১০. বিশাল বন রহস্য (ভলিউম ৪) [ওসিআর ভার্সন – প্রুফরিড সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ১০
প্রথম প্রকাশ ও ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৮
ঢাকা এয়ারপোর্ট।
| রানওয়েতে লণ্ডনগামী একখানি ট্রাইডেন্ট জেট বিমান মহাশূন্যে ডানা মেলে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
| রাত নটা বাজতে দশ মিনিট বাকি আছে আর। এমন সময় শহীদের ক্রিমসন কালারের ফোকসওয়াগনটা এয়ারপোর্টের পার্কিং সেন্টারে এসে প্রবেশ করতে দেখা গেল। পিছনে মি. সিম্পসনের গাড়িটাও।
গাড়ি পার্ক করে শহীদ আগে নামলো। তারপর একে একে মহুয়া, কামাল, লীনা ও গফুর।
মি. সিম্পসনের গাড়িটাও কিছুটা দূরে এসে থামলো। গাড়ি থেকে নেমে মি, সিম্পসন একবার পিছন ফিরে তাকালেন। তারপর শহীদের দিকে একটা ইঙ্গিত করে হাঁটতে লাগলেন সামনে। মি. সিম্পসনের ইঙ্গিতে পিছন ফিরে তাকালো শহীদ। দেখলো একটা নিউ মডেলের, কনভেয়ার অদূরেই পার্ক করা রয়েছে। একটা লোক কনভেয়ারের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্ধকারে লোকটার মুখাবয়ব দেখা যাচ্ছে না।
শহীদ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো। ওরা সকলে একসঙ্গে এগিয়ে চললো কথা বলতে বলতে।
‘আমার প্ল্যানটা তাহলে হানড্রেড পার্সেন্ট সাকসেসফুল বলেই প্রমাণিত হলো, ওয়েটিংরুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পার্শ্ববর্তী মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে বললো শহীদ।
‘ ‘সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, মি. সিম্পসন মৃদু হেসে বললেন, ‘তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারা যায় না।
মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে আরও কিছু বলবার জন্যে মুখ খুলেছিল শহীদ, এমন সময় মাইকে ঘোষকের গলার আওয়াজ শুনে চুপ করে গেল।
‘অ্যাটেনশন”,”ইওরী অটেনশন প্লীজপাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনস অ্যানাউন্সেস দ্যা ডিপারচার অব ইটস ফ্লাইট পি, কে, ফোর সেভেন নাইন, ফর লণ্ডন ভায়া করাচী। প্যাসেরিল অন বোর্ড প্লীজ। থ্যাঙ্কইয়ু।
আরও কিছুক্ষণ পর মহুয়া, লীনা এবং মি. সিম্পসনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে চললো ওরা অপেক্ষমাণ বিমানটির দিকে। শহীদ আর কামাল আগে আগে,
পিছন। ক’ | এগিয়েই কি মনে করে ফুয় আবার ফিরে এলো। মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দিদিমণি, আমি সঙ্গে থাকতে দাদামণির কোনো ভয় নেই এ কথা তুমি নিশ্চয় জেনো। আর মীরপুর মাজারে একবার যেতে ভুলো না যেন!
কুরের কথা বলার ভঙ্গি দেখে লীনা শব্দ করে না হেন পরিলা না। মহুয়াও হাসলো, কিন্তু তার হাসিটা কেমন যেন ম্লান। হাসির মধ্যে দতির সঙ্গে আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনাই যেন তাতে বেশি করে মূর্ত হয়ে উঠছে।
প্লেনের ভিতরে ঢুকবার আগ শহীদ ঘুরে দাঁড়িয়ে সকালের উদ্দেশে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। বিদায় জানাতে এসেছিল যারা তারাও হাত নাড়লা।
মিনিট দুই পর কুঁসে উঠলো ট্রাইডটটা। রানও ধর ছুটতে শুরু করলো তারপর। আর কমুহূর্ত পরই বিরাট এই যন্ত্রদানবটি ভূমি ছেড়ে উপর, আরও উপরে উঠে যাবে। যাত্রা শুরু হবে মহাশূন্যের পণ, আর এক মহাদেশের উদ্দেশে। …
এক
মি. সিম্পসনের অফিস রুম।
| মি, নিষ্পসন উত্তেজিত ভাবে ঘরম, পায়চারি করছেন। তার চোখমুখে গভীর চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। বড় বেশি বিচলিত দেখাচ্ছে তাকে। টেবিলের ওপর একটা, খোলা ফাইল। মাঝে মাঝে পায়চারি বন্ধ করে খোলা ফাইলটা নজর বুলিয়ে নিচ্ছেন তিনি। চেষ্টা করছেন কি যেন একটা সমস্যার সমাধান বের করতে। কিন্তু দ’ এক মুহূর্ত পরই ফাইল থেকে মুখ তুলে সরে আসছেন কি!কাছ থেকে। শেলফ থেকে একবার একটা বই বেছে বের করে পাত 3 |গলেন কিছুক্ষণ, কি যেন দেখে নিয়ে বইটা রেখে দিলেন, তারপর আবার শুরু করলেন পায়চারি। আর একবার টেবিলটার কাছে সরে গিয়ে খোলা ফাইলটায় চোখ রাখ অনেকখানি সময় নিয়ে বুকে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে। দুশ্চিন্তার গভীর রেখাগুলো কপাল থেকে ধীরে ধীরে মুছে গেল তাঁর। তারপর কোনটার দিকে হাত বাড়ালেন। ডায়াল করে মুখ খুললেন, ‘হ্যালোশহীদ? সিম্পসন স্পিকিং…শোনো, তোমাকে এখুনি দরকার বোধ করছি-”হাঁ, চলে এসো আমার অফিসে”হাঁ, বিশেষ জরুরী ব্যাপার একটানা, বলা যাবে না এখনই ..এখুনি ৭ বেশ, আমি অপেক্ষা করছি।’
কোনটা নামিয়ে রেখে মি. সিম্পসন আবার ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন।
‘আমি শখের গোয়েন্দা শহীদ খান, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের চৌরব মি, সিম্পসনের জরী ডাকে এখানে আমার আগমন ঘটছে।’
মি, সিম্পসন চমকে উঠে পায়চারি বন্ধ করে বললেন, ‘কে! ওহ শহীদ, কখন
এসছো?’
শহীদ হাসতে হাসতে বললো, ‘তা মিনিট দশেক তো হবেই। কিন্তু কি ব্যাপার। মি, সিম্পসন ..
মি. সিম্পসন প্রথানুসারে ক্ষমা চাইলেন, ‘আই অ্যাম সরি… তারপর ইঙ্গিতে টেবিলের ওপর খোলা কাইলটা দেখিয়ে দিলেন। শহীদ উঠে দাঁড়িয়েছিল আগেই, এবার এগিয়ে গিয়ে কাইলটা হাতে তুলে নিলো।
| ফাইলটাতে রয়েছে একটা টপ সিক্রেট মার্কা মারা রিপোর্ট। শহীদ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে রিপোর্টটা পড়তে শুরু করলো।
পাঠকের সুবিধার জন্য রিপোর্টটা সংক্ষিপ্তাকারে এখানে তুলে দেয়া হলোঃ
বিশালবনের ফরেস্ট অফিসারের জন্য নির্দিষ্ট বাংলোটি জঙ্গলাকীর্ণ একটি ছোটো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। গত সাত মাস ধরে আশ্চর্যজনক কয়েকটি হত্যাকাণ্ড টছে এই বাংলোটির মধ্যে। গত সাত মাস সময় সীমার মধ্যে পর পর তিনজন ফরেস্ট অফিসার নিহত হয়েছেন এই বাংলোর। একটি কামরায়। নিহত হওয়ার কারণটা খুবই বিপজ্জনক, সন্দেহজনক এবং রহসজনক। প্রথমজন নিহত হওয়ার প্রায় দেড়মাস পর নিহত হন দ্বিতীয়জন। তৃতীয়জন নিহত হন প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর, গত মাসের আঠারো তারিখে। তিনজন অফিসারই একই ঘরে এবং রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হন। জ্যামেইকা অঞ্চলের ব্ল্যাক উইডো নামে এক প্রকার বিষাক্ত মাকড়সার কামড়েই এদের তিনজনের মৃত্যু ঘটেছে বলে জানা
গেছে। স্ত্রী মাকড়সাকে না খাইয়ে রেখে বিষাক্ত করে তোলা হয়। আশ্চর্যের কথা হলো, আমাদের দেশে এই মাকড়সার অস্তিত্ব থাকা একেবারেই অসম্ভব–যদি না কেউ আমদানী করে থাকে। আশেপাশের জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই বিষাক্ত নাকড়সার কোনো চিহ্ন পুলিশ বিভাগ বা ইনফর্মার বের করতে পারেনি। পর পর তিনজন নিরীহ ফরেস্ট অফিসারকে এভাবে হত্যা করার কি কারণ থাকতে পারে, এতে, লাভ কি, কার লাভ, এসব প্রশ্ন না তুলে ব্যাপারটাকে হত্যাকাও মনে না করাই স্বাভাবিক। কিন্তু, যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা না গেলেও পুলিশ বিভাগ এই ঘটনাগুলোকে ঠিক দুর্ঘটনা বলে মেনে নিতে রাজি নয়। পুলিস বিভাগ মনে করে একটা রহস্যজনক কারণ এই আশ্চর্য ঘটনাগুলোর পিছনে কাজ করছে, যে কারণে তিনজন নিরীহ ফরেস্ট অফিসারকে পৃথিবী থেকে অকালে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে এই তিনজন অফিসারের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে। কোনো জটিলতা বা রহস্য এদের মধ্যে ছিলো না, সন্দেহজনক চরিত্রের মানুষ এদেরকে বলা যায় না কোনমতেই …
রিপোর্টটা পড়া শেষ করে মুখ তুলে চাইল শহদ। মি. সিম্পসন এতক্ষণ তাকিয়ে
ছিলেন শহীদের মুখের দিকে। এবার নীরবতা ভঙ্গ করে তিনি বলে উঠলেন, ‘কি মনে হয় তোমার?
শহীদ চিন্তিত স্বরে বললো, ‘অনেক কিছু মনে হওয়া সম্ভব, মি. সিম্পসন। কিন্তু, বুঝে না জেনে কিছুই মনে করতে চাই না আমি। ওটা আমার স্বভাব নয়।’ ‘ব্যাপারগুলো যে দুর্ঘটনা নয় এবং রহস্যজনক তা স্বীকার করো তো?’
শহীদ বললো, ‘না করে উপায় কি?’
মি. সিম্পসন বললেন, ‘যাক! আমরা তা হলে ব্যাপারটা সম্পর্কে একমত। এবার তোমাকে আমি একটা অনুরোধ করলো
শহীদ মি. সিম্পসনকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো, ‘ডোন্ট গো ইনটু ফর্মালিটিজ মি, সিম্পসন, আই অ্যাম ইন্টারেস্টেড ইন দিল কেস।’
| মি. সিম্পসনের আন্তরিক স্বর শোনা গেল, ‘থ্যাঙ্কিউ, মাই বয়।’
শহীদ বললো, ‘এবার কাজের কথায় আসা যাক। সরাসরি শহীদ খান বিশালবনে যাবে না। বর্তমানে নিশ্চয়ই ওখানে ফরেস্ট অফিসার বলতে কেউ নেই, তাই না? আপনি ব্যবস্থা করুন যাতে বিশালবনের ফরেস্ট অফিসারের পদটি আমি পাই। প্রকাশ্যে না গিয়ে ছদ্মবেশে নব নিযুক্ত ফরেস্ট অফিসার হিসেবে আমি ওখানে যেতে চাই, নতুন ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গে থাকবে তার সহকারী আর আরদালি। ঠিক আছে?
মৃদু হেসে মি. সিম্পসন বললেন, ‘ঠিক আছে। কবে তুমি তৈরি হতে পারবে বলে মনে করো?’
শহীদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা মি, সিম্পসনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, ‘সেটা নির্ভর করে আপনার উপর। চাকরিটার বন্দোবস্ত হয়ে গেলেই আমি রওনা হয়ে যাবো।
বেরিয়ে এলো শহীদ মি. সিম্পসনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। তার ক্রিমসন কালারের ফোকসওয়াগেনটা মৃদু গর্জন তুলে অকিস কম্পাউণ্ড ছেড়ে রাস্তায় নামলো।
| সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার পাশে অপেক্ষারত নিউ মডেলর একটি কনভেয়ারকে স্টার্ট দিয়ে শহীদের কোকসওয়াগেনটার পিছন পিছন দূরত্ব বজায় রেখে এগোতে দেখা গেল।
বাড়ি ফিরে শহীদ দেখলো, কামাল এসে বসে আছে। কথা বলছে লানার সঙ্গে। ঘরে মহুয়াও আছে। শহীদকে দ্রুত ঢুকতে দেখে সকলে ওর দিকে মুখ তুলে তাকালো। শহীদ কোনটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মৃদু স্বরে বললো, ‘মহুয়া, তোমরা একটু পাশের ঘর যাও, কামাল থাক।’
শহীদের কথা শুনে মহুয়া ও লানা নোকা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। যাবার সময় মহুয়া কপট অভিমানে জানতে চাইলো, ‘ কেন, ফোনে কারও সঙ্গে প্রেমালাপ চলবে নাকি এবার? দেখা করে এসেও হলো না!
শহীদ মিটি মিটি হেসে তার দিকে তাকালো।
ভলিউম-১
মহুয়া ও লীনা ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে শহীদ কামালকে নিচু স্বরে চটপট বললো, ‘একজন লোক বাড়ির আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। মি. সিম্পনের অফিস থেকেই আমাকে ফলো করে এসেছে বেটা। ওর মতি কি এবং গতি কোথায় সেটা একটু জানতে চেষ্টা কর দেখি।’
কামাল মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
শহীদ সাবধান করে দিয়ে বললো, দেখিস, তুই ওকে জানতে দিস না তোর অভিসন্ধি।’
কামাল ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতেই শহীদ রিসিভারটা তুলে ডায়েল করতে শুরু করলো।
‘হ্যালো মি. সিম্পসন? শহীদ স্পিকিং…আপনার অফিস থেকে ফিরতি পথে ফলো করা হয়েছে আমাকে না, কিছু করার নেই…তাই নাকি? আপনার কী মনে হয় বিশালবনের ঘটনার সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ রয়েছে? ..”মামিও সন্দিগ্ধ “যাকগে,
জানেন তো, কাকপক্ষীর অগোচরে আমি ওখানে যেতে চাই তাই প্রমাণ করা। প্রয়োজন…আর যেখানেই আমি যাই না কেন বিশালবনে নিশ্চয়ই যাচ্ছি না। …বিনা উদ্দেশ্যে আমার গায়েব হয়ে যাওয়াটা সন্দেহের উদ্রেক করবে নিশ্চয়ই সেটা আমি চাই না…শুনুন আমার প্ল্যান..আগামী পরশুদিন লণ্ডন যাচ্ছি আমি স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের আমন্ত্রণে…সঙ্গে যাবে কামাল ও গফুর-হ্যাঁ, সব ব্যবস্থা পাকাপাকিভাবে করা দরকার। কাগজে খবর বেরুবে, লণ্ডনের টিকিটও কাটা হবে, আপনারা আমাকে নি অক করে আসবেন, আমরা প্লেনে চড়বে, প্লেন রানওয়ে ধরে ছুটবে-কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থানুসারে প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রেখে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে আমরা নেমে পড়বে। জায়গাটা অবশ্যই ঢাকা এয়ারপোর্টের রানওয়েই হবে–পাইলট ব্যতীত ব্যাপারটা আর কেউ জানবে না..এই নামিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আপনি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলেই আমাদের গন্তব্যস্থানের পরিচয় আর কেউ জানতে পারবে না, “রাখি তাহলে, কেমন?
মিনিট দশেক পরে কামাল ফিরে এলো। বললো, কই রে, কাউকে তো দেখলাম না রাস্তায়। ব্যাপার কি বলতো?’
শহীদ বললো, ‘ব্যাপার অনেক কিছু। শোন
তরপর সব কথা কামালকে জানাবার জন্য সোফায় আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসলো শহীদ।
দুই
স্টেশন থেকে সাত মাইল ধর একটি ইট-বিছানো রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণমুখো। তারপরেও রাস্তা আছে। তবে ইট বিছানো নয়, মেটো। বিশালবনের জঙ্গলের শুরু এখান থেকেই। ক্রমেই জঙ্গল গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠেছে। মেটো পথটা একটা
জীপ গাড়ি চলার মতো চওড়া, এবড়োখেবড়ো, ধূলিময় আর অন্ধকার। দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো যথেষ্ট স্বাধীনভাবে প্রবেশ করতে পারে না। এই মেটা পথ ধরে মাইল চারেক এগিয়ে তোলেই দেখা যাবে ফরেস্ট অফিসারস কোয়ার্টার অত বিশালপুর। ছোট্টো একটা পাহাড়ের গা বাংলোটা। চারপাশে গভীর জঙ্গল, কেটেকুট খানিকটা খোলা জায়গা বের করা হয়েছে। ডানদিকে, চার পাঁচশ’ গজ দূরে একটি খাদ। খাদটির সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক কারণ। জলও নিশ্চয় কোনো ঝরনা থেকে উৎসারিত। তিনশো। ফিট নিচে বয়ে চলেছে প্রবল জলস্রোত। উপর থেকে দাঁড়িয়েও শোনা যায় খরস্রোতা পার্বত্য নদীর গর্জন।
ফরেস্ট অফিসারদের কোয়ার্টার ছাড়িয়েও কিছুদূর চলে গেছে সঙ্কীর্ণ মেটো পথটা। তবে মাইলখানেকও হবে না। যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে রাস্তাটা তারপরও মানুষ যাতায়াতের পথ আছে। পায়ে চলা পথ। একটা দুটো নয়, অগুণতি। এগুলো সভ্য মানুষের সৃষ্টি নয়, আদিবাসীরা এর কারণ। বন্য জন্তু জানোয়াররাও এ পথে চরে বেড়ায়।
অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে মাত্র মাইল খানেক দূরে আদিবাসীদের গ্রাম। বোত্তা, গারো, রাজবংশ বিশালবনের আদিবাসী। বোও রা থাকে পাহাড়ের ওপর, তাদের নিজেদের প্রাচীন গায়। খুব তেজী, দুর্ধর্ষ, ভয়ঙ্কর। সভ্যতার মুখ ওরা দেখেনি, দেখতে চায়ও না। সভ্য মানুষকে ওরা এখনও ঘৃণার দৃষ্টিতেই দেখে। অতি সামান্য কারণে রেগে ওঠা এদের স্বভাব। হঠাৎ ওরা তীর ছুঁড়ে বসতে পারে, বিষাক্ত সে তার। প্রাণ ছিনিয়ে নেবার জন্যই এর সৃষ্টি।
| বোণ্ড। মেয়েরা সকলেই মাথা কামিয়ে ফেলে। কাপড়-চোপড়ের ব্যবহার অত্যল্প, ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছুই পরে না। কিন্তু গহনা? সত্যি কথা বলতে কি, বোণ্ড। মেয়েরা একেকজন একেকটা জুয়েলারী দোকানের চলমান শো কেস। পুরুষরা শুধু নেট পরে। নিজেদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা মেনে চলে সবাই।
পাহাড়ের এদিকে, অর্থাৎ, জঙ্গলের ভিতর ঘরবাড়ি করে বসবাস কর রাজ বংশীরা। বে৷াদের মতো এরা অত ভয়ঙ্কর নয়, তেজী কম নয় যদিও। সভ্য মানুষ ওদের ওপর না চটলে পারতপক্ষে ওরাও চট না। তবে ব্যতিক্রমও ঘটেছে।
সভ্য মানুষও কোনো কোনো সময় এদিকে আসে বৈকি। শিকারই একমাত্র কারণ। কিন্তু সে দুই বা চারদিনের জন্য। গাছ কাটার ব্যবসায়ীরাও আসে। তারা থাকে বেশ কিছুদিন ধরে। গাছ কাটা সারা হলে একদিন চলে যায়। বেশিদিন ধরে থাকে শুধু ফরেস্ট অফিসাররা। উপজাতীয়দের চোখে এরা এখন অমঙ্গলের চর। দেবতা এদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। দেবতার অভিশাপ এদের ওপর অমাণ হয়ে দেখা দিয়েছে। রেগে গেছেন দেবতা, আর তাই বিশ্বাবুনের’ [বিশালবনের ওপর নেমে
আসছ একের পর এক ভঙ্কর শাস্তি। এ পর্যন্ত তিনজন সভ্য মানুষকে তেনারা সাজা। দি। অরি শুরু হয় গাছে অলৌকিক সব ক্রিয়াকাণ্ড। কালো ছায়া-মৃর্তি জঙ্গলে
|
জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। রাতে শোনা যায় অদ্ভুত সব রহস্যময় শব্দ। দেখা যায় ভৌতিক আলো। এ সবই দেবতাদের মানুষকে ভয় দেখাবার উপায়। ভয় দেখাচ্ছেন মানে মানুষকে সাবধান করে দিচ্ছেন। কেউ যদি তা না মানে তাহলে তাকে চরম শাস্তি পেতেই হবে। কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না।
উপজাতীয়রা তাই পরামর্শ সভা ডেকেছে। গুরুতর আলোচনা হচ্ছে দেবতাদের কিভাবে সন্তুষ্ট করা যায় তার উপায় উদ্ভাবনের জন্যে। ভয় ওদের মনের মধ্যে জমাট মেঘের মতো অবিচল দাঁড়িয়ে থেকে গর্জিন করছে। অভিশাপ দিচ্ছে, ওরা সভ্য মানুষদেরকে। অমঙ্গল ডেকে এনেছে তারা। কে বলতে পারে তারাও ছারখার হয়ে যাবে কিনা?
বুড়ো সর্দার আতীকু ভীষণ ভয় পেয়েছে। দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধানের আগে সভ্য মানুষদের সঙ্গে তাদের নতুন সম্পর্ক কি হবে সে ব্যাপারেই সে বেশি চিন্তিত। কিন্তু বুড়ো মানুষ বলে উজিত হয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাকে খুব চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে, একটি কথাও এ পর্যন্ত তার মুখ থেকে বের হয়নি। আদিবাসীরা হাঁটু গেড়ে বসে হৈ-চৈ করছে প্রবল উত্তেজনায়।
ছোট্ট স্টেশন বিশালপুর। টেন মিনিটখানেকের বেশি দাঁড়ায় না। শহর বলাতে স্টেশনের চারপাশটাকেই বোঝায়। দুটো পানবিড়ির দোকান, একটা চায়ের দোকান, দুটো কি তিনটে রিকশা, একটা ঠেলাগাড়ি, বইয়ের দোকান একটা এবং স্টেশন মাষ্টার ও রেলওয়ে কর্মচারীদের ছোটো একটা একতলা কোয়ার্টার নিয়ে বিশালপুর শহরণ পাকা বাড়ি আছে বটে চার-পাঁচটা ছড়ি ছিটি, কিন্তু তাতে লোকজন থাকে না। শহর। লোক এখানে বাস করার কথা ভাবতে পারে না। কখনও কখনও এসে দু’চারদিন কাটিয়ে যায় হয়তো, আমোদ ফুর্তি করে, শিকার করে, হাওয়া বদলাতেও আসে কেউ কেউ। নিম্নশ্রেণীর কিছু ছন্নছাড়া লোক থাকে বেড়ার ছাপড়া তুলে, কেউ বলতে পারে না কখন কে গাড়ি ধরে চলে যাবে কোথায়। কে পড়ে থাকতে চায় এই জংলী এলাকায়? লোকজন, গাড়িঘোড়া, আমোদ-ফুর্তি, আত্মীয়-স্বজন, কেউ নেই, কিছু নেই। কিসের আশায় পড়ে থাকবে লোক এখানে? ভালো না লাগলেই চলে যায় গাড়ি ধর। আবার ভাগ্যানেষী দু’চারজন কপর্দকহীন ভুলক্রমে নেমেও পড়ে ছোট্ট এই স্টেশনটায়। কিন্তু কদিনেই হাজার বছরের পুরানো হয়ে যায় তার কাছে এই বিশালপুর। এখানে আর থাকতে চায় না।
বেলা এগারোটা।
লোকাল একটি ট্রেন এসে ইন করলো বিশালপুর স্টেশনে। মাত্র তিনজন যাত্রী নামলো গাড়ি থেকে। বলা ভালো, তিনজনের একটি দল। বিশালবনের নতুন করে
অফিসার এলেন। সঙ্গে তাঁর সহকারী আর আদালী। বলাই বাহুল্য, নতুন এই ফরেস্ট
শp, সহকারী আর আন্দালী যথাক্রমে আমাদের পূর্ব পরিচিত শখের গোয়েন্দা
. পান, তার বন্ধু এবং সহযোগী কামাল এবং প্রভুভক্ত দশাসই গফুর। অবশ্য এই
ইন, সিপসনও এদের তিনজনকে দেখলে সনাক্ত করতে পারতেন কিনা সন্দেহ।
. . হরছে এদের ছদ্মবেশ।
tড় থেকে নেমে প্রাটফর্মের চতুর্দিকে অনুসন্ধিৎসু এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার সখ 11:শে শহীদ।
মাল বললো, ‘জাত:গাটা একেবারে যাচ্ছে তাই বলে মনে হচ্ছে। এখন প্রায়, অথচ কি রকম জনশূন্য, দেখেছিস!
শহীদ বললো, ‘ভালোই তো, কদিন বেশ নিরিবিলি থাকা যাবে।’
কামাল নিচু স্বরে বললো, ‘শহীদ খান যেখানে থাকবে সেখানে নিরিবিলি থাকবার উঃ কি?
চুপ! ভর্ৎসনা ফুটে উঠল শহীদের কণ্ঠে।
কামাল শহীদের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরলো। দেখলো একটা লোক এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।
সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটা। রোগা পাতলা চেহারা। দেখে মনে হয় যেন মন ভালো নেই,জড়োসড়ো হয়ে আছে কেমন। শহীদের উদ্দেশে মুখ খুললে লোকটা, ‘স্যার, আপনি মিস্টার রুহুল আমিন, নতুন ফরেস্ট অফিসার বিশালবনের, না?’
‘হাঁ,’ লোকটির চোখে চোখ রেখে শহীদ বললো, ‘তোমার নাম তিতু? ডাইভার?
জী হা। উত্তর দিয়ে লোকটা শহীদের দিকে কেমন আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে রইলো। ধমকে উঠলো শহীদ, ‘কি দেখছো?’
সঙ্গে সঙ্গে কয়েক পা পিছিয়ে গেল লোকটা। চোখ নামিয়ে থতমত খেয়ে বললো, ‘কিছু না, স্যার, এমনিনে, কিছু মনে করবেন না, স্যার!
শহীদ কিছু বলার আগেই কামাল বললো, কি ব্যাপার, তুমি কি মারামারি করতে অভাপ্ত নাকি? তোমার প্যান্টে রক্তের দাগ কেন? নিশ্চয়ই তুমি মদ খেয়ে মারামারি
ছো?’ ‘মদ আমি খাই না, স্যার। ‘ ব?’
একটা পাগল লোকের জন্যে আমার এই দুরবস্থা, স্যার। ড্রাইভার তিতু মিয়ার ১ তিমত উম্মার ভাব, ‘লোকটা আমাকে জ্বালিয়ে মারলো।
‘কে লোটা, নাম কি তার?
‘নাম. টমি জানি না, স্যার।’ তিতু মিয়া হাত নেড়ে বললো, ‘উনি হোসেন পাল বন্ধু বলে নিজের পরিচয় দেন। সারাদিন বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। আল্লা
লু, . এখানে এসে আমার মাথার ওপর ভূতের মত সওয়ার হয়ে বসেছেন।
‘এই হোসেন সাহেবটা কে?’
আপনারা জানেন না? আপনার আগে উনিই তো ছিলেন এখানকার করে অফিসার।
‘ওহ-হা, হোসেন সাহেব! কামাল যেন হঠাৎ চিনতে পেরেছে এমন গলায় বললো, ‘সত্যি এতো ভুলো মন আমার। মালপত্র তুলে নিয়ে সকলে জীপে চড়ে বসতে ডাইভার স্টার্ট দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বললো, ‘স্যার, আপনি গাড়ি চালাতে জানেন?
একথা জানতে চাইছো কেন?’ শহীদ জিজ্ঞেস করলো।
ড্রাইভার বিনীত কণ্ঠে যেন প্রার্থনা করলো, আমাকে এখান থেকে চলে যেতে দিন, স্যার! বিশালবনে থাকলে আমি মরে যাবো। আমার চাকরি আজ থেকে আপনার
আণ্ডারে, তাই আপনি অনুমতি দিলেই আমি চলে যেতে পারি।
‘কিন্তু তুমি মরে যাওয়ার কথা বলছো কেন? বিশালবন কি খুব খারাপ জায়গা?’ কামাল ড্রাইভারের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
ড্রাইভার উত্তর দিলো না। একমনে গাড়ি চালাতে লাগলো।
‘আচ্ছা, এই পাগলাবাবুর আস্তানাটা কোথায় বলতে পারো?’ শহীদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো।
‘আমার সঙ্গেই থাকেন। কিন্তু কখন থাকেন, কখন থাকেন না, তা ঠিক জানি না। রাতদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান, বই পড়েন, গুম মেরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে। থাকেন, নাওয়া-খাওয়ার কোনো সময় নেই, তাই তো আমি ওর নাম রেখেছি পাগলাবাবু।’
কবে থেকে তোমার সঙ্গে আছেন উনি? ‘দিন সাতেক হলো এসেছেন। ‘কোথা থেকে এসেছেন বলতে পারো?
না। ‘কেন এসেছেন? তার কেউ আছে নাকি এখানে? ‘কেউ না।’
তবে?’ : জানি না, সারি। আমি জানি না, আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না দয়া করে। | ডাইভারের এহেন আচরণে অবাক না হয়ে পারে না শহীদ। কিন্তু সে আর কিছু জিজ্ঞেসও করে না।
ইট-বিছানো রাস্তা ধরে গাড়ি দ্রুত চলছে, চারপাশে ঝোঁপঝাড়ের সমুদ্র। কোথাও ছোটো ছোটো ঢিবি দেখা যাচ্ছে। দু’পাশে খোলা মাঠও আছে। কিন্তু পাঁজা করে রাখা লাখ লাখ ইট সাজিয়ে মাঠের চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে। এতক্ষণ একটি মানুষেরও দেখা পায়নি ওরা। পৃথিবীর কোথাও এমন নির্জন জায়গা থাকতে পারে মেনে নিতে বাধে।
‘তুমি কতদিন আছে। বিশালবন?’ শহীদের গলা শোনা গেল আবার। ‘সাতমাস হব, স্যার। ‘তবে তো বিশালপুর তোমার খুব চেনা।’ মাথা নেড়ে চুপচাপ থাকলো তিতু মিয়া।
আর কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে গফুর জিজ্ঞেস করলো, ‘বাজারটা কোনদিকে, তিতু মিয়া?’
স্টেশন থেকে মাইল খানেক পুবে,’ ডাইভার রাস্তার ওপর থেকে চোখ না ফিরিয়ই বললো, ‘নামমাত্র বাজার, কিছু পাওয়া যায় না তেমন।’
‘বাজার কিছু পাওয়া যায় না। এটা আবার কেমন কথা,’ যেন খুবই অবাক হয়েছে এমন গলায় বললো গফুর, ‘লোকে খায় কি তবে?’
‘লোকই নেই বিশালপুর, গকুরের কথায় একটু হেসে বললো ডাইভার।
কোন কথা তোমার, তিতু মিয়া!’ গফুর অবাক কণ্ঠে বললো, ‘এই তো সাহেবরা এসেছেন, এনারা যদি কিছু খেতে চান তো আমি কি করবো?’
‘সে তোমাকে ভাবতে হবে না,’ ড্রাইভার বললো, ‘টাকা খরচ করতে পারলে এখানে পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই।’
গফুরের পিছনে বসেছিল কামাল, গফুরের কথা বলার ধরন দেখে নিঃশব্দে হাসতে লাগলো সে।
‘তোমার নামটা কি তা তো জানা হলো না, ড্রাইভার ‘ফুরের পানে তাকিয়ে বললো।
‘আমার নাম বশির আলী, গফুর স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো, ‘আমি স’হেবের আদালী, বাড়ি খুলনা।
ড্রাইভার বললো, ‘তা তোমার কোনো ভাবনা নেই, বশির আলী, এখানকার আদিবাসীরা ফরমায়েশ দিলে রোজই মুরগী এনে দেবে, অসংখ্য বনমুরগী পাওয়া যায় এখানে, ফলমূল তরিতরকারিও আছে।’
‘আদিবাসীরা কোন লোক, তিতু?’ কামাল হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো।
লোক ভালো। কিন্তু ‘কিন্তু কি? ‘আজকাল ওরা সভ্য মানুষকে ভালো চোখে দেখে না, স্যার। শহীদ বললো, ‘কেন?’ ‘ওরা বলে, সভ্য মানুষেরা নাকি অমঙ্গলের চর। ‘এ রকম মনে করার কারণ কি?
কারণ আছে, স্যার।’ কি কারণ? খুলে বলছ না কেন? অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেল শহীদের কণ্ঠে। ডাইভার হতাৎ কেমন যেন দমে গেল। চুপচাপ •াড়ি চালাতে লাগলো। যেন যাব।
. ভলিউম-১
কোনো কথা বলতে রাজি নয় সে।
‘কই, বলো?’ শহীদ আবার বাঘা উকিলের মতো জেরা করার ভঙ্গিতে তাকে জিজ্ঞেস করলো।
ডাইভার তিতু মিয়া কিন্তু চুপ করেই রইলো। কোনো কথা বলল না আর।
ইতিমধ্যে রাস্তা শেষ হয়েছে। গাড়ি ধার ধারে এগিয়ে চলছে ঝাঁকুনি খেতে খেত। উঁচু নিচু মেটা পথ। গতি বাড়ানো যাবে না গাড়ির। এভাবেই এগোতে হবে। ভরদুপুর বেলাতেও আলো যথেষ্ট নয়। মনোযোগ সহকারে না চললে যে কোনো মুহূর্তে একটা বিপর্যয় ঘটতে পারে।
কামাল ডাইভারকে হঠাৎ চুপ করে যেতে দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। শহীদ সেটা বুঝতে পেরে নিঃশব্দ ইঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিলো। বাকি পথটুকু আর কোনো কথা হলো না। সবাই মগ্ন যে যার চিন্তায়। কেউ লক্ষ্য করলো না একজন লোক গাছের মাথায় বসে তাঁর দৃষ্টিতে ওদের দিকেই তাকি রয়েছে। গাঢ় সবুজ রঙের জীপটা দুলের মোড়ে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সে কি রইলো নির্ণিমষে।
ওরা যখন বাংলাতে পৌঁছলো তখন বেলা দেড়টা বাজে। রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করার কোনো দরকার নেই। দুপুরের খাবার ওরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। গফুর মোটমাঠ নামিয়ে খুলতে লেগে গেল। ডাইভার বাংলোর শেষ মাথায় তার ঘরে চলে গেল সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে।
| দুটো ঘর মোট ফরেস্ট অফিসারের জন্য। একটি বেডরুম, অপরটি কিচেন হিসেবে ব্যবহার করা চলে। ঠিক হলো শহীদ আর কামাল থাকবে এক ঘরে, গফুর শয্যা পাতব রান্নাঘরেই।
ডাইভারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে প্রথমেই ডান দিকের ঘরটা খুলে ফেললো– শহীদ। মালপত্তর সেই ঘরেই ঢোকানো হলো। দুটো মাত্র দরজা ঘরটার। একটা খুলে বারান্দায় বের হওয়া যায়, আর একটা দরজা পাশের ঘরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করার
জন্য ব্যবহার করা হয়।
শহীদ মাঝখানের দরজাটা খুলে পাশের ঘর এবেশ করলো। পিছনে কামাল। এ ঘরটা আগেরটার চাইতে আকারে বেশ বড়। খাট, কাঠের টেবিল, একটা শেলফ, দুটো হাতলওয়ালা চেয়ার আর একটা ইজি চেয়ার ঘরটার মধ্যে। এতগুলো আসবাব থাকা
সত্ত্বেও ঘরটা কেমন খালি খালি লাগছে।
ঘরটা বেশ বড় ব্রে, শহীদ চারপাশে তাকাতে তাকাতে বললো। কিন্তু পাথরের দেয়াল কেন?’ কামাল জিজ্ঞেস করলো। ‘নিশ্চয়ই মজবুত করার জন্যে,’ শহীদ ঘরময় ঘুরতে ঘুরতে বললো।
‘ঘরটাতে মোট দুটো জানালা, তাও বেশ কিছুটা ওপরে। জানার লোহার রডগুলো অতিরিক্ত মোটা, শক্ত আর মজবুত। কামাল জানালার পাল্লাগুলো খোলা শেষ
১৫
করে বারান্দার দিককার দরজাটা খুলেই সামনে ড্রাইভার তিতু মিয়াকে দেখতে পেয়ে ভু. কুঁচকে বললো, ‘তুমি?’
‘পাগলাবাবু নেই, স্যার, আশেপাশে অনেক খোঁজাখুজি করেও তার কোনো হদিস পেলাম না।
| এমন সময় শহীদ ঘর থেকে বের হয় এলো। তার চোখমুখে বিরক্তির ছাপ সুস্পষ্ট। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে শহীদ বললে, ‘ঠিক আছে, ফিরে এলে খবর দিও।’
মাথা নেড়ে ঘুরে দাঁড়ালো ডাইভার। তারপর হঠাৎ কি মনে করে পিছন ফিরে বললো, ‘আমার কথা কি ভাবলেন, স্যার?’
এখনও কিছু ভাবিনি, ভেবে দেখি তারপর তোমাকে জানাবো,’ শহীদ বললো।
শ্লথ পদক্ষেপে ধীরে ধীরে চলে গেল ড্রাইভার। কামাল একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। শহীদ কামালের কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বললো, ‘তিতু মিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় উত্তেজিত হওয়াটা ঠিক হবে না।’
| ‘তোর সন্দেহ হয় না লোকটাকে?’ কামাল বললো, ‘এমন বাজে একটা অজুহাত দেখিয়ে হাজির হওয়ার অর্থ কি? আমরা ওর পাগলাবাবুর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে একেবারে পাগল হয়ে গেছি আর কি!’।
এ জন্যেই তোকে আমি উত্তেজিত হতে বারণ করেছি, শহীদ কামালের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো, ‘আমার বিশ্বাস ও এখানকার ঘটনা সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানে, হয়তো সেজন্যেই এতো ভয় পেয়েছে। যাই হোক, তুই ওকে নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করিস না। আমাদের কাজের পক্ষে সেটা অসুবিধাজনক হয়ে উঠতে পারে।’
‘তথাস্তু, কামাল বললো। কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। এই পাগলাবাবু লোকটা কে, কি ওর পরিচয়, সব ছেড়ে এই নির্জন নির্বান্ধব পুরীতে এসে আছে কেন, উদ্দেশ্য কি লোকটার, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, তাই না?’
‘সবই বোঝা যাবে ধীরে ধীরে, শহীদ বললো, ‘শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, আর কর্তব্যের কথা ভুললে চলবে না একমুহূর্তের জন্যেও। কিন্তু যথেষ্ট হয়েছে। আজকের মতো, তুই যা, গফুরকে খেতে দিতে বল, বড্ড খিদে পেয়েছে আমার।’
কামাল হেসে উঠে বললো, ‘তুই আমার মনের কথাটাই বলেছিস। কখন থেকে মনে হচ্ছে কোথায় যেন কি একটা গোলমাল ঘটেছে। সেটা যে আন্ত্রিক তা কিছুতেই ঠাহর করে উঠতে পরিনি!
কামালের কথা বলার ধরন দেখে হেসে উঠলো শহীদ। এমন সময় কুর ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
‘কি খবর বশীর আলী?’ শহীদ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো।
এখানে তো এখন কেউ নেই, দাদামণি, এখন আমি বশীর আলী হতে যাবো কোন্ দুঃখে।
নাহ্, তোকে নিয়ে আর পারা গেল না! আমার ভয় হয় তোর জন্যেই না আমাদের ছদ্মবেশ সব পণ্ড হয়ে যায়। | ‘সে তুমি কিছু ভেবো না, দাদামণি, গফুর একটুও না দমে বললো, ‘ লোকজনের
সামনে আদালী হয়েই থাকবো। কোনো ভুল হবে না।
‘তা খাবার-দাবারের কদুর বল দেখি,’ কামাল জিজ্ঞেস করলো।
খাবার তো দিয়েছি,’ গফুর বললো, ‘কিন্তু জানালাটা খোলা রাখলে চলবে না, দাদামণি।
‘কেন? জানালা খোলা রাখতে আপত্তি কিসের?’
‘পাহাড় দেখলে আমার ভয় করে, গফুর ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বললো, আর কালো মতো কি যেন একটা দেখলাম, ইয়া বড়
‘কোথায়। এতক্ষণ বলিসনি কেন?’ কামাল উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, ‘চল তো ‘দেখি।’
বলতে বলতে কামাল দ্রুত ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো। ওর পিছন পিছন শহীদ এবং গফুরও এলো। উঁচু পাহাড়ের ওপর ঘন গাছপালার দিকে আঙুল নির্দেশ করে গফুর বললো, ‘ওই যে, ওইখানটায় কালো মতো বিরাট একটা দেখলাম। ওইখানটায় নড়াচড়া করছিল, বড় একটা বাদুড়ের মতো, অতো বড় বাদুড় আমি জীবনে দেখ নাই, আমাকে দেখেই চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল।
শহীদ আর কামাল বেশ কিছুক্ষণ গফুরের নির্দেশিত জায়গাটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মিনিট দশেক সময় কেটে গেল প্রায়। কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না ওদের।
ও কিছু না, তোর চোখের ভুল, শহীদ বললো। আমি পষ্ট দেখলাম যে! ‘ভূত-টুত হবে হয়তো, কামাল বললো। ‘আমারও সেরকম সন্দেহ হয়, গফুর চিন্তিত কণ্ঠে বললো।
জানালাটা খোলাই থাক, শহীদ বললো। ‘অনেক দিন ধরে ভূত দেখার ইচ্ছে আমার, সুযোগটা হাতের কাছে পেয়ে ছাড়া উচিত হবে না।
খাওয়া-দাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নিয়ে শহীদ যখন উঠলো তখন বেলা শেষ হয়ে এসেছে। কামাল ঘুমিয়ে পড়েছিল। গফুর মেতে ছিলো মুরগী রান্না নিয়ে। মুরগী দুটো ডাইভার তিতু মিয়া জোগাড় করে এনে দিয়েছে। দাদামণি ভালো খাবার পেলে খুশি হয়, গফুর জানে। আর দাদামণিকে খুশি করতে পারলে সে আর কিছু চায় না। | কাপড়-চোপড় পরা শেষ করে কামালকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো শহীদ। তারপর– রাইফেলটা ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করতে লাগলো।
‘ওটা নিয়ে মেতে উঠেছিস যে হঠাৎ?’ চোখ মুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে শহীদের হাতের রাইফেলটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো কামাল। ২-
‘আজ আর প্ল্যান মতো কিছু করার সময় হাতে নেই,’ রাইফেলের নলের ভিতর এক চোখ রেখে বললো শহীদ, ‘ভেবেছিলাম জঙ্গলটার চারপাশে একটু ঘুরে ফিরে দেখবো,কিন্তু আপাততঃ তা কালকের জন্যে ভোলা থাক। তুই তৈরি হয়ে নে চটপট, বাংলোটার চারপাশটা একটু জরিপ করে নেবো আজ। | ‘কিন্তু সেজন্যে রাইফেল সঙ্গে নেয়ার কি দরকার?’ কামাল টাউজার পরতে পরতে বললো।
এ প্রশ্নের মানে কি, মি. রশীদ?’ মৃদু হেসে শহীদ বললো, ‘ফরেস্ট অফিসারের শিকার না করার অভ্যাসটা কি বেমানান নয়?
ওর রসিকতা শুনে হেসে উঠলো কামাল। খানিক পর বেরিয়ে পড়ল। দুজনে।
গভীর জঙ্গলে রাত কাটানো এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। পোকামাকড়ের একটানা অদ্ভুত সব। শব্দ, হাওয়া লেগে গাছের ডালে ডালে ঘষাঘষি শব্দ, বন্য জন্তু-জানোয়ারের অদ্ভুত ডাক, চিৎকার, নৈশ নিস্তব্ধতাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে যেন। কাছে পিঠে কোথাও ছুটোছুটি করছে শিয়াল, বনবিড়াল বা পাখা ঝাঁপটাচ্ছে বনমোরগ। ডেকে উঠছে রাত জাগা দু’একটা পাখি। এখানে পাহারাওয়ালার ডাক নেই, পথিকের বুটের শব্দ নেই, পুলিসের হুইসেলের শব্দ নেই, নেই যন্ত্রদানবের কর্ণপটাহবিদারণকারী শব্দ। উপভোগ করছিল শহীদ অদ্ভুত এই রাতটাকে।
এমন সময় আর্তমানুষের আতঙ্কিত চিৎকার নৈশ রাত্রির সমস্ত শব্দকে ছাপিয়ে শহীদের কানে এসে বাজলো। সচকিত হয়ে উঠলো সে। শব্দটা যেমন সহসা জেগে উঠেছিল তেমনি আবার কয়েক নিমেষের মধ্যেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বিচিত্র সব শব্দ আবার শোনা যেতে লাগলো।
শুনেছিস?’ কামালের গলা শুনতে পেলো শহীদ। ‘হু, শহীদ বললো। কামালও যে শব্দটা শুনেছে বুঝতে পারলো সে।
হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। কামালও। সেভেন এম. এম. উইনচেষ্টার রাইফেলটা মাথার বালিশের কাছেই আড়াআড়ি রাখা ছিলো, সেটা তুলে নিলো শহীদ। তারপর দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। পচি ব্যাটারির টর্চটা
জ্বালালো একবার। পরক্ষণেই শহাদ গম্ভীর গলায় ডাক দিলো, ‘কে?’
‘আমি স্যার! তিতু… ‘কি করছো তুমি ওখানে?’
আপনারা শোনেননি, স্যার? ওদিকটায় পাগলাবাবুর চিৎকার শুনলাম যেন, তাই বেরিয়ে এসেছি ঘর থেকে
তিতু মিয়ার গলার স্বরে চাপা উত্তেজনা প্রকাশ পাচ্ছে। ‘তুমি ঠিক জানো ওটা পাগলাবাবুরই চিৎকার?’ শহীদ জিজ্ঞেস করলো।
‘আমার কোনো ভুল হয়নি, স্যার। হলফ করে বলতে পারি ও চিৎকার পাগলাবাবুর
১৮
ছাড়া আর কারও নয়।’
‘উনি কি আজ একবারের জন্যেও ফেরেননি?’
‘না, স্যার। আজ সকাল থেকে ওনার দেখা পাইনি আর। তাছাড়া শুধু আজ নয়, রোজ রাতেই উনি এরকম বাইরে বাইরে কাটান।’
আর কখনও এ রকম চিৎকার শুনেছো?’ কামাল শহীদের ঘাড়ের পাশ থেকে বলে উঠলো।
‘না, সার।’ ‘শব্দটা এলো কোনদিক থেকে বলতে পারো?’
ড্রাইভার জঙ্গলের ডানদিকের অন্ধকারে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘ডানদিক মনে হলো, স্যার।
‘আমারও তাই মনে হলো যেন, কামাল বললো। ‘আসুন মিস্টার রশীদ, দেখা যাক। শহীদ কামালের উদ্দেশে কথাটা বললো।
কামাল টর্চ হাতে এগোলো শহীদের পাশাপাশি। বেশিদূর যেতে হলো না। প্রায় একশো গজ দূরে দেখা গেল একটা লোককে মাটিতে পড়ে থাকতে। কামাল টর্চের আলো ফেলতে দেখা গেল লোকটি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে। মরেনি। কোথায় আঘাত পেয়েছে তা-ও ঠিক বোঝা গেল না। গোঁ গোঁ করে একটা শব্দ বের হচ্ছে, লোকটার নাকমুখ দিয়ে।
ড্রাইভার তিতু মিয়া সামনে এগিয়ে এসে বললো, ‘ইনিই পাগলাবাবু, স্যার। রাইফেলটা কামালের হাতে দিয়ে হাঁটু গেড়ে লোকটার পাশে বসে পড়লো শহীদ।
পয়ে জখম হয়েছে লোকটার। গুরুতর কিছু নয়। হাঁটুর সামান্য নিচে কিছুটা চামড়া ছড়ে গেছে। রক্ত ঝরছে এখনও।
ধরাধরি করে লোকটাকে ড্রাইভারের ঘরে তুলে আনা হলো। শহীদ অবশ্য এলো সঙ্গে। সে অকুস্থলেই রয়ে গেল।
টর্চের উজ্জ্বল আলোয় কামাল দেখলো, না কামানো দাড়ি গোঁফ, চোখে অত্যন্ত ভারি পাওয়ারের চশমা, মাথায় পাহলওয়ানী ছাঁটের চুল, চোখে পিচুটি এবং অদ্ভুত বেঁটে ও রোগা শরীরের একটি মানুষ এই পাগলাবাবু। বয়স চল্লিশের কম নয়।
মিনিট দশেক পর ঘর থেকে ফাস্ট-এইডের বাক্সটা নিয়ে চিন্তিত মুখে হাজির হলো শহীদ।
জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল আহত লোকটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য চোখে-মুখে পানি ছিটাতেই জ্ঞান ফিরে এলো। ডাইভার তিতু মিয়ই প্রথম প্রশ্ন করলো, কি হয়েছিল আপনার?’
| লোকটা সে কথার উত্তর না দিয়ে শহীদ ও কামালের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘আমাকে উঠে বসতে দিন, আর আপনারা সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যান।’
১৯
শহীদ কিন্তু একটুও বিচলিত না হয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে এসে বললো, ‘তার আগে পরিচয় দিন মিস্টার
লোকটা সেই রকম ভারিকি চাল বজায় রেখে বললো, আমার নাম খোন্দকার হাবিবুর রহমান। আর আপনাদের পরিচয় আমার অজানা আছে ভেবেছেন? ফরেস্ট অফিসার আর তার সহকারী–তাই নয় কি? কিন্তু আমার পরিচয় এখনও আপনারা জানেন না নিশ্চয়–জানলে আমার হুকুম অমান্য করার স্পর্ধা আপনাদের কখনই হতা না। আমার পরিচয়ঃ আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। বিশালবনের জঙ্গলে মাকড়সা-রহস্য বের করার দায়িত্ব নিয়ে এখানে এসেছি–বুঝতে পেরেছেন? এখন যেতে পারেন আপনারা।’
কামাল শহীদের মুখের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো। মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এতো রাতে আপনি ওখানে কি করছিলেন, মিস্টার খোন্দকার?”
খোন্দকার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি আইনতঃ বাধ্য নই।
কামালের মুখে আর কথা জোগালো না।
শহীদ কামালকে মিস্টার খোন্দকারের জখমটা দেখিয়ে ব্যাণ্ডে জ করে দেবার ইঙ্গিত করে বললো, ‘আপনি একজন ডিটেকটিভ এ কথা জানতে পেরে খুব খুশি হলাম মিস্টার খোন্দকার। কেননা, এখানে আসার আগে শুনেছিলাম পরপর তিনজন ফরেস্ট অফিসার নাকি বিষাক্ত মাকড়সার কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখনও যদি এই বিষাক্ত মাকড়সা এই বাংলোর আশপাশে থেকে থাকে তবে সেটা বড় আশঙ্কার কথা। চাকরির জন্য এই জংলা দেশে এসে শেষ পর্যন্ত কি প্রাণ হারাবো! তা আপনি তো একজন ডিটেকটিভ, যাকে বলে কি না গোয়েন্দা। আপনি মাকড়সা-রহস্য ভেদ করতে এসেছেন জানতে পেরে খুব খুশি হলাম। আপনি বিষাক্ত মাকড়সা সমূলে ধ্বংস করতে সমর্থ হবেন আশা করি। আমি আমার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে আপনাকে যতটুকু পারি সাহায্য করবো। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেকার ঘটনাটির কোনো হদিসই আমি করতে পারছি না, মিস্টার খোন্দকার। আপনি বুঝি মাকড়সা ধরতে বেরিয়েছিলেন এতো রাতে? কিন্তু আপনার পায়ে রক্ত কেন? কিভাবে জখম হলেন?
‘আপনি ডিটেকটিভদের সম্বন্ধে সামান্যতম জ্ঞানও রাখেন না দেখছি, মিস্টার রুহুল আমিন। ডিটেকটিভরা মূলানুসন্ধান করে থাকে, গৌণ ব্যাপারে তাদের কোনো দায়িত্ব নেই, মিস্টার খোন্দকার অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলেন।
ভালমানুষের মতো মুখ করে শহীদ বললো, ‘আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম, মিস্টার খোন্দকার।
মুখে বিজ্ঞের হাসি ফুটিয়ে মি. খোন্দকার বললেন, ‘সেটা আপনার বোঝার কথাও নয়। কিন্তু আপনার সাহায্য আমার দরকার, মিস্টার রুহুল আমিন। আপনি আমায় সাহায্য করবেন আশা করি।’
‘নিশ্চয়। সে কথা তো আমি আগেই শুনিয়েছি আপনাকে। আর সে জন্যেই তো, যে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা কিছুক্ষণ আগে ঘটেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইছি আপনার কাছে।
ব্যাণ্ডে জ বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। মিস্টার খোন্দকার উঠে বসলেন বিছানার উপর। চশমাটা ঠিক কর নাকে লাগিয়ে নিলেন একবার, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘এক গ্লাস পানি।’
খানিক পরে ডাইভার তিতু মিয়া এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে দাঁড়ালো। মিস্টার খোন্দকার তাকে ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমি বলেছি না তুমি আমাকে কিছু খেতে দেবে না। যাও, নিয়ে যাও তোমার পানি।
| ওরা সবাই দাঁড়িয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। ডাইভার ঠকাস করে টেবিলের ওপর গ্লাসটা নামিয়ে বেখে একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। মিস্টার খোন্দকার চিৎকার করে উঠলেন, ‘লোকটাকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলুন তো, মিস্টার রুহুল আমিন। না, না আমিই হুকুম দিচ্ছি, ‘এই, তুমি বের হয়ে যাও ঘর থেকে, এখুনি! |
শহীদের ইঙ্গিতে তিতু ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল। মিস্টার খোন্দকার শহীদের দিকে সরে এসে ফিসফিস কণ্ঠে বললেন, ‘লোকটাকে বিশ্বাস করি না। আমার বিশ্বাস মাকড়সা-রহস্যের পিছনে ওরও একটা ভূমিকা আছে। অনেক কিছু জানি আমি ওর সম্পর্কে। মনে রাখবেন, আমাকে সাহায্য করতে হলে আমার উপদেশ মতো চলতে হবে আপনাকে। আমার প্রথম উপদেশঃ ডাইভার তিতু মিয়া লোকটাকে বিশ্বাস করবেন
মোটেই। দ্বিতীয় উপদেশঃ মনে প্রাণে বিশ্বাস করবেন মাকড়সার কামড়ে যে তিনজন ফরেস্ট অফিসার মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে সুপরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে। কোনো রকম দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়নি।’
কথাটা শুনে শহীদ যথাযথ স্তম্ভিত হবার ভান করলো। ‘দেয়ালেরও কান আছে
কথাটা বলে মিস্টার খোন্দকার প্রায় শোনা যায় না এমন নিচু গলায় বলতে শুরু করলেন তাঁর কথা।
| লোকটার রকম-সকম দেখে হেসে ফেলা উচিত হবে কি না তা ভেবে ঠিক করতে
পেরে কামাল অস্থির হয়ে উঠলো। ততক্ষণে মিস্টার খোন্দকার শহীদের কানের কাছে মুখ সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কি যেন বলছেন। মিনিটখানেক ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলো শহীদ কান পেতে। মিস্টার খোন্দকার তখনও ঠোঁট নাড়ছেন কানের কাছে। শহীদ হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বললো, ‘আপনার কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছি না, মিস্টার খোন্দকার বাঘ দেখলেন …বামটা আপনাকে কিছু না বলে আপনার পিছন পিছন আসছিল, তারপর আপনি আত্মরক্ষার জন্য গাছে চড়তে গিয়ে পড়ে যান। তারপর? তারপর কি হয়েছিল– একটু স্পষ্ট করে বলুন দিকি তারপর কি হয়েছিল।
শহীদের কথা শুনে মিস্টার খোন্দকার যেন হতবাক হয়ে গেলেন।
‘স্পষ্ট করে বলবো!
শহীদ বললো, ‘মানে একটু জোরে বলুন এরপর যা আপনার বলার আছে। একদম শুনতে পাচ্ছি না যে!
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন মিস্টার খোন্দকার। চাপা গলায় বললেন, ‘আমি আপনাকে সব কথা জোরে জোরে বলি আর ডাইভারের ছদ্মবেশে এই লোকটা জেনে ফেলুক আমার ধারণাগুলো। না, আপনাকেও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। সাবধান! রেহাই পাবেন না আমার হাত থেকে। কোনো সুযোগ নিতে চেষ্টা করলে ফল ভালো হবে না মনে রাখবেন।
| মিস্টার খোন্দকার চট করে এক লাফে ঘরের কোণে সরে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। শহীদ হতভম্বের মতো মুখ করে তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে।
| আবার শুরু হলো, ‘সন্দেহ আমার হাড়ে মজ্জায় মিশে আছে। নতুন ফরেস্ট অফিসার আসছে শুনে গাছের মাথায় চড়ে আগেই দেখে নিয়েছি সব। তখনই কেমন সন্দেহ হয়েছিল আমার এই মুহূর্তে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যান, নয়তো
চিৎকার শুনে ড্রাইভার তিতু মিয়া ঘরে এলে ঢুকেছিল। কামাল ও শহীদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাপারটা বুঝে নিলো সে। তারপর নিজের মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইলে, ‘মাথা খারাপ।’
যান বলছি। বেরিয়ে যান এখুনি!
নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো শহীদ। কামালও তার পিছু নিলো। সেই সঙ্গে একটি ছায়ামূর্তি ঘরের জানালাটার পাশ থেকে সরে দাঁড়ালো। ভয়ঙ্করদর্শন ছায়ামূর্তিটার কুটিল দৃষ্টির আওতায় এতক্ষণ ওরা বসে ছিল, কিছুই জানতে পারল না।
ঘরে ফিরে ঘড়ি দেখলো শহীদ। রাত তিনটে বাজে। ‘শুয়ে পড়, রাত শেষ হয়ে এলো প্রায়, শহীদ বলল কামালর দিকে তাকিয়ে।
‘ঘুম আসবে না আমার,’ কামাল বললো, ‘কুরকে উঠিয়ে চা করতে বলবে। ভাবছি।
শহীদ বললো, ‘আমি ঘুমোবো। তুই গফুরকে উঠিয়ে চায়ের কথা বলতে পারিস। রাত জাগার জন্য চা খুব ভালো। তারপর বললো, ‘তার চেয়েও ভালো কয়েকটা কথা বলি তোকে। কথাগুলো শুনলে একদম ঘুম আসতে চাইবে না। মিস্টার খোন্দকার কয়েকটা মিথ্যা কথা বলেছেন এবং কয়েকটা ব্যাপার লুকিয়ে রেখেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে।’
‘বলিস কি! ধরলি কি ভাবে? ‘এই দেখ
শহীদ পকেট থেকে একটা বুলেটের খোল বের করে কামালের হাত দিলো। তারপর খাটের তলা থেকে বের করে আনলো একটা মরা মনুরে মাথার খুলি। বললো, তোরা চলে আসার পর আমি পেয়েছি এ দুটো জিনিস। মরা মানুর খুলি অবশ্য আশা। করিনি। আর গুলির শব্দ আমরা কেউ শুনতে পাইনি বলে খালটা আশা করা যায় না
২২
বটে, কিন্তু আঘাতটা দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওটা বুলেটের কাজ। পিস্তলে, নিশ্চয় সাইলেন্সর লাগানো ছিলো। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম বুলেটটা, আর মরা মানুষের খুলিটাও পেয়ে গেলাম সেই সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে।
কামাল জিজ্ঞস করলো, ‘গুলিটা ছুঁড়েছিল কে? ‘কি করে বলি! ‘মরা মানুষের খুলিটাই ব কোত্থেকে এলো?’ ‘একই উত্তর আমারঃ বলতে পারি না এখনও কিছু।’ | কামাল কতক্ষণ একদৃষ্টে শহীদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, ‘মিস্টার খোন্দকার সম্পর্কে কি ধারণা হলো তোর?’
শহীদ ধীরে ধীরে বললো, ‘এরকম অদ্ভুত চরিত্রের লোক আমি খুব কম দেখেছি। কিন্তু ওর সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি এখনও।’
| ‘কিন্তু লোকটা মিথ্যা কথা বললো কেন? এ থেকে কিছু ধারণা করতে পারছিস
?”
কামালের অসহিষ্ণুতা দেখে হেসে ফেললো শহীদ। বললো, ‘না, এ থেকেও কিছু ধারণা করতে পারছি না। কিন্তু লোকটা সম্পর্কে তোর কি ধারণা?’
‘রহস্যজনক চরিত্রের লোক এবং বিপজ্জনকও বটে।’
শহীদ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বললো, আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। | তবে, ড্রাইভার তিতু মিয়াকে দেখা অবধি মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি লোকটাকে।
কিছুতেই মনে করতে পারছি না–কোথায়।
কামাল আর গফুরকে জাগায়নি। শহীদ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তে কামালও দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ পর তার অনুগামী হলো। তারপর দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লো অকাতরে।
তিন
সকালবেলা শহীদের ধাক্কায় কামালের ঘুম ভাঙলো। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো। কামাল, ‘শোবার সময় দরজা বন্ধ করিসনি কেন?’
কামাল আশ্চর্য হয়ে বললো, ‘কি বলছিস আবোল-তাবোল। দরজা আমি নিজের হাতে বন্ধ করে শুতে এসেছি।’
সন্দিগ্ধ কণ্ঠে শহীদ বললো, ‘ভালো করে স্মরণ করে দেখ দেখি, দরজা ঠিক বন্ধ করেছিলি তো?’
কামালের অসহিষ্ণু গলা শোনা গেল, ‘কি শুরু করেছিস বলতো কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে! দু’তিন ঘন্টা আগের ব্যাপার আর এখুনি আমি ভুলে যাবো?
শহীদ বললো, ‘বেশ। কিন্তু তারপর আবার উঠেছিলি?
‘না।’
তবে, দরজা খুললো কে?’
কামাল আশ্চর্য হয়ে বললো, ‘তোর কি মাথা খারাপ হলো নাকি? দরজা তো বন্ধই রয়েছে দেখছি।’
শহীদ বললো, ‘না, বন্ধ নেই। ছিটকিনি খোলা, শুধু ঠেলে ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে পাল্লা দুটো।’
‘তা কি করে সম্ভব?’
তড়াক করে খাট থেকে নামতে গোল কামাল। হঠাৎ শহীদ ওকে ধরে ফেলে বললো, ‘মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখ।
মেঝের দিকে চোখ পড়তে কামাল স্তম্ভিত হয়ে গেল। চোখ মুখে অবিশ্বাসের একটা রেখা মৃর্ত হয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। ঘরের সারা মেঝেতে মরে পড়ে রয়েছে কয়েক ডজন পাহাড়ী ইঁদুর। কামাল ভ্রূ কুঁচকে শহীদের দিকে তাকাতে শহীদ বললো, ‘এবার টেবিলের ওপর চেয়ে দ্যাখ |
| হতবাক হয়ে গেল কামাল। দেখলো, টেবিলের ওপর পাশাপাশি সাজানো রয়েছে মর মানুষের দুটো করোটি।
| ‘এ কি ভূতুড়ে কাণ্ড রে বাবা, কামাল বললো।
কামালের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে শহীদ সাবধানে খাট থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বেশ কিছুক্ষণ জানালা ও দরজাগুলো পরীক্ষা করে শহীদ তার সিদ্ধান্ত জানালো।
জানালা বা দরজা দিয়ে কেউ এ ঘরে প্রবেশ করেনি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। | কামাল এ কথার উত্তরে কিছু না বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়র মতো চেহারা করে তাকিয়ে রইলো শহীদের দিকে। তার যেন বাক স্ফুর্তি হচ্ছিলো না।
ঘন্টা দুয়েক পরের কথা।
ব্রেকফাস্ট সেরে কামাল উঠে দাঁড়ালো। শহীদ ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কোথায় চললি?’
‘সন্দেহ নিরসন করতে।
কিসের সন্দেহ?’ ‘মিস্টার খোন্দকার সম্পর্কে।
শহীদ এ কথার কোনো উত্তর দিলো না দেখে কামাল বললো, ‘তুই নিশ্চয় আপত্তি করবি না।’
হেসে ফেলে শহীদ বললো, ‘না। কিন্তু তোর প্ল্যানটা কি?’ ‘ওর মতামত জানতে চেষ্টা করবো, অনুরণ করবে। ওকে।’
শহীদ বললো, ‘বেশ। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরবি কিন্তু। জঙ্গলটায় আজ একবার ভালো করে ঘুরে দেখবো ভেবেছি।’
২১
মাথা নেড়ে বের হয়ে গেল কামাল।
কামাল বের হয়ে যেতেই শহীদ সোফা ছেড়ে পাহাড়ের দিককার জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো পাহাড়টার দিকে। হঠাৎ কি মনে করে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো সে। ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ি নিয়ে যেতে বললো স্টেশনের দিকে। সিগারেট আনতে হবে, বাজারও করে আনবে যা পাওয়া যায়।
গাড়ির শব্দ অনেক দূরে মিলিয়ে যেতে শহীদ ড্রাইভার তিতু মিয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। পকেট থেকে চাবির গোছা বের করলো একটা। তারপর একটার পর একটা চাবি নিয়ে দরজার তালা খোলবার চেষ্টা করলো। পাঁচ-ছ’টি চাবি দিয়ে চেষ্টা করবার পর সচল হলো।
ঘরটা ছোটো। একটা মাত্র তক্তপোষ ঘরে। হাঁড়িকুড়ি, চুলো, টিনের কৌটো, ছোটো ছোটো দুটো ট্রাঙ্ক, একটা বড় ট্রঙ্কি ইত্যাদি ঘরটার ভিতর অগোছালো ভাবে রাখা। মনোযোগ দিয়ে দেখলো শহীদ ঘরটার চেহারা। দু একটা জিনিস হাতে তুলে নেড়ে চেড়ে দেখলো। তারপর এক এক করে খুলে ফেললো সবকটা ট্রাঙ্ক। ছোটো দুটো ট্রাকের ভিতর উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই পেলো না সে। বড় ট্রাঙ্কটা খুলে ভিতরে হাত ঢাকাতেই আঙুলগুলো কেমন যেন পিছলে গেল। চোখের সামনে তুলে ধরলো শহীদ হাতটা। আশ্চর্য হয়ে দেখলো, তার হাতে সাদা পাউডার লেগে গেছে। ঝুঁকে পড়ে তাকালো শহীদ। দেখলো, ট্রাঙ্কের সব জিনিসের ওপর ছড়ানো রয়েছে সাদা পাউডার।
শার্ট-প্যান্ট, কাগজপত্র, ছদ্মবেশ ধারণের সস্তা একধরনের ছেলেমানুষী সরঞ্জাম, এক বালি সরু দড়ি ইত্যাদি হরেক রকম জিনিসে ট্রাঙ্কটা ভরা। কাগজের বাক্সে ভরা একটা জিনিস দেখে প্রথমে চমকে উঠলো শহীদ। কিন্তু পরক্ষণে সেটা হাতে তুলে নিয়ে। তার মুখে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি। অসংখ্য বই দেখা গেল ট্রাঙ্কের সর্বশেষ স্তরে। বই গুলো দেখে আবার একবার হাসলো শহীদ আপন মনে। কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে একটা ঠিকানা পেলো শহীদ। একটা ডায়েরীও পেলো। ভিতরে নাম লেখাঃ মিস্টার হোসেন, ফরেস্ট অফিসার অত বিশালপুর। চিরকুটে লেখা ঠিকানা আর ডায়েরীটা পকেটে রাখলো শহীদ। তারপর যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে তালা বন্ধ করে ফিরে এলো সে।
মিস্টার খোন্দকারকে বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুজি করার পর বিকল হয়ে ফিরে আসছিল কামাল। জঙ্গলের বেশ খানিকটা ভিতরে চলে গিয়েছিল সে। পথ চিনে ঠিক ঠিক ফিরে আসতে পারবে কি না সে সন্দেহও ছিলো মনে। হঠাৎ একটা গাছের ওপর নজর পড়তে চমকে উঠে থেমে গোল কামাল।
মিস্টার খোন্দকার একটা উঁচু গাছের ওপর বসে দূরের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখতে চেষ্টা করছেন। কামালকে তিনি দেখতে পাননি। একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কামাল কিছুক্ষণ দেখলো মিস্টার খোন্দকারের মতিগতি। তারপর কাছাকাছি
একটা উঁচু গাছে চড়ে বসলো।
মিস্টার খোন্দকারের দৃষ্টি অনুসরণ করে কামাল কিছুই দেখতে পেলো না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বুঝতে পারলো যে লোকটা আসলে বাঞ্ছিত অবাঞ্ছিত কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, দেখতে পাবে এই আশায় এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মাত্র।
| কৌতূহলী হয়ে উঠলো কামাল। লোকটার সম্পর্কে এমনিতেই যথেষ্ট সন্দেহ জনেছে তার। অপেক্ষা করে দেখা যাক আর কতদূর কি জানা যায়।
সময় গড়িয়ে চললো। লোকটা তেমনি বসে আছে গাছের মাথায়। দৃষ্টি সবসময়ই তার দূরের দিকে। কি যে খুজছে লোকটা বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। কামাল হঠাৎ লক্ষ্য করলে লোকটার হাতে কয়েকখানা সাদা কাগজ। কিছুক্ষণ পর পর কি যেন লিখছেন বলে মনে হলো তার।
ঘন্টা দেড়েক কটলো এই ভাব। ঘড়িতে তখন দুপুর দুটো বাজে। এমন সময় নামতে শুরু করলো লোকটা গাছ থেকে। ধীরে ধীরে অতি সাবধানে নামলো সে। মাটিতে পা দিয়ে কান খাড়া করে কি যেন শুনতে চেষ্টা করলো একমনে। এদিক ওদিক তাকালো সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে। তারপর সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলল।
| গাছ থেকে নেমে কামালও অনুসরণ করলো মিস্টার খোন্দকারকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে নিরাশই হতে হলো। ঘন্টাখানেক লোকটাকে একনাগাড়ে অনুসরণ করার পর। কামাল বুঝতে পারলো তারা এখন বাংলার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। মিস্টার খোন্দকার সম্পর্কে কি ধারণা করবে তা যেন কামাল ভেবে ঠিক করতে পারলো না।
পরদিন দুপুরবেলা মিস্টার খোন্দকারের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হয়ে এলো শহীদ ও কামাল। ড্রাইভার তিতু মিয়ার গলাও শোনা যাচ্ছে। ধমক মারছে মিস্টার খোন্দকার ড্রাইভারকে। বেজায় চোটপাট শুরু করে দিয়েছে।
‘কি হয়েছে সাহেব, এতো চিৎকার করছেন কেন?’ কামাল সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওদের। কাঁদ কাঁদ মুখ করে ড্রাইভার শহীদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
‘স্যার, আমি আজ থেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যাবে। এই পাগলাবাবু আমার জীবন অতিষ্ঠ কর তুলছেন, আপনি আমায় দয়া করে রেহাই দিন।
‘কি বলছেন উনি?’ শান্ত গলায় জানতে চাইলো শহীদ।
দেখবেন, আসুন স্যার, কি অসম্ভব পাগলামী।’
ডাইভার তিতু মিয়া কথাটা বলে হাত নেড়ে ওদেরকে অনুসরণ করতে বলে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো। পিছন পিছন ঢুকলে শহীদ, কামাল ও মিস্টার খোন্দকার।
মিস্টার খোন্দকার ড্রাইভার তিতু মিয়ার দিকে তীব্র অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সর্বক্ষণ। অন্য কোনো দিকে তাঁর মনোযোগ নেই। | ঘরের ভিতর ঢুকে শহীদ দেখতে পেলো মেঝেতে দশ-বারোটা কাগজ ছড়ানো
রয়েছে। দেয়ালেও আঠা দিয়ে আঁটা রয়েছে কয়েকটা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সবগুit কাগজেই আঁকা রয়েছে ছোটো বড় মাকড়সার ছবি।
| ড্রাইভার তিতু মিয়া অসহায় কণ্ঠে অভিযোগ করলো, ‘এই যে স্যার এই মাকড়সার ছবিগুলো উনি এতক্ষণ আমাকে ঘাড় গুঁজে দেখতে বাধ্য করছিলেন। আমি যতোই বলি, আমি দেখবো না। উনি ততই রেগে ওঠেন। আচ্ছা, আপনিই বলুন স্যার
কঠিন গলায় মিস্টার খোন্দকার শহীদের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললো, ‘বিশ্বাস করবেন না, মিস্টার রুহুল আমিন, লোকটার কথা। সাইকোলোজিকেল পরীক্ষা ছিলো এটা আমার। ধার নিতে পারেন আই হ্যাভ সাকসিডেড। আর ও যে এখান থেকে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে চায় সেটা একটা ভাঁওতা। খবরদার! ওকে যেতে দেবেন না! আর মাত্র কয়েকদিন পরই ওর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবো বলে আশা রাখি।’
শহীদ কোনো উচ্চবাচ্য করলো না। কামালও চুপ। ড্রাইভার তিতু মিয়া করুণ মুখ করে তাকিয়ে রইলো শহীদের পানে।
মিস্টার খোন্দকার হঠাৎ শহীদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘আমার কথা বুঝতে পারছেন না, তাই না? আচ্ছা, মিস্টার রুহুল আমিন, আমি
আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি কি?’
শহীদ নিঃশব্দে ঘড়ি দোলালো।
‘তবে চলুন আপনার ঘরে, শোনাবা আপনাকে ওর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগের ভিত্তিগুলো।
শহীদকে এক প্রকার ঠেলতে ঠেলতেই মিস্টার খোন্দকার ঘর থেকে বের করে আনলো।
| ঘরের বাইরে পা রেখেই থমকে দাঁড়ালো শহীদ। দেখতে পেলো, গফুরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত আকৃতির দশ-বারো জন লোক। বেটে, কালো, লোহার মতো শক্ত মাংসপেশীর অধিকারী লোকগুলো। এর জংলী অধিবাসী।
দ্রুত এগিয়ে গেল শহীদ একটা বিপদ আশঙ্কা করে। শহীদের পায়ের শব্দে ফিরে তাকালো লোকগুলো। গফুরকে ছেড়ে দিয়ে ওরা ঘুরে দাঁড়ালা একে একে।
| দৈত্যের মতো একজন লোক সবাইকে ছাড়িয়ে শহীদের সামনে এসে দু’হাত সামনে দুলিয়ে চোখ কুচকে তাকালো। কি করা উচিত ভেবে পেল নী শহীদ।
কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলো লোকটা শহীদকে। ভীটার মতো বড় বড় লাল চোখ লোকটার। কানে অসংখ্য তামার বালা, পরনে নেংটিমাত্র সম্বল, গলায় মোটা এবং ভারি একটা তামার ছোটো সাইকেলের চাকার মতো বস্তু। রং-বেরঙের মোতির মালাও। পরেছে লোকটা। অস্বস্তিবোধে জর্জরিত হতে লাগলো শহীদ। এতক্ষণ একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি কেউ। আচমকা গম্ভীর গলায় ঘড় ঘড় করে উঠলো লোকটি, ‘তু কেন
এসেছিস এখানে?
কামাল ও ড্রাইভার ততক্ষণে শহীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ড্রাইভার ফিসফিস করে বললো, কথা বলার সময় হাসতে হবে, স্যার!’ শান্ত ভাব না দেখালে চটে যাবে ওরা।
জংলী লোকটা হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠলো, ‘তু কে বটে? | ড্রাইভার তিতু মিয়া থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। শহীদের মুখে একটু হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল। শহীদ মাথা ঝাঁকিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কাজ কাম দেখা শোনা করতে এসেছি, জঙ্গলের মানুষের ভালো মন্দ দেখতে এসেছি। তোমরাই তো জঙ্গলের মানুষ, তোমাদের কোনো অসুবিধা থাকলে আমাকে বলবে, আমি সব শুনবো তোমাদের কথা, সবরকম সুবিধের ব্যবস্থা করে দেবো। বুঝতে পারছো তো আমার কথা?
| আদিবাসীরা মনোয়োগ দিয়ে শুনলে শহীদের কথা। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কি যেন আলোচনাও করলো। কিন্তু সর্দারের মতো লোকটা তখনও নিশ্চল। হঠাৎ সে উঠলো, ‘তু হটে না বাবু, সব্বেনাশ হবে, দেওতা গোসা হলো-তু হটে যা বাবু।
| লোকটি শেষের কথাগুলো বলে অনুরোধে যেন ভেঙে পড়লো।
পকেট থেকে সিগারেট বের করলো শহীদ। প্যাকেটটা লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ভালমানুষের মতো প্রশ্ন করলো, তোমার নাম কি?’
একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করে প্যাকেটটা নিয়ে লোকটি বললো, ‘আতাকু নাম আছে। কিন্তুক, আমার কণা তু কেলিস না বাবু, সব্বেনাশ হবে আমাদের-তু জানিস না…
অনেকক্ষণ পর আতাকু তার দলবল নিয়ে চলে গেল। আদিবাসী সর্দার সন্তুষ্ট হতে পারেনি মোটেই। শহীদ তাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে এই জঙ্গলে থাকা না থাকাটা তার নিজের ওপর নির্ভর করে না। তবু আতাকু যখন বলছে ওদের দেবতা গোনা করেছেন সভ্য-মানুষদের প্রতি তখন সে কথা অবিশ্বাস করা যায় না। সে চেষ্টা করবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেত। কিন্তু কবে যে যেতে পারবে তা বলতে পারছে না। আতাকু অনেক কথা শোনালো শহীদকে। রহস্যময় ছায়া দেখা যায় বনভূমিতে, পাহাড়ে, গাছের ডালে ডালে। মরা মানুষের খুলি ছুঁড়ে মারে দেবতা পাপীদের উদ্দেশ্যে, চারপেয়ে বাঘ পলকের মধ্যে রূপ নেয় দুপেয়ে মানুযে। সবই
দেবতাদের কাজ। সভ্য মানুষকে এই জঙ্গল ছেড়ে চলে যেতে হলে তাই তেনারা ভয়। দেখাচ্ছেন। কেউ যদি তা গ্রাহ্য করে তবে তার শাস্তি মৃত্যু। এ পর্যন্ত তিনজন সভা মানুষকে তেনারা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন এই বাংলো থেকেই। এতে করেই কি ব্যাপারটা বোঝা যায় না? তবে কেন নতুন বাবুরা আবার আসেন এখানে? এতো অবাধ্য হয় কেন সভ্য মানুষ? তাদের ভয়-ডর নাই?
আদিবাসীরা চলে যেতে মিস্টার খোন্দকারকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো শহীদ। তাঁকে চেয়ারে বসতে বলে শহীদ প্রশ্ন করলো, ‘চা খাবেন, মিস্টার খান্দকার?
২৮
খাবো?’ চিন্তান্বিত স্বরে বললেন মিস্টার খোন্দকার, ‘খেতে পারি, কিন্তু আপনার চাকরটা বিশ্বস্ত তো?’
শহীদ হাসলো মনে মনে। কিন্তু প্রকাশ্যে গুরুত্ব দিয়ে বললো, ‘নিশ্চয়ই।
তারপর রান্নাঘরের দিকে মুখ করে বললো, ‘বশীর, এখানে দু’কাপ চা দিয়ে যাস।
তা শুনুন, মিস্টার রুহুল আমিন, শুরু করলেন মিস্টার খোন্দকার, ড্রাইভারের বিরুদ্ধে আমার সন্দেহ ভিত্তিহীন নয় এ কথা আপনাকে বোঝাতে চাই। প্রথমতঃ ধরুন, লোকটা বিশালবনে আছে আজ সাত মাস ধরে আচ্ছা, মিস্টার রুহুল আমিন, যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাই ঘটুক না কেন তার চেহারা বার বার একই রকম হতে পারে
নিশ্চই–পারে কি?’
শহীদ সমর্থনসূচক উত্তর দিলো, ‘না, পারে না।
‘তবেই বুঝুন! এখানে সেই অসম্ভব ঘটনাই ঘটেছে। এবং এর কারণ কি? এর কারণ এগুলো কোনমতেই দুর্ঘটনা নয়। এর পিছনে কাজ করছে বিরাট একটা রহস্য যার সমাধান বের করা সহজ নয়। কিন্তু সহজ নয় বলেই, আমার মতো মানুষের, মানে ডিটেকটিভদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলে না। সমাধান বের করার জন্য এগিয়ে আসতেই হয়। মিস্টার হোসেন ছিলেন আমার বন্ধু। হঠাৎ একদিন শুনলাম, না কাগজে পড়লাম, হোসেন বিশালপুরে মারা গেছে বিষাক্ত, মাকড়সার কামড়ে। শুধু হোসেনই নয়, জানা গেল এর আগেও দুজন অফিসার নাকি জ্যামাইকা-মাকড়সার কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অথচ, মাকড়সা তো খোঁজ করে মেলেইনি, এ জাতীয় মাকড়সা নাকি আমাদের দেশে থাকতেই পারে না। ব্যস! আর কিছু জানবার দরকার ছিলো কি? ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম বিশালপুরের উদ্দেশে। .
‘সাত মাস ধরে আছে ড্রাইভার লোকটা। এই ক’ মাসে তিনজন মানুষ মাকড়সার কামড়ে মারা গেল–অথচ ভেবে দেখুন একবার, ওর গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগলো না। এটা কি সন্দেহের কারণ নয়? ওকে কয়েক দিন অনুরণ করে দেখেছি কয়জন লোকের সঙ্গে গভীর জঙ্গলে গিয়ে দেখা করে। তারপর আমি ওকে ফিরতি পথে একদিন আক্রমণ করে বসলাম। আমাকে চিনতে পেরেছিল বোধ হয়, কিংবা কেন জানি না ঠিক, আমাকে আঘাত করলো না। ওকে মারাত্মক জখম করে বেঁধে ফেলবার চেষ্টা করেছিলাম আমি। কিন্তু সেটা সম্ভবপর হয়নি। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেদিন আমি রিভলভারটা নিয়ে বের হইনি, পায়ে ইট মেরে জখম করেছিলাম।’
আবার ফিসফিস কণ্ঠে শুরু করলেন মিস্টার খোন্দকার। আর জানেন, হোসেনের ডায়েরীটাও পাচ্ছি না।’
মিস্টার খোন্দকার, যখন শহীদের ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। শহীদ কামালকে ডেকে জঙ্গলের আশপাশটা ঘুরে দেখে আসতে বললো
২৯
একবার। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে বলে কামাল তখুনি বের হয়ে গেল। কামাল চলে বেতই শহীদ কাপড়-চোপড় পরে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললো। কথায় কথায় জেনে নিলো পোস্ট অফিসটা স্টেশনের কোন দিকে। তারপর একাই গাড়িতে চড়ে বসলো।
এমন সময় গফুর সামনে এসে দাঁড়ালো।
কি, বশির মিয়া, কিছু বলবে নাকি?’ শহীদ ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।’
আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে গকুর অভিযোগ করলো, ‘দাদামণি, আমার দাড়ি ভালো লাগছে না মোটে। আয়নায় দেখলাম চেহারাটা। ঠিক যেন আট বছরের বুড়ো মনে হলো, চিনতেই পারলাম না নিজেকে। আর তাছাড়া অসুবিধাও কতো, সর্বক্ষণ সুড় সুড় করে।’
শহীদ মনে মনে হেসে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘তোকে বলছি না, বারবার ও কথা আমাকে শোনাবি না।’
মাথা নিচু করে গফুর বললো, সে আমার খুব মনে আছে, দাদামণি। কিন্তু শুধু একবার আমি আমাকে দেখতে চাই।’
শহীদ বলল, ‘এই গবেট, তুই নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না।’
গফুর দাড়িতে আঙুল ঠেকিয়ে বললো, ‘এই লোক আমি নই, দাদামণি। দাড়ি গোঁফ ছাড়া একবার নিজেকে দেখবো আয়নায়, তা না হলে বিশ্বাস হচ্ছে না এখানকার আমি আগেকার আমি কি না।’ | হাসি চাপতে পারলো না’ এবান শহীদ। কিন্তু ধমক দিয়ে বললো, ‘সরে যা হাদারাম, আবার ও কথা বললে মজাটা টের পাবি।’
| গফুর কোনো কথা না বলে গম্ভীর মুখে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। শহীদ স্টার্ট দিলো গাড়িতে।
পোস্টাফিস থেকে বেরিয়ে বাংলোর দিকে এগুতে লাগলো শহীদ। কিছু দূর এগোতেই পিছন থেকে গড় গড় করে একটা শব্দ উঠলো। পিছন ফিরে তাকাতে চমকে উঠলো শহীদ। দেখলো পিছনে সীটের নিচে গড়াগড়ি যাচ্ছে একটা মরা মানুষের মাথার খুলি। | ঠিক সন্ধ্যার সময় গম্ভীর মুখে ফিরলো শহীদ। কামাল তখনও ফেরেনি দেখে অবাক হলে একটু। ঘরে গিয়ে বসলো চিন্তিত মুখে। গফুর চা দিয়ে গেল এক সময়। শহীদ চুপচাপ বসে না থেকে মিস্টার খোন্দকারের ট্রাঙ্ক থেকে পাওয়া হোসেন সাহেবের ডায়েরীটা পড়তে শুরু করলো মনোযোগ সহকারে।
রাত ক্রমেই বেড়ে চললো। কামালের ফেরার নাম নেই তবু। কিছুক্ষণ পর পর চিন্তিত মুখে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে লাগলো শহীদ। সে ভাবছিল, কামাল পথ হারিয়ে ফেলেছে হয়তো কিংবা মিস্টার খোন্দকারকে অনুসরণ করতে গিয়ে গাছের মাথায় চড়ে
,
সে আছে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখবে, মনে মনে এই কথা ভেবে শহীদ চেয়ারে বসলো আবার ডায়েরীটায় চোখ মেলে। হঠাৎ সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলো শহদের সদাজাগ্রত চেতনা! এদিক ওদিক তাকালো বার বার। তারপর কান পেতে শোনবার চেষ্টা করলো কি রান। কোথা থেকে যেন একটা শব্দ আসছে। ঘড় ঘড় করে ভারি কোনো জিনিস যেন পাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে অন্যরকম শব্দও শোনা যেতে লাগলো। আছড়ে ফেলে ভারি কিছু ভাঙা হচ্ছে যেন। অতি অস্পষ্ট শব্দটা, কিন্তু অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছে, অতি কাছেই যেন শব্দটার উৎস। চঞ্চল হয়ে উঠলো শহীদের সন্দেহপ্রবণ মনটা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। কিন্তু বুঝতে পারলো না ভালো করে। একবার মনে হলো শব্দটা বাইরে থেকেই আসছে, বাইর বের হতে কিন্তু শব্দ আর শুনতে পাওয়া গেল না। ঘরে ঢুকতেই আবার সেই রহস্যময় শব্দটা শোনা যেতে লাগলো। পাথরের দেয়াল অনেকক্ষণ কান পেতে রইলো শহীদ, পাথরের মেঝেতেও কান পেতে বুঝতে চেষ্টা করলো শব্দটার উৎস। কিন্তু বৃথাই সব চেষ্টা। ঘর্মাক্ত কলেবরে ছুটোছুটি করে বেড়াতে লাগ বা শহীদ। মুখ চোখে উত্তেজনার চিহ্ন, কপালে চিন্তারেখা, চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে একটা কঠিন প্রশ্নঃ কোথায়? কোথা থেকে আসছে এই রহস্যময় শব্দ?
সময় কাটাতে লাগলো। অসহ্য লাগছে শহীদের। ছটফট করতে লাগলো সে। পাগলের মতো দেখাচ্ছে তাকে। এক সময় স্থির হয়ে দাঁড়ালো শহীদ। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড় মুখ কপাল মুছে স্থির হয়ে ভাবতে চেষ্টা করলো ব্যাপারটা। এতোটা দিশেহারা হয়ে পড়া উচিত হয়নি তার। তার পক্ষে ব্যাপারটা ছেলেমানুষই হয়ে গেছে, ভাবলো শহীদ। শব্দটা আশ্চর্য হয়ে যাবার মতোই একটা ঘটনা, শব্দ একটা হচ্ছে, অথচ ঘন্টা দুয়েক চেষ্টা করেও তার কোনো হদিস বের করতে পারলো না। এতে বরং তারলজ্জিতই হওয়া উচিত, উত্তেজিত না হয়।
হাত ঘড়িতে সময় দেখে রাইফেলটা হাতে তুলে নিলো শহীদ। রাত নটা বাজে। ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো শহীদ শীতকালের রাত নটা কম কথা নয়। কামালের কথা ভেবে কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো শহীদের। পথ হারিয়ে ফেললো নাকি? গফুরকে দিয়ে ব্রাইভার তিতু মিয়াকে ডাকিয়ে এনে প্রশ্ন করলো, ‘মিস্টার খোন্দকার কোথায়?’
তিতু মিয়া জানালো পাগলা বাবু ফেরেননি এখনও। মিস্টার রশীদের না ফেরার কথা শুনে তিতু মিয়া বললো সে খুঁজে দেখবে কি না।
শহীদ বললো, ‘।’ মিস্টার রশীদ বাংলোর কাছাকাছি কোথাও নেই, সুতরাং, খুঁজে কোনো লাভ হবে না। নিশ্চয় তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন–এখন বরং রাইফেলের শব্দ করে মিস্টার রশীদের সাড়া নেয়া যাক।
পর পর চারবার শব্দ করলো শহীদ আকাশের দিকে লক্ষ্য করে। রাইফেল ছোঁড়া শেষ হতে তিতু মিয়া নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরে ফিরে শহীদ গফুরকে খাবার দিতে
বললো। কামালের অনুপস্থিতিতে গফুরের মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে দেখে শহীদ আশ্বাস দিলো ওকে।
রাইফেলের আওয়াজ করার পর এক ঘন্টা সময় কেটে গেল। ঘরের ভিতর সেই অস্বস্তিকর শব্দ তেমনি হচ্ছে। শহীদ ঘর ছেড়ে আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বারান্দার এক কোণে গফুরও দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় কামাল ক্লান্ত পায়ে ফিরে আসছে দেখতে পেলো ওরা। ধীরে ধীরে হাঁটছে কামাল। যেন কতো অসুস্থ।
দূর থেকে ওকে দেখতে পেয়ে অজানা একটা আশঙ্কায় শহীদের মনটা শিউর উঠালো। শব্দ করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি খবর, মিস্টার রশীদ, জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন নাকি?’
কোনো উত্তর দিলো না কামাল। মহুর পদক্ষেপে এগিয়ে এলো। শহীদের দিকে একবার মাত্র অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে ধপাস করে বসে পড়লো বিছানার ওপর। পিছন পিছন ঘরে ঢুকলো শহীদ। আশ্চর্য! ঘরের ভিতরের রহস্যময় শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না!
স্থির দৃষ্টিতে তাকালো শহীদ কামালের দিকে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কামাল বসে আছে বিছানার ওপর।
‘কি হয়েছে রে কামাল, এতো নার্ভাস হয়ে পড়েছিল যে?
মুখ থেকে হাত সরিয়ে কামাল নির্বাক তাকালো। তার চোখ-মুখে একটা হতচকিত ভাব ফুটে রয়েছে দেখতে পেলো শহীদ। কিছুক্ষণ শহীদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে সে বললো, ‘এক গ্লাস পানি।
গফুর পানি এনে দিতে ঢক ঢক করে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে বললো, ‘আর এক গ্লাস।’
কামালের পানি পান করার ধুম দেখে মনে মনে মা হেসে পারলো না শহীদ।
কামালের দিকে মুখ করে একটা চেয়ারে বসে শহীদ বললো, ‘এবার বল দিকি ব্যাপারটা কি? তুই যেন খুব ভয় পেয়েছিল বলে মনে হচ্ছে।
খানিকক্ষণ পর স্থির হয়ে কামাল বললোঃ বনের আশপাশটা দেখে ফিরে আসার পথে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। দ্রুত পায়েই ফিরছিল সে। হঠাৎ দূরে কোথাও নারী কণ্ঠের খিল খিল হাসির শব্দ শুনে সে থমকে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ শোনার পর তার ম হলো হাসির শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে যেন। নির্জন বনভূমিতে সন্ধ্যা লগ্নে হাসিটা ক্রমেই বেড়ে চললো। রহস্যময়ী কে এক নারী উন্মাদিনীর মতো হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে যেন। হঠাৎ তার মনে হলো ক্রমেই আবার দূরে সরে যাচ্ছে খিল খিল হাসিটা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একেবারে মিলিয়েও গেল না। যেন কোনো এক ছলনাময়ী নারী হেসেই চলেছে। এক মুহূর্তের জন্যেও বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। রোমাঞ্চিত হলেও ভয় সে
তখনও পায়নি। প্রবল একটা কৌতূহল পেয়ে বসলো তাকে। একবার ভাবলো। বাংলোতেই ফিরে যায়। কিন্তু মন তাতে সায় দিলো না। হাসির শব্দটা যেদিক থেকে
৩২
আসছে সেদিক পানেই এগোতে থাকলো সে। তখন বনে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে। অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে এগোতে থাকলো সে। আরও খানিকটা এগিয়ে যেতে হঠাৎ থেমে গুলি শব্দটা। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ালো সে। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো। কিন্তু শুনতে পেলো না আর কিছু। নির্জন বনভূমি আবার নিঃশব্দ হয়ে গেল। যেন এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল কামাল। এইবার বাংলোর দিকে ফিরে আসবে বলে পা বাড়ালো কামাল। কিন্তু হঠাৎ পিছনে খিল খিল করে হেসে উঠলো সেই নারীকণ্ঠ। চমকে উঠলো কামাল। বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়ালো সে। কিন্তু বনভূমির, নিশ্চিদ্র তমিস্রা ভেদ করে কিছুই ঠাহর করতে পারলো না। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে। থেকেও অন্ধকার ভেদ করে কোনো নারীর আবছা চেহারাও চোখে পড়লো না তার। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। বিলম্বিত লয়ে ধীরে ধীরে হাসিটা মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্ত পরেই আবার চমকে উঠলো কামাল। এবার নারী কণ্ঠের সেই ভয় জাগানো হাসি মাত্র হাত কয়েক দূর থেকে ভেসে এলো। পাগলের মতো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো কামাল, কে! কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিলো না তার সে প্রশ্নের। আবার চিৎকার করে উঠলো কামাল। কিন্তু এরারও কেউ উত্তর দিলো না, থামলো না সে পাগল করা হাসি। কে যেন দমকে দমকে গড়িয়ে পড়তে পড়তে একটানা হেসেই চলেছে-বিরামহীন। এভাবেই চলতে লাগলো মিনিটের পর মিনিট ধরে। সাহস হারিয়ে ফেলেছিল কামাল। হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে অল্প কিছুক্ষণের জন্য। তারপর হাসির শব্দ লক্ষ্য করে অন্ধকারে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে সে। ফল হলো না কিছুই। একটা একটা করে শেষ হয়ে ঢোল রিভলভারের ছ’টা গুলি। শেষ গুলিটা ছুঁড়বার পরই বন্ধ হয়ে যায় মহাযন্ত্রণাকর হাসির খিল খিল শব্দটা। তারও বেশ কিছুক্ষণ পর চারবার গুলি ছোঁড়ার শব্দ শুনতে পায় সে। তখন ওই গুলির আওয়াজ তাকে যথেষ্ট সাহস জোগায়। সে ক্লান্ত পায়ে বাংলা অভিমুখে অগ্রসর হয়।
কামালের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে গম্ভীর হয়ে উঠলো শহীদের মুখ। কামাল প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছিল, ইতিমধ্যে সে তার কাহিনী শেষ করে বললো, তোর কি মনে হয়, শহীদ? আমি তো একেবারে পাড় হয়ে গেছি!”
শহীদ দুহাতের খাপের মধ্যে থুতনি রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক, কিন্তু রহস্যজনক যে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
‘প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করিস, শহীদ?’ কামাল হঠাৎ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো।
মৃদু হাসলো শহীদ, ‘বিশ্বাস-বিশ্বাসের কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?’
‘তুই বলছিস, ব্যাপারটা উদ্দেশামূলক। কিন্তু এতে করে কার কি উদ্দেশ্য সিদ্ধি হচ্ছে তাতো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’
শহীদ বললো, আমি একটা ডায়েরী পেয়েছি–ডায়েরীটাতেও ওই অদ্ভুত রহস্যময় হাসির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ডায়েরীটা মিস্টার হোসেনের।’
কামাল বললো, ‘তাই নাকি! কিন্তু কি বলতে চাইছিস তুই? মিস্টার হোসেন কি ৩-
এই হাসিটাকে উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করেছিলেন? মনে করে থাকলে তিনি কি ধরতে পেরেছিলেন এতে কার কি উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে?’ | শহীদ বললো, ‘না। ওর ধারণা ছিলো নারীকণ্ঠের এই ভৌতিক হাসি কোনো না কোনো ব্যর্থ প্রেমিকার অশান্ত প্রেতাত্মার।’
একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো কামাল শহীদের মুখের দিকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলা সে। তার চোখেমুখে ফুটে উঠলো গভীর চিন্তার ছাপ।
চার
বিশালবনের বাংলোর চারপাশে ঘটতে লাগলো আজব সব ঘটনা। শহীদের প্রতিটি রাত কাটতে লাগলো বিনিদ্র। উৎসহীন, অস্বস্তিকর শব্দ, রহস্যময়ী নারীর খিল খিল হামি এবং মরা মানুষের শূন্যগর্ভ করোটি ছাড়াও আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার প্রতিদিনই ঘটতে লাগলো।
একদিন রাতে বাতিটা কমিয়ে দিয়ে বিছানায় না গিয়ে শহীদ চেয়ারে বসলো একটা সিগারেট ধরি।
কামাল বললো, ‘কি রে, বলি যে, শুবি না নাকি? রহস্য করে শহীদ বললো, ‘এক ঘন্টা পর।’ ‘কেন?’ ‘হাউই দেখবো!’ ‘হাউই! কোথায় রে?’
শহীদ বললো, ‘জঙ্গলের ভিতর।’
ওর কথা বুঝতে না পেরে কামাল বিছানার উপর উঠে বসলো। বললো, ‘জঙ্গলের ভিতর হাউই? তা তুই ঘরের ভিতর বসে সেটা দেখবি কেমন করে?’
মৃদু হেসে শহীদ বললো, ‘ঘরে বসেই দেখা যাবে। তুইও দেখতে পারিস। কামালের অসহিষ্ণু গলা শোনা গেল, ‘হেলি করার অভেস্যটা ছাড় দেখি তুই।
শহীদ বললো, ‘আর মাত্র এক ঘন্টা অপেক্ষা কর, তাহলেই বুঝবি হেয়ালি করছি কি না।’
প্রায় একঘন্টা পর ঘড়ি দেয়ে শহীদ জানালার পাশে গিয়ে বাইরে দৃষ্টি ফেলে বললো, ‘আর পাঁচ মিনিট পর।’
মিনিট দুই অপেক্ষা করার পর কামাল জঙ্গলের গভীর অন্ধকারে চোখ রেখে বলে। উঠলো, ‘অন্ধকারে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।’
ঠাট্টা করে শহীদ উত্তর দিল, ‘আলোর নিচেই তত অন্ধকার বেশি।’
কামাল এ কথার কোনো উত্তর দিলো না। অন্ধকার বনানীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখে প্রতীক্ষার আভাস।
৩৪
| ঠিক মিনিট তিনেক পর দেখা গেল বনানীর একটা দিক উজ্জ্বল করে দ্রুত উঠে িেল একটা হাউই আকাশের দিকে। অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে হাউইটা লাল মোতির মালা হয়ে বাতাসে ভাসতে লাগলো। তারপর কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই নিভে গেল সেটা।
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল গফুরের। ঘুম ভাঙতেই তার দাদামণির ঘর থেকে কেমন যেন একটা ‘ধুপ’ শব্দ শুনতে পেলো সে। তড়াক করে বিছানা ছেড়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো গফুর। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিয়ে সন্তর্পণে শহীদের ঘরের জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভিতরে দৃষ্টি ফেলতেই একটা আঁতকে ওঠার শব্দ বেরিয়ে এলো ওর গলা দিয়ে। দেখলো একটা কালো পোশাক পরিহিত ছায়ামূর্তি ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অসতর্ক গফুরের কণ্ঠ থেকে শব্দটা বের হতেই ছায়ামূর্তিটা চকিতে ঘরের এককোণে সরে গেল। শহীদের মশারির ভিতরটা গফুর দেখতে পেলো না। দাদামণির বিপদের আশঙ্কায় চঞ্চল হয়ে উঠলো সে। মুহূর্তের মধ্যেই সে তার কর্তব্য স্থির করে ফেললো। একলাফে জানালার কাছে থেকে সরে এসে দরজার উপর দমাদম কিল ঘুসি লাথি মারতে লাগলো সে। আর গলা ফাটিয়ে ‘সাহেব, দরজা খোলেন–ও সাহেব! বলে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলো। কিন্তু দরজা তো খুললই না, ঘরের ভিতর থেকে এমন কি একটি শব্দও বের হলো না। গফুর একবার। ভাবলা দরজাটা ভেঙে ফেলবে কি না। তারপর কি মনে করে আবার জানালার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলো। ছায়ামূর্তিটিকে এবার দেখা গেল না। গফুর মনে মনে ভাবলো, নিশ্চয়ই ঘরের কোণে লুকিয়ে আছে বেটা। কিন্তু তার দাদামণির ঘুম ভাঙছে না কেন এই ভাবনা তাকে আশঙ্কায় জর্জরিত করতে লাগলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ়র মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে। এমন সময় অন্ধকারে শহীদের গলা শোনা গেল, ‘এক পা নড়ার চেষ্টা করেছো কি মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো।
ঘরের বাইরে শহীদের গলা শুনে আশ্বস্ত হয়ে দু’হাত মাথার ওপরে তুলে দাঁড়ালো গফুর। কেউ পিস্তল বাগিয়ে যদি হাত তুলে দাঁড়াতে বলে আর তুমি যদি নিরস্ত্র হও তাহলে তখনকার মতো মাথার ওপরে হাত তুলে দাঁড়ানোই ভালোশহীদের এই কথাটি গকুর অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখেছে। কিন্তু উত্তেজিত কণ্ঠে সে বলে উঠলো, ‘সব্বোনাশ হয়ে গেছে, সাহেব।
শহীদ ও কামাল গফুরের মুখ থেকে ব্যাপারটা কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই জেনে নিলা। দরজার তালাটা দ্রুত হাতে খুলে শহীদ আর কামাল রিভলভার হাতে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো। এক ঝটকায় দরজার পাল্লা দুটো খুলে ভিতরে টর্চের আলো ফেললো শহীদ। পরক্ষণেই গর্জে উঠলো দুজনের রিভলভার, গুডুমগুডুম…গুড়ুম।
| রিভলভারের, শব্দ মিলিয়ে যেতে স্তম্ভিত হয়ে ওরা তাকিয়ে রইলো ঘরের মেঝের দিক। মেঝেতে দশহাতী একটা অজগর পড়ে আছে, নিথর।
কাশা-১০
৩৫
গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে এক পা পিছিয়ে এসেছিল ওরা। টর্চের আলোয় দেখলো অজগরটা নিথর পড়ে আছে। গুলি বিশাল অজগরের মাথা ঘেঁচে দিলেও অজগরট। সঙ্গে সঙ্গে নির্জীব হয়ে যাবে না। শহীদ ফিসফিস কণ্ঠে উচ্চারণ করলো, ‘অজগরটা মরাই ছিলো।
টর্চের আলো সারা ঘরময় ফেলে দেখে নিয়ে ওরা ঘরের ভিতর ঢুকলো মরা অজগরটার পাশ কাটিয়ে। ঘরে কারও অস্তিত্ব নেই দেখে হতবাক হয়ে গেল গফুর।
কোথায় গেল, দাদামণি, লোকটা?’ শহীদের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো গফুর।
শহীদ আর কামাল ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে বের হয়েছিল প্রতি রাতে আকাশে নিক্ষিপ্ত হাউইয়ের ব্যাপারটার সন্ধান করতে। আন্দাজমত একটা জায়গায় গিয়ে সবচেয়ে উঁচু একটা গাছে চড়ে বসে ওরা দেখতে পেলো বাংলাটা সেখান থেকে নজর করা যায়। গাছে বসেই ওরা অপেক্ষা করছিল। এমন সময় শোনা গেল রহস্যময়ী সেই নারীর পাগল করে দেয়া খিল খিল হাসি। অদৃশ্য নারীকণ্ঠের অস্বস্তিকর এই হাসি শুনে ওরা একসময় ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গাছ থেকে নেমে পড়ে খোঁজ করতে চেষ্টা করলা এর উৎস। কিন্তু, বৃথাই সে চেষ্টা। কোনো হদিস করতে পারলো না ওরা।
হাসির শব্দটা লক্ষ্য করে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল ওরা। শহীদ বললো, ‘হাউইয়ের ব্যাপারটা আজ স্থগিতই থাক।’
পরিশ্রান্ত শরীরে চিন্তামগ্ন হয়ে ফিরে আসছিল ওরা। এমন সময় বারান্দায় গফুরকে দেখে চিনতে না পেরে রিভলভার উঁচিয়ে গর্জন করে উঠেছিল শহীদ।
এই ঘটনার ক’দিন পরের কথা।
রাত দশটা বাজে অথচ কামাল ফিরছে না দেখে শহীদ ড্রয়ার থেকে রিভলভারটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে পড়লো। ধীর পায়ে হাঁটছিল সে। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো তাকে। চকিতে একটা গাছের আড়ালে সরে গিয়ে দেখলো, তিতু মিয়ার ঘর থেকে বের হয়ে এলো একটা ছায়ামূর্তি। চাঁদের আলোয় নেমে এলো লোকটা সতর্ক পদক্ষেপে। বিস্মিত শহীদ দেখলো, ছায়ামূর্তি আর কেউ নয়, স্বয়ং তিতু মিয়া।
রিভলভারটা পকেটে হাত দিয়ে পরখ করে নিলো শহীদ। তারপর তিতু মিয়ার চলন্ত শরীরটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সেও এগোতে লাগলো এক পা এক পা করে।
পায়ে চলা সঙ্কীর্ণ একটা পথ ধরে হাঁটছে তিতু মিয়া। কিছুদূর এগোতেই চওড়া একটা রাস্তা পাওয়া গেল। এবার বেশ দ্রুত পায়েই হাঁটতে লাগলো তিতু মিয়া। পিছন পিছন নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করলো শহীদ।
মিনিট পাঁচেক অনুসরণ করার পর শহীদ বুঝতে পারলো তিতু মিয়া পাহাড়টা লক্ষ্য
রে হাটছে। ততক্ষণে পাহাড়টার কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ের পাথর ধর ধরে একটু একটু করে ওপরে উঠতে শুরু করল fতু মিয়া। এখন আর অনুসরণ করা ঠিক হবে না, ভাবলো শহীদ। জায়গাটা বেশ
ক}} তিতু একবার নিচের পানে তাকালেই চাঁদের আলোয় তাকে দেখে ফেলবে নিশ্চিত। যতক্ষণ না তিতু পাহাড়ের কিছুটা ওপরে উঠে একটি পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল ততক্ষণ অপেক্ষা করে রইলো শহীদ। তারপর সতর্ক পায়ে এক প্রকার ছুটেই পাহাড়টার পাদদেশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর উপরে উঠতে শুরু করলো। কিছুদূর উঠেই একটা সমতল জায়গা দেখতে পেলো শহীদ। প্ৰকাণ্ড প্রকাও পাথরের চাঁই দাঁড় রানো রয়েছে চারপাশে। চাঁদের আলো পাথরগুলোর ওপর পড়াতে আলোছায়ার অদ্ভুত একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে সমতল জায়গাটাতে।
চারপাশে তাকিয়ে তিতুকে কোথাও দেখতে পেলো না শহীদ। এক পা এক পা করে এগিয়ে একটা বড় আকারের পাথরের আড়ালে দাঁড়ালো সে। পাথরের আড়ালে আড়ালে থেকে সন্তর্পণে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো তিতুকে।
মিনিট দশেক কেটে যাবার পর দূরে একটা ছায়াকে নড়াচড়া করতে দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো শহীদ। তারপর এগোতে লাগলো ছায়াটা লক্ষ্য করে। ছায়াটা তিতু মিয়ারই। আশ্চর্য হয়ে শহীদ লক্ষ্য করলো তিতু মিয়া কি যেন খুঁজছে চারদিকে তন্ন তন্ন করে। একটা থেকে আরেকটা পাথরের দিকে সরে সরে গিয়ে চঞ্চল ভাবে খোঁজার আর বিরাম নেই তিতু মিয়ার। শহীদ লোকটার কার্যকলাপ দেখে কিছুই বুঝতে পারলো না।
আধঘন্টারও বেশি সময় খুঁজে চললো তিতু মিয়া। শহীদ ঠায় পাহাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে পর্যবেক্ষণ করলো তিতু মিয়ার ব্যর্থতা। কি যেন খুঁজছে লোকটা অথচ হদিস করতে পারছে না জিনিসটার।
| হঠাৎ একটা উজ্জ্বল আলোর আভা দেখা গেল চারদিকে। থমকে থেমে গেল তিতু মিয়া। শহীদও দেখলো, জঙ্গলের দিক থেকে আকাশে উঠে গেছে একটা হাউই। আকাশে উঠে গিয়ে হাউইটা একটা লাল মোতির মালার মতো জ্বলে আছে। বাতাসে। ভাসতে লাগলো হাউইটা। তারপর একসময় নিবে গেল মোতির দানাগুলো একে একে।
তিতু মিয়া হাউইটা দেখেই লুকিয়ে পড়ছে শহীদের মাত্র পাঁচ গজ দুরে একটি পাথরের আড়ালে। মিনিট পনেরো কেটে গেল নিঃশব্দে। তিতু মিয়া বের হচ্ছে না পাথরের আড়াল থেকে। লোকটার উপস্থিতি টের পাচ্ছে শহীদ। যেন কারও আগমনের
অপেক্ষা করছে সে।
শহীদও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলো পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষায়।
আর মাত্র ক’মিনিট পরই দেখা গেল অত্যন্ত নিচু একটি ছায়াকে শ্লথ, মন্থর গতিতে ওদের দিকে আসতে। কাছাকাছি আসতে শহীদ দেখলো ছায়াটি চতুষ্পদ জন্তুর। আরও এগিয়ে এলো জন্তুটা। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল জটা একটা বাঘ। বিশালবন
৩৭
বাঘও আছে এ কথা জানা ছিলো না শহীদের। থাকলে নিশ্চয়ই শুনত সে। কিন্তু অবিশ্বাস করার উপায় নেই। চোখের সামনে জলজ্যান্ত প্রমাণ এগিয়ে আসছে।
আত্মরক্ষার জন্য রিভলভারটা আঁকড়ে ধরলো শহীদ। হঠাৎ শহীদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়লো বাঘটার চোখ দুটো জ্বল জ্বল কার জ্বলছে না। আশ্চর্য তো! একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো শহীদ। কেমন যেন সন্দেহ হলো তার। এবং সেই মুহূর্তেই আবছা সন্দেহটা বিশ্বাসে পরিণত হয় িেল শহীদের চোখে। তিতু মিয়া যে পাথরটার আড়াল লুকিয়ে ছিলো তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়েছিল বাঘটা। চোখের পলকে চারপেয়ে জন্তুটাকে দুপেয়ে একটা মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যেতে দেখলো শহীদ।
| বাঘের ছাপমারা খোলসটা খুলে সেটা পাথরের ওপর রাখলো লোকটা। তারপর হঠাৎ দেখে ফেললো তিতু মিয়াকে। তিতু মিয়া কিছু বুঝে উঠবার আগেই একলাফে এগিয়ে গিয়ে লোকটি তাকে জাপটে ধরলো। হুমড়ি খেয়ে পড়লো দুজনই। শব্দ হতে লাগলো ধ্বস্তাধ্বস্তির। তিতু মিয়া বুঝতে পারেনি বলে পড়ে গিয়েছিল আচমকা ধাক্কা খেয়ে। কিন্তু তার শরীরেও শক্তি কম নয়। আক্রমণকারী তিতাকে ধাক্কা মেরে ফেলে। দিয়ে বুকের ওপর উঠে বসে ঘুসি চালাতে লাগলো এলোপাতাড়ি। কয়েক মুহূর্ত পর তিতু মিয়া লোকটাকে দুপায়ের প্যাঁচে আঁকড়ে ধরে ছুঁড়ে দিলো বুকের ওপর থেকে। পরক্ষণেই দুজনে উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো পরস্পরের দিকে হিংস্রভাবে তাকিয়ে। তারপর তিতু মিয়া ছুটে গিয়ে ঘুসি চালালো আক্রমণকারীর নাক বরাবর। প্রচণ্ড একটা ঘুনি খেয়েও লোকটা পড়ে গেল না। ঘুসি থেকে নাকটা বাঁচাতে গিয়ে একটু সরে গিয়েছিল শুধু, ঘুসিটা লাগলো মুখে। দ্বিতীয়বার আঘাত করার আগেই তীব্র একটা লাথি মারলো লোকটা তিতুর তলপেট লক্ষ্য করে। অদ্ভুত একটা কোঁৎ শব্দ করে দূর ছিটকে পড়লো তিতু মিয়া। আক্রমণকারী একলাফে এগিয়ে গিয়ে আবার চেপে বসলো তিতু মিয়ার বুকে, লোহার মতো দুটো হাত দিয়ে সাঁড়ালির মতো করে দশ আঙুলে চেপে ধরলো তিতুর কণ্ঠনালী। গলা থেকে আক্রমণকারীর হাত সরিয়ে দেবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো তিতু। কিন্তু ক্রমেই গলার চাপ বাড়তে লাগলো তার, কিছুই করতে পারছে না সে আক্রমণকারীর। শহীদ বুঝতে পারলো তিতুর শক্তিতে আর কুলোচ্ছে না। আক্রমণকারী দম বন্ধ করে ওকে এবার মেরেই ফেলবে নিশ্চিত।
| আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলো না শহীদ। রিভলভারের ট্রিগারটা পর পর দুবার টিপলো সে। একটা পাথরের গায়ে গিয়ে লাগলো গুলি দুটো। গুলির শব্দেই কাজ হলো। আক্রমণকারী তিতুকে ছেড়ে দিয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ছোটো বড় পাথরের চাঁই টপকে পালিয়ে গেল।
ছাড়া পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে তিতু মিয়া। ততক্ষণে শহীদ এক পা পিছনে সরে গিয়ে আবার পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। এদিক-ওদিক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে তিতু মিয়া আস্তে উচ্চারণ করলো, ভাইয়া!
| শহীদ ভাবলো, তিতু মিয়া আবার ‘ভাইয়া’ বলে ডাকে কাকে দ্বিতীয়বার তিতুর ৩৮
গলা শোনা গেল, ভাইয়া, কোথায় আপনি?
কোনো দিক থেকে কেউ সাড়া দিলো না দেখে তিতু মিয়া হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
চিন্তিত মনে ভাবছিল শহীদ, কে এই ‘ভাইয়া, লোকটা, তিতু যাকে শ্রদ্ধাপূর্ণ কণ্ঠে ডাকছে বার বার?
| ততক্ষণে কোনো উত্তর না পেয়ে তিতু মিয়া ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেছে। গুলির শব্দ শুনে তিতু মিয়া ভাবছে এ তার ভাইয়ার কাজ। তিতু মিয়ার ভাইয়ার সঙ্গে তিতুর কি সম্পর্ক সে কথাই ভাবছিল শহীদ। আক্রমণকারী লোকটাই বা কে? কেন এসেছিল এরা এই পাহাড়ে? কি খুজছিল তিতু মিয়া পাথরের ফাঁকে ফাঁকে অন কর? হাউইটা কে এবং কেন জঙ্গলের ভিতর থেকে আকাশের দিকে ছোঁড়ে?’।
প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর আপাততঃ খুঁজে পেলো না শহীদ। মনে মনে হেসে ফেললো সে। ভাবলা, এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে
। অনুসরণ করতে হবে তিতু মিয়াকে। তিতু মিয়া যে ছদ্মবেশ ধারণ করে আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর, তিতু মিয়ার আসল পরিচয় যেমন করে হোক তাকে
জানতেই হবে।
পাহাড় থেকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেছে তিতু মিয়া। শহীদ দ্রুত পাহাড় থেকে নেমে পড়ল। তারপর জোর কদমে হাঁটাতে লাগলো। কিছুটা দূরে তিতু মিয়াকে আবার দেখতে পেলো সে।
| তিতু মিয়া পায়ে চলা পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে। দ্রুত, পায়ে হাঁটছে সে। শহীদও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করতে লাগলো তাকে।
| বাংলোর দিকে না গিয়ে তিতু জঙ্গলের গভীরতর অঞ্চলের দিকে হাঁটতে লাগলো। তিতু মিয়া এদিক ওদিক তাকাচ্ছে না। সোজা হেঁটে যাচ্ছে জঙ্গলের দিকে। পাতার ফাঁক দিয়ে ছিটেফোঁটা চাঁদের আলো পিছলে পড়েছে বনভূমিতে। প্রায় অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে গভীর জঙ্গলের চারপাশটা।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর তিতু মিয়াকে একটা ঝোঁপের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে দেখা গেল। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো শহীদের দৃষ্টি। হঠাৎ তিতু দু’কদম এগিয়ে ঝোঁপটার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। গুটি গুটি এগোল শহীদ ঝোঁপটা লক্ষ্য করে। নিঃশব্দে ঝোঁপটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঝোঁপটা হাত দিয়ে ফাঁক করে ভিতরে তাকাবে কি না ভাবছে শহীদ, এমন সময় হঠাৎ তিতুর গলা শুনতে পেয়ে হাতটা গুটিয়ে নিলো সাবধানে।
কাদের সঙ্গে যেন কথা বলছে তিতু মিয়া। তিতু মিয়ার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শহীদ শুনতে পেলো, ‘ভাইয়া কোথায় তোরা জানিস কেউ?
‘ কে যেন উত্তর দিলো, ‘ভাইয়ার খোঁজ করার দরকার কি রে, পাগলা। তিনি দেখছেন, সব শুনছেন। প্রয়োজন ঘটলে তিনি নিজেই এসে দেখা দেবেন। এতো উতলা হবার মতো কি ঘটেছে?
তিতুর গলা শোনা গেল, তা আর জানি না তেবেছিস? কিন্তু সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটেছে আজ। ভাইয়াকে সব জানানো দরকার।’
| তৃতীয় আরেকজনের গলা শোনা গেল, ‘তুই পাহাড়ের দিক থেকে এলি বলে মনে হলো। খুঁজে পেলি কিছু। | তিতু বললো, ‘খুজতেই তো গিয়েছিলাম। খুঁজে না পেলেও আজ ঠিক জানতে পারতাম শিকলটা কোথায়। বিশ্বাসঘাতকদের একজন লোক যে আমাকে দেখে ফেললো, খুব খানিকক্ষণ মারামারি হলো, শেষ পর্যন্ত আমি হয়তো মারাই যেতাম, এমন সময় রিভলভারের গুলি ছুড়লো কে জানি না, অমনি লোকটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। আমি ভাবলাম, গুলি নিশ্চয়ই ভাইয়া ছড়েছেন, কিন্তু কোনো খোঁজ পেলাম না। তাই ছুটতে ছুটতে চলে এসেছি এখানে।’
প্রথমজন বললো, ‘গুলি তাহলে ভাইয়াই ছুঁড়েছেন। অন্যজন বললো, ‘তাই-ই হবে। কোনো বিশেষ কারণে হয়তো উত্তর দেননি।’ প্রথমজনের গলা শোনা গেল আবার, ‘নতুন ফরেস্ট অফিসার তোকে সন্দেহ করনি
তিতু বললো, মনে হয় না।
তিতুর কথা শুনে নিঃশব্দে হাসলো শহীদ। কিন্তু হাসিটা ঠোঁট থেকে মিলিয়ে যাবার আগেই সে আক্রান্ত হলো ভয়াবহভাবে। পিছনদিক থেকে পাঁচজন লোক একসঙ্গে শহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে মাটিতে। রিভলভারটাও ছিটকে পড়ে গেল অদূরে। মাটি থেকে শহাদকে নিজের চেষ্টায় উঠতে হলো না।
আক্রমণকারীরা হেঁচকা টানে তাকে দাঁড় করিয়ে ঘুসি বাগিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল হিংস্রভাবে। কিন্তু শহীদের দুহাতের দুটো মুঠোর প্রচণ্ড আঘাতে পলকের মধ্যে দুজন আক্রমণকারী কাতরে উঠে মাটিতে বসে পড়লো। একজন লোক পিছন থেকে শহীদের চুলের মুঠি ধরে ঝুলে পড়েছে ততক্ষণ। আর একজন ঘুসি বাগিয়ে গণ্ডারের মতো ছুটে আসছে। অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো পরক্ষণেই।
শহীদ সামনের আক্রমণকারীর বুক লক্ষ্য করে নিজের পা দুটো শূন্যে ছুঁড়ে দিলো। পা দুটো সিধা গিয়ে ধাক্কা দিলো লোকটার বুকে। এদিকে লোকটার বুকে জোড়া লাথি মেরেই শহীদ শূন্য থেকে চিত হয়ে মাটির দিকে পড়তে লাগলো। শহীদের পিছনের চুল ধরে ঝুলছিল যে লোকটা সে ব্যাপারটা তখনও বুঝতে পারেনি। বুঝলো, যখন শহীদ নিজের শরীরের সম্পূর্ণ ভারটা নিয়ে লোকটার ওপর ধপাস করে পড়লো। লোক দুজনের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে শহীদ উঠে দাঁড়ালো দ্রুত। দেখুলো, তিতু মিয়া এবং তার সঙ্গে আরও দুজন লোক ধস্তাধ্বস্তি করছে তিনজন লোকের সঙ্গে। এদিকে দুজন লোক এগিয়ে আসছে শহীদকে লক্ষ্য করে। শহীদ নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল বলে লোকগুলোর সাহস যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল। একজন এক লাফে এগিয়ে এসে একটা যুসি মারলো শহীদের মুখ লক্ষ্য কর। লোকটাকে বুঝতে না দিয়ে আচমকা বসে পড়লো ৪০
|
শহীদ। ঘুসিটা উঁচিয়ে ধরে পিছন থেকে ঠেলে দিলো। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল লোকটা। তার দিকে ফিরে না তাকিয়ে শহীদ সামনে আর একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখে রুখে দাঁড়ালো। ঠিক তখুনি শহীদ হঠাৎ লক্ষ্য করলা, তিতু মিয়া আর তার সঙ্গের লোক দুজন নেই। আক্রমণকারী লোকটা শহীদের পলকের অন্যমনস্কতার সুযোগ পেয়ে গোল। প্রচণ্ড একটা ঘুসি এসে লাগলা শহীদের মুখে। লোকটাকে পালটা আঘাত হানতে অবশ্য ভুল হলো না শহীদের। দ্বিতীয় ঘুনিটা মুখে লাগার আগেই একটা তীব্র লাথি ঝাড়লো শহীদ। কিন্তু লাথিটা জায়গা মতো লাগলো না। লোকটা একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার এগিয়ে আসতে লাগলো। হঠাৎ শহীদ দেখতে পেলো মাত্র কয়েক হাত দূরে পড়ে রয়েছে তার রিভলভারটা। কিন্তু এগিয়ে যাওয়া আর হলো না শহীদের। আচমকা পিছন থেকে একটা মোেটা লাঠির ঘা খেয়ে যন্ত্রণায় যেন মরে যেতে থাকলো শহীদ। ঘুরে উঠলো মাথাটা, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যেতে লাগলো, এর ওপর প্রচণ্ড একটা ঘুসি এসে লাগলো তার ডান চোয়ালে, পড়ে হোল শহীদ মাটিতে। জ্ঞান হারায়নি সে। কিন্তু এ এক অদ্ভুত অবস্থা। যন্ত্রণায় হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। শহীদ টের পেলো বুকের ওপর চেপে বসে গলা টিপে ধরেছে একজন লোক, আর একজন তার পা দুটো চেপে ধরে আছে, তারপর চোখ দুটো কোনমতে সামান্য একটু খুলেই দেখতে পেলো। আরও একজন লোক তীক্ষ্ণধার একখানা ছোরা তার বুক লক্ষ্য করে উঁচিয়ে ধরে কুৎসিত হাসিতে ভরিয়ে রেখেছে মুখ। মুহূর্তের মধ্যেই বসিয়ে দেবে আমূল ছোরা শহীদের বুকে। এমন সময় গুডুমগুডুমডুমতিনবার শব্দ শোনা ৫লি রিভলভারের। একটা গুলি এসে লাগলো যে লোকটা শহীদের বুক লক্ষ্য করে ছোরা উঁচিয়ে ছিলো তার ডান, হাতে। ছোরাটা ছিটকে পড়ে গেল তার হাত থেকে। উঃ! বলে কাতরে উঠলো লোকটা। দ্বিতীয় এবং তৃতায় গুলিটা লাগলো যে লোকটা শহীদের গলা চেপে ধরে দম বন্ধ রেখেছিল তার দুহাতের কনুই বরাবর। যে লোকটা শহীদের পা দুটো শক্ত করে চেপে ধরেছিল সে গুলির শব্দ শুনেই সবার আগে প্রাণভয়ে সটকে পড়েছে। বাকি দুজন আহত অবস্থায় পালিয়ে গেল।
মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তখনও শহীদের। তবু ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। মনে হলো পড়ে যাবে। কিন্তু চেষ্টা করে বসে থেকে সামনে চোখ মেলে দেখতে পেলো কালো- আলখেল্লাধারী একটা বিশাল ছায়ামূর্তিকে চকিতে গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যেতে।
কে এই রহস্যময় প্রাণরক্ষাকারী? তিতু মিয়ার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করলো যারা তাদের হাতে অবধারিত মৃত্যু ঘটতো তার। আজ কালো আলখেল্লাধারী বিশাল চেহারার ওই ছায়ামূর্তিটা সময়মত গুলি না ছুঁড়লে সে নির্ঘাত মারা পড়তো। রহস্যময় এই লোকটিরই দলের কেউ নাকি তিতু মিয়া? পরস্পর বিরোধী দুটি দল বিশালবনের জঙ্গলে বিচরণ করছে। কি এদের উদ্দেশ্য? মাকড়সা রহস্যের সাথে এদের কোথাও একটা যোগাযোগ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কিসের যোগাযোগ? গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে
পড়লো শহীদ। কোথায় যেন বিরাট একটা ফাঁক রয়ে গেছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো প্রশ্ন জাগলো তার মানে, আলখেল্লাধারী লোকটা কুয়াশা নয় তো?
‘ কুয়াশার নাম মনে পড়তেই গভীর শ্রদ্ধায় ভরে গেল শহীদের মন। কতবার মৃত্যুর অবধারিত ছোবল থেকে তাকে রক্ষা করছে কুয়াশা। কুয়াশার সঙ্গে শেষবার দেখা হওয়ার কথাটা মনে পড়লো তারঃ সেবার কুয়াশাই তাদেরকে রক্ষা করেছিল বার্তকের জংলীদের কবল থেকে। শয়তান নুরবক্সকে হাতের মুঠোয় পেয়েও কুয়াশা তাকে আঘাত করেনি। অসহায় শত্রুকে আঘাত করতে তার বিবেক বেধেছিল।
ঘড়ি দেখলো শহীদ। রেডিয়াম দেয়া ঘন্টার কাটাটা রাত তিনটের ঘর জ্বল জ্বাল করছে। রিভলভারটার খোঁজে এদিক-ওদিক তাকালো। কোথাও দেখতে পেলো না। সেটা। তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে উঃ করে বসে পড়লো হঠাৎ! তার পা’টা ভয়ানক ভাবে মচকে গেছে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল সে, তাই তখন পয়র আঘাতের কথাটা ভুলেই গিয়েছিল।
কষ্ট হচ্ছিলো খুব, তবু অতি কষ্টে বাম পায়ের ওপর ভর করে উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর ঝুঁকে পড়ে রিভলভারটার খোঁজে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এদিক সেদিক হাতড়ে বেড়াতে লাগলো। বেশ কতক্ষণ খোঁজাখুজির পর পাওয়া গেল সেটা।
| রিভলভারটা পকেটে পুরে ধীরে ধীরে বাংলোর দিকে হাঁটতে লাগলো শহীদ।
পাঁচ
দিগভ্রান্ত মেষশাবকের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কাল। গভীর জঙ্গল তার চারপাশ। পায়ে চলার পথগুলো এখনও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। কিন্তু ক্লান্তিতে তো বটেই, ভয়তও সে পথের কোনো একটিকে ধরে এগিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছে না সে। আজ সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি তার। খিদেতে এমনিতেই কাহিল হয়ে পড়ার কথা, আর সীমাহীন হাঁটাহাঁটি করছে সে। ক্লান্তিতে শরীর যে অবশ হয়ে আসতে চায় তার। ইচ্ছে করছে শুয়ে পড়ে। খেতে না পাক, অন্তত শরীরটাকে কিছুটা বিশ্রাম দেয়া দরকার। কিন্তু এখন সে কথা ভাবাই যায় না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এমন সময় গভীর জঙ্গলে ক্লান্ত-শ্রান্ত-ক্ষুধার্ত মানুষের শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম করার বাসনা বিলাসচিন্তার সামিল। নিশাচর জানোয়াররা বের হয়ে আসবে একটু পরেই। এমন অসহায় শিকার পেলে বর্ত যাবে তারা। মহোৎসব শুরু হয়ে যাবে তাদের মধ্যে। ছিঁড়ে, কামড়ে, চুষে, করে। ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবে তার চিরতরে।
আপাততঃ একটা উঁচু ডালে উঠে বসবে ভাবলো কামাল।
এমন সময় দুরাগত একটা শব্দ কানে ভেসে এলো কামালের। ঢোল-মাদলের শব্দ হচ্ছে। শব্দটা আসছে উত্তর দিক থেকে। ক’মহুর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইলো কামাল। তারপর শব্দটা লক্ষ্য করে পায়ে চলা একটা পথ ধরে হাঁটতে লাগলো সে। ৪২
মাত্র ক’ এগিয়েছে কামাল, এমন সময় নারীকণ্ঠের তীব্র আর্তচিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ালো সে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়েই ছুটতে শুরু করলো শব্দটা লক্ষ্য কর। কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেলো একজন লোক আদিবাসী একটি যুবতাঁকে ধর আছে শক্ত করে, আর একজন লোক মেয়েটির মুখ কাপড় দিয়ে বেধে ফেলার চেষ্টা করছে। কামাল দেখেই বুঝলো লোক দুজন আদিবাসী নয়।
কালবিলম্ব না করে কামাল অগ্রসর হলো ওদের দিকে।
লোক দুজনও ইতিমধ্যে কামালকে দেখতে পেয়েছে। তাদের একজন যুবতাকে শক্ত করে ধরে রেখে কি যেন বললো অপরজনকে। অপরজন রুখে দাঁড়ালা হিংস্রতঙ্গীতে কামালের দিকে। কামলি ছুটে গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটার ওপর।
সরে দাঁড়ালো লোকটা তার আগেই। কামাল টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল মাটিতে। লোকটা কামালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গোল আবার, কিন্তু কামাল সরে গোল খানিকটা মাটিতে গড়িয়ে, তারপর এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো।
লোকটিও ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সে এগিয়ে আসার আগেই কামাল প্রচণ্ড একটা ঘুসি মারলো লোকটির চোয়ালে। ঘুসি খেয়ে খানিকটা দূরে ছিটকে পড়লো লোকটা। এমন সময় কামাল লক্ষ্য করলো আদিবাসী যুবতীটিকে ছেড়ে দিয়ে অপর লোকটি তার দিকে তেড়ে আসছে। ইতিমধ্যে প্রথম আক্রমণকারীও এসে পড়েছে। লোকটা এগিয়ে আসছে এবার সতর্কপায়ে ধীরে ধীরে। ঘুসি মারার ভঙ্গি করে কামাল প্রথম আক্রমণকারী লোকটিকে লক্ষ্য করে এগোতে লাগলো, কাছাকাছি গিয়ে কিন্তু তীব্র একটি লাথি মারলো আচমকা লোকটার তলপেটে। পরমুহূর্তে দ্বিতীয় আক্রমণকারী লেকটা ছুটে এসে পড়লো কামালের ওপর। কামাল সামান্য একটু সরে গিয়ে কেবল একটা পা বাড়িয়ে ধরে ল্যাঙ মারলো কায়দা করে। হোঁচট খেয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে যেতেই কামাল লাফিয়ে পড়লো তার ওপর। তারপর এলোপাথাড়ি ঘুলি চালালো লোকটির চোয়াল-নাক-চোখ লক্ষ্য করে। লোকটার বাধা দেবার ক্ষমতা যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে বলে মনে হলো কামালের তখন সে দেখলো প্রথম আক্রমণকারীটি আবার মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয় লোকটিকে এবার ছেড়ে দিলো কামাল। ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করলো। কামাল আশ্চর্য হয়ে দেখলো প্রথম আক্রমণকারীও রণে ভঙ্গ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে।
চোখ তুলতে কামাল দেখলো একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে ভিত চকিত দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে আদিবাসী যুবতীটি। একটু আগে যারা মার খেয়ে পালিয়ে গেল তারা মেয়েটির শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিল। সে সময়মত এসে পড়েছিল বলেই মেয়েটি রক্ষা পেয়েছে।
‘মমাকে ভয় পাসনি রে তুই,’ কামাল আন্তরিকতাপূর্ণ গলায় বলে উঠলো, ‘চল্ তোকে আমি সঙ্গে করে তোদর গায়ে পৌঁছে দিই–কেমন?’
মেয়েটি তার ভাষা যথাযথ বুঝলো কিনা কে জানে। কিন্তু কামালের কথা শুনে সে
৪ত
যে আশ্বস্ত হয়েছে, তার যে ভয় কেটে গেছে সে কথা তার চোখ-মুখের ভঙ্গি দেখেই অনুমান করতে পারলা কামাল। | কামাল এগিয়ে গেল ‘এবার মেয়েটির দিকে। বললো, ‘দাঁড়িয়ে রইলি কেন, চল্ আমি তোকে পৌঁছে দিই।’ | আন্তরিক দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটি কামালের দিকে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বললো
না। তারপর হাঁটতে লাগলো ধীরে ধীরে। কামালও হাঁটতে লাগলো তার পাশাপাশি।
ঢোল-মদিলর শব্দ আরও প্রবল হয়ে লাগছে কানে। নাম-না জানা আরও কত বাদ্যযন্ত্রর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
চলতে চলতে যুবতীটি কখন দাঁড়িয়ে পড়েছে খেয়াল করেনি কামাল। হঠাৎ যুবতার কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো সে।
‘কুথায় থাকিস রে তুই? ওই পাহাড় ধারে?’ যুবতী প্রশ্ন করলো।
হেস কামাল উত্তর দিলো, ‘ঠিক বলেছিস তুই, পাহাড়ের ধারে বাংলায় থাকি আমি।’
আদিবাসী যুবতী প্রশ্ন করলো আবার, ‘তুই কবে এসেছিস, বাবু?’
কামাল হেসে আঙুলের কড়ি গুণে বললো, ‘আজ নদিন হলো। তারপর আবার বললো, ‘তোর নাম কি বললি না যে?’
. ‘বেলসা নাম আছে গো। তুই?
প্রশ্নটা ধরতে পারলো না কামাল। বেলেলা খিল খিল করে হেসে উঠলো গোলমালের প্রবল শব্দকে ছাপিয়ে।
‘তোর নাম পুছ করলাম, বাবু? কামাল এবার বললো, ‘রশীদ নাম আছে গো।’ আবার হেসে উঠলো বেলেসা। হাসতে হাসতে কামালের গায়ে গড়িয়ে পড়বে
যেন।
আরও খানিকটা এগিয়ে যেতেই ওরা একটা খোলা জায়গায় এসে পৌঁছলো। খানিকটা দূরে আদিবাসীদের মাটির কুটির নজরে পড়লো। বেলে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। সারা মুখ তার প্রবল রাগে উষ্ণ হয়ে উঠেছে। দ্রুত এগিয়ে চললো সে কামালের আগে আগে।
মাড়াই উৎসব শুরু হয়েছে আদিবাসীদের। চাষের মরশুম শুরু হলেই এ-গাঁয়ে ও-গাঁয়ে বেজে ওঠে টোরী–মোষের শিঙর মতো একরকম শিং। কয়েকদিন পরপর শোনা যায় মান্দ্রা ঢোলের ডুগু ডুও। ঢোল-মাদল জানিয়ে দেয় কবে কোথায় মাড়াই বলব। আদিবালারা জড়ো হতে থাকে সেখানে। বাৎসরিক মেলা বসে, খেলাধুলা হয়; খানা-পিনা, হৈ-হল্লার প্লাবন বয়ে যেতে থাকে। আর নাচ তো আছেই, আদিবাসী যুবক-যুবতী, ছেলে-বুড়ো সবাইয়ের জন্যে।
| আৰু সর্দারকে দেখতে পেলা কামাল। বেলে ছুটে গিয়ে আতাকুকে জড়িয়ে ১১
ধরে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। আতাকু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে কামালের দিকে তাকালো। তারপর কি যেন জিজ্ঞেস করলো বেলেসাকে। বেলসা মুখ খুলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কি যেন বলতে লাগলো তাকে। মশালের লালচে আলোয় কামাল দেখলো বুড়ো আতাকুর মুখটা ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে রাগে। চোখ দুটো তার ভাটার মতো জ্বলছে। কামাল ভাবলো, আকুর কে হয় বেলেসা? বেলের মাথায় হাত দিয়ে আতাকু সস্নেহে এক একটা কথা জিজ্ঞেস করছে, আর বেলেসার উত্তরগুলো মন দিয়ে শুনতে চেষ্টা করছে।
| ওদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চারদিকে তাকালো কামাল। আদিবাসীরা গাছের গুঁড়িতে মশাল জ্বেলে রেখেছে অজস্র। কারও কারও হাতেও রয়েছে জ্বলন্ত মশাল।
নাচ হচ্ছে একটু দুরে। কামালের দিকে পিছন ফিরে চক্রাকারে বসে রয়েছে আদিবাসীরা। সমভূমির মাঝখানে রয়েছে একটি বিরাটকার শ্বেতপাথর। পাথরটাকে ঘিরেই নাচছে আদিবাসীরা। পাহাড়ের নিচেই এই গ্রামটি। ছোট্ট পাহাড়। পাহাড়ের মাথাতেও মশাল জ্বলছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত রকমের সব প্রিচিং স্টোন।
নাচ চলছে পুরোদমে। কারও মুখে টু শব্দ নেই।
আতাকু বেলেসাকে নিয়ে অভিবাদনের ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়াতে কামাল তার সংবিত ফিরে পেলো যেন। অবাক না হয়ে পারলো না কামাল। আতাকুক সে প্রথমে দেখেছে বাংলোয়। তখন বুড়ো লোকটা কি দারুণ রেগে ছিলো। তখন লোকটা এমন কি আভবাদনের ভঙ্গিতে মাথাটা পর্যন্ত নোয়ায়নি। অথচ বেলেসার কাছে সব কথা শুনে লোকটা কৃতজ্ঞতা বোধ করছে কামালের ওপর। কামাল ভাবলো এর উপকারীর মর্যাদা দিতে জানে।
আতাকু কামালের সঙ্গে কথা বলার সময় বেলেসা দ্রুত পায়ে চলে গেল একদিকে। একটু পরে একটা কলাপাতা আর কি যেন নিয়ে এলো বেলেসা। ইঙ্গিতে বেলেসা কামালকে মাটির ওপর হাঁটু ভাঁজ করে বসতে বললো। কামাল বুঝলো, খেতে দেয়া হবে তাকে। খিদেটা জেগে উঠলো তার। ইঁদুর সেদ্ধ, কন্বমূল আর ওলসির ঝোল নয় তো? তাহলেই সর্বনাশ।
কামাল ভাবছিল, না খেলে বেলে নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবে। ভরসা করে বসে পড়লো তবু। তারপরই দেখলো, বেলেসার হাতে এক ছড়া পাকা কলা।
কামালকে মুখ তুলে তাকাতে দেখে বোলেসাও বসে পড়ল। তার পাশে। আতাকুও বসালো। একটি একটি করে কলার খোসা ছাড়িয়ে বেলৈসা কলাপাতার ওপর রাখছে। কোনো লৌকিকতা না করে ক্ষুধার্ত কামাল খেতে শুরু করলো রাহুর মতো।
ছয়
হাঁটতে পারছে না আর শহীদ। পায়ের যন্ত্রণা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে তার। বাংলো এখনো বেশ খানিকটা দূরে। খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে অতি ধীরে হাঁটছিল সে। হঠাৎ অতি মাত্রায়
৪৫
সজাগ হয়ে উঠলো তার শ্রবণেন্দ্রীয়। সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে তাকালো সে অজানা আশঙ্কায়। অন্ধকার ভেদ করে কিছুই দেখতে পেলো না। কিন্তু স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলো, কে যেন দুত হেঁটে আসছে এদিকেই। কোনমতে একটা গাছের আড়ালে আশ্রয় নিলো শহীদ। কয়েক মুহূর্ত পরই সে দেখতে পেলো একটা লোককে ঠিক তার দু’হাত দূর দিয়ে যেতে। লোকটা শহীদকে পিছনে রেখে আর ক’পা এগোতেই চিনতে পারলো
শহীদ। চিনতে পেরেই অকূল কুল পেলো যেন সে। মুখে মৃদু একটু হাসি ফুটিয়ে গাছের। আড়াল থেকে সরে এসে বিকৃত কণ্ঠে সে বলে উঠলো, ‘আর এক পা এগোলেই মাথার খুলি উড়িয়ে দেবা, মিস্টার রশীদ। দুহাত ওপরে তুলে দাঁড়ানো হোক!
| বিদ্যুৎ বেগ ঘুরে দাঁড়ালো কামাল প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে। কিন্তু পরক্ষণেই মৃদু হেসে উত্তর দিলো, ‘প্রতারিত হয়েছো, বন্ধু, তোমার রিভলভারের ট্রিগার টিপে দেখতে পারে। আমার জন্য ওতে একটিও বুলেট নেই।’
দুজনেই হেসে উঠলো এক সঙ্গে। হাসি থামতে শহীদ বললো, ‘পথ হারিয়েছিলি নিশ্চয়?
‘এমন হারিয়ে যেন রোজই যাই! কামাল উদাস কণ্ঠে বললো, ‘আর তুই আমাকে খুজতে বেরিয়েছিলি নিশ্চয়?’
শহীদ বললো, ‘আমার পা মচকে গেছে। ধরে ধর বাংলোয় নিয়ে চল আগে, তারপর সব শোনাবো তোকে।’
‘আমারও অনেক কিছু শোনাবার আছে, কামাল বললো, ‘কিন্তু তোর পা মচকাল কেমন করে?
চিন্তিতস্বরে শহীদ বললো, ‘সে সব পরে শুনবি।
গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠে হঠাৎ কামাল বলে উঠলো, ‘তোকে চমকে ওঠার মতো একটা তথ্য আমি দিতে পারি শহীদ।
শহীদ কোনো কৌতূহল প্রকাশ না করে কামালের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো সে তথ্য আমার জানা। তবে, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিলে তুই যে তথ্য জানিয়ে আমাকে চমকে দিতে চাইছিল সেটা আমিই তোকে জানিয়ে নিরাশ করে দিতে পারবো কিনা বুঝতে পারবো তখন।
কামাল বললো, ‘কি তোর প্রশ্ন?’ ‘তুই কি আলখেল্লাধারী কোনো ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেয়েছিস আজ?
সন্দিগ্ধ কণ্ঠে কামাল বললো, ‘হ্যাঁ পেয়েছি। তবে…
‘তবে, শহীদ গম্ভার কণ্ঠে বললো, ‘তুই কুয়াশাকে দেখতে পেয়েছিস এই কথাই বলতে চাস তো?’
‘কামাল, আই হ্যাভ নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট! আমি যাকে দেখেছি সে কুয়াশা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। কিন্তু তুই কুয়াশাকে কখন দেখলি?’ | মৃদু হেসে শহীদ বললো, ‘আমি অবশ্য ঘটনাচক্রে অনুমান করেই স্থির সিদ্ধান্তে
৪৬.
পৌঁছেছি। সব কথা পরে শুনিল।’
ততক্ষণ ওরা বাংলোর একেবারে কাছাকাছি এসে পৌঁছেছিল। ড্রাইভার তিতু মিয়ার ঘরটার কাছে গিয়েই দুজনে একসঙ্গে থমকে দাঁড়ালো হঠাৎ ডানদিক থেকে ভেসে এলো সেই রহস্যময়ী নারীর পাগলিকরা খিল খিল হাসির আওয়াজ।
একটা গাছের আড়ালে আশ্রয় নিলো শহীদ ও কামাল। অপ্রত্যাশিতভাবে, খানিকটা দূর থেকে ভেসে এলো একটা মানুর গলা, ফিসফিস কণ্ঠে লোকটি বললো, ‘অফিসার ব্যাটার ঘুম কতক্ষণ ভাঙবে কে জানে! আজ প্রায় একমাস হয়ে গেল গুরুজার সঙ্গে দেখা হয়নি। এদিকে এমন হঠাৎ করে এতগুলো মানুষ যে কোথা থেকে এলো, কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্যাটাদের প্রাণ ভয় নেই একটুও। যে কোনো উপায়েই হোক, গুরুজীকে খবরটা পৌঁছাতে হবে।’ অন্ধকারে আরও একজনের ফিসফিস গলা শোনা গেল, ‘জানিস, ওদের এক ব্যাটাক আজ শেষই করে ফেলতাম। কিন্তু একমুহূর্ত আগে। দলের সর্দারটাই বুঝি এসে হাজির হলো। আমি পিছনে ছিলাম বলে আমার গায়ে গুলি লাগেনি, নয় তো’
প্রথমজন বললো, আমার হাতটা ছুঁড়ে গেছে শুধু। গুলিটা লেগেছিল ছুরির ফলায়। কিন্তু শাকিলের দুটো হাতই কেটে বাদ দিতে হবে।’
দ্বিতীয়জন বললো, ‘গুরুজীর সঙ্গে দেখা করে ভালমত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারলে শাকিলকে হয়তো বাঁচানোই যাবে না।
কিছুক্ষণ কারও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না আর।
ইতিমধ্যে খিল খিল হাসিটা একবার থেমে গিয়ে এবার বাম পাশ থেকে শুরু হয়েছে। একটু পর আবার শোনা গুলি প্রথমজনের অধৈর্য কণ্ঠস্বর, ‘অফিসার ব্যাটা বের হচ্ছে না কেন বলতো? তাই মরে যাচ্ছে না তো?
| দ্বিতীয়জনের গলা শোনা গেল, তবে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে রে! যেমন করেই হোক ওদের দুজনকে ঘর থেকে সরিয়ে আনতে হবে। প্রথমজন বললো, ‘তুই কিন্তু, দোস্ত ওরা ঘর ছেড়ে বেরুলেই পাহাড়ে চলে যাবি। ঠিক পনেরো মিনিট পর আমি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়বো যেমন কর পারি? দেখিস, শিকল টানতে যেন দেরি করিস না। তুই দেরি করলে কিন্তু আমি ধরা পড়ে যাবো।
দ্বিতীয়জন বললো, ‘তুই কিছু ভাবিস না দোস্ত, আমি ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যেই শিকল ধরে টান দেবো।’
| এরপর আর কারও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
নারীকণ্ঠের খিল খিল হাসিটা বাংলোর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন সময় অন্ধকারে লোক দুজনার পায়ের শব্দ শোনা গেল। শহীদ ও কামাল শব্দ শুনে বুঝতে পারলো বাংলার দিকেই আরও খানিকটা এগিয়ে গেল ওরা।
কিছু বলবার জন্য মুখ খুলেছিল কামাল, কিন্তু সে মুখ খুলবার আগেই অচিন্তনীয় একটা ব্যাপার ঘটে গোল। অন্ধকার ভেসে এলো শহীদের উদ্দেশ্যে একটা ভারি কাশা-১০
৪৭
কণ্ঠস্বর, ‘লোকগুলোকে কোনমতেই ভিতরে ঢোকার সুযোগ দিও না শহীদ, ওদেরকে শেষ না করে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দাও শুধু।
স্তম্ভিত রোমাঞ্চিত শহীদ অস্কুটে বললো, ‘কুয়াশা, তুমি!’ |
পরক্ষণেই বাংলোর চারপাশটা উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। কুয়াশা ফুলঝুরির মতো একটি জ্বলন্ত আতসবাজি বাংলার সামনে ছুঁড়ে দিয়েছে। সে আলোয় দেখা গেল দুজন লোক শহীদের ঘর লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালো। আর একমুহূর্ত দেরি না করে ফায়ার করলা শহীদ। গুলির শব্দে বিমৃঢ়তা কাটিয়ে লোক দুজন পড়িমরি করে ছুটতে আরম্ভ করলো। | বারান্দার ওপর এককোণে দাঁড়িয়েছিল আর একজন–দেখেই চেনা গেল লোকটা গফুর।
* আতসবাজিটা তখনও জ্বলছে বাংলোর চারপাশটা উদ্ভাসিত করে। নারীকন্ঠের খিল খিল হাসিটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। নিস্তব্ধ বনভূমিতে শোনা গেল পলায়নপর। লোকগুলোর পায়ের শব্দ। কুয়াশার উদ্দেশে তাকালো শহীদ পিছন ফিরে। কিন্তু কুয়াশা
তখন সেখানে নেই!
শহীদ ডেকে উঠলো, ‘কোথায় তুমি, কুয়াশা?’ হঠাৎ নিভে গেল বাতিটা। কুয়াশার সাড়া মিললো না।
সকাল হয়ে যাবে আর কিছুক্ষণ পর। শহীদ চেয়ারে বসে গভীর চিন্তাচ্ছন মুখে কামালকে বললো, ‘এবার বল দিকি এতো রাত অব্দি কোথায় ছিলি কুয়াশার পরিচয়ই বা কেমন করে পেলি?’
কামাল পথ হারিয়ে ফেলার কথা থেকে বেলসার ইজ্জত রক্ষা করার ঘটনা সবিস্তারে উল্লেখের পর জানালো যে, সে আতাকুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে চেয়েছিল আদিবাসীদের নাচ গান কিছুক্ষণ দেখাশোনার পর। কিন্তু বেলেমার অনুরোধে সে ফিরে আসতে পারলো না। বেলনা বললো নাচ-গান আর কিছুক্ষণ পরই আজকের মতো থেমে যাবে, তখন কামালকে বাংলায় পৌঁছে দেবার জন্যে কয়েকজন লোক ঠিক করে দেবে তারা। কামাল বেলেসার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল। নাচ-গান শেষ হতে, কয়েকজন লোক সঙ্গে করে ফিরে আসছিল কামাল। এমন সময় হঠাৎ কুয়াশার সরোদ বাজনায় হতবাক হয়ে যায় সে। এদিকে বাজনা শুনে আদিবাসী লোকগুলো তাকে
কেলে ছুটে পালায়। কুয়াশা নিমগ্ন ছিলো সুর সাধনায়। বাজাচ্ছিল মালকোষ।
| কিছুক্ষণ পর বাজনা বন্ধ হয়ে গেল। কামাল দেখলো একটা কালো আলখেল্লাধারী বিশাল মূর্তি কয়েক গজ দূরের একটি গাছ থেকে লাফ দিয়ে পড়লো। তারপর অদৃশ্য হয়ে গোল অন্ধকারে ধরস্থির পদক্ষেপ।
কামালের সব কথা শেষ হয়ে যাবার পরও তার বকবকানি থামলো না। যুবতী বেলেসার কথা থেকে থেকেই সে শোনাচ্ছিল আবেগভর।
৪৮
গভীর চিন্তার অতল তলে ডুবে গিয়েও শহীদ কামালের মন বুঝতে পেরে ক্ষণিকের জন্য না হেসে পারলো না। শহীদের ধ্যানমগ্ন মুখাবয়ব দেখে কোনো একসময় লজ্জিত হয়ে কামাল বেলেসার কথা বলা বন্ধ করলো।
পরবর্তী কয়েকটা দিন কামালকে প্রায়ই অনুপস্থিত দেখা গেল বাংলোয়। শহীদ কিন্তু ঘর ছেড়ে রাতে একবারের জন্যও বের হয় না। বাংলোর আশেপাশে এই কয়দিনে প্রতি রাতই নারীকণ্ঠর অস্বস্তিকর খিল খিল হালি শোনা যেতে লাগলো। কিন্তু শহীদকে একটুও বিচলিত হতে দেখা গেল না।
দিনের বেলা প্রায় প্রত্যেকদিনই শহীদ একবার করে বেরিয়ে যায় পাহাড়ের দিকে। সে সময়টুকুর জন্য ঘরে তালা মেরে যেতে ভোলে না সে। একাই যায়। গফুরকে বারবার সতর্ক করে দিয়ে যায় সাবধানে থাকতে।
ডাইভার তিতু মিয়াকে সেদিনকার রাতের ঘটনার পর আর দেখা যায়নি বাংলোতে। কামালের প্রশ্নের উত্তরে শহীদ বলেছিল, ‘তিতু মিয়া যে ছদ্মবেশ ধারণ করে আছে সে তা আগেই অনুমান করেছিল একটা বিসদৃশ ঘটনা থেকে। আদিবাসী সর্দার আতাকু যেদিন বালোয় এসেছিল সেদিনই ধরা পড়ে যায় তিতু মিয়া শহীদের চোখে। তিতু মিয়া বলেছিল, এখানে সে সাত মাস ধরে আছে। তাহলে আতাকু তিতু মিয়াকে চিনতে পারলো না কেন? তাছাড়া, শহীদের মনে আরও আগে সন্দেহ হয়েছিল তিতু মিয়াকে সে যেন কোথায় দেখেছে। অবশ্যি, বিশালবনে কুয়াশার অস্তিত্বের কথা জানার পর তার স্মরণশক্তি আর ফাঁকি দেয়নি তাকে। ছদ্মবেশী তিতু মিয়া ছিলো আসলে কুয়াশারই বিশ্বস্ত অনুচর–মান্নান। এর আগে অবশ্যি তিতু মিয়া নামের একজন ডাইভার বিশালপুরে ছিলো, কিন্তু সে তিতু চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে কয়েক মাস আগে। মিস্টার হোসেনের ডায়েরী থেকে সে কথা বিশালনে আসার পরের দিনই জানতে পেরেছিল শহীদ। | মাড়াই উৎসব চলছে আদিবাসীদের গ্রামে। কামাল বেলেসার আকর্ষণে রাতদিন পড়ে আছে সেখানে। শহীদ সব বুঝতে পেরেও কিছু বলে না কামালকে। শুধু এক আধটা কথা বলে ঠাট্টা করে কখনো-সখনো। কামাল চটে উঠে আপত্তি করতে চায় শহীদের স্তবো। শহীদ কিছু না বলে শুধু সবজান্তার হাসি হাসতে থাকে। তাতে কামাল রেগে যায় আরও।
একদিন কিন্তু হাসি-খুশি মুখ নিয়ে গুণ গুণ করে গানের কলি ভজতে ভাজতে কামালকে বাংলোয় ফিরতে দেখা গেল না। সকালবেলা গিয়েছিল কামাল বেলেসাদের গ্রামে। ফিলো দুপুরেই।
কামালকে কেমন উত্তেজিত দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো শহীদ; ঘরে ঢুকে কামাল বললো, “সাংঘাতিক ব্যাপার হয়েছে, শহীদ। গত রাত আতাকু সর্দার কয়েকজন অপরিচিত সভ্য লোককে ধরে বেঁধে রেখেছিল। লোকগুলো নাকি ও ৪-
দেবতার গুহায় প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছিল। মোট তিনজন লোককে দেখতে পেয়েছিল ওরা। একজন নাকি রাতেই ওদেরকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে গেছে সেই গুহায়।
‘যে দুজনকে ওরা ধরে বেঁধে রেখেছিল তারাও আজ সকালবেলা পালিয়েছে বাঁধন খুলে। আশ্চর্যের কথা কি জানিস, আতাকুদের দেবতা হচ্ছে বিরাট একটি দু-হাত লম্বা অজগর সাপ। তুমুল হৈ-চৈ পড়ে গেছে ওদের মধ্যে। বেলেসার কাছে সব শুনে খবরটা তোকে জানাবার জন্য ছুটে এসেছি। ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে না তোর কাছে?
অন্যমনস্ক কণ্ঠে শহীদ বললো, ‘কি মনে হচ্ছে না হচ্ছে সে কথা পরে হবে– কিন্তু, কয়েকটি কথা অবশ্যই জানা দরকার। আচ্ছা, বলতে পারি, আদিবাসীদের গাঁ থেকে গুহাটা কতো দূরে?
কামাল বললো, খুব বেশি হলে পঁচিশ গজ।’ . শহীদ বললো, গুহাটা নিশ্চয়ই পাহাড়ের ওপর?’ ‘হ্যাঁ। ভিতরের দিকে অন্ধকার?” ‘‘সুড়ঙ্গ মতো চলে গেছে পাহাড়ের ভিতর দিকে, কিছুদূর অব্দি দেখা যায়, তারপরেই অন্ধকার।
‘সুড়ঙ্গটা কোন্দিকে মুখ করে এগিয়েছে?
উত্তর দিকে। শহীদ চিন্তিত স্বরে বললো, ‘তার মানে আমাদের বাংলোর দিকেই। ‘হাঁ।’।
ক’মিনিট কাটলো নীরবতার মধ্যে। হঠাৎ কামাল বললো, ‘‘ওদের দেবতা। অজগরটা সম্পর্কে আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে। আমাদের ঘরে যে অজগরটা পাওয়া। গিয়েছিল ওটা সেটাই নয় তো?’
শহীদ বললো, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’
গভীর রাত্রির নিস্তব্ধতা বিশালবনের ফরেস্ট অফিসারের বাংলোর চারপাশে জমাট বেঁধে রয়েছে। রাত আন্দাজ আড়াইটা হবে। ঘুমের ঘোরে মড়ার মতো বিছানায় পড়ে থাকার সময় এটা। শহীদের ঘরের ভিতর কোনো শব্দ নেই। বাতিটা জ্বলছে নিবু নিবু। শহীদ একাই আছে ঘরে। কামাল গেছে আদিবাসীদের মাড়াই উৎসবে। নিঝুম পড়ে আছে বাংলাটা। ঘুমের ঘোরে গফুরের নাক ডাকার শব্দ শুধু শব্দহীন রাতের সমাহিত
পরিবেশে মাঝে মাঝে নিবিড় একটা কাঁপন তুলছে।
শহীদের বিছানায় মশারির অভ্যন্তরে দৃষ্টি যায় না। এমন সময় দেখা গেল ঘরের চারকোণ। পাথরের মেঝের মাঝখান থেকে একটি বড় পাথর নিঃশব্দে এক বিঘত খানেক নিচে নেমে গিয়ে একপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। পাথরটা.সার যেতেই একটা সুড়ঙ্গ দেখা গেল। পরক্ষণেই কালো কাপড়ে ঢাকা গোল মতো কি যেন একটা উঠে এলো।
সুড়ঙ্গের মুখে। আরও খানিকটা উঠে এলো বস্তুটা, আরও খানিকটা। এবার দেখা গেল, গোল মতো বস্তুটি একটি মাথা, মানুষের মাথা। সুড়ঙ্গটার ভিতর দিক থেকে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলো মিশমিশে কালো কাপড়ে ঢাকা একটি ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তির সম্পূর্ণ শরীরটা বের হয়ে আসতে দেখা গেল তার হাতে চৌকোণ একটি ছোটো বীশের কাঠির তৈরি খাঁচা। খাঁচাটির ভিতর বিষাক্ত একটি মাকড়সা নড়াচড়া করছে সর্বক্ষণ। ছায়ামূর্তি ঘরের মাঝখান থেকে সরে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। তার চোখ দুটো নিষ্পলক, জ্বলছে যেন। মাকড়সার খাঁচাটা হাতে নিয়ে শহীদের বিছানার দিকে এগোলো সে। মশারির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো চোরের মতো, ক্ষণিকের জন্য মশারির পাতলা পর্দার ওপর চোখ রেখে ভিতরটা দেখে নিয়ে সন্তুষ্টির হাসি হাসলো। তারপর দ্রুত বসে পড়লো খাটের পাশে। অতি সাবধানে খুলে ফেললো হাতে ধরা খাঁচাটার তালা। তারপর এক হাতে মশারির কোণটা তুলে খাঁচাটা ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে খুলে দিলো দরজাটা একটা সুতো টেনে। বিষাক্ত মাকড়সাটা খাঁচা ছেড়ে শহীদের বিছানার ওপর নেমে যেতেই ছায়ামূর্তি সরে এলো খাটের পাশ থেকে। মশারির ভিতর থেকে একটি যন্ত্রণাকাতর অস্ফুট শব্দ শোনার জন্য কালো মূর্তির কান সজাগ হয়ে উঠলো। চোখ দুটো ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো জ্বলতে লাগলো অন্ধকারে। এমন সময় আচমকা শোনা গেল শহীদের কঠিন গলা, হাওস আপ!”
দেখা গেল বুকশেলফের পাশ থেকে এক পা সামনে এগিয়ে এসে রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ খান। শহীদের কণ্ঠস্বর শুনেই বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আগন্তুক। শহীদকে রিভলভার তাক করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আস্তে আস্তে দুহাত মাথার ওপর তুলে দাঁড়ালো।
দেখেই বোঝা যায় লোকটা বিপুল শক্তির অধিকারী। আরও দু’কদম এগিয়ে এলো শহীদ। দৃষ্টি তার এক মুহূর্তের জন্যও আগন্তুকের দিক থেকে অন্যত্র সরে যায়নি।
শহীদকে ঘরের মাঝ বরাবর এগিয়ে আসতে দেখে মৃদু একটা ব্যঙ্গের হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল লোকটার মুখ থেকে। ভয়ঙ্কর দর্শন, ক্ষতবিক্ষত মুখ লোকটার। অসহায়
অবস্থায় ধরা পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও মুখে ভয়-ভাবনার লেশ মাত্র প্রকাশ পাচ্ছে না।
| শহীদ শ্লেষাত্মক ভাষায় কিছু বলতে গিয়ে মুখ খোলবার আগেই একটা মোটা লোমশ হাত সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসে শহীদের পা দুটো পেচিয়ে ধরে হেচকা টান মারলো। কিছু বলবার আগেই হুমড়ি খেয়ে মেঝের ওপর পড়ে গেল শহীদ। রিভলভারটা তখনও শক্ত হাতে ধরে ছিলো শহীদ। কিন্তু আগন্তুক লোকটা যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো। মুখ থুবড়ে পড়তেই সবুট একটা লাথি তার ডান হাতের ওপর এসে লাগলো, হাত থেকে ছিটকে গেল রিভলভারটা।
সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে মোটা লোমশ হাতটা যে রকম নিঃশব্দে বের হয়ে এসেছিল সে রকম নিঃশব্দেই আবার ঢুকে গেছে ভিতরে। * শহীদ উঠে বসার আগেই লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর। কয়েক সেকেও
পর ৬ঙ্কর দর্শন লোকটা এলোপাতাড়ি ঘুসি চালালো শহীদের মুখ লক্ষ্য করে। শহীদ দুপায়ের বেড় দিয়ে হ্যাঁচকা টানে ছুঁড়ে ফেলে দিলো লোকটাকে। পরমুহূর্তে দুজনে একই সঙ্গে উ দাঁড়ালো মেঝের ওপর।
শহীদ দেখলো, লোকটার হাতে ঝলকাচ্ছে একটা তীক্ষ্ণমুখ ভোজালী। শহীদকে নিরস্ত্র দেখে কুৎসিত হাসিতে ভরে উঠলো লোকটার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাগে ভরা মুখ। এব. পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগলো লোকটা শীদের দিকে। তারপর আচমকা শহীদের বুক লক্ষ্য করে ভোজালীসুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়লো। শহীদ ইতিকৰ্তব্য স্থির করে ফেলেছিল পূর্বাহ্নেই। সে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো, তারপর লোকটার হাঁটুতে দু’হাত দিয়ে মৃদু ভাবে এমন একটা আঘাত করলো যে পরমূহুর্তে দেখা গেল লোকটা পাথরের দেয়ালে গিয়ে আছাড় খাচ্ছে। ভোজালাটা লোকটার হাত থেকে খসে পড়েছে। দুজনারই নাগালের বাইরে রইলো সেটা। শহীদ উঠে দাঁড়াত লোকটাও রক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো। আবার এগিয়ে আসতে লাগলো সে এক পা এক পা করে শহীদের দিকে।
শহীদ বুঝতে পারছিল, লোকটা বিপুল শক্তির অধিকারী। এতক্ষণ লড়ার পরেও লোকটার কিছু হয়নি যেন লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে, এখনও শুরু করেনি। শহীদ ভাবলো, সময় নিয়ে ওকে ক্লান্ত করে পরাজিত করার আশা দুরাশা মাত্র। এ ক্ষেত্রে দ্রুত আক্রমণ এবং প্রচণ্ড আঘাত হানতে পারবে যে, জিত হবে তারই। দেরি না করে চিন্তাটাকে কাজে পরিণত করলে শহীদ।
| লোকটা এগোচ্ছে, আর এক পা এগোতেই, শহীদ ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটাকে লক্ষ্য করে। প্রথম খুনিটা লালা ওর তলপেটে। কিছু বুঝতে না দিয়ে পর পর আরও দুটা ঘুসি চালালো শহীদ ওর মুখ লক্ষ্য কর। আঘাত করার মাত্রাতিরিক্ত নেশা তখন :পর বসেছে শহীদকে। এলোপাতাড়ি ঘুলি চালাচ্ছে, তখন সে লোকটার শরীরের
বভিন্ন জায়গায়। আচমকা শহীদ বুঝতে পারলে লোকটা তাকে পেচিয়ে ধরে খাটের। দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রাম করলো শহীদ খাটের কাছ থেকে সরে থাকতে। লোকটার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে পলকের জন্যে শিউরে উঠলো সে। বিছানার
পর ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিষাক্ত মাকড়সাটা। কামড়ালে আর রক্ষা নেই, সঙ্গে সঙ্গে ডবলীলা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু লোকটার অক্টোপাসের মতো প্যাঁচ থেকে মুক্তি পেলো না শহীদ; বিছানার ওপর ফেলে দিলো তাকে লোকটা। শহীদও ছাড়বার পাত্র নয়। লোকটাকে সে দু’হাতে জাপটে ধরে রাখলো শক্ত করে। তারপর শুরু হলো ধ্বস্তাধস্তি : প্রতি মুহূর্তে শহীদ আশঙ্কা করছিল মাকড়সার কা..ড়ের। সে খাটের কিনারা পড়ে আছে, আর লোকটা প্রাণপণ চেষ্টা করছে শহীদের পঁচি থেকে ছাড়া
পত হ5 শহীদ বুঝতে পারলো লোকটা এক হাত দিয়ে মশারির দড়ি ছিড়বার চেষ্টা
ছে, সুযোগটা ব্যবহার করার জন্য একমুহূর্ত মাত্র অপেক্ষা করতে হলো. শহীদকে। শাবির দড়িটা ছোঁড়ার শব্দ হতেই “হাদ এক ধাক্কায় অনেকটা কাত করে ফেললো নিজের শর! টক। কয়েক মুহূর্ত পাশাপাশি অবস্থান করলো দুজনে। ঠিক সেই
সময়েই মাকড়সাটা আট পা ফেলে ফেলে শহীদের ঠিক পিঠের কাছাকাছি এসে পড়লো। আরও দু’ইঞ্চি এগিয়ে এই কামড় দেবে মাকড়সাটা। শহীদ জানতে পারছে না কি ভয়ঙ্কর ঘটনা এখুনি ঘটে যেতে পারে। এমন সময় লোক িশহীদকে আবার পূর্ববং চিত করে শুয়েই দিলো এক ধাক্কায়। শহীদ অনুভব করলো তার পিঠের নিচে কি একটা যেন চেপে চটকে গেল। কিন্তু অনুভব শক্তি তখন সে একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছে। যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। শ্বাস নিতে পারছে না কোনমতে। আক্রমণকারীর লোহার মত শক্ত হাত তার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। শক্তিহীন, নির্জীব, নিঃসাড় হয়ে পড়ছে সে। তার হাত দুটো আক্রমণকারীর পেশল বাহু থেকে খসে পড়লো ধীরে ধীরে। হাত দুটো খসে পড়তেই শহীদFে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো লোকটি। শহীদের শরীরটা একটু সরিয়ে দেখলো, মাকড়সাটা চেপ্টে মরে গেছে একেবারে। ভয়ঙ্কর হিংস্রতায় লোকটি মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিলো বোজালিটা। শহীদের কে দুপা এগিয়েই কিন্তু থমকে দাঁড়ালো সে। পাশের ঘরের দরজা খুলে কে যেন ভিতরে ঢুকছে। মাঝখানের দরজাটা খুলে গেল। লোকটি এক মুহূর্ত দেরি না করে এক লাফে সুড়ঙ্গটার ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। পরক্ষণে চৌকোণা পাথরটাও অদৃশ্য স্থান থেকে বেরিয়ে যথাস্থানে জোড়া লেগে গেল।
ঘরের ভিতর উত্তেজিত মুখে একটা মোটা লাঠি হাতে গফু; এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে।
শহীদ কামালকে আতাকু সর্দারের কাছে পাঠিয়েছিল। আগামী পরশুদিন রাত এগারোটার সময় কয়েকজন সাহসী লোক দরকার। লোকগুলোকে নিয়ে কামাল ওদের দেবতার গুহায় প্রবেশ করবে। কামাল আতাকু সর্দারকে সব কথা বুঝিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ওদের দেবতা অজগর সাপটিকে হত্যা করেছে কয়েকজন দুষ্ট লোক। কামাল আতাকুকে বুঝিয়েছে, লোকগুলো আসলে ডাকাত। ওদের দেবতার গুহা দিয়ে প্রবেশ করলে ডাকাতগুলোকে হাতে নাতে . পাকড়াও করা যায়। লোক জোগাড় করে দিতে রাজি হয়েছে আকু সর্দার নির্দ্বিধায়।
সর্দার লোক জোগাড় করে দিতে রাজি এই খবরটা নিয়ে বাংলোয় ফিরে আসছিল কামাল। বেলেও সঙ্গে ছিলো। সে কামালকে খানিকটা এগিয়ে দেবার জন্য আসছিল।
| কথা বলতে বলতে এগোচ্ছিল ওরা। হঠাৎ দু’জন লোক ঝোঁপের আড়াল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ওপর। একজন লোক বেলেসাকে ধরার চেষ্টা করতেই বেলেসা ‘উইস’ বলে আর্তচিৎকার করে ছুটতে আরম্ভ করলো। পিছন পিছন লোকটিও ধাওয়া
করলো। দ্বিতীয় আক্রমণকারী কামালকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ অসহায় করে, রাখলো। সন্বিত ফিরে পেয়ে কামাল উঠতে চেষ্টা করলো। কিন্তু উঠে দাঁড়াবার আগেই,
সে দেখতে পেলো লোকটি একটি ছোরা তার দিকে উঁচিয়ে ধরে উদ্ধত ভঙ্গিতে দু’পা ফাঁক করে প্রায় বুকের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে।
| কামাল উঠেছিল। তার বুকের ধুকপুকুনিও বেড়ে গিয়েছিল। যে কোনো মুহূর্তে তীক্ষ্ণলা ওই ছোরা তার বুকে আমূল বিদ্ধ করে দেবে লোকটি, এই আশঙ্কায় সে কাঁপতে লাগলো।
কিন্তু ব্যাপারটা ঘটলো সম্পূর্ণ অন্যরকম।
আচমকা পিছন দিক থেকে গাছের একটা মোটা চালের প্রচণ্ড ঘা খেয় কামাল মাথা যুব পড়ে গেল মাটিতে।
| বেলেসাকে ধরতে না পেরে ফিরে এসেছিল যে লোকটি সে-ই পিছন দিক থেকে কামালের মাথায় হঠাৎ আঘাত করেছিল।
জ্ঞান ফিরে আসতে কামাল দেখলো একটা পাথরের গুহায় তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। দুজন গুণ্ডার মতো লোক কথা বলছে নিচু কণ্ঠে। এমন সময় সম্পূর্ণ অভাবিত একটি কাণ্ড ঘটলো। গুহা মুখে আবির্ভূত হয়ে রিভলভার হাতে মিস্টার খোন্দকারকে পাগলের মতো হেসে উঠতে দেখা গেল। আশ্চর্য চোখে তাকালো কামাল। গুণ্ডার মতো দেখতে লোক দুটিও প্রথমে চমকে উঠলো, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে পরস্পর অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো মিস্টার খোন্দকারের দিকে। মিস্টার খোন্দকার তখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন লোক দুটির অবাধ্যতা দেখে।
আর এক পা-ও এগিয়ো না শয়তানেরা, তাহলেই গুলি করবো।’ বার বার গলা ফাটিয়ে কথা কটি বলে চলেছেন তিনি।
কিন্তু লোক দুটি কর্ণপাত করলো না তাঁর কথায়। হিংস্র জানোয়ারের মতো শিকার ধরার ভঙ্গিতে তারা এগোতেই থাকলো। কিছুই বুঝতে পারছিল না কামাল, কিন্তু পরক্ষণেই শিউরে উঠলো সে। দেখলো, মিস্টার খোন্দকারের তলপেট লক্ষ্য করে নিষ্ঠুর শয়তান দুজন ছোরা মারছে ঘন ঘন। এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ড দেখার কথা কামাল চিন্তাও করতে পারে না।
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই মিস্টার খোন্দকারের শরীরটা পড়ে গেল মাটিতে। তারপরও ছোরার কোপ পড়তে লাগলো মিস্টার খোন্দকারের শরীরের যত্রতত্র।
জালে পড়া অসহায় সিংহের মতো গর্জাতে লাগলো কামাল। বিশ্রী গালাগাল বের হতে লাগলো তার মুখ থেকে। ‘কুত্তার বাচ্চারা, তোমাদের শাস্তি পেতে হবে মানুষ খুন। করার জন্যে-তা ভুলো না।
একজন গুণ্ডা আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হত্যার নেশায় বলে উঠলো, ‘পাগলটার সঙ্গে এই শালাকে খতম করে দিই?’
অন্যজন বললো, ‘খবরদার! গুরুজী তাহলে মুশকিল বাধাবে। তার চেয়ে মাথায় ছোরার পাঁটের ঘা মেরে অজ্ঞান করে দে শালাকে। | ছোরা হাতে এগিয়ে এলে অপরজন। ছোরার বাঁটের প্রচণ্ড আঘাতে কামালের
৫৪
মুখটা যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে উঠলো, গলা দিয়ে শব্দ উঠলো, ‘আ-আ-আঁ…।’
হাঃ! হাঃ হাঃ!’ দু’জন গুণ্ডার কুৎসিত হাসির শব্দের ভিতর আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললো কামাল।
সাত
সন্ধ্যাবেলা গফুর এসে খবর দিলো কয়েকজন কাঠুরে শহীদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। দ্রুত বের হয়ে এলো শহীদ ঘর থেকে। দেখলো, দু’জন কাঠুরের ছদ্মবেশে দুজন পুলিসকে সঙ্গে নিয়ে মি, নিষ্পসন বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মি. সিম্পসন ও ছদ্মবেশী কাঠুরে সর্দার সেজে এসেছেন। চিনতে পেরে মৃদু একটা হাসিতে অভ্যর্থনা জানাবার কাজটি সারলো শহীদ। প্রত্যুত্তর ছদ্মবেশী সিম্পসনের ঠোঁটেও একটা মৃদু হাসি পলকের জন্য খেলে গেল। তারপর কি বলবার জন্য এক পা এগিয়ে মুখ খুলবার আগেই গফুরের কড়া ধমক খেয়ে কাঁচুমাচু হয় চুপ করে গেলেন। গফুর মি. সিম্পসনকে চিনতে পারেনি। বললো, ‘সামনে এগোচ্ছো কেন হে, যা বলবার ওখানে থেকেই বলো। সাহেব বুঝতে পারবেন।’
‘হজুর, মি. সিম্পসন শহীদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘গাছ কাটার লোক আমরা, যদি কোনো কাজ পাই সেই আশায় এসেছি চিন্তাপুর থেকে, কাজকাম অনেকদিন হলো পাই না, তাই হুজুরের কাছে প্রার্থনা..’।
শহীদ কিছু বলবার আগেই গফুর সাফ বলে দিলো, যাও এখন, কাজ-টাজ হবে। এই সন্ধ্যেবেলা উনি এলেন গাছ কাটতে, ইয়ার্কি আর কি!’ হাসি চেপে শহীদ বললো, ‘না, না, বশির আলী, গাছ কাটার লোকের দরকার আছে। তুমি চা দাও দিকি আমাকে এক কাপ, আমি ওদেরকে কাজের কথাটা বুঝিয়ে বলি। | বাহাদুরী করার সুযোগটা মাঠে মারা গেল দেখে গফুর আর কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
মি. সিম্পসন এবার নিচু গলায় বললেন, ‘এতো তাড়াতাড়ি তোমার টেলিগ্রাম পাবো আশা করিনি শহীদ, তোমার কৃতিত্ব দেখে আনন্দ অনুভব করছি।’
| শহীদ সুদু হেসে বললো, ‘অনেক আগে সবকিছু মিটে যাওয়া উচিত ছিলো মি, সিম্পসন। তা যাকগে, আজ রাতেই সব রহস্যের উদঘাটন হবে।’
মি. সিম্পসন নিচু গলায় আবার বললেন, ‘কতদূর কি জানতে পেরেছে সেটা শুনতে অধৈর্য না হয় পারছি না, শহীদ।
শহীদ বললো, কয়েকটি আনুষঙ্গিক ব্যাপার ছাড়া মূল বিষয়বস্তুর কিছুই স্পষ্ট করে জানতে বা বুঝতে পারিনি এখনও আমি। তবে মূল রহস্যের সমাধান বের করার জন্যে যা জানার দরকার তা জানা হয়েছে। আজ রাতেই আপনার হাতে তুলে দিতে পারবো হত্যাকারীদের, এটুকু বলতে পারি।
৫৫
মি. সিম্পসন আর কিছু বললেন না। তার মুখে প্রশংসাসূচক হাসি দেখা দিলো। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কামাল কোথায়?’
| চিন্তিত স্বরে শহীদ বললো, ‘কামালকে পরশু থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, মিস্টার খোন্দকারও নিরুদ্দেশ হয়েছেন কাল থেকেই।’
‘তুমি কোনো খোঁজ করোনি!”
সম্ভাব্য সব জায়গাতেই অনুসন্ধান করেছি, কোথাও ওদের হদিস পাইনি। মি. খোন্দকারের জন্য আমার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। আজ রাতেই…’
এমন সময় গফুর আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বললো, সাহেব, চা দিয়েছি আপনার।
| শহীদ ঘরে ফিরে যেতে গফুর ছদ্মবেশী মি. সিম্পসনের সঙ্গে তাচ্ছিল্যভরে কথা বলতে শুরু করলো।
কাঁটায় কাঁটায় রাত এগারোটা। পাহাড়ের উপর দ্রুত উঠে এলো শহীদ গফুরকে নিয়ে। একটা প্রকাণ্ড বড় পাথরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। শহীদ পকেট থেকে দুজোড়া রবারের গ্লাভস বের করলো দ্রুত। নিজে এক জোড়া পরে আর এক জোড়া গফুরকে পরে নিতে বললো।
তারপর বড় পাথরটার একটা ফোকরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো একটা মোটা শিকল। শিকল ধরে সজোরে টান দিতেই আরও কিছুটা বের হয়ে এলো সেটা। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল হাত খানেক লম্বা ইঞ্চি চারক চওড়া কোকরটার ভেতর থেকে সড়াৎ করে বেরিয়ে এলো একটা লোহার কালো লিভার। লিভারটা ধরে ওপর দিকে ঠেলে তুলে দিলো শহীদ। তারপর গফুরের হাতে একটা রিভলভার ধরিয়ে দিয়ে জায়গাটা পাহারা দেবার কথা বুঝিয়ে বলে দ্রুত নেমে এলো পাহাড় থেকে। | গফুর একটা পাথরের আড়ালে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে পাহারা দিতে লাগলো লিভারটা।
মিস্টার সিম্পসন ও তাঁর লোকজনকে ঘরের ভিতরের সুড়ঙ্গটার মুখে রেখে এক এগিয়ে যাচ্ছে শহীদ। সুড়ঙ্গটা সঙ্কীর্ণ একটা পথ। ‘শক্ত পাথরের উপর দিয়ে ক্রেপসোলঅলা জুতো পরে নিঃশব্দে এগোচ্ছে শহীদ। কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লাগার আশঙ্কায় অতি সন্তর্পণে পা ফেলতে হচ্ছে তাকে। সুড়ঙ্গটা যেন শেষ হতেই চায় না। হাঁটছে তো হাঁটছেই। দু’দিকে পাথরের এবড়োখেবড়ো দেয়াল’। মাথার ওপরেও অসমতল পাথরের ছাদ। শহীদ ভাবলো, ঠিক পাহাড়ের নিচে এসে পড়েছি এতক্ষণে। কিন্তু আর কতদূর? কোন পাতালপুরীতে গিয়ে শেষ হয়েছে এই পথ? আর মিনিট পাঁচেক পর শহীদ দেখতে পেলো একটু আলোর স্নান ভাস। আলোর উৎসমুখটা দেখতে না পেলেও শহীদ বুঝতে পারলা কম পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাল জ্বলছ কোথাও। সতর্ক পায়ে হাঁটতে লাগলো ৫৬
।
শহীদ। আলাটার কাছাকাছি পৌঁছতে ফাঁকা একটা জায়গা দেখতে পাওয়া গেল। ফাঁকা জায়গাটার চারপাশে ভাঙা, আধভাঙা পাথরের চা পড়ে আছে। মৃদু হলুদাভ আলোয় শহীদ কাউকে দেখতে পেলো না। কোনো শব্দও আসছে না কোনো দিক থেকে। এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে গেল শহীদ। পাথরের আড়ালে আড়ালে থেকে সামনে এগোতে লাগলো সে।
পাথরের আড়ালও শেষ হয়ে গেল এক সময়। দেখা গেল সামনেই একটা ঘর। ঘরটা অসমতল পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে। থমকে দাঁড়িয়েছিল শহীদ। ঘরের ভিতর থেকে কোনো শব্দ শোনার আশায় সে কান পেতে রইলো। কিন্তু না, কোনো দিকে কোনো শব্দ হচ্ছে না। ঘরের দরজাটা কোনদিকে হবে ভেবে পেলো না শহীদ। তবু আন্দাজের উপর নির্ভর করে ডানদিক লক্ষ্য করে পা বাড়ালো সে। একটু এগোতেই একটা দরজা দেখতে পেলো। গাছের কাণ্ড দিয়ে অদ্ভুত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে দরজাটা। জানালাহীন ঘরটার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটু চাপ দিতেই ফাঁক হয়ে গেল দরজাটা। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকলো না শহীদ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সে। তারপর নিঃশব্দে ঢুকে পড়লো।
অন্ধকার ঘরে ঢুকে নরম কি যেন একটা বস্তুর ওপর পা পড়তেই থতমত খেয়ে দু’পা সরে গেল শহীদ। রিভলভারটা এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরে পেন্সিল টর্চটা বের করে ঘরের মেঝেতে আলো ফেলতেই একটি মানুষের মৃতদেহ দেখে চমকে উঠলো সে। একনজর দেখেই বুঝতে পারলো মাত্র কিছুক্ষণ আগে লোকটিকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। ঘরের চারদিকটা যথাসম্ভব দেখে নিয়ে শহীদ হঠাৎ কি মনে করে ঘরের মাঝ বরাবর এগিয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে ম্যানহোলের মতো একটা গর্ত দেখতে পেলো সে। গর্তটার মুখ থেকে কয়েকটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। ইতস্ততঃ না করে শহীদ নামতে লাগলো সিঁড়ি বেয়ে।
সিঁড়ির শেষপ্রান্তে সরু একটা পথ। কিছুদূর মাত্র গেছে পথটা, তারপর একটা ঘরের জানালা দেখা যাচ্ছে। ঘরের ভিতরের উজ্জ্বল আলো বাইরেও এসে পড়েছে। নিঃশব্দে জানালাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। কিন্তু ঘরে কোনো মানুষের অস্তিত্ব দেখতে পেলো না। অবশ্য বিস্মিত হবার মতো অনেক কিছুই রয়েছে ঘরটার ভিতরে। স্বনামধন্য কোনো পুরোদস্তুর প্রতিষ্ঠানের একটা ল্যাবরেটরী যেন ঘরটা। নানা প্রকার দুস্পাপ্য এবং মূল্যবান বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ঘটায় ঠাসা।
খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল শহীদ। এমন সময় একটা অস্পষ্ট শব্দ ঢুকলা তার কানে। এদিক-ওদিক তাকালো শহীদ। কিন্তু শব্দটার কোনো হদিস করতে পারলো না। তারপর ডানদিক লক্ষ্য করে জানালাটার কাছ থেকে সরে এসে এগোতে লাগলো গুটি গুটি। আর কয়েক পা এগিয়েই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো শহীদ।
দেখলো, তার সামনে দু’জন লোক আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা অবস্থায় মেঝের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে।
বিস্মিত ভাবটা কাটিয়ে উঠে আবার সামনে এগোতে লাগলো শহীদ। সে এখানে না আসতেই কে তার পথ পরিষ্কার করে রেখেছে, লে কথা ভেবে অবাক হলো সে। * আরো কিছুক্ষণ চলার পর বিশাল একটা হলনরের সামনে এসে পৌঁছলে শহীদ। জনপ্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পাওয়া গেল না কোথাও। হলঘরটার ভিতর থেকে কার যেন ধমকর গলা শোনা যাচ্ছে। দরজা একটা রয়েছে বটে, কিন্তু সেটা বন্ধ। আর দরজা কিংবা জানালা কোথাও আছে কি না খুঁজে বের করার জন্য হলঘরের দেয়াল ধরে এগোতে লাগলো শহীদ।
কিছুক্ষণ পর একটি খোলা দরজার সামনে এসে পড়ল। শহীদ। খোলা দরজা পথে অতি উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে বাইরে। দু’পা এগিয়ে খোলা দরজা দিয়ে সতর্ক পায় হলঘরটার ভিতর ঢুকে পড়লো ও। সামনেই রয়েছে কয়েকটা বিরাট বড় কাঁচের জার। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে আরও খানিকটা এলো শহীদ। তারপর শরীরটাকে একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে রেখে মুখ বাড়ালো শব্দ লক্ষ্য করে। উজ্জ্বল বাতির নিচে কয়েকজন লোককে দেখে চিনতে পেরে ভয়ানক চমকে উঠলো শহীদ। স্তম্ভিত হয়ে গেল
সে! এ-ও কি সম্ভব!
দশ-বারোজন লোকের মধ্যে তিনজনক চিনতে পারলো সে। মৃত্যু, জরা এবং রোগের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে এ সব শত্রুকে পরাজিত করার দুঃসাহসিক সংগ্রামে মেতে থেকে কুয়াশা কি ভীষণ অসাধ্য পরিশ্রম করে সৃষ্টি করেছিল তার জীবনের একমাত্র কাম্য বস্তু-একটি সত্যিকার চিরযুগজয় থিসি। বিশ্বাসঘাতকতা করে সেই অমূল্য থিসিসের অর্ধকটা নিয়ে পালিয়েছিল নুরবক্স, তারপর আরও অর্ধেকটা সে হাতিয়ে নেয় কুয়াশার ভক্ত শিয় শক্তির কাছ থেকে। সেই জঘন্য চরিত্রের নবক্সকে এখানে দেখতে পাবে কল্পনাও করতে পারেনি শহীদ। আর দেখতে পেলো ড, ক্লিনসবার্গকে। ড, ক্লিনসবার্গ কুয়াশার বিশ্বস্ত বিজ্ঞান-সাধক। একটা লোহার মঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রেখে ড. ক্লিনসবার্গের হাত দুটো পিছমোড়া করে একটা খামের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। কামালকেও দেখতে পেলো শহীদ একটি থামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা অবস্থায়।
নুরবক্স ড. ক্লিনসবারে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে গর্বিত ভঙ্গিতে। এতক্ষণ ধরে বোধহয় সে ড. ক্লিনসবার্গকেই ধমকাচ্ছিল। ঠিক তাই। আবার নুরবক্স কথা বলে উঠলো উদ্ধত ভঙ্গিতে, ভাবছো কি ক্লিনসবার্গ, তোমার জন্যে মাত্র দু’টো রাস্তাই খোলা আছে। আবার বলছি হয় আমার কথামত কাজ করা, না হয় তিলে তিলে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে খতম হতে হবে তোমাকে!’
দৃঢ় কণ্ঠ শোনা গেল ড, ক্লিনসবার্গের, ‘আমার একটিমাত্র উত্তর আছে-তামি কুয়াশার জন্য মরতে হয় মরবো, তবু তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে কোনো আপোষ করবো না।’
নুরক্স পাগলের মতো হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বলো, ‘কুয়াশা? সে এখন
৫৮
থিসিসের শোকে পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। তার কথা আর বলে কি লাভ, সে এখন ঢোঁড়া সাপ বৈ আর কিছু নয়। আর আমি, আমিই হবা তার থিসিস অনুয়ায়ী সাধনা করে জয়ী–পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে একমাত্র আমিই হবে৷ অমর।’
ড. ক্লিনবার্গ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘মানবজাতির কলঙ্ক তুমি, প্রভুভক্ত যে কোনো কুকুরও তোমার চাইতে পবিত্র চরিত্রের অধিকারী।
উ. ক্লিনসবার্গের কথা শেষ হবার আগেই সপাং করে একটা চাবুক এসে লাগলো তার মুখে। দাঁত কিড়মিড় করে নুরবক্স তার একজন অনুচরকে হুকুম দিলো, ‘আগুন জ্বালিয়ে দাও ওখানে।
| ড. ক্লিনসবার্গকে যে লোহার মঞ্চে বেঁধে রাখা হয়েছিল তার নিচে কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো। ৪. ক্লিনসবার্গের মুখের কয়া বেয়ে রক্তের ধারা ঝরে পড়তে লাগলো বুকের ওপর ফোঁটা ফোঁটা। .
প্রচণ্ড রাগে কাঁপছিল শহীদের সর্বশরীর। সে যদি গুলি কর, তব পালটা গুলিতে কাঁচের জারগুলো ভেঙে গিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য আগুন লেগে যাবে নির্ঘাৎ। তাছাড়া এতগুলো লোকের সঙ্গে সে একা যুঝেও উঠতে পারবে না। অথচ, ড. ক্লিনসবার্গের উপর নির্যাতন এখন ক্রমেই চরমে পৌঁছবে। শহীদ কি করবে ভেবে ঠিক করতে পরছিল
।
এমন সময় হঠাৎ মেশিন গানের ঠা-ঠা-ঠ৷ শব্দে হতভম্ব হয়ে গেল শহীদ। নুরবক্স ছাড়া আর ছ’জন অনুচর এক পলকের মধ্যে ঢলে পড়লো মাটিতে।
নাটকীয় ব্যাপার নিঃসন্দেহে। শহীদ ভাবলো, কিন্তু এই নাটকের নায়ক কে? পরক্ষণেই একটা গম্ভার কণ্ঠস্বর হলঘরের অদৃশ্য অংশ থেকে ভেসে এলো, ‘মাথার উপরে হাত তুলে দাঁড়াও, নুরবক্স। আমি তোমার মৃত্যুদূত, কুয়াশা। থিসিসের জন্য পাগল হয়ে আছি আমি! প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এমন শাস্তি তোমাকে দেবো যে তা দেখে মানুষ শিউরে উঠবে। সে ব্যবস্থাও সারা হয়েছে। এখন শুধু থিসিসটা পেতে হবে আমায়। তারপর
খুট করে পিছনে একটা শব্দ হতেই শহীদ চকিতে পিছন ফিরে গুলি করলো। একটা লোক খোলা ভোজালি হাতে এগিয়ে আসছিল তাকে লক্ষ্য করে। একটি মাত্র আর্ত চিৎকার করে পড়ে গেল লোকটা।
রিভলভারের শব্দ মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শহীদ শুনতে পেলো তার উদ্দেশে কুয়াশার কণ্ঠস্বর, নির্ভয়ে এগিয়ে যাও, শহীদ। ড. ক্লিনসবার্গের নিচে লোহা গরম হয়ে উঠেছে।
উদ্যত রিভলভার হাতে আত্মপ্রকাশ করলো শহীদ। নুরবক্সের পিছনে এসে দাঁড়াতেই কুয়াশাকে দেখতে পেলো সে। কালো আলখেল্লা পরিহিত বিশাল মূর্তি, মেশিনগান হাতে অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। আচমকা কুয়াশার পিছনে দৃষ্টি পড়লো তার। একটি লোক পিছন থেকে উঁচিয়ে ধরছে মোটা একটি লোহার রড কাশ-১০
কুয়াশার মাথা লক্ষ্য করে। অস্ফুট একটা শব্দ বের হলো শহীদের মুখ থেকে। শহীদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা টের পেল কুয়াশা। ঘুরে না দাঁড়িয়ে এক হাতে মেশিনগানটা সামলে পিছন দিকে একটা লাফ দিয়ে আরেক হাতে কুয়াশা জড়িয়ে ধরলো আক্রমণাদ্যত লোকটিকে। তারপর অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় লোকটিকে মাথার উপর তুলে নিয়ে জোরে ছুঁড়ে দিলো ঘরের এককোণে। আশাতীত অঘটন ঘটে গেল নিমেষের মধ্যে। সেই সঙ্গে শহীদের রিভলভারটাও গর্জে উঠলো নুরবক্সের হাত লক্ষ্য করে। কুয়াশার ছুঁড়ে দেয়া লোকটা একটা বিরাট বড় কাঁচের জারের উপর গিয়ে পড়লো। জারের উপরের কাঁচটা ভেঙে লোকটা ভিতর পড়তেই দপ করে একটা শব্দ হয়েই আগুন ধরে গেল। এদিকে র অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে নুরবক্স পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনছিল একটি রিভলভার। শহীদ গুলি করলো ঠিক যখন নুরবক্স রিভলভারটার অর্ধেকটা বের করে আনতে পেরেছে। গুলিটা নুরবক্সকে আঁচড়ও কাটলো না, শুধু রিভলভারটা পকেট থেকে বের হয়ে ছিটকে পড়লো দূরে।
জ্বলন্ত মানুষটাকে একবার দেখে নিয়ে কুয়াশা নরবক্সের সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় উচ্চারণ করলো, ‘আমার থিসিসটা কোথায় রেখেছিস, শয়তান?’
দুহাত মাথার উপর তুলে দাঁড়িয়েছিল নুরবক্স; সেই অবস্থাই অকস্মাৎ হাঃ হাঃ করে হাসিতে ফেটে পড়লো সে। পাগলের মতো দেখাচ্ছিল নুরবক্সকে। ধরা পড়ে গিয়ে মুরবক্স কি পাগল হয়ে গেলি? নাকি পালিয়ে যাবার সুযোগ তৈরি করবার জন্যে এটা একটা চাল?
| গুরুগম্ভীর গলায় কুয়াশা আবার বললো, ‘আমার থিসিস কোথায়?
হঠাৎ হাসি থামালো নুরবক্স। চিৎকার করে বলে উঠলো সে, ‘থিসিস! থিসিস চাও, না?’
আবার নুরবক্সর উন্মত্ত হাসিতে ভরে উঠলো ঘর।
হাসি বন্ধ হতেই কুয়াশার গলা কঠিনতর হয় গমগম করে বেজে উঠলো আবার, ‘শেষবারের মতো জানতে চাইছি, পিসিস কোথায় রেখেছিস, নরাধম?”
চিবিয়ে চিবিয়ে নুরবক্স যেন ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো, ‘সত্যি, থিসিসটার খোঁজ এবার তোমাকে তাহলে দিতে হয়। তা ব্যাপারটা কি জানো, কুয়াশা, থিসিসটা তুমি নিজের হাতেই জাহান্নামে পাঠিয়েছ, বুঝলে কিছু?
আবার হেসে উঠলো নুরবক্স উৎকট শব্দে।
এমন সময় ড, ক্লিনসবার্গ বলে উঠলেন, ‘আমাকে এখান থেকে সরান তাড়াতাড়ি, আমি আর পারছি না সহ্য করতে।’
| দ্রুত পায়ে ড. ক্লিনসবার্গের দিকে এগোলো শহীদ। ড. ক্লিনসবার্গের মুখ যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা ছাড়াও হতাশায় মাথাটা ঘাড় থেকে নুয়ে পড়তে চাইছে যেন। বাঁধন খুলে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ড. ক্লিন সবার চোখের কোণে পানি দেখে বিস্মিত হলো শহীদ। মঞ্চ থেকে নেমে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ড. ক্লিনসবার্গ কুয়াশার উদ্দেশে
৬০
ভলিউম-s
বলেন, ‘ব্যাপারটা ঠিক তাই ঘটেছে, স্যার! আপনি যে লোকটিকে কাঁচের জারের ভিতর ছুঁড়ে দিলেন সেই লোকটির কাছেই ছিলো থিসিসটার মাইক্রোফিল্ম। মূল থিসিসটা অনেক আগেই পুড়িয়ে ফেলেছে নুরবক্স। ড. নিসবার্গের কথা শেষ হতেই
অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতার মধ্যে কয়েক মুহূর্ত কাটলো শহীদের।
কুয়াশা সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে গগনবিদারী কণ্ঠে শিকার করে উঠলো– খোদা আ..অ…
কাঁপতে লাগলো কুয়াশা। কয়েক মিনিট কেটে গেল শোকাভিভূত নিস্তব্ধতায়। এমন সময় অনেক মানুষের মিলিত একটি হৈ-চৈ এর শব্দ কানে এসে লাগলো ওদের।
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে নুরবক্স। কুয়াশার চিৎকার শুনে তার মত জঘ। চরিত্রের লোকও কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই কুয়াশার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল, নুরব, আমি নিজের হাতে শাস্তি দেবো, শহীদ। ওকে আমি নিয়ে যাই।
মেশিনগান হাতে এগিয় এলো কুয়াশা। হলঘরের একটা অংশে তখন যেন দোজখের আগুন জ্বলছে। কুয়াশা নুরবক্সকে বেঁধে ফেলে টেনে নিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে এমন সময় শহীদ বলে উঠলো, ওদিকে যেয়ো না, কুয়াশা, মি. সিম্পসন আছেন।
| কুয়াশা হাসিমুখে শহীদের দিকে তাকালো। তারপর অন্তরঙ্গ কণ্ঠে বললো, ‘না। শহীদ, তুমি যাকে মি. সিম্পসন বলে জানো তিনি এখন বাংলোর গ্যারেজে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গজরাচ্ছেন। তার সেপাইগুলোর হালও একই হয়েছে। ওদের এই দুরবস্থার জন্য অবশ্য আমিই দায়ী। বাংলো ঘরের সুড়ঙ্গের মুখ পাহারা দিচ্ছে এখন। আমারই লোকজন। মুচকি হাসলো শহীদ। কুয়াশা আবার বললো, ‘চলি বন্ধু, আবার আমরা মিলিত হবো।
নুরবক্সকে নিয়ে চলে গেল কুয়শা। কুয়াশার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো শহীদ শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টিতে।
সংবিত ফিরে এলো শহীদের, নিকটেই অনেক মানুষের হৈ-চৈ শুনে। শশারগোল, করতে করতে এগিয়ে আসছে কারা যেন। শহীদ বুঝতে পারলে, লোকগুলো। আদিবাসী। কমূহুর্ত’ পরেই একটা দরজা দিয়ে আদিবাসী সর্দার আতাকুকে দেখা গেল ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে। পিছনে রয়েছে আকুর মেয়ে বেলেসা এবং আরো অসংখ্য আদিবাসী।
বিবাট হলঘরের ভিতর ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়েছিল ওরা। তারপর বেলে হঠাৎ সকলকে ছাড়িয়ে কামালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করতে করতে। সবাই কামালের দিকে ছুটে গেল। বেলেসাকে কামালের বাঁধন খুলে দিতে তৎপর হয়ে উঠতে দেখা গেল।
| আর কিছুক্ষণ পর কামালকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে ছুটতে সুড়ঙ্গপথ বেয়ে বাংলোতে উঠে এলো শহীদ। ঘরে কাউকে দেখতে পেলো না সে। শহীদ অবশা কাউকে দেখতে
১
পাবে আশা করেনি। ছুটলো এরপর দুজনে গ্যারেজের দিকে। ক্রন্ত হাতে ওরা মি. সিম্পসনের বাঁধন খুলে দিতেই তিনি রাগে গজরাতে গজরাতে কি যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু তখুনি কার যেন একটা অস্পষ্ট আর্তচিৎকার ওদের কানে এসে প্রবেশ করলো। হঠাৎ কামাল বলে উঠলো, ‘নুরক্সকে জীবিত ধরতে হলে এবং কুয়াশাকে হাতে-নাতে ধরতে হলে আমার সঙ্গে আসুন, মি. সিম্পসন।’
কথা ক’টি বলই ছুটলো কামাল শব্দ লক্ষ্য করে। মি. সিম্পসন আর বৃথা বাক্য ব্যয় না করে কামালের অনুগামী হলেন। তাঁর দেখাদেখি সেপাইগুলোও। শহীদ এক মুহূর্ত থমকে থেকে কি যেন ভেবে ওদের পিছু নিলো।
| বাংলোর ডানদিকে, চার-পাঁচ শ গজ দূরে একটি খাদ। আর্তচিৎকারটা সেদিক থেকেই ভেসে এসেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা খাদের কাছে এসে পৌঁছালো। খাদের নিচে ব চলেছে খরস্রোতা পার্বত্য নদী। ঝুঁকে পড়ে কল্পনাতীত একটা দৃশ্য দেখতে পেলো ওরা। কুয়াশা বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এমন অত্যাশ্চর্য ব্যবস্থা করছে দেখে ওরা বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ওরা দেখলো, খাদের নিচে তৈরি করা হয়েছে ঠিক যেন একটি নাগরদোলা। পানির তোড়ে অনবরত ঘুরে চলেছে সেটা। নাগরদোলার প্রচলিত আসনগুলোর পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা লোহার পাতের মতা, তার একটিতে নুরবক্সকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। অনেক উপরে একটি মচারমতো তৈরি করা হয়েছে। আগুন জ্বলছে তাতে দাউ দাউ করে। নাগরদোলার অদ্ভুত ধরনের মোটা লোহার পাতগুলো একটি একটি করে নেমে যাচ্ছে, নিচে, পানির কয়েক হাত নিচে। তারপর আবার উঠে এসে জ্বলন্ত মাচাটার ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। তারপর আবার নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। একই ভাবে নুরবক্সও আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায় নেমে যাচ্ছে কয়েক হাত পানির নিচে, আবার উঠে এসে মাচার আগুনে ঝলসাচ্ছে বার বার।
হাত তিরিশেক নিচে মাচার আগুনের লালচে আলোয় বীভৎস ব্যাপারটা দেখতে পেলো ওরা। তখন নুরবক্সের আর্তচিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না। কুয়াশার চিহ্নমাত্র ওরা খুঁজে পেলো না কোথাও। শুধু পার্বত্য নদীর খলখল হাসি শোনা যেতে লাগলো। ওদের কারও মুখে কোনো কথা ফুটলো না।
আট
রিজার্ভ করা একটা রেলের কামরায় চড়ে ফিরছিল কামাল, শহীদ আর গফুর। মি, সিম্পসনাবশালবনেই রয়ে গেছেন। জরুরী কয়েকটা কাজ বাকি আছে সেখানে।
বিঃ হৃদয় শহীদ ভাবছিল, ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হচ্ছিলো সে, একজনকে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি বলে। কামাল প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শহীদের দিকে, বললো, ‘কই শুরু কর। ৬২
শহীদ বললো, ‘তোর কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাকে বল, উত্তর দিচ্ছি অল্প কথায়।’
একটু চিন্তা করে কামাল বললো, ‘মি. খোন্দকারের ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও রহস্যই রয়ে গেছে, শহাদ।’।
| ‘মিস্টার খোন্দকারের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।’
শহীদ কামালকে চমকে দিয়ে শুরু করলো, ‘মি, খোন্দকার ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। কিছুদিন আগে ভদ্রলোকের মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেয়। ভদ্রলোক ইংরেজি ডিটেকটিভ উপন্যাসের খুব ভক্ত পাঠক ছিলেন। দিন-রাত ওইসব ক্রাইম উপন্যাস পড়ে পড়ে তিনিও নিজেকে ডিকেটটিভ বলে ভাবতে শুরু করেন।’
কামাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এ সব তুই জানলি কেমন করে?’
মি. খোন্দকারের ঘর তল্লাশি করে একটা ঠিকানা পাই আমি। সেই ঠিকানায় চিঠি লিখে আমি সব জানতে পারি।’
| কামাল আবার প্রশ্ন করলো, ‘নুরবক্সের লোক প্রতিদিন রাতে হাউই ছুড়তো সঙ্কত জানাবার জনো, তাই না?’
শহীদ বললো, ‘হা। নুরবক্সের পাঁচজন লোক ছিলো পাতালপুরার বাইরে। প্রতিদিন বাংলার বাতি নিভে যাবার একঘন্টা পর আকাশে হাউই ছোঁড়বার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তাদের।’
‘কেন?’
সঙ্কেতটার অর্থ হলো, অফিসাররা ঘুমিয়েছেন। সঙ্কেতটা নুরবক্সের পাতালপুরী থেকেও দেখা যেতো। তারপর দরকার বোধ করলে, অফিসারকে ভয় দেখাবার জন্যে বা তার বিছানায় বিষাক্ত মাকড়সা ছেড়ে দিয়ে হত্যা করবার জন্যে ঘরের পাথর সরিয়ে উঠে আসতে নুরবক্সর লোক।’
কামাল বললো, ‘তা হলে পাহাড়ের উপর শিকল এবং লিভার থাকার মানে? ভিতর থেকেও তো লিভার সরিয়ে পথ করে নেবার বন্দোবস্ত ছিলো।
| শহীদ বললো, ‘বাইরে থেকে পাতালপুরীতে নুরবক্সের সঙ্গে দেখা করার জন্য এই ব্যবস্থা। বাইরের পাঁচজনের ওপর ভার ছিলা ফরেষ্ট অফিসারকে ভয় দেখানো, রাতে সঙ্কেত জানানো, এবং বিশেষ কোনো খবর থাকলে বাংলোর ভিতর দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ গিয়ে নুরক্সের সঙ্গে দেখা করে সব জানানো।
| কামাল বললো, ‘বুঝলাম। আর নারীকণ্ঠের ওই খিল খিল হাসিটা নিশ্চই টেপ করা?’
‘হাঁ।’
‘কামাল প্রশ্ন করলো, নুরবক্স ফরেস্ট অফিসারদেরকে একের পর এক হত্যা করে যাচ্ছিলো কেন, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয় এখনও।
শহীদ বললো, ‘অত্যন্ত সহজ এর উত্তর। নুরবক্সের যাতায়াতের একমাত্র সহজ পথ ছিলো বাংলোর ঘরটার মধ্যে দিয়েই। দ্বিতীয় আর একটি পথ সে ব্যবহারোপযোগী কুশা-১০
|
|
|
করেছিল অজগর সাপটিকে হত্যা করে। কিন্তু এই পথটা ব্যবহার করা সম্ভব ছিলো না কোনো ক্রমেই। আদিবাসীরা তা হতে দিতো না কখনো। ফরেস্ট অফিসারেরা ঘরে থাকার ফলে নুরবক্স ও তার লোকজনরা নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারতো না। তার জন্যেই এই হত্যাকাণ্ড।
শহীদের কথা শেষ হতেই কামরায় নেমে এলো অটুট নীরবতা। শুধু চলন্ত ট্রেনের একঘেয়ে আওয়াজ বিরামহীন বাজতে থাকলো কানে।
Leave a Reply