স্বর্ণ খনির রহস্য
তখন দুপুর। ফ্রান্সিসরা সবেমাত্র খাওয়া-দাওয়া সেরেছে তখন। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। জাহাজ চলেছে। মেঘ দেখেই পেড্রো বুঝল প্রচণ্ড ঝড় আসছে। পেড্রো মাস্তুলের মাথা থেকে নেমে এল। ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস শুয়ে ছিল। ফ্রান্সিস বলল–পেড্রো কী হয়েছে?
–প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি আসছে। তুমি ডেক-এ এসো।
চলো। ফ্রান্সিস উঠে পড়ল। দ্রুতপায়ে ছুটল। ডেকে-এ উঠে এল। ভাইকিং বন্ধুরা এখন ডেক-এ দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস পড়ে গেছে। চারদিকের সমুদ্রে প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। ফ্রান্সিস সমুদ্রের চারদিক দেখে নিল। তারপর গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব ঝড়বৃষ্টি আসছে। পাল নামাও। তারপর ডেক-এ এসে ঝড়ের মোকাবিলা কর।
ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতেই ভাইকিং বন্ধুরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একদল দড়িদড়া খুলে পাল নামাতে লাগল। চারপাঁচজন মাস্তুলে বাঁধা দড়িদড়া খুলতে লাগল। অনেকটা করে দড়ির পাঁচ খুলে এল। সেই মোটা দড়িগুলো ধরে কিছু ভাইকিং তৈরি হয়ে দাঁড়াল।
কয়েকজন দাঁড়ঘরে গেল। দাঁড়গুলো আসনের সঙ্গে বেঁধে রেখে এল। ঝড়ের ধাক্কায় দাঁড়গুলো ভাঙবে না।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। যেন কালো আকাশটাকে চিরে ফেলছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ তুলে ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্রান্সিসদের জাহাজের ওপর। ফেনিল জল ডেক-এর ওপর দিয়ে গিয়ে অন্যপাশে পড়তে লাগল। তার সঙ্গেই বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি শুরু হল। একটু পরেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগল।
ডেক-এর ওপর দিয়ে কোনওরকমে হেঁটে ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে এল। ফ্লেজার হুইল এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল।
ফ্রান্সিস হুইল ধরে দাঁড়ানো জাহাজ চালক ফ্লেজারকে বলল–সাবধান জাহাজ যেন ডোবে না। কথাটা এই প্রচণ্ড ঝড়ে ফ্লেজার শুনতে পেল না। ফ্রান্সিস বুঝল সেটা। ফ্রান্সিস এবার ফ্লেজারের কানের কাছে মুখ এনে কথাটা আবার বলল। ফ্লেজার হাতটা একটু উঠিয়ে বলল–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস কথাটা শুনল না। কিন্তু বুঝতে পারল।
ডেক-এর ওপর দাঁড়িয়ে কয়েকজন ভাইকিং মাস্তুলে বাঁধা মোটা মোটা দড়িদড়া টেনে ধরে রইল। ওরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ–জাহাজ ডুবতে দেবে না।
কিছুক্ষণ পরে বাতাসের বেগ কমল। তারপরেই বৃষ্টি কমল। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাওয়ার সেই তেজ আর রইল না।
ভাইকিংরা ডেক-এর ওপর পড়ে আছে। সারা গা ভেজা যেন চান করেছে। একজন দু’জন করে সবাই উঠে দাঁড়াতে লাগল। ফ্রান্সিসও মাস্তুলে টানা কাছিতে হাত লাগিয়েছিল। ওরও অবস্থা বন্ধুদের মতই, ফ্রান্সিস কেবিনঘরের দিকে চলল। জাহাজ একটা দ্বীপের কাছে চলে এসেছে।
সন্ধ্যের পরে হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস তখন বিছানায় আধশোয়া। মারিয়া কীসব সেলাই করছিল। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস এখন কী করবে?
-কোথায় এলাম এটা সবকিছুর আগে জানা দরকার। নইলে হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তা তো ঠিকই। তাহলে আজকে তো আর তীরে নামছো না। হ্যারি বলল।
–না। আজকের রাতটা কাটুক। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। তাহলে কালকে খোঁজ নিতে যাবে। হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ। অঞ্চলের লোকদের সঙ্গে কথা বলে সব জানতে পারবো। ফ্রান্সিস বলল।
–সেটাই ভাল হবে। চলি। হ্যারি চলে গেল।
পরের দিন সকালের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে যাচ্ছে তখনই মারিয়া বলল–তুমি কী স্থির করেছো?
–কী স্থির করেছি সেটা বলার সময় এখনো আসে নি। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া একটু অভিমানভরে বলল–তুমি তো আমাকে আগে থেকে কিছু বলো না।
ফ্রান্সিস হেসে বলল–এ তোমার অনর্থক অনুযোগ, অভিমান। তোমাকে না জানিয়ে কোন কাজ আমি করি?
-হ্যাঁ, মাঝে মাঝে করো। মারিয়া বলল।
–এ তোমার ভুল বোঝা। এসব নিয়ে মিছিমিছি মন খারাপ করো না। আমি যা ঠিক করি তা আমাদের ভালর জন্যেই। ফ্রান্সিস বলল।
তখনই এক ভাইকিং বন্ধু খাবার নিয়ে এল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাবার খেয়ে নিল! তারপর বাইরে এল। ডেক-এ শাঙ্কোকে দেখল। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো –তোমার সকালের খাবার হয়েছে?
-হ্যাঁ। এখন কী করবে? শাকো বলল।
–সেটাই ভাবছিলাম। যাকগে-চলো তীরে নামি। খোঁজখবর করি। ফ্রান্সিস বলল।
দিনের বেলাই যাবে? শাঙ্কো বলল। –হ্যাঁ। রাতে নামলে বিপদে পড়তে পারি। ফ্রান্সিস বলল।
–আর কাকে নেবে? শাঙ্কো বলল।
–হ্যারি এখনও যথেষ্ট দুর্বল। ভাবছি বিস্কোকে নিয়ে যাবো।
বিস্কোকে একবার ডাকো তো। ফ্রান্সিস বলল।
একটু পরেই বিস্কো এল।
–বিস্কো–শোন–আমরা তীরে নামবো। জানতে হবে আমরা কোথায় এলাম। তুমি আর শাঙ্কো আমার সঙ্গে থাকবে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। বিস্কো মাথা কাত করে চলল।
–দু’জনেই তৈরি হয়ে এসো। তরোয়াল তীরধনুক সঙ্গে নিও না।
শাঙ্কো আর বিস্কো চলে গেল।
ফ্রান্সিসও তৈরি হল।
মারিয়া বলল–এখানে কি নামতেই হবে?
–উপায় নেই। সঠিক জানতে চাই আমরা কোথায় এলাম। ফ্রান্সিস বলল।
–বিপদ তো হতে পারে। মারিয়া বলল।
–নিশ্চয়ই বিপদ আছে। কিন্তু জীবনের ঝুঁকিটা নিতেই হবে। নইলে সত্যটা জানবো কী করে? ভয় নেই আমরা সাবধানে থাকবো।
শাঙ্কো আর বিস্কো এল। তিনজন ডেক-এ উঠে এল।
তিনজনে জাহাজের দড়ির সিঁড়ি বেয়ে একটা নৌকোয় নামল। শাঙ্কো নৌকোর দড়ি খুলে জাহাজের গায়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকো সরিয়ে আনল। তারপর তীরভূমি লক্ষ্য করে নৌকোর দাঁড় বাইতে লাগল।
তীরে পৌঁছল। আর একটা ছোট জাহাজও নোঙর ফেলে আছে। জাহাজের মাথায় উড়ছে পর্তুগালের পতাকা।
যেখানে নামল সেখানে একটু উঠেই পায়ে চলা পথের মতো দেখল। দুপাশে ঝোঁপ জঙ্গল।
শাঙ্কো নৌকেটা তীরভূমিতে তুলে রাখল। জোয়ার এলে নৌকোটা আর ভেসে যাবে না।
ওরা চলল। পাখির বিচিত্র সব ডাক। রোদও চড়া নয়। হাঁটতে ভালোই লাগছিল।
হঠাৎ ফ্রান্সিস দেখল দুতিনজন লোক জলাজঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিসদের দেখে ওরা সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস দেখে বুঝল লোকগুলো এখানে কোন বিদেশিকে দেখবে এটা বোধহয় কল্পনাও করেনি। ওরা থেমে আছে। ফ্রান্সিস বুঝল ওরা ছুটে পালাবার জন্যে তৈরি। ফ্রান্সিস আস্তে বলল–শাঙ্কো– ছোট। অন্তত একটাকে ধর। তখনই তিনজন বাঁ দিকে দৌড় দিল। শাঙ্কো ওদের চেয়েও দ্রুত ছুটে পেছনেরটাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে গেল। শাঙ্কো লোকটার হাত ধরল। লোকটাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
লোকটা হাঁপাচ্ছে তখন। শাঙ্কোও হাঁপাতে লাগল।
ফ্রান্সিস ওদের কাছে এল। লোকটাকে দেখল। ওর গায়ে মোটা সুতোয় তৈরি পোশাক পরে আছে। মুখচোখে ভয়।
ফ্রান্সিস বলল–ভয় নেই। আমরা তোমার কোন ক্ষতি করবো না। থেমে বলল– এই জায়গার নাম কী?
–গ্যালিগস।
–এটা কোন দেশ?
লোকটি মাথা এপাশ ওপাশ করল। ফ্রান্সিস বুঝল লোকটি দেশের নাম বলতে পারবে না। অতটা জ্ঞানবুদ্ধি ওর নেই। এবার শাঙ্কো বলল–তোমাদের রাজার নাম কী?
—-আত্তারিয়া। লোকটি বলল।
-উনি কোথায় থাকেন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
–ঐখানে উদিন্না পাহাড়ের নিচে। লোকটি বলল।
ফ্রান্সিসরা কথা বলছে তখনই পেছনের ছোট টিলাটার মাথায় পাঁচ ছ’জন যোদ্ধাকে দেখল। তাদের হাতে বর্শা। ফ্রান্সিস বুঝল বিপদ। গলা চড়িয়ে বলল– শাঙ্কো বিস্কো পালাও।
ফ্রান্সিসরা দ্রুতপায়ে সমুদ্রতীরের দিকে ছুটল। তখনই দেখল সমুদ্রতীরের দিক থেকে কয়েকজন যোদ্ধা উঠে আসছে। দুদিক থেকে ফ্রান্সিসরা আটকে গেল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ডানদিকে। কিন্তু ওরা ডানদিকে দৌড়োতে যাবে তখনই দেখল ডানদিকের জংলা গাছের জঙ্গল থেকে কয়েকজন যোদ্ধা এগিয়ে আসছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–আমরা ধরা পড়ে গেছি। পালাবার চেষ্টা করো না। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাক।
যোদ্ধারা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসদের ঘিরে ফেলল। ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে রইল। টিলার দিক থেকে একজন ন্যাড়ামাথা বলিষ্ঠ লোক এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বুঝল এই দলপতি। দলপতির হাতে একটা লোহার বর্শা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ভারী।
–তোমরা বিদেশী? দলপতি জিজ্ঞেস করল।
–হ্যাঁ। আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।
–এই দেশে এসেছো কেন? দলপতি জিজ্ঞেস করল।
বলতে পারেন বেড়াতে। শাঙ্কো বলল।
–তোমরা জানো পাহাড়ের ওপারের রাজ্যের রাজা হুয়াল্পারের সঙ্গে আমাদের লড়াই আর কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে। দলপতি বলল।
–না। এখানে আমাদের জাহাজে চড়ে এসেছি ঘণ্টাখানেক হল। ফ্রান্সিস বলল।
–বিশ্বাস করতে পারলাম না। রাজা হুয়াল্পার গুপ্তচর তোমরা। দলপতি বলল।
এই রাজ্যে আমরা যুদ্ধের জন্যে কী সব ব্যবস্থা নিচ্ছি এটাই তোমরা গোপনে নি জানতে এসেছে। দলপতি বেশ গলা চড়িয়ে বলল।
ফ্রান্সিস গলায় বেশ জোর দিয়ে বলল–আমরা গুপ্তচর নই। আমরা বিদেশি। জাহাজে চড়ে এসেছি। যদি গুপ্ত ধনভাণ্ডারের খবর পাই তাহলে আমরা থাকবো যতদিন না গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারছি। গুপ্তধন উদ্ধার করে গুপ্তধন যার বা যাদের পাওনা তাদের হতে দিয়ে চলে যাবো। এছাড়া এখানে আসার অন্য কোন কারণ নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা বিশ্বাস করি না। দলপতি বলল।
–তাহলে আমরা নাচার। আপনি যা ভাববার ভেবে নিন। ফ্রান্সিস বলল।
–সব কটাকে বন্দী কর। দলপতি হুকুম দিল।
একজন যোদ্ধা এগিয়ে এল। হাতে দড়ি। প্রথমে ফ্রান্সিসের হাতে দড়ি বাঁধল। ফ্রান্সিস কোন আপত্তি করল না। বরং বলল–আপত্তি করো না। এর সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে। শাঙ্কো বিস্কোর হাতও দড়ি দিয়ে বাঁধা হল।
দলপতির নির্দেশে ছোট পাহাড়টার দিকে চলল সবাই। পাহাড়ের নিচে পৌঁছে ফ্রান্সিসরা দেখল চামড়ার তাবু মত। তাঁবুগুলো অনেকটা জায়গা জুড়ে। ফ্রান্সিসদের দেখতেই বোধহয় তাঁবুগুলো থেকে মেয়েরা শিশুরা বেরিয়ে এল।
একটা তাবুর কাছে এল সবাই। দলপতি ফ্রান্সিসদের বলল–এইখানে তোমরা বন্দী হয়ে থাকবে। যতদিন রাজা বলবেন তত দিন। এবার তাঁবুটায় তোক। ফ্রান্সিসরা তাঁবুতে ঢুকল। মোটামুটি প্রশস্ত। টান হয়ে শুলে তাবুর বাইরে পা চলে যাবে। তবে তিনজন এঁটে যাবে। রান্নার জিনিসপত্র উনুন এসব রাখা নেই। তবে তিনজন এঁটে যাবে। বন্দীদের জন্যেই রাখা হয়েছে। একটা কাঠের পাটা মেঝেয় পাতা। ওটার ওপরেই তিনজনকে বসতে বলা হল।
জল খাবো। বিস্কো বসতে বসতে বলল। একজন আঙ্গুল দিয়ে কোণার দিকে দেখাল। বিস্কো ওখানে গেল। দেখল একটা চামড়ার থলিতে জল রাখা। ও থলিতে মুখ চেপে জল খেল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোও জল খেল।
–তোমাদের খাবার আসছে। খেয়ে দেয়ে আমাদের রাজা আত্তারিয়ার কাছে যেতে হবে। তোমাদের কী শাস্তি দেওয়া হবে সেটা রাজাই জানাবেন। দলপতি আর কয়েকজন চলে গেল। দু’জন পাহারায় রইল।
কিছুক্ষণ পরে খাবার এল। দু’জন লোক নিয়ে এল। বড় পাতা পেতে দেওয়া হল। তাতে খাবার দেওয়া হল। ফ্রান্সিস বলল–পেট পুরে খাও। ভালো না লাগলেও খাও। তিনজনে চেয়ে চেয়ে খেল। লোকেরা চলে গেল।
বিকেল হল। দলপতি একাই এল। বলল–চল আমাদের রাজার কাছে যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল-খাওয়ার সময়ও আমাদের হাতের বাঁধন খোলা হল না। বাঁধা দু’হাত নিয়ে খাওয়া যায়? এখনও বাঁধন খোলা হল না।
দলপতি ফ্রান্সিসদের হাতের দড়ি একটা ধারালো ছোট কুঠার দিয়ে কেটে দিল। তাঁবুর বাইরে এল ওরা। দলপতির পেছনে পেছনে চলল।
এলাকার মাঝখানে বেশ বড় একটা তাবু। তাবুর সামনে এল ওরা। দলপতি তাঁবুর ভাঁজকরা চামড়া সরিয়ে ভেতরে তাকাল। বলল–মাননীয় রাজা গুপ্তচরদের এনেছি।
–ভেতরে এসো। রাজার বেশ ভারী গলা। দলপতি ফ্রান্সিসদের তাঁবুতে ঢোকবার জন্যে ইঙ্গিত করল।
ফ্রান্সিসরা তাঁবুতে ঢুকল। বড় তাবু তাই মেঝেও বড়। একপাশে রাজা আত্তারিয়া কাঠের আসনে বসে আছেন। চোখ নাক মুখ সুন্দর। সুগঠিত দেহ। গলায় নানা রঙের ছোট ছোট পাথর। রাজা বসবার ইঙ্গিত করলেন। ফ্রান্সিসরা বসল।
রাজা বললেন–তোমরা বিদেশি। তবে কেন গুপ্তচরবৃত্তিতে জড়িয়ে গেলে।
–মান্যবর রাজা–ফ্রান্সিস বলল–এটা আমরা বুঝতে পারছি না কে বা কারা আমাদের গুপ্তচর বলে ধরে নিল। মাত্র একরাত হল আমরা এই গ্যালিগসে এসেছি। যে দেশকে আমরা জীবনে কোনদিন দেখি নি সেখানে এসে গুপ্তচরবৃত্তি করতে যাব কেন? কী লাভ আমাদের? আমরা গুপ্তধনের খোঁজখবর নিয়ে চলে যাবো। গুপ্তধনের খোঁজ পেলে থাকবো। গুপ্তধন খুঁজে আবিষ্কার করব। এর বাইরে আমরা কোন কাজ করি না। এখানকার লড়াইয়ে আমরা জড়াতে যাবো কেন?
–অর্থ–অর্থ–প্রচুর অর্থ পাবেন সেই লোভে। রাজা বললেন।
মাননীয় রাজা–আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না কী অপরিসীম মূল্যবান গুপ্তধন আমরা আবিষ্কার করেছি। তার সামান্য অংশ আমরা আমাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনে নিয়েছি। কাজেই আমাদের অর্থাভাব নেই। আমরা যথেষ্ট ধনী। সামান্য অর্থের বিনিময়ে গুপ্তচরবৃত্তি করবো আমরা এতটা নীচ নই। রাজা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন–তোমাদের কথা শুনলাম। তবে লড়াইয়ের আগে তোমাদের মুক্তি দেওয়া হবে না। ঐ তাবুতেই তোমাদের থাকতে হবে। শাঙ্কো বলল
সমুদ্রতীরে আমাদের জাহাজ রয়েছে। আমরা বন্দী হয়ে থাকলে বন্ধুরা আমাদের খোঁজে আসবে। তখন আপনার যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই হওয়া অসম্ভব নয়। ফ্রান্সিস বলল।
তোমাদের যোদ্ধারা তোমাদের মুক্ত করতে আসুক-হোক লড়াই দেখা যাক কী হয়। রাজা বললেন।
–মাননীয় রাজা–সেক্ষেত্রে আপনার দুটো লড়াই চালাতে হবে। হুয়াল্পার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ একদিকে, অন্যদিকে আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে। এরকম লড়াই কি আপনি চালিয়ে যেতে পারবেন?
রাজা একটু ভেবে নিয়ে বললেন–দু’ জায়গাতেই আমরা লড়াই চালাবো।
–আপনারা হেরে যাবেন। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। দেখা যাক। রাজা বললেন।
–আপনারা তরোয়ালের নামই শোনেনি। এই যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে বন্ধুরা লড়াইয়ে নামবে। আপনার যোদ্ধারা এই যুদ্ধাস্ত্রের সামনে শুধু বর্শা নিয়ে দাঁড়াতেই পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
-হু। রাজা মুখে শব্দ করলেন। ফ্রান্সিস বলল–তার চাইতে আমাদের মুক্তি দিন আমরা আমাদের জাহাজে ফিরে যাই।
না। তোমাদের বন্দী হয়ে থাকতে হবে। রাজা বললেন রাজা যযাদ্ধাকে ইঙ্গিত করলেন ডান হাত তুলে। যোদ্ধা এগিয়ে বলল–চল সব।
ফ্রান্সিসরা তাবুর বাইরে বেরিয়ে এল। চলল তাবুর কয়েদখানার দিকে। তাঁবুতে ঢুকে ফ্রান্সিসরা বসল। শাঙ্কো বলল–পালাবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বোঝো ফ্রান্সিস এখানে লোহার গরাদ নেই।
হু। কিন্তু পাহারাদারদের দেখে বুঝেছি এরা ভীষণ সতর্ক। পালানো সহজ হবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–সেটাই ভেবে উপায় ঠিক কর। বিস্কো বলল।
কাজটা হল–এখান থেকে যতদূর সম্ভব জোরে ছুটে জঙ্গলে ঢুকে পড়তে হবে। শাঙ্কো বলল।
–সেক্ষেত্রে প্রহরীরা বর্শা ছুঁড়ে মারবে। অল্প আলোতেও ওদের দৃষ্টি চলে। কাজেই নিখুঁত নিশানায় ওরা বর্শা ছুঁড়তে পারবে। আমরা মারাত্মক আহত হব অথবা মারা যাবো। কাজেই অপেক্ষা কর। দেখা যাক রাজা আত্তারিয়া আর হুয়াল্পার। সঙ্গে লড়াইটা কবে লাগে। যোদ্ধারা লড়াই নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আমরা সহজেই পালাতে পারবো। ফ্রান্সিস বলল।
প্রহরী রাতের খাবার নিয়ে এল। গোল রুটি আর কী পাখির মাংস। ক্ষুধার্ত দুজনেই গগপ করে খেল। খাওয়া শেষ। প্রহরী চলে গেল।
তিনি দিন কাটল। ফ্রান্সিসরা ফিরছে না। মারিয়া আর বন্ধুরা চিন্তায় পড়ল। শুধু জায়গাটা কী সেটা জানতে গেছে। এইজন্যে এতদিন লাগার কথা নয়। মারিয়ার শুকনো মুখ চোখ দেখে হ্যারি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ল। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বৈদ্য ভেন বয়েসে ফ্রান্সিসদের চেয়ে বড়। ভেনই মারিয়া হ্যারিকে সান্ত্বনা দেয়–কিচ্ছু ভেবো না–ফ্রান্সিসকে আটকে রাখার সাধ্য কারো নেই। হ্যারি একটু সান্ত্বনা পায়। মারিয়া কিছু বলে না।
দিন কয়েক কেটে গেল। ফ্রান্সিসদের পালানো হল না। ওরা গভীর রাতে উঠে দেখেছে প্রহরীরা বর্শা হাতে পাহারা দিচ্ছে। এরা কি রাতে ঘুমোয় না?
সেদিন শাঙ্কো বলল ফ্রান্সিস–চলো একবার পালাবার চেষ্টা করে দেখি।
লাভ নেই। উপরন্তু মরে যাব অথবা আহত হবো। ফ্রান্সিস বলল।
–আবার পালিয়েও যেতে পারি–অক্ষত। শাঙ্কো বলল।
-কতদিন এখানে পড়ে থাকবো? বিস্কো বলল।
–বেশ। চেষ্টা করে দেখা যাক্। ফ্রান্সিস বলল।
সেদিন রাতের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিসরা শুয়ে পড়ল না। বসে রইল।
রাত গভীর হচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো একবার আকাশটা দেখো তো। চাঁদের আলো কেমন? তাঁবুর বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখল শাঙ্কো। বলল– জ্যোৎস্না আছে। তবে খুব উজ্জ্বল নয়। কুয়াশাঢাকা।
–ঠিক আছে। তৈরি হও। পেছনের জঙ্গলটার দিকে ছুটতে হবে। একবার জঙ্গলে ঢুকতে পারলে নিশ্চিন্ত। ফ্রান্সিস বলল।
তিনজন উঠে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎই তিনজনে পেছনের জঙ্গলের দিকে ছুটল। প্রহরীরা কতটা সজাগ বোঝা গেল সেটা। দুজন প্রহরী ফ্রান্সিসদের পেছনে ছুটতে ছুটতে একজন বর্শা ছুঁড়ল ফ্রান্সিসদের লক্ষ্য করে। বর্শাটা ফ্রান্সিসের মাথায় প্রায় লেগেছিল। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে ফেলল। বর্শাটা সামনে মাটিতে গেঁথে গেল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল।
আবার বর্শা ছুটে এসে শাঙ্কোর ডান পা ছুঁয়ে মাটিতে পড়ল। মাটিতে গেঁথে গেল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–শাঙ্কো থেমে যাও। শাঙ্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। বিস্কো ছুটে চলেছে। মাটিতে গাঁথা বর্শা তুলে নিয়ে মারতে প্রহরীটি দেরি করল। বর্শা ছোঁড়ার আগেই বিস্কো জঙ্গলের প্রথম গাছটা পেরিয়ে গেল। জঙ্গলে ঢুকে গেল। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–বিস্কো–কেউ যেন না আসে। লড়াই নয়।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো নিজেদের কয়েদ তাবুতে ফিরে চলল। প্রহরীরাও সঙ্গে সঙ্গে চলল।
দুজনে ফিরে তাঁবুতে ঢুকল। দুজনেই হাঁপাচ্ছে তখন। তাঁবুর মধ্যে ঢুকে ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো বসে রইল। ফ্রান্সিস বলল–মুস্কিল হল প্রহরীরা এখন আমাদের ওপর নজরদারি বাড়াবে। অন্য উপায় ভাবতে হবে। আর ক’টা দিন থাকি। সুযোগ সুবিধেমত পালাবো।
এক সকালে রাজা আত্তারিয়া ফ্রান্সিসদের ডেকে পাঠাল। দলপতি ফ্রান্সিসদের তাবুতে এল। বলল–তোমরা এসো। রাজা ডাকছেন।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো সবে সকালের খাওয়া খেয়েছে তখন। চলল দুজনে।
দুজনে রাজার তাঁবুর সামনে এল। দলপতি ঢুকতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা তাবুতে ঢুকল। একটা কাপড়ের গদীতে রাজা বসে আছেন। দুজনকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। ফ্রান্সিস শাঙ্কো বসল। রাজা বললেন
–সেদিন তোমাদের কথা শুনে মনে হল তোমরা কিছু গুপ্তধন উদ্ধার করেছে। রাজা আত্তারিয়া বললেন।
–হ্যাঁ। তা করেছি। ফ্রান্সিস বলল।
একটু চুপ করে থেকে রাজা বললেন–এই উদিন্না পাহাড়ে একটা সোনার খনিমত আছে। অনেক সোনার পিণ্ড মত আছে। একজন জংলি রাজা কোনভাবে সেই খনির হদিশ জানতো। তার মৃতদেহের কাছ থেকে আমার ঠাকুর্দা একটা গুটোনো চামড়া পেয়েছিল। তাতে নকশা আঁকা। ঠাকুর্দা জংলিটার সৎকার করেছিলেন। তারপর সেই নকশাটা নিয়ে আসেন। রাজা থামলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন। তারপর থেকে ঐ নকশাটা আমাদের পরিবারের কাঠের ছোট বাক্সে ওটা রাখা ছিল। বাবা দু’একবার চেষ্টা করে নকশাটার সাহায্যে এই উদিন্না পাহাড়ে সোনার খনি আবিষ্কারের জন্যে। কিন্তু পারেন নি। রাজা থামলেন।
তারপর বললেন–আমি নিজেও চেষ্টা করেছি। নকশাটা দেখে দেখে আন্দাজে সোনার খনি খুঁজেছিলাম। কিন্তু কয়েক বছর পর হতাশ হয়ে খনি খোঁজা ছেড়ে দিয়েছিলাম। রাজা থামলেন।
–তাহলে ঐ নকশাটা এখনও আপনার কাছেই আছে। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হ্যাঁ। রাজা মাথা ওঠানামা করলেন।
নকশাটা একটু দেখবো? ফ্রান্সিস বলল।
-তোমাদের নকশাটা দেখাবো বলেই ডেকে পাঠিয়েছি। এই কথা বলে রাজা কোণার দিকে হাত বাড়ালেন। একটা ছোট কালো কাঠের বাক্স বের করলেন। বাক্সটা এনে একটু চাপ দিয়ে বাক্সটা খুললেন। সকালের আলোয় সবই দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা পাথর বসানো আংটি সবুজ পাথরের হার একটা সোনার ছোট ছোরা বেশ কয়েকটা রঙিন পাথর। সব অলংকারের নিচে থেকে এক টুকরো সাদা চামড়া বের করলেন। ফ্রান্সিসকে দিলেন। ফ্রান্সিস নকশাটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। গায় সবুজ রঙে চামড়ায় আনাড়ি হাতে কিছু আঁকা।
ফ্রান্সিস খুব মন দিয়ে নকশাটা দেখল। বুঝল এই নকশার সঙ্গে এই উদিন্না পাহাড়ের যোগ আছে।
–আপনার পিতা কি এই উদিন্না পাহাড়েই সোনার খনি আছে–এটা ভেবেছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। কারণ বাবা বলেছিলেন, পিতামহ বলেছিলেন এই উদিন্নার পাহাড়ের নিচেই জংলির মৃতদেহ দেখেছিলেন। তার কোমরের ফেট্টি থেকেই নকশাটা পেয়েছিলেন। রাজা বললেন।
–তাহলে এই উদিন্না পাহাড়েই রয়েছে সোনার খনি। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাদের তাই বিশ্বাস। রাজা আত্তারিয়া বললে।
–আর খোঁজাখুঁজি করলেন না কেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
রাজা একটু থেমে বললেন–উত্তরের রাজা হুয়াল্পা আমাদের যোদ্ধাদের পাহাড়ের ওপরে উঠতে দেয় না। বদলে আমার যোদ্ধারাও ওদের দেখলে তাড়িয়ে দেয়।
–রাজা হুয়াল্পা কি সোনার খনির কথা জানে? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ জানে। তাই পাহাড়ের অধিকার নিয়ে কিন্তু আমার পিতার সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলছে। রাজা আত্তারিয়া বললেন।
–আপনার পক্ষেই সোনার খনি খুঁজে বের করা সম্ভব। কারণ আপনার কাছে। একটা নকশা রয়েছে। রাজা হুয়াল্পার হাতে কিছুই নেই। তাকে খুঁজতে হলে আন্দাজে খুঁজতে হবে। এই উদিন্না পাহাড় তন্ন তন্ন করে খোঁজা প্রায় অসম্ভব। কাজেই উদ্মবত্র রাজা হুয়াল্পার পক্ষে সোনার খনি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। একটু থেমে রাজা বললেন–তাহলে তুমি নকশাটা নিয়ে যাও। ভালো করে দেখে আমাকে ফেরৎ দিও। নকশাটা যেন নষ্ট না হয়। সাবধানে রাখবে। দেখবে। বুঝবে। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস বিস্কো উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস নকশাটা নিল। বলল–বেশ ভাল করে নকশাটা দেখতে হবে। ততদিন–
–তোমার কাছেই থাক। এই নকশা থেকে চেষ্টা কর যাতে সোনার খনিটা আবিষ্কার করা যায়।
ফ্রান্সিস শাঙ্কো নিজেদের তাবুতে ফিরে এল। নকশাটা নিয়ে ফ্রান্সিস বিছানায় আধশোয়া হল।
দুপুরের খাওয়ার পরও ফ্রান্সিস নকশাটা নানাভাবে দেখতে লাগল। শাঙ্কোও নকশাটা নিয়ে দেখল।
সন্ধেবেলা নকশাটা রেখে ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো–নকশাটা দেখে তোমার কী .. মনে হল।
–এই আঁকাবাঁকাটা কী বুঝতে পারছি না। শাঙ্কো বলল।
–ওটা একটা পাতাঝরা গাছ। নকশাটা যখন আঁকা হয় তখন গাছটা চারাগাছ ছিল। এখন নিশ্চয়ই বড় হয়েছে। গাছটা খুঁজে বের করতে হবে। তারপর বল। ফ্রান্সিস বলল।
-বাঁদিকে কীসব যেন উপুর করা রয়েছে। শাঙ্কো বলল।
–ওসব পাথর। তারমানেই ওটা পাহাড়ের নিচের ভাগ। ওটা যদি বাড়াতে থাকো পাহাড় পাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–কত বড় পাহাড়? শাঙ্কো বলল।
–এটা উদিন্না পাহাড়। সোনার খনি আছে এই পাহাড়ে। কিন্তু কোথায় সেটা জেনেছিল এক জংলি মানুষ। কিন্তু সেও পারা যায়।
রাজা আত্তারিয়ার পিতামহ ঐ মৃত জংলির কাছ থেকে কিছুই জানতে পারে নি। জংলিটা কোথা থেকে কী করে নকশাটা পেয়েছিল এটা এক রহস্য। ফ্রান্সিস বলল।
–একটা ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না। শাঙ্কো বলল।
–কোন্ ব্যাপার? ফ্রান্সিস বলল।
লক্ষ্য করে দেখ–একটা পাথরের ওপরে একটা গোল চিহ্ন। শাঙ্কো বলল।
–হুঁ। দেখছি। ফ্রান্সিস বলল।–
-ওটা কী? শাঙ্কো বলল।
-একটা নিশানা। পাথরগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে কোন পাথরে ঐ চিহ্ন দেখা যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমার কি তাই মনে হয়। শাঙ্কো বলল।
-হ্যাঁ। রহস্য সমাধানে ঐ গোল দাগটার অর্থ বুঝতে হবে। দেখতে হবে কোন পাথরের গায়ে ঐ চিহ্নটা আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–এই চিহ্ন কি পাওয়া যাবে? শাঙ্কো বলল।
নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। না পেলে খুঁজতে হবে। এই গোল চিহ্নটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্সিস বলল।
দেখা যাক। শাঙ্কো বলল।
পরদিন সকালের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস বলল–চল–রাজার সঙ্গে কথা বলে আসি।
–কী কথা? শাঙ্কো বলল।
–মুক্তি চাই–তা নাইলে কিছুই করা যাবে না। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে তাবু থেকে বেরিয়ে এল। রাজার কাছে চলল। দলপতি আসছিল। বলল–কোথায় যাচ্ছো?
–রাজার সঙ্গে কথা বলতে। শাঙ্কো বলল।
–তোমরা বন্দী। দলপতি বলল।
পাহারাদার কিছু বলল না। শাঙ্কো বলল।
উঁহু। আমাকে না বলে কোথাও যাবে না। চল। দলপতি বলল।
রাজা আত্তারিয়া গদীতে আধশোয়া। গদীটা বোধহয় ভালো শুকনো ঘাসে করা। দুজনকে দেখে রাজা উঠে বসলেন।
–কী ব্যাপার? রাজা বললেন।
–সোনার খনি খুঁজে বের করার দায়িত্ব যদি আমাদের দেন তাহলে আমাদের বন্দী করে রাখা চলবে না। কারণ সেক্ষেত্রে ইচ্ছেমত যে কোন সময় যে কোন জায়গায় যাওয়া যাবে না। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা আত্তারিয়া একটু ভাবলেন। তারপর বললেন–এর আগেও এক শ্বেতাঙ্গকে খোঁজ করতে বলেছিলাম। তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। দিন কুড়ি পরে উধাও। ভাগ্যিস নকশাটা আমার কাছেই ছিল। নইলে ওটাও উধাও হয়ে যেত। একটু থেমে রাজা বললেন–এখন প্রশ্ন তোমাদের একেবারে ছেড়ে দিলে ঐ ব্যাপারই ঘটতে পারে কিনা।
আমরা বিশেষ করে এই উদিন্না পাহাড়েরই ধারে কাছে থাকবো। দূরে কোথাও গিয়ে বোধহয় লাভ হবে না। সোনার খনি এই পাহাড়েই আছে। ফ্রান্সিস বলল।
যাক গে। তোমাদের ছেড়েই দেওয়া হল। তবে দুজন প্রহরী তোমাদের ওপর নজর রাখবে। পালাতে গেলেই তোমাদের হত্যা করা হবে। বুঝেছো? রাজা বললেন।
–হ্যাঁ। আমরা পালাবো না। সমস্ত সময়টাই কাটাবো সোনার খনির অনুসন্ধানে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। রাজা বললেন।
শাঙ্কো বলল–আমার আমাদের তাবুতে খুবই অসুবিধের মধ্যে আছি। শুনলাম আরো দুজনকে ধরা হয়েছে। আমাদের তাঁবুতেই তাদের রাখা হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের খুবই অসুবিধে হবে। শুধু আমাদের জন্যে একটা তাবুর ব্যবস্থা করুন। শাঙ্কো বলল।
–বেশ। করা হবে। অনেক সুবিধে তোমাদের দেওয়া হচ্ছে। কাজের কাজটা করা চাই। রাজা বললেন।
ভাববেন না। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারবো গুপ্ত খনি আবিষ্কার করতে পারবো কি না। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখ চেষ্টা করে। রাজা মাথা নেড়ে বললেন।
রাজা দলপতিকে ডাকল। দলপতি এল। রাজা বললেন–এই দুজনকে থাকবার? জন্যে ভালো জায়গা দাও। ভালো খাবার-টাবার দাও।
–ঠিক আছে। সেনাপতি মাথা নিচু করে বলল।
ফ্রান্সিসরা তাবু থেকে বেরিয়ে এল। দলপতি এসে বলল–আমার সঙ্গে চলো। তোমাদের জন্যে একটা ভালো জায়গা দেখছি। হাঁটতে হাঁটতে এক কোণায় চলে এল দলপতি। একটা তাবুর কাছে এল।
দলপতি বলল–এখানে আমরা কয়েকজন থাকতাম। এখন একা আমার এক বন্ধু থাকে। তাকে চলে যেতে বলব। তোমরাই শুধু থাকবে।
ফ্রান্সিসরা তাঁবুটায় ঢুকল। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মেঝেয় পাতা বিছানাটাও বেশ মোটা। শুকনো ঘাসের। বোঝাই যাচ্ছে।
এবার ভালো জায়গা পেলে তো। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো বিছানায় বসল। বেশ নরম। ফ্রান্সিস আধশোয়া হল। মাথায় চিন্তা কী করে সোনার খনিটা খুঁজে বের করবে। অবশ্য কাজে নামলে তখনই বোঝা যাবে আমরা সফল হব কিনা।
তাঁবুর ফাঁক দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে দলপতি হেসে বলল
–তোমরা সোনার খনি খুঁজে বের করতে পারবে না। আগেও কেউ পারে নি।
–সব জেনেটেনে বুঝবো–পারবো কি পারবো না। শাঙ্কো বলল।
–দেখ চেষ্টা করে। স্বাধীনভাবে থাকার হুকুম তো পেয়েই গেছ।
–হুঁ। শাঙ্কো মুখে শব্দ করল। দলপতি চলে গেল।
ফ্রান্সিস বলল–খাওয়ার সময় হয়েছে। চলো আজ দুপুর থেকেই কাজে নামি। জাহাজে মারিয়া আর বন্ধুদের খুব একটা দুশ্চিন্তা হবে না এখানে কয়েকদিন থাকলেও। বিস্কো তো গেছে। ওর কাছেই সব শুনবে। নিশ্চিন্ত হবে।
–কিন্তু আমরা গুপ্তসোনার খনি খুঁজছি এটা কিন্তু বিস্কো জেনে যেতে পারে নি। আমরা কেন ফিরতে দেরি করছি এটা ওরা জানতে পারে নি। ওদের চিন্তা হবেই। শাঙ্কো বলল।
দুপুরে খেতে দেওয়া হল। রুটি আনাজের তরকারির মত আর মাংস। বোঝা যাচ্ছে পাখির মাংস। কিন্তু কোন্ পাখির মাংস সেটা আর জানা হল না। দুজনেই পেটপুরে খেল।
একটু বিশ্রাম করে দুজনে তাবু থেকে বেরোল। হাঁটতে শুরু করল উদিন্না পাহাড়ের দিকে। খুব একটা কাছে নয়। পাহাড়টা দেখে যতটা কাছে মনে হচ্ছিল হেঁটে যেতে গিয়ে বুঝল মোটেই তত কাছে নয়।
উদিন্না পাহাড়ের পাদদেশেই যা সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের মাঝামাঝি থেকেই রুক্ষ ধূলোটে রঙের পাথর। ফ্রান্সিস বলল-নক্শার চারাগাছটিকে আগে খুঁজে পেতে হবে।
–চারাগাছটা আর চারাগাছ নেই। এখন মহীরুহ বিরাট গাছ। শাঙ্কো বলল।
-হ্যাঁ। সেটা হিসেবে রাখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে পাহাড়ের ঠিক পাদদেশ দিয়ে চলল। লক্ষ্য একটা বড় গাছ। দুজনে পাহাড়ের গা ঘেঁষে মাথা তুলে দাঁড়ানো বড় গাছ খুঁজতে খুঁজতে চলল।
এরকম দুটো গাছ ওরা পেল। ফ্রান্সিস গাছের কাণ্ড বেয়ে উঠে একটা ডাল ভেঙে রাখল। আর একটা গাছেরই ডাল ভাঙল।
তখন শেষ বিকেল। দুজনেই বেশ ক্লান্ত। বেশ জলতেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু এখানে কোথায় জল?
হঠাৎ পেছনের ঝোঁপজঙ্গলে খখস্ শব্দ উঠল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। মৃদুস্বরে বলল–শাঙ্কো–আমরা বিপদে পড়লাম। ফ্রান্সিসের কথা শেষ হয়েছে মাত্র পেছনে বেশ জোরে সরসর শব্দ উঠল। মুহূর্তে চারপাঁচজন যোদ্ধা বর্শা হাতে ছুটে এল। ফ্রান্সিস দুহাত তুলে বলল–আমরা বিদেশি ভাইকিং। তোমাদের ঝগড়া লড়াইয়ের মধ্যে আমরা নেই।
যোদ্ধারা আস্তে আস্তে বর্শা নামাল। এই যোদ্ধাদের পোশাক অন্যরকম। ওরা ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। বর্শা নামানো।
ফ্রান্সিস বলল–ভাই তোমরা কোন রাজার যোদ্ধা?
উত্তরের হুয়াল্পা রাজার যোদ্ধা আমরা। আমরা উদিন্না পাহাড়ের নিচে পাহারা দিই।
-কেন পাহারা দাও? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
–এই উদিন্না পাহাড়ের কোথাও রয়েছে সোনার খনি। দলপতি যোদ্ধা বলল।
–এটা কি সত্যি? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ সত্যি। আমরা দক্ষিণ দিকটা পাহারা দিই না। ওটা দক্ষিণের রাজা আত্তারিয়ার যোদ্ধারা পাহারা দেয়। তোমরা উত্তরে এসেছো কেন? একজন বলল।
–এমনি। আমরা অনেক দেশে গেছি। কত ভালো ভালো মানুষ দেখেছি। আবার নৃশংস মানুষও দেখেছি। তবু সব মিলিয়ে পৃথিবীটা কী সুন্দর। এইজন্যেই মানুষ প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখবো বলে এখানে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা আর কিছু কর না? দলপতি যোদ্ধা বলল।
–হ্যাঁ গুপ্ত ধনভাণ্ডারের খোঁজ পেলে বুদ্ধি খাঁটিয়ে তা উদ্ধার করি। ফ্রান্সিস বলল।
তারপর ধনসম্পদ নিয়ে পালিয়ে যাও। যোদ্ধাটি বলল।
–এ কথাটা অনেকের মুখে শুনেছি। তারা আমাদের বিশ্বাস করে নি। এই নিয়ে কিছু বলবো না। ফ্রান্সিস বলল।
-হ্যাঁ বোঝা গেল। দলপতি বলল। তারপর গলা চড়িয়ে বলল–এদের হাতে দড়ি বাঁধে।
–তাহলে আমরা বন্দী হলাম। কোন অপরাধ না করে। শাঙ্কো বলল।
–রাজা হুয়াল্পা তোমাদের বিচার করবেন। রাজা যা বিচার করবেন তাই তোমাদের মেনে নিতে হবে। দলপতি বলল।
–কখন বিচার হবে? শাঙ্কো বলল।
–কাল সকালে রাজসভায়। দলপতি বলল। তারপর যোদ্ধাদের হুকুম দিল– এই বিদেশি দুজনকে নিয়ে চল। হাত বাঁধা অবস্থায় ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোকে ওরা নিয়ে চলল।
উত্তর দিকে বেশ কিছুটা হেঁটে রাজা হুয়াল্পার দেশে এল। নগরটি একটু বড়ই মনে হল ফ্রান্সিসের কাছে। লোকজনের ভিড় আছে। সন্ধ্যে হয়েছে। দোকানে বাড়িতে কাঁচটাকা আলো যতটুকু আলো ছড়াচ্ছে।
নগরের মধ্যে দিয়ে হাঁটিয়ে দুজনকে কয়েদখানার কাছে নিয়ে আসা হল। দলপতির নির্দেশে প্রহরীরা লোহার দরজা খুলল। ফ্রান্সিসদের ভেতরে ঢোকানো হল। একটু জোর খাটাল দুজন যোদ্ধা। ফ্রান্সিস একবার ওদের মুখের দিকে তাকাল। শাঙ্কো বুঝল ফ্রান্সিস ক্রুদ্ধ হয়েছে। ও বলে উঠল–ফ্রান্সিস ভাই সংযত হও। ফ্রান্সিস ঘরের এক কোণায় চলে এল। ছড়ানো শুকনো ঘাসপাতার ওপর শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো পাশে বসল। ফ্রান্সিস হেসে বলল-শাঙ্কো জীবনের কত দিন কয়েদঘরে কেটে গেল–হিসেব করিনি।
–তুমি তো এরকম জীবনই চাও। শাঙ্কো বলল।
–অবশ্যই চাই। এজন্যে আমার কোন দুঃখ নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–ফ্রান্সিস তুমি আমাদের মত নও। অন্যরকম। শাঙ্কো বলল।
–হবে। এসব ভাবিনি কোনদিন। ফ্রান্সিস বলল।
–আমার খুব খিদে পেয়েছে। শাঙ্কো বলল।
–আমারও। পাহারাদারদের বলে দেখতো? ফ্রান্সিস বলল।
–দেখি। শাঙ্কো উঠে লোহার দরজার কাছে গেল। বর্শা হাতে এক পাহারাদারকে হাতের ইঙ্গিতে ডাকল। প্রথম পাহারাদারটা মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। অন্য একজনকে ডাকল। সে এগিয়ে এল। বলল
–কী ব্যাপার? কী হয়েছে?
–আমরা দু’জন এইমাত্র এলাম। খুব খিদে পেয়েছে আমাদের। শাঙ্কো বলল।
–সেই রাতে খাবে। এখন নয়। পাহারাদার বলল।
–এটা রাজার হুকুম বোধহয়। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। পাহারাদারটি বলল।
উনি রাজা মানুষ। খিদে ব্যাপারটা কী উনি জানবেন কী করে। যাকগে তুমি কিছু রুটি চিনি আনন। শাঙ্কো বলল।
–আমি পারবো না। নিয়ম ভাঙলে আমি বিপদে পড়ে যাবো। প্রহরীটি বলল।
লুকিয়ে চুরিয়ে খাবার দিতে পারো। অবশ্য তোমার যদি ইচ্ছে হয়। শাঙ্কো বলল।
পাহারাদার বর্শা হাতে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছিল। এবার থামল। তারপর শাঙ্কোর মুখের দিকে তাকাল। কী ভাবল। দরজার কাছেই দুটো মশাল জুলছিল। পাহারাদারটি আলো থেকে আস্তে সরে গেল। অন্ধকার বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল। হাতে পাতায় জড়ানো রুটি আর চিনি। সঙ্গের পাহারাদার দরজা থেকে সরে যেতেই ও দ্রুত দরজার কাছে এল। তখনও শাঙ্কো দাঁড়িয়ে ছিল। ও শাঙ্কোকে খাবার দিয়েই সরে এল।
শাঙ্কোও পাতায় মোড়ানো রুটি চিনি নিয়ে নিল। পেছন ফিরে ফ্রান্সিসের কাছে এল। এখানে ঘরের কোণায় মশালের আলো তেমন জোরালো নয়। শাঙ্কো আর ফ্রান্সিস রুটি ভাগ করে চিনি দিয়ে খেতে লাগল। একটু আড়াল দিয়ে।
খাওয়া শেষ হল। আর এক কোণায় বড় জালায় রাখা জল তুলে তুলে খেল। খিদেটা একটু কমল।
শাঙ্কো উঠে দরজার কাছে এল। সেই প্রহরীর হাত ধরল। দুজনেই হাসল। শাফা ফিরে এল। ফ্রান্সিসের পাশে বসল।
রাতের খাওয়া সেরে ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো তখনও বসে আছে। ফ্রান্সিস বলল-শাঙ্কো ভেবে দেখলাম আগেই পালাবার কথা ভাববো না। চলো দেখি কালকে রাজা হুয়াল্পা কী বলে। নকশাটা দেখালে হুয়াল্পা একেবারে লাফিয়ে উঠবে। সোনার খনি বলে কথা।
–তাহলে রাজা হুয়াল্পা কি আমাদের ছেড়ে দেবে? শাঙ্কো বলল।
উল্টোটা–আমাদের অন্য ভালো ঘরে থাকতে দেবে। প্রত্যেক দিনই খবর নেবে আমরা কতদূর এগোলাম।
-নকশাটা তো নিয়ে নিতে পারে। শাঙ্কো বলল।
–নকশাটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে অর্থাৎ চোখ বুজলেই নকশাটা দেখতে পাই। ফ্রান্সিস বলল।
–তবে তো আমাদের এখানেই থাকতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–যে কদিন থাকবো রাজার হালে থাকবো। সোনার খনির লোভ–কেউ মাথা ঠিক রাখতে পারে না। রাজা হুয়াল্পাও পারবে না।
কালকে তো আমাদের রাজার কাছে নিয়ে যাবে। দেখা যাক কী করে রাজা। শাঙ্কো বলল।
পরদিন বেশ ভোরেই ফ্রান্সিসের ঘুম ভাঙল। দেখল শাঙ্কো চুপ করে বসে আছে। ফ্রান্সিস হেসে বলল–কী হল? এত তাড়াতাড়ি উঠলে?
–ঘুম আসছিল না। নানা কথা ভাবছিলাম। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস উঠে বসল। বলল–চিন্তা তো হবেই। আমরা এখানে বন্দী হয়ে পড়ে আছি, মারিয়া বন্ধুরা জাহাজে। আমাদের ফেরার প্রতীক্ষা করছে। শাঙ্কো ভেবো না সব ঠিক হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
সকালে খাওয়াদাওয়ার পরেই দলপতি লোহার দরজার কাছে এল। পাহারাদার দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে দলপতি ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল–রাজসভায় চল। তোমাদের বিচার হবে।
ফ্রান্সিস ও শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। দলপতির পেছনে পেছনে বাইরে এল। সবাই চলল একটা বড় বাড়ির দিকে।
–ঐ বড় বাড়িটা বোধহয় রাজবাড়ি। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। দলপতি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
রাজার সভাঘরে ঢুকল সবাই। একটা কাঠের সিংহাসনে রাজা হুয়াল্পা বসে আছেন। পাশে মন্ত্রী অমাত্যরা বসে আছেন। একটু পাশে সেনাপতি বসেছেন।
বিচার চলছিল। রাজা হুয়াল্পা এক পক্ষকে শাস্তি দিলেন। বিচারপ্রার্থীরা চলে গেল।
দলপতি সেনাপতিকে গিয়ে কিছু বলল। তখনও রাজা কাউকে ডাকেননি। সেনাপতি রাজার কাছে এসে কী বলল। রাজা গলা চড়িয়ে বলল–বিদেশিরা এসো। দলপতি ফ্রান্সিসদের এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা এগিয়ে এল। রাজা ফ্রান্সিসদের দেখে বললেন–তোমরা কোন্ দেশ থেকে এসেছো?
–আমরা ভাইকিংদের দেশ থেকে আসছি। শাঙ্কো বলল।
–এখানে কেন এসেছো? রাজা হুয়াল্পা বললেন।
–দেশ দেখতে, মানুষ দেখতে, প্রকৃতি দেখতে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাতে কী লাভ? রাজা একটু হেসে বললেন।
–লাভক্ষতির কথা আমরা ভাবি না। এইসঙ্গে অবশ্য অন্য একটা কাজও আমরা করি। কোন দেশে গুপ্তধনভাণ্ডারের খোঁজ পেলে আমরা সেই গুপ্তধনভাণ্ডার বুদ্ধি খাঁটিয়ে খুঁজে বের করি। ফ্রান্সিস বলল।
–তারপর সেই ধনভাণ্ডার নিয়ে নিজেদের দেশে পালিয়ে যাও। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না।
–তা এখানে কি কোন গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছো? রাজা বললেন।
–হ্যাঁ। এই উদিন্না পাহাড়েই আছে সোনার খনি। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা কী করে জানলে? রাজা জিজ্ঞেস করলেন।
–রাজা আত্তারিয়ার কাছ থেকে। ফ্রান্সিস বলল।
–সেই সোনার খনি কী ভাবে উদ্ধার করা যায় তা জেনেছো? রাজা বললেন।
–হ্যাঁ জেনেছি। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা হুয়াল্পা সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–সত্যি?
-হ্যাঁ সত্যি। ফ্রান্সিস ঘাড় কাত করে বলল।
–সেই সোনার খনি আবিষ্কারের জন্যে কোন উপায় পেয়েছো? রাজা বললেন।
–হ্যাঁ পেয়েছি। ফ্রান্সিস বলল।
–কী পেয়েছো? রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টি থেকে নকশাটা বের করে মেলে ধরল।
রাজা হুয়াল্পা প্রায় ছুটে এসে নকশাটা প্রায় কেড়ে নিলেন।
রাজা হুয়াল্পা হা হা করে হেসে উঠলেন। গলা চড়িয়ে বললেন–এই নকশা তোমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে না।
–বেশ। কিন্তু শুধু নকশা পেলে কী হবে। নকশার অর্থ তো বের করতে হবে। নকশার রহস্যটা তো ভেদ করতে হবে। রাজা হুয়াল্পা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল–তোমরা কি নকশাটার অর্থ বের করতে পেরেছো? রাজা সিংহাসনে বসলেন।
–এখনও সবই অনুমান। প্রকৃত রহস্যটা এখনও ভেদ করতে পারিনি। ফ্রান্সিস বলল।
–তা নকশাটা আমার কাছে থাক। আমার মন্ত্রী, অমাত্যরা রয়েছেন। তারা নিশ্চয়ই নকশার অর্থটা ভেদ করতে পারবেন। রাজা বললেন।
–এইসঙ্গে আমি বলি আমাদের দুজনকেও অনুমতি দিন নকশার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যে। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ তোমরাও চেষ্টা কর। মোট কথা সোনার খনি আমার চাই-ই চাই। রাজা গলা চড়িয়ে বললেন।
তাহলে আমাদের এই অনুমতি দিন–আমরা যখন যেখানে খুশি যেতে, পারবো। নকশার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গেলে আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ তো। আমি সেনাপতিকে বলে দেব। রাজা বললেন।
রাজা হুয়াল্পা সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–আজ আর আমি বিচারের করব না। সবাই চলে যাও।
বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। রাজার হুকুম। মানতেই হবে। সবাই আস্তে আস্তে সভাকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে লাগল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সভার পরিবেশ শান্ত হল। রাজা তখন মন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে নকশা দেখতে লাগলেন। মন্ত্রী নিবিষ্ট মনে নকশাটা দেখতে লাগলেন। রাজার নির্দেশে দুজন অমাত্যও মন্ত্রীর কাছে এলেন নকশা দেখতে লাগলেন। ফ্রান্সিস রাজাকে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলল-নকশাটা তো দিয়ে দিয়েছি। তাহলে আমরা এখন যাবো?
–বেশ। যাও। রাজা বললেন।
–কিন্তু কোথায় যাবো? কয়েদখানায়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–না-না। তোমরা সৈন্যাবাসে থাকবে। ওখানে তোমাদের নজরে রাখা যাবে। রাজা এবার সেনাপতির দিকে তাকালেন। বললেন–সেনাপতি এই দু’জন বন্দীর থাকার জন্যে সৈন্যাবাসের একটা ভালো ঘর দিন। লক্ষ্য রাখবেন যেন পালাতে না পারে।
সেনাপতি মাথা নিচু করে মাথা তুলল। ফ্রান্সিসদের ইঙ্গিত করল পেছনে পেছনে আসার জন্যে।
ফ্রান্সিসরা সেনাপতির পেছনে পেছনে চলল। সৈন্যাবাসে বেশ ভাল ঘর দেওয়া হল ওদের। সেনাপতি বলল–এই ঘরে থাকতে তোমাদের অসুবিধে হবে না। প্রয়োজনে আমার কাছে এসো। সেনাপতি চলে গেল।
লম্বা লম্বা শুকনো ঘাস আর কোন গাছের ছোবড়া দিয়ে তৈরি বেশ পরিপাটি বিছানা।
ফ্রান্সিস ঘরটায় ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো হেসে বলল– ফ্রান্সিস তোমার এই এক রকম। বিছানা পেলেই শুয়ে পড়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর চিন্তা করা চলে না। এইজন্যে চাই বিছানা আর সময়। এখানে দুটোই পাবো বলে ভরসা করছি। ফ্রান্সিস বলল।
দুপুরের খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস বলল–বেশ বেলা হয়ে গেছে। আজকে আর উদিন্না পাহাড় দেখতে যাবো না। আজ শুধু বিশ্রাম আর চিন্তা। কালকে থেকে কাজ শুরু করবো।
–মনে হয় উদিন্না পাহাড়টাকে বোধহয় দুই রাজা ভাগ করে রেখেছে। উত্তরের রাজা হুয়াল্পার অধীন। দক্ষিণদিকটা রাজা আত্তারিয়ার এলাকা। দুই রাজাই এই ভাগ মেনে নিয়েছে বোধহয়। শাঙ্কো বলল।
–হুঁ। তাহলে দুই রাজার কাছ থেকেই অনুমতি নিতে হবে। দুই রাজাই যদি অনুমতি দেয় তাহলে অনেক সমস্যার হাত থেকে বাঁচা যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখ কথা বলে। শাঙ্কো বলল।
পরের দিন দুপুরে ফ্রান্সিসরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। তারপর চলল। প্রথমে উত্তর দিক থেকে যাবে ফ্রান্সিস এটা ভেবে রেখেছিল।
হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে উদিন্না পাহাড়ের উত্তরে পৌঁছল।
ফ্রান্সিস বলল–প্রথমে দক্ষিণ দিক থেকে দেখেছি একটা বড় ওক গাছ। ঐ গাছটার একটা ডাল ভেঙে রেখেছি যাতে পরে বুঝতে পারি।
উত্তরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলল। খুঁজতে লাগল একটা গাছ। পেল একটা বড় চেস্টনাট গাছ। ফ্রান্সিস গাছটায় উঠে একটা ডাল ভেঙে রাখল।
গাছ থেকে নেমেই দেখল মন্ত্রী আর সেনাপতি কয়েকজন যোদ্ধার সঙ্গে আসছে। ফ্রান্সিস শাঙ্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। মন্ত্রী ওদের কাছে এল। জিজ্ঞেস করল– তোমরাও খোঁজাখুঁজি করছে।
-নকশাটাতে যে ইঙ্গিত পেয়েছি সেটাই সম্বল করে সোনার খনি উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।
–কিছু তথ্য-টথ্য পেলে? মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
–তেমন কিছু না। ফ্রান্সিস বলল।
–আচ্ছা–একটা কথা জানার আছে। মন্ত্রী নকশাটা মেলে ধরে বললেন –এই আঁকাবাঁকা জিনিসটা কী?
–আপনার কী মনে হয়? ফ্রান্সিস বলল।
–এটাও একটা নকশা। কিন্তু এই দুর্বোধ্য নকশা ঠিক কী বলছে বুঝতে পারছি না। মন্ত্রী বললেন।
–এটা বড় নকশার একটা অংশ। ফ্রান্সিস বলল।
–পাহাড়টা বুঝেছি। কিন্তু এই নকশাটা বুঝতে পারছি না। মন্ত্রী বললেন।
ফ্রান্সিস সাবধান হল। ভাবল–ওটা যে একটা চারাগাছ একথা বললে মন্ত্রীর সন্দেহ হবে। ধরে নেবে আমরা অনেকটা অর্থোদ্ধার করতে পেরেছি। আমরা বিপদে পড়বো।
ফ্রান্সিস বলল–ঐ ছোট নকশাটা আমরাও বুঝিনি তবে বুঝতে চেষ্টা করছি–ওটা নিয়ে ভাবছি।
–ঠিক আছে–মন্ত্রী বললেন–তোমরা তোমাদের মত খোঁজ আমরা আমাদের মত খুঁজি। হয়তো আমরা একই সিদ্ধান্তে উপনীত হব। মন্ত্রী বললেন।
তাহলে তো সব চুকেই গেল। ফ্রান্সিস বলল।
–চলি। মন্ত্রীমশাই কথাটা বলে হাঁটতে শুরু করলেন।
ফ্রান্সিস শাঙ্কো আবার পাহাড়ের গা ঘেঁষে গাছ খুঁজতে লাগল।
আর একটা শিশুগাছ পেল। শাঙ্কো গাছটার একটা ডাল ভেঙে চলে এল। ফ্রান্সিস বলল
–এই গাছটা পাহাড়ের দক্ষিণাংশে। তার মানে রাজা আত্তাদিয়ার রাজত্বের মধ্যে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা আসছে তখনই আত্তারিয়ার সেনাপতিকে আসতে দেখল। ও বুঝল, ওরা দক্ষিণাংশে চলে এসেছে।
সেনাপতি কাছে এল। ফ্রান্সিসকে দেখে বলল–তোমরা রাজা হুয়াল্পার রাজত্ব থেকে চলে গেছ। তোমরা আমাদের রাজা আত্তারিয়ার হয়ে সোনার খনি খুঁজলে না।
–আমরা রাজা আত্তারিয়া আর রাজা হুয়াল্পা দুজনের জন্যেই সোনার খনি খুঁজব। ফ্রান্সিস বলল।
–দুই রাজাকেই সন্তুষ্ট করতে পারবে? সেনাপতি বলল।
–দেখি। সোনার খনি আবিষ্কারের আশায় আছি। আবিষ্কার করতে পারলে তখন দেখবো। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা ফিরে এল।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস গুপ্ত সোনার খনির কিছু হদিশ করতে পারলে?
–গাছ আর পাহাড় এই দুটো ঠিক ঠিক বুঝতে পারলে সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
-এখন কী করবে? শাঙ্কো বলল।
–খুঁজবো–সোনার খনি। ফ্রান্সিস বলল।
–আমার কিন্তু কখনও কখনও মনে হচ্ছে এই নকশা একটা কাঁচা হাতে আঁকা ছবি। অর্থহীন। শাঙ্কো বলল।
–আমি এটা মানতে রাজি নই। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস নকশাটা বের করল এটা আসল নকশা নয়। ফ্রান্সিস নকল করে রেখেছে এটা। মশালের আলোয় নকশাটা বোঝাতে লাগল। বলল–দুটো জিনিস লক্ষ্য কর। একটা চারা গাছ–নিষপত্র মানে পাতা ঝরা গাছ। দ্বিতীয়টা হল– একটা পাথরের পাটায় গোল চিহ্ন। বোঝাই যাচ্ছে পাথর কুঁদে কুঁদে এই গোল দাগটা করা হয়েছে।
–গোল দাগটা অর্থহীন। শাঙ্কো বলল।
–তাহলে তো পুরো নকশাটাই অর্থহীন হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–যাই বল–এটা একটা ভূতুড়ে নকশা। শাঙ্কো বলল।
–আমার তা মনে হয় না। কিছুটা এগোই তখন বুঝতে পারবো। এটা ভূতুড়ে নকশা না অর্থ আছে এমন নকশা। ফ্রান্সিস বলল।
হবে হয়তো। শাঙ্কো বলল।
–এখন ঘুমোও। কালকে খোঁজাখুঁজি আছে। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস বিছানায় দুচারবার এপাশ-ওপাশ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে ফ্রান্সিসরা সবেমাত্র সকালের খাবার খেয়েছে সেনাপতি ঢুকল। বলল–মাননীয় রাজা হুয়াল্পা তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। চল।
–হঠাৎ রাজা ডেকে পাঠালেন–কী ব্যাপার বলুন তো। শাঙ্কো বলল।
–রাজা হুয়াল্পা কেন তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন–আমি জানি না। তবে এখন থেকে তোমরা কয়েদঘরে থাকবে এই খবরটা আমাকে জানানো হয়েছে। আমি এইটুকুই জানি–দেরি না–চল। সেনাপতি বলল।
-কী অপরাধ করলাম–বলতে বলতে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। শাঙ্কোও উঠল।
সেনাপতির পেছনে পেছনে ওরা চলল রাজবাড়ির দিকে।
রাজার রাজসভায় এল তিনজনে। তখন বিচার চলছিল। রাজা ফ্রান্সিসদের দেখল। কিছু বলল না। বিচারের রায় দিলেন রাজা। তারপর গলা চড়িয়ে বললেন- আজকে আর বিচার হবে না। সভা এখানেই শেষ।
রাজসভা থেকে লোকেরা চলে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সভায় রইল রাজা মন্ত্রী অমাত্য আর প্রহরীরা। আর রইল সেনাপতি ও ফ্রান্সিসরা।
–তোমাদের কয়েদঘরে পাঠানো হবে। মন্ত্রী বললেন।
–কেন? কী অপরাধ করেছি আমরা? শাঙ্কো বলল।
এবার রাজা হুয়াল্পা বললেন–উত্তর দিকে এক ছোট দেশে আমার এক বন্ধু। ওখানকার রাজা। ওখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। বন্ধু যোদ্ধা চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছে। ওখানে একশ যোদ্ধা পাঠিয়েছি আট দশদিন আগে। ঠিক এই সময়ই রাজা আত্তারিয়া আমার দেশ আক্রমণ করতে তৈরি হচ্ছে। আত্তারিয়া কী করে জেনেছে যে আমার যোদ্ধা সংখ্যা কমে গেছে। এটা নিশ্চয়ই তোমাদের কাজ। তোমরাই আত্তারিয়াকে খবরটা জানিয়েছে। রাজা আত্তারিয়া এই সুযোগটাই খুঁজছিল। তোমাদের জন্যই রাজা আত্তারিয়া আমার দেশ আক্রমণ করার জন্য তৈরি হয়েছে। বন্ধুকে পাঠানো যোদ্ধারা ফিরে আসার আগেই আত্তারিয়া আক্রমণ করবে।
–আপনি আমাদের ভুল বুঝেছেন। এসব ব্যাপারের সঙ্গে আমাদের কোনরকম যোগ নেই। একশ যোদ্ধা পাঠিয়েছেন এটা আপনার মুখ থেকেই প্রথম জানলাম। ফ্রান্সিস বলল।
–মিথ্যে কথা। সব মিথ্যে। তোমরা সব জানো। রাজা বললেন।
–আমাদের বিশ্বাস করুন। ফ্রান্সিস বলল।
-না। তোমাদের আমি বিশ্বাস করি না। হুয়াল্পা কথাটা বলে সেনাপতির দিকে তাকালেন। বললেন–এই দুই গুপ্তচরকে কয়েদখানায় ঢোকাও। সেনাপতি এগিয়ে এল।
একটু চুপ করে থেকে ফ্রান্সিস বলল–কিন্তু সোনার খনির অনুসন্ধান করা–। ফ্রান্সিসদের কথাটা শেষ হবার আগেই রাজা হুয়াল্পা যেন গর্জন করে উঠলেন : সোনার খনি–মিথ্যে–আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে। রাজা মন্ত্রীর দিকে হাত বাড়াল। মন্ত্রী নকশাটা রাজাকে দিল। রাজা নকশাটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেললেন।
–তাহলে তো আমাদের আর এই দেশে থাকার কোন অর্থ হয় না। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ কিছুদিন দণ্ডভোগের পর তোমরা এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে–আমার হুকুম। রাজা হুয়াল্পা বললেন।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকাল। তারপর আস্তে বলল
–মাননীয় রাজা আপনি আমাদের মিথ্যে সন্দেহ করে আমাদের দুঃখ দিলেন। সোনার খনি মিথ্যে নয়। আমাকে অনুসন্ধান করতে দিলে আমি সোনার খনি উদ্ধার করে দেখাতাম আপনাকে ভুল বোঝাইনি। এই উদিন্না পাহাড়েই আছে সোনার খনি।
–ওসব বলে লাভ নেই। তোমাদের দণ্ডভোগ করতেই হবে। রাজা বললেন।
সেনাপতি ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল–চল।
ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরের দরজার কাছে এল। সেনাপতি ইঙ্গিত করল। প্রহরী দরজা খুলে দিল। লোহার দরজা ঢংঢং শব্দে খুলে গেল। ফ্রান্সিসরা ঢুকল। দুজনে পাথরের দেওয়ালে পিঠ রেখে বসল। কেউ কোন কথা বলল না।
রাতের খাবার একটু তাড়াতাড়িই এল। ফ্রান্সিসরা খেয়ে নিল।
দুজনেই ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস পালাতে হবে।
–সে তো হবেই। কিন্তু কয়েকটা দিন অপেক্ষা করি। রাজা আত্তারিয়া এই দেশ আক্রমণ করবেই। আমরা লড়াইয়ের ডামাডোলের মধ্যে পালিয়ে যাবো।
–পালিয়ে কোথায় যাবে? জাহাজঘাটে? শাঙ্কো বলল।
–না। রাজা আত্তারিয়ার রাজত্বে লুকিয়ে থাকবো। তারপর নকশার অর্থ বের করে সোনার খনির হদিশ বের করব। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো আরো কিছুদিন এখানে থাকতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। তা তো হবে। আমি নিশ্চিত নকশাটা সত্যি। ভূতুড়ে নকশা নয়। ফ্রান্সিস বলল।
অল্প দিনের মধ্যেই সোনার খনি উদ্ধার করতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। শাঙ্কো–এখন ঘুমোও। শরীর সুস্থ রাখতে হবে। অসুস্থ হয়ে পড়লে সব মাটি। ফ্রান্সিস বলল।
পরদিন সকালের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস আবার শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো বসে ছিল। বলল–ফ্রান্সিস কী করবে এখন?
–সোনার খনি খুঁজবো। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা হুয়াল্পা তো তোমার দেওয়া নকশা ছিঁড়ে ফেলল।
–তাতে কী? আমার মনে নকশা অমলিন। মনে করলেই চোখের সামনে ভাসে। সোনার খনি আমি আবিষ্কার করবই। শুধু সময়ের অপেক্ষা। একটু পরে বলল–
এরপরেও আমি খোঁজ চালিয়ে যাবো।
–দুই রাজা কি এখনও তোমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করবে? শাঙ্কো বলল।
–হুয়াল্পা চটেছে। আত্তারিয়া আমাকে সুযোগ দেবে। সোনার লোভ কিন্তু সাংঘাতিক। এই লোভ কেউ এড়াতে পারে না। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–সোনার খনির কথা ভুলে যাও। চলো দেশে ফিরি।
–আগেও বলেছি। এখনও বলছি দেশে এখনই ফেরার ইচ্ছে আমার নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–যাক গে–তুমি যা ভালো বোঝে। শাঙ্কো বলল।
–এখন শুধু বিশ্রাম কর। ফ্রান্সিস বলল।
কিন্তু ওদের কপালে বিশ্রাম ছিল না। স্বয়ং সেনাপতি কয়েদঘরে এসে হাজির হল। ঢং ঢং শব্দ তুলে লোহার দরজা খুলে গেল। সেনাপতি ঢুকল। ফ্রান্সিসদের কাছে এল। গলা চড়িয়ে বলল–মহামান্য রাজা তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। চল।
ফ্রান্সিস শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। সেনাপতির পেছনে পেছনে চলল।
মাঠ পার হয়ে রাজবাড়িতে এল। ওরা দেখল আজ রাজসভায় ভিড় নেই। বিচার চলছে। ওরা অপেক্ষা করতে লাগল।
বিচারের কাজ শেষ হল। সবাই চলে গেল। রাজা হুয়াল্পা ফ্রান্সিসদের দিকে তাকালেন। বললেন, আমি নিশ্চিত যে তোমরা রাজা আত্তারিয়াকে আমাদের রণসজ্জা যোদ্ধাবাহিনী সম্পর্কে সব খবর পৌঁছে দিয়েছে।
–আপনি ভুল কথা বলছেন। আসন্ন লড়াই সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা যাই বল তোমরা যে গুপ্তচরের কাজ করেছে এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। রাজা বললেন।
–তাহলে তো আমাদের মুক্তির কোন আশাই নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা দুজন যে এখনও বেঁচে আছো তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও। রাজা বললেন।
–তার প্রয়োজন নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–কেন? রাজা বললেন।
কারণ আমরা গুপ্তচরের মত নিন্দনীয় কাজ করিনি–করবোও না। ফ্রান্সিস বলল।
–ওসব কথা বলে কী লাভ? এই কাজটা করার জন্যে তোমাদের মুক্তি দেওয়া হবে। সোনার খনি খুঁজতে দেওয়া হবে।
–গুপ্তখনি পেলে যতটা সোনা পাবো তার অর্ধেক তোমাদের দেওয়া হবে। রাজা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফ্রান্সিস আস্তে বলল শাঙ্কো কী করবে?
–মুক্তি তো পাবো। তারপরে দেখা যাক। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস একটু ভেবে বলল–এধরনের কাজ আমরা কখনও করিনি। কিন্তু আজ এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে আমাদের মুক্তির প্রশ্ন। আমরা এখন মনেপ্রাণে চাইছি মুক্তি আর সোনার খনি খুঁজে বের করার কাজ।
–ঠিক আছে। দুটোই পাবে। তাহলে তোমরা আজই যাও। আজই রাতে। দেরি করো না। আমি দুটি কথা জানতে চাই। কোনদিন আত্তারিয়া আক্রমণ করবে আর কবে আক্রমণ করবে।
–বেশ। আমরা এখন সৈন্যাবাসে থাকবার জন্যে যে ঘর পেয়েছিলাম সেই ঘরটায় আমাদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পড়ে আছে। সে সব নেব। তারপর রাজা আত্তারিয়ার রাজ্যে যাবো।
–বেশ। তাহলে আমাদের সঙ্গে এসো। সেনাপতি বলল।
সেনাপতির পেছনে পেছনে ওরা কয়েদঘর থেকে বাইরে এল। মাঠ পার হয়ে চলল। সেনাপতি চলে গেল। সঙ্গের এক প্রহরী আগের ঘরটার সামনে এল। দরজার তালা খুলে দিল।
ফ্রান্সিসরা ঘরে ঢুকল। প্রহরী বলল–কিছু প্রয়োজন পড়লে জানাবেন। প্রহরী চলে গেল। বিছানায় বসে শাঙ্কো বলল–কখন রওনা হবে?
–আজ রাতে। খাওয়া-দাওয়ার পর। ফ্রান্সিস বলল।
–ভাবছি কী করে খবরটা বের করবে। শাঙ্কো বলল।
–দেখি চেষ্টা করে। দলপতিকে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি! ফ্রান্সিস বলল।
–দলপতি যাতে বলে তার চেষ্টা করতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–হুঁ। ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। দেখা যাক–খবরটা জানা যায় কিনা।
রাতের খাওয়া হল। একটু বিছানায় শুয়ে নিয়ে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল– শাঙ্কো–চল।
দুজনে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল তখন গভীর রাত। আকাশে ভাঙা চাঁদ। জ্যোৎস্না উজ্জ্বল নয়। চারপাশ বেশ অন্ধকার। ওরা হাঁটতে লাগল।
ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। ভালোই লাগছিল হাঁটতে।
ভোর ভোর সময়ে গ্যালিগাস পৌঁছল। তখনও রাস্তায় তেমন লোক চলাচল শুরু হয় নি। ফ্রান্সিস বলল–চল–একটা সরাইখানা খুঁজি। দিনকয়েক থাকতে হবে।
কিছুদূর হাঁটতেই ডানদিকে একটা সরাইখানা দেখতে পেল। ফ্রান্সিসরা সরাইখানায় ঢুকল। মালিক হেসে বলল- আসুন-আসুন। সব রকম খাবারের ব্যবস্থা আছে।
ফ্রান্সিসরা সরাইখানায় ঢুকল। মালিক পেছনে পেছনে এল।
–আমরা হাতমুখ ধুয়ে আসছি। সকালের খাবার পাঠিয়ে দিন। ফ্রান্সিস বলল।
–অবশ্যই অবশ্যই। মালিক হেসে বলল।
–শুনুন–এখানে আমরা দু’চারদিন থাকবো। ব্যবসার কাজে।
–হা হা। মালিক মাথা ঝাঁকাল।
–কেনাকাটার ব্যাপার–বুঝলেন তোতা? ফ্রান্সিস বলল।
–হা হা। মালিক আবার মাথা ঝাঁকাল।
–ঠিক আছে আপনি যান। খাবার পাঠিয়ে দিন। সরাইওলা চলে গেল।
ফ্রান্সিস দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসল। বলল–শাঙ্কো আজ থেকেই কাজ শুরু করি। দেরি করবো না।
–দুপুরের খাবার খেয়েই চল। শাঙ্কো বলল।
— চল। প্রথমে সৈন্যাবাসের এলাকায় চল। কোন যোদ্ধাকে একা পেলে ভেতরের খবরটা নিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ চল। শাঙ্কো বলল–তবে আরো কয়েকটা উপায় ভেবে রাখো। শাঙ্কো বলল।
–হু–হু ভেবেছি। চল–এই উপায়টা কাজে লাগে কিনা দেখি। ফ্রান্সিস বলল।
রাজার যোদ্ধাদের আবাস রাজবাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। দুজনে অল্পক্ষণেই সেখানে পৌঁছল। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
মাঠে যোদ্ধারা ব্যায়াম ট্যায়াম করছিল। আবাস ফাঁকা। সব যোদ্ধাই মাঠে।
ফ্রান্সিসরা আবাসের বাইরে একটা শিশুগাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল।
কিছু পরে ব্যায়াম শিক্ষাদান ও যোদ্ধাদের অংশগ্রহণ শেষ হল। কিছু যোদ্ধা আবাসের বাইরে এল। বাইরে একটামাত্র মিষ্টির দোকান। যোদ্ধারা দোকানে ঢুকল। গলা চড়িয়ে দু’তিন জন খাবার খেতে চাইল।
–জলদি চল। ফ্রান্সিস আস্তে বলল। তারপর চলল মিষ্টির দোকানের দিকে।
ফ্রান্সিসরা দোকানে ঢুকল। কিন্তু জায়গা নেই। বাইরে বেরিয়ে এল। একজন যোদ্ধা খাবার বাইরে এনে খাচ্ছিল। ফ্রান্সিস তার কাছে গেল। হেসে উঠে যোদ্ধাটার পিঠে চাপড় মারল।
তুই সৈন্যদলে আছিস? যোদ্ধা ফ্রান্সিসের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস বলল–আমাকে চিনতে পাচ্ছি না। যোদ্ধা তবু তাকিয়ে রইল। হাসি থামিয়ে বলল–না। আমার ভুল হয়েছে। ঠিক আপনার মত দেখতে আমার এক বন্ধু আছে। আপনাকে ভুল করে–কিছু মনে করবেন না।
ফ্রান্সিসের কাণ্ড দেখে শাঙ্কো অনেক কষ্টে হাসি চাপল। ফ্রান্সিস যোদ্ধাকে বলল–আচ্ছা আপনাদের কি রোজই ব্যায়াম করতে হয়?
দু’বেলা। যোদ্ধাটি বলল।
–কিন্তু ধরুন যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন। তখনও ব্যায়াম করতে হয়? ফ্রান্সিস বলল।
–না। তখন তো যুদ্ধাস্ত্র চালানো। ব্যায়ামের সময় কই। যোদ্ধাটি বলল।
–কোথায় কখন যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন সেটা কি আপনারা রওনা হওয়ার দিন জানলেন–না আগে থেকেই জানেন। ফ্রান্সিস বলল।
–তার ঠিক নেই। তবে আগে থেকে আমরা সেনাপতির ব্যস্ততা দেখে বুঝি। যোদ্ধাটি বলল।
–কোথায় লড়াই করতে যেতে হবে সেটা আগে থাকতে জানেন? ফ্রান্সিস বলল।
–মোটামুটি একটা ধারণা হয়। যোদ্ধাটি বলল।
–এই যে উত্তরের রাজা হুয়াল্পার সঙ্গে আপনাদের লড়াই হবে সেটা কি জানেন? ফ্রান্সিস বলল।
যোদ্ধা ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল–আপনি কী করে জানলেন?
–রাজা হুয়াল্পার রাজ্যে বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানেই জেনেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন। যোদ্ধাটি বলল।
কিন্তু সমস্যা আপনারা কবে কখন লড়াইয়ে নামছেন সেটা তো ঐ রাজ্যের যযাদ্ধারা জানে না। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। আভাসে কিছু শুনেছেন কী? ফ্রান্সিস বলল।
-হ্যাঁ। আসছে সোমবার রাতে রাজা হুয়াল্পার রাজ্য আক্রমণ করা হবে। যোদ্ধাটি বলল।
–জোর লড়াই হবে তাই না? ফ্রান্সিস বলল।
–তা তো বটেই। যোদ্ধাটি বলল।
–আপনারা কি জানেন রাজা হুয়াল্পা তার এক বন্ধু রাজাকে একশোজন সৈন্য ধার দিয়েছেন। ফ্রান্সিস বলল।
যোদ্ধা এবার একটু হাসল। বলল–আমরা জানি। তাই আক্রমণের জন্য এই সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে।
–অনেক ধন্যবাদ ভাই। আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি। লড়াই লাগবে সেটা জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে বেড়াতে পারবো। তাই এত কিছু জানতে চাইছি। আবার ধন্যবাদ। চলি। ফ্রান্সিস একটু পা চালিয়ে চলল বড় রাস্তার দিকে। শাঙ্কোও ছুটে এসে পাশে দাঁড়াল।
–এত জোরে হাঁটার কী হল? শাঙ্কো জানতে চাইল।
–ওদের সেনাপতি মাঠে এসেছে। যোদ্ধাদের কিছু নির্দেশ-টির্দেশ দেবে বোধহয়। সৈন্যদের মধ্যে আমাদের দেখলেই বিপদ। সেনাপতির তখন সন্দেহ হতে না পারে। কাজেই পালাও।
দুজন খুব দ্রুত হেঁটে বড় রাস্তায় এল। এবার আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।
দুজনে শেষ বিকেলে সরাইখানায় পৌঁছল।
ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। সরাইখানার রাঁধুনি মাংসের বড়া দিয়ে গেল। দুজনে হাপুস হুপুস খেল। বেশ খিদে পেয়েছিল।
–এখন কী করবে? শাঙ্কো বলল।
–রাজা হুয়াল্পার রাজত্বে যাবো। যে সব খবর সংগ্রহ করেছি সেসব জানালে রাজা হুয়াল্পা খুব খুশি হবে। আমাদের মুক্তি দেবে। সোনার খনি খুঁজতে আমাদের সাহায্য করবে। কারণ সোনার লোভ। খুব কম মানুষই এই লোভ সামলাতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে কয়েকটা দিন এখানে থাকবে? শাঙ্কো বলল।
–না না। আজ রাতেই রওনা হব। মারিয়া বন্ধুরা জাহাজঘাটায় আছে। আমাদের জন্যে খুবই চিন্তা করছে। সব কাজ দ্রুত সারতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে শুয়ে পড়ল। শেষ রাতে রওনা দেবে রাজা হুয়াল্পার রাজ্যের দিকে। কিন্তু সেটা হল না।
সরাইখানার দরজায় কারা চাপড় দিচ্ছে। সরাইওয়ালার গলা শোনা গেল– যাই। সরাইখানার মালিক দরজা খুলে দিল। অল্প আলোয় দেখল– স্বয়ং সেনাপতি দাঁড়িয়ে।
মালিক হতবাক। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা সামলে বলল–আসুন–আসুন। কী সৌভাগ্য আমার।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। দেশের গণ্যমান্য কেউ একজন এসেছে বোঝা গেল কিন্তু সে কে তা বোঝা গেল না। ততক্ষণে সেনাপতির সঙ্গে আসা যোদ্ধারা তল্লাশী শুরু করেছে। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো দ্রুত পেছনের দরজার দিকে ছুটল। দেখল পেছনের দরজা আটকপাটি বন্ধ। যোদ্ধারা ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোর ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসরা বাধা দিল না। এরকম নিরস্ত্র অবস্থায় বাধা দিতে যাওয়া মানে মৃত্যু।
যোদ্ধারা ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। সেনাপতি ফ্রান্সিসদের দেখে বলল–অ– তোমরা। রাজাকে আর আমার যোদ্ধাদের কঁকি দিয়ে পালিয়েছিলে।
–আমরা পালাই নি। রাজা হুয়াল্পার যোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েছিলাম। কয়েকদিন কয়েদখানায় কাটাতে হয়েছিল। শাঙ্কো বলল।
–এখানেও কয়েদখানায় থাকতে হবে। অবশ্যই মাননীয় রাজা যদি তোমাদের মুক্তি দেন–সেটা আলাদা কথা। সেনাপতি বলল।
–দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
–যে নকশাটা তুমি দিয়েছো–সেটা আমরা খুব মনোযোগের সঙ্গে তা দেখেছি। বুঝেছি–ওটা জাল নকশা। তুমি আমাদের ধোঁকা দিয়েছে। সেনাপতি বলল।
–আমি বলছি নকশাটা জাল না। আমি সেটা প্রমাণও করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা আত্তারিয়া বোধহয় তোমাকে সেই সুযোগ দেবে না। সেনাপতি বলল।
–সেই ক্ষেত্রে আমরা জাহাজে ফিরে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–সেই সুযোগটাও তোমাদের হয়তো দেওয়া হবে না। সেনাপতি বলল।
–হাতে তরোয়াল থাকলে আমি শয়তানকেও ভয় করি না। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে, আগে দেখা যাক রাজা তোমাদের কি শাস্তি দেন। সেনাপতি বলল।
–আমরা কোন অন্যায় করিনি অপরাধ করিনি যে আমাদের শাস্তি দেবেন। শাঙ্কো বলল।
রাস্তার একটা মোড়ের কাছে এসে সেনাপতি বলল
–আমাকে একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি যাচ্ছি।
সেনাপতি দলপতির দিকে তাকিয়ে বলল–এদের কয়েদখানায় ঢোকাবি। কাল রাজসভায় এদের আনা হবে। সাবধান–পালিয়ে না যায়।
সেনাপতি ডানদিকের রাস্তার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
এবার ফ্রান্সিস শাঙ্কোর কাছে সরে এল। ফিফিস্ করে বলল–সামনে দেখ। একটা বিরাট শিশুগাছ। জায়গাটায় অন্ধকার বেশি। লাফ দিয়ে পালাব। রাজা হুয়াল্পার কাছে যাব। লড়াইয়ের ব্যাপারে আমরা যা জেনেছি সব বলবে। পেছন থেকে দলপতি বলল–ফিস্ ফিস্ করে কী কথা হচ্ছে?
–আমার বিয়ের ব্যাপারে। শাঙ্কো বলল।
–তাহলে বলতে পারো। বিয়ে বলে কথা। দলপতি হেসে বলল।
দুজনেরই হাত বাঁধা। সবাই তখন শিশুগাছের কাছে এসেছে। শাঙ্কো দুহাত তুলে রাস্তা থেকে লাফ দিয়ে শিশুগাছটার গোড়ায় গিয়ে পড়ল।
তখনই দলপতি শাঙ্কোকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়ল।
বর্শাটা গাছটার গায়ে বিধে গেল। শাঙ্কো ততক্ষণে জংলা গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে।
দলপতির নির্দেশমত এক প্রহরী গিয়ে বর্শাটা গাছের গা থেকে খুলে আনল।
দলপতি গলা চড়িয়ে বলল–সব সাবধান। এরা কিন্তু ধুরন্ধর। সুযোগ পেলেই পালাবে।
ভোর হল। তখনও ফ্রান্সিসরা চলেছে।
বেশ বেলায় কয়েদঘরের সামনে পৌঁছল। সেই প্রহরীরা এগিয়ে আসা। সেই– ঢডাংটং শব্দে কয়েদঘরের দরজা খোলা হল। সেই বন্দী জীবন! কিছুই করার নেই। তবে ফ্রান্সিস ভাবে পালানোর ফন্দী নকশার অর্থ এসব ভাবব।
একটু বেলায় খাওয়াদাওয়া হল। সারা সন্ধ্যে দরজার ফাঁক দিয়ে মাঠের সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাটাল। একটা চিন্তা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। সেটা হল শাঙ্কোর কথা। পালাতে পেরেছে। কিন্তু পরের কাজগুলো করতে পেরেছে। কিনা। রাজা হুয়াল্পাকে সব কথা বলতে পেরেছে কিনা কোথাও আশ্রয় পেয়েছে। কিনা। ফ্রান্সিস ভাবল–এখানে তো লড়াই শুরু হবে সামনের সোমবার। লড়াইয়ের সময় মারামারি কাটাকাটি চলবে। সেই সুযোগে ও হুয়াল্পার রাজত্বে চলে যাবে। শাঙ্কোকে খুঁজে বের করবে। তারপর দুজনে মিলে সোনার খনি আবিষ্কার করবে।
পরদিন একটু সকালের খাবার খাচ্ছে তখনই দলপতি কয়েদঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিসের কাছে গিয়ে বলল–তোমার এক বন্ধু তো পালিয়েছে। তুমি কী করবে?
রাজা হুয়াল্পার সঙ্গে কথা বলে স্থির করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–হুঁ। যাকগে তুমি রাজসভায় চল। দলপতি বলল।
–চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
মাঠ পার হয়ে রাজবাড়িতে এল দুজনে। রাজসভায় ঢুকল। তখন বিচারের কাজ চলছে। ফ্রান্সিস বার বার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। শাঙ্কোকে দেখতে পেল না। ভেবে পেল না শাঙ্কো কোথায় আছে? শাঙ্কো পালিয়েছে। বন্দী হলে কয়েদঘরেই থাকতে হত। মনে হয় শাঙ্কো যে অবশ্য প্রয়োজনীয় খবর রাজা হুয়াল্পাকে দিয়েছে তাতেই ও ধরা পড়লেও মুক্তি পেয়েছে।
ফ্রান্সিসের ডাক পড়ল। সেনাপতি ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল–এই বিদেশী গুপ্তখনি সম্পর্কে বেশ কিছু জানে। একে বন্দী করতে হবে। ওর কথা ফাঁস হয়ে গেলে সোনার খনি কোনদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মাননীয় রাজা–যে সব সংবাদ আপনি জানতে চেয়ে আমাদের পাঠিয়েছিলেন সেই সংবাদ আমার বন্ধু দিয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ দিয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। সেইজন্য তোমার বন্ধুকে যোদ্ধাদের আবাসে রেখেছি। রাজা বললেন।
–আমি বন্ধুর কাছে যেতে পারি। ফ্রান্সিস বলল।
–দুজনে একত্র হলে পালাবে। রাজা বললেন।
–না। পালাবো না। পালাতে হলে অনেক আগেই পালাতাম। ফ্রান্সিস বলল।
কিছু পরে ফ্রান্সিসকে দলপতি কয়েদঘরে নিয়ে এল।
ওদিকে শাঙ্কো তো পালাল। জংলা গাছপালা দুহাতে সরিয়ে সরিয়ে শাঙ্কো একটু দূরেই চলে এল। কান পাতল। দলপতির দল থেকে কারো কোন কথা শুনতে পেল না।
জংলা গাছ সরিয়ে সরিয়ে এল। শরীরের অনেক জায়গা ছড়ে গেছে। দু এক এক জায়গা কেটে গেছে।
দুদিকে ভালো করে দেখে শাঙ্কো রাস্তায় নামল।
চলল। আজ আর রাজার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। কাল সকালে দেখা করবে রাজসভায় নয়। অন্য কোন ঘরে। লড়াইয়ের যে খবর ও এনেছে সেটা অত্যন্ত গোপনে রাজাকে জানাতে হবে।
একটা সরাইখানা খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি আলগা করে তিনটি স্বর্ণমুদ্রা পেল। যাক দিন কয়েক বেশ চলে যাবে।
ও সরাইখানায় ঢুকল। যে ছোকরা খাবার টাবার দিচ্ছিল। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ছোকরাটা এল। শাঙ্কো কাঠের পাটাতনে বসল। দু’পাত্র জল খেয়ে মালিকের কাছে গেল। মালিক হাসিমুখে বলল–আপনি কি
–হ্যাঁ। থাকবো। খাবো। কতদিন থাকবো সেটা পরে জানাবো।
–ঠিক আছে–ঠিক আছে। সরাইওয়ালা হেসে বলল।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে শুয়ে পড়ল। কালকে আসল কাজটা করতে হবে অর্থাৎ লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো দিতে হবে রাজা হুয়াল্পাকে। রাজা কী করে দেখা যাক।
পরদিন। সকালের খাবার খেয়ে চলল রাজবাড়ির দিকে। যখন রাজসভায় ঢুকছে তখনই দেখল সেনাপতি আসছে। শাঙ্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। সেনাপতি কাছে। আসতে শাঙ্কো বলল–মাননীয় সেনাপতি–একটা কথা ছিল। সেনাপতি শাঙ্কোর দিকে তাকাল। চিনল। বলল–তুমি একা। বন্ধু কোথায়?
–ওর সঙ্গে এখনও আমার দেখা হয় নি। শাঙ্কো বলল।
কিছু বলবে? সেনাপতি বলল।
–গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কথা রাজাকে বলবো। এই রাজসভায় যেসব বলা যাবে না। অন্য কোন জায়গায় হলে ভালো হয়। শাঙ্কো বলল।
কোন ব্যাপারে? সেনাপতি বলল।
লড়াইয়ের ব্যাপারে। শাঙ্কো বলল।
–ও। আমাকে বলা যাবে না? সেনাপতি বলল।
–না। সর্বপ্রথম ব্যাপারটা রাজাকে বলতে হবে। শাঙ্কো বলল।
–বেশ। অপেক্ষা করো। সভা শেষ হলে রাজাকে মন্ত্রণাঘরে নিয়ে যাব। সেখানে এসে তুমি তোমার কথা বলল। সেনাপতি বলল।
–ঠিক আছে। শাঙ্কো বলল।
সেনাপতি চলে গেল। শাঙ্কো দাঁড়িয়ে রইল।
রাজসভার কাজ শেষ হল। রাজা আসন থেকে উঠলেন। তখনই সেনাপতি রাজার সামনে এসে দাঁড়াল। কিছু বলল।
রাজা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। রাজা বাইরের দিকে মন্ত্রণাকক্ষে এলেন। বসলেন।
সেনাপতি শাঙ্কোকে নিয়ে ঢুকল। সেনাপতি আবলুস কাঠের তৈরি আসনে বসল। রাজা শাঙ্কোকে ইঙ্গিতে বসতে বলল।
শাঙ্কো বুঝে উঠতে পারছে না কীভাবে কথা শুরু করবে। ফ্রান্সিস হ্যারির অভাব বেশ অনুভব করছিল। রাজা বলল
–রাজা আত্তারিয়া সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়েছে এ খবর আমরা জানি। তুমি আর কী সংবাদ এনেছো? রাজা বললেন।
আগামী সোমবার রাতে রাজা আত্তারিয়া আপনার দেশ আক্রমণ করবে। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। শাঙ্কো বলল।
–হুঁ। হাতে সময় নেই। আর কী খবর এনেছো? রাজা বললেন।
–আপনি যে একশ যোদ্ধাকে অন্যত্র পাঠিয়েছেন এটা রাজা আত্তারিয়া জানেন। শাঙ্কো বলল।
–আর তাই লড়াইয়ের জন্যে এই সময়টা বেচেছে। রাজা বললেন।
–হ্যাঁ। শাঙ্কো মাথা ওঠানামা করল।
রাজা সেনাপতির মুখের দিকে তাকালেন। বললেন–আপনি তো রাজা আত্তারিয়ার আক্রমণের দিন কাল সবই জানলেন। আজ থেকেই লড়াই-এর জন্য যোদ্ধাদের তৈরি করুন।
নিশ্চয়ই। আজ দুপুর থেকে লড়াইয়ের জন্য যোদ্ধাদের তৈরি করার কাজ শুরু করবো। সেনাপতি বলল। রাজা একটু ভেবে বললেন।
-তোমার নাম কী?
–শাঙ্কো। শাঙ্কো বলল।
–তোমাকে কিন্তু সৈন্যাবাসে থাকতে হবে। তোমার দেওয়া সংবাদ যদি সত্যি হয় তবে তোমাকে অনেক কিছু দেওয়া হবে। আর যদি মিথ্যে হয় তাহলে তোমাকে সারাজীবন কয়েদঘরে থাকতে হবে। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে।–শাঙ্কো বলল।
রাজা উঠে দাঁড়ালেন। রাজা রাজবাড়িতে চলে গেলে শাঙ্কো সেনাপতির সঙ্গে বাইরের মাঠে এল। একজন যোদ্ধা আবাসের দিকে যাচ্ছিল। সেনাপতি ইশারায় ডাকল। যোদ্ধাটি একটু মাথা নুইয়ে কাছে এল। সেনাপতি বলল–তোমাদের দলপতিকে এখানে আসতে বল। যোদ্ধাটি চলে গেল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই দলপতি ছুটতে ছুটতে এল। একবার মাথা নুইয়ে সেনাপতির সামনে এসে দাঁড়াল। তখনও হাঁপাচ্ছে। সেনাপতি শাঙ্কোকে দেখিয়ে বলল–এ বিদেশি। ওর এক বন্ধুও আছে। যাকগে–একে থাকবার জন্যে একটা ঘর দাও। দেখো যেন ওর কোন অসুবিধে না হয়।
-ঠিক আছে। দলপতি মাথা নুইয়ে বলল।
সেনাপতি চলে গেল। দলপতি শাঙ্কোকে বলল-চল। এদিকে ওদিকে দেখে টেখে দলপতি একটা ভাল ঘরেই শাঙ্কোকে থাকতে বলল। সেনাপতি চলে গেল।
শাঙ্কো ঘরে ঢুকে কাঠের পাটাতনে বসল। প্রথম চিন্তাটাই হল–ফ্রান্সিস কোথায়? ও তো বন্দী হল। সোমবার লড়াই শুরু হলে তবেই ওর সংবাদ সঠিক হবে। তখন নিশ্চয় ওকে আর ফ্রান্সিসকে মুক্তি দেওয়া হবে।
আবার অন্য দিকটাও ভাবা যায়। সোমবার রাতে আক্রমণ না হলে শাঙ্কোকে চিরজীবনের জন্যে কয়েদঘরে থাকতে হবে। তার চেয়ে মৃত্যুও ভালো। শাঙ্কো ভাবল ওকে ধরার আগেই ও পালাবে। লড়াই গোলমালে কে আর ওকে বন্দী করতে আসবে। তখন যে যার জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। কে আর ওর দিকে নজর দেবে? তবু ওর মন থেকে ভয় গেল না। কী হবে কে জানে।
ফ্রান্সিস কয়েদঘরে আছে–এটা শাঙ্কো শুনেছে। এবার ফ্রান্সিসের সঙ্গে একবার কথা বলতে হয়। এবার এরা কী করবে? ফ্রান্সিস কী ভেবেছে জানতে পারবে। ও নিজের কথাও বলতে পারবে।
পাহারাদার খাবার নিয়ে এল। খাবার খেতে খেতে শাঙ্কো বলল–একবার দলপতিকে ডেকে দাও না।
–এই রাতে উনি আসবেনই না। পাহারাদার বলল।
তবু বল ভাই যে আমি তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। শাঙ্কো বলল।
শাঙ্কো খাওয়া শেষ করল। পাহারাদার চলে যাচ্ছে তখন শাঙ্কো আর একবার দলপতিকে ডেকে দেওয়ার কথাটা বলল।
শাঙ্কো শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। যদি দলপতি আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝল দলপতি আসবে না। বৃথা প্রতীক্ষা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শাঙ্কো ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালের খাবার খাওয়া হয়েছে তখনই দলপতি ঢুকল। বলল–কী ব্যাপার আমার সঙ্গে তুমি দেখা করতে চেয়েছো কেন?
–আমাকে একটা অনুমতি দিতেই হবে। শাঙ্কো বলল।
–কীসের অনুমতি। দলপতি বলল।
–আমার এক বন্ধু কয়েদঘরে রয়েছে। বন্দী। শাঙ্কো বলল।
–ও। হা, হা একজন বিদেশী আছে বটে। দলপতি বলল।
–বন্ধুর সঙ্গে আমি কথা বলবো। অল্পক্ষণ। শাঙ্কো বলল।
–কী নিয়ে কথা বলবে। দলপতি বলল।
–কবে এখান থেকে চলে যাবো। গ্যালিগস বন্দর শহরে আমাদের জাহাজ নোঙর করে আছে। আমাদের জাহাজে যাবো। তারপর স্বদেশের দিকে যাত্রা শুরু করব। শাঙ্কো বলল।
–আগে দেখ–রাজা কী বলেন। তুমি না হয় ছাড়া আছে কিন্তু তোমার বন্ধু। তো কয়েদঘরে। ও তো ছাড়া পাবে না। সেনাপতি বলল।
বন্ধুকে মুক্তি দিতে রাজাকে রাজি করাবো। শাঙ্কো বলল।
–দেখ চেষ্টা করে। দলপতি বলল।
–এবার আমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দিন। শাঙ্কো বলল। দলপতি মাথা নিচু করে কী ভাবল। মাথা তুলে বলল–এরকম অনুমতি দেওয়া খুবই বিপজ্জনক। আমি তোমাদের দেখা করতে অনুমতি দিয়েছি এটা জানাজানি হলে আমি বিপদে পড়বো। সবচেয়ে ভালো হয় প্রহরীদের একজন নিমতা রাত বারোটার পর একা থাকে। নিমতাকে যদি রাজি করাতে পার তাহলে ও তোমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। এ ছাড়া অন্য কোনভাবে হবে না। দলপতি বলল।
–ঠিক আছে। আজকেই নিমতার সঙ্গে কথা বলবো। শাঙ্কো বলল।
–দেখ বলে। দলপতি চলে গেল।
শাঙ্কো নিজের ঘরে এল। কী ভাবে নিমতাকে পাওয়া যাবে? বিছানায় শুয়ে পড়ল শাঙ্কো। ভাবতে লাগল কীভাবে নিমতার সঙ্গে কথা বলবে।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর শাঙ্কো শুয়ে পড়ল। একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। শাঙ্কো ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম এল না।
রাত গভীর হচ্ছে। শাঙ্কো মাঝে মাঝেই উঠে দরজায় এসে দাঁড়াতে লাগল। নিমতা কখন একা হয়।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে বাইরে এসে দেখল নিমতা একা কয়েদঘরের সামনে বর্শা হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
শাঙ্কো একরকম ছুটে এল নিমতার কাছে। নিমতা শাঙ্কোকে দেখে অবাক–এত রাতে কে এল রে বাবা। পরক্ষণেই বুঝল বিদেশী লোকটা এসেছে। নিমতা বলল– কী ব্যাপার? এত রাতে এখানে এসেছো কেন? শাঙ্কো ডাকল–
–নিমতা?
—হুঁ বল। নিমতা বলল।
–আমার এক প্রাণের বন্ধু এইখানে বন্দী হয়ে আছে। শাঙ্কো বলল।
–হুঁ। নিমতা মুখে শব্দ করল।
–তার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই। শাঙ্কো বলল।
দলপতির লিখিত হুকুম এনেছো? নিমতা বলল।
–না। শাঙ্কো বলল।
তবে তো দেখা হবে না। নিমতা বলল।
–বলছি–নিমতা–ভাই তুমি এ কাজ না পারলে আর কেউ পারবে না। রাজা তোমার কথায় ওঠেন বসেন। শাঙ্কো বলল।
–এটা কোত্থেকে শুনলে? নিমতা বলল।
–এসব সবাই জানে। শাঙ্কো বলল।
–তা হতে পারে। অনেক ব্যাপারেই রাজা হুয়াল্পা আমার সঙ্গে কথা বলেন। এই যে শোনা যাচ্ছে রাজা আত্তারিয়া আমাদের দেশ আক্রমণ করবে এই নিয়েও রাজা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নিমতা বলল।
–তাহলে ভাই তুমি অনুমতিটা দাও। শাঙ্কো বলল।
–হুঁ। বারান্দায় এসে দাঁড়াও। সাবধান–এই ব্যাপারটা পাঁচকান না হয়। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে বারান্দায় উঠে দাঁড়াল।
–নাম কী? নিমতা বলল।
ফ্রান্সিস। শাঙ্কো বলল।
–ও। এবার গলা চড়িয়ে বলল–ফ্রান্সিস নামে কে আছো-দরজার কাছে এসো।
ফ্রান্সিস তখনও জেগে। রাতের ঘুমটা কমে গেছে। নিমতার ডাক শুনেই ও তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এল। মশালের আলোয় শাঙ্কোকে দেখে ফ্রান্সিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওঃ একটা সাংঘাতিক দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচলাম।
–বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না। শাঙ্কো বলল।
–তুমি কী করে বন্দীদশা এড়িয়ে গেলে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
লড়াইয়ের ব্যাপারে সংবাদ দিলাম। রাজা হুয়াল্পা খুব খুশি। আমাকে ভালোভাবে যোদ্ধাদের আবাসে আমার থাকার ব্যবস্থা করেছেন। শাঙ্কো বলল।
-বলেছো-সোমবার রাতে আত্তারিয়া আক্রমণ করবে? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ–সে সব বলেই বন্দীদশা এড়াতে পারলাম। শাঙ্কো বলল।
সময় হয়ে গেছে–সময় হয়ে গেছে নিমতা কথাটা বলতে বলতে বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল। দরজায় লোহার ফাঁকের মধ্যে দিয়ে শাঙ্কো হাত বাড়াল। ফ্রান্সিস ওর হাত চেপে ধরল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। শাঙ্কোর দু’চোখ জলে ভরে উঠল। ফ্রান্সিস দেখল সেটা। বলল–শাঙ্কো–মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ো না। মন শক্ত কর।
সময় হয়ে গেছে–সময় হয়ে গেছে–বলতে বলতে নিমতা তখনও পায়চারি করতে লাগল।
–ফ্রান্সিস–যাচ্ছি। খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। সোমবার রাতে যদি রাজা আত্তারিয়া আক্রমণ না করে তাহলে মিথ্যে কথা বলার জন্যে রাজা হুয়াল্পা আমাকে ফাঁসি পর্যন্ত দিতে পারে। শাঙ্কো বলল।
–যদি আক্রমণ না করে তুমি পালিয়ে যেও ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ–উত্তরের ভিসিয়াভো রাজ্যে চলে যাবো।
তাহলে চলি ফ্রান্সিস। শাঙ্কো বলল।
শাঙ্কো বারান্দা থেকে নেমে এল। চলল নিজের ঘরের দিকে। ফ্রান্সিস নিজের জায়গায় এসে শুয়ে পড়ল।
সোমবার এল। শাঙ্কো দুশ্চিন্তায়। কী হবে কে জানে। রাজা আত্তারিয়া তার যোদ্ধাবাহিনীকে নিয়ে রাজা হুয়াল্পার দেশ আক্রমণ করে কিনা এখন সেইটেই দেখার।
সারাদিন কাটল। সন্ধ্যে থেকে যোদ্ধাদের তোড়জোড় শুরু হল। লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত হল যোদ্ধারা।
ওর মধ্যেই ভাগ ভাগ করে যোদ্ধারা খেয়ে এল। শাঙ্কোও খেয়ে নিল।
রাত বাড়তে লাগল।
শাঙ্কো শুতে পারল না। একটা চেয়ে পাওয়া বর্শা হাতে নিয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। তারপর ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়ল।
বেশ কিছু পরে ভোর হল। পাখির ডাক শোনা গেল।
শাঙ্কোর একটু তন্দ্রামত এসেছিল। পাখির ডাক শুনে লাফ দিয়ে উঠল। বাইরে তাকিয়ে দেখল সেনাপতি ঘোড়ায় চেপে এসেছে। গলা চড়িয়ে সার বাঁধা যযাদ্ধাদের বলল–তোমরা সেনা ছাউনিতে গিয়ে বিশ্রাম কর। তবে খালি হাতে থেকো না। সঙ্গে বর্শা রাখবে। তরোয়ালও কোমরে ঝোলানো থাকবে যাতে আক্রান্ত হলে আমরা লড়তে পারি। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সেনাপতি বলল তোমাদের তরোয়াল চালানো শেখা হয়েছে বর্শা আর তরোয়াল দুটোই কাজে লাগবে। যাও। সেনাপতি থামল।
শাঙ্কো এবার তৈরি হতে লাগল। বাইরের দিকে চোখ রেখে কাপড়জামা বদলাল। দেখল–সকালের খাবার নিয়ে দুজন পাহারাদার আসছে।
শাঙ্কো আর দাঁড়াল না। আস্তে আস্তে মাঠ পার হল। রাস্তায় আসতেই শাঙ্কো খুব দ্রুত হাঁটতে লাগল। এক নজর পেছনে তাকিয়ে দেখল ওর ঘরের সামনে কোন যোদ্ধাই দাঁড়িয়ে নেই। ঠিক তখনই দেখল সেনাপতি ওর ঘরের সামনে এসেছে। সঙ্গে দু’জন যোদ্ধা।
শাঙ্কো প্রায় ছুটে চলল। এক নাগাড়ে হাঁটতে লাগল। একবারও থামল না।
দুপুর হতে শাঙ্কো একটা ছোট শহরমত জায়গায় এল। খাবারের দোকান হাতের কাছেই পেল। দোকানে ঢুকে বসল। কাজের ছেলেটা এল। শাঙ্কো রুটি মাংসের বড়া চাইল। ছেলেটি খাবার নিয়ে এল। ও পরপর দু গ্লাশ জল খেল। তারপর খাবার খেতে লাগল। খাবার শেষ। শাঙ্কো আরো খাবার চাইল। ছেলেটি দিয়ে গেল। সেটাও খেয়ে ফেলার পর ঢ ঢক্ করে আরো দু’গ্লাশ জল খেল। এবার উঠে দাঁড়াল। দোকান মালিকের কাছে এল। একটা সোনার চাকতি দিল। দোকান মালিক সোনার চাকরি রেখে ফেরৎ মুদ্রা দিল। বলল–আবার আসবেন। শাঙ্কো বলল– হ্যাঁ আসবো। এবার বলুন তো সামনে কোন রাজ্য আছে।
–ডিসিয়াডো।
–হেঁটে কতক্ষণে ওখানে পৌঁছবো? শাঙ্কো জানতে চাইল।
রাত হয়ে যাবে।
–হুঁ।
শাঙ্কো রাস্তায় নামল। এতদূর দ্রুতগতি রেখে হেঁটে এসে খুবই ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। হাঁটতে লাগল তবু।
যখন ডিসিয়াডো পৌঁছল, তখন বেশ রাত। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে একটা সরাইখানা পেল। সরাইখানায় ঢুকল। মালিক একটা পাটাতনে বসে আছে। হেসে বলল–আসুন।
–খাবো থাকবো। শাঙ্কো বলল। তারপর পাটাতনে বসল। মালিক উঠে দাঁড়াল।
–একটু খোঁজ নিয়ে আসি কেমন খাবার আছে। মালিক বলল। তারপর উঠে দাঁড়াল। ভেতরে চলে গেল। ফিরে এসে বলল–মাংস বেশি নেই। তরিতরকারির খাবার যা আছে বোধহয় আপনার হয়ে যাবে।
–আমি কোথায় থাকবো দেখিয়ে দিন। শাঙ্কো বলল।
মালিক শাঙ্কোকে নিয়ে পেছনের ঘরে এল। প্রায় ছ’সাতজন লোক পাটাতনে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। মালিক বলল–
–যেখানে খুশি শোবেন।
–হুঁ। আমি হাত মুখ ধুতে যাচ্ছি। এসেই যেন খাবার পাই। শাঙ্কো বলল।
নিশ্চয়ই পাবেন। মালিক দেখে বলল।
পেছনে জলের জায়গাটা মালিক শাঙ্কোকে দেখিয়ে দিয়েই চলে গেল।
শাঙ্কো বেশ ভালো করে হাতমুখ ধুলো। মুখে গলায় ধূলোয় ঢাকা ছিল যেন। শাঙ্কো আস্তে আস্তে ফিরে এল।
–আসুন–আসুন। মালিক একটা পাটাতন দেখিয়ে দিল। শাঙ্কো খেতে বসল। রুটির সঙ্গে মাংস খুব কমই দিল। শাঙ্কো ওসব আর ভাবল না। খেতে লাগল। এক দফা শেষ করে আবার খাবার চাইল। মাংস নেই। তরকারিমত জিনিস খেতে দিল। শাঙ্কো সেটাই গপ গপ্ খেতে লাগল।
খাওয়া শেষ। মালিক ওকে যে শোবার জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছিল সেখানেই শাঙ্কো এল। তারপর শুয়ে পড়ল।
লোকজনের কথাবার্তায় ওর ঘুম ভাঙল। শাঙ্কো উঠে বসল। হাতমুখ ধুয়ে সকালের খাবার খেতে খেতে মালিকের কাছে এল। বলল–এটাই তো ডিসিয়াডো দেশ।
হা। আপনি কোত্থেকে এসেছেন? সরাইওয়ালা জানতে চাইল।
–য়ুরোপ থেকে। শাঙ্কো বলল।
–বলেন কি? সরাইওয়ালা চমকে উঠল।
–আমরা নতুন নতুন জায়গায় যেতে ভালোবাসি। বিশেষ করে গুপ্তধনটনের। খোঁজ পেলে আমরা তা উদ্ধার করি। এরকম জীবনই আমরা ভালোবাসি। শাঙ্কো বলল।
–ও। তা আপনি একাই–সরাইওয়ালা বলতে গেল তার আগেই শাঙ্কো বলল–না-না। আমার বন্ধুরাও আছে। গ্যালিভাস বন্দরে আমাদের জাহাজ নোঙর করে আছে। আমরা গেলেই জাহাজ ভাসাবো স্বদেশের দিকে।
–ও। সরাইখানার মালিকের হাঁ মুখ বন্ধ হল।
ঘাসপাতার বিছানায় শুয়ে শাঙ্কো ভাবতে লাগল কী করবে এখন। রাজা আত্তারিয়া বা রাজা হুয়াল্পার দেশে যাওয়া অসম্ভব। আমাকে ধরতে পারলে ফাঁসিও দিতে পারে। একমাত্র উপায় পালিয়ে পালিয়ে গ্যালিগাস যাওয়া। কিন্তু ফ্রান্সিস মুক্তি পেলেই সব ভাবা যাবে। এখন জাহাজে ফিরে যাওয়ার চেয়েও প্রয়োজন উদিন্না পাহাড়ের সোনার খনি উদ্ধার করা। এই খনি আবিষ্কার না করে ফ্রান্সিস এক পাও যাবে না। তবে ফ্রান্সিসের অভিমত কী সেটা জানা না গেলে কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন সামনে একটাই কাজ–ফ্রান্সিসকে কয়েদঘর থেকে মুক্ত করা। কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব? ফ্রান্সিস অবশ্য একটা চেষ্টা করে মুক্তি আদায় করতে পারবে। শাঙ্কো জোরে একটা শ্বাস ছাড়ল। ও দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
সকালের খাওয়া খেয়ে শাঙ্কো তৈরি হল। রাজা রাজসভা সব দেখে আসি। শাঙ্কো মালিকের কাছে এল। বলল-রাজসভা দেখতে যাবো। কী করে যাবো?
–এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যান। যেতে যেতে ডানদিকে তাকাতে তাকাতে যাবেন-দেখবেন একটা মধুবিক্রির দোকান। থামবেন। দেখবেন কাঠ আর পাথরের তৈরি একটা বড় বাড়ি। ওটাই রাজবাড়ি।
যাই সব দেখেশুনে আসি। শাঙ্কো বলল। তারপর রাস্তায় এলো। মালিকের নির্দেশমত চলল। বেশ কিছুটা আসার পর দেখল একটা মধুর দোকান। বেশ ভিড় দোকানে।
এবার শাঙ্কো দোকানের উল্টোদিকে তাকাল। ঠিক। কাঠপাথর আর শুকনো ঘাসের ছাউনি। ও চলল। রাজসভার ফটকের কাছে দু’জন বর্শাধারী প্রহরী।
রাজসভাঘরে ঢুকতে যাবে তখনই একজন প্রহরী হাত বাড়িয়ে শাঙ্কোকে আটকালো। বলল–তুমি বিদেশী। এখানে কী চাই?
–আমি রাজসভা দেখতে এসেছি।
–হুঁ। যাও। প্রহরী ওকে ছেড়ে দিল।
শাঙ্কো রাজসভার কাছে এল। রাজার বিচার করা চলছে। রাজা একটু বয়স্ক। গায়ে ঢোলা আলখাল্লার মত দামি কাপড়ে তৈরি। গলায় দামি ছোট ছোট পাথর। মাঝখানে একটা মুক্তো বসানো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজসভার কাজ শেষ হল। শাঙ্কো চলল সদর দরজার দিকে। তখনই দেখল একজন প্রহরী ছুটে এল শাঙ্কোর কাছে।
–এই বিদেশী–প্রহরী ডাকল। শাঙ্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রহরীটা বলল—
–চল। মাননীয় রাজা ডাকছেন।
শাঙ্কো অবাক। এখানে তো সরাইওয়ালা ছাড়া আমাকে কেউ দেখেই নি। সেখানে স্বয়ং রাজা ওকে ডাকবে এতো কল্পনাই করা যায় না। শাঙ্কো বলল–চল।
রাজা ব্রাপেন-এর সামনে এসে শাঙ্কো মাথা একটু নোয়াল।
তুমি বিদেশি? রাজা ব্রাপেন জিজ্ঞেস করলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নাম শাঙ্কো। শাঙ্কো বলল।
তুমি কি এখানে একা এসেছো? রাজা বললেন।
–না। আমার বন্ধুরাও আছে। শাঙ্কো বলল।
–কী মতলব নিয়ে এসেছো? রাজা বললেন।
–আমরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেই ভালোবাসি। আর একটা কাজ আমরা করি কোন গুপ্তধনের খবর পেলে আমরা সেই গুপ্তধন উদ্ধার করি।
হুঁ। শোন আমার গুপ্তচরেরা ছড়িয়ে আছে। তাদের মারফৎ সব খবরই আমি পাই। যেমন–গতরাতে তুমি একটা সরাইখানায় ছিলে। তার কাছেও বলেছো যে তোমরা গুপ্তধন খোঁজো। তেমন খবর পেলেই তোমরা তা উদ্ধার করতে লাগো। ঠিক কিনা?
শাঙ্কো একটু অবাক হল। রাজা তাহলে ওদের খবরও জানে। বলল–
-হ্যাঁ। আপনি ঠিকই বলেছেন। শাঙ্কো বলল।
–তোমরা উদিন্না পাহাড়ের সোনার খনি আবিষ্কার করার চেষ্টায় আছো। রাজা বললেন।
–হ্যা–রাজা আত্তারিয়া এই খোঁজাখুঁজির ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবেন। শাঙ্কো বলল।
–সেই জন্যেই তোমাকে আমাদের কয়েদখনায় বন্দী করে রাখবো। রাজা বললেন।
–আমার বন্ধুরা তো আছে। শাঙ্কো বলল।
–আমি তাদের জানতেও দেব না। কেউ বুঝতেও পারবে না যে তুমি আসলে বন্দী। রাজা বললেন।
–ঠিক বুঝলাম না। শাঙ্কো বলল।
–মানে তুমি সকাল থেকে সারাদিন এখানে ওখানে নির্দেশমত কাজ করবে সন্ধ্যে হলেই কয়েদখানায় তোমাকে ঢোকানো হবে। রাজা বললেন।
-তারপর? শাঙ্কো বলল।
–কেউ বুঝতেও পারবে না তুমি বন্দী। রাজা বললেন।
–আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন কেন? শাঙ্কো বলল।
-না-না। তোমাকে মরতে দেওয়া হবে না। জীবিত তোমাকেই আমার প্রয়োজন। রাজা বললেন।
–আমি তো সোনার খনি সম্পকে কিছুই জানি না। শাঙ্কো বলল।
–জানবে। তোমাকে সময় আর সুযোগ দেওয়া হবে। রাজা বললেন।
শাঙ্কো কী করবে বুঝে উঠতে পারল না।
–সোনার খনি সম্পর্কে কী জানতে পেরেছো? রাজা বললেন।
–এটা আমার এক প্রাণের বন্ধু ফ্রান্সিস সব জানে ও। শাঙ্কো বলল।
–সে কোথায়? রাজা বললেন।
—রাজা হুয়াল্পার কয়েদঘরে। শাঙ্কো বলল।
–তোমাদের ফ্রান্সিসকে এখানে আনার ব্যবস্থা করছি। রাজা বললেন।
পারবেন? শাঙ্কো বলল।
রাজা হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন–কয়েদীঘরের প্রহরীরা সব যীশু না। একটা সোনার আধখানা চাকতি দিয়েই তোমার বন্ধু মুক্তি পাবে। আমি সেই ব্যবস্থা করছি। তুমি যদি চাও তোমার বন্ধুকে প্রহরী এখানে পৌঁছে দিয়ে যাবে। রাজা বললেন।
–না–না। ও একা এলেই হবে। আপনার রাজত্বে আসতে পারলেই হল। শাঙ্কো বলল।
–ঠিক আছে। তাই হবে। তোমার বন্ধু আসুক। তারপর গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য তোমাদের কাজে নামতে হবে। রাজা বললেন।
-বেশ। তবে আমার ঐ বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেই আমি আমাদের মত বলবো। শাঙ্কো বলল।
-খুব ভালো কথা।
রাজা ব্রাপেন আস্তে দুহাত দিয়ে শব্দ করলেন। একজন ন্যাড়ামাথা লোক রাজার কাছে এল। মাথা একবার নুইয়ে সম্মান জানাল।
–শোন–রাজা বললেন–এ একজন গুপ্তচর। অনেক কঠিন কঠিন কাজ করেছে। এবার ওকে বল তোমার বন্ধু কোন কয়েদঘরে বন্দী হয়ে আছে। দেখতে কেমন পোশাক কেমন এসব বলে দাও।
শাঙ্কো সব বলল। গুপ্তচর মাথা নেড়ে বলল–ঠিক আছে।
গুপ্তচর রাজা ব্রাপেনকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে চলে গেল।
শাঙ্কো অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। ও নিজে এখানে পড়ে আছে। ফ্রান্সিস একা। সহজে পালাতে পারবে না। সময় লাগবে। আর জাহাজে ফিরতে দেরি করা চলবে না। রাজকুমারী, বন্ধুরা দুশ্চিন্তায় পড়বে। যা হোক–এখন তো এই রাজা ব্রাপেন ফ্রান্সিসকে মুক্ত করিয়ে আনতে পারে কিনা দেখি।
ওদিকে দু’দিন পরে ফ্রান্সিস রাতে কয়েদঘরে শুয়ে আছে। রাত বাড়ছে। ওর ঘুম আসছে না এখন মাঝে মাঝেই ওর বিনিদ্র রাত কাটে।
রাত গভীর। ফ্রান্সিস চোখ বুজে শুয়ে আছে। হঠাৎ দেখল এক পাহারাদার আস্তে দরজা খুলল। পাহারাদার সোজা ওর কাছেই এল। মুখ নুইয়ে বলল–তুমিই তো ফ্রান্সিস?
–হ্যাঁ। কেন? কী ব্যাপার? ফ্রান্সিস বলল।
–আমার পেছনে পেছনে এসো। কোনরকম শব্দ করবে না।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। পাহারাদারের পেছনে পেছনে দরজার কাছে এল। পাহারাদারটি আস্তে দরজা খুলে দিল। দুজনে বাইরে এল। পাহারাদার বলল কোনরকম শব্দ না করে পালিয়ে যাও। ও দেখল একজন পাহারাদার পাথরের দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুচোখ বোঁজা।
ফ্রান্সিস বারান্দা থেকে নিচে নামল। তারপর দ্রুত প্রায় ছুটে চলল মাঠের শেষের দিকে। জ্যোৎস্না কুয়াশা ঢাকা। তার জন্যে আশপাশ সব অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
মাঠ ছাড়িয়ে রাস্তায় এল। ফ্রান্সিস বেশ হাঁপাচ্ছে তখন।
একসময় থামল। ভীষণ হাঁপাতে লাগল।
তখনই দেখল সেই প্রহরী ছুটে আসছে। গলা চড়িয়ে বলল–ভয় পাবে না। আমি বন্ধু।
ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে রইল। প্রহরী কাছে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–তুমি বিভাদাভিয়া যাবে। ঐখানে তোমার এক বন্ধু আছে।
–নাম কী? শাঙ্কো?
–তা জানি না। বিভাদাভিয়া যেতে হলে এই রাস্তা দিয়ে যাবে। এই একটা রাস্তাই সোজা গেলে বিভাদাভিয়া পাবে। এই রাস্তা ওখানেই শেষ। প্রহরী চলে গেল।
ফ্রান্সিস হাঁটতে লাগল।
যেতে যেতেই ভোর হল।
রোদ ছড়ালো। চারদিক আলোয় আলোময় হয়ে উঠল। চারদিকে টানা শস্যক্ষেত। চাষীদের বাড়িঘরদোর।
দুপুর হল। খিদেও পেয়েছে। জল তেষ্টাও পেয়েছে। এক চাষীর বাড়ির সামনে এল। দরজায় আস্তে শব্দ করল। ভেতর থেকে কে বলল–কে?
–আসুন। কথা হবে। ফ্রান্সিস বলল। দরজা খুলে গেল। এক মহিলা দাঁড়িয়ে। বলল–বলুন–কী কাজে এসেছেন।
–আমি বেশ দূর থেকে হেঁটে আসছি। যাবো বিভাদাভিয়া। বড্ড খিদে পেয়েছে। যদি
–আসুন–আসুন। আপনি আমাদের অতিথি। মহিলাটি সরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস ঢুকল। দরজা বন্ধ করে মহিলাটি এসে বলল–এই ঘরে আসুন। একটা ঘরে ফ্রান্সিস ঢুকল। কাঠের পাটাতন পাতা।
–শুয়ে বিশ্রাম করুন। মহিলাটি চলে গেল।
ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। সারারাত হেঁটেছে পরিশ্রম হবেই। একটা চিন্তা হল। আমি কত হাজার মাইল পার হয়ে এখানে এসেছি। কত রকম মানুষ দেখলাম। কত মানুষ আমাকে অতিথি বলে সাদরে গ্রহণ করেছে। দ্বীপ দেশ এর পার্থক্য আছে কিন্তু মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি দয়াহীন কুচক্রী মানুষ যেমন আছে তাদের চেয়ে হাজারগুণ ভালো মানুষেরাও আছে।
কিছুক্ষণ পরে মহিলাটি ফ্রান্সিসকে খেতে দিল। এক গোঁফওয়ালা মধ্যবয়সী লোক ঘরে ঢুকল। বলল-পেট পুরে খাবেন। পাতে যেন কিছু পড়ে না থাকে। ফ্রান্সিস হেসে বলল–আমি খুব ক্ষুধার্ত। আমাকে পেট পুরে খেতেই হবে।
খাওয়া শেষ। মহিলাটি বলল এবার একটু শুয়ে বিশ্রাম করে এখানেই থাকুন রাতটা।
–উপায় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে বিভাদাভিয়াতে পৌঁছুতে হবে। আচ্ছা–চলি। ভদ্রলোক বললেন–ফেরার পথে এখানে খেয়ে যাবেন।
-ঠিক আছে।
ফ্রান্সিস বাড়ির বাইরে এল। আবার হাঁটা। পরের দিনটাও পথে কাটল। সন্ধ্যের সময় বিভাদাভিয়ায় পৌঁছল। নগরে ঢুকছে তখনই একজন ওর কাছে এল। বলল–আপনি বিদেশি? ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল–হ্যাঁ।
–আপনি ফ্রান্সিস?
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।
–শাঙ্কো আপনার বন্ধু? লোকটি বলল।
–হা–শাঙ্কো কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।
–আমার সঙ্গে আসুন। লোকটি বলল।
–আপনি কে? মানে-ফ্রান্সিস বলল।
–ভয়ের কিছু নেই। আপনি আমাদের রাজা ব্রাপেন-এর অতিথি। লোকটি বলল।
–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস বলল।
একসময় দুজনে বড় মাঠটায় এল। চলল কয়েদঘরের দিকে। কয়েদঘরের কাছাকাছি পৌঁছতেই শাঙ্কো চিৎকার করে উঠল–ওহহহহ। ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। দুজনের চোখেই জল।
রাজা ব্রাপেন-এর কাছে খবর পৌঁছল। রাজা ব্রাপেন ঘোড়ায় চড়ে এলেন।
ফ্রান্সিসদের কাছে এসে ঘোড়া থামালেন। শাঙ্কোকে বললেন
কী? তোমার বন্ধুকে পেয়েছো?
–হ্যাঁ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শাঙ্কো বলল।
–আর কী চাও? রাজা ব্রাপেন জানতে চাইলেন।
–যোদ্ধাদের আবাসে আমাদের জন্যে একটা ঘর দিন। শাঙ্কো বলল।
–বেশ। আর কী চাও? রাজা ব্রাপেন জানতে চাইলেন।
–এখন কিছু চাইবার নেই। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাবো সব।
-বেশ। রাজা ব্রাপেন বিরাট মাঠটা পার হয়ে চলে গেলেন রাজবাড়ির দিকে। শাঙ্কো বলল।
দলপতিকে শাঙ্কো দেখল। দলপতি এগিয়ে এসে বলল–এবার তোমাদের একটা ঘর দিতে হবে। আমার সঙ্গে এসো।
দলপতি মাঠ পার হতে লাগল। পেছনে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো। দলপতি একটা ঘর দেখিয়ে বলল–এটাই তোমাদের ঘর। দলপতি চলে গেল।
ঘরে ঢুকল দুজনে। মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘর। ঘাসের বিছানায় বসল দুজনে। শাঙ্কো আস্তে আস্তে ওর সব কথা বলল। ফ্রান্সিস বলল–আমার তো কয়েদঘরে দিনরাত কেটেছে। বলবার মত তেমন কিছু নেই। তবে ঠিক বুঝছি না এই রাজা ব্রাপেন আমাকে নিয়ে এল কেন?
–আমি বলেছিলাম তাই।
–আমার মনে হয় রাজার নিশ্চয়ই কিছু কাজ আছে যেজন্যে আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন আছে।
–হ্যাঁ রাজা ব্রাপেনের লক্ষ্য–সোনার খনি দখল করা। ফ্রান্সিস বলল।
–এখনও তো সোনার খনির হদিশই পাওয়া গেল না। এখনই তার দখল চাই? শাঙ্কো বলল।
–সোনার লোভ বুঝতেই পারছো। এখন আমরা কী করবো? ফ্রান্সিস থামল। তারপরে বলল
সমস্ত ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে–এরকম–সোনার খনি উদ্ধার করতে চাইছে–এই রাজা ব্রাপেন আর হুয়াল্পা আর আত্তারিয়া। কিন্তু আমরা একটা নকশা পেয়েছি। একমাত্র রাজা হুয়াল্পাই আমাদের কাছ থেকে নকল নকশাটা পেয়েছে। অন্য দুজন কোন খোঁজই জানে না। ওরা চায় আমরা উদ্ধার করি আর সোনার খনি ওদের দিয়ে দিই। খনি উদ্ধার করতে পারলে কোন রাজাকে খনির, অধিকার দেব জানি না। তখন এই ব্যাপারটা নিয়ে সাংঘাতিক সমস্যা দেখা দেবে।
–তাহলে তুমি কীভাবে সমস্যার মোকাবিলা করবে। কোন পথে সমস্যাটার সমাধান করবে।
-ঠিক আছে–ঠিক কর কোন রাজার জন্যে আমরা খনি অনুসন্ধান করতে যাবো? ফ্রান্সিস বলল।
–খনি উদ্ধার করে এই রাজা ব্রাপেনকেই দাও।
–কিন্তু খনিটা রয়েছে উদিন্না পাহাড়ে। ঐ পাহাড়ের দক্ষিণভাগের রাজা আত্তারিয়া আর রাজা হুয়াল্পা উত্তরভাগের রাজা। এই রাজা ব্রাপেন উদিন্না পাহাড়ের থেকে বেশ দূরে রাজত্ব করেন। সোনার খনি উদ্ধার করে যদি এই রাজা ব্রাপেনকে দিই–এই রাজা ব্রাপেনকে হুয়াল্পার রাজত্বের মধ্যে দিয়ে আসতে হবে। রাজা হুয়াল্পা এই রাজা ব্রাপেনকে আসতেই দেবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–তা ঠিক। সোনার লোভ। শাঙ্কো বলল। একটু হেসে ফ্রান্সিস বলল– সমস্যার শেষ এখানেও নয়। আগে চল–খনি উদ্ধার করি। তারপর অবস্থাই বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে।
কিছু পরে দুজন প্রহরী খাবার নিয়ে এল। ফ্রান্সিসরা পেট পুরে খেল।
সন্ধ্যের সময় রাজা ব্রাপেন এলেন। ঘোড়ায় চড়ে। ঘোড়া থেকে নেমে ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢুকলেন। ফ্রান্সিস শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। রাজা ব্রাপেন বললেন– কী? তোমরা শলাপরামর্শ করেছো?
-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।
–কী সিদ্ধান্তে এসেছো? রাজা ব্রাপেন জানতে চাইলেন।
-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল–আমরা স্থির করেছি যে সোনার খনির সন্ধান শুধু আপনাকে দেব।
–আরো তো দুই রাজা রয়েছে। ব্রাপেন বললেন।
সোনার খনি উদ্ধারে তাদের কাছে কোন সাহায্য চাইবো না।
–সেটা সম্ভব নয়। উদিন্না পাহাড় ঐ দুই রাজা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। রাজা ব্রাপেন বললেন।
বলতে চাইছি–ঐ দুই রাজার অগোচরে আমরা সোনার খনি খুঁজবো উদ্ধার করবো। ফ্রান্সিস বলল।
–তা কি পারবে? রাজা বললেন।
–আমরা রাতের বেলা খুঁজবো। কেউ জানতেও পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
-দেখ চেষ্টা করে। ব্রাপেন ঘর থেকে চলে যেতে যেতে বললেন– সেনাপতিকে বলা আছে। উনি তোমাদের সবরকমভাবে সাহায্য করবেন।
ধন্যবাদ আপনাকে। শাঙ্কো বলল। রাজা ব্রাপেন চলে গেলেন।
ফ্রান্সিস বিছানায় বসল। শাঙ্কোও বসল। এবার শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস।
-বল?
এভাবে আগে থেকেই বলে সোনার খনির মালিকানা রাজা ব্রাপেনকে দিয়ে দিলে? শাঙ্কো বলল।
উপায় নেই। ব্রাপেন আমাদের সব ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। তাকেই সোনার খনির অবস্থান জানাবো। সোনার খনির উদ্ধারের পর কাকে মালিকানা দেব এই নিয়ে অনেক ভাবতে হবে। সেই ভাবনাটা আগেই শেষ করে রাখলাম। এখন বুঝে শুনে এগোতে পারবো। ফ্রান্সিস বলল।
–সমস্যাটা আছে একটা। সোনার খনি আছে উদ্দিন্না পাহাড়ে। ঐ পাহাড়ের রাজা দুজন–আত্তারিয়া আর হুয়াল্পা। ব্রাপেন নয়। সোনার খনির রহস্য মিটে গেলেও ব্রাপেন সব জেনেও কিছু করতে পারবে না। শাঙ্কো বলল।
-হ্যাঁ। এটা ঠিক। কিন্তু সোনার খনির হদিশ পেয়ে ব্রাপেন রাজা হুয়াল্পার রাজত্ব আক্রমণ করবে। হুয়াল্পাকে যুদ্ধে হারাতে পারলে সোনার খনি ব্রাপেনের হাতের মুঠোয় এসে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–যদি জেতে তবে তো। শাঙ্কো বলল।
–আছে আছে আরও পথ আছে। ব্রাপেন হুয়াল্পার সঙ্গের দল করবে। লক্ষ্য দুজনে মিলে রাজা আত্তারিয়ার রাজত্ব দখল করা। তখন সোনার খনি হাতে এসে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–সব জেনে হুয়াল্পা ঠিক সোনার খনির ভাগ চাইবে। তখনই হবে সমস্যা। দুই রাজার মধ্যে লড়াইও লেগে যেতে পারে। শাঙ্কো বলল।
–সেটা দুই রাজার ব্যাপার। ততদিন আমরা এখানে বসে থাকবো না। নিজেরা সব মিটিয়ে নিলে ভাল। তা না হলে লড়াই চলবে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। শাঙ্কোও শুয়ে পড়ল।
–আসল কথা তো খনি উদ্ধার। তারপর অন্যসব কথা। ফ্রান্সিস বলল।
–তা তো বটেই। এখন সোনার খনির খোঁজে নামতে হবে। আর দেরি করবো না। কালকেই চলো। দুপুরে খেয়েদেয়ে রওনা দেব। শাঙ্কো বলল। তারপর বলল–
কয়েকটা দরকারি জিনিস তো নিতে হবে।
-হ্যাঁ। মোটা দড়ি দুটো তেলেভেজা মশাল চকমকি পাথর। ফ্রান্সিস বলল। রাতের অন্ধকারে আমাদের সব কাজ সারতে হবে।
–একটা শস্যটানা গাড়ি পেলে ভালো হয়। শাঙ্কো বলল।
-ঠিক আছে। যাওয়া আসার ভাড়া দিলে মনে হয় ওরকম গাড়ি পাওয়া যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
পরদিন সকালের খাবার খেয়ে দুজনে বেরুলো দড়িটড়ি কিনতে। সেসব কেনা হল। এবার একটা শস্যটানা গাড়ি। বাজারের কাছেই দেখল ওরকম দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস শাঙ্কো গাড়োয়ানের কাছে গেল। গাড়োয়ান একজন এগিয়ে এল।
ফ্রান্সিস বলল–শোন ভাই আমরা দুজন আজ দুপুরে উন্নিা পাহাড়ে যাবো। তুমি নিয়ে যেতে পারবে?
অতদূর যাবো। আমাকে আবার ফিরতে হবে তো। গাড়োয়ান বলল।
–তোমাকে যাওয়া আসার ভাড়া দেব। শাঙ্কো বলল।
গাড়োয়ানটি হেসে বলল–যাবো। তবে রাস্তায় খাওয়া দাওয়া
–সব পাবে। একটা সোনার চাকতি দেব। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে আপনারা কখন আসবেন? গাড়োয়ান জানতে চাইল।
–দুপুরে খেয়ে দেয়ে। তুমি এখানে চলে এসো।
–ঠিক আছে। গাড়োয়ান মাথা কাত করে বলল।
দুজনে সৈন্যাবাসে ফিরে এল।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো দুপুরের খাওয়াটা তাড়াতাড়ি করল। দরকারি সব জিনিস নিল। সৈন্যদের ব্যবহারের জন্যে একটা চামড়ার থলি দেওয়া হয়। শাঙ্কো সেটাই দলপতির কাছে চাইল। দলপতি ওরকম থলি পাঠিয়ে দিল। থলিতে ভরা হল সব।
তখনই দলপতি ঘরে ঢুকল। বলল–তাহলে আপনারা যাচ্ছেন।
–হ্যাঁ। শাঙ্কো বলল।
–কীভাবে যাচ্ছেন? দলপতি জানতে চাইল।
–রাজা হুয়াল্পার রাজত্বের মধ্যে দিয়ে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে কীসব খনিটনির কথা শুনলাম সেখানে যাবেন না? দলপতি জানতে চাইল।
–ন্নাঃ! এখন তো নয়। দেখি পরে সময় পেলে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে চলল বাজারের দিকে। বাজারে এসে দেখল গাড়োয়ান গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে হাসল।
আগে গাড়িতে চামড়ার থলিটা রাখল। তারপর দুজনে গাড়িতে উঠল। ফ্রান্সিস বলল–এরকম গাড়িতে একবার চড়বার প্রয়োজন পড়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে মনে হল গায়ের হাড়টার যেন খুলে গেছে।
–এটা তো শস্যটানা গাড়ি। এই গাড়িতে একমাত্র শস্যই থাকে। সেখানে মানুষ চড়লে তো বিপত্তি হবেই।
গাড়োয়ান গাড়ি ছেড়ে দিল। খোয়া ফেলা রাস্তা দিয়ে ঠকাষ্ঠক্ শব্দ করতে করতে গাড়ি চলল।
সন্ধ্যের মুখে। শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস–একটু নেমে দাঁড়াই। গায়ের সব হাড় ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ফ্রান্সিস হেসে উঠল। এখনও অনেকটা যেতে হবে। হয়তো আর নামাই হবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–না না। রয়ে সয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে যাবো। শাঙ্কো বলল।
–দেখা যাক কোন বাজার টাজার পাই কিনা। ফ্রান্সিস বলল।
তখনই গাড়িটা একটা বাজারের কাছে এল। দুচারটে দোকান। সব দোকানে মোটা মোমবাতি জ্বলছে। শাঙ্কো বলল–গাড়োয়ান ভাই দেখো তো খাবারটাবার কিছু পাওয়া যায় কিনা।
গাড়োয়ান গাড়ি থামাল। নেমে খোঁজ নিতে গেল। একটু পরে ফিরে এসে বলল–গোল কাটা রুটি আর মাংসের বড়া পাওয়া যাচ্ছে।
শাঙ্কো কোমর থেকে একটা ছোট সোনার চাকতি বের করল। গাড়োয়ানকে বলল–ছটা রুটি আর ছটা মাংসের বড়া আনো।
তিনজনেরই খিদে পেয়েছে বেশ। গাড়োয়ান পাতায় করে খাবার নিয়ে এলো। তিনজনেই গোগ্রাসে খেতে লাগল। শাঙ্কো নিচে নেমে ঘুরে ঘুরে খাবার খেল।
আবার গাড়ি চলল।
রাত হল।
ফ্রান্সিস বলল–রাত বেশি হবার আগেই খেয়ে নিতে হবে। বেশি রাত হলে কোথাও দোকান খোলা পাবো না।
গাড়ি চলল।
ফ্রান্সিস গাড়োয়ানকে বলল–ও ভাই–একটু নজর রেখো–কোথাও বাজার টাজার দেখতে পাও কিনা।
গাড়ি চলল।
গাড়োয়ান বলল–সামনেই বেশ বড় বাজার।
–থামাও। শাঙ্কো বলল।
গাড়ি থামল। তিনজনেই নামল। বেশ বড় খাবারের দোকান পেল। দোকানে ঢুকল। বেশ ভিড়। একটা পাটাতনে বসল। দুটো করে সেদ্ধ ডিম আর মাখন দিয়ে ভাজা রুটি। সুস্বাদু খাবার। তিনজনেই পেট পুরে খেল।
সবাই গাড়িতে উঠল। আবার গাড়ি চলল।
সারারাত গাড়ি চলল। ঘোড়াটাকে খেতে দেওয়া হল।
পরের দিন দুপুর নাগাদ গাড়ি রাজা হুয়াল্লার রাজত্বে পৌঁছল। ফ্রান্সিস দুপুরের খাওয়া খেয়ে এই গাড়িতেই উদিন্না পাহাড়ের তলায় যেতে চাইল। কিন্তু শাঙ্কো বলল–রেহাই দাও ভাই। আমি বাকি রাস্তা হেঁটে যাবো।
–বেশ তাই চলো। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস গাড়ি থামাল। নামল দুজনে। ফ্রান্সিস গাড়োয়ানকে প্রাপ্য মূল্য দিল।, গাড়োয়ান গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
দুজনে সদর রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলল! বেশ বেলা হয়েছে। খিদেও পেয়েছে।
একটা বেশ বড় সরাইখানা পেল। ঢুকল দুজনে। সরাইওয়ালা ওদের দেখে বলল–আসুন। ভালো খাবেন, ভালো থাকবেন।
ওদের পাটাতনে জায়গা দেখিয়ে সরাইওয়ালা বলল–এখানে বিশ্রাম করুন। খাবেন তো?
নিশ্চয়ই। একটু তাড়াতাড়ি। শাঙ্কো বলল।
দুজনে বসল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিসদের তাড়াতাড়িই খেতে দেওয়া হল।
দুজনেই পেট পুরে খেল।
পাটাতনে দুজনে শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চোখ বুজে শুয়েছিল। হঠাৎই চোখ খুলল। বলল-শাঙ্কো।
-বলো।
–এত ছুটোছুটি করছি। সোনার খনি খুঁজে পাবো? ফ্রান্সিস বলল।
–চেষ্টা তো করি। দেখা যাক। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না।
ঘরে নতুন একজন ঢুকল। শাঙ্কো মোমবাতির আলোয় দেখল রাজা ব্রাপেনের দলপতি। ব্যবসায়ীর পোশাকে। ফ্রান্সিস তখনও চোখ বুজে আছে। দেখে নি। শাঙ্কো দ্রুত উঠে বসল। দলপতি হেসে বলল–
–আমিও এখানে উঠেছি। দলপতির গলা শুনে ফ্রান্সিস চোখ খুলল। দলপতিকে দেখে ফ্রান্সিসও অবাক। দলপতি পাটাতনের বিছানায় বসল। বলল– সেনাপতিরই আসার কথা ছিল। উনি একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে আসতে হল।
–আপনি কেন এসেছেন? শুয়ে থেকেই ফ্রান্সিস বলল
মাননীয় রাজা বললেন–তোমাদের সঙ্গে থেকে তোমাদের সাহায্য করতে। দলপতি বলল।
–আমাদের সাহায্যের দরকার নেই। শাঙ্কো বলল।
–এ কি একটা কথা হল। আপনারা কত কষ্ট করে খনি আবিষ্কার করতে এসেছেন। আপনাদের সাহায্য না করলে চলে। দলপতি বলল।
-বলছি তো আমাদের আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই। শাঙ্কো বলল।
–ঠিক আছে। ব্যাপারটা হল আপনারা আপনাদের কাজ করবেন। আমি শুধু দেখবো। খনি আবিষ্কার হলে কীভাবে সেটা করলেন এটা জেনে রাখা। আপনারাই বলেছেন খনির মালিকানা আমাদের মহামান্য রাজা ব্রাপেনকে দেবেন। দলপতি ই বলল।
-হ্যাঁ। বলেছি। সে কথা আমরা রাখবো। ফ্রান্সিস বলল।
তবে আমাকে কেন সরিয়ে দিতে চাইছেন? দলপতি বলল।
–ঠিক আছে। চলুন আমাদের সঙ্গে। কিন্তু কোন কারণেই আমাদের বিরক্ত করবেন না। ফ্রান্সিস বলল।
–না–না। আমি গাছের গুঁড়ির মত চুপ করে থাকবো। আমার শুধু জানার দরকার কীভাবে উদ্ধার করলেন। দলপতি বলল।
–হুঁ। যা বললাম, মনে রাখবেন। ফ্রান্সিস বলল।
–নিশ্চয়ই। দলপতি বেশ জোর দিয়ে বলল।
এবার দলপতি বলল–আমার ঘোড়াটার দানা পানির ব্যবস্থাটা করে আসি।
দলপতি চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল।
ফ্রান্সিস ও শাঙ্কো আর কোন কথা বলল না। দলপতি হুঁড়ি ফুলিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে রইল। একটু পরেই নাক ডাকতে শুরু করল।
ফ্রান্সিস উঠে বসল। শাঙ্কোও উঠে বসল। ফ্রান্সিস বলল–এই অশ্বডিম্ব তো ঘুম থেকে উঠবেই না।
আমি ঘুমোই নি। দলপতির ভাঙা গলা শোনা গেল।
ফ্রান্সিসরা হতবাক।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো আবার শুয়ে পড়ল। দলপতির নাক ডাকা বন্ধ হয়েছে।
ঘণ্টা খানেক পরে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো উঠে বসল। তৈরি হতে লাগল। কী করে দলপতি বুঝল সেটা। সে উঠে বসল। বলল–এখনই যাচ্ছেন?
–হ্যাঁ। শাঙ্কো বলল।
–দলপতি উঠে দাঁড়াল।
–কোথায় যাবেন? দলপতি বলল।
–আপনাকে বলেছি না যে চুপ করে থাকবেন। শাঙ্কো বলল।
–ঠিক আছে ঠিক আছে। দলপতি মাথা এপাশ করে বলল।
শাঙ্কো চামড়ার থলিটা নিল। তিনজনে চলল। প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটার পর উদিন্না পাহাড়ের নিচে এল। রাস্তায় নেমেই ফ্রান্সিস লক্ষ্য করেছে চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। চারদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো ঘুরে দেখতে হবে কোন কোন গাছের ডাল আমি ভেঙে রেখেছি। ওরা খুঁজতে শুরু করল। পেল একটা বড় গাছ। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর থলে থেকে দড়ি বের করল। শাঙ্কোকে বলল–দড়িটার এক কোণা গাছটার কাণ্ডে জড়াও। শাঙ্কো তাই করল। ফ্রান্সিস দড়ির অন্য মুখ টেনে নিয়ে চলল। পাহাড়ের গায়ের পাথরের স্কুপের ওপর রাখল। কিন্তু এখানে ছোট ছোট পাথরই বেশি।
ফ্রান্সিস ফিরে এসে বলল–এখানে পাথরের চাঁই নেই। সবই ছোট পাথরের টুকরো।
ফ্রান্সিসরা আবার চলল পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে।
আবার চলা শুরু করল দুজনে। পেছনে দলপতি। দলপতি বুঝে উঠতে পারছে না। ওরা এটা কী করছে। তবু কোন প্রশ্ন না করে চুপ করে রইল।
আর একটা ডালভাঙা গাছ পাওয়া গেল। চেস্টনাট গাছ। গাছটার কাণ্ডে শাঙ্কো দড়ি ধরল। অন্য মুখটা নিয়ে ফ্রান্সিস পাহাড়ের ধারে হেঁটে হেঁটে উঠতে লাগল। তখনই ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল বেশ কয়েকটা বড় বড় পাথরের চাই আছে। ফ্রান্সিস দড়ির মুখটা নিয়ে প্রথমে পাথরের চাইয়ের ওপর উঠল। দড়িটা টান করে ধরে প্রথম পাথরের চাই পেল দুটো। তার প্রথমটায় একবার ধরল। কিন্তু দড়িটা বেঁকে যাচ্ছে। ঠিক সোজা সমান হচ্ছে না। আর কিছুটা উঠল। দেখল একটা ছোট চাই। দড়িটা সোজা করল ফ্রান্সিস। দড়িটা টানা লম্বালম্বি হল। এই চাইটা একেবারে চেস্টনাট গাছের সঙ্গে লম্বালম্বি।
তখনই ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল। শাঙ্কো দলপতিকে ধরে টেনে গাছের আড়ালে নিয়ে গেল। ফ্রান্সিস পাথরের চাইটার ওপর শুয়ে পড়ল।
রাজা হুয়াল্পার দু’জন পাহারাদার ঘোড়া চালিয়ে চলে গেল।
ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলল–বোধহয় পাথরের চাইটা পেয়েছি। এখানে এসো। শাঙ্কো দড়ি নিয়ে এল। দলপতি এসে ওদের পেছনে দাঁড়াল। ঔৎসুক্য চেপে রাখতে পারল না। বলে ফেলল–শুধু তো দড়ি টানাটানি করছেন। সোনার খনি কোথায়? ফ্রান্সিস শাঙ্কো কোন কথা বলল না।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো পাথরের চাঁইয়ের খাঁজে ধরে পাথরের চাইটা তুলতে লাগল। কিছুটা তুললও। কিন্তু ছেড়ে দিতে হল। বেশ ভারি। এবার শাঙ্কো দলপতিকে বলল–হাত লাগান। দলপতি এগিয়ে এল। এবার তিনজনে মিলে চাইটা তুলতে লাগল। আস্তে আস্তে চাইটা উল্টে যেতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল– একসঙ্গে টানো। সময় নিয়ে গলা একটু নামিয়ে বলে উঠল–ওল্টাও। পাথরের চাইটার ওপরে গোল চিহ্ন কুঁদে তোলা নেই।
তিনজনেই কমবেশি হাঁপাতে লাগল। শাঙ্কো বলল–আমাদের হিসেবে ভুল হয়ে গেছে।
–কোন জায়গায় ভুল হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল।
–কী ভুল হয়েছে? শাঙ্কো বলল।
–সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।
–আবার দড়িটা গাছ থেকে লম্বালম্বি টানি। দেখা যাক কোন পাথরের চাইয়ের মাথায় দড়িটা লাগছে কিনা।
–বেশ। দেখ। শাঙ্কো বলল।
আবার গাছটা থেকে দড়ি টানা হল। আবার সেই উল্টে ফেলা পাথরের চাঁইয়ে এসে লাগল। কিন্তু সেই পাথরের বুকে কোন চিহ্ন নেই। ফ্রান্সিস বলে উঠল– নকশা দেখেই ভেবেছিলাম গাছ আর পাথরের চাইয়ের মধ্যে যোগ আছে। এছাড়া অন্য কোনভাবেই খনিতে পৌঁছোনো যাবে না।
–গাছটা কি আমরা ঠিক চিনেছি? শাঙ্কো বলল।
-হ্যাঁ। নকশায় আঁকা হয়েছে একটা ছোট গাছ। কতদিন আগের কথা কে জানে। ছোট গাছটি আর ছোট নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল। এবার দলনেতা বলল-এইসব এলাকায় দেখেছি এক ধরনের গাছ আছে যাদের বাড় নেই। ঐ পাঁচ ছয় হাত। তার বেশি কখনও বাড়ে না।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবল। তারপর মুখ তুলে বলল–সেই বামন গাছ কি এখানেও আছে?
–নিশ্চয়ই আছে। এই অঞ্চলেই আছে। অন্য কোথাও ঐ বামন গাছ দেখি নি। দলপতি বলল।
–আবার সব নতুন করে ভাবতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–অমনি বামন গাছ তো এখানেও থাকতে পারে। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস বলল”–নিশ্চয়ই আছে। নকশায় একটা চারাগাছের মত গাছ আছে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর চাইয়ের ওপর দিয়ে নামতে নামতে বলল–চল সেই বামন গাছ খুঁজতে হবে।
তিনজনেই পাথরের চাই থেকে নেমে এল। পাহাড়ের ধার দিয়ে বামন গাছ খুঁজতে লাগল। একটা ছোট গাছ পেল। ফ্রান্সিস দলপতিকে জিজ্ঞেস করল–এটা কি বামন গাছ?
দলপতি দেখেটেখে বলল–না। আরো দেখুন।
চলল বামন গাছের খোঁজ। একটা ছোট গাছ একটু দূর থেকে দেখে শাঙ্কো বলে উঠল–ঐ যে বামন গাছ। রাস্তার ধারে।
ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। গাছটা দেখল। এবার নিশ্চিত হল। এটা একটা বামন গাছ। পাতা ঝরে গেছে। শুকনো ডালগুলো উঁচিয়ে আছে। ফ্রান্সিস একবার চোখ বুজল। চোখ খুলে বললনকশায় ঠিক এরকম গাছই আঁকা। শাঙ্কোকে ডেকে বলল–এই গাছটায় দড়ির একটা দিক ধর। শাঙ্কো তাই করল। ফ্রান্সিস দড়ি টেনে নিয়ে চলল। পাহাড়ের ধারে উঠল। মাত্র একটা বড় পাথরের চাই পেল। বাকি সব ছোট ছোট পাথরের টুকরো।
ফ্রান্সিস পাথরের চাইটা ঘুরে ঘুরে দেখল। তারপর দড়িটা রেখে পাথরের চাইটায় হাত লাগাল। শাঙ্কোও হাত লাগাল। দুজনে চাইটা ওঠাবার চেষ্টা করল। পারল না। একটু উঠেই চাইটা পড়ে গেল।
দলপতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল।
শাঙ্কো দলপতিকে বলল–আসুন। হাত লাগান। হাতে ধুলো না লাগিয়ে সোনার খনি পাবেন তা হয় না। দলপতি এল। এবার তিনজনে মিলে পাথরের চাইটা টানল। আস্তে আস্তে পাথরের চাইটা শব্দ করে উঠে গেল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল স্পষ্ট কুঁদে-তোলা দাগ। ঠিক চিহ্নটা পাওয়া গেল।
এবার ফ্রান্সিস চামড়ার ঝোলা থেকে চকমকি পাথর বের করল। একটা মশালও বের করল। অন্য মশালটা শাঙ্কোকে দিল। বেশ হাওয়া বইছিল। তার মধ্যেই ফ্রান্সিস চমকি ঠুকে আগুন জ্বালল। মশাল জ্বলে উঠল। শাঙ্কোর হাতের মশালটাতেও আগুন ধরিয়ে দিল।
ফ্রান্সিস দড়ির এক মাথা কোমরে বাঁধল। তারপর জ্বলন্ত মশালটা গুহার অন্ধকার গর্ভে ছুঁড়ে দিল। একটু ভেতরে মশালটা পড়ল। দেখা গেল গুহামত। একজন মানুষ ঢুকতে পারে এরকম গুহা।
ফ্রান্সিস গুহামুখ দিয়ে নামতে লাগল। মশালটার কাছে পৌঁছে আবার মশালটা ছুঁড়ল। মশালটা পড়ে গেল। ফ্রান্সিস বুঝল মশালটা নিচে কোথাও পড়ে গেল। নিশ্চয়ই নিচে গহুরমত কিছু আছে। ফ্রান্সিস বুক দিয়ে প্রায় হিঁচড়ে টেনে চলল। বুকে পিঠে এবড়ো খেবড়ো পাথরের গা লাগছে। কেটেও গেছে বোধহয়।
কিছুটা এগোতেই দেখল গুহা। নিচে একটা গোলামত জায়গা। মশালটা ওখানেই পড়েছে। ফ্রান্সিস গুহামুখ থেকে বেরিয়ে গোলমত জায়গাটায় নামল। বেশি নিচে নয়।
ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ হাঁপালো। ততক্ষণে শাঙ্কোও নেমে এল। দলপতি নামল না। অবশ্য দলপতি ওর ভুড়ি আর মোটা শরীর নিয়ে গুহার মধ্যে দিয়ে আসতে পারতো না। তাই ও নিজেই সাহস করে নামেনি।
দুজনে জ্বলন্ত মশাল তুলে ধরল। দেখা গেল ডানপাশে একটা বড় ঘরের মত জায়গা। দুজনে মশাল নিয়ে সেখানে ঢুকল। দেখল একপাশে স্তূপীকৃত পিণ্ডের মত। একটা পিণ্ড তুলে নিল ফ্রান্সিস। একটা পিণ্ড তুলল। মশালের আলোয় পাথরের গায়ে সোনালি গুঁড়ো চিক্ চিক্ করে উঠল। বুঝল–পাথরের গায়ে গুঁড়ো সোনা। এইসব পাথরের গায়ের সোনা পাথর গালিয়ে বের করা হয়।
ফ্রান্সিস হেসে বলল–শাঙ্কো এইসব পাথর গালালেই সোনা পাওয়া যাবে।
পাথরের স্তূপ দেখে ডানদিকে ঘুরল। দেখল সোনার পিণ্ড ডাঁই করে রাখা। মশালের আলো পড়তে পিণ্ডমত সোনা চিচিক্ করে উঠল।
শাঙ্কো হেসে ধ্বনি তুলল–ও–হো–হো। ফ্রান্সিস বলে উঠল–কী পাগলামি করছে। এখানে সামান্য শব্দ হলেও ওপরে শোনা যাবে।
এখন কী করবে? শাঙ্কো বলল।
–ওপরে উঠবো।
–এত সোনা–নেবে না? শাঙ্কো বলল।
–হ্যাঁ। জামা খোল। জামায় যতগুলি পিণ্ড নেওয়া যায় ততটাই নাও।
দুজনে জামা খুলল। সোনার পিণ্ডমত যা পাওয়া গেল তাই ভোলা জামায় বেঁধে দিন।
দুজনে মশাল নিয়ে গুহামুখের দিকে চলল। মশাল ছুঁড়ে দিয়ে প্রথমে ফ্রান্সিস গুহায় ঢুকল। মশালের কাছে গিয়ে আবার ছুঁড়ে দিল মশালটা। সেই আলোয় বুক পিঠ বাঁচিয়ে আস্তে আস্তে উঠতে লাগল। গায়ে জামা নেই। এবড়ো খেবড়ো পাথরের ঘষা খেল। কেটে গেল পিঠ বুক। রক্ত পড়তে লাগল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো দুজনেরই এক হাল।
গুহামুখ থেকে দুজনে বেরিয়ে এল। দেখল ওল্টানো পাথরে দলপতি বসে আছে। ওরা উঠতেই দলপতি এগিয়ে এল। বলল–সোনার খনি পেয়েছেন?
–হু। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। সোনার একটা পিণ্ড জামার পুটুলি থেকে বের করে দলপতিকে দিল। চাঁদের আলোয় সোনার পিণ্ডটা ঝিকমিক্ করে উঠল। দলপতির মুখ হাঁ।
ফ্রান্সিস বলল–এখানেই পিণ্ডগুলো চামড়ার ঝোলায় ঢেলে রাখা। দুজনেই চামড়ার ঝোলায় সব সোনার পিণ্ড ঢেলে রাখল। ফ্রান্সিস একটা সোনার পিণ্ড দলপতিকে দিল। বলল–জামার ভেতরে রাখুন। দলপতি খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
–এবার পাথরের চাঁই ওল্টাতে হবে। হাত লাগাও। ফ্রান্সিস বলল।
তিনজনে পাথরের চাইটা ঠেলে তুলে গুহামুখে উল্টে রাখল। গোল দাগটা ঢাকা পড়ে গেল।
ফ্রান্সিস দলপতিকে বোঝাল–গুহার মুখটা পাথরের চাই দিয়ে ঢেকে দিলাম। গোল দাগটা দেখা যাবে না। আমরা ঐ গুহামুখ থেকে গুহা পার হলাম। বেশ সরু গুহা। তবে বুক দিয়ে হেঁচড়ে হেঁচড়ে যাওয়া যাবে। তারপরেই একটা বড় জায়গা। একটা বেশ বড় ঘরের মত। প্রথমে পাওয়া যাবে স্তূপীকৃত সোনা মেশানো পাথর। সেইগুলো আর এক দফা গলালে সোনা পাওয়া যাবে। অঢেল সোনা।
ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলল–বাঁদিকে একটা ঘরমত পাবেন। ওখানে পাথরগুলো থেকে সোনার পিণ্ড তৈরি করে রাখা হয়েছে। স্থূপীকৃত পড়ে রয়েছে সেইখান থেকে আমরা কিছু সোনার পিণ্ড নিয়েছি। এবার অসংখ্য সোনার পিণ্ড পাবেন। এই হল সোনার খনির রহস্য।
দলপতি মুখ হাঁ করে শুনল।
-সরাইখানায় চলো। ফ্রান্সিস বলল। ভোর হল। ভোরের নিস্তেজ রোদ ছড়ানো চারপাশে। একটা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল।
ফ্রান্সিস গাছটার কাণ্ড থেকে বাঁধা মোটা দড়িটা খুলে নিয়ে ঐ গাছটার তলাতেই বসল। চকমকি পাথর মশাল সব গাছটার নিচে রেখে দিল। তারপর গাছটার একটা ভাঙা ডাল দেখিয়ে বলল–একটা ডালভাঙা গাছ। এটা দেখলেই বুঝবেন এখানেই আছে সোনার খনি। একটু হেসে বলল
চলো–সরাইখানায় যাবো।
তিনজনে চলল শহরের দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরে এলো।
সরাইখানায় উঠল।
সকালের খাবার খেতে খেতে শাঙ্কো দলপতির দিকে তাকিয়ে বলল–এখন আপনি কী করবেন?
–দুপুরের খাবার খেয়ে আমি আমার রাজত্বে চলে যাবো। এখানে কী কী করেছি গুপ্ত সোনার খনি আপনারা কীভাবে পেলেন–সেসব মহামান্য রাজাকে বলবো। তারপর মহামান্য রাজা যা করতে চান করবেন। আমার কর্তব্য এইটুকুই ছিল। তা আমি পালন করেছি। দলপতি বলল।
ফ্রান্সিস ডাকল–শাঙ্কো–আমরা কী করবো। যে কাজটা করবো বলে স্থির করেছিলাম তা তো হয়ে গেল।
-চলো আমরাও দুপুর নাগাদ বেরিয়ে পড়ি। একটা শস্যটানা গাড়ি পেলে ভালো হত। খুব তাড়াতাড়িই গ্যালিগস বন্দর শহরে পৌঁছে যেতাম।
-না-না, মাফ কর ফ্রান্সিস। শস্যটানার গাড়িতে আমি আর উঠছি না। কী অবস্থা হয়েছিল আমার। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল–ঠিক আছে–হেঁটে চল। কিন্তু অনেক দেরি হবে পৌঁছোতে।
–হোক। গাড়িতে যাবো না। শাঙ্কো বলল।
–বেশ বাবা তাই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
দুপুরের খাওয়া খেল তিনজনে। ফ্রান্সিসরা একটু শুয়ে বসে বিশ্রাম করল। দলপতি আর বসল না। নিজের দেশের দিকে রওনা হল। ঘোড়াটা এক ছোকরা নিয়ে এল। সেনাপতি তাকে কিছু মূল্য দিল।
–আপনার রাজাকে বলবেন সোনা বিক্রি করে উনি অনেক অর্থ পাবেন। ঐ সব অর্থ দিয়ে গরীব প্রজাদের উন্নতির জন্য ব্যয় করবেন। দলপতি হেসে বলল– বলবো। দলপতি ঘোড়ায় উঠলেন। উত্তরমুখো ঘোড়া ছোটাল।
কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রান্সিসরাও তৈরি হল। সব গোছগাছ করে রাস্তায় এলো। শেষ দুপুরে রওনা হল গ্যালিগস বন্দর শহরের দিকে।
বেশ রাত তখন। ফ্রান্সিসদের ভাগ্য ভাল। একটা ছোট বাজারমত পেল। একটি কি দোকানে রুটি মধু পেল। দুজনে পেট পুরে রুটি খেল। দারুণ খিদে পেয়েছিল। খিদে মিটল। রাতের খাওয়াটা হয়ে গেল। খেয়েটেয়ে শাঙ্কো বলল-চলো দেখি রাতে কোথাও থাকার জায়গা পাওয়া যায় কিনা। এই দোকান সেই দোকানে জিজ্ঞেস করল। একজন দোকানদার বলল–একটু দূরে একটা ওক গাছের নিচে, একটা মাংস ডিমের দোকান আছে। ওরা কিছু মূল্যের বিনিময়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। গিয়ে দেখুন।
মুরগী ডিমের দোকান খুঁজে পেল। দোকানদারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দোকানদারের চেহারা লিকলিকে। কিন্তু গলার স্বর গম্ভীর। বলল–কী চান? মুরগী না ডিম।
–আমরা কিছুই চাই না। শুনলাম আপনার কাছে নাকি খালি ঘরটর আছে। অর্থের বিনিময়ে রাত কাটাবার ব্যবস্থা করে দিন। ফ্রান্সিস বলল।
–আপনারা রাত কাটাবার জায়গা পাচ্ছেন না–এই তো। দোকানি বলল।
–হ্যাঁ। মড়ার মত ঘুমোবো। কারো কোন অসুবিধার সৃষ্টি করি না।
–ঘুমের মধ্যে নাক ডাকো? দোকানি বলল।
–না। শাঙ্কো মাথা নাড়ল।
–বলছেন। কিন্তু নাক ডাকলেই বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো। দোকানি বলল।
বেশ তো। শাঙ্কো হেসে বলল।
তাহলে আসুন। দোকানি বলল।
দোকানদার দোকানের পেছনে এল। দোকানের লাগোয়া একটা ঘর। বুনো খড়ে তৈরি।
ঘরের মধ্যে ঢুকল দোকানি। মোমবাতির আলোয় দেখা গেল তিন চারজন লোক শুয়ে বসে আছে। ওপাশটা খালি। ওখানে দুটো কাঠের পাটাতন পাতা। জায়গাটা দেখল। দোকানদার গম্ভীর গলায় বলল–এই জায়গাটায় থাকবেন। ভাড়াটা আগে দিন। দুটো লোক ভাড়া না দিয়ে শেষ রাতে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে আমি অগ্রিম নেওয়া শুরু করেছি।
–ঠিক আছে। শাঙ্কো বলল। কোমরের ফেট্টি থেকে দুটো ছোট সোনার চাকতি বের করল। দোকানিকে দিল। দোকানি খুব খুশি। সাধারণত রুপোর চাকতি দেয় সব। এ একেবারে সোনার চাকতি। দোকানি চলে গেল।
ঘরের মেঝেয় রাখা কয়েকটা কাঠের পাটাতন। দুজনে পাটাতনের ওপর বসল। তারপরে ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল।
ওরা কিছুক্ষণ পরে দোকানির কাছ থেকে জল চেয়ে খেল। তারপর শুয়ে পড়ল।
দুজনেই অত্যন্ত ক্লান্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে ঘুমিয়ে পড়ল।
ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল ফ্রান্সিসের। শাঙ্কো তখনও ঘুমিয়ে। ফ্রান্সিস আর ওকে ডাকল না। ঘুমোক। কিছুক্ষণ পরে শাঙ্কোর ঘুম ভাঙল। উঠে বসল। হাতমুখ ধুল দুজনে। তারপর সকালের খাবার খেতে চলল। সামনের দোকানেই পেল মাছভাজা আর আধ হাত লাঠির মতো রুটি। দুজনে বেশ ভালোই খেল।
ওরা আর দাঁড়াল না। মুরগীর দোকান থেকে জিনিসপত্র নিয়েই এসেছিল। দুজনে চলা শুরু করল। দুপুরে এক চাষীর বাড়িতে অতিথি হল। পেট পুরে রুটি আনাজের ঝোল খেল।
সন্ধ্যেবেলা। ফ্রান্সিস বলল–একটু রাতে বাজার টাজার গেলে রাতের খাওয়া খাবো। তারপর সারারাত হাঁটবো। রাতে যাবার কোন সমস্যা হবে না।
–শরীর অত ধকল সহ্য করতে পারবে? শাঙ্কো বলল।
-খুব পারবে। জাহাজে পৌঁছে পাক্কা দুই দিন শুধু খাবো আর ঘুমুবো। ফ্রান্সিস বলল।
দুজনে যখন গ্যালিগস বন্দর শহরে পৌঁছল তখন বেশ রাত। দুজনে জাহাজঘাটায় এল। ওদের জাহাজটা যেখানে দেখে গিয়েছিল সেখানেই আছে।
জাহাজের কাছে এসে দেখল পাটাতন তুলে রাখা হয়েছে। সমুদ্রের পার থেকে শাঙ্কো দুহাতের চেটো গোল করে ডাকল–হ্যারি, বিস্কো। জাহাজে কারো কোনো সাড়া নেই। আবার ডাকলো। সাড়া নেই। শাঙ্কো পথ থেকে একটা ইটের টুকরো তুলে জাহাজ লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। জাহাজের গায়ে লেগে ঢিলটা জলে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস বলল-দাঁড়াও-জাহাজের ডেক-এ ঢিল ফেলতে হবে। রাত হয়েছে। গরমের দিন। কেউ না কেউ ডেক-এ নিশ্চয়ই শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস ঢিল তুলে ছুঁড়ল। ঠিক ডেক-এই পড়ল ঢিলটা। কারো গায়ে লেগেছে নিশ্চয়ই। কার চিৎকার শুনল–কে রে ঢিল ছোঁড়ে।
শাঙ্কো চিৎকার করে বলল–রেলিঙের ধারে আয়। নইলে আবার ঢিল ছুঁড়বো।
ভাইকিং বন্ধুদের কয়েকজন রেলিং-এর কাছে এল। শাঙ্কো আবার চিৎকার করে বলল–ফ্রান্সিস আর আমি এসেছি। পাটাতন পেতে দে।
এইবার ভাইকিংরা বুঝল ফ্রান্সিস শাঙ্কো ফিরে এসেছে। ওরা চিৎকার করে ধ্বনি তুলল– ও–হো–হো। জাহাজের রেলিং-এর ধারে ভিড় করে দাঁড়ালো ওরা। পাটাতন পেতে দেওয়া হল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো পাটাতন দিয়ে হেঁটে ডেক এ উঠে এল। আবার ধ্বনি উঠল–ও–হো–হো।
বন্ধুরা কেউ কেউ ছুটে এসে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোকে জড়িয়ে ধরল।
মারিয়া ফ্রান্সিসের কাছে এল। মুখ চোখ শুকনো। চোখের নিচে কালচে ভাব। শরীরও কিছুটা শীর্ণ। ফ্রান্সিস সবই দেখল। বলল–আমি অভিযানে বের হলে তুমি যদি ভেবে ভেবে শরীর খারাপ করে ফেল তাহলে আমাকে তো এখন দেশে ফিরে তে, যেতে হয়।
–আর দুশ্চিন্তা করবো না। এখন থেকে মন শক্ত করবো। মারিয়া আস্তে বলল।
দুজনে কেবিনঘরের দিকে চলল। ফ্রান্সিস যেতে যেতে রাঁধুনি বন্ধুকে পেল। বলল–প্রায় উপোস করে আছি। যা হোক কিছু খেতে দাও। শাঙ্কোকেও দিও।
ওদিকে শাঙ্কো তখন বন্ধুদের কাছে হাত পা নেড়ে ওদের স্বর্ণখনি অভিজ্ঞতার কথা বলছে।
ফ্রান্সিস আর মারিয়া নিজেদের কেবিনঘরে এল। ফ্রান্সিস বিছানায় বসল। বলল–একবার শাঙ্কোর কাছ থেকে চামড়ার ঝোলাটা নিয়ে এসো তো। মারিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
একটু পরে ঝোলাটা নিয়ে এল। ফ্রান্সিস হাত ঢুকিয়ে একটা সোনার পিণ্ড তুলল। মারিয়া অবাক হল না। এরকম গুপ্তধন ও আগেও দেখেছে। ফ্রান্সিস বলল–এই স্বর্ণভাণ্ডারের কে মালিক জানতে পারিনি। কাজেই কিছু সোনার পিণ্ড আমরা নিয়ে এলাম।
কীভাবে আবিষ্কার করলে?
-সেটা শোন। আসলে ওটা ছিল সোনার খনি। সোনার গুঁড়ো মেশানো পাথর গালিয়ে সোনা বের করা হত।
তারপরে ফ্রান্সিস সোনার খনির কথা বলতে লাগল। মারিয়া সেই উদ্ধারের কাহিনী শুনতে লাগল।
Leave a Reply