রাজা আলফ্রেডের স্বর্ণখনি
স্বদেশে ফেরার জন্য ভাইকিংদের আগ্রহ তুঙ্গে উঠল। এখন ওরা কোন কথা শুনতেই রাজি নয়। স্বদেশে ফিরবেই। কিন্তু ফ্রান্সিস? তাকে বোঝাবে কী করে? হ্যারি ব্যাপারটা আঁচ করতে পারল। কিন্তু ফ্রান্সিসকে কিছু বলল না। ও দেখবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল বন্ধুরা কী করে।
ভাইকিং বন্ধুরা হ্যারিকে বলল—তুমিই ফ্রান্সিসকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দেশে ফেরার জন্য রাজি করাও।
হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস আমার কথা শুনবে না।
–তুমি ওর প্রাণের বন্ধু। তোমার কথা শুনবে না।
–না। ও যা মনস্থির করে তাই করে। কারো মতামত গ্রাহ্য করে না। হ্যারি বলল।
–তাহলে উপায়? বন্ধুরা বলল।
–আমার অবশ্য বলা উচিত না তবু বলছি একমাত্র রাজকুমারীই পারে ফ্রান্সিসকে রাজি করাতে। হ্যারি বলল।
–ঠিক বলেছো। আমরা রাজকুমারীকে বলবো। বন্ধুরা বলল।
মারিয়া প্রতিদিন সূর্যাস্ত দেখতে জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। সেদিনও এসেছে।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সূর্য নেমে আসছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায়। আস্তে আস্তে উঁচু। উঁচু ঢেউয়ের মধ্যে সূর্য ডুবে গেল। একটু অন্ধকার হয়ে এল চারদিক।
শাঙ্কো বিস্কোরা রাজকুমারীর কাছে এল। এভাবে ভাইকিংরা কখনো রাজকুমারীর কাছে আসে না। সেদিন এল। রাজকুমারী একটু অবাক হয়েই ওদের দিকে তাকাল।
রাজকুমারী। শাঙ্কো ডাকল।
–কী ব্যাপার বলো তো৷ তোমরা আমাকে কিছু বলবে? মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ। শাঙ্কো বলল।
–বলো। মারিয়া বলল।
আমরা আর ঘুরে বেড়াতে রাজি নই। এবার আমরা দেশে ফিরে যেতে চাই। বিস্কো বলল।
–সে তো আমিও চাই। কতদিন বাবা-মাকে দেখি না।
–আপনি ফ্রান্সিসকে বলুন যাতে ও দেশে ফিরে যেতে রাজি হয়। বিস্কো বলল।
–আমি বললেই কি ও রাজি হবে? তবু তোমরা বলছো। দেখি বলে। রাজকুমারী বলল।
শাঙ্কোরা চলে গেল। মারিয়া কেবিনঘরে এল। দেখল ফ্রান্সিস চুপ করে চোখ বুজে শুয়ে আছে।
রাজকুমারী বিছানার পাশে বসল। আস্তে আস্তে বলল–একটা কথা বলছিলাম।
–কী কথা? ফ্রান্সিস চোখ খুলে বলল।
এবার দেশে ফিরে চলো। রাজকুমারী বলল।
–আমরা তো এ দেশ ঐ দ্বীপ এসব জায়গায় থেমে থেমে ফিরবো। যদি কোন গুপ্ত ধনভাণ্ডারের খবর না পাই ফিরে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
-যদি কোন গোপন ধনভাণ্ডারের খোঁজ পাও? মারিয়া জিজ্ঞেস করল।
–তাহলে তো উদ্ধারের কাজে নামবো। ফ্রান্সিস বলল।
তার মানে তো আরো বেশ কিছুদিন নষ্ট হওয়া। মারিয়া বলল।
নষ্ট বলবো কেন? সময়টা তো আমরা কাজে লাগাবো।
না না। আর বিলম্ব নয়। এখন সোজা দেশে চলো। মারিয়া বলল।
–আমি সে কথা দিতে পারছি না। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।
–না। আর কোথাও থামা চলবে না। মারিয়া বলল।
–তা হয় না মারিয়া। গোপন ধনভাণ্ডারের খবর পেয়ে আমাকে আবার লাগতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। এটাই আমি চাইছি না।
গোপন ধনভাণ্ডারের খবর পেলেও তুমি এড়িয়ে যাও। জাহাজে দেশের দিকে চলুক। মারিয়া বলল।
–দেখি। তবে কথা দিতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।
–না। তোমাকে কথা দিতে হবে। মারিয়া গলায় জোর দিয়ে বলল।
না মারিয়া। পারবো না। তবে তোমরা যদি চলে যেতে চাও যেতে পারো। যেসব বন্ধুরা আমার সঙ্গে থাকতে চাইবে তাদের নিয়ে আমি জাহাজ কিনে আমার কাজ করে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
তুমি ভালো করেই জানো তোমাদের কয়েকজনকে একা ফেলে আমরা কখনই যাবো না। মারিয়া বলল।
–আমিও সেটাই চাই। ফ্রান্সিস বলল।
যদি কোন গোপন ধনভাণ্ডারের খবর না পাও তাহলে দেশে ফিরে যাবে তো? মারিয়া জানতে চাইল।
হঠাৎ সেক্ষেত্রে আমার তোকিছু করার নেই। দেশের দিকেই থাকে। ফ্রান্সিস বলল—
–তাহলে ওকথাই রইল। মারিয়া বলল।
বেশ। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।
মারিয়া ডেক-এ উঠে এল। শাঙ্কোরা কয়েকজন রাজকুমারীর জন্যে অপেক্ষা করছিল। রাজকুমারী ওদের কাছে এল। শাঙ্কোরা এগিয়ে এল। রাজকুমারীর ফ্রান্সিসের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে বলল। তারপর বলল–কোন গোপন ধন ভাণ্ডারের খবর না পেলে ফ্রান্সিস দেশে ফিরতে রাজি হবে।
–তাহলে দেখা যাক কী ঘটে। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে।
সেদিন দুপুরে মাস্তুলের ওপর থেকে নজরদার পেড্রো চেঁচিয়ে বলল–ডাঙা দেখা যাচ্ছে–ডাঙা। সিঁড়িঘরের কাঠের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বিস্কো বসেছিল। পেড্রোর কথাটা ও শুনল। ও ছুটল ফ্রান্সিসকে খবর দিতে।
একটু পরে ফ্রান্সিস মারিয়া হ্যারি ডেক-এ উঠে এল। ফ্রান্সিস ভালো করে দেখেটেখে বলল–একটা ছোট বন্দর। চলো–খোঁজ নেওয়া যাক। জাহাজ বন্দরে ভেড়াতে বল।
জাহাজ চালক ফ্লেজার বন্দরে জাহাজ ভেড়াল।
বিকেলে কিছু বন্ধু ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–বরাবর তুমিই খোঁজখবর করতে যাও। আজকে আমরা যাবো।
বেশ তোমরাই খোঁজ নিয়ে এসো। কিন্তু কোন লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়োনা। ফ্রান্সিস বলল।
দশ বারোজন বন্ধু দল বেঁধে নেমে গেল।
শাঙ্কো হ্যারি বিস্কো আর কয়েকজন বন্ধু গেল না। জাহাজেই রইল।
অন্ধকার হয়ে এল। বন্ধুরা ফিরল না।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কেবিনঘরে এল। বলল–ফ্রান্সিস বন্ধুরা এখনও ফিরল না। খুবই বিপদের কথা।
মাটিতে নামার সুযোগ তো ওরা পায় না। আজকে পেয়েছে। ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া হেসে বলল–জাহাজের বাধাবদ্ধ জীবন। একটু বৈচিত্র্য সবাই চায়। বিশেষ করে ডাঙায় উঠে।
–তা ঠিক। তবু এটা আমাদের কাছে বিদেশ। ওদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। বন্ধুরা কোন বিপদে পড়ল কিনা কে জানে। হ্যারি বলল।
বন্দরটার নাম রেজিল। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা হৈ হৈ করে বন্দরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এই দলের মধ্যে ছিল সিনাত্রা। সিনাত্রা বেশ বুদ্ধিমান। বন্ধুরাও ওকে খুব ভালোবাসে।
ওরা বাজার এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তখনই এক একজন কালো মানুষ ওদের দিকে এগিয়ে এল। বলল–তোমরা বিদেশি?
–হুঁ। আমরা ভাইকিং। সিনাত্রা বলল।
–বন্দরে তোমাদের জাহাজ দেখলাম। লোকটি বলল।
–হ্যাঁ। আমরা দুপুরে এখানে এসেছি। একজন ভাইকিং বলল।
–তোমরা ঘুরে বেড়াচ্ছো নিশ্চয়ই তোমাদের খিদে পেয়েছে। আমার সঙ্গে এসো। খেতে দেব। কালো লোকটি বলল।
–খুব ভালো কথা–সিনাত্রা বলল-চলো ভাইসব নিমন্ত্রণ রক্ষা করা যাক।
লোকটার পেছন পেছন ওরা চলল।
একটা বেশ বড় বাড়ির সামনে এল ওরা।
লোকটি বলল–বাড়ির ভেতরে চলো।
ওরা বাইরের ঘরে ঢুকল। বেশ সাজানো গোছানো ঘর। বোঝাই যাচ্ছে গৃহকর্তা ধনী। ওরা এদিক-ওদিকেরাখা চেয়ারে বসল। সবাইয়ের জায়গা হলনা। কয়েকজন মেঝেয় বসল।
লোকটি বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
কিছু পরে একজন বেশ শক্তসমর্থ চেহারার মধ্যবয়স্ক পুরুষ ঘরে ঢুকল। সামনের ফাঁকা চেয়ারটায় বসল। বলল–শুনলাম তোমরা বিদেশি।
-হ্যাঁ। আমরা ভাইকিং। সিনাত্রা বলল।
–তোমরা বোধহয় লক্ষ্য করোনি আমার বাড়ির পেছনে বিরাট তুলোর ক্ষেত। মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি বলল।
না। অন্ধকার হয়ে এসেছে তো। সিনাত্রা বলল।
কথা হচ্ছে তখনই আট দশজন বলিষ্ঠদেহী নিগ্রো দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। সিনাত্রা বিপদ আঁচ করলো। কিন্তু কিছু বলল না। লোকটি বলল–আমার বাড়ির পেছনে বন্দীশালা। আমার তুলার ক্ষেতে কাজ করার জন্যে যাদের ধরে আনি তারা প্রথমে ঐ বন্দীশালায় থাকে। তারপর ক্ষেতে পাঠাই। দশবারোজন পাহারাদার থাকে ক্ষেতগুলোর চারপাশে।
এবার সিনাত্রা উঠে দাঁড়াল। বলল–এসব আমাদের বলছেন কেন?
–কারণ তোমরা এখন বন্দী। তবে যে তোমাদের তুষ্য মানে যে তোমাদের নিয়ে এসেছে সে বোধহয় বলেনি তোমাদের–আমি প্রচুর অর্থ দেব।
সিনাত্রা গলা চড়িয়ে বলল–কিন্তু আমাদের কেন বন্দী করা হবে?
কারণ তোমরাই আমার তুলোর ক্ষেত চাষ করবে। তুলো ফলাবে। তুলোর গাঁটরি কাঁধে করে জাহাজে চালান দেবার জন্য জাহাজে তুলে দেবে।
তার মানে আপনি আমাদের ক্রীতদাস করে রাখবেন। সিনাত্রা বলল।
–হ্যাঁ। পালাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। কারণ দরজায় দেখতেই পাচ্ছো আমাদের সব বাছাই করা যোদ্ধারা রয়েছে। ওদের সঙ্গে লড়াই করে পালাতে গেলে তোমরা অর্ধেকও বাঁচবে না। কাজেই আমার ক্ষেতের চাষি হও তোমরা। প্রচুর অর্থ পাবে।
সিনাত্ৰা বুঝল এখন ঐ নিগ্রো যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়তে যাওয়া বোকামি। ওরা গুরুতর আহত হবে। কয়েকজন মরবেও। তার চেয়ে এই লোকটি যা বলছে মেনে নেওয়াই ভালো। ভবিষ্যতে সুযোগ বুঝে পালানো যাবে।
তুম্ফা তখনই ঘরে ঢুকল। বলল–তোমরা যদি এখন পালিয়েও যাও তোমাদের জাহাজে উঠতে পারবে না। তোমাদের জাহাজ এখন প্রায় মাঝ সমুদ্রে।
সিনাত্রা ও বন্ধুরা ভীষণভাবে চমকে উঠল। সিনাত্রা বলল–আপনি দেখেছেন?
–না। আমি যখন দেখেছি তখন জলদস্যুরা সবেমাত্র তোমাদের জাহাজে উঠেছে। তারপর কী ঘটতে পারে ভেবে নাও। তুম্মা বলল। সিনাত্ৰাদের মন খারাপ হয়ে গেল। নিজেরা তো একটু পরেই বন্দীশালায় বন্দী হবে। ফ্রান্সিসরাও বন্দী হল?
সূর্যাস্ত দেখে মারিয়া কেবিনঘরে নেমে এল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি দুজনেই বন্ধুদের জন্যে ভাবছে। হ্যারি ফ্রান্সিসের বিছানায় বসে আছে। মারিয়া মোমবাতির আলোয় উঁচসুতোর কাজ করছে।
হঠাৎ ওপরের ডেক-এ অনেক পায়ের শব্দ। হ্যারি বলল–সিনাত্রারা বোধহয় ফিরে এল।
ফ্রান্সিসের কেবিনঘরের বন্ধ দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ। হ্যারি দরজা খুলতে গেল। বন্ধুরা এসেছে। হ্যারি দরজা খুলে দিল।
কালো দাড়ি গোঁফওয়ালা জলদস্যু ক্যাপ্টেন। সঙ্গে খোলা তরোয়াল হাতে কয়েকজন জলদস্যু।
জলদস্যু ক্যাপ্টেন দাঁত বের করে হাসল। বলল–তোমাদের জাহাজের সঙ্গে আমাদের জাহাজ বাঁধা হয়ে গেছে। এখন আমাদের ক্যারাভেন জাহাজ তোমাদের জাহাজকে টেনে নিয়ে চলেছে। মাঝ সমুদ্রে।
ততক্ষণ ফ্রান্সিসদের জাহাজ দুলতে শুরু করেছে। বড়বড় ঢেউ ভেঙে পড়ছে জাহাজের গায়ে।
–নাও। দেরি করো না। ওপরের ডেক-এ উঠে এসো। ক্যাপ্টেন বলল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি উঠে দাঁড়াল। হ্যারি দেশীয় ভাষায় বলল–কয়েদঘর থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
–তাই দেখছি। এখন কতদিন বন্দীদশা চলবে মা মেরিই জানে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়া ওপরে ডেক-এ উঠে এল। দেখল শাঙ্কো বিস্কো আর কয়েকজন বন্ধু ডেকএর একপাশে বসে আছে। পাহারা দিচ্ছে খোলা তরোয়াল হাতে কয়েকজন জলদস্যু।
পাহারাদার জলদস্যুরা ফ্রান্সিসদের শাঙ্কোদের পাশে বসিয়ে দিল। শাঙ্কো বলল– আমরা ছক্কা-পাঞ্জা খেলছিলাম। ডেক-এ কেউ ছিল না। আমরা বুঝতেই পারিনি কী ঘটে গেছে।
–যা ঘটে গেছে, গেছে। এখন আমাদের বন্দী জীবনই মেনে নিতে হবে। হ্যারি বলল।
কিছুক্ষণ পরে জলদস্যু ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিসদের কাছে এল। হেসে বলল–এবার বেশ তরতাজা ইউরোপীয় যুবক পাওয়া গেছে। ভালো দাম পাওয়া যাবে। ফ্রান্সিস বলল–ওদের। ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করা হবে। ক্যাপ্টেন গলা চড়িয়ে বলল–এগুলোকে কয়েদঘরে ঢোকা। তিনচারজন জলদস্যু খোলা তরোয়াল হাতে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল–চলো সব। ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস ক্যাপ্টেনকে বলল–একটা কথা ছিল?
কী? ক্যাপ্টেন বলল।
আমাদের সঙ্গে রয়েছেন আমাদের দেশের রাজকুমারী। তাঁকে আমাদের সঙ্গে কয়েদঘরে রাখবেন না। তাকে আমাদের জাহাজেই রাখুন। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল। জলদস্যু ক্যাপ্টেন একটু ভাবল। তারপর বলল-রাজকুমারী? তা বেশ। তবে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পালাতে গেলে মরবে।
–সেটা উনি ভালোভাবেই জানেন। বোকার মত উনি তা করতে যাবেন না। ফ্রান্সিস বলল।
–তা হলেই ভালো। তোমাদের রাজকুমারীকে বিক্রি করতে গেলে ভালো দাম পাবো। ক্যাপ্টেন বলল।
তিন চারজন জলদস্যুর পেছনে পেছনে ফ্রান্সিসরা চলল। নিজেদের জাহাজ থেকে জলদস্যুদের জাহাজে গিয়ে উঠল। সিঁড়ি দিয়ে একেবারে নিচের কয়েদঘরে নিয়ে আসা হল ফ্রান্সিসদের।
প্রহরীদের একজন কোমর থেকে চাবির গোছা বের করল। চাবি বেছে নিয়ে ঢং-ঢং কি, শব্দে লোহারদরজা খুলল।
রাজা আলফ্রেডের স্বর্ণখনি। ফ্রান্সিসরা আস্তে আস্তে কয়েদঘরে ঢুকল। দুধারের দুই মশালের আলোয় ফ্রান্সিসরা দেখল কিছু কৃষ্ণকায় মানুষও বন্দী রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাটে এদেরও বিক্রি করা হবে।
ফ্রান্সিসরা মেঝেয় বসল। হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–এবার আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য। শাঙ্কো ফিরলো না আমরাও বন্দী হলাম। সব কেমন তছনছ হয়ে গেল।
-বুঝতে পারছি না কীভাবে মুক্তির চেষ্টা করবো। একবার মুক্তি পেলে বন্ধুদের খোঁজে রোজিল বন্দরে যাবো। মনে তো হয়–ওরা ভালো আছে। ফ্রান্সিস বলল।
মনে হয় না। হয়তো ওদেরও কোন বিপদ হয়েছে। হ্যারি বলল।
–বিপদ হলে ওদেরই মোকাবিলা করতে হবে। আমরা তো অসহায় এখন। ফ্রান্সিস বলল।
–মুক্তির ব্যাপারটা গভীরভাবে ভাবো। হ্যারি বলল।
–তা তো ভাবতে হবেই। ফ্রান্সিস বলল।
একজন বলিষ্ঠ কৃষ্ণকায় বন্দী যুবক ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল আপনাদের দলনেতা কে?
হ্যারি নিঃশব্দে আঙুল তুলে ফ্রান্সিসকে দেখল। যুবকটি ফ্রান্সিসদের পাশে এসে বসল।
-তোমার নাম? যুবকটি জানতে চাইল।
–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস বলল।
–আমার নাম কোলা। যুবকটি বলল।
–ও। তুমি কিছু বলবে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
হ্যাঁ। অনেক ভেবেচিন্তে এখান থেকে পালাবার উপায় বের করতে হবে। কোলা বলল।
–কোন উপায় নেই। জলদস্যুরা আমাদের নিয়ে যা করতে চাইবে তাই করবে। ফ্রান্সিস বলল।
তার মানে ক্রীতদাসের জীবনই আমাদের ভাগ্য। কোলা বলল।
তাই তো মনে হচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা পালাতে পারি। কোলা বলল।
–কীভাবে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
-যখন এরা খেতে দিতে আসে তখন লোহার দরজা খোলা থাকে। তখন খোলা দরজা দিয়ে পালালো। কোলা বলল।
দরজার দুপাশে খোলা তরোয়াল হাতে প্রহরী থাকে। সেটা লক্ষ্য করেছো। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল।
–ওদের কাবু করে? কোলা বলল।
–অসম্ভব। ওরা অভিজ্ঞ তরোয়াল যুদ্ধে। খালি হাতে ওদের কাবু করা যাবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো আমাদের মুক্তির কোন আশাই নেই। কোলা বলল।
–না নেই। ফ্রান্সিস বলল।
কোলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পরে বলল–তোমরা আমাদের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। তবে তোমরা যদি লড়াই করে পালাতে চাও আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।
না। লড়াই করে পালাবার কথা এখন ভাবছিনা। সেটা করতে গেলে বেশ কয়েকজন বন্ধুকে হারাতে হবে। আমি তা চাই না। ফ্রান্সিস বলল।
লড়তে গেলে বাঁচামরা তো আছেই। কোলা বলল।
–তা ঠিক। তবে জেনেশুনে কেন মরতে যাবো? ফ্রান্সিস একটু থেমে বলল–বেশ কয়েকজন বন্ধুকে রেজিল বন্দরে ফেলে এসেছি। জানি না ওরা বেঁচে আছে কি না। তারপর আমরা যে কয়েকজন মাত্র আছি এদের মধ্যেও আবার কয়েকজনকে হারালে আমাদের দুঃখের শেষ থাকবে না।
–তুমি বন্ধুদের খুব ভালোবাসো? কোলা জিজ্ঞেস করল।
–প্রাণের চেয়ে বেশি। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল–যখন অভিযানে বের হয়েছিলাম তখন বন্ধুদের বলেছিলাম তোমাদের রক্ষা করার জন্যে আমি প্রাণ দিতে প্রস্তুত। আজকে সব জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিই কী করে?
–তাহলে ক্রীদাসের হাটেই আমরা বিক্রি হয়ে যাবো, এটাই আমাদের ভাগ্য। কোলা বলল।
তাই তো দেখছি। ফ্রান্সিস বলল।
কোলা উঠে দাঁড়াল। বলল–পালাবার ফন্দী আমিও আঁটছি। দেখি শেষ পর্যন্ত কী করতে পারি।
কোলা নিজের জায়গায় চলে গেল। ফ্রান্সিসের সঙ্গে যা কথাবার্তা হল বন্ধুদের বলতে লাগল।
শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস যে লোহার ডাটা দিয়ে খাবার দেবার আগে লোহার দরজায় শব্দ করে সেই ডাণ্ডাটা হাতের কাছেই থাকে। ওটা দিয়ে অন্তত দুটো প্রহরীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া যায়।
–শাঙ্কো ঐ পাগলামি করতে যেও না। যাই কর আমাকে না জানিয়ে কিছু করো না। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি মৃদুস্বরে বলল–ফ্রান্সিস, শেষ পর্যন্ত আমাদের ক্রীতদাসের জীবনই কাটাতে হবে। কেউ আমাদের বাঁচাতে পারবে না।
এবার আমারও তাই মনে হচ্ছে। এই জলদস্যুরা পশুর মতো। হিংস্র হ্যারি আর কোন কথা বলল না।
জলদস্যুদের জাহাজ চলল। পেছনে ফ্রান্সিসদের জাহাজ বাঁধা। সেই জাহাজের কেবিনঘরে রাজকুমারী মারিয়া দুশ্চিন্তায় দিন কাটায়। ফ্রান্সিসদের দুর্বিষহ কষ্টের কথা ভেবে মারিয়া মাঝে মাঝে কাঁদে।
হঠাই জাহাজ দুটো ঝড়ের মুখে পড়ল। জাহাজের সজোরে এপাশ-ওপাশ দুলুনিতে ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরের মেঝেয় এধার-ওধার গড়াতে লাগল। বিরাট বিরাট ঢেউয়ের ফাটলে জাহাজ পড়ছে উঠছে। সাংঘাতিক ঝাঁকুনিতে ফ্রান্সিসরা ছিটকে পড়ছে। বিদ্যুতের তীব্র আলো যেন আকাশ চিরে ফেলতে লাগল। সেইসঙ্গে গুরুগম্ভীর মেঘগর্জন আর প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া। বহুকষ্টে ফ্রান্সিসরা ঝড়ের দুলুনি সহ্য করতে লাগল।
ঝড় আধঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয়নি। তাতেই জলদস্যুদের প্রাণান্তকর অবস্থা। ঝড় থামলে দেখা গেল জলদস্যুরা ডেক-এর ওপর জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। অসাড় নিস্পন্দ।
অল্পক্ষণের মধ্যেই জলদুস্যরা উঠে দাঁড়াতে লাগল। পালের মাস্তুলের হালের ছেঁড়া দড়িটড়ি বাঁধতে লাগল।
ততক্ষণে ফ্রান্সিসরা কেউ কেউ উঠে বসেছে। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়েছে কেউ কেউ পায়চারি শুরু করেছে। ঝড়ের ধাক্কায় ফ্রান্সিসদের অবস্থা কাহিল।
জলদস্যুদের ক্যাপ্টেন তেমেলো একবার এসে ফ্রান্সিসদের অবস্থা দেখে গেল। হেসে বলে গেলঝড়ে এরকম অবস্থাই হয়। দু-একদিনের মধ্যেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে। পেট পুরে খাও। শরীর ঠিক রাখো। ভালো দাম উঠবে। ফ্রান্সিসরা কেউ কিছু বলল না।
জলদস্যুদের ক্যাপ্টেন তেমেলোকে মারিয়া বলল–এই ঝড়জলে আমার স্বামী ও বন্ধুরা কেমন আছে আমি দেখতে যাবো।
–বেশ। যান। ক্যাপ্টেন তেমেলো আপত্তি করল না।
ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেখে দরজার কাছে এগিয়ে এল।
–এই ঝড়জলে তোমাদের কোন কষ্ট হয়নি তো? মারিয়া জানতে চাইল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল-ঝড় একেবারে দলাই মালাই করে দিয়ে গেছে। তবে মারাত্মক আহত হয়নি কেউ। কয়েকদিনের মধ্যেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে। তোমার কিছুহয়নি তো?
–না না। আমি ভালো আছি। আমার চিন্তা তোমাদের জন্যে। মারিয়া বলল।
–আমাদের জন্যে ভেবো না। এখন চিন্তা এরপরে কী হবে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস মনে হয় এবার আমাদের কপালে অনেক দুঃখকষ্ট আছে। মারিয়া বলল।
–দেখা যাক। তুমি মন শক্ত রেখো। আমাদের জন্যে দুশ্চিন্তা করো না। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। তবু তুমি বলছো চেষ্টা করবো বেশি চিন্তা না করতে। মারিয়া বলল।
–আমি সেটাই বলছিলাম। ফ্রান্সিস বলল।
আকাশ নির্মেঘ। হাওয়ারও প্রচণ্ড বেগ। জলদস্যুদের জাহাজের আর ফ্রান্সিসদের জাহাজের পাল ফুলে উঠেছে। দুটো জাহাজই চলেছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে।
সেদিন দুপুরে। ফ্রান্সিসদের, জলদস্যুদের দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছে। রোদ বেশ চড়া। জলদস্যুদের জাহাজের ডেক-এ মাত্র কয়েকজন সিঁড়িঘরের ছায়ায় বসে আছে।
হঠাৎ ওরা লক্ষ্য করল জলদস্যুদের একটা জাহাজ ওদের জাহাজ লক্ষ্য করে দ্রুত আসছে। ওদের দুজন ছুটল সিঁড়িঘরের দিকে। কেবিনঘরের কাছে গিয়ে চিৎকার করতে লাগল–একটা জলদস্যুদের জাহাজ আমাদের আক্রমণ করতে আসছে। সবাই তরোয়াল নিয়ে এসো। সেই দু’জন ক্যাপ্টেন তেমেলোকেও গিয়ে বলল। তেমেলো তখন দিবানিদ্রায় ছিলো। ওদের চিৎকার চাঁচামেচিতে লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠল। ওরা জলদস্যুদের জাহাজ ওদের জাহাজ লক্ষ্য করে আসছে একথা বলল। ক্যাপ্টেন তেমেলো গলা চড়িয়ে বলল–লড়াই। সবাইকে ডেক-এ উঠে আসতে বলো।
–আমরা বলেছি। ওরা তৈরী হয়ে ওপরে উঠছে। সেই দুজন বলল।
ক্যাপ্টেন তেমেলো ডেক-এ উঠে এল। দেখল আক্রমণকারী জাহাজটা মাত্র কয়েকহাত দূরে। ঐ জাহাজের জলদস্যুরা খোলা তরোয়াল হাতে লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত। দুটো জাহাজ গায়ে গায়ে লাগান। আক্রমণকারীরা জাহাজের জলদস্যুরা লাফিয়ে তেমেলোর জাহাজে উঠে এল। শুরু হল লড়াই। তয়োয়ালে তরোয়ালে ঠোকাঠুকি চলল। চিৎকার আর্তনাদ গোঙানি শোনা যেতে লাগল।
ওদিকে ফ্রান্সিসরা প্রহরীদের ছুটোছুটি দেখে বুঝল কিছু একটা হয়েছে।
–হ্যারি–দেখো তোকী ব্যাপার। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি দরজার কাছে গেল। একজন প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলকী ব্যাপার বলো তো?
–এক জলদস্যুদের জাহাজ আমাদের জাহাজ আক্রমণ করেছে। ডেক-এ লড়াই চলছে। একজন প্রহরী বলল।
লড়াইয়ে তোমরা হেরে গেলে কী হবে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
–অসম্ভব। আমাদের বন্ধুরা দুর্ধর্ষ লড়িয়ে। তাদের হারানো যাবে না। লড়াই শেষ হোক দেখবে আমরা জয়ী হয়েছি। প্রহরীটি বলল।
–কিছুই বলা যায় না। উল্টোটাও হতে পারে। হ্যারি আস্তে বলল।
–হ্যাঁ। তোমরা তোআমাদের পরাজয়ই চাও। তাহলেই মুক্তি পাবে। ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ না। প্রহরীটি বলল। তোমরা কিন্তু মুক্তি পাবেনা। আমরা হেরে গেলে আমাদের জায়গায় ওরা তোমাদের বিক্রি করবে। তোমাদের মুক্তির কোন আশা নেই।
–তা তো বুঝতেই পারছি। তোমরা জলদস্যুরা সবাই এক চরিত্রের। ভালো মানুষ কখনও জলদস্যু হয় না। হ্যারি বলল।
কথা বাড়িও না। চুপচাপ বসে থাকো তো। প্রহরী বলল।
তা তো বটেই। হ্যারি বলল। তারপর ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বসল।
–হ্যারি–সব শুনলাম। একটা আশার আলো দেখছি। ক্যাপ্টেন তেমেলো যদি হেরে যায় তাহলে নতুন জলদস্যুদের পাল্লায় পড়বো আমরা। এটা ঠিক হয়তো এরা আমাদের বিক্রি নাও করতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
–ফ্রান্সিস–আমার কিন্তু তা মনে হয় না। অর্থের লোভ বড় সাংঘাতিক। আমাদের বিক্রি করলে হাজার হাজার পাউণ্ড পাওয়া যাবে। সেই লোভে এরাও আমাদের বিক্রি করতে নিয়ে যাবে। সব জলদস্যুদের চরিত্রই এক। হ্যারি বলল।
–এটা ঠিক বলেছো। তবু আশা হয়তো নতুন জলদস্যুরা আমাদের মুক্তি দিতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
–সম্ভাবনা কম। হ্যারি বলল।
ডেক-এ তখন লড়াই প্রায় থেমে এসেছে। ক্যাপ্টেন তেমেলোর জলদস্যুরা জয়ের মুখে। তরোয়াল ঠোকাঠুকির শব্দ কমে এসেছে। চিৎকারও প্রায় থেমে এসেছে। এখন শুধু আর্তনাদ গোঙানি ও শ্বাস ফেলার শব্দ।
ক্যাপ্টেন তেমেলো জিতে গেল। আক্রমণকারী জলদস্যুরা নিজেদের জাহাজে উঠতে লাগল। ওদের ক্যাপ্টেন অসহায়ভাবে মাস্তুলে হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
ওদের জাহাজ আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই অনেকটা সরে গেল। তারপর আরো দূরে সরে যেতে লাগলো।
ক্যাপ্টেন তেমেলোর জলদস্যুরা তরোয়াল উঁচিয়ে হাত তুলে হৈ হৈ করতে লাগল লড়াই জেতার আনন্দে।
আক্রমণকারী জাহাজ অনেক দূরে চলে গেল। ক্যাপ্টেন তেমেলোর জলদস্যুরা আক্রমণকারী মৃত ও আহত জলদস্যুদের দুহাত দুপা ধরে ধরে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। সিঁড়িঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন তেমেলো মৃদু মৃদু হাসতে লাগল।
ওদিকে ফ্রান্সিসদের কয়েদঘরের সামনে এসেই প্রহরীটি চিৎকার করে বলতে লাগল– তোমরা তো ভেবেছিলে আমরা লড়াইয়ে হেরে যাবো। দেখ–আমরা জিতেছি। লড়াইয়ে আমাদের হারানো অত সোজা নয়।
শাঙ্কো গলা বাড়িয়ে বলল–অত চেঁচিও না। আমাদের তরোয়াল দাও। আমরাই তোমাদের হারিয়ে দেব। প্রহরীটি কেমন থতমত খেয়ে গেল। বলল–তোমরা ভাইকিং। ভালো লড়িয়ে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে পারবে না।
–সেই পরীক্ষাটা তো আর হবার উপায় নেই। তোমরা তো আর আমাদের তরোয়াল দেবে না। শাঙ্কো বলল।
–ঠিক আছে। তোমার কথাটা ক্যাপ্টেন তেমেলোকে আমি বলব। প্রহরী বলল।
–হ্যাঁ বলো। দেখ ক্যাপ্টেন তেমেলো কী বলে। শাঙ্কো বলল।
ক্যাপ্টেন তেমেলো আর ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে।
ফ্রান্সিসদের একঘেয়ে জীবন কাটতে লাগল। ওরা জানেনা কোন বন্দরে জাহাজ দুটো ভিড়বে।
একসময় ফ্রান্সিস ডাকল–হ্যারি।
–কিছু বলবে? হ্যারি বলল।
একটা সমস্যার কথা বলছি। যে বন্দরে তেমেলো জাহাজ ভেড়াবে সেখানে আমাদের জাহাজটাও যদি বিক্রি করে না দেয়? হ্যারি একটুক্ষণ ভাবল। বলল–কথাটা ভাববার। তেমেলো এটা করতে পারে।
তার আগে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কীভাবে তেমেলোকে নিবৃত্ত করবো বুঝে উঠতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।
উপায় একটা বের করতেই হবে–হ্যারি বলল–আচ্ছা ফ্রান্সিস–আমরা হিচকক দ্বীপের রাজার কাছ থেকে সোনার চাকতি নিয়েছিলাম। সেই সোনার চাকতিগুলো কোথায় আছে? হ্যারি জানতে চাইল।
কিছু শাঙ্কোর কোমরবন্ধনীতে আর বাকি সবটাই আমার কেবিনঘরের কাঠের ফাঁকে। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজকুমারী জানেন? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
–হ্যাঁ। ওই রেখেছে। ফ্রান্সিস বলল।
–যদি তেমেলো আমাদের জাহাজটা বিক্রি করতে চায় তাহলে আমরাই কিছু সোনার চাকতি দিয়ে জাহাজটা কিনে নেবো। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস একটু ভেবে বলল–ঠিক বলেছো। ক্যাপ্টেন তেমেলোঅর্থপিশাচ। ও সোনার চাকতি পেলে সহজেই রাজি হয়ে যাবে।
এছাড়া তো অন্য কোন উপায় দেখছি না। আমাদের জাহাজটা হাতছাড়া করা চলবে না। হ্যারি বলল।
প্রায় এক মাস পরে তেমেলো আর ফ্রান্সিসদের জাহাজ একদিন সকালে একটা বন্দরে ভিড়ল।
ফ্রান্সিসরা বুঝল যে জাহাজ কোনো বন্দরে ভিড়ল। জাহাজ চলাচলের খুঁটিনাটি ফ্রান্সিসরা সহজেই বুঝতে পারে।
শাঙ্কো একজন প্রহরীর কাছে গেল। বলল
–জাহাজদুটো কোন্ বন্দরে ভিড়েছে?
–এই বন্দরের নাম তো শোননি।
–না শুনিনি।
আমারগো বন্দর। ক্রীদাস বেচাকেনার বাজার হিসেবে আমারগো বিখ্যাত। প্রহরটি বলল।
বিখ্যাত নয়, কুখ্যাত। হ্যারি বলল।
–সে তোমরা যা বল। প্রহরীটি বলল।
–তাহলে এখানেই আমাদের বিক্রি করা হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। ক্যাপ্টেন তাই এই বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়েছে।
বাঃ সুন্দর পরিকল্পনা। হ্যারি ঠাট্টা করে বলল।
–আমাদের ক্যাপ্টেন খুব বুদ্ধিমান। খুব ভেবেচিন্তে কাজ করে। প্রহরীটি বলল।
–মহাপুরুষ। হ্যারি আবার ঠাট্টা করল।
–ঠাট্টা করছো? প্রহরীটি বলল।
–তুমি ঠাট্টা বোঝো? হ্যারি একটু হেসে বলল।
ঠাট্টা বুঝি বৈ কি। তুমি ক্যাপ্টেনকে ঠাট্টা করে মহাপুরুষ বলেছো এটা যদি আমি ক্যাপ্টেনকে বলি ক্যাপ্টেন তোমার মুণ্ডু নেবে। প্রহরীটি বলল।
না ভাই। এত তাড়াতাড়ি আমি মু দিতে রাজিনই। তোমাদের মনমেজাজ তো বুঝি না। কাজেই কথাটা আমি ফিরিয়ে নিলাম। বলতে হলে বলো যে আমরা ক্যাপ্টেনের প্রশংসাই করি। বীর বুদ্ধিমান তরোয়াল চালনায় দক্ষ–এসব। হ্যারি বলল।
–ঠিক আছে। তোমরা প্রশংসা করেছো এটাই বলবো। প্রহরীটি বলল।
–হ্যাঁ। সেটাই বলো। তাহলে দুবেলা মাংস খেতে পাবো। হ্যারি বলল।
সেদিন হাটবার নয়। কাজেই ফ্রান্সিসদের কয়েদঘর থেকে বের করা হল না।
রাতে পরিবেশকদু’জন খাবার নিয়ে এলো। শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল–আমাদের ক্রীতদাস বিক্রির হাটে নিয়ে যাওয়া হল না কেন?
–কাল রোববার হাটবার? কালকে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রহরীটি বলল। তারপর পরিবেশকটি বলল–আজকে অঢেল মাংসের ঝোল। তোমরা পেট পুরে মাংস খাও।
খুব ভালো কথা। শাঙ্কো বলল। ফ্রান্সিসরা খেতে লাগল। খিদেও পেয়েছিল। তার ওপর চাইতেই মাংসের ঝোল পাওয়া যাচ্ছে। সবাই পেটপুরেই খেল।
ফ্রান্সিসরা তখন শুয়ে পড়েছে। কোলা ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–তাহলে আমাদের বিক্রি করতে কালকে নিয়ে যাছে।
-হ্যাঁ। প্রহরী তাই বলল। ফ্রান্সিস বলল।
–আর পালানো হল না। কোলা বলল।
–তাই তো দেখছি। ফ্রান্সিস বলল।
আমাদের যাতে একজন খরিদ্দার কেনে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা ক্যাপ্টেন তেমেলোকে বলবে। কোলা বলল।
–তা কি হবে? হয়তো ভাগ ভাগ করে আমাদের বিক্রি করল। ফ্রান্সিস বলল।
–তবু চেষ্টা করতে হবে যাতে আমরা একসঙ্গে থাকি। কোলা বলল।
–দেখি বলে। ফ্রান্সিস বলল।
–এখন পালাতে পারলাম না। পরে মালিকের হাত থেকে পালাবার চেষ্টা করতে হবে। কোলা বলল।
–মালিক আমাদের নিয়ে কী করে সেটা আগে দেখি। তারপর সময় সুযোগমতো পালানো। ফ্রান্সিস বলল।
— কি পারবো? কোলা সংশয় প্রকাশ করল।
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা যাতে একই মালিকের হাতে যাই তার ব্যবস্থাটা আগে করতে হবে। কোলা বলল।
–দেখি কীভাবে সেটা করা যায়। ফ্রান্সিস বলল।
কোলা আর কিছু বলল না। ঘুমুতে চলে গেল।
পরের দিন সকালের খাওয়ার পরই তেমেলো কয়েদঘরের সামনে এল। হেসে বলল– তোমাদের ক্রীতদাস কেনাবেচার হাটে নিয়ে যাওয়া হবে। সাবধান কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না। পালাতে গেলে মরতে হবে। ফ্রান্সিসরা কোন কথা বলল না।
–হাত বেঁধে নিয়ে চল। প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন তেমেলো বলল।
দু’জন প্রহরী কয়েদঘরে ঢুকল। সকলের হাত বেঁধে দিল। কোলা ফ্রান্সিসের কাছে এল। মৃদুস্বরে বলল–শুনেছি মালিকরা ক্রীতদাসদের পায়ে লোহার বেড়ি পরিয়ে নিয়ে যায়।
লোহার বেড়ি? ফ্রান্সিস চমকে উঠল।
–হ্যাঁ এখানেই কামারশালা আছে। কামারদের কাজই হল ক্রীতদাসদের পায়ে লোহার বেড়ি পরানো। কোলা বলল।
ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল। পায়ে লোহার বেড়ি পরালে তো পালাবার কোন আশাই নেই। সারা জীবনই ক্রীতদাস হয়ে থাকতে হবে।
কোলা বলল–তোমরা পাঁচজন আমরা তিনজন। মোট আটজন যাতে একই মালিকের হাতে পড়ি তার চেষ্টা করতে হবে।
–সব দেখিটেখি। তারপর। ফ্রান্সিস বলল।
ক্যাপ্টেন তেমেলো চলে গেল।
প্রহরীরা খোলা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসদের পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল ফ্রান্সিস পিছু ফিরে দেখল তেমেলোর জাহাজের মাথায় মড়ার হাড় ও মড়ার মাথা আঁকা পতাকা নামানো। সেখানে সাদা পতাকা উড়ছে। ফ্রান্সিস তখন মারিয়ার কথা ভাবছিল। যে করেই হোকমারিয়াকে সঙ্গে রাখতে হবে। যে খরিদ্দার ওদের কিনবে তাকে বলে ব্যবস্থা করতে হবে।
ফ্রান্সিসরা সারি বেঁধে জাহাজ থেকে পাতা পাটাতনের ওপর দিয়ে নামল। জাহাজঘাটায় বেশ কয়েকটি জাহাজ নোঙর করা। তার মধ্যে একটা ছোট সুদৃশ্য জাহাজও আছে।
রোদ চড়া। ভ্যাপসা গরম। ফ্রান্সিসরা ঘামতে লাগল।
বন্দরের কাছেই একটা মাঠমত। তার মাঝখানে একটা পাথরের বেদীমতো। যাদের বিক্রি করা হবে তাদের সেই বেদীতে তোলা হচ্ছিল। তিন-চারজন কালো পোশাক পরা লোক এই কাজ করছিল। তারা দুজন কৃষ্ণকায় যুবককে বেদীতে তুলল। বেদী ঘিরে বহু লোকের ভিড়। খরিদ্দাররা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই যুবকদের দেখছিল। নিলামের মতো দর হাঁকা শুরু হল। কালো পোশাকপরা লোকেরা যুবকদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল।
দুজন যুবক বিক্রি হয়ে গেল। যে কিনল সে তাদের নিয়ে চলে গেল।
এবার ফ্রান্সিসদের বেদীতে ওঠার পালা। কালো পোশাকপরা লোকেরা এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল আমাদের একসঙ্গে বেদীতে তোল। যাতে একজন খরিদ্দারআমাদের কেনে।
-বেশ। তোমাদের একসঙ্গেই তুলছি। তবে একজন খরিদ্দারই কিনবে এটা নাও হতে পারে। একজন কালো পোশাক পরা তোক বলল।
–ঠিক আছে। তুমি তোল তো। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসদের বেদীর ওপর তোলা হল। ফ্রান্সিস একবার চারদিকে তাকাল। অনেক লোকের ভিড়। সবাই ক্রেতা নয়। কিন্তু ভিড় জমিয়েছে। দুঃখে ফ্রান্সিসের বুক ভেঙে যেতে লাগল। ও মন শান্ত করল। আমরা বিক্রি হতে চলেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্রীতদাস হতে চলেছি। ওপরের দিকে তাকাল। সূর্যকরোজ্জ্বল আকাশ। সামুদ্রিক পাখি উড়ছে। তীক্ষ্ণসুরে ডাকছে। সবাই মুক্ত। সে সারাজীবনের জন্যে বন্দী হতে যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস দেখল ব্যাপ্টেন তেমেলো একপাশেদাঁড়িয়ে হাসছে। অনেকপাউণ্ড পাওয়া যাবে।
এবার কালো পোশাক পরা লোকটি ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে গলা চড়িয়ে বলল–এরা চাইছে এদের কেউ একসঙ্গে কিনুন। বোধহয় সবাই বন্ধু।
দাম হাঁকা শুরু হল। ভিড়ে চারদিক থেকে ক্রেতারা দর হাঁকতে লাগল। সবচেয়ে বেশি দাম যে দিল তার দিকে ফ্রান্সিস তাকাল। মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। মাথার চুল গোঁফ সোনালি রঙের। পরনের পোশাক বেশ দামী।
ভদ্রলোক বেদীর দিকে এগিয়ে এলেন। কালো পোশাকপরা লোকটি এগিয়ে ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বলল–এই আটজন আপনার ক্রীতদাস। ভদ্রলোকের সঙ্গে চার পাঁচজন সশস্ত্র দেহরক্ষী। দেহরক্ষীরা ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল।
তখনই রাজকুমারী মারিয়কে বেদীতে তোলা হল। ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। , এরকম সুন্দরী মেয়ে ক্রীতদাসী হবে?
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্রেতা ভদ্রলোকের দুহাত জড়িয়ে ধরল। বলল–আমরা তো আপনার ক্রীতদাস হলাম। যে ভদ্রমহিলাকে বিক্রির জন্য তোলা হল তিনি আমাদের দেশের রাজকুমারী। আমার স্ত্রী। আমার একান্ত অনুরোধ এই রাজকুমারীকে আপনি কিনুন। তাহলে উনি আমাদের কাছাকাছি থাকতে পারবেন। বলতে বলতে ফ্রান্সিসদের চোখে জল এল। ভদ্রলোক ফ্রান্সিসদের মানসিক আবেগ বুঝতে পারলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন–অনেক দাম উঠছে যে।
–আপনি পারবেন কিনতে। দোহাই আমার এই বিনীত অনুরোধটা রাখুন।
–দেখছি। ততক্ষণে মারিয়ার জন্য বেশ দাম উঠেছে। ভদ্রলোক বেশি দাম হাঁকলেন। দামাদামি চলল কিছুক্ষণ। সবশেষে ঐ ভদ্রলোকই বেশি দাম হেঁকে মারিয়াকে কিনলেন।
আনন্দে ফ্রান্সিস প্রায় কেঁদে ফেলল। হ্যারি ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রাখল। চোখ মুছে বলল–ঈশ্বর করুণাময়। আমার পরিকল্পনা সার্থক হল।
কালো পোশাকপরা লোকেরা আরো লোক বেদীতে তুলতে লাগল। একজন কালো পোশাকপরা লোকমারিয়াকে ভদ্রলোকের কাছে নিয়ে এল। মারিয়া ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ফ্রান্সিসের মন দমে গেল। হ্যারি ফ্রান্সিসদের কাধ চাপ দিয়ে বলল–আবেগপ্রাপ্ত হয়ে না। তাহলে রাজকুমারী আরো দুর্বল হয়ে পড়বেন। শান্ত হও। ফ্রান্সিস তখন আবেগে কাঁপছে। ক্রেতা ভদ্রলোক এটা লক্ষ্য করলেন। মৃদুস্বরে বললেন–তোমার স্ত্রীর যাতে বেশী কষ্ট না হয়, সেদিকটা আমি দেখবো। ভদ্রলোকের দুহাত ঝাঁকুনি দিয়ে ফ্রান্সিস ছেড়ে দিল। ভদ্রলোক বললেন–তোমার নাম কী?
–ফ্রান্সিস।
–আমার নাম পার্তাদো। আমার অনেক জমি-জিরেত আছে। সেখানে কাজ করার জন্যেই তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।
তাহলে আপনি বড় জমিদার।
–হুঁ, তোমরা চাষের কাজ জানো?
–না।
–তাহলে শিখে নেবে। তোমাদের কিন্তু বন্দী হয়ে থাকতে হবে। আমি কাজ চাই। সেটা ভালোভাবে পেলেই আমি সন্তুষ্ট। এবার চলো। পালাবার চেষ্টা করো না। আমার দেহরক্ষীরা রয়েছে। পালাতে গেলে মরবে। চলো। তোমাদের পায়ে লোহার বেড়ি পরাতে হবে। ভদ্রলোক বললেন।
–বেড়ি না পরালে চলে না? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–না। বেড়ি পড়াতেই হবে।
পার্তাদো হাঁটতে লাগল। ফ্রান্সিসরা পিছু পিছু চলল। সঙ্গে দেহরক্ষীরাও চলল।
কিছু দূর যাওয়ার পর বাঁ পাশে একটা কামারশালা দেখা গেল। ফ্রান্সিসদের কামারশালায় ঢোকানো। হল। ফ্রান্সিসরা দেখল আগে যেসব যুবকদের ক্রেতারা কিনেছে তাদেরও সেখানে আনা হয়েছে। তাদেরপায়ে লোহার বেড়িপরানো হচ্ছে। ফ্রান্সিস বুঝল পায়ে বেড়ি পরানো হবেই।
আগের যুবকদের বেড়ি পরানো শেষ হল। এবার ফ্রান্সিসদের পালা।
কামাররা কয়েকজন ফ্রান্সিসদের পায়ে লোহার বেড়ি পরাতে লাগল। গায়ে তপ্ত লোহার– আঁচ লাগছে। কিন্তু ফ্রান্সিসদের তা সহ্য করতে হল। উপায় নেই। তবে সান্ত্বনা এটুকু পেল যে কথাবার্তায় বুঝল পার্তাদো মানুষটা খারাপ নয়। হয়তো ওদের ওপর অত্যাচারটা কমই হবে। কিন্তু তবুক্রীতদাসের জীবন। ফ্রান্সিস খুশি হল দেখে যে মারিয়াকে বেড়ি পরানো হল না।
এবার বেড়ি পরা অবস্থায় হাঁটতে গিয়ে লোহার ভারে ভালো করে হাঁটতেই পারছিলনা কেউ।
জাহাজঘাটায় এল সবাই। ফ্রান্সিস দেখল জলদস্যুদের জাহাজটা নেই। বুঝল ক্যাপ্টেন তেমেলো প্রচুর অর্থ নিয়ে বেপাত্তা হয়ে গেছে।
একপাশে নোঙর করা ছিল যে সুদৃশ্য ছোট জাহাজটা, সেটার কাছে এল সবাই। বেশ কষ্ট করে হেঁটে জাহাজটায় উঠল সবাই।
পার্তাদো বলল–শোন–কেবিনঘরে জায়গা নেই। আমাদের সবাইকে ডেক-এ থাকতে হবে। শুধু ঝড়বৃষ্টির সময় তোমাদের নীচে নামানো হবে।
ফ্রান্সিস পার্তাদোর দিকে এগিয়ে গেল। বলল–
একটা কথা ছিল।
বল। পার্তাদো বলল।
–এখানে আমাদের জাহাজ নোঙর করা আছে। জলদস্যুরা খুব ভাগ্যি যে আমাদের জাহাজটা নিয়ে পালিয়ে যায়নি। আমার অনুরোধ আমাদের জাহাজটা আপনি আপনার জাহাজের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চলুন।
–আমার ছোটজাহাজ। তোমাদেরজাহাজকে টেনে নিয়ে যেতেপারবে? পার্তাদো বললেন।
–তাহলে আমি কথা বলি। ফ্রান্সিস বলল।
–বলো। পার্তাদো বললেন।
আমাদের চারজনকে আমাদের জাহাজ চালাতে দিন। জাহাজটা আপনার জাহাজের পেছনে পেছনেই চালাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–না। তোমাদের হাতের বাঁধন খোলা হবে না। পার্তাদো বললেন।
–হাত বাঁধা অবস্থাতেই আমরা জাহাজ চালাবো। ফ্রান্সিস বলল।
জলে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যেতে পারো। পার্তাদো বললেন।
–আমাদের পায়ের বেড়ি যে কী ভারী আপনার তা ধারণাই নেই। এই লোহার বেড়ি পায়ে সাঁতরানো অসম্ভব। জলে নামলেই আমরা জলে তলিয়ে যাবো। হাঙরের মুখে পড়বো আমরা। কেউ বাঁচবো না। জীবনের ভয় তো আমাদের আছে। ফ্রান্সিস বলল।
পার্তাদো কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন–ঠিক আছে। কিন্তু সবাই তোমাদের জাহাজে থাকবে না। মাত্র একজন–যে তোমাদের জাহাজ চালাবে।
–বেশ। তাই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–একটা কথা। পার্তাদো বলল।
–বলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–এই জাহাজে তোমরা ডেক-এ থাকবে। ঝড়-বৃষ্টির সময় শুধুনীচে নামবে। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেলে আবার ডেক-এ চলে আসবে। পার্তাদো বলল।
-ঠিক আছে। আমরা রাজি। হ্যারি বলল।
–আমাদের খুব খিদে পেয়েছে। খেতে দিন। শাঙ্কো বলল।
পাঁচসাতজন যুবকই আমি কিনবো ভেবেছিলাম। তাই তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা জাহাজে আগেই করে রেখেছি। একটু পরেই খাবার দেওয়া হচ্ছে। পার্তাদো বললেন।
পার্তাদো সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন।
ফ্রান্সিসরা ডেক-এ বসে পড়ল। পা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। লোহার বেড়ি পায়ে পায়ে লেগে শব্দ তুলছে।
ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। চোখ বুজল। হ্যারি ডাকল–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস চোখ বন্ধ রেখেই মুখে শব্দ করল–হু।
রাজকুমারী কোথায় থাকবেন? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
–মারিয়াকেও আমাদের জাহাজে রাখবো। ফ্রান্সিস বলল।
–সেটা তো বললে না। হ্যারি বলল।
–একসঙ্গে সব চাওয়া না। মনে তো হচ্ছে পার্তাদো ভদ্রলোক। আপত্তি করবে না। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া তখনই ফ্রান্সিসের কাছে এসে বসল। বলল–শেষ পর্যন্ত ক্রীতদাস হতে হল।
–উপায় কি। অবস্থার বিপাকে সবই মেনে নিতে হয়। তবে সময় সুযোগ বুঝে ঠিক পালাবো। ফ্রান্সিস বলল।
ক্রীতদাসের জীবন। শরীরের শক্তি অর্ধেক হয়ে যাবে। তখন পারবে পালাতে? মারিয়া বলল।
–অবশ্যই পারবো। মনের জোরটাই বড় কথা। মনে জোর থাকলে অথবঅবস্থায়ও পালানো যায়। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখা যাক। কিন্তু আমিও কি এই ডেক-এই থাকবো? মারিয়া বলল।
না। তোমাকে আমাদের জাহাজে রাখার জন্যে অনুরোধ করবো। পার্তাদো নিশ্চয়ই রাজি হবে। ফ্রান্সিস বলল।
দেখ বলে। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল।
এবার ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকাল। বলল–অনেক করে বলে পার্তাদোকে রাজি করিয়েছি। ফ্লেজার নেই। তুমি জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?
–নিশ্চয়ই পারবো। তুমি ঠিক জানোনা ফ্লেজার কিআর সবসময় হুইলে থাকতো? ওর জায়গায় আমিও অনেকদিন জাহাজ চালিয়েছি। কাজেই আমি ঠিক জাহাজ চালিয়ে যেতে পারবো। শাঙ্কো বলল।
দু’হাত কিন্তু বাঁধা থাকবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তা নিয়েও পারবো। আমার জামার নীচে ছোরা আছে। হাতের বাঁধন কেটে ফেলবো। শাঙ্কো বলল।
–পারবেনা। পার্তাদোর দেহরক্ষীরা জাহাজে থাকবে।
-হ্যাঁ। এটা ভুলে গিয়েছিলাম। ঠিক আছে হাত বাঁধা অবস্থাতেই জাহাজ চালাবো। শাঙ্কো গলায় জোর দিয়ে বলল।
ওরা কথাবার্তা বলছে তখনই সকলের জন্যে খাবার নিয়ে রাঁধুনি এল। চিনেমাটির বাসনে ওদের খেতে দেওয়া হল। সবাইক্ষু ধার্ত। প্রথমে সুপ দেওয়া হল। চেটে খেয়ে ফেলল সবাই। তারপর সবজি তরকারি। কী সুস্বাদু! সবাই সাগ্রহে খেতে লাগল। তারপর দেওয়া হল মাংস রুটি। এত সুস্বাদু খাবার কতদিন খায়নি। সবাই চেটেপুটে খেতে লাগল। বারবার মাংসের ঝোল চাইতে লাগল। রাঁধুনিও দিতে লাগল। তারপর রাঁধুনি হেসে বলল–আর নেই। শুধু আমাদের মালিকআর রক্ষীদের আর জাহাজ চালকের খাবার রয়েছে।
-কিন্তু তুমি? হ্যারি জানতে চাইল।
–আমি অল্প খাবো। তোমরা এরকম রাক্ষসের মতো খাবে তাতো জানতাম না। রাঁধুনি হেসে বলল।
তুমি বুঝবে না ভাই। কতদিন পরে যে এরকম সুস্বাদু খাবার খেলাম তা মনেও করতে পারছি না। হ্যারি হেসে বলল।
–জাহাজ কখন ছাড়া হবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–মালিক জানে। রাঁধুনি বলল।
তখনই পার্তাদো ডেক-এ উঠে এলেন। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। পার্তাদোর কাছে গেল। বিনীতভাবে বলল–আপনি আমাদের সব অনুরোধই রেখেছেন। এটাই আমার শেষ অনুরোধ। মারিয়াকে দেখিয়ে বলল–আমার স্ত্রীকে আমাদের জাহাজে তার কেবিনঘরে থাকতে দিন। এই ডেক-এর ওপর তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। পার্তাদো মারিয়ার দিকে তাকাল। ভাবতে লাগল। মারিয়া মৃদুস্বরে বলল বলল–আপনি দয়া করে এই অনুরোধ রাখুন।
–বেশ। তাই হবে। তবে পালাবার চেষ্টা করবে না। পার্তাদো বলল।
–আপনার দেহরক্ষীরা তো থাকবে। মারিয়া বলল।
–ওরা তো রাত জেগে তোমাকে পাহারা দিতে পারবে না। পার্তাদো বললেন।
–আমি আমার স্বামী-বন্ধুদের ফেলে একা পালাতে যাবো কেন? মারিয়া বলল।
—ঠিক আছে। তুমি ঐ জাহাজেই থাকবে। পার্তাদো বলল। ফ্রান্সিস বলে উঠল–কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছি না।
–ধন্যবাদের কিছু নেই। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হয়। পার্তাদো বলল।
–আপনি জাহাজ কবে ছাড়ছেন? ফ্রান্সিস প্রশ্ন করল।
–আমার সব কাজ মিটে গেছে। কাল সকালেই জাহাজ ছাড়বো। পার্তাদো বললেন।
পার্তাদো জাহাজ চালকের সঙ্গে কথা বলে চলে গেলেন।
ফ্রান্সিস ডেক-এ বসে রইল।
বিকেল হল। সূর্য তখন অস্ত যায় যায়। মারিয়া গিয়ে কাঠের রেলিং ধরে দাঁড়াল। মনে যত দুঃখ থাক মারিয়া সূর্যাস্ত দেখবেই।
সূর্য অস্ত গেল। গভীর কমলা রঙতখনও পশ্চিমের আকাশ জুড়ে। মারিয়া সেইদিকে তাকিয়ে রইল।
রাতের খাবারে মাংস দেওয়া হল না। ফ্রান্সিসরা অবশ্য সেটা আশাও করেনি। সামুদ্রিক মাছের ঝোলই খেতে হল। খাওয়ার সময় একজন রক্ষী এসে ফ্রান্সিসদের হাতের বাঁধন খুলে দিল। খাওয়া হলে আবার হাত বেঁধে দিয়ে গেল। দুপুরেও খাওয়া-দাওয়ার সময় এভাবেই ওদের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে পরে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
সেই রাতে মারিয়াকে আর তাদের জাহাজে পাঠানো হল না। মারিয়া ফ্রান্সিসদের সঙ্গে ডেক-এই ঘুমোলা। পরের দিন সকালে পার্তাদো জাহাজের ডেক-এ উঠে এল। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমাদের জাহাজ যে চালাবে সে উঠে এসো। শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। পার্তাদোর কাছে গেল। পার্তাদো বলল–তোমাদের জাহাজে যাও। তোমাদের রাজকুমারীকে নিয়ে যাও। দুজন দেহরক্ষীও যাবে। হাত খোলা হবে শুধু খাওয়ার সময়। অন্য সময় বাঁধা থাকবে।
–বেশ। শাঙ্কো মাথা ঝুঁকিয়ে বলল–হাত বাঁধা নিয়ে আমি জাহাজ চালাবো।
মারিয়াকে নিয়ে শাঙ্কো পার্তাদের জাহাজ থেকে নেমে গেল। পেছনে দু’জন সশস্ত্র দেহরক্ষী। নিজেদের জাহাজের কাছে গিয়ে দেখল পাটাতন পাতা নেই। শাঙ্কো সমুদ্রের জলে নামল। সাঁতরে নিজেদের জাহাজের কাছে গেল। দড়ির মই বেয়ে জাহাজের ডেক-এ উঠল। কাঠের পাটাতন এনে পেতে দিল। মারিয়া আর দেহরক্ষীরা জাহাজে উঠে এল।
ভেজা জামাকাপড় নিয়েই শাঙ্কো পাল খুলে দিল। দড়িদড়া বাঁধন। মারিয়া নিজের কেবিনঘরে চলে গেল।
একটু বেলা হতেই পাৰ্তাদোর জাহাজ ছাড়ল। সেই জাহাজের পেছনে পেছনে শাঙ্কোও ওদের জাহাজ চালাল। দুহাত বাঁধা হুইল ঘোরাতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু শাঙ্কোর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভালোভাবে জাহাজ চালাবেই। পায়ের বেড়িও কোন বাধা বলে মানবে না।
শান্ত সমুদ্র। বাতাসেরও তেমন বেগ নেই। দুটো জাহাজই দ্রুত চলল।
পার্তাদের জাহাজের ডেক-এই ফ্রান্সিসদের রাতদিন কাটতে লাগল।
পার্তাদোর জাহাজ একটা ছোট বন্দরে থামলো। পাটাতন ফেলা হল। পার্তাদোর রাঁধুনি নেমে গেল। ওদিকে শাঙ্কোও ওদের জাহাজ থামাল।
তখন বিকেল। মারিয়া জাহাজ থেকে নেমে ফ্রান্সিসদের জাহাজে এল। শাঙ্কোও এল। ফ্রান্সিস আর হ্যারির সঙ্গে কথাবার্তা বলল।
পার্তাদোর রাঁধুনি একগাদা ফুলফলের চারা নিয়ে এল। হয়তো পাৰ্তাদোর বাড়িতে বাগানটাগান আছে। গাছগুলো লাগানো হবে।
সূর্য অস্ত গেল। মারিয়া সূর্যাস্ত দেখে নিজেদের জাহাজে চলে গেল। শাঙ্কোও ফিরে গেল।
আবার জাহাজ দুটো চলল। সমুদ্র কিছুটা অশান্ত হলেও জাহাজ চালাতে অসুবিধে হচ্ছিলনা।
হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল
–একটা ব্যাপারে আমারা খুব ভাগ্যবান। ক্যাপ্টেন তেমেলো আমাদের জাহাজটা বিক্রি করে দিয়ে পালায়নি।
–যা বলেছো। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
–কিন্তু পাৰ্তাদোর জমিদারিতে ক্রীতদাসের কাজ করতে করতে কি আমরা পালাতে পারবো? পায়ের এই বেড়ি নিয়ে?
–এখন কিছু বলতে পারছি না। আমাদের থাকার ব্যবস্থা, কাজের ব্যবস্থা সব দেখি তখন ভাববো।
হ্যারি একটু থেমে বলল–ফ্রান্সিস-আমার কি ভয় জানো? হয়তো দেশে আর ফেরা হবে না।
–হবে। মন দুর্বল করো না। আমরা মুক্তিও পাবো দেশেও ফিরবো। ফ্রান্সিস গলায় জোর দিয়ে বলল।
-তুমি আশাবাদী। আমি অতটা আশাবাদী হতে পারছি না। হ্যারি আস্তে আস্তে বলল।
আগে থেকেই হতাশ হয়ে পড়ছো কেন? দেখই না কি হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–অগত্যা দেখা যাক। হ্যারি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
সেদিন দুপুরে আকাশ অন্ধকার করে গভীর কালো মেঘ জমল। ফ্রান্সিসরা বুঝলঝড় আসছে। আকাশ চিরে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। সেইসঙ্গে ঘন ঘন বাজ পরার গুরুগম্ভীরশব্দ।
পার্তাদোর রাঁধুনি ডেক-এ উঠে এল। বললঝড়বৃষ্টি আসছে। মালিক তোমাদের নিচে আসতে বলেছেন।
ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়াল। তারপর একে একে নীচে নামল। দুটো কেবিনঘর। একটা বড়। একটা ছোট। বড়টা বোধহয় পার্তাদোর জন্যে। অন্যটা রক্ষী আর রাঁধুনির জন্য।
সেই ঘরেই ফ্রান্সিসরা ঢুকল। কিন্তু এত ছোট কেবিনঘর যে ফ্রান্সিসদের প্রায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। পাশের কেবিনঘর থেকে পার্তাদো বলল–তোমরা কয়েকজন এইঘরে আসতে পারো।
ফ্রান্সিসরা কয়েকজন পার্তাদোর কেবিনঘরে গেল। ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। বোঝাই যাচ্ছে পার্তাদো খুব বিলাসী মানুষ। ঘরের সবকিছু সাজানো গোছানো। বিছানার চাদর ফুল আঁকা ধবধবে সাদা।
কাঠের দেয়ালে একটা ঝকঝকে আয়না আটকানো। আয়নার চারপাশের কারুকাজ দেখার মতো। তার সামনের তাকে দাড়ি কামাবার ক্ষুর। দাড়ি কামাবার সাবান রাখার একটা রুপোর বাটি। সুন্দর একটা তোয়ালে ঝুলছে। উল্টেদিকের দেয়ালে একটা তৈলচিত্র। স্টিল লাইফ ছবি। একটা আপেল, ভাঙা বেদানা, কলা একটা ফুল, জ্বলন্ত মোমবাতি। মোমবাতির আলো একপাশ থেকে পড়েছে। বড় সুন্দর ছবি। একটা ছোট্ট টেবিল। তার ওপর কয়েকটা বাঁধানো বই। তাহলে পার্তাদের পড়াশুনোর অভ্যেস আছে। এরকম মানুষ খারাপ হতে পারে না।
পার্তাদো বলল–সবাই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াও।
ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় জাহাজটা জোরে লাফিয়ে উঠল। ফ্রান্সিসরা প্রায় ছিটকে পড়ল। শুরু হল প্রচণ্ড দুলুনি। ফ্রান্সিসদের অনেক সময়ও জাহাজে কাটে। ঝড় জল বৃষ্টির ধাক্কা। ওরা ভালোই সামলাতে পারে।
প্রায় কুড়ি পঁচিশ মিনিট ঝড়-বৃষ্টি চলল। জাহাজে ক্যাচকোঁচ শব্দ উঠল।
পার্তাদো চুপ করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আয়না ছবি দেয়ালে শক্ত করে গাঁথা। ওগুলো নড়তে লাগল কিন্তু ছিটকে পড়ল না।
ফ্রান্সিস ভাবছিল একাশাঙ্কো ঝড়ের মোকাবিলা করতে পারছে কিনা। দেহরক্ষীরা তো আর নাবিক না। সমুদ্রের ঝড়ে জাহাজ সামলে নিয়ে যাওয়া ওরা জানে না। শাঙ্কোকে একাই সব সামলাতে হয়েছে। মারিয়াও একা। তবে ঝড়বৃষ্টিতে জাহাজে থাকা ওর অভ্যাস হয়ে গেছে।
বৃষ্টি থেমে গেল। ঝোড়ো বাতাসের বেগও কমে গেল। মেঘ কেটে গেল। সূর্য দেখা গেল। বিকেল হল। সূর্য অস্ত গেল। সমুদ্র অনেকটা শান্ত হল। জাহাজ দুটো চলল। ফ্রান্সিসদের জাহাজ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। শাঙ্কো একাই বোধহয় পালটাল ঠিককরছিল। জাহাজের গতি বাড়িয়েছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিসদের জাহাজ পার্তাদোর জাহাজের কাছে চলে এল।
পরের দিন কয়েক ধরে সমুদ্র শান্তই রইল। পার্তদোর নির্দেশে জাহাজের গতি বাড়ানো হল। উন্মুক্ত ডেক-এ ফ্রান্সিদের দিনরাত কাটতে লাগল। একঘেয়ে জীবন। উপায় নেই। মেনে নিতেই হচ্ছে।
তিন-চারদিন পর একদিন সকালে পার্তাদো ডেক-এ উঠে এলেন। ফ্রান্সিসদের কাছে এলেন। বললেন–সামনেই এনকোবার বন্দর। আমরা ওখানেই নামবো।
দূর থেকে এনকোবার বন্দর দেখা গেল। যতদূর দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা গেল খুব বড় বন্দর নয়।
আস্তে আস্তে দুটো জাহাজ এনকোবার বন্দরের জাহাজঘাটায় এসে থামল। নোঙর ফেলা হল। পাটাতন পাতা হল।
নিজেদের জাহাজ থেকে শাঙ্কো আর মারিয়া নেমে এল। পার্তাদের ছোট জাহাজে এল। দেখল ফ্রান্সিসরা ডেক-এ শুয়েবসে আছে। ফ্রান্সিসকে দেখে মারিয়া চমকাল। ফ্রান্সিসের চেহারা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। ও তাড়াতাড়ি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল– তোমার শরীর ভালো আছে তো? ফ্রান্সিস হেসে বলল–আমার জন্যে ভেবো না।
-তোমার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেছে। মারিয়া বলল।
বন্ধুদের দেখ! ওদেরও আমার মতো অবস্থা। দিনরাত ডেক-এ পড়ে থাকা। বেঁচে আছি এটাই যথেষ্ট। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল।
তুমি কক্ষনো মৃত্যুর কথা বলবে না। অভিমানী স্বরে মারিয়া বলল।
–আমরা কি মৃত্যুকে এড়াতে পারবো? ফ্রান্সিস আগের মতোই হেসে বলল।
–সেসব বুঝি না। তুমি এভাবে কখনও বলবে না। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল।
পার্তাদো ডেক-এ উঠে এলেন। বললেন–তোমরা এখানে নামো। আমার দেহরক্ষীরা তোমাদের পাহারা দিয়ে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবে।
ফ্রান্সিসরা আস্তে আস্তে জাহাজ থেকে নামতে লাগল। পায়ে বেড়ি। শব্দ হচ্ছে। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। তবু যেতে হবে। নতুন আস্তানা। কেমন হবে কে জানে। তবে ক্রীতদাসদের আস্তানা। সে কি কখনও ভালো হয়।
নীচে নেমে ফ্রান্সিস পার্তাদোর কাছে গেল। বলল–আপনার জাহাজের জন্য তো পাহারাদার থাকবে।
নিশ্চয়ই। পাহারাদার থাকবে জাহাজচালক। পার্তাদো বললেন।
–তাহলে একটা অনুরোধ। সে যেন আমাদের জাহাজটাও পাহারা দেয়। আমাদের কেউ তো থাকতে পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
না। তোমাদের কাউকে ছাড়া হবে না। পার্তাদো বললেন।
তাহলে আপনার জাহাজ চালক যেন আমাদের জাহাজটারও দেখাশুনা করে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। বলে দিচ্ছি। পার্তাদো বললেন। তারপর ইশারায় জাহাজ চালককে ডাকলেন। জাহাজচালক ওর কাছে এল। পার্তাদো বললেন–শোনো। আমাদের জাহাজটার যেমন দেখাশুনো করবে তেমনি এদের জাহাজটারও দেখাশুনা করো। দেখো দুটো জাহাজই যেন চুরি না হয়ে যায়। তারপর বললেন
–তোমাদের জাহাজটার জন্যে আর মায়া বাড়াচ্ছো কেন? আর কোনদিন কি জাহাজটায় চড়তে পারবে?
–তবু আমাদের অনেক সুখদুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐ জাহাজটা। ওটা চুরি হয়ে যাক এটা চাইনা।
–বেশ। তোমরা চাইছো তাই পাহারার ব্যবস্থা করে দিলাম। এবার চলো সব। পার্তাদো হাত নেড়ে বললেন। দেহরক্ষীরা ততক্ষণে ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। হাতে খোলা তরোয়াল। খুব বড় বন্দর নয় এই এনকোবার বন্দর। ছোট বন্দরই বলা যায়। আরো দুটো জাহাজ নোঙর করে আছে দেখা গেল।
ফ্রান্সিসরা বাঁচল যে রোদের তেমন তেজ নেই। বেশ হাওয়া ছেড়েছে। কষ্ট একটু কমল।
ফ্রান্সিস চারদিকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। দুপাশে দোকানপাট। লোকজনেরও ভিড় আছে। লোকেরা ফ্রান্সিসদের দেখল। তবে খুব একটা অবাক হল না। ক্রীতদাস দেখায় তারা অভ্যস্ত। তবে কৃষ্ণকায় যুবক-যুবতীদেরই ওরা দেখে থাকে। আজকে দেখল বিদেশি ইউরোপীয় যুবক ও মারিয়াকে। তাই একটু অবাকই হল।
একজন দেহরক্ষী ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। একটা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে পার্তাদো ওদের পেছনে পেছনে চলল।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–ফ্রান্সিস, ডানদিকে তাকিয়ে দেখ–একটা কামারশালা। ফ্রান্সিস দেখল।
হ্যারি বলল–তার মানে এখানে বেশ কয়েকন জমিদার আছে। ক্রীতদাসদের বেড়ি পরানোর কাজ এখানে ভালোই চলে।
–হুঁ। ঠিকই বলেছো। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।
তখনই কোলা ফ্রান্সিসদের পেছনে এসেদাঁড়াল। বলল–ভাই, তাহলে পালানো গেল না।
-তাই তো দেখছি। ফ্রান্সি একটু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
–আর কি পালানো যাবে? কোলা বলল।
দেখা যাক। সময় আর সুযোগ বুঝে পালাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
পারবে না। কোলা হাত নেড়ে বলল।
–দেখা যাক। ফ্রান্সিস আস্তে বলল।
পথ প্রদর্শক দেহরক্ষীটি একটা বিরাট বাড়ির প্রবেশপথের সামনে এসে দাঁড়াল। বেশ বড় একটা লোহার দরজা। একজন প্রহরী দরজায় পাহারা দিচ্ছে। ফ্রান্সিসদের দেখে ঘর ঘর শব্দেদরজা খুলে দিল। ফ্রান্সিসরা ঢুকল।
বাড়ি দেখে ফ্রান্সিস বেশ অবাক হল। কত বড় বাড়ি। পাথর আর কাঠে তৈরী। এসব অঞ্চলে এরকম বাড়ি দেখবে আশা করেনি। বোঝা গেল পাৰ্তাদো বেশ বর্ধিষ্ণু জমিদার।
ডানদিকে তাকিয়ে দেখল দূরে বিস্তৃত জমি। শূন্য। বোঝা গেল যা ফসল হয়েছিল তা কেটে ফেলা হয়েছে। নতুন করে চাষ শুরু হবে।
বাড়িতে ঢোকার দরজার সামনে এসে দেহরক্ষী দাঁড়াল। তখনই পাৰ্তাদের গাড়ি ঢুকল। পার্তাদো কোন কথা বললেন না। বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মারিয়াকে তার সঙ্গে যেতে ইঙ্গিত করলেন। মারিয়া দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–যাও। মারিয়া পার্তাদের পেছনে পেছেনে বাড়িতে ঢুকে গেল। ফ্রান্সিস স্ফস্তির শ্বাস ফেলল– যা হোক মারিয়া বাড়ির অন্দরমহলেই থাকবে।
দেহরক্ষীটি আবার হাঁটতে শুরু করল। ফ্রান্সিসরাও ওর পেছনে পেছনে চলল।
বাড়ির পেছনদিকে এল সবাই। একটা লোহার কাকদরজাওয়ালা ঘরের সামনে এল ওরা। দরজায় তালা ঝুলছে। দরজার কাছে দুজন সশস্ত্র প্রহরী দাঁড়িয়েছিল। একজন দরজা খুলে দিল। রক্ষীটি ইঙ্গিতে ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢুকতে বলল।
ফ্রান্সিসরা ঘরটায় ঢুকল। বেশ বড় পাথরের ঘর। এই দিনের বেলাতেও কেমন অন্ধকার অন্ধকার। অনেক ওপরে দু’দিকে দুটো ফোকর। জানালার মতো। সারা ঘরের মেঝেয় শুকনো ঘাস আর পাতায় তৈরি দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা বিছানার মতো। এককোণে দু’জন কৃষ্ণকায় যুবক বসে আছে। ওরাও ক্রীতদাস।
ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস বসল। হ্যারি পাশে এসে বসল। ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল–হ্যারি শরীর ভালো আছে তো?
–আমার তো জানোই। খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। এতটা পথ পায়ের বেড়ি টানতে টানতে আসা। ক্রীতদাস হব কোনদিন ভাবিনি।
–অবস্থা বিপাকে সবই হতে হয়। ফ্রান্সিস বলল–এই নিয়ে দুঃখ কোরো না। দেখি না কী করা যায়।
পরদিন ফ্রান্সিসরা সবে সকালের খাবার খেয়েছে দুজন কৃষ্ণকায় ক্রীতদাস দরজায় এসে দাঁড়াল। কয়েদঘরের দরজা খোলা হল।
কৃষ্ণকায়দের একজন এগিয়ে এল। বলল–তোমাদের কয়েকটা কথা বলার আছে– মানে কাজের কথা। তার আগে আমার নাম বলে রাখি। আমার নাম ওঙ্গা। তোমাদের মাতব্বর কে?
মাতব্বর কথাটা শুনে ফ্রান্সিসদের রাগ হল। ও প্রথমে কথা বলতে চাইল না। তারপর ভেবে দেখল এখন রাগারাগি করাটা বুদ্ধিমানের কাজ না। ও উঠে দাঁড়াল। বলল–
–আমি ফ্রান্সিস।
–ঠিক আছে। শোন–ওঙ্গা বলতে লাগল–এখানে গত চারমাস এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি অথচ এটাই বৃষ্টি হওয়ার ঠিক সময়। এখানে মুষলধারেই বৃষ্টি হয়। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার নাম নেই। তাই কর্তাসাহেবের নির্দেশ এই ঘরের পেছনে যে ইঁদারা আছে সেখান থেকে জল নিয়ে ক্ষেতে জল ছিটোতে হবে।
ক্ষেতে জল ছিটিয়ে চাষ হয়? হ্যারি বলল।
–সেটা কর্তাসাহেব বুঝবেন। ক্রীতদাসদের কর্তারা ক্রীতদাসদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ায় না। যতটাকাজ তাদের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব তা আদায় করে নেয়। তোমাদের যা বলা হচ্ছে তাই করতে হবে। রাজি না হলে সবাইকে চাবুক খেতে হবে। ওঙ্গা বলল।
–চাবুক? কর্তাসাহেব চাবুক মারবে? শাঙ্কো বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল–পার্তাদো চাবুক মারেন?
–হ্যাঁ। দরকার পড়লে। কর্তাসাহেবদের চেহারা সর্বত্রই এক। ওঙ্গা বলল।
–ঠিক। আমি ব্যতিক্রম আশা করেছিলাম। ফ্রান্সিস বলল।
–তবু তো চাবুক। কোথাও কোথাও হাত পা ভেঙে দিয়ে রাস্তায় বের করে দেওয়া হয়। ভিখারির জীবন কাটাতে হয় সেইসব ক্রীতদাসদের।
–এটা হতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
যাক গে–যেজন্যে এলাম। আমরা সব দেখিয়ে দিচ্ছি–তোমরা সেইভাবেই কাজে লাগো। ওঙ্গা বলল। তারপর হাত নেড়ে বলল–
এবার সবাই বেরিয়ে এসো।
ফ্রান্সিসরা বেরিয়ে এল। পুরনো বন্দী দুই কৃষ্ণকায়ও এল। কারো রেহাই নেই।
ফ্রান্সিসদের ঘরের পেছনে নিয়ে যাওয়া হল। একটা মস্তবড় ইঁদারা। তার ধারে ধারে আট দশটা বড় বড় কাঠের বালতি রাখা। ওঙ্গা বলল–এই বালতিগুলোয় জল ভরে ভরে ক্ষেতে ছিটোতে হবে। ক্ষেত জলে ভেজাতে হবে।
–অত বড় ক্ষেত–এ তো অনেকদিন লাগবে। শাঙ্কো বলল।
যতদিন লাগে লাগুক। তবে তোমাদের ভাগ্যি যদি ভালো হয় তবে হয়তো ততদিনে বৃষ্টি শুরু হবে। তাহলেই ক্ষেত ভেজানোর কাজ তখন বন্ধ হবে। ওঙ্গা বলল।
–তাহলে এখনই কাজ আরম্ভ করতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ এখনই। দুপুরে একঘণ্টা বিশ্রাম। তখন এখানে এসে খেয়ে যাবে। ওঙ্গা বলল।
–আমরা তো ক্ষেত থেকে পালাতে পারি। হ্যারি আস্তে বলল।
–পায়ের ঐ বেড়ি নিয়ে? সাত পাও যেতে পারবে না। তার আগেই প্রহরীরা মেরে ফেলবে। কাজেই পালাবার ভাবনা ছাড়ো। ভুলে যেও না তোমরা ক্রীতদাস। কর্তাসাহেবের সব হুকুম। মরে গেলেও সেই হুকুম মানতে হবে। একসময় আমরা দুজনেও এমনি অত্যন্ত কষ্টকর কাজ করেছি। দেখেছি সব সহ্য হয়ে যায়। সহ্য না হলে উপায়ও নেই। ওঙ্গা বেশ বিজ্ঞের মত বলল।
–ঠিক আছে। আমরা কাজ শুরু করছি। শাঙ্কো বলল।
কিন্তু একটা কথা। পায়ে বেড়ি নিয়ে তো আমরা দ্রুত কাজ করতে পারবো না। ফ্রান্সিস বলল।
–তবু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ করতে হবে। ওঙ্গা বলল।
ফ্রান্সিসরা ইঁদারার ধারে গেল। দড়ি-বাঁধা দুটো বড় বালতি। শাঙ্কো আর বিস্কো দুটো বালতির দড়ি হাতে নিল। তারপর জল তুলতে লাগল। বালতিতে ঢালতে লাগল।
বাকি সবাই জলভর্তি বালতি নিয়ে ক্ষেতের দিকে চলল। রোদ চড়া নয় বলে বাঁচোয়া।
ফ্রান্সিস দেখল ক্ষেতের মাটি শুকনো খটখটে। এত দূরবিস্তৃত ক্ষেতের মাটি শুধু বালতির জলে ভেজানো কি সম্ভব? কিন্তু উপায় নেই।
কর্তাসাহেবের হুকুম।
ফ্রান্সিসই প্রথম বালতি থেকে জল ছিটোলো। মুহূর্তে জল শুষে গেল। তবে জল পড়ে মাটির রঙ কালো হল। ফ্রান্সিস বুঝল কালো মাটি। তার মানে তুলোর চাষ হয়।
মাটিতে জল ছিটোনো চলল। বেড়ি পায়ে এতবার ইঁদারা থেকে ক্ষেত-এ যাওয়া। সবাই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল। হাঁপাতে লাগল। কিন্তু ওঙ্গাদের কোনো হেলদোল নেই। ওরা নির্বিকারে দেখতে লাগল। রোদের তেমন তেজ নেই বলে ওদের কষ্টটা একটু কম হচ্ছিল।
ফ্রান্সিস এবার ভালো করে চারিদিকে তাকাল। দেখল চারপাঁচজন সশস্ত্র প্রহরী দূরের চেস্টনাট গাছটার নীচে বসে আছে। পালাবার পথ বন্ধ।
ক্ষেতে জল ছিটোনোর কাজ চলল।
দুপুর হল। ওঙ্গা গলা চড়িয়ে বলল–খেতে চল।
ফ্রান্সিসরা হাঁপাতে হাঁপনাতে কয়েদঘরে ফিরে এল। প্রায় সবাই ঢ ঢক্ করে জল খেতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল–এক্ষুনি অত জল খেও না। একটু জিরিয়ে নাও।
কিছু পরেই খাবার এল। ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা চেয়ে চেয়ে রুটি মাংস খেল। সবজীর ঝোল খেল।
আবার কাজে নামা।
বিকেল পর্যন্ত জল ছিটোনোর কাজ চলল। ওঙ্গারা ঘুরেঘুরে কাজ দেখতে লাগল। কেউ বসে পড়লে উঠিয়ে দিতে লাগল। বোঝাই গেল কাজের সময় বিশ্রাম পাওয়া যাবে না।
ওঙ্গার উচ্চকণ্ঠ শোনা গেল–এবার কয়েদঘরে চলো।
তখনই পার্তাদো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। ওঙ্গারা ছুটে পার্তাদের কাছে গেল। পার্তাদো ওদের সঙ্গে কী কথাবার্তা বললেন। তারপর বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকালেনও না। ক্ষেতের ধারে চেস্টনাট গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীরাও ফিরে এল।
দুপুরের মতো এবারও সবাই পরিশ্রান্ত। অনেকেইহাঁপাচ্ছে। কয়েকজন শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের হুঁশিয়ারিতে কেউ তক্ষুণি জল খেল না। একটু জিরিয়ে নিয়ে জল খাওয়া চলল।
বিকেলের খাবার দেওয়া হল। কলা আর আটার পিঠে। তাইফ্রান্সিসরা গোগ্রাসে গিলল।
কয়েদঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
হ্যারি শুয়ে পড়েছিল। হঠাৎ শুয়ে থেকেই হ্যারি হো হো করে হেসে উঠল। হ্যারি কখনও এরকম হাসে না। বন্ধুরা অবাক। ফ্রান্সিসের পাশেই হ্যারি শুয়ে পড়েছিল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে হ্যারির মুখের ওপর ঝুঁকে বলে উঠল
–হ্যারি কী হয়েছে? তোমার শরীর ভালো তো?
হ্যারি উঠে বসল–জানো তো আমি শরীরের দিক থেকে দুর্বল। খুবই পরিশ্রান্ত লাগছে।
-তুমি পরিশ্রম সহ্য করতে পারবে? ফ্রান্সিস বলল।
–এই পরিশ্রম আর কতদিন? হ্যারি হেসে বলল।
তার মানে? ফ্রান্সিস কথাটা শুনে বেশ অবাক হল।
ইঁদারা কি সমুদ্র না নদী? হ্যারি আবার হেসে বলল।
–আঁ? ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠল। গলা চড়িয়ে বলল–সাবাস হ্যারি–আমি এটা আগে ভাবতেই পারি নি। শুধু পরিশ্রম কষ্টের কথা ভেবেছি। এবার ফ্রান্সিস সকলের দিকে তাকিয়ে বলল–বেশ দ্রুত হাঁদারা থেকে জল তুলতে থাকো। তাড়াতাড়ি ইঁদারার জল শেষ কর। তাহলেই এই অমানুষিক খাটুনি থেকে মুক্তি।
এবার সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বন্ধুরা ধ্বনি তুলল—হো হো হো। প্রহরীরা ছুটে এল। ভাবল বন্দীদের মধ্যে বোধহয় মারামারি লেগেছে। ফ্রান্সিসরা হাসতে লাগল। প্রহরীর বুঝল তেমন কিছু না। ওরা নিশ্চিন্ত মনে পাহারা দিতে লাগল।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর কোলা ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–তোমরা হো হো করছিলে। কী ব্যাপার?
আরে বাবা ইঁদারার জল তো অঢেল নয়। দিন কয়েকের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে। তখন আর জল উঠবে না। কাদামাটি উঠবে।
–তখন ঐ কাদামাটিই তুলতে বলবে। ফ্রান্সিস বলল কিন্তু সেটাই বা কতদিন? তারপর তো শুধুই মাটি।
তা ঠিক। আমরা এটা ভাবিনি। তাহলে তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জল তুলে ফেলতে হয়। কোলা বলল।
–সে কথাই সবাইকে বলছিলাম। ফ্রান্সিস বলল।
এটা করতেই হবে। কোলা বলল। তারপর বলল–এখানে আমাদের দেশের লোকও আছে।
ওঙ্গাই তো তোমাদের দেশের লোক। ফ্রান্সিস বলল।
–একবার ওদের বলে দেখবো? যদি ওরা আমাকে মুক্তি দিতে পারে। কোলা বলল।
–অসম্ভব। তোমার দেশের কেউ যদি তোমাকে পালাতে দেয় তাহলে সে পার্তাদোর চাবুক খেয়ে মরে যাবে। এসব বড় সাংঘাতিক জায়গা। কেউ একটু ওদিক করলে আর রক্ষা নেই। বেঘোরে মরতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি ঠিক বলেছো। এখান থেকে পালানো অসম্ভব। কোলা বলল। তারপর শুতে চলে গেল।
ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। তখনই পায়ের দিকে তাকাল। মশালের আলোয় দেখল-লোহার বেড়িতে ঘষা লেগেলেগে ঘা মতো হয়ে গেছে। জলের বালতি নিয়ে ছুটোছুটিতে আরো ঘা বাড়বে। পাশেই হ্যারি ঘুমিয়ে আছে। ফ্রান্সিস হ্যারির পায়ের দিকে তাকাল। হ্যারির পায়েরও এক অবস্থা। ওষুধ চাই। পার্তাদোকে বৈদ্যির কথা বলতে হবে। মারিয়াকেও দিনে একবার ওদের কাছে আসতে দিতে বলবে।
সেদিন জল ছিটোনোর কাজ সেরে ফ্রান্সিসরা সবে বিকেলের খাবার খাচ্ছে তখনই পার্তাদো কয়েদঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। প্রহরীরা মাথা নুইয়ে সম্মান জানান।
–কেমন আছো তোমরা? একটু হেসে পার্তাদো বললেন।
–ভালো নেই। ফ্রান্সিস কথাটা বলে দরজার কাছে গেল।
–কেন? খাবার দাবার তো যথেষ্ট দেওয়া হচ্ছে। পার্তাদো বললেন।
ক্ষেতে জল ছিটোনো অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ। শাঙ্কো বলল।
পরিশ্রমের জন্যেই তো তোমাদের কিনে এনেছি। আমার লোক দিয়েই যদি হবে তাহলে আর তোমাদের আনলাম কেন!
পরিশ্রম তো করতেই হবে। কিন্তু তার জন্য তো শরীরটাকেও সুস্থ রাখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
-কেন? তোমাদের কারো অসুখ করেছে? পার্তাদো বললেন।
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস পা দেখিয়ে বলল–লোহার বেড়ির ঘষায় আমাদের ঘা হয়ে গেছে। পার্তাদো তাকিয়ে দেখলেন। মুখে চুকচুশব্দকরলেন। বললেন–বৈদ্যি পাঠিয়ে দেব।
–পায়ের বেড়ি খুলে ফেললে হয় না? শাঙ্কো বলল।
–না। ওটি হবে না। পার্তাদো মৃদু হেসে বললেন।
এবার ফ্রান্সিস বলল–একটা কথা বলছিলাম।
-বলো। পার্তাদো ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকালেন।
–বলছিলাম-রাজকুমারী মারিয়াকে বিকেলবেলা মানে আমাদের কাজের শেষে যদি এখানে একবার সারাদিনেই একবার আসতে দেন তাহলে ভালো হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমাদের রাজকুমারী ভালো আছে। আমার স্ত্রীর খাস সহচরী হয়ে আছে। সহচরী হিসেবে অমন শিক্ষিতা মেয়ে তো পাওয়া যায় না। পার্তাদো হেসে বললেন।
-সেটাই ওর মুখ থেকে শুনতে চাই। ও নিজেও আমাদের জন্য চিন্তায় থাকে। আমাদের দেখলে, আমাদের সঙ্গে কথা বললে ওর মনটাও ভালো থাকে। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমাদের অনুরোধের দেখছি সীমা নেই। পার্তাদো আবার হেসে বললেন।
-এটাই শেষ অনুরোধ। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। দেখছি। পার্তাদো বললেন।
পরদিন সকালের খাবার খাচ্ছে ফ্রান্সিসরা। তখন বদ্যি এল। গায়ে কালো রঙের বিরাট আলখাল্লা। মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ। সব সাদা। গলায় নানারঙের পাথরের মালা। হাতে ঝোলানো কাপড়ের ঝোলা।
কয়েদঘরের দরজা খুলে দেওয়া হল। বদ্যি ঝোলা থেকে দুটো চিনেমাটির বোয়াম বের করল। আঠা-আঠামত কালচে মলম বেরকরল। দুটো মেশাল। তারপর ফ্রান্সিসদের পায়ের ক্ষতে লাগাতে লাগল। শাঙ্কোকে প্রথমে লাগাল। উরি বাবা! কী জ্বলুনি! শাঙ্কো প্রায় লাফাতে লাগল। একটু পরেই জ্বলুনি কমল। কোনো জ্বালা যন্ত্রণা নেই। সকলেরই এক অবস্থা হল।
বদ্যি হেসে বলল–খুব কড়া ওষুধ। লোহার বেড়ির ক্ষত এই ওষুধে অনেকটা সেরে যাবে। সবটা সারবে বিশ্রাম পাবার পর। অবশ্য যদি তোমাদের কপালে বিশ্রাম জোটে। সকলেরই কষ্ট যন্ত্রণা মোটামুটি কমল। বদ্যি ঝোলা তুলে চলে গেল।
এবার কাজ। ক্ষেতে জল ছিটানো। জল ছিটোনোর কাজ চলল দুপুর পর্যন্ত। তারপর খাওয়া। আবার ক্ষেতে নামা। বিকেলের দিকে ছুটি মিলল।
কয়েদঘরে ফিরে সবাই কমবেশি হাঁপাতে লাগল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস ডাকলশাঙ্কো?
শাঙ্কো এগিয়ে এল।
ইঁদারার জলের অবস্থা কী দেখলে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–অসম্ভব। এত গভীর ইঁদারা আর এত জল যেন সমুদ্রের জল। কবে ঐ জল। ফুরোবে বলা কঠিন। শাঙ্কো বলল।
এমনসময় মারিয়া এল। পেছনে একটি কৃষ্ণাঙ্গিনী মেয়ে। বোঝা গেল পাৰ্তাদো মারিয়াকে পাহারার ব্যবস্থাও রেখেছে।
মারিয়া দরজার কাছে এল। ফ্রান্সিস উঠে দরজার কাছে গেল।
–তোমাদের খুব খাটাচ্ছে? মারিয়া জানতে চাইল।
ক্রীতদাস দিয়ে তো খাটানোই হয়। তবে শুনে নিশ্চিন্ত হলাম তুমি নাকি কর্ত্রীর সহচরী হয়েছো? ফ্রান্সিস হেসে বলল।
–হ্যাঁ। তবে ক্রীতদাসী তো। সাবধানে থাকতে হয়। বেশি বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়। মারিয়া বলল।
–এ ব্যাপারে খুব সাবধানে থেকো। ফ্রান্সিস বলল।
–শুনলাম বদ্যি এসেছিল। মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ। বেড়ির ঘষায় পা ছুলে গিয়ে–ফ্রান্সিস বলল।
–ওষুধ দিয়েছে তো? মারিয়া জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। ওষুধে ভালো কাজ হয়েছে। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।
ইতিমধ্যে কোলা উঠে এল। সে হেসে হেসে কৃষ্ণাঙ্গিনী মেয়েটির সঙ্গেহাতমুখ নেড়েই ইঙ্গিতে কথা বলতে লাগল। মেয়েটি এবার একটু হেসে কী বলে উঠল। কোলা চেঁচিয়ে বলল–ফ্রান্সিস এ আমার দেশের মেয়ে।
–তাহলে গল্প জুড়ে দাও। ফ্রান্সিস হেসে বলল। মারিয়াও হাসল। এবার কোলা অনর্গল কী সব বলতে লাগল। মেয়েটি কোনটার জবাব দিল কোনটার জবাব দিল না। এতে মারিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সিসের কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছিল। ফ্রান্সিস একবার কোলার দিকে দেখে নিয়ে হেসে বলল–মারিয়া, ওদের কথা বলতে দাও। আমাদের কথা থাক। মারিয়াও হেসে সম্মত জানাল। কোলার কথার তখনও শেষ নেই।
মারিয়া ফিরে দাঁড়াল। মেয়েটিও মারিয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। দুজনে সদর দরজার দিকে চলল। কোলা তখনও ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্রান্সিস বুঝল কোলা কতদিন পরে দেশের লোক পেয়েছে। ওর কথা তাই ফুরোচ্ছে না।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর কোলা ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস তখন চোখ বুজে শুয়ে পড়েছে। কোলা ওর মাথার কাছে বসল। বলল–মেয়েটির বাড়ি আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে। একদিন গভীর রাতে ক্রীতদাস ব্যবসায়ী গুণ্ডারা ওদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে ওদের ধরে নিয়ে আসে। ঐআমারগো বন্দরেরক্রীতদাসেরহাটেইবিক্রি করে। ওদের কাজ হল যাঁতায় গম ভাঙা।
-একদিনেই এত কথা জেনে গেলে। ফ্রান্সিস চোখ বুজেই হেসে বলল।
জিজ্ঞেসটিজ্ঞেস করে জানলাম। কোলা হেসে বলল।
কালকেও তো ঐ মেয়েটি এলে বকরবকর করবে। ফ্রান্সিস বলল।
–কতদিন পরে দেশের লোক পেয়েছি। কোলা হেসে বলল।
তাহলে এক কাজ কর। তোমরাই কথা বল। আমরা বলবো না। ফ্রান্সিস বলল।
না–না। তা কী করে হয়। তোমরাও বলবে আমরাও বলবো। কোলা বলল।
–তাহলে ব্যাপারটা জগাখিচুড়ি হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে–আমরা অল্প কথা বলবো।
–আরে না না। –ফ্রান্সিস হেসে উঠল–তোমরা বেশি কথাই বলো।
–ঠিক আছে। কোলা বলল।
–গতকাল বিকেলের খাবার খাওনি। ফ্রান্সিস বলল।
–মনেই ছিল না। কোলা হেসে বলল।
–না খেয়ে থেকো না। শরীরটা ঠিক রাখো। ফ্রান্সিস বলল।
পরদিন বিকেল নাগাদ জল ছিটোনোর কাজ সেরে সবাই কয়েদঘরে ফিরে এল। সবাই শুয়ে বসে বিশ্রাম করছে। কোলা কিন্তু একা ঠায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ বাড়ির পূব দেয়ালের দিকে। ওদিক দিয়েই মারিয়ারা আসে।
তখনই বিকেলের খাবার দেওয়া হল। ফ্রান্সিস ডাকল–কোলা। কোলা ফ্রান্সিসের দিকে ফিরে তাকাল।
কোলা দরজা থেকে সরে এসে খাবার খেতে লাগল। তখনই মারিয়ারা এল। কোলার তখনও খাওয়া শেষ হয়নি। ফ্রান্সিস ধমক দিয়ে বলল–কোলা-খাবার খেয়ে যাও। এবার কোলা খাওয়া শেষ করল।
ফ্রান্সিসের আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ও গিয়ে দরজায় দাঁড়াল। মারিয়া বলল ওষুধে কাজ হয়েছে?
–হ্যাঁ। জ্বালা যন্ত্রণা অনেকটা কমেছে। তবে যতদিন ধরে বালতি টানাটানি করবো ততদিন সবটা সারবে বলে মনে হয় না। ফ্রান্সিস বলল।
কর্তাসাহেব বদ্যিকে বলেছে সবাইকে কাজকরবার মতো সুস্থ করে তুলতে। প্রত্যেক সন্ধ্যায় বদ্যি ওষুধ দিতে আসবে। মারিয়া বলল।
-হ্যাঁ। আমাদের তো সুস্থ থাকতেই হবে। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল।
ততক্ষণে কোলা এসে দাঁড়িয়ে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে। ফ্রান্সিস একবার হেসে ওদের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। মারিয়ার সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে লাগল।
হ্যারি দরজার কাছে এগিয়ে এল। মারিয়াকে জিজ্ঞেস করল রাজকুমারী, আপনি কেমন আছেন?
–আজ ভালোই আছি। কিন্তু তোমরা তো ভালো নেই। মারিয়া বলল।
—হ্যাঁ, গাধার খাটুনি খাটছি। হ্যারি বলল।
–হ্যারি তোমার শরীরের দিকে নজর রেখো। এত খাটুনি তুমি সহ্য করতে পারবে না। মারিয়া বলল।
–উপায় নেই। ক্রীতদাসত্ব এমনিই। হ্যারি বলল।
মারিয়া আর কিছু বলল না। ফ্রান্সিসও নিজেদের জায়গায় ফিরে এল। কোলা তখনও বব করে চলেছে।
মারিয়া ঘুরে দাঁড়াল। কোলাদের কথা বন্ধ হল। মারিয়া আর কালো মেয়েটি চলে গেল।
ফ্রান্সিস ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো ওর কাছে এল।
–ইদারার জলের অবস্থা কী? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–অফুরন্ত জল। জলের থই পাচ্ছি না। ইঁদারাটার সঙ্গে বোধহয় সমুদ্রের যোগ আছে।
সমুদ্রের নোনা জলে চাষ হয়? তা নয়। পার্তাদো খুব ভেবেচিন্তে কাজ করে। পার্তাদো খুব গভীর করে ইঁদারা খুঁড়িয়েছে। যাতে জলের অভাব না হয়। কবে জল শেষ হবে। ততদিন পশুর মত খাটতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–ফ্রান্সিস তাহলে পালানো যাবে না। শাঙ্কো বলল।
–তুমিই ভেবে বের করো না কীভাবে পালানো যায়। ফ্রান্সিস বলল।
-তোমার মতো বুদ্ধি আমার নেই। তুমি যা বল তাই আমরা করি। এটা তোমারই কাজ। শাঙ্কো মাথা নেড়ে বলল।
–ভাবছি বুঝলে? আমরা যাতে কেউ আহত না হই, মরে না যাই–সেভাবেই সব ভাবতে হচ্ছে। ফ্রান্সিস চিন্তিত স্বরে বলল।
–দেখ ভেবে। এই জীবন অসহ্য। শাঙ্কো বলে উঠল।
–মেনে নাও। তাহলে দেখবে কষ্টটা কম হচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো আর কিছু বলল না। নিজের জায়গায় ফিরে গেল।
জমিতে জল ছিটোনোর কাজ চলল। সারাদিন। মাঝখানে খাওয়ার জন্যে যেটুকু সময় বিশ্রামের।
সন্ধ্যেবেলা বৈদ্য আসে! ওদের পায়ের অবস্থা দেখে। ওষুধ দিয়ে যায়। রাতে জ্বালা যন্ত্রণা কমে। ওরা ঘুমুতে পারে। কিন্তু ক্ষত একেবারে সারেনা। বোধহয় পার্তাদো এভাবেই ওদের দিয়ে কাজ করাতে চায়।
বিকেলবেলা মারিয়া আর মেয়েটি আসে। মারিয়া ফ্রান্সিসদের সঙ্গে কথাটথা বলে। কোলা আর মেয়েটির বকবকানিও চলে। এটা ফ্রান্সিসদের গা সওয়া হয়ে গেছে। কোলার দুই বন্ধুস্থানীয় কোলার সঙ্গে ঠাট্টা তামাসা করে। কোলা কোন কথা বলে না। গুম হয়ে বসে থাকে।
সেদিন খাওয়া দাওয়ার পর কোলা ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–পাংলু এক অদ্ভুত কথা বলল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়েছিল। চোখ বুজেই বলল–পংলু কে?
কালো মেয়েটা। ওরা নাম পাংলু। কোলা বলল।
–অদ্ভুত নাম। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাদের দেশের বাড়িতে এমনি অদ্ভুত নামই হয়। কোলা একটু অভিমানের সুরে বলল।
–তা অদ্ভুত কথাটা কী? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
তুমিতো আমারগো বন্দরের কথা জানো। কোলা বলল।
–হ্যাঁ ওখানেই তোক্রীতদাসেরহাট থেকেআমাদের কেনা হয়ে হয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল।
–সেই আমারগো বন্দর থেকে বেশ কিছুটা দূরে রাজা আলফ্রেডের ভাঙা দূর্গ আছে। তার পাশেই থাকেন এক ইহুদী ভদ্রলোক। নাম সামুছা। ওখানকার জমিদার। আমারগো বন্দরের ক্রীতদাসের হাট থেকেপাংলুকেকিনেছিলেন। পাংলু সামুছার বাড়িতে ক্রীতদাসী হয়েছিল।
–অদ্ভুত ব্যাপারটা কী তাই বলো? ফ্রান্সিস বলল।
–বলছি। সামুছার বাড়ির কাছেই রাজা আলফ্রেডের ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ। ঐ দুর্গে আছে রাজা আলফ্রেডের গুপ্ত ধনভাণ্ডার।
–গুপ্ত ধনভাণ্ডার? ফ্রান্সিস চমকে চোখ মেলল। দ্রুত উঠে বসল। বলল–ঐ ভাঙা দুর্গে?
–হ্যাঁ। জমিদার সামুছা সেই গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করার জন্যে ভাঙা দুর্গের আনাচেকানাচে খুঁজে বেড়ায়। জমিদারি দেখে আর ধনভাণ্ডার খোঁজে। কোলা বলল।
–ঠিক আছে। আমি কয়েকটা বিষয় জানতে চাইছি। ফ্রান্সিস বলল।
–কী কী বিষয় বলো। কোলা বলল।
–জানবে কতকাল আগে রাজা আলফ্রেড রাজত্ব করতো। সামুছা কতদিন যাবৎ গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজছেন? তিনি কোন সূত্র পেয়েছেন কিনা। গুপ্ত ধনভাণ্ডার খোঁজার জন্য উনি কাউকে সাহায্য করতে রাজি কিনা। ফ্রান্সিস বলল।
–এতসব ব্যাপার পংলু বলতে পারবে? কোলা সংশয় প্রকাশ করল।
–তুমি জিজ্ঞেস তো করো। সামুছার বাড়িতেই ও কাজ করত। কাজেই ভেতরের অনেক খবর ওর পক্ষে জানা সম্ভব।
–দেখি কথা বলে। কোলা মাথা নেড়ে বলল।
পরের দিন বিকেলে পাংলু মারিয়ার পেছনে পেছনে এল। কোলা আগে থেকেই লোহার ফোকরওয়ালা দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল।
ফ্রান্সিস বলল–পংলুর কাছ থেকে কিছু দরকারি কথা কোলাকে জানতে বলেছি। কোলা সেসব জানুক। আমরা বেশি কথা বলবো না।
–বেশ। মারিয়া হেসে বলল। তারপর বলল কী এমন দরকারি কথা?
রাজা আলফ্রেডের গুপ্ত ধনভাণ্ডারের কথা। ফ্রান্সিস বলল।
–ব্যস্। দেশে ফেরা হয়ে গেল। মারিয়া বলল।
–ব্যস্ত হচ্ছো কেন। দেখাই যাক না। হদিশ করতে পারি কিনা। ফ্রান্সিস বলল।
–গুপ্ত ধনভাণ্ডার কি এখানে? মারিয়া জানতে চাইল।
–না। আমারগো বন্দর থেকে কিছুদূরে রাজা আলফ্রেডের ভগ্নদূর্গে ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো আমারগো বন্দরে যেতে হবে। যাবে কী করে? মারিয়া বলল।
–পালাবো। ফ্রান্সিস গলায় জোর দিয়ে বলল।
–পারবে? মারিয়া বলল।
–পারতে হবে। ক্রীতদাস হয়ে বাকি জীবন কাটাবো নাকি? ফ্রান্সিস বলল।
–দেখ চেষ্টা করে। মারিয়া বলল।
ওদিকে কোলা আর পাংলুর কথা শেষ হয় না। ফ্রান্সিস মারিয়া দুজনেই চুপ করে রইল। কোলা আর পাংলু দেশোয়ালি ভাষায় তখনও কথা বলে চলেছে।
কিছুক্ষণ পরে মারিয়া আর পাংলু ফিরে গেল। কোলা সেইদিকে তাকিয়ে রইল।
–কোলা বসবে চলো। ফ্রান্সিস বলল। তারপর নিজের জায়গায় এসে বসল। কোলা এসে পাশে বসল।
–এবার বলো পাংলু কী বলল? ফ্রান্সিস বলল।
–দেখলাম ও অনেক কিছু জানে। কোলা বলল।
–তাহলে বলো রাজা আলফ্রেড কতকাল আগে ওখানে রাজত্ব করতো?
–সামুছা কতদিন যাবৎ গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–সেটা পাংলু বলতে পারল না। তবে যখন থেকে সামুছার বাড়িতে ক্রীতদাসী হয়ে এল তখন থেকেই দেখেছে সামুছা প্রতি রোববার নেভানোমশাল নিয়ে ভাঙা দূর্গের দিকে যায়। বোধহয় ওখানে কিপাথরঠুকে মশাল জ্বালিয়ে গুপ্ত ধনভাণ্ডার খোঁজে। কোলা বলল।
হু। তাহলে খুব বেশিদিন নয়। আচ্ছা সামুছা কি এ ব্যাপারে কারো সাহায্য নিয়েছিল? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–পাংলু বলল–একজন স্পেন দেশের লোক নাকি একটা কি ছবির কাগজ নিয়ে এসেছিল। সামুছার সঙ্গে সেও কিছুদিন ভাঙা দূর্গে যেতো। কিন্তু দুজনের ঝগড়া হয়। স্পেনীয় লোকটি পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গিয়েছিল। কোলা বলল।
–তার মানে বখরায় বনেনি। ফ্রান্সিস বলল।
–ঐ রকমই কিছু হবে। কোলা বলল।
-বখরা না চাইলে সামুছা একসঙ্গে ধনভাণ্ডার খুঁজতে রাজি হতো। এটা আমার জানা দরকার ছিল। পাংলুকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এটা পাংলুকে বলো। ফ্রান্সিস বলল।
–বলবো। তাহলে তোমার সব জানা হল। কোলা বলল।
–মোটামুটি। এখনও অনেক কিছু জানতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু এসব জেনে তোমার কী হবে? কোলা বলল।
–আমি ঐ গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি কি পাগল হয়েছে? কোলা হেসে বলল–এখান থেকে বেরোতে পারলে তবে তো গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজবে।
–এখান থেকে পালাবার ছক কষেছি। ফ্রান্সিস বলল।
কোলা চমকে উঠল। বলল–তোমার ছক কষা হয়ে গেছে?
–প্রায়। আর কিছুদিন এখানকার ব্যবস্থাটা দেখতে হবে। কারণ রাতে তো আমরা বেরোতে পারি না। কাজেই জানি না বড় গেট-এ দরজায় কতজন প্রহরী থাকে। এটা জানতে হবে। গেট-এর দরজায় ক’টা তালা লাগানো থাকে। বাইরে ভেতরে দুদিকেই কি তালা লাগানো হয়? ফ্রান্সিস বলল।
–সেটা কী করে জানবে? কোলা বলল।
–একটু রাতে পংলু বেরিয়ে সেটা জেনে আসবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমাদের রাজকুমারীও জানতে পারে। কোলা বলল।
–না রাজকুমারী গেলে প্রহরীদের সন্দেহ হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে পাংলুকে একথা বলতে হয়। কোলা বলল।
–হ্যাঁ। বলবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে মুক্ত জীবন পাবো? কোলা বেশ আবেগের সঙ্গে বলে উঠল।
–হ্যাঁ পাবে। তবে এখনই একেবারে নিশ্চিন্ত থেকো না! সব খবরাখবর এখনও নেওয়া হয়নি। ফ্রান্সিস বলল।
একটু চুপ করে থেকে কোলা বলল–আমি একাই পালিয়ে যাবো।
–পাগল হয়েছ! ঐ কাজটিও করতে যেও না। বেঘোরে মরবে। ফ্রান্সিস কোলাকে সাবধান করল।
না। আমি পারবো। আমি অনেক জোরে ছুটতে পারি। কোলা বলল।
–পায়ের ঐ বেড়ি নিয়ে? পারবে? ফ্রান্সিস সংশয় প্রকাশ করল।
–হ্যাঁ পারবো। কোলা গলায় বেশ জোর দিয়ে বলল।
–ঠিক আছে। কিছুদিন অপেক্ষা করো। দেখি না ছক খাটে কি না। ফ্রান্সিস বলল।
–আমার অতো ধৈৰ্য্য নেই। তোমার ছকনাও খাটতে পারে। কোলা বলল।
— তা পারে। তবে একবার চেষ্টা তো করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–গেট ডিঙিয়ে পালাতে গেলে ঐ প্রহরীরা নিরস্ত্রআমাদের মেরে ফেলবে। কোলা বলল।
–দেখা যাক। ফ্রান্সিস মাথা ওঠা নামা করে বলল।
পরদিন ফ্রান্সিসরা সকালের খাবার খাচ্ছে তখনই পার্তাদো এল। কয়েদঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন-শোন। আমি বাইরে যাচ্ছি। কয়েকদিন পরে ফিরবো। তোমরা ভালা হয়ে থাকবে। কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না। করলে জীবন যাবে।
ফ্রান্সিসরা কেউ কিছু বলল না। পার্তাদো বললেন–আজ থেকে ক্ষেতের কাজ বন্ধ। আমার জমির দুপাশে যে জঙ্গল রয়েছে সে দুটো জঙ্গল সাফ করতে হবে। আমি ক্ষেত বাড়াবো। তোমাদের কাজ হল দুধারের জঙ্গল সাফ করা। ঠিক আছে। ওঙ্গারা তোমাদের দেখিয়ে দেবে। ভালো কথা দুধারের জঙ্গলের শেষে তিনজন তিনজন করে দেহরক্ষী থাকবে যাতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তোমরা পালাতে না পারো। ঠিক আছে।
ফ্রান্সিসরা কোন কথা বলল না। পার্তাদো ওঙ্গাদের আঙুল নেড়ে ডাকলেন। ওঙ্গারা এগিয়ে এল। ওদের দুহাতে তিনচারটে করে কুডুল।
পার্তাদো আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন।
কয়েদঘরের দরজা খুলে দেওয়া হল। কুড়ুল কম পড়ে গেল। ওঙ্গা বলল-কালকে আরো কুড়ুল পাবে। আজকে যে কটা পাচ্ছো তাই দিয়ে কাজ চলুক।
ফ্রান্সিসরা এই ভেবে খুশি হল যে এখন কটা দিন জঙ্গলের ছায়ার গাছ কাটা খুব একটা পরিশ্রমের কাজ নয়।
দুপাশে দু’দল ভাগ হয়ে গেল। শুরু হল গাছ আগাছা কাটা। ফ্রান্সিস এক ফাঁকে জঙ্গল ছাড়িয়ে এল। দেখল তিনজন সশস্ত্র দেহরক্ষী এক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ও চলে এল। দেহরক্ষীরা ছাড়াও রয়েছে ওঙ্গারা দু’জন। কড়া পাহারারই ব্যবস্থা হয়েছে।
দুপুরে খাওয়া। একটু বিশ্রাম। তারপরেই গাছ কাটা।
পরদিন দুপুরের দিকে আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমতে লাগল। হ্যারি গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে এটা লক্ষ্য করল। ও খুশির স্বরে বলে উঠল–ফ্রান্সিস-সৌভাগ্য। আকাশে মেঘ জমেছে।
-বলো কি? ফ্রান্সিস গাছের মাথার ওপর দিয়ে তাকাল। সত্যিই কালো মেঘের জটলা।
একটু পরেই শুরু হল বিদ্যুৎ চমকানো আর ঘন ঘন বাজ পড়া। তারপরই শুরু হল বড় ফোঁটা বৃষ্টি। একটু পরেই মুষলধারে বৃষ্টি। গাছ কেটে ফেলায় ওপরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। ফ্রান্সিসরা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল। গাছ কাটা বন্ধ।
ওঙ্গা গলা চড়িয়ে বলল কাজ চালাও। শাঙ্কো বলল–ভাইকতদিন গরমে সেদ্ধ হয়েছি। এবার বৃষ্টিতে ভিজে একটু ঠাণ্ডা হতে দাও। ওঙ্গা বলল–না, না। কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
ফ্রান্সিসরা আর আপত্তি করল না। আবার গাছ কাটতে লাগল। তখনও বৃষ্টি চলছে।
বিকেল হল। ওঙ্গা গলা চড়িয়ে বলল–এবার সবাই ক্ষেতের ওপর এল। ক্ষেতের মাটি তখন প্রায় কাদা হয়ে গেছে। ঐ কাদার ওপর দিয়েই ওরা হেঁটে চলল কয়েদঘরের দিকে। আজকে ওরা খুশি। দুএকজন কাদা ছোঁড়াছুঁড়িও করল। কাল থেকে আর জল ছিটোতে হবেনা।
ওঙ্গা বলল কর্তাসাহেব থাকলে খুব খুশি হত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজত।
বৃষ্টির জোর কমে গেছে। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। চারদিক বেশ অন্ধকার হয়ে গেল। আকাশের মেঘ কাটে নি। রাতেও বৃষ্টি হতে পারে।
ফ্রান্সিসদের বিকেলের খাবার তখন খাওয়া হয়ে গেছে। কোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবার খেল।
মারিয়া আর পাংলু এল। মারিয়া হেসেফ্রান্সিসকে বলল–তোমাদেরআরজল ছিটোতে হবে না। ফ্রান্সিসও হাসল। বলল হ্যাঁ। বৃষ্টি হতে বেঁচে গেলাম। ওদিকে কোলা পাংলুর সঙ্গে কথা বলছে।
ফ্রান্সিস একটু গলা নামিয়ে বলল–একটা খুব দরকারি কথা বলছি। বাড়িতে কোথায় অস্ত্রশস্ত্র মানে ঢাল তরোয়াল রাখা হয় কোথায়–সেই ঘরটা একবার দেখবে। সাবধান প্রহরীদের যেন কোনরকম সন্দেহ না হয়। খুব গোপনে কাজটা করতে হবে। পারবে তো?
–এটা কী এমন কাজ? মারিয়া বলল।
–কাউকে জিজ্ঞেস করে জানতে যেও না। তুমি একাই খুঁজে দেখবে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল।
রাতের খাওয়া সেরে কোলা ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস যথারীতি চোখ বুজে শুয়ে আছে। বলল–
–পাংলুকে বলেছো?
–হ্যাঁ। ও বলেছে রাতে ও লক্ষ্য করবে। কোলা বলল।
–ভালো কথা। ফ্রান্সিস বলল।
রাতে বৃষ্টি হল।
পরের দিন আবার জঙ্গল কাটা চলল।
বিকেল হল। ক্ষেতে কাদা আরও বেড়েছে। ওরা ক্ষেত পার হয়ে কয়েদ ঘরে এল।
তখনও ফ্রান্সিসদের বিকেলের খাবার খাওয়া হয়নি। মারিয়ারা একটু তাড়াতাড়ি এল। কোলা দরজায় দাঁড়িয়েই ছিল। পাংলুর সঙ্গে কথা বলছিল। ফ্রান্সিস এবারে তাকিয়ে দেখল। কিছু বলল না। ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল
–খোঁজ পেলে?
–হ্যাঁ। মারিয়াও আস্তে বলল–সদর দরজা দিয়ে ঢুকে ডানহাতি প্রথম ঘরটাই অস্ত্রাগার–তরোয়াল ঢাল চাবুক লোহার শেকল এসব রাখা।
–ঘরটা কি বন্ধ থাকে? ফ্রান্সিস বলল।
–না। দরজা ভেজানো থাকে। ঠেললেই খুলে যায়। মারিয়া বলল।
–কোন প্রহরী থাকে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–না। ফ্রান্সিস হেসে বলল–সবই অনুকুল। এবার ছক কাজে লাগানো।
রাতে কোলা এল।
পাংলুকে জিজ্ঞেস করেছো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
হ্যাঁ। ও বলল–শুধু ভেতর থেকে তালা দেওয়া থাকে। বাইরে কোন তালা লাগানো হয় না। কোলা বলল।
–কাজটা সহজ হয়ে গেল। ফ্রান্সিস হাঁফ ছেড়ে বলল।
–তোমরা কি পালাতে পারবে? কোলা জিজ্ঞেস করল।
–এখনই ঠিক বলতে পারছি না। আগে কাজ শুরু করি। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা কবে পালাতে পারবে কে জানে। আমি একাই পালাবো। কোলা অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে বলল।
সাবধান। এভাবে বিপদ ডেকে এনো না। ফ্রান্সিস বলল।
কোলা গম্ভীরগলায় বলল–আমি তোমাদের বিশ্বাস করিনা। কথাটা বলে ও চলে গেল। আর একটা কথাও বলল না। কথাটা ফ্রান্সিসের ভালো লাগল না। ও নিজের সম্পর্কে এরকম কথা ও কখনও শোনেনি। ও ভাবল কোলার ওপর রাগ না করে ওকে বুঝিয়ে বলবে।
জঙ্গল প্রায় অর্ধেক কাটা হয়ে গেল। শুধু কাটা গুঁড়িগুলো উঁচিয়ে আছে।
গাছকাটার কাজ সেরে ফ্রান্সিসরা ফিরে এল। আসতে আসতে ওঙ্গা বলল–গাছ। কাটা হলে তোমাদের চাষের কাজে নামতে হবে।
–এই ক্ষেতে কীসের চাষ হয়? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–তুলো। ওঙ্গা বলল।
–তুলো? শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। দেখছো না এখানে মাটির রঙ কালো। ওঙ্গা বলল।
ওরা কয়েদঘরে ফিরে এল।
ফ্রান্সিস কয়েকদিন যাবৎ লক্ষ্য করল কোলা রাতের খাওয়ার পর আর ওর কাছে। আসে না। কাজ করতে করতেও কথা বলতে আসে না। কেমন গুম মেরে থাকে।
দু’দিন পরের ঘটনা।
সেদিন ফ্রান্সিসরা গাছ আগাছা কাটছে। ফ্রান্সিস ভাবল দেখে আসি জঙ্গলটা কত বড়। ও কুড়ুল রেখে গাছের গুঁড়ি এড়িয়ে হাঁটতে লাগল।
বন শেষ। বনের বাইরে এল। ওকে দেখে দেহরক্ষীরা তরোয়াল উঁচিয়ে ছুটে এল। ফ্রান্সিস দুহাত তুলে ওদের থামাল। তারপর জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। কাজের জায়গায় এল।
–কোথায় গিয়েছিলে? ওঙ্গ জানতে চাইল।
–জঙ্গলটা দেখলাম। জঙ্গলের গাছ আর বেশী বাকি নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–পালাতে চেয়েছিলে? ওঙ্গা বলল।
–না। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল।
–সেই চেষ্টাও কোরো না। সাহেবকর্তার হুকুম কেউ পালাতে গেলে মেরে ফেলবে। বনের শেষে দেহরক্ষীরা আছে। ওঙ্গা বলল।
-জানি। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস কাজে লাগল। হঠাৎ ওঙ্গা আর তার সঙ্গীর চিৎকারে ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল। দেখল কোলা বনের মধ্যে দিয়ে ছুটে পূবমুখো যাচ্ছে আর ওঙ্গারা চিৎকার করে বলছে পালাচ্ছে–পালাচ্ছে।
গাছের কাটা গুঁড়িতে পা লেগে কোলা মুখ থুবড়ে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটল। উঁচিয়ে থাকা গাছের গুঁড়ি দুপায়ে বেড়ি। কোলা জোরে ছুটতে পারছিল না।
ফ্রান্সিসও কোলার পেছনে পেছনে ছুটতে লাগল। চিৎকার করে বলতে লাগল– কোলা পালাবার চেষ্টা করো না। ফিরে এসো। কোলা–আ। কিন্তু কোলা ছুটে জঙ্গলের বাইরে চলে এল। ফ্রান্সিস দেখল চারজন দেহরক্ষী মধ্যে কোলা একজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে খোলা প্রান্তর দিয়ে ছুটল। কিন্তু পায়ে বেড়ি। ও আর কত জোরে ছুটবে? প্রান্তরের প্রায় মাঝামাঝি এসেছে দেহরক্ষীরা ওকে ধরে ফেলল। ছুটন্ত কোলার মাথায় এক দেহরক্ষী কোপ বসাল। অন্যজন ওর বুকে তরোয়াল বিধিয়ে দিল। কোলা ঘাসের ওপর গড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে এই দৃশ্য দেখল। কোলা বারকয়েক এপাশ ওপাশ করে স্থির হয়ে গেল। ফ্রান্সিসের চোখে জল এল। বন্ধুরাও তখন ছুটে এসেছে। কিন্তু ওঙ্গা আর সঙ্গী দু’হাত ছড়িয়ে ওদের বনের বাইরে আস্তে দিল না।
ফ্রান্সিস–শাঙ্কো অস্ফুটস্বরে ডাকল। ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল। শাঙ্কো ওভাবেই বলল–এখন পালানো যায় না?
–পায়ে বেড়ি নিয়ে কত জোরে আর ছুটবে। দেখছো না কোলার কী অবস্থা হল। ফ্রান্সিস বলল।
দেহরক্ষীরা কোলার মৃতদেহ দুহাত ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসতে লাগল। উপস্থিত সবাই তখন স্তব্ধ। কোলার মৃতদেহ দেখে বন্ধুদের অনেকের চোখেই জল এল। শুধু ফ্রান্সিস অরুদ্ধস্বরে বলল–আমি কোলাকে অনেকবার মানা করেছি। ও শুনল না।
বনের মধ্যে দিয়ে কোলার মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে দেহরক্ষীরা নিয়ে আসতে লাগল।
ওঙ্গা গলা চড়িয়ে বলল–আজকের মতো কাজ শেষ। ফিরে চলো সব।
কাদাটে ক্ষেতের ওপর দিয়ে কোলার মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এল ওরা। কোলার দেহ কাদায় মাখামাখি।
মৃতদেহ এনে কয়েদঘরের সামনে ফেলে রাখা হল।
ফ্রান্সিসদের কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বাড়ির ভেতর থেকে কৃষ্ণকায়া পরিচারিকা এল। কিন্তু তাদের চোখেমুখে কোন দুঃখের চিহ্ন দেখা গেল না। কারণ ওরা এসব দেখে অভ্যস্ত।
কিছু পরে মারিয়া আর পাংলু এল। কোলার কাদামাখা মৃতদেহ দেখে পাংলু হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। মারিয়াও দুচোখ দুহাতে চেপে কান্না থামাল।
ফ্রান্সিসদের খুব তাড়াতাড়ি প্রহরীরা কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দিল। পাছে কোলার এই নির্মম মৃত্যু দেখে ফ্রান্সিসরা ক্ষেপে ওঠে।
কয়েদঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। বার বার কোলার কথা মনে হতে লাগল। কোলার এই মৃত্যু ও মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। কী হত কোলাকেনা মেরে যদি বাঁচিয়ে রাখা হত। ওকে তো কয়েদঘরেই বন্দী হয়ে থাকতে হত। কেন ওকে হত্যা করা হল?
গতরাতে ফ্রান্সিস অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পালাবার ছক কষেছিল। এবার সেসব গুছিয়ে ভাবতে লাগল।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ডাকল। হ্যারি ওর পাশেই বসে। ফ্রান্সিস গলার স্বর নামিয়ে দেশীয় ভাষায় ওর পালানোর ছকের কথা বলতে লাগল। হ্যারি আর শাঙ্কো মাথা নীচু করে শুনতে লাগল।
সব শুনে হ্যারি মৃদুস্বরে বলল–সাবাস ফ্রান্সিস।
–তাহলে পার্তাদো ফেরার আগেই ছক কাজে লাগাবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–সেটাই ইচ্ছে। কিন্তু পার্তাদো কবে ফিরবে ওঙ্গাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওঙ্গা বলতে পারল না। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক। পালানোর রাতটা ঠিক কর। হ্যারি বলল।
–সেটাই ভাবছি। ফ্রান্সিস বলল।
–অনেক রাত হল। ঘুমিয়ে পড়। হ্যারি বলল।
তিনজনে শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো ভাবল–ফ্রান্সিস অনেক দায়িত্ব দিল। পারবো? পরক্ষণেই ভাবলো–পারতেই হবে। এই ক্রীতদাসের জীবন থেকে মুক্তি চাই। যে কোন মূল্যে!
পরের দিন সকালে ফ্রান্সিসরা সবে সকালের খাবার খেয়েছে পার্তাদো এসে হাজির। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পার্তাদো গলা চড়িয়ে বলল–কেমন আছো সব?
–একজন আপনার দেহরক্ষীর হাতে মারা গেছে। বাকিরা বেঁচে আছি। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। ওঙ্গার কাছে সব শুনলাম। আমি তো বলেছি পালাবার চেষ্টা করবে না। ওটা করলে মরতে হবে। পার্তাদো বলল।
–যে ভাবে বেঁচে আছি। মরে যাওয়াই ভালো। হ্যারি বলল।
-না না। শুধু শুধুমরতে যাবে কেন? দেখছি তো ভালোই আছো তোমরা। পার্তাদো একাই হেসে বলল।
কেউ কোন কথা বলল না। কোলার মৃত্যু দেখে সবাই রাগে ফুঁসছে। কিন্তু কথা বলা বৃথা। পার্তাদো ওদের মানুষ হিসেবে দেখে না। ক্রীতদাস হিসেবেই দেখে।
–আমি বলেছি তোমাদের মাংসটাংস দিতে–যাতে তোমরা গায়ে জোর পাও। পার্তাদো বলল।
এবার কেউ কোন কথা বলল না।
পার্তাদো চলে গেল।
–ফ্রান্সিস-পার্তাদো তো ফিরে এল। শাঙ্কো বলল।
–ঠিক আছে। ছক অনুযায়ী কাজ চলবে। ফ্রান্সিস বলল।
বল কাটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
বিকেলে কাজের শেষে ফ্রান্সিসরা ফিরে আসছে। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–শাঙ্কো, দেহরক্ষীরা এখনও ফেরে নি। সবাইকে বলে রেখেছি। ওঙ্গা আর তার সঙ্গী দরজা দিয়ে ঢুকছে। কাজে লাগো।
তারপর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল–সব সদর দরজায় চলো। একসঙ্গে।
সবাই বেশ ছুটেই সদর দরজার কাছে গিয়ে জড় হল। শাঙ্কো ততক্ষণে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
দেহরক্ষীরা তখনই ক্ষেতের ওপর দিয়ে ফিরে আসছিল। দূর থেকে ফ্রান্সিসদের জটলা দেখে ছুটে এল। তরোয়াল উঁচিয়ে ফ্রান্সিসদের সামনে এল ওরা। তখনও ওরা হাঁপাচ্ছে। একজন দেহরক্ষী এগিয়ে এল। বলল–কী ব্যাপার? তোমাদের তো কয়েদঘরে। ঢোকার কথা। এখানে কী চাই?
কর্তাসাহেবকে ডেকে দাও। কথা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
কর্তাসাহেব তোমাদের মত ক্রীতদাস নয় যে ডাকলেই আসবে। অন্য রক্ষীটি বলল।
–কিন্তু একটা দরকারি কথা ছিল। ফ্রান্সিস বলল।
–কী কথা। রক্ষীটি বলল।
–তোমাকে নয়। কর্তাসাহেবকে বলব। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। আমাকে বলো। আমি কর্তাসাহেবের কাছে গিয়ে বলছি। রক্ষী বলল।
–তাহলে শোন। গত দুদিন যাবৎ বদ্যি আসছে না। আমাদের পায়ের ক্ষত এখনও শুকোয়নি। আরো ওষুধ চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। তোমরা কয়েদঘরে যাও। আমি গিয়ে বলছি। দেহরক্ষীটি বলল। তারপর ওরা বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরে ফিরে এল। বিকেলের খাবার খেল। তখনই মারিয়া আর পাংলু এল। পাংলুর চোখমুখ দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল পাংলু খুব কান্নাকাটি করেছে। ফ্রান্সিস মনে গভীর ব্যথা অনুভব করল। পাংলু চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল।
ফ্রান্সিস দেশীয় ভাষায় চাপাস্বরে বলল–মারিয়া আজ রাতে আমরা পালাবো। মারিয়া। চমকে উঠল। একবার চারিদিক তাকিয়ে নিয়ে বলল–পারবে?
–আলবাৎ পারবো। এবার তোমাকে যা বলছি মন দিয়ে শোন। আজ রাতে ঘুমিয়ে পড়বে না। পাংলুকেও বলবেনা ঘুমোতে। রাত গভীর হলে তোমরা দু’জনে সদর দরজার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। তোমাদের অন্দরমহলে কোন প্রহরী থাকে?
–না। মারিয়া বলল।
তারপর কান পেতে থাকবে বাইরে কুকুরের ডাক শোনার জন্য। ফ্রান্সিস বলল।
–এ বাড়িতে তো কুকুর নেই। মারিয়া বলল।
দরকার নেই। কুকুরের ডাক শুনলেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসবে। দেখবে আমরা আছি। পাংলু দরজা বন্ধ করে অন্দরমহলে চলে যাবে। পাংলুকে সব বুঝিয়ে বলতে পারবে? ফ্রান্সিস বলল।
অনেকদিন একসঙ্গে আছি। ইশারা ইঙ্গিতে পংলু আমার কথা বোঝে। ওর কথাও আমি বুঝি। সেদিক থেকে কোন অসুবিধে হবেনা। তবে একটা কথা বলছিলাম পাংলুকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলো না। পাংলুও তো মুক্তি চায়।
–পাংলুকে সঙ্গে নিলে সমস্যায় পড়তে পারি। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি গেলে পাংলুও যেতে পারবে। আমার সঙ্গে থাকবে। কোনো বন্দরে ওকে নামিয়ে দিও। ওর সমস্যার সমাধান ওই করবে। মারিয়া বলল।
–বেশ। পাংলুকেবলো। ফ্রান্সিস বলল–যা বললাম ঠিক সেইমতো কাজ করবে। একটু এদিক ওদিক হলে জীবন সংশয় হবে।
-না-না। আমি আমার কাজ ঠিক পারবো। মারিয়া বলল।
–ঠিক আছে। আর একটা হাত বাঁধার কিছু দড়ি নিয়ে আসবে। অস্ত্র ঘরেই পাবে। ফ্রান্সিস বলল।
ওদিকে শাঙ্কো অস্ত্রঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কান পেতে সব শুনছে।
কিছুক্ষণ পর বাড়ির দরজা খোলার শব্দ হল। শাঙ্কো বুঝল কেউ ঢুকল।
দেহরক্ষীরা ঢুকল। অস্ত্রঘরের দরজা খুলল। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই উঁইকারে রাখা তরোয়ালগুলোর ওপর ওদের তরোয়ালগুলো ছুঁড়ে ফেলল। ঝঝনাৎ শব্দ হল। শাঙ্কো তখন দেয়ালে প্রায় সেঁটে আছে। চার দেহরক্ষী চলে গেল। ঘরে ঢুকল না। ঘরে একটা মাত্র মশাল জ্বলছে। শাঙ্কোও ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে ঢুকলেও ওরা শাঙ্কোকে দেখতে পেত না। একটু পরেই সদর দরজার কাছে হালকা পায়ের শব্দ শোনা গেল। শাঙ্কো বুঝল মারিয়া আর পাংলু ফিরে এল। পাংশু দরজা বন্ধ করে দিল।
শাঙ্কো কিছুক্ষণ নিঃশব্দে অপেক্ষা করল। তারপরে আস্তে আস্তে কোন শব্দ না করে পাঁচটা তরোয়াল তুলে নিল। বগলে চেপে ধরল। তারপর পায়ের বেড়ি চেপে ধরে দরজার কাছে গেল। কিছু শব্দ না করে বসে বসে আস্তে আস্তে যাওয়ার জন্যে ওর সময় লাগল।
নিঃশব্দে দরজা খুলল। বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর যতটা সম্ভব দ্রুত দেবদারু গাছগুলোর দিকে ছুটে গেল। সদর দরজার দুপাশেই লম্ফলস্য দেবদারু গাছ জায়গাটাকে বেশ অন্ধকার করে রেখেছে।
শাঙ্কো একটা একটা করে তরোয়াল যতটা সম্ভব দ্রুত দেবদারু গাছগুলোর আড়ালে লুকিয়ে রাখল। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে কয়েদঘরের দিকে চলল। কয়দঘরের সামনে প্রহরীরা তখন এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। শাঙ্কো বুঝল ওকে খোঁজা হচ্ছে।
শাঙ্কো কয়েদঘরের আলোর কাছে এসে দাঁড়াল। প্রহরীরা ভূত দেখার মতো লাফিয়ে উঠল। একজন প্রহরী তরোয়াল খুলে শাঙ্কোর কাছে ছুটে এল। বলল–গুনতে গিয়ে দেখি একজন কম। কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
–প্রস্রাব করতে। শাঙ্কো নির্বিকার মুখে বলল।
কয়েদঘরে করলেই পারতে। প্রহরী বলল।
–ভীষণ পেয়েছিল। যাক গে–আমি তো এসে গেছি।
–ভেতরে ঢোক। প্রহরী গম্ভীরগলায় বলল।
শাঙ্কো কোন কথা না বলে ফ্রান্সিসদের কাছে এল। প্রহরীরা তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। মৃদুস্বরে বলল–ছকমতো কাজ হয়েছে? শাঙ্কো মৃদু হেসে বলল–পাঁচটা তরোয়াল-দেবদারু গাছের আড়ালে। ফ্রান্সিসও মৃদুস্বরে বলল–সাবাস।
রাতের খাওয়ার পর পরিবেশক চলে গেল। ফ্রান্সিস দরজার কাছে গেল। দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল–প্রহরীরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলতে লাগল–ভাইসব–পালাবার ছক প্রত্যেককে বলেছি। সবাইকে সৈইমতো কাজ করতে হবে। কোনরকম ভুল যেন না হয়। এবার সবাই শুয়ে পড়। কিন্তু কেউ ঘুমিয়ে পড়বেনা। ছকঠিকমতো খাটলে আমাদের বহু আকাঙিক্ষত মুক্তি। কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। এবার শেষ কাজটা বাকি।
রাত গভীর হতে লাগল। কয়েদঘর নিঃস্তব্ধ। বেশ গভীর রাতে ফ্রান্সিস মৃদু স্বরে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো কাছেই ছিল। বলল–বলো।
–সেই পুরনো কায়দাটাই কাজে লাগাতে হবে। সেই পেটব্যথা। প্রহরীদের ঘরে ঢোকানো। বন্দী কর। শুরু কর। ফ্রান্সিস বলল।
হঠাৎ শাঙ্কো চাপা চিৎকার শুরু করল। প্রায় সবাই উঠে পড়ল। শাঙ্কো বিছানার ওপর এপাশ ওপাশ করতে লাগল আর গোঙাতে লাগল। প্রহরী দু’জন ছুটে দরজার কাছে এল। ওরা বুঝে উঠতে পারল না কী করবে।
বিস্কো উঠে দরজার কাছে গেল। বলল–শিগগির বদ্যি ডাকো। আমাদের এক বন্ধু পেটের ব্যথায় মারা যাচ্ছে।
–এত রাতে বদ্যি কোথায় পাবো? একজন প্রহরী বলল।
–তাহলে বন্ধুটি কি মারা যাবে? বিস্কো বলল।
অন্য প্রহরীটি বলল–ও কিছুক্ষণ পরেই ঠিক হয়ে যাবে।
–ঠিক আছে। একবার এসে তো দেখ বন্ধুর অবস্থাটা।
তখনও শাঙ্কোর গোঙানি চলছে।
–দেখি তো কী ব্যাপার? চলো। একজন প্রহরী বলল।
দরজা খুলে একজন প্রহরী ঢুকল। অন্যজন দরজা ভেজিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–ঢুকল। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে গলার কাছ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা বের করে ছোরাসুদু হাতটা পিঠের নীচে রাখল। প্রহরীটি শাঙ্কোর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ছোরাটা ওর বুকে ঠেকাল। দাঁতচাপা স্বরে বলল–চুপ করে থাকো। চিৎকার করেছো কি মরেছো। দরজায় দাঁড়ানো প্রহরীটি বুঝল কিছু গণ্ডগোলে ব্যাপার। ও খাপ থেকে তরোয়াল খুলে ছুটে ঘরে ঢুকল। বিস্কো তৈরীই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে প্রহরীটির পেটে জোর ঠুমারল। প্রহরীটি দেয়ালের গায়ে গিয়ে পড়ল। হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গেল। দেয়ালে মাথা ঠুকে গেল। ও মেঝেয় বসে পড়ল।
হ্যারি ফ্রান্সিসের নির্দেশমত ওর কোমরের ফেট্টি খুলে ছিঁড়ে ছিঁড়ে লম্ফ ফিতের মতো করে রেখেছিল। হ্যারি সেসব বেরকরল। শাঙ্কো একজন প্রহরীর হাত বাঁধল ঐ ফিতে দিয়ে। ফ্রান্সিস তার মুখ চেপে ফিতে বাঁধল। প্রহরীটি গোঁ গোঁ করতে লাগল। শাঙ্কো ওর গালে জোরে এক থাপ্পড় মারল। প্রহরীটির গোঁ গোঁ বন্ধ হল। অন্যটিরও হাত মুখ বাঁধা হল।
কয়েদঘরের দরজা খোলা।
মুক্তি।
ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল–আস্তে।
আস্তে আস্তে সবাই কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এল।
সদর দরজার মাথায় মশাল জ্বলছে। মশালের আলোর বাইরে এসে ওরা অন্ধকারে। দাঁড়াল। শাঙ্কো দেবদারু গাছের নীচে ঢুকল। তরোয়ালগুলো বের করে নিল। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল কুকুরের ডাক। শাঙ্কো মুখের সামনে হাতের তালু রেখে ডেকে উঠল– ভৌ-ভৌ।
খটকরে সদর দরজা খুলে গেল। মারিয়া আর পাংলু বেরিয়ে এল। ওদের সঙ্গে যোগ দিল।
–গেট এর দিকে ছোটো। দু’পা ফাঁক করে ছুটতে হবে। তাহলে বেড়িতে বেড়িতে লেগে শব্দ হবে না। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল।
মারিয়া হাত বাঁধার দড়ির টুকরোগুলো হ্যারিকে দিল।
দেউড়ির দুপাশে মশাল জ্বলছে। সেই আলোতে ফ্রান্সিস দেখল তিনজন প্রহরী পাহারা দিচ্ছে।
তাড়াতাড়ি দেউড়ির সামনে চল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল।
দেউড়ির সামনে মশালের আলোয় প্রহরীরা অবাক। ওরা হকচকিয়ে গেল। তরোয়ালও বের করতে পারল না। ফ্রান্সিস একজনের বুকে তরোয়াল ঠেকিয়ে বলল-দরজা খুলে দাও। নইলে মারবে। শাঙ্কো আর বিস্কো অন্য দুটি প্রহরীর বুকে তরোয়াল চেপে ধরেছে। ফ্রান্সিস যার বুকে তরোয়াল চেপে ধরেছিল তার কোমরেই ঝুলছিল চাবির গোছা। সে চাবি বের করতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল–দুটোর হাত মুখ বাঁধো। হ্যারি দড়ি এগিয়ে দিল। শাস্কো দ্রুত হাতে একজনের হাত বাঁধল। ফিতে কাপড় দিয়ে মুখ বাঁধল। অন্যজনকে বিস্কো বাঁধল। তারপর দুজনকেই ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। দুজনের মুখ দিয়েই গোয়ানির শব্দ বেরিয়ে এল। শাঙ্কো ওদের গলায় তরোয়লের মুখ ঠেকিয়ে বলল গোঁ-গোঁ বন্ধ কর। নইলে মরবে। ওদের গোঁ গোঁ বন্ধ হল।
ততক্ষণে চাবিওয়ালা প্রহরী তালা খুলে দিয়েছে। সবাই দেউড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল। শুধু শাঙ্কো চাবিওয়ালার হাতমুখ বেঁধে একটু পরে এল।
সদর রাস্তায় এসে ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল–যতটা দ্রুত সম্ভব ছোটো। কামার শালার পেছনে লুকোবো।
সবাই যতটা সম্ভব জোরে ছুটল। কামারশালার সামনে পৌঁছতে পেছনে প্রহরীদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনল।
ওরা কামারশালার পেছনে গিয়ে লুকোল। ফ্রান্সিস কামারশালার ঘরের আড়াল থেকে পেছনে তাকাল। দেখল খোলা তরোয়াল হাতে চারজন দেহরক্ষী ছুটে আসছে।
ওরা কামারশালা ছাড়িয়ে ছুটতে ছুটতে জাহাজঘাটের দিকে চলে গেল। ওরা জানে ফ্রান্সিসরা জাহাজে চড়ে পালাবার চেষ্টা করবে।
এতগুলো লোক। ফিসফাস্ কথাবার্তাও চলছিল। কামারের ঘুম ভেঙে গেল। সে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ওর বুকে তরোয়াল ঠেকাল। দাঁতচাপা স্বরে বলল–
–একটি কথাও বলবে না। আমাদের পায়ের বেড়ি খুলে দাও।
–ঠিক আছে। দিচ্ছি। কিন্তু এতজনের বেড়ি—
–আরো কয়েকজন কামারকে ডাকো। ফ্রান্সিস একইভাবে বলল।
–আমার তিন ছেলেই পারবে। ওদের ডাকি। কামার বলল।
–কিন্তু আস্তে। কোন শব্দ করবে না। ফ্রান্সিস বলল।
কামার ওর ঘরে ঢুকল। আস্তে ডাকাডাকি করল। কামার বেরিয়ে এল। তিন ছেলেও এল। ওরা ফ্রান্সিসদের দেখে অবাক। ফ্রান্সিসরা আবার বলল–কেউ কোন শব্দ করবেনা।
কামাররা আগুন জ্বালল। আগুনে লোহার শাবল মতো লোহা ঢোকাল। হাঁপড়টানতে লাগল। — কিছুপরে সেই আগুন লাল লোহার মুখ দিয়ে পায়ের বেড়ি কাটা শুরু হল। ফ্রান্সিস বলল–দেহরক্ষীরা পিছু ধাওয়া করছে। ওদের সঙ্গে লড়তে হবে। কাজেই আমি শাঙ্কো বিস্কোর আর হ্যারি আগে বেড়ি কাটিয়ে নিচ্ছি।
বেড়ি কাটা শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যে পাঁচজনের বেড়ি কাটা হয়ে গেল। আগুন মুখ লোহার আঁচে তখনও ফ্রান্সিসদের পা দপ্ করছে। তবু বেড়ি থেকে মুক্তি। অন্যদের বেড়ি কাটা চলল।
ওদিকে দেহরক্ষীরা জাহাজঘাটে পৌঁছল। কিন্তু ফ্রান্সিসদের চিহ্নমাত্র নেই। কোথায় পালালো সব? একজন বলল–নিশ্চয়ই ওদের জাহাজে লুকিয়ে আছে। কিন্তু কোনটা ফ্রান্সিসদের জাহাজ তা বুঝল না। পার্তাদের বাহারি জাহাজটা জলে ভাসছিল। ওরা সেই জাহাজে উঠল। ঘুমন্ত চালককে তুলল। একজন বলল-ক্রীতদাসরা পালিয়েছে। এদিকেই এসেছে। ওদের জাহাজ কোনটা? চালক আঙুল তুলে ফ্রান্সিসদের জাহাজটা দেখাল।
দেহরক্ষীরা ফ্রান্সিসদের জাহাজের কাছে এল। পাটাতন পাতা নেই। একজন জলে নামল। সাঁতার দিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজের কাছে গেল। হালের কাছেদড়িদড়া ধরে জাহাজে উঠল। ডেক-এ এল। ডেকজনশূন্য। ও পাটাতন টেনে আনতে লাগল। কিন্তু দারুণ ভারি পাটাতন। আনতে সময় লাগল। বেশ কষ্ট করে পাটাতন পাতল। বাকি তিনজন উঠে এল।
ওরা তরোয়াল হাতে সিঁড়ি দিয়ে কেবিনঘরগুলোর কাছে এল। কেবিনঘর, রান্নাঘর খুঁজে দেখল। কেউ নেই। তাহলে ওরা গেল কোথায়? বেশিদূর তো যেতে পারেনি। পায়ের বেড়ি নিয়ে আর কত জোর ছুটবে?
তখনই একজন বলল–ওরা নিশ্চয়ই কামারশালায় গেছে। বেড়ি কাটতে।
–ঠিক। আর একজন বলল।
ওরা কামারশালার দিকে চলল।
কামারশালার কাছে এসে হাঁপর টানার শব্দ শুনল। তাহলে বেড়ি কাটার কাজ চলছে।
ফ্রান্সিস কামারশালার আড়াল থেকে নজর রেখেছিল। রক্ষীদের দেখল। গলা বাড়িয়ে বলল–শাঙ্কো, বিস্কো তোমরা এসো। ওরা এসেছে। একটাকেও ছাড়বেনা। সব কটাকেই হত্যা করবে। কোলাকে ওরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। বদলা নিতে হবে।
ফ্রান্সিস দ্রুত ছুটে গিয়ে একজন রক্ষীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রক্ষীরা এত দ্রুত আক্রমণ আশা করেনি। পায়ে বেড়ি নেই। এখন পায়ের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে না। ফ্রান্সিস সেই রক্ষীর তরোয়ালে এত জোরেঘা মারল যে রক্ষীরতরোয়াল ছিটকে গেল। খালি হাতেও বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস একমুহূর্তও দেরি করল না। সোজা ওর বুকে তরোয়াল বিঁধিয়ে দিল। তারপর তরোয়ালটা টেনে খুলে নিল। রক্ষীটি গড়িয়ে রাস্তার পাশের ঝোপে পড়ে গেল।
অন্য তিনজনের সঙ্গে তখন শাঙ্কোরা লড়াই চালাচ্ছে। পায়ে বেড়ি নেই। ওরা স্বচ্ছন্দে। লড়াই চালাচ্ছে। শুধু হ্যারিই পারছিল না। তরোয়ালের ডগা লেগে ওর জামা জায়গায় জায়গায় কেটে গেছে।
ফ্রান্সিস লাফিয়ে গিয়ে হ্যারিকে আড়াল করে দাঁড়াল। শুরু হল তরোয়ালের লড়াই। ফ্রান্সিস ভাবল একে হত্যা করতেই হবে। ও সাবধানে তরোয়াল চালাতে লাগল আর সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগল।
হঠাৎ ফ্রান্সিস ঐ রক্ষীটির পেছন দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলে উঠল–মারো একে। রক্ষীটি পেছনে ফিরে তাকাল। ফ্রান্সিস এই সুযোগই খুঁজছিল। আর দেরি করল না। রক্ষীটির গলায় তরোয়াল ঢুকিয়ে দিল। রক্ষীটি রাস্তার ওপর গড়িয়ে পড়ল। আর উঠল না।
অন্য রক্ষীটি একজন সঙ্গীদের এভাবে মরতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। সে তরোয়াল ফেলে পার্তাদোর বাড়ির সদর গেট-এর দিকে ছুটল। বাকি একজনকে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো মিলে হত্যা করল।
হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–কোলা–তোমাকে হত্যার বদলা নিলাম। তবে একটা বেঁচে গেল।
কামারশালায় তখন সকলেরই পায়ের বেড়ি কাটা হয়ে গেছে।
শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে একটা সোনার চাকতি বের করে কামারকে দিল। কামার খুব খুশি। এর আগেও বেড়ি কেটেছে। কিন্তু সোনা পায়নি। সবাই জাহাজঘাটের দিকে চলল। জাহাজঘাটে যখন পৌঁছল তখন ভোর হয়ে এসেছে।
পাটাতন পাতাই ছিল। সবাই একে একে জাহাজে উঠল।
ডেক-এ উঠে ফ্রান্সিস ডেক-এর ওপর শুয়ে পড়ে ডেক-এ চুমু খেল। ওদের সুখদুঃখের সঙ্গী জাহাজটাকে আবার পাওয়া গেছে।
ফ্রান্সিসের দেখাদেখি ওর বন্ধুরাও শুয়ে পড়ে ডেক-এ চুমু খেল।
এবার ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–জাহাজ চালাও। এক মুহূর্তও দেরি নয়। পালা খাঁটাও। কয়েকজন দাঁড়ঘরে চলে যাও। দাঁড় বাও। জাহাজের গতি বাড়াও।
শাঙ্কো হুইল ধরো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরে যেতে হবে।
সবাই কাজে লেগে গেল। নোঙর তোলা হল। জাহাজ চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জোর গতি পেল। পালগুলো ফুলে উঠল। জাহাজ চলল দক্ষিণমুখো।
নিজের পরিচিত কেবিনঘরে ঢুকেইমারিয়া মাথার কাছে কাঠের দেয়ালের কাছে গেল। কাঠ ফাঁক করে দেখল সোনার চাকতিগুলো রয়েছে। কাঠ চেপে ফাঁক বন্ধ করে দিল। পাংলুও ঘরে ছিল। কিছু বুঝল না মারিয়া ওভাবে ছুটে গেল কেন? কী দেখল? পাংলু কাঠের মেঝেয় বসল।
ফ্রান্সিস ঢুকল। সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। মারিয়াও বিছানার একপাশে বসল। মৃদুস্বরে বলল–
-তোমার পায়ের অবস্থা কী?
–অনেকটা সেরে গেছে। দিনকয়েকের মধ্যেই সেরে যাবে। বেড়ির ঘষা তো আর লাগছে না। ফ্রান্সিস মৃদু স্বরে বলল।
দরজায় আঙুল ঠোকার শব্দ হল। পাংলু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। হ্যারি শাঙ্কো আর একজন বন্ধু ঘরে ঢুকল।
হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস জাহাজ দক্ষিণদিকে চালাতে বললে কেন? দেশে যেতে হলে তো উত্তরদিকে জাহাজ চালাতে হবে।
–না। রেজিল বন্দরে নেমে যাবো। বাকি বন্ধুরা কী অবস্থায় আছে কে জানে। ওদের তো সঙ্গে নিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
-তা ঠিক। বন্ধুদের নিয়ে তো দেশে ফিরবে? শাঙ্কো বলল।
না। ফেরার পথে আমারগো বন্দরে নামবো। ওখান থেকে কিছুদূরে রাজা আলফ্রেডের গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করবো।
–আবার? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মারিয়া।
ফ্রান্সিস হেসে বলল হ্যাঁ। আবার। তারপর উত্তরমুখো–দেশে।
কিছু বলার নেই। তুমি যা ভালো বোঝ। মারিয়া গোমড়ামুখে বলল। হ্যারিরা চলে গেল। রেজিল বন্দর লক্ষ্য করে জাহাজ চলল। জাহাজ আমারগো বন্দরে ভিড়ল! জাহাজ নোঙর করল। তিনজন কৃষ্ণকায় ফ্রান্সিসের কাছে এল। আকারে ইঙ্গিতে বলল”আমরা এখানেই নেমে যাবো।
–বেশ তো। ফ্রান্সিস বলল।
পুরনো মনিবের কাছেই থাকবে বলছে। মারিয়া বলল।
ও যা চাইবে তাই হবে। আমিও ওর পুরনো মনিব সামুছার কাছে আসবো। সামুছার সাহায্য না পেলে কিছুই করতে পারবো না। ফ্রান্সিস বলল।
পাংলু আর কৃষ্ণকায় তিনজন নেমে গেল। পাংলুর জন্য মারিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। অনেকদিন একসঙ্গে ছিল। পাংলুর ওপর কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল।
জাহাজ চলল।
পনেরো কুড়িদিন পর জাহাজ রেজিল বন্দরে পৌঁছল। বন্দরে ব্যস্ত জীবন। দোকানে বাজারে ভিড়।
ফ্রান্সিস বলল–শোন–দেরি করা চলবে না। এক্ষুনি বন্ধুদের খোঁজে বেরোতে হবে। প্রথমে শাঙ্কো আর আমি যাচ্ছি।
ফ্রান্সিস ও শাঙ্কো পাটাতন দিয়ে নেমে এল। এদিক ওদিক ছোট ছোট বাড়িঘর। সেসব ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা আসতে দেখল একটা বড় বাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে বেশ অর্থব্যয় করে বাড়িটা তৈরী। কোন বড় জমিদারের বাড়ি হবে।
বাড়ির সামনেই অনেকদূর পর্যন্ত গমের ক্ষেত। একটা নয়, পরপর কয়েকটা। ক্ষেতের চারপাশে সশস্ত্র প্রহরী। ক্ষেতে চাষের কাজ চলছে।
ফ্রান্সিস ক্ষেতের সীমার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। একজন প্রহরী খাপ থেকে তরোয়াল খুলে ছুটে এল। গম্ভীর গলায় বলল–কী চাই?
–কিছুনা। দেখছিলাম–চাষীদের মধ্যে আমার বন্ধুরা আছে কিনা। ফ্রান্সিস বলল।
তুমি তো বিদেশি।
–হ্যাঁ। আমার বন্ধুরাও তো বিদেশি। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ কিছু বিদেশি আছে চাষীদের মধ্যে। প্রহরী বলল।
–বিদেশি আছে। ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বলল–তাদের একজনকে ডেকে দেবে।
–আমি তোমার ক্রীতদাস? হুকুম করলেই শুনবো। প্রহরী বলল।
–চাষীরা কি ক্রীতদাস? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
না। তবে ক্রীতদাসের মতোই। পায়ে বেড়ি নেই। কিন্তু বন্দী। পালাবার পথ বন্ধ। প্রহরী বলল।
–কোথায় রাখা হয় ওদের? ফ্রান্সিস বলল।
-তোমার অত প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না। ভুরু মোটা প্রহরীটি বলল–যাও। রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াও।
ফ্রান্সিস ক্ষেতের সীমা থেকে সরে এল। বুঝল বেশী কিছু জানা যাবে না। তবে বন্ধুরা এখানে বন্দী হয়ে থাকতে পারে। অন্তত সম্ভাবনা আছে।
ফেরার পথে ফ্রান্সিস দেখল একটা বাড়ির বারান্দায় একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে।
ফ্রান্সিস বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে বলল–দেখুন, আমরা বিদেশি। এই রেজিল বন্দর এলাকা আমরা চিনি না। এখানকার বড় বড় জমিদারেরা কি চাষাবাদের জন্যে ক্রীতদাস রাখে?
–কী বলবো? ঐ জমিদার কেদিয়া এখানকার রাজা বললেই হয়। কার সাধ্য ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। বৃদ্ধ বলল।
–তুম্ফা কী করে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–তুম্ফার কাজই হল যেসব জাহাজ বন্দরেআসে তাই থেকে যুবকদের লোভ দেখিয়ে কেদিয়ার বাড়িতে নিয়ে আসা পেট ভরে খাওয়ান। বলে এখানে চাষের কাজ করলে দুমাসে তোমরা বড়লোক হয়ে যাবে। জাহাজে কাজ করে কী পাও? বৃদ্ধ বলল।
–তারপর? ফ্রান্সিস আগ্রহী হল।
তারপরেই তাদের বন্দীঘরে বন্দী করে রাখা হয়। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া আদরযত্ন চলে। কিন্তু বন্দী হয়েই থাকতে হয়। বাইরে বেরোবার উপায় নেই। কড়া পাহারা। বৃদ্ধ বলল।
তারপর তাদের চাষের কাজে লাগায়। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক। সারাদিন ক্ষেতের কাজ করায়। খাওয়াও আর আগের মতো দেওয়া হয় না। বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন মিলিয়ে যায়। বৃদ্ধ বলল।
–এ তো ক্রীতদাসেরই জীবন। ফ্রান্সিস বলল।
–সত্যিই তাই। বৃদ্ধ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
–অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ফ্রান্সিসরা ফিরে এল।
জাহাজে এসে ফ্রান্সিস হ্যারি বিস্কো আর কয়েকজন বন্ধুকে ডাকল। যা খবর এনেছে বলল। তারপর বলল-যা বুঝতে পারছি আমাদের বন্ধুরা প্রায় ক্রীতদাস হয়ে আছে। হয় কেদিয়া বা অন্য কোন জমিদারের বাড়িতে। এবার খোঁজখবর নিতে হবে। রাতে আমি আর শাঙ্কোই যাবো খোঁজখবর নিতে।
মনে হয় কেদিয়ার বাড়িতেই ওদের পাবো। হ্যারি বলল।
–আমারও তাই মনে হয়। যারা চাষ করছিল তাদের এতদূর থেকে দেখেছি চিনতে পারিনি। কেদিয়াই বোধহয় এখানকার সবচেয়ে বড় জমিদার। অঢেল জমি। মনে হয় তার বাড়িতেই বন্ধুরা বন্দী হয়ে আছে। তুই ওদের ভুল বুঝিয়ে নিয়ে গেছে। কেদিয়ার বাড়িটাই আগে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
সেদিন রাতে খাওয়ার পর ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। বিশ্রাম করতে লাগল।
কিছুপরে দরজায় টোকার শব্দ। ফ্রান্সিস উঠে পড়ল।
-কোথায় যাচ্ছো? মারিয়া জিজ্ঞেস করল।
বন্ধুদের খোঁজে। ফ্রান্সিস বলল।
এত রাতে। এই বিদেশ। কোন বিপদআপদ
হতে পারে। তবে সাবধানে থাকবো। ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলল। শাঙ্কো দাঁড়িয়ে।
দুজনে জাহাজ থেকে নেমে এল। রাস্তা ধরে চলল কেদিয়ার বাড়ির দিকে।
রাস্তা জনশূন্য। চাঁদের আলো উজ্জ্বল। দুজনে হাঁটতে লাগল।
কেদিয়ার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।
বিরাট বাড়ি। ফ্রান্সিসরা বাড়ির পেছন দিকে এল। দেখল একটা লম্ফটে কাঠের ঘর। একেবারে ওপরে দুটি জানলামত। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–শাঙ্কো–এটাই বন্দীঘর।
ফ্রান্সিস কাঠের দেওয়ালের কাছে গেল। চাপাস্বরে ডাকল–ফ্লেজার সিনাত্রা। ঘরের ভেতরে কোন সাড়াশব্দ নেই। বেশি জোরে ডাকতে সাহস পাচ্ছেনা। নিশ্চই ঘরে প্রহরী আছে। আবার বার দুয়েক ডাকল-ফ্লেজার-ভেন। ঘরের ভেতর থেকে কোন শব্দ শোনা গেলনা।
দাঁড়াও। কাঠের দেয়াল ফুটো করছি। শাঙ্কো বলল। তারপর গলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ওর ছোরাটা বের করল। কাঠের দেয়ালে ছোরা চেপে ঘোরাতে লাগল। শক্ত কাঠ। তবু শাঙ্কো হাল ছাড়ল না। ছোরা ঘোরাতে ঘোরাতে সত্যিই একটা ফুটো মত হল। সেই ফুটোয় মুখ চেপে ফ্রান্সিস গলা চেপে ডাকল–ফ্লেজার সিনাত্রা–ফ্লেজার। ভেনভেন।
একটু পরে ঘরের ভেতরে নড়াচড়ার শব্দ পেল। কেউ যেন উঠে এল। ফুটোয় মুখ চেপে ফ্রান্সিস বলল–এইখানে এসো। এখানে ফুটো।
যে উঠেছিল সে ফুটোর কাছে এগিয়ে এল। ফুটোয় মুখ রেখে বলল–কে? ফ্লেজারের গলা। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে হাসল। শাঙ্কোও হাসল।
এবার ফ্রান্সিস ফুটোয় মুখ রাখল। বলল
–আমি ফ্রান্সিস। সঙ্গে শাঙ্কো। তোমরা কী বন্দী?
–হ্যাঁ। আমাদের দিয়ে চাষের কাজ করায়। ফ্লেজার বলল।
–জানি। ফ্রান্সিস বলল। ও বুঝল ফুটোর কাছে এসে কয়েকজন দাঁড়িয়েছে।
–আর দু’একদিন অপেক্ষা কর। তোমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করছি। ততদিন চুপচাপ থাকো। প্রহরীদের মনে যেন কোন সন্দেহ না হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। ফ্লেজার বলল।
বন্ধুদের আমাদের কথা বল। কালকে আবার আসবো। পালাবার ছক বলবো। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা আস্তে আস্তে চলে এল।
জাহাজে ফিরে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো হ্যারির কাছে গেল। হ্যারির ঘুম ভাঙিয়ে বলল তোমার অনুমানই ঠিক। কেদিয়ার বন্দীঘরেই আমাদের বন্ধুরা বন্দী হয়ে আছে। এখন আমাদের কাজ হল ওদের মুক্ত করা।
ফিরে আসার সময় শাঙ্কো বলল–বন্ধুরা পালিয়ে আসতে গেলেই প্রহরীরা ওদের তাড়া কররে। তখন তরোয়ালের লড়াই চালাতে হবে। হয়তো প্রহরীদের কয়েকজনকে হত্যা করতে পারবো। কিন্তু আমরাও অক্ষত থাকবো না। সবচেয়ে ভালো হচ্ছে তীরধনুক নিয়ে ওদের সঙ্গে লড়া।
–তাহলে সকালের খাবার খেয়েই চলো তীরধনুকের ব্যবস্থা করতে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাই চলো। শাঙ্কো বলল।
পরদিন সকালে ওরা দুজনে রাস্তা দিয়ে চলল। দোকানপাটে বাজারে বেশ ভিড়। ওরা একটা কামারশালা খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। ছোট দোকান। ওরা দোকানে ঢুকল। কামার একটা কুড়ুল বানাচ্ছিল।
–ভাই, তীরধনুক বানাতে পারো? শাঙ্কো বলল।
-কেন পারবোনা। অনেকেই শিকার ধরার জন্য তীরধনুক বানিয়ে নিয়ে যায়। তবে খাটুনি বেশি। বেশি দাম দিতে হবে। কামার হাপড় টানতে টানতে বলল।
শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে একটা সোনার চাকতি বের করে দিল। কামার সন্তুষ্ট। হেসে বলল কালকে সকালেই পেয়ে যাবেন।
সেদিন গভীর রাতেই ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো কেদিয়ার বাড়ির পেছনদিককার বন্দীঘরের কাছে গেল। ফ্রান্সিস ফোকরে মুখ দিয়ে চাপাস্বরে ডাকল-ফ্লেজার, সিনাত্রা–আ। ফ্লেজাররা জেগেই ছিল। ফ্লেজার ফোকরে মুখ রেখে বলল–বলো। ও মুখ সরাল। এবার ফ্রান্সিস বলল–তোমরা যখন ক্ষেতে কাজ করবে আমরা তখনই যাবো। শাঙ্কোর হাতে থাকবে একটা সাদা রঙের পতাকা। পতাকাটার দিকে নজর রাখবে। পতাকা দেখলেই আমাদের কাছে ছুটে আসবে।
–প্রহরীরাও তো আমাদের পিছু ধাওয়া করবে। ফ্লেজার বলল।
–শাঙ্কো তীর ছুঁড়ে ওদের আটকাবে। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কোর হাতে তীরধনুক থাকলে নিশ্চিন্ত। ফ্লেজার বলল।
ফ্রান্সিসরা জাহাজে চলে এল। বন্ধুদের কাছে ছকের কথা বলল। বন্ধুরা সব শুনে ঘুমুতে গেল।
সকালের খাবার খেয়েই ফ্রান্সিসরা তরোয়াল কোমরে গুঁজে জাহাজ থেকে নেমে এল। দোকানে বাজারে রাস্তায় ভিড়। তার মধ্যে দিয়েই ওরা চলল। শাঙ্কোর হাতের কাঠের ডায় সাদা পতাকা উড়ছে। ভিড়ের মধ্যে অনেকেই ফ্রান্সিসদের দেখল। তারা ভেবে পেল না কোমরে তরোয়াল গুঁজে হাতে পতাকা নিয়ে ওরা কোথায় চলেছে।
যেতে যেতে শাঙ্কো হেসে বলল–ফ্রান্সিস সাদা পতাকা কিন্তু শান্তির পতাকা।
–আমাদের কাছে আজ অশান্তির পতাকা। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
ফ্রান্সিসরা ক্ষেতের কাছে পৌঁছল। দেখল ক্ষেতের এককোনায় একজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে তরোয়াল। আর একজন প্রহরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
পতাকা হাতে ফ্রান্সিসদের দেখে প্রহরীটি কেমন হকচকিয়ে গেল। প্রহরীটি কিচ্ছু বোঝার আগেইশাঙ্কো পতাকা ফ্রান্সিসের হাতে দিয়ে ছুটে গিয়ে প্রহরীটির ওপরঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রহরীটি চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। শাঙ্কোর হাতে ছুরি ছিলই। ও প্রহরীটির বুকে ছুরিবিধিয়ে দিল।
ওদিকে ফ্রান্সিসের হাতের সাদা পতাকা দেখে ফ্লেজাররা ছুটে আসতে লাগল। প্রহরীরা বুঝল ওরা পালাচ্ছে। প্রহরীরাও ওদের পেছনে ছুটে আসতে লাগল। কাছাকাছি যে দাঁড়িয়ে ছিল সে খাপ থেকে তরোয়াল খুলে ফ্রান্সিসদের দিকে ছুটে এল। ফ্রান্সিস দ্রুত ছুটে গিয়ে প্রহরীটির ডান হাত লক্ষ্য করে তরোয়াল চালাল। প্রহরীটি সেই মার ঠেকাতে গেল। কিন্তু পারল না। ওর ডানহাতে তরোয়াল বসে গেল। ও তরোয়াল ফেলে হাত চেপে বসে পড়ল।
ততক্ষণে ফ্লেজাররা ফ্রান্সিসদের কাছে এসে গেছে। প্রহরীদের একজন ফ্রান্সিসদের– অনেক কাছে চলে এসেছিল। শাঙ্কো ধনুকে তীর পরিয়ে তীর ছুঁড়ল। শাঙ্কোর নিশানা নিখুঁত। তীর গিয়ে বিঁধল প্রহরীটির পেটে। প্রহরীটি ক্ষেতের ওপর পড়ে গেল।
এই দেখে অন্য প্রহরীরা থমকে দাঁড়াল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। এই সুযোগে শাঙ্কো একটার পর একটা তীর ছুঁড়তে লাগল। তীরগুলো কারো হাঁটুতে, কারো কাঁধে, কারো বুকের কাছে বিধল।
প্রহরীদের গতি রুদ্ধ হয়ে গেল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল জাহাজ ঘাটের দিকে জলদি।
সবাই জাহাজঘাটের দিকে ছুটল। লোকের ভিড়ের মধ্য দিয়েই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটল সবাই।
তিনজন প্রহরী কিন্তু জাহাজঘাটের কাছে এসে গেল।
ফ্রান্সিসরা ততক্ষণ জাহাজে উঠে গেছে। পাতা পাটাতনের কাছে দাঁড়াল ঐ তিনজন। ফ্রান্সিস কোমর থেকে তরোয়াল খুলল। চেঁচিয়ে বলল–উঠেএসো। তোমাদের লড়াইয়ের সাধ মিটিয়ে দিচ্ছি।
প্রহরী তিনজন নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করল। তারপর পিছু ফিরেহাঁটতে লাগল।
ওদিকে ফ্লেজারদের পালাবার সময় অন্য বন্দীরাও পালাল। প্রহরীরা ফিরে এসে দেখল একজন বন্দীও নেই। ওদের রাগ পড়ল ফ্রান্সিসদের ওপর। কিন্তু কিছুই করার নেই। এখন কর্তার কাছেজবাবদিহি করতে হবে। এই চিন্তা নিয়ে অলস পায়ে কেদিয়ার বাড়ির দিকে চলল।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল-জাহাজ ছাড়ো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কেদিয়া এখানকার জমিদার। তার যথেষ্ট লোকবল আছে। আমরা বিপদে পড়বো।
সবাই ভাগ হয়ে ছুটলো। পাল খুলে দেওয়া হল। পালগুলো ফুলে উঠল। নোঙর তোলা হল। দাঁড়ঘরে দাঁড় বাওয়া শুরু হল। জাহাজ চলল। অল্পক্ষণের মধ্যেই বেশ গতি পেল।
জাহাজ তখন বেশ দূরে চলে এসেছে। দূর থেকে ওরা দেখল জাহাজঘাটে বেশ ভিড় জমেছে।
জাহাজ ক্রমে মাঝ সমুদ্রে চলে এল। তখনও দাঁড় বাওয়া চলছে।
জাহাজ উত্তরমুখো চলল।
দুদিনের মাথায় জাহাজ ঝড়ের মুখে পড়ল। ভাইকিংরাঝড়ের মোকাবিলায় অভ্যস্ত। ওরা পাল নামিয়ে দড়িদড়া টেনে জাহাজ ভাসিয়ে রাখল।
প্রায় দিন পনেরো কুড়ি পরে ওদের জাহাজ আমারগো বন্দরে ভিড়লো।
তখন শেষ রাত।
ফ্রান্সিস স্থির করল আর দেরি করবে না। পরদিন সকালেই সামুছার খোঁজে যাবে।
পরদিন সকালেই ফ্রান্সিস, শাঙ্কো আর হ্যারিকে নিয়ে বন্দরে নামল। দোকানের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে সামুছার বাড়িতে এল।
এমন কিছু বিশাল বাড়ি নয়। ছোট বাড়ি। কাঠ পাথরে তৈরি।
বাড়ির ওপাশে তাকাতেই রাজা আলফ্রেডের দুর্গের প্রায় ধ্বংসস্তূপ দেখল। সমস্ত দূর্গটাই প্রায় ভেঙে পড়েছে। দুএকটা জায়গায় তখনও ছাদমত আছে। কয়েকটা দেয়ালও খাড়া আছে।
সামুছার বাড়ির দরজায় ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিল। একটু পরেই দরজা খুলে গেল। পাংলুদাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিস এখানে আসবে এটা পাংলু ফ্রান্সিসের কথা থেকে জেনেছিল। ও খুব অবাক হল না। হাসতে হাসতে ফ্রান্সিসের দুহাত জড়িয়ে দরজা খুলে ধরল। ফ্রান্সিস হেসে বলল–কেমন আছো পাংলু। পাংলু ওর দেশীয় ভাষায় কী বলে গেল ফ্রান্সিস কিছুই বুঝল না। তবে এটুকু বুঝল যে পাংলু ভালোই আছে।
এবার ফ্রান্সিস আকারে ইঙ্গিতে কর্তাকে ডেকে দিতে বলল। পাংলু চলে গেল।
কিছু পরে সামুছা দরজায় এসে দাঁড়াল। মুখে কঁচাপাকা দাড়িগোঁফ। বেশ রোগাটে চেহারা। তবে চোখদুটো খুব বুদ্ধিদীপ্ত। মাথার কাঁচাপাকা চুলে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে সামুছা বললেন–আপনারা কী চান? আপনারা তো বিদেশী।
হ্যাঁ। আমরা ভাইকিং। একটা ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। বলুন। সামুছা বললেন।
–এখানে নয়। একটু বসে কথা বলতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।
–খুব দরকারি কথা? সামুছা বললেন।
–হ্যাঁ। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। ফ্রান্সিস বলল।
সামুছা পেছন ফিরে বললেন–আসুন।
একটা ছোট ঘরে ঢুকল সবাই। গদীওয়ালা কয়েকটা চেয়ার। পাথরের দেয়ালে পাথরের পাটাতন পেতেই কিছু চামড়ার বই সাজানো। মাঝখানে একটা চৌকোনো টেবিলমত। সামনের চেয়ারটায় গদী নেই। সাধারণ কাঠের চেয়ার। সামুছা ওটাতেই বসলেন। ফ্রান্সিসরা গদী আঁটা চেয়ারে বসল।
ফ্রান্সিস একবার চারদিকে দেখে নিয়ে বলল–আমার নাম ফ্রান্সিস।
–ও। সামুছা মুখে শব্দ করলেন।
–আমরা শুনেছি যে আপনি রাজা আলফ্রেডের গুপ্ত ধনভাণ্ডার আবিষ্কারের জন্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফ্রান্সিস বলল।
ভুল শুনেছেন। সামুছা বললেন।
–না। ভুল শুনিনি। ফ্রান্সিস বলল।
–কথাটা যে সত্যি এটা কী জন্যে মনে করছেন। সামুছা বললেন।
–আপনি আমারগো বন্দর থেকে এতদূরে একা একা এই বাড়িতে নির্জন জায়গায় দিন কাটাচ্ছেন কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–বেশি লোকজন আমি একেবারে পছন্দ করি না। সামুছা বললেন।
–তাহলে রোববার রোববার রাতে রাজা আলফ্রেডের ঐ ভাঙা দূর্গে যান কেন? ফ্রান্সিস বলল।
-কে বলল? সামুছা একটু চমকালেন।
–তা বলবো না। সত্যি কিনা তাই বলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ যাই। ঘুরে ফিরে দেখি। সামুছা বললেন।
–এটা একটা যুক্তি হল? গভীর রাতে মশাল হাতে একটা ভাঙা দূর্গে ঘুরে বেড়ানো বিনা কারণে? ফ্রান্সিস বলল।
-হ্যাঁ। সামুছা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
না। আপনি গুপ্তধন ভাণ্ডারের কোন সূত্র পান কিনা তাই দেখে বেড়ান। ফ্রান্সিস বলল।
সামুছা বুঝল যুক্তিতে তিনি হেরে যাচ্ছেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন–বেশ যদি খুঁজেই থাকি তাতে আপনাদের কী?
–কিছুই না। গুপ্ত ধনভাণ্ডার যে কেউ খুঁজতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
সামুছা এবার আঙ্গুল দিয়ে তাকের চামড়ার বইগুলো দেখালেন। বললেন– ঐ বইয়ের একটাতে রয়েছে রাজা আলফ্রেডের নিজের লেখা তার জীবনী।
–তাহলে তো আপনি অনেক তথ্য পেয়েছেন। ফ্রান্সিস বলল।
না। গুপ্ত ধনভাণ্ডার নিয়ে রাজা আলফ্রেড একটি কথাও লেখেন নি। যাক গে। অনেক কষ্টে বইটা জোগাড় করেছিলাম কিন্তু আমার কোন কাজেইলাগল না। সামুছা বললেন।
ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল
এবার আমার কথা বলি। আমি এর আগে অনেক গুপ্তধন বুদ্ধি খাটিয়ে পরিশ্রম করে খুঁজে বের করেছি। আমার খুব ইচ্ছে যে রাজা অ্যালবার্টের গুপ্তধনও খুঁজে বের করি।
-কেন? সামুছা জানতে চাইলেন।
–এমনি। আমি এসব কাজ ভালোবাসি তাই। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। খুঁজে বের করলেন। তারপর? সামুছা বললেন।
–সেই গুপ্তধন যার প্রাপ্য তাকে দিয়ে চলে আসি। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা অ্যালবার্টের গুপ্তধন কার প্রাপ্য? সামুছা বললেন।
–কেন–আপনার। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনি কোন অংশ নেবেন না? সামুছা জানতে চাইলেন।
না। গুপ্তধনের প্রতি আমার কোন লাভ নেই। ফ্রান্সিস বলল। সামুছা বেশ চমকে উঠল। এন্টু চুপ করে থেকে বললেন সত্যিই আপনি কিছু চাইবেন না? ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল
–না।
–ঠিক আছে। আমি একটু ভেবে দেখি। আপনারা কাল সকালে আসুন। সামুছা। বললেন।
ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়াল।
বাড়ির বাইরে এল। পিংলা ছুটে এল। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে হাসল। ফ্রান্সিসও হাসল। কিছু বলল না। বললেও পাংলু বুঝবে না।
ফেরার পথে হ্যারি ডাকল–ফ্রান্সিস।
-বলো। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকাল।
–গুপ্তধন উদ্ধারে সামুছা কি তোমার সাহায্য নেবে? শাঙ্কো বলল।
আলবাৎ নেবে। আমার পিঠে চড়ে সামুছা গুপ্তধন হাতাবার তালে আছে।
–এটা ঠিক গুপ্তধন উদ্ধার হলে ওরই লাভ। শাঙ্কো বলল।
–সেটা ও ভালো করেই জানে। ফ্রান্সিস বলল।
পরের দিন সকালে ফ্রান্সিসরা আবার সামুছার বাড়িতে গেল। তার আগে বন্ধুদের সব কথা বলে গেল।
গতকালের মত পাংলুই দরজা খুলল। ফ্রান্সিসদের বসার ঘরে বসিয়ে গেল।
সামুছা এলেন। চেয়ারে বসল। বললেন–ভেবে দেখলাম আমি তো দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও গুপ্তধন আবিষ্কার করতে পারলাম না। ভাবছি তোমাদের সাহায্য নেব। ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। সামুছা এবার বললেন–যে কথাটা কেউই জানে না সে কথাটাই। বলছি। গুপ্ত ধনভাণ্ডার নয় রাজা অ্যালবার্ট একটা স্বর্ণখনি স্থাপন করেছিলেন।
–স্বর্ণখনি? ফ্রান্সিস বেশ চমকে উঠল।
–হ্যাঁ। রাজা অ্যালবার্ট তাঁর বইতে এইস্ফাখনির কথা উল্লেখ করে গেছেন। দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছে সেই স্ফাখনির ওপরেই। উনি দক্ষিণ দেশ থেকে কয়েকজন স্ফাখনি বিশেষজ্ঞ আনিয়েছিলেন। তারা স্ফরেণু জড়ানো পাথর থেকে সোনা গলিয়ে সোনার মণ্ড তৈরি করেছিল। সেসব তিনি আর ওপরে নিয়ে আসার সময় পান নি। তার আগেই তার মৃত্যু হয়।
-তাহলে তো সোনার মণ্ড সোনার খনি এই ভাঙা দূর্গের নীচেই রয়েছে? ফ্রান্সিস। জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। সেই স্বর্ণখনিই খুঁজে বের করতে হবে। রাজা অ্যালবার্টের গুপ্ত ধনভাণ্ডার বলে কিছু নেই। সামুছা বললেন।
–আশ্চর্য! আমরা তো ধনভাণ্ডারের কথাই শুনেছি। ফ্রান্সিস বলল।
-ওটাই প্রচলিত গল্প। আমি স্বর্ণখনির কথা কাউকে বলিনি। তোমাদেরই প্রথম বললাম সামুছা।
ফ্রান্সিস মাথা নীচুকরে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর মাথা তুলে বলল–স্বর্ণখনি সম্পর্কে রাজা অ্যালবার্ট তার বইতে কিছু লিখেছেন?
না। যা বললাম শুধু সেইটুকু। সামুছা বললেন।
–ঠিক আছে। কালকে সকাল থেকে আমি কাজ শুরু করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–লোকজনের দরকার হলে বলবেন। সামুছা বললেন।
না। আমার বন্ধুদের সাহায্য নেব। সমস্ত ভাঙা দুৰ্গটা ভালোভাবে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
পরের দিন সকাল থেকেই ফ্রান্সিস হ্যারি আর শাঙ্কো কাজে নেমে পড়ল।
ওরা ঘুরে ঘুরে ভাঙা দুৰ্গটা দেখতে লাগল। কোথাও কোথাও পাথর আলগা বলে ফ্রান্সিসরা বারকয়েক আলগা পাথরে পা রেখে হড়কে যাচ্ছিল। কোথাও পায়ের চাপে আলগা পাথর নীচে গরগর করে গড়িয়ে গেল। অগত্যা সাবধানে পা ফেলে ফেলে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।
তখনই সামুছা এলেন। ফ্রান্সিসরা তখন দূর্গের ভাঙা ছাদে দাঁড়িয়ে। সামুছা গলা চড়িয়ে বললেন–পূবদিকে যাবেন না। ওখানে সব আলগা পাথর। গড়িয়ে নীচে পড়ে যাবেন।
ফ্রান্সিসরা পূবদিকে গেল না। অন্য দিকগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।
–ভাঙা দূর্গের দেওয়াল যেমন হয়। ভাঙা পাথরের স্তূপ। এটাও তেমনি নতুনত্ব কিছু নেই। শাঙ্কো বলল।
-হু। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। তারপর বলল-বোঝা যাচ্ছে অনেকগুলো ঘর ছিল আর বেশ বড় বড় ঘর। একটা লম্বাটে ঘর দেখলাম। তার দেওয়ালে এখনও কয়েকটা কড়া ঝুলছে। তার মানে কয়েদঘর। রাজা অ্যালবার্ট শাস্তির ব্যবস্থাও রেখেছিলেন।
ওরা ভাঙা দূর্গ থেকে নেমে এল।
–তাহলে দেখলেন সব। সামুছা বললেন।
–হ্যাঁ। তবে প্রাথমিকভাবে। এবার ঘরগুলো দেখতে হবে। আমাদের দেখতে হবে মেঝে। খনি ওপরে থাকে না। ফ্রান্সিস বলল।
–তা ঠিক। যাক গে এখন আর জাহাজে ফিরে যাবেন না। আমি এখানেই আপনাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। সামুছা বললেন।
দুপুরে সামুছার খাবার ঘরে ওরা খেতে বসল। পাংলু আর একটি কৃষ্ণকায় মেয়ে ওদের খেতে দিল। চিংড়িমাছের খাবারটা ওদের খুব সুস্বাদু লাগল। ওরা চেয়ে খেল। খেতে খেতে হ্যারি বলল–আপনার কাছে একটা অনুরোধ ছিল।
–বলুন। সামুছা বলল।
রাজা আলফ্রেডের লেখা বইটা একটু দেবেন? হ্যারি বলল।
–পড়তে পারবেন? পুরোনো স্পেনীয় ভাষায় লেখা। সামুছা বললেন।
–আমি স্পেনীয় ভাষা অল্প জানি। পড়তে চেষ্টা করবো। তাছাড়া ছবিটবি থাকলে দেখবো। হ্যারি বলল।
–ছবি আছে। তবে সে সব নানা জাতের ফুলের ছবি। সামুছা বললেন।
–তাহলে রাজা অ্যালবার্ট ফুল ভালোবাসতেন। হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ। তার বিরাট ফুলের বাগান ছিল। সামুছা বললেন।
খাওয়াদাওয়া শেষ। ফ্রান্সিসরা বাইরের ঘরে এসে বসল। সামুছা এলেন। তাক থেকে চামড়া বাঁধানো বেশ বড় একটা বই টেবিলে রেখে বললেন বইপড়ুন। সামুছা বই দিয়ে চলে গেলেন।
ফ্রান্সিস চেয়ারে বসেছিল। উঠে দাঁড়াল। বলল
–দেরি করবো না। চলো।
—আমি বইটা দেখছি। তোমরা যাও। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো ভাঙা দুর্গে এল। এবার ফ্রান্সিস ভাঙা ঘরগুলো দেখতে লাগল। সবই ভাঙা। কয়েকটিকে ঘর বলে মনে হয় এই পর্যন্ত।
দুজনে ঘুরে ঘুরে ভাঙা ঘরগুলো দেখতে লাগল। ঘরগুলোর বৈশিষ্ট্য কিছু নেই। চারকোনা ঘর। প্রায় সবগুলো ঘরই দেখা হল। কিন্তু পূর্বদিকের ঘরগুলো দেখা হল না। ওদিকটা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। ঢোকার পথ নেই। সামুছা এইজন্যেই বোধহয় পূবদিকে যেতে বারণ করেছিল।
ফিরে এল দুজনে।
হ্যারি তখনও বইটা দেখছে।
–কিছু তথ্য পেলে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–যতটুকু পড়তে পারলাম স্ফাখনি সম্পর্কে সামুছা যা বলেছে তাই। বেশি কিছু নেই। তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম প্রায় সব পাতায় বিভিন্ন জাতের ফুলের ছবি।
সামুছা তো বলল–উনি ফুল ভালোবাসতেন। ফ্রান্সিস বলল।
–প্রথম পাতাতেই একটা বিরাট ত্রিভুজ এঁকেছেন। মা মেরিই জানে কেন এঁকেছেন। তার মধ্যেও ফুল।
–ত্রিভুজের মধ্যে ফুল? ফ্রান্সিস বেশ চমকে উঠল।
–মনে হয় রাজা অ্যালফ্রেডের কোন ত্রিকোন বাগান ছিল। হ্যারি বলল।
–হতে পারে। তবে ফ্রান্সিস কথাটা শেষ করল না।
–ত্রিকোণ বাগানের এক কোণায় ফুল। হ্যারি বলল।
–উঁহু। এই ফুল আঁকার গুরুত্ব আছে। ফ্রান্সিস বলল।
তুমি কি ফুলটাকে গুরুত্ব দিচ্ছো? হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ। তবে এখনও নিশ্চিন্ত নই। মনে করছি ফুলটা কোন কিছু নির্দেশ করছে। ফ্রান্সিস বলল।
কী নির্দেশ করছে? হ্যারি জানতে চাইল।
–সেটাই বুঝতে পারছি না। ত্রিকোণ ছবিটা দেখি। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি বইটা ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে দিল। ফ্রান্সিস মলাট উল্টেত্রিকোণ ছবিটা দেখল। ত্রিকোণটি সারা পাতা জুড়ে আঁকা। উত্তর কোণে একটা সূর্যমুখী ফুলআঁকা।
সামুছা ঘরে ঢুকে বসলেন।
ফ্রান্সিস বইটা এগিয়ে দিয়ে বলল–আচ্ছা–এই ত্রিভুজ-ফুলের ব্যাপারটা কী বলুন তো?
–এ তো একটা ছবি। রাজা আলফ্রেড ফুল ভালোবাসতেন। এন্তার এঁকে গেছেন। সামুছা বললেন।
–কিন্তু বইটাতে কোথাও তো কোনো ছবির মধ্যে ফুল আঁকা নেই। তাহলে এই ত্রিভুজের মধ্যে কেন আঁকলেন? ফ্রান্সিস বলল।
রাজরাজরাদের খেয়াল। বিচিত্র ধরনেরই হয়। সামুছা বললেন।
–আচ্ছা–আপনি আমাদের পূর্বদিকে যেতে মানা করেছিলেন। পূবদিকে কি ঘরটর আছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
থাকতে পারে। আমি যখন থেকে দেখছিতখন থেকেইপূর্বদিকভাঙা। সামুছা বললেন।
–আমার মনে হয় ওদিকে ঘর আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–তা থাকতে পারে। কিন্তু সেই ঘর দেখবে কী করে? সামুছা বললেন।
–দড়ি বেয়ে নেমে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
-পারবেন? সামুছা বললেন।
–পারবো।
–আজকে বিকেল হয়ে এল। মশালের আলোয় ভালো দেখা যাবে না। কাল সকালে আসছি। পূবদিকে নামবো। দড়ি আমরাই আনবো।
পরদিন ফ্রান্সিসরা একটু সকাল সকালই এল। জাহাজ থেকে দেখেশুনে বেশ লম্ফ দড়ি নিয়ে এল।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো পাথরে পা রেখে ভারসাম্য বজায় রেখে ভাঙা দূর্গের মাথায় উঠল। হ্যারি নীচে রইল। দুর্গের মাথাটাও ভাঙা। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে।
পূবদিকে গেল দু’জনে। সত্যিই এদিকটা ভেঙে পড়েছে। ফ্রান্সিস পাকানো দড়ি কাঁধে নিয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল। দড়ি বাঁধার জায়গা খুঁজতে লাগল। তখনই শাঙ্কো একটা ছোট নিরেট পাথুরে দেওয়াল দেখাল। ফ্রান্সিস কঁধ থেকে দড়ি নামাল। আস্তে আস্তে দড়ির একটা মুখ নামাতে লাগল। প্রায় সবটা দড়ি ছেড়ে দেখল বেশ নীচে নেমেছে।
এবার ফ্রান্সিস দড়ির মাথাটা দেয়ালে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধল। টেনে দেখল বেশ শক্তভাবেই বাঁধা হয়েছে। ওরা দড়ি বাঁধায় ওস্তাদ। কারণ জাহাজে দড়ির কাজ অনেক। নানারকম গিট বাঁধায় ওরা অভ্যস্ত। ওরা মশাল এনেছিল। কিন্তু তখনও জ্বালে নি।
ফ্রান্সিস দড়ি ধরে ধরে ভাঙা পাথরে পা রেখে রেখে নীচে নেমে আসতে লাগল। তখনও ভাবছে নীচে বোধহয় কোন অটুট ঘর পাবে না।
বেশ কিছুটা নেমে আসতে ভাঙা পাথরের মধ্যে একটা ভাঙা দরজামতো পেল। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ভেতরটা বেশ অন্ধকার। রোদ অল্পই ঢুকছে।
ফ্রান্সিস ভাঙা দরজায় পা রাখল। তারপর দড়ি ধরে ধরে ভেতরে ঢুকল। অন্ধকারটা চোখে সরে আসতে দেখল একটা ঘর। ও একনজর দেখে বুঝল একটা ভাঙা চৌকোনো ঘর। ও ঘরের ভেতর নামল। তখনই আবছা দেখল ওপাশে আর একটা ভাঙা দরজা। তবে ছোট।
ফ্রান্সিস দড়ির মুখ কাঁধে ঝুলিয়ে ভাঙা পাথরের মেঝের ওপর দিয়ে সেই ঘরের দরজার কাছে গেল। এদিকটা ভেঙে পড়ায় ওপরে ছাদের মত হয়ে গেছে। সেই ঘরটায় ঢুকতে গিয়ে ফ্রান্সিস দ্রুত পিছিয়ে এল। আবছা দেখল সেই ঘরটা বেশ নীচে। ওর মনে হল বোধহয় দূর্গের ভিতেরও নীচে। কিন্তু একেবারে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঘরটা কেমন বোঝাই যাচ্ছে না। শুধু পাথর আর পাথর।
মশাল চাই। ফ্রান্সিস সরে এল। দড়ি ধরে ধরে আগের ঘরের দরজার কাছে এল। দুহাতের তালু মুখের কাছে গোল করে চিৎকার করে ডাকল–শাঙ্কো–শাঙ্কো।
শাঙ্কো ডাক শুনে ঘাবড়ে গেল। ফ্রান্সিস কি কোন বিপদে পড়ল? ও চিৎকার করে বলল–কোন বিপদ নয়তো?
–না–না। তুমি একটা মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।
কিছু পরে শাঙ্কো একটা জ্বলন্ত মশাল বাঁ হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে দড়ি ধরে ধরে নেমে এল।
দড়ি ধরে ধরে দুজনে প্রথম ভাঙা ঘরটায় ঢুকল। সেই ঘর পার হয়ে সেই ছোট ঘরটার ভাঙা দরজার কাছে এল।
ফ্রান্সিস এবার জ্বলন্ত মশালটা নীচের ঘরের মাঝখানটায় ছুঁড়ে ফেলল। মশালের আলোয় ছোটঘরটা কিছুটা স্পষ্ট দেখা গেল। ফ্রান্সিস ভীষণভাবে চমকে উঠল। আশ্চর্য! ঘরটা ত্রিকোণ ঘর। এরকম ত্রিকোণ ঘরভাঙা দুর্গ কোথাও দেখেনি। রাজা আলফ্রেডের বইয়ে ত্রিকোণ আঁকা আছে। তাহলে তিনি এই ঘরটাকেই বুঝিয়েছেন। ত্রিকোণের উত্তরের মাথাটায় আঁকা আছে একটা চন্দ্রমুখী ফুল। সেই ঘরের উত্তরের কোণের দিকে তাকাল ফ্রান্সিস। খুব অস্পষ্ট দেখলপথটা পাথরের স্তূপ।
ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে ডাকল–শাঙ্কো।
-বল। শাঙ্কো এগিয়ে এল।
ঘরের উত্তরের কোণার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েফ্রান্সিস বলল–ঐখানে আছে স্বর্ণখনি। শাঙ্কো বলল–ওখানে তো পাথরের স্তূপ।
–ওসবের নীচেই আছে স্বর্ণখনি। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি নিশ্চিত? শাঙ্কো সংশয় প্রকাশ করল।
—হ্যাঁ নিশ্চিত। এবার স্ফাখনি খুঁজে বের করা। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো এই ঘরে নামতে হয়। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ নামবো। তারপর পাথরের পাটা সরাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। চলো। নামি। শাঙ্কো বলল।
দুজনে দড়ি বেয়ে বেয়ে সেই ত্রিকোণ ঘরটার ভাঙা মেঝেয় নামল। ভাঙা পাথরে পা রেখে রেখে শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে ওরা উত্তর কোণায় এল। দেখল পাকার পাথরের ভাঙা পাটা।
–সব পাথর সরাতে হবে। হাত লাগাও। ফ্রান্সিস বলল।
–বলছো কি। আমরা দুজনে সব সরাতে পারবো? শাঙ্কো বলল।
হাত তো লাগাই। দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে পাথরের পাটা সরাতে লাগল। ভাঙা হলেও কোন কোন পাটা বেশ ভারি। ওরা পাথরের পাটা সরাচ্ছে। ভাঙা দূর্গে শব্দ উঠছে–দুমদুম্।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা হাঁপিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ ভাঙা পাটায় বসে বিশ্রাম নিল। আবার সরাতে লাগল। বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে পাটা সরানোর কাজ চলল। স্তূপীকৃত পাটার উচ্চতা কিছু কমল। কিন্তু রইল অনেক।
শাঙ্কো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–এসব সরানো দুজনের কর্ম নয়। আরো লোকলাগবে।
–হুঁ। দেখি সামুছাকে বলে–লোক পাই কিনা। তবে সোনার খনি আবিষ্কার করতে যাচ্ছি। সমস্যা আছে। যদি সত্যিই সোনার খনি পাই তখন যারা সাহায্য করতে আসবে তারা রূদ্রমূর্তি ধরতে পারে। তখন আমাদের জীবন বিপন্ন হবে। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো মাথা নেড়ে বলল– এটা হতে পারে।
হতে পারে না-হবেই। সোনার লোভেই সামুছা এখানে বছরের পর বছর একা পড়ে আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে কী করবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–লোক আনবো। কিন্তু আগে থেকেই সাবধান থাকতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–এখন কী করবে? শাঙ্কো বলল।
–চলো উঠে পড়ি। লোক জোগাড় করে কালকে আসবো। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস ফেরার পথে হ্যারিকে সব বলল। সামুছা বাইরের ঘরেই বসেছিলেন। ফ্রান্সিসরা ঘরে ঢুকতেই বললেন–কোন খোঁজ পেলে?
–এখনও নিশ্চিত নই। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
-এত বছর ধরে চেষ্টা করে আমি পারলাম না। তোমরা পারবে? সামুছা সংশয় প্রকাশ করলেন।
–দেখি। একটা কথা। ফ্রান্সিস বলল।
–বলো। সামুছা বললেন।
প্রায় স্তূপাকার পাথর একটা ঘরে। সেসব সরিয়ে ভাঙা মেঝেটা বের করতে হবে। কিন্তু আমাদের তিনজনের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। ফ্রান্সিস বলল।
সময় নাও। তোমরাই সরাও। সামুছা বললেন।
–না। আমাদের তাড়াতাড়ি জাহাজে ফিরতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা পারবো না। ভীষণ খাটুনি। শাঙ্কো বলল।
–পিংলা বলছিল তোমরা ক্রীতদাস ছিলে। অনেকদিন। শুকনো ক্ষেতে জল ছিটোনোর কাজ করেছে। সামুছা বললেন।
–হ্যাঁ। তবে মুক্ত অবস্থায় পারবো না। শাঙ্কো বলল।
–তাই বলছি তিনচারজন লোক যদি দিতে পারেন তাহলে দ্রুত কাজ সারতে পারি। ফ্রান্সিস বলল।
–তা দেয়া যাবে। পাংলুকে খবর দিতে পাঠাচ্ছি। সামুছা বললেন।
–ঠিক আছে। আমরা কাল সকালে আসবো। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। সামুছা বললেন।
ফেরার পথে শাঙ্কো বলল–ত্রিকোণ ঘর ফুলের ছবি এসব নিয়ে তো সামুছাকে কিছু বললে না।
-মাথা খারাপ। এসব বললে সামুছা আমাদের হটিয়ে নিজেই কাজে নেমে পড়বে। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু তুমি তো ওকেই সব দেবে। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। তা দেব। কিন্তু একটা ব্যাপার আছে। মারিয়াকে দেখতে বলবো কত সোনার চাকতি আছে। যদি দেখি অনেক কম তাহলে স্বর্ণখনি আবিষ্কার করতে পারলে সামুছার কাছ থেকে কিছু সোনা নেব। ফ্রান্সিস বলল।
–সোনা থাকলে কেমনভাবে আছে? চাকতির মত? শাঙ্কো জানতে চাইল।
সঠিক কী করে বলি। তবে পুরোনো আমলে খনির সোনা গোল তাল করে রাখা এ হত। হয়তো সেভাবেই রাখা আছে।
জাহাজে এসে ফ্রান্সিস মারিয়াকে জিজ্ঞেস করল–সোনার চাকতি কেমন আছে? মারিয়া দেয়ালের কাঠ সরিয়ে দেখল। বলল–কমে গেছে। কিছু আছে শাঙ্কোর কাছে।
-তাহলে সোনা চাই। ফ্রান্সিস বলল।
পরের দিন সকালে ফ্রান্সিরা এল।
দেখল বসার ঘরের বারান্দায় চারজন কালো যুবক বসে আছে। সামুছা বেরিয়ে এলেন। বললেন–এই যে তোমাদের লোক। ফ্রান্সিস বুঝল তরতাজা বলিষ্ঠ যুবক ওরা। ওদের দিয়ে দ্রুতই কাজ হবে।
ফ্রান্সিস পাংলুর কাছে দড়িটা রেখে গিয়েছিল। পাংলু সেটা নিয়ে এল।
সকলে চলল ভাঙা দুর্গের দিকে। হ্যারি নীচে রইল।
গতকালের মত দড়ি বেঁধে প্রথমে ফ্রান্সিস নেমে গেল। শাঙ্কোও নামল। দুজনের হাতেই জ্বলন্ত মশাল। সঙ্গীদের একজনও একটা জ্বলন্ত মশাল নিল।
সবাই প্রথম ভাঙা ঘরটার ভাঙা দরজার সামনে এল। ভাঙা মেঝের ওপর দিয়ে ছোট ঘরটার দরজার কাছে এল।
পরদিন সকালে ফ্রান্সিস এল। দেখল চারজন কালো যুবক বারান্দায় বসে আছে। তাদের নিয়ে ফ্রান্সিস চলল।
তিনটে মশাল নিয়ে সবাই ছোট ঘরে নামল। এখন চারদিক অনেকস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এবার ফ্রান্সিস কালো যুবকদের বলল–ঐ উত্তরকোনায় একটা তামার খনি আছে। তামা এমন কিছু দামি নয়। আমরা সেই খনিটা খুঁজে বের করবো। সেটা করতে গেলে ঐ স্তূপাকার পাথর সরাতে হবে। বুঝেছো? ওরা ঘাড় নাড়ল।
তাহলে কাজে লাগা যাক। ফ্রান্সিস বলল। মশালগুলো পাথরের খাঁজে রাখা হল। মশালের আলোয় সবাই মিলে পাথরের ভাঙা পাটা সরাতে লাগল। বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে পাথর সরানো দুপুরের পরেই শেষ হয়ে এল। সবাই কাজ থামাল। সবাই কমবেশি হাঁপাতে লাগল।
ফ্রান্সিস উত্তর কোনায় ভাঙা মেঝের কাছে এল। ভাঙা পাথর সরাতে লাগল। ভাঙা পাথর ফেলে দিতেই দেখল–একটা তিনকোণা পাথরের পাটা। তারওপর উত্তর কোনায় চন্দ্রমুখী ফুল কুঁদে তোলা।
ফ্রান্সিস চোখ বুজে নিজের উচ্ছ্বাস গোপন করল। ফিরে তাকিয়ে বলল–বৃথা চেষ্টা। এখানে তামার খনিটনি নেই। সবটাই ভাঙা পাথরে ভর্তি।
শাঙ্কো হতাশ গলায় বলল–তাহলে সব চেষ্টাই মাটি।
–হ্যাঁ। একটু বিশ্রাম নিয়ে ওপরে উঠে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
কালো যুবকরা বসেছিল। একজন উঠেদাঁড়িয়ে বলল–তাহলে আমরা চললাম।
–হ্যাঁ তাই। আমরাও একটু পরে চলে যাবো। ফ্রান্সিস দুহাত ছড়িয়ে বলল।
কালো যুবকরা উঠেযাবার জন্যে দড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল।
ফ্রান্সিস তখন একটা পাথরের ওপর বসেছিল।
কিছু পরে উঠে দাঁড়াল। বলল শাঙ্কো উঠে দেখতো ওরা চলে গেল কিনা। শাঙ্কো দড়ি বেয়ে উঠে এল। ওপরে তাকিয়ে দেখল চার যুবকই উঠে গেছে।
শাঙ্কো নেমে এল। বলল–ওরা চলে গেছে। ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠল। চাপাগলায় সজোরে বলে উঠল
–শাঙ্কো–আমি সফল।
–সেকি? শাঙ্কো অবাক।
এসো! দেখাচ্ছি। ফ্রান্সিস হাসতে হাসতে বলল।
দুজনে সেই ত্রিকোণ ফুল তোলা পাথরের পাটার কাছে এল। ফ্রান্সিস পাটাটা তুলে দেখিয়ে বলল–শাঙ্কো–এর নীচেই আছে স্বর্ণখনি।
–নিশ্চিন্ত? শাঙ্কোর বিস্ময়তার তখনও কাটেনি।
–এখন নিশ্চিত। চলোপাটাটা তুলি। এবার দুজনকেইতুলতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে মিলে পাটাটা টানতে গেল। আশ্চর্য। আস্তে পাটাটা উঠেএল। ভেতরটা অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–দুটো মশাল নিয়ে এসো। শাঙ্কো দুটো মশাল পাথরের খাঁজ থেকে তুলে নিয়ে এল।
গর্তটার দুপাশে দুজনে মশাল দুটো ধরল। ফ্রান্সিস একটা মশাল গর্তের মধ্যে ফেলে দিল। এবার প্রায় স্পষ্ট দেখা গেল কয়েকটা গোল তালা। মশালের আলোয় একটু ঝিকিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস অভিজ্ঞ চোখে বুঝল–
–সোনা। ও প্রায় চিৎকার করে উঠল শাঙ্কো–সোনা। শাঙ্কোও আনন্দে লাফিয়ে উঠল।
ফ্রান্সিস দুহাতে ভর রেখে আস্তে আস্তে গর্তটায় নেমে গেল। একটা সোনার তাল নিয়ে ওপরে উঠে এল।
এবার মশালের আলোয় সোনার তালের এবড়োখেবড়ো গা বেশ ঝিকিয়ে উঠল।
চলো। মুখটা বন্ধ করি। ফ্রান্সিস বলল। পাটা দিয়ে গর্তটার মুখ বন্ধ করে দুজনে ওপরে উঠে এল। হ্যারি ফ্রান্সিসের হাতে সোনার তাল দেখে ছুটে এল। হেসে বলল– সাবাস ফ্রান্সিস। তিনজনেই হেসে উঠল। তারপর মৃদুস্বর ধ্বনি তুলল—হো—হো–হো।
ফ্রান্সিস হেসে গলা নামিয়ে বলল–এখন কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করো না। দেখবে সামুছাও এই কথা বলবে।
ওরা সামুছার বসার ঘরে এল। বসল।
ফ্রান্সিস সোনার তালটা লুকিয়ে রাখল।
একটু পরে সামুছা এলেন। চেয়ারে বসলেন।
সামুছা মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন–হদিশ পেলে?
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস মাথা কাত করে হেসে বলল।
তখনই পাংলু বিকেলের খাবার নিয়ে ঢুকল। সবাইকে দিল। ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা প্রায় গোগ্রাসে খাবার গিলতে লাগল। সামুছা মৃদু হেসে বললেন–ওদের আরো খেতে দাও। আবার খাবার। এবার ফ্রান্সিসরা আস্তে আস্তে খেল। পাংলু তখন ঘরে নেই।
সামুছা আবার মৃদুস্বরে বললেন– প্রমাণ? ফ্রান্সিস লুকিয়ে রাখা সোনার তালটা সামুছার হাতে দিল। সামুছার দুচোখ যেন জ্বলে উঠল। সোনার তালটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেন। তারপর উঠে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখলেন। এসে চেয়ারে বসলেন। মৃদুস্বরে বললেন–আরো সোনার তাল আছে?
–হ্যাঁ, আছে। ফ্রান্সিস বলল।
সামুছা বললেন–তোমাদের বুদ্ধি চিন্তার প্রশংসা না করে পারছি না। কিন্তু একটা কথা। সোনার খনির কথাটা যেন জানাজানি হয়। শুধু আমরা চারজন। এমন কি পাংলুকেও বলা হবে না। আমি পরে সোনার খনির ব্যবস্থা করছি।
এবার আমার একটা অনুরোধ। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা ধনী নই। তবে হতে পারতাম। সে থাক–আমরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। সব দেশের মুদ্রা তো আমাদের কাছে থাকে না। তাই সোনাই আমাদের একমাত্র দাম দেবার মাধ্যম। আপনি যদি আমাকে কিছু সোনার চাকতি এই মণ্ড থেকে দেন তাহলে খুবই উপকার হত।
নিশ্চয়ই দেব। তোমরাই তো কষ্ট করে উদ্ধার করলে। তবে এই সোনা থেকে নয়। আমার কাছে একথলি খাঁটি স্পেনীয় স্বর্ণমুদ্রা আছে। সেটাই দিচ্ছি।
সামুছা উঠে বাড়ির ভেতরে গেলেন। একটু পরেই ফিরে এলেন। একটা নীল সাটিন কাপড়ের থলি টেবিলে রেখে বললেন–এই তোমাদের পারিশ্রমিক। থলিটা তুলে নিয়ে ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে দিল। শাঙ্কো সেটা কোমরের ফেট্টিতে ঝুলিয়ে রাখল।
ফ্রান্সিস বলল–তাহলে আমরা চলি।
–বেশ। তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। সামুছা মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন।
ফ্রান্সিসরা জাহাজঘাটের দিকে চলল।
শাঙ্কো বলল–পাংলুকে দুটো মুদ্রা দিয়ে আসবো।
না। সামুছা জানতে পারলে মনঃক্ষুণ্ণ হবেন।
ফ্রান্সিসরা পাটা পাটাতন দিয়ে জাহাজে উঠে এল। বন্ধুরা ছুটে এল। জানতে চাইল ফ্রান্সিসরা স্বর্ণখনি খুঁজে বের করতে পেরেছে কিনা।
–হ্যাঁ। আমরা সফল। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
বন্ধুরা ধ্বনি তুলল—হো-হো-হো। আশেপাশের জাহাজ থেকে লোকেরাও দেখল। বুঝল না এত উল্লাসের কারণ কী?
মারিয়া হাসিমুখে এগিয়ে এল। শাঙ্কো মারিয়াকে স্যামুদ্রা ভরা থলিটা দিল। ফ্রান্সিস শুধু বলললুকিয়ে রেখো। মারিয়া মাথা কাত করল।
শাঙ্কো তখন হাত পা নেড়ে বন্ধুদের স্ফাখনি আবিষ্কারের ঘটনা বলছে।
তখনও সূর্য অস্ত যায় নি। মারিয়া সূর্যাস্ত দেখার জন্যে রেলিঙ ধরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসও এসে পাশে দাঁড়াল।
সূর্য পশ্চিম আকাশে গভীর কমলা ছড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে ডুবে গেল।
Leave a Reply