শায়িত দেবতাদের মন্দির
মাস্তুলের ওপর থেকে নজরদার পেড্রো অনেক আগেই জানিয়েছিল ফ্রান্সিসদের জাহাজ একটা বন্দরের কাছে এসেছে।
ফ্রান্সিস আর মারিয়া জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল। মারিয়া সূর্যাস্ত দেখছিল। প্রতিদিন জাহাজের ডেকে এসে মারিয়া সূর্যাস্ত দেখে। সমুদ্রে বিরাট বিরাট ঢেউ। তারই মাথায় সূর্য নেমে এসেছে। পশ্চিম দিককার আকাশে কত রঙ ফুটে উঠছে। সূর্যকে ঘিরে লাল আলোর বলয় যেন। আস্তে আস্তে সেই আলো মিলিয়ে গেল। নামল অন্ধকার।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। সঙ্গে শাঙ্কো। হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস, এখন কী করবে? বন্দরে জাহাজ ভেড়াবে, নাকি বন্দর ছাড়িয়ে চলে যাবে?
ঠিক বুঝতে পারছি না কোথায় এলাম। এটা তো সবার আগে জানা দরকার। ফ্রান্সিস বলল।
তাহলে তো বন্দরে গিয়ে জাহাজ নোঙর করতে হয়।
তাই করব। তারপর বন্দরে নেমে খোঁজখবর নেব। ফ্রান্সিস বলল।
তাহলে ফ্লেজারকে গিয়ে বলি। হ্যারি বলল।
যাও।
কিছু পরে ফ্রেজার এল। বলল, ফ্রান্সিস, এখন কী করবে?
জাহাজ বন্দরের কাছে নিয়ে চল। নোঙর কর। জাহাজ থেকে নেমে এই বন্দরের নাম জানতে হবে। এটা কোনো দ্বীপ না দেশ জানতে হবে। তাহলেই বুঝব আমরা কোথায় এলাম। এখান থেকে আমাদের দেশই বা কতদূর!
বেশ। জাহাজ নোঙর করছি। ফ্লেজার বলল।
ফ্লেজার জাহাজের গোল হুইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জাহাজটা জাহাজঘাটার কাছে নিয়ে এল। নোঙর করল।
সন্ধ্যের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস হ্যারিকে সঙ্গেনিয়ে জাহাজে পাতা কাঠের পাটাতন দিয়ে হেঁটে জাহাজঘাটায় উঠল।
বন্দরটা খুব ছোট না। বেশ কয়েকটা জাহাজ নোঙর করে আছে। চাঁদের আলো উজ্জ্বল। সেই আলোয় দেখলবাজার মতো এলাকা। ফলটল, জামাকাপড়, দড়ি, পালের কাপড় বিক্রি হচ্ছে।
কাছের দোকানের সামনে এল। দোকানিকে ভাঙা ভাঙা তলতেক ভাষায় বলল, এই দেশের নাম কী? দোকানি বুঝল না। বলল, বুঝতে পারছি না। এবার হ্যারি হাত-মুখ, নেড়ে বোঝাল এই জায়গার নাম কী? এবার দোকানি বুঝল। বলল, আলকাবা। কিন্তু শুধু এইটুকু জেনে তো আন্দাজ করা যাবে না ইউরোপ কতদূর।
কিছুক্ষণ বাজার এলাকায় ঘোরাঘুরি করে দুজনে জাহাজে ফিরে এল। বন্ধুরা এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল, বিশেষ কিছু খবর পেলাম না। শুধুজানলাম এ দেশের নাম আলকাবা। মা মেরিই জানেন ইউরোপ থেকে কতদূরে আছি আমরা।
এখানেই ঘোরাঘুরি করি। নিশ্চয়ই হদিস পাব। তখন দেশের দিকে যাত্রা করবো। হ্যারি বলল।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো। ফ্রান্সিস কেবিনঘরে এল। মারিয়া বলল, তাহলে কী ঠিক করলে।
এই এলাকায় ঘোরাঘুরি করে জানতে হবে ইউরোপ কোনদিকে। এখান থেকে কতদূর? তারপর দিক ঠিক করে নিয়ে জাহাজ চালাবো। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো আর ওর দু’তিনজন বন্ধু ডেকে উঠে এল। ওখানেই শুয়ে পড়ল। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ, জোর হাওয়া ছুটেছে। শাঙ্কোরা ঘুমিয়ে পড়ল।
শেষ রাতের দিকে হঠাৎ কিসের শব্দেশাঙ্কোর ঘুম ভেঙে গেল। ও কান খাড়া করল। হালের দিকে অস্পষ্ট শব্দ। শাঙ্কো নিঃশব্দে সিঁড়িঘরের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। একটু পরেই দেখল হাঁটুঝুল চিত্রবিচিত্র আলখাল্লা মতো পরা একজন বয়স্ক লোক নীচে নামার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে। নিঃশব্দে। লোকটির আলখাল্লা ভেজা নয়। তাহলে বয়স্ক লোকটি নৌকোয় চড়ে এসেছে।
শাঙ্কো দ্রুতপায়ে এসে লোকটির সামনে দাঁড়াল। লোকটি বেশ চমকেই উঠল। শাঙ্কো বলল, আপনি কে?
লোকটি আস্তে আস্তে বলল, আমি রাজপুরোহিত পিরেল্লো।
আমাদের জাহাজে কীভাবে এলেন?
গাছের গুঁড়ি কুঁদে বানানো আমার নৌকোয় চড়ে।
কেন এলেন? শাঙ্কো জানতে চাইল।
তোমরা কারা? পিরেল্লো জিগ্যেস করলেন।
আমরা ভাইকিং। শাঙ্কো বলল।
আমি তোমাদের জাহাজটা দেখলাম। কোনো পতাকা উড়ছেনা। বুঝলাম তোমরা দূর দেশের মানুষ। আমিও সেটাই চেয়েছিলাম। আমি ঠিক করেছি কাছাকাছি নয়, দূরের কোন দেশে চলে যাব। পিরেল্লো বললেন।
আপনি রাজপুরোহিত। কত সম্মান আপনার। দেশের লোক আপনাকে কত ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তবে কেন দেশত্যাগ করতে চাইছেন? শাঙ্কো জানতে চাইল।
সে অনেক কথা। পিরেল্লো বললেন।
ততক্ষণে শাঙ্কো আর রাজপুরোহিতকে ঘিরে কয়েকজন ভাইকিং বন্ধুও দাঁড়িয়েছে। রাজপুরোহিত বললেন, তোমাদের দলনেতা কে? তার সঙ্গে কথা বলব।
ঠিক আছে। আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমাদের দলনেতাকে নিয়ে আসছি।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কেবিনঘরের সামনে এল। দরজায় টোকা দিল।
কে? ফ্রান্সিসের গলা।
ফ্রান্সিস, একটু এসো। এদেশের রাজপুরোহিত আমাদের জাহাজে এসেছেন তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আসছি।
ফ্রান্সিস কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে এল। পেছনে মারিয়াও এল।
ডেকে উঠে এল দুজনে। আসবার সময় শাঙ্কো ফ্রান্সিসকে রাজপুরোহিতের সঙ্গে যা কথা হয়েছে তা বলল।
ফ্রান্সিস রাজপুরোহিত পিরেল্লোর সামনে এসে দাঁড়াল।
আপনার কথা বন্ধুর মুখে শুনলাম। আপনি কী চান স্পষ্ট করে বলুন। ফ্রান্সিস বলল।
আমি আপনাদের জাহাজে আশ্রয় চাইছি। কেন?
আমি সাতটি দেবতার মূর্তি চুরি করে এনেছি। এই আলকাবা দেশ থেকে পালাতে চাই। মূর্তিগুলো গালালে প্রচুর সোনা পাব। তাই দিয়ে আরামে বাকি জীবনটা নিজের দেশ পর্তুগালে কাটাতে পারব।
ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল, সেই সাতটি দেবতার মূর্তি কোথায়?
আমার নৌকোয় রেখেছি। পিরেল্লো বললেন।
ঠিক আছে। বিস্কোকে বলল, যাও তো মূর্তিগুলো নিয়ে এসো।
বিস্কো চলে গেল। পিরেল্লো বললেন, তাহলে এই সুযোগে আপনি আমার মূর্তিগুলো নিয়ে নেবেন মানে চুরি করবেন।
ফ্রান্সিস রেগে গেল, চোর আপনি। কোনো চোরকে আমরা আমাদের জাহাজে আশ্রয় দিইনা।
তাহলে আমার মূর্তিগুলো রেখে আমাকে তাড়িয়ে দেবেন?
আমি চোরের ওপর বাটপাড়ি করি না। এই মূর্তির সঠিক মালিক আলকবার রাজা। মূর্তিগুলো তাকেই দিয়ে দেব। আরআপনি মূর্তিগুলো চুরি করেছেন এটাও বলব। তারপর রাজা যা করার করবেন।
বিস্কো একটা বোঁচকা কাঁধে করে ফিলে এল।
তখন ভোর হয়েছে। সূর্যের আলো পড়েছে জাহাজে, সমুদ্রের জলে, আকাশে। চারদিক ঝলমল করছে।
ফ্রান্সিস বোঁচকা থেকে একটা মূর্তি বের করল। কী সুন্দর মূর্তি। ফ্রান্সিসরা অবাক হয়ে দেখল মূর্তির মাথায় মুকুট, গায়ে নানারকম কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি আলখাল্লা। বাকি। মূর্তিগুলো আর খোলা হল না।
ফ্রান্সিস রাজপুরোহিতকে জিগ্যেস করল, বলুন, এখন আপনি কী করতে চান?
এই সাতটি মূর্তি নিয়ে আপনাদের জাহাজে চড়ে পালাব।
ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল, হ্যারি কী করবে বল।
হ্যারি বলল, দেখুন রাজপুরোহিত, আমরা আগেই বলেছি কোনো চোরকে আমরা আশ্রয় দিই না। আপনাকেও আশ্রয় দেওয়া হবে না। আপনি একটু ভাঙা-ভাঙা পর্তুগীজ ভাষায় কথা বলছেন। আপনি এ দেশের অধিবাসী নন। তাহলে আপনি কি করে এখানে এলেন? আর কিভাবেই বা রাজপুরোহিত হলেন?
আপনার অনুমান ঠিক। আমি পর্তুগীজ। দাস-ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়েছিলাম। এক দুঃসহ পরিবেশে জাহাজের নীচের খোলে বন্দী হয়ে ছিলাম। আমাদের দলনেতার নির্দেশে এক রাতে আমরা বিদ্রোহ করলাম। লোহার গরাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম একসঙ্গে। একটা লোহার গরাদ আমাদের চাপে নড়ে গেল। ঐ গরাদের ওপরেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলাম। গরাদটা খুলে গেল। আমরা নিরস্ত্র। দাস-ব্যবসায়ীর রক্ষীরা আমাদের আটকাতে চেষ্টা করল। আমরা ওদের হাত থেকে তরোয়াল ছিনিয়ে নিলাম। ওদের সঙ্গে লড়াই করলাম। অনেক রক্ষী মারা গেল। আমাদের মধ্যেও অনেকের মৃত্যু হল। আমি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। রাতের অন্ধকারে সাঁতরাতে-সাঁতরাতে তীরে এলাম। একটু থেমে আমার বলতে লাগলেন, তীরভূমির চারদিকে তাকিয়ে অন্য বন্দীদের কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি বালিয়াড়ির ওপর শুয়ে রইলাম। ক্রমে ভোর হল। চারদিকে আলো ছড়াল। বারবার চারপাশে দেখলাম। সঙ্গীরা বোধহয় দূরে কোথাও তীরে উঠেছে। যাই হোক, এভাবেই আমি আলকাবায় এলাম।
পিরেল্লো থামলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের শুরু করলেন, বেলা বাড়ল। জন বসতিতে এলাম। খিদেয় পেট জ্বলছে। একপাত্র জলও খেতে পারিনি। একটা ঘর দেখলাম। অন্যরকম। নারকেলপাতার ছাউনি। দেয়াল কাঠ কেটে তৈরি। মেঝে মাটির।
ঘরটার দরজায় টোকা দিলাম। পর্তুগীজ ভাষায় বললাম, আমি খুব ক্ষুধার্ত। কিছু খেতে দিন। একবার দু’বার বললাম। ভিতর থেকে গম্ভীর গলায় কে পর্তুগীজ ভাষায় বললেন, চলে এসো। দরজা খোলা।
আমি ঘরটায় ঢুকলাম। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে দেখি একজন বয়স্ক লোক গাছের। ডাল কেটে তৈরি বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর মাথার চুল, দাড়ি, গোঁফ সব সাদা। লোকটি বলল, ডানদিকে দেখ একটা টেবিল। তাতে খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। যতটা খেতে পারো খাও।
কথামতো আমি টেবিলটার কাছে গেলাম। সেটাও বিছানার মতো গাছের ডাল কেটে করা। তার ওপর ঢাকা দেওয়া কয়েকটি মাটির পাত্র। ঢাকনা খুলে দেখলাম কিছু রুটি। অন্যটায় মাছের ঝোল। অন্য দুটো পাত্রে ভাজা-টাজা।
আমি খেতে বসে গেলাম। খাচ্ছি, তখন বৃদ্ধ বললেন, তুমি পর্তুগীজ?
হ্যাঁ।
এখানে কি করে এলে?
আমি তাকে সব বললাম। ক্রীতদাস বেচাকেনার হাটে আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমরা কি করে পালিয়ে এসেছি শুনে উনি বললেন, এখানে থাকবে স্থির করেছো?
হা। উপায় কী?
কিন্তু তুমি তো পর্তুগীজ। এখানকার ভাষা জানো না। কী করবে তুমি?
আসার সময় দুপাশে দেখেছি তুলার খেত। সেসব খেতেই কোনো কাজ নেব। আমি বললাম।
দরকার নেই। একটা কথা, তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি?
নিশ্চয়ই পারেন। আমি বললাম।
তাহলে শোন, আমি রাজপুরোহিত হোমক। তুমি আমার সহকারী হিসেবে কাজ করবে? রাজি?
হ্যাঁ, রাজি। আমি সাগ্রহে উত্তর দিলাম।
হোমক আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠলেন। বললেন, তুমি এখানকার পূজিত সাতটি দেবতার কথা জানো না?
না। আমি বললাম।
ঠিক আছে। আমি সব শিখিয়ে-পড়িয়ে নেব। আমি মন্দিরেতাদের পুজো করতে যাচ্ছি। তুমি এখানেই থাকবে। খিদে পেলে আরো খাবে। আমি কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসছি।
হোমক বেরিয়ে গেলেন।
তারপর? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
তারপর হোমকের শিষ্য হয়ে আমি তাকে পুজোর সময় সাহায্য করতে লাগলাম। আমার থাকা-খাওয়ার কোনো অসুবিধেই আর হল না। আমার পুরোহিতের কাজ শেখা হয়ে গেল। হঠাৎ হোমক অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আমিই পুজোর কাজ চালাতে লাগলাম। রাজবৈদ্য হোমকের চিকিৎসা করতে লাগলেন। কিন্তু তাকে সুস্থ করতে পারলেন না। রাজ পুরোহিত হোমক মারা গেলেন।
এবার এখানকার রাজা কানবহনা আমাকে রাজপুরোহিত করলেন। প্রতিদিন রাজপুরোহিতের কাজ করে আমার বেশ ভালোই দিন কাটছিল।
ফ্রান্সিস বলল, এই সাতটি দেবতারই পুজো করতেন আপনি?
হা। রাজপুরোহিতের সব দায়িত্বই আমি পালন করতাম। একটা কথা বলা হয়নি। যে রাতে হোমকমারা যান সেই রাতে হঠাই আমাকে হাতের ইশারায় বিছানার কাছে যেতে বললেন। আমি গেলাম। উনি আমাকে কান পাততে বললেন। আমি মাথা নিচু করলাম। থেমে থেমে উনি বললেন, আমার লতাপাতায় তৈরি বাটায় একটা চামড়ার টুকরো পাবে। তাতে অতীতের এক রাজা-রাজা হানম, যিনি এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন তিনি প্রাচীন স্প্যানিশ ভাষায় লিখে গেছেন একটা ছড়া।
ছড়াটা মনে আছে আপনার? ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল।
হা। পিরেল্লো বললেন।
শোনান তো ছড়াটা। ফ্রান্সিস বলল।
পিরেল্লো বললেনঃ
ছোট্ট সাজের ঘরে।
রেখেছি বড় আদরে।
ধনসম্পদ কার তরে?
বুদ্ধিমান উদ্ধার করে।
বোকারা হা-হুঁতাশ করে।
ফ্রান্সিস বলল, সহজ ছড়া। ধনসম্পদের কথা বলা হয়েছে। সেই গুপ্ত ধনসম্পদ উদ্ধারের জন্যে এই ছড়াটা খুব কাজে লাগবে বলেই মনে হয়।
আমারও তাই মনে হয়। পিরেল্লো বললেন।
এই ছড়াটা পাওয়ার পর আপনি কি পুজোর ঘরে, সাজঘরে খোঁজাখুঁজি করেছিলেন?
হা। কিন্তু কোনো হদিস করতে পারিনি। পিরেল্লো বললেন।
আপনি দেবতার মূর্তি চুরি করে পালাতে চাইছেন কেন? হ্যারি বলল।
কতদিন এই বিদেশে পড়ে আছি। ভালো লাগছিল না। শুধু পর্তুগাল চলে যেতে মন চাইছিল।
দেবতার মূর্তিগুলো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলেন কেন? ফ্রান্সিস বলল।
মূর্তিগুলো নিখাদ সোনায় তৈরি। বিক্রি করলে খুব ভালো দাম পাবো এই আশায়। পিরেল্লো বললেন।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল, এঁকে নিয়ে কী করবে?
এখানকার রাজা কানবহনার কাছে ওঁকে নিয়ে চল। দেবতার মূর্তির কথা বলব। মূর্তিগুলো পেলে রাজা যা করতে চাইবেন করবেন। এ দেশের যা বিচার তাই-ই হবে। একটা চোরের সঙ্গে আমরা কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। হ্যারি বলল।
তাহলে সকালের খাবার খেয়ে রাজসভায় চলো। ফ্রান্সিস বলল।
ঠিক আছে, তাই চলো। হ্যারি বলল।
খাওয়া-দাওয়ার পর হ্যারি পিরেল্লোকে বলল, আমাদের রাজসভায় নিয়ে চলুন।
পিরেল্লো হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, এই দেশের যা আইন তাতে যে অপরাধ আমি করেছি তার জন্য ফাঁসি দেওয়া হবে। আমাকে রাজার কাছে নিয়ে যাবেন না।
এছাড়া উপায় নেই। হ্যারি বলল। পিরেল্লো কাঁদতে লাগলেন।
পিরেল্লো দেবতার মূর্তি-বোঝাই পোঁটলাটা কাঁধে নিলেন। ফ্রান্সিস, হ্যারি আর শাঙ্কো এগিয়ে এল।
দড়ির মই বেয়ে চারজনে জাহাজের সঙ্গে বেঁধে রাখা ছোট্ট নৌকোয় নেমে বসল। ফ্রান্সিস বৈঠা বাইতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই নৌকো তীরে পৌঁছল।
তীরে উঠল সবাই। পিরেল্লো পশ্চিমমুখে হাঁটতে লাগলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ওরা রাজবাড়ির সামনে এল।
রাজবাড়ির সামনে বেশ ভিড়। ফ্রান্সিসরা বিচারসভার ঘরের সামনে এল। ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে বলল, আমাদের ভেতরে নিয়ে চলুন।
দরজায় পেতলের বর্শা হাতে দুই প্রহরী দাঁড়িয়ে। ওরা পিরেল্লোকে দেখে মাথা একটু নোয়াল। পিরেল্লো ওদের সঙ্গে কথা বলে ফ্রান্সিসদের বললেন, আসুন।
চারজনে রাজসভায় ঢুকল। পাথর দিয়ে তৈরি ঘরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার অন্ধকার। রাজা কাঠের সিংহাসনে বসে আছেন। সিংহাসনের গদিটা পাখির পালক দিয়ে তৈরি। দু’পাশে মন্ত্রী, সেনাপতি ও অমাত্যরা। পিরেল্লো তখন প্রায় কাঁদতে শুরু করেছেন। চাপা গলায় বারবার বলছেন, আমাকে চলে যেতে দিন। নইলে আমাকে রাজা মৃত্যুদণ্ড দেবেন।
উপায় নেই। অভিযুক্ত হলেও রাজা আপনাকে মুক্তি দেবেন। ফ্রান্সিস বলল।
অসম্ভব। আমার নিশ্চিত মৃত্যু। পিরেল্লো বললেন।
দেখা যাক। তবে মূর্তিগুলো ফেরৎ পেলে রাজা খুশিই হবেন। হয়তো আপনাকে # সাধারণ শাস্তি দেবেন।
না-না। আমাকে মরতে হবে। পিরেল্লো কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন।
বললাম তো দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি ডাকল, ফ্রান্সিস।
বলো।
দেখ এই আলকাবা দেশ আমাদের কাছে বিদেশ। এখানে কে কী চুরি করল সেসব ব্যাপারে আমরা জড়াব কেন?
তাই বলে একটা চোরকে জেনে-শুনে পালাতে দেব? ফ্রান্সিস বলল।
এ-ব্যাপারে আমাদের না জড়ানোই ভালো। তুমি পিরেল্লোকে ছেড়ে দাও। উনি যেখানে যেতে চান যান।
ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে বলল, আপনিও এটাই চান?
হা। একবার আমার ব্যাপারটা রাজার কানে গেলে আমার রেহাই নেই।
আপনি যে মূর্তিগুলো চুরি করেছেন সেসব ঠিক জায়গায় রেখে দেবেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
নিশ্চয়ই রেখে দেবো। পিরেল্লো বললেন।
আমাদের ধোঁকা দিয়ে মূর্তি নিয়ে পালাবেন না তো? হ্যারি বলল।
না-না। আপনারা যা বলবেন আমি তাই শুনবো।
ঠিক আছে। এবার আমি রাজার সঙ্গে কথা বলবো। আপনি ব্যবস্থা করে দিন। ফ্রান্সিস বলল।
দেখছি। বলে পিরেল্লো এগিয়ে গেলেন। একজন বৃদ্ধ অমাত্যের কাছে গিয়ে মুখ নিচু করে কী বললেন। বৃদ্ধ অমাত্যটি আসন থেকে উঠে রাজার কাছে গেলেন। রাজাকে কী বললেন। রাজা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। যিনি বিচারপ্রার্থীদের নাম ডাকছিলেন বৃদ্ধ অমাত্য তাকে ডেকে কিছু বললেন। তিনি এবার ডাকলেন, রাজপুরোহিত যাঁদের নিয়ে এই সভায় এসেছেন তারা এগিয়ে আসুন।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি রাজার কাছে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসরা মাথা একটু নুইয়ে রাজাকে সম্মান জানাল। রাজা খুশি হলেন। বললেন, শুনলাম তোমরা বিদেশী।
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরা জাতিতে ভাইকিং। আপনার রাজপুরোহিতের সঙ্গে আমাদের হঠাই পরিচয় হয়েছে। তিনি জানালেন আপনাদের একমন্দিরে নীচের ঘরে রাজা হানম ধনসম্পদ গোপনে রেখে গেছেন।
আমাদের বংশের অনেকেই সেই ধনভাণ্ডার খুঁজেছিলেন। কিন্তু কেউ উদ্ধার করতে পারেননি।
পিরেল্লোর গুরুদেব রাজপুরোহিত হোমক মৃত্যুর পূর্বে পিরেল্লোকে চামড়ার ওপর লেখা একটা ছড়া দিয়ে গিয়েছিলেন।
পিরেল্লো তো এ-কথা আমাদের বলেননি। রাজা পিরেল্লোর দিকে তাকিয়ে বললেন।
মান্যবর রাজা, আমি ঐ ছড়াটার কোনো গুরুত্ব দিইনি। পিরেল্লো বললেন।
ঠিক আছে। তোমরা কী বলতে চাও। রাজা ফ্রান্সিসকে জিগ্যেস করলেন।
আমাদের যদি আপনার রাজত্বের যেখানে খুশি যাওয়ার অনুমতি দেন তবে আমরা সেই গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারবো।
বলো কি! রাজা বেশ আশ্চর্য হলেন। বললেন, তোমরা পারবে?
এখনই খুব জোর দিয়ে বলতে পারছি না। এক সপ্তাহের মধ্যে সব দেখেশুনে বিচার বিবেচনা করে সঠিক বলতে পারব ঐ ধনসম্পদ উদ্ধার করতে পারব কিনা। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ, সেই চেষ্টা কর, আর তোমাদের স্বাধীন গতিবিধির জন্যে সেনাপতিকে বলে দিচ্ছি। রাজা বললেন।
মহামান্য রাজা, আর একটা নিবেদন। ফ্রান্সিস বলল।
বলো কী নিবেদন। রাজা জানতে চাইলেন।
আলকাবা বন্দরে আমাদের জাহাজ নোঙর করে আছে। অতদূর থেকে যাতায়াত করা অসুবিধেজনক। এখানে আপনার প্রাসাদে যদি একটা ঘরে আমাদের থাকতে দেন তাহলে খুবই ভালো হয়। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ। রাজা বললেন। তারপর ইশারায় সেনাপতিকে ডাকলেন। সেনাপতি আসন ছেড়ে দ্রুত রাজার কাছে এলেন। রাজা ফ্রান্সিসদের ব্যাপারে সেনাপতিকে সব বললেন। সেনাপতি রাজার কথা শুনে ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বললে আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।
ফ্রান্সিসরা আবার রাজাকে সম্মান জানিয়ে রাজসভা থেকে বেরিয়ে এল। রাজবাড়ির বাইরে বিরাট মাঠ, কয়েকজন অশ্বারোহী সৈন্য সেই মাঠে ঘোড়া চালানো অভ্যেস করছিল। সেনাপতি একজনকে ডাকলেন। সৈনিকটি কাছে এলে সেনাপতি বললেন। এই তিনজন ভাইকিং-এর থাকবার মতো একটা ভালো ঘর দেখ। এদের সেখানে নিয়ে যাও। সেনাপতি রাজপুরোহিত পিরেল্লোকে বললেন, আপনার তো কোনো ঘরের প্রয়োজন নেই।
না-না। আমার থাকা-খাওয়ার কোনো অসুবিধে নেই। পিরেল্লো বললেন।
যাও। সেনাপতি বলল।
সৈন্যটি ফ্রান্সিসদের একটা ঘরের সামনে নিয়ে এল। বলল, এই ঘরটা খুবই ভালো। এখানেই আপনারা থাকবেন।
ফ্রান্সিস, শাঙ্কো ও হ্যারি ঘরটায় ঢুকল। সত্যিই বেশ খোলামেলা সুন্দর ঘর। মেঝেয় খড়ের বিছানা। ফ্রান্সিস বসে পড়ল। শাঙ্কো, হ্যারিও বসল। সৈন্যটি বলল, খাওয়ার সময় আপনাদের ডেকে নিয়ে যাবো। মাননীয় সেনাপতি আমাকেই দায়িত্ব দিয়েছেন আপনাদের দেখাশোনার জন্যে। কোনো প্রয়োজন পড়লে আমাকে ডাকবেন।
সৈন্যটি চলে গেল।
এতক্ষণ পিরেল্লো দেবমূর্তি ভরা বোঁচকাটা কাঁধে নিয়ে ফ্রান্সিসদের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। ওঁর ভয় ফ্রান্সিস না সেনাপতিকে বলে দেয় যে তিনি চোর। দেবমূর্তি চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছিলেন। দেখলেন ফ্রান্সিস কাউকে কিছু বলল না।
এবার ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে বলল, দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা যাব মন্দিরে। দেবমূর্তিগুলো যেখানে ছিল সেখানেই রাখা হবে।
কী, রাজি তো? শাঙ্কো বলল।
হ্যাঁ-হ্যাঁ তাই চলুন। পিরেল্লো বললেন।
দুপুরের খাবার খেয়ে দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এল সবাই।
মন্দিরে চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
চলুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি। পিরেল্লো বললেন।
পিরেল্লো পুবমুখো চললেন। সবাই যেতে লাগল। রাজারবাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ওরা হাঁটতে লাগল। সূর্যের আলো চড়া। ওরা ঘেমেনেয়ে উঠল। কিন্তু যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। হ্যারি জিজ্ঞেস করল–ও ঠাকুরমশাই আর কতদূর যেতে হবে?
–আর একটুখানি। যে বলটা দেখা যাচ্ছে–ওটার মধ্যেই মন্দির।
হাঁটতে হাঁটতে বনের কাছে এল ওরা। ঘন ঘন গাছপালা নয়, বেশছাড়া ছাড়া গাছগাছালি। বনের মধ্যে ঢুকল সবই। সূর্যাস্ত হতে বেশী দেরি নেই। বনের নীচে অন্ধকার জমেছে।
মন্দির কোথায়? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
–এই সামনেই। পিরেল্লো বললেন।
হঠাৎ সামনেই দেখা গেল গাছ কেটে এক উঠোনমতো জায়গা। চারধারে বাড়িঘর। পাতায় ছাওয়া। গাছের কাটা ডাল দিয়ে তৈরি বাড়ি। উঠোনমতো জায়গায় গাছের ছাল বিছোনো। তার ওপর এক বৃদ্ধ বসে আছে। হঠাৎ পিয়েল্লো গলা চড়িয়ে কী বলে উঠল। বাড়িঘর থেকে বন থেকে বেশ কিছু লোক ছুটে এল। তারা ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–হ্যারি–পিরেল্লো বিশ্বাসঘাতক।
পিরেল্লো গাছের ছালের ওপর বসা লোকটির কাছে গেলেন। কী কথাবার্তা বলল দুজনে। ফ্রান্সিসরা দেখল-লোকগুলোর চেহারা একটু অদ্ভুত। মাথায় টানটান বাঁধা চুল। গালে লালচে রঙের দাড়ি গোঁফ। চোখগুলো বেশ গোল গোল। কারো কারো হাতে বর্শা।
পিরেল্লো ফ্রান্সিসদের কাছে এল। সেই মাটিতে বসা লোকটিকে দেখিয়ে বলল– উনিই এদের দলপতি। এরা বুনো। ভীষণ হিংস্র। আমার ওপরে খুব ভক্তি।
তাহলে এখানে মন্দির নেই। শাঙ্কো বলল।
পিরেল্লো দাঁত বের করে হাসল। বললনা। আপনাদের চারপাঁচদিন এখানে আটকে রাখার জন্য এনেছি। আমি কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পেরেছি শুধু আপনারা আপনাদের রাজা হানমের গুপ্তসম্পদ খুঁজে বের করতে পারবেন। কাজেই আপনাদের কোনভাবে গুপ্তধন উদ্ধারের সুযোগ দেওয়া হবে না। আমিই দুজন ভক্ত নিয়ে ঐ গুপ্তধন উদ্ধার করবো।
–ভালো কথা। ফ্রান্সিস বলল–আপনারাই যদি উদ্ধার করতে পারেন তাহলে আমাদের ওপর সেই ভার দিতে চাইছিলেন কেন?
–বাজিয়ে দেখছিলাম। পিরেল্লো হেসে বললেন।
–কী দেখলেন। হ্যারি বলল।
–আপনারা গর্দভ।
–তা ঠিক। নইলে জানা নেই। শুনো নেই আপনাকে বিশ্বাস করে বসলাম।
–আমরা মানুষকে বিশ্বাস করে থাকি। আমরা ইচ্ছে করলে আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারতাম। কিন্তু আমরা করিনি। কারণ আপনি চোর হলেও আমাদের আশ্রয়প্রার্থী। কি তাই আপনাকে বাঁচালাম।
যাই হোক–গুপ্তধন আপনি উদ্ধার করতে পারবেন না। অত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, চিন্তাশক্তি আপনার নেই। তবু দেখুন চেষ্টা করে। শাঙ্কো বলল।
–চেষ্টা তো করি। দেখি। এবার তোমাদের কয়েদঘরে ঢোকানো হবে। পিরেল্লো বললেন। পিরেল্লো বুনোদের ভাষায় কী বললেন গলা তুলে। কয়েকজন যোদ্ধা এগিয়ে এল। দাঁড়াল ফ্রান্সিসদের সামনে। ওরা ইঙ্গিত করল কয়েদঘরে ঢোকার জন্যে। শাঙ্কো বলল–কী করবে ফ্রান্সিস?
–যা করতে বলছ কর। সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা এগিয়ে চলল যোদ্ধাদের নির্দেশমতো। কয়েদুঘরের কাছাকাছি এসেছে তখন বোঁচকা কাঁধে পিরেল্লো ওদের কাছে এল। হেসে বলল–এবার রাজা হানমের গুপ্তধনের স্বপ্ন দেখোগে। ঐ স্বপ্ন দেখতে দেখতেই একদিন মরে যাবে। গুপ্তধন আর পাওয়া যাবে না।
ফ্রান্সিসরা কিছু বলল না। শাঙ্কো এক কাণ্ড করল। ও পিরেল্লোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিরোল্লোর বোঁচকা এক হ্যাঁচকা টানে নিয়ে নিল। বোঁচকা ছুঁড়ে ফেলল কয়েদঘরের মধ্যে। পিরেল্লো পর্তুগীজ ভাষায় চিৎকার করে–চোর, চোর–আমার বোঁচকা চুরি করেছে। যোদ্ধারা কয়েদঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। পিরেল্লোর কথা ওরা কিছুই বুঝল না।
এবার পিরেল্লো নিজেই কয়েদঘরের সামনে এল। বারবার বলতে লাগল–আমার বোঁচকা ফিরিয়ে দাও।
তার আগে আমি দলপতির সঙ্গে কথা বলবো। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। দলপতি এই উঠোনেই গাছের বাকলের বিছানায় দিনরাত শুয়ে থাকে। অবশ্য কখনও কখনও উঠে বসে। সে অল্পক্ষণ। তারপরেই শুয়ে পড়ে।
–দলপতি কোথাও যায় না? হ্যারি জানতে চাইল।
দলপতি যখন বসে থাকে তখনই আমাকে কথা বলিয়ে দিন। ফ্রান্সিস বলল।
–সে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তার আগে আমার বোঁচকাটা দাও। পিরেল্লো বলল।
না। আগে দলপতির সঙ্গে কথাবার্তা, তারপর। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তারপর–পিরেল্লো বললেন।
–হ্যাঁ, তারপর যা কিছু ঘটুক। ফ্রান্সিস বলল।
দুপুরে খাবার দিল অন্য লোকেরা এনে। একটা বড় শুকনো পাতায় রুটির মতো কিছু সঙ্গে তারকারি আর পুঁটি মাছের মতো মাছ। বরাবরের মতো ফ্রান্সিস বলল–পেটপুরে খাও। খেতে ভালো না লাগলেও খাও। শরীরের শক্তি ঠিক রাখো।
খাওয়া শেষ। ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল কখন দলপতি উঠে বসে। একসময় দেখল উঠানের বিছানা ছেড়ে দলপতি উঠে বসেছে। পিরেল্লো কাছেই ছিল। ছুটে কয়েদঘরের সামনে এল। বলল, দলপতি উঠে বসেছে। চলো। একজন পাহারাদারকে বলল-দরজা খুলে দাও। পাহারাদার দরজা খুলে দিল। ফ্রান্সিস আস্তে বলল–হ্যারি থাকো। শাঙ্কো বোঁচকা নিয়ে আমার সঙ্গে এসো।
দুজনে কয়েদঘরের বাইরে এল। শাঙ্কোর মাথায় বোঁচকা। পিরেল্লো ছুটে এল। বলল বোঁচকাটা আমাকে দাও। শাঙ্কো এক ধাক্কায় ওকেসরিয়ে দিল। পিরেল্লো তবুপিছু ছাড়লনা।
তিনজনেই দলপতির কাছে এল। পিরেল্লোমুখ নিচু করে দলপতিকে কী বলল। দলপতি মুখ তুলে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। কিছু বলল। কিন্তু ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝতে পারল না। পিরেল্লোকে বলল–আপনি দলপতিকে কী বললেন। উনিই বা আমাকে কী বললেন?
–আমি বললাম–তোমরা চোর। আমার বোঁচকা নিয়ে পালাবার জন্যে চেষ্টা করছ।
এইসময় একজন দাড়ি গোঁফ কাটা লোক এল। উঠোনে এসেদাঁড়াল। তারপরদলপতির পাশে এসে বসল। দলপতিকে কী বলল। দলপতি মাথা ঝাঁকাল। দলপতি আর আগত লোকটি কথাবার্তা বলতে লাগল। পিরেল্লোকে দেখে বলল–ভাঙা ভাঙা পর্তুগীজ ভাষায়। লোকটি বলল–কী ব্যাপার পুরুতমশাই। আপনি এখানে কেন?
–আমি সমস্যায় পড়েছি। পিরেল্লো প্রায় কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল।
কী সমস্যা? লোকটি বলল।
ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বলল–এরা আমার বোঁচকা চুরি করেছে।
ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে লোকটি বলল–আপনারা–চুরি–পুরুতমশাই বলছেন।
–আমরা চুরি করিনি। কেড়ে নিয়েছি। শাঙ্কো বলল।
–কিন্তু কেন? লোকটি বলল।
–আমরা চুরি করা জিনিস কেড়ে নিয়েছি। শাঙ্কো বলল।
–তাহলে–পুরুতমশাই–চুরি।
বাজে কথা–মিত্তাল। আমি চুরি করিনি।
রাজামশাই আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে দিয়েছেন। পিরেল্লো বললেন।
ফ্রান্সিস বলল–অসম্ভব। শায়িত দেবতাদের মূর্তি কখনো রাজা বিকিয়ে দেবেন না। পিরেল্লো চুরি করেছেন।
–সেই মূর্তিগুলো কোথায়? মিত্তাল জানতে চাইল।
–শাঙ্কো–মূর্তি বের কর। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো বোঁচকা খুলে একটা মূর্তি বের করল। ফ্রান্সিস সেটা নিয়ে মিত্তালকে দিল। দলপতিও মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইল। মিত্তাল মূর্তিটা কপালে ঠেকাল। দলপতির হাতে দিল। দলপতিও মূর্তিটা কপালে ঠেকাল। তারপর মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইল। সোনার জিনিস সম্পর্কে দলপতির কোন ধারণাই নেই। দলপতি মিত্তালকে কী বলল। মিত্তালও দলপতিকে কিছু বলল। ফ্রান্সিসরা বুঝল না।
এটা আপনাদের উচিৎ হয়নি। মিত্তাল বলল।
পিরেল্লো বলল–আমি তো বললাম, রাজা আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে এই মূর্তিগুলো আমাকে দিয়েছেন।
-এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যেখানে হাজার হাজার দেশবাসীরা পুতপবিত্র দেবমূর্তিগুলো পুজো করে নৈবেদ্য দেয়। সেই দেবমূর্তিগুলো রাজা কামবহনা আপনাকে কে পুরস্কারস্বরূপ দেবেন–এটা অসম্ভব। তাছাড়া আমাদের জাহাজে যখন আশ্রয় নিতে এসেছিলেন তখন মূর্তি চুরি করেছেন একথাই বলেছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা বিদেশী। মূর্তি চুরির কথা তোমরা জানলেও কোন ক্ষতি নেই–এই ভেবে তোমাদের বলেছি। মিত্তাল বলল –যা হোক পুরুতমশাই। মূর্তিগুলো স্বস্থানে রেখে আসুন। চুরি ধরা পড়লে রাজা নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি শুরু করবেন। প্রথমেই সন্দেহ করবেন আপনাকে। আপনার খোঁজ শুরু হবে। চুরির দায় আপনার ঘাড়ে চাপবে। তখন ধরা পড়লে আপনার নির্ঘাৎসি হবে।
–ঠিক আছে। তাহলে মিত্তাল এখন আমি কী করব? পিরেল্লো জানতে চাইল।
–চুরির ব্যাপারে কোন কথা কাউকে বলবেন না। দেবমূর্তিগুলো স্বস্থানে রেখে দেবেন। মিত্তাল বলল।
–ঠিক আছে। পিরেল্লো বলল।
স্থির হল পরদিন সকালে পিরেল্লোকে নিয়ে ফ্রান্সিসরা রওনা হবে রাজধানীর উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যে হল। ফ্রান্সিসরা বিকেলের খাবার খেল। দলপতি একজন যোদ্ধাকে বলল ফ্রান্সিসদের একটা ঘরে রাখতে। কথাটা ফ্রান্সিসদের বুঝিয়ে বলল পিরেল্লো। ভালো একটা ঘরে ফ্রান্সিসদের নিয়ে এল দুই যোদ্ধা। পিরেল্লোও ওদের সঙ্গে থাকতে এল।
ঘরে ঢুকতে যাবে তখনই অল্প অন্ধকারে শাঙ্কো দেখল কোনার দিকে কয়েকটিকলাগাছে পাকা কলার কাঁদি ঝুলছে। শাঙ্কো ছুটে গিয়ে ওর ছোরা দিয়ে একটা কাঁদির অর্ধেক কাটল। সেই কাঁদি ওরা বোঁচকার ওপরে রাখল। যারা দেখবে তারা ভাববে বোঁচকায় কলা আছে। কারুর মনে কোন সন্দেহ হবে না। নিশ্চিন্তে চলাফেরা করা যাবে।
রাতের খাওয়ার সময় ফ্রান্সিসদের যোদ্ধারা ডেকে নিয়ে গেল। ঘরটায় ঢুকেফ্রান্সিসরা বুঝল এটা রান্না করার ও খাওয়ার ঘর।
ফ্রান্সিসদের শোয়ার ব্যবস্থা হল একটা ঘরে। ফ্রান্সিসরা খেয়েদেয়ে এসে ঐ ঘরে শুয়ে পড়ল। তখনও বর্শা হাতে যোদ্ধারা বাড়িঘর পাহারা দিতে লাগল। ফ্রান্সিস ওদের এত সতর্কভাবে পাহারা দেবার কী অর্থ বুঝল না। এত সাবধানতার কী কারণ বুঝল না।
তখন রাত গভীর। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধুএকদল যোদ্ধা ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে।
হঠাৎ যোদ্ধাদের একটা ধ্বনি–আ-আ-আ। শোনা গেল তারপরেই অন্য একদলের চিৎকার। ফ্রান্সিসদের ঘুম ভেঙে গেল। ওরা উঠে বসল। ফ্রান্সিস বলল—পিরেল্লো–বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির কারণ কী? পিরেল্লো উঠে বসল। বলল–পেছনেই ইরা নদী। নদীর ওপারে থাকে আর এক বুনো মানুষেরা। ওদের সঙ্গে এপারের বুনোদের ঝগড়াঝাটি লেগেই আছে। শুধুঝগড়াঝাটিনয়। লড়াইও চলে। নদীর ওপারের বুনোরা আক্রমণ করেছে। লড়াই চলছে। মানুষের চিৎকার গোঙানি শোনা যাচ্ছে। ফ্রান্সিসকেহ্যারি বলল কী করবে?
–এখন ঘর থেকে বেরুলে বিপজ্জনক। আমরা বিদেশী। কোন দলের সঙ্গে আমাদের মিতালি নেই–একথা বলতে হবে। এখন দেখা যাক কারা জেতে। ফ্রান্সিস বলল।
–নদীর ওপারের বুনোরা দুর্ধর্ষ। ওদের হারানো মুস্কিল। পিরেল্লো বললেন।
লড়াই চলল। সেই সঙ্গে চিৎকার গোঙানি জোরে শ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ লড়াই চলল। তারপর আস্তে আস্তে পরিবেশ শান্ত হল। শুধু আহতদের আর্তস্ফর শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎ ফ্রান্সিসদের ঘরের বন্ধ দরজাটায় দমাদম লাথি শোনা গেল। আবার এক দফা লাথি মারা শুরু হতেই অর্ধেকটা দরজা ভেঙে পড়ল। মশাল হাতে দুজন যোদ্ধা ছুটে এসে ঘরে ঢুকল। মশালের আলোয় ফ্রান্সিসদের দেখল। ফ্রান্সিসদের দেখে থমকে গেল। এই বিদেশী ভূতগুলি এখানে এল কী করে! আরও দুতিনজন যোদ্ধা ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিস পিরেল্লোর দিকে তাকাল। দেখল, পিরেল্লোর মুখ শুকিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল পিরেল্লো কী ব্যাপার?
–ওরা নদীর এপারের বুনোদের দলপতিকে খুঁজছে। নদীর ওপারের বুনোদের জয় হয়েছে।
একজন যোদ্ধা এগিয়ে এসে মুখ বেঁকিয়ে কী বলল।
–পিরেল্লো? ফ্রান্সিস বলল।
পিরেল্লো বলল–জানতে চাইছে তোমরা এখানে কী করে এলে?
-বলো যে জাহাজ চালিয়ে এসেছি। পিরেল্লো বলল সেটা। এবার পিরেল্লো মারফৎ কথা চলল।
–তোমরা এখানে কেন এসেছো? লোকটি বলল।
–বেড়াতে, দেশ দেখতে। ফ্রান্সিস বলল।
–হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় তোমরা রাজা হানমের গুপ্ত ধনভাণ্ডার চুরি করতে এসেছে। লোকটি বলল।
–যাক গে–তোমরা ইরানদীর ওপারে আমাদের রাজ্যে বন্দী থাকবে। লোকটা বলল। পির্নেল্লোর দিকে তাকিয়ে বলল–আপনাকে চিনি। আপনি অলিকাস দেশের রাজ পুরোহিত। আপনাকে বন্দী করা হবে না।
–না না। আমাকেও বন্দী কর। পিরেল্লো বলল। আরো বলল–আমি এই বিদেশীদের সঙ্গেই থাকবো।
বেশ থাকবেন। লোকটি বলল। তবে বন্দীর মতো নয়। দুজন যোদ্ধা ঘরে ঢুকল। লোকটি মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানিয়ে কী বলল। লোকটিও কী বলল। পিরেল্লো মৃদুস্বরে বলল–ফ্রান্সিস, এই লোকটা নতুন দলপতি। আগের দলপতিকে আমি চিনতাম। এরা লড়াইয়ে জিতেছে। এ পারের দলপতি কিছু যোদ্ধাসহ পালিয়েছে। তাদের ধরবার জন্যে ওপারের যোদ্ধারা ছুটোছুটি করছে। লক্ষ্য করে দেখ ইরা নদীর এপারে যারা থাকে তারা গোঁফ দাড়ি কামায় না। নদীর ওপারে যারা থাকে তারা গোঁফ দাড়ি কামায়।
দলপতি গলা চড়িয়ে হুকুম করল–এদের সবাইকে বন্দী করে নিয়ে চল। যোদ্ধারা কয়েকজন এগিয়ে এল ছোট দড়ি হাতে। দলপতি পিরেল্লোকে বন্দী করতে মানা করল।
ফ্রান্সিসদের ঘরের বাইরে আনা হল। ফ্রান্সিস মৃত ও আহত এপারের যোদ্ধাদের দেখল। ওদের মধ্যে জীবিত আহতদের বন্দী করা হল। পিরেল্লো ছাড়া ফ্রান্সিসদের হাতও বাঁধা হল। ফ্রান্সিস মনে মনে ভাবল–আবার কষ্টের দিন দুঃখের দিন শুরু হল। কবে মুক্তি পাওয়া যাবে কে জানে। এরা মুক্তি দেবে সে আশা নেই। নিজেদের মুক্তির ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নিতে হবে।
দুজন যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল। আহত বন্দীদেরও নিয়ে যাচ্ছে ওরা। কিছু পাথর কাঠের বাড়ি। লম্বা লম্ফ শুকনো ঘাসের ছাউনি বাড়ি এ রাস্তার দুপাশে। বাড়িগুলোর ধারে কাছে কেউ নেই। বেশ দূরে হেঁটে আসতে হয়েছে। পূব আকাশে লাল আভা। একটু পরেই সূর্য উঠল। ফ্রান্সিসদের বড় ভালো লাগে সূর্যোদয়। কিন্তু আজ ভালো লাগল না। বন্দীদশা বন্ধুদের জন্যে মারিয়ার জন্য দুশ্চিন্তা। ভালো লাগছিল না কিছু।
নদীর ওপারের বুনোরা ফ্রান্সিসদের হাত দড়ি দিয়ে বাঁধল। শুধু পিরেল্লোর হাত বাঁধা হল না। ওরা লড়াইয়ে আহতদের সঙ্গে নিল না। তবে ওদের আহত যোদ্ধাদের মোটা কাপড়ে চাপিয়ে নিয়ে চলল।
সবাই ইরা নদীর ধারে যখন পৌঁছল তখন রোদের তাপ বাড়ছে।
ইরা নদী ছোট নদী। তবে স্রোতের টান আছে। নদীতীরে দুটো লম্বাটে নৌকো। নৌকো দুটোয় দুজন মাঝি বসে আছে। ঢালু তীর দিয়ে সবাই নৌকোর কাছে এল। নৌকোয় উঠতে লাগল। শাঙ্কো উঠতে গিয়ে সমস্যায় পড়ল। কানের কাছে শুনলপিরেল্লোর কথা–দুহাতই বাধা। তুমি ওটা নিয়ে যেতে পারবে না। আমাকে দাও। শাঙ্কোর এবার পিরেল্লোর দিকে তাকাল। তারপর পাশে বসা যোদ্ধাদের ইঙ্গিতে জানাল বোঁচকাটা নিতে ওর অসুবিধে হচ্ছে। যদি সে নেয় তবে ও সহজে যেতে পারবে। যোদ্ধাটি কিছু বলল না। বোঁচকাটা নিল।
নৌকো পরপারে পৌঁছাল। এবার নামবার পালা। আস্তে আস্তে সবাই নেমে এল। হাত বাঁধা অবস্থায় নৌকোয় ওঠা নামা অত্যন্ত কষ্টকর। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–হ্যারি তোমাকে সাহায্য করবো।
-পারবেনা। তোমারও তো হাত বাঁধা। ভেবো না। ঢালুনদীতীর দিয়ে উঠতে পারবে।
–দেখ চেষ্টা করে। তুমি আমার পাশেই থাকবে। দুজনে চলল। বুনোরা অনায়াসে নদীর উঁচু তীরে উঠে গেল অল্পক্ষণের মধ্যে।
হঠাৎ হ্যারির পা ধুলো মাটিতে একটু ঢুকে গেল। হ্যারি আর দাঁড়াতে পারল না। ধুলো মাটিতে পড়ে গেল। ঢালু তীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। নদীর জলের কাছাকাছি এসে বুনো ঘাসের ঝোঁপের মধ্যে পড়ে নেমে গেল। বুনো যোদ্ধারা হেসে উঠল। ফ্রান্সিস নীচে নেমে চলল। হ্যারির কাছে এসে হ্যারির হাত ধরল। হাত টেনে বলল–চল–আমাদের উঠতে হবে। চলো। হ্যারির কোমরে হাত ধরে কিসে বলল–ওঠো। হ্যারি আস্তে আস্তে উঠতে লাগল। ফ্রান্সিসও হ্যারির কোমরে চাপ দিয়ে হ্যারিকেউঠতে সাহায্য করতে লাগল। দুজনে তীরে উঠে এল। সবাই নদীতীরে জড়ো হল। দলপতির আদেশ হল। চলল সবাই।
বুনোদের গ্রামে এল। সেই কাঠ আর পাথর দিয়ে তৈরি বাড়িঘর। ফ্রান্সিসদের আসতে দেখে ওরা অবাক হয়ে গেল। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। দরজায় জানালায় ওরা এসে দেখতে লাগল ফ্রান্সিসদের।
ফ্রান্সিসরা হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় উঠোনমতো জায়গায় এল। জায়গাটার মধ্যে একটা বিরাট শিশু গাছের নীচে একটা বড় কাঠের আসন। দলপতি গিয়ে আসনটায় বসল। একটু হাঁপাতে লাগল। তারপর গলা চড়িয়ে আদেশ দিল কিছু। চার-পাঁচজন যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের দিকে এল। ওরা ফ্রান্সিসদের অন্য জায়গায় নিয়ে এল। এসময় পিরেল্লো এগিয়ে এল। দলপতিকে কিছু বলল। আঙ্গুল তুলে শাঙ্কোর হাতের বোঁচকাটা দেখাল। দলপতি আঙুল তুলে ইশারায় শাঙ্কোকে তার কাছে আসতে বলল। শাঙ্কো বুঝল সেটা। শাঙ্কো এগিয়ে দলপতির কাছে গেল। বোঁচকাটা দেখিয়ে পিরেল্লো দলপতিকে বললো। দলপতি হাত তুলে মাথা ওঠানাম করল।
দলপতি কি বলছে? শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল পিয়েল্লোকে।
হেসে বলল–আমার জিনিস আমাকে ফেরৎ দেওয়া হবে।
না। সব জিনিস আমার। শাঙ্কো বলল।
–তুমি চোর। পিরেল্লো বলল।
–এইবার জিজ্ঞেস করি দলপতি যদি বোঁচকার ভেতর কী আছে সেটা দেখতে চায় তখন আপনি কী বলবেন? শাঙ্কো বলল।
–আঁ? হা হা মানে–পিরেল্লো–বলতে গিয়ে থেমে গেল।
–সোনার দেবমূর্তিগুলো দেখতে চাইলে আপনি বিপদে পড়বেন। আপনাকে স্ফকার করতে হবে যে পুরোহিত হিসেবে থাকায় আপনি অতি সহজে দেবমূর্তিগুলো চুরি করেছেন। কারণ সেটা আপনার পক্ষেই সম্ভব। পিরেল্লো ঘাবড়ে গেল। সত্যিই তো–দেবমূর্তিগুলো দেখলে দলপতির মনে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
–তা ঠিক। পিরেল্লো বলল।
এবার দলপতি শাঙ্কোকে জিজ্ঞেস করল–তুমি কি এই বোঁচকাটা পিরেল্লোর কাছ থেকে চুরি করেছে?
না। এই বোঁচকা আমার। শাঙ্কো বলল।
–রাজ পুরোহিতওতো বলছে এই বোঁচকা ওর। দলপতি বলল।
–তাহলে পিয়েল্লোকে জিজ্ঞেস করল। উনি বলুন বোঁচকায় কি কি জিনিস আছে? ফ্রান্সিস বলল।
–রাজপুরোহিত বলুন তো আপনার বোঁচকায় কী কী জিনিস আছে। দলপতি বলল।
–আমি রাজপুরোহিত হিসেবে কাজ করে যাঅর্থসঞ্চয় করেছি এই বোঁচকায় রেখেছি। পিরেল্লো বলল।
এবার দলপতি শাঙ্কোকে জিজ্ঞেস করল তুমি বলো তো কী আছে বোঁচকায়?
-দামি কিছুই নয়। পুরনো কাপড়চোপড় আর একহাত পিঠে আর গোটা দশেক আপেল। শাঙ্কো বলল।
–ঠিক আছে। দেখা যাবে। দলপতি একজন যোদ্ধাকে ইঙ্গিত করল। যোদ্ধাটি বর্শাটা মাটিতে রাখল। তারপর বোঁচকাটা শাঙ্কোর হাত থেকে নিয়ে খুলতে লাগল।
কাপড়ে জড়ানো সোনার মূর্তিগুলো দেখা গেল।
–রাজপুরোহিত-দলপতি পিরেল্লোকেজিজ্ঞেস করল–এই মূর্তিগুলো কি সোনার?
–আসল সোনার। পিরেল্লো বলল।
–আঁ? বলেন কী! দলপতি হাঁ করে দেবমূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
–ঠিকই বলেছি। পিরেল্লো বলল।
দলপতি দ্রুত একটা মূর্তি তুলে নিল। মূর্তিটার পোশাক খুলে ফেলল। বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মূর্তিটার দিকে। তারপর হো হো করে হেসে উঠল। চারপাশেদাঁড়ানো যোদ্ধারাও হাসল। দলপতি যোদ্ধাটিকে বলল ক’টা মূর্তি আছেদ্যাখতো। যোদ্ধাটি গুণে গুণে বলল
–সাতটা।
–আমার কাঠের সিন্দুকে রেখে আয়। দলপতি বলল।
–আজ্ঞে চাবি? যোদ্ধাটি বলল।
–ওটা খোলাই থাকে। যোদ্ধাটি চলে গেল।
দলপতি এবার ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমরা দুজনেই মিথ্যে বলেছে। তোমাদের কয়েদ করবো।
–আমি মিথ্যে বলেছিলাম আপনার শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে। শাঙ্কো বলল।
–আমাকেও বন্দী থাকতে হবে? পিরেল্লো বলল।
–হ্যাঁ আপনিও। দলপতি বলল।
দলপতি পাহারাদারদের বলল–যা, এই চারজনকেই কয়েদঘরে বন্দী করে রাখ।
কয়েদঘরে বন্দী হওয়ার মতো কোন কাজ করিনি। ফ্রান্সিস বলল।
–সে সব বিচার পরে হবে। দলপতি বলল। শাঙ্কো কিছুটা এগিয়ে এসে বলল– মর্তিগুলো তো নিলেন। মূর্তিদের পোশাকগুলো আমাকে দিন।
বেশ। দলপতি একজন যোদ্ধাকে ডাকল। বলল–ঐ পোশাকের বোঁচকাটা একে দে।
যোদ্ধাটি ডাঁই করে রাখা পোশাকগুলো শাঙ্কোকে দিল। কয়েকজন প্রহরী এগিয়ে এল ফ্রান্সিসদের দিকে। মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল ওদের সঙ্গে যাবার জন্যে। ফ্রান্সিসরা চলল কয়েদঘরের দিকে।
চারজনে কয়েদঘরে ঢুকল। প্রহরী বাইরে থেকে দরজার হুড়কোটা আটকে দিল।
ঘরে ঢুকেফ্রান্সিস টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। শুকনো লক্ষ্য লম্বা ঘাসের বিছানামতো। আর সবাই বসল। হ্যারি ডাকল–ফ্রান্সিস?
-বলো।
–এখন কী করবে? হ্যারি বলল।
–দলপতির মাথা কাটবো। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
–ইয়ার্কি করো না। কী করবে এখন তা ভেবেছো? হ্যারি বলল।
–ভাবছি। ভাবা এখনও শেষ হয়নি। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো অপেক্ষা করতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–সে তো বটেই। ফ্রান্সিস পিরেল্লোর দিকে তাকাল। বলল পিরেল্লো আপনি কী বলেন?
–কোন ব্যাপারে? পিরেল্লো বলল।
এখান থেকে পালানোর ব্যাপারে ফ্রান্সিস বলল।
–অসম্ভব। এখান থেকে পালানো যাবে না। চেষ্টা করে লাভ নেই। বরং সেটা বিপজ্জনক হবে। পালাতে গেলে ওরা বর্শা বুকে ঢুকিয়ে দেবে। কাজেই চুপ করে থাকুন। কী হয় দেখুন। তবে দেখে আর ভেবে কী হবে। পিরেল্লো বলল।
হবে। এরা কীভাবে পাহারা দেয়। কতজন একএকবার পাহারা দেয়। কেমন করে খেতে দেয় এসব দেখতে হবে। সব দেখে টেখে পালানোর উপায় ভাবতে হবে এবং সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখুন চেষ্টা করে। পিরেল্লো ঠোঁট উলটে বলল।
ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না। হ্যারিও শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চমকে উঠে বলল হ্যারি শরীর ভালো আছে তো?
-ঐ একটু–হ্যারি বলল।
–কী হয়েছে বলো। ফ্রান্সিস বলল।
শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে। তোমরা আমার জন্যে ভেবো না। হ্যারি বলল।
–ওষুধটষুধ সঙ্গে রেখেছো তো? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ হ্যাঁ ভেন আমাকে ওষুধ দিয়ে রেখেছে।
–হ্যারি বলল।
–তাহলে সময়মতো ওষুধ খেও। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। একটু জল খাবো। হ্যারি একটু দুর্বল স্বরে বলল। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ঘরটার কোনার দিকে গেল। মশালের আলো এতদূর ভালোভাবে এসে পৌঁছয়নি। শাঙ্কো কাঠের গ্লাসে জল নিয়ে এল। হ্যারি এক গ্লাস জল খেয়ে আবার চাইল। শাঙ্কো আবার জল নিয়ে এল। হ্যারি খেল। তারপর জোরে শ্বাস ফেলল।
শাঙ্কো নিজের জায়গায় এল।
হঠাৎ ফ্রান্সিস উঠে বসল। ডাকল শাঙ্কো। শাঙ্কো ওর দিকে তাকাল।
ফ্রান্সিস বলল–মূর্তিগুলো পরানো কাপড়চোপড়গুলো কোথায়?
–গ্রামপতির ঘরেই পড়ে আছে। আমি আনি নি। শাঙ্কো বলল।
-খুব ভুল করেছে। এখন ঐ টুকরো কাপড়গুলো খুব দরকার। ফ্রান্সিস ডাকল– পিরেল্লো। পিরেল্লো বললেন–বলুন।
দেবমূর্তিতে পরানো কাপড়গুলো কোথায় জানেন? ফ্রান্সিস বলল।
— গ্রামপতির ঘরে। পিরেল্লো বললেন।
এখন আপনি আর শাঙ্কো গ্রামপতির ঘরে যান। গিয়ে গ্রামপতিকে বুঝিয়েসুজিয়ে কাপড়গুলো নিয়ে আসুন। ফ্রান্সিস বলল।
পিরেল্লো উঠতে উঠতে বলল কাপড়গুলো কোথায় ফেলেই দিয়েছে কিনা কেজানে।
গিয়ে দেখুন তো। ফ্রান্সিস বলল।
পিরেল্লো দরজার কাছে এল। পেছনে শাঙ্কো। গাছের ডাল কেটে তৈরি দরজার কাছে এল। পিরেল্লো প্রহরীকে ডাকল। প্রহরী এল। পিরেল্লো কী বলল। একটু পরেই দরজা খুলে গেল। পিরেল্লো আরশাঙ্কো ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দুজন যোদ্ধা ওদের দুপাশে দাঁড়াল। ওরা চলল গ্রামপতির ঘরের দিকে।
ঘরের সামনে এল দুজনে। গ্রামপতির ঘরের সামনে দুজন প্রহরী। হাতে বর্শা। পিরেল্লো : ওদের কী বলল। একজন ঘরের দরজার কাছে গেল। দরজায় শব্দ করল। ভেতর থেকে গম্ভীর গলা শোনা গেল। –কে? প্রহরীটি কিছু বলল। একটু পরে দরজা খুলে গেল। গ্রামপতি দরজার কাছে এল। বলল–এসে নিয়ে যাও। শাঙ্কো ছুটে ঘরে ঢুকল। মশালের আলোয় দেখল কাপড়গুলো ঘরের এক কোণায় স্তূপাকার করে রাখা। শাঙ্কো প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ঐ কাপড়ের স্তূপের ওপর। দ্রুতহাতে কাপড়গুলো বের করতে লাগল আর কোমরে পাঁচাতে লাগল। গ্রামপতি দেখল সেটা। কিন্তু কিছু বলল না। যখন শেষ হল শাঙ্কোর কাছে তখন গ্রামপতি বলল–কী করবে এই কাটা কাপড় দিয়ে?
-খুবই পবিত্র এই পোষাক। যথাস্থানে কাপড়গুলো রেখে দেওয়া হবে। নতুন পোশাক পরানো হবে। সেই উপলক্ষে খুব আনন্দ উৎসব হয় ঐ দেশে। পিরেল্লো বলল।
গ্রামপতি মুখে শব্দ করল–হু।
সাত দেবতার পোশাকের কাপড় নিয়ে ওরা কয়েদঘরে ফিরে এল। পিরেল্লো হেসে বললেন–কী হবে এসব নিয়ে?
–সময়মতো দেখবেন। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো নিজের কোমর থেকে কাপড়গুলো খুলে খুলে একত্র করল। এক জায়গায় রেখে দিল।
কেউ কোন কথা বলছে না। দুপুরে পাহারাদাররা খাবার নিয়ে এলো। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল দুজন প্রহরী ওদের খাবার নিয়ে আসে। একজন বাইরে পাহারায় থাকে। প্রহরীরা ডেকচিতে মাংস, বড় লোহার থালায় রুটি আর একটা ছোট মাটির হাঁড়িতে ডালপাতা আর বুনো আলুর তরকারি। খেতে খেতে ফ্রান্সিস বরাবর যা বলে তাই বলল-পেট পুরে খাও। রান্না ভালো না লাগলেও খাও।
খাওয়া শেষ। প্রহরীরা এঁটো থালাটালা নিয়ে চলে গেল।
সন্ধ্যে হল। ফ্রান্সিসরা শুয়ে বসে আছে। সবাই চুপ। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল–ফ্রান্সিস কিছু ভাবলে?
–আমার সব ছক হয়ে গেছে। এবার কাজে নামা। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো মৃদুস্বরে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। হ্যারিও সঙ্গে যোগ দিল। ফ্রান্সিস হাসল। বলল–সিদ্ধান্ত নিলাম কাল রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর পালাবো।
–আজ রাতেও তো পালানো যায়। পিরেল্লো বলল।
–না। শুধু পালানো নয়। মূর্তিগুলো নিয়ে পালাতে হবে। তার জন্য একটু ভেবেচিন্তে এগোতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
অন্যেরা একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। ওর একটা চিন্তা কী করে রাজা হানমের গুপ্তধন খুঁজে বের করবে। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজে ফেরা।
পরের দিনটা একইভাবে কাটল। চুপচাপ ঘাসের বিছানায় শুয়ে বসে।
সন্ধ্যে হল। রাত হল। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো কিছু কাপড় নিয়ে দড়ির মতো পাকাও। প্রহরীর, গ্রামপতির মুখ বাঁধতে হবে।
রাত একটু গম্ভীর হল। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়াল। ওর দেখাদেখি আর সবাই উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে বলল–দেখুন প্রহরী ক’জন?
–দু’জন? ফ্রান্সিস বলল–এদের নিয়ম অনুযায়ী থাকার কথা ছিল একজনের। গতরাতেই পাহারায় ছিল একজন। যাক গে ফ্রান্সিস বলল।
আমরা দু’জনকে অকেজো করে দিতে পারবো। শাঙ্কো বলল।
–শাঙ্কো। শোন। পাহারাদার দুজনকেই ডাকা হবে। ওরা দরজা একটু খোলার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা প্রচণ্ড জোরে মুখের ওপর ধাক্কা দেব। বুঝতেই পারছো কী হবে তাহলে। অন্যটাকেও কাছে আসতে বলবো। কাছে এলে আমি মারবো ধাক্কা আর তুমি ওর মুখ বেঁধে দেবে। সব কাপড় সঙ্গে নাও। কখন কোন কাজে লাগবে বলা যায় না। একটু থেমে বলল–পিরেল্লো আপনি একজন প্রহরীকে ডাকুন।
পিরেল্লো দরজার কাছে গেল। ওদের ভাষায় গলা চড়িয়ে কী বলল। একজন এগিয়ে দরজার কাছে এল। ফ্রান্সিস ফিসফিস্ করে বলল–ভেতরে আসতে বলুন। পিরেল্লো বলল সেটা। –ভেতরে এসো।
একজন প্রহরী ঘরের ভেতরে আসার জন্যে দরজার কাছে এল। হুড়কো খুলতেই ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দরজাটা প্রচণ্ড জোরে প্রহরীর নামে মুখে লাগল। নাক দিয়ে রক্ত ছুটল। ও নাক ধরে ছিটকে চিৎ হয়ে পড়ল। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখ বেঁধে ফেলল। প্রহরীটির মুখ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বেরোতে লাগল। শাঙ্কো ছিটকে পড়া বর্শাটা নিয়ে ওর গলায় চেপে ধরল। প্রহরীটির গলার শব্দ বন্ধ হল। শাঙ্কো ওর হাত দুটোও বেঁধে ফেলল। ওদিকেফ্রান্সিস আহত প্রহরীর বর্শাটা নিয়ে অন্য প্রহরীটির দিকে এগিয়ে চলল। প্রহরীটি হাতের বর্শাটা বাড়িয়ে ফ্রান্সিসের গায়ে লাগাবার জন্যে চেষ্টা করল। ফ্রান্সিস বর্শার ধাক্কায় প্রহরীটির হাতের বর্শাটা সরে গেল। শুরু হল বর্শার লড়াই। প্রহরীটি শূন্যে বর্শাটা ঘোরাতে ঘোরাতে দ্রুত নামিয়ে এনে ফ্রান্সিসের বুকে বেঁধাতে চেষ্টা করল। কিন্তু ফ্রান্সিস তার আগেই সাবধান হয়ে গেছে। বর্শাটা ঘুরিয়ে সরে এসেছে। এবার ফ্রান্সিস প্রহরীটির উরু লক্ষ্য করে বর্শা চালাল। বর্শাটা প্রহরীটির ডানপায়ের উরুতে বিধে গেল। ও বর্শা ফেলে উরু চেপে ধরল। ফ্রান্সিস ওর নিজের বর্শাটঠা টেনে নিয়ে এল। প্রহরীটি মাটিতে পড়ে গেল। ওর মুখ থেকে আর্তস্ফর বেরোবার আগেই শাঙ্কো ওর মুখে কাপড় চেপে ধরল। তারপর মুখ বেঁধে ফেলল। হাতদুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলল। সব ঐ সাজের কাপড় দিয়েই করল।
ফ্রান্সিস হাত তুলে নিঃশব্দে গ্রামপতির বাড়িটা দেখাল! তারপর ছুটল সেই দিকে। গ্রামপতির ঘরের দরজার সম্মুখে এসে প্রায় সবাই হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে ফিফিস্ করে বলল–গ্রামপতিকে ডাকুন। বলবেন জরুরি কথা আছে।
পিরেল্লো এগিয়ে এসে দরজায় শব্দ করল। ভেতর থেকে গম্ভীর কথা শোনা গেল কে? পিরেল্লো’বলল–আমি পিরেল্লো। রাজপুরোহিত।
–তা এত রাতে?
আপনার সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। পিরেল্লো বলল।
–হ্যাঁ একটু পরেই বোঝা গেল গ্রামপতি দরজার কাছে এসেছে। দরজা একটু খুলল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো দরজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। গ্রামপতি ছিটকে মাটির মেঝেয় পড়ে গেল। শাঙ্কো ছুটে গিয়ে গ্রামপ্রধানের মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলল। হাতও বাঁধল। গ্রামপতি আস্তে-আস্তে গোঙাতে লাগল।
ততক্ষণে ফ্রান্সিস কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে ফেলেছে। সাজিয়ে রাখা দেবমূর্তিগুলো শাঙ্কোকে দিল। শাঙ্কো কাপড়ের মধ্যে মুর্তিগুলো লুকিয়ে ফেলল।
ফ্রান্সিস অস্ফুট স্বরে বলল–এবার পালাও।
চারজন বাইরে এল। ফ্রান্সিস গলা চেপে বলল–পিরেল্লো–কোন দিকে যাবো? উত্তর দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলল–এই দিকে।
চারজনই উত্তরমুখো ছুটল। চাঁদের আলোয় ফ্রান্সিস দেখল একটা বনাঞ্চল। তখনও দূরে দেখল গ্রামপতির যোদ্ধারা মশাল হাতে ফ্রান্সিসদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। হৈ হৈ করছে।
ফ্রান্সিসরা বনে ঢুকে পড়ল। আর ধরা পড়ার ভয় নেই। বনের গাছপালা খুব ঘন নয়, ছাড়া ছাড়া। ওর মধ্যে দিয়েই ফ্রান্সিসরা যতটা দ্রুত দৌড়োনো সম্ভব ততটা জোরে ছুটল।
বনটা খুব বেশি বড় নয়। একসময় বন শেষ। সামনেই একটা বেশ বড় ছড়ানো পাথরের আর ঘাসের প্রান্তর।
ফ্রান্সিসরা হাঁটতে লাগল।
হঠাৎ হ্যারি অস্পষ্টস্বরে ডাকল–ফ্রান্সিস।
ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল। দেখল হ্যারি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস ছুটে এসে হ্যারিকে ধরল। কিন্তু ধরে রাখতে পারল না। হ্যারিঘাসেরওপর শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে হ্যারিকে কাঁধে তুলে নিল। তারপর হাঁটতে লাগল। পিরেল্লো বলল–আমরা এসে গেছি। বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিস শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল– ওখানেই আশ্রয় নেব। শাঙ্কো এগিয়ে এল। বলল–ফ্রান্সিস এবার আমি নিচ্ছি। ও দুহাত ছড়িয়ে হ্যারিকে ধরল। তারপর আস্তে আস্তে কাঁধে রাখল। তখন সকাল হয়ে গেছে।
প্রথম বাড়িটার সামনে এসে ওরা দাঁড়াল। কিছু কাচ্চা বাচ্চা ওদের ঘিরে দাঁড়াল। এক মহিলা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এল। কী বলল। ফ্রান্সিসরা বুঝল না। পিরেল্লোও কীসব বলল। মহিলাটি পাশের ঘরটা দেখিয়ে কী বলল। তারপর ঐ ঘরটার কাছে এল। কোমর থেকে চাবির বড় একটা থোকা বের করল। ওটাতে অনেক চাবি। মহিলাটি দেখে দেখে একটা চাবি বের করল। চাবিটা দিয়ে দরজা খুলল।
ফ্রান্সিসরা ঘরের ভেতরে ঢুকল। মেঝে মাটির। তার ওপর ঘাসপাতা দিয়ে তৈরি একটা বিছানামতো। শাঙ্কো আর ফ্রান্সিস হ্যারিকে ধরাধরি করে ঘাসের বিছানার ওপর শুইয়ে দিল। হ্যারির গোঙানি বাড়ল। ফ্রান্সিস কী করবে বুঝতে পারছে না। পিরেল্লো বলল–আপনাদের বন্ধুর এরকম হয়?
–হ্যাঁ। হঠাই অজ্ঞানমতো হয়ে যায়। শাঙ্কো বলল।
–অনেক দেরিতে জ্ঞান ফিরে পান? পিরেল্লো বলল।
-হ্যাঁ। তখন আগের ঘটনার কিছুই মনে করতে পারেনা। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনারা যে বন্দরে জাহাজ থামিয়েছেন সেই বন্দর এলাকাতেই থাকেন এক সাধু। তার ওষুধ খেয়ে এক অন্ধ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে। কারো ভাঙা পা জোড়া লেগেছে।
–আপনি নিজে দেখেছেন তেমন কিছু? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
না না। লোকমুখে শুনেছি। পিরেল্লো বলল।
–এসবের কোনো গুরুত্ব নেই। লোক ঠকানো ব্যবসা। ফ্রান্সিস বলল।
দুপুর কেটে গেলে। খাওয়ার ডাক পড়ল না। অবশ্য ফ্রান্সিসদের খিদেই পাচ্ছিল না।
শেষ দুপুরে হ্যারি চোখ মেলে তাকাল। গোঙানি বন্ধ হয়েছে তার আগেই। হ্যারি আস্তে আস্তে ওর কোমরের ফেট্টি থেকে একটা কাঠের কৌটো বের করল। কৌটোর মুখ খুলতে খুলতে বলল–শাঙ্কো এক গ্লাশ জল আনো। শাঙ্কো ছুটে গিয়ে কাঠের গ্লাশে করে জল নিয়ে এল। হ্যারি কৌটো থেকে একটা গুলি বের করল। আস্তে আস্তে খেয়ে নিল।
তখন বিকেল হয়ে এসেছে। গৃহকর্তা এসে বলল–আপনারা কোন দেশ থেকে এসেছেন? ভদ্রলোক খুবই অমায়িক। ফ্রান্সিস বলল–আমরা ভাইকিং। পশ্চিম ইউরোপ থেকে এসেছি। পিরেল্লোকে দেখিয়ে বলল–ইনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?
–খেতে আসুন। বড় দেরি হয়ে গেল। মানে নতুন করে রান্না চাপাতে হল। কিছু মনে করবেন না।
সবাই উঠে দাঁড়াল। হ্যারিও উঠতে যাবে। ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি–তুমি এই ঘরেই যাও। বেশি নড়াচড়া করো না।
–বেশ। হ্যারি বসে রইল।
হ্যারি পেট ভরে খেও। তারপর একটু পায়চারি করো। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা ওপাশের ঘরে ঢুকল। দেখল মাটির মেঝেয় পরপর একটা করে লম্বাটে পাতা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ফ্রান্সিসরা খেতে বসল। গৃহকত্রী আর তার মেয়ে খাবার পরিবেশন করতে লাগল। গৃহকর্তা এবার বললেন–এত বেলায় বেশি রান্না করা গেল না। আমরা মুরগী পুষি। তাই
–খেতে কোন অসুবিধে হচ্ছেনা তো? শাঙ্কো বলে উঠল–মাংস হয়েছে, আলুভাজা হয়েছে–ব্যস্ আর কী লাগে।
খেয়েদেয়ে ওরা হ্যারির কাছে এল। হ্যারি আরও একটা বড়ি খেল। হ্যারি অনেকটা সুস্থ এখন। হ্যারি ঘরেই খেয়েছে। গৃহকত্রী নিজেই হ্যারির খাবার এনে দিয়েছে।
এবার শোওয়া। চারজনের পক্ষে ঘরটা ছোটই। এরকম ছোট জায়গায় থাকা ফ্রান্সিসদের অভ্যেস আছে। পিরেল্লোর একটু অসুবিধে হল। পিরেল্লো কিছু বলল না। চেপেচুপে শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস ডাকল-পিরেল্লো?
–বলুন।
–এই রাজ্যের রাজার নাম কী?
মুজার্তা।
–লোক কেমন?
–চিন্তা করতে পারবেন না কী অমায়িক এই রাজা মুজার্তা। অনেক রাজাই তো দেখেছি-মুজার্তার মতো এমন সহৃদয় পরোপকারী প্রজাবৎসল রাজা আমি দেখিনি। প্রজাদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন। প্রজারাও তাকে দেবতার মতো মানে। পিরেল্লো বলল।
–তাহলে তো রাজা মুজার্তাকে একবার দেখতে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–চলুন। কাল সকালে রাজসভায়। পিরেল্লো বলল।
–ঠিক আছে। যাবো ফ্রান্সিস বলল। এবার হ্যারিকে বলল হ্যারি, তুমি পারবে যেতে?
–আমি আর যাবো না। এখানেই থাকবো। হ্যারি বলল।
–বেশ। তুমি যদি চাও আমরা একজন তোমার সঙ্গে থাকতে পারি। শাঙ্কো বলল।
–না-না। আমি একাই থাকতে পারবো। হ্যারি বলল।
–বেশ। ফ্রান্সিস বলল।
সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। রাজা হানমের গুপ্তধন ভাণ্ডার আবিষ্কার করতে দেবতার জন্যে সময় চাই। আবার শায়িত দেবতাদের মন্দিরে যেতে হবে ফিরতে দেরি হলে জাহাজের বন্ধুরা, মারিয়া ভাবতো। এইসব চিন্তা করতে করতে ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।
একটু বেলাতেই ফ্রান্সিসদের ঘুম ভাঙল। হাতমুখ ধুয়ে এল সবাই। সকালের খাবার দিয়ে গেল কর্তা নিজেই। তিনকোণা রুটি আর সজির ঝোল।
সবাই খেল। এবারে রাজবাড়ি যাওয়া। হ্যারি শুয়ে রইল। ওরা জিন চলল রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে।
রাস্তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দুধারে বাড়ি। কাঠ আর পাথরের। লোকজন খুব বেশি নয়। ওরা হঠাৎ বাজনার শব্দ শুনল। একটা মোড়ে পীপের একদিকে চামড়া ঢাকা। অন্য পাশ খোলা। তাই দিয়ে বাজনা বাজাচ্ছে দু’তিনজন পুরুষ। একদঙ্গল ছেলেমেয়ে বাজনার তালে তালে নাচছে। ফ্রান্সিস বলল–এরা নাচছে কেন পিরেল্লো?
–আনন্দে। এই দেশে গান-বাজনা লেগেই আছে। কখনও কখনও সারারাত নাচগান চলে। গৃহকর্তা বললেন।
–তাহলে এরা সুখী। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা মুজাৰ্তর প্রজারা সুখী। কোনঅসুবিধে কোন সমস্যা নেই এদের। পিরেল্লো বললেন।
ডানহাতি দেখা গেল বহুদূর বিস্তৃত তুলোর ক্ষেত।
ফ্রান্সিস বলল–এখানে খুব ভালো তুলা চাষ হয়।
–হ্যাঁ। তুলোই প্রধান আয়ের পথ। পিরেল্লো বলল।
এবার পিরেল্লো আঙুল তুলে রাজবাড়ি দেখাল। কাঠপাথরে তৈরি রাজবাড়ি। তবে সাধারণ বাড়ির চেয়ে বেশ বড়। প্রবেশদ্বারে লোকজনের জটলা। সেখানে ফ্রান্সিসরা এসে দাঁড়াল। ঝকঝকে বর্শা হাতে প্রহরী। ফ্রান্সিসদের দেখে একটু অবাকই হল। বোঝাই যাচ্ছে বিদেশী। প্রহরী সবাইকে ঢুকতে দিচ্ছে না। পিরেল্লো এগিয়ে গিয়ে প্রহরীকে কী বলল। প্রহরী ঘাড় নাড়ল। পিরেল্লো ফ্রান্সিসদের ইশারায় ডাকল।
ফ্রান্সিসরা এবার সহজেই ভেতরে ঢুকল। দেখল বেশ ভিড়। দফায় দফায় দর্শনার্থী প্রজাদের ঢোকানো হচ্ছে। একদফা ভিড় চলে যেতেই ফ্রান্সিসরা ভালোভাবে রাজা মুজার্তাকে দেখল। রোগা লক্ষ্য মুখে দাড়ি গোঁফ। কাঠের সিংহাসনে বসে আছেন। সিংহাসনে ফুলতোলা মোটা কাপড়ে ঢাকা। রাজা মাঝে মাঝে হাত নাড়ছেন। দর্শনার্থীরা আনন্দে চিৎকার করে রাজার জয়ধ্বনি দিচ্ছে। ফ্রান্সিসরা দেখল কোন বিচারপ্রার্থী কেউ নেই। হয়তো এ দেশে কোন অপরাধ হয় না। হয়তো ঝগড়া-বিবাদ হয় না।
একদফা দর্শনার্থীরা বেরিয়ে যেতেই রাজা মুজার্তা ফ্রান্সিসদের দেখল। রাজা সঙ্গে সঙ্গে আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। দ্রুতপায়ে হাসিমুখে ফ্রান্সিসদের কাছে এলেন। ফ্রান্সিসকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপরশাঙ্কোকেতারপরপিরেল্লোকেবললেন–আসুন রাজপুরোহিত।
রাজা বললেন–আপনাদের তিনজন আসার কথা।
–হ্যাঁ। আমরা তিনজনই। একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারেননি। শাঙ্কো বলল।
আসনের কাছে এসে বললেন–আপনারা বসুন। তিনটি আসনই রাখা ছিল। ফ্রান্সিসরা বসল। রাজা বলতে লাগলেন পিরেল্লো স্পেনীয় ভাষায় তা বলতে লাগলেন। রাজা বললেন–বেশ কয়েকবছর আগের কথা। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম। একটা পাহাড়। গাছ গাছালি ঘাসে সব সবুজ। পাহাড়ের সবই সবুজ এটা হয় না। কিন্তু স্বপ্নে দেখেছিলাম আমি যেন পাহাড় থেকে নামছিলাম। হঠাৎ মেঘশূন্য আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। একবার দুবার তিনবার। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম আমার সামনে তিনজন শ্বেতাঙ্গ। একজন শ্বেতাঙ্গ বললেন–প্রজাদের নিজের ছেলের মতো ভালোবাসবেন। দ্বিতীয়জন বললেন–নিজের প্রাণরক্ষার জন্যে যুদ্ধ করবেন। অন্যথায় নয়। তৃতীয়জন বললেন–আপনার রাজত্বে দারিদ্র্য যেন না থাকে। তিন পুরুষ পাহাড়ের চূড়ার দিকে হেঁটে চললেন। কিছুক্ষণ তাদের দেখলাম। তারপর তারা দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন।
সবাই চুপ করে রইলেন। ফ্রান্সিস বলল–সেই নিপুরুষ যে আমরাই সেটা বুঝলেন কী করে?
–স্বপ্নে যতটা দেখেছিলাম তাতে আপনাদের সঙ্গে মিল আছে। রাজা বললেন।
আবার একদফা দর্শনার্থীদের ছাড়া হল। রাজসভার কাছে আবার ভিড় হল। রাজার জয়ধ্বনি চলল। রাজাও হাত নেড়ে দর্শনার্থীদের উৎসাহিত করতে লাগলেন।
আর একদফা দর্শন দিয়ে রাজা মুজার্তা প্রহরীদের আর কাউকে ঢুকতে মানা করে দিলেন। সভাঘর আস্তে আস্তে নিঃশব্দ হল।
এবার রাজা মুজাৰ্তা ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বললেন–বেশ শান্তিতেই ছিলাম। প্রজাদের অভাব-অভিযোগ জেনে সে সব দূর করতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পাহাড়ের ওপারে একটা রাজ্য আছে। রাজার নাম জুদেবা। অত্যন্ত হিংস্র প্রকৃতির মানুষ। ও দেশে প্রজাদের অনেক কষ্টে দিন কাটে। এই রাজা জুদেবা নরহত্যা ছাড়া কিছু বোঝে না। সারা রাজ্যে চর ঘুরে বেড়ায়। কেউ রাজা জুদেবের বিরুদ্ধে একটি কথা বললে তাকে ধরে রাজার কাছে নিয়ে আসে। তার ওপর শুরু হয় নির্মম অত্যাচার। তাই সবাই মুখ বুজে থাকে। একটু থেমে বলতে লাগলেন–রাজা জুদেবা বার তিনেক আমার রাজ্য আক্রমণ করেছে। আমার প্রজারা প্রাণপণ লড়াই করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার দেশপ্রেমিক কিছু যোদ্ধাও মারা গেছে। আমার লোকজনেরা সংবাদ নিয়ে এসেছেআজ অথবা কালকে রাজা জুদেবা আমার রাজ্য আক্রমণ করবে। তাই বড় চিন্তায় আছি।
আপনার যোদ্ধাদের একত্র করেছেন তো? পিরেল্লো বলল।
হ্যাঁ। আমার যোদ্ধাদের উপর আমার অগাধ বিশ্বাস। আমাকে বাঁচাবার জন্য ওরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে লড়াই চালাবে। কিন্তু আমার দুঃখ যে বেশ কিছু প্রজা মারা যাবে, আহত হবে। তাই আমি যুদ্ধ চাই না। রাজা জুদেবাকে বলব–আমি হার স্বীকার করলাম।
–কিন্তু আপনার ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে আপনাকে তো যুদ্ধ করতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিকই বলেছেন। রাজা মুজার্তা বললেন–আমরা এখন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। তবে আমরা সমস্যায় আছি। আমার রাজত্বের উত্তরভাগে দুর্ধর্ষ লড়িয়ে সৈন্য ছিল। কিন্তু ভূমিকম্পে সেই লড়িয়ে সৈন্যরা অনেক মারা পড়েছে কিছুদিন আগে। রাজা জুদেবা সেই খবর জানে। আমরা যে হীনবল হয়ে পড়েছি সেটা বুঝে লড়াই করতে আসছে। সাধারণ সৈন্যদের নিয়ে আমরা যতটা পারি লড়বো। এখন পর্যন্ত ভেবে রেখেছি আমরা হার স্বীকার করবো না। রাজা মুজার্তা বললেন।
হ্যাঁ। লড়াইয়ে মনের জোরটাই বড় কথা। কথাটা বলে ফ্রান্সিস উঠেদাঁড়াল। শাঙ্কোও উঠল। ফ্রান্সিস বলল–আমরা বিদেশী। আপনাদের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে পারি না। তবু আপনার মতো রাজার জন্য প্রয়োজনে আমরা লড়বো। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো ভালোই। রাজা মুজার্তা বললেন।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো মাথা একটু নুইয়ে রাজাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সভাঘরের দরজার দিকে চলল। ফ্রান্সিস বাইরে এসে দেখল ডানদিকে বিরাট প্রান্তর। পাহাড়ের কাছে তাই প্রস্তরাকীর্ণ। চাষ হয় না। ফ্রান্সিস বুঝল লড়াইটা এখানেই হবে। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো রাজা জুদেবার সঙ্গে লড়াইটা এখানেই হবে। রাজা মুজার্তাকে তার দেশবাসী পিতার মতো শ্রদ্ধা করে, বন্ধুর মতো ভালোবাসে। কাজেই রাজা মুজার্তাকে হারানো মুশকিল।
-তাহলে লড়াই তো হবেই। শাঙ্কো বলল।
হা–কোন সন্দেহ নেই। ফ্রান্সিস বলল।
হাঁটতে হাঁটতে ফ্রান্সিসরা যে বাড়িটাতে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে এল। হ্যারি বলল তোমাদের ফিরতে বেশ দেরি হল। ফ্রান্সিস বিছানায় বসল। তারপর হ্যারিকে সব বলল। হ্যারি বলল–ওরকম একজন রাজা তাকে আমাদের সাহায্য করা উচিত।
–কিন্তু কীভাবে সাহায্য করবো? ফ্রান্সিস বলল।
–তার স্বপক্ষে লড়াই করে। শাঙ্কো বলল।
–তাহলে তো বন্ধুদের এখানে নিয়ে আসতে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি বলি কি আগেই বন্ধুদের নিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। লড়াই হোক। যদি রাজা মুজার্তা হেরে যায় তখন আমরা সাহায্য করবো। শাঙ্কো বলল।
–শাঙ্কো ঠিকই বলেছে। হ্যারি বলল।
–ঠিক আছে। তবে আমাদের এখানে কয়েকটা দিন থাকতেই হবে। হ্যারি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। ফ্রান্সিস বলল।
-না-না। আমি অনেকটা সুস্থ। হ্যারি বলল।
উঁহু তোমার এখনও কয়েকটা দিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। ফ্রান্সিস বলল।
সেদিন সকালে রাজা জুদেবা আক্রমণ করল। রাজবাড়ির সামনে বিরাট প্রান্তরে দু’দলে লড়াই শুরু হল। চিৎকার হৈ-হল্লা। আহতদের আর্তনাদ গোঙানি ফ্রান্সিসরা সবই শুনতে পারছিল। দুপুরবেলা বাড়ির মালিক এসে জানিয়ে গেল রাজা মুজার্তা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিচ্ছে। রাজা মুজাৰ্তার সৈন্যরা ভালোই লড়ছিল। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরে হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ফ্রান্সিস বলল–এখন কী করবে হ্যারি?
–এই বাড়িতেই শাঙ্কোদের জন্য অপেক্ষা করবো। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়াল। হ্যারি বলল–কোথায় যাচ্ছো?
–বাইরেটা দেখে আসি। নৃশংস রাজা জুদেবার সৈন্যরা নিশ্চয়ই পরাজিত রাজার প্রজাদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। রাজা জুদেবার সৈন্যদের কয়েকটাকে খতম করে আসি। অবশ্য শেষ লড়াই এখনও বাকি। ফ্রান্সিস বলল।
-যা করবে সাবধানে করো। ভুলে যেও না–আমরা বিদেশী। দু’পক্ষের কোন সৈন্যই আমাদের বুঝবে না। হত্যা করতে চাইবে। হ্যারি বলল।
–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস হাত নেড়ে বলল। ফ্রান্সিস বাড়ির মধ্যে গেল। গৃহকর্তার স্ত্রীকে গিয়ে বলল–আমাকে কিছু কাঠকয়লা দিন।
উনি কিছুই বুঝলেন না। ফ্রান্সিস এবার উনুন দেখে উনুনের নীচে জমে থাকা কাঠকয়লা দেখলো। এবার উনি বুঝলেন। উনুনের নীচ থেকে কিছু কাঠকয়লা এনে ফ্রান্সিসকে দিলেন। উনি বুঝতে পারলেন না এখন এই বিকেলে কাঠকয়লা দিয়ে ফ্রান্সিসরা কী করবে।
ফ্রান্সিস হ্যারির কাছে এল। কিছুক্ষণের মধ্যে মুঠো মুঠো কাঠকয়লা এনে ফ্রান্সিসকে। দিলেন। উনি বুঝতে পারলেন না এখন এই বিকেলে কাঠকয়লা দিয়ে ফ্রান্সিসরা কী করবে।
ফ্রান্সিস হ্যারির কাছে এল। কিছুক্ষণের মধ্যে মুখে কাঠকয়লা ঘষল। মুখটা কালো গুঁড়ো দেখতে লাগল। এইভাবে গায়ের রঙ লুকিয়ে বাইরের রাস্তায় এলো। বাড়িগুলোর আড়ালে আড়ালে উত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে চলল। জানতে হবে রাজা মুজার্তা কোথায় আশ্রয় নিয়েছেন। অবশ্য এখন সেটা জানা খুব মুশকিল। বলা যায় অসম্ভব। কোথায় এখন আত্মগোপন করলেন সেটা আগে জানতে হবে।
ফ্রান্সিস চলেছে। এখান থেকে ওখান থেকে মানুষের গোঙানি চিৎকার কান্না সবই শুনতে পারছিল। হঠাৎ দেখল দুতিনজন রাজা মুজাৰ্তার সৈন্য পালিয়ে গেল। ফ্রান্সিস বলল বোঝাই যাচ্ছে রাজাকে না দেখে ওরা ভীত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় একমাত্র রাজাই ওদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
একটা বিরাট গাছের কাছে এল। নীচেটা পাথর বাঁধানো। ফ্রান্সিস বসল বাঁধানো পাথরে। ওর মন বলল ও নিরাপদে নেই। এই কথাটা ভাবতে ভাবতেই দুজন রাজা জুদেবার সৈন্য গাছের আড়াল থেকে ফ্রান্সিসের সামনে এল। কাঠকয়লা মাখা মুখ দেখে ওরা বুঝে উঠতে পারল না লোকটা কোন দেশের। একজনের হাতে বর্শা, অন্যজনের হাতে ছোরা। বর্শাধারী সৈন্যরা ওদের ভাষায় বলল–তুমি কে? কোত্থেকে এসেছো?
ফ্রান্সিস দুই কান মুখ দেখাল। বোঝালো বোবা। কানেও শুনতে পায় না। সৈন্যদের কেমন মনে হল ফ্রান্সিস কালোদেশের লোক। ফ্রান্সিসনানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করল– ও অন্য দেশ থেকে এসেছে। বর্শাধারী বলল–এখন এই দেশে যুদ্ধকালীন অবস্থা চলছে। এর মধ্যে তুমি এসেছো কেন? ফ্রান্সিস কিছুই বুঝল না। জোরে মাথা নাড়তে লাগল। বর্শাধারী যোদ্ধাটি এবার ফ্রান্সিসকে মেরে ফেলতে চাইল। ও ওর দুচোখ দেখে ফ্রান্সিস সেটা বুঝতে পারল। ফ্রান্সিস সজাগ হল। সৈন্যটি বর্শার ফলাটা ফ্রান্সিসের বুক লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। ফ্রান্সিস দ্রুত সরে গিয়ে বর্শার হাতলের দিকটা ধরে ফেলল। ফ্রান্সিস স্পেনীয় ভাষায় বলল–তুমি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে। কাজেই তোমাকে ছাড়া হবে না। এইবার মর। তখন ফ্রান্সিসের চোখ দুটো জ্বলে উঠল। বর্শাটা ধরে সৈন্যটির বুক লক্ষ্য করে বর্শাটা ছুঁড়ল। যোদ্ধাটি লাফিয়ে উঠল। বর্শাটা ওর পেটে ঢুকে গেল। সৈন্যটি কাতরাতে কাতরাতে বর্শাটা টেনে বের করতে গেল। কিন্তু বর্শা বের করতে পারল না। বর্শাটা ধরে ও মাটিতে পড়ে গেল।
এবার বড় ছোরা হাতে অন্য সৈন্যটি ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস দ্রুত সরে গেল। সৈন্যটি ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস দ্রুত সরে গেল। সৈন্যটি ফ্রান্সিসকে ধরতে পারল না। মাটিতে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস ওর ছোরাসুদ্ধ হাতটা পা দিয়ে চেপে ধরল। সৈন্যটি ছোরাটা বের করার জন্যে চেষ্টা করতে লাগল। সৈন্যটি এপাশ ওপাশ করতে লাগল। ফ্রান্সিস অতি দ্রুত ছোরাটা বের করল। তারপর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করল না সোজা সৈন্যটির গলায় বসিয়ে দিল। সৈন্যটি চিৎকার করে উঠল। তারপর ও আর কোন শব্দ করতে পারল না। তারপর হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস ছোরাটা কোমরে গুঁজল। বর্শাটা হাতে নিল। চলল পাহাড়ের নীচের প্রান্তরটার দিকে। হঠাৎ দেখল রাজা জুদেবার একদল সৈন্য আসছে। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় গাছের আড়ালে চলে এল। সৈন্যরা চলে গেল। ফ্রান্সিস এবার হ্যারির কাছে চলে এল।
হ্যারি চুপ করে শুয়েছিল। ফ্রান্সিস একটু উদ্বিগ্ন হল। বলল–এখন তোমার শরীর কেমন?
–এখনো একেবারে সুস্থ নই। শরীরের দুর্বলতাটা আছেই। হ্যারি বলল।
–তুমি বিশ্রাম করো। ফ্রান্সিস বলল। তারপর সেই দুই সৈন্যের কথা বলল। পিরেল্লো চুপ করে বসেছিল। এবার বললো–যাক দুটোকে তো মেরেছেন। এভাবেই ওদের মারতে হবে।
সেদিন বিকেলেই বাড়ির কর্তা একটা শস্যটানার গাড়ি নিয়ে এল। শাঙ্কো আর হ্যারি তৈরিই ছিল। দুজনে গিয়ে গাড়িটার কাছে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস তখন পিরেল্লোকে নিয়ে এল। বলল–এই দু’জন যাবে আলকাবার বন্দরে। পিরেল্লো বুঝিয়ে বলল সেটা। গাড়োয়ান মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল সে বুঝেছে। সেই সঙ্গে বলল–বড় দূর।
–তোমাকে একটা সোনার চাকতি দেব। শাঙ্কো বলল।
বেশ। গাড়োয়ান হাসল। ফ্রান্সিস বলল শাঙ্কো এই গাড়িটা ছেড়ে দিও না।
আলকাবা থেকে গাড়ি জোগাড় করে এই গাড়িটিকেও নিয়ে চলে এসো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি খুব চিন্তায় থাকবো।
পিরেল্লো বলল, গাড়োয়ানকে বলুন কিছু খড় জোগাড় করে আনতে। পিরেল্লো গাড়োয়ানকে বলল সেটা। গাড়োয়ান গাড়ি থেকে নেমে এল। একটু পরেই একগাদা খড় নিয়ে এল। সেই খড় গাড়ির ভেতরে বিছিয়ে দিল। শাঙ্কো কিছুটা খড় তুলে একপাশে বেশি করে রাখল। বলল হ্যারি তুমি এখানে বসো। হ্যারিতাই বসল। শাঙ্কো গাড়ি ছেড়ে দিতে বলল। গাড়োয়ান কিছুই বুঝল না। শাঙ্কো হাত নেড়ে বোঝাল। গাড়োয়ান গাড়ি ছেড়ে দিল।
ঘরে ফিরে ফ্রান্সিস বিছানায় বসল। গৃহকর্তা ভেতরে চলে গেল। অনেক চিন্তা এখন ফ্রান্সিসের মাথায়। সবচেয়ে বড় চিন্তা হ্যারির জন্যে। শস্যটানা গাড়িতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেতে খেতে যাওয়া যারিনা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপর লড়াইয়ের চিন্তা। রাজা জুবেদার সৈন্যরা ভালো যোদ্ধা কিনা। রাজা জুবেদা মানুষটাই বা কেমন। শেষ কথা হল একটাই– রাজা জুবেদার সৈন্যদের হার স্বীকার করতে হবে। এখন শুধু প্রতীক্ষা–ভাইকিং বন্ধুদের জন্যে।
বাড়ির কর্তা ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢুকল। বলল–আমাদের রাজা হেরে গেলেন–এটা যে কী বেদনার আমি বলে বোঝাতে পারবো না।
ফ্রান্সিস বলল–আচ্ছা, রাজা মুজার্তা কোথায় আত্মগোপন করেছেন?
কী হবে তা শুনে। আপনারা তো মাত্র তিনজন। গৃহকর্তা বলল।
–অপেক্ষা করুন তিনজন তিরিশজন হবে। আপনি আমাকে রাজা মুজার্তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারেন?
কী হবে রাজার সঙ্গে কথা বলে। গৃহকর্তা বলল।
–সব ব্যাপারেই আপনি এত হতাশ হয়ে পড়ছেন কেন? ফ্রান্সিস বলল। রাজা জুবেদা আজকে জিতেছেন। সময় এলে আমরা পরের লড়াইয়ে জিতবো। ফ্রান্সিস বলল।
জানি না আপনি কী করে যুদ্ধে জেতার আশা করছেন। গৃহকর্তা বলল।
সেসব পরে দেখা যাবে। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন।
রাজা কোথায় আত্মগোপন করেছেন? ফ্রান্সিস আবার বলল।
–এক অমাত্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। গৃহকর্তা বললেন।
–আপনি তো অমাত্যের বাড়ি চেনেন। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–চিনি বৈকি। রাজার চিঠি ফরমান এসবঅমাত্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার কাজ। গৃহকর্তা বললেন।
–তাহলে আমাকে নিয়ে চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। একটু রাত হোক। গৃহকর্তা বলল।
–বেশ। আমাকে ডাকবেন। ফ্রান্সিস বলল।
রাত গভীর হল। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। ও তখন ভাবছে কখন ভাইকিং বন্ধুরা আসবে। জোরদার লড়াই হবে। রাজা জুবেদার সৈন্যরা শুধু বর্শা হাতে লড়াই করবে। একবার বর্শাটা ছুঁড়লেই সৈন্যদের হাতে লড়াই করার অস্ত্র থাকবেনা। তখন অতি সহজে সৈন্যদের ধরে ফেলা যায়। তরোয়ালের কাছে ওরা তখন হার স্বীকার করতে বাধ্য।
বাড়ির কর্তা এল। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। শাঙ্কো ওর ছোরাটা রেখে গেছে। ফ্রান্সিস ছোরাটা কোমরে গুঁজে নিল। পিরেল্লো বলল–আমিও যাবো। ফ্রান্সিস বলল–দোভাষী হিসেবে আপনাকে যেতেই হবে।
আকাশে ভাঙা চাঁদ। চারদিক মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। তিনজনে হেঁটে চলল। একটা ইঁদারার কাছে এল ওরা। বাড়ির কর্তা ডানদিকে ঘুরে একটা বাড়ির সামনে এল। পাথর আর কাঠের বাড়ি। বাড়িটা বেশ বড়। চারদিকে ফুলের গাছ। বিচিত্র সব ফুল ফুটে আছে।
ওরা বড় দরজাটার কাছে এল। সাধারণ বাড়িটাড়ির থেকে অনেক ভালো। বেশ অর্থব্যয়েই বাড়িটা করা হয়েছে। গৃহকর্তা দরজায় কান রেখে দরজায় আঙুল দিয়ে খটখট শব্দ করল। সঙ্গে সঙ্গে দরজার একটা পাল্লা খুলে গেল। একজন প্রহরী মুখ বাড়াল। দুচোখ কুঁচকে সেই গৃহকর্তাকে দেখল। আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে গেল। ফ্রান্সিসরা ভেতরে ঢুকল। বেশ বড় ঘর। বাঁকা পাথরের চেয়ার। শ্বেতপাথরের টেবিল। একেবারে অন্ধকার ঘর। ঐ ঘরের পরে এল গৃহকর্তা। ফ্রান্সিসকে বলল–ভেতরের ঘরে আসুন।
ভেতরের ঘরে মোটা মোমবাতি জ্বলছে। সেই আয়নায় ফ্রান্সিস দেখল বাঁ দিকে। একটা খাট। রাজা মুজার্তা তার ওপর শুয়ে আছেন। ফ্রান্সিসরা ঢুকতে উনি পাশ ফিরে শুলেন। পিরেল্লো দুজনের কথা দোভাষীর মতো বুঝিয়ে দিতে লাগল।
-মাননীয় রাজা–আপনি কেমন আছেন। ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল।
–একজন রাজ্যহারা রাজা যেমন থাকে। রাজা বিষাদের সুরে বললেন।
–আপনি আবার রাজ্য ফিরে পাবেন। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা মুজার্তা একটু অবাক চোখে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকাল।
–হ্যাঁ–আপনি জয়ী হবেন। আমি ফ্রান্সিস বলছি। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা কিছুক্ষণ ওপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ফ্রান্সিস দেখল স্বল্প আলোয়–আর একটা খাটে রাণী শুয়ে আছেন। সঙ্গে শিশুপুত্র। ফ্রান্সিস বলল–মাননীয় রাজা আপনি ভেঙে পড়বেন না। মনে সাহস রাখুন। রাণীর কাছে এল। পিরেল্লোও এল। ফ্রান্সিস বলল–মাননীয়া রাণী–আপনি শক্ত থাকুন। দুশ্চিন্তা করবেন না। মাননীয় রাজা আবার তার রাজ্য ফিরে পাবেন। রাণী কোন কথা বললেন না। চুপ করে শুয়ে রইলেন।
গৃহকর্তার সঙ্গে ফ্রান্সিসরা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিসকে গৃহকর্তা বলল– একটা কথা বলি,
-বলুন, কর্তা বলল।
–আমার একত্রিশ জন বন্ধু কাল পরশুর মধ্যে এখানে আসবে। তাদের থাকা খাওয়ার ব্যাপারটা আপনি দেখবেন আমার অনুরোধ। ফ্রান্সিস বলল।
–তারা এখানে আসবে কেন? গৃহকর্তা জানতে চাইলেন।
–রাজা মুজাৰ্তার হয়ে লড়াই করবে। ফ্রান্সিস বলল।
তারা কি জুবেদার সৈন্যদের হারাতে পারবে? গৃহকর্তা সন্দেহ প্রকাশ করলেন।
–আমরা ভাইকিং। আমার বন্ধুরা যে কী দুর্ধর্ষ যোদ্ধা সেটা লড়াই দেখলেই বুঝবেন। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে রাজা মুজার্তার মুক্তির আশা আছে। পিরেল্লো বলল।
–নিশ্চয়ই আছে। ফ্রান্সিস কথাটা জোর দিয়ে বলল।
–আপনার কথা শুনে আমি আশ্বস্ত হলাম। এই রাজাকে আমরা শ্রদ্ধা তো করিই বড় ভালোবাসি। গৃহকর্তা বলল।
পরের সারাটা দিন ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে রইল। বাড়ির কর্তা দু-তিনবার এসে জানতে চাইল–আপনার শরীর ভালো তো?
–আমি ভালো আছি। একখানা তরোয়াল হাতে পেলে আমি এক্ষুনি লড়াইয়ে নামতে পারি। ফ্রান্সিস দাঁত চেপে কথাটা বলল।
–তরোয়াল কী? গৃহকর্তা জানতে চাইল।
–একটা যুদ্ধাস্ত্র। এই অস্ত্রটি আমাদের হাতে থাকলে আমাদের পরাস্ত করা অসম্ভব। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনারা এই তরোয়াল দিয়ে লড়াই করেন? গৃহকর্তা জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। ঐ অস্ত্রটা দিয়েই আমরা শত্রুদের পরাস্ত করি। ফ্রান্সিস বলল।
পরের সারাটা দিনফ্রান্সিসঘর থেকে বেরুলোনা। রাজা জুবেদার সেনাপতিরাজামুজার্তার প্রজাদেরনাচ-গান-বাজনা করতে আদেশ দিয়েছিল। কিন্তু প্রজারা রাজি হয়নি। কথাটা ফ্রান্সিস গৃহকর্তার মুখে শুনল। ফ্রান্সিস বলল–এটা ঠিক কাজ হল না। আপনি রাজার অনুমতি নিয়ে প্রজাদের গানবাজনা করতে বলুন। এসব করলে রাজা জুবেদার সৈন্যরা অলস হয়ে পড়বে। ওরা নিশ্চিন্তে থাকবে। ওরা বুঝেযাবে যে আরলড়াই করতে হবেনাআমি এটাইচাইছি। ওদের মধ্যে আর শৃঙ্খলা থাকবে না। আমাদের লড়াই করতে সুবিধে হবে।
–দেখি। বলে বাড়িরকর্তা চলে গেল। ফ্রান্সিস এক গ্লাশ জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল।
সন্ধ্যের সময় ফ্রান্সিস শুনল বাইরে বাজনার সঙ্গে নাচগান শুরু হয়েছে। ফ্রান্সিস আপন মনে হাসল। বুঝল বাড়ির কর্তা কাজটা করতে পেরেছে। এবার যুদ্ধের জন্যে প্রতীক্ষা।
ফ্রান্সিস মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে এসে অপেক্ষা করল। ও পায়চারি করতে লাগল। বনের ওপরের আকাশটা পূবদিকে লাল হল। কিছুক্ষণ পরে সূর্য উঠল। ফ্রান্সিস সারারাত ঘুমোতে পারল না।
সকালেও বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ বনের পাশের রাস্তার ওপর। কিন্তু বন্ধুদের দেখা নেই।
ফ্রান্সিস পেটপুরে দুপুরের খাবার খেল। কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর উঠে বসল। বাড়ির বাইরে এল। তাকিয়ে রইল দূরের রাস্তার দিকে।
হঠাৎ দেখলধুলো উড়িয়ে তিনটেশস্যটানা গাড়ি আসছে। ফ্রান্সিস সেইদিকে ছুটল।
গাড়িগুলোর কাছে এল। বন্ধুরা ধ্বনি তুললও-হো-হো। ফ্রান্সিস দুহাত ওপরে তুলে ও বন্ধুদের ধ্বনি থামাতে বলল। বন্ধুরা এবার চুপ করল। বন্ধুরা গাড়ি থেকে নামল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে চলল বাড়িটার দিকে। বাড়ির কাছে এসে বিস্কোকে বলল–তোমরা খাবে তো?
না না, আমরা এক সরাইখানায় খেয়ে এসেছি। বিস্কো বলল।
বাঁচালে। তোমাদের এতজনের জন্যে রান্না করতে বলবো ভেবেছিলাম। কিন্তু বাড়ির কর্তাকে রাঁধতে বলিনি। এত রান্না হবে। তোমরা না এলে সব নষ্ট হবে। ঘরের কাছে এসে ফ্রান্সিস বলল–আপাতত এই ঘরেই ঠেসেটুসে বসো। বেশি শব্দ করবে না। তোমাদের কথা কেউ যেন জানতে না পারে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির কর্তা আসবে। তোমাদের আসার জন্য কর্তাকে বলেছি। উনি ভঁড়ার ঘর খালি করে দেবেন। তাতে অনেকেই থাকতে পারবে। ঘরে ঢুকে কয়েকজন শুয়ে পড়ল। বাকিরা কেউ কাঠের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। ফ্রান্সিস ঘরটায় ঢুকল। বলল-শাঙ্কোর মুখে সব শুনেছো তোমরা। নৃশংস রাজা জুবেদা এখানকার রাজা মুজার্তাকে হারিয়ে রাজবাড়ি দখল করে বসে আছে।
রাজা মুজার্তার মতো এমন সহৃদয় প্রজাবৎসল রাজা আমি দেখিনি। এখন রাজা জুবেদার সঙ্গে আমাদের লড়াই করতে হবে। আমরা সৈন্যসহ রাজা জুবেদাকে দেশ থেকে তাড়াবো। এবার বলো কখন আক্রমণ শুরু করতে চাও? ভাইকিং বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। কিছু পরে বিস্কো বলল,
–ফ্রান্সিস আমরা রাতের বেলা রাজবাড়ি ঘিরে ফেলবো। তখন রাজার সৈন্যরা লড়াই করতে আসবে। তখন লড়াইও হবে। রাজা জুবেদার সৈন্যরা তখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকবে।
–আমার এতে আপত্তি নেই। ফ্রান্সিস বলল।
এরমধ্যে গৃহকর্তা এলো। ভাড়ার ঘর থেকে মালপত্র সরিয়ে ফ্রান্সিসদের থাকার ব্যবস্থা করে দিল। দুটো ঘর পাওয়ায় শোয়া বসার জায়গা পাওয়া গেল।
ফ্রান্সিস গৃহকর্তাকে ডাকল। বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর কর্তাকে বলল–রাজা মুজাৰ্তার খবর কী?
–চুপ করে বসে থাকেন। কারো সঙ্গে কথা নেই। মাঝে মাঝে ফুঁপিয়েও ওঠেন। তখন রাণী সান্ত্বনা দেন। এভাবেই রাজার দিন কাটছে। গৃহকর্তা বলল।
আমাকে রাজা মুজার্তার কাছে নিয়ে চলুন। রাজার সঙ্গে কিছু কথা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনাকে তো বাড়িটা চিনিয়ে দিয়েছি। গৃহকর্তা বলল।
–বাড়ি চিনি। কিন্তু প্রহরীরা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। আমাকে তো ওরা চেনে না। তার ওপর আমি বিদেশী। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। চলুন যাওয়া যাবে। গৃহকর্তা বলল।
–পরে নয়, আজকেই সন্ধ্যের সময় যেতে হবে। পরে অনেক কাজ আছে আমাদের। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনারা কি রাজা জুবেদার সৈন্যদের আজকেই আক্রমণ করবেন? গৃহকর্তা জানতে চাইল।
হ্যা। কাজ সেরে আমাদের জাহাজে ফিরে যেতে হবে।
গৃহকর্তা মাথাটা এপাশ ওপাশ করল। বলল–আপনারা কি পারবেন?
–অবশ্যই পারবো। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। তাহলে সন্ধ্যের সময় যাবো। আমাকে ডেকে নিয়ে যাবেন। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। গৃহকর্তা চলে গেল। বিস্কো বলল–ফ্রান্সিস আমিও তোমাদের সঙ্গে যাবো।
–সে যেও। এবার পিরেল্লো এগিয়ে এল। বলল–আমিও যাবো।
–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস বলল।
সন্ধ্যের সময় গৃহকর্তা এলো। ফ্রান্সিসকে বলল–
–আপনি তৈরি তো?
–অবশ্যই। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনাদের জন্যে তিনটি রাঁধুনি এনেছি। গৃহকর্তা বলল।
–সে তো বটেই। এতজনের রান্না একা আপনার স্ত্রীর পক্ষে অসম্ভব।
–বেশ। গৃহকর্তা বলল।
–রাধুনিকে আমরা কিছু পারিশ্রমিক দেবো। ফ্রান্সিস বলল।
এবার চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
চারজন রাস্তায় নেমে চলল উত্তরমুখো। ওদিকেই অমাত্যের বাড়ির দিক।
এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। ধুলো উড়ছে। আকাশে চঁদ আছে। অস্পষ্ট গঁদের আলো ছড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস ভাবলো–মোটামুটি চাঁদের আলো পাওয়া যাবে। এতে লড়াই চালাতে সুবিধেই হবে।
চারজনে অমাত্যের বাড়িতে পৌঁছল। পিরেল্লো দরজার টোকা দিল। দরজা খুলে দিল।
ফ্রান্সিসরা ভেতরে ঢুকল। গৃহকর্তার পেছনে পেছনে ফ্রান্সিসরা রাজার শোয়ার ঘরে এল। মোমবাতিরআলোয় দেখল রাজা মুজাৰ্তা চুপ করে বিছানায় বসে আছেন ফ্রান্সিসদের মুখ তুলে দেখলেন। কোন কথা বললেন না। ফ্রান্সিস একটু মাথা নুইয়ে দিল। তারপর বলল–আপনাকে একটা শুভসংবাদ দিচ্ছি। আমার বীর যোদ্ধা বন্ধুরা এসেছে। রাজা জুবেদাকে আমরা হারাতে পারবো। আমাদের দু’একজন বন্ধু যুদ্ধে মারা যেতে পারে আহত হতে পারে। তবুও আপনাকে আপনার রাজ্য ফিরিয়ে দিতে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
রাজা মুজার্তা কিছু বললেন না।
মাননীয় রাজা আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। ফ্রান্সিস বলল–এবার আপনার কাছে জানতে চাইছি যুদ্ধে রাজা জুদেবার পরাজয় ঘটলে আপনি কী চান?
–কী আর চাইবো। তিনি বেঁচে থাকা সৈন্যদের নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে যাবেন। রাজা বললেন।
-যদি বলি আমরা রাজা জুবেদাকে হত্যা করতে পারি। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা মুজার্তা চমকে উঠলেন। দুহাত নেড়েবললেন-না-না। তার মৃত্যু আমি চাইনা।
–রাজা জুবেদা কিন্তু নির্মম নিষ্ঠুর হিংস্র। ফ্রান্সিস বলল।
–তবু আমি কখনও তার মৃত্যু চাইনা। রাজা মুজার্তা বললেন।
-ও কিন্তু আপনাকে খুঁজে পেলে বন্দী করতে পারে, আপনাকে হত্যা করতে পারে। ফ্রান্সিস বলল
–তা হোক। তবুও আমি ওর মৃত্যু চাইনা। রাজা বললেন।
-বেশ। তা হলে আমি স্থির করলাম–রাজা জুবেদাকে এবং সৈন্যদের হাত বেঁধে তার রাজ্যের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেব। তারপর তারা যেখানে খুশি যায় যাক। ফ্রান্সিস বলল।
–তাই করুন। আমিও এটাই চাই। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস বলল–বেশ। তাই করবো।
হঠাৎ বাইরের দরজার কাছ থেকে দরজা ধাক্কা দেবার শব্দ হল। কারা গলা চড়িয়ে বলছে–দরজা খোলো। বাড়ির মালিক অমাত্য ভেতরের ঘর থেকে ছুটে এলেন।
রাজা বললেন অমাত্যকে–বোধহয় রাজা জুবেদার সৈন্যরা আমার খোঁজ পেয়েছে। তাই আমাকে বন্দী করতে এসেছে।
দেখছি–দেখছি। অমাত্য চলে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল বর্শা উঁচিয়ে দুজন সৈন্য এই ঘরের দিকে আসছে। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–বিস্কো।
বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে বুকের কাছে হাত ঢুকিয়েওর ছোরাটা বেরকরল। অমাত্য ছুটে ঐ দুজন সৈন্যের দিকে এগোলেন। একজন সৈন্য বর্শা নামিয়ে অমাত্যের বুকলক্ষ্য করেছুঁড়ল। বর্শা অমাত্যর বুকে বিঁধে গেল। অমাত্য বর্শাটা ধরে মাটিতে পড়ে গেলেন। বর্শাটা ঐ সৈন্যের হাতছাড়া হল। ফ্রান্সিস ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওর চোয়াল লক্ষ্য করে ঘুষি চালাল। সৈন্যটি ছিটকে মেঝেয় পড়ে গেল। অন্য সৈন্যটি বর্শা হাতে এগিয়ে এল। বিস্কো দ্রুত ছুটে গিয়ে ঐ সৈন্যটির বুকে ছোরা বিধিয়ে দিল। সৈন্যটির মুখ থেকে অক্ শব্দ বেরিয়ে এল। ও মেঝেয় পড়ে গেল।
ওদিকে ফ্রান্সিস ঐ সৈন্যটির কানের ওপর চোয়ালে কপালে ঘুষি চালাতে লাগল। সৈন্যটি কাটা কলাগাছের মতো ধপ করে মেঝেয় পড়ে গেল। সৈন্যটি জ্ঞান হারালো।
ফ্রান্সিস অমাত্যের বুক থেকে বর্শাটা খুলে নিল। বলল–বিস্কো। এই দুটোকে বাড়ির বাইরে ফেলে দিতে হবে। হাত লাগাও। দুজনে একটা একটা করে দুটো সৈন্যকে বাড়ির বাইরে নিয়ে এল। অস্পষ্ট আলোয় দেখল রাস্তার পাশেই একটা জলা। দুজনে একটা সৈন্যকে হাতে আর পায়ে ধরে ঝুলিয়ে দুপাশে দোলাতে দোলাতে ছুঁড়ে জলায় ফেলে দিল। সমুদ্রে এই রীতিতেই মৃতদেহ ফেলা হয়। অন্যটিকেও সেইভাবে ফেলল। অমাত্যের বাড়িতে এল। বাড়ির অন্দরমহল তখন কান্নার রোল উঠেছে।
ফ্রান্সিস রাজা মুজার্তার কাছে এসে বলল-আমরা যাচ্ছি কাল সকালে রাজা জুবেদা তার সৈন্যদল নিয়ে আপনার রাজত্ব ছেড়ে চলে যাবে।
–আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে। সে সময় আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–না-না।
পিরেল্লো এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ফ্রান্সিস তাকে ডাকল।
ফ্রান্সিসরা অমাত্যর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। বন্ধুদের কাছে এসে অমাত্যের বাড়ির ঘটনাটা বলল। সবাই উৎসাহিত হল।
রাতের খাবার একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে নিতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে বসে বিশ্রাম নিয়ে আমরা রাজবাড়ি আক্রমণ করবো। একটু অন্যরকম লড়াইহবে। ওরা লড়বে বর্শা দিয়ে আমরা লড়বো তরোয়াল দিয়ে। এরা জীবনে কখনো তরোয়াল দেখেনি। কাজেই ওই তরোয়াল দিয়ে কীভাবে লড়ে এসম্মন্ধে এদের কোনো ধারণাই নেই। ফ্রান্সিস বলল। হঠাৎ একটা চিন্তা ওর মাথায় এল। রাজা মুজার্তার তো সৈন্যদল নিশ্চয়ই আছে।
ফ্রান্সিস পিরেল্লোর দিকে তাকাল। বলল–পিরেল্লো–রাজা মুজার্তার তো সৈন্যবাহিনী ছিল। সেই সৈন্যরা এখন কোথায়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
মা মেরিই জানে। কোথায় কোথায় লুকিয়ে আছে। বাইরে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। পিরেল্লো বলল।
–আপনি এক্ষুণি রাজা মুজার্তার কাছে যান। তিনিই হয়তো তার সৈন্যদের খোঁজ দিতে পারতেন। ফ্রান্সিস বলল।
মনে হয় না। রাজার এখন যা অবস্থা। আসলে রাজা মুজার্তার সৈন্যরা সংখ্যায় খুবই কম। রাজা তো যুদ্ধবিগ্রহের কথা ভাবতেনই না। পিরেল্লো বললেন।
এটা ভুল। রাজত্ব রাখতে গেলে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী সৈন্যবাহিনী রাখতে হয়। উনি নিজে যুদ্ধ চান না। ভালো কথা। কিন্তু অন্যদেশের শাসক যে কোন মুহূর্তে তার রাজত্বের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এজন্যে আগে থেকে তৈরি থাকা উচিত।
–আসলে রাজা মুজার্তা এত সব ভাবতেন না। পিরেল্লো বললেন।
যাক গে। আপনি সৈন্যদের খোঁজ কী করে পাবেন তা জেনে আসুন। আমাদের খেতে বসার আগে আপনি চলে আসবেন। ফ্রান্সিস বললেন।
পিরেল্লো চলে গেলেন। ভাইকিংরা নিজেদের মধ্যে শুয়ে বসে গল্পটল্প করতে লাগল।
পিরেল্লো অমাত্যের বাড়িতে পৌঁছল। চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় দেখল বাড়ির সামনে তিনচারজন যোদ্ধা। বোঝাই যাচ্ছে ওরা রাজা জুবেদার সৈন্য।
পিরেল্লো তাদের সামনে এলো। প্রধান দরজার দিকে চলল। যোদ্ধারা হাত তুলে পিরেল্লোকে আটকাল। পিরেল্লো বললেন–আমি রাজপুরোহিত। রাজা মুজার্তার সঙ্গে দেখা করব। দরকারি কথা আছে। দলনেতা নাকেমুখে শব্দ করল। তারপর বলল,
–রাজা মুজাৰ্তা আর কতক্ষণ বেঁচে থাকবে। কাল সকালেই ফাঁসি দেওয়া হবে বাজারের সামনে ফাঁসিকাঠে।
–ঠিক আছে। তার আগেই আমাকে কথাটা বলতে হবে। পিরেল্লো বললেন।
–এখন কী কথা? একজন সৈন্য বলল।
আছে–আছে–আপনারা বুঝবেন না। পিরেল্লো বলল।
বেশ যান। শুনে রাখুন আমাদের কোন ক্ষতি করার যদি চেষ্টা করেন–তাহলে আপনাকে মরতে হবে। সৈন্যটি বলল।
–ঠিক আছে। পিরেল্লো মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে চলল।
পিরেল্লো বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। রাজার কাছে এলেন। রাজা শুয়েছিলেন। পিরেল্লোকে, দেখে উঠে বসলেন। ম্লানমুখে হেসে বললেন–পিরেল্লো শেষ রক্ষা হলো না।
–আপনি একেবারে দুশ্চিন্তা করবেন না। পিরেল্লো বললেন। তারপর গলা নামিয়ে বললেন–ভাইকিংরা দুঃসাহসী, লড়াইয়ে অপরাজিত। দেখবেন আপনি কালকেই মুক্তি লাভ করবেন।
–দেখি। রাজা মৃদুস্বরে বললেন।
মাননীয় রাজা আপনার কাছে যেজন্য এসেছি সেটা বলি। তারপর পিরেল্লো ফিসফিস করে বলল–আপনার সৈন্যরা সব কোথায়?
–সবার কথা তো বলতে পারবো না–রাজা গলা নামিয়ে বললেন–ওরা বেশির ভাগই বনের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে।
–বনে কীভাবে আছে? পিরেল্লো বললেন।
বনের মধ্যে আমার একটা সুতাকল আছে। বাড়িটা আমাদেরই তৈরি। বেশ বড় বাড়ি। সুতাকলের কর্মীরা থাকে। সেখানে আমার সৈন্যরা আশ্রয় নিয়েছে। রাজা বললেন।
–তাহলে ঐ সূতাকলের বাড়িতেই ওদের পাবো। পিরেল্লো বললেন।
–হ্যাঁ, কিন্তু ওদের কেন? রাজা জানতে চাইলেন।
–ওরা তো সৈন্য। লড়াই আরম্ভ হলে ওদের তো লড়তে হবে।
–ওরা কি পারবে লড়াইয়ে জিততে? রাজা বললেন।
–চেষ্টা তো করতে হবে। ভাইকিংরা আপনার কথা শুনেছে। ওরা আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করে। ওরা মনেপ্রাণে আপনার মুক্তি চায়। পিরেল্লো বলল।
রাজা মুখে শব্দ করলেন–হু। আর কোন কথা বললেন না।
পিরেল্লো বাড়ির বাইরে এলেন। চললেন বনের দিকে।
ফাঁকা প্রান্তরটায় তবুচাঁদের অস্পষ্ট আলো ছিল। এখানে একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। প্রায়ই গাছের মোটা শেকড়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে। পিরেল্লো চলল। কিন্তু কোথায় সেই বাড়িটা? আবার কয়েক পাক দিয়ে পিরেল্লো খুঁজতে লাগল।
হঠাৎ দেখল একটু ফাঁকায় বেশ বড় জন্তুর মত একটা লম্বাটে ঘর। পিরেল্লো দ্রুত পায়ে এসে বাড়িটার দোরগোড়ায় দাঁড়ালেন। কাঠের দরজায় আঙুল ঠুকলো। ভেতরে কোন সাড়া নেই। আবার শব্দ করল। দরজা খুলে গেল। বর্শা তুলে এক সৈন্য দাঁড়িয়ে। পিরেল্লো দুহাত ওপরে তুলে বললেন–আমি বন্ধু, শত্রু নই। যোদ্ধাটি বর্শা নামাল। বলল–আপনাকে আমরা চিনি। আপনি রাজা আনকহনার দেশের রাজপুরোহিত।
হা। এখন আর অন্য কথা নেই। শুধু লড়াইয়ের কথা। আরো কয়েকজন যোদ্ধা। ততক্ষণে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
পিরেল্লো বললেন আপনারা লড়াইয়ে হেরে গেছেন। এখানে লুকিয়ে আছেন। কিন্তু এখন আপনাদের লুকিয়ে থাকা চলবে না। আবার লড়াই করতে হবে। এই লড়াইয়ে যোগ দেবে কিছু ভাইকিং যোদ্ধা। জয় আমাদের হবেই। আপনারা তৈরি হয়ে নিন। তারপর আমাদের সঙ্গে চলুন। একজন যোদ্ধা মৃদুস্বরে বলল–নিশ্চয়ই যাবো।
–আপনি বসুন। একজন যোদ্ধা বলল।
পিরেল্লো একটা বস্তার ওপর বসলেন। বস্তাভর্তি তেলের বীজ। যোদ্ধারা তৈরি হল। তারপর ঘরের দরজার দিকে চলল। একজনকে চারদিক দেখার জন্য পাহারায় রাখল।
সবাই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। যে এখানে পাহারায় রইল সে দরজা বন্ধ করল।
— পিরেল্লোরা আধো আলো আধো অন্ধকারে ভেজা ভেজা বনের মধ্যে দিয়ে চলল সবাই। আবছা আলোর মধ্যে দিয়ে সবাই চলল ফ্রান্সিসদের ডেরার দিকে।
ফ্রান্সিসদের ডেরায় যখন সবাই এল তখন ফ্রান্সিসদের খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। ফ্রান্সিস রাজা মুজার্তার সৈন্যদের কাছে এল। বলল
-আপনাদের খাওয়া হয়েছে?
একজন সৈন্য বলল না। আমাদের তো খেতে দেরি হয়।
–ঠিক আছে। আমরা সব খাবার ভাগ করে খাবো। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস বিস্কো খেতে বসল না। খাবার পরিবেশন করতে লাগল। রুটি বুনো আলুর ঝোল শাকপাতা দেবার সময় ফ্রান্সিস বলল–কেউ দুবার চাইবেন না। রাজা মুজার্তার সৈন্যরা আমাদের সঙ্গে যাবে লড়াই করতে। তাদের জেন্যে তো রান্না হয়নি। কাজেই খাবার কম পড়ে গেছে। পেটপুরে খাওয়া হবে না। বেশি চাইবেন না। একটা কথা বলি–বেশি খেয়ে লড়াই করতে গেলে দ্রুত চলাফেরা করা যায় না। অল্প খাওয়ার জন্যে তোমাদের চলাফেরা দ্রুত হবে। তরোয়াল চালানো সহজ হবে। একদিক থেকে এই ভালো হল।
ভাইকিংরা খাওয়া শেষ করল। উঠে দাঁড়াল। এবার রাজা মুজার্তার সৈন্যরা খেতে বসল। তাদের সঙ্গে ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে বসিয়ে দিল।
খাওয়া চলল। বিস্কো ফ্রান্সিসের কাছে এল। গলা নামিয়ে বললেন–ফ্রান্সিস আমাদের দুজনের মত খাবার অল্প পড়ে আছে। কী করবে?
–এরা চাইলে দিয়ে দাও। ফ্রান্সিস বলল।
তার মানে–বিস্কো বলতে গেল।
–হ্যাঁ। উপবাস। ফ্রাসিস বলল।
সবার খাওয়া হল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল
—বলে লাভ নেই। তবু বলছি কেউ ঘুমিয়ে পড়বে না। রাজা মুজাৰ্তার সৈন্যদেরও বলছি কথাটা। সময় হলেই আমি ডাকবো।
ভাইকিংরা, সৈন্যরা শুয়ে বসে সময় কাটাতে লাগল।
ফ্রান্সিস আর বিস্কো পাশাপাশি বসেছিল। বিস্কো বলল–ফ্রান্সিস। আমাদের বন্ধুরা রাজা জুদেবার সৈন্যদের কীভাবে চিনবে?
–পোশাক দেখে আর গায়ের বাদামী রং দেখে। ফ্রান্সিস বলল।
–সেটা বন্ধুদের বলে দাও। বিস্কো বলল।
–তুমিই বলো। আমি একটু বিশ্রাম করবো। ফ্রান্সিস বললো।
বিস্কো উঠে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব আমরা রাজা জুবেদার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছি। সেই সৈন্যদের পরনে থাকবে জামার রঙ হলুদ আর চোঙের মতো প্যান্টের রঙ কালো। এটা আমি জেনেছি রাজপুরোহিত পিরেল্লোর কাছ থেকে। তাদের। গায়ের রং তামাটে। এসব দেখেই ওদের চিনবে। এসময় পিরেল্লো উঠে দাঁড়াল। বলল–
শাঙ্কো যা বলল সেটা রাজা জুবেদার সৈন্যদের পোশাক সম্মন্ধে। তোমরা অবশ্য সহজেই চিনবে।
ভাইকিংরা রাজা মুজার্তার সৈন্যরা কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। কেউ বসে রইল। তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে।
ফ্রান্সিস শুয়ে শুয়ে আক্রমণের নকশা ঠিক করছিল ও ভাবছিল–সদর দেউরি দিয়ে একদল ভাইকিং আর সৈন্যরা ঢুকবে। রাজবাড়ির পেছনে বিস্কো খিড়কির দরজা দিয়ে ভাইকিং, সৈন্যদের দিয়ে আক্রমণ করবে। যতক্ষণ রাজা জুবেদার সৈন্যরা হার স্বীকার না করবে ততক্ষণ লড়াই চলবে। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলতে লাগল–ভাইসব–আমার পরিকল্পনা শোন। একদল সদর দেউড়ির সৈন্যদের আক্রমণ করবে। অন্য দল রাজবাড়ির পেছনের খিড়কি দরজার প্রহরীদের আক্রমণ করবে। একসঙ্গে। দু’জায়গাতেই লড়াই হবে। রাজা জুবেদার সৈন্যরা পরাজয় স্বীকার করবে। ওরা হেরে যাবে এটা ঠিক। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–কিন্তু আসল লড়াই হবে এরপরে। ওরা রাজা মুজার্তার সৈন্যাবাস দখল করেছে। সেখানে রাজবাড়ি আক্রান্ত এই খবর ওদের দেওয়া হবে। তখন ওরা ছুটে আসবে। ঐ প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়াব আমরা। ওখানেই ওদের সঙ্গে আমাদের লড়াই হবে। শেষ লড়াই। তোমরা সেই আক্রমণের মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকো। একটু থেমে বলল–রাজবাড়ির পাহারাদাররা হয় মরেছে, আহত হয়েছে নয়তো পালিয়েছে। এখন রাজা বন্দী, রাজবাড়িও আমার কজায়। শেষ লড়াই। তোমরা তৈরি হও।
সূর্য উঠল। পূবের আকাশ লাল হয়ে গেছে। এখন সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারদিক আলোয় আলোময়।
জুদেবার সৈন্যরা ছুটে আসছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–আক্রমণ করো। ওদের একমাত্র অস্ত্র বর্শা। যে করেই হোক সেই অস্ত্র ওদের হাত থেকে ছাড়াতে হবে। তাহলেই ওরা নিরস্ত্র হয়ে পড়বে। খালি হাতে ওরা কী লড়াই করবে। অস্ত্র কাড়ো।
ফ্রান্সিসরা প্রান্তরে উঠে এল। সার বেঁধে দাঁড়াল।
জুদেবার সৈন্যরা ফ্রান্সিসদের ওপর বর্শা ছুঁড়ে মারল। ফ্রান্সিসরা বিদ্যুৎগতিতে সরে সরে গেল। বর্শাগুলো মাটিতে পড়ে রইল। অবশ্য দুজন-একজন ভাইকিং অন্যটি রাজা মুজার্তার সৈন্য আহত হল। ফ্রান্সিসরা কয়েকজন আহত যুবককে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে রাজবাড়িতে এক একটা ঘরে মেঝেয় শুইয়ে দিল।
ওদিকে প্রান্তরে লড়াই চলছে। জুবেদার সৈন্যরা বর্শা ছুঁড়তে লাগল। বর্শা হাতছাড়া হতেই তারা অস্ত্রহীন দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাইকিংরা তাদের তরোয়াল চালিয়ে আহত করতে লাগল। জুদেবার সৈন্যরা কখনও তরোয়ালের সঙ্গে লড়াই করে নি। ওরা হকচকিয়ে গেল। কীভাবে লড়বে তা বুঝে উঠতে পারল না।
লড়াই চলল। রাজা জুদেবার সৈন্যরা বিদ্যুৎগতিতে তরোয়ালের মার রুখতে পারল না। দলে দলে হার স্বীকার করতে লাগল।
বিকেলের দিকে জুদেবার সব সৈন্য হার স্বীকার করল। ওদের দড়িতে হাত বেঁধে রাজবাড়িতে নিয়ে আসা হল।
রাজা জুদেবা শয়নকক্ষে পালঙ্কের ওপর বসে রইলেন। পরাজিত অসহায় রাজা জুদেবা পিরেল্লোকে নিয়ে ফ্রান্সিসশয়নকক্ষে এল। পিরেল্লো বলললড়াইয়ের খবর জানেন তো?
–আন্দাজ করতে পারছি। আমার সৈন্যরা পরাজিত। জুদেবা বললেন।
–হ্যাঁ। বেশ কিছু সৈন্যকে বন্দী করা হয়েছে। ফ্রান্সিস বলল–এই রাজবাড়ির দেউড়িতে প্রহরীরা পেছনের খিড়কি দুয়ারের প্রহরীরা সবাই হেরে গেছে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে আমাকে তোরাজা জুদেবা বলতে গেল।
–এই রাজ্য থেকেবিদায় সঙ্গে আপনার সৈন্যদেরও বিদায় নিতে হবে। আর একটা কথা আপনাকেমুক্তির এষ্টা শর্তআছে। আপনি ভবিষ্যতে কোনদিন এই রাজ্য আক্রমণ করবেন না।
-বেশ। বেশ ভারি গলায় রাজা জুদেবা বলল।
–আপনাদের একটু পরেই রওনা হতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
না না। অন্ধকারে খুব অসুবিধে হবে। রাজা বলল।
না। আপনাকে একটু পরেই যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা রাতের খাবার খেয়ে-রাজা বলতে গেল।
–না। আপনাকে খেতে দেওয়া হবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–উপবাস?
–হ্যাঁ। পিরেল্লোর কাছে শুনেছি–আপনীনাকিনিরীহ প্রজাদের উপোসী রেখে তাদের তিলে তিলে মৃত্যু দেখতে ভালোবাসেন। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল বলুন–ঠিক কিনা।
– না মানে–অপরাধ করলে–রাজারা বলতে গেল।
–না। নির্দোষকেও হত্যা করে থাকেন। ফ্রান্সিস বলল। রাজা জুদেবা কোন কথা বলল না। তারপর বলল
–দুটো মশাল যদি
না। অন্ধকারে হেঁটে যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল–যা শুনেছি আপনী নিরীহ প্রজাদের অন্ধকার রাতে বনের মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেন। অন্ধকারে বনের মধ্যে গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে অনেকেই মারা যেত। তাছাড়া বন্য পশুদের আক্রমণ বা সাপের ছোবলে তারা মারা যেত। বলুন–ঠিক কিনা।
রাজা জুদেবা চুপ করে রইল। হয়তো বিনা অপরাধে প্রজাদের উপর যে অত্যাচার করেছে তার কথাই ভাবল।
রাতের খাওয়া শেষ হল। বিস্কো ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–ফ্রান্সিস এবার রাজা জুদেবা আর তার সৈন্যদের নিয়ে কী করবে?
–রাজা জুদেবা রাতে অন্ধকারে বনের মধ্যে দিয়ে ফিরে যেতে হবে। সৈন্যরাও রাজার– সঙ্গেই যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু সৈন্যদের কী দোষ? ওরা তো রাজার হুকুম তামিল করেছে। বিস্কো বলল।
–বেশ ওদের হাতের দড়ি কেটে দাও। ফ্রান্সিস বলল।
–সেটাই এখন করি তাহলে। বিস্কো বলল।
হা। যাও। ফ্রান্সিস বলল।
বিস্কো রাজা জুদেবার সৈন্যদের হাতে বাঁধা দড়ি কেটে দিল। তারপর প্রান্তরে নিয়ে এল। হাতের বাঁধন কাটা হয়েছে। ওরা এতেই খুশি। ওরা অন্ধকারে হেঁটে চলল। রাজা জুদেবাকে প্রান্তরে নিয়ে আসা হল। ফ্রান্সিস অন্ধকারে রাজার কাছে এসে বলল–নিন–পথে খাবেন। এই বলে দুটো আপেল রাজাকে দিল। রাজা নিল। তারপর তার দেশের দিকে পা বাড়াল।
রাজা জুদেবাকে সামনে রেখে তার সৈন্যরা চলল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ঐ বনের মধ্যে দিয়ে রাজাকে নিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু রাজা কি পারবেন? এই অন্ধকারে যেতে হবে। রাজা জুদেবার একজন সৈন্য বলল।
–তোমাদের রাজা নিরপরাধ প্রজাদের এইভাবেশাস্তি দিত। নিরপরাধ মানুষগুলোকে কী কষ্টে এই বনভূমি পার হতে হতো আজ তোমাদের রাজা সেই কষ্টটা ভোগ করুক। বুঝুক কষ্ট কাকে বলে। তোমাদের রাজাকেআমি রাতের খাওয়াও খেতে দিই নি। ফ্রান্সিস বলল। ফ্রান্সিস প্রান্তরে কিছুদূর পর্যন্ত রাজা জুদেবা আর তার পরাজিত সৈন্যদের সঙ্গে চলল বনের দিকে। বনের কাছাকাছি এসে ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর ফিরে চলল রাজবাড়ির দিকে। ওখানেই বন্ধুরা আছে।
ফ্রান্সিস রাজবাড়িতে ফিরে এল। দেখল বন্ধুরা সব ছড়িয়ে টড়িয়ে শুয়ে আছে। মোমবাতির আলোয় যা দেখল তাতে বুঝল কিছু ভাইকিং গৃহকর্তা ভদ্রলোকের বাড়িতে চলে গেছে।
ফ্রান্সিস রাজা মুর্তাজার শয়নকক্ষে এল। রাজার জাজিম বিছানো বিছানায় বন্ধুরা শুয়ে আছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বিস্কো বলে উঠল–এসো তোমার জন্যে জায়গা রেখেছি। ফ্রান্সিস বিস্কোর পাশে শুয়ে পড়ল। ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। বিস্কোর সঙ্গেও কথা বলতে ইচ্ছে করল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস সাধারণত ভোরেই ওঠে। সেদিন পারল না। উঠতে একটু বেলাই হল। উঠে দেখল রাজপুরোহিত পিরেল্লো ওর পাশেই বসে আছেন। ফ্রান্সিস উঠে বসল। তারপর ভেতরের ঘরে এসে হাতমুখ ধুল। দুহাত তুলে হাই তুলল। পিরেল্লোর কাছে এল। বলল
কিছু বলবেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। তারপর গলা নামিয়ে বলল–দেবতার মূর্তিগুলো বোঁচকায়–ফেরৎ দিন।
–উঁহু। রাজা কানবহনাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আমার সমস্ত পরিকল্পনাই মাঠে মারা গেল। পিরেল্লো বলল।
—-চোরাই মাল হাতছাড়া হয়ে গেল। ফ্রান্সিস বলল।
বিস্কো খাবার নিয়ে এল। তিনজনের জন্যেই আনল। বুনো আলু আর সজিপাতার ঝোল। সঙ্গে দুটো করে রুটি। তিনজনে খেতে লাগল।
–এখন কী করবে? বিস্কো বলল।
–সেকথাই ভাবছি কাল রাত থেকে। রাজা হানমের গুপ্তধনের কথা জেনেছি। কাজেই ঐ গুপ্তধন উদ্ধার করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
কী করে করবে? পিরেল্লো জানতে চাইল।
আগে তো রাজা হানমের মন্দিরে যাই। সব দেখিটেখি। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে সোনার মূর্তিগুলো ফেরৎ পাবোনা? পিরেল্লো বলল।
—না। ফ্রান্সিস বলল।
আমি-গুপ্তধন খোঁজার ব্যাপারে আপনাদেরসাহায্য করতে পারতাম। পিরেল্লো বলল।
ফ্রান্সিস হাসল। বলল–আপনি যদি ঐ ধনভাণ্ডারের খোঁজ জানেন তবে উদ্ধার করলেন না কেন?
–চেষ্টা করেছি। নানাভাবে। গুপ্তধন পাইনি। আরো চেষ্টা করলে পেয়ে যাবে হয়তো। পিরেল্লো বলল।
–তাহলে সেই চেষ্টাই করুন। আমরা চলে যাই। বিস্কো বলল।
–না না। এটা রাজা কানবহনা শুনলে আমি বিপদে পড়ে যাবো। পিরেল্লো বলল।
–তাহলে আর কথা না। গৃহকর্তার বাড়িতে যান। গৃহকর্তাকে দিয়ে তিনটে শস্যটানা গাড়ির ব্যবস্থা করুন। ফ্রান্সিস বলল।
ঠিক আছে যাচ্ছি। পিরেল্লো বলে গেলেন।
রাজা মুজার্তা রাণী ও পুত্রকে নিয়ে বিকেলে এলেন। শয়নকক্ষে ফ্রান্সিসদের দেখলেন। রানী ছেলেকে নিয়ে অন্তঃপুরে চলে গেলেন। পরিচারক পরিচারিকারা ফিরে এল। রাজবাড়িতেও সমস্ত দেশে আনন্দ উৎসব শুরু হল।
রাজা এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের ডানহাতটা ধরলেন। বললেন–আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ রইলাম। আপনাদের জন্যেই আমি সব ফিরে পেলাম। ফ্রান্সিস বলল–আপনি আপনার সব ফিরে পেয়েছেন এতেই আমি আনন্দিত।
–আপনারা কি আজকেই চলে যাবেন? রাজা জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ। বন্ধুরা জাহাজে চলে যাবে। আমরা কয়েকজন রাজা কানবহনার রাজধানীতে থাকবো কিছুদিন।
–আপনারা কয়েকজন থাকবেন কেন? রাজা জানতে চাইলেন।
ফ্রান্সিস একটু থেমে বলল–অতীতের রাজা হানমের গুপ্তধনের কথা তো শুনেছেন।
-হ্যাঁ। শুনেছি। রাজা বললেন।
–সেই গুপ্তভাণ্ডার আমরা উদ্ধার করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–পারবেন? রাজা একটু হতাশার সঙ্গেই বললেন।
–নিশ্চয়ই পিরবো। ফ্রান্সিস জোর দিয়ে বলল।
ফ্রান্সিসরা খেতে বসেছে তখনই পিরেল্লো দুটো ঘোড়ায় টানা গাড়ি নিয়ে এল। গাড়ি রেখে পিরেল্লো রাজবাড়িতে ঢুকল। খাওয়ার ঘরে ঢুকে দেখল ফ্রান্সিসরা খেতে বসেছে। ফ্রান্সিস গলা তুলে বলল–পিরেল্লো আপনি আসুন এখানে আপনার জন্যে জায়গা রেখেছি। পিরেল্লো এসে বিস্কোর পাশে বসল।
–কটা গাড়ি পেলেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
দুটো। তবে ঐ গৃহকর্তা বলেছেন আর একটা গাড়ি তিনি এনে রাখবেন। পিবেল্লো বললেন।
–তাহলে কোন সমস্যাই নেই। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসদের খাওয়া শেষ হল।
ফ্রান্সিস আর বিস্কো রাজবাড়ির বাইরে এল। দেখল ভাইকিং বন্ধুরা রাজবাড়ির বাইরের প্রান্তরটায় সবাই বসে আছে।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলতে লাগল–ভাইসব যে কাজের জন্যে আমাদের এখানে আসতে হয়েছিল সেই কাজ বলা যায় সুসম্পন্ন হয়েছে। এখন জাহাজে ফেরা। তোমরা গিয়ে জাহাজে উঠবে কিন্তু আমি আর বিস্কো যাবো না। এরপরেই রাজা কানবহনার রাজ্য। সেখানে রাজা হানমের গুপ্তধন খুঁজে বের করতে হবে। এই কাজ সেরে আমরা জাহাজে ফিরবো। ভাইকিং বন্ধুরা চুপ করে ফ্রান্সিসদের কথা শুনল। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–গাড়ি এসে গেছে। আমরা এক্ষুনি যাত্রা শুরু করবো। তবে আমাদের তিনটি গাড়ি পেলে ভালো হত। যে বাড়িতে আমরা ছিলাম তার কর্তা আর একটা গাড়ির ব্যবস্থা করবেন জানিয়েছেন। যাওয়ার পথে গাড়ি পেলেই আমাদের ঠাসাঠাসি করে আর যেতে হবে না। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–তাহলে এবার যাত্রা শুরু।
সব ভাইকিংরা গাড়ি দুটোয় উঠল। সবার জায়গা হল না। ওরই মধ্যে চাপাচাপি করে ভাইকিং বন্ধুরা জায়গা করে নিল। পিরেল্লোও ফ্রান্সিসের পাশে জায়গা করে নিল।
গাড়োয়ানের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–এবার চলল।
গাড়ি চলল। ভাইকিংরা ধ্বনি তুলল–ও–হো–হো। কাঠের চাকায় কাঁচ কোচ শব্দ তুলে গাড়ি দুটো চলল।
গাড়ি বেশ আস্তে আস্তে চলল। দু-একজন ভাইকিং বন্ধু গলা তুলে বলল-ও ভাই গাড়োয়ান–একটু তাড়াতাড়ি চালাও। একটু তাড়াতাড়ি চলেই আবার টিকির ঢিকির চলল।
প্রায় সন্ধ্যের মুখে ফ্রান্সিসরা সেই গৃহকর্তার বাড়ির সামনে এল। দেখল একটা শস্যটানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভাইকিংরা ধ্বনি তুলল–ও–হো–হো।
গৃহকর্তা বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিসের কাছে এসে বলল
আপনাদের জন্য গাড়ি আনিয়ে রেখেছি।
–অনেক ধন্যবাদ। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
বিস্কো ডাকল–ফ্রান্সিস।
–কী বলছো? ফ্রান্সিস ওর দিকে তাকাল।
–বলছিলাম এখন সামনে রাত। কোথায় থাকবো, খাবো। বরং এখানেই আমরা আশ্রয় নিই। থাকা-খাওয়া দুটোই জুটবে। কাল ভোরে বেরিয়ে পড়বো। বিস্কো বলল।
ফ্রান্সিস গৃহকর্তাকে বলল–এই রাতে গেলে রাতের খাওয়াদাওয়ার সমস্যায় পড়বে। আপনি যদি আমাদের মানে এই রাতটা
–অবশ্যই। আসুন–আসুন। গৃহকর্তা বলল।
রাতে ঐ বাড়িতেই ভাইকিংরা থাকল-খেল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে সবাই কমবেশি গা হাত কোমরের ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়ল।
হাত পায়ে ব্যথা নিয়েই রাত কাটাল ভাইকিংরা।
ভোর হল। ফ্রান্সিসের ঘুম ভাঙল। বন্ধুরা মুখটুখ ধুচ্ছে। নিজেও মুখ ধুয়ে এল। একটুপরেই সকালের খাবার দেওয়া হল। বাসি মোটা রুটিআর তরিতরকারী। খেতে খেতেবিস্কো বলল
–ফ্রান্সিস এখন কী করবে?
–আমরা দুজন বাদে তোমরা সবাই জাহাজে ফিরে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা হানমের গুপ্তধন খুঁজবে? বিস্কো বলল।
নিশ্চয়ই। ফ্রান্সিস বলল।
এবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস যদি কিছু না মনে কর তবে একটা কথা বলি।
-বলো। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি ভাবছি–মানে শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। এটা তো সবাইকে বলা যায়না। আমি জাহাজেই থাকবো। কয়েকটা দিন বিশ্রাম নেবো। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল–তুমি কি দেশে ফিরে যেতে চাও? শাঙ্কো চমকেগিয়ে বললনা, নাফ্রান্সিস। তোমার সঙ্গ আমি কোনমতেই ছাড়বো না। একটু থেমে বলল–আমি জাহাজে যাবো না।
না তোমার বিশ্রাম চাই। আমি বিস্কোকে নেব। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। কয়েকদিন বিশ্রাম না নিলে আমি পারবো না। শাঙ্কো বলল।
–ঠিক আছে। তুমি বিস্কোকে ডেকে দাও। ফ্রান্সিস বলল।
একটু পরে শাঙ্কো বিস্কোকে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর শরীর খারাপের কথা বলল। এটাই বলল শাঙ্কো বিশ্রাম নেবে। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।
–ঠিক আছে। তবে শাঙ্কোর ছোরা ছোঁড়ার হাত আমার নেই। ও নিখুঁত।
কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু এল ফ্রান্সিসের কাছে। বলল–দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে বিকেল নাগাদ রওনা দিতে চাই। ফ্রান্সিস মাথা এপাশ ওপাশ করল। বললনা। এখনই রওনা দেব।
–দুপুরে কোথায় খাব? একজন ভাইকিং বন্ধু বলল।
–যদি খাবারের ব্যবস্থা না করতে পারি তবে খাব না। ফ্রান্সিস বলল।
–রাতও তো হয়ে যাবে। একজন ভাইকিং বলল।
–হ্যাঁ তা তো হবেই। আমরা রাতেই গাড়ি চালাবো।
এবার যাওয়ার তোড়জোড় চলল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ভাইকিংরা গিয়ে গাড়িতে চড়ল। ফ্রান্সিস এ বাড়ির কর্তা ভদ্রলোককে কাছে আসতে বলল। ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। ফ্রান্সিস তার দু’হাতনিজের দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। বলল–আপনি আপনার স্ত্রী মেয়েকে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাবেন।
গাড়ি ভাইকিংদের নিয়ে চলল। ঝাঁকুনিও চলল। আজকে আর আগের দিনের মত কষ্ট হচ্ছে না। পাথরের টুকরো পাতা মাটির পথ। বোধহয় সেইজন্যেই।
অন্ধকার। কোনদিকে কোথাও আলোর চিহ্নমাত্র নেই।
হঠাৎ একটা মোড়ে কিছু মোমবাতির আলো দেখা গেল। কিছু দোকানপাট। ভাগ্যি বলতে হবে একটা সরাইখানাও পাওয়া গেল।
ফ্রান্সিস বিস্কোকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। দুজনে সরাইখানায় ঢুকলো। কয়েকটা টানা টেবিল মতো। তার ওপর জ্বলন্ত মোমবাতি রাখা। সরাইখানার মালিক এগিয়ে এল। কৃতার্থের হাসি হেসে বলল–আপনারা খাবেন?
– ফ্রান্সিস মোটামুটি বুঝল। মাথা ঝাঁকাল। তারপর মালিককে বাইরে নিয়ে এল। গাড়ি দেখিয়ে বলল–আমরা সবাই খাবো। মালিক ভাইকিংদের অন্ধকারে যতটুকু দেখল বুঝল এত লোকের খাবার তার নেই। সে বলল সে কথা। ফ্রান্সিস বিস্কোকে বলল–যাও শাঙ্কোর কাছ থেকে দুটো সোনার চাকতি নিয়ে এসো। বিস্কো চলে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সোনার চাকতি নিয়ে এল। দুটো চাকতিই মালিককে দিল। বলল-রান্না চড়ান। বুনো মুরগী কিনে আনুন। বুনো মুরগীর ঝোল আলু দিয়ে আর রুটি। কী? পারবেন তো? মালিক হাসল। বলল পারবো।
দোকানের মালিক তার দুই রাঁধুনিকে নিয়ে রান্নার আয়োজন করতে লাগল। গাড়ি থেকে কিছু ভাইকিং বন্ধু নেমে এল। দোকানে ঢুকল। লম্ফ টুলে হাত পা ছড়িয়ে বসল। গল্পটল্প চলল। এক বন্ধু ডাল-ফ্রান্সিস?
ফ্রান্সিস তার দিকে তাকাল। ভাইকিং বন্ধুটি বলল–মনে হয় কাল সকালের আগে খেতে পাবো না।
কী যে বলো। এদের পেশাই হল রান্না করা, পরিবেশন করা। ঠিক পারবে। দেখো। ফ্রান্সিস বলল।
সময় তো কাটাতে হবে। ভাইকিংরা কয়েকজন দল বেঁধে রাস্তার ওপর দাঁড়াল। হাততালি শুরু হল তারপর সেই সঙ্গে নাচ। ইয়া মোটা একবন্ধু গান ধরল। দেশের গান। কয়েকজন ভাইকিংওকে থামিয়ে দিল। বলল–অন্য গান গা। দেশের গান শুনলে ভষণ মনখারাপ করবে। মোটা গায়ক তাই সরু নাকি গলায় অন্য গান ধরল। গান আর হাততালির সঙ্গে নাচও চলল।
একসময় রান্না শেষ হল। সবাই দুড়দাড় ছুটে এল। লম্ফ টুলে সবাই বসতে পারল না। মালিক আর একটা লম্ফ টুল এনে দিল। তাতেও কুলোল না। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–দুতিনটে করে পাতা নাও। তারপর মাংসের ঝোল আটকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাও। ফ্রান্সিস আর কয়েকজন ভাইকিং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে লাগল।
ফ্রান্সিস যা আশঙ্কা করছিল তাই হল। মাংসের ঝোলে টান পড়ল। মালিক ফ্রান্সিসের কাছে এল। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল–মাংস তো শেষ। কী করি?
–কী আর করবেন। একটা দুটো মুরগী কাটতেই পারতেন।
–আর মুরগী ছিল না। সরাইওয়ালা বলল।
–হুঁ। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–মাংস কম পড়ে গেছে। শুধু রুটি খাও। একটু গুঞ্জন উঠল। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। গাড়োয়ান তিনজনকেও ফ্রান্সিস খেতে ডাকল।
আবার গাড়ি চলল অন্ধকারে।
ফ্রান্সিস আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ সাদাটে হয়েছে। পূর্বদিকে আকাশ লালচে হয়েছে।
একটু পরেই সূর্য উঠল।
ভোর ভোর সময়ে ওরা কানবহনার রাজ্যে পৌঁছল।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–গাড়ি থামাও। তিনটে গাড়িই থামল।
ফ্রান্সিস বিস্কো আর পিরেল্লোকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। গলা চড়িয়ে বলল –ভাইসব জাহাজে উঠে রাজকুমারীকে বলল যে আমি দিনকয়েকের মধ্যেই ফিরবো। আমার জন্যে যেন দুশ্চিন্তা না করে।
-ঠিক আছে। তুমি তাড়াতাড়ি কাজ সার। শাঙ্কো বলল। তারপর ওর বোঁচকাটা বিষ্ণোকে দিল। বলল–এই বোঁচকায় চোরাই মাল আছে। বেশ দামি। সাবধানে রাখবে। ফ্রান্সিস তোমায় সবকিছু বলবে।
শাঙ্কোদের গাড়ি চলে গেল।
ফ্রান্সিসরা ওদের ঘরের সামনে এল। ঘর তালাবন্ধ। ফ্রান্সিস পিরেল্লোর দিকে তাকাল। বলল–সেনাপতি মশাইকে একটু খবর পাঠাতে হয় যে আমরা এসেছি। ঘরের চাবিটাও
তো আনতে হয়।
যাচ্ছি। পিরেল্লো চলে গেল।
কিছু পরে একজন সৈন্যকে নিয়ে ফিরলেন। সৈন্যটি বলল–আপনারা যেন কাল রাজদরবারে যান। আপনাদের সঙ্গে সেনাপতি কথা বলবেন।
সৈন্যটি ঘরের দরজাটা খুলল। ফ্রান্সিসের দিকেচাবিটা বাড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিস চাবিটা নিল।
তিনজনে ঘরে ঢুকল। ঘরে পাতা ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। বিস্কোও বোঁচকাটা মেঝেয় রাখল।
পিরেল্লো বলল–ফ্রান্সিস বোঁচকাটা এবার আমাকে দিন।
না। ফ্রান্সিস মাথা নাড়লেন। রাজা কানবহনাকে দিয়ে দেব।
–পেলেন কোথায় জিজ্ঞেস করলে আপনি কী বলবেন? পিরেল্লো বলল।
আপনার কথা বলবো। ফ্রান্সিস বলল।
–আমি দেবমূর্তি চুরি করেছি জানলে আমার ফাঁসি হয়ে যাবে। পিরেল্লো বলল।
–ঠিক আছে। দেখি কী করা যায়। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনি এখন কী করবেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–বাড়ি যাবো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবো। আমার কাজের বৌটিকে ডাকবো। কিছু খাবো। তারপর রাজসভায় যাবো।
–সেখানেই দেখা হবে। ফ্রান্সিস বলল।
পিরেল্লো চলে গেলেন।
ফ্রান্সিসরাও কিছু খেয়ে নিল। তারপর রাজবাড়ির দিকে চলল।
রাজসভায় বেশ ভিড়। বিচার চলছে। ফ্রান্সিসরা গিয়ে দাঁড়াল। সেনাপতিও একপাশে বসে আছে। সেনাপতি রাজার অনুমতি নিয়ে আসন থেকে নেমে এল। ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল–আপনাদের কী ব্যাপার? কোথায় গিয়েছিলেন?
–রাজা মুজার্তার দেশে। ফ্রান্সিস বলল।
–কেন? সেনাপতি জানতে চাইল।
–কী আর বলব। আমাদের মিথ্যে বলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিস্কো বলল।
–সে আবার কী? সেনাপতি বলল।
–সব পরে বলবো। এখন আমারা রাজা হানমের গুপ্তধন উদ্ধার করতে কাজ শুরু করবো। রাজার কাছে সেই ব্যাপারে অনুমতি নিতে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।
সেনাপতি রাজার কাছে এল। কী বলল রাজাকে। রাজা কী বললেন। সেনাপতি ফ্রান্সিসদের ডাকল। ফ্রান্সিসরা এগিয়ে গেল। রাজা ফ্রান্সিসকে চিনলেন। বললেন
–শুনুন। আপনাদের সবরকম সাহায্য দেওয়া হবে। আপনারা কাজ শুরু করুন।
হঠাৎ ফ্রান্সিস শুনল পেছন থেকে রাজপুরোহিত পিরেল্লো গলা চড়িয়ে বলে উঠল– মান্যবর রাজা এই দুই বিদেশী মন্দিরের শায়িত সাত দেবমূর্তি চুরি করেছে।
মিথ্যে কথা। বিস্কো গলা চড়িয়ে বলল। ফ্রান্সিসের কাছে এরমধ্যে বিস্কো সবই শুনেছিল।
–আমার কথা বিশ্বাস না হয় মাননীয় সেনাপতিকে পাঠান। উনি নিজের চোখে সব দেখবেন। এরা চোর। পিরেল্লো বললেন।
রাজা ক্রুদ্ধ চোখে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকালেন। বললেন তোমরা মূর্তি চুরি করেছো?
ফ্রান্সিস এরকমভাবে একটা সমস্যায় জড়িয়ে যাবে এটা আগে ভাবে নি। একটা বোকার মত কাজ করেছেও। মনে জোর আনল। বলল–মহামান্য রাজা আমরা এখনও জানি না সাত দেবতাদের মন্দির কোথায়? মূর্তি দেখা তো দূরস্থান, চুরিটুরির কথা তো ওঠেই না।
–দেখা যাক। রাজা সেনাপতিকে ডাকলেন। সেনাপতি কাছে এল।
রাজা বললেন–মূর্তি চুরির খবর আপনি কবে পেয়েছেন?
–দিন সাতেক আগে। সেনাপতি বলল।
–ঠিক আছে। আপনি যান। রাজা বললেন। তারপর পিরেল্লোকে বললেন–আপনি যান। দেবমূর্তিগুলো যথাস্থানে রাখবেন।
–আমার একটা কথা ছিল। ফ্রান্সিস বলল।
–কী কথা?
–দিন ছয় সাতেক আগে–এক গভীর রাতে এই রাজপুরোহিত পিরেল্লো আমাদের জাহাজে এসেছিলেন। তিনি বললেন–আমি সোনার দেবমূর্তি চুরি করে এনেছি। এই দেশ থেকে পালাবো। আমাদের জাহাজে চড়ে। আমরা বলি এ দেশের রাজপুরোহিত আপনী। কত সম্মান আপনার। এসব ছেড়ে চলে যাবেন কেন? উনি বলেন বহুদিন দেশছাড়া। আর এখানে ভালো লাগছে না। জিজ্ঞেস করলাম–আপনার দেশ কোথায়? বললেন পর্তুগাল। আমরা তাকে স্পষ্ট বলি আমরা একজন চোরকে আশ্রয় দেব না। ফ্রান্সিস বলল তারপর আপনার সভায় আসবো আর বোঁচকায় বাধা দেবমূর্তি দিয়ে দেবো। কিন্তু পরে আমি মত পাল্টলাম। পিরেল্লো বলছিলেনধরা পড়লে তাকে ফাঁসি কাঠে ঝোলানো হবে। তখন ঠিক করলাম রাজপুরোহিতকে আর বিপদে ফেলবো না। মূর্তিগুলো একটা বোঁচকায় ভরে সেটা আমাদের ঘরে রেখে এলাম। রাজা হানমের গুপ্তধন উদ্ধারের বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলবো। তাই এসেছি। আমরা চোর না। যা ঘটেছিল তার সবই আমি বললাম। ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলল–যদি অনুমতি দেন আমার আরও কিছু বলার ছিল।
–ঠিক আছে, বলো। রাজা বললেন।
–আমি পিরেল্লোকে বললাম আমাদের মন্দিরে নিয়ে চলুন আমরা ওখানে যথাস্থানে মূর্তি রেখে দেব। পিরেল্লো রাজি হল। আমাদের নিয়ে আর দেবমূর্তি নিয়ে আমাদের মন্দিরে নিয়ে চললেন। ফ্রান্সিস একটু থামলো। পরে বলতে লাগলো–আমরা হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু কোথায় মন্দির? আমরা মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করেছি মন্দির কোথায়? পিরেল্লো বলেছেন সে মন্দির মাটির নীচে। ওপর থেকে দেখাবো কী করে। আমরা আর কোন কথা না বলে হাঁটতে লাগলাম। দেবমূর্তির বোঁচকাটা আমরা হাতছাড়া করলাম না। সন্ধ্যে হয় হয় এমন সময় আমরা রাজা মুজাৰ্তার রাজত্বে পৌঁছালাম। গর্ভগৃহের মন্দির আর আমাদের দেখা হল না। সব ঘটনা সত্যি সত্যি বললাম। এখন আপনার বিচার।
রাজা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন–একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে তোমরা মন্দির দেখোনি। কাজেই সাত দেবমূর্তি চুরির সঙ্গে তোমরা জড়িত নও।
–না, না। ওরা মিথ্যেবাদী। পিরেল্লো বলে উঠলেন।
–না। মিথ্যেবাদী আপনি। আপনিই কারো সাহায্য নিয়ে মূর্তি চুরি করেছিলেন। বিস্কো বলল।
সেনাপতি রাজার দিকে এগিয়ে এলেন। বলল–
-মান্যবর রাজা। ঐ ঘরে একটা বোঁচকায় মূর্তিগুলো রাখা আছে।
রাজা কানবহনা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। চারদিকে তাকিয়ে বললেন–আজকের সভা এখানেই শেষ। ততক্ষণে সভায় আসা প্রজারা চলে যেতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই। প্রজারা চলে গেল। রাজা পিরেল্লোর দিকে তাকালেন।
বললেন–আপনি স্নান করে আসুন। আপনি দেবমূর্তিগুলো যথাস্থানে রেখে দেবেন। পিরেল্লো মাথা একটু নুইয়ে চলে গেলেন।
–সেনাপতি। রাজা ডাকলেন।
–বলুন মান্যবর। সেনাপতি বলল।
–আমাদের ঐ ঘরে নিয়ে চলুন। রাজা বললেন।
–আসুন। সেনাপতি বলল।
রাজা সেনাপতি আর ফ্রান্সিসরা রাজবাড়ির বাইরে এলেন। সেনাপতি একটু এগিয়ে হাঁটতে লাগলেন। ফ্রান্সিসদের ঘরের সামনে এসে ঘরটা সেনাপতি দেখালেন।
সেনাপতি দরজার তালা খুলল। রাজা ভেতরে ঢুকলেন। সেনাপতি বোঁচকাটা দেখালেন। রাজা বোঁচকাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন–কেউ যেন বোঁচকাটা না। ছোঁয়। স্নান সেরে এখুনি পিরেল্লো আসছেন। উনি দেবমূর্তিগুলো যথাস্থানে রাখবেন।
রাজা আর ফ্রান্সিসরা বাইরেএল। ফ্রান্সিস বলল–মাননীয় রাজা, আমরা এখন কী করবো?
–হ্যাঁ ভেবেছিলাম কয়েদঘরে ঢোকাবো। এখন ভাবছি একটা সুযোগ তোমাদের দেব। রাজা বললেন।
-তাহলে রাজা হানমের গুপ্তধনের সন্ধান শুরু করবো? ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। তবে একটা কথা না বলতে পারলে তোমাদেরসি দেব। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল মাননীয় রাজা আমাদের ওপর অতটা নির্মম হবেন না। আমাদের ফাঁসী দিয়ে আপনার লাভ? আমরা তো আপনার শত্রু নই। আপনার দেশবাসীও নই।
-ঠিক আছে। পরে সব দেখা যাবে। রাজা বললেন। তখনই পিরেল্লো এলেন।
আপনারা কাজ করুন। এই বলে সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়ে রাজা চলে গেলেন।
ফ্রান্সিস আর বিস্কো ঘরটায় ঢুকলো। দেখল পিরেল্লো বোঁচকাটা তুলছে–ফ্রান্সিস বলল–আপনাদের সঙ্গে আমরাও যাবো।
-কোথায়? পিরেল্লো বলল।
মন্দিরটা দেখতে। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনারা বিদেশী। মন্দিরে ঢাকা বারণ। পিরেল্লো বললেন।
রাজামশাইতো সেনাপতিকে ঢালাও বলে দিয়েছেন আমরা এই রাজ্যের যেখানে খুশি যেতে পারি আমাদের যাতে কেউ বাধা না দেয় রাজা সেকথাও বলেছেন। আপনিও তখন রাজসভায় উপস্থিত ছিলেন।
-বেশ। চলুন। পিরেল্লো অগত্যা রাজী হলেন।
পিরেল্লো বোঁচকাটা মাথায় তুলে নিল। ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিসরা দরজা বন্ধ করে বাইরে এলো। তিনজন চলল।
মন্দিরটা রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই। মন্দিরে ঢুকতেই চারজন প্রহরী ফ্রান্সিসদের আক্রমণ করল।
অন্য প্রহরীটি ফ্রান্সিসকে লক্ষ্য করে বর্শা তুলতে গেল কিন্তু ফ্রান্সিস ওকে হাত তুলতেই দিল না। এক লাফে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রহরীটি কিছু বোঝার আগেই ফ্রান্সিস ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রহরীর বর্শাটা ধরে ফেলল। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে বর্শাটা প্রহরীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল। বিস্কো তখন অন্য প্রহরীর হাত থেকে ছোরাটা বের করে নিয়ে তার পিঠে বসিয়ে দিল। প্রহরীটি মুখে শব্দ তুলল–অ্যাঁ। তারপর পাথরের সিঁড়ির ওপর গড়িয়ে পড়ল।
হাতে ধরা বর্শাটা ফ্রান্সিস পিরেল্লোর বুকে তাক করল। চাপা স্বরে বলল, এখন আপনি আমার নিশানার সামনে। শুধু বর্শাটা ছোঁড়ার অপেক্ষা।
পিরেল্লো কেঁদে ফেললেন। বলে উঠলেন, দোহাই আমায় হত্যা করবেন না।
আপনি আমাদের হত্যা করতে চেয়েছিলেন। বলুন, তাই কিনা? ফ্রান্সিস গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল।
না। হত্যা নয়, আপনাদের আহত করতে চেয়েছিলাম। পিরেল্লো বললেন।
কিন্তু কেন?
সোনার লোভে। আমি বুঝেছিলাম আপনারা রাজা হানমের গুপ্ত ধনসম্পদ উদ্ধার করতে পারবেন। তখন আহত নিরস্ত্র আপনারা আমাকে বাধা দিতে পারবেন না। দুজন প্রহরী আর আমি মিলে আপনাদের উদ্ধার করা ধনসম্পদ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারব।
হু। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। তারপর বলল, কাল সকালে আমি রাজসভায় যাবো। রাজা কানবহনাকে সব বলব। উনি আপনাদের যা করবার করবেন।
না না। দোহাই, আপনি রাজাকে কিছু বলবেন না। রাজা আমাদেরফাঁ সিতে লটকাবেন। পিরেগ্লো বললেন।
ফ্রান্সিস একটু ভাবল। তারপর বলল, আপনারা আমাদের হত্যা করতে চেয়েছিলেন। আমরা কোনরকমে জীবন রক্ষা করলাম। তার আগে কি একবারও ভেবেছিলেন যে আমরা বিদেশী, নিরস্ত্র, অসহায়!
–আপনাদের হত্যা করতে গিয়েছিলাম এই অপরাধের জন্যে যা শাস্তি দিতে চান দিন। শুধু একটা অনুরোধ, রাজাকে কিছু জানাবেন না।
ফ্রান্সিস, একে ছেড়ে দাও। কী হবে এই ছুঁচোটাকে মেরে? বিস্কো বলল।
আহত প্রহরীরা তখন সিঁড়ির ওপর শুয়ে কাতরাচ্ছে। তাদের পাশ দিয়ে ফ্রান্সিসরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাইরে চলে এল। বাইরে তখন সন্ধ্যে। চলল রাজবাড়ির দিকে।
ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। বিস্কো ফ্রান্সিসের পাশে বসল। বলল, এবার কি করবে?
রাজা হানমের গুপ্তধন আছে ঐ সাজঘরে। ফ্রান্সিস বলল।
ছড়াটায় সাজঘরের উল্লেখ আছে। বিস্কো বলল।
হা। সেইজন্যই সাজঘরটা ভালো করে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
তুমি কি নিশ্চিত যে গুপ্তধন সাজঘরেই আছে? বিস্কো বলল।
সম্পূর্ন নিশ্চিত নই। তবে পুজোর ঘরে অথবা সাজঘরে রাজা হানমের গুপ্তধন আছে। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
এখন কি করবে? বিস্কো জানতে চাইল।
কাল সকালে রাজসভায় যাব। রাজা কানবাহনার অনুমতি নেব, তারপর খোঁজাখুঁজি শুরু করবো। রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে ওরা ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। বিস্কো ঘুমিয়ে পড়লেও ফ্রান্সিস এর চোখে কিন্তু ঘুম নেই। রাজা কানবহনার অনুমতি পাওয়া যাবে। কারণ ফ্রান্সিস আগেই বলে দেবে যে গুপ্তধন উদ্ধার করাই তার উদ্দেশ্য। গুপ্তধন থেকে ওরা কিছুই নেবেনা। এটা শুনলে রাজামশাই লাফিয়ে উঠবেন। গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য সর্বপ্রকারে সাহায্য করবেন। গুপ্তধন পাওয়ার লোভ কেউ দমন করতে পারেনা। রাজাও পারবেন না। মনে হয় অনুমতি সহজেই পাওয়া যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালের জলখাবার খেয়ে ফ্রান্সিসরা রাজসভার দিকে চলল। রাজসভায় ঢোকার মুখে দেখল রাজপুরোহিত পিরেল্লো ওদের অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছেন। কাছাকাছি আসতেই রাজপুরোহিত বলেলন আমি আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি। তারপর ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বললেন, গতকালের কথা ভুলে যান। আপনাদের আমরা আহত করতে চেয়েছিলাম তার জন্য মাপ চাইছি।
বেশ আমি এ ব্যাপারে রাজাকে কিছু বলব না। আপনি আমাদের তার সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন।
দেখছি। পিরেল্লো চলে গেলেন। একটু পরে ফ্রান্সিসরা দেখল, মন্ত্রীর সামনে মাথা নীচু করে পিরেল্লোকী বলছেন। মন্ত্রী মাথা ঝাঁকালেন। পিরেল্লো ফ্রান্সিসদের কাছে এলেন। বললেন, কিছু পরে আপনাদের ডাক পড়বে। ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না। দুজনে অপেক্ষা করতে লাগল।
সেনাপতি ফ্রান্সিসদের নাম ডাকলেন। ফ্রান্সিস, বিস্কো এগিয়ে এল মাথা ঝুঁকিয়ে রাজাকে সন্মান জানিয়ে বলল, আপনি আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন তাতে আমরা খুশি। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল, এবার কাজের কথা বলি। রাজপুরোহিত পিরেল্লো আমাদের মন্দিরে নিয়ে গেছেন, গর্ভকক্ষে নিয়ে গেছেন। পাশের সাজকক্ষও দেখিয়েছেন। শুধু একবার দেখেছি সেসব। কাজেই মাত্র একবার দেখে কিছু সিদ্ধান্তে আসা যাবে না আমরা আবার ভালোভাবে দেখব। তারপর বলতে পারব–রাজা হানমের ধনসম্পদ কোথায় রাখা হয়েছে।
হুঁ। দেখ চেষ্টা করে। কোনকিছুর প্রয়োজন পড়লে সেনাপতিকে বলবে। সব পাবে। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিসরা একটু মাথা ঝুঁকিয়ে চলে এল। পিরেল্লোও ওদের কাছে এলেন। পিরেল্লো নিশ্চিন্তের হাসি হেসে বললেন, আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ রইলাম। আমার বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ উঠলে আজ রাতেই আমার জীবন শেষ হয়ে যেত। এই রাজা কি খুব বদরাগী? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
সাংঘাতিক। যে তাকে মাথা নুইয়ে ভক্তি-শ্রদ্ধা না জানায় তাকে হাত-পা বেঁধে ইরা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
ভাগ্যিস যথাসময়ে মাথা নীচু করে শ্রদ্ধা-ভক্তি জানিয়েছি। আমরা খুব বেঁচে গেলাম। বিস্কো বলল।
ফ্রান্সিসরা তাদের আস্তানায় ফিরে এল। পিরেল্লো পিছু ছাড়লেন না। ঘরের তালা খোলা হলো। সবাই ঘরটায় ঢুকল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। পিরেল্লো বিস্কো বলল।
ফ্রান্সিস? পিরেল্লো ডাকলেন।
হু।
সত্যিই কি আপনি এই রহস্যের সমাধান করতে পারবেন?
সবকিছু না দেখে না বুঝে বলতে পারবো না। তবে রাজা হানমের গুপ্তধন আমি উদ্ধার করবোই। তার জন্য একটু সময়ের দরকার। সেই সময়টা আমাদের পেতে হবে।
সেই সময় আপনারা পাবেন। পিরেল্লো বললেন।
দেখা যাক।
ফ্রান্সিস, আপনারা তো মন্দিরে রাজা হানমের গুপ্তধনের খোঁজে যাবেনই। অনুরোধ, আমাকেও সঙ্গে নিন। পিরেল্লো বললেন।
না। আপনাকে বিশ্বাস করিনা। আপনি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন না। ফ্রান্সিস বলল।
আমি আপনাদের কোনো ক্ষতি করব না। বরং আপনাদের সাহায্য করব।
আপনার সাহায্যের দরকার নেই। আমরাই সব পারব। বিস্কো বলল।
তবু আমাকে সঙ্গে নিন। পিরেল্লো বললেন।
না। আপনার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বিদেয় হোন। ফ্রান্সিস বলল।
আমার অনুরোধ-পিরেল্লো বলতে গেলেন।
আপনার কোনো অনুরোধ শুনতে আমার আগ্রহ নেই। ফ্রান্সিস বলল।
পিরেল্লো আর কোনো কথা বললেন না। বেরিয়ে চলে গেলেন।
ফ্রান্সিস? বিস্কো ডাকল।
বলো। ফ্রান্সিস ওর দিকে তাকাল।
পিরেল্লোকে সঙ্গে রাখলে ভালো হতো।
বিস্কো তুমি ঠিক বুঝতে পারোনি। পিরেল্লো গুপ্তধনের লোভে প্রায় পাগল হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে আমাদের হত্যা করতে পারে।
ওর হাতে তো কোনো অস্ত্রই নেই।
কোমরে একটা বড় ছোরা গোঁজা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
বলো কি? বিস্কো আঁতকে উঠল।
হা। আমরা কাজে ব্যস্ত থাকবো। গুপ্তধন উদ্ধারের মুখে ও আমাদের হত্যা করবে।
হুঁ। এটা হতে পারে। এখন কী করবে? বিস্কো জানতে চাইল। শোন। একটা লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। পিরেল্লো এ-দেশের রাজপুরোহিত। প্রহরীরা ওর কথা শুনবে। ও প্রহরীদের গুপ্তধনের লোভ দেখাবে। দলে টানবে। প্রহরীরা নির্দেশ পেলেই আমাদের অক্রমণ করবে। কাজেই আমাদেরও সাবধান থাকতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
অর্থাৎ আমাদেরও লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বিস্কো বলল।
হ্যা, ঠিক তাই। কয়েকজনকে তরোয়াল নিয়ে আসতে বলবে। ওরা সবাই এলে মন্দিরে নামব। ফ্রান্সিস বলল।
বিস্কো খাবার খেয়ে রওনা হয়ে গেল।
একটু রাতে জাহাজে পৌঁছল বিস্কো। ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে এল। সকলেই জানতে চাইছে–ফ্রান্সিস ভালো আছে কিনা। গুপ্তধন উদ্ধার হয়েছে কিনা।
বিস্কো সব বলল। ফ্রান্সিসের শেষ নির্দেশটাও বলল। বিস্কোরা চারজন পোশাক পাল্টে কোমরে তরোয়াল গুঁজে জাহাজের ডেকে উঠে এল।
শাঙ্কো তৈরী হয়ে এল। বলল আমিও যাব চলো।
ডেকের একপাশে মারিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। বিস্কো মারিয়ার কাছে এল। বলল, ভয়ের কিছু নেই। ওখানে একটা ছোটোখাটো লড়াইয়ের মতো হতে পারে। আমরা জিতব। কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবেন না। আমরা তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো। শাঙ্কোরা এবার চলল রাজবাড়ির দিকে।
ভোর হয় হয় এমন সময় ওরা রাজবাড়ি পৌঁছল। প্রধান প্রবেশদ্বারে পেতলের বশা হাতে চারজন প্রহরী পথ আটকাল। শাঙ্কো এগিয়ে এল। বলল, সেনাপতি আমাদের সবরকম স্বাধীনতা দিয়েছেন। আমাদের আটকাবে না। একজন প্রহরী শাঙ্কোকে চিনল। দরজা খুলে বলল, আপনারা আসুন।
শাঙ্কোরা বিরাট মাঠে এল। শাঙ্কোর পেছনে পেছনে ওরা চলল ফ্রান্সিসদের আস্তানার দিকে। ফ্রান্সিসদের ঘরের সামনে এল সবাই। শাঙ্কো দরজায় ধাক্কা দিল।
আসছি। ফ্রান্সিসের গলা। ফ্রান্সিসের দরজা খুলল। বন্ধুরা ঘরে ঢুকল।
শাঙ্কো আর বিস্কোর কাছে সবই শুনেছিল ওরা। নতুন করে জানার মতো কিছু ছিল না। ফ্রান্সিসের কাছে আর কিছু জানতে চাইল না।
শুকনো খড়ের বিছানায় বসল সবাই। ফ্রান্সিস বলল, সবই শুনেছ। আমার কেমন মনে হচ্ছে গুপ্তধনের কথা বলে পিরেল্লো কয়েকজন প্রহরীকে দলে টেনেছে। গুপ্তধন আবিস্কৃত হয়ে গেলে ওরা আমাদের আক্রমণ করতে পারে। আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
মন্দিরে কখন যাবে? বিস্কো বলল।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে। ঐ মন্দিরে কতক্ষণ থাকতে হবে জানি না। কাজেই পেট ভরে খেয়ে যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
একসময় রাজবাড়ির রাঁধুনি এসে খবর দিয়ে গেল, এখন খেতে দেওয়া হবে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে ফ্রান্সিসরা তৈরী হলো। বিস্কো ফ্রান্সিসের তরোয়ালটা এনেছিল। এবার ফ্রান্সিসকে দিল।
ফ্রান্সিসরা চলল মাটির নীচের মন্দিরের দিকে।
মন্দিরের সামনে যখন ওরা এল, দূর থেকেই ফ্রান্সিস দেখল প্রহরীর সংখ্যা বেশী। ওখানে নিশ্চয়ই পিরেল্লো আছেন। উনি এত সহজে হাল ছেড়ে দেবেন না।
প্রবেশদ্বারের সম্মুখে দেখল পিরেল্লো দাঁড়িয়ে আছেন।
ফ্রান্সিসরা এসে দাঁড়াল। পিরেল্লো কি ইঙ্গিত করলেন প্রহরীরা সারি দিয়ে মন্দিরে ঢোকার মুখে দাঁড়াল।
ফ্রান্সিস প্রহরীদের সামনে গেল। বলল, আমরা লড়াই চাই না। আমাদের দুজনকে গর্ভমন্দিরে ঢুকতে দাও।
না। সর্দার প্রহরী বলল।
তুমি ভাই সেনাপতির হুকুম জানোনা। ফ্রান্সিস বলল।
কী হুকুম? সর্দার জিগ্যেস করল।
গুপ্তধনের সন্ধান করতে আমরা যে কোনো জায়গায় যখন খুশি যেতে পারব। এটা রাজার হুকুম। ফ্রান্সিস বলল।
অদ্ভুত হুকুম। সর্দার বলল।
হ্যাঁ, একটু অদ্ভুতই। পথ ছাড়ো।
সেনাপতির কাছে লোক পাঠাচ্ছি সেনাপতির হুকুম জানতে। সর্দার প্রহরী বলল।
বেশ। মিছিমিছি দেরি হবে এই আর কি। ফ্রান্সিস হতাশার ভঙ্গি করে বলল।
একজন প্রহরী বর্শা হাতে ছুটে গেল। কিছু পরে তাকে দেখা গেল মাঠের ওপার দিয়ে ছুটে আসছে। সর্দার প্রহরীর কাছে এসে সে হাঁপাতে লাগল। বলল, সেনাপতি বলেছেন, এঁরা যেখানে খুশি যেতে পারেন। আর আমরা যেন এঁদের সাহায্য করি।
ঠিক আছে। আপনি যান। সর্দার বলল।
ফ্রান্সিস বন্ধুদের বলল, প্রথমে আমি আর বিস্কো যাবো। তোমরা এখানেই থাকো। ফ্রান্সিস-বিস্কো পাথরের দরজার দিকে চলল।
পিরেল্লো ছুটে এসে বললেন, আমাকেও নিয়ে চলুন।
না, আপনি যাবেন না। শাঙ্কো বলল।
কেন যাব না? এ দেশ আমাদের। দেশের ভালো-মন্দ তো আমরাই দেখবো। আপনারা তো বিদেশী। পিরেল্লো উত্তর দিলেন।
ফ্রান্সিস ঢোকার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ঠিক আছে। আপনারাই যান। রাজা হানমের গুপ্ত ধনসম্পদ খুঁজে বের করুন।
আমরা পারব না। আপনারা পারবেন। গুপ্তধন পেলে আপনারা সেটা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন। পিরেল্লা বললেন।
সেটা দেখার জন্যে এই প্রহরীরা আছে। রাজা আছেন। ফ্রান্সিস বলল।
না। রাতের অন্ধকারে আপনারা সব মূল্যবান গুপ্তধন নিয়ে পালাবেন। পিরেল্লো বললেন।
ঠিক আছে। আপনার যখন এরকম সন্দেহ, আসুন আমাদের সঙ্গে। শুধু একটা কারণে আপনাকে সঙ্গে নিচ্ছি। রাজা হানমের ছড়াটা আপনি আমাদের দেখিয়েছেন। এতে গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজতে সুবিধে হবে। চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
পাথরে রদরজার পাশে লোহার আংটায় আটকানো দুটো মশাল বিস্কো নিল। পিবেল্লো বললেন, একটা আমাকে দিন। বিস্কো ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে শাঙ্কো দুটো মশাল ধরাল। ফ্রান্সিস বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইসব, তোমরা অপেক্ষা কর। অধৈর্য হয়ো না।
শাঙ্কো একটা মশাল নিল। পিরেল্লো অন্যটা। সিঁড়ি দিয়ে ওরা নামতে লাগল। বেশ গরম লাগছে। তিনজনই ঘামছে।
সিঁড়ি শেষ। একটা পাথরের মেঝে। ফ্রান্সিস মশালের আলোয় চারদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। দেখতে-দেখতে ছড়াটা ও আওড়াতে লাগল।
ছোট্ট সাজের ঘরে
রেখেছি বড় আদরে।
ধনসম্পদ কার তরে?
বুদ্ধিমান উদ্ধার করে
বোকারা হা-হুতাশ করে।
ফ্রান্সিস বলল, কী পিরেল্লো! ঠিক বলেছি।
হ্যাঁ। আশ্চর্য। আপনি ছড়াটা একবার দেখেই মুখস্থ করে ফেলেছেন।
ফ্রান্সিস কিছু বলল না। দেওয়ালগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। বেদীর মতো টানা পাথরের উপর ফুলপাতা।
ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে বলল, এই বেদীটা কি বরাবর আছে নাকি আপনারা গেঁথে ছিলেন?
না। এই বেদী আমরা বরাবর এইরকমই দেখে আসছি।
হু। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। তারপর পাথরের জোড়াগুলো খুব ভালো করে দেখতে লাগল। নাঃ, কোনো আলগা জোড়া নেই।
এবার ফ্রান্সিস পেছনের সাজঘরে ঢুকল। দেবতাদের পোশাকএকটা লম্ফটে পাথুরে পাটাতনের ওপর জড়ো করা। ফ্রান্সিস চারপাশে তাকিয়ে দেখল। পাথরের দেওয়াল। এবড়ো-খেবড়ো। শুধু দেবতাদের পোশাক যে পাথুরে পাটাতনের ওপর রাখা সেই, পাটাতনটা মসৃণ পাথরের।
ফ্রান্সিস ভাবতে লাগল কোথায় থাকতে পারে রাজী হানমের গুপ্ত ধনভাণ্ডার। ফ্রান্সিস বলল, পিরেল্লো–দেবতাদের পোশাক এখানেই থাকে।
হা। বছর অন্তর-অন্তর পুরোনো পোশাক খুলে ফেলে দেবতাদের নতুন সাজপোশাক পরানো হয়।
পুরোনো পোশাকগুলো ফেলে দেওয়া হয়? ফ্রান্সিস বলল।
না। সে-সব পোশাক রাজ্যের ধনীরা কিনে নেয়। খুব পবিত্র সেই পোশাকগুলো। পিরেল্লো বললেন।
এত পোশাক জমে আছে কেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
এখনও বিক্রি করার সময় আসেনি। পিরেল্লো বললেন।
ফ্রান্সিস পাথুরের পাটাতনে রাখা সাজপোশাক দেখতে লাগল। একটা পাটাতনে কুঁদে কুঁদে গোল দাগ তোলা হয়েছে। এর নীচে কী আছে? এখানে পাথুরে পাটাতনটা কি ফাঁপা? নীচে কিছু আছে? বিস্কোকে ডাকল। মশালটা বিস্কোর হাতে ছিল। বলল, মশালটা নিচু কর।
বিস্কো মশলাটা নীচু করে ধরল। ফ্রান্সিস গোল দাগটা ভালো করে দেখল।
বিস্কো মশাল হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। একটু দ্রুতই পা ফেলে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিঁড়ি শেষ। বাইরে বেরিয়ে দেখল উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। চারদিক বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। বন্ধুদের দেখল মাঠটায় বসে আছে। দুজন ভাইকিং বন্ধু এগিয়ে এল। বলল, কী খবর বল।
ফ্রান্সিস খুব সম্ভব হদিস পেয়েছে।
তাহলে মনে হচ্ছে ফ্রান্সিস রহস্যের সমাধান করেছে। বন্ধুটি বলল।
তাই তো মনে হচ্ছে। বিস্কো বলল।
বিস্কো নিজেদের আস্তানায় চলল।
ওদিকে পিরেল্লো সর্বক্ষণ ফ্রান্সিসকে লক্ষ্য করে যাচ্ছেন। এতে ফ্রান্সিস বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল। কিন্তু উপায় নেই।
এবার পিরেল্লো এগিয়ে এলেন, বললেন, কোনো হদিস পেলেন?
না। তবে চেষ্টা করছি। ফ্রান্সিস বলল।
মিথ্যে কথা। আপনি গুপ্তধনের হদিস পেয়েছেন।
না। হদিস পাইনি এখনও। তবে কিছুটা আন্দাজ করেছি। ফ্রান্সিস বলল।
তবে সেটা বলুন। পিরেল্লো বললেন।
না। গুপ্তধন সম্মন্ধে সব বলতে আমি আপনার কাছে দায়বদ্ধ নই। ফ্রান্সিস উত্তর দিল।
তবে কাকে বলবেন আপনার এই গুপ্তধন খোঁজার কথা। পিরেল্লো জানতে চাইলেন।
বলবো রাজা কানবহনাকে। ফ্রান্সিস বলল।
না। আপনি আমাকে সব বলবেন। পিরেল্লো জোর দিলেন।
আগেই বলেছি আপনার কাছে আমি দায়বদ্ধ নই।
তাহলে আপনাদের মরতে হবে। পিরেল্লো বললেন।
অতটা কব্জির জোর থাকলে আমাদের হত্যা করুন। ফ্রান্সিস জানাল।
ফ্রান্সিস কিছু বোঝার আগেই পিরেল্লো কোমর থেকে একটা বাঁকা মাথা বড় ছোরা বের করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অন্যমনস্ক ফ্রান্সিস ছিটকে পড়ল মেঝেয়। পিরেল্লো ছোরাটা ফ্রান্সিসের বুক লক্ষ্য করে বিধতে গেলে ফ্রান্সিস ঘুরে গেল আর ছোরাটা বিঁধল ওর বাঁ বাহুমূলে। রক্ত বেরিয়ে এল। বিস্কো একটা লাফ দিয়ে পিরেলল্লাকে জাপটে ধরল। তারপর বুকের নীচে হাত দিয়ে ওর ছোরাটা বের করল। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে উঠল, ওকে হত্যা করো না। গুপ্তধনের ব্যাপারে ভাবতে-ভাবতে ওর মাথার ঠিক নেই।
শাঙ্কো দ্রুত ফ্রান্সিসের কাছে এল। মশালের আলোয় দেখল কাটা জায়গাটা বড় না হলেও বেশ রক্তপাত হচ্ছে। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে কাপড় ছিঁড়ে ফ্রান্সিসের কাটা জায়গাটা বেঁধে দিল। ফ্রান্সিসের একটু আরাম লাগল। রক্ত পড়া বন্ধ হলো।
ওদিকে পিরেল্লো দ্রুত উপরে উঠে এলেন। চার বর্শাধারীকে ডাকলেন। বললেন, দুটো চোর রাজা হানমের গুপ্তধন উদ্ধার করেছে। সেই ধনভাণ্ডার নিয়ে ওরা বাইরে আসবে। পালাতে চাইবে। ওদের পালাতে দিও না। তৈরী থাকো।
বিস্কো গলা চেপে বলল, বোঝাই যাচ্ছে এই লোকটা প্রহরীদের সাহায্যে ফ্রান্সিস আর বিস্কোকে বন্দী করবে।
এখনই প্রহরীদের আক্রমণ করবো? একজন ভাইকিং বন্ধু জানতে চাইল।
না। আগে ফ্রান্সিসরা উঠে আসুক। বিস্কো বলল।
কিছুপরে ফ্রান্সিসকে ধরে ধরে বিস্কো প্রধান দ্বার পর্যন্ত এল। এবার পিরেল্লো গলা চড়িয়ে বললেন, এই দুজনেরই কথাই বলছিলাম। ওদের হত্যা কর।
বিস্কো দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল, ও—হো–হো—
বন্ধুরাও ধ্বনি তুলল, ও-হো-হো।
প্রহরীরা বর্শা হাতে ফ্রান্সিস আর বিস্কোর দিকে ছুটে এল। বিস্কোরা প্রহরীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো লড়াই। বর্শা দিয়ে তরোয়াল ঠেকানো অসুবিধে। একবার বর্শা হাতছাড়া হলে আক্রমণকারী নিরস্ত্র হয়ে যায়। লড়াইয়ের মধ্যে ফ্রান্সিসের উচ্চস্বর শোনা গেল, ভাইসব, কাউকে হত্যা করো না। প্রয়োজনে বন্দী কর।
অল্পক্ষনের মধ্যে লড়াই শেষ। প্রহরীদের মধ্যে দু তিনজন আহত হয়ে ঘাসে ঢাকা মাঠে পড়ে রইল।
ফ্রান্সিস চারদিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে পিরেল্লোকে খুঁজতে লাগল। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় দেখল পিরেল্লো আর একজন প্রহরী একটা ওক গাছের তলা দিয়ে ছুটছে। ফ্রান্সিস বলল, বিস্কো আমি ছুটতে পারছি না। রক্তপড়া বেড়ে যাবে। তুমি ছুটে গিয়ে পিরেল্লোকে ধর।
বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে ছুটল। পলায়মান পিরেল্লো আর একজন প্রহরী তখন রাজবাড়ির পাশ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। বিস্কো দ্রুত ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিস্কো পিরেল্লোদের? কাছে এসে পড়ল। চেঁচিয়ে বলল, পিরেল্লো পালিয়ে রেহাই পাবেন না। কাজেই পালাবার চেষ্টা না করে আমাদের কাছে আসুন। ফ্রান্সিস আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে বলেছে।
পিরেল্লো দাঁড়িয়ে পড়লেন। সঙ্গের যোদ্ধাটিও থামল। দুজনেই মুখ খুলে হাঁপাতে লাগল। বিস্কো ওদের কাছে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বিস্কো বলল–যদি রাজা হানমের ধনভাণ্ডার আবিষ্কার করতে পারি, রাজা কানবহনাকে বলবো ধনভাণ্ডারের কিছু অংশ আপনাকে যেন দেন।
সত্যি বলছো? পিরেল্লো বললেন।
হা, সত্যি বলছি। আপনি ফ্রান্সিসের কাছে চলুন। আমরা আপনার কোনোরকম ক্ষতি করবো না। বরং আপনি ফ্রান্সিসকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন সেইজন্যে আমি আপনাকে এক্ষুণি মেরে ফেলতে পারি। বিস্কো বলল।
আমার দোষ হয়ে থাকলে– পিরেল্লো বলতে লাগলেন।
তাকে থামিয়ে দিয়ে বিস্কো বলল, ঠিক আছে, আপনি ফিরে চলুন।
তিনজন ফিরে চলল মন্দিরের দিকে। মন্দিরের দরজার কাছে এসে দেখল প্রহরীরা আহত হয়ে এখানে ওখানে ঘাসের ওপর পড়ে আছে। ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টিতে তরোয়াল ঢুকিয়ে রেখেছে।
ফ্রান্সিস মশালের আলোয় খুব ভালো করে পাথরের পাটাতনটা দেখতে লাগল। দেবতাদের পোশাকের স্তূপ সরিয়ে দেখতে লাগল। তারপর পোশাকগুলো সরাতে শুরু করল। হঠাই দেখল-পাথরেরনয় মসৃণ কাঠের বেদীমত। ফ্রান্সিস মাথা তুলে বলল– বিস্কো–মশালটা নামিয়ে ধরো। এ জায়গাটা ভালোভাবে দেখতে হবে। বিস্কো মশাল নামিয়ে ধরল। ফ্রান্সিস বুঝল ওরঅনুমান ঠিক। ঐ একহাত লম্বা জায়গাটা মসৃণ কাঠের।
-বলেন কী?
–হ্যাঁ। পিরেল্লো কাঠের পাটাতনটা দেখলেন। বললেন–আশ্চর্য আমরা কোনদিন এটা লক্ষ্য করি নি। ওখানকার পোশাকও তুলে দেখি নি।
–আরো আছে। ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে দেখাল নীচের দিকে কাঠের তাকমত। ফ্রান্সিস আঙ্গুল চেপে দেখল তাকটা ভীষণ শক্ত। ফ্রান্সিস বলল–মশালটা কাছে আন। বিস্কো তাই করল। ফ্রান্সিস দেখলকাঠ কুঁদে কুঁদে একটা ত্রিভুজমত আঁকা। তার মাঝখানে একটা ফুটোমত। বোঝাই যাচ্ছে ওটা তালা। কিন্তু এইতালার চাবিকই? ফ্রান্সিস অস্ফুটস্বরে বলতে লাগল। কথাটা বলতে বলতে ঐ জায়গাতেই কয়েক পাক ঘুরল।
তারপর বলে উঠলো–শায়িত দেবতার গর্তগুলো দেখতে হবে। বিস্কো এসো। দেবমূর্তিগুলো দেখবো। দুজনে গুনল। সব মিলিয়ে সাতটা গর্ত। তাতে দেবমূর্তি শায়িত। ফ্রান্সিস সাতের শেষে আরো দুটি গর্তমত দেখল। ফ্রান্সিস মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। তখনই মশালটা নিভু নিভু হয়ে এল।
–পিরেল্লো তেল পাওয়া যাবে কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।
-বাইরে। সদর দরজার পাহারাদারদের কাছে। বিস্কো প্রায় নিভে যাওয়া মশালের আলোয় আস্তে আস্তে ওপরে উঠে এল। প্রহরীদের কাছ থেকে একটা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে নীচে নেমে এল।
–মশাল দেবমূর্তির মুখের কাছে নিয়ে এস। বিস্কো তাই করল। ফ্রান্সিস বলল–এখন অনেক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করলখানে মাটি একটু উঁচু হয়ে আছে। ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে জায়গাটা ঘসল। মাটি ঝুরঝুকরে পড়ল। দেখা গেল গর্ত। অন্য গর্তওগুলোর মতোই। ফ্রান্সিস বলল পিরেল্লো বলুন তো এখানে একটা গর্ত আছেকিন্তু দেবমূর্তি নেই।
–হ্যাঁ। তাই দেখেই তো ভাবছি বাড়তি গর্ত। আমরা এটা কোনদিন লক্ষ্য করিনি।
—পিরেল্লো হঠাৎ বলল–ফ্রান্সিস?
বলুন।
–আপনী কি গুপ্তধনের হদিশ করতে পারলেন?
–না। ঠিক জায়গাটা এখনও বুঝতে পারি নি। আচ্ছা পিরেল্লো সেই চামড়ায় লেখা ছড়াটা আপনার কাছে আছে?
ওটা সবসময় আমার বুকে সাঁটা থাকে। ছড়াটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। কাজেই ওভাবে রেখেছি। আমি বহুবার ছড়াটা দেখেছি। কিন্তু ছড়াটা ছাড়া আর কিছুই বুঝি নি।
–আমি পুরো চামড়াটা একবার দেখব। খুলে দেখাতে পারেন?
–বেশ দেখুন। পিরেল্লো কথাটা বলে বুকে দুহাত দিল। তারপর আঙ্গুল দিয়ে খুঁটে খুঁটে চামড়ার টুকরোটা খুলে নিল। ফ্রান্সিসের হাতে দিল। ফ্রান্সিস একটু গভীর মনোযোগ দিয়ে ছড়াটা বলতে লাগল। তারপর চামড়াটা ওল্টল। খুব অস্পষ্ট আঁকিঝুঁকির মতো। ফ্রান্সিস বলে উঠল–শাঙ্কো আরও একটা জ্বলন্ত মশাল আনা চাই। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না। শাঙ্কো একছুটে দরজায় একটা মশাল নিয়ে এল। ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে বলল–আচ্ছা এটার উল্টেপিঠ কোনদিন দেখেছিলেন?
না তো। পিরেল্লো বোকার মত ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তবু এবারে আরেকটু স্পষ্ট দেখা গেল। একটা অস্পষ্ট ত্রিকোণ আঁকা। এই চিহ্নটাও পূজোর ঘরে দেখিনি। এবার সাজঘরটা দেখতে হবে।
–চলো৷ ফ্রান্সিস মন্দিরের দরজার দিকে চলল। মশাল হাতে ফ্রান্সিস নামতে লাগল। পূজোর ঘরে এল। তারপর সাজঘরে এল। মশাল শাঙ্কোর হাতে দিল। পাথরের তাকে জড় করা পোশাক সব সরাতে লাগল। পোশাকগুলি সরিয়ে দিতেই পাটাতনের কোণার দিকে অস্পষ্ট দাগ ত্রিকোণ। তার ঠিক মাঝখানে ছোট্ট গোল দাগ। সেটাও অস্পষ্ট।
ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে চামড়াটা ফিরিয়ে দিল। পিরেল্লো নিয়ে বুকে সেঁটে রাখলেন। বললেন–কিছু হদিশ পেলেন। ফ্রান্সিস হেসে বলল-অত সহজে।
–তাহলে কী নিয়ে আপনি ভাবছেন? পিরেল্লো জানতে চাইলেন।
–একটা সমস্যা। পিরেল্লোকে বলল ফ্রান্সিস।
–কী সমস্যা?
আপনার গুরুদেব হোমক যে চামড়ার টুকরো আপনাকে দিয়েছেন তাতে কিছু নির্দেশ আছে। ছড়াটা এমনি এমনি লেখানয়। এটারও অর্থ আছে। সেটা নিয়েও ভাবছি।
–বুঝলাম-বাঁকা হাসি হেসে পিরেল্লো বললেন–গুপ্তধন উদ্ধার করা আপনার অসাধ্য। ঠিক কিনা?
উঁহু। ফ্রান্সিস বলল–আমি সমাধানের শেষ পর্যায়ে।
–তাহলে বের করুন।
–এখনই হবে না। শুধু শেষ সমস্যাটার সমাধান বাকি।
–সমস্যাটা কী?
–শেষ সাত সংখ্যক গর্তটায় দেবমূর্তি ঢুকিয়ে শায়িত রাখা আছে। কিন্তু তারপরেও আট সংখ্যক একটা গর্তত রয়েছে। তাতে দেবমূর্তি নেই। তাহলে ওটা কেন রাখা হয়েছে? গর্তটা কিছু মাটি দিয়ে ভরা আছে। কথাটা বলে ফ্রান্সিস গর্ত থেকে সব মাটি বের করল। বলল–বিস্কো–এই গর্তটায় কী আছে দেখ তো।
এবার বিস্কো গর্তটার মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেখল শুধু মাটিই নয় আরো কিছু আছে। নরম কিছু। ও আঙ্গুল বেঁকিয়ে সেই নরম জিনিসটা টেনে বের করল। তুলো। নরম তুলো। বিস্কো বলল–ফ্রান্সিস–এই দেখ শুধুতুলল। ফ্রান্সিস হাতে নিয়ে দেখল। বলল– নিশ্চয়ই একটা শক্ত কিছু লাগল। ফ্রান্সিস ঠিক বুঝতে পারল না ওটা কী? আস্তে আস্তে জিনিসটার গায়ে আঙ্গুল বুলোত বুলোত বলল–মনে হচ্ছে–একটা –একটা চাবি।
–চাবি? পিরেল্লো বললেন।
—হ্যাঁ চাবি। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে চাবিটা বের করল। ফ্রান্সিস চাবিটা চোখের সামনে এনে দেখাল।
কীসের চাবি? চাবিটা কেন রাখা আছে? পিরেল্লো বলল।
কারণ নিশ্চয়ই আছে। দামী কোন কিছুজিনিস গোপনে রাখার জন্যে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে কি রাজা হানমের গুপ্ত ধনভাণ্ডার খোলার চাবি এটা? পিরেল্লো বললেন।
–সেটা দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাই দেখুন। পিরেল্লো বললেন।
–শুধু আমরা থাকলে সেটা হবেনা। সেনাপতি মশাইকেও থাকতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো মাননীয় সেনাপতিকে ডাকতে হয়। পিরেল্লো বললেন।
–সে কথাই বলছিলাম। আপনি বিস্কোকে নিয়ে যান। সেনাপতিমশাইকে বলবেন রাজা হানমের গুপ্ত ধনভাণ্ডার আমরা প্রায় উদ্ধার করেছি। ফ্রান্সিস বলল।
-মিথ্যে কথা। আপনি গুপ্তধনের হদিশ পেয়েছেন। পিরেল্লো বলল।
–না। হদিশ এখনও পাই নি। ফ্রান্সিস বলল।
–তবে সেটা বলুন। পিরেল্লো বলল।
না। গুপ্তধন সম্বন্ধে সব আপনাকে বলতে আমি দায়বদ্ধ নই। ফ্রান্সিস বলল।
–তবে কাকে বলবেন এই গুপ্তধন খোঁজার কথা? পিরেল্লো জানতে চাইল।
–বলবো মাননীয় রাজা আর সেনাপতিকে। ফ্রান্সিস বলল।
না। আপনি আমাকে সব বলবেন। পিরেল্লো গলায় জোর দিয়ে বলল।
–আগে সব বলেছি, আমি আপনার কাছে দায়বদ্ধ নই। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে আপনাদের মরতে হবে। পিরেল্লো কড়া গলায় বলল।
অতটা কব্জির জোর থাকলে আমাদের হত্যা করুন। ফ্রান্সিস শান্ত সুরে বলল।
ফ্রান্সিস কিছু বোঝার আগেই পিরেল্লো কোমর থেকে একটা বাঁকা মাথা বড় ছোরা বের করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অন্যমনস্ক ফ্রান্সিস ছিটকে পড়ল মেঝেয়। পিরেল্লো ছোরাটা ফ্রান্সিসের বুক লক্ষ্য করে বিধতে গেলে ফ্রান্সিস ঘুরে গেল আর ছোরাটা বিধল ওর বাঁ বাহুমূলে। রক্ত বেরিয়ে এল। বিস্কো একটা লাফ দিয়ে পিরেল্লোকে জাপটে ধরল। তারপর বুকের নীচে হাত দিয়ে ওর ছোরাটা বের করল। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে উঠল, ওকে হত্যা করো না। গুপ্তধনের ব্যাপারে ভাবতে-ভাবতে ওর মাথার ঠিক নেই।
বিস্কো দ্রুত ফ্রান্সিসের কাছে এল। মশালের আলোয় দেখল কাটা জায়গাটা বড় না হলেও বেশ রক্তপাত হচ্ছে। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে কাপড় ছিঁড়ে ফ্রান্সিসের কাটা জায়গাটা বেঁধে দিল। ফ্রান্সিসের একটু আরাম লাগল। রক্ত পড়া বন্ধ হলো।
ওদিকে পিরেল্লো দ্রুত উপরে উঠে এলেন। চার বর্শাধারীকে ডাকলেন। বললেন, দুটো চোর রাজা হানমের গুপ্তধন উদ্ধার করেছে। সেই ধনভাণ্ডার নিয়ে ওরা বাইরে আসবে। পালাতে চাইবে। ওদের পালাতে দিও না। তৈরী থাকো।
বিস্কো গলা চেপে বলল, বোঝাই যাচ্ছে এই লোকটা প্রহরীদের সাহায্যে ফ্রান্সিস আর বিস্কোকে বন্দী করবে।
এখনই প্রহরীদের আক্রমণ করবো? একজন ভাইকিং বন্ধু জানতে চাইল।
না। আগে ফ্রান্সিসরা উঠে আসুক। বিস্কো বলল।
কিছুপরে ফ্রান্সিসকে ধরে ধরে বিস্কো প্রধান দ্বার পর্যন্ত এল। এবার পিরেল্লো গলা চড়িয়ে বললেন, এই দুজনেরই কথাই বলছিলাম। ওদের হত্যা কর।
বিস্কো দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল, ও-হো-হো-।
প্রহরীরা বর্শা হাতে ফ্রান্সিস আর বিস্কোর দিকে ছুটে এল। বিস্কোরা প্রহরীদের ওপর আঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো লড়াই। বর্শা দিয়ে তরোয়াল ঠেকানো অসুবিধে। একবার বর্শা হাতছাড়া হলে আক্রমণকারী নিরস্ত্র হয়ে যায়। লড়াইয়ের মধ্যে ফ্রান্সিসের উচ্চস্বর শোনা গেল, ভাইসব, কাউকে হত্যা করো না। প্রয়োজনে বন্দী কর।
অল্পক্ষনের মধ্যে লড়াই শেষ। প্রহরীদের মধ্যে দু তিনজন আহত হয়ে ঘাসে ঢাকা মাঠে পড়ে রইল।
ফ্রান্সিস চারদিকেতাকিয়ে তাকিয়ে পিরেল্লোকে খুঁজতে লাগল। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় দেখল পিরেল্লো আর একজন প্রহরী একটা ওক গাছের তলা দিয়ে ছুটছে। ফ্রান্সিস বলল, বিস্কো আমি ছুটতে পারছি না। রক্তপড়া বেড়ে যাবে। তুমি ছুটে গিয়ে পিরেল্লোকে ধর।
বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে ছুটল। পলায়মান পিরেল্লো আর একজন প্রহরী তখন রাজবাড়ির পাশ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। বিস্কো দ্রুত ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিস্কো পিরেল্লোদের কাছে এসে পড়ল। চেঁচিয়ে বলল, পিরেল্লো পালিয়ে রেহাই পাবেন না। কাজেই পালাবার চেষ্টা না করে আমাদের কাছে আসুন। ফ্রান্সিস আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে বলেছে।
পিরেল্লো দাঁড়িয়ে পড়লেন। সঙ্গের যোদ্ধাটিও থামল। দুজনেই মুখ খুলে হাপাতে লাগল। বিস্কো। ওদের কাছে এল হাঁপাতে হাঁপাতে বিস্কো বলল যদি রাজা হানমের গুপ্ত ধনভাণ্ডার আবিষ্কার করতে পারি, রাজা কানবহনাকে বলবো ধনভাণ্ডারে কিছু অংশ আপনাকে যেন দেন।
সত্যি বলছো? পিরেল্লো বললেন।
হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আপনি ফ্রান্সিসের কাছে চলুন। আমরা আপনার কোনোরকম ক্ষতি করবো না। বরং আপনি ফ্রান্সিসকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন সেইজন্যে আমি আপনাকে এক্ষুণি মেরে ফেলতে পারি। বিস্কো বলল।
আমার দোষ হয়ে থাকলে পিরেল্লো বলতে গেলেন।
তাকে থামিয়ে দিয়ে বিস্কো বলল, ঠিক আছে, আপনি ফিরে চলুন।
তিনজন ফিরেচলল মন্দিরেরদিকে। মন্দিরের দরজার কাছে এসে দেখল প্রহরীরা আহতহয়ে এখানে ওখানে ঘাসের ওপর পড়ে আছে। ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টিতে তরোয়াল ঢুকিয়ে রেখেছে।
ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে বলল–আপনি একটা কাজ করুন। একবার সেনাপতিমশাইয়ের বাড়িতে যান। সেনাপতিকে বলুন–আমরা গুপ্তধন উদ্ধার করেছি। আপনি কিছু যোদ্ধাকে পাঠিয়ে দিন। নিজেও আসুন। বিস্কো বলল–ফ্রান্সিস আমি রাজপুরোহিত পিরেল্লোকে কথা দিয়েছি যে তাকে আমরা গুপ্তধনের কিছু অংশ দেব।
-বেশ। রাজাকে বলবো। তারপর অনুরোধ করবো। ফ্রান্সিস বলল।
ভোর হয়েছে। রাজবাড়ির পেছনে বিরাট বাগান। গাছগাছালি। পাখির ডাক শুরু হয়ে গেছে। রোদও উঠল।
পিরেল্লো আর বিস্কো সেনাপতির বাড়ির সামনে এল। বাইরের দরজা বন্ধ। একজন প্রহরী বর্শা হাতে পাহারা দিচ্ছে। প্রহরী পিরেল্লোকে দেখে মাথা একটুনুইয়ে শ্রদ্ধা জানাল। পিরেল্লো বললেন–প্রহরী সেনাপতিকে খবর দাও। খুব দরকারি কথা আছে।
প্রহরীটি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। পিরেল্লোদেরও ঢুকতে বলল। পিরেল্লো আর বিস্কো ঢুকল। একটা বেশ বড় ঘর। গোল শ্বেতপাথরের টেবিল ঘরের মাঝখানে। টেবিলটার চারপাশে কালো আবলুস কাঠের আসন পাতা। গদিপাতা। দুজনে বসল।
একটু পরে প্রহরী ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। বলল–অপেক্ষা করুন। মাননীয় সেনাপতি আসছেন।
আরো কিছুক্ষণ পরে সেনাপতি এল। বিস্কোরা উঠে দাঁড়াল। সেনাপতিমশাই বসতে ইঙ্গিত করল। বিস্কোরা বসল। পিরেল্লোর দিকে তাকিয়ে বলল কী ব্যাপার বলুন তো? এত সকালে এসেছেন।
পিরেল্লো বিস্কোকে কিছু বলার জন্যে ইঙ্গিত করলেন। বিস্কো বলতে লাগল আমরা জাতিতে ভাইকিং। দেশে দেশে আমাদের জাহাজটায় চড়ে ঘুরে বেড়াই। কোথাও কোনো গুপ্তধনের কথা জানলে আমরা বুদ্ধি খাটিয়ে উদ্ধার করি।
তারপর উদ্ধারকরা গুপ্তধন নিয়ে পালিয়ে যান। সেনাপতি গোঁফেরাকে হাসলেন।
–অনেক জায়গাতেই এই ধরনের কথা আমরা শুনেছি। কথাটা আমাদের কাছে নতুন নয়। আর একথাটা যে সত্যি নয় সেটার প্রমাণ আপনাকে দিয়ে যাবো। বিস্কো বলল।
–ঠিক আছে। এখন রাজপুরোহিত বলুন আমার কাছে এসেছেন কেন?
এই ভাইকিংরা রাজা হানমের গুপ্তধন উদ্ধার করেছে বলে দাবি করছে। তাই একবার সব বুঝেশুনে নিতে আপনাকে যেতে অনুরোধ করেছে। পিরেল্লো বললেন।
-সত্যিই কি পেরেছে গুপ্তধন উদ্ধার করতে? সেনাপতি বললেন।
মন্দিরে গেলেই সব জানতে পারবেন। বিস্কো বলল।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সেনাপতিবলল–ঠিকআছে। আপনারা যান–আমি আসছি।
বিস্কোরা ফিরে এল। ফ্রান্সিসকে বলল–সব বলা হয়নি। তবে সেনাপতি বললো যে সে আসবে।
–ফ্রান্সিস–বিস্কো ডাকল।
–হুঁ। বলো। ফ্রান্সিস বিস্কোর দিকে তাকাল।
-সত্যিই কি তুমি রাজা হানমের গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছো? বিস্কো বলল। ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টিতে রাখা একটা লম্ফ চাবি বেরকরল। বিস্কোকে চাবিটা দেখিয়ে বলল সমাধান। সেনাপতি মশাইকে আসতে দাও।
কিছুপরে সেনাপতি ঘোড়ায় চড়ে এল। সঙ্গে চারজন প্রহরী।
ঘোড়া থেকে নেমে সেনাপতি বলল–রাজপুরোহিত কী উদ্ধার করেছেন দেখান। পিরেল্লো ফ্রান্সিসের দিকে তাকালেন। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে মাথা একটু নিচু করে সম্মান জানিয়ে বলল–আমার সঙ্গে আসুন।
সবাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল আহত প্রহরীরা এখান থেকে চলে গেছে। ফ্রান্সিস ভাবল যাক বাঁচা গেল। কিছুক্ষণের লড়াইয়ের খবরটা সেনাপতি পায় নি।
মশালের আলোয় মন্দিরের গর্ভকক্ষে এল সবাই। ফ্রান্সিস পেছনের সাজঘর দেখিয়ে বলল–মাননীয়, গুপ্তধন রয়েছে ঐ সাজঘরে।
-তাই নাকি! সেনাপতি গলা চড়িয়ে বলল।
সেনাপতিকে নিয়ে ফ্রান্সিস আর পিরেল্লো সাজঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিস কাঠের বেদীর কাছে এল। ফেটি থেকে চাবিটা বের করল। বেদীটার ওপর জড়ো করা পোশাক সরিয়ে দিল। বেদীর গায়ে চাবির ফুটো। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ওর চাবিটা ঢোকাতে লাগল। চাবিটা শেষ পর্যন্ত ঢুকিয়ে আসতে ডানদিকে মোচড় দিল। ডালা খুলল না।
বিস্কো দ্রুত ফ্রান্সিসের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। যদি গুপ্তধন দেখাতে না পারে তবে ফ্রান্সিস বিপদে পড়তে পারে। তখন সাহায্য চাই।
ফ্রান্সিসের মুখ তখন ঘেমে উঠেছে। শুধু হাতে মুখ কপাল মুছে নিয়ে ফ্রান্সিস আবার চাবিটা ঢোকাল। দুএকবার এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে জোরে ডানদিকে মোচড় দিল। কট। একটা মৃদুশব্দ হল। পাটাতন খুলে গেল। ফ্রান্সিস পাটাতনের ঢাকনাটা এবার খুলে ফেলল। একটা কালো চামড়ার ব্যাগমত দেখা গেল। ফ্রান্সিস ব্যাগটা তুলে বেদীর ওপর রাখল। তারপর মুখ বাঁধা সোনালি মোটা সুতোয় বাঁধা দড়িটা খুলে ফেলল। মুখটা খুলে একমুঠো সোনার চাকতি তুলে এনে বেদীতে রাখল। তারপরে বের করল একটা চারপাশে হীরে বসানো আয়না। সবাই অবাক হয়ে দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস একটা মুক্তোর মালা তুলে দেখিয়ে সব কালো চামড়ার ব্যাগটায় ভরে রাখল। দড়ি বন্ধ করে ব্যাগটা সেনাপতিকে। দিয়ে বলল–মাননীয় সেনাপতি এটাই রাজা হানমের গুপ্ত ধনভাণ্ডার। আমাদের কাজ শেষ। এবার আমরা জাহাজে ফিরে যাবো।
-সে কি। সেনাপতি বলল–ধনভাণ্ডারের কিছু অংশ তো আপনাদের প্রাপ্য।
–না। আমরা কিছু নেব না। তবে একটা অনুরোধ করছি। মাননীয় রাজাকে বলবেন এই গুপ্ত ধনভাণ্ডারের কিছু অংশ যেন রাজপুরোহিত পিরেল্লোকে দেওয়া হয়। উনিঃ গুপ্তধনের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। এবার ফ্রান্সিস পিরেল্লোকে বলল–এবার দেখলেন তো গুপ্তধনের প্রতি আমাদের কোন লোভ নেই।
বিস্কো ধ্বনি তুলল–ও–হো–হো।
ভাইকিং বন্ধুরাও গলা মেলালোও-হো-হো।
ফ্রান্সিসরা সদর রাস্তায় এল। চলল বন্দরের দিকে। গরম হাওয়া ছুটেছে। তার মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিসরা হাঁটতে লাগল। বিস্কো বলল–ফ্রান্সিস।
–হ্যাঁ বলো।
বলছিলাম বেশ বেলা হয়েছে। জাহাজে ফিরে আর আমাদের জন্যে রান্না করতে হবেনা।
–ঠিক আছে। একটা সরাইখানা দেখ। ফ্রান্সিস বলল।
পাওয়া গেল একটা বেশ বড়সরাইখানা। ফ্রান্সিসরা সরাইখানায় ঢুকল। সবারবসার জায়গা হল না। ফ্রান্সিস সরাইওয়ালাকে গিয়ে বলল-যত তাড়াতাড়ি পারো খেতে দাও। আমরা খুব ক্ষুধার্ত নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। সরাইওয়ালা পাকা দাড়ি নেড়ে বলল। ছুটল রান্নাঘরের দিকে।
ফ্রান্সিসরা খাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
Leave a Reply