২৫টি দমফাটা হাসি – সম্পাদনা : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড
প্রথম সংস্করণ ২০১২
ভূমিকা
অস্বীকার করার উপায় নেই—বাংলা সাহিত্যে হালকা মেজাজের মজার মজার গল্পের খুব অভাব। কারণ একটাই—জীবন খুব জটিল হয়ে গেছে। যে সুখে মানুষ সবাইকে নিয়ে মজা করতে পারে সেই সুখের পরিবেশটা নেই। প্রাচুর্য এসেছে, বিজ্ঞানজাত নানা সুখের উপকরণে আমরা ভরপুর। জল-ক’ল-হোম থিয়েটার, ঠান্ডা মেশিন, মাইক্রোওভেন, বিমানভ্রমণ, চেকনাই ফ্ল্যাট, দ্যাখনাই পোশাক, রাতক্লাবে নাচ, বোতল পানি, চুলের রং, ত্বকের মলম, মুখে মারার মতো জুতো, ডুবে যাওয়ার মতো বিছানা, চারচাকা দু-চাকার গমক, ঝটকা। চতুর্দিকে উষ্ণ শ্বাস, টাকা, টাকা, আরো টাকা। প্রয়োজনটুকু রাখো, অপ্রয়োজন ছেঁটে ফেলো। বৃদ্ধ, বৃদ্ধা দূর করে দাও, বেকার ভ্রাতা মরে যাক। বিধবা বোন ভিক্ষে করুক। একটা স্বামী, একটা বউ যথেষ্ট নয়। যে আদর্শে কামাই হয় না তেমন কেতাবী আদর্শ ‘ফার্স্ট বুকে’ থাকে থাক, জীবনে যেন না ঢোকে। নীতি দুর্নীতির সীমারেখা ঘুচে যাক। হেসে কী হবে? চোখের জলে টাকা গুনি। দুঃখ ভুলি দেমাক দেখিয়ে। চরিত্র কাকে বলে? পবিত্রতা—সেটা আবার কী?
স্নিগ্ধ প্রভাত, অরুণোদয়। যৌথ পরিবারের দেবালয়ে প্রভাতী শঙ্খধবনি, ঘন্টার শব্দ, ভোরের বৈষ্ণব গান গেয়ে যায়—গোপাল জাগো। লালপাড় শাড়ি, কপালে সিঁদুরের টিপ, শিবের মাথায় জল ঢালা। প্রসন্ন বৃদ্ধার স্নেহের কণ্ঠ—’এতখানি বেলা হল, নেয়ে আয়। আর কখন খাবি!’ এত বড়ো ছেলে, তবু তার নাম খোকা। এখনো মায়ের কোলে আশ্রয় খোঁজে, শুনতে চায় বাবার রাগের গল্প। শুনতে চায় জ্যাঠামশাইয়ের মাছ ধরার গল্প। জামাইবাবুর পেল্লায় ভুঁড়ি। তিনি যখন হাহা করে হাসতেন ভুঁড়ি নাচত। হাসি থেমে গেছে, ভুঁড়ি নেচে চলেছে। ঠাকুরদা তীর্থে গিয়ে বউ হারিয়ে ফেলেছেন। বাড়িতে তার করলেন—I have lost my wife. সবাই কেঁদে অস্থির। আবার তার এল—Got her in a temple. ফিরে এসে গল্প করেছিলেন—’আসলে আমি চিনতে পারিনি। অমন প্রসন্ন রূপ। চিরকাল রান্নাঘরেই দেখেছি তো!’
এই বাঙালি জীবন বাণিজ্যিক সভ্যতার গুঁতোয় অন্যরকম হয়ে গেছে। জীবনবোধ চলে গেলে জীবন হয়ে যায় ‘মেশিন’। যন্ত্র হাসে না, যন্ত্র কাঁদে না। যন্ত্র ঘোরে, শব্দ করে, উৎপাদন করে। পুরোনো হয়ে গেলে ‘স্ক্র্যাপ’।
তাই অতি কষ্টে সেকাল থেকে একালে ধরে আনা হল ভিন্ন প্রজাতির এক খাঁচা পাখি। সাহিত্যের আকাশে এক সময় উড়ত, শিস দিত। এখন শুধু পালক।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
Leave a Reply