সিয়োভোর রত্নভান্ডার
ফ্রান্সিসদের জাহাজ পূর্ণগতিতে চলেছে। জাহাজের পালগুলো বেগবান হাওয়ায় ফুলে উঠেছে। মোটামুটি উত্তর দিক ধরে জাহাজ চলছে। জাহাজচালক ফ্লেজারের লক্ষ্য স্বদেশে ফেরার। ডেক ধোওয়া মোছা সেরে ভাইকিংদের হাতে যথেষ্ট সময়। কারন দাঁড়ও বইতে হচ্ছে না বেশ খুশির মেজাজে ভাইকিংরা।
রাতের খাওয়া সেরে ডেক-এ নাচগানের আসর বসায়। ফ্রান্সিস ওদের উৎসাইই দেয়। আসরে মারিয়াকে নিয়ে আসে। নাচের আসরে দুজনে নাচেও। মারিয়া খুশি মনে এসব দেখে। হাসে। যা মারিয়া খুশি। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হয়।
সিনাত্রা সুরেলা কন্ঠে দেশের চাষীদের ভেড়াপালকদের গান গায়। দ্রুত লয়ের বিয়ের বাসরের গানও গায়। আসর জমে ওঠে। কাঠের ডেকে থপ থপথপ্ পা ঠুকে ভাইকিংরা নাচে। শাঙ্কো খালি জীপে বাজায়। এভাবেই রাতের আসর জমে ওঠে।
মাঝে কয়েকদিন বাতাস পড়ে গিয়েছিল। তখন ভাইকিংদের ব্যস্ততা। পাল খাটাবার কাঠের কাঠোমোয় উঠে পাল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যথাসাধ্য হাওয়া লাগাতে চেষ্টা করে। অনেকে দাঁড় ধরে গিয়ে দাঁড় টানে। তখন আর নাচের আসর বসে না। তখন শুধু কাজ। ছক্কাপাঞ্জা খেলা বন্ধ। সবাই ব্যস্ত। নাচগানের আসর আর বসে না। জাহাজের চলার বেগ বাড়াবার জন্যে চেষ্টা চলে। দেশে ফিরে যাচ্ছে এই চিন্তা উৎসাহ জোগায়।
দিনকয়েক পরে বাতাসের বেগ বাড়ে। জাহাজ চলে দ্রুত গতিতে। আবার আনন্দ ভাইকিংদের মনে। জাহাজের কাজ কমে যায়। অবসর। আবার নাচ গানের আসর বসে। নেচে গেয়ে খুশির সময় কাটায় ওরা।
জাহাজ পুণগতিতে চলছে। কিন্তু ডাঙার দেখা নেই। এভাবেই দিন দশেক কাটল। ভাইকিংরা চিন্তায় পড়ে–পথ হারালাম না তো?
রাতে ফ্রান্সিসরা ডেকে উঠে আসে। অনুজ্জ্বল চাঁদের আলোয় চারিদিকে তাকায় যদি ডাঙ্গার দেখা পাওয়া যায়। ওপরের দিকে তাকিয়ে নজরদার পেড্রোকে বলে ঘুমিয়ে পড়ো না। নজর রাখো। পেড্রো মাস্তুলের ওপরে নিজের গলা চড়িয়ে বলে– কিচ্ছু ভেবো না। ঠিক নজর রাখছি। হ্যারিও ডেকে উঠে আসে। ফ্রান্সিস বলে হারি– চিন্তার কথা। এখনও ডাঙ্গার দেখা পাচ্ছি না।
–ঠিক ডাঙ্গার দেখা পাওয়া যাবে। আট দশদিন কেটেছে মাত্র। কয়েকদিনের মধ্যেই ডাঙ্গার দেখা পাওয়া যাবে। তাছাড়া খাদ্য জল সব মজুত আছে। আরোও কিছুদিনের জন্যে নিশ্চিন্ত। জাহাজ চলুক। হ্যারির কথা শুনে ফ্রান্সিসের উদ্বিগ্ন মন শান্ত হয়। ও কিন্তু শুধুমাত্র হ্যারির সঙ্গেই এসব কথা বলে। অন্য বন্ধুদের সঙ্গে। এসব কথা বলে না। তাহলে মারিয়াও উদ্বিগ্ন হবে। সেটা মারিয়ার শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে।
দিন কয়েক পরের কথা। সেদিন শেষরাতে মাস্তুলের ওপর থেকে পেড্রো চেঁচিয়ে বলল–ভাইসব সাবধান জলদস্যুদের জাহাজ। এদিকেই আসছে। ফ্রান্সিসকে খবর দাও। সবাই তৈরী হও। সামনে লড়াই।
ডেকের ওপর কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে শাঙ্কোও ঘুমিয়ে ছিল। পেড্রোর উঁচু গলায় কথায় ওর ঘুম ভেঙে গেল। ছুটে জাহাজের রেলিংয়ের ধারে গেল। কিছুটা উজ্জ্বল চাঁদের তালোয় দেখল একটা জাহাজ দ্রুত গতিতে ওদের জাহাজের দিকে আসছে। জলদস্যুদের ক্যারাভেল জাহাজ।
শাঙ্কো আর একমূহুর্তে দেরি করল না। সিঁড়ির দিকে ছুটল। নিচে নামতে নামতে গলা চড়িয়ে বলতে লাগল–ভাইসব–তৈরী হও–তৈরী হও। একটা জলদসুদের জাহাজ আসছে। লড়াই। অস্ত্র নাও।
ফ্রান্সিসের কেবিনঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে শাঙ্কো চেঁচিয়ে বলল-ফ্রান্সিস জলদস্যুদের জাহাজ আসছে শিগগির এসো।
ফ্রান্সিসসের ঘুম ভেঙে গেল। এক লাফে বিছানা থেকে নামল। বিছানার তলা থেকে তরোয়াল বের করল। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল।
ততক্ষনে জাহাজে সাজো সাজো রব পড়ে গেছে। ভাইকিংরা অস্ত্রঘর থেকে তরোয়াল বের করে ডেক উঠে আসতে লাগল।
অল্পক্ষনের মধ্যেই খোলা তরোয়াল হাতে ডেকএ এসে জড়ো হল সবাই। সবাই দেখল জলদস্যুদের জাহাজের ডেক-এ খোলা তরোয়াল হাতে জলদুস্যরা দাঁড়িয়ে। মাথায় কালো কাপড়ের ফট্টি। গাল অব্দি জুলপি মোটা গোঁফ। জলদস্যুর দল ভেবেছিল নিঃশব্দে জাহাজ দখল করবে। কিন্তু যখন দেখল ফ্রান্সিসরা ওদের দেখে ফেলেছে তখন ওরা : লড়াইয়ের জন্য তৈরী হল।
জলদস্যুদের জাহাজটা ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। জলদস্যুরা তরোয়াল উঁচিয়ে লাফ দিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠতে লাগল। ফ্রান্সিসরা ওদের প্রথম আক্রমণ করল। শুরু হল লড়াই। জলদস্যুরা ফ্রান্সিসদের চেয়ে সংখ্যায় কম। তবে ওরা তো নৃশংস আর নিভীক। ওদের প্রাণেরও মায়া নেই। ওরা জানে মানুষ মেরে ফেলতে। কাজেই ওরা প্রথম উন্মাদের মত তরোয়াল চালাতে লাগল। দুজন ভাইকিং আহত হয়ে ডেক-এ পড়ে গেল। কয়েকজন ভাইকিং থমকে গেল। ফ্রান্সিস উচ্চকণ্ঠে ধ্বনি তুলল–ও–হো–হো। এই ধ্বনি লড়াইয়ের ধ্বনি। মন্ত্রের মত কাজ হল। ভাইকিংরা নতুন উদ্যমে লড়াই চালাতে লাগল। কয়েকজন জলদস্যুকে আহত করল ওরা। ফ্রান্সিস নিপুনহাতে তরোয়াল চালিয়ে ঘুরে ঘুরে লড়াই করতে লাগল।
একজন জলদস্যু মারা গেল। দু’তিনজন আহত হল।
এমন সময় জলদস্যুদের ক্যাপ্টেন তাদের জাহাজের ডেক-এ এসে দাঁড়াল। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে লড়ই দেখতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই বুঝল–ভাইকিংরা তরোয়াল চালনায় যথেষ্ট দক্ষ। জলদস্যুরা হেরে যেতে লাগল। ক্যাপ্টেন গলা। চড়িয়ে বলে উঠল-লড়াই থামাও। সবাই চলে এসো। জলদস্যুরা লড়াই করতে করতে নিজেদের জাহাজে পালাতে লাগল।
ফ্রান্সিসও গলা চড়িয়ে বলল–যে কটাকে পারো আহত করো। জাহান্নামে যাক সব। ভাইকিংরা নতুন উদ্যমে জলদস্যুদের আক্রমন করল। এবার জলদস্যুরা বুঝল লড়াই করতে গেলে বাঁচার আশা নেই। ওরা দ্রুত লড়াই থামিয়ে নিজেদের জাহাজের ডেক লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়তে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লড়াই শেষ। নিহত আহত জলদস্যুরা ফ্রান্সিসদের জাহাজের ডেকএ পড়ে রইল। ফ্রান্সিস বলে উঠল–এগুলোকে জলে ফেলে দাও। ভাইকিংরা সব কটা জলদস্যুকে সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলল।
জলদস্যুদের জাহাজের মুখ ঘুরল। আস্তে আস্তে জলদস্যুদের ক্যারাভেল জাহাজটা মাঝ সমুদ্রের দিকে চলে যেতে লাগল। লড়াইয়ে বিজয়ী ভাইকিংরা ধ্বনি তুলল ও–হো–হো।
জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচা গেছে এই ভেবে ফ্রান্সিস স্বস্তির শ্বাস ফেলল। গলা চড়িয়ে ডাকল–পেড্রো? পেড্রো নিজের জায়গা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল কী বলছো? অনেক ধন্যবাদ, তোমাকে। সময়মত জানানি দিয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
তখন ভোর হয়েছে। ভোরের নিস্তেজ আলো পড়েছে সমুদ্রে জাহাজে নির্মেঘ আকাশে।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলল।
দিন কয়েকের মধ্যেই ডাঙা দেখা গেল। সেদিন ভোরে মাস্তুলের ওপর থেকে নজরদার পেড্রো গলা চড়িয়ে বলে উঠল–ভাইসব বাঁদিকে ডাঙ্গা দেখা যাচ্ছে– ডাঙ্গা। ডেক-এ ঘুম ভেঙে শাঙ্কো বসেছিল। ছুটল ফান্সিসকে খবর দিতে। একটু পরেই ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে এল। ডানদিকে তাকিয়ে দেখল একটা খাঁড়িরমত। তার এ পাশে গভীর বন। ওপাশে পাহাড়। বুঝতে পারল না-এটা কোন দ্বীপ না দেশের অংশ। এপাশে একটা ঘাটমত দেখা গেল। এদিকে সমুদ্র গভীর। বড় বন্দর নয়। তবে জাহাজ ভেড়ানো থাকে।
হ্যারি এসে ওর পাশে দাঁড়াল। ওকে ফ্রান্সিস এসব কথা বলল। হ্যারি বলল দেখা যাক জাহাজ ভেড়ানো যায় কিনা। ফ্লেজারের কাছে চলো। দু’জনে জাহাজ চালক ফ্লেজারের কাছে এল।
–ফ্লেজার –ফ্রান্সিস বলল–বুঝতে পারছি না এটা কোন দ্বীপ না দেশের অংশ। যাহোক তুমি দেখো জাহাজ তীরে ভেড়ানো যায় কিনা।
জাহাজ ততক্ষণে তীরের কাছে চলে এসেছে। ফ্লেজার বলল-তীরের কাছে জল গভীর। জাহাজ তীরে ভেড়ানো যাবে। ফ্লেজার আস্তে আস্তে জাহাজটা তীরে ভেড়াল।
দেখা গেল বালিয়াড়ির পরেই বনভূমি। টানা বনভূমি চলে গেছে। বসতির চিহ্নমাত্র নেই।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–কী করবে?
–এখনই এখানে নামবো। দেখি মানুষজনের দেখা পাই কিনা। ফ্রান্সিস বলল,
–কিন্তু এ তো গভীর বন। এখানে মানুষজন কোথায় পাবে? হ্যারি বলল।
মনে হচ্ছে বনের ওপাশে বসতি আছে। এখন নেমে গিয়ে সেটা দেখাত হবে। ফ্রান্সিস বলল।
একটু পরেই ফ্রান্সিসরা সকালের খাবার খেয়ে নিল। এবার ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ডেকে পাঠাল। শাঙ্কো আসতে বলল–শাঙ্কো–সিনাত্রা আর তুমি তৈরী হয়ে নাও। আমরা নামব।
-এখনই? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–হ্যাঁ দিনে দিনেই দেখব সব। মনে হচ্ছে এই বনভূমির ওপারে লোকজনের বসতি এলাকা পাব। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। চলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই ফ্রান্সিস শাঙ্কো আর সিনাত্রা তৈরী হল। শাঙ্কো আর সিনাত্রা কাঠের পাটাতন পাতল তীরভূমি পর্যন্ত। পাটাতন দিয়ে তিনজন নেমে এল। বেলাভূমি পার হয়ে বনের মধ্যে ঢু। সেই অদ্ভুত গাছের জঙ্গল। গাছের পাতা প্রায় গোল। মোটা ভারী পাতা। শক্ত ডাল। অন্য গাছও রয়েছে। কিন্তু এরকম গাছের সংখ্যাই বেশি। এই গাছগুলো বেশ উঁচু। ডালগুলো দেখে মনে হল বেশ শক্ত।
হঠাৎই ওরা দেখল গাছের মধ্যে ঘর। গাছের চারটে ডালের মধ্যে ডাল কেটে বেড়ামত। তাতে দরজা। ঘরের মাথায় শুকনো লম্বাটে ঘাসের ছাউনি। এরকম তিন চারটে ঘর দেখল ওরা। তাহলে এখানকার বাসিন্দারা একরম ঘরেই থাকে। অবাক কান্ড! ঘরগুলো থেকে গাছের ডাল থেকে তৈরি মই লাগানো। ঐ মই বেঁধেই ওঠানামা।
ফ্রান্সিসরা ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটা ঘর থেকে একজন বাদামি রঙের পুরুষ মুখ বাড়িয়ে ফ্রান্সিসদের দেখেই ই ই করে মুখে জোরে শব্দ করল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য ঘরগুলো থেকে পুরুষরা হাতে গাছের ডাল কেটে তৈরী বর্শা নিয়ে মই বেয়ে দ্রুত নেমে আসতে লাগল। মই বেয়ে ওঠা নামায় ওরা অভ্যস্থ। কাজেই ফ্রান্সিসরা পালিয়ে আসার সুযোগ পেল না। ততক্ষণে বর্শা হাতে যোদ্ধারা ঘিরে ধরেছে। ফ্রান্সিস দু’হাতে ওপরে তুলে চীৎকার স্পেনীয় ভাষায় বলে উঠল–আমরা বন্ধু। তোমাদের শত্রু নই। যোদ্ধারা আর বর্শা ছুঁড়ে মারল না।
–পালিয়ে গেলে হত। শাঙ্কো মৃদুস্বরে বলল।
–এখন আর সম্ভব নয়। পালাতে গেলে আহত হব। বর্শা বুকে ঢুকে গেলে মরেও যেতে পারি। তার চেয়ে দেখা যাক এরা আমাদের নিয়ে কি করে। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।
একজন যোদ্ধা এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের গায়ে বর্শা খোঁচা দিল। ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল। যোদ্ধা ওকে সামনের জঙ্গলের দিকে হাঁটতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস রেগে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। শাঙ্কো আর সিনাত্রাও চলল।
কিছুদূর যেতে দেখা গেল চারপাঁচটা গাছের গায়ে শুকনো লতার ডালমত। সমস্ত জায়গাটতেই লতার জাল। ফুট পাঁচেক উঁচু। সেই যোদ্ধাটি এগিয়ে গেল। জালির গায়ে গাছের ডাল কেটে দরজামত বানানো। যোদ্ধাটি দরজা দিয়ে ফ্রান্সিসদের ভেতরে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা একে একে ঢুকলো। ওপরের ডাল মাথায় লেগে যাচ্ছে। তিনজনে বসে পড়ল। ফ্রান্সিস দেখল আরোও তিনজন বন্দী ঐ জালঘরে আগে থেকেই রয়েছে। জালঘরের মেঝে বালিভরা। তার ওপর শুকনো ঘাস বিছানো। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়তে পড়তে বলল–শাঙ্কো এরকম বিচিত্র কয়েদঘর আর কোনদিন হয়ত দেখবো না।
-হ্যাঁ। মনে হচ্ছে আমরা যেন জীবজন্তু। ফাঁদে ধরা পড়েছি।
–আমাদের মেরে ফেলবে না তো? সিনাত্রা ভয়ার্তস্বরে বলল।
সময় সুযোগ মত পালাবো। কিচ্ছু ভেবো না। শাঙ্কো বলল। যোদ্ধাটি দরজাটা শুকনো লতা দিয়ে বাঁধল। শাঙ্কো যোদ্ধাটিকে ইঙ্গিত ওদের সর্দার আছে কিনা জানতে চাইল। যোদ্ধাটি মাথা দোলাল। একজন যোদ্ধাকে পাহারাদার রেখে অন্য যোদ্ধারা চলে গেল।
ফ্রান্সিস মাথা তুলে চারিদিক এবার দেখে নিল। দেখল চারদিকেই গভীর জঙ্গ ল। সেই মোটা ভারিপাতার গাছের সংখ্যাই বেশি।
ফ্রান্সিস শুয়ে বসে সময় কাটাতে লাগল। দুপুর নাগাদ কয়েকজন যোদ্ধাকে নিয়ে একজন লম্বামত লোক জালঘরের দরজার সামনে এল। পাহারাদার তাকে দেখে ডান হাত তুলে নামল। ফ্রান্সিস বুঝল এই লোকটাই গোষ্ঠীপতি। ফ্রান্সিস এই। গোষ্ঠিপতির জন্যেই সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। গোষ্ঠীপতি ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় শব্দে বলল–পরিচয়?
–আমরা বিদেশী ভাইকিং। জাহাজে চড়ে জাহাজ ঘাটায় এসেছি। ফ্রান্সিস বলল। গোষ্ঠীপতি মোটামুটি বুঝল। কিন্তু সত্যি বলে মেনে নিল না। দুপাশে মাথা নেড়ে বলল–ওরাইকাবু–একসঙ্গে শাস্তি।
–কী শাস্তি? শাঙ্কো বলে উঠল। গোষ্ঠীপতি এতক্ষণে একটু হাসল। বলল– দেখবে।
–কিন্তু আমাদের শাস্তি দেবেন কেন? আমারা কী অন্যায় করেছি? ফ্রান্সিস বলল।
–ইকাবু–গুপ্তচর। গোষ্ঠীপতি বলল। ফ্রান্সিস বুঝল ইকাবুরা এদের শত্রু। ফ্রান্সিসদের ইকাবুদের গুপ্তচর ধরে নিয়েছে। ফ্রান্সিস বুঝল গোষ্ঠীপতিকে বোঝানো হয়। যাবে না। তবু ও হাল ছাড়ল না। বলল–ইকাবু কারা কী ব্যাপার আমরা কিছুই জানি না। আমরা এখানে এই প্রথম এসেছি। ইকাবু তো দূরের কথা এই জায়গাই আমরা চিনতাম না। গোষ্ঠীপতি আবার মাথা দোলাল। বলল–বন্দী–শাস্তি। কথাটা বলেই গোষ্ঠীপতি ফিরে দাঁড়াল। তারপর বনের দিকে চলে গেল। একজন পাহারাদার রইল। বাকিরা গোষ্ঠীপতির পিছনে পিছনে চলে গেল।
দুপুরে ফ্রান্সিসদের ভারী শুকনো পাতায় খেতে দেওয়া হল। বুনো গমের রুটি, আনাজের ঝোল আর আধ কাঁচা চিংড়ি মাছ। একটু অন্যরকম খাবার। একনাগারে সামুদ্রিক মাছ আর ভাল লাগছিল না। ওরা চেটে পুরে খেল।
ওদের খাওয়া শেষ হতেই কালো মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়ল। ফ্রান্সিস বলল–জালঘরের মাথায় কোন ছাউনি নেই। বৃষ্টি হলে ঠায় বসে বসে ভিজতে হবে।
হঠাৎ আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল।
ঝির ঝির বৃষ্টি শুরু হল। বনের গাছগাছালির পাতার শব্দ হতে লাগল–চট চট। ফ্রান্সিসরা ভিজতে লাগল।
ওদের ভাগ্য ভাল। একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গেল। ততক্ষণে মেঘ সরে গিয়ে সূর্য দেখা দিয়েছে। চড়ারোদ উঠল। ওদের ভেজা পোশাক গায়েই শুকোতে লাগল।
শাঙ্কো তখন বন্দী তিনজনের সঙ্গে ভাব জমাতে ওদের কাছে গেল। স্পেনীয় ভাষায় বলল–তোমরা কে?
ওরা কিছুই বুঝল না। বারকয়েকের চেষ্টায় একজন বলল–ইকাবু। শাঙ্কো বুঝল, এরা গোষ্ঠীপতির শত্রু আর এক গোষ্ঠীর মানুষ। শাঙ্কো আকার ইঙ্গিতে কী ধরনের শাস্তি গোষ্ঠীপতি দিতে পারে সেটা জানতে চাইল। বন্দী ইকাবু হাত পা জোড়া করে দেখিয়ে দিতে বোঝাল হাত পা বাঁধা হবে। তারপর সমুদ্রের খাঁড়িতে ছুঁড়ে ফেলা হবে। শাঙ্কো আর কোন কিছু জানতে চাইল না। ফ্রান্সিসের কাছে এসে বন্দীটির কথা জানাল। ফ্রান্সিস মৃদু স্বরে বলল। তাহলে তো পালাতে হয়।
–কিন্তু কী ভাবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।
দেখছো তো হাত পা বাঁধে নি। খোলা হাত পা নিয়ে একবার বনের মধ্যে ঢুকতে পারলে সহজেই পালানো যাবে।
–তা ঠিক। শাঙ্কো মাথা ওঠা নামা করল।
–পালাতে পারবে? সিনাত্রা আগ্রহে বলল।
অনায়াসে। এসব শুকনো লতা বুনে বানানো দড়ি। শাঙ্কো সহজেই ছোরা দিয়ে কাটতে পারবে। রক্ষী ও মাত্র একজন। ও বুঝতেই পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
-দেখ চেষ্টা করে। সিনাত্রা বলল।
–সিনাত্রা একটা গান গাও। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমার মাথা খারাপ। ভয়ে আমার গলা দিয়ে কথা সরছে না।
আর গান গাইব? সিনাত্রা বলল।
–ঠিক আছে! শুয়ে বিশ্রাম কর। গায়ের জোর রাখো। এখান থেকে বনের দূরত্ব হাত পঞ্চাশেক। সময় মত এ টুকু ছুটে পার হবার মত মনের জোর রাখো। তাহলেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
-দেখি। সিনাত্রা দু’হাত ছড়িয়ে বলল। তারপর ফ্রান্সিসের কথা মত শুয়ে পড়ল। বৃষ্টির জল বালির মধ্যে তখন অনেকটা শুষে গেছে। ভেজা বালির ওপরই শুয়ে রইল ওরা।
রাতে সেই একই খাবার খেতে দেওয়া হল। দু’জন প্রহরী পাহারায় রইল। দু’জন প্রহরী খাবার দিল। ফ্রান্সিসরা বেশ খুশি মনে খেয়ে নিল। ফ্রান্সিসের ততক্ষণে পালাবার ছক ভাবা হয়ে গেছে।
কিন্তু তারপরই বোঝা গেল গোষ্ঠীপতি ফ্রান্সিসদের মত চালাক না হলেও যথেষ্ঠ বুদ্ধি ধরে। প্রহরীরা প্রত্যেকের হাত আর পা লতা দিয়ে বেঁধে দিল। শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস গোষ্ঠীপতিকে যতটা বোকা ভেবেছিলাম সে ততটা বোকা নয়। পালাবার রাস্তা বুদ্ধি করে আটকে দিল।
–কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। হাত পা বাঁধা হল। তবে কি আজ রাত্রেই আমাদের সমুদ্রের খাঁড়িতে ফেলে দেবে? ফ্রান্সিস বলল।
–চিন্তার কথা। শাঙ্কো মাথা দুপাশে নাড়িয়ে বলল।
–শাঙ্কো একটা কাজ কর। বন্দীদের কাছ থেকে জানো তো হাত পা কেন বাঁধা হল? ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো বন্দীদের কাছে গেল। বেশ কয়েকবার আকার ইঙ্গিতে কথাটা জানতে চাইল। একজন বন্দী আকার ইঙ্গিতে সেই মোটা পাতার গাছ দেখাল। ফুল টুল দেখাল। দু’হাত তুলে প্রনাম করার ভঙ্গী দেখাল। শাঙ্কো বুঝল সমুদ্রের খাঁড়িতে ছুঁড়ে ফেলার আগে এরা বৃক্ষপূজা করে। ফ্রান্সিসের কাছে এসে বলল সে কথা। ফ্রান্সিস বলল–এই বড় বড়। মোটা পাতাওয়লা গাছ গুলো এদের কাছে খুব পবিত্র গাছ। দেখছো না গাছের ডালে ঘর তৈরী করে। এই গাছের শুকনো পাতা আর ঘাস দিয়ে ঘরের ছাউনি তৈরী করে। এই গাছের পাতা পেতে খাবার খায়। বোধহয় কাছেই কোথাও কোন গাছ ওরা কোন কাজের আগে মানে বিয়েটিয়ে বন্দীকে শাস্তি দেওয়ার আগে পূজো করে ফুল পাতা দিয়ে। ঐপূজো সেরেই আমাদের শাস্তি দেওয়া হবে। আজ রাতে সেই পূজো হচ্ছে না। হলে হৈ চৈ শুনতাম। কাজেই আজ রাতের মত আমরা নিশ্চিন্ত। তবে সময় নষ্ট করা চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সারতে হবে।
ফ্রান্সিসরা শুয়ে পড়ল। আকাশে চাঁদ উজ্জ্বল। চারিদিক মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিস আড়চোখে প্রহরীর ওপর নজর রাখল। প্রহরী বর্শা হাতে ঘুরাঘুরি করছিল। একটু রাত হতেই প্রহরী আবার কাটাগাছের গুঁড়িতে বসল। হাতের বর্শাটা মাটিতে রাখল। বোধহয় একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।
ফ্রান্সিস একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে ফ্রান্সিস বুঝল প্রহরটি অনড় বসে। তাহলে একটু ঘুম মত এসেছে। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাক–শাঙ্কো। শাঙ্কো ঘুমোয় নি। শুয়ে শুয়েই গড়িয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস বাঁধা দু’হাত শাঙ্কোর বুকের কাছ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। তারপর শাঙ্কোর জামার তলা থেকে ছোরাটা বের করল। শাঙ্কোর হাত বাধা লতাটায় ছোরাটা ঘষতে লাগল। লতা কেটে গেল। শাঙ্কো ছোরাটা নিয়ে গড়িয়ে পেছনে জালের কাছে গেল। তারপর জাল কাটতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ ছোরা ঘষেও লতার জাল কাটতে পারল না। ঘন বুনটের জাল কাটা প্রায় অসম্ভব মনে হল। শাঙ্কো গড়িয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফিস ফিস করে বলল–লতা কাটা যাচ্ছে না।
–বলো কি? ফ্রান্সিস বেশ চমকে উঠল।
–সর্বনাশ। ঐ লতার জাল না কাটতে পারলে তো–আবার দেখ। ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল।
শাঙ্কো আবার গড়িয়ে জালের কাছে গেল। জোরে ছোরা ঘষতে লাগল জালে। জাল একটু কাটল। কিন্তু সময় লাগল বেশি। যেটুকু কাটল তাতে ফাঁক হল সামান্যই। সেই ফাঁকা দিয়ে গলে যাওয়া অসম্ভব। আবার গড়িয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এল। ওর অসাফল্যের কথা বলল। ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল। বোঝাই যাচ্ছে সহজে ঐ লতার বুনট করা কাটা যাবে না। অন্য উপায় ভাবতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রহরীকে কবজা করে পালাতে হবে এবং একবারের চেষ্টায় না পারলে প্রহরীর সংখ্যা গোষ্ঠীপতি বাড়িয়ে দেবে। তখন পালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
ফ্রান্সিস এসব ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরল। তখনই দেখল বন্দী তিনজন একেবারে কোনে লতার জালের কাছে শুয়ে পড়ে কী করছে। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো ওর কাছে এল।
–দেখ তো ঐ তিনজন কী করছে? শাঙ্কো একবার প্রহরীর দিকে তাকাল। দেখল প্রহরী ঝিমোচ্ছ। ও গড়িয়ে কোনার দিকে এল। বন্দীদের একজন হাতের চেটো দেখিয়ে শাঙ্কোকে চুপ করে থাকতে বলল। শাঙ্কো দেখল তিনজন লতার দড়ি বুনট নিপুন হাতে খুলছে। শাঙ্কো এবার বুঝল লতা দড়ি কাটা যাবে না। বুনট খুলে লতার দড়ির জাল খুলতে হবে। আর সেটা করতে হবে উল্টে দিকের বুনট খুলে। ও গড়িয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এল। বন্দীরা কী করছে বলল। ফ্রান্সিস বলল–এটাই পালাবার সহজ পথ। ওরা বুনট খুললেই বেরিয়ে যাওয়া যাবে।
তখন রাত শেষ হয়ে এসেছে। বন্দীরা চেষ্টা করেও বেশি অংশ খুলতে পারল না।
ভোর হওয়ার আগেই ওরা খোলা লতার দড়ি জালে জড়িয়ে রাখল। তারপর সরে এল। ফ্রান্সিস এবার শাঙ্কোর হাতের কাটা বাঁধনটা নিয়ে শাঙ্কোর হাতে বেঁধে দিল। শাঙ্কোর হাত খোলা দেখলে বিপদে পড়তে হবে। বাঁধা হাত নিয়ে শাঙ্কো শুয়ে পড়ল।
তখনই সিনাত্রার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ও এতসব ঘটনা জানতে পারল না। ফ্রান্সিস ওকে কিছু বলল না। ও ফ্রান্সিসকে বলল–তাহলে পালাতে পারবে না?
-হা পারবো। সময় এলেই দেখবে। শাঙ্কো বলল।
–কী ভাবে সেটা বল। সিনাত্রা জানাতে চাইল।
–আজ রাতেই দেখবে। ফ্রান্সিস বলল।
ততক্ষণে বন্দী তিনজন কোনা থেকে সরে এসে মাঝামাঝি জায়গায় শুয়ে পড়েছে। অবশ্যই ঘুমের ভান করে।
সকাল হল। প্রহরীরা সকালের খাবার নিয়ে এল। সবার হাতের বাঁধন খুলে দিল। সবাই খেল। প্রহরীরা জাল ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে গেল। একজন প্রহরী বর্শা হাতে পাহারা দিতে লাগল।
এরপরে প্রহরীরা ওদের দুবার খেতে দিল। দুপুরে আর রাতে। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর আবার সবার হাত পা বেঁধে দেওয়া হল। দু দুবারেও ভোলা জাল প্রহরীদের নজর পড়ল না। প্রহরীরা একজন প্রহরীকে রেখে চলে গেল। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল–যাক–ফাড়া কাটল। আজ রাতেই পালাতে হবে।
সব বন্দীরাই শুয়ে পড়ল।
রাত বাড়তে লাগল। প্রহরীটি কাটাগাছের গোড়ায় বসল। একটু পরেই তন্দ্রায় ঢুলতে লাগল। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল সেটা। ও গলা চেপে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো উঠে বসল। ফ্রান্সিস ওর জামার মধ্যে হাত চালিয়ে ছোরাটা বার করল। শাঙ্কোর হাতের বাঁধনে ঘষতে ঘষতে কেটে ফেলল। এবার শাঙ্কো ছোরাটা ঘষে ঘষে ওর পায়ের বাঁধন কাটল। ঘুমন্ত সিনাত্রার পিঠে আস্তে ধাক্কা দিয়ে বলল–চুপ করে শুয়ে থাকো। তারপর সিনাত্রার হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিল। সিনাত্রা হাঁ করে দেখতে লাগল। এবার শাঙ্কো বন্দী তিনজনের হাতপায়ের বাঁধন কেটে দিল। খোলা হাত পা পেয়ে ওরা খুশি। এবার অনেক দ্রুত হাতে বুনট খুলতে হবে।
শেষ রাত নাগাদ অনেকটা বুনট ওরা খুলে ফেলল। ওরা আর দাঁড়ল না। ফাঁক গলে দ্রুত বনের দিকে ছুটল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–পালাও। তিনজনে ফাঁক গলে তাড়াতাড়ি বাইরে এল।
ফ্রান্সিসের পালাও কথাটা বোধহয় তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রহরীর কানে গিয়েছিল। ওর তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। ও অবাক হয়ে দেখল ফ্রান্সিসরা জাল ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ও মাটি থেকে বর্শা তুলে ছুটে এল। ওদের কাছাকাছি এসে বর্শা তোলার আগেই শাঙ্কো ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধাক্কা খেয়ে প্রহরীটি মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। হাত থেকে বর্শাটা ছিটকে পড়ল। শাঙ্কো দ্রুত ফ্রান্সিসের কাছে এল। এবার তিনজনই ছুটল বনের গাছগাছালির দিকে। প্রহরীটা উঠে বসে গলায় শব্দ করল– হি-হি-ই। এটা বোধহয় ওদের লড়াইয়ের ডাক।
তখন ফ্রান্সিসরা বনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কখনও গাছের গুঁড়িতে পা রেখে কখনও গাছের পাশ দিয়ে ওরা ছুটল সমুদ্রের দিকে। বনতল অন্ধকার। কাজেই খুব জোরে ওরা ছুটতে পারল না। সিনাত্রা দু’একেবার হোঁচট খেল। ওদিকে প্রহরীর চিৎকার বনের মধ্যে শোনা যেতে লাগল। গাছের ঘরে ঘরে লোক জনের কথা। শোনা যেতে লাগল। যোদ্ধারা বর্শা হাতে মই বেয়ে গাছের ওপরের ঘর থেকে নেমে আসতে লাগল। কিন্তু অন্ধকারে ফ্রান্সিসদের দেখতে পেল না। ওরা এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল। ততক্ষণে ফ্রান্সিসরা বনের বাইরে চলে এসেছে। ছুটে চলেছে। বালিয়াড়ির দিকে। বালিয়াড়ি পার হচ্ছে তখনই যোদ্ধারা বনভূমি থেকে বেরিয়ে এল। দূর থেকে বর্শা ছুঁড়ল কয়েকজন যোদ্ধা। বর্শাগুলো বালিয়াড়ির বালিতে গেঁথে গেল।
জাহাজের পাটাতন পাতাই ছিল। তখন সূর্য উঠেছে। ভোরের আলোয় পাটাতন দিয়ে দ্রুতপায়ে ওরা জাহাজে উঠে পড়ল। ফ্রান্সিসরা তখন মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে। ওরা দু’জনে পটাতন তুলে ফেলল।
জাহাজের ডেক-এ যেসব ভাইকিংরা শুয়ে ছিল তারা ছুটে ফ্রান্সিসদের কাছে এল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপতে বলল–এখন কথা নয়। পাল খুলে দাও। দাঁড় ঘরে যাও। নোঙর তোল। যত তড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাবো আমরা।
ভাইকিং বন্ধুরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যোদ্ধারা তখন হালের কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু অসহায় চোখে ফ্রান্সিসদের দেখতে লাগল। কিছুই করার নেই। ওরা লড়াইয়ের ডাক দিল–হি-ই-ই। কিন্তু কাদের সঙ্গে লড়াই করবে? জাহাজ ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে সমুদ্রতীর থেকে জাহাজের দূরত্ব বাড়তে লাগল। এক সময় ফ্রান্সিসদের জাহাজ মাঝ সমুদ্রে চলে এল। শাঙ্কো তখন হাত পা নেড়ে বন্ধুদের বলছে বৃক্ষবাসী মানুষদের কথা। কী করে পালাল সেইসব কথা।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলছে। সেদিন সকাল থেকে বাতাস পড়ে গেছে। কেমন একটা গুমোট ভাব। অগত্যা জাহাজের গতি বাড়াতে দাঁড় ঘরে যেতে হল কিছু ভাইকিংকে। বিনেলা নামে এক ভাইকিংকে ফ্রান্সিস দায়িত্ব দিল দাঁড় ঘরের কাজ দেখার জন্যে। বিনেলো শাঙ্কোর মতই দুঃসাহসী। ফ্রান্সিস ওকে নানা দায়িত্ব দিয়ে দিয়ে তৈরী করতে লাগল। বিস্কোর অভাব ও পূরণ করবে। ভাইকিংরা বিনেলোর নির্দেশ মানতে লাগল। বিনেলো লক্ষ্য রাখল যাতে দাঁড় টানার ছন্দে কোন ছেদ না পড়ে।
দিন আট দশ কাটল। সমুদ্রে সেদিন উত্তাল হাওয়া। পালগুলো ফুলে উঠছে যেন বেলুনের মত। পূর্ণ গতিতে জাহাজ চলছে। কিন্তু তখন ও পর্যন্ত ডাঙ্গা দেখা গেল না। নজরদার পেড্রো মাস্তুলের উপরে নিজের জায়গায় বসে চারিদিক নজর রাখছে। কিন্তু কোথায় ডাঙ্গা?
দিন পনেরো পরে সেদিন বিকেলে পেড্রো ডাঙ্গা দেখতে পেল। বরাবরের মত চিৎকার করে মাস্তুলের ওপর থেকে বলল–ডাঙা-ভাইসব ডাঙা দেখা যাচ্ছে। ডানদিকে। মারিয়া তখন জাহাজের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে। ও যেমন প্রত্যেকদিন সূর্যাস্ত দেখতে আসে। ডানদিকে তাকিয়ে দেখল–সূর্যাস্তের ঘোর কমলা রঙের আকাশের নিচে কালো মাটি। অস্পষ্ট দেখল জাহাজ ঘাট। দু’একটা জাহাজও রয়েছে।
ততক্ষণে ফ্রান্সিসও ডেক-এ উঠে এসেছে। সঙ্গে হ্যারি। দু’জনেই জাহাজ ঘাট দেখল। অন্য বন্ধুরাও এসেও রেলিং ধরে দাঁড়াল। হ্যারি বলল–এখন কী করবে ফ্রান্সিস?
একটু পরেই সন্ধ্যে হয়ে যাবে। অন্ধকারে এখানে নামা চলবে না? এখানের কিছুই আমারা জানি না। এটা কোন দ্বীপ না দেশের অংশ তাও জানি না। কাল সকালে নামা যাবে। ফ্লেজারকে গিয়ে বলো তীরের কাছে জল গভীর থাকলে তীরে জাহাজ ভেড়াতে–ফ্রান্সিস বলল। কিছুক্ষণ পরে ফ্লেজার জাহাজ তীরে ভেড়াল। জল ওখানে গভীর। নোঙর ফেলা হল। তখনই ঘাটে নোঙর করা জাহাজ দুটো হ্যারি মনোযোগ দিয়ে দেখল। একটা জাহাজ ছোট। অন্যটা মালবাহী জাহাজ। ছোট জাহাজের মাথায় সাদা পতাকা। তার মানে যে কোন দেশের জাহাজ হতে পারে ওটা। মালবাহী জাহাজের মাথায় স্পেন দেশের পতকা উড়ছে। তার মানে স্পেনীয় মানুষদের জাহাজ।
আশ্চর্য। দুটো জাহাজই জনহীন। কোন মানুষের চিহ্নমাত্র নেই।
ফ্রান্সিস–হ্যারি ডেকে বলল–লক্ষ্য করে দেখ জাহাজে দু’টোয় কোন নাবিক বা ক্যাপ্টেন কেউ নেই।
–কী জানি। শাঙ্কো বলল–তবে হতে পারে কাছেই এখানকার নগর। জাহাজীরা ফুর্তিটুর্তি করতে গেছে। কতদিন পরে মাটির দেখা পেয়েছে। খুশি হওয়ারই কথা। ফ্রান্সিস বলল।
উঁহু। ব্যাপারটা তেমন মনে হচ্ছে না। হ্যারি মাথা নেড়ে বলল।
–দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
গভীর রাত তখন। শাঙ্কোরা কয়েকজন ডেক-এ ঘুমিয়ে আছে। পেড্রোও ওদের সঙ্গে ঘুমিয়ে আছে। নজরদারি করছে না। সমুদ্রের বেগবান বাতাসে অন্যরাও ঘুমোচ্ছে।
হঠাৎ তরোয়ালের খোঁচা খেয়ে পেড্রোর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে ও ভাঙা চাঁদের আলোয় দেখল খোলা তরোয়াল হাতে কয়েকজন যোদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। ও চিৎকার করে উঠতে গেল। যোদ্ধাটা তরোয়ালের ডগাটা ওর গলায় ঠেকিয়ে মৃদুস্বরে বলল–কোন শব্দ করবে না। উঠে চুপ করে বসে থাকো। পেড্রো আর কী করবে? উঠে বসে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। শাঙ্কোরাও উঠে বসেছে। যোদ্ধাদের সবার হাতেই খোলা তরোয়াল। ওরা সংখ্যায় আট দশজন। মাথায় লম্বা লম্বা চুল। গায়ে নানা রঙের সূতোয় কাজ করা ঢোলা হাতা পোশাক?
শাঙ্কো তখন ভাবছে হাতে তরোয়াল থাকলে একটা লড়াই দেওয়া যেত। শাঙ্কো লক্ষ্য করল যোদ্ধাদের পোশাক ভেজা। তার মানে জলে ডুব সাঁতার দিয়ে এসে ওরা জাহাজে উঠেছে। বোঝাই যাচ্ছে এরা জলদস্যু নয়। কিন্তু এভাবে সহজে এসে ওদের বন্দী করার কারন কী? এরা কারা?
ওদিকে চারপাঁচজন যোদ্ধা সিঁড়ি দিয়ে নিচের কেবিনঘরের দিকে নেমে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রান্সিস, মারিয়া, হ্যারি, ভেন আর অন্য বন্ধুরা ডেক-এ উঠে এল। পেছনে খোলা তারোয়াল হাতে যোদ্ধারা। একজন বেশ মোটা যোদ্ধা গলা চড়িয়ে বললে– তোমাদের দল নেতা কে? ফ্রান্সিস এগিয়ে গিয়ে বলল–আমি।
–তোমরা রাজা কার্তিলার আদেশে বন্দী হলে। দলপতি বলল।
–আমাদের অপরাধ? ফ্রান্সিস বলল।
–সেটা মহামান্য রাজা কার্তিলা বুঝবে। দলপতি বলল।
ওদিকে সিঁড়িঘরের আড়ালে বিনেলো ঘুমিয়ে ছিল। ওই জায়গাটাই ওর বরাবরের ঘুমের জায়গা। মোটা যোদ্ধাটিই যযাদ্ধাদের সর্দার। ওর কথাবার্তায় বিনেলোর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ও আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে সব দেখল।
কেউ কিছু বোঝার আগেই বিনেলো ছুটে এসে এক দলপতিকে প্রচন্ড ধাক্কা দিল। দলপতি এই হঠাৎ আক্রমণে টাল সমালাতে পারল না। উবু হয়ে ডেক-এ উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। হাতের তরোয়াল খাস পড়ল। বিনোলা তরোয়ালটা তুলে নিল। তারপর বিনেলো নিপুণ হাতে ওদের সঙ্গে লড়াই চালাতে লাগল। ফ্রান্সিস বাধা দেবার সময়ই পেল না। চারজন সৈন্যের সঙ্গে বিনেলা একাই লড়াই করছে। একজন যোদ্ধা সুযোগ বুঝে বিনেলোর পায়ে তারোয়ালের ঘা বসাল। রক্ত বেরিয়ে এল। তবু বিনেলে লড়াই চালাতে লাগল। দু’জন যোদ্ধা আহত হয়ে সরে দাঁড়াল। শাঙ্কো আর স্থির করতে পারল না। ও বুকের দিক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ওর ছোরাটা বের করল। তারপর যে যোদ্ধাটি বিনেলোকে আহত করেছিল ছুটে গিয়ে তার পেটে আমূল ছোরা বসিয়ে দিল। ফ্রান্সিস বুঝল বিপদ। এবার যোদ্ধারা সবাই ওদের দু’জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিনোলা আর শাঙ্কোর জীবন বিপন্ন হবে।
ফ্রান্সিস দু’হাত তুলে উঠে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল–বিনোলা–শাঙ্কো– লড়াই নয়। বিনোলা দাঁড়িয়ে পরে হাঁপাতে লাগল। যোদ্ধারাও হাঁপাচ্ছে তখন। লড়াই থেমে গেল। দলপরি চেঁচিয়ে বলল-তোমাদের বিচার হবে। চলো সব।
যোদ্ধারা নিজেরাই কাঠের পাটাতন পেতে দিল। আগে আহত যোদ্ধাদের নিয়ে ওরা কয়েকজন নেমে গেল। দলপতি ফ্রান্সিসদের ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা নেমে গেল। অন্য যোদ্ধারা ওদের পেছনে পেছনে নামল। সবাই বড় রাস্তা ধরে চলল।
তখন ভোর হয়ে গেছে। রাস্তায় লোকজনের চলাচল শুরু হয়েছে। রাস্তার দু’পাশে দোকান টোকান খুলছে। ফ্রান্সিসরা নির্দেশমত চলল। হাঁটতে হাঁটতে ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো ওর কাছে এল। ফ্রান্সিস একই স্বরে বলল–ওরকম মাথা গরম করা তোমার উচিত হয়নি। এতে আমাদের বিপদ বাড়ল।
–যোদ্ধাটি অন্যায়ভাবে বিনেলোকে আহত করেছে। শাঙ্কো বলল।
–স-অব মেনে নিতে হবে। পরে অস্ত্রহাতে লড়াইয়ের সুযোগ করে নেবে। এখন এ চুপচাপ সব সহ্য করে যাও। ফ্রান্সিস বিনেলোকে কাছে ডেকে একই কথা বলল।
রাস্তার লোকজন ফ্রান্সিসদের বেশ উৎসুকের সঙ্গে দেখছে। এতজন বিদেশী ক. নিশ্চয়ই সাজা হবে এদের।
ওদিকে বিনেলোর পায়ের ক্ষত থেকে রক্ত পড়ছে। ফ্রান্সিস পিছনে ফিরে ভেনকে দেখল মারিয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। ও বলল–ভেন। বিনোর তো চিকিৎসার দরকার।
–উপায় কি বলো। আমার ওষুধ পড়লে এক্ষুণি রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু ওষুধ তো জাহাজে। ভেন বলল।
-দেখ রাজাকে বলে। ভেন বলল। মারিয়া নিজের পোশাকের নিচে থেকে কিছুটা লম্বা কাপড় ছিঁড়ে ভেনকে দিয়ে বলল–তুমি অন্তত পট্টিটা বেঁধে দাও। ভেন কাপড়ের পুটলিটা নিয়ে বিনেলার কাছে যাচ্ছে তখনই একজন যোদ্ধা ছুটে এল বলল–নড়াচড়া চলবে না। সব দাঁড়িয়ে থাক।
–ওর পা থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। অন্তত পট্টিটা বাঁধতে দাও। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল।
–না। মহামান্য রাজার হুকুম না হলে কিছু হবে না। যোদ্ধাটি বলল।
–তাহলে তোমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। ঠান্ডা মাথার হ্যারি চিৎকার করে বলল।
–না। রাজার হুকুম চাই। যোদ্ধাটি বলল। ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর যযাদ্ধাদের দলপতি এগিয়ে এল। বলল– সবাইকে রাজসভায় নিয়ে যাও।
যোদ্ধারা সামনে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসদের রাজসভায় নিয়ে চলল। ..
রাজসভায় ঢুকে ফ্রান্সিসরা দেখল বেশ বড় ঘর। রাজা কার্তিলা একটা কাঠের সিংহাসনে বসে আছে। ফ্রান্সিসরা গিয়ে দাঁড়াতেই দলপতি এগিয়ে গিয়ে সেনাপতিকে কিছু বলল। সেনাপতি ফ্রান্সিসদের রাজার কাছে এগিয়ে যাবার ইঙ্গি ত করল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি এগিয়ে গেল। রাজা কিছু বলার আগেই ফ্রান্সিস বলে উঠল–আমরা বিদেশী ভাইকিং। আপনার রাজত্বে আমরা এই প্রথম এলাম। এখানকার নিয়ম কানুন আমরা কিছুই জানি না। কী অপরাধে আমাদের বন্দী করা হল তাই জানতে চাইছি। রাজা দলপতির দিকে তাকাল। দলপতি মাথা একটু নিচু করে সম্মান জানিয়ে বলল–মহামান্য রাজা এরা আমাদের সঙ্গে লড়াই করেছে। দু’জনকে আহত করেছে। আর একজনকে হত্যা করেছে। ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বুঝল–খুবই বিপদ উপস্থিত। হ্যারি বলে উঠল–
–আমাদেরও একজন আহত হয়েছে। তবু মৃত্যুর জন্যে আমরা গভীরভাবে দুঃখিত। আমাদের বন্ধু এক বন্ধুকে আহত হতে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। আঘাতকারীকে সে আহতই করতে চেয়েছিল। হত্যা করতে চায়নি।
কোন কথা শুনতে চাই না। রাজা প্রায় চিৎকার করে বলল। তারপর e সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বলল–কে সেই হত্যাকারী?
দলপতি শাঙ্কোকে অঙ্গুল তুলে দেখাল।
–চাবুক মারো। উপযুক্ত শাস্তি। রাজা বলে উঠল।
দলপতি ছুটে এসে শাঙ্কোকে রাজার সামনে নিয়ে এল। একজন প্রহরী চাবুক হাতে এগিয়ে এল। দলপতি চাবুকটা হাতে নিল। তারপর শাঙ্কোর পিঠে চাবুক মারতে লাগল। চারপাঁচটা চাবুকের ঘা শাঙ্কো মুখ বুঝে সহ্য করল। তারপর আর পারল না। ওর মুখ থেকে গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে এল। শাঙ্কোর কষ্ট বিকৃত মুখের দিকে ফ্রান্সিস তাকিয়ে থাকতে পারল না। মাথা নিচু করল। শাঙ্কোর পিঠের দিকে পোশাক ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে এল।
ফ্রান্সিস হাত তুলে চিৎকার করে উঠল–থামো। দলপতি হাঁপাতে হাঁপতে রাজার দিকে তাকাল।
–চাবুক চালিয়ে মেরে ফেল। রাজা কার্তিনা চেঁচিয়ে বলে উঠল। ফ্রান্সিস দাঁত চাপাস্বরে বলল–আর একবার চাবুক মারলে আমরা লড়াইয়ে নামব।
রাজা হো হো করে হেসে উঠল। বলল–তোমাদের হাতে একটা লাঠিও নেই।
–নিরস্ত্র অবস্থায় কী করে লড়াই করতে হয় আমরা জানি। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা সবাই মরবে। রাজা বলল।
আমাদের বন্ধুকে বাঁচাতে আমরা মরতে প্রস্তুত। ফ্রান্সিস বলল। মনে রাখবেন আমরা ভাইকিং। আমরা মৃত্যুর পরোয়া করি না।
তখনই মন্ত্রী উঠে দাঁড়াল। বলল–কিন্তু ও তো আমাদের এক যোদ্ধাকে হত্যা করেছে।
–তার জন্যে আমরা ক্ষমা চাইছি। আমরা তো বললাম–ও হত্যা করতে চায়নি। যোদ্ধাটিকে আহত করতে চেয়েছিল। হ্যারি বলল।
-বেশ। তার শাস্তি ও পেয়েছে। মন্ত্রী বলল। তারপর আসনে বসে পড়ে রাজাকে বলল–মান্যবর রাজা–ক্ষমা করে দিন। রাজা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–বেশ। আপনার কথাই থাক।
–মান্যবর রাজা–ফ্রান্সিস বলল–আমাদের কোথায় বন্দী হয়ে থাকতে হবে?
কয়েদ ঘরে। রাজা বলল।
একটা কথা ছিল। ফ্রান্সিস বলল।
–বলো। রাজা বলল।
মারিয়াকে দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলল ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী। কয়েদঘরের পরিবেশে উনি থাকতে পারবেন না। অনুরোধ করছি তাঁকে আমাদের জাহাজে রাখুন। উনি তো আর একা জাহাজ চালিয়ে পালাতে পারবেন না।
-থাকুক। তবে আমাদের এক যোদ্ধা পাহারায় থাকবে। রাজা বলল।
–বেশ। ফ্রান্সিস এবার ভেনকে দেখিয়ে বলল–ইনি আমাদের চিকিৎসক বৈদ্য। ইনিও মধ্যবয়স্ক। একা ওর পক্ষে পালানো অসম্ভব। ওঁকেও আমাদের জাহাজে থাকতে অনুমতি দিন।
–তাহলে দুজন প্রহরী থাকবে। রাজা বলল।
–ঠিক আছে। আমাদের আহত দুই বন্ধুকে উনিই চিকিৎসা করবেন। সেই অনুমতি দিন।
–আমার কোন আপত্তি নেই। তোমাদের আর কোন অনুরোধ রাখা আমার হবে না। রাজা এবার সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বলল–এদের দু’জন ছাড়া সব কজনকে কয়েদঘরে বন্দী করুন। সেনাপতি বলল– মাননীয় রাজা–আমাদের হুকুমে বন্দরে একটা স্পেনীয় জাহাজ থেকে আর একটা মালবাহী জাহাজ থেকে নাবিকদের বন্দী করে এনে কয়েদঘরের রাখা হয়েছে।
জাহাজ দুটো তল্লাশী হয়েছে? রাজা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। সেনাপতি ঘাড় কাত করে বলল।
–মূল্যবান কিছু পাওয়া গেছে? রাজা আবার প্রশ্ন করল।
–সামান্য কিছু বিদেশী স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। সেনাপতি বলল।
–ওদের মুক্তি দাও। প্রতিদিনের খাওয়ার খরচ বাঁচানো যাবে। রাজা বলল।
সেনাপতি মাথা নুইয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল–চলে সব। বিনেলো শাঙ্কোকে ধরে ধরে নিয়ে এল। সিনাত্রাও সাহায্য করল।
রাজবাড়ির বাইরে এল সবাই। সামনে পেছনে যোদ্ধারা। রাজবাড়ির পেছনে কয়েদঘরের সামনে এল। দলপতি সকলের আগে ছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে সবাইকে দাঁড়াতে ইঙ্গিত করল। তারপর এগিয়ে গিয়ে প্রহরীদের একজনকে বলল–বন্দর থেকে যে নাবিকদের বন্দী করা হয়েছে তাদের সবাইকে ছেড়ে দাও।
প্রহরীরা দরজা খুলে নাবিকদের বেরিয়ে আসতে বলল। বন্দী নাবিকরা আস্তে। আস্তে বেরিয়ে এল। তারা সংখ্যায় পঁচিশ তিরিশ জন।
তারা সদর রাস্তায় নেমে জাহাজ ঘাটের দিকে চলল।
তোমরা তো হত দরিদ্র। তল্লাশী হয়ে গেছে। প্রায় কিছুই পাওয়া যায় নি। দলপতি বলল। কথাটা হ্যারিও শুনতে পেল। গলা নামিয়ে বলল–রাজকুমারীর সোনার চাকতি গুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন। ফ্রান্সিস কিছু বলল না। মৃদ্যু হাসল। কষ্ট করেই হাসল। কারন শাঙ্কোর জন্যে ওর মন ভালো নেই।
ফ্রান্সিসদের কয়েদঘরে ঢোকানো হতে লাগল। মারিয়া আর ভেন একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরে ঢুকে গেল।
দলপতি দু’জন প্রহরীকে সঙ্গে নিয়ে মারিয়াদের কাছে এল। প্রহরীদের দেখিয়ে বলল–এরা তোমাদের জাহাজে যাচ্ছে। পালাবার চেষ্টা করবে না। মারিয়ার কথা বলতে ইচ্ছা করল না। দু’জনে প্রহরীর পাহারায় জাহাজ ঘাটের দিকে চলল।
কয়েদঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস দেখল ঘরটা নেহাৎ ছোট না। হাত পা ছড়িয়ে থাকা যাবে। দেখল আগে থেকেই তিনজন বন্দী রয়েছে। মধ্য বয়স্ক একজন বৃদ্ধ আর অন্যজন যুবক। মধ্যবয়স্কর চেহরায় বেশ রাশভারি। মুখে অল্প কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফ। সুগোঠিত দেহ। একজন সাহসী যোদ্ধার মতই চেহারা।
শাঙ্কোকে ততক্ষণে ধরে ধরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ও চিৎ হয়ে শুতে পারছে না। ও বাঁদিকে কাতর হয়ে শুয়ে রইল। ও গোঙাচ্ছে না। কিন্তু ওর যন্ত্রনাক্লিষ্ট মুখ। দেখে বোঝা যাচ্ছে ও প্রাণপণে যন্ত্রনা সহ্য করছে।
ফ্রান্সিস আশায় রইল কতক্ষণে ভেন আসে।
বেশ কিছুক্ষর পরে ভেন ঝোলা কাঁধে এল। যাহোক প্রহরীরা ওকে বাধা দিল না। দরজা খোলা হল। ভেন ঘরে ঢুকল। কাধ থেকে ঝোলা নামিয়ে মেঝেতে রাখল। শাঙ্কোর কাছে গেল। বলল–জামাটা খোল। শাঙ্কো মাথা নেড়ে বলল–পারবেনা। খুলে দাও। বিনেলা এগিয়ে গেল। শাঙ্কোর গায়ে চাবুকেরমারেছিড়ে ছিঁড়ে যাওয়া জামাটা কোনরকমে খুলে দিল। তারপর পিঠের ক্ষত ভেন পরীক্ষা করল। বোঝা থেকে দুটো বোয়াম বের করল। হাতের তালুতে ওষুধ নিয়ে ঘষে ঘষে বড়ি বানাল। বিনেলোকে বলল–এখন একটা বড়ি খাইয়ে দাও। পরে দিনে তিনটে করে বড়ি খাওয়াবে। ওষুধগুলো ঠিকমত খাইয়ে দিও। বিনেলোর পা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে তখনও। ভেন ঝোলা থেকে একটা কাঠের কৌটো বার করল। কৌটার মুখ খুলে সবুজেমত গুঁড়ো ক্ষতস্থানে ঢেলে দিল। বিনেলা আঃ শব্দ করল মুখে। ভেন বলল–রক্ত পড়া বন্ধ হবে। ব্যাথাও কমবে। একটু সহ্য কর। বিনেলো কিছু বলল না।
ভেন ঝোলায় বোয়াম কৌটো ভরতে ভরতে বলল
–তরোয়ালের ক্ষত শুকিয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই। তবে শাঙ্কোর ঘা সারতে একটু সময় লাগবে। ও যেন বেশি নাড়াচাড়া না করে। আমি পরশু আসবো। ওষুধ দেব।
রাজকুমারীর দিকে নজর রেখো। জাহাজে তুমি ছাড়া আর কেউ তো রইল। না। হ্যারি বলল।
তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো। রাজকুমারীকে আমি প্রাণ দিয়ে হলেও রক্ষা করব। ভেন বলল। তারপর ঝোলা কাঁধে নিয়ে চলে গেল।
দুপুরে খাবার দেওয়া হল। লম্বাটে শুকনো পাতায় দেওয়া হল আধপোড়া গোলরুটি আনাজের ঝোল আর সবশেষে আশ্চর্য! পাখির মাংস। ফ্রান্সিসরা, পেট পুরে খেল। প্রহরীরাই খেতে দিয়েছিল। শাঙ্কোকে ওষুধ খাওয়ানো হল। পাখীর মাংস বেশ পেট পুরেই খেল ওরা। পাথরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ফ্রান্সিস চোখ বুজে ছিল। হঠাৎ প্রশ্ন শুনল–তোমরা তো বিদেশী। ফ্রান্সিস চোখ মেলে তাকাল। দেখল লম্বা চুলওয়ালা যুবকটি কখন ওর কাছে এসে বসেছে। শাঙ্কোর জন্যে মনটা ভাল নেই তবু কথা বলল
-হ্যাঁ অমারা ভাইকিং।
–ও। দুঃসাহসী হিসেবে তোমাদের সুনাম আছে। যুবকটি বলল।
ফ্রান্সিস চুপ করে রইল।
–তোমার নাম কী? যুবকটি জানতে চাইল।
–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস বলল।
–আমার নাম আতলেতা। পর্তুগালে আমার জন্ম। কিন্তু বড় হয়েছি এখানে। আতলেতা বলল।
–রাজা কার্তিনা তোমাদের বন্দী করেছেন কেন? আতলে জিজ্ঞেস করল।
ফ্রান্সিস আহত শাঙ্কোকে দেখিয়ে বলল-ও মাথা গরম করে কার্তিনার এক যোদ্ধাকে মেরে ফেলেছে।
মাত্র একটাকে মেরেছে। গোটা পাঁচেক যোদ্ধাকে মারতে পারল না। আতলেতা বলল।
–একটাকে মেরেই চাবুক খেয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা কার্তিনা তোমার বন্ধুকে মেরে ফেলেনি এটাই আশ্চর্য। কার্তিনার মত নরপশু দুটি নেই। আতলেতা বলল।
-তোমাদের অপরাধ। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
সেই রাশভারি চেহারার মানুষটি দেখিয়ে আতলেতা বলল
–উনি এই লাগাস রাজ্যের রাজা–এনিমার। বৃদ্ধকে দেখিয়ে বলল– উনি মন্ত্রীমশাই। রাজা কার্তিনার রাজ্য পশ্চিমের পাহাড়ের ওপর। লড়াই করে এই লাগাস রাজ্য জয় করেছে রাজা কার্তিনা। মন্ত্রীকে আর আমাকে এই কয়েদ ঘরে বন্দী করে রেখেছে। এখন আমাদের ফাঁসি দিলেও আমরা অবাক হব না। আতলেতা বলল।
–আর সেনাপতি? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
লড়াইয়ে মারা গেছেন। তখন আমাকেই সেনাপতির কাজ চালাতে হচ্ছিল। সেই আমিও হেরে গিয়ে বন্দী। আতলেতা বলল।
–রাজা এনিমারের তো এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল।
উনি অন্য রকম মানুষ। নিজের গ্রন্থাগারেই দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতেন। লড়াই রক্তপাত মৃত্যু এসব মোটেই পছন্দ করেন না। তাই রাজা কার্তিনা সহজেই জয়লাভ করেছে।
-রাজত্ব রাখতে গেলে যুদ্ধ লড়াই আছেই। তারপর পাশ্ববর্তী রাজ্য যদি আক্রমণকারী হয়। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা এনিমার এসব ব্যাপারে উদাসীন। ভালো মানুষ যেমন হয় আর কি। আতলেতা বলল।
–তোমরা বন্দী হলে কীভাবে। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
রাজা এনিরের জন্যে। দিন দশেক আগের কথা। তখন বেশ রাত। ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎই বড় রাস্তায় হৈ চৈ শুনলাম। তরোয়াল নিয়ে বেরিয়ে এলাম। দেখি রাজা কার্তিনার নেতৃত্বে তার যোদ্ধারা রাস্তা দিয়ে ছুটছে আমাদের সৈন্যবাসের দিকে। বুঝলাম ঘুমন্ত সৈন্যদের ওরা অক্রমন করতে চলেছে। তখন আর আমাদের সৈন্যদের সাবধান করার সময় নেই। রাজা এনিমারকে বাঁচাতে আমি বাড়িঘরের ছায়ায় ছায়ায় লুকিয়ে রাজবাড়ির সামনে এলাম। দেখলাম প্রহরীদের সঙ্গে ওদের সৈন্যদের লড়াই চলছে। আমি লড়াইয়ে জড়ালাম না। যেকরে তোক রাজা এনিমারকে বাঁচতে হবে। লড়াইয়ের ফাঁকে আমি রাজবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে পড়লাম। দেখি রাজা এনিমার ঘুম ভেঙ্গে বিছানায় উঠে বসে আছেন। আমি ছুটে এসে অন্দরমহলে প্রহরীকে বললাম
-শিগগিরি যাও। পেছনের দরজা খুলে দাও। ফিরে এসে দেখি রাজা পোশাক বদল করেছেন। বেরোবার জন্যে তৈরি। আমি বললাম
–প্রহরীরা শত্রুসেনার সঙ্গে লড়ছে। এই সুযোগ আমরা পেছনের দরজা দিয়ে পালাবো।
–না। আমি ধরা দেবো। রাজা এনিমার বলল।
–বলেন কি? আমি বেশ চমকে উঠলাম।
–হ্যাঁ। আমি ধরা দিলেই লড়াই বন্ধ হবে। আর রক্ত ঝববে না। রাজা বললেন।
–আপনার ফাঁসিও দিতে পারে। আমি বললাম।
–দিক। তবু রক্তপাত তো বন্ধ হবে। রাজা বললেন।
আমি নানাভাবে রাজা এনিমার বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রাজা অনড়। বন্দীদশাই মেনে নেবেন। আতলেতা থামল।
-তারপর? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–তখনই একজন প্রহরী এসে জানিয়ে গেল লড়াই করতে করতে সেনাপতি মৃত্যবরণ করেছেন। মন্ত্রীর বাড়ি আক্রমন করে মন্ত্রীকে বন্দীকে করা হয়েছে। রাজা এনিমার আমাকে বললেন-যাও। এখনও যে যোদ্ধারা বেঁচে আছে তারা যেন অস্ত্রত্যাগ করে। অথবা লড়াই থামিয়ে পশ্চিমে বনজঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। মোট কথা লড়াই নয়। রাজার আদেশ। মানতেই হবে। একটু থেমে আতলেতা বলতে লাগল–রাজবাড়ির দেউড়ি ছাড়িয়ে রাস্তায় এলাম। তখন প্রহরীদের সঙ্গে লড়াই শেষ। আহত মৃত প্রহরীরা দেউড়ি এখানে ওখানে পড়ে আছে। একটু থেমে আতলেতা বলতে লাগল
রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তখনও আমাদের যোদ্ধারা লড়াই করে চলেছে। আমি দুহাত তুলে চিৎকার করে লড়াই থামালাম। আমাদের যোদ্ধাদের রাজার আদেশ জানালাম। আত্মসর্মপন করতে বললাম। যোদ্ধারা আমার ইঙ্গিত বুঝল। গ্রেপ্তারি এড়াতে সবাই দলে দলে পশ্চিমের জঙ্গলের দিকে ছুটল। কিছু বন্দী হল অবশ্য। তাদের সৈন্যবাসের একটি ঘরে বন্দী রাখা হয়েছে। একটু থেমে আতলেতা বলতে লাগল-রাজবাড়ির অন্তঃপুরে তখন রাজা কার্তিনার সৈন্যরা ঢুকে পড়েছে। রাজা কার্তিনা স্বয়ং রাজা এনিমারের শয়নঘরে এসে হাজির হল। হাতে খোলা তরোয়াল। রাজা এনিমার বললেন–আমাকে বন্দী করুন। অনুরোধ লড়াই বন্ধ করুন। লড়াই ততক্ষণে থেমে গেছে। রাজা কার্তিনা আমাকে আর রাজাকে বন্দী করল। তারপরে আমাদের এই কয়েদঘরে বন্দী করে রাখা হল। ওরা মন্ত্রীর বাড়িও আক্রমন করেছিল। সেখান থেকে মন্ত্রীকেও বন্দী করেছিল। ফ্রান্সিস চুপ করে সব শুনল। তারপর বলল–আতলেতা আমাকে তুমি তোমাদের রাজার কাছে নিয়ে চলো।
-বেশ। চলো। আতলেতা বলল।
দু’জনে রাজা এনিমার কাছে এল। আতলেতা ফ্রান্সিসদের সম্পর্কে সব কথাই বলল। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রাজা এনিমার বলল–তোমাদের দেখেই বুঝেছি তোমরা বিদেশী। তোমাদের শাস্তি দেওয়া হবে এটা ভেবেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
–মহামান্য রাজা–আমরা নির্বিঘ্নে পালাবো। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুক। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল। রাজা এনিমার কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না।
–শুধু এদের খাওয়ার দেওয়ার ব্যবস্থা আর পাহারা দেওয়ার অবস্থাটা দেখতে দিন। মুশকিল হয়েছে আমার এক বন্ধু আহত। এসব ব্যাপারে আমি তার ওপর খুব নির্ভর করি। যাইহোক আর কোন বন্ধুকে নিয়েই সেই কাজটা করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু রাজা কার্তিনা খুব ধুরন্ধর লোক। পাহারায় কোন গাফিলতি রাখবে না। এনিমার একটু নিম্নস্বরে বলল।
–তাহোক। অনেক কড়া পাহাড়া থেকে আমরা এর আগে পালিয়েছি। এখন সময় আর সুযোগ বুঝে নেওয়া। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখো–যদি পারো। একটু হতাশভঙ্গীতেই রাজা এনিমার বললেন।
–আপনি একজন সত্যিকারে মহানুভব রাজা। ফ্রান্সিস বলল।
–মহারাজা আমাদের সন্তানতুল্য দেখেন। আতলেতা বলল।
–সেইজন্যে আমি স্থির করেছি আপনাদের যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে আমরাও আপনাকে মুক্ত করতে আর আপনার রাজত্ব আপনাকে ফিরিয়ে দিতে রাজা কার্তিনার বিরুদ্ধে লড়াই করব।
রাজা কার্তিনার সৈন্য সংখ্যা কিন্তু কম নয়। রাজা বললেন।
–আমরা চোরাগোপ্তা আক্রমন করে ওদের নাজেহাল করে ছাড়বো। ফ্রান্সিস বলল। রাজা এনিমার আর কিছুই বলল না। ফ্রান্সিস নিজের জায়গায় চলে এল। হ্যারি এগিয়ে এসে বলল–রাজার সঙ্গে কী কথা হল? ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সব কথা বলল।
–আবার লড়াইয়ে নামব? হ্যারি প্রশ্ন করল।
–আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেই লড়াই চালাবো। রাজা এনিমার সম্পর্কে সব তো শুনলে। এরকম একজন মানুষের জন্যে একটু করব না? ফ্রান্সিস বলল।
দুপুর হল। দু’জন পাহারাদার কাঠের গামলায় খাবার দাবার নিয়ে এল। সবার সামনে একটা করে গাছের লম্বাটে পাতা একজন প্রহরী পেতে দিল। তারপর অন্যজনের সঙ্গে মিলে খাবার দিতে লাগল। আধপোড়া রুটি আনাজপাতির ঝোল আর সমাদ্রিক মাছের ঝোল মত। ফ্রান্সিসরা পেট পুরে খেয়ে নিল। শুধু শাঙ্কো খেতে পারছিল না। ফ্রান্সিস ওকে জোর করে খাওয়াল। রাজাও নিঃশব্দে একই খাবার খেলেন। বন্দীদের জন্য রান্না করা খাবার রাজা কখনও খাননি। কিন্তু এই খাবার খেলেন। তাঁর বিরক্তির কোন কারন নেই। নিজের জীবনে এই আকস্মিক দুরবস্থা সরল মনেই মেনে নিয়েছেন। এটা ফ্রান্সিসের খুব ভাল লাগল। যখন খাবার খাচ্ছিল তখন লক্ষ্য করছিল দু’জন প্রহরী বর্শা হাতে দরজায় পাহারা দিচ্ছে। আর দু’জন যোদ্ধা খোলা তরোয়াল হাতে এদিক ওদিক ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে পাহারায় কোন ঢিলেমি নেই।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। আতলেতা ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–রাজা এনিমার বলছিলেন পালানোর ব্যাপারে তুমি কিছু ভেবেছো কিনা।
–রাজার কাছে চলো। রাজার সঙ্গে কথা আছে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর হ্যারিকে ডেকে নিয়ে রাজার কাছে এল। রাজা দেওয়াল ঠেস দিয়ে চোখ বুজে বসেছিলেন। পাশে মন্ত্রী।
–মান্যবর রাজা–আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।
–বলো। চোখ খুলে রাজা বললেন।
–আপনি রাজা কার্তিনার সঙ্গে কথা বলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি মুক্তিভিক্ষা করব না। রাজা বলল।
আমাকে ভুল বুঝবেন না। সেসব কথা বলতে বলছি না। দু’টো কথা আপনি বলবেন–এক মন্ত্রী বৃদ্ধ মানুষ। তিনি কোনভাবেই রাজা কার্তিনার কোন ক্ষতি করতে পারবেন না। তাকে তার বাড়িতে নজরবন্দী করে রাখা হোক। কয়েদঘরের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারবেন না। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ। আর কি নিয়ে কথা বলবে? রাজা বললেন।
–দুই–বন্দরের জাহাজ থেকে বেশকিছু নাবিক ও জাহাজীকে বন্দী করে এই কয়েদঘরে রাখা হয়েছিল। তারা মুক্তি পেয়ে চলে গেছে। এখন এই বড় কয়েদঘরে আপনার বন্দী যোদ্ধাদের বন্দী করে রাখা হোক অর্থাৎ আমরা ঐ যযাদ্ধাদের সঙ্গেই শাস্তি ভোগ করতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।
-কিন্তু এই ঘরে অত সৈন্য-থাকতে অসুবিধা হবে না? রাজা বললেন।
–তা হবে। কিন্তু আমাদের সেটা মানিয়ে নিতে হবে। এসব বলছি এই জন্যে যে আমাদের একটা পরিক্লপনা আছে। দু’একদিন আমাদের সবাইকে একটু কষ্ট স্বীকার করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। কথা বলব। তবে কথা রাখবে কিনা জানি না। রাজা বলল।
–রাখবে। কারন এসবের জন্যে তার কোন ক্ষতি হবে না। তাহলে কাল সকালে রাজসভায় গিয়ে–ফ্রান্সিস কথা শেষ করতে পারল না।
– না। এখানেই আসতে বলল। রাজা বললেন।
–বেশ। তাই বলুন। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস দরজার কাছে গেল। একজন প্রহরীকে ডেকে বলল–এসো। রাজা এনিমার রাজা কার্তিনার সঙ্গে কথা বলবেন। রাজা কার্তিনাকে খবর পাঠাও।
–রাজা কার্তিনা কি দেখা করবেন? প্রহরী বলল।
–তুমি একবার বলে তো দেখ। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখি বলে। প্রহরী কথাটা বলে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল–রাজা কার্তিনা দেখা করবে না। ফ্রান্সিস বেশ হতাশ হল। অথচ যে দুটি ব্যাপার নিয়েও কথা বলবে ভেবেছিল সেসব অবশ্যই করাতে হবে।
এবার আতলেতা এগিয়ে এল। বলল–রাজা কার্তিনা যাতে কথা বলতে আসে আমি তার ব্যবস্থা করছি। ও রাজা এনিমারকে বলল–মান্যবর রাজা আপনি অতীতের রাজা সিয়াভোর গুপ্ত রত্নভান্ডারের কথা বলবেন এই খবর পাঠান। দেখবেন লোভী রাজা কার্তিনা ছুটে আসবেন।
ওসব নিয়ে আর কি বলবো? রাজা বললেন।
প্রোমিওর কথা বলবেন। তারপর ফ্রান্সিস যা বলতে চাইছেন তা বলবেন। আতলেতা বলল।
-ঠিক আছে। প্রহরীকে বল। রাজা বললেন। আতলেতা দরজার কাছে গেল। প্রহরীকে বলল–তুমি রাজা কার্তিনাকে খবর দও যে রাজা এনিমার অতীতের এক রাজার গুপ্ত রত্ন ভান্ডারের কথা বলবেন।
–বেশ। গিয়ে বলছি। তবে রাজা কার্তিনা আসবে না। প্রহরী বলল।
দেখা যাক। আতলেতা বলল। প্রহরী চলে গেল।
অল্পক্ষনের মধ্যেই রাজা কার্তিনার এসে হাজির। পিছনে সেই প্রহরী। রাজা কার্তিনার হেসে বলল–রাজা সিয়েভোর গুপ্ত রত্নভান্ডারের কথা শুনেছি। কোথায় আছে সেই রত্নভান্ডার?
–তা বলতে পারবো না। রাজা এনিমার বলল।
–কেউ কি সেই গুপ্ত রত্নভান্ডার খোঁজার চেষ্টা করে নি? কার্তিনা বলল।
-হ্যাঁ। আমার পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোন হদিশ পাননি। সবশেষে চেষ্টা করেছিল এক স্পেনিয় যুবক-প্রোমিও। কিন্তু সে রহস্যজনকভাবে মারা গেছে। রাজা এনিমা বললেন।
এবার আমি খুঁজবো। কার্তিনা বলল।
-বেশ। রাজা এনিমার মাথা কাত করে বললেন। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল– মান্যবর রাজা–আমার কথা দু’টো।
একটা কথা। আমার দুটো অনুরোধ আছে। রাজা এনিমার বললেন।
–বলুন বলুন। নিশ্চয়ই আপনার অনুরোধ রাখার চেষ্টা করবো। কার্তিনা বলল।
–বিশেষ কিছুই না। এক–মন্ত্রী মশাই বৃদ্ধ। এই কয়েদঘরের ধকল তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তাঁকে তাঁর বাড়িতে নজরবন্দী করে রাখুন।
–বেশ তো। আর একটা অনুরোধ? রাজা কার্তিনা বলল।
–এই ঘরে যথেষ্ট জায়গা আছে। আমার বন্দী যোদ্ধাদের এইঘরে ওদের রাখুন। ওদের সঙ্গে আমি দন্ডভোগ করতে চাই। রাজা এনিমার বললেন।
-কিন্তু আপনার অত সৈন্য কি এইঘরে আঁটবে? কার্তিনা বলল।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ। আমরা কষ্ট করেই থাকব। রাজা এনিমার বলল।
–আপনার যেমন অভিরুচি। কার্তিনা বলল। তারপর দু’জন প্রহরীর দিকে তাকিয়ে বলল–তোমরা সৈন্যাবাস থেকে দু’জন প্রহরীকে নিয়ে এসো। তারপর মন্ত্রীমশাইকে মুক্ত করে তার বাড়িতে তাঁকে নিয়ে গিয়ে রাখো। বাড়ির বাইরে সেই দু’জন প্রহরী দিনরাত পাহারা দেবে। নজর রাখবে–মন্ত্রীমশাই যেন পালাতে না পারে। মন্ত্রীকে নিয়ে প্রহরী দু’জন চলে গেল। রাজা কার্তিনা বলল–আপনি একজন স্পেনীয় যুবক প্রোমিওর কথা বলছিলেন। সে কী ভাবে গুপ্তধন খুঁজেছিল?
–প্রোমিও একটা বইমত লিখে গেছে–জনৈক জলদস্যুর কাহিনী। যে সরাইখানা প্রোমিওর আকস্মাৎ মৃত্যু হয়েছিল বইটা সেখানেই পাওয়া গিয়েছিল। সেই বইতে ওর গুপ্তধন খোঁজার কথা লেখা আছে। রাজা এনিমার বললেন।
-কোথায় আছে সেই বই? রাজা কার্তিনা বললেন।
–আমার পাঠকক্ষে। বই নিন পড়ন। কিন্তু দোহাই-হারাবেন না। যথাস্থানে রেখে দেবেন। রাজা এনিমার বলল।
–নিশ্চয়ই। রাজা কার্তিনা ঘাড় নেড়ে বলল। তারপর কিছু না বলে চলে গেল।
ফ্রান্সিস গুপ্তধনের কথা এই প্রথম শুনল। ও সমস্ত কাহিনীটা জানতে আগ্রহী হল। কিন্তু বইটা তো এখন পাওয়া যাবে না। অগত্যা অপেক্ষা করতে হবে। এখন ভাবতে হবে মুক্তির কথা। ও মনকে তাই বোঝাল।
পরের দিন সকালেই রাজা এনিমার বন্দী সৈন্যরা দল বেঁধে এল। রাজা কার্তিনার সৈন্যরা ওদের পাহারা দিয়ে নিয়ে এল। তারা সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও কয়েদঘরে গাদাগাদি ভিড় হল। অসুস্থ শাঙ্কোরই কষ্ট হল বেশি। ওর পিঠের ক্ষত। ভেনের ওষুধে এখন শুকিয়ে যাবার মুখে। তবে এরকম গাদাগাদি করে থাকা। হ্যারি শরীরের দিক থেকে বরাবরই দূর্বল। ওরও কষ্ট হতে লাগল।
ফ্রান্সিস ওদের কাছে এল। বলল–দু’একটা দিন কষ্ট করে থাকো। এরমধ্যেই পালাবো। রাজা এনিমারের সৈন্যরা আসায় আমাদের যোদ্ধা সংখ্যা বাড়ল। পালাতে সুবিধে হবে। সৈন্যবাসে গিয়ে ঐ বন্দীদের আমরা মুক্ত করতে পারতাম না। এখান থেকে মুক্তি হওয়া অনেক সহজ। ছক কষা হয়ে গেছে। এখন কাজে লাগানো।
পরের দিনটা ফ্রান্সিস প্রায় শুয়ে শুয়ে কাটাল। সর্বক্ষণ পালাবার ছকটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবল। পালানোর ছক নিখুঁত হওয়া চাই।
সন্ধ্যেবেলা আতলেতা আর বিনেলোকে কাছে ডাকল। আতলেতাকে বলল তোমাদের অস্ত্রাগারটা কোথায়?
–এই কয়েদঘরের ওপাশে রাজার পাঠকক্ষ। তারপরের ঘরটাই অস্ত্রগার।
–ঠিক আছে। এবার বিনেলোকে বলল–শাঙ্কো অসুস্থ। এসব কাজে শাঙ্কোই আমার বড় ভরসা ছিল। যাহোক তোমাকে যা বলছি তা শাঙ্কোরই মতই করতে হবে। সব কাজ যত দ্রুত সম্ভব সারতে হবে। তারপর ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে পালাবার ছকটা বুঝিয়ে দু’জনকে বলল। বিনেলোক চাপাস্বরে গা বলে উঠল–সাবস্ ফান্সিস। ফ্রান্সিস মৃদু হাসল। বলল–সাফল্য নির্ভর করছে তোমাদের তৎপরতার ওপর আর আমাদের সাহসের উপর।
এবার ফ্রান্সিস হ্যারিকে ডাকল। সব বলল। হ্যারি বলল–তোমার পরিকল্পনা নিখুঁত।
তারপর ফ্রান্সিস চারজন বন্ধুকে ডাকল। ওরা কাছে এলে বলল–তোমরা কোমরেব ফেট্টি খুলে সিনাত্রার হাতে দাও। চারজনই ফেট্টি খুলে সিনাত্রাকে দিল।
–এ ব্যাপারে রাজাকে কিছু বলবে না? আতলেতা জানতে চাইল।
–না এসব শুনে রাজার দুশ্চিন্তা বেড়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল–
–রাজাকে নিশিন্তে থাকতে দাও। বিনেলো শাঙ্কোর কাছ থেকে ছোরাটা নিয়ে রাখলো। শাঙ্কোকে ছোরাটা বের করে দিল।
রাত হল। ফ্রান্সিস কয়েকজন নিয়ে তৈরি হল।
রাত বাড়ল। রাতের খাবার নিয়ে দু’জন প্রহরী ঢুকল। একজনের হাতে কাঠের গামলায় খাবার রাখার লম্বাটে শুকনো পাতা। ফ্রান্সিস বাইরের দিকে তাকাল। ভেজানো দরজার লম্বাটে ফাঁকের মধ্যে দিয়ে দেখল তরোয়াল হাতে দু’জন যোদ্ধা এদিক ওদিক ঘুরছে। তরোয়াল কোষবদ্ধ।
সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে এক প্রহরীর হাতের খাবার-ভরা কাঠের গামলাটা তুলে নিয়ে প্রহরীর মুখে ছিটিয়ে দিল। প্রহরীটি এই হঠাৎ আক্রমনে দিশেহারা হল। খাবারের ঝোল লেগে ওর চোখ জ্বালা করে উঠল। দুহাতে দুচোখ চেপে বসে পড়ল। বিনেলো ততক্ষণে অন্য প্রহরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তার হাত থেকে রুটির থালা পাতা ছিটকে গেল। ও ছিটকে মেঝেয় পড়ে গেল। সিনাত্রা ছুটে এসে ফেট্টির কাপড় দিয়ে ওর মুখ বেঁধে ফেলল। অন্য প্রহরীটি তার চোখ দু’হাতে চোখ মুছে দিল। সিনাত্রা এক লাফে তার সামনে এসে ফেট্টি কাপড় দিয়ে ওর মুখ বেঁধে ফেলল। দু’জন প্রহরীর মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বেরোতে লাগল।
বাইরের যোদ্ধা দু’জন তরোয়াল খাপ থেকে খুলে নিয়ে ছুটে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। বিনেলো সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রহরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কাঁধে ছোরা বসিয়ে দিল। প্রহরীটি তরোয়াল ফেলে দিয়ে বসে পড়ল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে তরোয়াল তুলে নিল। অন্য প্রহরীটা ফ্রান্সিসের মাথা লক্ষ্য করে তরোয়াল চালাল। ফ্রান্সিস তৈরিই ছিল। এখন লড়াইয়ের সময় নেই। দ্রুত প্রহরীটিকে পরাস্ত করতে হবে। ফ্রান্সিস প্রচন্ড বেগে তার তরোয়ালের ঘা মারল। প্রহরীর হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গেল। বিনো সঙ্গে সঙ্গে সেই তরোয়ালটা তুলে নিল।
সিনাত্রা ছুটে এসে আহত প্রহরীটির মুখ বেঁধে ফেলল। অন্য প্রহরীটিকে তখন কয়েকজন ভাইকিং চেপে ধরেছে। তার মুখ ফেট্টির কাপড় দিয়ে বাঁধা হল। চারজনের মুখই বাঁধা পড়ল। ফ্রান্সিস প্রহরী আর যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল–কেউ টু শব্দটি করবে না। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–পালাও-জলদি। বন্ধুরা খোলা দরজার দিকে ছুটল। রাজা এনিমার হাঁ করে এসব দেখছিলেন। আতলেতা রাজার কাছে এসে বলল–মাননীয় রাজা বেরিয়ে আসুন–তাড়াতাড়ি।
রাজা উঠে দাঁড়িয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত কয়েদঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। কার্তিনার যোদ্ধাদের ঘর থেকে বেরোতে দিল না ফ্রান্সিস। নিজে বাইরে এসে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিল। চাবি নেই। ঝোলানো তালাতেই কাজ চলবে।
সবাই বাইরের ছোট মাঠটায় এল। ফ্রান্সিস ডেকে বলল–আতলেতা কোনদিকে পালাবো?
পশ্চিম দিকে। পাহাড়ে জঙ্গলে। চলো সব। আতলেতা বলে উঠেই বড় রাস্তা দিয়ে পশ্চিমদিকে ছুটল। পেছনে আর সবাই। বিনেলো শাঙ্কোকে প্রায় জড়িয়ে ধরে ছুটল। চাঁদের আলো উজ্জ্বল। সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সবাই ছুটে চলেছে। সিনাত্রা রাজাকে ছুটতে সাহায্য করছে। ফ্রান্সিস আগেই ওদের এই দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছে।
সবাই হাঁপাচ্ছে তখন।
ফ্রান্সিস পিছনে তাকিয়ে দেখল দূরে সৈন্যরা ছুটে আসছে। ততক্ষণে ফ্রান্সিস বনের গাছগাছালির কাছে চলে এসেছে।
অল্পক্ষনের মধ্যেই সবাই অন্ধকার বনভূমিতে ঢুকে পড়ল।
পেছনে দূর থেকে সৈন্যদের হৈ হল্লা শোনা যাচ্ছে। বনের মধ্যে ভাঙা জ্যোৎস্না পড়েছে। কখনও বড় বড় গাছের গুঁড়ির ওপর পা রেখে কখনো পাশ কাটিয়ে ফ্রান্সিসরা বনের মধ্যে যেতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে সৈন্যদের হৈ হল্লা আর শোনা গেল না।
হঠাৎ সামনে একটা আধভাঙা ঘর। আতলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–এই মন্দিরেই আশ্রয় নেওয়া যাক। এই মন্দিরে রাজা এনিমারের কুলদেবতা প্রতিষ্ঠিত আছেন। রাজা এখানেই প্রতি শনিবার সকালে পূজো দিতেন।
সবাই মন্দির ঘরে ঢুকল। লম্বাটে ঘরটার এক কোনায় উঁচু পাহাড়ের বেদী। তার উপর একটা পাথরের এবড়ো খেবড়ো মূর্তিমত। কিছুটা ভাঙা চালা দিয়ে জোৎস্না পড়েছে। মূর্তির সামনে ফুলপাতা ছড়ানো।
এবড়োখেবড়ো পাথরের মেঝেয় সবাই বসে পড়ল। সবাই হাঁপাচ্ছে। রাজা এনিমার বেদীর কাছে গিয়ে বসে পড়লেন। বেদী ছুঁয়ে হাতটা বুকে রাখলেন।
ফ্রান্সিস দ্রুত শাঙ্কোর কাছে এল। বলল–শাঙ্কো—তুমি–। ওকে থামিয়ে দিয়ে শাঙ্কো হেসে বলল–আমি ঠিক আছি। আমার জন্যে ভেবো না। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না।
এবার ফ্রান্সিস হ্যারির কাছে এল। দেখল হ্যারি শুয়ে পড়েছে। হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–ওরা হয়ত আমাদের খোঁজে এখানে আসবে।
উঁহু। এখন নয়। কাল সকালে আসবে। দিনে তবু কিছু আলো পাবে। তখনই খোঁজা সুবিধে। এখন তো বনতল অন্ধকার। ফ্রান্সিস হ্যারির পাশে শুয়ে পড়ল।
রাতে কারো খাবার খাওয়া হয়নি। খাবারভর্তি কাঠের গামলা প্রহরীর মুখে ছুঁড়ে ফেলে ফ্রান্সিসরা পালিয়েছে। কাজেই সবাই ক্ষুধার্ত।
ফ্রান্সিস শুয়ে শুয়ে এই খাবারের সমস্যার কথাই ভাবছিল। একটু পরে ডাকল হ্যারি?
-বলো।
–আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। ফ্রান্সিস বলল।
-হ্যাঁ।
কতদিন বনে জঙ্গলে পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতে হবে বুঝতে পারছি না। সুতরাং খাবারের জোগাড় রাখতে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো খাবারের দোকান থেকে সেসব চুরি করে বা সোনার চাকতির বিনিময়ে কিনে আনতে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
-পারবে? হ্যারি একটু সংশয়ের সঙ্গে বলল।
–সেটা সদর রাস্তায় না গেলে বুঝতে পারছি না। মনে হয় রাজা কার্তিনার সৈন্যরা সৈন্যাবাসে চলে গেছে। অন্ধকার বনে জঙ্গলে-আমাদের খোঁজ পাবে না। কাজেই সকালের জন্যে ওরা অপেক্ষা করবে। এই সুযোগে আমাদের খাবার জোগাড়– করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে লুকিয়ে নগরে যেতে হয়। হ্যারি বলল।
–তাই যাবো। আজ রাতের মধ্যেই কাজটা সারাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
বন্ধুদের ডাকো। হ্যারি বলল।
–না। শুধু আমি একা যাবো। রাজা এনিমারের জন দশেক সৈন্য নিয়ে। আমরা বিদেশী দোকানদাররা আমাদের চিনে ফেলবে। রাজা এনিমার সৈন্যরা গেলে দোকানদারের মনে কোন সন্দেহ হবে না। সহজেই আটা ময়দা চিনি পাওয়া যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ তো। তুমিই ওদের নিয়ে খাবারের জিনিসপত্র আনো। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে বসল। আতলেতার কাছে গেল। আতলে শুয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল–আতলেতা–ওঠ। কাজ আছে। আতলেতা উঠে বসল।
–তুমি নগরের আটা ময়দার দোকান তো চেনো। ফ্রান্সিস বলল।
— হ্যাঁ হ্যাঁ। আতলেতা মাথা কাত করে বলল।
–সে সব আনতে যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–এখন? আতলেতা জানতে চাইল।
–হ্যাঁ আজ বাকি রাতের মধ্যেই আনতে হবে। তুমি কয়েকজন তোমাদের সৈন্য নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলো। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু–আতলেতাকে থামিয়ে ফ্রান্সিস বলল
-কোন কিন্তু নয়। আমরা সবাই ক্ষুর্ধাত। না খেয়ে লড়াই করা যাবে না। খাদ্য চাই। যাও কয়েকজনকে নিয়ে এসো।
–বেশ। চলো। আতলেতা বলল। তারপর শুয়ে বসে থাকা কয়েকজন সৈন্যকে ডাকতে গেল।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোর কাছে এল। বলল–শাঙ্কো এখন কেমন আছো?
–অনেকটা ভালো আছি। শাঙ্কো বলল।
-শোন–খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি চারটে সোনার চাকতি দাও। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টিতে গোঁজা চারটে সোনার চাকতি বের করে ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস দেখল কয়েকজন সৈন্যকে সঙ্গে দিয়ে আতলেতা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস তরোয়ালটা ভাল করে কোমরে গুঁজে নিলো।
ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সবার আগে আতলেতা চলল। ফ্রান্সিসরা পিছন পিছন চলল।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বনাঞ্চল শেষ। সবাইকে গাছের আড়ালে রেখে ফ্রান্সিস বড় রাস্তাটায় এসে দাঁড়াল। চাঁদের আলোয় যতদূর দৃষ্টি যায় দেখল। রাজা কার্তিনার সৈন্যদের চিহ্নমাত্র নেই। ফ্রান্সিস হাত নেড়ে সবাইকে ডাকল।
বড় রাস্তার ধার দিয়ে ফ্রান্সিস চলল। পিছনে আতলেতারা।
দুধারে দোকানপাট শুরু হল। ফ্রান্সিস দূরে নজর রেখে চলল। বেশ দূরে রাস্তায় রাজা কার্তিনার কয়েকজন সৈন্যের নড়াচড়া লক্ষ্য করল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা থেকে একটা দোকানের পেছনে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আতলেতা সৈন্যদের নিয়ে এসে ফ্রান্সিসের পিছনে দাঁড়াল। ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে চলা শুরু হল। আরোও বেশ কিছুটা গিয়ে ফ্রান্সিস নিম্নস্বরে বলল–আতলেতা–দোকানটা কোথায়?
এসে গেছি। ঐ খেজুর গাছটার নিচে। আতলেতা মৃদুস্বরে বলল। খেজুর গাছের কাছে এসে দাঁড়াল সবাই। ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টি থেকে সোনার চারটে চাকতি বার করে আতলেতাকে দিল। বলল–আটা ময়দা চিনি ছাড়াও মাটির বড় হাঁড়ি কাঠের বড় থালা একখন্ড কাঠের ছোট পাটাতন কাঠের কিছু গ্লাস এসব লাগবে। দোকানদারকে দিয়েই একটু তাড়া দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ সারবে। হাতে সময় কম।
–তুমি যাবে না? আতলেতা বলল।
–না আমি এই খেজুর গাছের নীচে তোমাদের অপেক্ষায় থাকব। ফ্রান্সিস বলল।
আতলেতা এগিয়ে গিয়ে দোকানের পিছনে কাঠের দরজায় টোকা দিল। বারকয়েক টোকা দিতে দরজা খুলে গেল। দোকানদার এসে দাঁড়াল। আতলেতার সঙ্গে তার কথাবর্ত হল। আতলেতা সৈন্যদের নিয়ে পিছন দিয়ে দোকানে ঢুকল।
ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে রইল। অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষনের মধ্যেই সৈন্যরা কাঁধে আটা ময়দা চিনির বস্তা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। একটু পড়ে আতলেতার সঙ্গে বাকিরাও বেরিয়ে এল। হাঁড়ি কাঠের ছোট পাটাতন গ্লাস এসব নিয়ে। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলে উঠল–জলদি চলো সব। এ এক মুহূর্ত দেরি নয়।
সবাই জিনিসপত্র নিয়ে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বনভূমির দিকে চলল। ঝোঁপজঙ্গ লের মধ্যে দিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে ওরা তো সৈন্য। কষ্ট গায়ে মাখল না। চলল সবাই।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বনের ধারে এসে পৌঁছল সবাই। ফ্রান্সিস পেছনে ফিরে তাকাল। রাজা কার্তিনার সৈন্যদের দেখা নেই।
আধ-ভাঙা মন্দিরঘরের এসে পৌঁছল সবাই। ফ্রান্সিস বন্ধুদের কাছে এসে বলল–সবাই যাও। উনুনের জন্যে পাথর কাঠকুটো জোগাড় করে আনন। ভোরের আগেই খাওয়া সেরে নিতে হবে। জদি।
বন্ধুরা বেশ কয়েকজন উঠে দাঁড়াল। ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। চলল কাঠকুঠো পাথর জোগাড় করতে।
সেসব জোগাড় করে ফিরে এল অল্পক্ষনের মধ্যেই। ফ্রান্সিস দুই রাধুনি বন্ধুকে বলল রান্নায় লেগে পড়।
জল চাই। একজন রাঁধুনি বলল। আতলেতা পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বলল– ঝর্না আছে দুটো। হাঁড়ি নিয়ে চলো। হাঁড়ি নিয়ে একজন আতলেতার সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
ভোরের আগেই রুটি তৈরী হয়ে গেল। চিনি দিয়ে রুটি খেল সবাই। রাজাও খেল। যাহোক ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর হল।
ওরা খাচ্ছে তখনই গাছে গাছে পাখির ডাক শুরু হল। বোঝা গেল, ভোর হয়ে এসেছে।
ভোর হল। সবাই শুয়ে শুয়ে বসে বিশ্রাম করতে লাগল। কিছু পরেই ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। একটু উঁচু গলায় বলল–উঠে পড়ো সবাই। এখানে থাকলে আমরা ধরা পড়ে যাবো। এই মন্দিরের ঘর কার্তিনার সৈন্যরা চেনে। ভুলে যেও না আমাদের মাত্র দু’জনের হাতে তরোয়াল আছে। বাকি সবাই নিরস্ত্র। আমাদের আত্মগোপন করতে হবে।
— ফ্রান্সিস—একটা গুহা আছে। আতলেতা বলল।
–না। ওখানে নয়। গুহার কথাও ওরা জানে। ঘন বনের এলাকাটা কোনদিকে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
-একটা সরোবর আছে। তার পূর্বদিকে বন খুব ঘন। বড় বড় গাছলতাপাতার সংখ্যাটা বেশি। নিচে দিয়ে হাঁটাই যায় না। আতলেতা বলল।
–ওখানেই চলো সব। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই উঠে দাঁড়াল। সারা রাত ঘুম নেই করো। শরীর একটু দুর্বল লাগছে সবারই। কিন্তু উপায় নেই। সবাই নিরস্ত্র। কার্তিনার সৈন্যরা এলে ধরা পড়তে হবে সহজেই। এসব কথা ভাবতে হল সবাইকে। রাজা এনিমার উঠে দাঁড়ালেন। আতলেতার পেছনে পেছনে চলল সবাই।
বেশ কিছুটা যেতে দেখা গেল সামনেই একটা সরোবর। সকালের আলো পড়ে। জলে মৃদু ঢেউ চিকচিক্ করছে। সরোবরের ডানপাশে জঙ্গলে ঢুকল সবাই। সত্যিই গভীর বন। বড় বড় গাছের জটলা। একফোঁটাও রোদ ঢুকছে না। অন্ধকার বনতল। মোটা মোটা গাছের গুঁড়িতে পা রেখে অথবা কোনরকেমে পাশ কাটিয়ে একটা একটু ফাঁকা জায়গায় এল সবাই। অতলেতা বলল–এখানেই বিশ্রাম নেব। চারধারে বড় বড় গাছ। নজরে পড়ার কোন সম্ভবনা নেই। সবাই এখানে ওখানে বসল। কেউ মোটা দুলছে এমন লতায় কেউ গাছের গুঁড়িতে কেউ ঝরাপাতার স্কুপের ওপর। সবাই কম বেশি হাঁপাচ্ছে তখন। রাজা এনিমার বসলেন একটা গাছের গুঁড়িতে। কেউ কোন কথা বলছে না।
তখন একটু বেলা হয়েছে। হঠাৎ দূরে ঐ মন্দিরঘরের দিকে রাজা কার্তিনার সৈন্যদের ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকির শব্দ কিছুটা অস্পষ্ট শোনা গেল। বোঝা গেল ফ্রান্সিসের অনুমান ঠিক। ওরা সকলেই ফ্রান্সিসদের খুঁজতে বেরিয়েছে।
হঠাৎ রাজা এনিমার গাছের গুঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ালেন। একটু গলা চড়িয়ে বললেন–তোমরা এখানেই থাকো। আমি রাজা কার্তিনার হাতে ধরা দিতে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস শুকনো পাতার স্তূপের উপর বসেছিল। দ্রুত উঠে রাজার কাছে ছুটে এল। বলল–আপনি কী বলছেন? আপনি ধরা দিলে রাজা কার্তিনা আপনাকে ফাঁসি দিতে পারে।
–দিক। লড়াইতো বন্ধ হবে। আর কারো প্রান যাবে না। রক্তপাত বন্ধ হবে। রাজা বললেন।
–আপনি ধরা দিলে রাজা কার্তিনা নির্বিঘ্নে আপনার প্রজাদের হত্যা করতে মরীয়া হয়ে উঠবে। ফ্রান্সিস বলল।
–না-না। ও এই লাগাস রাজত্বে রাজা হবে। আর নরহত্যা করবে না। রাজা। বললেন। ফ্রান্সিস নানাভাবে রাজা এনিমাকে বোঝাতে লাগল। কিন্তু রাজা এনিমা নিজের সিদ্ধান্তে অটল। ফ্রান্সিস আতলেতাকে বলল-ভাই তুমি রাজাকে বোঝাও। আতলে মৃদুস্বরে বলল তুমি রাজা এনিমাকে জানোনা। ওর সঙ্কল্প থেকে কেউ ওকে নড়াতে পারবে না। তখন ফ্রান্সিস রাজাকে বলল–মান্যবর রাজা আমার অনুরোধ–আজকের রাতটা আমাকে সময় দিন। যা করবার কালকে করবেন।
–দেখ–তোমরা বিদেশী–আমার জন্যে তোমরা প্রান দেবে কেন? রাজা বললেন।
আমরা সবাই মারা যাবো এটা ভাবছেন কেন? আমরা পরিকল্পনা মত এগোব। যাতে একজন যোদ্ধাও মারা না যায়। তার জন্যে সাবধান হব আমরা। আর আমাদের দু’একজন বন্ধু যদি লড়াই করতে গিয়ে মারা যায় বা আহত হয় তার জন্যে আপনাকে আমরা দোষী মনে করব না। তাই আবার অনুরোধ করছি আজ রাতটা আমাকে সময় দিন। রাজা মাথা নিচু করলেন। কিছুক্ষণ ভাবলেন। মাথা তুলে বললেন–ঠিক আছে। আজকের রাতটাই তোমাকে সময় দিলাম। কিন্তু যাই করনা কেন কেউ যেন মারা না যায়।
কিন্তু মান্যবর রাজা লড়াই হবেই। ওরা সহজে আত্মসমর্পন করবে না। তবে কেউ যাতে মারা না যায় সেভাবেই লড়াই চালাব আমরা। তবে আহত হতে পারে। এটা আপনাকে মেনে নিতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
-বেশ। মৃত্যু না হলেই হল। রাজা বলল।
–কিন্তু ওরা তো মারা যেতে পারে আহত হতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
–তার দায়িত্ব ওদের রাজার কার্তিনার আমার নয়। রাজা বললেন।
যাইহোক রাজা এনিমাকে তাঁর সংকল্প থেকে সরাতে পেরেছে এই ভেবে ফ্রান্সিস খুশি হল। তবে দায়িত্ব বাড়লো। মাত্র আজ রাতের মত সময়টুকু পেল। রাজা কার্তিনাকে যুদ্ধে হারাতে হবে। তার জন্যে পরিকল্পনা চাই। বেশ ভেবে চিন্তে আক্রমণ করতে হবে। জয়ী হতেই হবে। ভরসা এইটুকুই যে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বন্ধুরা রয়েছে। রাজা এনিমার সৈন্যরাও রয়েছে। লড়াইটা প্রায় সমানে সমানেই হবে। আর একটা বড় সমস্যা ভাবতে হচ্ছে। ওরা দু’জন বাদে সবাই নিরস্ত্র। যে করেই হোক রাজা এনিমারের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র জোগাড় করতে হবে। এটা করতে পারলে অর্ধেক লড়াই জেতা হয়ে যাবে। লড়াই করতে হবে বুদ্ধি খাটিয়ে যাতে আমাদের হতাহতের সংখ্যা কম হয়।
রাজা এনিমার নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। সবাই নিশ্চিন্ত হল। ফ্রান্সিস হ্যারির কাছে এল। ও যা ভাবছে সব বলল। সব শুনে হ্যারি বলল–চোরাগোপ্তা আক্রমন চালাতে হবে। আমাদের লোকক্ষয় যাতে কম হয় অথবা একেবারেই যাতে না হয়।
হ্যাঁ। দায়িত্বটা বেড়ে গেল। এখন চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্যে আমাদের তৈরী হতে হবে।
হঠাৎ আরো দূরে রাজা কার্তিনার সৈন্যদের হৈ হল্লা খুব অস্পষ্ট শোনা গেল। আতলেতা কাছেই বসে ছিল। বলল–গুহার কাছে গেছে ওরা। ভেবেছে ঐ গুহাতেই আশ্রয় নিয়েছি আমরা।
–বলছিলাম কি না যে গুহায় আশ্রয় নেওয়া চলবে না। ধরা পড়ে যাবো। নিরস্ত্র অসহায় আমরা। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল। রাজা কার্তিনার সৈন্যরা হয়ত বনের মধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে। কিন্তু এদিককার গভীর বনের দিকে ওরা এল না। বোধহয় বুঝে নিল ফ্রান্সিসরা পাহাড় ডিঙ্গিয়ে চলে গেছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। সকলেই ক্ষুধার্ত সেই রাতে শুধু রুটি খাওয়া হয়েছে।
ফ্রান্সিস ঝরা পাতার স্তূপের উপর বসে ছিল। এবার উঠে দাঁড়াল। একটু গলা চড়িয়ে বলল–মন্দিরঘরে চলো সবাই। আগে খেয়ে বিশ্রাম করে নিতে হবে। রাতে ওদের আক্রমন করতে হবে। চলো।
গভীর বনের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিসদের চলা শুরু হল। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল–দেখবে যাতে কম শব্দ হয়।
বেশ সাবধানে চলল সবাই। সবার আগে ফ্রান্সিস আর বিনেলো খোলা তরোয়াল হাতে চলল। তরোয়াল দিয়ে জংলা ঝোঁপের গাছ লতা কাটতে কাটতে চলল।
মন্দির ঘরের কাছাকাছি এসে ফ্রান্সিস হাত তুলে সবাইকে দাঁড়িয়ে পড়তে ইঙ্গি। ত করল। তারপর এক গাছের আড়ালে আড়ালে মন্দিরঘরের খুব কাছে চলে এল। একটা গাছের আড়াল থেকে দেখল মন্দিরঘরে ধারে কাছে কার্তিনার কোন সৈন্য নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। মন্দিরঘরের মধ্যেও কোন শব্দ হচ্ছে না।
ফ্রান্সিস ফিরে এসে চাপা গলায় বলল–ওরা চলে গেছে। সবাই মন্দিরঘরে এসো।
সবাই মন্দিরঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস আর বিনেলো খোলা তরোয়াল হাতে মন্দিরঘরে আস্তে আস্তে ঢুকল। দেখল মন্দিরঘর জনশূন্য। ফ্রান্সিস মুখ ফিরিয়ে বলল–এসো সবাই।
সবাই ঘরে ঢুকল। মেঝেয় বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস বন্ধু রাঁধুনি দু’জনকে বলল–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুটি করো। রুটি চিনি খাওয়া হবে।
রাঁধুনি বন্ধুরা রান্নায় লেগে পড়ল। উনুন জ্বালা হল। কাঠের পাটাতনে আটাময়দা মাখা চলল। ভাগ্য ভাল রাজা কাৰ্জিার যোদ্ধারা হাঁড়ি উনুন ভেঙ্গে দিয়ে যায়নি। অনেক তাড়াতাড়ি রুটি করা হল। চিনি দিয়ে রুটি খাওয়া হল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে সবাই শুয়ে বিশ্রাম করতে লাগল। শুধু রাজা এনিমার মন্দিরঘরের বেদীর কাছে চুপ করে বসে রইলেন। ফ্রান্সিস তাঁর কাছে এল। বলল মান্যবর–আপনি একটু বিশ্রাম করে নিন। আপনি কিন্তু আমাদের সঙ্গে যাবেন না। আপনি এখানেই থাকবেন ঘুমোবেন।
–না–রাজা মাথা নাড়লেন–আমি তোমাদের সঙ্গে যাবো। আমার জন্যে তোমরা জীবন বিপন্ন করবে আর আমি এখানে নিশ্চিন্তে ঘুমাবো এটা হয় না। আমি অবশ্য লড়াই করতে ভাল জানি না। তবু আমি তোমাদের কাছাকাছি থাকব।
–বেশ। আপনার যেমন ইচ্ছে। তবে চেষ্টা করবেন যেন ওদের হাতে ধরা না পড়েন।
–আমার জন্যে ভেবো না। রাজা বললেন।
এবার ফ্রান্সিস নিজেও শুয়ে পড়ল। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়ল। তবে বেশির ভাগ বন্ধু আর রাজার সৈন্যরা জেগেই রইল।
রাত গভীর হল। ফ্রান্সিসের একটু তন্দ্রা মত এসেছিল। পরক্ষণেই তন্দ্রা ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল–তুমি থাকো।
–বেশ। শাঙ্কো বলল। সবাইকে নিয়ে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে মন্দিরঘর থেকে বেরিয়ে এল। সবশেষে রাজাও চললেন। প্রায় অন্ধকার বনতল দিয়ে সবাই চলল।
বন শেষ। সামনেই সদর রাস্তা। দোকান ঘরগুলোর পেছনের ঝোঁপঝাড় দিয়ে সবাই চলল। ফ্রান্সিস কাউকে সদর রাস্তায় উঠতে দিল না। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় সবই দেখা যাচ্ছিল।
রাজবাড়ির কাছাকাছি এসে দেখল রাজবাড়ির দেউড়িতে দু’জন প্রহরী রয়েছে। এ ফ্রান্সিস রাজবাড়ির পেছনে দিয়ে ঘুরে চলল। তারপর রাজবাড়ির পাশে এল। দেখল সৈন্যবাসের সামনে মশাল জ্বলছে। সামনের মাঠে বা সদর রাস্তায় কোন সৈন্য নেই। ফ্রান্সিস আশ্বস্ত হল।
এবার ফ্রান্সিস শুধু বিনেলোকে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়ির ছায়ায় ছায়ায় অস্ত্রঘরের কাছে। এল। দেখল দু’জন প্রহরী বর্শা হাতে অস্ত্রাগার পাহাড়া দিচ্ছে। ফ্রান্সিস একটুক্ষণ লক্ষ্য করে চাপা গলায় বলল–আমি বাঁদিকেরটা তুমি ডানদিকেরটা। লড়াইয়ের জন্যে সময় দেবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের আহত করবে। চলো।
দ্রুত ছুটে গিয়ে দুজনে দুই প্রহরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাঁদিকের প্রহরীটি ফ্রান্সিসের তরোয়ালের কোপ বাঁ কাঁধে পেয়ে বসে পড়ল। ফ্রান্সিস এক ঝটকায় ওর হাত থেকে বর্শা কেড়ে নিল। বর্শার ছুঁচোলো মুখ ওর বুকে ঠেকিয়ে বলল–একেবারে শব্দ করবে না। কয়েদঘরে গিয়ে ঢোকো। প্রহরীটি বাঁ কাধ ডান হাতে দিয়ে চেপে বিকৃতমুখে কয়েদঘরের দিকে চলল। ততক্ষণে বিনেলো অন্য প্রহরীটির পায়ে তরোয়ালের ঘা মেরেছে। প্রহরীটি পা দুহাত চেপে বসে পড়েছে। ফ্রান্সিস তাকেও কয়েদঘরের দিকে নিয়ে চলল। দু’জনকেই খোলা দরজা দিয়ে কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দিল। দরজার পাশে বড় তালাটা ঝুলছিল। দরজা আস্তে বন্ধ করে কড়ায় তালা ঝুলিয়ে দিল। চাপাস্বরে বলল–কোনরকম শব্দে করলেই মরবে। একেবারে চুপ করে থাকবে। এবার অস্ত্রঘরের চাবিটা দাও। একজন কোমরের চামড়ার বন্ধনী থেকে চাবিটা খুলতে লাগল। ফ্রান্সিস তাড়া দিল–জদি। প্রহরীটি চাবি খুলে নিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে চাবিটা ফ্রান্সিসকে দিল।
ফ্রান্সিস ছুটল। অস্ত্রঘরের সামনে এল। পেছনে বিনেলো। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–সবাইকে ডাকো। তাড়াতাড়ি। বিনেলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সবাই অস্ত্রাগারের সমানে এল। ততক্ষণে ফ্রান্সিস দরজার তালা খুলে ফেলেছে। সবাই ঘরে ঢুকে তরোয়াল নিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। রাজবাড়ির আড়াল থেকে রাজা এনিমার এসব দেখতে লাগলেন।
সবাই তরোয়াল হাতে একত্র হলে ফ্রান্সিস সবাইকে চাপাস্বরে বলল–এবার আমরা সৈন্যাবাস আক্রমন করব। ওরা নিরস্ত্র এবং ঘুমন্ত। নিজের জীবন বিপন্ন না হলে কাউকে হত্যা করবে না। আহত করবে। চলো সব। এক মূহুর্ত দেরি করা চলবে না। সবাই খোলা তরোয়াল হাতে ছুটে মাঠ পার হয়ে সৈন্যাবাসের দরজার সামনে এল। ফ্রান্সিস বলে উঠল-লাথি মেরে দরজা ভাঙো। ওরা দরজায় লাথি মারতে লাগল। দরজা ভেঙে যেতে লাগল। রাজা কার্তিনার সৈন্যদের ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। বিছানায় উঠে বসে দেখল সামনে তরোয়াল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে হয় ভাইকিংরা নয় তো রাজা এনিমারের সৈন্যরা। রাজা কান্সিার নিরস্ত্র সৈন্যরা সহজেই হার স্বীকার করল।
–এদের মাঠে নিয়ে চলো। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল। রাজা কার্তানির সৈন্যরা স্বপ্নেও ভাবে নি এভাবে তারা পরাস্ত হবে। তখনও ওদের ঘুম কাটেনি। দু’তিনজন সৈন্য গাঁইগুই করছিল। তারা হাতে পায়ে তরোয়ালের ঘা খেল। আর বন্দী হতে আপত্তি করল না।
রাজা কার্তিনার সৈন্যদের মাঠে সারি দিয়ে দাঁড় করানো হল। ফ্রান্সিসরা ওদের ঘিরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস এই ভেবে স্বস্তি পেল যে ওদের কেউ মারা যায় নি বা তেমন আহত হয়নি। অভিযান সফল।
ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল–বিনেলা–সিনাত্রা–যাও দড়ি নিয়ে এসো। এদের হাত পা বাঁধো দু’জনে সৈন্যাবাসের দিকে ছুটল। খুঁজে খুঁজে পাকানো দড়ি নিয়ে এল। বিনেলো জামার তলা থেকে ছোরা বের করল। দড়ি কেটে কেটে টুকরো করতে লাগল। ভাইকিং বন্ধুরা দড়ি নিয়ে রাজা কার্তিনার সৈন্যদের হাত পা বাঁধতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার হাত পা বাঁধা হয়ে গেল। ফ্রান্সিস ওদের বসে পড়তে বলল। ওরা মাঠের ঘাসের ওপর বসে পড়ল।
রাজা এনিমার বেশ ক্লান্ত বোধ করলেন। সৈন্যাবাসের বারান্দায় বসে পড়লেন। ফ্রান্সিস তার কাছে এল। বলল–রাজা কার্তিনার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি। আপনিও চলুন।
–তাকে আর কী বলব বলো। রাজা বললেন।
–অন্তত এদেশ থেকে সসৈন্যে চলে যেতে বলতে পারেন। ফ্রান্সিস বলল।
-বেশ। চলো। রাজা উঠলেন। দু’জন রাজবাড়ির প্রধান প্রবেশপথের দিকে যাচ্ছে আতলেতা ছুটে এসে দু’জনের সঙ্গে চলল। ফ্রান্সিস দেখল কিন্তু কিছু বলল না।
প্রধান প্রবেশপথের সামনে আসতে প্রহরী দু’জন বেশ চমকাল। বর্শা বাগিয়ে ধরল। ফ্রান্সিস হেসে বলল–ও! তোমরা এখনও দেখো নি। এগিয়ে এসে মাঠের দিকে তাকাও। একজন বর্শা নিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেল। মাঠের মধ্যে বসে থাকা কার্তিনার বন্দী সৈন্যদের দেখল। ফ্রান্সিস আর আতলেতার হাতে খোলা তরোয়াল দেখে ওর মুখ শুকিয়ে গেল। ও পরিমরি সদর রাস্তার দিকে ছুটল। অন্য প্রহরীটিও ওকে পালাতে দেখে ওর পেছনে পেছনে ছুটল।
তিনজন প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকল। আর কোন প্রহরীর দেখা পেল না। সোজা রাজার শয়নকক্ষে এল। ঘুম থেকে উঠে রাজা কার্তিনা বিছানাতেই বসে পড়ল। মাথা নোয়ালো। ফ্রান্সিস পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল। বলল–সব জানি। আমাকে কি বন্দী করা হবে?
–সেটা রাজা এনিমার বলবেন। ফ্রান্সিস বলল।
কার্তিনা রাজা এনিমারের দিকে তাকাল। এনিমার বলল–দেখুন–আমি আপনার দেশ আক্রমণ করি নি। আপনিই আগ বাড়িয়ে আমার রাজত্ব জয় করতে এসেছিলেন। রাজা কার্তিনা বলল–যাক গে–আমি এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমার সৈন্যদের হাতপা–পায়ের বাঁধন খুলে দিতে হবে কিন্তু হাতের বাঁধন–খোলা হবে না। ফ্রান্সিস বলল।
ঠিক আছে। আমি বাঁধা অবস্থাতেই আমার সৈন্যদের নিয়ে যাবো। রাজা বলল।
–আর একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে আপনাকে। ফ্রান্সিস বলল।
–কী প্রতিজ্ঞা? রাজা কার্তিনা জানতে চাইল।
আপনি ভবিষ্যতে আর কখনও রাজা এনিমারের এই রাজ্য আক্রমণ করবেন না। ফ্রান্সিস বলল। একটুক্ষন চুপ করে থেকে কার্তিনার বলল–বেশ। প্রতিজ্ঞা করলাম।
–অবশ্য আপনি এই প্রতিজ্ঞা কতটা রাখবেন তাই নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ফ্রান্সিস বলল। রাজা কার্তিনা কোন কথা বলল না। এবার ফ্রান্সিস বলল, আপনি কখন এই রাজ্য ছেড়ে যাবেন?
-কালকে? রাজা কার্তিনা বলল।
-না। আজকে। এক্ষুনি। ফ্রান্সিস গলায় জোর দিয়ে বলল। রাজা কার্তিনা একটু থামল। তারপর মাথা কাত করে বলল–বেশ।
-পোশাক পাল্টে রাজবাড়ির বাইরে আসুন। ফ্রান্সিস বলল। তারপর রাজ এনিমারের দিকে তাকিয়ে বলল–মাননীয় রাজা–আপনি অন্তঃপুরে যান। আমরা দেখি কোথাও থাকবার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।
–না। তোমরা আমরা অতিথিশালায় থাকবে। রাজা এনিমার বললেন–চলো আমি তোমাদের অতিথিশালায় নিয়ে যাচ্ছি। আতলেতা বলল।
ফ্রান্সিস আতলেতাকে নিয়ে রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তখন ভোর হয়ে গেছে। রাজবাড়ির বাগানে পাখির ডাক শুরু হয়েছে। আকাশে চাঁদ নিষ্প্রভ হয়ে গেছে।
বন্ধুদের কাছে আসতে আসতে ফ্রান্সিস ডাকল–আতালেতা।
-বলো। আতলেতা ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকাল।
–বলছিলাম–রাজা সিয়াভোর গুপ্ত রত্ন ভান্ডার সম্বন্ধে তুমি কী জানো?
প্রোমিও নামে এক স্পেনীয় যুবকের লেখা একটা বইয়ের কথা শুনেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। বইটা বোধহয় রাজা কার্তিনার কাছে আছে। আতলেতা বলল।
–সেই বইটা আমার চাই। তুমি যদি বইটা জোগাড় কর আমাকে দাও তাহলে আমার খুব উপকার হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক সময়ে কথাটা মনে করিয়েছে। রাজা কার্তিনার কাছ থেকে আমি বইটা নিয়ে আসছি। তোমরা আমাদের কোন সৈন্যকে গিয়ে বল। সে তোমাদের অতিথিশালায় নিয়ে যাবে। আতলেতা বলল।
–বেশ। আর একটা অনুরোধ। তাড়াতড়ি কিছু খাবারের ব্যবস্থা কর। তুমি তো জানো কী খেয়ে আছি। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
-কিছু ভেবো না। রাজবাড়ির রাঁধুনিরা তো আর বন্দী হয়নি। কাজেই কিছু গরম খাবারের ব্যবস্থা যত তাড়াতড়ি সম্ভব করছি।
কথাটা বলে আতালে রাজবাড়ির দিকে চলে গেল।
মাঠে এসে ফ্রান্সিস দেখল বন্ধুরা মাঠে ঘাসের ওপর বসে আছে। রাজা এনিমারের সৈন্যরা সৈন্যবাসের দখল নিয়ে নিয়েছে। বন্দীরাও মাঠে বসে আছে। ফ্রান্সিস বিনোলোকে ডাকল। বলল–সৈন্যাবাসে যাও। ওদের কাছ থেকে জেনে এসো অতিথিশালাটা কোথায়? আর একটা কথা। একটু পরেই রাজা কার্তিনা এখানে তার বন্দী সৈন্যদের কাছে আসবে। তখন ঐ বন্দী সৈন্যদের পায়ের বাঁধন কেটে দিও।
–সেকি! ওরা তখন তো আমাদের আক্রমন করবে। বিনেলা বলল।
–পাগল। নিরস্ত ওরা ভালো মারেই করেই জানে খালি হাতে লড়াই করতে এলে ওরা মরবে। যাক গে–যা বললাম করো। ফ্রান্সিস বলল।
বিনেলো সৈন্যাবাসের দিক চলে গেল। তখন কয়েকজন কাঠের মিস্ত্রী সৈন্যাবাসের ভাঙা দরজা মেরামত করছিল।
ফ্রান্সিস হ্যারির কাছে এল। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাইসব–নিখুঁত পরিকল্পনা করে আমরা জয়লাভ করেছি। তোমাদের শৌয সাহসের জন্য ই এটা সম্ভব হল। আমাদের কেউ মারাও যায় নি আহতও হয়নি। আমাদের কাজ শেষ। এখন খাবার আনতে বলছি। আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। একটু পরেই রাজা কার্তিনা আসবে। তার সৈন্যদের নিয়ে এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে। তখন আমাদের কাজও শেষ হবে। তাই বলছিলাম দুপুরের খাবার খেয়ে তোমরা জাহাজে ফিরে যাও। আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি। এখানে এখন আমি থাকব আর আমার সঙ্গে থাকবে হ্যারি আর বিনোলা। এখন খাবার খেয়ে দু’জন পশ্চিমের বনভূমির মন্দিরঘরে চলে যাও। শাঙ্কো ওখানে রয়েছে। ওকে নিয়ে এসো। শাঙ্কো এখনও সম্পূর্ন সুস্থ নয়। জাহাজে ওর চিকিৎসার প্রয়োজন। ফ্রান্সিস থামল।
দু’জন ভাইকিং বন্ধু পশ্চিমের বনভূমির দিকে শাঙ্কোকে আনতে চলে গেল।
বিনেলো ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–অতিথিশালায় চলো। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–এখন অতিথিশালায় চলো। বিনেলো ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল। একজন ভাইকিং বন্ধু যেতে যেতে বলল–ফ্রান্সিস–আমরা কি তরোয়াল গুলো অস্ত্রঘারে রেখে আসব?
–না। এখনও আমরা বিপদ-মুক্ত নই। আগে রাজা কার্তিনা তার সৈন্যদের নিয়ে চলে যাক। তারপর আমরা অস্ত্র জমা দেব। ফ্রান্সিস বলল।
রাজবাড়ির উত্তর কোণায় অতিথিশালা। ফ্রান্সিসরা অতিথিশালায় ঢুকল। বেশ বড় ঘর। মেঝেয় দড়ি বাঁধা শুকনো ঘাসের বিছানামত। ভাইকিংরা কেউ কেউ বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস সটান শুয়ে পড়ল। তারপর হ্যারিকে কাছে আসতে বলল। হ্যারি ওর কাছে এল। ফ্রান্সিস বলল
–অতীতের রাজা সিয়াভোর রত্নভান্ডারের কথাতো শুনেছো।
-হ্যাঁ। তাই আমরা তিনজন থেকে যাবো। রাজা এনিমারের সঙ্গে এই নিয়ে কই কথা বলব। তবে আজ নয়। আজ বিশ্রাম। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ফ্রান্সিস একটু হাঁপিয়ে উঠে বলল।
কাল সকালে হয়ত রাজসভা বসবে। তখনই কথা বলব। হ্যারি বলল।
–তাই ঠিক করেছি। ফ্রান্সিস বলল।
তখনই রাজবাড়ির রাঁধুনিরা কয়েকজন কাঠের বড় বড় পাত্রের খাবার নিয়ে এল। আগে পাতা পেতে দিল। তারপর খাবার দিল। পাখির মাংসের ঝোল। ভাইকিংরা চেটে পুটে খেল। রাজবাড়ির রান্না। তার স্বাদই আলাদা। শাঙ্কোকে নিয়ে দুই বন্ধু এল। তারাও খেল।
তখনই ওরা দেখল- হাত বাঁধা বন্দী সৈন্যদের নিয়ে রাজা কার্তিনা চলে যাচ্ছে। তার মাথা নিচু। বোঝাই যায় এভাবে ছেড়ে যাবে তা কল্পনাও করতে পারেনি।
দুপুর হল। আর এক দফা খাবার এল। সবাই খেল। এবার ভাইকিংরা অস্ত্রঘরের তরোয়াল জমা দিয়ে জাহাজ ঘাটের দিকে দল বেঁধে চলল। ধ্বনি তুলল—ও–হো–হো।
সন্ধ্যের একটু পরে আতলেতা এল। হাতে একটা মোটা চামড়ার বই। বইটা ফ্রান্সিসের হাতে দিল। বলল–সেই স্পেনীয় যুবক পোমিওর লেখা বই। রাজা দিলেন।
ফ্রান্সিস শুয়ে ছিল। দ্রুত উঠে বসল। বলল–মনে হচ্ছে বইটা কাজে লাগবে। হ্যারির হাতে বইটা দিয়ে বলল–হ্যারি তুমি বইটা পড়ে যাও। আমি শুনি। হ্যারি বইটা নিল। চামড়া বাঁধাই বইটার মলাট ওল্টলো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা জনৈক জলদস্যুর কাহিনী। হ্যারি পড়তে শুরু করার আগে একটু পড়ে নিয়ে। বলল–পুরোন স্পেনীয় ভাষায় লেখা। শোন–আমার নাম প্রোমিও। অনেক দুঃখদারিদ্র্যের মধ্যে দিন কেটেছে আমার। স্পেনের সমুদ্র তীরবর্তী একটা ছোট বন্দরশহরে আমার জন্ম। জন্মবধি শুধু অভাবই দেখেছি আমি। বাবা ছিল সেই ছোট বন্দরের মোট বাহক। মা মারা গিয়েছিল। আমরা তিন ভাইবোন। আমি সকলের বড় ছিলাম। বাবা আমাকে একটা চাল-ভাঙা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। ছাত্র হিসাবে খারাপ ছিলাম না। কিন্তু বাবা তো আমাকে বই খাতাই কিনে দিতে পারত না। কাজেই স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধার নিতে হত। তারাও সব সময় বই দিত না। হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাস মাইনে দিতে না পেরে আমি বিপদে পড়লাম। স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিতে আর পাড়লাম না। শেষ পর্যন্ত বাবার কাজটা পেলাম। তখন আমি যুবক। মোট বাহকের কাজ করতে লাগলাম। বাবা সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিল। বন্দরের কর্তা আমাকে ছাড়িয়ে দিল।
আমার বয়সী যুবকদের দেখতাম সুখে আছে। কেউ কেউ বিয়ে করে সংসারীও হয়েছে। বড়লোকের ছেলেদের উদ্দাম আনন্দের জীবন দেখতাম। তখনই ভেবেছিলাম– বড়লোক হতে হবে। তখন এক যাত্রীবাহী জাহাজে কাজ নিলাম।
জাহাজের খালাসি হয়ে সমুদ্রে ভেসে পড়লাম। একঘেয়ে জীবন কাটতে লাগল। তখনই এক জলদস্যু দলের জাহাজের পাল্লায় পড়লাম আমরা। লড়াই করলাম। কিন্তু ওদের সঙ্গে পারলাম না। কিছু যাত্রীর সঙ্গে আমাদেরও অনেকে মারা গেল। তাদের কোনরকম শেষকৃত্য হল না। জলদস্যুদের ক্যাপটন পরে নাম জেনেছি সার্ভানো–সব মৃতদেহ ছুঁড়ে সমুদ্রে ফেলে দিতে আদেশ দিল। আদেশ পালিত হল। যাত্রীদের স্বর্ণমুদ্রা সহ জামাকাপড় সব লুঠ করা হল। আমি দেখলাম জলদস্যুতা করলে বড়লোক হতে পারব। আমি ক্যাপটেন সার্ভানোকে আমার ইচ্ছে জানালাম। আমি অভাবের মধ্যে মানুষ হলেও আমি দীর্ঘদেহী সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলাম। সার্ভানো আমাকে পছন্দ করল। জলদস্যুদের জাহাজে আশ্রয় নিলাম।
শুরু হল এক নতুন জীবন। যাত্রীবাহী জাহাজ লুঠ করা, যাত্রীদের বন্দী করে ক্রীতদাসের হাটে বিক্রী করা–লড়াই নরহত্যা–এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু বড়লোক হতে পারলাম না। লুন্ঠিত সবকিছুই ক্যাপ্টেন সার্ভানো নিজের কাছে নিয়ে নিত। বদলে আমাদের সামান্য কিছু দিত। অথচ লড়াই করছি আমরাই লুঠ করছি আমরাই আহত হয়েছি রক্ত হয়েছি আমরাই–সেই আমরাই বঞ্চিত হয়েছি।
তখন জলদস্যুদের পাকড়াও করতে বিভিন্ন দেশ থেকে নৌবাহিনী পাঠানো শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি জলদস্যুদের জাহাজ ধরা পড়েছে। সেই সব দেশে জলদস্যুদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের ফাঁসিও দেওয়া হয়েছে।
হতাশ আমি পাবার উপায় ভাবতে লাগলাম। ক্যাপ্টেনের সজাগ দৃষ্টি এড়িয়ে পালানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু আমি তখন মরিয়া হয়ে উঠেছি যদিও জানতাম ধরা পড়লে মৃত্যু।
সেসময় আমাদের জাহাজ একটা ছোট বন্দরের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। রাতও ছিল, অন্ধকার রাত। গভীর রাতে ডেক থেকে উঠে গড়াতে গড়াতে হালের কাছে। এলাম। দড়িদড়া ধরে জলে কোন শব্দ না তুলে জলে ডুব দিলাম। ভেসে উঠে দেখলাম জাহাজ বেশ দূরে চলে গেছে। অন্ধকার সমুদ্রে আস্তে আস্তে জলে কোন শব্দ না তুলে তীরের দিকে সাঁতরাতে লাগলাম। তীরের বন্দরে যখন পৌঁছলাম তখন ভোর হয় হয়। কোমরে আমার পুরোনো পোশাক বেঁধে এনেছিলাম। জল দস্যুর মার্কামারা পোশাক ছেড়ে সেই ভেজা পোশাক পরলাম।
বন্দরের দোকানপাট খুলছে তখন। একটা ছোট সরাইখানায় আশ্রয় নিলাম।
তারপর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের জীবন। এ জাহাজ সে জাহাজ কাজ নিয়ে এদেশে সেদেশে ঘুরে বেড়ালাম। কিছু স্বর্ণমুদ্রাও জমালাম।
অবশেষে এক জাহাজে চড়ে এলাম এই লাগাসে। আশ্রয় নিলাম এক সরাইখানায়। ভেবেছিলাম কয়েকদিন থাকব। মাটির ওপরতো বিশেষ থাকতে পারিনি। শুধু জলে জলেই দিন কেটেছে। কাজেই মাটির ওপর ভীষন টান আমার। কিন্তু এদেশ ছেড়ে যাওয়া হল না। একদিন একটা ঐতিহাসিক ঘটনা শুনলাম।
সেদিন রাজা এনিমারের রাজসভায় গেছি। রাজবাড়ি রাজসভা রাজাকে দেখতে। দেখলাম একটা শুনানি চলছে। অপরাধি এক পর্তুগীজ যুবকের বিচার চলছে। রাজা জিজ্ঞেস করলেন–তোমার নাম কী?
–কাবানা। যুবকটি বলল।
–তুমি কোন দেশের মানুষ? রাজা জানতে চাইলেন।
–পোর্তুগাল। কাবানা বলল।
–এই দেশে এসেছো কেন? রাজা জিজ্ঞেস করল।
মাননীয় রাজা জাহাজে আসার সময় এক বৃদ্ধ নাবিকের কাছে শুনেছিলাম এই লাগাসে অতীতের এক রাজার মহামূল্যবান গুপ্ত রত্নভান্ডার আছে। যুবকটি বলল।
— হ্যাঁ–রাজা সিয়োভোর গুপ্ত রত্ন ভান্ডার। কিন্তু সেসবের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? রাজা বললেন।
–আমি সেই রত্নভান্ডার উদ্ধার করার জন্যে চেষ্টা করছি। যুবক কাবানা বলল।
-বৃথা চেষ্টা। অতীতে সিয়াভোর পরে দু তিনজন রাজা সেই রত্নভান্ডার উদ্ধার করার জন্যে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কোন হদিশ পান নি। তুমি এখানে কয়েকদিনের মধ্যেই তা উদ্ধার করবে ভেবেছো?
–আমি চেষ্টা করব। আপনি অনুমতি দিন। কাবানা বলল।
–তোমার এই অপরাধের জন্যেই তোমাকে বন্দী করা হয়েছে। তুমি আমার অনুমতি না নিয়েই গোপনে রাজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছিলে। কেন? রাজা বললেন।
–গোপন রত্নভান্ডার খুঁজতে। কাবানা বলল।
–অথচ আমার কোন অনুমতি নাওনি। রাজা বললেন।
মাননীয় রাজা–আমি আমার অপরাধ স্বীকার করছি। আমাকে ক্ষমা করুন। গুপ্ত রত্নভান্ডার উদ্ধারের জন্যে আমাকে অনুমতি দিন। কাবানা বলল।
–বেশ। তুমি এখানে বিদেশী। তবু তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি। কিন্তু তোমার পরিশ্রম বৃথাই যাবে। রাজা এনিমার বললেন।
তবু আমি চেষ্টা করব। কাবানা বলল।
-করো চেষ্টা। কিন্তু অন্তঃপুরে আবার যেতে হলে দু’জন প্রহরী তোমার সঙ্গে থাকবে। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে। আপনার আদেশ শিরোধার্য। কাবানা বলল।
–কোথায় উঠেছো তুমি? রাজা এনিমার জানতে চাইলেন।
–এক সরাইখানায়। কাবানা বলল।
–না। সরাইখানায় থাকা চলবে না। আমার অতিথিশালায় আমার প্রহরীদের নজরের মধ্যে থাকবে। রাজা বললেন।
–কিন্তু আমাকে তো সারা রাজ্য ঘুরে বেড়াতে হবে। কাবানা বলল।
বেশ তো। ঘুরে বেড়াবার সময় একজন প্রহরী তোমার সঙ্গেই থাকবে। যদি গুপ্ত রত্নভান্ডার উদ্ধার করতে পারো তবে আর ঐ রত্নভান্ডার নিয়ে পালাতে পারবে না। রাজা এনিমার বললেন।
–ঠিক আছে। যেমন আপনার আদেশ। কাবানা বলল।
–যাও। একজন প্রহরী তোমাকে অতিথিশালায় নিয়ে যাবে। তোমাকে পাহারা দেবে। রাজা এনিমার বললেন।
একজন প্রহরীর সঙ্গে কাবানা বেরিয়ে গেল।
এই ঘটনা আমার মনে গভীর রেখাপাত করল। মনের বড়লোক হওয়ার ইচ্ছাটা মাথা চড়া দিল। আমিও চেষ্টা করে উদ্ধার করতে পারে কি না। সেটা করতে গেলে সমস্ত ঘটনাটা জানতে হবে। তার চেয়ে সহজ পথ কাবানাকে অনুসরন করা। ও কীভাবে খোঁজে সেটা আবিষ্কার করা। যদি ও সত্যিই সেই রত্নভান্ডার আবিষ্কার করতে পারে তখন ও কে আর যদি ওর সঙ্গে প্রহরী থাকে তাহলে দু’জনকেই মেরে রত্নভান্ডার নিয়ে পালাতে পারবো। একটা ছোরা সবসময়ই আমার কোমরে গোঁজা থাকে। আর ছোরা চালাতে আমি ওস্তাদ। তরোয়ালের দরকার নেই।
দুপুরে সরাইখানার খাওয়া সেরেই বেরিয়ে পড়লাম রাজার অতিথিশালায় খোঁজে। রাজবাড়ির দেউড়ির সামনে পাহারারত এক প্রহরীকে জিজ্ঞেস করতে সে আঙ্গুল তুলে রাজবাড়ির পেছনে বাঁদিকে একটা ঘর দেখিয়ে দিল।
আমি ঘরটার সামনে উপস্থিত হলাম। দেখলাম একজন প্রহরীদরজার সামনে পাহারা দিচ্ছে। প্রহরীটি আছে। তার মানে কাবানা এখন রত্নভান্ডার খুঁজতে বেরোয়নি। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঠিক সামনেই একটা বিরাট চেন্টনাট গাছ। আমি গাছের তলায় দাঁড়ালাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম–কখন কাবানা বেরোয়।
কিছুক্ষণ পরে কাবানা বেরিয়ে এল। আমি বেশ দূরত্ব রেখে কাবানা আর প্রহরীর পেছনে পেছনে চললাম।
বড় রাস্তা দিয়ে ওরা চলল পশ্চিমের পাহাড় জঙ্গলের দিকে। আমিও ওদের পেছনে চললাম। লক্ষ্য করলাম কাবানা একটা নেভানো মশাল নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বুঝলাম না। তারপর রাস্তাটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে দক্ষিণমুখো। ঐদিকে কাবানা গেল না। ও পাহাড়ের নিচের জঙ্গলে ঢুকল। আমিও একটু দূরত্ব রেখে ওদের পেছনে পেছনে চললাম। এখানে নগরের ভিড় নই যে লোকের আড়াল নেব। তাই সাবধানে চললাম।
ঘন বন। অন্ধকার। গাছ লতাপাতার আড়ালে আড়ালে চললাম। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরল ওরা। তারপর একটা আধভাঙা ঘরের কাছে এল। বুঝলাম না এখানে ঘর তৈরী হয়েছিল কীসের জন্যে? কাবানা ঘরের মধ্যে ঢুকল। প্রহরী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। আমি গাছের আড়ালে লুকোলাম।
কিছুক্ষণ পরে কাবানা বেরিয়ে এল। চলল পশ্চিমমুখে।
প্রায় অন্ধকার বনের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে সামনেই পাহাড়ের পাদদেশ। কাবানা পাহাড়ে উঠতে লাগল। পেছনে প্রহরী। আমিও পাথরের আড়ালে আড়ালে উঠতে লাগলাম। কিছুক্ষণে মধ্যেই দেখলাম একটা বড় গুহামুখ। এবার বুঝলাম কেন কাবানা একটা মশাল নিয়ে এসেছে। ও কোমর থেকে চমকি পাথর বার করল। পাথরে লোহার টুকরো ঠুকে মশাল জ্বালাল। তারপর জলন্ত মশাল হাতে গুহায় ঢুকল।
আমিও ওদের পেছনে পেছনে ঢুকলাম। মশালের আলো লক্ষ্য করে আমিও চললাম। মশাল হাতে কাবানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গুহার এবড়ো খেবড়ো পাথুরে গা দেখতে দেখতে চলল। ওদের এগোতে সময় লাগছিল। বেশ কিছুক্ষণ যাবার পর একটু দূর থেকে মশালের আলোয় দেখলাম গুহা শেষ। কাবানা সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। তারপর ফিরে আসতে লাগল। বুঝলাম এর আগে ও এখানে এসেছিল।
আমিও ফিরে দাঁড়িয়ে দ্রুত গুহার মুখের দিকে চললাম। আমার পায়ের শব্দ হল। কাবানা চেঁচিয়ে বলল–কে? গুহায় জোর শব্দ হল। আমি ততক্ষণে গুহার বাইরে চলে এসেছি। ছুটে গিয়ে একটা পাথরের চাইয়ের পেছনে গিয়ে লুকোলাম।
কিছুক্ষণ পরেই ওরা দুজনেই বেরিয়ে এল। আড়াল থেকে কাবানার মুখ দেখেই বুঝলাম ও গুপ্তধনের খোঁজ পায়নি।
দু’জন বনের মধ্যে ঢুকল। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে আমি ওদের পেছনে পেছনে আর গেলাম না। এখন আর ওদের অনুসরন করার কোন অর্থ নেই। কাবানার সব দেখা হয়ে গেছে। ও আর এখন অন্য কোথাও যাবে না। আমি এখানেই একটা ভুল করলাম। আমি অন্য পাশ দিয়ে বনের বাইরে রাস্তার কাছে এলাম। বনের আড়াল থেকে লক্ষ্য করলাম ওরা কখন বেরিয়ে আসে। কিন্তু অপেক্ষাই করতে লাগলাম। ওরা আর বেরিয়ে আসে না। তাহলে ওরা কি অন্য কোথাও গেল? কোথায় গেল?
আমি আবার বনের মধ্যে ঢুকলাম। ওদের খুঁজতে লাগলাম। দক্ষিণমুখো চললাম। বেশ কিছুটা যেতে হঠাৎ দেখি সামনে একটা হ্রদ। কাবানা আর প্রহরীটি জলের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্রুত জলের ধারে জংলা গাছের জঙ্গলের আড়ালে বসে পড়লাম। হ্রদের ধারে ধারে কাবানা একবার ডানদিকে একবার বাঁদিকে গেল। ঘুরে ঘুরে চারপাশ ভালো করে দেখল। তারপর দুজনেই ফিরে এল। বুঝলাম ও কিছু হদিশ করতে পারেনি। এবার আর আমি ভুল করলাম না। বনের মধ্যে দিয়ে ওদের পেছনে পেছনে আসতে লাগলাম। এখানে একটা হ্রদ আছে তা আমি জানতাম না। কাজেই আবার ওদের হারাই তাই ওদের দিকে লক্ষ্য রেখে বনের মধ্যে দিয়ে আসতে লাগলাম। কী জানি-কাবানা যদি অন্য কোথাও যায়?
বন শেষ। ওরা রাস্তায় উঠল। এবার আমি ওদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দিলাম। অল্প লোকই রাস্তায় যাতায়াত করছে। কাজেই ওদের ওপর নজর রাখার সুবিধে। হল।
নগরীর ভিড় শুরু হল। কাবানা আর অন্য কোথাও গেল না। সোজা অতিথিশালায় ঢুকল। তারপর কাবানা আর বেরোলো না দেখে সরাইখানায় ফিরে এলাম।
সেদিন রাতে খাবার আগেই আমি মহাবিপদে পড়লাম। বিপদে ফেলল আমার, ডান গালের আঁচিল। আমি জানতাম না জলদস্যু ক্যাপ্টেন সার্ভানো এই বন্দরেই জাহাজ ভিড়িয়েছে। জানতাম জলদস্যু এসব সময়ে জাহাজের মাথায় সাদা মরার হাড় আর মাথা আঁকা কালো পতকা নামিয়ে সাদা পতকা উড়িয়ে দেয়। কেউ ওদের জলদস্যু বলে চিনতে পারে না।
আমি যে জাহাজে চড়ে এসেছিলাম সেই জাহাজটা তখনও বোধহয় নোঙর করা ছিল। সেই জাহাজের কারে-কাছ থেকে আঁচিলওয়ালা আমার খোঁজ পেয়েছিল ক্যাপ্টেন সার্ভানো।
আমাকে ঠিক খুঁজে খুঁজে আমার সরাইখানায় এসে হাজির। সঙ্গে একজন সাধারন পোশাকের জলদস্যু। ক্যাপ্টেনের পোশাক ক্যাপ্টেনের মতই। ক্যাপ্টেন সার্ভানো তরোয়াল কোষমুক্ত করে আমার গলায় তরোয়ালের ডগাটা ঠেকিয়ে বলল–পালিয়েছিলে। এর শাস্তি তো জানো। জাহাজে চলো। বুঝলাম–রেহাই নেই। সরাইখানার লোকজন তার মারমূর্তি দেখে এগোতে সাহস করল না। আমি তখন অসহায়। বুঝলাম ক্যাপ্টনকে ঠেকাতে হলে গুপ্তধনের লোভ দেখাতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। আমি তখন বললাম–একটা গুপ্তধনের উদ্ধারের কাজে লেগেছি। এখন জাহাজে চলে গেলে গুপ্তধনের আশা ছাড়তে হবে।
গুপ্তধন? সার্ভানো বেশ চমকে উঠল। বলল-কোথায় সেই গুপ্তধন?
–সেটার খোঁজেই তো আমি এখানে আছি। সার্ভানো তরোয়াল কোষবদ্ধ করে আমার পাশে এসে বলল–সব ব্যাপারটা খুলে বলো তো?
আমি তখন অতীতের রাজা সিয়াভোর গুপ্ত রত্নভান্ডারের কথা কাবানাকে অনুসরনের কথা সব বললাম। ক্যাপ্টেন সার্ভানো খুশির ভঙ্গিতে উরুতে এক চাপড় দিয়ে বলল এইতো একটা খবরের মতো খবর দিলে। চলো–আমিও তোমার সঙ্গে থাকবো। গুপ্তধন উদ্ধার হলে দু’জনে ভাগাভাগি করে নিয়ে পালাবো।
এক্ষেত্রে কাবানাকে অনুসরন করতে হবে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আপনাকে এই মার্কামারা ক্যাপ্টনের পোশাক ছাড়তে হবে।
–ঠিক আছে। সঙ্গের জলদস্যুকে বলল– যাও আমার সাধারন পোশাক নিয়ে অ্যায়া আর সবাইকে বলবি জাহাজ এই বন্দরে থাকবে। আমি ফিরে গিয়ে জাহাজ ছাড়বো। সঙ্গী জলদস্যু চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সঙ্গী সার্ভানোর জন্যে সাধারন পোশাক নিয়ে এল। ওকে সার্ভানো চলে যেতে বলল–এখন তোমার সঙ্গে এখানেই থাকবো। রত্নভান্ডার নিয়ে জাহাজে ফিরবো।
পরের দিন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম। সার্ভানকে নিয়ে প্রায় ছুটে অতিথিশালার সামনে এলাম। চেস্টনাট গাছের নীচে দাঁড়ালাম দুজনে।
দাঁড়িয়ে আছি। কাবানার বেরোবার নাম নেই। চিন্তায় পড়লাম। তবে কি ও আগেই বেরিয়েছে। না–ঐতো কাবানা বেরিয়ে এল। পেছনে সেই প্রহরী।
এবার দুজনে চলল পূবমুখো সমুদ্রের দিকে। আমরাও পিছু নিলাম। ভাবলাম ওরা বোধহয় বন্দরে যাবে। দেখলাম ওরা বন্দরে এল না মরুভূমি মত বালিভর্তি এলাকায় এল। এখানে শুধু কাঁটাগাছ আর ফণিমনসার ঝোঁপ।
মরুভূমির মত শুধু বালি। সেই সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আমরা সহজেই কাবানার নজরে পড়তে পারি। তাই আমরা কখনও এইকাঁটা ঝোঁপ ঐফনীমনসার ঝোঁপের পিছনে আত্মগোপন করে করে চললাম।
কিছুদূর যেতেই দেখা গেল একটা পাথরের থামমত কী একটা বালির ওপর বেরিয়ে আছে। কাবানা ওখানে গিয়ে থামল। খুব মনোযোগ দিয়ে পাথরের থামটা চারপাশ দেখতে লাগল। ও হঠাত ফিরে দাঁড়ালেই আমাদের দেখতে পেত। তার আগেই আমি ক্যাপ্টেন সার্ভানোকে হাত টেনে ধরে একটা। মনসাঝোঁপের আড়ালে উবু হয়ে শুয়ে পড়লাম। ঠিক তখনই কাবানা প্রহরীকে কি বলতে বলতে পিছু ফিরে তাকাল। মনসাগাছের আড়ালে আমাদের দেখতে পেল না।
কিছুক্ষণ পাথরের থামটার কাছে দাঁড়াল কাবানা। তারপর এদিক ওদিক ঘুরে বালিভরা জায়গা দেখে পিছু ফিরল। ফিরে আসতে লাগল। ফনীমনসার গাছের আড়াল থেকে দেখলাম কাবানা কিছু গভীর ভাবে ভাবতে ভাবতে আসছে। ওকে কিছু আশান্বিত মনে হল।
ওরা যত এগিয়ে যেতে লাগল। আমরাও মনসা গাছের আড়ালে তত সরে সরে যেতে লাগলাম। ওরা আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। বালি এলাকা ছেড়ে বড় রাস্তার পাশয় গিয়ে ওরা পৌঁছালেই আমরা আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম। বড় রাস্তায় লোকজনের ভিড়। ওরা তারমধ্যে দিয়ে চলল। আমরাও অনুসরন করতে লাগলাম।
কাবানা আর কোথাও গেল না। অথিতিশালায় ঢুকে পড়ল। প্রহরীটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আমিও ফিরে আসব ভাবছি হঠাৎ কাবানা বেরিয়ে এল। খুব কাছে না থাকলেও শুনতে পেলাম কাবানা প্রহরীটিকে বলল–কালকে কখন রাজসভা বসবে?
দুপুরে। কাল শনিবার। রাজা বনে দেবপূজা করতে যাবেন। প্রহরী বলল।
–কখন। কাবানা জানতে চাইল।
–সকলে। প্রহরী বলল।
কাবানা আর কিছু বলল না। অতিথিশালায় ঢুকে পড়ল।
আমরা সরাইখানায় ফিরে এলাম। সার্ভানোকে বললাম মনে হচ্ছে কাবানা রাজার সঙ্গে কিছু দরকারি কথা বলবে। আমরাও রাজ সভায় যাবো। যেন নতুন এসেছি সব দেখে বেড়াচ্ছি।
সেভাবেই দুপুরে খাবার খেয়েই দুজনে রাজসভায় এলাম। তখন একটা বিচার চলছিল। আড়চোখে দেখলাম কাবানা প্রজাদের সঙ্গে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন কাবানার ডাক পড়ে।
একটা বিচার শেষ হল। মন্ত্রী তার আসন থেকে উঠে রাজাকে গিয়ে কিছু বললেন। রাজা এনিমার কাবানাকে এগিয়ে এসে মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–মাহামান্য রাজা শুনেছি সমুদ্রের তীরের কাছে নাকি প্রাচীন রাজধানী ছিল।
–ঠিক শুনেছে। প্রাচীন রাজধানী ওখানেই ছিল। পরে বালি পড়ে পড়ে ঐ রাজধানি বালির নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। রাজা বললেন।
–তাহলে তো রাজপ্রাসাদও ওখানে ছিল। কাবানা বলল।
–হ্যাঁ। তবে এখন তো সেই প্রাসাদ বালির নীচে। রাজা বললেন।
–আমি বালি তুলে ফেলে ঐ রাজবাড়ি উদ্ধার করতে চাই। কাবানা বলল।
কী লাভ তাতে? তাছাড়া ওখানে তো প্রাসাদের কোন চিহ্নই নেই। রাজা বললেন।
না। আছে। আমি একটা পাথরের থাম দেখেছি। ওখানে বালি খোঁড়ার অনুমতি আমাকে দিন। কাবানা বলল।
বেশ খুঁড়ে দেখো। রাজা বলল।
–তার জন্যে তিরিশ জন লোক দিন। তাদের দিয়ে বালি খোঁড়ার কাজ করাবো। তিরিশটা বেলচাও লাগবে। কাবানা বলল।
রাজা সেনাপতির দিকে তাকালেন বললেন–ওকে বালি খোঁড়ার কাজের জন্যে লোক দিন। সেনাপতি উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে আসন থেকে নেমে এল। কাবানার কাছে গিয়ে বলল–চলোলোক বেলচা দিচ্ছি। তবে সবটাই পন্ডশ্রম হবে।
–তবু আমি একবার খুঁড়ে দেখতে চাই। কাবানা বলল।
–বেশ। কাবানা সেনাপতির পেছনে পেছনে রাজসভা থেকে বেরিয়ে গেল।
আমরাও ওদের দুজনকে অনুসর করলাম। সেনাপতি যোদ্ধাদের আবাসে গেল। আমরা সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পরে তিরিশ জন যোদ্ধা বেলচা হাতে মাঠে এসে দাঁড়াল। সেনাপতি তাদের কাজের কথা বুঝিয়ে দিল। কাবানা যোদ্ধাদের নিয়ে সমুদ্রেরতীরের দিকে চলল। আমরাও অনুসরণ করতে লাগলাম। যেতে যেতে আমি সার্ভানোকে বললাম–বোঝাই যাচ্ছে বালি খোঁড়ার কাজ বেশ কিছুদিন ধরে চলবে। আত্মগোপনের জন্যে একটা ভাল জায়গা দেখে নিতে হবে। আমরা যেন কোনভাবেই কাবানার নজরে না পড়ি।
যোদ্ধাদের নিয়ে কাবানা সেই পাথরের থামের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কীভাবে কোথা থেকে বালি খুঁড়তে হবে সেটা বোঝাল।
আমি আর সার্ভানো সেই ফণীমনসার আর কাঁটাঝোঁপের আড়ালে শুয়ে পড়লাম। দৃষ্টি কাবানার দিকে। ওখানে থেকে কাবানার কিছু কথাবর্তাও শুনতে পাচ্ছিলাম।
যযাদ্ধারা বালি তোলার কাজে লাগল। বেলচা দিয়ে বালি তোলা আর একপাশে সমুদ্রের দিকে বালি ফেলা। বালির স্তূপ হতে লাগল।
কাজ চলল। বুঝলাম এত বালি তুলতে সময় লাগবে। তবে যোদ্ধারা কর্মঠ এবং সংখ্যায়ও বেশি। বেশিদিন লাগার কথা নয়।
দুপুর হল। এখন খাওয়ার সময়। কাবানার নির্দেশে যোদ্ধারা নগরের দিকে ফিরে আসতে লাগল। আমরা শুয়ে থেকে বালির এদিক ওদিক সরে সরে অতগুলো লোকের নজর এড়ালাম।
ওরা নগরের কাছাকাছি চলে গেছে তখন আমি উঠে দাঁড়ালাম। দু’জনে খোঁড়ার জায়গায় গেলাম। দেখলাম পাথরের স্তম্ভের বেশ নিচে পর্যন্ত খোঁড়া হয়ে গেছে। গর্তের নিচে পাথরের বালিচাপা সিঁড়ির মত দেখা যাচ্ছে। তাহলে কাবানার অনুমান ঠিক। এখানে রাজপ্রাসাদ ছিল।
যোদ্ধারা বেলচাগুলি জড়ো করে রেখে গিয়েছিল। আমি নিজে একটা বেলচা নিলাম আর একটা সার্ভানোকে দিলাম। সার্ভানোকে নিয়ে সেই ফণীমনসার আর কাটার ঝোঁপের পেছনে এলাম বেলচা দিয়ে বালি খুঁড়তে লাগলাম। দু’জনেই হাত লাগালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বড় গর্তমত হল। নিশ্চিন্ত হলাম। এখানে আত্মগোপন করে সবদিক নজর রাখা যাবে। বেলচাগুলো যেখানে ছিল সেখানেই বেলচা দুটো রাখলাম।
সরাইখানায় ফিরে এলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে আবার চললাম সমুদ্রতীরে ঐ জায়গটার দিকে।
ওখানে পৌঁছে সেই গর্তে আত্মগোপন করে নজর রাখতে লাগলাম। কাবানা ফিরে এল। বালি খোঁড়ার কাজ চলল।
এইভাবে দিন সাতেক কেটে গেল। ওখানে যাওয়া লুকিয়ে নজর রাখা যেন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেল।
দুপুরে ওরা চলে গেলে আর বিকেলে চলে গেলে আমরা কতটা খোঁড়া হয়েছে। তা দেখতে যাই।
একদিন বিকেলে গিয়ে দেখলাম অনেক খোঁড়া হয়েছে। খননকাজের পাশেই বালির স্তূপজমে উঠেছে। আমরা নিচেনামলাম। থাক করা বালির সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। তারপরই পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে। একটা বিরাট ছাদহীন ঘর। ঘরের দুপাশে দুটো কাঠের সিন্দুমত। আমি ছুটে গিয়ে একটা সিন্দুক খুললাম। ভেতরে মরচে পড়া তরোয়াল আর ঢাল। অন্যটা খুললাম–জাহাজের পাল ভাজ করে রাখা। তাহলে কাবানা এখনও গুপ্ত রত্নভান্ডারের সন্ধান পায়নি। ঘরটার উত্তর দিকে একটা ভাঙা দরজা। তারপরই একটা ছোট পাথরের দেওয়াল। দেখে ভাবলাম নিশ্চয়ই ঐ দেওয়ালের পেছনে কিছু আছে। নিশ্চয়ই ওখানেই রত্নভান্ডার আছে। তখন উত্তেজনায় আমার সমস্ত শরীর কাঁপছে। কিন্তু আমার ধারনার কথা সার্ভানোকে বললাম না। চুপ করে সব দেখে টেখে ওপরে চলে এলাম।
সরাইখানায় ফিরে এলাম।
আমার কেমন মনে হল কাবানা ওই দেওয়াল ভাঙার চেষ্টা করবে। দেখতে চাইবে দেওয়ালের ওপাশে কী আছে। কিন্তু সেটা ও প্রহরীকে এড়িয়ে যোদ্ধাদের খ এড়িয়ে একা করবে। সুতরাং দিনে নয় রাতে।
সেদিন রাতে খাবার পর আমি শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুমোলাম না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইলাম। উদ্দেশ্য সার্ভানোকে না জানিয়ে অতিথিশালায় যাওয়া। রাতে কাবানা বেরিয়ে এসে সমুদ্রতীরে সেই জায়গায় যায় কিনা সেটা দেখা ও পিছু নেওয়া।
হঠাৎ অন্ধকারে সার্ভানোর গলা শুনলাম–
-ঘুমোচ্ছো না কেন? বুঝলাম ধরা পড়ে গেছি। বুঝলাম সার্ভানোও আমার ওপর নজর রাখছে। তখন বাধ্য হয়ে বললাম–সেই বড়ঘরের উত্তরদিকে একটা পাথরের দেওয়াল দেখেছেন তো?
–হুঁ। সার্ভানো মুখে শব্দ করল।
–ঐ দেওয়ালের ওপাশেই আছে গুপ্ত রত্নভান্ডার। আমি বললাম।
বেশ চমকে সার্ভানো উঠে বসল। বলল–তাহলে চলো ঐ দেওয়াল ভাঙবো।
–আমরা না। কাবানাই আজ রাতে ঐ দেওয়াল ভাঙতে যাবে। আমি বললাম।
–কী করে বুঝলে। সার্ভানো জানতে চাইল।
–আড়াল থেকে ওর চোখে মুখে বেশ উত্তেজনা লক্ষ্য করছি। রাতেই যাবে। একা কাজ সারতে যাবে। আমি বললাম।
–তাহলে অতিথিশালার সামনে ঐ বড় গাছটার নীচে-সার্ভানো বলতে গেল। বাধা দিয়ে বললামনা। সমুদ্রতীরের দিকেই যাবো। কাবানাকে তো ওখানেই যেতে হবে। সেইজন্যেই ঘুমোয়নি। আমি বললাম।
–ওঠো তাহলে। সার্ভানো বলল।
–হুঁ। চলুন। এখন রাস্তাঘাট নির্জন। আমরা অনুসরন করতে গেলে আমরা ধরা পড়ে যাবে। তাহলে কাবানা সাবধান হয়ে যাবে। সমস্ত পরিশ্রম মাটি হবে। আমি বললাম।
আমরা সরাইখানা থেকে বেরিয়ে এলাম। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার রাত। নির্জন বড় রাস্তা দিয়ে চললাম সমুদ্রের দিকে। খননকাজের জায়গায় পৌঁছালাম। তখন বেশ রাত। সেই ফণীমনসার গাছের আড়ালে শুয়ে পড়লাম।
অপেক্ষা করছি কখন কাবানা আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর থেকে দেখলাম কাবানা আসছে। একা। প্রহরীর নজর এড়িয়ে এসেছে। ও দ্রুত সেই খননের জায়গায় এল। ওর চলা দেখে বুঝলাম ও বেশ উত্তেজিত। তখনই চাঁদের আলোয় দেখলাম ও একহাতে একটা কুড়ুল অন্যহাতে একটা মশাল নিয়ে আসছে। যা ভেবেছিলাম তাই। ও ছোট দেওয়ালটা ভাঙতে আসছে।
ও খননের জায়গায় এল। ও একবার চারিদিক ভালো করে তাকাচ্ছে তখনই আমরা আড়াল নিলাম।
ও বালির ধাপ বেয়ে নীচে নেমে গেল। দূর থেকে ঠকঠক শব্দ শুনলাম। কাবানা মশাল জ্বালাচ্ছে। ও তৈরী হয়ে এসেছে।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। তারপরই দেওয়ালে কুড়ুলে ঘা মারার শব্দ শুনলাম। চারিদিক নির্জন নিস্তদ্ধ।
হঠাৎ কাবানার চিৎকার শুনলাম–পেয়েছি। আমরা ভীষন ভাবে চমকে উঠলাম। সার্ভানো মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল। ও ছুটল। আমি তার পিছু নিলাম।
বালির সিঁড়ির ধাপ বেয়ে দু’জনেই নিচে নেমে পড়লাম। মশালটা বালির দেওয়ালে পোঁতা। মশালের আলোয় সার্ভানোর মুখ দেখেই বুঝলাম তাঁর মাথায় খুন চেপেছে। সে কাবানাকে মেরে ফেলবে। হলও তাই। সাভার্নো কাবানার ওপর শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাবানারহাত থেকেকুঁ ছিটকে গেল। কাবানা পাথরের বালিভরা মেঝেয় ছিটকে পড়ল। মূহুর্তের মধ্যে সার্ভানো কুড়ুলটা তুলে নিল। তারপর দুহাতে কুডুলটা ধরে কাবানা বুকে বসিয়ে দিল। নরহত্যার দৃশ্য তো অনেক দেখেছি। আমি বিচলিত হলাম না। সার্ভানো আমার দিকেফিরে তাকাল। আমি একঝলকশুধু দেখছিলাম দেওয়ালে কয়েকটা পাথরের খন্ড নিচে পড়ে আছে। একটা ফোকরের সৃষ্টি হয়েছে। দেওয়ালটা পুরো ভেঙে পড়েনি। কিন্তু তখন আর কিছু দেখার মত মনের অবস্থা আমার ছিল না। বুঝলাম এবার আমার পালা। সার্ভানো আমাকে হত্যা করবে।
আমি একমূহুর্ত আর দাঁড়ালাম না। পেছনে ফিরে বালির সিঁড়ির ধাপ দিয়ে উঠে। এলাম। ছুটলাম নগরের দিকে।
একটা নতুন সরাইখানায় আশ্রয় নিলাম। সেখানে বসেই রাত জেগে লিখছি। সার্ভানো নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজছে। আমার জীবন বিপন্ন। গুপ্ত ধনভান্ডারের লোভ
বড়লোক হবার স্বপ্ন শেষ–রাজা সিয়েভোর রত্নভান্ডারের খবর আমরা দুজন মাত্র জানি–আমি আর ক্যাপ্টেন সার্ভানো। কাজেই নৃশংস ক্যাপ্টেন সার্ভানো আমায় বেঁচে থাকতে দেবে না।
রাত শেষ হয়ে আসছে। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ শুনছি। সরাইয়ের মালিক দরজা খুলে দিল। আমার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত
বইয়ের লেখা এখানেই শেষ। তারপর বাকি সব পাতা সাদা। কিছুক্ষণ পরে ফ্রান্সিস বলল–ক্যাপ্টেন সার্ভানো ঐ গুপ্ত রত্নভান্ডার অবিষ্কার করতে পারে নি। পারলে প্রোমিও হয়ত পারত। তার আগেই ওর মৃত্যু হয়। মৃত্যু মানে ক্যাপ্টেন সার্ভানো ওকে হত্যা করে। তারপর খুঁড়ে বের করা সেই প্রাচীন প্রাসাদের সর্বত্র খোঁজাখুঁজি করেছিল নিশ্চয়ই কিন্তু ওর বুদ্ধিতে কুলায় নি। হাল ছেড়ে সে চলে গিয়েছিল নিজের জাহাজে। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–প্রোমিও আমার কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। তবে আমি প্রথমেই খুঁড়ে তোলা প্রাসাদ দেখতে যাব না। পশ্চিমের বন মন্দিরঘর গুহা সরোবর সব দেখবো। তন্ন তন্ন করে খুঁজবো। তারপর খুঁড়ে-তোলা প্রাসাদে যাবো। যা হোক কাল সকালে রাজসভায় গিয়ে রাজার সঙ্গে কথা বলতে হবে। দেখি রাজার কাছ থেকে কোন সূত্র পাই কিনা। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস প্রোমিওর লেখাটা আমার বড় ভালো লাগল। ও বড় দরদ দিয়ে লিখেছে। ওর লেখা থেকে নিশ্চয়ই কিছু তথ্য পাওয়া যাবে।
–নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তবে আমি প্রথমে আমার মত করে খুঁজবো।
–তাহলে চলো। কালকে রাজার কাছে যাওয়া যাক। আতলেতার দিকে তাকিয়ে?
ফ্রান্সিস বলল–আতলেতা তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে। সব জায়গাতো তোমার ভাল চেনা। তোমার সাহায্য খুব কাজে লাগবে।
–বেশ। আমি তোমাদের সঙ্গী হব। আতলেতা বলল।
পরের দিন সকালে ফ্রান্সিস ও হ্যারি রাজসভায় এল। তখন একটা বিচার চলছিল। আতলেতা এপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ও এখনো সেনাপতির পদ পায় নি। এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসদের বলল–রাজা তোমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলেছেন।
ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে বিচার পর্ব দেখতে লাগল। বিচার পর্ব শেষ। প্রজারা চলে যেতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই রাজসভা জনশূন্য হয়ে গেল।
রাজা এনিমার ইশারায় ফ্রান্সিসদের এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস রাজার দিকে এগিয়ে গেল। মাথা একটু নুইয়ে নিয়ে বলল–মান্যবর রাজা–আমরা স্থির করেছি অতীতের রাজা সিয়োভোর গুপ্ত রত্নভান্ডার আমরা উদ্ধার করবো।
বেশ তো। চেষ্টা করে দেখ। আচ্ছা তোমরা প্রোমিওর বইটা পড়েছো তো? রাজা জানতে চাইলেন।
–হ্যাঁ। বইটা পড়ে কিছু দরকারি তথ্য পেয়েছি। তবে নতুন করে অনুসন্ধান চালাবো। এখন অনুরোধ আপনি যদি ঐ গুপ্ত ধনভান্ডার সম্পর্কে যা জানেন বলেন তাহলে আমরা উপকৃত হব।
–আমি যা জানি তা প্রোমিওকে বলেছিলাম। নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে শুনেছি ঐ গুপ্তধন শুধু চুন্নিপান্না মুক্তো হীরের টুকরোর। সোনা রুপো নেই। ওটা শুধু মনিরত্নের ভান্ডার। রাজা বললেন।
–আচ্ছা–ঐ রত্নভান্ডার গোপনে কোথায় রাখা হয়েছে বলে আপনার মনে হয়? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
-কী করে বলি। আমার পূর্বপুরুষরা খুঁজছে আমিও খুঁজেছি। কিন্তু কোন হদিশ পায়নি। রাজা বললেন–ঐ প্রোমিও কম খোঁজেনি। মরে না গেলে হয়তো ও খোঁজ পেত। ফ্রান্সিস তারপর বলল–
–এ ব্যাপারে সর্বাগ্রে আপনার সাহায্য চাই।
বলো কী রকম সাহায্যে চাও। রাজা জানতে চাইলেন।
–প্রোমিও প্রাচীন রাজপ্রাসাদের অর্ধেকটা বালি খুঁড়ে উদ্ধার করেছে। আমি বাকি অর্ধেকটা উদ্ধার করতে চাই। তাঁর জন্যে বেলচা পঁচিশ তিরিশ জন যোদ্ধা চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। তোমাদের যা কিছু প্রয়োজন তা আতলেতাকে বল সে সব কিছুর। ব্যবস্থা করে দেবে। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে। মাথা কাত করল ফ্রান্সিস। তারপর বলল
আমরা আপনার অন্তঃপুরে খুঁজবো।
–বেশ তো। তবে দু’তিন দিন পরে এসো। রানি অসুস্থ। রাজা বললেন।
–ও। ঠিক আছে। পরেই যাবো। আমাদের সব রকম সাহায্যে করছেন এর জন্যে ধন্যবাদ। আমার আর কিছু বলার নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–আশা করছি–তোমরা সফল হবে। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস হ্যারি আতলেতা সভাঘর থেকে বেরিয়ে এল। রাজবাড়ির বাইরে এসে ফ্রান্সিস বলল–
–আতলেতা। আমি এখনই পশ্চিমের বনটা খুঁজে দেখতে চাই।
বেশ তো চলো। বনে একটা গুহা আছে। দু’টো মশাল চকমকি পাথর নিয়ে আসছি। অল্পক্ষণের মধ্যেই আতলেতা ফিরে এল। তিনজন সদর রাস্তায় এল। চলল–পাহাড় ও বনের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বনের ভেতরে ঢুকল তিনজনে। কিছুদূর যেতেই সামনে পড়ল আধ-ভাঙা মন্দির–ঘর।
–আচ্ছা আতলেতা। মন্দিরঘরটা তো ভেঙে পড়ার অবস্থা। রাজা এটার সংস্কার করেন না কেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–এটা রাজা সিয়োভো প্রতিষ্ঠা করেছিলন। রাজা এনিমার এটাকে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় রাখতে চায়নি। পূর্বপুরুষদের স্মৃতি হিসাবে। আতলেতা বলল।
–স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে আর কি। হ্যারি বলল।
ওরা মন্দির–ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে লাগল। পাথরের বেদীর কাছে এল। বেদীর ওপর একটা বড় লাইলাক ফুল ঘিরে নানা ফুললতা পাতার রঙীন নকশা। অবশ্য রঙগুলি প্রায় বিবর্ন। তবু এখনও নকশাগুলো সুন্দর দেখাচ্ছে।
–ফ্রান্সিস দেখেছো কী সুন্দর নকশা। হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ। রাজা সিয়োভোর শিল্পবোধের প্রশংসা করতে হয়। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বেদীর পাথরের জোড়াগুলো খুঁটিয়ে দেখল। বেশ শক্ত জোড়। মাথা নিচু করে দেখছিল। এবার মাথা তুলে বলল–চলো। এই বেদীটা পরে ভালো করে দেখতে হবে।
তিনজনে মন্দিরঘরের বাইরে এল। ফ্রান্সিস বলল–আতলেতা এখানে একটা গুহা আছে বলেছিলে।
–হ্যাঁ। চলো। দেখাচ্ছি। আতলেতা বলল।
বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গুহাটার মুখে এসে দাঁড়াল ওরা। আতলে চমকি পাথর ঠুকে মশাল জ্বালল। ফ্রান্সিস আর আতলেতা মশাল নিল। গুহায় ঢুকল ওরা। ফ্রান্সিস মশাল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। গুহার এবড়ো। খেবড়ো পাথরের গা যেমন হয়। গুহার উচ্চতা কোথাও বেশি কোথাও কম। এবড়ো খেবড়ো গুহার দেওয়াল দেখে ফ্রান্সিস বুঝল কোথাও মানুষের হাত পড়েনি। দুতিনটে খোদল পেল। কিন্তু সেগুলোর মুখ পাথর-চাপা নয়। খোলা।
গুহা শেষ। টানা দেয়াল উঠে গেছে। দেয়ালের নিচে একটা পাথরের ছোট চাই পড়ে আছে। তার নিচে একটা খোঁদলের মুখমত। ফ্রান্সিস বসে পড়ল। বলল–হাত লাগাও। পাথরের চাইটা সরাতে হবে। আতলেতা আর হ্যারি চাইটা ধরল। ফ্রান্সিসও বাঁ হাতে মশাল নিয়ে ডানহাতে ধরল। তিনজন মিলে দুতিনবার টানতেই পাথরের চাইটা সরে গেল। হুড় হুড় করে বেশ কয়েকটা চামচিকে খোদল থেকে বেরিয়ে উড়ে গুহামুখের দিকে উড়ে গেল। ফ্রান্সিস খোদলটা দেখল। ফাঁকা। কিচ্ছু নেই।
তিনজনে ফিরে এল। মশাল নিভিয়ে দিল আতলেতা। ফিরে লল। অতিথিশালায় এল।
ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিসরা বসল। একটু পরেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিল। আতলেতাও ফ্রান্সিসদের সঙ্গে খেয়ে নিল। আতলেতা বলল–আজকে আর কোথাও যেতে হবে?
না। কাল সকালে বনে যাবো। দেখি বনের কোথাও কোন হদিশ পাই কিনা। ফ্রান্সিস বলল।
–প্রোমিও যে জায়গাটা খুঁড়িয়েছিল সেখানে কবে যাবে? আতলেতা বলল।
রাজবাড়ির অন্তঃপুরটা প্রথমে দেখবো। রানি সুস্থ হল কিনা এই খবরটা এনো। ফ্রান্সিস বলল।
-বেশ। তাহলে আমি যাচ্ছি। আতলেতা চলে গেল।
পরের দিন সকালে আতলেতা এল। বিনেলো বলল–এখানে একা একা পড়ে থাকবো না। আমিও তোমাদের সঙ্গে যাবো।
-বেশ। চলো। ফ্রান্সিস বলল।
চারজন হাঁটতে হাঁটতে বনের কাছে এল। বনে ঢুকল। আজকে আকাশটা মেঘলা। তেমন রোদ ওঠে নি। বনতল বেশ অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ফ্রান্সিস বলল–সরোবরের ধারে নিয়ে চলো। ওদিকে সেদিন আত্মগোপন করেছিলাম। তখন ভালো করে ঐ জায়গাটা দেখা হয় নি।
কিছুক্ষণ পরে ওরা সরোবরের ধারে এল। আকাশ মেঘলা বলেই সরোবরের জল কেমন যেন কালচে দেখাচ্ছে। এখানে ঘন বন। গাছগাছালির মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখল। কিন্তু গাছ লতাপাতা বুনো ফুল ছাড়া কিছুই দেখা গেল না।
–ওপারে চলো। ফ্রান্সিস বলল-ওদিকটা প্রোমিও দেখে নি। সরোবরের পাশ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরোবরের ওপারে এল ওরা। এদিকে বন তত ঘন নয়। ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে দেখল। সেই গাছগাছালি লতাপাতা বুনো ফুল। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে এল সবাই।
ফেরার পথে আতলেতা বলল–ফ্রান্সিস রানিমার সঙ্গে কথা বলেছি। তোমরা অন্তঃপুর খোঁজাখুঁজি করতে আসবে সে কথা বলেছি। রানিমা এখন অনেকটা সুস্থ। তোমাদের অন্তঃপুরে যেতে অনুমতি দিয়েছেন।
–ঠিক আছে। কাল সকালে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
পরের দিন সকালের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিসরা রাজসভাঘরের পাশ দিয়ে অন্তঃপুরের দরজার সামনে এল। প্রহরী দাঁড়িয়ে। ওকে দিয়ে ভেতরে খবর পাঠানো হল। প্রহরী ফিরে এসে বলল–আপনারা যান।
ফ্রান্সিসরা অন্দরমহলে ঢুকল। বেশ ছিমছাম। সাজানো গোছানো চারদিক। ফ্রান্সিসরা ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগল। পাথরের দেয়ালে রঙীন ফুল লতাপাতা আঁকা। কোথাও কোন পরিত্যক্ত ঘর নেই। ফ্রান্সিস পাথরের মেঝে ভালোভাবে দেখতে লাগল। না। মেঝের নিচে কোন ঘর নেই। আলমারি সিন্দুক সবই ব্যবহৃত হয়। গোপনীয় কিছুই ওসবের মধ্যে থাকতে পারে না। ফ্রান্সিসরা গুপ্ত ধনভান্ডারের কোন হদিশ করতে পারল না। ওরা অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসছে তখনই ফ্রান্সিসরা দেখল কোনার দেয়ালে একটা রঙীন লাইলাক ফুল আঁকা। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। কাছে গিয়ে দেখল ফুলটার হাল্কা নীলে রক্তিমাভ রং। রং মোটামুটি উজ্জ্বল। ও বুঝল অতীতের রাজা সিয়াভো ফুল ভালোবাসতেন। বিশেষ করে লাইলাক ফুল। রাজবাড়ির অন্দরমহল দেখা শেষ। বাকি রইল বালি খুঁড়ে বের করা প্রাচীন রাজপ্রাসাদ।
ওরা অতিথিশালায় ফিরে এল। শুয়ে পড়তে পড়তে ফ্রান্সিস বলল–আতলেতা কালকে পুরোনো রাজপ্রাসাদ দেখতে যাবো।
-বেশ। আমি সকাল সকাল চলে আসবো। আতলে চলে গেল।
হ্যারি বলল–ঐ পুরোনো প্রাসাদ তো সবটা খুঁড়ে বার করা হয়নি।
-কী মনে হচ্ছে তোমার? হ্যারি প্রশ্ন করল।
দু’টো জায়গাই ভালোভাবে দেখতে হবে। এক–ঐ মন্দিরঘরটা আর পুরোনো রাজপ্রাসাদটা। এই দুটোর মধ্যে কোনটাতে আছে গুপ্ত রত্নভান্ডার। ফ্রান্সিস বলল।
-কোন সূত্র পেলে? হ্যারি জানতে চাইল।
–না। এখনও অন্ধকারে আছি। তবে ওখানে খোঁড়ার কাজ তো চলুক। দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
–কালকেই কি খোঁড়ার কাজ শুরু করবে? হ্যারি বলল।
–না। কালকে যতটা খোঁড়া হয়েছে দেখাবো। পরশু থেকে খোঁড়ার কাজে হাত দেব। ফ্রান্সিস বলল।
পরের দিন আতলেতা সকাল সকাল এল। চারজন তৈরি হয়ে চলল সমুদ্রতীরের দিকে।
খোঁড়া জায়গাটায় পৌঁছল সবাই। বালিতে কাটা সিঁড়ি দিয়ে চারজনে নিচে নামল। প্রধান প্রবেশপথের কাঠের দরজাটা ভেঙে পড়ে আছে। দরজার কাঠে নানা ফুল লতাপাতার রুপো গেঁথে নকশা করা। দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। ঢুকেই একটা লম্বা ঘরের শুধু পাথরের মেঝে। কয়েকটা পাথরের ভাঙা থাম এদিক ওদিক পড়ে আছে। দুপাশে দুটো কাঠের সিন্দুকের মতো। প্রোমিত্ত ওর বইতে এই সিন্দুকদুটোর কথা লিখেছে।
ঐ ঘরের পরেই পাথরের দেয়াল। অর্ধেকটা ভাঙা। ফ্রান্সিস বলল–প্রোমিত্ত ওর বইতে এই দেয়ালের কথা লিখেছে। তবে ও দেয়াল ভাঙবার চেষ্টা করেছিল। পরে জলদস্যু ক্যাপ্টেন সার্ভানো নিশ্চয়ই দেয়ালের অনেকটা ভেঙেছিল। কিছুই পায় নি। চলো ভাঙা দেয়ালের মধ্যে দিয়ে ওপাশে যাবো।
চারজনে পর পর ভাঙা দেয়ালের মধ্যে দিয়ে ওপাশে গেল। ছাদ তো ভেঙে পড়েছে। সূর্যের আলোয় দেখল ঘরটার মাঝখানে একটা মসৃণ পাথরের বেদী। বড় বেদীর ওপরে একটা ছোট চৌকোনো পাথরের বেদী। তার মাথায় লাইলাক ফুলের নকশা। তবে রংগুলো অনুজ্জ্বল। বোধহয় রোদে জলে।
ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে বেদীটা দেখল। লাইলাক ফুলের নকশাটাও ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল বেশি। রাজা সিয়াভো এত জায়গায় লাইলাক ফুলের নকশা করিয়েছেন কেন? ফ্রান্সিসের মনে এই প্রশ্নটা ঘুরে ঘুরে এল।
ঐ পর্যন্তই বালি খোঁড়া হয়েছে। এরপরে আরও ঘর আছে নিশ্চয়ই। অন্দরমহলটা এখনও বালি খুঁড়ে বের করা যায় নি। ফ্রান্সিস স্থির করল অন্দরমহলটা খুঁড়ে বের করবে। অন্দরমহলের কোথাও গুপ্ত রত্নভাণ্ডার থাকার সম্ভাবনা বেশি।
দুপুরের আগেই ওরা অতিথিশালায় ফিরে এল। আতলেতাকে বলল–কাল সকালে বেলচাসহ যোদ্ধাদের নিয়ে এসো। খোঁড়ার কাজ শুরু করবো।
-ঠিক আছে। আতলেতা মাথা কাত করে বলল। তারপর বলল –গুপ্ত রত্নভাণ্ডার উদ্ধারের আশা আছে?
–এখনই বলতে পারছি না। সবটা খোঁড়া হোক আগে। ফ্রান্সিস বলল। একটু থেমে বলল–রাজা এলিমারের সঙ্গে একবার দেখা করা প্রয়োজন।
–এখনই চলো। রাজসভাতেই রাজাকে পাবে।
–চলো। হ্যারিদের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমরা অপেক্ষা কর। আমি ঘুরে আসি।
দুজনে রাজসভায় এল। তখন বিচারপর্ব শেষ হয়েছে। লোকজনের ভিড়ও কম। আতলেতা এগিয়ে গিয়ে রাজাকে কিছু বলল। রাজা ফ্রান্সিসকে ইঙ্গিতে এগিয়ে আসতে বললেন। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। বলল–মহামান্য একটা কথা বলছিলাম।
-বলো। রাজা বললেন।
–অতীতের রাজা সিয়াভো যা কিছু নির্মাণ করেছিলেন সেসব জায়গায় লাইলাক ফুলের নকশা করিয়েছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। যতদূর শুনেছি উনি লাইলাক ফুল খুব ভালোবাসতেন। তাঁর যেসব পোশাক অন্তঃপুরে সযত্নে রাখা আছে সেসব পোশাকে লাইলাক ফুলের নকশা তোলা আছে। পোশাকের বুকের কাছে। শুনেছি তার আমলের প্রাসাদের বাগানে শুধু লাইলাক ফুলের গাছই লাগিয়েছিলেন। লাইলাক ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিলেন তিনি। রাজা বললেন।
লাইলাক ফুল সত্যিই সুন্দর। ফ্রান্সিস বলল।
অতিথিশালায় ফিরে আসার পথে আতলেতাকে ফ্রান্সিস বলল–কাল থেকে বালি খোঁড়ার কাজে লাগবো। তুমি যোদ্ধাদের এনো। অন্দরমহলটাকে বের করতে হবে।
–ঠিক আছে। আতলেতা বলল। তারপর চলে গেল।
অতিথিশালায় ঢুকে ফ্রান্সিস দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল।
–রাজার সঙ্গে কী নিয়ে কথা বললে? হ্যারি জানতে চাইল। ফ্রান্সিস সব বলল।
পরদিন সকালেই পঁচিশ তিরিশজন যোদ্ধাকে নিয়ে আতলেতা অতিথিশালার সামনে এসে হাজির হল। আতলেতা বলল–পোমিত্ত যাদের নিয়ে বালি খোঁড়ার কাজ চালিয়েছিল বেশিরভাগ তাদেরই এনেছি।
–এটা একটা কাজের কাজ করেছে। অভিজ্ঞ লোকের খুব দরকার ছিল। ফ্রান্সিস বলল।
সকালের খাবার খেয়েই সবাইকে নিয়ে ফ্রান্সিস চলল। খোঁড়ার জায়গায় পৌঁছে ফ্রান্সিস যোদ্ধাদের বলল–খোঁড়ার সময় লক্ষ্য রাখবে যেন খুব বেশি ভাঙচুর না হয়। বেলচার হাতল ঠুকতেই দেয়াল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। যোদ্ধারা ভেতরে ঢুকল। তারপর বালি খুঁড়তে লাগল।
দুপুর পর্যন্ত কাজ চলল। ফ্রান্সিসরা যোদ্ধাদের নিয়ে নগরে ফিরে এল। সবাই খাওয়াদাওয়া সেরে আবার খোঁড়ার জায়গায় এল। আবার বালি খোঁড়া শুরু হল। চলল বিকেল পর্যন্ত। সন্ধ্যের আগেই সবাই ফিরে এল।
প্রতিদিনই এইভাবে বালি খোঁড়া চলল।
দিন সাতেকের মধ্যে অন্দরমহলের বালি খোঁড়া হয়ে গেল। অন্দরমহলের আয়তন বেশ বড়। কিছু ভাঙা কাঠের আসবাবপত্র পাওয়া গেল। পাথরের দেয়ালে কোথাও কোথাও দেয়াল আলমারিমত ছিল। সেসব এখন ফঁকা। কয়েকটা ভেঙেও পড়েছে।
পূবদিকে একটা ছোট ঘর দেখা গেল। সেই ঘরে ফ্রান্সিসরা ঢুকল। বালি সরানো হয়েছে। ছোট ঘরটার মাঝখানে একটা মোটা কার্পেট পাতা। বালি সরানোতে এখন কার্পেটটা ভালভাবে দেখা যাচ্ছে। কার্পেটে হালকা নীল ও রক্তিমাভ রঙের লাইলাক ফুলের নকশা। বেশ বড়।
–আবার লাইলাক ফুল। ফ্রান্সিস বিড় বিড় করে বলল। তারপরে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল নিরেট পাথরের দেয়াল। এটা বোধহয় নিরলংকার প্রার্থনা ঘর ছিল।
প্রার্থনা ঘর থেকে বেরিয়ে এল সবাই। হ্যারি বলল
–ফ্রান্সিস গুপ্তধন রাখার মত সম্ভাব্য কোন জায়গাই তো দেখা যাচ্ছে না।
–দেয়াল ভেঙে যে ঘরটা পেলাম সেই ঘরটায় চলো। ফ্রান্সিস বলল। সেই ঘরটায় ওরা এল। বেদীটা দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলল–এই বেদীটা ভাঙতে হবে। আতলেতার দিকে তাকিয়ে বলল কালকে কয়েকটা কুড়ুল আনতে হবে। যোদ্ধাদের বলে দাও।
-ঠিক আছে। তাহলে বেদীটা ভাঙবে? আতলেতা জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। লাইলাক ফুলের রহস্য ভেদ করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
সেদিনের মতো ওরা অতিথিশালায় ফিরে এল।
পরের দিন সকালে ফ্রান্সিসরা আবার খোঁড়ার জায়গায় এলো। দু’তিনজন যোদ্ধা কুড়ুল নিয়ে এসেছিল।
সেই ঘরে এসে ফ্রান্সিস যোদ্ধাদের বলল–
–এই বেদীটা ওপর থেকে ভাঙতে হবে। কুড়ুল, চালাও।
বেদীর মাথায় যোদ্ধারা কুড়ুলের ঘা মারতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই চৌকোনো মাথাটা ভেঙে গেল। দেখা গেল চৌকোনো একটা গর্ত মত। ফ্রান্সিস হাত তুলে যোদ্ধাদের থামাল। চৌকোনো গর্তটার কাছে গিয়ে দেখল ভেতরে একটা কিছু আছে। হাত ঢুকিয়ে দেখল একটা কালো কাঠের বাক্সমত। ও দুহাত দিয়ে বাক্সটা তুলে আনল। হ্যারি বলে উঠল–ফ্রান্সিস। এটাই কি রত্নভাণ্ডার?
–বাক্সটা খুবই ছোটো। খুলে দেখছি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বাক্সটা খুলল। আশ্চর্য। ভেতরে একটা শুকনো লাইলাক ফুল। ফুল বিবর্ণ।
–আবার লাইলাক ফুল। ফ্রান্সিস বলল। ততক্ষণে সবাই ফুলটা দেখল। বাক্সটার গায়ে সোনারূপের কাজ করা নানা ফুলপাতার নকশা। বড় সুন্দর দেখতে বাক্সটা।
–হ্যারি–বোঝা যাচ্ছে লাইলাক ফুলের নকশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবার আর কোথায় আছে লাইলাক ফুলের নকশা সেটা দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
লাইলাক ফুলের নকশাই তাহলে গুপ্ত রত্নভাণ্ডারের নিশানা। হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ। চলো দেখি আর কোথায় আছে লাইলাক ফুলের নকশা। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস আবার ভাঙা অন্দরমহল ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ন্নাঃ। অন্দরমহলে কোথাও আর লাইলাক ফুলের নকশা নেই।
ফ্রান্সিস প্রার্থনাকক্ষে ঢুকল। মেঝেয় পাতা ভারি কার্পেটে রয়েছে লাইলাক ফুলের নকশা। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ কার্পেটটার দিকে তাকিয়ে বলল–হাত লাগাও। কার্পেটটা, তুলতে হবে। আর্টদশজন যোদ্ধার সঙ্গে ফ্রান্সিসরা কার্পেটের চারপাশ ধরল। টেনে তুলে ফেলা হল মোটা ভারি কার্পেটটা। আবার লাইলাক ফুল। এবার ফুলটার হালকা নীল রক্তিমাভ পাপড়িগুলোর রং উজ্জ্বল। কতদিন নকশাটা কার্পেটের তলায় চাপা পড়েছিল কে জানে। ফুলের নকশাটা ঘরের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে। বেশ বড়। সবাই বেশ অবাক হয়ে ফুলের নকশাটা দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল
–হ্যারি। আবার লাইলাক ফুল। এটা সবচেয়ে বড় নকশা। সবচেয়ে সুন্দর।
ফ্রান্সিস উবু হয়ে মেঝেয় বসল। নকশায় হাত বুলোলো কয়েকবার। উঠে দাঁড়িয়ে বলল–পাথর কেটে ফুলের ছাঁচ করা হয়েছে। পরে রঙ দেওয়া হয়েছে। এখন এই পাথরের ছাঁচটা তুলে ফেলতে হবে।
তা কেন। ভেঙে ফেললেও তো হয়। বিনেলো বলল।
না। এত সুন্দর পাথরের ওপর ফুলের নকশা। আভাঙা অবস্থায় তুলে নেব। তাহলেই নীচে কী আছে দেখা যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু আভাঙা অবস্থায় ভোলা যাবে? হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ। হাত দিয়ে দেখেছি। কুড়ুলের মাথা দিয়ে আস্তে চাড় দিয়ে দিয়ে তোলা যাবে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল-দুপুর হয়ে এসেছে। চলো খেতে সবাই।
কাজ বন্ধ করে সবাই নগরের দিকে চললো। আসতে আসতে ফ্রান্সিস যোদ্ধাদের দলনেতাকে ডেকে বলল–ভাই তোমাদের আর প্রয়োজন নেই। বালি খোঁড়া হয়ে গেছে। এখন অনুসন্ধানের পালা। ওটা আমরা কয়েকজনে পারবো।
-ঠিক আছে। বাকি কাজ আপনারাই করুন। দলনেতা বলল।
দুপুরে খাবার খেয়ে ফ্রান্সিসরা শুয়ে বসে বিশ্রাম করতে লাগল। বিনেলো ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–যোদ্ধাদের চলে যেতে বললে বাকি কাজ আমরা পারবো?
-পারতে হবে। ঐ যোদ্ধাদের ধারে কাছেও রাখবো না বলে ওদের আসতে মানা করেছি। যদি ওদের সামনে সেই গুপ্ত রত্নভাণ্ডার উদ্ধার হয় ওরা ঐ ভাণ্ডার লুঠ করে নেবে। আমরা বাধা দিতে গেলে আমাদের ঐ কুড়ুল দিয়েই মেরে ফেলবে। ধনসম্পদের লোভ বড় সাংঘাতিক। ফ্রান্সিস বলল।
-তাহলে কালকের অনুসন্ধানে শুধু আমরাই যাবো? আতলেতা বলল।
কালকে নয়। আজ রাতে। ফ্রান্সিস বলল।
রাতে খুঁজবে? আতলেতা জানতে চাইল।
হ্যাঁ-যতটা সম্ভব গোপনে। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো এগিয়ে এল। বলল ফ্রান্সিস আমার এভাবে একা একা এই অতিথিশালায় পড়ে থাকতে ভালো লাগছে না। তোমাদের সঙ্গে আমিও যাবো।
–তোমার শরীর–ফ্রান্সিস বলতে গেল।
শাঙ্কো বলে উঠল– আমি এখন অনেক সুস্থ।
–বেশ। যেও। তবে আমাদের কাজে হাত লাগাবে না। শুধু বসে থাকবে।
–ঠিক আছে। শাঙ্কো মাথা কাত করে বলল।
হ্যারি বলল -–ফ্রান্সিস কোন সূত্র পেলে?
–একমাত্র সূত্র ঐ লাইলাক ফুলের নকশা। ঐরকম নকশা কয়েকটা জায়গায় রয়েছে। তার একটা ভেঙে ছোট বাক্সে শুকনো লাইলাক ফুল পেয়েছি। এবার প্রার্থনা ঘরের মেঝের নকশা খুলে কী পাই দেখি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বিনেলোর দিকে তাকিয়ে বলল–বিনেলো কুড়ুলগুলো যোদ্ধাদের কাছ থেকে চেয়ে রেখেছো তো?
–সব ঘরের কোনায় রেখেছি। বিনেলো বলল।
–ভালো করেছ। সিনাত্রার দিকে তাকিয়ে বলল–সিনাত্রা-তিনটে বেশ ভালো করে তেল ভেজানো মশাল জোগার করে আনো। কার কাছে মশাল চাইবে?
–সৈন্যাবাস থেকে আনবো। সিনাত্রা বলল।
–কী বলবে? ফ্রান্সিস বলল।
–রাতে পুরোনো প্রাসাদে গুপ্ত ধনভান্ডার খুঁজতে যাবো। সিনাত্রা বলল।
-নির্বোধ। ওসব বললে সব জানাজানি হয়ে যাবে। বলবে অতিথিশালার মশাল শেষ রাতে নিভে যায়। কাজেই বেশি তেল মাখানো মশাল চাই। বুঝেছো? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ। সিনাত্রা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
–তবে যাও। ফ্রান্সিস বলল।
সিনাত্রা চলে গেল।
ফ্রান্সিসরা রাতের খাবার বেশ তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল–একটু বিশ্বাস করে নাও। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়বে না কেউ।
রাত বাল। ফ্রান্সিস শুয়ে ছিল। উঠে দাঁড়াল। বলল–কুড়ুল মশাল নাও। চলো সবাই।
সবাই হাতে কুড়ুল মশাল নিয়ে অতিথিশালার বাইরে এসে দাঁড়াল। আকাশে ভাঙা চাঁদ। জ্যোৎস্না অনুজ্জ্বল। ওরা নিঃশব্দে চলল বালি খুঁড়ে তোলা পুরোনো রাজপ্রসাদের দিকে।
সেখানে এসে বালির ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল সবাই।
দেওয়ালে জ্বলন্ত মশাল রাখা হল। প্রার্থনা ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস একটা কুড়ুল নিল। কুড়ুলের মুখটা দিয়ে নকশার ধার গুলোতে চাড় দিতে দিতে বলল–এইভাবে চাড় দিয়ে দিয়ে নকশা অভগ্ন অবস্থায় তুলতে হবে। নকশা এখানে ওখানে একটু নড়ল। চলল সাবধানে চাড় দেওয়া। যাতে কোনভাবেই ভেঙে না যায় সেভাবেই সাবধানে কাজ চলছিল। কাজেই সময় লাগছিল।
বাকি সারারাত ধরে কাজ চলল। মশাল নিভু নিভু হয়ে এল। ভোরের দিকে সবটা নকশা আলগা হ’ল। শাঙ্কো ছাড়া সবাই মিলে–হাত লাগাল–আস্তে আস্তে লাইলাক ফুলের নকশাটা তুলে ধরল সবাই। পাথরের দেওয়ালে ওটা ঠেসান দিয়ে রাখা হল। কত সুন্দর দেখাচ্ছিল নকশাটা। ফ্রান্সিস এই ভেবে তৃপ্তি পলে যে নকশাটা নষ্ট হয়নি।
এবার নকশার বাকি ফোকরওয়ালা পাথরের পাটটা তুলে ফেলল। ভেতরে তিনকোনা গৰ্তমত। ফ্রান্সিস নিভু নিভু একটা মশাল ভেতরে ফেলে দিল। নিভু নিভু আলোয় দেখা গেল একটা তিনকোনা কালেকাঠের বাক্স। বেশ বড়। বাক্সটার গায়ে সোনার লতাপতার কাজ। বাক্সের সঙ্গে ওপরে কাঠের হাতল।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ দেখল। ততক্ষনে ভোরের আবছা আলো পড়েছে। এবার ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি–এটাই রাজা সিয়োভোর রত্নভান্ডার।
–তুমি নিশ্চিত? হ্যারি বলল।
–আমি নিশ্চিত। দেখ। কথাটা বলে ফ্রান্সিস কাঠের হাতলটা ধরে বাক্সটা আস্তে তুলে আনল। চাবির জায়গায় একটা বড় ফুটো। ফ্রান্সিস হাতল ধরে টানল। বাক্স খুলল না। বিনেল সিনাত্রাকে ডাকল। তিনজনে মিলে হাতলটা টানাটানি করল। কিন্তু বাক্স খুলল না। একটু হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস বলল–উপায় নেই। বাক্সটা ভাঙতে হবে। ও বাস্কটার ফুটোর কাছে ডালা দু’টোর ফাঁকে কুড়ুলের মাথা দিয়ে চাড় দিতে লাগল। সামান্য যক হল। ফ্রান্সিস বলল বিনেলো ঐ মুখটায় চাড় দাও। বিনোলাও কুড়লের মুখ চেপে চাড় দিতে লাগল। আরো একটু ফাঁক হল
কুড়ল চালিয়ে ভেঙে ফেললেই তো হয়। শাঙ্কো বলে উঠল।
–না। এত সুন্দর বাক্সটা অধৈর্য হয়ে এটা নষ্ট করব? ফ্রান্সিস বলল।
এ ভাবেই খুলবো।
আবার চাড় দেওয়া শুরু হল। দড়াম করে বাক্সের ডালাটা খুলে গেল। উজ্জ্বল রোদে ঝিকিয়ে উঠল বাক্সের অদ্ধের্ক বোঝাই চুনি পান্না হীরে জহরত। ফ্রান্সিসরা খুবএকটা অবাক হল না। এরকম গুপ্তধন ওরা আগেও উদ্ধার করেছে। আতলেতার মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। একসঙ্গে চুনিপান্না হীরে জহরৎ দেখবে কোনদিন কল্পনাও করেনি।
বাক্স বন্ধ করে ফ্রান্সিস মেঝেয় বসে পড়ল। একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল– এবার বাকি কাজটা। বাক্সটা ভেঙে গেছে। হাতল ধরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কাঁধে করে নিয়ে চলো। রাজা এনিমারকে দিতে হবে। যে বাক্সটায় শুকনো লাইলাক ফুল পাওয়া গিয়েছিল হ্যারি সেই বাক্সটা নিল।
বিনেলো আর সিনাত্রা বাক্সটা দুপাশে ধরে কাঁধে তুলল। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। সবাই নগরের দিকে চলল।
তখন রাস্তায় লোক চলাচল শুরু হয়েছে। সবাই দেখল একটা সুন্দর কারুকাজকরা কালো কাঠের তিনকোণা বাক্স বিদেশীরা কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকলেরই ঔৎসুক্য কী আছে বাক্সটায়?
সবাই রাজবাড়ির প্রধান প্রবেশপথের সামনে এসে দাঁড়ালো প্রহরীরা ফ্রান্সিসদের দেখল। বাধা দিতে গেল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে বলল–আমাদের বাধা দিও না। রাজার সঙ্গে আমাদের বিশেষ প্রয়োজন। দেখা করতে হবে।
প্রহরীরা এই কদিনে ফ্রান্সিসদের চিনেছে। ওরা আর বাধা দিল না।
ফ্রান্সিসরা অন্দরমহলের দরজার কাছে এল।
ফ্রান্সিস প্রহরীদের বলল-রাজামশাই ঘুম থেকে উঠেছেন?
–হ্যাঁ। এখন সকালের খাবার খাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরেই রাজসভায় বসবেন।
না। রাজসভায় নয়। আমাদের জন্য মন্ত্রণাকটা খুলে দাও আর রাজামশাইকে বলল যে বিদেশীরা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ফ্রান্সিস। বলল।
–বেশ। মন্ত্রণাকক্ষ ভোরেই খুলে দেওয়া হয়েছে। আপনারা গিয়ে বসুন। প্রহরীটি বলল।
ফ্রান্সিসরা বাক্স নিয়ে মন্ত্রণাকক্ষে এসে বসল। ওরা অপেক্ষা করতে লাগল কখন রাজা আসেন তার জন্যে।
কিছুক্ষণ পরেই রাজা এনিমার ঘরে ঢুকলেন। ফ্রান্সিসরা একটু উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল। রাজা বসতে বসতে বললেন–বসো বসো। এই সকালে এসেছে। কী ব্যাপার? ফ্রান্সিস বলল–আপনার পূর্বপুরুষ রাজা সিয়োভোর রত্নভান্ডার আমরা বুদ্ধি খাটিয়ে উদ্ধার করেছি।
-কোথায় সেই রত্ন ভাণ্ডার? রাজা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন।
–আপনার সম্মুখে। কথাটা বলে ফ্রান্সিস হাতল ধরে বাক্সটার ডালা খুলল। রাজা অবাক চোখে সেই চুনি-পান্না-হীরে জহরতের ভান্ডারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সোল্লাসে বলে উঠলেন–তোমরা তো অসাধ্য সাধন করেছে। তারপর চুনি পান্না জহরৎ মুঠো করে তুলে তুলে দেখলেন। বললেন–তোমরা উদ্ধার করেছো। তোমরাও কিছু নাও।
–না। আমরা কিছু নিই না। আমাদের মাফ করবেন। ফ্রান্সিস বলল।
এবার হ্যারি কালো ছোট বাক্সটা দেখিয়ে বলল–শুধু এই বাক্সটা আমরা নেব।
বেশ তো। রাজা বললেন।
–বলো কি? যাক গে–এই লাগাস রাজ্য তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ রইল। রাজা বললেন।
–আমার কয়েকটা কথা ছিল। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। বলল। রাজা বললেন।
-আমরা প্রাচীন প্রাসাদের প্রার্থনাঘরের মেঝেয় করা লাইলাক ফুলের নকশার নিচে থেকে এই রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করেছি। খুব যত্নের সঙ্গে লাইলাক ফুলের নকশাটা ঐ ঘরেই রেখে দিয়েছি। বড় সুন্দর নকশাটা। অনুরোধ ওটা আপনার প্রাসাদে এনে রাখুন।
-খুব ভালো বলেছো। নিশ্চয়ই এখানে রাখবো। রাজা বললেন।
–আর একটা কথা। এই বাক্সে রত্নগুলো মাত্র অর্ধেক রাখা হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে আরো রত্নভান্ডার আছে? রাজা জানতে চাইলেন।
-হ্যাঁ। মহামান্য রাজা। আপনার রাজত্বে যেখানে যেখানে লাইলাক ফুলের নকশা রয়েছে যেমন অন্দরমহলের একটা দেয়ালে আর মন্দির–ঘরের বেদীতে সেসব ভাঙলে আরও মণিমাণিক্য হীরে জহরত পাওয়া যাবে।
–ওসব ভেঙে নষ্ট করবো? রাজা বললেন।
–সেটা আপনার বিবেচনা। আমি শুধু সম্ভাবনার কথা বললাম। ফ্রান্সিস বলল।
–ভেবে দেখি। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে। আমাদের কাজ শেষ। আমরা জাহাজঘাটে আমাদের জাহাজে ফিরে যাচ্ছি। আপনার সাহায্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ফ্রান্সিস বলল। রাজা উঠে দাঁড়ালেন। ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়াল।
রাজবাড়ির বাইরে এসে হ্যারি বলল–তাহলে এখন জাহাজে ফিরে যাই।
না। দুপুরের খাওয়াটা সেরে যাবো। কাজও তো হয়ে গেছে। এখন আর এখানে থাকবো কেন? ফ্রান্সিস বলল।
দুপুরে খাওয়া সেরে সবাই জাহাজঘাটের দিকে চলল। ওরা জাহাজে উঠতেই গনিবন্ধুরা ছুটে এল। মারিয়া হাসিমুখে এগিয়ে এল। বলল–রাজা সিয়োভোর রত্নভান্ডার নিশ্চয়ই উদ্ধার করতে পেরেছো? ফ্রান্সিসও হাসলো। বলো। একটা তিনকোণা বাক্স প্রায় ভর্তি চুনি পান্না হীরে জহরৎ। রাজা এলিমার খুব খুশি। কিন্তু
আমাদের হাত শূন্য।
-তোমরা নিরাপদে ফিরে এসেছো এটাই আমার কাছে অনেক। তবে শাঙ্কো নাকি অসুস্থ। ওকে আমি আর ভেন মিলে কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ করে তুলবো। ওর জন্যে ভেবো না।
হ্যারি এতক্ষণ সেই কালো কাঠের কারুকাজকরা ছোট বাক্সটা দুহাতে পেছনে ধরে ছিল। মারিয়া দেখতে পায়নি। এবার বাক্সটা এগিয়ে ধরে বলল-রাজকুমারী আমাদের হাত একেবারে শূন্য নয়। এই নিন বাক্সটা। বাক্সটা হাতে নিয়ে মারিয়া শিশুর মত লাফিয়ে উঠল–ঈস্ কী সুন্দর বাক্সটা। বিকেলের রোদ পড়ে বাক্সটার গায়ের সোনারূপোর কাজকরা ফুললতাপাতাগুলো চক্ করছিল তখন।
বন্ধুরা ততক্ষণে বিনেলোর মুখে সব শুনেছে। কারুকার্যময় ছোট বাক্সটাও দেখল। আনন্দে সবাই ধ্বনি তুলল—ও–হো–হো।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব-নোঙর তোল। পাল তোল। দাঁড় বাও। ফ্লেজারকে বলো জাহাজ চালাতে উত্তর-পূর্ব মুখো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ চলতে শুরু করল।
Leave a Reply