রাণীর রত্ন ভাণ্ডার
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে ওদের দেশের দিকে। ভূমধ্যসাগরের জল শান্ত। ঢেউয়ের মাতামাতি নেই। ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা খুব খুশি। কতদিন পরে দেশের দিকে চলেছে ওরা। মারিয়া অবশ্য মুখ ফুটে কিছু বলেনি। তবে ফ্রান্সিস বেশ বুঝতে পারছিল মারিয়াও দেশে ফেরার আনন্দে অধীর। মারিয়ার দোষ নেই। ফ্রান্সিসদের মতো দেশে দেশে বিদেশ-বিভূইয়ের বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়াবার অভ্যস তো মারিয়ার নেই। কাজেই ওর আনন্দ হবে এ তো স্বাভাবিক।
জোর বাতাসে জাহাজের পাল ফুলে উঠেছে। বেশ দ্রুতগতিতে জাহাজ চলেছে। ভাইকিংদের দাঁড় টানতে হচ্ছে না। ডেক-এর এখানে-ওখানে কেউ কেউ শুয়ে বসে আছে। কোথাও কয়েকজন জড়ো হয়ে বসে ছক্কা-পাঞ্জা খেলছে। বেশ অবসরের মেজাজ সকলের।
সেদিন দুপুর থেকে কিন্তু হাওয়া পড়ে গেল। হাওয়ায় আর সেই জোর নেই। পালগুলো নেতিয়ে পড়ল। বিকেল নাগাদ জাহাজের গতি আরও কমে গেল। সমুদ্রের চারদিকে একটা গভীর স্তব্ধতা। যেন একফোঁটা হাওয়া নেই। সমুদ্রের সোঁ সোঁ ডাকও কেমন নিস্তেজ। ভাইকিংরা ঝড়ের আশঙ্কা করল। জাহাজ-চালক ফ্লাইজারের কাছে এলো বিস্কো। সঙ্গে দু’জন ভাইকিং বন্ধু। বিস্কো জাহাজ-চালককে বলল, কী ব্যাপার বলো তো? হাওয়া বন্ধ। চারদিক থমথমে।
জাহাজ-চালকের কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ। ও শুধু বলল, ফ্রান্সিসকে ডাকো একবার।
বিস্কো বলল, তা ডাকছি। কিন্তু তোমার কি আশঙ্কা প্রচণ্ড ঝড় আসবে?
জাহাজ-চালক ফ্লাইজার শুধু বলল, ফ্রান্সিসকে খবর দাও।
বিস্কো আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। বিপদ আশঙ্কা করে ছুটল ফ্রান্সিসকে খবর দিতে। একটু পরেই ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো।
ফ্লাইজারের কাছে এসে বলল, কী হয়েছে? ঝড় আসবে?
জাহাজ-চালক একবার ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ফ্রান্সিস, সমুদ্রে চোরা স্রোত থাকে। আমরা সেই চোরা স্রোতে পড়েছি। আমার দিকজ্ঞান লোপ পেয়েছে। চোরা স্রোতের টান কাটাতে পারছি না। জাহাজ কোথায় চলেছে আমি জানি না।
সর্বনাশ। বলো কি? ফ্রান্সিস চিন্তিত স্বরে বলল।
হ্যারি জাহাজ-চালককে বলল, যদি সব দাঁড় টানা যায়?
জাহাজ-চালক ফ্লাইজার মাথা এপাশ-ওপাশ করল। বলল, তাহলেও এই চোরা স্রোতের প্রচণ্ড টান থেকে জাহাজকে মুক্ত করা যাবে না। জাহাজ ডুবে যাবার ভয় নেই। কিন্তু জাহাজের গতিমুখ নিয়ন্ত্রণ করা এখন অসম্ভব।
তবে তো আমাদের এখন কিছু করার নেই। হ্যারি বলল।
হ্যাঁ, যতক্ষণ না এই চোরা টান নিস্তে হবে ততক্ষণ জাহাজ যেদিকে যাবে যাক। ফ্লাইজার বলল।
এই চোরা টান কতক্ষণ চলবে? ফ্রান্সিস বলল।
জাহাজ-চালক মাথা নাড়ল। বলল, জানি না। সমুদ্রের অনেক জায়গায় এরকম চোরা টান থাকে। জাহাজকে যেন টেনে নিয়ে যায়।
ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল—জাহাজ ডুবে যাবে না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জাহাজ কোথায় কোনদিকে যাবে কে জানে। ফ্রান্সিস মুখ তুলে বলল, হ্যারি জানো, সার্দিনিয়ার ধারে কাছে কোনো দ্বীপ আছে বা মূল ভূখণ্ড কতদূর?
হ্যারি বলল, রাজকুমারী মারিয়ার ভূগোল জ্ঞান আমার চেয়ে অনেক বেশি। রাজকুমারী হয়তো বলতে পারবেন।
হুঁ, চলো, মারিয়াকে জিজ্ঞেস করি। কথাটা বলে ফ্রান্সিস নীচে নামার সিঁড়ির দিকে চলল।
দু’জনে ফ্রান্সিস ও মারিয়ার কেবিন ঘরে এলো। ফ্রান্সিস দেখল মারিয়া চুপ করে শুয়ে আছে। এসসম মারিয়া কখনো শুয়ে থাকে না। ডেক-এ গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সমুদ্রের আকাশ দেখে। সূর্যাস্তের রঙিন খেলা দেখে, সূর্য অস্ত গেলে, কেবিনে ফিরে আসে। আজকে মারিয়া শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস বলল, শুয়ে আছো কেন?
মারিয়া আস্তে আস্তে উঠে বসল। হেসে বলল, এক্ষুণি ডেক-এ যাবো ভেবেছিলাম। যাক গে, বিস্কো তোমাকে ডেকে নিয়ে গেল। কী হয়েছে?
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে জাহাজ-চালকের কথা, সমস্যার কথা বলল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মারিয়া, সার্দিনিয়ার কাছাকাছি কোনো দ্বীপ বা মূল ভূখণ্ড আছে?
মারিয়া একটু ভেবে নিয়ে বলল, সার্দিনিয়ার উত্তরে আছে কর্সিকা দ্বীপ। কিন্তু সেটা কত দূরে তা আমি জানি না।
আর মূল ভূখণ্ড? হ্যারি জিজেস করল।
সেটা আরো উত্তরে—দূরে। মারিয়া বলল, এটুকুই বলতে পারি।
হুঁ। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। তারপর বলল, ডেক-এ চলো। মারিয়া হেসে বলল, এতক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে বোধহয়। আজ থাক।
বেশ। ফ্রান্সিস বলল। তারপর হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজ-চালকের কাছে চলল।
আসলে সকাল থেকেই মারিয়ার শরীর ভালো নেই। ঘুম থেকে ওঠা পর্যন্ত মুখে একটা তেতো বিস্বাদ ভাব। সকালের খাবার তো খেতেই পারেনি। ও খাবার ঘরেই খাচ্ছিল। বিস্কো পাশে বসে খাচ্ছিল। ফ্রান্সিসের আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বিস্কো বলল, রাজকুমারী, আপনি যে কিছুই খেলেন না।
মারিয়া হেসে বলল, খিদে পায়নি তেমন। রাতে বেশি করে খাবো। মারিয়া বিস্কোকেও বুঝতে দিল না যে ওর শরীর খারাপ।
দুপুরের দিকে মারিয়া বুঝতে পারল জ্বর এসেছে। গা হাত-পায়ের ব্যথাটা বেড়ে চলেছে। মাথায় টনটনানি শুরু হলো। মুখ বুজে মারিয়া সব সহ্য করতে লাগল। ফ্রান্সিস যতক্ষশ ঘরে রইল ততক্ষণ মারিয়া ফ্রান্সিসের ছেঁড়া পোশাক সেলাই করছিল। ফ্রান্সিস কিছু বুঝতে পারেনি। দু’একটা কথাটথা যা বলেছে স্বাভাবিকভাবেই বলেছে। মাথার টনটনে ব্যথায় মারিয়া দুচ চোখেই দেখতে পারছিল না। উল্টে মাথা নিচু করে সেলাই করতে গিয়ে মাথার ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল। তবু মারিয়া নিজের শরীরের কষ্ট ফ্রান্সিসকে বুঝতে দেয়নি। বিস্কো যখন ফ্রান্সিসকে ডেকে নিয়ে গেল তখন আর পারল না। শুয়ে পড়ল। তখনও অল্প অল্প কাশি হচ্ছিল। বুকে একটা হাঁপধরা ভাব। মারিয়া বুঝল—বুকে কফ জমেছে। গত রাতে ডেক এ একটু রাত পর্যন্ত ছিল। ভালো হয়নি সেটা। ঠাণ্ডা লেগেছে।
সন্ধের পর থেকেই জ্বর বাড়তে লাগল। সেইসঙ্গে কাশিও বাড়ল। বুকের হাঁপ-ধরা ভাবটাও বেড়ে চলল। মারিয়া একটা মোটা গায়ের কাপড় জড়িয়ে শুয়ে রইল। সারা শরীরে ব্যথা আর শীত শীত ভাব। কঁপুনি। মারিয়া দাঁত চেপে সব সহ্য করতে লাগল।
বেশ রাতে ফ্রান্সিসকেবিনঘরে এলো। দেখল মারিয়া কাপড় জড়িয়ে শুয়ে আছে। মারিয়া ঘুমিয়ে আছে ভেবে ফ্রান্সিস আর ডাকল না। রাঁধুনি বন্ধু মারিয়াকে রাতের খাবার খেতে ডাকতে এসেছিল। মারিয়া বলে দিয়েছিল, খিদে নেই।
হঠাৎ বুকের হাঁপ-ধরা ভাবটা বাড়তেই মারিয়া কাশতে লাগল। ও উঠে বসল। কাশতে কাশতে যেন দম বন্ধ হয়ে গেল। ফ্রান্সিস দ্রুত দু’হাতে মারিয়াকে জড়িয়ে ধরল। জুরে গা পুড়ে যাচ্ছে যেন। ফ্রান্সিস ভীষণভাবে চমকে উঠল। মারিয়া কাশছে। তখনও। ফ্রান্সিস কিছু বলল না। কাশিটা কমল। মারিয়া হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস মারিয়াকে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় শুইয়ে দিল। দুশ্চিন্তায় ফ্রান্সিস তখনও গুছিয়ে কিছু ভাবতে পারছে না। শুধু একটু অভিমানের সুরে বলল, মারিয়া, তুমি এত অসুস্থ অথচ আমাকে একবার বললেও না।
মারিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে হেসে বলল, সর্দিজ্বর এসব—ভেবো না, সেরে যাবে। কতবার হয়েছে সেরে গেছে ভেন-এর ওষুধ খেয়ে।
ফ্রান্সিস দ্রুত বিছানা থেকে নামল। বলল, বিছানা থেকে নেমো না। আমি এক্ষুণি আসছি।
ফ্রান্সিস ছুটে হ্যারির কেবিন ঘরে এলো। ডাকল, হ্যারি—ওঠো শিগগির।
হ্যারির ঘুম ভেঙে গেল। মোমবাতির আলোয় ফ্রান্সিসের উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে হ্যারি এক লাফে বিছানা থেকে নামল। বলল, জাহাজের কিছু হয়েছে?
ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল, না। মারিয়ার ভীষণ জ্বর এসেছে। তুমি বৈদ্য ভেনকে ডাকো। আমি যাচ্ছি। ফ্রান্সিস দ্রুতপায়ে চলে গেল। ততক্ষণে বিস্কোও উঠে পড়েছে। ফ্রান্সিসের কথাও শুনেছে। হ্যারির পেছনে পেছনে বিস্কোও ছুটল বৈদ্য বন্ধুর কাছে।
ফ্রান্সিস আর মারিয়ার কেবিনঘরে বেশ হন্তদন্ত হয়েই ভেন ঢুকল। হাতে পুঁটলি আর চিনেমাটির বোয়াম। ভেন মারিয়ার কপালে হাত দিল। দু’চোখে আঙুল চেপে খুলে দেখল। হাতের নাড়ি টিপে চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, রাজকুমারী, পিঠটা দেখব একটু। মারিয়া একটু কষ্ট করেই উবু হয়ে শুলো। মারিয়ার পিঠে বাঁ হাত পেতে ডান হাতের আঙুল দিয়ে ভেন ঠুকতে লাগল। পরীক্ষা শেষ হলো। ঘরে আর ঘরের বাইরে অল্প জায়গায় ভাইকিং বন্ধুরা জড়ো হয়েছে। ফ্রান্সিস বৈদ্যকে বলল, কী বুঝলে?
বুকে ভীষণ কফ জমেছে। কষ্টের অসুখ। ওষুধ দিচ্ছি। বৈদ্য ভেন আস্তে আস্তে বলল।
খুব কাশি হচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল।
হবেই। ওষুধ পড়ুক দেখি। ভেন বোয়াম থেকে কালো আঠার মতো ওষুধ বের করতে করতে বলল। আঙুলে-তোলা ওষুধ হাতের তেলোয় ঘষে ঘষে বড়ি মতো। করল। ফ্রান্সিসকে বলল, একটা বড়ি খাইয়ে দাও। জ্বর নামবে।
বিস্কো কাঠের গ্লাসে জল নিয়ে এলো। ফ্রান্সিস মারিয়ার মাথার পেছনে হাত দিয়ে বলল, মারিয়া ওষুধটা খেয়ে নাও মাথাটা তুলে ধরতে মারিয়া জলের সঙ্গে বড়িটা খেয়ে নিল। মারিয়া এতক্ষণে বুঝতে পারল—শরীর আর ওর বশে নেই। একদিনেই শরীর যেন অসাড় হয়ে গেছে। গায়ে হাতে পায়ে অসহ্য ব্যথা। জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। মাথাটা ব্যথায় টনটন করছে। ছিঁড়ে পড়ছে যেন। বুকে আবার চাপ ভাবটা বাড়তেই শুরু হলো বেদম কাশি। কাশতে কাশতে মারিয়ার শরীরটা বেঁকে যেতে লাগল। কাশি থামাতে মারিয়া বালিশে মুখ গুজল। কিন্তু কষ্টকর কাশিটা কমল না। ফ্রান্সিস নিচু হয়ে মারিয়ার পিঠে হাত বুলাতে লাগল। মারিয়া হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল।
মারিয়ার কষ্ট দেখে ফ্রান্সিসের মতো শক্ত মনের মানুষও অস্থির হয়ে পড়ল। ভেনকে বলল, যেভাবে পারো মারিয়ার কষ্টটা কমাও।
ভেন তখন ওর কাপড়ের ঝোলা থেকে পাথরের ছোট্ট শিলনোড়া বের করেছে। বলল, দেখি। ঝোলা থেকে চারটে কালো কী ফল বের করল। দু’আঙুলে টিপে খোসাটা ভাঙল। ভেতরের সবুজ রঙের ফলগুলো বের করল। শিলনোড়া দিয়ে গুঁড়ো করল। গুঁড়ো জলে ভিজিয়ে বড়ো গোল করল। ওটা থেকে সবজে ওষুধগুলো টেনে খুলে হাতে পাকিয়ে চারটে বড়ি মতো করল। হ্যারির দিকে তাকিয়ে ভেন বলল, ঐ কালো বড়ি খাওয়াবার এক ঘণ্টা পরে পরে এই সবুজ বড়িগুলো খাওয়াবে। হ্যারি সব বড়িগুলো নিয়ে মারিয়ার শিয়রের কাছে রাখা একটা চিনেমাটির পাত্রে রাখল।
সময় কাটতে লাগল। একঘণ্টা সময় গেল। হ্যারি মারিয়াকে সবুজ বড়িটা খাইয়ে দিল। আবার
সকলের প্রতীক্ষা। ভেনও মাথা নিচু করে বসে রইল চোখ কুঁজে কোনো কথা বলল না।
ভোর হলো। বাইরে সাগরপাখির ডাক শোনা গেল। ভেন ফ্রান্সিস হ্যারি বিস্কোরা তো সারারাত চোখের পাতা এক করেনি। ভাইকিং বন্ধুরাও কেউ একটানা সারারাত ঘুমোয়নি। মাঝে মাঝেই এসে মারিয়ার শরীরের অবস্থা সম্বন্ধে বারবার খোঁজ নিয়ে গেছে।
দুপুর নাগাদ মারিয়ার শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হলো। প্রায় অজ্ঞানের মতো মারিয়া বিছানায় অসাড় হয়ে শুয়ে রইল। ফ্রান্সিস বারবার ভেনকে বলল, মারিয়া কি সুস্থ হবে না?
ভেন কোনো কথা বলল না। আবার নতুন ওষুধ তৈরি করল। ফ্রান্সিস ই মারিয়ার মাথা তুলে ধরল। হ্যারি অনেক কষ্টে ওষুধটা খাওয়াল।
বিকেল হলো। ভেন মারিয়াকে পরীক্ষা করল। আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসকে বলল, জ্বর একটু কমেছে। তবে বিপদ এখনও কাটেনি। আমার জ্ঞানবুদ্ধিমতো সবরকম চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ভালো বদ্যিকে আজ রাতের মধ্যেই দেখাতে হবে। নইলেভেন চুপ করল।
ফ্রান্সিস আর বসে থাকতে পারল না। ছুটে ডেক-এ উঠে এলো। দেখল—পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ও জাহাজ-চালকের কাছে ছুটে এলো। বলল, ফ্লাইজার যে করে হোক কোনো ডাঙায় আমাদের পৌঁছতেই হবে। তুমি জাহাজ আরো জোরে চালাও।
জাহাজ-চালক ফ্লাইজার একটুক্ষণ ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিসকে এরকম অস্তির হয়ে পড়তে ও কোনোদিন দেখেনি। বুঝল—সত্যি কথাটা এখন বলা উচিত হবে না। ও বলল, ফ্রান্সিস অস্থির হয়ো না। স্থির হও। আমরা আজ রাতের মধ্যেই কোনো না কোনো দ্বীপে বা দেশে পৌঁছবো। তুমি রাজকুমারীর কাছে যাও। তাকে সাহস দাও। তুমি পাশে থাকলে রাজকুমারী মনে অনেক জোর পাবেন। তুমি যাও। আমরা যা করার করছি। ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলতে পারল না। নিজের কেবিনে ফিরে এলো।
নজরদার পেড্রো গতকাল থেকেই একনাগাড়ে জাহাজের মাস্তুলের মাথায় ওর জায়গায় বসে আছে। শুধু খাওয়ার সময় গোগ্রাসে খেয়েই আবার নিজের জায়গায় চলে গেছে। সারারাত তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে চারদিকে যদি ডাঙা চোখে পড়ে। পরের দিনও ও নজর রাখতে লাগল।
ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুদের কারো মন ভালো নেই। ওরা শুকনো মুখে ডেক-এর এখানে-ওখানে কেবিনঘরে শুয়ে বসে সময় কাটাতে লাগল। কিছুতো করার নেই শুধু মারিয়ার সুস্থ হয়ে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া। শুধু শাঙ্কো রেলিঙের ধারে সারারাত দাঁড়িয়ে রইল। চারদিকে নজর রাখতে লাগল—কোনোদিকে ডাঙা দেখা যায় কিনা। কিন্তু কোথায় ডাঙা? চারদিকে শুধু জল আর জল।
সন্ধের পর চাঁদ উঠল। পূর্ণিমার কাছাকাছি সময়। তাই জ্যোৎস্না বেশ উজ্জ্বল। এতে চারদিকে নজর রাখার সুবিধে হলো।
জাহাজ চলেছে। জাহাজ-চালক ফ্লাইজার হুইলে হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু। চোরা স্রোতের টানের জোর কমেছে। কিন্তু ফ্লাইজার ভেবে পাচ্ছে না কোনদিকে জাহাজের মুখ ঘোরাবে। জাহাজ কোথায় এলো তাও বুঝতে পারছে না। অগত্যা জাহাজ যেদিকে যায় যাক। ম্লান মুখে অসহায়ভাবে ও দাঁড়িয়ে রইল।
একটু রাতে হঠাৎ পেড্রোর চোখে পড়ল ডানদিকে দূরে সাদাটে কুয়াশার পাতলা আস্তরণের মধ্যে দিয়ে আগুনের ক্ষীণ আভা। পেড্রো মাস্তুলের মাথা থেকে সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠল—ডাঙা—ডাঙার কাছে এসেছি আমরা। অনেক ভাইকিং বন্ধু। ছুটে এলো রেলিঙের ধারে। বিস্কো ছুটল ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে খবর দিতে। জাহাজ চালক ফ্রান্সিসের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পরেই ফ্রান্সিস আর হ্যারি ছুটে এলো রেলিঙের ধারে। ওরা আলো দেখল। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল না ওটা সমুদ্রের বুকের আলোকস্তম্ভ কিনা। একটু পরেই বুঝল—ওটা ডাঙায় আছে। ওটা নিশ্চয়ই কোনো দ্বীপ বা দেশ।
ফ্রান্সিস ফ্লাইজারের কাছে এলো। বলল, যত দ্রুত সম্ভব ঐ আলো লক্ষ্য করে জাহাজ চালাও। ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল, একদল দাঁড়ঘরে নেমে যাও। দাঁড় টানো। আর একদল পালের দড়িদড়া খুলে বেঁধে পাল ঠিক রাখো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ আলোর কাছে আমাদের পৌঁছতে হবে। ভাইকিং বন্ধুরা সমস্বরে হাঁক দিল—ও-হো-হো-হো। তারপর ছুটল নিজেদের কাজের জায়গায়। জাহাজের গতি বাড়ল। জাহাজ ছুটল ঐ আলো লক্ষ্য করে।
ফ্রান্সিস কেবিন ঘরের দিকে যাচ্ছে তখন হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস, একটু খোঁজখবর না নিয়ে এই বন্দরে জাহাজ ভেড়ানো কি উচিত হবে। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল, হ্যারি উপায় নেই। মারিয়ার শরীরের যা অবস্থা তাতে যত দ্রুত সম্ভব ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারলে মারিয়াকে—আর বলতে পারল না ফ্রান্সিস ওর গলা বুজে এলো।
জাহাজঘাটের কাছাকাছি আসতে চাঁদের আলোয় দেখা গেল একটা বন্দর এলাকা। বেশ কয়েকটা জাহাজ নোঙর করে আছে। নানা দেশের পতাকা উড়ছে জাহাজগুলোর মাথায়। যে আলো ফ্রান্সিসরা দূর থেকে দেখেছিল সেই আলো জ্বলছে একটা বেশ উঁচু মিনারের মাথায়। যেন অনেকগুলো মশাল একসঙ্গে জ্বলছে। বোঝাই যাচ্ছে সমুদ্রে নজরদারির জন্যেই এরকম পাথর গেঁথে মিনার তৈরি করা হয়েছে।
ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে ছিল জাহাজের রেলিঙ ধরে। তাকিয়ে ছিল জাহাজঘাটার দিকে। তখন দেখল একটা জাহাজ দ্রুত ফ্রান্সিসদের জাহাজের দিকে আসছে। ফ্রান্সিস জাহাজটা দেখেই বুঝল ওটা যুদ্ধজাহাজ।
ফ্রান্সিস দু’হাত তুলে চিৎকার করে বলে উঠল, ভাইসব, আমরা লড়াই করবো না। কেউ তলোয়ার হাতে নেবে না। আস্তে আস্তে সব ভাইকিংরা ডেক-এ এসে দাঁড়াল। কারো মুখে কথা নেই। শুধু বিস্কো আর বৈদ্যবন্ধু ভেন রইল মারিয়ার কাছে। মারিয়া তখনও চোখ বুজে শুয়ে আছে। জ্বর কমলেও মারিয়ার শরীরের কোনো সাড়া নেই। যখন কাশি উঠছে তখন মারিয়ার কষ্ট হচ্ছে বেশি। কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে আসে যেন। বিছানায় এপাশে-ওপাশে ছটফট করে। কাশি কমলে মুখ হাঁ করে হাঁপাতে থাকে।
যুদ্ধ জাহাজটা ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। ফ্রান্সিসদের জাহাজটা জোর ধাক্কা খেয়ে দুলে উঠল। যুদ্ধজাহাজ থেকে জনা দশেক সৈন্য তলোয়ার হাতে লাফ দিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজের ডেকে উঠে এলো। সর্বপ্রথমে যে উঠে এলো সে ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এলো। বোঝা গেল সেই দলনেতা। বেশ শক্তসমর্থ চেহারা। মুখে দাড়ি-গোঁফ। লম্বা টান টান শরীর। সৈন্যদের গায়ে হাঁটুঝুল মোটা কাপড়ের পোশাক। মাথায় শিরস্ত্রাণ, গায়ে বর্ম নেই। কোমরে চামড়ার ফেট্টি। তাতে তলোয়ারের খাপ গোঁজা।
দলনেতা ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে লো ল্যাতিন ভাষায় বলল, তোমরা তো এই অঞ্চলের লোক নও। তোমরা এখানে এসেছে কেন?
হ্যারি এগিয়ে এলো। ভাঙা ভাঙা লো ল্যাতিন ভাষায় বুঝিয়ে বলল, আপনার অনুমান ঠিক। আমরা বিদেশি, জাতিতে ভাইকিং আমরা। আমাদের মধ্যে একজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার চিকিৎসার জন্যে আমরা এখানে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমরা শান্তি চাই—যুদ্ধ চাই না।
দলনেতা একটু ভাবল। তারপর বলল, শুধু তোমার মুখের কথায় বিশ্বাস নেই। আমরা জাহাজ তল্লাশি করবো। তোমরা দস্যু লুটেরার দল হতে পারো।
হ্যারি ফ্রান্সিসকে মৃদুস্বরে সব কথা বুঝিয়ে বলল। ফ্রান্সিস বলল, ওরা যা করতে চায় করুক। বাধা দিও না।
হ্যারি বলল, আপনি জাহাজ তল্লাশি করুন—আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে জেনে রাখুন আমরা জলদস্যু নই। আমরা ভাইকিং—বীরের জাতি।
দলনেতা এসব কথায় বিশেষ কান দিল না। সঙ্গের সৈন্যদের ইঙ্গিত করল জাহাজ তল্লাশির জন্যে। চারজন সৈন্য সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। দুজন সৈন্য ডেক-এ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।
হ্যারি বলল, এটা কি কোনো দ্বীপ না দেশ?
এটা কর্সিকা দ্বীপ। এই বন্দরের নাম বোনিফেসিও—কর্সিকার দক্ষিণ প্রান্তের শেষ বন্দর। এখানকার সামন্ত রাজা সিনার্কা। দলনেতা বলল।
হ্যারি সব কথা ফ্রান্সিসকে বুঝিয়ে বলল। তারপর দলপতিকে বলল, তল্লাশি শেষ হলেই বুঝবেন আমরা জলদস্যু বা লুটেরার দল নই। আমাদের দেশের রাজকুমারী এই জাহাজে সাংঘাতিক অসুখে মৃতপ্রায়। আমাদের বিনীত অনুরোধ—আমরা নির্দোষ প্রমাণিত হলেই যত শিগগির সম্ভব রাজকুমারীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেবেন।
সেসব মাননীয় সিনার্কাকে বলবেন কাল সকালে। দলনেতা বলল।
হ্যারি বলল, না কাল সকালে নয়। আজ রাতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
দলপতি বেশ কড়া চোখে হ্যরির দিকে তাকাল। বলল, একটু পরেই সবাইকে কয়েদঘরে ঢুকতে হবে। তার জন্যে তৈরি হোন।
হ্যরি চিৎকার করে বলে উঠল, আমাদের নরকে নিয়ে যান—কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু রাজকুমারীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা আজ রাতেই করতে হবে। হ্যারিকে ক্রুদ্ধস্বরে এভাবে চিৎকার করে কথা বলতে ভাইকিং বন্ধুরা কখনও দেখেনি। ওরা বেশ আশ্চর্য হলো। হ্যারি ও দলপতির কথা ওরা না বুঝলেও হ্যারিকে সমর্থন জানাতে ওরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল—ও-হো-হো-হো।
ভাইকিংদের এভাবে উত্তেজিত হতে দেখে দলপতি বেশ ঘাবড়ে গেল। তবু গম্ভীরভাব বজায় রেখে বলল, মাননীয় সিনার্কা উত্তরে সারিনে গিয়েছেন বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে। উনি কাল সকালে ফিরবেন। তখন উনিই যা করবার করবেন।
হ্যারি ফ্রান্সিসকে সব কথা বুঝিয়ে বলল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল, হ্যারি, এখন উত্তেজিত হয়ো না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে সব কাজ করতে হবে।
—কিন্তু ফ্রান্সিস, বৈদ্য বলেছে আজ রাতের মধ্যেই সুচিকিৎসা চাইই চাই। হ্যারি বলল। জানি জানি। দেখা যাক দলপতি কী করে। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সমুদ্রের মৃদু গর্জন আর শোঁ শোঁ হাওয়ার শব্দ। যারা তল্লাশি চালাচ্ছিল তারা দলপতির কাছে এলো। ওরা বলল, জাহাজে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। শুধু একজন অসুস্থ মহিলার ঘরে কিছু গয়নাগাঁটি পাওয়া গেছে।
তেমন মূল্যবান কিছু জাহাজে লুকানো নেই।
দলপতি একবার মাথা ঝাঁকাল। তারপর গলা চড়িয়ে বলল—এই জাহাজটা দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে বন্দরে চলো। তারপর যা করার করবো।
দলপতি নিজেদের যুদ্ধজাহাজে চলে গেল। তার সৈন্যরা কয়েকজন মিলে ফ্রান্সিসদের জাহাজটা ওদের যুদ্ধজাহাজের পেছনের হালের সঙ্গে শক্ত কাছি দিয়ে বাঁধল। তারপর টেনে নিয়ে চলল ফ্রান্সিসদের জাহাজটা।
শাঙ্কো, ফ্রান্সিস আর বৈদ্য ভেন-এর কথাবার্তা থেকে বুঝতে পেরেছিল আজ রাতের মধ্যেই মারিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারলে মারিয়ার বাঁচার আশা কম। তাই শাঙ্কো জাহাজ থেকে পালাবার উপায় ভাবতে লাগল। তখনই সৈন্যরা জাহাজের তল্লাশি সেরে দলপতিকে সব জানাচ্ছিল। শাঙ্কো দেখল—এই সুযোগ। সৈন্যরা সব দলপতিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে নজর নেই। ও আস্তে আস্তে নিজেদের দল থেকে সরে এলো। গলা নামিয়ে হ্যারিকে বলল, হ্যারি আমি পালাচ্ছি। তারপর ডেক-এর ওপর নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল। দ্রুত গড়িয়ে গিয়ে মাস্তুলের পেছনে চলে গেল তারপরই সিঁড়িঘর। সিঁড়িঘরের আড়ালে গড়িয়ে চলে এলো পেছনে হালের কাছে। ঝোলানো দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল। তারপর হালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে নেমে এলো জলের ওপর। আস্তে জলে ডুবিয়ে দিল নিজেকে। দম বন্ধ করে ডুব সাঁতার দিয়ে বেশ দূরে গিয়ে আস্তে আস্তে জলের ওপর মাথা ভাসাল। দেখল, সেই সৈন্যরা কয়েকজন ওদের জাহাজের হালের সঙ্গে কাছি বাঁধছে। শাঙ্কো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল—যাক সময়মতোই পালানো গেছে। আর একটু দেরি হলে ও ধরা পড়ে যেত। শাঙ্কো জলে শব্দ না তুলে আস্তে আস্তে ওদের জাহাজের পেছনে পেছনে সাঁতরে চলল।
বোনিফেসিও বন্দরের ঘাটে এসে ফ্রান্সিসদের জাহাজ লাগল। দলপতির নির্দেশে সৈন্যরা কাঠের পাটাতন ফেলল। ফ্রান্সিসরা তখনও বুঝতে পারছে না দলপতি ওদের নিয়ে কী করবে।
এবার দলপতি ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে এলো। পাটাতনের সামনে দাঁড়িয়ে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল, সবাইকে নামতে হবে। তুমি সবাইকে নেমে আসতে বলো।
হ্যারি বলল, আপনাকে আগেই বলেছি আমাদের রাজকুমারী অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে অন্তত এই জাহাজে থাকতে দিন। পাহারা দিয়েই রাখুন।
দলপতি মাথা ঝাঁকিয়ে গলা চড়িয়ে বলে উঠল, না না—সবাইকে দুর্গে যেতে হবে। ওসব অসুখ-বিসুখ বুঝি না। হ্যারি, ফ্রান্সিসকে সব কথা বলল।
ফ্রান্সিস বলল, হ্যারি, এখন ওর কথা শুনে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ও যা বলছে। তাই করতে হবে।
কিন্তু সাংঘাতিক অসুস্থ রাজকুমারীকে—
ফ্রান্সিস ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমিই মারিয়াকে নিয়ে যাবো। দলপতির আদেশ মেনে চললে হয়তো মারিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা ঐ দলপতিই করে দেবে। দলপতি চিৎকার করে বলল, কী হলো? নামো সবাই।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল, সবাইকে নামতে বলো। আমি মারিয়াকে নিয়ে আসছি। ফ্রান্সিস নিজের কেবিনঘরের দিকে চলল।
হ্যারি এবার ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল, সবাই জাহাজ থেকে নেমে এসো। আমি জানি—এভাবে আমরা কখনো বিনা লড়াইয়ে বিনা প্রতিবাদে হার স্বীকার করি না। কিন্তু আজকের অবস্থা অন্যরকম। ফ্রান্সিস বলেছে দলপতি যা বলে তাই মেনে নিতে।
ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। দলপতি হ্যারির দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলল, এক্ষুণি সবাইকে নামতে বলো। নইলে সব ক’জনকে আমরা মেরে ফেলবো।
হ্যারি কথাটা বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল। ভাইকিংদের গুঞ্জন থামল। হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস অনেক ভেবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। ফ্রান্সিসের কথার অবাধ্য হয়ো না। এতক্ষণে ভাইকিংরা আস্তে আস্তে পাটাতন দিয়ে জাহাজঘাটায় নামতে লাগল। ওরা বুঝল রাজকুমারী অসুস্থ। তার চিকিৎসার দরকার সবার আগে।
ওদিকে ফ্রান্সিস কেবিনঘরে ঢুকে দেখল—বৈদ্য ভেন মাথা নিচু করে মারিয়ার মাথার কাছে বসে আছে। ফ্রান্সিস বৈদ্যকে ডাকল। তারপর আস্তে আস্তে সব কথা বলল।
বৈদ্য ভেন মারিয়ার কপালে হাত দিল। গলায় হাত দিল। বলল, জ্বর বেশি নেই। কিন্তু বিপদ এখনও কাটেনি। এ অবস্থায় রাজকুমারীকে নিয়ে যাওয়া খুব ঝুঁকি।
ফ্রান্সিস বলল, উপায় নেই। এই ঝুঁকি নিতেই হবে। মাথা নিচু করে মারিয়ার মুখের কাছে। মুখ এনে ফ্রান্সিস ডাকল, মারিয়া। মারিয়া কোনো সাড়া দিল না। ফ্রান্সিস আবার ডাকল, মারিয়া।
মারিয়া আস্তে আস্তে চোখ খুলল। একটু হাসার চেষ্টা করল। কোনো কথা বলতে পারল না। ফ্রান্সিস বলল, মারিয়া তোমাকে সব পরে বলবো। এখন আমাদের সবাইকে তীরে নামতে হবে। তোমাকে আমি পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাবো। যাতে তোমার কোনো কষ্ট না হয় তার জন্যে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো। শুধু তুমি একটু কষ্ট হলে সহ্য কোরো। পারবে তো? মারিয়া খুব আস্তে আস্তে মাথা কাত করলো। ফ্রান্সিস অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো।
মারিয়ার কাঁধের পেছনে হাত দিয়ে মাথাটা তুলল। হাঁটুর নীচে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে মারিয়াকে বিছানা থেকে তুলল। তারপর বেশ আস্তে আস্তে দরজার দিকে চলল। পেছন না ফিরে বলল, ভেন তোমার দরকারি ওষুধগুলো আনতে ভুলো না।
মারিয়াকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ডেক-এ ওঠার সময় বেশ অসুবিধে হলো ফ্রান্সিসের। অনেক আস্তে অনেক সাবধানতা সত্ত্বেও আঁকুনি লাগল। মারিয়ার মুখে কষ্টের শব্দ হলো—উঃ উঃ। মারিয়া কপাল কোঁচকাল। চোখ বন্ধই রইল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। আবার সাবধানে উঠতে লাগল।
কাঠের পাটাতনের সামনে এসে দেখল—বন্ধুরা আস্তে আস্তে সোজা রাস্তাটা দিয়ে চলেছে। সামনে পেছনে খোলা তলোয়ার হাতে সৈন্যরা পাহারা দিয়ে চলেছে। এসময় মারিয়ার হঠাৎ কাশি উঠল। ফ্রান্সিস বেশ ঘাবড়ে গেল। কাশি হলেই মারিয়ার কষ্ট হয় সবচেয়ে বেশি। কাশতে কাশতে মারিয়ার শরীরটা যেন বেঁকে যেতে লাগল। ফ্রান্সিস বহুকষ্টে মারিয়াকে ধরে থাকল। মুখ ঘুরিয়ে বৈদ্যকে ডাকল, ভেন—শিগগির এসো৷ বৈদ্য ভেন ছুটে এলো। মারিয়ার পিঠে দুহাতের তালু চেপে ধরল। কাশি কমল। ফ্রান্সিস তবু নড়ল না। কাশি থেমে গেল। মারিয়া মুখ হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। ওর চোখমুখ কুঁচকে গেল। মারিয়ার রোগার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে, মারিয়ার কষ্ট দেখে ফ্রান্সিসের মনটা হাহাকার করে উঠল। এত কষ্টের জীবন মারিয়ার সহ্য হবে না—এটা ওর আগে ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু এখন ওসব ভাবলে মন দুর্বল হয়ে যাবে।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে পাটাতন দিয়ে নামতে লাগল। ওর চোখেমুখে তখন সংকল্পের দৃঢ়তা। আলোর মিনার ছাড়িয়ে দলপতির পেছনে পেছনে সৈন্যদের পাহারায় ফ্রান্সিসরা পাথর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে চলল। দুপাশে ছাড়া ছাড়া পাথরের বাড়িঘর নিস্তব্ধ। এত রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তার এখানে-ওখানে মশাল জ্বলছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সবাই একটা দুর্গের সামনে এলো। দুর্গের সদর দেউড়িতে অনেক মশাল জ্বলছে। পাহারাদার সৈন্যরা দলপতিকে দেখে মাথা একটু নোয়ালো। পাহারাদারের সঙ্গে কী কথা হলো। ঘড় ঘড় শব্দে বিরাট কাঠের দরজা খোলা হলো। সবাই দুর্গের মধ্যে ঢুকল। একটা পাথর বাঁধানো ছোটো চত্বরের পরে একটা দরজার সামনে এসে সবাই দাঁড়াল। লোহার গরাদের দরজার মাথায় মশাল জ্বলছে। দুজন পাহারাদার সৈন্য পাহারা দিচ্ছিল। দলপতির নির্দেশে একজন এগিয়ে গিয়ে দরজার তালা খুলল। ঠং ঠাং শব্দে দরজা খোলা হলো। দলপতি হ্যারিকে বলল, সবাইকে ভেতরে ঢুকতে বলো।
হ্যারি বলল, কিন্তু আমাদের রাজকুমারী ভীষণ অসুস্থ। তাকে অন্তত রেহাই দিন।
দলপতি মাথা নেড়ে বলল, সেসব কাল সকালে সিনার্কাকে বলবেন।
হারি ফ্রান্সিসকে বলল সেকথা। ফ্রান্সিস বলল, আর কোনো অনুরোধ করো না। দেখা যাক কী হয়।
ঘরটা বেশ বড়ো। পাথুরে দেয়ালের আংটায় মশাল জ্বলছে। মশালের আলোয় ফ্রান্সিস দেখল ঘর জুড়ে দড়িবাঁধা শুকনো ঘাসের বিছানামতো। তার ওপর মোটা কাপড় পাতা। প্রায় দশ-বারো জন লোক শুয়ে আছে তাতে। ফ্রান্সিস বুঝল—ওরা বন্দি। এটা কয়েদঘর। ও মারিয়াকে নিয়ে ডানদিকের দেয়ালের কাছে এসে বিছানায় আস্তে আস্তে শুইয়ে দিল। মারিয়ার মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এলো। ফ্রান্সিস মারিয়ার কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বৈদ্য ভেন মারিয়ার একপাশে বসল। হাতের পুঁটুলি রাখল পাশে। হ্যারি এসে বসল ফ্রান্সিসের কাছে। আস্তে আস্তে বলল, ফ্রান্সিস শাঙ্কো জলে নেমে পালিয়েছে।
ফ্রান্সিস বলল, শাঙ্কো কি জানে আমাদের এখানে বন্দি করা হয়েছে?
আমি জাহাজ থেকে নামার সময় গলা চড়িয়ে দুবার বলেছি—শাঙ্কো আমাদের অনুসরণ করো। হ্যারি বলল।
যাক, একজন তো বাইরে রইলো। ফ্রান্সিস ক্লান্তস্বরে বলল।
হ্যারি ঘরটার চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ভাইকিং বন্ধুরা প্রায় সবাই শুয়ে পড়েছে। কয়েকজন হঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। অবশ্য কথা বলার মতো মনের অবস্থা এখন ওদের নেই। একদিকে রাজকুমারীর এই অবস্থা অন্যদিকে কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ—ওরা একেবারে নিশ্চল্প হয়ে গেছে। হ্যারি রা আসার আগে যে বন্দিরা ছিল তাদের দেখা গেল সবাই ঘুমিয়ে আছে। তাদের পরনে এই অঞ্চলের চাষিদের জোব্বামতো পোশাক। শুধু একজন পাথরের দেয়ালে পিঠ দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। মশালের আলো ওখানে অল্পই পৌঁছেছে। হ্যারি আবছা দেখল লোকটির পরনের পোশাক একইরকম তবে রঙটা ঘন নীল। একটু দামি ভালো কাপড়ের পোশাক। লোকটির মাথার এলোমেলো বড়ো বড়ো চুল কপালে নেমে এসেছে। মুখে পাতলা দাড়ি-গোঁফ। কতদিন এখানে বন্দি হয়ে আছে কে জানে। হ্যারি ওপরের দিকে তাকাল। পাথরের ছাদ। ডানদিকে ছাদের একটু নীচে মনে হলো একটা ফোকরমতো। আগে বোধহয় লোহার গরাদ বসানো জানালা ছিল। তাতে গরাদ নেই। ফোকরের জায়গাটা পাথর ভেঙে বড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু এত দ্রুত যে দেয়াল বেয়ে পৌঁছনো অসম্ভব।
হঠাৎ ফ্রান্সিস বলল, ভেন দ্যাখো তো। মনে হচ্ছে মারিয়ার জ্বরটা বেড়েছে।
ভেন এগিয়ে এলো। মারিয়ার কপালে গলায় হাত চাপল। বলল, একটা ওষুধ খাওয়াতে হবে।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে বল, একপাত্র জলের ব্যবস্থা করো। হ্যারি উঠে দাঁড়াল। বন্ধুদের কাউকে ডাকল না। কিন্তু জল কোথায়? হ্যারি চারদিকে তাকাল। বোধহয় হ্যারিকে চারিদিকে তাকাতে দেখেই প্রায় অন্ধকার থেকে লোকটি স্পেনীয় ভাষায় বলল, আপনি ও কি কিছু খুঁজছেন? বেশ ভারী গলা লোকটির।
হ্যারি একটু দ্রুতই শায়িতদের ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে লোকটির কাছে এলো। বলল, একজন অসুস্থকে ওষুধ খাওয়াতে হবে। জল কোথায় রাখা আছে?
লোকটি আঙুল তুলে বাঁ দিকের কোণটা দেখাল। বলল, ওখানে একটা বাড়তি কাঠের পাত্রও আছে। হ্যারি চলল সেই দিকে। একটু পরেই কাঠের পাত্রে জল নিয়ে ফিরে এলো। ভেন ততক্ষণে ওর ঝোলা থেকে ওষুধ বের করে হাতের তালুতে ঘষে ঘষে বড়ি বানিয়েছে। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে মারিয়ার মাথার নীচে হাত দিল। মৃদুস্বরে বলল, মারিয়া একটা ওষুধ খেয়ে নাও। তারপর হাত দিয়ে মাথাটা একটু উঁচু করল। ভেন বড়িটা হ্যারির হাতে দিল। হ্যারি জল আর বড়িটা আস্তে আস্তে মারিয়াকে খাইয়ে দিল। মাথা নামিয়ে দিতেই মারিয়া গোঙাতে লাগল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে মারিয়ার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল। কপালে মাথায় হাত বুলোতে লাগল। আস্তে আস্তে মারিয়ার গোঙানি বন্ধ হলো।
হ্যারি চুপ করে বসেছিল। শরীর ক্লান্ত। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। কিন্তু ফ্রান্সিস আর মারিয়ার দিকে চোখ পড়তে হ্যারি আর ঘুমের কথা ভাবতেই পারছিল না। হঠাৎ হ্যারি শুনল, আপনাদের মধ্যে অসুস্থ কে? হ্যারি মুখ ফিরিয়ে দেখল সেই লোকটি ওদের কাছে চলে এসেছে। হ্যারি হাত তুলে মারিয়াকে দেখাল। লোকটি বেশ আশ্চর্য হলো মারিয়াকে দেখে। বলল, ইনি তো মহিলা। তার ওপর অসুস্থ। সিনাৰ্কার সৈন্যরা এঁকেও বন্দি করল?
হ্যারি বলল, ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী।
আপনারা বিদেশি। লোকটি বলল।
হ্যাঁ, আমরা ভাইকিং। হ্যারি বলল।
আমার নাম রোক্কা। লোকটি বলল।
ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে হ্যারি বলল, ও ফ্রান্সিস—রাজকুমারীর স্বামী। আমি হ্যারি রোক্কা একটু মাথা নুইয়ে নিয়ে এ অঞ্চলের ভদ্রতা দেখাল। ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না। চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইল। হ্যারি ভাবল রোক্কার সঙ্গে কথা বলে সময়। কাটানো যাবে। জেগেও থাকা যাবে।
—রোক্কা, আপনাদের এই বন্দিদশার কারণ কী?
সে অনেক কথা। শুধু এটুকু বলি—সিনার্কা জেনো। জেনোয়ার অধিবাসীদের আমরা জেনো বলি। কর্সিকার এই দক্ষিণ অঞ্চলে সিনার্কা তার রাজস্ব কায়েম করেছে। দরিদ্র চাষি আর জেলেদের ওপর তার অত্যাচার নিপীড়নের শেষ নেই। আমরা তাই সিনার্কার অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি। আমাদের শক্ত ঘাঁটি হলো কিছু উত্তরে সারিন-এ। এখানে সব চাষি জেলেদের বিদ্রোহী করে তুলতে আমরা এসেছিলাম। সামান্য ভুলের জন্য ধরা পড়ি। মাস ছয়েক আমরা এখানে বন্দি হয়ে আছি। একবার এখান থেকে বেরুতে পারলে সিনার্কা ও তার তাবেদার ভূস্বামীদের কর্সিকা থেকে তাড়াবো। রোকা থামল। তারপর মারিয়ার চিকিৎসা কী হচ্ছে, ওরা কী করে এখানে এলো, এসব নিয়ে হ্যারির সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
.
শাঙ্কো সমুদ্রের জলে ডুব দিয়ে কখনো আস্তে আস্তে সাঁতরে সমুদ্রতীরে এলো। জল থেকে উঠে শাঙ্কো বাড়িঘরের আড়ালে আড়ালে রাস্তার ধারে এলো। পাথুরে দেয়ালের ৭ আড়াল থেকে দেখল—ফ্রান্সিসরা দুর্গে ঢুকল। বুঝল, এখানে নিশ্চয়ই কোনো কয়েদঘর আছে। ফ্রান্সিসদের সেখানেই বন্দি করা হলো।
শাঙ্কো বিছুদূরের একটা চেস্টনাট গাছের আড়াল থেকে চাঁদের আলোয় দুর্গটা দেখতে লাগল। কালো পাথরের দেয়ালে দেয়ালে কোথাও কোথাও ফাটল ধরা। সবুজে শ্যাওলার ছোপ। দেখে বুঝল দুৰ্গটা পুরনো। তবে এদিকটা সারাই করে দেউড়িতে কাঠের বিরাট দরজা বসানো হয়েছে। শাঙ্কো বুঝল এখান দিয়ে দুর্গে ঢোকা যাবে না। শাঙ্কো চলল দুর্গার পেছন দিকে।
দুর্গা ঘুরে শাঙ্কো দুর্গার পেছনদিকে এলো। দেখল—পেছন থেকে পাথুরে দেয়াল ভেঙে পড়েছে। দুর্গের এই ভাঙা অংশটার নীচেই একটা খাদমতো। খুব গভীর খাদ নয়। খাদটায় গাছপালার জঙ্গল। এদিকটায় দুর্গের ভাঙা পাথরের স্তূপ। সেই ভাঙা স্তূপ জমে জমে দুর্গার প্রায় মাথার কাছে উঠে গেছে। চাঁদের আলোয় ঐ দিকে ভালো করে নজর দিয়েও কোনো প্রহরীকে দেখল না। বুঝল—এদিক দিয়ে কেউ দুর্গে ঢুকতে পারবে না বলেই এদিকটা অরক্ষিত হয়ে আছে।
এবার শাঙ্কো খাদের বড়ো বড়ো গাছগুলোর মাথা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। চাঁদের আলোয় যতটুকু দেখতে পেল তাতে বুঝতে পারল ঐ বড়ো বড়ো গাছগাছালি বেয়ে উঠে পাথরের স্তূপের কাছে যাওয়া যাবে। তারপর ভাঙা পাথরের স্তূপের ওপর দিয়ে দুর্গের অনেকটা ওপরে ওঠা যাবে।
শাঙ্কো দ্রুত কাজে নামলো। খাদটার গায়ে গায়ে পাথরের এবড়োখেবড়ো চাইয়ের ওপর পা রেখে রেখে একটা বেশ উঁচুতে ডালপালা ছড়ানো ওক গাছের নীচে এলো। তারপর উঁচুতে ঝুঁকেপড়া ডাল দেখে হিসেব করল। গাছটায় উঠতে লাগল। ডালপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে যেটুকু চাঁদের আলো আসছে সেই আলোই শাঙ্কোর ভরসা। একসময় ওক গাছটার মগডালে উঠে এলো। ডালটা ধরে তন্য একটা মোটা ডালে পা টিপে টিপে এগোতে লাগল। দুর্গোর ভাঙাপাথরের স্তূপের কাছে এলো। শাঙ্কো তখন বেশ হাঁপাচ্ছে। গাছটার কাণ্ড বেয়ে বেয়েও ওকে উঠতে হয়েছে অনেকটা। একটু অপেক্ষা করে দম নিল। তারপর ঐ ডালটা ছেড়ে দিয়ে পাথরের স্তূপের ওপর নেমে এলো। এখানে জ্যোৎস্না উজ্জ্বল। ও সাবধানে ভাঙা পাথরে পা রেখে রেখে দুর্গের ওপর উঠতে লাগল। তখনই দেখল বাঁ দিকের পাথরের ভাঙা সিঁড়ি নেমে গেছে। ফ্রান্সিসদের কোন ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে শাঙ্কো তো জানে না তা। ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে কিছুটা নামতেই দেখল ডানহাতি একটা জানালার মতো ফোকর। তবে ভাঙা। শাঙ্কো দেখল ভাঙা সিঁড়িগুলো থেকে ফোকরটা হাত পনেরো দূরে। এই ফাঁকটা পার হবার উপায় নেই। শাঙ্কো ওখান থেকে দু’হোৈতর চেটো মুখের কাছে গোল করে ফোকরের দিকে মুখ এগিয়ে ডাকল, ফ্রান্সিস হ্যারি ফোকরের নীচের কয়েদঘরে তখন হ্যারি আর রোক্কা মৃদুস্বরে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিল। ওরা সেই ডাক শুনতে পেল না। কিন্তু ফ্রান্সিস ডাকটা অস্পষ্ট শুনল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। কান পাতল। হ্যারি আর রোক্কা কথা থামিয়ে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। আবার একটু স্পষ্ট ডাক শোনা গেল, ফ্রান্সিস—হ্যারি হ্যারি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। চাপাস্বরে বলল, নিশ্চয়ই শাঙ্কো।
কিন্তু কোথা থেকে ডাকছে শাঙ্কো? ফ্রান্সিস চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল। হ্যারি আঙুল দিয়ে ছাদের কাছে ভাঙা জানালাটা দেখিয়ে বলল—ঐখান থেকে শাঙ্কো ডাকছে।
ফ্রান্সিস ও দুহাতে চেটো গোল করে বলল—শাঙ্কো—আমরা এই ঘরে।
ভাঙা জানালার নীচে শাঙ্কোর কথা শোনা গেল, অপেক্ষা করো। আমি দড়ি নিয়ে আসছি। ফ্রান্সিস হ্যারি রোক্কা তিনজনেই কথাটা শুনল।
রোক্কা বলল, কে কথা বলছে?
আমাদের এক বন্ধু—শাঙ্কো। ও যদি ঐ ভাঙা জানালা দিয়ে দড়ি নামিয়ে দিতে পারে তাহলে আমরা দড়ি বেয়ে উঠে ঐ ভাঙা জানালা দিয়ে পালাতে পারবো। হ্যারি বলল।
শাঙ্কো নিশ্চিন্ত হলো—যাক ফ্রান্সিসদের পাওয়া গেছে ভাঙা জানালার নীচের ঘরটাতে। শাঙ্কো আর দাঁড়াল না। ভাঙা পাথরের স্তূপের ওপর দিয়ে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব নামতে লাগল। ওক গাছটার কাছে এসে লাফিয়ে উঠে মগডালটা ধরল। তারপর গাছ থেকে কখনও ডাল ধরে কখনও কাণ্ড বেয়ে বেয়ে দ্রুত নীচে নেমে এলো। ছুটল জাহাজঘাটের দিকে। জাহাজ থেকে মোটা কাছি আনতে হবে।
রাস্তা দিয়ে নয়—শাঙ্কো বাড়িঘরদোরের আড়ালে আড়ালে গাছ ছোপ পাথুরে মাটির ওপর দিয়ে বেশ দ্রুত ছুটে এলো জাহাজঘাটে। চাঁদের আলোয় দেখল—নোঙকরা ওদের জাহাজটাকে মাঝখানে রেখে দুটো যুদ্ধজাহার্জ দাঁড়িয়ে আছে—এখানে যুদ্ধ জাহাজকে বলে ফেল্লকা। সৈন্যদের হাঁটুঝুল কাপড়ের পোশাককে বলে কাপট। শাঙ্কো ঠিক করল ওদের জাহাজ থেকেই লম্বা কাছি আর দড়ির মই নেবে। তার আগে ফেল্লকা দুটোর নোঙরের দড়ি কেটে দিতে হবে যাতে ফেল্লকা দুটো বাতাসের ধাক্কায় আস্তে আস্তে গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যায়। বাতাস সমুদ্রের দিকেই বইছে। আস্তে আস্তে ফেল্লকা দুটো ভেসে গেলে ভেতরের সৈন্যরা বুঝতেই পারবে না।
শাঙ্কো দেখল জাহাজঘাটের এখানে-ওখানে মশাল জ্বলছে নজরদার মিনারের ওপারের আগুনও স্তিমিত। একটা অন্ধকার জায়গা বেছে নিয়ে শাঙ্কো সেখান দিয়ে গুঁড়ি মেরে গিয়ে সমুদ্রের জলে নামল। জলে কোনো শব্দ না তুলে চলল বাঁদিকের ফেলুকার দিকে। ফেলুকার কাছে এসে চাঁদের আলোয় দেখল—মাত্র একজন কাপটপরা সৈন্য ডেক-এ ঘোরাফেরা করছে। শাঙ্কো জলে ডুব দিয়ে ফেলুকার নোঙরবাঁধা কাছিটার কাছে আস্তে জল থেকে মাথা তুলল। তারপর কোমর থেকে ছোরাটা খুলল। ধারালো ছোরার কয়েকটা পোঁচেই নোঙরের কাছি কেটে গেল। ফেল্লুকাটা (জাহাজ) আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল গভীর সমুদ্রের দিকে।
শাঙ্কো কোমরে ছোরা গুঁজে এ পাশের ফেল্লকার দিকে নিঃশব্দে জল ঠেলে চলল। নোঙরের কাছির কাছে এলো। কাছিটা দেখে ওর মনে হলো এই কাছিটাই নিয়ে গেলে ভালো হয়। ও এই কথা ভেবে জলে ডুব দিল। কাছিটার গায়ে হাত দিয়ে দিয়ে বেশ নীচে নেমে এলো। তারপরে ছোরা বের করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাছিটা কাটল। কোমরে ছোরা গুঁজে আস্তে জলের ওপর মাথা তুলল। তখনই নজরে পড়ল ফেল্লুকার পেছনে হালের কাছে মইটা ঝুলছে। কাঠের ছোটো ছোটো ধাপবাঁধা দড়ির মইটা বেশ শক্তপোক্ত। ওদের দড়ির মইয়ের চেয়ে অনেক ভালো আর লম্বাও।
শাঙ্কো ফেল্লকার পেছনে হালের কাছে নিঃশব্দে এলো। হালের কাঠের খাঁজে খাঁজে পায়ের ভর রেখে রেখে পেছনে ডেক-এ উঠে এলো। ছোরা বের করল। দ্রুত হাতে মইটা যে লম্বা দড়ির সঙ্গে বাঁধা সেটা কেটে ফেলল। নোঙরের বাঁধা কাছিটা কেটে ছোরাটা কোমরে গুঁজল। কাটা কাছির মুখটা কোমরে জড়ালো। তারপর দড়ির মইয়ের মুখের দড়িটা হাতে নিয়ে হালের মইয়ের প্রথম ফাঁকটায় বাঁ হাত গলিয়ে কাঁধে আটকে নিল। কাছির মুখটাও বাঁ হাতে ধরল। ডান হাতটা দিয়ে জল টেনে টেনে আস্তে আস্তে সাঁতরে চলল তীরের দিকে। মই আর লম্বা কাছি টেনে আনতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। তবে দুরত্ব কম বলে কিছু পরেই সব নিয়ে তীরে উঠল। কাছির সবটা কোমরে পেঁচিয়ে নিল। শাঙ্কোর শরীর দেখাল পিপের মতো। মইটা দ্রুত হাতে ভাজ করে করে গুটিয়ে কাঁদে ফেলে শাঙ্কো চলল সেই দুর্গের পেছন দিকে। এক্ষণে সমুদ্রের জোর হাওয়ায় শাঙ্কোর জলে ভেজা শরীর শীত শীত করে উঠল। একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। সমুদ্রের ওপর পাতলা সাদাটে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখল ফেল্লকা দুটো অনেক দূরে ভেসে যাচ্ছে।
দুর্গের পেছনে যখন এলো তখন আকাশের দিকে তাকালরাত শেষ হতে কত দেরি? দেখল—চাঁদ আর তারাগুলোর আলো ম্লান হয়ে এসেছে। বুঝল—রাত বেশি নেই। শাঙ্কোরা তো জাহাজে জাহাজেই ঘুরে বেড়ায়। দিন রাতের আকাশ দেখে ওরা মোটামুটি সময় হিসাব করতে পারে।
কাছি আর মই নিয়ে বেশ কসরৎ করে শাঙ্কো ওক গাছটার ডাল থেকে পাথরের স্তূপের ওপর নামল। সাবধানে পা ফেলে ফেলে ভাঙা সিঁড়িগুলোর কাছে এলো। তারপর আগের মতোই হাতের তেলো গোল করে ডাকল, ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস তখনও দাঁড়িয়ে আছে।
উৎকণ্ঠায় ফ্রান্সিস তখন ভাবছে-শাঙ্কো কি ওদের পালাবার উপায় বের করতে পারবে?
শাঙ্কোর ডাক শুনেই ফ্রান্সিস আগের মতোই বলল, শাঙ্কো? শাঙ্কো তখন চাঁদের ম্লান আলোয় চারদিকে তাকাতে লাগল। দেখল দুটো বড়ো বড়ো পাথরের পাটাতন সিঁড়ির ওপর পড়ে আছে। শাঙ্কো মইয়ের একমুখের টানা দড়িটা দিয়ে পাথর দুটোয় পেঁচিয়ে বাঁধল। তারপর মইয়ের অন্য মুখটা দুহাতে ছুঁড়ে দিল ভাঙা জানালার ফোকরের দিকে। কিন্তু ফোকর দিয়ে গলে গেল না মইয়ের মাথাটা। পাথরে ঠকঠক শব্দ তুলে নীচে গড়িয়ে পড়ল। শাঙ্কো সাবধান হলো। কোনোরকম শব্দ হওয়া চলবে না। মইয়ের মুখটা টেনে তুলল। বার কয়েক মইয়ের মাথাটা শূন্যে ঘুরিয়ে জোরে ছুঁড়ে দিল ভাঙা ফোকরটার দিকে। এবার মুখটা ফোকরের মধ্যে দিয়ে গলে গেল। শাঙ্কো মইটা ছাড়াতে লাগল। মইয়ের মাথাটা নীচে নামতে নামতে মেঝের কাছে চলে এলো। তখন ফ্রান্সিস হ্যারি রোক্কা তিনজনই ছুটে এলো মইয়ের কাছে। ফ্রান্সিস মইয়ের মাথাটা কয়েকবার জোরে টানল। দেখল মইটা যথেষ্ট শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। এবার ফ্রান্সিস দ্রুতপায়ে মারিয়ার কাছে এলো। মারিয়ার কানের কাছে মুখ এনে ডাকল মারিয়া-মারিয়া। মারিয়া চোখ খুলল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল—আমরা পালাব। তোমার কষ্ট হবে, ব, কিন্তু দাঁত চেপে তোমাকে কষ্ট সহ্য করতে হবে।
কোনরকম শব্দ করবে না।
মারিয়া ঠোঁট একটু ফাঁক করে দুর্বলস্বরে বলল—আচ্ছা।
ফ্রান্সিস মারিয়াকে পিঠ আর হাঁটুর কাছে ধরে ধরে ঘাসের বিছানা থেকে তুলল। তারপর মারিয়াকে বাঁ কাঁধে শুইয়ে নিল। এই ঝাঁকুনিটা যত কমই হোক আর ফ্রান্সিস সাবধান থাকা সত্ত্বেও মারিয়ার কাশি এলো। শুরু হল মারিয়ার দমবন্ধকরা কাশি। ভেন তাড়াতড়ি মারিয়ার পিঠে হাত দিয়ে চেপে চেপে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস এক পাও নড়ল না। মারিয়াকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরের মধ্যে মারিয়া কাশলে ভয়ের কিছু নেই। মারিয়া এর আগেও কেশেছে—পাহারাদার সৈন্যরা শুনতেও পেয়েছে। কিন্তু ঐ ভাঙা জানালার কাছে উঠে কাশলেই বিপদ হবে। সেই কাশির শব্দ পাহারাদারদের কানে গেলে ওদের সন্দেহ হবেই। সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এই কয়েদঘর থেকে মুক্তির আর কোনো আশাই থাকবে না। মারিয়ার কাশি কমল। তবু ফ্রান্সিস নড়ল না। মশালের আলোয় হ্যারি দেখল—দুচোখ বন্ধ করে ফ্রান্সিস স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঘামে-ভেজা মুখ মশালের আলোয় চকচক করছে। একদিকে মারিয়ার জন্যে দুশ্চিন্তা অন্যদিকে পালাবার এই সুবর্ণ সুযোগ এবং শেষ সুযোগ ফ্রান্সিসের মনে কী ঝড়ের তোলপাড় চলছে হ্যারি সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারল। মারিয়ার কাশি বন্ধ হলো। মারিয়া মুখ হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস মারিয়াকে কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে মইয়ের দিকে এগোল। মইয়ের কাঠে পা রেখে আস্তে আস্তে উঠতে লাগল। ততক্ষণে ভাইকিংরা রোক্কার বিদ্রোহী বন্ধুরা সবাই দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগল ফ্রান্সিস কী অসীম ধৈর্য আর মনের জোরে সব কষ্ট সহ্য করে এক-পা এক-পা করে মই দিয়ে উঠছে। ভাইকিং বন্ধুদের কয়েকজনের চোখে জল এলো। সবাই মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল—ফ্রান্সিস যেন সফল হয়।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে মারিয়াকে নিয়ে উঠতে লাগল। একসময় ভাঙা জানালার ফোকরের নীচের পাথরে পা রাখল। পাথরগুলো জোড়ের জায়গায় ভেঙে গিয়ে বেশ আলগা হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস ডান পাটা রেখেই বুঝল সেটা। পা’টা নামিয়ে আনল। হিসেব করে পায়ের চাপ দিতে হবে। জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট আলোয় ও ডানদিকের জোড়া পাথরটায় ডান পা’টা রেখে পায়ের চাপ আস্তে আস্তে বাড়াতে লাগল সাবধানে। বেশি নড়ে গেলে ভারসাম্য রাখতে পারবে না। কাঁধে প্রায় অজ্ঞান মারিয়ার শরীরের চাপও রয়েছে। পাথরটা বেশি সরে গেলে ভারসাম্য হারিয়ে দুজনকেই ছিটকে পড়তে হবে সামনের হাত পনেরো অন্ধকার ফাঁকটার মধ্যে। তারপর অন্ধকারে নীচে কোথায় আছড়ে পড়বে। দুজনেরই মৃত্যু অবধারিত। ফ্রান্সিস মৃত্যুর চিন্তাটাকে অগ্রাহ্য করল মনে মনে। ওসব চিন্তা মনটাকে দুর্বল করে দেবে। শরীরটাকেও এখন সবচেয়ে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। এই অন্ধকারে বাঁকটায় পেতে রাখা দড়ির মই দিয়ে পার হতেই হবে।
দু একবার জোরে ডান পায়ের চাপ দিল পাথরটায়। পাথরটা নড়ে উঠলেও খুলে বেরিয়ে আসার মতো আলগা হয়ে যায়নি। ডান পায়ে চাপ দিয়ে ভর রেখে বাঁ দিকের পাথরটায় বাঁ পা রাখল। আস্তে। চাপ দিয়ে দেখল ওটার জোড়টা বেশ শক্ত। পাথরটা নড়লোই না। নিশ্চিন্ত হয়ে ফ্রান্সিস ওটায় বাঁ পা রেখে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে দাঁড়াল। ওর নাক দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে তখন। কাঁদে প্রায় অচেতন মারিয়ার শরীরের ভার। আবার হাতে সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে।
ফ্রান্সিস সামনের দিকে তাকাল। হাত পনেরো অন্ধকার গহ্বরমতো জায়গাটার ওপর শাঙ্কো টান টান দড়ির মইটা পেতে রেখেছে। সিঁড়ির মতো কাঠের ফালি বাঁধা দুটো শক্ত দডিতে। ঐ কাঠের ফালিগুলোতে পা রেখে রেখে অন্ধকার গহ্বরমত জায়গাটা পার হলেই পাথরের সিঁড়ি। ওপরের দিকে উঠে গেছে। সিঁড়িতে শাঙ্কো হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিঁড়ির ওপরটায় পাথরের দরজা। দরজার পাল্লা নেই। ভেঙে গেছে নিশ্চয়ই। ওপরে বোধহয় দুর্গের খোলা ছাদ। কারণ ওখান দিয়ে সামনের সিঁড়িতে পাথুরে দেয়ালে চাঁদের আলো কোণাকুণি পড়েছে। অতি দ্রুত ফ্রান্সিস এসব ভেবে নিল।
ফ্রান্সিস একটু দম নিল। তাকাল ঐ একফালি চাঁদের আলোটার দিকে। তাকিয়ে ওর হঠাৎ মনে হল কে যেন সাদা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। এরকম সুতোর কাজ করা পোশাক পরেও অনেকদিন যাকে গির্জার উৎসবে যেতে দেখেছে। ফ্রান্সিসের শরীরটা একটু কেঁপে উঠল। চোখ বুজে অস্ফুটস্বরে ডাকল—মা। ওর মনের জোর অনেক বেড়ে গেল। ও চোখ খুলে নিচু হল। প্রায় হামা দিয়ে কাঠের ধাপগুলোয় কখনও পা রেখে কখনও হাঁটু চেপে চেপে ও অন্ধকার গহ্বরমতো জায়গাটা পার হতে লাগল। পিঠে মারিয়ার নাক মুখ দিয়ে গরম শ্বাস পড়ছে। মারিয়ার শরীরও গরম। বেশ জ্বর। মারিয়া দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কিন্তু জ্বরের ঘোরে হাত আলগা হয়ে যেতে পারে। গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে। শরীরে একটা আলতো ঝাঁকুনি দিয়ে দু’তিনটে ধাপ দ্রুত পার হয়েই শেষ ধাপটাও পার হল। তখনই শাঙ্কো দুহাতে ওর বাহু ধরল। পাথরের সিঁড়ির দিকে টেনে আনল। ফ্রান্সিস পাথরের সিঁড়িতে দু পা রাখল। শাঙ্কো নিচু হয়ে বসল। ফ্রান্সিস ওর কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে শাঙ্কোর সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস তখন জোরে জোরে মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে অস্ফুটস্বরে ডাকল—মারিয়া। কোনো উত্তর নেই। আবার ডাকল—মারিয়া।
—উঁ। মারিয়া মুখে গোঙানির মতো শব্দ করল। ফ্রান্সিস বলল—তোমার কষ্ট হয় নি তো? মারিয়া কোনো কথা বলল না। এতক্ষণে ফ্রান্সিস বুঝল ওর পিঠে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। মারিয়া নিঃশব্দে কাঁদছে। পিঠের ওখানটার পোশাক ভিজে গেছে যেন।
ফ্রান্সিস আর দাঁড়াল না। মারিয়ার কাশি উঠলে ভয়ানক বিপদ হবে। পাহারাদারবা শুনতে পারে।
শাঙ্কো তখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। ফ্রান্সিস ও মারিয়াকে কাঁধে নিয়ে উঠতে লাগল। দুর্গের ছাদে উঠে শাঙ্কো এগিয়ে চলল। ফ্রান্সিস ও পিছু পিছু চলল। এখানে-ওখানে ভাঙা পাথরের পাটাতন ছড়িয়ে আছে। সেইগুলোর ওপর দিয়ে সাবধানে পা ফেলে ফেলে চলল। অসাবধান হলে পায়ের চাপে পাথর নড়ে যেতে পারে পাও পিছলে যেতে পারে।
শাঙ্কো তো জায়গাটা চেনে। ও ফ্রান্সিসের আগেই খাদের ধারে চলে এলো। এখানেই ও কাছিটা কোমর থেকে খুলে রেখেছিল। কাছির একটা মুখ টেনে বাঁধলো একটা পাথরের চাইয়ের সঙ্গে তারপর কাছিটা খাদে ঝুলিয়ে দিল। ফ্রান্সিস মারিয়াকে নিয়ে ততক্ষণে এসে পড়েছে।, শাঙ্কো বলল, ফ্রান্সিস, আমিই না হয় রাজকুমারীকে কাঁধে নিয়ে নামি।
ফ্রান্সিস শুধু বলল, আমি পারবো। তারপর মারিয়াকে কাঁধে নিয়ে কাছিটা ধরল। বলল, মারিয়া এবার কষ্ট হলেও আমাকে ভালো করে আঁকড়ে ধরো। মারিয়া দুর্বল শরীরের আর কতটা জোর পাবে। তবু জোরে আঁকড়ে ধরল ফ্রান্সিসকে। ফ্রান্সিস বলল, শরীরের সমস্তশক্তি দিয়ে আরো জোরে ধরো। একটুক্ষণ। আমরা মুক্তির দোরগোড়ায়। মারিয়া আরো জোরে আঁকড়ে ধরল। ফ্রান্সিস খাদের ওখানে পাথরে পা রেখে রেখে কাছি বেয়ে বেয়ে বেশ দ্রুতই নেমে এলো। বুঝল মারিয়া এত জোরে বেশিক্ষণ ধরে থাকতে পারবে না। এখানটায় পাথর কম। ম্লান চাঁদের আলোয় একটা ঘাস-ঝোপে-ঢাকা জায়গায় মারিয়াকে শুইয়ে দিল। তারপর পাশে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মুখ হাঁ করে হাঁপাতে লাগল।
হাঁপাচ্ছে তখন কয়েদঘরে সবাই এতক্ষণ মই বেয়ে পালিয়ে যাওয়া দেখছিল। হ্যারি যখন বুঝল মারিয়াকে নিয়ে ফ্রান্সিস পালাতে পেরেছে তখন রোক্কার দিকে তাকাল। বলল, রোক্কা, ফ্রান্সিস নিরাপদে পালাতে পেরেছে। এখন আপনাকে সবার আগে পালাতে হবে। পালিয়ে গিয়ে প্রথম আপনাকে রাজকুমারীর ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ এখন রাজকুমারীকে সুস্থ করে তোলার আগে পর্যন্ত আমরা কিছু ভাবতে পারছি না। আমাদের কারো মনে এখন শান্তি নেই। রোক্কা একটু ভাবল। বলল, কথাটা ঠিকই বলেছেন।
ফ্রান্সিস নিশ্চয়ই অসুস্থ রাজকুমারীকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। কারণ, ফ্রান্সিস এখানকার কিছুই চেনে না। হ্যারি বলল।
খুবই স্বাভাবিক। রোক্কা বলল। একটু ভেবে নিয়ে রোক্কা বলল, কিন্তু আর দেরি করা যাবে না। রোক্কা এবার দুহাত ওপরে তুলে নিঃশব্দে হাতের ইঙ্গিতে সবাইকে কাছে। আসতে বলল। সবাই এসে রোক্কাকে ঘিরে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়াল। রোক্কা লো ল্যাতিন ভাষায় নিজের দলের লোকেদের বলল, বন্ধুরা—এরা ভাইকিং-বিদেশি। এই কর্সিকা দ্বীপের কিছু ওঁরা চেনেন না। তোমরা ওঁদের আন্তরিকভাবে সাহায্য করবে এই আমার নির্দেশ। কারণ—এঁদের যেটুকু পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে নির্দ্বিধায় বলতে পারো এঁরা শুধু সৎ ও বিবেকবান নন—বীর ও দুঃসাহসী। একটু থামল রোক্কা। তারপর বলল, আমাদের আর দেরি করা উচিত হবে না! তোমরা এই ভাইকিং বন্ধুদের নিয়ে বার্গ পাহাড়ে আমাদের আস্তানায় চলে যাবে। আমি পরে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। রোকা থামল। তারপর হ্যারিকে বলল, আপনি আপনার বন্ধুদের আবার কথাগুলো বুঝিয়ে বলে দেবেন। এবার সবাই পালাবার জন্যে তৈরি হও। বলেই রোক্কা মইটার কাছে গেল। মই বেয়ে দ্রুত উঠতে উঠতে চাপা গলায় বলল, কোনো গোলমাল যেন না হয়। হ্যারি বন্ধুদের রোক্কার নির্দেশ বুঝিয়ে বলল। রোক্কা মই বেয়ে উঠে ফাঁকের জায়গাটা পার হয়ে ভাঙা পাথরের স্তূপের ওপর এলো। শাঙ্কো একটা পাথরের চাইয়ের আড়ালে আত্মগোপন করে চারদিকে নজর রাখছিল। এবার এগিয়ে এসে ঝোলানো কাছিটা আঙুল দিয়ে দেখাল। রোক্কা দ্রুত কাছি বেয়ে খাদে নামল। ফ্রান্সিস রোক্কাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। রোক্কা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, রাজকুমারীকে নিয়ে চলুন। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হলো। মারিয়াকে আস্তে আস্তে দুহাতে তুলে পাঁজাকোলা করে রোক্কার পেছনে পেছনে চলল। তখনই দেখল, পুব আকাশে লাল ও রং ধরেছে। সূর্য উঠতে দেরি নেই। চিন্তা হলো বন্ধুরা সূর্য ওঠার আগেই পালাতে পারবে কিনা। কিন্তু এখন আর ফিরে বন্ধুদের সাহায্য করার কথা ভাবতে পারল না। মারিয়ার জুরে গা পুড়ে যাচ্ছে। রোক্কা বসতি এলাকা এড়িয়ে ঝোঁপঝাড় পাথুরে এলাকা দিয়ে চলল। পেছনে মারিয়াকে নিয়ে ফ্রান্সিস ও যতটা সম্ভব দ্রুত ছুটল।
প্রায় আধঘণ্টা পরে রোক্কা একটা কাঠ আর পাথরে তৈরি বাড়ির পেছনে এলো। পেছনে পাথরের দেয়ালের গায়ে একটা কাঠের দরজা। রোক্কা দরজাটা বার কয়েক ধাক্কা দিল। দরজা খুলে গেল। সাধারণ পোশাকপরা একটি যুবক মুখ বাড়িয়ে রোক্কাকে দেখে হাসল। মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানাল। রোক্কা ফ্রান্সিসকে ইশারা করে ঢুকে পড়ল। ফ্রান্সিস ও ঢুকল। রোক্কা দুপাশের ঘর ছাড়িয়ে টানা বারান্দা দিয়ে বাইরের ঘরটায় এলো। কয়েকটা কাঠের তক্তা পেতে বিছানা করা। বালিশও আছে। রোক্কা ফ্রান্সিসকে হাতের ইঙ্গিতে মারিয়াকে শুইয়ে দিতে বলল। ফ্রান্সিস মারিয়াকে আস্তে আস্তে বিছানায় শুইয়ে দিল। রোক্কা যুবকটিকে বলল, শিগগির বৈদ্যমশাইকে আসতে বলো। যুবকটি ছুটে চলে গেল।
ফ্রান্সিস তক্তাপাতা বিছানায় বসল। হাঁপাতে লাগল। হঠাৎ ফ্রান্সিস মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। মারিয়া চোখ খুলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো দারুণ লাল। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়াল। ও বুঝে উঠতে পারল না কী করবে এখন? মারিয়া চোখ বুজল। অসাড় হয়ে শুয়ে রইল।
রোক্কার সঙ্গে একজন বয়স্ক লোক ঢুকলেন। তার গায়ে রোক্কার মতোই দামি পোশাক। তিনি বেশ দ্রুতই বিছানায় বসলেন। মারিয়ার কপালে হাত দিলেন। চোখ টিপে ধরে চোখের নীচটা দেখলেন। গোড়ালির কাছে হাত দিয়ে টিপে ধরলেন। রোক্কাকে বললেন, রোগীকে একটু পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দাও। লো ল্যাতিন ভাষা। ফ্রান্সিস বুঝল না। রোক্কা স্পেনীয় ভাষায় ফ্রান্সিসকে বলল কথাটা। ফ্রান্সিস মারিয়াকে ধরে আস্তে আস্তে বলল, বৈদ্যমশাই তোমাকে পরীক্ষা করবেন। একটু পাশ ফিরে শোও। মারিয়া পাশ ফিরতে গেলে ফ্রান্সিস সাহায্য করল। বৈদ্যমশাই মারিয়ার পিঠে আঙুল পেতে অন্য আঙুলে বেশ কয়েকবার ঠুকলেন। ফ্রান্সিসকে ইঙ্গিতে সোজা করে শোয়াতে বললেন। কয়েকটা নির্দেশ দিলেন। তারপর চুপ করে বসে রইলেন। কেউ কোনো কথা বলল না। একটু পরে যুবকটি একটা ছোটো চিনেমাটির বাটিতে সবজে রঙের জল নিয়ে এলো। তখনই মারিয়ার কাশি উঠল। আবার সেই কষ্ট, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে কাশতে কাশতে। মারিয়া মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগল। ফ্রান্সিস অসহায়ের মতো মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কাশি কমল। একটু পরে কাশি বন্ধ হলো। মারিয়া মুখ হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস বৈদ্যর মুখের দিকে তাকাল। দেখল বৈদ্যমশাইয়ের কপালে চিন্তার রেখা। উনি একদৃষ্টিতে মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এবার ফ্রান্সিসকে ইঙ্গিতে ওষুধটা খাইয়ে দিতে বললেন। ফ্রান্সিস ওষুধের বাটিটা মারিয়ার মুখের কাছে এনে বলল, মারিয়া একটু কষ্ট করে এই ওষুধটা খাও। অসুখ সারবে। ফ্রান্সিস বাঁ হাতে মারিয়ার মাথাটা তুলে ধরল। মারিয়া চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ওষুধটা খেয়ে নিল। মুখ বিকৃত করল। বোঝা গেল ওষুধটা বিস্বাদ। মাথাটা বালিশে নামাল ফ্রান্সিস বৈদ্যমশাই একটুক্ষণ বসে থেকে উঠলেন। মৃদুস্বরে ডাকলেন—কামেরাত যুবকটি এগিয়ে এলো, কামেরাতকে কী নির্দেশ দিলেন। এবার রোক্কা জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলেন? বৈদ্যমশাই লো ল্যাতিন ভাষায় বললেন, নিশ্চয়ই আগে কিছু ওষুধ পড়েছিল। নইলে উনি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতেন। বৈদ্যমশাই চলে গেলেন।
উৎকণ্ঠিত ফ্রান্সিস বলল—রোক্কা, বৈদ্যমশাই কী বললেন?
রোক্কা আসল কথা না বলে একটু হেসে বলল, বললেন অসুখ সেরে যাবে। তবে কয়েকদিন ওষুধ পড়তে হবে। ফ্রান্সিস একটু আশ্বস্ত হলো। মারিয়া চোখ বন্ধ অবস্থাতেই শুয়ে রইল। ফ্রান্সিস বুঝল না মারিয়া কথাটা শুনেছে কি না।
কামেরাত একটি মোটা কাপড় নিয়ে এলো। মারিয়ার গায়ে ঢাকা দিল গলা পর্যন্ত। তারপর চলে গেল। রোক্কা বলল, আমি একটু আসছি। রোক্কা চলে গেল। একা ফ্রান্সিস মারিয়ার শিয়রে বসে রইল। ফ্রান্সিস ভাবতে লাগল, বন্ধুরা কেউ তো জানতেই পারল না আমরা এখানে আছি। রোক্কাকে বলতে হবে ওদের খবর দেবার জন্যে।
.
ওদিকে কয়েদঘর থেকেই রোক্কার বিদ্রোহী সৈন্যরা আর ভাইকিংরা মই বেয়ে পালাতে লাগল। ভাইকিংরা দশ-পনেরো জন আর কয়েকজন রোক্কার বিদ্রোহী সৈন্য পালিয়েছে তখন। এতজনের নড়াচড়া মই বেয়ে ওঠায় বেশ শব্দ হতে লাগল। তখনই দেখা গেল ভাঙা জানালা থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ল। পাথরটা মাঝের বিছানা ঘেঁষে পড়ল। আবার জোর শব্দ তুলে পাথরটা ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে গেল। পাহারাদার জেনো সৈন্যদের সন্দেহ হলো। ওরা লোহার দরাজ খুলে দ্রুত কয়েদঘরে ঢুকল। মসালের আলোয় মই দেখেই ওরা বুঝল কিছু কয়েদী পালিয়েছে। রোক্কাও পালিয়েছে। দুজন পাহারাদার সৈন্য নিরস্ত্র ভাইকিংদের ওপর তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাইকিংরা কয়েকজন আহত হলো। অন্য সৈন্য দু’জন তলোয়ার চালিয়ে চালিয়ে মইয়ের দড়ি কেটে দিল। বাকি ভাইকিংদের আর রোক্কার বিদ্রোহী সৈন্যদের একজনের পালানো হলো না। কয়েদঘরে তালা লাগিয়ে পাহারাদার সৈন্যরা চলে গেল।
ভাঙা সিঁড়িটার কাছে দাঁড়িয়েছিল শাঙ্কো। কয়েদঘরে গোলমাল, পাহারাদার সৈন্যদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনেই বুঝল—ওরা টের পেয়েছে। বোধহয় মইয়ের দড়িও কেটে দিয়েছে। আর কারো পালানোর সম্ভাবনা নেই।
শাঙ্কো ভাঙা পাথরে পা রেখে রেখে যতটা দ্রুত সম্ভব খাদে নেমে এলো। মুক্ত বন্ধুরা এসে শাঙ্কোকে জড়িয়ে ধরল। শাঙ্কো বলল, বন্ধুরা, এখনও সব বন্ধু পালাতে পারেনি। পাহারাদার সৈন্যরা টের পেয়ে মইয়ের দড়ি কেটে দিয়েছে। এক্ষুণি আমাদের জাহাজে যেতে হবে। অস্ত্র এনে লড়াই করে বাকি বন্ধুদের মুক্ত করতে হবে।
হ্যারি বলল, কিন্তু জেনো সৈন্যদের যুদ্ধজাহাজ দুটো আমাদের জাহাজের দুপাশেই রয়েছে।
শাঙ্কো একটু হেসে বলল, আমি দুটো জাহাজেরই নোঙর বাঁধা দড়ি কেটে দিয়েছি। দুটো জাহাজই এখন মাঝ সমুদ্রে। এখানকার পাহারাদার আর কিছু সৈন্য হয়তো এখন আছে। ওদের লড়াই করে হারাতে অসুবিধে হবে না। এই সুযোগ। আর দেরি নয়। সব জাহাজঘাটায় চলো।
ওরা দল বেঁধে ছুটল জাহাজঘাটার দিকে। শাঙ্কো যে পাথুরে মাটি ঝোঁপঝাড়ের এলাকা দিয়ে জাহাজঘাটায় এসেছিল সেই জায়গা দিয়েই বন্ধুদের নিয়ে চলল। বসতি। এলাকা থেকে দূরে।
জাহাজঘাটায় এসে চাঁদের আলোয় দেখল সত্যি শুধু ওদের জাহাজটাই ভাসছে। জেনোদের যুদ্ধজাহাজ দুটো নেই। বোঝা গেল—ঐ দুই জাহাজের সৈন্যরা এখনও বোধহয় বুঝতে পারেনি যে ওদের জাহাজ জাহাজঘাটা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে।
শাঙ্কো হ্যারি রা দ্রুত কাঠের পাটান দিয়ে ওদের জাহাজে উঠল। দ্রুত ছুটল অস্ত্রঘরের দিকে।
অস্ত্রঘর থেকে তলোয়ার নিয়ে ওরা ডেক-এ উঠে এলো। শাঙ্কো নিয়ে এলো ওর তীর ধনুক।
জাহাজ থেকে নামলেই দেখল তিনচারজন জেনো সৈন্য জাহাজঘাটার দিকে ছুটে আসছে। ওরা বোধহয় ওদের ফেল্লুকা মানে যুদ্ধজাহাজ দেখতে না পেয়েই ছুটে আসছিল।
সামনেই অস্ত্র হাতে শাঙ্কোরা। শুরু হলো লড়াই। তখন চাঁদ আর তারার আলো নিস্তেজ হয়ে আসছে। ভোর হতে দেরি নেই। লড়াই চলল। বিস্কোর নিপুণ তলোয়ার চালানো দেখে জেনো সৈন্যরা বুঝল এদের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে না। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনজন জেনো সৈন্য আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। গোঙাতে লাগল। শেষেরটির হাতের তলোয়ার বিস্কোর একটা জোরালো মার ঠেকাতে গিয়ে তখন ছিটকে গেছে। সেই সৈন্যটি সঙ্গে সঙ্গে ছুটল দুর্গের দিকে।
দুর্গের সামনে যখন ওরা এলো তখন সকালের রোদ পড়েছে দুর্গের কালচে পাথুরে গায়ে। কাছে এসে দেখল সদরদেউড়ির সামনে খোলা তলোয়ার হাতে জেনো সৈন্যরা আট-দশ জন দাঁড়িয়ে আছে। সবার সামনে সেই দলপতি। হ্যারি চিৎকার করে বলল, দাঁড়াও। সবাইদাঁড়িয়ে পড়ল। হ্যারি বলল, শাঙ্কো, পায়ে তির ছুঁড়ে কয়েকটাকে ঘায়েল করো। বুকে মেরো না। বন্ধুদের উদ্ধার করাই আমাদের লক্ষ্য—অকারণে নরহত্যা আমরা চাই না।
শাঙ্কো পাথুরে রাস্তায় বাঁ হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর নিশানা স্থির করে তির ছুঁড়ল দলপতির দিকে। দলপতি তলোয়ার ফেলে দু’হাতে হাঁটু চেপে বসে পড়ল। শাঙ্কো আর একটা তির ছুঁড়ল। ওটা দুর্গের কাঠের দরজায় গিয়ে বিঁধে গেল। আবার দ্রুতহাতে তির ছুঁড়ল শাঙ্কো। আর একজন সৈন্যের ডান হাতে লাগল তিরটি। সে তলোয়ার ফেলে বা হাত দিয়ে ডান হাতটা চেপে ধরল। এবার জেনো সৈন্যদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। ওরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। তারপর ছুটে পালাতে লাগল দুর্গের ডানপাশে। একটু পরেই ওদের আর দেখা গেল না। গাছগাছালির আড়াল দিয়ে কোথায় পালিয়ে গেল ওরা।
হ্যারি সঙ্গীদের নিয়ে ছুটে দুর্গের সদর দেউড়িতে এলো। দেখল বিরাট কাঠের দরজাটা একটু খোলা। তার মানে ভেতরের কয়েদঘরের পাহারাদার 1্যৈরাও এসেছিল বাধা দিতে। শাঙ্কোর তিরে আহত একজন পাহারাদার সৈন্যের কোমরে ঝোলানো আংটায় কয়েদঘরের চাবি পাওয়া গেল। হ্যারি চাবি নিয়ে দরজা পার হয়ে কয়েদঘরের দিকে ছুটল। পেছনে বন্ধুরা।
কয়েদঘরের তালা খুলল হ্যারি তারপর জোরে ধাক্কা দিয়ে লোহার দরজা খুলেই চিৎকার করে বলল—বন্ধুরা পালিয়ে এসো। বন্দি ভাইকিংরা ছুটে এলো। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল, তাড়াতাড়ি পালাতে হবে। সবাই ছুটে দুর্গের বাইরে এলো। এবার কোথায় যাবে ওরা? হ্যারি দেখল রোক্কার একজন বিদ্রোহী সৈন্য মাত্র মুক্ত বন্ধুদের দলে আছে। হ্যারি ছুটতে ছুটতে সেই সৈন্যটিকে লো ল্যাতিন ভাষায় বলল, রোক্কা আমাদের যেতে বলেছে তোমাদের বার্গ পাহাড়ের আস্তানায়। আমাদের সেখানে নিয়ে চলো।
সৈন্যটি বলল, রোক্কার নির্দেশ মানার জন্যেই আমি আগে পালাইনি। চলুন। কিন্তু সদর রাস্তা দিয়ে নয়। অন্যদিক দিয়ে যেতে হবে। সেই সৈন্যটি সবার সামনে এসে ছুটতে লাগল।
পাথর ছড়ানো অসমতল জায়গা দিয়ে, পাথুরে মাটির ওপর দিয়ে গাছ-গাছালির আড়ালে আড়ালে ওরা ছুটতে লাগল বার্গ পাহাড়ের দিকে।
বেশ কিছুটা আসার পর দূর থেকে দেখল ওরা ধুলো উড়িয়ে রাস্তা দিয়ে কারা যেন আসছে। সৈন্যটি সঙ্গে সঙ্গে হ্যারিকে বলল, সবাইকে ঝোঁপের আড়ালে শুয়ে পড়তে বলুন। হ্যারি একটু গলা চড়িয়ে কথাটা বলেই নিজেও একটা কাটাঝোঁপের আড়ালে শুয়ে পড়ল। সবাই এখানে-ওখানে ছোটা ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে শুয়ে পড়ল।
দুর থেকে প্রথমে সিনার্কার গাড়িটা দেখা গেল। তারপর অশ্বারোহী সৈন্যরা। পরে পদাতিক সৈন্যরা। স্পষ্ট দেখা গেল না। কিন্তু সৈন্যটি সিনার্কার গাড়ি দেখেই চিনল। সিনাকার সৈন্যরা চলে যেতে বিদ্রোহী সৈন্যটি হ্যারিকে বলল, বোধহয় সারিনের লড়াইয়ে সিনার্কা আমাদের সৈন্যদের কাছে হেরে গেছে।
আবার ছোটা শুরু হলো। কিছুক্ষণ পরে দূরে একটা ছোটো পাহাড় দেখিয়ে রোক্কার সৈন্যটি বলল, ঐ যে বার্গ পাহাড়। দেখা গেল পাহাড়টায় গাছগাছালি বিশেষ নেই। হ্যারি রা চলল ঐ বার্গ পাহাড় লক্ষ্য করে। বার্গ পাহাড়টার নীচে এসে দেখা গেল বেশ ঘন জঙ্গল। ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে ফিরে গাছের নুয়ে পড়া ডালপালা সরিয়ে ওরা রোক্কার বিদ্রোহী সঙ্গীটির পেছনে পেছনে একটা বিরাট পাথরের চাইয়ের সামনে এলো। বিদ্রোহীটি মুখ নামিয়ে কী যেন বলে উঠল। পাথরের চাইয়ের আড়াল থেকে দু’তিন জন যোদ্ধা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে এলো। ভাইকিংদের দেখে ওরা বেশ আশ্চর্য হল। তারপরেই হ্যারি দের সশস্ত্র দেখে ওরা থমকে দাঁড়াল। বিদ্রোহী সঙ্গীটি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ওদের কী বলল। ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে এবার হাসল। হাতের ইশারায় হ্যারিকে ডেকে ওদের পেছনে পেছনে আসতে ইঙ্গিত করল। ভাইকিংরা ওদের পেছনে পেছনে চলল। পাথরের চাইটার নীচে দিয়ে গুঁড়ি মেরে সবাই একটা বেশ বড়ো লম্বাটে গুহায় ঢুকল। দেখল—জনা পঁচিশেক বিদ্রোহী সৈন্য শুয়ে বসে আছে। এটাই তাহলে বিদ্রোহীদের আস্তানা। হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে পাথুরে মেঝেয় বসে পড়ল। অন্য ভাইকিং বন্ধুরাও হাঁপাচ্ছে তখন। ওরাও বসে পড়ল। এই সকালেও গুহাটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার।
ওদিকে রোক্কা যা আশঙ্কা করেছিল তাই ঘটল।
সেদিন সকালে কয়েকজন ভাইকিং বিদ্রোহীদের আস্তানা সেই গুহা থেকে বেরিয়ে এলো। পাহারাদার বিদ্রোহী সৈন্যটি তখন সকালের খাবার খেতে গুহার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। কেউ ছিল না গুহা মুখে। ভাইকিং বা কয়েকজন বাইরে এসে গুহার মুখের কাছে বিরাট পাথরের চাইটার ওপর আস্তে ওঁচানো পাথর খোদলে পা রেখে রেখে চাইটার ওপর উঠল। চারদিকে ঝকঝকে রোদ সবই দেখতে পাচ্ছিল ওরা। বার্গপাহাড়ের মাথার দিকে সবুজের চিহ্ন মাত্র নেই। কিন্তু নীচে গভীর জঙ্গল। ওরা দেখে আশ্চর্য হল যে বড়ো বড়ো ফার্ণ গাছের সংখ্যাই এই বনে বেশি। অনেক দূরে বোনিফেসিওর পাথরের বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। দুৰ্গটাতো ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। তবে জাহাজঘাটা দেখা যাচ্ছে না। দুর্গের আড়ালে পড়ে গেছে। তবে অস্পষ্ট হলেও সমুদ্র দেখা যাচ্ছে।
ভাইকিংরা কিছু পরেই পাথরের চাইটা থেকে নেমে এলো। গুহায় ঢুকল। হ্যারি মেঝেয় একটা মোটা কাপড় পেতে শুয়েছিল। ওদের দেখে বলল—কোথায় গিয়েছিলে। ভাইকিং বন্ধুদের একজন বলল—এই গুহার দমবন্ধকরা অন্ধকার ভালো লাগছিল না। তাই বাইরে গিয়েছিলাম।
—বাইরের বনটা সত্যই সুন্দর। আর একজন ভাইকিং কি বলল।
তখনই গুহার পাহারাদার ছুটে হ্যারির কাছে এলো। পাহারাদর জানে যে একমাত্র হ্যারিই লো ল্যাতিন ভাষা বোঝে। পাহারাদার এসে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল—আপনার বন্ধুরা বাইরে গিয়েছিল?
—হ্যাঁ। হ্যারি বলল।
পাহারাদর বলল—আপনার বন্ধুরা এটা ভালো করেনি।
—কেন বলুন তো? হ্যারি জানতে চাইল।
—সারিনের লড়াইয়ে আমাদের বিদ্রোহী দলের কাছে হেরে গিয়ে সিনার্কা ক্ষেপে আগুন হয়ে গেছে। এই বোনিফেসিও আর ধারে কাছে সব জায়গায় সব সময়ের জন্যে গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছে। এই সংবাদ পাওয়ামাত্র আমরা সাবধান হয়ে গেছি। কিন্তু এসময় গুহার অস্তানা থেকে আপনার বন্ধুরা না জেনে বাইরে গেছে। যদি সিনার্কার কোনো গুপ্তচরের নজরে পড়ে থাকে তবে আমরা বিপদে পড়ে যাবো। তখন এই গুহার মতো ভালো আস্তানা ছেড়ে পালাতে হবে। নতুন আস্তানা খুঁজে নিতে হবে। আত্মরক্ষার সময় নাও পেতে পারি। আমাদের দলের ভীষণ ক্ষতি হতে পারে। পাহারাদর বিদ্রোহী যোদ্ধাটি বলল।
হ্যারি কিছু বলতে পারল না। কারণ যা ঘটবার ঘটে গেছে। আসলে ভাইকিং বন্ধুরা ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারে নি। হ্যারি সেই কথাটাই বলল শুধু। তারপর বলল তাহলে এখন তো আমাদের সব সজাগ থাকতে হবে।
—তা তো বটেই পাহারাদারটি বলল।
সারাটা দিন কিছু ঘটল না। বিকেল থেকে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। গুহার আস্তানায় গুমোট গরমে সবাই অস্থির হয়ে উঠল। সন্ধে হতেই শুরু হল ঝড়। সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। গুহার বাইরে বন এলাকার গাছগাছালির মাতামাতির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছিল না। তাই গুপ্তচরের কাছে খবর পেয়ে সিনার্কার আদেশে তার যোদ্ধারা বিদ্রোহীদের ঐ গুহার আস্তানা ঘিরে ফেলেছিল সন্ধের আগেই। ঝড়জল শুরু হতে ওরা জঙ্গল ঝোঁপঝাড়ে শব্দ তুলে বিরাট পাথরের চাইটার কাছে। এলো। এখানেই গুপ্তচরটি হ্যারির বন্ধুদের দেখেছিল। ঝড়জলের মধ্যেই সিনার্কার যোদ্ধারা আস্তানাটা খুঁজতে লাগল। কিছু পরে পেয়েও গেল। গাছগাছালির আড়াল থেকে সেই দলপতি ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ঝাপসা দেখল দু’জন পাহারাদার খোলা তলোয়ার হাতে গুহামুখ পাহারা দিচ্ছে। তারা ঝড়জলের শব্দের মধ্যেই বুঝতেই পারে নি সিনার্কার যোদ্ধারা প্রায় গুহামুখে চলে এসেছে। ওরা পাহারা দিতে লাগল। দলপতি চারজন যোদ্ধার কানের কাছে মুখ এনে ব’লে গেলঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ দুই পাহারাদারকে নিকেশ করো। ঠিক তখনই আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। সেই আলোর ঝলকানির সঙ্গে। সঙ্গে চারজন সিনার্কার সৈন্য পাহারাদার দুই বিদ্রোহী যোদ্ধার ওপর ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিদ্রোহী পাহারাদার দু’জন আক্রমণ, হতেই চিৎকার করে উঠল। কিন্তু তখনই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। সেই চিৎকারের শব্দ গুহার মধ্যে বিদ্রোহীদের কেউ শুনতে পেল না। পাহারাদার দু’জন সিনার্কার যোদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারাল।
এবার সিনার্কার যোদ্ধারা দলবেঁধে গুহার মুখে এসে দাঁড়াল। গুহার মধ্যে তখন বিদ্রোহী যোদ্ধারা ভাইকিংরা শুয়ে বসে আছে। বাইরে জলঝড়ের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দই ওদের কানে যাচ্ছিল না।
হ্যারি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। হ্যারি বুঝেছিল ওর বন্ধুদের কোনো না কোনো গুপ্তচর নিশ্চয়ই দেখেছে আর সহজেই বুঝে নিয়েছে এমন জায়গা বিদেশিরা এলো কী করে? নিশ্চয়ই এখানে বিদেশিদের অথবা বিদ্রোহীদের আস্তানা আছে। এই আশঙ্কা থেকে হ্যারি ভাইকিং বন্ধুদের বলে রেখেছিল কেউ তলোয়ার হাতছাড়া করবে না। সবাই হাতের কাছে তলোয়ার রাখবে। এমনকি রাতে ঘুমোবার সময়ও।
সিনাকার যোদ্ধারা গুহায় ঢোকামাত্র হ্যারি ঠিক বুঝতে পারল। হ্যারি গুহার মুখেরদিকে তাকিয়েই বসেছিল। হ্যারি লাফিয়ে উঠল। চিৎকার করে বলে—বন্ধুরা—তৈরি হও। লড়াই।
হ্যারির কথা কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ভাইকিং বন্ধুরা তলোয়ার হাতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। এবার হ্যারি লো ল্যাতিন ভাষায় বলে উঠল—বিদ্রোহী বন্ধুরা—সিনার্কার সৈন্যরা গুহায় ঢুকছে—লড়াই।
সিনার্কার যোদ্ধাদের প্রথম আক্রমণের ধাক্কাটা ভাইকিংরা সামলাল। ততক্ষণে বিদ্রোহীরাও অস্ত্র হাতে নিচ্ছে। কিন্তু সবাই অস্ত্র হাতে নেবার আগেই সিনকার যোদ্ধাদের হাতে মারা গেল।
গুহাটা এমন কিছু বড়ো নয়। কাজেই তলোয়ার চালিয়ে লড়াই করতে অসুবিধে হচ্ছিল। গুহায় ততক্ষণে জোর লড়াই চলছে। এক ফাঁকে হ্যারি ছুটে গিয়ে তলোয়ারের খোঁচা দিয়ে একটারপর একটা মশাল মেঝেয় ফেলে দিতে লাগল। মশালগুলো মেঝেয় পড়ে যেতেই গুহাটা অন্ধকার হয়ে গেল। এবার হ্যারি চিৎকার করে বলল বন্ধুরা গুহার পেছন দিকে ছুটে চলো। ওখানে যে পাথরখণ্ডটা রয়েছে সেটা সরিয়ে সবাই গুহার বাইরে চলে যাও। তারপর অন্ধকারে হ্যারি চেঁচিয়ে বলল—বিদ্রোহী বন্ধুরা—আমার বন্ধুরা যা করছে অপনারাও তাই করুন।
গুহাটা তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। দুটো মশাল মেঝেতে পড়ে গিয়েও নিবু নিবু হয়ে জুলছিল। ভাইকিংরা দ্রুত গুহার পেছন দিকে ছুটল। বিদ্রোহী বন্ধুরাও অন্ধকারে আন্দাজে বুঝে নিয়ে ভাইকিংদের পেছনে পেছনে ছুটল। সিনার্কার যোদ্ধারা অন্ধকারে নিজেদের মধ্যেই তলোয়ার চালাতে লাগল। বুদ্ধিমান হ্যারি ওদের দেশের ভাষায় বন্ধুদের কীভাবে পালাতে হবে বলেছে। সিনাৰ্কার সৈন্যরা কিছুই বোঝে নি। আবার লো ল্যাতিন ভাষায় বিদ্রোহীদের শুধু বলেছে ভাইকিং বন্ধুদের অনুসরণ করতে। এটা শুনে সিনার্কার সৈন্যরা এলোপাথারি তলোয়ার চালাচ্ছে।
সবার আগে হ্যারিই গুহার শেষ মাথায় এলো। অন্ধকারে দেখল—একটা বড়ো পাথর গুহা মুখে বসানো। হ্যারি চিৎকার করে বলল—বন্ধুরা—পাথর সরাও। ভাইকিং বন্ধুরা কয়েকজন তলোয়ার কোমরের ফেট্টিতে গুঁজে গুহার মুখের পাথরটা সরাল। এবার সবাই দ্রুত বেরিয়ে আসতে লাগল। বাইরে তখন ঝড়বৃষ্টির প্রচণ্ডটা কমে এসেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তারই আলোয় গাছ ঝোঁপঝাড় দেখে দেখে ভাইকিংরা আর বিদ্রোহীরা পালাতে লাগল।
বড়ো বড়ো গাছগুলো তখনও ঝড়ের বেগে মাথা নাড়ছে। বৃষ্টি কমে এসেছে। আকাশে থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চারদিকে তাই নানারকম শব্দ আর বিদ্যুতের ঝলক। এসবের মধ্যে দিয়ে গাছ ঝোঁপঝাড় লতাপাতার মধ্যে দিয়ে ভাইকিংরা আর বিদ্রোহীরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটল।
হঠাৎ বনজঙ্গল শেষ। সামনেই পাথুরে প্রান্তর। হ্যারি চিৎকার করে বলল—থামো। ভাইকিংরা দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখে দেখে বিদ্রোহীরাও দাঁড়িয়ে পড়ল। হ্যারি বুঝেছিল সিনকার সৈন্যরা জাতযোদ্ধা। বিদ্রোহীরা সুদক্ষ যোদ্ধা নয়। গুহার অপরিসর জায়গায় তলোয়ারের লড়াই লড়ে বিদ্রোহীরা সিনাৰ্কার সৈন্যদের হারাতে পারবে না। কাজেই এই অবস্থায় পালিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
বিদ্যুতের আলোয় হ্যারি গালকাটা বিদ্রোহী সৈন্যটিকে খুঁজল। এই গালকাটা বিদ্রোহীটাই ওদের পথ দেখিয়ে এনেছিল। হ্যারি দেখল সেই বিদ্রোহী সৈন্যটির বাঁ হাতে তলোয়ারের কোপ পড়েছে। তখনও বৃষ্টিভেজা বাঁ হাতটা থেকে রক্ত পড়ছে। হ্যারি তাকে বলল—এখন আর ঐ গুহায় আস্তানায় ফিরে যাওয়া যাবে না। অন্য কোথাও আস্তানা নেওয়ার জায়গা আছে? গালে কাটা দাগ বিদ্রোহীটি বলল—এই পাথুরে প্রান্তরের শেষে একটা গ্রাম মতো আছে। আপাতত ওখানেই কোনো বাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে। এভাবে উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে কী হবে।
—ঠিক—হ্যারি বলল—তাহলে ঐ গ্রামেই চলুন।
পাথুরে প্রান্তরটা পেরোতে পেরোতেই ভোর হয়ে এলো। বৃষ্টি থেমে গেছে তখন। মাঝে মাঝে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
গ্রামের মানুষরা তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। মেঘ-ভাঙা রোদ পড়ল গ্রামটির পাথর-মাটির বাড়িগুলোয়। দাঁড়িয়ে পড়ল গালকাটা বিদ্রোহীটি। কাঠের দরজায় কয়েকবার থেমে থেমে টোকা দিল। দরজা খুলে গেল। একজন মধ্যবয়স্ক লোক দরজা খুলে দাঁড়াল। তার গায়ে রোক্কার মতোই রঙিন জোব্বামতো। গালকাটা বিদ্রোহীটিকে দেখে আর অন্য বিদ্রোহী আর ভাইকিংদের দেখে লোকটি খুবই বিব্রত হল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। গালকাটা বিদ্রোহীটি বলল—আপনার কোনো ভয় নেই। শুধু দুপুর পর্যন্ত আপনার বাড়িতে আমরা থাকবো। জামা কাপড় শুকিয়ে নিয়ে কিছু খাওয়াদাওয়া করে আমরা চলে যাবো। এদের আপনার কোনো বিপদ হবে না।
—বেশ—আসুন। লোকটি সরে দাঁড়াল। সবাই বাড়িটার প্রশস্ত-উঠোনে এলো। ডানদিকে একটা বেশ বড়ো লম্বাটে ঘর। ঘরে ঢুকে দেখা গেল একপাশে—উঁইকরা শস্যদানা। অন্যপাশটা ফাঁকা। সেই ফাঁকা জায়গায় সবাই বসে পড়ল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। সবাই ভীষণ ক্লান্ত তখন। আহত কয়েকজনের কষ্টই বেশি হচ্ছিল।
কিছুপরে চার-পাঁচজন লোক খাবার নিয়ে ঢুকল। গোল রুটি আর নানা আনাজপত্রের তরকারি মত। সবাই খেতে লাগল। খিদেও পেয়েছিল সকলের। অনেকেই আরো রুটি চেয়ে নিল।
সকাল থেকেই মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠল। বেশ চড়া রোদ। সকলে বাইরের প্রান্তরে এসে দাঁড়াল। যতটা সম্ভব পোশাক শুকিয়ে নিল।
দুপুরে পাখির মাংসের ঝোল লম্বাটে রুটি খেল সকলে। একটু বেলা হতেই সেই গালকাটা বিদ্রোহীর নির্দেশে সবাই সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। উত্তরমুখো হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যেতেই ওরা দেখল বার্গ পাহাড়ের দিক থেকে কে ঘোড়ায় চড়ে আসছে।
কাছে এলে সবাই দেখল ওদেরই বিদ্রোহী বন্ধু একজন। ঘোড়া থামিয়ে বন্ধুটি সেইগাল-কাটা বিদ্রোহীটির কাছে এলো। বলল—আমি রোক্কার নির্দেশ তোমাদের জানাতে এসেছি। রোক্কা বলেছে তোমরা বার্গের গুহাতেই ফিরে গিয়ে আস্তানা করো। তবে এখন থেকে খুব সাবধানে সর্বক্ষণ নজরদারি চালাতে হবে যেন সিনার্কার সৈন্যদের সঙ্গে ভালো লড়াই চালানো যায়।
অগত্যা রোক্কার নির্দেশ মেনে সবাই ফিরে চলল বার্গ পাহাড়ের আস্তানার দিকে। বেলা বাড়তে লাগল। কামারেত হাতে একটা জলের পাত্র নিয়ে ঘরে ঢুকল। ইঙ্গি তে ওষুধটা মারিয়াকে দিতে হবে জানাল। ফ্রান্সিস অস্তে আস্তে মারিয়ার মাথার পেছনে হাত দিল। বলল, মারিয়া ওষুধ খেয়ে নাও। ফ্রান্সিস মাথাটা তুলে ধরল। কামারেত মারিয়াকে একটু জল খাওয়াল। তারপর শুকনো পাতায় মোড়া দু’টো কালো রঙের বড়ি বের করল। মারিয়াকে খাইয়ে দিল। তারপর আবার জল খাওয়াল। মারিয়া পাত্রের সবটা জলই খেয়ে ফেলল। বোঝা গেল ওর যথেষ্ট জল তেষ্টা পেয়েছিল।
তখনই রোক্কা ঘরে ঢুকল। বলল, ফ্রান্সিস, আপনি ও রাজকুমারী এ বাড়িতেই থাকবেন। বেলা হলো। আপনি খেতে চলুন। ফ্রান্সিস আস্তে বলল, মারিয়া তো না খেয়ে আছে। ওকে আগে কিছু খেতে দিন। রোক্কা কামারেতকে বলল সেকথা। কামারেত কী বলে চলে গেল। রোক্কা বলল, রাজকুমারীকে এখন শক্ত খাবার খেতে দেওয়া হবে না। স্যুপ, ফলের রস এসব এই কামারাতেই খেতে দেবে।
তাহলে মারিয়ার খাওয়া হোক। তারপর আমি খাবো। ফ্রান্সিস বলল। তখনই কামারেত দুটো বড়ো চিনেমাটির বাটি নিয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকল। হেসে রোক্কাকে কী বলল। রোক্কা খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠল। হাসতে হাসতে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল, সারিনে আমার বিদ্রোহী বন্ধুদের কাছে যুদ্ধে হেরে গেছে সিনার্কা। সিনার্কা পরাজিত সৈন্যদের নিয়ে ফিরে আসছে। কথাটা বলে রোক্কা ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল।
ফ্রান্সিসের তখন এসব ভাববার মতো মনের অবস্থা নেই। ও মারিয়াকে তখন ধরে ধরে আস্তে আস্তে উঠিয়ে বসাল। পিঠে ঘাড়ে হাত দিয়ে ধরে থাকল। ফ্রান্সিস বলল, মারিয়া, একটু খেয়ে নাও। মারিয়া বন্ধ চোখ খুলে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল মারিয়ার চোখের সেই লালচে ভাবটা নেই। গায়ের গরম ভাবটা অনেক কম। কামারেত আস্তে আস্তে মারিয়াকে স্যুপ আর ফলের রস খাইয়ে দিল। মারিয়াকে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে শুইয়ে দিল। মারিয়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল।
তখনই রাস্তায় শোনা গেল ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। লোকজনের কথাবার্তা। ফ্রান্সিস দরজার কাছে গেল। রোক্কার পেছনে দাঁড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল। একটা ছাদখোলা ঘোড়ায় টানা গাড়ি আসছে। গাড়িটা কালো রঙের। তাতে রুপোলি লতাপাতা ফুলের কাজ করা। গাড়িতে বসে আছে একজন প্রৌঢ়। মাথার কঁচাপাকা চুল এলোমেলো। কপালে নেমে এসেছে। গায়ে বেশ দামি কাপড়ের হলুদ রঙা জোব্বামতো। বেশ ধুলো কাদা লেগে আছে পোশাকে। গম্ভীর থমথমে মুখে বসে আছে। রোক্কা ফিসফিস করে বলল, এখনকার সামন্তরাজা সিনাৰ্কা। আস্তে আস্তে গাড়িটা চলে গেল। পেছনে পাঁচ ছটা ঘোড়ায় চড়া জেনো সৈন্য। কাপট-পরা। পরিশ্রান্ত ক্লান্ত মুখ-চোখ সৈন্যদের। তাদের পেছনে পদাতিক সৈন্যরা। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা সব। পোশাক ছেঁড়া। ধুলো কাদা মাখা। আস্তে আস্তে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে গেল ওরা। ফ্রান্সিস দরজার কাছ থেকে সরে এলো।
বিকেল নাগাদ মারিয়ার শরীরের অবস্থা অনেকটা ভালো হলো। কামারেত এসে মারিয়াকে। ওষুধ খাওয়াল। মারিয়া ওষুধ খাওয়ার সময় চোখ খুলে উঠে বসে ওষুধ খেল। কামারেত মারিয়ার কপালে গলায় হাত বুলিয়ে হেসে ফ্রান্সিসকে বলল, এখন উনি অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। ফ্রান্সিস কথাটা বুঝল না। লো ল্যানি ভাষা। তবে কামারেতকে হাসতে দেখে বুঝল মারিয়া ভালো আছে। কামারেত চলে গেল। রোক্কা তখনও ফিরে আসেনি।
সন্ধের সময় বৈদ্যমশাই এলেন। সঙ্গে রোক্কা আর সেই কামারেত। বৈদ্যমশাই মারিয়াকে পরীক্ষা করে রোক্কার দিকে হেসে তাকালেন। বললেন, এত তাড়াতাড়ি উনি বিপদ কাটিয়ে উঠবেন ভাবিনি। যা হোক—আর কোনো ভয় নেই। খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রাম। দু’তিন দিনের মধ্যেই উনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। রোক্কা হেসে কথাগুলো ফ্রান্সিসকে বুঝিয়ে বলল। ফ্রান্সিস আনন্দে কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। দ্রুত এগিয়ে এসে বৈদ্যমশাইয়ের ডানহাতটা নিজের দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে মাথা নোয়াল। অনেক কষ্টে চোখের জল আটকাল। তারপর মারিয়ার দিকে তাকাল। দেখল মারিয়া খুশি চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
বৈদ্যমশাই মৃদুস্বরে কামারেতকে কী নির্দেশ দিলেন। তারপর চলে গেলেন। কামারেও সঙ্গে সঙ্গে গেল।
ফ্রান্সিস এবার রোক্কাকে বলল, কিন্তু আমার বন্ধুরা কি জানে আমরা এখানে আছি?
—সব খবর তাদের দেওয়া হয়েছে। শুধু আপনাদের রাজকুমারী অনেকটা সুস্থ। হয়েছেন এই খবরটা এখনও দেওয়া হয়নি। এই খবরটা আমি দিতে যাবো। আপনারা বিদেশি। সবাইয়ের এখানে আসাটা সিনার্কার সৈন্যদের নজরে পড়লে বিপদ হবে। সারিনের যুদ্ধে হেরে ওরা রেগে আগুন হয়ে আছে। রোক্কা বলল।
তাহলে এক কাজ করুন—শুধু হ্যারি নামের আমার বন্ধুটিকে আপনি আসার সময় সঙ্গে নিয়ে আসুন। ফ্রান্সিস বলল।
বেশ। রোক্কা বলল। তারপর চলে গেল।
সন্ধে হলো। কামারেত একটি রুপোর মোমবাতিদানে বসানো মোটা হলুদ রঙের জ্বলন্ত মোমবাতি ঘরে রেখে গেল। ফ্রান্সিস তখনও মারিয়ার বিছানার পাশে বসে মারিয়ার ডান হাতটা ধরে আছে। ফ্রান্সিস বুঝতে পারল জ্বর একেবারে ছেড়ে গেছে। বেশ স্বাভাবিকভাবেই মারিয়া দু’একটা কথা বলছে তখন।
একটু রাত হলে হ্যারিকে নিয়ে রোকা ঘরে ঢুকল। রোক্কাকে একা দেখে ফ্রান্সিস বলে উঠল—হ্যারিকে পেলেন না?
রোক্কা বলল—সে অনেক কথা। গত রাতেই সিনার্কার সৈন্যরা আমাদের বার্গ পাহাড়ের আস্তানার খবর পেয়েছিল। হয়তো সিনার্কার গুপ্তচরেরাই সন্ধান দিয়েছিল। সিনার্কার সৈন্যরা প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করেছিল। লড়াই হয়েছিল। তবে আমাদের বিদ্রোহীরা বুদ্ধিমানের মতো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে গুহার অন্য মুখটা দিয়ে পালাতে পেরেছিল। হ্যারি আর আপনার ভাইকিং বন্ধুদের নিয়ে আমার বিদ্রোহী বন্ধুরা উত্তর দিকে পালিয়েছে। তবে বার্গ পাহাড় এলাকায় আমার দুই বন্ধুকে রেখে এসেছি। বলে এসেছি ভাইকিংদের মধ্যে হ্যারিকে দেখলে যেন তাকে সঙ্গে নিয়ে এখানেই আসে।
—লড়াই যখন হয়েছে তখন হতাহত হয়েছে কিছু, ফ্রান্সিস বলল।
—হ্যাঁ—তা হয়েছে। সিনার্কার সৈন্যরাও আমাদের বিদ্রোহী যোদ্ধারাও। তবে ভাইকিংরা কেউ হত আহত হয়েছে কিনা সে খবর পাইনি। রোক্কা বলল। তারপর বলল—আমার আর এক বন্ধুকে পাঠিয়েছি পলাতক বিদ্রোহীদের কাছে যেতে। আমি বলে দিয়েছি—সবাই আবার বার্গ পাহাড়ের গুহার ঘাঁটিতে ফিরে আসতে। পাহারা জোরদার করতে বলেছি। যেন আবার আক্রান্ত হবার আগে সবাই তৈরি থাকতে পারে। মনে হয় আমার নির্দেশ পেলে আজকে সন্ধের আগে ওরা বার্গের ঘাঁটিতে ফিরে আসতে পারবে। রোক্কা বলল।
পরের দিন রাতে রোক্কা হ্যারিকে নিয়ে মারিয়ার ঘরে ঢুকল। হ্যারি ঘরে ঢুকে দেখল মারিয়া দুর্বলস্বরে ফ্রান্সিসের সঙ্গে কথা বলছে। হ্যারি এত খুশি হলো যে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ছুটে গিয়ে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিস হেসে হ্যারির পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বলল, হ্যারি, মারিয়ার বিপদ কেটে গেছে। হ্যারি আনন্দে কোনো কথা বলতে পারল না।
হ্যারি আর রোক্কা মারিয়ার বিছানার পাশে বসল। রোক্কা বলল, রাজকুমারী এখন কেমন আছেন? মারিয়া অল্প হেসে বলল, অনেকটা ভালো।
—ভালো হতেই হবে। সারা কর্সিকায় এই বৈদ্যমশাইয়ের যে কী সুনাম আপনারা তা কল্পনাও করতে পারবেন না। রোক্কা বলল। মারিয়া একটু হেসে বলল, এই কর্সিকা দ্বীপকে পুরনো দিনের নাবিকরা বলত সুগন্ধির দ্বীপ তাই না? রোক্কা বেশ আশ্চর্য হলো। বলল, কত দূরে আপনাদের দেশ অথচ এই ছোট্ট দ্বীপটার কথাও আপনি জানেন দেখছি। আপনি সত্যিই বিদুষী। মারিয়া হেসে বলল, নানা—তেমন কি আর। আমাদের গ্রন্থাগারে বেশ কিছু প্রাচীন হাতে লেখা গ্রন্থ আছে। সে সব পড়েই জেনেছি। একটু থেমে মারিয়া বলল, তবে কর্সিকার অতীত ইতিহাসে দেখা গেছে বিভিন্ন শক্তিমান জাতি শত্রু হিসেবে এই কর্সিকাকে আক্রমণ করেছে। কেউ বন্ধু হিসেবে আসেনি।
ঠিক বলেছেন—রোক্কা মাথা ওঠানামা করে বলল। তারপর বলল, কর্সিকাবাসীদের জীবনে তাই বোধহয় বন্ধুত্ব ভালোবাসার স্থানটা কম। আমাদের জীবনে মৃত্যুটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভেনদেত্তা কথাটা আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন।
হ্যাঁ—খুনোখুনির বদলা নেওয়া। মারিয়া বলল।
ঠিক। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও এই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বংশের সবাইকে হত্যা করা এখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এখানে পেশাদার কাঁদুনেরা আছে। তাদের ভাড়া করে আনা হয়। মৃতের জন্য তারা দীর্ঘদিন ধরে কাঁদে। কান পাতলে অনেক বাড়ি থেকে এই কান্নার শব্দ শুনতে পাবেন। আমাদের গানও তাই বোধহয় বড়ো বিষাদের। বড়ো বেদনার। সেখানে আনন্দের স্থান নেই।
সকলেই চুপ করে রইল। রোক্কার কণ্ঠস্বরে যে বেদনার সুর ছিল তা ফ্রান্সিসদের মন স্পর্ষ করল। ও আর কথা বলতে পারল না। রোক্কা একটু পরে বলল, একজন রানীর কাহিনী আপনাদের বলি। তার নাম ইসাবেলা। প্রায় একশো বছর আগের কথা। এই দক্ষিণ কর্সিকার রাজা ছিলেন তখন দ্বিতীয় জেমস। এখানে নিজেদের আধিপত্য স্থাপনের জন্য মূল ভূখণ্ডের জেনোয়া ও পিসার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল অনেককাল ধরে। দ্বিতীয় জেমস এই দ্বন্দ্ব মেটাবার জন্যে জেনোয়াবাসী ও পিসাবাসীদের এখানকার অনেক অংশ দিয়ে দিয়েছিলেন। সিনার্কারা ছিল জেনোর মানে জেনোয়ার অধিবাসী। আজকের সিনার্কাদের পূর্বপুরুষরা তখন এখানে ঘাঁটি গাড়ে। রাজা দ্বিতীয় জেমসের সঙ্গে তার আত্মীয়দের এক পারিবারিক বিবাদে সিনার্কার রাজার শত্ৰু আত্মীয়দের সঙ্গে গোপনে যোগ দিয়েছিলেন। রাজা দ্বিতীয় জেমসের রানী ইসাবেলা ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন শুধু। রাজার আর তার জীবন নয়, তাদের একমাত্র কন্যারও জীবন বিপন্ন। তাছাড়া পুরুষানুক্রমে রাজা জেমস এবং রানী ইসাবেলার ছিল অতি মূল্যবান রত্নালংকার। কেউ জানেন না কতগুলো অলংকার। তবে লোক-প্রচলিত কাহিনী বলে তার সংখ্যা নাকি অনেক। সিনার্কাদের ভীষণ লোভ ছিল সেই রত্নভাণ্ডারের দিকে। সেই রত্নালংকারগুলো নাকি রাখা ছিল দামি ওক কাঠের একটা পেটিকার মধ্যে। রোক্কা থামল।
তারপর? মারিয়া বলল। রোক্কা বলতে লাগল, রানী ইসাবেলা একদিন বোনিফেসিওর ঐ দুর্গে যার নীচের কয়েদঘরে আমরা বন্দি ছিলাম—সেই দুর্গে গেলেন। ওপরের দিকের দুটি কক্ষ দেখলেন এবং সেইদিন থেকেই তাঁর নির্দেশে ঐ দুইটির একটি কক্ষে খাদ্য, আনাজপত্র এবং দীর্ঘদিনেও নষ্ট হয় না এমন ম্যাকুয়েস-দানা, সেজ আলু, জলপাই প্রচুর রাখা হলো। সেইসঙ্গে জলের বেশ বড়ো কয়েকটি পিপে। খুবই গোপনে বিশ্বস্ত কিছু প্রাসাদরক্ষীরা করল এসব। তারপর একদিন গভীর রাতে রানী তার ঘুমন্ত কন্যাকে নিয়ে দুর্গের সেই কক্ষ দুইটির একটিতে আশ্রয় নিলেন। কথা ছিল রাজা জেমসও রাজকোষের স্বর্ণমুদ্রা একত্র করে নিয়ে পালিয়ে সেই কক্ষে আশ্রয় নেবেন। কিন্তু শেষ রাতে সিনার্কার অর্থ দিয়ে প্রাসাদরক্ষীদের বশীভূত করে জেনো সৈন্যদের নিয়ে প্রাসাদ আক্রমণ করল। রাজা জেমস বন্দি হলেন। হয়তো তিনি প্রাণে বেঁচে যেতেন। হয়তো তাকে জেনোয়ায় নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখা হতো। কিন্তু ঐ যে বললাম, ভেনদেত্তা—রাজা জেমস-এর আত্মীয়রা রাজাকে হত্যা করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করল। রোক্কা থামল।
আর রানী ইসাবেলা ও রাজকুমারী? ফ্রান্সিস বলল।
রানী ইসাবেলা রাজা জেমসের মৃত্যুসংবাদ পেয়েই দুর্গরক্ষীদের আদেশ দিলেন ঐ ঘর দুটি থেকে নামার সিঁড়িটা ভেঙে ফেলতে। রক্ষীর অবাক হয়ে গেল। ওরা বুঝল না—রানী ইচ্ছে করে কেন এভাবে নিজেকে ও রাজকুমারীকে নিয়ে স্বেচ্ছানির্বাসন নিচ্ছেন। রানী ক্রুদ্ধ হলেন। আবার জোরের সঙ্গে আদেশ দিলেন। অগত্যা দুর্গরক্ষীরা লোহার বড়ো বড়ো শাবল সংগ্রহ করে সিঁড়ির পাথরগুলোর খাঁজে খাঁজে চাড় দিয়ে সিঁড়িটা সম্পূর্ণ ভেঙে দিল। রানীও সিঁড়িতে নামার কাঠের দরজাটা চিরদিনের জন্যে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলেন। দেখলে মনে হবে দুটি ঘরই যেন শূন্যে ঝুলছে। আপনারা পালাচ্ছিলেন, কাজেই ঘর দুটো লক্ষ্য করেননি। রোক্কা থামল।
আর সেইসব রত্নালংকারগুলো? ফ্রান্সিস বলল।
ঐ দুটো ঘরের কোথাও আছে হয়তো। রোক্কা বলল।
হয়তো বলছেন কেন? হ্যারি বলল।
একটা ঘরের একটিমাত্র গরাদ দেওয়া জানালা আছে। পশ্চিমদিকে খাড়া দুর্গের দেওয়ালের গায়ে। এত উঁচুতে যে মাটি থেকে ওখানে ওঠা অসম্ভব। কাজেই ঐ ঘর দুটোয় যাওয়া এবং খোঁজ করার কথা কেউ কল্পনাও করেনি। রোক্কা বলল।
ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল, দুর্গের ওপরটা যতটা দেখেছি তাতে বলতে পারি ওপর থেকে দড়ি বেয়ে নেমে বোধহয় ঐ জানালাটায় পৌঁছানো যায়। রোক্কা বলল, হ্যাঁ আমি শুনেছি পরে নাকি সিনাকার নির্দেশে দু’জন দু’বার ওপর থেকে দড়ি বেয়ে নেমে জানালার লোহার গরাদ ভেঙে ঢোকবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দু’জনেই জানালায় গিয়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে রানী ইসাবেলা ছোরা মেরে দু’জনকেই ফেলে দিয়েছে নীচের পাথরের চত্বরে। দু’জনেই শেষ।
তারপরেও কি ওভাবে চেষ্টা করা হয়নি? ফ্রান্সিস বলল।
হা হয়েছে—অনেক বছর পরে। সেই লোকটা জানালার কাছে এসে গরাদ ধরে দাঁড়িয়েছিল। তখনই জানালার ওপর থেকে বড়ো পাথরের টুকরো খসে পড়েছিল ওর মাথায়। লোকটা তীর খাওয়া পাখির মতো খসে পড়েছিল জানালা থেকে নীচের পাথরে চত্বরে। তারপরেও হয়তো লুকিয়ে-টুকিয়ে কেউ কেউ চেষ্টা করে থাকবে। হাজার হোক অত মূল্যবান রত্নভাণ্ডার। কিন্তু কেউ গরাদ ভেঙে ঢুকতে পারেনি। গরাদসহ জানালাটা এখনও অটুট আছে। রোক্কা থামল।
ফ্রান্সিসরা কেউ কোনো কথা বলল না। তিনজনেই সমস্ত ঘটনাটা ভাবছে তখন। একসময় ফ্রান্সিস বলল, দুৰ্গটা, জানালাটা ভালো করে দেখতে হবে। কিন্তু দেখতে গেলে তো আবার কয়েদঘর বন্দি করে রাখবে। আমরা তো বিদেশি।
পারবেন ঐ ঘর দুটোয় ঢুকতে? রোক্কা হেসে বলল।
সব দেখেটেখে ভেবে নিয়ে বলতে পারব। ফ্রান্সিস বলল।
তাহলে সিনার্কাকে একবার বলে দেখতে পারেন। সিনাকা যা অর্থপিশাচ আর লোভী ও আপনাকে ঠিক খোঁজ-খবরের অনুমতি দেবে। রোক্কা বলল।
হ্যারি বলল, কী ফ্রান্সিস ? চেষ্টা করবে নাকি? ফ্রান্সিস হেসে একবার মারিয়ার দিকে তাকাল। বলল, হ্যারি, অনেক অভিযানেই বেরিয়েছি বাবার অনুমতি তো নয়ই-মা’র অনুমতিও নিইনি। আজ কিন্তু আমি হার স্বীকার করছি। মারিয়ার অনুমতি পেলে তবেই রত্নভাণ্ডারের উদ্ধারে যাব।
মারিয়া হেসে বলল, আমি জানি আমি মানা করলে তুমি মনে কী ভীষণ কষ্ট পাবে। তুমি চেষ্টা করো—আমাকে তো দু’তিন দিন বিশ্রাম নিতেই হবে। ফ্রান্সিস প্রায় লাফিয়ে উঠল—সত্যি মারিয়া, তুমি আমার মনোভাবটা খুব সহজেই বুঝতে পারো।
রোক্কা বলল, ফ্রান্সিস, আপনি চেষ্টা করুন, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু লোকে ঐ ঘর দুটোকে বলে ভূতের ঘর। অনেক অর্থের প্রলোভন দেখিয়েও সিনার্কারা কাউকে ওই জানালার কাছেও পাঠাতে পারেনি। অনেকে রাতের বেলা ঐ জানালায় মোমের অস্পষ্ট আলো দেখেছে। ফ্রান্সিস হেসে বলল, ওসব ভূতেটুতে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। আমার ভয়টা একটু কমই। আসল কথা সব কিছুকেই আমি গভীরভাবে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে ভাবি এবং সত্য উদ্ঘাটন করি। সব কথাই যাচাই করে নিতে হয়।
পরদিন সকালে মারিয়া অনেকটা সুস্থ হলো। ঘরে পায়চারি করল। ফ্রান্সিস তাই দেখে বলল, মারিয়া এবার তাহলে নিশ্চিন্তমনে সিনার্কার দরবারে যেতে পারি। মারিয়া হেসে ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু দুঃখ আমি যেতে পারলাম না।
তাতে কি! কাজে লাগলে তুমি থাকবে তখন। ফ্রান্সিস বলল।
তখন গভীর-রাত। কিছুটা সুস্থ মারিয়ার কাশি অনেক কমে গেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস অনেক স্বাভাবিক এখন। গত কয়েকদিন ধরে উৎকণ্ঠায় উদ্বেগে ফ্রান্সিসের ভালো করে ঘুমই হতো না। আজ অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। মেঝেয় একটা মোটা কাপড় বিছিয়ে নিয়ে ফ্রান্সিস আর হ্যারি ঘুমিয়ে আছে। কাঠের পাঠাতনের বিছানায় মারিয়া ঘুমিয়ে আছে। মোটা মোমবাতিটা জ্বলছিল।
হঠাৎ বাড়িটার-চারদিকে কোলাহল শোনা গেল। ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ও দ্রুত উঠে বসল। ছুটে গরাদ দেওয়া জানালাটার কাছে এলো। গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখল সিনার্কার সৈন্যরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজনের হাতে জ্বলন্ত মশাল। মশালের আলোয় দেখল—প্রত্যেকটি সৈন্যের হাতে খোলা তলোয়ার। ওরা চিৎকার হৈ হল্লা করছে।
হ্যারি আর মারিয়ারও তখন ঘুম ভেঙে গেছে। দুর্বল মারিয়া বিছানা থেকে নামল না। হ্যারি ছুটে এসে ফ্রান্সিসের পাশে দাঁড়াল। মারিয়া দুর্বলস্বরে বলল—কী হয়েছে ফ্রান্সিস ?—সিনার্কার কিছু সৈন্য এই বাড়িটার কাছে জড়ো হয়েছে। কিন্তু ওরা কেন এসেছে জানি না। ফ্রান্সিস মারিয়ার কাছে আসতে আসতে বলল।
তখনই সৈন্যদের প্রচণ্ড ধাক্কায় সদর দরজাটা ভেঙে পড়ল। চিৎকার আরো বাড়ল। দড়াম করে ফ্রান্সিসদের ঘরের দরজাটা খুলে গেল। কামেরাত এক লাফে ঘরে ঢুকে বলে উঠল—শিগগির পালিয়ে যান। ওর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দু’জন সৈন্য ঘরে ঢুকল। সামনের সৈন্যটি কামেরাতের মাথার ওপর তলোয়ার তুলল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে ডান পা তুলে সৈন্যটার বুকে প্রচণ্ড জোরে লাথি মারল। সৈন্যটা ছিটকে দেয়ালের গায়ে গিয়ে পড়ল। ওর হাত থেকে তলোয়ারটা ছিটকে গেল। পেছনের সৈন্যটি তলোয়ার হাতে কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। ওরা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি ওরা এভাবে আক্রান্ত হতে পারে। ছিটকে পড়া তলোয়ারটা ফ্রান্সিস দ্রুত তুলে নিল। রুখে দাঁড়াল। মোমবাতির আলোয় ফ্রান্সিসের ঐ ইস্পাত কঠিন ভঙ্গ ীতে দাঁড়ানো দেখে মারিয়া আশ্চর্য হয়ে গেল। ফ্রান্সিসের এই চেহারা তো কখনও দেখেনি। হ্যারি কিন্তু আশ্চর্য হল না। ফ্রান্সিসের এই ক্রুদ্ধমূর্তি ও আগেও দেখেছে। সৈন্য দু’জন তখন হতবাক দাঁড়িয়ে আছে। হ্যারি বলল—তোমাদের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার নাম ফ্রান্সিস ওর হাতে তলোয়ার থাকলে কেউ ওর গায়ে আঁচড়টিও কাটতে পারবে না। কাজেই লড়াইয়ে যেয়ো না। হ্যারির লো ল্যাতিন ভাষা ওরা বুঝল। পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। কামেরাতও অবাক তখন।
বেশ ভীতস্বরে মারিয়া বলে উঠল—ফ্রান্সিস শান্ত হও। মারিয়ার গলার স্বর কানে যেতেই ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে উদ্যত তলোয়ার নামাল। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হল ফ্রান্সিস এতক্ষণে ফ্রান্সিস বুঝলমারিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। এই অবস্থায় লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়া বোকামি। আস্তে আস্তে হ্যারিকে বলল—কামেরাতকে জিজ্ঞেস করো তো—রোক্কা কোথায়? হ্যারি কামেরাত ফিসফিস করে বলল সেকথা। কামেরাতও ফিসফিস করে বলল—উদতবের ঘরে আত্মগোপন করেছিলেন। এতক্ষণে বোধহয় ধরা পড়েছেন। ফ্রান্সিসকে হ্যারি বলল সেকথা। ফ্রান্সিস হাতের তলোয়ারটা মেঝেয় ফেলে দিল। ঝনাৎ শব্দ হল। মারিয়া দুর্বল শরীরে বিছানায় বসে থাকতে পারল না। আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল। হাঁপাতে লাগল।
ততক্ষণে আরো কয়েকজন সৈন্য দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সিস সৈন্যদের দেখে বলল—হ্যারি, কামেরাতকে বলো—লড়াই নয়—আত্মসমর্পণ। তাদের থেকে দু’জন ছুটে এসে ফ্রান্সিস হ্যারি আর কামেরাতকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। ওরা কেউ বাধা দিল না। সৈন্যরা মারিয়াকে বন্দি করবে কিনা বুঝে উঠতে পারল না। হ্যারি মারিয়াকে দেখিয়ে বলে উঠল—উনি মারিয়া আমাদের দেশের রাজকুমারী। রাজকুমারী অসুস্থ। তাকে বন্দি করলে ফল ভালো হবে না। একজন সৈন্য এগিয়ে এসে হ্যারিকে বলল—তোমাদের রাজকুমারীকে এখন ছেড়ে দেওয়া হল। ও তো অসুস্থ। পালাতে পারবে না। মাননীয় সিনার্কার হুকুম হলে পরে বন্দি করা যাবে। তোমরা চলো।
—কোথায়? হ্যারি বলল।
—গেলেই দেখতে পাবে। একজন সৈন্য বলে উঠল। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল সব কথা। ফ্রান্সিস বলল ঠিক আছে। ওদের কথামতোই এখন চলতে হবে।
ফ্রান্সিস দরজার দিকে যেতে যেতে বলল—মারিয়া—এখানেই থেকো। তুমি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হও নি, ভয় নেই—আমরা ঠিক অক্ষত শরীরে ফিরে আসবো।
ফ্রান্সিসের পেছনে পেছনে হ্যারি আর কামেরাত চলল। পেছনে তলোয়ার হাতে সৈন্যরা। ফ্রান্সিসরা চলে যেতে মারিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এক নিজের শরীরে এই অবস্থা তারওপর ফ্রান্সিসরাও বন্দি হল। নিজেকে মারিয়ার বড়ো অসহায় মনে হতে লাগল। কান্নায় ওর শরীর ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।
ফ্রান্সিসদের নিয়ে সৈন্যরা বাড়িটার বাইরে এলো। দেখা গেল খোলা তলোয়ার হাতে একদল সৈন্য দাঁড়িয়ে এবং সৈন্যদলের মধ্যে পেছনে হাত-বাঁধা অবস্থায় রোক্কা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রোক্কার গায়ের পোশাক এখানে-ওখানে ছিঁড়ে গেছে। সেখানে গায়ের ক্ষত দেখা যাচ্ছে। কপালে গলায় কানের পাশে তলোয়ারের ক্ষতগুলো থেকে রক্ত পড়ছে। রোক্কা তখনও ভেবে পাচ্ছে না সিনার্কার সৈন্যরা কীভাবে খবর পেল ও এই বাড়িতে আত্মগোপন করে আছে। ফ্রান্সিস দেখে নিশ্চিন্ত হল যে বৈদ্যমশাইকে বন্দি ও করা হয় নি। মারিয়ার চিকিৎসার কোনো ব্যাঘাত হবে না। ফ্রান্সিস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
ফ্রান্সিসদের রোক্কার সঙ্গে দাঁড় করানো হল। চারদিক থেকে খোলা তলোয়ার হাতে সৈন্যরা ওদের ঘিরে দাঁড়াল। তাদেরই দলপতি বোধহয়—তলোয়ার উঁচিয়ে হাঁটতে নির্দেশ দিল। ফ্রান্সিসদের মাঝখানে রেখে সৈন্যরা হাঁটতে শুরু করল। ফ্রান্সিসরা চলল সদর রাস্তা দিয়ে।
হাঁটতে হাঁটতে ফ্রান্সিস বলল-রোক্কা—আপনি বেশ আহত। বৈদ্যমশাইকে বলে ওষুধ লাগালে পারতেন।
রোক্কা ম্লান হেসে বলল—বৈদ্যমশাই দূরের গ্রামে রোগী দেখতে গেছেন। এখানে থাকলেও সিনার্কার সৈন্যরা ওষুধ লাগাতে দিতো না। সিনার্কা আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসির হুকুম দেবে। কথাটা শুনে ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। দৃঢ়স্বরে বলল—আমি বেঁচে থাকতে নয়। রোক্কা একটু আশ্চর্য হল। ফ্রান্সিস ওর স্বজন নয় স্বদেশবাসীও নয়। ফ্রান্সিসের মুখের দিকে একবার তাকাল। মৃদুস্বরে বলল—কিন্তু আপনি আমাকে বাঁচাবেন কেন? এবার ফ্রান্সিস হাঁটতে হাঁটতে বলল—কারণ আপনি মারিয়াকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। নইলে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে মারিয়াকে আমরা বাঁচাতে পারতাম না। আমি অকৃতজ্ঞ হতে শিখি নি। রোক্কা প্রশংসার চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল।
ফ্রান্সিসরা চলল। সদর রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর নিস্তব্ধ। জনশূন্য পথে শুধু সৈন্যদের পায়ের শব্দ।
রোক্কা হঠাৎ বলে উঠল—এইবার বুঝেছি। ফ্রান্সিস রোক্কার দিকে তাকাল। রোক্কা বলল—মনে আছে আপনার—সেই দরজা একটু ফাঁক করে পরাজিত সিনার্কা আর সৈন্যদের ফিরে আসা দেখছিলাম।
—হ্যাঁ। কিন্তু দরজার ততটুকু ফাঁক দিয়ে—।
রোক্কা মাথা নেড়ে বলল—না—খুশিতে মাথার ঠিক ছিল না। হঠাৎই দরজাটা একটু বেশি ফাঁক করে ফেলেছিলাম। তখনই নিশ্চয়ই সিনাৰ্কার সৈন্যদের কেউ আমার মুখ দেখে ফেলেছিল। আমি তখন বুঝতে পারিনি। নিজের বোকামির জন্যে আবার ধরা পড়লাম।
আপনার বিদ্রোহী বন্ধুরা কি এই সংবাদ পেয়েছে? হ্যারি বলল।
রোক্কা মাথা নেড়ে বলল—না—। একমাত্র কামেরাতকে দিয়ে এই খবর পাঠাতে পারতাম। কিন্তু সেও তো বন্দি।
—তবে এই খবর কি গোপন থাকবে—নিশ্চয়ই কালকে আপনার বন্ধুরা খবর পেয়ে যাবে। হ্যারি বলল।
রোক্কা মাথা নেড়ে বলল—উঁহু—সিনার্কা অত্যন্ত ধূর্তও আমার বন্দি হওয়ার খবর কিছুতেই ফাঁস হতে দেবে না। গোপনে আমাকে মেরে ফেলবে। কথাটা শুনে ফ্রান্সিস বেশ আশ্চর্য হল। বুঝল—বিদ্রোহীদের কাছে একটা যুদ্ধে হেরে গিয়ে সিনার্কা এখন আহত বাঘের মতো ক্ষেপে আছে। অনেক ভেবেচিন্তে এগোতে হবে। কোনোরকমে একটা সুযোগ পেলেই রোক্কার পালাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
সৈন্যদের পাহারায় ফ্রান্সিসরা যখন সেই দুর্গের সামনে এসে পৌঁছল তখন পুব আকাশে লালচে ছোপ লেগেছে। দুর্গের কাছাকাছি গাছে গাছে পাখির ডাক শুরু হয়েছে।
দুর্গের প্রধান প্রবেশ পথের সামনেই দেখা গেল সেই দাড়িগোঁফওয়ালা শক্তসমর্থ চেহারার দলপতি দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ পায়ের হাঁটুতে মোটা কাপড়ের পট্টি বাঁধা। শাঙ্কোর তিরের ক্ষত এখনও শুকোয় নি।
দলপতি বেশ খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বলল–সৈন্যরা সব দরজার কাছে সার বেঁধে দাঁড়াও। ফ্রান্সিসদের চারপাশ থেকে সৈন্যরা দ্রুত চলে গিয়ে দুর্গের ফটকের সামনে সার বেঁধে দাঁড়াল। দুর্গরক্ষীরাও স্থির হয়ে দাঁড়াল। দলপতি বলতে লাগল—মাননীয় সিনার্কার হুকুম বিদ্রোহী নেতাকে যে বন্দি করা হয়েছে—এই সংবাদ একেবারে গোপন রাখতে হবে। কোন সাধারণ প্রজার কানে যেন এই সংবাদ না যায়। বুঝেছো? সৈন্যরা হাতের তলোয়ার আর বর্শা উঁচু করে ধরল। নামাও। দলপতি গলা চড়িয়ে বলল। সৈন্যরা তলোয়ার বর্শা নামাল।
কয়েকজন সৈন্য দ্রুত এসে ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। ঘড় ঘড় শব্দে ফটকের বিরাট কাঠের দরজার একটা পাল্লা খুলে গেল। দলপতি ফ্রান্সিসদের দুর্গে ঢোকাতে ইঙ্গি
ত করল। ফ্রান্সিসরা দরজার দিকে চলল।
পাথুরে চত্বর পার হবার সময় হ্যারি ফ্রান্সিসকে সিনার্কার হুকুমের কথা বলল। তারপর বলল—দলপতিকে বলবো আহত রোক্কার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে।
—পাগল হয়েছে—রোক্কার প্রতি সহানুভূতি চাইলে আমাদের বিপদ বেড়ে যাবে। কোনো কথা বলো না। দেখা যাক কী হয়। ফ্রান্সিস বলল।
সেই কয়েদঘরের লোহার দরজা ঘটাং-ঘং শব্দে খোলা হল। ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরে ঢুকল। দেয়ালের আটকানো মশালের আলোয় দেখল তিনজন বন্দি ঘাসের দড়ি বাঁধা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। দরজা খোলার শব্দে দুজনের ঘুম ভেঙে গেল। একজন উঠে বসল। রোক্কাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই সে চমকে উঠল। ছুটে এলো রোেক্কার কাছে। বলল—রোক্কা—আপনি বন্দি হলেন—আমরা কি হেরে গেছি?
রোক্কা বলল—নানা। আমি আমার বোকামির জন্যে ধরা পড়েছি। খুব পরিশ্রান্ত আমি। পরে কথা হবে। রোক্কা আর কোনো কথা না বলে সেই ঘাসের বিছানায় বসে দড়ি বাঁধা দুহাত মাথার দিকে তুলে শুয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস হ্যারি ও বিছানায় বসল। ফ্রান্সিস ও কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। কামেরাতও বসল। বন্দি দু’জন কামেরাতের পাশে বসল। ওরা নিম্নস্বরে কথা বলতে লাগল। হ্যারি চুপ করে বসে রইল। ফ্রান্সিসের মাথায় তখন নানা চিন্তা। ওদিকে মারিয়া এখনও সম্পূর্ণ সেরে ওঠেনি। বন্ধুরাও জানে না ওদের বন্দিদশার কথা। যে রোক্কার জন্যে মারিয়াকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হল সেই রোক্কার নিজের জীবন আজ বিপন্ন। ফ্রান্সিসের ভাবনার শেষ নেই যেন তখনও ফ্রান্সিসদের কিছু খাওয়া জোটে নি।
হঠাই দুর্গের পাহারাদারদের মধ্যে ডাকাডাকি কথাবার্তা শোনা যেতে লাগল।
একটু পরেই ঠাঠাং-ঠং শব্দে কয়েদঘরের দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকল সিনার্কা। হ্যারি আস্তে বলল—ফ্রান্সিস সিনার্কা এসেছে। ফ্রান্সিস উঠে বসল। দেখল—এখন নানা রঙের ফুলপাতা তোলা গাঢ় নীল একটা ঢোলাহাতা দামি কাপড়ের পোশাক সিনার্কা পরে আছে। মাথার কাঁচাপাকা চুল পরিপাটি আঁচড়ানো। চোখে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
গম্ভীর গলায় সিনার্কা ডাকল—রোক্কা। রোক্কা চোখ খুলল। কিন্তু শুয়েই রইল। “ উঠে বসল না। সিনার্কা পেছনে দাঁড়ানো দলপতির দিকে তাকাল। দলপতি সঙ্গে সঙ্গে কোমরবন্ধ থেকে তলোয়ার টেনে খুলল। দু-পা খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে রোক্কার হাতের কনুইয়ের ওপর তলোয়ারের খোঁচা মারল। কেটে গেল জায়গাটা। রক্ত পড়তে লাগল। যন্ত্রণা মুখ বিকৃত করে রোকা উঠে বসল। কাটা জায়গাটা হাত চেপে সিনার্কার দিকে তাকাল। সিনার্কা কেঠো হাসি হেসে বলল—এই যে বিদ্রোহী নেতা—কী ভাবে মরতে চাও বলো—ফাঁসিকাঠে না তলোয়ারের কোপে না জীবন্ত কবরে ঢুকে।
রোক্কা আস্তে আস্তে বলল—আমার কাছে সব মৃত্যুই সমান। তাছাড়া মাতৃভূমির মঙ্গলের জন্য মৃত্যু তো আনন্দের গৌরবের।
—এসব বড়ো বড়ো কথা শুনিয়েই বুঝি দল বাড়িয়েছে। সিনার্কার বলল।
—দল বাড়াতে হয় নি। আপনার প্রজারা আপনার অপশাসনের জন্যে মনে মনে গর্জাচ্ছিল। তবে বিচ্ছিন্নভাবে। আমি শুধু ওদের একত্র করেছি। অর্ধেক কাজ আপনিই করে রেখেছিলেন। রোক্কা শান্তভাবে বলল।
—চোপ শয়তান—সিনার্কা যেন গর্জন করে উঠল। রোক্কা আর কোনো কথা বলল না। চোখ বুজে চুপ করে বসে রইল। সিনার্কার পেছনেই দাঁড়িয়েছিল একজন কাঁচাপাকা চুলদাড়িওয়ালা অমাত্য। তার গায়েও দামি কাপড়ের জোব্বা মত। নিশ্চয়ই সিনার্কার পরামর্শদাতা। লোকটি এবার একটু ক্রুদ্ধ সিনাৰ্কার কানের কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে বলল—এখন মাথা গরম করবেন না। তারপর বলল—রোক্কাকে বন্দি করা হয়েছে এই খবর আপনি বেশিদিন গোপন রাখতে পারবেন না। আজ রাতেই রোক্কাকে জাহাজে নিয়ে গিয়ে নিকেশ করে দিন। কেউ খোঁজই পাবে না। কথাগুলো আস্তে বললেও হ্যারি কিছু কথা শুনতে পেল। বাকিটুকু আন্দাজে বুঝে নিয়ে নিজেরে দেশের ভাষায় ফ্রান্সিসকে এই কথাগুলো ফিসফিস্ করে বলে বুঝিয়ে দিল। সিনার্কা তখন মাথাটা একটু ওঠানামা করে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। বলল—তোমরা কারা? হ্যারি বলল—আপনার দলনেতা আমাদের সব কথা জানেন। সিনার্কা দলপতির দিকে তাকাল। দলপতি দুপা খুঁড়িয়ে এসে ফ্রান্সিসদের সম্পর্কে যা জানে মৃদুস্বরে বলল। সিনার্কা ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে স্পেনীয় ভাষায় বলল—হুঁ—তোমরা ভাইকিং-জলদস্যুর দল-জাহাজ লুঠ করো।
—মাননীয় সিনার্কা—হ্যারি বলল—আপনার দলপতিকে জিজ্ঞেস করুন। তিনিই সব বলতে পারবেন।
তখন দলনেতা জানাল যে ভাইকিংদের জাহাজ তল্লাশি করা হয়েছিল। লুঠের জিনিসপত্র কিছু পাওয়া যায় নি।
সিনার্কা বলল—ঐ বাড়িটায় রোকা আত্মগোপন করেছিল। তোমরা ওখানে কী করছিলে?
—আমাদের রাজকুমারী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার চিকিৎসার জন্যই হ্যারি কথাটা শেষ করতে পারলো না। সিনার্কা বলে উঠল—বাজে কথা—তোমরা রোক্কার বিদ্রোহী দলে যোগ দিয়েছিলে। তোমাদেরও রেহাই নেই।
এবার হঠাৎ ফ্রান্সিস এক লাফে উঠে দাঁড়াল। মাথা অনেকটা নুইয়ে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। একজন বিদেশির কাছে এই সম্মান পাওয়ায় সিনার্কা বেশ কুশিই হল। হ্যারি অবশ্য একটু অবাকই হল। ওদের দেশের রাজাকেও ফ্রান্সিস এতক্ষণ মাথা নুইয়ে সম্মান জানায় না। ফ্রান্সিস এবার আস্তে আস্তে মাথা তুলে বলল—মহামান্য রাজা—সার্দিনিয়া দ্বীপেও লোকমুখে আপনার কত প্রশংসা শুনেছি। জ্ঞানী বিচক্ষণ আর প্রজাবৎসল রাজা হিসেবে আপনার গুণগান করে এখানকার আপনার প্রজারা। আমি শুনেছি সেসব। তখন থেকেই আপনাকে একবার দর্শন করবার জন্য প্রাণ আকুল হয়ে ছিল। আজ আপনাকে দর্শন করে আমার জীবন ধন্য হল। কথা শেষ করে ফ্রান্সিস আবার মাথা নিচু করে রইল। কিছুক্ষণ। এবার সিনার্কা খুশির হাসি হেসে বলল—ঠিক আছে তুমি কি বলতে চাও বলো। ফ্রান্সিস মাথা তুলল। আঙ্গুল তুলে রোক্কাকে দেখিয়ে বলল মহামান্য রাজা—এই লোকটা প্রবঞ্চক ঠগবাজ। রোক্কা চম্কে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারি আর কামেরাতেরও এক অবস্থা। রোক্কা কোনো কথা বলল না। ফ্রান্সিস বলল—মাননীয় রাজা—এই লোকটা আমাদের কয়েদ-ঘর থেকে পালাবার ব্যবস্থা করেছে। আমাদের রাজকুমারী চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেব বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাজকুমারীর মূল্যবান গয়নার বাকশো চুরি করেছে। তারপর আমাদের ঐ বাড়িতে বন্দি করে রেখেছিল।
রোক্কা ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে থেকে ম্লান হাসল–মানুষ এক অকৃতজ্ঞ হয়। হ্যারি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিসকে বাধা দিতে গেল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে বলে উঠল—চুপ করে থাকো। এমন একজন মহান রাজার বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে মৃত্যুই তাদের একমাত্র শান্তি। কথাটা শেষ করে ফ্রান্সিস আবার মাথা নিচু করল। সিনার্কা একজন সামন্তরাজা মাত্র। তাকে একবারে কর্সিকা দ্বীপের মহামান্য রাজার মতো সম্মান দিল ফ্রান্সিস সিনার্কা খুশিতে আটখানা। সিনার্কা সগর্বে হেসে অমাত্য দলপতি আর সৈন্যদের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল ঠিক আছে সে ব্যবস্থা হচ্ছে। এবার তুমি কী চাও বলো। ফ্রান্সিস মাথা নিচু অবস্থাতেই বলল—যদি অভয় দেন তো বলি।
—বলো—বলো। সিনার্কা খুশি হয়ে বলল। ফ্রান্সিস মাথা তুলে বলল—মহামান্য রাজা—এখানকার আপনার রাজাদের মুখে অতীতের একটা রহস্যময় ঘটনার কথা শুনেছি।
—কোনো রহস্যময় ঘটনা? সিনার্কা কপাল কুঁচকে বলল।
—রানী ইসাবেলার রত্নালংকারের পেটিকার কথা। ফ্রান্সিস বলল।
—ও। সিনার্কা মুখে শব্দ করল।
—শুনেছি এই দুর্গের ওপরের দিকে দুটি কক্ষের কোথাও ইসাবেলার সেই রত্নালংকারের পেটিকা আজও আছে।
—হ্যাঁ—বংশানুক্রমে এটা আমরা শুনে আসছি। সিনার্কা বলল। ফ্রান্সিস আবার একটু মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল—
—মহামান্য রাজা আপনি যদি দয়া করে অনুমতি দেন তবে আমরা সেই রত্নভাণ্ডার উদ্ধারের জন্যে চেষ্টা করতে পারি।
—পারবে তোমরা উদ্ধার করতে? সিনাৰ্কার কথায় বেশ আগ্রহ ফুটে উঠল। ফ্রান্সিস আবার একটু মাথা নুইয়ে বলল—মহামান্য রাজা—আপনি তো আমাদের মৃত্যুদণ্ডই দেবেন। মরার আগে একবার শেষ চেষ্টা করবার সুযোগ দিন। মরে তো a যাবোই-রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করতে গিয়েই না হয় মরলাম।
—হুঁ—ওদুটো ভূতুরে ঘর। কয়েকজন লোক ঐ ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে মারা গেছে—তা জানো। সিনার্কা বলল।
—বললামই তো—মরে যেতে পারি জেনেই যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
—বেশ দেখো চেষ্টা করে। সিনার্কা বলল।
-তাহলে মহামান্য রাজা—আপনি সবাইকে আদেশ দিন কেউ যেন আমাদের স্বাধীন চলাফেরায় বাধা না দেয়। ফ্রান্সিস বলল।
—বেশ—আদেশ দেওয়া হবে। সিনার্কা বলল।
—এবার একটা ঘটনা আপনাদের বলি—বোধহয় আপনারা জানেন না। ফ্রান্সিস বলল।
—কোন্ ঘটনা? সিনার্কা বলল।
—ঐ ঘরদুটোর একটা নক্শা রানী ইসাবেলা এঁকেছিলেন একটা পার্চমেন্ট কাগজে। ফ্রান্সিস বলল।
—বলো কি? সিনার্কা অমাত্যের দিকে তাকাল। দু’জনেই অবাক।
—হয়তো মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে রানী ইসাবেলা ঐ নকশায় সঠিক নিশানা দিয়েছিলেন কোথায় গোপনে রাখা হয়েছে সেই বহু মূল্যবান রত্নালংকারের পেটিকা। তারপর হয়তো নকশাটি জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন।
—সেই নকশা কোথায়? সিনার্কা সাগ্রহে বলে উঠল।
—সব বলছি। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল—সেই নকশা অনেক হাত ঘুরে এই বিদ্রোহীদের হাতে এসেছে।
—তুমি কী করে জানলে? অমাত্যটি স্পেনীয় ভাষায় বলল।
—ঐ বাড়িটায় মানে বিদ্রোহী কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময় রোক্কা এই কথা বলেছিল। আমরা আড়াল থেকে শুনেছিলাম। বিদ্রোহীদের ঐ আস্তানাতেই কোথায় লুকোনো আছে সেই নশা। ফ্রান্সিস বলল। সিনার্কা ক্রুদ্ধদৃষ্টি রোক্কার দিকে তাকিয়ে বলল—কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সেই নকশা?
—সব মিথ্যে কথা—রোক্কা প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠল—সব বানানো গপপো। ফ্রান্সিস একটু নরম গলায় বলল—মহামান্য রাজা—ঐ নকশা পেয়ে কী লাভ! আগে তো ঘর দুটোয় ঢুকতে হবে তারপরে তো নকশা মেলাতে হবে। সিনার্কা এবার সমস্যাটা বুঝতে পারল। সত্যিই তো সেই ঘরদুটোয় ঢোকাই তো সবচেয়ে বড়ো সমস্যা।
—হুঁ—তা ঠিক। সিনার্কা বলল। তারপর একটু ভেবে বলল—তাহলে ঐ রত্নপেটিকা উদ্ধারের উপায় কী? ফ্রান্সিস বলল—
—প্রথমে মানে আজকেই দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা ঐ বাড়িটায় মানে বিদ্রোহীদের ঐ আস্তানায় যাবো। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে নশাটা উদ্ধার করবো।
—পারবে? সিনার্কা একটু সংশয়ের সুরে বলল।
—নিশ্চয়ই পারবো। ফ্রান্সিস গলায় বেশ জোর দিয়ে বলল।
—বেশ—তারপর? সিনার্কা বলল।
—এবার ঐ বন্ধ ঘরদুটোয় ঢোকার উপায় বের করতে হবে। এটাই আসল সমস্যা। ঘরদুটোয় ঢোকার উপায় বের করতে পারলে তখন—রোক্কাকে দেখিয়ে বলল—এই ৭ লোকটাকে নকশার রহস্য বুঝিয়ে দিতে বলবো।
—যদি না বলতে চায়? অমাত্যটি বলল।
উৎপীড়ন চালিয়ে কথা বের করতে হবে। ফ্রান্সিস বলল—
—মহামান্য রাজা-নকশার রহস্যের সমাধান একমাত্র এই লোকটাকে জানে। কিন্তু সেটা ওর কাছ থেকে জেনে নেওয়ার আগেই যদি লোকটাকে মেরে ফেলেন তাহলে সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
—তাহলে—সিনার্কা অমাত্যটিকে বলল কী করবেন? অমাত্যটি একটু চিন্তা করে বলল—দেখুন—এই ভাইকিং যোদ্ধাটি কী বলে।
—এই বিদ্রোহী লোকটাকে এখন বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তারপর কী করতে হবে আমি মহামান্য রাজাকে সময়মতো বলবো। ফ্রান্সিস বলল। অমাত্যটি এবার বলল—বেশ। কিন্তু একটা শর্ত আছে। রত্নভাণ্ডার উদ্ধার হলে সব মাননীয় সিনার্কার হাতে তুলে দিতে হবে।
—হ্যাঁ-হ্যাঁ—সিনার্কা দ্রুত বলে উঠল—তোমরা বিদেশি তোমাদের বিশ্বাস কি। কিন্তু এই কথাটা ভালো করে জেনে রেখো রত্নভাণ্ডার নিয়ে পালাবার চেষ্টা করলে তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে বন্দি করা হবে।
—বেশ—ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করল। তারপর বলল—এবার তাহলে আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করুন।
কামেরাতকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে সিনার্কা বলল—কিন্তু এই বিদ্রোহীটাকে মুক্তি দেওয়া হবে না। ফ্রান্সিস আবার মাথা একটু নুইয়ে বলল—এর নাম কামেরাত। ঐ বিদ্রোহীদের আস্তানাটার দেখাশুনো করতো। ও ঐ বাড়িটার সবকিছু চেনে। ওর সাহায্য খুবই প্রয়োজন।
—হুঁ—একটু ভেবে সিনার্কা বলল কিন্তু ও যেন পালাতে না পারে।
—আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—ওর হাতের দড়ি আরো শক্ত করে বেঁধে নিয়ে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
—বেশ। সিনার্কা বলল।
সিনার্কা যাবার জন্যে ফিরে দাঁড়াল। অমাত্যটি একটু এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একটুক্ষণ। তারপর ভারি গলায় বলল—ঐ অভিশপ্ত ঘর দুটোয় ঢুকতে পারবেন? ফ্রান্সিস একটু হেসে বলল—সব দেখে-শুনে ভাবনা-চিন্তা করে তবেই বলতে পারবো ঢোকা সম্ভব কি না।
জানো-রানী ইসাবেলার প্রেতাত্মা একটা মোমবাতি হাতে সারারাত ঘরটায় ঘুরে বেড়ায়। আমাদের দুর্গরক্ষী সৈন্যরা আমাকে বলেছে ঐ ঘর দুটোয় নাকি পা ঘষে ঘষে চলার অস্পষ্ট শব্দ শুনেছে। কাঠের দরজাটায় নাকি টোকা দেবার শব্দও শুনেছে। ঐ ঘরের কাছের ঘরগুলোয় যোদ্ধারা রাতে থাকতে সাহস পায় না। সেই ঘরগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অমাত্যটি থামল। তারপর বলল—এত সব জানার পরও তুমি ঐ ঘর দুটোয় ঢুকতে যাবে? সে সাহস আছে তোমার? ফ্রান্সিস সহজভাবে বলল—আপনারা তো আমাকে আর আমার বন্ধুকে ফাঁসিই দেবেন। ফাঁসিতে মরার আগে না হয় প্রেতাত্মার হাতেই মরবো। অমাত্যটি ফ্রান্সিসের আরো কাছে এসে ফিসফিস করে বলল—তুমি যদি ঐ ঘরে ঢোকার চেষ্টা না করে তবে তোমাদের মুক্তির জন্যে সিনার্কাকে আমি রাজি করাবো। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল ঠিক আছে—আপনার এই করুণার কথাটা ভেবে দেখি। পরে যা বলার বলবো।
অমাত্যটি আর কিছু বলল না। সিনার্কার পেছনে পেছনে চলল। একটু পরে ঠং ঠাং শব্দে কয়েদঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
ফ্রান্সিস এতক্ষণের কথাবার্তায় বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এবার ঘাসের বিছানাটায় বসল। তারপর হ্যারির পাশে শুয়ে পড়ল। হ্যারি এতক্ষণ মাথা নিচু করে নির্বাক বসেছিল। যে রোক্কার জন্যে মারিয়াকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হল সেই রোক্কাকে ফ্রান্সিস লোকটা’ লোকটা’ বলে শুধু অপমান করলে না ডাহা মিথ্যে কথা বলে সিনার্কার মতো একটা অত্যাচারী শাসককে নির্লজ্জের মতো তোষণ করল। ফ্রান্সিসের এই অধঃপতন দেখে দুঃখে হতাশায় হ্যারির বুক ভেঙে যেতে লাগল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে ডাকল—হ্যারি হ্যারি ডাকটা শুনেও অনড় বসে রইল। ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকাতেও ঘৃণাবোধ করল।
হঠাৎ রোক্কা হো হো করে হেসে উঠল। বলল—ভাইকিংরা-বীর, দুঃসাহসী সৎ-বিবেকবান। পরক্ষণেই শায়িত ফ্রান্সিস আর হ্যারির দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ঘৃণাময় মুখ চোখ কুঁচকে থুতু ফেলল—-থু-থুঃ—।
অপমানে হ্যারির চোখ কান জ্বালা করে উঠল। দুচোখ জ্বলে ভিজে উঠল। কিন্তু ও কাঁদতেও পারল না। ও চোখ বন্ধ করে বসে রইল।
শুনল ফ্রান্সিস খুব মৃদুস্বরে ডাকল—হ্যারি হ্যারির আর সহ্য হল না। ও মুখ তুলে চিৎকার করে বলে উঠল—তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার—আমার ঘৃণা—হ্যারি আর বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আবাল্য বন্ধু ফ্রান্সিস নিজের জাত ভাইয়ের চেয়েও যে ফ্রান্সিসকে বেশি ভালোবাসে স্বপ্নেও ভাবে নি সেই ফ্রান্সিসকে এত বড়ো কঠিন কথা ও বলতে পারবে। হ্যারি হাঁপাতে লাগল। রোক্কা যেভাবে ফ্রান্সিসকে অপমান করল হ্যারি কখনও ফ্রান্সিসকে এরকম অপমানিত হতে দেখেনি। হঠাৎ রোক্কা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে একলাফে শায়িত ফ্রান্সিসের কাছে এলো তারপর ডান পা চালাল ফ্রান্সিসের পেঠের ধারে। ওঁক করে ফ্রান্সিসের মুখ দিয়ে শব্দ বেরিয়ে এলো। লাথি খেয়ে বিছানার ওপর দুপাক ঘুরে গেল। রোক্কা চিৎকার করে বলে উঠল—অকৃতজ্ঞ জানোয়ার। দু পা ছুটে এসে আবার পা তুলল। ফ্রান্সিস তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল। তারপর বাঁধা দুটো হাতের মুঠি দিয়ে রোক্কার থুতনিতে এত জোরে ঘা মারল যে রোক্কা চিৎ হয়ে ছিটকে পড়ল। ঘাসের বিছানার বাইরে। পাথুরে দেয়ালে মাথাটা ঠুকে গেল। আঁ—একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ তুলে রোকা অনড় পড়ে রইল। মশালের আলোয় হ্যারি দেখল—রোক্কার কপালের কাটা জায়গাটা থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে। একে তলোয়ারের ঘায়ে রোক্কার শরীর ক্ষতবিক্ষত। তার ওপর এই মার খাওয়া। রোক্কা গোঙাতে লাগল। ক্রুদ্ধ কামেরাত এবার উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলে উঠল খবরদার-চুপ করে বসে থাকো। কামেরাত কথাটার অর্থ বুঝল না। কিন্তু ফ্রান্সিসের ধমক খেয়ে ও কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। দাঁড়িয়ে রইল।
তখনই ঘটঘটাং শব্দ তুলে লোহার দরজা খুলে গেল। রক্ষীরা কয়েকজন খাবারদাবার নিয়ে কল। বোকার অন্য তিন বিদ্রোহী বন্ধু ক ঘটল তা দেখল কেন রোল্ক এত ক্রুদ্ধ হল বুঝল না।
রোক্কা বাদে সবাই খেতে বসল। কামেরাত কোনোরকমে রোক্কাকে উঠিয়ে বসাল। রোক্কার সামনেও খাবার দেওয়া হল। গোল কাটা রুটি। বেশ পোড়া। সঙ্গে আলু আনাজের ঝোল। একজন রক্ষী সকলের হাতে দড়ি খুলে দিল। সবাই খেতে লাগল।
ফ্রান্সিস এই সময় যা বরাবর বলে তাই বলল—হ্যারি-পেট পুরে খাও। খেতে ভালো না লাগলেও খাও। হ্যারির মনে পড়ে গেল অতীতের কত বন্দি জীবনের কথা। ও একটু। আশ্চর্য হয়েইফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। এত কাণ্ডের মধ্যেও ব্যারি দেখল ফ্রান্সিস নির্বিকার।
সকলের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে একজন রক্ষী ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে বলল—তোমরা দুজন মুক্ত। ফ্রান্সিস কথাট বুঝল না। তবে দেখল রক্ষীটি অন্য সবাইয়ের দু হাত বেঁধে দিল। কিন্তু ফ্রান্সিস আর হ্যারির খোলা হাত আর বাঁধল না। এবার ফ্রান্সিস বুঝল—সিনার্কা কথা রেখেছে। ওদের মুক্তি দিয়েছে। অবশ্যই নিজের স্বার্থোদ্ধারের জন্যে-রানী ইসাবেলার রত্নভাণ্ডার যদি এরা উদ্ধার করে দিতে পারে—এই আশায়। রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারলে সিনার্কার লাভ। উদ্ধার করতে গিয়ে বিদেশিটা মরে গেলেও সিনার্কার কোনো ক্ষতি নেই। ফ্রান্সিস চোখ বুজে একটু ভেবে নিল। তারপর উঠে দাঁড়াল। ডাকল—হ্যারি হ্যারি উত্তর দিল না। চুপ করে বসে রইল। ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি—চলো যে বাড়িতে অসুস্থ মারিয়া রয়েছে সেখানে যেতে হবে।
হ্যারি রাগ স্বরে বলে উঠল—এবার তাহলে রাজকুমারীকে বন্দি করার কথা ভাবছো।
ফ্রান্সিস আগের মতোই শান্তগলায় বলল—কথা বাড়িও না। সময় কম—চলো।
—না—আমি তোমার সঙ্গে যাবো না। হ্যারি মাথা নেড়ে বলল। ওরা দুজন নিজেদের দেশের ভাষায় কথা বলছিল। রোক্কা আর অন্য বন্দিরা ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছিল না। তবে এটুকু বুঝল যে ফ্রান্সিস হ্যারিকে কোথাও যেতে বলেছে—হ্যারি সেখানে যেতে চাইছে না।
ফ্রান্সিস এবার একটু দ্রুত রক্ষীটির কাছে গেল। তারপর রক্ষীটির কোমরে ঝোলানো খাপ থেকে এক টানে তলোয়ারটা বের করল। রক্ষীটি চমকে উঠে বাধা দিতে লাগল। ফ্রান্সিস বাঁ হাত তুলে ওকে চুপ করে থাকতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিস স্থির তাকিয়ে আছে। হ্যারি অসহায় বোধ করল। ফ্রান্সিস ওর বুকে লোয়ার ঠেকিয়ে হুমুক করবে হ্যারি এটা কোনোদিন কল্পনাও করেনি। ও বুঝল-এখন প্রতিবাদ বৃথা। ফ্রান্সিসের মাথার ঠিক নেই এখন।
হ্যারি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস বলল-কামেরাতকে বলো আমাদের সঙ্গে যেতে। হ্যারি আর কী করে। কামেরাতকে বলল সেকথা। কামেরাত মাথা আঁকিয়ে বলে উঠল-না আমি যাবো না। দ্রুত সরে এসে ফ্রান্সিস কামেরাতের বুকেও তলোয়ার ঠেকাল। হ্যারিকে বলল-কামেরাতকে বলে দাও—আমাদের সঙ্গে যেতে না চাইলে ওর ভালো হবে না। হ্যারি কামেরাতকে বলল সেকথা। কামেরাত বেশ ভীত চোখে ফ্রান্সিসের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
ওরা দরজার দিকে চলল। সামনে তলোয়ার হাতে ফ্রান্সিস পেছনে হারি আর কামেরাত। খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ফ্রান্সিস একজন রক্ষীকে ইঙ্গিতে কামেরাতের হাতের দড়ি শক্ত করে বেঁধে দিতে বলল। রক্ষীটি একটা দড়ি নিয়ে এলো। শক্ত করে কামেরাতের হাত বেঁধে দিল।
দুর্গের পাথুরে চত্বর পার হল ওরা। সদর দেউড়ির দ্বাররক্ষীরাও ওদের বাধা দিল না।
ওরা বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস পুবমুখে হাঁটতে শুরু করল। বিনা প্রতিবাদে হ্যারি আর কামেরাত পেছনে পেছনে চলল। তখনই চারজন সৈন্য কোমরে তলোয়ার নিয়ে ওদের পিছু পিছু চলল। পথে দোকান-পাঠ খোলা। ব্যস্ত, লোকজনের চলাফেরা। ফ্রান্সিস কোনোদিকে তাকাল না। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। রাস্তার লোকজন দেখল ওদের। ওরা একটু আশ্চর্যই হল—তলোয়ার হাতে বিদেশি ফ্রান্সিসকে আর মাথা নিচু করে চলা হ্যারিকে দেখে আশপাশের লোকজনের মধ্যে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি হল। এই বিদেশিদের সৈন্যরা পাহারা দিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস হাঁটতে হাঁটতে একবার ওপরে সূর্যের দিকে তাকিয়ে নিল। বেলা আন্দাজ করল। দুপুর এখনও। চারদিকে ঝকঝকে রোদ।
হাঁটতে হাঁটতে ফ্রান্সিস হঠাৎ হাঁটার গতি কমিয়ে হ্যারির গা ঘেঁষে চলল। নিজেদের দেশীয় ভাষায় মৃদুস্বরে বলল—হ্যারি—অনেক কাজ সামনে। আমি যা বলি তাই করো সেভাবেই চলো। বিরোধিতা করো না। পেছনের একজন সৈন্যের নজরে পড়ল ফ্রান্সিস সৈন্যটি বুঝল—ওরা কোনো গোপন কথা বলছে। দায়িত্ব দেবার সময় দলপতি বারবার বলে দিয়েছে এই বিদেশিরা ভীষণ চালাক। সৈন্যটি এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ওরা একটু দূরে সরে হাঁটতে লাগল। হ্যারি তখন ভাবছে ফ্রান্সিসের এসব কথার মানে কি? তবে কি ফ্রান্সিসের এইসব বিশ্রী ব্যবহার লোক দেখানো? হ্যারি ভীষণ ধন্দে পড়ে গেল।
সেই বাড়িটির সামনে এলো সবাই। একজন লম্বামতো সৈন্য আধভাঙা দরজায় ধাক্কা দিল। দু’বার ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। দেখা গেল সিনার্কার একজন সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা গেল মারিয়াকে পাহারা দেবার জন্যেই তাকে এখানে রাখা হয়েছে। বাঁদিকের শেষ ঘরটায় অসুস্থ মারিয়া আছে। ঢোকার আগে ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল—হ্যারি সৈন্যদের বলো যে এখন আমি তোমাকে আর কামেরাতকে নিয়ে রানী ইসাবেলার নকশা খুঁজে বের করতে সারা বাড়ি তল্লাশি চালাবো। আরো বল—সিনার্কা এ ব্যাপারে আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। বলেছেন এ সময় আমাদের স্বাধীন চলাফেরায় কেউ বাধা দেবে না। হ্যারি একটু চুপ করে থেকে লো ল্যাতিন ভাষায় সৈন্যদের কথাগুলো বলল। সৈন্যরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ফ্রান্সিস বলল—ওদের বলো যে মারিয়ার ঘরের পাহারাদার সৈন্যকে ঐ ঘরেই থাকতে হবে। বাকিরা এখানে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদের পাহারা দেবে। হ্যারি সেকথা সৈন্যদের বলল। সৈন্যরা সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফ্রান্সিস হ্যারি আর কামেরাতকে নিয়ে চলল। মারিয়ার পাহারাদার সৈন্যটি মারিয়ার ঘরের দিকে চলে গেল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে হ্যারিকে বলল—কামেরাতকে নিয়ে ডানদিকের বারান্দা দিয়ে চলো। তাড়াতাড়ি। হ্যারি বুঝল—ফ্রান্সিস নিশ্চয়ই কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। ও কামেরাতের হাত ধরে বলল—শিগগির ডান দিকের বারান্দা না দিয়ে চলো৷ তিনজনে প্রায় ছুটে চলল। শেষ ঘরটার দরজা ঠেলে ফ্রান্সিস ঢুকে পড়ল। পেছনে হ্যারি আর কামেরাত।
ঘরটা অন্ধকার অন্ধকার। ফ্রান্সিস ঘরটায় ঢুকেই কামেরাতকে বলল–স্পেনীয় ভাষা বোঝ?
কামেরাত স্পেনীয় ভাষাতেই বলল—বুঝি-বলতে-ভালো—পারি না।
ফ্রান্সিস বলল—শিগগির আমাকে একটা কাগজ কালি কলম এনে দাও।
কামেরাত বলল—কেন?
ফ্রান্সিস একটু রেগেই বলল—প্রশ্ন করো না। যা বলছি করো।
ফ্রান্সিসের ওপর কামেরাতের রাগ তখনও পড়ে নি। মাথা নেড়ে বলল—পারবো না।
ফ্রান্সিস দাঁত চেপে বলল কামেরাত—একটা নকশা আঁকতে হবে। শিগগির।
কামেরাত আবার মাথা নাড়ল।
এবার হ্যারি বলল কামেরাত তুমি জানো না—অমাত্যের পরামর্শমতো আজ রাতেই তোমাদের জাহাজে রোক্কাকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হবে। কামেরাত অমাত্যের কথা শোনে নি। ও অবাক হয়ে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারি বলল—তাড়াতাড়ি কাগজ আনো।
ফ্রান্সিস বলল কামেরাত-এর ওপর আমাদের তোমার রোক্কার মরণ-বাঁচন নির্ভর করছে। তাড়াতাড়ি সময় কম। কামেরাত এবার ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারল। ছুটে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই একটা বড়ো পার্চমেন্ট কাগজ নিয়ে এলো হলদেটে পুরোনো কাগজ। রুপোর দোয়াত আর পাখির পালক কেটে তৈরি কলম।
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে কাগজটা নিয়ে মেঝেয় পাতলা। আলো কম। তবু কালিতে কলম ডুবিয়ে দ্রুতহাতে একটা নকশামতো আঁকলো। নকশাটা দেখতে এরকম—আঁকা শেষ করে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। কামেরাতকে বলল—খুব মন দিয়ে শোন। আমি মারিয়া মানে ঐ কোণার ঘরে যাকে চিকিৎসা করা হচ্ছে তাকে আমি নিয়ে আসছি। এর মধ্যে তুমি ঐ রোগীর আর রোক্কার চিকিৎসার জন্য ওষুধগুলো একত্র করে একটা মোটা কাপড়ে পোঁটলামতো বেঁধে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও। যে করে তোক একটা শস্যটানা গাড়ি জোগাড় করো। এখানে সবাইকে তুমি চেন—তুমি সহজেই এটা পারবে। গাড়ি নিয়ে কোনো শব্দ না করে পেছনের জংলা জায়গাটায় নিয়ে এসো। এখান থেকে মারিয়াকে নিয়ে আমি পেছনের দরজার কাছে থাকবো। তুমি মারিয়াকে গাড়িতে তুলে নেবে। ওষুধগুলো বের করে মোটা কাপড়টা দিয়ে মারিয়াকে ঢেকে দেবে যাতে কেউ ওর মুখ দেখতে না পায়। তারপর গাড়ি নিয়ে সোজা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজঘাটায় চলে যাবে। মারিয়া আমাদের জাহাজ চিনিয়ে দেবে। সেই জাহাজে মারিয়াকে নিয়ে উঠবে। ঐ জাহাজেই থাকবে। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। কথাটা একটানা শেষ করে ফ্রান্সিস একটু থেমে হাঁপানো গলায় বলল—সব কথা বুঝলে। কামেরাত মাথা দুলিয়ে এতক্ষণে হেসে বলল—বুঝেছি। ফ্রান্সিসের হাতে তখনও তলোয়ারটা ছিল। ও তলোয়ারের ফলা ঘষে ঘষে কামেরাতের হাতে বাঁধা দড়িটা কেটে দিল। কামেরাত সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ফ্রান্সিস এবার খোলা তলোয়ারটা পিঠের দিকে পোশাকের নিচে ঢুকিয়ে তলোয়ারটা এ হ্যাঁচকা টানে তুলে আনল। পিঠ লম্বালম্বি কেটে গেল। ফ্রান্সিস তলোয়ারটা চোখের সামনে ধরল। দেখা গেল তরোয়ালের ফলার গায়ে রক্ত লেগে রয়েছে।
হ্যারি শিউরে উঠে বলল—এ কী করল?
ফ্রান্সিস বলল—আস্তে। মারিয়ার ঘরে যাবো। এখন খুব জোরে লো ল্যাতিন ভাষায় চেঁচিয়ে কাতর আর্তনাদ করে বললা—মরে গেলাম—মরে গেলাম। তাড়াতাড়ি। হ্যারি আর দেরি করলো না। শেখানো মতো আর্ত চিৎকার করে বলে উঠল-উঃ-আঁ আঁ মরে গেলাম—মরে গেলাম।
ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল—চলো মারিয়ার ঘরে। ঐ ঘরের পাহারাদারকে বলবে—কামেরাতকে আমি মেরে ফেলেছি। কারণ কামেরাত কিছুতেই বলতে চাইছিল না—নকশাটা কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। চলো।
দু’জনে ছুটে এসে মারিয়ার ঘরে ঢুকল। মারিয়া বিছানায় শুয়ে ছিল। হঠাৎ ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে ঢুকতে দেখে দুর্বল শরীরেও আনন্দে উত্তেজনায় উঠে বসল। হেসে দু’হাত তুলে বলল—ফ্রান্সিস
কিন্তু এ কোন ফ্রান্সিস ? হাতে তলোয়ার। দু’চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। মারিয়ার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। ও চিৎকার করে উঠতে গেল। দুর্বল শরীরে গলা দিয়ে শব্দ বেরুলো না। পাহারাদার ফ্রান্সিসের হাতে তলোয়ার দেখে নিজেও কোমরে গোঁজা তলোয়ারের বাঁটে হাত রাখল। হ্যারি ছুটে এসে ওকে বলল—লড়াই নয়। সেই ই বিদ্রোহী লোকটা কিছুতেই বলছিল না রানী ইসাবেলার নকশাটা কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তাই সিনাৰ্কার হুকুমে লোকটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। পাহারাদার হ্যারির আর্ত চিৎকার শুনেছিল। তাই সন্দেহ করল না।
মারিয়া হ্যারির কথা বুঝল না। ও ফ্যাল ফ্যাল করে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইল। পাহারাদার হতবাক দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস ওদের দেশীয় ভাষায় বলল—হ্যারি মারিয়াকে নিয়ে যাচ্ছি। সত্য না বললে ওকেও মেরে ফেলা হবে। কথাটা শেষ করে ফ্রান্সিস তলোয়ার কোমরে গুজল। তারপর এক লাফে মারিয়ার বিছানার কাছে এল। তারপর মারিয়া কিছু বোঝার আগেই মারিয়ার মাথার চুলের মুঠি ধরে এক হাকা টান মারিয়াকে মেঝেয় নামিয়ে আনল। চুল ধরে টেনে নিয়ে চলো। যন্ত্রণায় মারিয়া চোখে অন্ধকার দেখল। ওর দু’চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। দুর্বল শরীর। মারিয়া কাঁদতে লাগল। পাহারাদার সৈন্যটি বাধা দিতে গেল। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে ওকে থামাল। বলল—এই মেয়ে লোকটা জানে রানী ইসাবেলার নকশা কোথায় গোপনে রাখা হয়েছে। যদি তার হদিশ না বলে তবে—সিনার্কা হুকুম দিয়েছেন—একেও মেরে ফেলা হবে। পাহারাদার সৈন্যটি দাঁড়িয়ে পড়ল। আর বাধা দেবার চেষ্টা করল না।
বাইরের বারান্দায় পাহারাদার সৈন্যটি চোখের বাইরে আসতেই ফ্রান্সিস মারিয়ার চুলের মুঠি-ছেড়ে দিল। তারপর মারিয়াকে পাঁজা কোলা করে তুলতে গেল। মারিয়া দুর্বল শরীরে দু’হাত যতটা সম্ভব ফ্রান্সিসকে বাধা দিতে লাগল—আর কাঁদতে লাগল। ফ্রান্সিস ফিসফিস করে বলতে লাগল—মারিয়া বাধা দিও না। বাধা দিও না—মারিয়া শান্ত হও। কিন্তু মারিয়া সে কথায় কান দিল না। ফ্রান্সিস আবার বলল—মারিয়া আমি সেই আগের ফ্রান্সিস ই আছি—যা বলছি শোনেনা। মারিয়া ভাঙা গলায় বলে উঠল—তুমি শয়তান—খুনী। ফ্রান্সিস বুঝল মারিয়াকে এখন কিছু বলে লাভ নেই। ও আবার মারিয়ার চুলের মুঠি ধরল। মারিয়া আর্ত চিৎকার করে উঠল—মা-মা—। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে মারিয়ার ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে জোরে চাপড় মারল। দুর্বল মারিয়া মুখে ওঁক করে শব্দ তুলে অজ্ঞানের মতো হয়ে গেল। ফ্রান্সিস এটাই চাইছিল। ও তাড়াতাড়ি মারিয়াকে দু’হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে পেছনের দরজার দিকে ছুটল।
ভেজানো দরজা পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খুলল। দেখল জংলামতো জায়গাটার কিছুটা আড়ালে একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জংলামতো জায়গাটায় কামেরাত গুঁড়ি মেরে বসে ছিল। ফ্রান্সিসদের দেখেই ও ছুটে এলো। দুহাত বাড়িয়ে মারিয়ার প্রায় অচেতন শরীরটা পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গাড়িটার দিকে ছুটল। আস্তে আস্তে মারিয়াকে গাড়িতে শুইয়ে দিল। গাড়িতে উঠল না। ঘোড়াটার মুখের কাছে লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চলল। গাড়ি চলার শব্দ কম হল। গাড়িটা কিছুদূর যেতেই ফ্রান্সিস ফিরে এলো। ছুটে শেষের ঘরটায় ঢুকল। মেঝে থেকে নকশাটা তুলে নিল। কোমরে এটা গুঁজে রাখল। ঘরের বাইরে এসে ডাকল—হ্যারি হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো। তখনই দেখল তলোয়ারে কাটা ফ্রান্সিসের পিঠের দিকটার পোশাকের কাপড় রক্তে ভিজে গেছে। হ্যারি কিছু বলল না। এর মধ্যেই ফ্রান্সিস নকশার কাগজটা মেঝের ধূলোয় ঘষে নিল যাতে সিনার্কা দেখে বুঝতে পারবে নকশাটা পুরোনো।
দুজনে বাইরে এলো। সদর দরজায় দাঁড়ানো সৈন্যরা কামেরাত আর মারিয়ার আর্ত চিৎকার অস্পষ্ট শুনেছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে।
হ্যারি তখন ফ্রান্সিসের হাত থেকে নকশাটা নিয়ে উঁচু করে ধরে চেঁচিয়ে বলল—রানী ইসাবেলার এই নকশাটা উদ্ধার করা হয়েছে। শিগগির মহামান্য সিনার্কাকে সংবাদ পাঠাও। সৈন্যরা ভেতরের ব্যাপার কিছুই বুঝল না। ওরা শুনেছে এই বিদেশিরা নকশা খুঁজে বের করতে এখানে আসবে। নকশাটা তাহলে খুঁজে পেয়েছে ওরা। ওদিকে তলোয়ার হাতে ফ্রান্সিসের রুদ্রমূর্তি দেখে ওরা বেশ ঘাবড়ে গেল। কোনো কথা না বলে ওরা দাঁড়িয়ে রইলো। হ্যারি বলল—একজন ঘোড়ায় চড়ে গিয়ে মহামান্য সিনার্কাকে সংবাদটা পৌঁছে দাও। একজন ঘোড়ার খোঁজে চলে গেল। হ্যারি বলল—এবার চলো—দুর্গে যাবো আমরা।
সৈন্যদল হাঁটতে শুরু করল। তখনই মারিয়ার ঘরের পাহারাদার সৈন্যটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। অন্য সৈন্যদের কাছে জানতে চাইল কী ব্যাপার? অন্য সৈন্যরা ওকে হ্যারির কথাটাই বুঝিয়ে বলতে বলতে চলল। পেছনে তলোয়ার হাতে ফ্রান্সিস আর হ্যারি
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হ্যারি মৃদুস্বরে বলল—সাবাস্ ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস ও চাপা গলায় বলল-চুপ—এখনও অনেক বাকি। এবার হ্যারি বলল-তলোয়ারটা কোমরে গোঁজো।
ফ্রান্সিস তলোয়ার কোমরে গুঁজে রাখল।
সারা রাস্তা দুজনে আর কোনো কথা বলল না পাছে সৈন্যদের মনে কোনো সন্দেহ জাগে। ফ্রান্সিসের চিন্তা পরের কাজ। হ্যারির চিন্তা-ফ্রান্সিস সফল হবে তো? ফ্রান্সিস আকাশের দিকে তাকাল। মধ্য-আকাশ থেকে সূর্য পশ্চিম মুখো হয়েছে। ফ্রান্সিস ভুরু কুঁচকে সময়ের হিসেব করল।
ওদিকে কামেরাত শস্যটানা গাড়িতে মারিয়াকে শুইয়ে নিয়ে চলেছে। মারিয়ার শরীর ঢেকে দিয়ে ছিল একটা ফুল তোলা মোটা কাপড়ে। সেই কাপড়ে মারিয়ার মুখও ঢাকা। মারিয়া আচ্ছন্নের মতো শুয়েছিল।
একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ির ঝাঁকুনি কম নয়। সেই ঝাঁকুনিতে মারিয়ার আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। উঠে বসতে গেল। পারল না। একে তো অসুস্থ। তার ওপর ফ্রান্সিস ওর চুলের মুঠি ধরে যেভাবে টানাটানি করেছে তাতে মারিয়া আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। গাড়িটার চারদিকে তাকিয়ে দেখল। একপাশে একটা কাপড়ের পুঁটুলি। মারিয়া কিছুই বুঝতে পারল না। ও গাড়িতে শুয়ে আছে কেন? কার গাড়ি? চালাচ্ছেই বা কে? আর যাচ্ছেই বা কোথায়?
দুর্বল স্বরে মারিয়া বলল—আমি এখানে কেন? কিন্তু চাকার ঘটু ঘটু শব্দে সে কথা গাড়িচালক কামেরাতের কানে গেল না।
হঠাৎই গাড়িটা থামল। চালকের আসন থেকে কামেরাত নেমে এলো। পেছনে এসে দেখল—মারিয়া মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কামেরাত হেসে বলল—এখন শরীর কেমন লাগছে? ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষা মারিয়া বুঝল। বলল—অনেকটা ভালো। একবার ভাবল মারিয়া ফ্রান্সিসের কথা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু ফ্রান্সিস যে দুর্ব্যবহার ওর সঙ্গে করেছে তাতে ফ্রান্সিসের সন্ধান করতে ওর মন চাইল না। মারিয়ার কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। তবু বলল—আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
—আপনাদের জাহাজে। কামেরাত বলল।
—হ্যারি রা এখনও বন্দী? মারিয়া জানতে চাইল।
—হ্যাঁ। কামেরাত বলল। তারপর বলল—মুখটা কাপড়ে ঢেকে শুয়ে থাকুন। সিনার্কার গুপ্তচররা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনার মুখ দেখলেই ওরা সন্দেহ করবে এই বিদেশি মহিলা এখানে কেন? যাচ্ছেই বা কোথায়?
মারিয়া মুখের ওপর কাপড়টা টেনে মুখ ঢাকল। ঠিক তখনই দু’জন সৈন্য গাড়িটার কাছে দাঁড়াল। মুখ-ঢাকা মারিয়াকে দেখে সন্দেহ হল। কামেরাতকে জিজ্ঞেস করল—এই মহিলা কে? মুখ ঢাকা কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো একে? কামেরাত বলল—ইনি আমার স্ত্রী। বাচ্চা হবে তাই শরীর খারাপ। নিয়ে যাচ্ছি দাইমার কাছে।—হুঁ—সাবধানে নিয়ে যাও। একজন সৈন্য বলল। সৈন্য দু’জন চলে গেল।
কামেরাত আবার গাড়ি চালাতে লাগল।
এবার মারিয়া পাশ ফিরে শুতে গেল। ঢাকা কাপড়ে টান লেগে কাপড়টা কিছুটা সরে গেল। মারিয়ার গাউনটার পায়ের কাছে কিছু অংশ বেরিয়ে এলো। গাড়িটা তখন সেই দুর্গের কাছাকাছি এসেছে। এসময় সিনার্কার গুপ্তচরেরা নজরে পড়ল গাড়িটা। গুপ্তচরটির সন্দেহ হতেই। ও ছুটে গাড়ির কাছে এলো। বলল—গাড়ি থামাও। কামেরাত গাড়ি চালাতে চালাতেই বলল—কেন গাড়ি থামাবো কেন? গুপ্তচরটি ততক্ষণে মারিয়ার পায়ের কাছে গাউনের অংশটা দেখে ফেলেছে। ওর মনে সন্দেহ বাড়ল—এরকম সুতোর লেসের কাজ করা গাউনতো এখানকার মেয়েরা পরে না। গুপ্তচরটি আবার বলল—গাড়ি থামাও। কামেরাত কানেও নিল না কথাটা। যেমন গাড়ি চালাচ্ছিল চালাতে লাগল। গুপ্তচরটি চিৎকার করে দুর্গের সামনে দাঁড়ানো সৈন্যদের ডাকল—সৈন্যরা এখানে এসো। দু’তিনজন সৈন্য ছুটে এল। গুপ্তচরটি বলল—গাড়ি থামাও এবার। কামেরাত দেখল আর উপায় নেই ধরা পড়তেই হল। মারিয়াও কী হচ্ছে দেখার জন্যে মুখ থেকে কাপড় সরিয়েছে। গুপ্তচরটি বলে উঠল এই বিদেশিনী আর তার দলের লোকেরা সব বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দিয়েছে। দুটোকেই কয়েদঘরে ঢোকাও। কামেরাত গাড়ি থামাল। সৈন্যরা ওকে নেমে আসতে বলল। কামেরাত নেমে এলো। সৈন্যরা মারিয়াকে উঠে বসতে বলল। মারিয়া বুঝল না! কামেরাত স্পেনীয় ভাষায় বলল—রাজকুমারী আমরা ধরা পড়েছি। ওরা আমাদের কয়েদঘরে বন্দি করে রাখবে। শেষ মুহূর্তে ধরা পড়ে গেলাম।
মারিয়া গাড়িটায় উঠে বসল। সৈন্যরাই ধরে ধরে রাজকুমারীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনল। কামেরাত ওষুধের পোঁটলাটা নামিয়ে নিল। দুর্গের সদর দেউড়ির দিকে যেতে যেতে কামেরাত সৈন্যদের বলল—উনি ভাইকিং দেশের রাজকুমারী ভীষণ অসুস্থ। অন্য কোনো ঘরে ওঁকে রাখুন। আমারও চিকিৎসা করতে সুবিধে হবে। দেউরিতে দলপতি ছিল। সৈন্যরা গিয়ে তাকে কথাটা বলল। দলপতি ঘাড় নেড়ে বলল—না—সিনার্কার অনুমতি না নিয়ে কিছু করা যাবে না।
অগত্যা সেই কয়েদঘরেই মারিয়া আর কামেরাতকে ঢোকানো হল। ঢঢং ঢং করে কয়েদঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এটুকু হেঁটে এসেই মারিয়া হাঁপিয়ে পড়ল। খড় বাঁধা বিছানায় শুয়ে পড়ল। কামেরাত পাশে বসল। পুঁটুলি খুলে একটা ওষুধ বের করে মারিয়াকে খেতে দিল। ওষুধ খেয়ে মারিয়া অসাড় হয়ে শুয়ে রইল। মারিয়া এতক্ষণ বুঝলকী দুর্বল হয়ে পড়েছে ও। কামেরাতকে বলল ও সেকথা। কামেরাত বলল—ভয়ের কিছু নেই রাজকুমারী। কয়েকটা দিন ওষুধ খেলেই আপনি আবার শরীরে জোর পাবেন। এই দুর্বলতা কেটে যাবে। একটু থেমে বলল—সমস্যা হল আপনি এই বন্দি। জীবন কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন।
মানিয়ে নিতেই হবে। মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। বার বার মারিয়ার মনে হতে লাগলো ফ্রান্সিস আর আগের মতো নেই। এই বিদেশ বিভুইয়ে ও একেবারে অসহায়।
প্রায় অন্ধকার কয়েদ ঘরটায় এই দিনের বেলাও মশাল জ্বলছে। সেই আলোয় চারদিকে তাকাতে তাকাতে কামেরাত দেখল রোক্কাও শুয়ে আছে। হাত দুটো বাঁধা।
কামেরাত তাড়াতাড়ি রোক্কার কাছে উঠে গেল। রোক্কা কামেরাতকে দেখে ম্লান হাসল। বলল—তুমিও ধরা পড়েছো?
—শুধু আমি নই ফ্রান্সিসদের দেশের রাজকুমারীকে এ ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কামেরাত বলল। কথাটা শুনে রোক্কা একটু আশ্চর্য হল। ফ্রান্সিস তো সিনার্কাকে প্রায় দেবতার আসনে বসিয়েছে। অথচ তাদের দেশের রাজকুমারীকে বন্দি করা হল। রোক্কা এসব কিছু বলল না। শুধু বলল—কামেরাত—তোমার কাছে কিছু ওষুধটষুধ আছে।
—সব আছে। আমার পুটুলিতে। সিনার্কার সৈন্যরা পুটুলির ভেতরের ওষুধটষুধ দেখে ছেড়ে দিয়েছে। আমি এক্ষুণি ওষুধ আনছি। কামেরাত বলল। তারপর নিজের জায়গায় ফিরে এসে পুঁটুলি খুলে প্রয়োজনীয় ওষুধ বের করল। মারিয়াকে বলল রাজকুমারী রোক্কাকেও এই কয়েদঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মারিয়া শুনে আশ্চর্য হল। বলল—রোক্কা বন্দি। তাহলে তো তোমাদের বিদ্রোহের নেতা কে হবে।
—সেসব ঠিক হবে। রোক্কাকে তার বিদ্রোহী বন্ধুরা ঠিক মুক্ত করে নিয়ে যাবে। কামেরাত বলল।
রোক্কার কাছে এলো কামেরাত। তারপর কাটা জায়গাগুলোয় মলম লাগিয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রোক্কা অনেকটা সুস্থ বোধ করল।
.
দুর্গের সদর দেউড়ির সামনে পৌঁছল ওরা। দেখল এখানে-ওখানে সৈন্যরা জটলা করছে। ওদের দেখে সবাই ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মানে রানী ইসাবেলার নকশাটা ফ্রান্সিস উদ্ধার করেছে এই খবর সবাই জেনে গেছে।
দেউড়ির দরজার কাছে দলপতি দাঁড়িয়েছিল। দলপতি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফ্রান্সিসের কাছে এলো। হেসে বলল—মহামান্য সিনাৰ্কা রানী ইসাবেলার নকশাটা দেখতে চেয়েছেন।
হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল সেটা। ফ্রান্সিস-কোমরে গোঁজা নকশাটা বের করে হ্যারিকে দিয়ে বলল—মহামান্য সিনার্কা যেন দেখেই ফিরিয়ে দেন। আমাদের এখনই কাজে নামতে হবে। দলপতির হাতে নকশাটা দিয়ে হ্যারি বলল সেকথা।
দলপতি দু’একবার নকশাটা এপিঠ-ওপিঠ দেখল। মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝল না। নকশাটা একজন সৈন্যের হাতে দিয়ে সিনাৰ্কার কাছে পাঠিয়ে দিল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি বন্ধ সদর দেউড়ির কাছে এলো। সৈন্যরা সরে গিয়ে ওদের যাবার জায়গা করে দিল। ঘর ঘর শব্দে দরজার একটা পাল্লা খুলে দেওয়া হল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি পাথুরে চত্বরটায় এলো।
দলপতি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফ্রান্সিসদের কাছে এলো। হাসতে হাসতে বলল—জানেন নকশা পেয়ে মহামান্য সিনার্কা আনন্দে সিংহাসনে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। হ্যারি বলল—তা তো হবেই। প্রায় একশো বছর আগে রানী ইসাবেলায় নিজের হাতে আঁকা নকশা পেয়েছেন। খুশি তো হবেনই। তবে নকশা পেলেই তো আর গুপ্ত রত্নভাণ্ডার পাওয়া যাবে না। ঐ ঘর দু’টোয় আগে তো ঢুকতে হবে। নকশা মেলাতে হবে। তবে তো।
তা ঠিক। দলপতি ওর বড়ো মাথাটা ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো এপাশ-ওপাশ দোলাল।
দলপতি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওদের নিয়ে দুর্গের পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। একটা পরিচ্ছন্ন ঘরে ওদের নিয়ে এলো। বলল—এই ঘরে আমি একা থাকি। এখন থেকে আপনারাও থাকবেন। মহামান্য সিনার্কা হুকুম দিয়েছেন আপনাদের আদর যত্নে যেন কোনো অবহেলা না হয়। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল—হ্যারি-রানী ইসাবেলার রত্নালংকারের ভাণ্ডার। সিনার্কা এখন আমাদের জন্য কতকিছু করবে।
ঘরটায় দেখা গেল পরিচ্ছন্ন দড়িবাঁধা মোটা ঘাসের বিছানা। ওপরে পরিষ্কার মোটা নকশাদার কাপড় পাতা।
—আপনারা বিশ্রাম করুন। যথাসময়ে খাবার দেওয়া হবে। হেসে এই কথা বলে দলপতিগহ্বর চলে গেল।
ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথার পেছনে দু’হাত পেতে চোখ বুজে শুয়ে রইল। অনেক চিন্তা মাথায়—মারিয়াকে নিয়ে কামেরাত জাহাজে উঠতে পারলো কিনা। সত্যিই রত্নালংকারের ভাণ্ডার আছে কিনা—নাকি সবটাই লোকমুখে প্রচলিত গল্প। এবার ভাবনা—কী করে রত্নভাণ্ডার পাওয়া যাবে। কী করে সবাইকে নিরাপদে জাহাজে ফিরতে পারবে।
গরাদ বসানো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ফ্রান্সিস সময় অনুমান করল। আর দেরি নয়। ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি বসে থেকো না। শুয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও। তারপরেই তোমাকে যেতে হবে। বার্গ পাহাড়ে বিদ্রোহীদের আস্তানায় গিয়ে বন্ধুদের বলবে তারা যেন সদর রাস্তা নয়—ঝোঁপ-জঙ্গল পাথুরে মাটির ওপর দিয়ে এসে জাহাজে চলে যায়। শুধু বিস্কো জাহাজে উঠবে না। তির-ধনুক নিয়ে আলোকস্তম্ভের আড়ালে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। শুধু শাঙ্কোকে তুমি এখানে নিয়ে আসবে।
কিছুক্ষণ পরে দলপতি এসে ঘরে ঢুকল। নকশার কাগজটা কোমরের ফেট্টি থেকে বের করে হেসে ফ্রান্সিসকে ফেরৎ দিল। নকশাটা নিয়ে ফ্রান্সিস এমনভাবে নকশাটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল যেন খুব মূল্যবান কিছু দেখছে। তখনই একবার হ্যারিকে বলল—দলপতির কাছ থেকে একটা ঘোড়া চেয়ে নাও। এতটা পথ তুমি হাঁটাহাঁটি করলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়বে। এখন ক্লান্ত হওয়া চলবে না। অনেক কাজ সামনে।
হ্যারি দলপতিকে ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে বলল। সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সঙ্গে যদি চান সৈন্যও দিতে পারি। দলপতি বলল।—না-না—আমি একাই যাবো। হ্যারি বলল।
হ্যারি উঠে দাঁড়াল। তারপর সেনাপতির পেছনে পেছনে চলল।
দুর্গের বাইরে হ্যারির জন্যে একটা তেজিয়ান ঘোড়া আনা হল। হ্যারি ঘোড়ায় চড়ে প্রথমে জাহাজঘাটার দিকে গেল। যাতে সেনাপতির মনে কোনো সন্দেহ না হয়। তারপর সদর রাস্তা এড়িয়ে ঝোঁপজঙ্গল আর পাথুরে মাটির মধ্য দিয়ে বার্গ পাহাড়ের দিকে ঘোড়া ছোটাল। ছোটো ছোটো ঝোঁপঝাড় পাথুরে মাটির ওপর দিয়ে ঘোড়া অনায়াসে জোর কদমে ছুটল।
ঘোড়ায় চড়ে হ্যারি আর বার্গ পাহাড়ের কাছে এলো তখন সূর্য পশ্চিম আকাশের দিকে অনেকটা নেমে এসেছে। ফ্রান্সিস তাড়া দিয়েছে। কাজেই সময় নষ্ট করা চলবে না।
বার্গ পাহাড়ের সেই গুহাটার কাছে আসতেই কয়েজন বিদ্রোহী খোলা তলোয়ার হাতে হ্যারির সামনে এসে দাঁড়াল একজন ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল। হ্যারি হেসে বলল—আমি রোক্কার লোক। ভয়ের কোনো কারণ নেই। বিদ্রোহীদের মধ্যে দু’জন হ্যারিকে চিনল। ওরা জিজ্ঞেস করল কী ব্যাপার? হ্যারি বলল—বন্ধুদের কাছে এসেছি। বেশ যান। একজন বিদ্রোহী বলল।
ঘোড়া থেকে নেমে হ্যারি প্রায় অন্ধকার গুহায় ঢুকল। বেশ বড়ো গুহাটা টানা চলে গেছে। বিদ্রোহীরা কেউ শুয়ে আছে কেউ বসে আছে। জ্বলন্ত মশালের আলোয় হ্যারিকে দেখে বন্ধুরা ছুটে এলো। হ্যারি বলল—আমাদের এখানে আর থাকা চলবে না। ফ্রান্সিসের নির্দেশ—তোমরা সবাই বার্গ পাহাড় থেকে বেরিয়ে নির্জন ঝোঁপঝাড় পাথুরে জায়গায় দিয়ে জাহাজঘাটায় চলে যাবে। কেউ যেন তোমাদের দেখতে না পায়। শুধু শাঙ্কোকে সঙ্গে নিয়ে আমি আগেই ঘোড়া ছুটিয়ে সেই দুর্গে গিয়ে পৌঁছবো।
—ফ্রান্সিস কোথায়? রাজকুমারী কোথায়? বিস্কো জিজ্ঞেস করল।
—রাজকুমারী এতক্ষণে বোধহয় জাহাজে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু আমাকে আর ফ্রান্সিসকে সিনার্কা বন্দি করেছে। তবে রানী ইসাবেলার রত্নভাণ্ডার উদ্ধারের লোভ দেখিয়ে সিনাৰ্কাকে কবজা করেছে ফ্রান্সিস রত্নভাণ্ডার উদ্ধারের জন্যে সিনার্কা আমাদের দুজনকে বন্দি করেও মুক্তি দিয়েছে। এখন ফ্রান্সিস পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবছে।
বিদ্রোহীদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে হ্যারিকে বলল—রোকার সংবাদ জানেন?
—না—হ্যারি মাথা দুলিয়ে বলল—তবে রোক্কাকে শেষ দেখেছি বৈদ্যিমশাই-এর বাড়িতে। মনে হয় রোক্কা ভালোই আছেন। হ্যারি আগেই ভেবে রেখেছিল—রোক্কার আবার বন্দি হওয়ার কথাটা বিদ্রোহী সঙ্গীদের বলা চলবে না। তাহলে বিদ্রোহী বন্ধুরা রোক্কাকে মুক্ত করার জন্য সেই দুর্গে যাবে। লড়াই হবে। রক্ত ঝরবে। কারণ সারিনের যুদ্ধে জয়লাভ করে এখন বিদ্রোহীদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। তাই হ্যারি এক্ষুণি কোনো লড়াইতে যেতে চাইছে না। একবার লড়াই শুরু হলে রত্নভাণ্ডার উদ্ধারের কাজ অনেক পিছিয়ে যাবে। তাই হ্যারি রোক্কার বন্দি হওয়ার সংবাদটা জানালো না।
ভাইকিং বন্ধুরা সব তৈরি হয়ে গুহার বাইরে এলো। হ্যারি রোক্কার এক বিদ্রোহী সঙ্গীকে অনুরোধ করল যাতে সে গোপনে বন্ধুদের জাহাজঘাটায় পৌঁছে দিতে পারে। সঙ্গীটি ভাইকিংদের নিয়ে চলল।
হ্যারি আর শাঙ্কো ঘোড়ায় উঠে ঘোড়া ছোটাল সেই দুর্গের দিকে।
দুর্গের চত্বরে তখন বেনিফেসিওর অধিবাসীরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। লোকমুখে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল যে প্রায় একশো বছর পরে এক সাহসী ভাইকিং রানী ইসাবেলার আঁকা একটা নকশা পেয়েছে। সিনার্কা অনুমতি দিয়েছেন। তাই আজ সেই দুঃসাহসী ভাইকিং নকশা নিয়ে রানী ইসাবেলার ঘরে ঢুকবে। রানীর রত্নপেটিকা উদ্ধার করবে। লোকের ভিড় বেড়েই চলল।
হ্যারি আর শাঙ্কো যখন ঘোড়ায় চড়ে দুর্গের সামনে এলো সৈন্যেরা তোকজন সবাইকে সরিয়ে দিয়ে ওদের দুর্গের মধ্যে ঢুকতে সাহায্য করল। ওরা দুর্গ চত্বরে দাঁড়ানো ফ্রান্সিসকে দেখল সিনার্কার সঙ্গে কথা বলছে। সিনার্কা আর দু’জন অমাত্য সিনার্কার রাজকীয় গাড়িতে বসে আছে। কালো ওক কাঠের গাড়ি। তাতে রুপোলি লতাপাতা ফুল বসানো। সিনার্কা হাসছে। খুব খুশি।
হ্যারি আর শাঙ্কোকে দেখে ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। হ্যারি রা ঘোড়া থেকে নামল। ফ্রান্সিস বলল—আর সময় নষ্ট নয়। চলো। ফ্রান্সিসের পেছনে দেখা গেল দশ পনেরোজন সৈন্য। তবে তাদের হাতে অস্ত্র নেই। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল—তুমি ওদের লো ল্যাতিন ভাষায় বুঝিয়ে বলো যে আমি আগে দুর্গের ছাতে উঠে যেমন ইঙ্গিত করবো সেইভাবে যেন ওরা কাজ করে। হ্যারি সেই সৈন্যদের কথাটা বুঝিয়ে বলল। সৈন্যরা মাথা নেড়ে জানাল যে ওরা বুঝেছে। সৈন্যদের দুর্গের জানালার নীচে অপেক্ষা করার জন্যে ফ্রান্সিস ইঙ্গিত করল।
এবার ফ্রান্সিস হ্যারি আর শাঙ্কোকে নিয়ে দুর্গের পেছনে এলো।
ওরা দুর্গের পেছনের খাদটায় এলো। দেখল শাঙ্কোর বাঁধা লম্বা কাছিটা তেমনি বাঁধা আছে। পড়ে থাকা দড়িটার একটা মুখ শাঙ্কো কোমরে বেঁধে নিল। কাছি বেয়ে বেয়ে তিনজনেই গাছের ডালপালা ধরে দুর্গের পেছনের স্তূপাকার খসে পড়া পাথর ক্রুপের ওপর উঠে এলো। পাথরের চাইয়ের সঙ্গে বাঁধা কাছিটার মুখটা ফ্রান্সিস কোমরে বেঁধে নিল। তিনজনে এবার খুব সাবধানে ভাঙা পাথরের ওপর পা রেখে রেখে চলল দুর্গের মাথার দিকে। দু’জায়গায় পাথর নড়ে গিয়ে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। পড়লে গড়িয়ে খাদের মধ্যে গিয়ে পড়তো। প্রাণে বেঁচে গেলেও হাত পা ভাঙতোই। কোনোরকমে ভারসাম্য রাখল। আস্তে আস্তে তিনজন দুর্গের মাথায় উঠে এলো। ফ্রান্সিস পশ্চিমদিকে তাকাল। দেখল পশ্চিমে সমুদ্রের মাথায় লাল আর কমলা রঙের খেলা চলেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল ভিড়ে ভিড়াক্কার। সারা বোনিফেসের লোকেরাই যেন হাজির হয়েছে। হ্যারি আর শাঙ্কোও এসে নীচের ভিড় দেখল। ফ্রান্সিসদের দুর্গের ছাদে দেখে নীচের ভিড়ের মানুষেরা চিৎকার হৈ হৈ শুরু করে দিল। সিনাৰ্কাও গাড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল ফ্রান্সিসদের দিকে।
এবার ফ্রান্সিস চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল দু’তিনটে বড়ো বড়ো পাথরের পাটাতন পড়ে আছে। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ঐ পাটাতনগুলোর সঙ্গে দড়ির মুখটা বাঁধতে বলল। তিনজনে মিলে চেপে বাঁধল দড়িটা। দড়িটার অন্য মুখটা ফ্রান্সিস দুর্গের মাথা থেকে ঝুলিয়ে দিল। দড়ির সেই মুখটা দুর্গের পাথুরে দেয়ালের গা গিয়ে ঘেঁসে এলো জানালার কাছে। ফ্রান্সিস দড়িটা বের কয়েক টেনে দেখল। বেশ শক্ত করেই বাঁধা হয়েছে।
ফ্রান্সিস দড়িটা ধরে ঝুলে পড়ল। দুর্গের পাথুরে দেয়ালের গায়ে পা রেখে রেখে নামতে লাগল। দুর্গের পাথুরে গায়ে তখনও রোদ লেগে আছে। সূর্য অস্ত যেতে তখনও দেরি আছে। পাথুরে দেয়ালে পায়ের ভর রেখে রেখে ফ্রান্সিস জানালাটার সামনে এলো। কিন্তু জানালার লোহার গরাদ ধরল না। দেয়ালে পা রাখল। কারণ রোক্কা বলেছিল দু’জন লোক জানালার গরাদ ধরে টেনেছিল ঘরে ঢোকার জন্যে। জানালার মাথা থেকে আলগা পাথর খুলে পড়েছিল আর দু’জনই মাথা ফেটে মারা গিয়েছিল। ফ্রান্সিস দুপা দিয়ে দড়ি আঁকড়ে ধরে কোমরে বাঁধা কাছির মুখটা বের করল। খুব সন্তর্পণে আস্তে আস্তে গরাদগুলোর মধ্যে দিয়ে কাছির মুখটা ঢুকিয়ে বেশ শক্ত গেরো দিল। তারপর দড়ি বেয়ে বেয়ে দুর্গের মাথায় উঠে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল—শাঙ্কো কাছির অন্য মুখটা নীচে ফেলে দাও। শাঙ্কো কাছির অন্য মাথাটা টেনে আনল। তারপর দুর্গের মাথা থেকে নীচে ফেলে দিল। ফ্রান্সিস তখন নীচে দাঁড়ানো সিনার্কার সেই আটদশ জন সৈন্যকে কাছিটা ধরে টানতে বলল। সৈন্যরা বুঝল—ফ্রান্সিস কাছি টেনে জানালার গরাদগুলো ভেঙে ফেলতে বলছে।
সৈন্যরা কাছির মুখটা টেনে ধরল। তারপর মুখে শব্দ করে একসঙ্গে সবাই ভীষণজোরে টান মারল। সঙ্গে সঙ্গে জানালার মাথা থেকে বড়ো বড়ো পাথরের টুকরো বৃষ্টির মতো নীচে ছিটকে পড়ল। ধুলো বালি উড়ল। পাথর পড়তে দেখে নীচের লোজন ভয়ে ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল। ফ্রান্সিস বুঝল—রানী ইসাবেলা কোনোভাবে জানালার মাথার পাথরগুলো আঙ্গা করে রেখেছিলেন যাতে কেউ যেন জানালার গরাদ ধরে দাঁড়াতে না পারে। যে দু’জন এসে গরাদ ধরে দাঁড়িয়েছিল তারা খসে পড়া পাথরে মাথা ফেটে মারা গিয়েছিল।
আবার ফ্রান্সিস কাছি টানার জন্যে সৈন্যদের ইঙ্গিত করল। আবার সৈন্যরা মুখে শব্দ করে একসঙ্গে হ্যাঁচকা টান দিতে লাগল। বারকয়েক টানতে হঠাৎ শব্দ তুলে গরাদগুলো ভেঙে গেল। ছিটকে নীচে পড়ল। সৈন্যরা দ্রুত সরে গেল। বাঁ পাশের একটা গরাদ ভাঙলো না বাঁধা ছিল না বলে।
এবার জানালা খোলা। ফ্রান্সিস আগের মতোই দড়ি বেয়ে বেয়ে জানালার কাছে এসে জানালার নীচের অংশে পা রাখল। দেখল একটু কাত হয়ে অনায়াসে ঘরটায় ঢোকা যাবে। ও শরীর একটু বেঁকিয়ে কাত হয়ে আস্তে আস্তে ঘরটায় ঢুকল।
নীচে থেকে সিনার্কা অমাত্যরা সৈন্যরা ভিড় করা বেনিফোসিওর লোকেরা সাগ্রহে তাকিয়ে রইল ঐ ভাঙা জানলাটার দিকে।
চারদিক নিস্তব্ধ। কোনো শব্দ নেই ভিড়ে জটলায়। শুধু সমুদ্রের মৃদু গর্জন শোনা যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ফ্রান্সিস ভাঙা জানালাটা দিয়ে মুখ বাড়াল। নীচের ভিড়ে চিৎকার হৈ হুল্লা শুরু হল। ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে ঝুলন্ত দড়িটা ধরল। তারপর বেরিয়ে এলো জানালাটা দিয়ে। কিন্তু ফ্রান্সিসের হাতে কিছুই নেই। বোনিফেসিওর লোকেরা হতাশ হল। ওরা আশা করেছিল প্রায় একশো বছর যাবৎ প্রচলিত লোকগল্পে শোনা রানী ইসাবেলার রত্নভাণ্ডার ঐ দুঃসাহসী বিদেশিটা উদ্ধার করতে পারবে। কিন্তু ওর হাতে কোথায় সেই রত্নভাণ্ডারের পেটিকা। ছাত থেকে হ্যারি আর শাঙ্কোও দেখল—ফ্রান্সিস খালি হাতে দড়ি বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে। ওদের মনে তখন একটাই চিন্তা—তাহলে ফ্রান্সিস কি এবার ব্যর্থ হলো? এই প্রথম হার স্বীকার করল?
দড়ি বেয়ে বেয়ে ফ্রান্সিস আগের মতো দুর্গের ছাতে উঠে গেল। হ্যারি আর শাঙ্কো রত্নভাণ্ডারের ব্যাপারে ফ্রান্সিসকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। ওরা জানে ফ্রান্সিস ঠিক সময়মতো সব বলবে।
হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস বলল—তোমরা এখানে থাকো। আমি সিনাৰ্কার সঙ্গে। একটা কাজের কথা সেরে আসি।
ফ্রান্সিস আবার ছাতের ভাঙা অংশের পাথরের পাটাতনের ওপর সাবধানে পা রেখে রেখে খাদটার গাছের ডাল ধরে ধরে নেমে এলো।
চলল সিনার্কার কাছে। সিনার্কা তখনও দু’জন অমাত্যকে নিয়ে গাড়িতে বসে আছে। ফ্রান্সিস তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল—মাননীয় সিনার্কা আমি দু’টো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও রানী ইসাবেলার রত্নপেটিকা পাইনি।
—কিন্তু তোমার কাছে তো রানী ইসাবেলার আঁকা নকশাটা রয়েছে। সিনার্কা বলল।
—হ্যাঁ—কিন্তু নকশাটার রহস্যের সমাধান করতে পারিনি। ফ্রান্সিস বলল।
—চেষ্টা করো—দেখো। সিনার্কা বলল।
ফ্রান্সিস এবার মাথা ঝাঁকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সিনার্কা রাজার মতো সম্মান পেয়ে খুব খুশি। বলল-কিছু বলবে?
—হ্যাঁ মহামান্য—বলছিলাম নকশাটার রহস্য সমাধান জানে একমাত্র রোক্কা। যদি রোক্কাকে আমি ঐ ঘরে নিয়ে যেতে পারি তাহলেই রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করা সম্ভব। নইলে আমি একা পারবো না। ফ্রান্সিস বলল। সিনার্কা একটুক্ষণ চিন্তা করল। একদিকে মহামূল্যবান রত্নপেটিকা অন্যদিকে রোক্কার জন্য চিন্তা—যদি সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায়। সিনার্কা বলল—রোক্কাকে সঙ্গে দিতে পারি কিন্তু যদি রোক্কা পালিয়ে যায়?
—আমরা রোক্কাকে পালাতে দেব না। ফ্রান্সিস বলল। সিনার্কা ইঙ্গিতে দলনেতাকে ডাকল। দলনেতা খোঁড়াতে খোঁড়াতে সিনার্কার গাড়ির কাছে এসে মাথা একটু ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাল। সিনার্কা বলল–কয়েদঘর থেকে রোক্কাকে এখানে নিয়ে এসো। শুধু রোক্কাকে অন্য কোনো বন্দিকে নয়। দলপতি মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে চলে গেল।
একটু পরেই রোক্কাকে নিয়ে দলপতি ফিরে এলো। ফ্রান্সিস রোক্কাকে দেখেই বুঝল রোক্কা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। কপালে মুখে খোলা হাতে তলোয়ারের কাটাগুলো ফুটে উঠেছে। দুতিনটে কাটা জায়গায় রক্ত জমে কালচে হয়ে উঠেছে। রোক্কার হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। ফ্রান্সিস এবার চিন্তায় পড়ল—রোক্কার সঙ্গে ও যেরকম দুর্ব্যবহার করেছে। তাতে রোক্কা বোধহয় ওকে বিশ্বাসই করবে না। কাজেই ওর সঙ্গে যেতেও চাইবে না। ফ্রান্সিস বুঝতে পারল—অনেক সাবধানে ওকে এগোতে হবে।
রোক্কা কাছে আসতে ফ্রান্সিস বলল—দেখুন রোক্কা—যে নকশাটা আমি পেয়েছি সেটার সমাধান শুধু আপনিই জানেন। রোক্কা দুর্বল শরীরে যতটা পারে চেঁচিয়ে বলল নকশাটা একেবারে জালমিথ্যে। ইসাবেলা ওরকম কোনো নকশাই এঁকে জানালার গরাদ দিয়ে নীচে ফেলে দেন নি। ডাহা মিথ্যে এসব। ফ্রান্সিস বলল—আসলে এটা যে রত্নভাণ্ডার উদ্ধারের নির্দেশ আঁকা নকশা এটাই আপনারা বুঝতে পারেন নি।
—আপনি বুঝেছেন? অকৃতজ্ঞ ভাইকিং? গলায় বেশ জোর দিয়ে রোক্কা বলল।
—হ্যাঁ অনেকটা বুঝেছি। এবার আপনার সাহায্য চাই। ফ্রান্সিস বলল।
—আমি কোনোরকম সাহায্য করবো না। রোক্কা চেঁচিয়ে বলল।
সিনার্কা সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে দলপতিকে বলল—রোক্কাকে গলায় মাথায় তলোয়ারের ঘায়ে আধমরা করে ফেল। তবেই কথা শুনবে। দলপতি তলোয়ার খুলে ছুটে এলো। তখনও রোক্কার হাত বাঁধা। ফ্রান্সিস দু’হাত তুলে বলল—এসবের কোনো দরকার নেই। আমি রোক্কাকে নিয়ে যাচ্ছি। আমি রোক্কার কাছ থেকে নকশার নির্দেশ বের করবো। আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য না করলে আমিই ওকে নিকেশ করবো। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল—প্রথমে যে করেই হোক রোক্কাকে নিয়ে ঘরটায় ঢুকতে হবে।
—কিন্তু রোক্কাকে পাহারা দেবার জন্যে দু’জন সশস্ত্র সৈন্য ওর সঙ্গে থাকবে যাতে রোক্কা পালাতে না পারে। সিনার্কা বলল।
—বেশ। এবার তাহলে আমাদের যাবার অনুমতি দিন। ফ্রান্সিস বলল।
রোক্কাকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস দুর্গের পেছনের সেই খাদের দিকে চলল। যেতে যেতে পাহারাদার সৈন্যদের স্পেনীয় ভাষায় বলল—তোমরাও কি দুর্গের ছাতে উঠবে? দু’জন পাহারাদার সৈন্য নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হল—এরা স্পেনীয় ভাষা জানে না।
এবার ফ্রান্সিস রোক্কাকে স্পেনীয় ভাষায় বলল—প্রথমেই আমি আপনার সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছি তার জন্য—কথাটা বলে মাথা একটু নিচু করে বলল আমি ক্ষমা চাইছি। একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা হিসেবে আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। রোক্কা বেশ আশ্চর্য হল। ফ্রান্সিস কি তাহলে অভিনয় করেছিল?
রোক্কা বলল—আমার সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করেছিলেন কেন?
—সিনার্কার মন পাওয়ার জন্যে। আমার ঐ ব্যবহারে সিনার্কা সন্তুষ্ট হয়েছিল। আমার কথাগুলো বিশ্বাস করেছিল। তাই আজকে আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে দিল। ফ্রান্সিস বলল।
—রানী ইসাবেলার নকশা কী আমি তাই জানি না। রোক্কা বলল।
ফ্রান্সিস বলল—নকশাটা পুরো ধাপ্পাবাজি। নকশাটা আমিই দ্রুত হাতে এঁকেছি। তারপর ধুলোবালি মেখে ময়লা করেছি যাতে সিনার্কা মনে করে নকশাটা অনেক পুরোনো।
—তাহলে আমি কী করবো? রোক্কা বলল।
—আমি যখন যা বলবো আপনি তাই করবেন। ফ্রান্সিস বলল। রোক্কা মৃদু হেসে বলল—আপনি যে সিনার্কার জন্যে নিজের জীবন বিপন্ন করতে চলেছেন সেই সিনার্কা আপনাদের রাজকুমারী আর কামেরাতকে কয়েদঘরে বন্দি করে রেখেছে। ফ্রান্সিস চমকে উঠে বলল—সে কি। এসব কথা তো সিনার্কা বা দলপতি কেউ আমাকে বলে নি।
—বললে আপনি যদি আর রত্নভাণ্ডারের খোঁজে না যান। তাই এ খবর আপনার ৩ কাছে গোপন করে রাখা হয়েছে। রোক্কা বলল।
ফ্রান্সিস দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল। রোক্কাকে পাহারাদার দুই সৈন্য ইঙ্গিতে অপেক্ষা করতে বলে ছুটে চলল সিনার্কার গাড়ির দিকে। সিনার্কা অমাত্যরা তখন রত্নভাণ্ডারের চিন্তায় মগ্ন। সবার মনেই সংশয়—এই বিদেশিটা কি রানী ইসাবেলার রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারবে?
তখনই ফ্রান্সিস সিনাৰ্কার কাছে এসে দাঁড়াল। বলল—মহামান্য রাজা—আপনি এটা কী করলেন?
—কেন? কী হয়েছে? সিনার্কা ঠিক বুঝতে না পেরে বলল।
—আপনি রাজকুমারী আর কামেরাতকে কয়েদঘরে বন্দি করে রেখেছেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ। সিনার্কা বলল। ঠিক আছে রত্নভাণ্ডার উদ্ধার হলেই ওদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
—না মহামান্য রাজা এতে আমার উদ্যম নষ্ট হয়ে যাবে। আমার বিনীত অনুরোধ রাজকুমারী আর কামেরাতকে আমার এই প্রচেষ্টা দেখতে দিন। পাহারাদার কয়েকজন ওদের পাহারা দিক। তারপর রত্নভাণ্ডার পেলে ওদের মুক্তি দেবেন। ফ্রান্সিস বলল।
—আর না পেলে? সিনার্কা বলল।
—তখন আবার আমাদের বন্দি করে রাখবেন। ফ্রান্সিস বলল। সিনার্কা একটু ভেবে নিয়ে পাশে বসা অমাত্যদের সব বলল। কী কথাবার্তা হল তাদের মধ্যে ফ্রান্সিস বুঝল না। সিনার্কা এবার বলল—দলপতিকে পাঠাচ্ছি রাজকুমারী আর কামেরাতকে নিয়ে আসতে। কিন্তু সঙ্গে প্রহরী থাকবে চারজন।
—বেশ তাহলে ওদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন মহামান্য রাজা। ফ্রান্সিস বলল। ফ্রান্সিস বার বার সিনার্কাকে মহামান্য রাজা বলাতে সিনার্কা খুশিতে আটখানা। সিনার্কা দলপতিকে ডেকে হুকুম দিল।
ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে মারিয়ার হাত ধরে ধরে কামেরাত এলো। ফ্রান্সিস দেখল মারিয়ার চোখমুখের সেই ঔজ্জ্বল্য নেই। কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ফ্রান্সিসের মন দুঃখার্ত হল। কিন্তু ও মন শক্ত করল। সকলের মুক্তি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে ফ্রান্সিসের পরিকল্পনার ওপর। এখন কারো কোনো কষ্টের কথা ভাবতে গেলে চলবে না। সব দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হবে। কিন্তু ফ্রান্সিসকে দেখে মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল মাথা নিচু করল। ফ্রান্সিস বুঝল—মারিয়ার সঙ্গে যে ব্যবহার করতে ও বাধ্য হয়েছে তাতে মারিয়াকে এখন সামলানো মুস্কিল হবে। তাই ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে বলে উঠল—মারিয়া আমাকে ক্ষমা করো। মারিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস বলল—আমি এখন যা বলছি সেইভাবে কাজ করো। লক্ষ্মীটি এখন রাগ করে থাকার সময় নয়। আমি কামেরাতকে নির্দেশ দিতাম কিন্তু সেটা দিতে গেলে আমাকে স্পেনীয় ভাষায় দিতে হবে। সিনার্কা বা অমাত্যরা সব বুঝে নেবে। আমাদের বিপদই বাড়বে তাতে। তাই তোমাকে আমাদের মাতৃভাষায় বলছি যা কেউ বুঝবে না। ফ্রান্সিস থামল। লক্ষ্য করল মারিয়া যেন একটু শান্ত হল। ফ্রান্সিস স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। বলল—আমি যখন রোক্কাকে নিয়ে ঐ ভূতুড়ে ঘরটায় ঢুকবো তখন সবাই ঐ দিকেই তাকিয়ে থাকবে। তোমাদের পাহারাদাররাও অন্যমনস্ক হবে। ঠিক তখনই ভিড়ের মধ্যে তুমি আর কামারেত একসঙ্গে মিশে মিশে থাকবে। যখন আমরা ঘরটায় ঢুকবো তখন পাহারাদাররা অন্যমনস্ক হবেই। ঠিক তখনই তোমরা ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পালাবে। কামেরাতকে নিয়ে জাহাজঘাটায় পালিয়ে যাবে। দু’জনেই আমাদের জাহাজে উঠবে। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। আমরা কাজ সেরে ঠিক জাহাজে ফিরবো। এই নিয়ে একেবারে দুশ্চিন্তা করবে না। তুমি এখনও সম্পূর্ণ, সুস্থ নও। সাবধানে থাকবে। ব্যস আর কিছু বলার নেই। শুধু শেষ অনুরোধ আমার ওপর বিশ্বাস রেখো।
ফ্রান্সিস কথাটা শেষ করে মারিয়ার দিকে তাকাল। দেখল—মারিয়ার চোখেমুখে খুশির আভা। ফ্রান্সিস অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। ওর এত কথা চারপাশের লোকেরা পাহারাদাররা সিনার্কা আর অমাত্যরা কিছুই বুঝল না।
ফ্রান্সিস রোক্কার কাছে এলো। বলল চলুন। মারিয়া মৃদুস্বরে ফ্রান্সিসের সব কথা কামেরাতকে বুঝিয়ে বলল।
খাদটার কাছে এলো দুজনে। ফ্রান্সিস পাহারাদার দু’জন সৈন্যের মুখের দিকে তাকাল। বুঝল—ওরা স্পেনীয় ভাষায় কথাবার্তা কিছুই বোঝে নি। ফ্রান্সিস একজন পাহারাদার সৈন্যের কোমরের খাপ থেকে এক ঝট্কা তলোয়ারটা খুলে নিল। অন্য সৈন্যটি সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার বের করল। ফ্রান্সিস হেসে হাত তুলে ওকে শান্ত করল। তলোয়ারটা দিয়ে রোক্কার হাতবাঁধা দড়িটা কেটে ফেলল। তলোয়ার ফিরিয়ে দিল।
ফ্রান্সিস বলল—রোক্কা—আপনাকে একটু কষ্টকরে দড়ি বেয়ে কিছুটা উঠতে হবে। পারবেন তো?
—হ্যাঁ পারবো-রোক্কা বলল—এখন আমি শরীরে মনে অনেক জোর পাচ্ছি।
দু’জনে খাদ থেকে দড়ি বেয়ে বেয়ে উঠতে লাগল। অসুস্থ শরীর নিয়েও রোক্কা দমল না। দড়ি ধরে উঠতে গিয়ে দাঁত চেপে কষ্ট, কাটা জায়গার জ্বালা সহ্য করল। দড়ির ঘন্টায় গালে কাটা জায়গাগুলো থেকে রক্ত পড়তে লাগল।
পাথরের ভাঙা পাটার ওপর দিয়ে সন্তর্পণে হেঁটে হেঁটে চলল দুজনে। প্রথমে ফ্রান্সিস পেছনে রোক্কা। ওদের দেখাদেখি পাহারাদার দুজনও উঠতে লাগল। পাহারাদার দুজন বুঝল—রোক্কাকে নজরের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। তাহলে সুযোগ পেয়ে রোক্কা নিশ্চয়ই পালাবে।
সবাই দুর্গের ছাদে উঠে এলো।
তখন সূর্য ডুবে গেছে। পশ্চিম আকাশের লাল কমলা রঙের আলো মিলিয়ে গেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। অন্ধকার বাড়বে। এখন মশাল চাই। নইলে কিছুই দেখা যাবে না।—ফ্রান্সিস আর রোক্কা দুজনেই হাঁপাচ্ছে তখন।
হ্যারি এগিয়ে এসে বলল—ফ্রান্সিস—শাঙ্কো মশাল জ্বালিয়ে আনতে গেছে।
ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে হাসল—শাঙ্কো আসল কাজটাই করতে গেছে।
ওরা ছাদের ওপর বসে রইল শাঙ্কোর অপেক্ষায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে শাঙ্কো জ্বলন্ত মশাল নিয়ে ওদের কাছে এলো।
এবার ফ্রান্সিস জ্বলন্ত মশাল হাতে নিয়ে দুর্গের ছাদের ধারে এলো। দেখল নীচের ভীড় যেন আরো বেড়েছে। অনেক মশাল বেড়েছে। ফ্রান্সিস রোক্কাকে ডাকল। বলল—আসুন—আমরা দড়ি দিয়ে জানালাটার কাছে যাবো। তারপর ঘরটায় ঢুকবো।
—কিন্তু ঘরটার জানালায় মোটা মোটা লোহার গরাদ রয়েছে যে। রোক্কা বলল। ফ্রান্সিস হেসে বলল—সব ভেঙে উপড়ে ফেলা হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন—ঘরে ঢুকতে কোনো অসুবিধে নেই।
এবার বাঁ হাতে মশাল ধরে ফ্রান্সিস দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল। আস্তে আস্তে নামতে লাগল। একটু পরে রোক্কাও দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল। দুজনে দড়ি ধরে ধরে নামতে লাগল। নীচে গাড়িতে বসা সিনার্কা গভীর মনোযোগ দিয়ে ফ্রান্সিসের হাতের মশালের দিকে তাকিয়ে রইল। সমুদ্রের হাওয়ায় মশালের আগুন কাঁপছে। সেই কাঁপা কাঁপা আলো পড়ছে ফ্রান্সিসের মুখে। অন্ধকারে শুধু এইটুকুই দেখা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস ডান হাত দিয়ে দড়ি ধরে ধরে আস্তে আস্তে নামছে তখন। নীচে দাঁড়ানো ভিড়ের লোকেরা ফ্রান্সিসের এই দুঃসাহসিক কাজের জন্যে মনে মনে প্রশংসা করতে লাগলো আর মশাল উঁচু করে নেড়ে নেড়ে ফ্রান্সিসকে উৎসাহ দিতে লাগল। ওরা ভেবে পেল না দিনের বেলা ঐ ভূতুড়ে ঘরে ঢুকতে লোকে সাহস পায় না। আর এই রাতের অন্ধকারে মাত্র একটা মশাল নিয়ে বিদেশিটা ঘরটায় ঢুকতে যাচ্ছে। বুকের পাটা আছে বলতে হবে।
বাঁ হাতে মশাল ধরে ফ্রান্সিস এবার জানালার পাথুরে জায়গাটায় বাঁ পাটা রাখল। তারপর আগে মশালটা ঘরের মধ্যে ফেলে দিল। তারপর জানালা দিয়ে ঢুকল। রোক্কাও তখন জানালাটায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঘর থেকে হাত বাড়িয়ে ফ্রান্সিস রোক্কাকে ধরে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে এলো। ভিড়ের মধ্যে থেকে চিৎকার হৈ হল্লা করে ফ্রান্সিসদের উৎসাহ দিতে লাগল। কামারেত বুঝল—এই সুযোগ। ওদের পাহারাদাররাও উত্তেজনায় চ্যাঁচাচ্ছে। ওদের দিকে নজরই নেই। কামেরাত ভিড়ে মিশে গেল। মারিয়াও ওকে অনুসরণ করল। ভিড় ছাড়িয়ে দুর্গের দেউড়ি পার হয়ে দুজনে দুর্গের বাইরে এলো। কেউই ওদের লক্ষ্য করল না। সবাই তাকিয়ে আছে দুর্গের জানালার দিকে। দুঃসাহসী বিদেশিটা রানীর ইসাবেলার রত্নপেটিকা উদ্ধার করতে পারবে কিনা। বিদেশিটার সঙ্গে রোক্কাও যোগ দিয়েছে। দেখা যাক।
রাস্তায় নেমে মারিয়া বলল—ইস ফ্রান্সিস রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করল এটা আগে দেখা হল না। কামেরাত বলল—উপায় নেই রাজকুমারী। এখন সবাই ঐ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। এখনই পালানো সহজ। এবার যতটা সম্ভব দ্রুত চলুন জাহাজঘাটার দিকে। আমাদের জাহাজে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। ফ্রান্সিস তো তাই বলেছেন।
—হ্যাঁ—মারিয়া বলল। শরীরের দুর্বলতা সত্ত্বেও মারিয়া যতটা দ্রুত সম্ভব হাঁটতে লাগল। পথ জনহীন। সবাই বোধহয় দুর্গের চত্বরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে গিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠল।
মশালের আলোয় এখন ঘরটা অনেকটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। বোধহয় মশালের আলো চোখে লাগতেই একপাল চামচিকে ঝটাঝ শব্দ তুলে জানালা দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল। ফ্রান্সিস তো ঘরটা আগে দেখেছে। রোক্কা দেখে নি। তাই চারদিকে পাথরের ঘরটা দেখতে লাগল। দেখল—খাটটাও। খুব দামি ওক কাঠের তৈরি খাটটা এখন ধুলোয় ধুলোয় ধূসর। বিছানা শতছিন্ন। দেয়ালে একটা দেরাজমতো। তাতে আয়না আটকানো। এখন আয়নার কাঁচ ধূলিমাখা।
দেয়ালের মশাল রাখার আংটায় ফ্রান্সিস মশলাটা বসালো। তারপর ধূলিময় মেঝেতে নকশাটা পেতে উবু হয়ে দেখতে লাগল। রোক্কা তখন খাটটার দিকে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস বলে উঠল—এ ঘরটা আমার দেখা হয়ে গেছে। আপনি পাশের ঘরটায় দেখুন। কথাটা বলে # ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল—রোক্কা—আমার জামার পেছনটা ছিঁড়ে ফেলুন তো।
—সে কি। জামা ছিঁড়বেন কেন? রোক্কা বলল। ফ্রান্সিস বলল—ঐ আয়নাটা পরিষ্কার করতে হবে। দেরাজটাও পরিষ্কার করতে হবে।
রোক্কা এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের জামার পেছনদিকটা ধরে দুটো হাচটা টান দিতেই জামাটা ছিঁড়ে গেল। আর একটানে ছেঁড়া কাপড়ের অংশটা খুলে এলো। ফ্রান্সিসের জামাটা এখন শুধু সামনের দিকে রইল। ফ্রান্সিস ছেঁড়া কাপড়টা নিয়ে দেবরাজের দিকে গেল। রোক্কা পাশের ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে চিঁ চিক্ চিক্ শব্দ তুলে ছুঁচো আর ইঁদুরের ছুটোছুটি শুরু হল। বোঝাই যাচ্ছে এ ঘরটা ভাড়ার ঘর হিসেবেই ব্যবহৃত হত। মশালের যেটুকু আলো এ ঘরটায় এসে পড়েছে তাই দেখে রোক্কার একথা মনে হল।
রোক্কা ফ্রান্সিস যে ঘরে আছে সেই ঘরে ফিরে এলো। দেখল—ফ্রান্সিস ওর ছেঁড়া জামার কাপড়টা দিয়ে কী বাঁধছে। রোক্কা বলল—কী বাঁধছেন? ফ্রান্সিস হেসে বলল—রানী ইসাবেলার রত্নপেটিকা।
—সে কি? পেয়েছেন সেটা? কী করে পেলেন? রোক্কা জিজ্ঞেস করল।
—ঐ দেরাজের মধ্যে ছিল। ফ্রান্সিস বলল।
—আমাকে দেখতে দেবেন না? রোক্কা সাগ্রহে বলল।
—এখন নয়—পরে। এখন ছাদে উঠতে হবে। এখানে একটা ভ্যাপসা গন্ধে গা গুলোচ্ছে। চলুন আর এখানে থাকার দরকার নেই। ফ্রান্সিস আংটা থেকে মশালটা তুলে নিয়ে বলল—রোক্কা—এবার আপনি মশালটা নিন। আমাকে তো রত্নপেটিকাটা নিতে হবে। আপনার কষ্ট হবে না তো?
—না—না। রোক্কা মশালটা নিয়ে জানালার কাছে গেল। জানালা থেকেই ডান হাতটা বাড়িয়ে ঝোলানো দড়িটা ধরল। তারপর দড়িটায় ঝুলে পড়ল। তারপর আস্তে আস্তে উঠতে লাগল ছাদের দিকে। নীচে তখন বহুলোকের চিৎকার শুরু হল। কিন্তু চিৎকার থেমে গেল। রোক্কার হাতে তো রত্নপেটিকা নেই।
একটু পরেই জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ফ্রান্সিস দড়িটায় ঝুলে পড়ল। মশালের আলোয় নিচের সবাই দেখল ফ্রান্সিসের বাঁ হাতে ঝোলামতো। তবে তো ওর মধ্যেই রত্নপেটিকা আছে—রানী ইসাবেলার রত্নভাণ্ডার। নীচের মানুষের হৈ হৈ চিৎকার শুরু হল। তারা হাতে ধরা মশাল ওঠাতে নামাতে লাগল। যতক্ষণ পর্যন্ত না ফ্রান্সিস দুর্গের মাথায় উঠে গেল ততক্ষণ পর্যন্ত চিৎকার হৈ হল্লা চলল। সিনার্কা আনন্দে গাড়ির ওপরেই প্রায় নেচে উঠতে লাগলেন। প্রায় একশো বছর ধরে অনেক চেষ্টা করেও কেউ ঐ ঘরে ঢুকতেই পারে নি। সেই রানী ইসাবেলার রত্নালংকারের পেটিকা এই বিদেশিটা উদ্ধার করেছে। একটা চিন্তাও হল সিনার্কার। যদি বিদেশিরা রত্নভাণ্ডার নিয়ে পালিয়ে যায়? পারবে না। দুজন সশস্ত্র সৈন্য পাহারায় রয়েছে। ওরা সাহস পাবে না।
প্রথমে রোক্কা তারপরে ফ্রান্সিস ছাদে উঠে এলো। শাঙ্কো হ্যারি ছুটে এলো। সৈন্য দুজনও। হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস—এটাই কি সেই রানী ইসাবেলার রত্নপেটিকা। ফ্রান্সিস হেসে বলল—হ্যাঁ।
—আমরা একটু দেখব না? শাঙ্কো বলল।
—না—এটা সিনার্কাদের সম্পত্তি—তাদের হাতেই এটা পৌঁছে দিতে হবে। এখন খোলা চলবে না। ফ্রান্সিস এবার হ্যারিকে বলল—হ্যারি সৈন্যদের হাতে রত্নপেটিকা দিয়ে বললো যে এটা যেন ওরা সিনার্কার হাতে পৌঁছে দেয়। হ্যারি লো ল্যাতিন ভাষায় সৈন্যদের নির্দেশটা জানাল। ফ্রান্সিস ওর জামা ছিঁড়ে তৈরি ঝোলাটা একজন সৈন্যের হাতে দিল। সৈন্যটি ঝোলাটা হাতে নিয়ে বলে উঠল—বড্ড ভারী। রোক্কা বলল—কত রত্ন কত অলঙ্কার—ভারী তো হবেই। দুই সৈন্য তখন নেমে আসার জন্যে অন্ধকারের মধ্যে ছুটল পাথরের ভাঙা পাটার ওপরে পা রেখে রেখে। দুজনে হা হা করে হাসছে। সিনার্কাকে এই রত্নপেটিকা দিতে পারলে কত ইনাম পুরষ্কার পাওয়া যাবে। ওরা তখন সেই চিন্তায় মগ্ন। খেয়ালই নেই যে রোক্কাকে পাহারা দিতেই ওদের পাঠানো হয়েছে। সৈন্য দুজন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দড়ি বেয়ে নেমে চলে গেল।
এবার ফ্রান্সিস সবাইকে ডেকে বলল—আর একমুহূর্ত দেরি নয়। আমাদের যত শিগগিরি সম্ভব জাহাজঘাটায় পৌঁছতে হবে। জদি নামো সবাই।
পাথরের পাটার ওপর দিয়ে ওরা যত দ্রুত সম্ভব ছুটে পার হল। তারপর দড়ি বেয়ে খাদে নেমে ফ্রান্সিস বলল—শাঙ্কো তুমি নিশ্চয়ই জাহাজঘাটায় পৌঁছবার জন্যে কোন্ দিক দিয়ে কীভাবে যেতে হবে তা জানো।
—আমার পেছনে পেছনে এসো। বলেইশাঙ্কো কিছু ঝোঁপঝাড়ের দিকে ছুটল ফ্রান্সিসরাও পেছনে পেছনে ছুটল। রোক্কা বলল—সিনার্কা তো রানী ইসাবেলার রত্নপেটিকা পেয়েই গেছে। সিনার্কার আশা মিটেছে। তবে কেন পালিয়ে যাচ্ছেন? ফ্রান্সিস বলল—ঝোলাটা খুলে সিনার্কা পাবে একখণ্ড পাথর। একটাও রত্নালংকার নেই।—সেকি—রোক্কা চমকে উঠে বলল। হ্যারি শাঙ্কোও অবাক হল ফ্রান্সিসের কথা শুনে। ফ্রান্সিস বলল—পরে সব বলবো। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজে উঠে জাহাজ ছেড়ে দিতে হবে।
ঝোঁপঝাড় পাথুরে মাটির ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে সকলে জাহাজ ঘাটার কাছে এলো। জাহাজঘাটার আলোকস্তম্ভে আজ আগুন জ্বলছে না। ফ্রান্সিসরা আলোকস্তম্ভের কাছাকাছি আসতেই বিস্কো বেরিয়ে এলো। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল—কী ব্যাপার? আলোকস্তম্ভে আগুন জ্বলছে না কেন? বিস্কো বলল—সিনার্কার সৈন্যদের আগুন জ্বালাতে দিই নি। দুটো সৈন্য ঘায়েল হতেই বাকিরা পালিয়েছে। শাঙ্কোর ধনুক থেকে আমি তির ছুঁড়েছিলাম। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল–শাঙ্কো আমরা যে কোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারি। তুমি তির-ধনুক নিয়ে তৈরি হও। ফ্রান্সিসের কথাটা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল মশাল হাতে সিনার্কার একদল সৈন্য জাহাজঘাটার দিকে ছুটে আসছে। সবার আগে গাড়িতে চড়ে আসছে সিনার্কা নিজে। ফ্রান্সিস বুঝল—রত্নপেটিকার বদলে পাথর দেখে সিনার্কা রেগে আগুন হয়ে গেছে। ওর এখন মাথার ঠিক নেই। তাই নিজেই গাড়িতে চড়ে ফ্রান্সিসদের বাধা দিতে আসছে। সিনার্কা ধরেই নিয়েছে আসল রত্নপেটিকা ফ্রান্সিসরাই চুরি করেছে। এখন জাহাজে চড়ে পালাবে। তাই যত সৈন্য হাতের কাছে পেয়েছে তাদের নিয়েই ফ্রান্সিসদের জাহাজ আক্রমণ করতে আসছে।
শাঙ্কো তির ছুঁড়ে মশাল হাতে সকলের সামনের সৈন্যটিকে ঘায়েল করল। সৈন্যটা মশাল ফেলে দিয়ে হাঁটু চেপে বসে পড়ল। মশালের আগুন লাগল অন্য দুজন সৈন্যের কাপড়ে মানে পোশাকে। তারা দুজনেই আগুন নেবাবার জন্যে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। এতে ছুটে আসা সিনার্কার সৈন্যদের গতি কমে গেল। শাঙ্কো পেছনে তাকিয়ে দেখল ফ্রান্সিসরা সবাই জাহাজে উঠে গেছে। শুধু ফ্রান্সিস তখনও জাহাজে উঠার পাটাতনের কাছে তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
শাঙ্কো এবার তীর ছুঁড়ল সিনার্কাকে লক্ষ্য করে।
নিখুঁত নিশানা। সিনকার কাঁধে গিয়ে লাগল তিরটা। সিনার্কা গাড়ির নরম আসনের ওপর গড়িয়ে পড়ল। সিনার্কার এই অবস্থা দেখে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে গেল। কিছু সৈন্য পালিয়ে গেল। কিছু সৈন্য সিনার্কার গাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল।
এবার শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে ছুটে এলো। ফ্রান্সিস বলল—হাত লাগাও। দুজনে কাঠের পাটাতন দিয়ে জাহাজে উঠল। দুজনে মিলে জাহাজ থেকে পাতা কাঠের পাটাতনটা তুলে ফেলল। শাঙ্কো ছুটে গিয়ে জাহাজের নোঙরটা ঘড় ঘড় শব্দে তুলে ফেলল। একদল ভাইকিং চলে গেল জাহাজের পাল খাটাতে। পাশেই ফেল্লুকা মানে যুদ্ধজাহাজে সিনার্কার কিছু সৈন্য ছিল। তারা কিছু বোঝার আগেই ফ্রান্সিসের নির্দেশে জাহাজঘাটা থেকে জাহাজ বেরিয়ে এসে চলল মাঝ সমুদ্রের দিকে। জোর হাওয়ায় জাহাজের পাল ফুলে উঠল। জোর গতিতে ফ্রান্সিসদের জাহাজটা অনেক দূর চলে এলো।
ডেক-এর রেলিঙে ধরে ফ্রান্সিস আর হ্যারি জাহাজঘাটার দিকে তাকিয়ে ছিল। অল্পক্ষণের মধ্যে বোনিফেস বন্দর সিনার্কার যুদ্ধজাহাজ সব চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। ফ্রান্সিসদের জাহাজ মাঝ সমুদ্রে চলে এলো।
নিশ্চিন্ত হয়ে ফ্রান্সিস আর হ্যারি নীচে নামার সিঁড়ির দিকে চলল।
নীচে কেবিনঘরগুলোয় এসে যে ঘরে আহত অসুস্থ রোক্কাকে রাখা হয়েছে সেই কেবিনঘরে ঢুকল। দেখল বৈদ্য কামেরাত রোকার পাশে বিছানায় বসে আছে আর মারিয়া রোক্কার কাটা জায়গাগুলোতে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছে।
ফ্রান্সিস বুঝল—মারিয়ার শরীর অনেকটা সেরেছে। ফ্রান্সিস কামেরাতকে বলল রোক্কার শরীর কেমন? অনেকটা ভালো। তবে জ্বরটা এখনও ছাড়ে নি। কালকে নাগাদ জ্বর ছেড়ে গেলে বিপদের কিছু নেই। কিন্তু জ্বর না ছাড়লে চিন্তার কথা। কামেরাত বলল।
—মারিয়া কেমন আছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
—উনি এখন প্রায় সুস্থ। আর দুদিন ওষুধ পড়লে উনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। কামেরাত বলল। ফ্রান্সিস ডাকল—মারিয়া। মারিয়া একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিল। ফ্রান্সিস বুঝল—এখনও মারিয়ার রাগ পড়ে নি। ফ্রান্সিস ডান হাতটা আস্তে আস্তে মারিয়ার কাঁধে রাখল। মারিয়া সেই হাত নিজের হাতে ঠেলে সরিয়ে দিল। ফ্রান্সিস মৃদু হাসল। বলল—মারিয়া—তোমার সঙ্গে ওরকম দুর্ব্যবহার না করলে তোমাকে নিয়ে কামেরাত পালাতে পারতো না। তুমি যেরকম চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করেছিলে তাতে আমার সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যেত। কাজেই তোমাকে থামাতে হয়েছিল। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল—আমাকে ক্ষমা করো। মারিয়া চুপ করে নিজের কাজ করে যেতে লাগল। ফ্রান্সিস আবার বলল—মারিয়া আমার ওপর রাগ করে থেকো না।
এবার রোক্কা বলল-রাজকুমারী—আপনি ফ্রান্সিসের ওপর রাগ করে থাকবেন না। আমার সঙ্গেও ফ্রান্সিস অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছিলেন। তখন বুঝিনি। এখন বুঝেছি ফ্রান্সিস ঠিক পরিকল্পনা করে এগিয়ে চলেন। ফ্রান্সিস আমাকে জীবনদান করেছেন। নইলে সিনার্কার ঐ কয়েদখানা থেকে কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারতাম না। আমার বিদ্রোহী বন্ধুরা অবশ্যই আমাকে মুক্ত করতো কিন্তু একফোঁটা রক্ত খরচ না করে ফ্রান্সিস স্রেফ বুদ্ধির খেলায় সিনার্কাকে হারিয়ে আমাকে মুক্ত করছেন। একটু থেমে বলল—আপনি ফ্রান্সিসকে ক্ষমা করুন। উনি যা করেছেন সে সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক করেছেন।
হ্যারি বলল—রাজকুমারী আমিও ফ্রান্সিসকে ভুল বুঝেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি ফ্রান্সিস নিখুঁত পরিকল্পনা করে কাজে নেমেছিল। মারিয়া এবার যেন একটু নরম হল। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তারপর নিজেদের কেবিনঘরে এসে শুয়ে পড়ল। সারাটা দিন যা ধকল গেছে। ফ্রান্সিস ছেঁড়া জামাটা খুলল। তারপর ভীষণ ক্লান্তিতে চুপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস মারিয়া হ্যারি শাঙ্কো সবাই রোক্কার কেবিনঘরে জড়ো হল। রোক্কা এখন অনেকটা সুস্থ। জ্বর ছেড়ে গেছে। কামারেত বলল-রোক্কার আর কোনো ভয় নেই। কাটা জায়গা থেকে রক্ত পড়ার জন্য রোক্কা যতটা দুর্বল হয়েছিল কয়েকদিনের মধ্যেই সেই দুর্বলতা কেটে যাবে।
রোক্কা বলল—ফ্রান্সিস-আপনি তো আমাকে পালঙ্কের দিকে যেতেই দিলেন না। কী ছিল ঐ পালঙ্কে।
ফ্রান্সিস হেসে বলল—সব বলছি।
হ্যারি বলে উঠল—তুমি কি রানী ইসাবেলার রত্নপেটিকা খুঁজে পেয়েছিলে?
ফ্রান্সিস হেসে বলল—হ্যাঁ। ফ্রান্সিসের কথা শুনে সবাই চমকে উঠল। শাঙ্কো বলল তবে ঐ রত্নপেটিকা নিয়ে এলে না কেন? হ্যারি কিছু বলল না। ওর কেমন মনে হল ফ্রান্সিস এবার ইচ্ছে করে হার স্বীকার করেছে।
—রত্নালংকারগুলো দেখেছিলে? মারিয়া বলল।
—না—ফ্রান্সিস বলল—তবে আমি নিশ্চিত ঐ রত্নপেটিকায় রানী ইসাবেলার সব রত্ন আর অলঙ্কার ছিল।
—ঠিক কী হয়েছিল বলো তো? হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলতে লাগলো—প্রথমবার তো আমি একাই ঘরটায় ঢুকেছিলাম। জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরের মধ্যে মেঝেয় পা রাখলাম। প্রায় একশো বছর পরে এই ঘরের মেঝেয় বাইরের মানুষের পা পড়ল। জানালায় চেয়ে দেখলাম বাইরে বিকেলের আলো। সেই আলো জানালা দিয়ে আসছিল। সামান্য আলো। তাতে ঘরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না।
অন্ধকার অন্ধকার ভাবটা চোখে একটু সয়ে এলে দেখলাম—ঘরের বাঁদিকের পাথুরে দেয়ালে লাল পাথর দিয়ে অনেকগুলো লম্বাটে দাগ। বুঝলাম—রানী ইসাবেলা এইভাবেই দিনের হিসেব রাখতেন। ডানদিকে তাকিয়ে দেখলাম—পাথরের দেয়ালে একটা কাঠের দেরাজ। একটা মাঝারি আকারের আয়না বসানো। সবকিছুর গায়ে চাপ চাপ ধুলো।
এবার দেখলাম ওদিকের দেয়ালে ঠেলে লাগানো একটা দামি ওক কাঠের পালঙ্ক। পালঙ্কের দুদিকের মাথায় উঁচু করে পেতল দিয়ে তৈরি নানা লতাপাতার নকশা। পালঙ্কের বিছানা ছিঁড়ে খুঁড়ে গেছে। পালক তুলো বেরিয়ে আছে। ধুলো জমে জমে পালঙ্কের কাঠ বিছানা যেন ঢাকা পড়ে গেছে। পালঙ্কের গায়ে নানা ফুললতাপাতার কাজ। কুঁদে কুঁদে তোলা। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল।
আস্তে আস্তে পালঙ্কটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছেঁড়া খোঁড়া বিছানাটার মাঝখানে একটা কাঠের পেটিকা। দামি চেষ্টট কাঠের পেটিকাটার গায়ে মীনে করা ফুললতা পাতা। পেটিকাটা ভালো করে দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম। সাদা হাড়ের ধূলিময় দুটো হাত রত্নপেটিকাটা ধরে আছে। এবার ধুলোর মধ্যে দিয়ে আন্দাজ করে বুঝলাম—দুটি কঙ্কাল। একটা বড়ো একটা ছোটো। বুঝলাম—বড়োটা রানী ইসাবেলার ছোটোটি রানীর মেয়ে রাজকুমারীর। কী গভীর মমতায় দুজনে রত্নপেটিকাটা ধরে আছে। সন্দেহ নেই এই পেটিকাটাই রানী ইসাবেলার রত্নভাণ্ডার। ফ্রান্সিস থামল। উপস্থিত সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে ফ্রান্সিসের কথাগুলো শুনছিল। ফ্রান্সিস বলতে লাগল রত্নপেটিকাটা তুলে নেব বলে হাত বাড়ালাম। কিন্তু পারলাম না পেটিকাটা তুলে নিতে। কী অপরিসীম ভালোবাসায় মমতায় মা আর মেয়ে সেই পেটিকাটা ধরে আছে। এখন আর ওরা রানী রাজকুমারী নয়। সাধারণ মানুষ-মা আর মেয়ে। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল—এক অদ্ভুত পরিবেশ। কতদিন আগের কথা। সেই সময়টাই যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মৃত্যুর সময়ও তারা রত্নপেটিকাটা হাতছাড়া করে নি। কী বলবো? আমার চোখে জল এসে গেল। আমি রত্নপেটিকাটা না নিয়েই জানালার কাছে চলে এলাম। দড়িধরে দুর্গের ছাতে উঠে এলাম।
—তারপরে তো আমাকেও নিয়ে গেলেন। রোক্কা বলল।
—ওটা সিনার্কাকে ধোঁকা দেবার জন্যে জামা ছিঁড়ে সেই কাপড়ের ঝুলি তৈরি করে একটা প্রায় চৌকোণো পাথর ভরে আপনাকে নিয়ে ছাতে উঠে এলাম। সৈন্য দুটিকে ঐ পাথরটাই রত্নপেটিকা এরকম বুঝিয়ে সিনাৰ্কার কাছে পাঠালাম। জানতাম রত্নপেটিকা পাওয়া গেছে এই আনন্দে সৈন্য দুটি রোক্কাকে পাহারা দেবার কথা ভুলে যাবে। হলও তাই। রোক্কাকে মুক্ত করে আমাদের জাহাজে নিয়ে এলাম।
সবাই নির্বাক হয়ে ফ্রান্সিসের বলা ঘটনাগুলো ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না একসময় রোক্কা আবেগে ফ্রান্সিসের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরল। একটু কান্নাভেজা গলায় বলল ফ্রান্সিস যদিও রত্নভাণ্ডার উদ্ধার হলো না—তবু আমি আপনার মানবতাবোধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। আপনি সত্যিই সাধারণ মানুষ নন। ফ্রান্সিস হেসে বলল—কী যে বলেন। মারিয়া হেসে বলল—রোক্কা ঠিক আমাদের মনের কথাই বলেছেন। ফ্রান্সিস বলল—এখন তো রানী ইসাবেলার রত্নভাণ্ডার আপনাদের হাতের মুঠোয়। সেই রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করে আপনার দেশবাসীদের কল্যাণের কাজে লাগাবেন—এই অনুরোধ। রোক্কা বলল—আগে সিনার্কা আর ওর মোসাহেবের দলকে দক্ষিণ কর্সিকা থেকে তাড়াবো। তারপর রানী ইসাবেলা আর রাজকুমারীকে রাজকীয় সম্মানে কবর দেবার ব্যবস্থা করবো। মা মেয়ে হাত ধরাধরি করে যেভাবে আপনি দেখেছেন একই কবরে তেমনিভাবে তাদের শুইয়ে রাখবো। শুধু রত্ন আর রত্নালংকারে বিক্রি করবার জন্য নেব। রত্নপেটিকাটি দুজনে যেভাবে শুয়ে ধরে ছিলেন সেভাবে তাদের হাতে রাখবো। রত্নালঙ্কার বিক্রির অর্থ দিয়ে দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণে ব্যয় করবো। আপনাদের সামনে এই প্রতিজ্ঞা করছি আমি। একটু থেমে রোক্কা বলল—এখন তো সিনার্কার সৈন্যরা আর জাহাজ আক্রমণ করতে আসবে না। নিশ্চিন্তে জাহাজটা ডাঙার কাছাকাছি নিয়ে চলুন। ভোর নাগাদ সারিন বন্দরে পৌঁছে যাবো তাহলে। সারিন আমাদের শক্ত ঘাঁটি। সব বিদ্রোহীদের একত্র করে আমরা বোনিফেস আক্রমণ করবো কালকেই।
ভোর নাগাদ ফ্রান্সিসদের জাহাজ সারিন বন্দরে পৌঁছল। খুব বড়ো বন্দর নয়। রোক্কা আর কামারেত ফ্রান্সিসদের কাছ থেকে বিদায় নিল। কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে দুজনে নেমে গেল।
আবার ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলল। বেগবান বাতাসে ফুলে উঠলো পালগুলো। জাহাজ ঢেউ ভেঙে চলল মাঝ সমুদ্রের দিকে।
Leave a Reply