সম্রাটের রাজকোষ
হুয়েনভা বন্দর শহর। ফ্রান্সিসদের জাহাজে তীরে ভেড়ানো। ফ্রান্সিস বলেই রেখেছে। পরদিন ওরা নিজেদের দেশের দিকে জাহাজ চালাবে। ভাইকিংরা খুব খুশি। কতদিন পর দেশে ফেরা। নিজেদের দুঃসাহসিক অভিযানের কথা কত মূল্যবান ধনসম্পদ কত বুদ্ধি খাঁটিয়ে ফ্রান্সিস উদ্ধার করেছে। কতবার ওরা মৃত্যু মুখ থেকে ফিরে এসেছে। বিশেষ করে ফ্রান্সিস হ্যারি আর বিস্কো সব কাহিনী ওরা দেশবাসীকে বলবে।
মানুষের সঙ্গে যেমনি লড়াই করেছে তেমনি প্রচন্ড ঝড়ের সঙ্গেও লড়াই করেছে। কতবার ঝড়ের প্রচন্ড শক্তিশালী ঝাপটায় ওদের জাহাজ ডুবতে ডুবতে উঠে পড়েছে। ঢেউয়ের মাথায়। সমুদ্রের জলে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে ওরা বেঁচে গেছে।
সেদিন গভীর রাত। জ্যোৎস্নালোকিত সমুদ্র। ঢেউয়ের মাথায় চাঁদের আলো নাচছে।
মাস্তুলের মাথায় বসে থাকা নজরদার পেড্রোর একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। তন্দ্রা ভাবটা চলছিল পেড্রোর। হঠাৎ ধড়ফড় করে জেগে উঠল। একবার চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে তখনই দেখল দক্ষিণ দিক থেকে দুটো জাহাজ আসছে বন্দরের দিকে। দেখল–একটা যুদ্ধ জাহাজ আর একটা শৌখিন ছোটো জাহাজ।
পেড্রো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।নীচের জাহাজের ডেক-এর দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলল –ভাইসব সাবধান, দুটো জাহাজ আসছে এদিকে। ফ্রান্সিসকে খবর দাও। দু’চারজন ভাইকিং ডেক-এ ঘুমিয়েছিল। দুজনের ঘুম ভেঙে গেল পেড্রোর ডাকে। পেড্রোর কথা শুনল। উঠে দাঁড়াল। ছুটলো ফ্রান্সিসকে খবর দিতে।
একটু পরেই ফ্রান্সিস আর হ্যারি ডেক-এ উঠে এলো। পেছনে মারিয়া।
মাস্তুলের ওপর থেকে গলা চড়িয়ে পেড্রো বলল–দক্ষিণ দিকে দ্যাখো। ফ্রান্সিসরা দেখল দুটো জাহাজ এই হুয়েনভা বন্দরের দিকেই আসছে। একটা যুদ্ধজাহাজ। একটা শৌখিন জাহাজ।
কী করবে ফ্রান্সিস? হ্যারি বলল।
বুঝতে পারছি না জাহাজ দুটো এত গভীর রাতে এদিকে এই হুয়েনভা বন্দরে আসছে কেন?
–ফ্রান্সিস আমি নিশ্চিত ওরা লড়াই করতে আসছে। এই হুয়েনভা থেকে রাজধানী সেভিল পর্যন্ত রাজা ফার্নান্দোর রাজত্ব। যারা আসছে তারা লড়াই করে হুয়েনভা বন্দর দখল করবে। হ্যারি বলল।
দুটো জাহাজ খুব দ্রুতবেগে আসছে। ততক্ষণে ঐ জাহাজ দুটো অনেক কাছে এসে পড়েছে। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি জাহাজচালক ফ্লেজারের কাছে এলো। বলল–ফ্লেজার জানি না কেন দুটো জাহাজ এই হুয়েনভা বন্দরে আসছে। এরা কারা আমরা জানি না। কিন্তু এই সমুদ্রতীরের জাহাজ ঘাটায় আমরা থাকবো না। জাহাজ ছাড়ো। যতটা সম্ভব মাঝ সমুদ্রের দিকে জাহাজ নিয়ে চলো। এখানে এখন থাকা বিপজ্জনক।
ফ্রান্সিসদের জাহাজ আরব সমুদ্রের দিকে সরে এলো। ফ্রান্সিসরা দেখল দুটো জাহাজ থেকেই অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সৈন্যরা দলে দলে নেমে এলো। এত সৈন্য। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছে না। চারদিক নিঃশব্দ। শুধু সমুদ্রের শোঁ শোঁ হাওয়ার শব্দ। আর তীরে ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ।
সৈন্যরা যুদ্ধ জাহাজ থেকে নেমে আসতে লাগল। যতটা সম্ভব জুতোয় কোনোরকম শব্দ না তুলে ওরা নেমে আসতে লাগল। পরপর। তারপর রাস্তায় উঠে সারি বেঁধে দাঁড়াল। সেনাপতি নামল জাহাজ থেকে। একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু গলা চড়িয়ে বলল–সৈন্যবাহিনী–এখান থেকে পাঁচশো হাত দূরে ডানদিকে রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যদের সৈন্যাবাস।নিঃশব্দে ঐ সৈন্যাবাসে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ঐ সৈন্যদের প্রস্তুত হবার সময় দেওয়া চলবে না। তারপর নিরস্ত্র ওদের হত্যা করতে হবে। চলো সব।
সৈন্যদল ছুটল। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ওরা সৈন্যাবাসের কাছে গেল। সৈন্যাবাসে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ওরা সৈন্যাবাসে ঢুকে দেখল–একজন সৈন্যও নেই। ওরা প্রত্যেকটি ঘর দেখল। কোনো ঘরে কোনো সৈন্য নেই।, ওরা বাইরে এলো। চাঁদের আলোয় পুবদিকে তাকিয়ে দেখল ওখানকার প্রান্তরে যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।
বেশ কিছুক্ষণ দুই সৈন্যবাহিনীই স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তারপর রাজা রিকার্ডো তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে প্রান্তরের দিকে ফার্নান্দোর সৈন্যবাহিনীর দিকে ছুটে গেল। রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যবাহিনীও ছুটে এলো।দুই সৈন্যবাহিনী পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হল লড়াই।
ফ্রান্সিস তাদের জাহাজ থেকে শুনতে পেল তলোয়ারের ঠোকাঠুকির শব্দ। সৈন্যদের যুদ্ধকালীন চিৎকার আহতদের গোঙানির শব্দ। লড়াই চলল।
নজদার পেড্রো গলা চড়িয়ে বলল–একটা লোক আমাদের জাহাজের দিকে সাঁতার আসছে। এবার ফ্রান্সিসরাও উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় দেখতে পেল একটা লোক দ্রুত সাঁতার আসছে। ফ্রান্সিসদের জাহাজের হাল ধরে একটু বিশ্রাম নিল লোকটা। তারপর হাল বেয়ে বেয়ে ওপরে ডেক-এ উঠে এলো। ডেক-এর ওপর শুয়ে পড়ল। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল। ভাইকিংরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নোকটাকে দেখতে লাগল। ওরা বুঝে উঠতে পারল না–লোকটা কে? তবে পরনে এদেশীয় লোকদের পোশাক।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি এবার লোকটার কাছে এলো। ফ্রান্সিস বলল–এবার উঠে বসো। লোকটা আস্তে আস্তে বসল। ফ্রান্সিস বলল–তুমি কে? আর কোথাও না গিয়ে আমাদের জাহাজে এলো কেন?
–আপনারা বিদেশি।তাইনির্ভয়ে এলাম।জানি এখানে কোনো বিপদ নেই। লোকটা বলল।
–তুমি বুঝলে কী করে যে আমরা বিদেশি? হ্যারি বলল।
জাহাজের গড়ন দেখে। আমাদের দেশের জাহাজের সঙ্গে প্রায় কোনো মিলই নেই। লোকটি বলল। ফ্রান্সিস হেসে বলল
–তুমি বেশ বুদ্ধিমান। তোমার নাম কী?
–আলখাতিব। আমি সোনীয়। লোকটা বলল।
–তুমি কোত্থেকে এলে? হ্যারি বলল।
রাজা ফার্নন্দোর কয়েদঘর থেকে। আলখাতিব বলল।
কী করে পালালে? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
–এখান থেকে বেশ কিছু দূরে ক্যামেরিনাল বন্দর। আলখাতিব বলল।
–হ্যাঁ সেই বন্দর শহরে আমরা থামি নি। পার হয়ে এখানে এসেছি। হ্যারি বলল।
–ঐক্যামেরিনাল এলাকার রাজারিকার্ডো। এই রিকার্ডো জাহাজে তার সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছে ফার্নান্দোকে হারাতে। সেভিল অঞ্চল দখল করতে। আলখাতিব বলল।
–ও! তাহলে দুই রাজার লড়াই? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। আর একটা মজার ব্যাপার কি জানেন? রিকার্ডো ফার্নান্দোর বড়ো ভাই। দুই ভাইয়ের লড়াই লেগেই আছে। রিকার্ডোর সৈন্যরা সৈন্যাবাস আক্রমণ করেছিল। কয়েদঘরের চারপাশে লড়াই চলছিল। আমরা কুড়ি পঁচিশজন বন্দী ধাক্কা দিয়ে দিয়ে লোহার দরজা ভেঙে পালিয়েছি। আলখাতিব বলল।
–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল–যাও–আলখাতিবকে শুকনো পোশাক দাও। ওর থাকার ব্যবস্থা করো। আলখাতিব শাঙ্কোর সঙ্গে চলে গেল। অনেক ভাইকিং গিয়ে শুয়ে পড়ল। ডেক-এ দাঁড়িয়ে রইল ফ্রান্সিস, হ্যারি আর মারিয়া। কেউ কেউ ডেক-এ বসে রইল। ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে রইল যুদ্ধের ফলাফল জানতে।
ফ্রান্সিস আকাশের দিকে তাকাল। তারাগুলোর উজ্জ্বলতা কমে আসছে। অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। আকাশ সাদাটে হয়ে আসছে। পুবদিকের দিগন্তে কমলা রং ফুটে উঠল। সূর্য উঠতে দেরি নেই।
যুদ্ধের উন্মাদনা থিতিয়ে এসেছে। সৈন্যদের হৈ হৈ চিৎকার থেমে গেছে। তবে আহতদের আর্তনাদ গোঙানি এখনও শোনা যাচ্ছে।
ভোর হল। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগল। সূর্যের স্নিগ্ধ আলো ছড়াল সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায় দূরে তীরভূমির গাছপালায়। ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি এই পৃথিবী কত সুন্দর। ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো এই আলো এই বাতাস। নির্দয় মানুষেরা এই পরিবেশেও পরস্পর হানাহানি করে। আহত হয়ে মরে। অশ্চর্য!
তখন একটু বেলা হয়েছে। সকালের খাবার নিয়ে ফ্রান্সিস হ্যারি আর মারিয়া ডেক এ এলো। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তাকিয়ে রইল তীরভূমির দিকে। আল-খাতিবও ফ্রান্সিসদের সঙ্গে দাঁড়াল।
ওরা অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ দেখল রিকার্ডোর সৈন্যরা দলে দলে ছুটে আসছে। ওদের জাহাজে উঠে আসছে। ফ্রান্সিস বলল–আলখাতিব–রিকার্ডোর সৈন্যরা কি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসছে?
–হ্যাঁ। যুদ্ধে রাজা রিকার্ডো মনে হয় হেরে গেছেন। আলখাতিব বলল। তখনই দেখা গেল একটা ঘোড়ার পিঠে কে বসে আছে। তাকে ঘিরে সৈন্যরা জাহাজঘাটার দিকে আসছে। আলখাতিব বলে উঠল–যা ভেবেছি তাই। ঘোড়ার পিঠে বসে আছে রাজা রিকার্ডো। বোধহয় আহত। ঐ দেখুন–আরো সৈন্য আসছে। আহতদের কাঁধে করে নিয়ে আসছে।
রাজা রিকার্ডোকে সৈন্যরা ধরাধরি করে জাহাজে উঠতে সাহায্য করল। রাজা রিকার্ডোকে জাহাজে তোলা হল। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের নোঙর তোলা হল। পরিশ্রান্ত, আহত সৈন্যদের তখনও আনা হচ্ছিল। কিন্তু তাদের তীরে রেখেই জাহাজ চলতে শুরু করল। যুদ্ধকরে ক্লান্ত আহত সৈন্যদের কথা রাজা রিকার্ডো লএকবারও ভাবলো না। জাহাজঘাটায় শুইয়ে রাখা আহত সৈন্যদের আর্তনাদে গোঙানিতে ভরে উঠল জাহাজঘাটা। কিন্তু রাজা রিকার্ডোর জাহাজ ফিরল না। মাঝ সমুদ্রের দিকে আসতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল-হ্যারি–মনে আছে সেই রাজা হুঁকোমোক-এর কথা। আহত তৃষ্ণার্ত সৈন্যদের সঙ্গে রাজা হুঁকোমক রাত জেগে তাদের চিকিৎসা ও জলপানের ব্যবস্থা করেছিলেন। সভ্যদেশের রাজা হয়ে রিকার্ডো তার সৈন্যদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। আহত সৈন্যদের সুস্থ সৈন্যদের রাজা ফার্দিনান্দোর দয়ার ওপর ছেড়ে দিয়ে এলো। যুদ্ধজয়ী রাজা ফার্নান্দো ঐ পরিতাক্ত সৈন্যদের হত্যাও করতে পারে। হত্যা না করলেও বন্দী করে রেখে দেবে। কয়েদঘরের জঘন্য পরিবেশে তিলে তিলে মরবে ওরা।
ফ্রান্সিসরা দেখল জাহাজঘাটা থেকে রাজা রিকার্ডোর সৈন্যরা সমুদ্রতীর ধরে এদিক ওদিক পালাচ্ছে।
রাজা রিকার্ডোর শৌখিন জাহাজটা ফ্রান্সিসদের জাহাজের কাছাকাছি এলো। অন্য যুদ্ধ জাহাজটা এলো পেছনে পেছনে। শৌখিন জাহাজটা ফ্রান্সিসদের জাহাজের খুব কাছে এলো। ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়া তখনও ওদের জাহাজের ডেক-এ দাঁড়িয়ে ছিল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল-হ্যারি–ব্যাপার সুবিধের মনে হচ্ছেনা। রাজা রিকার্ডোর শৌখিন জাহাজ আমাদের জাহাজের কাছে আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজা রিকার্ডোর শৌখিন জাহাজটা ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে আস্তে ধাক্কা দিয়ে থেমে গেল। ফ্রান্সিসরা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ফ্রান্সিস একবার ভাবল দ্রুত জাহাজ চালিয়ে চলে যাই। তাহলে রাজা রিকার্ডোর যুদ্ধজাহাজ ওদের ধাওয়া করে ধরে ফেলবে। ওদের নিশ্চয়ই বন্দী করবে। আবার শুরু হবে বন্দীজীবন। তার চেয়ে দেখা যাক না রাজা রিকার্ডো কী বলে কী করে।
রাজা রিকার্ডোর শৌখিন জাহাজ থেকে রোগা লম্বা চেহারার একজন সশস্ত্র লোক ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে এলো। সঙ্গে তিন চারজন সৈন্যও এলো। রোগা লম্বা সৈন্যটি বলল তোমাদের দলনেতা কে?
–আমি। ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো।
–তোমরা বিদেশি। লোকটি বলল।
–হ্যাঁ–আমরা ভাইকিং। দেশে দেশে দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে বেড়ানো আমাদের নেশা। কোথাও কোনো গুপ্তধনের খোঁজ পেলে আমরা তা উদ্ধার করি। ফ্রান্সিস বলল।
–উদ্ধার করে সেই গুপ্তধন নিয়ে পালিয়ে যাও। লোকটি বলল।
–আপনি কিন্তু তার কোনো প্রমাণ পান নি। মিথ্যে সন্দেহ। ফ্রান্সিস বলল।
লম্বা রোগা লোকটি বলল–যাক গে ওসব। আমি রাজা রিকোর্ডোর সেনাপতি। লোকটি বলল। ফ্রান্সিস একটু আশ্চর্য হল–এই লম্বা রোগা তালপাতার সেপাই রাজা রিকার্ডোর সেনাপতি? এবার সেনাপতি বলল–
–তোমাদের বন্দী করা হল।
–কেন? কোনো অপরাধে? হ্যারি বলল।
–আমরা প্রায় নিঃশব্দে খুব সতর্কতার সঙ্গে রাজা ফার্নান্দোর সেনানিবাস আক্রমণ করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যবাহিনীর একজন সৈন্যও সেনানিবাসে নেই। সশস্ত্র সৈন্যরা সামনের প্রান্তরের শেষে যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। সেনাপতি বলল।
–ওঁরা নিশ্চয়ই আপনাদের আক্রমণের সংবাদ আগে থেকে ওদের জানিয়েছিল। হারি বলল। সেনাপতি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলল–ঠিক এই কথাটা বলতে চাইছি। ওরা কী করে আমাদের আক্রমণের সংবাদ জানল?
হয়তো তাদের নিয়োগ করা কোনো গুপ্তচর আগেভাগে খবরটা জেনে ওদের জানায়। ফ্রান্সিস বলল। সেনাপতি আবার ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল–হ্যাঁ–সেই গুপ্তচর হবে তোমরা? ফ্রান্সিস হ্যারি কোনো কথা বলতে পারল না। ওরা দুজনে অবাক হয়ে পরস্পরে মুখের দিকে তাকাল। হ্যারি বলল–
–আমারই যে সেই গুপ্তচর তার প্রমাণ আপনারা কীভাবে পেলেন?
–রাজা রিকার্ডোই প্রথমে বুঝতে পারেন। আমাদের জাহাজ দুটো যখন তীরে ভিড়ল তোমরা তোমাদের জাহাজ মাঝ সমুদ্রের দিকে এখানে চলে এলে। সেনাপতি বলল।
–আমরা যুদ্ধে জড়াতে চাইনি। ফ্রান্সিস বলল।
–গুপ্তচরবৃওি কি যুদ্ধে জড়ানো না? সেনাপতি বলল।
নিশ্চয়ই।কিন্তু আমাদের মিথ্যে অপরাদ দেওয়া হচ্ছে। গুপ্তচরবৃওি করে আমাদের কী লাভ? ফ্রান্সিস বলল।
–প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা। সেনাপতি বলল। ফ্রান্সিস রাগম্বরে গলা চড়িয়ে বলল–না– আমরা গুপ্তচরবৃওি করি নি। আমরা এই প্রথম রাজা ফার্নান্দো আর রাজা রিকার্ডোর লড়াইর খবর জানলাম। ফ্রান্সিস বলল।
সেনাপতি একটু চুপ করে থেকে বলল–তাহলে শোনো-লড়াই শুরুর পরে আমাদের জাহাজের নজরদার একটা লোককে সমুদ্রে সাঁতরে গিয়ে তোমাদের জাহাজে উঠতে দেখেছে।
হ্যাঁ–একজন এ দেশীয় লোকনাম আলখাতিব আমাদের জাহাজে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাকে দিয়েই তোমরা গুপ্তচরবৃওি করিয়েছে। সেনাপতি বলল।
–ঠিক আছে। আলখাতিবকে ডাকছি। ওকেই জিজ্ঞেস করুন। ফ্রান্সিস কথাটা শেষ করে বিস্কোর দিতে তাকাল। বলল–আলখাতিবকে নিয়ে এসো।
বিস্কো কিছুক্ষণের মধ্যেই আলখাতিবকে নিয়ে এলো।
ফ্রান্সিস বলল–আলখাতিব বলো তো তুমি কি আগে আমাদের কখনো দেখছো।
–না। আলখাতিব মাথা নেড়ে বলল।
সেনাপতি বলল—শোন্–তুই আগে থেকেই এদের চিতিস। এদের কথামতোই তুই গুপ্তচরের কাজ করতিস।
আলখাতিব ভীত মুখে বলে উঠল—না না আমি এদের আজকেই প্রথম দেখলাম। –
-তুই কোথায় থাকিস? সেনাপতি বলল।
–এই হুয়েনভা নগরে। আমাদের বাড়িঘর তৈরির পৈতৃক ব্যবসা।
–তুই সমুদ্র সাঁতরে এই জাহাজে এসে উঠলি কেন? সেনাপতি বলল।
–এরা বিদেশি বলে। এখানে বিপদে পড়বে না বলে। আলখাতিব বলল।
–বিপদের কথা ভেবেছিলি কেন? সেনাপতি বলল।
–এখানে রাজা ফার্নন্দোর কয়েদঘরে আমি বেশ কয়েক বছর বন্দী হয়ে ছিলাম। আজকে লড়াইয়ের ডামাডোলে কয়েদঘরের লোহার দরজা ভেঙে আমরা যারা বন্দী ছিলাম সবাই পালিয়েছি। আলখাতিব বলল।
–তোকে বন্দী করা হয়েছিল কেন? সেনাপতি বলল।
–সে অনেক কথা। আলখাতিব বলল।
–তবু অল্প কথায় বল্। সেনাপতি বলল। একটু থেমে আলখাতিব বলতে লাগল–সেভিলে প্রায় দেড়শ বছর আগে মাডিস নামে এক রোমান সম্রাট রাজত্ব করতেন। তাঁর রাজ্য আক্রান্ত হতে পারে এই আশঙ্কায় তাঁর রাজকোষের বহু মূল্যবান পাথর সোনার চাকতি এসব জিরাল্ডাটাওয়ারে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এই জিরাল্ডা টাওয়ার তিনিই নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে তিনি আমার প্রপিতামহের মোনক্কার সাহায্য নিয়েছিলেন। আমরা বংশনুক্রমিক সেই গল্প শুনে আসছি। মোনক্কা ছিলেন স্থপতি-বাড়িঘর তৈরি করতেন।
–হুঁ। তারপর? সেনাপতি মাথা ওঠানামা করে বলল।
–রাজা ফার্নান্দোর এক মন্ত্রী জানতো সেটা। ঐ মন্ত্রীই রাজাকে বলে আমাকে বন্দী করায়। চাবুক মেরে আমার কাছ থেকে জানতে চায় এই রাজকোষ গোপনে রাখার ব্যাপারে আমি কিছু জানি কি না। আমি বললাম আমি এসবের কিছুই জানি না। মন্ত্রী সেকথা মানলে না। আমাকে কয়েদঘরে বন্দী করল। আজকের লড়াইয়ের ডামাডোলের মধ্যে কয়েদঘর থেকে পালালাম।
–হুঁ। যাক তোমাকে রাজা রিকার্ডোর কাছে যেতে হবে।
–আমরা? ফ্রান্সিস বলল।
–আর হা–ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমাকেও যেতে হবে।
–বেশ যাবো। সঙ্গে আমার এক বন্ধুও যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ–চলো। সেনাপতি বলল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজের সঙ্গে শৌখিন জাহাজটার দূরত্ব মাত্র তিন হাত। সেনাপতি আর সঙ্গের দুজন সৈন্য লাফিয়ে আগে শৌখিন জাহাজটায় উঠল। ফ্রান্সিস হ্যারি আর শাঙ্কো পরে উঠল। সবশেষে আলখাতিব।
ওরা রাজা রিকার্ডোর শয়নকক্ষের সামনে এসে দাঁড়াল। একপাট দরজা বন্ধ। সেনাপতি দরজায় টোকা দিল।
–ভেতরে এসো। রাজা রিকার্ডোর গম্ভীর গলা শোনা গেল।
সেনাপতি দরজা খুলল। ভেতরে ঢুকল। ইঙ্গিতে ফ্রান্সিসদের ঢুকতে বলল।
ফ্রান্সিসরা ভেতরে ঢুকল। দেখল রাজা রিকার্ডো একটা সুসজ্জিত বিছানায় বসে আছেন। রাজার বাহুতে পট্টি বাঁধা। বোঝাই যাচ্ছে যুদ্ধে আহত হয়েছেন। গায়ে একটা ফুলতোলা দামি কাপড় জড়ানো। সেনাপতিমাথাঝুঁকিয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–মহারাজ এই তিনজনেই গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। ফ্রান্সিস বলে উঠল–মিথ্যে কথা।
–তোমরা বিদেশি? রাজা রিকার্ডো বললেন। রাজার বেশ ভারী গলা।
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।
–কোথায় দেশ তোমাদের? রাজা বললেন।
–আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ–তোমাদের কথা শুনেছি। বীর জাতি। একটু থেমে বললেন–কিন্তু একটা কথা আমাকে বোঝাও তো। আমরা নিঃশব্দে রাজা ফার্ণান্দোর সৈন্যাবাস আক্রমণ করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সৈন্যাবাসে কোনো সৈন্য নেই। তারা যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রান্তরের শেষে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কী করে হল?
ওরা আগে খবর পেয়েছিল বোধহয়। হ্যারি বলল।
–বোধহয় না। নিশ্চয়ই কোনো গুপ্তচর আগেভাগে আমাদের আক্রমণের কথা তাদের জানিয়েছিল। রাজা বললেন।
– হতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
হতে পারে নয়। তাই হয়েছে। তোমারাই আগেভাগে আমাদের আক্রমণের কথা ফার্নান্দোকে জানিয়েছে। রাজা রির্কাডো বললেন।
–কিন্তু আমাদের কী স্বার্থে? ফ্রান্সিস বলল।
–তোমরা বিদেশি। তোমাদের অর্থাভাব থাকবেই। অর্থের লোভে তোমরা এই কাজ করেছো। তোমাদের সুবিধে হল তোমরা বিদেশি। কাজ সেরে প্রাপা অর্থ নিয়ে জাহাজ চালিয়ে চলে যাবে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। রাজা রিকার্ডো বললেন।
–তা তো আমরা করি নি। আমরা সবাই এখনও এ তল্লাট ছেড়ে পালই নি। ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু তীর থেকে দূরে গিয়ে তোমাদের জাহাজ নোঙর করেছে। রাজা বললেন।
আমরা যুদ্ধে জড়াতে চাই নি। হ্যারি বলল।
–কিন্তু আমার যুদ্ধ জাহাজ এই হুয়েনভা বন্দরে আসবে যুদ্ধ করার জন্যে–এই, সংবাদটা তোমরা আগেই ফার্নান্দোকে জানিয়েছো। রাজা বললেন।
–এসব মিথ্যে অপবাদ। হ্যারি বলল।
রিকার্ডো চিৎকার করে বলে উঠল–থামো। তারপর সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বললেন–সবকটাকে বেত মারুন।
সেনাপতি ছুটে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই একজন পাহারাদারকে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো। তার হাতে চাবুক জড়ানো। রিকার্ডো প্রথমে আলখাতিবকে দেখিয়ে বলল –আগে এটাকে মার। গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তিটা আগে ওটাকে বুঝিয়ে দে। পাহারাদার এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস ডানহাত তুলে চিৎকার করে উঠল–আমাদের অন্যায়ভাবে চাবুক মারা হচ্ছে। চাবুকের মার খাবার মতো কোনো কাজ আমরা করি নি। রাজা রিকার্ডো এক ঝটকায় উঠে পড়লেন। গা থেকে চাদরটা খসে পড়ল। খালি গায়ে দ্রুত পাহারাদারের কাছে এলেন। চাবুকটা কেড়ে নিয়ে এলোপাথারি ফ্রান্সিসদের গায়ে চাবুক মারতে লাগলেন। ফ্রান্সিস হ্যারিকে আড়াল করে দাঁড়াল। এই চাবুকের মার হ্যারি সহ্য করতে পারবে না। চাবুকের মার চলল। আলখাতিব সহ্য করতে পারল না। আর্তনাদ করে উঠল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো নিঃশব্দে মার খেতে লাগল। রাজারিকার্ডো এক সময় চাবুক ফেলে দিয়ে হাঁপাতে লাগলেন। বাঁ বাহুতে তলোয়ারের কোপ পড়েছে। আহত। বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কাজেই অল্পক্ষণের মধ্যেই রাজা রিকার্ডো চাবুক মারা বন্ধ করলেন। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বললেন –সবকটাকে বন্দী করুন। আমার রাজ্যে নিয়ে চলুন। চাবুকের মারের জন্যে পিঠ জ্বলে যাচ্ছে ফ্রান্সিসদের। আন্দাজে বুঝল –পিঠে রক্ত বেরিয়েছে। চাবুক পিঠ কেটে বসে গেছে। ফ্রান্সিস চোখ বুজে মার খেয়েছে। এবার চোখ খুলে বলল —
আমার বন্ধুদের কী হবে?
–আমার যুদ্ধ জাহাজের একেবারে নিচে আছে ছোটো কয়েদঘর। সবাইকে সেখানে রাখা হবে। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল–হ্যারি–তুমি ভালো আছো তো।
–তুমি তো আমাকে চাবুকের মার খেতেও দাওনি। সব মার নিজে গায়ে নিয়েছে। হ্যারি বলল।
–শাঙ্কো? ফ্রান্সিস শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল।
–আমি ভালো আছি। শাঙ্কো বলল।
–জ্বালা যন্ত্রণা। ফ্রান্সিস বলল।
–তা তো হবেই। কিন্তু আমি সহ্য করছি। আমার জন্যে ভেবো না। শাঙ্কে বলল।
তখনই একজন সৈন্য ছুটতে ছুটতে কেবিনঘরে ঢুকল। রাজা রিকার্ডোকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–একদল বিদেশি আমাদের যুদ্ধ জাহাজ আক্রমণ করেছে। তখনই বাইরে হৈ হল্লা চিৎকার আহতদের আর্তনাদ শোনা গেল। ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে চেয়ে বলল–হ্যারি–সর্বনাশ হল। এই অবস্থায় বোকার মতো লড়াইয়ে নেমেছে।
রাজা রিকার্ডো চিৎকার করে বলল–যারা সুস্থ আছে তাদের লড়াইয়ে নামতে বলল। হোক লড়াই।
–একটু ধৈর্য ধরতে পারল না। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল।
–হ্যাঁ ইশ্বর–ওরা এটা কী করল। শাঙ্কে বলল।
রাজা রিকার্ডো বলল–যাও তোমাদের বন্ধুদের লড়াই বন্ধ করতে বলো।
বেশ–আমরা যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।
রিকার্ডোর শৌখিন জাহাজ থেকে ফ্রান্সিসরা রিকার্ডোর যুদ্ধ জাহাজে উঠে এলো। দেখল ভাইকিংদের সঙ্গে রিকার্ডোর সৈন্যদের জোর লড়াই চলছে জাহাজের ডেক-এ। ফ্রান্সিস দুহাতে চেটো গোল করে মুখের কাছে এনে চিৎকার করে বলল–ভাইসব লড়াই থামাও। তখন বিস্কোকে দেখল ফ্রান্সিস। বিস্কো তলোয়ার চালাতে চালাতে বলল– আমরা শুনেছি– তোমাদের চাবুক মারা হয়েছে। তার বদলা নিচ্ছি। ফ্রান্সিস আবার চিৎকার করে বলল–বিস্কো ফ্লেজার–তোমরা লড়াই থামাও। আমার কথা শোনো। বদলা নেবার সময় এখন নয়।
আস্তে আস্তে লড়াই থেমে গেল। ডেক-এ শোনা গেল আহতদের আর্তনাদ গোঙানি। ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে এলো। বলল- বিস্কো শাঙ্কো তোমরা দেখো আমাদের বন্ধুদের কী অবস্থা। শাঙ্কে বিস্কো আহত বন্ধুদের খুঁজে খুঁজে নিয়ে এলো ডেক-এ। দেখা গেল তিনজন ভাইকিং বন্ধু মারা গেছে। তিনটি বন্ধুর মৃতদেহ ডেক-এ রাখা হল। ফ্রান্সিসরা তাদের ঘিরে দাঁড়াল। ভাইকিং বন্ধুরা কেউ কেউ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফ্রান্সিসের চোখেও জল। কত সুখ আনন্দে দুঃখের বন্ধু এরা তিনজন। ভেনকে ডাকা হল। মারিয়াও ততক্ষণে লড়াই থেমে গেছে দেখে যুদ্ধ জাহাজের ডেক-এ এসেছে। মৃত বন্ধুদের দেখে মারিয়া চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ফ্রান্সিস দেখল। কিছু বলল না।
ততক্ষণে ভেন এসে গেছে। ওর জোব্বামতো পোশাকের পকেট থেকে একটা ছেঁড়া খোঁড়া বাইবেল বের করল। একটা পাতা খুলে একটু পড়ল। বলল–আমেন। সবাই মৃদুস্বরে বলল, আমেন।
তিনটি মৃতদেহ পর পর তুলে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করা হল। বন্ধুরা কিছুক্ষণ নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল।
ফ্রান্সিস এতক্ষণে লক্ষ্য করল যে রাজা রিকার্ডোর সৈন্যরা ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস বুঝল একটু বেচাল হলে এরা ঝাঁপিয়ে পড়বে।
সেনাপতি ভেন-এর কাছে গেল। বলল–আমাদেরও সাতজন সৈন্য মারা গেছে। তাদের শেষকৃত্যটা আপনি করুন।
–চলুল। ভেন বলল।
ভেনকে সেনাপতি নিয়ে ডেক-এর শেষদিকে এলো। দেখা গেল সাতটা মৃতদেহ পড়ে আছে। ভেন জোব্বামতো পোশাকের পকেট থেকে ছেঁড়াখোঁড়া বাইবেলটা বের করল। আধপাতা পড়ল। অন্য সৈন্যরা মৃতদেহগুলি পরপর সমুদ্রের জলে ফেলে দিল। এতগুলি মৃত মানুষ। সবাই জলে নিক্ষিপ্ত হল। নিজের বন্ধুদের জন্যে তো বটেই শত্রু পক্ষের মৃত সৈন্যদের জন্যেও ফ্রান্সিসের চোখ ভিজে উঠল।
সেনাপতি ফ্রান্সিসের কাছে এলো। মৃদুস্বরে বলল–
–রাজা রিকার্ডো তোমাদের কী শাস্তি দিয়েছেন তা তুমি জানো?
–হ্যাঁ জানি। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমার বন্ধুদের সেটা বলো। সেনাপতি বলল।
এবার ফ্রান্সিস বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাইসব–রাজা রিকার্ডো বলেছে এই জাহাজের নিচের দিকে একটা কয়েদখর মতো আছে আমাদের সেখানে বন্দী করে রাখবে যাতে আমরা পালাতে না পারি। ক্যামেরিনালে রাজা রিকার্ডোর রাজত্ব। সেখানে আমাদের বন্দী করে রাখা হবে। ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। শাঙ্কো বলল ফ্রান্সিস আমরা এভাবে বন্দীদশা মেনে নেব?
এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। অসময়ে লড়াইয়ের ফল তো দেখলে–তিনজন প্রিয়বন্ধুকে হারালাম। ফ্রান্সিস বলল।
সেনাপতি তাড়া লাগাল–এবার সবাই সিঁড়ির দিকে চলল। নিচে নামতে হবে। ভাইকিংরা আর কেউ কিছু বলল না। সিঁড়িঘরের দিকে চলল। ফ্রান্সিস সেনাপতিকে বলল–দেখুন–একটা অনুরোধ ছিল।
–সেনাপতি বলল–বলো।
ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেখিয়ে বলল–ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী।কয়েদ-ঘরের কষ্ট ইনি সহ্য করতে পারবেন না। এঁকে কোনো কেবিনঘরে রাখুন।
–দেখি–রাজাকে বলে। সেনাপতি বলল।
মারিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললনা–না। আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকবো।
–মারিয়া-জাহাজের নিচের কয়েদঘরে কী অমানুষিক কষ্ট তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি কাছেই ছিল। বলল–ফ্রান্সিস ঠিক কথাই বলেছেন রাজকুমরী। আমাদের সঙ্গে আপনার থাকা চলবে না।
মারিয়া আর কোনো কথা বলল না।
সেনাপতি চলে গেল শৌখিন জাহাজটায়। রাজার সঙ্গে কথা বলে এলো। ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল উনি রাজকুমারীকে দেখতে চান কথা বলতে চান।
–বেশ তো চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–না। রাজমশাই একা কথা বলতে চান। সেনাপতি বলল।
–বেশ রাজকুমারীকে নিয়ে যান। ফ্রান্সিস বলল।
কয়েকজন সৈন্যসহ সেনাপতি শৌখিন জাহাজের ডেকটা কাছাকাছি আনল। মারিয়াকে বলল–উঠে যান। মারিয়া দুই জাহাজের অলী ফঁকটা ডিঙিয়ে গেল। তারপর সেনাপতির পেছনে পেছনে চলল।
মারিয়াকে রাজার কেবিনঘরে পৌঁছে দিয়ে সেনাপতি চলে এলো। রাজা রিকার্ডোর কেবিনখরটা মারিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। মারিয়া রাজপ্রাসাদে বড়ো হয়েছে। এসব ওর কাছে নতুন কিছু নয়। ও অবাক হল না। যেমন ফ্রান্সিসরা হয়েছিল।
রাজা রিকার্ডো হেসে বললেন–শুনলাম তুমি নাকি রাজকুমারী।
–হ্যাঁ মারিয়া বলল।
–কোন্ দেশের? রাজা বললেন।
–ভাইকিং দেশের। মারিয়া বলল।
–তা রাজপ্রাসাদ আর সেখানকার আরাম আয়েস ছেড়ে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন?
–আমার স্বামীর ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে। মারিয়া বলল।
–বেশ ভালো রাজা বললেন।
–এইভাবে দেশে দেশে দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন আমার স্বামী। আমিও তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। মারিয়া বলল।
–ও। এসব এক ধরনের পাগলামি। রাজা বললেন।
–বাইরে থেকে দেখলে তাই মনে হবে। মারিয়া বলল।
–তোমার ভালো লাগে এসব? রাজা বললেন।
–নিশ্চয়ই। মারিয়া বলল।
যাক গে–এসব কথা। একটু থেমে রাজা রিকার্ডো বললেন–
–তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই দামি দামি গয়নাগাঁটি আছে? আঙ্গুলের আংটিটা দেখিয়ে মারিয়া বলল–শুধু এই আংটিটা ছাড়া আমার কোনো গয়নাগাঁটি নেই।
–উঁহু তুমি মিথ্যে কথা বলছো। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে। আপনি তল্লাশি তো হবেই রাজা বললেন।
–তোমাদের জাহাজে তল্লাশি করান। মারিয়া বলল।
–তাহলে তো সবই জানবেন। মারিয়া বলল।
–তোমার স্বামীর নাম কী? রাজা বললেন।
–ফ্রান্সিস। মারিয়া বলল।
–আমার হাতে আজ চাবুকের মার খেয়েছে। রাজা বললেন।
–হ্যাঁ। মারিয়া মাথা ওঠানামা করে বলল।
–ঠিক আছে। তোমাদের দুজনকে আলাদা কেবিনঘর দেওয়া হবে। রাজা বললেন।
দুজন নয়–একজন। মারিয়া বলল।
তার মানে? রাজা বললেন।
–শুধু আমি থাকবো। ফ্রান্সিস থাকবো না। মারিয়া বলল।
–সে কি ঐ কয়েদঘরে থাকবে নাকি? রাজা বললেন।
–হ্যাঁ বন্ধুদের সঙ্গে ফ্রান্সিস ঐ কয়েদঘরেই থাকবে। মারিয়া বলল।
–ও। তাহলে তুমি একাই থাকবে? রাজা বললেন।
–হ্যাঁ।
দরজায় দ্বারী ছিল পাহারায়। গায়ে যোদ্ধদের বেশ। হাতে পেতলের ঝঝকে বর্শা। রাজা রিকার্ডো তুড়ি দিল। দ্বারী এগিয়ে এসে মাথা নুইয়ে দাঁড়াল। রাজা বললেন সেনাপতিকে ডাক। দ্বারী চলে গেল। একটু পরেই সেনাপতি এলো। রাজা বললেন–
–এই রাজকুমারী যে কেবিনঘরে থাকতো সেই ঘরটায় তল্লাশি চালাও। নিশ্চয়ই সোনাদানা দামি পাথরটাথর পাওয়া যাবে। কী বলেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। এরা গুপ্তধনও খুঁজে বেড়ায়। কাজেই এদের কেবিনঘরে মূল্যবান কিছু পাওয়া যাবেই। সেনাপতি বলল।
–হুঁ। তাহলে আপনি যান আর তল্লাশি চালান আর এই রাজকুমারীকে একটা কেবিনঘরে রাখবেন। রাজা বললেন।
সেনাপতি মাথা নুইয়ে বলল ঠিক আছে। আপনার হুকুমমতো সব কাজ হবে।
মারিয়াকে নিয়ে সেনাপতি বেরিয়ে আসছে তখন মারিয়া ঘরটা আর একবার ভালো করে দেখল। ভাবল–আমাদের প্রাসাদে বাবার মন্ত্রণাকক্ষও এর চেয়ে সুন্দর। তবে রাজা রিকার্ডো বড়লোক সন্দেহ নেই। ওদিকে ভেন যুদ্ধে আহত বন্ধুদের চিকিৎসা করতে শুরু করল। ভালো ওষুধ পেয়েছে। তাই ভাবলসবাইকে সুস্থ করা যাবে। মারিয়া সেনাপতি যুদ্ধ জাহাজে ফিরে এলো। ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো। বলল– রাজা কী বললেন?
ঐ রাজার কেমন ধারণা হয়েছে আমার কেবিনে মূল্যবান কিছু গোপন রাস্তা আছে। সেনাপতিকে হুকুম দিয়েছে সেসব খুঁজে বের করতে। আমি আঙুলের একটি আংটি দেখিয়ে যখন বললাম –এই আংটি ছাড়া আমার কাছে দামি কিছু নেই। কথাটা শুনে রাজা যেভাবে তাকালো তাতে বুঝলাম কথাটা উনি বিশ্বাস করেন নি। মারুক গে।
রাজকুমারীকে এনে যখন তার জন্যে নির্দিষ্ট কেবিনঘরে রাখা হল তখন নিজেকে বড়ো একা মনে হল। কিন্তু উপায় নেই। রাজা রিকার্ডোর সন্দেহের এখনও নিরসন হয় নি। এখনও তার বিশ্বাস ফ্রান্সিস হ্যারি আর আলখাতিব গুপ্তচরবৃত্তি করেছে। এই গুপ্তচরদের বিশেষ করে আলখাতিবের আগাম খবরের জন্যেই তাকে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে।
ওদিকে সেনাপতি ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল–আমার সঙ্গে চলো তোমাদের কেবিনঘরগুলো তল্লাশি চালাবো।
–শুধু আমার আর রাজকুমারীর কেবিনঘরটা তল্লাশি নিলে হত না? ফ্রান্সিস বলল।
না আমরা সব কেবিনঘর দেখবো। সেনাপতি বলল।
–বেশ। চলুন। ফ্রান্সিস বলল।
–আমিও যাবো। হ্যারি বলল। সেনাপতি হ্যারির দিকে তাকাল। বলল–বেশ তো চলো।
তিনজনে যুদ্ধজাহাজ থেকে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে এলো। সেনাপতি একে একে খালি কেবিনঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। দামি কিছুই পেল না। ফ্রান্সিসকে জিজ্ঞেস করল- তোমার আর রাজকুমারীর কেবিঘর কোন্টা? ফ্রান্সিস ওর আর রাজকুমারীর কেবিনঘরটা দেখাল। সেনাপতি সেদিকে চলল।ফ্রান্সিস তখন উত্তেজনায়। একটু কেঁপে কেঁপে উঠেছে। মারিয়ার চামড়ার ব্যাগে সোনার অনেক চাকতি রাখা হয় আছে। মারিয়া তো সেসব সরাবার সময়ও পায়নি। ধরা পড়তেই হবে। রাজা রির্কাডো সব নিয়ে নেবে। হাসবে। উল্লসিত হবে। ভালো দাও মারা গেছে। যেভাবে তোক যখন ওরা মুক্তো হবে তখন হাতে একটা সোনার চাকতিও থাকবে না। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের কেবিনঘরে ঢুকল। সেনাপতি হ্যারিও ঢুকল।
সেনাপতি কাপড় চোপড় সরিয়ে খুঁজতে লাগল। দুটো লম্বাটে ছোটো বাক্সও পেল। একটাতে দেখল সেলাই ফোঁড়াইয়ের সরঞ্জাম। অন্য বাক্সটায় বোম পিন এসব রয়েছে।
কিন্তু সেনাপতি হাল ছাড়ল না। মারিয়ার ব্যাগগুলি খুলে খুলে দেখতে লাগল। বড়ো বড়ো ব্যাগগুলোর নতুন পুরোনো পোশাক। সেই পোশাকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে খুঁজতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ সেনাপতি তল্লাশি চালালো। দামি বলতে পেল–হাতলে সোনারুপোর কাজ করা দুটো চিরুনি। দুটো চিরুনিই সেনাপতি নিল।
–ও দুটো চিরুনি রাজকুমারীর। চিরুনি দুটো রেখে দিল। হ্যারি বলল।
বা। এতে সোনারুপোর কাজ করা। কাজেই দামি। রাজাকে দিতে হবে। একেবারে খালি হাতে রাজার কাছে গেলে রাজা যাচ্ছেতাই বলে আমাকে অপমান করবে। সেই আপমানের হাত থেকে তো বাঁচা যাবে। সেনাপতি বলল।
–তাহলে নিয়ে যান। ফ্রান্সিস বলল।
তিনজনে যুদ্ধজাহাজে ফিরে এলো। সেনাপতি রাজা রিকার্ডোর কাছে চলল। ফ্রান্সিস জোরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল–মারিয়া সোনার চাকতিগুলো দামি পাথরগুলো কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। সেসব রাজা রিকার্ডোর হাতে পড়ল না– আমরা বেঁচে গেলাম।
–দেখতে হবে না ফ্রান্সিস, এ রাজকুমারীর কাজ। উনি দারুণ বুদ্ধিমতি। হ্যারি বলল।
দুজনে খুঁজে খুঁজে মারিয়ার কেবিনঘরে এলো।ফ্রান্সিস বলল–ঘরটা কেমন?মারিয়া বলল –একটা যুদ্ধ জাহাজ কত বিলাসী আয়োজন থাকে। যা আছে তার সমস্তই অধিকার নিতে হবে। এবার হ্যারি গলা নামিয়ে বলল–রাজকুমারী–রাজা রিকার্ডোর সেনাপতি আমাদের জাহাজে আপনার আর ফ্রান্সিসের ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজছে।
–কিছু পায় নি এই তো। মারিয়া দেখে বলল।
–হ্যাঁ শুধু আপনার চিরুনি দুটো পেয়েছে। ঐ দুটোতে তো সোনারুপোর কাজ আছে। তাই তাই নিয়েছে। হ্যারি বলল।
–চিরুনি দুটো ফেরা নিতে হবে। মারিয়া বলল।
–কিন্তু আমাদের সোনার চাকতিগুলো–ফ্রান্সিস বলতে গেল। মারিয়া হেসে ফ্রান্সিসকে হাত তুলে থামাল। ডান পায়ের কাছে গাউনটা তুললো। ফ্রান্সিস আর হ্যারি দেখল– একটা কাপড়ের ব্যাগমত পায়ের সঙ্গে ফিতে দিয়ে শক্ত করে বাঁধা।
–এটা তো–হ্যারি বলতে গেল।
হা কাপড়ের ব্যাগ। এর মধ্যেই ঠেসে ভরা আছে সোনার চাকতিগুলো আর মণি-মাণিক্য দামি পাথর–আর সব দামি জিনিস। মারিয়া বলল।
আশ্চর্য! ফ্রান্সিস আর হ্যারি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ফ্রান্সিস বলল তুমি কখন–মানে–
–রাজা রিকার্ডোর জাহাজ আমাদের জাহাজের দিকে আসছে দেখেই বুঝলাম আমরা বিপদে পড়লাম। রাজা রিকার্ডো সোনার খোঁজে আমাদের জাহাজ তল্লাশি করবেই। তখনই এই ব্যবস্থা করলাম। ফ্রান্সিস হেসে বলল–তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়।
সেনাপতি এসে দাঁড়াল। বলল–তোমরা এখানে? কয়েদঘরে চল।
ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া দুশ্চিন্তা করো না, ভয় পেয়ো না। আমরা মুক্তো হবোই।
দুজনে সেনাপতির সঙ্গে হেঁটে চলল। সিঁড়ি ঘরের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগল। ফ্রান্সিস অস্ফুটস্বরে বলল–হ্যারি আবার সেই বন্দী জীবন, বিনা অপরাধে।
–রাজা রিকার্ডোর সূন্দেহ অত সহজে যাবে না। হ্যারি বলল।
–হ্যা–কপালে ভোগান্তি আছে। ফ্রান্সিস বলল।
নীচে যে ঘরটার সামনে এসে ওরা দাঁড়াল সেখানে এই দিনের বেলাও অন্ধকার অন্ধকার একটা কাঁচ-ঢাকা মোমবাতি জ্বলছে। তাতেই যতটুকু অন্ধকার কেটে গেছে। মোটা লোহার গরাদ দেওয়া ঘর। দুজন পাহারাদার পাহারা দিচ্ছিল। তাদের একজনকে সেনাপতি ইঙ্গিত করল। সে কোমরে ঝোলানো চাবির গোছা থেকে চাবি নিয়ে ঘরের দরজা খুলল। শব্দ হল ঢ–অং। সেনাপতি বলল–ভেতরে ঢোক। ফ্রান্সিস একবার চারদিকে তাকাল? আর কেউ নেই। শুধু পাহারাদার দুজন আর সেনাপতি। কয়েদঘরের দরজা খোলা। একবার যদি নিজেদের ডাক দেয়। দরজা খোলা পেয়ে ওরা অনায়াসে ছুটে আসতে পারে। সেনাপতি আর দুজন পাহারাদারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। পাহারাদার দুজন আর সেনাপতিকে উল্টে কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দরজায় তালা দিয়ে, অনায়াসে ওরা পালাতে পারে। ফ্রান্সিস দীর্ঘশ্বাস ফেলল অসম্ভব। তাহলে মারিয়াকে ফেলে পালাতে হয়। মারিয়ার নিরাপত্তার জন্যে ওরা মনের দিক থেকে দুর্বল।
খোলা দরজা দিয়ে ফ্রান্সিসরা ঢুকল। শব্দ তুলে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। শুয়ে বসে। থাকা ভাইকিংরা চেয়ে দেখল। শুধু বিস্কো উঠে এলো। বলল–ফ্রান্সিস–পালাবার সব রাস্তাই বন্ধ। তা ছাড়া ওসব ভেবেও লাভ নেই। রাজকুমারীকে ফেলে রেখে তো পালাতে পারবে না।
–দেখা যাক। সময় বুঝে সবদিক ভেবে মারিয়াকে নিয়ে পালাবো। এখন জাহাজ তো যাবে রাজা রিকার্ডোর রাজ্যের দিকে। রাজধানী ক্যামেরিনাল বন্দর শহরে জাহাজ ভিড়বে। জাহাজ থেকে আমাদের নামিয়ে ক্যামেরিনালের কয়েদঘরে বন্দী করে রাখা হবে। ওখানকার পাহাড়ের ব্যবস্থাটা দেখবো। মারিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে পালাবার সময় মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে পালাতে পারি।
ওদিকে রাজা রিকার্ডোর সৈন্যরা ফ্রান্সিসদের জাহাজটা ওদের যুদ্ধজাহাজের হালের সঙ্গে কাছি দিয়ে বাঁধলো। রাজা রিকার্ডো সেনাপতিকে হুকুম দিল জাহাজ ছাড়বার জন্য।
কিছুক্ষণ পর যুদ্ধজানের নোঙর তোলা হল। শৌখিন জাহাজের নোঙরও ভোলা হল। তার পাল খুলে দেওয়া হল।
জনাদশেক সৈন্য দাঁড়ঘরে নেমে এলো। সমুদ্রের জলে দাঁড় টানার শব্দ হল– ছলাৎ ছলাৎ ছপছপ।
জাহাজ তিনটি চলল।
সারারাত জাহাজ চলল।
ভোর হয় হয়। তখন জাহাজতিনটি ক্যামেরিনাল বন্দরশহরের জাহাজঘাটায় পৌঁছুল।
রাজা রিকার্ডো যুদ্ধে হেরে গেছে। এই দুঃসংবাদ রাজারিকার্ডোর রাজধানীতে আগেই পৌঁছে গেছে।
সূর্য উঠলো। দলে দলে ক্যামেরিনালের অধিবাসীরা জাহাজঘাটায় জমায়েত হতে লাগল। রাজা রিকার্ডো শৌখিন জাহাজ থেকে নামলেন। প্রাসাদের মধ্যে কোনো আনন্দের হৈ-হল্লা নেই। সবাই চুপচাপ। রাজা রিকার্ডো একটা খয়েরী রঙের ঘোড়ায় চেপে রাজপ্রাসাদের দিকে ঘোড়া ছোটালেন।
কিছুক্ষণ পরে যুদ্ধ জাহাজ থেকে সৈন্যরা একে একে নামল। জাহাজঘাটায় সৈন্যরা কয়েকজন ঘোড়ায় টানা গাড়ি নিয়ে এলো। এই গাড়িগুলোয় চাষীরা শস্য নিয়ে যায়। আট-দশজন আহত সৈন্যকে সৈন্যরা ধরাধরি করে নামাল। তারপর ঐ গাড়িগুলোয় শুইয়ে দিল বসিয়ে দিল। আহত সৈন্যদের নিয়ে গাড়িগুলো আস্তে আস্তে সৈন্যাবাসের দিকে চলল।
আটজন সৈন্য এবার কয়েদঘরের সামনে এলো। প্রত্যেকের হাতেই চার-পাঁচ হাত দড়ি, কয়েদঘরের লোহার দরজা খোলা হল। একজন একজন করে ভাইকিংদের কয়েদঘরের বাইরে নিয়ে আসা হতে লাগল। তারপর দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা হতে লাগল। একজন একজন করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ডেক-এ নিয়ে আসা হতে লাগল।
ফ্রান্সিস হাত বাঁধা অবস্থায় ডেক-এ উঠে এলো। দেখল-মারিয়া চুপ করে ডেক এর একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিসরা পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে জাহাজঘাটে নামতে লাগল। ওদের পেছনে মারিয়াও নামল।
এবার বেশ কয়েকজন সৈন্য ফ্রান্সিসদের পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিস দেখল–
ক্যামেরিনাল বন্দর শহরটা খুব বড়ো না। লোকবসতিও মনে হল বেশি নয়। কিন্তু বাড়িঘরদোর বেশ সাজানো গোছানো। সামনেই চাররাস্তার মোড়ে স্কুলের বাগান। অজস্র ফুল আছে। মাঝখানে এক পরীর মূর্তি। শ্বেতপাথরের। পরী ঝারি থেকে জল ঢালছে। জমা জল থেকে ফোয়ারা। বেশ উঁচু পর্যন্ত ফোয়ারার জল উঠছে।
ফ্রান্সিসরা রাস্তা দিয়ে চলল।বিদেশি পোশাক পরা দুহাত দড়ি দিয়ে বাঁধা। চারপাশের লোজন ফ্রান্সিসদের দেখতে লাগল। বোঝাই যাচ্ছে বিদেশি। কিন্তু ওদের বন্দী করা হল কেন? ওদের বোধহয় কয়েদঘরে বন্দী করে রাখা হবে।
এর মধ্যেই সূর্য আকাশে উঠে এসেছে। চড়া রোদ। ফ্রান্সিসদের অসহ্য গরমের মধ্যে হাঁটতে হচ্ছে। খাওয়া এখনও জোটে নি।ফ্রান্সিস দেখল মারিয়া ওদের পেছনে পেছনে আসছে। মাথা ঢেকে বড়ো রুমাল বেঁধে নিয়েছে মারিয়া।
সৈন্যাবাসের সামনের মাঠটায় এলোওরা। পাহারাদার সৈন্যরা ওদেরদক্ষিণ দিককার একটা পাথরের ঘরের দিকে নিয়ে চলল।
ঘরটার সামনে এসে সবাই দাঁড়াল। দুজন সৈন্য গেল ঘরটার লোহার দরজার দিকে। একটু পরেই ফিরে এলো। গলা চড়িয়ে বলল–সবাই এই কয়েদঘরে ঢোকো। ফ্রান্সিসরা এগিয়ে গিয়ে দেখল লোহার দরজা খোলা। দুজন পাহারাদার সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছে। একজনু চাবির গোদা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে রইল। অন্য বন্ধুরা একে একে কয়েদঘরে ঢুকতে লাগল। হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল
রাজকুমারী মারিয়াকে বন্দী করে কোথায় রাখা হবে?
এই নিয়ে কথা বলতে হবে। তাই দাঁড়িয়ে আছি।
–রাজা রিকার্ডোর অন্দরমহলে রাজকুমারীকে রাখতে বলল। হ্যারি বলল।
তাই বলবো। কিন্তু সেনাপতি রাজি হবে কিনা তাই ভাবছি। সৈন্যরা তাড়া দিল। হ্যারি কয়েদঘরে ঢুকে পড়ল। ফ্রান্সিস তখন দাঁড়িয়ে আছে। দুজন সৈন্য ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল–এই বিদেশি ভূত–দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ফ্রান্সিসের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ভাবল–এই সৈন্যটাকে আমি খালি হাতেই নিকেশ করতে পারি। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ফ্রান্সিস সৈন্যটাকে বলল তোদের সেনাপতির সঙ্গে কথা বলবো। তাই দাঁড়িয়ে আছি। সেনাপতি কোথায়?
–সেনাপতি তোর চাকর নাকি–ডাকলেই আসবে। একজন সৈন্য বলল।
আমরাই কি তোদের চাকর নাকি। ফ্রান্সিস বলল।
–চাকর ছাড়া কি। সৈন্যরা বলল।
-তবে রে।কথাটা ফ্রান্সিস সৈন্যটির কোষবদ্ধ তলোয়ারটা দ্রুত হাতে একঝট্রায় খুলে আনল। তলোয়ারটা উঁচিয়ে বলল–তুইও একটা তলোয়ার নে। দু তিনজন সৈন্য তলোয়ার কোষমুক্ত করে ছুটে এলো। ফ্রান্সিসের তখন রুদ্রমূর্তি। তলোয়ার উঁচিয়ে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। লড়াই শুরু হয় হয়। মারিয়া ছুটে এলো। চিৎকার করে বলল-ফ্রান্সিস রোগে যেও না। মাথা ঠাণ্ডা করো। আমাদের বিপদ বাড়িও না। তলোয়ার ফেলে দাও। ফ্রান্সিসের অনড় শরীরটা নড়ল। তলোয়ারটা ছুঁড়ে ফেলল। সৈন্যরাও তলোয়ার কোষবদ্ধ করল।
একজন সৈন্য ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল কী ব্যাপার বলো তো? ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেখিয়ে বলল ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী। সেনাপতিকে অনুরোধ করবো একে যেন রাজ-অন্তঃপুরে রাখা হয়।
–কিন্তু সেনাপতি তো এখন নিজের বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম করছেন। যুদ্ধে হেরে গিয়ে সেনাপতির এখন মন খারাপ। উনি এখন কিছু শুনতে চাইবেন না। সৈন্যটি বলল।
–তাহলে আমাকে পাহারা দিয়ে সেনাপতির বাড়িতে নিয়ে চলো। আমাদের সমস্যাটা বুঝিয়ে বললে–উনি শুনবেন। উনি হয়ত রাজিও হবেন। সৈন্যটি একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল–চলল। দেখা যাক।
মারিয়া তখন একটা কাঠের বাটিভর্তি জল নিয়ে এলো। ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে ধরল। ফ্রান্সিস হাসল। মারিয়াও হাসল। নিশ্চিন্ত হল যে, ফ্রান্সিসের মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে। ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে এটা ফ্রান্সিস বুঝল জল দেখে। বাটিমুখে ঠেকিয়ে ঢ ঢক্ করে জল খেয়ে নিল। বাটিটা মারিয়াকে ফিরিয়ে দিল। মারিয়া বলল–আমিও খাবো।
বেশ চলো। ফ্রান্সিস বলল। ঐ বাটিটা ছিল কয়েদঘরের। একজন সৈন্যকে মারিয়া ফিরিয়ে দিল। তারপর চলল ফ্রান্সিসের সঙ্গে। সেই সৈন্যটিই ফ্রান্সিস ও মারিয়াকে নিয়ে যাবার জন্যে এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস বলল–তুমি একা যেও না। আরো দুতিনজন সৈন্য সঙ্গে নাও। নইলে তুমি একা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে–সেনাপতি এটা ভালো চোখে দেখবে না।
–তাও তো বটে। সেনাপতি রেগে গেলে বিপদে পড়বো। সৈন্যটি তখন আরও তিন সঙ্গীকে সঙ্গে নিল। সবাই চলল সেনাপতির বাড়ির দিকে।
ওদিকে লোহার গরাদের মধ্যে দিয়ে বন্ধুরা দেখছিল ফ্রান্সিস-মারিয়া যাচ্ছে। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস নিশ্চয়ই সেনাপতির কাছে যাচ্ছে।
-কেন? শাঙ্কো বলল।
রাজকুমারীর খাবার ব্যবস্থা করতে। হ্যারি বলল।
–ফ্রান্সিস কী চায়? শাঙ্কো বলল।
–ফ্রান্সিস চায় রাজকুমারী রাজা রিকার্ডোর অন্তঃপুরে থাকুক। হ্যারি বলল।
–দেখো–সেনাপতি রাজি হয় কিনা দেখো। শাঙ্কো বলল।
মনে হয় রাজি হবে। হ্যারি বলল।
ওরা ফ্রান্সিসের চলে যাওয়া দেখতে লাগল।
তিনজন সৈন্যসহফ্রান্সিস মারিয়া সেনাপতিরআবাসের সামনে এলো। দেখল একজন প্রহরী পেতলের বর্শা হাতে পাহারা দিচ্ছে। সৈন্যটি ঐ প্রহরীর কাছে গিয়ে কী বলল। বোধহয় সেনাপতির সঙ্গে দেখা করবে এরকম কিছু বলল। প্রহরীটি ইঙ্গিতে ওদের অপেক্ষা করতে বলে বাড়িটার প্রধান দরজার সামনে গেল। বিরাট দরজা ওক কাঠের। সেই কাঠ কুঁদে কুঁদে নানা নকশা আঁকা।
দরজা খুলে প্রহরীটি ভেতরে গেল।কিছু পরে বেরিয়ে এলো। বলল–এসো। দু’জন সৈন্য বাইরে রইল। ফ্রান্সিস ও মারিয়া সৈন্যটির সঙ্গে ভেতরে ঢুকল।
একটা ঘর। ঘরের দুদিকে দুটো জানালা। তাতেও ঘরটার অন্ধকার অন্ধকার ভাবটা কাটেনি। ঘরের মাঝখানে একটা শ্বেতপাথরের গোল টেবিল। টেবিলের চারপাশে চারটে চেয়ার ওক কাঠের। পায়াগুলোও বাঁকা। বসার জায়গায় সাটিন কাপড় ঢাকা। তার নীচে পাখির পালকের গদী। ঘরের দেয়াল পালিশ করা রঙিন ছবি আঁকা। ফ্রান্সিস বসল। একটু পরেই সেনাপতি ঢুকল। পরনে সাধারণ পোশাক। ঢোলাহাতাহলুদ জামা। তাতে নীল সুতোর কাজ করা।
সেনাপতি ঢুকতে ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়িয়েছিল। সেনাপতি হাতের ইঙ্গিতে ওদের বসতে বলল। দুজনে বসল। সেনাপতি ফ্রান্সিস আর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল তোমরা এসেছো কেন?
আমাদের একটা কথা বলার ছিল। ফ্রান্সিস বলল।
সেনাপতি সেই সৈন্যটার দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি একা এই দুজনকে নিয়ে এলে কেন? তুমি তো জানো এরা বন্দী।
আজ্ঞে বাইরে আমার দুজন সঙ্গী রয়েছে। সৈন্যটি বলল।
–হুঁ। সেনাপতি মুখে শব্দ করল। তারপর ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল তোমরা কী বলতে চাও বলল।
–একটা নিবেদন আছে আমাদের। ফ্রান্সিস বলল।
–বলো। সেনাপতি বলল।
মারিয়াকে দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলল-ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী।
–হু। সেনাপতি মুখে শব্দ করল। বলল–তোমরা কী বলতে চাও বলো।
ফ্রান্সিস বলল–বলছিলাম যে কয়েদঘরে আমাদের বন্দী করে রাখা হয়েছে সেখানে ইনি থাকতে পারবেন না। ঐ পরিবেশ এর সহ্য হবে না।
–হু। তারপর?
–যদি রাজকুমারীকে রাজ-অন্তঃপুরে থাকতে অনুমতি দেন তাহলে আমরা উপকৃত হব।
সেনাপতি মাথার চুলে একবার আঙ্গুল বুলিয়ে বলল–কিন্তু এই অনুমতি তো আমি দিতে পারি না। রাজা অনুমতি দেবেন। আমাকে রাজার কাছে যেতে হবে। তোমরা বসো। আমি রাজামশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আসছি। তবে তোমাদের অনুরোধ রাখবেন কিনা বলতে পারছি না। কারণ যুদ্ধে হেরে গিয়ে রাজার মন মেজাজ ভালো নেই। তবু তোমাদের কথা বলবো। তারপর দেখা যাক।
সেনাপতি উঠে দাঁড়ালো তারপর খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ফ্রান্সিসরা অপেক্ষা করতে লাগল।
প্রায় আধঘণ্টা পরে সেনাপতি ফিরে এলো। চেয়ারে বসে বলল-রাজা সম্মতি দিয়েছেন। তোমাদের রাজকুমারীকে অন্তঃপুরে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। একমাত্র দিনের বেলা রাজকুমারী সকালে ও বিকেলে তোমাদের মোট দুবার দেখতে যেতে পারবেন। ফ্রান্সিস মারিয়া দুজনেই খুশি।
সেনাপতি চেয়ার ছেড়ে উঠল।ফ্রান্সিস মারিয়াও উঠে দাঁড়াল। সেনাপতি সৈন্যটিকে বলল–ওদের রাজকুমারীকে তুমি অন্দরমহলে পৌঁছে দিও।
ফ্রান্সিস ও মারিয়া সেনাপতির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
সৈন্যটি এবার মারিয়াকে বলল–আপনি আমার সঙ্গে চলুন। মারিয়া ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–দিনে দুবার তোমাদের দেখতে যাবো।
–তাতেই হবে। আমাদের জন্যে ভেবো না। তুমি নিজে ভালো থেকো। ফ্রান্সিস। বলল।
কিছুটা এসে সৈন্যটি মারিয়াকে বলল–আমার সঙ্গে আসুন। সৈন্যটির সঙ্গে মারিয়া চলে গেল।
রাজ-অন্তঃপুরে ঢোকার দরজাটার সামনে এসে সৈন্যটি ও মারিয়া দাঁড়াল। কালো দরজায় নানা রঙীন চিত্র। মারিয়া চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তাতেই একজন পরিচারিকা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। সৈন্যটি পরিচারিকাটির দিকে এগিয়ে গেল। বলল–শোনো-রাজার হুকুম–এই রাজকুমারী অন্তঃপুরে বন্দী থাকবে।নজর রাখবে পালাতে না পারে। এঁর স্বামী আর তার বন্ধুরা কয়েদঘরে বন্দী হয়ে আছে। ইনি সকালে ও বিকেলে দুবার কয়েদঘরে যেতে পারবেন। তোমরা কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। সবধান পালাতে দেবে না।
–আসুন। পরিচারিকার সঙ্গে মারিয়া রাজ-অন্তঃপুরে ঢুকল। মারিয়া দেখল– মেঝে শ্বেতপাথরের। পাথরের দেয়ালে নানা রঙের ছবি আঁকা। পরিচারিকারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু এগোতেই কানে এলো বীণার সুরেলা বাজনা। যত এগোচ্ছে বাজনা তত স্পষ্ট হচ্ছে। কী সুন্দর সুরঝংকার। মারিয়া গানবাজনা কম শোনেনি।ও রাজপ্রাসাদের একটা ঘরই আছে নানা বাজনার। মারিয়ার অদ্ভুত ভালো লাগল। মারিয়া যে ঘরে বাজনার আসর বসেছে সেখানে এলো।
একটি সুসজ্জিত বিছানায় বসে এক মহিলা তন্ময় হয়ে গ্রীক বীণা বাজাচ্ছেন। চোখ ঝুঁজে বাজাচ্ছেন। তাই মারিয়াকে দেখলেন না। সহচরীরা গোল হয়ে বসে বীণার বাজনা শুনছে। মারিয়াও একপাশে বসে পড়ল।
বাজনা চলল।
একসময় বাজনা থামল। মারিয়ার তখন কান্না পাচ্ছে। এত সুন্দর বাজনা। আবার নিজেদের প্রাসাদেও তো বাজনা শুনেছে। সে কথাটাই মনে পড়তে মারিয়ার দুচোখ জলে ভরে উঠল।
মারিয়ার দিকে মহিলাটি তাকালো। যে পরিচারিকাটি মারিয়াকে নিয়ে এসেছিল সে মহিলাটিকে বলল-রানিমা। রানি ফিরে তাকালেন।
পরিচারিকা মারিয়াকে দেখিয়ে বলল-রানিমাইনি এক দেশের রাজকুমারী। এখানে এসে বন্দী হয়েছেন। মাননীয় রাজা এঁকে অন্তঃপুরে থাকতে বলেছেন।
রানি হেসে বললেন–তোমার নাম কী?
-মারিয়া।
তুমি কোন্ দেশের রাজকুমারী? রানি বললেন।
–ভাইকিং দেশের। মারিয়া বলল।
–তুমি বন্দী হলে কেন? রানি বললেন।
–আপনি তো জানেন রাজা রিকার্ডো রাজা ফার্নান্দোর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেছেন। মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ শুনেছি। রানি বললেন।
–আমরা জাহাজ চালিয়ে হুয়েভা বন্দরে এসেছিলাম। মারিয়া বলল।
–আমরা মানে কারা? রানি বললেন।
–আমি আমার স্বামী আর তার বন্ধুরা। মারিয়া বলল।
–ও। তারপর? রানি বললেন।
যুদ্ধে হেরে যাওযায় রাজা রিকার্ডোর কেমন সন্দেহহয় আমরা গুপ্তচর। আমরাই আগেভাগে রাজা ফার্নান্দোকে এই আক্রমণের কথা বলে দিয়েছি। মারিয়া বলল,
-তোমরা কি তাই করেছো? রানি বললেন।
না। আমরা এ দেশের কাউকে চিনি না, জায়গাও চিনি না।
–ও। তোমার স্বামী আর বন্ধুদের সঙ্গে তোমাকেও বন্দী করা হয়েছে।রানি বললেন।
-হ্যাঁ।তবে আমাকে কয়েদঘরে থাকতে হয়নি। রাজা রিকার্ডো আমাকে অন্তঃপুরে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। মারিয়া বলল।
হু। তাহলে তুমি বন্দী? রানি বললেন।
–হ্যাঁ। আমরা দেশে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম তখনই গুপ্তচর এই বদনাম দিয়ে আমাদের বন্দী করা হয়েছে। মারিয়া বলল।
–তোমরা ভাইকিং জাতি। রানি বললেন।
হ্যাঁ। তোমরা বীর নির্ভীক। জাহাজ চালাতে ওস্তাদ তাই তো? রানি বলল।
–হ্যা–লোক তাই বলে। মারিয়া বলল।
–জিপসি কাদের বলে জানো তো? রানি বলল।
হা–জিপসিদের নিজেদের দেশে বলে কিছু নেই। যাযাবর–দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। মারিয়া বলল।
–গতমাসে একদল জিপসি এসেছিল। একটি জিপসি মেয়ে, এক ভাইকিং যুবকের দুঃসাহসী অভিযানের কাহিনী নিয়ে রচিত গান শুনিয়ে গিয়েছে। রানি বললেন।
–সেই ভাইকিং যুবকের নাম ফ্রান্সিস। তাই না? মারিয়া বলল।
হা। তুমি চেনো তাকে? রানি বললেন।
–ফ্রান্সিস আমার স্বামী। মারিয়া বলল।
–সেকি! ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুদের তাহলে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে? রানি বললেন।
–আজ্ঞা হা। মারিয়া বলল।
–ও। রানি থামলেন। তারপর বললেন–রাজার মনটন এখন ভালো নেই ভাই ফার্নান্দোর কাছে যুদ্ধেপরাজিত হয়েছেন। আহতও হয়েছেন। কয়েকটা দিন যাক। রাজা একটু সুস্থ হলে তোমাদের মুক্তির কথা বলবো।
–ঠিক আছে। মারিয়া বলল। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
মারিয়া অন্দরমহলেই রয়ে গেল। পরিচারক পরিচারিকারা মারিয়াকে যত্নেই রাখল। রানিও মারিয়াকে একেবারে বান্ধবীর মতো মেনে নিল। মারিয়া সুখেই রইল। কিন্তু ফ্রান্সিসদের জন্য দুর্ভাবনা কিছুতেই যেতে চায় না। সুসজ্জিত টেবিল ঝকঝকে কাঁটা চামচ থালা প্লেট। সুস্বাদু খাবার। এসবের মধ্যেও মারিয়ার মন বিষণ্ণ। ফ্রান্সিসরা না জানি কী অখাদ্য খাচ্ছে। কেমন আছে ওরা।
রানি প্রতিদিন সকালে রাজা রিকার্ডোকে দেখতে যান। মারিয়াও সঙ্গে যায়। রাজা উঠে বিছানায় বসে থাকেন। রানি এলে খুশি হন। মারিয়ার সঙ্গেও দুএকটা কথা বলেন। কিন্তু মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। রানি রাজাকে সন্ত্বনা দেন সুস্থ হন আবার যুদ্ধে নেমো। তোমার জয় হবেই। রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
না। আমার আর যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা নেই।
অত হতাশ হয়ে পড়ো না। রানি বলেন।
রাজা চুপচাপ থাকেন। মারিয়াকে বলেন–রাজকুমারী তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো?
–না–না। আমি ভালোভাবেই আছি। মারিয়া বলে।
সেদিন এরকমই কথা প্রসঙ্গে মারিয়া বলল–
–মহামান্য রাজা–একটা প্রার্থনা ছিল।
বলো।
–আমার স্বামী তার আর বন্ধুদের আপনি সন্দেহের বশে কয়েদ করে রেখেছেন। মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ–ওরা সত্যিই গুপ্তচরের কাজ করেছিল কিনা সেটা নিয়ে সেনাপতি তদন্ত করছে। যদি তোমার স্বামী ও বন্ধুরা নির্দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। রাজা বললেন।
–ঠিক আছে আপনার সিদ্ধান্ত। এই নিয়ে কিছু বলার নেই। মারিয়া আস্তে আস্তে বলল।
সেদিন যে লোকটি রাজার ক্ষতস্থান ধুইয়ে ওষুধ দিয়ে পট্টি বেঁধে দেয়–সে এলো। মারিয়া ওর কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে রাজার ক্ষতে ওষুধ লাগিয়ে নিপুণ হাতে পাট্টি বেঁধে দিল। যে লোকটি পট্টি বাঁধে সে হেসে বলল–আপনি আমার চেয়ে ভালো পারেন। মারিয়া হেসে বলল–এসব ছোটোবেলায় মা আমাকে শিখিয়েছেন। মা আমাকে ছোট্টখাটো জ্বর সর্দি ব্যথার ওষুধও শিখিয়েছেন। রাজাও খুশি হলেন। মারিয়ার ব্যান্ডেজ বাঁধায় অনেকটা আরাম পেলেন। বললেন–তুমিই আমার পট্টি বেঁধে দেবে প্রত্যেকদিন।
এটা মারিয়ার প্রতিদিনের কাজ হল। মারিয়া মোটেই বিরক্ত হল না। ও সাগ্রহেই কাজটা করতে লাগল। ফ্রান্সিসের মুক্তির কথা মারিয়া আর বলে নি।
রাজা নিজে থেকেই ফ্রান্সিসদের মুক্তি দেবে তার জন্যেই মারিয়া অপেক্ষা করতে লাগল।
মারিয়া সারাদিন দুবেলা ফ্রান্সিসদের কয়েদঘরের সামনে আসে। মারিয়ার শরীর ভালো আছে জেনে ফ্রান্সিস খুশি হয়। দুজনে কয়েদঘরের দরজার কাছে কথাবার্তা বলে। এ সময় পাহারাদাররা কিছুটা সরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ফ্রান্সিস আর মারিয়া কথা বলে মারিয়া বলে। তোমরা কেমন আছো?
কয়েদঘরে বন্দীরা যেমন থাকে–তেমনি আছি। অখাদ্য খাবার, হাত ছড়িয়ে শোবার উপায় নেই। অতিরিক্ত গরম ঘাম জলতেষ্টা এসব নিয়ে ভালোই আছি। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া বলে–আর আমি পালঙ্কে শুয়ে ঘুমোচ্ছি নানা সুস্বাদু খাবার খাচ্ছি।
যাকগে আমাদের নিয়ে দুশিন্তা করো না। সময় সুযোগমতো ঠিক পালাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা বলেছে–সেনাপতি সব খোঁজখবর নিচ্ছে তোমাদের ব্যাপারে। তোমরা বিশেষ করে আলখাতিবকে সেনাপতি গুপ্তচর প্রমাণ করবার চেষ্টা করছে। মারিয়া বলল।
–হ্যাঁ–তাই সব ভোগান্তি ভুগছি আমরা। ফ্রান্সিস বলল।
–বলছিলাম-রাজাকে কি আবার তোমাদের মুক্তি দেবার কথা বলবো? মারিয়া বলল।
–কোনো লাভ নেই। আগে তো একবার বলেছো। কোনো লাভ হয়নি। ছেড়ে দাও–যা হবার হবে। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া এবার হ্যারি শাঙ্কোদের ডেকে কথা বলে। তারপর চলে আসে।
সেদিন মধ্যরাত। আকাশে চাঁদ অনুজ্জ্বল। ক্যামেরিনালের জাহাজঘাট জনশূন্য। ছ’সাতটা জাহাজ কম করে নোঙর করে আছে। জাহাজগুলোয় কাঁচটাকা আলো জ্বলছে। সমুদ্রের জল ঝলাৎ ঝলাৎ শব্দে তীরভূমিতে ভেঙে পড়ছে। সমুদ্রের জলের ওপর এখানে ওখানে নীল কুয়াশার জটলা।
কুয়াশার জটলার মধ্যে দিয়ে দুটো যুদ্ধজাহাজ আস্তে আস্তে তীরে এসে ভিড়লো। যুদ্ধজাহাজ দুটো রাজা ফার্নান্দোর। দুটো পাটাতন ফেলা হল। একটা পাটাতন পাশে হাত পাঁচেক। অন্যটা সাধারণ মাপের। বোঝা গেল মোটা পাটতন দিয়ে ঘোড়া নামানো হবে।
প্রথমে একটা ধবধবে সাদা ঘোড়া নামানো হল। রাজা ফার্নান্দো জাহাজ থেকে বেরিয়ে এলো। পাটাতন দিয়ে হেঁটে তীরে উঠলেন। পেছনে সেনাপতি।
এবার সশস্ত্র সৈন্যরা পাটাতন দিয়ে হেঁটে পার হয়ে তীরের ওপরের রাস্তায় এসে সারিবদ্ধ বেঁধে দাঁড়াল।
সাদা ঘোড়াটাকে তীরের পরেই উঁচু রাস্তাটায় এলে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। রাজা ফার্নান্দো সেখানে এলেন সাদা ঘোড়াটায় উঠলেন।
চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু জলে ঢেউয়ের শব্দ আর শন্ শন্ বাতাসের শব্দ।
আরো দুটো ঘোড়া নামানো হল। সে ঘোড়া দুটোয় চড়ল সেনাপতি আর একজন রাজার দেহরক্ষী।
রাজা তলোয়ার উঁচিয়ে আক্রমণের ইঙ্গিত করল। সব সৈন্য আস্তে আস্তে খাপ থেকে তলোয়ার খুলল যাতে কোনোরকম শব্দ না হয়।
রাজা উত্তর মুখে ঘোড়া আস্তে আস্তে চালালেন। সৈন্যরাও পেছনে পেছনে চলল। এত সৈন্যর চলা। একটু শব্দ হল।
রাজ্য রিকার্ডো সৈন্যদের সৈন্যাবাসে পৌঁছতে দেরি হল না। রাজারিকার্ডোর সৈন্যরা তখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।
হঠাৎ রাজা ফার্নান্দো তলোয়ার তুলে সৈন্যাবাস দেখাল। সঙ্গে সঙ্গে তার সৈন্যবাহিনী রাজা রিকার্ডোর সৈন্যদের আবাসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের হৈ হৈ চিৎকারে রাজা রিকার্ডোর সৈন্যরা ঘুম থেকে উঠে পড়ল। দেখল রাজা ফার্নান্দোর সশস্ত্র সৈন্যরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। পালাবার পথ নেই।দু-একজন পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু ফার্নান্দোর সৈন্যদের হাতে মারা পড়ল।
এবার শুরু হল একপেশে লড়াই। রাজা রিকার্ডোর সৈন্যরা মারা পড়তে লাগল। শুরু হল চিৎকার আর্তনাদ গোঙানি মৃত্যু। অস্ত্রহীন রাজা রিকার্ডোর সৈন্যরা পালাতে লাগল।
ওদিকে ফ্রান্সিসরা জেগে উঠেছে। সবাই কয়েদঘরের লোহার দরজার সামনে এসে ভিড় করে দাঁড়াল। অল্প আলোয় দেখল রাজা ফার্নান্দোর সশস্ত্র সৈন্যরা। নিরস্ত্র রাজা রিকার্ডোর সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। রাজা রিকার্ডোর সৈন্যরা নিরস্ত্র। তারা মরতে লাগল।
কয়েদঘরের পাহারাদার সৈন্যদের ওপর রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাহারাদার তিনজন সশস্ত্র। ওরা লড়াই চালাল। কিন্তু পারল না। দুজন ওখানেই মারা গেল। অন্য পাহারাদারটি গুরুতর জখম হয়ে কয়েদঘরের দরজার সামনে গড়িয়ে পড়ল। সেই পাহারাদারের কোমরেই গোঁজা আছে চাবির বড়ো রিংটা। ফ্রান্সিস এটাই চাইছিল। কয়েদঘরের দরজার দুপাশে মশাল জ্বলছিল। তারই আলোয় ফ্রান্সিস দেখল আহত পাহারাদারটি পাথরের বারান্দায় পড়ে আছে। ফ্রান্সিস লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়াল। আহত পাহারাদারের বুক পর্যন্ত হাত গেল। কিন্তু চাবির বড়ো রিংটা কোমরে গোঁজা। ফ্রান্সিস মেঝেয় শুয়ে পড়ল। তারপর পা বাড়াল পাহারাদারের কোমরে গোঁজা চাবির রিং-এর দিকে। আস্তে আস্তে ডানপাটা বাড়াতে বাড়াতে চাবির রিং-এর কাছে আনল। বুকে পায়ের বুড়ো আঙুলটা রিং-এর মধ্যে গলিয়ে জোরে টান দিল। চাবির রিংটা ঝাঁকুনি খেয়ে সরে এলো। কিন্তু পড়ে গেল না। ফ্রান্সিস তখন হাঁপাচ্ছে। ওদের সকলের মুক্তি নির্ভর করছে ঐ চাবির রিং-এর ওপর। ফ্রান্সিস আবার পা বাড়াল। আবার রিং-এর মধ্যে পা ঢুকিয়ে ঝাঁকুনি দিল। চাবির রিংটা কোমর থেকে খসে পাথুরে বারান্দায় পড়ে গেল।ঝং করে শব্দ হল। কিন্তু সৈন্যরা লড়াইয়ে ব্যস্ত। শব্দটা কারো কানে গেল না।
ফ্রান্সিস পা দিয়ে টেনে টেনে চাবির রিংটা কয়েদঘরের দরজার কাছে আনল। তারপর হাত দিয়ে টেনে কাছে আনল। হাত বাড়িয়ে কয়েদঘরের চাবিটা খুঁজতে লাগল। কিন্তু বারান্দার মশালের আলোয় দেখেও বুঝল না কোষ্টা কয়েদঘরের চাবি। হ্যারি বলল– ফ্রান্সিস আমাকেরিংটা দাও!ফ্রান্সিস রিংটা হ্যারির দিকে সরিয়ে দিল।হ্যারি খুবমনোযোগ দিয়ে চাবিগুলো একটা একটা করে সরিয়ে সরিয়ে চাবি খুঁজতে লাগল। মশালের আলোয় দেখল একটা লম্বা চাবি বেশ পরিষ্কার। বাকি চাবিগুলো কেমন ময়লা। কোনো কোনোটা আবার জংধরা। হ্যারি চাবিটা এগিয়ে আনল। বলল–ফ্রান্সিস–এই চাবি দেখো—কেমন পরিষ্কার। তার মানে এই চাবিটা নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। তাই ময়লা জমে নি। এটাই কয়েদঘরের তালার চাবি। ফ্রান্সিস চাবিটা নিল। কয়েদঘরের দরজাটা ফাঁক ফাঁক লোহার গরাদ দিয়ে তৈরি।
ফ্রান্সিস চাবিটা নিয়ে দরজার তালার কাছে এলো। গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে চাবিটা তালার মধ্যে ঢোকাল। একটু চাপ দিয়ে জোরে মোচড় দিতেই তালাটা শব্দ করে খুলে গেল। ভাইকিংরা মৃদুস্বরে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো।
সবাই কয়েদঘরের বাইরে চলে এলো। আগে যারা বন্দী ছিল তারা কয়েদঘর থেকে বেরিয়েই এদিক-ওদিক ছুটে পালাল।
ফ্রান্সিস বলে উঠল–ভাইসব, তোমরা আমাদের জাহাজে ফিরে যাও। আমি মারিয়াকে নিয়ে যাচ্ছি।হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস,তুমি জানোনা রাজকুমারী এখন কোথায়?
–না, জানি না। তবে খুঁজে বের করতে হবে। লড়াইর শেষে ফার্নান্দোর সৈন্যরা নিচ্ছুই রিকার্ডোর প্রাসাদ লুঠ করবে। তার আগেই আমি মারিয়াকে নিয়ে পালিয়ে জাহাজে যাবো।
-বেশ। তাই করো। আমরা জাহাজে ফিরে যাচ্ছি। হ্যারি বলল।
দল বেঁধে যেও না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাও। বোঝাই যাচ্ছে রাজারিকার্ডোর সৈন্যরা হেরে গেছে। এখন রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা বিশ্রাম করবে। এই সুযোগে পালাও। রাজা ফার্নান্দোর হাতে ধরা পড়লে বলবে রাজা রিকার্ডো আমাদের কয়েদঘরে বন্দী করে রেখেছিল। মুক্তি পেয়ে আমরা এখন আমাদের জাহাজে ফিরে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।
ভাইকিংরা সামনের প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর চলল জাহাজঘাটের দিকে। ফ্রান্সিস চলল। রাজপ্রাসাদের দিকে। ফ্রান্সিস প্রান্তরে নামল। চারপাশে তাকিয়ে দেখল পূর্বদিকে কিছু সৈন্য চলাফেরা করছে।
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমদিকে ঘুরে দাঁড়াল। দ্রুতপায়ে চলল রাজারিকার্ডোর প্রাসাদের দিকে। প্রাসাদের কাছে এসে ফ্রান্সিস প্রাসাদের সিংহদ্বারের দিকে গেল না। দূরে থেকে দেখল সিংহদ্বারের সম্মুখে রাজা ফার্নান্দোর সেনাপতি আর রাজার দেহরক্ষী দুটো ঘোড়ার চড়ে সিংহদ্বার পাহারা দিচ্ছে।
ফ্রান্সিস পেছনের দরজার দিকে গেল। রাজা রিকার্ডো পালালে পেছনের দরজা দিয়েই পালাবে।
ফ্রান্সিস পেছনের দরজার কাছাকাছি আসতেই দেখল দরজা খুলে গেল রাজবাড়ির গাড়ি বেরিয়ে এলো। ফ্রান্সিস সমস্যায় পড়ল। মারিয়া কি এই গাড়িতেই আছে? ফ্রান্সিস দ্রুত ভাবতে লাগল কী করবে এখন?
গাড়িটার দরজা জানালা বন্ধ। ফ্রান্সিস স্থির করল এই গাড়িটাই ধরতে হবে। ও গাড়িটার পেছনে পেছনে ছুটল। ততক্ষণে রাজা ফার্নান্দোর সেনাপতি আর দেহরক্ষী গাড়িটা দেখতে পেয়েছে। ওরা ঘোড়া ছুটিয়ে এলো। ফ্রান্সিস দ্রুত ছুটে গিয়ে দেহরক্ষীর ঘোড়ার রেকাবে রাখা বাঁপাটা ধরে মুচড়ে দিল। দেহরক্ষী ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস এবার পা ধরে প্রাণপণে হাল্কা টান দিল। দেহরক্ষী হুড়মুড় করে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। পায়ের বাথায় কেঁকাতে লাগল। ফ্রান্সিস দ্রুত ঘোড়ার পিয়ে উঠে বসল। ঘোড়া চালাল রাজা রিকার্ডোর গাড়ির পেছনে।
ফ্রন্সিসের সামনে ঘোড়ায় ছুটে চলছে সেনাপতি। তার পেছনে ফ্রান্সিস ঘোড়াছুটিয়ে চলেছে। সেনাপতির হাতে খোলা তলোয়ার। বুকে বর্ম। মাথায় শিরস্ত্রাণ। ফ্রান্সিস নিরস্ত্র শুধু নিরস্ত্র নয়।কয়েদঘরে কিছুদিন কাটিয়ে আর ঐ অখাদ্য খাবার খেয়ে শরীরও দুর্বল।
ফ্রান্সিস দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে সেনাপতির চলন্ত ঘোড়ার পাশে এলো। সেনাপতি ফ্রান্সিসকে লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল। ফ্রান্সিস দ্রুত সরে গেল। এবার ফ্রান্সিস সেনাপতিকে ছাড়িয়ে গাড়িটার কাছে এলো। তখনও ফ্রান্সিসের মনে দ্বন্দ্ব। মারিয়া কি এই গাড়িতে আছে না প্রাসাদেই রয়ে গেছে।
চলন্ত গাড়ির পাশে এলো ফ্রান্সিস। গাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। ফ্রান্সিস হাঁপাচ্ছে তখন। গলা চড়িয়ে ডাকল–মারিয়া। গাড়ির ভেতর থেকে মারিয়াও গলা চড়িয়ে ডাকল–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিসের মুখে হাসি ছুটল। ওর আন্দাজই ঠিক। ফ্রান্সিস মনে অনেক জোর পেল। যাক্–মারিয়া সুস্থ আছে। এতক্ষণে রিকার্ডোর প্রাসাদ নিশ্চয়ই আক্রান্ত হয়েছে। অন্তঃপুরেও লুঠ চলছে। মারিয়া ওখানে থাকলে বেঁচে থাকতো কিনা সন্দেহ।
ফ্রান্সিস পিছিয়ে এলো। সেনাপতিকে তাড়াতে হবে। সেনাপতির কাছে এসে ঘোড়া চালাতে লাগল। দেখল সেনাপতি তলোয়ার কোষে ধরে রেখেছে। ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বাঁধা চাবুকটা বের করেছে। ফ্রান্সিস কাছাকাছি আসতেই সেনাপতি চাবুক হাঁকাল। ফ্রান্সিসের পিঠে চাবুকের মার লাগল। পিঠটা জ্বালা করে উঠল। সেনাপতি আবার চাবুক চালাল। এবার চাবুকের মারটা লাগল গলার কাছে। গলার কাছে জ্বালা করে উঠল। চাবুকের পরের মারটা ফ্রান্সিসের গায়ে লাগল না। কারণ ফ্রান্সিস তখন অনেকটা সরে গেছে। সেনাপতি ডান হাতে চাবুক ঘোরাতে লাগল। আবার চাবুকহাঁকাল। ফ্রান্সিস দ্রুত হাতে চাবুকটা ধরে ফেলল। তারপর সেনাপতি কিছু বোঝার আগেই চাবুকটা চেপে ধরে শরীরের সব শক্তি নিয়ে মারল হ্যাঁচকা টান। সেনাপতি ঘোড়ার পিঠে টাল খেল।ফ্রান্সিস আবার সজোরে মারল টান। সেনাপতি ঘোড়ার পিঠ থেকেছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস আর দাঁড়াল না। ঘোড়া ছুটিয়া চলল।
রাজা রিকার্ডোর গাড়ির পাশে এলো।
তখনই ফ্রান্সিস দেখল একদল সৈন্য ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। ফ্রান্সিস দেখেই বুঝল ফার্নান্দোর সৈন্য ওরা। রাজা রিকার্ডোর সৈন্যাবাসের ঘোড়াশাল থেকে ঘোড়া জোগাড় করেছে। তারপর ঘোড়া চালিয়ে রাজা রিকার্ডোকে ধরতে আসছে। ফ্রান্সিস বুঝল গাড়ির গতি বাড়াতে না পারলে ধরা পড়তে হবে।
ফ্রান্সিস একটু এগিয়ে কোচম্যানকে ইঙ্গিতে নেমে আসতে বলল। কোচম্যান চলন্ত গাড়ি থেকে এখানে ওখানে পা রেখে নেমে আসতে ফ্রান্সিস তাকে নিজের ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিল। নিজে গাড়ির পাদানিতে পা রেখে তারপর কোচম্যানের মতো কয়েকটা জায়গায় পা ফেলে ফেলে কোচম্যনের আসনের কাছে এলো। আসনে বসেই কোচম্যানের রেখে যাওয়া চাবুকটা ধরল। ততক্ষণে ফ্রান্সিসের গাড়ির গতি কমে গেছে। ফ্রান্সিস ঘোড়া দুটোরপিঠেচাবুক মেরে বলে উঠল–তুমি ভাই যেভাবে পারো পালাও, কোচম্যান বাঁদিকে ঘোড়ার মুখ ঘোরাল। তারপর প্রাণপণে ঘোড়া ছোটাল।
ফ্রান্সিস একবার পেছন দিকে তাকাল। দেখল ফার্নান্দোর সৈন্যরা ছুটে আসছে। ওরা অনেকটা এগিয়ে এসেছে। তখনই দেখল সৈন্যদের আগে রাজা ফার্নান্দো নিজে ঘোড়া চালাচ্ছে। ফ্রান্সিস স্থির করল ধরা দেবে না।
ফ্রান্সিস কোচম্যানের পাদানির ওপর ভর রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর ঘোড়া দুটোর পিঠে চাবুক মেরে চলল। গাড়ির গতি বাড়ল। একটু পরেই দেখল নিজেদের গাড়িটা অনেকটা এগিয়ে এসেছে। আবার চাবুক মারতে লাগল। গাড়িটা আরো এগিয়ে গেল। ফার্নান্দো বেশ পেছনে পড়ে গেছে।
তখনই ডানদিকে একটা টিলামতো দেখা গেল। টিলাটার মাথা ন্যাড়া। টিলার নীচে ছাড়া ছাড়া ছোটো ছোটো জংলা গাছ। তারপরেই উঁচু উঁচু গাছ টিলার তলা পর্যন্ত বিস্তৃত।
ফ্রান্সিস দ্রুত গাড়ি ডানদিকে ঘোরাল। ছোটো ছোটো গাছপালার ওপর দিয়ে গাড়ি চলল। বড়ো বড়ো গাছগুলো আসতেই ফ্রান্সিস গাড়ি থামাল। তারপর সন্তর্পণে গাড়ি চালিয়ে কয়েকটা বড়ো গাছের আড়ালে এসে গাড়ি থামাল।
কোচওয়ানের জায়গা থেকে নেমে এলো। গাড়ির বন্ধ জানালার কাছে এসে গলা চড়িয়ে বলল-মানবের রাজা রাজা ফার্নান্দো কয়েকজন সৈন্য নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে আমাদের পিছু ধাওয়া করছে। আমি গাড়িটা একটা উঁচু টিলার আড়ালে এক জঙ্গলে এনেছি। মনে হয় ওদের দৃষ্টি এড়াতে পারবো। রাজা একটু ভগ্ন গলায় বলল–গাড়ি চালিয়ে ওদের নাগাল থেকে পালানো যায় না।
ফ্রান্সিস বলল না। আমাদের গাড়ির ঘোড়া দুটো খুবই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। ওরা তো শুধু ঘোড়া চালিয়ে আসছে। আমাদের ঘোড়া দুটোকে একটা গাড়ি আর আরোহীদের টেনে আনতে হয়েছে।
হু। মনে হয় আমরা ওদের হাত থেকে পালাতে পারবো না। রাজা বললেন।
–সেইজন্যেই এইভাবে আড়াল নিয়ে এড়াবার চেষ্টা করলাম। এখন দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইল।
একটু পরে রাজা ফার্নান্দো আর পাঁচজন সৈন্য টিলার কাছে এলো। সম্মুখে তাকিয়ে দেখল পাথর ছড়ানো রাস্তা সোজা চলে গেছে। রাজা রিকার্ডোর গাড়িটা বেপাত্তা।
ফার্নান্দো ঘোড়া থামালেন। সৈন্যরাও ঘোড়া থামাল। ফার্নান্দো বললেন– যেভাবে একটা গাড়ি আরোহীসমেত শুন্যে মিলিয়ে যেতে পারেনা।ওরা এখানে কোথাও গাড়িসুদ্ধ নিজেরাও গা ঢাকা দিয়েছে। টিলার ওপাশটা খোঁজ।
সৈন্যরা ঘোড়া থেকে নামল। চলল টিলার পেছন দিকে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে খুঁজল। টিলাটার ঠিক নীচেই ঘন বনটায় ঢুকতে পারল না। এত ঘন জঙ্গল। ওরা ফিরে এলো। রাজাকে এসে বলল সব।
এবার রাজা ফার্নান্দো ঘোড়া থেকে নামালেন।তলোয়ার বের করলেন। তলোয়ারটা উঁচিয়ে ধরে প্রথমে ছোটো ছোটো গাছের ডালপালা কেটে কেটে এগিয়ে গেলেন টিলাটার নীচের জঙ্গলের দিকে। পেছনে পাঁচজন সৈন্য। বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ি কাণ্ড ডালপালা সব মিলিয়ে বেশ ঘন বন।
আর ঢোকা গেল না। রাজা ফার্নান্দো তবুঐ জায়গারই আশেপাশে খুঁজতে লাগলেন।
তখনই হঠাৎ ঘোড়ার মৃদু ডাক শোনা গেল। রাজা থককে দাঁড়িয়ে পড়ল। কান পেতে রইল। আবার ঘোড়ার ডাক। আগের চেয়ে একটু জোরে। বাঁদিক থেকে ডাক শোনা গেল।
রাজা ফার্নান্দো সঙ্গে সঙ্গে বাঁদিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। তলোয়ার লতাপাতা ডাল কাটার জন্যে খোলাই ছিল। খোলা তলোয়ার নিয়ে ফার্নান্দো ঘোড়ার ডাকের দিক স্থির করে চলল। সৈন্য পাঁচজনও চলল। ফার্নান্দো সাবধান হলেও পায়ের নীচে শুনো ডালপাতা ভাঙার শব্দ হতে লাগল।
হঠাৎ গাড়ি চলার শব্দ হল। ফার্নান্দো চিৎকার করে বললেন–গাড়ি আটকাও। ফার্নান্দোর সঙ্গে পাঁচজন সৈন্যও ছুটল।.
একটু এগোতেই দেখল গাড়িটা জোরে চালাবার চেষ্টা করছে কোচওয়ান। সৈন্যরা ছুটে গিয়ে গাড়ির চাকা ধরে ফেলল। গাড়ি থেমে গেল।
রাজা ফার্নান্দো এগিয়ে গেলেন। গাড়ির দরজা খোলার ইঙ্গিত করলেন। একজন সৈন্য ছুটে গিয়ে গাড়ির জানালা খুলতে চেষ্টা করল। পারল না। সঙ্গী সৈন্য দুজন এগিয়ে এলো। তার মানে ওরা জানালা ভেঙে ফেলবে।
ফ্রান্সিস কোচওয়ানের আসন থেকে নীচে নেমে এলো। বলল–জানালা ভাঙবেন না। আমি খোলবার ব্যবস্থা করছি। সৈন্য তিনজন দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস বন্ধ জানালার গায়ে মুখে নিয়ে বলল–মান্যবর রাজা–আমরা ধরা পড়ে গেছি। একটা ঘোড়া ডেকে উঠেছিল বলে। যাকগে–রাজা ফার্নান্দো সামনেই কয়েকজন সৈন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা ধরা পড়ে গেছি। আপনার জানালা খুলে দিন।
একটু পরেই জানালা খুলে গেল। দেখা গেল রাজা রিকার্ডো রানি রাজকুমারী আর মারিয়া গাড়িতে বসে আছে।
রাজা ফার্নন্দো গাড়ির জানালার কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন–রিকার্ডো– আজাকে তোর নিস্তার নেই। থেমে আয়। শুধু দুজনের লড়াই। দেখা যাক কে বাঁচে কে মরে। রিকার্ডো দুর্বলকণ্ঠে বললেন–আমি আহত। আমাকে সুস্থ হতে দে। তারপর যেখানে খুশি আমাকে ডাকলেই একা লড়তে যাবো।
না না। আজকেই ফয়েসলা হবে। ফার্নান্দো খোলা তলোয়ার ঘুরিয়ে বললেন বাইরে আয়।
রানী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। মারিয়া রাজকুমারকে কোলে বসান। রাজা রিকার্ডো আস্তে আস্তে উঠলেন। গাড়ি থেকে নেমে এলেন।
রাজা রিকার্ডোর মাথায় মুকুট নেই। কাঁচাপাকা লম্বা লম্বা চুল কপাল পর্যন্ত নেমে এসেছে। মাথার পেছনের লম্বা চুল নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত। চোখ দুটো লালচে। ঘুমুতে পারেন নি বলে অথবা কেঁদেছেন–নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে।
সম্রাটের রাজকোষ রাজা ফার্নান্দো চেয়ে চেয়ে দেখলেন। পট্টি বাঁধা জায়গাটা দেখলেন। তারপর বললেন তলোয়ার বের কর। আজ দুজনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ। রিকার্ডো আস্তে আস্তে কোমরের খাপ থেকে তলোয়ার বের করলেন।
রাজা ফার্নান্দোঝাঁপিয়ে পড়লেন। রিকার্ডো কোনোরকমে মারটা ঠেকালেন তলোয়ার দিয়ে।
হঠাৎ ফ্রান্সিস ছুটে এসে দুজনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ান। ফার্নান্দো একটু অবাকই হলেন। বললেন–দ্বন্দ্বযুদ্ধ হচ্ছে। তুমি সরে যাও। ফ্রান্সিস ফার্নান্দোকে আস্তে আস্তে বলল–মান্যবর রাজা–এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের ফলাফল কী হবে তা এখানে উপস্থিত সবাই জানে। দ্বন্দ্বযুদ্ধ বলে নিজের আপনি সান্ত্বনা দিচ্ছেন। একে সুযোগ বুঝে হত্যা করা বলা যায়। যে মানুষটা তলোয়ার পর্যন্ত তুলতে পারছেন না আপনি তার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমেছেন। এটা অমানবিক।
–তুমি সরে যাও। দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলবে। ফার্নান্দো বললেন।
–হ্যাঁ দ্বন্দ্বযুদ্ধই চলবে। তরে রাজা রিকার্ডোর জায়গায় লড়বো আমি। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা ফার্নান্দো হাহা করে হেসে উঠলেন। বললেন–তার আগে আমার দেহরক্ষীদের সঙ্গে লড়ো। তারপর আমার সঙ্গে লড়বে।
–ঠিক আছে। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
–আমার দেহরক্ষীরা কিন্তু সাধারণ সৈন্য নয়। শ্রেষ্ঠ যোদ্ধরাই আমার দেহরক্ষী হয়। রাজা ফার্নান্দো বললেন।
–পরোয়া নেই। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
তখনই মারিয়া চিৎকার করে ডাকল–ফ্রান্সিস–শান্ত হও।
–উপায় নেই মারিয়া। একজন আহত মানুষকে খুন করা চোখে দেখি কী করে। ভেবো না–আমি জয়ী হবোই। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসের চারপাশে পাঁচজন দেহরক্ষী খোলা তলোয়ার নিয়ে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস রিকার্ডোকে গিয়ে বলল–
মান্যবর–আপনার তলোয়ারটা দিন।
কিন্তু তুমি আমার জন্যে
— হ্যাঁ–আপনার জন্যেই লড়বো।
রাজা রিকার্ডো তরোবারিটা ফ্রান্সিসকে দিলেন। কিছু বললেন না। মাথা ঝুঁকিয়ে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে এদিকে-ওদিকে নাড়ালেন।
ফ্রান্সিস তলোয়ারটা নিয়ে একটুক্ষণ চোখ বুজে রইল। তারপর চোখ খুলে তৈরি হয়ে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের তখন অন্য চেহারা। রুখে দাঁড়াল ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিসের সে এক রুদ্রমূর্তি।
শুরু হল তলোয়ারের যুদ্ধ। ফ্রান্সিস বিদ্যুৎবেগে ঘুরে ঘুরে দেহরক্ষীদের সঙ্গে। তলোয়ারের লড়াই চালাল। একজন দেহরক্ষী সুযোগ বুঝে ফ্রান্সিসের বুকে লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল। সরে আসতে গিয়েও তলোয়ারটা ফ্রান্সিসের বুকের ওপর দিয়ে ঘেঁষ্টে গেল। জামা কেটে গেল। শরীরও কেটে গেল। রক্ত বেরিয়ে এলো। জামা খোলা। ফ্রান্সিস মুহূর্তে সেই দেহরক্ষীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রক্ত দেখে ফ্রান্সিসের মাথায় যেন খুন চেপে গেল। প্রচণ্ড জোরে তলোয়ার চালাল। দেহরক্ষীর ঘাড়ের ওপর পড়ল সেই মার। দেহরক্ষী উবু হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এপাশ-ওপাশ করতে লাগল।
এবার দুজন দেহরক্ষী ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস তৈরি ছিল।
দ্রুত হাতে তলোয়ার চালাল। একজনের হাত কেটে গেল। ও বসে পড়ল হাত থেকে তলোয়ার খসে পড়ে গেল। অন্যজনের পিঠে তলোয়ার গভীরভাবে বসে গেল। সে উবু হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
রাজা ফার্নান্দো গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন থামো।
ফ্রান্সিস তলোয়ার নামাল। বাকি দুজন দেহরক্ষী ভীতমুখে সরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস তখন মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে।
ফার্নান্দো তারোয়াল কোষবদ্ধকরলেন। গলা চড়িয়ে বললেন–আমার সিদ্ধান্ত আমি জানাচ্ছি।
রিকার্ডোকে সেভিল নিয়ে যাবো। একটা কয়েদঘরে সারা জীবনের জন্য বন্দী হয়ে থাকতে হবে।
–আর রানি ও রাজকুমার? ফ্রান্সিস বলল।
–তারা এখানকার প্রাসাদে থাকবে। তাদের সঙ্গে তো আমার শত্রুতা নেই। ফার্নান্দো। বললেন।
রানিমা গলা চড়িয়ে বললেন–আমি রাজপ্রাসাদে থাকবো না। ছেলেকে নিয়ে আমি স্বামীর সঙ্গে থাকবো। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন।
রাজা ফার্নান্দো দুহাতে ছড়িয়ে হতাশার ভঙ্গি করলেন। বললেন, ঠিক আছে আপনি যা চান তাই হবে। আপনার এখন প্রাসাদে ফিরে যান। কালকে সেভিলে ফিরে যাবার সময় রিকার্ডোকে নিয়ে যাবো।
রানিমা বললেন, আমরাও যাবো।
বেশ যাবেন। তারপর দুই আহত দেহরক্ষীকে বললেন তোমরা এখানকার কৃষকদের বাড়িতে যাও। একটা ঘোড়ার টানা গাড়ি জোগাড় করো। আহতদের নিয়ে ক্যামেরিনালে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।
রাজা ফার্নান্দো ধবধবে সাদা ঘোড়াটার রেকাবে পা রেখে লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়লেন। তারপর ঘোড়া ছোটালেন ক্যামেরিনালের দিকে।
রাজা রিকার্ডো আস্তে আস্তে রাজবাড়ির গাড়িতে উঠলেন। রানি কোনো কথা বললেন না, বার বার চোখ মুছলেন, মারিয়া রাজকুমারকে জড়িয়ে ধরে রইল।
ফ্রান্সিস কোচওয়ানের জায়গায় উঠে বসল। তারপর ঘোড়া দুটোর পিঠে চাবুক মারল। ঘোড়া দুটো ছুটল। গাড়ি কিছুটা দ্রুতই চলল। ওর গাড়ি চালানো দেখে রাজা রিকার্ডো বললেন ফ্রান্সিস বোধহয় একসময় কোচওয়ানের কাজ করেছে। ফ্রান্সিস এবার ঘোড়াদুটোর এপাশে-ওপাশে চাবুক হাঁকালো। গাড়িটা আরো দ্রুতগতিতে ছুটল।
একসময় ফ্রান্সিস দেখল একজন অশ্বারোহী ওদের গাড়ির দিকে ছুটে আসছে। কাছাকাছি আসতে ফ্রান্সিস চিনল–এই গাড়ির কোচওয়ান।ফ্রান্সিস হেসে গলা চাড়িয়ে বলল,–তাহলে বেঁচে আছে। কোচওয়ান হেসে বলল–হ্যাঁ। ঘোড়া নিয়ে একটা তুলাক্ষেতে ঢুকে পড়েছিলাম। যাব তোরাজারানি কেমন আছেন?
–ভালো। তবে আর বোধহয় ভালো থাকতে পারবেন না। রাজা ফার্নান্দো রাজা রিকার্ডোকে সেভিলে নিয়ে গিয়ে চিরদিনের জন্য কয়েদঘরে বন্দী করে রাখবে বলেছে। ফ্রান্সিস বলল।
-বলেন কি? কোচওয়ান বলল।
–হ্যাঁ-এটাই রাজা ফার্নান্দোর পরিকল্পনা। যাকগে সবই শুনবে জানবে। এখন ভাই, তুমি কিছুক্ষণ গাড়ি চালাও। গাড়িতে গিয়ে উঠেকিছুক্ষণ বিশ্রাম করবো। বড়ো পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। ফ্রান্সিস গাড়ির গতি কমাল। কোচওয়ান ঘোড়া থেকে নামল। ঘোড়াটার গলার সাজে একটা দড়ির মুখ বাঁধল। তারপর দড়ির অন্য মুখটা গাড়ির পেছনে বাঁধল। ঘোড়াটা গাড়িটার সঙ্গে সঙ্গে চলল।
কোচওয়ান গাড়িতে উঠল। ফ্রান্সিস ততক্ষণে নেমে পাদানিতে পা রেখেছে। গাড়ির দরজায় টোকা দিয়ে ঢাকল মারিয়া। গাড়ির ভিতর থেকে মারিয়া বলল-বলো। দরজা খোলো। আমি গাড়ির ভেতরে বসবো। খুব ক্লান্ত আমি। ফ্রান্সিস বলল।
গাড়ির দরজা খুলে গেল। ফ্রান্সিস ভেতরে ঢুকে মারিয়ার পাশে বসল। দেখল রাজা রিকার্ডো গম্ভীর মুখে বসে আছেন। চোখ দুটো লাল। বোঝা গেল–উনি কেঁদেছেন। রানি তো কেঁদে কেঁদেই চলেছেন। কিশোর রাজকুমার কিছুই বুঝতে পারছে না–এখন কী করবে। ছোটো রাজকুমার মারিয়ার গা ঘেঁষে বসে আছে। মারিয়া মাঝে মাঝে ওর কপালে গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
ফ্রান্সিস নিম্নস্বরে বলল–মাননীয় রাজা–এখন আর গাড়ির দরজা জানালা বন্ধ রেখে কী হবে? জানালা খুলে দেব?
দাও। রাজা রিকার্ডোর গম্ভীর কণ্ঠস্বর। মারিয়া জানালাগুলো খুলে দিল। একটা শীতার্ত হাওয়া ছুটে এলো। গাড়ির মধ্যে আর গুমট ভাবটা রইল না।
–মহামান্য রাজা–এখন আপনি কী করবেন? ফ্রান্সিস বলল? রাজা রিকার্ডো একবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। দেখলেন তাকে ও রানীকে দেখতে লোজন ছুটে আসছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালেন। বললেন–আমার ছোটো ভাই ফার্নান্দো তো আমার ভাগ্য নির্ধারণ করে গেছে। আমাকে আর মাননীয়া রানি, রাজকুমার! রানি বলে উঠলেন–আমরাও রাজার সঙ্গে ঐ বন্দীশালায় থাকবো। যতদিন বাঁচবো ততদিন।
রাজপ্রাসাদের প্রশস্ত পাথর বাঁধানো চত্বরে গাড়ি এসে দাঁড়াল।
রাজা রানি রাজকুমার নামল। রাজপ্রাসাদের কয়েকজন পরিচায়ক এগিয়ে এলো। রাজা বিকার্ডো কোনোদিকে না তাকিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। নিজের শয়ন কক্ষে গিয়ে বিছানায় বসলেন। বাঁ হাতের কাটা জায়গাটার ব্যথা আরও বেড়েছে। কিন্তু তিনি রাজবদ্যিকে ডেকে পাঠালেন না। ব্যথা বেদনা সহ্য করতে লাগলেন।
রানি রাজকুমারকে সঙ্গে নিয়ে নিজের শয়নকক্ষের দিকে যাচ্ছেন তখনই সব। পরিচায়িকারা দল বেঁধে এলো। ওরা বলল–রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা তাদের এখানকার ঘরগুলোতে বন্দী করে রেখেছিলেন। দিন তিনেকতাদের শুধু জল খেতে দেওয়া হয়েছিল। তিন দিন ওরা না স্নান না খাওয়া। ওদের ঘর থেকে বেরোবার হুকুম ছিল না।
তিন দিন পর ওদের ওপর শাসন একটু শিথিল হল।
পরিচারিকাদের স্নান করতে দেওয়া হয় খেতে দেওয়া হয়। তিন দিনের বন্দী দশা থেকে ওরা মুক্তি পায়। রাজা রানি আর রাজকুমারকে ফিরে পেয়ে রাজপ্রাসাদের পরিচারক পরিচারিকারা খুব খুশি। আনন্দে তারা প্রায় নাচানাচি শুরু করল। কিন্তু যখন শুনল রাজাকে রাজা ফার্নান্দো সেভিলে নিয়ে গিয়ে চিরজীবনের জন্যে বন্দী করে রাখবে তখন তাদের কষ্টে বুক ভেঙ্গে গেল। সেই বন্দীশালায় রানি ও তার ছেলেকে নিয়ে থাকবেন এটাও তারা শুনল। ওরা ভেবেছিল রাজা রানি রাজকুমার ফিরে এলেন। ওরা সেই উপলক্ষ্যে আনন্দে উৎসব করবে। এখন এসব জেনে ওরা মনমরা হয়ে গেল।
ওদিকে রাজা ফার্নান্দোর হুকুমে সেনাপতিসহ সব সৈন্যরা প্রান্তরে সমবেত হল।
রাজা ফার্নান্দো এলেন। পরনে যুদ্ধের পোশাক নয়। ঢোলা হাতা গভীর রঙের। আলখাল্লা মতো। গলায় ঝুলছে মুক্তোর মালা। আর কোনো অলঙ্কার নেই।’
সৈন্যরা তাকে দেখে তার নামে জয়ধ্বনি করল। রাজা ফার্নান্দো ডালা চড়িয়ে বলতে লাগলেন–আমার দেশপ্রেমিক সৈনিকরা–যুদ্ধে আমাদের জয় হয়েছে। এখন তোমাদের যা করণীয় তা বলছি। আমি কাল সকালে রিকার্ডোর শৌখিন জাহাজে চড়ে দেশে ফিরে যাব। একটা যুদ্ধজাহাজ আমার সঙ্গে যাবে। তাতে অর্ধেক সৈন্যদল যাবে। বাকিরা এখানে থাকবে। আমি চলে গেলে আমাদের সেনাপতির হাতে আমার সব ক্ষমতা দিয়ে যাবো। সেনাপতিই আমার প্রতিনিধিরূপে এখানে রাজত্ব করবে। তোমরা তার হুকুম মেনে চলবে। রিকার্ডোর আহত সৈন্যদের এখানকার সৈন্যাবাসে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা চলছে। বাকিরা তিনটি কয়েদঘরে বন্দী হয়ে আছে। এখন না পরে ভেবে দেখছি তাদের নিয়ে কী করা যায়। রাজা ফার্নান্দো থামলেন। তারপরে আবার বলতে লাগলেন- গুপ্তচরেরা খবর এনেছে মালাগার শাসনকর্তা ডিসিলভা এই ক্যামেরিনাল আক্রমণ করার জন্যে সৈন্য বাহিনীকে তৈরি করছেন। কাজেই আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। একটু থেমে বলতে লাগলেন– এক সপ্তাহের মধ্যে শৌখিন জাহাজটা ফিরে আসবে। রিকার্ডোকে বন্দী করে সেভিল নিয়ে যাবে। সেখানে তাকে কয়েদঘরে সারা জীবনের জন্যে বন্দী করে রাখা হবে। আজ যে আদেশগুলি দিয়ে গেলাম তাই তোমাদের পালন করতে হবে। রাজা ফার্নান্দো থামলেন। সৈন্যরা মুক্তকণ্ঠে রাজা ফার্নন্দোর জয়ধ্বনি দিল।
পরদিন সকালে জাহাজঘাটে রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা জড় হল। সেনাপতি ঘোড়া চড়ে সব তদারকি করছে। সেনাপতি সৈন্যদের দুটো ভাগ করল। একদল ফার্নান্দোর সঙ্গে সেভিল ফিরে যাবে। অন্যদল এখানে থাকবে।
একটু বেলা হতে রাজা ফার্নান্দো ঘোড়ায় চড়ে জাহাজঘাটে এলেন। সৈন্যরা তার জয়ধ্বনি করল। রাজা ফার্নান্দো হাত নেড়ে সৈন্যদের উৎসাহিত করলেন। তারপর ঘোড়া থেকে নেমে শৌখিন জাহাজ থেকে পাতা পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে জাহাজ উঠলেন। যে সৈন্যরা সেভিল দিয়ে যাবে তারাও পাতা পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যুদ্ধজাহাজটায় উঠল।
কিছুপরে দুটো জাহাজই যাত্রা শুরু করল। সেদিন জোরে বাতাস বইছিল। জাহাজদুটোর পালগুলো সেই হাওয়ায় দ্রুত চলল সমুদ্রের জলের বিন্দুর মতো হয়ে গেল। তারপরই দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। ফার্নান্দোর সৈন্যরা তখনও ঘাটে দাঁড়িয়ে রইল। সেনাপতির উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল–সৈন্যাবাসে ফিরে চলো। সৈন্যরা সারি বেঁধে দাঁড়াল। তারপর চলল সৈন্যাবাসের দিকে।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো দাঁড়িয়ে এই ঘটনা দেখল। ফার্নান্দোর সৈন্যরা যখন সার বেঁধে ফিরে এলো ওরাও তখন ফিরে এলো রাজপ্রাসাদে। ওখানেই একটা ঘরে ওরা আশ্রয় নিয়েছে।
পরদিন সকালেই দুজন সৈন্য নিয়ে সেনাপতি এসে হাজির। দরজায় ধাক্কা দিল সঙ্গী সৈন্যদের একজন চেঁচিয়ে বলল–এই বিদেশি ভূতেরা–দরজা খোল।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কোর আগেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দরজায় ধাক্কা দেওয়া চলল। শাঙ্কো উঠল। আস্তে আস্তে গিয়ে দরজা খুলল! সেনাপতি আর সৈন্যরা হুড়মুড় করে ঢুকল। সেনাপতি বলল–চলো–তোমরা বন্দী! তোমাদের কয়েদঘরে থাকতে হবে। ফ্রান্সিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–আর কতবার কয়েদঘরে ঢুকবো। আমরা যাবো না।
তার মানে? সেনাপতি বলল।
–আমরা এখানেই থাকবো। শাঙ্কো বলল।
–এখন এখানে আমার কথাই আদেশ তা জানো? সেনাপতি বলল।
-হা হা জানি। ফ্রান্সিস বলল–রাজা ফার্নান্দো আপনাকে এখানকার শাসনকর্তা করে গেছে। কিন্তু সেটা আপনাদের সৈন্যদের ওপরে এখানকার অধিবাসীদের ওপরে। আমরা বিদেশি। আমাদের ওপর আপনার হুকুম চলবে না।
–কী বললে? সেনাপতি চেঁচিয়ে বলল। তারপর সৈন্যদুজনের দিকে তাকিয়ে বলল–এদের কয়েদখানায় নিয়ে যাও।
সৈন্য দুজন এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস একজন সৈন্যের বর্মের চামড়ার ফিতে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল। বর্ম মেঝেয় পড়ে গেল। সৈন্যটি অসহায়ভাবে সেনাপতির দিকে তাকাল। সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে তরবারি কোষমুক্ত করল। শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস ঝামেলা বাড়িও না। চলো কয়েদখানায়। যা বলছে শোনো।
–বেশ–চলো। দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সেনাপতি চলল কয়েখানার দিকে। প্রহরীরা দরজা খুলল। ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢোকাল। সেনাপতি তলোয়ার কোষবদ্ধ হয় করল।
ফ্রান্সিসদের একঘেয়ে দিন কাটতে লাগল।
ওদিকে রাজা রিকার্ডোর দিন কাটতে লাগল গভীর দুঃখে-বেদনায়। তাকে রাজপ্রাসাদে তার ঘরেই থাকতে দেওয়া হয়েছে। হাত বাঁধা নেই। তবু রিকার্ডোর মনে শান্তি নেই। কাঁধের ঘা খুবই কষ্ট দিয়েছে তাকে। এখন সুস্থ। কাটা ঘা সেরে গেছে।
রাজা রিকার্ডো বিছানায় চুপ করে বসে ভাবেন। ভাবেন আর ভাবেন। সেভিলে নিয়ে গেলে চিরজীবনের বন্দীদশা। এখানেই বা কম কি। তার কাছে কারো আসার হুকুম নেই। এই হুকুম সেনাপতির।রিকার্ডো মুক্তির উপায় ভাবতে লাগলেন। উত্তরের পাহাড়ি এলোকায় তলেদোবাসীরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধ। রাজা ফার্নান্দো হঠাৎই আক্রমণ করেছিল। তই তিনি তলেদোদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন নি। তাদের সাহায্য সহযোগিতা পেলে হয়তো আবার হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। কিন্তু কিভাবে যোগাযোগ করবেন? এখন তো তিনি বন্দী। তাঁর কাছে কারো আসার হুকুম নেই। রানি পর্যন্ত আসতে পারেন সারাজীবনে একবার সেনাপতির কড়া হুকুম।
হঠাৎই মনে পড়ে ফ্রান্সিসের কথা। ঋজু দেহ। বলিষ্ঠ যুবক। ওর সাহায্য পেলে তলেদোদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। কিন্তু যুবকটি এখন কোথায়? রাজা রিকার্ডো এসব ভাবছেন তখনই রানি ঘরে ঢুকলেন।বিছানায় এসে বসলেন। রিকার্ডো বললেন জানো একটা উপায়ের কথা ভাবছি। সফল হলে ফার্নান্দোর সৈন্যদের যুদ্ধে হারিয়ে আমি মুক্ত হতে পারবো।
উপায়টা কী? রানি বললেন।
উত্তরদিকে তলেদো উপজাতির থাকে। দুর্ধর্ষ যোদ্ধ ওরা। ওদের নিয়ে যুদ্ধেনামতে পারলে জয় সুনিশ্চিত। রাজা বললেন।
–কিন্তু তুমি তো বন্দী। ওদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবে? রানি বললেন।
–একটি যুবক। ভাইকিং ওরা। আমাদের উদ্ধার করল। রাজা বললেন।
হা হা–ওর নাম ফ্রান্সিস। ওদেশের রাজকুমারীই তো ফ্রান্সিসের স্ত্রী মারিয়া। রানি বললেন।
-তাই নাকি। তাহলে তো ভালোই হল। এই মারিয়াকে বলো ও যে ভাবেই হোক। ফ্রান্সিসের সঙ্গে যেন যোগাযোগ করে। রাজা বললেন।
–আচ্ছা বলবো। রানি বললেন।
নিজের শয্যাকক্ষে এসে রানি একজন পরিচারিকাকে পাঠালেন মারিয়াকে ডেকে আনতে। কিছু পরে মারিয়া এলো। রানি রাজার সব কথা বললে। তারপর বলল– ফ্রান্সিস এখন কোথায় তুমি জানো?
–না। তবে ফ্রান্সিসকে আর কোথাও পাওয়া না গেলে বুঝতে হবে কয়েদঘরে আছে। মারিয়া বলল।
–তাহলে সেখানেই একবার খোঁজ করো। রানি বললেন।
–দেখি। মারিয়া বলল।
–ফ্রান্সিসকে বলো আমাদের দেশে উত্তরদিকেতলেদো বলে একটা পাহাড়ি জায়গা আছে। তলেদোর অধিবাসীরা বীর যোদ্ধ। ওরা রাজারিকার্ডোকে শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে। রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা গভীর রাতে আক্রমণ করেছিল। তখন আমাদের সৈন্যরা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। রাজা রিকার্ডো যদি তলেদোদের সংবাদ পাঠাবার সময় পেতেন তাহলে যুদ্ধের ফল অন্যরকম হত। আমরা জয়ী হতাম। থাকগে–মারিয়া, তুমি ফ্রান্সিসের খোঁজখবর করো।
–দেখি চেষ্টা করে কোনো খবর পাই কি না। মারিয়া বলল।
সকালের খাবার খেয়ে মারিয়া একজন পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে এলো। চলল সৈন্যাবাসের দিকে। সৈন্যাবাসের সামনে আসতে একজন প্রহরী এগিয়ে এলো। বলল
–আপনার এখানে কেন?
কাজ আছে। মারিয়া বলল।
কার সঙ্গে কাজ? প্রহরী বলল।
–সেনাপতির সঙ্গে। মারিয়া বলল।
দাঁড়ান। সেনাপতিকে কী বলবো? প্রহরী বলল।
–বলবেন যে ভাইকিং দেশের রাজকুমারী দেখা করতে এসেছেন। মারিয়া বলল। প্রহরীটি একটা ছোটো ঘরের দিকে চলল। ঘরটায় ঢুকল। একটু পরে বেরিয়ে এলো। মারিয়াদের কাছে এসে বলল–আপনি যান।
মারিয়া ঘরটায় ঢুকল। দেখল রোগা সেনাপতি একটা কালো কাঠের বাঁকা পায়ের চেয়ারে বসে আছে। সামনে একটা পাথর বাঁধানো ছোটো টেবিল। তাতে কিছু কাগজপত্র। ওপাশে একটা খালি চেয়ার। সেনাপতি ইঙ্গিতে বসতে বলল। মারিয়া চেয়ারটায় বসল। সেনাপতি বলল–কী ব্যাপার?
–ব্যাপার এমন কিছু নয়। আমার স্বামী ফ্রান্সিস–সে এখন কোথায়? মারিয়া বলল।
–গুপ্তচরের যেখানে জায়গা হয় কয়েদখানায়। সেনাপতি বলল।
–ফ্রান্সিস বা আমরা কেউ গুপ্তচর নই। যাকগে ফ্রান্সিসের সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই। মরিয়া বলল।
–কেন? সেনাপতি বলল।
–আমাদের সোনার চাকতিগুলো আমাদের জাহাজের কোথায় আছে সেটা জানতে চাইব। ফ্রান্সিস ছাড়া আর কেউ এটা জানে না। মারিয়া বলল।
–হুঁ। সেনাপতি মাথা ওঠাল নামালো। তারপর বলল–এতে আমার আপত্তি নেই। প্রহরীকে সঙ্গে দিচ্ছি। ওর সামনে আপনারা কথা বলবেন। বুঝতেই পারছেন এখন আমাদের অনেক সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কথাটা শেষ করে প্রহরীকে ডাকলেন। সব নির্দেশ বুঝিয়ে দিল।
প্রহরী আগে আগে চলল। পেছনে মারিয়া আর পরিচারিকা। মারিয়া তখন ভেবে চলেছে কীভাবে প্রহরীটাকে এড়ানো যায়। ও গলা নামিয়ে সমস্যার কথাটা পরিচারিকাকে বলল। বলল ঐ প্রহরীকে যেভাবে পারো একটু দূরে সরাবে যাতে আমরা ভালোভাবে সব কথা বলতে পারি। পরিচারিকাটি খুবই চালাক। হেসে বলল– আপনি কিছু ভাববেন না। আমিই ওকে জব্দ করবো।
তিন চারটে কয়েদঘর ছাড়িয়ে প্রহরী একটা কয়েদঘরের সামনে এসে হাজির হল। পাহারাদারের একজনকে বলল–ঐ যে বিদেশি ভূতটা-ওটা কি এখানে আছে?
–হ্যাঁ। পাহারাদার বলল।
–ডাকো তো ওকে। সৈন্যটি বলল।
লোহার গরাদের ফাঁকে মুখ রেখে পাহারাদার ডাকল–এই বিদেশি ভূত তোকে ডাকছে। ততক্ষণে দরজার কাছে ভিড় জমে গেছে। অবাক হয়ে সবাইমারিয়াকে দেখছে। মারিয়ার খুব অস্বস্তি হতে লাগল।
ফ্রান্সিস একটু পরেই লোহার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। প্রহরীটি এগিয়ে আসতে যাবে তখনই পরিচারিকাটি প্রহরীটির প্রায় পথ আটকে দাঁড়াল। বলল–আচ্ছা আপনার দেশ কোথায় বলুন তো?
-কেন বলুন তো? প্রহরী বলল।
–মানে আমার মনে হচ্ছে আপনাকে আপনার গ্রামে দেখেছি। পরিচারিকাটি বলল।
–ও। আমাদের বাড়ি মার্সিয়ার হিন্তাল গ্রামে
পরিচারিকাটি হেসে উঠে হাততালি দিল। প্রহরীটিও হেসে উঠল।
মারিয়া একনজর ব্যাপারটা দেখে নিল। তারপর নিম্নস্বরে বলল–উত্তরদিকেতলেদো নামে এক উপজাতি বাস করে। তারা যুদ্ধে নিপুণ। তেমনি সাহসী। তারা রাজা রিকার্ডোকে ভালোবাসে ভক্তিও করে। রাজা রিকার্ডো এদের এনে যুদ্ধে লাগাতে পারেন নি। যুদ্ধে হেরে যান তিনি।
–ও। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল।
–এখন রাজা রিকার্ডো বললেন–তোমার কাছে এসে একথা বলতে রাজা চাইছেন। যদি তুমি কোনোভাবে তলদো উপজাতিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো আর ওদের এখানে আনতে পারো তাহলে এখানে আবার লড়াই হবে। রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা হেরে যাবে।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ চুপ করে রইল। ভাবল। বলল–এটা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। কিন্তু তার আগে তো এই কয়েদখানা থেকে মুক্তি চাই।
–হ্যাঁ–তোমাকে এখান থেকে পালাতে হবে। মারিয়া বলল।
–আগে সেই চেষ্টাটা করি। তুমি রাজাকে বলো গে আমি এখান থেকে পালাবার উপায়টা ভাবছি। যদি শেষ পর্যন্ত পালাতে পারি আমি তলেদোদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। আবার লড়াই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
তখনই প্রাসাদের প্রহরী মারিয়ার কাছে এলো। বলল–আপনার কথা হয়েছে?
–হ্যাঁ–মারিয়া বলল।
–তাহলে এবার আপনাকে ফিরে যেতে হবে। প্রহরী বলল।
–ঠিক আছে। চলো। মারিয়া বলল।
মারিয়া আর কোনো কথা ফ্রান্সিসকে বলল না। পরিচারিকাটি এলো। মারিয়া ওর সঙ্গে প্রাসাদে ফিরে এলো। রানিমাকে সব কথা বলল। রানিমা যেন একটু আশার আলো দেখলেন।
সন্ধেবেলা রানি রাজার শয়নকক্ষে এলেন। ফ্রান্সিসের সব কথা বললেন। রাজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–যুবকটি বলশালী। সাহসী। ও যদি ওর বন্ধুদের নিয়ে আমার হয়ে লড়াইয়ে নামে তবে ফার্নন্দোর সৈন্যরা হার স্বীকার করতে বাধ্য। রাজা বললেন।
–এখন তুমি একটা কাজ করো। ফার্নান্দোর সেনাপতিকে অনুরোধ করো উনি যেন ফ্রান্সিসকে মুক্তি দেন। রানি বললেন।
–অসম্ভব। আমি রাজা। রাজা হয়ে আমি একজন সেনাপতিকে অনুরোধ করতে পারি না। রাজা বললেন।
–তাহলে ফ্রান্সিসকে কয়েদঘর থেকে পালাতে হয়। কিন্তু সেটা খুবই কঠিন। রানি বললেন।
দিন কয়েক থাক। দেখা যাক ফ্রান্সিস পালাতে পারে কিনা। রাজা বললেন।
–হ্যাঁ–এখন আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া অন্যকিছু করণীয় নেই। রানি বললেন।
ওদিকে ফ্রান্সিস মারিয়ার সঙ্গে কথা বলে নিজের জায়গায় এলো। দেয়ালে ঠেসান দিয়ে বসল।শাঙ্কো এগিয়ে এলো।ফ্রান্সিসের পাশে বসে বলল –রাজকুমারী এসেছিলেন কেন? কী কথা হল? ফ্রান্সিস সব কথা বলল। শাঙ্কো বলল–এখন তো আমরা বন্দী। এখন আমরা কী করতে পারি।
–হ্যাঁ–সে কথাই তো বললাম। তবে যা বুঝতে পারছি এখান থেকে পালাবার একটা উপায় বের করতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–আচ্ছা ফ্রান্সিস–আমরা যদি সেনাপতিকে বলি–আপনি তো যুদ্ধে জিতে গেছেন। রাজার মতোই এখন আপনি ক্ষমতাধর। আমাদের দুজনকে মুক্তি দিন। আমরা আমাদের জাহাজে চলে যাবো। রাজকুমারীকে নিয়ে আমরা দেশের দিকে জাহাজ চালিয়ে চলে যাবো।
-কী বলছো শাঙ্কো? ঐ তালপাতার সেপাইয়ের কাছে মাথা নোয়াবো? ফ্রান্সিস বলল।
কার্যসিদ্ধির জন্য নানারকম চাল দিতে হয়। এও একটা চাল। এ চাল লাগলে ভালো না লাগলেও ক্ষতি নেই। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ভাবল। তারপর বলল
–আগে পালাবার উপায়টা ভাবতে হবে। এটা যখন বুঝবো যে পালাবার কোনো এক উপায় নেই তখন সেনাপতির সঙ্গে দেখা করে মুক্তি চাইতে যাবো। তার আগে নয়। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ–তাই করো। শাঙ্কো বলল।
ওদিকে মারিয়া রানি মারফৎফ্রান্সিসের সঙ্গে যা কথাবার্তা হয়েছে রাজাকে জানাল। সব শুনে রাজা রিকার্ডো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন
ফ্রান্সিসকে না পেলে কোনো কাজই হবে না।
–ঠিক আছে। আগে দেখো ফ্রান্সিস কয়েদঘর থেকে পালাতে পারে কি না। না পারলে এখন অন্যরকম কিছু ভাবা যাবে। রানি বললেন।
ওদিকে ফ্রান্সিস কয়েদঘরে থেকে পালাবার উপায় ভাবতে লাগল। কিন্তু কোনোটাই মনমতো হচ্ছে না। ও চাইছিল এমনভাবে পালাবে যাতে নরহত্যা না হয়। কিন্তু দু’ একজন পাহারাদারকে না হত্যা করলে পালানো যাবে না। কিন্তু ফ্রান্সিস অন্যভাবে ভাবতে লাগল। পাহারাদার কাউকে না মেরে পালাতে হবে।
শাঙ্কোও ভাবে। কিন্তু কুলকিনারা কিছু পায় না।
ফ্রান্সিস ও শাঙ্কো বাদে আর সবাই রিকার্ডোর সৈন্য। পালাবার কথা ওরাও ফ্রান্সিসদের বলে। কিন্তু কেউই কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না।
সেদিন রাজা রিকার্ডোর কয়েকজন সৈন্য ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল– পেছনের দেয়ালে একটা পাথর নড়ে গেছে। দেখতো সেটাকে খুলে ফেলা যায় কিনা। ফ্রান্সিস আধশোয়া ছিল। লফিয়ে উঠল। বলল শাঙ্কো চলো তো।
কয়েকজন সৈন্যের সঙ্গে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো পেছনের দেয়ালের কাছে এলো। সৈন্যরা পাথরের পাটাটা দেখাল। শাঙ্কো পাটাটার গায়ে হাতে রাখল। ধাক্কা দিল। সত্যিই একটু নেড়ে উঠেছে। এবার জোরে ধাক্কা দিল। পাটাটা আরো নড়ল। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে শাঙ্কো বলল–এটা খুলে ফেলা যাবে। একটু সময় লাগবে।
তাই করো। যত সময় লাগুক ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো ঢোলা জামার নীচে থেকে ওর ছোরাটি বের করল। তারপর পাথরের পাটাটার খাঁজে খাঁজে ছোরার মাথা ঢুকিয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাথরের পাটাটা অনেকটা আলগা হয়ে গেল। শাঙ্কো ছোরাটা ফ্রান্সিসকে দিল। হাঁপাতে লাগল। এবার ফ্রান্সিস পাথরের খাঁজে বন্দীরা মুক্তির আলো দেখতে পেল। তিন-চারজন একসঙ্গে পাথরের পাটাটায় ধাক্কা দিল। পাথরের পাটাটায় একটু শব্দ করেই খসে পড়ল। এবার দেয়াল ভাঙার ব্যাপারটা সহজ হল। একজনের পরে একজন বাকি পাটায় ধাক্কা দিতে লাগল। আলগা হয়ে পাথরের পাটা খসে পড়তে লাগ কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকাটা বড়ো হল। রিকার্ডোর সৈন্যরা হাঁক দিয়ে গেল এদিক-ওদিক ছুটে পালিয়ে গেল। কয়েদঘর শূন্য হয়ে গেল।
ফ্রান্সিস শাঙ্কো কয়েদঘরের বাইরে এলো। দুজনে এক ছুটে দূরে চলে এলো। শুনল ফার্নান্দোর সৈন্যরা চিৎকার চাচামেচি করছে। এতক্ষণে ওরা জানতে পেরেছে যে কয়েদঘর থেকে সব বন্দী পালিয়ে গেছে।
শাঙ্কো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–কী করবে এখন?
–উত্তরদিকে চলো। তলোদা উপজাতিদের গ্রামে যাবো। রাজা রিকার্ডোকে ওরা নাকি খুব শ্রদ্ধভক্তি করে। ওরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধ।ওদের এখানে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের বন্ধুদেরও নিয়ে আসতে হবে। তারপর ফার্নান্দোর সৈন্যদের বিরুদ্ধেলড়াই। ফ্রান্সিস বলল।
–ফার্নান্দোর সৈন্যরাও তো সংখ্যায় কম নয়।
–অর্ধেক চলে গেছে। বাকিদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামলে ওরা হার স্বীকার করতে বাধ্য হবে। ফ্রান্সিস বলল।
উত্তরদিকে প্রান্তরের পরেই শুরু হয়েছে জঙ্গল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো জঙ্গলে ঢুকল। বনতল খুব একটা অন্ধকার নয়। ভাঙা ভাঙা জ্যোৎস্না পড়েছে। গাছপালা খুব ঘন নয়।
দুজনে চলল বনের মধ্যে দিয়ে।
বনজঙ্গল শেষ। একটু দূর ওরা একটা পায়ে চলা পথ দেখতে পেল। সেই পথটা ধরে দুজনে চলল।
ফ্রান্সিস আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ সাদাটে হয়ে এসেছে। তার মানে ভোর হতে দেরি নেই।
সূর্য উঠল। ভোরের রোদ পড়ল পায়ে চলা পথটার ওপর। ওরা দুজনে হেঁটে কিছুটা এগোতেই সামনে দেখল এখানে-ওখানে কিছু বাড়িঘরদোর। মাটি মেশানে দেয়াল ছাউনি।
ফ্রান্সিসরা প্রথমেই যে বাড়িটা ছিল সেখানে এলো। বাড়ির বাইরে একটি স্বাস্থ্যবান যুবক বাড়ির লাগোয়া ক্ষেতে গাছগুলোয় জলটল দিচ্ছিল। ফ্রান্সিস তাকে ডাকল। যুবকটি বিদেশি লোক দেখে একটু অবাকই হল। হাতের বালতিটা রেখে ফ্রান্সিসদের কাছে এলো।
–তোমরা তো তলেদো জাতি? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। যুবকটি বলল।
তোমাদের গ্রামের মোড়লের সঙ্গে দেখা করবো। তুমি আমাদের নিয়ে যেতে পারবে? ফ্রান্সিস বলল।
কি ব্যাপার বলুন তো? যুবকটি বলল।
–সেটা তোমাদের মোড়লকে বলবো। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ। চলো। যুবকটি বলল।
যুবকটি আগে আগে চলল। ফ্রান্সিসরা পেছনে। রাস্তার ধারের বাড়িঘর থেকে লোকজন ওদের দেখতে লাগল। ওরা বোধহয় ভাবছিল এই বিদেশিগুলো কোত্থেকে এলো? এখানে কী করতে এসেছে?
একটা বড়ো বাড়ির সামনে এসে ওরা দাঁড়াল। যুবকটি বলল–এটাই মোড়লের বাড়ি। বাড়ির বাইরে লাঠি হাতে একজন পাহারাদার বসেছিল। যুবকটি এগিয়ে গিয়ে পাহারাদারকে কী বলল! পাহারাদার বাড়ির ভেতরে চলে গেল। একটু পরে বেরিয়ে এলো। বাইরের ঘরের দরজা খুলে দিল। ফ্রান্সিসরা ঘরটায় ঢুকল। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘর। মাটিতে একটা নানা রঙের সুতোর কাজ করা মোটা কাপড় বিছানো। যুবকটি বলল–বসো। ফ্রান্সিস শাঙ্কো ঐ কাপড়ের ওপর বসল।
একটু পরেই মোড়ল ঘরে ঢুকল। মোড়ল বয়স্ক লোক। শরীরের বাঁধুনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যৌবনে সুদেহী পুরুষ ছিল। মোড়ল মোটা কাপড়টায় বসল। বলল–
–আপনারা তো বিদেশি?
–হা–আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।
–ও। আপনারা আমার কাছে এসেছেন কেন? মোড়ল জানতে চাইল।
কয়েকদিন আগে সেভিলের রাজা ফার্নান্দো ক্যামেরিনাল আক্রমণ করে। ক্যামরিনালের রাজা রিকোর্ডা লড়াইয়ে হেরে গেছেন। এখন তার প্রাসাদে তিনি বন্দী। ফ্রান্সিস বলল।
–সে কি। এই লড়াইয়ের কোনো খবরই তো আমরা জানতাম না। মোড়ল বলল।
–এখন রাজা রিকার্ডো চাইছেন তার দেশ থেকে শত্রুদের তাড়াতে। সেইজন্যে উনি আপনাদের সাহায্য চেয়েছেন। ফ্রান্সিস বলল।
–আমরা নিশ্চই লড়াইয়ে নামবো। রাজা রিকার্ডোকে আমরা শ্রদ্ধা করি ভালোবাসি মোড়ল বলল।
–তাহলে আর দেরি না করে আজ সন্ধ্যাবেলা আপনার সাহসী যোদ্ধাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করি। ফ্রান্সিস বলল।
-ঠিক আছে। মোড়ল বলল। তারপর যুবকটির দিকে তাকিয়ে কয়েকজন যোদ্ধার নাম করে তার সঙ্গে দেখা করতে বলল।
ফ্রান্সিসরা বাড়ির বাইরে এলো। যুবকটি ফ্রন্সিসদের নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো। একটা ঘরে ফ্রান্সিসদের থাকবার ব্যবস্থা করল। ঘরটার মেঝেয় নানা কাজ করা মোটা চাদর বিছানো৷ ফ্রান্সিসরা বসল। একটু পরে ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে বলল– শাঙ্কো–এবার আমাদের বন্ধুদের কী করে খবর পাঠাবে?
–তুমি ভেবো না। আমি ঠিক ওদের খবর দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাতে আসতে পারে তার ব্যবস্থা করবো। শাঙ্কো বলল।
–দেখো চেষ্টা করে। ফ্রান্সিস বলল।
কিছুক্ষণ পরে একটা বাচ্চা মেয়ে একটা চিনেমাটির বাটি নিয়ে ঢুকল। মেঝেয় রাখল। ফ্রন্সিস আর শাঙ্কো বাটি দুটো নিয়ে খাবার খেতে লাগল। যরে ছাতুতে তৈরি সুস্বাদু খাবার। একে গত কয়েকদিন কয়েদঘরের অখাদ্য খাবার আর আজকে এতটা হেঁটে আসা দুজনের খিদেয় পেট জুলছিল। মুহূর্তে খেয়ে নিল।
পরদিন। দুপুরের খাওয়া খেয়ে শাঙ্কো চলে গেল। জাহাজ থেকে বন্ধুদের আনতে হবে।
সন্ধের মধ্যেই ফ্রান্সিসরা রাতের খাবার খেয়ে নিল। প্রায় চল্লিশ-পঞ্চশজন তলোদা সেনা এসে মোড়লের বাড়ির সামনে জড়ো হল। বর্ম শিরস্ত্রাণ পরা। কটিদেশে তলোয়ার ঝুলছে। বোঝা গেল লড়াইতে ওরা পটু। প্রত্যেকেরই স্বাস্থ্যজ্জ্বল দেহ।
মোড়ল বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সব কথাবার্তা থেমে গেল। মোড়ল দুহাত তুলে বসতে লাগল–রাজা রিকার্ডো ছোটো ভাই ফার্নান্দোর কাছে লড়াইয়ে হেরে গেছেন। এখন তিনি বন্দী ফার্নান্দোর সেনাপতির হাতে। রাজা রিকার্ডো, রানি ও রাজপুত্রকে মুক্ত করতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে সেনাপতি তাঁদের মুক্তি দেবে না। লড়াই করে সেনাপতিসহ অন্য সৈন্যদের লড়াইয়ে হারিয়ে রাজা রানি আর রাজপুত্রকে মুক্ত করতে হবে। লড়াইয়ে জয়ী হয়ে তোমরা ফিরে এসো। তোমাদের শৌর্য বীর্যের প্রতি আমি বিশ্বাস রাখি। ভাইকিংরা বিদেশি। তবু রাজারানির মুক্তির জন্যে তারা তোমাদের দলে থেকে লড়াই করবে। মোড়ল থামল। তলোয়ার কোষমুক্ত করে উঁচু করে তুলে ধরে তলেদোরা চিৎকার করে উঠল। তারপর তলোয়ার কোষবদ্ধ করল। এবার যুদ্ধযাত্রা।
ফ্রান্সিস সকলের সামনে দাঁড়াল। বলল–আমিই তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমি সেনাপতির কয়েদঘরে বন্দী ছিলাম। কাজেই সেনাপতির সৈন্যদের কোথায় কোথায় মোতয়েন করা হয়েছে আমি জানি। সেনাপতির সেনা শিবির কোথায় কোথায় তা আমি জানি। সৈন্যাবাসের আগে আছে একটা বিস্তৃত প্রান্তর! তারপরেই বনজঙ্গল। আমরা এখন যাত্রা শুরু করলে মধ্যরাত নাগাদ ঐ বনজঙ্গলের আড়ালে পৌঁছুতে পারবো। সেনাপতির নিদ্রিত সৈন্যদের আমরা আক্রমণ করবো। এবার চলো।
তলেদো সেনাদের নিয়ে ফ্রান্সিস যাত্রা শুরু করল।
ফ্রান্সিসের হিসেবটাই ঠিক ছিল। ওরা যখন বনের শেষপ্রান্তে এসে গাছগাছালির আড়ালে দাঁড়াল তখন বেশ রাত।
ওদিকে শাঙ্কো ক্যামেরিনাল নগর থেকে দূরে দূরে ঘুরে জাহাজঘাটার কাছে এলো। দেখল সেনাপতির যুদ্ধে জাহাজ জলে ভাসছে। চাঁদের আবছা আলোয় দেখল বেশ দূরে ওদের জাহাজটা নোঙর করা।
শাঙ্কো কোনো শব্দ না তুলে আস্তে আস্তে সমুদ্রের জলে নামল। তারপর নিঃশব্দে সাঁতরে চলল ওদের জাহাজের দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজের হালটা ধরল। তখন শাঙ্কো বেশ হাঁপাচ্ছে। জাহাজের দড়িদড়া ধরে হালের খাঁজে খাঁজে পারে রেখে রেখে জাহাজে উঠল।
ডেক-এ আট দশজন ভাইকিং ঘুমিয়ে। শাঙ্কো গিয়ে ওদের কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে বলল–খুব ঘুমিয়েছো এবার ওঠো। ভাইকিংরা ধড়ফড় করে উঠে বসল। শাঙ্কো বলল অস্ত্রঘরে যাও। অস্ত্র নিয়ে তৈরি হও। আজ লড়াই।
বন্ধুরা উঠে ছুটল অস্ত্রঘরের দিকে। হ্যারির কেবিনঘরে ঢুকে শাঙ্কো হ্যারিকে সব বলল। হ্যারি বলল –কিন্তু ফ্রান্সিস কেন লড়াই করতে চাইছে বুঝলাম না। শাঙ্কো বলল–সেনাপতি যেভাবে রাজপ্রাসাদ পাহারার ব্যবস্থা করেছে তাতে কারো পালাবার উপায় নেই। রাজা রানি রাজপুত্র আর বিশেষ করে মারিয়ার মুক্তির জন্যে আমাদের লড়াইতে নামতেই হবে।
–ঠিক আছে। কিন্তু আমরা যাবো কীভাবে? সদর রাস্তা ধরে যাওয়া চলবে না। সশস্ত্র আমাদের যেতে দেখলো সেনাপতি জানতে পারবেই। তাহলে ওখানেই লড়াই, শুরু হয়ে যাবে। শাঙ্কো বলল।
–না না। সেসব আমি আর ফ্রান্সিস ভেবেছি।
সেনাপতির সৈন্যাবাসের সামনেই বিরাট প্রান্তর। তারপর একটা বন। আমরা সেই বনের আড়ালে আড়ালে বনের প্রান্তে চলে আসবো। ওখান থেকে গভীর রাতে আমরা রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যদের ছাউনিতে ঝাঁপিয়ে পড়বো। ঘুমন্ত সৈন্যরা ঘুম ভেঙে উঠে তলোয়ার হাতে নেবার সময়ও পাবে না। হ্যারি বলল।
–ঠিক পরিকল্পনা। কিন্তু ঐ বনের প্রান্তে আমরা যাবো কি করে? জাহাজ চালিয়ে তীরে নিয়ে গিয়ে–শাঙ্কো বলল।
–অসম্ভব। আমরা জাহাজ থেকে সমুদ্রের জলে নামবো। তারপর নিঃশব্দে সাঁতরে বেশ কিছুটা গিয়ে তীরে উঠব। তারপর রাজপ্রাসাদকে ডাইনে রেখে আমরা হাঁটবো উত্তর মুখে। বেশ কিছুটা গেলেই বন পাবো। বনের আড়ালে আড়ালে ফ্রান্সিসদের কাছে। চলে যাবো।
–ফ্রান্সিসদের মানে? ফ্রান্সিস তো একা। হ্যারি বলল।
–না–উত্তরদিকেতলেদো নামে একদল উপজাতি থাকে। তারা রাজা রিকার্ডোকে খুব শ্রদ্ধকরে ভালোবাসে। আমরা ওদের সঙ্গে নিয়ে লড়াইয়ে নামবো।
–তাহলে তো তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বেরোতে হবে। শাঙ্কো বলল।
— হ্যাঁ–এটা তুমি বন্ধুদের বলে দাও। হ্যারি বলল।
বন্ধুরা হ্যারির কাছে সব শুনলো। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে সবাই তৈরি হল।
জাহাজ রইল শুধু ওদের বৈদ্য ভেন। আর সবাই তলোয়ার কোমরের ফেট্টিতে গুঁজে জাহাজের হালে পা রেখে রেখে সমুদ্রের জলে নামল।
শাঙ্কো একটু গলা চড়িয়ে বলল–তোমরা সবাই আমার পেছনে পেছনে এসো।
শাঙ্কো নিঃশব্দে সাঁতার কাটতে লাগল। পেছনে আর সবাই। শাঙ্কো লক্ষ্য ঠিক করে নিল। জাহাজঘাট থেকে বেশ দূরে তীরভূমিতে একটা জায়গা বেছে নিল। আকাশে ভাঙা চাঁদ। জ্যোৎস্না উজ্জ্বল নয়। পরিষ্কার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর সমুদ্রের বুকে কুয়াশা। সমুদ্রের জোর হাওয়ায় কখনো কখনো কুয়াশা ছড়িয়ে যাচ্ছে। তখনই তীরভূমি দেখা যাচ্ছে।
শাঙ্কোরা তীরভূমিতে উঠল। সবাই হাঁপাচ্ছে তখন। ওখান থেকে আবছা রাজা ফার্নান্দোর জাহাজ দেখা যাচ্ছে।
শাঙ্কোর পেছনে পেছনে বন্ধুরা আড়াআড়ি সদর রাস্তা পার হল। ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে রাজপ্রাসাদের ঘেরা দেয়াল দেখল। রাজপ্রাসাদ পার হয়ে একটা ছোটো মাঠমতো। তারপরেই শুরু হয়েছে বনাঞ্চল।
শাঙ্কোরা বনে ঢুকল। শাঙ্কো তখন ভাবছে ফ্রান্সিসরা এসে পৌঁছেছে কিনা। বনের ফাঁক দিয়ে শাঙ্কো দেখল ডানদিকে প্রান্তর শুরু হয়েছে। শাঙ্কোরা হাঁটতে লাগল।
এবার বনের আড়াল থেকে শাঙ্কো দেখল প্রান্তরের ওপাশে সৈন্যাবাস। এখান থেকে আক্রমণ করা সহজ।
কিন্তু ফ্রান্সিসরা কোথায়? শাঙ্কো বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাইসব–তোমরা আস্তে আস্তে কথা বলতে বলতে এসো।
–একথা কেন বলছো? বিস্কো বলল।
–আমরা নিঃশব্দে ফ্রান্সিসদের দিকে গেলে ওরা আমাদের শত্রু মনে করতে পারে। তলোয়ার নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। শাঙ্কো বলল।
কিছুটা গিয়ে শাঙ্কো একটু গলা চড়িয়ে ডাকল–ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস। উত্তর নেই। শাঙ্কো যেতে যেতে আবার ডাক–ফ্রান্সিস। বনজঙ্গলের মধ্যে থেকে ফ্রান্সিসের গলা শোনা গেল–শাঙ্কো? ফ্রান্সিসরা জঙ্গলের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। তলেদোরাও এলো। দুদল একত্র হল।
এবার আক্রমণ। সবাই তলোয়ার কোষমুক্ত করল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল– যোদ্ধরা। অযথা নরহত্যা করবে না। জীবন বিপন্ন হলে তবেই নরহত্যা করবে। চলো।
সবাই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর প্রান্তরের অস্পষ্ট চাঁদের আলোর মধ্য দিয়ে সৈন্যাবাসের দিকে ছুটতে লাগল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সৈন্যাবাসের কাছে এলো। তারপর লাথি দিয়ে দরজাগুলো ভাঙতে লাগল। ঘরের ভেতরে ঢুকতে লাগল। দরজা ভাঙার শব্দে রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যদের ঘুম ভেঙে গেল। তারা বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। কিছুই করার নেই। অস্ত্রঘরে যাবারও উপায় নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যে রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা বন্দী হল। ফ্রান্সিসরা ওদের প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল। কিন্তু সেনাপতি কোথায়? ফ্রান্সিস চারদিকেতাকাতে লাগল। তৎক্ষণাৎ দেখল সেনাপতি প্রান্তরের মধ্য দিয়ে ছুটছে।
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে সেনাপতির পিছু ধাওয়া করল। আরও দুজন তলেদো সেনা ফ্রান্সিসের পিছু পিছু ছুটল।
বনজঙ্গলে পৌঁছোবার আগেই সেনাপতি ফ্রান্সিসের হাতে ধরা পড়ল। তলেদো সৈন্যরাও এসে পৌঁছেছে। সেনাপতির হাতে তলোয়ার নেই। ফ্রান্সিস একজন তলেদো সেনার হাত থেকে তলোয়ার নিয়ে সেনাপতির দিকে ছুঁড়ে দিল। তলোয়ার মাটিতে পড়ল। বলল–অস্ত্র দিলাম। লড়াই করো। দুজনেই হাঁপাচ্ছে তখন। মাটি থেকে তলোয়ার তুলে সেনাপতি ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস একটু সরে গিয়ে তলোয়ারের প্রথম মারটা সামলাল। তারপর আক্রমণ করল। দুজনের তলোয়ারের লড়াই চলল। ফ্রান্সিসের দ্রুত আক্রমণের মুখে সেনাপতির নিজেকে অসহায় মনে হল। তলোয়ারে কাটা হাত কাঁধ মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। লড়াই চলল।
হঠাৎ একজন তলেদো সৈন্য সেনাপতির দিকে ছুটে গেল। ফ্রন্সিস বাধা দেবার আগেই সৈন্যটি সেনাপতির বুকে তলোয়ার বিধিয়ে দিল। সেনাপতি তলোয়ার ফেলে দুহাত তুলে পেছনে গড়িয়ে পড়ল। কয়েকবার হাঁ করে শ্বাস নিয়ে মারা গেল।
ফ্রান্সিস বেশ রেগে গেল। তলেদো সৈন্যটির কাছে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল– তোমার আগেই আমি সেনাপতিকে হত্যা করতে পারতাম। কিন্ত করি নি। চেষ্টা করেছি সেনাপতিকে হার স্বীকার করাতে। যুদ্ধযাত্রার আগেই আমি বলেছিলাম বিনা কারণে আমরা নরহত্যা করব না তুমি তাই করলে?
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেনাবাসের দিকে ফিরে এলো। সেনাপতির সৈন্যদের তখন হাতে দড়ি বেঁধে কয়েদঘরে ঢোকানো হচ্ছে।
হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল কী করবে এখন? রাজা রিকার্ডোর কাছে যাবো। তাঁর জয়ের সংবাদ জানাবো। তারপর মারিয়াকে নিয়ে চলে আসবো। জাহাজে ফিরে এসে জাহাজ চালাবো দেশের দিকে।
সব বন্ধুদের ডেকে এনে একত্র করা হল। সবাই চলল রাজপ্রাসাদের দিকে।
রাজপ্রাসাদের সামনে যখন ওরা এলো তখন ভোর হয়ে গেছে। রাজা রিকার্ডোর জয়ের সংবাদ তখন সারা ক্যামেরিনালে ছড়িয়ে পড়েছে। দলে দলে প্রজারা আসতে লাগল রাজপ্রাসাদের দিকে।
ফ্রান্সিসরা রাজপ্রাসাদের সামনে এলো। দেখল সদর দেউড়ি বন্ধ। প্রাসাদের সীমাঘেরা পাথরের দেয়ালের পরেই প্রজারা দাঁড়িয়ে আছে।
হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস–সমস্যায় পড়া গেল।
–হ্যাঁ। ভেতরেই তো যাওয়া যাবো না এখন। ফ্রান্সিস বলল।
–তারপর যুদ্ধে জয়ী রাজা এখন প্রজাদের দর্শন দেবেন। এতেও কম সময় যাবে না। শাঙ্কো বলল।
ফ্রান্সিসরা প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করল। রাজা রিকার্ডো ডান হাত তুলে প্রজাদের উৎসাহিত করতে লাগলেন। প্রজারা রাজার জয়ধ্বনি করল।
আস্তে আস্তে প্রজারা চলে যেতে লাগল। প্রাসাদের চারপাশের ভিড় কমে গেল।
ফ্রান্সিস সদর দেউড়িতে এলো। প্রহরীকে ফ্রান্সিস বলল–ভাই–আমাদের একবার ভেতরে যেতেই হবে।
–কেন বলুন তো? প্রহরী বলল।
–দেখতেই পাচ্ছো আমরা বিদেশি। আমাদের দেশের রাজকুমারী প্রাসাদে আছেন। আমরা তাঁকে নিতে এসেছি। ফ্রান্সিস বলল।
তার জন্যে রাজার হুকুম লাগবে। প্রহরী বলল।
–ঠিক আছে–আমরা রাজার কাছে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–মাত্র দুজন আসুন। কথাটা বলে প্রহরী দরজা খুলে দিল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি ঢুকল। পাথর বাঁধা ছোটো পথটা ধরে ওরা প্রাসাদের প্রথমে ঘরটার সামনে এলো। দরজায় দুজন প্রহরী। হাতে পেতলের বর্শা। ঝকঝক করছে। ফ্রান্সিস মনে মনে হাসল। এত যে যুদ্ধ হল তখন কোথায় ছিল এরা। ফ্রান্সিস প্রহরীকে বলল–রাজা রিকার্ডোকে গিয়ে বলো দুজন ভাইকিং তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। প্রহরী চলে গেল। একটু পরেই এলো। বলল–আপনারা এ ঘরে বসুন। রাজা আসছেন।
ফ্রান্সিস হ্যারি ঘরটায় ঢুকল। দেখল ঘরটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ঘরের মাঝখানে একটা শ্বেতপাথর বাঁধানো বড়ো টেবিল। টেবিলটার চারপাশে চেয়ার পাতা। চেয়ারের গদী পাখির পালকের।
ফ্রান্সিসরা বসল। রাজা রিকার্ডো ঢুকলেন। হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন। ফ্রান্সিস
হ্যারি উঠে দাঁড়াল। রাজ এগিয়ে এসে ফ্রন্সিসের হাতটা ধরলেন। হাতটা ঝুঁকুনি দিতে দিতে বললেন–আমি সব শুনেছি। আপনারা আমার দেশ শত্রু মুক্ত করলেন এজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
ও কথা বলবেন না। তলেদোরাও দুর্ধর্ষ যোদ্ধ। ওদের সহায়তা পেয়েই আমরা যুদ্ধে জয়ী হলাম।
–তবু আপনারা তো এদেশবাসী নন। এখানে কে রাজা হল কে হল না এসবের সঙ্গে আপনাদের তো কোনো সম্পর্ক নেই। তবু আমার হয়ে লড়াই তো করেছেন।
মাননীয় রাজা একটা কথা বলছিলাম।
–বলুন।
–আমাদের দেশের রাজকুমারী আপনাদের অন্দরমহলে রয়েছেন। আমরা তাঁকে নিয়ে যেতে এসেছি।
বেশ তো। রাজা আস্তে হাততালি দিলেন। প্রহরী দুজন প্রায় ছুটে এলো।
অন্তঃপুরে রানিমাকে খবর পাঠাও।একজন বিদেদিনী রাজকুমারী অন্তঃপুরে রয়েছেন। তাঁকে এই ঘরে যেন পাঠানো হয়।
কিছুক্ষণ পরে একজন পরিচারিকার সঙ্গে মারিয়া ঘরটায় ঢুকল।ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে দেখে হাসল। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল–মারিয়ার চোখমুখ কেমন শুকনো। চোখের নীচে কালি। মারিয়া এই কদিনেই বেশ রোগা হয়ে গেছে। মারিয়ার মুখটাও কেমন বিষণ্ণ।
রাজা রিকার্ডো আর একবার ফ্রান্সিসদের ধন্যবাদ জানালো।
ফ্রান্সিসরা প্রাসাদের বাইরে এলো। সদর দেউড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। তখন ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া–তোমার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গেছে। আর না এবার দেশে ফিরে যাবো। মারিয়া হেসে বলল–আবার খোঁজাখুঁজি করার কিছু পেলে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভুলে যাবে।
–ঐ তো এক জ্বালা। কী যে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–আমার জন্যে ভেবো না। আমি ভালো আছি। মারিয়া বলল।
–তোমাকে সঙ্গে আনা ভালো হয়নি। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক উল্টে। আমার যে কী আনন্দ হয় কত বিচিত্র দেশ কত বিচিত্র মানুষ। রাজবাড়ির ঘরে পড়ে থাকলে এ জীবনেও দেখা হত না। আমি এসে খুশি হয়েছি। শরীরের ভালো-মন্দ লেগেই থাকে। একটু বিশ্রাম পেলেই আমার শরীর ভালো হয়ে যাবে। মারিয়া বলল।
–না। ভেনকে বলতে হবে ও যেন এখানকার কোনো কবিরাজের কাছ থেকে ভালো ভালো ওষুধ সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। বিশেষ করে তোমাকে চিকিৎসার জন্যে।
আমার কোনো অসুখ নেই। মারিয়া বলল।
–ঠিক আছে–সেটা ভেন বুঝবে। ফ্রান্সিস বলল।
প্রাসাদের বাইরে আনতে বন্ধুরা ছুটে এলো। আনন্দে ওরা ধ্বনি তুলল–ও-হো হো।
এবার সবাই জাহাজঘাটের দিকে চলল।
জাহাজে উঠে ফ্রান্সিস প্রথমেই ভেন-এর কেবিনঘরে গেল। ভেন আধশোয়া হয়ে ছিল। ফ্রান্সিসকে দেখে উঠে বসল। ফ্রন্সিস বলল–ভেন–তোমায় ওষুধটষুধ নিশ্চয়ই শেষ হয়ে এসেছে।
— কিছু ওষুধ জোগাড় করতে হবে। ভেন বলল।
–তাহলে এক কাজ করো। দুপুরে খেয়েদেয়ে তীরে নামো। দুএকজন কবিরাজকে খুঁজে বের করো। দরকারি ওষুধ তাদের কাছ থেকে নাও। শাঙ্কোর কাছ থেকে দশটা স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যাও। ফ্রান্সিস বলল।
-স্বর্ণমুদ্রা লাগবে না। ভেন বলল।
–না লাগলে নিজের কাছেই রেখে দেবে। আবার আর এক বন্দরে পৌঁছলে সেখানেও ওষুধ জোগাড় করবে। ফ্রান্সিস বলল।
-ঠিক আছে। ভেন বলল।
–শোনো ভেন তোমার ওষুধ সংগ্রহের জন্যে আমরা এখানে দুদিন থাকবো। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো খুবই ভালো হয়। ভেন বলল।
দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে ভেন তীরভূমিতে নামল। তারপর সদর রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল উত্তরমুখো। খোঁজ করতে করতে তিনজন কবিরাজের ঠিকানা পেল। ভেন বেরুলো তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে।
ফ্রান্সিসরা দুদিন ক্যামেরিনাল বন্দর শহরে রইল। ভেনও খুব ছুটোছুটি করে ওষুধ জোগাড় করল।
এবার যাত্রা। জাহাজের নোঙর তোলা হল। গোটানোপাল খুলে দেওয়া হল। বাতাস পড়ে গেছে। দাঁড়ঘরে গেল কয়েকজন। দাঁড় বাইতে লাগল। জাহাজ দ্রুত চলল সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে।
সেদিন দুপুরবেলা। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে। ফ্রান্সিসের কেবিনঘরে হ্যারি আর শাঙ্কো এলো। গল্পগুজব চলল। মারিয়াও যোগ দিল।
আলখাতিব ঢুকল। ফ্রান্সিস আলখাতিবকে ওর বিছানায় বসতে বলল। আলখাতিব বিছানায় বসল। তারপর বলল–আপনারা তো জাহাজ চালিয়ে চলে যাবেন। আমি কী করবো? ফ্রান্সিস বলল–তুমি এখানেই থাকবে।
–কিন্তু দৈবাৎ যদি রাজা ফার্নান্দোর গুপ্তচরের নজরে পড়ে যাই তাহলে ফাঁসির হাত থেকে আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। আলখাতিব বলল।
ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল–আচ্ছা আলখাতিব কিছুদিন আগে তুমি এক রোমান সম্রাটের কথা বলেছিলে। জিরাল্ডা টাওয়ারের কোথাও সম্রাট মাতিস তার রাজভাণ্ডার লুকিয়ে রেখেছিলেন ব্যাপারটা কী বলল তো। তোমার প্রপিতামহ নাকি জানতো কোথায় মাতিস ধনসম্পদ রেখেছিল। আলখাতিব একটু চুপকরে থেমে বলল– সে অনেক কথা। সেসব আপনার শুনে কী হবে। সেটা আমরা বুঝব। তুমি বলো। হ্যারি বলল।
আলখাতিব একটু থেমে বলতে লাগল–সেভিল বন্দর শহরে প্রায় দেড়শো বছর আগে একজন রোমান সম্রাট মাতিস রাজত্ব করতেন। তিনি সেভিলে জিরাল্ডা টাওয়ার নির্মাণ করে ছিলেন। সেই টাওয়ার নির্মাণ করাবার সময় আমার এক পূর্বপুরুষ সোনিকা রাজমিস্ত্রির কাজ করেছিলেন। আলখাতিব থামল।
-তারপর? ফ্রান্সিস বলল।
–ঐসময়ে খলিফা আনমন সুরে সেভিল আক্রমণ করতে এসেছিল। গুপ্তচরমারফৎ এই খবর পেয়ে সম্রাট মাতিস স্থির করলেন রাজকোষ জিরাল্ডা টাওয়ারের মধ্যে কোথা গোপনে রেখে দেবেন।
সেইদিনই রাতে আমার পূর্বপুরুষ সোনিকা আর একজন রাজমিস্ত্রিকে রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠালেন। সেই রাতে দুজনকে নানা সুস্বাদু খাবার খাওয়ালেন। পেটপুরে খেল দুজনে। তারপর পাখির পালকে তৈরি বিছানায় দুজনেল শুল। কী সুন্দর ঘর। পাথরের দেয়ালে পাখি লতাপাতা ফুলের কাজ করা। ঘরের এক কোণায় কী জ্বলছে। ধূয়ো ছড়াচ্ছে। কী সুন্দর গন্ধ।
দুর্জনেঘুমিয়ে পড়ল।
গভীর রাতে দুজনেরই ঘুম ভেঙে গেল সম্রাটের ডাকে। দুজনে বিছানায় উঠে বসল। বিছানা থেকে নেমে এলো। সম্রাট সোনিক্কার হাতে দিলে একটা চামড়ার বড়ো থলি। সোনিক্কা ওটা কাঁধে করে নিয়ে নিল। সম্রাট বললেন আমার সঙ্গে এসো।
সম্রাটের সঙ্গে দুজনে প্রাসাদের বাইরে এলো।
সম্রাট হাঁটতে লাগলেন জিরাল্ডা টাওয়ারের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে বললেন–সব দ্বারী প্রতিহারীকে ছুটি দিয়েছি। আমি যা তোমাদের দিয়ে করাব না সেটা আমি গোপনে করতে চাইছি।
সোনিক্কা দেখল প্রাসাদের দরজায় বড়ো দেউড়ির কাছে কোথাও কোনো প্রহরী নেই।
রাত্রি জ্যোৎস্নালোকিত। সবই অনেকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
তিনজনে জিরল্ডো টাওয়ারের নীচে এসে দাঁড়াল। সম্রাট সোনিকাকে নিয়ে টাওয়ারের প্রথম সিঁড়ির কাছে এলেন।সিঁড়ির ওপরে কয়েকটা পাথরের পাটা রাখা।সম্রাট বললেন অন্য মিস্ত্রিটাকে–তুমি বেশ শক্তসমর্থ। এই পাথরের পাটা নিয়ে টাওয়ারের মাথায় উঠতে হবে। তুমি যথেষ্ট বলশালী। তুমি পারবে। পাটাতনগুলো নাও। ঐ রাজমিস্ত্রি টানগুলোনিল।মাথার ওপর পাটাতনগুলো চাপিয়ে মিস্ত্রি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।
–তুমি এতসব জানলে কী করে? হ্যারি বলল।
–আমরা বংশপরম্পরায় এই ঘটনাটি শুনে আসছি। আমাদের পূর্বপুরুষ সোনিক্কা নিশ্চয়ই এই ঘটনা বংশের কাউকে বলেছিলেন। সেটাই আমাদের বংশের মানুষদের মধ্যে গল্পকথার মতো চলে আসছে। আলখাতিব বলল।
–তারপর বল। হ্যারি বলল।
অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে তিনজনে উঠতে লাগলেন। টাওয়ারের জায়গায় জায়গায় তো জানালার মতো চৌকো ফোকর। এখানে চাঁদের আলো পড়েছে।
সম্রাট সামনে। পেছনে অন্য মিস্ত্রিটি। শেষে সোনিক্কা। তিনি আগেঅন্ধকারে চামড়ার বড়ো থলিটার মুখ খুলে ফেলেছিলেন। এবার থলিতে হাত ঢোকালেন। একমুঠো কী যেন তুলে আনলেন।চাঁদের আলোয় দেখলেন হীরেমণিমাণিক্য। রেখে দিলেন সেসব। মুহূর্তে বুঝলেন এসব রাজকোষ থেকে আনা। এই জিরাল্ডা মিনারের কোথাও লুকিয়ে রাখার জন্যে সম্রাট এনেছেন। দুজন মিস্ত্রির সাহায্যে তিনি এটা করবেন। তারপর বুদ্ধিমানেরা যা করে তাই করবেন। সোনিক্কা আর অন্য মিস্ত্রিটাকে হত্যা করবেন।
–সোনিক্কা পালালেন–তাই না? ফ্রান্সিস বলল।
–হ্যাঁ। সোনিক্কা থলিটা সিঁড়িতে রেখে ফিরে দাঁড়ালেন। সম্রাটের সতর্ক দৃষ্টিতে ধরা পড়ল। সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে সোনিকাকে বললেন–পালাবার চেষ্টা করবে। না। কিন্তু সোনিক্কা ততক্ষণে কয়েকটা সিঁড়ি শেষে এসেছেন। সম্রাট সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার কোষমুক্ত করলেন। অন্ধকারেই তলোয়ার চালালেন। সেই তলোয়ারের ঘা সোনিক্কার পিঠে পড়ল। আহত সোনিকা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন। সম্রাটও কয়েকটা সিঁড়ি দ্রুতপায়ে নেমে এলেন। সোনিকা ততক্ষণে মিনারের বাইরে চলে এসেছেন। পাগলের মতো ছুটতে লাগলেন। সম্রাট বুঝলেন সোনিকাকে ধরা যাবে না।তিনি টাওয়ার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। দেখলেন সোনিকা সদর দেউড়ির মাথায় উঠে পড়েছেন। সান্ত্রী প্রহরী কেউ নেই যে সোনিক্কার পিছু ধাওয়া করবে।
সম্রাট টাওয়ারে ফিরে এলেন।
হ্যারি বলল–তাহলে বোঝা যাচ্ছে সম্রাট তার রাজকোষ কোথায় গোপনে বানালেন সেটা তোমার পূর্বপুরুষ সোনিকা দেখতে পান নি।
না। আলখাতিব বলল–তবেঅন্য রাজমিস্ত্রিটি রাজকোষ কোথায় গোপনে রাখা হল সেটা জানতো কারণ ও নিজেই কাজটা করেছিল। কিন্তু সেই রাজমিস্ত্রিটিকে পরে কেউ কোনোদিন দ্যাখেনি। তার মানে সম্রাট তাকে হত্যা করেছিলেন।
কিন্তু রাজা তোমাকে বন্দী করে রেখেছিল কেন ফ্রান্সিস বলল।
–রাজা ফার্নান্দোর মন্ত্রীরা বংশের সঙ্গে আমাদের বংশের শত্রুতা অনেকদিন যাবৎ, চলে আসছে। সেই সেনাপতিই রাজাকে বলেছিল যে আমাদের পরিবারের লোকরা জানে–রোমান সম্রাট কোথায় তার রাজকোষ গোপনে রেখেছিলেন।
রাজা ফার্নান্দোর সৈন্য আমাকে বন্দী করে রাজার সভা ঘরে নিয়ে এলো। সেনাপতিটি যখন সেনাপতি হল তখনই আমি জানতাম আমাদের পরিবারের ওপর অত্যাচার শুরু হবে। তাই বাবা আর ঠাকুর্দাকে হুয়েনভায় নিয়ে গিয়েছিলাম। এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। সৈন্যরা বাবা আর ঠাকুর্দাকে পায় নি।
-তারপর? ফ্রান্সিস বলল।
–রাজ ফার্নান্দো আমার কাছে জানতে চাইলেন আমার কোনো পূর্বপুরুষ সম্রাট মাতিসের রাজকোষ কোথায় লুকিয়ে রাখা হল তা জেনেছিল কিনা। আমি বললাম রাজকোষ জিরাল্ড টাওয়ারের কোথাও গোপনে রাখা হয়েছে এটা আমার পূর্বপুরুষ সোনিকা জানতে পারেন নি। সোনিকা জিরাল্ডা টাওয়ারে ওঠার আগেই পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাজা ফার্নান্দো সেটা বিশ্বাস করলেন না। কয়েদঘরে রেখে আমার ওপর ভীষণ অত্যাচার চালাল। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমি মিথ্যে করে বললাম যে আমার পূর্বপুরুষ সোনিক্কা মৃত্যুর সময় বলে গিয়েছিলেন যে সম্রাট মাতিসের গুপ্তধন জিরাল্ডো টাওয়ারের সিঁড়ির ধাপে পুঁতে রাখা হয়েছে। কথাটা বলে আমি অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচলাম। কিন্তু আমার বিপদ কাটল না। রাজা ফার্নান্দো তাঁর শ’পাঁচেক সৈন্যকে লাগালেন জিলাল্ডা টাওয়ারের সব সিঁড়ি ভেঙে ফেলার জন্যে। আমাকে মুক্তি দেওয়া হল।
কিন্তু রোমান সম্রাটের কোষাগার পাওয়া গেল না–এই তো? ফ্রান্সিস হেসে বলল।
–হ্যাঁ। আমি হুয়েনভা বন্দর শহরে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ক্রুদ্ধ রাজা ফার্নান্দো আমাকে ধরবার জন্যে গুপ্তচর লাগাল।আমি ধরা পড়লাম।আবারকয়েদখানায় ঢোকানো হল আমাকে। আলখাতিব থামল।
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না।
ভেন ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিস বলল-ভেন দরকারি ওষুধটষুধ পেয়েছো?
—হ্যাঁ।
–তাহলে কাল সকালেই জাহাজ ছাড়তে হবে। হ্যারিকে বলল
–হ্যারি সবাইকে ডেক-এ আসতে বলল। আমার কিছু কথা বলার আছে। হ্যারি ঘর থেকে বেরিয়ে সবাইকে খবর দিতে চলল।
কিছুক্ষণ পরে হ্যারি ফিরে এলো। বলল–ফ্রান্সিস সবাই এসেছে। তুমি চল।
ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়া জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো।
ডেক-এ বন্ধুরা সব জড়ো হয়েছে। ফ্রান্সিস কী বলে শুনতে এসেছে। ফ্রান্সিস একবার চারদিকে তাকিয়ে নিল। গলা চড়িয়ে বলতে লাগল–ভাইসব–আমরা এখন হুয়েন বন্দর শহরে যাবো। ওখান থেকে যাবো সেভিলে। প্রায় দেড়শ বছর আগে এক রোমান সম্রাট মাতিস জিরাল্ডা টাওয়ারের কোথাও তাঁর রাজকোষ গোপনে রেখে গেছেন সেটা আমি উদ্ধার করবো। ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। শাঙ্কো একটু গলা চড়িয়ে বলল–ফ্রান্সিস আমরা অনেকদিন দেশছাড়া। এখানে পড়ে না থেকে চলো এবার দেশে ফিরে যাই।ফ্রান্সিসদৃঢ়স্বরে বলল-শাঙ্কো চোমরা ভালো করেই জানোআমাকেসঙ্কল্পচ্যুত মুক্ত করা যায় না। আর কোনো বন্ধু কিছু বলল না। ফ্রান্সিস বলল–সেভিলে যাবো আমি হ্যারি আর বিস্কো। গুপ্ত রাজকোষ খুঁজবো। তোমরা এখানে হুয়েভা বন্দরে থাকবে।
সভা ভঙ্গ হল। ভাইকিং বন্ধুরা কেউ কেউ নিজেদের কেবিনঘরে ফিরে গেল। কেউ কেউ ডেক-এ শুয়ে বসে রইল।
কেবিনঘরে ফিরে মারিয়া বলল–তুমি কি দেশে ফিরতে চাও?
না চাই না। এভাবে দেশে দেশে দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে জীবনটা কাটাতে চাই।
–আমি তা চাইনা। মারিয়া বলল।ফ্রান্সিস মনে ব্যথা পেল।বলল–মারিয়া, তুমি যদি দেশে ফিরে যেতে চাও আমি তার ব্যবস্থা করে দেব।
মারিয়া ফুঁপিয়ে উঠল। বলল–আমার ভুল হয়েছে আমাকে মাফ করো। আমি ফিরে যাবো না। তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো। ফ্রান্সিস হাসল। বলল
ঘরের বাইরের জীবন আমাদের অনেক কিছু শেখায়। হিংসা দ্বেষ থেকে মুক্তি দেয় আমাদের। যাকগে–তুমি যদি সেভিলে যেতে চাও যেতে পারো।
–হ্যাঁ আমি যাবো। মারিয়া বলল।
–বেশ। ফ্রান্সিস বলল।
পরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে ফ্লেজার জাহাজ ছাড়ার জন্যে তৈরি হল। গুটানো পাল সব খুলে দেওয়া হল।হওয়া উদ্দাম। পালগুলো ফুলে উঠল। জোরগতিতে জাহাজ মাঝ সমুদ্রের দিকে চলল।
বিকেল নাগাদ ফ্রান্সিসদের জাহাজ হুয়েনভা বন্দর শহরের কাছে এলো। ফ্রান্সিস হ্যারি জাহাজের রেলিং ধরে জাহাজঘাটের দিকে তাকিয়েছিল। জাহাজঘাটায় রাজা ফার্নান্দোর দুটো যুদ্ধজাহাজ নোঙর করে আছে।
হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস জাহাজঘাটে জাহাজ নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমরা রাজা ফার্নান্দোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এখন আমরা বাঘের মুখে।
–কিছু ভেবো না হ্যারি। আমার কাছে মহাস্ত্র আছে। সব রাজারাই সেই অস্ত্রে ঘায়েল হয়। ফ্রান্সিস বলল।
–মহাস্ত্রটা কী? হ্যারি বলল।
রোমান সম্রাট মাতিসের গুপ্তধন ভাণ্ডার।ফ্রান্সিস বলল।
–কিন্তু তোমাকে সে ক্ষেত্রে সেই গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতেই হবে।
–ঠিক। কিন্তু যদি কোনো ব্যাপারটা জটিল গুপ্তভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারবে না তবে রাতের অন্ধকারে পালাবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে চলো জাহাজ জাহাজঘাটেই লাগাই। দেখা যাকে কী হয়। হ্যারি বলল।
দূর থেকে ফ্রান্সিস আর হ্যারি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগল। যা আশঙ্কা করা গিয়েছিল তাই হল। রাজা ফার্নান্দোর দুই যুদ্ধ জাহাজেই সৈন্যদের ছুটোছুটি দেখল
–ফ্রান্সিস আমরা ধরা পড়ে গেছি। হ্যারি বলল।
–সেটা জেনেই এখানে এসেছি। দেখা যাক রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা কী করে। ফ্রান্সিস বলল।
তীরভূমির খুব কাছে এসে ফ্রান্সিসদের জাহাজ থামল। নোঙর ফেলা হল। কাঠের পাটাতন ফেলা হল না।
বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দেখা গেল তীরভূমি দিয়ে কয়েকজন রাজা ফার্নান্দোর সৈন্য ফ্রান্সিসদের জাহাজের দিকে আসছে।
সামনের লোকটিকে দেখে বোঝা গেল নতুন সেনাপতি। ওরা ফ্রান্সিসদের জাহাজের সামনে এসে দাঁড়াল। একজন সৈন্য চেঁচিয়ে বলল–এ দেশের সেনাপতি এসেছেন। পাটাতন ফ্যালো৷ ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো যা বলছে তা করো। বিস্কো পাটাতন ফেলল। সেনাপতি দলবল নিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে পড়ল। নতুন সেনাপতির চেহারা আগের সেনাপতির বিপরীত। ঠোঁটের ওপর মোটা গোঁফ। গোবদা গোবদা শরীর। কুকুতে চোখ। জাহাজে উঠে বলল তোমাদের দলনেতা কে?
ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো। বলল আমি।
–তোমাদের সবাইকে বন্দী করা হল। কয়েদঘরে থাকতে হবে তোমাদের। নতুন সেনাপতি বলল।
-বেশ। আপত্তি নেই। কয়েদঘরে থাকবো আমরা। কিন্তু কাল সকালে রাজা ফার্নান্দোর কাছে আমাদের যেতে দেবেন। ফ্রান্সিস বলল।
-কেন? সেনাপতি বলল।
–সেটা আমি রাজা ফার্নান্দোকেই বলবো। ফ্রান্সিস বলল।
–না। আগে আমাকে বলবে। সব শুনে আমি অনুমতি দিলে তবেই রাজার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করবো। নতুন সেনাপতি বলল।
–বেশ শুনুন–প্রায় দেড়শো বছর আগে এক রোমান সম্রাট শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে তাঁর রাজকোষেরসবমূল্যবান অলঙ্কার পাথর সোনার চামচ জিরাল্ডারটাওয়ারের কোথাও গোপনে রেখেছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
-হ্যাঁ এই ঘটনার কথা আমি শুনেছি। পরে এখানকার রাজারা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেই মূল্যবান ধনসম্পদ উদ্ধার করতে পারে নি। নতুন সেনাপতি বলল।
–আমিও চেষ্টা করবোই ঐ ধনসম্পদ উদ্ধার করতে। ফ্রান্সিস বলল।
নতুন সেনাপতি খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। বলল–হাতিঘোড়া গেল তল মশা বলে কত জল। ফ্রান্সিসও সঙ্গে সঙ্গে জোরে হো হো করে হেসে উঠল। সেনাপতি হাসি থামিয়ে কড়াচোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর বলল–ঠিক আছে। রাজা ফার্নান্দোর সঙ্গে তোমার কথা বলিয়ে দেবো। কালকে সকালে রাজসভায়।
-খুব ভালো কথা। শাঙ্কো বলল।
নাও-এবার কয়েদখানায় চলো। সেনাপতি বলল।
ফ্রান্সিসরা দল বেঁধে চলল। সঙ্গে মারিয়া। ওদের ঘিরে নিয়ে চলল সৈন্যরা সেনাপতির পাশের হাঁটছিল শাঙ্কো।শাঙ্কো বলল–আগের সেনাপতি যে ছিল সে তো তালপাতার সেপাই। হা–সেনাপতি হলে তার চেহারা আমার মতোই হাওয়া চাই। সেনাপতি ঠোঁটের ফাঁকে হাসল। তারপর শাঙ্কোর মন্তব্যটা সবাই শুনল কিনা সেটা চারদিকে তাকিয়ে যাচাই করে নিল। বোঝা গেল তাদের কয়েকটি সৈন্য শাঙ্কোর মন্তব্য শুনেছে। সেনাপতি একবার গোঁফে তা দিল।
সন্ধে নাগাদ ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরের সামনে পৌঁছল। কয়েদঘরের দরজার দুপাশে মশাল জ্বলছে। দুজন পাহারাদার পাহারা দিচ্ছে।
ঢং ঢং শব্দ তুলে দরজা খোলা হল। শাঙ্কো সেনাপতির কাছে গেল। বলল-দেখুন, মহামান্য সেনাপতি আমাদের দেশের রাজকুমারী আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। এই কয়েদঘরে স থাকতে তার খুবই কষ্ট হবে।
কী করা যাবে আলাদা রাখার হুকুম না হলে তো যায় না।
কী যে বলেন–আপনার হুকুম কি কিছু কম? মহামান্য–আপনি শুধু পাহারাদারকে বলুন রাজকুমারীকে রাজা ফার্নান্দোর অন্দরমহলে রেখে আসতেওরা শুনতে বাধ্য। আপনাকে ওরা যমের মতো ভয় করে। সেনাপতি দাঁত বের করে হাসল। বলল– তা করে।
তবে আর ভাবছেন কেন? শাঙ্কো বলল।
–না ভাবছি রাজা যদি জানেন—
শুধু তো একটা রাত। কালকেই তো তোমার হুকুম জানা যাবে। শাঙ্কো বলল।
-তা বটে-এক রাতের জন্যে-সেনাপতি কথাটা শেষ করল।
–তাই তো বলছি–আপনার ক্ষমতা কিকিছুকম?শাঙ্কো বলল। সেনাপতি খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। বলল–দেখছি।
শাঙ্কো মারিয়ার ইশারায় কয়েদঘরে ঢুকতে মানা করল। মারিয়া কয়েদঘরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
সেনাপতি রাজপ্রাসাদের দিকে চলল। সঙ্গে কয়েকজন সৈন্য।
কিছু পরে দুজন সৈন্য এলো। মারিয়াকে বলল আপনিই তো রাজকুমারী।
–হ্যাঁ। মারিয়া মাথা ওঠানামা করল।
–আমাদের সঙ্গে আসুন। আপনি প্রাসাদের অন্দরমহলে থাকবেন। মারিয়া মাথা। নেড়ে বলল–না আমি এখানেই থাকবো।
ফ্রান্সিসরা দরজা ধরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল। ফ্রান্সিস মারিয়ার কথা শুনল। বলে উঠল–মারিয়া পাগলামি করো না। এই পরিবেশে এক রাত থাকলেই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। শাঙ্কো বলল- আমাদের জন্যে ভাববেন না। এসবে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আপনি অন্তঃপুরে যান।
মারিয়া আর কিছু বলল না। সৈন্য দুজনের সঙ্গে একটা ঘাসে-ঢাকা প্রান্তর দিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে চলে গেল।
কয়েদঘরে ফ্রান্সিস দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। হ্যারি শাঙ্কো আলখাতিব দুপাশে বসে আছে। আলখাতিব বলল–ভাগ্যিস আগের শুটকো সেনাপতিটা মারা গেছে, নইলে আমাকে ঠিক চিনতো। আমার বিপদ বাড়তো।
তখনই বিস্কো ফ্রান্সিসের কাছে উঠে এলো।মৃদুস্বরে বলল–আপনি এভাবে বন্দীদশা মেনে নেওয়াতে কিছু বন্ধু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে।
–এটা তো ভালো কথা নয়।কথাটা বলে ফ্রান্সিস উঠেদাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল ভাই সব–আমি অযথা রক্তপাত মৃত্যু থেকে তোমাদের বাঁচাবার জন্যেই ধরা দিয়েছি। ওদের দুজাহাজ বোঝাই সৈন্য। এদিকে আমরা কজন মাত্র। লড়াইয়ে নামলে আমরা শুকনো পাতার মতো উড়ে যেতাম। আমি সবদিক ভেবেই এই বন্দীদশা মেনে নিয়েছি। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল কালকে রাজা ফার্নান্দোর দরবারে যাচ্ছি। অর্থ সম্পদের লোভ রাজা গরিব সবারই সমান। বরং রাজাদের এই লোভ আরো বেশি। দেখা যাক কাল কী হয়।
পরদিন ফ্রান্সিসরাসকালের খাবার খাচ্ছেতখন সেনাপতি এলো। বলল–খেয়েটেয়ে চলো রাজসভায় তবে এতজনকে যেতে হবেনা। তোমাদের শুধুদলপতি গেলেই চলবে।
–আমি একা যাবো না–দুজন বন্ধুকেই নিয়ে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। তাই যেও। সেনাপতি বলল।
ফ্রান্সিস হ্যারি আরশাঙ্কো রাজসভা ঘরে গিয়ে পৌঁছল। ঘরটা একটু অন্ধকার মতো। দেয়ালে আটকানো মশাল জ্বলছে। আর একটা বিচার চলছিল। রাজা ফার্নান্দো একটা কাঠের সিংহাসনে বসে আছেন। সিংহাসনের গদীটা নীল ভেলভেটের কাপড়ে ঢাকা। রাজা ফার্নান্দোর বেশ বয়েস হয়েছে। মাথার পাকা চুলের ওপর সবুজ মিনে করা মুক্তো বসানো সোনার মুকুট। মুখে পাকা দাড়ি গোঁফ।
তখন একটা বিচার চলছিল। বিচার শেষ হল। যে দু’জন বিচার চাইতে এসেছিল তাদের একজন হাতের উল্টেপিঠে চোখের জল মুছতে মুছতে গেল। অন্যজন হাসছিল। সে কয়েকজন সঙ্গীর সঙ্গে সভাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এবার সেনাপতি ফ্রান্সিসদের এগিয়ে আসতে ইশারা করল। ফ্রান্সিসরা এগিয়ে এসে মাথা একটু নিচু করে রাজাকে সম্মান জানিয়ে দাঁড়াল। সেনাপতি বলতে লাগল কী করে সে ফ্রান্সিসদের বন্দী করেছে।
ওদের কী বলে আপনার সন্দেহ হয়? রাজা সেনাপতিকে জিজ্ঞেস করলেন।
–ওরা ভাইকিং ভাই কিংবা জলদস্যু। ওদের জাহাজে তল্লাশী চালালে অনেক সোনাদানা চুনীপান্না পাওয়া যাবে। সেনাপতি বলল। এবার ফ্রান্সিস বলল–মহামান্য রাজা ইচ্ছে করলে সেনাপতিমশাই আমাদের জাহাজে তল্লাশী চালাতে পারেন। কিন্তু শুধু সন্দেহ করে আমাদের বন্দী করতে পারেন না।
–সেটা পরে দেখছি। এখন কয়েদঘরে থাকতে হবে। রাজা বললেন।
এবার ফ্রান্সিস আলখাতিবকে ফিফিস্ করে বলল–এগিয়ে যাও। কোনো ভয় নেই।
আলখাতিব রাজসিংহাসনের দিকে একটু এগিয়ে গেল। আলখাতিব রাজার নজরে পড়ল রাজ গলা চড়িয়ে বললেন–কি নিজে থেকেই ধরা দিতে এসেছো?
আলখাতিব কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মাথা তুলে বলল মাননীয় রাজা–আমি যা জেনেছিলাম যা শুনেছিলাম সবই আপনাকে বলেছি।
-না-না-তুই মিথ্যে কথা বলেছিস। তুই সব জানি। রাজা বললেন।
এবার ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো। মাথা নিচু করে সম্মান জানিয়ে বলল–মান্যবর রাজা! আমরা জাতিতে ভাইকিং। আমরা বেশ পরিশ্রম করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে নানা গুপ্তধন সম্পদ উদ্ধার করেছি। রাজা ফার্নান্দো সাগ্রহে বললেন–সত্যি! তোমরা কি রোমান সম্রাট মাতসের গুপ্ত রাজকোষ উদ্ধার করতে পারবে?
-সব কিছু দেখে শুনে খোঁজখবর করে তবে বলতে পারবো। সেই ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারবো কি না। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ দ্যাখো চেষ্টা করে। রাজা বললেন।
এবার কয়েকটা অনুরোধ। আমার বন্ধুরা কয়েদঘরে বন্দী। তাদের মুক্তি দিতে হবে। ওরা আমাদের জাহাজে ফিরে যাবে।
–বেশ। তারপর? রাজা বললেন।
–এই রাজপ্রাসাদেই একটা ঘর আমাদের চারবন্ধুকে দিতে হবে। এতে আমাদের কাজ করার সুবিধে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ তোমাদের থাকবার ঘর দেওয়া হবে। রাজা বললেন।
–আমাদের সঙ্গে আছেন আমাদের দেশের রাজকুমারী। তাকে অন্দরমহলে থাকতে দিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
-বেশ। তিনি অন্দরমহলেই থাকবেন। রাজা বললেন।
ফ্রান্সিসরা রাজসভা থেকে বেরিয়ে আসছে তখনই দেখল একটু দূরে মারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে একজন পরিচারিকা। ফ্রান্সিস মারিয়ার কাছে গেল। মারিয়া মাথা নেড়ে বললনা, না আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকবো।
–তা হয় না মারিয়া। তার চেয়ে তুমি যখন খুশি আমাদের ঘরে এসো। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে। কথাটা বলে মারিয়া পরিচারিকাটির সঙ্গে চলে গেল।
প্রাসাদের বাইরে আসতে একজন রাজসভায় প্রহরী পেতলের বর্শা হাতে ওদের কাছে এলো।
চলুন–আপনাদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছি।
দ্বারীর সঙ্গে ওরা চলল। প্রাসাদের দক্ষিণ কোণায় প্রহরী একটা তালাবন্ধ ঘরের তালা হল! ফ্রান্সিসরা ঘরে ঢুকল। পাথর আর কাঠ দিয়ে ঘরটা তৈরি। ঘরটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন! মেঝেয় কাঠের বড়ো তক্তার ওপর বিছানাপত্র পাতা। ফ্রান্সিস ঘরে ঢুকেই হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। হ্যারি প্রহরীকে বলল–খাবার সময় আমাদের ডেকো। প্রহরীটি মাথা ওঠানামা করে চলে গেল।
এবার হ্যারিও বসল। শাঙ্কো ঘরে আস্তে আস্তে পায়চারি করতে লাগল।হ্যারি বলল– ফ্রান্সিস তোমার কি মনে হয়? রোমান সম্রাট মাতিসের রাজকোষ ঐ জিরাল্ডা টাওয়ারেই আছে? ফ্রান্সিস শুয়ে শুয়েই বলল–নিশ্চয় আছে। সেই গভীর রাতে সম্রাট ঐ টাওয়ারে গিয়েছিলেন কোষাগার গোপনে লুকিয়ে রাখার জন্য। খাতিবের প্রপিতামহকে আর একজন মিস্ত্রিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। লক্ষ্য করো সম্রাট মাতিস অন্য কাউকে নিয়ে যান নি। নিয়ে গেলেন দুজন অভিজ্ঞ রাজ মিস্ত্রিকে। কাজেই ঐ টাওয়ারের কোথাও রাজকোষ লুকোবার জায়গা ওদের দিয়ে করিয়ে নিয়ে রাজকোষ লুকিয়ে রেখেছিলেন।
হ্যারি বলল–কিন্তু ঐ টাওয়ারের সব সিঁড়িই তো ভেঙে ফেলা হয়েছে। উঠবে কী করে?
–হ্যারি, বেশি ভাবতে পারছি না। ভীষণ খিদে পেয়েছে। ফ্রান্সিস চোখ বুজে বলল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন প্রাসাদরক্ষী ফ্রান্সিসদের খেতে ডাকল। প্রাসাদরক্ষী ফ্রান্সিসদের প্রাসাদের খাবার ঘরেই নিয়ে এলো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর। টেবিলে ফিকে নীল রঙের কাপড়ের ঢাকনা। প্লেট ছুরি কাঁটা চামচ ঝকঝক করছে। তখনই মারিয়া ঢুকল। বলল–আমি বলেছি যে দিনের বেলার খাবার আমি তোমাদের সঙ্গে খাবো। খেতে বসে মারিয়ার মনে পড়ল ওদের প্রাসাদের খাবার ঘরের কথা। মারিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। ও গম্ভীর মুখ খেতে লাগল। পাশেই খেতে খেতে ফ্রান্সিস বুঝল সেটা কিছু বলল না।
হঠাৎ মারিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকাল। মারিয়া তখন হাতের উল্টো পিঠে চাখ মুছছে। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–মারিয়া আমাদের জীবনটাই এমনি। কখনও বারোয়ারি অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ কখনও কয়েদখানার নোংরা পরিবেশ কখনও এইরকম সাজানো গোছানো সুন্দর ঝকঝকে পরিবেশ। আমাদের জীবনে দুটোই সত্যি। একটু চুপ করে থেকে ফ্রান্সিস বলল–কেঁদো না। আমার মন দুর্বল করে দিও না। মারিয়া চোখের জল মুছতে মুছতে হাসল। বলল–আর কাঁদবো না।
খেয়েদেয়ে ফ্রান্সিসরা ঘরে ফিরল। মারিয়া অন্দরমহলে চলে গেল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। বলল–অনেকদিন এত সুস্বাদু খাবার খাই নি। হ্যারি বলল–ভালো খাবারের স্বাদই ভুলে গিয়েছিলাম। হ্যারি আর শাঙ্কো বসল।
হঠাৎ ফ্রান্সিস উঠে বসল। বলল–বলেছিলাম না পেটপুরে খেলেই আমার বুদ্ধি খুলবে।
হ্যারি হেসে বলল–তোমার বুদ্ধি কী বলছে?
ফ্রান্সিস হেসে বলল-বুদ্ধি বলছে এখনও তোমার ভাবনার শেষ হয় নি। আরো ভাবো।
ওরা যখন কথাবার্তা বলছে তখনই সেই প্রহরীটি এলো। বলল–সেনাপতিমশাই আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না জানতে।
ফ্রান্সিস বলল গিয়ে বলল যে আমাদের খুবই অসুবিধে হচ্ছে। উনি যেন একবার আসেন। প্রহরীটি চলে গেল।
একটু পরে সেনাপতি বেশ ব্যস্ত হয়ে এলো। বলল–আপনাদের কী অসুবিধে হচ্ছে।
–বিশেষ কিছু না। আমাদের এবার দুটো জিনিস চাই। বেশ লম্বা একগাছা কাছি নয় তো দড়ি। শক্ত দড়ি। ধরে ওঠানামা করা যায় এমনি। অন্যটা হল একটা বড় লাঠি মতো। এটা কাঠের টুকরোয় জোড় দিয়ে করা যায়। ফ্রান্সিস বলল।
–কাছি বা দড়ি দেখছি পাওয়া যায় কিনা। তবে লাঠির মতো যেটা করতে বলছেন। সেটা আমাদের কাঠের মিস্ত্রিকে বলুন সে তৈরি করে দেবে। আর কিছু? সেনাপতি বলল।
–না শুধু এই। ফ্রান্সিস বলল।
সেনাপতি চলে গেল।
একটু পরে কাঠের মিস্ত্রি এলো।
ফ্রান্সিস তাকে বলল–তুমি তো ঐ জিরাল্ডা মিনারটা দেখেছে।
-হা ও তো ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি। মিস্ত্রি হেসে বলল।
–ঐ মিনারের ঠিক মাঝমাঝি পর্যন্ত ওঠে এরকম একটা লাঠি তৈরি করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
মিস্ত্রি একটু ভেবে নিয়ে বলল–তা করা যাবে।
–তাহলে আজকেই লেগে পড়ো কাল দুপুর নাগাদ ওটা আমার চাই। ফ্রান্সিস বলল।
পরদিন দুপুর নাগাদ মিস্ত্রি এলো। বলল দেখে যান কাঠের লাঠিটা ঠিক বানানো হল কিনা। ফ্রান্সিসরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দেখল লম্বা কাঠ জোড়া দিয়ে দিয়ে বেশ বড়ো একটা কাঠের লাঠি মিস্ত্রি তৈরি করে প্রাসাদের চত্বরে রেখেছে। ফ্রান্সিস দেখল। টাওয়ার আর তার কাছেই চেস্টনাট গাছের উচ্চতাটা হিসেব করল। বলল ঠিক আছে।তারপরলাঠিটারমাথা দেখিয়ে মিস্ত্রিকে বলল–ঐ চেস্টাট গাছটা থেকে গুলতির মতো জোড়া ডাল কেটে আন। তারপর সেটাকে লাঠির মাথায় পেরেক দিয়ে ঠুকে গুলতির মতো কাটা ডালটা লাগিয়ে দাও।
মিস্ত্রি চলল টাওয়ারের কাছে অনেকটা উঁচু চেস্টাট গাছটার দিকে। ডাল কেটে এনে গুলতির মতো লাঠির মাথায় লাগিয়ে দিল।
এমন সময় দেখা গেল চারজন সৈন্য একটা দড়ির কুণ্ডুলি নিয়ে আসছে। সেটা জিরাল্ডা টাওয়ারের নীচে রাখা হল।
দুপুরের খাওয়া সেরে ফ্রান্সিসরা টাওয়ারে নীচে এলো। মারিয়াও অন্দরমহল থেকে এলো। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল–শোনো–আমি গাছটার মগ ডালে উঠি। তোমরা আমাকে লাঠিটা দেবে। লাঠিটার মাথায় গুলতি মতো জায়গায় দড়ির একটা মুখ আটকে দেবে। আর দড়ির মাথায় পাথরের ছোটো চাঙ বেঁধে দেবে। আমি গাছে উঠছি?
ফ্রান্সিস চেস্টনাট গাছের কাণ্ড ধরে ধরে উঠল। তারপর খুব সহজেই ডাল ধরে ধরে একেবারে মগডালে উঠে এলো। এবার নীচে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল শাঙ্কো, দড়ির একটা মুখ দাও।
শাঙ্কো তৈরি ছিল। লাঠির মাথায় গুলতির মুখটাতে দড়ির একটা মুখ আটকাল। তারপর হ্যারি আর মারিয়ার সাহায্যে লাঠিটা গাছের মগডাল পর্যন্ত তুলল। ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে লাটিঠা ধরল। দড়ি পরানো অবস্থায় ও লাঠিটা টাওয়ারের মাথার কাছে তুলল। তারপর একটা ঝাঁকুনি দিতেই লাঠির মাথা থেকে দড়িবাঁধা পাথরের চারটা টাওয়ারের মধ্যে পাথরের দেওয়ালে ঘা খেয়ে নীচে পড়ে গেল। টাওয়ারে গম্ভীর শব্দ উঠল। ঢং-ঢং।
ফ্রান্সিস চেস্টনাট গাছ থেকে নেমে এলো।টাওয়ারের মধ্যে ঢুকল।দড়ি বাঁধা পাথরটা পড়ে আছে। হ্যারিরা এগিয়ে এলো। হ্যারি হেসে বলে উঠল-সাবাস্ ফ্রান্সিস। মারিয়া হেসে বলল–তোমার মাথায় এতও আসে।
এবার ফ্রান্সিস দড়ির মুখ থেকে পাথরের চাঙরটা খুলে ফেলল। তারপর দড়িটা টানতে লাগল। একসময় টাওয়ারের মাথা থেকে চেস্টাট গাছ পর্যন্ত দড়িটা টানটান হয়ে গেল। ফ্রান্সিস দড়ি ধরে টান দিল বার কয়েক। দেখা গেল চেস্টনাট গাছের কাণ্ড বাঁধা দড়িটা টাওয়ারের মুখ দিয়ে নেমে বেশ শক্ত হল টান টান হয়ে আছে।
ফ্রান্সিস এবার দড়ি টেনে ধরে উঠতে লাগল। টাওয়ারের দেয়ালের গায়ে সারা জানালার মতো চৌকোণো ফোকর আছে মাঝে মাঝে। চৌকোণা ফোকর গরাদ নেই। ওগুলো থেকে কিছু আলো টাওয়ারের ভেতরে আসছে। তবু টাওয়ারের ভেতরের অন্ধকার কাটে নি।
ফ্রান্সিস উঠতে লাগল।
ওদিকে রোমান সম্রাট মাতিসের গুপ্ত কোষাগার একজন বিদেশি উদ্ধার করার চেষ্টা করছে–এই খবর রটে গেল। দলে দলে লোকজন এসে টাওয়ারের নীচে দাঁড়াল। ততক্ষণে রাজা ফার্নান্দোও এসেছেন। প্রাসাদ থেকে একটা আবলুস কাঠের আসন নিয়ে আসা হল। রাজা ফার্নান্দো বসলেন তাতে। দুজন অমাত্য রাজাসনের দুপাশে দাঁড়িয়ে রইল।
ফ্রান্সিস টাওয়ারে আস্তে আস্তে উঠে ওপরে উঠে পড়ল। টাওয়ারের মাথায় বসে দড়িটা ধরে থাকল। নীচের দর্শকরা মহা উৎসাহে হাততালি দিল। এবার আসল কাজ। ফ্রান্সিস টাওয়ারের মুখটায় উঠে দাঁড়াল। দেখল পাথরের গোল মুখটা। সিঁড়িগুলো ভেঙে ফেলেও কোষাগার পাওয়া যায় নি। তাহলে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। রাজকোষ? ফ্রান্সিস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল গোল মুখটা। দেখল ওপরে একটা পাথরের ধাপ আছে। সম্রাট মাতিস এখানে কোথাও রাজকোষ লুকিয়ে রেখেছেন। এ সিঁড়িগুলো ভেঙে ফেলেও কোথাও রাজকোষ পাওয়া যায় নি। ফ্রান্সিস পাথরের ধাপটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। অল্প আলোতেও ফ্রান্সিস হঠাৎ দেখল পাথরের ধাপটায় তিন রঙের তিনটি পাথরের পাটা কালো কাঞ্চিপাথর, শ্বেতপাথর আর হলদেটে রঙের পাথরের তিনটি পাটা। মিনারে যদি নকশা করার উদ্দেশ্য হত তাহলে বাইরের দিকে করা হত। ভেতরের নকশা কে দেখতে আসবে?
ফ্রান্সিস তিন রঙের পাথরের পাটায় হাত বুলোল। বুঝল এই পাথর তিনটি পরে গাঁথা হয়েছে। আগের তিনটি পাথর খুলে ফেলে সেখানে এই তিনরঙা পাথরের পাটা গেঁথে রাখা হয়েছে। জোড়ে মেলে নি। তাই তিনটি পাথরই একটু বেরিয়ে আছে। এই তিনটি পাথর খুলতে পারলে সম্রাটের গুপ্ত ধনভাণ্ডার দেখা যাবে। এখানে ছাড়া অন্য কোথাও গুপ্ত রাজকোষ রাখা হয়নি।
এবার তিনটি পাথর খুলে ফেলতে হবে। নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে রোমান সম্রাট মাতিসের গুপ্ত রাজকোষ। ফ্রান্সিস টাওয়ারের মাথায় বসল। কোনোরকম হাত বাড়িয়ে কষ্টিপাথরটা টানল। কয়েকবার হ্যাঁচকা টান দিতে পাথরটা একটু নড়ল। ওরকম শুধু টানাটানি করে ঐ তিনটি পাথর খুলে ফেলা যাবে না।
নীচের দিকে মুখ নামিয়ে ফ্রান্সিস ডাকল–শাঙ্কো–ও–ও। ডাকের শব্দটা টাওয়ারের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হল। শাঙ্কো নীচে থেকে বলল–বল–শুনছি।
ফ্রান্সিস কথাটা শুনতে পেল। বলল–একটা কুড়ুল নিয়ে এখানে উঠে এসো।
একটু পরেই একটা কুড়ল কোমরে গুঁজে দড়ি বেয়ে বেয়ে শাঙ্কো উঠে এলো। শাঙ্কোর হাত থেকে ফ্রান্সিস কুড়ুলটা নিল। দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল। দড়িতে দুপা জড়িয়ে একটু আলগা হয়ে কষ্টিপাথরে কুড়ুলের ঘা মারল। কুড়ুলের ঘায়ে মিনারেশব্দ উঠল– গম–গম্।
ফ্রান্সিস আরো কয়েকবার ঘা মারলো। কষ্টিপাথরটা ভাঙল না।ক্লান্ত ফ্রান্সিস বলল– শাঙ্কো কুড়ুলটা নাও। মনে হচ্ছে কষ্টিপাথরটা ভাঙা যাবে না। ঠিক খাঁজে খাঁজে মারো। শাঙ্কো কুড়ল নিল। দড়িতে পা জড়িয়ে ভারসাম্য রেখে কষ্টিপাথরটার খাঁজে খাঁজে কুড়ুলের ঘা মারতে লাগল। কষ্টিপাথরটার একটা কোণা ভেঙে পড়ল। আরো কটা ঘা মারতে কষ্টিপাথরের অর্ধেকটা ভেঙে পড়ে গেল। খোঁদল হল। খোঁদলের মধ্যে দেখা গেল রুপোর সুতোয় প্যাচানো একটি দড়ি। শাঙ্কো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–ফ্রান্সিস একটা দড়িমতো দেখা যাচ্ছে। তুমি উঠে এসো। আমি দেখছি। ফ্রান্সিস বলল।
শাঙ্কো উঠে এলো। মিনারের মুখে বসল। ফ্রান্সিস বলল কষ্টিপাথর ভেঙেছে। এখন বাকি দুটো পাথর সহজেই বের করা যাবে।
এবার ফ্রান্সিস দড়ি ধরে ঝুলে কষ্টিপাথরটায় কটা কুড়ুলের ঘা মারতেই কষ্টিপাথর ভেঙে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল। দেখল একটা দড়ি। দড়িটা রুপোর সুতোর কাজ করা। ফ্রান্সিস দড়িটা ধরে টানল। কিন্তু দড়িটা বেরিয়ে এলো না। ওটার পরেই শ্বেতপাথরের পাটা। ফ্রান্সিস সেটায় কুড়লের ঘা মারতে লাগল। শ্বেতপাথরটা মাঝামাঝি ভেঙে পড়ে গেল। দেখা গেল একটা বড়ো চামড়ার থলির মুখ।
ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–সম্রাট মাতিসের গুপ্ত কোষাগার আমাদের সামনে। ফ্রান্সিসের কাথাটা টাওয়ারের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হল। নীচে দাঁড়ানো লোকেদের কানেও গেল রাজাও শুনলেন। মারিয়া রাজার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। মারিয়া হেসে দুহাত তুলে বলে উঠল–ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস শ্বেতপাথরের বাকি অংশটা ভেঙে ফেলল। বডোক্লান্ত লাগছে। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো হলদেটে পাথরটা ভাঙো। ফ্রান্সিস মিনারের মুখটায় উঠে বসল। শাঙ্কো দড়ি ধরল। পা দিয়ে দড়িটা জড়িয়ে হলদেটে পাথরটায় কুড়লের ঘা মারতে লাগল। সেটাও ভেঙে গেল। দেখা গেল একটা সুদৃশ্য চামড়ার বড়ো থলি। মুখটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফ্রান্সিস থলেটা ধরে জোরে হাঁচকা টান দিল। হলদেটে পাথরের বাকিটা ভেঙে পড়ে গেল। শাঙ্কো বলে উঠল–সাবাস ফ্রান্সিস। দুজনে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। নীচে মারিয়াও ধ্বনি তুলল- ও-হো-হো।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো টাওয়ারের মাথায় বসল। ফ্রান্সিস থলেটার দড়ি আলগা করে হাত ঢোকাল। একমুঠো তুলে আনল মণিমুক্তো হীরের টুকরো। বিকেলের নিস্তেজ আলোতে সব ঝিকিয়ে উঠল।
ফ্রন্সিস সব থলেতে রেখে দিল। বলল–শাঙ্কো চলো নামি।
দুজনে দড়ি ধরে ধরে নেমে এলো।
চামড়ার থলেহাতে ফ্রন্সিস নেমে আসতেই হ্যারি হাসতে হাসতে ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। হ্যারি আর শাঙ্কো ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো।
ফ্রান্সিস রাজা ফার্নান্দোর দিকে এগিয়ে গেল। থলিটা রাজকে দিল। রাজা মুখ বাঁধা দড়িটা খুলে থলিটার মুখ খুলল। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন একমুঠো মণিমাণিক্য। সেগুলো রোদ লেগে ঝিকঝিক করতে লাগল।
রাজা এবার ফ্রন্সিসকে বললেন–তোমরাই সম্রাট মাতিসের রাজকোষ উদ্ধার করেছে। বল–তোমরা কী চাও?
ফ্রান্সিস হেসে বলল–মান্যবর রাজা–আমরা কিছুই চাইনা। শুধু বলি–আপনার প্রজাদের কল্যাণে এই ধনসম্পদ ব্যয় করুন। এটাই আমাদের অনুরোধ।
ফ্রান্সিসরা রাজা ফার্নান্দোর কাছ থেকে বিদায় নিল। চলল হুয়েনভা বন্দরের দিকে যেখানে ওদের বন্ধুরা আর ওদের জাহাজ আছে।
Leave a Reply