চিচেন ইতজায় ফ্রান্সিস
একটা নিঃসঙ্গ জাহাজ চলেছে সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে। জাহাজটা স্পেনীয় জলদস্যুদলের জাহাজ।
সূর্য অস্ত গেছে বেশ কিছুক্ষণ। এখন অন্ধকার রাত্রি। আকাশে উজ্জ্বল তারার ভিড়। অমাবস্যার কাছাকাছি। কাজেই অন্ধকার চারদিক।
জলদস্যুদের মধ্যে আলস্য। আলফানসো এই জলদস্যুদের দলে ভিড়তে বাধ্য হয়েছে। আলফানসো একটা পোর্তুগিজ জাহাজে চড়ে যাচ্ছিল দক্ষিণদিকের কোনও দেশের দিকে। ওর যাওয়াটা উদ্দেশ্যহীন। দেশে থাকতে ও ছিল খুবই গরিব চর্মকার। হাড়ভাঙা খাটুনি। কিন্তু রোজগারে সংসার চলে না। তাই আলফানসো অনেক ভেবে ঠিক করল সুদূর দক্ষিণ দিকে এমন কিছু দেশ আছে যেখানে সোনা দিয়ে তৈরি সাঁকো আছে। সে দেশের সর্বত্র সোনার ছড়াছড়ি। লোকমুখে শোনা এই স্বর্ণসাম্রাজ্যের কাহিনী কতটা সত্য ও জানে না। কিন্তু এই সোনার হাতছানিতে ও দেশ ঘরবাড়ি ছেড়ে দক্ষিণমুখো যাচ্ছে এমন একটা জাহাজে উঠে বসল। যে করেই হোক সেই স্বর্ণসাম্রাজ্যে পৌঁছতে হবে।
আলফানসো জাহাজের ডেকে শুয়ে ছিল। অন্ধকার নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে ও নিজের ভবিষ্যতের কথাই ভাবছিল।
হঠাৎ কানে এল মাস্তুলের ওপর বসে থাকা নজরদারের চিৎকার, “সাবধান জলদস্যুদের জাহাজ, সাবধান, সবাই তৈরি হও।”
জাহাজে সাড়া পড়ে গেল। সবাই ছুটল নীচের অস্ত্রঘরের দিকে। তরোয়াল হাতে ওরা দল বেঁধে ডেকে উঠে এল। জলদস্যুদের জাহাজটা তখনই আলফানসোদের জাহাজের গায়ে এসে ধাক্কা দিল। খোলা তরোয়াল হাতে চিৎকার করতে করতে জলদস্যুরা আলফানুসোদের জাহাজের ডেকে উঠে আসতে লাগল। শুরু হল তরোয়ালের লড়াই। জলদস্যুরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। ওদের মনে দয়ামায়ার স্থান নেই। নির্মম নৃশংস ওরা।
তরোয়ালের ঠোকাঠুকির শব্দ, আহতদের আর্তনাদ গোঙানির শব্দে জাহাজ ভরে উঠল।
আলফানসোও তরোয়াল নিয়ে লড়াই করছিল এক জলদস্যুর সঙ্গে। হঠাৎ ওই জলদস্যু ওর তরোয়ালে নিজের তরোয়ালটার এত জোরে ঘা মারল যে আলফানসোর। তরোয়ালটা হাত থেকে ছিটকে গেল। অন্ধকারেও আলফানসো দেখল জলদস্যুটা দাঁত বের করে হাসছে। নিরস্ত্র আলফানসোর মাথা লক্ষ্য করে তরোয়ালটা চালাল জলদস্যুটা। আলফানসো দ্রুত মাথা নিচু করল। তরোয়ালের কোপ পড়ল বাঁ কাঁধে। আলফানসো বাঁ কাঁধে ডান হাত চাপা দিয়ে বসে পড়ল। জলদস্যুটা অবশ্য ততক্ষণে আলফানসোদের এক নাবিকের তরোয়ালের ঘায়ে ডেকে ছিটকে পড়েছে। আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না।
আলফানসো আস্তে-আস্তে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে নিজেদের কেবিনঘরে ফিরে এল। ততক্ষণে লড়াই থেমে গেছে। দু’পক্ষেরই আহতদের আর্তনাদে গোঙানিতে চারদিক ভরে উঠেছে।
আলফানসোদের জাহাজের যাত্রী নাবিকরা লড়াইয়ে হেরে গেল।
জলদস্যুরা আহত যাত্রীদের নাবিকদের রেলিঙের ওপর দিয়ে সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। ওরা নিজেদের দলের মৃত লোকদেরও জলে ছুঁড়ে ফেলল।
পূবদিকের আকাশে কমলা রঙ ছড়াল। কিছুক্ষণ পরেই সূর্য উঠল। ভোরের নিস্তেজ রোদ ছড়ালো সমুদ্রের জলে জাহাজে।
এবার জলদস্যুদের দলপতি আলফানসোদের জাহাজে উঠে এল। মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ। বেশ তেল চকে। মোম দিয়ে গোঁফের ডগা উঁচলো করা। গায়ে দামি কাপড়ের জোব্বামতো। কোমরে চামড়ার মোটা বল্টের মতো একটা জিনিস। তাতে তরোয়াল ঝুলছে। তরোয়ালের বাঁট হাতির দাঁতের।
এসেই হুকুম দিল, “এই জাহাজে যারা বেঁচে আছে তাদের আমার কাছে নিয়ে এসো।” জলদস্যুরা খুঁজে খুঁজে জীবিত ও আহত মিলিয়ে প্রায় তিরিশজনকে দস্যুদলপতির সামনে নিয়ে এল। তার মধ্যে আলফানুসোও ছিল। জলদস্যুপতি বলল, “তোমাদের আর হত্যা করা হবে না। আহতদের চিকিৎসা করে সুস্থ করা হবে। আমার দলে এখন বড় লোকাভাব। তোমরা আমার দলে আসবে। আমার আদেশমতো চলবে। ডাকাতি করে লুঠপাট করে যা পাব তার ভাগ লেমরাও পাবে।”
এসময় আলফানসোদের জাহাজের ক্যাপ্টেন এগিয়ে এল। বলল, “আমরা যদি তোমার দলে যোগ না দিই?”
“তাহলে সবাইকে মরতে হবে।” জলদস্যুসর্দার বলল।
“আমরা মরব তবু জলদস্যুতা করব না।” ক্যাপ্টেন বলল।
দস্যুসর্দার হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, “মিছিমিছি কেন মরতে যাবে। তার চাইতে আমার দলে এলে সবকিছু পাবে আবার নগদ অর্থও পাবে।”
“না, আমরা তোমার দলে যাব না।” ক্যাপ্টেন বলল।
“তাহলে তো তোমাদের এখন মেরে ফেলতে হয়। খুব বাজে কাজ। আমি এসব নরহত্যা-ত্যা একেবারেই পছন্দ করি না। কিন্তু উপায় নেই। কখনও লোকের ঔদ্ধত্য দেখলে হত্যা করতেই হয়।” একটু থেমে দস্যুসর্দার বলল, “এবার তোমরা কে কে আমার দলে আসতে চাও হাত তুলে দাঁড়াও।” অনেকেই হাত তুলে জলদস্যুদের সর্দারের দিকে এগিয়ে গেল। তাদের মধ্যে আহত আলফানসোও আছে। ও বেশ ভেবেই দস্যুদলে যোগ দিতে রাজি হল। বাড়ি ফিরলে তো সেই অভাব, অনটন, উপবাস। তার চেয়ে জলদস্যুদের দলে যাওয়া অনেক ভাল। খেতে পরতে পাবে। লুটের মালের বিক্রির ভাগের অর্থ ঋবে। বেশ সুখেই দিন কাটবে।
দেখা গেল আলফানসোদের প্রায় অর্ধেক জাহাজি দস্যুদলে ঢুকল।
দস্যুসর্দার বলল, “সামনে যে বন্দর পড়বে সেখানে এই জাহাজের সব মালপত্র বিক্রি করা হবে। অবশ্যই জলের দামে। আমাদের খুব তাড়াতাড়ি অর্থের প্রয়োজন। তারপর অর্থ ভাগ বাটোয়ারা হবে। আমাদের সময় কম।”
এবার জলদস্যুসর্দার জলদস্যুদের দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও, এই জাহাজে যা # পাও লুঠ করে আমাদের জাহাজে নিয়ে যাও।”
জলদস্যুরা আলফানসোদের জাহাজে তল্লাশি শুরু করল। পেল প্রচুর ভেড়ার। চামড়া, আয়না, আলকাতরা। সব মাথায় করে নিয়ে ওদের জলদস্যুদের জাহাজে নিয়ে গেল। যারা জলদস্যুদের দলে যাবে বলে হাত তুলেছিল তারা সবাই ওই জাহাজে চলে গেল। আলফানসোও গেল। জলদস্যুদের জাহাজ আস্তে আস্তে সরে গেল। তারপর সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে চলল দক্ষিণমুখো।
লুঠ হয়ে যাওয়া জাহাজের ক্যাপ্টেন জাহাজ চালককেউত্তর দিকে জাহাজ চালাতে বলল।
জলদস্যুদের জাহাজে আলফানসোর নতুন জীবন শুরু হল। জলদস্যুদের খুব নিয়ম মেনে চলতে হয়। এদিক ওদিক হলে চাবুক মারা হয়। কখনও বা একেবারে মেরে ফেলা হয়। তাই সবাই সর্দারের হুকুম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। দিন আট দশের মধ্যেই আলফানসো সুস্থ হল। ওর চিকিৎসা করল জলদস্যুদলের বৈদ্য। কয়েকদিন পরে আলফানসোদের জাহাজ থেকে দেখা গেল একটা জাহাজ আসছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যাত্রিবাহী জাহাজ। জাহাজের মাথায় উড়ছে ফরাসি দেশের পতাকা। আলফানসোদের জাহাজ ছুটল ওই জাহাজের দিকে। ততক্ষণে আলফানসোদের জাহাজের মাথা থেকে নরওয়ে দেশের পতাকা নামিয়ে জলদস্যুদের মড়ার খুলি আর মানুষের হাড় আঁকা কালো পতাকা তুলে দেওয়া হল। যাত্রীবাহী জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে চিৎকার আর কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল। নির্মম জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পেতে গেলে সব সোনাদানার, হীরে-জহরতের গয়নাগাঁটি ওদের দিয়ে দিতে হবে। না দিতে চাইলে তরোয়ালের ঘায়ে মরতে হবে।
তখন দুপুর। সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যাত্রীবাহী জাহাজটার চালক জাহাজের গতি বাড়িয়ে দিল। কিন্তু জলদস্যুদের জাহাজচালক অনেক অভিজ্ঞ ওস্তাদ। ও ওদের জাহাজটা বড় করে একটা পাক খাইয়ে যাত্রীবাহী জাহাজটার সামনে চলে এল। জাহাজটা নিয়ে এল যাত্রিবাহী জাহাজটার গায়ে। দলে দলে জলদস্যুরা খোলা তরোয়াল হাতে উঠে পড়তে লাগল যাত্রিবাহী জাহাজটাতে। শুরু হল তরোয়ালের লড়াই। যাত্রীবাহী জাহাজের প্রহরীরা যা লড়তে লাগল। যাত্রীরা তত দক্ষ নয় তরোয়াল চালনায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রিবাহী জাহাজের যাত্রীরা হার স্বীকার করল।
জলদস্যুরা আহত সঙ্গীদের নিজেদের জাহাজে নিয়ে গেল। উভয়পক্ষেরই যারা লড়াইতে মারা গেল তাদের সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হল।
এবার জীবিত যাত্রীদের ডেকে দাঁড় করানো হল। একপাশে মহিলা যাত্রীরা। অন্যদিকে পুরুষ যাত্রীরা।
সেই জাহাজে জলদস্যুসর্দার উঠে এল। হো হো করে কিছুক্ষণ হাসল। তারপর বলল, “এইসব লড়াইটড়াই বাঁচা-মরা আমার একেবারেই ভাল লাগে না।” আবার হাসল। বলল, “সবচেয়ে ভাল হয় তোমাদের কাছে মূল্যবান যা কিছু আছে আমাদের দিয়ে দাও। তাহলেই মরে যাওয়া বা ঘায়েল হয়ে যাওয়া কোনওটাই হয় না।”
“যদি আমরা সেসব না দিই?” একজন যাত্রী বলল। দস্যুসদার যাত্রীদের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে বলল,–“কথাটা কে বলল, কে বলল?”
যাত্রীটি এগিয়ে এল। বলল–“আমি বলেছি।” দস্যুসর্দার হাসতে লাগল। হাসতে হাসতেই বলল,–“তোরা কে আছিস, এটাকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেল।” দুজন জলদস্যু ছুটে এল। যাত্রীকে চেপে ডেকে শুইয়ে দিল। তারপর একজন দু’পা আর একজন দু’হাত ধরে দোলাতে লাগল। তারপর রেলিঙ ডিঙিয়ে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলল।
যাত্রীরা আর কেউ কোনও কথা বলল না। সদার হেসে বলল–“আমি এরকমই। আমার কথা অমান্য করলে হয় তরোয়ালের ঘায়ে মৃত্যু, নয়তো সমুদ্রশয্যা। যাকগে, মহিলা যাত্রীদের বলছি আমার লোক তোমাদের কাছে একটা বড় রুমাল নিয়ে যাচ্ছে। সব গয়নাগাটি খুলে ওই রুমালে ফেলে দাও।”
মহিলাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করল না। দু’জন জলদস্যু মহিলা যাত্রীদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর দুজনে একটা বড় নকশা আঁকা রুমাল মহিলা যাত্রীদের সামনে নিয়ে এল। মহিলারা বুঝল এই জলদস্যদের। সর্দার ওদের যে কোন সময়ে মেরে ফেলতে পারে। তারা কেউ কোন কথা বলল না। হাত গলা কানের মূল্যবান অলঙ্কার খুলে রুমালে ফেলে দিতে লাগল। সর্দার জোরে হেসে উঠে বলল, “দ্যাখো কেমন নিঃশব্দে সবকিছু ঘটে যাচ্ছে। আমি ঠিক এটাই চাই।” দস্যুসর্দার নিজের জাহাজে চলে গেল।
জলদস্যুরা পুরুষ যাত্রীদের কাছ থেকে গিনি আংটি সব নিল।
এবার জলদস্যুরা হানা দিল কেবিনঘরগুলোতে। যে যা পেল নিল। মূল্যবান সবই সর্দারের কাছে জমা দিতে হবে। কিন্তু শৌখিন পোশাক টোশাক সদার নেয় না। এগুলো দস্যুদলের প্রাপ্য।
বিকেল নাগাদ জলদস্যুদের জাহাজ ওই তল্লাট ছেড়ে চলে গেল। জাহাজের রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আলফানসো সব দেখল। আলফানসো তখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। কাজেই সঙ্গীরা ওকে লড়াই করতে ডাকেনি।
আলফানসো সম্পূর্ণ সুস্থ হল। শুধু বাঁ হাতের জোরটা আগের মতো রইল না। মৃত্যুর কালো দরজা থেকে ফিরে এসেছে আলফানসো। এতেই খুশি ও।
তারপর কত জাহাজ লুঠ দেখল। শুধু দেখল না, সর্দারের হুকুমে তাতে অংশও নিতে হল। আত্মরক্ষার জন্যে নরহত্যাও করতে হল। লুঠের ভাগ পায়। খাদ্য পায়। কখনও কোন বন্দরে ওদের জাহাজ ভেড়ে। জাহাজের মাথায় সেই দেশেরই পতাকা ওড়ে। ওরা যে জলদস্যু, জাহাজটা যে জলদস্যুদের এটা অনেকেই বোঝে না। সাধারণ যাত্রীবাহী জাহাজ মনে করে। ওরা বন্দর শহরে নামে। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে পেটভরে খায়, পোশাক কেনে, বন্দর শহরে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। মুক্ত জীবনের স্বাদ পায়। এভাবেই আলফানসোর দিন কাটছিল।
এক গভীর রাতে সমুদ্রে ঝড় উঠল। প্রচণ্ড জোরে ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ল আলফানসোদের জাহাজের ওপর। রাতের আকাশ যেন ফালা ফালা হয়ে যেতে লাগল বিদ্যুৎ রেখায়। সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি।
আলফানসোরা জাহাজের মাস্তুলের পালের দড়িদড়া টেনে ধরে জাহাজটা ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে লাগল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। মাস্তুলটা প্রচণ্ড শব্দে ভেঙ্গে পড়ল। জাহাজটা মাঝামাঝি ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে গেল। আলফানসো বুঝল ভাঙা জাহাজে থাকলে জাহাজের নিচে চাপা পড়ে যাবে। তখনই বিদ্যুতের আলোয় একঝলক দেখল সমুদ্রতীরের গাছগাছালি। তাই ডুবন্ত জাহাজ থেকে ও উত্তাল সমুদ্রের বিরাট বিরাট ঢেউয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আবার বিদ্যুৎ চমকালো। সাঁতরাতে সাঁতরাতে দেখল তীরে বনজঙ্গল। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আলফানসো সাঁতরাতে লাগল। ওই বিরাট বিরাট ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতরানো অসম্ভব। ওরই মধ্যে আলফানসো শরীর ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগল।
ঝোড়ো হাওয়ার দাপট কমল। বৃষ্টিও কমল। আলফানসো দেখল তীর খুব দুরে নয়। ও প্রাণপণে সাঁতার কেটে তীরের দিকে চলল। কিছুটা সাঁতরে যেতেই পায়ের নীচে বেলেমাটি ঠেকল। আলফানসো আনন্দে মাটিতে পা রেখে লাফিয়ে উঠল। চলল তীরের মাটির দিকে। তীরে উঠে মুখ হাঁ করে হাঁপাতে হাঁপাতে আলফানসো মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। আর হাঁটার শক্তি নেই। শুয়ে শুয়ে হাঁপাতে লাগল। দেখল ঝড় থেমেছে। বৃষ্টি আর নেই। আকাশে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে তারা জ্বলছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল।
পূব আকাশে লালচে রং ফুটে উঠল। সূর্য উঠল। ভোরের রোদে চারদিক দেখা যাচ্ছে। আলফানসো মাথা ঘুরিয়ে দেখল; ওর মাথার কাছে একজন জলদস্যু উবু হয়ে পড়ে আছে। আলফানসো বেশ কষ্টে উঠে এগিয়ে গেল। দস্যুবন্ধুকে ধরে তুলল। বন্ধুটি আলফানসোকে চোখ খুলে দেখল। তারপর হাসল। উঠে বসল।
আলফানসো বলল, “এখানে শুয়ে থেকে কী হবে?’চলো খাবার-টাবার পাওয়া যায় কিনা দেখি।” বন্ধুটি উঠে দাঁড়াল। চলল ঢালু তীরের মাটির দিকে। আলফানসো চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। অন্য কোনও জলদস্যুকে দেখতে পেল না। ওখানে উঠে দেখল জঙ্গল সামনে। জনবসতি দেখল না। হয়তো জঙ্গল পার হতে পারলে লোকালয় পাওয়া যাবে।
দু’জনে জঙ্গলে ঢুকল। খুব ঘন বন নয়। ছাড়া ছাড়া গাছপালা। তারই মধ্যে দিয়ে দু’জন চলল। কিছুদূর যাওয়ার পরই বনজঙ্গল শেষ। একটা জলা জায়গা। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা টিলা। হয়তো ওখানে মানুষের বসতি আছে। এই ভেবে আলফানসো জলদস্যু বন্ধুকে বলল, “ওই টিলাটা লক্ষ্য করে চলো। দেখা যাক লোকজনের বসতি পাওয়া যায় কিনা।”
দু’জনে জলা জায়গাটায় নামল। জল তেমন বেশি নয়। নিচটা কেমন যেন পেছল পেছল। ওরা পা দিয়ে জল ঠেলে ঠেলে চলল।
হঠাৎ বন্ধুটি বলে উঠল, পায়ে কী যেন লেগেছে। আলফানসো নিচু হয়ে দেখল দুটো আঙ্গুলের মতো মোটা জোঁক। বন্ধুটির পা কামড়ে ধরে আছে। রক্ত বেরোচ্ছে। আলফানসো চিৎকার করে বলল, “পালাও।” দু’জনে ছুটে চলল জলাভূমিটা পার হতে। বন্ধুটি পারল না। প্রচুর রক্তক্ষরণের জন্যে বন্দুটির শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ও পিছল মাটিতে ছুটতে পারল না। পা পিছলে পড়ে গেল। আলফানসো তখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। ও বুঝতেও পারে নি যে বন্ধুটি পা পিছলে পড়ে গেছে।
জলাভূমির পরেই পাথুরে ডাঙা। আলফানসো ডাঙায় উঠে নিশ্চিন্ত হল। ভয়ে ও তখন কাঁপছে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল বন্ধুটি জলায় পড়ে আছে। আলফানসো তখন মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে হঠাৎ ওর বাঁ পায়ের গোড়ালিটা সুড়সুড় করে উঠল। আলফানসো তাকিয়ে দেখল একটা একবিঘত লম্বা জোঁক গোড়ালিতে কামড় বসাবার চেষ্টা করছে। আলফানসো এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। বারকয়েক পা ছুঁড়ে জোঁকটাকে ফেলবার চেষ্টা করল। জোঁক লেগে রইল। তখনও কামড় বসাতে পারেনি। আলফানসো একটা পাথরের বড় টুকরো তুলে নিল মাটি থেকে। তারপর জোঁকটার মাথায় পাথরটা ঠুকতে লাগল। কয়েকবার ঠোকার পরও জোঁকটা খসে পড়ল না। আলফানসো আবার ঠুকতে লাগল। ওর গোড়ালির ওই জায়গাটা ঘেঁচে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। গোড়ালি ব্যথায় টনটন করতে লাগল। একটা জোরে ঘা মারতে জোঁকটা খসে পড়ল। আলফানসো সঙ্গে সঙ্গে এই জায়গা ছেড়ে দ্রুত ছুটল। আর এক মুহূর্তও এখানে নয়।
আলফানসো মাটিতে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে বিশ্রাম করল কিছুক্ষণ।
তখন বেলা হয়েছে। আলফানসো উঠে দাঁড়াল। খাদ্য চাই, আশ্রয় চাই। ও টিলাটার দিকে চলল। টিলাটার কাছাকাছি পৌঁছে দেখল টিলাটার নিচে একটা বাড়ি। বাড়িটার থামগুলো কাঠের তৈরি। দেওয়ালগুলো চুনাপাথরের, চাল খড়ের। বাড়ির দেওয়ালে নানারকমের কারুকাজ–গাছ, ফুল, লতাপাতা আঁকা। বাড়ির লোকেরা আলফানসোকে কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগল। একজনকে বাড়ির মালিক বলে আলফানসোর মনে হল। মালিক আলফানসোর দিকে এগিয়ে এল। তলতেক ভাষায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? এখানে কী করে এলে?” আলফানসো সেই কথা কিছুই বুঝল না। ও স্পেনীয় ভাষায় বলল–“এই জায়গাটার নাম কী?” লোকটিও কিছুই বুঝল না। আলফানসো আকার ইঙ্গিতে বোঝাল জায়গাটার নাম কি? লোকটা আন্দাজে বুঝল। বলল, “তুলাম।” চারপাশের আরও কয়েকটা বাড়ি থেকে লোকজন বেরিয়ে এল। আলফানসোকে প্রায় ঘিরে ধরল। আলফানসো ভাবল বলে জাহাজডুবি হয়ে ও এখানে এসেছে। সঙ্গের বন্ধু জোঁকের কামড়ে মারা গেছে। আমার পোশাক এখনও ভিজে। খিদেও পেয়েছে। আলফানসো হাত পা নেড়ে মুখের চোখের ভঙ্গি করে এসব বোঝাতে চাইল। দেখল কিছু লোক মোটামুটি বুঝেছে। ওরা কয়েকজন। ছুটে নিজেদের বাড়িতে গেল। একটু পরেই ওরা গতরাতের বাড়তি খাবার নিয়ে এল চিনেমাটির পাত্রে। একজন একটা জলের পাত্রে ভরা জল নিয়ে এল। দু’জন ঝোলা জোব্বা নিয়ে এল। প্যান্টের মতো পোশাকও নিয়ে এল।
আলফানসো এতক্ষণ পরে হাসল। লোকেরাও হাসল। ও আগে পোশাক পাল্টাল। ভেজা পোশাকে এতক্ষণ থাকতে হয়েছে। জলেভেজা শরীরে কাঁপুনি ধরল। ভেজা পোশাক এতক্ষণ পরে ছাড়তে পেরে আলফানসো যেন প্রাণ ফিরে পেল।
এবার খাওয়া। আলফানসো খাবারের বড় পাত্রটা নিল। তারপর খিদের জ্বালায় না থেমে একনাগাড়ে খেতে লাগল। একটুক্ষণের মধ্যেই সব খাবার শেষ। ওকে ঘিরে থাকা লোকজন খুশি হল। আলফানুসো হাসল। ইঙ্গিতে বোঝাল ও একটু শুয়ে বিশ্রাম নিতে। চায়। যার বাড়িতে আলফানসো প্রথম গিয়েছিল সেই লোকটি এগিয়ে এল। হাতের ইঙ্গি তে বাড়িতে ঢুকতে বলল। আলফানসো বাড়িটার ভেতরে একটা ঘরে ঢুকলো। ঘরটা বেশ বড়। একপাশে বিছানামতো পাতা। লোকটা ওই বিছানা দেখাল। আলফানসো হেসে লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিছানাটায় শুয়ে পড়ল। বাইরে লোকজন যে যার নিজের নিজের বাড়িতে চলে গেল। আলফানসো অল্পক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে পড়ল।
কয়েকদিন তুলামে থেকে আলফানসো রওনা হলো চিচেন ইতজা নগরের দিকে। পথে এদেশের লোকদের খেতখামার দেখল। মেজ ম্যাওইর খেত, তুলোর খেতও আছে। পুরুষদের পোশাক জোব্বার মতো। কোমরে মোটা কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা। মেয়েরা পরে নানা রঙিন সুতোয় কাজ করা পোশাক।
বেশ কয়েকদিন হেঁটে আলফানসো চিচেন ইতজা নগরে এসে পৌঁছল।
এই ঘটনার প্রায় পনেরো বছর পরের কাহিনী।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে। বাতাস বেগবান। পালগুলো ফুলে উঠেছে। ঢেউ ভেঙে ফ্রান্সিসদের জাহাজ বেশ দ্রুতগতিতেই চলেছে। ভাইকিংরা শুয়ে, বসে, গল্প করে সময় কাটাচ্ছে।
সেদিন বিকেলের দিকে নজরদার পেড্রো মাস্তুলের মাথায় নিজের জায়গায় বসেছিল। হঠাৎ দেখল দক্ষিণদিক থেকে গভীর কালো মেঘ মাঝ আকাশের দিকে উঠে আসছে। পেড্রো চিৎকার করে বলল, “ভাইসব, ফ্রান্সিসকে ডাকো। প্রচণ্ড ঝড় আসছে।” ভাইকিংরা সব উঠে দাঁড়াল। আকাশের দিকে তাকালো। সত্যিই আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। তখনই পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকারে ঢেকে গেল সবকিছু। শাঙ্কো ছুটল ফ্রান্সিসকে ডাকতে।
ফ্রান্সিস ডেকে উঠে এল। আকাশের অবস্থা দেখেই বুঝল ঝড় আসছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল, “ভাইসব, ঝড় আসছে। সবাই তৈরি হও।” ভাইকিংরা পাল গুটিয়ে ফেলল। পালের দড়ি টেনে ধরে সবাই তৈরি হল। পেড্রো মাস্তুলের মাথা থেকে নেমে এল। মাস্তুলের গায়ে জড়ানো দড়িদড়া ধরল কিছু ভাইকিং।
সমুদ্রের বুক অন্ধকার করে প্রচণ্ড হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্রান্সিসদের জাহাজের ওপর। শুরু হল মেঘের গর্জন। বিদ্যুতের তীব্র আঁকাবাঁকা আলো আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি।
ভাইকিংরা ঝোড়ো বাতাসে কাত হয়ে যাওয়া জাহাজ দড়ি ধরে টেনে সোজা করতে লাগল। বিরাট বিরাট ঢেউ ডেকের ওপর আছড়ে পড়তে লাগল।
ভাইকিংরা আধঘণ্টা ধরে ঝড়ের সঙ্গে লড়ে জাহাজ ডুবতে দিল না।
হাওয়ার তীব্রতা কমে গেল। আকাশ পরিচ্ছন্ন হয়ে গেল। তারা উঠল।
যেন জলে স্নান করে উঠেছে ভাইকিংরা। ডেকের এখানে ওখানে ওরা শুয়ে রইল। তখনও হাঁপাচ্ছে সবাই।
গায়ে জলে ভেজা পোশাক নিয়ে ফ্রান্সিস জাহাজ চালক ফ্লেজারের কাছে এল। বলল, “জাহাজ কোনদিকে চালাচ্ছ?”
“উত্তরমুখো চালাব ভেবেছিলাম কিন্তু ঝড়ের ধাক্কায় কোথায় ছিটকে এসেছে বুঝতে পারছি না।” ফ্লেজার বলল।
“তা হলে কি সমুদ্রে আমরা দিক হারালাম?” ফ্রান্সিস বলল।
“তাই তো মনে হচ্ছে। তাই ভাবছি হুইল আর ঘোরাবো না। জাহাজ যেদিকে যায় যাক।” ফ্লেজার বলল।
“অগত্যা। উপায় কী?” ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল, “আমাদের জাহাজের দিক ভুল হয়নি তো?”
“হ্যাঁ, তাই হয়েছে।” ফ্রান্সিস বলল। ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। ফ্রান্সিস বলল, “ধৈর্য হারিও না। আমরা ঝড়ে জলে তো ডুবে মরিনি। বেঁচে আছি। নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও গিয়ে জাহাজ তীরে ভিড়বে।”
জাহাজ চলল। পেড্রো মাস্তুলের মাথায় বসে চারদিকে নজর রাখতে লাগল। কিন্তু ডাঙার দেখা নেই। ভাইকিং বন্ধুদের মনে সেই আনন্দ উচ্ছ্বাস নেই। সকলেরই ভাবনা–এ আমরা কোথায় চলেছি? কোনওদিন কি কোনও সমুদ্রতীরে পৌঁছতে পারব? না কি ক্ষুধায় তৃষ্ণায় জাহাজেই মারা যাব? মারিয়া ফ্রান্সিসকে বলল, “সবাই কেমন মনমরা হয়ে গেছে। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাব কী করে?”
“নিশ্চয়ই উদ্ধার পাব। মনকে শক্ত করো। হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই।” ফ্রান্সিস বলল।
সবাই তো আর তোমার মতো নয়।” মারিয়া বলল।
সাতদিন কেটে গেল। ডাঙার দেখা নেই। ভাইকিংরা ভীষণ মুষড়ে পড়ল।
সেদিন খুব ভোরে নজরদার পেড্রো দূরে ডাঙামতো দেখল। কিন্তু পরক্ষণেই তা কুয়াশায় ঢেকে গেল। পেড্রো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কুয়াশা সরে যেতেই সকালের রোদে দেখল সমুদ্রতীরের বালিয়াড়ি, গাছপালা। পেড্রো গলা চড়িয়ে বলল, “ভাইসব, ডাঙা। ডাঙা দেখা যাচ্ছে।”
ভাইকিংরা ডেকে উঠে এল। রেলিং ধরে দাঁড়াল। দেখল সমুদ্রতীরে গাছগাছালি। সবাই ধ্বনি তুলল, ও-হো-হো। ফ্রান্সিস, মারিয়া, হ্যারিও ডেকে উঠে এল। সমুদ্রতীর দেখল। হ্যারি বলল, “ফ্রান্সিস, এখন কী করবে?”
“তাই ভাবছি।” ফ্রান্সিস বলল।
“তা হলে আজ রাতেই নৌকোয় চড়ে তীরভূমিতে চলল। দেখা যাক লোকজনের দেখা পাই কি না। জিজ্ঞেস করে তা হলে জানা যাবে কোথায় এলাম।” হ্যারি বলল।
“বেশ চলো।” ফ্রান্সিস বলল।
সেদিন রাতে ফ্রান্সিস, শাঙ্কো আর হ্যারি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল।
রাত গম্ভীর হতে ওরা তৈরি হয়ে জাহাজের হালের কাছে এল। ফ্রান্সিস, হ্যারি কোনও অস্ত্র নেয়নি। শুধু শাঙ্কো নিয়েছে জামার তলায় রাখা ছোরাটা।
হালে বাঁধা দড়িদড়া ধরে তিনজন ওদের একটা ছোট নৌকোয় নেমে দাঁড়াল। তারপর ফ্রান্সিস নেমে আসতে ওরা নৌকোয় বসল। ফ্রান্সিস দড়িটা হাতে নিল। তারপর নৌকো খুলে দাঁড় বাইতে লাগল। নৌকো চলল তীরভূমির দিকে। চারদিক নিকষ কালো। কোথাও জ্যোৎস্নার চিহ্নমাত্র নেই। শুধু আকাশেজ্বলছে লক্ষ লক্ষ তারা। ওই তারাগুলির ক্ষীণ আলোয় যা কিছু দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের জল ছুঁয়ে হাওয়া বইছে। তাতেই যা একটু ঠাণ্ডা লাগছে। সমুদ্র শান্ত। নৌকো চলল।
নৌকো তীরের কাছাকাছি এল। অন্ধকারে ফ্রান্সিস তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল তীরভূমির দিকে। ঢালে বালিয়াড়ি। কিন্তু যতটা সম্ভব দেখতে পাচ্ছে তাতে কোথাও কোনও বাড়িঘর দেখতে পেল না।
একটা ধাক্কা খেয়ে নৌকোটা তীরে লাগল।
তিনজনে নেমে এল। শাঙ্কো নৌকোটা তীরে অনেকটা তুলে রাখল যাতে জোয়ারে ভেসে না যায়।
বালিয়াড়ি পেরিয়ে তীরে উঠে দেখল একটা রাস্তা চলে গেছে। ফ্রান্সিস বলল, “হ্যারি, মনে হচ্ছে এখানে লোকজনের যাতায়াত আছে।”
“হ্যাঁ, সেটা বোঝা যাচ্ছে। মনে হয় ধারেকাছে জনবসতি আছে। চলো, দেখা যাক।” হ্যারি বলল।
অন্ধকারে আন্দাজেই ওরা চলল এই রাস্তা ধরে। সমুদ্রের জোরালো হাওয়ায় রাস্তার ধুলো উড়ছে। ওরা তার মধ্যে দিয়েই চলল।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর প্রথমেই একটা পাথরের বাড়ি দেখল। তারপরেই দেখল সারি সারি ঘরদোর। সবই অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, “চলো, সামনের ওই বাড়িটায় যাই। একটা বড় বাড়ির সামনে এসে ওরা দাঁড়ালো। কাঠের মোটা থাম চুনাপাথর আর চালে শুকনো ঘাস দিয়ে বাড়িটা তৈরি।
ফ্রান্সিস এগিয়ে গিয়ে দরজায় আঙুল দিয়ে ঠকঠক শব্দ করল। ভেতরে কোনও সাড়া নেই। আবার ফ্রান্সিস ঠকঠক করল। ভেতর থেকে কারও কথা শোনা গেল। কথাটা ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝল না। ওরা দাঁড়িয়ে রইল।
দরজা খোলার শব্দ হল। এক বৃদ্ধ মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিসদের দেখে বেশ অবাকই হলেন। এই বিদেশি পোশাকপরা লোকগুলো এখানে এল কী করে? বৃদ্ধ বলল, “তোমরা কী চাও?” ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝল না।
হ্যারি বুকে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বলল, “আমরা ভাইকিং।” বৃদ্ধটি শুধুভাইকিং শব্দটা বুঝলেন। তখনই ঘরের ভেতর থেকে এক যুবক এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। ভাইকিং কথাটা সে শুনল। বুঝল এইনবাগতরা ভাইকিং। গায়ে তো বিদেশী পোশাক। তবুযুবকটির সন্দেহ গেল না। এত রাতে এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে কী জন্য? এরা নিশ্চয়ই মায়াপানদের পাঠানো গুপ্তচর। যুবকটি আর দাঁড়াল না। আস্তে-আস্তে রাস্তায় নামল। চলল পুবমুখো। একটু যেতেই অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল। এবার হ্যারি মাটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বোঝাল জায়গার নাম কি? বৃদ্ধটি ইঙ্গিত বুঝলেন। বললেন, “তুলাম, তুলাম।” বুকে হাত দিয়ে বললেন, “য়ুকাতান, য়ুকাতান।” তার মানে এরা য়ুকাতান জাতি। বৃদ্ধটি এবার দু’হাত আড়াআড়ি রেখে বোঝালেন, যুদ্ধ, লড়াই। হ্যারি বুঝল সেটা। ফ্রান্সিসকে বলল, “ফ্রান্সিস এরা হচ্ছে য়ুকাতান জাতি। এদের লড়াই চলছে মায়াপান উপজাতিদের সঙ্গে।”
বৃদ্ধটি আর কোনও কথা না বলে ঘরে ঢুকে গেলেন। ফ্রান্সিস হঠাৎ বুঝতে পারল, সামনে বিপদ। যুবকটি আস্তে-আস্তে বেরিয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু ওদের চোখের আড়ালে যুবকটি নিশ্চয়ই ছুটে গেছে য়ুকাতান যোদ্ধাদের খবর দিতে যে, আমরা মায়াপানদের গুপ্তচর। ফ্রান্সিস বলে উঠল, “হ্যারি, শাঙ্কো, জাহাজের দিকে ছোটো।”
তিনজনেই লাফিয়ে রাস্তায় নামল। তারপর সমুদ্রতীরের দিকে ছুটল।
তখন অন্ধকার কেটে গেছে। পূব আকাশ কুয়াশা ঢাকা। লাল রঙের আভা। তিনজন ছুটছে তখন। হঠাৎ শুনল ঘোড়ার পায়ের শব্দ। পেছনে তাকিয়ে দেখল–দুটো ঘোড়া ছুটিয়ে দু’জন যোদ্ধা আসছে। হাতে বর্শা। গায়ে মোটা কাপড়ের পোশাক। পোশাকে লাল-নীল রঙের সুতোর কাজ করা।
ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ছুটে লাভ নেই। উলটে আমাদের ওপর লোকেদের সন্দেহ বাড়বে। হয়তো বর্শা ছুঁড়ে আমাদের হত্যা করতে পারে।”
তিনজনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। অশ্বারোহী দু’জন সৈন্য ফ্রান্সিসদের কাছে এসে থামল। যোদ্ধা দু’জন নামল। বর্শা হাতে এগিয়ে এল। ওদের নিজেদের ভাষায় কী জিজ্ঞেস করল। ভাইকিং কথাটা শুনে ফ্রান্সিস বুঝল। ও মাথা ওঠানামা করলো। যোদ্ধা দুজন আরও কিছু জিজ্ঞেস করল। ফ্রান্সিস তার কিছুই বুঝল না।
এবার একজন যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের পুবদিকে আঙুল তুলে দেখাল। ইঙ্গিতে বলল, ওইদিকে ওদের পেছন পেছন যেতে। ফ্রান্সিস কিছুই না বোঝার ভান করল। এক যোদ্ধা তার হাতের বর্শার ফলাটা দিয়ে ফ্রান্সিসকে খোঁচা দিল। ফ্রান্সিস বুঝল-বর্শার ফলাটা ওর পিঠ কেটে দিয়েছে। নিশ্চয়ই রক্ত বেরোচ্ছে। হ্যারি বলল, “ফ্রান্সিস বেশি চটে গেলে হয়তো বর্শা বুকে ঢুকিয়ে দেবে। তার চাইতে ওরা যেভাবে চাইছে আমরা সেইভাবেই চলব।” যোদ্ধাদের ইঙ্গিতে ফ্রান্সিস পুবমুখো হাঁটতে শুরু করলো। ওর পেছনে পেছনে হ্যারি আর শাঙ্কোও চলল।
ওরা তিনজন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। তখন সকাল। দু’পাশের বাড়িঘর থেকে লোকজন কাজে বেরিয়ে পড়েছে। তারা অবাক হয়ে ফ্রান্সিসদের দেখতে লাগল। বাজারের কাছে ভিড় বাড়ল। যোদ্ধ দু’জন ঘোড়া থেকে নামল। এই ভিড়ের মধ্যে বন্দিরা পালিয়ে যেতে পারে। ঘোড়ার সামনের দিকে ফ্রান্সিসদের আসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা ঘোড়াদুটোর সামনে এলো। যোদ্ধাদের একজন হাঁটতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা হাঁটতে লাগল। সামনে একজন যোদ্ধা লাগাম ধরে একটা ঘোড়াকে নিয়ে চলল। পেছনে আর একজন ঘোড়ার লাগাম ধরে চলল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সকলে একটা লম্বাটে ঘরের কাছে এল। সামনে বিরাট প্রান্তর। সবুজ ঘাসে ঢাকা। লম্বাটে ঘর দেখে ফ্রান্সিস বুঝল কয়েদঘর। আবার বন্দিদশা।
লম্বাটে ঘরটার কাছে এসে দাঁড়াল সবাই। ফ্রান্সিস দেখল, ঘরের দরজাটা লোহার। দরজায় বড় তালা ঝুলছে। দরজার বাইরে বর্শা হাতে পাহারা দিচ্ছে দু’জন পাহারাদার। কোমরে তরোয়াল। তাদেরই একজনকে একজন যোদ্ধা ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে কী বলল। পাহারাদার তালা খুলল লম্বা চাবি দিয়ে।
ফ্রান্সিসদের প্রায় টেনে ঘরে ঢোকানো হল। যোদ্ধাদের একজন পাহারাদারদের কী বলল। তারপর ঘোড়া চালিয়ে চলে গেল।
লম্বাটে ঘরটার একদিকে এই কয়েদঘর। ফ্রান্সিসদের ঢোকানো হল। ফ্রান্সিসরা দেখল চার পাঁচজন বন্দি রয়েছে। কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ বসে আছে। দু’জন শুয়ে আছে। মেঝেটা পাথরের, তার ওপর শুকনো ঘাসপাতা ছড়ানো। এটাই বিছানা।
আগে যে বন্দিরা জেগে ছিল তারা বেশ অবাক চোখে ফ্রান্সিসদের দিকে চেয়ে রইল। ফ্রান্সিসরা বসে পড়ল।
শাঙ্কো শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, “ফ্রান্সিস, মাত্র দু’জন যোদ্ধা ছিল– লড়াইয়ে নামলেও ওরা হেরে যেত।”
“তা হয়তো যেত। কিন্তু তারপর? বাইরে তাকিয়ে দ্যাখো প্রান্তরের শেষে লম্বা ঘরগুলো। ওটা সৈন্যনিবাস। তাদের কাছে নিশ্চয়ই খবর পৌঁছত। আমরা সমুদ্রতীরে পৌঁছে জাহাজ চালাবার আগেই ওরা ঘোড়ায় চেপে সমুদ্রতীরে পৌঁছত। আমাদের জাহাজ দখল করত। এক অসম লড়াইয়ে আমাদের প্রাণ দিতে হত। তার চেয়ে এটাই ভাল হল। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবই। কিন্তু তার জন্য সময় ও সুযোগের প্রতীক্ষা করতে হবে। হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। ফ্রান্সিসের ওপর শাঙ্কোর অগাধ বিশ্বাস। ফ্রান্সিস একটা উপায় বের করবেই।
দুপুরে কয়েদঘরের দরজা খোলা হল। দু-তিনজন সৈন্য ঢুকল। একজনের হাতে কাঠের বেশ বড় রেকাবি। অন্যজনের হাতে একটা বেশ বড় হাঁড়ি। আর একজনের হাতে গোল গোল পাতা। সে পাতাগুলো ফ্রান্সিসদের সামনে পেতে দিতে লাগল। পাতায় দেওয়া হল নানা সবজি, আলুর ঝোল। আর গোল গোল করে কাটা কাটা রুটি। সবাই খেতে লাগল। দু’জন প্রহরী দরজায় দাঁড়িয়ে রইল।
ফ্রান্সিসদের খাওয়া শেষ হল। সবাই ঘরের কোণায় রাখা মাটির জালা থেকে জল তুলে খেল।
ফ্রান্সিস শুকনো ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। হ্যারি, শাঙ্কো বসে রইল। ফ্রান্সিস চোখে আড়াআড়িভাবে হাত রেখে শুয়ে রইল। ও গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল, কীভাবে এই কয়েদঘর থেকে পালাবে। কিন্তু কোনও পরিকল্পনাই কাজে লাগবে বলে ওর মনে হল না। ও অন্য উপায় ভাবতে লাগল।
রাত কাটল। মুক্তির কোনও আশা দেখছে না ফ্রান্সিস। সকালের খাবার নিয়ে সৈন্যরা কয়েদঘরে ঢুকল। বন্দিদের খাওয়া চলছে, তখন গোঁফদাড়িওয়ালা একজন ঢুকল। সৈন্যরা, প্রহরীরা মাথা ঝুঁকিয়ে সেই লোকটিকে সম্মান জানাল। বোঝা গেল ওই লোকটি সেনাপতি।
সেনাপতি তলতেক ভাষায় কী সব বলে গেল, ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝল না। শুধু একটা কথা বুঝল, রাজা তুতজ! ওই দেশীয় বন্দিরা জলটল খেয়ে দরজার কাছে সারি দিয়ে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসরাও গিয়ে সারিতে দাঁড়াল। সেনাপতি দেখল কিন্তু কোনও কথা বলল না।
ঘর থেকে বন্দিরা বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিসরাও ওদের পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল। সবাই সারি দিয়ে হেঁটে চলল একটা বেশ বড় পাথর বাঁধান বাড়ির দিকে। পেছনে সেনাপতি। সঙ্গে চার-পাঁচজন সৈন্য। সবাই সেই বাড়িটায় ঢুকল। ঘরটা অন্ধকার অন্ধকার। ফ্রান্সিস কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। অন্ধকার ভাবটা অল্পক্ষণের মধ্যেই চোখে সয়ে গেল। ফ্রান্সিস দেখল একটা পাথরের সিংহাসনে রাজা তুতজ বসে আছে। সিংহাসনের গায়ে নানা জায়গায় মণিমাণিক্য গাঁথা। রাজার দু’পাশে দুটো কাঠের আসনে বসে আছে দুই বৃদ্ধ। বোঝা গেল মন্ত্রী ও অমাত্য।
রাজা তুতজ বয়স্ক লোক। ঢোলা হাতা জামা পরে আছে। পোশাকে সুতোর কারুকাজ। মাথায় কাপড়ের টুপিমতো। পাকানো গোঁফ।
সেনাপতি মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে তলতেক ভাষায় একনাগাড়ে কী বলে গেল। রাজা তুতজ ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। কিছু বলল। ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝল না। এবার আসনে বসা অমাত্যটি ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলল, “তোমরা কে? এখানে এসেছ কেন?”
ফ্রান্সিস আশ্বস্ত হল, যাক, ভাঙা ভাঙা বললেও একজন স্পেনীয় ভাষা জানা লোক পাওয়া গেছে।
আমরা জাতিতে ভাইকিং। বিভিন্ন দেশে, দ্বীপে আমরা ঘুরে বেড়াই আমাদের জাহাজ নিয়ে। গুপ্তধনের কথা শুনলে তা উদ্ধার করি। সেই গুপ্তধনের মালিককে তা দিয়ে দিই। একটা স্বর্ণমুদ্রাও আমরা নিই না।” হ্যারি বলল।
অমাত্য হ্যারির কথাগুলি রাজা তুতজকে বলল। রাজা আবার কী বলল। সেটা অমাত্য বলল–“দেশের পশ্চিমদিকে মায়পানদের রাজ্য-শত্রু- তোমরা গুপ্তচর।”
ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল, “এটা মিথ্যে। আমরা কারও গুপ্তচর নই।” রাজা তুতজের কথা এবার অমাত্য স্পেনীয় ভাষায় অনুবাদ করে দিতে লাগল।
রাজা তুতজ বলল, বলছিলে তোমরা গুপ্তধন উদ্ধার করেছ। পারবে রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন ভাণ্ডার উদ্ধার করতে?”
ফ্রান্সিস বলল, “সেই গুপ্তধন কোথায় আছে বলুন। আমরা যা দেখতে চাই, যেখানে যেতে চাই তার অনুমতি দিন আমরা রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন উদ্ধার করব।”
“বৃথা চেষ্টা। পারবে না। অবশ্য মায়াপানদের দেশের চিচেন ইতজাতেও রাজা হুনাকমিনের ধনসম্পদ লুকানো আছে।” রাজা তুতজ বলল।
“এখানকার গুপ্তধনই আমরা খুঁজব। এখানে কোথায় আছে সেটা?” ফ্রান্সিস বলল।
“সঠিক কেউ বলতে পারবে না। তবে এখানকার মন্দিরে কোথাও আছে– এটাই আমাদের বিশ্বাস।” রাজা তুতজ বলল।
“ঠিক আছে। আমাদের মুক্তি দিন। আমরা গুপ্তধন খুঁজব।”
“বেশ, তোমাদের মুক্তি দেওয়া হল। সেনাপতি তোমাদের কাল সৈন্যাবাসে থাকতে দেবেন।” রাজা তুতজ বললেন।
এবার রাজা তুতজ হেসে উঠল। ফ্রান্সিস এবার লক্ষ্য করল রাজা তুতজের। কুতকুতে চোখ। চোখের চাউনিটাও অত্যন্ত ক্ষুরধার। চোখমুখ দেখে বোঝা দায় লোকটা মনে মনে ঠিক কী চাইছে? রাজা তুতজ হাসি থামিয়ে বলল, “তোমরা ফিরে এসে বল–গুপ্তধনের কোনও হদিস পেলে কি না।”
“নিশ্চয়ই বলব।” ফ্রান্সিস বলল। “তবে মন্দিরের গর্ভগৃহটা বড় ছোট। একটু বড় হলে ভাল হত।”
ফ্রান্সিস কোনও কথা বলল না, রাজা তুতজ আবার হেসে উঠল।
ফ্রান্সিস বুঝল না রাজা তুতজ বারবার হেসে উঠছে কেন? লোকটার কি অন্য মতলব আছে?
ফ্রান্সিসরা সভাগৃহের বাইরে এল। একজন সৈন্য এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসদের ইশারায় পেছনে পেছনে হাঁটতে বলল। ফ্রান্সিসরা সৈন্যটার পেছনে পেছনে চলল। বিস্তৃত প্রান্তর পার হয়ে লম্বা ঘরগুলোর সামনে এল। সৈন্যটি একটা ঘরের দরজা খুলে ওদের ঢুকতে বলল। ফ্রান্সিসরা ঘরটায় ঢুকল। ঘরটার মেঝেয় ঘাসপাতা দড়ি দিয়ে বাঁধা বিছানা। তাতে সুতোর কাজ করা চাদর পাতা। সৈন্যটি ইঙ্গিতে বিছানাটা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। ফ্রান্সিসরা বিছানায় বসল। আরও দু’জন সৈন্যকে দেখল শুয়ে আছে। ফ্রান্সিসও শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে ভাবতে লাগল–ব্যাপারটা কি এত সহজ? মন্দিরের গর্ভগৃহে গুপ্তধন আছে এটা যদি সকলের জানাই থাকবে তা হলে এতদিনেও তা উদ্ধার করা হল না কেন? এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও গোপনীয় কিছু আছে। যাক গে, কালকে গর্ভগৃহ দেখলেই বোঝা যাবে কোনও কিছু ওদের কাছে গোপন করা হয়েছে কি না। ওদিকে আর এক চিন্তা মারিয়া আর বন্ধুরা। ওরা বোধ হয় চিন্তায় পড়েছে–ফ্রান্সিসদের ফিরে আসতে দেরি হচ্ছে কেন?
পরদিন সকালের খাবার ওরা খেয়ে উঠেছে তখন। দু’জন সৈন্য বর্শা হাতে ওদের কাছে এল। তলতেক ভাষায় কী বলল। হ্যারি বারবার বলল, “মন্দির, মন্দির। সৈন্যটি মাথা ওঠানামা করল। তারপর ঘরের বাইরে আসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস, হ্যারি আর শাঙ্কো ঘরের বাইরে এল।
দু’জন সৈন্য হাতে বর্শা নিয়ে প্রান্তরে নামল। ওদের একজনের হাতে একটা নেভানো মশাল।
ফ্রান্সিসরা ওদের পেছনে পেছনে চলল। ফ্রান্সিস তখনও ভেবে চলেছে এসবের পেছনে রাজা তুতজের কোনও অসৎ ইচ্ছা আছে কি না। ওদের বিপদে ফেলাই রাজা তুতজের ইচ্ছে কি না।
কিছু দূরে একটা টিলা দেখা গেল, তারই নীচে মন্দিরটা। তিনকোনা মন্দির। মন্দিরের সামনে থাক থাক সিঁড়ি উঠে গেছে। দু’পাশে পাথরের দেওয়াল। মন্দিরটা পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।
সবাই সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। সৈন্য দু’জন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। ফ্রান্সিসদের আসতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। দু’পাশের চুনাপাথরের দেওয়ালে পাথর কুঁদে পাখি ফুল লতাপাতার নকশা। সব রঙিন। এই পিরামিড-মন্দিরে অতীতের মৃত রাজাদের সমাধি দেওয়া হয়। এখানে সেই মৃত রাজাদের পুজো হয়।
সৈন্য দু’জন এবার সিঁড়ি দিয়ে নীচের দিকে নামতে লাগল। পেছনে ফ্রান্সিসরা। একটু নামতেই অন্ধকারের মধ্যে ওরা এসে পড়ল। সৈন্যটা চকমকি ঠুকে মশাল জ্বালল। মশালের কঁপা কাঁপা আলোয় সিঁড়ি দেখা যেতে লাগল।
সবাই নেমে চলল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সিঁড়ি শেষ হল। সামনে পাথরের দরজা খোলা। সকলে দরজা পার হল। আবার ছোট ছোট সিঁড়ি। আরও নীচে নামল সবাই। একটা চৌকোনো ঘরে এসে সিঁড়িটা শেষ হল। ফ্রান্সিসরা অসহ্য গরমে ঘামতে লাগল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি জামা খুলে ফেলল। শাঙ্কো জামা খুলল না। জামা খুললে ছোরাটা লুকিয়ে রাখা যাবে না।
চৌকোনো ঘরটা দেখিয়ে সৈন্যদের একজন ইঙ্গিত করল ঘরটায় নামতে। ঘরটার মেঝেয় বাসি ফুলপাতা ছড়ানো। ফ্রান্সিস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশটা দেখল। কোথাও কোনও ফাঁকফোকর নেই। মেঝেটা তেলতেলে। মশালের আলোয় পড়ে চকচক করছে। ফ্রান্সিস এর কোনও কারণ বুঝল না।
হ্যারি মেঝেয় নামেনি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল। ফ্রান্সিস হঠাৎ ওপরের দিকে তাকাল। মশালের আলোয় দেখা যাচ্ছে পাথরের ছাদ। চোখ নামাতে গিয়ে দেখল মশাল হাতে সৈন্যটি হাসছে। ফ্রান্সিস ভাবল, সৈন্যটি হাসছে কেন?
তখনই ওই সৈন্যটি হাতের মশাল ঘরটার মেঝেয় ছুঁড়ে দিল। দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। ধোঁয়া উঠল। আগুন ছড়াতে লাগল। ফ্রান্সিস ততক্ষণে চিৎকার করে বলল, “শাঙ্কো, উঠে পড়ো সিঁড়িতে।” সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিতেই ধোঁয়া কেটে গিয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ল মেঝেয়। সৈন্য দু’জন এবার হ্যারিকে বর্শা দিয়ে খোঁচা দিয়ে ইঙ্গিত করল আগুন-জ্বলা মেঝেতে নামতে। ফ্রান্সিস এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেই সৈন্যটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সৈন্যটি বর্শা ছোঁড়ার অবকাশ পেল না।ফ্রান্সিস ওকে এক জোর ধাক্কা দিল। সৈন্যটি সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে মেঝের আগুনে পড়ে গেল। আর্তনাদ করে উঠল। অন্য সৈন্যটি শাঙ্কোর দিকে বর্শা ছুঁড়ল। শাঙ্কো জামার তলা থেকে ছোরাটা বার করে সৈন্যটির বুক লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। শূন্যে পাক খেয়ে ছোরাটা সৈন্যটির বুকে বিঁধে গেল। সৈন্যটি দু’হাতে ছোরাটা টেনে বার করল। ছোরাটা সিঁড়ির ওপর রেখে সৈন্যটি সিঁড়ির ওপর গড়িয়ে পড়ল। শাঙ্কো এক ছুটে গিয়ে ছোরাটা তুলে নিল।
ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল, “হ্যারি, শাঙ্কো, ওপরের দিকে চলো, জলদি।”
তিনজনে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। কিছুটা উঠেই দেখল সব অন্ধকার। মেঝেয় জ্বালা আগুনের আলো এতদূর এসে পৌঁছয়নি। অন্ধকারেই ওরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। অন্ধকারে হ্যারি কয়েকবার পা ফসকে সিঁড়ির ওপর পড়ে গেল। ফ্রান্সিস অন্ধকারেই হারিকে তুলে দাঁড় করাল। তারপর আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল।
ওরা যখন মন্দিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তখন বিকেল। ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল, হ্যারি, শাঙ্কো ওই জঙ্গলটার দিকে ছোটো।”
বেশ কিছুদূরে একটা জঙ্গল শুরু হয়েছে। তিনজনে সেদিকে ছুটল। কিছুটা গিয়ে ফ্রান্সিস বলল, “এখানে আমাদের থাকা চলবে না। একটা সৈন্যকে মেরেছি, আর একটাকে আহত করেছি। রাজা তুতজ আমাদের ধরতে পারলে মেরে ফেলবে। কাছেই ওই বনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢুকে পড়তে হবে। তারপর দেখা যাক বনের শেষে কী আছে।”
তিনজনে ছুটছে। মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। হ্যারির শরীর বরাবরই দুর্বল। ও বেশ পিছিয়ে পড়ছে। ফ্রান্সিস একটু পিছিয়ে পড়ে হ্যারিকে উৎসাহ দিচ্ছে। কখনও # গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ছুটছে।
ওরা জঙ্গলটায় ঢুকে পড়ল। কয়েকটা গাছগাছালি পার হয়ে হ্যারি দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা গাছের কাণ্ডে ভর রেখে দাঁড়াল। ভীষণ হাঁফাতে লাগল। ফ্রান্সিস, শাঙ্কো হ্যারির কাছে এল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছুটা সবুজ ঘাসের জমির ওপর বসল। তারপর শুয়ে পড়ল। হ্যারি আর শাঙ্কো সেখানে বসে পড়ল। তিনজনেই হাঁপাতে লাগল।
ফ্রান্সিস বলল, “শাঙ্কো, বনের আড়াল থেকে দেখে এসো তো রাজা তুতজের সৈন্য আমাদের খোঁজে এদিকে আসছে কিনা।” শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। আস্তে-আস্তে বনের শেষ দুটো গাছের আড়ালে দাঁড়াল। দেখল দূরে লোকজন নিজেদের কাজ করছে। ছোট ছোট দোকানে কেনাকাটা করছে। ধারেকাছে কোথাও কোনও সৈন্য নেই।
শাঙ্কো ফিরে আসবে বলে পা বাড়িয়েছে তখনই দেখল চার-পাঁচজন সৈন্য বর্শা হাতে জঙ্গ লের দিকে ছুটে আসছে। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় কর্ণার ধারালো মুখগুলো কচক করছে।
শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ফিরে দাঁড়াল। ছুটে ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল, “ফ্রান্সিস, চার-পাঁচজন সৈন্য ছুটে আসছে এই বনের দিকে।”
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। বলল, “বনটা বোধহয় গভীর বন। গাছের গুঁড়ির জটলার মধ্যে দিয়ে ছুটতে হবে। কাজেই জোরে ছুটতে পারব না। কিন্তু এখানে থাকা নিরাপদ নয়। ছোটো।”
তিনজনে আবার ছুটতে লাগল। কিছুটা যেতেই গভীর বন শুরু হল। গাছের গুঁড়িতে শেকড়বাকড়ের মধ্যে দিয়ে ছোটা অসম্ভব। তবু যতটা দ্রুত সম্ভব ওরা চলল। অন্ধকার বনের তলে কোথাও কোথাও রোদের টুকরো দেখা যাচ্ছে। সারাদিন স্নান খাওয়া নেই, তারপর অতটা ছুটে আসা। ওরা ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল। বিশেষ করে হ্যারি আর চলতেই পারছিল না।
ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “আর যাব না এখন। আমরা এখন সৈন্যদের নাগালের বাইরে।”
ওরা ওখানেই বসে পড়ল। হাঁফাতে লাগল। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল ওরা। শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। এ-গাছের মাথা ও-গাছের মাথা দেখতে লাগল। প্রায় অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তার মধ্যেই ও দেখল, ডানদিককার গাছটার মাথায় বেশ কিছু হলুদ রঙের পাকা ফল। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল। সেই গাছটার কাণ্ড বেয়ে বেয়ে গাছটায় উঠল। ডালপালার মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে গাছটার মাথায় উঠে গেল। ডালপালার মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু পাকা ফল ঝুলছে। শাঙ্কো কোমর থেকে ছোরাটা বার করল। তারপর ডালটার গোড়াটায় ছোরার কয়েকটা ঘা মারল। ডাল কেটে গেল। এদিকে ওদিকে আরও পাকা ফল। কী গাছ কী ফল কিছুই বুঝল না। ওখানে বসেই একটা পাকা ফলে কামড় বসাল। আশ্চর্য! কী মিষ্টি!কী স্বাদ! শাঙ্কো ফলটা খেতে খেতে অন্য ফলগুলো নিয়ে নেমে এল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি ফল ছিঁড়ে নিয়ে খেতে লাগল। খুব সুস্বাদু ফল। শাঙ্কো বলল, “গাছে উঠছি। আরও কিছুফল নিয়ে আসছি।”শাঙ্কো আবার গাছে উঠল।কয়েকটা ফলসহ গাছের ডাল কেটে নিয়ে নীচে নেমে এল। সবাই ফল খেতে লাগল। খিদেটা কিছুটা মিটল।
এবারে বন থেকে বেরোন। ফ্রান্সিস বলল, “চলো, আমরা উত্তরদিকে লক্ষ্য করে যেতে থাকি। দেখা যাক বনের বাইরে যেতে পারি কি না।”
আবার অন্ধকারে চলা শুরু হল। জল তেষ্টায় ওরা তখন কাহিল। কিছু দূর যেতেই একটা ডোবামতো পেল। অন্ধকারে বোঝাই গেল না–ওই ডোবার জল কেমন। তখন আর সেসব ভাববার সময় নেই। ইচ্ছেও নেই। তিনজনেই আঁজলাভরে জল তুলে খেতে লাগল। শুকনো জিভে মুখে যেন এতক্ষণে সাড় এল। ফ্রান্সিস উবু হয়ে বসে মাথাটা জলে ডোবাল, জল খেল। তারপর ঘাড়ে মাথায় জল ছেটালো। হ্যারি আর শাঙ্কোও তাই করল। এতক্ষণে শরীরটা যেন ঠাণ্ডা হল।
তারপর আবার চলা।
অন্ধকারে সাবধানে গাছের শেকড়বাকড়ে পা ফেলতে হচ্ছে। কাজেই চলার গতি কমে আসছে।
হঠাৎ ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছনে শুকনো ডালপালা ভাঙার শব্দ। ফ্রান্সিস হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে শব্দটা থেমে গেল। হ্যারি বলল, “ফ্রান্সিস শব্দটা আমিও শুনেছি। নিশ্চয়ই কেউ আমাদের অনুসরণ করছে।” ফ্রান্সিসরা আবার হাঁটতে লাগল। পেছনে আবার শব্দ। শুকনো ডালপাতা ভাঙার শব্দ। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। শাঙ্কো ছোরাটা কোমর থেকে খুলে হাতে নিল। আবার চলল ওরা। আবার শব্দ।
এবার শব্দটা অনেক কাছে। ফ্রান্সিস হঠাৎ পেছনদিকে ঘুরে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল, “কে আমাদের অনুসরণ করছ! সাহস থাকে আমাদের সামনে এসো।”
পেছনের অন্ধকার থেকে কার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “আমি আলফানসো, স্পেনীয়, আমি আপনাদের কোনও ক্ষতি করব না। আপনাদের বন্ধুত্ব চাই।”
“সামনে এসো।” ফ্রান্সিস বলল। পেছনের অন্ধকার গাছগাছালির আড়াল থেকে আলফানসো বেরিয়ে এল! ফ্রান্সিসদের সামনে এসে দাঁড়াল। অন্ধকারে মোটামুটি দেখা গেল মুখে গোঁফদাড়ি ভর্তি এক বয়স্ক লোক। মাথার কাঁচাপাকা চুল বড় বড়, এলোমেলো, ঘাড় ছাপিয়ে নেমে এসেছে।
নাম তো শুনলাম আলফানসো। আমাদের অনুসরণ করছ কেন?” ফ্রান্সিস বলল।
আলফানসো বলল, “সে অনেক কাহিনী আমার জীবনের। আপনারা যখন ছুটে এসে বনে ঢুকলেন তখন থেকেই আপনাদের পেছন পেছন আসছি। আপনারা স্পেনীয় ভাষায় কথা বলছিলেন। শুনে এত ভাল লাগল। আঃ, কতদিন মাতৃভাষা শুনিনি–বলিওনি। আপনাদের পরিচয় জানতে ইচ্ছে করছে।”
হ্যারি বলল, “আমরা জাতিতে ভাইকিং। তবে নিজেদের মাতৃভাষা ছাড়া আমরা পোর্তুগিজ স্পেনীয় ভাষা জানি।” তারপর হ্যারি আস্তে-আস্তে নিজেদের দেশে দ্বীপে ঘুরে বেড়ানো গুপ্তধন আবিষ্কার সংক্ষেপে বলে গেল। আলফানসো বলে উঠল, আপনারা রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবেন?”
সব না জেনে, না বুঝে বলি কী করে?” ফ্রান্সিস বলল।
“আমরা এই বনের উত্তরপ্রান্তে এসে গেছি। আর কিছুক্ষণ হাঁটলে বনের শেষে এক বড় প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছব। আগে সেখানে চলুন। ওখানে খাবার জোগাড় করব। খেয়েটেয়ে সব বলব।”
ফ্রান্সিসরা আর কিছু বলল না। নীরবে হাঁটতে লাগল।
সত্যিই আধঘণ্টার মধ্যে ওরা বনের শেষে এসে উপস্থিত হল।
অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় ঘাসে ঢাকা প্রায় অন্ধকার প্রান্তরটা দেখা গেল। আলফানসো বলল, “চলুন, আমার এক পরিচিত বুড়িমার বাড়ি আছে। সেখানে আশ্রয়, খাওয়া দুটোই জুটবে।”
ওরা প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে উত্তরমুখো চলল। ততক্ষণে আকাশের অন্ধকার কেটে গেছে। পুবদিকের আকাশ লালচে হয়েছে। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
একটু পরেই সূর্য উঠল। ফ্রান্সিস সেদিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। মনে মনে ভাবল, কী সুন্দর সূর্যোদয়। সমুদ্রে সূর্যোদয় তো কত দেখেছে। এক উন্মুখ প্রান্তরের পরে এরকম সূর্যোদয় কোনওদিন দেখেনি। মারিয়া এই দৃশ্য দেখলে খুশিতে নেচে উঠত। মারিয়া আর বন্ধুরা জাহাজে রয়েছে। একথা ভাবতেই ফ্রান্সিসের মন খারাপ হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্রান্সিস হাঁটতে লাগল। ওসব ভাবতে গেলে মন দুর্বল হয়ে পড়বে।
ঘাসে ঢাকা প্রান্তর শেষ হল। কিছু ঘরবাড়ি দেখা গেল। সকালের উজ্জ্বল রোদ পড়েছে বাড়িঘরে। গাছগাছালিতে বিস্তৃত প্রান্তরে বাড়িগুলি চুনাপাথর আর কাঠে তৈরি। একটা ছোট রাস্তায় ওরা ঢুকল। কয়েকটা বাড়ির পরে একটা বেশ পুরনো বাড়ির সামনে এল ওরা। আলফানসো বাড়িটার দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে কে যেন সাড়া দিল। কী বলল, ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝল না। বাড়ির দরজা খুলে গেল। দেখা গেল এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে। তিনি এগিয়ে এসে আলফানসোকে জড়িয়ে ধরলেন। আলফানসো কী বলে উঠল, বৃদ্ধা ফোকলা দাঁতে হাসলেন। কী যেন বললেন, আলফানসো ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে কী বলল। বৃদ্ধা চোখমুখ কুঁচকে হেসে উঠলেন। ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ভেতরে আসতে ইঙ্গিত করলেন। সবাই বাড়িটাতে ঢুকল। সামনের ঘরটাতে ঢোকবার জন্য বৃদ্ধা ইঙ্গিত করলেন। সবাই ঘরটায় ঢুকল। দেখল মেঝের শুকনো ঘাস বুনে বুনে বিছানামতো করা হয়েছে, সেটা পাতা। ঢাকা কাপড়টায় নানা রঙের লতাপাতা সেলাই করে তোলা। সবাই বসল। আলফানসো বলল, “মজার ব্যাপার শুনুন। এই বৃদ্ধার একটি ছেলে যৌবনে মারা গিয়েছিল। আমার নাক চোখ মুখ ঠিক তার মৃত ছেলের মতো, বৃদ্ধা বলেছিল। তাই আমাকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসে। শুধু থাকা-খাওয়া নয় আমাকে অর্থ সাহায্যও করে। এদিকে কোনও কারণে এলে এই বৃদ্ধা মার কাছে আমাকে আসতেই হয়। বৃদ্ধা মা আমাকে কত যত্ন আত্তি করে। নিজের ছেলের মতো ভালবাসে।”
গতকাল খাওয়া জোটেনি। জলও খেতে পারেনি। রাত কেটেছে নিদ্রাহীন। ফ্রান্সিসরা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। হ্যারি বরাবরই দুর্বল। ও এত ধকল সইতে পারল না। না খেয়েই অসহ্য ক্লান্তিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস, শাঙ্কো হ্যারিকে আর ডাকল না। ঘুমোক।
একটু বেলায় বৃদ্ধা এলেন। আলফানসোকে ডাকলেন। ওদের চিনেমাটির থালায় গোল চাকা চাকা রুটি, শাকসবজির ঝোল খেতে দিলেন। শাঙ্কো হ্যারিকে ডাকল, “হ্যারি, ওঠো খেয়ে নাও।” হ্যারি উঠে বসল।
ওরা চারজন খেয়ে নিল। খাওয়া দাওয়া সেরে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চোখ বুজল। নানা ভাবনা মাথায়। জাহাজে মারিয়া কেমন আছে, বন্ধুরা কেমন আছে। আমরা তো পালাতে গিয়ে এখানে এসে পড়লাম!
বিকেল নাগাদ সকলের ঘুম ভাঙল। ফ্রান্সিস শুয়ে থেকেই আলফানসোকে বলল, “তুমি তো স্পেন দেশের লোক। তুমি এখানে এলে কী করে?”
তখন আলফানসো ওর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলল। তারপর বলতে লাগল, “আমি তুলাম নগরে এসে পৌঁছেছিলাম। সেখানে বেশ কিছুদিন ছিলাম। তার মধ্যে তলতেক ভাষাটা শিখে নিয়েছিলাম। আমার ঢোলা জামাটার হাঁটু অবধি ঝুল ছিল। কোমরের তলায় তরোয়ালটা ঝুলিয়ে রাখতাম। জাহাজে কালো রং করা হয়। এক ধরনের ফল জলে সেদ্ধ করে এই রং পাওয়া যায়। আমি সেটা দিয়েই তরোয়ালটা রং করলাম। এখানকার লোকেরা জীবনে কখনও তরোয়াল দেখেনি। আমিও রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ তরোয়ালটার ওপর ঝুঁকে মাথা নোয়াতাম। বিড়বিড় করে কিছু বলতাম। আবার হাঁটতে থাকতাম। লোকেরা ধরে নিল তরোয়ালটা কোনও দেবমূর্তি। একটা পবিত্র জিনিস।
“দিন আমার ভালই কাটছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ভাল রইল না। রাজা তুতজ আমাকে রাজসভায় ডেকে পাঠাল।
“গেলাম রাজসভায়। রাজা তুতজ খুব হেসেটেসে বলল, তোমরা বিদেশী। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। আমি চুপ করে রইলাম আরও কী বলে শোনার জন্য। রাজা তুতজ বলল রাজা হুনাকমিনের নাম শুনেছ?”
“শুনেছি। এখানে এসে।” আমি বললাম।
“এখানকার মন্দিরের গর্ভগৃহে তার ধনসম্পত্তি গোপনে রাখা আছে এটা শুনেছ?” রাজা তুতজ বলল।
“শুনেছি, তবে পরিষ্কার বুঝিনি।” আমি বললাম।
“এখন সব বুঝবে ওই গর্ভগৃহে গুপ্তধন খুঁজতে গেলে।” রাজা তুতজ বলল।
“কিন্তু মাননীয় রাজা, একটা কথা বুঝতে পারছি না। যদি আপনারা জানেনই যে ওই গর্ভগৃহে গুপ্তধন আছে তবে তার খোঁজ করেননি কেন?”
“আমার লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে কিন্তু পায়নি।”
“তবে আমি কী করে পারব?” আমি বললাম।
“বললাম তো, তোমরা বিদেশী, খুব বুদ্ধি তোমাদের। রাজা তুতুতজ বলল।
“বেশ দেখি গর্ভগৃহে নেমে।” আমি বললাম।
“পরের দিন নামলাম গর্ভগৃহে।”
ফ্রান্সিস হেসে বলল, “তারপর গর্ভগৃহের মেঝেয় সঙ্গের পাহারাদার মশাল ছুঁড়ে ফেলল। আগুন জ্বলে উঠল।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমাদেরও নামতে বলেছিল?” আলফানসো বলল।
“হ্যাঁ, পাহারাদার সৈন্য দু’জনকে কাবু করে আমরা পালিয়ে এসেছি।”ফ্রান্সিস বলল।
“ঠিক, ঠিক। আমিও তাই করে এখানে পালিয়ে এসেছি।” আলফানসো বলল।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “সত্যিই কি অতীতের বীর রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন ওখানে আছে?”
“না। তুলামের মন্দিরে নেই। আছে চিচেন ইতজার মন্দিরে।” আলফানসো বলল।
“সেটা তুমি কী করে বুঝলে?” ফ্রান্সিস বলল।
একটু চুপ করে থেকে আলফানসো বলল, “তোমাদের এসব বলে কী হবে। তোমরা কি পারবে হুনাকমিনের গুপ্তভাণ্ডার খুঁজে বের করতে?” ফ্রান্সিস হাসল। বলল, “তুমি আগে সমস্ত ব্যাপারটা বলল। সব দেখি, শুনি, তবেই বুঝতে পারব সেই গুপ্তধন উদ্ধার করা যাবে কি না।”
“সব বলছি। কিন্তু তার আগে আমাকে কথা দাও যে হুনাকমিনের গুপ্তধন উদ্ধার হলে আমাকে ভাগ দিতে হবে।” আলফানসো বলল।
“আগে উদ্ধার তো হোক।” হ্যারি বলল।
“না। আমি তার আগেই বাটোয়ারা চাই। আমি অর্ধেক নেব।” আলফানসো বলল।
“অর্ধেক কেন? সবটাই নিও।” ফ্রান্সিস বলল।
আলফানসো লাফিয়ে উঠলো, “আঁ! ঠিক তো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। এবার তুমি এই ব্যাপারে যা যা জানো বলো।” ফ্রান্সিস বলল।
“তোমাদের তো বলেছি আমি জলদস্যুদের জাহাজে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তারপর এই দেশে আসা। এই দেশে এসে আমি কী করলাম সেটা বলি। কীভাবে নকশাটা পেলাম সে কথাও বলি।” একটু থেমে আলফানসো বলতে লাগল, “এখানে তুলাম বন্দরশহরে এলাম। বেশ মনোযোগ দিয়ে এখানকার তলতেক ভাষা আরও ভাল করে শিখলাম। তারপরে রাজা তুতজ আমাকে লোভ দেখিয়ে গর্ভগৃহে পাঠাল। আমি পালালাম। চললাম চিচেন ইতজার দিকে। যাওয়ার পথে এই কোবানগরে এলাম। বুড়িমাকে পেলাম। বেশ আদরযত্নে মাস কয়েক রইলাম।”
আলফানসো একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এখানকার ইতিহাস জানলাম। এই দেশটার পুবদিকে বাস করে মায়াপানরা। পশ্চিমদিকে চিচেন ইতজা। রাজা হুনাকমিনের সঙ্গে মায়পানদের যুদ্ধ হয়েছিল। মায়পানরা হেরে যায়। হুনাকমিন চিচেন ইতজার মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কী সুন্দর মন্দির। ওখানে গেলে দেখতে পাবেন।” আলফানসো থামল।
“আলফানসো কোনও একটা গোপন কিছু তুমি জান। সেটা বলো।” হ্যারি বলল।
“হ্যাঁ, এবার সেটাই বলব। এই কোবা থেকে আমাকে পালাতে হল। এখানকার গোষ্ঠীপতি আমাকে ডেকে পাঠাল। গোষ্ঠীপতি জিজ্ঞেস করল, “শুনেছি তুমি বিদেশী। এখানে এসেছ কেন?”
“ভাগ্যক্রমে। জলদস্যুদের জাহাজ থেকে পালিয়ে আমি এখানে এসেছি। আবার ভাগ্যক্রমে এখানে আহার, বাসস্থান পেয়েছি। আমি বললাম।
“উঁহু, তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তুমি চিচেন ইতজার রাজা পাকানের গুপ্তচর।” গোষ্ঠীপতি বলল।
“আমি তলতেক ভাষাটা মোটামুটি শিখেছি। তাই আপনাকে বলছি, আপনিই ভেবে দেখুন, গুপ্তচরবৃত্তি আমি কেন করতে যাব। আমি বিদেশী। আপনাদের এই * দেশে হঠাৎই এসেছি।” আমি বললাম।
“বাজে কথা বলছ।” গোষ্ঠীপতি দু’জন পাহারাদারকে ইঙ্গিতে ডাকল। ওরা আমার দু’হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলল। বুঝলাম, হাজার চেষ্টা করেও গোষ্ঠীপতির সন্দেহ আমি দূর করতে পারব না। তাই দুর্ভাগ্য মেনে নিলাম।
“পাহারাদার দু’জন আমাকে একটা তালা লাগানো ঘরের সামনে নিয়ে এল। তালা খুলে আমাকে ওরা ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিল।
আমার বন্দীজীবন শুরু হল। আমি পালাবার ছক কষতে লাগলাম। ও-ঘরে আরও দু-তিনজন বন্দী ছিল। জঘন্য খাবার খেতে দিত। বমি উঠে আসে। মনে পড়ল বুড়িমার কথা। কী সুস্বাদু খাবার খেতে পেয়েছি। শুকনো ঘাসের নরম বিছানায় শুয়েছি। ঘুমিয়েছি।” আলফানসো থামল।
ফ্রান্সিস বলল, “তারপর? তুমি পালাতে পারলে?”
“হ্যাঁ। আমি লক্ষ্য করলাম যে দু’জন পাহারাদার খাবার নিয়ে আসে। হাতে বর্শা থাকে না, ওদের পেছনে থাকে দু’জন। দু’জনের হাতেই কাঠের বর্শা। লোহার ছুঁচলো মুখ। আমি অন্য বন্দিদের বললাম, শোনো, আমি পাহারাদারদের বলব যে আজ একটু রাতে আমরা খাব।” বন্দিদের একজন বলল, কেন?
“আমি পালাবার ছক কষে ফেলেছি। আমরা সবাই পালাব।” আমি বললাম।
রাত হল। আমি একজন পাহারাদারকে ডাকলাম। ও এল। বললাম, “আজ একটু রাতে খাব আমরা।”
“কেন?” পাহারাদার বলল।
“আমাদের খিদে নেই।” কথাটা বলে আমি বন্দিদের দিকে তাকালাম, ওরাও বলে উঠল, “আমরাও পরে খাব।
“বেশ।” পাহারাদার চলে গেল।
রাত বাড়ল।
“এবার পাহারাদাররা খাবার নিয়ে এল। দরজা খোলা হল। দু’জন বড় কাঠের পাত্রে সবজি, ঝোল নিয়ে এল। অন্যজনের হাতে রুটি রাখা কাঠের বড় রেকাবি। দরজার কাছ থেকে একজন পাহারাদার এগিয়ে এল। বর্শাটা পাথরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলাম। সবজি ঝোলের বড় কাঠের পাত্রটা তুলে নিয়ে দরজায় দাঁড়ানো একজন পাহারাদারের মাথায় ঢেলে দিলাম। পাহারাদার দুহাতে চোখ কচলাতে কচলাতে মেঝেয় বসে পড়ল। অন্য পাহারাদার কিছু বোঝার আগেই আমি খোলা দরজা দিয়ে দ্রুত ছুটে বাইরে চলে এলাম। অন্ধকারে দৌড় দিলাম প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। পেছনে শুনলাম পাহারাদারদের চাচামেচি। আমি ততক্ষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্য বন্দিরাও ততক্ষণে পালিয়ে গেছে।
আলফানসো থামল। তারপর আবার বলতে লাগল, “বুড়িমার এই বাড়িতে কয়েকদিন আত্মগোপন করে রইলাম। তারপর একদিন ভোরে ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চললাম চিচেন ইতজার উদ্দেশ্যে। বড় সড়ক এড়িয়ে জংলা জায়গা দিয়ে চললাম। দিনটা সেদিন একটু মেঘলা ছিল। কাজেই হাঁটতে কষ্ট হয়নি।
“সন্ধের সময় চিচেন ইতজা পৌঁছলাম। শরীর ক্ষুধাতৃষ্ণা আর ক্লান্তিতে যেন ভেঙে পড়ছে। দুপুরে একটা গ্রামের বাড়িতে চারটে মাংসের বড়া খেয়েছিলাম। তাতে খিদে মেটেনি, বরং বেড়ে গেছে।
“খুঁজতে খুঁজতে একটা ছোট সরাইখানা পেলাম। এখন এখানেই আশ্রয় নিতে হবে। সরাইখানার মালিক আমাকে দেখে হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। বেশ কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে মাথা একটু ঝুঁকিয়ে বলল, “কী খাবেন বলুন?”
“মাংস রুটি। এক্ষুনি চাই।” আমি বললাম।
“এক্ষুণি দেওয়া হবে। আপনি পেছনের ঘরে একটু বিশ্রাম নিন।” আমি পেছনের ঘরে ঢুকলাম। দেখি একটা মোটা মোমবাতি জ্বলছে। মেঝেয় কাঠের পাটাতনে বসলাম। বসে থাকতে পারলাম না। শুয়ে পড়লাম। সরাইখানার একটি অল্পবয়সী ছেলে একটা কাঠের পাত্রে জল নিয়ে এল। আমাকে দিল। আমি উঠে বসে সেই কাঠের পাত্রের সব জল খেয়ে ফেললাম। মুখ-গলার শুকনো ভাবটা কাটলো। তখন বুঝলাম আমার কী জলতেষ্টা না পেয়েছিল! পাত্রটা ফিরিয়ে দিলাম। ছেলেটি চলে গেল। আমি আবার শুয়ে পড়লাম।
“কিছুক্ষণ পরে ছেলেটি আমাকে গরম গরম রুটি আর মাংস দিয়ে গেল। আমি উঠে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। পর পর আরও একপাত্র মাংস রুটি নিয়ে জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম।
“ভোরবেলা ঘুম ভাঙল। পাখির ডাক শুনলাম। উঠে বসলাম। শরীরের আর ক্লান্তভাব নেই।” আলফানসো থামল।
“তারপর?”
“তারপর আমি ওই সরাইখানাতেই রইলাম। বেশ কিছুদিন। ঘুরে ঘুরে নগরটা দেখলাম। বেশ সাজানো-গোছানো শহর। অনেক ফুলের বাগান। রাস্তায় লোকজনের বেশ ভিড়। দোকানে দোকানে কাঁচ ঢাকা আলো। পথে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে করে চিচেন ইতজা মন্দিরের সামনে এলাম। মন্দিরের চারপাশে জলে ঘেরা। একেবারে সামনেই সিঁড়ি। সোজা উঠে গেছে মন্দিরের প্রায় মাথা পর্যন্ত। একটা সাঁকো মতো পার হয়ে মন্দিরের চত্বরে উঠতে হয়। সাঁকো পার হয়ে মন্দিরের চত্বরে এলাম। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। মন্দিরের প্রায় মাথার কাছাকাছি এসে সিঁড়িটা নীচে নেমে গেছে। মন্দিরের মাথায় একটা বড় একটা ছোট ঘরমতো। চারদিকে তাকিয়ে দেখে বুঝলাম ওই দুটো ছোট ঘরে ওঠার মতো সিঁড়ি নেই। ওখানে কেউ উঠতে পারবে না। তা হলে কি ওখানে ওঠা যায় না? এবার ঢাল সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলাম, চুনাপাথরে তৈরি দেওয়ালে ফুল, পাখি কুঁদে কুঁদে তোলা। নীচে নেমেই যাচ্ছি যেন এই সিঁড়ির শেষ নেই। ততক্ষণে চারদিকে অন্ধকার জমা হয়ে গেছে। কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। সিঁড়িগুলোতে আন্দাজে পা ফেলতে হচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। মশালের আলো ছাড়া এখানে কিছুই দেখা যাবে না, আমি ফিরে দাঁড়ালাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। কালকে আবার আসব। একটা মশাল ভাল করে তেলে ভিজিয়ে আনতে হবে।”
“তা হলে পরদিনও গিয়েছিলে?” ফ্রান্সিস বলল।
“হ্যাঁ, মশাল নিয়ে। আস্তে-আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। একটু পরেই সব অন্ধকার। মশাল জ্বালালাম। তিনদিকে পাথুরে দেওয়াল মতো। সিঁড়ি দেখতে দেখতে নামতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখলাম সিঁড়ি শেষ। একটা চৌকোনো ঘর। এবড়োখেবড়ো পাথরের দেওয়াল। চৌকোনো ঘরটার চারদিকে দেখলাম চুনাপাথরের আর বালির নয়টি পুরুষ মূর্তি। বুঝলাম মায়া ধর্মশাস্ত্রে বর্ণিত রাত্রির নয় দেবতার মূর্তি। ঘরের মাঝখানে ফুল, লতাপাতার স্তূপ। বোধ হয় এ দেশবাসিরা দেবতাদের পুজো করেছে?” আলফানসো থামল।
“তুমি ওইটুকুই দেখেছিলে?” হ্যারি বলল।
“শুধু ওইটুকুই নয়। ওই ছোট ঘরটার নীচেই রয়েছে আবার সিঁড়ি। ফুল, পাতা সরাতেই দেখলাম সেই সিঁড়ি। মশাল হাতে নামতে লাগলাম। মশালের আলো খুব কাঁপছেনা। বুঝলাম এখানে বেশি বাতাস ঢুকছে না। ফুল, পাতা, সরিয়ে দিয়ে সিঁড়িতে পা রাখলাম। এবারের সিঁড়িগুলো তত বড় নয়। বেশ দেখেশুনে নামতে হচ্ছিল। নামতে লাগলাম। খুব সাবধানে নামতে হচ্ছিল বলে চলার গতি কমে গিয়েছিল।” আলফানসো থামল।
শুধু ফ্রান্সিস বলল, “তারপর?” আর সবাই চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ পরে আলফানসো বলতে লাগল, “পরে দেখি আগের মতোই চৌকোনো একটা ঘর। তবে খুব ছোট। মেঝেয় রাখা একটা কফিন মতো। কফিনের ঢাকনা আর খুললাম না। বুঝলাম ওই কফিনে রয়েছে মিশরের মমির মতো কোনও রাজার মমি। হতে পারে সেই রাজা হুনাকমিন। মশালটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে দেখলাম। এবড়োখেবড়ো পাথুরে দেওয়াল। চুনাপাথর মেশানো। এখানেই কি রাজা হুনাকমিন তার ধনসম্পদ সব গুপ্তভাবে রেখে গেছেন? বারকয়েক চারদিক দেখে নিয়ে সিঁড়ির কাছে এলাম। একটু অপেক্ষা করলাম। তারপর আস্তে-আস্তে ওপরে উঠতে লাগলাম। নয় দেবতার ঘরটাও খুব ভাল করে দেখলাম। সেই চুনাপাথর মেশান এবড়োখেবড়ো দেওয়াল। বুঝলাম এখানে রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন নেই। মানুষের হাতে তৈরি এই গুহায় সকলেই আসতে পারে। কাজেই দীর্ঘকাল ধরে মানুষ এখানে পুজো দিতে এসেছে। রাজা হুনাককেও শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে। এখানকার গোপনীয়তা কিছু নেই। এখানে রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন থাকলে বহু আগেই তা আবিষ্কার হয়ে যেত। তাই আমার কেমন বিশ্বাস হল রাজা হুনাকমিনের ধনসম্পদ অন্য কোথাও গোপনে রাখা হয়েছে। এই গর্ভগৃহে নয়। এখনও মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্য কোথাও যা দেখবার তা দেখলাম। তারপর আমি আস্তে-আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম।” আলফানসো থামল।
সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। হ্যারি বলল, “ফ্রান্সিস, কী ভাবছ?” ফ্রান্সিস হেসে বলল, “রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন উদ্ধার।”
“আপনি পারবেন?” আলফানসো একটু অবাক হয়ে বলল।
“সেটা ঠিক এক্ষুনি বলতে পারছি না। চিচেন ইতজায় যাই, সব দেখি, শুনি, জানি, তখনই বলতে পারব এটা সম্ভব কি না। অর্থাৎ রাজা হুনাকমিনের গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করা যাবে কি না।”
অসম্ভব। পারবেন না।” আলফানসো বলল।
“বললাম তো, সব আগে দেখিটেখি, তারপর বলা যাবে অসম্ভব না সম্ভব।” ফ্রান্সিস বলল।
“বেশ, চলুন, সব জানুন, দেখুন।” আলফানসো বলল।
তখন সন্ধে হয়ে গেছে। আলফানসোর বুড়িমা একটা কাঠের বড় রেকাবি নিয়ে ঘরে ঢুকল। রেকাবিতে রাখা বড় বড় মাংসের পিঠে। ফ্রান্সিসরা খুব খুশি। পিঠে তুলে নিয়ে খেতে লাগল।
খাওয়া শেষ হলে ফ্রান্সিস বলল, “চলো, কোবা নগরটা কেমন দেখে আসি। আলফানসোই আমাদের দেখাবে সব।”
ওরা তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। চলল নগর দেখতে। ছোট নগর। লোকজনের খুব ভিড় নেই।
আলফানসো বলল, “চলো, আগে মন্দিরটা দেখি।”
আলফানসোর নির্দেশমতো চলল ওরা। বড় সড়কের ধারেই দেখল মন্দিরটা। খুবই ছোট মন্দির। দুটো সিঁড়ি সোজা ওপর দিকে উঠে গেছে। মাথায় একটা ছোট ঘরমতো।
ফ্রান্সিসরা ঘুরে ঘুরে দেখল। তখন তো রাত। মশালের আলোয় যতটুকু দেখবার দেখল।
ওরা যখন ফিরে আসছে, তখন একটা ঘটনা ঘটল। আলফানসো একটু পিছিয়ে পড়েছিল। দুটো লোক ওর দু’পাশে এসে দাঁড়াল। আলফানসোও দাঁড়িয়ে পড়ল। অল্প আলোয় আলফানসো দেখেই চিনল, সাইল, সঙ্গের লোকটা একটা গুণ্ডা। অর্থ পেলে সব করতে রাজি। আলফানসো বলল, “কী চাও তোমরা?”
সাইল একটু হেসে বলল, “চিচেন ইতজার এক সরাইখানায় একটা বয়স্ক লোক এসেছিল। তোমাকে একটা নকশা দিয়েছিল।”
“নকশা-টকশা কিছুনা, চিচেন ইতজার মন্দিরের হাতে আঁকা ছবি।” আমি বললাম।
“ঠিক আছে। যদি ওটা নকশা না হয় তা হলে আমাকে দিয়ে দাও।” সাইল বলল।
“দিতে তো পারতাম। কিন্তু আমার কাছে তো ওটা নেই।” আলফানসো বলল।
“কোথায় আছে নকশাটা?” সাইল বলল।
“সেই সরাইখানার মালিকের কাছে রেখে এসেছি। কী আর হবে ওই ছবি দিয়ে।” আলফানসো বলল।
“তুমি মিথ্যে কথা বলছ। ওই সরাইখানায় আমরা গিয়েছিলাম।” সরাইখানার মালিক বলল, “আমি ওই ছবির ব্যাপারে কিছুই জানি না।”
“ও মিথ্যে বলেছে।” আলফানসো বলল।
“বেশ, কাল সকালে চিচেন ইতজা চলো। সেইসরাইখানায় আমরা কালকে যাব। তুমিই মিথ্যে বলছ না সরাইখানার মালিক মিথ্যে বলেছে সেটা বোঝা যাবে।” সাইল বলল।
“চলো, দেখা যাক।” আলফানসো বলল।
“এখন নয়, কাল সকালে যাব আমরা।” সাইল বলল।
“আচ্ছা, আমি এখন তা হলে আমার আস্তানায় যাই।” আলফানসো বলল।
“না, তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে।” গুণ্ডাটা বলল
“কোথায়?” আলফানসো বলল।
“গেলেই দেখতে পাবে। তুমি আজ রাতের মতো আমাদের বন্দি হিসেবে থাকবে। কালকে আমাদের সঙ্গে চিচেন ইতজায় যাবে।”
গুণ্ডাটা শেষে বলল, “আমাদের কথামতো না চললে শেষ করে দেব।”
“বেশ আমি যাব।” আলফানসো বলল।
সাইল আর গুণ্ডাটার সঙ্গে আলফানসো চলল।
ওদিকে বেশ কিছুটা গিয়ে শাঙ্কো বলে উঠল, “আলফানসো কোথায়?”
ফ্রান্সিস আর হ্যারি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। আলফানসো নেই। ওরা রাস্তায় এদিকে ওদিকে ঘুরে এল। না। আলফানসো নেই।
ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো অনেকদিন এ-দেশে আছে। এই কোবা নগরও ওর খুবই পরিচিত। আমরা হারিয়ে গেলে বিপদ ছিল।”
“আমার মনে হয় আলফানসো বুড়িমার আস্তানায় চলে গেছে। চলো, আমরাও ওখানে যাই।” হ্যারি বলল।
চারদিকে তাকাতে-তাকাতে ফ্রান্সিস বলল, “বুড়িমার বাড়িটা যে কোথায় আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না।”
হ্যারি বলল, “আমার মনে আছে। সামনের মোড়টার বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে যেতে হবে। দেখতে থাকো কোনও বড় একটা ডুমুর গাছ পাও কি না। ওই ডুমুর গাছের গায়েই বুড়িমার বাড়ি।”
ডুমুর গাছ তো অনেক জায়গাতেই থাকতে পারে।” শাঙ্কো বলল।
“তা পারে। কিন্তু এতদূর ঘুরে এলাম, একটাও ডুমুর গাছ দেখিনি।” হ্যারি বলল।
“ঠিক আছে। ওই রাস্তা ধরেই চলো। দেখা যাক, ডুমুর গাছপাই কিনা।”ফ্রান্সিস বলল।
ওরা বাঁ দিকের রাস্তাটাই ধরল। বেশ কিছুটা যেতেই বাঁ দিকে একটা বড় ডুমুর গাছ দেখা গেল। হ্যারি হেসে বলল, “দ্যাখো, ডুমুর গাছটার গায়েই বুড়িমার বাড়ি।”
শাঙ্কো গিয়ে দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে গেল। বুড়িমা দাঁড়িয়ে আছেন। বুড়িমা ফোকলা মুখে হেসে বললেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য বেঁধেছি। তোমরা বাইরে কোথাও খাবে না।”
তলতেক ভাষা। ফ্রান্সিস ঠিক বুঝল না। হ্যারি কিছুটা আন্দাজ করে মাথা নাড়ল। বুড়িমা এটাকে সম্মতি ধরে নিয়ে হাসতে লাগলেন।
ফ্রান্সিসরা এসে বিছানায় বসল। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল, “বিপদ আসছে। আলফানসো আমাদের সঙ্গে নেই। বুড়িমা ফ্রান্সিসদের সবাইকে দেখতে দেখতে বললেন, “আমার ছেলে কই?”
হ্যারি হাতের ইঙ্গিতে বোঝাল আলফানসো আসছে। বৃদ্ধা আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন।
রাত হল। খাওয়ার সময় হল। আলফানসো তখনও ফিরল না। আলফানসোর বুড়িমা ঘর-বার করতে লাগলেন।
হ্যারি হাতের, চোখের ইঙ্গিতে বোঝাতে লাগল আলফানসো আসবে। বুড়িমা ইঙ্গিতটা বুঝলেন। কিন্তু আর একটু রাত বাড়তেই বুড়িমার কান্না শুরু হল।
ফ্রান্সিস বলল, “এখন তো সরাইখানাও ভোলা পাব না। আজকে রাতের মতো খাওয়া জুটবে না, শুয়ে পড়ো।” বুড়িমার ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না চলতেই লাগল।
ফ্রান্সিসরা ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু বুড়ির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার একঘেয়ে শব্দ আর খালি পেট। ঘুম আর আসবে না।
ওদিকে সাইল আর গুণ্ডাটা আলফানসোকে একটা বাড়িতে নিয়ে এল। পাথর আর কাঠের ভাঙাচোরা বাড়ি। বাইরের ঘরটায় ওরা ঢুকল। শুকনো ঘাসে তৈরি বিছানা। ওরা বসল বিছানায়।
সাইল বলল, “আলফানসো, আমি সবই দেখেছি। সেই নকশাটা পেয়ে তুমি খুশিতে আত্মহারা। আমি ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। বুড়োর সব কথা শুনিনি। কিন্তু যেটুকু শুনেছি তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এটা কোনও গুপ্তধনের নকশা।”
“ঠিক আছে। তুমি তো বললে বিশ্বাস করবে না। ছবি আঁকা কাগজটা দেখে কিছু বুঝলে কি না সেটা ভেবে দ্যাখো৷ ওটা চিচেন ইতজার ছবি ছাড়া কিছুই না।”
গুণ্ডাটা উঠে দাঁড়াল। বলল, “সাইল, চল, খেয়ে আসি। ভীষণ খিদে পেয়েছে।” তিনজনে ঘরে তালা দিয়ে খেতে বেরোল।
রাস্তায় যেতে যেতে আলফানসো একটা উপায় ভাবল। সেইমতো করলও। ও একপাশে ছিল। অন্যপাশে গুণ্ডাটা আর সাইল। আলফানসো হঠাৎ বসে পড়ল। গুণ্ডাটা আর সাইল নিচু হয়ে দেখতে গেল কী হয়েছে। আলফানসো সঙ্গে-সঙ্গে দু’জনকে জোরে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। দু’জনে দু’পাশে ছিটকে পড়ল। আলফানসো দ্রুতবেগে ডান দিকের অন্ধকার গলিটায় ঢুকে পড়ল। সাইল আর গুণ্ডাটার “ধর, ধর” চিৎকার শুনতে পেল। আলফানসো এবার অন্য একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। পেছনে আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। ও ছুটল বুড়িমার বাড়ির দিকে।
ফ্রান্সিসের বারেবারে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। হঠাৎ শুনল দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ। ফ্রান্সিস দ্রুত বিছানায় উঠে বসল। আস্তে-আস্তে দরজার কাছে গেল। মৃদুস্বরে বলল, “কে?”
“আমি, আমি আলফানসো।”
ফ্রান্সিস দরজা খুলে দিল। আলফানসো ঘরে ঢুকল। ও হাঁফাচ্ছে। দরজা খোলার শব্দে হারি আর শাঙ্কোর ঘুমও ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস আলফানসোকে বলল, “ভাই, তুমি আগে তোমার বুড়িমার কাছে যাও। তোমার বুড়িমা এখনও বোধহয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।”
আলফানসো বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ফ্রান্সিস বলল, “যাক, বাঁচা গেল। বুড়িমা এবার কান্না বন্ধ করবেন।”
একটু পরেই বুড়িমা ফ্রান্সিসদের ঘরে এলেন। একগাল হেসে বললেন, “তোমরা এখন ঘুমিয়ে পড়বে না। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো তোমার কী হয়েছিল?”
“সব ঘটনা না বললে ঠিক বুঝবে না।” আলফানসো বলল।
“আমারও মনে একটা খটকা আছে। তুমি সব কথা আমাদের বলোনি।”
আলফানসো বলল, “এবার সব বলছি। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি সে সময় চিচেন ইতজায় একটা সরাইখানায় ছিলাম। সেই সময় সাইল নামে একটা লোকও আমার ঠিক পাশেই ঘুমোত। আমাদের দুজনের মিলটা ভাল হল। সাইলেরও ত্রিসংসারে কেউ নেই। আমারও সেই অবস্থা।” আলফানসো থামল।
“তারপর?” হ্যারি বলল।
“একদিন গভীর রাতে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ শুনলাম। সরাইখানার মালিক দরজা খুলে দিল। অন্ধকারে কিছুই দেখেছিলাম না। শুধু গোঙানির শব্দ। সরাইখানার মালিক মোটা মোমবাতিটা জ্বালল। দেখি একজন বয়স্ক লোক। বুক দিয়ে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে মেঝের ওপর দিয়ে আসছে। সারা গায়ে মাথায় ধুলো জমে আছে। পোশাকে রক্তের দাগ। অবাক হয়ে ভাবলাম এই বয়সে লোকটা মারপিট করতে গেছে নাকি।
“মোমের আলোয় দেখলাম, লোকটার বাঁ পা রক্তমাখা। লোকটার গোঙানি চলল। ভাবলাম এর এক্ষুণি চিকিৎসার প্রয়োজন। সরাইখানার মালিক বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। সাইলও ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে। আমি সরাইখানার মালিককে বললাম, “আমি এই জায়গাটা ভাল চিনি না। ধারে কাছে কোথায় একজন বৈদ্যকে পাব?”
“রাস্তায় নেমে ডান দিকে দেখবেন একটা মাঠমতো। ওই মাঠের শেষেই একটা বিরাট গাছ। গাছটার ধারেই একটা বাড়ি। ওখানেই একজন বৈদ্য থাকেন। এই শেষ রাত। আসবে কি?” মালিক বলল।
“দেখা যাক।” এই বলে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। একটু গিয়েই মাঠ পেলাম। ঝাঁকড়া মাথা বিরাট গাছ। পেছনের বাড়িটায় গিয়ে টোকা দিলাম। ভেতরে কোনও শব্দ নেই। আবার জোরে টোকা দিলাম। ভেতর থেকে কেউ বলল, “কে?”
“খুব বিপদে পড়ে এসেছি। বৈদ্যমশাইকে একটু আসতে বলুন।”
“একটু পরেই দরজা খুলে গেল। এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। মুখে দাড়ি গোঁফ। বললাম, “বড় রাস্তায় যে সরাইখানাটা আছে আপনাকে দয়া করে সেখানে একবার যেতে হবে।”
“কিন্তু এত রাতে–মানে–“
“দয়া করে চলুন। লোকটির বাঁ পা বোধহয় ভেঙে গেছে। শরীরের অনেক জায়গায় আঘাত।” আমি বললাম।
“হু। আসছি।” বৈদ্য বললেন।
ওষুধের থলেটা নিয়ে বৈদ্য অল্পক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে এলেন। আমার সঙ্গে চললেন।
“আমরা সরাইখানায় ঢুকলাম। বৈদ্য ভীষণ আহত লোকটির কাছে বসলেন। পায়ের দিকের পোশাকটা কিছুটা তুললেন। মোমবাতির আলোয় দেখা গেল, পাটা মুচড়ে গেছে। তখনও রক্ত পড়ছে, তবে অল্প। বৈদ্য লোকটির পরনের ঢোলা হাতা জামা তুলে দেখলেন। লোকটির গোঙানি তখনও থামেনি। বৈদ্য ওর চোখ বুক কোমর দেখলেন। আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। মৃদু স্বরে বললেন, “বোধ হয়। কোনও উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গেছে। একটা পা ভেঙে গেছে। অন্য পা-টা মচকে গেছে। দাঁড়াতে পারবে না। মাথার পেছনেও ভীষণ লেগেছে। কী চিকিৎসা করব বলুন। এ বাঁচবে না।” আমি বললাম, তবু আপনি যতটা করার করুন।
“বেশ।” বৈদ্য কাপড়ের পোঁটলা থেকে ওষুধ বের করলেন। দুটো ছোট বোয়ামও বের করলেন। বোয়াম থেকে কী একটা কালো রঙের জিনিস তুলে দু’হাতের তেলো দিয়ে চেপে চেপে দুটো বড়ি করলেন। আমার হাতে দিলেন। বললেন, “দুটোই খাইয়ে দিন।” লোকটির দুই চোয়াল চেপে ধরে বললাম, “ওষুধটা খেয়ে নিন। লোকটি খেল। বৈদ্য একটা কাপড়ের টুকরো চাইলেন। সরাইখানার মালিক এনে দিলেন। বৈদ্য আহত লোকটির মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্ত মুছে দিলেন। তারপর বললেন, অল্প জল দিন। মালিক কাঠের গ্লাসে জল নিয়ে এলেন। বৈদ্য ঝোলা থেকে একমুঠো হলুদের গুঁড়ো বার করলেন। একটু একটু করে মিশিয়ে একটা লেই করলেন। ভাঙা কাটা জায়গাগুলোতে আস্তে আস্তে লাগিয়ে দিলেন। লোকটি এবার নড়েচড়ে উঠল। একটু পরেই তার গোঙানি বন্ধ হল। বৈদ্য আরও ওষুধ আমাকে দিলেন। পরে খাওয়াতে হবে। লাগাতে হবে।
“বৈদ্য উঠে দাঁড়ালেন। আমি কোমরের ফেট্টি থেকে কিছু অর্থ বের করে বৈদ্যকে দিলাম। বৈদ্য চলে গেলেন। আমি লোকটার পাশে বসে রইলাম। বৈদ্য বলে গেছেন বাঁচার কোনও আশা নেই। তবু মরার সময় যাতে যন্ত্রণা না ভোগ করতে হয় তার জন্যই বৈদ্যকে ডেকে এনেছিলাম।
সাইল এতক্ষণে উঠে আমার কাছে এল। বলল, মিছিমিছি এত কিছু করছেন কেন? এ তো বাঁচবে না।
“তবু চেষ্টা করা। দেখি।”
“বাইরে পাখির ডাক শুনলাম। ভোর হয়েছে। আমি বসে বসেই একটু ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম ভেঙে দেখি লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। স্থির দৃষ্টিতে। একটু চমকে উঠলাম। বললাম, এখন কেমন আছেন?
“লোকটি ভাঙা গলায় বলল, একটু ভাল। তারপর ভাঙা ভাঙা বলতে লাগল, আপনি আমার জন্য এত করছেন। বাধা দিয়ে বললাম, “এটুকু মানুষ হিসেবে আমার করা উচিত। নইলে, একটা জানোয়ারের সঙ্গে আমার তফাৎ কোথায়? লোকটি আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করল।
“লোকটিকে সকালের খাবার খাওয়ালাম। ওষুধও খাওয়ালাম। দুপুরেও খাওয়ালাম।
“সন্ধের দিকে মনে হল লোকটি গায়ে একটু জোর পেয়েছে। পাশ ফিরে শুল।
“পরের দিন দুপুরে লোকটির জ্বর এল। সাইলকে বললাম, সাইল, তুমি এর পাশে বোসো। আমি বৈদ্যর কাছে যাচ্ছি।
বৈদ্যকে পেলাম না। কোনও রোগীর বাড়িতে গেছেন।
“সন্ধের দিকে জ্বর বাড়ল। আমি সাইলকে বসিয়ে রেখে বৈদ্যর কাছে গেলাম। জ্বর শুনে বৈদ্য বললেন, লক্ষণটা ভাল নয়। তবু আমার সাধ্যমতো করছি। একটা ওষুধ তৈরি করে দিলেন। তিনটি বড়ি।
ফিরে এসে লোকটিকে একটা বড়ি খাওয়ালাম।
সন্ধের পর জ্বর বোধ হয় একটু কমল।”
“আমি আবার কোমরে ফেট্টি থেকে চেপে চেপে একটু কাপড় ছিঁড়ে জলে ভিজিয়ে কপালে দিতে লাগলাম। লোকটির বোধ হয় ভাল লাগল। চুপ করে শুয়ে রইল।
“গভীর রাত তখন। সাইলকে বললাম, তুমি ভাই লোকটির কপালে আমার এই জলেভেজা ন্যাকড়াটা চেপে-চেপে লাগাও। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। দু’রাত টানা ঘুমোতে পারিনি।
“সাইল লোকটির কাছে বসল। কপালে জলপট্টি দিতে লাগল। আমি একপাশে শুয়ে কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
“যখন ঘুম ভাঙল তখন শেষ রাত। দেখলাম সাইলও লোকটির পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি সাইলকে আস্তে ধাক্কা দিয়ে ওর ঘুম ভাঙালাম। পরে ভেবে দেখেছি সাইলের ঘুম না ভাঙানোই উচিত ছিল। সাইল উঠে বসল।
“তখনই দেখি লোকটা কী যেন বলছে। আমি লোকটার মুখের কাছে কান পাতলাম। লোকটা বলছে, ভাই তুমি কে জানি না। কিন্তু আমাকে সুস্থ করে তুলতে যা কষ্ট স্বীকার করেছ তার জন্য আমি তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ রইলাম।”
ওসব নিয়ে ভাববেন না। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন এটাই আমি চাই। লোকটি একটু দম নিল। তারপর আস্তে আস্তে বলতে লাগল, আমি তোমাকে রাজা হুনাকমিনের গোপন ধনভাণ্ডারের হদিস দেব।
ঠিক বুঝলাম না। আমি বললাম।
বলছি সব, তা হলেই বুঝতে পারবে। একটু দম নিয়ে লোকটি বলতে লাগল রাজা হুনাকমিনের আমলের কথা। আমার প্রপিতামহ রাজা হুনাকমিনের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মৃত্যুর আগে রাজা আমার প্রপিতামহকে একটা নকশা দিয়ে যান। আমাদের পারিবারিক গয়নাগাঁটি যে বাক্সটায় থাকত প্রপিতামহ সেই বাক্সে নকশাটা রেখে দিয়েছিলেন। আমার পূর্বপুরুষের হাতে হয়তো নকশাটা পড়েছিল কিন্তু তারা এটার গুরুত্ব দেননি। ধরে নিয়েছিলেন এটা উদ্ভট কিছু। লোকটি থামল।
আপনার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। এখন কথা বলবেন না। আমি বললাম।
উপায় নেই, এখনই বলতে হবে। মৃত্যু আমার শিয়রে। একটু থেমে দম নিয়ে লোকটি বলতে লাগল, একদিন মা ওই বাক্সটা খুলে কী গয়নাটয়না বোধহয় খুঁজছিলেন। তখন আমি ওখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখনই আমার নজরে পড়ল নকশাটা। বেশ কৌতূহল হল। কী ওটা? আমি মাকে বলে নকশাটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম। আশ্চর্য! চিচেন ইতজার একপাশের ছবি। আমি মার কাছে নকশাটা চাইলাম।
“তুই এটা নিয়ে কী করবি? মা বললেন।”
“আমার কাছে রেখে দেব। আমি বললাম।”
“কেন? মা বললেন।”
“জিনিসটা কী পড়ে দেখব। আমি বললাম।”
“এর আগেও তোর বাবা ঠাকুর্দারা এই নকশাটা দেখেছিলেন। তারা কিছুই বুঝতে না পেরে রেখে দিয়েছিলেন। এখন তুই কি বুঝবি এসব?” মা বললেন।
“দেখি না চেষ্টা করে।” আমি বললাম।
“তা হলে নে তোর কাছে রাখ।” মা বললেন। লোকটি থামল। বেশ হাঁফাচ্ছে তখন। তারপর থেকে নকশাটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমি বুঝেছিলাম এই নকশাটা কোনও গুপ্তধনের নকশা। সেই গুপ্তধন রাখা আছে চিচেন ইতজায়। এটাও বুঝলাম এই গুপ্তধন রাজা হুনাকমিনের।
“তারপর?” ফ্রান্সিস বলল।
“আমি নকশাটা মিলিয়ে-মিলিয়ে চিচেন ইতজা মন্দিরের মধ্যে নানাভাবে খুঁজতে লাগলাম।” বয়স্ক লোকটি বলল।
“বুঝতে পারলেন কিছু?” আমি বললাম।
“হ্যাঁ এটুকু বুঝলাম। চিচেন ইতজার ডানদিনের অংশটা আঁকা হয়েছে এখানে। চিচেন ইতজার দুটো গর্ভগৃহই তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও নকশার মিল পেলাম না।”
“লোকটি থামল। লোকটি মুখ হাঁ করে জল খেতে চাইল। আমি ঘরের কোণার দিকে রাখা মাটির জালা থেকে কাঠের গ্লাসে জল এনে দিলাম। লোকটি জল খেল।
“তারপর?” আমি বললাম।
“একটি যুবককে সঙ্গে নিয়ে কাজে নামলাম। কিন্তু যুবকটি আমার সঙ্গে প্রতারণা করল। আমাকে ফেলে দিল। তাই আমার এই দশা। আমি তবু জলের কাছে পড়লাম। সেই যুবকটি ছিটকে পড়ল একেবারে পাথুরে চত্বরে। সঙ্গে-সঙ্গে মারা গেল।” একটু থেমে বলল, “আমি প্রায় হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে এখানে এলাম।”
“নকশাটা কোথায়?” আমি জানতে চাইলাম।
“লোকটি কোনও কথা না বলে কোমরের ফেট্টির দিকে হাত বাড়াল। ফেট্টিটা খুলতে চাইল।
“কিন্তু দুর্বল আঙুলে পারল না খুলতে। আমিই ফেট্টি থেকে টেনে টেনে নকশাটা বের করলাম। লোকটি ক্লান্তস্বরে বলল, “তোমাকেই দিলাম। দ্যাখো চেষ্টা করে যদি রাজা হুনাকমিনের গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারো।” একটু থেমে বয়স্ক লোকটি বলতে লাগল, “নকশাটা আমি আমার ফেট্টি জড়িয়ে রাখলাম। এতক্ষণে আমি দেখলাম সাইল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ও সব দেখেছে, শুনেছে। গুপ্তধনের লোভে ও এখন আমাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে। আমি সাবধান হলাম। সাইলকে কখনও দৃষ্টির বাইরে যেতে দিলাম না।
“বাইরে সূর্য উঠল। পাখপাখালির ডাক শোনা গেল। ভোর হয়েছে। লোকটি কাঁপা কাঁপা হাতে আমার হাত দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। তারপর মাথাটা এপাশ-ওপাশ করতে-করতে মারা গেল। আমি কেঁদে ফেললাম।”
আলফানসো থামল। সকলেই চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পরে ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো, তোমার নকশাটা একটু দেখতে পারি?”
“তা দেখাচ্ছি। তবে তোমরা তিনজন। জোর করে আমার নকশাটা নিয়ে নিতে। পারো।”
ফ্রান্সিস বলল, “আমাদের কি এতটা খারাপ লোক বলে মনে হয়?”
“না, না।” আলফানসো বলল, “আমার কোমরের ফেট্টিতে সেলাই করে রেখেছি। সাবধানে খুলতে হবে।”
শাঙ্কো ওর ছোরাটা বের করল। আলফানসো চমকে উঠল। ফ্রান্সিস হেসে বলল, “আমাদের এখনও বিশ্বাস করতে পারছ না?”
আলফানসো আর কিছু বলল না। শাঙ্কো আলফানুসোর কোমরের ফেট্টিটা একটু আলগা করল। দেখল নকশাটা কাপড়ের সঙ্গে সেলাই করা। ও ছোরার মুখ দিয়ে সেলাই করা সুতোটা আস্তে-আস্তে কাটতে লাগল। শাঙ্কো সন্তর্পণে নকশাটা বের করল। ভাঁজ খুলে আস্তে আস্তে মেঝেয় মেলে ধরল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি এগিয়ে এল। নকশাটা দেখল। নকশাটা এরকম
ফ্রান্সিস আর হ্যারি বেশ কিছুক্ষণ ধরে নকশাটা দেখল। তারপর ফ্রান্সিস বলল, “আচ্ছা আলফানসো, তুমি তো চিচেন ইতজার দুটো গর্ভগৃহ দেখেছ?”
“হ্যাঁ, একটাতে রয়েছে নয়টি দেবমূর্তি। অন্যটায় রাজা হুনাকমিনের কাঠের কফিনের মতো।”
“তা হলে আরও একবার আমরা দেখব। কোন সূত্র পাই কিনা দেখি।” ফ্রান্সিস বলল।
“বেশ।” আলফানসো বলল।
“সেই লোকটি তোমাকে বলেছিল যে আমরা উঠছিলাম। উঠছিলাম মানে কোথায় উঠছিল?” ফ্রান্সিস বলল।
“হয়তো সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিল।” আলফানসো বলল।
“সিঁড়ি দিয়ে উঠে মাথার দুটো ঘরে যাওয়া যায় না। নকশাটা দ্যাখো”
আলফানসো নকশাটা ভাল করে দেখল। ঠিক। সিঁড়িটা অনেকটা উঠে নেমে গেছে। গর্ভগৃহের দিকে। সিঁড়ির মাথা থেকে ঘর দুটো বেশ দূরে।
“তা হলে ওরা সিঁড়ি কোথায় পেল?” আলফানসো বলল।
ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।” হ্যারি বলল।
“যাকগে, আগে চিচেন ইতজা মন্দিরটা দেখি।” ফ্রান্সিস বলল।
“তা হলে ওই দুটো ছোট ঘরেই কি গুপ্তধন রাখা হয়েছে?” আলফানসো বলল।
“এখনই সেটা বলা যাচ্ছে না। গিয়ে আগে ভাল করে সব দেখি।” ফ্রান্সিস বলল।
“তা হলে কি কালকেই চিচেন ইতজা যাবে?” হ্যারি বলল।
“ আর দেরি করা চলবে না। বন্ধুরা আমাদের জন্য চিন্তায় পড়বে।” ফ্রান্সিস বলল।
আলফানসো বুড়িমাকে বলল, “ওরা সকাল-সকাল চিচেন ইতজায় যাবে।”
বুড়িমা সকালের মধ্যেই রুটি সবজির ঝোল বেঁধে দিলেন। এদিকে আলফানসোকে বুড়িমা কিছুতেই যেতে দেবে না। বুড়িমা কোন কথাই শুনবেন না। ফ্রান্সিস অনেক কথাটথা বলে চেষ্টা করল বুড়িমাকে শান্ত করতে। কিন্তু বুড়িমা নাছোড়বান্দা। সেই থেকে আলফানসোর হাত ধরে রইলেন। এইবার হ্যারি এগিয়ে এল। বলল, “বুড়িমা, আলফানসো আমাদের সঙ্গে না গেলে একটা খুব দরকারি কাজ হবে না। আপনি ওকে আটকালে ওর খুব ক্ষতি হবে।” বুড়িমা একটু শান্ত হলেন। আলফানসোর হাত ছেড়ে দিলেন। হ্যারি বলল, “আপনি কিছু ভাববেন না। দিন চারেকের মধ্যেই আলফানসোকে নিয়ে আপনার কাছে আসবো।” বুড়িমা আর কোন কথা বললেন না। আলফানসো তলতেক ভাষায় অনুবাদ করে বুড়িমাকে বুঝিয়ে বলল। বুড়িমা আর কিছু বললেন না। তবে বারবার চোখ মুছতে লাগলেন।
রওনা হতে একটু বেলাই হল। ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো একটা শস্যটানা গাড়ি পাওয়া যাবে?”
“খোঁজ করতে হবে।” আলফানসো কয়েকটা বাড়ির দিকে গেল। এক কৃষকের বাড়ির বাইরে একটা ঘোড়ায় টানা শস্যটানার গাড়ি পেল। কৃষকের সঙ্গে কথাটথা বলে ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল, “আমি তাকে অর্থ দিয়ে এসেছি। লোকটি একজন গাড়োয়ান দেবে বলেছে।” কিছু পরে একটা শস্যটানা গাড়ি চালিয়ে এক রোগাটে চেহারার গাড়োয়ান এল। ফ্রান্সিস বলল, “রোগাপটকা গাড়োয়ান কি চিচেন ইতজা পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবে?”
“যাকগে, যা পাওয়া গেছে।” ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা গাড়িতে উঠল। গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়িটায় কিছু গমগাছের শুকনো পাতা ছড়ানো ছিল। ফ্রান্সিসরা তার ওপরই বসল।
গাড়ি চলল। একটা ঘোড়া আর কত জোরে গাড়ি টানবে? তাই টিকির-টিকির করে গাড়ি চলল।
দুপুর নাগাদ একটা বর্ধিষ্ণু গ্রামে এসে ওরা পৌঁছল। খিদেয় জলতেষ্টায় বেশ কাতর ফ্রান্সিসরা তখন। গাড়ি থেকে নেমে গ্রামের মধ্যে ঢুকল ওরা। এক বর্ধিষ্ণু কৃষকের বাড়ি পেল ওরা। ফ্রান্সিসদের কথা তো এখানে কেউ বুঝবে না। তাই আলফানসো এগিয়ে গেল কৃষকের দিকে। ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে কী যেন বলল। কৃষকটি হেসে ফ্রান্সিসদের হাতছানি দিয়ে ডাকল। বাড়ির বাইরের ঘরটায় কৃষকের পিছু পিছু ওরা ঢুকল। চুন-বালি মিশিয়ে কাঠের কাঠামোয় বাড়িটা তৈরি হয়েছে। ফ্রান্সিসরা ঘরে ঢুকল। কাঠের পাটাতন পেতে চৌকি মতো করা। তাতেই বসল ওরা। কৃষকের একজন কাজের লোক দরজায় এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো লোকটিকে খাবার জল আনতে বলো।”
একটু পরেই একটা বড় চিনেমাটির পাত্রে জল আনল লোকটি। ফ্রান্সিসরা চিনেমাটির বড় গ্লাসে জল খেল। এতক্ষণে তৃষ্ণা মিটল। কৃষক এসে আলফানসোর সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বলতে লাগল।
কিছু পরে সেই কাজের লোকটি এসে কৃষককে কী বলল। কৃষক আলফানসোকে– কী বলল। আলফানসো ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা ভেতর বাড়িতে খাবেন, না এই ঘরে খাবেন?”
“এখানেই খাব। আর বলল যে, খাবারটা তাড়াতাড়ি দেওয়া হোক।” কৃষক আলফানসোর কাছে ফ্রান্সিসদের কথা বুঝে নিয়ে হেসে কী বলল। আলফানসো বলল, “তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা হচ্ছে।”
কিছু পরে ফ্রান্সিসদের চিনেমাটির থালায় খেতে দেওয়া হল। কাটা রুটি, নানা আনাজ দিয়ে তৈরি তরকারি আর মাংস। খিদের জ্বালায় ফ্রান্সিসরা হাপুস হুপুস খেতে লাগল।
খাওয়াদাওয়া শেষ হল। এবার চিচেন ইতজা যাওয়া। সবাই ঘোড়ায়-টানা গাড়িটায় উঠল। গাড়োয়ান গাড়ি ছাড়ল। মাটির ওপর ছোট ছোট পাথর ফেলে রাস্তা তৈরি হয়েছে। ঝাঁকুনিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। একসময় হ্যারি বলল, “এর চাইতে হেঁটে গেলে ভাল হত।” প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাড়ি চলল।
সন্ধ্যা নাগাদ ওরা চিচেন ইতজা পৌঁছল। চিচেন ইতজা বেশ বড় নগর। রাস্তায় মানুষের ভিড়। দোকানপাটে কাঁচে ঢাকা আলো জ্বলছে। নগরটা বেশ সরগরম।
গাড়ি থেকে নেমে কেউ আর হাঁটতে পারছে না তখন। ঘাড়ে, কোমরে, পায়ে আড়ষ্ট ভাব। ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো তোমার জানা শোনা কোনও সরাইখানা আছে?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলুন নিয়ে যাচ্ছি।” আলফানসো বলল।
বড় রাস্তাটা ধরে চলল ওরা। কিছু দূর যেতে ডানদিকে সরাইখানাটা পাওয়া গেল। সরাইখানায় বেশ ভিড়। মালিক সামনে একটা কাঠের বাক্স রেখে বসে আছেন। আলফানসো গিয়ে মালিকের সামনে দাঁড়াল। মালিক হেসে বলে উঠলেন।আলফানসোও হাসল।দু’জনে কিছুক্ষণ হেসে হেসে নানা কথা বলল। ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝল না। এবার আলফানসো ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে কী বলল। মালিক কী বললেন। মাথা নাড়লেন। আলফানসো ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল, “মালিক বলছে কালকে রাতে এখানে নাকিনাচ-গানের আসর বসবে। দূর দূর জায়গা থেকে মানুষজন এসেছে। সব সরাইখানা ভর্তি। তবে এই মালিকের ভাইয়ের একটা ছোট সরাইখানা আছে। ওটা একটু দূরে। ওখানে জায়গা পাওয়া যাবে।”
“তা হলে ওখানেই চলো।” ফ্রান্সিস বলল।
ওরা আলফানসোর নির্দেশমতো চলল। রাস্তায় বেশ ভিড়। সেই ভিড় ছাড়িয়ে একটা ছোট গলিতে ঢুকল ওরা। কিছুটা যেতেই পেল সেই সরাইখানাটা। ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো, ওই মালিকের ভাইকে জিজ্ঞেস করো তো কিসের উৎসব কালকে?”
আলফানসো সরাইখানায় কাঠের আসনে বসা ভাইকে দেখল। আলফানসো মালিকের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলল। ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল “ভাই বলছে চারজনের জায়গা হবে। কালকে পূর্ণিমা। বছরের এই দিনে এখানে নগরের একটু বাইরে কোপান নামের মাঠে এই উৎসব হয়। নাচ, গান, খানা চলে গভীর রাত পর্যন্ত।”
“ভালই হল। কালকের রাতটা আমরা কাজে লাগাতে পারব।” ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলল।
“তা হলে কাল রাতেই গুপ্তধনের জন্য চেষ্টা করবে?” হ্যারি বলল।
“হ্যাঁ।” ফ্রান্সিস বলল।
“ঠিক বুঝলাম না।” হ্যারি বলল।
“শোনো, সেই আহত লোকটি বলেছিল, সিঁড়ি থেকে ও আর তার সঙ্গী এক যুবক ছিটকে পড়ছিল। কালকে চিচেন ইতজায় যেতে হবে। সারাদিন ওখানেই থাকব। সব ভাল করে দেখতে হবে। একটা সূত্র নিশ্চয়ই পাব। সেটা ভেবে নিয়ে কাজে নামতে হবে।” ফ্রান্সিস বলল।
“গুপ্তধন আবিষ্কারের আগে রাজার সঙ্গে কথা বলে তার অনুমতি নেবে না?” হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস হাসল। বলল, “হ্যারি, এই প্রথম আমি অন্যরকম ভাবছি। গুপ্তধনের হদিস খুঁজতে তো কয়েকদিন যাবে। তার মধ্যে উদ্ধার করা গুপ্তধন রাজাকে না দিয়ে কাকে দেওয়া যায় সেটা ভেবে দেখব।”
“এ তো চুরি হয়ে গেল ফ্রান্সিস।” হ্যারি বলল।
“না। যার খুবই প্রয়োজন তাকে দেব। তা হলে তো চুরির দায় নিতে হবে না।”
“দেখো ভেবে কী করবে।” হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস বলল, “হ্যারি শাঙ্কো চলো চিচেন ইতজা মন্দিরটা দেখে আসি।”
“এই অন্ধকারে?” শাঙ্কো বলল।
“আরে বাবা প্রাথমিক ভাবে তো কিছু দেখা যাবে। কালকে সকালে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাব।” ফ্রান্সিস বলল।
“–বেশ চলো।” শাঙ্কো বলল।
আলফানসো মালিককে গিয়ে বলে এল, “আমরা একটু শহর দেখতে বেরোচ্ছি। ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। খাবার রাখবেন।”
চারজনে সরাইখানা থেকে বেরোল। বাইরে এসে দেখল, ভিড় অনেকটা কমেছে। চারজন চলল চিচেন ইতজা মন্দিরের দিকে। যেতে যেতে আলফানসো বলল, “পূর্ণিমা রাতের উৎসবে যোগ দিতে দূরের নগর গ্রাম থেকে অনেক লোক এখানে আসে। সেইজন্যই এত ভিড়।”
চারজনে ইতজা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল। পূর্ণিমার আগের রাত। কাজেই উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় চারদিক মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। উঁচু মন্দিরটায় জ্যোৎস্না পড়েছে। চূড়ো, সিঁড়ি, ঘরটা দেখা যাচ্ছে। ঢোকার মুখে দুটো পাশাপাশি ঘর। ঘর দুটোর সামনে দাঁড়িয়ে লোহার ফলা লাগানো বর্শা হাতে দু’জন প্রহরী। ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো, আমার সঙ্গে এসো।”আলফানসো এগিয়ে এল। আলফানসো মারফৎ ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল, “এটাই কি চিচেন ইতজার মন্দির?”
হা। দেখেই তো বোঝা উচিত। এতবড় মন্দির এখানে কোথাও নেই।” প্রহরী বলল।
“ও। তা আমরা একটু ঘুরে দেখতে পারি?” ফ্রান্সিস বলল।
“না। রাতে কারও ঢোকার হুকুম নেই।” প্রহরী বলল।
“একটু দেখেই চলে আসতাম।” ফ্রান্সিস বলল।
“না।” প্রহরীর মুখে দাড়িগোঁফ। গোঁফ মুচড়ে বলল, “কাল সকালে এসো।”
“বেশ তাই আসব। তবে একটা কথা বলি, লোকে বলে এই মন্দিরে নাকি রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন আছে।”
“লোকে তো কত কথাই বলে।” প্রহরী বলল।
“আগে কি সেই গুপ্তধন খোঁজা হয়নি।” ফ্রান্সিস বলল।
“হয়েছে। আগের দু’জন রাজার মন্ত্রী আর সেনাপতি রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন খুঁজেছিলেন।”
“পায়নি।” ফ্রান্সিস বলল।
“না, না।” প্রহরী মাথা এপাশ ওপাশ করে বলল।
“তারা কোথায় খুঁজেছিলেন?”
“এই মন্দিরেই খুঁজেছিলেন। এতসব জানতে চাইছেন কেন?” প্রহরী বলল।
“আমরা বিদেশী।” ফ্রান্সিস বলল।
“সে তো চেহারা আর পোশাকই বলছে।” প্রহরী বলল।
“দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই আমরা। এমনই সব গুপ্তধন-টুপ্তধনের কথা শুনলে খুঁজিটুজি।” ফ্রান্সিস বলল।
তা হলে তো রাজার অনুমতি নিতে হবে।” প্রহরী বলল।
“সেসব আমরা করব।” ফ্রান্সিস বলল।
“রাজার অনুমতি নিয়ে এসো। যদি অনুমতি পাও তখন জানতে পারবে আগে কারা কীভাবে গুপ্তধন খুঁজেছিলেন।” প্রহরী বলল।
“তা তো বটেই। আচ্ছা ভাই, তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।” ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসরা সরাইখানায় ফিরে এল। ফ্রান্সিস শুকনো ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। হ্যারি, শাঙ্কো আর আলফানসো বসল। হ্যারি বলল, “ফ্রান্সিস, আমরা বিদেশী, গুপ্তধন খুঁজে বের করি–এসব ওই প্রহরীদের বলা ঠিক হয়নি।”
ফ্রান্সিস বলল, “হ্যারি, আমি প্রথম থেকেই ভেবে রেখেছি যে, রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন খুঁজে পেলে এখানকার রাজাকে জানাব না। সেই গুপ্তধন আমরা কিছু নেব। বাকিটা কী করব, এখনও ভেবে ঠিক করতে পারিনি। কাজেই প্রহরীরা আমাদের সম্বন্ধে কী ভাবল না ভাবল এ ব্যাপারে আমি বেপরোয়া। কারণ ওই প্রহরীদেরই বন্দি করে আমরা গুপ্তধন খুঁজব। কাজেই ভুল আমি করিনি। বরং একটা কাজের কথা আমরা জানলাম ইতিপূর্বে অতীতের এক রাজা ও এক মন্ত্রী গুপ্তধন খুঁজেছিলেন। তারাও ভেবেছিলেন গুপ্তধন এই মন্দিরেই আছে। কীভাবে তারা গুপ্তধন খুঁজেছিলেন এটা জানা গেল না। তবু কয়েকবার খোঁজা হয়েছে। তার মানে গুপ্তধন সহজে পাওয়া যাবে না। নানাভাবে চেষ্টা করতে হবে। প্রহরীদের সঙ্গে কথা বলে এইটুকু লাভ হল আমাদের।”
“তা হলে এবার গুপ্তধন পেলে তা চুরি করবে?” হ্যারি বলল।
“হ্যাঁ। মণিমাণিক্য সোনাদানা যা পাব সব বিক্রি করব। আর একটু আগেই তো বললাম সেই অর্থ আমরা কীভাবে ভাগ করব।”
“অর্ধেক গুপ্তধন নিয়ে কী করবে তুমি?”
“আমাদের আর্থিক সমস্যা মেটাবো। তারপর দেশে ফিরে গিয়ে আমাদের রাজাকে দেব।”
“ঠিক আছে।” হ্যারি বলল। আড়মোড়া ভেঙে শাঙ্কো বলল, “ফ্রান্সিস, ভীষণ খিদে পেয়েছে। ঘুমও পেয়েছে। চল খাওয়াটা সেরে আসি।”
“বেশ চলো৷” ফ্রান্সিস বলল।
পাশের ঘরটা খাবার ঘর। ফ্রান্সিসরা এসে দেখল সরাইখানায় যারা আশ্রয় নিয়েছে তারা অনেকেই খেতে বসেছে। ফ্রান্সিসরা একপাশে বসল। সরাইখানার লোকে ফ্রান্সিসদের সামনে বেশ বড় গোল শুকনো পাতা রেখে গেল। এবার খাবার দেওয়া হতে লাগল। ফ্রান্সিসরা খিদের জ্বালায় গোগ্রাসে খেতে লাগল।
খাওয়াদাওয়া সেরে ফ্রান্সিসরা নিজেদের জায়গায় এল। হ্যারি, শাঙ্কো শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস বসে রইল। আলফানসোকে বলল, “আলফানসো, ঘুমিয়ে পড়ো না তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
আলফানসো কিছু বুঝল না। উঠে বসে রইল।
একটু পরে ফ্রান্সিস ডাকল, “আলফানসো।”
–“বলুন।” আলফানসো বলল।
–“আমি তোমার সম্বন্ধে সব কথা জানতে চাই। আমাকে মিথ্যে বলবে না। যা সত্য তাই বলবে।” ফ্রান্সিস বলল।
–“বেশ, কিন্তু কী ব্যাপারে–মানে” বলতে গিয়ে আলফানসো থেমে গেল।
–“বলছি।” ফ্রান্সিস বলল। তারপর একটু থেমে বলল, “তোমার দেশের বাড়ির অবস্থা কেমন?”
–“অবস্থা বলতে কী বোঝাচ্ছেন?” আলফানসো বলল।
–“আর্থিক অবস্থা। তুমি সব ছেড়েছুঁড়ে জাহাজে চাকরী নিলে কেন?”ফ্রান্সিস বলল।
–“সে অনেক কথা ফ্রান্সিস।” আলফানসো বলল।
–“শুনুন তাহলে”, আলফানসো আস্তে আস্তে বলতে লাগল, “খুব দরিদ্রের ঘরে আমার জন্ম। ছেলেবেলায় মাকে হারিয়ে ছিলাম। আমার কোনও ভাইবোন ছিল না। আমি আর বাবা থাকতম লিসবন বন্দরের কাছে ঘুপচি ঘরে। বাবা সেই ভোরে উঠে দু’জনের রান্না করত। নিজের ভাগের খাবার খেয়ে চলে যেত আর আমি সারা সকাল সারা দুপুর রাস্তায়, ডকে খেলে বেড়াতাম।” আলফানসো থামল। তারপর বলতে লাগল, “বাবা কাজ করতেন বন্দর এলাকায়। মালপত্র ওঠানো নামানোর কাজ। বড় পরিশ্রমের কাজ। সন্ধ্যের মুখে কাজ থেকে ফিরে এলে বাবার ক্লান্ত মুখখানা দেখতাম। বাবা তখন মড়ার মত শতচ্ছিন্ন বিছানায় শুয়ে থাকত। রাতে আর রান্না হত না। দোকান থেকে একটা বড় রুটি আর ঝোল কিনে আনতাম। তাই খেয়ে রাত কাটত।” আলফানসো একটু চুপ করে থেকে বলল–“এমনিতে আমি দুঃখটুঃখ বড় একটা গায়ে মাখতাম না। কিন্তু সমবয়সী ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে দেখলে আমার ভীষণ মনখারাপ হয়ে যেত। ধরে নিতাম পড়াশুনা আমার কপালে নেই।” আলফানসো চুপ করে রইল। তারপর বলতে লাগল, “একদিন বাবা কাজ থেকে ফিরে বললেন,
–“কালকে তোকে স্কুলে ভর্তি করে দেব। কী? পড়াশুনা করবি তো?”
আমি বললাম, “বাবা প্রতি মাসে স্কুলের মাইনে দিতে গেলে তো আমাদের একবেলা উপোস করে থাকতে হবে।”
–“না রে। জাহাজের এক মালিক আমার কাজকর্ম দেখে খুশি হয়ে বেশ কিছু অর্থ আমাকে দিয়েছে। অন্তত বছর কয়েক তোর পড়াশুনা চালাতে পারব। আমি একটু বিশ্রাম করে নিই। তারপর তোকে পণ্ডিত কস্টিল্লোর কাছে নিয়ে যাব। আলফানসো থামল। তারপর বলতে লাগল, “সন্ধ্যের একটু পরে বাবা আমাকে নিয়ে কস্টেল্লোর কাছে গেলেন। কস্টেল্লো বললেন, “তোমার ছেলেকে ভর্তি করে নেব। কিন্তু ও তো রাস্তায় রাস্তায় খেলে বেড়ায়, পড়াশোনা করবে কখন?” বাবা আমার দিকে তাকালে। বাবা কিছু বলার আগে আমি বললাম, “স্কুলে ভর্তি হলে আমি আর এভাবে ঘুরে বেড়াব না। সব ছাত্রের মতো আমিও পড়াশোনা করব।” একটু থেমে আলফানসো বলতে লাগল, স্কুলে ভর্তি হলাম। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। মাস কয়েক পর ক্লাসের পরীক্ষার ফল বেরোল। আমি সেই পরীক্ষায় প্রথম হলাম। বাবা তো আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরে রইলেন। পড়াশোনায় আমার উন্নতি দেখে পণ্ডিত কস্টেল্লো আমাকে ছেলের মতো ভালোবাসতেন। বছরচারেক পড়তে পেরেছিলাম, হঠাৎ একদিন বাবা মারা গেলেন। আর পড়াশোনা হল না। দু’বেলা খাবারই জোটে না–এই অবস্থা।”
একটু চুপ করে থেকে আলফানসো বলতে লাগল, “একদিন সকালে আমার জামাটামা বইটই সব পোঁটলা বেঁধে জাহাজঘাটায় এলাম। এ জাহাজে সে জাহাজে কাজ খুঁজতে খুঁজতে একটা জাহাজ পেলাম। সেখানে জাহাজ ধোয়ামোছা রান্নাঘরে কাজে সহায়তা করা এসব কাজের চাকরি পেলাম। সেই জাহাজ দেশ বিদেশের মালপত্র আমদানি রফতানির কাজ করে। কত দেশে ঘুরলাম। তারপরের কথা তো বলেছি।”
ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো, যেসব পড়ার বই নিয়ে বেরিয়েছিলে সে সব বই আর আছে?”
–“হ্যাঁ, বুক দিয়ে আগলে রেখেছি সেসব বই। জাহাজ যখন দেশে ফিরে আসতো তখন আরও বই কিনতাম। সব আছে।” আলফানসো বলল।
–“কিন্তু সেসব বই রেখে কী হবে?” ফ্রান্সিস বলল।
–“যদি কখনও সুযোগ পাই, বিচ্ছু বেশি অর্থ জমাতে পারি তো দেশে ফিরে একটা স্কুল খুলব বন্দর এলাকায়। স্থানীয় দরিদ্র শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করব।”আলফানসো বলল।
–“পারবে স্কুল চালাতে?” হ্যারি বলল।
–“নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু অর্থাভাব বেশি হলে হাল ছেড়ে দিতে হবে। আমার সেই ভয়। আমি তো ভিখিরি।” আলফানসো বলল।
–“তুমি সব পাবে, অর্থ সাহায্য ভবিষ্যতের জন্যে অর্থ ও নিরাপত্তা মানে কেউ তোমাকে বাধা দেবে না–তুমি নিশ্চিন্তে তোমার খুশিমতো তোমার কাজ করে যাবে।” ফ্রান্সিস বলল।
–“তাহলে তো আমি–মানে–আমি আমার সমস্ত জীবন শিক্ষাদানে ব্যয় করব।” আলফানসো বলল।
–“ঠিক আছে। তুমি প্রয়োজনে অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য পাবে। কিন্তু তোমাকে স্কুল করতে হবে তোমার দেশে নয়, এখানে।” ফ্রান্সিস বলল।
“এখানে!” আলফানসো অবাক হয়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস বলল, “হ্যাঁ এখানে তুমি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তোমার মাতৃভাষা স্পেনীয় ভাষা শেখাবে। তলতেক ভাষা তুমি ভালই শিখেছ। সেই ভাষার লিখিত রূপ : দেবে। সেই ভাষায় বই লিখবে কী? পারবে তো?”
আলফানসো কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মাথা নিচু। তারপর মাথা তুলল। ফ্রান্সিস দেখল আলফানসোর চোখে জল। আলফানসো কান্নাভেজা গলায় বলল, “ছেলেবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন আমি শিক্ষকতা করব। ভাবিনি কোনওদিন সেই স্বপ্ন সার্থক হবে।”
ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। বলল, “আলফানসো ঘুমোও। রাত হয়েছে।”
আলফানসো শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম আসছে না। ফ্রান্সিসের সাহায্য পেলে ও সবকিছু করতে পারবে। কিন্তু ফ্রান্সিস কী সাহায্য করবে তা বলেনি। একটু বেশি রাতে আলফানসো ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন একটু সকাল সকাল খাওয়াদাওয়া সারল ফ্রান্সিসরা। তারপর চলল চিচেন ইজ্জার মন্দিরে। মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। প্রহরী দু’জন বর্শা হাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকজন ঢুকছে বেরোচ্ছে অবাধে। প্রহরী দু’জন কাউকে বাধা দিচ্ছে না।
ফ্রান্সিসরাও ঢুকল। সামনেই সিঁড়ি বেয়ে উঠল ওরা। সিঁড়ি অনেকটা উঠে নীচে নেমে গেছে। ফ্রান্সিস সেখানে এসে আলফানসোকে বলল–“তুমি তো নীচের গর্ভগৃহ, নয় রাত্রির দেবতার মূর্তি, রাজা হুনাকমিনের কফিন সবই দেখেছ।”
–“হ্যাঁ, সে সব আমি আপনাদের বলেছি।” আলফানসো বলল।
–“কিন্তু সেসব জায়গায় কোথাও রাজা হুনাকমিনের গুপ্ত ধনসম্পদ গুপ্তভাবে রাখা আছে এমন কিছু লক্ষ্য করো নি?” ফ্রান্সিস বলল।
–“ন্নাঃ! দ্যাখো এত লোকজন প্রতিদিন ওইসব গর্ভগৃহে যাচ্ছে কারও না কারও নজরে নিশ্চয়ই কিছু পড়তো।” আলফানসো বলল।
–“হু।” ফ্রান্সিস সিঁড়িটা যেখানে বাঁক নিয়ে নীচে নেমে গেছে সেখানটায় দাঁড়াল। চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। মন্দিরের মাথায় রয়েছে দুটো কুঠুরি। একটা বড় তার ওপর আর একটা ছোট। এখান থেকে এই দুটো কুঠুরির দূরত্ব হবে ন’দশ হাত। কাজেই এখান থেকে ওই কুঠুরি দুটোয় যাওয়া অসম্ভব। কাজেই সেই প্রৌঢ় লোকটি তাদের দুজনের সিঁড়ি থেকে ছিটকে পড়ার কথা বলেছিল সেই সিঁড়ি এই সিঁড়ি নয়। কিন্তু অন্য কোনও সিঁড়ি ফ্রান্সিসের চোখে পড়ল না। তারা কোন সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল? ফ্রান্সিস চারদিকে তাকাতে লাগল। বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেও লাগল। তখনই দেখল মন্দিরের একপাশে চুনাপাথর বালি এসব দিয়ে গাঁথা একটা পাথরের দেওয়াল। দেওয়ালটা উঠে গেছে একবারে মন্দিরের মাথার কাছে। সেই দেওয়াল থেকে দুটো অংশ সোজা বেরিয়ে ওই দুটো কুঠুরির নীচে গিয়ে শেষ হয়েছে। ওপাশেও একটা দেওয়াল উঠেছে। তারও একটা অংশে গিয়ে মিশেছে কুঠুরি দুটোর নীচে। ফ্রান্সিস বুঝল ওই দুটো বর্ধিত অংশ দুটো কুঠুরি দুটোর ভারসাম্য রক্ষা করছে? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওই কুঠুরি দুটোয় যাওয়া। মিস্ত্রিরা কী করে অত উঁচুতে উঠে গিয়ে কুঠুরি দুটো তৈরি করেছিল? নিশ্চয়ই কুঠুরিতে যাওয়ার জন্য কোনও উপায় ছিল। ফ্রান্সিস ভাল করে দেখল। দু’পাশ থেকে দুটো পাথরের টানা দেওয়াল। তার ওপরই ওই দুটো কুঠুরি। তা হলে পাথরের দেওয়ালের মাথা থেকে ওই টানা পর্যন্ত উঠতে হবে। তারপর টানা ধরে যেতে হবে ওই কুঠুরিতে। রাজা হুনাকমিনের ধনসম্পদ কি ওখানেই গোপনে রাখা হয়েছে? কিন্তু ওখানে যাওয়ার কোনও উপায়ই তো নেই।
ফ্রান্সিস বলল, “হ্যারি, আমি একটু চারদিক ঘুরে দেখছি। তোমরা এখানেই থাকো।”
শাঙ্কো বলল, না ফ্রান্সিস তোমাকে একা ছাড়ব না। আমিও তোমার সঙ্গে যাব।”
–“বেশ চলো।” ফ্রান্সিস বলল।
খাওয়ার পরে ফ্রান্সিসরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করল। তারপর ফ্রান্সিস সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল। মন্দিরটার চারদিক একবার ঘুরে এল। কিন্তু কোনও সিঁড়ি পেল না। অথচ সেই বয়স্ক লোকটি বলেছিল এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে সঙ্গী তাকে ধাক্কা মেরেছিল। ছিটকে পড়ে সাংঘাতিকভাবে আহত হয়ে পড়ে যুবকটিও মারা যায়।
ফ্রান্সিস মন্দির থেকে কিছুটা দূরে সরে এল। শাঙ্কোও এল। ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টি থেকে নকশাটা বের করল। মন্দিরের সঙ্গে মেলাতে লাগল। দেখল সবই মিলে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা কীভাবে ওঠবার চেষ্টা করেছিল তার কোনও নির্দেশ নকশাটায় নেই। ফ্রান্সিস নকশা দেখিয়ে শাঙ্কোকে সেই কথা বলল। তারপর নকশাটা শাঙ্কোকে দিয়ে বলল, “দ্যাখো তো, ওপরের কুঠুরিদুটোতে যাওয়ার কোনও নির্দেশ নকশাটায় আছে কি না।”
“হ্যারি থাকলে ভাল হত। ও পারত। আমি অতশত বুঝি না। হ্যারিকে ডেকে আনছি।” শাঙ্কো চলে গেল। ফ্রান্সিস নকশাটা দেখতে লাগল। এখানে লোকজনের ভিড় কম।
হ্যারি এল। নকশাটা হাতে নিল। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ হ্যারি বলে উঠল, “ফ্রান্সিস, দ্যাখো তো এটা কিসের দাগ?”
দাগ? দেখি তো।” ফ্রান্সিস নকশাটা হাতে নিল। হ্যারি ডান দিকের দেওয়ালের গা ঘেঁষে একটা খুব অস্পষ্ট রেখা দেওয়ালের গায়ে গায়ে ওপরের দিকে উঠে গিয়ে বাঁ দিকে বেঁকে কুঠুরি দুটোয় গিয়ে শেষ হয়েছে।”
হ্যারি বলল, “এই রেখাটার অর্থ বুঝতে পারলে?”
“না।” ফ্রান্সিস ভাবতে ভাবতে বলল।
“এটার অর্থ হল দেওয়াল ধরে ধরে ওপরে উঠতে হবে।”
ফ্রান্সিস বলে উঠল, “হ্যারি, এখন সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেওয়ালের পাথর ভেঙে ভেঙে সিঁড়ির মতো করে আস্তে আস্তে উঠে যেতে হবে। শেষে বাঁদিকে গিয়ে ওই কুঠুরি দুটোয় ঢুকতে হবে। আমি নিশ্চিত ওই কুঠুরি দুটোতেই রয়েছে রাজা হুনাকমিনের গুপ্ত ধনভাণ্ডার। ওই বয়স্ক লোকটি এইভাবে বানানো সিঁড়ির কথাই বলেছিল।”
“এবার কী করবে?” শাঙ্কো বলল।
“চলো ডানদিকের দেওয়ালটা ভাল করে দেখা যাক।” ফ্রান্সিস বলল।
দু’জনে ডান দিকের দেওয়ালের কাছে এল। দেখল দেওয়ালের বেশ কিছু উঁচু পর্যন্ত জংলা গাছপালায় ঢাকা। ফ্রান্সিস গাছটাছ সরাল। দেখল–দেওয়ালের গোড়া থেকে বেশ কিছু উঁচু পর্যন্ত এক হাত অন্তর অন্তর ভাঙা খোদল। ওই খোদলগুলোয় পা রেখে রেখে অনায়াসে ওপরে ওঠা যায়। সিঁড়ির মতো। ওই বয়স্ক লোকটি এই সিঁড়ির কথাই বলেছিল।
রাতের খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিসরা শুয়ে বসে বিশ্রাম করতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল, “শাঙ্কো, সরাইখানার মালিকের কাছ থেকে হাতপাঁচেক শক্ত দড়ি নিয়ে এসো তো।” শাঙ্কো মালিকের কাছে গেল। বেশ লম্বা দড়ি নিয়ে এল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর ছোরাটা দিয়ে দড়িটা দু’টুকরো করল। রেখে দিল।
“কখন যাবে?” হ্যারি বলল।
“সন্ধের পরে। সারারাত সময় পাব। তবু কাজটা দ্রুত করতে হবে।” ফ্রান্সিস বলল।
“ফ্রান্সিস, আগে যেমন গুপ্তধন উদ্ধারের আগে সেই রাজ্যের রাজার সম্মতি নিতে, এবার কিন্তু তা করছ না।” শাঙ্কো বলল।
“উপায় নেই শাঙ্কো। এভাবে বলতে গেলে রাজা আমাদের কয়েদঘরে ঢোকাতে পারে। কাজেই এবার সেসব না করে লুকিয়ে গোপনে গুপ্তধন উদ্ধার করব।”
.
ফ্রান্সিসরা সকলে সরাইখানায় ফিরে আসছে তখনই দেখল ঘোড়ার গাড়িতে লোকজন শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পায়ে হেঁটেও চলে যাচ্ছে অনেকে। ফ্রান্সিসরা অবাক। একজন লোককে হ্যারি ধরল। বলল–ভাই আপনারা চলে যাচ্ছেন কেন? লোকটি বলল–রাজকুমারের অসুখ। রাজকুমার সম্পূর্ণ সুস্থ হলে তবেই পূর্ণিমা উৎসব হবে।
ফ্রান্সিস হ্যারিদের দিকে তাকিয়ে বলল, পূর্ণিমা উৎসব এখন বিশ বাঁও জলে। কবে রাজকুমার সম্পূর্ণ সুস্থ হবে কে জানে? ততদিন উৎসব বন্ধ।
ফ্রান্সিসরা সরাইখানায় এল। সরাইখানার মালিক বলল–দেখুন কী কাণ্ড। রাজকুমারের অসুখ করেছে সব উৎসব বন্ধ। হ্যারি বলল–এই পূর্ণিমা উৎসব কতদিন হয়ে আসছে?
–অনেকদিন থেকে। দু’তিনদিন ধরে উৎসবের জায়গা সাজানো হয়। বেশ বড় মঞ্চও হয়। রাজকুমার রাজকুমারীকে নিয়ে রাজরাণী আসেন। সারারাত ধরে গানবাজনা নাচ চলে। দর্শক শ্রোতারা যেন পাগল হয়ে যায়। কী আনন্দ। কী উল্লাস। এখন সব গেল। কবে রাজকুমার সুস্থ হবে। কবে পূর্ণিমা উৎসব হবে সেসব ঝুলে গেল।
সরাইখানাগুলো ফাঁকা হয়ে গেল। কত লোক চলে গেল। এইসময় সরাইখানাগুলো। কত অর্থ লাভ করে। এখন কী হবে কে জানে।
ফ্রান্সিসরা ঘরে এসে টানা বিছানায় বসল। ফ্রান্সিস পড়তে পড়তে মৃদুস্বরে বলল–“হ্যারি আজকের উৎসবের দিনটাতেই ভেবেছিলাম কাজে নামবো–সব পিছিয়ে গেল।
–দিনটা ভালোই বেছেছিলে। কিন্তু তুমি কি নকশাটার অর্থ বের করতে পেরেছো। হ্যারি বলল।
–প্রায়। এখন নকশার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা। তখনই বুঝবো আমি নকশার অর্থটা ঠিক বুঝেছি কি বুঝিনি। কাজটা শুরু করলেই বুঝবো আমি নকশার নির্দেশ বুঝলাম কি বুঝলাম না।
–তাহলে এখন তুমি কী করবে?
–এই সরাইখানাতেই থাকবো। যতদিন না রাজপুত্র সুস্থ হয় ততদিন।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসদের কথা শুনছিল। এবার বলল–আচ্ছা ফ্রান্সিস তুমি পূর্ণিমা উৎসবের রাতটাই বেছে নিতে চাইছো কেন?
ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল–নকশার নির্দেশ অনুযায়ী দেয়ালের পাথর ভাঙতে হবে। কিন্তু সব পাথর একই সময় ভাঙা হবে না। আস্তে আস্তে ভাঙতে হবে। নকশাটা তো এখন বের করা চলবে না। অন্য সময় তোমাকে নকশা থেকে বুঝিয়ে দিতাম মন্দিরের ওপর দিকের ঘর দুটোও দেখতে হবে। ঘর দুটো প্রায় ঝুলে আছে। কাজ শুরু করলেই মনে হয় ভেঙে পড়বে। কাজেই পাথরভাঙা ঘর ভেঙে পড়া এত শব্দ ধারেকাছের লোকজনের কানে যাবেই। উৎসবের দিন বাড়িতে বড় কেউ থাকবে না। সবাই তখন নাচগানের উৎসবে। কাজেই তখন কারও কিছু কিছু ভাঙাটাঙার কাজ চালানো যাবে। তাই পূর্ণিমা উৎসবের রাতটাকেই বেছেছি। সবদিক থেকে সুবিধাজনক। এখন সমস্ত কাজই পিছিয়ে গেল।
–সাবাস ফ্রান্সিস। সমস্ত ব্যাপারটাই সহজে বুঝিয়ে দিলে।
ফ্রান্সিস হেসে বলল–শাঙ্কো আমার কথাটাতো জানো-শুধু কব্জির জোরে লড়াই হয় না বুদ্ধির জোরও লাগে।
ফ্রান্সিসরা ফিরে আসছে। রাস্তায় দেখল ঘোড়ায়টানা গাড়িতে বোঝাই হয়ে লোকজন নগর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দু’একজন কাঁদছেও। সত্যিই তো অনেক আশা করে এসেছিল–নাচগান দেখবে শুনবে সারারাত আনন্দ করবে ফুর্তি করবে। সব বন্ধ হয়ে গেল। এখন রাজপুত্রের সুস্থ হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে থাকা। দূর দূর জায়গা থেকে লোকজন এসেছিল। আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে সবাই ফিরে যাচ্ছে নিজের ঘরবাড়িতে।
ফ্রান্সিসরা সরাইখানায় দেওয়া ঘাসের বিছানায় আধশোয়া হয়ে কথা বলছিল। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস এখন তো বেশ কয়েকদিন বেকার হয়ে বসে থাকতে হবে। কিছুই করবার নেই। তারপর বলল–আচ্ছা ফ্রান্সিস রাজপুত্রের চিকিৎসার জন্যে আমরা তো আমাদের চিকিৎসক ভেনকে নিয়ে আসতে পারি। ফ্রান্সিস বলল– সম্ভাবনা নয়। এখন তুলামে গিয়ে জাহাজঘাটায় নোঙর করা আমাদের জাহাজে যেতে হবে। ভেনকে এতটা পথ নিয়ে আসতে হবে। ততদিনে হয়তো রাজপুত্রের অসুখ বেড়ে গেল। অবশ্য দুটো ঘোড়া পেলে আমি দু’একদিনের মধ্যেই ভেনকে নিয়ে আসতে পারি। কিন্তু ভুলে যেও না হ্যারি–আমরা বিদেশী। রাজা আমাদের বিশ্বাস করবে না। ভেনকে চিকিৎসা করতে দেবে না। কাজেই আমরা আগ বাড়িয়ে কিছু করবো না। আমাদের কোন সমস্যার সৃষ্টি করবো না। হ্যারি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো–তুমি ঠিকই বলেছো। আসলে আমি চাইছিলাম রাজকুমারের সুচিকিৎসা হোক রাজকুমার দ্রুত সুস্থ হোক। ভেন সেটা পারবে?
শাঙ্কো বলল রাজবৈদ্য নিশ্চয়ই আছে। তিনিই চিকিৎসা করুন। রাজা বিদেশী ভেনকে চিকিৎসা করতে অনুমতি দেবে না। কাজেই সে চেষ্টা না করাই ভালো।
ফ্রান্সিসরা এসব কথাবার্তা বলছে তখন সরাইখানার মালিক ঘরে ঢুকল। বলল– রান্না হয়ে গেছে। আপনারা খেতে বসুন। ফ্রান্সিস তড়াক করে উঠে বসল। বলল– হ্যারি ভীষণ খিদে। আর রাত করবো না। খেতে বসো। ফ্রান্সিসরা বসে পড়ল। মালিক আর দুটো মোম জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। পরিচারক এসে ফ্রান্সিসদের সামনে গোল গোল শুকনো পাতা পেতে দিয়ে গেল। ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল–কী খাওয়াবে ভাই?
–আজ মাংস হয়েছে।
–বেঁচে থাকুক সরাইওয়ালা। একটু তাড়াতাড়ি দাও। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসের কথাটথা শুনে হারি হাসল। বলল–ফ্রান্সিস তুমি দিনকে দিন পেটুকহচ্ছে।
কদিন আর বাঁচবো। ফ্রান্সিস গম্ভীরমুখে বলল। হ্যারি হো হো করে হেসে উঠল।
সবাইর খাওয়া হল। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রান্সিসরা বিছানায় বসল। ওখানে মোটা কাপড় পাতা। ওটাই বিছানা। ওখানেই শোয়া ঘুমোনো।
ফ্রান্সিসরা নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমোবার আগে হ্যারি বলল–বেশ কিছুদিন আমরা জাহাজ ছেড়ে এসেছি। রাজকুমারী আর বন্ধুদের কথা বড় বেশি মনে পড়ছে।
“ওসব নিয়ে ভেবো না। মন দুৰ্বল হবে। এখন গুপ্ত ধনভাণ্ডার ছাড়া অন্য কিছু ভেবো না। ফ্রান্সিস বলল।
তখন সবে ভোর হয়েছে। হঠাৎ সরাইখানার দরজা ধাক্কা দেবার শব্দ শোনা গেল। ফ্রান্সিস হ্যারি উঠে বসল। আবার দরজায় ধাক্কা। এবার বেশি জোরে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–ও মালিকমশাই দেখুন তো কী ব্যাপার। মালিক কাশতে কাশতে এল। আবার ধাক্কা। মালিক গলা চড়িয়ে বলল–যাচ্ছি।
মালিক দরজা খুলল। ঢুকল দুজন। মাইল আর ওর এক সঙ্গী রবার্ট মালিক ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বিড় বিড় করে বলল–এদের একজন রবার্ট। এখানকার কুখ্যাত গুণ্ডা। মানুষ মারতে ওর হাত কাঁপে না। সঙ্গে সাইল। আর এক চীজ। মালিক সরে গেল।
সাইল ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এল। আলফানসো দ্রুত উঠে দাঁড়াল। সাইল বলল–পালাবার চেষ্টা করবে না। আমার বন্ধু–রবার্ট–ছোরা চালাতে ওর মতো এই নগরে আর কেউ নেই। ভয়ে আলফানসোর মুখ শুকিয়ে গেল। ও বলল তোমরা এসেছো কেন?
সাইল বলল–নকশাটা নিতে এসেছি।
আমি তো বলেছি সেই সরাইখানার মালিকের কাছে আমি রেখে দিয়েছিলাম। আলফানসো বলল।
–সেই মালিক বলছে কোনরকম নকশা বা ছবি কেউ তাকে দেয় নি। সাইল বলল।
মালিক মিথ্যে কথা বলছে। আলফানসো বলল।
–ঠিকআছে। এক্ষুণি তুমি আমাদের সঙ্গে চলো। ঐ মালিকের কাছে যাবো। সাইল বলল।
আমি যাবো না। আলফানসো বললো, সাইল রবার্টকে ইঙ্গিত করল। সাইল কোমর থেকে ছোরা বের করল। ছুটে এসে আলফানসোর গলায় ছোরাটা চেপে ধরল। শাঙ্কো দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। এক ঝটকায় তরোয়ালটা খুলল। রবার্টের বুকের ওপর তরোয়ালটা টেনে নিল। জামাটা দোফালি হয়ে গেল। দেখা গেল বুক কেটে রক্ত বেরুচ্ছে। রবার্ট ঘাবড়ে গেল। দুতিন পা পিছিয়ে এল। শাঙ্কো সাইলের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমার জামাটাও কেটে দেব? সাইল সঙ্গে সঙ্গে দু’পা পিছিয়ে গেল। ওরা কখনও তরোয়াল দেখে নি। চ্যাপ্টানো কালো রঙের লাঠিটা যে এত ধারালো তা ওরা কল্পনাও করেনি। রবার্ট ছোরাটা কোমরে গুঁজল। তারপর দুজনে ছুটে পালালো।
–আলফানসো নকশাটা কোথায় রেখেছো?
–আমি রেখে দিয়েছি। শাঙ্কো বলল।
চিচেন ইতজায় ফ্রান্সিস–ওটা আলফানসোকে দিয়ে দাও। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি থেকে নকশাটা বের করে আলফানসোকে দিলে। আলফানসো ওটা কোমরের ফেট্টিতে রেখে দিল। ফ্রান্সিস বলল–আলফানসো, এবার সাইল আর ঐ গুণ্ডাটা তোমাকে ধরলে নকশাটা দিয়ে দেবে।
-বলেন কি। তাহলে তো ওরা
–জীবনেও গুপ্তধন খুঁজে বের করতে পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু আপনাকে তো নকশার নির্দেশ মানতে হবে। আলফানসো বলল।
ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল–আমার কাছে নকশাটার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আমার সব ভাবা হয়ে গেছে। এখন শুধুই কাজে নামা।
–তাহলে আপনি কি নকশা ছাড়াই গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবেন? আলফানসো বলল।
–এখন পর্যন্ত পারবো ভাবছি। তবে কাজে নেমে কিছু কাজ এগিয়ে বুঝতে পারবো গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবো কি না। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে আপনার আর নকশাটার দরকার নেই? আলফানসো বলল।
–না। তুমি সাইলদের নকশাটা দিয়ে দিও। তোমাকে একা পেলে ওরা তোমার ক্ষতি করতে পারে। তার আগেই নকশাটা দিয়ে দিও। ফ্রান্সিস বলল।
সকালের খাবার খেতে খেতে হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস তাহলে তো এখন আমাদের কিছুই করণীয় নেই।
-না। শুধু শুয়ে বসে সময় কাটানো। রাজকুমারের রোগমুক্তির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল!
ফ্রান্সিসদের একঘেঁয়ে দিন কাটতে লাগল। এরমধ্যে দু’দিন ওরা চিচেন ইতজায় গেল। ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে সব দেখল–সিঁড়ি দিয়ে উঠল নামল। সব দেখেই সে ফিরে এল। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস–পারবে রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন উদ্ধার করতে?
–অবশ্যই পারবো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ফ্রান্সিস দৃঢ়কণ্ঠে বলল।
–কিন্তু নকশাটা যদি আলফানসো জীবন বাঁচাতে ওদের দিয়ে দেয়। তাহলে তুমি কোন অসুবিধেয় পড়বে না?
–এখন পর্যন্ত ভাবছি কোন অসুবিধে হবে না। ফ্রান্সিস বলল।
.
বিকেল হলে ফ্রান্সিসরা বেড়াতে বের হয়। নগরে ঘুরে বেড়ায়। রাজপ্রাসাদ দেখে বিখ্যাত রাজউদ্যান দেখে। সন্ধ্যে নাগাদ সরাইখানায় ফিরে আসে।
দিন পাঁচেক কেটে গেল। সেদিন রাজপ্রাসাদের সম্মুখ দিয়ে ওরা আসছে দেখল। প্রাসাদে ঢোকবার প্রধান দরজার সামনে লোকজনের ভিড়। প্রাসাদ রক্ষীদের সামনে লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস চলো তো কী ব্যাপার দেখি। ফ্রান্সিসরা প্রাসাদ রক্ষীদের কাছে এল। তখনই গোমড়ামুখো রক্ষীদের দেখল-হাসছে। বেশ খুশি। ফ্রান্সিস একজনকে জিজ্ঞেস করল-কী ব্যাপার ভাই?
–শোনেননি? রাজপুত্র সম্পূর্ণ সুস্থ। রাজা জানিয়েছেন পূর্ণিমা উৎসব হবে। তবে দিনটা এখনও স্থির করেন নি। দিনটা জানার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি। ফ্রান্সিসরা সবাই শুনল ব্যাপারটা। ফ্রান্সিস বলল–আমরা এখানে অপেক্ষা করবো। পূর্ণিমা উৎসবের দিনটা জেনে যাবো।
ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল। ভিড় বাড়তে লাগল। একসময় ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি তোমার সরাইখানায় চলে যাও। আমি খবরটা জেনে আসছি। হ্যারি আর শাঙ্কো চলে গেল। ফ্রান্সিস এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করল কিছুক্ষণ। একজন লোককে ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–রাজার আদেশ কী করে জানবো?
লোকটি আঙ্গুল দিয়ে একটা চৌকোনো পাথর দেখাল। ফ্রান্সিস সেইদিকে গেল। দেখল পাথরের দেয়ালে একটা কষ্টিপাথর গেঁথে দেওয়া। প্রধান প্রবেশপথের আলো এখানে এসেছে। আট দশজন লোক কষ্টিপাথরের লেখাটা পড়ছে। লেখাটা স্পেনীয় ভাষায় লেখা। তলতেক ভাষায় কোন লিপি বা লিখিত রূপ নেই। ফ্রান্সিস পড়তে লাগল–ঈশ্বরের কৃপায় রাজপুত্র সুস্থ হয়েছে। পূর্ণিমা উৎসবের দিন ঘোষিত হবে।
ফ্রান্সিস লেখাটা সবে পড়ে শেষ করেছে একটা বলিষ্ঠ হাত পেছন থেকে ফ্রান্সিসের গলা পেঁচিয়ে ধরল। ফ্রান্সিস দুহাত দিয়ে গলায় চেপে ধরা হাতটা খুলতে চেষ্টা করতে লাগল। এইভাবে কিছুক্ষণ চলল। দুজনেই হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রবার্ট ওরা গলা পেঁচিয়ে ধরে আছে। সঙ্গে সাইল। সাইল ফ্রান্সিসের হাত দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধল। এবার দুজন ফ্রান্সিসকে টেনে নিয়ে চলল। ভিড়ের দু’একজন জানতে চাইল–কী ব্যাপার? সাইল গলা চড়িয়ে বলল–লোকটা চোর। তাই ধরে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস এই অভিযোগের কোন জবাব দিতে পারল না। রবার্ট ওর গলা চেপে আছে।
ওরা ফ্রান্সিসকে টেনে নিয়ে চলল। রোগাটে চেহারার রবার্টের হাত লোহার মতো শক্ত। ফ্রান্সিস নানাভাবে চেষ্টা করেও গলা ধরা হাতটা সরাতে পারল না।
প্রাসাদের উদ্যানের কাছে এল সাইলরা। একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিসকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হল। সবাই গাড়িতে বসে পড়ল। গাড়ি চলল। পাথুরে রাস্তায় টক্ টক্ শব্দ উঠল। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ।
গাড়ি বেশ কিছুটা পথ যেতে রবার্ট হাতের চাপ কমাল। ফ্রান্সিস হাঁপানো গলায় বললো–আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
–আমাদের আস্তানায়। সাইল বলল।
–কেন? ফ্রান্সিস বলল।
–একমাত্র তুমিই নকশাটার নির্দেশ বুঝতে পেরেছো। তোমরা বার কয়েকবার চিচেন ইতজায় গেছ। আমরা সর্বক্ষণ তোমাকেনজরে রেখেছিলাম। তুমি নকশার নির্দেশ মেনে সব দেখেছো। আমরা নিশ্চিত তুমিই নকশাটার অর্থ ও নির্দেশ বুঝতে পেরেছে।
–আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি মিথ্যে কথা বলছে। সাইল গলা চড়িয়ে বলল।
এই ব্যাপারে আমি কোন কথাই বলবো না। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমাকে বলতে বাধ্য করবো। দাঁত চাপাস্বরে সাইল বলল।
–আমাকে বাধ্য করার চেষ্টা করো না। সে চেষ্টা করলে তোমরা দুজনেই নরকে যাবে? ফ্রান্সিস বলল।
-বেশ। দেখা যাবে কে নরকে যায়! সাইল বলল।
গাড়ি একটা পাথরে টিলার সামনে এসে থামল। রবার্ট গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল–তোমার গলা ছেড়ে দিলাম। চাঁচামেচি করবে না।
টিলাটার পাশ দিয়ে ওরা চলল। কিছুদূর গিয়ে দেখা গেল একটা বাগান মতো। সবাই বাগানাটায় ঢুকল। বাগানের পরেই টিলার গায়ে একট গুহামত। তার মুখটা এমন ছোট যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। রবার্ট হামা দিয়ে চলে।
ফ্রান্সিসদেরও হামা দিয়ে ঢুকতে হল। গুহার মধ্যে তখন অন্ধকার সাইল অন্ধকার খুঁজে খুঁজে একটা মোমবাতি বের করল চকমকিঠুকে আলো জ্বালল। মোমবাতির আলো ছড়াল।
ফ্রান্সিস বলল–তেষ্টা পেয়েছে। জল দাও। সাইল একটা বড় চামড়ার থলি আনল। মাটির গ্লাসে জল ঢেলে ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে ধরল। ফ্রান্সিস জল খেল। গুহার মেঝেয় একটা মোটা কাপড় পাতা। এটাই বিছানা। রবার্ট শুয়ে পড়ল।
এবার ফ্রান্সিস বলল–তোমরা আমার এভাবে ধরে আনলে কেন?
“নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। সাইল বলল।
–সেটাই তো জানতে চাইছি। ফ্রান্সিস বলল।
–যারা রাজা হুনাকমিনের ধন ভাণ্ডার খুঁজেছে আর এখনও যারা খুঁজছে তুমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। আমার বিশ্বাস তুমি রাজা হুনাকমিনের গোপনে রাখা ধনভাণ্ডারের খোঁজ পেয়েছে। সাইল বলল।
অত সোজা। নকশাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি কিন্তু ধনভাণ্ডারের হদিশ পাই নি। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি মিথ্যে কথা বলছে। সাইল বলল।
যদি খোঁজ পেতাম তাহলে কবে সব ধনভাণ্ডার নিয়ে পালাতাম।
–সেসব বুঝি না। তোমার মুক্তি নেই। তোমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে। সাইল বলল।
আমাকে বাদ দাও। যে সরাইখানায় আলফানসো আছে সেখানে যাও নকশাটা চাইলেই পেয়ে যাবে। সেটা এনে দেখে বুঝে তোমরাই ধন ভাণ্ডার উদ্ধার কর। ফ্রান্সিস বলল।
–আমাদের সেই সাধ্য নেই। একমাত্র তুমিই পারবে ঐ ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে। সাইল বলল।
-তোমার সঙ্গী ঐ গুণ্ডাটাকে-ফ্রান্সিস কথাটা শেষ করতে পারল না। রবার্ট লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। কোমর থেকে একটা বড় ছোরা এক ঝটকায় বের করল। চড়া গলায় বলল–আর একবার আমাকে গুণ্ডা বললে তোমার পেট ফাঁসিয়ে দেব।
-রাগ কর কেন? তুমি যা আমি তাই বলেছি। ফ্রান্সিস বলল।
–আবার? রবার্ট চেঁচিয়ে বলল।
–ঠিক আছে। আর এসব নিয়ে কথা বলবো না। কিন্তু আমাকে যে তোমরা ভীষণ বিপদে ফেললে। ফ্রান্সিস বলল।
কীসের বিপদ? সাইল বলল।
–আমার একদল বন্ধু পড়ে রইল তুলামের জাহাজঘাটায়। বাকি দু’জন পড়ে রইল এক সরাইখানায়। কবে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, কবে তোমাদের হাত থেকে রেহাই পাবো। সব জগাখিচুড়ি পাকিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল।
–সব হবে। বন্ধুদের কাছে ফিরে যেতে পারবে। তার আগে রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। সাইল বলল।
তাই তো তোমাকে ধরে এনেছি। সাইল বলল।
–হুঁ। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। বেশ রাত হয়েছে। সাইল উঠে দাঁড়াল। মোমবাতিটা নিয়ে কোনার দিকে গেল। মোমবাতি রেখে জমানো খড় গাছপালার শুকনো ডাল নিয়ে পাথরের উনুনে মোমবাতি দিয়ে আগুন লাগাল। উনুন ধরতে ধরতে সাইল বস্তা থেকে আটা ময়দা বার করল। আটা ময়দা ঠাসলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুটি বানাল। আলু শিমের তরকারি দুপুরেই করা ছিল বোধহয়।
সাইল গলা চড়িয়ে ডাকল–ফ্রান্সিস, রবার্ট খাবার তৈরি। বসে পড়। ফ্রান্সিস আর রবার্ট বিছানা থেকে উঠল। রান্নার জায়গায় এল। সাইল লম্বাটে শুকনো পাতা পাতল। রুটি তরকারি দিল। ফ্রান্সিস প্রায় হাপুস হুপুস করে খেতে লাগল। খিদেও পেয়েছে। একেবারে রাক্ষুসে ক্ষিদে। খেতে খেতে ফ্রান্সিস বলল–আমি একটু বেশি খাই। সাইল সেটা ভালোভাবেই বুঝল। কিছু বলল না। ফ্রান্সিস আড়চোখে তাকিয়ে দেখল মাত্র কয়েকটা রুটি পড়ে আছে লোহার তাওয়ায়। ফ্রান্সিস আর রুটি চাইল না। তরকারি শেষ।
ফ্রান্সিস আর রবার্ট হাতমুখ ধুয়ে এসে বিছানায় বসল। ওদিকে সাইলকে মাত্র তিনটে রুটি তরকারি ছাড়াই খেতে হল।
আর একটু রাত বাড়তেই ওরা ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। ও চুপ করে শুয়ে রইল। ঘণ্টা দুয়েক সময় পরে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠল। মোমবাতি বোধহয় সাইল নিভিয়ে দিয়েছে। গভীর অন্ধকারে ফ্রান্সিস শুধু গুহার মুখটা দেখতে পাচ্ছিল। সেইদিক লক্ষ্য রেখে ফ্রান্সিস দু’পা যেতেই রবার্টের গলা শুনল।
“চুপ করে শুয়ে পড়ো গে। আমি যতক্ষণ খুশি জাগতে পারি, যতক্ষণ খুশি ঘুমুতে পারি। আমার চোখেকে ফাঁকি দিতে পারবে না। যাও।
ফ্রান্সিস বুঝল–এভাবে পালানো যাবে না। অন্য ছক কেটে পালাতে হবে। ফ্রান্সিস ফিরে এসে শুয়ে পড়ল। নানা চিন্তা মাথায়। ফ্রান্সিস মনকে শান্ত করল। আস্তে আস্তে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালের জলখাবার খেয়ে রবার্ট বলল–আমি আলফানসোর কাছ থেকে নকশাটা আনতে যাচ্ছি। ভালো কথা–ফ্রান্সিস নকশাটা এখন কার কাছে আছে?
–আমার বন্ধু শাঙ্কোর কাছে। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো কি ভালোয় ভালোয় দেবে না আমাকে ছুরি চালাতে হবে।
না ভালোয় ভালোয় তোমাকে দেবে। আমি বলেছি এইকথা বলবে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। রবার্ট বলল।
গুহার মুখের দিকে যেতে যেতে রবার্ট বলল–সাইল, একে সাবধানে পাহারা দেবে। এ কিন্তু ভীষণ চালাক। সবসময় চোখে চোখে রাখবে। হঠাৎ রবার্ট ফিরে এল। সাইলের কানে কানে বলল–আমার শিয়রে দিনের বিছানার নিচে একটা ছোরা আছে। দরকারে কাজে লাগাবে।
রবার্ট গুহা থেকে বেরিয়ে চলে গেল।
এবার ফ্রান্সিস বলল–আমাকে এভাবে আটকে রেখেছো কেন?
দরকার আছে। সাইল বলল।
–তোমরা আমার কাছে কী চাও? ফ্রান্সিস বলল।
–খুব সামান্য জিনিস রাজা হুনাবমিনের গুপ্ত ধনভাণ্ডারের হদিশ। সাইল বলল।
–আমি ওসব ভাণ্ডারের কী জানি। ফ্রান্সিস বলল।
–একমাত্র তুমিই জানো। সাইল বলল।
–তাহলে আমাকে পালাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–কোনভাবেই পালাতে পারবে না। সাইল বলল।
–দেখি। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল।
সাইল আস্তে আস্তে গিয়ে গুহার মুখে দাঁড়াল–একটা পাথরের আড়ালে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। একটা অল্পবয়সী ছেলে সাইলের কাছে এল। কী কথা হল দুজনে। সাইল ফেট্টি থেকে বোধহয় দাম বের করে দিল।
সাইল গুহার ভেতরে এসে বিছানায় বসল। কোনার রান্না করার জায়গাটায় রান্নার আয়োজন করতে লাগল।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রবার্ট ফিরে এল। গুহার মুখ থেকে দ্রুত ছুটে এল। ফ্রান্সিস বুঝলসাইল রবার্ট এই গুহায় গোপনে আশ্রয় নিয়েছে। এটাই ওদের গোপন আস্তানা।
রবার্ট ঢুকতেই সাইল বলে উঠল–রবার্ট–নকশা পেলে?
নকশা না দিয়ে যাবে কোথায়? মানে ছোরা টোরা দেখাতে হয় নি। রবার্ট বুঝতেই পারেনি যে শাঙ্কো যে নকশাটা দিয়েছে সেটা নকল। আসলটা রয়েছে হ্যারির কাছে।
নকশাটা দাও। সাইল বলল। রবার্ট কোমরে গোঁজা নকশাটা বের করে দিল। সাইল খুব মনোযোগ দিয়ে নকশাটা দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস মৃদু হাসল। সাইলের নজরে পড়ল সেটা। সাইল বলল-হাসছো কেন?
কেউই যেখানে থৈ পাচ্ছে না সেখানে তুমি এমন ভাব দেখাচ্ছো যেন নকশাটার অর্থ বুঝে ফেলেছে। ফ্রান্সিস বলল।
–মন দিয়ে নকশাটা দেখছিলাম আর কি। অবশ্য নকশার অর্থ বোঝবার জন্যে তুমিই তো আছো। সাইল বলল।
–আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। প্রথমেই চিন্তা তুলামেও এমনি একটা মন্দির আছে। এখন বুঝতে হবে এই নয় যে মন্দির মতো আঁকা হয়েছে সেটা তো তুলামের মন্দিরও হতে পারে। ফ্রান্সিস বলল। সাইল একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল–আচ্ছা, নকশায় কোথাকার মন্দিরটা আর্কা আছে বলে তুমি মনে কর।
–এখানকার মন্দিরটা তুলামের মন্দিরের চাইতে অনেক বড়। কিন্তু মন্দির দুটো দেখতে একরকম। তুমি তো রাজা।
–হা সাইল বলল।
তাই এবার প্রশ্ন কোন মন্দিরটা খুঁজবে? ফ্রান্সিস বলল।
সাইল চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল–আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। একটা কাজ করা যাক–তুলামের মন্দিরটা একবার খোঁজাখুঁজি করা যাক। দেখি হদিশ পাই কিনা। ফ্রান্সিস একবার ভাবল ওদের অভিজ্ঞতার কথা বলবে। পরক্ষণেই ভাবল আমি যা জানি বলি। তারপরেও যদি যেতে চায় মন্দিরটা দেখতে যায় তার দায়িত্ব সাইল আর রবার্টের। তবু ফ্রান্সিস ওদের সাবধান করে দিতে বলল–ঐ মন্দিরের নিচে গর্ভগৃহ আছে। তাতে আগুন জ্বলে।
–সবসময়? সাইল জানতে চাইল।
–না। আগুন জ্বললো না। কিছু পড়লেই দপ করে জ্বলে ওঠে। আগুন ধোঁয়ায় ঢেকে যায় গর্ভগৃহটি। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা তার আগেই খোঁজা শেষ করবো। সাইল বলল।
–পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা নাকি ভাইকিং। খুব বীর নাকি তোমরা। এইটুকু ব্যাপারেই ভয় পেয়ে গেলে? সাইল হেসে বলল।
–ঠিক আছে। চলো৷ তবে তোমাদের কিছু ক্ষতি হলে আমাকে দোষ দিও না। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমাকে দোষ দেব না। তুমি রাজা হুনাকমিনের গুপ্তভাণ্ডারের সন্ধান দাও তাহলেই হবে। সাইল বলল।
বদলে আমাকে কী দেবে? ফ্রান্সিস বলল।
–আগে পাইতো তারপর দেওয়ার প্রশ্ন। সাইল বলল।
ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বললনা। আগে সেটা ঠিক করে নিতে হবে।
–বেশ তা করা যাবে। সাইল বলল।
–উঁহু–আমাকে আগে কথা দাও। ফ্রান্সিস বলল।
“ঠিক আছে গুপ্ত ধনভাণ্ডার তিনটে ভাগ করা হবে। আমরা তিনজনে এক ভাগ করে নেব। সাইল বলল।
— এইবার আমি রাজি। এখন বলো তুলামের মন্দিরেখুঁজতে যাবে?ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। সাইল বলল। এবার রবার্টকে বলল তুলামে যাবে তো?
–হ্যাঁ, হা–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলো। রবার্ট বলল।
তাহলে কালকে সকালেই খেয়েটেয়ে তুলামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বো। সাইল বলল।
দুপুরের মধ্যে সাইলের রান্না হয়ে গেল। সাইল ফ্রান্সিসকে একটা পাহাড়ি ঝর্ণায় নিয়ে গেল। ঐ ঝর্ণার জলে স্নান সারল ওরা।
বিকেলে তিনজন বেড়াতে বেরুলো। কিছুক্ষণ রাজপ্রাসাদ বাগানটাগান দেখল। তাড়াতাড়িই আস্তানায় ফিরে এল। এসময় ফ্রান্সিস রাজপ্রাসাদের দেওয়াল দেখে এল। এখনও রাজা পূর্ণিমা উৎসবের দিনক্ষণ ঘোষণা করেন নি। রাজা এখনও ঐ উৎসবের ব্যাপারে মনস্থির করেন নি।
অন্ধকারের মধ্যেই তিনজন গুহায় ঢুকল। ভেতরের দিকে যেতে লাগল সবাই। কিন্তু নিকষ অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারের মধ্যেই সাইল চকমকি ঠুকে। মোমবাতি জ্বালল।
কিছুক্ষণ পরে সাইল রান্না করতে শুরু করল। ফ্রান্সিস এর মধ্যে পালাবার ছক কষতে লাগল। কিন্তু রবার্ট গুণ্ডা খুনে। মানুষ মারতে ওদের হাত কাঁপে না। রবার্ট সবসময়ই সজাগ। ওর দৃষ্টি এড়ানো প্রায় অসম্ভব।
খাওয়া দাওয়ার পর ফ্রান্সিসরা একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের ঘুম আসছে না। শুধু ভাবনা মারিয়া, বন্ধুরা কেমন আছে। ওরা ফ্রান্সিসের হঠাৎ বেপাত্তা হওয়ার খবর পেয়েছে কিনা। পেলে ওরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে।
রাত গম্ভীর হল। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। অন্ধকারে ও উঠে বসল। আস্তে আস্তে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে গুহার মুখের দিকে চলল। কিন্তু যখন রবার্টের পায়ের কাছ দিয়ে ও যাচ্ছে তখনই রবার্টের ভারি গলা শুনল–ঘুমোও তো-নইলে ছুরি খেয়ে মরবে।
হতাশ ফ্রান্সিস ফিরে এসে শুয়ে পড়ল। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল।
ওদিকে হ্যারি আর শাঙ্কো ফ্রান্সিসদের না ফেরার জন্যে চিন্তায় পড়ল। সরাইখানায় রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেল। সরাইখানার সকলের খাওয়া হয়ে গেল। হ্যারিরা তখনও ফ্রান্সিসদের জন্য অপেক্ষা করছে। সরাইখানার লোক দু’তিনবার এসে খেয়ে নিতে বলল। হ্যারি বলল–আমাদের বন্ধু এখনও ফেরে নি। বন্ধু এলে তবে খাবো।
রাত গম্ভীর হল। হ্যারি, শাঙ্কো তখনও খেল না। সরাইখানার কাজের লোকেরা সবাই শুয়ে পড়ল। ঘরের মোমবাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। অন্ধকারে হ্যারি আর শাঙ্কো চুপ করে শুয়ে রইল। ওদের আর খাওয়া হল না।
পাখির ডাক শোনা গেল। রাত শেষ। হ্যারি আর শাঙ্কো তখনও জেগে। দুজনের আর ঘুম হল না।
সকাল হল। সরাইখানার লোক ওদের সকালের খাবার দিতে এল। হ্যারি আর শাঙ্কো মাথা নাড়ল। লোকটি বলল–আপনারা কাল থেকে কিছু খান নি।
বন্ধু ফিরলে খাবো। হ্যারি বলল।
বন্ধু হয়তো অন্য কোথাও গেছে। ফিরতে দেরি হচ্ছে। আপনারা কি ততদিন পর্যন্ত না খেয়ে থাকবেন? লোকটি বলল।
-দেখি। হ্যারি বলল। লোকটা চলে গেল।
দুজনে হাতমুখ ধুয়ে এল। হ্যারি বলল-শাঙ্কো চলো রাজপ্রাসাদের সামনে যাই। ফ্রান্সিস ওখানেই ছিল। আমরা চলে এসেছিলাম।
-চলো। শাঙ্কো বলল। উঠে দাঁড়াল। হ্যারিও উঠল।
দুজনে রাজপ্রাসাদের দিকে চলল। রাস্তায় নোকজন যে যার কাজ করছে। হ্যারি এই লোকজনের মধ্যে ফ্রান্সিসকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথায় ফ্রান্সিস? হ্যারি হতাশ হল। শাঙ্কোর মনে একটা আশঙ্কা ছড়াল–ফ্রান্সিসকে কেউ মেরে ফেলে নি তো? হ্যারিকে বলল সে কথা। হাারি একটু ভেবে বলল–এটা কী করে হবে? এই বিদেশে কারো সঙ্গে তো আমাদের শত্রুতা নেই। আমার মনে হয় ফ্রান্সিসকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
–কে বা কারা ফ্রান্সিসকে বন্দী করবে? শাঙ্কো বলল।
–সেটাই তো ঠিক বুঝতে পারছি না। হ্যারি বলল।
দুজনে রাজপ্রাসাদের সামনে এল। এই সকালেও এখানে লোকজন জড়ো হয়েছে। বোধহয় দেখতে যে পূর্ণিমা উৎসব সম্পর্কে রাজা কোন বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন কি না। ওরা দেখল পাথুরে গায়ে রাজার সেই পুরোনো বিজ্ঞপ্তিটাই রয়েছে। ফ্রান্সিস এখানে এসেছিল। ফ্রান্সিস ওদের চলে যেতে বলেছিল। ওরা চলে গিয়েছিল। সেইদিন থেকে ফ্রান্সিস নিরুদ্দেশ। হ্যারি ও শাঙ্কো চারদিকের লোকজন দেখতে লাগল। কিন্তু ফ্রান্সিস নেই। শাঙ্কো বলল–হ্যারি–ফ্রান্সিস একাই চিচেন ইতজায় গিয়ে রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন খুঁজছে না তো।
–না–না। মনে আছে তোমার ফ্রান্সিস বলেছিল পূর্ণিমা উৎসবের দিন ফ্রান্সিস ঐ গুপ্তধন উদ্ধার করতে যাবে।
–হ্যাঁ ফ্রান্সিস বলেছিল বটে। শাঙ্কো বলল।
কিছুক্ষণ পরে হ্যারি বলল–এখানে ফ্রান্সিসকে পাবো না। ভাবছি–চিচেন ইতজায় যাবো কি না।
–তাই চলো। একবার তো দেখি।
দুজনে চিচেন ইতজার দিকে চলল। গত কয়েকদিনের মতো রাস্তায় মানুষের ভিড় নেই। তখন পূর্ণিমা উৎসবে অনেক লোক এসেছিল। রাজকুমারের অসুখের জন্যে পূর্ণিমা উৎসব বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় সবাই চলে গেছে। এজন্যেই রাস্তায় লোকজনের তেমন ভিড় নেই।
চিচেন ইতজায় এল ওরা। হ্যারি চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। এই মন্দিরে কিন্তু মানুষের ভিড় আছে।
শাঙ্কোকে নিয়ে হ্যারি মন্দিরের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। কত লোক উঠছে। নামছে। কিন্তু কোথায় ফ্রান্সিস? দুজনে গর্ভগৃহেও নামল। আবার উঠে এল। ওরা বুঝল এভাবে খুঁজে লাভ নেই। ফ্রান্সিসের যদি শারীরিক কোন ক্ষতি না হয়ে থাকে তবে ও নিজেই এদিকে আসবে। তবু মন মানে না। দুজনে ফ্রান্সিসকে খুঁজতে খুঁজতে সরাইখানায় ফিরে এল। সরাইওয়ালার দেওয়া বিছানায় বসল। বিছানা মানে শুকনো ঘাস ভেতরে। বাইরে একটা মোটা কাপড়।
শাঙ্কো বলল হ্যারি। কাল রাত থেকে না খেয়ে আছি। চল–কিছু খাওয়া যাক।
–ফ্রান্সিসকে না দেখা পর্যন্ত আমি খাবো না। হ্যারি বলল।
–পাগলামি করো না হ্যারি। ফ্রান্সিসকে খুঁজতে হলে আমাদের সুস্থ থাকতে হবে। অনাহারে দুর্বল শরীর নিয়ে আমরা কিছুই করতে পারবো না। কথাটা ভেবে দেখ। শাঙ্কো বলল।
হ্যারি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললো–বন্দী দশায় ফ্রান্সিস বলতো –পেট ভরে খাও। খেতে ভালো না লাগলেও খাও। শরীরটা চাঙ্গা রাখো।
–আমিও তাই খেয়েটেয়ে সুস্থ থাকার কথা বলছিলাম। বুঝে দেখ–রাজবাড়ি গেলাম চিচেন ইতজায় গেলাম এখন ফিরে আসছি–শরীর একটু দুর্বল লাগছে না?
হ্যারি বলল–হ্যাঁ। ঠিকই বলেছো। শরীর বেশ দুর্বল লাগছে।
কাজেই পেট পুরে খেতে হবে। আবার সন্ধ্যেবেলা বেরোতে হবে। ফ্রান্সিসকে খোঁজা চলবে। শাঙ্কো বলল।
–ঠিক আছে। দুপুর থেকে আমরা খাওয়াদাওয়া করবো। আমাদের সুস্থ থাকতে হবে। হ্যারি বলল।
সরাইখানার মালিক এল। হেসে হেসে ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলল– গতকাল রাতে খান নি। সকালেও খান নি। রান্না ভাল হয়নি?
রান্না ঠিক আছে। আমাদের এক প্রাণের বন্ধুর কোন হদিশ পাচ্ছি না। সে নিজের থেকেও ফিরে আসেনি–তার জন্যেই আমরা খাই নি। হ্যারি বলল।
–কী করে বন্ধুটি হারালো? সরাইখানার মালিক জানতে চাইলো।
–গত সন্ধ্যায় রাজবাড়ির সামনে আমরা গিয়েছিলাম কবে রাজা পূর্ণিমা উৎসব করতে কোন বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন কিনা সেটা দেখতে। আমরা তেমন কোন বিজ্ঞপ্তি দেখলাম না। রাত হল। বন্ধুটি বলল–তোমরা সরাইখানায় চলে যাও আমি অপেক্ষা করি। দেখি–বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হল কিনা। আমি পরে যাচ্ছি। একটু থেমে হ্যারি বলল
আমরা দুজনে ফিরে এলাম। বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাতে গেলাম না। সারারাত ঘুমুতেও পারি নি। বন্ধু ফিরল না। আজও রাজবাড়ির কাছে চিচেন ইতজায় বন্ধুকে খুঁজে বেড়ালাম। বন্ধুকে পেলাম না।
সরাইখানার মালিক মাথা এপাশ ওপাশ করে বলল–সত্যি এটা তো খুবই দুশ্চিন্তার ব্যাপার।
শাঙ্কো বলল–আজ থেকে আমরা খাবো। শরীর সুস্থ রাখতে হবে।
হ্যারি বলল–আর এক সমস্যা। তুলামের জাহাজঘাটায় আমাদের জাহাজ রয়েছে। বত্রিশজন বন্ধু রয়েছে। তারা এখনও বন্ধুর নিখোঁজ হয়ে যাবার খবর জানে না। তারাও আমরা ফিরলাম না দেখে ভীষণ চিন্তায় পড়বে।
–তাহলে এখন কী করবেন? মালিক বলল।
–সেটাই ভেবে ঠিক করতে পারছি না। হ্যারি বলল।
–আমি বলি কি একজন জাহাজে যান। বন্ধু নিখোঁজ এই সংবাদটা জানান। আরো কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে আসুন।
হ্যারি মাথা নিচু করে ভাবল। তারপর শাঙ্কোকে বলল
–শাঙ্কো কী করবে?
–ঠিকআছে। আমরা এন্টু ভেবে দেখি। শাঙ্কে বলল সরাইখানার মালিক চলে গেল।
সেদিন বিকেলে ফ্রান্সিসরা রুটি, মধু খেল। সাইল কয়েকটা থলি নিল। আটা-ময়দা তরিতরকারি এসব কিনে আনতে তৈরি হল। ফ্রান্সিস বলল–সাইল–রাজপ্রাসাদের সামনের পাথুরে দেওয়ালে রাজার বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে কিনা দেখো তো?
–কীসের বিজ্ঞপ্তি? সাইল বলল।
–পূর্ণিমা উৎসব কবে হবে তারা জানিয়েছেন কিনা। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ দেখবো। সাইল চলে গেল।
রবার্ট পাহারায় রইল। রবার্ট দুপুরের খাওয়াদাওয়া করার পর সেই যে পাতলা কম্বলের ওপর শুয়েছে আর ওঠার নাম নেই।
সন্ধ্যা নামল। অন্ধকার গুহায় ফ্রান্সিস বসে রইল। রবার্ট শুয়ে রইল।
একসময় ফ্রান্সিস বলল-রবার্ট।একটুগাত্রোত্থান কর–মানে ওঠ। মোমবাতিটা জ্বালাও।
–আমি অন্ধকারেও দেখতে পাই। রবার্ট বলল।
–আমি তো তোমার মতো বেড়াল নই। অন্ধকার আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। ফ্রান্সিস বলল।
–সাইল এসে মোমবাতি জ্বাললো। ততক্ষণ অন্ধকারে বসে থাকো। রবার্ট বলল।
–বেশ। অন্ধকার থাকলে ভালো–আমার পালানোর সুবিধে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেঘোরে ছোরা খেয়ে মরবে। রবার্ট বলল।
–হুঁ। তুমি জবরদস্ত পাহারাদার। ফ্রান্সিস বলল।
রবার্ট কোন কথা বলল না। জোরে একবার শ্বাস ফেলে পাশ ফিরল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দরকারি জিনিস নিয়ে সাইল ফিরল।
ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল রাজার বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে?
–না। রাজপুত্র সুস্থ হয়েছে সেই বিজ্ঞপ্তিটাই সাঁটা আছে। সাইল বলল।
–শুভ সংবাদ। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
–ওকথা বলছ কেন? সাইল জানতে চাইল।
–আছে আছে। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করে বলল।
একটু রাত হতে সাইল রাঁধতে বসল। রাঁধতে রাঁধতে বলল–তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। কাল সকাল সকাল খেয়ে বেরুবো আমরা।
–তাহলে তুলমের মন্দির দেখতে যাচ্ছো? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। সাইল বলল।
তখন রাত গভীর। ফ্রান্সিস তখনও ঘুমোয়নি। আবার পালানোর জন্যে তৈরি হল। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে গুহামুখের দিকে চলল। অন্ধকারে সাইলকে ছাড়াল। রবার্টকে ছাড়িয়ে যেতেই রবার্টের মোটা গলা শুনল–ফ্রান্সিস মিছিমিছি মৃত্যুকে ডেকে এনো না। রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন খুঁজে বের করতে আমাদের সাহায্য কর। গুপ্তধন পেলেই তোমার মুক্তি।
ফ্রান্সিস নিজের জায়গায় ফিরে এল। বলল–রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধন কোথায় আমি জানি না।
নকশায় নির্দেশ আছে। একমাত্র তুমিই সেই নির্দেশ বুঝে গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবে। কাজেই আমাদের হাত থেকে তোমার মুক্তি নেই। পালাবার চেষ্টা করো না। ছোরা তোমার হৃৎপিণ্ড ভেদ করবে। তুমি মারা যাবে। রবার্ট থেমে থেমে বলল।
ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন ভোরে সাইল রবার্টের কথাবার্তায় ফ্রান্সিসের ঘুম ভাঙল। ঝর্ণার জলে, হাত মুখ ধুতে যাচ্ছে রবার্ট পেছন পেছন এল।
গুহায় ফিরে দেখল সাইল খেতে দিয়েছে। রুটি আর কলা, আধখানা আপেল।
সাইল বলল–ফ্রান্সিস খাবার খেয়ে নিয়ে তৈরি হও। অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা তৈরি হল। ফ্রান্সিসকে একটা ঝোলা দেওয়া হল। রবার্ট আর সাইল ঝোলায় রান্নার বাসনটাসন নিল। গুহা থেকে বেরিয়ে এল। চলল পূবমুখো। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহর ছাড়িয়ে উন্মুক্ত প্রান্তরে এল। রোদ বেশ চড়া। রোদের তেজ সহ্য করে ওরা চলল।
শেষ দুপুরে একটা ছোট বসতিতে এল। এখন খাওয়া। সাইল বলল- চল দেখি কারো বাড়িতে খেতে পারি কিনা।
একটা দোকানের সামনে এল। সাইল দোকানদারের কাছে গেল। বলল–আমরা বেশ দূর থেকে আসছি। আমাদের কিছু খেতে দিতে পারেন? দোকানদার বলল দেখি–স্ত্রীকে রাজি করাতে হবে। একটা পাটাতন দেখিয়ে বলল আপনারা বসুন। ফ্রান্সিসরা বসল। এতদূর হেঁটে শরীর বিশ্রাম চাইছিল। কিন্তু সাইল বলল–এত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে চলবে না। আমাদের অনেক দূর যেতে হবে।
দোকানদার এল। হেসে বলল–আমাদের তো রান্না খাওয়া হয়ে গেছে। আপনারা বিশ্রাম করুন। কিছুক্ষণের মধ্যে রান্না হয়ে যাবে। আপনারা কি ততক্ষণ এখানেই বিশ্রাম করবেন না ভেতরবাড়িতে বিছানায় বিশ্রাম করবেন? সাইল ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল–আমরা ভেতরবাড়িতে যাব। শোবো। শুধু বসে থেকে বিশ্রাম হয় না।
ঠিক আছে। আসুন। দোকানদারের পেছনে পেছনে ওরা ভেতরবাড়িতে ঢুকল। একটা ঘরের দরজা খুলে দোকানদার ফ্রান্সিসদের অপেক্ষা করতে বলল।
ফ্রান্সিসরা ঘরে ঢুকে দেখল মেঝেয় বিছানা পাতা। শুকনো ঘাসপাতার বিছানা। ফ্রান্সিসরা আস্তে আস্তে বিছানায় বসল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। সাইলও শুয়ে পড়ল। কিন্তু রবার্ট শুয়ে পড়ল না। বসে রইল।
কেউ কোন কথা বলছিল না। এত খিদে পেয়েছে যে কেউ কথা বলতে পারছে না।
ঘণ্টাখানেক পরে একটি অল্পবয়স্ক মেয়ে এল। হাতে গোল গোল বড় পাতা। ওদের সামনে মেঝেয় পাতাগুলো দিল। একটু পরে দোকানদারের স্ত্রী ঢুকল। হাতে কাঠের বড় বেকারি। তাতে রুটি রাখা। দোকানদারের স্ত্রী রুটি পাতায় দিতে লাগল। ফ্রান্সিস শুধু রুটিই খেতে লাগল। দেখাদেখি সাইল আর রবার্টও শুধু রুটি খেতে লাগল। দোকানদারের স্ত্রী এবার কাঠের গামলায় শাকসজির ঝোল নিয়ে এল। পাতায় দিল। ফ্রান্সিসরা খেতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে স্ত্রীলোকটি মাংস নিয়ে এল। ফ্রান্সিসদের ঝোলসহ মাংস দিল। তিনজন গোগ্রাসে খেতে লাগল। আর এক দফা রুটি দেওয়া হল। ফ্রান্সিস আরো দুখানা রুটি চাইল। স্ত্রীলোকটি হেসে মাথা এপাশ ওপাশ করে বলল- আর রুটি নেই। যদি বলেন তাহলে রুটি করে দিতে পারি।
–ঠিক আছে। আমরা আর থাকবো না। চলে যাবো। ফ্রান্সিস বলল। তিনজনেই উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি হাতমুখ ধোবার জল দিল। জল খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রান্সিসরা বাড়ির বাইরে এল। দোকানদারের কাছে গিয়ে ফ্রান্সিস বলল– আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমরা ভাল খেয়েছি। রবার্ট বলল—-আর বসা নয়। চলো সব।
দোকানের বাইরে গিয়ে ওরা আবার পূবমুখো হাঁটতে লাগল।
বিকেল হল। যেতে যেতে সন্ধ্যে হল। একটা জঙ্গলের কাছে পৌঁছল ওরা। সাইল থামল। ফ্রান্সিস, রবার্টও থামল। সাইল বলল–চলোএখানেই রাতের খাওয়া খাবো, শোবো, ঘুমোবো।
একটা বিরাট গাছের গোড়ায় এসে সাইল ওর পোটলা থেকে বাসনটাসন রাখল। ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝোলাটোলা রাখল। সাইল বলল–এখন সবচেয়ে জরুরী কাজটা করতে হবে। একটা ঝর্ণাটর্ণা খুঁজে বের করতে হবে। জল না হলে কিছুই রান্না করা যাবে না। একটা ঝর্ণার খোঁজে বনে ঢুকতে হবে।
–তাহলে তো তোমাকে যেতে হয়। রবার্ট বলল।
–আমি যেতে পারি। এসব আমার অভ্যেস আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–না। তুমি যাবে না। রবার্ট বলল।
–আমি যাচ্ছি। সাইল বলল। তারপর বাসনের ঝোলা থেকে একটা একটু বড় কাঠের পাত্র বের করল। সেটা হাতে নিয়ে সাইল জঙ্গলে ঢুকল।
ফ্রান্সিস গাছের নিচে বসল। রবার্টও ওর পাশে বসল। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল– রবার্ট কিছুতেই ফ্রান্সিসকে চোখের আড়ালে যেতে দিচ্ছে না। দুজনে বসে রইল অন্ধকারে। ফ্রান্সিস পালাবার ছক কষতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইল কাঠের বড় বাটিটা ভর্তি জল নিয়ে এল। বগলে শুকনো ডালটাল নিয়ে এল। বলল–এই জলটা আমরা খাই। আমাদের নিশ্চয়স তেষ্টা পেয়েছে। বাটিটা ধরে ধরে তিনজনে জলটা খেয়ে নিল। সাইল শুকনো ডালটাল রাখল। রবার্টকে বলল আমি আবার জল আনতে যাচ্ছি। রবার্টকে বলল–তিনটে পাথর এনে উনুন বানাও।
সাইল ঘটি নিয়ে চলে গেল। রবার্ট অন্ধকারের মধ্যে গাছতলাটার একটু দূরে থেকে তিনটে বড় পাথর আনল। উনুন বানাল।
সাইল জল নিয়ে এল। পাত্র বের করে আটা মাখতে লাগল। বলল-রবার্ট উনুন চকমকি দিয়ে জ্বালাও। রবার্ট অন্ধকারে হাতের আন্দাজে ঝোলা থেকে চকমকি পাথর বের করল। শুকনো ডালটাল আর শুকনো পাতা নিয়ে চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালল।
অল্পক্ষণের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। সাইল উনুনে একটা লোহার চ্যাপ্টামত পাত্র বসাল। মোমবাতি বের করল। উনুনের আগুন থেকে মোমবাতি জ্বালল। জোর বাতাস নেই। মোমবাতি একেবারে নিভে গেল না। তবে মোমবাতির শিখা নড়তে লাগল মাঝে মাঝে। সাইল রুটি বানাতে লাগল। মোমবাতির আলোয় দেখতে দেখতে পনেরোখানা রুটি বানাল। বলল–যাও বড় পাতা নিয়ে এসো। রবার্টঅন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে কয়েকটি পাতা পেল। নিয়ে এল। সাইল মধুর পাত্রটা বের করল। বলল–বসে পড়। ফ্রান্সিস আর রবার্ট পাতা সামনে নিয়ে বসল। সাইল ওদের পাতায় রুটি দিল। তারপর মধুর পাত্র থেকে মধু ঢেলে দিল। মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখে দেখে রুটি খেতে লাগল। ঐ মধুমাখা রুটি ফ্রান্সিসের কাছে যে কী সুস্বাদু লাগল! এবার সাইলও খেতে লাগল।
খাওয়া শেষ। সাইল যে জলটুকু বাঁচাতে পেরেছিল সেই জল ওরা ভাগ করে– খেল। খিদে মিটল।
এবার শুয়ে পড়া। তিনজনেই গাছের নিচেই শুকনো পাতা জড়ো করে তার ওপর শুয়ে পড়ল। পরিশ্রান্ত ওরা একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল হল। ফ্রান্সিসদের ঘুম ভাঙল। সাইল বলল–আর দেরি করবো না। সকালের খাওয়া খেয়েই বেরিয়ে পড়বো। আজকেই তুলামে পৌঁছবো।
গতরাতের বাসি রুটি মধু খেল। তারপর আটার ঝোলা, বাসনটাসনের ঝোলা নিয়ে চলল ওরা।
দুপুরে এক চাষীর বাড়িতে খেল। তারপর শেষ বিকেলে ওরা তুলামে পৌঁছল। ওরা খুঁজে খুঁজে একটা সরাইখানায় এল। দরদাম করে সরাইখানার পাতা বিছানায় ওরা বসল।
ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে পড়ল। সাইলও আধশোয়া হল। রবার্ট বসে রইল। ফ্রান্সিস বলল–এখন তো রাজা তুতজের সঙ্গে দেখা করা যাবে না। কাল সকালে রাজসভায় গিয়ে কথা বলতে হবে। কাজেই আজ রাতে খাওয়া ও বিশ্রাম।
রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল ওরা।
পরদিন তৈরি হয়ে ওরা রাজবাড়ির দিকে চলল। তখনই ফ্রান্সিস দেখল বেশ কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি পশ্চিমমুখে চলেছে। আরোহীরা আনন্দে হৈ হৈ করছে। এরা কি তবে পূর্ণিমা উৎসবে যাচ্ছে?
একটা গাড়িতে লোক তোলা হচ্ছিল। ফ্রান্সিস কাছে একজন যুবককে জিজ্ঞেস করল–আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
–পূর্ণিমা উৎসবে।
–পূর্ণিমা উৎসব কবে?
–পরশু। যুবকটি গাড়িতে উঠে পড়ল।
ফ্রান্সিস বেশ উত্তেজনা বোধ করল। আমাকে আজকেই পালাতে হবে।
পরদিন সকালে ওরা রাজা তুতজের রাজসভায় গেল। রাজা তুতজ সিংহাসনে বসে আছেন। বিচার চলছে। ফ্রান্সিস সবকিছুই তাড়াতাড়ি সারতে চাইছিল। মাত্র একটা দিন হাতে।
একটু পরেই একজন বন্দীকে নিয়ে সেনাপতি রাজসভায় এল। ফ্রান্সিস সাইলকে বলল–তুমি সেনাপতিকে বল যে আমি রাজাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। সাইল আস্তে আস্তে সেনাপতির কাছে গেল। বলল–আমরা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ রাজাকে দিতে চাই। কী সংবাদ? সেনাপতি বলল।
–আমরা রাজাকে রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধনের একটা নকশা দিতে চাই।
বলো কি? ঠিক তো? সেনাপতি বলল।
–হ্যাঁ।
–দেখছি। সেনাপতি হেঁটে হেঁটে রাজার পাশের আসনে বসা মন্ত্রীর কাছে গেল। এসব বলল। একটু পরেই সেনাপতি ফ্রান্সিসদের এগিয়ে আসতে বলল।
ফ্রান্সিসরা এগিয়ে গেল। রাজা ফ্রান্সিসকে দেখে বললেন–তুমি তো ভাইকিং। দুজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলে। তারপর পালিয়ে ছিলে।
–হ্যাঁ মান্যবর। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমাদের কাছে রাজা হুনাকমিনের গুপ্তধনের নকশা আছে? রাজা বলল।
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল। তারপর সাইলকে নকশা দিতে বলল। সাইল নকশা বের করে দিল। ফ্রান্সিস রাজাকে দিল। রাজা মন্ত্রী দুজনেই ঝুঁকে পড়ে নকশাটা দেখতে লাগল।
–এটা ভূতুড়ে নকশা নয় তো? রাজা বললেন।
–না। আপনি আমাদের অনুমতি দিন। এখানকার মন্দিরে আমরা গুপ্তধন খুঁজে বের করবো। সাইল বলল।
–পারবে? রাজা বলল।
–নকশা পেয়েছি কাজেই কোন অসুবিধা হবে না। সাইল বলল।
–দেখ চেষ্টা করে। রাজা বলল।
–আপনি দুজন প্রহরী দিন। কিন্তু তারা গর্ভগৃহে নামতে পারবে না। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। নকশাটা আমার কাছেই থাকবে। রাজা বলল।
–কোন অসুবিধে নেই। তাহলে আমরা গুপ্তধন খুঁজতে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।
–হুঁ। তুতজ মুখে শব্দ করল।
ওরা রাজবাড়ির বাইরে এল। ফ্রান্সিস বলল–আমরা এখনই খুঁজতে যাবো। আমি সময় নষ্ট করতে পারবো না। তোমরা আমাকে একা ছেড়ে দিলে আমিই খুঁজতে যেতাম। তোমরা সরাইখানায় খেয়ে টেয়ে আসতে পারতে।
–তোমাকে একা ছাড়া হবে না। রবার্ট বলল।
–বেশ চলো। ফ্রান্সিস বলল।
তখনই দুজন প্রহরী ওদের কাছে এল। বলল–সেনাপতি আপনাদের সাহায্য করতে বলেছেন। তাই আমরা এসেছি। চলুন। দুজন প্রহরীর হাতে দুটো নেভানো মশাল।
–আমাদের একটা মশাল লাগবে। ফ্রান্সিস বলল।
–পাবেন। প্রহরী বলল।
ওরা মন্দিরের সামনে এল। সিঁড়ির কাছে এল। ফ্রান্সিস মুখ ফিরিয়ে প্রহরীদের বলল–একটা মশাল জ্বেলে দাও। প্রহরীটি চকমকি পাথর ঠুকে মশাল জ্বালিয়ে দিল।
এবার তিনজনে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল! তারপরই সিঁড়ি নেমে গেছে। ওরা নামতে লাগল। সিঁড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। এখন মশালের আলোতে দেখে দেখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।
সিঁড়ি শেষ। সেই চৌকোনো ঘরটি। ফ্রান্সিস সাইলকে মশালটা দিয়ে বলল– মশালটা ধরো। কিন্তু সাবধানে আগুনের একটা ফুলকিও যেন মেঝেয় না পড়ে। যদি পড়ে ধোঁয়া আর আগুনে আমাদের মৃত্যু সুনিশ্চিত।
ফ্রান্সিস মশালের আলোতে ঘরটা ভাল করে দেখতে লাগল। হঠাৎ দেখল পাথরের একটা জোড়ের মধ্যে একটু ফাঁক রয়েছে। ফ্রান্সিস পাথরটায় ধাক্কা দিল। পাথরটা নড়ল। আবার জোরে ধাক্কা দিল। পাথর দুটো বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিস পাথর দুটো খুলে রাখল। তারপর নিচু হয়ে ঐ খোঁদলের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিস এবার হাত বাড়িয়ে বলল–মশালটা দাও। এই ফোঁকরের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসো।
ফ্রান্সিস জ্বলন্ত মশাল তুলল। দেখল একটা বড় ঘর। ঘরভর্তি কঙ্কাল। শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে। সাহসী ফ্রান্সিসও একটু ঘাবড়ে গেল। অত কঙ্কাল দেখে সাইল আর রবার্ট ভয়ে শিউরে উঠল।
ফ্রান্সিস মশাল হাতে ঘরটা দেখতে লাগল। ফ্রান্সিসের কেমন মনে হল এই ঘর থেকে বেরোবার পথ নিশ্চয়ই আছে। ও দেয়ালগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস দেয়ালগুলো ধাক্কাতে লাগল। হঠাৎ একটা দেয়ালের অংশ নড়ে উঠলো। ফ্রান্সিস জোরে ঠেলা দিল। পাথরের অংশ খুলে গেল। বাইরে রোদ। ফ্রান্সিস ভেবে নিল এইবার পালাতে হবে। ও বাইরে আসছে তখনই রবার্ট ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিস এক ঝটকায় ওকে ফেলে দিল। রবার্ট কোমর থেকে ছোরা বের করল। ফ্রান্সিস হাতের মশালটা দিয়ে রবার্টের মুখে জোরে এক ঘা লাগাল। রবার্টের হাত থেকে ছোরাটা খসে পড়ল। ও মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল। সাইল তখন বেরিয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস মশাল ছুঁড়ে ফেলে বনভূমির দিকে ছুটতে লাগল।
একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল দুই প্রহরী ছুটে আসছে। ফ্রান্সিস গতি বাড়াল। দুই প্রহরী কাছে আসার অনেক আগে ফ্রান্সিস বনভূমিতে ঢুকে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস কয়েকটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখল সাইল ও রবার্টকে প্রহরীরা নিয়ে চলেছে। বোধহয় কয়েদঘরে বন্দী করে রাখবে।
এবার ফ্রান্সিস হাঁটতে হাঁটতে বন পার হতে লাগল। বনতল বেশ অন্ধকার। সাবধানে পা ফেলে হাঁটতে হচ্ছে। তারই মধ্যে যতটা দ্রুত হাঁটা যায় ততটা দ্রুতই ফ্রান্সিস হাঁটতে লাগল। পূর্ণিমা উৎসবের দিনে রাতের আগে চিচেন ইতজায় পৌঁছুতে হবে।
ভীষণ পেছল গাছের গোড়ায় আছাড় খেল কয়েকবার। তবু ফ্রান্সিস থামল না। যতটা দ্রুত সম্ভব চলল।
বনভূমি শেষ। সামনেই বিস্তৃত প্রান্তর। বাঁদিকের রাস্তায় এল। রাস্তার দু’ধারে দেখতে দেখতে চলল বুড়িমার বাড়ির উদ্দেশ্যে। খুঁজে খুঁজে বুড়িমার বাড়ি পেল। হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস দরজায় ধাক্কা দিল। ভেতরে কোন সাড়া নেই। এবার জোরে ধাক্কা দিল। দরজাটা নড়ে গেল।
যাচ্ছি। বুড়িমার গলা দরজা খুলল। ফ্রান্সিস দেখে বলল–বুড়িমা, আমাকে চিনতে পারছেন? বুড়িমা কিছুক্ষণ ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল– চিনতে পারছি। আমার ছেলের বন্ধু। ছেলের সঙ্গে এসেছিল। একটু থেমে বলল– আচ্ছা আমার ছেলে এখন কোথায়?
চিচেন ইতজায়। ও সুস্থ। আনন্দে আছে। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখা হলে তুমি আমার কাছে নিয়ে এসো। বুড়িমা বলল।
–আপনি কিছু ভাববেন না। আপনার ছেলেকে গেলেই ধরে নিয়ে আসবো। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
বুড়িমা বলল–এসো। ফ্রান্সিস ঘরে ঢুকল। পাতা বিছানায় বসল। বলল– বুড়িমা, একটা কথা।
–কী কথা?
–বলছিলাম, রাজা তুতজের প্রহরীদের হাত থেকে আমি পালিয়ে এসেছি। বিকেল হয়ে এলো। এখনও একটা বাসি রুটি একটু মধু খেয়ে আছি। আপনি যদি একটু খেতে দিতেন।
–দেব বৈ কি। বল তো তোমাকে বেঁধে খাওয়াতে পারি। তুমি আমার ছেলের বন্ধু।
–তাহলে আমাকে কিছু খেতে দিন। আমার হাতে সময় কম। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। বস। বুড়িমা বলল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বুড়িমা একটা কাঠের থালা নিয়ে এল। ফ্রান্সিসের দিকে থালাটা এগিয়ে ধরে বলল–এই সামান্য খাবারই আছে।
–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস কাঠের থালাটা নিল। দেখল–বেশ কিছু মাংসর বড়া আর হাতে তৈরি কেক।
ফ্রান্সিস গোগ্রাসে খেতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সব শেষ। বুড়িমা জলের ঘটি দিল। ফ্রান্সিস ঢ ঢক্ করে জল খেল। বলল–বুড়িমা আর কিছু বড়া হবে? রাস্তায় খেতাম।
–খাও না। বুড়িমা বলল।
–আপনি?
রান্না করে খাব।
–ফ্রান্সিস বলল–একটা কাপড়ের টুকরোয় বেঁধে দেবেন।
বুড়িমা চলে গেল। একটু পরেই কাপড়ের থলেতে মাংসের বড়া বেঁধে নিয়ে এল। ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস ওটা কোমরের ফেট্টিতে গুঁজে রাখল।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–বুড়িমা আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাবো
ধন্যবাদের দরকার নেই। তুমি আমার ছেলেকে নিয়ে এসো। বুড়িমা বলল। ফ্রান্সিস রাস্তায় এসে দাঁড়াল। রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। ঘোড়ায় টানা গাড়ি যাচ্ছে আসছে। একটা গাড়িতে দেখল খুবই ভিড়। গাড়িটা থামল। ঘোড়াটাকে জল, ছোলা খাওয়ানো হচ্ছে। তখনই ফ্রান্সিস একজনকে জিজ্ঞেস করল- আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
–চিচেন ইতজা–পূর্ণিমা উৎসবে।
দেখুন আমার ভাড়া দেবার ক্ষমতা নেই। আমাকে নিয়ে যাবেন?
–বিনি ভাড়ায়? পাগল? আমরা দুদিন আগেই ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। কত লোককে নেওয়া হল না–জায়গা নেই বলে। আর বিনা ভাড়ায় যেতে চাইছেন? লোকটি বলল। ফ্রান্সিস সরে এল। হাঁটতে লাগল।
রাত হল। ফ্রান্সিস সমানে হেঁটে চলল। রাত হয়েছে। মাংসের বড়া শেষ। ফ্রান্সিস অন্ধকারে হেঁটে চলল। জল তেষ্টা পেয়েছে। বেশ খিদেও পেয়েছে।
একটা মোড়ে স্ত্রীলোক কয়েকজনের ভিড় ফ্রান্সিস কাছে এল। দেখল একটা বড় ইঁদারা। একজন স্ত্রীলোক একটা লোহার পাত্রে জল তুলতে লাগল। দড়ি বাঁধা পাত্রটি ওপরে তুলল। ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। মুখের কাছে হাত পাতল। স্ত্রীলোকটি ফ্রান্সিসকে জল খেতে দিল। ফ্রান্সিস জল খেল। জল নিয়ে চোখ মুখে ঝাঁপটা দিল। মুখ তুলল। তেষ্টা মিটল।
ফ্রান্সিস হাঁটতে লাগল। এতক্ষণ আকাশে মেঘ ছিল। উঁদ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ বৃষ্টিও হল। ফ্রান্সিস বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বৃষ্টি থেমে যেতেই আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ দেখা গেল। চারদিকে চাঁদের আলো। সব কিছু রাস্তা বাড়িঘর গাছপালা সব পরিষ্কার দেখা যেতে লাগল। ফ্রান্সিস আনন্দে দু’হাত তুলে ওদের ভঙ্গিতে জিগির দিল–ওহোহো।
এবার আর একটা মোড়ে এল। একটা দোকানে বেশ ভিড়। ফ্রান্সিস দোকানটায় ঢুকল। দেখল শরতের দোকান। দোকানের দুদিকে দুটো বেঞ্চি মতো কাঠের পাটাতন রাখা। ফ্রান্সিস বসে পড়ল।
দোকান মালিক কাঠের গ্লাসে সরবৎ দিচ্ছে। ফ্রান্সিসও একটা গ্লাস নিল। সরবৎ খেতে লাগল। কী কী মিশিয়ে সরবৎ তৈরি সেটা তো জানার উপায় নেই। তবে শরবণ্টা খেয়ে গায়ে বেশ জোর পেল। হাঁটার ক্লান্তিটা কমে গেল। ফ্রান্সিস বেরোতে গেল। দোকানের মালিক হাত পাতল। ফ্রান্সিস বলল–আমি আপনাকে সত্যি কথাই বলছি। একটা গুণ্ডার জন্যে আমি বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। এক বন্ধুর কাছে অর্থ দামী জিনিস থাকে। আমার কাছে এখন রাজার একটা মুদ্রা নেই। আমি দাম দিতে পারবো না।
মালিক জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল-না-না। যেভাবে পারো দাম দাও।
সত্যি বলছি আমার থলি শূন্য।
–আমি সেসব বুঝি না দাম দাও নইলে তোমাকে বেঁধে রাখা হবে। কাল সকালে শান্ত্রী এলে তোমাকে ধরিয়ে দেব।
ফ্রান্সিস হো হো করে হেসে উঠল। যারা খাচ্ছিল তারা অনেকেই ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে দেখল।
একজন লম্বামতো লোকফ্রান্সিসের কাছে এগিয়ে এল। সে মালিককেবললক হয়েছে?
দেখুন না এই লোকটা শরবৎ-এর দাম না দিয়ে পালাতে চাইছে। ফ্রান্সিস মালিকের সামনে এগিয়ে এল। দাঁত চাপা স্বরে বলল–মিথ্যে বলো না। আমি পালাতে চেষ্টা করি নি। মালিক ফ্রান্সিসের চোখের দিকে তাকিয়ে বেশ ঘাবড়ে গেল। চুপ করে রইল। লম্বা লোকটি কোমর থেকে একটা ভেলভেটের থলে বের করল। বলল–কত পাওনা হয়েছে আপনার?
দুই মুদ্রা।
–এই নিন। লম্বা লোকটি মুদ্রা দিয়ে বলল–আর একটি কথাও নয়। চলে যান এখান থেকে। মালিক প্রায় দৌড়ে চলে গেল। লম্বা লোকটি ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে এল। মোমবাতির আলোয় ফ্রান্সিস দেখল–ভদ্রলোকের গায়ে বেশ দামী পোশাক। লোকটি ফ্রান্সিসের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল ইউবেক। ফ্রান্সিসও হাতটা ধরে বলল– ফ্রান্সিস। দুজনে করমর্দন করল।
–আসুন একটু কথা বলি। ইউবেক বলল। দুজনে কাঠের পাটাতনে বসল। ইউবেক বলল–আপনি বিদেশী। এখানে এলেন কী জন্যে?
–সে আরেক কথা। ফ্রান্সিস বলল।
–তবু একটু শুনি।
ফ্রান্সিস অল্প কথায় নিজেদের দল বেঁধে দেশে দেশে ঘোরা, গুপ্তধন আবিষ্কার এসব বলল।
–আপনি কোথায় যাবেন? ইউবেক বলল।
–চিচেন ইতজা–পূর্ণিমা উৎসবে। ফ্রান্সিস বলল।
-সে তো আমরাও যাচ্ছি। আমরা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে যাচ্ছি। গাড়োয়ানকে বলে দেখি আর একজনকে নিয়ে যাওয়া যাবে কি না। চলুন।
দুজনেই উঠল। ইউবেক বলল–আপনি তখন হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন কেন? ফ্রান্সিস হেসে বলল–কত কত বহুমূল্যবান অলঙ্কার সোনার চাকতি একটা বিরাট সোনার ঘণ্টা–এসব গুপ্তধন আমি বুদ্ধি খাঁটিয়ে উদ্ধার করেছি। আর আজ আমার পকেটে একটা তামার মুদ্রাও নেই।
যাক গে এই নিয়ে দুঃখ করবেন না। আমরা এবার যাবো। ইউবেক গলা চড়িয়ে বলল বন্ধুরা–গাড়িতে এসো। ইউবেক-এর বন্ধুরা দোকান থেকে বেরিয়ে এল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল একটা দুই ঘোড়া টানার গাড়ি দাঁড়িয়ে। ইউবেক-এর বন্ধুরা গাড়িতে উঠতে লাগল। ইউবেক ফ্রান্সিসকে নিয়ে গাড়োয়ানের কাছে গেল। ডাকল–বিভান?
–বলুন স্যার। বিভান বলল।
আমাদের গাড়িতে একজন লোক নেয়া যেতে পারে? ইউবেক বলল।
–গাড়ির ভেতরে আর জায়গা হবে না। উনি আমার পেছনে বসতে পারেন। তবে বেশ কষ্ট হবে।
–আমি ওভাবে যেতে পারবো। ফ্রান্সিস বলল।
ইউবেকআর বন্ধুরা গাড়িতে উঠল। ফ্রান্সিস বিভানের পেছনে টানা কাঠেরওপর বসল।
বিভান মুখে শব্দ করে চাবুকমারল। তখনইবিভানের কনুইফ্রান্সিসের পাঁজরায় গুতো দিল।
ফ্রান্সিস বুঝল বিভান যতবার চাবুক মারবে আবার একটু গুঁতো খেতে হবে। ফ্রান্সিস পরেরবার একটু কাত হয়ে গুঁতো এড়াল। এটা বারবারই হতে লাগল।
রাস্তায় গাছগাছালিতে জোৎস্না ছড়ানো। ঘোড়ার ক্ষুরের টক্ টক্শব্দ। নিশাচর পাখি। গাছের ডালের মধ্যে দিয়ে উড়ে গেল। আনন্দে ফ্রান্সিসের মন ভরে গেল।
বাকি রাতটা না ঘুমিয়েই কাটল। অবশ্য এমন একটা জায়গায় ফ্রান্সিসকে বসতে হয়েছে যেখানে ঘুমোনো অসম্ভব।
পূবদিকের আকাশে কমলা রং ধরল। একটু পরেই সূর্য উঠল। ভোরের স্নিগ্ধ আলো ছড়াল। ঠাণ্ডা বাতাস বইল।
গাড়ি যখন চিচেন ইতজায় পৌঁছল তখন বিকেল। একটা সরাইখানার সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল। ফ্রান্সিস নামল। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। কোমর, পা যেন অসাড় হয়ে গেছে।
ইউবেকের কাছে এল ফ্রান্সিস। অনেক ধন্যবাদ জানাল। ইউবেক বলল, আমাদের সঙ্গে খাবেন চলুন।
–উপায় নেই। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুদের কাছে যেতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস দ্রুত হাঁটতে লাগল। কোমরে পায়ের ব্যথাটা কমে গেছে। রাস্তায় বেশ ভিড়। আজকে রাতেই পূর্ণিমা উৎসব।
সরাইখানার সামনে এল ফ্রান্সিস। তখনও হাঁপাচ্ছে। দরজা থেকেই গলা চড়িয়ে ডাকল–হ্যারি-শাঙ্কো। হ্যারি, শাঙ্কো শুয়ে ছিল। দুজনেই উঠে ফ্রান্সিসের দিকে ছুটে এল। হ্যারি ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। শাঙ্কোরও সেই অবস্থা।
ফ্রান্সিস বলল–হ্যারিশক্ত হও। শাঙ্কো মালিককে বলো তো কিছু খেতে দিতে পারবে কিনা। শাঙ্কো চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এসে বলল–তরকারি আছে। মাংস নেই, মাংসের ঝোল আছে।
–ঠিক আছে। ওসব থাকলেই হবে। আমায় খেতে দিতে বল। ফ্রান্সিস বলল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস খেয়ে নিল। এতক্ষণে মাথা শরীর যেন শান্ত হল।
ফ্রান্সিস বলল–আমি কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেব। একটু রাত হলেই চিচেন ইতজায় যাবো। কাজে নামবো। ফ্রান্সিস গায়ের জামাটা খুলে সরাইখানার বিছানায় শুয়ে পড়ল। শরীর এত ক্লান্ত প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে উঠল। কিন্তু বিছানা থেকে উঠল না। শুয়ে রইল।
“তোমার কি বিশ্বাস যে, ওই দুটো ছোট্ট কুঠুরিতেই গুপ্তধন আছে?” হ্যারি বলল।
“আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যাকগে–একটা সূত্র তো পেলাম নকশাটায়। দেখা যাক, পাই কি না। না পেলে আবার চেষ্টা করতে হবে। দেখতে হবে, অন্য কোনও উপায়ে গুপ্তধনের হদিস করা যায় কিনা।” ফ্রান্সিস বলল।
সন্ধে হওয়ার আগেই দেখা গেল রাস্তায় নোকজনের ভিড় বাড়ছে। ভিড় চলেছে পূর্ণিমা উৎসবের নাচগানের আসরে।
ফ্রান্সিস শুয়ে শুয়ে ভাবছে কীভাবে সমস্ত কাজটা সারবে।
কিছু পরে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল, “চলো সব। আজকে রাতের মধ্যেই গুপ্তধন খুঁজে বের করতে হবে। আজকের রাতটাও ভাল পেয়েছি। এক– পূর্ণর্চাদের আলো, দুই–বহু লোক পূর্ণিমা উৎসবে যাবে। নগর প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে যাবে। সারারাত। এই দুটো সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে।”
দুড়ি দুটো কোমরে বেঁধে নিয়ে ফ্রান্সিসরা সরাইখানার বাইরে এল। চলল চিচেন ইতজার মন্দিরের দিকে।
চাঁদের আলোয় মন্দিরের সামনে এসে দেখল বড় দরজাটা খোলা। তারপর চত্বরে বর্শা হাতে দুই প্রহরী পাহারা দিচ্ছে। মন্দিরে কোনও জনপ্রাণী নেই। একেবারে শূন্য।
ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল, “শাঙ্কো, ডান দিকের দাড়িওয়ালা আমার বাঁদিকেরটা তোমার। দু’জন প্রহরী চত্বরে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে।”
দেওয়ালের আড়ালে গিয়ে চুপ করে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো প্রহরী দু’জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রহরী একজনের হাতে বর্শা রইল কিন্তু অন্যজনের বর্শা ছিটকে গেল। দুজনেই মন্দির চত্বরে পড়ে গেল। প্রহরী দু’জনের কোমরের ফেট্টি খুলে নিল ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো। যার হাতে বর্শা ছিল তার হাতটা শাঙ্কো পা দিয়ে চেপে ধরল। প্রহরীটি বর্শা ছেড়ে দিল। এবার ফেট্টি দিয়ে দু’জনের মুখ বাঁধা হল। প্রহরী দু’জন চেঁচিয়ে ওঠারও সময় পায়নি–এত দ্রুত দু’জনের কোমরের ফেট্টি চেপে বাঁধা হল মুখ। তারপরে কাটা দড়ি দিয়ে দু’জনের হাত বাঁধা হল। একজন প্রহরী মুখে গোঁ গোঁ শব্দ করছিল। ফ্রান্সিস তার মুখে জোরে এক চড় কষাল। গোঙানি বন্ধ হয়ে গেল।
এবার প্রহরী দু’জনকে তাদের থাকার ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। একটা ঘরের দরজা খুলে দুজনকে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল।ফ্রান্সিস একজন প্রহরীর ফেট্টি খোলার সময় ঘরের চাবিটা পড়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সিস সেটা তুলে নিজের কোমরের ফেট্টিতে রেখেছিল।
এবার সেই চাবি দিয়ে ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে ফ্রান্সিসরা মন্দিরের ডান দিকের দেওয়ালের কাছে এল। তখনই ফ্রান্সিস বলে উঠল, “হিসেবে গোলমাল হয়ে গেছে। আসার সময় একটা কুড়ুল আনতে ভুলে গেছি। কিন্তু দেরি করা যাবে না। শাঙ্কো একটা কুড়ুল নিয়ে এসো। নইলে সব চেষ্টা বৃথা।”
শাঙ্কো প্রহরীদের ঘরের কাছে এল। প্রহরীদের নিশ্চয়ই এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হয়। তা হলে কাঠকুটো জোগাড় করতে হয়। কাঠ কাটতেও হয়। তার মানে কুড়ুল লাগে।
শাঙ্কো প্রহরীদের যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে তার পাশের ঘরটার দোরগোড়ায় এল। ঘরটার বারান্দায় চাঁদের উজ্জ্বল আলো পড়েছে। সেই উজ্জ্বল আলোয় ঘরের অন্ধকার অনেকটা দূরীভূত হয়েছে। শাঙ্কো ঘরে ঢুকল। দেখল–একপাশে কাঠটাঠ রাখা। শাঙ্কো কাঠগুলোর কাছে এল। দেখল পাশেই একটা কুড়ুল পড়ে আছে। শাঙ্কো কুড়ুলটা তুলে নিল। বাইরে এল। দেখল, কুলটা ছোট। কিন্তু মুখটা বেশ ধারালো। শাঙ্কো ফিরে এল।
ফ্রান্সিস কুড়ুলটা নিল। কুড়ুলটা ছোট হয়ে ভাল হয়েছে।
এবার ফ্রান্সিস জংলা গাছ ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে দেওয়ালের কাছে এল। দেওয়ালের নীচের দিকে পাথরের পাটা ভেঙে পা রাখার ব্যবস্থা সেই বয়স্ক লোকটি করে রেখেছিল।
ফ্রান্সিস খোঁদলে পা রেখে রেখে অনেকটা উঠে এল। এই খোঁদলগুলো সেই বয়স্ক লোকটি কুড়ুল চালিয়ে ভেঙে ভেঙে করেছিল। এবার ফ্রান্সিস চাঁদের আলোয় দেখে দেখে পাথরের পাটায় কুড়ল চালিয়ে খুলে ফেলতে লাগল। আর সব লোকজন। পূর্ণিমার উৎসবে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। অস্পষ্ট গানবাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কুড়ুল চালাবার শব্দ আর কে শুনবে বন্দি প্রহরী দু’জন ছাড়া।
আস্তে-আস্তে ফ্রান্সিস উঠতে লাগল। একটা-দুটো পাথরের পাটা খসিয়ে ফ্রান্সিস নীচে ফেলে দিচ্ছে। ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রান্সিস দেওয়ালের মাথায় উঠে গেল। নীচে দাঁড়ানো হ্যারি, শাঙ্কো, আলফানসো তাকিয়ে আছে ফ্রান্সিসের দিকে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় ফ্রান্সিসকে ওরা বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল।
এবার ফ্রান্সিস দেওয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে কুঠুরিতে যাওয়ার কাঠের আর গুঁড়ো পাথরচুন দিয়ে তৈরি লম্বা অংশটা দেখল। এখান থেকে সাঁকোর মতো ওটার ওপর দিয়ে হেঁটে কুঠুরি দুটোয় যাওয়া যাবে।
ফ্রান্সিস চারদিক ভাল করে দেখে নিল। না–কুঠুরিতে যাওয়ার অন্য কোনও পথ নেই। ফ্রান্সিস সেই পাটাতন দিয়ে তৈরি পথটায় ডান পা রাখল। পা দিয়ে চাপ দিয়ে বুঝল দীর্ঘদিনের রোদ বৃষ্টি জলে পাটাতনটা বেশ নরম হয়ে গেছে। পায়ের চাপ দিলে দোল খাচ্ছে ওই পাটাতনটা।
ফ্রান্সিস চাঁদের আলোয় সব দেখতে পাচ্ছিল। পা-টা তুলে এনে নিচু হয়ে হাত রাখল ওই পাটাতনে। স্পষ্ট বুঝল পাটাতনটা পড়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস হাত তুলে নিয়ে এবার আবার বাঁ-পাটা রাখল। চাপ দিয়ে দাঁড়াতে গেল। পাটাতনটায় কড়কড় শব্দ, হল। ফ্রান্সিস বুঝল ওই পাটাতনে একটু বেশি চাপ পড়লে ভেঙে পড়বে।
ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টি থেকে নকল নকশাটা বের করল। হ্যারি নকশাটা নকল করে রেখেছিল। ভাল করে দেখল–ওই অস্পষ্ট রেখাটা কুঠুরির দিকেই যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা অসম্ভব। হয়তো পাথরকুচি চুন বালি জল মিশিয়ে দেওয়া আস্তরণটা আগে শক্ত ছিল। কিন্তু এখন রোদ বৃষ্টিতে পাটাতনটা নরম হয়ে গেছে। অল্প ধাক্কায় ভেঙে পড়ে যেতে পারে। ফ্রান্সিস কী করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। হ্যারিদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে মনস্থির করতে পারত। কিন্তু এখন তার উপায় নেই। পাটাতন ভেঙে গেলে কুঠুরি দুটোও ভেঙে পড়বে। সেই ভগ্নস্তূপেই খুঁজতে হবে রাজা কমিনের গুপ্ত ধনভাণ্ডার।
এবার ফ্রান্সিস নীচের দিকে তাকাল। দেখল শাঙ্কো ওরা ডান দিকের দেওয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে ফ্রান্সিসের দিকে। কুঠুরি ভেঙে পড়লে ওদের কিছু হবে না। তবু সাবধানের মার নেই। ফ্রান্সিস দু’হাতের তালু গোল করে নীচের দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে নিজেদের ভাষায় বলে উঠল,”কুঠুরি ভেঙে পড়বে। সাবধান।” হ্যারিরা আরও সরে গেল।
পাটাতনের কাছে এসে দাঁড়াল ফ্রান্সিস। ডান পা নামিয়ে পাটাতনে পায়ের চাপ দিতে লাগল। দু-চারবার জোরে পায়ের চাপ দিতেই কুঠুরি দুটো সশব্দে ভেঙে পড়ল সিঁড়ির ওপর। চারদিকে নৈঃশব্দের মাঝখানে বেশ জোরালো শোনাল শব্দটা। চুনের গুঁড়ো ছড়িয়ে গেল। সাদা আস্তরণ সৃষ্টি করল। হ্যারিরা চুনের সাদাটে আস্তরণ উড়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
ফ্রান্সিস যত দ্রুত সম্ভব নেমে এল।
সাদা চুনের আস্তরণ উড়ে গেল। এবার সকলে ধ্বংসস্তূপের কাছে এল। চাঁদের আলোয় দেখতে লাগল যদি গুপ্তধনের কিছুনজরে পড়ে। কিন্তু চুনাপাথর বালি ছাড়া কিছু নেই।
শাঙ্কো বলল, “ফ্রান্সিস ওই কুঠুরি দুটোর কোনওটাতে গুপ্তধন ছিল না।”
“না, না” ফ্রান্সিস বলল, “এখনও সেটা প্রমাণিত হয়নি। সব পাথরটাথর সরাও।”
সকলে হাত লাগাল। ধুলো-পাথর ভাঙা কাঠ সরিয়ে দেখতে লাগল। এক জায়গায় প্রায় আধখানা দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। শাঙ্কো দেওয়ালটা বেশ গায়ের জোর খাঁটিয়ে তুলে ফেলল। তখনই দেখা গেল একটা লম্বাটে বাক্স। গুঁড়ো চুনের মধ্যে। শাঙ্কো বলে উঠল, “ফ্রান্সিস, এই বাক্সটা দ্যাখো।” ফ্রান্সিস ছুটে এল। বাক্সটা দেখে বলল, “রাজা হুনাকমিনের এই গুপ্তভাণ্ডার এখন আমাদের হাতে।” ফ্রান্সিস কোমর থেকে ফেট্টিটা খুলল। বাক্সটার গায়ে লেগে থাকা চুনের ধুলো মুছল। দেখা গেল কালো কাঠের বাক্সটার গায়ে সোনারমিনে করা ফুল, লতা-পাতা। মাঝখানে নৃত্যরত হরিণ। রাস্তায় লোকজনের কথাবার্তা শোনা গেল। উৎসব শেষ। সকলে বাড়ি ফিরছে। ফ্রান্সিস ফেট্টির কাপড়টা দিয়ে বাক্সটা জড়াল। তারপর চাপাস্বরে বলল, “আর এক মুহূর্তও এখানে নয়। চলো সব।”
ওরা মন্দিরের চত্বর পার হচ্ছে তখনই প্রহরীদের একজনের চাপা কথা শুনতে পেল, “বাঁচাও, বাঁচাও।”
ওরা দ্রুত ছুটে এসে রাস্তায় উঠল। বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল সরাইখানার দিকে। এখন সড়কপথ জনশূন্য নয়। উৎসব থেকে লোজন ফিরছে। কথাবার্তায় খুশির ধ্বনিতে ভরে উঠেছে বড় রাস্তাটা।
গুপ্তধনের বাক্সটা ফ্রান্সিস ফেট্টির কাপড় চাপা দিয়ে নিয়ে চলেছে।
ভোর ভোর ওরা সরাইখানায় পৌঁছল। নিজেদের জায়গায় এসে বসল। হ্যারি বলল, “ফ্রান্সিস, তুমি কি নিশ্চিত যে গুপ্তধন এই কাঠের বাক্সটাতেই আছে?”
আমি নিশ্চিত–এই বাক্সটাতেই রাজা হুনাকমিন তার গুপ্তধন রেখে গেছেন। নকশায় দ্যাখো এক নৃত্যরতা হরিণের ছবি আছে। বাক্সের ওপরেও সেই ছবিটাই মিনে করে করা।”
“এখন বাক্সটা কি খুলবে?” হ্যারি বলল।
“না, এখানে নয়। তুলাম যাব–আমাদের জাহাজে উঠব, তারপর।” আলফানসো বলল, “আমার একটা কথা ছিল। আমাকে বলেছিলেন–
ফ্রান্সিস বলে উঠল, “ঠিক, ঠিক। আমার মনেই ছিল না। হ্যাঁ। হ্যারি আলফানসো নতুন করে জীবন শুরু করুক, ওইজন্যই আমি ওকে গুপ্তধনের কিছু অংশ দেব।”
“তা হলে তো বাক্স খুলতেই হয়।” হ্যারি বলল।
“ঠিক আছে।” কথাটা বলে ফ্রান্সিস ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে দেখল। উৎসব শেষ। অনেক লোক চলে গেছে। পাঁচ-ছ’জন লোক এদিক-ওদিক শুয়ে-বসে আছে। ফ্রান্সিস বলল, “এখন খোলা যাবে। কিন্তু আসল জিনিসটাই তো নেই। বাক্সটার চাবি কোথায়?”
শাঙ্কো বলল, “উপায় নেই ফ্রান্সিস, বাক্সটা ভাঙতে হবে।”
“বুঝলাম, কিন্তু কীভাবে ভাঙবে।” ফ্রান্সিস বলল।
“একটা সরু লম্বা পেরেক চাই। তা হলেই তালাটা ভাঙা যাবে।” শাঙ্কো বলল।
“তা হলে সেইরকম একটা পেরেক জোগাড় করো।” ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি বলল, “শাঙ্কো, বাক্সটা এখানে ভাঙা উচিত হবে না। এখানে লোক কম থাকলেও বাক্স ভাঙা আর ভাঙা বাক্স থেকে সোনা, মণি-মাণিক্য বের হলে এই কয়েকজনের নজরে পড়বেই। দৃশ্যটা সাধারণ দৃশ্য থাকবে না। অত দামী দামী জিনিস, এরাই হয়তো আমাদের কাবু করে সব মূল্যবান জিনিস নিয়ে পালাতে পারে।”
“তা হলে তুমি কী বলো?” ফ্রান্সিস বলল।
“এই সরাইখানার পেছনেও দু-একটি ঘর আছে। রান্নাঘর আর ভাঁড়ার ঘর। এখন সকালের খাবার তৈরি হচ্ছে। রাঁধুনিরা সব রান্নাঘরে। ভাড়ার ঘর ফাঁকা। ওখানে গিয়ে বাক্স ভাঙতে হবে। তা হলে আর কারও কিছু সন্দেহ হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, মূল্যবান কিছুই কারও নজরে যেন না পড়ে।” ফ্রান্সিস একটু হেসে বলল, “হ্যারি ধন্যবাদ। এতটা আমি ভাবিনি। তা হলে শাঙ্কো-যাও। রাঁধুনিদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করো। সেই সঙ্গে পেরেকের খোঁজটাও করো।”
শাঙ্কো চলে গেল। পেছনে রান্নাঘরে এল। দেখল দু’জন খাবার তৈরি করছে। একজন সেসব কাঠের গামলায় তুলছে।
শাঙ্কো সেই পরিবেশনকারীকে বলল, “আপনার সঙ্গে একটা জরুরি কথা ছিল।”
“বলুন।” লোকটি বলল।
“আপনাদের পাশের ভাড়ার ঘরের তো কেউ নেই এখন?” শাঙ্কো বলল।
না। কেন বলুন তো?” লোকটি বলল।
“একটা বাক্স আমাদের সঙ্গে ছিল। তার চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না। কাজেই বাক্সটা “ভাঙতে হবে। আপনাদের ভাড়ার ঘরে বাক্সটা নিয়ে গিয়ে তালা ভাঙব। এখন আপনারা যদি অনুমতি দেন।”
শাঙ্কোর এত সম্মান দিয়ে কথা বলায় রাঁধুনি খুব খুশি। বলল, “যান না।”
“তখন ওই ঘরে কেউ যাবে না তো?” শাঙ্কো বলল।
“না। কেউ যাবে না।” লোকটি বলল।
“আচ্ছা, আপনারা তো কখনও বস্তাটস্তা সেলাই করেন। সেইরকম সূচ আছে আপনাদের কাছে?” শাঙ্কো বলল।
“ওরকম দুটো সূচ আছে আমাদের।” লোকটি বলল।
“তার একটা পাব?” শাঙ্কো বলল।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভাঁড়ার ঘরের কাঠের তাকের ওপর আছে।” লোকটি বলল।
“ঠিক আছে। তা হলে আমাদের বাক্সটা নিয়ে আসছি।” শাঙ্কো বলল।
“আসুন।” রাঁধুনি বলল।
শাঙ্কো এসে সব বলল। ফ্রান্সিস হেসে বলল, “শাবাশ শাঙ্কো।”
সকলে ভাড়ার ঘরের দিকে চলল। শাঙ্কো কাপড় জড়ানো বাক্সটা নিয়ে চলল।
ভাড়ার ঘর এই সকালেও একটু অন্ধকার-অন্ধকার। শাঙ্কো তাকটায় হাত দিয়ে খুঁজল। দুটো সরু সঁচ পেল। দু-তিনটে কাঠের পাটাতনের ওপর আটা-ময়দা এসবের বস্তা রাখা। শাঙ্কো সেই পাটাতনের ওপর বাক্সটা রাখল। তারপর চাবির ফুটোয় সঁচটা ঢুকিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাতে লাগল। কিন্তু বাক্স খুলল না। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর হাত থেকে সূচটা নিল। ঘোরাতে লাগল। কিন্তু তালা খুলল না। ফ্রান্সিস বলল, “এভাবে খোলা যাবে না। ভেতরের তলাটা ভাঙতে হবে। তার জন্য লম্বা পেরেক, হাতুড়ি চাই। শাঙ্কো, দ্যাখো একটা হাতুড়ি, পেরেকের ব্যবস্থা করতে পারো কি না।”
শাঙ্কো আবার সেই রাঁধুনির কাছে গেল। দেখল সেই রাঁধুনি নেই। অন্য রাঁধুনি বলল, “ও সকালের খাবার দিচ্ছে। কিছু পরে আসবে।”
শাঙ্কো ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল, “বাক্সটা নিয়ে চলো সকালের খাবারটা খেয়ে আসি। তারপর তো হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে।”
সকলে সকালের খাবার খেতে এল। খাওয়ার পর ওরা চলল পেছনের ভাড়ার ঘরের দিকে। শাঙ্কো চলল সরাইখানার মালিকের কাছে। হাতুড়ি, পেরেক চাই। মালিক বলল কিছু পেরেক একটা কাঠের বাক্সে ছিল। হাতুড়িও ছিল। কিন্তু এখন কোথায় সেগুলো সে জানে না। খুঁজতে হবে।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল সব। ফ্রান্সিস বলল, “তা হলে হাতুড়ি, পেরেক খোঁজা যাক।”
শাঙ্কো চারদিকে যখন তাকিয়ে দেখছে, তখনই নজরে পড়ল কুড়ুলটা। পাশেই কাঠের চ্যালা রাখা। শাঙ্কো ছুটে কুড়ুলটা নিয়ে এল।
ফ্রান্সিস বলল, “কী হলো?”
“কুড়ুল দিয়ে বাক্সটার তালার জায়গাটা ভেঙে ফেলব।” শাঙ্কো কথাটা বলে বাক্সটা মাটির মেঝেয় রাখল। তারপর কয়েকটা চ্যালাকাঠ নিয়ে এল। কুড়ুল দিয়ে কাটতে লাগল। আলফানসো বলল, “আপনি কী করছেন?” শাঙ্কো কোনও কথা বলল না। হ্যারি ব্যাপারটা বুঝতে পারল না।
ফ্রান্সিস বলে উঠল, “শাবাশ শাঙ্কো।”
“আর ব্যাপারটা কী?” হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল, “শাঙ্কো কাঠের বাক্সে কুড়ুল চালাবার আগে কাঠ কাটছে। সবাই কাঠ কাটছে এইটাই বুঝবে। তার মধ্যেই শাঙ্কো বাক্সটায় কুড়ুলের ঘা বসাবে। সকলে ভাববে কাঠই কাটা হচ্ছে। অন্য কিছু নয়।” ফ্রান্সিসের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাঙ্কো কাঠের বাক্সের চাবির ছিদ্রের ফুটোটার ওপর জোরে কুড়ুল চালাল। বাক্সটার ডালাটা ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস ছুটে গিয়ে বাক্সটার ভাঙা ডালাটা তুলতে গেল। তখন সকলে ভাঙা বাক্সটার কাছে এল।
ফ্রান্সিস ভাঙা ডালাটা টান দিতেই উঠে এল। মণিমাণিক্যে ভর্তি ভাঙা বাক্সটা। কতরকম গয়না, অলঙ্কার। সেগুলো থেকে হীরের দ্যুতি বের হচ্ছে। ফ্রান্সিস ওপর থেকে বিচিত্র নকশার গয়নাগাঁটিগুলো নামিয়ে রাখল। সেসবের নীচেই অনেক স্বর্ণমুদ্রা।
সেই অতি মূল্যবান অলঙ্কার, মিনে করা ছোট্ট ছুরির বাঁট, সোনার ফ্রেমে বাঁধানো আয়না এসব দেখে আলফানসোর চোখ তখন ছানাবড়া। এত মূল্যবান জিনিস! ফ্রান্সিস, হ্যারি, শাঙ্কোর কাছে এরকম ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। কাজেই ওরা অবাক হল না।
ফ্রান্সিস বলল, “হারি, শাঙ্কো এসব এখানেই ভাগ করে আমরা নিয়ে যাব। কী বলো?”
“বাক্স ঢেকে রাখো।” হ্যারি বলল।
“শুধু বাক্স ঢেকে রাখা নয়। একেবারে এখানেই সব সেরে নিই। এ রকম শূন্য ঘর এখানে আর কোথাও পাব না।” ফ্রান্সিস বলল।
“ঠিক আছে। যা করার তাড়াতাড়ি করো।” হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস বাক্স থেকে সোনার মুদ্রাগুলো সব তুলতে তুলতে বলল, “হ্যারি তোমার কোমরের ফেট্টিটা খুলে পাতো।” হ্যারি ফেট্টি খুলে পাতল। ফ্রান্সিস সোনার মুদ্রাগুলো সেই কাপড়ে ঢালল। তারপর কাপড়টা পেঁচিয়ে নিয়ে তার মধ্যে সোনার মুদ্রাগুলো বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নিল।”
“আলফানসো, আমরা এখন চলে যাব। আমরা আর দেরি করতে পারব না। তুমি কাঠের বাক্সে অলঙ্কারগুলো ভরে কোমরের ফেট্টি খুলে তাতে বেঁধে নাও। বাক্সটা এখানেই রেখে দাও।” ফ্রান্সিস বলল।
“কিন্তু বাক্সটার গায়ে সোনার গিল্টিগুলো রয়েছে।” আলফানসো বলল।
“বেশি লোভ কোরো না। যাকগে, তোমাকে কেন এত অলঙ্কার দিলাম এবং এসব নিয়ে তুমি কী করবে তা আমি আগেই তোমাকে বলেছি। তুমিও রাজি হয়েছ। কথার খেলাপ কোরো না।” ফ্রান্সিস বলল।
“না ফ্রান্সিস। আপনার সব নির্দেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।” আলফানসো বলল।
“ফ্রান্সিস, এখন কী করবে?” হ্যারি বলল।
“দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে সমুদ্রতীরের তুলাম নগরের দিকে রওনা হব। বন্ধুরা। নিশ্চয়ই আমাদের কোনও খবর না পেয়ে চিন্তায় পড়েছে।
ফ্রান্সিসরা দুপুরের খাওয়া খেল। স্বর্ণমুদ্রায় ভরা পুঁটুলিটা হ্যারির কাছ থেকে নিল। শাঙ্কোকে দিয়ে বলল, “কোমরে পেঁচিয়ে নাও।” শাঙ্কো পুঁটুলিটা লম্বা করে কোমরে বেঁধে নিল।
ফ্রান্সিস বলল, “আলফানসো, বাক্সটা এখানে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি কোমরের ফেট্টিটা খুলে বাক্সটাও জড়িয়ে নাও। কেউ যেন না দ্যাখে। তারপর তোমাকে কী করতে হবে বলেছি।”
আলফানসো ফ্রান্সিসের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরল। কান্না-ভেজা গলায় বলল, “আপনি আমাকে নতুন জীবন দান করলেন। এই জীবনই আমি ছেলেবেলা থেকে কামনা করেছি। আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব জানি না।”
ফ্রান্সিস হেসে আলফানসোর পিঠে আস্তে চাপড় দিল। বলল–“তা হলে আলফানসো, আমরা জাহাজে বন্ধুদের কাছে ফিরে যাচ্ছি। চলি।”
ফ্রান্সিস, হ্যারি, শাঙ্কো সরাইখানার পাওনা মিটিয়ে রাস্তায় নামল। আলফানসো তখনই তাড়াতাড়ি ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বলল, “আপনাদের অতটা পথ হেঁটে যেতে কষ্ট হবে। আমি একটা শস্যটানা গাড়ি নিয়ে আসছি। আপনারা অপেক্ষা করুন।”
ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে পড়ল। আলফানসো ডানদিকের গলিপথে ঢুকল। কিছুক্ষণ পরে ও একটা শস্যটানা গাড়িতে চড়ে এল। গাড়োয়ানের সঙ্গে ভাড়া ঠিক করে দিল।
ফ্রান্সিসরা গাড়িটাতে উঠল। এক ঘোড়ায় টানা গাড়ি চলল কোবা নগরের দিকে।
ঘণ্টাকয়েকের মধ্যে ওরা কোবা নগরে পৌঁছল। সেখানে এক সরাইখানায় রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে একটা গাড়ি ভাড়া করে চলল তুলাম নগরের দিকে।
বিকেলের দিকে তুলাম নগরে পৌঁছল। জাহাজঘাটায় এল। দূর থেকে বন্ধুরা ফ্রান্সিসদের দেখতে পেল। অনেকটা ছুটে ফ্রান্সিসদের কাছে এল। বন্ধুরা ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো।
সকলে জাহাজে উঠল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল, “ভাইসব, এবার আমি বাধ্য হয়ে গুপ্তধনের অংশ নিয়েছি। বাকিটা একজন বিশ্বস্ত লোককে দিয়েছি। এবার চলো আমাদের মাতৃভূমির দিকে।”
বন্ধুরা সঙ্গে সঙ্গে পাল খাটাতে চলল। ঘড়ঘড় শব্দে নোঙর তোলা হল। জাহাজ চলল। জোর বাতাসে পালগুলো ফুলে উঠল। দাঁড় টানার প্রয়োজন নেই। সমুদ্রের জলের ঢেউ ভেঙে জাহাজ চলল।
হৃদয় হাসান
অসাম সেই মজা লাগছে