল। বলল, ‘মাহমুদ কেমন আছ?’
‘ভাল ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? কতদিন পর আপনার সাথে কথা বলছি।’ ওপার থেকে বলল ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ।
‘তুমি খুব ব্যাস্ত, তা আমি জানি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার প্রতি অবিচার করবেন না ভাইয়া। আমার কিছু ব্যাস্ততা আছে এ কথা ঠিক, কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাওয়াই আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়।’ বলল মাহমুদ।
‘তুমি ঠিক বলেছ মাহমুদ। অবস্থার কারণে সব খবর তোমাদের আমি সব সময় জানাতে পারি না। যাক, এসব কথা। তোমার স্ত্রী এমিলিয়ার কাছে সব শুনেছি। এখন বল, হাসান তারিক কোথায়? বলল আহমদ মুসা।
‘আমার পাশে বসে আছে ভাইয়া। তাকে টেলিফোন দেব, তার আগে বলুন, আপনার ডাক পাবার এই সৌভাগ্য হাসান তারিকের কেন হলো? বলল মাহমুদ।
‘এটা সৌভাগ্য নয় মাহমুদ, দুর্ভাগ্য। কঠিন এক অভিজানে ওকে সাথী করতে চাচ্ছি। কিছু দিনের জন্য ওকে সকল সুখ কোরবানি দিতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোরবানির সুযোগ তো মুসলমানদের জন্য সৌভাগ্যের ভাইয়া? বলল মাহমুদ।
‘এটা হাসান তারিকই বলুক।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
পরক্ষণেই টেলিফোনে হাসান তারিকের কন্ঠ শোনা গেল। বলল ‘আমার উপর আপনার এই রাগের কারন কি ভাইয়া?’
‘রাগ কোথায় দেখলে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই যে আপনি বললেন কোরবানী আমি দিতে পারব কিনা তা আমাকেই বলতে হবে। এটা তো অনাস্থা অথবা রাগের কথা ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা হাসল। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।
বলল, ‘হাসান তারিক তোমার উপর খুব রাগ, খুব অবিশ্বাস তো, তাই কঠিন এক অভিযানে সাথি হবার জন্যে তোমাকেই স্মরণ করছি।’
‘আমার সৌভাগ্য ভাইয়া যে, আপনি আমাকে এত ভালবাসেন।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল হাসান তারিক।
‘তোমার আবেগ দেখি আগের মতই আছে। মুছে ফেল চোখের পানি। বল, আয়েশা আলিয়েভা কেমন আছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাল। আমি যাচ্ছি শুনলে সে কিন্তু পিছু নেবে। আপনার হুকুমই শুধু তাকে থামাতে পারে। ‘হাসান তারিক বলল।
‘সে আমি দেখব। তুমি তৈরী হও আসার জন্য।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শোনা কি যাবে অভিযানটা কোথায়? বলল হাসান তারিক।
‘বলা গেলে শুরুতেই বলতাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘ধন্যবাদ হাসান তারিক। এখন রাখি।’ বলে, সালাম দিয়ে আহমদ মুসা টেলিফোটা রেখে দিল।
ড্রইংরুমে যায়েদ, ফতিমা ও লতিফা কামাল উদগ্রীব হয়ে শুনছিল আহমদ মুসাদের কথা-বার্তা।
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখতেই ফাতিমা বলে উঠল, ‘আপনি কোন অভিযানে মানে কোথাও যাচ্ছেন ভাইয়া?
আহমদম মুসা তাকাল যায়েদ ও ফাতিমার দিকে। বলল, ‘হ্যাঁ বোন এবার যেতে হবে ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপে।’
মলিন হয়ে উঠল যায়েদ, ফাতিমা ও লতিফা কামালের মুখ। ফাতিমাই আবার বলল, সেদিন প্রফেসর জ্যাক সাইমনের কাছে সাও তোরাহ দ্বীপের যে পরিচয় শুনেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে ওটা রূপকথার এক দানবীয় দ্বীপ। ওখানে যেতে হলে সৈন্য-সেনাপতি দরকার। আপনি সত্যিই সেখানে যাবেন ভাইয়া? ভারি কন্ঠ ফাতিমার।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘ওটা রূপকথার দ্বীপ নয় ফাতিমা, আটলান্টিকের বুকের এক বাস্তব সত্য। আর ওটা দানবীয় দ্বীপ নয়, আমার অনুমান সত্য হলে ওটা কিছু অমানুষের অক্টোপাশে বাঁধা একটা অশ্রুর দ্বীপ, এক ‘নিউ গুলাগ’। ওখানে যেতে সৈন্য-সেনাপতির দরকার নেই, দরকার শুধু মানুষের প্রতি মমতার অস্ত্র।’
‘আপনি কি নিশ্চিত ভাই সাহেব, ওখানেই কামাল সুলাইমানদের রাখা হয়েছে? বলল মিসেস লতিফা কামাল।
‘কম্পিউটারের ডকুমেন্টগুলো পাওয়ার পর আমি নিশ্চিত হয়েছি, সাও তোরাহ দ্বীপেই বন্দীদের রাখা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই যদি হয়, তাহলে পুলিশ ও সরকারকে বলতে পারি এবং সরকার দ্রুত তাদের উদ্ধারের ব্যাবস্থা করতে পারে।’ বলল লতিফা কামাল।
‘যে কম্পিউটার থেকে আমরা তথ্য পেয়েছি সে কম্পিউটার এখন পুলিশের হাতে। পুলিশ তাদের প্রেস ব্রিফিংকালে সাও তোরাহ দ্বীপের কথা গোপন করেছে। এটা দুই কারণে হতে পারে, এক, কৌশলগত কারণে পুলিশ এটা প্রকাশ করেনি। দুই, পুলিশ উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এই তথ্যটা গায়েব করেছে। আমার যতদুর মনে হচ্ছে পুলিশকে দিয়ে এটা গায়েব করানো হয়েছে। কা্রণ পুলিশ সাও তোরাহ দ্বীপের ব্যাপারে কোন এ্যাকশনে যাবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় সাও তোরাহ দ্বীপের সন্ধান যদি পুলিশকে বা সরকারকে দেয়া হয়, তাহলে এ খবর সংগে সংগেই শত্রুদের কানে পৌছে যাবে এবং শত্রুরা যখনই জানবে, সাও তোরাহ দ্বীপের কথা ফাঁস হয়ে গেছে, সংগে সংগেই বন্দীদেরকে ওরা সাও তোরাহ দ্বীপ থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে পারে, এমনকি হত্যাও করে ফেলতে পারে।’
আহমদ মুসার শেষ কথায় ভীষন কেঁপে উঠেছে মিসেস লতিফা কামাল, ফাতিমা ও যায়েদ। তাদের সবার মুখ পাংশু হয়ে গেছে। মিসেস কামাল আর্তকন্ঠে বলে উঠল, ‘ভাই সাহেব আমি আমার কথা প্রত্যাহার করছি।
সরকার কিংবা পুলিশকে জানানোর দরকার নেই।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তাহলেই দেখুন, আমাদের সেখানে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই।’ আহমদ মুসা থামল।
তিনজনের কেউ কোন কথা বলল না।
কিছুক্ষণ পর যায়েদ ধীরে ধীরে বলল, ‘ভাইয়া আমরা সেখানে যেতে পারি না? আমরা একসাথে যাতে আপনার সংগে কাজ করতে পারি, এ জন্যেই তো আপনি বিয়ে করিয়েছেন।’
‘না যায়েদ, এই অভিযান ফাতিমার জন্য উপযুক্ত নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে তাহলে আমাকে নিন। তাহলে এই অভিযানে স্পুটনিক পরিবারের অংশ গ্রহণও থাকল।
‘না যায়েদ ফাতিমা ও স্পুটনিক পরিবারের সাথে তুমি থাক।’
‘বুঝেছি আমি যোগ্য নই।’
‘অযোগ্যতার কোন প্রশ্ন নেই যায়েদ। হাসান তারিক ছাড়াও ডজন ডজন যোগ্য সহকর্মী আছে যারা ডাক পেলেই ছুটে আসবে। তাদের বাদ দিয়ে আমি হাসান তারিককে নিচ্ছি কেন? নিচ্ছি এই কারণে যে, সে ইহুদীবাদী বিশেষজ্ঞ হওয়া ছাড়াও একজন মেরিন ইঞ্জিয়ার। এই অভিজানে যারা যাবে তাদের এই জ্ঞানের দরকার হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
মাথা নিচু করল। কোন কথা বলল না যায়েদ।
মুখ তুলল মিসেস লতিফা কামাল। বলল, ‘আমি গর্বিত ভাই সাহেব আল্লাহ আপনার মত একজনকে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। আপনাকে আমাদের বুক ভরা কৃতজ্ঞতা ও দোয়া ছাড়া দেবার কিছু নেই।’ শেষে কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল লতিফা কামালের কন্ঠস্বর।
ফাতিমা কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলে উঠল, ‘আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। অনেক্ষণ ধরে নাস্তা টেবিলে অপেক্ষা করছে। চলো উঠি। আমাকে এখনি একটু বাইরে বেরুতে হবে।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সাথে ফাতিমা, যায়েদ ও লতিফা কামালও উঠল।
লিবসন শহরতলীতে অন্ধকার ঘেরা আলোকজ্জ্বল এক বাড়ি। বাড়িটার ড্রইংরুমে বসে আছে লালমুখ দীর্ঘদেহী একজন মানুষ। তার চোখে-মুখে দারুন উত্তেজনা। বেশিক্ষণ সে বসে থাকতে পারছে না। উঠে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে ঘরময়। মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে টেলিফোনের দিকে, আবার ঘড়ির দিকেও। বুঝা যাচ্ছে আকাঙিখত একটা টেলিফোন কল সে পাচ্ছে না, অন্যদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে।
লোকটির নাম মারিও জোসেফ। সে WFA এর লিসবন ষ্টেশন চীফ। সে এই মাত্র ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা সুত্রে খবর পেয়েছে, দু’জন মুসলমান নাম ভাড়িয়ে দুটি পর্তুগীজ পাসপোর্ট জোগার করেছে এবং আজ রাত ১২টার দিকে পর্তুগীজ ইয়ারে আজরস দ্বীপপুঞ্জের ‘লেজে’ এয়ারপোর্ট যাত্রা করছে। কোন নামে পাসপোর্ট কোন নামে টিকিট তার কিছুই জানা যায়নি। এই নাম জানার জন্যেই মারিও জোসেফ পাগল হয়ে উঠেছে। নাম জানলে তবেই তাদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়া আটকানো যাবে।
ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন মুসলমানকেই আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যেতে দেয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তের পর অনেকের যাত্রা তারা ঠেকিয়েছে। এ বিষয়টা ইতিমধ্যে মুসলমানদের মধ্যে জানা জানি হয়ে গেছে। এরপর মুসলমানরা নাম ভাঁড়িয়ে আজোরসে যাবার চেষ্টা করছে। এ ধরনেরই একটা চেষ্টার খবর আজ মারিও জোসেফ পেয়েছে। যে কোন মুল্যে তাকে এদের এই যাত্রা বন্ধ করতে হবে। না পারলে আজর ওয়াইজম্যানের ক্রোধের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে।
টেলিফোন বেজে উঠল মারিও জোসেফের। পায়চারি করছিল মারিও জোসেফ। দাঁড়িয়ে পড়ে দ্রুত গিয়ে টেলিফোনের ভয়েস বোতামে চাপ দিল। সংগে সংগে ওপার থেকে কন্ঠ ভেসে এল, মিঃ মারিও জোসেফ দুঃখিত, বহু চেষ্টা করেও লোক দু’জনের নাম পাওয়া গেল না। তবে এই টুকু জানা গেছে, আজ রাত ১২ টার প্লেনের টিকেট যারা কিনেছে তারা সবাই শ্বেতাংগ তিনজন ছাড়া। একজন তুর্কি চেহারার এশীয় দু’টি টিকিট কিনেছে এবং একজন আফ্রিকান কিনেছে একটি। লিসবনের হোটেল চেক করে আরেকটা বিষয় জানা গেছে, গত সাত দিনে মাত্র তুর্কি চেহারার বা এশীয় দু’জন লিসবনের হোটেলে উঠছে এবং এরা দু’জনেই ভাস্কোডাগামা শেরাটন হোটেলের ৭১১ ও ৭১২ নাম্বার কক্ষে রয়েছেন।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো ওপারের কন্ঠটি। কন্ঠটি লিসবনের একজন শীর্ষ গোয়েন্দা অফিসারের।
‘ধন্যবাদ মি. এ্যানটোনিও। নাম দিতেনা পারলেও যে তথ্য দিয়েছেন, সেটা কম মূল্যবান নয়। আবারও ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
বলে টেলিফোন অফ করে দিল মারিও জোসেফ। তারপর সোফায় সোজা হয়ে বসেই ডাকল, ‘সিলভা।’
কোমরে রিভলবার ঝুলানো ষ্টেনগানধারী একজন ঘরে প্রবেশ করল।
লোকটি প্রবেশ করতেই মারিও জোসেফ বলল, ‘সবাই কে তৈরী হতে বল। দুটি গাড়ি রেডি কর। এখনি যাব ভাস্কোডাগামা শেরাটনে।’ কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাও, আমি তৈরী হয়ে আসছি।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাড়িটা থেকে দুটি গাড়ি বেরিয়ে এল। একটি জীপ, অন্যটি মাইক্রো। গাড়ি দু’টি ছুটছে হোটেল ভাস্কোডাগামা শেরাটন লক্ষ্যে।
হাঁটু ভেঙে দাঁড়ানো তিন বন্দীর খালি গা। পরনে পাতলা কাপড়ের হাফ ট্রাউজার।
বন্দীদের চেহারা বিপর্যস্ত। শরীরে শত নির্যাতনের চিহ্ন।
তিন বন্দীই কাঁপছিল। পা, হাঁটু তাদের দেহের ভার বইতে পারছিল না। কিন্তু বসার উপায় নেই, নিচে তীক্ষ্ণ পেরেক আঁটা চেয়ার। আবার সোজা হয়ে দাঁড়াবারও সুযোগ নেই, মাথার চার ইঞ্চি উপরেই অনুরূপ তীক্ষ্ণ পেরেক আঁটা ইস্পাতের বোর্ড স্থির হয়ে আছে।
‘এই প্রশ্ন তোমরা শতবার করেছ। এ পর্যন্ত শতবারই জবাব দিয়েছি, তোমরা আমাদের স্পুটনিক অফিস পুড়িয়ে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছ।’ কান্নায় ভেঙে পড়া কন্ঠে বলল তিন বন্দীর মাঝের জন।
‘আমরা বিশ্বাস করি না তোমাদের কথা। তোমরা কম ধড়িবাজ নও। ডকুমেন্টগুলোর শুধু একটি করে কপি তোমাদের কাছে ছিল এটা অবিশ্বাস্য। তোমাদের বলতে হবে ডকুমেন্টগুলোর ডুপ্লিকেট কোথায়।’ বলল চেয়ারে বসা সেই মাঝের জনই।
বন্দীরা তাদের সহ্য ও শক্তির শেষ সীমায় পৌঁছেছিল। তাদের দেহে কম্পন বেড়ে গেছে। শরীর তাদের আঁকা-বাঁকাভাবে দুলতে শুরু করেছে। চোখ তাদের বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ তিনটি দেহ তাদের এক সাথেই খসে পড়ল সারি সারি পেরেক আঁটা চেয়ারের উপর। সঙ্গে সঙ্গে তাদের তিনটি কন্ঠই যন্ত্রনায় বুকফাটা চিৎকার দিয়ে উঠল।
চেয়ারে বসা তিনজন হো হো করে হেসে উঠল। বলল তিনজনের ডান পাশের জন, ‘তোদের ঈমান গেল কোথায়? দাঁড়িয়ে থাকতে পারলি না তো ঈমানের শক্তিতে। তোদের আল্লাহ শক্তি যোগাল না হাঁটুতে এবং পায়ে?’
তিন বন্দীই যন্ত্রনায় আর্তনাদ করছিল। কিন্তু আর উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। কারণ পেরেক আঁটা সেই ইস্পাতের বোর্ড নেমে এসেছে ঠিক আগের মতই মাথার চার ইঞ্চি উপরে।
চারদিক থেকে শত শত যন্ত্রনা-জর্জরিত চোখ দেখছিল তাদের অসহ্য আহাজারি।
স্থানটা বিশাল একটি গোলাকার হলঘর। নিচু ছাদ আট-নয় ফুটের বেশি উচুঁ হবে না।
হলঘরটার চারদিক ঘিরে মোটা লোহার গ্রীল ঘেরা ছোট ছোট ঘর। ঘরগুলোকে খোঁয়ার বলাই ভাল। ঘরগুলোতে দাড়ানো যায় না, পা মেলে শোয়াও যায় না। ঘরের মেঝেগুলো এবড়ো-থেবড়ো কাঠের তৈরী। মাথার উপরের কংক্রিটের ছাদগুলো মুভেবল। সুইচ টিপে সেগুলো সরিয়ে দেয়া যায়, আবার লাগানো যায়। দরকার হলে বন্দীদের রোদে পোড়ানো, আবার বরফ বৃষ্টিতে শাস্তি দেবার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
বিশাল ঘরের ঠিক মাঝখানে প্রায় ২০ বর্গফুট আয়তনের গোলাকার একটা কংক্রিটের বেদী। এই চত্বরের উপরের ছাদটা গম্বুজের মতো উঁচু। বিশেষভাবে নির্মিত এই গম্বুজে এবং বেদীর নিচে নির্যাতনের হাজারো উপকরণ সাজিয়ে রাখা। যখন যেটা তাদের প্রয়োজন সুইচ টিপলেই উপর থেকে নেমে আসে এবং নিচ থেকে উঠে আসে। বন্দীদের একাকী বা দলবদ্ধভাবে এখানে এনে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের যতপ্রকার মারাত্মক পন্থা আছে, সবই তারা পরীক্ষা করেছে এখানে বন্দীদের উপর।
হলঘরের চারপ্রান্তের দু’একটি ছাড়া সবগুলো খোঁয়াড়েই বন্দী রয়েছে। তাদের সংখ্যা দু’শ জনের কম হবে না। তাদেরই বেদনা জর্জরিত চোখ অসহায় দৃষ্টিতে দেখছে তিন বন্দীর উপরে চলমান নির্যাতন। কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে কানে আঙুল দিয়ে চেষ্টা করছে বাঁচতে। কিন্তু মনের কষ্ট তাতে এক বিন্দুও লাঘব হচ্ছে না। কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে প্রার্থনার হাত উপরে তুলে।
তিন বন্দীর অসহায় কাতরানী ছাপিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে চেয়ারে বসা তিনজনের উল্লাস ধ্বনি।
এক ঝাঁক পেরেক বিদ্ধ স্থান থেকে রক্ত ঝরছে তিন বন্দীর। রক্ত চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়ছে বেদিতে।
নির্যাতনকারী টিমের তিনজনের মাঝের জনই টিম লিডার। তার বয়স অন্য দু’জনের চেয়ে কিছু বেশী। তবে কারো বয়স চল্লিশের বেশি নয়। তিনজনের পরনেই ইউরোপিয়ান স্যুট। তবে ইউরোপিয়ানদের মত সাদা নয়। মুখের গড়নও এ্যাভারেজ ইউরোপীয় থেকে আলাদা। যারা ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেগীন, ইয়াহুদ বারাক, এ্যারিয়েল শ্যারনদের দেখেছেন, তারা বলবেন এরা তিনজন ঐ প্রধানমন্ত্রীদের ভাই হবেন কোন না কোন দিক থেকে। এরা যে নিখাদ ইহুদী তা তাদের দিকে একবার তাকিয়েই ওয়াকিফহাল যে কেউ বলে দিতে পারে।
তিন চেয়ারের মাঝের লোকটি তার ডান পাশের লোকটিকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, ‘মি. আইজ্যাক, সুইচে এবার হাত দিন। রক্ত বেশি গেলে আমাদের ক্ষতি।’
হাসল আইজ্যাক শামির। বলল, ‘ঠিক বলেছেন মি. দানিয়েল ডেভিড, ওদের তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের ডকুমেন্টের মতই ওদের রক্ত আমাদের কাছে মুল্যবান। ওরা বাঁচলে ডকুমেন্ট বের হবেই।’
বলে আইজ্যাক শামির তার চেয়ারের পাশেই মেঝের উপর সেট করা একটা বাক্সের ঢাকনা খুলে ফেলল একটা হুক অন করে। ওটা ইলেক্ট্রনিক কনট্রোল বক্স। প্যানেলে সারি সারি অনেক সুইচ। একটা প্যানেলের একটা সুইচকে আইজ্যাক শামির রেড কেবিন থেকে গ্রীন কেবিনে নিয়ে গেল। সংগে সংগেই তিনজন বন্দীর নিচ থেকে পেরেক আঁটা চেয়ার মেঝের ভেতর ঢুকে গেল এবং অনুরূপভাবে মাথার উপর থেকে পেরেক বিছানো ইস্পাতের আয়তাকার বোর্ডটিও চোখের নিমেষে উঠে গম্বুজে ঢুকে গেল।
আহত রক্তাক্ত বন্দী তিনজন আছড়ে পড়ল মাটিতে। বসবার তাদের শক্তি ছিল না, উপায়ও ছিল না। তাদের তিনটি দেহই মেঝেতে শুয়ে পড়ল।
নির্যাতনী টীমের জিজ্ঞাসাবাদকারী তিনজনের নেতা দানিয়েল ডেভিড বলে উঠল সংগে সংগেই, ‘না তোমরা শুতে পারবে না, আরাম তোমাদের কপাল থেকে মুছে গেছে। পরকালে যখন বেহেশত আশা কর, তখন জাহান্নামের শাস্তিটা এখানেই ভোগ করে যাও।’
বলে দানিয়েল ডেভিড চেয়ারের হাতলে তার হাতের নিচেই থাকা একটা সুইচে চাপ দিল। চাপ দেয়ার সাথে সাথেই বেদিটির এক প্রান্ত থেকে ৩ বর্গফুটের মত জায়গার মেঝে একটু নিচে নেমে মেঝের আড়ালে হারিয়ে গেল এবং উঠে এল একটা লিফট। লিফটে একজন মানুষ। লোকটির পরনে সামরিক ইউনিফর্ম। কুস্তিগীরের মত চেহারা।
‘এসটি জিরো ওয়ান, তুমি ওদের আমাদের সামনে সারিবদ্ধ করে বসিয়ে যাও। আর এক পেগ করে ব্রান্ডি দাও ওদের।’ লিফট দিয়ে উঠে আসা ইউনিফরমধারীকে লক্ষ্য করে বলল দানিয়েল ডেভিড।
আদেশ শুনে এসটি জিরো ওয়ান লিফটে করে আবার নিচে নেমে গেল। এক বোতল ব্রান্ডি নিয়ে ফিরে এল আধা মিনিটের মধ্যেই।
জিরো ওয়ান লোকটি তিনটি চেয়ারের সামনে তিনজন বন্দীকে খেলনার মত তুলে এনে বসিয়ে দিল।
বন্দীদের এভাবে বসার ক্ষমতা ছিল না। বসেই তারা কঁকিয়ে উঠল ব্যথায়। ক্লান্তি ও যন্ত্রনায় তারা মাথা সোজা করে বসে থাকতে পারছিল না।
জিরো ওয়ান পেগ ভর্তি ব্রান্ডি ওদের সামনে রেখে বলল, ‘খেয়ে নাও। এ হলো এখনকার জন্যে মেডিসিন। খেলেই দেখবে মাথা সোজা করতে পারছ।’
‘তোমরা এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝেছ, মদ, ব্রান্ডি ধরনের হারাম জিনিস আমাদের খাওয়াতে পারবে না। কিছু দিতে চাইলে আমাদের পানি দাও।’ বলল তিনজনের সারি থেকে মাঝের বন্দী।
‘ব্রান্ডি না খেলে তোমাদের পানি দেওয়া হবে না।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
দানিয়েল ডেভিড ৩ জনের জিজ্ঞাসাবাদকারী দলের নেতা।
বন্দীরা কেউ কোন কথা বলল না।
দানিয়েল ডেভিড তার বাম পাশের লোকের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘মি. হাইম হারজেল তাহলে আপনার জিজ্ঞাসাবাদটা সেরে নিন।’
হাইম হারজেল নড়ে চড়ে বসল।
তাকাল বন্দীদের দিকে।
চোখ তার নির্দিষ্ট করল মাঝের জনের দিকে। বলল, ‘কামাল সুলাইমান, অনেক কথাই বলেছ। এখন বল, মোস্তাফা কামাল আতাতুর্কের বংশধর হবার পরেও তোমার এই পরিবর্তন কেন?’
‘কোন পরিবর্তন?’ হাইম হারজেলের দিকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল কামাল সুলাইমান।
এই কামাল সুলাইমান ৭ জনের গোয়েন্দা সংস্থা স্পুটনিক এর প্রধান। সে কামাল আতাতুর্কের বংশধর, একমাত্র জীবিত বংশধর।
‘তোমাদের মৌলবাদ গ্রহনের কথা বলছি। কামাল আতাতুর্কের যুক্তি ও প্রগতির পথ পরিত্যাগ করে তোমরা মৌলবাদী পথ বেছে নিতে গেলে কেন? যেমন ধর তোমার নামের দুটো অংশ ‘কামাল’ ও ‘সুলাইমান’। কামাল ঠিক আছে, এটা পারিবারিক ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রতি স্বীকৃতি। কিন্তু সুলেমান কেন? ‘সুলেমান’ তো ওসমানীয় খলিফাদের একজনের নাম। কামাল আতাতুর্ক এদের পরিত্যাগ করেছিলেন। এদের একজন তোমার নামের অংশ হলো কি করে?’ বলল হাইম হারজেল।
‘নামটা রেখেছিলেন আমার পিতা। তিনি আমার নাম রাখার সময় পারিবারিক ইতিহাস এবং জাতীয় ঐতিহ্য দুই-ই সামনে রেখেছিলেন’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘জাতীয় ঐতিহ্য কোনটা? সুলেমান নাম?’ জিজ্ঞেস করল হাইম হারজেল।
‘হ্যাঁ, সুলাইমান নাম’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘সুলাইমান জাতীয় ঐতিহ্য হলো কি করে? কামাল আতাতুর্ক তো এই ঐতিহ্য পরিত্যাগ করেছিলেন’। বলল হাইম হারজেল।
‘কামাল আতাতুর্ক যাঁকে এবং যাঁদেরকে পরিত্যাগ করেছিলেন, আমার পিতা নিশ্চয় তাঁদেরকেই গ্রহন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ওসমানীয় খিলাফতের মহান বিজেতা, মহান শাসক এবং ইউরোপের মহাভয়ের ঝান্ডা সুলাইমানকে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে। তার চাওয়ার স্মারক আমার ‘সুলাইমান নাম’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘তার মানে তোমার পিতা তাহলে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, তুর্কিরা শুধুই তুর্কি এবং তুর্কিদের পরিচালনা করবে তুরস্ক ও পাশ্চাত্যের জ্ঞান, ইসলাম নয়-এই মতবাদ পরিত্যাগ করেছিলেন?’ বলল হাইম হারজেল।
‘শুধু আমার পিতা কেন, সাধারণভাবে তুর্কিরা সবাই এই মতবাদ পরিত্যাগ করেছে’। কামাল আতাতুর্ক ১৭ বার সামরিক আইন ব্যবহার করে তুর্কি জনগণকে ধর্মনিরপেক্ষ বানানোর জন্যে বহু আইন করেছেন, কিন্তু এরপরও মসজিদে বসার আসন স্থাপন, মসজিদে জুতা পায়ে নামাজ আদায়, নামাজের ভাষা হিসেবে তুর্কি ভাষা চালু, আরবী বিলোপ, নামাজে সেজদার নিয়ম বাতিল, মসজিদে প্রার্থনাকে সুন্দর করার জন্যে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র চালু ইত্যাদির মত পরিকল্পনা তাকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হতে হয়। সেই তুর্কি জনগণ আজ আরও স্বাধীন এবং শক্তিশালী’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘আচ্ছা তোমার পিতার কথা বাদ দিলাম। তোমার পিতা আংকারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ গ্রাজুয়েট। কিন্তু তুমি তো ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেছ, ইউরোপের সংস্কৃতি-সভ্যতার মধ্যে বড় হয়েছ, কিন্তু তুমি মৌলবাদী হলে কি করে?’ জিজ্ঞেস করল হাইম হারজেল।
‘মৌলবাদ বা মৌলবাদী পরিভাষা পশ্চিমের একশ্রেণীর সংবাদ মাধ্যমের উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি। মুসলিম জাতির ক্ষেত্রে এই পরিভাষা প্রযোজ্য নয়। সুতরাং আমাকে মৌলবাদী নই, বলতে পারেন ধর্মনিরপেক্ষতা পরিহার করে আমি মুসলিম হলাম কি করে’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘ঠিক আছে বল, গোঁড়া মুসলিম হলে কি করে?’ বলল হাইম হারজেল।
‘গোঁড়া বা অগোঁড়া মুসলমান বলে কিছু মুসলিম জাতির মধ্যে নেই’। ‘মুসলিম’ হওয়ার গুণগুলো যার মধ্যে যত বেশি বর্তমান সে তত বেশি পূর্ণাংগ মুসলমান, যার মধ্যে যত কম সে তত অপূর্ণাংগ।’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘আচ্ছা বল, যে কামাল আতাতুর্ক একদিন বলেছিলেন, ‘কেবলমাত্র ইসলামের কর্তৃত্ব নির্মূল করার পরই তুর্কিরা অগ্রগতি লাভ করতে পারে এবং সম্মানিত আধুনিক জাতিতে পরিণত হতে পারে’, সেই কামাল আতাতুর্ক পরিবারের ছেলে হয়ে পূর্ণাংগ মুসলমান হলে কি করে? বলল হাইম হারজেল।
‘এই প্রশ্নের জবাবের সাথে আমার বন্দী হওয়া বা তোমাদের স্বার্থের তো সম্পর্ক দেখছি না?’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘দেখ, তোমাদের ‘স্পুটনিক’ সংস্থা ধ্বংস ও তোমাদের বন্দী করার পেছনে নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাসি ও লিবার্টি টাওয়ার ধ্বংস বিষয়ে তোমাদের তদন্ত বানচাল করা ছিল একটি বড় কারণ মাত্র, সব কারণ নয়। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো, ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মহীনতা, ভোগ-বিলাস আর চরিত্রহীনতার সয়লাবের মধ্যে থেকে তোমরা এবং তোমাদের মত হাজার হাজার যুবক কি করে নিখাঁদ ইসলামে ফিরে এলো!এই ফিরে আসার পথগুলো, কারণগুলো আমরা চিহ্নিত করতে চাই। এ জন্যেই দেখ আমরা তো তোমাদের সাতজনকেই মাত্র ধরিনি। এই বন্দীখানাতেই তোমরা আছ দু’শজনের মত। তোমাদের সাথে আরও যারা এখানে আছে, তারা সবাই তোমাদের মত নেতৃস্থানীয় এবং ‘ডু অর ডাই’ ধরনের সাংঘাতিক এ্যাকটিভিস্ট যুবক। তাদের ধরে তাদের আন্দোলন বানচাল করতে চেয়েছি এটা ঠিক, কিন্তু আসল কারণ এদের আদর্শবাদিতার উৎস সন্ধান করা। এক্সরে করার মত করে সব অজানা রহস্য জেনে নেয়া। এই একই কারণে তোমাকে এই জিজ্ঞাসাবাদ। এখন বল, উত্তর দাও’। বলল হাইম হারজেল। তার দুই চোখে ঠান্ডা সাপের মত ক্রুরতা।
‘এই অজানাকে জানা তোমাদের কোন কাজে লাগবে?’ জিজ্ঞেস করল কামাল সুলাইমান।
ঠান্ডা হাসি হাসল হাইম হারজেল। বলল, ‘রোগ জীবানু কি, কেমন, তার ধর্ম কি জানলেই তো কেবল প্রতিষেধক তৈরী করা যায়। তোমাদের মৌলবাদ কোত্থেকে কিভাবে এল জানলে তবেই তো প্রতিবিধানের পথ বের করা যাবে। আচ্ছা বল, আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
‘তুমি যে প্রশ্ন করেছ, এক কথায় তার কোন জবাব নেই। অনেক কথা বলতে হবে এজন্য’। বলল কামাল সুলাইমান।
‘ক্ষতি নেই বল। আমরা শুধু তা শুনবই না রেকর্ডও করব।’ বলল হাইম হারজেল।
‘তুমি ঠিকই বলেছ, ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মহীনতা এবং ভোগবাদিতার সয়লাবের মধ্যে আমি মানুষ হয়েছি জার্মানীর এক অভিজাত পল্লীতে। আমার পিতার মধ্যে ঐতিহ্য-প্রীতি প্রবল ছিল। কিন্তু সেটা ছিল তার মনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাইরের কাজ-কর্মে তার কোন প্রকাশ ছিল না। জার্মান-সংস্কৃতির আবহাওয়ায় আর দু’দশজনের মতই আমি মানুষ হয়েছিলাম। চেতনা আমার প্রথম ধাক্কা খেল নূরী এ্যারেন-এর Turkey today and tomorrow বইয়ের কয়েকটা লাইন পড়ে। কামাল আতাতুর্কের অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের মধ্যে ৪৬ জন কুর্দি নেতাকে কামাল এক সাথে ফাঁসি দিয়েছিলেন। ফাঁসির মঞ্চে একজন কুর্দি নেতা শেখ সাইদ হত্যাকারীকে যে কয়টি বলেছিলেন, নূরী এ্যারেন তার বইতে সে কথাগুলো উল্লেখ করেছেন। শেখ সাইদ বলেছিলেন, ‘তোমার প্রতি আমার কোন ঘৃণা নেই। তুমি ও তোমার মনিব কামাল আল্লাহর নিকট ঘৃণিত। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর কাছে আমাদের ফায়সালা হবে।’ শেখ সাইদের এ কথাগুলি প্রথমবারের মত আমার মনে চাবুকের মত আঘাত করে। এই ঘটনার পরপরই আরেকটা বড় ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনা আমার কাছে প্রায় অপরিচিত আমাদের গ্রন্থ আল কোরআন-এর মর্যাদা আমার কাছে আকাশস্পর্শী করে তোলে। ঘটনাটি হলো, একটা ম্যাগাজিনে বৃটিশ রাজনীতিক গ্লাডস্টোন-এর একটা উক্তি পাঠ। উক্তিটি বৃটিশ পার্লামেন্টে গ্লাডস্টোন-এর ভাষণের একটা অংশ। এতে বৃটিশ পার্লামেন্টের ‘সেক্রেটারী ফর কলোনিজ’ মি. গ্লাডস্টোন বলেছিলেন। ‘যতদিন মুসলমানদের আল কোরান থাকবে, আমরা ততদিন তাদেরকে বশ করতে পারবো না। হয় আমাদেরকে তাদের কাছ থেকে এটি কেড়ে নিতে হবে, অথবা তারা যেন এর প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে তার ব্যবস্থা করতে হবে। (So long as the Muslims have the Quran, “we shall be unable to dominate them. We must either take it from them, or make them lose their love of it.”) এই বক্তব্য পাঠ করার সংগে সংগে আমার মনে ঝড়ের বেগে একটি কথা প্রবেশ করল এবং সেটা হলো, ‘আল কোরআনই আমাদের মানে মুসলমানদের স্বাধীনতার শক্তি, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি। আরও মনে হলো, আমার পূর্ব-পুরুষ মোস্তফা কামাল তাহলে হয়তো তার অজান্তেই গ্লাডস্টোনদের পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করেছিলেন। এই চিন্তা হঠাৎ করে আমাকে নতুন মানুষে পরিণত করল। পাল্টে গেল আমার জীবন ধারা। পড়া-শোনার বিষয় আমার পাল্টে গেল। পরিবারের সবাইকে বিস্মিত করে আমি নামাজী বনে গেলাম। এই সময় আমি মোস্তফা কামালের সমসাময়িক তুরস্কের নির্ভীক জননেতা বদিউজ্জামান নূরসীর জীবন ও কর্মের উপর একটা গ্রন্থ পড়লাম যা আমার জীবনকে আমূল পাল্টে দিল। তার অনেক কথা আমার কাছে অথৈ সমুদ্রে পথহারা নাবিকের কাছে ‘বাতি ঘর’ এর মত জীবনদায়িনী মনে হলো । যেমন মোস্তফা কামাল এক ঘটনায় নামাজকে কটাক্ষ করে উক্তি করলে জনাব নুরসী তুরস্কের লৌহ মানবের মুখের উপর বলেছিলেন, ‘পাকা, ঈমানের পর ফরয নামাজই তো ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যারা নামাজ আদায় করে না, তারা বিশ্বাসঘাতক। আর বিশ্বাসঘাতকের অভিমত গ্রহন করা যায় না।’ ইসলামের প্রতি ভালোবাসাও আমি নূরসীর কাছ থেকে শিখেছি। মোস্তফা কামালের শাসনে তুরষ্কে ইউরোপীয় সংস্কৃতির সয়লাব যখন অপ্রতিরুদ্ধ হয়ে উঠল, তখন স্বাস্থ্যগতভাবে নুরসী খুবই ভেঙে পড়লেন, অথচ তার কোন রোগ ছিল না। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার নিজের দুঃখ গুলো সইতে পারি। কিন্তু ইসলামের দুঃখ আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। ইসলামী দুনিয়ার উপর আমি প্রদত্ত প্রতিটি আঘাত আমার অন্তরের উপর হানা দেয়। তাই আমি এমন ভেঙে গেছি। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলের উপর নীতি ও আইনকে স্থান দেয়া, মানুষকে ভালোবাসা, মুসলমানদেরকে ভালোবাসার শিক্ষাও আমি জনাব নুরসীর কাছ থেকে পেয়েছি। মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক জনাব নুরসীর উপর জেল-জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নির্বাসন কতই না করেছেন। কিন্তু যখন মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে অস্ত্র, সৈন্য, গোলা-বারুদ সব প্রস্তুত করে তার কাছে যুদ্ধের অনুমতি চাওয়া হলো, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা কার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান? মোস্তফা কামালের সৈন্য কারা? ওরা এদেশেরই ছেলে। আপনি কাদেরকে হত্যা করবেন? তারা কাকে হত্যা করবে? আপনি কি চান আহমদ মুহাম্মদকে আর হাসান হোসাইনকে হত্যা করুক।’ যে কোন অবস্থায় অস্ত্রের চেয়ে যুক্তিকে, বুদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেবার শিক্ষা আমি নূরসীর কাছ থেকেই পেয়েছি। তিনি সশস্ত্র তৎপরতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। যুক্তি ও বুদ্ধি অস্ত্রকেই তিনি সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর মনে করতেন। আমরা ‘স্পুটনিক’ গড়েছি তা অনেকটা তাঁর এ শিক্ষা থেকেই। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যুক্তি ও বুদ্ধির অস্ত্র দিয়েই আপনাদের এবং সকলের সব ষড়যন্ত্র আমরা নস্যাত করতে পারব।’ থামল কামাল সুলাইমান।
‘যদি বেঁচে থাক।’ বলেই হাইম হারজেল চোখ ফেরাল কামাল সুলাইমানের বামপাশে বসা ওসমান আবদুল হামিদের দিকে। তুরষ্কের ওসমানীয় খিলাফতের শেষ সক্রিয় খলিফা সুলতান আবদুল হামিদের বংশধর। তার দিকে চোখ তুলে ধরে বলল হাইম হারজেল, ‘তোমার পূর্ব পুরুষদের কামাল আতাতুর্ক সুইজারল্যান্ডে নির্বাসন দিয়েছিল। পরবর্তীকালে তোমাদের পরিবার নিরেট একটি ইউরোপীয় পরিবারে পরিণত হয়। আরবী ভাষার চর্চা তাদের মধ্য থেকে উঠে যায়। আরবী ভাষা ভুলে যায় তারা। তুমি কিভাবে মৌলবাদী হলে মানে পূর্ণাংগ মুসলমান হলে সে কাহিনী তোমার কাছ থেকে শুনেছি। শুধু একটা বিষয়ই জানার বাকি আছে সেটা হলো, তুমি আরবী শিখলে কোথায়?’
‘আরবী আমি শিখিনি। আরবী ভাষা আমি জানি না। সবে শিখতে শুরু করেছি।’ বলল ওসমান আবদুল হামিদ।
‘জান না? তাহলে কোরআন ও হাদিস পড় কি করে?’ হাইম হারজেল বলল।
‘ইংরেজী অনুবাদ পড়ি।’ জবাব দিল ওসমান আবদুল হামিদ।
‘ও, আচ্ছা।’ বলে হাইম হারজেল ফারুকের বংশধর এবার আবদুল্লাহ আল ফারুকের দিকে তাকাল। তাকে উদ্দেশ্য করে বলল হাইম হারজেল, ‘সেদিন তোমার কাছ থেকে কিছু জেনেছি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বিষয় জিজ্ঞেস করতে বাকি রয়ে গেছে। বল, তোমার ঘরে ফেরার উপলক্ষ বা কারণটা কি?’
‘ঘরে ফেরা মানে কি ইসলামে ফিরে আসা?’ জিজ্ঞেস করল আবদুল্লাহ আল ফারুক।
‘হ্যাঁ ঠিক, ইসলামে ফেরা।’ বলল হাইম হারজেল।
‘এটা ঠিক ইসলামের চর্চা আমাদের পরিবার থেকে লোপ পেয়েছিল। কিন্তু আমরা মুসলমান এ কথা কেউ আমরা কখনোও ভুলিনি। তারপর নানা কার্যকারণ ও ঘটনায় পূর্ণাংগ ইসলামে আমি ফিরে এসেছি। সে অনেক কথা, কোনটা বলব আমি?’ বলল আবদুল্লাহ আল ফারুক।
‘শুধু বল, কোরআন হাদিস পড়ে, না কিভাবে তোমরা প্রথম চোখ খুলল?’ বলল হাইম হারজেল।
সংগে সংগে উত্তর দিল না আবদুল্লাহ আল ফারুক হারজেলের প্রশ্নের। ভাবছিল সে। একটু পর সে বলল, ‘আমি তখন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একদিন লাইব্রেরীতে বসে নোট তৈরী করছিলাম। নোট শেষে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম আমার হাতের কাছেই ইবনে খালদুনের মুকাদ্দামা পড়ে আছে। এই বিখ্যাত বইটির অনেক নাম শুনেছি। কিন্তু কোন দিন হাতে নিয়ে দেখিনি। কাছে পেয়ে আজ হাতে তুলে নিলাম। সূচীটা দেখে নিলাম। তারপর পাতা উল্টাতে লাগলাম। এক জায়গায় কয়েকটা লাইন সবুজ মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করা দেখলাম। ভাবলাম আমার মতই নোটকারী পাঠকের কাজ। আগ্রহ নিয়ে মার্ক করা লাইন কটি পড়তে লাগলামঃ ‘নবীর আল্লাহ প্রদত্ত বাণী ছাড়া রাজনৈতিক ও স্থায়িত্ব অর্জনে আরবরা অক্ষম। কারণ চারিত্রিক কঠোরতা, গর্ব, বর্বরতা এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে পরস্পরের প্রতিহিংসা তাদের মজ্জাগত। ইচ্ছা ও আকাঙ্খার ঐক্য ছাড়া এগুলো দূরিভূত হওয়া খুবই কষ্টকর। নবীর ধর্মই তাদের রুক্ষতা ও প্রতিহিংসাকে দমন করতে পারে। কারণ এই ধর্মই তাদেরকে বর্বর জাতি থেকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে এ সময় এমন ব্যক্তির আবির্ভাব হওয়া উচিত যিনি তাদেরকে সত্যের দিকে আহ্বান করবেন এবং অসত্য থেকে বিরত রাখবেন তবেই তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে এবং নেতৃত্ব দানে সক্ষম হবে।’ ইবনে খালদুনের এ বক্তব্য একবার দু’বার নয় অনেকবার পড়লাম। কথাগুলো সম্মোহিত করে ফেলল আমাকে। আমার মনে হলো এই লাইন কয়টিতে পৃথিবীর সমাজ বিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুন যা বলেছেন তার চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। এক মুহূর্তেই আরব দেশগুলোর অনৈক্য, দূর্বলতা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বহুমুখিতা, পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদির কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মনে হলো, নবীর শিক্ষা ও আদর্শের শক্তিই আরবদের এবং মুসলমানদের আবার শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করতে পারে। এই চিন্তা আমার সত্ত্বা জুড়ে তড়িত প্রবাহের মত ছড়িয়ে পড়ল। আমি যেন নতুন চিন্তা চেতনায় নতুন মানুষে পরিণত হলাম। তারপর কয়েকদিনে আমি ইবনে খালদুনের এই মুকাদ্দামা পড়ে শেষ করলাম। তখন শুধু আরব জীবন, আরব ইতিহাস নয়, গোটা পৃথিবীর ইতিহাস ও সভ্যতা নতুন পরিচয় নিয়ে আমার সামনে আবির্ভুত হলো। আমার মনে হলো মুসলমানরা ঈমান, কোরআন ও হাদীসের ভূমিকা পরিহার করলে তাদের সংস্কৃতি সভ্যতার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না-আরবতত্ত্ব নয়, জাতিতত্ত্ব নয়, লীন হয়ে যেতে হয় বৈরী সভ্যতা সংস্কৃতি ও জাতিদেহের মধ্যে। সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম শুধু স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিয়ে বাঁচার জন্যে নয়, সুন্দর মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী চিরন্তন শান্তির জন্যে আমাকে ইসলামে ফিরে আসতে হবে। এই হলো আমার ঘরে ফেরার কাহিনী।’ থামল আবদুল্লাহ আল ফারুক।
আবদুল্লাহ আল ফারুক থামতেই দানিয়েল ডেভিড বলে উঠল আবদুল্লাহ আল ফারুকদেরকে লক্ষ্য করে, ‘তোমরা খুব সরল এবং সৎ। কিন্তু স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন তোমাদের ভাগ্যে নেই, সুন্দর মৃত্যুও নয়। পরকালীন শান্তি হয়তো পাবে। কারণ আর যাই হোক আজকের বিশ্ব পরিচালনা তোমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।’
‘হ্যাঁ, জানোয়ারের বিশ্ব যদি হয় তা পরিচলানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু মানুষের বিশ্ব পরিচালনা সম্ভব। আর এ বিশ্ব জানোয়ারদের নয় মানুষের।’ বলল কামাল সুলাইমান।
‘জানো মানুষই সবচেয়ে বড় জানোয়ার?’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘তাদের মানুষ করার জন্যই তো শেষ নবীর শেষ রেসালত।’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘কিন্তু তা করতে পারেনি তোমাদের শেষ নবীর শেষ রেসালত। এই কারণেই তো জানোয়ার বন্দী করতে পারনি, যাদের জানোয়ার বল তারা তোমাদের বন্দী করে এনেছে।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘তোমার কথাই শেষ কথা নয়, দেখো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তোমাদের লীলা-খেলার ইতি ঘটছে, ঘটবে। সেখানে জেনারেল শ্যারনসহ তোমাদের অনেকেই বিচারের সম্মুখিন হচ্ছে।’
চোখ দুটি জ্বলে উঠলো দানিয়েল ডেভিডের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তার শোধ নিচ্ছি আমরা এবং নেব।’
বলে একটু থামল দানিয়েল ডেভিড। একটু পর বলল, ‘তোমাদের আস্ফালন বুদবুদের মত। জানো, মি.হাইম হারজেল তোমাদের কাছ থেকে কি জেনে নিল?’
কামাল সুলাইমানরা এ জিজ্ঞাসার জবাবে কিছুই বলল না। দানিয়েল ডেভিডই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘তোমাদের ঈমান ও শক্তির গভীরতা তিনি যাচাই করলেন। দেখলেন, মূল কোরআন হাদিস থেকে কোন শিক্ষা তোমরা পাওনি। কোরআন হাদিসের গোটা শিক্ষাও তোমরা জান না। কিছু কার্যকারণের মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে একটা জাতীয় আবেগের সৃষ্টি হয়েছে মাত্র এবং এটা পরীক্ষায় টিকবে না। তোমরা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।’
হাসল কামাল সুলাইমান। বলল, ‘ইসলামের প্রথম যুগে যাঁরা মক্কায় শহীদ হয়েছিলেন, বদর প্রান্তরে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, ওহোদ-খন্দকে শহীদ হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা সকলে গোটা কোরআন পড়েছেন-জেনেছেন বলেছেন বলেই শহীদ হননি। বরং ঈমানের জন্যে নয় আমলের জন্যে গোটা কোরআন জানা শর্ত। আর মানুষ জীবন দিতে পারে ঈমানের যুক্তিতেই। সুতরাং তোমাদের ইচ্ছা এতদিন পূরণ হয়নি, কোনদিনই পূরণ হবে না।’
চোখ দু’টি আবার জ্বলে উঠল দানিয়েল ডেভিডের। শক্ত হয়ে উঠল তার চোয়াল। সে তার ডান দিকে বসা আইজ্যাক শামিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কিছু নির্দেশ দিতে যাচ্ছিল এমন সময় একটা শক্তিশালী বীপ বীপ শব্দ ভেসে এল।
সংগে সংগে নিজেকে সামলে নিয়ে লাল চোখে কামাল সুলাইমানের দিকে চেয়ে বলল, ‘বস আসছে। এখন আর সময় নেই। যে মুখে এই অহংকারের কথা বললে, সে মুখ গুঁড়ো করে দেব। তৈরী থেক।’
কথা শেষ করল এবং তার পরেই দু’পাশের দু’জনকে বলল, ‘চল এদের খোঁয়াড়ে রেখে আসি।’
বলেই বন্দী তিনজনকে টেনে নিয়ে ওরা ছুটল খোয়াড়ের দিকে।
ওদের খোয়াড়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে, গ্রীলের দরজায় বিশাল তালা ঝুলিয়ে দ্রুত ফিরে এল নিজ নিজ চেয়ারের কাছে।
বীপ বীপ শব্দ তখনও চলছিল।
কিন্তু তাদের সামনের মেঝের চেহারাটা পাল্টে গেছে। বন্দীদের রক্তে ভেজা মেঝেটা কোথায় সরে গেছে। তার জায়গায় শোভা পাচ্ছে শ্বেত পাথরের সুন্দর মেঝে।
ওরা তিনজন ফিরে এসে চেয়ারে বসল না। তাদের দৃষ্টি শ্বেত পাথরের মেঝের দিকে। অপেক্ষা করছে তারা তাদের বসের।
মাত্র কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা।
তার পরেই শ্বেত পাথরের ওপাশ ঘেঁষে অনেকখানি জায়গায় মেঝে সরে গেল এবং সেখানে চোখের পলকে উঠে এল একটা চেয়ার সমেত একজন মানুষ। চেয়ারে বসা লোকটার তীরের মত ঋজু দেহ। লাল মুখটা পাথরের মত কঠিন। চোখের দৃষ্টিটা শূণ্য। তাতে কোন ভাষা নেই। গায়ে সামরিক পোশাক। হাতে সোনার একটি গ্লোব। গ্লোবের মাঝে জেরুসালেমের প্রোথিত নল আকারের একটা সোনারই দন্ড। তার মাথায় ছয় তারকার একটা পতাকা।
ইনিই আজর ওয়াইজম্যান। ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির’ অবিসংবাদিত নেতা। তার হাতের গ্লোবটি নেতার মনোগ্রাম। নেতার হাতেই শুধু এটা শোভা পায়।
ওরা তিনজন দাঁড়িয়েই ছিল।
আজর ওয়াইজম্যান উঠে এসে স্থির হতেই ওরা তিনজন তাকে সামরিক কায়দায় স্যালুট দিল।
আজর ওয়াইজম্যানও একজন সর্বাধিনায়কের মত সামরিক কায়দায় স্যালুট গ্রহন করল এবং তাদেরকে ‘গুড মর্নিং’ বলে স্বাগত জানিয়ে বসতে বলল।
বসল ওরা তিনজন।
‘মি.দানিয়েল ডেভিড, আপনাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, আপনাদের হাত শূণ্য। কিন্তু আজ তিন সপ্তাহ যাচ্ছে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘আমরা দুঃখিত। আমাদের হাত সত্যিই শূণ্য। অবিশ্বাস্য ব্যাপার স্যার, শারীরিক এধরনের নির্যাতনে হাতিও কথা বলে কিন্তু এই নির্যাতনেও তাদের কথা বলা পারছে না।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘বিস্ময়ের কথা বলছেন কেন? এটা তো জানা কথা। আর হাতির সাথেও তুলনা চলে না। হাতি পশু, মানুষ নয়। সুতরাং মানুষ হাতির চেয়ে শক্ত হবে। আর মানুষের মধ্যে মুসলমানরা শক্তিশালী, একথা বাইরে না বললেও তোমাদের তো মনে রাখা উচিত।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ঠিক বলেছেন স্যার। নির্যাতনের এখানকার সকল প্রক্রিয়াই ব্যর্থ হয়েছে তাদের কথা বলাতে। তারা বলে জাহান্নামের শাস্তি এর চেয়েও ভয়াবহ।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘এটাই তো ওদের শক্তি। মৃত্যুকে যারা সোনালী জগতে প্রবেশের সোনার সিংহদ্বার বলে মনে করে, তারা দুনিয়ার সব ভয়কেই জয় করে। কিন্তু মি.দানিয়েল ডেভিড, তাদের কথা বলাতে হবে। ডকুমেন্টের ডুপ্লিকেট তাদের কাছে অবশ্যই আছে এবং সেগুলো আমাদের অবশ্যই চাই।’ আর ওয়াইজম্যান বলল।
‘ডুপ্লিকেটগুলো যখন ওদের কাছে আছে, নিশ্চয় তারা কোথাও সেগুলো রেখেছে। স্যার, সেগুলো খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব নয়?’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘তা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা আমরা করেছি। ফল হয়নি। আবার চেষ্টা আমরা শুরু করতে যাচ্ছি। এই সাতজনের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব কাউকেই এই অনুসন্ধান তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে না। এরপর আমরা চিন্তা করেছি, এই সাতজনের যাদের স্ত্রী-সন্তান-সন্ততি আছে তাদের এখানে নিয়ে আসব। তাদের কথা বলাবার এটাই শেষ পথ।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
আজর ওয়াইজম্যানের শেষের কথাগুলো শুনে তিনজনের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল দানিয়েল ডেভিড, ‘স্যার ওদের কথা বলাবার হন্যে ওদের স্ত্রী সন্তান ও মায়েরাই হবে অব্যর্থ অস্ত্র। স্যার, আমার মতে এই সাতজনের আত্মীয় বন্ধুদের সন্ধানে সময় ব্যয় না করে অবিলম্বে এদের পরিবার পরিজনদের এখানে আনলেই কাজ হবে বেশি।’
‘হ্যাঁ, সেটাও আমরা ভাবছি। আমি যাচ্ছি স্ট্রাসবার্গে দু’একদিনের মধ্যে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আপনাকেই যেতে হবে? খুব বড় কাজ তো ওটা নয়। নির্দেশ দিলেই তো ওদের এখানে নিয়ে আসবে।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘ওখানে যেতে হবে। মনে হচ্ছে আমরা নতুন এক বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছি। খবর পাওয়া গেছে, আহমদ মুসা নাকি স্ট্রাসবার্গের উদ্দেশ্যে সুরিনাম ছেড়েছে। আমরা খবরটাকে অবিশ্বাস করছি না। যে মাফিয়া গ্রুপের কাছে থেকে খবর পাওয়া গেছে তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক সুরিনাম সরকারের। তাদের মাধ্যমে আহমদ মুসার টিকিটের বিস্তারিত বিবরণ পেয়ে গেছি। সে সুরিনাম থেকে মদিনায়, মদিনা থেকে আসছে স্ট্রাসবার্গে। এই স্ট্রাসবার্গে আসার দিনক্ষণটাই অনিশ্চিত রয়ে গেছে আমাদের কাছে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কেন সে আসছে স্ট্রাসবার্গে?’ জিজ্ঞেস করল দানিয়েল ডেভিডের পাশ থেকে হাইম হারজেল।
‘ইউরোপের একমাত্র কার্যকর মুসলিম গোয়েন্দা সংস্থা স্পুটনিক ধ্বংস হয়েছে, সংস্থার ৭জন পরিচালকের সবাই নিখোঁজ। স্ট্রাসবার্গে এমন সাংঘাতিক ঘটনা ঘটার পর জিজ্ঞাসার প্রয়োজন আছে কি যে আহমদ মুসা সেখানে কেন আসছে!’
‘স্যরি। ঠিক বলেছেন স্যার। কিন্তু আমি ভাবছিলাম, ইউরোপের বাঘা বাঘা গোয়েন্দারা যেখানে স্পুটনিক ঘটনার কোন কুল কিনারা করতে পারেনি, সেখানে আহমদ মুসা এসে কি করবে।’ বলল হাইম হারজেল।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আহমদ মুসা কি ঘটিয়েছে এটা দেখার পরেও আপনি একথা বলছেন? মার্কিন এফবিআই বহু বছরেও যার টিকির নাগাল পায়নি, আহমদ মুসা তার শুধু নাগাল পাওয়া নয়, ইহুদীদের শত বছরের সব আয়োজনই তো সে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইহুদি গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারনের গায়ে কেউ কোন দিন হাত দিতে পারে নি। কিন্তু আহমদ মুসা তাকে মার্কিন কারাগারে নিক্ষেপ করে এমন মামলায় জড়িয়েছে যে জেলের বাইরে আসাই হয়তো তার পক্ষে আর সম্ভব নয়।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
মুখ শুকিয়ে গেছে হাইম হারজেলের। মুখ নিচু করল সে। কথা বলতে পারল না।
মুখ খুলল দানিয়েল ডেভিড। বলল, ‘স্ট্রাসবার্গে আহমদ মুসার আগমন সত্যিই খুব খারাপ খবর। আজ পর্যন্ত দুনিয়ার যে জায়গাতেই সে পা দিয়েছে, সেখানেই ভাগ্যের আনুকুল্য সে পেয়েছে। আর………।’
‘মি.হাইম হারজেল আহমদ মুসাকে জিরো করতে চেয়েছিলেন। আর আপনি তাকে ‘হিরো’ করতে চাচ্ছেন। আমরা যদি তাকে অজেয় হিরোই মনে করি, তাহলে তো আমাদের করার কিছুই থাকে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘স্যরি স্যার।’ দানিয়েল ডেভিড বলল।
‘ধন্যবাদ মি.দানিয়েল ডেভিড। আসলে কি জানেন, অতীতে আহমদ মুসা সম্পর্কে আমাদের পলিটিক্স ঠিক হয়নি। তাকে বন্দী করে আমরা আর্থিক ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছি। এটা ঠিক হয়নি। তার মত লোককে যে বন্দী রাখা যায় না, এটা বুঝতে আমরা ভুল করেছি। সুতরাং এবার আমাদের সিদ্ধান্ত সুট অন সাইট। দেখা মাত্রই তাকে গুলী করা হবে। তাকে আমাদের দরকার নেই, তার লাশ দরকার।’
‘স্ট্রাসবার্গে আপনি কবে যাবেন স্যার?’ জিজ্ঞেস করল দানিয়েল ডেভিড।
‘আজই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘একটা কথা স্যার।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
‘কি কথা?’
‘স্পুটনিকের ৭জন ছাড়া আর ২শর মত যারা আছে, তারা কিন্তু এদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। মুখ থেকে মুখে, কান থেকে কানে এই পদ্ধতিতে তারা তথ্য আদান-প্রদান ও শিক্ষা ক্লাস চালু করেছে। এদের এক সাথে এইভাবে রাখা আমাদের লক্ষ্যের পক্ষে কল্যাণকর হচ্ছে না।’ বলল দানিয়েল ডেভিড।
হাসল আজর ওয়াইজম্যান। বলল, ‘মি.ডেভিড, স্পুটনিকের সাতজন ছাড়াও যাদের এখানে রাখা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই তাদের স্ব স্ব অঞ্চলের ইসলামের নেতা। তারা প্রত্যেকেই একটি করে শক্তির জেনারেটর। এখানে তাদের শেখার এবং শেখাবার কিছু নেই মি.ডেভিড।’
বলে একটু থামল আজর ওয়াইজম্যান। শুরু করল আবার, ‘আমাদের এটাকে ‘ক্যাম্প গ্রিনডার’ বলতে পারেন। মানুষকে পেষণ করে তার রস নিংড়ে নেয়াই এই ক্যাম্পের লক্ষ্য। ওদের কাছ থেকে সব তথ্য, সব কথা নিংড়ে নিয়ে ওদের আমরা আটলান্টিকে ডুবিয়ে দেব।’
‘কিন্তু ওদের সন্ত্রাসী সংগঠন ও অস্ত্রপাতি সম্পর্কে তো কিছুই জানা যাচ্ছে না। বলছে না কিছুই ওরা শত নির্যাতনেও।’ বলল তিনজনের একজন আইজ্যাক শামির।
‘থাকলে তো বলবে কিছু ওরা। ওরা সন্ত্রাসী নয়, সন্ত্রাসী কোন সংগঠনও ওদের নেই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘কিন্তু আমরা ওদের সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছি সন্ত্রাসী সংগঠন হওয়ার অভিযোগে এবং ওদেরও তো আটক করেছি ভয়ানক সন্ত্রাসী হিসেবে।’ বলল সেই আইজ্যাক শামিরই।
আজর ওয়াইজম্যানের পাথুরে মুখে হাসি ফুটে উঠল বলল, ‘তোমরা জান, ওটা আমাদের প্রোপাগান্ডা, ওদের সংগঠন নিষিদ্ধ করা ও ওদের আটক করার একটা ওজর। আসলে আমরা চাই, ইসলামী পূণর্জাগরনের সব সংস্থা সংগঠন ধ্বংস করতে এবং ওদের পুনর্জাগরণের গোপন কথাগুলো জানতে।’
‘কিন্তু সেরকম কোন তথ্য আমরা বের করতে পারছি কি?’ বলল হাইম হারজেল।
‘প্রচার। এই কিছুক্ষণ আগে কামাল সুলাইমানের কাছ থেকে যে কথাগুলো বের করলেন, তার প্রিন্টের উপর আমি আসার সময় চোখ বুলিয়ে এসেছি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সে দিয়েছে। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো, গত ৫০ বছরে মুসলিম বিশ্বে এমন কি ঘটল যে, মুসলিম তরুণরা, যুবকরা হঠাৎ করে ধর্ম নিরপেক্ষ, এমন কি তাদের অতিপ্রিয় ভাষা ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ ছেড়ে দিয়ে ইসলামের প্রতি অসীম ভালোবাসায় পাগল হয়ে উঠল। এই রহস্য উদঘাটন হচ্ছে। এই তো ক’মিনিট আগে কামাল সুলাইমানদের কাছ থেকে যা শুনলে, তাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান।
সে থামতেই দানিয়েল ডেভিড বলে উঠল, ‘সেটা কি?’
‘এক ধরনের ইতিহাস, এক ধরনের বই-পুস্তক এবং এক ধরনের ঘটনাবলী এমনকি সেকুলার মুসলিম যুবকদেরকেও ইসলামে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রবল শক্তিশালী জেনারেটরের ভূমিকা পালন করছে। কামাল সুলাইমানদের দেয়া তথ্য থেকে এই বিষয়টা সুনির্দিষ্টভাবে জানা গেল।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘এই জানায় লাভ কি?’ কামাল সুলাইমান বলল।
‘জানায় লাভ হলো, আমরা এখন মুসলিম পাবলিকেশন্স এবং মুসলিম লাইব্রেরীসহ সব পাবলিকেশন্স ও লাইব্রেরীর দিকে নজর দেব। কিছু দিনের মধ্যেই দেখবেন, লাইব্রেরী থেকে ঐ ধরনের বইগুলো উধাও হয়ে গেছে, পুস্তক বিক্রেতাদের দোকান থেকে ঐ ধরনের বই সব রাতারাতি বিক্রি হয়ে গেছে এবং কোন প্রকাশনাই আর ঐ ধরনের বই প্রকাশ করছে না। দু’একটা প্রকাশনা যদি বেয়াড়া হয়, তাহলে স্পুটনিকের মতই সেগুলো জন্মের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে। তাছাড়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অংশ হিসেবে আমরা মুসলিম সরকারগুলোকে বাধ্য করবো যাতে মৌলবাদী, উত্তেজক, প্ররোচক ঐসব বই এর প্রকাশনা শান্তির স্বার্থেই বন্ধ করে দেয়া হয়।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান।
দানিয়েল ডেভিডের চোখ-মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল দানিয়েল ডেভিড, ‘ধন্যবাদ স্যার। আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি। কিন্তু স্যার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার নিয়ে কি করবেন? ওরা আমাদের বিরুদ্ধে তো উঠে পড়ে লেগেছে। জেনারেল শ্যারনকে ওরা মনে হয় ফাঁসি দিয়েই ছাড়বে।’
চিন্তা করছিল আজর ওয়াইজম্যান। দানিয়েল ডেভিড থামার একটু পর বলল, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক দেশ। মার্কিন জনগণ তাদের স্বার্থে আঁচড় লাগাতে দিতেও নারাজ। আমরা ইহুদীবাদীরা এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেইনি। আমরা তাদের পাতের ভাত কেড়ে খেতে শুরু করেছিলাম। কিছু মানুষকে হয়তো চিরদিনই বোকা বানিয়ে রাখা যায়, তবে সব মানুষকে সব সময়ের জন্যে বোকা বানিয়ে রাখা অসম্ভব, আমরা এ সত্যটাকেও আমলে দেইনি। নিউইয়র্কের লিবার্টি টাওয়ার ও ডেমোক্রাসি টাওয়ার ধ্বংসের দায় মুসলমানদের ঘাড়ে সফলভাবে চাপাবার পর যে মহাসুযোগ আমরা পেয়েছিলাম, তা আমাদেরকে বেশি বেপরোয়া করে তুলেছিল। এটা আমাদের ক্ষতি করেছে। আর আহমদ মুসা আমেরিকায় গিয়ে এরই সুযোগ গ্রহন করেছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোটা পরিবেশ আমাদের প্রতিকূলে। নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হবে আমাদের সেখানে। ভয়ের কিছু নেই, আমরা চিন্তা করছি, আগামী নির্বাচনে মার্কিন কংগ্রেসে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল লোকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করার চেষ্টায় আমরা হাত দিয়েছি এবং পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট আমাদের পছন্দনীয় হয় তার জন্যে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। কিন্তু আমাদের এসব প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে যাবে যদি নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসি টাওয়ার ধ্বংসের আসল রহস্য মার্কিন জনগনের সামনে এসে যায়। এজন্যেই আমরা স্পুটনিক ধ্বংস করেছি, স্পুটনিকের হোতা সাত শয়তানকে আমরা আটক করেছি এবং তাদের সংগ্রহ করা লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসি টাওয়ার ধ্বংসের প্রকৃত প্রমাণাদি আমরা হাত করার চেষ্টা করছি। ঐ সাত শয়তানের কাছ থেকে যে কোন মূল্যে আমাদেরকে ঐ ডকুমেন্ট উদ্ধার করতেই হবে। দরকার হলে ওদের সব আত্মীয় পরিজনকে এখানে নিয়ে আসব এবং সাত শয়তানের মুখ খোলার জন্যে এদের গিনিপিগ বানাব। সুতরাং এই সাও তোরাহ দ্বীপের আমাদের মিশন সফল হওয়ার উপরই নির্ভর করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের ভবিষ্যত। নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসি টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য ফাঁস হয়ে গেলে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা দুনিয়ার কাছে আমরা বিশ্বাসঘাতকে পরিণত হবো।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান।
আজর ওয়াইজম্যানের পাথুরে মুখ ভাবলেশহীন। কিন্তু দানিয়েল ডেভিডের চোখে মুখে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বলল দানিয়েল ডেভিড, ‘স্যার, সাও তোরাহ মিশন ব্যর্থ হবে না স্যার। সাত শয়তানকে অবশেষে কথা বলতেই হবে। তবে আহমদ মুসাকে ঠেকানো দরকার স্যার।’
‘হ্যাঁ, আহমদ মুসার ব্যাপারটা আমরা দেখছি। যে যাতে স্পুটনিকের ঘটনার ব্যাপারে নাক গলাতে না পারে, সে ব্যবস্থা আমরা যে কোন মূল্যেই করব। আমি আজই যাচ্ছি সেখানে।’
কথা শেষ করেই ‘গুড মর্নিং টু অল। উইথ ইউ গুডলাক’ বলে চলে গেল আজর ওয়াইজম্যান।
‘গুড মর্নিং’ বলে দানিয়েল ডেভিডরাও তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল।
ততক্ষনে চেয়ার সমেত আজর ওয়াইজম্যান অদৃশ্য হয়েছে।
তিনজনই আবার বসে পড়ল চেয়ারে। ঘড়ির দিকে তাকাল দানিয়েল ডেভিড। বলল, ‘চলুন আমাদেরও সময় হয়েছে যাবার।’
২
উপর থেকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে স্ট্রাসবার্গ শহরকে। বিমানটি তখন চক্কর দিচ্ছে স্ট্রাসবার্গের আকাশে। সবুজ রাইন উপত্যকা। গাঢ় সবুজ উপত্যকার পশ্চিম বরাবর নেমে আসা পাহাড়ের দেয়াল। ইউরোপের প্রধান ধমনী রাইন নদী বয়ে চলেছে আকাশের রংধনুর মত এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে। উপত্যকার সবুজ শাড়িতে রাইন যেন জীবন্ত এক রূপালী পাড়।
আহমদ মুসার মুগ্ধ চোখ দু’টি রাইন উপত্যকা ঘুরে এসে নিবদ্ধ হলো স্ট্রাসবার্গের উপর।
সবুজের সমুদ্রে লাল-সাদায় মেশানো সুন্দর শহর স্ট্রাসবার্গ। শহরের সবকিছু ছাড়িয়ে সবার উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ‘গথিক গীর্জা’। গথিক গীর্জার উপর নিবদ্ধ হলো আহমদ মুসার উৎসুক দু’টি চোখ। শহরের সবচেয়ে পুরানো অংশ এই ঐতিহাসিক গীর্জার সামনেই ‘দি রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল’। এ হোটেলে সিট বুক করা আছে আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার নজর পড়ল সুন্দর পাহাড়ী নদী ‘রাইনে’র উপর। এই নদীটি ঘিরেই গড়ে উঠেছে স্ট্রাসবার্গ নগরী। ‘রাইন’ থেকে একটা ক্যানেল গিয়ে পড়েছে রাইনে। এর ফলেই স্ট্রাসবার্গ কার্যত সমুদ্র বন্দরে পরিণত হয়েছে।
স্ট্রাসবার্গ এয়ারপোর্টে নামল আহমদ মুসা। স্ট্রাসবার্গ এয়ারপোর্ট থেকে রাস্তাটা তীরের মত সোজা গিয়ে প্রবেশ করেছে স্ট্রাসবার্গে। গাড়ির রিয়ার ভিউতে দীর্ঘ পথ এবং পথে গাড়ির দীর্ঘ সারির গোটাটাই নজরে আসে।
স্ট্রাসবার্গে ঢুকে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। খুবই প্রাচীন শহর, কিন্তু রাস্তাগুলো আধুনিক। এয়ারপোর্ট রোডের মতই রাস্তাগুলো সোজা, ছবির মত সাজানো। গাড়ি থেকে সামনে পেছনে অনেকদূর দেখা যায়। চোখ রাখা যায় অনেক দূর।
ভাড়া করা ট্যাক্সির পয়সা মিটিয়ে দিয়ে আহমদ মুসা প্রবেশ করল দি রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে।
রিসেপশন কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটা জার্মান মিশ্রিত ফরাসী ভাষায় আহমদ মুসাকে স্বাগত জানাল। আর মেয়েটাকেও পুরো জার্মান মনে হলো না, আবার পুরো ফরাসীও নয়।
ভাষা ও চেহারাগত দিকটা এই রাইন উপত্যকা এবং এর সন্নিহিত এলাকার একটা বৈশিষ্ট্য। কারণ ফ্রান্স ও জার্মান বর্ডারের এই এলাকাটা শত শত বছর ধরে ফ্রান্স-জার্মান সংঘাতের শিকার। এই অঞ্চলটা কখনও ফ্রান্সের অংশ থেকেছে, কখনওবা জার্মানীর অংশ হয়েছে। ১৫০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই এলাকা জার্মানরা শাসন করেছে। তারপর ফরাসীরা এটা দখল করে। জনগণ তাদের উপর ফরাসী পরিচয় চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু এই জনগনই আবার ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের পর ফরাসী হবার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে। ১৮৭১ সালে জার্মানরা যখন এই এলাকা দখলে করে নেয়, তখন এই এলাকার মানুষ জার্মানদের প্রত্যাখ্যান করে ফ্রান্সে হিজরত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফরাসীরা এই এলাকা জার্মানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই জার্মান এ অঞ্চলটা আবার দখল করে নেয়। যুদ্ধের পর ফ্রান্স অঞ্চলটা আবার ফিরে পায়।
রিসেপশনিস্ট মেয়েটা স্বাগত জানালে আহমদ মুসা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘আমি বিদেশী বলেই আমার কৌতূহল। আমি বুঝতে পারছি না আপনি জার্মান না ফরাসী।’
মেয়েটা হাসল। বলল, ‘আপনার কি মনে হয়?’
‘জার্মান ও ফরাসী দুই-ই মনে হয় আমার কাছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমি ইউরোপীয়।’ বলে আবার হাসল মেয়েটি। বলল আবার আহমদ মুসাকে কথা বলবার সুযোগ না দিয়েই, ‘এটা বললাম কেন জানেন, স্ট্রাসবার্গ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী, মানে এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড কোয়ার্টার।’
‘জানি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরও কি জানেন, স্ট্রাসবার্গ সম্রাট শার্লেম্যানের স্পিরিচুয়াল ক্যাপিটাল ছিল?’ হেসে বলল মেয়েটি।
‘জানি। কিন্তু শার্লেম্যানের ধর্মরাজ্যের স্পিরিচুয়াল ক্যাপিটালকে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী হিসেবে বেছে নিলেন কেন?’ হাসির সাথে হালকা কন্ঠেই বলল আহমদ মুসা।
প্রায় ৫০ বছর আগে জার্মানী ও ফ্রান্সের দুই রাষ্ট্রপ্রধান এই স্ট্রাসবার্গে বসেই শার্লেম্যানের আদর্শে ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করার নীল নক্সা করেছিলেন বলে বোধ হয়।’
‘শার্লেম্যানের খৃষ্টীয় মৌলবাদী আদর্শে নব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন!’ আহমদ মুসার চোখে মুখে কৃত্রিম বিস্ময়।
‘তা জানি না।’ হেসে উঠে কথাটা বলেই মেয়েটি মুখে সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘ওকে স্যার। এবার নিশ্চিন্ত থাকুন আমি একজন ফরাসী।’
‘আমি আহমদ আবদুল্লাহ। সৌদি আরব থেকে একটা কক্ষ বুক করা আছে। বুকিং নাম্বার ডবল ‘এ’ ডবল ‘জিরো’ ডবল ‘নাইন’।
‘প্লিজ স্যার, বলে মেয়েটি কমপিউটার কী বোর্ডে আঙুল ঘুরিয়ে স্ক্রীনের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বলল, ‘ওকে স্যার। ওয়েলকাম।’
ফরমালিটিজ সেরে আহমদ মুসার হাতে চাবি তুলে দিতে গিয়ে হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় বলে উঠল, ‘মি.আহমদ আবদুল্লাহ, একটা খবর দিতে ভুলে গেছি। আপনার দুজন বন্ধু আপনি এসেছেন কিনা, কবে আসবেন জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নাম বলেননি।’
ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। বলল, ‘আমার বন্ধু, নাম বলেনি!’
‘স্যার, ব্যাপারটা খুবই অসৌজন্যমূলক এবং অগ্রহনযোগ্য। সেজন্যে বিষয়টার আমরা ফরমাল রেকর্ডও করিনি।’ বলল মেয়েটি।
‘মাফ করুন, বলতে পারেন কন্ঠ দুটি কি জার্মান না ফরাসী ছিল?’
‘ওকে স্যার। জার্মান-ফরাসী কোনটিই নয়। খাঁটি বৃটিশ উচ্চারণ।’ বলল মেয়েটি।
ভাবছিল আহমদ মুসা। এমন কোন বৃটিশ বন্ধু নেই যারা তার এখানে আসার কথা জানে এবং এখানে সিট বুক করার কথা জানতে পারে!আবার ভাবল, ভুলও তো ওদের হতে পারে? আবার এমনও হতে পারে মুসলিম নামে বুকিং দেখে সরকারী কোন এজেন্সী অথবা অন্য কোন মহল পরিচয় চেক করার জন্যেই টেলিফোন করতে পারে। বেদনাদায়ক হলেও এটা সত্য যে, নিউইয়র্কের লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে মুসলমানদেরকে ইউরোপ আমেরিকায় সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। কিন্তু সেটা হলে সব মুসলিম বোর্ডারের ব্যাপারেই খোঁজ-খবর নেয়া হবে। সেটা হচ্ছে কি?
এটা চিন্তা করেই আহমদ মুসা রিসেপশনিস্ট মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হোটেলে কি আর কোন মুসলিম বোর্ডার আছেন?’
‘আছেন। দু’জন। একজন জার্মান ছাত্রী ‘ফাতিমা কামাল’, অন্যজন ফরাসী ছাত্র যায়েদ ফারুক। কিন্তু কেন বলুন তো?’
‘তাদের ব্যাপারে কেউ কি টেলিফোনে কিছু জিজ্ঞেস করেছে?’
‘না ।’ ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠেছে মেয়েটির। বলল সে আবার, ‘মি.আহমদ আবদুল্লাহ, আপনি কিছু সন্দেহ করছেন?’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভাবছিলাম। বেনামী টেলিফোন তো!’
‘মি.আহমদ আবদুল্লাহ, আপনি ইচ্ছা করলে পুলিশকে জানাতে পারেন।’
আবার হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপাতত থাক। ধন্যবাদ আপনাকে।’
আহমদ মুসা কক্ষের চাবি নিয়ে চলে গেল তার কক্ষে।
কক্ষ পছন্দ হলো আহমদ মুসার। কক্ষের স্টাইল গথিক গীর্জার মত ট্রেডিশনাল হলেও উপকরণ সবই আধুনিক ।
আহমদ মুসা গোসল সেরে বিশ্রামে যেতে যেতে ভেবে নিল। কাজ শুরু করার আগে শহরটাকে ভালো করে দেখে নেবে । আজ পূর্ণ বিশ্রাম, কাল থেকে শহর দেখে শুরু।
সেদিন আহমদ মুসা ফিরছিল ‘ইউরোপা’ রোড হয়ে । বিখ্যাত এই ইউরোপা রোডেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড কোয়ার্টার। আহমদ মুসা রাস্তার থার্ড লেইন ধরে গাড়ি চালাচ্ছিল। অভ্যাস বশতই রেয়ারভিউতে চোখ যাচ্ছিল তার।
এক সময় বিস্মিত আহমদ মুসার চোখ দুটি আঠার মত লেগে গেল রেয়ারভিউতে। দেখল, দু’টি গাড়ি, একটা ব্রাউন, অন্যটি এ্যাশকালার, অনেক্ষণ ধরে তার পেছনে আসছে একই গতিতে। গাড়ি দুটি মাঝে মাঝেই সমান্তরালে চলে যাচ্ছে, আবার আগে পিছে চলে আসছে। তাও আবার বাই রোটেশানে একবার ব্রাউনটা আগে আসছে, পরে আবার এ্যাশকালারটা। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল গতকালও গাড়ি দুটিকে সে তার পেছনে দেখেছে এবং এয়ারপোর্ট থেকে আসার সেই প্রথম দিনেও এই গাড়িই তার পেছনে ছিল । হতে পারে অন্যান্য দিনেও গাড়ি দুটি তার পেছনে ছিল, কিন্তু হয়তো তার চোখে পড়েনি।
ভাবল আহমদ মুসা। এটা কি কোন কো-ইন্সিডেন্ট, না কেউ তাকে ফলো করছে? সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা, আগামীকালও সে এ বিষয়টি পরীক্ষা করবে।
হোটেলের পার্কিং প্লেসে গাড়ি পার্ক করে গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা। গাড়ি থেকে নেমেই গীর্জা ও হোটেলের মাঝের রাস্তার উপর চোখ ফেলল, না গাড়িটা এ রাস্তায় ঢোকেনি। গীর্জার মোড়ে বাঁক নিয়ে তাকে গীর্জার রাস্তায় প্রবেশ করতে হয়েছে। হতে পারে, ওরা বাঁকের আড়ালে দাঁড়িয়ে এদিকে চোখ রাখছে।
আহমদ মুসা ঢুকে গেল হোটেলে।
পরদিন আহমদ মুসা যাচ্ছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্পুটনিক অফিসে। সেদিন এসেই একবার গেছে। কিন্তু আরও ভালো করে দেখা প্রয়োজন।
যা ভেবেছিল তাই। গাড়ি দু’টি আসছে তার পেছনে।
ওরা ফলো করছে তাকে, এটা নিশ্চিত। কিন্তু ওরা কারা? ওরা কি তাকে নবাগত মুসলিম ব্যক্তিত্ব হিসেবে ফলো করছে, না তাকে আহমদ মুসা হিসেবে ফলো করছে? কিন্তু তাকে আহমদ মুসা হিসেবে চিনবে কি করে? সন্দেহ নেই, তার ফটো ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইরগুন যাই লিউমি’ ও ‘মোসাদে’র কাছে আছে। কিন্তু আহমদ মুসার এই স্বাভাবিক চোহারার ফটো তাদের কাছে নেই। তাছাড়া তাকে আহমদ মুসা হিসেবে যদি চিনেই থাকে, তাহলে তাকে শুধু ফলো করবে কেন? তাকে এ কয়দিনে হত্যা বা বন্দী করার উদ্যোগ নেয়াই স্বাভাবিক ছিল। তাহলে কি ওরা আমাকে ধরার আগে আমার কন্ট্যাক্ট পয়েন্টগুলে চিহ্নিত করতে চায়? যাদেরকে তাদের দরকার হতে পারে? শুধু মুসলিম ব্যক্তিত্ববলে পরিচয় জানা বা কন্ট্যাক্ট পয়েন্টগুলোর সন্ধান করার জন্যে এভাবে কেউ পেছনে লেগে থাকতে পারে? হয়তো পারে। তবে আহমদ মুসার মন বলল, ওরা নিছক একজন মুসলিম ব্যক্তিত্বে সন্ধানে ঘুরছে না। তাহলে? তাহলে কি তারা তাকে আহমদ মুসা হিসেবে চিনতে পেরেছে, না আহমদ মুসা হিসেবে সন্দেহ করছে?
গ্রীন সার্কেলে পৌঁছে গেছে আহমদ মুসা। এই গ্রীন সার্কেলেই স্পুটনিকের অফিস ছিল।
গ্রীন সার্কেলটা বিশাল একটি সার্কুলার মার্কেট। বিশাল সার্কুলার মার্কেটটির মাঝখানে বিরাট গ্রীন সার্কেল, বৃত্তাকার বিরাট বাগান। বাগানটা গাছে ঠাসা। মাঝে মাঝে বসার বেঞ্চি ও বাচ্চাদের দোলনা। বৃত্তাকার বাগানটির মাঝখানে আবার ঘাসে ঢাকা বৃত্তাকারি একটি উন্মুক্ত চত্বর। বৃত্তাকার বাগান ও তার চারপাশ ঘিরে বৃত্তাকার মার্কেটটি, মাঝখান দিয়ে বৃত্তাকার একটি রাস্তা। আবার বৃত্তাকার মার্কেটটির বাইরের চারপাশ ঘিরে একটা প্রশস্ত সার্কুলার রোড।
আহমদ মুসার গাড়ি প্রবেশ করল এই সার্কুলার রোডে। দিনটা রোববার। বিকেল। মার্কেট বন্ধ।
সার্কুলার রোডে গাড়ি ছিল না বললেই চলে।
আহমদ মুসার এক মিনিট পর অনুসরণকারী গাড়ি দুটি প্রবেশ করল সার্কুলার রোডে।
আহমদ মুসা কি করবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। যে লেন দিয়ে স্পুটনিক অফিসে প্রবেশ করতে হয়, সেই লেন দিয়ে আহমদ মুসা ধীর গতিতে প্রবেশ করল মার্কেট ও বৃত্তাকার বাগানের মাঝের ইনার সার্কুলার রোডে।
গাড়ি দুটিও প্রবেশ করল।
বাগানে দু’চার জন লোক দেখা যাচ্ছে। ছুটির দিনে বাগানে যে ভীর হয়, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
আহমদ মুসা তার গাড়ির রিয়ারভিউতে দেখল, গাড়ি দুটো দুরত্ব আগের চেয়ে কমিয়ে দিয়েছে। সার্কুলার রোড হওয়ার কারণে আহমদ মুসার গাড়ি যাতে চোখের আড়ালে না যায়, সেজন্যেই এ দূরত্ব কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
পেছনের গাড়ি দুটি পাশাপাশি ড্রাইভ করে আহমদ মুসার পেছনে পেছনে আসছিল।
আহমদ মুসা এক সময় চোখের পলকে তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তীব্র বেগে এগিয়ে গাড়ি দুটি ব্লক করে তাদের সামনে দাঁড়াল এবং তার সাথে সাথেই গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এল আহমদ মুসা।
গাড়ি দুটিও হার্ড ব্রেক কষে দাড়িয়ে পড়েছিল। প্রথমটায় তারা হচকচিয়ে গিয়েছিল। সে ভাবটা কাটিয়ে উঠে আহমদ মুসাকে সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখেই ওরা গাড়ির দুপাশে দুজন বেরিয়ে এল। তারা দুদিক থেকে দুজন এক পা দু’পা করে এগিয়ে আসতে লাগল। তাদের একজনের হাতে রিভলবার কোটের আড়ালে লুকানো। আরেকজনের হাতে রেশমি ফাঁস। ওরা এত তাড়াতাড়ি এগ্রেসিভ হয়ে উঠবে, আহমদ মুসা তা ভাবে নি। আর আহমদ মুসা এভাবে এখানে রিভলভার ব্যবহার করাকেও ভাল মনে করছে না।
আহমদ মুসা তার ভাবনা শেষ করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই সে দেখল, যার হাতে ফাসি তার ফাঁসিটা আকাশে উড়তে শুরু করেছে।
সংগে সংগেই আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল এবং এ্যাক্রোব্যাটিক কায়দায় দু’হাত প্রসারিত করে সামনে মাটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পা আকাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে শূন্যেই শরীরটাকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে দু’পায়ের প্রচন্ড লাথি মারল রিভলবার হাতে নিয়ে দাড়াঁনো লোকটির মাথায়।
লোকটি রিভলবার তুলেছিল এবং গুলিও করেছিল আহমদ মুসার লাথি তার মাথায় আঘাত করার সময়। কিন্তু গুলিটা ৭৫ ডিগ্রী কোণ করে আসা আহমদ মুসার দেহের অনেক নিচ দিয়ে চলে গেল।
জোড়া পায়ের লাথি খেয়ে লোকটির দেহ ছিটকে পড়ে গেল গাড়ির পাশে। তার সাথে আহমদ মুসার দেহও ভূপাতিত হলো।
মাটিতে পড়েই উঠে বসল আহমদ মুসা। লোকটির হাত থেকে ছিটকে পড়া রিভলবার কুড়িয়ে নিয়েছে সে।
লোকটি উঠে বেসেছিল। আহমদ মুসা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রিভলবারের বাট দিয়ে তার মাথায় প্রচন্ড এক ঘা দিল।
লোকটি সংগা হারিয়ে ফেলল।
আহমদ মুসা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ফাঁসিওয়ালা লোকটি কোথায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
আহমদ মুসা ক্রলিং করে গাড়ির পেছনে ঘুরে গাড়ির ওপাশটায় উকি দিল। কিন্তু কেউ নেই।
‘তাহলে কি ওপাশের গাড়ির ওপারে লুকিয়েছে?’ ভাবল আহমদ মুসা।
ভাবার সংগে সংগেই আহমদ মুসা হাতে রিভলবার বাগিয়ে ধরে কয়েক লাফে ওগাড়ির পেছনে চলে গেল। তার পর মুহূর্তকাল থেমেই গাড়ির ওপাশটায় উঁকি দিল। না কেউ নেই। তাহলে কি পালিয়েছে?
পরক্ষনেই তার মনে হলো, সে তো তাকে বোকা বানায়নি?
সংগে সংগেই স্প্রিং এর মত উঠে দাড়িয়ে পেছন ফিরল আহমদ মুসা। কিন্তু তখন দেরী হয়ে গেছে। তার চোখের সামনে দিয়ে প্রথম গাড়িটা সাঁ করে বেড়িয়ে গেল। দেখল, যাবার সময় দ্বিতীয় লোকটি তার সংগাহীন সাথিকে তুলে নিয়ে গেছে। বুঝল আহমদ মুসা, সে যখন দু’গাড়ির এপাশ ওপাশ দেখছিল, তখন ঐ দ্বিতীয় লোকটি প্রথম গাড়ির সামনের দিকটায় গিয়ে লুকিয়েছিল। তারপর সে দ্বিতীয় গাড়ির দিকে চলে যাওয়ায় তার সুযোগ নিয়ে সাথিকে সহ পালিয়েছে।
বোকার মত কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল আহমদ মুসা। তারপর রিভলবারটা পকেটে ফেলে এগুলো দ্বিতীয় গাড়িটার দিকে। টার্গেট হলো, ওদের খোঁজ পাওয়ার মত কোন কাগজপত্র ওদের গাড়িতে পাওয়া যায় কিনা।
গাড়িতে লাইসেন্স, ব্লুবুক ছাড়া কাগজ জাতীয় আর কিছুই পেল না।
লাইসেন্স ও ব্লুবুকের ঠিকানাগুলো টুকে নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
আসরের নামাজের সময় তখন যায় যায় অবস্থা। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি বাগানে প্রবেশ করে একটা গাছের আড়াল খুঁজে নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম অর্থাৎ কাবামুখী হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।
চারটি চোখ আহমদ মুসাকে ফলো করছিল। একজন তরুনীর দুই চোখ এবং একজন তরুনের দুই চোখ। এই চার চোখ আহমদ মুসার সাথে দুই গাড়িওয়ালার সংঘাত –সংঘর্ষটাও দেখেছে। কিভাবে আহমদ মুসার গাড়িটা অনুসরণকারী দু’গাড়ির মুখোমুখি হলো, কিভাবে আহমদ মুসা একজন রিভলবারওয়ালা ও একজন ফাঁসওয়ালার মুখোমুখি হলো, কেমন দক্ষ এ্যাক্রোব্যাটিক কায়দায় আহমদ মুসা একই সাথে ফাঁস থেকে বাচল এবং রিভলবারধারীকে কুপোকাৎ করল, কিভাবে একজন গাড়িওয়ালা সংগাহীন একজন সাথীকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচল, সবই তাদের চার চোখ অবলোকন করেছে বাগানের এক গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসা বাগানে প্রবেশ করার পরও সে তাদের চোখের সামনেই ছিল। তাদের সে বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি যে, একজন শান্তশিষ্ট চেহারার ও সাধারণ মাপের একজন মানুষ কিভাবে দু’জন ষন্ডামার্কা ফরাসীকে নাকে খত দিয়ে ছাড়ল!কিন্তু তারা যখন আহমদ মুসাকে নামাজ পড়তে দেখল তখন তাদের চার চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল। দু’জন এক সাথেই স্বগত কন্ঠে বলে উঠল, ‘লোকটি তাহলে মুসলমান।’
ধীরে ধীরে তাদের দু’জনের চোখমুখের বিস্ময় কেটে গিয়ে সেখানে আনন্দের প্রকাশ ঘটল। আহমদ মুসা মুসলমান একথা জানার পর তাদের মনে আনন্দের অন্ত রইল না। তারা ভেবে খুশি হলো যে, একজন এশিয়ান মুসলিম দু’জন বন্দুকধারী ফরাসীকে অবলীলাক্রমে পরাজিত করতে পারল।
দুজনেই ধীরে ধীরে এগুলো নামাজরত আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা তখন মুনাজাত করছে।
আহমদ মুসার পাশে গিয়ে থমকে দাঁড়াল ওরা।
আহমদ মুসাও মুনাজাত এই সময় শেষ করেছিল। ঘাসের উপর পায়ের ক্ষীণ নরম শব্দ আহমদ মুসার কান এড়ায়নি। তাকাল আহমদ মুসা ওদের দিকে।
আহমদ মুসার চোখে ছিল ক্ষীপ্র এক সতর্কতা। চোখ যখন সে ওদের দিকে ঘুরাচ্ছিল, তখন তার হাত চলে গেল গিয়েছিল রিভলবারের বাঁটে।
পাশে এসে দাঁড়ানো তরুণ-তরুণীদেরও এটা চোখে পড়েছিল।
আহমদ মুসার চোখ ওদের উপর পড়তেই তরুণীটি বলে উঠল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘আসসালামু আলাইকুম।’ তরুণটিও বলে উঠল তরুণীটির কন্ঠ থামতেই।
তরুণ তরুণী দু’জনের চেহারাই ইউরোপ-এশিয়ায় মেশানো। চোখ ও চুল ওদের এশিয়ান। কিন্তু গায়ের রং ইউরোপীয়, তবে তার সাথে একটা সোনালী মিশ্রণ আছে যা তাদেরকে অপরূপ করে তুলেছে।
এমন এক জোড়া তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে আকস্মিক সালাম পেয়ে আহমদ মুসা বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেল। সে এ সময় তার শত্রুদেরকেই আশা করেছিল।
আহমদ মুসার মুহূর্তকালের নিরবতার সুযোগে তরুণীটিই আবার বলে উঠল, ‘রিভলবার হাতে রাখার দরকার নেই। আমরা আপনার বন্ধু। আপনার মারামারি আমরা দেখেছি। আপনি মুসলিম দেখে পরিচয়ের জন্যে আমরা এলাম।’ মেয়েটির মুখে মিস্টি হাসি।
আহমদ মুসার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘দু’টি সংশোধনী। আপনারা আমার বন্ধু না হয়ে ভাই বোন হলে খুশি হবো। দ্বিতীয়ত, ঘটনাটা মারামারি ছিল না। ওরা আমাকে মারতে চেয়েছিল, আমি আত্মরক্ষা করেছি।’
তরুণ তরুণী দু’জনেই হাসল। আহমদ মুসার সামনে বসতে বসতে বলল, ‘ওয়েলকাম। আমরা আনন্দের সাথে ভাই-বোন হতে রাজী আছি। তবে শর্ত ‘আপনি’ সম্বোধন ‘তুমি’ তে নিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়টাও আমরা মেনে নিচ্ছি। দু’গাড়িওয়ালারা আসলে, যতদূর বুঝেছি, আপনাকে ওরা ফলো করছিল এবং সেখান থেকেই ঘটনার সৃষ্টি। সুতরাং তারাই আক্রমনকারী।’
‘কিন্তু ভাইয়া, কোন জার্মান-ফরাসীকে আমি কোনদিন এইভাবে এশিয়ানের হাতে কুপোকাত হতে দেখিনি। এই বিজয়ের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ এবং সেই সাথে জানাচ্ছি ওরা কিন্তু আপনাকে ছাড়বে না। আর কি ঘটনা আছে জানি না, কিন্তু ওদের আর্য অহং এ দারুণ ঘা লেগেছে।’ বলল তরুণীটি।
‘বোন, জার্মান ফরাসী ও এশিয়ান এই দৃষ্টিতে বিষয়টিকে না দেখাই ভাল। এটা যেমন ন্যায়-অন্যায়ের একটা দ্বন্দ্ব ছিল, তেমনি যখন কোন সংঘাত বাধে সেটা কোন অন্যায় থেকেই বাধে। কিছু ক্রিমিনাল ছাড়া সব জার্মান ফরাসীই ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’ বলল আহমদ মুসা।
তরুণীটি আহমদ মুসার মুখের শেষ শব্দ সম্পূর্ণ হবার আগেই বলে উঠল, ‘আপনি কে জানি না। আপনার চিন্তা অবশ্যই মহৎ। কিন্তু সাধারণভাবে এটা বাস্তব নয়। পশ্চিমের যারা এশিয়া আফ্রিকা দখল করে একদিন এশিয়া আফ্রিকার মানুষকে যথেষ্ট শাসন শোষনের শিকারে পরিণত করেছিল, তারা এখনও এশিয়া আফ্রিকার মানুষকে সেই একই দৃষ্টিতে দেখে। শাসন শোষনের কৌশল শুধু তারা পাল্টেছে।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কথা আমি অস্বীকার করছি না বোন। কিন্তু একে পূব-পশ্চিমের সংঘাত বা পশ্চিমের শোষণ হিসাবে দেখো না। বেদনাদায়ক হলেও যেটা ঘটছে, সেটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেক ব্যক্তির মত প্রতিটি জাতি গোষ্ঠীই তাদের ভাল চিন্তা করবে, স্বার্থ চিন্তা করবে এটাই স্বাভাবিক। পশ্চিম আজ ‘গণতন্ত্রের’ নামে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে যে হস্তক্ষেপ করছে, মুক্ত অর্থনীতির নামে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকে যে কব্জা করছে, মানবাধিকারের শ্লোগান তুলে এশিয়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের জাতি গঠন ও সংহতিকে যে বাধাগ্রস্থ করছে এবং তথাকথিত ‘সাসটেইনেবল ফেইথ বা ভ্যালুজে’র নামে তারা জাতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের উপর যে ছড়ি ঘুরাতে চাচ্ছে, সেটা পশ্চিমী বিভিন্ন রাষ্ট্র বা জাতির ‘ভাল’ বা ‘স্বার্থ’ চিন্তা করেই। প্রশ্ন হলো তাদের এই ‘ভাল’ বা ‘স্বার্থ’ চিন্তা আমাদের ক্ষতি করছে। আমাদের এই ক্ষতি তারা করতে পারছে তাদের বুদ্ধি ও শক্তির বলে। এর প্রতিকার ভিক্ষা চেয়ে পাওয়া যাবে না, কারণ ভিক্ষুকের আবেদনে তারা কিছু ভিক্ষা দিতে পারে, কিন্তু তাদের ‘ভাল’ বা ‘স্বার্থ’ যাতে, সেখান থেকে সরে দাঁড়াবে না। এর অর্থ হলো আমাদের ‘ভালো’ আমাদের ‘স্বার্থ’ আমাদের দেখতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই তরুনীটি বলে উঠল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি চিন্তার একটা বাস্তব ও বিপ্লবাত্মক দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন। কিন্তু এটা কিভাবে? আপনিই তো বললেন, ওরা শক্তি ও বুদ্ধির জোরে এটা করছে। শক্তি বা বুদ্ধি কোন যুদ্ধেই তো আমরা ওদের সাথে পারবো না।’
‘না পারা পর্যন্ত মার খেতেই হবে। দুর্বলরা এভাবেই মার খায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেচ্ছার কি এখানেই শেষ? কোন পথ তাহলে নেই?’ বলল তরুনীটি।
‘আছে। ইউরোপের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইউরোপ যদি তাদের স্বার্থে একক মুদ্রা, একক অর্থনীতি, একক একটি পার্লামেন্ট গড়তে পারে, তাহলে মুসলিম দেশগুলো অর্থাৎ এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলো নিজস্ব বানিজ্য ব্যবস্থা, নিজস্ব বিনিয়োগ ব্যবস্থা ইত্যাদি গড়তে পারবে না কেন?’ আহমদ মুসা হাসল।
‘আপনার মারামারি দেখে মনে হয়েছিল, আপনি সাংঘাতিক একজন লড়াকু ব্যক্তি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনি একজন সাংঘাতিক পলিটিশিয়ান। আসলে……….।’
তরুণীটি তরুণকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, ‘এই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, আগে বিশ্ব রাজনীতিটা শেষ হোক।’
তরুণীটি মুহূর্তের জন্যে থামল। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, আপনি মুসলিম দেশ ও আফ্রো-এশীয় দেশগুলোকে যা করতে বলেছেন, তার জন্যেও তো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি দরকার।’
‘সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ন্যায়কে ভালোবাসা এবং অন্যায়ের সাথে কোন সমঝোতায় না যাওয়ার শক্তি। এই শক্তি অন্যসব শক্তি সৃষ্টি করে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনি এক দূর্লভ শক্তির কথা বললেন, যার দুর্ভিক্ষ এখন সবচেয়ে প্রকট।’ আহমদ মুসা থামতেই দ্রুত কন্ঠে বলে উঠল তরুণটি।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এই দুর্ভিক্ষ প্রকট বলেই আমাদের ভোগান্তিও প্রকট।’
‘ধন্যবাদ। রাজনীতির কথা এখন থাক। বলুন, দুই ইউরোপীয় আপনাকে তাড়া করছিল কেন? চেনেন ওদের? বলল তরুণটি।
‘ওদের চিনি না। কিন্তু তাড়া করার কারণ বোধ হয় জানি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি কারণ?’ বলল তরুণীটি।
আহমদ মুসা ওদের দুজনের দিকে তাকাল। বলল, ‘তার আগে তোমাদের পরিচয় জানা দরকার।’
সংগে সংগে তরুণীটি বলে উঠল, ‘আমি ফাতিমা কামাল। জার্মানীর ‘বন’ এ বাড়ি। বনের স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী।’
তরুণীটি কথা শেষ না হতেই তরুণটি বলা শুরু করল, ‘আর আমি যায়েদ ফারুক। প্যারিসে বাড়ি। প্যারিস ইউনিভার্সিটির ছাত্র।’
বিস্ময় ও আনন্দের চিহ্ন আহমদ মুসার চোখে মুখে। তরুনটির কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা কি দি রাইন ইন্ট্যারন্যাশনাল হোটেলে থাক?’
‘হ্যাঁ। কি করে জানলেন?’ এক সাথে বলে উঠল তরুণ-তরুণী দু’জনেই।
‘আমিও ঐ হোটেলেই উঠেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আমাদের কথা জানলেন কি করে?’ বলল তরুণীটি।
‘আমি যেদিন হোটেলে আসি, সেদিনই আমি কাউন্টারে খোঁজ নিয়েছিলাম আর কোন মুসলিম এই হোটেলে আছে কিনা? তারাই আমাকে তোমাদের দু’জনের নাম বলেছিল।’
বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘কিন্তু তোমরা তো দুই প্রান্তের দুইজন, তোমাদের পরিচয় কিভাবে? না বন্ধু ছিলে তোমরা?’
‘না কেউ কাউকে চিনতাম না। আমি যেদিন হোটেলে আসি, সেদিন রিসেপশনে ‘হালাল’ খাবার নিয়ে আলাপ করছিলাম। এ সময় যায়েদ পাশে দাড়িয়ে ছিল। সে অযাযিতভাবেই আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এভাবেই আমাদের পরিচয়।’ বলল তরুণীটি।
‘তোমরা কি হালাল-হারাম মান? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা। ঠোটে এক টুকরো হাঁসি।
‘না মানলে মুসলমানিত্ব থাকবে কি করে?’ তরুণটি বলল।
আহমদ মুসার ঠোটে আরও স্পষ্ট মিস্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘মুসলমানিত্ব রক্ষার জন্যে আর কি কর? তোমরা দুজন কি আসরের নামাজ পড়েছ?’
তরুণ-তরুণী দুজনের মুখই ম্লান হয়ে গেল। মুখ নিচু হয়ে গেল তাদের। একটু পরেই তরুনীটি মুখ তুলল। বলল, ‘স্যরি ভাইয়া। আমি নামাজ পড়ি। তবে বাইরে বেরুলে অনেক সময় অবস্থার কারণে পড়তে পারি না। কিন্তু কাজা পড়ে নেই।’
যায়েদ ফারুকের মুখ লাল। তরুনীটি মানে ফাতিমা কামাল থামতেই যায়েদ ফারুক বলে উঠল, ‘আমার জবাব দেবার কিছু নেই ভাইয়া। আমাকে কেউ কোনদিন এভাবে বলেনি। নামাজ না পড়ার অপরাধ-বোধ আমার ভেতরে আছে। আমি আজ থেকে নামাজ পড়ব ভাইয়া।’
‘তোমাদের ধন্যবাদ।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘তোমরা জিজ্ঞেস করছিলে ওরা আমাকে তাড়া করার কারণ কি, তাই না? আমি স্ট্রাসবার্গ বিমানবন্দরে নামার পর থেকেই ওরা আমাকে ফলো করছে। আমি যেখানে যাচ্ছি, তারা পিছু পিছু যাচ্ছে। প্রথম দু’দিন আমি বুঝতে পারিনি। আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওদের মুখোমুখি হবো। তাদের মুখোমুখি হতে গিয়েই এই সংঘর্ষ।’ থামল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনের চোখে মুখে বিস্ময়। আহমদ মুসা থামতেই তারা বলল, ‘সাংঘাতিক ঘটনা। কিন্তু এ শত্রুতার কারণ কি?’
‘কারণ কি আমি জানি না। তবে আমি যেটা অনুমান করি, সেটা হলো ব্যাপারটা খুবই বড়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি সেটা?’ বলল ফাতিমা কামাল। তার চোখে শংকা।
আহমদ মুসার চোখে মুখে নেমে এল গাম্ভীর্য। ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার মনে হয় ‘স্পুটনিক’ নামের গোয়েন্দা সংস্থা যারা ধ্বংস করেছে এবং এর গোয়েন্দাদের যারা কিডন্যাপ করেছে, তারা বা তাদের ভাড়া করা লোক এরা।’ আহমদ মুসা থামল।
‘স্পুটনিকে’র নাম শুনেই চমকে উঠেছে যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেই। আহমদ মুসা যখন তার কথা বলা শেষ করল, তখন বিস্ময় শংকায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে তাদের চেহারা।
আহমদ মুসা থামলেও কয়েক মুহূর্ত তারা কথা বলতে পারল না। পরে ফাতিমা কামালই ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনি স্পুটনিকের ঘটনা জানেন? কিন্তু ওরা আপনার পেছনে লাগবে কেন?’
‘জানি। লা-মন্ডে পত্রিকায় পড়েছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আর ওরা আপনার পেছনে কেন? বলল ফাতিমা কামাল।
‘ওরা বোধ হয় ধরে নিয়েছে আমি যখন স্ট্রাসবার্গে এসেছি, তখন স্পুটনিকের ব্যাপার নিয়ে নিশ্চয় আমি কিছু করব। এ জন্যেই তারা আমার গতি বিধির উপর নজর রাখছে।’
যায়েদ ও ফাতিমার বিধ্বস্ত চার চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
এক সময় ফাতিমার ধীর কন্ঠ থেকে বের হয়ে এল, ‘আপনি কে ভাইয়া? আপনার কথা থেকেই প্রমাণ হচ্ছে স্পুটনিক ধ্বংসকারীরা আপনাকে চেনে এবং স্ট্রাসবার্গে এলে আপনি স্পুটনিক ঘটনার অনুসন্ধান করতে পারেন, তাও তারা জানে। কে তাহলে আপনি ভাইয়া?’
ফাতিমা থামতেই যায়েদ বলে উঠল, ‘ঠিক, আমরা এ পর্যন্ত তো আপনার কিছু জানি না। এমনকি আপনার নাম পর্যন্তও না। বলুন ভাই।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমাকে আহমদ আবদুল্লাহ বলে ডাকাই যথেস্ট নয় কি?’
‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’ বলল ফাতিমা।
‘সৌদি আরব থেকে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু আপনি এখানে এলেই স্পুটনিক ব্যাপারে অনুসন্ধান করবেন এটা তারা ভাবতে গেল কেন? আপনাকে কেমন করে ওরা চেনে?’ জিজ্ঞেস করল যায়েদ ফারুক।
‘আমি গোয়েন্দা কাজে খুব আগ্রহী। বিশেষ করে মুসলমানরা এ ধরনের কোন বিপদে পড়লে আমি সেখানে যাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু মনে হচ্ছে ওরা আপনাকে ভয় করে। সে জন্যে আপনার গতিবিধি ওরা পাহারা দিচ্ছে এবং সুযোগ পেয়েই আপনাকে আটকাবার বা মারার চেষ্টা করেছিল। এটা কেন?’ বলল ফাতিমা।
‘স্পুটনিকের ব্যাপারে কেউ খোঁজখবর নিক, কেউ এর সাথে জড়িয়ে পড়ুক তা নিশ্চয় তারা চায় না। কারণ এটাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরাও তো এই কাজেই এসেছি এবং এ নিয়ে প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থার সাথেও আলাপ করেছি। আমরা তাদের আত্মীয়। আমরা এ ঘটনায় জড়িত হয়ে পড়তেই পারি। কিন্তু আমাদের উপর তাদের চোখ পড়েনি।’ বলল ফাতিমা।
‘তোমরা তাদের আত্মীয়? কে তোমরা?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
ফাতিমাই প্রথম কথা বলে উঠল। বলল, ‘আমি স্পুটনিকের নাম্বার ওয়ান গোয়েন্দা পরিচালক কামাল সুলাইমানের ছোট বোন। আমি বনের পারিবারিক বাড়িতে থাকি। স্পুটনিকের ব্যাপারে অনুসন্ধানের জন্যেই এখানে এসেছি। শত্রু চোখ এড়াবার জন্যেই ভাইয়ার বাড়িতে উঠিনি। আর যায়েদও স্পুটনিকের দ্বিতীয় গোয়েন্দা পরিচালক আবদুল্লাহ ফারুকের ছোট ভাই। সেও একই লক্ষ্যে স্ট্রাসবার্গে এবং আমার মত একই কারণে হোটেলে উঠেছে।’
‘তোমাদের অভিনন্দন। তাহলে আমরা একই উদ্দেশ্যে স্ট্রাসবার্গে এসেছি এবং কাকতালীয়ভাবে একই হোটেলে অবস্থান করছি। শুধু একটাই পার্থক্য। আমি স্পুটনিকের সাতজন ঐতিহাসিক পরিচালকের কারও সাথেই কোনভাবে সম্পর্কিত নই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনাকেও ধন্যবাদ। আমাদের মধ্যে আরেকটা পার্থক্য আছে। সেটা হলো আমরা এসেছি রক্তের টানে, আর আপনি এসেছেন হৃদয়ের টানে। রক্তের টানের চেয়ে হৃদয়ের টানটাই বেশি মূল্যবান।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘এসব কথা থাক বোন। তোমরা এবার কাজের কথায় এস। কিছুক্ষণ আগে যা ঘটল, তাতে শত্রুর লেজে পা পড়েছে। এরা দ্রুত একটা পাল্টা ছোবল মারবে।’ বলল আহমদ মুসা।
যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেরই চোখে মুখে শংকা ফুটে উঠল। যায়েদ বলল, ‘তার মানে ওরা আক্রমন করবে?’
‘আমার তাই বিশ্বাস।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘আক্রমনকারী গাড়ি দুটির নাম্বারসহ থানায় একটা ডায়েরী করতে চাই যে, গ্রীন সার্কেলের ইনার সার্কুলার রোডে আমি আক্রান্ত হই। দু’টি গাড়িতে দু’জন লোক আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে। ওদের একটা গাড়ি এবং তোমরা ঘটনার সাক্ষী।’
‘আমরা সাক্ষী হতে রাজি আছি। কিন্তু পুলিশের কাছে বিশেষ কোন সাহায্য মিলবে না।’ বলল যায়েদ।
‘আমি পুলিশের সাহায্য চাই না, আইনকে আমার পক্ষে চাই। এ জন্যেই এই ডায়েরী।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার চিন্তা ঠিক ভাইয়া। গ্রীন সার্কেলের একটু পরেই একটা থানা আছে। যাবার সময় ডায়েরী করা যাবে।’ ফাতিমা বলল।
‘যে গাড়ি ফেলে ওরা পালিয়েছে, সেই গাড়িও পুলিশের হাতে দেওয়া দরকার।’ বলল যায়েদ।
‘সার্কেল পুলিশকে ডেকে বললেই হবে।’ ফাতিমা বলল।
‘যায়েদ-ফাতিমা, ঘটনার ব্যাপারে তোমরা কি পরিমাণ এগিয়েছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘না ভাইয়া। আমরা কিছুই এগুতে পারিনি। আমাদের দু’জনের পরিচয় হবার পর আমরা চেষ্টা করছি ভাইয়ারা যে সব করেছেন ও করছেন তার ভিত্তিতে ভাইয়াদের শত্রুদের একটা তালিকা করার।’ ফাতিমা বলল।
‘কিভাবে করছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘অতীতের পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে ও ভাইয়াদের বন্ধু-বান্ধবদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে।’ বলল যায়েদ।
‘আপনার কাজ কতদূর ভাইয়া?’ ফাতিমা বলল।
‘সবে আজ কাজ শুরু হলো। এ কয়দিন আমি শহর দেখে বেড়িয়েছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আজ কিভাবে কাজ শুরু হলো’, ফাতিমা বলল।
‘কিছুক্ষণ আগে গ্রীন সার্কেলে ওদের আক্রমনের মাধ্যমে। শুরুটা খুবই ভাল হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিভাবে?’ যায়েদ বলল।
‘শত্রুরা আক্রমন করা মানে শত্রুর সাথে দেখা হওয়া। তার মাধ্যমে শত্রুদের পরিচয় উদ্ধারের একটা সুযোগ সৃষ্টি হলো। গাড়ি চুরি করা ও গাড়ির লাইসেন্স ও ব্লবুক ভূয়া হতে পারে, কিন্তু ওগুলোতে হাতের যে ছাপ আছে তা ভূয়া নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই সংঘাত আরও সংঘাতের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সুতরাং আমি খুশি যে, আবারও তাদের দেখা পাব।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ও যায়েদের চোখে মুখে বিস্ময়। ফাতিমা বলল, ‘ওরা আবার আক্রমন করবে। আরও সংঘাত হবে। এতে আপনি খুশি। কিন্তু আমাদের তো বুক কাঁপছে।’
‘বুঝলাম, আপনি জাত গোয়েন্দা ভাইয়া। কিন্তু সংঘাতের রেজাল্ট পক্ষে-বিপক্ষে দুই-ই হতে পারে। বিপক্ষে যাবে সে ভয় আপনার নেই?’ বলল যায়েদ।
‘এসব ভাবলে তো এগুনো যাবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝা গেল, আপনি আমাদের মত সাধারণ কেউ নন এবং এও বুঝা গেল ওরা আপনাকে ভয় করে কেন?’ বলল ফাতিমা।
‘আমরা আনন্দিত ভাইয়া। আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন। আমরা যা করছি, সেটা পুলিশ যা করছে সে রকমই। কিছুই হবে না এতে।’ যায়েদ বলল।
যায়েদ থামতেই ফাতিমা কামাল বলে উঠল, ‘ভাইয়া, আমাদের দু’জনকে কি আপনি সাথে নিতে পারেন?’
ফাতিমার হঠাৎ এই প্রশ্নে আহমদ মুসা মুখ তুলে তাদের দিকে তাকাল। তারপর মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘নিতে পারি। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।’
‘কি সমস্যা?’ বলল ফাতিমা।
‘সমস্যা হলো তোমরা দু’জন বিবাহিত নও।’ আহমদ মুসা বলল।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনের মুখেই বিস্ময় ফুটে উঠল তারপর লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল মুখ।
সংগে সংগে কথা বলতে পারল না তারা। একটু পর ফাতিমা বলল, ‘আপনার কথা বুঝলাম না ভাইয়া। বিয়ের সাথে আমাদের প্রস্তাবের সম্পর্ক কি!’
‘অনধিকার চর্চার জন্যে মাফ করো বোন। আমি তোমাদের দু’জনের মধ্যেকার বিয়ের কথা বলছি। তোমাদের দু’জনের মধ্যে বিয়ে না হয়ে থাকলে কিংবা বিয়ে না হলে তোমরা দু’জনে যেমন একত্রে এভাবে কাজ করতে পার না, তেমনি তোমরা দু’জনে বিবাহিত হলেই শুধু তোমরা একত্রে আমার সাথে কাজ করতে পার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এর কারণ কি ভাইয়া?’ ফাতিমাই বলল আবার।
‘ইসলামের বিধান অনুসারে যাদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ নয়, এমন ছেলে মেয়েরা বিবাহ ছাড়া এভাবে মেলামেশা করতে পারে না। এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে নিভৃতে দু’জনের মধ্যে কিছুক্ষনের জন্যেও দেখা হওয়া নিষিদ্ধ।’
‘নিষিদ্ধ? মানে হারাম?’ বলল ফাতিমা।
‘হ্যাঁ, তাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কারণ?’ বলল ফাতিমা।
‘কারণ শয়তান মানুষকে খারাপ পথে টেনে নেবার জন্যে সদা প্রস্তুত। আর ইসলাম সকল অঘটনের পথ বন্ধ করতে চায়।’
‘বুঝেছি।’ লাজ রাঙা মুখে বলল ফাতিমা।
একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু ভাইয়া আমি ও যায়েদ এমন নিভৃতে অনেক বসেছি, মিশেছি।’
‘কিছু ঘটেনি। কিন্তু ঘটবে না এমন কথা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? আর ব্যতিক্রম তো থাকতেই পারে। কিন্তু আইন হয় সকলের জন্যে। সকলকেই সেই আইন মানতে হয়। ব্যতিক্রম যারা, তাদেরকেও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে তো আমরা এতদিন অপরাধ করেছি ভাইয়া। কিন্তু আমাদের কি দোষ? আমাদের জার্মানীতে মুসলিম পরিবারে এমন মেলামেশা আছে।’ ফাতিমা বলল।
‘আপনি কি ইসলামের সকল বিধিবিধান মেনে চলেন ভাইয়া?’ বলল যায়েদ।
‘পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে অনেক সময়ই পারি না। কিন্তু মানার ইচ্ছা আছে, চেষ্টা আছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদেরও তাই করা উচিত। কিন্তু ভাইয়া আপনি যে বিষয়ে প্রস্তাব করেছেন, সেটা নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। যায়েদ ভেবেছে কিনা জানি না।’ বলল ফাতিমা।
যায়েদের মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আমি ভাইয়ার কাছে মিথ্যা বলব না। মিস ফাতিমা আমাকে মাফ করুন, আমি তাঁকে নিয়ে ভেবেছি।’
‘কিন্তু আমার অজ্ঞাতে সেটা, আমাকে কিছু বলনি কখনও।’ বলল ফাতিমা লজ্জায় লাল হয়ে।
‘দুঃখিত, ভাবনাটা কখন যে আমার মনে এসেছে বলতে পারব না। যখন ভাবনাটা আমার জন্যে সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে, তখন বিষয়টা বার বার আমি তোমাকে বলতে চেয়েছি, কিন্তু তুমি একে কিভাবে নেবে তাই বলতে সাহস পাই নি।’
‘তাহলে তুমি আমাকে ভয় কর দেখছি?’ ফাতিমার ঠোঁটে লজ্জা ও হাসির মিশ্রণ।
‘কারণ, সত্যিই তোমার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।’ বলল যায়েদ মুখ নিচু করে।
‘ও, এই কারণেই অপ্রয়োজনেও তোমাকে আমার কক্ষে আসতে দেখেছি।’ বলল ফাতিমা। তার কন্ঠে শাসনের সুর।
‘আমি দুঃখিত ফাতিমা আমার দূর্বলতার জন্যে।’ বলল যায়েদ নরম কন্ঠে।
ফাতিমা হেসে উঠল। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘ভাইয়া, আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। আমরা ধরা পড়ে গেছি। আমি বিয়ের কথা ভাবিনি বটে, কিন্তু শুধু যায়েদ নয়, আমিও দেখছি ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমি ওর ঘরে যাইনি বটে, কিন্তু আমি মনে মনে চাইতাম ও আমার ঘরে আরও বেশি আসুক। আমি আরও স্বীকার করছি ভাইয়া। আপনার কথাই ঠিক। কিছু ঘটেনি বটে, কিন্তু সব কিছুই ঘটতে পারতো। আমি আপনার প্রস্তাবে রাজী ভাইয়া। এখন ওর মত জিজ্ঞাসা করুন।’ ফাতিমার শেষের কথাগুলো কান্নাজড়িত আবেগে রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
যায়েদ মুখ তুলে বলল, ‘অন্যায় অবাঞ্চিত গোপন দূর্বলতার জন্যে আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। অবাধ মেলামেশারই এটা স্বাভাবিক পরিণতি ছিল। ভাইয়া, আপনি ঠিকই বলেছেন এই অবস্থা অব্যাহত থাকা আর এক মুহূর্তও উচিত নয়। ফাতিমাকে ধন্যবাদ। ফাতিমা কি ভাববে এজন্যে আমার রাজী থাকার কথা বলতে পারিনি। আমি আনন্দের সাথে আমার মত দিচ্ছি।’
যায়েদ থামতেই ফাতিমা বলে উঠল, ‘আনন্দ শব্দ যোগ করার কোন দরকার ছিল না। ভাইয়া সম্মতির কথা জানতে চেয়েছেন, কোন বিশেষণ নয়।’
‘স্যরি। তবে এটা খারাপ বিশেষণ নয়, ভাল বিশেষণ।’ যায়েদ বলল।
‘প্যারিসের লোকদের ঘরোয়া বুদ্ধি মোটা শুনেছিলাম। আজ প্রমাণ পেলাম। আমাদের ‘বনে’ ব্যক্তির লজ্জাশীলতা এখনও আছে, প্যারিসে তা নেই।’ বলল ফাতিমা।
‘দেখুন ভাইয়া, ফাতিমা প্যারিস তুলে কথা বলছে। বন আর জার্মানীর কথা আমরা কম জানি না।’ কৃত্রিম ক্ষোভ ফুটে উঠল যায়েদের কন্ঠে।
ফাতিমা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে বলল, ‘বিয়েটা বন-প্যারিসের মধ্যে হচ্ছে না, হচ্ছে ফাতিমা ও যায়েদের মধ্যে। তাদের কালচার শুধুই বন ও প্যারিস ভিত্তিক নয়।’
থামল আহমদ মুসা। থেমেই আবার বলে উঠল, ‘তাহলে তোমরা তোমাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলো। শুভ কাজ সত্ত্বরই হয়ে যাওয়া উচিত।’
বলে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। তোমরা যাও অজু করে এস। দু’জনেই আমার সাথে নামাজ পড়বে।’
ওরাও আহমদ মুসার সাথে উঠে দাড়িয়েছে। আনন্দের সাথে ওরা চলল অজু করার জন্যে।
ঘুম ভেঙ্গে গেল আহমদ মুসার।
একটা শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেছে।
কিসের শব্দ?
ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা।
ঘর অন্ধকার। কিন্তু দক্ষিনের দেয়াল জোড়া নীল পর্দার মধ্যে দিয়ে বাইরের নগর রাতের নিস্তব্ধতা এসে ঘরের দক্ষিণ প্রান্তের স্বচ্ছতা কিছুটা ফিঁকে করে ফেলেছে।
আহমদ মুসা চোখ খোলার পর তার চোখ আশপাশটা ঘুরে এসে প্রথমেই সোজা গিয়ে নিবদ্ধ হলো দক্ষিণ দেয়ালের পূব প্রান্তের তার বরাবর পর্দার উপর। চোখ পড়তেই আটকে গেল সেখানে তার চোখ। পর্দা নড়ছে।
কেন নড়ছে? দক্ষিণে গোটাটাই কাঁচের দেয়াল। কোন ফাঁক নেই। বাতাসের প্রবাহ প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। তাহলে নড়বে কেন পর্দা?
নড়ে উঠা পর্দা আবার স্থির হয়েছে।
আহমদ মুসা চোখ সরায়নি পর্দার সেই অংশের উপর থেকে।
মুহূর্তকাল পরেই পর্দা ধীর গতিতে আবার দুলে উঠল এবং সেই সাথে একটা চলন্ত ছায়ামূর্তি পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এল।
ঘরের অন্ধকারে ছায়ামূর্তিটিকে আরও গাঢ় অন্ধকার দেখাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে আহমদ মুসা দেখল ছায়ামূর্তিটির ডান হাত কোমর পর্যন্ত উচুঁতে প্রসারিত। দেহটি সামনের দিকে একটু বেঁকে আসা।
লোকটির ডান হাতে রিভলবার এবং সে আক্রমণাত্মক ভংগিতে পা পা করে অতি সাবধানে তার বেডের দিকে এগিয়ে আসছে।
বুঝল আহমদ মুসা কি ঘটতে যাচ্ছে।
শক্ত হয়ে উঠল আহমদ মুসার দেহ। তার চোখ দু’টি স্থির নিবদ্ধ লোকটির উপর।
আস্তে আস্তে আহমদ মুসা তার ডান হাত বালিশের তলায় নিল। কিন্তু হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল কার রিভলবারটা জ্যাকেটের পকেটেই রয়ে গেছে। গত রাতে বাইরে থেকে ফেরার পর রিভলবারটা রীতি অনুসারে পকেট থেকে বের করে বালিশের তলায় রাখা হয়নি।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আহমদ মুসার। যেদিন প্রয়োজন সেদিনই তার এ ভূলটা হয়ে গেছে।
লোকটি এগিয়ে আসছে।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘুমের ভান করে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আহমদ মুসা। যেহেতু ওর হাতে রিভলবার, তাই সে দূরে থাকতে প্রতিরোধ বা প্রতিআক্রমনের চেষ্টা করে লাভ নেই।
লোকটি খাটের কাছাকাছি পৌঁছে খাট ঘুরে আহমদ মুসার পেছন দিক থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। খাটের পশ্চিম পাশ দিয়ে আহমদ মুসার মাঝ বরাবর আসার পর লোকটি বাম হাত থেকে ডান হাতে রিভলবারটি নিল এবং লোকটির ডান হাত ঢুকে গেল তার পকেটে। বেরিয়ে এল সাদা রঙের কিছু একটা নিয়ে।
আহমদ মুসা বুঝল ওটা একটা সাদা রুমাল। সাদা রুমাল কেন? মনে প্রশ্নটা জাগার সাথে সাথেই আহমদ মুসা বুঝল, নিশ্চয় ঐ রুমালের ভেতর রাখা আছে ক্লোরোফরম ক্যাপসুল। হাতের চাপে ওটা ভেঙে নিয়ে রুমাল নাকে চাপার সেকেন্ডের মধ্যেই একজন মানুষ সংগা হারিয়ে ফেলে।
লোকটির পরিকল্পনা বুঝে খুশি হলো আহমদ মুসা। এখন আহমদ মুসা নিশ্চিত যে, সে প্রথমেই গুলী করবে না।
লোকটি আহমদ মুসার ডান পাশ ঘুরে তার মাথার পেছনে আসছিল। তার রিভলবার ধরা বাম হাতটি তখন আহমদ মুসার ডান বাহুর উপরে। রিভলবারের নল আহমদ মুসার দেহকে তাক করে নয়, বুকের উপর দিয়ে সমান্তরাল।
আহমদ মুসা বুঝতে পারল, লোকটি মাথার পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে ক্লোরোফরম করতে চায়। যাতে আহমদ মুসার ঘুম ভাঙলেও হাত দিয়ে আক্রমন করার উপযু্ক্ত সুবিধা না পায়।
তার আগেই তার হাতে যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছে তার সদ্ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিল। এমন একটি নিরাপদ সুযোগেরই সে অপেক্ষা করছিল।
সিদ্ধান্তের সাথে সাথেই কাজ।
আহমদ মুসার ডান হাত বিদ্যুত বেগে উঠে এল এবং আঘাত করল লোকটির রিভলবার ধরা বাম হাতে।
রিভলবার তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা তার দেহটাকে একটা পাক দিয়ে মেঝেয় নেমে দাঁড়াল। কিন্তু আহমদ মুসা স্থির হয়ে দাঁড়াবার আগেই লোকটি আহমদ মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা সরে দাঁড়াবার সুযোগ পেল না। সে পড়ে গেল মেঝের উপর এবং তার দেহের উপর এসে পড়ল লোকটি।
লোকটি এসে পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসা তাকে কঠিনভাবে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ফেলল, যাতে সে এ্যাকশনে যাবার সুযোগ না পায়। তারপর আহমদ মুসা লোকটির পাল্টা কিছু শুরু করার আগেই নিজের দেহটায় একটা মোচড় দিয়ে লোকটিকে নিচে ফেলল। তারপর তাকে কাবু করার জন্যে আহমদ মুসা তার বুকে উঠে বসার জন্যে দেহটাকে একটু গুটিয়ে নিতে গেল। তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই আহমদ মুসার দেহের চাপ কিছুটা লুজ হয়েছিল মুহূর্তের জন্যে। এই সুযোগই কাজে লাগাল লোকটি। সে দেহটাকে একটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আহমদ মুসাকে ছিটকে ফেলে আবার সে আহমদ মুসার উপর চেপে বসল।
কিন্তু সেও আহমদ মুসাকে সামলাতে পারল না। আহমদ মুসা আবার লোকটিকে ফেলে দিয়ে তার উপর চড়ে বসল।
ঠিক এই সময় অন্ধকারের ভেতর থেকে একজন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসার উপর ঝাপিয়ে পড়া এই লোকটি দক্ষিণ দেয়ালের পশ্চিম পাশ দিয়ে কাঁচ কেটে ভিতরে প্রবেশ করেছিল। আহমদ মুসার নজর শুধু পুব দিকে নিবদ্ধ ছিল বলে পশ্চিম দিক দিয়েও যে আরেকজন ঘরে প্রবেশ করছে সেটা দেখতে পায়নি।
লোকটি এতক্ষন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শত্রু-মিত্র চেনার চেষ্টা করেছে। নিশ্চিত হয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসা ছিটকে পড়ল পাশেই। আকষ্মিক এই আক্রমনের জন্যে প্রস্তুত ছিল না আহমদ মুসা। ঘাড়ে আঘাত পেল সে।
ছিটকে পড়ার পর নিজেকে সামলে নিতে একটু দেরী হলো আহমদ মুসার। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। এ সময় ওরা দু’জন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।
আহমদ মুসা চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ল আবার।
আছড়ে পড়ার পর আহমদ মুসা অনুভব করল তার ডান হাত গিয়ে পড়েছে একটা শক্ত ধাতব জিনিসের উপর। হাত নেড়ে পরীক্ষা করে আনন্দিত হলো আহমদ মুসা ধাতব জিনিসটি একটি রিভলবার। আহমদ মুসার মনে পড়ল এই রিভলবারটিই প্রথম লোকটির হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল।
ওরা দু’জন এসে চেপে বসেছিল আহমদ মুসার উপর। ক্লোরোফরমের গন্ধ আবার পেল আহমদ মুসা। বুঝল, ওরা তাকে সংগাহীন করার চেষ্টা করছে।
আহমদ মুসা তার ডান হাত সক্রিয় করল। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, রিভলবার ব্যবহার না করে উপায় নেই।
ডান হাতটা টেনে এনে আহমদ মুসা প্রথম গুলীটা করল তার উপর চেপে বসা একজনের বুকের পাঁজরে ঠেকিয়ে।
লোকটা বুক ফাটা চিৎকার করে তার বুকের উপর থেকে উল্টে পড়ল তার পাশের লোকটির উপর।
আহমদ মুসা আর ঝুঁকি নেয়া ঠিক মনে করল না। দ্বিতীয় লোকটির হাতে রিভলবার থাকতে পারে। সে এবার রিভলবার ব্যবহারে মরিয়া হয়ে উঠবে।
ইতিমধ্যে পাশের লোকটি চিৎকার করে উঠেছে, ‘কুত্তার বাচ্চা গুলী করেছ। তোমাকেও মরতে…..’
লোকটি কথা শেষ করতে পারল না। আহমদ মুসার রিভলবার শব্দ লক্ষ্যে পর পর দু’বার অগ্নিবৃষ্টি করল।
লোকটি চিৎকার করারও সুযোগ পেল না। নিরব হয়ে গেল।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। কক্ষের আলো জ্বেলে দিয়ে সোজা টেলিফোনের কাছে গেল। টেলিফোন করল হোটেল সিকুরিটিকে। বলল, ‘আমার ঘরে দু’জন লোক ঢুকে আমাকে আক্রমন করেছিল। দু’জনেই নিহত হয়েছে। আপনার আসুন, পুলিশে খবর দিন।’
সংগে সংগেই হোটেল সিকুরিটির লোকেরা এসে গেল। দশ মিনিটের মধ্যেই এসে গেল পুলিশ। এল গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনও।
পুলিশের হাঙ্গামা শেষ হতে সকাল ৮টা বেজে গেল। পারিপার্শ্বিক সব তথ্যাদি পাওয়ার পর পুলিশ আহমদ মুসার বক্তব্য গ্রহন করেছে। প্রথমত, প্রমাণিত হয়েছে লোক দু’জন হোটেলের সম্মুখ দরজা দিয়ে বৈধভাবে প্রবেশের কোন রেকর্ড নেই। দ্বিতীয়ত, প্রমাণিত হয়েছে অসৎ উদ্দেশ্যে তারা লাইলন কর্ড ব্যবহার করে পেছন দেয়াল বেয়ে আহমদ মুসার ঘরে প্রবেশ করেছে। লোক দু’জনের জুতার তলায় হোটেলের দেয়ালের পিংক রং পাওয়া গেছে। তৃতীয়ত, গোয়েন্দা পুলিশের মাইক্রো এক্সরে ক্যামেরায় দক্ষিণ দেয়ালের যে গ্লাস কেটে ওরা দু’জন প্রবেশ করেছিল, তাতে তাদের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। চতুর্থত, ক্লোরোফরম লোক দু’জনই বহন করেছে তার প্রমাণ তাদের পকেট থেকে পাওয়া গেছে। সর্বশেষ আহমদ মুসার হাতে যে রিভলবার আছে তাতে নিহত দু’জনের একজনের হাতের আঙুলের ছাপও পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, আহমদ মুসা নির্দোষ এবং লোক দু’জন আহমদ মুসাকে কিডন্যাপ করতে এসেই নিহত হয়েছে। তাদের মোটিভ হিসেবে রেকর্ড করেছে, স্পুটনিক ঘটনায় অপহৃতদের দু’জন আত্মীয় আহমদ আবদুল্লাহ (আহমদ মুসা)সহ এসেছেন স্ট্রাসবার্গে স্পুটনিকের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এবং স্পুটনিকের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের আক্রমনের এরা শিকার হয়েছে।
পুলিশ এই কেসকে ডাকাতি ও অপহরণ করার চেষ্টার মামলা হিসেবে গ্রহন করে আহমদ মুসাকে সব সন্দেহ ও দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছে এবং পুলিশবাদী কেস হিসেবে একে গ্রহন করা হয়েছে।
আহমদ মুসার কক্ষকে পুলিশ সীল করল। হোটেল কর্তৃপক্ষ আহমদ মুসাকে হোটেলের সর্বোচ্চ তলায় একটা অধিকতর নিরাপদ কক্ষ বরাদ্দ করল।
পুলিশ চলে যেতেই ফাতিমা কামাল আহমদ মুসাকে বলল, ‘ভাইয়া, বেয়ারা আপনার সুটকেস আপনার ঘরে নিয়ে যাক। আপনি এখন আমার ঘরে চলুন। ওখানে যায়েদ অপেক্ষা করছে। অনেক জরুরী কথা আছে।’
বলেই, ফাতিমা কামাল বেয়ারাকে আহমদ মুসার সুটকেস তার কক্ষে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসার হ্যান্ড ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘আসুন ভাইয়া’।
আহমদ মুসা তার সাথে হাঁটতে শুরু করল।
ফাতিমা কামালের ঘরে এসে বসল সবাই।
আহমদ মুসা বসতেই যায়েদ বলে উঠল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর যে, তিনি ভয়ংকর ঘটনা থেকে আপনাকে রক্ষা করেছেন, আমাদেরকেও সাহায্য করেছেন।’
‘আমার কিন্তু এখনও স্বপ্ন মনে হচ্ছে যায়েদ। অন্ধকার রাত। দু’জন লোক টার্গেট করে দেখে শুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু যারা আক্রমন করল তাদেরকে তাদেরই রিভলবার দিয়ে হত্যা করা হলো। এ যেন জগতের শীর্ষ এক গোয়েন্দা কাহিনী।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘তুমি ঠিকই বলেছ ফাতিমা। আশায় আমার বুক ভরে উঠেছে। আমাদের জন্যে যা অসম্ভব, আমাদের জন্যে যা অকল্পনীয়, সেটাই আমাদের এই নতুন ভাইয়ার জন্যে খুবই সাধারণ। আল্লাহ তাঁকে পাঠিয়েছেন আমাদের মহাসংকটে। বুক আমার ভরে উঠেছে আশায়।’ বলল যায়েদ।
‘একজন গোয়েন্দা অফিসার কি মন্তব্য করেছেন জান। বলেছেন, ‘আটঘাট বাধাঁ ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচা অসম্ভব ছিল। মি.আহমদ আবদুল্লাহ নিশ্চয় অসাধারণ লোক।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘এই জন্যেই বিপদ তাঁর উপর এসে চেপে বসেছে। নতুন বিপদও আসন্ন।’ যায়েদ বলল।
‘কি বিপদ?’ সংগে সংগেই প্রশ্ন করে উঠল ফাতিমা কামাল। উদ্বেগে তার দু’চোখ কপালে।
‘ঐ বিপদের কথাই তো তোমাকে বলেছি। ভাইয়াকে এখনই আসতে বলেছিলাম সে কথা বলার জন্যেই।’ বলল যায়েদ।
‘বল তাড়াতাড়ি।’ ফাতিমা কামাল বলল।
‘রাতে ঘটনার খবর পাওয়ার পর থানা কর্মকর্তার সাথে পুলিশের যে বড় অফিসার, সহকারী পুলিশ কমিশনার এসেছিলেন, তিনি আমার পরিচিত। আমার এক বন্ধুর বড় ভাই। ভোর পর্যন্ত তিনি এখানে ছিলেন। তারপর চলে যান। দশ মিনিট আগে আমাকে টেলিফোন করে ভয়াবহ খবর দিলেন। সেটা হলো, পুলিশ কমিশনার হঠাৎ উল্টে গেছেন। তিনি পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন সুযোগমত কোন রেকর্ড বা সাক্ষী না রেখে ভাইয়াকে গ্রেপ্তার করতে। তিনি মনে করেন, ভাইয়াকে যারা অপহরণ করতে গিয়েছিল তাদের পেছনে সাংঘাতিক বড় কোন পক্ষ আছে, হতে পারে তারা স্পুটনিক ধ্বংস ও এর ৭জনকে অপহরণ করার সাথে জড়িত। তিনি আশংকা করেন পুলিশ ভাইয়াকে ধরে নিয়ে গিয়ে ঐ পক্ষের হাতে তুলে দিবে।’ থামল যায়েদ।
সংগে সংগেই ফাতিমা কামাল বলে উঠল, ‘কিভাবে পুলিশ গ্রেফতার করবে? পুলিশের স্পট ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টের (SIP) যে কপি ভাইয়াকে পুলিশ দিয়েছে তাতে তাকে সব সন্দেহ থেকে মুক্ত করা হয়েছে।’
‘বললাম তো, পুলিশ তো আইনের মাধ্যমে গ্রেপ্তার দেখাবে না। কোন রেকর্ড বা সাক্ষী না থাকে এমনভাবে কথা বলার জন্যে তাকে তুলে নিয়ে এবং তারপর গায়েব করবে।’ বলল যায়েদ ফারুক।
‘ফরাসী পুলিশের একজন শীর্ষ অফিসারকে এইভাবে মুহূর্তে পাল্টে ফেলল, এই পক্ষটা আসলে কে?’ ফাতিমা কামাল বলল।
যায়েদ ফারুক কিছু বলল না।
আহমদ মুসার ঠোঁটের কোণে কেবল এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘চিন্তা করো না ফাতিমা। নিশ্চয় শীঘ্র তাদের পরিচয় দিনের আলোতে বেরিয়ে আসবে। সে পর্যন্ত ধৈর্য্য ধর।’ বলল আহমদ মুসা শান্ত কন্ঠে।
‘আল্লাহ সেটা করুন, কিন্তু তার আগে তো মহাবিপদ। সব তো শুনলেন ভাইয়া, আমরা এখন কি করব?’ ফাতিমা কামাল বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই। শত্রুরা এসব করে আমাদেরই সাহায্য করছে।’
‘কিভাবে ভাইয়া?’ দু’চোখে কপালে তুলে প্রশ্ন করল যায়েদ ফারুক।
‘শত্রুরা আমাদেরকে চেনে, আমরা তাদের চিনি না। তারা এ্যাকশনে না এলে আমরা এ্যাকশনে যাব কি করে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝলাম। তারা এ্যাকশনে এল। সেই পরিমাণে এ্যাকশনে যাবার ক্ষমতা কি আমাদের আছে? তার উপর দেখছি পুলিশ ওদের সহযোগিতা করবে বলল।’
‘এটা নতুন কিছু নয়। পুলিশের একটা গ্রুপ নিশ্চয় ওদের সহযোগিতা করে আসছে। তা না হলে স্পুটনিক মামলাটা এগুচ্ছে না কেন?’
‘ডবল বিপদ। এখন তাহলে আমাদের কি করণীয়? বুঝা যাচ্ছে, পুলিশ এখন ওঁৎ পাতছে আপনাকে ধরার জন্যে।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল ফাতিমা কামাল।
‘এত উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই বোন। হোটেল কর্তৃপক্ষকে আমি এখনি জানিয়ে দিচ্ছি। হোটেলে কক্ষ আমার ঠিকই থাকবে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে আমি বাইরে থাকব।’ শান্ত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমরা কোথায় যাবো?’ জিজ্ঞেস করল ফাতিমা কামাল।
‘তোমাদেরকে হোটেল ছেড়ে দিতে হবে। তোমরা তোমাদের আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠবে। অথবা বাড়ি চলে যাও।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না ভাইয়া। আত্মীয়রা এমনিতেই বিপদের মধ্যে আছে। তাদের বিপদ বাড়াতে চাই না। আপনাকে সে খবর তো এখনও বলিনি। আমাদের দু’জনের আত্মীয়ের বাসা আজ রাতে তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হয়েছে। অন্যান্য……………’
কথা শেষ করতে পারলো না যায়েদ। আহমদ মুসা তার কথার মাঝখানে বলে উঠল, ‘তোমাদের দু’জন আত্মীয় মানে আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও কামাল সুলাইমানের বাসা?’
‘জি ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘কারা সার্চ করেছে, পুলিশ?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘পুলিশ নয়। অন্য কেউ। বাড়ির সবাইকে ক্লোরোফরম করে অঢেল সময় নিয়ে তারা বাড়িতে কি যেন খুঁজেছে। প্রতিটি সুটকেস, ব্যাগ, কাপবোর্ড, ড্রয়ার, আলমিরাসহ বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা তারা সার্চ করেছে। এমন কি সোফা, চেয়ারের গদিও তারা ফেঁড়ে দেখেছে।’ বলল যায়েদ।
‘অন্য পাঁচজনের বাসা?’ আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘খবর জানতে পারিনি। তবে আরও জানতে পেরেছি, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও কামাল সুলাইমানের বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজন যারা স্ট্রাসবার্গে আছেন, তাদের বাসাও এভাবে সার্চ করা হয়েছে।’ বলল যায়েদ।
‘বল কি?’
বলে আহমদ মুসা অল্প কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘কোন অতিমূল্যবান দলিল বা কোন প্রমাণ তারা হাত করতে চায়। কিন্তু সে দলিল বা প্রমাণ কোথায় আছে তা তারা জানে না। আমার মনে হচ্ছে, অন্য পাঁচজনের বাড়ি ও তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের বাড়িও আজ রাতে সার্চ করা হয়েছে।’
থামল আহমদ মুসা। কিন্তু তার কপাল তখনও কুঞ্চিত। ভাবছে সে। আবার সে বলা শুরু করল, ‘এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আমার তিনটা জিনিস মনে হচ্ছে-এক, ৭জন যাদের অপহরণ করা হয়েছে তাদের ইন্টেরোগেট করেও কোন এক মূল্যবান দলিলের হদিস বের করতে শত্রুরা পারেনি। অবশেষে নিজেরাই দলিল উদ্ধারে বের হয়েছে। দুই, সবকিছু সমেত স্পুটনিক অফিস পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও কোন অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল বা প্রমাণ এখনও অক্ষত আছে যা স্পুটনিক অফিসের বাইরে কোথাও সরিয়ে রাখা হয়েছিল। তিন, আমার মনে আশা জাগছে, এই দলিল হাত করার পূর্ব পর্যন্ত অপহৃতদের শত্রুরা হত্যা করবে না।’ থামল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ও যায়েদ হা করে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। ফাতিমার দু’চোখের কোনায় অশ্রু চিক চিক করছে।
দু’জনেই কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।
প্রথম তাদের নিরবতা ভাঙল ফাতিমা। বলল, ‘ভাইয়া, আল্লাহ আপনার কথা মঞ্জুর করুন। তারা বেঁচে আছেন, একথা সত্য হোক।’ কান্নায় ভারী হয়ে গেল ফাতিমার কন্ঠ।
‘ভাইয়া, আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আপনার মত সাহসী, শক্তিমান ও তীক্ষ্ণধী সংগ্রামী মানুষের আমাদের প্রয়োজন ছিল। আল্লাহ তা পূরণ করেছেন।’
বলে একটু থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘ভাইয়া, বাড়ি সার্চ করা থেকে আপনি যে তিনটি জিনিস বের করে আনলেন, তার প্রতিটি অক্ষর আমার কাছে সত্য মনে হচ্ছে। ভাইয়া বলুন, এখন আমরা কি করতে যাচ্ছি। আমরা তিনজনেই তো একটা বাড়ি নিতে পারি।’
‘না, তোমরা এক সাথে বাড়ি নিতে পার না। তোমরা………..’
আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মাঝখান থেকে যায়েদ বলে উঠল, ‘ভাইয়া, আমি ও ফাতিমা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। দু’জনের পরিবারকেও জানিয়েছি। এখন আপনার অনুমতি হলেই আমরা বিয়ে করতে পারি।’ লজ্জা সংকোচে বিব্রত কন্ঠ যায়েদের।
লজ্জা এসে ছেয়ে ফেলেছে ফাতিমার মুখে। রাঙা হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল। নত মুখে সেও বলে উঠল, ‘ভাইয়া, ও ঠিকই বলেছে।’
‘আমার অনুমতি কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আপনাকেই আমরা প্রকৃত অভিভাবক মনে করছি। আপনি যেভাবে আমাদের কল্যাণ কামনা করেছেন, যেভাবে আপনি আমাদের ব্যক্তি জীবনের দিকে তাকিয়েছেন, খোলামেলা পরামর্শ দিয়েছেন, সেভাবে আমাদের পরিবার আমাদের দিকে কখনও তাকায়নি।’ বলল যায়েদ।
‘তবু আমি তোমাদের পরিবারের কেউ নই। পরিবারের অনুমতি তোমাদের অবশ্যই নিতে হবে। তোমরা পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু সব মুসলমানই তো ভাই ভাই এবং একটি পরিবারের মত।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘হ্যাঁ, ইসলাম এটা বলেছে। কিন্তু সেই সাথে পারিবারিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে বলেছে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া প্রথম কর্তব্য বলে উল্লেখ করেছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে ভাইয়া। আমরা পরিবারকে জানিয়েছি মানে তাদের অনুমতিও নিয়েছি।’ বলল ফাতিমা।
‘ধন্যবাদ। তাহলে যায়েদ তুমি প্যারিসে তোমার দু’একজন নিকটতম লোকদের নিয়ে জার্মানির বনে ফাতিমার বাড়িতে যাও। সেখানেই বিয়ে অনুষ্ঠিত হোক।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, তাহলে আপনাকে যেতে হবে। সবাই খুশি হবে।’ বলল ফাতিমা।
‘পরে যাব। তোমাদের দু’জনের শুধু নয়, স্পুটনিকের ৭জনের পরিবার সম্পর্কে আমার দারুণ আগ্রহ। পরিবারগুলোকে আমি দেখতে চাই, তাদের কথা শুনতে চাই। কি করে এই ঐতিহাসিক ও সেকুলার পরিবারগুলো থেকে স্পুটনিকের জন্ম হলো, তা জানার আমার ইচ্ছা অসীম। এই পরিবারগুলো একদিন মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে, মুসলিম উম্মাহর বর্তমান বিপর্যয়ের জন্যে এই পরিবারগুলো বিরাটভাবে দায়ী। সেই পরিবার থেকেই আবার স্পুটনিকের জন্ম কেমন করে হলো তা আমি জানতে চাই।’ থামল আহমদ মুসা। আবেগে তার কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল।
ফাতিমা ও যায়েদের বিস্ময় ও শ্রদ্ধামিশ্রিত চার চোখ নিবদ্ধ ছিল আহমদ মুসার উপর। বলল, ভাইয়া, চাচাতো ভাই কামাল সুলাইমানের পরিবর্তন কিভাবে হলো সেটা আমাদের কাছে বিস্ময়। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের উত্তর পুরুষ কামাল সুলাইমান কামাল আতাতুর্কের মতই ইসলামের প্রতি ক্রিটিক্যাল ছিল। নিউইয়র্কের টুইন (লিবার্টি ও ডেমোক্রেসি)টাওয়ার ধ্বংসের জন্যে মুসলমানরা যখন অভিযুক্ত হলো, তখন সে ইসলাম ও মৌলবাদী মুসলমানদের গালিগালাজ করার ব্যাপারে অন্যান্যা জার্মানদের চেয়েও অগ্রণী ছিল। তারপর হঠাৎ করে তার পরিবর্তন ঘটল। শুধু তার পরিবর্তন নয়, গোটা পরিবারকেও সে পরিবর্তন করে ছেড়েছে। আমার সাথে দেখা হলেই বলতো, ‘হাসবি কম। মনে রাখবি তুই মজলুম মুসলিম জাতির একজন সদস্য।’ মাঝেই মাঝেই আরও বলত, ‘জানিস মুসলমানদের উপর আজ যে যুলুম চলছে তার জন্যে মুসলমানরা দায়ী নয়, দায়ী একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। যারা মুসলমানদের ঘর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে, যারা তাদের সহায় সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে, তারাই পুলিশ সেজে চুরি ডাকাতির অভিযোগে মুসলমানদের গ্রেফতার করছে এবং নিজেরা চুরি ডাকাতি ও খুন জখম সংঘটিত করে মুসলমানদের ফাঁসিতে লটকাচ্ছে।’ থামল ফাতিমা। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল তার কন্ঠ।
আহমদ মুসা সংগে সংগে কথা বলল না। তারও মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
যায়েদের মুখ নিচু।
আহমদ মুসাই নিরবতা ভাঙল। বলল, ‘আলহামদুল্লিাহ। কামাল সুলাইমান ‘কামাল’ না হয়ে ‘সুলাইমান’ হয়েছেন।’
‘বুঝলাম না ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘অর্থ হলো কামাল সুলাইমান তুরষ্কের মোস্তফা কামাল না হয়ে তুরষ্কের ওসমানীয় খিলাফতের ‘সুলাইমান, দি ম্যাগনিফিসেন্ট’ হয়েছেন। সুলাইমান দি ম্যাগনিফিসেন্ট (১৪৯৪ খৃঃ-১৫৬৬খৃঃ) তুর্কি খিলাফতের সবচেয়ে সফল শাসক। গোটা ভূমধ্যসাগরে তার নৌবাহিনী ছিল অপ্রতিরোধ্য।’
কথা শেষ করে একটু থামতেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘ইতিহাসের এসব কথা থাক। এস, বর্তমান নিয়ে ভাবি।’
ফাতিমা কামাল চোখ মুছে বলল, ‘আপনিও আমাদের সাথে ‘বন’ এ যাবেন, একথা এখনও বলেননি।’
‘না বোন এ সময় নয়। শত্রুরা অনেক কাছাকাছি এসেছে। এ সময় দূরে সরা যাবে না। ওরা আমাদের বাড়িতে ঢুকেছে, এখন আমরা ওদের বাড়িতে ঢুকতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা নরম কন্ঠে।
‘তাহলে ‘বন’ থেকে ওদের আসতে বলি। যায়েদও বলুক তার পরিবারকে আসার জন্যে। বিয়ে স্ট্রাসবার্গেই হবে।’ ফাতিমা বলল দৃঢ় কন্ঠে।
‘ফাতিমা ঠিকই বলেছে। এটাই হবে।’ বলে একটু থামল যায়েদ। একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, ‘তাহলে বাড়ি নেয়ার কি হবে? আজ এ মুহূর্তেই তো আপনার হোটেল থেকে সরা দরকার ভাইয়া।’
‘ঠিক আছে। একটা বাড়ি আজই ঠিক করে ফেল। লোকেশন যাতে নিরিবিলি ও নিরাপদ হয়। বাড়িটার এক অংশে আমি থাকব। অন্য অংশে বিয়ের পর তোমরা থাকবে।’
‘তাহলে ভাইয়া, আমি বাড়ির খোঁজে বের হচ্ছি। উঠব, অনুমতি দিন।’
‘ঠিক আছে, আমিও বের হচ্ছি। চল।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাড়াল।
‘কিন্তু বাইরে তো পুলিশ ওঁৎ পেতে আছে।’ এক সাথে বলে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ। তাদের কন্ঠে প্রতিবাদের সুর।
‘শুধু পুলিশ কেন, ওরাও ওঁৎ পেতে থাকার কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে বেরুবেন কেন?’ দুজনেই আবার বলে উঠল।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘পুলিশ এবং ওরা জানে আমি হোটেলে আছি। এই অবস্থায় বাইরে যাওয়া ও ভেতরে থাকা এক কথাই। পুলিশ পক্ষে থাকলে হোটেলের ভেতরটা ওদের জন্যে আরও সুবিধাজনক।’
বলে আহমদ মুসা সোফায় সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘তোমরা চিন্তা করো না। আল্লাহ আছেন।’
উঠে দাড়াল আহমদ মুসা।
যায়েদও উঠে দাড়াল। বলল, ‘আপনি এগোন ভাইয়া, আমি আমার রুম থেকে আসছি।’
যায়েদ সালাম দিয়ে কক্ষ থেকে বেরুবার জন্যে হাঁটতে শুরু করল।
আহমদ মুসাও।
নিরব ফাতিমা। উদ্বিগ্ন তার দু’চোখ। শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকল ওদের যাত্রা পথের দিকে।
৩
আজর ওয়াইজম্যানের চোখ দু’টি তার সামনে টেবিলে রাখা দু’টি ফটোর উপর স্থিরভাবে নিবদ্ধ।
দু’টি ফটোই আহমদ মুসার বলে কথিত। একটি ফটো ওয়াইজম্যানদের ফটো। আহমদ মুসার ফটো হিসাবে ফাইলে সংরক্ষিত। আরেকটি ফটো স্ট্রাসবার্গ পুলিশের কাছ থেকে সদ্য সংগৃহীত। ফটোটি পুলিশ তুলেছে আহমদ মুসার হোটেল কক্ষে দু’জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর।
আজর ওয়াইজম্যানের হাতে একটা পাওয়ারফুল এ্যামপ্লিফায়ার লেন্স। সেটা দিয়ে খুঁটে খুঁটে সে পরীক্ষা করছে ফটো দু’টিকে।
আজর ওয়াইজম্যান ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির (WFA) প্রধান। সাও তোরাহ দ্বীপ থেকে মাত্র কিছুক্ষণ আগে সে স্ট্রাসবার্গে পৌছেছে।
ফটো দুটি গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করার পর মুখ তুলল আজর ওয়াইজম্যান। হাতের লেন্সটা টেবিলে রেখে সামনে বসা WFA এর স্ট্রাসবার্গ এর স্টেশন চীফ লাইবারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমাদের ফাইল ফটোর সাথে হোটেলের কথিত আহমদ মুসার ফটোর মুখের আদল হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিন্তু চোখ-মুখের মাইক্রো রিডিং মিলছে না। একেবারেই আলাদা। এটা কি করে সম্ভব বুঝতে পারছি না।’
আজর ওয়াইজম্যান থামতেই লাইবারম্যান বলে উঠল, ‘কিন্তু হোটেলের এই লোক আহমদ মুসা হতেই হবে। গ্রীন সার্কেল ও হোটেলের সাংঘাতিক ঘটনা প্রমাণ করছে লোকটি আহমদ মুসা না হয়েই পারে না। হোটেলের ঘটনায় পুলিশ পর্যন্ত বিস্মিত হয়েছে। সাফল্যের সাথে আমাদের লোকেরা হোটেল কক্ষে প্রবেশ করেছিল। পুলিশের মতে তারা প্রথমে আক্রমণ করারও সুযোগ পেয়েছিল। ক্লোরোফরম ভেজা রুমাল খাটের পাশে পাওয়ার অর্থ আহমদ মুসাকে তারা নিদ্রিত অবস্থায় পেয়েছিল এবং তাকে সংগাহীন করার জন্যে ক্লোরোফরমসহ রুমালও তারা বের করেছিল। কিন্তু নিদ্রিত অবস্থায় প্রথমে আক্রমণ করেও দু’জনে আহমদ মুসাকে এঁটে উঠতে পারেনি। আহমদ মুসার মত অসাধারণ কেউ না হলে এটা সম্ভব ছিল না।’
‘আমার কথাও এটাই। মদিনা থেকে স্ট্রাসবার্গে আসা আহমদ মুসার সিডিউলের সাথে এ লোকটির স্টাসবার্গে আসার সিডিউল মিলে যাচ্ছে। চেহারা ও মুখের আদলটাও মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আসল জায়গায় তো মিলছে না’, বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কোন কারণ নিশ্চয় আছে। কিন্তু লোক যে একই এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।’ লাইবারম্যান বলল।
‘সে কারণটা কি হতে পারে?’ জিজ্ঞেস করল আজর ওয়াইজম্যান।
‘হতে পারে দুটি ফটোগ্রাফের কোন একটিতে আহমদ মুসার ছদ্মবেশ আছে।’ বলল লাইবারম্যান।
‘কিন্তু ছদ্মবেশ তো মুখের মাইক্রোরিডিং পাল্টাতে পারে না।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘পারে স্যার। প্লাস্টিক মেকআপ সম্পর্কে আমার বিশেষ পড়াশুনা আছে। আমি জানি, সর্বাধুনিক এমন কিছু প্লাস্টিক মেকআপ আছে যা সব দিক দিয়ে চামড়ার মত। চামড়ার মতই এতে রেখা, লোম ও লোমকূপ আছে। আলট্রা মাইক্রো লেন্সেও চামড়ার সাথে এর কোন ভিন্নতা ধরা পড়ে না।’ বলল লাইবারম্যান।
‘ধন্যবাদ লাইবারম্যান। আপনার এ মত আমি গ্রহন করছি এবং আমরা এখন এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, হোটেলের এই লোকটি আহমদ মুসাই।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘অবশ্যই।’ বলল লাইবারম্যান।
‘তাহলে একথাও বলা যায় যে, সে এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘তা আমরা বলতে পারি। হোটেল কক্ষে নিহত হওয়ার ঘটনার পুলিশ রিপোর্টটি আহমদ মুসার পক্ষে গেলেও পুলিশ আমাদেরকে সহযোগিতা করবে তার ব্যবস্থা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার পুলিশের প্রতি কিছু নির্দেশ দিয়েছেন। তারা সুযোগমত আহমদ মুসাকে গ্রেপ্তার করে আমাদের হাতে তুলে দেবে।’ বলল লাইবারম্যান।
‘পুলিশের সাহায্য একটা বাড়তি বিষয়। তাদের উপর নির্ভর করে বসে থাকা যাবে না।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘না স্যার। আমরা বসে নেই। হোটেলের চারদিকে আমরা ২৪ ঘন্টা পাহারা বসিয়ে রেখেছি। আমরা আহমদ মুসাকে চোখের আড়াল হতে দেব না। সুযোগ পেলে আমরা পুলিশের অপেক্ষা করব না। আমরা নিজেরাই তাকে জালে আটকাব।’ বলল লাইবারম্যান।
‘আমি চাই আহমদ মুসাকে ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপের খাঁচায় পুরতে। তাকে খাঁচায় ভরতে পারলে শুধু বহু তথ্য পাওয়া যাবে তা নয়, গোটা দুনিয়ায় আমাদের মিশন নিরাপদ হয়ে যাবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের এতবড় বিপর্যয় ঘটাতে আহমদ মুসা পারল কিভাবে?’ জিজ্ঞেস করল লাইবারম্যান।
‘আহমদ মুসা শৃগালের মত ধূর্ত, বাঘের মত ক্ষিপ্র, সিংহের মত সাহসী এবং স্যার এ.এইচ. ডুনান্টের চেয়েও মানবিক এবং পোপের চেয়েও দয়ালু। কোন গুণের ঘাটতি তার ভেতর নেই। নিজের জীবন বিপন্ন করে বিপজ্জনক ওহাইও নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে এফবিআই চীফ মি.জর্জের নাতিকে উদ্ধার করে আহমদ মুসা এফবিআই চীফের হৃদয় জয় করে নেয়। সবুজ পাহাড় ও লস আলামাসের মধ্যকার আণবিক ও সামরিক তথ্য পাচারের ইহুদী গোয়েন্দা সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করে তা মার্কিন সরকারের হাতে তুলে দেয়াসহ বহু নিঃস্বার্থ ও উপকারী কাজের মাধ্যমে সে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আস্থা অর্জন করে। অন্যদিকে সে আমাদের বেশ কিছু অপরাধমূলক বড় ধরনের কাজকে হাতে নাতে ধরিয়ে দেয়। এভাবেই সে গত একশ বছরে মার্কিন মাটিতে প্রোথিত আমাদের শেকড়কে আমূল উপড়ে ফেলার ব্যবস্থা করেছে। মার্কিন সরকার, মার্কিন কংগ্রেস ও মার্কিন সমাজে আমাদের শক্তিশালী লবি আজ সম্পূর্ণই অকার্যকর হয়ে পড়েছে এক আহমদ মুসার তৎপরতায়। এই আহমদ মুসাই এসেছে স্ট্রাসবার্গে। স্পুটনিক যে কাজ হাতে নিয়েছিল, সে কাজ করার জনেই সে যদি স্ট্রাসবার্গে এসে থাকে, তাহলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কয়েক বছর আগে সংঘটিত নিউইয়র্কের ‘লিবার্টি ও ডেমোক্র্যাসি’ টাওয়ার ধ্বংস আমরাই করেছি একথা যদি সে প্রমাণ করতে পারে, তাহলে দুনিয়ার কোথাও আমাদের জায়গা হবে না। সুতরাং স্ট্রাসবার্গে এখন আমাদের একমাত্র কাজ সর্বশক্তি দিয়ে আহমদ মুসাকে ধ্বংস করা।’
দীর্ঘ বক্তব্য দেয়ার পর থামল আজর ওয়াইজম্যান। তার চোখে-মুখে সফরের ক্লান্তি এবং কন্ঠে হতাশার সুর।
‘স্যার, আপনি কি নিশ্চিত আহমদ মুসা ‘স্পুটনিক মিশন’ নিয়ে স্টাসবার্গ এসেছে?’ বলল লাইবারম্যান উদ্বিগ্ন কন্ঠে।
‘এছাড়া কোন কাজে সে স্ট্রাসবার্গ আসবে? আহমদ মুসার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এ ধরনের মিশন নিয়ে সে বার বার বিভিন্ন জায়গায় গেছে। আর ‘স্পুটনিক মিশনে’র ব্যাপারটা সফল হয়, তাহলে একদিকে মুসলিম জাতিকে তারা ইতিহাসের জঘণ্য অপরাধের দায় থেকে বাচাঁতে পারবে, অন্যদিকে আমাদের তারা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘স্পুটনিকের সবই তো ধ্বংস হয়ে গেছে। তাছাড়া স্পুটনিকের সাত শয়তানও আমাদের হাতে। আহমদ মুসা যতই করিতকর্মা হোক, আমার বিশ্বাস খুব বেশি সামনে এগুতে পারবে না। আরেকটা বড় বিষয় হলো, স্ট্রাসবার্গ পুলিশের কাছ থেকে সে ভাল সহায়তা পাবে না।’ লাইবারম্যান বলল।
লাইবারম্যানের চোখে-মুখে যতটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠেছিল, ততটাই অস্বস্তি প্রকাশ পাচ্ছিল আজর ওয়াইজম্যানের মুখে। তার কপাল কুঞ্চিত। অস্বস্তিকর ভাবনায় ডুবে যাওয়া তার মুখমন্ডল। লাইবারম্যান থামার পর একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সে বলল, ‘স্পুটনিক অফিসের সবরকমের দলিল দস্তাবেজ আমরা ধ্বংস করেছি। কিন্তু অফিসের দলিল দস্তাবেজই যে সবটুকু এটা কে বলবে। এ সবের কপি তারা অন্যকোন নিরাপদ জায়গায় রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। এগুলো তো আহমদ মুসা পেয়েও যেতে পারে। কারণ, স্পুটনিকের সাথে জড়িত সব পরিবার থেকেই সে সমান সহযোগিতা পাবে।’ থামল আজর ওয়াইজম্যান।
উদ্বেগে ভরে উঠেছে লাইবারম্যানের চোখ-মুখ। বলল, ‘তাহলে এ দলিলগুলো তো আমাদের যে কোন মূল্যে খুঁজে পেতে হবে। সাও তোরাহে ওদের কাছ থেকে কিছু জানতে পারেননি, বলেনি কিছু তারা?’ লাইবারম্যানের কন্ঠে উত্তেজনা।
‘না কিছুই বলেনি। কোনওভাবেই তাদের মুখ খোলা যায়নি। যে নির্যাতনে হাতিও চিৎকার করবে, সে নির্যাতনও তারা হজম করে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘মানুষ এমন হতে পারে?’ বিস্ময় লাইবারম্যানের কন্ঠে।
‘তারা ভিন্ন মানুষ।’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘কেমন?’
‘মৃত্যুকে ওরা সাফল্যের সিংহদ্বার বলে মনে করে। সেই সাফল্যের তুলনায় এই কষ্টটা নাকি খুবই ছোট।’ ওয়াইজম্যান বলল।
‘তাহলে?’
‘পথ একটাই, আহমদ মুসাকে সরিয়ে দেয়া।’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘সেটা তো এক নাম্বার কাজ। স্পুটনিক পরিবারে কি হানা দেয়া যায় না এই দলিল দস্তাবেজের সন্ধানে?’ লাইবারম্যান বলল।
‘কেন, গত রাতে তো স্পুটনিকের ৭ নেতার বাড়িসহ ওদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়ি আদ্যপান্ত সার্চ করেছ।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘আচ্ছা, তাহলে এসব কাগজই কি খুঁজেছি গত রাতে? কিন্তু কিছুই তো মেলেনি!’ লাইবারম্যান হতাশ কন্ঠে বলল।
‘মিলবে কি এত সহজে! ওদের বৌ-বেটিকেও নিয়ে যেতে হবে সাও তোরাহতে। দেখা যাবে তারপর তাদের মুখ বন্ধ থাকে কতক্ষণ।’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘ঠিক বুদ্ধি। ওদের দেহ যতটা শক্ত, তাদের নৈতিকতা ততটাই স্পর্শকাতর। বৌ বেটির ইজ্জত যেতে দেখলে, স্রোতের মত বেরিয়ে আসবে ওদের মুখ থেকে কথা।’
বলে একটু থেমেই সে আবার বলা শুরু করল, ‘তাহলে এই কাজে আমরা দেরি করছি কেন? নির্দেশ দিন আমরা শুরু করি।’
‘না মি.লাইবারম্যান। আহমদ মুসাকে ধ্বংস করাই প্রথম কাজ। তাকে শেষ করলে, অন্য কাজ ধীরে সুস্থে করায় কোন ক্ষতি হবে না।’
এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল লাইবারম্যানের।
টেলিফোন কানের কাছে তুলে নিল লাইবারম্যান। ওপ্রান্তের কথা শুনে সে বলে উঠল, ‘জরুরী খবর? বল বল।’
ওপারের খবর শুনল। তারপর এক ঝলক তাকাল সে ওয়াইজম্যানের দিকে এবং বলল ওপ্রান্তকে, ‘একটু হোল্ড কর, কথা বলি স্যারের সাথে।’
বলে টেলিফোন এক পাশে সরিয়ে নিয়ে ওয়াইজম্যানকে লক্ষ্য করে দ্রুতকন্ঠে বলল, ‘স্যার, আহমদ মুসা হোটেল থেকে বেরিয়েছে। সে একা একটি ট্যাক্সিতে চড়ে বিষমার্ক রোড ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছে।’ থামল লাইবারম্যান।
লাইবারম্যান থামতেই আজর ওয়াইজম্যান বলে ঊঠল, ‘ওরা যারা আছে সবাইকে পিছু নিতে বল। ঈল পার্কের মোড়ে ওকে চারদিক থেকে আটকাতে হবে। এ অঞ্চলটায় মানুষের যাতায়াত খুবই পাতলা। এখানেই ওর নিপাত ঘটাতে হবে। বলে দাও আমরা আসছি।’
লাইবারম্যান সব কথা ওদের বুঝিয়ে বলে টেলিফোন রাখল।
ওয়াইজম্যান লাইবারম্যানকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আরও যাদের দরকার তাদের বলে দাও সেখানে যেতে। দেখ, আমাদের ব্যর্থ হওয়া চলবে না। আর তৈরী হও এখনি।’
বলে ওয়াইজম্যান উঠে দাঁড়াল।
উৎসাহের সাথে উঠে দাড়াল লাইবারম্যানও।
ওয়াইজম্যান তার কক্ষের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে পাশে ফিরে তাকিয়ে লাইবারম্যানকে বলল, ‘পুলিশ কমিশনারকে কি আমাদের এই মিশনের কথা বলবে?’
‘হ্যাঁ, বলল তাদের সাহায্যও পাওয়া যেতে পারে।’ লাইবারম্যান বলল।
চিন্তা করছিল ওয়াইজম্যান। বলে উঠল, ‘না লাইবারম্যান, পুলিশকে জড়িয়ে লাভ নেই। তাদের কারণে কোন সমস্যারও সৃষ্টি হতে পারে।’
বলে সে পুনরায় চলতে শুরু করল তার কক্ষের দিকে তৈরী হওয়ার জন্যে।
লাইবারম্যানও এগুলো তার কক্ষের দিকে।
ঈল পার্কটি স্ট্রাসবার্গ শহরের মতই পুরাতন।
পার্কটি নদীর সমান্তরালে। বিরাট জায়গা জুড়ে।
পার্কের পাশ দিয়ে রাস্তা। রাস্তার সমান্তরালে নদীর তীর ঘেঁষে মাঝে মাঝে হোটেল ও ট্যুরিস্ট ভিলায় মাঝে মাঝে রয়েছে বাগান। এ বাগানগুলো নদীর পানি পর্যন্ত নেমে গেছে।
শান্ত নিরিবিলি এলাকা। শহরের হৈ-হুল্লোড়ের বিন্দুমাত্রও এখানে নেই।
পার্কের পাশের সড়ক ধরে চলছে আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসার টার্গেট নগরীর মেয়র অফিস। মেয়র অফিসের রেজিস্ট্রেশন বিভাগ থেকে আহমদ মুসা একটা ঠিকানা যোগাড় করতে চায়। গতকাল বিকেলে তাড়া খেয়ে যে গাড়ি ছেড়ে ওরা পালিয়েছিল, সে আমেরিকান গাড়িটার কাগজপত্রে যে নাম ঠিকানা পাওয়া গেছে, তাতে রাস্তার নাম আছে, কিন্তু বাড়ির নাম ও নাম্বার নেই। মেয়র অফিস থেকে এই নাম নাম্বার পাওয়া যায় কিনা, সেটাই সে দেখতে চায়।
আহমদ মুসার গাড়ি চলছিল মধ্যম গতিতে।
সামনেই ঈল পার্কের একটা মোড়। মোড়টা ত্রিরাস্তার একটি সংযোগ স্থল। এই মোড় থেকে একটা রাস্তা ঈল নদীর কিনারা পর্যন্ত নেমে গেছে।
মোড়টাতেও তেমন ভীড় ও গাড়ি ঘোড়ার সমাগম নেই। তবে বেশ কিছু গাড়ি পার্ক করা আছে দেখতে পেল আহমদ মুসা। সবগুলো গাড়িরই মুখ মোড়ের দিকে। হয়তো আরোহীরা নেমে পার্কে ঢুকেছে ভাবল আহমদ মুসা।
মোড়ে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়ি তখন মোড়ের মাঝামাঝি এসে পৌঁছেছে। হঠাৎ আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে দেখল, সামনে ও বাম দিক থেকে এক জোড়া করে দুই জোড়া গাড়ি তীরবেগে এগিয়ে আসছে। প্রথমে আহমদ মুসা মনে করেছিল মোড় ঘুরে গাড়িগুলো কোন দিকে চলে যাবে। কিন্তু পরক্ষনেই তার বুঝতে বাকি রইল না গাড়িগুলো তার গাড়ি লক্ষ্য করেই পাগলা গতিতে এগিয়ে আসছে।
হঠাৎ করেই ব্রেক কষেছে আহমদ মুসা তার গাড়ি। সামনে এগুনো যায় না, বামেও না। আর ডাইনে পার্কের দেয়াল। পেছনে হটা ছাড়া পথ নেই।
কিন্তু পেছনে হটতে গিয়ে রিয়ারভিউতে চোখ পড়তেই দেখল, পেছন থেকে আর এক জোড়া গাড়ি সেই একই গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
গাড়িতে আবার ব্রেক কষে গাড়ি থেকে আহমদ মুসা বেরোতে যাবে এমন সময় তিন দিক থেকে বৃষ্টির মত গুলী শুরু হলো।
তিন দিকের গুলির বৃষ্টি এসে ছেঁকে ধরল তার গাড়িকে। গাড়ির সামনে ও পেছনের উইন্ড স্ক্রিন ও সব জানালা মুহূর্তেই উড়ে গেল। ঝাঁঝরা হতে লাগল গাড়ি।
হোটেল থেকে ভাড়ায় আনা গাড়িটার জন্যে কষ্ট লাগল আহমদ মুসার। গাড়ির মেঝেয় শুয়ে নিজের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করল।
পাল্টা আক্রমনের কোন সুযোগ পেল না আহমদ মুসা। তিন দিকের অবিরাম গুলিবৃষ্টির মধ্যে মুহূর্তের জন্যেও মাথা তোলার কোন সুযোগ নেই। আর একটা মাত্র রিভলবার দিয়ে সে সামলাবে কোন দিকে।
হঠাৎ গুলীবর্ষণ তিন দিক থেকেই থেমে গেল। কি ব্যাপার? মুখ ঘুরিয়ে চোখ উপরে তুলল আহমদ মুসা। দেখল, চারদিক থেকেই ছয়টি স্টেনগানের নল প্রবেশ করেছে আহমদ মুসার গাড়ির মধ্যে।
আহমদ মুসা গাড়ির মেঝে থেকে উঠে বসল। শান্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ‘কি ব্যাপার? কে তোমরা? এভাবে কেন আমাকে আক্রমন করেছ, আমার গাড়ি ধ্বংস করেছ?’
‘বাঃ আহমদ মুসা বাঃ! ছয় ছয়টি স্টেনগানের মুখে দাঁড়িয়েও এমন স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলতে পার তুমি?’ বলল সাড়ে ছয় ফুট লম্বা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও নেতা গোছের একজন লোক।
বলেই সে একজনকে নির্দেশ দিল, ‘ওকে বের করে আন।’
তাদের পেছন থেকে আরও দু’তিন জন লোক ছুটে এল। তাদের একজন টান দিয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া একটা দরজা খুলে ফেলল।
দু’জনে হিড় হিড় করে টেনে আহমদ মুসাকে গাড়ি থেকে বের করল এবং শুইয়ে দিল রাস্তায়।
সাড়ে ছয় ফুট লম্বা সেই লোকটি এগিয়ে এল আহমদ মুসার কাছে। বলল, ‘ওয়েলকাম আহমদ মুসা। গত দুদিন ছিল তোমার, আজ তৃতীয় দিনটা আমাদের এবং এই তৃতীয় দিনটাই ফাইনাল। তোমাকে হত্যা করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম, তোমার পেটের অনেক কথা তাহলে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাবে। সে কথাগুলো আমাদের খুবই দরকার। এ জন্যেই এখনও তুমি প্রাণে বেঁচে আছ।’
‘আমার সৌভাগ্য।’ বলল আহমদ মুসা লোকটির দিকে তাকিয়ে। এই সাথে ভাবল আহমদ মুসা, এই লোকটিই কি স্পুটনিক ধ্বংসের নেতা? নেতা না হলে নেতা গোছের যে কেউ হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
‘সৌভাগ্য নয়, প্রমাণ হবে এটাই চরম দুর্ভাগ্য, যখন যাবে ‘সাও তোরাহ’তে। আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের ‘গুলাগ’টা কাল্পনিক ছিল, ঈশ্বরের এই ‘গুলাগ’ কিন্তু কাল্পনিক নয়।’
‘ঈশ্বরের কোন ‘গুলাগ’ থাকে না মি.। তাঁর আছে জাহান্নাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ ‘গুলাগ’ না বলে ‘জাহান্নাম’ও একে বলতে পার। কারণ এখানেও লোক ঢোকে, কিন্তু বের হয় না।’ বলল সেই সাড়ে ছয় ফুট লম্বা লোকটা।
‘দুনিয়ার সাজা নকল ঈশ্বরদের জাহান্নাম সম্পর্কে এ দাবী করা যায় না মি.।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমরা দুনিয়ার ঈশ্বর নই, অধীশ্বর আহমদ মুসা। জাহান্নাম সম্পর্কে ঐ কথা বলছ? ঠিক আছে তোমাকে দিয়েই তার প্রমাণ হবে, তুমি দেখতে পাবে।’
বলেই লোকটি যারা আহমদ মুসাকে টেনে বের করেছিল, তাদের একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘একে ক্লোরোফরম লাগাও।’
সংগে সংগেই লোকটি এগিয়ে এল।
আহমদ মুসার কাছে এসে পকেট থেকে বের করল ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার।
আহমদ মুসাও তাকাল ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার কনটেইনারের দিকে। দেখেই চিনল ওটা ভয়ংকর ধরনের একটা ক্লোরোফরম। এ ক্লোরোফরম দিয়ে কাউকে অজ্ঞান করলে দশ বারো ঘন্টার আগে তার জ্ঞান ফেরে না। এর কার্যকারিতাও অত্যন্ত দ্রুত। কারো নাকে স্প্রে করার দুই তিন সেকেন্ডের মধ্যে সে সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আবার এর আরেকটা গুণ হলো, কোথাও এটা স্প্রে করলে তিন চার গজের মধ্যে কেউ থাকলে সেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সুতরাং এটা যে ব্যবহার করে তাকে একটা ছোট গ্যাস মাস্ক পরতে হয়। তবে এর একটা অসুবিধা রয়েছে। সেটা হলো, এর সংজ্ঞাহীন করার কার্যকারিতা স্প্রে করার এক মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না।
লোকটি ক্লোরোফরম স্প্রেয়ার হাতে নেয়ার সাথে সাথে নাকে গ্যাস মাস্কও পরে নিয়েছে।
গ্যাস মাস্কের ট্রিগারে তার তর্জনি স্থাপন করল লোকটি।
আহমদ মুসাকে ঘিরে রাখা স্টেনগানধারীরা তাদের স্টেনগান আহমদ মুসার দিকে উদ্যত রেখেই ওরা চার পাঁচ গজ দূরে সরে গেল।
আহমদ মুসাকে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছে।
লোকটি স্প্রে করতে লাগল আহমদ মুসার নাকে। প্রায় পাঁচ সেকেন্ড সে স্প্রেটা ধরে রাখল আহমদ মুসার নাকের উপর।
পাঁচ সেকেন্ড স্প্রে করার পর স্প্রে বন্ধ করে সে দু’তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করল। তারপর হঠাৎ আকষ্মিকভাবে সে লোহার স্পাইকওয়ালা জুতার গোড়ালী দিয়ে প্রচন্ড এক ঘা দিল আহমদ মুসার বাম হাতের তালুতে। আহমদ মুসার দেহ নড়ল না, হাতও নয়। শুধু মুখ থেকে অস্ফুট ‘আ….আ’ শব্দ বেরিয়ে এল। তার গলার স্বরটা ঘুমিয়ে পড়ছে এমন মানুষের কন্ঠস্বরের মত শোনাল।
লোকটি আবার সেকেন্ড খানেক সময় নিয়ে আহমদ মুসার নাকে স্প্রে করল।
তারপর সেকেন্ড দেড়েক অপেক্ষ করে আগের মত লোহার স্পাইক দেয়া গোড়ালি দিয়ে আকষ্মিকভাবে প্রচন্ড এক আঘাত করল আহমদ মুসার পায়ের পাতায়।
কিন্তু এবার আর আহমদ মুসার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুল না।
‘ধন্যবাদ জ্যাকব, তোমার কাজ শেষ। এখন তুমি ওকে টেনে নিয়ে লাইবারম্যানের মাইক্রোটার কাছে চল।’ বলল সেই সাড়ে ছয়ফুট লম্বা লোকটি ক্লোরোফরম স্প্রে করা ‘জ্যাকব’ নামক লোকটিকে লক্ষ্য করে।
জ্যাকব আহমদ মুসাকে টেনে নিয়ে এল লাইবারম্যানের মাইক্রোর কাছে।
লোকটি এখানে পৌঁছে তার নাক থেকে গ্যাস মাস্ক খুলে ফেলল।
সবাই সেখানে এল।
সেই সাড়ে ছয়ফুট লম্বা লোকটিও।
সে বলল লাইবারম্যানকে লক্ষ্য করে, ‘লাইবারম্যান, মিশন সফল। পূর্ণ সফল হবে যখন একে ‘সাও তোরাহ’তে নিয়ে খাঁচায় পুরতে পারব। এর জন্যে সেখানে একটা সোনার খাঁচা তৈরী করব। অন্য খাঁচায় একে মানায় না।’
বলে একটু থেমে লাইবারম্যানকে লক্ষ্য করে আবার বলে উঠল, ‘আহমদ মুসাকে নিয়ে তোমার মাইক্রোর মেঝেতে শুইয়ে দাও। আরও চারজন স্টেনগানধারীকে নাও তোমার মাইক্রোতে। সে দশ বারো ঘন্টার আগে জাগবে না। তবু সাবধান থাকবে। নিয়ে গিয়ে হাত পা বেঁধে খাঁচায় ফেলে রাখবে। আমি ‘রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল’ হয়ে ঘাঁটিতে ফিরব।
‘রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে কেন মি.আজর ওয়াইজম্যান?’ বলল লাইবারম্যান।
‘আহমদ মুসার নতুন রুম কোনটি, তার হ্যান্ডব্যাগসহ তার লাগেজ কোথায় সে সব খোঁজ নিয়ে আসব। ওগুলো হাত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যে ডকুমেন্টগুলো আমি খুঁজছি তা আহমদ মুসার কাছে থাকার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। সাত গোয়েন্দার অসমাপ্ত কাজ এর পক্ষেই করা সম্ভব। দেখা যাক, এর কাছে ঐ সব কোন কিছু তথ্য পাওয়া যায় কিনা।’ বলল সাড়ে ছয় ফুট লম্বা আজর ওয়াইজম্যান লোকটি।
‘ঐ ছুঁড়ি-ছোঁড়া দু’জনের কি করা যায়?’ লাইবারম্যান বলল।
‘ওরা জিরো। ওদের গায়ে হাত দিয়ে খামাখা কেন পুলিশের ঝামেলায় পড়তে যাবে?’ বলল ওয়াইজম্যান।
‘ঠিক আছে স্যার।’ লাইবারম্যান বলল।
কথা শেষ করেই লোকজনের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমরা আহমদ মুসাকে আমার মাইক্রোতে তোল। আর স্টেনগানওয়ালা চারজন ওঠ আমার গাড়িতে।’
বলে লাইবারম্যান এগুলো তার গাড়িতে ওঠার জন্যে।
ওয়াইজম্যানও এগুলো তার কারের দিকে।
অল্পক্ষনের মধ্যেই এলাকাটা ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু পড়ে থাকল আহমদ মুসার ভাড়া করে আনা ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়িটা।
চলছে লাইবারম্যানের মাইক্রোবাসটি। গাড়ির মেঝের উপর উপুড় হয়ে আছে আহমদ মুসা।
তার পাশেই গাড়ির সিটে পাশপাশি বসে আছে চারজন লোক।
আর গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে আছে লাইবারম্যান। তার পাশে ড্রাইভিং সিটে আরেকজন ড্রাইভ করছে গাড়ি।
স্টেনগানধারী একজন তার জুতা দিয়ে আহমদ মুসার গায়ে টোকা দিয়ে বলল, ‘ব্যাটা নাকি খুব সাংঘাতিক। কিন্তু আমাদের বুদ্ধির কাছে কুপোকাত!এমন ফাঁদে ফেলা হয়েছে যে, কিছুই করতে পারল না।’
‘আমাদের দু’জন লোক মেরেছে গত রাতে এই লোক। মজা করে শোধ নেয়া যাবে।’ বলল তার পাশের আরেকজন স্টেনগানধারী।
‘কি শোধ নেবে, এতো দেখছি লিকলিকে ছেলে মানুষ। এর সম্পর্কে শোনা কথাগুলো আমার খুব বিশ্বাস হয় না।’ বলল আরেকজন।
‘একে আমার কোথায় নিচ্ছি, শার্লেম্যানের ৫নং বাড়িতে, না বড় বসের ফ্ল্যাটে?’ চতুর্থজন বলে উঠল।
‘কেন বলছ একথা?’ প্রথমজন বলল।
‘শোধ তোলার কথা বলছ তাই। ফ্ল্যাটে নিলে তো সেখানে আমাদের শোধ নেয়া যাবে না।’ চতুর্থজন উত্তর দিল।
‘চিন্তা করো না, তোমাদের সব ইচ্ছা পূরন হবে। তোমরা যেখানে চাচ্ছ সেখানেই নেয়া হবে।’ বলল লাইবারম্যান।
তাদের এই সব গল্প কথা চলতেই থাকল।
আহমদ মুসা সবই শুনছিল। ক্লোরোফরম তাকে সংজ্ঞাহীণ করতে পারে নি। ক্লোরোফরম স্প্রে করার সময় থেকে পাকা দেড় মিনিট সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিল। তাকে গাড়ির দিকে টেনে নেয়ার সময় যখন সে নিঃশ্বাস নিয়েছে, তখন ক্লোরোফরম এর কার্যকারিতা শেষ।
সংজ্ঞাহীন হওয়ার ভান করতে গিয়ে তাকে দারুণ কষ্ট করতে হয়েছে। জুতার লোহার স্পাইকওয়ালা গোড়ালী দিয়ে তার হাতের তালুতে আকষ্মিক এমন আঘাত করেছে যে চুপ করে থাকা অসম্ভব। আহমদ মুসা ধৈর্য্যের সব শক্তি একত্রিত করে চুপ থেকেছে শুধু একটা ক্ষীণ ‘আহ’ শব্দ করার মাধ্যমে। এটুকু শব্দ আহমদ মুসা ইচ্ছা করেই করেছে এটা প্রমাণ করার জন্যে যে, আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে। পায়ের তালুতে দ্বিতীয় আঘাতও তাকে হজম করতে হয়েছে কোন শব্দ না করে।
তাদের গল্পের মাঝে আহমদ মুসা একবার পলকের জন্যে চোখ খুলল। তার ভাগ্য ভাল যে উপুড় অবস্থায় তার মুখ স্টেনগানধারীদের দিকে ফেরানো ছিল। ফলে পলকটুকুতেই দেখতে পেল তার পাশেই গাড়ির সিটে বসা চারজনকে। তাদের পাগুলো আহমদ মুসার গা প্রায় স্পর্শ করে আছে। তাদের একজনের স্টেনগানটা কোলে। অন্য তিনজনের স্টেনগান মাটিতে রেখে ব্যারেল কোলে ঠেসে দেয়া। একজনের স্টেনগানের গোড়া আহমদ মুসার ডান বাহু স্পর্শ করে আছে।
আহমদ মুসা হিসেব কষল, সামনে থেকে লাইবারম্যানের এ্যাকশনে আসতে কতক্ষন সময় নেবে? এর মধ্যে সে কি পেছনটা নিকেশ করতে পারবে? কিন্তু এছাড়া তো উপায় নেই।
মসৃণ রাজপথের উপর দিয়ে মাইক্রোটা চলছিল তীরের বেগে।
চোখ দুটি আহমদ মুসা আবার অর্ধ নির্মিলিতের মত খুলে স্টেনগানের বাটটা আবার দেখে নিল।
তারপর চোখের পলকে আহমদ মুসা বাট ধরে স্টেনগানটা টেনে নিয়েই দেহটা ঘুরিয়ে চিৎ হয়ে গেল।
ওদের চারজনেরই চোখ পড়ে গিয়েছিল আহমদ মুসার উপর। কিন্তু ভুত দেখার মত আৎকে উঠেছিল সবাই। তাদের এই আৎকে ওঠার ভাব তারা কাটিয়ে ওঠার আগেই আহমদ মুসার হাতের স্টেনগান ওদের চারজনের উপর দিয়ে ঘুরে এল।
কি রেজাল্ট হয়েছে না দেখেই শোয়া অবস্থাতেই মুখটা ডানদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে স্টেনগান তাক করলো লাইবারম্যানকে।
চেয়ারের আড়ালে সে। তবু তার চেয়ারের ডানপাশ দিয়ে তার শরীরে ডান পাশের কিছু দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আহমদ মুসার হাতে নিখুঁত টার্গেট নেবার সময় ছিল না। সঠিক লক্ষ্যেই আহমদ মুসার স্টেনগান থেকে গুলির ঝাঁক বেরিয়ে গেছে।
গুলি করেই আহমদ মুসা উঠে দাড়াল। গাড়ি কিন্তু ছুটে চলছে তীর বেগেই।
আহমদ মুসার হাতের স্টেনগান তাক করা ড্রাইভারের দিকে। বলল, ‘ড্রাইভার, সামনে গাড়ি দাঁড় করাও। মনে রেখ দ্বিতীয়বার বলব না, গুলী করব।’
বলার সংগে সংগেই ড্রাইভার গাড়ির লেন চেঞ্জ করে রাস্তার কিনারে নিয়ে গেল। কয়েক গজ গিয়েই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা হাতের স্টেনগানটা গাড়ির পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে দরজা খুলে নামতে নামতে বলল, ‘ড্রাইভার, এখনি এদের কোন ক্লিনিকে নিলে এদের কেউ কেউ বেঁচে যেতে পারে।’
কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে ওখানেই দাড়িয়ে থাকল। মাইক্রোটি চোখের আড়ালে চলে যাবার পর একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘হোটেল রাইন ইন্টারন্যাশনাল’।
হোটেল রাইন ইন্টারন্যাশনাল যাওয়ার কথা আহমদ মুসা বলল বটে, কিন্তু পরে চিন্তায় এল, ওদের বড় বস আজর ওয়াইজম্যান তো হোটেল রাইনেই গেছে। সে সেখানে কি করবে, কি বলবে কে জানে!হুট করে হোটেলে যাওয়া তার ঠিক হবে কিনা। কিন্তু হোটেলে না গেলে সে যাবে কোথায়? সে যে লাইবারম্যানদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে একথা আজর ওয়াইজম্যান এখনি জানতে পারবে। জানতে পারার সংগে সংগে সে নিশ্চয় এবার পুলিশকে লেলিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তৎপর হবে। এই সাথে ওয়াইজম্যানরাও আরও মরিয়া হয়ে উঠবে। এই অবস্থায় খোঁজ খবর না নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করা তার জন্যে ঠিক হবে কিনা। তাছাড়া হোটেলের টুরিস্ট সেকশনের যে গাড়ি সে ভাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল, সেটা কোথায় এ প্রশ্নও উঠবে। গাড়ি হারিয়ে গেছে এ কথাও বলা যাবে না, আবার যে হাল হয়েছে গাড়ির সেটাও বলা যাবে না। কারণ তাতে অনেক প্রশ্ন উঠবে, যার জবাব সে দিতে পারবে না।
এসব চিন্তার মধ্যেই আহমদ মুসা পৌঁছে গেল হোটেলের কাছে। সে ঠিক করল হোটেলে না গিয়ে আপাতত সে গীর্জার সামনে নেমে যাবে।
গীর্জার পার্কিং এ নেমে পাশের একটা গাড়ির দিকে তাকাতেই খুশি হয়ে উঠল আহমদ মুসা। দেখল, ফাতিমা ও যায়েদ একটা গাড়িতে বসে।
ওদের দেখে খুশি হওয়ার পরক্ষনেই আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল আহমদ মুসা। ফাতিমারা হোটেলের বদলে গীর্জার পার্কিং এ কেন? হোটেলে কি কিছু ঘটেছে?
আহমদ মুসা এগুলো ওদের দিকে।
ওরাও দেখতে পেয়েছে আহমদ মুসাকে।
ওরা ছুটে এল আহমদ মুসাকে দেখে।
ওদের মুখে এ সময় যে হাসিটা থাকা স্বাভাবিক সেটা নেই।
ওদের এই অবস্থা দেখে আহমদ মুসাও হাসতে পারল না।
ওরা কাছে আসতেই আহমদ মুসা বলল, ‘কি ব্যাপার, তোমরা এখানে? ভাল আছো তো?’
আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার কোন জবাব না দিয়ে ফাতিমা ও যায়েদ এক সাথে বলে উঠল, ‘আপনি সুস্থ আছেন, আপনি ভাল আছেন তো ভাইয়া?’ তাদের কন্ঠে উদ্বেগ।
‘তোমরা একথা বলছ কেন? উদ্বিগ্ন কেন তোমরা এত?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া আপনাকে ওরা ধরে নিয়ে যায়নি?’ বলল যায়েদ চোখ কপালে তুলে।
‘হ্যাঁ গিয়েছিল। মুক্ত হয়ে আসলাম। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?’
‘এই তো ক’মিনিট আগে আমি আসার সময় ঈল পার্কের মোড়ে আপনার গাড়ি ঝাঁঝরা অবস্থায় দেখলাম। আমি গাড়ির নাম্বার দেখে চিনতে পারি ও গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। জিজ্ঞেস করে সেখানে জড়ো হওয়া লোকদের একজনের কাছে শুনলাম, ছয় সাতটা গাড়ি এ গাড়িটাকে ঘিরে ফেলে বিরামহীন মেশিনগানের গুলী চালিয়ে গাড়ির এ হাল করেছে। এ গাড়ি থেকে একজনকে বের করে ঐ গাড়িওয়ালারা ধরে নিয়ে গেছে। কি ঘটেছিল ভাইয়া, কি করে আপনি মুক্ত হলেন?’ বলল যায়েদ।
আহমদ মুসা সংক্ষেপে ঘটনাটা ওদের বলল। ঘটনা শুনে ওদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বলল ফাতিমা, ‘ভাইয়া মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যে আপনি দ্বিতীয়বার জীবন পেলেন।’
তারপর যায়েদ ও ফাতিমা দু’জনেই হাত উপরে তুলে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। হে আল্লাহ, আমাদের ভাইয়ার বুদ্ধি, শক্তি, সাহস আরও বাড়িয়ে দিন। এ ধরনের সব বিপদেই তিনি যেন জয় করতে পারেন।’
তারা থামতেই আহমদ মুসা বলল, ‘তোমরা এখানে কি করছ? ঐ শয়তানদের একজন নেতা আজর ওয়াইজম্যান তো হোটেলে আসার কথা আমার রুমের খোঁজ খবর নেবার জন্যে!’
‘সে এসেছিল এবং খোঁজ নিতে আপনার কক্ষেও ঢুকেছিল। সে যখন কাউন্টারে কথা বলছিল, তখন আমি কাউন্টারের পাশে ছিলাম। সব আমি শুনি এবং তাকে ফলো করি। তার ছবিও আমি নিয়েছি। যেভাবে অথরিটির সাথে সে কথা বলছিল এবং কাজ করছিল, তাতে আমার মনে হয়েছে সে ষড়যন্ত্রকারীদের একজন বড় কেউ হবেন। যাই হোক, তার কথা শুনে আমি বুঝে যে, আপনার কোন বিপদ হয়েছে। সেজন্যে হোটেলের লবিতে বসেই আমি যায়েদের অপেক্ষা করি। সে এলে তার কাছে সব শুনে গাড়ি নিয়ে আমরা হোটেল থেকে সরে এসে এখানে অপেক্ষা করি। আমাদের ভয় হচ্ছিল আপনাকে হস্তগত করার পর আমাদের কক্ষেও ওরা হানা দেবে।’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘দিতে পারে। কারণ তারা যে জিনিস খুঁজছে তা আমার সুটকেসে পায়নি। আমার হ্যান্ডব্যাগ ও তোমাদের ব্যাগেজ দেখার জন্যে তোমাদের কক্ষেও হানা দিতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি খুঁজছে ভাইয়া ওরা?’ বলল যায়েদ।
‘স্পুটনিকের গোয়েন্দারা নিউইয়র্কের টুইন (লিবার্টি ও ডেমোক্রাসি) টাওয়ার ধ্বংসের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে যে দলিল দস্তাবেজ যোগাড় করেছিল, সে সবেরই কতকগুলো বা কোনটি সম্ভবত তারা খুঁজছে। লা-মন্ডের রিপোর্টে গোয়েন্দা অপহরণ করার কারণ হিসাবে এ ধরনের কিছুকেই সন্দেহ করা হয়েছিল। আজ আজর ওয়াইজম্যানের মুখেও এ ধরনের কথাই শুনেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, আপনি ওদের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পর ওরা নিশ্চয় দারুণ ক্ষেপে গেছে। এই অবস্থায় হোটেল আপনার জন্যে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, আমাদের জন্যেও। কি করা যায় এখন। বাড়ি একটা পেয়েছি। ভাড়া একটু বেশি হলেও আপনি যেমন চেয়েছিলেন, সেরকমই বাড়িটা। বাড়িটাতে কালকে উঠলে ভাল হয়, ‘তবে আজকেও উঠা যায়।’ বলল যায়েদ।
‘আমরা এখনি হোটেল ছেড়ে দেব। আমি ও যায়েদ গিয়ে উঠব ভাড়া করা বাড়িতে। আর ফাতিমা উঠবে আপাতত তার আত্মীয়ের বাড়িতে।’ আহমদ মুসা বলল।
ম্লান হয়ে গেল ফাতিমা কামালের মুখমন্ডল। পরক্ষনেই লজ্জায় ছেয়ে গেল তার মুখ। ফুটে উঠল ঠোঁটে লজ্জা মিশ্রিত হাসি। বলল, ‘ভাইয়া, আপনার জন্যে আরও কিছু খবর আছে। কামাল সুলাইমান ভাইয়ার বাসা থেকে অল্পক্ষন আগে জানিয়েছে, আজ বাদ আসর স্ট্রাসবার্গ মসজিদ কম্যুনিটি হলে দু’পক্ষই বিয়ের আয়োজন করার ব্যাপারে রাজী। আপনার মত পেলেই এটা চূড়ান্ত হবে।’
আহমদ মুসার মুখে ফুটে উঠল মিস্টি হাসি। বলল, ‘ওয়েলকাম বোন। আমার আগের কথা বাতিল। তুমিও আজ যায়েদের সাথে ভাড়াবাড়িতে উঠবে। ওদের বলে দাও। শুভস্য শীঘ্রম।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ মুখ নত করে বলল ফাতিমা কামাল।
আহমদ মুসার মুখে সংকোচ জড়িত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ফাতিমা, যায়েদ, মনে করতে পারো আমি তোমাদের উপর অন্যায় চাপিয়ে দিয়েছি। ভাবতে পার যে, তোমাদের ইনটিগ্রিটিকে আমি সন্দেহ করছি। আমি………’।
আহমদ মুসার কথায় বাধা দিয়ে ফাতিমা কামাল বলে উঠল, ‘ভাইয়া আপনার কথা ঠিক নয়। আপনি আমাদের সত্যিকার অভিভাবকের কাজ করেছেন। আপনি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, আমরা আমাদের অল্পই জানি, স্রষ্টা জানেন সবটুকুই। সুতরাং আমাদের জন্যে তাঁর নির্দেশই চূড়ান্ত।’ ফাতিমার কন্ঠ আবেগাপ্লুত ও দৃঢ়।
‘ধন্যবাদ বোন’, বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘চল হোটেলের বিল চুকিয়ে আমরা চলে আসি।’
আহমদ মুসাসহ ওরা দু’জন আবার গিয়ে গাড়িতে বসল।
গাড়ি চলতে শুরু করল হোটেলের দিকে।
‘ভাইয়া, আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাচ্ছি?’ বলল ফাতিমা কামাল।
‘বাদ আসরের অনুষ্ঠান পর্যন্ত তুমি তোমার ভাইয়া কামাল সুলাইমানের বাড়িতে থাকবে। আমি যায়েদকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে উঠব। যায়েদ বাসায় উঠে বাড়ি গুছাবে। আর আমি পরবর্তী অভিযানের জন্যে কিছু খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করব।’
‘কি অভিযান?’ জিজ্ঞেস করল ফাতিমা।
‘ও কথা এখন থাক। পরে বলব।’ বলল আহমদ মুসা।
গাড়ি প্রবেশ করল হোটেলের কার পার্কিং এ।
সত্যিই আহমদ মুসা যেমন চেয়েছিল, সে রকমই বাড়িটা।
আহমদ মুসার কক্ষটি বেশ বড়। এটাচড বাথ। কক্ষ থেকে ফ্ল্যাটের বাইরে বেরুবার ইন্ডিপেনডেন্ট প্যাসেজ। অন্যদিকে দুটি বেডরুম আর একদিকে গেস্টরুম নিয়ে ফাতিমা যায়েদদের অংশ। আহমদ মুসার কক্ষ থেকে ডাইনিং ড্রইং এ প্রবেশের একটা দরজা রয়েছে। এই দরজা বন্ধ থাকলে ফ্ল্যাটের দুই অংশ বলা যায় আলাদাই হয়ে পড়ে। দরজাটা দুই দিক থেকেই বন্ধ করা যায়। সিদ্ধান্ত হয়েছে দরজাটা দুই দিক থেকেই বন্ধ রাখা হবে। দুই পক্ষের কারও প্রয়োজন হলে নক করে দরজা খুলতে হবে। ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বেরুবার জন্য ফাতিমা-যায়েদদের প্যাসেজও আলাদা।
নতুন দম্পতি হিসেবে ফাতিমা ও যায়েদ ফ্লাটে উঠেছে মাগরিবের নামাজের আধা ঘন্টা আগে। স্ট্রাসবার্গ মসজিদ কম্যুনিটি হলে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটি হয়েছে খুবই সুন্দর, কিন্তু সংক্ষিপ্ত। স্ট্রাসবার্গের পনেরটি মুসলিম পরিবার যোগ দিয়েছিল এই বিয়ের অনুষ্ঠানে। বিয়ের পর ফাতিমা ও যায়েদের আত্মীয় স্বজনরা তাদেরকে ফ্ল্যাটে তুলে দিয়ে গেছে।
রাত ১১টা। আহমদ মুসা নক করল ফাতিমা-যায়েদদের অংশে ঢোকার পার্টিশন ডোরে।
খুলে গেল দরজা।
দরজা খুলে দিয়েছে যায়েদ।
আহমদ মুসা সালাম দিল যায়েদ ও ফাতিমা দুজনকে।
ফাতিমা কামাল বসেছিল সোফায়।
আহমদ মুসা দরজায় এসে সালাম দিতেই সালামের জবাব দিয়ে উঠে দাড়াল ফাতিমা। আরও বলল, ‘ওয়েলকাম ভাইয়া।’
বিয়ের পোশাকটা নেই ফাতিমা কামালের পরনে। কিন্তু যে পোশাক পরেছে তাতেও তাকে নববধুই লাগছে। ফুলহাতা কামিজ তার পা পর্যন্ত নেমেছে। মাথার রুমাল কপাল ঢেকে গলা জড়িয়ে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। ফাতিমা কামালের শ্বেতাভ গোলাপী দেহে গোলাপী এই পোশাক তাকে অপরূপ করে তুলেছে।
নত দৃষ্টিতে আহমদ মুসা যায়েদের সাথে গিয়ে সোফায় বসল।
ফাতিমা কামালও বসল।
যায়েদ গিয়ে বসেছে ফাতিমার পাশে। আর আহমদ মুসা তাদের সামনের আরেকটি সোফায়।
ফাতিমার চোখে মুখে লজ্জার ছাপ। লাল হয়ে উঠেছে মুখ।
যায়েদও অনেকটাই বিব্রত।
প্রথম নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসাই। বলল, ‘নতুন সংসার, কোন অসুবিধা নেই তো তোমাদের?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। কোন অসুবিধা নেই ভাইয়া।’ বলল যায়েদ। তার মুখে সলজ্জ হাসি।
‘ভাইয়া, আমরা তো জানি না, আপনি কি বাইরে বেরিয়েছিলেন? ফিরলেন এখন?’ বলল ফাতিমা।
‘না তো, কোথাও বের হইনি? কেন বলছ এ কথা?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বাইরের পোশাক আপনার পরনে।’ বলল ফাতিমা।
‘ও’ বলে হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বাইরে বের হইনি, বের হবো। সে কথাই তোমাদের বলতে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই রাত ১১টায় বাইরে বেরুবেন? কোথায়?’ বলল ফাতিমা ও যায়েদ একই সাথে। তাদের কন্ঠে বিস্ময়।
‘বলেছিলাম তো এক অভিযানে বেরুতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোথায়?’ বলল যায়েদ।
‘ওদের একটা আস্তানার সন্ধান পেয়েছি। আমি যখন সংজ্ঞাহীন হওয়ার ভান করে ওদের গাড়ির মেঝেতে পড়েছিলাম, তখন ওদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমি ওদের একটা ঘাঁটির ঠিকানা পেয়ে যাই। সেখানেই যাব। দেখি, ওদের পরিচয়, পরিকল্পনা এবং অপহৃত সাতজনকে কোথায় রেখেছে-এসব ব্যাপারে কোন তথ্য উদ্ধার করা যায় কিনা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আজই একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। ওরা সাংঘাতিক ক্ষেপে আছে আপনার উপর। এই অবস্থায় এত রাতে আপনার একা তাদের ঘাঁটিতে যাওয়া ঠিক হবে না।’ বলল ফাতিমা দৃঢ় প্রতিবাদের কন্ঠে।
‘না ফাতিমা। শত্রুকে আঘাত করার পর শত্রু পাল্টা আঘাত করার আগেই যদি তাকে আবার আঘাত করা যায়, তাহলে শত্রুকে তাড়াতাড়ি কাবু করা যায়। আজ ওরা যে আঘাত খেয়েছে, তার পাল্টা আঘাতের চিন্তায় ওরা এখন ব্যস্ত। নতুন আঘাত আসতে পারে এটা তারা ভাবছে না এবং আত্মরক্ষারও কোন চিন্তা তাদের মাথায় নেই। সুতরাং এটা একটা বড় সুযোগ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আপনার সাথে যুক্তিতে পারবো না ভাইয়া। আপনার এই যুক্তির জবাবে কি বলতে হবে আমার জানা নেই। কিন্তু আমি যেটা জানি, সেটা হলো আপনার একা ঐ শত্রুপুরীতে যাওয়া ঠিক নয়’।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এসব অভিযান দল বেধে হয় না ফাতিমা। দলবল নিয়ে গেলে শত্রুদের আগাম জেনে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। তাতে লোকক্ষয় হলেও লক্ষ্য অর্জন হয় না। এ জন্যে একা যাওয়াটাই নিরাপদ ও ফলপ্রসু’।
‘কিন্তু একা গিয়ে যদি আপনি বিপদে পড়েন, কোন সাহায্যের যদি আপনার দরকার হয়? না ভাইয়া, আপনার একা যাওয়া হবে না’। বলল ফাতিমা।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সবচেয়ে বড় সাহায্যদাতা যিনি, তিনি তো সাথেই আছেন। তিনিই সাহায্য করবেন ফাতিমা। আমাদের তার উপরই নির্ভর করা উচিত’।
‘আল্লাহর কথা বলছেন ভাইয়া? তিনি তো আছেনই। তিনি অবশ্যই সাহায্য করবেন। কিন্তু তিনিই তো শত্রু মোকাবিলায় আমাদের উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কিন্তু আপনি তা করেছেন না ভাইয়া’। বলল ফাতিমাই।
‘আমার সাধ্য যা সেভাবেই আমি প্রস্তুতি নিয়েছি ফাতিমা। বলতে পার, লোক সাথে নেই, একা যাচ্ছি। কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে এমন অনেক কাজ আছে যা একা করতে হয়। আমি সে রকম একটা কাজেই যাচ্ছি। আমি গোপনে তাদের ঘাঁটিতে ঢুকব। অনুসন্ধান করব। তাদের সম্পর্কে তথ্যাদি যোগাড়ের চেষ্টা করব। এমন ধরনের কাজে একা যেতে হয়। আমি সেটাই করছি বোন’। আহমদ মুসা বলল।
‘বুঝলাম। কিন্তু ভাইয়া, এ ধরনের কাজেও তো সংঘর্ষ হয়। প্রয়োজনীয় সাহায্যের দরকার হয়’। বলল ফাতিমা।
‘দোয়া কর তোমরা বোন। এই সাহায্য যেন আল্লাহ করেন, আমাকে তোমরা বাধা দিওনা। আমি এই কাজ নিয়ে একাই তো এসেছি শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে। সর্বজ্ঞ আল্লাহ এটা জানেন এবং তিনিই আমাকে সাহায্য করবেন’।
ফাতিমা কোন জবাব দিল না। তার অপলক দু’চোখ তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
যায়েদের বিস্ময় বিমুগ্ধ দু’চোখ নিবদ্ধ আহমদ মুসার মুখের উপর।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘ভাই বোনরা এভাবে তাকিয়ে কেন?’
‘ভাবছি ভাইয়া’। ফাতিমা বলল।
‘কি ভাবছ?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাবছি, ভাইয়ার পরিচয় জানার ভাগ্য কি আমাদের এখনও হলো না? আমি নিশ্চিত ভাইয়া, আপনার এমন একটা পরিচয় আছে যা এত বড় যে আমরা সামান্য মানুষ হয়ে তা জানা ঠিক নয়’। ফাতিমা বলল।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘ফাতিমা, যায়েদ, গত দু’তিন দিনের পরিচয় থেকে, আমার আচরণ থেকে কি তোমাদের এই বিশ্বাসই হয়েছে?’
‘না ভাইয়া, এ বিশ্বাস নয় বরং উল্টো বিশ্বাসই হয়েছে এবং এ কারণেই মনে কষ্ট লাগছে যে, এত আপন করে যিনি আমাদের নিয়েছেন, স্নেহ ও অভিভাবকত্বের ছত্রছায়া যিনি আমাদের পরম আকাঙ্খিত এক নতুন জীবনে নিয়ে এসেছেন, তার পরিচয় আমরা জানি না, আমাদের জন্যে এটা অবশ্যই বড় কষ্টের ভাইয়া’। বলল ফাতিমা আবেগে ভারী কন্ঠ তার।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তোমার কথা বুঝতে পারছি বোন। তোমাদের কাছ থেকে আমার পরিচয় গোপন করার কোন সিদ্ধান্ত আমি নেইনি। আমি এই মিশনে এখানে আসার আগে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার পরিচয় আমি কোথাও প্রকাশ করব না। তাতে আমার কাজ অনেকখানি সহজ হবে এবং শত্রুকে অনেকখানি অসতর্ক ও অপ্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যাবে। কিন্তু শত্রুরা আমার পরিচয় যেভাবেই হোক জেনে ফেলেছে। আমার পরিচয় আগাম জেনেই আজ সকালে ওরা আমাকে ঐভাবে আট-ঘাট বেঁধে বন্দী করতে এসেছিল। শত্রুদের কাছ থেকে আমার পরিচয় গোপন রাখার জন্যেই নিজের পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শত্রুরা সেই পরিচয় যখন জেনেই ফেলেছে, তখন আর পরিচয় গোপনের প্রয়োজন দেখি না’।
বলে আহমদ মুসা সামনের টি টেবিল থেকে স্লিপ পেপারের একটা পাতা ছিড়ে নিয়ে তাতে খস খস করে নিজের নাম লিখল এবং তা স্লিপ প্যাডের নিচে চাপা দিয়ে একটু হেসে বলল, ‘আমি আমার পরিচয় লিখে রাখলাম, পরে পড়ে নিও’।
বলে আহমদ মুসা একটু থামল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে তা যায়েদের হাতে দিয়ে বলল, ‘এতে আমি যেখানে যাচ্ছি তার ঠিকানা লেখা আছে। আমি যদি ভোর পর্যন্ত না ফিরি, তাহলে তোমার পরিচিত পুলিশ অফিসারকে এবং পুলিশ স্টেশনকে এই ঠিকানা জানিয়ে বলবে, স্পুটনিক যারা ধ্বংস করেছে, স্পুটনিকের ৭ গোয়েন্দাকে যারা কিডন্যাপ করেছে, তাদের একটা ঘাঁটির ঠিকানা এটা। ঠিকানাটায় আপনারা এখনি রেড করুন’।
যায়েদ স্লিপটা হাত পেতে নিল। কিন্তু কোন কথা বলল না।
ফাতিমাও কিছু বলল না।
হঠাৎ করে তাদের দু’জনের দু’চোখ ছল ছল করে উঠেছে। উদ্বেগে-আশঙ্কায় তাদের মুখ পান্ডুর।
ফাতিমার দু’চোখের অশ্রু তার দু’গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
আহমদ মুসা তাদের অশ্রু দেখে আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘তোমাদের এই মমতার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তোমরা চিন্তা করো না। আল্লাহই আমাদের সহায়’।
বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
সালাম দিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে আহমদ মুসা ফ্ল্যাটের গেটের দিকে এগুলো।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই উঠল। তারা আহমদ মুসার পেছন পেছন গেট পর্যন্ত এগুলো। তারপর ‘ফি আমানিল্লাহ, আল্লাহ হাফেজ’ বলে বিদায় জানাল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসাও ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে লিফটের দিকে এগুলো।
লিফট নেমে গেলেও ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই গেটের দু’চৌকাঠে ঠেস দিয়ে সামনে শূণ্য দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে থাকল।
অনেকক্ষন পর ফাতিমা একইভাবে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে বলে উঠল, ‘যায়েদ, ভাইয়া তো আসলেই আমাদের কেউ নন। কিন্তু মন মানছে না কেন? তার বিপদের ভয় এমন করে মনকে পীড়া দিচ্ছে কেন? এ কিসের টান যায়েদ?’
যায়েদও ঐভাবেই স্বগতোক্তির মত জবাব দিল, ‘আমিও জানি না ফাতিমা। তবে এটুকু অনুভব করি, তিনি তার অসীম মমতা দিয়ে আমাদের মন জয় করে নিয়েছেন। বলতে পার ফাতিমা, তার মত এত মমতা এত দায়িত্ববোধ, এত মধুর শাসন আর কারও কাছ থেকে কখনও আমরা পেয়েছি?
‘কিন্তু কেন তিনি এত আদর করেন, কেন তাঁর এই দায়িত্ববোধ, কেন এই মধুর শাসন যায়েদ? আমরা তো তাঁর কেউ নই’। বলল ফাতিমা উদাস কন্ঠে।
‘হতে পারে এটা এক আদর্শের সহমর্মিতা’। যায়েদ বলল।
‘কিন্তু আদর্শিক ভাইদের সাথে তো আমাদের কম দেখা হয়নি। এমন তো দেখিনি কখনও’।
‘হতে পারে খাঁটি আদর্শে গড়া এক মানুষের সন্ধান আমরা এই প্রথম পেলাম’। যায়েদ বলল।
কে তাহলে আমাদের অদেখা, অচেনা অতুলনীয় এই মানুষটি? জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল ফাতিমার কন্ঠে।
‘চল দেখি, তাঁর পরিচয়, তিনি কি লিখে গেছেন’। বলে যায়েদ সোজা হয়ে দাঁড়াল।
সম্বিত ফিরে পাওয়ার মত চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল ফাতিমা। ভেতর দিকে ছুটতে ছুটতে বলল, ‘ধন্যবাদ যায়েদ, তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছ। এস তুমি’।
ফাতিমা ছুটে গিয়ে না বসেই স্লিপ প্যাডের নিচ থেকে আহমদ মুসার রাখা কাগজটা তুলে নিল। কাগজের উপর চোখ বুলাতে বুলাতে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফাতিমা।
স্লিপে লেখা ‘আহমদ মুসা’ নাম পড়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা খেল ফাতিমা। সমস্ত সত্তায় তার যে ধাক্কাটা ব্যঙ্ময় হয়ে উঠল তা হলোঃ ‘আহমদ মুসা। কোন আহমদ মুসা? ক্যারিবিয়ান, আমেরিকা ও সুরিনামের ঘটনায় সদ্য আলোচিত সেই আহমদ মুসা, যিনি ফ্রান্সে, সুইজারল্যান্ড, কংগো, ফিলিস্তিন, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, মিন্দানাওয়ের অসংখ্য সুঘটনার জনক?’
এই সব জিজ্ঞাসার মধ্যে হারিয়ে গেল ফাতিমা। কাগজের স্লিপটা তার হাতে ধরা। তার উপর আঠার মত লেগে আছে ফাতিমার চোখ। মূর্তির মত নিরব-নিশ্চল ফাতিমা।
যায়েদও ফাতিমার কাছে এসে পৌছাল। বলল, ‘কি ফাতিমা, কি দেখলে? কি নাম, কি পরিচয় লিখেছেন তিনি?’
কোন কথা বলল না ফাতিমা।
নির্বাক মূর্তির মত হাতের কাগজটা যায়েদের হাতে তুলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সোফায়।
কাগজটিতে দ্রুত চোখ বুলাল যায়েদ।
‘আহমদ মুসা’র নাম পড়ে চমকে উঠল যায়েদ। কয়েকবার পড়ল নামটা। না তার পড়া ঠিক। এই নামটাই লেখা আছে কাগজে। কাগজ থেকে মাথা তুলে ভাবল একটু আহমদ মুসার কথা। তারপর ‘ও গড’ বলে বসে পড়ল সোফায় ফাতিমার পাশে।
দু’জন পাশাপাশি বসে।
দু’জনেই নিরব।
দু’জনের চোখে-মুখেই বিস্ময় ও বিহবলতার ভাব।
নিরবতা ভাঙল যায়েদ। বলল, ‘আমি ভাবতে পারছি না ফাতিমা। আমরা তিন দিন ধরে আহমদ মুসার সাথে আছি। ভাবলেই আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে যে, ঐ ঘরটিতে বিশ্ব বিখ্যাত আহমদ মুসা থাকেন, আর এইমাত্র তিনি বেরিয়ে গেলেন আমাদের সাথে কথা বলে’।
ধীরে ধীরে ফাতিমা মুখ খুলল। সম্মোহিত কন্ঠে স্বগতোক্তির মত বলল, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না আমারও, আহমদ মুসা এত সহজ, এত সরল, এত সাধারণ। আবার বিশ্বাস হচ্ছে এই কারণে যে, গত তিন দিনে তিনি যা করেছেন সেটা আহমদ মুসারই কাজ। আজকের পাশ্চাত্যের দুর্বিনীত, অহংকারী যোগ্যতাকে এভাবে ধুলায় মিশিয়ে দিতে আহমদ মুসাই পারেন, আর কেউ নয়’। আবেগে কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছে ফাতিমার।
‘আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে যে, আহমদ মুসা স্ট্রাসবার্গে এসেছেন, স্পুটনিক ধ্বংসের কেসটাকে তিনি গ্রহন করেছেন এবং মুসলামানদের এইটুকু বিপদও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে’। আবেগে ভারী হয়ে উঠেছে যায়েদের কন্ঠও।
ফাতিমার স্বগত কন্ঠ আবার, ‘বড়ত্বের প্রকাশ একটুও তাঁর মধ্যে নেই। কিন্তু স্নেহ-মমতার সিড়ি বেয়ে তিনি কখন যেন আমাদের মাথার উপর উঠে বসেছেন। তিনি যা বলেন তা করা আমাদের জন্য অমোঘ হয়ে যায়। এ ভাবেই বুঝি তিনি নেতা না হয়েও সবার নেতা’।
‘আলহামদুলিল্লাহ ফাতিমা। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। স্ট্রাসবার্গে আহমদ মুসার সাথী হবার জন্যে আল্লাহ আমাদেরকেই বেছে নিয়েছেন’। বলল আবেগ জড়িত কন্ঠে যায়েদ।
ফাতিমা একটু ঘুরে বসে যায়েদের দু’হাত চেপে ধরে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ যায়েদ। এটা আমাদের জন্যে পরম গর্বের’। থামল ফাতিমা।
যায়েদ কিছু বলল না। দু’জনেই নিরব।
একটু পর নিরবতা ভাঙল ফাতিমাই। বলল, ‘কিন্তু আমরা তাকে কোন সহযোগিতা করতে পারছি কই? বিপজ্জনক ও সংঘাতের সব কাজ তিনি একাই করেছেন। আজও তাই গেলেন। আজ সকালের ঘটনায় তিনি বন্দী হয়েছিলেন। ভাবতে পার, যদি তিনি মুক্ত হতে না পারতেন। তার মত এত মূল্যবান মানুষ এতটা নিরাপত্তাহীন থাকা কি ঠিক?’
‘আমরা কি সহযোগিতা করব, আর কি সহযোগিতা তিনি নেবেন। আমরা রিভলবার চালাতে পারা ছাড়া এই লাইনে আর কোন অভিজ্ঞতাই নেই। আচ্ছা বল, এখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমাদের কি করণীয়?’ বলল যায়েদ।
‘আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে’। বলল ফাতিমা।
‘কি বুদ্ধি?’ জিজ্ঞেস করল যায়েদ।
‘পরে বলছি। বুদ্ধিটা একটু পাকিয়ে নেই’।
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ফাতিমা, ‘তার আগে একটু গড়িয়ে নেব’।
যায়েদও উঠে দাড়িয়েছে। বলল, ‘আমি?’
‘তোমার পথ তুমি দেখ? তোমার বেডরুম ওদিকে’। বলল ফাতিমা। তার ঠোঁটে হাসি।
‘কিন্তু আজ দুই পথ তো এক হয়ে গেছে।’ বলল যায়েদ। তারও মুখে হাসি।
‘তা ঠিক। কিন্তু আমরা তো যুদ্ধক্ষেত্রে।’ ফাতিমা বলল।
হাসল যায়েদ। বলল, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বলতে পার যুদ্ধের তাঁবুতে। এক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের (স.) দৃষ্টান্তই আমাদের পথ দেখাতে পারে’। হাসল যায়েদ।
সলজ্জ হাসিতে রাঙা হয়ে উঠল ফাতিমার মুখ। বলল, ‘মনে থাকে যেন সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর রাসূলের (সঃ) এর দৃষ্টান্ত এভাবে খোঁজ করা হবে’।
‘অবশ্যই’। বলে যায়েদ তার এক হাত বাড়িয়ে দিল ফাতিমার দিকে।
ফাতিমার এক হাত এগিয়ে এসে ধরল যায়েদের হাত।
দু’জনেই এক সাথে পা বাড়াল সামনে।
৪
শার্লেম্যান রোডের ৫ নাম্বার বাড়িটা বেশ বড়। তিনতলা বাড়ি। প্রাচীর ঘেরা।
গেটের উপর বিরাট সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, ‘হিউম্যান রাইটস ইউনিভার্সাল গ্রুপ, স্ট্রাসবার্গ’। সাইনবোর্ডে রাস্তার নামও নেই, বাড়ির নাম্বারও নেই।
আহমদ মুসা বিকেলে এসে দেখে না গেলে এই বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হতো। আশে পাশের লোকদের জিজ্ঞেস করে তবেই আহমদ মুসা ‘হিউম্যান রাইটস ইউনিভার্সাল গ্রপে’র অফিসকে ৫ নাম্বার বাড়ি বলে চিনতে পেরেছিল।
বাড়িটা চেনা আছে বলে আহমদ মুসা খুব নিশ্চিন্তে বাড়ি থেকে বেশ দূরে গাড়ি থেকে নেমে গাড়িটা ছেড়ে দিল।
পথচারীর মত হেঁটে হেঁটে বাড়িটার প্রান্তে এসে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
আর কিছুটা এগুলে গেট। কিন্তু আহমদ মুসা গেট দিয়ে প্রবেশ করতে চায় না।
আহমদ মুসা যেখানে এসে দাড়িয়েছিল, সেখান থেকেই বাড়িটার প্রাচীর শুরু। সেখান থেকে একটা প্রাচীর শার্লেমান সড়কের পাশ ঘেঁষে দক্ষিণে এগিয়ে গেছে। এই প্রাচীরেই বাড়িতে প্রবেশের গেট। আরেকটা প্রাচীর বাড়ির উত্তর সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে গেছে। এই প্রাচীরটাই বাড়ির পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমানা ঘুরে শার্লেম্যান রোডের প্রাচীরের সাথে এসে মিশেছে।
আহমদ মুসা তাঁর হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল, রাত সাড়ে এগারটা বাজে।
সে উত্তরের প্রাচীরের ধার ঘেঁষে পশ্চিম দিকে এগুলো।
আহমদ মুসা ঠিক করেছে প্রাচীর টপকে সে ভেতরে ঢুকবে। এভাবে সবার অলক্ষ্যেই সে ভেতরে ঢুকবে। মারামারি বা শত্রু নিধনে তার কোন লাভ নেই। তার চাই কিছু দলিল-প্রমাণ। যা থেকে জানা যাবে, স্পুটনিকে কি ঘটছে, কেন ঘটছে এবং স্পুটনিকের ৭ গোয়েন্দা কোথায়। এজন্যে গোপনে সে বাড়ি সার্চ করতে চায়। সে নিশ্চিত যে, এভাবেই সে একদিন এখান থেকে বা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় দলিল দস্তাবেজ পেয়েই যাবে।
আহমদ মুসা পশ্চিম প্রাচীরের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাড়াল।
এ প্রাচীরের পর একটা ফলের বাগান। তারপর বাড়িটা। বাড়িটার উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ফুলের বাগান। ফলের বাগান শুধু পশ্চিম দিকেই।
বাড়িটাতে পৌঁছা পর্যন্ত গাছের আড়াল পাওয়া যাবে বলেই আহমদ মুসা এ দিকটা বেছে নিয়েছে। প্রাচীরটা সাত ফুটের মত উঁচু।
কোন কষ্টই হলো না আহমদ মুসার প্রাচীর ডিঙ্গাতে।
একটু দৌড়ে এসে কয়েক ফুট প্রাচীর বেয়ে উঠে গিয়ে প্রাচীরের মাথা ধরে ফেলে খুব সহজেই প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে গেল আহমদ মুসা।
বাগানের গাছগুলো বেশ দূরে দূরে। তার ফলেই গাছগুলো বড় বড়।
আহমদ মুসা বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগোচ্ছে বাড়ির দিকে।
বাড়ির চারদিকে চারটি আলোর ব্যবস্থা আছে। সেই আলোতে বাড়ি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বাগানের জমাট অন্ধকার একটুও দূর হয়নি। অনেকটা অন্ধের মতই হাঁটছে আহমদ মুসা।
চোখে কিছু দেখছে না বলেই কান দু’টি সে বেশি সতর্ক রেখেছে। হঠাৎ তার মনে হলো, নরম ঘাসের উপর তার পায়ের যে শব্দ, সে রকম অনেকগুলো শব্দ তার কানে আসছে। যেন তার ডানে, বামে, পেছনে অনেকগুলো পা তার মত করেই সামনে অগ্রসর হচ্ছে, এই অনুভূতি হওয়ার সাথে সাথেই থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
চারদিকে সতর্ক চোখ বুলাচ্ছে সে।
এই সময় একটা গম্ভীর কন্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘ঠিকই সন্দেহ করেছ আহমদ মুসা। আমরা ঘিরে ফেলেছি তোমাকে চারদিক থেকে। ডজনখানেক স্টেনগান তোমাকে তাক করে আছে। আমাদের প্রত্যেকের চোখে ইনফ্রারেড গগলস। তোমার সবকিছুই আমরা দেখছি। কোন বেয়াদবীর দূর্মতি হলে একেবারে ভর্তা হয়ে যাবে। যেভাবে হাঁটছিলে, সেভাবেই সামনে এগুতে থাক’। কন্ঠটি থেমে গেল।
তার প্রত্যেকটি কথাই আহমদ মুসা বিশ্বাস করল। মনে খুব কষ্ট লাগল আহমদ মুসার, এমন দিনেই সে তার ইনফ্রারেড গগলস নিয়ে আসেনি।
হাঁটতে লাগল আহমদ মুসা। সেই কন্ঠটি অন্ধকারে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আজ গাড়িতে আমাদের একজন লোক বোকার মত এই ৫ নাম্বার বাড়ির কথা উচ্চারণ করেছিল, তুমি পালাবার পর আমরা বুঝেছি তুমি ৫ নাম্বার বাড়িতে আসবে। কিন্তু এত দ্রুত আসবে, আজই আসবে, সেটা আমরা কল্পনাতেও ভাবিনি। কিন্তু আহমদ মুসা তুমি চালাক হয়েও এই বোকামি কেন করলে। প্রকাশ্যে দিবালোকে তুমি বাড়ি দেখতে আসবে, বাড়ি দেখে যাবে, আর তোমাকে কেউ দেখবে না, এটা তুমি ভাবতে পারলে কেমন করে। এটাই ঈশ্বরের মার বুঝলে?’
‘তোমরা ঈশ্বর মান নাকি?’ আহমদ মুসা বলল। তার কন্ঠে বিদ্রুপ।
‘মায়ের কাছে মাসির কথা বল না আহমদ মুসা। তুমিও জান ইহুদীরা মানে বনি ইসরাইলা ঈশ্বরের চিরকালীন বাছাই করা সন্তান’। বলল কন্ঠটি।
‘বাছাই করা ঠিকই, তবে সেটা বেহেশতে যাওয়ার জন্যে নয় নিশ্চয়’। আহমদ মুসা বলল।
বাড়ির পেছনে তখন তারা পৌঁছে গেছে। আলোর মধ্যে সবাই দাড়িয়ে।
আহমদ মুসা দেখল, ঠিকই প্রায় চৌদ্দজন স্টেনগানধারী তাকে ঘিরে আছে।
‘আহাম্মকের কথার কোনো জবাব হয় না আহমদ মুসা’।
আহমদ মুসা দেখল কন্ঠটি ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মির স্ট্রাসবার্গের স্টেশন চীফ লাইবারম্যানের।
লাইবারম্যানের বাম হাতে রিভলবার। আর ডান হাতটা গলার সাথে ঝুলিয়ে রাখা। আহমদ মুসা বুঝল, লাইবারম্যান সকালের ঘটনায় শুধু আহতই হয়েছিল।
কথা শেষ করেই লাইবারম্যান ঘুরে দাঁড়াল বাড়ির দিকে। তারপর রিভলবারটা পকেটে রেখে পকেট থেকে বাঁ হাত দিয়ে ক্ষুদ্র মোবাইল সেটের মত একটা কিছু বের করল।
সামনেই ছিল একটা দরজা। বাড়ির পেছনের দরজা এটাই।
লাইবারম্যান তার বাম হাত উঁচু করল দরজাটির সমান্তরালে। সংগে সংগে দরজাটা খুলে গেল। আহমদ মুসা বুঝল লাইবারম্যানের হাতের ওটা রিমোট কনট্রোল।
দরজা খুলে যেতেই একজন লোক বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। তার হাতে একটি হ্যান্ডকাফ।
তাকে দেখেই লাইবারম্যান বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, তুমি আহমদ মুসাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাও। সকালের ভুল আমরা করব না’।
আহমদ মুসাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হলে তাকে নিয়ে সবাই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। সবার আগে লাইবারম্যান। তার পেছনে আহমদ মুসা। অন্য অস্ত্রধারীরা আহমদ মুসার পেছনে।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে আহমদ মুসাকে নিয়ে সবাই এল একটা সিড়ি ঘরে। এখান থেকে সিড়ি উঠে গেছে দু’তলা, তিনতলায়।
সিঁড়ি ঘরে ঢুকেই বৈদ্যুতিক বোর্ডের সুইচের সারি থেকে একটা সুইচে চাপ দিল লাইবারম্যান। সুইচটা অন করার সাথে সাথেই সিড়িঘরের মেঝের একাংশ সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল নিচে নামার সিড়ি।
সিড়ি দিয়ে নামল ওরা আহমদ মুসাকে নিয়ে।
নিচের আন্ডারগ্রাইন্ড ফ্লোরটার মাঝখানে সোফা সজ্জিত একটা লবী ছাড়া গোটাটাই ছোট বড় বিভিন্ন কক্ষে ভরা।
আহমদ মুসাকে নিয়ে ওরা একটি কক্ষে তুলল। কক্ষটি বেশ বড়। কক্ষের একপ্রান্তে সিংগল সাইজের লোহার খাট। খাটটি মেঝের সাথে ফিক্সড করা।
আহমদ মুসাকে কক্ষে ঢুকিয়েই লাইবারম্যান বলল, ‘আহমদ মুসা এটাই তোমার ঘর। তবে বেশিক্ষণ তোমাকে এখানে থাকতে হবে না। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আজর ওয়াইজম্যান আসছেন। তিনি ফিরে এলেই আমরা এখানে আসব। আমরা আসার আগ পর্যন্ত তুমি শুয়ে শুয়ে তোমার জীবনের একটা হিসেব নিকেষও করে নিও। কারণ আমরা আসার পর আর তুমি সুযোগ পাবে না’। থামল লাইবারম্যান।
‘পাব না যদি তুমি ঈশ্বর হও। কিন্তু তুমি ঈশ্বর নও মি.লাইবারম্যান’। বলল আহমদ মুসা।
‘ঈশ্বর হওয়ার প্রয়োজন নেই আহমদ মুসা। ঈশ্বর অনেক স্বাধীনতাই মানুষকে দিয়ে দিয়েছেন’। থামল লাইবারম্যান।
কিন্তু আহমদ মুসা কোন উত্তর দিল না। ভাবল, বেহুদা আলোচনায় কোন লাভ নেই।
লাইবারম্যানই আবার কথা বলে উঠল। বলল, ‘আহমদ মুসা আজ সকাল পর্যন্ত তুমি অসংখ্যবার সুযোগ পেয়েছ। কিন্তু সব কিছুরই একটা শেষ আছে আহমদ মুসা। সেই শেষ মাথায় তুমি পৌঁছে গেছ। আর তোমাকে নিয়ে আমরাও ধৈর্য্য সহ্যের শেষ মাথায় পৌঁছেছি। তোমার লাশ পড়ত ঐ অন্ধকার বাগানেই। কিন্তু আজর ওয়াইজম্যান নিজেই তোমার শেষ বিচারটা করতে চান বলেই তুমি কিছুটা সময় পেয়ে গেলে’।
বলেই ঘুরে দাঁড়াল লাইবারম্যান। কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েই আবার ফিরল সে। বলল সে একজনকে লক্ষ্য করে, ‘লেগ চেইনটা আননি?’
‘ইয়েস বস’। বলল লোকটি।
‘লাগাওনি কেন এতক্ষণ?’ ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল লাইবারম্যান।
‘বস আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি’। বলল লোকটি।
কথা শেষ করেই লোকটি তড়িঘড়ি করে আহমদ মুসার পায়ের কাছে বসে পড়ল। পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিল আহমদ মুসার এবং সেটা লক করে দিল।
লাইবারম্যান বলে উঠল, ‘তোমার ব্যাপারে আমরা আর কোন ঝুঁকি নিতে চাই না আহমদ মুসা। সকালে তোমার হাত-পায়ে শৃঙ্খল পরালে আমাদের তিনজন লোককে জীবন দিতে হতো না, আমিও আহত হতাম না’।
‘এখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চিন্তই লাইবারম্যান?’ আহমদ মুসা বলল।
‘বলতে পার। তুমি পালাতে পারছ না, তোমার হাত-পা নিষ্ক্রিয় করা গেছে এব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। সকালের ভুল আমরা শুধরে নিয়েছি’।
বলে ঘুরে দাঁড়াল লাইবারম্যান। বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
তার সাথে সাথে অন্য সকলেও।
লাইবারম্যান তার শেষ কথাটার কোন জবাব পেল না আহমদ মুসার কাছ থেকে। কিন্তু ঘুরে না দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকালে সে দেখতে পেত একটা হাসি। এ হাসি বিদ্রুপ করছে লাইবারম্যানকে।
আহমদ মুসার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
দরজা বন্ধ হতেই বসে পড়ল আহমদ মুসা মেঝেতে।
তার হাতের হ্যান্ডকাফের মতই পায়ের চেইনটা। ছয়সাত ইঞ্চির বেশি লম্বা নয়।
দুই হাঁটু দুই দিকে ছড়িয়ে বসতে পারল না আহমদ মুসা। ঐভাবে বসতে পারলে জুতার গোড়ালী হাতের বেশি কাছে পেত। দুই হাটু একদিকে নিয়ে দুই পা এক সাথে ছড়িয়ে বসল আহমদ মুসা।
পা দু’টি গুটিয়ে যথাসম্ভব কাছে নিয়ে এল সে। তারপর দু’হাত দিয়ে ডান জুতায় হুক দিয়ে আটকানো গোড়ালিটা খুলে ফেলল।
জুতার গোড়ালী হাতে নিয়ে আহমদ মুসা গোড়ালীর ভেতরের পাশের একটা বিশেষ স্থানে চাপ দিতেই গোড়ালীর গোটা সারফেসটাই ক্লিক করে উঠে গেল। বেরিয়ে পড়ল একটা কেবিন। কেবিন থেকে আহমদ মুসা বের করে আনল সিগারেটের চেয়ে সরু এবং আধা সিগারেটের মত লম্বা সুচবিহীন সিরিঞ্জের মত একটা ছোট বস্তু। এটাই ‘মাইক্রো লেসার টর্চ’। এর লেসার বীম দিয়ে যে কোন তালা, সরু সাইজের যে কোন আইরন বার এবং আধা ইঞ্চি পরিমাণ পুরু স্টিলশিট গলিয়ে ফেলা যায়, কেটে ফেলা যায়।
আহমদ মুসা জুতার গোড়ালিটা আবার লাগিয়ে দিয়ে হাত-পায়ের শৃঙ্খল কাটার দিকে মনোযোগ দিল।
লেসার বীম দিয়ে হ্যান্ডকাফের লক এবং পায়ের চেইনের লক গলিয়ে শেষ করে দিতেই হাত পায়ের চেইন খুলে গেল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা লেসার টর্চ পকেটে পুরে হ্যান্ডকাফ ও পায়ের চেইন কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়াল। এগুলো খাটের দিকে।
স্টিলের খাটের উপর রঙিন কাপড়ে মোড়া ফোমের তোষক। পায়ের দিকে একটা কম্বল মুড়িয়ে রাখা। কম্বল দেখে খুশি হলো আহমদ মুসা। কম্বল মুড়ি দিয়ে তার হাত-পাকে সে ওদের চোখের আড়ালে রাখতে পারবে।
আহমদ মুসা হাতের হ্যান্ডকাফ ও পায়ের চেইন তোষকের তলে রেখে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।
ঘুমাবার আগে আহমদ মুসার একটাই অস্বস্তি ছিল যে, তার কাছে কোন অস্ত্র নেই। সার্চ করে সব অস্ত্রই ওরা কেড়ে নিয়েছে। এমনকি ঘড়ি, কলমও। তার ভাগ্য ভাল যে জুতা জোড়া খুলে নেয়নি তারা।
দরজা খোলার শব্দে আহমদ মুসার তন্দ্রা ভাঙল। কিন্তু চোখ খুলল না সে। কিন্তু অনুভব করল ঘরে অনেক লোক প্রবেশ করেছে।
প্রথম কন্ঠ শুনতে পেল সে লাইবারম্যানের। বলছিল সে, ‘ঘুমাচ্ছে আহমদ মুসা’।
‘এই অবস্থায় মানুষের ঘুম আসে। আচ্ছা লোক এই আহমদ মুসা’। একটি ভারী কন্ঠ বলে উঠল। আহমদ মুসা বুঝতে পারল এ কন্ঠ আজর ওয়াইজম্যানের।
‘শেষ ঘুম তো স্যার’। বলল লাইবারম্যান।
বলে একটু থেমেই বলে উঠল সে আবার, ‘এই ঘুমটাই তার শেষ ঘুম হোক স্যার’।
‘না লাইবারম্যান, মৃত্যুটা তাহলে খুব শান্তির হবে তার। সে মরবে খুবই অসহায়ভাবে এবং অসহ্য যন্ত্রনা তাকে পেতে হবে’।
বলে একটা দম নিয়ে হাতের রিভলবারটাকে একবার চেক করে একজনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি গিয়ে ওকে লাথি মেরে জাগিয়ে দাও। দেখুক সে যম তার শিয়রে’।
আহমদ মুসা অনুভব করল একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটির পায়ের শব্দ যখন প্রায় মাথার পাশ পর্যন্ত এল, তখন আহমদ মুসা চোখ ও মুখকে ঘুম কাতর রেখেই দু’চোখের পাতা সামান্য খুলল। দেখতে পেল, স্টেনগানধারী একজন লোক দু’হাতে স্টেনগান ধরে ব্যারেল উচু করে রেখে তার ডান পা তুলছে আহমদ মুসার বুকে লাথি মারার জন্যে।
তার লাথিটা আহমদ মুসার বুক স্পর্শ করার আগেই চোখের পলকে আহমদ মুসার দু’হাত ছুটে গিয়ে লোকটির স্টেনগান কেড়ে নিল এবং শুয়ে থেকেই তার আগুন ঝরা স্টেনগানকে ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরিয়ে নিতে লাগল।
তার মধ্যেই সে দেখতে পেল একজনকে ঢাল সাজিয়ে তার আড়ালে দাঁড়িয়ে পিছু হটে কে একজন ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
ঘরে তখন কেউ দাড়িয়ে নেই। সবার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটানো। রক্তে ভাসছে তারা।
আহমদ মুসা ষ্টেনগান হাতে রেখেই উঠে দাঁড়াল। লাশগুলোর দিকে একবার নজর করল। লাইবারম্যানের লাশ সে দেখতে পেল, কিন্তু আজর ওয়াইজম্যানকে দেখতে পেলনা। বুঝল সে, আজর ওয়াইজম্যানই তাহলে তাদের একজনকে ঢাল সাজিয়ে নিজেকে রক্ষা করে পালিয়ে গেছে। কিন্তু তাকে পেলে তো সব পাওয়া হয়ে যায়।
চিন্তাটা মাথায় আসতেই আহমদ মুসা ছুটল তার পিছু নেবার জন্য।
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে সিঁড়িতে এল।
সিঁড়ি মুখটা বন্ধ।
আহমদ মুসা দেখল সিঁড়ি মুখের কোথাও কোন বোতাম বা কোন সুইচ নেই।
দ্রুত নেমে এলো আহমদ মুসা সিঁড়ি ঘরে। সিঁড়ি ঘরে সে পেয়ে গেল সুইচবোর্ড। দেখল, সব সুইচ অন, শুধু একটাই অফ। অফ সুইচটাকে অন করে দিয়ে আহমদ মুসা সিঁড়ির গোড়ায় ছুটে এল। দেখতে পেল, সিঁড়ির মুখ খুলে গেছে।
আহমদ মুসা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল। সিঁড়ি ঘরে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত চোখে পড়ল তার। ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো যে, আজর ওয়াইজম্যান আহত হয়েছে।
রক্তের দাগ অনুসরন করে ছুটল আহমদ মুসা।
বাইরের গেটে যখন এসে দাঁড়াল, দেখতে পেল ছুটন্ত একটা গাড়ির পেছনের লাল আলো।
‘ঐ গাড়িতেই পালাল আজর ওয়াইজম্যান, ভাবল আহমদ মুসা।
এ সময় পাশে একাধিক পায়ের শব্দ শুনে ষ্টেনগান তাক করে তাড়াক করে ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া, আমরা বলে চিৎকার করে উঠল সামনে থেকে।
আহমদ মুসা তার ষ্টেনগানের ব্যারেল সংগে সংগেই নিচু করল।
এক ঝাঁক গুলী গিয়ে মাটিতে বিদ্ধ হলো। আহমদ মুসা ততক্ষনে ষ্টেনগানের ট্রিগার থেকে তার তর্জ্জনি সরিয়ে নিয়েছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে এসে দাঁড়াল যায়েদ এবং ফাতিমা।
প্রচন্ড বিস্ময় ও বিরক্তি আহমদ মুসার চোখে মুখে। ধমকের স্বরে বলল, এ তোমরা কি পাগলামী করেছ, এখনি সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেতে পারতো।
‘আমাদের ভুল হয়েছে ভাইয়া। কথা না বলে এভাবে এগোনো ঠিক হয়নি।’ ভয় মিশ্রিত ভেজা গলায় বলল ফাতিমা।
‘তার চেয়ে বড় ভুল হয়েছে এভাবে তোমাদের আসা।’ বলল
আহমদ মুসা।
‘ফাতিমা প্রস্তাব করল। আমিও ঠিক মনে করলাম। তাই……..।’
কথা শেষ না করেই থেমে গেল যায়েদ।
যায়েদ থামতেই ফাতিমা বলে উঠল, ‘মাফ করবেন ভাইয়া, আমরা সব জানার পর ঘরে শুয়ে থাকতে পারিনি। বিশেষ করে যখন ভেবেছি আমরা বাসায় রাত যাপন করছি, আর আমাদের এক ভাই আমাদের জন্য মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, তখন ঘরে থাকা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়েছে।’ ফাতিমার আবেগ জড়িত কন্ঠে কান্নার সুর।
আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ তোমাদের দায়িত্ববোধের জন্য। আমি হয়তো ঠিক মনে করছি না। কিন্তু তোমরা যা করা উচিত, সেটাই করেছ।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার মন, আপনার বিচারবোধ এবং আপনার স্নেহ এত বড় বলেই আপনি এত বড় এবং আহমদ মুসা। আপনার প্রতি আমাদের অভিনন্দন। আজ আমরা দু’জন আমাদের কে সব চেয়ে ভাগ্যবান মনে করছি।’
‘ওয়েলকাম বোন তোমাদের। তোমাদের কান্ড দেখে আমার স্ত্রী জোসেফাইনের কথা মনে পড়ছে। ঘটনাগুলো বিয়ের আগের। আমি ওকে নির্দেশ দিয়ে আসতাম। কিন্তু আমার অনুপস্থিতির সময় সে তার বিচারবোধ দ্বারা পরিচালিত হতো। বেশ কিছু অভিযানে সে আমার নির্দেশ অমান্য করে আমার পিছু নিয়েছে এবং আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, ভাবীকে এজন্যে কি আপনি বকেছেন?’ বলল ফাতিমা মুখে হাসি টেনে।
‘বকেছি। কিন্তু তার যুক্তিতে তিনি অনড়। আমার অনুপস্থিতিতে তাঁর বিচারবোধ দ্বারা পরিচালিত হবার অধিকার তাঁর রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।’
ফাতিমার মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এ জন্যেই তিনি আমাদের ভাবী এবং আপনার উপযুক্ত সঙ্গিনী।’
ফাতিমা থামতেই যায়েদ তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘ভাইয়া আপনি শুধু আমাদের ভাইয়া নন, আমাদের মানে ফরাসীদের জামাই আপনি। এটা আমাদের একটা বড় গর্ব, যেটা ফাতিমাদের নেই।’ কি রকম? বুঝলাম না। ভাইয়া ফরাসীদের জামাই কি করে? বলল ফাতিমা। তার কন্ঠে বিস্ময়।
‘ও, তুমি জানই না। ভাবী তো মারিয়া জোসেফাইন লুই, ফ্রান্সের সর্বশেষ রাজবংশ বরবুনদের রাজকুমারী। ‘লুই দ্যা গ্রেট’ নামে পরিচিত ফ্রান্সের শক্তিমান সম্রাট চতুর্দশ লুই-এর তিনি সরাসরি বংশধর।’ বলল যায়েদ চোখ–মুখ উজ্জল করে।
‘ও গ্রেট নিউজ আমাদের জন্যে। কিন্তু যায়েদ ফরাসী হিসাবে তোমার যে গর্ব, তার চেয়ে আমার গর্ব বড়, মুসলমান হিসাবে।
আমার একজন ভাই বিয়ে করেছেন তোমাদের রাজকুমারীকে।’
ফাতিমা বলল।
‘সেই হিসাবে তো আমার গর্ব ডবল। ফরাসী হওয়ার পাশা পাশি আমি মুসলমানও।’ চট করে বলল যায়েদ।
ফাতিমা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা তাকে বধা দিয়ে বলল, তোমরা ঝগড়াটা বাড়িতে গিয়ে করো। এখন কাজের কথায় এস।
তোমরা এসে ভালই হয়েছে, এত বড় বাড়ি সার্চ করতে হবে, তোমাদের সাহায্য দরকার। চলো ভেতরে। বলে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল।
যায়েদ ও ফাতিমা চলল তার পেছনে পেছনে।
সিঁড়ি রুমে ঢুকে আহমদ মুসা বলল, ‘চলো যাই আগে আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ওখানে ডজন খানেক মানুষ মরে পড়ে আছে। ওদের সার্চ করা থেকেই কাজ শুরু করি।’
আহমদ মুসা সুইচ অন করে সিঁড়ি মুখ উন্মুক্ত করে নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। যায়েদ ও ফাতিমা তার পেছনে পেছনে চলল।
তারা পৌছল সেই রক্ত প্লাবিত কক্ষ।
ঘরে রক্তের বন্যা ও লাশের স্তুপ দেখে আঁৎকে উঠল ফাতিমা।
বলল, এত রক্ত এত লাশ।
‘ফাতিমা, এই কক্ষ আমার লাশ পড়ে থাকার কথা ছিল, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় পড়ে আছে তাদের লাশ। আমি এখানে আসব, আগেই ওরা আঁচ করতে পেরেছিল। তার ফলে আমি এসেই ওদের ফাঁদে পড়ে যাই এবং বন্দী হই। হাত পায়ে বেড়ি লাগিয়ে এ ঘরেই ওরা আমাকে বন্দী করে রেখেছিল। আজ রাতেই আমাকে হত্যা করার কথা। সে উদ্দেশ্যেই-অল্প ক’মিনিট আগে ওরা আমার ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। মারতে এসে সবাই ওরা মরেছে শুধু পালাতে পেরেছে ওদের শীর্ষনেতা লোকটি।’ বলে থামল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেরই বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা থামলেও সংগে সংগে কথা বলল না ওরা।
একটু পর যায়েদ বলে উঠল, ‘একজন আহত, রক্তাক্ত লোককে আমরা গাড়ি করে পালাতে দেখলাম। সেই তাহলে নেতা?’
যায়েদ থামতেই ফাতিমা বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনাকে অভিনন্দন ভাইয়া।’ মাত্র দুই দিনে চারটি অভূতপূর্ব বিজয়। আগের অবস্থায় বিস্মিত হতাম, কিন্তু এখান সেই অবস্থা নেই। এসব বিজয় আহমদ মুসার জন্য কিছুই নয়। শুধু বলব, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।
আহমদ মুসা তখন মৃতদের সার্চ শুরু করে দিয়েছে। যায়েদ ও আহমদ মুসাকে সহযোগিতা করতে লাগল। কিন্তু তাদের কাছে কিছুই পাওয়া গেল না।
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ওদের পকেটে কোন তথ্য-প্রমাণ না পেলে ও একটা বড় জিনিস পাওয়া গেছে। সেদিন হোটেলে মৃত দু’জনের সার্টের কলারে যে ইনসিগনিয়া পাওয়া গিয়েছিল, এদেরও সার্টের কলারে সেই ইনসিগনিয়াই রয়েছে। তারা যে একই দলের লোক পুলিশ এটা সহজেই বুঝতে পারবে।এটা স্পুটনিক কেসের জন্য ভালই হবে।
‘কিন্তু এই ঘটনায় পুলিশ কি আপনাকে সন্দেহ করবে?’ বলল ফাতিমা।
‘পুলিশ বুঝবে কিনা জানি না, কিন্তু পুলিশকে বুঝানো হবে। আজর ওয়াইজম্যান বেঁচে গেছে। সেই পুলিশের বিশেষ কাউকে জানাতে পারে এবং আমার পিছনে পুলিশকে লেলিয়ে দেয়ার কাজ জোরদার করতে পারে। তবে আইনগতভাবে পুলিশের চিন্তা আজর ওয়াইজম্যানদের বিরুদ্ধেই যাবে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা দরজার দিকে হাঁটা শুরু করল। বলল, ‘এস উপরে সব ফেলার সার্চ করতে হবে, নিশ্চয় কিছু পাওয়া যাবে।’
ফাতিমা ও যায়েদ আহমদ মুসার পিছে পিছে চলল।
নিচের তলায় তারা কিছুই পেল না। দেখে তাদের মনে হলো, নিচের তলাটা এক সময় ষ্টোর ও চাকর বাকরদের বাসস্থান হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। অবশ্য কয়েকটিতে কিছুক্ষন আগেও লোক ছিলো বলে তাদের মনে হলো।
দু’তলাটা সুসজ্জিত। দু’তলার ঘরগুলো প্রায় সবগুলই চেয়ার- টেবিল-সোফায় সাজানো অফিস ও সিটিং কক্ষ। তবে কাগজপত্র নেই কোন টেবিলে। আফিসগুলো পরিত্যক্ত মনে হলো তাদের। টেবিলের ড্রয়ার, আলমারি হাতড়িয়ে কিছু কাগজপত্র ও কয়েকটা টেলিফোন ইনডেক্স যা পেল তা সবই ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের এবং পুরানা।
তিন তলার অধিকাংশ কক্ষই ফাঁকা। দক্ষিন দিকে পেল চারটা বেড রুম একই সারিতে। দেখে মনে হলো, এ বেড রুমগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। চারটি বেড রুমের পাশে একটা কম্পিউটার কক্ষ খুঁজে পেয়ে গেল। ঘরটি একদম তাজা। কিছুক্ষন আগেও ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হলো তাদের। কয়েকটি বাটনে ক্লিক করে আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো যে, কম্পিউটার আজও ব্যবহৃত হয়েছে।
ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা ফাতিমা ও যায়েদের দিকে। বলল, যায়েদ, ফাতিমা এবার তোমাদের বিদ্যার পরীক্ষা হবে। দু’টা কম্পিউটার টার্মিনালের সব ফাইল, সব কিছু তোমাদের খুঁটে খুঁটে সার্চ করতে হবে। আমি ততক্ষণে অন্য কক্ষগুলো দেখে আসি।’
বলে আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুতে যাচ্ছিল। যায়েদ পেছন থেকে বলে উঠল, কম্পিউটারের সিক্রেট ফাইলগুলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেশি। নিশ্চয় ওগুলোর কোড কোথাও রেখে যায় নি। কোন ফাইলে বা কোন প্রোগ্রামে কোড বা কোডগুলোকে ক্যামোফ্লেজ করে রেখে গেলেও তা এত তাড়াতাড়ি বের করা অসম্ভব হতে পারে। ওদের কোড কি হতে পারে, এ ব্যাপারে আপনি কিছু অনুমান করেন কি না।
থমকে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসা। তার চেখে মুখে নেমে এল ভাবনার ছাপ। মুখ নিচু হলো তার। চোখ দু’টিও বন্ধ হয়ে গেল মুহুর্তের জন্য। বুঝা গেল গোটা ভাবনাকে সে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছে।
একটু পর চোখ খুলল আহমদ মুসা। মুখ তুলল সে।
যায়েদর মুখে দুই চোখ নিবদ্ধ করে বলল আহমদ মুসা, ‘অত্যন্ত কঠিন, মানে অসম্ভব একটা প্রশ্ন করেছে যায়েদ। তবে আমি যদি ওদের কেউ হতাম, তাহলে যে কোডগুলো আমি ব্যবহার করতাম, সেটা তোমাকে বলতে পারি।’
বলে আহমদ মুসা মুহূর্তকাল চিন্তা করে বলল, ‘তোমাকে অনেকগুলো অপশন নিয়ে ট্রাই করতে হবে। তার প্রথমটি হলো, ‘Harzel’ অথবা ‘H’, দ্বিতীয় ‘Azr Wiseman’ অথবা AW, তৃতীয় ‘World Freedom Army’ অথবা ‘WFA, চতুর্থ ‘HAWWFA’, পঞ্চম ‘HAWFA’ এবং ষষ্ঠ ‘New Gulag’ অথবা ‘NG’, হলো সর্বশেষ।’
আহমদ মুসা থামতেই বিস্মিত কন্ঠে ফাতিমা বলল, ‘World Freedom Army’(WFA) থেকে যে কোড নিয়েছেন তার যুক্তি
বুঝলাম।ওটা ওদের সংগঠনের নাম। সংগঠনের নামে কোড হতে পারে। কিন্তু অন্য কোডগুলোর যুক্তি বুঝছি না। ওগুলো কি আপনার নিছক কল্পনা?
‘কোনটাই কল্পনা নয় ফাতিমা। ইহুদীরা ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রিয়। Hazrel (H) ইহুদীবাদের জনক। Azr Wiseman (AW) এর Wiseman একজন বৃটিশ ইহুদী বিজ্ঞানী, তিনি বলা যায় ইসরাইল রাষ্ট্রের জনক। আর ‘Azr’ হলো ‘World Freedom Army’ (WFA) আন্দোলনের জনক। ‘HAWWFA’ and ‘HAWFA’ উপরোক্ত তিনটি নামের শব্দগুলোর আদ্যাক্ষরের সমাহার। সব শেষ সাবেক সোভিয়েতের ‘New Gulag’ সংস্কৃতির প্রতি ইহুদীদের আকর্ষণ খুব বেশি। সর্ব কনিষ্ঠ হিসাবে সাবেক সোভিয়েতের ‘নির্মূলকরণ’ সংস্কৃতি তারা অনুসরণ করছে। সুতরাং তাদের জন্য ‘New Gulag’ সুন্দর কোড ওয়ার্ড হতে পারে। বলল, আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। কিন্তু একটা কথা। ইহুদীরা ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রিয় হলে তো’ Temple’ ‘Solomon’ ‘Sabat’ ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী শব্দও তো তাদের কোড ওয়ার্ড হতে পারে। কিন্তু এগুলোকে তো আপনি বাদ দিয়েছেন।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘ইসরাইল, ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ ‘ইরগুনজাইলিউমি’ ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডোম আর্মি’ প্রভৃতি ধর্মবাদী নয়, ইহুদীবাদী, আধিপত্যবাদী ঐতিহ্যের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি। এ কারণে ওদের ধর্মবাদী ঐতিহ্যের চেয়ে ইহুদীবাদী ঐতিহ্যের প্রতিই নজর দিতে হবে।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
হাসি মুখে এক সাথে বলে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ। পরে যায়েদ আবার বলল, ‘আল্লাহ আপনার চিন্তাকে কবুল করুন এবং আমাদের কামিয়াব করুন।’
বলে যায়েদ কম্পিউটারের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ফাতিমাও।
আহমদ মুসাও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে হাটা শুরু করেছে।
আধা ঘন্টা পরে আহমদ মুসা ফিরে এলো হতাশ হয়ে। তিনতলার অবশিষ্ট ঘরগুলো সার্চ করে কিছুই পাওয়া যায়নি।
আহমদ মুসা কম্পিউটার রুমে ঢুকতেই ফাতিমা চাপা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ইউরেকা, ইউরেকা। আমরা যা খুঁজছিলাম তা বোধ হয় পেয়ে গেছি ভাইয়া। সব আমরা বুঝছি না, আপনি বুঝবেন। আসুন।
আহমদ মুসা গিয়ে যায়েদের পাশে বসল।
কথা শেষ করেই ফাতিমা আবার বলে উঠল, আপনাকে আরও অভিনন্দন ভাইয়া। আপনার অনুমান সত্য। আপনার দেয়া কোড দিয়ে দুই কম্পিউটারের সিক্রেট ফাইলগুলো খোলা গেছে।’
‘কোন দু’টি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘New Gulag এবং Harzel’ উত্তর দিলো ফাতিমা।
আহমদ মুসা আর কোন কথা না বলে মনোযোগ দিল কম্পিউটারের স্ক্রীণের দিকে।
‘ভাইয়া মনে হয় আমরা সাংঘাতিক জিনিস পেয়ে গেছি।’ বলল যায়েদ। তারপর যায়েদ ‘কিবোর্ডে’ একটা বোতাম চাপ দিয়ে স্ক্রীনের একটা জিনিসের দিকে ইংগিত করে বলল, ওটা কি চিনতে পারছেন ভাইয়া।
হ্যাঁ , ওটা ‘স্পুটনিক।’ রাশিয়ার প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ স্পুটনিকের নিচের হেডিংটা পড়ুন। বলল, যায়েদ।
‘এর বিপজ্জনক পরিকল্পরা’-পড়ল শিরোনামটি আহমদ মুসা।
স্ক্রীনের শিরনাম দেয়া পাতাটি যায়েদ ধীরে ধীরে উপরে তুলল। বলল, ‘ভাইয়া, এবার স্পুটনিকের বিপজ্জনক পরিকল্পনাটা, পড়ুন।
পড়তে লাগল আহমদ মুসা। পাতাটি ধীরে ধীরে উপরে উঠছে আর পড়ছে তা আহমদ মুসা।
পড়ার এক পর্যায় এসে আহমদ মুসা আনন্দে যায়েদের পিঠ চাপড়ে চিৎকার করে উঠল, ‘যায়েদ, এ তো আমাদের স্পুটনিকের পরিকল্পনা!
নিউইয়র্কের ‘লিবার্টি’ ও ডেমোক্রাসি’ টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য উন্মোচনে স্পুটনিক তদন্তের যে পরিকল্পনা করেছিল এবং এর যে উদ্দেশ ছিল, এ সবইতো এখানে বলা হয়েছে ! আলহামদুলিল্লাহ। থামল আহমদ মুসা।
কম্পিউটার স্ক্রীনে পাতাটি থেমে গিয়েছিল। আবার তা উপরে উঠতে লাগল। সামনে এসে দাঁড়াল পাতার দ্বিতীয় শিরনাম। যায়েদ বলল, ‘ভাইয়া পড়েন শিরোনামটা।’
‘ষ্টার ওয়ারঃ স্পুটনিককে গুলি করে নামানো’ পড়ল শিরোনামটি আহমদ মুসা। বলল, ‘তার মানে এবার স্পুটনিক ধ্বংসের পরিকল্পনা। আগাও যায়েদ।’
কম্পিউটার স্ক্রীনে পাতা উপরে উঠতে লাগল। উম্মুক্ত হতে লাগল পাতার লেখাগুলো। বলল যায়েদ, ‘ধীরে ধীরে পড়তে থাকুন ভাইয়া’ পড়তে লাগল আহমদ মুসা। তার পড়া যতই এগুলো, তার চোখে-মুখে আনন্দ-বিস্ময়ের খেলা ততই বাড়তে লাগল।
এক সময় পাতাটা কম্পিাউটার স্ক্রীনে স্থির হয়ে গেল। তার মানে দ্বিতীয় শিরোনামের বক্তব্য শেষ।
যায়েদ বলল, ‘কি বুঝলেন ভাইয়া?’
আহমদ মুসা ভাবছিল। তার ভাবনায় ছেদ নামল যায়েদের কথায়।
তাকাল সে যায়েদের দিকে। বলল, একটু ক্যামোফ্লেজ করেছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না। ওদের ‘ষ্টার ওয়ার’ টা হলো নিউইয়র্কের টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য অনুসন্ধানে স্পুটনিকের পরিকল্পনা। ‘ষ্টার ওয়ার’ বর্জন মানে স্পুটনিকের তদন্ত বর্জন করার জন্য তারা স্পুটনিকের পিসফুল ডেথ ঘোষনা করেছে। ষড়যন্ত্রের এই প্রকল্পে আরও দেখা যাচ্ছে ওদের কাছে স্পুটনিকের চেয়ে বড় হলো স্পুটনিকের সাত নির্মাতা। কারণ ‘স্পুটনিক ওয়ান’ হারালে ‘স্পুটনিক টু’ তৈরী করতে পারে। তাই স্পুটনিকের জন্য যে দন্ড সেই দন্ড সাত নির্মাতার জন্যও। তবে তার আগে সাত নির্মাতার এক্সরে প্রয়োজন ‘ষ্টারওয়ার’ অর্থাৎ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য সন্ধানে তারা কতটুকু এগিয়েছে, কাদেরকে আরও তারা জানিয়েছে তা বের করার জন্য।’ থামল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমরা এটাই বুঝেছি। তবে স্পুটনিকের ‘পিসফুল ডেথ’ ব্যাপারটা বুঝিনি।’ বলে উঠল যায়েদ ও ফাতিমা প্রায় এক সংগেই।
‘পিসফুল ডেথ’ মানে উত্তাপ-উত্তেজনাহীন নিরব মৃত্যু। স্পুটনিককে এভাবেই ধ্বংস করা হয়েছে। স্পুটনিকের সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু বিল্ডিং-এর গায়ে কোন আঁচড় লাগেনি, আসবাবপত্রও সব ঠিক আছে। শুধু নেই ফাইল কাগজ-পত্র, ফিল্ম এবং কম্পিউটারের সফটওয়ার ও ডিস্কগুলো। এগুলো নেই, কিন্তু কি হয়েছে এগুলোর সামান্য নির্দশনও কোথাও নেই। মনে হতে পারে, স্পুটনিকের সাত গোয়েন্দা অফিস ছেড়ে দিয়ে ফাইল-পত্র নিয়ে কোথাও উধাও হয়েছে। এটাকে বলা হয়েছে স্পুটনিকের পিসফুল ডেথ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অদ্ভুত এ কৌশল ভাইয়া। ফারাসী গেয়েন্দারা যদি স্পুটনিকের অফিসের কেমিকেল টেষ্ট না করত, তাহলে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে তার কিছুই জানা যেত না, বলল ফাতিমা।
ফাতিমা থামতেই যায়েদ বলে উঠল, আরও মজার জিনিস ভাইয়া, আমরা যার কিছুই বুঝতে পারিনে।’
কথা বলতে বলতেই যায়েদ কস্পিউটারের কীবোর্ডে তার আঙুল চালনা শুরু করেছে। আহমদ মুসা তাকিয়ে আছে কম্পিউটারের স্ক্রীনের দিকে। বলল, মজার জিনিসটা কি যায়েদ?
‘একটা মানচিত্র ভাইয়া।’ বলেই যায়েদ কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে আঙুলি সংকেত করল, দেখুন ভাইয়া তৃতীয় একটা শিরোনাম।’
আহমদ মুসা আবার চোখ ফিরাল কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে। তাকাতেই চোখে পড়ল ‘নিউগুলাগ’ শিরোনামটা। ভ্রুকুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার।
শিরোনামটা উপরে উঠে এল।
তার সাথে সাথে স্ক্রীনে ভেসে উঠল একটা মানচিত্র।
মানচিত্রটা যে একটা দ্বীপের, তা পরিস্কার বুঝা যায় তার চারদিকের রং দেখে। মানচিত্রেও বিভিন্ন বর্নের ল্যান্ড স্কেপ। মানচিত্রের নীচে লেখা ‘নিউ গুলাগ সাও তোরাহ।’
কম্পিউটার স্ক্রীনের উপর ঝুঁকে পড়েছে আহমদ মুসা।
যায়েদ, ফাতিমাও নিরব।
কিছুক্ষন পর মাথা সোজা করে বসল আহমদ মুসা। চোখ বন্ধ তার।
ভাবছে আহমদ মুসা।
মূহূর্ত কয়েকপর চোখ খুলল আহমদ মুসা। বলল, ‘এটা মজার জিনিস নয় যায়েদ। এটা ভয়ংকর একটা স্থানের মানচিত্র। মানচিত্রের নিচে ফুট নেট আকারে তারকা চিহ্নিত দু’টো প্যারাগ্রাফ পড়েছ যায়েদ?’
‘জ্বি, ভাইয়া।’ যায়েদ বলল।
‘দেখ এক নাম্বার প্যারাগ্রাফে বলা হয়েছে, ধর্মহীন ও ধর্মনিরপেক্ষ ছিল বলে, ‘ওল্ড গুলাগ’ ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ‘নিউ গুলাগে’র ভিত্তি হবে ঈশ্বরের মনোনীত ধর্ম এবং নিউ গুলাগ পরিচালনা করবে ঈশ্বরের সহস্র সহস্র বছরের পরীক্ষিত ও মনোনীত লোকেরা। দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে আছে, নিউ গুলাগ ঈশ্বরের বিশ্ব গড়ার একটা কারখানা এবং ল্যাবরেটরী। পৃথিবীর পথভ্রষ্ট মিলিট্যান্ট-মৌলবাদীদের এখানে এনে এক্সরে করা হবে এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে চিকিৎসা চলবে, গোটা পৃথিবীতে যাতে দ্রুত ইসরাইলের ঈশ্বরের রাজত্ব কায়েম হয়।’
থামল আহমদ মুসা। একটু থেমেই আবার বলল, কি বুঝলে যায়েদ, ফাতিমা।
‘বুঝলাম, ধর্মহীন কম্যুনিষ্টদের গুলাগ ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু ইহুদীদের ধর্মের নিউ গুলাগ সফল হবে। কিন্তু ঝুঝতে পারছিনা এক্সে-রে এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসার ব্যাপারটা।’ বলল, ফাতিমা।
‘ব্যাপারটা আমার কাছেও খুব স্পষ্ট নয়। তবে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে বিষয়টা এই রকম হতে পারে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিউ গুলাগে ধরে নিয়ে যাবে। সেখানে তাদের সব কথা বের করে নেয়া হবে বা জেনে নেয়া হবে যেমন এক্সরে’র মাধ্যমে করা হয়। এর ফলাফলের ভিত্তিতেই অতঃপর গোটা দুনিয়ায় তারা অপারেশন পরিচালনা করবে।’
আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমারও তাই মনে হয়।’ বলল যায়েদ।
‘সবটাই ভয়ংকর ব্যাপার ভাইয়া। ঐ এক্সরের পর নিশ্চয়ই ওখানে
কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না। আর বিশ্বব্যাপী ওদের অপারেশনটা ওল্ড গুলাগের ষ্ট্যালিনের মত।’ বলল ফাতিমা। তার চোখে-মুখে আতংক।
‘ঠিক বলেছ ফাতিমা। তবে ইহুদীবদীরা এটা করবে ধর্ম, মানবতা, মানবাধিকার ও সন্ত্রাস দমনের পোশাক পরে।’ বলে একটা দম নিয়েই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের স্পুটনিকের সাত গোয়েন্দাকে নিউ গুলাগ সাও তোরাহ দ্বীপেই রাখা হয়েছে।’
চমকে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই। তাদের দু’জনের চোখে-মুখেই নেমে এল অন্ধকার। দু’জনে এক সাথে বলে উঠল, ‘কোথায় এই দ্বীপ?’ কান্নার মত ভারী শোনাল তাদের কন্ঠস্বর।
আহমদ মুসা গা এলিয়ে দিল চেয়ারে। বলল, এটাই এখন প্রধান প্রশ্ন।’
সংগে সংগেই আবার সোজা হয়ে বসল আহমদ মুসা। বলল, ‘যায়েদ সবগুলোর প্রিন্ট নাও। আর চল যাবার আগে পুলিশকে টেলিফোনে সব কিছু বলে যাই।’
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘যায়েদ তুমি প্রিন্টগুলো তাড়াতাড়ি সেরে ফেল। আমি এখনি আসছি।’
আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল পাঁচ মিনিট পরে দ্রুত। বলল, ‘যায়েদ প্রিন্ট শেষ?’
‘জি ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘তাহলে তোমরা দু’জন দ্রুত আমার পেছনে এস।’ বলেই আহমদ মুসা ঘর থেকে বেরুবার জন্য হাঁটা শুরু করল।
ফাতিমা উঠে দাঁড়িয়েছিল সংগে সংগেই। যায়েদও কাজ গুছিয়ে নিয়ে আহমদ মুসার পেছনে হাঁটতে লাগল।
তারা দ্রুত নেমে এল নিচের তলায়।
এসে বাড়ির ভেতরে প্রবেশের গেট থেকে যে করিডোরটা ভেতরে এগিয়ে এসেছে তার মুখে দেয়ালের আড়ালে ওঁৎ পেতে দাঁড়াল তারা। আহমদ মুসা তার হাতে রিভলবার তুলে নিয়েছে।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেরই চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল, যায়েদ ‘কি ব্যাপার ভাইয়া?’ ফিস ফিস কন্ঠ যায়েদের।
‘একটা প্রাইভেট কারকে আমি বাইরের গেটে দাঁড়াতে দেখেছি। দেখেছি দু’জন লোক নামতে। এরা নিশ্চয় WFA-এর লোক। ওদের রিল্যাক্স মুড দেখে মনে হয়েছে ওরা এখানকার ভেতরের খবর জানে না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আমরা এগুচ্ছিনা কেন?’ ফাতিমা বলল।
‘সামনে এগিয়ে ওদের মুখোমুখি হয়ে আমি আর লড়াই বাধাতে চাই না। আমি ওদের ধরতে চাই। এ পর্যন্ত ওদের কাউকে আমরা জীবন্ত হাতে পাইনি। ওদের কাউকে জীবন্ত হাতে পেলে ‘নিউ গুলাগ সাও তোরাহ’ দ্বীপ কোথায় জানার চেষ্টা করা যেত।
ফাতিমা ও যায়েদের মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। ফাতিমা বলে উঠল, ‘আপনার এ চিন্তা ঠিক ভাইয়া।’
‘কিন্তু ওরা তো এতক্ষনে ভেতরে প্রবেশ করার কথা। আসছেনা কেন? ঠিক আছে, তোমরা এখানে দাঁড়াও। আমিএকটু ওদিকে…..।’
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলনা। পেছন থেকে একটা কর্কশ কন্ঠ ধ্বনিত হলো, ‘ও দিকে নয়, এ দিকে তোমার যম আহম …….। তারও কথা শেষ হতে পারল না।
পেছনের দিকে কর্কশ কন্ঠ ধ্বনিত হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সাথে নিজেকে ছুড়ে দিল মেঝেতে এবং সেই সাথেই তার হাতের রিভলবার গর্জন করে উঠল পরপর কয়েকবার।
ওদিকে পেছন থেকে যে কন্ঠ গর্জন করে উঠছিল তারা ছিল দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দু’জনের হাতে উদ্যত রিভলবার। তাদের কন্ঠ থেমে যাবার সাথে সাথে তাদের রিভলবার ও গর্জন করে উঠেছিল।
আহমদ মুসা আগেই মেঝেয় ছিটকে পড়ার ফলে গুলি দু’টি তার উপর দিয়ে চলে যায়। তারা দ্বিতীয় গুলি করার আগেই আহমদ মুসার গুলি তাদের বিদ্ধ করল। বুকে গুলি খেল তারা দু’জনেই। তাদের রক্তাক্ত দেহ লুটোপুটি খাচ্ছিল মেঝেতে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
ভয় ও আকস্মিকতায় কাঠ হয়ে ফাতিমা ও যায়েদ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়েছিল। বাকরোধ হয়ে গেছে যেন তাদের। মৃত্যুকে যেন তারা একদম চোখের উপর নাচতে দেখল। জীবন ও মৃত্যু এত কাছাকাছি!
আহমদ মুসা যদি ঠিক সময়ে মেঝতে নিজেকে ছুঁড়ে দিতে না পারতো, তাহলে ওদের প্রথম গুলিই তার বক্ষ ভেদ করত। তারপর আহমদ মুসা যদি তার গুলিগুলো করতে কয়েক মুহুর্তও বিলম্ব করতো, তাহলে ওদের দ্বিতীয় গুলীর শিকার হতো আহমদ মুসা। তারপর ওদের তৃতীয় গুলি নিশ্চয় ছুটে আসতো যায়েদ ও ফাতিমার লক্ষ্যে। তাদের পকেটে একটি করে রিভলবার আছে, কিন্তু বের করার কথা মনে হয় নি, কখন বের করবে তাও বুঝতে পারেনি। আহমদ মুসা এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন!এত ক্ষিপ্র তিনি !যা ঘটে গেল তা অবিশ্বাস্য এক ঘটনা বলে মনে হচ্ছে তাদের কাছে। তাদের স্থির চোখের শূন্য দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এস যায়েদ এদের একটু চেক করি।’
বলে আহমদ মুসা ওদের দিকে এগুলো।
আহমদ মুসার কথা শুনল যায়েদ। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা তার মধ্যে। যেমন নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।
আহমদ মুসা প্রথমেই ওদের জামার কলার ব্যান্ড পরীক্ষা করল। তারপর তাদের পকেটগুলো সার্চ করল। দু’জনের পকেটে দু’টি মানিব্যাগ ছাড়া আর কিছুই পেলনা। মানিব্যাগে কোন কাগজপত্র পেলনা। এমনকি কোন নেমকার্ডও নয়। শুধু কিছু ইউরো মুদ্রা রয়েছে মানিব্যাগে। মানিব্যাগ দু’টি আবার ওদের পকেটে রেখে দিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল এবং বলল, ‘যায়েদ ফাতিমা এ দু’জনের কলার ব্যান্ডে ঐ একই ইনসিগনিয়া রয়েছে।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার বলল, চলো আমরা যাই।
আশে-পাশের কোন টেলিফোন বুথ থেকে পুলিশকে এখনি খবরটা জানাতে হবে। যাতে WFA -এর কেউ এখানে আসার আগেই পুলিশ আসতে পারে, সেটাও আমাদের দেখতে হবে।
আহমদ মুসা ‘এসো’ বলে হাঁটতে শুরু করল।
নিশ্চল মূর্তির আবস্থা থেকে ওরা নড়ে উঠল এবং আহমদ মুসার সাথে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে ফাতিমা বলল, ‘এ ধরনের সংঘাতে জীবন-মৃত্যু যে কত কাছাকাছি, তা আজ প্রথম দেখলাম।
আপনার খারাপ লাগেনা ভাইয়া? একটুও চিন্তা হয়না আপনার? আমার বুক এখনোও কাঁপছে। যদি মেঝেয় ছিটকে পড়েগুলী করতে একমুহুর্তও দেরী করতেন তাহলেই তো আপনি আর থাকতেন না। আমি ভাবতেই পারছিনা এ সব কথা।’ কন্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠছিল ফাতিমার।
‘জীবন-মৃত্যু কোন বুলেটের বা কোন অস্ত্রের হাতে নয়। এর ফায়সালা আসে আল্লাহর কাছ থেকে এবং তা আসে যখন তা আসার কথা। সুতরাং এ নিয়ে ভাবনার কিছু নেই।’ তারা গেটে পৌছে গিয়েছিল।
‘ভাইয়া সামনেই রাস্তার পূর্ব পাশে টেলিফোন আছে। আমি আসার আগে দেখেছি।’ বলল, যায়েদ গেটে পৌছেই।
‘যায়েদ চল, টেলিফোনটা করবে তুমি। টেলিফোন করে আমরা পাশেই কোথাও অপেক্ষা করব। এ বাড়িটা পাহাড়া দিতে হবে, যাতে পুলিশ আসার আগে ওরা কেউ আসতে না পারে।’
আহমদ মুসা ‘এস’ বলে আবার হাঁটা শুরু করল।
‘টেলিফোনে কি বলব ভাইয়া?’ বলল যায়েদ।
‘বলবে, ‘অমুক নাম্বার বাড়িতে গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি। বড় কিছু ঘটছে সেখানে। ব্যস আর কিছু নয়।’ আহমদ মুসা বলল।
টেলিফোন করে আহমদ মুসারা পাশেই অপেক্ষা করল। দশ মিনিটও পার হলো না। পুলিশের দু’টি গাড়ি ছুটে এল তীব্রবেগে এবং তাদের অতিক্রম করে চলে গেল বাড়িটার দিকে।
এবার যায়েদ গাড়ি ষ্টার্ট দিল যাবার জন্যে। গভীর রাতের নিরবতা ভেঙে ছুটে চলছে গাড়ি। যায়েদের পাশে আহমদ মুসা।
পেছনের সিটে ফাতিমা।
চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে আহমদ মুসা।
তিন জনেই নিরব।
নিরবতা ভাঙল যায়েদ। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের স্বরণীয় রাত চির স্বরণীয়ভাবে কাটল ভাইয়া। আমরা খুব খুশি।’
‘তোমাদের অভিনন্দন। কিন্তু মনে রেখ, তোমাদের দু’জনের নতুন জীবন যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এবং সে যুদ্ধটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়েকে প্রতিষ্ঠার জন্য। সুতরাং এটা আমাদের সৌভাগ্য।’ যায়েদ বলল।
‘ধন্যবাদ যায়েদ, তোমাদের মত করে সব মুসলমান যে দিন ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধের সংগ্রাম কে তাদের জন্য সৌভাগ্যের মনে করবে, সেদিন গোটা দুনিয়ার মুসলমানদের জীবন থেকে, অন্ধকারের অমানিশা কেটে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সেদিন কত দূরে ভাইয়া? ফাতিমা বলল।
‘সেটা নির্ভর করছে তোমরা তরুন-তরুনীরা কত দ্রুত সামনে আগাতে পারছো তার ওপর।’ বলল আহমদ মুসা।
ফাতিমা কোন কথার উত্তর দিল না। তার নিরব দৃষ্টি প্রসারিত হলো সামনে।
যায়েদের দৃষ্টিও সামনে প্রসারিত।
আবার আহমদ মুসা তার চোখ বন্ধ করেছে। ভাবছে সে।
এক সময় যায়েদ মুখ তুলল আহমদ মুসার দিকে। বলল, কি ভাবছেন ভাইয়া?
চোখ খুলল আহমদ মুসা। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘ভাবছি ওদের নিউ গুলাগ ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপের কথা। কেথায় এই ভয়ংকর দ্বীপটা? কিন্তু এই মুহুর্তে তার চেয়েও বেশি ভাবছি আজকের রাতের ঘটনাকে পুলিশ কতটা, কিভাবে ব্যাবহার করবে? তারা প্রেসকে এ চাঞ্চল্যকর বিষয়টা জানতে দিবে কিনা?
বলেই আহমদ মুসা হঠৎ সোজা হয়ে বসল। তার চেখে- মুখে চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। বলল দ্রুত কন্ঠে, যায়েদ ফাতিমা কোন সাংবাদিকের ঠিকানা তোমাদের কাছে আছে?
ফাতিমা, যায়েদ দু’জনেই সোজা হয়ে বসল। যায়েদ বলল, আমার কাছে কোন সাংবাদিকের টেলিফোন নাম্বার নেই। তবে আবদুল্লাহ ভাইয়ের বাসায় সাংবাদিক বুমেদিন বিল্লাহর টেলিফোন নাম্বার থাকতে পারে। কাল ঐ সাংবাদিক ভাইয়ার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ছিলেন।’
‘বুমেদিন বিল্লাহ’ মানে লা-মন্ডের সাংবাদিক যিনি প্রথম নিউজটা করেছিলেন।’
‘হ্যাঁ ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, তাকেই আজ বেশি দরকার। কিন্তু তিনি কি স্ট্রাসবার্গে আছেন?
‘শুনেছিলাম আছেন। তিনি নাকি এই কেসটার ব্যাপারে আগ্রহী।’ যায়েদ বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে যায়েদ মোবাইলে তুমি তোমার ভাইয়ার বাসায় টেলিফোন কর। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহর টেলিফোন নাম্বার নাও।’ দ্রুত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
গাড়ির ষ্টিয়ারিং এ এক হাত রেখে অন্য হাতে মোবাইলে টেলিফোন করল যায়েদ। প্রথমবার ও দ্বিতীয়বারের চেষ্টাতেও টেলিফোন কেউ ধরল না। তৃতীয় বারের চেষ্টায় টেলিফোন রিসিভ করল ওপার থেকে। খুশিতে মুখ উজ্জল হয়ে উঠল যায়েদের। বুমেদীন বিল্লাহর নাম্বার সে নিয়ে নিল।
টেলিফোন অফ করে দিয়ে বলল যায়েদ, ‘আলহামদুলিল্লাহ, নাম্বারটা পেয়েছি ভাইয়া।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। এবার, মিঃ বুমেদীন বিল্লাহকে দেখ। পেলে তাকে বল, ‘শার্লেম্যান রোডের ৫নং বাড়িটা স্পুটনিক ধ্বংসকারী ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরনকারীদের একটা ঘাঁটি। আজ রাতে ওখানে ওদের বার চৌদ্দজন লোক মারা গেছে। ওখানে ওদের ঐ অফিসে কয়েকটা কম্পিউটার রয়েছে। কম্পিউটারে স্পুটনিক ধ্বংস ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরনের ব্যাপারে চাঞ্চলকর তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
ব্যাস, এই টুকুই বললে হয়ে যাবে। এই মাত্র পুলিশ সেখানে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাইয়া’ বলে যায়েদ মোবাইল তুলে নিল। টেলিফোন করল। প্রথম বারেই ওপার থেকে সাড়া পেয়ে গেল যায়েদ। আহমদ মুসা যেভাবে বলেছিল সেই ভাবেই সব কথা যায়েদ সাংবাদিক বুমেদিন বিল্লাহকে জানাল। তারপর ওপারের কথা সে শুনল। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল যায়েদের। ধন্যবাদ বলে সে মোবাইলটা অফ করে দিল।
আহমদ মুসা ও ফাতিমা উদগ্রীব হয়ে শুনছিল যায়েদের কথা।
যায়েদ কথা শেষ করতেই ফাতিমা দ্রুত কন্ঠে বলল, কি রেজাল্ট? কি বলল সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ?
‘খুব খুশী হয়েছেন। এখনি যাচ্ছেন উনি ৫নং শার্লেম্যান রোডে। আমাকে অনেক করে ধন্যবাদ দিয়েছেন তিনি।’ বলল যায়েদ।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ যায়েদ তোমার এ সফল মিশনের জন্য। যদি বিষয়টা পত্রিকায় আনা যায় তাহলে তো একটা বিরাট ব্যাপার হবে। ফরাসি পুলিশও তখন চাপে পড়বে।’ থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই যায়েদ বলে উঠল, ‘মিশন আমার কোথায় ভাইয়া! আমি তো মাত্র আপনার প্রক্সি দিলাম।’
‘রাখ এসব কথা। বল, আরও কিছু বলেছেন উনি? বলল আহমদমুসা।
‘একটা প্রশ্ন উনি করেছেন। সেটা হলো, কে তাদের হত্যা করল। প্রশ্ন করে তিনিই আবার তার উত্তর দিয়েছেন। বললেন সেদিন হোটেলে যে ভাবে যে কারনে মরেছে, সে ধরনের ঘটনাই বোধহয় ঘটেছে। দেখলেই বোঝা যাবে। বাড়তি একথা টুকুই তিনি বলেছেন।’ যায়েদ বলল।
‘এ কথাটুকুই অনেক কথা যায়েদ। সাংবাদিক বুমেদীন বিল্লাহ দেখছি খুব বুদ্ধিমান। আমার বিশ্বাস ওখানকার সব কিছুই তার কাছে ধরা পড়ে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাই যেন হয় ভাইয়া।’ বলে উঠল ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনেই।
আহমদ মুসা আর কিছু বললনা। গাড়ির চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ফাতিমা ও যায়েদ নিরব। আশায় উজ্জ্বল তাদের চারটি চোখ সামনে নিবদ্ধ।
ছুটে চলছে গাড়ি।
৫
আহমদ মুসা বসে আছে ড্রইংরুমে পুবের জানালার পাশে এক সোফায়।
আহমদ মুসাদের এ ফ্ল্যাটটি আট তলায়। বাড়িটা দাঁড়ানো একেবারে ঈল নদী তীর ঘেঁষে।
আহমদ মুসার দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাইরে নিবদ্ধ। ঈল নদী পেরিয়ে সুন্দর রাইন উপত্যকার অনেকখানিই দেখা যায় এ জানালা দিয়ে। আহমদ মুসা চোখ বুলাচ্ছে রাইন উপত্যকার সবুজ বুকের উপর।
আহমদ মুসার চোখ দুটি রাইন উপত্যকার নরম সবুজের উপর নিবদ্ধ থাকলেও মন তার হারিয়ে গেছে ফেলে আসা এক অতীতের দিকে। তার দু’চোখে ভেসে উঠল রাইনের সবুজের অন্তরালে জমাট রক্তের এক সাগর। পৃথিবীর দুর্ভাগা যতগুলো ভুখন্ড আছে তার মধ্যে সুন্দর সবুজ এই রাইন উপত্যকাও একটি। ফ্রান্স-জার্মান আধিপত্যের লড়াই সবচেয়ে বেশি পীড়িত করেছে এই রাইন উপত্যকাকে। সপ্তম শতাব্দি শেষে এই উপত্যকা সম্রাট শার্লেম্যানের সম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। শার্লেম্যানের উত্তরসুরীদের কাছ থেকে জার্মানি এই উপত্যকা কেড়ে নেয়। ১৫ শতক পর্যন্ত এখানে চলে জার্মানির আধিপত্য। পরে ফ্রান্স কেড়ে নেয় এই উপত্যকা জার্মানির কাছ থেকে এবং শুরু করে এখানে ফরাসীকরণ। বিশেষ করে ফরাসী বিপ্লবের পর এখানকার জনগণ এতটাই ফরাসী হয়ে যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দির শেষভাগে যখন এই উপত্যকা জার্মানি দখল করে নেয় এবং পাল্টা জার্মানিকরণ শুরু করে তখন এখানকার ৫০হাজার মানুষ ফ্রান্সে হিজরত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স রাইন উপত্যকার উপর তার অধিকার ফিরে পায়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই জার্মানি এটা আবার দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই উপত্যকার উপর ফ্রান্সের আধিপত্য পুনঃ প্রতিষ্ঠত হয়। তার পর অর্ধ শতাব্দির বেশি কাল ধরে এখানে চলে ফ্রান্সের শাসন। আবার জার্মানরা এখানে ফিরে আসবে না এ গ্যারান্টি ইতিহাস দিতে পারেনা।
দুই আধিপত্যবাদী শক্তির মাঝে রাইন উপত্যকার মানুষ তৃতীয় শক্তি। কিন্তু তারা দূর্বল। দূর্বল বলেই তাদের স্বাতন্ত্র, স্বাধিকার ও স্ব-মতের কোন মূল্য নেই। এই দূর্বলতার কারণে সুন্দর এই রাইন উপত্যকার মানুষ শুধু নয়, তাদের মত শত শত জাতি-গোষ্ঠি আজ শক্তিমানদের দ্বারা পদদলিত হচ্ছে একইভাবে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, স্বাধীকার, মানবাধিকার সবই শক্তি নির্ভর। যাদের শক্তি আছে তাদের এসব নিশ্চিত থাকবে, আর যাদের তা নেই, এ অধিকার ভোগের অধিকার তাদের পদদলিত হচ্ছে। স্বাধীনতা, স্বাধীকার, মানবাধিকার, সন্ত্রাস এসব কিছুরই সংগা শক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছে। শক্তিমানরা এসবের যে সংগা দেয় সেটাই হয়ে উঠে অনুসরণীয়। বার্মা’র সুচি’র আন্দোলন গনতন্ত্র, কিন্তু আলজিরিয়ার আব্বাস মাদানীর আন্দোলন তা নয়। সূচী পেল নোবেল পুরস্কার, আর আব্বাস মাদানী পেল জেল-দন্ড। পূর্ব তীমুরের আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রাম, কিন্তু কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম অভিহিত হয়েছে সন্ত্রাস হিসেবে। এ সবের সংগায়নের ব্যাপারে জাতিসংঘের কিছু করনীয় নেই। জাতিসংঘ শক্তিমানরা গঠন করেছিল এবং তা শক্তিমানদের কথা শুনতেই বাধ্য। জাতিসংঘ আজ ভারবাহী গাধার মত। সে শুধু ভার বহনকারী, ভার নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণের কোন সুযোগ তার নেই। জাতিসংঘ ত্বরিত গিয়ে পূর্ব তীমুরের ভারটা গ্রহণ করেছিল, কিন্তু কাশ্মীর ও ফিলিস্তিন কিংবা চেচনিয়ার ভার সে গ্রহণ করতে পারেনি। এদিক থেক জাতিসংঘ কিছুটা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়তেও বাধ্য হয়েছে। যেমন ………..।
হঠাৎ আহমদ মুসার চিন্তায় ছেদ এসে পড়ল ফাতিমার কথায়। বলছিল ফাতিমা, ‘রাইন উপত্যকা নিয়ে এত গভীর ভাবে কি ভাবছেন ভাইয়া ?
এর আগেই ফাতিমা ও যায়েদ আহমদ মুসার সামনে এক সোফায় এসে পাশাপাশি বসে পড়েছিল।
দু’জনকেই সুনদর পোশাকে খুব ফ্রেশ লাগছিল। ফাতিমাকে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিপারের একজন গৃহবধু বলে মনে হচ্ছে। তার পরনে পা পর্যন্ত নেমে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ঘাগরা। গায়ে ফুলহাতা ঢিলা কামিজ। মাথার রুমালটা গলা পেঁচিয়ে কাঁধ ও বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে।
আহমদ মুসা ফাতিমার কথা শুনে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকাল। দু’জনের দিকে পলকের জন্য দৃষ্টি দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে উপরের দিকে শুন্য দৃষ্টি তুলে ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, ফাতিমা, আমি রাইন উপত্যকা নিয়েই ভাবছিলাম। তোমরা দু’আসামীই আমার সামনে হাজির। তোমরা জার্মান ও ফরাসীরা সুন্দর সবুজ অতি মনোহর এই রাইন উপত্যকাকে এবং তার মানুষদেরকে ফুটবল বানিয়েছ।
ফাতিমা ও যায়েদ দু’জনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ফাতিমা যায়েদের দিকে ইশারা করল উত্তর দেবার জন্য। কিন্তু যায়েদ ইশারা করল ফাতিমাকে উত্তর দেবার জন্য। ফাতিমা বলল, ভাইয়া আপনি জার্মান-ফরাসীদের দুষছেন কেন! ভূমি নিয়ে এমন লড়াই তো দুনিয়ার সব চেয়ে প্রাচীন ইতিহাস। কোন দেশ, কোন জাতি কি এই দোষ থেকে মুক্ত আছে?’
‘কিন্তু ছোট বিশেষ একটা ভুখন্ড নিয়ে এমন রক্তক্ষয়ী টাগ অব ওয়ার পৃথিবীর আর কোথাও নেই ফাতিমা।’ আহমদমুসা বলল।
‘কোন দুই দেশের সীমান্তে রাইন উপত্যকার মত এমন সুন্দর ও বিশেষ অবস্থানের ল্যান্ডও দুনিয়ার কোথাও নেই ভাইয়া। পাহাড়ের দেয়াল একে বিচ্ছিন্ন করেছে ফ্রান্স থেকে, আবার রাইনের মত
আন্তর্জাতিক নদী একে বিচ্ছিন্ন করেছে জার্মান থেকে। দুই দেশই এই ন্যাচারাল ব্যারিয়ারের অজুহাত তুলে এলাকাটা দখলে রাখতে চায়। নিশ্চয় এ বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনার বিষয় ভাইয়া।’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘তার মানে সংগত কারনেই আধিপত্ত্যের এ লড়াই চলতেই থাকবে?’
হাসল ফাতিমা। বলল, ‘আমরা তা চাইনা। চাইনা বলেই তো জার্মান এবং ফ্রান্স এক হয়ে গেছি।’
আহমদ মুসা ও যায়েদ দু’জনেই এক সংগে হেসে উঠল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল।
বাধা দিয়ে ফাতিমা বলে উঠল, ‘এ নিয়ে আর কথা নয়। বলুন, ওদের নতুন গুলাগ ‘সাও তোরাহ’ নিয়ে আর কি ভাবছেন।
আবার সোফায় হেলান দিয়ে বসল আহমদ মুসা। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। সংগে সংগেই কোন উত্তর দিল না। পরে ধীরে ধীরে বলল, ‘ভেবেছি, কিন্তু ভেবে কোন কুল পাইনি। আমরা শুধু দ্বীপটার নামটাই জানতে পেরেছি, আর কিছু নয়। এবং আমি নিশ্চিত এই নামটা আসল নয়।’
‘সর্বনাশ নামটাও যদি নকল হয় তাহলে? বলল ফাতিমা। কন্ঠ তার আর্তনাদের মত শোনাল।
‘দ্বীপটাকে কিভাবে চেনা যাবে, এটাই এখন প্রধান সমস্যা আমাদের কাছে। সে জন্যই আমি চেয়েছিলাম ওদের কাউকে জীবন্ত ধরতে। কিন্তু পারলাম না।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চেষ্টা তো সেদিন করেছিলেন। আচ্ছা আপনি যদি ও দু’জনকে গুলি না করতেন, তাহলে কি ঘটত? ওরা কি গুলি করত?
যায়েদ ‘কি ঘটত আমি জানিনা। তবে ওদের প্রথম গুলি করা থেকে বুঝা যায়, ওদের মারতে না পারলে ওদের হাতে আমাদের মরতে হতো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আরেকটা বিকল্প হয়তো ছিল। সেটা হলো অস্ত্র ফেলে দিয়ে ওদের কাছে আত্মসমর্পন করা। যা হতো আমাদের জন্য মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।’ যায়েদ বলল।
হ্যাঁ, এটাও বিকল্প হতে পারতো।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন। আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি ভাইয়া, আপনি বুঝলেন কি করে যে, আপনাকে শুয়ে পড়ে গুলী করতে হবে?’ বলল ফাতিমা।
‘ওরা আগেই আমাদের দিকে রিভলবার তাক করেছিল। আমরা রিভলবার ওদের দিকে তুলতে গেলেই ওদের গুলী খেতে হতো। মাটিতে নিজেকে ছিটকে দিয়েছিলাম ওদের চোখের আড়ালে রিভলবার তাক করার সুযোগ নেয়া এবং যদি ওরা গুলী করে বসে তাও এড়াতে পারার জন্য।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার দু’লক্ষ্যই অর্জিত হয়েছিল।’ বলল যায়েদ।
‘আল্লাহ সাহায্য করেছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলে একটু দম নিয়েই ফাতিমা আবার বলে উঠল, ‘আগের কথায় ফিরে আসি ভাইয়া।’ সাও তোরাহে’র সন্ধান করার জন্য আপনি এখন কি চিন্তা করছেন।
‘চিন্তা করে কোন কিনারায় পৌঁছাতে পারিনি আমি। নানাভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। দ্বীপটার নামের দু’টি শব্দআছে একটি ‘সাও’ অন্যটি ‘তোরাহ’। এর মধ্যে ‘সাও’ ল্যাটিনীয় স্প্যানেশ। আর ‘তোরাহ’ শব্দ ওল্ড টেস্টামেন্টের। শব্দ-প্রকৃতির বিচার থেকে আমি মনে করি, দ্বীপটা মিড-উত্তর আটলান্টিকের পূর্বাংশে অথবা মিড-দক্ষিণ আটলান্টিকের মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ল্যাটিন এলাকার কোথাও হবে।’
ফাতিমা ও যায়েদ তাকিয়েছিল আহমদ মুসার মুখের দিকে।
তাদের চোখে-মুখে বিস্ময়। কিছু বলতে যচ্ছিল যায়েদ। এ সময় দরজায় নক হলো। ওঠে দিয়ে দরজা খুলল যায়েদ।
নিচ থেকে বেয়ারা আজকের কয়েকটি কাগজ নিয়ে এসেছে।
দরজা বন্ধ করতে করতে যায়েদ উপরে যে কাগজটা আছে তার দিকে নজর বুলাচ্ছিল।
নজর বুলিয়েই চিৎকার করে উঠল যায়েদ। বলল, ‘সেদিনের ঘটনাকে লা-মন্ডে লিড আইটেম করেছে ভাইয়া।’
বলে দরজা বন্ধ করে ছুটে এল যায়েদ। কাগজটা আহমদ মুসার হাতে দিল।
আহমদ মুসা কাগজ হাতে নিয়ে তাকাল হেডিংটার উপর। পড়ল হেডিংটাঃ
‘ঘটনার চাঞ্চল্যকর মোর, স্পুটনিক ধ্বংসের সাথে জড়িতদের আরও ১৪ জন নিহত ও কম্পিউটার থেকে পুলিশ কর্তৃক মূল্যবান দলিল উদ্ধার।’
হেডিংটা পড়েই চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। চোখ বুলাল ক্রেডিট লাইনের উপর। দেখল লেখা আছে ‘ষ্ট্রাসবার্গ থেকে বুমেদিন বিল্লাহ।’ আরও খুশি হয়ে উঠল আহমদ মুসা বুমেদিন বিল্লাহর নাম দেখে। সে নাম গোপন করেনি। সাহস আছে তার।
যায়েদ ও ফাতিমা তখন আন্য পত্রিকায় নজর বুলাচ্ছিল। যায়েদ বলে উঠল, প্যারিসের আর মাত্র দু’টি পত্রিকা এবং ষ্ট্রাসবার্গের একটি পত্রিকা সিংগল কলামে নিউজটি দিয়েছে। বলছে, অজ্ঞাতনামা আততায়ীর গুলিতে ১৪ জন অজ্ঞাত নামা নিহত।’
‘লা-মন্ডেই যথেষ্ট যায়েদ। আল্লাহর শুকরিয়া, লা-মন্ডে বিস্ময়কর ভাবে ইহুদী চাপ উপেক্ষা করেছে। আমি………।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই যায়েদ বলে উঠল, ‘এর কারণ আছে ভাইয়া। অতি-সম্প্রতি লা-মন্ডে দ্য গলপন্থীদের হাতে এসেছে।
এর সম্পাদকও নিযুক্ত হয়েছে একজন ন্যাশনালিষ্ট।’
‘ও, কারণ তাহলে এটাই।’ বলে আহমদ মুসা তার হাতের লা-মন্ডেটি যায়েদের দিকে তুলে ধরে বলল, ‘যায়েদ পড় নিউজটা। কি লিখেছে দেখা যাক।’
যায়েদ হাতে নিল কাগজটা।
সে আবার কাগজটা ফাতিমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘পড় না, পড়ায় তুমি খুব ভাল।’
‘তোমাদের ফরাসী তুমিই পড়।’ বলল ফাতিমা।
‘ভাইয়া দেখুন, অল্পক্ষণ আগেও বলছে আমরা জার্মান-ফরাসী এক হয়ে গেছি। আর এখন কি বলছে শুনুন।’ যায়েদ বলল।
ফাতিমা হাসল। যায়েদের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘ভাইয় কথা সে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে। আমি ভাষার কথা বলছি। আর প্রত্যেক জাতির জন্যে তার ভাষা আল্লাহর দান।’
‘আচ্ছা, তোমাদের ঝগড়ার ফয়সালা পরে করব। এবার খবরটা পড়। লা-মন্ডে তোমাদের কাগজ যায়েদ, তুামই এটা পড়বে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমিও ভাইয়াকে সমর্থন করছি।’ বলল ফাতিমা মুখ টিপে হেসে।
‘ভোট তুমি না দিলেও আমি পড়ছি।’ বলে যায়েদ কাগজ গুছিয়ে নিয়ে সামনে ধরল এবং পড়তে শুরু করলঃ
‘স্ট্রাসবার্গ থেকে বুমেদিন বিল্লাহ্। গত পরশু গভীর রাতে স্ট্রাসবার্গের শার্লেম্যান রোডের ৫নং বাড়ি থেকে পুলিশ স্পুটনিক ধ্বংসের সাথে জড়িত বলে কথিত ১৪ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। সেই বাড়িটির তৃতীয় তলায় তাদের অফিস কম্পিউটার থেকেমূল্যবান দলীল দস্তাবেজ ও উদ্ধার করেছে পুলিশ। এই উদ্ধারের কাজের সময় লা-মন্ডের এই রিপোর্টারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ১৪ জনের মধ্যে ১২ জনের লাশ পাওয়া যায় ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষ। আর বার জনের মধ্যে ১১ জনের কাছেই একটি করে ষ্টেনগান পাওয়াগেছে, অবশিষ্ট একজনের কাছে পাওয়া গেছে একটি রিভলবার।
কক্ষটিকে বন্দিখানা বলে সন্দেহ করা হয়েছে। ঘরে একটা সিংগেল খাট দেখা গেছে এবং খাটের উপর পাওয়া গেছে একটি হ্যান্ডকাফ। হ্যান্ডকাফের তালা ল্যাসার বীম দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা। পুলিশ মনে করছে একজন লোককে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেই বন্দী হ্যান্ডকাফের তালা গলিয়ে মুক্ত হয় এবং ঘরে প্রবেশকারী ১২ জনকে তাদেরই ষ্টেনগান দিয়ে হত্যা করে পালাতে সমর্থ হয়।
উল্লেখ্য, ক’দিন আগে হোটেল রাইন ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে দু’জনের লাশ পাওয়া যায়। তারাও কক্ষের বাসিন্দাকে হত্যা বা কিডন্যাপ করতে গিয়ে নিহত হয় বলে পুলিশ নিশ্চত হয়েছে। এরা দু’জন এবং উপরোক্ত চৌদ্দজন একই দলের বলে পুলিশ নিশ্চিত ভাবে মনে করছে। তাদের সকলেরই কলার ব্যান্ডে একই ধরনের ইনসিগনিয়া পাওয়া গেছে।
শার্লেম্যান রোডের ৫ নং বাড়িতে অবশিষ্ট ২ জনের লাশ পাওয়া যায় নীচের এক করিডোরে। পুলিশ মনে করছে বন্দী পালাবার সময় এ দু’জনকে হত্যা করে। এ দু’জনের হাতেও একটি করে রিভলবার পাওয়া গেছে।
নিহতদের সব অস্ত্রই লাইসেন্স বিহীন অবৈধ বলে পুলিশ উল্লেখ করেছে।
তিন তলার অফিস কক্ষ কম্পিউটারে যে দলিল দস্তাবেজ পাওয়া গেছে তার মধ্যে স্পুটনিক ধ্বংসের ব্লু- প্রিন্টও রয়েছে। পুলিশ তাদের তদন্তের স্বার্থে এ ব্লু-প্রিন্টের বিবরণ সম্পর্কিত কোন কিছু জানাতে রাজী হয়নি। তবে পুলিশ বলছে, নিছক ঐ ব্লু-প্রিন্ট দিয়ে সংশ্লিষ্ট দল বা ব্যাক্তিকে চিহ্নিত করা মুস্কিল।
নিহতদের সূত্র ধরে ক্রিমিনাল দলটির সন্ধান করা যায় কিনা এ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে পুলিশ বলেছে তারা তা চেষ্টা শুরু করেছে।
ক্রিমিনাল দলটির পরিচয় সম্পর্কে পুলিশ বলতে না পারলেও ইনসিগনিয়ার বৈশিষ্টের প্রতি ইংগিত করে ওয়াকিফহাল মহল বলেনে, কোন ইহুদী সংগঠন স্পুটনিক ধ্বংসের ঘটনার সাথে জড়িত।
ক্রিমিনাল এই ইহুদী সংগঠনটির সাথে কাদের সংঘাত বেধেছে, যাকে সেদিন তারা হেটেলে মারতে বা ধরতে গিয়েছিল তার পরিচয় কি এবং কাকে তারা শার্লেম্যান রোডের ৫ নাম্বার বাড়িতে বন্দী করেছিল, সে সম্পর্কে পুলিশ এবং পর্যবেক্ষক মহল কিছুই বলতে পারছে না। তবে তাদের মতে পুলিশের তদন্ত আগাতে ব্যার্থ হওয়ার পটভুমিতে প্রতিকার ও সাত গোয়েন্দাকে উদ্ধারের জন্যে কোন তৃতীয় পক্ষ এগিয়ে এসেছে কিংবা স্পুটনিক পরিবাররা এই তৃতীয় পক্ষকে নিয়োগ করেছে। অবশ্য কয়েকটি স্পুটনিক পরিবারের সাথে এই প্রশ্ন নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা এধরনের কোন পদক্ষেপের চিন্তাই করেনি বলে জানিয়েছে।
এই তৃতীয় পক্ষের পরিচয় সম্পর্কে হোটেল রাইনে আক্রান্ত ব্যাক্তিটি আসল কথা জানতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লোকটিকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। লোকটি হোটিল থেকে চলে গেছেন এবং গা ঢাকা দিয়েছে। ক্রিমিনাল দলটির ভয়ে এবং তাদের আক্রমন থেকে আত্মরক্ষার জন্যই লোকটা এটা করেছে বলে পুলিশও মনে করেছে। তবে তাকে পুলিশের এখন খুব বেশি প্রয়োজন।
স্পুটনিক ধ্বংস থেকে শুরু করে গত পরশু রাত পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনা দেশের সচেতন ও শান্তিকামী মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। কোন ইহুদী সংগঠন যদি স্পুটনিক ধ্বংস ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরনের সাথে জড়িত থাকে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে এ ইইহুদী সংগঠন স্পুটনিকের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হওয়ার কারণ কি? উল্লেখ্য, সাত গেয়েন্দার স্পুটনিক সংস্থা নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস সম্পর্কে নতুন করে তদন্ত শুরু ও কিছু দলিল হাত করার পরেই তাদের উপর ধ্বংসও বিপর্যয় নেমে আসে।’
পড়া শেষ করেই কাগজটা টি টেবিলে রাখতে রাখতে বলল যায়েদ, ‘ভাইয়া পুলিশ আপনার খোঁজ করছে বন্ধু হিসাবে না শত্রু হিসাবে?
‘আমি কে? ইহুদী সংগঠনটির সাথে যাদের সংঘাত বেঁধেছে, তাদের পরিচয় জানার জন্য আমাকে তাদের প্রয়োজন। শুরুটা ওদের বন্ধুত্বপূর্ন হলেও পরে বন্ধু থাকবে বলে আমি মনে করিনা।’
‘কেন থাকবে না? আপনার দেয়া তথ্য ও আপনার কাজ তো পুলিশের তদন্তে বাড়তি শক্তি যোগাবে।’ বলল, যায়েদ।
‘আমরা হোটেল থেকে কেন তাড়িঘড়ি চলে এলাম, এত তাড়াতাড়ি ভূলে গেছ? পুলিশের একটা গ্রুপ উর্ধ্বতন পুলিশের নির্দেশে আমাকে আন অফিসিয়ালী গ্রেপ্তার করে ঐ ইহুদী সংগঠনের হাতে তুলে দেবে, এটা জানতে পেরেই তো চলে এসেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বুঝেছি ভাইয়া।’ বলল যায়েদ।
‘পুলিশ যে আন্তরিক নয়, লা-মন্ডের এ রিপোর্ট থেকেও তা বুঝা যাচ্ছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কি থেকে বুঝা গেল ভাইয়া?’ বলল ফাতিমা।
‘কম্পিউটারে স্পুটনিক ধবংসের যে ব্লু প্রিন্ট ছিল তার কিছুই পুলিশ জানায় নি। উপরন্তু বলেছে, নিছক ঐ ব্লু প্রিন্ট থেকে সংশ্লিষ্ট দল বা ব্যাক্তিকে চিহ্নিত করা যাবে না। এর অর্থ ব্লু প্রিন্টটিকে অকেজ একটা দলিল হিসাবে কোল্ড স্টোরেজে ঠেলে দিতে পারে। সব চেয়ে বড় কথা হলো ক্রিমিনালরা নিজেরাই যাকে নতুন গুলাগ হিসাবে অভিহিত করেছে, সেই ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপের মানচিত্রটি নিউজে নেই। পুলিশরা সাংবাদিকের কাছ থেকে বিষয়টা একদম গোপন করে ফেলেছে। কোন দিনেই হয়তো সাংবাদিকরা বা বাইরের দুনিয়া পুলিশের কাছ থেকে ‘সাও তোরাহে’র কথা আর জানতে পারবে না।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা থামল ও সংগে সংগে কোন কথা বলল না ফাতিমা ও যায়েদ। তাদের চোখ-মুখে ভাবনা ও হতাশার চিহ্ন।
একটু পরে ফাতিমা হতাশা জড়িত কন্ঠে বলল, ‘আমরা পুলিশের ভুমিকায় এ ব্যাখ্যা করতে পারি যে, ‘পুলিশ তদন্তের স্বার্থেই এটা প্রকাশ করে নি। সাও তোরাহ দ্বীপের মানচিত্র পুলিশের হাতে পড়েছে জানলে ক্রিমিনালরা সাবধান হয়ে যাবে এবং দ্বীপ থেকে সব কিছু তারা অন্যত্র সরিয়ে ফেলবে।’
আহমদ মুসা হাসল।বলল, ‘এ যুক্তি খাটেনা ফাতিমা। কম্পিউটার পুলিশের হাতে পড়ার পর ওরা নিশ্চিত হয়েছে, সাও তোরাহের মানচিত্রও পুলিশ পেয়ে গেছে। বিশেষ করে স্পুটনিক ধ্বংসের ব্লু প্রিন্টটা পুলিশ যখন পেয়েছে, এটা ক্রিমিনালরা বুঝতে মুহুর্তও দেরি হবার কথা নয়।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি ঠিক বলেছেন। তা হলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, পুলিশের কোন সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি না।’ বলল ফাতিমা হতাশ কন্ঠে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, একটা সহযোগিতা আমরা পেলাম।
‘কি সেটা? ত্বড়িত কন্ঠে প্রশ্ন করল যায়েদ।
‘পুলিশ দলিলগুলো প্রকাশ না করায় এবং ক্রিমিনালদের সাথে আঁতাত করায় আমরা এখন নিশ্চিত হতে পারছি যে, ক্রিমিনালদের নতুন গুলাগ ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপেই থাকছে। পুলিশ ক্রিমিনালদের সাথে যোগসাজোশে না গিয়ে মানচিত্রসহ দলিল প্রকাশ করলে, ফাতিমা যেটা বলেছে, ক্রিমিনালরা সাবধান হতো এবং সাও তোরাহ থেকে সব কিছু সরিয়ে নিত। তাতে আমরা যে টুকু এগিয়ে ছিলাম, সে টুকু পিছিয়ে পড়তাম।’ আহমদ মুসা থামল।
আহমদ মুসা থামতেই ফাতিমা ও যায়েদ আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। ফাতিমা বলল, ‘তাহলে আজকের নিউজের এটাই একমাত্র লাভ ভাইয়া।’
‘না, আরও লাভ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আরও লাভটা কি?’ জিজ্ঞাসা যায়েদের।
‘এই নিউজটা প্রথম বারের মত এ কথা সামনে নিয়ে এল যে, স্পুটনিক ধ্বংস ও সাত গোয়েন্দাকে অপহরণের কাজ ইহুদী একটা ক্রিমিনাল সংগঠন করেছে। নিউজটি আরেকটি বড় বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে সেটা হলো, নিউইয়র্কের টুইনটাওয়ার ধ্বংসের সাথে ক্রিমিনাল ইহুদী সংগঠনটি জড়িত থাকতে পারে। তা না হলে টুইন টাওয়ারের ঘটনার উপর নতুন ভাবে তদন্তকারী স্পটনিকের উপর ক্রিমিনাল ইহুদী সংগঠনটি খড়গহস্ত হলো কেন? নিউজটি স্পুটনিকের তদন্ত কাজে পুলিশের ব্যার্থতাকেও তুলে ধরেছে এবং বলেছে যে, প্রতিকার ও সাত গোয়েন্দাকে উদ্ধারের জন্য অবশেষে তৃতীয় একটি পক্ষ কাজে নেমেছে। এই তৃতীয় পক্ষকে ধ্বংসের জন্যও ইহুদী ক্রিমিনাল সংগঠনটি উঠে পড়েলে গেছে এবং এর খেসারত হিসাবে সংগঠনটির এপর্যন্ত কম পক্ষে ষোল জনকে বলী হতে হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু নিউজটা সবচেয়ে বড় খবর তৃতীয় পক্ষ হিসাবে স্বয়ং আহমদ মুসা আবির্ভূত একথা বলতে পারেনি।’ বলল ফাতিমা। তার মুখে আনন্দের হাসি।
‘রিপোর্টারকে এ জন্য ধন্যবাদ ফাতিমা।’ হেসে উঠে বলল যায়েদ।
ফাতিমা হাসিতে যোগ দিল না। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল সে। বলল, ‘স্যরি ভাইয়া। হালকা চিন্তার সময় এটা নয়। পুলিশের সাহায্য আমরা পাচ্ছি না। আপনি কার্যতঃ একা। কি ভাবছেন ভাইয়া?
‘সত্যি নিউজটা আমাদের উপকার করেছে। পুলিশের যোগসাজস অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমাদের ‘শাপেবর’ হয়েছে। বলে আহমদ মুসা সোফায় গা এলিয়ে দিল। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। মুহুর্ত কয়েক নিরব থাকার পর সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, কোন ভাবনার কথা বলব ফাতিমা। শেষ নেই। আমাদের সামনে দীর্ঘ পথ। স্পুটনিকের সাত নেতাকে উদ্ধার করতে হবে, তারপর আসবে
স্পুটনিক মিশন সফল করার কাজ করবে। এই পথের গোটাটাই আজ অন্ধকারে।’
ফাতিমার দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ভাইয়া স্পুটনিকের মিশন’ মানে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের তদন্তের দায়িত্ব আপনি নেবে?
‘দায়িত্ব তো স্পুটনিক নিয়েছে্ স্পুটনিককে সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হবো। আর এটা এমন একটা কাজ যার সাথে বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের স্বার্থ আজ জড়িত আছে। মুসলমানদের মাথা থেকে পুরানো একটা কলংকের বোঝা নামাতে হলে যে সত্য মিথ্যার স্তুপে ঢাকা পড়েছে তাকে উদ্ধার করতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এত দিন পর সত্যটা আসলেই উদ্ধার করা যাবে? আপনিও অনেক দিন আমেরিকা ছিলেন, তখন কিছু কি ভেবেছিলেন? জিজ্ঞেস করল যায়েদ।
‘উদ্ধার করা যাবে না কেন? আমি শুনেছি, স্পুটনিক অনেক এগিয়েছিল। তাছাড়া এখন এ ব্যাপারে মার্কিন সরকারের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। তোমরা জান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন দাবার ছক পাল্টে গেছে। ‘ধরাকে সরা’ জ্ঞান কারী জেনারেল শ্যারণ সেখানে আজ বন্দী এবং বিচারের সম্মুখিন।’
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার বলা শুরু করল, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় ডেমোক্রাসি টাওয়ার’ ও ‘লিবার্টি টাওয়ার’ বিষয় নিয়ে ভাবার আমার সুযোগ হয়নি। আমি আনন্দিত যে, স্পুটনিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটা শুরু করেছে।’
বলতে বলতে আহমদ মুসা সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘স্পুটনিকের সাত নেতা উদ্ধার হলে এ বিষয়ে কাজ করার সময় আসবে, এখন নয়। এখন তাদের উদ্ধারই আমাদের সামনে একমাত্র বিষয়।’
‘ঠিক ভাইয়া, ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপ কোথায়, এ প্রশ্নটাই এখন সব চেয়ে বড়।’ বলল যায়েদ।
‘ভাইয়া আমরা আগামী কাল কামাল সুলাইমান ভাইয়ার বাসায় যাচ্ছি। লতিফা ভাবী কিন্তু একজন ভুগোলবিদ। তার সাথে ‘সাও তোরাহ’ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।’ ফাতিমা বলল।
‘উনি কি কোথাও অধ্যাপনা করেন? জিজ্ঞেস করল আহসদ মুসা।
‘হ্যাঁ উনি স্ট্রসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একজন শিক্ষক।’ বলল ফাতিমা।
খুশি হলো আহমদ মুসা। বলল, ভালই হলো, দেখা যাক তিনি কোন আলো দেখাতে পারেন কিনা।’
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘আপনি কোথাও যাবেন ভাইয়া?’ জিজ্ঞাসা করল যায়েদ।
‘হ্যাঁ, আমি একটু বেরুচ্ছি।’ বলে ওদের সামনে দিয়ে আহমদ মুসা তার কক্ষের দিকে হাঁটা শুরু করল।
‘ভাই সাহেব, আমাদের পরিবারে গত কয়েক জেনারেশনের মধ্যে মোস্তফা কামাল একজনই হয়েছেন। মোস্তফা কামালের জন্ম আর হয়নি। অতএব ইসলাম সম্পর্কে মোস্তফা কামালের বিশেষ দৃষ্টিভংগি আমাদের পরিবারের আর কারও মধ্যেই আর দেখা যায় নি। বরং ইতিহাস হলো, আমাদের পরিবারের তৃতীয় জেনারেশনের যিনি তুরস্ক ছেড়ে জার্মানীতে এসে স্থায়ী বসতি গড়েন, তিনি চেয়ে ছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের স্মৃতি ঘেরা পরিবেশ থেকে দূরে সরে আসতে। তিনি বলতেন, তার পূর্বপুরুষ মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক নিজের মত করে একটি জাতি গড়তে গিয়ে যা করেছেন, সে স্মৃতি একটি সুন্দর ও সুস্থ পরিবারের জন্য দুঃসহ। এই দুঃসহ স্মৃতির হাত থেকে বাঁচার জন্যই তিনি জার্মানীতে হিজরত করেন।’
আহমদ মুসার এক জিজ্ঞাসার জবাবে কথাগুলো বলছিলো লতিফা কামাল। স্পুটনিকের প্রধান গোয়েন্দা ও প্রধান পরিচালক কামাল সুলাইমানের স্ত্রী সে।
আহমদ মুসার সামনের এক সোফায় বসে কথা বলছিলো লতিফা কামাল। মোস্তফা কামাল তুর্কি মহিলাদের ইংরেজী পোশাক পড়িয়ে ছিলেন। মাথা থেকে খুলে ফেলেছিলেন রুমাল এবং নামিয়ে দিয়েছিলেন গা থেকে চাদর। কিন্তু মোস্তফা কামাল পরিবারের সদস্য লতিফা কামালের পরনে তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম গৃহবধুর পোশাক।
লতিফা কামালের পাশে বসেছে ফাতিমা কামাল। আর আহমদ মুসার পাশের সোফায় বসেছে যায়েদ।
এটা লতিফা কামাল ও কামাল সুলাইমানের বাড়ি। স্বামী কামাল সুলাইমান কিডন্যাপ হবার পর লতিফা কামালের বাপ-মা এবং মাঝে মাঝে ভাইরা এসে থাকছে এখানে।
লতিফা থামতেই আহমদ মুসা বলল, বোন মিসেস কামাল, ‘বড় আনন্দের খবর দিলেন আপনি। ধন্যবাদ আপনাকে। এ থেকে আবারও প্রমাণিত হলো, সব কিছু মূলের দিকেই ফেরে।’
‘মোস্তফা কামালের পরিবার মূলের দিকে ফিরেছে। তবে মোস্তফা কামালের দেশ কিন্তু এখনও মূলের দিকে ফিরতে পারেনি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অধিকাংশ মানুষ মূলের দিকে ফিরছে, কিন্তু অধিকাংশ নেতা মূলের দিকে ফেরেননি ভাইয়া।’ বলল ফাতিমা।
‘ফাতিমা ঠিক বলেছে ভাই সাহেব।’ লতিফা কামাল বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে। ‘হ্যাঁ মিসেস কামাল, ফাতিমা ঠিকই বলেছে। তবে আমার মতে নেতারা বড় বাধা নয়, বাধা সেখানকার কামালীয় সংবিধান। গণতন্ত্রে জনতা জননেতাদের গড়ে নিতে পারে, কিন্তু সেখানকার সংবিধান জনতার ধরা-ছোঁয়ার উর্ধে বলল আহমদ মুসা।
হাসি ফুটে উঠল লতিফা কামালের মুখে। বলল, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনি আহমদ মুসা। ফাতিমা ও আমাদের জানা এবং আপনার জানার মধ্যে যোজন পার্থক্য। আপনি যেটা বলেছেন, সেটাই ঠিক। সংবিধানই আসল বাধা।
বলে একটু থামল লতিফা কামাল। মুহুর্তের জন্যে মাথাটা নীচু করল। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল গাম্ভীর্য। আহমদ মুসার দিকে চোখ তুলে সে বলল, ‘কামাল সুলাইমান প্রায়ই বলত, , আমাদের দেশ ছাড়া হওয়াটা আমাদের পারিবারিক পাপের একটা প্রায়শ্চিত্ত। মোস্তফা কামাল যে ইউরোপীয় হতে চেয়ে ছিলেন, তার পরিবার আজ সে ইউরোপীয় হয়েছে। কিন্তু এতেই আমাদের প্রয়শ্চিত্ত হয়েছে বলে কামাল সুলাইমান মনে করতেন না। বলতেন, আমাদের পরিবারকে আরও মূল্য দিতে হবে। স্পুটনিকের ঘটনা, তিনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তার কথিত সেই মূল্য কিনা কে জানে।’
থামল লতিফা কামাল। চাঁপা কান্নায় তার কন্ঠ প্রায় রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। হঠাৎই ড্রইংরুমের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। বেদনার ছায়া নেমে এল উপস্থিত সবার মুখে।
নেমে এসেছিল এক নিরবতাও।
নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। বলল, আমি কামাল সুলাইমানের সাথে একমত নই। আল্লাহ একের পাপে অন্যকে শাস্তি দেন না। আর কামাল পরিবারের জার্মানিতে হিজরত আল্লাহর শাস্তি নয় পুরুস্কার। আল্লাহ কামাল পরিবারের কাছ থেকে ইউরোপের মাটিতে ইসলামের পক্ষে খেদমত নিতে চান। সেই খেদমত কামাল পরিবার করছে।
স্পুটনিক তারই একটা অমর দৃষ্টান্ত। স্পুটনিকে যা ঘটেছে, কামাল সুলাইমানের যা ঘটেছে তা আদর্শের সৈনিকের জন্য একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এ ঘটনা প্রমাণ করেছে অন্যান্যদের সাথে কামাল পরিবাকেও আল্লাহ কবুল করেছেন।’
লতিফা কামাল চোখ মুছে বলল, ‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব। আপনার মত বুঝ আল্লাহ আমাদের দান করুন। কামালের দুর্ভাগ্য যে সে আপনার দেখা পেলনা।’
‘দোয়া করুন ভাবী, এ ভাইয়ার সাথে কামাল ভাইয়ার দেখা হবে।
ভাইয়া তো তাঁদের জন্যেই ফ্রান্সে এসেছেন ভাবী।’
‘আল্লাহ সাহায্য করুন। তোমাদের কাছে যেদিন আমি ভাই সাহেবের কথা শুনেছি, সেদিন গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবারের মত বুকটা আমি হাল্কা অনুভব করেছি, বুক ভরে আমি নিঃশ্বাস নিতে পেরেছি। মনে হয়েছে, আল্লাহ তাঁর বিশেষ দয়ার দৃষ্টি আমাদের উপর দিয়েছেন।’ বলল আবেগ–কম্পিত কন্ঠে লতিফা কামাল।
‘ভাবী আপনার একটা সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।’ বলল ফাতিমা।
‘সাহায্যের কথা বলছ কেন? বল কি কাজ আমাকে করতে হবে?’
বলল লতিফা কামাল। তখনও ভারী তার কন্ঠস্বর।
লতিফা থামতেই কথা বলে উঠল আহমদ মুসা। ‘আমরা একটা দ্বীপের সন্ধান করছি, যে দ্বীপে কামাল সুলাইমানরা বন্দী থাকতে পারেন বলে সন্দেহ।’
‘দ্বীপের নাম কি? উদগ্রীব কন্ঠে বলল লতিফা কামাল।
‘সাও তোরাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাও তোরাহ’ নামটি মুখে উচ্চারণ করে ভাবল কিছুক্ষণ লতিফা কামাল। তারপর বলল, ‘এই ধরনের কোন দ্বীপ আছে বলে আমি জানি না। এটা কোন ছদ্মনাম হবে।’
আহমদ মুসা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সেটা লতিফা কামালের দিকে মেলে ধরে বলল, ‘এটা দ্বীপটার আকার। আকার দেখে কোন আন্দাজ করতে পারেন কিনা দেখুন।’
লতিফা কামাল কাগজটি কিছুক্ষণ হাতে দেখে বলল, ‘স্যরি, আমার এবিদ্যা নেই ভাই সাহেব। ‘সমুদ্র পৃষ্ট ও দ্বীপত্তত্ব বিষয়ে যারা পড়া শুনা করেছেন, তাদের পক্ষেই শুধু এব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব।’
এই সময় কলিংবেল বেজে উঠল টেবিলে রাখা কলিং বক্স থেকে।
লতিফা কামাল ‘এক্সকিউজ মি’ বলে কলিং বক্সটা টেনে সামনে নিয়ে একটা সুইচ অন করে বলল, ‘মিসেস কামাল বলছি, কে আপনি দয়া করে বলুন’
ওপারের কথা শুনল লতিফা কামাল। শুনেই প্রবল একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠল তার চোখ মুখে। বলল সে ওপারের লোককে উদ্দেশ্য করে, ‘হোল্ড অন প্লিজ।’
বলে কলিং বক্স নিরব করে দিয়ে বলল, ‘স্যরি ভাই সাহব, একটা কান্ড ঘটে গেছে। আমি লা-মন্ডের রিপোর্টার বুমেদীন বিল্লাহকে সময় দিয়েছিলাম। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম এই এ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা। তিনি এসেছেন। কি করি এখন?
‘বুমেদী বিল্লাহ?’ কোন অসুবিধা নেই মিসেস কামাল। তাঁকে ডাকুন। তাঁর সাথে দেখা হলে আমরাও খুশি হবো। তিনি আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলে আমরা পাশের ঘরে সরে যাবে’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ ভাই সাহেব।’ বলে লতিফা কামাল কলিং বক্স অন করে বলল, ‘স্যরি ফর ট্রাবল, প্লিজ আপনি আসুন।’
লতিফা কামাল কলিং বক্স অফ করতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, মিসেস কামাল, বুমেদীন বিল্লাহর সাথে আমাদের এই দেখা হওয়াকে আমি আল্লাহর এক সাহায্য বলে মনে করছি। মনে মনে তাঁকে আমি চাইছিলাম।
যদি উনি রাজী হন আমরা কথা বললে আপনার আপত্তি নেই তো?
বিষণ্ণতা ফুটে উঠল লতিফা কামালের মুখে। বলল, ‘এভাবে অনাত্মীয়ের মত কথা বলছেন কেন? আমি এবং আপনারা কি আলাদা ভাই সাহেব?
‘ধন্যবাদ বোন লতিফা কামাল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যাই উনি এসে পড়বেন’ বলে লতিফা কামাল উঠে গেল দরজার দিকে মেহমানকে রিসিভ করার জন্য।
আধা মিনিটের মধ্যে মেহমানকে রিসিভ করে সাথে নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল লতিফা কামাল।
আহমদ মুসা, ফাতিমা ও যায়েদ উঠে দাঁড়িয়েছে মেহমানকে স্বাগত জানানোর জন্য।
বুমেদীন বিল্লাহকে দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। একেবারে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ‘আহমদ বেন বেল্লা’র চেহারা।
বেন বেল্লাহর যে চেহারা আহমদ মুসার চোখে ভাসছে তার বয়স একটু বেশি, এর বয়স একটু কম।
আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে স্বাগত জানিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনাকে ‘বুমেদীন বিল্লাহ’ না বলে ‘বেন বেল্লাহ’ বললেই মানাত ভাল।’
বুমেদীন বিল্লাহ হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলল, ‘আহমদ বেন বেল্লাহর’ বেল্লাহ’ তো আছেই, আমার মাতৃকূলের ঐতিহাসিক ব্যাক্তি ‘হুয়ারী বুমেদিনে’র ‘বুমেদীন’ বাদ দেবেন কেন। আমার পিতা আমার পিতৃকুল মাতৃকুলকে এক সঙ্গে ধরে রাখার জন্যই দুই ইতিহাসকে যোগ করে আমার নাম রেখেছেন।’
আহমদ মুসা তাকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দুই ইতিহাসের যোগ ফল হয়ে আপনি তাদের চেয়ে বড় ইতিহাস।’
বুমেদীন বিল্লাহ আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি মৃত ইতিহাসের সাক্ষী বটে, কিন্তু আপনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। পুলিশ আপনাকে খুঁজছে, তার চেয়েও বেশি খুঁজছি আমি। আমি কিন্তু আপনাকে ছাড়ছিনা।’
আহমদ মুসা জড়িয়ে ধরা থেকে ছেড়ে দিয়ে তাকে নিয়ে এক সোফায় পাশাপাশি বসতে বসতে বলল, ‘আমিও আপনাকে ছাড়ছি না মিঃ বুমেদীন বিল্লাহ। বিশেষ করে আপনার দ্বিতীয় নিউজ পড়ার পর আপনাকে দারুণভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’
‘চমৎকার, দু’জনকে দু’জনার প্রয়োজন। আসুন তাহলে, আরেকবার হ্যান্ডশেক করি।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘দু’জনে হ্যান্ডশেক করল আবার।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করে বুমেদীন বিল্লাহকে ধরে রেখেই বলল, ‘আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?
‘সেদিন রাতে হোটেল কক্ষে দু’জন লোক নিহত হওয়ার ঘটনার পর পুলিশের সাথে আমিও গিয়েছিলাম। দেখেছি আপনাকে।
আপনার ভোলার কথা নয়। পুলিশ যাই ভাবুক, সেদিন রাতেই কিন্তু আমার মনে হয়েছে পুরো পরিচয় আপনার পাওয়া গেল না।
তারপর সেদিন রাইন পার্কের মোড়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যওয়া যে গাড়ি পাওয়া গেছে তার আরোহী ছিলেন আপনি, সেটা অনুসন্ধানে আমি জানতে পেরেছি। এরপর শার্লেম্যানের ৫ নং বাড়ির ১৪ জনের হত্যার যে ঘটনা সেও আপনিই ঘটিয়েছেন বলে আমি নিশ্চিত।
আপনি সেখানে বন্দী ছিলেন। ওদের হত্যা করে আপনি মুক্ত হয়েছেন। এ সব থেকে আমার নিশ্চিত ধারনা হয়েছে, স্পুটনিকের ঘটনায় আপনি তৃতীয় পক্ষ। এই তৃতীয় পক্ষের কোন পরিচয় আমার জানা নেই। এটা না জানলে আমি ঘটনা নিয়ে আমি আগাতে পারছি না।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘রাইন পার্কের মোড়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়ির আমি আরহী ছিলাম, এটা হোটেল রাইনের গাড়ি রেজিষ্টার থেকে জানা সম্ভব, কিন্তু শার্লেম্যানের ৫ নং বাড়িতে ১৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে আমাকে জড়িত করছেন কিসের ভিত্তিতে? জিজ্ঞেসা করলে আহমদ মুসা।
‘দুই কারণে আমি এটা মনে করছি। এক, হোটেলের নিহত দু’জন এবং শার্লেম্যান ৫ নং বাড়িতে নিহত ১৪ জন একই গ্রুপের। দ্বিতীয়তঃ স্পুটনিক ধ্বংসকারী এই গ্রুপের সাথে আপনি ছাড়া আর কারো সাথে সংঘাত বাধেনি। বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘ঘটনার পেছনে মোটিভ একটা বড় জিনিস। আমাকে আপনি তৃতীয় পক্ষ ধরে নিয়েছেন। কিন্তু এই তৃতীয় পক্ষ আমি হবো কেন? আমার স্বার্থ কি এখানে? আহমদ মুসা বলল।
‘এটা আমারও প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সমাধান আমি করতে পারিনি। এই কারণেই আমি আপনাকে খুঁজছি। আপনার পরিচয় জানতে পারলে মোটিভটা পরিস্কার হতে পারে’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, মিঃ বুমেদীন বিল্লাহ, আমরা কিন্তু মিসেস কামালের প্রতি অবিচার করছি। আপনার এপয়েন্টমেন্ট হয়েছে মিসেস কামালের সাথে। আর এসে কথা বলছেন আপনি আমার সাথে।
এটা ঠিক নয়। এবার আপনি………….।’
কথার মাঝখানে আহমদ মুসাকে থামিয়ে বুমেদীন বিল্লাহ লতিফা কামালের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলে উঠল, ‘ম্যাডাম মিসেস কামাল আমাকে মাফ করুন। আসলে তৃতীয় পক্ষ সম্পর্কে আপনি কি জানেন, কিংবা জানার ব্যাপারে কি সাহায্য করতে পারেন, আপনার আত্মীয় এই ফাতিমা কামালকে কোথায় পাওয়া যাবে, এসব জিজ্ঞাসার জন্যেই আমি আপনার এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলাম। এখন আপনার এখানে এসে দেখি শুধু ফাতিমা কামাল ও যায়েদ নয়, স্বয়ং তৃতীয় পক্ষ এখানে হাজির। সুতরাং তার সাথেই কথা বলছি। আমি আপনার সহযোগিতা চাই।’
হাসল লতিফা কামাল। বলল, আমি এখানে এখন তৃতীয় পক্ষ। আপনাদের দু’পক্ষকেই আমি সমান সহযোগিতা করব।’ দেখুন মিঃ বুমেদীন বিল্লাহ, আপনি আসার প্রায় পূর্ব মুহুর্তে মিসেস লতিফা কামাল আমাকে বলেছেন, তিনি এবং আমরা একপক্ষ। এখন তিনি আলাদা হতে চাচ্ছেন।’ আহমদ মুসা বলল মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টেনে।
হাসল লতিফা কামাল। বলল, ঠিক আছে। আপনার কথা আমি অস্বীকার করছিনা। কিন্তু এক পক্ষের হয়েও অন্য পক্ষকে সহযোগীতা করা যায়, যদি স্বপক্ষের স্বার্থের বিরুদ্ধে না যায়। তাছাড়া হোষ্ট হিসাবে আমার মেহমানদারীরও একটা ভুমিকা আছে।
‘এরপর আর কোন কথা নেই। মেহমানদারীর প্রয়োজনটা আসন্ন হয়ে উঠেছে। সুতরাং মিসেস কামালের প্রস্তাবের প্রতি আমার পূর্ণ সম্মতি আছে।’ বলল আহমদ মুসা হাসতে হাসতে।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই বুমেদীন বিল্লাহ বলে উঠল, ‘নিঃস্পত্তি হয়ে গেল। আসুন তাহলে আমরা আমাদের কথায় ফিরে আসি।’
‘অবশ্যই। তবে শুরুটা এবার আমি করব।’ বলল আহমদ মুসা।
বুমেদীন বিল্লাহ থমকে গিয়ে একটু চিন্তা করে বলল, ‘ঠিক আছে মি.আহমদ আবদুল্লাহ। শুরু করুন।’
‘আচ্ছা মি. বুমেদীন বিল্লাহ, সেদিন শার্লেম্যান রোডে ওদের অফিস কম্পিউটারটা কি আপনি দেখে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ দেখেছি। পুলিশ পরীক্ষা ও ডিকোড করার জন্য কম্পিউটার তাদের অফিসে নিয়ে যায়।’
‘কম্পিউটারে পাওয়া দলিল-দস্তাবেজ সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিংকালে পুলিশ কি দলিলগুলো আপনাদের দেখিয়েছিল?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘তাদের নোট থেকে আমাদের বলেছিল।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘নতুন গুলাগ’ সম্পর্কে কিছু বলেছিল? জিজ্ঞেসা করল আহমদ মুসা।
‘নতুন গুলাগ?’ কাদের নতুন গুলাগ? বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল। ‘বলছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে যে, ‘আমাদের এখানকার গোটা আলোচনা ‘অফ দ্যা রেকর্ড।’ এর কোন কিছুই পত্রিকায় দিতে পারবেন না। মনে করুন আপনি আমার সাথে কথা বলছেন বেন বেল্লাহ ও হুয়ারী বুমেদীনদের একজন উত্তরসূরী হিসাবে, সাংবাদিক হিসাবে নয়। বলল আহমদ মুসা শান্ত এবং দৃঢ় কন্ঠে।
‘আপনি মজার কথা বলছেন আহমদ আব্দুল্লাহ। আমার পরিচয়কে এভাবে কেউ কোন দিন তুলে ধরেনি।’ বলেই আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরে বলল, হ্যাঁ আমি কথা দিচ্ছি আহমদ আবদুল্লাহ।’
‘ধন্যবাদ মি. বুমেদীন বিল্লাহ।’ বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলতে শুরু করল, ‘‘আলেকজান্ডার সোলঝে-নিৎসীনের উপন্যাসে ‘গুলাগ দ্বীপপুঞ্জে’র কথা আছে। মানবতার দোজখ অমন ‘গুলাগ’ সোভিয়েত দেশে অনেক ছিল। তবে সে অতীতের কথা। কিন্তু ইহুদী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডমআর্মি’(WFA) সোভিয়েত ও নাজী স্টাইলে ‘নতুন গুলাগ’ স্থাপন করেছে।’
বিস্ময় জেগে উঠল বুমেদীন বিল্লাহর চোখে-মুখে। বলল, কি উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছে? নতুন গুলাগে কারা আছে?
‘তাদের গুলাগ লোক চক্ষুর সামনে এখনো আসেনি। তবে আমি মনে করি, সক্রিয়বাদী মুসলিম ও কামাল সুলাইমানদের মত সত্যসন্ধানীরা আছেন।’
ভ্রু কুচকে গেল বুমেদীন বিল্লাহর। বলল, ‘তার মানে কি আপনি মনে করেন কামাল সুলাইমান সহ স্পুটনিকের সবাইকে ঐ নতুন গুলাগে রাখা হয়েছে?
‘আমি এ চিন্তা করতে চাইনা, কিন্তু এ চিন্তার কোন বিকল্প নেই।’ আহমদ মুসার কন্ঠ শান্ত এবং দৃঢ়।
আহমদ মুসার এ কথা শোনার সাথে সাথে ভয় ও উদ্বেগ ফুটে উঠল লতিফা কামালের চোখে মুখে।
বুমেদীন বিল্লাহর চোখে-মুখেও ভাবান্তর। আহমদ মুসা থামলেও সে কথা বললনা। একটু পর সে বলে উঠল, ‘এই গুলাগের কথা কি শার্লেম্যান রোডে সেদিন ধারা পড়া কম্পিউটারে আছে? ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’ নামটাও কি ঐ কম্পিউটারে আছে?
‘হ্যাঁ আছে।’ আহমদ মুসা বলল। ‘কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? জিজ্ঞাসা বুমেদীন বিল্লাহর।
‘ওখান থেকে ফেরার আগে আমরা সেদিন তিন তলার অফিস-কম্পিউটারটা চেক করেছিলাম এবং সব দলিল-দস্তাবেজের প্রিন্ট নিয়ে এসেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রবল বিস্ময়ে ছেয়ে গেল বুমেদীন বিল্লাহর মুখ। বলল সে, ‘কোড ভেঙ্গেছিলেন আপনারা? কিন্তু পুলিশ তো পারেনি। অফিসে নিয়ে বিশেষজ্ঞ এনে তবেই কম্পিউটারের গোপন ফাইলগুলো ওপেন করা সম্ভব হয়।’
‘হ্যাঁ কোড ভাঙা সম্ভব হয়েছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমারা যাওয়ার কথা আপনি বললেন। ‘আমরা’- এর মধ্যে আর কে ছিল।’ জিজ্ঞাসা করল বুমেদিন বিল্লাহ।
‘ফাতিমা ও যায়েদ।’ আহমদ মুসা বলল।
বুমেদীন বিল্লাহ বিস্মিত চোখে তাকাল ফাতিমা ও যায়েদের দিকে। বলল, ‘আপনারা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের পড়ার বিষয় কি ছিল?
হাসল যায়েদ। বলল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সাবজেক্ট কম্পিউটার বিজ্ঞান নয়। আমি সেদিন কম্পিউটার অপারেট করেছি বটে, কিন্তু ভাইয়া আমাকে কতগুলো কোড ট্রাই করতে বলেছিল এবং তারই দু’টি দিয়ে দুই কম্পিউটারের লক খুলে গিয়েছিল।’
বুমেদিন বিল্লাহ বিস্মিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
বুমেদিন বিল্লাহর কিছু বলার আগে আহমদ মুসা বলে উঠল, নিশ্চয় আপনি এখন প্রশ্ন করবেন, কম্পিউটারের নতুন গুলাগে কি ছিল?
বুমেদিন বিল্লাহ গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘না’ আমার প্রশ্ন আপনি আসলে কে? শুনেছি, যার হাতে বন্দুক খুব বেশি চলে তার মাথা বেশি চলে না। কিন্তু আপনি দেখছি, বন্দুক চালনা ও মাথা চালনায় সমান দক্ষ। যাক এ প্রশ্ন। আপনি ঐ প্রশ্নের জবাব দিন, বলুন নিউ গুলাগে কি আছে?’ নিউ গুলাগ ফাইলে আছে একটা দ্বীপের স্কেচ এবং নিউ গুলাগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু কথা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘দ্বীপের স্কেচ তার মানে ঐ দ্বীপটাই নিউ গুলাগ? দ্বীপটার নাম কি? দ্রুত ও এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘দ্বীপের নাম ‘সাও তোরাহ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘সাও তোরাহ?’ কোথায় এদ্বীপ? বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘এই প্রশ্নেরই জবাব আমি সন্ধান করছি বুমেদীন বিল্লাহ। মিসেস লতিফা কামালের কাছেও এসেছিলাম এই উদ্দেশ্যে। তিনি ভূগোলবিদ, দ্বীপটার সন্ধান নিশ্চয় তিনি দিতে পারবেন, এ আশা নিয়েই আমরা ছুটে এসেছিলাম।’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথা শুনে বুমেদীন বিল্লাহ একবার তাকাল মিসেস কামালের দিকে। তারপর আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘পেয়েছেন দ্বীপের সন্ধান?’
‘দ্বীপের সন্ধান পাইনি, তবে দ্বীপের সন্ধান কার কাছে পাওয়া যেতে পারে সেটা তিনি আমাদের জানিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি কি জানতে পারি দ্বীপের সন্ধানটা কোথায় পাওয়া যাবে?’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘উনি বলেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ ও দ্বীপতত্ত্ব বিশেষজ্ঞের কাছে এর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই লতিফা কামাল বলে উঠল, হ্যাঁ, আমি এটাই বলছি। ‘সমুদ্রপৃষ্ঠ ও দ্বীপতত্ত্ব’ বিশারদরা দ্বীপের সাইজ দেখে সমুদ্র স্রোত নির্ণয় করতে পারেন এবং সমুদ্র স্রোত বিচার করে সমুদ্রের স্থানটাও চিহ্নিত করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়। এছাড়া আরও উপাদান ও উপলক্ষ তাঁদের বিচার্য আছে।
‘ধন্যবাদ মিসেস কামাল। আপনার একথায় আমার মনে আশা জাগছে যে, দ্বীপটার সন্ধান আমরা পাব। আমার মনে হয় তারা দ্বীপের নাম দেখ ও দ্বীপের এলাকা নির্ধারণ করতে পারবেন। যেমন আমি ভাবছি, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ল্যাটিন অঞ্চলের কোথাও অথবা উত্তর আটালান্টিকের স্পেন ও পর্তুগাল বরাবর পশ্চিমে কোথাও এ দ্বীপটা থাকতে পারে।’
‘ভাই সাহেব, এই ভাবনার আপনার ভিত্তি কি? জিজ্ঞেস করল মিসেস কামাল।
‘দ্বীপের নামের দুটি অংশ আছে। তার এক অংশ হিব্রু, অন্য অংশ ল্যটিন। আমি মনে করছি হিব্রু শব্দটা এসেছে ইহুদীদের ঐতিহ্য বোধ থেকে এবং ল্যাটিন অংশটা এসেছে আঞ্চলিক বিবেচনা বা প্রভাব থেকে। আমি যে অঞ্চল গুলোর উল্লেখ করছি সেগুলো ল্যাটিন ভাষা প্রভাবিত।’ আহমদ মুসা বলল।
চমৎকার। আপনার যুক্তি অকাট্য মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ। আমার বিশ্বাস আপনার এ যুক্তি বিশেষজ্ঞদের এই দ্বীপ সন্ধানে সাহায্য করবে।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আপনাকে ধন্যবাদ ভাই সাহেব। আপনি যে চিন্তা করছেন, আমার মাথায় এই চিন্তা কোন দিন আসত কিনা সন্দেহ’ লতিফা কামাল বলল।
‘মিসেস কামাল, দ্বায়িত্ব মানুষকে দ্বায়িত্বশীল বানায়। দ্বায়িত্ব এসে পড়লেই চিন্তা এমনিতেই মাথায় চাপত।’
বলে আহমদ মুসা একটু থামল, তারপর বলে উঠল, মিসেস কামাল, পরামর্শ দিন কার কাছে আমরা যেতে পারি। আমি তো কাউকে চিনি না।
‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ যিনি, তিনি এখন দেশের বাইরে। অন্য কাউকে তো আমি দেখছিনা।’ বলল মিসেস কামাল।
মিসেস কামাল থামতেই বুমেদীন বিল্লাহ বলল, মিঃ আবদুল্লাহ, একজন প্রবীণ আটলান্টিক বিশেষজ্ঞের সাথে আমার পরিচয় আছে। তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমিরিটাস। বাস করেন এই স্ট্রাসবার্গেই।
আটলান্টিক সমুদ্র স্রোত, ভূতত্ব, দ্বীপের গঠন ও প্রকৃতি ইত্যাদি আটলানিটক সংক্রান্ত বিষয়ের উপর তাঁর অনেক বই আছে। আমি মনে করি তার সাথে আপনি কনসাল্ট করতে পারেন। আমি সাথে করে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলুন, আপনি কেন এসব করবেন। আপনার লক্ষ্য কি?
‘আপনি তো আগেই আমাকে তৃতীয় পক্ষ বলে অভিহিত করেছেন। আসলেই আমি তৃতীয় পক্ষ। আমি স্পুটনিকের অপহৃত নেতাদের উদ্ধার করতে চাই। এবং সেটা করতে গিয়ে স্পুটনিক ধ্বংসের আসল লক্ষ্য সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া এবং এ বিষয়ে কিছু করণীয় থাকলে করতে চাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কিন্তু যত দূর জানি আপনি একা। একাকি করতে পারবেন।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘না একা নই, সাথে আল্লাহ আছেন।’ আহমদ মুসা বলল।
বুমেদীন বিল্লাহর মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। বলল, আরেকটা কথা, স্পুটনিক নিউইয়র্কের ডেমোক্রাসি ও লিবার্টি টাওয়ার ধ্বংসের উপর তদন্ত করছিল। এ ব্যাপারে আপনার মত কি?
‘আমি মনে করি স্পুটনিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হাতে দিয়েছে। এই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। স্পুটনিক চাইলে আমিও তাদের সাথে থাকব।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এবার আমি আমার পুরানা প্রশ্ন করতে চাই মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ।
সেটা হলো, আপনি কে? কেন আপনি তৃতীয় পক্ষ হতে এলেন? বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আমার প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, আপনি এই স্পুটনিক কেসে কেন বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছেন?
কেন আপনি আমাদের সহযোগিতা করতে চাচ্ছেন? ফ্রান্সের সাংবাদিকদের মধ্যে আপনি ব্যাতিক্রম কেন ? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার কথা শেষ করার পর সংগে সংগে জবাব দিল না বুমেদীন বিল্লাহ। মুখটা সে একটু নীচু করছে। গম্ভীর হয়ে উঠেছে তার মুখমন্ডল।
কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকার পর ধীরে ধীরে বলল, স্পুটনিক ধ্বংসযজ্ঞ আমাকে আহত করেছে। পুলিশের নিস্ক্রিয়তা আমি মেনে নিতে পারিনি, সাংবাদিকদের বৈষম্য দৃষ্টি আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তাই স্পুটনিকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি।’
‘স্পুটনিকের ধ্বংসযজ্ঞ আপনাকে আহত করেছে কেন? সেটা কি শুধু স্পুটনিক একটা ভাল মানবতাবাদী সংস্থা বলেই? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
আবার নিরবতা বুমেদীন বিল্লাহর। একটু পরে সে বলে উঠল, কি আপনি জানতে চাচ্ছেন, আমি বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ, মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ, কিন্তু ফরাসী পুলিশও কিছু ফরাসী সাংবাদিক খৃষ্টান ও ইহুদী হওয়ার কারণে যেমন মুসলিম প্রতিষ্ঠানের সাথে অসহযোগিতা করেছে, তেমনি আমি মুসলিম হিসাবে স্পুটনিককে সহযোগিতা করতে চাচ্ছি।’
বুমেদীন বিল্লাহ থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ধন্যবাদ মিঃ বিল্লাহ। আপনার মত ঐ একই কারণেই আমি স্ট্রসবার্গ ছুটে এসেছি। কারণ আমিও একজন মুসলিম। নিউইয়র্কের ডেমোক্রাসি ও লিবার্টি টাওয়ার ধ্বংসের পুরানো দায়টা আমরা মুসলমানরা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। স্পুটনিক এ দায় থেকে আমাদের মুক্ত করতে চেয়েছিল। তাই স্পুটনিকের উপর ধ্বংসযজ্ঞ আপনার মত আমাকেও আহত করেছে। স্পুটনিকের সাত গোয়েন্দার মহান মিশনকে সহযোগিতা করার জন্য আমি এসেছি।’
‘মি. আহমদ আবদুল্লাহ আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার কাছে আমার দু’টি প্রশ্ন ছিল। দু’টির মধ্যে ‘আপনি কেন এসেছেন’ এ প্রশ্নের জবাব আপনি দিলেন। কিন্তু ‘আপনি কে’ এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু এখনও হয়নি।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, আজই হলো প্রথম সাক্ষাত। প্রথম দিনেই জানা শোনা সব শেষ হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। পরের জন্য কিছু রাখুন।’
বুমেদীন বিল্লাহও হাসল। বলল, আমার আপত্তি নেই। তবে আগ্রহটা আমার আরও বাড়ল।
বুমেদীন বিল্লাহ কথা শেষ করতেই লতিফা কামাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘খাবার টেবিলে নাস্তা এসেছে। আমি সকলকে নাস্তা খাবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
‘খাবার সামনে রেখে নামাজও চলে না, কথা তো চলতেই পারে না। সুতরাং চলুন।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
তার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল।
‘শুনলেন তো অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল, আমরা কত বড় শনির দশায় পড়েছি!’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কিন্তু এত বড় বস্নানডার কিভাবে হলো? আমি বুঝলাম, আপনার লোকেরা প্রাণপণ লড়াই করেছে। সবাই মারা গেছে এটাই তার প্রমাণ। কিন্তু লড়াই-এর মত সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল কম্পিউটারের রেকর্ড নষ্ট করে দেয়া। কিন্তু তারা সেটা করেনি।’ অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘আহমদ মুসা বন্দী হবার পর এত বড় বস্নান্ডার ঘটবে, এটা কারও কল্পনাতেও ছিল না। যাক, যখন বিপর্যয় ঘটেছে তখন আমাদের দূর্বলতাতেই ঘটেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখন বলুন শেষ রক্ষার উপায়, স্পুটনিক ধবংসের পরিকল্পনা, ওদের সাত জনকে কিডন্যাপ করার ডকুমেন্ট, সাও তোরহ দ্বীপের মানচিত্র, সবই গিয়ে পড়েছে পুলিশের হাতে। স্ট্রসবার্গের পুলিশ কমিশনারকে অনুরোধ করে কোন রকমে মানচিত্র ও ডকুমেন্টের বিস্তারিত প্রেসে দেয়া আটকাতে পেরেছি। কিন্তু ডকুমেন্টগুলো প্যারিস থেকে চেয়ে পাঠানো হয়েছে। ডকুমেন্টগুলো প্যারিসে গেলেই পত্রিকায় এসে যাবে। পুলিশ প্রধান যে ধরনের লোক, আমি কোন কথা-ই তাকে মানাতে পারবো না। যে টুকু পত্রিকায় এসেছে, তাতেই আমাদের বাইরে বেরুবার উপায় নেই। এর পর ডকুমেন্টের সব কথা যদি পত্রিকায় আসে তাহলে আমরা শেষ হয়ে যাব।’
‘আমর মন কিছুতেই মানছে না মি.ওয়াইজম্যান, একজন লোক একাই এভাবে আপনাদের তুলা ধুনা করল।’ বলল অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল।
‘আমাদের কথা আর কি বলব। আপনি জানেন, বলতে গেলে আহমদ মুসার একার হাতেই ইহুদীবাদের গর্ব জেনারেল শ্যারণ তার দলবল সহ শেষ হয়ে গেল। গোটা ইহুদীবাদই আজ মহা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে অধ্যাপক ডেভিড। যে কোন ভাবে ডকুমেন্টগুলোর প্রেসে যাওয়া আটকাতে হবে।’ আজর ওয়াইজম্যান বলল।
‘আমাকে কি করতে হবে বলুন।’ অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘জনাব প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সম্মানিত প্রফেসর এমিরেটাস আপনি। তার উপর প্রেসিডেন্ট আপনার ব্যাক্তিগত বন্ধু। এই সুযোগ আপনাকে কাজে লাগাবার অনুরোধ করছি।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘প্রেসিডেন্টকে আমি কি বলব? অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘ডকুমেন্টগুলো ভূয়া বলে গোটা বিষয়টাই ধামা চাপা দিতে হবে। বলতে হবে যে, মুসলিম মৌলবাদীরা ইহুদীদের ফাঁসাবার জন্য এই ভূয়া ডকুমেন্ট সাজিয়েছে।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কিন্তু মি.ওয়াইজম্যান, এটুকু করলেই আপনার বিপদ কেটে যাবে। মূল বিপদ তো বলছেন আহমদ মুসা। তার কি করবেন! এত কিছু পারছেন, ফরাসী পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাকে পথ থেকে সরাতে পারছেন না? অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘সেখানেও এক বিপদ আছে। ফরাসী রাজকুমারীকে আহমদ মুসা বিয়ে করার পর ফরাসী পুলিশের কাছে সে অনেকটা আপন হয়ে গেছে। তার উপর আমেরিকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে ফরাসী পুলিশের কাছে আহমদ মুসার ইমেজ অনেক অনেক বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় ফরাসী পুলিশের কাউকে কাউকে তার বিরুদ্ধে পাওয়া যাবে, সবাইকে পাওয়া যাবে না।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
‘কিন্তু এই যে বললেন, পুলিশ স্ট্রাসবার্গে কোথাও আহমদ মুসাকে দেখতে পেলে ধরে তাকে আপনাদের হাতে তুলে দেবে। সেটা কিভাবে? অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল বলল।
‘স্ট্রাসবার্গের পুলিশের কাছে আহমদ মুসার পরিচয় আহমদ আবদুল্লাহ হিসাবে। তারা আহমদ আবদুল্লাহকে আমাদের হাতে তুলে দেবে, আহমদ মুসাকে নয়।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান।
অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল কিছু বলতে যাচ্ছিল। আজর ওয়াইজম্যানের মোবাইলটি বেজে উঠল।
থেমে গেল অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েল।
‘মাফ করুন’ বলল আজর ওয়াইজম্যান টেলিফোন ধরল।
ওপারের কথা শুনেই ভ্রু কুঁচকে উঠল আজর ওয়াইজম্যানের। বলল দ্রুত কন্ঠে, ‘তোমার দু’জন বাড়ির সামনে পাহারায় থাক আমি লোকজন নিয়ে আসছি।
বলে মোবাইল অফ করে দিয়ে আজর ওয়াইজম্যান অধ্যাপক ডেভিডের উদ্দেশ্যে দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘অধ্যাপক ডেভিড আহমদ মুসার সন্ধান পাওয়া গেছে। একটা বাড়িতে সে আরও দু’জনকে সাথে নিয়ে থাকে। আমাদের দু’জন লোক বাড়িটার সামনে পাহারায় আছে।
লোকজন নিয়ে আমি ওখানেই যাচ্ছি। পরে আবার কথা বলব আপনার সংগে।’ বলে অধ্যাপক ডেভিড দানিয়েলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল আজর ওয়াইজম্যান।
চারজন লোক নিয়ে ছুটল সে আহমদ মুসার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কিন্তু আজর ওয়াইজম্যান যখন তার লোকজন নিয়ে আহমদ মুসার আটতলায় গিয়ে পৌছল, তার বেশ কিছু আগে আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে নিয়ে আটলান্টিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এমিরিটাস জ্যাক সাইমনের সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে গেছে। আর তখন ফাতিমা এবং যায়েদ ও বাসা থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে এগুচ্ছিল। এই সময় তারা দেখল লিফঠ থেকে বেরিয়ে তাদের ফলাটের দিকে এগুচ্ছে ক’জন লোক। এটা দেখে ফাতিমা এবং যায়েদ দুজনে একটা আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ব্যাপার কি তা দেখার জন্যে। ওরা পাঁচজন যখন ফাতিমাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সে সময় ওদের একজনের মোবাইল বেজে উঠল। লোকটি মোবাইল তুলে নিয়ে চাপা কন্ঠে বলল, ‘ইয়েস, আজর ওয়াইজম্যান।’
লোকটা ওপারের কথা শুনল। শুনেই গা ঝাড়া দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়াল। উত্তেজনা ঠিকরে পড়তে লাগল তার চোখ মুখ থেকে। অনেকটা স্বাগতঃই বলে উঠল লোকটা, ‘আমরা আহমদ মুসার তালাশে এসেছি তার বাড়িতে, আর আহমদ মুসা গিয়ে বসে আছে আমাদের হাতের মুঠোর মধ্য। চল সকলে।
তারা পাঁচজন আবার লিফটে গিয়ে উঠল।
চলে গেল তারা।
আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল ফাতিমা ও যায়েদ।
দু’জনেরই চোখ মুখ শুকনো।
চোখ-মুখে তাদের উদ্বেগ।
আজর ওয়াইজম্যান স্বাগতোক্তিতে যা বলেছে তা শুনতে পেয়েছে ফাতিমা ও যায়েদ দুজনেই।
দু’জন কারো মুখে কোন কথা নেই। অবশেষে নিরবতা ভাঙল ফাতিমা। বলল, ‘আহমদ মুসা ভাইয়ারা আজর ওয়াইজম্যনদের হাতের মুঠোয় যাবেন কি করে? ওরা তো গেলেন অধ্যপক সাইমনের সাথে দেখা করতে। তাহলে কি বুমেদীন বিল্লাহ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?
আহমদ মুসা ভাইকে অন্য কোথাও নিয়ে তুলছে? থামল ফাতিমা।
আতংক ফুটে উঠল যায়েদের চেখে-মুখে। বলল, ‘আমারও এই রকমই সন্দেহ হচ্ছে।
ফাতিমা স্থির দাঁড়িয়েছিল। নড়ে উঠল। চলতে শুরু করল ফ্ল্যাটের দরজার দিকে। বলল, এস যায়েদ, নোট বুকে অধ্যাপক জ্যাক সাইমনের ঠিকানা লেখা আছে।’
যায়েদ ফতিমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘অধ্যপক জ্যাক সাইমনের ঠিকানা দিয়ে কি করবে?
‘কিছু একটা তো করতে হবে আগে জ্যাক সাইমনের ঠিকানা তো দেখি!
দরজা খুলে দু’জনেই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল।
৬
গাড়ি থামল বিশাল এক গাড়ি বারান্দায়।
গাড়ি থামতেই উর্দীপরা একজন যুবক বারান্দা থেকে দ্রুত নেমে এল। এসে গাড়ির দরজা খুলে সামনে বসা বুমেদীন বিল্লাহকে লক্ষ্য করে বলল, স্যার আপনি নিশ্চয় মিঃ বিল্লাহ। স্যার আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ওয়েলকাম।’
বুমেদীন বিল্লাহ গাড়ি থেকে নেমে ‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
আহমদ মুসাও গাড়ি থেকে নেমেছে।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে বুমেদীন বিল্লাহ ও এ্যাটেনড্যান্টের দিকে চাইতেই গাড়ির বারান্দার উপরে বারান্দায় উঠার সিঁড়ির পাশেই দেয়া সুন্দর একটি নেম প্লেট আহমদ মুসার নজরে পড়ল।
নেমপ্লেটটিতে সাদা পটভুমির উপর সুন্দর সাদাটে নীল কালিতে লেখা প্রফেসর (এমিরিটাস) জ্যাক সাইমন। নেমপ্লেটের সাদা পটভূমির উপর ও নীচের গোটা অংশ সাদাটে নীল।
আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরে বুমেদীন বিল্লাহর পাশে এসে একসাথে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
আগে চলছিল এ্যাটেনড্যান্ট।
হাঁটতে হাঁটতে আহমদ মুসা বুমেদীন বিল্লাহকে নেমপ্লেটটি দেখিয়ে বলল, ‘নামটা তুলে নিয়ে যদি ওখানে নীল রংয়ের নামের বদলে যদি নীল ছয় কোণা তারকা বসানো যায়, তাহলে ওটা কি হয় বলুন তো?
মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে নেমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করে বল, ‘বলতে পারলাম না। এ রকম কোন জিনিসের কথা আমার মনে পড়ছে না।’
‘ইসরাইল রাষ্ট্রের পতাকা। এখন মিলিয়ে দেখুন।’
মনে করার একটু চেষ্টা করে বুমেদীন বিল্লাহ বলল, ‘পতাকা দেখেছি, কিন্তু এখন স্মৃতিতে আনতে পারছি না। কিন্তু আহমদ আবদুল্লাহ সুদুরের দুই বিষয়কে এভাবে মিলানোর কথা আপনার মনে পড়ল কি করে?
‘কালার এবং তার সেট আপ ও আকার দেখে মনে হলো।’ বলল আহমদ মুসা।
আবার চলতে শুরু করছে দু’জন।
ভেতরে ঢুকে একটা কক্ষ পেরিয়ে একটা দরজার সামনে এ্যাটেনন্ড্যান্ট থমকে দাঁড়াল। আহমদ মুসারাও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এ্যাটেনন্ড্যান্ট লোকটি বন্ধ দরজায় কয়েকবার নক করল। ভেতর থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এ, ‘ইয়েস’।
এ্যাটেনন্ড্যান্ট বলল, ‘স্যার আপনারা যান।’
দরজা ঠেলে আহমদ মুসা ও বুমেদীন বিল্লাহ ঘরে প্রবেশ করল।
তারা দেখল, প্রৌঢ় দীর্ঘদেহী ভারী চশমাওয়ালা সোনালী সাদা রংয়ের একজন লোক দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
আহমদ মুসারা ঢুকতেই লোকটি উঠে দাঁড়ল এবং কয়েক ধাপ এগিয়ে এল। ‘ওয়েলকাম’ বলে আহমদ মুসার সাথে হাত মেলাল।
বুমেদীন বিল্লাহ নিজের পরিচয় দিয়ে আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বলল,
‘আমার বন্ধু। নাম আলী আবদুল্লাহ। সমুদ্র ভ্রমনের নেশা। ইদানিং তিনি সমুদ্রের উপর কুইজ তৈরী করছেন।’
আহমদ মুসার এই নাম ও পরিচয় আগেই ঠিক করে রেখেছিল বুমেদীন বিল্লাহ। তার যুক্তি ছিল রাইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে দু’জন লোক নিহত হওয়ার ঘটনার পর ‘আহমদ আবদুল্লাহ’ নামটি পত্র-পত্রিকায় এসেছে। এ নাম প্রফেসর জ্যাক সাইমন ও পত্র-পত্রিকায় দেখতে পারেন। সুতরাং নামটি কোন বিপত্তির সৃষ্টি করতে পারে। আহমদ মুসা ও বুমেদীন বিল্লাহর এ চিন্তাকে ওয়েলকাম করেছিল।
‘ওয়েলকাম টু বোথ’ বলে প্রফেসর জ্যাক সাইমন বাম পাশের দুটি সোফার দিকে ইংগিত করে বসতে বলল এবং নিজেও ফিরল সোফায় বসার জন্য।
আহমদ মুসা ও বুমেদীন বিল্লাহ সোফায় বসল।
ঘরটি বৃত্তাকার। ঘরের চারদিকে বৃত্তাকার করেই সোফা সাজানো।
বৃত্তের মাঝখানটা ফাঁকা।
বসার পর প্রফেসর জ্যাক সাইমন আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি সমুদ্রকে ভালবাসেন জেনে খুশি হয়েছি। সমুদ্রকে আমিও ভালবাসি। তবে বেশি ভালবাসি আটলান্টিককে।’
‘ধন্যবাদ। বলুন কি করতে পারি আপনার জন্যে।’ প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল।
‘স্যার জার্মানীর এক কুইজ ফার্ম থেকে কিছু কুইজ পেয়েছি, সেগুলো আমি কাজে লাগাতে চাই। কিন্তু একটা আইল্যান্ডের কোন ট্রেস করতে পারছি না। বুমেদীন বিল্লাহ বলল, এর সমাধান শুধু আপনার কাছেই পাওয়া যেতে পারে। বলল আহমদ মুসা।
‘আইল্যান্ডের ছবি আছে। এর নাম, অবস্থান ও কোন রাষ্ট্রের অংশ, এটা বলে দিতে হবে তো? প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল।
‘জি স্যার।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘দাও ছবিটা। প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল।
‘ছবি নয় আকার বোঝা যায় এমন একটা স্কেচ আছে।’ বলে আহমদ মুসা স্কেচটা প্রফেসর সাইমনের হাতে তুলে দিল।
স্কেচটি হাতে নিল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
চোখের সামনে তুলে ধরল স্কেচটি।
দেখতে লাগল সে দ্বীপটাকে।
ধীরে ধীরে ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠল তার। বিস্ময়, সেই সাথে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল তার চোখ-মুখে। এক সময় এক চোরা দৃষ্টিতে তাকাল সে আহমদ মুসার দিকে। তারপর হঠাৎ সহজ হয়ে উঠে প্রশ্ন করল, ‘দিকের চিহ্নটা কি ঠিক আছে দ্বীপের ?
‘জি হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দ্বীপ সম্পর্কে আপনারা কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন? প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল।
‘না, পারিনি।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলে উঠল, ‘দ্বীপটার সাইজ এ্যাভারেজ ক্যারেক্টরের। এক দৃষ্টিতে চিহ্নিত করা মুস্কিল।
আপনারা একটু বসুন। আমার কম্পিউটারের ইনডেক্স ও ক্যাটালগ একটু কনসাল্ট করে আসি। আপনারা গল্প করুন। চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
বলে উঠে ভেতরে চলে গেল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
প্রফেসর জ্যাক সাইমন চলে যাবার পর বুমেদীন বিল্লাহ আহমদ মুসাকে ফিস ফিস করে বলল, ‘কি মনে করছেন , দ্বীপটাকে উনি কি চিহ্নিত করতে পারবেন?
‘মি. বুমেদীন বিল্লাহ আমার চোখ যদি ভুল না দেখে থাকে তাহলে আমি বলব তিনি দ্বীপটাকে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করেছন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কি করে বুঝলেন? জিজ্ঞেস করল বুমেদীন বিল্লাহ।
‘আমার দিকে চেয়ে যখন তিনি কথা বলছিলেন, তখন তার চোখ-মুখের ভাব দেখে আমি এটা বুঝেছি। না চিনতে পারলে যে অবস্থা, যে চেহারা মানুষের হয়, সেটা তাঁর মধ্যে আমি দেখলাম না। যখন তিনি ইনডেক্স ও ক্যটালগ দেখার কথা বললেন, তখনও কথায় অন্তরের কোন স্পর্শ ছিল না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘চিনতে পারলে তা গোপন করবেন কেন? কম্পিউটারে ইনডেক্স ও ক্যাটালগ কনসাল্ট করার কথাইবা বলবেন কেন? বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘আমার কথাটা চুড়ান্ত নয় মিঃ বিল্লাহ। ওটা আমার একটা ধারনা। হতে পারে প্রফেসর জ্যাক সাইমন এমন এক ধরনের মানুষ যার মনের ভাবটা চোখ-মুখে ফুটে উঠতে পারে না এবং চোখ-মুখের ভাব মনের কথা বলে না। এ ধরনের শক্ত মনের ব্যতিক্রমী ব্যাক্তিত্ব দুনিয়াতে অনেক আছে। প্রফেসর জ্যাক সাইমন হতে পারেন তাদেরই একজন। বলল আহমদ মুসা।
চা এসে গিয়েছিল। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল বুমেদীন বিল্লাহ, দ্বীপের সন্ধান পেলে কি করবেন মিঃ আহমদ আবদুল্লাহ?
‘দ্বীপ সম্পর্কে খোজ খবর নিতে হবে। তার পর প্রয়োজনে দ্বীপে যেতে হবে, যদি স্পুটনিকের লোকেরা সেখানে আটক থাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থ্রিলের প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়েছে। মনে হচ্ছে কি জানেন, এ ধরনের অভিযানে আমি আপনার সংগী হই।’ বুমেদীন বিল্লাহ বলল।
‘তাহলে সাংবাদিকতার কি হবে? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘এ ধরনের অভিযানে সাংবাদিকতা বাধা হবে কেন? যুদ্ধে কি সাংবাদিকরা শরীক হয় না? বলল বুমেদীন বিল্লাহ। আহমদ মুসা হাসল। বলল ‘আসলে কি জানেন, আপনি আপনাকে চিনতে পারেন নি, দুই ঐতিহাসিক রক্তের ধারা আপনার শরীরে। একটি ধারা এসেছে আলজেরিয়ার বিপ্লবী নেতা আহমদ বেন বেল্লাহর কাছ থেকে। এ সেই মহান বেন বেল্লাহ যিনি ১৯৫৪ সালে ফরাসী ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার জনগণের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়ে ছিলেন। আরেকটি রক্তের ধারা হুয়ারি বুমেদীনের দিক থেকে। তিনিও আলজেরিয়ার একজন স্বাধীন সংগ্রামী এবং আলজেরিয়ার দীর্ঘকালীন প্রেসিডেন্ট। এই দুই রক্ত আপনাকে একটা স্বভাব সংগ্রামী মানসিকতা দিয়েছে। আপনার সাংবাদিকতা আপনার এই স্বভাব সংগ্রামেরই অংশ। এখন আবার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পরিবেশ দেখে আপনার মন তার সাথেও শামিল হতে চাচ্ছে।’ থামল আহমদ মুসা।
বিস্ময় দৃষ্টিতে বুমেদীন বিল্লাহ অপলক তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা থামলে আরও কয়েক মুহুর্ত সময় নিয়ে বুমেদীন বিল্লাহ ধীরে ধীরে বলল, ‘আপনি কে জানি না। কিন্তু মনে হয় আপনি আর এক আহমদ বেন বেল্লাহ হবেন, যিনি মানুষকে জাগাতে, তাকে সংগ্রামী বানাতে পারেন। এখন সত্যিই আমার নিজেকে নতুন পরিচয়ের নতুন মানুষ মনে হচ্ছে। আমি কখনই বেন বেল্লাহ কিংবা বুমেদীনকে আমার মডেল ভাবতে পারিনি, বরং ঘৃনা করেছি তাদের রাজনীতিকে। অথচ এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে, আহমদ বেন বেল্লাহ ও বুমেদীনের আরেকটা পরিচয় ছিল। সেটা বিপ্লবীর পরিচয়। এই পরিচয় আমার জন্য মডেল হতে পারে এবং এটা সময়েরও প্রয়োজন। আপনাকে…………।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল বুমেদীন বিল্লাহ। কিন্তু এ সময় ড্রয়িং রুমে ফিরে এলেন প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
তার সোফায় বসতে বসতে প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল, ‘স্যরি, অনেক্ষণ আপনাদের বসিয়ে রেখেছি। ‘
‘স্যরি স্যার। আমাদেরই তো দুঃখ প্রকাশ করা দরকার। আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি আমরা।’ বলল বুমেদীন বিল্লাহ।
আমাদের জন্যে কোন সুখবর আছে স্যার ?’ আহমদ মুসা বলল।
‘অবশ্যই ইয়ংম্যান।’ বলে একটু থামল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
তারপর ধীরে ধীরে আবার শুরু করল, ‘কুইজের উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ দিতে হয় মি. আলী আবদুল্লাহ। এ দ্বীপের সন্ধান তারা পেল কি করে ?
কোন মানচিত্র, এমনকি স্যাটালাইট চিত্রেও এ দ্বীপের কোন আকার স্পষ্ট নয়। কিন্তু আপনার স্কেচে দ্বীপটির নিখুঁত আকার এল কি করে?
কথা শেষ করতেই প্রফেসর জ্যাক সাইমনের মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে নিয়ে প্রফেসর জ্যাক সাইমন বলল, ‘ইয়েস সাইমন স্পিকিং।’
ওপারের কথা শুনে বলল, ‘ইয়েস।’ OK, বলে মোবাইল রেখে দিল।
মোবাইল রেখে দিয়েই প্রফেসর জ্যাক সাইমন তার পূর্ব কথার রেশ ধরে বলে উঠল , হ্যাঁ মি. আলী আবদুল্লাহ , কুইজ উদ্যোক্তারা এ দ্বীপের এই নিখুঁত মাপটা পেল কোথায়?’
ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। একটু ভাবল আহমদ মুসা। প্রফেসার জ্যাক সাইমনের এ জিজ্ঞাসার মধ্যে বিদ্রুপ ও অভিযুক্ত করার মানসিকতা রয়েছে। তার চোখে-মুখেও একটা অযৌক্তিক কাঠিন্য।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে বলল, ‘কোন অভিযাত্রি, কোন গ্রন্থ অথবা সরকারী কোন সূত্র থেকেও পেতে পারে।’
প্রফেসর জ্যাক সাইমন আহমদ মুসারা যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিল সেই দরজার দিকে তাকিয়েছিল। তার ঠোটে ফুটে উঠেছে এক টুকরো শক্ত হাসি। আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই প্রফেসর বলে উঠল,
‘কেন কোন তিন তলার কম্পিউটার থেকে পেতে পারে না?
প্রফেসর জ্যাক সাইমনের কথা শেষ হবার আগেই আহমদ মুসা যেন এক ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে উঠল। কখন তার ডান হাত কোটের পকেটে চলে গিয়েছিল। বের হয়ে এল রিভলবার। রিভলবারটি উঠল প্রফেসর জ্যাক সাইমনের মাথা লক্ষ্যে। সেই সাথে আহমদ মুসার কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এল, ‘দেরী হয়ে গেছে, নেম প্লেটটা দেখেই আমার সব কিছু বুঝা উচিত ছিল।’
হঠাৎ হো হো হাসির শব্দ এল ড্রইংরুমের সামনের দরজার দিক থেকে।
তাকাল আহমদ মুসা সেদিকে। দেখল, চারটি ষ্টেনগান ও একটি রিভলবার তাদের দিকে তাক করা। হো হো করা কন্ঠটি আজর ওয়াইজম্যানের। হাসির সাথে সাথেই সে বলে উঠল, ‘সত্যিই দেরী হয়ে গেছে আহমদ মুসা। আর তোমার করার কিছুই নেই।’
বলে সে প্রফেসর জ্যাক সাইমনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘প্রফেসর ডেভিড দানিয়েল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার ঐতিহাসিক টেলিফোনের জন্য। আপনি দয়া করে আহমদ মুসার হাত থেকে রিভলবারটি নিয়ে নিন।’
প্রফেসর জ্যাক সাইমন উঠে এসে আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে রিভলবার কেড়ে নিল।
‘প্রফেসর জ্যাক সাইমন আপনার ইহুদী নাম দেখছি ডেভিড দানিয়েল। নাম কবে পাল্টেছেন? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘পাল্টাব কেন? ফ্যামিলী নাম হিসাবে এটা সব সময় চালু আছে। পাবলিকলী আমি জ্যাক সাইমন।’
‘মি. জ্যাক সাইমন আপনার মত লোক যে ছব্দবেশী হবেন এটা বিশ্বাস করতে মন চায়নি। তাই রিভলবার বের করতে অনেক দেরী হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কেন আমাকে সন্দেহ করেছিলে নাকি? জিজ্ঞেস করল জ্যাক সাইমন।
‘অবশ্যই। আপনার নেমপ্লেটটা তো একটা ইসরাইলি পতাকা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাও তুমি ধরে ফেলেছ? তুমি সত্যিই অদ্বিতীয় আহমদ মুসা।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
প্রফেসর জ্যাক সাইমন থামতেই আজর ওয়াইজম্যান বলে উঠল, ‘প্রফেসর ডেভিড দানিয়েল আহমদ মুসার এই কথা বলা কিন্তু একটা কৌশল। শৃগালের মত ধূর্ত, আর সাপের মত বিষাক্ত এই লোক মিঃ প্রফেসর। আপনি দূরে থাকুন।
বলেই আজর ওয়াইজম্যান চোখ ফেরাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘তোমরা দু’জন মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড় আহমদ মুসা। আমি কিন্তু দু’বার নির্দেশ দেব না এবং তোমাকে এক মূহুর্ত বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছাও আমার নেই।
আহমদ মুসা তাকাল বুমেদীন বিল্লাহর দিকে। দেখল বুমেদীন বিল্লাহর চোখ ভরা একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা তার দিকে চাইতে সে বলে উঠল, ‘ওরা যা বলেছে এটাকি ঠিক? আপনি সত্যিই আহমদ মুসা?
‘হ্যাঁ ভাই।’ বলে একটু থামল। তারপর হেসে বলল, ‘আসুন মিঃ ওয়াইজম্যানের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।’
আহমদ মুসা সোফা থেকে উঠল এবং এগুলো মেঝের মাঝখানটার দিকে।
বুমেদীন বিল্লাহও আহমদ মুসার পেছনে।
আহমদ মুসা পূর্ব দিকে মাথা দিয়ে উপুর হয়ে কার্পেটের উপর শুয়ে পড়ল। বুমেদীন বিল্লাহ আহমদ মুসার বাম পাশে একইভাবে শুয়ে পড়ল।
‘বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান’ বুঝলে আহমদ মুসা। দু’বার তোমার ভাগ্য সহায় হয়েছে, খাঁচা কেটে পালাতে পেরেছ। এবার তোমাকে মরতে হবে, তবে তার আগে তোমাকে একটু নাচাতে চাই।’ বলল আজর ওয়াইজম্যান আহমদ মুসাকে লক্ষ করে।
কথা শেষ করেই আজর ওয়াইজম্যান একজন ষ্টেনগানধারীর দিকে একটা প্যাকিং টেপের বান্ডিল ছুড়ে দিয়ে নির্দেশ দিল ওদের পিছ মোড়া করে বেঁধে ফেল।
নির্দেশ দিয়ে আজর ওয়াইজম্যান প্রফেসর ডেভিড দানিয়েলকে লক্ষ্য করে বলল, মিঃ ডেভিড দানিয়েল, আসুন পাশের ঘরে একটু কথা বলি।’
আজর ওয়াইজম্যান ও প্রফেসর ডেভিড দানিয়েল পাশের ঘরে চলে গেল।
একজন ষ্টেনগানধারী এক হাতে ষ্টেনগান অন্য হাতে টেপ নিয়ে এগুলো প্রথমে আহমদ মুসার দিকে।
সে আহমদ মুসার পেছন দিক দিয়ে গিয়ে তার উপর চেপে বসে তাকে পিছমোড়া করে বাঁধতে চাইল।
আহমদ মুসা দু’পা এবং দু’হাত ছড়িয়ে শুয়ে ছিল।
ষ্টেনগানধারী লোকটি আহমদ মুসার দু’পায়ের মাঝখান দিয়ে এগুলো তার পিঠের দিকে।
লোকটি যখন আহমদ মুসার নিতম্বের কাছাকাছি এসে পৌছেছে, তখন আহমদ মুসার দুই পা তীব্র বেগে উঠে এসে লোকটির দুই হাঁটুর উপর আঘাত করল। আকস্মিক এই আঘাতে লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল আহমদ মুসার উপর। আর তার ষ্টেনগানটি গিয়ে পড়ল আহমদ মুসার পাশে একেবারে তার ডান হাতের উপর।
আহমদ মুসা এক মুহুর্তও সময় নষ্ট করেনি। লোকটি আহমদ মুসার উপর পড়ে যাবার আগেই আহমদ মুসা পাশ ফিরে তার বাম হাত ঘুরিয়ে নিয়েছিল ডান হাতের কাছে। ষ্টেনগান ডান হাতের উপর পড়ার সাথে সাথেই আহমদ মুসার দুই হাত ষ্টেনগান নিয়ে তাক করল তিন ষ্টেনগানধারীকে। শুয়ে থেকেই আহমদ মুসা ট্রিগার চাপল।
তিনজন ষ্টেনগানধারী ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তার উপর তাদের সহযোগী লোকটি আহমদ মুসার উপর গিয়ে পড়ায় তারা দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল।
ফলে অসহায়ভাবে তারা আহমদ মুসার গুলী বৃাষ্টর শিকার হলো। মূহুর্তেই তিনজনের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ ঝরে পড়ল মেঝের উপর।
এদিকে আহমদ মুসা উপর পড়ে যাওয়া লোকটি প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ঘটনা বুঝে উঠেই সক্রিয় হয়ে উঠল। আহমদ মুসা যখন গুলী করছিল, তখন লোকটির দু’হাত সাঁড়াশীর মত আহমদ মুসার গলা লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা যখন তিনজন ষ্টেনগানধারীকে ভূপাতিত করে তার ষ্টেনগানের ব্যারেল নীচে নামাল, তখন লোকটির দুই হাত সাঁড়াশীর মত চেপে বসেছে আহমদ মুসার গলায়।
প্রতিরক্ষার জন্য আহমদ মুসা ষ্টেনগানকেই ব্যাবহার করল।
দু’হাতে ধরা ষ্টেনগানের বাট দিয়ে প্রচন্ড গুঁতা মারল আহমদ মুসা লোকটির মাথায় এবং সাথে সাথেই আহমদ মুসা মোচড় দিয়ে দেহটাকে ঘুরিয়ে নিল।
মাথায় আঘাত পেয়ে লোকটার দুই হাত আহমদ মুসার গলা থেকে আলগা হয়ে পড়েছিল এবং দেহটাও শিথিল হয়ে পড়েছিল।
আহমদ মুসার দেহের ধাক্কায় সে পাশে গড়িয়ে পড়ল। লোকটি তখন গলা ছেড়ে দিয়ে ষ্টেনগান ধরার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। আহমদ মুসা ততক্ষণে তার ষ্টেনগান ঘুরিয়ে নিয়েছে। আহমদ মুসা ট্রিগার চেপে ধরল ষ্টেনগানের ব্যারেল তার পাঁজরে ঠেকিয়ে।
লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়া এবং আহমদ মুসা ট্রিগার চাপা এক সাথেই হয়েছিল। এক ঝাঁক গুলীর তোড়ে লোকটার দেহ একটা রক্তাক্ত মাংসপিন্ডে পরিনত হলো।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াচ্ছিল। এই সময় চিৎকার করে উঠল বুমেদীন বিল্লাহ, মিঃ আহমদ মুসা গুলী……….।’
ভীত, আতংকিত বুমেদীন বিল্লাহ তখনও গুলী গোলার মধ্যে উঠে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। শুয়ে থেকেই চারদিকটা সে দেখার চেষ্টা করছিল।
বুমেদীন বিল্লাহর চিৎকার করে উঠার সংগে সংগেই আহমদ মুসা নিজের দেহ পেছনের দিকে ছুঁড়ে দিল। তার উপর দিয়ে একটা বুলেট শাঁ করে চলে গিয়ে দেয়ালে বিদ্ধ হলো।
আহমদ মুসা মাটিতে আছড়ে পড়লেও ষ্টেনগান তার হাত থেকে পড়েনি এবং তার আঙুল ট্রিগার থেকে সরেনি।
যে দিক থেকে গুলী এসেছে, তার বিপরিত দিকে পড়েছে আহমদ মুসার মাথা। ফলে সে মেঝেতে শুয়ে পড়লে তার চোখ গিয়ে পড়েছে দরজাটির উপর যেখানে আজর ওয়াইজম্যান গুলী করেছে।
আহমদ মুসা শুয়ে পড়েই ট্রিগার টিপেছে তার ষ্টেনগানের। এক ঝাঁক গুলী ছুটে গেল দরজার উপর।
আজর ওয়াইজম্যান টার্গেট ঠিক করে দ্বিতীয় গুলী করার আর সুযোগ পেল না। আহমদ মুসা দেখতে পেল তার দেহটা একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠে দরজার আড়ালে ছুটে গেল। আহমদ মুসার মনে হলো আহত হয়েছে আজর ওয়াইজম্যান।
শোয়া অবস্থা থেকে আহমদ মুসা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল এবং ছুটল দরজার দিকে।
আহমদ মুসা দরজার ওপারে রক্তের ফোটা ফোটা দাগ দেখতে পেল। রক্তের দাগ অনুসরণ করে ছুটল।
বাইরের বারন্দায় বেরিয়ে দেখল একটা গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে গেট দিয়ে।
আহমদ মুসা ফিরতে যাচ্ছিল এ সময় একটা থামের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এল ফাতিমা ও যায়েদ। বেরিয়েই রক্তে ভেজা আহমদ মুসার দিকে আতংকিত চোখে ফাতিমা বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন ভাইয়া? কাঁধ চেপে ধরে একজন এদিক দিয়ে পালাল।’
‘ভাল আছি। তোমরা এস।’ বলে আহমদ মুসা ছুটল ভেতরে। প্রফেসার জ্যাক সাইমনকে পেতে হবে, ধরতে হবে তাকে।
আহমদ মুসা চারটি লাশ পড়ে থাকা রক্তাক্ত হল রুমটিতে প্রবেশ করতেই সামনের দরজার দিক থেকে, যে দরজা দিয়ে প্রফেসার জ্যাক সাইমন ওরফে ডেভিড দানিয়েল দ্বীপের ইনডেক্স ও ক্যাটালগ দেখার জন্য ভেতরে গিয়েছিল, বুমেদীন বিল্লাহর চিৎকার ভেসে এল মিঃ আহমদ মুসা প্রফেসর জ্যাক সাইমন পালাচ্ছিল ধরে ফেলেছি।’
বলতে বলতে বুমেদীন বিল্লাহ প্রফেসর জ্যাক সাইমনকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে দরজা দিয়ে হল রুমে প্রবেশ করল এবং বলল, ‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে এই প্রফেসরই টেলিফোন করে এই কিলারদের ডেকে এনেছে।’
‘আপনি ঠিক অনুমান করেছেন মি. বিল্লাহ। দ্বীপের ইনন্ডেক্স ও ক্যাটালগ দেখার ভান করে ইনি আজর ওয়াইজম্যানদের টেলিফোন করার জন্যই ভেতরে গিয়েছিলেন। আধা ঘন্টার ও বেশি ভেতরে দেরী করেছিলেন তাদের আসার সুযোগ দেয়ার জন্য। একে পাকড়াও করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ মিঃ বিল্লাহ।’ বলল আহমদ মুসা।
বুমেদীন বিল্লাহ প্রফেসর জ্যাক সাইমনকে সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে আকস্মিকভাবে আহমদ মুসার সামনে ঝুঁকে পড়ে আহমদ মুসার দু’পায়ে দুই হাত দিয়ে বলল, আপনার পদধুলি গ্রহন করলাম দুই আনন্দে। একটি আ্নন্দ হলো কিংবদন্তী নায়ক আহমদ মুসাকে দেখলাম। অন্যটি হলো, তাঁর সাথে একটা অভিযানে শরিক হওয়ার আনন্দ।’
বলতে বলতে উঠে দঁড়িয়ে বিস্ময় বিমূঢ়তায় স্তব্ধ ফাতিমাদের লক্ষ্য করে বলল, মিঃ যায়েদ ও মিসেস ফাতিমা আসুন পদধুলি নিন, জানেন ইনি কে?
‘আগেই পদধুলি নিয়েছি আমরা।’ বলল যায়েদ।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছি বুমেদীন বিল্লাহ। আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, মিঃ বিল্লাহ অনেক কাজ বাকি। প্রফেসর জ্যাক সাইমন আমাদের কতটা সময় নেবে কে জানে!’
বলেই আহমদ মুসা তাকাল ফাতিমার দিকে। বলল, ‘তোমরা কি বাইরে থেকে গুলীর আওয়াজ পেয়েছ?
‘গুলীর শব্দ বলে বুঝিনি। তবে এক ধরনের শব্দ পেয়েছি। আহত আজর ওয়াইজম্যানকে পালাতে দেখে বুঝলাম ওগুলো গুলীর শব্দ ছিল।’ বলল যায়েদ।
‘ঘরগুলো ভাল শব্দ প্রুফ। নিশ্চয় বাড়ির বাইরে কোন শব্দ যায়নি। ‘আহমদ মুসা বলল। তার মুখে খুশি হওয়ার চিহ্ন।
কথাটা বলেই আহমদ মুসা ফিরল প্রফেসর জ্যাক সাইমনের দিকে।
প্রফেসর জ্যাক সাইমন জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসে ছিল।
আহমদ মুসা তার কাছাকাছি হয়ে বলল, ‘প্রফেসর জ্যাক সাইমন আপনি নাম ভাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করেছে?
‘নাম ভাঁড়িয়ে নয়। আমার সার্টিফিকেট নামই জ্যাক সাইমন।’ শুস্ক কন্ঠে বলল জ্যাক সাইমন।
‘কিন্তু আপনার আসল নাম তো ডেভিড দানিয়েল।’ আহমদ মুসা বলল।
কথা বলল না প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘খৃস্টান সেজে সারা জীবন গোপনে ইহুদীদের পক্ষে কাজ করে এসেছেন, এভাবে প্রতারণা করেছেন জনগনের সাথে।’ বলল আহমদ মুসা।
মুখ খুলল না প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘স্পুটনিক ধ্বংস করা, স্পুটনিকের লোকদের কিডন্যাপ করার সাথে আপনি জড়িত।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার কন্ঠ কঠোর।
মুখ নিচু করে ছিল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। চমকে উঠে মুখ তুলল সে। আর্তকন্ঠে বলে উঠল, ‘না আমি এর সাথে জড়িত নয়। আমি পরে জানতে পেরেছি।’
‘আপনার একথা ঠিক নয়। আপনি জড়িত না থাকলে, পরে জানতে পারলে পুলিশকে আপনি এ বিষয় জানান নি কেন? বলল আহমদ মুসা।
কথা বলল না প্রফেসর জ্যাক সাইমন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে।
‘আমি একজন সাংবাদিক নিয়ে স্পুটনিক ধবংস- ঘটনার অনুসন্ধানের ব্যাপারে একটা তথ্য নিতে আপনার কাছে এসেছিলাম, আপনি আমাদের খুন করার জন্যে টেলিফোন করে ক্রিমিনালদের এনেছেন।
‘খুন করার জন্যে নয়, আমি তাদের খবর দিয়েছিলাম মাত্র।’ আর্তকন্ঠে কম্পিত গলায় বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘খুন করার জন্যে নয় তাহলে বন্দী করার জন্যে? বলল আহমদ মুসা।
‘তাও নয়। এসব ঘটবে আমি ভাবতে পারিনি।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। কান্নাজড়িত কন্ঠ তার।
‘তাহলে ঘটাল কে? আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা এসব ঘটাবে বুঝিনি।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। তাঁর কন্ঠে কান্না মিশ্রিত অনুনয়ের সুর।
‘তাহলে এই কাজ আপনি সমর্থন করেন না? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘না সমর্থন করি না। ‘কন্ঠে শক্তি এনে বলার চেষ্টা করল প্রফেসার জ্যাক সাইমন।
‘আপনি কি স্পুটনিক ধবংস সমর্থন করেন? স্পুটনিকের ৭ জনকে কিডন্যাপ করা সমর্থন করেন? আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘না সমর্থন করি না।’ দৃঢ় কন্ঠে বলল প্রফেসার জ্যাক সাইমন।
‘তাহলে তাদের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য করা আপনার কর্তব্য নয়? আহমদ মুসা বলল।
মাথা নিচু করল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। কোন উত্তর দিল না।
‘তাহলে ওদের অন্যায়কেই সহযোগিতা করবেন? বলল আহমদ মুসা কঠোর কন্ঠে।
‘ওদের সাহায্য না করলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। ‘বলে কেঁদে উঠল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। একটু থামল। থেমেই আবার বলা শুরু করল, ‘জানেনা ওরা স্বজাতি হলেও শত্রুর চেয়েও বড় শত্রু। ওরা যে সহযোগিতা চাইবে, সে সহযোগিতা না দেয়ার অর্থ মৃত্যুকে আলিংগন করা। আমি একজন ধর্ম প্রান ইহুদী ছিলাম। ইহুদীবাদীদের সমর্থন করতাম না। কিন্তু প্রাণের ভয়ে বাধ্য হয়েছি তাদের সহযোগিতা করতে এবং যখন যা চায় সেই পরিমাণ অর্থ সাহায্যও করতে হয়। আরও জানেন না, ইহুদীরা আজ ইহুদীবাদীদের কেনা গোলাম। ইসরাইল রাষ্ট্রের নাগরিক না হয়েও ইসরাইলের নাগরিকদের চেয়েও দ্বিগুন ট্যাক্স আমাদের দিতে হয় ইসরাইল রাষ্টকে। আমার সামনের যে নেমপ্লেট ওটা ওদের সরবরাহ করা। আমি টাঙাতে বাধ্য হয়েছি। এ রকম বাধ্য লোকের সংখ্যা ওদের লাখ লাখ।
‘আপনার কথা আমি বিশ্বাস করলাম। আমাদেরকে আপনি সাহায্য করুন। আমরা আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেব।’ বলল আহমদ মুসা।
উদ্বেগ ফুটে উঠল প্রফেসর জ্যাক সাইমনের চোখে- মুখে। বলল, ‘কি সাহায্য ?
‘আপাতত আমরা জানতে চাই, ‘সাও তোরাহ দ্বীপটা কোথায়?
প্রফেসর জ্যাক সাইমন কম্পিত কন্ঠে বলল, ‘আপনারা এ বিষয়টা জানলেই ওরা নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, তথ্যটা আমিই আপনাদের দিয়েছি। তখন দুনিয়ার কোথাও গিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। যেখানে যাব সেখানে গিয়েই ওরা আমাকে হত্যা করবে। আর্তকন্ঠে বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘এ ভয় আপনাকে করতে হবে না। এ বাড়িতে থাকা আপনার ঠিক হবে না। আপনি এখন আজর ওয়াইজম্যানকে টেলিফোন করুন। বলুন যে, বাড়ি থেকে আমি পালিয়ে এসেছি। ফ্রান্সের বাইরে চলে যাচ্ছি, আহমদ মুসাদের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাকে কিছু দিন আত্মগোপনে করতে হবে। এই কথা সে জানার পর আপনাকে দোষ দিতে পারবে না কোন মতেই।’ বলল আহমদ মুসা।
প্রফেসর জ্যাক সাইমনের মুখ উজ্জল হয়ে উঠল আনন্দে। কৌশলটি তার খুব পছন্দ হয়েছে বলে মনে হলো। বলল, ‘কিন্তু আমি থাকব কোথায়?
‘প্যারিসেই থাকবেন। আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব। আপনার নিরাপত্তার দিকটা আমাদের লোকেরাই দেখবে। ‘আহমদ মুসা বলল। ‘ধন্যবাদ মিঃ আহমদ মুসা। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ যে, আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছেন। ‘বলে একটু থামল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। তারপর বলল আবার, ‘আমি আপনার অনেক কথা শুনেছি। সাম্প্রতিক আমেরিকার ঘটনাও আমি জানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদীবাদকে নির্মূল করার ব্যাবস্থা আপনি করেছেন। যদি এভাবে গোটা বিশ্বের ইহুদীদেরকে আপনি ইহুদীবাদের অক্টোপাশ থেকে মুক্ত করতে পারতেন, তাহলে তাদের দোয়া আপনি পেতেন।’ আবেগে কন্ঠ ভারী হয়ে উঠেছিল। প্রফেসর জ্যাক সাইমনের।
‘ধন্যবাদ প্রফেসর জ্যাক সাইমন। ইহুদীবাদের পাপই ইহুদীবাদকে ধবংস করবে। কিন্তু আমার একটা ধারনা ছিল, অধিকাংশ ইহুদী ইসরাইল রাষ্ট্রকে সমর্থন করে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এক সময় করত। যতদিন ইসরাইল শান্তি কামনা করেছে, আরবদের উপর হাত তোলেনি ততদিন সব ইহুদীই ইসরাইলকে সমর্থন করেছে। তারা কামনা করেছে আরবরা এবং অন্য সবাই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে শান্তিতে থাকার ব্যাবস্থা করুক। কিন্তু পরে যখন ইসরাইল শক্তি নির্ভর হয়ে উঠল, অন্যের ভূখন্ড দখল করে নিতে শুরু করল এবং ফিলিস্তিনে ইহুদী বসতি বাড়ানোর অব্যাহত প্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে চলল, তখন থেকেই বিশ্বের শান্তিকামী ইহুদীরা বুঝে নিয়েছে শান্তি ইসরাইল ও ইহুদীবাদীদের লক্ষ্য নয় তারা এক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে যা জ্বালিয়ে রাখবে এক অশান্তির আগুন। ধর্মপ্রাণ ইহুদীরা ইসরাইলকে আজ তাদের জন্যে বিপজ্জনক মনে করছে।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
বলে একটা দম নিল। সোফায় একটু হেলান দিল। তারপর বলল, ‘নতুন গুলাগ বা সাও তোরাহ দ্বীপের কথা আপনি জিজ্ঞেস করেছেন।’ দ্বীপটা কোন মানচিত্রে নেই। পর্তুগাল থেকে ৮০০ মাইল পশ্চিমে ৩৮ ডিগ্রী নর্থ ল্যাটিচুডের উপর আটলান্টিকের ‘আজোরস’ দ্বীপপুঞ্জ। এ দ্বীপপুঞ্জ থেকে সোয়া’শ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ক্ষুদ্র ফ্লোরেস দ্বীপপুঞ্জ। ফ্লোরেস দ্বীপপুঞ্জের মাথার উপর ‘করভো’ নামে একাটা দ্বীপ। করভো দ্বীপের ৫ মাইল সোজা উত্তরে ৩০ ডিগ্রী পশ্চিম ল্যাটিচুডের ৫০ মাইল পশ্চিমে ছোট্ট বেনামা নির্জন একটা দ্বীপ। এটাই ‘নিউ গুলাগ’। নাম রাখা হয়েছে ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপ।’ থামল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
খুশিতে মুখ উজ্জল হয়ে উঠছে আহমদ মুসার মুখ। বলল, ধন্যবাদ প্রফেসর জ্যাক সাইমন। সাও তোরাহ দ্বীপকে আপনি নির্জন বলছেন। ওখানে কোন মানুষই বাস করে না। ‘না’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন। ‘তাহলে গোটা দ্বীপে বন্দীরা এবং তাদের পাহারাদাররাই শুধু বাসিন্দা। ‘আহমদ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ তাই। আসলে গোটা দ্বীপ পাহাড়ের টিলায় ভর্তি। প্রায় সমগ্র উপুকুল জুড়ে কোথাও খাড়া পাহাড়ের দেয়াল, কিছু কিছু সমতল উপকূল ভূমিও রয়েছে। সব মিলিয়ে দ্বীপটা সাধারণ ভাবে বাসযোগ্য নয়।’ বলল প্রফেসর জ্যাক সাইমন।
‘সেখানে কি বন্দীখানা গড়া হয়েছে, না গোটা দ্বীপকেই বন্দীখানা বানানো হয়েছে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘স্যরি। এ সম্পর্কে তারা কোন সময়ই আমার সামনে কোন আলোচনা করেনি এবং আমিও জিজ্ঞাসা করিনি।’ বলল প্রফেসর সাইমন।
ধন্যবাদ প্রফেসর। চলুন আমরা এখন উঠি। এখনি আমাদের চলে যাওয়া উচিত, গাড়িতে শুইয়ে নিয়ে যাব আপনাকে, কেউ টের পাবে না, বাইরে গিয়ে আজর ওয়াইজম্যানকে টেলিফোন করবেন। আজকের মধ্যেই আমরা আপনাকে প্যারিস পৌছাবো।’
‘এ লাশগুলোর কি হবে এবং আমার বাড়ির? জিজ্ঞাসা করল প্রফেসর সাইমন।
‘লাশগুলো গুম করার ব্যাবস্থা আমরা করছি। আর আপনার বাড়িটা আপাতত তালাবদ্ধ থাকবে। আপনার পালিয়ে যাওয়া লোকজন নিশ্চয় ফিরবে না আপনি না ফিরা পর্যন্ত। আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে।’ বলে সায় দিল প্রফেসর সাইমন। সবাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
প্রফেসর সাইমন, ফাতিমা ও যায়েদকে তাদের গাড়িতে তুলে নিল।
গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা মোবাইল বের করল টেলিফোন করার জন্যে। সেদিন ফাতিমা-যায়েদের বিয়েতে গিয়ে মুসলিম সেচ্ছাসেবী একটা গ্রুপের সাথে পরিচিতি হয়েছিল, যাদের সাথে ‘সাইমুমে’র সম্পর্ক আছে বলে তারা জানিয়েছিল। তাদের নাম্বারেই টেলিফোন করতে লাগল আহমদ মুসা।
উত্তেজনায় মিসেস লতিফা কামালের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বলছিল সে, আমার গয়না আছে ব্যাংকের লকারে। সে জন্যই লকার খুলতে গিয়েছিলাম। গত ছয়মাসের মধ্যে লকার খুলিনি। শুধুমাত্র কামাল ও আমিই এই লকার খুলতে পারি। গত ছয়মাসে কামালেই কয়েকবার লকার খুলেছে। আমার যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
বলে একটু দম নিয়ে আবার শুরু করল মিসেস লতিফা কামাল, আজ গিয়ে লকার খুলে গহনা অন্যান্য ফ্যামিলী ডকুমেনেটর সাথে ছোট ও সুদৃশ্য একটা প্লাস্টিক ব্যাগ দেখতে পেলাম। দেখে বিস্মিত হলাম এ ধরনের ব্যাগ আমাদের লকারে ছিল না। তাহলে কি কামাল পরে রেখেছে?
মনে প্রশ্ন জাগায় নতুন ব্যাগটাই প্রথমে খুললাম। খুলে দেখলাম ব্যাগে রয়েছে কতগুলো কাগজ পত্র এবং তার সাথে ডজন খানেকর মত ডিস্ক। আমি একটা কাগজ হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলালাম। দেখলাম, ওটা স্পুটনিকের একটা অনুসন্ধান রিপোর্ট। আরেকটা কাগজেও দেখলাম তাই। বুঝলাম কাগজপত্র ও ডিস্ক সবগুলোই স্পুটনিক সম্পর্কিত। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো, এই ডকুমেন্টগুলোই শয়তানরা খুঁজছে। এগুলোর সন্ধানেই তারা আমাদের বাড়ি এবং আত্মী-স্বজনের বাড়ি পর্যন্ত তছনছ করেছে। ভয়ে আমি কাঁপতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি ব্যাগ বন্ধ করে লকার লক করে আমি চলে এসেছি।’ থামল মিসেস লতিফা কামাল।
লতিফার পাশেই বসে ফাতিমা। তাদের সামনের সোফায় পাশা-পাশি বসে আহমদ মুসা ও যায়েদ।
আহমদ মুসার চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জল হয়ে উঠেছে। বলল আহমদ মুসা দ্রুতকন্ঠে, ‘ওটা কোন ব্যাংকে?
‘আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক।’ মিসেস লতিফা কামাল বলল। ‘গুড। ম্যানেজার কে জানেন? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘জি। মিঃ কার্টার জুনিয়র।’ বলল মিসেস কামাল।
‘মিঃ জন কার্টার জুনিয়র? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘জি, পুরো নাম মি. জন র্কাটার জুনিয়র।’
‘আল হামদুলিল্লাহ। লোকটা ভাল। এর আগে তিনি একবার প্যারিসে ছিলেন।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ভাইয়া, লকারের খোঁজ কিন্তু ওরা পেয়ে যাবে। সরিয়ে নেয়াই কি নিরাপদ নয়? বলল ফাতিমা।
‘কিন্তু আমি মনে করি, লকারটাই এখন বেশি নিরাপদ। আমেরিকান ব্যাংকের সিস্টেম ভাল। তার উপর ম্যানেজার খুব ভাল লোক। তার উপর ইহুদীদের কোন চাপ পড়বে না। আমাদের কোন বাড়িই এখন নিরাপদ নেই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ডুপ্লিকেট করে এক সেট অন্য কোথাও রাখলে ভালো হয় না।’ বলল যায়েদ।
‘তা করা যায়। কিন্তু ডকুমেন্ট নিয়ে আমাদের কেউ মুভ করা ঠিক হবে কিনা ভাব বার বিষয়। তবে সুযোগ পেলে ডুপ্লিকিট করা যায়। ঠিক আছে, দেখা যাক অবস্থা কি দাঁড়ায়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘যাই হোক, ডকুমেন্টগুলো আপনার একবার পড়া প্রয়োজন।’ বলল ফাতিমা।
‘এখন এ দিক চিন্তা করছি না ফাতিমা। এখন প্রথম কাজ গুলাগ অভিযান, কামাল সুলাইমানদের উদ্ধার। এরপর শুরু হবে ইনশাআল্লাহ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের রহস্য উদ্ধার।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাহলে ডকুমেন্টগুলো লকারেই থাকছে? প্রশ্ন করল মিসেস কামাল।
‘হ্যাঁ। ডুপ্লিকেট যদি করা যায়, সেটা বাইরে রাখা যাবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে। তাই হবে মি. আহমদ মুসা।’ বলল মিসেস কামাল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এ সময়ে যায়েদ ফিরে এল। সে বারান্দায় উঠে গিয়েছিল। এসে আহমদ মুসাকে বলল, ‘ভাইয়া একটা ট্যাক্সি এদিকে মুখ করে সেই আপনি আসার সময় থেকে দাঁড়িয়ে আছে।
‘ঠিক আছে আমি উঠছি। দেখবো আমি। তোমরা পরে যাবে।
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আসি মিসেস কামাল।’
‘ভাইয়া প্রফেসর সাইমন কি প্যারিসে পৌছেছে?’ বলল ফাতিমা।
‘হ্যাঁ, বুমেদীন বিল্লাহ পৌছে টেলিফোন করেছিল।’
বলে আহমদ মুসা হাতের ব্যাগটা তুলে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।
কিছুক্ষন পরে বেরিয়ে এল কাঁচা-পাকা দাড়ি-চুলওয়ালা প্রৌঢ় সেজে।
পরনে ফুলপ্যান্ট জ্যাকেটের পরিবর্তে লুজ সার্ট ও ট্রাউজার।
যায়েদরা সবাই হেসে উঠল। মিসেস কামাল বলল, আমার আগে জানা না থাকলে আমারই চিৎকার করে ওঠার দশা হত।
‘ধন্যবাদ সকলকে। আসসালামু আলাইকুম।’ বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ধীরে ধীরে এগুলো ট্যাক্সিটার দিকে।
নিকটবর্তী হলো সে ট্যাক্সিটার।
ট্যাক্সি ড্রাইভার লোকটি গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটকে ইজি চেয়ারে পরিনত করে মিসেস কামালের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বসেছিল। প্রৌঢ় বয়সী আহমদ মুসার দিকে তাকাবার প্রয়োজনই বোধ করেনি লোকটা।
আহমদ মুসা গাড়ির কাছে চলে এসেছে।
হঠাৎ একটা কুকুর লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে প্রচন্ড গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
ঘটনাটি আহমদ মুসার জন্য অকল্পনীয় ছিল।
শেষ মূহুর্তে আহমদ মুসা তার মাথা লক্ষ্যে ছুটে আসা কুকুরকে মাথার কাপড় ধরা দেয়ার জন্যে বাম বাহুকে লাঠির মত শক্ত করে সামনে বাড়িয়ে দিল এবং ডান হাতটি প্রবেশ করল পকেটে রিভলবার বের করার জন্যে।
উড়ে আসা চলন্ত কুকুর হাতের সাথে ধাক্কা খেয়ে হাতটা কামড়ে মাটিতে পড়ে গেল। বাহুর যেটুকু অংশ কুকুরটি কামড়ে ধরেছিল তা ছিঁড়ে নিয়ে গেল।
আহমদ মুসার ডান হাত তখন বেরিয়ে এসেছে রিভলবার নিয়ে।
মাটিতে পড়ে যাওয়ার সংগে সংগেই আবার কুকুরটি উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং নতুন করে আক্রমনের জন্য সামনের দু’পা উপরে তুলে পেছনের দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসার ডান হাতের তর্জনি ট্রিগার টিপতে একটুও দেরী করেনি। বুলেট ছুটে গিয়ে কুকুরটির বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
কুকুরটির দেহটা উল্টে আছড়ে পড়ে গেল মাটিতে।
আহমদ মুসা গুলী করেই তাকাল গাড়ির সিটে বসা লোকটির দিকে। দেখল, লোকটির ডান হাত বেড়িয়ে আসছে কোটের পকেট থেকে। হাতে রিভলবার।
আহমদ মুসা চোখ লোকটির দিকে ঘুরে যাবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার হাতের রিভলবারও ঘুরে গিয়েছিল লোকটির দিকে।
আহমদ মসার তর্জনি চেপে বসল রিভলবারের ট্রিগারে। একটা গুলী ছুটে গিয়ে কুকুরটির মতই এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল লোকটি বুক।
গাড়ির দরজা খোলাই ছিল।
আহমদ মুসা কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে টেনে সিট থেকে মাটিতে নামিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল আহমদ মুসা।
দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বের করে বাম বাহুর রক্তক্ষরণরত আহত স্থানটা ডান হাত ও দাঁতের সাহায্যে বেঁধে গাড়ি স্টাট দিল।
চারিদিকে চেয়ে দেখল আশে-পাশে কেউ নেই। রাস্তার বাম পাশে দু’তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দু’জন লোক এদিকে তাকিয়ে আছে। আর সামনে রাস্তার ডান পাশে মিসেস লতিফা কামালের বাড়ির ব্যালকনিতে ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
আহমদ মুসা খুশি হলো। অল্পক্ষনের মধ্যেই এখানে পুলিশ আসবে এবং খোজ-খবর নিয়ে জানতে পারবে যে, একজন দাড়িওয়ালা প্রৌঢ় লোককে একটি কুকুর আক্রমন করে কামড়ে ধরেছিলো। লোকটি কুকুর ও কুকুরের মালিক গাড়িওয়ালাকে হত্যা করে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেছে।
আনন্দিত হবার সাথে সাথে চিন্তিতও হলো সে। আহমদ মুসার কোন সন্দেহ নেই যে, কুকুরটিকে শিখিয়ে পড়িয়ে আনা হয়েছিল আহমদ মুসাকে ধরার জন্যেই এবং কুকুর তাকে ঠিকেই চিনেছিল। আজর ওয়াইজম্যানরা যে সাংঘাতিক বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আহমদ মুসাকে ধরার জন্যে কুকুরের ব্যাবহার এরই একটা প্রমাণ। এই ঘটনার তার গায়ে আরও আগুন ধরবে। মিসেস লতিফা কামালের এ বাড়িটা ছেড়ে দেয়া দরকার, ভাবল আহমদ মুসা। হিংসায় অন্ধ হয়ে আজর ওয়াইজম্যানরা কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
এক সময় গাড়ির স্টিয়ারিং হুইললের নীচে তাকাতেই একটা মানিব্যাগ চোখে পড়ল আহমদ মুসার। ভাবল, গুলীতে যে মারা গেছে মানিব্যাগটা সে লোকের হতে পারে। মানিব্যাগটা তুলে নিলো আহমদ মুসা।
মানিব্যাগে দেখল কয়েকশ ডলারের নোট, ২টি নেম কার্ড এবং একটি চিঠি পর্তুগীজ ভাষায়। পর্তুগীজ ভাষা আহমদ মুসা জানে না বিধায় চিঠির সে কিছুই বুঝতে পারল না। কার্ডের দিকে মনোযোগ দিল। চমকে উঠল আহমদ মুসা। কার্ডটিতে ঠিকানার বটমে লেখা রয়েছে ‘আজোরস দ্বীপপুঞ্জ’। আজোরস দ্বীপপুঞ্জের নাম পড়েই কার্ডের অবশিষ্টটুকু গোগ্রাসে পড়ল আহমদ মুসা। কার্ডের নামটি হলো, ‘এ্যানটিনিও সোরেস।’ পরিচয় হিসাবে লেখা ‘ব্যাবসায়ী ও সমাজকর্মী’। আর ঠিকানা, ‘১১, গনজালো রোড, হরতা, সাও জর্জ, আজোরস। আকাশের চাঁদ হতে পাওয়ার মতই খুশি হলো আহমদ মুসা। ঠিকানা পেয়ে। চিঠি দিয়ে কার্ডটা মুড়িয়ে কার্ডটা পকেটে রেখে দিতে দিতে আহমদ মুসা ভাবল, প্রথম সুযোগেই চিঠিটা কারও কাছ থেকে পড়ে নিতে হবে। এই চিন্তার রেশ ধরেই আহমদ মুসা ভাবতে লাগল, কে এই এ্যনটিনিও? চিঠিটাও তার হবার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু এসব এই সন্ত্রাসীর কাছে কেন? এ্যনটিনিও কি এদের দলের? এমন হাজারো চিন্তা এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে। গাড়ি চলছে আহমদ মুসার। ফোটা ফোটা রক্ত ঝরছে আহমদ মুসার আহত বাম বাহু থেকে।
৭
আন্তর্জাতিক পুলিশ ইন্টারপোলে’র ইউরোপীয় সদর দফতর প্যারিসে ইউরোপীয় ‘ইন্টারপোল’ বৈঠক। এ বৈঠকে ইন্টারপোলের ইউরোপীয় কমিটি ছাড়াও ফ্রান্স সহ কয়েকটি দেশের পুালশ প্রধানও হাজির।
বৈঠকে স্বাগতিক দেশের পুলিশ প্রধান মিঃ মিতেরাঁ তার স্বাগতিক বক্ত্যবে এজেন্ডার উপর ব্রিফিং দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘ইন্টারপোলকে ধন্যবাদ যে, আমাদের আবেদনে বিশেষ এক এজেন্ডার উপর আলোচনা করতে রাজি হয়েছে।’
এজেন্ডার বিষয়ে আমার প্রথমিক বক্তব্য হলো, আপনারাও কিছুটা হলেও স্ট্রাসবার্গের দুটি ঘটনা সম্পর্কে জেনেছেন। এ দুই ঘটনার একটি ঘটনা ঘটে গেছে, আরেকটি ঘটতে চলছে। কিছুদিন আগে ইউরোপের বিখ্যাত একটা অনুসন্ধানী সংস্থা স্পুটনিককে সমূলে ধবংস করা হয়েছে এবং এর ৭ জন কর্মকর্তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতই নিপুন ভাবে কাজটা করা হয়েছে যে, কোন ক্লুই পাওয়া যায়নি সামনে এগুবার। তার ফলেই গত কয়েক মাসে এর তদন্তে কোন অগ্রগতি হয়নি। কিন্তু গত এক পক্ষকালে ঐ স্ট্রাসবার্গেই কিছু ঘটনা ঘটেছে যার সাথে স্পুটনিক ধবংসের ঘটনা সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। স্ট্রাসবার্গের শার্লেম্যান রোডের ৫ নং বাড়ি থেকে ১৪টি লাশ ও দু’টি কম্পিউটার পাওয়া গেছে। এ সম্পকির্ত খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আপনারা দেখেছেন। তবে রিপোর্টে অনেক কিছুই ছাপা হয়নি।
ঐ রিপোর্ট ও আমাদের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে ‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি’ নামে একটা ইহুদী সংস্থা সুপরিকল্পিতভাবে স্পুটনিক ধ্বংসের ঘটনা ঘটিয়েছে এবং কম্পিউটার থেকে আরও তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।’ থামল ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান।
পুলিশ প্রধান থামতেই ইন্টারপোলের প্রধান জর্জ জ্যাকব বিরক্তির স্বরে বলে উঠল, মিঃ মিতেরাঁ কম্পিউটার থেকে পাওয়া কোন তথ্য দলিল নয়। কম্পিউটারে যে কেউ যে কোন জিনিস ঢুকিয়ে দিতে পারে।
আপনি বলুন, স্ট্রাবার্গে এ পর্যন্ত দেড় ডজনের ও বেশি লোক খুন হয়েছে। এই খুনগুলো কে করলো? যারা এই খুনগুলো করতে পারে, তারা কম্পিউটারে কোন তথ্য ঢুকিয়ে দিতে পারে।’
‘মি.জ্যাকব, যারা খুন হয়েছে তারা সকলেই এক দলের লোক এবং এরা আক্রমনকারী হিসাবে খুন হয়েছে।’ বলল ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান।
‘কাকে এবং কেন তারা আক্রমন করতে গিয়েছিল? যাকে তারা আক্রমন করতে গিয়েছিল সেই কালপ্রিটকে আপনারা বের করার কি চেষ্টা করেছেন? সে কি করছে ফ্রান্সে, তা কি সন্ধান করেছেন? মাফ করবেন, আমার মনে হয় ফ্রান্সের পুলিশের মধ্যে নাজী পন্থী না হলেও এ্যান্টি সেমেটিক প্রবনতার বিস্তার ঘটেছে।’ বলল ইনটারপোলের প্রধান স্পষ্ট ও দৃঢ় কন্ঠে।
ফ্রান্সের পুলিশ প্রধানের মিতেরাঁর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘সব জাতির মধ্যেই ক্রিমিনাল আছে, ক্রিমিনাল গ্রুপ আছে। তেমনি ইহুদীবাদীদের মধ্যেও ক্রিমিনাল গ্রুপ থাকতে পারে। কিন্তু তারা কোন অপরাধে জড়িত হবার ঘটনা ঘটলেই একথা বলা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে যে, এটা এ্যান্টি -সেমেটিকদের ষড়যন্ত্র। আপনাদের সবার কাছে ফাইল দেয়া হয়েছে। ফাইলই সুস্পষ্টভাবে প্রমান করছে, ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি বিরুদ্ধে অভিযোগ এ্যান্টি সেমেটিক কোন ষড়যন্ত্র নয়।’ থামল মিতেরাঁ।
সংগে সংগেই বলে উঠল ইন্টারপোলের প্রধান জ্যাকব, ‘ফাইল দেখেছি। প্রমাণগুলো সবই অবস্থাগত এবং কম্পিউটার রেকর্ড ভিত্তিক। যারা মারা গেছে, তারা সবাই একদলের বলা হচ্ছে এবং রেসিয়াল টেষ্টেও প্রমান করছে তারা সবাই ইহুদী। সবগুলো হত্যাকান্ড ঘটেছে আহমদ মুসার দ্বারা, সেটা যে পরিস্থিতিতেই হোক। প্রতিপক্ষ এখানে আহমদ মুসা। নিছক কম্পিউটারে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্ট্রাসবার্গের সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনাকে স্পুটনিকের সাথে জুড়ে দেয়া ঠিক হবে না। বিষয়টাকে আহমদ মুসার সাথে সংঘাত হিসাবে দেখতে হবে।’
ইন্টারপোল প্রধান জ্যাকব থামতেই বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই এক সাথে বলে উঠল, ‘সন্দেহাতীত আরও প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত মাঝামাঝি এই সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত হবে।’
সংগে সংগেই ফরাসী পুলিশ প্রধান বলে উঠল, ‘আমি দুঃখিত যে, আপনাদের এই মতের সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। ফরাসী পুলিশ মনে করে, স্পুটনিকের ঘটনার সাথে স্ট্রাসবার্গের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো গভীর ভাবে সম্পর্কিত। স্পুটনিকের অপহৃতদের আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকেই আহমদ মুসা স্পুটনিক ধবংসের ঘটনা নিয়ে কাজ করছে। সুতরাং আহমদ মুসার সাথে ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীর সংঘাতকে বিচ্ছিন্ন বলে চলাবার কোন যুক্তি নেই। তাছাড়া আহমদ মুসা কাজ শুরু করার পর স্পুটনিকের ঘটনায় অপহৃত ৭ জনের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সবার বাসা তছনছ হয়েছে। আহমদ মুসার উপর বার বার আক্রমনকারী ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীই যে এই তছনছের কাজ করেছে এতে আমাদের পুলিশের কোন সন্দেহ নেই। স্পুটনিকের সাথে সম্পর্কিত লোকদের বাসাবাড়ির উপর তারা চোখ রাখছে এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। সর্বশেষ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে স্পুটনিকের প্রধান গোয়েন্দা কামাল সুলাইমানের বাড়ির সামনে। প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য অনুসারে কামাল সুলাইমানের বাড়ি থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলে তার উপর আক্রমন চালানো হয়। কিন্তু সংঘর্ষে আক্রমনকারী লোকটি এবং তার কুকুর মারা যায়। যে লোকটি মারা যায় সে ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীর সদস্য। সুতরাং আহমদ মুসাকে এবং স্ট্রাবার্গের সাম্প্রতিক ঘটনাকে স্পুটনিকের ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এই বাস্তবতাকেই যদি ইন্টারপোল অস্বীকার করে তাহলে তাদের সাহায্য আমরা পাব কি করে? আমরা ইন্টারপোলের সাহায্য এই জন্যই চেয়েছিলাম যে, স্পুটনিক যারা ধবংস করেছে এবং এর লোকদের যারা কিডন্যাপ করেছে, তারা ফ্রান্সে সীমাবদ্ধ নয়। আমদের নিশ্চিত বিশ্বাস স্পুটনিকের লোকদের আটকেও রেখেছে ফ্রান্সের বাইরে। এদিক থেকেই ইন্টারপোলের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন ছিলো।’ বলল ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান মিঃ মিতেরাঁ।
ইন্টারপোলের বৃটিশ প্রতিনিধি মিঃ উইলসন বলল, ‘আমি মিঃ মিতেরাঁর যুক্তিকে সমর্থন করছি। স্পুটনিক ও স্ট্রাবার্গের সাম্প্রতিক ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। ফ্রান্সকে এই ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্যও করা উচিত। তবে একটা কথা। ফ্রান্সের জামাই আহমদ মুসার প্রতি ফ্রান্সের দুর্বলতার অর্থ আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু ইহুদীদের প্রতি মিতেরাঁ এত কঠোর হয়ে উঠলেন কেন?
আবার মিতেরাঁ বলে উঠল, ‘স্পুটনিকের মত কোন কিছু ধবংসের ঘটনা যদি ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মী বৃটেনে ঘটাত, তাহলে মিঃ উইলসন আমার চেয়েও কঠোর হতেন আমি হলফ করে বলতে পারি।’
এইভাবে আলোচনা চলল।
দীর্ঘ আলোচনার পর বৈঠক তিনটি সিন্ধান্তে উপনীত হলোঃ এক, বিশ্ব মুক্তি সেনা বা ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মীকে (WFA) স্ট্রাসবার্গের ঘটনাবলীর জন্য দায়ী বলে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হলো, তবে এই সংস্থাকে ইহুদী সংগঠন হিসাবে প্রকাশ করা হবে না, দুই, ঘটনার সাথে
‘ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মী’ (WFA) জড়িত থাকা সম্পর্কে ফ্রান্সকে আরও প্রত্যক্ষ প্রমান সংগ্রহ করতে হবে এবং তিন, ইন্টারপোল ফ্রান্সকে সব রকম সহযোগিতা করবে।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাবার সময় মিতেরাঁ, উইলসান এবং জার্মান পুলিশ প্রধান ভন ক্রয়েগার এক সাথে হাঁটছিল। ফ্রান্সের পুলিশ প্রধান মিতেরাঁ বলল, ‘ইহুদীবাদীদের এ ধরনের পাপকে আর কতদিন আমরা ঢেকে রাখব? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিশেষ করে বিজ্ঞানী জন জ্যাকব ও জেনারেলে শ্যারণদের অপকীর্তি থেকে কি আমরা শিক্ষা গ্রহন করবো না?
বৃটিশ পুলিশ প্রধান জর্জ উইলসনের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘মিটিং এ অনেক সময়েই পোষাকী কথা বলতে হয়। কিন্তু ফ্যক্ট হলো আমাদের প্রশ্রয় কিন্তু ইহুদীদের আরও ক্রিমিনাল বানাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তাদেরই ক্ষতি করছি আমরা।’
উইলসন থামতেই ভন ক্রয়েগার বলে উঠল, ‘এর পরিনতি হতে পারে ভয়ংকর। ‘নাজী’রা হয়তো কোনদিনই আর ফিরবে না। কিন্তু ‘নাজী’দের ভাইয়েরা তো ফিরতে পারে।’
‘সাংঘাতিক কথা বলছেন মিঃ ক্রয়েগার।’ বলে উঠল জর্জ উইলসন।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ভন ক্রয়েগার। কিন্তু বলা হলো না ইনটারপোল প্রধান মিঃ জন জ্যাকব তাদের মধ্যে এসে পড়ায়।
কথার প্রসংগ পাল্টাল ভন ক্রয়েগার।
হাঁটতে লাগল চারজন।
টেলিফোন ধরে ওপারের কথা শুনেই চমকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফাতিমা। বলল, এক্সেলেন্সি, প্লিজ হোল্ড করুন। উনি আছেন, ওনাকে দিচ্ছি আমি।
বলে ফাতিমা মহাব্যস্ত হয়ে টেলিফোটা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভাইয়া ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের টেলিফোন।’
হাঁ ফাতিমা গলা শুনেই বুঝতে পেরেছি।’ বলে আহমদ মুসা টেলিফোন সেট সামনে টেনে নিল। আহমদ মুসা সালাম দিয়ে কথা বলা শুরু করল। বলল, ‘মাহমুদ কেমন আছ?’
‘ভাল ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? কতদিন পর আপনার সাথে কথা বলছি।’ ওপার থেকে বলল ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ।
‘তুমি খুব ব্যাস্ত, তা আমি জানি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার প্রতি অবিচার করবেন না ভাইয়া। আমার কিছু ব্যাস্ততা আছে এ কথা ঠিক, কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাওয়াই আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়।’ বলল মাহমুদ।
‘তুমি ঠিক বলেছ মাহমুদ। অবস্থার কারণে সব খবর তোমাদের আমি সব সময় জানাতে পারি না। যাক, এসব কথা। তোমার স্ত্রী এমিলিয়ার কাছে সব শুনেছি। এখন বল, হাসান তারিক কোথায়? বলল আহমদ মুসা।
‘আমার পাশে বসে আছে ভাইয়া। তাকে টেলিফোন দেব, তার আগে বলুন, আপনার ডাক পাবার এই সৌভাগ্য হাসান তারিকের কেন হলো? বলল মাহমুদ।
‘এটা সৌভাগ্য নয় মাহমুদ, দুর্ভাগ্য। কঠিন এক অভিজানে ওকে সাথী করতে চাচ্ছি। কিছু দিনের জন্য ওকে সকল সুখ কোরবানি দিতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘কোরবানির সুযোগ তো মুসলমানদের জন্য সৌভাগ্যের ভাইয়া? বলল মাহমুদ।
‘এটা হাসান তারিকই বলুক।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
পরক্ষণেই টেলিফোনে হাসান তারিকের কন্ঠ শোনা গেল। বলল ‘আমার উপর আপনার এই রাগের কারন কি ভাইয়া?’
‘রাগ কোথায় দেখলে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই যে আপনি বললেন কোরবানী আমি দিতে পারব কিনা তা আমাকেই বলতে হবে। এটা তো অনাস্থা অথবা রাগের কথা ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা হাসল। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।
বলল, ‘হাসান তারিক তোমার উপর খুব রাগ, খুব অবিশ্বাস তো, তাই কঠিন এক অভিযানে সাথি হবার জন্যে তোমাকেই স্মরণ করছি।’
‘আমার সৌভাগ্য ভাইয়া যে, আপনি আমাকে এত ভালবাসেন।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল হাসান তারিক।
‘তোমার আবেগ দেখি আগের মতই আছে। মুছে ফেল চোখের পানি। বল, আয়েশা আলিয়েভা কেমন আছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাল। আমি যাচ্ছি শুনলে সে কিন্তু পিছু নেবে। আপনার হুকুমই শুধু তাকে থামাতে পারে। ‘হাসান তারিক বলল।
‘সে আমি দেখব। তুমি তৈরী হও আসার জন্য।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শোনা কি যাবে অভিযানটা কোথায়? বলল হাসান তারিক।
‘বলা গেলে শুরুতেই বলতাম।’ আহমদ মুসা বলল।
‘স্যরি ভাইয়া।’ বলল হাসান তারিক।
‘ধন্যবাদ হাসান তারিক। এখন রাখি।’ বলে, সালাম দিয়ে আহমদ মুসা টেলিফোটা রেখে দিল।
ড্রইংরুমে যায়েদ, ফতিমা ও লতিফা কামাল উদগ্রীব হয়ে শুনছিল আহমদ মুসাদের কথা-বার্তা।
আহমদ মুসা টেলিফোন রাখতেই ফাতিমা বলে উঠল, ‘আপনি কোন অভিযানে মানে কোথাও যাচ্ছেন ভাইয়া?
আহমদম মুসা তাকাল যায়েদ ও ফাতিমার দিকে। বলল, ‘হ্যাঁ বোন এবার যেতে হবে ‘সাও তোরাহ’ দ্বীপে।’
মলিন হয়ে উঠল যায়েদ, ফাতিমা ও লতিফা কামালের মুখ। ফাতিমাই আবার বলল, সেদিন প্রফেসর জ্যাক সাইমনের কাছে সাও তোরাহ দ্বীপের যে পরিচয় শুনেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে ওটা রূপকথার এক দানবীয় দ্বীপ। ওখানে যেতে হলে সৈন্য-সেনাপতি দরকার। আপনি সত্যিই সেখানে যাবেন ভাইয়া? ভারি কন্ঠ ফাতিমার।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘ওটা রূপকথার দ্বীপ নয় ফাতিমা, আটলান্টিকের বুকের এক বাস্তব সত্য। আর ওটা দানবীয় দ্বীপ নয়, আমার অনুমান সত্য হলে ওটা কিছু অমানুষের অক্টোপাশে বাঁধা একটা অশ্রুর দ্বীপ, এক ‘নিউ গুলাগ’। ওখানে যেতে সৈন্য-সেনাপতির দরকার নেই, দরকার শুধু মানুষের প্রতি মমতার অস্ত্র।’
‘আপনি কি নিশ্চিত ভাই সাহেব, ওখানেই কামাল সুলাইমানদের রাখা হয়েছে? বলল মিসেস লতিফা কামাল।
‘কম্পিউটারের ডকুমেন্টগুলো পাওয়ার পর আমি নিশ্চিত হয়েছি, সাও তোরাহ দ্বীপেই বন্দীদের রাখা হয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাই যদি হয়, তাহলে পুলিশ ও সরকারকে বলতে পারি এবং সরকার দ্রুত তাদের উদ্ধারের ব্যাবস্থা করতে পারে।’ বলল লতিফা কামাল।
‘যে কম্পিউটার থেকে আমরা তথ্য পেয়েছি সে কম্পিউটার এখন পুলিশের হাতে। পুলিশ তাদের প্রেস ব্রিফিংকালে সাও তোরাহ দ্বীপের কথা গোপন করেছে। এটা দুই কারণে হতে পারে, এক, কৌশলগত কারণে পুলিশ এটা প্রকাশ করেনি। দুই, পুলিশ উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এই তথ্যটা গায়েব করেছে। আমার যতদুর মনে হচ্ছে পুলিশকে দিয়ে এটা গায়েব করানো হয়েছে। কা্রণ পুলিশ সাও তোরাহ দ্বীপের ব্যাপারে কোন এ্যাকশনে যাবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় সাও তোরাহ দ্বীপের সন্ধান যদি পুলিশকে বা সরকারকে দেয়া হয়, তাহলে এ খবর সংগে সংগেই শত্রুদের কানে পৌছে যাবে এবং শত্রুরা যখনই জানবে, সাও তোরাহ দ্বীপের কথা ফাঁস হয়ে গেছে, সংগে সংগেই বন্দীদেরকে ওরা সাও তোরাহ দ্বীপ থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে পারে, এমনকি হত্যাও করে ফেলতে পারে।’
আহমদ মুসার শেষ কথায় ভীষন কেঁপে উঠেছে মিসেস লতিফা কামাল, ফাতিমা ও যায়েদ। তাদের সবার মুখ পাংশু হয়ে গেছে। মিসেস কামাল আর্তকন্ঠে বলে উঠল, ‘ভাই সাহেব আমি আমার কথা প্রত্যাহার করছি।
সরকার কিংবা পুলিশকে জানানোর দরকার নেই।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘তাহলেই দেখুন, আমাদের সেখানে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই।’ আহমদ মুসা থামল।
তিনজনের কেউ কোন কথা বলল না।
কিছুক্ষণ পর যায়েদ ধীরে ধীরে বলল, ‘ভাইয়া আমরা সেখানে যেতে পারি না? আমরা একসাথে যাতে আপনার সংগে কাজ করতে পারি, এ জন্যেই তো আপনি বিয়ে করিয়েছেন।’
‘না যায়েদ, এই অভিযান ফাতিমার জন্য উপযুক্ত নয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক আছে তাহলে আমাকে নিন। তাহলে এই অভিযানে স্পুটনিক পরিবারের অংশ গ্রহণও থাকল।
‘না যায়েদ ফাতিমা ও স্পুটনিক পরিবারের সাথে তুমি থাক।’
‘বুঝেছি আমি যোগ্য নই।’
‘অযোগ্যতার কোন প্রশ্ন নেই যায়েদ। হাসান তারিক ছাড়াও ডজন ডজন যোগ্য সহকর্মী আছে যারা ডাক পেলেই ছুটে আসবে। তাদের বাদ দিয়ে আমি হাসান তারিককে নিচ্ছি কেন? নিচ্ছি এই কারণে যে, সে ইহুদীবাদী বিশেষজ্ঞ হওয়া ছাড়াও একজন মেরিন ইঞ্জিয়ার। এই অভিজানে যারা যাবে তাদের এই জ্ঞানের দরকার হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
মাথা নিচু করল। কোন কথা বলল না যায়েদ।
মুখ তুলল মিসেস লতিফা কামাল। বলল, ‘আমি গর্বিত ভাই সাহেব আল্লাহ আপনার মত একজনকে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। আপনাকে আমাদের বুক ভরা কৃতজ্ঞতা ও দোয়া ছাড়া দেবার কিছু নেই।’ শেষে কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল লতিফা কামালের কন্ঠস্বর।
ফাতিমা কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলে উঠল, ‘আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। অনেক্ষণ ধরে নাস্তা টেবিলে অপেক্ষা করছে। চলো উঠি। আমাকে এখনি একটু বাইরে বেরুতে হবে।’
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
তার সাথে সাথে ফাতিমা, যায়েদ ও লতিফা কামালও উঠল।
লিবসন শহরতলীতে অন্ধকার ঘেরা আলোকজ্জ্বল এক বাড়ি। বাড়িটার ড্রইংরুমে বসে আছে লালমুখ দীর্ঘদেহী একজন মানুষ। তার চোখে-মুখে দারুন উত্তেজনা। বেশিক্ষণ সে বসে থাকতে পারছে না। উঠে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে ঘরময়। মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে টেলিফোনের দিকে, আবার ঘড়ির দিকেও। বুঝা যাচ্ছে আকাঙিখত একটা টেলিফোন কল সে পাচ্ছে না, অন্যদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে।
লোকটির নাম মারিও জোসেফ। সে WFA এর লিসবন ষ্টেশন চীফ। সে এই মাত্র ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা সুত্রে খবর পেয়েছে, দু’জন মুসলমান নাম ভাড়িয়ে দুটি পর্তুগীজ পাসপোর্ট জোগার করেছে এবং আজ রাত ১২টার দিকে পর্তুগীজ ইয়ারে আজরস দ্বীপপুঞ্জের ‘লেজে’ এয়ারপোর্ট যাত্রা করছে। কোন নামে পাসপোর্ট কোন নামে টিকিট তার কিছুই জানা যায়নি। এই নাম জানার জন্যেই মারিও জোসেফ পাগল হয়ে উঠেছে। নাম জানলে তবেই তাদের আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়া আটকানো যাবে।
ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম আর্মি সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন মুসলমানকেই আজোরস দ্বীপপুঞ্জে যেতে দেয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তের পর অনেকের যাত্রা তারা ঠেকিয়েছে। এ বিষয়টা ইতিমধ্যে মুসলমানদের মধ্যে জানা জানি হয়ে গেছে। এরপর মুসলমানরা নাম ভাঁড়িয়ে আজোরসে যাবার চেষ্টা করছে। এ ধরনেরই একটা চেষ্টার খবর আজ মারিও জোসেফ পেয়েছে। যে কোন মুল্যে তাকে এদের এই যাত্রা বন্ধ করতে হবে। না পারলে আজর ওয়াইজম্যানের ক্রোধের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে।
টেলিফোন বেজে উঠল মারিও জোসেফের। পায়চারি করছিল মারিও জোসেফ। দাঁড়িয়ে পড়ে দ্রুত গিয়ে টেলিফোনের ভয়েস বোতামে চাপ দিল। সংগে সংগে ওপার থেকে কন্ঠ ভেসে এল, মিঃ মারিও জোসেফ দুঃখিত, বহু চেষ্টা করেও লোক দু’জনের নাম পাওয়া গেল না। তবে এই টুকু জানা গেছে, আজ রাত ১২ টার প্লেনের টিকেট যারা কিনেছে তারা সবাই শ্বেতাংগ তিনজন ছাড়া। একজন তুর্কি চেহারার এশীয় দু’টি টিকিট কিনেছে এবং একজন আফ্রিকান কিনেছে একটি। লিসবনের হোটেল চেক করে আরেকটা বিষয় জানা গেছে, গত সাত দিনে মাত্র তুর্কি চেহারার বা এশীয় দু’জন লিসবনের হোটেলে উঠছে এবং এরা দু’জনেই ভাস্কোডাগামা শেরাটন হোটেলের ৭১১ ও ৭১২ নাম্বার কক্ষে রয়েছেন।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো ওপারের কন্ঠটি। কন্ঠটি লিসবনের একজন শীর্ষ গোয়েন্দা অফিসারের।
‘ধন্যবাদ মি. এ্যানটোনিও। নাম দিতেনা পারলেও যে তথ্য দিয়েছেন, সেটা কম মূল্যবান নয়। আবারও ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
বলে টেলিফোন অফ করে দিল মারিও জোসেফ। তারপর সোফায় সোজা হয়ে বসেই ডাকল, ‘সিলভা।’
কোমরে রিভলবার ঝুলানো ষ্টেনগানধারী একজন ঘরে প্রবেশ করল।
লোকটি প্রবেশ করতেই মারিও জোসেফ বলল, ‘সবাই কে তৈরী হতে বল। দুটি গাড়ি রেডি কর। এখনি যাব ভাস্কোডাগামা শেরাটনে।’ কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘যাও, আমি তৈরী হয়ে আসছি।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাড়িটা থেকে দুটি গাড়ি বেরিয়ে এল। একটি জীপ, অন্যটি মাইক্রো। গাড়ি দু’টি ছুটছে হোটেল ভাস্কোডাগামা শেরাটন লক্ষ্যে।
Leave a Reply