সোনার ঘর
চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। ডেকে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস আর মারিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে সমুদ্রের জলে চাঁদেরআলোর ঝিকিমিকি দেখছিল।
সমুদ্রতীরে বিস্তৃত বনভূমি। ফ্রান্সিসের জাহাজ বনভূমির কাছে এল।
পেড্রো একটা গাছের মোটা ডালের সঙ্গে মাস্তুলের টানা দাঁড় বাঁধল ও আর নোঙর ফেলল না। জাহাজ আর বনভূমির ভেতরে ঢুকল না।
পেড্রোমাস্তল থেকে নেমে এল। ফ্রান্সিসকেবলল-বনেরমধ্যে আরজাহাজ ঢোকালামনা।
–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস বলল।
রাত বাড়ল, সে আসার জন্য হাঁকডাক শুরু হল।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হল। আজকে বেশ গরম পড়েছে। সমুদ্রের হাওয়ারও তেমন জোর নেই।
খালাশিরা অনেকেই ডেকের ওপরই শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়ল।
ফ্রান্সিসরা এখনও জানে না কী বিপদের মুখে ওরা জাহাজ বেঁধেছে।
ঐ বনভূমির ওপাশে ঘন গাছের আড়ালে নোঙর করা ছিল একদল জলদস্যুরজাহাজ। ফ্রান্সিসদের সাড়া পেতেই জলদস্যুরা সব চুপ করে গেল। নিঃশব্দে চলল ওদের চলাফেরা। কারো মুখে কথা নেই।
নিস্তব্ধ রাত। শুধু সমুদ্রের বাতাসের শন্ শন্ শব্দ। সময় বুঝে জলদস্যুনেতা ওদের জাহাজটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে চালিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজের কাছে নিয়ে এল। এত নিঃশব্দে যে ফ্রান্সিসরা বুঝতে পারল না। ফ্রান্সিসরা তখন নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে।
জলদস্যুরা নিঃশব্দে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠতে লাগল। ডেকের ওপর ঘুমিয়ে থাকা ভাইকিংদের কাছেবিস্ময় শালকাদেরপিঠে বুকেতরোয়ালের খোঁচা দিতে লাগল। শাঙ্কোদের ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়েই দেখে জলদস্যুর দল। ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি আবার জলদস্যুদের পাল্লায় পড়বে। ভাইকিংরা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে লাগল। জলদস্যুদের জনাকয়েক নিচে কেবিন ঘরে নেমে গেল। দুজন খোলা তরোয়াল হাতে অস্ত্রঘরের সামনে দাঁড়াল যাতে ফ্রান্সিসরা অস্ত্র না নিতে পারে।
জলদস্যুরা ভাইকিংদের সারি বেঁধে দাঁড় করাল কেবিনঘর থেকে সবাইকে বন্দী করে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস মারিয়াও এল।
জলদসুপতি বলল–তোমাদের দলনেতা কে?
ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে বলল–আমি।
–তোমরা বিদেশী?
–হ্যাঁ। আমরা ভাইকিং।
–তা তোমাদের কথা শুনেছি। জাহাজ চালাতে আর তরোয়াল চালাতে তোমরা ওস্তাদ। সমুদ্রের সঙ্গে তোমাদেরনাড়ির যোগ। একটু থেমে জাহাজের চারদিকেতাকিয়ে জলদস্যুনেতা বলল–তোমাদের তো ভিখিরির দশা। তোমাদের জাহাজ লুঠকরে কিছুই পাবনা।
দলনেতা এবার মারিয়ার দিকে তাকাল। বলল–এ কে?
আমাদের দেশের রাজকুমারী। হ্যারি বলল।
–তা এখানে কেন?
–আমাদের দলনেতা এঁর স্বামী। কাজেই স্বামীর সঙ্গেই তিনি যাবেন। হ্যারি বলল।
–আগে হলে এর কাছ থেকে গয়নাগাঁটি পাওয়া যেত। এখন তো ভিখারিনী। দলনেতা থামল। তারপর বললনা-না। গলায় সোনার হার আছে। দলপতি মারিয়ার দিকে হাত বাড়াল। মারিয়ারহাত সরিয়ে দিল। দলনেতা দ্রুত হাত বাড়িয়ে হারটা ছিঁড়ে নিল। মারিয়া কেঁদে উঠল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল কান্নাকাটি করো না। দলনেতা গলা বাড়িয়ে বলল সবাইকে আমাদের ক্যারাভেল জাহাজে নিয়ে চল। সবচেয়ে নিচের কয়েদঘরে বন্দী করে রাখো! ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলল–আমরা কী অপরাধ করেছি যে আমাদের বন্দী করবে?
দলনেতা হো হো করে হেসে উঠল। বলল–শোন তাহলে তোমাদের নিয়ে ক্রীতদাস বেচাকেনার হাটে নিয়ে যাবো। য়ুরোপীয় ক্রীতদাস তো পাওয়া যায় না। তোমাদের জন্য ভালো দাম পাবো। তার ওপর রয়েছে তোমাদের রাজকুমারী। ক্রীতদাসী হিসেবে দারুণ দাম পাবো। শাঙ্কো ওদের দেশিয় ভাষায় বলল–ফ্রান্সিস-লড়াই। ফ্রানিস মাথা নাড়ল। বলল–আমরা কি এখনও নিরস্ত্র সহজেই হেরে যাবো।
–এদের সবকটাকে কয়েদ ঘরে ঢোকাও জলদস্যপতি বলল। ফ্রান্সিস বলল–না। আমাদের রাজকুমারীকে ঐনরককুণ্ডে রাখা চলবে না।
–তাহলে তো এখানে রাজপ্রাসদে নিয়ে আসতে হয়। জলদস্যপতি বলল।
–তার দরকার নেই। উনি আমাদের জাহাজে থাকবেন। ফ্রান্সিস বলল।
যদি পালিয়ে যায়, জলদস্যুপতি বলল।
–উনি একা সমুদ্র সাঁতরে পার হবেন অসম্ভব? ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে তাই থাকবে। জলদস্যুপতি বলল।
মারিয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাটা হতে ফ্রান্সিস খুশি হল। এবার পালানোর ধান্দা। কিন্তু ঐ নরক থেকে কি পালানো সম্ভব? চেষ্টা চালিয়ে দেখতে হবে।
ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল জলদস্যুরা। একেবারে নিচেরতলায় কয়েদখানা।
প্রহরীরা কয়েদখানার লোহার দরজার বড় বড় তালা খুলল। সশব্দেদরজা খোলা হল। .ফ্রান্সিসরা দলবেঁধে ঢুকল।
লোহার দরজা বন্ধ করা হল। অন্ধকার ঘরে দুটো মশাল জ্বলছে। ফ্রান্সিসরা বসে পড়ল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। ও দেখল ওদের আগেও চারপাঁচজন কয়েদী আছে। তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ। একে বন্দী করেছে কেন? ক্রীতদাস কেনা বেচার হাটে এই বৃদ্ধের কী মূল্য?
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সেই বৃদ্ধের কাছে গেল। পাশে গিয়ে বসল। বলল–আপনি এখানে কতদিন বন্দী আছেন?
–হিসাব করে বলতে পারবো না। তবে দীর্ঘদিন। বৃদ্ধ বলল।
আপনাকে নিয়ে ওরা কি করবে? ক্রীতদাস কেনাবেচার হাটে আপনার কোন মূল্যই নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–কী জানি। কেন যে ওরা আমাকে এভাবে ফেলে রেখে দিয়েছে তা ওরাই জানে। বৃদ্ধ বলল।
–আপনাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ফ্রান্সিস বলল।
–এরা উচিত অনুচিতের ধার ধারে না। বৃদ্ধ বলল।
ফ্রান্সিস বন্ধুদের কাছেফিরে এল। জলদস্যুদের এই ক্যারাভেল জাহাজের বন্দীশালা যে কী ভয়াবহ তার অভিজ্ঞতা ফ্রান্সিসদের আছে। ফ্রান্সিস ভাবল যে ভাবেই হোক এই বন্দীশালা থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? ও এটাও স্থির করল প্রহরীদের সঙ্গে লড়াই করে পালাতে হবে। নিরস্ত্র অবস্থায় লড়তে গেলে হয়তো পালানো যাবে কিন্তু তাতে কিছু বন্ধুর জীবন যাবে। ও ভাবল–এই ব্যাপারে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা যাক। ও বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাইসব একটা কথা বলছিলাম। এই কয়েদঘরে আমাদের জীবন শেষ করতে আমি রাজি নই। তাই বলছিলাম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা প্রহরীদের সঙ্গে লড়াই করে পালাবো। কিন্তু সেটা করতে গেলে কিছু বন্ধুর প্রাণ যাবে। তোমরা কজন প্রাণ দিতে রাজি বল।
বন্ধুরা ফ্রান্সিসের কথা শুনে বেশ অবাকই হল। ফ্রান্সিস এভাবে বলছে কেন? ফ্রান্সিস বলল–এখানে থাকলেও আমাদের প্রাণ যাবে। সুতরাং আগে থেকে মৃত্যু বরণ করে কয়েকজন বন্ধুর জীবনের বিনিময়ে আমরা পালাতে পারবো।
–কিন্তু ফ্রান্সিস তুমি শুধু আমাদের মুক্তির কথা ভাবছে রাজকুমারী মারিয়ার কী হবে? হ্যারি বলল।
–আমরা মুক্তি পেলে মারিয়াকেও মুক্ত করতে পারবো। ফ্রান্সিস বলল।
–সেক্ষেত্রে সমস্ত জলদস্যুদের লড়াইয়ে হারাতে হবে। সেটা কি পারবে? শাঙ্কো বলল।
–একটা তরোয়াল হাতে পেলে পিরবোফ্রান্সিস বলল। বন্ধুরা চিন্তায় পড়ল। ফ্রান্সিস এরকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কেন বুঝে উঠতে পারল না। আসলে ফ্রান্সিস অধৈর্য হয়ে উঠেছিল।
বন্ধুরা কয়েকজন বলে উঠল–ফ্রান্সিস তুমি যদি বল আমরা প্রাণ দিতে রাজি।
–তাহলে সেভাবেই তৈরি থাকব। লড়াই হবেই। ফ্রান্সিস বলল।
লোহার দরজাটার ঢং ঢং শব্দ হল। প্রহরীরা খাবার নিয়ে এসেছে। দরজা খুলে দুজন প্রহরী খোলা তরোয়াল হাতে দরজার দুপাশে দাঁড়াল। বাকি দুজন প্রহরী খাবার নিয়ে ঢুকল। ফ্রান্সিসদের সামনে একটা করে গোল পাতা পেতে দিল। তারপর দুজনে মিলে খাবার দিল। পোড়া রুটি। তরিতরকারির ঝোল আর মাছ। ফ্রান্সিসরা খেতে লাগল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে সেই একই কথা বলল–পেটপুরে খাও। ভালো না লাগলেও খাও। শরীর ঠিক রাখো।
খাওয়া শেষ। প্রহরীরা এঁটো পাতা নিয়ে চলে গেল। দরজা বন্ধ হল।
ফ্রান্সিসরা শুয়ে বসে সময় কাটাতে লাগল।
ফ্রান্সিস বৃদ্ধটির কাছে গেল। কথাইবা বলে সময় কাটানো। বৃদ্ধটি শুয়ে ছিল, ফ্রান্সিস কাছে আসতে উঠে বসল। ফ্রান্সিস বলল–আপনার দেশ কোথায়?
পর্তুগাল।
–কী করে বন্দী হলেন?
–সে অনেক কথা। আমাদের জাহাজ জলদস্যুরা লুঠ করল। সবাইকে বন্দী করল। তারপর ক্রীতদাসের বেচাকেনার হাটে অনেককে বিক্রি করল। আমার তখন প্রচণ্ড জ্বর। অসুস্থ মানুষকে কেকিনবে? আমি বেঁচে গেলাম। আমাকে যতবারই ঐসব হাটে নিয়ে গেছে আমি হাত পা ভাঙার ভান করেছি। খরিদদার একজন হাত পা ভাঙা মানুষকে কিনবে কেন? জলদস্যুরা যত বলে আমি সুস্থ আমি ততবারই হাত পা ভাঙার ভান করি। এভাবেই আমি বেঁচে গেলাম। অবশ্য যদি এইনরককুণ্ডে থাকাকে তুমি বেঁচে থাকা বলো।
–আপনি কখনও পালাবার চেষ্টা করেন নি। ফ্রান্সিস জিজ্ঞাসা করল।
না। সেটা অসম্ভব। বৃদ্ধ বলল। তারপর দরজার দিকে একবার দেখে নিয়ে বলল– আমি একটা কাজ অনেকদূর এগিয়ে রেখেছি। বাকিটা পারবে?
ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বলল কী কাজ?
জাহাজের তলায় যে জোড়া থাকে আমি দীর্ঘদিন ধরে তা ঘষে ঘষে পাতলা করেছি। বৃদ্ধ বলল।
–সত্যি? ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বৃদ্ধ কী বলছে?
–হ্যাঁ এই লোহার হাতল দিয়ে। বৃদ্ধ একটা লোহার হাতল পাশ থেকে দেখাল। তারপর বলল–ঐ জোড় একবারে পাতলা হয়ে গেছে। এখন শক্ত কিছু দিয়ে চাড় দিতে পারলে জোড় খুলে যাবে। মানুষ বেরোবার মত ফাঁক অনায়াসে করা যাবে।
স্থান কাল ভুলে ফ্রান্সিস ধ্বনি তুলল–হো হো হো। বন্ধুরা অবাক। সঙ্গে ওরাও অবশ্য ধ্বনি তুলল। সবাই ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলল–এখন কিছু বলা যাবে না। সব পরে বলছি।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিল। প্রহরীরা দরজা থেকে দূরে ওদের দৃষ্টির আড়ালে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
চলুন। দেখান ব্যাপারটা। ফ্রান্সিস বৃদ্ধকে বলল। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াল। দুজনে নিচে নেমে এল। বৃদ্ধ জোড়ের জায়গাটায় এল! আলো খুবই কম। তার মধ্যেই বৃদ্ধ জোড়াটা দেখাল ফ্রান্সিস হাত দিয়ে দেখল–সত্যি জোড়ের মুখটা পাতলা লাগছে। ও বুঝল শক্ত লোহার শাবল দিয়ে চাড় দিলে জোড় খুলে যাবে। এবার শেষ সমস্যা একটা লোহার শাবল। এটা জোগাড় করা সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা করতে হবে।
ফ্রান্সিস এবার প্রহরীদের একবার দেখে নিল? ওরা ধারে কাছে নেই। ও এবার বন্ধুদের কাছে ডাকল। তারপর সমস্ত ঘটনাটা বলল। তারপর বলল–এখন সমস্যা একটা শাবলের মত লোহার।
হ্যারি বলল–প্রহরীরা যে লোহার ডাণ্ডাটা দিয়ে শব্দ করে ওটা ওখানে ঝোলানো থাকে। ওটা হলে হবে তো?
সাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল। দরজার কাছে গেল। ঝুলিয়ে রাখা লোহার ডাণ্ডাটা নিয়ে এল। দেখা গেল এটার মুখ ভোতা হবে না।
হ্যারিই এবার বুদ্ধি দিল। বলল–যদি একটা তরোয়াল পাওয়া যায় তাহলে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তরোয়ালের চাড় দিলে ফঁক বাড়ানো যাবে।
–কিন্তু তরোয়াল পাবো কোথায়? বিস্কো বলল।
–চাইলে প্রহরীরা দেবে না? শাঙ্কো বলল।
–অসম্ভব–ফ্রান্সিস বলল–তাছাড়া তরোয়ালটা অনেকক্ষণ আমাদের কাছে রাখতে হবে। অত সময় পাবো না।
এবার হ্যারি বলল-শোন। আমি একটা উপায় বলছি। আমরা দস্যনেতাকে বলবো যে আমাদের তরোয়াল পূজোর একটা রীতি আছে। দুটো তরোয়াল আমাদের দিতে হবে। একদিন একরাত ধরে পূজো হবে। পূজো হয়ে গেলে তরোয়াল ফেরত দেব।
–সাবাস হ্যারি। এটাই একমাত্র পথ। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস প্রহরীদের ডাকলেন প্রহরী এগিয়ে এল।
ফ্রান্সিস বলল–তোমাদের দলনেতাকে বল আমি একটা অত্যন্ত দরকারি কথা বলবো।
–কী কথা? প্রহরী বেশ আয়েসি ভঙ্গীতে বলল।
–মুণ্ডু। ফ্রান্সিস বলল।
এ্যা? প্রহরী চমকে উঠল।
–আমার কথা হবে দলনেতার সঙ্গে। তুমি কে হে? ফ্রান্সিস বলল।
না। না মানে–প্রহরী আমতা আমতা করতে লাগল।
যাও। দলনেতাকে আসতে বল। ফ্রান্সিস হুকুমের সুরে বলল। প্রহরী চলে গেল। কিছু পরে দলনেতা এল। দাঁত ছড়িয়ে হেসে বলল–
–কেমন আছো সব?
—খুব ভালো। শাঙ্কো বলল।
-হা শরীরটা ঠিক রাখো৷ এবার থেকে মাংসও খেতে দেওয়া হবে। দলনেতা বলল।
–তাহলে তো খুবই ভালো। হ্যারি বলল।
এবার ফ্রান্সিস বলল–একটা দরকারি কথা ছিল।
-বলো। দলনেতা উৎসুখ মুখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল।
–আমাদের দেশের একটা রীতি আছে–তরোয়াল পুজো। ফ্রান্সিস বলল।
–সে আবার কী? দলনেতা বেশ আশ্চর্য হলো।
-বীরত্বের পূজো। সেটা আমরা এখানে করবো। তার জন্য দুটো তরোয়াল লাগবে। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ তো দুটো তরোয়াল নিও। তবে আগেই বলছি, পালাবার মতলব থাকলে কেউ রেহাই পাবে না। দলনেতা চড়া গলায় বলল।
–পালাবার মতলব থাকলেই কি পালাতে পারবো। আপনার কয়েদখানা থেকে পালানো প্রায় অসম্ভব। শাঙ্কো বলল।
প্রায় অসম্ভব মানে? একেবারে অসম্ভব। দলনেতা বলল।
ফ্রান্সিস সাবধান হল। বলল–ঐ একই কথা। এবার দুটো তরোয়াল দিন।
পূজো হবে কখন? দলনেতা জিজ্ঞেস করল।
সন্ধ্যে থেকে শুরু হবে। সারারাত চলবে। হ্যারি বলল।
–ও। জলদস্যুপতি আস্তেআস্তে চলে গেল। যাবার সময় একজন প্রহরীকে বলল– ওদের দুটো তরোয়াল দে। প্রহরী দুটো তরোয়াল দিল।
সন্ধ্যের একটু পরেই ফ্রান্সিসরা দুটো জ্বলন্ত মশালই খুলে নিল। তরোয়াল মশাল নিয়ে চলল নিচে খোলের দিকে। প্রহরীরা বলল কী ব্যাপার? তোমাদের পূজো কোথায় হবে? নিচে। সেলে। মশাল লাগাব। বিস্কো বলল।
নিচে খোলে নেমে এল ওরা। দুজন দুদিকে মশাল ধরে রইল। ফ্রান্সিস একমুহূর্ত দেরি করল না। একটা তরোয়ালের মাথা পাতলা জোড়টায় ঢুকিয়ে দিল। শাঙ্কো একটু দূরে আর একটা তরোয়ালের মাথা ঢোকাল। এবার আস্তে আস্তে চাড় দিতে লাগল। জোড় খুলে যেতে লাগল। খুলতে খুলতে একজন মানুষের শরীরের সমান হল।
সকালের আলো দেখা গেল–নিচে বালি। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল–শেষ সমস্যাটা মিটল। ভেবেছিলাম জলের মধ্যে পড়ব। এখন সহজেই নেমে যাওয়া যাবে। কিন্তু ফাঁক তো বেশি নয়। বেশ টেনে হিঁচড়ে শরীরটা জাহাজের নিচে থেকে বের করে আনতে হল। হাতপা কেটে গেলেও তবুমুক্তি। এখন সহজেই নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু ফাঁক যে বেশি নয়। তবু আস্তে আস্তে সবাই বেরিয়ে এল।
ভাইকিংরা মশাল নিভিয়ে দিল। বৃদ্ধকে ধরাধরি করে বাইরে আনল।
সবাই একত্র হল।
আকাশের চাঁদ উজ্জ্বল। চারদিক মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জলদস্যুদের জাহাজটার সঙ্গে ওদের জাহাজ দড়ি দিয়ে বাঁধা। এবার নিজেদের জাহাজ চালিয়ে পালানো।
সবাই জলে নামল নিঃশব্দে সাঁতরে চলল ওদের জাহাজের দিকে।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে নিয়ে হাল বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠল। তখনই দেখল কয়েকজন জলদস্যু মাস্তুলের নিচে বসে আছে। ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল–শাঙ্কো তরোয়াল দুটো আনো। শাঙ্কো নিচের দিকে তাকিয়ে তরোয়াল দিতে বলল।
একটু পরেই দুজনে তরোয়াল হাতে পেল। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল–এরা নরঘাতক। নিরীহ মানুষ নির্বিকারে হত্যা করে। এদের ওপর দয়া দেখানোর কোন মানে হয় না। দুটোকে খতম কর। বাকি দুটোকে দড়ি দিয়ে বাঁধো। তারপর কিছুদুরে গিয়ে জলে ফেলে দাও। এখানে ফেললে শব্দ হবে। জলদস্যুরা টের পাবে।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো খোলা তরোয়াল হাতে জলদস্যুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওরা। ভুত দেখার মত চমকে উঠল। ওরা তরোয়াল খোলার আগেই ফ্রান্সিস একজনের বুকে তরোয়াল ঢুকিয়ে দিল। সে ডেকের ওপর গড়িয়ে পড়ল। অন্যজন ততক্ষণে তরোয়াল তুলেছে। শাঙ্কো দ্রুত দুপা সরে গিয়ে তরোয়ালের কোপ বসালো ওর মাথায়। জলদস্যুটি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।
অন্য দুজনের সঙ্গে তরোয়ালের লড়াই চলল। ফ্রান্সিস জলদস্যুটির সঙ্গে হালকা চালে তরোয়াল চালাতে লাগল। ও চাইছিল জলদস্যুদের ক্লান্ত করতে। তাহলে সহজেই বন্দি করা যাবে।
লড়াই চলল। যে জলদস্যু ফ্রান্সিসের সঙ্গে লড়াই করছিল সে হঠাৎই লড়াই থামিয়ে হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল। ফ্রান্সিস দ্রুত ওর তরোয়াল দিয়ে জলদস্যুটির তরোয়ালে ঘা মারল। জলদস্যুর তরোয়াল ছিটকে পড়ল। মাস্তুলের গা থেকে ছেঁড়া দড়ি এনে ফ্রান্সিস ওর হাত বেঁধে ফেলল। অন্য জলদস্যুটিকেসঙ্গে তখন শাঙ্কোর তরোয়ালের লড়াই চলছে। শাঙ্কো তক্কে তক্কে রইল ওর পায়ে তরোয়ালের ঘা মারতে। সুযোগ পেয়ে গেল, শাঙ্কো। হঠাৎ এক লাফে ওর সামনে গিয়ে হাজির হল। জলদস্যুটি হকচকিয়ে গেল। শাঙ্কো এক মুহূর্ত দেরি না করে ওর পায়ে তরোয়াল চালাল। পা কেটে গেল। জলদস্যু পা টিপে বসে পড়ল। শাঙ্কোও ফ্রান্সিসের দেখা দেখি মাস্তুল থেকে ছেঁড়া দড়ি নিয়ে জলদস্যুটির হাত বেঁধে ফেলল। হাত বাঁধা দুজনে ডেকের ওপর বসে রইল।
ততক্ষণে বন্ধুরা জাহাজে উঠে পড়েছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–যত দ্রুত সম্ভব জাহাজ ছাড়। দাঁড়ঘরে যাও। দাঁড় টানা শুরু কর। পাল খাটাও। কিন্তু কোনরকম শব্দ যেন না হয়। সব কাজ নিঃশব্দে করতে হবে। জলদস্যদের জাহাজে হৈচৈ শুরু হয়েছে। ওরা এতক্ষণ বুঝতে পেরেছে যে আমরা পালিয়েছি। সব জলদি।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিসদের জাহাজের পাল ফুলে উঠল। জাহাজ গতি পেল। জলদস্যুদের জাহাজ পেরিয়ে যাবার সময় শাঙ্কো চার জলদস্যুকে দুহাতে ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলল।
ফ্রান্সিস চারদিকে তাকাল। মারিয়া কোথায়? মারিয়া ডেকে উঠে আসেনি। ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল ও দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিজেদের কেবিনঘরে এসে দেখল দরজা খোলা। ফ্রান্সিস এক লাফে ঘরে ঢুকল। দেখল মারিয়া চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছে। দুচোখ বোঁজা। ফ্রান্সিস দ্রুত কাছে এসে ডাকল মারিয়া-মারিয়া। মারিয়া চোখ মেলে তাকাল। হাসল।
কী হয়েছে তোমার?
জ্বর হয়েছে। তবে ভাল আছি। মারিয়া বলল।
ফ্রান্সিস মারিয়ার কপালে গলায় হাত বুলোল। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।
ফ্রান্সিস বলল–কী বলছো? সাংঘাতিক জ্বর। আমি ভেনকে ডেকে আনছি।
একটু পরে ভেন এল। হাতে দুটো বোয়াম। ন্যাকড়া, দুটো পাথর। ভেন মারিয়ার কপালে হাত রাখল।
ঝোলা থেকে দুটো শুকনো ফুল বের করল। পাথর দুটো চেপে ফল দুটো গুঁড়ো করল। ন্যাড়ায় ছাঁকল জল মিশিয়ে হাতের তালুতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিনটে বড়ি বানাল। মারিয়ার হাতে দিয়ে বলল–এখন একটা খান। রাত্রে একটা খাবেন। কাল সকালে একটা খাবেন। মারিয়া বড়ি তিনটে নিল ফ্রান্সিস কাঠের গ্লাসে জল নিয়ে এল। মারিয়া একটা বড়ি নিলো।
ভেন চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল–কিছুনা। ঠাণ্ডা লেগেছে।
–তাই হবে। কাল রাত্রে অনেকক্ষণ ডেকএর ওপর ছিলাম। ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঠাণ্ডা কি, লেগেছে। তবু ফ্রান্সিসের চিন্তা গেল না। এই বিদেশে এমন কঠিন অসুখ করলে মরিয়াকে বাঁচানোই যাবে না। মারিয়ার কপালে সারা রাত ফ্রান্সিস জলপট্টি লাগল। ভেন এর ওষুধে কাজ হল। পরদিন সন্ধ্যে নাগাদ মারিয়া সুস্থ হল।
সেই বৃদ্ধ লোকটিকে ফ্রান্সিসরা নিজেদের জাহাজেই তুলে নিয়েছিল। ফ্রান্সিসদের সঙ্গেই রইল।
দিন কয়েক পরে।
সেদিন ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে এল। বলল–ফ্লেজার কিছু দিকঠিক করতে পারলে?
–কিছুনা। বলতে পারো একেবারে আন্দাজে চলছে জাহাজ।
–শুধু উত্তরদিকটা ঠিক রাখো। ফ্রান্সিস বলল।
–তাই বা পারছি কই। ফ্রেজার বলল।
এ ছাড়া কোন উপায় নেই। দেখি ধারে কাছে কোন দেশ দ্বীপ পাই কিনা। পেলে দিক চেনাটা সহজ হবে। ফ্রান্সিস বলল।
চারপাঁচদিন পরের কথা। সেদিন দুপুরে নজরদার পেড্রো চেঁচিয়ে বলল–আমাদের দেশের এক জাহাজ যাচ্ছে। জাহাজে দেশের পতাকা উড়ছে। ফ্রান্সিসকে বলো। বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিসের কেবিনঘরে এল, বলল–আমাদের দেশের একটা জাহাজ আমাদের জাহাজের খুব কাছে। ওদের সঙ্গে কথা বলব?
–নিশ্চয়ই। দেশবাসী বলে কথা। চলো ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল।
–আমাদের কাছে যে কোন পতাকাই নেই। ওরা বুঝতে পারেনি। বিস্কে বলল।
–আমাদের জাহাজে অনেকদিন আগেই ছিঁড়ে উড়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্লেজার তাদের জাহাজ নতুন জাহাজের কাছাকাছি আনল। ফ্রান্সিস চিৎকার করে। বলল–ভাই তোমরা কি ভাইকিং? ভাইকিং দেশ থেকে এসেছো?
–হ্যাঁ। ঐ জাহাজের একজন গলা চড়িয়ে বলল। ফ্রান্সিসদের জাহাজের ভাইকিং বন্ধু ধ্বনি তুলল–ও হে বো। ঐ জাহাজ থেকেও ভাইকিংরাও গলা মেলাল। সবাই আনন্দ করতে লাগল।
জাহাজ দুটো গায় গায় লাগল। ফ্রান্সিস লাফিয়ে ঐ জাহাজে গেল। ভাইকিংদের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমাদের দলনেতা। এজন বেশ শক্তসমর্থ যুবক এগিয়ে এল। বলল– আমি। ডেভিড।
–আমি ফ্রান্সিস তোমরা এদিকে এসেছো কেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
ব্যবসা করি আমরা। বড় বড় বন্দর থেকে দড়িপালের কাপড় সস্তায় কিনে বিভিন্ন ছোট ছোট বন্দরে বিক্রি করি।
–তোমরা গুপ্তধনের সন্ধান করো না? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–না-না। ডেভিড মাথা নাড়ল।
–আমরা তাই করি। অনেক গুপ্তধন আমরা আবিষ্কার করেছি। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে, গুপ্তধন খুঁজে বের করতে আমরা আনন্দ পাই। ফ্রান্সিস বলল।
বদলে তোমরা কি পাও? ডেভিড জানতে চাইল।
–কিছুইনা। ফ্রান্সিস বলল।
–সেকি কত কষ্ট করে গুপ্তধন খুঁজে বের করলে অথচ বিনিময়ে কিছুই নাও না। ডেভিড বলল।
–হ্যাঁ। ওটাই আমাদের নীতি। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো বহু দেশ ঘুরেছো? ডেভিড বলল।
অনেক অনেক দেশ। ফ্রান্সিস বলল।
–দেশে ফিরবে না? ডেভিড জানতে চাইল।
–সেটাই আর হয়ে উঠবে না। ফ্রান্সিস বলল।
ডেভিড হঠাৎ বলল–দাঁড়াও দাঁড়াও। তুমি তোমার নাম বললে ফ্রান্সিস।
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল।
–তুমি আর তোমার বন্ধুরাই কি সোনার ঘণ্টা উদ্ধার করেছো? ডেভিড বলল।
হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা রাজবাড়িতে দেখেছি। ডেভিড বলল। তোমাদের বীরত্বের কথা সারা দেশ জানে। তোমাকে চিনতে আমার দেরি হল এজন্য মাফ কর। ডেভিড বলল।
না না তাতে কী? তোমরা কবে দেশে ফিরবে? ফ্রান্সিস বলল।
–মাস ছয়েক পরে। ডেভিড বলল।
–আমরাও দেশে ফেরার চেষ্টা করছি। কিন্তু সমুদ্রপথ হারিয়ে কোথায় যে যাচ্ছি। তার ঠিক নেই।
–সোজা উত্তরমুখো জাহাজ চালাও-দেশে পৌঁছুতে পারবে। ডেভিড বলল।
অন্য জাহাজের ভাইকিংরা এতক্ষণে ফ্রান্সিসের কথা জেনে গেছে। ওরা দলবেঁধে এসে ফ্রান্সিসের সঙ্গে করমর্দন করে গেল। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–তোমরা কোথা থেকে ফিরছ?
–ঐ যে পাহাড়ি দ্বীপ হিচকক ওখান থেকে আসছি। ডেভিড বলল।
–এখন ওখানকার রাজা কে? ফ্রাসিস জানতে চাইল।
–রাজা সামুল। ভীষণ রগচটা না? কারো কথায় ব্যবহারে একটু এদিকওদিক দেখলেই কয়েদ ঘর। আমাদেরও ধরেছিল। বলেছিল–নিশ্চয়ই তোমাদের জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র আছে।
বললাম–আমরা ব্যবসায়ী মানুষ। অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আমরা কী করব? বিশ্বাস করল না আমাদের জাহাজ তল্লাসী করল। বিপদ হল–আমরা তরোয়াল বর্শা তৈরি করি জমা করি। বিক্রি করি। একটা ঘরে এসব জমা রাখতাম। কিন্তু সেসব পাচার করার সময় পেলাম না। ধরা পড়ে গেলাম। রাজা মামুলির সে কি রাগ। আমাদের এই মারে তো সেই মারে। আমাদের পাঁচদিন কয়েদঘরে আটকে রাখলো পরে কী ভেবে কে জানে আমাদের সমস্ত অস্ত্রপাতি নিয়ে আমাদের মুক্তি দিল।
মুক্তি পেয়ে আমরা আর জাহাজে ফিরলাম না। কখন আবার আমাদের ধরে। উঠলাম গিয়ে এক সরাইখানায়।
সেখানে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা শুনলাম। সেদিন গভীর রাত। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কে গোঙাচ্ছে। কে? সরাইখানায় অনেকেই ঘুমিয়ে আছে। শুনলাম, একটা কোণ থেকে কাতরানোর শব্দ ভেসে আসছে। একটু দেখতে হয়। কী ব্যপার? বিছানা ছেড়ে উঠলাম। সেইদিকে গেলাম। একটা আলোঅন্ধকারে দেখলাম এক বৃদ্ধ শুয়ে গোঙাচ্ছে। বৃদ্ধের মুখের ওপর ঝুঁকে বললাম–আপনি কি অসুস্থ? বেশ কষ্ট করে বৃদ্ধ বলল—হ্যাঁ। আমি বাঁচবোনা। কথাটা মিথ্যে নয়। সত্যিই বৃদ্ধ গুরতর অসুস্থ। বৃদ্ধহাঁপাতে হাঁপাতে বলল– আমার কাছে একটা জিনিস আছে। সেটা কাকে দিয়ে যাবো তাই আমার চিন্তা।
–সেটা কী? আমি জানতে চাইলাম।
–একটা পেতলের মাপকাঠি। বৃদ্ধ বলল—
–একটা মাপকাঠি নিয়ে এত ভাবছেন কেন? আমি বললাম।
সব ঘটনা শুনলে তুমি বুঝতে পারবে। ডেভিড বলল–এবার সেই বৃদ্ধ যা বলল– তাই বলছি। প্রায় দেড়শো দুশো বছর আগে বর্তমান রাজা মামুনের পূর্ব পুরুষ এক রাজা ছিল। রাজা সুমালী। সেও ছিল এক আধ পাগল রাজা। তার মাথায় বিচিত্র সব চিন্তা আসতো। একদিন সমুদ্রের ধারে বেড়াচ্ছে একটা ঝুনো নারকেল তার কাঁধে পড়ল। রেগে গিয়ে সে এলাকার সব নারকেল গাছ কেটে ফেলার হুকুম দিল। তার বিচিত্র সব কাণ্ড কারখানার কথা শুনলে অবাক হয়ে যাবে।
সবচেয়ে অদ্ভুত কাণ্ড করল রাজা প্রাসাদের বিরাট এক ঘরে ছোট ছোট ঘর তৈরি করলো। কোন ঘরেরই দরজা জানলা নেই। ঘরগুলোর মাঝখান দিয়ে গলি। রাজা সুমালীর শখ–সেই ঘরের আড়ালে আড়ালে গলিপথ দিয়ে ছুটো ছুটি করে লুকোচুরি খেলবেন।
সেই খেলা যেদিন শুরু হল প্রাসাদের বাইরে রাজ্যের লোক ভেঙে পড়ল। দুপুরে রাজা সুমালী এলো। মন্ত্রী সেনাপতি অমাত্যরা সবাই এলেন। পাকা দাড়ি গোঁফের ভিড়। তারা ঘরের আড়ালে আড়ালে লুকোচুরি খেলা শুরু করল। সেকিউৎসাহ কী উদ্দীপনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই খেলা জমে গৈল। বুড়োদের সে কিছুটোছুটি। প্রজারা হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিতে লাগল।
কিন্তু হাজার হোক বয়েস তো হয়েছে। কতক্ষণ আর ছুটোছুটি করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুড়োরা হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। খেলা বন্ধ হয়ে গেল।
আবার পরদিন খেলা হল। এই অদ্ভুত খেলা দেখতে বিদেশী রাজাদের লোকেরাও এল। প্রজারাতো আছেই।
কয়েকদিন পরপর খেলা চলল রাজঅন্তঃপুরের মেয়েরাও খেলা দেখতে এল। সেখানেই খেলা শেষ হতে রানি এসে দাঁড়ালেন। রাজা সুমালীকে ধমক দিয়ে বললেন-বুড়ো বয়েসে ভিমরতি ধরেছে। বন্ধ কর এসব খেলা। এই পরিশ্রম আমাদের সহ্য হবেনা। অকালে মারা যাবেন। এই খেলা আর হবে না।
রাজা সুমালী মাথা চুলকোতে লাগলেন। কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেননা। প্রজাদের সামনে মন্ত্রী অমাত্যের সামনে রাজা বেশ অপ্রস্তুত হলেন।
আর কি। খেলা বন্ধ হয়ে গেল। রাজা সুমালীর মন খুব খারাপ হয়ে গেল।
ঘরগুলো আর ভাঙা হল না। সেগুলো রয়েই গেল।
পাগল রাজার বিচিত্র সব কাহিনী হিচকক দ্বীপের ধারে সমুদ্রে প্রচুর ঝিনুক। ঝিনুকে বড় বড় মুক্তো। সমুদ্রের ধারে ঝিনুক তুলে মুক্তো খোঁজে যারা তাদের ভিড় লেগেই আছে। দলে দলে লোক ঝিনুক তোলে আর ঝিনুকের মুখ খুলে খুলে মুক্তো বের করে। অনেক লোকের এটাই জীবিকা।
হঠাৎ রাজা সুমালী ঘোষণা করলেন কেউ সমুদ্র থেকে মুক্তো তুলতে পারবে না। শুধু উনি নিজে তুলবেন।
হাতে ছোট জাল নিয়ে রাজা সুমালী একদিন সকালে সমুদ্রের ধারে এলেন। সেদিনও প্রজাদের সে কি ভিড়।
মুক্তোশিকারীদের মতই রাজার পরনে নেংটি। জাল হাতে সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। উঠলেন একটু পরেই। জালে পড়া ঝিনুক। জাল নিয়ে পাড়েরাখলেন। এক সৈন্যকে বললেন– এ্যাই সব ঝিনুক ভাঙ। দ্যাখ-মুক্তো পাস কিনা। সৈন্যটি ঝিনুক ভাঙতে লাগল।
রাজা আবার নামলেন জলে। কিছুক্ষণ পরেই উঠে এলেন। জাল ভর্তি ঝিনুক। আবার এক সৈন্যকে বললেন–ঝিনুক ভাঙ।
ঝিনুক ভাঙা হতে লাগল। রাজার ভাগ্যি। দু দফায় ঝিনুকে দুটো বড় মুক্তো পাওয়া গেল। সমবেত প্রজারা রাজার জয়ধ্বনি দিল–রাজা সুমালীর জয় হোক। রাজা সুমালীও খুশি। সগর্বে চারিদিক তাকাতে তাকাতে পোশাক পরলেন। রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন।
মুক্তো শিকারীদের জীবিকাই ছিল এটা। তারা রাজার দরবারে গেল। নিজেদের সমস্যার কথা বলল। রাজা অনড়-না–শুধু আমি মুক্তো তুলবো।
এবারেও রানিই প্রজাদের বাঁচালেন। রানি রাজসভায় প্রজাদের বললেন–দাঁড়াও। আমি দেখছি। রাজার দিকে চেয়ে বললেন-তোমার কি মাথা খারাপের বাকি নেই। ঐ জলে চুবানি খেয়ে মুক্তো তুলতে যাচ্ছ? বন্ধ কর এসব। মুক্তো শিকারীরা এই মুক্তো বিক্রী করে সংসার চালায় বেঁচে আছে, আর সেটা তুমি বন্ধ করে দিতে যাচ্ছ?
রাজা সুমালী কয়েকবার মাথা চুলকে বললেন–ঠিক আছে। তারা মুক্তো তুলবি। রাজসভায় উপস্থিত প্রজারা উচ্চকণ্ঠে রাজার নামে জয়ধ্বনি দিল।
তারপর? ফ্রান্সিস বলল।
–এই পাগলা মনভুলা রাজা আর একটি কাণ্ড করেছিলেন। সেটা জানা গেল তার মৃত্যুর পূর্বক্ষণে।
তখন তিনি মৃত্যুশয্যায়।
হঠাৎ ঘোষণা করলেন–আমি ইনকা কর্মকারদের সাহায্যে একটা সম্পূর্ণ সোনার ঘর তৈরি করিয়েছে। সেটা আমি অত্যন্ত গোপনে করিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হল আমি যে মাপকাটি ব্যবহার করেছিলাম সেটা হারিয়ে ফেলেছি। আমি জানি না সেটা কোথায়? কাজেই একমাত্র নির্ভর উত্তরপুরুষরা। তারা যদি সেই সোনার ঘর আবিষ্কার করতে পারে। আমি কোন সূত্রও দিয়ে যেতে পারলাম না।
রাজা সুমালী মারা গেলেন।
রাজা সুমালী ঘরটি তৈরি করেছিলেন অত্যন্ত গোপনে। যে দরজা জানালাহীন ঘরগুলো তৈরি করা হয়েছিল সেটাকে চারদিক দিয়ে দেওয়াল গাঁথা হল। একটা মাত্র দরজা। তাও তালাবন্ধ। গভীরভাবে ইনকা কর্মকারেরা আগুনের উনুন জ্বেলে মোম গলিয়ে সোনার ঘরে ঢালে। আস্তে আস্তে সোনার ঘর তৈরি হয়। বেশ সময় লেগেছিল। সেই কাজের সময় ধারেকাছে কাউকে যেতে দেওয়া হত না, এমন কি প্রহরীদেরও না।
রাজা সুমালীর প্রচুর ফাসম্পদ ছিল। দু’তিন পুরুষের সঞ্চয়। কাজেই একটা ছোট ঘর নিশ্চয়ই তৈরি করার মত সোনা তার ছিল।
সোনার ঘর তৈরির চিন্তাটাই পাগল রাজার মাথায় এসেছিল কেন সেটা বোঝার উপায় ছিল না। পাগলের খেয়াল।
–তাহলে সেই সোনার ঘর কেউ উদ্ধার করতে পারে নি। ফ্রান্সিস বলল।
–না। তোমরা চেষ্টা করবে? ডেভিড বলল।
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল।
–তাহলে মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলতে পারো। মন্ত্রীমশাই খুব ভাল মানুষ। ডেভিড বলল।
–দেখি ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা নিজেদের জাহাজে ফিরে এল। ফ্রান্সিস নিজের কেবিনঘরে ঢুকল। মারিয়া চুপচাপ বসেছিল। ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া তোমার এ দেশের অতীতের এক রাজার কথা বলি। সে এক বিচিত্র কাহিনী।
হ্যারি দরজায় এসে দাঁড়াল।
–এসো এসো হ্যারি। এই হিচকক দ্বীপের অতীতের এক রাজার কাহিনী বলি।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে শোনা কাহিনী সব বলল। সব শুনে মারিয়া হ্যারি দুজনেই অবাক।
–সেই সোনার ঘর তাহলে হিচকক দ্বীপে আছে? হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ। কোথায় আছে সেটার খোঁজখবর করতে গেলে ওখানে যেতে হবে। সব দেখতে হবে জানতে হবে। মারিয়ার মুখ ভার হল। আস্তে আস্তে বলল–তার মানে আরো কিছুদিন এখানে থাকতে হবে।
হ্যাঁ মারিয়া। কী করবো বলো। আমার ভালো লাগে এসব। কী হবে দেশে ফিরে? সেই তো খাও দাও ঘুমোও এর জীবন। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু আমার তো বাবা মাকে দেখতে ইচ্ছে করে। মারিয়া বলল।
–খুবই স্বাভাবিক। তবু বলে মারিয়া এই কষ্টটা মেনে নাও। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ মারিয়া আর কোন কথা বলল না।
এরমধ্যে ভাইকিংরা পাগলারাজা সুমালীর কাহিনী শুনে নিয়েছে। ফ্রান্সিস সোনার ঘর খুঁজে বের করার পরিকল্পনা নিয়েছে তাও জানল ওরা।
সেদিন শাঙ্কো ছুটতে ছুটতে এল। খুবখুশী। শাঙ্কো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল উৎসব উৎসব
–কীসের উৎসব? হ্যারি জানতে চাইল।
–এই হিচকক দ্বীপে প্রতিবছর এই দিনে সমুদ্র পূজা হয়। মেলা বসে সমুদ্রতীরে। রাজা রানি আসেন। রাজ পুরোহিত ফুলপাতা দিয়ে সমুদ্র পূজা করে। শাঙ্কো বলল।
–সমুদ্র পূজা কথাটা নতুন শুনলাম। ফ্রান্সিস বলল।
–ফ্রান্সিস হ্যারি হেসে বলল–আমরাও তো তরোয়ালি পূজা করেছিলেন।
ফ্রান্সিস হেসে ফেলল। বলল–ঐ তরোয়ালপূজা করেই তো পালাতে পারলাম।
তুমি মাথা থেকে জব্বর পরিকল্পনা বের করেছিলে। কত লোক সমুদ্রতীরে জড়ো হয়েছে। মেলা বসেছে। নানা দোকানপাট বসেছে। জৈার কেনাকাটা চলছে। আমরাও যাবো।
–বেশ। সবাই যাবো। এরকম মেলাটেলায় তো যাওয়া হয় না।
–দেশের মেলার কথা মনে করিয়ে দিলে ফ্রান্সিস। মনটা খারাপ হয়ে গেল। হ্যারি একটু ভারি গলায় বলল।
–পাগল। ওসবনিয়ে ভেবোনা। আমরাকি কোনদিন দেশে ফিরবোনা? ফ্রান্সিস বললো।
–সত্যিই কি দেশে ফিরে যেতে পারবো ফ্রান্সিস? হ্যারি বলল। হা। এটা ঠিক কয়েকজন বন্ধুকে আমরা হারিয়েছি। এটা তো স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন ধরে কত কত দ্বীপে, দেশে ঘুরে বেড়ালাম। বিপদ আপদ তো হবেই। এর জন্যে ভয় পেয়ে দেশে ফিরে যাওয়া কোন কাজের কথা নয়। ফ্রান্সিস বলল আমরা এখনই যাবো।
–ঠিক আছে। বন্ধুদের বল। সবাইকে খবর দিতে শাঙ্কো প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল।
ফ্রান্সিস নিজের কেবিনঘরে গেল। দেখল মারিয়া সঁচ-সুতে দিয়ে ছেঁড়া পোশাক সেলাই ফোঁড়াই করছে। ফ্রান্সিস হেসে বলল–মারিয়া–অনেকদিন তো মেলা-টেলা দেখনা।
সমুদ্রের জলে মেলা বসে? হু! মারিয়া মুখ ঘুরিয়ে বলল।
না ডাঙাতেই বসে। মেলায় যাবে? ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া হাঁ করে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস জানে মেলায় লোকজন দোকানপাট এসব দেখলে মারিয়া সবচেয়ে খুশি হয়।
–কী বলছো বুঝে উঠতে পারছি না। মারিয়া বলল। এসোসমুদ্রের ধারে কত লোক এসেছে। ডেক-এ উঠে দেখে এসোসমুদ্রের ধারে কত লোক এসেছে। মেলা। বসেছে? ফ্রান্সিস বলল।
-বলো কি। দেখি তো! মারিয়া হাতের কাজ রেখে দরজার দিকে ছুটল।
একটু পরেই ফিরে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মেলা দেখতে যাবো।
সবাই যাবে। এবার তুলে রাখা ভালো পোশাক-টোশাক গুলো বের কর। আমরা সবাই ভালো পোশাক পরে যাবো।
মারিয়া পোশাক বের করার জন্যে বাটা’ চামড়ার ঝোলা খোঁজাখুজি শুরু করল।
একটু পরেই দরজায় টোকা দেয়ারশব্দ। ফ্রান্সিস দরজা খুলল। শাঙ্কো দাঁড়িয়ে। পরনে নতুন পোশাক। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল–তোমরা এখনও তৈরি হওনি। ওদিকে
–আরে বাবা আমরা যেতে যেতে মেলা উঠেযাবেনা। তোমরা ডেকেগিয়ে অপেক্ষা কর। আমরা যাচ্ছি। শাঙ্কো ছুটে চলে গেল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর সাজসজ্জা দেখে খুশি হল। ময়লা পোশাকপরেজাহাজেরহাজারটা কাজ, কখনও কখনও ডেকেরাত কাটালো দুপুরের চড়া রোদ কয়েকঘরের কষ্টকঅন্তত একদিনের জন্যে হলেও নিজের খুশিমত সাজতে পেরেছে।
মারিয়া ফ্রান্সিসকে একটা নতুন পোশাক বের করে দিল। পরিয়েও ছিল। পরিয়েও দিল। ফ্রান্সিস হেসে বলল এবার এই ঘরে একটা আয়না রাখব। দেওয়ালে আটকে রাখবো। জাহাজের ঝাঁকুনিতে পড়ে যাবেনা।
–কোন দরকার নেই–মারিয়া বলল–আয়নায় মুখটুখ দেখলে মন খারাপ হবে। তার চেয়ে এই বেশ আছি।
-বেশ। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না।
মারিয়াও একটা নতুন গাউন পরল। নীল সবুজ রঙের। মাথার চুল আঁচড়াল। মুখটা একবার দু’হাতে ঘসে নিল। তারপর বলল–চলো। ফ্রান্সিস একবার মারিয়াকে দেখল। মারিয়ার চেহারায় এখনও রাজকুমারীর সৌন্দর্য মুছে যায় নি। শুধু গায়ে ও মুখের দুধ আলতা রংটা আর নেই। একটু তামাটে হয়েছে।
দুজনে ডেকে উঠে এল। বন্ধুরা হৈ হৈ করে উঠল। আজকে সবাই নতুন পোশাকে উচ্ছল। ফ্রান্সিস বলল-সবাই যাবে।
–সবাই যাবো। শাঙ্কো বলল।
কয়েকজন জাহাজের পাহারায় থাকো। ফ্রান্সিস বলল।
–না-না। সবাই যাবো। বিস্কো বলল।
–ঠিক আছে। শুধু ভেন থাকুক। ও বয়স্ক মানুষ। হৈ চৈ করতে পারবেনা। হ্যারি বলল।
–বেশ। শাঙ্কোরা বলল।
সবাই জাহাজ থেকে নেমে এল। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে।
মেলা এলাকায় লোকজনের ভিড়। ফ্রান্সিসরা ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
শাঙ্কো বিকেলেই এক স্বর্ণকারের দোকানে গিয়েছিল। দুটো সোনার চাকতি বদলে কিছু স্থানীয় মুদ্রা এনেছিল। সেসব বন্ধুদের দিল। বনসুরা মনের আনন্দে কেনা কাটা করল। কারো জাহাজে ফেরার নাম নেই।
তখন রাত হয়ে গেছে। মেলার এলাকায় লোকের ভিড় কমে গেছে।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাই সব আর নয়। এবার জাহাজে ফেরা।
বেশ আনন্দে সময় কাটল ভাইকিংদের। সবাই জাহাজ ঘাটের দিকে ফিরে আসতে লাগল।
জাহাজ ঘাটে এসে সবাই হতবাক। একী? ওদের জাহাজ কোথায়? সেখানে ছোট নৌকা ভাসছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব জাহাজ চুরি হয়ে গেছে। একা ভেন রয়েছে সেই জাহাজে। ভেন নিশ্চয়ই বুঝতে পারে নি। এরকম বিপদে কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না।
–ফ্রান্সিস দেখো তো নৌকোটার মাঝিকে বলে। ও কিছু দেখেছে কিনা? হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস নৌকাটার কাছে গেল। গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল–ভাই শুনছো? মাঝি বোধহয় রান্নাটান্না করছিল এগিয়ে এসে বলল–আমাকে ডাকছো কেন?
এখানে আমাদের জাহাজ ছিল। তুমি দেখেছো? ফ্রান্সিস বলল।
–হা হা। মাঝিমাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
–ওটা চুরি হয়ে গেছে। তুমি দেখেছো কিছু? হ্যারি বলল।
-হ্যাঁ, দেখলাম আটদশজন লোক জাহাজটায় উঠল। নোঙর তুলে জাহাজ ছেড়ে দিল। ভাবলাম তোমারই বোধহয়। মাঝি বলল।
কতক্ষণ আগে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–ঘণ্টা খানেক হবে। হ্যারি বলল।
তাদের হাতে অস্ত্র ছিল? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। তরোয়াল ছিল। মাঝি বলল।
–তাদের তুমি আগে দেখেছো? ফ্রান্সিস জিজ্ঞাসা করল।
–না। মাঝি মাথা নাড়ল।
জাহাজ কোনদিকে গেল? হ্যারি জানতে চাইল।
–দক্ষিণ মুখো। মাঝি হাত তুলে দক্ষিণ দিকে দেখাল।
এবার শাঙ্কো বলল—ফ্রান্সিস কী করবে?
–এখানে জাহাজ কিনবো। দক্ষিণমুখো জাহাজ চালাবো। জাহাজ চোরদের ধরতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
জাহাজ কিনবে। অত সোনার চাকতি তো আমার কাছে নেই। মারিয়া এগিয়ে এল। বলল আমাদের বোধনঘরের কাঠের দেওয়ালে আমি সোনার চাকতি রেখেছিলাম।
জাহাজ তো নেই। ফ্রান্সিস তারপর বলল–শাঙ্কো তোমার কাছে কটা সোনার চাকতি আছে? শাঙ্কো পেটি থেকে সোনার চাকতিগুলো বের করল। গুনে বলল–ছোট জাহাজ কেনা যেতে পারে।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করল আমরা জাহাজ কিনবো। এখানে বিক্রির জন্য জাহাজ আছে?
–যে সব রুবিন বলতে পারবে। ও জাহাজ কেনাবেচার কাজ করে। মাঝি বলল।
রুবিন কোথায় থাকে?
মাঝি আঙ্গুল তুলে সমুদ্রতীরের একা ঘর দেখাল। বলল–ওখানেইরুবিন থাকে। তবে ওর বদনামও আছে। খালি জাহাজ পেলে ও নিজের বলে বিক্রি করে দেয়। মাঝি বলল।
রুবিন নিশ্চয়ই আমাদের জাহাজের বেলায়ও এই কাণ্ডটি করেছে। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।
রুবিনকে পাকড়াও কর। হ্যারি বলল।
–চলো৷ ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
ওরা রুবিনের ঘরের কাছে এল। ছোট ঘর। তবে শক্তপোক্ত। ঘরের দরজা খোলা। ফ্রান্সিস আর হ্যারি ঘরে ঢুকল। দেখল একটা বিছানায় একটা লোক শুয়ে আছে। কাছে। গিয়ে দেখল লোকটা ঘুমুচ্ছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে ডাকলরুবিন। লোকটা ধড়মড়িয়ে উঠে বলল–কী ব্যাপার?
–ব্যাপার গুরুতর। তুমিই রুবিন? ফ্রান্সিস ভারি গলায় জিজ্ঞেস করল। –
-হ্যাঁ। রুবিন মাথা নত করল।
জাহাজ কেনাবেচার কাজ কর। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। কিন্তু আমি তো তোমাদের চিনি না। রুবিন বলল?
এবার চিনবে? আমাদের জাহাজে মাত্র একজন লোকছিল। সেই অবস্থায় তুমি। আমাদের জাহাজ বিক্রি করে দিয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
কী সব বলছ। তোমাদের জাহাজের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। রুবিন মাথা। ঝাঁকিয়ে বলে উঠল।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–শাঙ্কো-ছোরাটা নিয়ে এসো তো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল। ডালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা বের করে ফ্রান্সিসের হাতে দিল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ছোরাটার মুখ রুবিনের গলায় চেপে ধরল। দাঁতচাপা স্বরে বলল–আসল ঘটনাটা বল।
রুবিন মাথা নেড়ে বলল–আমি কিছুই জানিনা। ফ্রান্সিস ছোরার চাপ বাড়াল। একইভাবে বলল–যদিমরতে না চাও সত্যি ঘটনাটা বলো। তোমাকে এখানে কেউ বাঁচাতে আসবেনা।
রুবিন আবার মাথা নাড়ল। ফ্রান্সিস ছোরার চাপ বাড়াতেই রুবিনের গলায় একটু চেপে রক্ত বেরিয়ে এল। এবার রুবিন বুঝলো জীবন বিপন্ন। এইবিদেশিটা ওকে অনায়াসে মেরে ফেলতে পারে। ও বলে উঠাছোরা সরাও–বলছি। হ্যাঁ চেড়ে রুবিন বলল তোমাদের জাহাজে কেউ নেই দেখে ঐ জাহাজ আমার বলে বিক্রি করে দিয়েছি।
কার কাছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–একজন নয়। জন দশ বারো লোকের কাছে। রুবিন বলল।
তারা কোথাকার লোক? ফ্রান্সিস আবার প্রশ্ন করল।
–পাতুই দ্বীপ থেকে এসেছিল। রুবিন বলল।
–পাতুই দ্বীপ কোথায়? কতদূর? ফ্রান্সিস আবার জিজ্ঞেস করল।
দক্ষিণ দিকে। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। হ্যারি বলল–যাক একটা হদিশ পাওয়া গেল। এবার ফ্রান্সিস রুবিনের দিকে তাকাল। বলল–আমাদের জাহাজ বিক্রি করে যে মুদ্রা পেয়েছো সে সব কোথায়?
–সে সব দিয়ে আর একটা জাহাজ কিনেছি। রুবিন বলল।
–চুরি করে না দাম দিয়েছো। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ-হ্যাঁ–দাম দিয়েই কিনেছি। খোদ মালিকের কাছ থেকে। রুবিন বলল।
–সেই জাহাজ কোথায়? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
রুবিন পূর্বদিক আঙ্গুলি দেখিয়ে বলল–ঐখানে নোঙর করা।
চলো? সেই জাহাজ দেখবো। ফ্রান্সিস বলল।
–পুরনো জাহাজ। ভাঙাচোরা। রুবিন বলল।
–ঠিক আছে। তুমি জাহাজটি দেখাবে চলো। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু ঐ জাহাজ আমি রুবিন কথাটা শেষ করতে পারল না?
কথা বাড়িওনা। চলো ফ্রান্সিস বাধা দিয়ে বলল। ফ্রান্সিস ছোরাটা শাঙ্কোকে ফিরিয়ে দিল। শাঙ্কো ছোরাটা বুকের কাছে পোশাকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল।
ঘরের বাইরে এসে রুবিন ফ্রান্সিসের বন্ধুর দলকে দেখল। মারিয়াকে দেখে একটু অবাকও। হলরুবিন বুঝল এরাদলে ভারি। একটু এদিক-ওদিকহলে ওরা ওকে বিপদে ফেলতে পারে?
সবাই পূবমুখো চলল।
দু-তিনটি জাহাজ ছাড়িয়ে রুবিন একটা জাহাজের সামনে এল। জাহাজটা দেখিয়ে, বলল–দেখ একেবারে লজঝর একটা জাহাজ। সস্তাতেই কিনেছি।
জাহাজটার পাটাতন ফেলাই ছিল। রুবিন আগে জাহাজটায় উঠল। পেছনে ফ্রান্সিস ও হারিআর শাঙ্কো।
ভালো করে দেখল ফ্রান্সিস। সত্যিই একটা পুরোনো আধভাঙা জাহাজ। ফ্রান্সিস ডাকল–শাঙ্কো? শাঙ্কো এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–ভালো করে জাহাজটা দেখতো। মেরামতি করে জাহাজটা চালানো যাবে কিনা। রুবিন প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠল–আমার কেনা জাহাজ- তোমরা নেবে কেন?
–আমাদের জাহাজ তুমি চুরি করে বিক্রি করেছিলে কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–তাই বলে আমার জাহাজ নিয়ে নেবে? রুবিন গলা চড়িয়ে বলল।
–তোমাকে মেরে ফেলিনি এটাই যথেষ্ট। এখন বিদেয় হও। ফ্রান্সিস বলল।
–তার মানে রুবিন কী বলতে গেল। ফ্রান্সিস বলে উঠল–
–আর একটা কথাও নেই। এই জাহাজ এখন আমাদের। রুবিন কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। বলল–আমি রাজার কাছে নালিশ করবো।
–আমরা বলবো একজাহাজ চোরের জাহাজ আমরা নিয়ে নিয়েছি। হ্যারি বলল।
–ঠিক আছে। তোমাদের এই দ্বীপ থেকে আমি তাড়াবো। রুবিন বলল।
তার আগে তুই জাহাজ থেকে নেমে যা। ফ্রান্সিস বলল।
রুবিন গজর গজর করতে করতে জাহাজ থেকে নেমে গেল।
শাঙ্কো জাহাজের সব দেখেটেকে ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস বলল–কেমন দেখলে?
জাহাজটার অবস্থা খুব খারাপ। হাল আধভাঙা। ডেকের কাঠের পাটাতন কোথাও কোথাও ভাঙা। মাস্তুল পালের দড়িদড়া জরাজীর্ণ।
–নিচে যাও। কেবিন ঘরটরগুলো দেখ। জাহাজাটা কেমন? কাঠটাট, যন্ত্রপাতি মজুত, আছে দেখ। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো চলে গেল।
এবার মারিয়া আর বন্ধুরা জাহাজে উঠে এল। বিস্কো বলে উঠল–এ তো একশো বছরের পুরোনো জাহাজ।
–এই জাহাজ নিয়েই আমাদের জাহাজ উদ্ধারের জন্য যেতে হবে।
নতুন জাহাজ কেনার মত স্বর্ণমুদ্রা নেই। ফ্রান্সিস বলল।
বনসুরা ঘুরে ঘুরে জাহাজটা দেখতে লাগল। কত সুন্দর মজবুজ ওদের জাহাজ। এই জাহাজের সঙ্গে তুলনাই চলবে না। কিন্তু এখন এই জাহাজই ভরসা। চুরি হয়ে যাওয়া জাহাজ উদ্ধার না করা পর্যন্ত এই জাহাজই চালাতে হব।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে ফিরে এল।
-কেমন দেখলে?
–অবস্থা খুব একটা খারাপ নয়। আর আশ্চর্য হল গুদাম ঘরে যথেষ্ট কাঠ আর যন্ত্রপাতি আছে। জাহাজের মালিক বোধ হয় জাহাজটা সারাইটারাই করবে ভেবেছিল। কিন্তু করে নি। এই অবস্থাতেই বিক্রি করে দিয়েছে।
–যাক। তাহলে মেরামতি করে কাজ চালানো যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
জাহাজ কি এই অবস্থাতেই চালাবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। দেরি করবোনা। জাহাজ চলতে চলতেই মেরামতির কাজ চলবে। ফ্রান্সিস বলল?
–সবার আগে খাদ্য আর জলের ব্যবস্থা করতে হবে। হ্যারি বলল।
হাঁ ওটাই প্রাথমিক কাজ। শাঙ্কো কয়েকজনকে নাও। জলের পীপে বস্তা নিয়ে যাও। কেনাকাটা সেরে খাবার জল নিয়ে এসো৷ ফ্রান্সিস বলল?
শাঙ্কোরা কয়েকজন বস্তা পীপে নিয়ে চলে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পরেশাঙ্কোরা আটা ময়দা চিনি পীপে ভর্তি খাবার জল নিয়ে ফিরে এল।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–এখন কী করবে?
–ফ্লেজারকে বলো ও জাহাজ ছেড়ে দিক। যাবো দক্ষিণের পাতুই দ্বীপে। জাহাজ উদ্ধার করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু এই ভাঙা জাহাজ নিয়ে–হ্যারি আপত্তি করতে গেল।
–পারবো। তবে ঝড়ঝাপটা এলে সমস্যায় পড়বো। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে এই বন্দরে জাহাজ মেরামতি করিয়ে নেবেনা? হ্যারি বলল
না। দেরি করা চলবে না। জাহাজ চলতে চলইে মেরামতির কাজ চালাতে হবে। সবাইকে হাত লাগাতে হবে। জাহাজে অনেককাঠ যন্ত্রপাতি আছে। সমস্যা হবেনা। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। তুমি যা বলল। হ্যারি বলল।
জাহাজ চালাবার দায়িত্বে থাকাবে তিনজন–ফ্লেজার, শাঙ্কো আর সিনেত্রা। বাকি সবাই জাহাজ সারাইয়ের কাজে লাগবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে–আজ রাতেই জাহাজ ছাড়বে! হ্যারি জানতে চাইল।
–দেরি করা চলবে না। ফ্রান্সিস বলল। রাতের খাওয়া সেরে তিনজন বাদে সবাই জাহাজ মেরামতিতে হাত লাগল। তার আগে পালগুলো পালের কাঠে ভালো করে বেঁধে দিল। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ। আলোর অভাবহচ্ছিল না।
সমুদ্রে জোর হাওয়া পালগুলো জোর বাতাস পেয়ে ফুলে উঠল। দু-একটা পালে ফুটো ছিল। তবু পালের টানে জাহাজ বেশ বেগেই চলল।
প্রথমেই ফ্রান্সিসরা ভাঙা হাল মেরামতিতে হাত লাগল। কর্মরত ভাইকিংদের কথাবার্তা হাতুড়িরঠুকঠাকশব্দকাঠের পাঠানটানাটানির গরুগশব্দ চলল। সারারাতসারাইয়েরকাজ চলল।
পূব আকাশে কমলা রং ছড়িয়ে সূর্য উঠল। ভোরহল। নরম রোদ পড়ল সমুদ্রে জাহাজে।
ভাইকিংরা কাজ থামিয়ে ডেকে বসে বিশ্রাম করতে লাগল।
সকালের খাবার খেয়ে আবার কাজে হাত লাগাল।
কাজ চলল দুপুর পর্যন্ত।
দুপুরের খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম তারপর আবার কাজ।
সন্ধ্যের মধ্যেই হাল মেরামত হয়ে গেল।
ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে এল। বলল হাল ঠিক হয়েছে। ফ্লেজারহুইল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল–ঠিক আছে। হালের জোর বেড়েছে। জাহাজ এবার ভালো চলবে।
একটা দিন কাটল।
এর মধ্যে জাহাজের ফুটো ফাটা ভাঙা রেলিং সিঁড়ি ঘরের ডেক-এর মেরামতি চলল। আরো কাজ বাকি।
সেদিন গভীর রাতে ফ্রান্সিস যা আশঙ্কা করেছিল তাই হল।
প্রচণ্ড ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্রান্সিসদের জাহাজের ওপর। সমস্ত জাহাজটা কেঁপে উঠল। তারপরেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড শব্দ তুলে বাজ পড়া।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব যে করেই হোক জাহাজ ডুবতে দেওয়া চলবে না। সবাই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়।
ভাইকিংরা দ্রুত পাল নামিয়ে ফেলল। পালের কাঠের দড়িদড়া মাস্তুলের দড়িদড়া প্রাণপণে টেনে ধরে জাহাজটা ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা চালাল। ভাইকিংরা যথেষ্ট অভিজ্ঞ নাবিব। ঝড়ঝাঁপটার সঙ্গে লড়াই করা ওদের কাছে নতুন কিছু নয়। চলল ঝড়ের সঙ্গে লড়াই। ফ্লেজার দৃঢ়হাতে হুইল ঘোরাতে লাগল। উঁচু উঁচু ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজ একবার দুলুনীতে কয়েকজন ভাইকিং ছিটকে ডেক-এর ওপর পড়ে গেল। পরক্ষণেইউঠেদাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজে লাগল।
জাহাজের ডেক-এর ওপর ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। সমস্ত জাহাজটাতেই কাঁক– কাঁক শব্দ হতে লাগল।
হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়তে লাগল। আকাশ মেঘমুক্ত হতে লাগল। ঝড়ো বাতাস অনেকটা শান্ত হল।
মেঘ সরে গিয়ে উজ্জ্বল চাঁদ দেখা দিল।
ঝড়ের সঙ্গে লড়াইয়ে ক্লান্ত ভাইকিংরা জলজমা ডেক-এর এখানে ওখানে শুয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলে উঠল-সাবাস ভাইসব। ভাঙ্গা জাহাজ নিয়েও আমরা ঝড়ের বিরুদ্ধে জিতে গেলাম। ও হো হো। ভাইকিংরাও গলা মেলাল। তবে তাদের। কণ্ঠস্ফরেভীষণ ক্লান্তি।
ডেক-এর জমা জল সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। শাঙ্কো বলল– ফ্রান্সিস। ডেক-এর ধারে ফুটো করতে হবে। নইলে জমা জল বেরোবে না।
তখনই মারিয়া ডেক-এ উঠে এল। ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল–নিচে কেবিন ঘরগুলোতে জল পড়ছে। কেবিন ঘরের মেঝেয় জল জমে গেছে।
–বোঝা যাচ্ছে জাহাজের ভাঙা ফাঁকফোকর দিয়ে নিচে জল পড়ছে। ফ্রান্সিস বলল।
–জল সরাবার উপায় কী? মারিয়া জানতে চাইল।
জল ছেঁচে ফেলতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। শাঙ্কো বলল।
–কী ভাবে জল ছেঁচবে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
আমাদের তো গোটা চারেকের কাঠের বালতি রয়েছে। সেই বালতিগুলোয় কেবিন ঘরের জল তুলতেহবে। আমরা কেবিন ঘর থেকে ডেক-এর রেলিংপর্যন্ত সারদিয়েদাঁড়াব। জলভর্তি বালতি ধরাধরিকরে রেলিং পর্যন্তনিয়েআসব। তারপরজল সমুদ্রে ফেলে দেব। এছাড়া কেবিন ঘরেরজমা জল সরাবারঅন্য কোন উপায় নেই। শাঙ্কো বলল?
–হু পদ্ধতিটা মন্দ বলোনি। তবে এভাবে জল সরাতে গেলে সময় লাগাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তা লাগবে। শাঙ্কো বলল।
–তাহলে কাজ শুরু কর। এবার ডেক-এর জমা হল। রেলিং-এর একেবারে নিচে বেরিয়ে সমুদ্রের সমতলে একটা দুটো ফুটো করতে হবে। জল গড়িয়ে বেরিয়ে সমুদ্রের জলে পড়বে। ফ্রান্সিস বলল।
–হুঁ। তা করা যাবে। শাঙ্কো বলল।
দুটো কাজই শুরু কর। ফ্রান্সিস বলল।
কাজ শুরু হল। ভাইকিংরা কেবিন ঘরগুলো থেকে সার দিয়ে জাহাজের রেলিং পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। নিচে কেবিন ঘরের জল বালতিতে ঘেঁচে তোলা হতে লাগল। জলভর্তি বালতি হাতে হাতে রেলিং পর্যন্ত আনা হতে লাগল। তারপর সমুদ্রে ঢেলে ফেলা হতে লাগল। এভাবেই কেবিন ঘরগুলো থেকে জল সরানোর কাজ চলল।
শাঙ্কো আর বিস্কো গেল ফুটো করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে হাতুড়ি বাটালি দিয়ে কেটে কেটেদুটো ফুটো করে ফেলল। ডেক-এরজমা জল ঐ দুটো ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে ডেক-এর জল একেবারেই বেরিয়ে গেল। আনন্দেশাঙ্কো ভাঙা ডেক এর ওপরেই শুয়ে পড়ল। বিস্কোও হাসতে হাসতে ওর পাশে শুয়ে পড়ল। ওদের দুজনের কাণ্ড দেখে ভাইকিং বন্ধুরাও কেউ কেউ হেসে উঠল।
ওদিকে কেবিন ঘর থেকে জল ছেঁচাও চলল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে কেবিন ঘরগুলো জলমুক্ত হল। তবে কাঠের মেঝে ভেজাই রইল।
সেদিন ভোরে ফ্রান্সিসদের জাহাজ একটা দ্বীপের কাছে পৌঁছিল। মাস্তুলের ওপর থেকে নজরদার পেদ্যে চিৎকার করে বলল–একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস, হ্যারি ডেক-এ উঠে এল। তাকিয়ে দ্বীপটা দেখল।
নিস্তেজ রোদ পড়েছে সমুদ্রে ফ্রান্সিসদের জাহাজে কাছের দ্বীপটায়।
-বুঝতে পারছি না–এটা পাপুই দ্বীপ কিনা? হ্যারি কি বলো? ফ্রান্সিস বলল।
কাছে গেলেই বোঝা যাবে? পাপুই দ্বীপ হলে জাহাজ ঘাটে আমাদের জাহাজ দেখতে পাবো। হ্যারি বলল।
–তা ঠিক। চলো জাহাজ ঘাটের কাছে যাই। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে গেল। বলল-ঘাটেইজাহাজ ভেড়াও। জাহাজঘাটের কাছে এল।
কিছুদূর থেকে ভাইকিংরা দেখল একটা জাহাজ ঘাটে নোঙরকরা। কাছাকাছি আসতেই বুঝল ওটা ওদের চুরি যাওয়া জাহাজ।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ ঘাটে ভিড়ল। পাটাতন নামানো হল। মারিয়া আর ফ্লেজার বাদে সবাই দল বেঁধে নেমে এল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি ওদের চুরি করা জাহাজের পাতা পাটাতনের কাছে গেল। তারপর জাহাজে উঠল। দেখল ডেকও মাস্তুলের কাছে একজন লোকদাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে লোকটি প্রায় ছুটে এল। বলল এখানে কী চাই?
দাঁড়াও দাঁড়াও কথা আছে ফ্রান্সিস একহাত তুলে বলল?
–এই জাহাজটা তোমরা হিচকক দ্বীপ থেকে এনেছো–তাই না? হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ। লোকটি বলল।
–এটা আমাদের জাহাজ। রুবিন এটা চুরি করে বিক্রি করেছে। ফ্রান্সিস বলল।
–অতসব আমরা জানি না। আমরা দস্তুরমত ফর্ণমুদ্রা দিয়ে কিনেছি। লোকটি বলল।
—বলছিলাম পাশের ঐ জাহাজটা তোমরা নাও। আমাদের জাহাজটা ফিরিয়ে দাও। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে লোকটা বলল–ঐভাঙা জাহাজের সঙ্গে আমাদের জাহাজ বদল করবো। পাগল হয়েছ।
–আমরা ভাইকিং। জাহাজ মেরামতিতে ওস্তাদ। ঐ জাহাজাটা এখন যথেষ্ট ভালো অবস্থায় আছে। ওটা নাও। ফ্রান্সিস আবার বলল।
লোকটা কী বলে চিৎকার করে উঠল। নিচের কেবিনঘর থেকে দু-তিনজন লোক উঠে এল। সবাই যুবক। লোকটা ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বলল এরা ঝামেলা করতে এসেছে। এই জাহাজটা নাকি ওদের।
এক যুবক মুখভঙ্গী করে বলে উঠল–কী পেয়েছো তোমরা? এ্যা? জানো–এই জাহাজ এখন রাজা কুতুবুর।
কে রাজা কুতুবু কী ব্যাপার আমরা জানি না। এটাই আমাদের চুরি যাওয়া জাহাজ এটাই জানি। ফ্রান্সিস বলল। এসময় ভেন আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। ফ্রান্সিস ছুটে গিয়ে ভেনকে জড়িয়ে ধরল। বলল ভেন ভালো আছো ভাই?
ভেন হেসে বলল–ভাল আছি।
ঠিক তখন একজন যুবক জাহাজ থেকে পাটাতনের ওপর দিয়ে দ্রুত নেমে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে তীরভূমির দিকে ছুটল। শাঙ্কো বাধা দিতে গিয়েও পারল না। ? যুবকটি ছুটতে ছুটতে সমুদ্রতীর পার হয়ে গেল।
ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছেনা। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।
–ফ্রান্সিস বিপদ হতে পারে। হারি বলল।
ফ্রান্সিস আর ঐ যুবকদের কিছু বলল না।
অল্পসময়ই কেটেছে। ফ্রান্সিসরা দেখল তীরভূমির ওপর দিয়ে একদল যোদ্দা খোলা তরোয়াল হাতে ছুটে আসছে। বোঝা গেল যে, যুবকটি বলে গেল সেইরাজাকে খবর দিয়েছে।
ফ্রান্সিসরা নড়বারও সময় পেল না। যোদ্ধার দল দ্রুত ছুটে এসে ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। যোদ্দাদলের সবাই কালো। যোদ্ধাদলের সর্দার এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসদেরকাছে এসে বলল কী ব্যাপার? তোমরা নাকি রাজা কুতুবুর জাহাজ জোর করে নিয়ে যেতে এসেছো?
না। আমরা কোনরকম জোর করিনি। এই জাহাজ আমাদের হিচকক দ্বীপের বন্দরে চুরি হয়ে গিয়েছিল। আমরা সেই জাহাজফিরিয়ে নিতে এসেছি। বদলে আমরা যে জাহাজ জড়ে এসেছি সেই জাহাজাটা দিয়ে দেব বলেছি। ফ্রান্সিস বলল।
-ঠিক আছে রাজা কুতুবুর কাছে চল। যা বলার তাকেই বলো।
ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে রইল।
–বললাম আমার সঙ্গে এসো। বেশ ধমক দিয়ে সর্দার বলল।
যোদ্ধারা ফ্রান্সিসদের ঘিরে নিয়ে চলল। কেউ এদিক ওদিক করে গেলে তরোয়ালের খোঁচা দিতে লাগল। ফ্রান্সিসদের ঘিরে নিয়ে যোদ্ধারা চলল তীরভূমি ছাড়িয়ে বসতির দিকে।
এখানে ওখানে ছাড়া ছাড়া বাড়ি ঘরদোর। কালো কালো মানুষজন। তারা অবাক চোখে ফ্রান্সিসদের দেখতে লাগল।
একটা বড় বাড়ির সামনে এসে যোদ্ধারা দাঁড়াল। বোঝা গেল এটাই রাজবাড়ি। মাটি বালি আর পাথরের বাড়ি।
বাড়ির সামনে কিছুটা ফাঁকা ঘাসের জমি। সেখানে একটা কাঠের আমলে একজন মধ্যবয়স্ক কালো মানুষ বসে আছে। কাটা ডাব মুখের কাছে নিয়ে ডাবের জল খাচ্ছে।
যোদ্ধা-সর্দার লোকটির কাছে গেল মাথা একটুনুইয়ে সম্মান জানিয়ে কিছু বলে গেল। ডাব ছুঁড়ে ফেলে লোকটি ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর ফ্রান্সিসদের এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল।
যোদ্ধা-সর্দার মৃদুস্বরে বলল-রাজা কুতুবুর কাছে যাও।
ফ্রান্সিসরা রাজার সামনে এসে দাঁড়াল। রাজা কুতুবুবলল–তোমরা বিদেশী? আশ্চর্য তোমরা সবাই নতুন জামাকাপড় পরে আছো।
–হুঁ। আমরা ভাইকিং। জাহাজে চড়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই।
–উদ্দেশ্য? রাজা কুতুবু কুৎকুতে চোখে তাকিয়ে বলল।
–কোন উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। গুপ্তধন ভাণ্ডারের কথা জানতে পারলে সেসব বুদ্ধি খাঁটিয়ে পরিশ্রম করে উদ্ধার করি।
তারপর গুপ্তধন চুরি করে জাহাজে চড়ে পালাও। রাজা কুতুবু বলল।
–না। গুপ্তধনের যিনি প্রকৃত মালিক তাকে দিয়ে দি। ফ্রান্সিস বলল।
বিশ্বাস হচ্ছেনা। যাক গে–তোমরা আমার জাহাজ চুরি করতে এসেছো। তোমাদের সাহসতো কম নয়। কুতুব বলল
–আমরা আপনার জাহাজ চুরি করতে আসি নি। ঐ জাহাজটা আমাদের। হিচকক দ্বীপের একজন লোক ঐ জাহাজটা চুরি করে আপনার লোকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। তাই আমরা আমাদের জাহাজের খোঁজে এসেছি। অনুরোধ আমাদের জাহাজটা আমাদের ফিরিয়ে দিন। ফ্রান্সিস বলল।
কক্ষনো না। ঐ জাহাজ আমার। কুতুবু গলা চড়িয়ে বলল।
–ঠিক আছে। আমরা ফিরে যাচ্ছি।
না। তোমাদের কাউকে ছাড়া হবে না। তোমাদের এখানে বন্দী হয়ে থাকতে হবে।
—আমাদের অপরাধ?
–তোমরা জাহাজ চোর। আমার জাহাজ চুরি করতে এসেছিলে। তার শাস্তি পেতে হবে। কুতুবু বলল।
–আমরা যে জাহাজটা চড়ে এসেছি সেই জাহাজটা আপনি রাখুন আমাদের জাহাজটা আমাদের ফিরিয়ে দিন। হ্যারি বলল।
–তোমরা যে জাহাজ চড়ে এসেছে সেটাও চোরাই জাহাজ। আমার সর্দার তাই বলছে। কুতুব বলল।
আমাদের ওপর মিথ্যে অপবাদ। ফ্রান্সিস বলল।
–কোন কথা শুনতে চাই না। রাজা কুতুবু বলল।
তারপর যোদ্ধা সর্দারকে বলল কয়েদী মাঠেনিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখ। দেখিস্ পালাতে না পারে। জাহাজ চোরের দল। কুতুবু বলল।
ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না।
যোদ্ধারা আবার ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। নিয়ে চলল একটা জঙ্গলের দিকে।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথ। সেই পথ দিয়ে সবাই চলল। ফ্রান্সিস দুদিকে ভালোভাবে তাকাতে তাকাতে চলল। একটা শুকনোমরা গাছ দেখল ডানদিকে। ঘন জঙ্গ ল নয়। গাছপালা ছাড়া ছাড়া।
কিছু পরে সবাই একটা ঘাসে ঢাকা ফাঁকা জায়গায় এল। ফাঁকা জায়গাটা প্রায় গোল। চারদিকে কোন পাথরের দেওয়াল বা গাছের ডাল পুঁতে রাখা হয়নি।
সর্দার যোদ্ধা বলল–কয়েদী মাঠের মাঝখানে গিয়ে তোমরা বসো।
ফ্রান্সিসরা মাঠটার মাঝামাঝিজায়গায় এল। তারপর ঘাসের ওপর বসে পড়ল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। তখনই দেখল আরো কয়েকজন মানুষ হাত-পা বাধা অবস্থায় বসে অছে। বোঝা গেল ওরাও বন্দী।
একটু পরেই সর্দার যোদ্ধা কয়েকজন যোদ্ধকে নিয়ে এল। যোদ্ধারা ফ্রান্সিসদের হাত-পা শক্ত শুকনো লতাগাছ দিয়ে বাঁধতে লাগল। ফ্রান্সিস হাতমুছড়ে বুঝল বুনে লতা বেশ শক্ত। দড়ি বাঁধলে তবু সহ্য করা যায়। কিন্তু এই শুকনো বুনোলতা হাতে পায়ে যেন কেটে বসছে।
দুপুর হয়ে এল। শাঙ্কো একজন যোদ্ধার দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলল–আমাদের খিদে পেয়েছে। খেতে দাও। খাবার জল দাও।
–চেঁচিও না। অপেক্ষা কর। যোদ্ধা সর্দার বলল।
হাত-পা বাঁধা শেষ হল।
একটু পরেই নারকেল গাছের গুড়ি কুঁদে বড় পাত্ৰ মত করার পাত্র নিয়ে কয়েকজন এল। মাটির পাত্রে জল। সবার সামনে পাতা দেওয়া হল। ভাত সামুদ্রিক মাছের ঝোলমত দেওয়া হল।
হ্যারি যোদ্ধা সর্দারের দিকে তাকিয়ে বলল–হাত-বাঁধা। খাবো কী করে?
ওভাবেই খেতে হবে। রাজার হুকুম। যোদ্ধা সর্দার বলল।
ক্ষুধার্ত ফ্রান্সিসরা কেউ আর কোন কথা বলল না। বেশ অসুবিধার মধ্যেই ওরা খাবার খেয়ে নিল।
সান্ধ্য হল। ফ্রান্সিসরা কোনরকমে শুয়ে বসে রইল।
রাতের খাওয়া শেষ হল। চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। চারপাশে সব কিছু মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শাঙ্কো ফ্রান্সিসেরকাছে এল। ফিসফিস করে বলল–ছোরাটা বেরবো?
না আজকে নয়। দু-একদিন যাক। আমরা নতুন। ওরা এখন আমাদের কড়া পাহাড়ায় রাখবে। ফ্রান্সিস বলল।
–প্রহরীই তো নেই। শাঙ্কো বলল।
রাজবাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো ঝাউ গাছটার নিচে তিনজন প্রহরী বসে আছে। ফ্রান্সিস আস্তে বলল।
–মাটিতে বসে আছে? শাঙ্কো বলল।
–না। নারকোল গাছের কাটা কাঠের ওপর। আমি অনেকক্ষণ যাবৎ লক্ষ্য করছি। তাই দেখতে পেয়েছি।
–তাহলে পালাব না? শাঙ্কো বলল।
নিশ্চয়ই পালাবো। সমস্ত সুযোগ বুঝে। ফ্রান্সিস আস্তে বলল।
সকলের খাবার খাওয়া হল। হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই। বাঁধা হাত নিয়ে খাওয়া। অর্ধেক খাবারই পড়ে গেল। কিন্তু ওরা বুঝল এই অবস্থাতে থাকতে হবে। পালাতে না পারলে এই জীবনই মেনে নিতে হবে।
দুপুরে রাজা কুতুবু এল। হাতের শেকলে বাঁধা একটা অ্যালশেসিয়ান কুকুর। ফ্রান্সিসদের ঐ অবস্থায় দেখে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ শুরু করল। বিরক্তির সঙ্গে শাঙ্কো বলে উঠল কুকুরের ডাক থামান।
–তোমাদের বিদেশি দেখে তো তাই ডাকছে। চিনে গেলে আর ডাকবেনা। কালো মুখে সাদা দাঁত বেরকরেকুতুবু হেসে ফেলল। তারপর বলল–ভাবছি তোমাদেরভাঙা জাহাজটা বিক্রি করে দেব। কী হবে আর ঐ জাহাজটা রেখে। তোমরা তো আর ঐ ভাঙা জাহাজে এই জীবনে আর চড়তে পারবেনা। বিক্রি করে মাঝখান থেকে আমার কিছু স্বর্ণমুদ্রা আয় হবে।
ফ্রান্সিসরা কেউ কোন কথা বলল না।
–তোমরা কী বল? কুতুবু হেসে জানতে চাইল।
ফ্রান্সিস বেশ কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল। বলল–তাহলে আপনার জীবন বিপন্ন হবে।
–কী? আমাকে হত্যা করবে? রাজা কুতুবু চিক্করে করে বলে উঠল। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে চাপা স্বরে বলল–ফ্রান্সিস শান্ত হও। ভুলে যেও না আমরা বন্দী। রাজা আমাদের আরও ক্ষতি করতে পারে।
রাজার চিৎকার শুনে প্রহরীরা খোলা তরোয়াল হতে ছুটে এল।
–তোমাদের এক বেলার খাবার বন্ধ করে দেওয়া হল। দেখি তোমাদের গায়ে কত জোর। রাজা কুতুবু গলা চড়িয়ে বলল।
–একবেলা কেন–দুবেলার খাবারই বন্ধ করে দিন। তাড়াতাড়ি মরে যেতে পারবো। এই জানোয়ারের মত বেঁচেথাকা। হ্যারি বলল।
জাহাজ চোরদের এভাবেই শাস্তি দিতে হয় যাতে ভবিষ্যতে আর জাহাজ চুরি না করে। রাজা কুতুবু বলল।
আমাদের আর ভবিষ্যৎ কোথায়। এখানেই তো আমাদের জীবন শেষ। ফ্রান্সিস বলল। রাজা ছুটে ফ্রান্সিসের কাছে এল। চেঁচিয়ে বলল–তুমিই এই দলের সর্দার-না?
-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস ঘাড় নাড়ল।
–আমাকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছো। রাজা কুতুবু বলল।
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমাকে গাছের ডালে লটকাবো। কথাটা বলেই রাজা কুতুবু প্রহরীদের দিকে তাকাল। চেঁচিয়ে বলল অ্যাই–এটাকে ঐ বড় গাছটার ডালে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখ।
প্রহরী কয়েকজন তরোয়াল কোমরে গুঁজেফ্রান্সিসদের কাছেছুটে এল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়েই ছিল। ওরা ফ্রান্সিসকে টেনে নিয়ে চলল বড় গাছটার দিকে।
গাছের প্রথম ডালটা বেশ উঁচুতে। প্রহরীরা গাছের ডালে উঠল। ডালে দড়ির ফাঁস পড়াল। তারপর দড়ির মাথা নামিয়ে দিল। নিচে থেকে প্রহরীরা ফ্রান্সিসের বাঁধা হাতের মধ্যে দড়ি ঢুকিয়ে ডালে বসা প্রহরীটার হাতে দড়ির মুখটা ছুঁড়ে দিল। প্রথমবার ডালেবসা প্রহরীটি দড়িরমুখটা ধরতে পারল না। আবার দড়িরমুখাটা ছোঁড়া হল। এবারও ধরে ফেলল। দড়িটা টানতে লাগল। হাত-পা বাঁধা ফ্রান্সিস ওপরের দিকে উঠতে লাগল। বেশি কিছুটা উঠতে প্রহরীটা দড়িটা ডালে জড়িয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। ফ্রান্সিসের শরীরটা ঝুলতে লাগল।
রাজা কুতুবু গাছের তলায় এল। ওপরের ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–আমাকে হত্যার হুমকি? মনা খেয়ে। খাবার জলও পাবি না।
–আমাদের জাহাজী জীবন। মাঝে মাঝেই খাদ্যে জলে টান পড়ে। ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না। আর কিছু বলতে গেলে রাজা চটে যেতে পারে। চুপ করে থাকাই ভালো।
রাতে খাওয়ার পর শাঙ্কো হ্যারির কাছে এল। বলল হ্যাঁরী কি করবে?
–কিছুই বুঝেউঠতে পারছি না। ফ্রান্সিস এভাবে মেজাজ হারাবে ভাবিনি। হ্যারি বলল।
–কিন্তু ফ্রান্সিসকে তো বাঁচাতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–সেটা একমাত্র তুমি পারো। ছোরাটা আছে তো? হ্যারি বলল।
–তা আছে। শাঙ্কো মাথা ওঠানামা করল।
আর একটা দিন দ্যাখো। হ্যারি বলল।
–খাবার না পেয়ে, জল না পেয়ে ফ্রান্সিস বাঁচবে না। শাঙ্কো বলল। আমরা তার আগেই ওকে নিয়ে পালাবো। হ্যারি বলল।
–দুপুরে খেতে দেয় নি। রাতের বেলায়। কিন্তু হাত বাঁধা। অর্ধেক খাবার ফেলা গেল। শাঙ্কো বলল।
–তা তো হবেই। হ্যারি বলল।
শরীর বেশ দুর্বল লাগছে। শাঙ্কো বলল।
দুর্বলতাকে প্রশয় দিও না। শরীরের দুর্বলতা মনকেও দুর্বল করে করে। হ্যারি বলল
–তাহলে বলছো কালকে পালাব। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ আমি ছক কষেছি। প্রহরীদের কাছে যাচ্ছি। হ্যারি বলল।
প্রহরীদের কাছে? কেন? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–গায়ে দেবার চাদরের মত মোটা কাপড় চাইবো। হ্যারি বলল।
–দেবে? শাঙ্কো বলল।
–দেখি। নাদিলে রাজা কুতুবুর কাছে চাইবো। তাই একদিন সময় নিচ্ছি। হ্যারি বলল।
–এই গরমে গায়ের চাদর নিয়ে কী করবে?
–ছক বলবো। আর বুঝবে। হ্যারি বলল।
হ্যারি উঠে দাঁড়াল। পা বাঁধা। থপ্ থপ্ করে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রহরীদের কাছে গেল।
চাঁদের আলোয় হ্যারিকে দেখে একজন প্রহরী উঠে এল। বলল–কী ব্যাপার?
–বড্ড ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। গায়ে দেবার মত মোটা কাপড় চাই। হ্যারি বলল।
প্রহরীটি হো হো করে হেসে উঠল। বলল–ঠাণ্ডা? তোমায় ঠাণ্ডা?
–আমাদের ঠাণ্ডা লাগছে। মোটা কাপড় দাও। হ্যারি বলল।
আমরা দিতে পারবে না। রাজা বললে তবে পাবে। প্রহরী বলল।
–বেশ। রাজাকে বলবো। হ্যারি ফিরে এলো।
হ্যারি ফিরে এলে শাঙ্কো জানতে চাইল
-কী? দেবে কাপড়?
–এরা দেবেনা। রাজা কুতুবুকে বলতে হবে। কালকে বলবো?
–দেখ বলে। কিন্তু এই গরমে মোটা কাপড় চাইছো কেন?
–পালবার ছক।
খুলে বলো তো।
হ্যারি আস্তে আস্তে ওর পালাবার ছকের কথা বলল? শাঙ্কো চাপা গলায় বলে উঠল—শাবাস হ্যারি।
–এখন সবকিছু নির্ভর করছে তোমার ওপর। ছোরা দিয়ে কত তাড়াতাড়ি হাত পায়ের বাঁধা লতা কাটতে পারো। হ্যারি বলল।
দড়ি কাটার চেয়ে কম সময় লাগবে। শাঙ্কো বলল।
তাহলে তো ভালোই। হ্যারি বলল।
পরের দিন দুপুরেও হ্যারিদের খেতে দেওয়া হল না।
বিকেলের দিকে রাজা কুতুবু এল। হেসে বলল- এবার তোমাদের গায়ের জোর কমবে। মেজাজ ঠাণ্ডা হবে। পালাবার কথা আর কল্পনাতেও আনবে না।
হ্যারি উঠে দাঁড়াল। বলল–মহামান্য রাজা আমার কিছু বলার ছিল। কুতুবুখুব খুশি। ওকে মহামান্যান্য তো কেউ বলে না। হেসে বলল–বলল।
–আমরা ঠাণ্ডায় কষ্ট পাচ্ছি। হ্যারি বলল।
–তোমাদের ঠাণ্ডা লাগছে? বলল কি? রাজা বলল।
–হ্যাঁ। একবেলা খেয়ে শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারছি না। আমাদের মোটা কাপড় দিন যাতে আমরা একসঙ্গে গায়ে দিতে পারি। হ্যারি বলল।
তখন মোটা কাপড় বালিয়ারিতে পাতা হয়। সেই কাপড়টা দেয়া যায় কিনা দেখি। রাজা বলল।
মাননীয় রাজা। আর একটা অনুরোধ। হ্যারি বলল।
–বলল। রাজা বলল।
–আমি ফ্রান্সিস মানে আমাদের দলনেতা যে গাছের ডালে ঝুলছে তাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই। হ্যারি বলল।
–বেশ। গিয়ে বল। কিন্তু ওর মুক্তি নেই। রাজা বলল।
–তা জানি। আমি বললে ও হয়তো আপনার কাছে মাফ চাইবে। হ্যারি বলল।
-তাহলে যাও। কথা বল। রাজা বলল।
রাজা কুতুবু চলে গেল। যাবার আগে ঝুলন্ত ফ্রান্সিসের দিকে একবার তাকিয়ে গেল। যাবার সময় প্রহরীদের কী বলে গেল।
একজন প্রহরী হ্যারিদের কাছে এল। বলল কথা বলতে যাবো। এসো।
হ্যারি দাঁড়িয়ে ছিল। প্রহরীর পিছুপিছু চলল।
ফ্রান্সিস ডালে ঝুলছে।
হ্যারি এসে নিচে দাঁড়াল। দেশীয় ভাষায় বললনা হেসো না। কোনরকম আনন্দ প্রকাশ করো না। আমার ছক বলছি। তারপর হ্যারি গরগর করে ওর ছক বলে গেল। ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না।
ফেরার পথে প্রহরী বলল–কী বললে? বললাম যে ও যেন রাজা কুতুবুর কাছে। মাফ চায়। হ্যারি বলল, প্রহরী খুশির হাসি হাসল।
সন্ধ্যের সময় প্রহরীরা একটা বিরাট মোটা কাপড় নিয়ে এল। কাপড়টা হ্যারিদের সামনে রাখল।
–তাতে খাওয়ার পর সবাই গায়ের ওপর পেতে দেব। এখন থাক। হ্যারি বলল।
প্রহরীরা কাপড় রেখে চলে গেল। হারি গলা নামিয়ে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো হ্যারির কাছে এল। সবাইকে ফিসফিস করে আমার পালাবার ছকের কথা বলে দাও। হ্যারি আস্তে বলল।
শাঙ্কো একে একে সবার কাছে গেল। হ্যারির ছকের কথা ফিসফিস করে বলে এল। শাঙ্কো সাবধান করে বলে এল–এই ছকের বাইরে কেউ যাবেনা।
রাতের খাওয়া শেষ হল।
হ্যারি বলল–সবাই শুয়ে পড়। ভাইকিংরা সবাই শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো আর বিস্কো বিরাট কাপড়টা সবার গায়ের ওপর পেতে দিল। এক বন্ধু বলল–এই গরমে গায়ে মোটা কাপড়। –আপত্তি করো না। হ্যারি বলল।
সবাই কাপড়ের নিচে শুয়ে পড়ল।
তখন মাঝ রাত।
হ্যারি চাপাস্বরে ডাকলশাঙ্কো। চলো।
দু’জনে কাপড়ের তলা থেকে বেরিয়ে এল। তারপর ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। হিঁচড়ে হিঁচড়ে চলল একটা আগাছার ঝোঁপের দিকে।
পৌঁছল সেখানে। বেশ কিছু আগাছা মাঠ থেকে ঊপড়ে তুলল। তারপর ফিরে এল। অনেকের হাতে আগাছা গুলো দিল। ওরা আগাছা গুলো মাটিতে চেপে রাখল। আগাছাগুলি কাপড়টার এখানে-ওখানে উঁচিয়ে রইল। দূর থেকে দেখাবে যেন মানুষের মাথা। মানুষ শুয়েআছে।
এইবার আসল কাজ। কাপড়ের তলা দিয়ে শাঙ্কো বিস্কোর কাছে এল। বিস্কোর ওর বাঁধা হাত শাঙ্কোর গলার দিক দিয়ে ঢুকিয়ে ওর পোশাকের তলা থেকে ছোরাটা বের করল। তারপর দ্রুত হাতে শাঙ্কোর হাতের লতার বাঁধন কাটতে লাগল। একটু পরেই শুকনো লতা কেটে গেল। শাঙ্কো ছোরাটা নিল। পায়ের বাঁধন কাটল। তারপরবিস্কোর হাত পায়ের বাঁধন কাল। এবার বিস্কো ছোরাটা নিল। হ্যারির হাত-পায়ের বাঁধন কাটল। আস্তে আস্তে সবার হাত ও পায়ের বাঁধন কাটা হল। এমন কি দু’জন কালো বন্দীর হাত পায়ের বাঁধন কাটা হল।
হ্যারি চাপা গলায় বলল–যে গাছটায় ফ্রান্সিস ঝুলছ সেই গাছের তলা দিয়ে পায়ে চলা পথ। সবাই গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাও। আস্তে আস্তে। শব্দ না হয়। তারপর পায়ে চলা পথ ধরে সমুদ্রেতীরে।
হ্যারিযখন এই নির্দেশগুলো দিচ্ছে শাঙ্কো ফ্রান্সিসের ঝুলে থাকা গাছটার নিচে
চলে এসেছে। শাঙ্কো কোন শব্দ না করে দ্রুত গাছটায় উঠল। ফ্রান্সিসদের হাতের বাঁধন কেটে দিল। ফ্রান্সিস সোজা এক ঝোঁপের ওপর পড়ল। যাতে শব্দ না হয় তার জন্যে সোজা হয়েই নেমেছিল। তবু শব্দ হল। দুজনেই চুপ করে যে যার জায়গায় রইল। একটু পরে বোঝা গেল শব্দটা প্রহরীদের কানে যায়নি।
ওদিকে হ্যারিরা দ্রুত ছুটছে সমুদ্রতীরের দিকে।
শাঙ্কো নিচু হয়ে ফ্রান্সিসের পায়ে বাঁধা দড়ি কেটে দিল। এবার দু’জনে পায়ে চলা পথটা ধরে ছুটল সমুদ্রতীরের দিকে। সবাই সমুদ্রতীরে পৌঁছল। ওদের জাহাজের কাছে এসে দাঁড়াল। কম বেশি সবাইহাঁপাচ্ছে।
জাহাজ থেকে পাটাতন পাতা নেই। চাঁদের আলোয় চারদিকে মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
–শাঙ্কো-পাটাতন। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো জলে নামল। ডুব দিল। ডুব সাঁতার দিয়ে ওদের জাহাজের গায়ে গিয়ে উঠল। দড়ির মই ঝোলানো নেই। ডেকও তোলা। হালের কাছে ঝুলন্ত দড়িদড়া ধরে শাঙ্কো ডেক-এ উঠে এল। মাস্তুলের আড়াল থেকে দেখল কেউ নেই। ও আস্তে আস্তে পাটাতনটা বের করে নিয়ে এল। কোন শব্দ না করে পাটাতনটা পেতে দিল। তারপর ছুটল অস্ত্র ঘরের দিকে। আট-দশটা তরোয়াল বগলদাবা করে নিয়ে এল। ডেক থেকে তরোয়ালগুলো একটা একটা করে বালির ওপর ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। বালির ওপর তরোয়ালগুলো পড়ায় কোন শব্দ হল না। প্রথম তরোয়ালটা ফ্রান্সিস তুলে নিল। অন্য বন্ধুরাও এবার তরোয়াল তুলে নিল।
ফ্রান্সিস ভাবল জাহাজে নিশ্চয়ই সেইযুবকরা আছে। তার মানে সামনেই লড়াই।
আস্তে আস্তে তরোয়াল হাতে সবাই জাহাজের ডেক-এ উঠে এল। এত মানুষের জাহাজে ওঠা মৃদুস্বরে কথাবার্তা। কেবিন ঘরের একযুবকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে তরোয়াল হাতে ডেক-এ উঠে এল। চাঁদের আলোয় ফ্রান্সিসদের দেখে সে অবাক।
–তরোয়াল ফেলে দাও। লড়তে এলে মরবে। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়েই বলল। যুবকটি বুঝল লড়তে গেলে ওর জীবন বিপন্ন হবে। ও ডেক-এর ওপর তরোয়াল ফেলে দিল। তাতে ঝনাৎ করে শব্দ হল। কেবিন ঘরে ঘুমন্ত যুবকদের ঘুম ভেঙে গেল। তখন ভোর হয়ে এসেছে।
যুবকরা দল বেঁধে তরোয়াল হাতে ওপরে ডেক-এ উঠে এল। খোলা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসদের দেখে ওরা থমকে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস তরোয়াল ঘুরিয়ে দাঁত চাপাস্বরে বলল– তোমরা যদি লড়াই চাও আমরা লড়াই করবো। কিন্তু আমরা সংখ্যায় বেশি। প্রত্যেকের # হাতেই তরোয়াল রয়েছে। ভুলে যেও না ভয় পাইনা। লড়াইহলে তোমরা কেউ বাঁচবে না।
যুবকরা মৃদুস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। ওদিকে একটি যুবক মারিয়ার কেবিন ঘরে ঢুকল। মারিয়ারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মারিয়া ডেক-এ আমার জন্যে বিছানা ছেড়ে উঠল। দেখল দরজায় তরোয়াল হাতে একটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে। যুবকটি ছুটে এসে হাতের তরোয়ালের ডগাটা মারিয়ার গলায় চেপে ধরে গম্ভীরগলায় বলল–ওপরে চলো। নিরুপায় মারিয়া দরজার দিকে চলল। ডেক-এ উঠে এল।
ফ্রান্সিস অবাক। মারিয়া এই জাহাজে এলো কী করে? বোধহয় ওদের খোঁজেই মারিয়া এই জাহাজে এসেছিল। তারপর বন্দী হয়েছে।
ফ্রান্সিসরা দেখল যুবকটি মারিয়ার গলায় তরোয়াল চেপে আছে।
এখানে তো মারিয়ার জীবন বিপন্ন।
যুবকটি গলা চাপাস্বরে বলল–সবাই জাহাজ থেকে নেমে যাও। তারপর রাজা কুতুবুর যোদ্ধাদের হাতে ধরা দাও। নইলে তোমাদের এই সঙ্গিনীকে মেরে ফেলবো।
কেউ কিছু বোঝার আগেই শাঙ্কো দ্রুত গলার দিক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ওর ছোরাটা বের করল। তারপর এক মুহূর্ত দেরি না করে যুবকটির বুক লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। শাঙ্কোর নিশানা নিখুঁত। ছোরাটা যুবকটির বুকে বিঁধে গেল। ও চিৎহয়ে পড়ে গেল। হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গেল। ও এপাশ ওপাশ করল। তারপর স্থির হয়ে গেল।
ফ্রান্সিস বুঝল আবার মারিয়াকে হত্যার চেষ্টা হবে। এক মুহূর্তে দেরি না করে ও তরোয়াল হাতে যুবকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বন্ধুরা ধ্বনি তুলল–ও হো হো। তারপর ওরাও যুবকদের ঠোকাঠুকির ধাতব শব্দ। সুযোগ বুঝে মারিয়া ছুটে এসে ফ্রান্সিসদের পেছনে দাঁড়াল।
ফ্রান্সিস প্রথম সুযোগেই একজন যুবকের বুকে তরোয়াল ঢুকিয়ে দিল। ও চিৎ হয়ে ডেক-এর ওপর পড়ে গেল। লড়াই চলল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সংখ্যায় বেশি ভাইকিংদের কাছে যুবকরা হার স্বকার করতে লাগল। কেউ কেউ আহত হয়ে ডেক-এ পড়ে গেল। দুজন যুবক তরোয়াল ফেলে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাঁতরে তীরে উঠল। তারপর ছুটল রাজবাড়ির দিকে।
আহত যুবকরা জাহাজ থেকে নেমে গেল।
তখনই ভোরের আলোয় দেখা গেল রাজা কুতুবের প্রহরীরা খোলা তরোয়াল হাতে ছুটে আসছে।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–আর লড়াই না। পাল খোল। দাঁড় ঘরে যাও। নোঙর তোল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজ চালাও।
ততক্ষণে পাল খোলা হয়ে গেছে। দাঁড়াটানতেও ভাইকিং বন্ধুরা চলে গেছে। ফ্লেজার হুইলে দাঁড়াল। নোঙর তোলা হয়ে গেছে।
জাহাজ চলল। অল্পক্ষণেরমধ্যেই জাহাজগতি পেল। রাজা কুতুবুর প্রহরীরা ভাঙা জাহাজে উঠল। ফ্রান্সিসদের জাহাজ ধরবার জন্যে ওরাও ভাঙা জাহাজ চালাল। কিন্তু তাদের জাহাজ তেমন গতি পেল না। ফ্রান্সিসদের জাহাজের সঙ্গে তাদের জাহাজের দূরত্ব বেড়েই চলল।
প্রহরীরা হাল ছেড়ে দিল। ওদের জাহাজ থেমে গেল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলল।
ভাগ্য ভালো। ওদের ঝড়ের মুখে পড়তে হল না।
একদিন পরে। জাহাজে জলাভাব দেখা দিল।
চারটে পীপের মধ্যে মাত্র একটা পীপেয় অর্ধেক জল আছে। তিনটি পীপেই ফাঁকা।
হ্যারি ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল–ফ্রান্সিস কী করবে?
–পেডোকে বল–ভালো ভাবে নজর রাখতে। কোন দ্বীপটীপ দেখা যায় কিনা।
জাহাজ চলল। নজরদার পেড্রো মাস্তুলের ওপর থেকে নজর রেখে চলেছে।
পরদিন দুপুরের দিকে পেড্রো মাস্তুলের ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠল ডাঙা দেখা যাচ্ছে ডাঙা। বিস্কো ফ্রান্সিসকে ডেকে নিয়ে এল।
ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে গেল। বলল।
–একটা দ্বীপমত দেখা যাচ্ছে। কত বড় দ্বীপ বা এই দ্বীপে মানুষ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। দ্বীপের কাছে যাও। জাহাজ ভেড়াও। জল নিতে হবে।
দ্বীপটা বেশি বড় নয়। তবে বেলাভূমি বিস্তৃত। ফ্রান্সিস আরসিনাকে জল আনতে যেতে বলল। দুজনে কিছু আগেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিল। জাহাজ থেকে পাটাতন ফেলা হল।
শাঙ্কো এগিয়ে এল। বলল–ফ্রান্সিস আমি গেলে ভালো হত না। –না-না। জল আনবো। এইজন্যে তোমার মাস্তুলের দরকার নেই। ফ্রান্সিস বলল
বিস্কো আর সিনেত্রা দুটো খালি পীপে নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে এল। বালিয়াড়ি পার হয়ে চলল। কিছুদূরেই কয়েকটা ঘরবাড়ি দেখল।
–চলো। ওখানকার লোকদের কাছে জলের খোঁজ করি। বিস্কো বলল।
–চল। সিনেত্রা মাথা নেড়ে বলল।
বাড়িগুলোর কাছাকাছি এসে দেখল। সব কালো নারীপুরুষ বাচ্ছা-ছেলেমেয়ে। বোঝা গেল এখানে কালো লোকয়জনেরই বাস।
বর্শা হাতে এক যুবক ওদের দিকে এগিয়ে এল। বলল-তোমরা কে?
–আমরা বিদেশি–ভাইকিং। বিস্কো বলল।
–এখানে কেন এসেছো? যোদ্ধাটি জিজ্ঞেস করল।
–আমরা জাহাজে চড়ে এখানে এসেছি। জাহাজে খাবার জল ফুরিয়ে এসেছে। তাই খাবার জল নিতে এসেছি। বিস্কো বলল।
–তোমরা জানো আমাদের সর্দার অনুমতি না দিলে এখান থেকে এক ফোঁটাও জল নিয়ে যেতে পারবে না। যোদ্ধাটি বলল।
–না। আমরা জানি না। সিনেত্রা বলল।
–সর্দারের কাছে চলো। এই বলে যুবকটি একটা বড় বাড়ির দিকে হেঁটে চলল। বিস্কোরাও পীপের হাতে পেছনে পেছনে চলল।
যেতে যেতে সিনেত্রা বলল–বোধহয় বিপদে পড়লাম।
না-না। সদারের কাছে অনুমতি নেব। জল নিয়ে চলে যাব। বিস্কো বলল।
দুজনে ঘরে ঢুকল। প্রায় অন্ধকার ঘর। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে দেখল ঘরে, একটা নারকোল গাছ কেটে পায়াওয়ালা একটা কাঠের তক্তপোষ একটি কালো মতো বয়স্ক লোকবসে আছে। গায়ে বেশ দামি কাপড়ের জামা। পরনে রঙিন পায়জামা।
যোদ্ধা যুবকটি বলল–আমাদের সর্দার। মাথা নোয়াও। দুজনে মাথা একটা নোয়াল। যোদ্ধাটি বলল–এরা বিদেশি। কী যেন কিং-এর জাত। এখানে খালি পীপে হাতে জল নিতে এসেছে,
–চালাকি–চালাকি। এরা চোর। আমার রত্নভাণ্ডার চুরি করতে এসেছে। বেশ গলা চড়িয়ে সর্দার বলল।
–আমাদের মিথ্যে দোষ দিচ্ছেন। আমরা চোর নই। বিস্কো বলল।
–উঁহু। তোমরা জল খোঁজার নাম করে রাত পর্যন্ত এখানে থাকবে। তারপর রাত বেশি হলে আমার রত্নভাণ্ডার চুরি করে পালাবে। –এই মতলব তোমাদের। সর্দার বলল।
–আমরা এই দ্বীপে এই প্রথম এসেছি। আমরা জানিই না যে আপনার রত্নভাণ্ডার আছে। সিনেত্রা বলল।
–সবজানো তোমরা আমাররত্নভাণ্ডারের খোঁজেএসেছো তোমরা। সর্দারবলল। তারপর চেঁচিয়ে বলল-দুটোকেইকয়েদ ঘরে ঢোকা। আরো দুটো চোর বোধহয় আছেওখানে।
–হ্যাঁ। যোদ্ধাটি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
দুজনে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। সিনেত্ৰা বলবার চেষ্টা করল
–শুধু সন্দেহের বশে আমাদের
–চোপ–সর্দার ধমকে উঠল!
যোদ্ধাটি ওদের ঘরের বাইরে নিয়ে এল। তখনও দুজনের হাতে পীপে।
বাইরে এসে দেখল প্রায় আট দশখানা যোদ্ধা বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। যোদ্ধাটি এগিয়ে গিয়ে ওদের বলল। দু’জন যোদ্ধা এগিয়ে এল। ওর পেছনে পেছনে আসতে ইঙ্গিত করল।
দু’জনে পিপে হাতে চলল।
একটা বড় গাছের নিচে ছোটঘর। গাছের ডাল দিয়ে তৈরি দেয়াল। মাটি লেপা। ঘরটার সামনে দু’জন প্রহরী দাঁড়িয়ে। দুজনে যেতেই একজন প্রহরী কোমরের ফেটি থেকে চাবি খুলল। দরজার তালা খুলে ঢুকতে বলল। দু’জনে ঢুকে যাবে একজন প্রহরী পীপেটা নেবে বলে হাত বাড়াল। সিনেত্রা পীপে সরিয়ে নিয়ে বলল–না পীপে দুটো। আমাদের কাছেই থাকবে। প্রহরীটি আপত্তি করল না।
ঘর অন্ধকার। জানালা বলে কিছু নেই। মাথার ওপরে বেশ উঁচুতে বেলে মাটি আর। শুকনো ঘাসের ছাউনি।
মেঝেয় নারকেল পাতায় ছড়ানো। তার ওপরেই দুজনে বসল। প্রহরী এসেনারকেলের দড়ি দিয়ে দুজনের হাত বেঁধে দিয়ে গেল।
অন্ধকার চোখে সয়ে আসতে দেখল আরো দুজন বন্দী রয়েছে। দুজনেই কালো। একজন বিস্কোর কাছে এগিয়ে এল। বলল তোমার তো বিদেশি। তোমাদের আটকালো কেন?
–আমরা নাকি চোর। সর্দারের রত্নভাণ্ডার চুরি করতে এসেছি। সিনেত্রা বলল।
–আমরা পাকুই দ্বীপের বাসিন্দা। বেকার। এখানে এসেছিলাম কাজের খোঁজে। আমাদেরও চোর বলে আটকে রেখেছে। কালো লোকটা বলল।
–সর্দারের এটা একটা চালাকি। চোর অপবাদ দিয়ে এইভাবে আটকে রাখা। বিস্কো বলল। কালো লোকটা আর কোন কথা বলল না। অন্য লোকটি এগিয়ে এল। ফিস ফিস করে বলল–এখান থেকে পালানো যায় না?
–কী করে পালাব? দরজায় দুজন প্রহরী বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। পালাতে গেলে মরতে হবে। বিস্কো বলল।
-একটা উপায় বের করতে হবে। লোকটা বলল।
–দেখি কয়েকটা দিন। সিনেত্রা বলল।
সেদিন কাটল।
ওদিকে ফ্রান্সিসরা চিন্তায় পড়ল। বিস্কো সিনেত্রা জল আনতে গিয়ে সারা রাতেও ফিরল না।
পরদিন সকালে শাঙ্কো বলল-আমি একা যাচ্ছি। জাহাজে জলের অভাব। জল তো আনতে হবে।
–বেশ যাও। তবে বিপদ দেখলে পালিয়ে এসো। কোনকমে ওদের দুজনের খোঁজ নিয়ে এসো। তেমনঅবস্থা দেখলে আমরা সবাইযাবো। আরতরোয়াল নিয়ে যেওনা। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো জাহাজ থেকে নেমে এল। চলল। বাড়িঘরগুলোর দিকে।
বাড়িঘরগুলোর কাছে আসতে দু’জন বর্শাধারী যোদ্ধা ছুটে এলো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল। বালিয়ারির মধ্যে দিয়ে জাহাজের দিকে ছুটল। কিন্তু পালাতে পারল না। বালির ওপর দিয়ে দৌড়ানো যায় না। পা আটকে আছে। যোদ্ধারা বালির ওপর দিয়ে দৌড়াতে অভ্যস্ত। সহজেই শাঙ্কোকে ধরে ফেলল। বর্শা উঁচিয়ে বলল–আমাদের সঙ্গে চলো।
–কোথায় শাঙ্কো জানতে চাইল।
সর্দারের কাছে। যোদ্ধাটি বলল।
–বেশ। চলো। শাঙ্কো বলল। শাঙ্কো সর্দারের কাছে এসে দাঁড়াল। সর্দার পাতায় মোড়া তামাক টানছিল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল–
এই দ্বীপে কেন এসেছো?
–জল নিতে। শাঙ্কো বলল।
–কীসে করে জল নেবে? সর্দার বলল।
বন্ধুদের কাছে পীপে আছে। শাঙ্কো বলল।
–ও। তাহলে যে দুটোকে কয়েদ ঘরে আটকে রেখেছি তারা তোমার।
–হ্যাঁ। শাঙ্কো মাথা ওঠানামা করল।
–তোমরা সবাই চোর। আমার রত্নভাণ্ডার চুরি করতে এসেছে। সর্দার বলল।
–আপনার রত্নভাণ্ডারের নামও আমরা শুনিনি। শাঙ্কো বলল।
–এসব চালাকির কথা। তুমিও বন্ধুদের কাছে যাও। সর্দার বলল।
তার মানে আমিও–শাঙ্কো কথাটা শেষ করতে পারল না।
–হ্যাঁ। বিদেশিদের আমি বিশ্বাস করি না। সর্দার চেঁচিয়ে বলল।
সর্দার কার নাম ধরে ডাকল। একজন যোদ্ধা ঘরে ঢুকল।
–যা। এটাকেও কয়েদঘরে ঢোকা। সর্দার বলল।
যোদ্ধাটি ইঙ্গিতে শাঙ্কোকে বাইরে আনতে বলল। শাঙ্কো সর্দারের ঘরের বাইরে এলো।
আরও একজন যোদ্ধা এগিয়ে এল। দুজনেশাঙ্কোকে নিয়ে চলল কয়েদঘরের দিকে।
শাঙ্কোকে কয়েদ ঘরের সামনে এনে শাঙ্কোর দু’হাত দড়ি দিয়ে বাঁধল। তারপর দরজা খুলে শাঙ্কোকে ঢুকিয়ে দিল।
অন্ধকার ঘরে শাঙ্কো বিস্কোদের ভালো করে দেখতে পেল না।
–শাঙ্কো–তুমিও আটকা পড়লে? বিস্কোরা বলে উঠল।
–পালাতে পারলাম না। অবশ্য আমি ধরা দিতে চেয়েছিলাম যাতে তোমাদের কী হল জানতে পারি শাঙ্কো বলল।
শাঙ্কো নারকেল পাতার ওপরে বসে পড়ল। তারপর শুয়ে পড়ল।
–তাহলে এখান থেকে পালানো যাবে না। সিনেত্রা বলল।
–যাবে। পালানোর ছক কষে ফেলেছি। এখন কাজে লাগানো। শাঙ্কো বলল।
তারপর শাঙ্কো শুয়ে শুয়েই ওর পালাবার ছকের কথা চাপা গলায় বলল। বিস্কো ও সিনেত্রা বলে উঠল–সাবাস শাঙ্কো।
পীপে দুটো কোথায়? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–ঐদিকে কোথায় রেখে দিয়েছি। বিস্কো বলল।
–জল নিয়ে যাওয়া যাবে না। যে অর্ধেক পীপে জল আছে তাই দিয়ে চালাতে হবে হিচকক দ্বীপে পৌঁছোবার আগে পর্যন্ত। শাঙ্কো বলল।
–কখন পালাবে? বিস্কো জানতে চাইল।
–রাতে যখন খাবার দিতে আসবে। শাঙ্কো বলল।
সঙ্কোচ হল। শাঙ্কো উঠে বসল। মাথা নিচু করে বলল–বিস্কো–আমার জামার তলায় ছোরাআছে। বেরকর। বিস্কোদড়িবাঁধা হাতশাঙ্কোরজামার নিচে ঢোকাল। আস্তেআস্তে ছোরাটা বের করে আনল। তারপরশাঙ্কোর হাত বাঁধা বিস্কো আর সিনেত্রার হাত বাঁধা দড়ি কেটে দিল। তারপর দুজন কালা মানুষ অবাক চোখে এই কাণ্ড দেখছিল। শাঙ্কো গিয়েওদের হাতেরদড়িও কেটে দিল। মৃদুস্বরে বলল রাজাকুতুবুবন্দীমাঠেআমাদেরহাতপা বাঁধা ছিল। সেখান থেকে আমরা অতগুলো মানুষ পালাতে পেরেছি। আর এ তো শুধুহাত বাঁধা।
একটু রাত হল।
দুজন প্রহরী খাবার দিতে এল।
দরজা খোলা হল।
একজন প্রহরী খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল।
শাঙ্কো একটা পীপে তুলে নিয়ে তৈরিই ছিল। পীপেটা ছুড়ল প্রহরীটির মুখের দিকে। প্রহরীটি দরজার ওপর পড়ল। হাতে আনা খাবারও ছিটকে গেল। দরজার দুটো পাটাই খুলে গেল।
সবাই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। সানেই অন্য প্রহরীটিও অবাক। পরক্ষরেই বর্শা তুলল। শাঙ্কো তৈরি ছিল। ছোরাটা ছুড়ল রহরীটির বুকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ছোরাটা গেঁথে গেল প্রহরীটির ডান হাতে। বর্শা ফেলে ও মাটিতে বসে পড়ল। শাঙ্কো এক লাফে সামনে গিয়ে ছোরাটা খুলে নিয়ে চাপাস্বরে বলল–ছোটো প্রাণপণে জাহাজের দিকে। আহত প্রহরীটি আর্তনাদ করে উঠল।
তিনজনে ছুটল সমুদ্রতীরের দিকে। কালোলোক দুজনও ওদের পিছু পিছু ছুটল। আহত প্রহরীটির আর্তনাদ শুনেই বোধহয় ঘুমন্ত যোদ্ধাদের কারো কারো ঘুমে ভেঙে গেল। তারা বর্শা হাতে ছুটে বাইরে এল।
চাঁদের আলো ম্লান। তবু শাঙ্কোদের ছুটতে দেখা গেল।
যোদ্ধারা পিছু ধাওয়া করল। শেষে কাছাকাছিও এসে গেল। একজন বর্শা ছুঁড়ল। কালো মানুষের একজনের পিঠে বর্শা ঢুকে গেল। সে গড়িয়ে বালিয়ারির ওপর পড়ে গেল।
শাঙ্কোরা ছুটছে। আবার একজন যোদ্ধা বর্শাছুঁড়ল। কারো গায়েই লাগল না। অন্যজন ছুঁড়ল। শাঙ্কোর বাঁ কাধ কেটে বর্শাটা বালির ওপর পড়ল। কাঁধ থেকে রক্ত পড়তে লাগল। কিন্তু শাঙ্কো দাঁড়িয়ে পড়ল না। সমানে ছুটে চলল।
ফ্রান্সিস তখনও ঘুমোয় নি। জাহাজের ডেক-এ দাঁড়িয়ে তীর ভূমির দিকে তাকিয়ে ছিল। বন্ধুরা ফিরল না। এই নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল ওর।
হঠাৎ দেখল কারা ছুটে আসছে। চাঁদের ম্লান আলোয় চিনল শাঙ্কোরা। পিছনে উদ্ধত বর্শা হাতে ছুটে আসছে যোদ্ধারা। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–ভাইসব। তরোয়াল নিয়ে চলে এসো। তখনও সবাই ঘুমোয় নি।
অল্পক্ষণের মধ্যে তরোয়াল হাতে অনেক বন্ধু ডেক-এ উঠে এল। যোদ্ধারা তখনও বর্শা ছুঁড়ছে। কিন্তু আর কারো গায়ে বর্শা লাগল না।
শাঙ্কোরা তখন জাহাজের পাতা কাঠের তক্তার কাছে এসে গেছে।
তরোয়াল উঁচিয়ে ভাইকিংরা পাতা তক্তা দিয়ে নেমে আসতে লাগল।
শাঙ্কোদের পিছু ধাওয়া করা যোদ্ধারা থমকে দাঁড়াল। শাঙ্কোরা জাহাজে উঠে এল। যোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করতে করতে চলে গেল। শাঙ্কো জাহাজের ডেক এর ওপর শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস ছুটে এল হাঁপাতে হাঁপাতে। দেখল শাঙ্কোর বাঁ কাঁধের ক্ষত থেকে রক্ত পড়ছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে ডাকল–শিগগির ভেনকে আসতে বল। বেশি রক্ত বেরুলে শাঙ্কো একেবারে দুর্বল হয়ে পড়বে।
হ্যারি ছুটল ভেনকে ডাকতে। একটু পরে ভেন ওর পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে এল। শঙ্কো পাশে বসল। একটা বোতল থেকে সমুদ্রের নোনা জল, কয়েকটা শুকনো পাতা বের করল। পাতাগুলো হাতের তালুতে ডলে গুড়ো করল। গুড়োটা ক্ষতস্থানে ছড়িয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রক্তপড়া বন্ধ হয়ে গেল। এবার বোয়াম থেকে কালো আঠার মত ওষুধ বের করল। ক্ষতস্থানে আস্তে আস্তে লাগিয়ে দিল। শাঙ্কো একটু নড়ে উঠে স্থির হল। ভেন পোঁটলা-পুটলি গোছাতে লাগল। বিড়বিড় করে বলল–কিছুনা। কয়েকদিন ওষুধ পড়লেই সেরে যাবে। সব গুছিয়ে নিয়ে বলল–ফ্রান্সিস এখন কোথায় যাবে?
সোজা হিচকক দ্বীপে। ফ্রান্সিস বলল।
ওখানে কটা ছোট ঢিলা দেখেছি। চারপাশে জঙ্গল। আমার ওষুধের জন্যে কিছু গাছপাতা শেকড় খুঁজে বের করতে হবে। আমি দেখব খুঁজতে যাবো। ভেন বলল।
–তা যেও। ওখানে তো আমরা লড়াই করতে যাচ্ছিনা। কাজেই শান্তিতেই তোমার কাজ করতে পারবে। ফ্রান্সিস বলল।
এবার ফ্রান্সিস কালো লোকটিকে দেখল। বিস্কো সিনেত্রার সঙ্গে সেও ডেক-এ বসে আছে। ফ্রান্সিস বললশাঙ্কো–ওকে?
–আমাদে রসঙ্গে বন্দী ছিল। আমাদের সঙ্গেই পালিয়ে এসেছে। পাতুই দ্বীপের বাসিন্দা। এই দ্বীপে কাজের খোঁজে এসেছিল। সর্দার চোরঅপবাদ দিয়ে কয়েদ ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। চলুক আমাদের সঙ্গে হিচককদ্বীপে। সেখানে না হয় কাজ জোগাড় করে নেবে। শাঙ্কো বলল।
–হুঁ। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। বলল–তোমার নাম কী?
–তুতুম্ফা। যুবকটি কালো মুখে সাদা দাঁত বের করে হাসল।
–ঠিক আছে। চলো আমাদের সঙ্গে। ফ্রান্সিস বলল।
–ফ্রান্সিস। শাঙ্কো একটু দুর্বলকেই ডাকল।
–বলো।
রাতের খাওয়া হয় নি। বড্ড খিদে। শাঙ্কো বলল।
–চলো। তোমাকে খাবার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোর বা বগলটা ধরে শাঙ্কোকে দাঁড় করাল। শাঙ্কো ডান হাত দিয়ে ফ্রান্সিসের গলা জড়িয়ে ধরল। দুজনে সিঁড়ি ঘরের দিকে চলল।
যেতে যেতে শাঙ্কো বলল–জল আনতে পারলাম না।
–ঠিক আছে। পীপের অর্ধেক জল অল্প অল্প করে খেয়ে চালিয়ে দেব। হিচকক দ্বীপ বেশি দূরে নয়। ফ্রান্সিস বলল।
সিঁড়ি ঘরের গোড়ায় দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–জাহাজ ছেড়ে দাও। দাঁড় টানো, আমাদের যত দ্রুত সম্ভব হিচকক দ্বীপে পৌঁছতে হবে। যতটুকু জল না খেলে নয় ততটুকু জল খাবে।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ তীরভূমি ছাড়ল। হাওয়ার বেশ তেজ। পালগুলো ফুলে উঠল। ওদের জাহাজ বেশ দ্রুতই চলল।
একদিন পরে ফ্রান্সিসদের জাহাজ হিচকক দ্বীপের জাহাজ ঘাটে এসে নোঙর করল।
এবার সোনার ঘর খোঁজার পালা।
একদিন পর ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল–সোনার ঘরের খোঁজের আগে আর একটা কাজ। শুনলাম এই দেশবাসী একজনের মুখে এই হিচককের দক্ষিণে এক সমুদ্র আছে। তারপরেই এক দ্বীপ ক্রীট। হিচকক দ্বীপের সঙ্গে চির বিরোধ। ঐ যে মাঝখানের সমুদ্রের ফালি বললাম ঐ ফালিতে প্রচুর ঝিনুক। মুক্তোও পাওয়া যায়। কিন্তু দুই দ্বীপের কেউ ঐ সমুদ্রের ফালিতে ঝিনুক তুলতে নামে না। দুদেশের প্রহরীরাই বর্শা ছুঁড়ে মারে।
–তা তুমি কী স্থির করেছো? শাঙ্কো বলল।
–ঐ একফালি সমুদ্রে মুক্তো শিকার করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–পাগল হয়েছ? ঐ প্রহরীদের বর্শার কথা ভাবছো না। শাঙ্কো বলল।
–সেসব ভাবতে গেলে কোন কাজই করা হয় না। মনে আছে আর তো আমার সেই মুক্তোর সমুদ্রে ডুব দিয়ে মুক্তো তোলা। ফ্রান্সিস বলল।
—হ্যাঁ। তুমি তো মুক্তো শিকারীদের দলে ভিড়ে কী করে বেশিক্ষণ দম রাখতে দ্রুত ঝিনুক তুলতে হয় এসব শিখেছিলে। শাঙ্কো বলল।
এবার সেটা কাজে লাগানো। ফ্রান্সিস বলল।
–কবে যাবে? শাঙ্কো বলল।
–পূর্ণিমার রাতে। তুমি তো জানোনা পূর্ণিমার রাত কবে? ফ্রান্সিস বলল।
–না। ভেন এসব জানে। শাঙ্কো বলল।
–ভেন-এর কাছে চলো। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে ভেনএর কাছে এল। ভেন হিসেব করে বলল–পরশুদিন পূর্ণিমা।
ফ্রান্সিস সেই দিনটাই স্থির করল।
কিন্তু ফ্রান্সিসের দুর্ভাগ্য। দক্ষিণের দ্বীপে ক্রীট সেই রাতেই হিচকক দ্বীপ আক্রমণ করে বসল।
উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো-ফালি সমুদ্রের তীরে এল। সারি সারি নারকেল গাছের পেছন দিয়ে আড়ালে আড়ালে ওরা ফালি সমুদ্রের জলে নামল। হিচকক দ্বীপের প্রহরী তখন দূরে পাহারারত। ফ্রান্সিসরা বেশ কায়দা করে ওদের চোখকে ফাঁকি দিল।
দুজনে জলে নামল। কিছুটা ডুব সাঁতার দিয়ে গেল। মাথা তুলল।
আজই ক্রীট দ্বীপের দিকে হৈ হৈ চিৎকার শোনা গেল। ফ্রান্সিসরা দেখল একটি দ্বীপের সৈন্যরা চিৎকার করতে করতে ছুটতে ছুটতে আসছে। হাতে খোলা তরোয়াল। হিচকক দ্বীপের পাহারাদাররা পড়িমরি ছুটল রাজবাড়ির দিকে। ক্রীট এর সৈন্যরা আক্রমন করেছে। লড়াই।
ওদিকে ক্রীটের সৈন্যরা জলে নেমে পড়েছে। সাঁতরে আসতে শুরু করেছে। হিচকক দ্বীপের সৈন্যদের মধ্যেও সাজো সাজো রব পড়ে গেল। তারাও তরোয়াল হাতে ছুটে এল। জলের মধ্যেই লড়াই শুরু হয়ে গেল। চিৎকার আর্তনাদ গোঙ্গানি শোনা যেতে লাগল।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো জল পার হয়ে ক্রীট দ্বীপের দিকে চলে এল।
লড়াই তখনও চলছে। লড়াইয়ের চিৎকার তরোয়ালের ঝনঝনানি চলল।
হিচককের সৈন্যরা সংখ্যায় বেড়ে গেল। ক্রীটের সৈন্যরা সংখ্যায় বেশ কমে গেল। ওরা লড়াই চালাল। তবে বোঝা গেল ক্রীটের সৈন্যরা পারবে না। হেরে যাবে।
হলও তাই। ক্রীটের সৈন্যরা আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসতে লাগল। একসময় সবাই পিছিয়ে এল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো একটা নারকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। ক্রীটের সৈন্যদের এক দলনেতা হঠাৎ ফ্রান্সিসের হাত ধরে ফেলল। অন্য হাতে ধরল শাঙ্কোর হাত। চিৎকার করে উঠল–এরা বিদেশী গুপ্তচর। হিচককের সৈন্যরা এত তাড়াতাড়ি আমাদের আক্রমনের কথা জানল কী করে? নিশ্চয়ই এরা আগেভাগেই খবর দিয়েছে।
–আপনি অন্যায় কথা বলছেন। ফ্রান্সিস বলল আপনাদের এইলড়াইয়ের সঙ্গে আমাদের। কোন যোগ নেই। আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। ফ্রান্সিস বলল।
না। তোমরা গুপ্তচর। দলনেতা গলা চড়িয়ে বলল–এ্যই এই দুজনকে বাঁধ। দুজন ও সৈন্য দড়ি হাতে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস রেগে গেল। বলল–দুটো তরোয়াল দিন তারপর আমাদের হার স্বীকার করুন।
— না। তোমাদের লড়তে দেওয়া হবে না। দুজনকে কয়েদ ঘরে ঢোকাও। দলনেতা বলল। শাঙ্কো মৃদুস্বরে বলল–ফ্রান্সিস শান্ত হও।
আরো কিছু হিচকক দ্বীপের সৈন্যকেও বন্দী করা হল। সবাইকে কয়েদ ঘরে ঢোকানো হল।
ঘরে একটা মাত্ৰ মশাল জ্বলছে। তাতেই যা অন্ধকার দূর হয়েছে। মেঝেয় ঘাস পাতা বিছোনো। ফ্রান্সিস প্রথমে বসল। তারপর শুয়ে পড়ল। ও ভাবল–বোকার মত ধরা পড়লাম। পালাতে পারতাম। যা হবার হয়েছে। এখন এই বন্দী দশা থেকে পালাবো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
আরো কিছু হিচকক দ্বীপের সৈন্যও বন্দী ছিল।
একটু রাত হল। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো দলনেতাকে আসতে বল তো।
শাঙ্কো লোহার দরজার কাছে গেল। দরজায় ধাক্কা দিল। একজন প্রহরী এল। বলল– কী ব্যাপার?
–তোমাদের দলনেতাকে আসতে বল। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা কী এমন রাজা এলে যে তোমরা ডাকলেই দলনেতা আসবে। প্রহরী বলল।
বাজে কথা ছাড়ো। ডেকে আন। ফ্রান্সিস বলল।
–না। প্রহরী মাথা নাড়ল।
ফ্রান্সিস উঠে এল। আস্তে আস্তে বলল–ভাই–আমরা কোন অপরাধ করি নি অথচ কয়েদ খাটা। আমাদের গুপ্তচর বলে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে। দলনেতাকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবো। আজ বন্দি হয়েই এই অন্যায় আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে।
–হুঁ। দেখছি।
কিছু পরে দলনেতা এল। বলল কী বলবে তোমরা?
–একটা কথাই বলবো। গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে আমাদের অন্যায়ভাবে বন্দী করা হয়েছে। আমরা নির্দোষ। ফ্রান্সিস বলল।
–না। তোমাদের কথা রাজাকে বলা হয়েছে। রাজা তোমাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। দলনেতা বলল।
মৃত্যুদণ্ড? ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বলল ঠিক আছে আমরা রাজার সঙ্গে কথা বলবো।
–রাজা কথা বলতে রাজি নাও হতে পারেন। দলনেতা বলল।
–তবু একবার বলে দেখুন। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে রাজা এলেন। ফ্রান্সিস বলল–মাননীয় রাজা আমাদের অন্যায়ভাবে বন্দী করা হয়েছে। আমরা নির্দোষ।
–তোমরা বিদেশী। রাজা বলল।
আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।
–জলদস্যুর জাত। রাজা বলল। ফ্রান্সিস রেগে আগুন হয়ে গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করল। বলল–আমরা বিদেশী। আপনাদের এই দেশের যুদ্ধবিগ্রহের। সঙ্গে আমাদের কী যোগ বলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা হিচকক দ্বীপের সৈন্যদের কাছে আমাদের সৈন্যসঙঘার খবর পৌঁছে দিয়েছো নইলে ওরা অত দ্রুত আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করল কী করে? রাজা বলল।
–আমরা সর্বক্ষণ সমুদ্রের জলেই ছিলাম। হিচকক দ্বীপের সৈন্যদের খবর দেব কী করে? ফ্রান্সিস বলল।
–ওসব বুঝিনা। তোমাদের জন্যই আমরা লড়াইয়ে হেরে গেছি। রাজা বলল।
–না আমাদের কোন দোষ নেই’ ফ্রান্সিস বলল।
–ওসব বলে লাভ নেই। তোমাদের কয়েদঘরে থাকতে হবে। মুক্তি নেই। মুক্তি আছে। একবারে মৃত্যুতে। রাজা বলল।
তার মানে আপনি আমাদের হত্যা করবেন? ফ্রান্সিস বলল।
–নিশ্চয়ই। রাজা বলল।
–কী অন্যায় বিচার। শাঙ্কো বলল।
–এটাই তোমাদের প্রাপ্য শাস্তি। রাজা বলল।
ফ্রান্সিস বুঝল রাজা কোন যুক্তি মানবে না। ওদের হত্যা করবেই।
কয়েকদিন কাটল। ফ্রান্সিস শাঙ্কো চুপচাপ শুয়ে বসে থাকে। ভাবে ভবিষ্যৎ কী? এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কিভাবে? যা থেকে সব এখানকার নিয়মটিয়ম দেখতে বুঝতে হবে। তারপর উপায়।
কদিন পর গভীর রাত্রে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় শুরু হল। কালো আকাশ যেন ছিঁড়ে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। সেইসঙ্গে প্রবল বাতাস।
প্রচণ্ড জোর শব্দে একটা বাজ পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কয়েদ ঘরের একটা কোনা ভেঙে পড়ল। ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠল। যাক প্রকৃতিই বাঁচার পথ করে দিল। ফ্রান্সিস বলল– শাঙ্কো–আর বসে থেকো না। রাস্তা খোলা, পালাও।
দু’জনে এক লাফে ভাঙা কয়েদ ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পেছনে অন্য বন্দীরাও।
দুজনে ছুটল দক্ষিণের সমুদ্রের দিকে।
ততক্ষণে বৃষ্টিকমে গেছে। হাওয়ার গতিও কমের দিকে। ছুটতে ছুটতেশাঙ্কো বলল– দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে গিয়ে কী হবে?
-ওখানে নৌকো পাবো। নোকায় চড়ে পালাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–চলো। দেখা যাক। ফ্রাঙ্কো বলল।
দুজনে দক্ষিণ সমুদ্রতীরে পৌঁছল। এবার নৌকো জোগাড় করা। সমুদ্রতীর থেকে বেশ কিছু দূরে লোকজনের বাড়ি-ঘর। সেই বাড়িঘরটরের কাছে বালিতে নৌকো রাখা। নৌকোর ভেতরে দাঁড়। তখন ভোর হয়ে গেছে। ফ্রান্সিসরা নৌকা খুঁজতে লাগল।
ফ্রান্সিসরা যেখানে এল। স্থানীয় বাসিন্দারা ওদের দেখল কিন্তু ওরা যে কয়েদঘর থেকে পালিয়েছে তা তো ওরা জানে না। ফ্রান্সিসরা নিশ্চিন্তমনেই ঘুরে বেড়াতে লাগল। নজর নৌকার দিকে।
দেখল একটা নৌকা একটা ঝোঁপের কাছে রাখা। ধারে কাছে কোন বাড়িঘর নেই।
শাঙ্কো আস্তে আস্তে নৌকোটার কাছে গেল। তারপর দাঁড় দুটো ফ্রান্সিসের হাতে দিয়ে এক হঁচকা টানে নৌকাটা মাথারওপর তুলে ফেলল। তারপর সমুদ্রের দিকেছুটল। পেছনে ফ্রান্সিস।
দুজনে সমুদ্রের ধারে এল তখনই দেখল নৌকার মালিক লাঠি হাতে ছুটে আসছে। ওরা দুজনে লাফিয়ে নৌকায় উঠে গেল। তারপরদাঁড়বাইতে শুরু করল। নৌকার মালিক লাফিয়ে জলে নৌকার দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করল। ফ্রান্সিসরা নৌকার গতি বাড়িয়ে দিল।
মালিক মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল। হাত-পা টেনে মালিক হাল ছেড়ে দিল। সমুদ্রতীরের দিকে ফিরে চলল। তীরে উঠে গেল।
সমুদ্রের ঢেউ তখনও শান্ত হয় নি। উঁচু উঁচু ঢেউ তার মাঝখান দিয়েই ফ্রান্সিস নিপুন। হাতে দাঁড় বেয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে কাত হওয়া নৌকায় ছিটকে জল উঠছে। শুধু হাতেই শাঙ্কো করুন জল ঘেঁচে ফেলছে।
নৌকো চলেছে। কোথায় চলেছে ওরা জানে না। ফ্রান্সিস বলল–মোটকথা ক্রীট দ্বীপ থেকে পালাতে হবে। তারপর সেখানে গিয়ে পৌঁছেই।
বিকেলের দিকে দূরে একটা দ্বীপমত মনে হল। শাঙ্কো চেঁচিয়ে বলল–ফ্রান্সিস একটা দ্বীপ! ঐ দিকেই নৌকো চালাচ্ছি তখন শাঙ্কো নৌকো বাইছিল।
সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার নেমে এল। সেই আলো অন্ধকারে ফ্রান্সিসদের নৌকো দ্বীপটার তীরে ভিড়ল।
দুজনে নামল। সামনেই কিছু বাড়িঘরদোর। বাড়িগুলোয় মশাল জ্বলছে। ফ্রান্সিস বলল শাঙ্কো কী করবে।
–চলো। এসেছি যখন। দেখা যাক কেমন মানুষ এরা। শাঙ্কো বলল।
দরজায় জানালায় উৎসুক মুখের ভিড়। ফ্রান্সিস সামনের বাড়িটায় এল। বোধহয় বাড়ির মালিক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল–জায়গাটা কি দ্বীপ?
-হ্যাঁ। পিলকে দ্বীপ।
–আপনাদের পেশা কী?
–এই দ্বীপের মাঝখানে রয়েছে একটা বিরাট হ্রদ। মিষ্টি জলের হ্রদ। এইদই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এই হ্রদেই আমরা মাছ ধরি। মাছ চাষ করি। সেই মাছ বিক্রির অর্থেই আমরা সংসার চালাই। ওটাই আমাদের রোজগার। বাইরের দ্বীপ থেকেও মানুষ আসে মাছ কিনতে। নিজেরাও চালান দিই। খাড়ির মালিক বলল।
আবার বলল আপনারা বোধহয় বিদেশী।
–হ্যাঁ। সারা পৃথিবী আমরা ঘুরে বেড়াই। এতেই আমরা আনন্দ পাই। হিচকক দ্বীপে আমাদের জাহাজ রয়েছে। মাঝখানে ক্রীট দ্বীপে আমরা বন্দী হয়ে রইলাম। সেখান থেকে, পালিয়ে এসেছি। এখন এখান থেকে আমাদের জাহাজ ফিরবে।
–ততদিন কি এখানে থাকবেন? গৃহকর্তা জিজ্ঞাসা করল।
কিছু ঠিক করি নি তবে দু’চারদিন তো থাকবেই। যাক গে–সারা দিন না খেয়ে আছি। কিছু খেতে দিন। শাঙ্কো বলল।
নিশ্চয়ই। আসুন। গৃহকর্তা বলল।
দুজনে ঘরের মধ্যে ঢুকল। কাঠ ও মাটির তৈরী বাড়ি। ছাউনি শুকনো ঘাসপাতার। ঘরে তিমি মাছের তেলের প্রদীপ জ্বলছে। অন্ধকার মোটামুটি দূর হয়েছে।
মালিক তার স্ত্রীর সঙ্গে কী কথাবার্তা বলল। তারপর ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল দুপুরের বাসি খাবার তো বেশি নেই। আমাদের পেট ভরবেনা। তার চেয়ে রাতের রান্নার তো সময় হয়ে গেল। একটু অপেক্ষা করুন। আপনাদের টাটকা খাবার দেওয়া হবে।
ঘাস দিয়ে বোনা একটা আচ্ছাদন মাটিতে পাতা। তার ওপরেই বসল দুজনে।
তারপর কথাবার্তা চলল। বাড়ির মালিক বলল–আমাদের কোথায় আর শোবেন। খেয়েদেয়ে এখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। পাশের ছোট ঘরটায় আমরা থাকবো।
ফ্রান্সিস শাঙ্কো বেশ পেট ভরেই খেলো। ঘুমও পেল তাড়াতাড়ি। দুজনে বেশ তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে তিনখানা রুটি আর শাকপাতার ঝোল দিয়ে খেল। তারপর হ্রদ দেখতে গেল। সত্যিই বিরাট হ্রদ। পরিষ্কার ঝকঝকে জল। মাছ ধরা চলছে নৌকায়। পাত্র ভরে খাবার জল তুলে নিয়ে যাচ্ছে। চারদিক লোকজনের সাড়াশব্দ।
কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে ফ্রান্সিসরা গৃহকর্তার বাড়িতে ফিরে এল। যাত্রীরা ওদের ছাড়ল না। বলল গৃহকর্তা।
যে কদিন এখানে থাকবেন আমাদের বাড়িইে থাকুন। আপনাদের কোন অসুবিধে হবেনা।
না-না-আপনি যত্নে আমাদের রেখেছেন। ঠিক আছে কটা দিন এখানেই থাকবো।
বিকেলে ফ্রান্সিসরা ঘুরে ফিরে আসার জন্য বেরুবেতখন ভদ্রলোক বললেন–এখানে তো সবই ভালো। কিন্তু বিপদ হল উত্তরের-আগ্নেয়গিরিটা। ওটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। মাঝে মাঝেই মাটি কাপে। তবে অগ্নদগার হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। আবার কবে অগ্নদগার হয় সেই ভয়ে থাকি আমরা।
–আগ্নেয়গিরিটা কোথায়? ফ্রাঙ্কো জিজ্ঞেস করল।
–হ্রদের উত্তর কোণায়। যান–দেখে আসুন। গৃহকর্তা বলল।
–শাঙ্ক। চলো দেখে আসি। ফ্রান্সিস বলল।
দু’জনে হ্রদের ধারে এল। উত্তর দিকে চলল। জঙ্গল এখানে। তার মধ্য দিয়ে দু’জনে হেঁটে চলল। জঙ্গল খুব ঘন নয়।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় আগ্নেয়গিরিটা দেখল। কালো পাহাড়। ওরা পাহাড়ের নিচে এসে পৌঁছাল। বিকেলের নরম রোদে পাহাড়টা মাথা উঁচিয়ে আছে।
দুজনে পাহাড়টায় উঠতে লাগল। জমাট গলাপাখিরা মাঝে মাঝে ছাইয়ের মত কিছু ছড়ানো।
ফ্রান্সিস বলল–কী মাথায় উঠবে?
–এতদূর এলাম। একটু আগ্নেগিরির মুখটা দেখে আসব না? শাঙ্কো বলল।
–না শাঙ্কো। যদি হঠাৎ জেগে ওঠে আমরা পুড়ে ছাই হয়ে যাবো। অত ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না। এখান থেকে যা দেখা যায় তাই দেখে ফিরে চলো। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে ওখানেই দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। জ্বালামুখ থেকে পাতলা কুয়াশার মত নিলচে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। এটাই জীবন্ত আগ্নেয়গিরির প্রমাণ।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল দুজনে। হঠাৎই দেখল ধোঁয়াটা ঘন হতে শুরু করেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই জ্বালামুখ দিয়ে ঘন ধোঁয়া আকাশে উঠতে লাগল। মাটিতে খুব মৃদু কম্পন অনুভব করল দুজনে। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো লক্ষণ সুবিধের নয়। ফিরে চলো।
দুজনে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব ফিরে চলল।
যখন গৃহকর্তার কাছে ফিরল তখন সন্ধে হয়ে গেছে।
বসতি এলাকার মানুষের মধ্যে তখন উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে। লোকজন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস বলল-শাঙ্কো বোধহয় অগ্নদগার হবে। এরা অভিজ্ঞ। জানে কখন কী অবস্থায় আগ্নেয়গিরি জাগে।
–কী করবে? শাঙ্কো বলল?
আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। চলো পালাই। ফ্রান্সিস বলল।
–ঐ নৌকোয় চড়ে পালাতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–পারবো? ফ্রান্সিস বলল।
–পারতেই হবে। এখানে থাকলে মারা পড়বো। চলো।
গৃহকর্তা ওদের দেখে এগিয়ে এল। বলল–আগ্নেগিরি জেগেছে। তবে এরকম মাঝেমাঝে হয়। ঘণ্টা কয়েক গলিত লাভা ছাই ছিটকে বেরোয়। তারপর সব বন্ধ হয়ে যায়। আগ্নেয়গিরি ঘুমিয়ে পড়ে। ভয় পাবার কিছু নেই। এই আগ্নেয়গিরি আমাদের কাছে দেবতার মত। আমরা বছর বছর ফুল পাতা দিয়ে পূজা করি। আমরা রক্ষা পাই।
ফ্রান্সিস বলল–এটা সবসময় হয় না। আগুনে পাথর লাভাস্রোত শুরু হলে রেহাই নেই। আমরা চলে যাচ্ছি।
–ঐ ছোট নৌকোয় চড়ে? ফ্রাসিস বলল।
–হুঁ। শাঙ্কো মাথা ঝাঁকাল।
–দাঁড়ান আপনাদের একটা বড় নৌকো দিচ্ছি। গৃহকর্তা কোথায় চলে গেলেন। একটু পরে ফিরে এল। ওদের সমুদ্রের ধারে নিয়ে গেল। দেখা গেল একটা বেশ বড় নৌকো। মাথা ঢাকা নৌকোর কাছে গিয়ে ওরা দেখল নৌকায় দাঁড় হাল রাখা।
ফ্রান্সিসরা দেরি করলো না। নৌকায় উঠে বসল। নৌকা ছেড়ে দিল। দূর থেকে দেখল সত্যিই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে আগুনের ধোঁয়া বেরুনো অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু ফ্রান্সিসরা তীরে নেমে এল না। নৌকা ভাসাল।
যতটা জেগেছে আগ্নেয়গিরি তাতেই সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে উঠছে। ফ্রান্সিসরা দক্ষ হাতে হাল ধরে রইল। শাঙ্কো দাঁড় বাইতে লাগল। আগ্নেয়গিরির মাথার আকাশটা আস্তে আস্তেস্ফভাবিকহল। আগুনেরআভা নিভেএল। গৃহকর্তাঠিকইবলেছিল ওরা আগ্নেয়গিরিকে দেবতার মত শ্রদ্ধা করেফুলপাতা দিয়ে পূজো করে। আগ্নেয়গিরিটিও ওদের বাঁচিয়ে রাখে।
রাত কাটল। ওর মধ্যেই জলে দাঁড়বন্ধ করে ওরা কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিল। জল ফুলে ফেঁপে ওঠা বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ।
পরদিন দুপুরে দূর থেকে একটা দ্বীপ দেখল। দূর থেকে ঠিক বুঝল না কতদূর। তবু ঐ দ্বীপ লক্ষ্য করেই ওরা নৌকো চালাল।
সন্ধ্যের অন্ধকারে সেই দ্বীপে পৌঁছল। তীরে বেশ কয়েকপা যেতেই ফ্রান্সিস বলে উঠল–সর্বনাশ।
কী হল? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–আমরা সেই ক্রীট দ্বীপেই ফিরে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–বলো কি। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।
–কী করে বুঝলে? শাঙ্কো বলল।
–ফ্রান্সিস আঙুল তুলে একটা বাজ পড়া নারকেল গাছ দেখাল।
–আবার কয়েদ ঘর? শাঙ্কো বলল?
–অগত্যা উপায় কি। এখন উপায়।
ওরা কয়েকটা ঝোঁপের আড়ালে বসে রইল।
রাত বাড়ল। খিদেয় পেট জ্বলছে। ফ্রান্সিস বলল চলো খাবার চুরিকরবে। ভীষণ খিদে।
দুজনে এবাড়ি ওবাড়ির গা ঘেঁষে ঘুরতে লাগল। একটা ফাঁকা এলাকায় একটা বাড়ি পেল। ফ্রান্সিস বলল–এই বাড়িটার ধারে কাছে বাড়ি নেই। এটাতেই চেষ্টা করি।
দু’জনে জানলা দিয়ে তাকাল। দেখল মেঝেয় দুটো বিছানো পাতায় খাবার সাজানো। গাছের ডালে তৈরি বিছানায় একজন পুরুষ শুয়ে আছে। একজন স্ত্রীলোক। মেঝেয় বসেছিল। এবার পাশের ঘরে গেল। বোধহয় জল অথবা নুন আনতে।
ফ্রান্সিস কাঁপা গলায় বলল-জলদী। দুজনে গোল দরজা দিয়ে ঘরটায় ঢুকে পড়ল। স্ত্রীলোকটি ফেরার আগেই দুটো পাতাভর্তি খাবার নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল। পুরুষটি হৈ হৈ করে উঠল। ফ্রান্সিসরা তার আগেই একটা বড় ঝোপে ঢুকে পড়ল।
দুজনে হাঁপাচ্ছে তখন ওরা একটুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপরঅল্প অন্ধকারে গোগ্রাসে খাবার গিলতে লাগল।
খাওয়া শেষ। কোথায় আর হাত মুখ ধুতে যাবে। জংলি গাছের পাতা ছিঁড়ে হাত মুছল। জামার হাতায় মুখ মুছল।
রাত বেড়ে চলল। রাতের মত খাওয়া হয়েছে।
নিশ্চিন্ত মনে দুজনে গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পাতল। তারপর ওখানেই শুয়ে পড়ল।
এবার কী করবে? শাঙ্কো বলল।
ধরা দেব। ফ্রান্সিস বলল।
–বলো কি। আবার কয়েদ ঘর? শাঙ্কো বলল।
–উপায় নেই। এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে থেকে লাভ নেই যদি না পালাতে পারি। কয়েদ ঘর থাকলে দুটো খাওয়া ও নিশ্চিন্তে থাকা যায়। তারপর পালানো। ফ্রান্সিস বলল।
–বড় বেশি ঝুঁকি নেওয়া হবে। শাঙ্কো বলল।
ঝুঁকি তো থাকবেই। কালকে সোজা কয়েদ ঘরে গিয়ে হাজির হবে। প্রহরীদের কাছে আমরা যথেষ্ট পরিচিত। ওরাই আমাদের কয়েদঘরে পাঠাবে। রাজা বা দলনেতার দরকার নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–এভাবে ধরা দেওয়া। শাঙ্কো বলল।
–দাঁড়াও। দুচারটে দিন বিশ্রাম নিই। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে টুমিয়ে শরীরে কিছু জোর করি। তারপর পালানো। ফ্রান্সিস বলল।
সকাল হল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোর ঘুম ভাঙল। কাছেই পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে এল।
এখন যাবে কয়েদখানায়? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। সকালের খাবারটাও জুটবে। চলো। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে কয়েদ ঘরের সামনে এল।
একজন প্রহরী দলনেতাকে নিয়ে এল। দলনেতা হেসে বলল–তাহলে নিজেরাই এসে ধরা দিলি। আমাদের খাটুনি কমিয়ে দিলে।
সকালের খাবার খেতে দাও। ফ্রান্সিস বলল।
আগে কয়েদঘরে ঢোকো। দলনেতা বলল। প্রহরীরা দুজনকে কয়েদঘরে ঢোকাল। দুজনে ঘরে ঢুকেই বসে পড়ল। একটু পরেই সকালের খাবার এল। দুর্জনে পেটপুরে খেল।
এখন তো শুধু শুয়ে বসে সময় কাটানো।
পরদিন রাজা কয়েদ ঘরে এল। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল শুনলাম তোমরা নিজেরাই ধরা দিয়েছ।
–হ্যাঁ। খিদে পেয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল?
–ঠিক আছে। থাকো। দেখি তোমাদের কী শাস্তি দেওয়া যায়। রাজা বলল।
–কী আর শাস্তি দেবেন। এইনরককুণ্ডে আছি এটাই তো যথেষ্ট শাস্তি। শাঙ্কো বলল।
–উঁহু, অন্য কোন শাস্তি। রাজা বলল।
–দোহাই প্রাণে মারবেন না। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখি ভেবে। রাজা গম্ভীর গলায় বলল। তারপর চলে গেল।
রাতে শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস পালানোর একটা জব্বর উপায় ভেবে বের করেছি। রাজার পেটে ছোরা ঢুকিয়ে দুজনে পালাবো। পরদিন বিকেলে ফ্রান্সিস প্রহরীদের একজনকে বলল-রাজাকে খবর দাও। তিনি যেন এখানে আসেন।
–ডাকলেই রাজা আসেন না। প্রহরী বলল।
তখনই দলনেতা এসে হাজির। প্রহরীটি তাকেফ্রান্সিসের কথা বলল। দলনেতা বলল– রাজাকে কী দরকার?
–রাজার সঙ্গে কথা আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। ফ্রান্সিস বলল।
-আমাকে বল তাহলেই হবে। দলনেতা বলল।
আপনাদের বলে লাভ নেই। রাজাকে বলবো। ফ্রাসিস বলল।
–ঠিক আছে। কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা। দলনেতা বলল।
–কী আর করি। আপনাকেই বলি। দক্ষিণে যে মিঠে জলের ছোট-পুকুরটা আছে তাতে গুপ্তধন আছে। ফ্রান্সিস ফিস ফিস করে বলল।
দলনেতা চমকে উঠল। বলল–সত্যি?
–হ্যাঁ অতীতের কোন এক রাজা গোপনে রেখে গেছেন হীরে মুক্তো মনি মাণিক্য। একটা দ্বীপের মধ্যে। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা এতদূর জানো? দলনেতা বলল।
–হ্যাঁ। আরো জানি কী করে সেটা উদ্ধার করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো–দলনেতা বেশ অস্থির হয়ে পড়ল।
মনিমুক্তো বোঝাই পিপে। ও ছুটল রাজাকে খবর দিতে। ফ্রান্সিস প্রহরীদের কাছে। কাগজ কলম চাইল। প্রহরীরা হাসল। এখানে কাগজ কলম কোথায়? একটু পরেই রাজা এল। মুখ চোখ লাল। জোরে শ্বাস ফেলছে। বোঝা গেল ছুটে এসেছে। বলল কী ব্যাপার গুপ্তধনের ব্যাপারে তোমরা কী জানো?
সব বলছি। তার আগে একটু কাগজ আর কলমখানির ব্যবস্থা করুন। রাজা। দলনেতাকে হুকুম দিল কাগজ কলম আনার জন্য। দলনেতা কাগজ কলম নিয়ে এল। ফ্রান্সিস কাগজ কলম মেঝেয় পেতে রাজাকে বলল এসে দেখুন। রাজা সোৎসাহে গিয়ে মেঝেয় বসল। ফ্রান্সিস কাগজে নকশা আঁকতে আঁকতে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে গলাবুক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ওর ছোরাটা বের করল। তারপর রাজার পিঠে ঠেকিয়ে বলল–উঠে আসুন। রাজার প্রহরীরা অবাক। এরকম একটা কিছু ঘটবে ওরা কল্পনাও করতে পারে নি। শাঙ্কো প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে বলল–কেউ চেঁচালে রাজাকে খতম করে দেব। আমরা ফালি সমুদ্রের দিকে যাবো চলো।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল রাজামশাই আমাদের সঙ্গে চলুন।
রাজা আর কী করে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।
রাজাকে সামনে রেখে পিঠে ছোরা ঠেকিয়ে শাঙ্কো বলল কয়েদঘরের বাইরে চলুন।
প্রহরীরা কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না? ভাইকিংটা যে কোন মুহূর্তে রাজার পিঠে ছোরা বসিয়ে দিতে পারে। তাহলেই রাজার দফা শেষ।
প্রহরীরা, রাজা, ফ্রান্সিসরা চলল ফালি সমুদ্রের দিকে।
সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার হয়ে এল চারদিক। ফালি সমুদ্রের সামনে এল সবাই।
ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল–সবাই দূরে যাও। প্রহরীরা কিছুদুরে সরে গেল। রাজার মুখ শুকনো। হঠাৎ যদি ছোরাটা ঢুকিয়ে দেয় পিঠে দফারফা।
হঠাৎ ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো জলে ঝাঁপ দিল। কেউ কিছু বোঝার আগেই। অন্ধকারও হয়ে গেছে। ফ্রান্সিসদের ভালো করে দেখাও যাচ্ছেনা।
অন্ধকারে সাঁতরে চলল ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো। পেছন থেকে প্রহরীরা বর্শা ছুড়ল। কিন্তু কোনটাই ফ্রান্সিসদের গায়ে লাগল না।
কিছু পরে ফ্রান্সিসরা হিচকক দ্বীপের তীরে উঠল। মুক্তি!
দুজনে আস্তে আস্তে হেঁটে চলল রাজবাড়ির দিকে। রাজবাড়ির কাছে যখন পৌঁছল তখন অন্ধকার ঘন হয়েছে। রাজবাড়ির প্রধান প্রবেশ পথে এখানে ওখানে মশাল জ্বলছে।
ওরা সমুদ্রতীরের দিকে চলল।
একটু রাতেই ওরা ওদের জাহাজের কাছে এল। দু হাতের চেটো গোল করে শাঙ্কো ডাকল–হ্যারি–আমরা এসেছি।
বারকয়েক ডাকতে হ্যারি ডেকএ উঠে এল। অন্ধকারে আন্দাজে ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে দেখল। চেঁচিয়ে বলল–নৌকো নামাও। ফ্রান্সিসরা এসেছে।
একটা নৌকা জলে নামানো হল। নৌকোর বিস্কো জানিয়ে পারে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস শাঙ্কো নৌকোয় উঠে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিসরা জাহাজে উঠে এল।
বন্ধুরা ওদের ঘিরে ধরল। শাঙ্কো আস্তে আস্তে সব ঘটনা বলতে লাগল। মারিয়া এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বলল–কিছু ভেবোনা আমরা অক্ষত। ভালোভাবেই ফিরেছি। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–সবার আগে আমাদের খেতে দাও। আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত।
পরদিন ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল—এখানকার সমুদ্রে মুক্ত পাওয়া যায়। চেষ্টা করবো নাকি?
–পারবে?
–মুক্তোর সমুদ্র থেকে মুক্তো তুলেছি। মুক্তো শিকারীদের দলে ভিড়ে নানা কৌশল শিখেছি। ঠিক পারবো। তবে ঝিনুক না ভেঙে তো বলা যাবে না। দেখি কয়েকটা ঝিনুক তুলে।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফ্রান্সিস দড়ি ধরে ধরে জাহাজ থেকে লে নামল। সঙ্গে নিল ঝিনুক-তোলার ছোট জাল।
কিছুক্ষণ পরে জাল ভৰ্ত্তি ঝিনকু এনে বিস্কোকে দিল। বিস্কো সব ঝিনুক ডেক ঢালল। বন্ধুরা ছুরি হাতে বসে পড়ল। ঝিনুকের মুখ ছুরি দিয়ে চাপ দিয়ে খুলতে লাগল।
ফ্রান্সিস আর এক দফা ঝিনুক আনল। তারপর ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে এল। সবাই ভিড় করে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ভিড়ে মারিয়াও আছে।
আজ ঝিনুক প্রায় সব তোলা হয়ে গেল। মুক্তো পাওয়া গেল না।
হঠাৎ বিস্কো একটা মুখখোলা ঝিনুক হাতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভাঙ্গা ঝিনুকে একটা মুক্তা। সবাই ধ্বনি তুলল–ও-দো-দো। ফ্রান্সিস হেসে বলল–সবে একটা মুক্তা পাওয়া গেল। ফ্রান্সিস মুক্তটা হাতের চেটোয় রাখল। সবাইকে দেখাতে লাগল। স্থির হল মুক্তোটা। মারিয়ার গহনার বা’ থাকবে। সবাই খুশি।
ফ্রান্সিস বলল–এবার সোনার ঘর খুঁজে বেরকর।
–কী মনে হয়? পারবে? হ্যারি বলল।
–কিছু সূত্র জানা নেই। যেমন পাঁচরিন্দেয় মাপকাঠিটা। দরজা জানালাহীন ঘরগুলো। ওখান থেকেই হদিস বার করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
সেদিন সন্ধেবেলা হ্যারি জাহাজে এসে ফ্রান্সিসের কাছে এল।
–কী ব্যাপার? তোমাকে বেশ চিন্তাগ্রস্ত দেখছি। ফ্রান্সিস বলল।
–চিন্তারই কথা ফ্রান্সিস আবার হিচকক আর ক্রীটের লড়াই। ক্রীটের রাজা বিদেশ থেকে বহু সৈন্য ভাড়া করে এনেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই হিচকক আক্রমণ করবে। হিচকক দ্বীপ জয় করবে।
–পারবে কী? ফ্রান্সিস বলল।
এবার মনে হয় পিরবো। শাঙ্কো বলল।
–দেখা যাক ফ্রান্সিস বলল।
দুদিন পরে গভীর রাতে ক্রীটের রাজা হিচকক দ্বীপ আক্রমণ করল। হাজার হাজার সৈন্য নিঃশব্দে ফালি সমুদ্র পার হয়ে আক্রমণ করল।
হিচককের সৈন্যরাও ঘুম ভেঙে ছুটল লড়াই করতে। লড়াই চলল। ক্রীটের সৈন্যরা সংখ্যায় অনেক বেশি। তারা হিচককের সৈন্যদের ঘিরে ফেলল।
হিচককের রাজা মামুন শয়নঘরে পায়চারি করছিলেন। মাঝে মাঝে দূতেরা এসে খবর দিয়ে যাচ্ছে। সেসব খবর সুখবর নয়। তিনি বুঝতে পারলেন লড়াইয়ে জিতবেন না। স্থির করলেন বন্দী হবেন না। আত্মগোপন করবেন।
একজন দূতকে ডাকলেন। বললেন–সমুদ্রতীরে যাও। দেখবে কিছু বিদেশী জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। সেই জাহাজের ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে কথা বলা চলল রাজা মানুন রানি ও পুত্রকন্যাসহ আশ্রয় চান। তারা আশ্রয় নিতে পারবেন কিনা।
দূত রাজপ্রাসাদের পেছনের গোপন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। দেরি করার উপায় নেই। প্রায় ছুটে চলল সমুদ্রতীরের দিকে। প্রথমেই ফ্রান্সিসদের জাহাজটা পেল। জাহাজের সামনে এসেচিৎকার করে বলল–আপনাদের সঙ্গে কথাছিল। আমি জাহাজে উঠলে কথা বলবো।
ওদিকে লড়াই চলছে। তার চিৎকার হৈহুল্লায় ভাইকিংদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ওরা অনেকেই জাহাজের বানিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা দূতের কথা শুনল। ফ্রান্সিসকে ডাকল। ফ্রান্সিস রেলিং ধরে উঁচু হয়ে গলা চড়িয়ে বলল
–বিশেষ কোন কথা আছে?
–হ্যাঁ। আমাকে জাহাজে উঠতে দিন। দূত বলল।
-বেশ। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বিস্কোকে বলল-লোকটি কী বলতে চায় জানি না। ওকে জাহাজে নিয়ে এসো।
বিস্কো হালের কাছে এল। দড়ি বেয়ে বেয়ে নৌকোয় নামল। সেটিকে ধরে তীরে নিয়ে এল। দূতটি দ্রুত উঠল। বলল–একটু তাড়াতাড়ি চলুন। বিস্কো একটু দ্রুতই বেয়ে দূতকে জাহাজে নিয়ে এল।
দূত জাহাজে উঠে বলল–আপনাদের ক্যাপ্টেন কে?
ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। বলল–বলো কী ব্যাপার?
–আমাদের রাজা আমুন খুবই বিপদগ্রস্ত। আমরা ক্রীটদের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা প্রাসাদ দখল করবে। রাজা আমুন আমাকে সমুদ্রতীরে পাঠিয়েছেন কোন বিদেশী জাহাজে উনি আশ্রয় নেবেন। বিদেশী জাহাজেই ঠিক আশ্রয় পাওয়া যাবে।
ফ্রান্সিস একটু ভাবল। তারপর বলল–ভাই তোমাদের এই লড়াইয়ের সঙ্গে আমাদের তো কোন সম্পর্ক নেই। আমরা এর মধ্যে জড়াবো কেন?
–এটা মানবিকতার প্রশ্ন। স্ত্রী সন্তান সহ রাজাকে বন্দী করা হবে। বন্দীর জীবন কী কষ্টের হয় সে তো আপানদের জানা আছে। এটা একটা বিনীত আবেদন। দূত বলল।
ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকালো। বলল–হ্যারি কী করবে?
–দেখ রাজা মানমুনের জীবন সংশয়। যদি আমরা আমাদের জাহাজে আশ্রয় দিই তাহলে হয়তো বেঁচে যাবেন। হ্যারি বলল।
–কিন্তু ক্রীটদের রাজা কি চুপ করে বসে থাকবে? সব জাহাজে তল্লাশী চালাবে। রাজা মামুনকে খুঁজে বের করবে। শাঙ্কো বলল সেটা হতে পারে। আমরা জাহাজ নিয়ে দূরে গিয়ে নোঙর করবো। ক্রীটের দলনেতা এতদূর গিয়ে তল্লাশীনাও করতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ তা হতে পারে–ফ্রান্সিস বলল ঠিকআছে রাজা মামুনকে আমরা আশ্রয় দেব।
দূত বলল–আপনাকে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো। রাজা মামুনের জীবন বাঁচালেন আপনি।
তুমি বেশি দেরি করনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজা রানি আর পুত্রকন্যাকে নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।
দূত দ্রুত হালের দিকে ছুটল। দড়ি বেয়ে বেয়ে নৌকোয় বেয়ে নেমে এল। বিস্কোও এল। নৌকো চালিয়ে তীরে ভেড়াল। দ্রুত তীরে নেমে রাজপ্রাসাদের দিকে ছুটল?
বিস্কো নৌকায় বসে রইল।
ওদিকে যুদ্ধক্ষেত্রের চিৎকার চ্যাঁচামেচির শব্দ অনেক কমে গেছে।
কিছুক্ষণ পরে গায়ে দামি কাপড়ের চাদর জড়িয়ে রাজা ও রানি এলেন। দূত পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।
তখন ভোর হয়ে এসেছে। সূর্য ওঠেনি। দূত রাজা রানি ও পুত্রকন্যাকে নৌকোয় তুলে দিয়ে নিজে উঠল। বিস্কো দ্রুত নৌকো বেয়ে এনে জাহাজের হালের কাছে লাগাল।
শাঙ্কো ওপর থেকে দড়ির মই ফেলে দিল। বিস্কো রাজপুত্র রাজকুমারীকে ধরে ধরে মইয়ের থাকে তুলে দিল। দুজনে মই বেয়ে বেয়ে উঠে পড়ল। তারপর রানি উঠতে লাগলেন। মইটা পাক খেল। রানি প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন। বিস্কো দুহাত দিয়ে রানির কোমর ধরল। রানি টাল সামলালেন। আস্তে আস্তে উঠে পড়লেন।
ফ্রান্সিস নিজেদের কেবিন ঘর রাজা রানিদের ছেড়ে দিল। মারিয়া আগেই যা কিছু ভালো বিছানার জিনিস আছে সব পেতে দিল।
রাজা রানি বিছানায় বসলে। রাজকুমার রাজকুমারীকেশাল্কো জাহাজের সবকিছু দেখাতে নিয়ে গেল।
রাজা শুকনো মুখে বসে রইলেন। রানিও চুপ করে বসে রইলেন।
একসময় রাজা বললেন–আপনাদের ক্যাপ্টেন কে? ফ্রান্সিস একটু এগিয়ে এসে মাথা নুইয়ে বলল–আমি। আমরা জাহাজে চড়ে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই। কোথাও কোন গুপ্তধনের সংবাদ পেলে সেই গুপ্তধন উদ্ধার করি।
যখন আমার পূর্বপুরুষ জারা সুমালার সোনার ঘরও আপনারা খুঁজে দেখতে পারেন। হঠাৎ থেমে বললেন–কী বা বলছি। আমি তো আর হিচককের রাজা নই।
–আপনার দুর্ভাগ্য কাটুক আপনি আবার রাজ্য ফিরে পান। আমি আপ্রান চেষ্টা করবো রাজা সুমার গুপ্ত সোনার ঘর খুঁজে বের করতে আপনাকে আমি ফ্রান্সিস এই কথা দিলাম। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা কিছু বললেন না। এই দুঃখের দিনেও একজন বিদেশী তাকে সম্মান জানাচ্ছে দেখে রাজার দুচোখ জলে ভরে উঠল। রানি তার মাথা ঢাকা দামি পাতলা কাপড়ের কানা দিয়ে রাজার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।
রাজরানির জন্য ফ্রান্সিস শাস্কোকে কাছিমের মাংস দুধের মিষ্টি এসব আনতে পাঠাল। শাস্কো দেখেশুনে ভালো ভালো জিনিস আনলো।
রাজারানির কাছে এসব খুবই সাধারণ খাবার।
রাজা-রানির ছেলেমেয়েরা সেই খাবারই খেল। ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রে বোঝা গেল ওদের খুব অসুবিধে হচ্ছে। রাজরানি কিন্তু কোনরকম মুখভঙ্গীনা করেই খেয়ে নিলেন।
পরদিন সকালে শাঙ্কো নৌকোয় চড়ে তীরভূমিতে গেল। ক্রীটের রাজা কী করছে সেটা জানতে।
রাজপ্রাসাদের কাছে এসে দেখল ক্রীটের সৈন্যরা রাজপ্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে। লোকের বাড়ি বাড়ি রাজারানির খোঁজে তল্লাশী চলছে।
তাহলে ক্রীটের সৈন্যরা এখনও জাহাজ তল্লাসী শুরু করে নি।
শাঙ্কো ফিরে এল। ফ্রান্সিসকে বলল সব। হ্যারি বলল-ওরা ছাড়বে না। আমাদের জাহাজেও তল্লাসী চালাবে।
সারা দুপুর ক্রীটের সৈন্যরা জাহাজগুলোও তল্লাশী চালান। রাজরানিকে পেল না।
সন্ধ্যের সময় ফ্রান্সিসদের জাহাজ ওদের নজরে পড়ল। ওরা একটা বড় নৌকোয় চড়ে দশ পনেরজন সৈন্য নিয়ে দলনেতা ফ্রান্সিসদের জাহাজের দিকে আসতে লাগল।
ফ্রান্সিস বুঝল বিপদ। কিন্তু কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। হ্যারিকে বলল–এখন কী করবে?
–চলো রাজার সঙ্গে কথা বলি। হ্যারি বলল।
দুজনে রাজার কেবিনঘরে এল। রাজা পায়চারি করছিলেন। ফ্রান্সিসদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। হ্যরি বলল মাননীয় রাজা কয়েকটা কথা বলছিলাম।
-বলো। রাজা বলল।
-ক্রীটের সৈন্যরা সংখ্যায় দশ পনেরজন হবে একটা বড় নৌকায় চড়ে আমাদের জাহাজ তল্লাশী করতে আসছে। হ্যারি বলল।
জানতাম আত্মগোপন করলেও ধরা পড়তেহবে। রাজা বেশ দুঃখের সঙ্গে বললেন দেখুন আমরা ওদের হারিয়ে দিতে পারি। ওরা খালি হাতে ফিরে যেতে বাধ্য হবে। আমাদের সঙ্গে লড়াই হবে। ওদের কয়েকজন মরবে। আমাদেরও আহত হবে। কিন্তু এদিকে গেলেও আরো নৌকো আরো সৈন্য ক্রীটের রাজা পাঠাবে। তখন পুরোদস্তুর লড়াইয়ে নামতে হবে। আমরা তা চাইছিনা। ফ্রান্সিস বলল।
-না-না। তোমরা এর মধ্যে জড়াবে কেন। আমি ধরা দেব। রাজা বললেন।
–কিন্তু আপনার প্রাণসংশয় হবে। হ্যারি বলল।
–তা জানি। কিন্তু আমি নিরুপায়। রাজা বললেন।
ক্রীটের দলনেতার নৌকো ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। দলনেতা গলা চড়িয়ে বলল–এই জাহাজে রাজা মামুন আছেন?
–এসে দেখ। বিস্কো বলল।
ওরা নৌকার হালের দিকে নিয়ে গেল। ঝুলন্ত দড়ি ধরে ধীরে ধীরে দশজনের মত সৈন্য ডেকে উঠে এল।
রাজা মামুন রানি আর রাজকুমার রাজকুমারীকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ডেকে উঠে এলেন। দলনেতা ছুটে গিয়ে নৌকোটা দড়ি মইয়ের নিচে আনতে বলল। নৌকো আনা হল। রাজা ও রানি ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বললেন অনেক ধন্যবাদ তোমাদের।
রাজারানি ছেলেমেয়েদের নিয়ে দড়িমইয়ের সাহায্যে দলনেতার নৌকায় নামলেন।
ওদিকে রাজা মামুনের সেনাপতি ধরা পড়তে পড়তেও ক্রীট সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েনি। হিচককদ্বীপের মানুষের কাছে সেনাপতি খুবই জনপ্রিয়। সেনাপতি এ বাড়িতে সে বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচল। এবার সেনাপতির চিন্তা হল কী ভাবে ক্রীটের রাজার সৈন্যদের এখান থেকে তাড়ানো যায়। এজন্য অনেক সৈন্য প্রয়োজন। এইজন্য অন্য দ্বীপে যেতে হবে। প্রচুর সৈন্য এনে ক্রীট সৈন্যদের আক্রমণ করতে হবে। বেশি সৈন্যের চাপে ওদের হারিয়ে দেওয়া সহজ হবে।
কিন্তু অত সৈন্যকে ভাড়া করে আনতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এত অর্থ দেবে কে? রাজা এখন ফ্রান্সিসদের জাহাজে।
সেনাপতি দূতের কাছে খোঁজ নিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজে এসে উঠল। বলল–রাজা মামুনের সঙ্গে কথা আছে।
–যান।
সেনাপতি রাজার ঘরে ঢুকল। রাজা রানিকে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলল– একটা বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি।
–বলুন সেটা কী। রাজা বললেন।
–এই ক্রীটদ্বীপের সৈন্যদের হারাতে হলে আমাদের আরো অনেক ভাড়াটে সৈন্য চাই। তারজন্যে সোনার চাকতি অর্থ চাই। বেশ কিছু পরিমান ভাড়া করা সৈন্য আনতে হবে। সেনাপতি বলল।
–সোনার চাকতি অত অর্থ পাবেন কোথায়? রাজা বললেন।
এবার রানি বললেন–দেখুন রানিমাতার অনেক অর্থ আছে। সোনার চাকতিও আছে। এসব নিয়ে সেনাপতিমশাই অনেক সৈন্য আনতে পারবেন।
–কিন্তু রানিমাতা আমাকে এত অর্থ স্মর্শ দেবেন কেন? সেনাপতি বলল।
–রানিমাতা আপনাকে চেনেন। রানি বললেন।
–তার একটা চিহ্ন ছিল।
রাজা ভাবলেন। তারপর মধ্যমা আঙ্গুল থেকে একটা আংটি বের করে সেনাপতিকে দিলেন। বললেন–এই আংটিটাই চিহ্ন। আমাকে তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন, এটা দেখলেই রাজমাতা চিনবেন।
সেনাপতি চলে গেল। ফ্রান্সিস রাজাকে বলল–সেনাপতি সঠিক পথ ধরেছেন। এই উপায় ছাড়া ওদের তাড়ানো যাবে না।
সেনাপতি বলল–মাননীয় রাজা–আপনি ক্রীটের রাজার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবেন।
ক্রীটের রাজা কি আমাদের ফাঁসি দেবে? রাজা বললেন।
–হ্যাঁ ওর মনোভাব তাই। তবে বলছিলাম ক্রীটের রাজার সঙ্গে কোন তর্কবিতর্কে যাবেন না। যা বলে মেনে নেবেন। মোট কথা আপনাকে অন্ততঃ পাঁচদিন বেঁচে থাকতে হবে। তার মধ্যেই আমি সৈন্য নিয়ে ফিরে আসবো। আমরা একবার আসতে পারলে আর কোন ভয় নেই।
সেদিনই গভীর রাতে সেনাপতি প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকল। এ ঘর ওঘর করতে করতে রানীমাতার ঘরে এল।
রানীমাতা ঘুমিয়ে আছে। রানিমাতা যাতে বেশি চমকেনা ওঠে তার জন্য সেনাপতি রানিমাতার কপালে হাত। একটু পরেই রানীমাতা নড়লেন। আবছা আলোয় সেনাপতির মুখের দিকে তাকালো। বলল তুমি সেনাপতি।
–আজও আমি ওই দেশের সেনাপতি। সেনাপতি বলল।
কী করে বিশ্বাস করবো। রানিমাতা বললেন।
সেনাপতি আংটিটা বের করে রানিমাতার হাতে দিল। বলল—এই আংটি আপনি রাজা মামুনকে দিয়েছেন। উনি চিহ্ন হিসেবে ওটা আমায় দিয়েছেন যাতে আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন।
–আমার কাছে যখন এসেছো তখন নিশ্চয়ই আমার কাছে কিছু চাও? কী চাও?
–তাহলে সব বল। ক্রীটের রাজা প্রচুর সৈন্য নিয়ে আমাদের আক্রমণ করে আমাদের হারিয়ে দিয়েছে। এখন ওদের হারাতে হলে আমাদেরও সৈন্য ভাড়া করতে হবে বিভিন্ন দেশ থেকে। তারপর লড়াই।
–বেশ তবে সৈন্য সংগ্রহ করে লড়াই করো।
কিন্তু মাননীয় রাজমাতা–সোনার চাকতির বিনিময়ে সৈন্য দের ভাড়া করতে হবে। তার জন্যে বেশি পরিমান সোনার চাকতি চাই।
তার মানে সোনার চাকতি আমাকে দিতে হবে। রানিমাতা বললেন।
–হাঁ নইলে কোথায় পাবো? সেনাপতি বলল।
–বেশ। রানিমাতা মাথা নাড়লেন।
রানিমাতা বিছানা থেকে নামলেন। সেনাপতির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তারপর একটা করে কাজ করা কালো বা’রে সামনে এলেন। তালা খুলে বা’ খুললেন। সেনাপতি কোমরের ফেট্টিটা খুলে ফেলল। সোনার চাকতিও থোলেতে ভরতে লাগল। বা’রে প্রায় অর্ধেক সোনার চাকতি সেনাপতি বেঁধে নিল।
তারপর বলল–ঠিক আছে। এতেই হবে।
সেনাপতি সোনার চাকতির বস্তাটা কাঁধে ঝুলিয়ে এক বন্ধুর বাড়ি এল। বন্ধু বলল– ক্রীট সৈন্যরা তোমাদের খুব খুঁজছে।
খুঁজুক। আমার নাগাল পাবে না। সেনাপতি বলল।
সেনাপতি বিকেলের আলো আঁধারিতে চাদরে মুখ ঢেকে সমুদ্রতীরে এল। বিদেশি জাহাজ খুঁজতে লাগল। দুটো বিদেশী জাহাজ পেল। একটাতে উঠল। ক্যাপ্টেন দাড়িওয়ালা। মোটা। এগিয়ে এল। বলল কী ব্যাপার?
–আপনারা কোন দেশের? সেনাপতি জানতে চাইল।
–এখানে কেন? ক্যাপ্টেন বলল।
–আপনারা এরমধ্যে জাহাজ ছাড়ছেন? সেনাপতি বলল।
না আমাদের দেশে যেতে এখনও দিন দশেক লাগবে। ক্যাপ্টেন বলল।
সেনপাতি অন্য জাহাজটায় এল। সোজা ক্যাপ্টেনের ঘরে গেল। বলল–আপনারা কোন দেশের।
–আপনারা কি এর মধ্যে দেশে ফিরছেন? সেনাপতি জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। আজ শেষ রাতে আমরা পোর্তুগালের দিকে জাহাজ চালাবো। ক্যাপ্টেন বলল।
–আমার একটা বিনীত অনুরোধ ছিল। যদি আপনাদের জাহাজে আমাকে নিয়ে যান তাহলে আমার বড়ই উপকার হয়। সেনাপতি বলল।
–আপনার পরিচয়? ক্যাপ্টেন জানতে চাইল।
–আমি এই হিচককদ্বীপের সেনাপতি। সেনাপতি বলল।
–ভাড়া তো লাগবে। ক্যাপ্টেন বলল।
সেনাপতি কোমরের ফেট্টি থেকে দুটো সোনার চাকতি বের করে দিল। ক্যাপ্টেন খুব খুশি। ভাড়া হিসেবে অনেক পাওয়া গেল।
–তাহলে শেষ রাতে আমি আসছি। সেনাপতি বলল। তারপর জাহাজ থেকে পাটাতন দিয়ে হেঁটে নেমে এল।
শেষরাতে সেনাপতি তৈরি হল। একটা মোটা কাপড়ের বস্তা নিল। পোশাকটোশাকের সঙ্গে একটা থলেতে সোনার চাকতিগুলো নিল। ঠিক করল এটাই হবে ওর বালিশ।
ঠিক সময়েই জাহাজে পৌঁছল সেনাপতি।
শেষ রাতে জাহাজ ছাড়ল।
কয়েকদিন পরে জাহাজটা একটা দ্বীপে পৌঁছল। সেনাপতি নেমে গেল। দ্বীপের বন্দরটা মোটামুটিবড়ই। সেনাপতি দ্বীপের রাজার সভায় গেল। শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজাকে বলল আমি হিচকক দ্বীপের সেনাপতি। শত্রুরা আমাদের দেশ দেখল করেছে। আমরা তাদের জানিয়ে দিতে চাই। তার জন্য সৈন্য চাই। আপনি যদি আমাকে কিছু সৈন্য ধার দেন তাহলে তাদের নিয়ে লড়াই চালাতে পারি।
–সৈন্য ভাড়া করবেন তার মূল্য তো দিতে হবে। রাজা বলল। সেনাপতি কোমরের ফেট্টি থেকে চারটে স্বর্ণমুদ্রা বের করে রাজাকে দিল। রাজা খুশি হলেন। নিজের সেনাপতিকে হুকুম দিলেন সৈন্য ভাড়া দেওয়ার জন্য।
এক দল সৈন্য পাওয়া গেল। এবার সৈন্যদের নিয়ে সেনাপতি জাহাজঘাটায় এল। দরদস্তুর করে একটা জাহাজ কিনে ফেলল। সৈন্যদের নতুন কেনা জাহাজে তুলে দিল। এবার কিছুঅভিজ্ঞ জাহাজী জোগাড় করল। তারা জাহাজে উঠে কাজে লাগল। পালটাল খাটাল। সন্ধ্যের মধ্যেই জাহাজ রওনা হবার জন্যে তৈরি হয়ে গেল।
ভোরবেলা জাহাজ ছাড়া হল। আবার এক দ্বীপে গেল জাহাজ। এইভাবে সেনাপতি সৈন্য যোগাড় করল। আর একটা জাহাজ মিলল। দ্বীপদেশ থেকে সৈন্য জোগাড়ও করল।
এবার দেশে ফেরা।
সৈন্যবোঝাই দুই জাহাজ নিয়ে সেনাপতি ফিরে চলল।
ওদিকে ক্রীটের রাজা মামুনের ফাঁসির ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
বাজারের কাছে ফাঁসিকাঠ তৈরি হয়েছে। দেশের লোক রাজার ফাঁসি হবে দেখে দুঃখে ভেঙে পড়ল।
সেদিন একটু বেলায় রাজা মামুনের ফাঁসির ব্যবস্থা হল। বাজারে অনেক লোক জড় হল। সকলেই দুঃখে কাতর। একটু ক্ষ্যাপাটে হলেও রাজা মামুনকে ওরা ভালোবাসে।
সেদিনই সেনাপতির জাহাজ জাহাজঘাটায় ভিড়ল।
সেনাপতি তীরে নামল। তখনই নৌকোর আড়াল থেকে দুজন দেশবাসী সেনাপতির কাছে ছুটে এল। বলল–মাননীয় সেনাপতি ক্রীটের রাজা রাজামশাইকে ফাঁসি দেবার সব ব্যবস্থা করেছে। বাজারের কাছে।
সেনাপতি একদৃষ্টে নিজের জাহাজে গিয়ে উঠল। গলা চড়িয়ে বলল–সৈন্যভাইয়েরা আমরা এখনই আক্রমণ করবো। তোমরা তৈরি হয়ে নেমে এসো।
সৈন্যরা খোলা তরোয়াল উঁচিয়ে জাহাজ থেকে নেমে আসতে লাগল।
তখন রাজা মামুনকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হয়েছে। ফঁসুড়েও হাজির। কিন্তু ক্রীটের রাজা হুকুম দেবার আগেই সেনাপতির সৈন্যরা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ফাঁসি বন্ধ হয়ে গেল। লড়াই শুরু হল। সেনাপতির সৈন্যরা অভিজ্ঞ যোদ্ধা কাকুশলী। রাজা ক্রীটের সৈন্যরা কচুটা হতে লাগল। বাকিাদক্ষিণমুখখানিজেদেরদ্বীপেরদিকেপালাতে লাগল।
রাজা মামুনের প্রাসাদশত্রুমুক্ত হল। দ্বীপবাসীরা রাজার জয়ধ্বনি তুলল। হিচকক দ্বীপ শত্রু মুক্ত হল। দ্বীপে আনন্দ উৎসব চলল।
ক্রীটের রাজা পরাজয় স্ফকার করল। সৈন্যবাহিনী নিয়ে ক্রীটে পালিয়ে গেল।
এবার ফ্রান্সিস সোনারঘরের খোঁজ শুরু করল। ও একটা জিনিস বুঝল সোনার ঘর প্রাসাদের বাইরে নয়। প্রাসাদের মধ্যেই আছে। রাজা সুমালা যে খেলাঘরগুলো তৈরি করেছিল ওখানেই আছে সোনার ঘর।
ফ্রান্সিস মাপকাঠিটা নিয়ে বসল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারল না পাঁচ হাত লম্বা মাপকাঠিটা। পেতলের মাপকাঠিটা যেখানে থেকে শুরু হয়েছে। ওখানে একটা ইংরেজি ত্ৰ-এর মত চিহ্ন। ফ্রান্সিস এই চিহ্নটার অর্থ বুঝল না।
ফ্রান্সিস খুব বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে মন্ত্রীর কাছে শুনেছে।
সেদিন মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির হল। প্রহরীরা বলল–বল গে ভাইকিং দলনেতা সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। বিশেষ প্রয়োজন। প্রহরী চলে গেল। একটু পরে ফিরে এল। ফ্রান্সিসের ইঙ্গিতে প্রথম ঘরটায় ঢুকতে বলল।
ফ্রান্সিস ঘরটায় ঢুকল। বেশ সাজানো গোছানো ঘরে একটা বড় গোল টেবিল। চারদিকে বসার চেয়ার। পায়াওলা বাঁকা একটা চেয়ারে বসল ফ্রান্সিস।
কিছু পরে মন্ত্রী ঢুকলেন। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। মন্ত্রী বললেন–বসে বসে ফ্রান্সিস বললেন–তোমরাই তো ভাইকিং?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা কী কর? মন্ত্রী বললেন।
–দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই। কোথাও গুপ্তধনভাণ্ডারের খবর পেলে সেই ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করি। ফ্রান্সিস বলল।
বদলে গুপ্তধন ভাণ্ডারের অংশ নাও না? মন্ত্রী বলল।
আজ্ঞে না। ফ্রান্সিস বলল।
–বাঃ। তোমাদের নীতিবোধের প্রশংসা করছি। কিন্তু আমি তোমাদের কী উপকার করতে পারি? মন্ত্রী বলল।
–আপনি তো সোনার ঘরের কথা জানেনই। সেই ঘরটা রাজা সুমালা কোথায় তৈরি করেছিলেন বলে আপনার মনে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–সেটা বের করা খুবই মুশকিল। কারণ কোন সূত্র নেই। মন্ত্রী বললেন।
আমার কাছে একটা সূত্র আছে। অনেক হাত ঘুরে আমার হাতে এসেছে ওটা। ফ্রান্সিস মাপকাঠিটা বের করল।
–কী সেটা? মন্ত্রী বললেন।
-ফ্রান্সিস পাঁচ হাত লম্বা মাপকাঠিটা দেখালে মন্ত্রী কিছুক্ষণ হাতে নিয়ে দেখলেন তারপর বললেন–এটা কিসের মাপ?
–রাজা সুমাল যে সব খেলার জন্য ঘর বানিয়েছিলেন এই মাপকাঠিটা দিয়েই মাপা হয়েছিল সেসব। ফ্রান্সিস বলল।
–তা হতে পারে। মন্ত্রী বলল।
–মাপকাঠিই নাকি ওখানেইইটবালি ধুলোর মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল।
–এখন বল আমার কাছে এসেছো কেন?
ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে মাপকাঠির চিহ্নটা দেখিয়ে বলল–এই চিহ্নটার অর্থ কী?
মন্ত্রীমশাই বেশ কিছুক্ষণ চিহ্নটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন–এটা আমি বলতে পারবো না। সবচেয়ে ভালো হয় যদি জ্ঞান বৃদ্ধের কাছে যেতে পারো। উনি আমার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তা ছাড়া পুরোনো আমলের লেখা চিহ্ন এসব নিয়ে চর্চা করেন। সহজেই চিহ্নের অর্থ বলে দিতে পারবেন।
–তাঁকে কোথায় পাবো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–ঐ উত্তরের পাহাড়ের নিচে তার আশ্রম। মন্ত্রী বললেন।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। তখনই হ্যারি এল ফ্রান্সিসের খোঁজে। দুজনে চলল উত্তরের পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের নিচে এসে দেখল–একটা আশ্রম। বাড়ি ও গাছগাছালি। কয়েকটা হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি অল্পবয়স্ক ছেলে হরিণগুলোর সঙ্গে খেলা করছিল। ফ্রান্সিস ছোট ছেলেটিকে ডাকল। ছেলেটি কাছে এল। ফ্রান্সিস বলল–জ্ঞানবৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করবো। তিনি কোথায় আছেন?
–আমার সঙ্গে আসুন। ছেলেটি ফ্রান্সিসদের নিয়ে চলল। পেছন দিকে একটা ছোট ঘর। ঘাসপাতায় তৈরি। সেই ঘরের দরজায় এসে ছেলেটি দাঁড়াল। হাত দিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখাল।
দুজনে ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। দেখল–এক বৃদ্ধ একটা হরিনের চামড়ার আসনে বসে আছেন। হ্যারি বলল–একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছিলাম।
-ঠিক আছে। ভেতরে এসে বসো।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি একটা পাতা কম্বলে গিয়ে বসল। ফ্রান্সিস মাপকাঠিটা জ্ঞানবৃদ্ধকে দিল। বলল–একটা ক্ৰ৩ চিহ্ন আছে মাপকাঠিটায়। এটার অর্থ কী?
জ্ঞানবৃদ্ধ কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। তারপরে বললেন–এটার অর্থ গুণ। মাপকাঠিটা দিয়ে কিছু একটা মাপতে হবে তারপর গুণ করতে হবে। মহন্ত বললেন।
–তাহলে তো তিন পাঁচে পনেরো দাঁড়ায়। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। মহন্ত বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।
–ঠিক আছে। এইটাই আমার জানার দরকার ছিল। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। হ্যারিও উঠল।
–কিন্তু তোমরা এই মাপামাপি করছো কেন? জ্ঞানবৃদ্ধ বলল।
–আপনি তো জানেন রাজা সুমালা একটা সেনার ঘর তৈরি করিয়েছিলেন। আমার সেই সোনার ঘরটা খুঁজছি। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ কঠিন কাজ। দেখ পাও কিনা। জ্ঞানবৃদ্ধ বললেন।
দুজনে আশ্রম থেকে বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল হ্যারি। সোনারঘর বেরকরতে পারবে।
–মাপকাঠির মাপটাপ সমাধান করেছো? হ্যারি বলল।
হ্যারি, এবার রাজা মামুনকে খেলাঘরগুলির জায়গায় নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে রাজপ্রাসাদে এল। একটু পরে রাজা মামুন মন্ত্রী দুজনেই এলেন খেলাঘরের এলাকাটায় রাজা সুমালা দেয়াল তুলে ঘিরে দিয়েছিল। তার যে ঢাকার দরজাটা ছিল ফ্রান্সিস সেই দরজার ঠিক মাঝখান থেকে মাপকাঠি দিয়ে মেপে চলল। একটা ঘরের সামনে এসে পনেরো হাত শেষ হল। ফ্রান্সিস বলল–কুড়ুল চাই। ঘরটা ভাঙতে হবে।
ততক্ষণে সেখানে অনেক লোকজড়ো হয়েছে। সোনারঘর দেখা যাবে–সোজা কথায়। রাজা মামুন এলেন। তিনিও উত্তেজিত। সোনার ঘর আবিষ্কৃত হবে। তাঁরআনন্দের শেষ নেই।
হ্যারি একজন সৈন্যকে একটা কুড়ুল আনতে বলল। অল্পক্ষণের মধ্যেই কুড়ুল আনা হল।
ফ্রান্সিস ঘরটায় কুড়ুল চালাতে লাগল। ইটের টুকরো ধুলোবালি ছিটকে বেরুতে লাগল। প্রায় অর্ধেক ভাঙা হয়ে গেল। সোনার ঘরের দেখা নেই।
আরো ভাঙা হল। কিছুই পাওয়া গেলনা। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে রইল। রগচটা রাজা মামুন বিরক্তির সঙ্গে বলল কী সব কাণ্ড। সোনারঘর বেরকরা অত সহজ কাজ নয়। আমি যাচ্ছি। রাজা মামুন চলে গেলেন। মন্ত্রী বললেন–আরো ভালোভাবে খোঁজ কর। পাওয়া যাবে ঠিকই।
বেশ লোকজন জড়ো হয়েছিল। তারাও চলে যেতে লাগল। তখনই শাঙ্কো বিস্কোরা এল।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–কী ব্যাপার ফ্রান্সিস।
–ঠিক বুঝতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।
–আর একবার মাপজোক কর। হ্যরি বলল।
–দেখি। ফ্রান্সিস পেতলের মাপকাঠিটা নিল। হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎই দেখল একটা হাতার কোনায় একটা ছোট কড়া। ফ্রান্সিস চমকে উঠল তাহলে তো এখানেও একটা এক হাতের সমান পিতলের কাঠি ছিল যার মাপ অন্যগুলির মতই এক হাত।
তুমি কি এ বিষয়ে নিশ্চিত? হ্যারি।
–নিশ্চিত। এখন কাজ। বিস্কোকে ডাকল।
–বলো৷ বিস্কো বলল।
–জাহাজে যাও তোমার কাঠের কাজে হাত ভালো। মাপকাঠিটা নিয়ে যাও। এই কাঠির সমান একটা টুকরো কর তারপর সেটাকে একটা কড়া দিয়ে পেতলের কড়ার সঙ্গে আটকে দাও। মাপকাঠিটা ছয় হাতই ছিল। পরে একটা হাত ভেঙে হারিয়ে যায়। বিস্কো পেতলের মাপকাঠিটা নিয়ে চলে গেল। ভাইকিং বন্ধুরাও সেখানে এল।
ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল। কিছু পরে বিস্কো ফিরে এল। সঙ্গে মাপকাঠিটা। কাঠের হাতা লাগানোয় দৃঢ় হাত হল।
এবার ফ্রান্সিস দৃঢ় হাত মাপের মাপকাঠিটা নিয়ে মাপতে লাগল। একেবারে সদর দরজা থেকে মাপতে লাগল। মেপে মেপে আঠারো হাত পরে থামল। এ এর সঙ্গে ছিল তিন। তাই তিন দিয়ে গুণ করল ফ্রান্সিস।
ফ্রান্সিস কুড়ল চালিয়ে আঠারো নম্বর ঘরটা ভাঙতে লাগল। কিন্তু কোথায় সোনা? পাথর ধূলো বালি ছিটকোচ্ছে।
ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল। ওর গণনায় কোন ভুল নেই। সোনার ঘর এখানেই আছে। এই আঠারো নম্বর ঘরের নিচে আছে।
উৎসাহে ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–শাঙ্কো বিস্কো কুড়ুল জোগাড় করে আনন। এই ভিতের নিচে খুঁড়তে হবে।
শাঙ্কো বিস্কো কুড়ুল জোগাড় করে নিয়ে এল। তিনজনে ঘরের ভিত ভাঙতে লাগল। কুড়ুলের ঘায়ে গর্ত হতে লাগল। হঠাৎ একটা সোনার টুকরো ছিটকে পড়ল। ফ্রান্সিস সোনার টুকরোটা হাতে নিয়ে তুলে ধরল। লোকের ভিড়ে চাঞ্চল্য জাগল। সবাই অবাক। তাহলে এখানেই আছে সোনার ঘর?
ফ্রান্সিসরা তিনজনে বসে পড়ল। হাঁপাতে লাগল। সেনাপতি এগিয়ে এল। বলল– তোমরা নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের দেশের সম্পদ উদ্ধার করছো। তোমরা বিশ্রাম কর। বাকি খোঁড়ার কাজ আমরা করবো। সেনাপতি কয়েকজন সৈন্যকে বলল–খুঁড়ে ফেল ভিতটা।
সৈন্যরা কুড়ুল চালাতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সোনার স্তর দেখা গেল। আস্তে আস্তে সবটা খোঁড়া হল। সোনার ঘর দেখা গেল। নিরেট সোনার ঘরের মত। জমাট সোনা। রোদের আভা পড়ে চক্ করছে। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–ফ্রান্সিস একটা কাজ করতে হবে যে।
–কী কাজ? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
শাঙ্কোর কাছে সোনার চাকতি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। রাজা মামুনকে বল আমাকে হাজার পাঁচেক স্বর্ণমুদ্রা দিতে।
বেশ বলছি। ফ্রান্সিস রাজা মামুনের কাছে গেল। বলল–মাননীয় রাজা দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াই। অর্থের খুবই প্রয়োজন। এখন সেই অর্থ আমাদের কমে এসেছে। আপনি যদি আমাদের পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দেন তাহলে বড়ই উপকার হয়।
নিশ্চয়ই দেব। আমার সঙ্গে কেউ আসুন। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে যেতে বলল। হ্যারি রাজার সঙ্গে গেল।
কিছুক্ষণ ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করল। হরি কোমরের মধ্যেও সোনার চাকতি ভরে নিয়ে এল। জাহাজঘাট নয় জাহাজের কাছে আসতেই জাহাজ থেকে বন্ধুরা ধ্বনি তুলল–হো– হো-রে। ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেখে বলল–মারিয়া এবার কিছু স্বর্ণমুদ্রা এনেছি। কাল সকালে আমরা কাপড়ের দোকানে যাব। সবাই পোশাক তৈরি করাবো। বিছানাপত্রের কাপড় চোপড়ও কিনবো। আমরা দরিদ্র নই। জলদস্যু আমাদের ভিখিরি বলেছিল।
Leave a Reply