রাজা ম্যাগনামের পাণ্ডুলিপি
কতদিন হয়ে গেল ফ্রান্সিস মারিয়া আর ভাইকিং বন্ধুরা দেশছাড়া। কত দ্বীপ, দেশ ঘোরা হল। কত মানুষ, কত বিচিত্র তাদের ভাষা, জীবনযাত্রা। কতবার বন্দী হল ওরা। কখনও লড়াই করে, কখনও বুদ্ধি খাটিয়ে পালাতে হল। মৃত্যু হল কয়েকজন বন্ধুর। বিস্কো তো আর ফিরেই এল না। ওদের মাঝে মাঝেই মন খারাপ হয়। দেশের কথা মনে পড়ে। বিশেস করে সিনেত্রা যখন দেশের গান গায়। কত বীর ওরা। কত শক্ত মন ওদের। তবু সেই সব গান শুনে ওদের অনেকের চোখেই জল আসে। ফ্রান্সিসেরও মন খারাপ হয়। প্রয়াত মার কথা মনে পড়ে। বাবার কথা, দেশের বাড়ির কথা মনে পড়ে। সবচেয়ে ব্যাকুল হয় মারিয়ার মন। তখন ও একেবারে গুম হয়ে থাকে। ফ্রান্সিস বোঝে সেটা। বেশ কষ্ট করে মারিয়ার মনকে শান্ত করে।
সেদিন ফ্রান্সিসদের জাহাজ মাঝ সমুদ্রে চলে এসেছে। তখন পশ্চিম দিকের আকাশ অস্তগামী সূর্যের শেষ গাঢ় কমলা রঙে স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। বরাবরের মতো মারিয়া সূর্যাস্ত দেখছে–জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎকী এক গভীর দুঃখে মারিয়ার মন। ভরে উঠল। চোখে উপচে এল জল। লম্বা হাতা জামায় চোখ মুঝতে গিয়ে দেখল হাতার কাপড়টা ছেঁড়া। সেলাই করা হয়নি। এবার ভালো করে নিজের ময়লা পোশাকটার দিকে তাকাল। এ কী শ্রী হয়েছে ওর! কোথায় সেই রাজবাড়ির আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে সুবেশা নরনারীর মাঝে সম্রাজ্ঞীর মতো সে ঘুরবে ফিরবে তা নয় ভিখারিনির বেশে জাহাজে চড়ে অকূল সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে! মারিয়া রেলিঙে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ঠিক তখনই হ্যারি যাচ্ছিল জাহাজচালক ফ্লেজারের সঙ্গে কথা বলতে। মারিয়াকে কাঁদতে দেখে ও তাড়াতাড়ি ওর কাছে এল। বলে উঠল, রাজকুমারী, কী হয়েছে? আপনার শরীর ভালো তো?
মারিয়া মাথা নাড়তে নাড়তে আরও জোরে কেঁদে উঠল।
ডেকের একপাশেশাঙ্কোরা কয়েকজন বসেছিল। মারিয়াকে কাঁদতে দেখে ছুটে এল। হ্যারি বুঝল এক্ষুনি ফ্রান্সিসকে নিয়ে আসতে হবে। নইলে রাজকুমারীকে কেউ শান্ত করতে পারবে না। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ফ্রান্সিসকে নিয়ে এল। মারিয়া তখনও কেঁদে চলেছে। ফ্রান্সিস এসে মারিয়ার মাথায় হাত রাখল। মৃদুস্বরে বলল, মারিয়া শান্ত হওঁ। তুমি অস্থির হয়ে পড়লে আমরাই বা স্থির থাকব কী করে? বলল, কী হয়েছে? কেন মন খারাপ করছ?
মারিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, দেশের কথা মনে পড়ছে, বাবা-মাকে ভীষণ দেখতে.. মারিয়া কথাটা শেষ না করে আবার কাঁদতে শুরু করল।
ওদিকে ভাইকিং বন্ধুরা মারিয়ার দুঃখ দেখে দেশ বিচলিত হল। প্রায় সবাই সেখানে। এসে জড়ো হয়েছে। রাজকুমারী হলেও মারিয়ার ব্যবহারে, আচার-আচরণে এতটুকু আভিজাত্যের গর্ব কেউ কোনোদিন দেখেনি। আপন বোনের মতো ওরা সবাই মারিয়াকে ভালোবাসে। ওদের অসুখ-বিসুখে মারিয়া কখনও কখনও রাত জেগেও সেবা শুশ্রূষা করেছে। বৈদ্য ভেন বলে, আমার ওষুধে কাজ হয় অর্ধেক। বাকিটা রাজকুমারীর সেবা শুশ্রষা।
এবার ফ্রান্সিস বন্ধুদের মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ডাকল, হ্যারি!
বলো? হ্যারি এগিয়ে এল।
আমরা দেশে ফিরব।
হ্যারি একটু চুপ করে থেকে বলল, ফ্রান্সিস তোমার কথাই তো আমাদের কাছে শেষ কথা। তাহলে ফ্লেজারকে ডাকি?
ডাকো।
হ্যারি জাহাজচালক ফ্লেজারের কাছে চলে গেল।
ফ্রান্সিসের কথায় গভীর নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল জাহাজে। শুধু কানে আসছিল সমুদ্রের দুরন্ত হাওয়ার শন্ শন্ শব্দ আচমকা শাঙ্কো ধ্বনি তুলল–ও হো হো। সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত ধ্বনি উঠল। হো হো হো দেশে ফেরার আনন্দে ওরা তখন মারোয়া। মারিয়া মৃদুস্বরে বলল, আমার ওপরে নিশ্চয়ই তোমার রাগ হয়েছে।
ফ্রান্সিস হাসল। বলল, না। আমিই সবসময়ই চাই, তুমি সুখী হও। আনন্দে থাক। তখনই হ্যারি ফ্লেজারকে নিয়ে এল।
ফ্লেজার, ফ্রান্সিস বলল, মোটামুটি উত্তর দিকটা ঠিক রেখে জাহাজ চালাও। এবার দেশে ফিরব আমরা।
ঠিক আছে। ধ্রুব নক্ষত্রই আমার ভরসা। মনে হয় দিকভুল হবে না। তবে কতদিনে য়ুরোপে পৌঁছব জানি না।
ফ্রান্সিস বলল, মারিয়া, যাও বিশ্রাম করো গে।
মারিয়া আর কোনো কথা বলল না। চলে গেল ওর কেবিনের দিকে।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে পূর্ণ গতিতে। দিন যায়। রাত যায়। রাতে বন্ধুরা জাহাজের ডেকে নাচগানের আসর বসায়। সিনাত্রা গান গায়। বন্ধুরা ছোট ছোট দল বেঁধে নাচে। সিনাত্রা কখনও গায় ওদের দেশের বিয়ের গান, কখনও মেষপালকদের গান, কখনও বা রাজসভার গান।
নাচ গানের আসরে ফ্রান্সিস মারিয়াও যোগ দেয়।
দু’দুবার ঝড়-বৃষ্টির পাল্লায় পড়তে হল। সেই আকাশ অন্ধকার করে মেঘজমা, বিদ্যুতের ঝলকানি যেন ফালা ফালা করে দিচ্ছে আকাশ। সেই সঙ্গে বজ্রনির্ঘোষ আর মুষলধারায় বৃষ্টি। পালের কাঠামোর দড়িদড়া ধরে ভাইকিংদের লড়াই চলে ঝড়ের বিরুদ্ধে।
জাহাজ চলার পথে বেশ কয়েকটা ছোট-বড় বন্দর পেল ওরা। কিন্তু জাহাজ ভেড়ানো হল না। শুধু পাল দড়ি মেরামতের জন্যে একটা বন্দরে থামতে হয়েছিল। অন্য একটা বড় বন্দরে খাবার আর জলসংগ্রহের জন্যে জাহাজ ভেড়াতে হয়েছিল। নজরদার পেড্রোর কাজও হালকা হয়ে গেছে। শুধু রাত পর্যন্ত মাস্তুলের ওপরে উঠে নজরদারি করে সে।
সেদিন সকালে ফ্রান্সিস-মারিয়া সবে সকালের খাওয়া শেষ করেছে, হ্যারি ছুটে এল। বলল, ফ্রান্সিস, একটা জাহাজ আসছে দেখলাম। মাস্তুলের মথায় স্ক্যাণ্ডেনেভিয়ার পতাকা উড়ছে। মনে হচ্ছে আমরা দেশের কাছে চলে এসেছি।
তাহলে তো ওদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, ফ্রান্সিস উঠেপঁড়াল। মারিয়া উঠল। তিনজনে ডেকে উঠে এল। উজ্জ্বল রোদে আকাশ ঝলমল করছে দেখা গেল। জাহাজটা অনেক কাছাকাছি এসে গেছে। ফ্রান্সিস পতাকাটা দেখল। হ্যারিকে বলল, যাও। ফ্লেজারকে বলো ঐ জাহাজটার কাছে যেতে। হ্যারি চলে গেল। শাঙ্কোরা কয়েকজন এগিয়ে এল। ওদের জাহাজটা আস্তে আস্তে স্ক্যাণ্ডেনেভিয়ার জাহাজের গায়ের কাছে এল। ঐ জাহাজের লোকেরাও ততক্ষণে ওদের জাহাজের রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সিসদের দেখছে।
কী করবে? হ্যারি জানতে চাইল।
ওদের জাহাজে যাব।
একাই যাবে? দূর থেকে কথা বলা যাবে না?
না।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ আস্তে আস্তে ঐ জাহাজের গায়ে এসে লাগল। জোর ঝাঁকুনি খেল ফ্রান্সিসদের জাহাজটা ঝাঁকুনি সামলে ফ্রান্সিস লাফিয়ে ঐ জাহাজের ডেকে উঠে। এল।
জাহাজে উঠে বুঝল যাত্রী জাহাজ নয়। জাহাজের লোকেদের পরনে যোদ্ধার পোশাক। ফ্রান্সিস বুঝল, ওরা কোথাও যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। যোদ্ধাদের কয়েকজন ফ্রান্সিসের কাছে এসে দাঁড়াল। ভাইকিংদের দেশীয় ভাষায় জিগ্যেস করল, তোমাদের দেখে তো মনে হচ্ছে ভাইকিং।
হ্যাঁ, আমরা ভাইকিং। তোমাদের দলপতির সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।
দুজন গিয়ে দলপতিকে ডেকে আনল। দলপতির পরনে বেশ দামি পোশাক। কোমরে তরোয়াল ঝুলছে। ফ্রান্সিসদের সেলাই করা ময়লা পোশাক দেখে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে দলপতি বলল, শুনলাম তোমরা আমাদের দেশের মানুষ।
হ্যাঁ । আমরা ভাইকিং।
কিন্তু আসছ কোত্থেকে? চেহারা পোশাকে তো দেখছি একেবারে ভিখিরি।
মন্তব্য শুনে ফ্রান্সিস মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেও নিজেকে সংযত করল। ও তখন জনতে ব্যস্ত কোথায় ওরা এসেছে। তাই বলল, আমরা অনেকদিন আগে দেশ থেকে বেরিয়েছি। অতলান্তিক সাগরে, ভূমধ্য মহাসাগরে ভেসে বেড়িয়ে অনেক দ্বীপ দেশ ঘুরে দেখেছি।
এমনি এমনি এত দেশ ভ্রমণ করেছ?
কতকটা তাই। তবে কিছু গুপ্ত ধনভাণ্ডারও বুদ্ধি খাটিয়ে উদ্ধার করেছি।
তাহলে তোমাদের এই দুর্দশা কেন? দলপতি হেসে বলল।
ওসব কথা থাক। আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?
ব্রিটেনে। রৌয়েন বন্দর থেকে ফিরছি।
ব্রিটেনে কেন গিয়েছিলেন? ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল।
ব্যবসা করতে। সীলমাছের চর্বি, পশুর লোমের পোশাক–এসব।
ফ্রান্সিস একটু চমকাল। দলপতি মিথ্যে কথা বলছে। এবারও ভালো করে দলপতির মুখের দিকে তাকাল। ধৃত দৃষ্টি। কিন্তু মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই মিথ্যে কথা বলছে। দলপতির দেখেই বোঝা যাচ্ছে মোটেই ব্যবসায়ীদের মতো নিরীহ চেহারার মানুষ নয় ওরা।
দেশের কোন বন্দরে যাবেন?
দোরস্তাদ। ওখানে কিছুদিন থেকে কিন্তু এত কথা জিগ্যেস করছ কেন?
অনেকদিন পরে দেশের মানুষদের দেখছি, কথা বলছি–দেশের বন্দরের নাম শুনছি, কত কাছে চলে এসেছি ভালো লাগছে বন্ধুর মতো কথা বলতে। চলুন না একসঙ্গে ফিরি।
ঠিক আছে। চলো। কিন্তু তার আগে জানতে হয় তুমিই কি দলপতি?
হ্যাঁ।
নামটা?
ফ্রান্সিস।
অ্যাঁ। দলপতি বেশ চমকে উঠল। বলল, মানে–আপনিই কি সেই ফ্রান্সিস যে সোনার ঘণ্টা, হাঁসের ডিমের মতো মুক্তো–
হ্যাঁ, আমিই সেই ফ্রান্সিস। সঙ্গে আমার বীর বন্ধুরা।
ও। তা–এ তো আনন্দের কথা। চলুন। একসঙ্গেই যাওয়া যাক।
চলুন। ফ্রান্সিস রেলিং ধরে লাফিয়ে নিজেদের জাহাজে চলে এল। হ্যারিরা এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস ওদের সব কথা বলল। সবাই চলে গেল। হ্যারি আর মারিয়ার সঙ্গে ফিরে আসতে আসতে ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে ডাকল, হ্যারি!
হ্যারি ওর দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস একইভাবে বলল, ওদের দলপতি বলল বটে ওরা ব্যবসায়ী কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ওরা ব্রিটেনে এমন কিছু করতে গিয়েছিল যা করতে বলপ্রয়োগ প্রয়োজন। নিছক ব্যবসার ব্যাপার নয়। স্পষ্ট বুঝতে পারছি ওরা কিছু গোপন করছে। ওদের কাউকে জিগ্যেস করে দলপতির নামটা জেনো তো। লোকটা মোটেই সুবিধের নয়। জানি তো আমাদের দেশের কিছু বিপথগামী মানুষের দল আছে। জাহাজে চড়ে এদিকে ব্রিটেন ওদিকে স্থলপথে রাশিয়া পর্যন্ত গিয়ে ব্যবসার নামে দস্যুতা করে। ধনসম্পদ লুঠ করে আনে। বিক্রির জন্য ধনী ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে তাদের। এরা তেমনি একদল বলে আমার সন্দেহ হচ্ছে। ফ্রান্সি আর কিছু বলল না। কিন্তু স্থির করল ওদের জাহাজটা ভালো করে দেখবে।
হ্যারি চলে গেল। ঘরে ঢুকে মারিয়া বলল, হ্যারিকে চুপিচুপি কী বলছিলে?
তোমাকে পরে বলব। এখনও বলার মতো কিছু ঘটেনি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হ্যারি এল। বলল, ওদের দলপতির নাম হ্যারল্ড।
হুঁ। হ্যারল্ডের জাহাজটা যেভাবে হোক ভালো করে দেখতে হবে। হ্যারল্ড অনেক কিছু গোপন করছে।
কিন্তু বেশ ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাবে না? যদি সত্যি ওরা দস্যু হয়? হ্যারি আশঙ্কা প্রকাশ করল।
সবদিক ভেবেই কাজে নামব। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়তে পড়তে বলল।
পরের দিন সন্ধেবেলা ফ্রান্সিস ডেকে উঠে এল। শাঙ্কো মাস্তুলে ঠেসান দিয়ে বসেছিল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর কাছে এল। আস্তে আস্তে বলল, শাঙ্কো, একটা জরুরি কাজ আছে। শোনো। শাঙ্কো উঠে এল। ফ্রান্সিস বলল, ঐ জাহাজের দলপতির নাম হ্যারল্ড। আজ গভীর রাতে ঐ জাহাজে যাবে। লুকিয়ে জাহাজটা ঘুরে ভালোভাবে সবকিছু দেখবে। ওরা যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়।
তরোয়াল নিয়ে যাব?
না। পরে দরকার পড়লে লড়াই করা যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
তুমি গেলে ভালো হত না?
না। যদি ধরা পড়ে যাও তাহলে বলতে পারবে, আমাদের জাহাজে শুয়ে বড় অসুবিধে হচ্ছে তাই দেখতে এসেছিলাম আমাদের কয়েকজন এখানে এসে রাতটা থাকতে পারব কিনা। তোমাদের দলপতি হিসাবে আমার এই অনুরোধ করাটা ওরা সন্দেহের চোখে দেখতে পারে। তুমি বললে ওদের কোনো সন্দেহ হবে না।
রাত হল। শাঙ্কো ডেকে এসে হালের কাছে শুয়ে পড়ল। দু’চারজন বন্ধু ওকে ওদের কাছে এসে শুতে বলল। শাঙ্কো গেল না।
আকাশে আধভাঙা চাঁদ অনেকটা উজ্জ্বল। জোর হাওয়া বইছে। রাত বাড়তে লাগল। চাঁদের আলোয় হ্যারল্ডের জাহাজের দিকে ও তাকিয়ে রইল। দেখল, মাস্তুলের ওপর কোনো নজরদার নেই। উঠে বসল। রেলিঙের ধারেও কেউ নেই। ওরা শুয়ে পড়েছে, নিশ্চয়ই। ঘুমুচ্ছে। শাঙ্কো আস্তে আস্তে গড়িয়ে হালের কাছে এল। উঠে দাঁড়াল। হালের এক দড়িদড়া ধরে আস্তে আস্তে সমুদ্রের জলে নামল। যেটুকু আওয়াজ হল বাতাসের শনশন শব্দে ঢাকা পড়ে গেল। ও ডুব সাঁতার দিয়ে হ্যারল্ডের জাহাজের কাছে গিয়ে ভেসে উঠল। হাঁ করে শ্বাস নিল। তারপর হ্যারল্ডের জাহাজের হালের কাছে গেল। দড়িদড়া ধরে নিঃশব্দে জাহাজের ডেকেউঠে এল। দেখল কেউপাহারা দিচ্ছেনা। ডেকেরএখানে-ওখানে দু’তিনজন ঘুমুচ্ছে। শাঙ্কো চারদিকে তাকাল। মাস্তুল-পাল-দড়িদড়া। নজরে পড়ার মতো কিছু নেই। আর পাঁচটা জাহাজে যেমন থাকে। ও নিঃশব্দেসিঁড়িঘরের কাছে এল। তারপর আস্তে আস্তে পা ফেলে নীচে নামল। এখানে-ওখানে বাতি ঝুলছে। দু’পাশের ছোট ছোট কেবিন পার হল। সামনেই একটা ঘর। বেশ বড়। অল্প আলোয় দেখল। সেই ঘরের দরজা লোহার গরাদের। ভিতরে কোনো আলো নেই। গরাদের গায়ে একটা বড় তালা ঝুলছে। শাঙ্কো হামাগুড়ি দিয়ে তালাটার কাছে গেল। উঁকি দিয়ে দেখল, অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় ব্যবসার মালপত্র রাখা হয়। তখনই হঠাৎ নিঃশ্বাস ফেলার মৃদু শব্দ শুনল। শাঙ্কো চমকে উঠল। তাহলে ভেতরে মানুষ আছে। স্পষ্ট শুনল কেউ যেন পাশ ফিরল। ও আবার তাকাল। খুব অস্পষ্ট দেখল শুয়ে থাকা মানুষ। ক’জন বুঝল না। কোনায় একটা লম্বাটে সিন্দুকের আভাস। শাঙ্কো বুঝল এটা কয়েদঘর। ও দ্রুত পিছিয়ে এল। তারপর পা টিপে টিপে সিঁড়ির কাছে চলে এল। আস্তে আস্তে সিঁড়ির মাথায় আসতে ও ডেকে শুয়ে থাকা একজনের বিরক্তি ভরা কথা শুনল, অ্যাই, চাদরটা নিয়েছিস কেন?
বেশ করেছি। অন্যজনের ঘুমজড়িত কণ্ঠস্বর। শাঙ্কো মাথাতুলতে গিয়েইনামিয়ে ফেলল। তবু যে লোক্টা ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল সে ওর মাথাটা দেখে ফেলেছে। সতর্ক কণ্ঠে বেশ জোর গলায় বলে উঠল–কে রে ওখানে? অ্যাই?
শাঙ্কো বুঝল ধরা পড়ে গেছে। ও আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। ডেকে উঠেই দ্রুত ছুটে গিয়ে রেলিং ডিঙিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওরা দু’একজন কিছু বুঝে ওঠার আগে ঘটে গেল ঘটনাটা। ওরা অবাক। শাঙ্কো ডুব সাঁতার দিয়ে ওদের জাহাজের কাছে এসে আস্তে মাথা তুলল। হাঁপাতে হাঁপাতে দু’হাতে জল ঠেলে হালের কাছে চলে এল। হাল ধরে চুপ করে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
ওরা ততক্ষণে ডেকে ছুটোছুটি করে চারদিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু শাঙ্কোকে দেখতে পেল না। শাঙ্কোর মাথা তখন হালের আড়ালে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা হতাশ হয়ে ডেকে গিয়ে শুয়ে পড়ল। একজন ছুটে গেল হ্যারল্ডের কাছে, খবরটা দলপতিকে জানাতে। দলপতি কিছু পরে ডেকে উঠে এল। চারদিকে সমুদ্রের জল দেখল। সব শুনল। তারপর ফিরে গেল। শাঙ্কো অপেক্ষা করতে লাগল। ওদিক আকাশে চাঁদ ম্লান হয়ে আসছে। পুব আকাশ সাদাটে হয়ে গেছে। সূর্য উঠতে বেশি দেরি নেই। শাঙ্কো আর অপেক্ষা করল না। ডেকে উঠে এসে ভেজা পোশাকেই শুয়ে পড়ল। আর ওদের নজরে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
সকাল হল। ডেক থেকে শাঙ্কো নেমে এল নিজেদের কেবিনে। বন্ধুরা ওর ভেজা পোশাক দেখে বলল, কী রে–জলে নেমেছিলি কেন?
গরম লাগছিল। স্নান করলাম। শাঙ্কো ভেজা পোশাক ছাড়তে ছাড়তে বলল।
সকালের খাবার খেয়ে শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস ওর জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। তখনই হ্যারিও এল। হ্যারি এ সময় প্রায় নিয়মিত ফ্রান্সিসের কাছে আসে কথা বলতে। জাহাজের কাজকর্ম ঠিক চলছে কিনা, কারও অসুখ-বিসুখ হল কিনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা–এসব নিয়ে কথা হয় দুজনের।
শাঙ্কো কী দেখলে বলো, ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল। শাঙ্কো আস্তে আস্তে সব বলে গেল। দুই বন্ধু শুনল সব।
যাক নির্বিঘ্নে পালাতে পেরেছ। এখন কথা হল, কেন কয়েদঘর আছে ঐ জাহাজে। কেন কিছু মানুষকে বন্দী করে রাখা হয়েছে? হ্যারি, কী বলে?
এটা তো স্পষ্ট হয়ে গেল যে হ্যারল্ডরা ব্যবসায়ী নয়। তবে এও হতে পারে শৃঙ্খলা ভাঙায় বা দলবিরোধী কিছু করেছিল বলে ওদের বন্দী করে রাখা হয়েছে।
উঁহু। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। হ্যারি, ব্যাপারটা অত সহজ সরল নয়। ভুলে যেও না ইংল্যান্ডে গিয়ে আমাদের দেশের কিছু দুরাচারী মানুষ লুঠপাট করে ধনসম্পদ নিয়ে এসেছে। আমরা দুর্নামের ভাগী হয়েছি। কাজেই খুব পরিষ্কার হ্যারল্ডরা ডাকাতের দল। যারা এসবের বিরোধিতা করেছে তাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। এবার শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল, সিন্দুকের মতো কিছু দেখেছ বলছিলে।
হ্যাঁ । অন্ধকারে তো স্পষ্ট দেখতে পাইনি, খুব আবছা দেখেছি।
লুঠের ধনসম্পদ ওটাতেই রাখা আছে, হ্যারি বলল।
হুঁ। এখন আমরা কী করব? ফ্রান্সিস একটু চিন্তিত স্বরে বলল।
চুপ করে থাকব। দোরস্তাদ বন্দরে নেমে ওদের রাজার সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দেব, হ্যারি বলল।
অত সহজে হবে না। ডাকাত লুঠেরার দল। বিপদ আঁচ করতে পারলে আমাদের মেরে ফেলতেও এদের হাত কাঁপবে না। এবার আমাদের সাবধান হবার সময় এসেছে।
উঁহু, বেশি সাবধান হতে গেলে আমাদের আচার-আচরণে, কথাবার্তায় অস্বাভাবিকতা এসে যাবে। জানলাম শুধু আমরা চারজন। তারপরমারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘটনাক্রমে তুমিও সব জানলে। সাবধান, এইসব নিয়ে কারো সঙ্গে কোনো কথা বলবে না।
হ্যারিরা চলে গেল।
দিন দুয়েক পরের কথা। সকালের দিকে হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল, হ্যারল্ড তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। বলছে বিশেষ দরকার।
দুজনে ডেকে উঠে এল। দেখা গেল হ্যারল্ডের জাহাজটা ঘুরিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে লাগানো হয়েছে। ঐ জাহাজের রেলিং ধরে হ্যারল্ড দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস, হ্যারি এগিয়ে গিয়ে হ্যারল্ডের মুখোমুখি দাঁড়াল। হ্যারল্ড বলল, খুব সমস্যায় পড়েছি। আপনাদের জাহাজে কোনো বৈদ্য আছে?
হ্যাঁ। কেন বলুন তো?
আমাদের একজন সঙ্গী বৃদ্ধ। খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যদি আপনাদের বৈদ্য তাকে দেখে ওষুধ-টষুধের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে খুবই উপকার হয়। হ্যারল্ড বলল।
মুশকিল হয়েছে আমাদের বৈদ্য ভেনও প্রৌঢ়। রোগী দেখতে হবে, ওষুধ দিতে হবে, ওষুধে কাজ হচ্ছে কিনা পরীক্ষা করতে হবে। ভেন তো বারবার আপনাদের জাহাজে যাওয়া-আসা করতে পারবে না। তাও এই মাঝ সমুদ্রে। তার চেয়ে ভালো হয় আপনার রোগী আমাদের জাহাজে এসে থাকুক। চিকিৎসা সেবা-শুশ্রূষার কোনো গাফিলতি হবে না, কথা দিচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারল্ড কিছুক্ষণ কী ভাবল। তারপর বলল, হুঁ। এছাড়া তো উপায় দেখছি না। তবে একটা কথা বলছি, বৃদ্ধটি মানে ক্রেভান বেশ ছিটগ্রস্ত। প্রায় পাগলই। আজেবাজে বকে। ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না। যত আজগুবি কথাবার্তা।
বেশ, ফ্রান্সিস বলল।
তাহলে ক্রেভানকে পৌঁছে দিচ্ছি আপনাদের জাহাজে।
ঠিক আছে। ফ্রান্সিস, শাঙ্কো, সিনাত্রা আর দু’একজন বন্ধুকে ডাকল। হ্যারল্ডের জাহাজের কয়েকজন বৃদ্ধ ক্রেভানকে কাঁধে করে রেলিঙের ধারে নিয়ে এল। শাঙ্কোরা এগিয়ে গেল। ওরা ক্রেভানকে শোয়া অবস্থাতেই আস্তে আস্তে এগিয়ে দিল শাঙ্কোদের দিকে। শাঙ্কোরা ক্রেভানকে ধরে ধরে নিয়ে এল।
শাঙ্কো, ক্রেভানকে আমার কেবিনে নিয়ে যাও আর ভেনকে আসতে বলল। শাঙ্কোদের কাঁধে ক্রেন দু’চোখ বুজে শুয়ে আছে। রোগজীর্ণ চোখমুখ। সারা মুখে পাকা দাড়ি গোঁফ। মাথার ঝাঁকড়া চুলও সাদা ধবধবে। শাঙ্কোরা ক্রেভানকে নিয়ে গেল।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে নিজের কেবিনে এল। ক্রেভানকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সিস ক্রেভানের কাছে এল। দু’চোখ বোজা। শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস ওর মুখে কাছে মুখ নিয়ে ডাকল, ক্রেভান। ক্রেন চুপ। ফ্রান্সিস আবার ডাল, ক্রেভান, শুনছেন? ক্রেভান এবার আস্তে আস্তে চোখ খুলল।
কী কষ্ট আপনার?
বড্ড–দুর্বল। ক্রেভান মৃদুস্বরে টেনে টেনে বলল।
আমাদের বৈদ্য ভেন ওষুধ দেবে। ও খুব ভালো বৈদ্য। ওষুধ খাবেন। মারিয়া আপনার সেবা-শুশ্রুষর করবে। কয়েকদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবেন।
তখনই ভেন ওর ওষুধের বোয়াম নিয়ে এল। ক্রেভানের পাশে বসল। চোখের নীচে টেনে, কপালে গলায় হাত দিয়ে যেমন করে রোগী পরীক্ষা করে তেমনি করে পরীক্ষা করল। ভেন জিগ্যেস করল, দেখছি জ্বর আছে। কদিন জ্বর হয়েছে আপনার?
জানি না, তবে সাত-আট দিন–বেশিও–
হুঁ। আর কী কষ্ট?
মাথায়–অসহ্য-ব্য–আথা। বলতে বলতে ক্রেভানের শরীর খুব জোরে কেঁপে উঠল। বুকেও ককষ্ট। ক্রেভান খুব আস্তে আস্তে বলল।
ভেন ওর ঝোলা থেকে বোয়ামগুলো বের করে পাথরের বাটিতে কীসের শেকড়ের টুকরো নিয়ে ঘষতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেনের ওষুধ তৈরি হয়ে গেল। ভেন এবার মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনিই তো সেবা-শুশ্রূষা করবেন। ওষুধ-পথ্যি বুঝে নিন। ভেন মারিয়াকে সব বুঝিয়ে দিল।
কেমন দেখলে ভেন? ফ্রান্সিস সাগ্রহে জানতে চাইল।
রোগীর শরীরের ওপর দিয়ে খুব ধকল গেছে। ভালো খাওয়া জোটেনি, ঠাণ্ডা লেগে বুকে সাংঘাতিক কফ জমেছে। বলতে গেলে কোনো চিকিৎসাই হয়নি। সুস্থ হতে সময় লাগবে। ভেন বলল।
কিছুক্ষণ পরে হ্যারল্ড ফ্রান্সিসের কেবিনে এল। বৈদ্য কেমন দেখল, ওষুধ দিয়েছে। কিনা, কবে নাগাদ সুস্থ হবে এসব কথা জিগ্যেস করল। তারপর বলল, সেবা-শুশ্রূষার জন্যে লোক পাঠাব?
দরকার নেই। ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেখিয়ে বলল, উনিই সব করবেন।
এতক্ষণ হ্যারল্ড মারিয়াকে বারবার দেখছিল। কৌতূহল চেপে ছিল। এবার বলল, মানে ইনি কে?
রাজকুমারী মারিয়া, হ্যারি বলল।
কিন্তু উনি রাজকুমারী হয়ে মানে
ও প্রসঙ্গ থাক। ফ্রান্সিস বলে উঠল।
হ্যারল্ড ক্রেনের দিকে তাকিয়ে বলল, বুড়ো, চুপ করে শুয়ে থাকবে। এক্কেবারে আজেবাজে বকবে না। তারপর ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল, মাথায় ছিট আছে, পাগলের মতো বকে। ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না।
হ্যাঁ, আপনি বলেছেন আগে। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারল্ড চলে গেল।
দু’দিন কাটল। এর মধ্যে হ্যারল্ড এসেছে। বারবার একই কথা বলে গেছে, পাগল, ক্ষ্যাপা।
ওষুধ, সেবা-শুশ্রূষায় ক্রেভান অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। এর মধ্যে ক্রেভান কখনও পথ্য খাবার সময়, কখনও ঘুমের ঘোরে নানা অসংলগ্ন কথা বলেছে কত দেশ ঘুরলাম… বাড়িছাড়া দেশছাড়া… রাজা ম্যাগনাম…কী সংঘাতিকঝড়… ডুবে গেল…সব ডুবে গেল।
ফ্রান্সিস ভেনকে এসব কথা বলেছে। তারপর জিগ্যেস করেছে, তোমার কি মনে হয় লোকটা পাগল?
ভেন মাথা নেড়ে বলেছে, জ্বরের ঘোরে অনেকে আবোল-তাবোল বকে। ঘুমের মধ্যে কথা বলাও অনেকের অভ্যেস। তবে রোগীর সঙ্গে আমার যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে তাতে বুঝেছি, কোনো কারণেই হোক ও খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারছে না। তাই বলে ওকে পাগল বলা যায় না। মনে হয় ওর সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা হয়েছে। ভেন ক্রেভানকে দেখে টেখে কিছু জিগ্যেস-টিগ্যেস করে মারিয়াকে নির্দেশ দিয়ে চলে যাবার আগে বলল, রোগী অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে।
ভেন বেরিয়ে যেতেই হঠাৎ ক্রেভান বলে উঠল, উঠে বসি।
ফ্রান্সিস দ্রুত এগিয়ে এল। বলল, না না, শুয়ে থাকুন।
ক্রেভান মৃদু হেসে বলল, বদ্ধ ঘরে মেঝেয় শুয়েই তো থাকতাম সবসময়। ইচ্ছে করে খেতাম না। মরতেই চেয়েছিলাম… কিন্তু… ক্রেন থেমে গেল।
ফ্রান্সিস ভীষণভাবে চমকে উঠল, এ তো পাগলের কথা নয়। ও ক্রেভানকে ধরে আস্তে আস্তে বসাল। ক্রেভানের মুখের দিকে তাকাল। বৃদ্ধের চোখে-মুখে বেশ উজ্জ্বলতা। ক্রেভান অল্পক্ষণ বসে থেকে বলল, দাঁড়াব।
না-না, একদিনে এতটা পারবেন না। ফ্রান্সিস বলল।
পারব। শুধু একটা শর্ত, হ্যারল্ডের হাতে আমাকে ছেড়ে দেবেন না। ক্রেভান কাতর দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল।
কেন বলুন তো?
সে অনেক কথা। অত কথা এক নাগাড়ে বলতে পারব না। আর একটু সুস্থ হলে
ফ্রান্সিস দ্রুত মারিয়ার দিকে তাকাল। মারিয়াও ক্রেভানের কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।
শীগগির হ্যারিকে ডাকো। মারিয়া চমক ভেঙে দ্রুত উঠে গেল। একটু পরেই হ্যারি ছুটে এল।
ক্রেভান বলল, কথা দিন।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার কোনো ক্ষতি আমি হতে দেব না। আমি ফ্রান্সিস। সঙ্গে আমার বীর বন্ধুরা। কোনো অন্যায় অবিচার অত্যাচার আমরা সহ্য করি না।
ক্রেভান একটু থেমে থেমে বলতে শুরু করল
তবে শুনুন। সংক্ষেপে বলি। চিরকাল বাউণ্ডুলে আমি। কিন্তু শিক্ষা গ্রহণ করেছি এদেশ-ওদেশে-নরওয়ে থেকে রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত। একটু থামল ক্রেভান। বলল, জল। মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে কাঁচের গ্লাসে জল নিয়ে এল। জল খেয়ে যেন একটু ধাতস্থ হল। তারপর ফের শুরু করল, নরওয়ের রাজবাড়ির গ্রন্থাগারে একটা সূত্র পেয়েছিলাম। পুরোনোকালের এক ইতিহাসবিদের লেখা বই, কাগজের মতো পাতলা চামড়ায়। প্রায় জরাজীর্ণ অবস্থা তার। বইতে ছিল অতীতের এক রাজা ম্যাগনামের কথা। সাতটা জাহাজে দুর্ধর্ষ সব সৈন্যদের নিয়ে সাধারণ পোশাক পরে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। ওদের কাছে এ নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন ব্যবসায়ী বলে। ক্রেন থামল। একটু জিরিয়ে বলতে লাগল, তীরের কাছাকাছি বড় বড় মঠ-গির্জা লুঠ করেছিলেন। নরহত্যা থেকে শুরু করে সব রকম অত্যাচার করেছিলেন। যা হোক ফিরে এলেন জাহাজঘাটায়। নৌযুদ্ধে ইংল্যান্ডের লোকেরা অত্যন্ত দক্ষ। রাজা ম্যাগনামের একটা মাত্র জাহাজ ডুবে গেলনা। সেই জাহাজেই প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে আসছে যে বন্দরে, হ্যারল্ডের জাহাজও যাবে সেই দোরস্তাদ বন্দরে, নোঙর করবে বলে–উঠল প্রচণ্ড ঝড়। জাহাজডুবি হয়ে রাজা ম্যাগনাম মারা গেলেন।
আর সেই ধনসম্পদ? ফ্রান্সিস সাগ্রহে জিগ্যেস করল।
সলিল সমাধি।
কোথায়?
উত্তরের খাঁড়িতে। কিন্তু সেই ইতিহাসবিদ সবশেষে একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন রাজা ম্যাগনাম মারা যাননি, যদিও সবাই জানত যে রাজা বেঁচে ফেরেননি।
সেই ইতিহাসবিদ জানলেন কী করে?
তিনি ফুটনোটে এই কথাগুলি খুব অস্পষ্ট অক্ষরে লিখেছিলেন, ঠিক এই কথা– সেই খাঁড়ির ধারে, স্লাভিয়া গিয়েছিলাম, একপাটি জুতো পেয়েছিলাম, দামি, অভিজাত–। ব্যস–পরের পাতা নেই। হয়তো কিছু লেখা ছিল। ক্রেন থামল। একটু হাঁপাতে লাগল। দম নিয়ে বলল, একটু ধরো তো উঠে দাঁড়াব। পায়ের জোর দেখি, পালাতে হলে–1 ফ্রান্সিস আর হ্যারি এসে দু’দিক থেকে ক্রেভানকে ধরল। আস্তে আস্তে উঠিয়ে দাঁড় করাল। ক্রেভানের শরীরটা একটু কেঁপে উঠল। সে পা ফেলে দু’তিন পা হাঁটল। হেসে বলল, একটু জোর পাচ্ছি। তখনই দরজার বাইরে শাঙ্কোর গলা শোনা গেল, হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু ভালো আছেন।
হুঁ। তাহলে তো নিয়ে যেতে হয়। হ্যারল্ডের গলা। হ্যারল্ডের গলা শোনামাত্র আতঙ্কে ক্রেভানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ফ্রান্সিসদের হাত ছাড়িয়ে এক ছুটে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। দ্রুত হাতে কম্বলটা টেনে নিল। হ্যারল্ড ঢুকল।
এই যে বুড়ো, শুনলাম ভালো আছ। কাষ্ঠহাসি হেসে বলল হ্যারল্ড। ক্রেভান কোনো কথা বলল না। ফ্রান্সিস তখন ভাবছে ক্রেভান এতটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল কেন? নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর ব্যাপার আছে।
ফ্রান্সিস বলল, তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। আমাদের বৈদ্য বলছিল, দু’চার দিন না গেলে ঠিক বোঝা যাবে না।
না-না। আর এখানে ফেলে রাখা যায় না।
ঠিক আছে। বৈদ্য ভেন কী বলে দেখি। ফ্রান্সিস বলল।
বসতে পারছে? দাঁড়াতে পারছে? হ্যারল্ড জানতে চাইল।
না, এসে অব্দি তো শুয়েই থাকেন। ফ্রান্সিস বলল।
ও। কাল সকালে খবর নিতে আসব। দেখি কেমন থাকে।
হঠাৎই ক্রেভান বলতে লাগল, কালো অন্ধকার আকাশ… পাথরের মতো জমাট মেঘ… বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে… ঝড় ধেয়ে এল… প্রচণ্ড ঝড়… হাল ভেঙে গেল।
ঐ শুনুন। একে পাগল ছাড়া কী বলবেন? যত আজগুবি প্রলাপ। বিশ্বাস করবেন না ওর কথা। হ্যারল্ড হাত নেড়ে বলল।
বিকেল হল। ক্রেভানকে ওষুধ খাইয়ে মারিয়া সূৰ্য্যাস্ত দেখতে চলে গেল। হ্যারি এল। ফ্রান্সিস বলল, খুব সময়ে এসেছ। এবার চোখ বুজে থাকা ক্রেভানের মুখের ওপর ঝুঁকে ফ্রান্সিস ডাল, ক্রেভান শুনছেন? ক্রেভান চোখ খুলে তাকাল।
আপনার যদি কষ্ট না হয় তাহলে আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?
বলো।
হ্যারল্ডের সঙ্গে আপনার কীভাবে পরিচয় হল? হ্যারল্ডকে আপনি এত ভয় পান কেন? মরে যেতে চান কেন?
ক্রেভান একটুচুপ করে থেকে বলল, সব বলছি সংক্ষেপে, তাই থেকে বুঝেনাও। তারপর বলতেলাগল, অনেক বছর এদেশও-দেশ ঘুরে বয়েসের ভারেআর পারছিলাম না। জাহাজ থেকে নামলাম ঐ দোরস্তাদ বন্দরে। মনে পড়ে গেল সেইইতিহাসবিদের বইয়ের কথা। লোভ হল, ধনসম্পত্তিরতৃষ্ণা। দেখিইনা রাজাম্যাগনামেরডুবে যাওয়া জাহাজেরহদিসপাইকিনা। স্লাভিয়া গেলাম। খোঁজ–খোঁজ। কয়েক বছর ধরে খুঁজছি। একটা কৃষকের বাড়িতে গেলাম, যত্ন করে রেখেছিল একপাটিজুতো। দেখেই বুঝেছিলাম। সোনার কাজছিল, দামি পাথরটাথর বসানোছিল। রাজাদের জুতোই। বুঝলাম, রাজা ম্যাগনামের জাহাজ পাশের খাঁড়ি এইস্লাভিয়া পর্যন্ত এসেছিল। খাঁড়ি, খাঁড়ির আশপাশ, দু’পাশের এলাকা চষে বেড়ালাম। কাটল বেশকিছুদিন। মনে পড়ল, বইয়ের লেখা…ইংল্যান্ডের রউয়েন বন্দর থেকেলয়েরউপত্যকারমঠ গির্জার ধন সম্পদ… লুঠ…হত্যা। এন্টু থামল ক্রেভান।
আপনি লয়ের উপত্যকায় গিয়েছিলেন?
ঠিক ধরেছ। দোরস্তাদ বন্দরে হ্যারল্ডের দলের সঙ্গে পরিচয়। ব্যবসায়ী, কিন্তু লয়ের উপত্যকায় পৌঁছে স্বমূর্তি। লুঠ, হত্যা। দস্যুর দল, পালাতে পারলাম না। হ্যারল্ডকে রাজা ম্যাগনামের জাহাজডুবি, খাঁড়িতে লুণ্ঠিত ধনসম্পদের কথা সব বলেছিলাম। ওরা আমাকে বন্দী করল। কী অত্যাচার! মরতে চাইলাম, মরতে দিল না। ক্রেভান দম নেবার জন্যে থামল।
মনে হয় আরো কিছু লোক বন্দী।
হ্যাঁ, ক্রীতদাস ওরা। ধনী মুসলিম ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করবে। লুণ্ঠিত সম্পদ, বিক্রির দাম কত কত রিকা, আরবীয় স্বর্ণমুদ্রা–
এবার ফ্রান্সিস চমকে উঠল-ক্রীতদাস।
ফ্রান্সিস, হ্যারল্ড কী জঘন্য মানুষ! হ্যারি বলে উঠল।
ক্রেভান বলতে লাগল, স্লাভিয়ার সেই বাড়িতে বহু পুরোনো পাণ্ডুলিপি–রাজা ম্যাগনামের লেখা পেয়েছিলাম। হ্যারল্ডকে দেখিয়েছিলাম। সেটাই কাল হল। ছিনিয়ে নিল। অনেক কষ্টে পড়ে পড়ে মুখস্থ করল। কিন্তু অসম্পূর্ণ। হঠাৎ ছিঁড়ে গেছে।
সেই পাণ্ডুলিপির সবটা মনে আছে আপনার? ফ্রান্সিস তখন উত্তেজিত। সাগ্রহে জিগ্যেস করল।
হ্যাঁ ।
বলুন।
প্রথমে লুঠপাটের কথা। সেসব থাক, দরকারি জায়গাটা বলছি। একটু থেমে বলতে লাগল, ইংল্যান্ডবাসীরা জাহাজ ডোবাল। একটা জাহাজেই ধনসম্পদ নিয়ে ফিরে আসতে লাগলাম। লক্ষ্য দোরস্তাদ বন্দর। ব্যবসায়ীর পোশাক ছেড়ে লুকোনো রাজপরিচ্ছদ পরলাম। জাহাজ চলল তীরবেগে। দু’রাত জেগে আনন্দ হৈ-হল্লা নাচগান চলল। দোরস্তাদ বন্দরের কাছে এলাম। আবার একটু থামল ক্রেভান। তারপর বলল, ঝড় শুরু হল। প্রচণ্ড ঝড়। ফের বিরতি। তারপর বলল, এখান থেকে অক্ষর-গুলো আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে পাঠোদ্ধার করেছি, আমি লিখে চলেছি, কী দেখছিলিখছি। বুঝলাম খাঁড়িতে ঢুকে পড়েছি। মুষলধারে বৃষ্টি। দু’পাশেটাল খেতে খেতে… আর লিখতে পারছি না, প্রচণ্ড ধাক্কা। কে ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে বলল, সামনে, সাদাটে–ক্রেভান বলল, এখানেই পাণ্ডুলিপির শেষ, তার পরই ছেঁড়া। জানি না আরও কিছু লেখা ছিল কিনা।
ফ্রান্সিস এতক্ষণ গভীর মনোযোগের সঙ্গে ক্রেভানের কথা শুনছিল। এবার বলল, বোঝা গেল রাজা ম্যাগনামের জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। আপনার কি মনে হয় রাজা ম্যাগনামের ডুবে-যাওয়া জাহাজে ধনৈশ্বর্য ছিল?
অবশ্যই। শুধু খুঁজে উদ্ধার করা। ক্রেভান বলল।
আমাকে আরও কিছু জানতে হবে। তার জন্য স্লাভিয়ার গ্রামে যেতে হবে। তার আগে আপনাকে আর হ্যারল্ডের জাহাজে বন্দী ক্রীতদাসের মুক্ত করতে হবে।
ক্রেভান ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, হ্যারল্ড সাংঘাতিক লোক নিষ্ঠুর, নৃশংস। তোমাদের হত্যা—
ফ্রান্সিস তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, দেখা যাক।
হ্যারল্ড পরদিন সকালেই এসে হাজির। সেঁতো হাসি হেসে বলল, অ্যাই বুড়ো খুব আয়েস করেছিস, চল্ এবার।
ফ্রান্সিস দেখল হ্যারল্ড তিন-চারজন সঙ্গী নিয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে সোজা হ্যারল্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরস্বরে বলল, ক্রেভান যাবেনা। হ্যারি চমকে উঠে চাপাস্বরে বলে উঠল, ফ্রান্সিস! হ্যারল্ড এরকম কথা বোধহয় আশা করেনি। চোখ কুঁচকে বলল, কেন বলুন তো? ক্রেভান আমাদের সঙ্গেইংল্যান্ডে এসেছে, আমাদের সঙ্গেই ফিরবে।
ক্রেভান বলেছে, ও ইচ্ছে করে কম খেত। কারণ ও মরে যেতে চেয়েছিল।
বলেছিলাম না পাগল। আর কী বলেছে ও?
আপনারা ব্যবসায়ী সেজে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। তারপর ওখানকার মঠ- গির্জার সঞ্চিত ধনৈশ্বর্য লুঠ করে এনেছেন। নরহত্যা, অত্যাচার
বদ্ধ পাগল। বলেছিলাম না। হ্যারল্ড চড়া গলায় বলে উঠল।
শুধু তাই নয়, আরবীয় ধনী ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করবেন বলে ক্রীতদাসের মতো ইংরেজদের বন্দী করে এনেছেন।
পাগলের প্রলাপ। হ্যারল্ড হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, আপনি ভালো করে দেখুন আমরা সশস্ত্র।
আমি আপনাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছি। কথাটা বলে ফ্রান্সিস হাত বাড়াল, হ্যারি তরোয়ালটা দাও। দুজনের কথা চলতে চলতে ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে কেউ ভাবেনি এক ফ্রান্সিস ছাড়া।
ফ্রান্সিস, শান্ত হও, ভয়ার্ত গলায় মারিয়া বলে উঠল।
কাঁপা কাঁপা গলায় ক্রেভান বলল, ফ্রান্সিস, আমার জন্যে
শুধু আপনার জন্যে নয়। সমস্ত ভাইকিং জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে আমাকে লড়তেই হবে। হ্যারি ততক্ষণে ফ্রান্সিসের বিছানার নীচ থেকে ফ্রান্সিসের তরোয়ালটা নিয়ে এসেছে। হ্যারল্ড কেমন নিরীহের মতো বলল, দেখুন, এইসব লড়াই, রক্তপাত, আমি পছন্দ করি না। তার চেয়ে আপনি আমার জাহাজে আসুন, সব নিজের চোখে দেখবেন। ক্রেভান কতবড় মিথ্যেবাদী সেটাও বুঝতে পারবেন।
বেশ চলুন। কিন্তু আপনাকে নিরস্ত্র যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
ভালো কথা। হ্যারল্ড কোমরবন্ধনী থেকে তরোয়াল খুলে একজন সঙ্গীর হাতে দিল। তারপর বলল, কিন্তু আপনাকৈ একা যেতে হবে। তরোয়াল রেখে দিন।
বেশ। তাই যাব। ফ্রান্সিস মাথা তুলে বলল। তারপর হ্যারিকে তরোয়ালটা দিয়ে দিল।
সবার আগে হ্যারল্ড চলল সিঁড়ির দিকে। শাঙ্কো বন্ধু কয়েকজনকে নিয়ে তার আগেই দ্রুত ডেকে উঠে এল। শাঙ্কোর মনে তখন আশঙ্কা। হাঙরের কামড়ে আহত ফ্রান্সিস এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। তরোয়ালের লড়াইয়ে আগের মতো বিদুৎগতিতে আক্রমণ করতে পারে না। দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামলে ফ্রান্সিস জয়ী হলেও অক্ষত থাকবে না। ও নিঃশব্দে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে অস্ত্রঘরে চলে এল। ডেকে উঠে এল সবাই। জাহাজ দুটো গায়ে গায়ে লাগানো রয়েছে। প্রথমে হ্যারল্ডের সঙ্গীরা লাফ দিয়ে ওদের জাহাজে গিয়ে উঠল। পেছনে হ্যারল্ড আর ফ্রান্সিস। হ্যারল্ড ডেকের চারদিক হাত ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলল, দেখুন, কোথায় ধনসম্পদ? কোথায় বন্দী ক্রীতদাস?
ও সব ডেকে কেউ সাজিয়ে রাখে না। ফ্রান্সিস ক্রুদ্ধ হলেও মৃদু হাসল। বলল, সিঁড়ি দিয়ে নীচে চলুন। সিঁড়ির ধারে এসে হ্যারল্ড ফিরে দাঁড়াল। ওর সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, আগে তোরা নেমে যা। যে সঙ্গীটি হ্যারল্ডের তরোয়ালটার হাতল ধরে ঝুলিয়ে আসছিল সে এগিয়ে এল।
ফ্রান্সিস বলে উঠল, সবাই তরোয়াল ডেকে রেখে যাবে। ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতে না হতেই হ্যারল্ড দ্রুত হাতে সঙ্গীর হাত থেকে তরোয়ালটা ছিনিয়ে নিল। সতর্ক ফ্রান্সিস শরীরের এক ঝটকায় কয়েক পা পিছিয়ে এল। কিন্তু একটু কমজোরি বাঁ পাটার জন্যে ভারসাম্য রাখতে পারল না। ডেকের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। মুখে ক্রুর হাসি হত্যাকারীর জ্বলন্ত চোখ নিয়ে হ্যারল্ড একলাফে উদ্যত তরোয়াল হাতে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস গড়িয়ে গেল। বিদুৎবেগে পাক খেয়ে ছুটে এল শাঙ্কোর ছোঁড়া ছোরাটা। হ্যারল্ডের বুকে লাগল না। ওর ডান কাঁধ ছুঁয়ে গেল। এইটুকু বাধাতেই হ্যারল্ড আর ফ্রান্সিসের শরীর লক্ষ্য করে তরোয়াল চালাতে পারল না। ও একটু থমকাল।
ততক্ষণ হ্যারিও জোরগলায় ‘ফ্রান্সিস’ ডাক দিয়ে তার দিকে তরোয়াল ছুঁড়ে দিয়েছে। ফ্রান্সিস দ্রুত মুখ তুলে তরোয়ালের ফলাটা ধরে ফেলল। ওর হাতের তালু ও আঙুল কিছুটা কেটে গেল। রক্ত বেরিয়ে এল। তরোয়ালের হাতলটা ধরে ও দ্রুত উঠে দাঁড়াল। কাঁধে ছোরার ক্ষত নিয়ে হ্যারল্ড তরোয়াল উঁচিয়ে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তরোয়ালের প্রথম মারটা ঠেকিয়ে ফ্রান্সিস একটু পিছিয়ে এল। তারপর রুখে দাঁড়াল। শুরু হল দুজনের লড়াই। হ্যারল্ড তরোয়াল চালাতে চালাতে চড়া গলায় বলে উঠল, সবাইকে ডাকো। খতম করো এগুলোকে। ওদিকে শাঙ্কো, বিনোলারা খোলা তরোয়াল হাতে উঠে এসেছে হ্যারল্ডের জাহাজে। হ্যারল্ডের বাকি সঙ্গীরাও কেবিন থেকে ডেকে উঠে এসেছে।
লড়াই শুরু হয়ে গেল। অল্পক্ষশলড়াইচালিয়েইহ্যারল্ডেরদলের যোদ্ধারা বুঝল, ফ্রান্সিসের বন্ধুরা তরোয়ালের লড়াইয়ে কতটা নিপুণ, কত অভিজ্ঞ। ওরা আহত হতে লাগল। কমজোরি পাটা নিয়ে ফ্রান্সিসের লড়াই চালাতে অসুবিধেই হচ্ছিল। তবু ফ্রান্সিস হ্যারল্ডের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে তরোয়াল চালাতে লাগল। ও এটা বুঝতে পারল হ্যারল্ডের উদ্দেশ্য দলপতি হিসেবে ফ্রান্সিসকে মারাত্মক আহত করে জাহাজে চড়ে পালানো। স্লাভিয়া গিয়ে রাজা ম্যাগনামের নিরুদ্দিষ্ট ধনভাণ্ডারের উদ্ধারের চেষ্টা করবে–এটা ও ভেবেছিল। কিন্তু যার সাহায্য ছাড়া সেটা সম্ভব নয় সেই ক্রেভানকে তো পাওয়া যাবে না। ফ্রান্সিস ততক্ষণে ভেবে নিয়েছে হ্যারল্ডকে হত্যা করতে হবে। ওকে বাঁচিয়ে রাখা চলবে না। ও মারা গেলে ওরসঙ্গীরা সহজেই পরাজয় স্বীকার করবে। বেশি রক্তপাত এড়ানো যাবে। কাজেইফ্রান্সিস হ্যারল্ডের তরোয়ালের মার ঠেকাতে লাগল। হ্যারল্ডকে ক্লান্ত করতে লাগল। একসময় হ্যারল্ড বেশ ক্লান্ত হল। জোরে হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস সেই সুযোগ কাজে লাগাল। হঠাই দ্রুত দু’পা এগিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে তরোয়াল চালাল। হ্যারল্ড সেই মার ঠেকাল বটে কিন্তু ওর হাতের তরোয়াল নেমে এল। ফ্রান্সিস এই সুযোগ ছাড়ল না। হ্যারাল্ডের বুকেতরোয়াল বিঁধিয়ে দিল। হ্যারাল্ডের মুখ থেকে কাতরধ্বনি ছিটকে গেল। ও হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। দু’হাতে বুকে বেঁধা তরোয়াল খুলে আনতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। কাত হয়ে ডেকের ওপর গড়িয়ে পড়ল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। আস্তে আস্তে ওর দেহ স্থিব হয়ে গেল।
ওদিকে হ্যারল্ডের সঙ্গীদের বেশ কয়েকজন মারা গেছে। আহতের সংখ্যাও কম না। ফ্রান্সিসের বন্ধুরাও দু’তিনজন আহত হল। একজন মারাও গেল। ফ্রান্সিস দু’হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, ভাইসব, লড়াই নয়। হ্যারল্ডের সঙ্গীরা শোনো। হ্যারল্ড মারা গেছে। তোমরা অস্ত্র ত্যাগ করো। আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। হ্যারল্ডের সঙ্গীরাও ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে লড়াই করে জেতা যাবে না। ওরা আস্তে আস্তে তরোয়াল ডেকের ওপর ফেলে দিয়ে হাঁপাতে লাগল। ভাইকিং বন্ধুরা তরোয়াল উঁচিয়ে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো।
হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস ডাকল, হ্যারি–শাঙ্কো। হ্যারি আর শাঙ্কো এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস ওদের নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল। দু’পাশের কয়েকটা কেবিন পার হয়ে সেই তালাবন্ধ কয়েদঘরের কাছে এল। বড় তালা ঝুলছে। ফ্রান্সিস ডাকল, শাঙ্কো।
শাঙ্কো এদিক ওদিক খুঁজে একটা বড় হাতুড়ি নিয়ে এল। তারপর প্রচণ্ড জোরে তালাটায় ঘা মারল। তিন-চারটে ঘা পড়তেই তালা ভেঙে ঝুলে পড়ল। ততক্ষণে বন্দীরা এসে গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। শাঙ্কো দু’হাতে ঠেলে দরজা খুলে ফেলল। কাঁচকেঁচ ধাতব শব্দ তুলে দরজা খুলে গেল। প্রায় অন্ধকার ঘর থেকে বন্দীরা বেরিয়ে এল। শাঙ্কো দেখল, বন্দীরা সকলেই বেশ সুস্থ-সবল। তবে পরনের পোশাক শতচ্ছিন্ন। একটু অবাক হয়েই শাঙ্কো বলল, ফ্রান্সিস, এরা তো ভালোই আছে দেখছি।
সেটাই তো স্বাভাবিক। অসুস্থ ক্রীতদাসকে কে কিনবে? ফ্রান্সিস বলল।
একজন বন্দী বলে উঠল, আমরা খেতে না চাইলে জোর করে খাইয়েছে।
ভাই, তোমরা মুক্ত। যেখানে খুশি যেতে পারো। ফ্রান্সিস বলল।
আমরা ইংল্যান্ডে–আমদের দেশে ফিরে যেতে চাই। কয়েকজন বলল।
বেশ। আমরা দোরস্তাদ বন্দরে যাচ্ছি। ওখানে নেমে তোমাদের দেশে যাওয়ার জাহাজে উঠে চলে যেও। তোমরা ডেকে উঠে যাও। ফ্রান্সিস বলল।
এবার ফ্রান্সিস ঘরটার চারদিকে তাকাতে লাগল। অন্ধকার ভাবটা অনেকটা সয়ে এসেছে। দেখল, এককোণে কালো কাঠের লম্বাটে সিন্দুকের মতো রয়েছে। তাহলে শাঙ্কো ঠিকই দেখেছিল। সিন্দুকের ডালায় দুটো বড় বড় তালা ঝুলছে। ওটা তো খুলতে হবে। ফ্রান্সিস ডাকল, শাঙ্কো। শাঙ্কো বাইরে থেকে হাতুড়িটা নিয়ে এল। একটা তালায় দমাদম হাতুড়ির ঘা মারতে লাগল। তালা ভেঙে ছিটকে গেল। অন্যটাও একইভাবে ঘা মেরে ভাঙল। হ্যারি আর ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। হাতুড়ি রেখে শাঙ্কো ডালা ধরে চার পাঁচবার হ্যাঁচকা টান দিল। ডালা নড়ল। ফ্রান্সিসও হাত লাগাল। টেনে দুজনে ডালা খুলল। অন্ধকারেও দেখা গেল অনেক স্বর্ণমুদ্রা ও গয়নাগাটিও রয়েছে। তবে দামি পাথর নেই। একপাশে বেশ কিছু আরবীয় স্বর্ণমুদ্রা, রুপোর বাট।
হ্যারল্ডের লুঠ করা ধনসম্পদ। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল।
হ্যারল্ড । ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপরশাঙ্কোকে বলল, বিনোলা আর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এসো। এই সিন্দুক আমাদের জাহাজে নিয়ে চলো। শাঙ্কো চলে গেল। বিনোলারা কয়েকজন এল। সিন্দুকটা কাঁধে নিয়ে ওপরে ডেকে উঠে এল। ওপরে এসে ফ্রান্সিস দেখল, ভেন আহতদের ওষুধ দিচ্ছে। ক্ষতস্থান বেঁধে দিচ্ছে মারিয়া। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। কাজ সেরে মারিয়া ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল, শাঙ্কোরা কী নিয়ে গেল?
সব বলছি। চলো।
ওরা নিজেদের জাহাজে ফিরে এল। নিজের কেবিনে ঢুকে ফ্রান্সিস মারিয়াকে সব কথা বলল। হ্যারল্ডের লুঠ করা ধনসম্পদের লম্বা সিন্দুকটা শাঙ্কোরা রেখেছিল কোনার দিকে কাঠ, পাল আর যন্ত্রপাতি রাখার জায়গাটাতে। মারিয়া সাগ্রহে সেসব দেখতে ছুটল।
ফ্রান্সিস বিছানায় আধশোয়া হল। হাতের কাটা জায়গাটায় তখনও রক্ত জমে আছে। শরীরের নানা জায়গায় বিশেষ করে বুকে তরোয়ালের খোঁচা লেগে কেটে গেছে। হ্যারি পাশে বসল। বলল, ভেনকে ডাকব?
না-না। যারা বেশি আহত হয়েছে ভেন তাদের দেখুক। আমি তেমন কিছু আহত হইনি।
এখন কী করবে?
কোন ব্যাপারে?
ঐ সব ধনসম্পদ। ও সবই তো ইংরেজদের নিজেদের দেশের। ওদেরই দিয়ে দাও। ওদের দেশের সম্পদ ওরা নিয়ে যাক। হ্যারি বলল।
হ্যারি, ফ্রান্সিস হেসে বলল, কথাটা কি খুব ভেবে বললে?
কেন বলো তো?
বিনা পরিশ্রমে পাওয়া ধনসম্পদের লোভ বড় সাংঘাতিক। ঐ ধনসম্পদ নিয়ে যে জাহাজে চড়ে ওরা দেশে ফিরবে সেই জাহাজে মাঝসমুদ্রেই ওদের মধ্যে খুনোখুনি শুরু হয়ে যাবে। তাতে অন্য যাত্রীরাও জড়িয়ে পড়বে। তা ছাড়া সত্যিকারের দাবিদার কোন মঠ বা গির্জা তা কে খুঁজে বের করবে?
হ্যারি একটু চুপ করে থেকে বলল, তোমার যুক্তি অকাট্য, আমি অত ভেবে বলিনি। পাশে শুয়ে থাকা ক্রেভান এবার আস্তে আস্তে উঠে বসল। বলল, তোমার বন্ধুদের মুখে সব শুনলাম। দোরস্তাদ বন্দরে আমাকে নামিয়ে দিও। ওখান থেকেই হেঁটে বিরকা চলে যাব।
কিন্তু স্লাভিয়ার রাজা ম্যাগনামের নিরুদ্দিষ্ট ধনভাণ্ডার–তার কী হবে? ফ্রান্সিস বলল।
ওটার ওপর আমার আর বিন্দুমাত্র লোভ নেই। তুমি কি ঐ ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে যাবে?
অবশ্যই যাব।
অনেক ধনসম্পদ তো পেলে। আর কেন? ক্রেভান একটু বিরক্তির সুরেই বলল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল, এই ধনসম্পদ সব আমাদের রাজাকে দিয়ে দেব। উনি প্রজাদের কল্যাণের কাজে লাগাবেন। ক্রেভান একটু অবাক হল। ফ্রান্সিসকে সে আর পাঁচজন মানুষের মতোই অর্থলোভী ভেবেছিল।
ক্রেভান, ঐ নিরুদ্দিষ্ট ধনভাণ্ডারের খোঁজ করতে গেলে আপনার সাহায্য ছাড়া এক পাও এগোনো যাবেনা। আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে। কাজের শেষে আপনাকে আমরা বিরকায় পৌঁছে দেব।
কতদিন আগের কথা। কীভাবে কোথায় পড়ে আছে সেই ধনভাণ্ডার। এখন কি আর সেটার হদিস পাবে?
আগে তো এরকম গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করেছি। এবারও দেখি চেষ্টা করে। এখন আপনার শরীর কেমন? ফ্রান্সিস বলল।
প্রায় সুস্থ। একটু আগেই হেঁটে দেখলাম। শরীরটা একটু কাঁপছে বটে তবে মনে হয় দু’একদিনের মধ্যেই সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারব।
আমি সেটাই চাই। স্লাভিয়ায় গিয়ে আপনাকে তো আমার সঙ্গে একটু হাঁটাহাঁটি করতেই হবে। পারবেন তো?
মনে হয় পারব।
ঠিক আছে। শুয়ে পড়ুন। বিশ্রাম করুন। ভালো কথা, দোরস্তাদ বন্দরটা ঠিক কোনদিকে পড়বে?
উত্তর-পশ্চিম দিকে কোনাকুনি।
হ্যারি, ফ্লেজারকে ঐ দিকেই জাহাজ চালাতে বলো।
আচ্ছা। হ্যারি উঠে চলে গেল। তখনই মারিয়া ঢুকল। বলল, সোনা-রুপোর গয়না টয়নাও আছে দেখলাম।
হ্যাঁ। ভক্তরা মঠে, গির্জায় মূল্যবান জিনিস যীশুর নামে উৎসর্গ করে থাকে। এটা তো একদিনের ব্যাপার নয়। দীর্ঘদিন চলে আসছে। সঞ্চিত হয়েছে। আচ্ছা ক্রেভান, স্লাভিয়া তো একটা গ্রাম?
হ্যাঁ, খাঁড়ি থেকে উঠে যাওয়া ঢালের গায়ে। ক্রেভান বলল।
ভালো কথা। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে বসল, আচ্ছা, রাজা ম্যাগনামের পাণ্ডুলিপিটা কি হ্যারল্ড নষ্ট করে ফেলেছিল?
বলতে পারব না। তবে আমার তো পড়ে, পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছে।
উঁহু। ঐ পাণ্ডুলিপিটা খুঁজতে হবে। ওটা পেলে কিছু না কিছু সূত্র পাব। ফ্রান্সিস দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
মারিয়া ক্রেভানকে ওষুধ খাওয়াতে বসল।
হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস হ্যারল্ডের জাহাজে এল। দেখল হ্যারল্ডের নিরস্ত্র সঙ্গীরা ও যারা বন্দী ছিল তারাও কয়েকজন ডেকের এখানে-ওখানে বসে আছে।
সিঁড়ি দিয়ে দুজনে নীচে নেমে এল। প্রথমেই হ্যারল্ডের কেবিনে গেল। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় দেখল ঘরটা বেশ সাজানো-গোছানো। একপাশে দামি পোশাক-টোশাক গুছিয়ে রাখা। বিছানাটা দামি চাদরে ঢাকা। বোঝা গেল হ্যারল্ড একটু শৌখিন ছিল। একপাশে কয়েকটা মরক্কো চামড়ার ঝোলানো ব্যাগ। ফ্রান্সিস ব্যাগগুলো খুলতে লাগল। হ্যারিও হাত লাগাল। কাগজপত্র বিশেষ কিছু পেল না। কাপড় টাপড়, সোনার কাজ করা কোমরবন্ধনী, এসব পেল। সব কটা ঝোলাই দেখা হল। সেই ছেঁড়া পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেল না।
ফ্রান্সিস, মনে হয় হ্যারল্ড সেটা বেছে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল। হ্যারি বলল।
উঁহু। হ্যারল্ডের লক্ষ্য ছিল দোরস্তাদ বন্দরের পাশের খাঁড়ি দিয়ে স্লাভিয়া যাওয়া। ঐ পাণ্ডুলিপি আর ক্রেনের সাহায্যে রাজা ম্যাগনামের নিরুদ্দিষ্ট ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে। আরো সম্পদ চাই, আরো ঐশ্বর্য। এ বড় সাংঘাতিক তৃষ্ণা। ফ্রান্সিস আবছা আলোয় চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল। হঠাৎ ও খুব অস্পষ্ট দেখল, একেবারে নীচে কাঠের কিছুটা চৌকোনো কাঠ উঁচু হয়ে আছে। চামড়ার ঝোলাগুলো সরিয়ে আনতে ওটা দেখা গেল। ফ্রান্সিস দ্রুত এগিয়ে এসে উবু হয়ে বসল। উঁচু হওয়া কাঠটা টানতেই খুলে এল। দেখা গেল কারুকাজ করা একটা চৌকো চামড়ার থলিমতো। ফ্রান্সিস থলিটা নিয়ে হ্যারির কাছে এল। হ্যারিও থলিটা দেখে অবাক হল। ফ্রান্সিস থলিটা খুলল। কাগজের মতো পাতলা ভাঁজ করা দুটো চামড়া। একটা খুব পুরোনো। বিবর্ণ। অন্যটা পরিষ্কার। ফ্রান্সিস দুটোই হ্যারিকে দিয়ে বলল, দ্যাখো তো? হ্যারি প্রথমে পরিষ্কার চামড়াটার ভাঁজ খুলে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ বলে উঠল, ফ্রান্সিস, এটা একটা হাতে আঁকা মানচিত্র।
কোন দেশের?
দেখছি… লন্ডন। তার মানে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের?
কোনো চিহ্ন দেখছ?
হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ছোট ফুটকি আর ত্রিভুজ মতো।
ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে ভাবল। মাথা তুলে বলে উঠল, গুনে দেখো ফুটকির সংখ্যা কম, ত্রিভুজের সংখ্যা বেশি। একটু দেখেই হ্যারি বলল, ঠিক বলেছ।
সব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ত্রিভুজগুলো হল মাঠের চিহ্ন, ফুটকিগুলো গির্জার চিহ্ন। সংখ্যায় গির্জা কমই হবে। হ্যারল্ড আটঘাট বেঁধেই লুঠ করার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল।
হ্যাঁ হ্যাঁ। রউয়েন বন্দরের নাম রয়েছে। যারল্ড ঐ বন্দর থেকেই জাহাজ চালিয়ে ফিরছিল।
এবার অন্যটা দেখো। ভাজ খুলে ঐ বিবর্ণ চামড়াটা দেখতে দেখতে হ্যারি বলল, খুব অস্পষ্ট। আঁকাবাঁকা পুরোনো স্ক্যান্ডিনেভীয় দ্বীপ এটা বুঝতে পারছি কিন্তু পড়তে সময় নি লাগবে। তবে অসম্পূর্ণ। এই দেখো নীচের দিকে ছেঁড়া।
চলো। সব ভালো করে দেখতে হবে।
দুজনে নিজেদের জাহাজে ফিরে এল। ফ্রান্সিস ক্রেভানকে পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে বলল, দেখুন তো এটাই সেই রাজা ম্যাগনামের পাণ্ডুলিপি কিনা?
ওটা দেখেই ক্রেভান বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই। কিন্তু আরও কিছু পাতা ছিল। আলো জ্বালোদেখি।
অন্ধকার হয়ে এসেছিল। মারিয়া সূর্যাস্ত দেখতে গেছে। হ্যারিই চকমকি পাথর ঘষে মোমবাতিটা জ্বালল। সেই আলোয় চোখ কুঁচকে দু’এক লাইন পড়ে ক্রেভান বলে উঠল, হ্যাঁ, এটাই শেষ পাতা। বাকি পাতাগুলো হ্যারল্ড ছিঁড়ে ফেলেছে। ঠিক বুঝেছিল এই পাতাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
দু’তিন দিন পরে। সেদিন সকালের খাবার খেয়ে শাঙ্কো ডেকএ উঠে এল। আকাশ পরিষ্কার। রোদ উজ্জ্বল। শাঙ্কো পূর্বদিকে তাকাতেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় দূরে বেশ কয়েকটা জাহাজের মাস্তুল দেখল। মাস্তুলের মাথায় বিভিন্ন দেশের পতাকা উড়ছে। শাঙ্কো একটু গলা চড়িয়ে বিনোলাকে ডাকল। বিনোলা কাছে এলে বলল–ফ্রান্সিসকে গিয়ে বল–একটা বন্দর দেখা যাচ্ছে। বোধহয় ওটাই দোরস্তাদ বন্দর। খবর পেয়ে ফ্রান্সিস এসে রেলিং ধরে দাঁড়াল। জাহাজ তখন সেই বন্দরের দিকে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। কিছু পরে জাহাজে বাড়িঘর দেখা গেল। তখনই হ্যারি সেখানে এল। বলল এটাই দোরস্তাদ বন্দর। ক্রেভানের নির্দেশমতই তো ফ্লেজার জাহাজ চালিয়েছিল।
কাছে গেলেই বোঝা যাবে।
–তবু। নামবার আগে তো জানতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–ক্রেভানকে এখানে আনতে পারলে ভালো হত। হ্যারি বলল।
না-না। ক্রেভানকে এখন বেশি টানাটানি করা ঠিক হবে না। ও বিশ্রাম করুক। বরং তুমি ওকে জিজ্ঞেস করে এসো একটা বড় বন্দরের কাছে আমরা এসেছি। সেই বন্দরে বেশ কয়েকটা জাহাজ নঙর করে আছে। সেটা কোন বন্দর ঠিক বুঝতে পারছি না–ফ্রান্সিস বলল।
–ক্রেভানকে বলছি। হ্যারি চলে গেল। এতক্ষণে ফ্রান্সিসদের জাহাজ বন্দরের অনেক কাছে চলে এসেছে। লোকজন, বাড়িঘর, গাছপালা, নোঙরকরা জাহাজ সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটু পরেই হ্যারি ফিরে এল। বলল– ক্রেভান বলছে বন্দর এলাকার ডানদিকে একটা বড় গাছের পাশে একটা গীর্জার উঁচু চুড়ো দেখা যাবে। মাথায় পেতলের ক্ৰশ।
–ঐ তো। ফ্রান্সিস আঙুল তুলে বলল।
–হ্যাঁ। গাদাগীর্জার ক্রশ বসানো চুড়ো। এটাই দোরস্তাদ বন্দর। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল হ্যারি কতদিন পর পরম নিশ্চিন্তে একটা বন্দরে নামতে পারবো। কত বন্দরে ঘাটে কত দুশ্চিন্তা নিয়ে হঠাৎ আক্রান্ত হবার আশঙ্কা নিয়ে জাহাজ ভেড়াতেহয়েছে। নামতে হয়েছে। পানীয় জল খাদ্য সংগ্রহের জন্যে। ফ্রান্সিস বলল।
–ফ্রান্সিস–সভ্য দেশেই নামছি সত্য কিন্তু এখানেও বিপদে পড়তে পারি। হ্যারি বলল।
হ্যাঁ হ্যাঁ। বিপদ সব জায়গাতেইহতে পারে। তবে মানুষ ভাষা পরিবেশতো মোটামুটি পরিচিত। বিপদ আঁচ করা অনেক সহজ। কঙ্কাল দ্বীপ বা রেসিকের মত? ? ? ? ? ? ? দ্বীপ রাজ্য তো নয়। কথাটা বলে ফ্রান্সিস জাহাজচালক ফ্লেজারের কাছে গেল। বলল– ফ্লেজার জাহাজ ভেড়াও। ফ্লেজার জাহাজের হুইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আস্তে আস্তে বন্দরে জাহাজ ভেড়াল। শাঙ্কো আর বিনোলা গিয়ে পাটাতন পেতে দিল পাথুরে জাহাজ ঘাটে। একে তো দেশে ফেরার আনন্দ সেই সঙ্গে কতদিন পরে ইউরোপের ডাঙা। সুসজ্জিত ভদ্র মানুষদের ভিড়। রঙ বেরঙের পোশাকপরা মহিলারা পরিচিত ভদ্র মানুষদের মুখ। শহরের কত আনন্দ উচ্ছ্বাসের হাতছানি। কয়েকজন বন্ধু মিলে উৎসাহের সঙ্গে হ্যারির কাছে ছুটে এল। বলল চলো এখনই নামি। একটুঘুরেফিরে আসী হ্যারি হেসে বলল– তোমাদের মনে খুব আনন্দ উৎসাহ। স্বাভাবিক। কিন্তু ফ্রান্সিস কী বলে দেখি। তারপর নামা। শহর দেখা। ঘুরে বেড়ানো।
তাহলে রাজকুমারীকে বলি গিয়ে। ওরা বলল।
–কোন লাভ নেই। ফ্রান্সিস না বলা পর্যন্ত কেউ রাজকুমারীকে গিয়ে বিরক্ত করবে না। ডাঙায় নামবে না। হ্যারির কথায় ওদের উৎসাহে ভাটা পড়ল। দেখা যাক–ফ্রান্সিস কী বলে।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। মারিয়াও যেন বিছানার একপাশে এসে ছেঁড়া পোশাক সেলাই করছিল। দেখে হ্যারি বেশ দুঃখ পেল। বলল–রাজকুমারী–আমরা একটা বড় বন্দর শহরে এসেছি। ছেঁড়া পোশাক টোশাক আর সেলাই করবেন না। নতুন পোশাক কিনতে নামবো আমরা। মারিয়া হেসে বলল–হ্যারি–পুরোনো পোশাকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক স্মৃতি। কোন পোশাক পরে জাহাজে রাতের নাচগানের আসরে গেছি। কোন পোশাক পরে কোন বিদেশি রাজার অন্দরমহলে থেকেছি বা কয়েদগারে থেকেছি। এইসব স্মৃতি কি ভোলা যায়? ফ্রান্সিস সপ্রশংস দৃষ্টিতে মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। মৃদু হাসল। কিছু বলল না। একপাশে সে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। এবার মাথা নেড়ে পাকা দাড়ি গোঁফের ফাঁকে হেসে বলল–বড় সুন্দর কথা বলেছেন।
–ক্রেভান–এই আমাদের রাজকুমারী। আমাদের এই ছন্নছাড়া জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা মা বোনেদের স্নেহ সাহচর্য পাই ওঁর কাছেই। হ্যারি বলল ফ্রান্সিস অমনি উঠে দাঁড়াল। বলল–হ্যারি চলো হ্যারল্ডের জাহাজে যাবো। কিছু কাজ বাকি আছে।
কিন্তু বন্ধুরা তো এখনই এখানে নামতে চাইছে। শহরটা ঘুরেফিরে–হ্যাঁ কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ফ্রান্সিস বলল”উঁহু, এখন না। বাকি কাজগুলো সেরে তারপর।
দু’জনে ডেক উঠে এল। দেখল–শাঙ্কোরা অনেকে দল বেঁধে রেলিং ধরে দোরস্তাদ শহরের দিকে আগ্রহে তাকিয়ে আছে।
–শাঙ্কো শোনো। ফ্রান্সিস ডাকল। শাঙ্কো এগিয়ে এল।
-যাও। হ্যারল্ডের জাহাজের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা কেটে দাও। আর ওদের জাহাজ চালককে বলো ওদের জাহাজটাকেবন্দরে ভেড়ায়। পাটাতন ফেলো আমরা ওদের জাহাজে যাবো। ফ্রান্সিস চলল। শাঙ্কো চলে গেল। জামার তলা থেকে ওর ছোরাটা বের করে বাঁধা দড়িটা কেটে দিল। হ্যারল্ডের জাহাজ চালককে ডেকে–ওদের জাহাজের পাশেই জাহাজ ভেড়াতে বলল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি জাহাজ থেকে নেমে পাতা পাটাতন দিয়ে হ্যারল্ডের জাহাজে গিয়ে উঠল। দেখল ইংরেজ বন্দীরা খুব উৎসাহ নিয়ে জাহাজের রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের কাছে তো এটা নতুন দেশ। কিন্তু হ্যারল্ডের লুঠেরা সঙ্গীরা চুপ করে ডেকে বসে আছে। ওদের কাছে এটা নতুন জায়গা নয়। এর আগেও এখানে এসেছে ওরা। মাস কয়েক আগেও ওরা এই বন্দর থেকেই ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিল। একজনের হাতে কাঁধে কাপড়ের পট্টি বাঁধা দেখা গেল। তরোয়ালের লড়াইয়ের সময় কেটে ছড়ে যাওয়া ওরা গায়ে মাখে না। সমুদ্রের লবণাক্ত জলই এসবের ভালো ওষুধ। বেশি কেটে গেলে বেশি রক্তপাত হলে তবেই সঙ্গী বৈদ্যরা চিকিৎসা করে ওষুধ দেয়। ভাইকিংদের ক্ষেত্রেও এই রীতিই চলে আসছে।
ওদের দুজনকে দেখে ইংরেজ বন্দীরা এগিয়ে এল। দু’একজন হাসি মুখে বারবার বলতে লাগল–আপনাদের কী বলে ধন্যবাদ জানাবো। ক্রীতদাসত্বের দুঃসহ জীবন থেকে আমাদের বাঁচালেন। আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ রইলাম। কথাগুলো বলে ওরা একে একে এসে ফ্রান্সিস ও হ্যারিকে জড়িয়ে ধরতে লাগল। ফ্রান্সিস হেসে বলল ঠিক আছে–ঠিক আছে। এখন বলো তোমরা কী করবে। একজন বলল–আমরা ঠিক করেছি এই জাহাজে চড়েই আমরা ইংল্যান্ডে ফিরে যাবো।
–ভালো কথা। তাই করো। ফ্রান্সিস বলল। তারপর হ্যারিকেনিয়ে সেই ভাইকিং লুঠেরার দলের কাছে এল। ওরা চুপ করে ডেকে বসেছিল। একজন এসে ফ্রান্সিসের সামনে দাঁড়াল বলল–আমরা আপনাদের সঙ্গে দেশে ফিরেযাবো।
-তোমার নাম কী? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
–চাৰ্মান্ত। লোকটি বলল।
–না। তা হবে না। ফ্রান্সিস বলল–তোমরা ইংল্যান্ডে গিয়ে লুঠপাট করেছে নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছে। ভাইকিং জাতির কলঙ্ক তোমরা।
–আমরা তো হ্যারল্ডের নির্দেশেই এইসব করতে বাধ্য হয়েছি। চাৰ্মান্ত বলল।
–এটা একটা যুক্তি হল? হ্যারি বলল–হ্যারল্ড তো একটা কুলাঙ্গার। সে বলল আর তোমরা নির্বিবাদেনরহত্যা করলে।
–আমরা তো আপনাদের স্বজাত, আপনাদের স্বদেশবাসী। চাৰ্মান্ত বলল।
ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল–না-না। তোমাদের মত ঘাতকদের কোন দায়িত্ব আমরা নেবনা। তোমাদের এই বন্দরেই নেমে যেতে হবে। তারপর বাঁচোমরো–তোমাদের ব্যাপার।
–হ্যারল্ডের ধনসম্পদ তো আপনারা নিয়ে গেছেন। সেখান থেকেই আমাদের খাওয়া পরা জাহাজের ভাড়ার জন্য–কথার শেষ করতে না দিয়েই ফ্রান্সিস বলল–ঐ সম্পদ তোমাদের না। ঐ সম্পদ ইংল্যান্ডবাসীদের। দিতে হলে ঐ ইংরেজ বন্দীদেরই দেব। তোমাদের নয়।
চাৰ্মান্ত ভালো করেই বুঝল স্বজাতি হলেও ফ্রান্সিসরা ওদের কোনরকম সাহায্য করবে না। ও চুপ করে রইল। মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল। দুজনে ইংরেজ বন্দীদের কাছে ফিরে এল। বলল–তাহলে তোমরা কখন দেশের দিকে জাহাজ চালাবে?
–কত দিনের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়েছি। অন্তত একটা দিন বিশ্রাম নিয়ে ফিরবো ভাবছি। একজন বলল। অন্যজন বলল–
–কিন্তু আমাদের জামা কাপড়ের অবস্থা তো দেখছেন। আমরা কপর্দকশূন্য। পথে খাদ্যওতো লাগবে।
–ঠিক আছে। ভাই আমরাও ধনী নই। দু’একজন রাজা খুশি হয়ে আমাদের সোনার চাকতি কিছুকিছু দিয়েছে। আমি কিছু তোমাদের পাঠিয়ে দেব। এই বিদেশে পড়ে থেকো না। এখানে তোমাদের কে চেনে যে খাদ্য আশ্রয় দেবে। ফ্রান্সিস বলল।
না না। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরে যাবো। একজন বলল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি নিজেদের জাহাজে ফিরে এল। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে শাঙ্কো দু’জনের কাছে এল। ফ্রান্সিস ওদের মুখ দেখেই বুঝল–ওরা কী বলতে চাইছে। হেসে বলল–দুপুরে খাওয়া শেষ করে আমরা এই বন্দর শহরে যাবো। ঠিক আছে। বন্ধুরা খুশিতে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। কেবিন ঘরে ঢুকলে মারিয়া বলল–বন্ধুরা খুশির ধ্বনি তুলল। কী ব্যাপার?
দুপুরে এইখানে নামবে। ঘরেটুরে আনন্দ করবে। ফ্রান্সিস বলল খুশি হয়ে মারিয়া বলল–সত্যি?
-হ্যাঁ। বড় শহর। অনেক কিছু পাওয়া যাবে। দু’দুবার জাহাজ লুঠ হয়েছে। অন্তত কাপড় জামা তো কটা বানাতে হবে। ফ্রান্সিস হাসতে হাসতে বলল। মারিয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠে হাততালি দিল। মারিয়াকে এত খুশি দেখে ফ্রান্সিস নিজেও খুশি হল। মারিয়ার বিমর্ষ ভাবনা অনেকটা কেটে গেছে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরেই সবাই পোশাক পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নতুন পোশাকগুলো তো সব ডাকাতরা নিয়ে গেছে। বাকি পোশাক যেগুলো একটু ভালো অবস্থায় আছে সেসব পরে ওরা একে একে ডেকে এসে জড়োহ’ল। ক্রেভানের দেখাশুনার জন্যে বৈদ্য ভেনকে রেখে ফ্রান্সিস আর মারিয়া ডেকে উঠে এল। দু’জনের গায়েই ভালো পোশাক। মারিয়া একটা হালকা নীল রঙের পোশাক পরেছে। গলার নেকলেসটা ডাকাতরা নিয়ে নিয়েছে। সবচেয়ে দামি নেকলেসটা পরেছে। মাথার চুল বেঁধেছে টান টান করে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে রাজকুমারীকে। সবাই পরস্পর দৃষ্টিতে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারিও নতুন পোশাক পরে ততক্ষণে এসে গেছে।
সবাই পাটাতন দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাথুরে তীরে নামল। সবাই একত্র হলে হ্যারি বলল–শোন–আমাদের জামা কাপড় তো ডাকাতি হয়ে গেছে। সবার আগে আমরা। কোন দর্জির দোকানে যাবো। কাপড় বেছে মাপটাপ দেব। তারপর তোমাদের হাতে সোনার চাকতি দেওয়া হবে। সবাই ঘুরে ঘুরে শহর দেখবে। শহরের বাইরে দূরে যাবে না। আনন্দ করবে। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। আঙুল তুলে উঁচু গীর্জাটা দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলল–সবাই ঐ গীর্জাটার নিচে এসে জড়ো হবে। বেশি দেরি করবে না। সবাই বড় রাস্তাটায় এল। দু’দিকে বাড়িঘর লোকজন দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগল। দু’চারটে বেশ শৌখিন ঘোড়ার গাড়ি দেখল। সুবেশ পুরুষ মহিলাদের দেখল।
হ্যারল্ডের জাহাজের ডেক-এ বসেছিল লুটেরা ভাইকিংরা। চাৰ্মান্তই ওদের দলনেতা। হ্যারল্ডের ডান হাত। ফ্রান্সিসরা ওদের লুঠ করা ধনসম্পদ নিজেদের জাহাজে নিয়ে গেল এটা ওদের সহ্য হচ্ছিল না। ওরা একই সঙ্গে নিষ্ঠুর আর মিথ্যেবাদী। চাৰ্মান্ত এবার বন্ধুদের বলল–শোন–স্বজাতি স্বদেশের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ফ্রান্সিস আমাদের জন্যে কিছুই করতে চাইল না। বরং এই জাহাজের আশ্রয় থেকেও আমাদের বিতাড়িত করতে চাইল। একটু থেমে বলল–থাক সেসব্যারল্ডের সঙ্গে এই বন্দরে ঐ শহরে বেশ ঘুরেছি। কয়েকটা আস্তানা জানা আছে আমার। এই দারস্তানে আছে ইউসুফ। লোকে ওকে অন্য নামে চেনে। ইউসুফ আসলে আরবদেশের মানুষ। বাইরে ব্যবসায়ী। আসলে ক্রীতদাস কেনাবেচার ব্যবসা। বেশ ধনী। ওর বাড়িতেও আমি গেছি। বাইরে থেকে সাদামাটা বড় বাড়ি। ভেতরে আছে গরাদ দেওয়া কয়েদ ঘর। আমরা য়ুরোপের ইংলন্ডের সাদা মানুষ ধরে আমাদের জাহাজে আটকে রেখে এখানে আসি। গভীর রাতে তাদের ইয়ুসুফের বাড়িতে নিয়ে যাই। ইয়ুসুফের কয়েদঘরে ওদের বন্দী করে রাখা হয়। হ্যারল্ড তাদের বিক্রি করে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে চলে আসে। ইয়ুসুফ আরো বেশি কুফি মানে আরবীয় স্বর্ণমুদ্রায় তাদের বিক্রি করে। চার্মান্তের সঙ্গীরা এতসব খবর জানতো না। হেরন্ডের নির্দেশমত নরহত্যা লুঠপাট করতো। একজন দলের লোক বলে উঠল– এসব ভেতরের খবর শুনে আমাদের কী হবে। আমরা দেশেও ফিরে যেতে পারবো না। ফ্রান্সিস আমাদের রাজার খুব প্রিয়পাত্র। কোনভাবে আমাদের কথা জানতে পারলে আমাদের হয় মেরে ফাঁসি দেবেন নয়তো দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। না খেয়ে মরবো আমরা সেইজন্যেই সবদিক ভেবে বলছি–হ্যারল্ড তো মারা গেছে। ও যা করে স্বর্ণমুদ্রা পেতো আমরা তাই করবো। চাৰ্মান্ত বলল। সঙ্গী লুঠেরারা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। চার্মান্তের মতলব বুঝতে পারল না। চাৰ্মান্ত এবার চারদিকে তাকাল। দেখল সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীরা একটু দূরে গল্পগুজব করছে। চাৰ্মান্ত গলা নামিয়ে বলল–শোন–আমি নেমে শুক– যাচ্ছি। ইয়ুসুফের আস্তানায় যাবো। হ্যারল্ড মারা গেছে এটা বলবো না। বলবো আমরাই এগারোটা ইংরেজ ক্রীতদাস এনেছি। শ্বেতকায় মানে আরবীয়র। যাদের সাহিব বলে সেইসব ক্রীতদাসের দাম অনেক। অর্ধেক দাম পেলেও আমাদের হাতে যথেষ্ট কুফি আসবে। তখন যে যার মত নিজের রাস্তা দেখবো। বুঝলি বোকার দল?
সঙ্গীরা নিজেদের মধ্যে মৃদুস্বরে কথা বলতে লাগল।
তারপর একজন বলল–ঠিক আছে। এ ছাড়া তো বেঁচে থাকার কোন উপায় দেখছি না। কিন্তু আমাদের সমান স্বর্ণমুদ্রা দিতে হবে।
–অবশ্যই। তবে আমার বুদ্ধিতেই তো এসব হবে। কাজেই আমি বেশিরভাগটা নেব। কী? তোরা রাজী।
–তোমার খুব কূটবুদ্ধি চার্মান্ত। একজন বলল।
–আগে বল্ তোরা আমাকে সাহায্য করবি কিনা। চাৰ্মান্ত বলল।
–উপায় কি। নইলে এই বিদেশে না খেয়েই মরতে হবে একজন বলল। চাৰ্মান্ত দ্রুত উঠে দাঁড়াল। বলল আমি সব ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি। তোদের জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতে এলে বলবি আমার এক বন্ধু গেছে আমাদের আস্তানা খুঁজতে। ও এলেই আমরা নেমে যাবো। ঠিক আছে? ওরা আর কী বলবে। চুপ করে রইল। চাৰ্মান্ত একটু সতর্কভাবে চারদিক দেখেটেখে পাটাতন দিয়ে জাহাজঘাটে নেমে পড়ল। তারপর দ্রুত ভিড়ের রাস্তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ছোট মোড় পার হয়ে দুটো গাছের মাঝখানে একটা বড় পাথর গাঁথা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল! বাড়িটার নিচে রাস্তায় দুটো ঘোড়ায়টানা মালবাহী গাড়ি দেখল। গাড়ি দুটোর পেছনে একটা বেশ বড় লোহার দরজা খোলা। বিরাট ঘর। মালপত্র বোঝাই! একপাশে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে বসে আছে। খাটের আসনে একজন বসে একটা লম্বা কাগজে বোধহয় হিসেবটিশেব লিখছে। চাৰ্মান্ত নিঃশব্দে ওদের দৃষ্টি ছাড়িয়ে বাড়িটার পাশের চিলতে গলিটায় ঢুকে পড়ল। কিছুটা এগিয়েই বাঁদিকে পেল একটা কাঠের দরজা। চাৰ্মান্ত চিনতো। গলিটার এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে দরজাটায় দুটো টোকা দিল। একটু পরেই দরজাটা খুলে গেল। এক দশাসই চেহারার কালো মানুষ মুখ বাড়াল। তার চামড়ার কোমর বন্ধনীতে ঝুলছে একটা বড় ছোরা। ছোরাটার কোন খাপ নেই। প্রহরীর খালি গা। একটা চামড়ার ফিতে বুকেপিঠে আড়াআড়ি বাঁধা। চাৰ্মান্তকে দেখে মৃদু হেসে বলল হ্যারল্ড।
সাহিব?
–পরে আসবে। লোকটা সরে দাঁড়াল। চাৰ্মান্ত একটু দ্রুত ঢুকে পড়ল। দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। বেশ অন্ধকার সামনে। চার্মান্তের পরিচিত জায়গা। তবু ও অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে চলল। কিছুটা এগোতে ডানদিকে একটা বেশ কাজ করা দরজা। চাৰ্মান্ত দরজাটা আস্তে ঠেলল। দরজাটা খুলে গেল। একটা বড় ঘরে ঢুকল ও। ঘরটায় বেশ আলো দু’ধারে কয়েকটা কাঁচে ঢাকা আলো জ্বলছে। মেঝেয় কার্পেট পাতা। সামনে একটা ঝলমল কাপড় পাতা বিছানায় একটা ফুলপাতা বোনা কাপড়ে ঢাকা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে মধ্যবয়স্ক ইউসুফ বসে আছে। পরনে এই অঞ্চলের অভিজাত মানুষদের জাঁকালো পোশাক। মুখ পরিষ্কার কামানো। ইয়ুসুফ একটু হেসে স্পেনীয় ভাষায় বলল–কী ব্যাপার? হ্যারল্ড সাহিব কই?
–উনি এখন ইংল্যান্ডে। একদফা পাঠিয়েছে আমার সঙ্গে। মোট এগারোজন উনি নতুন জাহাজ নিয়ে পরে আবার একদফা আসবেন।
— কখন পাঠাবে? ইসুয়ুফ বলল।
–গভীর রাতে। যেমন পাঠানো হয়। চার্মান্ত বলল।
–পাহারা দিয়ে আসবে। চাঁচামেচি যেন না হয়। ইয়ুসুফ বলল।
না-না। চাৰ্মান্ত জোরে মাথা নাড়ল।
–পৌঁছে দিলে দাম পাবে। সব সাহেব তো? ইয়ুসুফ বলল।
–হ্যাঁ হ্যাঁ। চাৰ্মান্ত মাথা কাত করল। তারপর হ্যারল্ডের সম্পত্তির কথা ফ্রান্সিসদের কথা–সিন্দুক নিয়ে যাওয়ার কথা বলল। বেশ মন দিয়ে শুনে ইয়ুসুফ বলল–ঐ ধনসম্পত্তির সিন্দুকের কথা পরে ভাবা যাবে। কী নাম ওদের দলনেতার?
–ফ্রান্সিস। চাৰ্মান্ত বলল–আমাদের মতই ভাইকিং।
–ওরা এখানে কতদিন জাহাজ নোঙর করে থাকবে? ইয়ুসুফ জানতে চাইল।
–বোধহয় দু-তিন দিন। চাৰ্মান্ত বলল।
–হুঁ। মুখে শব্দ করল ইয়ুসুফ। তারপর বলল–তোমরা যেভাবে বরাবর আনো সেভাবে আনা যাবে না। ফ্রান্সিসরা পাশের জাহাজে থাকবে। কিছু কথাবার্তা তোমাদের মধ্যে হবেই। কারণ তোমাদের জোর খাটাতে হবে। ফ্রান্সিসরা টের পাবে। ধরা পড়ে যাবে। কাজেই কৌশলে কাজ সারতে হবে। আমি বিকেলে তোমাদের জাহাজে যাবো। যা ব্যবস্থা করার করবো।
–চাৰ্মান্ত ঠিক বুঝল না। বলল–ওরা খুব দুর্ধর্ষ।
-এক ফোঁটাও রক্ত পড়বে না। যাও। আমি সময়মত যাবো। তারপর মুখে একটা বা হাতে তুড়ি দিল। ওপাশের দরজা খুলে দু’জন বলশালী কালো যোদ্ধা দ্রুত ঢুকল। ওদেরও কোমরে খোলা বড় ছোরা ঝুলছে। ইয়ুসুফ আঙ্গুল তুলল। একজন প্রহরী ছুটে গিয়ে একটু অন্ধকারে কাজ করা লোহার টেবিল থেকে একটা ছোট লাল রঙের থলে নিয়ে এলো। ইয়ুসুফের হাতে দিল। ইয়ুসুফ থলি থেকে বাঁহাতে দুটো স্বর্ণমুদ্রা বের করে চাৰ্মান্তকে দিল। বলল–পরেআরো পাবে। চাৰ্মান্ত ইয়ুসুফের ডান হাতটা কোমর বন্ধনীতে ঢোকানো দেখল। আগেও তাই দেখেছে।
চাৰ্মান্ত ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বুঝে উঠতে পারল না ইয়ুসুফ নিজেই যাবে কেন। তবে কি ইয়ুসুফ ওকে বিশ্বাস করছেনা? এসব ভাবতে ভাবতেই চাৰ্মান্ত জাহাজে ফিরে এল। জাহাজের সঙ্গীদের কাছে এসে মৃদুস্বরে বলল ইউসুফ বিকেলে আসবে। কীসব ব্যবস্থা করবে বলল। সবাই চুপ করে রইল। এখন শুধু অপেক্ষা করা।
ওদিকে ফ্রান্সিস মারিয়ারা জাহাজ ঘাটে নেমেছে। ঘরবাড়ি লোকজন দেখতে দেখতে ওরা চলল। সবাই বেশ খুশি। প্রথমেই শাঙ্কোকে পাঠানো হল একটা ভালো কাপড় জামার দোকানের খোঁজে। শাঙ্কো একটু পরেই ফিরে এসে একটু দূরে ডানদিকে একটা বড় দোকান দেখাল। সবাই এগিয়ে এসে দোকানে ঢুকল। দোকানের একপাশে কাপড়ের গাঠরি সাজিয়ে রাখা। টাকমাথা দোকানদার হাসিমুখে এগিয়ে এল। স্পেনীয় ভাষায় বলল–আসুন আসুন। এত খদ্দের। ভালো বিক্রি হবে। ওরা অভ্যস্ত চোখেই বুঝল এরা বিদেশি। এদের জামা, পোশাকই বলছে অনেকদিন এরা সমুদ্রে জাহাজে জাহাজে ঘুরে বেড়িয়েছে। এরা কী কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেসব জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহও দোকানদার দেখাল না। ও জানে জলদস্যুরাও পোশাক পাল্টে নতুন পোশাক কিনতে আসে। কিন্তু মারিয়াকে দেখে বেশ কৌতূহলী চোখে মারিয়ার দিকে তাকাল। পরক্ষণেই চোখ ঘুরিয়ে বলে উঠল আপনারা নিশ্চয়ই নতুন পোশাক তৈরি করাবেন?
–হ্যাঁ। হ্যারি বলল। সবার মাপটাপ নিন। আর হ্যারিমারিয়াকে দেখিয়ে বলল– এই ভদ্রমহিলারও পোশাকের জন্যে যে কোন দামের যে কাপড় এর পছন্দমত হবে সেই মতো দেবেন।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। ওপাশেই আমার সেলাইয়ের দোকান। সব পোশাক আমি তৈরি করে দেব ঠিক যেমনটি আপনারা চাইবেন।
–তাহলে তো ভালোই। কিন্তু সব পোশাক তৈরি করিয়ে দিতে হবে কাল দুপুরের মধ্যে। আমরা কাল সন্ধ্যের আগেই জাহাজ ছাড়বো।
–নিশ্চয়ই পাবেন। তবে কিছু অগ্রিম দেবেন। রাত জাগতে হতে পারে। মারিয়া কোমরবন্ধনী থেকে পাঁচটা সোনার চাকতি বের করল। হাত বাড়িয়ে দিল।
আসুন কাপড় পছন্দ করুন। দোকানদার নিজেই গাঠরির মুখ খুলে কাপড় দেখাতে লাগল। ভাইকিংরাও আগ্রহের সঙ্গে পছন্দমত কাপড় দেখতে লাগল।
–সবাই একরকম কাপড় পছন্দ কর ফ্রান্সিস বলল। সবাই কাপড় দেখেশুনে বাছতে লাগল। এবার দোকানদার মারিয়ার জন্যে কাপড়ের একটা ছোট গাঁটরি খুলে মারিয়াকে দেখাতে লাগল। সবাইমিলে একরকম কাপড় পছন্দ করল। দোকানদার মাথা চুলকে বলল–অতজনের কাপড় তো হবে না। এবার বাকি কাপড় অন্যরকম পছন্দ করা হল। মারিয়াও একটা দামি কাপড় পছন্দ করল। ফ্রান্সিসের দিকে হেসে তাকিয়ে বলল–এটা তোমার পছন্দ হচ্ছে? ফ্রান্সিস বলল–ভালোই তো এসব পছন্দ ছন্দের বালাই আমার নেই। বরং হ্যারিকে বলো। কিন্তু যা করবে তাড়াতাড়ি কর। পছন্দের পাট চুকল। সবাই রাস্তায় নেমে এল। হ্যারি বলল–এবার নিজেদের মত ঘুরে বেড়াও। খেতে চাইলে খেতেও পারো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই যেমন বলা হয়েছে গীর্জার সামনে এসে জড়ো হবে। দুজন তিনজন একসঙ্গে কেউ একা ছড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস মারিয়া আর হ্যারি ঘোরাঘুরি শুরু করল।
কিছুক্ষণ পরেই একজন দুজন করে গীর্জাটার সামনে এসে জড়ো হল। ফ্রান্সিসরাও এল। শাঙ্কোর হাতে একটা গোল চামড়ার ঢাকনাওয়ালা বাজনা। যন্ত্রটার গায়ে ঘুঙ্গুরমত আটকানো। হাত দিয়ে চাপড় দিয়ে বাজিয়ে শাঙ্কো ওটা বাজাতে বাজাতে হাসতে লাগল। বাজবার সঙ্গে ঘুঙুরের শব্দও তালে তালে বাজছিল।
–ওটা এখানকার জীপসিদের বাজনা। মারিয়া দেখে বলল।
সবাই শেষ বিকেলে জাহাজে ফিরে এল। ওরা যখন পাটাতন দিয়ে জাহাজে উঠছে তখন হ্যারি দেখল পাশে নোঙর করা হ্যারল্ডের জাহাজের পাটাতন দিয়ে এক অভিজাত পোশাকপরা মধ্যবয়স্ক লোকও উঠছে। আর চাৰ্মান্ত তাকে সাদরে তুলে আনছে। হ্যারি ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–ভদ্রলোক কে?
এবার ফ্রান্সিসও তাকিয়েই ইয়ুসুফকে দেখল। ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঐ দিকে তাকিয়ে দেখল ইয়ুসুফকে চাৰ্মান্তরা আর ইংরেজরা ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইয়ুসুফ সবাইর দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে।
–তাহলে চাৰ্মান্তরা এখনও জাহাজ থেকে নেমে যায়নি। হ্যারি বলল।
তাইতো দেখছি। কিন্তু এরকম অভিজাত চেহারা পোশাকেরমানুষ। ওদের জাহাজে এল কেন। ওদের বলছেই বা কী? ফ্রান্সিস একটু চিন্তিত স্বরে বলল।
-বোধহয় জাহাজটা কিনতে এসেছে। হ্যারি বলল।
হতে পারে। তবু মনে একটা খটকা লাগছে। চলো তো দেখি। ফ্রান্সিস বলল। বলে ফ্রান্সিস পাটাতনের দিকে এগোল। হ্যারিও পেছনে পেছনে এল।
দু’জনে হ্যারল্ডের জাহাজের ডেক উঠে এল। ভিড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে চাৰ্মান্ত বেশ সতর্ক ভঙ্গীতে ফ্রান্সিসদের কাছে এল। ও কিছু বলার আগেই ইয়ুসুফ ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল–আপনারা–মানে এখানে এসেছেন কেন?
–আমরা ঐ চার্মান্তের দেশের লোক। ভাইকিং। আপনার পরিচয়? ফ্রান্সিস বলল।
চর্মান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল–ইনি এই শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী। এর নাম–। কিন্তু ইয়ুসুফ সঙ্গে সঙ্গে চাৰ্মান্তকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল–শুনলেন তো আমি ব্যবসায়ী। এই জাহাজটার মালিক আমি–ফিগান আমার নাম।
-ঠিক বুঝলাম না। এই জাহাজ তো হ্যারল্ডের। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। হ্যারল্ড মাস ছয়েক আগে আমাকে বিক্রি করেছে। ইয়ুসুফ সাদা মাটা গলায় বলল।
কিন্তু হ্যারল্ড তো মারা গেছে। ইয়ুসুফ একটু চমকে উঠেও বেশ নির্বিকার গলায় বলল–এ্যাচাৰ্মান্ত আমাকে বলেছে সেকথা।
-কিন্তু আপনিই যে এই জাহাজ কিনেছেন তার প্রমান কিছু আছে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল। ইয়ুসুফ মৃদু হেসে বাঁহাত দিয়ে ডানদিকের পোশাকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা এক ভাঁজ করা লম্বাটে ছাইরঙা পাৰ্চসমেন্ট কাগজ বের করে বাঁ হাতেই হ্যারির হাতে দিল। হ্যারি পড়ল স্পেনীয় ভাষায় লেখা একটা জাহাজ বিক্রির দলিল। হ্যারি পড়ল– ফিগোন নামে দোরস্তাদের ব্যবসায়ীকে এই জাহাজ পঁচিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রায় বিক্রি করলাম। নিচে হ্যারল্ডের স্বাক্ষর। তারিখ ছ’ মাস আগেকার।
হ্যারি পড়ে কাগজটা ফিগোনকে ফেরৎ দিল। ফিগোন ওটা নিয়ে আবার বাঁহাতে পোশাকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। মাথা ওঠানামা করে হ্যারি বলল–হ্যাঁ। হ্যারল্ড ছ’মাস আগে এই জাহাজটা পাঁচিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রায় এঁর কাছে বিক্রি করেছে। ফ্রান্সিস এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে ইয়ুসুফের মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করছিল–লোকটার চোখেমুখে কোন ভাবান্তর নেই। কেমন একটা অদ্ভুত নির্বিকার ভঙ্গী। এমনকি হ্যারল্ড মারা গেছে শুনেও একটু চমকে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়েছে। এসব লোকের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই মনে মনে কী ফন্দী আঁটছে। একেবারে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ফ্রান্সিস বলল– কিন্তু এতদিন দখল নেননি কেন?
–হ্যারল্ড ইংল্যান্ড চলে গেল। বলে গিয়েছিল ফিরে এসেও জাহাজটা আমাকে দিয়ে অন্য জাহাজ কিনে নিয়ে নিজের দেশে চলে যাবে। ইয়ুসুফ বলল।
–কিন্তু একটা জাহাজ কেনার ক্ষমতা আয আছে সে তার জাহাজটা বিক্রি করবে কেন? ফ্রান্সিস প্রশ্ন তুলল।
ব্যবসা সেরে লাভের টাকা থেকে নতুন একটা ভালো জাহাজ কেনার ক্ষমতা হবে তখন। অকাট্য যুক্তি। ফ্রান্সিস কিছু বলল না। লোকটার বেশ কূটবুদ্ধি আছে সন্দেহ নেই।
তখনই ইয়ুসুফ হাততালি দিয়ে বলল–তোমরা সবাই সার দিয়ে দাঁড়াও। কিছুঅগ্রিম দেব। বাঁহাতে তুড়ি দিয়ে চাৰ্মান্তকে ইশারায় ডাকল। আবার বাঁহাত পোশাকের ভেতর ঢুকিয়ে একটা সাটিন কাপড়ের নীল থলে বের করল। বাঁহাতে থলেটা ধরে চাৰ্মান্তকে দিয়ে বলল–সবাইকে দুটো করে স্বর্ণমুদ্রা দাও। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল ফিগোন সেই যে ডান হাতটা প্রায় কব্জি পর্যন্ত কোমরের রুপোর কাজ করা চামড়ার বেলটে ঢুকিয়ে রেখেছে একবারও সেই কোমরবন্ধনী থেকে তুলে আনল না। বোধহয় লোকটা বাঁহাতী। অনেকেরই বাঁহাতটা বেশি শক্তি ধরে। তারা বাঁহাতই বেশি ব্যবহার করে। এমনকি লেখেও। প্রত্যেককে যখন স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হচ্ছে তখন ইয়ুসুফ বলল–তাহলে চাৰ্মান্তর সঙ্গে তোমরা চলে এসো। তোমাদের জামা কাপড়ের যা অবস্থা যাক গে–যাবার সময় চার্মান্ত তোমাদের কাপড়ের দোকানে নিয়ে যাবে। কাল সকালেই তৈরি পোশাক পেয়ে যাবে। আজ রাতটা আমার বাড়িতেই থাকবে। তোমাদের জন্যে নৈশ ভোজের ব্যবস্থা রয়েছে। কাল সকালেই নতুন পোশাক পরে থলিপত্র এনে জাহাজে তুলবে। ঠিক আছে। ইংরেজরা ভাইকিংরা খুব খুশি হল স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে। ওরা দু’তিন জন মাথা ঝাঁকাল।
-তাহলে ওদের মাল বাহকের কাজে লাগালেন। হ্যারি বলল।
ইয়ুসুফ হ্যারির কথা গ্রাহ্যই করল না। একটু দ্রুত পাটাতনের দিকে হাঁটতে লাগল। আর একবারও পেছনদিকে না তাকিয়ে ঘাটে নেমে গেল।
জাহাজে ফিরে হ্যারি বলল–যাহোক ওরা এই বিদেশে কাজ পেয়ে গেল। এখানে ওদের খাওয়াপরা জুটে যাবে। ফ্রান্সিসকে একটু চিন্তিত করে বলল–হ্যারি–ব্যাপারটা বোধহয় এত সহজ সরল না। অবশ্য ফিগোন ব্যাপারটা খুবই সাধারণ–মানে জাহাজ কেনা লোককে অগ্রিম দিয়ে কাজে লাগানো এভাবেই দেখাবার চেষ্টা করেছে।
–কিন্তু লোকটা তো নিজের পরিচয় দিলই। সবাই তো ওর প্রস্তাবে রাজি হল। গণ্ডগোলটা কোথায়? হ্যারি বলল।
–আছে আছে। ওরা কাল সকালে মালপত্র নিয়ে জাহাজে উঠতে এলে তবেই এটা একটা মালিক মজুরের সম্পর্ক ব’লেই মেনে নেব। তার আগে নয়। দু’জনের মধ্যে আর কোন কথা হল না।
সেই রাতটা ফ্রান্সিস বেশ অস্বস্তির মধ্যে কাটাল।
পরদিন সকালে দেখল হ্যারল্ডের জাহাজ জনশূন্য। চাৰ্মান্তরা তখনও ফিরল না। দুপুর হল। সন্ধা হল। তখনও চাৰ্মান্তদের বা অন্যদের দেখা নেই। হ্যারি বিকেল থেকেই জাহাজের রেলিঙ ধরে ঘাটের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু ওরা কোথায়?
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস তখন বিছানায় চোখ বুজে আধশোয়া হয়ে আছে। হ্যারি বলল–ওরা তো এখনও ফিরল না।
জানতাম। মৃদুস্বরে কথাটা বলে ফ্রান্সিস চোখ খুলে উঠে বসল। বলল–চলো। ওদের খোঁজ করতে হবে।
–তাহলে তো ফিগোনের বাড়ি যেতে হবে। হ্যারি বলল।
তাই যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–ওরা হয়তো কাল সকালে মালপত্র নিয়ে আসতে পারে। হ্যারি বলল।
–হ্যারি–মনে হয় ওরা আর ফিরবেনা। ফ্রান্সিস কথাটা বলে দরজার দিকে এগোল।
–কী ব্যাপার? এভান জানতে চাইল।
এসে বলবো। হ্যারি কথাটা বলে ঘরের বাইরে চলে এল।
দু’জনে ডেক-এ উঠে এল। জাহাজঘাটের দুপাশে দু’টো মশাল জ্বলছে। অন্ধকার মত জাহাজঘাটে নামল। বড় রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে বাঁদিকে দেখল একটা দোকানে বেশ ভিড়। কিছু কিছু বিদেশি জাহাজের নাবিক গ্লাসে চুমুক দিয়ে কী খাচ্ছে। ফ্রান্সিস বুঝল ওরা অবাকজাতীয় কিছু নেশার পানীয় খাচ্ছে। ওদের জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। ওরা বিদেশি। একটা বুনো মধু বিক্রির দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল–ভাই ফিগোনার বাড়িটা কোথায় জানো? দোকানদার আঙুল তুলে বেশ দূরে দেখিয়ে বলল–ঐ যে ডানদিকে লাল বাড়িটা ওটাই ফিগোনার বাড়ি। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ঐ লাল বাড়িটার সামনে এল। বড় পাথর দিয়ে গাঁথা বাড়ি। কাঠের বড় দরজাটায় ফুল, লতাপাতার কাজ করা। একজন দ্বাররক্ষী দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সশস্ত্র নয়। আঁটোসাঁটো হলদে পোশাক পরা। হ্যারি জানালায় আলোর আভাস। দরজার মাথায় একটা কাঁচে ঢাকা আলো ঝুলছে। হ্যারি দ্বাররক্ষীর কাছে গেল। বলল–ফিগোন আছেন?
না। উনি এক বন্ধুর বাড়ি গেছেন। দ্বাররক্ষী বলল।
–ফিরতে দেরি হবে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
–একাই গেছেন। এখনই ফেরার কথা বলতে বলতেই দ্বাররক্ষী রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল –ঐ তো। উনি আসছেন। দেখা গেল একজন বেশ মোটামত মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন। দরজার আলোয় ভদ্রলোককে দেখে ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল–
–হ্যারি-লোকটা ডাহা মিথ্যে কথা বলেছে। ভদ্রলোক কাছাকাছি এসে বলল আপনারা? —
–আমরা ভাইকিং। জাহাজে চড়ে এসেছি। আপনিই কি ফিগোনা?
হ্যাঁ। ভদ্রলোক একটু মাথা ওঠানামা করলেন।
–আপনিই কি আজ বিকেলে জাহাজঘাটে গিয়েছিলেন? হ্যারল্ডের জাহাজে? ফ্রান্সিস। বলল।
–কে হারল্ডং নামই শুনিনি কখনো। ফিগোনা বললেন।
–আপনি হ্যারল্ডের জাহাজ কেনেন নি? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
–না না। একটু থেমে বললেন–সত্যি কথাটাই বলি। বেশ কিছুদিন আমার ব্যবসায় খুব মন্দা চলছে। জাহাজ কেনার সাধ্য নেই। তবে ডন তিমব্রান্টের এখন খুব সুদিন আছে। একটা কেন দুতিনটে জাহাজ কেনার ক্ষমতা ওঁর আছে। ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বলল–আচ্ছা–ডন তিব্রান্ট কি বাঁহাতি। মানে–। ফিগোনা মৃদু হেসে বললেন–
–ওর ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা নেই। উনি বলেন–জন্ম থেকেই নাকি নেই। লোকে অবশ্য অন্য কথা বলে। থাকগে–লোকে তো কত কিছুই ভাবে।
-আপনাকে বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না। হ্যারি বলল।
–না না। দ্বাররক্ষী দরজা খুলে দিল।
–আচ্ছা ডন তিমব্রান্টের বাড়িটা কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।
আঙুল তুলে ডানদিকের রাস্তাটা দেখিয়ে বললেন ভদ্রলোক ঐ রাস্তা ধরে সোজা চলে যান। দশ বারোটা বাড়ির পর বাঁদিকে দুটো চেস্টনাট গাছের মাঝখানে যে বাড়িটা দেখবেন সেটাই ডন তিব্রান্টের বাড়ি।
অনেক ধন্যবাদ। ফ্রান্সিস বলল।
দু’জনে একটু এগিয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরল। দু পাশের বাড়িঘরের জানালায় আলোর আভাস। প্রায় অন্ধকার পথ ধরেই দু’জনে চলল। অল্পক্ষণের মধ্যেই বাঁদিকে দুটো গাছ দেখল। বাঁদিকে একটা লোহার নানা কাজ করা বড় কাঠের দরজা বন্ধ। কিন্তু সামনে কোন দ্বাররক্ষী নেই। মাঝখানে বেশ বড় একটা বাড়ি। নিচে বিরাট গুদাম। বিরাট দরজার একপাট বন্ধ। অন্যপাট আধখোলা। ফ্রান্সিস এগিয়ে গিয়ে সেখান দিয়ে গুদামে ঢুকল। পেছনে হ্যারি। দেখা গেল একটা কাঠের বড় চৌকোনো আসনে একজন লোক মাথা নিচু করে কী লিখছে। অন্য একটি লোক দাঁড়িয়ে থেকে কিছু বলছে। বোঝা গেল কর্মচারি। মাথার ওপর একটা বড় কাঁচে থেকে আলো জ্বলছে।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি দুজনের কাছে কাছে এসে দাঁড়াল। যে দাঁড়িয়ে ছিল সে দু’জনকে দেখতে পেয়ে বলে উঠল–কী চাই? যে লিখছিল সেও মুখ তুলে তাকাল।
-বাইরে দরজায় কোন দ্বাররক্ষী নেই দেখে আপনাদের কাছে এলাম। হ্যারি বলল।
–ঠিক আছে। কী চাই বলুন। বসে থাকা লোকটি জিজ্ঞেস করল।
–আমরা ব্যবসা সূত্রে এসেছি। জাহাজঘাটে আমাদের জাহাজ নোঙর করা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনারা কোন দেশের ব্যবসায়ী লোকটা জানতে চাইল।
–পোর্তুগালের। প্রায় পঞ্চাশ ষাট হাজার স্বর্ণমুদ্রার মালপত্র কিনতে এসেছি।
–বেশ তো। কী কী চাই লিখে দিন। লোকটি বেশ খুশি হয়ে বলল।
–কিন্তু এই ব্যাপারে ডন তিমব্রান্টের সঙ্গে আগে কথা বলতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–অসুবিধে আছে। সন্ধ্যের পর ডন তিমব্রোন্ট কারোর সঙ্গে দেখা করেন না। লোকটি গম্ভীর হয়ে বলল।
-কিন্তু আমরা তো দেরি করতে পারবো না। তাছাড়া ব্যবসা সংক্রান্ত জরুরী কথা আছে। কাল দুপুরের মধ্যেই জাহাজে মালপত্র নিয়ে চলে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–মুস্কিল হ’ল। ঠিক আছে। কথা বলে আসছি। অপেক্ষা করুন। লোকটি পেছনের একটা ছোট দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। কিছু পরে এসে বলল–আসুন। পেছনের দরজা দিয়ে ফ্রান্সিসরা ঢুকতেই দেখল এক বলশালী কালো দ্বাররক্ষী অল্প আলোয় পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। কোমর বন্ধনীতে খোলা বড় ছোরা গোঁজা। আর কোন অস্ত্র নেই। ওদের হাত বাড়িয়ে এগোতে ইঙ্গিত করে সামনের দিকে চলল। কিছুটা যাওয়ার পর পাথুরে দেয়ালে সুদৃশ্য কঁচে-ঢাকা আলো দেয়ালে ঝুলছে দেখল। আবার দুটো বাঁক। ফ্রান্সিস সর্বক্ষণ চারদিকেতীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখতে দেখতে চলল। এইবার ডানদিকে একটা টানাপথ পড়ল। পথের শেষে আলোয় দেখল বলশালী চেহারার এক দ্বাররক্ষী পাথরের মতদাঁড়িয়ে আছে। তারমানে ওদিক দিয়ে ঢোকার দরজাআছে। এবার ডানদিকের ঘরের সামনে এসে দ্বাররক্ষী দাঁড়াল। একটা সেই লোহার কারুকাজকরা দরজা দেখিয়ে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস হ্যারি দরজা খুলে ঢুকল। চাৰ্মান্ত এই ঘরেই আগে ঢুকেছিল। দেখল সেই লোকটি বসে আছে। গায়ে পাতলা হলদে রঙের দামি কাপড়ের পোশাক। সেই মোটা চামড়ার কোমরবন্ধনী। তবে অন্যরকম। ফ্রান্সিসদের দেখেই ইয়ুসুফ একটু চমকাল সঙ্গে সঙ্গে স্থির দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। একটু চুপ করে থেকে বলল-ব্যবসার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন।
কীসের ব্যবসা আপনাদের?
ফ্রান্সিস সে কথার জবাব না দিয়ে বলল–কাল বিকেলে আপনি জাহাজঘাটে গিয়েছিলেন। নিজেকে ব্যবসায়ী ফিগোনা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। আর–ফ্রান্সিসকে থামিয়ে দিয়ে ইয়ুসুফ গম্ভীর স্বরে বলে উঠল–থামুন। ওসব বাজে কথা রেখে ব্যবসার কথা বলুন।
–তাহলে আপনি কালকে বিকেলে–আবার ফ্রান্সিসকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল স্টপ। তারপর বাঁহাতে তুড়ি দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাঁপাশের দরজা দিয়ে দুই দশাসই কালো প্রহরী ছুটে এল।
–এই দুটোকে বাইরে বের করে দে। ইয়ুসুফ বলল। দ্বাররক্ষী দু’জন দ্রুত এসে। ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে ধরতে এল। ফ্রান্সিস হাত তুলে বলল–থাক। আমরা যাচ্ছি। দু’জনে ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল দরজার দিকে।
সেই গুদামের মধ্যে দিয়েই ফ্রান্সিসরা বাইরে এসে রাস্তায় নামল। চলল জাহাজ ঘাটের দিকে।
–কী সাংঘাতিক লোক। হ্যারি গলা নামিয়ে বলল।
–আর সন্দেহ নেই। ঐ লোকটা তিমব্রান্ট–শ্বেতকায় ক্রীতদাস কেনাবেচার ব্যবসা করে। তাই এই দোরস্তাদ বন্দরের সবচেয়ে বড় ধনী ব্যবসায়ী। ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। ফ্রান্সিস বলল।
কী করবে?
–এই নরাধমের হাত থেকে ওদের বাঁচাতেই হবে। হ্যারি বলল–যে ভাবেই হোক।
ছক ভাবছি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর কেউ আর কোন কথা বলল না।
আসতে আসতে সেই আরকের দোকানের সামনে এল। ভিড় কমে এসে গেছে। ফ্রান্সিস বলল–ঐ দোকানে চলো। হ্যারি তো অবাক। বলল তুমি তো এসব খাওনা।
–আজও খাবো না। তবে খাওয়ার ভান করবো। ফ্রান্সিস বলল।
একটু ভেবে নিয়ে হ্যারি বলল–তাহলে তুমি সন্দেহ করছো যে তিব্রান্টের লোক আমাদের অনুসরণ করছে।
ঠিক তাই, তিমব্রান্টের লোককে দেখাতে হবে যে আমরা সাধারণ জাহাজীদের মত এসব খাই। বিদেশি ধনী ব্যবসায়ীদের জন্যে মালপত্র কিনতে এসে ফুর্তি টুর্তি করি। তিব্রান্টের সন্দেহ দূর হবে। ও নিশ্চিন্ত হবে। অত্যন্ত ধূর্ত ও ফ্রান্সিস বলল।
দোকানটায় ঢুকে দেখল প্রায় সবাই গা এলিয়ে বসে আছে। সবাই বিদেশি নাবিক। একজন আবার জড়ানো গলায় গান গাইছে। দু’ গ্লাস আরক চেয়ে ফ্রান্সিস ও হ্যারি টানা কাঠের আসনে বসল। একজন হাড় জিরজিরে লোক ওদের সামনে দু’গ্লাশ আরক রেখে গেল। দু’জনে চুপ করে বসে রইল। ফ্রান্সিস আড় চোখে রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখল। , একটু পরেই দোকানের ঝোলানো আলোয় দেখল একটা কালো মানুষ দোকানটার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। একনজর ভেতরে তাকিয়ে ফ্রান্সিসদের দেখেই দ্রুত সরে গেল।
কিছুপরে ফ্রান্সিস উঠেদাঁড়াল। বলল চলো রাস্তায় এবার মৃদুস্বরে বলল–তিব্রান্টের কাছে খবর চলে যাবে। ও নিশ্চিন্ত হবে। আর দেরি নয়। আজ রাতেই ওদের মুক্ত করতে হবে। জোরে হাঁটো।
দু’জনেই দ্রুত হেঁটে চলল জাহাজঘাটের দিকে।
দু’জনে জাহাজে উঠতেইশাঙ্কোরা কয়েকজন এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–সব পরে বলবো। শাঙ্কো বিনোলা যত তাড়াতাড়ি পারো খেয়ে নাও। তরোয়াল নিয়ে তৈরি হয়ে এসো। ফ্রান্সিস আর কেবিনঘরে ঢুকল না। খাবার জায়গায় চলে এল। রাঁধুনী বন্ধুরা বলল–সব তো রান্না হয়নি।
দরকার নেই। যা হয়েছে তাই খেতে দাও। হ্যারি আমার তরোয়ালটা নিয়ে এসো। জলদি।
কেবিনঘরে বিছানার একপাশে বসে মারিয়া ফ্রান্সিসের পোশাকের ছেঁড়া জায়গাগুলো সেলাই করতে করতে ক্রেভানের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল। হ্যারিকে ঢুকতে দেখে মারিয়া বলল–
–ফ্রান্সিস কোথায়?
–খাচ্ছে। হ্যারি বলল।
–এত তাড়াতাড়ি মারিয়া অবাক। হ্যারি বিছানার তলা থেকে তরোয়ালটা বের করে বলল–রাজকুমারী আমি এসে সব বলছি। হ্যারি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এল। শাঙ্কো আর বিনোলা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে তরোয়াল কোমরে গুঁজে ডেকএ উঠে এল। ফ্রান্সিস আগেই অপেক্ষা করছিল। তিনজনে পাটাতন দিয়ে হেঁটে পাথুরেঘাটে নেমে এল।
রাস্তা দিয়ে তিনজনে চলল। লোকজনের ভিড় কমে গেছে। দু’পাশের বাড়িঘরে কোন বাড়ির জানালায় আলোর আভাস। বেশির ভাগ বাড়িই অন্ধকারে ডুবে আছে। চাঁদের আলোও অনুজ্জ্বল। ওরা নিঃশব্দে হেঁটে চলল।
ইয়ুসুফের বাড়ির সামনে এসে দেখল গুদাম ঘরের দরজা বন্ধ। বাইরে কোন রক্ষী নেই। ফ্রান্সিস একটু দাঁড়াল। বাঁদিকে খাবার সময়ে কিছু দূরে গলিপথের শেষে যে বন্ধ দরজা আর তার সামনে প্রহরী মোতায়েন দেখেছিল সেই দিকটা হিসবে করে নিয়ে মৃদুস্বরে বলল–চলো। বাড়িটার ডানদিকের চিতে গলিটা দিয়ে ঢুকে আবছা অন্ধকারে কিছুটা এগোতেই বাঁদিকে একটা দরজা দেখল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। ফিসফিস্ করে বলল–এই দরজা দিয়েই ভেতরে ঢুকতে হবে। দরজার ওপারেই প্রহরী আছে। বড় ছোরা কোমরে গোঁজা। ওকে কবজা করতে হবে। একটু থেমে বলল–নিশ্চয়ই দরজায় কোন সাঙ্ঘাতিক শব্দ করতে হয়। তিমন্ত্রাটের সব ব্যবস্থা পাকা। ফ্রান্সিস দরজাটায় আঙুল দিয়ে দুটো টোকা দিল। দরজা খুলল না। আন্দাজে আর একটা টোকা দিল। দরজার, একপাট খুলে প্রহরীটি মুখ বাড়াল আর ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই শাঙ্কো ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলশালী কালো প্রহরীটি সেই হঠাৎ ধাক্কায় মেঝেয় পড়ে গেল না, দ্রুত কোমরে হাত বাড়িয়ে ছোরা বের করতে গেল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে খোলা তরোয়ালে ডগাটা ওর গলায় চেপে ধরে চাপাস্বরে বলল–চেঁচিয়েছো কিমরেছো। পেছোও। প্রহরীটি বিপদ বুঝতে পারল। এক পা এক পা করে পিছিয়ে গেল। তিনজনেই দ্রুত ঢুকে পড়ে দরজা বন্ধ করে দিল। বিনোলা তখনই তরোয়ালের ডগাটা প্রহরীর বুকে চেপে ধরল।
কাল যাদের আনা হয়েছিল তারা কোথায়? ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল।
–ভীতমুখে প্রহরীটি ভেতরদিকে ইঙ্গিত করল।
–চলো। ওদের নিশ্চয়ই বন্দী করে রাখা হয়েছে? ফ্রান্সিস বলল।
প্রহরীটি মাথা ওঠানামা করল।
–আমাদের নিয়ে চলো। জলদি। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল।
দরজার মাথায় একটা সুদৃশ্য কাঁচের আলোবদানে আলো ঝুলছিল। প্রহরীটি নিঃশব্দে সেই আলোয় গলিপথটা দিয়ে চলল। বুকে পিঠেতবোয়াল চেপে ধরে ফ্রান্সিস …নিঃশব্দে চলল। গলিপথ শেষ হতেই দেখা গেল পাথর বাঁধানো চত্বর। তারপরেই ডানদিকে লোহার গরাদ দেওয়া একটা ঘর। ঘরটার লোহার দরজার মাথায় আলো জ্বলছে। একজন প্রহরী খোলা তরোয়াল হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কালো। বেশ বলশালী। ফ্রান্সিস হাত তুলে পাথুরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস ফিস্ ফিস্ করে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে সেই অবছা অন্ধকারে খোলা তরোয়াল হাতে প্রহরীটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল। এই হঠাৎ আক্রমণে প্রহরীটি প্রায় ছিটকে লোহার গরাদের ওপর পড়ল। মাথাটা লোহার গরাদে জোর ধাক্কা খেল। গরাদে ঠন শব্দ হল। ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলে উঠল শাঙ্কো শব্দ নয়। মাথায় প্রচণ্ড ঘা খেয়ে প্রহরীটি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। ফ্রান্সিস একলাফে প্রহরীটির বুকে তরোয়াল চেপে ধরে চাপাস্বরে বলল-দরজা খোল। নইলে মরবে। এরকমভাবে হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে দুই প্রহরীই তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। তখনই বাঁদিকের ঘর থেকে একটা শব্দ উঠল–শব্দ কীসের? ফ্রান্সিস তরোয়ালের ডগাটা প্রহরীটির বুকে জোরে চেপে ধরে দাঁত চাপাস্বরে বলল–বল–দরজা খুলছি। প্রহরীটি তখনও অবাক চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্রান্সিস জোরে তরোয়াল চাপল। বুকে কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। প্রহরীটির পোশাকের ঐ জায়গাটা রক্তে ভিজে গেল। ফ্রান্সিস আবার চাপাস্বরে বলল-বলো। প্রহরীটি তাড়াতাড়ি বলে উঠল–দরজা খোলার শব্দ।
তালা খোল। আস্তে তরোয়াল ফেলে দাও। ফ্রান্সিস একইভাবে বলল–খোল দরজা। প্রহরীটি অবশ্য পাথুরে মেঝেতে তরোয়াল রাখল। ককাময়ের ফেট্টি থেকে চাবি বের করে কয়েদঘরের দরজা খুলে দিল। শাঙ্কো একলাফে এগিয়ে এগিয়ে দরজার সবটা খুলে দিয়ে চাপাস্বরে বলল–পালাও। প্রথমেই ছুটে বেরিয়ে এল চাৰ্মান্ত। ফ্রান্সিস ওকে দেখে খুব একটা অবাক হল না। তারপরেই বাকিরা দরজার দিকে ছুটল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–সবাই জাহাজঘাটের দিকে ছোটো। যত জোরে পারো। দুই প্রহরীকে ফ্রান্সিসরা তরোয়াল ঠেকিয়ে আটকে রাখল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–শাঙ্কো-বিনোলা–পালাও। ওরা তিনজনই এবার তরোয়াল সরিয়ে নিয়ে পেছন ফিরে দরজার দিকে ছুটল। প্রহরী দু’জন এবার পালাচ্ছে–পালাচ্ছে বলে চেঁচিয়ে উঠল। দুজনেই ফ্রান্সিসদের ধরবার জন্য দরজার দিকে ছুটে এল। শাঙ্কো বিনোলা একলাফে দরজা পার হয়ে চিলতে গলিতে নামল। নেমেই আবছা অন্ধকারে চিলতে গলি ধরে রাস্তার দিকে ছুটল। ফ্রান্সিস দেখল চাৰ্মান্ত দাঁড়িয়ে আছে। চাৰ্মান্ত চাপাগলায় বলে উঠল-সাবধান–ওপাশের ঘরে একজন যোদ্ধা থাকে। তখনই একজন প্রহরী চাঁচাতে চাঁচাতে দরজার কাছে চলে এসেছে। ফ্রান্সিস এই সুযোগটাই চাইছিল। ও সঙ্গে সঙ্গে তরোয়াল ফেলে দু’হাতে প্রচণ্ড জোরে দরজার পাল্লাটা দিয়ে প্রহরীর মুখের ওপর বন্ধ করে দিল। তখনই চিলতে গলি দিয়ে একজন যোদ্ধাকে ছুটে আসতে দেখা গেল। কিন্তু কারো হাতে অস্ত্র নেই। অস্ত্র নেবার সময় পায়নি। চাৰ্মান্ত ততক্ষণ চিলতে গলি দিয়ে রাস্তার দিকে ছুটেছে। ফ্রান্সিসও তরোয়ালটা ফেলে রেখে চাৰ্মান্তর পেছনে পেছনে প্রাণপণে ছুটে রাস্তায় চলে এল। অনুজ্জ্বল চাঁদের আলোয় দেখল শাঙ্কোরা বেশ দূরে ছুটে চলেছে।
ফ্রান্সিসের পাশে পাশে ছুটতে ছুটতে চার্মান্ত হাঁপানো গলায় বলল–আর ভয় নেই। ঐ যোদ্ধারা সদর রাস্তায় আসবেনা। ইয়ুসুফ যে একদল যোদ্ধা পোষে–এ খবরটা ও গোপন রাখে সবার কাছে।
হুঁ ধুরন্দর–সন্দেহ নেই। হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিসও বলল। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে ছুটে চলা শাঙ্কোকেলক্ষ্য করে বলল–ছুটো না। আস্তে। আস্তে। ও নিজেই গতি কমাল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–তুমি ইয়ুসুফ–বলছিলে কাকে? ঐ তিমব্রানটকে। ও আসলে আরব দেশের লোক। ক্রীতদাস ব্যবসা
–গোপন রাখতে–ঐ নাম নিয়েছে। চাৰ্মান্ত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
–এখানকার রাজা কে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–রাজা নেভেল। ইয়ুসুফের সঙ্গে খুব ভাব রাজা নেভেলের।
–ইয়ুসুফ তো–ধনী ব্যবসায়ী। চাৰ্মান্ত বলল।
–হুঁ। ফ্রান্সিস বলল–এভাবে ছোটা চলবে না। রাজার পাহারাদের নজরে পড়ে যেতে পারি। ও আবার চেঁচিয়ে বলল–শাঙ্কো–থামো। শাঙ্কোরা দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল। কাছে এসে ফ্রান্সিস বলল–সবাই স্বাভাবিকভাবে হাঁটো। কারো নজরে যেন না পড়ি। সবাই এবার হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটতে লাগল।
শাঙ্কো–তুমি একটু জোরে ছুটে যাও। জাহাজের নোঙর তুলে ফেল। নয়ত পোল তোল। দাঁড় বাইতে বলো। এই বন্দরে আর একমুহূর্তও থাকবো না। এখানকার রাজা নেভেল আমাদের বিপদে ফেলতে পারে। যাও। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ ঘাটের দিকে ছুটল।
জাহাজঘাটে পৌঁছে ফ্রান্সিস দেখল ওদের জাহাজে বন্ধুরা ততক্ষণে পাল খাটিয়ে ফেলেছে। বোধহয় দাঁড়ঘরেও দাঁড় বাইতে চলে গেছে একদল। ও বুঝল-বন্ধুরা কেউ ঘুমোয় নি। যথেষ্ট সজাগ ছিল। রেলিঙ ধরে মারিয়াও দাঁড়িয়েছিল।
ইংরেজ বন্দীরা কয়েকজন এসে ফ্রান্সিসদের দুহাত জড়িয়ে ধরল। একজন বলল কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো।
–ওসব পরে হবে। এখনও আমাদের বিপদ কাটেনি। তোমরা তাড়াতাড়ি তোমাদের জাহাজে উঠে পড়ো। জাহাজ ভাসিয়ে দাও। কিছুদূরের কোন বন্দরে জাহাজ নিয়ে যাও। শিগগির দেরি করো না। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–কিছু স্বর্ণমুদ্রা তোমরা পেয়েছে। আমরা তো ধনী নই। কিছু সোনার চাকতি পাঠাচ্ছি। তোমরা খাদ্য জল সংগ্রহ করে দেশে ফিরে যেও। তখনই চাৰ্মান্ত এগিয়ে এল। বলল–ফ্রান্সিস আমরা কী করবো?
–তোমরা ইয়ুসুফের হাত থেকে রেহাই পাবে না। ওদের জাহাজে উঠে পালাও। তারপর লুঠেরাদের দলে ঢুকবেনা–স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে সেটা তোমাদের বিবেচনা। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা আর লুঠপাট করবো না। আমাদের দেশে নিয়ে চলো চাৰ্মান্ত বলল।
–না। তোমরা অনেক নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। তোমাদের সেই নৃশংসতার শাস্তি পেতেই হবে। আমি তোমাদের দায়িত্ব নেব না। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস জাহাজে উঠতেই মারিয়া এগিয়ে এল। বলল–
–তোমাদের কোন বিপদ হয়নি তো।
না-না যাও–শিগগির কিছু সোনার চাকতি নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস তাগাদা দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই মারিয়া সোনার চাকতি নিয়ে ফিরে এল। একটা রুমালে বেঁধে। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকিয়ে শাঙ্কোকে হালের কাছে দেখল। কয়েকজন বন্ধুকে রাতের অভিযানের কথা বলছে। ফ্রান্সিস ভাবলশাঙ্কো এসো। শাঙ্কো তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল। রুমালে বাঁধা সোনার চাকতিগুলো শাঙ্কোকে দিয়ে বলল–তাড়াতাড়ি যাও। ইংরেজদের সোনার চাকতিগুলো দিয়ে এসো। দেরি করবে না। এক্ষুনি জাহাজ ছাড়া হবে। শাঙ্কো ছুটে চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ ছাড়া হ’ল। কিছুদূর জাহাজ চলে আসতেই পূব আকাশে কমলা রঙের বন্যা বইয়ে সূর্য উঠল। ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে এসে বলল–ক্রেভান যে খাঁড়িটা দেখিয়েছে সেই খাঁড়িতে যত তাড়াতাড়ি পারো জাহাজ ঢুকিয়ে দাও। মনে হয় খাড়িটা বড়। জলও গভীর। কারণ প্রচণ্ড ঝড়ের ধাক্কা, রাজা ম্যাগনামের জাহাজ খাঁড়িতে নির্বিঘ্নে ঢুকতে পেরেছিল। জাহাজ চলল খাড়ির দিকে।
সমুদ্রতীরের ছোট ছোট টিলা বনজঙ্গল দেখা গেল। মানুষের বসতি নেই। সমুদ্রতীরের বেশ কাছে ফিরে যেতে যেতে দূর থেকে খাঁড়ির মুখ দেখা গেল। বেশ বড় খাঁড়ি। ধারেকাছে কোন জনবসতি নেই।
তখন একটু বেলা হয়েছে। হ্যারি ডেক ফ্লেজারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বিনোলাকে ডেকে বলল–ফ্রান্সিসকে খবর দাও। একটু পরেই ফ্রান্সিস ডেকএ উঠে এল। ফ্লেজার ও হ্যারির পাশে এসে দাঁড়াল।
–হ্যারি–এইটাই সেই খাঁড়ি কিনা একমাত্র ক্রেভানই বলতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
-ঠিক আছে। আমরা ক্রেভানকে নিয়ে আসছি। হ্যারি চলে গেল। হ্যারি আর শাঙ্কো ক্রেভানকে ধরে ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে এল ফ্রান্সিসদের কাছে।
-দেখুন তো–এটাই সেই খাঁড়ি কিনা? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল। ক্রেভান খাঁড়ির মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল–হ্যাঁ-এটাই সেই খাঁড়ি। তবে আগে মুখের দু’পাশে কিছু গাছপালা ছিল। এখন দেখছি নেই।
–ফ্রান্সিস কী করবে? হ্যারি বলল।
–এক্ষুনি জাহাজ খাঁড়িতে ঢোকাতে হবে। কিছুদূর গেলেই আড়ালে পড়ে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–দুপুরে নেয়েটেয়ে–হ্যারি বলতে গেল।
–না না ইয়ুসুফ আমাদের সহজে ছেড়ে দেবে না। নিশ্চয়ই রাজা নেভেলের সৈন্য নিয়ে জাহাজে চড়ে ইয়ুসুফ আমাদের খুঁজতে বেরোবে। তার আগেই আমরা যতটা পারি খাঁড়ির ভেতর ঢুকে পড়বো৷ ফ্রান্সিস বলল। তারপর ক্রেভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–সেই স্লাভিয়াগ্রাম কতদূর?
–বেশ ভেতরে। জাহাজ চলুক। দেখিয়ে দেব। ক্রেভান বলল।
ফ্লেজার জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে আস্তে আস্তে জাহাজটা খাঁড়ির মধ্যে ঢোকাল। বেশ চওড়া খড়ি। দু’দিকের তীর ভূমিই পাথুরে।
ফ্রান্সিস এবার বলল–ফ্লেজার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালাও।
বাতাস, বেশ জোরে বইছিল। পালগুলো দুলে উঠেছে। শাঙ্কোরা কয়েকজন চলে গেল দাঁড়ঘরে। দ্রুত দাঁড় টানতে লাগল। খাঁড়ির দুদিকের পাড়ই বেশ উঁচু।
বেশ বেলায় বাঁদিকে একটা ছোট পাহাড় দেখা গেল। খাঁড়ি থেকে খাঁড়া উঠে গেছে। চূড়াটা যেন ডাঙা সমান। ক্রেভান বলে উঠল–এসে গেছি। ঐ পাহাড়ের উল্টেদিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল–ঐ যে বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। ওটা স্লাভিয়াগ্রাম। আমি যখন এসেছিলাম তখন এত ঘরবাড়ি দেখিনি। ঘাটমত আছে একটা। ঐ ঘাটেই জাহাজ ভেড়াতে হবে। গ্রামের কাছাকাছি এসে দেখা গেল বেশ জলকাদা ছাড়িয়ে পাথুরে তীর উঠে গেছে। এখানে জোয়ার ভাটা খেলে বলেই কাদাটে। ফ্লেজার আস্তে আস্তে ঐ ঘাটমত জায়গাটায় জাহাজ ভেড়াল। তখন দুপর হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল, হ্যারি, কত অজানা, অচেনা ঘাটে বেশ চিন্তা-ভাবনা করে বিপদের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে নেমেছি। তারপর, সে তো কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এখানে যাহোক নিশ্চিন্তে নামা যাবে।
এখন কি নামবে? হ্যারি জানতে চাইল।
অনেক বেলা হয়েছে। খাওয়া সেরে ক্রেভানকে সঙ্গে নিয়ে নামব। ফ্রান্সিস বলল।
দুপুরের খাওয়া শেষ হল। শাঙ্কো আর সিনাত্রা ঘাট মতো জায়গাটায় পাটাতন ফেলল। হ্যারি আর ফ্রান্সিস নামল। তখনই মারিয়া এল।
–আমিও যাব।
–বেশ। এসো।
শাঙ্কো আর সিনাত্রা ধরে ধরে ক্রেভানকে নামাল। মারিয়াকেও নামতে সাহায্য করল। ঢাল বেয়ে সবাই উঠতে লাগল। উঠতে উঠতে ফ্রান্সিস বলল, অন্য কোনো বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই। যে বাড়িতে আপনি রাজা ম্যাগনামের একপাটি জুতো দেখেছিলেন, পাণ্ডুলিপি পেয়েছিলেন সেই বাড়িতে নিয়ে চলুন।
আস্তে আস্তে হোঁচট খেতে খেতে ক্রেভান ফ্রান্সিসদের একটা বাড়ির সামনে নিয়ে এল। বাড়িটা অন্য বাড়িগুলোর মতোই। তবে খাঁড়ির জলের কাছে। ওদিকে গ্রামের লোকজন কৌতূহলী হয়ে ফ্রান্সিসদের কাছে এসে দাঁড়াল। সকলেই জানতে চায় ওরা এসেছে কেন? তবে ক্রেভানকে অনেকে আগে এখানে থাকতে দেখেছে। তাদের কেউ কেউ এসে ক্রেভানের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল।
বাড়িটায় ঢুকল সবাই। প্রথম ঘরটাতে দেখল একটা গাছের কাটা ডাল থেকে তৈরি বিছানায় পশুলোমের কম্বল জড়িয়ে এক বেশ বৃদ্ধ, সারা মুখে দাড়িগোঁফ, বসে আছে। তখনই ভেতরে থেকে এক বয়স্ক লোক এগিয়ে এল। ঢোলা হাতা জামা পরা। ক্রেভানকে দেখে হেসে এগিয়ে এল। দুজনে কিছু কথাবার্তা কুশল বিনিময় হল।
ক্রেভান, জুতোটা দেখাতে বলুন। ক্রেভান লোকটিকে বলল সে কথা।
এই ঘরেই আছে। লোকটি উবু হয়ে পাথরের মেঝেতে বসল। মাথা নিচু করে হাত বাড়িয়ে একপাটি জুতো নিয়ে এল। ফ্রান্সিস হাতে নিল জুতোটা। দেখল, বেশ দামি চামড়ায় তৈরি জুতো। জুতোর এখানে-ওখানে ছোট ছোট গর্ত দেখে বুঝল দামি কিছু সোনা-হিরেও হতে পারে জুতোটায় গাঁথা ছিল। কাজ করাও ছিল। জুতোটার কোথাও ছেঁড়া নেই। মজবুত চামড়ার জুতো। তবে খুব পুরোনো।
-জুতোটা আপনাদের বাড়িতে কী করে এল? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–সেসব তো গল্পকথা। বংশানুক্রমে আমরা শুনে আসছি।
সেই বৃদ্ধকে দেখিয়ে ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল, উনি কিছু বলতে পারবেন?
–অনেক বয়েস হয়েছে ঠাকুর্দার। শরীরের মনে কোনো সাড়াই নেই। তবে ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি, অনেক দিন আগে এই খাঁড়িতে প্রচণ্ড ঝড় হয়েছিল। তার পরদিন সকালে নাকি একজন খুব অভিজাত সুপুরুষ আমাদের বাড়ি এসেছিলেন।
–সেই রাতে কি এই খাঁড়িতে জাহাজডুবি হয়েছিল?
–তেমন তো কিছু শুনিনি।
সেই সুপুরুষ কোথা থেকে এসেছিলেন?
তা তো শুনিনি।
সেই সুপুরুষ কিছু বলেননি?
তিনি কথাই বলতে পারেননি।
কেন?
তার দু’হাত ভাঙা ছিল। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত। সারা পোশাক, রাজারাজড়ার পোশাক যেমন হয়, রক্তে ভেজা। সারা শরীর, মুখ-হাত কাদায় মাখামাখি। পায়ে ছিল নাকি ঐ একপাটি জুতো।
হুঁ। পাও ভেঙেছিল। বোঝাই যাচ্ছে বুকে হিঁচড়ে খাঁড়ি থেকে উঠে এসেছিলেন। আচ্ছা, পাণ্ডুলিপির ছেঁড়া কিছু পাতা কি আপনাদের সেই সময়কার পূর্বপুরুষ কেউ পেয়েছিলেন? ফ্রান্সিস সাগ্রহে জিগ্যেস করল।
এটা তো সেদিনের কথা। ক্রেভানকে দেখিয়ে লোকটি বলল, উনি এখানে অনেকদিন ছিলেন। ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। মনে হত উনি কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমাদের কাঠকুটো রাখার ঘরে এক দড়ির ঝোলায় নাকি উনি কিছু পাতা পেয়েছিলেন। কী সব নাকি লেখা ছিল তাতে। তা আমরা তো মুখসুখু মানুষ–পড়তেই জানি না। উনিও অবশ্য এই ব্যাপারে কোনো কথা আমাদের কিছু বলেননি।
শুনুন, সেই সুপুরুষ ছিলেন নরওয়ের রাজা ম্যাগনাম। পাতাগুলোয় কিছু লিখে রেখেছিলেন তিনি। ফ্রান্সিস বলল।
তাই নাকি? লোকটি ভীষণ অবাক হল। সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, তাহলে এসব গল্পকথা নয়?
না। উনি কতদিন বেঁচে ছিলেন?
শুনেছি মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এখানে ভালো বৈদ্য কোথায়?
তারপর?
এসবই শুনেছি। খাঁড়ির তীরে কোথায় নাকি তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব জেনে কী হবে?
সেটা আপনাকে কয়েকদিন পরে বলব। আরো কিছু জানার থাকলে আসব। আশা করি আপনি আমাদের সাহায্য করবেন। ফ্রান্সিস বলল।
ক্রেভান আমাদের মত পরিচিত। কত ভালো মানুষ। তাঁকে নিয়ে আপনারা এসেছেন। নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য পাবেন। লোকটি হেসে বলল।
ফ্রান্সিস হ্যারিদের দিকে তাকিয়ে বলল, চলো ফেরা যাক। ঢাল বেয়ে নেমে পাটার ওপর দিয়ে সবাই জাহাজে ফিরে এল। ফ্রান্সিস বলল, হ্যারি, রাতে এসো। কথা আছে।
শাঙ্কো ক্রেভানকে ধরে ধরে নিয়ে এল। বিছানায় শুইয়ে দিল।
রাতের খাওয়া শেষ। ফ্রান্সিস নিজেদের কেবিনে এসে আধশোয়া হল। মারিয়া
ক্রেনের সারা গা ভেজা কাপড়ে মুছিয়ে দিয়ে খাইয়ে দিল। তারপর ওষুধ খাইয়ে ফ্রান্সিসের পাশে এসে বসল। হ্যারি তখনই এল। ফ্রান্সিস ডাকল, ক্রেন?
উ?
রাতে ছেঁড়া পাণ্ডুলিপিটা ঠেকে ঠেকে পড়লাম। বুঝলাম, শেষ পাতা ওটা। পাণ্ডুলিপির আরম্ভটা আর একবার বলতে পারবেন?
কতবার পড়েছি। সব মুখস্থ হয়ে গেছে। বলছি, শুনুন। ক্রেভান শুয়ে শুয়ে দু’চোখ বুজে বলতে লাগল।
আমি, ম্যাগনাম, নরওয়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা আজহঠাই লিখতে শুরু করলাম এই সব। কেউ পড়বে সেজন্য নয়। এ যেন আমার মনের সঙ্গে কথা বলা। বলা যায় মনের সঙ্গে বোঝাঁপড়া একটা ঘটনা জানি না শুনেছিলাম কিনা হঠাইমনটা ভীষণ নাড়া দিল। এইমাত্র নেমে এলাম ডেক থেকে। ওখানে–রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ধূসর কুয়াশা ঢাকা সমুদ্রের দিগন্ত। ওপরে ধোঁয়াটে মেঘের মধ্যে অস্পষ্ট পূর্ণ চাঁদ। চারদিকে। আবছা আলো। বাতাসের শন্ শন্ শব্দ নেই। নিস্তেজ বাতাস। অসীম নৈঃশব্দ্যের মধ্যে জাহাজের গায়ে ভেঙে পড়া ঢেউয়ের মৃদু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। হঠাৎ খুব অস্পষ্ট একটা কথা শুনলাম, ধিক্। ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। কে বলল কথাটা? চারদিকেতাকালাম। গভীর রাত। ডেকে কেউ নেই। ঠাণ্ডার রাত। কান পাতলাম। খুব মৃদুস্বরে, ধিক্। কথাটা কে বলল? মুহূর্তে বুকে একটা অসহ্য কষ্ট– এ কি আমাকেই লক্ষ্য করে বলা? কষ্টটা সহ্য করতে করতে এলোমেলো পা ফেলে কেবিনে এসে শুয়ে পড়লাম। জানি না–ঘুম–
ক্রেন থামল। ফ্রান্সিসরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ক্রেভান বলল, তারপরের পাতাগুলিতে বর্ণনা করেছেন লুঠ, অগ্নিসংযোগ আর নির্বিচারে নরহত্যার কাহিনি। কী অনির্বচনীয় কী অর্থবহ কী নিপুণ ভাষায় মৃত্যুকে বর্ণনা করেছেন। কী গভীর মমতায় স্মরণ করেছেন সেইসব নারী-পুরুষ-শিশুর মৃত মুখগুলি। ক্রেন থামল। তার পরের পাতাটায় কিছু লেখা নেই। শুধু কাটাকুটি আঁকিবুকি। তারপর লেখা–দেশে ফিরে সব লুটের ধন প্রজাদের মধ্যে বিলিয়ে দেব। শূন্য করে দেব রাজকোষের সঞ্চিত সবকিছু। রাজপ্রাসাদের রাজকীয় বিলাসবাসন, আত্মসুখী উদ্দাম উজ্জ্বল জীবন-সব পেছনে ফেলে চলে যাব দীর্ঘ রাত্রি আর দীর্ঘ দিবসের দেশ আইসল্যান্ডে। শুনেছি কয়েকটা ধর্মীয় মঠ আছে ওখানে। মঠবাসীর কঠিন তপস্যাই হবে আমার শেষ জীবন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। ধিক্ কথাটা যেন আমাকে আর শুনতে না হয়।
ক্রেন থামল। ফ্রান্সিসরা কেউ একটি কথাও বলতে পারল না। ক্রেভান একটু চুপ করে থেকে বলল, তারপরের শেষাংশ তো তোমাদের হাতেই আছে। ফ্রান্সিস মুখ নিচু করে শুনছিল। এবার মৃদুস্বরে ডাকল, হ্যারি।
হ্যাঁ। রাজা ম্যাগনামের মনে গভীর বৈরাগ্য এসেছিল–আশ্চর্য পরিবর্তন। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল।
পরদিন সকালে ফ্রান্সিস ডেকে উঠে এল। চারদিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখতে লাগল। রাজা ম্যাগনামের জাহাজ ঝড়ের ধাক্কায় এতদূর এসেছিল। তারপর ডুবে গিয়েছিল। এখানেই। কিন্তু কোথায়? মোটামুটি বিস্তৃত খড়ির জলরাশি। এদিকে স্লাভিয়া গ্রামের সেই লোকটির বাড়ি। মারাত্মক আহত রাজা ঐ বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওপাশে দেখা যাচ্ছে একটাই মাত্র পাহাড়। তেমন উঁচু নয়। পাহাড়ের গায়ে সবুজ ছাড়া ছাড়া গাছ-গাছালি। একটা ব্যাপার একটু অদ্ভুত লাগল। পাহাড়ের মাথাটা ভাঙা। ওপরে গাছ গাছালি নেই। ঘাসও নেই। কেমন ধূসর রঙ। গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে পাহাড়ের যেটুকু ছাড়া ছাড়া গা দেখা যাচ্ছে তারও রঙ ধূসর। ফ্রান্সিস চুপ করে গভীর ভাবে সব কিছু ভাবতে লাগল।
হ্যারি এসে পাশে দাঁড়াল। বলল, জাহাজ কীভাবে ডুবেছিল?
প্রচণ্ড ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজ ভেঙে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল।
তাহলে ডুবে যাওয়া জাহাজটা তো এখানেই কোথাও জলের নীচে
হ্যাঁ কিন্তু কোথায়? এতটা বিস্তৃত খাঁড়ির জল। এখানে জোর জোয়ার-ভাটা খেলে। ভাঙা ডোবা জাহাজটা যে কোনোদিকে সরে যেতে পারে।
আবার বালিকাদার স্তরে গেঁথেও যেতে পারে।
হ্যাঁ, তা পারে।
তাহলে কোথায় খুঁজবে?
সেটাই তো আসল রহস্য। কোথায়? একটা জায়গা তো নির্দিষ্ট করতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে করব? একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল, জাহাজটা ডুবে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত। রাজা ঐ কাগজে লিখছিলেন। আচ্ছা হ্যারি, ঐ ছেঁড়া পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে এসো তো। ঐটা কোনোরকমে বাঁচিয়েছিলেন তিনি।
আমার কোমরেই গোঁজা আছে। সময় পেলেই পড়ি।
বের করো। শেষের দিককার লেখাগুলো পড়ো তো।
হ্যারি কোমরে-গোঁজা পাণ্ডুলিপিটা বের করল। সামনে মেলে ধরে পড়তে লাগল মুষলধারে বৃষ্টি…দু’পাশেটাল খেতে খেতে.. আর লিখতে পারছি না… প্রচণ্ড ধাক্কা… কে ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে বলল, সামনে সাদাটে–ব্যস, এখানেই শেষ। শেষ শব্দ ঐ সাদাটে।
ঐ সাদাটে কী?
বৃষ্টির সময় চোখের সামনে সাদাটে আস্তরণ মতো মনে হয়। এটা তো সাধারণ অভিজ্ঞতা। হ্যারি বলল।
না হ্যারি। ভুলে যেও না তখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল বারবার। সেই আলোয় বৃষ্টির আস্তরণ ছাড়িয়েও কিছুদূরের জিনিস দেখা যায়। তাই প্রশ্ন, সাদাটে কী? আচ্ছা, সাদাটে শব্দটা আর কোথাও আছে?
দেখছি। হ্যারি কাগজটা উঁচু করল। দেখছে, তখনই ফ্রান্সিস কাগজটার দিকে তাকাল। আলো পড়েছে কাগজটায়। ফ্রান্সিস অস্পষ্ট দেখল, কাগজটায় আবছা তিনকোনা বড় দাগমতো। ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বলে উঠল, দাঁড়াও। কাগজটা ধরে থাকো। ফ্রান্সিস দ্রুত এগিয়ে গেল। এবার আবছা তিনকোনা দাগটা দেখতে পেল।
সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিস দ্রুত ঘুরে তাকাল ঐ পাহাড়টার দিকে। অস্পষ্ট ছাপটা ঠিক ঐ পাহাড়ের মতো। পাহাড়ের মাথাটা ভাঙা। বেশ সমান। ঠিক ছাপটার মতো। ফ্রান্সিস বলে উঠল, হ্যারি, ঐ পাহাড়টার দিকে তাকাও। পাহাড়টা দেখো। হ্যারি কিছু বুঝল না। পাহাড়টা দেখতে লাগল।
এবার ঐ মাথাভাঙা পাহাড়ের সঙ্গে কাগজের এই অস্পষ্ট ছাপটা মেলাও। দেখো একরকম কিনা। কাগজটা উল্টেনাও, ভালো করে মেলে ধরে দেখো।
হ্যারি কাগজটা ঘুরিয়ে উঁচু করে মনোযোগ দিয়ে দেখল। সত্যিই খুব অস্পষ্ট তিনকোনা দাগ। বেশ মোটা দাগ।
দেখো, পাহাড়টা দেখতে এরকম কিনা। মাথাটা ভাঙা, সমতল। হ্যারি মিলিয়ে দেখে, বলে উঠল, তাই তো।
এসব কাগজের মতো পাতলা চামড়ায় তো কোনো দাগ থাকে না। কীসের দাগ এটা?
রক্তের দাগ। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।
বলো কী! হ্যারি চমকে উঠল।
আবার কল্পনার রাশ আলগা করছি। রাজা ম্যাগনাম মৃত্যুর পূর্বে রক্তঝরা হাতের আঙুল দিয়ে শেষ দেখা এই পাহাড়টা এঁকেছিলেন। অবশ্য এটাকে আঁকা বলা চলে না। চিহ্ন বলা যায়।
কিন্তু এই পাহাড়টা তো সবুজ। সাদাটে কথাটা লিখেছিলেন কেন?
ভালো করে পাহাড়টার দিকে তাকাও। দেখো মাথায় গাছ-গাছালি নেই, পাথরের রঙ ধূসর। তাছাড়া গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে বেশ দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের গা। ধূসর, প্রায় সাদাটে। জাহাজ ডুবেছিল অনেকদিন আগে, তখন এই পাহাড়ে গাছপালা বলে কিছু ছিল না। আসলে পাহাড়টা চুনা পাথরের সাদা পাহাড় ছিল। পরে দীর্ঘ দিন ধরে অল্প অল্প মাটি জমে জমে আজকের গাছ-গাছালির জন্ম। লক্ষ করো ঘাস নেই। সবুজে ভাবটাই নেই।
তাহলে কি
হ্যাঁ, ঐ পাহাড়ের নীচে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে রাজার জাহাজ ভেঙে ডুবে গিয়েছিল। ঐ পাহাড়ের নীচেই জলের মধ্যে দেখতে হবে। খুঁজতে হবে।
এখনই যাবে?
হ্যাঁ, এখুনি। শাঙ্কোকে ডাকো। আর আমার তরোয়ালটা নিয়ে এসো। হ্যারিশাঙ্কোদের ডাকল। ফ্রান্সিতেরোয়াল আনতে কেবিনে নেমে এল। বিছানার পাশ থেকেও তরোয়াল নিল। মারিয়া বলে উঠল, কী ব্যাপার হ্যারি?
ফ্রান্সিসরা ঐ পাহাড়ের নীচে যাবে।
আমিও যাব। মারিয়া উঠেদাঁড়াল।
আসুন। দেখুন, ফ্রান্সিস নিয়ে যেতে রাজি হয় কিনা। ক্রেভান তাকিয়ে রইল। কিছুই বুঝল না।
দড়ির মই বেয়ে ফ্রান্সিসরা নৌকোয় নেমে এল। শাঙ্কো নৌকো বাইতে লাগল। খাঁড়ির জলে খুব ঢেউ নেই। উজ্জ্বল রোদ চারদিকে। একসময় নৌকোতিনকোনা পাহাড়টার নীচে এসে থামল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে নৌকো একপাশে থামানো হল। ফ্রান্সিস তরোয়ালটা কোমরে গুঁজে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর ডুব দিল।
ওপরের সূর্যালোকে নীলচে জলের নীচে বেশ কিছুটা দেখা যাচ্ছে। সেই মুক্তোর সমুদ্রে মুক্তো তোলার জন্যে ফ্রান্সিস ওর দেশের ডুবুরিদের কাছে জলে বেশিক্ষণ ডুবে থাকার কায়দা শিখেছিল। সেই শিক্ষাটা এবারে কাজে লাগল।
ফ্রান্সিস অল্পক্ষণের মধ্যেই দু’হাতে জল ঠেলে ঠেলে একেবারে নীচে নেমে এল। পাথরের ছোট ছোট চাই ছড়ানো। সামুদ্রিক শ্যাওলাগাছ, ঝোঁপটোপ নেই। পাথরের এদিক-ওদিক কখনও আড়ালে নানা রঙিন মাছের আঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফ্রান্সিস পাথরে পা ফেলে ফেলে লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকার দিকে চলল। এখানে নিস্তেজ আলো। বেশ আবছা দেখাচ্ছে সবকিছু। দম ফুরিয়ে গেল। ফ্রান্সিস ডোবা পাথরে পা দিয়ে ধাক্কা মেরে দ্রুত ওপরে উঠে এল। জল থেকে ভুস্ করে মুখ তুলে হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। দেখল বাঁ দিকে কিছুদূরে নৌকো ভাসছে। ফ্রান্সিসকে জল থেকে মাথা তুলতে দেখে শাঙ্কো দ্রুত নৌকো চালিয়ে ওর কাছে এল। গলা চড়িয়ে বলল, কিছু হদিস পেলে?
ফ্রান্সিস মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়ল।
মারিয়া বলে উঠল, হাঙর-টাঙর নেই তো?
চোখে পড়েনি। ফ্রান্সিস হাঁপানো স্বরে বলল। একটুক্ষণ দম নিয়ে ফ্রান্সিস আবার ডুব দিল। দ্রুত জল কেটে নীচে নেমে এল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবছা আলোর মধ্যে দিয়ে দেখতে দেখতে দশ-পনেরো পা যেতেই দেখল একটা বিরাট পাথরের চাইয়ের গায়ে জাহাজের ভাঙা কাঠামো। চারদিকে ছড়ানো ভাঙা মাস্তুল, কাঠ, ছেঁড়া পাল, দড়িদড়া। কিন্তু দম ফুরিয়ে এসেছে। আবার জল ঠেলে দ্রুত ওপরের দিকে উঠতে লাগল। জলের ওপর হুস করে মাথা তুলল। হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। বেশ কিছুটা দূরে নৌকোটা ভাসছে।
শাঙ্কো দ্রুত নৌকো চালিয়ে এল। গলা চড়িয়ে বলল, চোখে পড়ল কিছু? ফ্রান্সিস হেসে হাত তুলল। শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে নৌকোয় উঠে এল। মারিয়া সাগ্রহে বলে উঠল, জাহাজটা দেখেছ?
হ্যাঁ। তবে ভেঙে চৌচির। আজকে আর নয়। কাল সকালে আসতে হবে। হাতে সারাটা দিন পাওয়া যাবে। ভালো আলো পাওয়া যাবে।
পরের দিন সকালেই নৌকোয় চড়ে এল ওরা। ফ্রান্সিস জলে ডুব দিল, ভাঙা জাহাজের ছড়ানো কাঠ, বড় বড় পেরেক, এটা-ওটা পড়ে আছে। ফ্রান্সিস সেই আবছা আলোয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিক তাকাতে তাকাতে দেখল সাদাটে মাটির আস্তরণের মধ্যে একটা বসে যাওয়া লম্বাটে সিন্দুক। দম ফুরিয়ে আসছে। দু’হাতে দ্রুত জল সরিয়ে ফ্রান্সিস ভুস করে জলের ওপর মাথা তুলল। হাঁপাতে হাঁপাতে গলা চড়িয়ে বলল, রাজা ম্যাগনামের ধনসম্পদ—শুধু তুলে আনার অপেক্ষা। হ্যারির কাছেশাঙ্কো মারিয়া ফ্রান্সিসের উদ্দেশ্যের কথা শুনেছিল।
মারিয়া বলল, তাহলে তোমার অনুমানই সত্য হল।
হ্যাঁ। ও নৌকোয় উঠে বলল, চলো, জাহাজটা এখানে আনতে হবে। নৌকো দিয়ে হবে না।
বেলা হয়েছে। খেয়েটেয়ে এসো।
হুঁ। শাঙ্কো জাহাজ লক্ষ করে নৌকো বাইতে লাগল।
ওরা জাহাজে ফিরে এল। ভাইকিং বন্ধুরা এগিয়ে এসে ওদের ঘিরে দাঁড়াল। শাঙ্কো বলল, রাজা ম্যাগনামের ডুবেথাকা ধনসম্পদের হদিস মিলেছে।
ফ্রান্সিস সব বলে বলল, চলো, খাওয়া সেরে যাব।
না। আমরা সবাই এখনই যাব। বিনোলা বলে উঠলো। দু’চারজন বন্ধুও তখন বলে উঠলো–চলল, এখনই যাই। এসে খাওয়া-দাওয়া হবে।
ফ্রান্সিস হেসে বলল, খাটাখাটুনির ব্যাপার আছে। উপোসী থেকে সে সব করা কঠিন। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও সবাই।
এবার ফ্লেজার জাহাজ চালিয়ে সেই জায়গায় নিলে এল। ফ্রান্সিস বলল, দড়িসুন্ধু। নোঙরটা নিয়ে এসো আর শাঙ্কো–তুমি দেখো তো যেমন-তেমন একটা নোঙর পাও কিনা। শাঙ্কো চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুঁজে পেতে মরচে ধরা প্রায় বাতিল একটা নোঙর নিয়ে এল। ফ্রান্সিস একটা শক্ত লম্বা দড়ি নিল। ও আরও দুটো লম্বা দড়ি আনাল।
ফ্রান্সিস সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই সব–মন দিয়ে শোনো। আমি আর শাঙ্কো কয়েক দফা জলের নীচে ডুবে গিয়ে সিন্দুকটা দড়ি দিয়ে বাঁধব। তারপর দুটো নোঙর সিন্দুকটার দুপাশে বাঁধা দড়িতে আটকে দেব। তোমরা ডেক থেকে ওটা টেনে তুলবে। খুব আস্তে আস্তে তুলবে। রেলিঙের ওপর দিয়ে আনবে সাবধানে। দেখো, কাঠের রেলিং না ভেঙে যায়। এবার তৈরি থাকো সবাই। আমরা জলে নামছি।
ফ্রান্সিস লম্বা দড়ির একটা কোমরে জড়িয়ে নিল। তরোয়াল খুলে হ্যারির হাতে দিল। তারপর জলে ঝাঁপ দিল। দ্রুত জল কেটে নীচে নেমে এল। কোমর থেকে দড়ি খুলে দ্রুত সিন্দুকটা পাশাপাশি বাঁধতে তৈরি হল। ওরা শক্ত গিট বাঁধার নানা কৌশলে অভিজ্ঞ। কিন্তু কতদিন আগে থেকে সিন্দুকটা জলের তলায় পড়ে আছে। সাদাটে মাটিতে বেশ এঁটে বসে গেছে। সিন্দুকটা দুহাতে ধরে তুলতে দেরি হল।
দম ফুরিয়ে আসছে। ফ্রান্সিস দড়ি রেখে জলের ওপরে তাড়াতাড়ি উঠে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, শাঙ্কো ডুব দাও। সিন্দুকটার একপাশে বাঁধা। শাঙ্কো তৈরি হয়েই ছিল।
জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শাঙ্কোও জল কেটে দ্রুত নীচে নেমে এল। আবছা আলোয় দেখল ফ্রান্সিস একটা পাশ তুলে রেখেছে। ও দ্রুত দড়িটা সেই পাশে বেঁধে গিঁট দিয়ে জলের ওপরে উঠে এল। হাঁ করে হাঁপাতে লাগল।
এবারে ফ্রান্সিস ডুব দিল। সিন্দুকের অন্য পাশটা দু’হাতে জোরে কয়েকটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে কাদার ওপর তুলে জলের ওপরে উঠে এল। এবার শাঙ্কো ডুব দিল। দড়ি বাঁধল। শক্ত গিট দিল। জলের ওপরে উঠে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে রেলিঙের কাছে জড়ো হওয়া বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল, মরচে পড়া নোঙরটা দড়ির মাথায় বাঁধো। দুটোই আমাকে দাও। বন্ধুরা অল্প সময়ের মধ্যেই বেঁধে দড়ি ধরে নামিয়ে দিল। ফ্রান্সিস দড়ি বাঁধা নোঙর দুটো কাঁধে রেখে এক হাতে জল ঠেলে ঠেলে নীচে নামল। দ্রুত নামতে পারল না। সিন্দুকটার দু’পাশে আড়াআড়ি বাঁধা দড়ির মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি নোঙরের মাথা দুটো ঢুকিয়ে দিয়ে জলের ওপর হুস করে ভেসে উঠল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, সাবধানে আস্তে আস্তে টেনে তোল। চুনামাটির কাদায় সিন্দুকের কাঠ ক্ষয়ে গেছে। আঁকুনি লাগলেই ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে।
এবার বন্ধুরা দড়ি দুটো ধরে আস্তে আস্তে টানতে লাগল। জলের মধ্যে বস্তুর ওজন কমে যায়। কাজেই জলের ওপরে ওঠা পর্যন্ত সিন্দুকের সঠিক ওজনটা বোঝা যাচ্ছিল না। জলের ওপরে সিন্দুকটা উঠে এল। এবার টেনে তুলতে গিয়ে ওরা বুঝল ওজনটা ভালোই। সিন্দুক্টা ওঠাতে লাগল। খুব আস্তে আস্তে। রেলিঙের গায়ে পর্যন্ত সিন্দুকটা উঠে এল। এবার রেলিংটা পার করতে গিয়েই হল বিপত্তি। দড়াম করে রেলিঙের বেশ কিছুটা অংশ ভেঙে গেল। সিন্দুকটা প্রায় ছিটকেডেকের ধারে পড়েইতলার কাঠটা ভেঙে ছিটকে গেল। সোনার কত চাকতি, মণিমুক্তো, দামি গয়না-টয়না ডেকের ওপর ছড়িয়ে গেল। কিছু কিছু সমুদ্রের জলেও পড়ে গেল। পচা কাঠের টুকরোও এদিক-ওদিক ছিটকে গেল।
ভাইকিংরা থমকে দাঁড়াল। দেখতে লাগল ডেকে ছড়িয়ে থাকা সোনা রুপোর ধনসম্পদ। তারপরই ধ্বনি তুলল, ও হো হো। হ্যারি ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে। নীচে নেমে একটা ছেঁড়া পালের বড় টুকরো নিয়ে এল। সেটা ডেকে পেতে ছড়িয়ে-থাকা সোনার চাকতি, রুপো, মণিমুক্তো কাপড়ের ওপর রাখতে লাগল। দেখাদেখি বন্ধুরাও কয়েকজন এগিয়ে এল ওকে সাহায্য করতে। সব রাখা হলে হ্যারি আরশাঙ্কো একটা গাঁঠরি মতো বাঁধল।
হ্যারি বলল, বিনোলা, এটা ফ্রান্সিসের কেবিনে রেখে দাও। বিনোলা গাঁঠরিটা কাঁধে নিয়ে চলে গেল।
ওদিকে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো জাহাজে উঠে এল। ফ্রান্সিস ভেজা পোশাকেই ডেকের ওপর শুয়ে পড়ল। হ্যারি এসে ওর পাশে বসল।
মারিয়া এসে বলল, ভেজা পোশাক ছাড়বে এসো।
ও আমার অভ্যেস আছে। খুব খাটাখাটুনি গেছে। একটু জিরিয়ে নিই। ফ্রান্সিস তখনও হাঁপাচ্ছিল।
হ্যারি বলল, সাবাস ফ্রান্সিস! তোমার কল্পনাশক্তির প্রশংসা করতে হয়। ফ্রান্সিস মৃদু হাসল। কিছু বলল না।
রাজা ম্যাগনামের ধনসম্পদ কী করবে? হ্যারি জানতে চাইল।
হ্যারল্ডের সিন্দুকে ভরে রাখব।
সব দেশে নিয়ে যাবে তো? পাশে বসা মারিয়া বলল।
না। নরওয়ে যাব আমরা। নরওয়ের বর্তমান রাজাকে সব দিয়ে দেব। রাজা ম্যাগনামের শেষ সিদ্ধান্তটা জানাব। অনুরোধ করব সেই অনুযায়ী ধনসম্পদ কাজে লাগাতে। হ্যারি, কী বলো?
তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক। হ্যারি বলল।
মারিয়া বলল, এবার চলো৷ ফ্রান্সিস উঠে বসল। আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে হেঁটে চলল।
Leave a Reply