কাউন্টরজারের গুপ্তধন
সেদিন সকালে খানিয়া নগর ঘুরে বেড়াবার জন্যে ভাইকিংদের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হলো। সকালের খাবার ফ্রান্সিস আর মারিয়া কেবিনঘরে বসেই খেল। এবার মারিয়া চামড়ার দুটো বড়ো পেটী খুলল। ফ্রান্সিসের জন্যে যে ভালো দুটো পোশাক এনেছিল তা একটা খুঁজে বের করল। পোশাক দেখে ফ্রান্সিস হেসে বলল, এ তো তোমাদের বাড়িতে, মানে রাজবাড়িতে নাচের আসরে যাবার পোশাক।
—আমরা খানিয়া নগর ঘুরে বেড়াতে যাচ্ছি। আজকে অন্তত ভালো পোশাকটা পরো। সবসময় তো ঐ লড়াইয়ের পোশাকটা পরে থাকো। মারিয়া বলল।
—মারিয়া, আমরা ভাইকিং। এটাই আমাদের উপযুক্ত পোশাক। জীবনটাই তো একটা লড়াই। ফ্রান্সিস বলল।
খুব হয়েছে। নাও পরো এটা। মারিয়া হেসে বলল।
কিছুক্ষণের মধ্যে হ্যারি, বিস্কো, শাঙ্কো আর অন্য সব ভাইকিংরা যে যার ভালো পোশাক পরে তৈরি হয়ে জাহাজের ডেক-এ এসে সে জড়ো হলো। জাহাজের জীবন বড়ো একঘেয়ে। দিনরাত চারদিকে সীমাহীন সমুদ্রে মাটির দেখা পাওয়ার জন্যে, মাটিতে নামার জন্যে ওরা আকুল হয়ে থাকে। আজকে শুধু মাটিতে নামা নয়, মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো। যুদ্ধনয়, শান্তির দিন আজ। ওরা সাগ্রহে ফ্রান্সিস ও মারিয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পরেই সুন্দর পোশাক পরে ফ্রান্সিস ও মারিয়া ডেক-এ উঠে এলো। মারিয়া পরেছে হালকা গোলাপি রঙের পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢাকা গাউন। মারিয়াকে আজকে দেখতে রাজকুমারীর মতোই লাগছে। অবশ্য দীর্ঘদিন সমুদ্রে জাহাজে থাকার জন্যে মারিয়ার গায়ের রঙ আগের মতো গোলাপিফর্সা নেই। একটু যেন তামাটে হয়ে গেছে। ওরা দুজনে আসতেই ভাইকিং বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল, ও-হো-হো। এটা ওদের আনন্দে, ধ্বনি, প্রতিজ্ঞার ধ্বনি, আবার প্রতিবাদেরও ধ্বনি।
এমন সময় দেখা গেল কাভাল্লি জাহাজের পাটাতন দিয়ে উঠে আসছে। ওকে দেখে ফ্রান্সিসরা সকলেই খুশি হলো। কাভাল্লি ফ্রান্সিসের কাছে এলো। হেসে বলল, কালকেই শুনেছি আপনারা আজ খানিয়া নগরে ঘুরে বেড়াবেন। আপনারা তো চেনেন না, তাই আমি এলাম। সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো আপনাদের।
—এ তো ভালোই হলো। ফ্রান্সিস হেসে বলল।
সবার আগে জাহাজের ফেলা পাটাতন দিয়ে কাভাল্লি, ফ্রান্সিস ও মারিয়া জাহাজঘাটায় নামল। পেছনে একে একে আর সব বন্ধুরা নামল। কাভাল্লি সবাইকে নিয়ে নগরের রাস্তা ১ দিয়ে চলল। পথের লোকজন দোকানদারেরা অনেকেই ফ্রান্সিসদের এই দলকে দেখল। তারা ভেবে পেলনা এরকম পোশাকপরা লোকগুলো কোন দেশের! বিশেষকরে মহিলারা মারিয়াকে বারবার দেখতে লাগল। এরকম মেয়েদের পোশাক ওরা কখনও দেখেনি। দল বেঁধে হৈ হৈ করে চলল ওরা।
প্রথমে কাভাল্লি ওদের নিয়ে গেল বিরাট দুৰ্গটায়। রাজা বোনিফেস-এর বাসস্থান আর সভাগৃহ এখানে। কাভাল্লি সবাইকে নিয়ে দুর্গের মধ্যে ঢুকল। ফ্রান্সিস, মারিয়া, হ্যারি দুর্গটা আগেই ভালো করে দেখেছে। ওরা দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বারে বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
দুর্গ দেখা হলে কাঙাল্লি ওদের নিয়ে চলল। একটা ছোটো অ্যাম্ফিথিয়েটার দেখাতে। খুব বেশি বড়ো নয় সেটা। চারদিকে পাথরে দেয়াল। প্রধান প্রবেশদ্বার নিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকল। দেখল চারদিকে গোল করে পাথরে বসার জায়গা। মাঝখানে গোল জায়গা। কাভাল্লি ঐ জায়গাটা দেখিয়ে বলল, এটাকে বলে এরেনা। এখানে তলোয়ারের লড়াইয়ের প্রতিযোগিতা হয়। রাতে মশালের আলোয় নাটকও অভিনীত হয়। তারপরে চলল সবাই উত্তর দিকে। দেখল ছবির মতো সুন্দর একটা হ্রদ। তারপরেই ঘাসে-ঢাকা ছোটো পাহাড়। পাথরে ছড়ানো ছোটো পাহাড়ি ঝর্ণা।
খানিয়া নগর খুব একটা বড়ো নয়। দুপুরের মধ্যেই প্রায় সব দেখা হয়ে গেল। ঘোরাঘুরির জন্যে বেশ খিদেও পেয়েছে সকলের। মারিয়াই প্রস্তাব দিল, এখল জাহাজে ফিরে গিয়ে রান্নবান্নার দরকার নেই। এখানেই কোনো সরাইখানায় খেয়ে নেওয়া যাক।
সব ভাইকিংরা হৈহৈ করে এই প্রস্তুবে রাজি হলো।
কাভাল্লি দুর্গের কাছে এক বড়ো সরাইখানায় এদের নিয়ে গেল। এত খদ্দের পেয়ে সরাইখানার মালিক খুশিতে আটখানা। সবাই টানা কাঠের বেঞ্চিতে বসল। সামনে কাঠের টানা টেবিলমতো। খেতে দেওয়া হলো বড়ো বড়ো গোল রুটি, তরকারি আর গরম গরম ভেড়ার মাংস। সবাই ক্ষুধার্ত। হাপুস হুপুস করে খেতে লাগল।
বিকেল নাগাদ ভাইকিংরা হৈহৈ করতে করতে জাহাজে ফিরে এলো। রাতে খাওয়া দাওয়ার সময় ভাইকিংরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল, এবার আর কোথাও নয়। সোজা দেশে ফিরবো। দু’একজন বলল, দেখো ফ্রান্সিস কী বলে।
রাত হলো। ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে আছে। ও ভেবে পাচ্ছে না এবার কী করবে? মারিয়া জিজ্ঞেস করল, ফ্রান্সিস, এখন কী করবে?
ফ্রান্সিস হেসে বলল, আমিও ঠিক এই কথটাই ভাবছি। তুমি,আমার বন্ধুরা সবাই তো দেশে ফেরার জন্যে আকুল। আমার কিন্তু দেশে ফিরে অলস সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটাবার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে করছে না।
—এখন তো কোথাও যাবার নেই। তবে দেশে ফিরতে চাইছো না কেন? মারিয়া বলল।
—কে বলতে পারে হয়তো ফেরার পথেই কোনো রহস্যের, কোনো গুপ্তধনের সংবাদ পেয়ে গেলাম। তখল? ফ্রান্সিস বলল।
—সে তখন ভাবা যাবে। এখন দেশের দিকে জাহাজ চালাতে বলো। মারিয়া বলল।
—বেশ, তোমরা যেমন চাও। ফ্রান্সিস বলল।
পরদিন সকালের খাবার খাওয়া হলো। জাহাজচালক আর নজরদার পেড্রোকে নিয়ে হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল, ফ্রান্সিস, এখন কী করবে?
—তাই তো ভাবছি। ফ্রান্সিস বলল।
—আমরা অনেকদিন দেশ ছেড়ে এসেছি। সবাই দেশে ফিরতে চাইছে। পেড্রো বলল। ঠিক আছে। ফ্রান্সিস জাহাজচালকের দিকে তাকিয়ে বলল, জাহাজ ছাড়ো দেশের দিকে। জাহাজচালক হেসে খুশিতে লাফিয়ে উঠল। পেড্রো দু’হাত তুলে হো-হো ধ্বনি তুলল। দু’জনেই ছুটল নিজেদের কাজের জায়গায়। দেশে ফেরার খবর ভাইকিংদের মধ্যে রটে গেল। সবাই হৈ হৈ করে উঠল।
পেড্রো দড়ি বেয়ে মাস্তলের মাথায় ওর বসার জায়গায় গিয়ে বসল। ঘরঘর শব্দে নোঙর তোলা হলো। কয়েকজন উঠে গেল পালের মাথায়। দড়িদড়া খুলে পালগুলো তুলে দিল। কিন্তু হাওয়ার তেমন জোর নেই। পালগুলো খুব ফুলে উঠলো না। তাই দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে নেমে গেল।
খানিয়ার জাহাজঘাটা থেকে ভাইকিংদের জাহাজ সরে এলো অনেকটা। সমুদ্রের জলে অনেকগুলো দাঁড় পড়ার শব্দ উঠল, ছপ—ছপ—
ফ্রান্সিস, মারিয়া আর হ্যারি জাহাজের ডেক-এ এসে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে খানিয়া বন্দর দূরে মিলিয়ে গেল। চারদিকে শুধু জল। জাহাজ তখন মাঝসমুদ্রে চলে এসেছে। সমুদ্রের জলে রোদ পড়েছে। ঝলসে উঠেছে শান্ত ঢেউ। শান্ত সমুদ্রের ওপর দিকে জাহাজ বেগে ভেসে চলেছে ভাইকিংদের দেশের উদ্দেশে।
তিন-চার দিন কাটল। ঝড়বৃষ্টি নেই। ভূমধ্যসাগরের শান্ত সমুদ্র। সমুদ্রের জল গভীর নীল। কদিনই হাওয়া বেগে বইছে। পালগুলো ফুলে উঠেছে। জাহাজ চলেছে। ভাইকিংরা খুশি। দাঁড় বাইতে হচ্ছে না। ডেকে বসে শুয়ে ওরা বিশ্রাম করে। দল বেঁধে কয়েকজন। ছক্কাপাঞ্জা খেলে। রাত হলে দেশের গল্প করে। কতদিন পরে দেশে ফিরছে ওরা। কেউ কেউ হেঁড়ে গলায় গানও ধরে।
সেদিন সন্ধে হয় হয়। পশ্চিম আকাশে তখন সবে সূর্য ডুবেছে। একটা গভীর কমলা রঙের আভা সারা পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে আছে।
হঠাৎ নজরদার পেড্রো চিৎকার করে বলে উঠল, ডাভা-ডাঙা দেখা যাচ্ছে। কথাটা ডেক-এ শুয়ে বসে থাকা ভাইকিংদের কানে গেল। ওরা ছুটে এসে রেলিং ধরে দাঁড়াল। পশ্চিম আকাশের কমলা রঙের আলোয় ওরা দেখল পশ্চিম দিকে কিছু দূরে ডাঙ। তবে সমতল নয়। ছোটো ছোটো উঁচু-নিচু টিলার সারি। এটা কোনো দ্বীপ না দেশ, বুঝে উঠতে পারল না ওরা। ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে খবর পাঠানো হলো।
একটু পরে দু’জনে এলো। সঙ্গে মারিয়া। সেই টিলার সারির রঙ কেমন বোঝা যাচ্ছে না। সন্ধের নিস্তেজ আলোয় কালো কালো দেখাচ্ছে। ফ্রান্সিস ডাকল, হ্যারি
—বলো। হ্যারি বলল।
—এটা কোনো দ্বীপ না দেশ বুঝতে পারছি না। কী করবে এখন?
দ্যাখো ফ্রান্সিস, আমরা এখন দেশে ফিরছি। এটা কোনো দ্বীপ না দেশ সেটা এখন জানার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। তবে একটা সমস্যা হচ্ছে এই, ডাঙার পাশ দিয়েই আমাদের যেতে হবে। কাজেই ডাঙায় কারা থাকে, তারা আমাদের কোনো বিপদে ফেলে কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে। হ্যারি বলল।
—তা ঠিক। ফ্রান্সিস বলল, তবে আমরা কোথায় এলাম এটাও তো জানা দরকার।
তাহলে এক কাজ করো, হ্যারি বলল, সন্ধের একটু পরে আমরা কেউ নৌকায় চড়ে ওখানে যাবো। যদি দেখি লোকজন আছে, কোনো ভয়ের কারণ নেই, তবে তাদের কাছে জেনে নেব এই জায়গাটা কী? দ্বীপ না কোনো দেশ? সেটা জানতে পারলে বুঝতে পারবো আমরা কোথায় এলাম, আমাদের দেশ কতদুর।
ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে একটু ভাবল। তারপর মাথা তুলে বলল, বেশ, আমিই যাবো।
—আমিও যাবো, মারিয়া বলে উঠল। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল, অচেনা অজানা জায়গা। দু’জনে বিপদে পড়লে তখন আমাদের উদ্ধার করতে গিয়ে আমার বন্ধুদের হয়তো লড়াইয়ে নামতে হবে। মিছিমিছি বোকার মতো রক্তক্ষয়, মৃত্যু আমি চাই না। আমি একাই যাবো।
সন্ধের পরে পরেই ফ্রান্সিস দ্রুত রাতের খাবার খেয়ে নিল। কোমরে তলোয়ার খুঁজল। মারিয়া একটু ভীত স্বরে বলল, তুমি একা একা যাবে। যদি কোনো বিপদে পড়ো।
ফ্রান্সিস হেসে বলল, অত ভয় পেলে তো বাড়ি থেকেই বেরুনো যায় না। অথচ কোথায় কোনো অচেনা সমুদ্রে, অজানা দেশে এসেছি আমরা তাহলে এলাম কেন?
মারিয়া আমতা আমতা করে বলল, না, বলেছিলাম—সাবধানে—
—কিছু ভেবো না। মনে সাহস আনন। ফ্রান্সিস বলল।
ডেক-এ উঠে ফ্রান্সিস রেলিঙের ধারে এলো। ঝুঁকে দেখল একটা নৌকা নামানো হয়েছে। ঢেউয়ে দুলছে নৌকোটা। হ্যারি শাঙ্কো—ওপা কয়েকজন ওর কাছে এলো। হ্যারির গায়ে একটা চাদরের মতো কাপড় জড়ানো। ফ্রান্সিস সেটা দেখল, কিন্তু কিছু বলল না। ওরা ফ্রান্সিসের সঙ্গী হতে চাইছিল। ফ্রান্সিস নৌকোয় নামবার জন্যে তৈরি হচ্ছে তখন হ্যারি এগিয়ে এলো। বলল, ফ্রান্সিস, তুমি কি একাই যাবে?
—হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।
—একটা কথা ভেবেছো? হ্যারি বলল।
—কী? ফ্রান্সিস বেশ আশ্চর্য হয়েই বলল।
—যদি ওখানে গিয়ে কোনো লোকের সঙ্গে বা লোকেদের সঙ্গে দেখা হয় তখন কী বলবে?
—বাঃ। জানতে চাইবো যে এটা কোন দেশ। ফ্রান্সিস বলল।
—তোমার কথা ওরা বুঝবে? হ্যারি হেসে বলল।
—আরে! ফ্রান্সিস প্রায় লাফিয়ে উঠল, সত্যিই তো-এটা তো ভেবে দেখিনি। ওদের ভাষা তো আমিও বুঝবো না।
সুতরাং—হ্যারি হেসে বলল, আমি কিন্তু গ্রীক ভাষাটা অল্পস্বল্প বুঝি।
হ্যারি, যাও শিগগির তৈরি হয়ে এসো। তুমি না থাকলে তো—
হ্যারি গায়ের কাপড়টা খুলে বিস্কোর হাতে দিল। দেখা গেল হ্যারির কোমরে তলোয়ার গোঁজা। পোশাকটাও নতুন। বলল, চলো আমি তৈরি হয়েই এসেছি।
দুজনে দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে পরপর নৌকাটার ওপর নামল। ফ্রান্সিস দাঁড় রইতে লাগল। হ্যারি শরীরের দিক থেকে খুব সবল না। বেশি পরিশ্রম করতে পারেনা। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিস নৌকো চালালো ঐ টিলাগুলো লক্ষ্য করে।
বাঁকা চাঁদ রয়েছে আকাশে। কিন্তু চাঁদের আলো নিস্তেজ। অস্পষ্ট সমুদ্রের জল, টিলাগুলো দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিস এটাই চাইছিল। এই আধো-আলো আধো-অন্ধকারে সমুদ্রতীরে লোকজনের অলক্ষ্যে পৌঁছুনো যাবে। সবকিছু স্বাভাবিক দেখলে তবেই লোকজনের সামনে যাওয়া যাবে। অবশ্য যদি ওখানে মানুষজন থাকে।
.
তীরের কাছে নৌকোটা বেয়ে নিয়ে এলো ফ্রান্সিস দেখল এখানে সমুদ্রের জল থেকে টিলা উঠে গেছে। এখানে নামার অসুবিধে। তবু এখানেই নামতে হবে।
তারপর টিলাটার মাথার ওঠা যায় কিনা দেখতে হবে। উঠতে পারলে ওপর থেকে সহজেই চারদিক দেখা যাবে।
নৌকাটা টিলার গায়ের কাছে নিয়ে এলো ফ্রান্সিস অন্ধকারে দু’চোখ কুঁচকে দেখতে লাগল নৌকো কোথাও ভেড়ানো যায় কিনা। পেল একটা জায়গা। গুহার মতো লম্ফাটে ফাঁক একটা। ফ্রান্সিস ফাঁকের মধ্যে নৌকো ঢুকিয়ে দিল। আটকে গেল নৌকোটা।
এবার ফ্রান্সিস টিলা পাথুরে গা-টা দেখতে লাগল। খাড়ানো বেশ হেলে আছে দেখল কিছু পাথরের চাই উঁচিয়ে আছে। ফ্রান্সিস বুঝল,ওগুলো ধরে ধরে ওপরে ওঠা যাবে। ফ্রান্সিস প্রথমে পাথরে একটা ওঁচানো চাঁই ধরল। তারপর পাথরের খাঁজে পা রেখে রেখে উঠতে শুরু করল। মুখ নিচু করে বলল, হ্যারি, আমি যেভাবে উঠছি, দেখে দেখে তুমিও উঠে এসো।
—পারবো? হ্যারি একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল।
—কেন পারবে না। উঠতে শুরু করো। ফ্রান্সিস বলল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সাবধানে উঠতে লাগল। একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার নয়। খুব অস্পষ্ট চাঁদের আলো রয়েছে। পেছনে হ্যারি ও উঠতে লাগল।
বেশি উঁচুনা। একসময় শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ফ্রান্সিস টিলার ওপরে উঠে এলো। প্রথমেই দাঁড়িয়ে পড়ল না। একটা পাথরের চাইয়ের আড়াল থেকে সামনের দিকে তাকাল। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখল সামনে একটা ঘাসে ঢাকা প্রান্তর। তারপরে গাছপালা, কিছু কাঠপাথরের ঘরবাড়ি। ওসব ছাড়িয়ে দূরে ধূ ধূ দেখা যাচ্ছে জলের আভাস। ফ্রান্সিস ভাবল তাহলে এটা একটা ছোটো দ্বীপ। যতদূর চোখ যায়,জনমানবের দেখা নেই। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হলো। উঠে দাঁড়ালো। তখনই হ্যারির হাঁপানো গলা শুনল, ফ্রান্সিস, হাতটা ধরো। ঘুরে দেখল হ্যারি হাত বাড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস নিচু হয়ে হাত বাড়িয়া হ্যারির হাত ধরল। তারপর হ্যারিকে টেনে তুলে নিল। হ্যারি উঠে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।
দু’জনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ দেখল ঐ গাছগাছালি ঘরবাড়ির দিক থেকে অনেক লোক আসছে প্রান্তরের দিকে। অনেকের হাতে জ্বলন্ত মশাল, খোলা তলোয়ার,বর্শা।
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে হ্যারির ডান হাত ধরে টান দিয়েই পাথরের আড়ালে বসে পড়ল। হ্যারি ও সঙ্গে সঙ্গে ওর পাশে বসে পড়ল।
ওরা পাথরের আড়াল থেকে দেখল সেই দলবেঁধে আসা লোকগুলোর সামনে একজন লোকও আসছে। বেশ দৃপ্তভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে আসছে লোকটা। বোঝা গেল ঐ লোকটাই ওদের নিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই ওদের নেতা-টেতা হবে।
ঘাসে-ঢাকা প্রান্তরে লোকগুলো দলে দলে এসে দাঁড়াল। এ প্রান্তরে পড়ে-থাকা একটা বড়ো পাথরসহ সেই নেতা উঠে দাঁড়াল। উপস্থিত লোকদের কথাবার্তা থেমে গেল। একজন লোক নেতার পাশে একটা জ্বলন্ত মশাল তুলে ধরে রইল। এবার সেই নেতাকে ফ্রান্সিস একটু ভালোভাবে দেখল। নেতাটি যুবক, সুন্দর সুগঠিত শরীর। বুকে লোহার বর্ম। কিন্তু মাথায় শিরস্ত্রাণ নেই। মাথার লজ্জ্বা লা চুল ঘাড়ের পেছনে ঝুলে পড়েছে। সমুদ্রের জোর হাওয়ায় তার মাথার চুল উড়ছে।
এবার নেতা যুবকটি গলা চড়িয়ে বলল, আমার বিদ্রোহী বন্ধুরা—
সমুদ্রের জোর হাওয়া। ফ্রান্সিসদের দিকে বইছে। যুবকটির কথা কাজেই ওরা একটু অস্পষ্ট হলেও শুনতে পেল। যুবকটির কথা ফ্রান্সিস বুঝল না। হ্যারি বুঝল। আস্তে বলল, ফ্রান্সিস,যুবকটি লো ল্যাতিন ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছে। এই লো ল্যাতিন ভাষাটা বেশ সহজ। আমি ভালো বুঝি একটু বলতেও পারি। তবে অক্ষর চিনি না।
এবার যুকবটি যা বলতে লাগল হ্যারি আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসকে তা বুঝিয়ে দিতে লাগল। যুবকটি বলছে, আমরা সারাসেনরা সিসিলি দ্বীপের প্রাচীন অধিবাসী। অথচ রাজা ফ্রেডারিক আমাদের সব অধিকার জমি অর্থ কেড়ে নিচ্ছে। অত্যাচারও চালাচ্ছে। রাজা ফ্রেডারিক বিদেশি নৰ্মানদের বংশধর। আমরা তার অধীনতা স্বীকার করবো কেন? সিসিলি আমাদের মাতৃভূমি। আমরা সিসিলি থেকে ঐ নর্মান বিদেশিকে তাড়াবো। রাজা ফ্রেডারিকের বংশব্দ ভূস্বামীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দক্ষিণ সিসিলি থেকে পালিয়ে আমরা এই লিপারি দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছি। যুবকটি থামল। তারপর আবার বলতে লাগল, আমরা আজ রাতেই অন্ধকারের মধ্যে সিরাকস বন্দরে নামবো। আক্রমণ করবো ম্যামিয়েস দুর্গ। সমবেত বিদ্রোহীরা হৈহৈ করে চিৎকার করে উঠল। যুবকটি আবার বলতে লাগল, আমরা সংবাদ পেয়েছি রাজা ফ্রেডারিকের একদল সৈন্য রাজধানী পোলামো থেকে জাহাজে চড়ে এই সিরাকস বন্দরে আসছে। উদ্দেশ্য, ম্যামিয়েস দুর্গ রক্ষা। আমরা নতুন সৈন্যদল পৌঁছবার আগেই দুর্গ দখল করবো। যুবকটি থামল। আবার চিৎকার হৈ-হল্লা খোলা তলোয়ার ঘোরানো, বর্শা উঁচিয়ে ধরা, মশাল নাচানো শুরু হলো। যুবকটি আবার বলতে লাগল, সমুদ্রতীরে আমাদের যত নৌকো আছে সব জড়ো করা হয়েছে। নৌকোয় চড়ে আমরা সিরাকস বন্দরে নামবো। তারপর দুর্গ দখলের লড়াই। লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে। বক্তৃতা শেষ করে পাথর থেকে নেমে দাঁড়াল।
এরপর যুবকটি হেঁটে চলল সেই গাছগাছালি ঘেরা বাড়িগুলোর দিকে। বিদ্রোহীরাও হৈহৈ করতে করতে পেছনে পেছনে চলল।
ফ্রান্সিস বলল, হ্যারি কী বুঝলে?
বুঝলাস এটা একটা ছোটো দ্বীপ, লিপারি। কাছেই সিসিলি দ্বীপ। ঐ দ্বীপের রাজা এখন ফেডারিক। এই দ্বীপে যারা আশ্রয় নিয়েছে তারা সারাসেন। সিসিলির আদিঅধিবাসী। রাজা ফ্রেডারিকের অনুগত কিছু ভূস্বামী এদের দ্বীপছাড়া করেছে। তদুপরি রাজা ফ্রেডারিক বিদেশি নৰ্মানদের বংশধর। কাজেই এই সারাসেনরা একটি যুবকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছে। আজ রাতে ওরা এই দ্বীপ থেকে নৌকোয় চড়ে গিয়ে মূল দ্বীপ সিসিলির সিরাকস বন্দরে # নামবে। তারপর ম্যামিয়েস দুর্গ আক্রমণ করবে। হ্যারি বলল।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ফ্রান্সিস বলল, আমরা সিসিলি দ্বীপের কাছে এসেছি। এখানে এখন যুদ্ধ চলবে। কাজেই আমরা এখানে নামবো না। বাঁ দিক দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবো।
তাই ভালো। হ্যারি বলল, এসবের সঙ্গে আমরা জড়াবো না।
এবার ফ্রান্সিস বলল, চলো জাহজে ফিরবো। দু’জনে আগের মতোই ওঁচানো পাথর ধরে ধরে পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে নীচে নেমে এলো। দেখল নৌকোটা ঠিকই আছে। ওরা আস্তে আস্তে নৌকোয় নেমে বসল। ফ্রান্সিস দাঁড় বাইতে লাগল। নৌকো চলল জাহাজের দিকে।
দু’জনে জাহাজে উঠল। ভাইকিং বন্ধুরা ওদের ঘিরে ধরল। মারিয়াও এসে একপাশে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সব কথা বলল। তারপর বলল, আমরা সিসিলির বিদ্রোহ, যুদ্ধএসবের সঙ্গে জড়াবো না। রাত একটু বেশি হলে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সিসিলির দক্ষিণ দিক দিয়ে জাহাজ চালিয়ে চলে যাবো। কথাটা শুনে ভাইকিং বন্ধুরা খুশিই হলো। সিসিলিতে নামা হবে না। সোজা দেশের দিকে যাওয়া যাবে।
ফ্রান্সিস কেবিনের দিকে চলল। সঙ্গে মারিয়া আসতে আসতে বলল, জানো, সিসিলি ভূমধ্যসাগরের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো দ্বীপ। সিসিলিকে বলা হয় ভূমধ্যসাগরের উদ্যান।
ফ্রান্সিস হাসল। বলল, মারিয়া–তুমি কত পড়াশুনা করেছো?আমি কিন্তু গোমুখখু গোঁয়ার।
—মারিয়া বেশ দৃঢ়স্বরে বলল, না। তুমি আমাদের দেশের গর্ব, ভাইকিং জাতির গর্ব।
—ফ্রান্সিস হেসে মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলল না।
—রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে ডেক-এ উঠে এলো। কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস বলল, পাল খাটাও। এখুনি জাহাজ ছাড়বো। বন্ধুরা পালের কাঠে উঠে গেল। দড়িদড়া ঠিক করে পাল খুলে দিল। জাহাজচালক হুইলের কাছেই দাঁড়িয়েছিল। ফ্রান্সিস তাকে বলল, দিক ঠিক রেখে দেশের দিকে জাহাজ চালাও। জাহাজচালক হুইল ঘোরাল। জাহাজ ঘুরে পশ্চিমমুখো হলো। ওদিকে পালেও হাওয়া লেগেছে। জাহাজ চলল। কিন্তু বাতাসের তেমন জোর নেই। জাহাজ আস্তে আস্তে চলল। হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস—হাওয়া পড়ে গেছে। দাঁড় বাইলে ভালো হতো।
—কী দরকার রাত জেগে দাঁড় বাইবার। সকাল পর্যন্ত দেখি। হাওয়ার জোর না বাড়লে তখন দেখা যাবে। এখন সবাই বিশ্রাম করুক। ঘুমিয়ে নিক। ফ্রান্সিস বলল।
জাহাজের গতি মন্থর। লিপারি দ্বীপের দক্ষিণে জাহাজ এলো। তখনই দ্বীপটায় অনেক লোকের চিৎকার হৈ-হল্লা শোনা গেল। একটু পরেই দেখা গেল দ্বীপের বাড়িঘরে আগুন লেগেছে। দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। আকাশে কালো ধোঁয়া উঠেছে। এবার তলোয়ারের ঠোকাঠুকির শব্দ, লোকজনের চিৎকার, কাতর আর্তনাদ, আহতের গোঙানি শোনা গেল। দ্বীপের আগুনের আভায় দ্বীপের পশ্চিমদিকে দুটো জাহাজের মাস্তল দেখা গেল। পালগুলো গোটানো। ফ্রান্সিস বলল, হ্যারি, বলো তো কী ব্যাপার?
গোলমাল, আহতদের আর্তনাদ শুনে মনে হচ্ছে ফ্রেডারিকের নতুন সৈন্যরা লিপারি—দ্বীপ আক্রমণ করেছে। বিদ্রোহী যুবটি বলেছিল রাজা ফ্রেডারিকের নতুন সৈন্যদল আসছে। তারাই জাহাজে চড়ে এসেছে। বিদ্রোহীদের ঘাঁটি এই দ্বীপটির বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। রাজা ফ্রেডারিকের সৈন্যরা সুশিক্ষিত সৈনিক সন্দেহ নেই। বিদ্রোহীদের তো দেখেছি। তেমন অস্ত্রশস্ত্র বা শিক্ষা নেই। ওদের লড়তে হবে মনের জোরে।
—যা বুঝছি বিদ্রোহীরা হেরে গেছে। ফ্রান্সিস বলল।
—তারই সম্ভবনা বেশি হ্যারি বলল।
জাহাজ চলেছে। লিপারি দ্বীপের চিৎকার হৈহল্লা শুনে বিস্কো,শাঙ্কো আর কয়েকজন ভাইকিংও ডেকে উঠে এসেছে ততক্ষণে। সবাই রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে রইল।
দ্বীপটায় এ সময় হঠাৎ দু একটা জ্বলন্ত ঘর বোধহয় ধসে পড়ল। দাউ দাউ করে আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠল। ফুলকি উড়ল বেশ উঁচু পর্যন্ত। দ্বীপ থেকে ফ্রান্সিসদের জাহাজ পর্যন্ত আগুনের উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়ল। সমুদ্রের জলেও সেই আভা ছড়াল। তখনই বিস্কো চেঁচিয়ে উঠল, ফ্রান্সিস, একটা নৌকো জলে ভাসছে। ততক্ষণে সবাই সেই নৌকোটা দেখেছে। নৌকোটায় কোনো আরোহী নেই। আস্তে আস্তে ওটা ভেসে চলেছে। বিস্কো বলল, খালি নৌকো-কোনো মানুষ নেই নৌকোটায়।
আবার দ্বীপটায় জ্বলন্ত বাড়িঘর কিছু ধসে পড়ল। আগুনের ফুলকি উড়ল। আবার আগুনের আভা ছড়াল। তখনই ফ্রান্সিস দেখল—নৌকোটার মধ্যে একটা হাত উঠেই নেমে গেল। এটা হ্যারির চোখেও পড়ল। ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, পেড্রো-পেড্রো কোথায়? পেড্রো একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস বলল, পেড্রো মাস্তুলের মাথায় উঠে গেল। একটু পরে অমনি দ্রুত নেমে এলো। বেশ হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল, নৌকোটায় দুজল লোক। গলুইয়ের মধ্যে মাথা গুঁজে শুয়ে আছে। তাই আমরা এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে মরে গেছেনা বেঁচে আছে বুঝলাম না।
—বেঁচে আছে। আমি হাত তুলতে দেখেছি। ফ্রান্সিস বলল।
—কী করবে এখন? হ্যারি বলল।
—যে দেশেরই হোক, মানুষ তো। ফ্রান্সিস বলল, ওদের বাঁচাতে হবে। বিস্কো, এক্ষুণি যাও। নৌকোটো টেনে নিয়ে এসো। কিন্তু আমাদের নৌকোয় চড়ে যেও না। বলা যায়না হয়তো রাজা ফ্রেডারিকের সৈন্যরা এদিকে নজর রাখছে। সাঁতরে যাও।
বিস্কো জাহাজের হালের দিকে চলে গেল। ঝোলানো দড়িদড়া ধরে ধরে আস্তে সমুদ্রের জলে নামল। জলে বেশি শব্দ না করে সাঁতরে চলল নৌকোটার দিকে।
নৌকোর কাছাকাছি পৌঁছে বিস্কো ঠিক করল আগেই নৌকোর মধ্যে উঁকি দেবেনা। বলা যায় না ভেতরে যে দুজন লোক আত্মগোপন করে আছে তারা হয়েতো সশস্ত্র। চমকে উঠে হয়তো ওকে আক্রমণও করতে পারে। বিস্কো তত তলোয়ারই আনেনি।
বিস্কো নৌকাটার পেছন দিকে গেল। নৌকোর গায়ে হাত রেখে একটু বিশ্রাম করল। নৌকোর পেছন দিকটা লম্বাটে নয়, চ্যাপ্টামতো। এই ভূমধ্যসাগর এলাকায় এরকম নৌকোই লোকেরা ব্যবহার করে। ওখান থেকে একটা দড়ি ঝুলছিল। বিস্কো দড়িটা নিয়ে দাঁতে চেপে ধরল। তারপর সাঁতরে চলল ওদের জাহাজের দিকে। নৌকোটাও ভেসে চলল সঙ্গে সঙ্গে।
নৌকোটা জাহাজের গায়ে এসে লাগল। এবার দেখা গেল দুজন লোক নৌকোটার গলুইয়ে শুয়ে আছে। মড়ার মতো। হ্যারি একটু গলা চড়িয়ে লো ল্যাতিন ভাষায় বলল তোমাদের কোনো ভয় নেই। দড়ি ফেলা হচ্ছে, দড়ি ধরে ধরে উঠে এসো। লোক দুজনের মধ্যে একজন আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। অল্প আলোয় দেখা গেল লোকটি বয়স্ক। মুখে কাঁচাপাকা দাঁড়িগোফ। লোকটি নৌকো থেকে মুখ তুলে বলল, আমি মোটামুটি সুস্থ। কিন্তু সঙ্গের যুবকটি বেশ আহত। ও দড়ি ধরে উঠতে পারবে না। এবার বিস্কো নিশ্চিন্ত হলো—লোক দুটো সশস্ত্র নয়। বিস্কো নৌকোটায় উঠল। ওদিকে শাঙ্কোরা কয়েকজন মিলে জালের মতো বাঁধা দড়ি জাহাজ থেকে নামিয়ে দিল। বিস্কো আহত যুবকটিকে ধরে দাঁড় করাল। তারপর দড়ির জালে বসিয়ে দিল। আহত যুবকটি গোঙরাতে শুরু করল। ওপর থেকে শাঙ্কোরা দড়ির জালে বসে থাকা যুবকটিকে আস্তে আস্তে জাহাজের রেলিঙের ওপর দিয়ে তুলে এনে ডেক-এনামাল। আহত যুবকটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ডেক এই শুয়ে পড়ল। এবার জাহাজের কাঁচঢাকা চৌকোণো লণ্ঠনের আলোয় ফ্রান্সিস হ্যারি যুবকটিকে দেখেই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। যুবক সেই বিদ্রোহী নেতা। ঘাড়ের ওপর ঝুলে-পড়া মাথার চুল। এখন বুকে বর্ম পরা নেই। খালি গা। হাত-কাঁধ-মুখ-কপাল ক্ষতবিক্ষত। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল, শিগগির বৈদ্যকে ডেকে আনে। ওদিকে বিস্কো আর বয়স্ক লোকটি দড়ি বেয়ে জাহাজে উঠে এসেছে। বিস্কো তাড়াহুড়োতে একটা মারাত্মক ভুল করল। যুবক আর লোকটি যে নৌকোয় ভাসছিল সেই নৌকোটা বিস্কো দড়ি দিয়ে ওদের জাহাজে গায়ে বেঁধে রেখে এলো। তখন ফ্রান্সিস হ্যারি রা আহত যুবকটিকে নিয়ে ব্যস্ত। ওরা এটা লক্ষ্য করল না।
জাহাজের বৈদ্য ওষুধের ঝোলা নিয়ে এলো। আহত যুবকটির ক্ষতগুলো পরীক্ষা করল। বৈদ্যকে ফ্রান্সিস বলল, কেমন দেখলে?
—তলোয়ার বর্শার ঘায়ে কেটে গেছে। বেশি রক্ত পড়েছে তাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভয়ের কিছু নেই। বৈদ্য ঝোলা খুলল। চিনেমাটির বোয়াম বের করল। চটচটে আঠার মতো হলুদরঙা ওষুধ ক্ষতস্থানে আস্তে আস্তে লাগিয়ে দিল। যুবকটি কঁকিয়ে উঠেই শান্ত হলো। ওর মৃদু গোঙানি বন্ধ হলো। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল, একে তোমরা সাবধানে নিয়ে যাও। কোনো কেবিনে রেখো। মারিয়াকে বলো ও যেন যুবকটির দেখাশুনো করে।
শাঙ্কোরা কয়েকজন মিলে যুবকটিকে কাঁধে করে নিয়ে গেল।
বয়স্ক লোকটি তখন ডেক-এ বসে পড়েছে। বোঝা গেল ভীষণ ক্লান্ত লোকটি। ফ্রান্সিস একবার দেখল লোকটিকে। লোকটির পরনে সাধারণ চাষিীর পোশাক। ফ্রান্সিস এবার হ্যারিকে মৃদুস্বরে বলল,হ্যারি চিনতে পেরেছো যুবকটিকে?
—হ্যাঁ। সেই যে বক্তৃতা দিচ্ছিল, বিদ্রোহী নেতা।
—কী করবে এখন? ফ্রান্সিস বলল।
-–ও ভীষণ আহত। বিপন্নও। ওকে তো আশ্রয় দিতেই হবে। চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তো ওকে রাখতেই হবে। হ্যারি বলল।
—বুঝলাম এটা আমাদের মানবিক কর্তব্য। কিন্তু পরাজিত আহত এই বিদ্রোহী নেতাকে ফ্রেডারিকের সৈন্যরা নিশ্চয়ই খুঁজে বেড়াবে। যদি আমাদের জাহাজ খানাতল্লাশি করতে আসে? ফ্রান্সিস বলল।
—কিন্তু ওরা কী করে বুঝবে যেযুবকটিআমাদের জাহাজেই আশ্রয় নিয়েছে?হ্যারি বলল।
তা ঠিক। যাক গে, কালকের দিনটা দেখা যাক। ফ্রান্সিস বলল।
এ সময় মারিয়া ডেক-এ উঠে এলো। ফ্রান্সিসের কাছে এসে বলল, আহত যুবকটি এখন একটু ভালো আছে। ওর সঙ্গের লোকটি কোথায়?
ফ্রান্সিস ডেক-এ বসা লোকটিকে দেখাল। মারিয়া লোকটির কাছে গেল। স্পেনীয় ভাষায় বলল, আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন? লোকটি মাথা নেড়ে স্পেনীয় ভাষায় বলল, আমি আসলে স্পেনীয়। অনেকদিন আগে জাহাজডুবি হয়ে এই সিসিলিতে এসেছিলাম। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হলো। লোকটির সঙ্গে কথা বলে সব জানা যাবে।
ফ্রান্সিস ও হ্যারি লোকটির কাছে এলো। ফ্রান্সিস বলল, আপনার নাম কী?
—সাভোনা। লোকটি আস্তে বলল।
—ঐ যুবকটি তো বিদ্রোহী নেতা?
সাভোনা একটু আশ্চর্য হলো। বলল—আপনারা জানলেন কী করে?
—যে ভাবেই তোক জানতে পেরেছি। যুবকটির নাম কী?
—মোরাবিত। ও আমার সন্তানের মতো। সাভোনা বলল।
—হুঁ। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল, কী হয়েছিল অল্প কথায় বলুন তো।
লোকটি বলতে লাগল, আমরা লিপারি দ্বীপ থেকে সিসিলি আক্রমণের জন্যে তৈরি হইচ্ছলাম। তার আগেই রাজা ফ্রেডারিকের সৈন্যরা দুটো জাহাজে চড়ে এলো। লিপারি দ্বীপে আমাদের আক্রমণ করল। আমরা হেরে গেলাম। সৈন্যরা আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল। ভীষণ আহত মোরাবিতকে কাঁধে নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে সমুদ্রতীরে এলাম। পেয়ে গেলাম আমাদের একটা নৌকো। মোরাবিতকে নৌকোয় শুইয়ে দিয়ে আমিও পাশে শুয়ে পড়লাম যাতে রাজার সৈন্যরা আমাদের দেখতে না পায়। নৌকো। সমুদ্রের জলে ভাসতে ভাসতে চলল। তারপর—লোকটি থামল।
—হুঁ। ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল, দেখুন, আমরা ভাইকিং-বিদেশি। মোরাবিত আর আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি আপনারা অসুস্থ ও বিপন্ন বলে। কিন্তু আপনাদের দেশের কোনো ব্যাপারের সঙ্গে আমরা নিজেদের জড়াতে চাই না। তাই আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অঞ্চল থেকে চলে যেতে চাইছি। কিন্তু আপনারা জাহাজে থাকলে তো আমাদেরও জাহাজ থামিয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
সাভোনা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে। মোরাবিত কাল নাগাদ একটু সুস্থ হলে আমরা আপনাদের জাহাজ থেকে নেমে যাবে।
ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না। শুধু শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল, জাহাজের পাল নামিয়ে নোঙর ফেলতে বলল। জাহাজ এখানেই থামিয়ে রাখতে হবে। অন্তত কাল অবধি।
মারিয়া সাভোনাকে বলল, আসুন, আপনাদের দুজনকেই খেতে দেব। সাভোনা আস্তে আস্তে উঠল। মারিয়ার সঙ্গে চলে গেল খাবার ঘরের দিকে।
রাত শেষ হয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস হ্যারি শুতে চলে গেল। ফ্রান্সিসের ঘুম আসতে একটু দেরি হলো। ওর মাথায় নানা চিন্তা।
ভোর হলো। ফ্রান্সিসদের জাহাজ থেমেই আছে। হ্যারি বরাবরই খুব ভোরে ওঠে। হ্যারি জাহাজের ডেকে উঠে এলো। অনেক ভাইকিং বন্ধু ডেকের এখানে-ওখানে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।
সবে সূর্য উঠেছে। সমুদ্রে আকাশে হালকা নরম রোদ ছড়ানো। হ্যারি লিপারি দ্বীপের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। দেখল দুটো যুদ্ধজাহাজ ওদের জাহাজের দিকে আসছে। বেশ দ্রুতই আসছে।
হ্যারি চিৎকার করে বলল, এই সবাই উঠে পড়ো। তারপরই ছুটল নীচে নামার সিঁড়ির দিকে। ফ্রান্সিসের কেবিনঘরের দরজায় ঘা দিয়ে ডাকল, ফ্রান্সিস ! ফ্রান্সিস !
মারিয়া জেগেই ছিল। ও ছুটে এসে দরজা খুলে দিল। ফ্রান্সিস ও ততক্ষণে উঠে পড়েছে। হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস, ডেক-এ এসো। দুটো যুদ্ধজাহাজ আমাদের জাহাজের দিকে আসছে।
বলো কি? ফ্রান্সিস বিছানা থেকে লাফিয়ে নামল। ছুটল ডেক-এ সিঁড়ির দিকে।
ডেক-এ তখন ভাইকিং বন্ধুরা জড়ো হয়েছে। ফ্রান্সিসকে দেখে বিস্কো বলল, ফ্রান্সিস, এখন কী করবে?
—দাঁড়াও, দেখি। ফ্রান্সিস তাকাল জাহাজ দুটোর দিকে। জাহাজ দুটো তখন অনেক কাছে চলে এসেছে। সৈন্যরা জাহাজের রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীক সৈন্যদের মতো মাথায় শিরস্ত্রাণ, বুকে লোহার বর্ম। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হলো যে জলদস্যুর দল নয়। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা হলো এরা কারা? ওদের জাহাজের দিকে আসছে কেন?
ফ্রান্সিস, আমরা আগেই লড়াইয়ে নামবো না—দেখি এদের উদ্দেশ্য কী? হ্যারি বলল।
—আমিও তাই ভাবছি। ফ্রান্সিস বলল।
তারপর ডেক-এ জড়ো হওয়া বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল,ভাইসব, আমরা আগেই লড়াইয়ে জড়াবো না। এরা কারা, কী চায় আগে শুনি সব।
বন্ধুরা লড়াইয়ের জন্যে তৈরি হচ্ছিল মনে মনে। ফ্রান্সিসের কথা শুনে ওরা একটু হতাশ হলো। হতাশা চাপা থাকলো না বিস্কোর কথায়। বিস্কো বলল, যদি এই সৈন্যরা নিরস্ত্র আমাদের হত্যা করে?
ফ্রান্সিস বলল, আমরা এখনও তা মনে হচ্ছে না। তবু সবাই অস্ত্র আনো। অস্ত্র নিয়ে ডেক-এ একপাশে দাঁড়াও। আমার আর হ্যারির তলোয়ার দুটোও এনো।
সবাই ছুটল অস্ত্রঘরের দিকে। ভাইকিংদের ছুটোছুটিতে কথাবার্তায় মারিয়া বুঝল কিছু একটা হয়েছে? ও দ্রুতপায়ে ডেক-এ উঠে এলো। ওদিকে মোরাবিতের পাশে সাভোনা ঘুমিয়েছিল। ভাইকিংদের ডাকাডাকি ছুটোছুটির শব্দে ওর ঘুম ভেঙে গেল। ও উঠল, দেখল মোরাবিত তখনও ঘুমিয়ে আছে। ও মোরাবিতকে আর ডাকল না। কেবিনঘরের বাইরে এলো। সিঁড়ি বেয়ে ডেক-এ পা রেখেইও চমকে উঠল। রাজা ফ্রেডারিকের জাহাজ। সামনের জাহাজের ডেকে-এ দাঁড়িয়ে আছে রাজা ফ্রেডারিকের প্রধান সেনাপতি এলাইমা। সাভোনা। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করল। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। ছুটল নিজেদের কেবিনের দিকে।
ওদিকে সেনাপতি এলাইমো যে জাহাজে ছিল সেই জাহাজটা ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। ফ্রান্সিসদের জাহাজটা ঝাঁকুনি খেয়ে দুলে উঠল। এলাইমো এক লাফে ফ্রান্সিসদের জাহাজে রেলিং ধরে ডেক-এ উঠে এলো। পেছনে পেছনে আরো কয়েকজন সৈন্য।
এলাইমো এগিয়ে এলো ফ্রান্সিস,হ্যারি আর মারিয়ার দিকে। এলাইমো দীর্ঘদেহী। বলিষ্ঠ। মুখে দাড়িগোঁফ। বেশ সযত্নে ছাঁটা। বলল,—আপনারা কারা? কোত্থেকে আসছেন? লো ল্যাতিন ভাষা। হ্যারি এক পা এগিয়ে এসে বলল,আমরা ভাইকিং। ক্রীট দ্বীপ থেকে ফিরছি।
সশস্ত্র ভাইকিংদের দেখে এলাইমো মৃদু হাসল। বলল, শুনেছি আপনারা বীরের জাতি। আমাদের সঙ্গে লড়াই চান?
—না। তবে আমাদের জীবন বিপন্ন হলে লড়াইতে তো নামতেই হবে। হ্যারি বেশ দৃঢ় স্বরে বলল।
যাকগে, এলাইমো সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমি এলাইমো, রাজা ফ্রেডারিকের প্রধান সেনাপতি। এক বিদ্রোহী নেতা আর তার পরামর্শদাতার খোঁজে এসেছি।
—আমরা এখানকার কাউকেই চিনি না। হ্যারি বলল।
—কিন্তু তাদের আপনারা দেখেছেন। এলাইমা বলল।
—না, দেখেনি। হ্যারি বলল।
-–ঠিক আছে, রেলিঙে ঝুঁকে দেখুন তো আপনাদের জাহাজের সঙ্গে একটা নৌকো বাঁধা রয়েছে কিনা।
হ্যারি রেলিঙের কাছে গিয়ে ঝুঁকল। সর্বনাশ! বিস্কো কী সাংঘাতিক ভুল করেছে। মোরাবিতদের নৌকোটা বেঁধে রেখেছে। হ্যারি একবার বিস্কোর দিকে তাকাল। তারপর ফ্রান্সিসের কাছে এলো। নিচুস্বরে সবকথা বলল।
ফ্রান্সিস বলল, দ্যাখো মিথ্যে বলে কাজ হয় কিনা। হ্যারি এলাইমোর দিকে তাকাল। বলল, ওটা আমাদেরই নৌকো।
—অসম্ভব। ঐরকম গ গোলের মতো দেখতে নৌকো একমাত্র এই অঞ্চলের লোকেরাই ব্যবহার করে। এলাইমো বলল।
—খালি নৌকোটা ভাসছিল, আমরা জাহাজে বেঁধে নিয়েছি। হ্যারি বলল।
এলাইমো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, গতরাতে অন্ধকারে মধ্যে ওরা ঐ নৌকোটায় লুকিয়ে পালিয়েছিল। কাজেই—এস্টুথেমে বলল,—ওরা দুজন আপনাদের জাহাজেই আশ্রয় নিয়েছে।
এবার হ্যারি ফ্রান্সিসকে নিম্নস্বরে সব বলল।
ফ্রান্সিস বুঝল এখন সব স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই। ফ্রান্সিস দ্রুত হ্যারিকে বলে গেল কী বলতে হবে। হ্যারি বলল, আমরা সত্যি কথাই বলছি। কাল রাতে নৌকোয় আত্মগোপন করে যে দুজন এসেছিল তারা কারা আমরা জানি না। দুজন বিপদগ্রস্ত মানুষ। তার মধ্যে একজন আবার গুরুতর আহত, তাই আমরা মানবিক কারণেই তাদের আশ্রয় দিয়েছি, আহতকে চিকিৎসা করিয়েছি।
—কোথায় ওরা? এলাইমো বলল।
—একটা কেবিনে। হ্যারি বলল।
—আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চলুন। এলাইমা বলল।
—নিয়ে যাবো একটি শর্তে। আপনি ওদের হত্যা করতে পারবেন না। হ্যারি বলল।
—যদি করি। এলাইমো বলল।
—তাহলে আমরা লড়াইয়ে নামবো। হ্যারি কথাটা বলে ফ্রান্সিসকেও বলল। ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন করল।
এলাইমো একটু চুপ করে ভাবল। তারপর বলল, ঠিক আছে। ওদের জীবিত রাজা ফ্রেডারিকের ইচ্ছে। ওদের রাজার কাছে নিয়ে যাবো।
—আমরাও ওদের সঙ্গে যাবো। হ্যারি বলল।
—আপনারা যাবেন কেন? এলাইমো একটু আশ্চর্য হয়ে বলল।
—যদি যাওয়ার পথে আপনারা ওদের মেরে ফেলেন। হ্যারি বলল।
এলাইমো বুঝল এরা সহজে মোরাবিত আর সাভোনাকে ছাড়বে না। ও বলল, ঠিক আছে, আপনারা ক’জন যাবেন চলুন।
—আমরা সবাই যাবে। হ্যারি বলল।
—তার মানে? এলাইমো বলল।
—মোরাবিত আরসাভোনা আমাদের জাহজে যে কেবিন ঘরে আছে সেখানেই থাকবে। আমরা মোরাবিতের চিকিৎসা ও শুশ্রূষা করবো। আপনাদের জাহাজের
সঙ্গেই আমাদেরও জাহাজ যাবে।
এবার এলাইমো বলল, রাজা ফ্রেডারিক সিরাক বন্দরের ম্যামিয়েস দুর্গে আছেন। সিরাকস বন্দর কাছেই। একটু থেমে বলল, কিন্তু—আপনাদের বিশ্বাস কি! আমাদের দুটো জাহাজ আপনাদের জাহাজের দুপাশে থাকবে। এভাবেই আমাদের নজরদারির মধ্যে দিয়ে আপনাদের সিরাকস বন্দরে যেতে হবে।
হ্যারি নিম্ন স্বরে ফ্রান্সিসকে সব বলল। ফ্রান্সিস বলল, বলো আমরা এই প্রস্তাবে রাজি। হ্যারি সে কথাই বলল।
এলাইমো সঙ্গের জনা দশেক সৈন্যকে ফ্রান্সিসদের জাহাজে পাহারায় থাকতে হুকুম দিল। দুজন সৈন্যকে দেখিয়ে বলল, এরা মোরাবিত আর সাভোনা যে কেবিনঘরে আছে।
সে ঘরের সামনে পাহারা দেবে।
হ্যারি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, বেশ। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল সে কথা। মারিয়া বলল, আমি এই সৈন্য দুজনকে নিয়ে যাচ্ছি। মারিয়া হাত নেড়ে সৈন্য দুজনকে আসতে বলে নীচে নামার সিঁড়ির দিকে চলল। পেছনে খোলা তলোয়ার হাতে সৈন্য দূজনও চলল। এলাইমো নিজের জাহাজে ফিরে গেল।
ফ্রান্সিসের নির্দেশে জাহাজের গুটানো পাল তুলে দেওয়া হলো। জাহাজ চলল। দুধারে এলাইমোর দুটো যুদ্ধজাহাজও সঙ্গে সঙ্গে চলল।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নীচে মোরাবিতদের কেবিনঘরের সামনে এলো। দেখল, খোলা তলোয়ার হাতে দুজন সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। ও কেবিনঘরে ঢুকল। মারিয়া তখন মোরাবিতের শরীরের ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগাচ্ছে। সাভোনা চুপ করে বসে আছে। ফ্রান্সিস সাভোনার সাহায্যে মোরাবিতের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
ফ্রান্সিস বলল, এখন কেমন আছো?
মোরাবিত হেসে বলল, এখন অনেকটা ভালো আছি। কিন্তু মনে শান্তি পাচ্ছি না।
কেন? ফ্রান্সিস বলল।
আপনাদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু সেই আপনারা আমাদের জন্যে কী বিপদে পড়লেন! এর চেয়ে আমরা ধরা দিলে ভালো হতো। মোরাবিত বলল।
তুমি এই নিয়ে ভেবো না। ফ্রান্সিস বলল।
সাভোনা বলল, আমরা বিদ্রোহী—প্রাণপণে লড়াই করেছি কিন্তু আমরা অস্ত্রে বা যুদ্ধবিদ্যায় রাজার সৈন্যদের সমকক্ষ নই। যদি কিছু অর্থ জোগাড় করতে পারতাম—
—ওর সঙ্গে মোরাবিতও কী বলে উঠল। সাভোনা হেসে উঠল।
—মারিয়া বলল, হাসছেন যে?
—মোরাবিত বলছে কাউন্ট রজারের গুপ্তধন ও খুঁজে বার করবার চেষ্টা করবে। সাভোনা হেসে বলল।
এবার ফ্রান্সিস চমকে ওদের দিকে তাকাল। বলল, কাউন্ট রজার কে? তার গুপ্তধন—মানে ব্যাপারটা কী বলুন তো?
—সাভোনা বলল, সেসব শুনে আপনাদের কী হবে?
মারিয়া বলল, ওর নাম ফ্রান্সিস অনেক গুপ্তধনের রহস্য ও ভেদ করেছে। ওকে বলেই দেখুন না।
সাভোনা, বলুন তো কাউন্ট রজারের গুপ্তধনের ব্যাপারটা। ফ্রান্সিস বলল। তখনি হ্যারি ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিস বলে উঠল, হ্যারি ভালো সময়েই এসেছো। শোনো সাড়োনা এক গুপ্তধনের কাহিনী বলছে।
সাভোনা আস্তে আস্তে বলতে লাগল—
প্রায় একশো বছর আগের কথা। দুই নর্মান ভাই রজার ও রবার্ট সমুদ্র পথে সিসিলি এসেছিল। দু ভাই-ই ছিল দুঃসাহসী আর অত্যন্ত বলশালী। দুদলেই ছিল দস্যু। দস্যুবৃভি করে জমানো প্রচুর ধনসম্পদ ছিল ওদের। ক্রমে সিসিলি জয় করে রবার্ট উত্তরের আর রজার দক্ষিণের রাজা হয়ে বসল। রজার উপাধি নিল কাউন্ট। রাজা হিসেবে কাউন্ট রজার কিন্তু যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিল। যা হোক, মৃত্যুর কয়েক বছর আগে কাউন্ট রজারের ধর্মে মতি হলো। খ্রীষ্টধর্মগুরু পেপাপের সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলল। পুরোনো জীর্ণ গ্রীক মঠগুলো সংস্কার করল। সিরাকস আর কাতনিয়ায় দুটো গীর্জা তৈরি করল। তারপর কাউন্ট রজার মারা গেল। উত্তরের পোলার্মো থেকে ভাই রবার্ট ছুটে এলো। উদ্দেশ্য কাউন্ট রজারের ধনসম্পতি অধিকার করা। দুজনেই তো অতীতে দস্যু ছিল। রবার্ট সিরাকসের রাজবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউন্ট রজারের ধনসম্পত্তির কোনো হদিসই পেল না। রাজকোষের কিছু স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে রবার্ট ফিরে গেল। তারপর একশ বছর ধরে কাউন্ট রজারের বংশধরেরা, ধনী ভূস্বামীরা অনেকেই খুঁজছে। কিন্তু কেউ কাউন্ট রজারের গুপ্তধনের হদিস করতে পারেনি। সাভোনা থামল।
ফ্রান্সিস এতক্ষণ সব মন দিয়ে শুনছিল। এবার বলল, আচ্ছা, কাউন্ট রজার কি তার গুপ্তধন কোথায় রাখা হয়েছে সেসব ব্যাপারে কোনো সূত্র রেখে যায়নি?
—কিছুই না। সাভোনা বলল।
—কাউন্ট রজারের মৃত্যু হয়েছিল কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।
—এই সিরাকসের রাজবাড়িতে। সাভোনা বলল।
—সেই রাজবাড়ি কি সিরাকসে এখনও আছে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
—না। বেশ কয়েক বছর আগে এখানকার রাজা ফ্রেডারিক সেসব ভেঙে ফেলেছিল। তৈরি করছিল যে বেশ ভালো একটা দুর্গ তৈরি করবে। করেছেও একটা দুর্গ, ম্যামিয়েস দুর্গ। কিন্তু আসল কারণ ছিল কাউন্ট রজারের গুপ্ত ধনভারের সন্ধান করা। কিন্তু রাজবাড়ি ভেঙে ফেলেও ফ্রেডারিক কিছুই পায়নি। সাভোনা বলল।
—তাহলে কাউন্ট রজারের তৈরি কোনো কিছুই সিরাকসে নেই? ফ্রান্সিস বলল।
—আছে। তার তৈরি গীর্জাটা। ওটা ম্যামিয়েস দুর্গের উত্তর কোণায় আছে। রাজা ফ্রেডারিক ওটার কিছু সংস্কার করেছিল। ভাঙেনি। তবে এখন ঐ গীর্জায় শুধু রাজপরিবারের মানুষদেরই প্রবেশাধিকার আছে, অন্য কারো নয়।
—তাহলে ঐ গীর্জাটা আপনি দেখেননি? ফ্রান্সিস বলল।
একটু চুপ করে থেকে সাভোনা বলল, দেখুন, আমি একসময় রাজা ফ্রেডারিকের একজন অমাত্য ছিলাম। রাজা আমার কাছ থেকে স্পেনীয়, পর্তুগীজ ভাষা শিখেছিল। কয়েকটা ভাষা জানতাম বলে রাজসভায় যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। তারা সারসেনদের ওপর অবিচার হচ্ছিল দেখে আমি সেই পদ ছেড়ে দিয়ে বিদ্রোহীদের দলে চলে এসেছিলাম। ঐ গীর্জায় আমি রবিবারের প্রার্থনা অনুষ্ঠানে অনেকবার গেছি।
—গীর্জাটার কিরকম সংস্কার রাজা ফ্রেডারিক করেছেন? ফ্রান্সিস বলল।
—যা কিছু সংস্কার ওপরেই হয়েছে। ভিত্তিষ্টা সেই কাউন্ট রজার যেমন করিয়েছিলেন তেমনি আছে। বোধহয় ভিতটায় সুন্দর মোজেকের কাজ ছিল বলেই রাজা ফ্রেডারিক ভেঙে ফেলেনি। সাভোনা বলল।
ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে কাউন্ট রজারের গুপ্তধন সম্পর্কে একেবারে নীরব থাকার কারণ কী তাই ভাবতে লাগল।
হ্যারি বলল, কী ফ্রান্সিস, কাউন্ট রজারের গুপ্তধনের অনুসন্ধান করবে নাকি?
—অবশ্যই। ফ্রান্সিস বেশ জোর দিয়ে বলল।
মারিয়া বলল, রাজা বিদ্রোহীদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি, এজন্যে রাজা ফ্রেডারিক নিশ্চয়ই চটে যাবে। আমাদের না কয়েদঘরে বন্দি করে রাখে।
দেখা যাক। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল।
সেনাপতি এলাইমোর নির্দেশ মতো ফ্রান্সিসদের জাহাজ পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল তাদের দুটো জাহাজ দুপাশ দিয়ে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই দূরে সিরাকস বন্দর দেখা গেল। আস্তে আস্তে তিনটি জাহাজই ভিড়ল সিরাকস বন্দরের জাহাজঘাটায়।
এলোইমো ফ্রান্সিসদের জাহাজে এলো। তখন ফ্রান্সিস হ্যারি ডেক-এ দাঁড়িয়েছিল। এলাইমো হ্যারিকে বলল, মোরাবিত আর সাভোনাকে নিয়ে আসুন। ওদের বন্দি করে—রাজার কাছে নিয়ে যেতে হবে।
—আমরা কী করবো? হ্যারি বলল।
—রাজার হুকুম না পাওয়া পর্যন্ত আপনাদের এই জাহাজে এখানেই থাকতে হবে। এলাইমো বলল!হ্যারি কথাটা ফ্রান্সিসকে বলল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল, বলল যে বন্দিদের সঙ্গে আমরা তিনজন রাজার কাছে যাবো। হ্যারি বলল সে কথা।
—আপনারা যাবেন কেন? এলাইমো একটু আশ্চর্য হয়েই বলল।
—রাজা ফ্রেডারিকের সঙ্গে আমাদের কথা আছে ফ্রান্সিসের শেখানো মতো হ্যারি বলল, এলাইমো একটু ভাবল। বলল,বেশ বিদ্রোহীদের আপনারা আশ্রয় দিয়েছেন কাজেই রাজা আজ হোক কাল শোক আপনাদের শাস্তি দেবেনই।
এলাইমোর আটজন সৈন্য যে কেবিনঘরে মোরাবিত আর সাভোনা ছিল সেই ঘরে গেল। ওদের দুহাত দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এলো।
জাহাজঘাটায় দাঁড় করানো ছিল একটা সুসজ্জিত সাদা ঘোড়া। এলাইমো সেই ঘোড়ায় উঠে বসল। ঘোড়া আস্তে আস্তে চলল।
বন্দি দুজনকে মাঝখানে রেখে দুপাশে দাঁড়াল খোলা তলোয়ার হাতে আটজন সৈন্য। পেছনে ফ্রান্সিস, মারিয়া আর হ্যারি মেরাবিত তখনও সুস্থ হয়নি। হাঁটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ওর খুব কষ্ট হচ্ছে।
নগরে ঢুকল সবাই। সিরাকস মোটামুটি বড়ো একটা বন্দর-শহর। রাস্তায় লোকজনের বেশ ভিড়। সারি সারি খোলা দোকানপাট। এর মধ্যেই রটে গেছে মোরাবিত আর সাভোনাকে বন্দি করে নিয়ে আসা হচ্ছে। লোকজন যে যার কাজ ফেলে মোরাবিকে দেখতে ছুটে এলো। সাভোনা রাজ-অমাত্য ছিল। তাকে অনেকেই দেখেছে। চেনেও। কিন্তু বিদ্রোহীযুবক মোরাবিতের নামই সবাই শুনেছে। চোখ কখনও দেখেনি। তাই সকলে সাগ্রহে মোরাবিকে দেখতে রাস্তায় ভিড় করল। ফ্রান্সিস, মারিয়া, হ্যারিকে দেখেও ওরা একটু আশ্চর্য হলো। এই ভিনদেশী লোকগুলোকে তো বন্দি করা হয়নি। তাহলে এদের দুর্গে রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন?
ম্যামিয়েস দুর্গ অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে। উঁচু পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রধান দরজার কাছে এলাইমো ঘোড়া থেকে নামল। প্রধান ফটকটি মজবুত কাঠের। দ্বাররক্ষীরা এলাইমোকে দেখে মাথা নিচু করে সম্মান জানাল। একটু শব্দ তুলে দরজা খুলে দিল ওরা।
সবাই দুর্গের ভেতরে ঢুকল। একটা পাথরের তৈরি চত্বরের পর দুর্গের পাথরে তৈরি বাড়িঘর। চত্বর পেরিয়ে একটা বড়ো দরজার সামনে সবাই এলো। দুজন দ্বাররক্ষী এলাইমোকে সন্মান জানাল। এলাইমো একজন দ্বাররক্ষীকে কী বলল। সে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। একটু পরে বেরিয়ে এলাইমাকে কী বলল। এলাইমো পেছন ফিরে হাতের ইঙ্গিতে সবাইকে ঘরে ঢুকতে বলল।
সৈন্যরা বাদে ঘরে ঢুকল সবাই। ঘরটা বেশ বড়। একটু অন্ধকার মতো। পাথরের দেয়ালের পাথর কুঁদে ফুল-লতাপাতার কাজ করা। সামনেই একটা পাথরের রঙিন কাপড় ঢাকা আসনে রাজা ফ্রেডারিক বসে আছেন। দুপাশে লম্ফাটে পাথরের কাপড়-ঢাকা আসনে রাজা ফ্রেডারিক বসে আছেন। নিশ্চয়ই মন্ত্রী-অমাত্যরা। রাজা ফেডারিকের মাথায় দামি পাথর বসানো সবুজ মীনে করা মুকুট। রাজা মধ্যবয়স্ক। পরনে রেশমী কাপড়ের ঢিলে পোশাক। অমাত্যদের গায়েও একই রকম পোশাক।
এলাইমা মাথা নিচু করে রাজাকে সম্মান জানাল। মোরাবিত সাভোনা মাথা নোয়ালো না। ফ্রান্সিস এটা দেখে মনে মনে ওদের প্রশংসা করল। এলাইমা একনাগাড়ে কী বলে যেতে লাগল। হ্যারি মৃদুস্বরে সেসব ফ্রান্সিসকে বুঝিয়ে দিল। এলাইমোর কথা শেষ হলে রাজা ফ্রেডারিক মোরাবিতের দিকে তাকিয়ে বললেন,—সারাসেনদের ক্ষেপিয়ে তুমি রাজবিদ্রোহী হয়েছে। তোমরা ফাঁসি হবেই। এবার সাভোনার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের সুরে বললেন, সাভোনা, বেশ তো আমার রাজসভায় সুখে ছিলে। সে সুখ তোমার সহ্য হল না। সব ছেড়েছুঁড়ে চলে গেলে। বিদ্রোহীদের পরামর্শদাতা হলে। এবার বাকি জীবন কয়েদঘরে কাটাতে হবে যে। মোরাবিত সাভোনা কোনো কথা বলল না।
এবার রাজা ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। স্পেনীয় ভাষায় বলল, শুনলাম আপনার ভাইকিং। মোরাবিত আর সাভোনাকে আশ্রয় দিয়েছেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়েছেন। কিন্তু আপনারা কি জানতেন না ওরা রাজদ্রোহী?
ফ্রান্সিস একটু মাথা ঝাঁকিয়ে সত্যি কথাই বলল,হ্যাঁ, মোরাবিত বিদ্রোহী আমরা ঘটনাক্রমে সেটা জানতাম। কিন্তু সাভোনার পরিচয় জানতাম না।
ফ্রান্সিসের কথা শুনে হ্যারি মৃদুস্বরে বলল এটা স্বীকার করলে কেন? এতে তো আমাদের বিপদ বাড়বে।
—দেখা যাক। ফ্রান্সিস ও মৃদুস্বরে বলল।
রাজা ফ্রেডারিক বললেন, আপনারা বিদেশি। তবু জেনেশুনে যখন ওদের আশ্রয় দিয়েছেন তখন আপনাদেরও বিচার হবে কয়েকদিনের মধ্যেই।
ফ্রান্সিস বলল, বেশ। তবে আপনাকে আমার কয়েকটা কথা বলার আছে।
—বলুন।
—সাভোনা এদেশের অতীত ইতিহাস ভালোই জানেন। ওঁর কাছে শুনেছি প্রায় একশো বছর আগের রাজা কাউন্ট রজার এখানে তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ কোথাও গোপনে রেখেছিলেন। আমরা স্থির করেছি সেই গুপ্তধন অনুসন্ধান করে উদ্ধার করবো। ফ্রান্সিস বলল।
কথাটা শুনে রাজা ফ্রেডারিক বেশ আশ্চর্য হলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, প্রায় একশো বছর ধরে আমার পূর্বপুরুষরা ঐ গুপ্তধন উদ্ধারের কত চেষ্টা করেছেন। কেউ পারেননি। আপনি বলেছেন পারবেন।
—পারবোই একথা বলার সময় এখনো আসেনি। সব দেখাশুনে চিন্তাভাবনা করে তবেই পারবো কিনা সেটা বলা যাবে। তবে আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস রাখি। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা ফেডারিক অবাক চোখে ফান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফ্রান্সিস বলল, আপনার কাছে আমি কয়েকটা কথা জানতে চাই।
-বলুন।
—কাউন্ট রজার তাঁর রাজত্বকালে কী কী তৈরি করিয়েছিলেন?
—এখানে আর কাতানিয়ার দুটো গীর্জা আর যে বিরাট বাড়িটা কাতনিয়ার তৈরি করাবার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সেই বাড়িটা। তারপরেই উলি মারা যান। রাজা বললেন।
—অসুস্থতার সময় কোথায় ছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।
—কাতনিয়ার সময় কোথায় ছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।
—কাতনিয়ার ঐ বাড়িটায়। অবশ্য দুদিন পরেই তাঁকে এখানে নিয়ে আসা হয়। এখানকার রাজবাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ফ্রান্সিস চুপ করে শুনল। তারপর বলল, আজকে আমরা জাহাজে ফিরে যাবো। এই দুর্গে আমাদের একটা থাকবার জন্যে ঘর দেবেন। কাল থেকে আমরা তিনজন এখানেই থাকবো। আর একটা কথা, মোরাবিত আর সাভোনা আমাদের সঙ্গে থাকবেন। ওঁদের সাহায্য আমাদের খুবই প্রয়োজন।
—যদি সাভোনা মোরাবিত পালিয়ে যায়? রাজা বললেন।
—আমি তার জন্যে দায়ী থাকবো। ফ্রান্সিস বলল।
—হুঁ। রাজা মুখে শব্দ করলেন।
—আর আমরা যেন সর্বত্র অবাধে যেতে পারি, খোঁজখবর করতে পারি, কেউ যেন আমাদের বাধা না দেয়—এই আদেশ আপনি দেবেন। ফ্রান্সিস বলল।
—বেশ। রাজা মাথা একটু ঝাঁকিয়ে বললেন।
এবার ফ্রান্সিস বলল, যদি গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারি তাহলে আমাদের তো বটেই, মোরাবিত আর সাভোনাকেও মুক্তি দিতে হবে।
রাজা ফ্রেডারিক একটু ভাবলেন। তারপর দুজন অমাত্যকে ইঙ্গিতে ডাকলেন। দুজন রাজার সামনে গেলেন। তিনজনের মধ্যে কী কথাবার্তা হলো। অমাত্যরা ফিরে গিয়ে নিজেদের জায়গায় বসলেন। রাজা বললেন, দেখুন, কাউন্ট রজারের গুপ্তধন আপনারা উদ্ধার করতে পারবেন না। তবু আপনার শর্তে আমি রাজি হলাম। কিন্তু যদি গুপ্তধন উদ্ধার করতে না পারেন? রাজা বললেন।
—তাহলে আমার স্ত্রী ও বন্ধুদের জাহাজ চালিয়ে জ্বদেশে ফিরে যেতে দেবেন। মোরাবিত ও সাভোনার সঙ্গে আমাকে যে শাস্তি দেবেন তা আমি মাথা পেতে নেব। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসের এই শর্ত শুনে হ্যারি ভীষণভাবে চমকে উঠল। বলল, কী বলছে ফ্রান্সিস ? মারিয়াও বিস্ময়ে বলে উঠল, কী সাংঘাতিক। ফ্রান্সিস গম্ভীরস্বরে বলল, অনেক ভেবেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরা বাধা দিও না। রাজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ফ্রান্সিসের দিকে। মোরাবিত সাতোনো ওর আত্মীয় নয়, স্বজন নয়, নিজের দেশবাসীও নয় অথচ ওদের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্য জড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না এই বিদেশি। রাজা দুজন অমাত্যকে ডাকলেন। তাদের বললেন সব। এবার সবাই ফ্রান্সিসের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। সবাইনীরব। হঠাৎ সাভোনা ফুঁপিয়ে উঠল। বলল,ফ্রান্সিস, এ তুমি কী বললে! কী সাংঘাতিক শর্ত! উম্।
—সাভোনা মোরাবিতকে ফ্রান্সিসের শর্তের কথা বুঝিয়ে বলল। মোরাবিত চিৎকার করে কী বলে উঠল।
—হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস মোরাবিতও বলছে তুমি এরকম শর্ত দিও না। ফ্রান্সিস হাসল। বলল, এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
—রাজা ফ্রেডারিক বললেন, ঠিক আছে। আমরা পরস্পরের শর্ত মেনে চলবো। আপনারা জাহাজে ফিরে যেতে পারেন। তবে সৈন্যদের কড়া পাহারার মধ্যে আপনাদের থাকতে হবে।
—বেশ। ফ্রান্সিস মাথা একটু ঝাঁকিয়ে বলল।
লোকদল সৈন্যের পাহারায় জাহাজে ফিরে এলো ফ্রান্সিসরা। আসার পথে হ্যারি মারিয়া একটি কথাও বলতে পারল না। ফ্রান্সিসের শর্তের কথা ভেবে ওরা দুজনেই বিমর্ষ।
জাহাজে উঠতেই সব বন্ধুরা ছুটে এসে ওদের ঘিরে ধরল। হ্যারি বলল, ভাইসব, ফ্রান্সিসকে বিশ্রাম করতে যেতে দাও। রাজকুমারীও ফ্রান্সিসের সঙ্গে যান। যা বলার আমি বলছি। ফ্রান্সিস আর মারিয়া নিজেদের ঘরে চলে গেল। হ্যারি বন্ধুদের সব বলল।
ফ্রান্সিসের শর্তের কথা শুনে বন্ধুরা ভীষণ উত্তেজিত হলো। কেউ কেউ অভিমানের সুরে বলল, ফ্রান্সিস আমাদের কিছু না জানিয়ে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিল! কয়েকজন উত্তেজিত স্বরে বলল, ফ্রান্সিসকে আমরা জাহাজ ছেড়ে যেতে দেব না। আজ রাতেই পাহারাদার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করে জাহাজ নিয়ে পালাবো। পাহারাদাররা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা ভাইকিংদের কথা কিছুই বুঝল না।
হ্যারি বিপদ আঁচ করল। বন্ধুরা যদি সত্যিই উত্তেজিত হয়ে লড়াইয়ে নামে তাহলে মৃত্যু রক্তক্ষয় অনিবার্য। ও গলা চড়িয়ে বলল, ওসব ভাবনা ছাড়ো। ফ্রান্সিসকে বলছি, ও তোমাদের সব বুঝিয়ে বলবে। হ্যারি চলে গেল। ফ্রান্সিস তখন নিজের কেবিনে চুপ করে শুয়ে চিন্তা করছে। অনেক চিন্তা মাথায়। হ্যারি এলো। দেখল মারিয়া মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। হ্যারি বন্ধুদের মনোভাবের কথা বলল।
ফ্রান্সিস চুপ করে শুনল। তারপর বলল, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সবাইকে ডেক-এ জড়ো হতে বললো। আমি যা বলার বলবো।
রাতে জাহাজের ডেক-এ জড়ো হলো সবাই। ফ্রান্সিস এলো। সঙ্গে মারিয়া। সকলের কথাবার্তা থেমে গেল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলতে লাগল, ভাইসব, ধর্ম-ভাষা মাটির ব্যবধান সত্ত্বেও আমরা এই পৃথিবীর অধিবাসী। আমাদের একটাই পরিচয় আমরা মানুষ। তাই মোরাবিত আমার ভাই। সাভোনা আমার পিতৃতুল্য। একটু থেমে বলল, ওদের লড়াই অত্যচারী রাজার বিরুদ্ধে, ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে। সেটা ওদের দেশের ব্যাপার। কিন্তু মোরাবিতের কথাই ভেবে দেখো। কা সুন্দর সুগঠিত শরীর! কত অল্প বয়েস! ওর দিকে যতবার আমি তাকিয়েছি এক অদ্ভুত স্নেহের টান বারবার অনুভব করেছি। সাভোনার কথা ভাবো। রাজার প্রিয় অমাত্য ছিলেন। যথেষ্ট বুদ্ধিমান। চিন্তাশীল। সারাজীবন তিনি সুখ-স্বচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করে তিনি মেনে নিয়েছেন বিদ্রোহীর কষ্টকর দুঃখময় জীবন। এমন দুটি মানুষের মৃত্যু হবে এ আমি মেনে নিতে পারিনি। কাজেই আমি আমার জীবনকে বাজি ধরেছি। আর একটু গলা চড়িয়ে ফ্রান্সিস বলল, কাউন্ট রজারের গুপ্তধন আমি উদ্ধার করবোই। মোরাবিত আর সাভোনাকে আমি বাঁচাবোই। তার জন্যে যদি আমাকে বাকি সারাজীবন এই সিসিলিতে থাকতে হয় আমি থাকবো। ততদিন তো ভাই মোরাবিত, পিতৃতুল্য সাভোনা দুজনেই বেঁচে থাকবে। থামল ফ্রান্সিস তারপর বলল, ভাইসব, আমার শর্তের সঙ্গে আমি কিন্তু তোমাদের জড়াইনি। তোমরা ইচ্ছে করলে জাহাজ নিয়ে স্বদেশে চলে যেতে পারো। এবারে বুদ্ধির লড়াই। আমার একবার লড়াই।
ফ্রান্সিস থামল। কেউ কোনো কথা বলল না। মাথার ওপরে ঝকঝকে তারাভরা আকাশ। শনশন সমুদ্রের হাওয়ার শব্দ। জাহাজের গায়ে ঢেউ ভেঙে পড়েছে ছলাৎ ছলাৎ।
হঠাৎ বিস্কোর গলা শোনা গেল—ফ্রান্সিস, তোমাকে ছেড়ে আমরা কেউ এখান থেকে এক পাও নড়বো না শেষ। পর্যন্ত তোমাকে যদি রাজা ফ্রেডারিক ফাঁসি দেন আমরা প্রত্যেকে তখন একইসঙ্গে মৃত্যুবরণ করবো। সব ভাইকিং উত্তেজিত ভঙ্গিতে দুহাত ওপরে তুলে চিৎকার করে উঠল, ও-হো-হো।
ফ্রান্সিসের দু চোখ ভিজে উঠল। চোখ মুছে ও ভাঙা গলায় বলল, ভাইসব, আমার বুদ্ধি চিন্তাশক্তির গভীরতার ওপর বিশ্বাস রাখো। জীবনের বাজি আমাকে লড়তে দাও। আমি কাউন্ট রজারের গুপ্তধন উদ্ধার করবোই।
সবাই আবার চিৎকার করে ধ্বনি তুলল, ও-হো-হো। সভা ভেঙে গেল। সবাই পরস্পর কথা বলতে বলতে চলে গেল।
পরদিন সকালেই ফ্রান্সিস মারিয়া আর হ্যারিকে নিয়ে ম্যামিয়েস দুর্গে এলো। দুজন সৈন্য ওদের দুর্গের একটা বড়ো ঘরে নিয়ে এলো। ওরা দেখল, ঘরটায় শুকনো ঘাসের ওপর কাপড় ঢাকা সুন্দর বিছানা পাতা। বলিশও রয়েছে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর। বিছানায় মোরাবিত শুয়ে আছে। মুখচোখ দেখে ফ্রান্সিসের মনে হল মোরাবিত এখন অনেকটা সুস্থ। সাভোনা আধশোয়া হয়ে কিছু ভাবছিল। ফ্রান্সিসদের দেখে উঠে বসল। বলল,ফ্রান্সিস, তোমাকে যতটুকু দেখেছি তাই থেকে একটা কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি তুমি জীবনে কিছু আদর্শকে বিশ্বাস করো এবং সেই আদর্শকে রক্ষা করতে তুমি সিদ্ধান্ত নাও। তাই আমি তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো কথা বলবো না। একটু থেমে বলল, বলো এবার তুমি কী করতে চাও?
—প্রথমেই কাউন্ট রজারের আমলের রাজবাড়ির যে অংশটা ভাঙা হয়নি সেটা দেখতে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
—বেশ চলো। সাভোনা বলল।
সাভোনার দুর্গ-এলাকা ভালো করেই চেনা। ও ওদের দুর্গের উত্তর কোণায় নিয়ে এলো। দেখা গেল একটা ছোটো গীর্জা। সাভোনা গীর্জাটা দেখিয়ে বলল, এটাই কাউন্ট রজারের তৈরি গীর্জা। এটার কথা তোমাদের বলেছি। ওরা গীর্জার সামনে এলো। গীর্জার চারদিকে সুন্দর বাগান। অনেক ফুলগাছ। গোলাপ টিউলিপ ডালিয়া আরো নাম-না-জানা ফুল ফুটে আছে। কাঠের দরজা খুলে ওরা গীর্জার দরজার সামনে এলো। দেখলো প্রবেশ পথের মেঝেয় নানারঙের সুন্দর মোজেকের কাজ করা। সাভোনা বলল, এই মেঝে কিন্তু কাউন্ট রজারই তৈরি করিয়েছিল। রাজা ফ্রেডারিক এই মেঝেটা ভাঙেনি।
ওরা গীর্জার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ছোটো গীর্জা। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি। দেয়ালে মাতা মেরীর ছবি। বেশ ভাবগম্ভীর শান্ত পরিবেশ। দেখা গেল মেঝেতেও মোজেকের কারুকাজ। ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখল। গীর্জা যেমন হয় তেমনি সব। জানলায় রঙিন কাঁচ। সকালের রোদ কাঁচের রঙ মেখে মেঝেয় পড়েছে। ফ্রান্সিস বেশ ভালো করেই দেখল সব।
সবাই বেরিয়ে এল। ফ্রান্সিস সাভোনাকে বলল, সাভোনা, কাল আমরা কাতনিয়া যাবো। আপনি ব্যবস্থা করতে পারবেন?
সাভোনা হেসে বলল, রাজা ফ্রেডারিক দুজন সৈন্যকে রেখেছে, দেখেছো তো? পাহারাদারির জন্যে ওদের কিন্তু রাখা হয়নি। আমাদের সব ব্যাপারে সাহায্য করবার জন্য ওদের নিযুক্ত করেছে রাজা। গুপ্তধন বলে কথা! রাজা ফ্রেডারিক এখন রাজধানীতে ফিরে যাবে না। গুপ্তধন খুঁজছো তুমি। খুব উৎসাহ রাজা ফ্রেডারিকের। রাজা এখন এখানেই থাকবে।
দিন দুয়েক কাটল। সেই ঘরেই ফ্রান্সিসদের শুয়ে বসে ঘুমিয়ে দিন কাটে।
সেদিন সকালে দুর্গের পাহারাদার সৈন্যদের মধ্যে বেশ ব্যস্ততা দেখা গেল। ফ্রান্সিস সাভোনাকে জিজ্ঞেস করল—কী ব্যাপার বলুন তো?
—মনে হচ্ছে রাজা ফ্রেডারিক দুর্গ পরিদর্শনে আসছেন। সাভোনা বলল।
—রাজা কি এরকম দুর্গ পরিদর্শন করেন নাকি? হ্যারি বলল।
—হ্যাঁ—সাভোনা বলল—আর রাজাদের এই পরিদর্শনের কাজ করা উচিতও। তা নইলে সৈন্যরা অলস হয়ে পড়ে।
একটু পরেই ফ্রান্সিসদের ঘরের সামনে কয়েকজনের পায়ের শব্দ শোনা গেল। দরজা দিয়ে ঢুকলেন রাজা ফ্রেডারিক। পেছনে দুজন অমাত্য। রাজার মাথায় মুকুট নেই। পরনে হাল্কা সবুজ রঙের ঢোলা পোশাক। পোশাকে সোনার সুতোর লতা ফুল তোলা।
রাজাকে দেখে আধশোয়া ফ্রান্সিস উঠে বসল। রাজা বললেন—গুপ্তধনের কোনো হদিশ করতে পারলেন?
—না—ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল—সবে তো খোঁজা শুরু করলাম। কয়েকটা দিন যাক। সব দেখি শুনি জানি তবে তো।
—দেখুন, চেষ্টা করে তবে এর আগেও তো কম চেষ্টা হয় নি কিন্তু কেউ কোনো হদিশও করতে পারে নি।
—দেখি চেষ্টা করে। ফ্রান্সিস বলল।
এবার রাজা সাভোনা ও মোরাবিতের দিকে তাকালেন। বললেন-তোমরা আপাতত এখানেই থাকবে। কিন্তু খবরদার—পালাবার চেষ্টা করবে না। এখন কাউন্ট রজারের গুপ্তধনের খোঁজ চলছে দেখা যাক। কী হয়। রাজা অমাত্যদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন।
তখনই দুর্গের ছোটো গীর্জাটায় প্রার্থনার ঘন্টা বেজে উঠল—ঢং ঢং। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল—সাভোনা চলুন গীর্জায় যাবো।
—কিন্তু রাজপরিবার আর অমাত্যদের পরিবারের লোক ছাড়া ঐ গীর্জায় আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। সাভোনা বলল।
—হুঁ।—তবু যেতে ইচ্ছে করছে। গীর্জার ভেতরে যাবো না আমরা। বাইরে থেকে প্রার্থনা অনুষ্ঠান যতটা পারি দেখবো শুনবো। ফ্রান্সিস বলল।
—বেশ—চলুন। সাভোনা উঠে দাঁড়াল। হ্যারি মারিয়া মোরাবিতও উঠে দাঁড়াল। সবাই চলল দুর্গের ছোটো গীর্জাটার দিকে। মোরাবিত এখন অনেকটা সুস্থ। ওর হেঁটে যেতে কোনো কষ্ট হচ্ছিল না।
গীর্জায় তখন ধমর্যাজকের বাইবেল পাঠ চলছে। ফ্রান্সিসরা গীর্জাটায় সামনের দিকে কিছুটা দূরে পাথরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। একটু পরেই শুরু হল প্রার্থনা সংগীত। ল্যাতিন ভাষায় রচিত প্রার্থনা সংগীতের অর্থ ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়া বুঝল না। সাভোনা আর মোরাবিত বুঝল। ফ্রান্সিসরা গানের অর্থ বুঝলোনা কিন্তু গানের সুর বড়ো ভালো লাগল। সকালের উজ্জ্বল রোদে বাতাসে আকাশের নীলে ছড়িয়ে যাওয়া গানের সুর এক সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করল। মারিয়া অস্ফুটস্বরে বলে উঠল—অপূর্ব। ফ্রান্সিস ও বলে উঠল—সুন্দর গান। সাভানো বলল—এই গান কার রচনা জানেন? ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল।
—কাউন্ট রজারের। সাভোনা হেসে বলল।
—বলেন কি? হ্যারি বলে উঠল।
—হ্যাঁ—কাউন্ট রজারের অনেক এরকম খৃষ্টবন্দনা গীতি এই দক্ষিণ সিসিলিতে আজও গাওয়া হয়। সাড়োনা বলল তাহলে তো কাউন্ট রজার শুধু রাজাই দিলেন না—গীতশিল্পীও ছিলেন। মারিয়া বলল।
—সাভোনা একটু মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল।
গীর্জায় বন্দনাগীতি শেষ হল। গীর্জা থেকে স্ত্রী পুরুষরা বেরিয়ে আসতে লাগলেন। তাঁরা রাজাপরিবার অমাত্যদের পরিবারের স্বজন আত্মীয়। স্ত্রীলোকদের পোশাকে কত পারিপাট্য। কত সাজসজ্জা। পুরুষরাও দামি পোশাক পরেছেন। কথাবার্তা বলতে বলতে তাঁরা দুর্গের প্রশস্ত পথ ধরে অন্দরমহলের দিকে চললেন। তারা কথা বলতে বলতেও উৎসুক্যের সঙ্গে ফ্রান্সিসদের এক নজর দেখে গেলেন। বিশেষ করে মারিয়াকে। মারিয়া এতক্ষণে নিজেদের পোশাক সম্পর্কে সচেতন হল। দেখল নিজের পোশাকটা একসময় দামি কাপড়ে তৈরি করা হয়েছিল। এখন কাপড়ের রঙ জ্বলে গিয়ে ব্যবহারে একেবারে ন্যাকড়ার মতো হয়ে গেছে। ফ্রান্সিসের হ্যারির পোশাকেরও এক অবস্থা। মারিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল।
ফ্রান্সিসরা ফিরে আসতে লাগল। পথে মারিয়া কতকটা আপন মনে বলল আমাদের পোশাক-আশাকের যা ছিরি হয়েছে। ওঁদের সামনে লজ্জাই করছিল। ফ্রান্সিসদের মাথায় তখন গুপ্তধনের চিন্তা। ও অন্যমনস্ক ছিল। তবু কথাটা ওর কানে গেল।
ও মারিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল—মারিয়া পোশাক নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কী আছে। আসল তো মানুষটা যে পোশাক পরে। ভালো ভালো পোশাক তো দোকানেই কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নীতিবোধ মনের উদারতা এসব তো দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। এসব অনেক কষ্টে অর্জন করতে হয়। বলো ঠিক কিনা।
মারিয়া একটু চুপ করে থেকে বলল তুমি এতসব ভাববা?
—নিশ্চয়ই—ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—জীবন আমাকে অনেক কিছু খয়েছে। মারিয়া। মারিয়া আর কোনো কথা বলল না।
ওরা পাথুরে পথটার একটা বাঁকে এলো। ডানদিকের পথটা দুর্গে ওদের ঘরের দিকে চলে গেছে। সোজা পথটা গেছে দুর্গের প্রধান দেউড়ির দিকে।
হঠাৎ মোরাবিত দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্রুদ্ধস্বরে কী বলতে লাগল। হ্যারি লো ল্যাতিন ভাষায় বলা কথাগুলো বুঝল। হ্যারি বলে উঠল—সর্বনাশ।
ফ্রান্সিস বলল—কী ব্যাপার হ্যারি
মোরাবিত বলছে—ওর সহযোদ্ধারা জলে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কী কষ্ট সহ্য করছে ওরা আর আমি এখানে নিশ্চিন্তে খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমোচ্ছি। আমি পালাবো।
তখনই দেখা গেল সাভোনা মোরাবিতের দুহাত ধরে কী বোঝাচ্ছে ওকে। মোরাবিত এল মাথা নাড়তে নাড়তে হঠাৎ এক ঝাঁকুনিতে সাভোনার হাত ছাড়িয়ে সদর দেউড়ির দিকে দ্রুত ছুটল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ওর পেছনে ছুটতে শুরু করল। ডাকতে লাগল মোরাবিত—মোরাবিত। ঠিক তখনই দুজন সৈন্য ওদিক থেকে মোড় ঘুরে মোরাবিতের সামনে এসে পড়ল। মোরাবিতকে ওরা চেনে। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য দুজন খাপ থেকে দ্রুতহাতে তলোয়ার খুলে ফেলল। তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়াল। মোরাবিত দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন সৈন্য দুপা এগিয়ে এসে মোরাবিতের কাধ লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল। মোরাবিত এক লাফে সরে এলো। তলোয়ারের কোপ লাগল না। সেই সৈন্যটি তলোয়ার উচিয়ে ধরার আগেই মোরাবিত শুন্যে লাফিয়ে উঠে সৈন্যটির বুকে লাথি চালাল। সৈন্যটি ছিটকে পাথুরে রাস্তায় পড়ে গেল। ওর হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে পড়ে গেল। মোরাবিত দ্রুত হাতে নিচু হয়ে তলোয়ারটা তুলে নিয়েই অন্য সৈন্যটির মুখোমুখি দাঁড়ল। সৈন্যটি তলোয়ার হাতে মোরাবিতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মোরাবিতের বুকে তো বর্ম নেই। তলোয়ারের ফলা ওর বুক ছুঁয়ে গেল। বুক লম্ফালম্ফি কেটে গেল। রক্ত বেরোলো।
মোরাবিত সৈন্যটার ওপর লাফিয়ে পড়ার আগেই ফ্রান্সিস পেছন থেকে মোরাবিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। চেঁচিয়ে বলল—সাভোনা—মোরাবিতকে বলুনা ও যদি সত্যি ওর মাতৃভূমিকে ভালোবাসে ওর বিদ্রোহী বন্ধুদের ভালোবাসে তবে যেন এক্ষুণি অস্ত্রত্যাগ করে। সাভোনা তখনই সেখানে এসে পড়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিসের কথাগুলোও বলল। মো রাবিত একটু শান্ত হল। তোয়ার নামাল।
ফ্রান্সিস বলল—সাভোনা—বলো যে এখন একা এত সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাওয়া নিরেট বোকামি। ও পালাতে পারবে না বরং মৃত্যু ডেকে আনবে। তাতে না ওর মাতৃভূমির না ওর বিদ্রোহী বন্ধুদের কারো উপকারই হবে না। বরং বেঁচে থাকলে—সময় সুযোগ বুঝে ও পরে লড়াই করবে। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সাভোনা দ্রুত ফ্রান্সিসের কথাগুলো বলে গেল। মোরাবিত চুপ করে দাঁড়িয়ে হাঁপতে লাগল। মন দিয়ে শুনল কথাগুলো। পাথুরে পথে ছিটকে পড়া সৈন্যটি আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্য সৈন্যটি তলোয়ার উচিয়ে ছুটে এলো। ফ্রান্সিস মোরবিতকে ছেড়ে দিয়ে দু’হাত তুলে সৈন্যটির দিকে এগিয়ে এলো চেঁচিয়ে বলল—সাভোনা মোরাবিতকে অস্ত্রত্যাগ করতে বলুন। সাভোনাও চিৎকার করে কথাটা বলল। মোরাবিত হাতের তলোয়ার ফেলে দিল। পাথুরে রাস্তায় শব্দহল ঝনাৎ। সৈন্যটি তলোয়ার নামাল। ফ্রান্সিস মোরাবিতকে ধরে নিজেদের ঘরের দিকে চলল। পেছনে পেছনে চলল সাভোনা হ্যারি আর মারিয়া।
যেতে যেতে মোরাবিত ক্রুদ্ধভঙ্গীতে বিড়বিড় করে কী বলতে লাগল। ফ্রান্সিস বুঝল না। ও গলা চড়িয়ে বলল-–সাভোনা—মোরাবিকে বলো—ও যেন আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। যদি সত্যিই শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে নামতে হয় তবে আমি আর আমার বীর বন্ধুরা ওর পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করবো। মৃত্যু হলে মৃত্যুকে মেনে নেব। মোরাবিত যেন এখন আমাদের ভুল না বোঝে। সাভোনা ফ্রান্সিসের কথাগুলো মোরাবিতকে বলে গেল। মোরাবিত একবার ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকাল। কোনো কথা বলল না। শান্তভাবে হাঁটতে লাগল।
ওদিকে ফ্রান্সিসদের জাহাজে কয়েকজন ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হল। এদের মধ্যে ভেক্তর বন্ধুদের এই ক্ষোভকে কাজে লাগাল। আগের কোনো অভিযানে ভেক্তর ফ্রান্সিসদের সঙ্গে আসেনি। এবারই প্রথম। ও ক্ষুদ্ধ বন্ধুদের কয়েকজনকে বোঝাতে লাগল—এভাবে বিদেশ বিভুইয়ে দিনের পর দিন পড়ে থাকা অর্থহীন। ফ্রান্সিসরা পড়ে থাকুক। চলো আমরা জাহাজের দখল নিয়ে দেশের দিকে জাহাজ চালাই ফ্রান্সিসরা না হয় পরে অন্য কোনো জাহাজে দেশে ফিরবে।
দু’একদিনের মধ্যে ভেক্তরের এইসব কথাবার্তা শুনে বেশ কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে বিক্ষোভ দানা বাঁধল। জাহাজে ফ্রান্সিস আর হ্যারি নেই। বিস্কো আর শাঙ্কো এই বিক্ষোভ আঁচ করতে পারল না। ওদের তখন চিন্তা ফ্রান্সিস গুপ্তধন খুঁজে বের করতে পারল কিনা।
সেদিন দুপুর থেকেই অসহ্য গুমোট আবহাওয়া। সমুদ্রে বাতাস পড়ে গেছে। জলে শান্ত ঢেউ। গরমে ভাইকিংরা দুপুরে কেউ ঘুমুতে পারল না।
বিকেল হতে গরম একটু কমল বটে কিন্তু গুমোট ভাবটা কাটল না।
সন্ধের সময় ভেক্তর বিক্ষুদ্ধ বন্ধুদের জড়ো করল জাহাজের হালের দিকে। মাস্তুলের আর সিঁড়িঘরের আড়ালে পড়া জায়গাটায়। এখানে ডেক-এর ওপর ভেক্তর বিক্ষুদ্ধ বন্ধুদের নিয়ে একটা ছোটোখাটো সভা মতো বসাল। ভেক্তর আগের কথাগুলোই বলল।
এবার একজন ভাইকিং বলল—কিন্তু—আমাদের জাহাজ তত সেনাপতি এলাইমোর দুটো জাহাজ পাহারা দিচ্ছে। আমাদের জাহাজেও রয়েছে আটজন সশস্ত্র পাহারাদার সৈন্য।
এরমধ্যে আমরা জাহাজ নিয়ে পালাবো কী করে?
ভেক্তর বলল—সেসব পরিকল্পনা আমার ছকা হয়ে গেছে। তোমরা জাহাজ নিয়ে পালাতে রাজি কি না সেটা আগে বলো। প্রায় সকলেই বলে উঠল—হ্যাঁ—আমরা রাজি।
—প্রয়োজনে এলাইমার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে হবে। বলল—তোমরা রাজি। ভেক্তর বলল।
সবাই বলে উঠলো-–হ্যাঁ হ্যাঁ রাজি।
একজন ভাইকিং বলে উঠল—আমরা বহুদিন হল দেশ ছেড়ে এসেছি। এখানে-ওখানে বিদেশে বিভূঁইয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর নয়। এবার দেশে ফিরবো। কোনো বাধা আমরা মানবো না। প্রায় সকলেই তার কথা সমর্থন করল।
ভেক্তর বলল আমার সঙ্গে ছজন থাকো। বাকিরা তৈরি থাকো আমি বলার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ ছাড়ার জন্য। যত দ্রুত সম্ভব জাহাজ চালিয়ে পালাতে হবে। একটু থেমে ভেক্তর বলল এবার সবাই চলে যাও। তারপর বলল—বিস্কো শাঙ্কো যেন ঘুণাক্ষরেও আমাদের এই পরিকল্পনা জানতেনা পারে। ওদের সঙ্গে অন্য যারা ফ্রান্সিসের জন্য এখানেই অপেক্ষা করতে চাইবে বা আমাদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যাবে প্রয়োজনে তাদের বন্দি করবো। একটু থেমে ভেক্তর বলল এখন সবাই যাও। এমন স্বাভাবিকভাবে থাকবে যেন কেউ তোমাদের সন্দেহ না করতে পারে। সভা ভেঙে গেল। সবাই চলে গেল। এবার ছজন সঙ্গীকে ভেক্তর বলল—তোমরা কাছাকাছি থাকো। প্রয়োজন পড়লেই তোমাদের যেন হাতের কাছে পাই।
ভেক্তর পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল। দেখল আকাশে গভীর লাল রঙ ছড়িয়ে “ আছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ভেক্তর সেইদিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে লাগল।
জাহাজের কেবিনঘরে বিস্কো শাঙ্কো আর ভাইকিংরা ভেক্তরের এই পরিকল্পনার কথা কিছুই জানতে পারল না। জানতেও পারল না ওপরে ডেক-এ জড়ো হয়ে ভেক্তর আর ভেক্তরের সঙ্গীরা কী মতলব করছে।
রাত হল। রাত বাড়তে লাগল। ভাইকিংদের রাতের খাওয়ার সময় হয়ে এলো।
ভেক্তর একা ডেক থেকে নেমে এলো। যতটা নিঃশব্দে সম্ভব ও এলো ওদের বৈদ্যির কাছে। কেবিনঘরে যে তিনজন ভাইকিং বন্ধু ছিল তারা ভেক্তরেরই দলের লোক। বৈদ্যি বিছানায় শুয়ে ছিল। ভেক্তর বৈদ্যির পিঠে হাত চেপে বলল এই ওঠো। কথা আছে।
বৈদ্যি উঠে বসল। বলল—কে আবার অসুখে পড়ল?
ভেক্তর গলা নামিয়ে বলল। কেউ না। একটা কথা—তুমি যে ওষুধগুলো দাও তারমধ্যে বিষাক্ত ওষুধও তো আছে।
—হ্যাঁ আছে বৈকি। কাটা ঘায়ে যে হলুদ রঙের ওষুধটা লাগাই ওটা কেউ ভুলে খেয়ে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে। কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। বৈদ্যি বলল।
—যদি খাবারের সঙ্গে খেয়ে ফেলে? ভেক্তর জানতে চাইল।
—তবে একটু দেরি হবে মানে বিষের কাজ শুরু হলেই মারা যাবে। বৈদ্যি একটু থেমে হেসে বলল—তবে শখ করে কেউ খাবারের সঙ্গে বা জলের সঙ্গে খেতে যাবে নাকি?
—কিন্তু শত্রু মারতে তো এই ওষুথটা কাজে লাগানো যায়। ভেক্তর বলল।
—হ্যাঁ তা যায় বৈকি? বৈদ্যি বলল। বৈদ্যির শিয়রের কাছেই কাঠের তক্তার ওপর সাজানো ওষুধের কাঁচের বোয়ামগুলোর দিকে ভেক্তর তাকালো তারপর হাত বাড়িয়ে হলুদ বোয়ামটা নিল। তাক থেকে কিছুটা কাগজ ছিঁড়ে নিল। বোয়োমের মুখ খুলল।
বৈদ্যি হাত তুলে চেঁচিয়ে বলল—কী করছো ভেক্তর?
ভেক্তর বলল—এই ওষুধ কিছুটা নিচ্ছি। বলা যায় না যদি হঠাৎ দরকার পড়ে ভেক্তর হাত ঢুকিয়ে বেশ কিছুটা হলুদ রঙা ওষুধ টুকরো কাগজটায় রাখল। তারপর বোয়াম তুলে রাখল। বৈদ্যি কী বললে বুঝে উঠতে পারল না। চুপ করে রইল। ভেক্তর ওষুধটা নিয়ে কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কেবিনঘরের তিনজন ভাইকিং দেখল। কিন্তু বুঝল না কিছুই।
ভেক্তর কিছুক্ষণ পরে ডেক-এ উঠে এলো। সঙ্গী ছজনকে ইশারায় ডাকল। ওরা কাছে এলে ভেক্তর ওদের সঙ্গে নিয়ে এলাইমোর পাহারাদার সৈন্যদের কাছে গেল। হেসে বলল—সৈন্যভাইরা একটা কথা বলছিলাম। সৈন্যরা ওর স্পেনীয় ভাষা বুঝল না। এবার ভেক্তর হেসে হেসে হাতের ইঙ্গিতে ওদের একসঙ্গে খেতে আমন্ত্রণ জানাল। সৈন্যরা কিছুটা বলল। কেউ কেউ হাসল।
ভেক্তরের নির্দেশমতো হালের কাছে ডেক-এর ওপর ততক্ষণে দুজন ভাইকিং দুসারিতে পাতা কাঠের থালায় গরম রুটি ভেড়ার মাংসের ঝোল সাজিয়ে দিয়েছে। এবার এলাইমোর সৈন্যরা বুঝল। ভেক্তর হেসে ওদের খেতে আসতে বলল। সৈন্যরা খুব খুশি। খোলা তলোয়ার কোমরের খাপে ঢুকিয়ে রেখে খেতে এলো। ভেক্তর হেসে হেসে ওদের একটা সারিতে বসতে বলল। সৈন্যরা খেতে বসে পড়ল। অন্য সারিটার সামনে বসল ছ জন সঙ্গীসহ ভেক্তর। সবাই খাওয়া শুরু করল।
ভেক্তর খাচ্ছে কিন্তু ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে সৈন্যদের দিকে। খেতে খেতে হঠাৎ একজন সৈন্য ওয়াক তুলে বমি করবে বলে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু দুপা এগিয়েই কাঠের ডেক-এ গড়িয়ে পড়ল। অন্য একজন সৈন্য কয়েকবার ওয়াক তুলে শুয়ে পড়ল। একে একে সাতজন সৈন্যই বিষাক্ত খাবার খেয়ে মারা পড়ল। ঠিক তখনই সমুদ্রের স্তব্ধ পরিবেশে একটা শোঁ শোঁ শব্দ উঠল। পর মুহূর্তেই প্রচুর ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ল জাহাজটার ওপর। কালো দেয়ালের মতো ঢেউ ভেঙে পড়ল জাহাজের ডেক-এ। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল, গম্ভীরধ্বনিতে বাজ পড়ল। শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি সেইসঙ্গে মুহুর্মুহু আকাশ জুড়ে বাজ পড়া।
ভীষণ দুলছে জাহাজটা। ওর মধ্যেই ভেক্তর চেঁচিয়ে বলল—সৈন্যদের উষ্ণীর বর্ম তলোয়ার খুলে নাও।
ওর ছজন সঙ্গী ঝাঁপিয়ে পড়ল সৈন্যদের ওপর।
সৈন্যরা তখন কেউ কেউ মারা গেছে। কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়েছে। তীব্র বিষের ক্রিয়া শুরু হয়েছে তখন। উষ্ণীষ বর্ম তলোয়ার খুলে নিয়ে ভেক্তরের সঙ্গীরা মৃত সৈন্যদের হালের দিকের রেলিঙের কাছে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো। তারপর গড়িয়ে ফেলে দিল ঝড়বিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের জলে। ভেক্তরের সঙ্গীরা সৈন্যদের উষ্ণীষ মাথায় পরল। বৰ্ম বুকে বাঁধল। তলোয়ার খাপে গুঁজে রাখল। এত কা দুপাশের পাহারাদার জাহাজ থেকে এলাইমোর কোনো দেখতে পেল না। কারণ প্রচ ঝড়ে দুটো জাহাজই ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রবল বেগে উঠছে পড়ছে।
অন্ধকারে চারপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। এলাইমোর পাহারাদার জাহাজ দুটো বৃষ্টির ঝাঁপটার সাদা ধোঁয়াটে আস্তরণের মধ্যে দিয়ে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ধাক্কায় উঠছে পড়ছে। ভীষণভাবে এপাশে-ওপাশে দুলছে। হঠাৎ কখনো বিদ্যুতের তীব্র ঝলকানিতে জাহাজ দুটো দেখা যাচ্ছে। পরক্ষণেই বৃষ্টির ঝাঁপটায় ধোঁয়াটে চারপাশ।
ফ্রান্সিসদের জাহাজেও চলছে প্রচুর দুলুনি। কেউ ভালো করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। প্রায় সব ভাইকিংরাই সিঁড়ি দিয়ে নিজে কেবিনঘরে নেমে গেছে। ভেক্তরের দুজন সঙ্গী মাস্তুল আঁকড়ে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। ভেক্তর এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। ও নিজে তখনও ডেক-এ রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওর তখন লক্ষ্য নোঙর তুলে জাহাজ গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের আলোয় ভেক্তর দুজন সঙ্গীকে দেখল। ও ডেক-এর ওপর হামাগুড়ি দিয়ে কখনও গড়াতে গড়াতে ঐ সঙ্গী দুজনের কাছে এলো। সঙ্গী দুজনের কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বলতে লাগল—শিগগির নোঙর তোল। নোঙর তোল জাহাজ ছাড়ো মাঝ সমুদ্রের দিকে। জলদি—। সঙ্গী দুজন মাস্তুল ছেড়ে ডেক-এ বুক দিয়ে শুয়ে পড়ল। অন্ধকারে হিঁচড়ে হিঁচড়ে চলল নোঙর বাঁধা দড়ির দিকে। বেশ কসরৎ করে অনেক কষ্টে নোঙর তুলে ফেলল।
নোঙর তোলা হতেই ঝড়ের প্রচ ধাক্কায় জাহাজটা কাত হয়ে যেন ছুটে চলল।
এতসব কাণ্ড ঘটেছে বিস্কো শাঙ্কো তার কিছুই জানে না। ওরা তখল নিজেদের কেবিনঘরে। বিস্কো বিছানায় শুয়ে আছে। শাঙ্কো ওর বিছানায় বসে বিস্কোর সঙ্গে গল্পগুজব করছে। সেই কেবিনঘরে আরো দুজন ভাইকিং বন্ধু বিছানায় বসে ছক্কা পাঞ্জা খেলছে। র জাহাজ যে সমুদ্রে ভেসে চলেছে এটা জাহাজের দুলুনিতে ঝড়ের মাতমে ওরা বুঝতেও পারে নি।
কিছুক্ষণ পরেই ঝড়ের প্রচরতা কমল। আকাশে মেঘ কেটে যেতে লাগল। সমুদ্র শান্ত হতে লাগল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। ভাঙা অনুজ্জ্বল চাঁদটা দেখা গেল। বাতাসের বেগ অনেক কমে গেল। সমুদ্র শান্ত হল।
অন্য ভাইকিং বন্ধুদের সঙ্গে বিস্কো আর শাঙ্কো রাতের খাবার খেতে খাবার ঘরে এলো। বিস্কো আর শাঙ্কো ওদের শিরস্ত্রাণ বর্ম পরা দেখে বেশ আশ্চর্য হল।
বিস্কোর সঙ্গী কয়েকজনও অবাক। ওদের কোমরে বাঁধা তলোয়ারও সোজা লম্ফাটে। বাঁকা নয়।
বিস্কো এগিয়ে গিয়ে ভেক্তরকে জিজ্ঞেস করল—কী ব্যাপার? এলাইমোর সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র তোমরা পেলে কী করে?
—এলাইমোর পাহারাদার সৈন্যরা কেউ বেঁচে নেই। ভেক্তর বলল।
—তার মানে? শাঙ্কো বলে উঠল।
—ওদের নির্দেশ করা হয়েছে। ভেক্তরের পাশে দাঁড়নো সঙ্গীটা বলল। বিস্কো চেঁচিয়ে বলে উঠল—সর্বনাশ। আমাদের দুপাশে এলাইমোর জাহাজ ঘিরে আছে। ওরা এই হত্যার কথা জানতে পারলেই আমাদের আক্রমণ করবে। তখন নিরস্ত্র আমরা কেউ বাঁচবো না। ফ্রান্সিসদেরও মেরে ফেলা হবে।
একটু থেমে বিস্কো বলল তোমাদের কে বলেছে ওদের একেবারে প্রাণে মেরে ফেলতে?
—আমি বলেছি। ভেক্তর গম্ভীর গলায় বলল।
—এরকম একটা সাংঘাতিক কাজ করলে তুমি? শাঙ্কো বলল।
ভেক্তর বেশ ঠাণ্ডা মেজাজে বলল—এখন এলাইমোর দুটো পাহারাদার জাহাজ অনেক দূরে।
—তার মানে? বিস্কো বেশ আশ্চর্য হয়েই বলল।
—আমাদের জাহাজ এখন মাঝ সমুদ্রের দিকে চলেছে। ডেক-এ উঠে দেখগে। ভেক্তরের একজন সঙ্গী বলল।
—বলো কি? বিস্কো শাঙ্কোর মুখের দিকে তাকাল।
তারপরে দুজনেই ছুটল ডেক-এ ওঠার সিঁড়ির দিকে। ডেক-এ উঠে দেখল জাহাজের পাল খাটানো হয়েছে। জোর বাতাসে ভোলা পাল ফুলে উঠেছে। জাহাজ দ্রুত চলেছে ঢেউ ভেঙে। বিস্কো ভেবে পেল না এখন কী করবে। শাঙ্কোও অবাক।
তখনই ভেক্তরওর সশস্ত্র সঙ্গীদের নিয়ে ডেক-এ উঠে বিস্কোদের কাছে এলো। বিস্কো ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল—ভেক্তর—জাহাজ ফেরাও সিরাকস বন্দরের দিকে। ফ্রান্সিসদের ফেলে রেখে আমরা দেশে ফিরতে চাই না। ভেক্তর কুটিল হাসি হাসল—ফ্রান্সিসের কথা ভুলে যাও। এখন এই জাহাজের ক্যাপ্টেন আমি। আমি যা বলবো তাই হবে। আমি হুকুম দিয়েছি জাহাজ দেশের দিকে চালাতে। কিন্তু ফ্রান্সিসের এই বিদেশ বিভূঁইয়ে ফেলে রেখে আমরা চলে যাবো? ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়া—এরা কি আমাদের বন্ধু নয়? শাঙ্কো বলল।
—ফ্রান্সিসের পাগলামিকে আমরা আর প্রশয় দেব না। ভেক্তরের এক কী বলল।
—ভেক্তর—বিস্কো বলল তুমি এই অভিযানে প্রথম এসেছে। তাই জানো না ফ্রান্সিস কতশক্ত শক্ত ধাঁধার সমাধান করেছে। সোনার ঘন্টা, দু সের ডিমের মতো মুক্তো উদ্ধার করেছে। ফ্রান্সিসের চেয়ে হয়তো বেশি বলশালী তুমি। কিন্তু ফ্রান্সিসের বুদ্ধি চিন্তা ধীরশক্তির কাছে তুমি ছেলেমানুষ। সবচেয়ে বড়ো কথা—ফ্রান্সিস বন্ধুদের বাঁচাবার জন্যে নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত সবসময়—যেকোনো মুহূর্তে। একটু থেমে বিস্কো বলল—আজ তুমি ফ্রান্সিসের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছো—কিছু বন্ধুকে ক্ষেপিয়ে—।
বিস্কো কথাটা শেষ করতে পারল না। ভেক্তর একটানে কোমর থেকে তলোয়ার খুলে বিস্কোর ওপর তলোয়ারের ডগাটা চেপে ধরল। কঠিনস্বরে বলল—এই জাহাজে যে আমার হুকুম অমান্য করবে তাকেই বন্দি করে রাখবো।
বিস্কো শাঙ্কোর পেছনে দাঁড়ানো কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু চিৎকার করে বলল—তোমার হুকুম আমরা মানবো না। আমাদের নেতা ফ্রান্সিস ওরা এই কথা বলেই ছুটলো নিচে নামার সিঁড়ির দিকে। লক্ষ্য অস্ত্রঘর।
ওরা অস্ত্রঘরের সামনে এসে দেখল—ভেক্তরের দলের দুজন ভাইকিং উষ্ণীষ বর্ম পরে খোলা তলোয়ার হাতে অস্ত্রঘর পাহারা দিচ্ছে। ওরা বুঝল ভেক্তর দল পাকিয়েছে। ওদের দেশে ফেরার লোভ দেখিয়েছে। অনেকদিন ওরা দেশ ছেড়ে এসেছে। দেশে ফেরার জন্য ওরা আকুল হয়ে উঠেছে। কাজেই সহজেই ভেক্তরের দলে গিয়ে ভিড়েছে। ভুলে গেছে ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়ার কথা। যে দুজল এলাইমোর সৈন্যদের পোশাক পরে অস্ত্রঘর পাহারা দিচ্ছে তারা তো ভাইকিং ওদের সুখদুঃখের বন্ধু। ভাইয়ের মতো। স্বদেশবাসী। ওদের দুজনকে কাবু করা যায়। কিন্তু তাতে রক্তপাত হবেই। ভেক্তরের বিরোধীরা বুঝে উঠতে পারলনা এখন কী করবে। ওদিকে জাহাজ চলেছে। সিরাকসবন্দর থেকে অনেকটা চলে এসেছে। জাহাজ এখনি ফেরাতে হবে।
ফ্রান্সিসের বন্ধুরা অস্ত্রঘরের সামনে থেকে সরে এলো। নিজের মধ্যে নিচুস্বরে কথা বলল। স্থির হল ঐ দুজন ভেক্তরের দলের পাহারাদারকে আক্রমণ করে ত ঘর দখল করতে হবে।
ওরা পরামর্শ সেরে আস্তে আস্তে অস্ত্রঘরের দিকে চলল। তারপর একসঙ্গে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঐ দুজন পাহারাদারের ওপর। আচমকা এই আক্রমণে পাহারাদার দুজন কিছুই বুঝে উঠতে পারলোনা। একজল তো ছিটকে কাঠের মেঝেয় পড়ে গেল। ওর হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। অন্যজন কিন্তু দ্রুত হাতে তলোয়ার চালাতে লাগল। নিরস্ত্র দু’তিনজন কাঁধে বুকে তলোয়ারের ঘা লেগে আহত হল। রক্তে ভিজে গেল ওদের শরীর। কিন্তু পাহারাদারটি ততক্ষণে কাঠের মেঝেয় ওদের ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে। একজন ওর তলোয়ার ধরা হাতটা বাঁটসুষ্ঠু পা দিয়ে চেপে ধরল। ও যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠে তলোয়ার ছেড়ে দিল।
ওরা ভেক্তরের দলের পাহারাদার দুজনকে অল্পক্ষণের মধ্যেই দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। অস্ত্রঘরের একপাশে ওদের ফেলে রাখল। তলোয়ারেব ঘায়ে যারা আহত হয়েছিল তাদের দুজন বন্ধু নিয়ে চলল বৈদ্যির কাছে। এই প্রথম ভাইকিং বন্ধুরা বন্ধুর রক্ত ঝরালো। ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি নিজেদের মধ্যে লড়াই হবে কোনোদিন।
ওরা এবার অস্ত্রঘর থেকে তলোয়ার বর্শা দ্রুত হাতে তুলে নিয়ে ছুটল ডেক-এ ওঠার সিঁড়ির দিকে।
ডেক-এ তখন বিস্কো আর শাঙ্কোর দুহাত দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়ে গেছে। ওদের বন্ধুর দল তলোয়ার বর্শা উঁচিয়ে ছুটে এলো ওদের মুক্ত করতে। ভেক্তরের দল তো আগে থেকেই যুদ্ধসাজে তৈরি হয়ে আছে। ওরাও ভেক্তরের নেতৃত্বে তলোয়ার উঁচিয়ে রুখে দাঁড়াল। ভাইকিংরা নিজেদের মধ্যে লড়াই-এর জন্যে প্রস্তুত তখন। লড়াইমৃত্যু রক্তপাত অনিবার্য।
বিস্কো বাঁধা দুহাত তুলে চিৎকার করে বলে উঠল –এ কী করছো? আমরা ভাইকিং এক দেশের মানুষ—ভাই আমরা—বন্ধু—আমরা পরস্পর লড়াই করবো—ভাইয়ের রক্তে হাত রাঙাবো? দুদলই থমকে দাঁড়াল।
শাঙ্কো চিৎকার করে বলল—ভেক্তর—এবার দেখো তুমি আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছে। আমরা যারা এতদিন পরস্পরের জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলাম আজ
সেই আমরা পরস্পরের প্রাণ নেবার জন্যে তলোয়ার ধরেছি।
-ভাইসব বিস্কো চিৎকার করে বলল—অস্ত্র নামাও। দুদল ভাইকিংরাই একটু দ্বিার পর বিস্কোর কথা মেনে নিল। আস্তে আস্তে তলোয়ার নামাল। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
শাঙ্কো ভেক্তরের দিকে তাকিয়ে বলল—ভেক্তর এবার বলো তোমরা কী চাও? ভেক্তর বেশ রাগতস্বরে বলল—তোমাদের দুজনকে আমরা নিকেশ করে দিতাম। কিন্তু তা করিনি।
—কেন? বিস্কো বলল।—কারণ তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে গেলেও তোমরা আমাদের বন্ধু। বিস্কো দেখে বলল এখন আর সেকথা ওঠে না। আমরা পরস্পর আর বন্ধু নেই।
—যাক গে—ভেক্তর তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বাঁ হাত ঘুরিয়ে বলল—তোমাদের দুজনকে কেবিনঘরে বন্দি করে রেখে আমরা জাহাজ চালিয়ে দেশে ফিরে যাবো।
—না—বিস্কো বলল—ফ্রান্সিসদের এইভাবে বিদেশের মাটিতে ফেলে রেখে আমি স্বর্গেও যেতে চাইনা, একটু থেমে বিস্কো বলল বরং সামনের কোনো বন্দরে আমরা নেমে যাবে। তারপর অন্য কোনো জাহাজে চড়ে সিরাকস বন্দরে ফিরে যাবো। ফ্রান্সিসের কাজ শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবো। ফ্রান্সিস কাউন্ট রজারের গুপ্তধন আবিষ্কার করবেই—এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
ভেক্তর হেসে বলল—ফ্রান্সিস জীবন থাকতে সেটা পারবে না।
—দেখা যাক—শাঙ্কো বলল—যদি তার জন্যে ফ্রান্সিস সারা জীবন এই সিসিলি দ্বীপেই থাকে তাহলে আমরাও থাকবো।
—ঠিক আছে—ভেক্তর বলল—তোমাদের সামনের বন্দরেই নামিয়ে দেওয়া ও হবে। কিন্তু তার আগে তোমাদের সবাইকে অস্ত্রত্যাগ করতে হবে। সব অস্ত্র অস্ত্রঘরে জমা রাখতে হবে। সেই অস্ত্রঘর একেবারে বন্ধ করে রাখা হবে যাতে তোমরা কেউ অস্ত্র হাতে নিতে না পারো।
বিস্কো শাঙ্কোর বন্ধুরা চেঁচিয়ে বলল—ঠিক আছে। কিন্তু তোমাদেরও অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে।
—না আমরা সশস্ত্রই থাকবো। ভেক্তর দৃঢ়স্বরে বলল। বিস্কো শাঙ্কোর বন্ধুরা চেঁচিয়ে উঠল— না।
বিস্কো বুঝল বিপদ। দুদলই যেভাবে উত্তেজিততে সংঘর্ষ, রক্তক্ষয় মৃত্যু অনিবার্য। বিস্কো বাঁধা দুহাত ওপরে তুলে চিৎকার করে বলে উঠল—থামো। উত্তেজিত দুদলই একটু থমকালো। উদ্যত তলোয়ার বর্শানামালো কেউ কেউ। বিস্কো চিৎকার করে বলতে লাগল –-ভাইসব—ভুলে যেও না আমরা ভাইকিং –এক জাতিআমরা পরস্পরের ভাই। একটু থেমে বিস্কো এবার ভেক্তরের দিকে তাকাল। বলল—ভেক্তর-তুমি আমাদের কোথায় নামিয়ে এনেছো দেখো। ভাই অস্ত্র ধরেছে ভাইয়ের বিরুদ্ধে।
—তার জন্যে আমি দায়ী নই। ভেক্তর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
—না—তুমিই দায়ী—বিস্কো বেশ গলা চড়িয়ে বলল—আমাদের মতো যারা জাহাজে জাহাজে দেশ দেশান্তর ঘুরে বেড়ায় মাটির প্রতি তাদের তীব্র আকর্ষণ থাকে। আবার সেই মাটি যদি হয় স্বদেশের মাটি তাহলে সেই আকর্ষণ হয়ে ওঠে আরো দুর্বার। তুমি আমার বন্ধুদের সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে। আমাদের বন্ধুদের ক্ষেপিয়ে তুলে—বিস্কো কথাটা শেষ করতে পারলো না।
ভেক্তর এক লাফ দিয়ে ছুটে এসে বিস্কোর বুকে তলোয়ারের ডগাটা চেপে ধরল। দাঁত-চাপাস্বরে বলল—আর একটা কথা বললে তোমাকে নিকেশ করবো। বিস্কোর বন্ধুরা বুঝে উঠতে পারলোনা কী করবে। ভেক্তর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল—তোমরা হাতের অস্ত্র ফেলে দাও। ওরা তখনও বিস্ময়বিমূঢ়। ভেক্তর চেঁচিয়ে বলল—অস্ত্রত্যাগ কর নইলে বিস্কোর প্রাণ যাবে। বিস্কোও বলে উঠল—অস্ত্র রেখে দাও। ওরা অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারল। ওরা বুঝল এখন লড়াইয়ে নামলে ভেক্তর প্রথমেই বিস্কোকে হত্যা করবে। ওরা আস্তে আস্তে হাতের তলোয়ার বর্শা ডেক-এর ওপর ফেলে দিল। শব্দ হল ঝনাৎ—ঝন্ ঝনাৎ।
ওদিকে পুব আকাশে সূর্য উঠেছে। ভোরের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের নীলাভ জলে জাহাজে। সমুদ্র বেশ শান্ত।
ভেক্তর ওর সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল—তোমরা চারজন বিস্কো আর শাঙ্কোকে নিয়ে যাও। একটা ঘরে ওদের দুজনকে বন্দি করে রাখো। দরজায় তালা দিয়ে সবসময় একজন পাহারা দেবে। বাকি এই অস্ত্রগুলো নিয়ে অস্ত্রঘরে রেখে দাও। দরজায় তালা দিয়ে দুজন পাহারায় থাকবে।
ভেক্তরের নির্দেশমতো ওরা বিস্কো ও শাঙ্কোর সামনে এসে দাঁড়াল। বিস্কো কোনো আপত্তি করল না। ক্রুদ্ধস্বরে বলল—শাঙ্কো চলো। বিস্কো নীচে নামবার সিঁড়ির দিকে চলল। শাঙ্কোও চলল ওর পেছনে পেছনে। ভেক্তরের সঙ্গীরা খোলা তলোয়ার হাতে ওদের পেছনে পেছনে চলল। অন্য দুজন ডেক থেকে সমস্ত অস্ত্র তুলে নিয়ে চলল।
যেতে যেতে পেছন ফিরে বিস্কো বন্ধুদের বলল—ভেক্তরদের সঙ্গে কেউ লড়াই করতে যাবে না। সামনের কোনো বন্দরে আমরা নেমে যাবো। অপেক্ষা করবো অন্য জাহাজের জন্যে। জাহাজ পেলে আমরা ফিরে যাবো সিরাকস বন্দরে। সব করতে হবে শান্তিতে। বন্ধুদের রক্তপাত মৃত্যু আমরা চাইনা। বিস্কোরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বিস্কোর কেবিনঘরে বিস্কো আর শাঙ্কোকে বন্দি করে রাখা হল। দরজায় তালা দিয়ে পাহারাদার দাঁড়াল। অস্ত্র রেখে অস্ত্রঘরেও তালা লাগানো হ।
বিস্কো বিছানায় আধশোয়া হল। ওর মাথায় তখন অনেক চিন্তা। যদি ওর দলের বন্ধুরা ভেক্তরদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামে তাহলে রক্তপাত মৃত্যু অনিবার্য। যে করে হোক এই লড়াই হতে দেওয়া চলবে না। কিন্তু এখন তো ও নিজে বন্দি। কিছু যদি ঘটে যায় ও কিছুই করতে পারবেনা। ভয় আশঙ্কা এখানেই।
তখন বেলা হয়েছে। সমুদ্রে বাতাস পড়ে গেছে। জাহাজের পালগুলো নেতিয়ে পড়েছে। জাহাজের গতি অনেক কমে গেছে।
বাঁ দিকে লিপারি দ্বীপের তটভূমি দেখা গেল। ছোটো একটা বন্দর মতো জায়গা থেকে একটা জাহাজ বিস্কোদের জাহাজের দিকে আসছে দেখা গেল। জাহাজ চালকের পাশেই সশস্ত্র ভেক্তর দাঁড়িয়ে ছিল। ও ঠিক বুঝল না ঐ জাহাজটা কাদের। এটাও বুঝল
জাহাজটা ওদের জাহাজ লক্ষ্য করেই আসছে কিনা। জাহাজটা ওদের জাহাজের পাশ কাটিয়ে চলে যাবে বলেই ভেক্তরের মনে হল। হয়তো তাই যেত। ঐ জাহাজটা ছিল সেনাপতি এলাইমোর সৈন্যদের। মোরাবিত আর সাভোনার বিদ্রোহী বন্ধুদের বিদ্রোহ দমনকরে ওরা ফিরে আসছিল। জাহাজটা বিস্কোদের জাহাজের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল।
তখনই এলাইমোর সৈন্যদের দলপতি লক্ষ্য করল বিস্কোদের জাহাজে ওদেরই মতো অস্ত্র পোশাক সজ্জিত ভেক্তর আর ওর বন্ধুদের কয়েকজনকে। ওরা ঠিক বুঝল না—এরা কারা? জাহাজে ভাইকিংদের পোশাক পরা জনা কয়েককেও ওরা দেখল। দলপতি বুঝল কিছু বিদেশিও ঐ জাহাজে আছে। দলপতির সন্দেহ বাড়ল। ও দাঁড়িদের নির্দেশ দিল দাঁড় বাইবার জন্যে। সিঁড়ি নেমে দাঁড়িরা ছুটল দাঁড় ঘরের দিকে। সারি সারি কাঠের আসনে বসে পড়ল দাঁড় তুলে নিল। সমুদ্রের জলে দাঁড় পড়তে লাগল—ছপ—ছপ। জাহাজের গতি বাড়ল। দ্রুত ছুটল বিস্কোদের জাহাজ লক্ষ্য করে।
ওদিকে ভেক্তর বুঝতে পারল যে ঐ ছুটে আসা জাহাজটা যাদেরই হোক তারা ওদের জাহাজটা ধরতেই আসছে। ভেক্তর তাড়াতাড়ি চিৎকার করে বলল—দাঁড়ঘরে যাও। প্রাণপণে দাঁড় বাও। ঐ জাহাজটা আমাদের কাছে আসার আগেই আমাদের পালাতে হবে। কিন্তু ভেক্তরের দলের লোক তো বেশি নয়। তবু তারা ছুটল দাঁড়ঘরের দিকে। দাঁড় বাওয়াও শুরু হল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই এলাইমোর সৈন্যদের জাহাজ বিস্কোদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। কেঁপে উঠল দুটো জাহাজই। দলপতির সঙ্গে আট দশজন সৈন্য বিস্কোদের জাহাজে উঠে এলো দলপতি ডেক-এরওপর দাঁড়ানো ভাইকিংদের দেখল। তখনই ভেক্তর চাপাস্বরে পাশের ভাইকিংকে বলল—শিগগির যাও। অস্ত্রঘরের আর বিস্কোদের ঘরের পাহারাদারদের এক্ষুণি ডেক-এ আসতে বলল। ওরা সশস্ত্র। লড়াই হলে ওদের থাকতেই হবে। ভাইকিংটি দ্রুত পায়ে ছুটল নীচে নামার সিঁড়ির দিকে।
নিজেদের কেবিনঘরে বন্দি বিস্কো আর শাঙ্কো ঘরের বাইরে ভেক্তরের দলের লোকদের দ্রুতপায়ে ছুটোছুটির শব্দ শুনল। বুঝল-ডেক-এ কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু বুঝল না কী ঘটেছে।
তখনই ওদের কেবিনঘরের দরজায় ধাক্কা দিল কারা। দুজনেই বিছানা ছেড়ে উঠে দ্রুত দরজার কাছে এলো। ওদিকে কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু দরজার তালার ওপর হাতুড়ির ঘা মারতে লাগল। কয়েকটা প্রচ ঘা পড়তেই তালা ভেঙে পড়ে গেল। দরজা খুলে গেল। বন্ধুরা ঘরে ঢুকল। জাহাজের বৈদ্যিও ঢুকল ওদের সঙ্গে। বিস্কোর দিকে তাকিয়ে বলল—বিস্কো—তুমি একটা সাংঘাতিক ঘটনা জানোনা। বিস্কোরা ওর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
—বিস্কো—ভেক্তরের দল আমার বিষাক্ত ওষুধ খাইয়ে এলাইমোর আটজন সৈন্যকে মেরে ফেলেছে। বৈদ্যি বলল।
বিস্কো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তারপর বলল—কী সাংঘাতিক। কিন্তু তুমি ওষুধ দিলে কেন?
—ভেক্তর চাইল। বলল আহত হলে লাগবে। বৈদ্যি বলল।
—কী মারাত্মক ভুল করেছো ভেক্তরকে বিশ্বাস করে। বিস্কো মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে বলল। এবার একদল ভাইকিং বন্ধু ভেক্তরেরা কী নৃশংসভাবে এলাইমোর সৈন্যদের হত্যা করেছে সেসব কথা বলল।
বিস্কো বলে উঠল-ইস!—ভেক্তররা শেষ পর্যন্ত এই নিষ্ঠুর কাজ করল। আমরা যুদ্ধ করেছি আমার বন্ধুরা সামনাসামনি লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে কিন্তু কক্ষণো এইরকম নিষ্ঠুরভাবে নিরপরাধ সৈন্যদের বিশ্বাস উৎপাদন করিয়ে এভাবে মারেনি। ভেক্তররা ভাইকিং জাতির কলঙ্ক।
একজন ভাইকিং বন্ধু তাড়া দিল বিস্কো শঙ্কে ডেক-এ চলো। একদল সৈন্য জাহাজে চড়ে এসে আমাদের জাহাজে উঠেছে। মনে হচ্ছে ওরা এলাইমোর সৈন্য। শিগগির চলো!
ওরা ছুটল সিঁড়ির দিকে। ডেক-এ এসে দেখল—ভেক্তর তার দলবল নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য জাহাজের সৈন্যদের দলপতিও সঙ্গে জনা দশবারো সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে জাহাজটা ঘুরে ঘুরে দেখছে।
একটু পরেই সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে দলপতি ভেক্তদের দিকে এগিয়ে এলো। ভেক্তরের দিকে তাকিয়ে লো ল্যাতিন ভাষায় জিজ্ঞেস করল-তোমরা কে? কোত্থেকে আসছো? ভেক্তররা সেই ভাষা কিছুই বুঝল না। বিস্কোরাও বুঝল না।
তবে ভেক্তর আন্দাজে বুঝে নিয়ে বলল—আমরা ভাইকিং—ভাইকিং-সিরাকস বন্দর—সিরাকস আসছি। দলপতি এটুকু বুঝল যে ওরা বিদেশি। সিরাকস বন্দর থেকে জাহাজে চড়ে আসছে।
দলপতি লো ল্যাতিন ভাষাতেই বলল—তোমরা আমাদের অস্ত্র পোশাক কী করে পেলে? ভেক্তর কথাটা বুঝল না। তখন দলপতি ওর নিজের শিরস্ত্রাণ বর্ম তলোয়ার আঙুল ঠুকে দেখাতে লাগল।
এবার ভেক্তর বুঝল। ও হেসে তাড়াতাড়ি বলে উঠল—ক্রীট-ক্রীট-খানিয়া-খানিয়া। বোঝাতে চাইল ক্রীটের রাজধানী খানিয়ানগর থেকে এনেছে। দলপতি বুঝল সেটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। ভেক্তরের দল বিস্কো শাস্কেদের দল তখনও বুঝে উঠতে পারছে না কী ঘটবে এরপরে? তবে বিস্কো বুঝল ঐ দলপতির সন্দেহ যায় নি।
হঠাৎ ভেক্তর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দলপতি খুব দ্রুত দুপা ছুটে এসে ভেক্তরের কোমরের ঝোলানো তলোয়ারটা এক ঝটকায় খুলে নিল।
ভেক্তর চিৎকার করে বলে উঠল—বন্ধুরা—তৈরি হও। ভেক্তরের দলের ভাইকিংরা কোমরে তলোয়ারের বাঁটে হাত রাখল।
দলপতি হাতের খোলা তলোয়ারটা চোখের কাছে আনল। দেখল—তলোয়ারের বাঁটের ঠিকনীচেই একটা তাঁড়া চিহ্ন খোদাই করা। তাঁড়া চিহ্নের মাথার দুটো ফুটকি। এটা রাজা ফ্রেডারিকের রাজকীয় চিহ্ন। রাজার সৈন্যদের তলোয়ারে ঐ জায়গায় এই রাজকীয় চিহ্ন খোদাই করা থাকে। দলপতির সন্দেহ এবার দৃঢ় হল। স্পষ্ট বুঝল ওদের সৈন্যদের হত্যা করে ভেক্তররা এই অস্ত্র পোশাক সংগ্রহ করেছে।
দলপতি চিৎকার করে কী বলে উঠল। সেনাপতির সঙ্গী সৈন্যরা তলোয়ার কোষমুক্ত করল। ওপরের দিকে তুলে ধরল। উজ্জ্বল রোদ পড়ে চকচকে তলোয়ারের ফলাগুলো ঝলসে উঠল। ভেক্তরের বন্ধুরাও তলোয়ার কোষমুক্ত করল। একজন ভেক্তরের খালি হাতে একটা তলোয়ার দিল।
দলপতির জাহাজ থেকে আরো সৈন্য চিৎকার করে খোলা তলোয়ার হাতে এই জাহাজে উঠে এলো।
সৈন্যরা ভেক্তরের দলের ওপর তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হল তলোয়ারের লড়াই। অল্পক্ষণের মধ্যেই তলোয়ারের ঠোকাঠুকির শব্দে আহতের গোঙানিতে মৃত্যু। চিৎকারে জাহাজের ডেক ভরে তুলল।
বিস্কো শাঙ্কে আর ওদের বন্ধুরা তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে এই লড়াই দেখতে লাগল। হাজার হোক ওরা তো ভাইকিং। বীরের জাত। চোখের সামনে বন্ধুদের এইভাবে আহত হ’তে মৃত্যু হতে দেখে ওরা স্থির থাকতে পারল না। দু’তিনজল বিস্কোর কাছে ছুটে এলো। উত্তেজিত স্বরে বলল—বিস্কো আমাদের বন্ধুরা মারা যাচ্ছে। আমরা লড়াই করবো। বিস্কো চেঁচিয়ে বলল-না—ওরা যে নির্মম কাজ করেছে তার প্রায়শ্চিও ওদের করতে দাও। ওদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল দলনেতার সৈন্যরা সংখ্যাই শুধু বেশি নয় যুদ্ধেও নিপুণ। শুরু হ’ল ভেক্তরের দলের হার। আসলে ভেক্তরের দলে নিপুণ ভাইকিং যোদ্ধারা বেশি ছিল না।
তখন ভেক্তর আর দলপতির মধ্যে তলোয়ারের লড়াই চলছে। এগিয়ে পিছিয়ে লড়াই চলছে। ভেক্তরের মাথায় শিরস্ত্রাণ। বুকে বর্ম আঁটা। ওকে তলোয়ারের ঘায়ে কাবু করতে পারছিল না দলপতি। হঠাৎ দলপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ভেক্তর। দলপতি এই হঠাৎ আক্রমণ ঠেকাতে ঠেকাতে পিছিয়ে যেতে লাগল। একসময় জাহাজের রেলিঙের ওপর পিঠ রেখে তলোয়ার চালিয়ে আত্মরক্ষা করতে লাগল। কিন্তু ভেক্তরের প্রবল আক্রমণের মুখে এক মুহূর্তের জন্য হার মানল। দলপতি রেলিঙের ওপর প্রায় চিৎ হয়ে পড়ল। দুজনেই তখল ভীষণ হাঁপাচ্ছে। দলপতির মাথা থেকে শিরস্ত্রাণ খসে পড়ল সমুদ্রের জলে। ভেক্তর এই সুযোগ ছাড়ল না। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে ও দলপতির মাথা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল। কিন্তু দুর্ভোগ্য ভেক্তরের। মাস্তুলের ঝুলন্ত দড়িতে লাগল মাথার ওপর থেকে নেমে আসা তলোয়ারের কোপ। দড়ি কেটে গেল বটে। কিন্তু আচমকা বাধায় ভেক্তরের হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে সমুদ্রের জলে পড়ে গেল। দলপতি উঠে দাঁড়িয়ে নিরস্ত্র ভেক্তরের গলা লক্ষ্য করে সজোরে তলোয়ার চালাল। ভীষণভাবে আহত ভেক্তর সশব্দে ডেক এর ওপর গড়িয়ে পড়ল। একটুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে স্থির হয়ে গেল।
তখনই বিস্কো চিৎকার করে বলে উঠল—ভাইকিং ভাইসব-লড়াই থামাও। ভেক্তর যে পাপ করেছে তার ফল পেয়েছে। আর লড়াই নয়। ভাইকিংরা অস্ত্র নামাল। বিস্কো ব’লে উঠল—সবাই অস্ত্র ফেলে দাও। ভাইকিংরা হাতের তলোয়ার ডেক-এ ফেলে দিল। দলপতিও কী বলে উঠল। তার সৈন্যরাও তলোয়ার নামাল।
এবার দলপতি ক্লান্ত পায়ে আস্তে আস্তে বিস্কোর সামনে এসে দাঁড়াল। দলপতি বিস্কোর কোনো কথাই বুঝতে পারেনি। তবে এটা যে বুঝেছিল যে বিস্কোই ওদের দলনেতা। দলনেতা বার দুয়েক ক্লান্তস্বরে বলল—তোমরা কোথায় যাচ্ছিলে?
বিস্কো বুঝল না। তবে বিস্কো ডান হাত তুলে পেছন দিকে সমুদ্র দিগন্ত দেখিয়ে বারবার বলতে লাগল-সিরাকস বন্দর। দলপতি সিরাকস কথাটা শুনে বুঝল ওরা সিরাকস বন্দরে ফিরে যেতে চায়। দলপতি মাথা ওঠানামা করে বোঝার ইঙ্গিত করল।
বিস্কো ভেক্তরের দলের ভাইকিং বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল—তোমরা যদি দেশে ফিরে যেতে চাও বলো তাহলে লিপারির ঐ ছোটো বন্দরটায় তোমাদের নামিয়ে দেব। কোনো জাহাজে উঠে তোমরা দেশে চলে যেও।
ভেক্তরের অনুগামীদের দুজন গুরুতর আহত হয়েছিল। অনেকেই মারাও গিয়েছিল। বাকিদের মধ্যে কয়েকজন বলল-না—আমরা তোমাদের ফ্রান্সিসদের ফেলে দেশে ফিরবো না। ফিরলে সবাই একসঙ্গে ফিরবো।—এই তো খাঁটি ভাইকিংদের মতো কথা। বিস্কো বলল।
দলপতি আর এলাইমোর সৈন্যরা নিজেদের জাহাজে চলে গেল। বিস্কো জাহাজ চালকের কাছে এল। বলল—বন্দরে ফিরে যাবো। জাহাজের মুখ ঘোরানো হ’ল।
তখন দুপুর। বিস্কোদের সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। রাঁধুনি বন্ধুরা রান্না শুরু করল। ওদের দফায় দফায় খেতে খেতে বিকেল হয়ে গেল। ততক্ষণে সমুদ্রে জোর হওয়া দাপাদাপি শুরু হয়েছে। জাহাজের সব পাল খুলে দেওয়া হ’ল। জাহাজ দ্রুত ঢেউ ভেঙে চলল সিরাকস বন্দরের দিকে। দলপতির জাহাজটাও পেছনে পেছনে আসতে লাগল। জাহাজ যখন সিরাকস বন্দরে পৌঁছল তখন রাত হয়েছে। ফ্রান্সিসদের জাহাজ জাহাজঘাটায় লাগতেই ঘাট থেকে এলাইমোর পাহারাদার কয়েকজন সৈন্যের ক্রুদ্ধ চিৎকার ভেসে এলো। বিস্কো শাঙ্কো রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল। বিস্কো বুঝল ওদের জাহাজের দশজন পাহারাদার যে নিখোঁজ হয়েছে এটা এলাইমোর সঙ্গী সৈন্যরা জানতে পেরেছে। ভেক্তর ঝড়ের সময় জাহাজ নিয়ে পালিয়েছিল। কাজেই ওরা ধরে নিয়েছে ভাইকিংরা ওদের সঙ্গী পাহারাদারদের হত্যা করেছে।
ঘাটে পাটাতন ফেলতেই এলাইমো সর্ব প্রথমে উঠে এলো। পেছনে খোলা তলোয়ার হাতে আরো পাঁচ ছ’জন সৈন্য। সবারই মুখ থমথমে। বিস্কো বুঝল—ভীষণ সমস্যায় পড়ল ওরা। হ্যারি ছাড়া ওরা কেউই লো ল্যাতিন ভাষা জানেনা। ওরা কী করে এলাইমোকে সমস্ত ব্যাপারটা বলবে। কী করে বোঝাবে ঐ দশজনকে হত্যার জন্যে ওরা দায়ী নয়। স্পেনীয় ভাষায় চেষ্টা করে দেখা যাক। বিস্কো এগিয়ে এলো। স্পেনীয় ভাষায় বলল আপনাদের ভাষা আমি জানি না। আমি স্পেনীয় ভাষায় সব বুঝিয়ে বলছি।
এলাইমো গম্ভীর সুরে ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলল—স্পেনীয় বুঝি ভালো বলতে পারি না। বলো সব।
বিস্কো থেমে থেমে আস্তে আস্তে ভেক্তরের দল পাকানো পাহারাদারদের হত্যা করা—পালনো—অন্য জাহাজের আক্রমণ ও ভেক্তর ও তার সঙ্গী অনেকের মৃত্যুসব বলল।
এলাইমো চুপ করে সব শুনল। তারপর বলল—তুমি মিথ্যা-সত্য কী বুঝবো?
বিস্কো দুশ্চিন্তায় পড়ল। ওর ভাগ্য ভালো। তখনই দলপতির সেই জাহাজটা জাহাজঘাটায় এসে লাগল। শাঙ্কো দেখল সেটা। শাঙ্কো চেঁচিয়ে বলল-বিস্কো সেই দলপতির জাহাজ এসেছে। আমি দলপতিকে নিয়ে আসছি। শাঙ্কো দ্রুত পায়ে পাতা পাটাতনের ওপর দিয়ে ছুটল।
বিস্কো এলাইমাকে বলল—আপনার সৈন্য বাহিনীর এক দলপতি সব ঘটনা দেখেছে—জানে সে আসছে সব বলবে আপনাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দলপতিকে সঙ্গে নিয়ে শাঙ্কো ফিরে এলো। শাঙ্কো তখনও হাঁপাচ্ছে। সেনাপতি এলাইমোকে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে দলপতি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এবার এলাইমো দলপতির কাছে সব জানতে চাইল। দলপতি আস্তে আস্তে সব ঘটনা বলল। আরো বলল—সে সন্দেহ করছিল ঐ কয়েকজন ভাইকিং তাদেরই সৈন্যদের হত্যা করে অস্ত্র পোশাক নিয়ে সশস্ত্র হয়েছিল। এটা যে সত্য তা সে এখানে এসে জানতে পেরেছে। এখানকার পাহারাদার সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলে।
এলাইমো বলল—সেই ভাইকিংরা কী করে সৈন্যদের হত্যা করেছিল কখন হত্যা করেছিল?
দলপতি মাথা নেড়ে বলল—সেটা কেউ বলতে পারছে না। বিস্কো ওদের সব কথা বুঝল না। কিন্তু এটা বুঝল যে এলাইমো জানতে চাইছে কী করে কখন জাহাজে পাহারাদার ওর সৈন্যরা মারা গেল। আশঙ্কায় বিস্কোর বুক কেঁপে উঠল। ভেক্তররা নির্মমভাবে ঐ পাহারাদারদের হত্যা করছিল। এটা যদি এলাইমো জানতে পারে তাহলে এলাইমো ক্ষিপ্ত হবেই। বিস্কোদের ওপর সে প্রতিশোধ নেবেই। তার অর্থ ওদের সবাইকে আত্মরক্ষার জন্যে লড়াই-এ নামতে হবে। ক’জন বাঁচবে আর ক’জনই বা জাহাজে চড়ে পালাতে পারবে?
ভাগ্য ভালো বলতে হবে। এলাইমো দলপতির দিকে তাকিয়ে বলল—এই বিদেশি ভাইকিংদের মধ্যে কারা তোমাদের সঙ্গে লড়াই করেছিল চিনিয়ে দিতে পারবে।
দলপতি উপস্থিত বিস্কো শাঙ্কে আর ওদের বন্ধুদের দেখে দেখে মাথা নেড়ে বলল——এরা লড়াই করেনি।
—তাহলে কারা লড়াই করেছিল? এলাইমা জানতে চাইল।
—তাদের বেশিরভাগই হয় মারা গেছে নয়তো আহত হয়েছে। দু’চারজন সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়েছে। দলপতি বলল।
এলাইমো এবার বিস্কোর দিকে তাকাল। বলল–আহতরা কোথায়?
বিস্কো দ্রুত ভাবল বলবে আহত কেউ নেই। সব মরে গেছে। কিন্তু এলাইমো যদি জাহাজ খানাতল্লাশী করে তবে দু’জন আহত বন্ধু ধরা পড়ে যাবে। তখন মিথ্যে বলার জন্য ওদের সবাইকে বিপদে পড়তে হবে। কাজেই সত্যি কথাই বলতে হ’ল। বিস্কো বলল-আসুন।
বিস্কো নীচে নামার সিঁড়ির দিকে চলল। পেছলে এলাইমো। তার পেছনে দলপতিসহ চার-পাঁচজন সৈন্য। যে কেবিনঘরে আহত দুই ভাইকিং বন্ধু ছিল। বিস্কো সেই ঘরে ঢুকল। এলাইমো দলপতিও ঢুকল। আহত দু’জনের পরনে তখনও এলাইমোর সৈন্যদের সেই পোশাক। শুধু শিরস্ত্রাণ আর তলোয়ার নেই। একজন শুয়েই ছিল। তবে উরুতে কল মতো কাপড়ের মোটা ফেট্টি বাঁধা। অন্যজনের বাঁ কাঁধে ঐরকম মোটা ফেট্টি। দু’জনেই এলাইমোকে দেখে ভীষণভাবে চমকে উঠল। এলাইমো ওদের পোশাক দেখে থমকে দাঁড়াল। রাগে ওর দু’চোখ জ্বলে উঠল। এক ঝটকায় কোমর থেকে রুপালি বাঁটের তলোয়ার খুলে ফেলল। বিস্কো একলাফে এলাইমোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দু’হাত জোড়া করে বারবার বলতে লাগল—দোহাই ওদের হত্য করবেন না। রাজা ফ্রেডারিকের দরবারে নিয়ে চলুন। বিচার হোক ওদের। রাজা ফ্রেডারিক যা শাস্তি দেবেন মেনে নেবো। দুই আহত ভাইকিং-এর মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এলাইমো কী ভেবে তলোয়ার কোষবদ্ধ করল। দলপতিকে কী আদেশ দিয়ে কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দলপতি ওর পাঁচজন সৈন্যকে আনতে বলল। সৈন্যরা বসে থাকা ভাইকিংকে এক হ্যাঁচকা টানে বিছানা থেকে মেঝেয় দাঁড় করাল। অন্য তিনজন সৈন্য শুয়ে থাকা ভাইকিংকে জোর করে তুলে দাঁড় করাল। ওরা দুজনেই ব্যথায় গোঙাতে লাগল।
বিস্কো দলপতিকে বার বার বলতে লাগল-ওরা ভয়ানক আহত। দুটো দিন সময় দিন। আমরাই ওদের নিয়ে যাবো।
দলপতি সেকথা বুঝল না। কানও দিল না। সৈন্যদের ইঙ্গিত করল টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে। সৈন্যরাও বিন্দুমাত্র করুণা দেখাল না আহত ভাইকিংদের প্রতি। টেনে হিঁচড়ে দু’জনকে কেবিনঘর থেকে বের করল। নিয়ে চলল সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি দিয়ে টেনে তুলতে গিয়ে একজন ভাইকিং-এর কাটা উরুতে বাঁধা ফেট্টিটা খুলে গেল। ও চিৎকার করে উঠল। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ছুটল। দু’জনের আর্তনাদে অসহ্য যন্ত্রণার জন্য কান্নায় ভরে উঠল জাহাজের ডেক। সৈন্যরা সে সবে কান দিল না। ওদের দুজনকে টেনে হিঁচড়ে জাহাজঘাটায় নামল।
অন্য ভাইকিং বন্ধুরা অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। শাঙ্কো বলল—বিস্কো—এখন কী করবে?
—চলো—ওদের দু’জনকে একটা খুব জরুরি কথা বলতে হবে। কথাটা বলে বিস্কো ওদের আহত বন্ধু ও সৈন্যদের দলের দিকে ছুটল। শাঙ্কোও পেছনে পেছনে ছুটল। আহত দু’জন তখন যন্ত্রণাকাতর চিৎকার করে চলেছে।
বিস্কো ছুটে ওদের কাছে এলো। ওদের দেশীয় ভাষায় চিৎকার করে বলল—সাবধান সৈন্যদের বিষ খাইয়ে মেরেছো রাজার কাছে একথা কখনও বলবে না। বলবে—লড়াই হয়েছে। কথাটা দু’তিনবার বলে বিস্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। দলপতি বা পাহারাদার সৈন্যরা বিস্কোর কথা কিছুই বুঝল না। ওরা বন্দি দু’জনকে টেনে নিয়ে চলল। নিস্তব্ধ রাতে পথে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত শোনা গেল বন্দি দু’জনের যন্ত্রণাকাতর চিৎকার আর্তনাদ। বড়ো করুণ সেই পরিবেশ।
শাঙ্কো কাছে আসতে বিস্কো বলল—চলো—এক্ষুণি ফ্রান্সিসকে সব বলতে হবে। একমাত্র ফ্রান্সিস ই রাজা ফ্রেডারিককে বলে ওদের প্রাণে বাঁচাতে পারে।
—কিন্তু এত রাতে ফ্রান্সিসদের সঙ্গে দেখা করতে দেবে? শাঙ্কো বলল।
-–উপায় নেই। দেখা করতেই হবে। চলো—দুর্গে যাবো। বিস্কো হাঁটতে শুরু করল শাঙ্কোও সঙ্গে চলল।
জনশূন্য অন্ধকার পথ দিয়ে ওরা দ্রুত হাঁটতে লাগল দুর্গের দিকে।
ওরা দুজনে দুর্গের প্রধান দেউড়ির সামনে এলো। লোহার বিরাট দরজা বন্ধ। লোহার মোটা গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখল খোলা তলোয়ার হাতে সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে।
বিস্কো সৈন্যদের বলল—বিশেষ দরকারে এসেছি ভাই। আমাদের একটা অনুরোধ রাখো। দু’জন সৈন্য হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিস্কোর কথা কিছুই বুঝল না। তবু একজন গরাদের কাছে মুখ বাড়াল। বিস্কোর এতক্ষণে খেয়াল হ’ল ওরা তো ওর কোনো কথাই বুঝবে না। বিস্কো এবার বার বার বলতে লাগল—সাভোনা-সাভোনা। সৈন্যটি বুঝল এরা সাড়োনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। সৈন্যটি আঙ্গুল তুলে আকাশ দেখিয়ে বোঝাতে চাইল অনেক রাত হয়ে গেছে। কিন্তু বিস্কো হাল ছাড়ল না। বার বার সাভোনা সাভোনা বলতে লাগল। সৈন্যটি বুঝল বিস্কোকে নিরস্ত করা যাবে না। সৈন্যটি মাথা ওঠানামা করে সন্মতি জানাল। হাতের ইঙ্গিতে ওদের ওখানেই দাঁড়াতে বলল। তারপর পাথরের চত্বর পেরিয়ে চলল দুর্গের ঘরগুলোর দিকে।
অল্পক্ষণ পরেই সাভোনা এলো। দরজার কাছে এসে মশালের আলোয় বিস্কোদের চিনতে পারল। বলল—কী ব্যাপার? এত রাতে এসেছো?
—শিগগির ফ্রান্সিসকে আসতে বলুন। এরমধ্যে অনেক কা ঘটে গেছে। বিস্কো বলল। সাভোনা আর কোনো কথা বলল না। দুর্গের ঘরগুলোর দিকে চলে গেল।
একটু পরেই ফ্রান্সিস হ্যারি আর মারিয়া প্রায় ছুটতে ছুটতে এলো। দরজার কাছে এসে ফ্রান্সিস বলল—বিস্কো কী হয়েছে? এ্যাঁ?
—সে অনেক কথা। সব বলছি—শোনো। একটু থেমে বিস্কো ওদের দেশীয় ভাষায় আস্তে আস্তে সমস্ত ঘটনা বলল।
সব কথা শেষ হতে মারিয়া বলে উঠল—কী সাংঘাতিক! হ্যারি বলল—তোমরা ভেক্তরকে বাধা দিতে পারলে না?
—যখন জানলাম তখন যা ঘটার ঘটে গেছে। বিস্কো বলল। ফ্রান্সিস ঘটনা শুনতে শুনতে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছিল। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-ভেক্তর আর আমার বন্ধুরা এরকম নির্মম কা ঘটাতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি। মানুষ কতটা নীচে নামলে এরকম নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে। বিস্কো বলল—ভীষণ আহত বন্ধু দু’জনকে যেভাবে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে—
—থামো—ফ্রান্সিস ধমকে উঠল—ঐ নৃশংস মানুষ দুটোকে কি রাজা ফ্রেডারিকের গাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে যাবে?
—তবু—ওরা যে আমাদেরই বন্ধু। ওদের প্রাণে বাঁচাবার চেষ্টা করবেনা? বিস্কো বলল।
—না। ফ্রান্সিস ক্রুদ্ধস্বরে চিৎকার করে উঠল। হ্যারি মারিয়া অবাক চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে থাকল।
—রাজা ফ্রেডারিককে তুমি যদি একবার অনুরোধ করো-বিস্কো বলল।
—বিস্কো—একটা কথা জেনো এভাবে কাপুরুষের মতো যারা মানুষকে হত্যা করে তাদের আমি বন্ধু বলে স্ফীকার করি না। আমি মরে গেলেও ওদের জন্য প্রাণভিক্ষা চাইবো না। ওদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ওদেরই করতে দাও। ফ্রান্সিস থেমে থেমে কথাগুলো বলল। তারপর বলল-তোমরা যাও। আমি যা বললাম বন্ধুদের তা বুঝিয়ে বলল। কেউ যেন আমাকে ভুল না বোঝে। মারিয়া বা হ্যারি কোন কথা বলল না। ওরা ভালো করেই জানে ফ্রান্সিসকে কোনোভাবেই সঙ্কল্পচ্যুত করা যাবে না।
ওরা ফিরে চলল নিজেদের ঘরে।
বিস্কো মৃদুস্বরে শাঙ্কোকে বলল—ফ্রান্সিস কতগুলোনীতি মেনে চলে। কোনো অবস্থাতেই ফ্রান্সিস ওর নীতিবিরোধী কাজ মেনে নেয় না। তাই বন্ধু হলেও ওকে শ্রদ্ধা করি।
দু’জনে মন্থর পায়ে জাহাজঘাটার দিকে চলল। এতক্ষণে ওরা বুঝতে পারল ওরা কত ক্লান্ত।
জাহাজঘাটের কাছে এসে বিস্কো হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। শাঙ্কো বলল—কী হল বিস্কো?
বিস্কো বেশ চিন্তান্বিতস্বরে বলল—আহত বন্দি দু’জন তো আমাদেরই স্বদেশবাসী ভাই বন্ধু। জানিনা ওদের দু’জনকে কোথায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। ভীষণ আহত ওরা। এলাইমোর সৈন্যরা ওদের দুজনকে নির্মমভাবে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই এই টানা হ্যাঁচড়ায় ওদের শরীরের ক্ষত থেকে আরো রক্ত পড়েছে। দুর্বল হয়ে পড়েছে ওরা। ওদের চিকিৎসার কিছু ব্যবস্থা হয়েছে কিনা তাও জানি না।
—ঠিকই বলেছো বিস্কো –শাঙ্কো বলল—তবু ওরা যেমন নিষ্ঠুরভাবে এলাইমোর পাহারাদার সৈন্যদের বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে—এটাকে মোটেই মেনে নেওয়া যায়না। ওদের এই ঘৃণ্য আচরণের জন্য যে শাস্তি ওদের পাওয়া উচিৎ তাই পাক। আমরা কী করবো বলো?
—তবু-শাঙ্কো—ভেবে দেখো আমরা যখন দেশে ফিরবো তখন ওদের বাবা-মা তো জানতে চাইবে ওদের ছেলেদের কী হয়েছে?
—রাজা ফ্রেডারিক কি ওদের মুক্তি দেবে না?শাঙ্কো জানতে চাইল।
মাথা খারাপ—বিস্কো বলল—রাজা ফ্রেডারিক যখন সব জানতে পারবে তখন ওদের প্রাণ দেবেই। ফাঁসি ওদের হবেই। পারবে দেশে ফিরে ওদের পুত্র হারা বাবা মাকে সান্ত্বনা দিতে? কী ব’লে ওদের সান্ত্বনা দেবে?
—কী করবো বলো—যা সত্য তাই বলবো। শাঙ্কো বলল।
বিস্কো জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল—না শাঙ্কো তা হয় না। ওরা যাই করুক তবু ওরা আমাদের ভাইয়ের মতো বন্ধুও। ওদের যেভাবে হোক বাঁচাতে হবে। এ
—কিন্তু কী করে?শাঙ্কো বলল—দেখে এলে তো রাজার সৈন্যরা কীভাবে ম্যামিয়েস দুর্গ পাহারা দিচ্ছে। রাজা ও রাজপরিবারের অনেকে এখন ঐ দুর্গে আছে, তাই এত নিরাপত্তার কড়াকড়ি। পারবে ঐ কড়া পাহারার মধ্যে দিয়ে বন্ধুদের মুক্ত করতে?
—দেখি তো চেষ্টা করে। বিস্কো বলল। তারপর ফিরে দাঁড়াল। বলল—চলল—ম্যামিয়েস দুর্গের মাঝে। শাঙ্কো বুঝল বিস্কোকে ফেরোনো যাবে না। ও যদি সঙ্গে না যায় তাহলে বিস্কো একাই বন্ধুদের মুক্ত করতে যাবে। তাতে একা বিস্কো বিপদে পড়বেই। অথচ এখন বিস্কোকে সেকথা বোঝানো যাবেনা। বিস্কো শাঙ্কোর জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত ম্যামিয়েস দুর্গের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
শাঙ্কো ডাকল—বিস্কো—দাঁড়াও। বিস্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল—তুমি যাবে,না যাবে না!
—যাবো। জাহাজ থেকে আমার তির-ধনুক নিয়ে আসছি। তুমি একটু দাঁড়াও। কথাটা বলে শাঙ্কো দৌড়ে চলল জাহাজের ঘাটের দিকে।
একটু পরেই শাঙ্কো তির-ধনুক নিয়ে এলো দু’জনে চলল ম্যামিয়ে দুর্গের দিকে। দুর্গের প্রধান দেউড়ি দূর থেকে দেখল। দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনে। আর এগোলো না। দেউড়িতে দশ-পনেরোজন পাহারাদার সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছে। দেউড়ির আশেপাশে সাত-আটটা মশাল জ্বলছে। বেশ আলো ছড়িয়ে আছে চারদিকে।
দেউড়ির কাছে যাওয়া যাবেনা। ওরা রাস্তার অন্যপাশে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল। টানা পাথরের উঁচু দেয়ালের জায়গায় জায়গায় মশাল জ্বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে রইল। লক্ষ্য করল কিছুক্ষণ পর পর তিনজন সৈন্য দেয়ালে গুঁজে রাখা মশালের তলা দিয়ে ভোলা লোয়ার হাতে দেয়ালের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাহারা দিচ্ছে। যদি পাথরের উঁচু দেয়াল। ডিঙোতে হয় তাহলে ওরা যখন পাহারা দিতে দূরে চলে যাবে তখনই ডিঙোতে হবে ওরা ফিরে আসার আগেই কাজ সারতে হবে।
বিস্কো বেশ নজর দিয়ে দেয়ালটা দেখতে দেখতে ফিস্ ফিস্ করে বলল–শাঙ্কো লক্ষ্য করো—পাথরের দেয়ালের খোঁদলে খোঁদলে মশালগুলো বসানো আছে। আচ্ছা তির মেরে মশালগুলো ফেলে দেওয়া যায় না?শাঝে বেশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বুঝল যে তির ছুঁড়ে ঠিক ঘা দিতে পারলে মশালগুলো খোদাল থেকে ছিটকে পড়ে যাবে। কিন্তু মশালগুলো ছিটকে মাটিতে পড়লেও তো নিভবে না। ধুলোটে পথে পড়ে গিয়েও নিভে যাবে কিনা সেটাই সমস্যা। না নিভে যদি অল্প অল্পও জ্বলতে থাকে তাহলেও তো ওখান দিয়ে দেয়ালের কাছে যাওয়া যাবেনা। দেয়ালও টপকে পার হওয়া যাবে না। শাঙ্কো ওদিকে তাকিয়ে এসব ভাবছে তখনই দেখল সেই তিনজন প্রহরী সৈন্য মশালগুলোর নীচে দিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে আসছে। হঠাৎ দুটো মশালের নীচে দিয়ে আসার সময় একজন প্রহরী দাঁড়িয়ে পড়ল। শাঙ্কোর কানে খুব মৃদু শব্দ এলো ছপ। শাঙ্কো চমকে বিস্কোর দিকে তাকাল। ফিসফিস্ করে বলল—বিস্কো ঐ মশাল দুটোর নীচের মাটিতে জল কাদা জমেছে।
বিস্কো কথাটা শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠল। বলল তাহলে তো ওখানে মশাল দুটো ফেলতে পারলে মশালের আগুন নিভে যাবে। অনেকটা জায়গা অন্ধকার হয়ে যাবে।
শাঙ্কো অন্ধকারে হেসে বলল—ঠিক তাই। ততক্ষণে পাহারাদাররা দূরে চলে গেছে। শাঙ্কো কাঁধে কোমরে ঝুলিয়ে রাখা ধনুকটা খুলে হাতে নিল। কাঁধের তিরের খাপ থেকে একটা তির তুলে নিয়ে ধনুকে পরাল। ছিলা টেনে ধরে সামনের মশালটার দিকে নিশানা করল। তারপর তির ছুঁড়ল। অন্ধকারে তির ছুটল। কিন্তু মশালটার আগুনে লাগল না। খোদলটায় ঢুকে ছিটকে এসে নীচে পড়ে গেল।
বিস্কো চাপা গলায় বলল—শাঙ্কো—আবার তির ছোঁড়ো নিশানা যেন নিখুঁত হয়। তির নষ্ট করা চলবে না। শাঙ্কোর কেমন জেদ চেপে গেল। এবার একটু সময় নিয়ে লক্ষ্য স্থির করে তির ছুঁড়ল। তিরটা ছুটে গিয়ে জ্বলন্ত মশালের গায়ে বিঁধে গেল। মশালটা খোঁদাল থেকে ছিটকে গিয়ে নীচের জলকাদার মধ্যে পড়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল। আবার তির ছুঁড়ল। পরের জ্বলন্ত মশালটাও ছিটকে পড়ল নীচের জলকাদায়, সেটাও সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল। দেয়ালের কাছে অনেকটা জায়গা একবারে অন্ধকার হয়ে গেল। বিস্কো খুশিতে শাঙ্কোর পিঠ চাপড়াল।
দু’জনে অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর বিস্কো মাথা ঝুঁকিয়ে অন্ধকারে এক ছুটে রাস্তাটা পেরিয়ে দেয়ালের ধারে চলে এলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অন্ধকারে ও শাঙ্কোর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে শাঙ্কোও একইভাবে এক ছুটে দেয়ালের কাছে চলে এলো। অন্ধকারে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দুজনেই অল্প অল্প হাঁপাতে লাগল। বিস্কো ভালো করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল বেশ কিছুটা দূরে দুর্গের সদর দেউড়ির সামনে প্রহরী সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছে। অন্ধকারে এত দূরে ওদের দেখতেই পাবে না।
এবার বিস্কো খুব ক্ষীণ জ্যোৎস্নায় দেয়ালের গায়ে কয়েকটা পাথরের খাঁজ দেখল। ছোটো খোঁদাল আছে—বোধহয় মশাল রাখার জন্যে। বিস্কো প্রথম খাঁজটায় পা রাখল। তারপর আস্তে আস্তে খাঁজে খাঁজে পা রেখে দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগল। একেবারে দেয়ালের মাথার কাছে মশাল রাখান খোঁদল। খোঁদলটায় পা রেখে শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দেয়ালের মাথায় উঠে বসল। তারপর দেয়ালের ওপাশে আবার পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে দুর্গের পাথুরে চত্বরে নামল। নেমেই অন্ধকারে বসে পড়ল। শাঙ্কোও বিস্কোর মতো পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে উঠতে লাগল। দেয়ালের মাথার কাছে। খোদালটায় পা রেখে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে পা-টা পিছলে গেল। একটা পাথরের বড়ো টুকরো খসে গিয়ে নীচে পড়ে গেল। জলে কাদায় পড়ে শব্দ হল গ্রুপ। দেউড়ির একজন প্রহরী কানে গেল শব্দটা। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হ’ল। দেয়ালে বুক চেপে অনড় দাঁড়িয়ে রইল। প্রহরীটা অন্ধকারে এদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কপালে গোল করে হাত রেখে মশালের আলো আড়াল করেও কিছুক্ষণ দেখল। কিন্তু অন্ধকারে যতটা দেখতে পেল তাতে কোন কিছুর নড়াচড়া দেখতে পেল না। নিশ্চিন্ত মনে খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিতে লাগল। শাঙ্কোও নিশ্চিন্ত হল। ও আবার সেই খোঁদলে পা রেখে শরীর ঝাঁকিয়ে দেয়াল ডিঙোল দেয়ালের ওপাশে নেমেই বিস্কোর গা ঘেঁষে বসে পড়ল।
একটু পরে বিস্কো বলল—শাঙ্কো—দেখ-দুর্গের ঘরগুলোর জায়গায় জায়গায় মশাল জ্বলছে। সেই আলোয় যা দেখছি তাতে বুঝতে পারছি ওগুলো থাকা শোয়ার ঘর। আমাদের আহত বন্ধু দু’জনকে এইসব ঘরে নিশ্চয়ই রাখা হয়নি। ওদের বন্দি করা হয়েছে। কাজেই নিশ্চয়ই রাখা হয়েছে কয়েদঘরে। এবার সেই কয়েদঘরটা খুঁজে বের করতে হবে। চলো রাত শেষ হবার আগেই ওদের মুক্ত করতে হবে। বিস্কো অন্ধকারে মাথা নিচু করে প্রায় হামাগুড়ি দিতে দিতে দুর্গের ঘরগুলোর দিকে চলল। একইভাবে পেছনে পেছনে শাঙ্কোও চলল। দুর্গের প্রথম ঘরটার কাছাকাছি এলো। মশালের আলো যতদূর গেছে তার বাইরে এসে থামাল। না এসব ঘর না। বাঁদিকে ঘুরে আবার চলল। পরপর ঘরগুলো পার হতে লাগল। একটা বড়ো ঘরের সামনের সিঁড়িতে দেখল অনেকগুলো মশাল জ্বলছে। প্রহরীর সংখ্যাও বেশি। তার মানে এখানে রাজা ফ্রেডারিক আছে। বিস্কোরা অন্ধকার পাথুরে চত্বর দিয়ে চলল। অন্দরমহল পার হল। তখনই দেখল পশ্চিম কোণায় দেয়ালের গা ঘেঁষে একটা লম্ফাটে পাথরের ঘর। ঘরটার সামনে দরজার দুপাশে মশাল জ্বলছে। কাছাকাছি আসতে দেখল ঘরটার দরজায় লোহার গরাদে একটা বড়ো তালা লাগানো দরজায়। দুজন প্রহরী খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছে। বিস্কো ফিস ফিস করে বলল শাঙ্কো এটাই কয়েদঘর। আহত বন্ধুদুজনকে নিশ্চয়ই এখানে কয়েদ করা হয়েছে।
—কিন্তু ওদের মুক্ত করবে কী ভাবে? দেখছোনা—দুজন পাহারাদার পাহারা দিচ্ছে। শাঙ্কো বলল। তারপর বলল—তবে যদি বলো তির ছুঁড়ে মশাল দুটো ফেলে দিতে পারি।
—কোনো লাভ নেই। ওখানে জল নেই। মশাল সহজে নিভবে না। উল্টে রাজার ঘরের পাহারাদারদের নজরে পড়বে। অন্য উপায় ভাবো। বিস্কো বলল।
—দুটোকেই তির মেরে জখম করতে পারি। শাঙ্কো বলল।
—কী লাভ তাতে। ওরা আহত হলেই চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করবে। তিরে আহত হয়েছে দেখলে ওরা বুঝে নেবে ধারে কাছে কোনো শত্রু তিরন্দাজ আছে। সারা দুর্গ এলাকা দল বেঁধে খুঁজে বেড়াবে। আমাদের তখন পালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না। তারপর সৈন্যরা প্রহরীরা আরো সাবধান হয়ে যাবে। বন্ধুদের উদ্ধর করা তখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। বিস্কো বলল।
তারপর বলল-শোনো পাহারাদার দু’জনকে কাবু করতে হবে। ওদের কোমরে ঝোলানো চাবি নিয়ে দরজা খুলে বন্ধুদের মুক্ত করতে হবে। তারপর দেয়াল ডিঙিয়ে পালাতে হবে।
—কিন্তু বন্ধুরা তো বেশি আহত পারবে ওরা? শাঙ্কো বলল।
—পারতেই হবে। নইলে ওদের ফাঁসির হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। ফ্রান্সিস চেষ্টা করলে হয়তো পারতো। কিন্তু ফ্রান্সিস এরকম নৃশংস কাজকে কক্ষণো সমর্থন করবে না। বিস্কো বলল। তারপর মাথা নিচু করে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে চলল কয়েদঘরের দিকে। কয়েদঘরের বারান্দায় প্রহরী দু’জন পাহারা দিচ্ছিল। অন্ধকার থেকে মাথা নিচু করে ছুটে এসে বারান্দায় উঠে বিস্কো আর শাঙ্কো ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রহরী দুজনের ওপর। দুজন প্রহরী কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজনের মাথায় গুঁতো খেয়ে ওরা ছিটকে বারান্দায় চিৎ হয়ে পড়ে গেল। হাতের তলোয়ারও ছিটকে গেল। বিস্কো চিৎ হয়ে থাকা দু’জন প্রহরীর গলা দুহাত দিয়ে চেপে ধরে দ্রুত বলল–শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি খোল। মুখ বাঁধা। প্রহরী দুজন গোঙাতে লাগল। শাঙ্কো দ্রুত হাতে নিজের কোমরের ফেট্টিটা খুলল। একদল প্রহরীর মুখ চেপে পেঁচিয়ে বাঁধল। প্রহরীটা অস্পষ্ট স্বরে গোঙাতে লাগল। বিস্কোর কোমরের ৭ ফেটি খুলে শাঙ্কো অন্য প্রহরীটার মুখ চেপে পেঁচিয়ে বাঁধল। তারপর দু’জনেই প্রহরীদের তলোয়ার দুটো তুলে নিল।
একজন প্রহরী উঠে দাঁড়াতে গেল। শাঙ্কো তার বুকে তলোয়ারের ধারালো ডগাটা চেপে ধরে বলল—উঠতে গেলেই মরবে। মুখের বাঁধনেও হাত দেবে না। দুদল প্রহরীই ওদের দিকে চিত হয়ে শুয়ে থেকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। বিস্কো প্রহরীদের কোমরে গোঁজা চাবির থোকা খুঁজতে লাগল। সর্বনাশ। দুজনের কারো কোমরেই তো চারি গোছা নেই। বিস্কো আর শাঙ্কো পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। যে প্রহরীর কোমরে চাবির গোছা থাকে সে গিয়েছিল অন্য প্রহরীদের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করে সময় কাটাতে। সেই প্রহরী ঠিক তখনই বারান্দার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে তো অবাক। বিস্কো শাঙ্কো তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন প্রহরী বারান্দায় পড়ে আছে। গোঙাচ্ছে। বিস্কো শাঙ্কো লাফিয়ে প্রহরীটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। তার আগেই প্রহরীটি তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে ছুটল রাজার ঘরের সামনের প্রহরীদের দিকে। চিৎকার করে বলতে লাগল শিগগির আয় কয়েদঘরে ডাকাত পড়েছে।
—পালাও—বলেই বিস্কো বারান্দা থেকে লাফিয়ে পাথুরে চত্বরে নামল। শাঙ্কোও লাফিয়ে নামল। দুজনে প্রাণপণে ছুটল পাথরের প্রাচীরের দিকে।
কিন্তু ততক্ষণে দুর্গের প্রহরীরা চিৎকার করতে করতে মশাল হাতে ছুটে আসতে শুরু করেছে। তখন প্রাচীরের পাথুরে দেয়াল মাত্র হাত পাঁচেক দূরে। বিস্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। শাঙ্কোও দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে শাঙ্কো বলল কী হল?
—অসম্ভব। দেয়ালের সবটা উঠতে পারবোনা। সেই চেষ্টা করলে প্রহরীরা এলোপাথারি তলোয়ার চালাবে। আমরা ভীষণভাবে আহত হবো। বলা যায়না। আমাদের মেরেও ফেলতে পারে। তার চেয়ে লড়াই না করে ধরা দাও? প্রাণে তো বাঁচবো। পরে দেখা যাবে। বিস্কোর কথা শেষহবার আগেই প্রহরীরা বিস্কোদের কাছে এসে দাঁড়াল। ওরা হাঁপাচ্ছে তখন। মশালের আলো পড়েছে বিস্কো আর শাঙ্কোর মুখে গায়ে। বিস্কো হাতের তলোয়ারটা পায়ের কাছে ফেলে দিল। পাথরের চত্ত্বরে শাঙ্কো ও তলোয়ার ফেলে দিল। শব্দ হল ঝনাৎ ঝনাৎ। দুনি জন প্রহরী এগিয়ে এলো। একজন জিজ্ঞাসা করল—তোমরা কারা? কোত্থেকে এসেছে? বিস্কোরা লো ল্যাতিন ভাষা বুঝল না। ওরা দুজনেই মাথা নাড়ল।
বিস্কো ও শাঙ্কোকে ঘিরে ধরা প্রহরীরা বুঝে উঠতে পারল না এরা কারা। দুজন প্রহরী ফ্রান্সিস হ্যারিকে গতকাল দেখেছিল। শুনেছিল ওরা ভাইকিং বিদেশি। বিস্কোদের পরনেও ফ্রান্সিসদের মতো পোশাক। বুঝল এরাও ভাইকিং। ও বলল এরা ভাইকিং। বিদেশি। ভাইকিং কথাটা শুনে বিস্কো আর শাঙ্কো দুজনেই মাথা ওঠানামা করে সমর্থন জানালো।
দুতিনজন প্রহরী তলোয়ারের ইঙ্গিতে কয়েদঘর দেখাল। তারপর ওদের সঙ্গে যেতে ইঙ্গিতে জানাল। আগে আগে চলল বিস্কো আর শাঙ্কো। পেছনে প্রহরীর দল।
কয়েদঘরের বারান্দায় প্রহরী দুজন তখন উঠে বসেছে। কয়েদঘরের লোহার গরাদের দরজা খোলা হল। বিস্কো আর শাঙ্কোকে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। তখন পূব আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। সূর্য উঠতে বেশি দেরি নেই।
কয়েদঘরে ঢুকে মশালের আলোয় বিস্কো আহত বন্ধু দু’জনকে খুঁজতে লাগলো। ঘরটি শুকনো ঘাস ছড়ানো বিছানামতো। তাতে সাত-আটজন বন্দি হয়ে বসে আছে। বাইরের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ওদের ঘুম ভেঙে গেছে। বিস্কো দেখাল একেবারে বা কোণায় দু’জন বন্ধুই শুয়ে আছে। বিস্কো ছুটে ওদের কাছে গেল। পেছনে শাঙ্কোও ছুটে এলো। আহত এক বন্ধু আস্তে আস্তে উঠে বসল। ডান হাত ধরল। অন্যজন উঠে বসতে পারল না। বিস্কোদের দিকে তাকিয়ে রইল। বিস্কো শাঙ্কো দু’জনে ওদের পাশে বসল। বন্ধুটি একটু আশ্চর্য হয়েই বলল তোমাদের বন্দি করা হল কেন? রাজার সৈন্যদের মেরে ফেলার জন্যে তোমরা তো দায়ী নাও।
তখন বিস্কো কীভাবে ওদের মুক্ত করার জন্যে চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়েছে সব বলল। বন্ধুটিরদু’চোখ জলে ভরে উঠল। মাথা নামিয়ে বলল তোমরা তাহলে সত্যিই আমাদের বন্ধুর মতোই এখনও ভালোবাসো।
ভালোবাসি বই কি। সেই নৃশংস ঘটনার জন্যে দায়ী ভেক্তর। সেই তোমাদের ভুল বুঝিয়ে দলে টেনেছে। তোমরাও দেশে ফেরার আকুলতায় সব ভুলে গিয়ে ভেক্তর যা বলেছে তাই করেছো। তোমাদের কোনো দোষ নেই। বিস্কো বলল। শুয়ে থাকা আহত বন্ধুটির দু’চোখও জলে ভিজে উঠল। ও চোখে হাত চাপা দিল।
বিস্কো আর শাঙ্কো বন্ধুদের পাশে ঘাসের বিছানায় বসল। শাঙ্কো কাঁধ থেকে ধনুক আর তৃণীর খুলে পাশে রাখল। বিস্কো নিজেকে এত ক্লান্ত বোধ করছিল যে বসে থাকতে পারল না। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। ওর মাথায় তখন নানা চিন্তা বন্ধুদের উদ্ধার করতে এসে এভাবে নিজেরাও বন্দি হয়েছে এই খবরটা ফ্রান্সিস পাবে নিশ্চয়ই! ফ্রান্সিস এতে ওদের রাগ করবে কিনা কে জানে। আবার হয়তো ফ্রান্সিসরা এ খবর নাও পেতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে বিস্কোর একটু তন্দ্রা এলো।
সকাল হ’ল। লোহার দরজা খুলে প্রহরীরা কয়েদঘরের বন্ধিদের জন্যে খাবার নিয়ে এলো। গোল আধপোড়া রুটি আর নানা শাকসজির ঝোল। বিস্কোরা হাতমুখ ধুয়ে সকালের খাবার খেতে লাগল।
ওদিকে দুর্গরক্ষীরা সাভোনাকে সকালেই জানাল যে গত রাতে দুজন ভাইকিং দুর্গের মধ্যে ধরা পড়েছে একটু বেলায় রাজা ফ্রেডারিকের কাছে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে। বিচার হবে। সাভোনা বেশ চিন্তায় পড়ল। বুঝে উঠতে পারল না ফ্রান্সিসকে এই খবরটা দেবে কি না। কিন্তু ফ্রান্সিসকে কথাটা না জানালে পরে যদি ফ্রান্সিস জানতে পারে তবে সাভোনার ওপর বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হবে। কাজেই ফ্রান্সিসকে সব জানানো উচিত। বলা যায় না রাজা ফ্রেডারিকের বিচারে ঐ দুজনকেও হয়তো ফাঁসি কাঠে চড়ানো হবে।
সবে সকালের খাওয়া শেষ হয়েছে ফ্রান্সিসদের। তখনই সাভোনা ফ্রান্সিসদের গতরাতের ঘটনাটা আস্তে আস্তে বলল—ফ্রান্সিস বেশ চমকে উঠল। বুঝল বিস্কো আর শাঙ্কো গতরাতে ওদের সঙ্গে কথা বলে আর জাহাজে ফিরে যায় নি। আহত বন্ধু দুজনকে মুক্ত করতে প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে দুর্গের মধ্যে কোনো ভাবে ঢুকেছিল। হ্যারি আরমারিয়াও খবরটা শুনল। মোরাবিত ও সাভোনার কাছে সব শুনল। ওরা দুজনেই ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিসরা এখন কী করবে? দেখল—ফ্রান্সিস মাথা ঝুঁকিয়ে চুপ করে বসে আছে। খুব চিন্তায় পড়ল ফ্রান্সিস বিস্কো শাঙ্কো দুজনেই নির্দোষ। বন্ধু দুজনকে বাঁচাতেই ওরা দুর্গের মধ্যে কোনোভাবে ঢুকেছিল। কিন্তু রাজা ফ্রেডারিক কি সেটা মানবেন? হয়তো ওদের ওপর ক্রুদ্ধ হবেন। ওদের বেত মারার অথবা ফাঁসি দেওয়ার হুকুমও দিতে পারেন।
ফ্রান্সিস মুখ তুলে সালভানাকে বলল—আপনি খোঁজ নিয়ে জানুন তো বন্দিদের কখন রাজা ফ্রেডারিকের সম্মুখে হাজির করা হবে। সাভোনা বিছানা ছেড়ে উঠল। বাইরে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই ফিরে এসে বলন—ফ্রান্সিস—বন্দিদের আর অল্পক্ষণ পরেই মন্ত্রণাকক্ষে নিয়ে যাওয়া হবে। রাজা আর কয়েকজন ওখানে বসেই বিচার করবেন।
তাহলে চলুন না। ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হ্যারি, মারিয়া, মোরাবিতও উঠল। সাভোনা আগে আগে চলল? পেছনে ফ্রান্সিসরা।
মন্ত্রণাকক্ষের সিঁড়ির কাছে প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছে। সাভোনা এগিয়ে গেল প্রহরীদের দিকে বলল—মন্ত্রণাকক্ষে কয়েকজন বন্দির বিচার হবে। আমরা যাবো।
প্রহরীরা মাথা নাড়ল। কারো যাবার হুকুম নেই। সাভোনা ফিরে এসে ফ্রান্সিসদের বলল সে কথা। ফ্রান্সিসরা হতাশ হল। বন্ধুদের মুক্ত করার জন্য একবার অন্তত চেষ্টা করা যেত। কিন্তু বিচারের সময় উপস্থিত থাকতে না পারলে কিছুই করা যাবে না। আহত বন্ধু দুজনের ফাঁসি তো হবেই বিস্কো শাহ্মেকেও কয়েদঘরে আটকে রাখা হবে। কতদিন কে জানে। বিস্কো শাঙ্কো কোনো অপরাধ করেনি তবু রাজা ফ্রেডারিক বা সেনাপতি এলাইমোর অনুমতি ছাড়া ওরা গোপনে দুর্গের মধ্যে ঢুকেছিল। বন্দি বন্ধুদের মুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। এই অপরাধে কয়েদঘরে বন্দি করে রাখা হবেই। ফ্রান্সিস সাভোনাকে এই আশঙ্কার কথা বলল।
সাভোনা মাথা ওঠানামা করে বলল—এটা হতে পারে। রাজা ফ্রেডারিক সহজে ওদের মুক্তি দেবেনা।
ফ্রান্সিস বুঝে উঠতে পারলো না কী করবে। সাভোনা নিজেই রাজবিদ্রেহী। কাজেই সেও এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারবে না। ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে রইল।
তখনই দেখা গেল। একদল প্রহরী সৈন্য বিস্কো শাঙ্কো আর আহত দুজন ভাইকিংকে নিয়ে আসছে। সকলের সামনে আসছে সেনাপতি এলাইমো।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল—হ্যারি এলাইমোকে বুঝিয়ে বলো। একমাত্র এলাইমোই রাজা ফ্রেডারিককে বলে আমাদের মন্ত্রণাকক্ষে নিয়ে যেতে পারে।
বন্দিদের নিয়ে এলাইমো ততক্ষণে সিঁড়ির কাছে এসেছে হ্যারি এগিয়ে গেল। বলল—মাননীয় সেনাপতি—আমাদের কিছু বলার ছিল। এলাইমো দাঁড়িয়ে পড়ল। সেনাপতি–ঐ বন্দি চারজনই আমাদের বন্ধু স্বজাতি। রাজা ফ্রেডারিক বিচারে ওদের যা শাস্তি দেবেন তাই মাথা পেতে মেনে নেব। কিন্তু বিচারের সময় শুধু ওদের কথা শুনে রাজা সন্তুষ্ট নাও হতে পানে। সেই জন্যে বলছি যদি বিচারের সময় রাজা ফ্রেডারিক মন্ত্রণাকক্ষে আমাদের উপস্থিত থাকতে অনুমতি দেন তাহলে আমরা ওদের স্বপক্ষের বক্তব্য রাজা ফ্রেডারিককে বুঝিয়ে বলতে পারবো।
এলাইমো ফ্রান্সিস মারিয়ার মুখের দিকে তাকাল। তারপর হ্যারিকে বলল ঐ সাভোনা আর মোরাবিতের জন্যে আমি বলবো না। তবে বন্ধু হিসেবে আপনাদের কথা বলবো। যদি মহামান্য রাজা অনুমতি দেন তাহলে আপনাদের নিয়ে যাবো।
এলাইমো সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্ত্রণাকক্ষের দিকে চলে গেল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে রইল। চার বন্দি বন্ধুই ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে রইল। আহত বন্ধু দুজনের মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বেশি আহত বন্ধুটি ব্যথা-যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে তখন।
অন্য বন্ধুটি কাঁদকাঁদ স্বরে বলল—ফ্রান্সিস—তুমি বিশ্বাস করো পাহারাদারদের খাবারে বিষ দেওয়া হয়েছিল এটা অন্ততঃ আমরা দুজনে জানতাম না। ভেক্তর আগে আমাদের কিছু বলেনি। তবে রাজার সৈন্যদের সঙ্গে আমরা লড়াই করেছি ভেক্তরের নির্দেশে। তা ছাড়া ভেবেছিলাম লড়াইয়ে জিততে পারলে দেশে ফিরে যেতে পারবো। একটু থেমে বলল ফ্রান্সিস একমাত্র তুমিই আমাদের বাঁচাতে পারো। ফ্রান্সিস কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে বন্ধুর কথাগুলো শুনে গেল। আহত বন্ধুটি মুখে হাতচাপা দিয়ে কেঁদে উঠল।
ফ্রান্সিস এবার মুখ তুলে বিস্কো আর শাঙ্কোর দিকে তাকাল। বলল—তোমরা কেন ওদের মুক্ত করতে গেলে? কেন এভাবে বিপদ ডেকে আনলে?
বিস্কো একটু মনঃক্ষুন্নস্বরে বলল—কী করবো—তুমি ওদের ওপর এত রেগে গেলে যে—
বিস্কো—ওদের কাছে সব জেনে সময়মতো ওদের মুক্ত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতামই। তার আগেই তোমরা মাথা গরম করে ভবিষ্যতে কী হতে পারে এসব না ভেবেই বোকার মতো জীবনের ঝুঁকি নিলে। ফ্রান্সিস বলল।
-–ফ্রান্সিস তুমি এটাকে বোকামি বলেছো? বিস্কো বেশ বিরক্তির সুরেই বলল।
—হ্যাঁ—বোকামিই করেছো—ফ্রান্সিস বলল—দুজন বন্ধুই আহত। একজনের উরু এতটা জখম যে চেয়ে দেখো ও ভালো করে দাঁড়াতেও পারছে না। পারবে এই আহত বন্ধুদের নিয়ে পাহারাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে?
—চেষ্টা তো করতাম। বিস্কো বলল।
—বেশ। ধরে নিলাম পালাতে পারতে। ওদের সঙ্গে নিয়ে কোথায় আশ্রয় নিতে? ফ্রান্সিস বলল।
-কেন? আমাদের জাহাজে? বিস্কো বলল।
—আর এক বোকামির কাজ ফ্রান্সিস একটু থেমে বলল—তখন এলাইমা আমাদের জাহাজ তল্লাশী করতোই। তোমরা ধরা পড়ে যেতে। তখন ক্রুদ্ধ রাজা ফ্রেডারিক আমাদের সবাইকে কয়েদঘরে বন্দি করে রাখতো আর সবচেয়ে মারাত্মক যে কাজ করতো সেটা হল আমাদের জাহাজের খোলা ভেঙে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতো। ফ্রান্সিস একটু থেমে বলল তখন বন্দিদশা মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকতো না। ধরো যদি কয়েদঘর থেকে পালাতেও পারতাম জাহাজের অভাবে আমরা এই সিসিলির বাইরে যেতে পারতাম না। আবার ধরা পড়তাম। আবার কয়েদঘরে বন্দিদশা ভোগ করতে হতো।
বিস্কো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল ফ্রান্সিস আমি এতসব ভাবি নি। তুমি আমাকে মাফ করো। আজকে বুঝলাম আমাদের মধ্যে তুমি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কেন। ফ্রান্সিস তোমার ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।
ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না। হ্যারি মারিয়াও অবাক চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিসের প্রত্যেকটি কাজের পেছনে এত চিন্তা-ভাবনা থাকে ওরা বেশ আরাম হল।
এলাইমো তখনই মন্ত্রণাকক্ষ থেকে বেরিয়ে ফ্রান্সিসদের কাছে এলো। হ্যারিকে বলল—রাজা ফ্রেডারিক অনুমতি দিয়েছেন। আপনারা মন্ত্রণাকক্ষে যেতে পারেন। তবে রাজা ফ্রেডারিক অনুমতি না দিলে আপনারা কোনো কথা বলতে পারবেন না।
এলাইমোর কথাটা ফ্রান্সিসকে বলে হ্যারি বলল—তবে আর আমাদের মন্ত্রণাকক্ষে গিয়ে কী হবে।
ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল-এটা একটা সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না। রাজা ফ্রেডারিক যখন বিচারের সময় উপস্থিত থাকার অনুমতি দিয়েছেন তখন কিছু বলারও অনুমতি আমাদের দেবেন। চলো না। দেখা যাক।
এলাইমোর নির্দেশে হরীরা ততক্ষণে বন্দিদের মন্ত্রণাকক্ষে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফ্রান্সিসরাও তারপরেই ঢুকল।
মন্ত্রণাকক্ষের ভেতরটা একটু অন্ধকারমতো। পাথরের দেয়ালে আটকানো জ্বলন্ত মশালের আলোয় মোটামুটি সবই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটা লম্বাটে শ্বেতপাথরের বড়ো টেবিল। তার ওপাশে রাজা ফ্রেডারিক বসে আছেন। দুপাশে তার দুজন অমাত্য। রাজা ফ্রেডারিক মাথায় মীনেকরা মুকুট। গায়ে অবশ্য রাজবেশ নয়। হালকা সবুজ রঙের সাটিনের চাদর জড়ানো। পেশীবহুল হাতকঁধ উন্মুক্ত। অমাত্যদের পরনেও একই পোশাক। শুধু সাটিনের কাপড়ের রং আলাদা।
টেবিলের এপাশে বন্দিদের দাঁড় করানো হল। ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়া ঘরের আর একপাশে পাথরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।
এলাইমা রাজাকে সম্মান জানিয়ে বন্দিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে তার বিবরণ দিতে লাগল। হ্যারি মূদুস্বরে এলাইমোর কথাগুলো ফ্রান্সিসকে বলে দিতে লাগল। এলাইমা বলল মহামান্য রাজা—এরা সবাই জাতিতে ভাইকিং। আপনার আদেশে বন্দরে আমাদের দুটো জাহাজ ওদের জাহাজ পাহারায় ছিল। আমাদের আটজন সৈন্যও ওদের জাহাজে পাহারাদার হিসেবে ছিল। ঝড়ের সুযোগে আমাদের প্রহরীদের লড়াই করে হারিয়ে দিয়ে জাহাজ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। লিপারি দ্বীপের কাছে ওদের জাহাজ আটকানো হয়। আমাদের সৈন্যদের সঙ্গে ওদের লড়াই হয়। দুপক্ষের অনেকেই মারা যায় নয় তো আহত হয়। এই আহত দুজন ভাইকিং সেই লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল। অন্য দুজন গতরাতে আহত বন্দি বন্ধুদের মুক্ত করতে ওরা সকলের অলক্ষে দুর্গে ঢুকেছিল। ধরা পড়েছিল। ওদের দুজনকেও এখানে হাজির করা হয়েছে। এই দুজন কি আমাদের সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করেছিল? ফ্রেডারিক বললেন।
-–না–ওরা সেই লড়াইয়ে নামেনি। এলাইমো বলল।
—ঠিক আছে। আহত দুজন এগিয়ে এসো। রাজা ফ্রেডারিক বললেন। ওরা দুজন টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
তখনই ফ্রান্সিস বলল মহামান্য রাজা যদি আমাকে দু-একটা কথা বলতে অনুমতি দেন তবে বাধিত হবো।
রাজা ফ্রেডারিক ফ্রান্সিসের দিকে তাকালেন। বললেন–তোমরাই তো কাউন্ট রজারের গুপ্তধন খুঁজে বের করার চেষ্টা করছো?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।
—ঠিক আছে। বলো তোমার কী বলার আছে। জা বললেন।
—মহামান্য রাজা সেনাপতি এলাইমো যে লড়াইয়ের কথা বললেন এবং যে লড়াইয়ে
আমাদের এই দুই বন্ধু আহত হয়েছিল সেই লড়াই হয়েছিল অনেক পরে। আপনার প্রহরী সৈন্যদের মৃত্যু হয়েছে লড়াই করতে গিয়ে না। ফ্রান্সিস বলল।
—তবে? রাজা বেশ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
—বিষ প্রয়োগ করে তাদের হত্যা করা হয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল।
—বলো কি? রাজা ফ্রেডারিক চমকে উঠে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। মারিয়া ফিসফিস করে বলল—ফ্রান্সিস তুমি একথা বলে দিলে কেন?
ফ্রান্সিস হাতটা একটু তুলে মারিয়াকে চুপ করে থাকতে ইঙ্গিত করল। হ্যারি কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। বুঝলনা—যে মর্মান্তিক ঘটনাটা রাজা ফ্রেডারিক সেনাপতি এলাইমো বা অন্য কেউ জানে না সেটা ফ্রান্সিস বলতে গেল কেন।
রাজা ফ্রেডারিক অমাত্য দুজনের সঙ্গে মৃদুস্বরে কথা বললেন। তারপর ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললেন—কে কীভাবে তাদের বিষ খাইয়ে মারল?
ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল—আমাদের এক বন্ধু ভেক্তর আমাদের জাহাজে কিছু বন্ধুদের নিয়ে দল পাকিয়েছিল। তাদের বুঝিয়েছিল আমি কাউন্ট রজারের গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবো না। তবে কেন ওরা এই বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকবে? ফ্রান্সিস একটু থেমে বলল মহামান্য রাজা আমরা জাহাজে জাহাজে দূর দূর দেশে দ্বীপে ঘুরে সমুদ্রযাত্রার একঘেয়েমির মধ্যে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে মাটির প্রতি টান বিশেষ করে স্বদেশে ফেরার টান অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। কাজেই ভেক্তর এই দুর্বলতার সুযোগ নেয় এবং আমাদের কিছু বন্ধুকে ভুল বোঝায়। ফ্রান্সিস থামল।
–এখন ভেক্তর কোথায় আছে? রাজা ফ্রেডারিক জানতে চাইলেন।
—ভেক্তর লড়াই করতে গিয়ে মারা গেছে। তার দলের বন্ধুরা কেউ মারা গেছে কেউ জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। তাদেরই আহত দুজন আপনার সন্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস বলল।
—হুঁ। বলো কী বলছিলে। রাজা ফ্রেডারিক বললেন।
—আপনার যে প্রহরী সৈন্যরা আমাদের জাহাজে থেকে পাহারা দিচ্ছিল ভেক্তর তাদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে মাত্র দুজন বন্ধুকে নিয়ে। তারা কেউ আর বেঁচে নেই। আপনার প্রহরী সৈন্যদের খাদ্যে বিষ মিশিয়ে ভেক্তর আর দুজন বন্ধু তাদের হত্যা করে। এই নির্মমতা ক্ষমার অযোগ্য। ফ্রান্সিস বলল।
-ঠিক। রাজা ফ্রেডারিক মাথা একটু ঝাঁকিয়ে বললেন।
—এইবার মহামান্য রাজা আপনার সুবিচারের জন্যে কয়েকটা কথা বলছি। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল আপনি দেখলেন আমি যদিনা বলে দিতাম তাহলে আপনারা কেউই জানতে পারতেন না আপনার আটজন প্রহরী সৈন্যের কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল। আমি অনায়াসে সেই সত্য গোপন করতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। তাহলেই আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন—আমি যা সত্য তা বলি এব? স্বীকার করি। কোনো অবস্থাতেই সত্য আমি গোপন করিনা। ফ্রান্সিস থামল। রাজা ফ্রেড’কে পাশের অমাত্যদের ফ্রান্সিসদের কথাগুলি লো ল্যাতিন ভাষায় বুঝিয়ে বললেন। অমাত্যরা ফ্রান্সিসদের স্পেনীয় ভাষা বুঝতে পারছিলেন না। তারা সব শুনে রাজাকে মৃদুস্বরে কিছু বললেন।
রাজা সব শুনে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললেন—বেশ—আমরা তোমাকে সত্যবাদী বলে মেনে নিলাম।
তাহলে এবার আমি একটি সত্য কথা বলছি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর আঙুল তুলে আহত দুই ভাইকিং বন্ধুকে দেখিয়ে বলল—এই বন্ধু দু’জনও ভেক্তরের চাতুরীতে ভুল বুঝে ঐ দলে ভিড়ে ছিল এবং ভেক্তরের নির্দেশে আপনার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করেছিল। আহত হয়েছিল। কিন্তু আপনার প্রহরী সৈন্যদের যে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হবে এ কথা ভেক্তর ওদের কখনো বলে নি। ওরা সেকথা অন্যকোনো ভাবে জানতেও পারেনি। কাজেই আমার বিনীত আবেদন এই নিরপরাধ দুই বন্ধুকে আপনি মুক্তি দিন। এমনিতে আহত হয়ে বিনা চিকিৎসায় ওরা যথেষ্ট কষ্ট ভোগ করেছে। ফ্রান্সিস থামল।
রাজা ফ্রেডারিক আবার মৃদুস্বরে অমাত্যদের সঙ্গে সব জানিয়ে পরামর্শ করলেন। তারপর সেনাপতি এলাইমোর দিকে তাকিয়ে বললেন—এলাইমো –আপনি কী বলেন?
এলাইমো একটু মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল—মহামান্য—রাজা একটা কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ইনি সত্যবাদী। এই দুজন আহত ভাইকিং আমাদের প্রহরীদের মৃত্যুর ষড়যন্ত্র অংশ নেয়নি—ইনি সেকথা বলেছেন এবং আমাদের এক্ষেত্রে ওর কথা সত্য বলে মেনে নেওয়া উচিৎ। এলাইমোর কথাগুলি হ্যারি ফ্রান্সিসকে বুঝিয়ে বলল।
রাজা ফ্রেডারিক আবার অমাত্যদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তারপর ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বললেন—দেখো—এই আহত দু’জন ভাইকিং আমাদের সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করেছে। আমাদের সৈন্যদের হত্যা করেছে না তো আহত করেছে। কাজেই শাস্তি তাদের পেতেই হবে।
ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল হ্যারি শাস্তি মুকুব করা যাবে না। বলো কী করবে।
হ্যারি মাথা নিচু করে একটু ভাবল। তারপর বলল—মহামান্য রাজা এই দুজন। আমাদের বন্ধু স্বদেশবাসী ভাইয়ের মতো। তবু ওদের শাস্তি দিন এটাই আমরা চাই। যদি আপনি আমাদের অনুমতি দেন তাহলে কেমন শাস্তি দেবেন সেটা বলি।
—বলো। রাজা বললেন।
—ওদের চারজনকেই কয়েদঘরে বন্দি করে রাখুন। আহত দুজনের কোনোরকম চিকিৎসা হবে না। যদি বিনা চিকিৎসায় ওরা সুস্থ হয় তো হবে। নইলে ওদের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। হ্যারি বলল।
—বেশ। কিন্তু তোমরা তো ওদের মুক্তি চাইছো। রাজা বললেন। এবার ফ্রান্সিস বলল—মান্যবর রাজা যখন আমরা—কাউন্ট রজারের গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবো তখন ওদের মুক্তি দেবেন—আমার এই নিবেদন।
হ্যারি নিচুস্বরে বলল—ফ্রান্সিস—ভীষণ ঝুঁকি নিচ্ছো।
এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। ফ্রান্সিস মাথা নাড়তে নাড়তে বলল।
রাজা ফ্রেডারিক আবার অমাত্যদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তারপর বললেন—বেশ তোমাদের অনুরোধই মেনে নেওয়া হ’ল। যতদিন তোমরা কাউন্ট রজারের গুপ্তধন আবিষ্কার করতে না পারছো ততদিন এই চারজন কয়েদঘরে বন্দি থাকবে।
মারিয়া বলল—মহামান্য রাজা—আমার একটা নিবেদন আছে। রাজা মারিয়ার দিকে তাকালেন। বললেন।
-বেশ বলো।
—এমনিতেই দুজন আহত বন্ধুর চিকিৎসা হবে না। অনেক কষ্ট বেদনা ওদের সহ্য করতে হবে। কাজেই অনুরোধ কয়েদঘরের কষ্ট থেকে ওদের রেহাই দিন। মারিয়া বলল।
-কীভাবে? রাজা বললেন।
—ওরা সবাই আমাদের জাহাজে থাকুক। প্রয়োজনে আপনি ওদের জন্যে প্রহরী রাখুন। ফ্রান্সিস হ্যারি আর আমি তো এখানে আপনার দুর্গেই থাকবো। ওরা আমাদের ফেলে রেখে তো পালিয়ে যেতে পারবেনা।
রাজা ফ্রেডারিক অমাত্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে বললেন—বেশ। তবে প্রহরী থাকবে তোমাদের জাহাজে।
মারিয়া হেসে বলল—মহামান্য রাজার জয় হোক। বিচার শেষ হল।
ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়া বেরিয়ে এলো। পেছনে পেছনে এলো এলাইমো। তারপর আহত বন্ধুটিকে ধরাধরি করে বিস্কো ওরা বেরিয়ে এলো। আহত বন্ধুটি তখনও দাঁত চেপে ব্যথা কষ্ট সহ্য করছে। বন্ধুটি বলল-ফ্রান্সিস কী বলে তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো জানি না। তুমি ফাঁসির হাত থেকে আমাদের বাঁচালে। তারপর আমাদের ভাগ্যে যা ঘটে ঘটুক। ফ্রান্সিস বন্ধুটির পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দিয়ে সান্ত্বনা দিল।
পাঁচজন প্রহরীর পাহারায় বিস্কো ওরা জাহাজঘাটার দিকে চলল। ওরা এই ভেবে আশ্বস্ত হল যে কয়েদঘরের বদ্ধ ঘরে ওদের বন্দিজীবন কাটাতে হবে না। বন্ধুদের মধ্যে ওদের নিজেদের জাহাজেই—বন্দি থাকতে হবে। বন্ধুদের মুখ তো দেখতে পাবো। নীল আকাশ সমুদ্র উড়ন্ত সামুদ্রিক পাখি, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখতে পাবো।
হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস—এত বড়ো ঝুঁকি নিলে কেন?
—কী করবো। ওদের প্রাণে বাঁচতে এছাড়া অন্য পথ ছিল না। একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি মারিয়া এবার উঠে পড়ে লাগতে হবে। কাউন্ট রজারের গুপ্তধনের হদিশ বের করতেই হবে। একটু থেমে ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে বলল—শুধু একটা ক্ষীণ সূত্র চাই। কাউন্ট রজার নিশ্চয়ই কোনো সূত্র রেখে গেছেন। সেটা যেখানে যেভাবে থাকুক হদিশ বের করতেই হবে।
পরদিন দুপুরেই ফ্রান্সিসদের জন্যে রাজবাড়ির একটা চার ঘোড়ার গাড়ি আনা হলো। গাড়িটা পুরোনা হলেও দেখতে সুন্দর। ফ্রান্সিসরা উঠল গাড়িটায়। গাড়ি দুর্গ থেকে বেরিয়ে ছুটল কাতানিয়ার দিকে। বিকেলের মধ্যেই ওরা কাতনিয়া পৌঁছল এটাও একটা বন্দর শহর। তবে সিরাকসের মতো অত জমজমাট নয়। সাভোনার নির্দেশে গাড়ি একটা বিরাট গীর্জার সামনে এসে থামল। গীর্জার মাথায় নানা কারুকাজ করা।
গীর্জার বড়ো দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে সাভোনা বলল, এই গীর্জাটাও কাউন্ট রজার ও তৈরি করেছিলেন। তবে এটা সর্ব সাধারণের জন্যে। ভেতরে সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশ। ক্রুশবিদ্ধ যীশুখ্রীস্টের বড় মূর্তি। দেওয়ালে যীশুর জীবন বিষয়ক ছবি। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল এই গীর্জার মেঝেতেও মোজেকের নানা রঙদার কাজ। এসব দেখতে দেখতে একটা কথা হঠাৎই ফ্রান্সিসের মনে পড়ল। দুটো গীর্জাই কাউন্ট রজার তৈরি করিয়েছিলেন। ওপরের কাঠামো জীর্ণ হয়েছিল বলে রাজা ফ্রেডরিক ওপরের কাঠামো সংস্কার করিয়েছিলেন। কিন্তু মেঝে ভাঙা হয়নি। সংস্কারও করা হয়নি। কাজেই অক্ষত মেঝেটাই কাউন্ট রজারের নির্দেশে তৈরি। কাজেই মেঝেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবার ফ্রান্সিস খুব খুঁটিয়ে মেঝের রঙিন মোজেকের নকশাগুলো দেখতে লাগল। তবে ওর তো ছবি-আঁকিয়ের চোখ নয়। নকশাগুলোর ফুল পাতা ঘুলিয়ে যাচ্ছে। ও মারিয়াকে বলল, মারিয়া, তুমি তো সেলাই করো, ছবি নকশা বোঝে—এই মেঝের নকশাটা লক্ষ্য করো তো। ম্যামিয়েস দুর্গের গীর্জার মেঝেতেও নকশা দেখেছিলাম। দুটো নকশাই কি এক রকম? মারিয়া কিছুক্ষণ মেঝের নকশার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,মনে হচ্ছে একই রকম নয়, তবে ম্যামিয়েসের গীর্জাটা ছোটো। নকশাগুলো ছোটো। এটা বড়ো কারণ মেঝেটাও বড়।
—হুঁ। তুমি ভালো করে নকশাগুলো দেখো। পরে ম্যামিয়েসের গীর্জার মেঝের সঙ্গে মেলাবো। ফ্রান্সিস বলল।
—ঠিক আছে। মারিয়া বলল। তারপর মেঝেটায় ঘুরে ঘুরে সব নকশা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।
গীর্জার শান্ত পরিবেশ থেকে সবাই বেরিয়ে এলো। সাভোনা বলল, এরকম অনেক গীর্জা বাড়িঘরে বিচিত্র স্থাপত্যরীতি দেখা যায়। রোমীয় বাইজেন্টাইন আরবীয় আবার সিসিলির নিজস্ব রীতি সব মিলেমিশে একাকার।
হ্যারি বলল, এই অঞ্চলে মিশ্রণটা বেশি হয়েছে। ফ্রান্সিস খুব মন দিয়ে ওদের কথা শুনছিল না। ও ডুবছিল নিজের চিন্তায়।
মারিয়া বলে উঠল, সিসিলি এলাম অথচ এটনা আগ্নেয়গিরি দেখবো না?
সাভোনা হেসে বলল, উত্তরে তাত্তরমিয়ার দিকে কিছুটা গেলেই এটনা আগ্নেয়গিরি ভালোভাবে দেখা যাবে।
তাই চলুন। মারিয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
হ্যারি ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। দেখল, ফ্রান্সিস নিজের চিন্তায় মগ্ন। হ্যারি বলল, কী ফ্রান্সিস, এটনা দেখতে যাবে?
ফ্রান্সিস অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাসল। বলল, চলো। মারিয়া যখন দেখতে চাইছে।
গাড়ি চলল উত্তরে তাত্তরমিয়ার দিকে। পথে দেখা গেল সেই একই দৃশ্য। গাধা খচ্চরের পিঠে গমের বস্তা চাপিয়ে চাষিরা চলেছে। গাধা খচ্চরের গলায় বাঁধা ঘণ্টার শব্দে চারদিক ভরে উঠেছে। পথের দুপাশে সিট্টাস গাছ। গমের ক্ষেত, নানা শাকসবজির চাষের জমি। কিছুদূর যাওয়ার পর বাঁ দিকে হাত বাড়িয়ে সাভোনা বলে উঠল,ঐ যে এটনা আগ্নেয়গিরি। গাড়ি থামল। সবাই নেমে একটা ছোট্ট টিলায় উঠল। দেখা গেল এটনা আগ্নেয়গিরি বিকেলের আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়টা ছাই রঙের। সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। চারদিকের শান্ত পরিবেশের মধ্যে এটনার ভাবগম্ভীর রূপ দেখে ফ্রান্সিসরা অভিভূত হলো। এখন শান্ত এটনা। অতীতে কতবার আগুন ছাই লাভা ধোঁয়া উদগিরণ করেছে। ভূমিকম্প ঘটিয়েছে। না জানি কত ঘরবাড়ি ভেঙেছে। কত মানুষ গৃহহীন হয়েছে। মারাও গেছে কত।
এবার ফেরার পালা। কাতানিয়া নগরে ওরা সন্ধের আগেই ফিরে এলো। সাভোনা বলল, ফ্রান্সিস এখন কোথায় যাবে?
—যে বাড়িতে কাউন্ট রজার মৃত্যুর পূর্বে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
—সাভোনার নির্দেশ মতো গাড়ি চলল। নগরে মানুষজনের ব্যস্ততা। অনেকেই ফ্রান্সিসদের বেশ ঔৎসুক্যের সঙ্গে দেখল। ভিনদেশিগুলো রাজবাড়ির গাড়িতে যাচ্ছে। কারা এরা?
বিরাট একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামল। সবাই গাড়ি থেকে নামল। বাড়িটার সদর দরজা হাট করে খোলা। ঢুকল সবাই। বড়ো চত্বরটায় অশ্বশালা। অনেক ঘোড়া বাঁধা। কিছু লোক ঘোড়াগুলোর তদারকিতে ব্যস্ত। অন্যপাশে অনেক মাছধরা জাল শুকোচ্ছে। কয়েকজন বসেজাল বুনছে। ওদিকের ঘরগুলোতে অনেক পরিবারের বাসা। সাভোনা বলল, এখানে সৈন্যদের অশ্বশালা হয়েছে। ওদিকে জেলেদের বসতি। কাউন্ট রজারইনাকি ওদের এখানে বাস করার অধিকার দিয়েছিলেন। এরা পুরুষানুক্রমে সমুদ্রে মাছ ধরে।
দক্ষিণ কোণার দিকে সাভোনা চলল। পেছনে ফ্রান্সিসরা। কোণায় পাথর দিয়ে তৈরি বেশ বড়ো একটা ঘর। ঘরটার সামনে জেলেদের পোশাক-পরা একটি লোক বসে আছে। সাভোনা লোকটার সঙ্গে কথা বলল। লোকটি উঠে গিয়ে ঘরটার তালা খুলতে লাগল। সাভোনা বলল, কাউন্ট রজারের স্মৃতিবিজড়িত এই ঘরটা এখানকার জেলেরাই দেখাশুনো করে।
তালা খোলা হলো। ঘরটায় ঢুকল সবাই। একটু অন্ধকারমতো ঘরটা। তবে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোনো আসবাবপত্র নেই। শুধু কোণায় রাখা রয়েছে একটা খাপে ঢাকা তলোয়ার, লোহার বর্ম আর শিরস্ত্রাণ। সাভোনা বলল, এই সবই নাকি কাউন্ট রজারের। ঘরটার মেঝেয় সুন্দর মোজেকের কাজ করা। ফ্রান্সিস মেঝেয় মোজেকের কাজ দেখতে দেখতে বলল, মারিয়া, আগের গীর্জা দুটোয় যে নকশা দেখেছিল এগুলোও কি তেমনি, মানে একই নকশা?
মারিয়া দেখতে দেখতে বলল, না। আগের দুটোয় লতাপাতা বেশি ছিল। এটাই ফুলের সংখ্যা বেশি।
মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সাভোনা হেসে উঠে বলল, এখানেও গান? ফ্রান্সিস বলে উঠল, কী ব্যাপার সাভোনা? সাড়োনা বলল, তোমাদের বলেছিলাম না কাউন্ট রজার শেষ বয়েসে খুব খ্রীস্টভক্ত হয়েছিলেন। তখন তিনি কিছু ভক্তিগীতি লিখেছিলেন। সেই ভক্তিগীতিরই একটা এখানে ফুল লতাপাতা দিয়ে মোজেকের কাজের মধ্যে দিয়ে লিখেয়েছেন। অনেকদিন আগে এখানে এসেছিলাম। তখন লক্ষ্য করিনি। আজকে দেখছি একটা গান লেখা।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি দুজনেই চমকে উঠল। ফ্রান্সিস বলল, পড়ে বলুন তো গানটা কী?
সাভোনা মেঝের দিকে তাকিয়ে পড়ে পড়ে বলে গেল—
কোথাও নাই শান্তি
যীশুর চরণে ক্ষান্তি
সব দুঃখ সব ভ্রান্তি
হৃদয়ে রাখো ভক্তি।
ফ্রান্সিস মন দিয় শুনল সবটা। হ্যারি বলল, আমি লো ল্যাতিন ভাষা শুনলে বুঝি বলতেও কিছু পারি। কিন্তু অক্ষর খুব ভালো চিনি না। ফ্রান্সিস বলল, সাভোনা, আপনি এই গান লেখা দেখে হাসলেন কেন?
-আরে, এইরকম মেঝেয় মোজেকের কাজের মধ্যে কাউন্ট রজার গান লিখিয়েছেন আগের দুটো গীর্জার মেঝেতেও। আমি জানতাম গীর্জার মেঝেতেই লিখিয়েছেন। এখন দেখছি এখানেও লিখিয়েছেন।
ফ্রান্সিস বলে উঠল, ঐ গান দুটো আপনার মনে আছে?
—কেন নয়? বহুদিন ধরে বড়োদিন বা গুডফ্রাইডের উৎসবের দিনে ঐ গান দুটো গাওয়া হয় এই দক্ষিণ সিসিলিতে। শুনুন গান দুটো। বলে সাভোনা চোখ খুঁজে আস্তে আস্তে গাইতে লাগল—
লোভ হিংসায় কাতর
হলুদ লাল পাথর
দুর কর এই দোসর
হৃদয় শ্বেত পাথর
যেমন যীশুর ঘর।
গান থামিয়ে সভোনা বলল, এই গানটা লেখা আছে ম্যামিয়েস দুর্গের সেই ছোটো গীর্জাটায়। ফ্রেডরিক ঐ জায়গায় দুর্গ নির্মাণের আগে ঐ গীজাটায় কিন্তু সব মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। সাভোনার গানের সুর বড়ো সুন্দর লাগল ফ্রান্সিসদের।
মারিয়া বলল, আর একটা গান করুন না।
সাভোনা হেসে বলল, এই গানটা লেখা আছে এই কাতানিয়ায় যে বিরাট গীর্জা দেখে এলাম তার মেঝেতে। বলে সাভোনা চোখ বুজে আস্তে আস্তে গাইল—
নীরবে সহ যন্ত্রণা
কর যীশুর বন্দনা
ভুলে যাও সব মন্ত্রণা
হৃদয়ে পাবে সন্ত্বনা
গানের কথা এবং সুর ঘরটায় একটা সুন্দর আবহাওয়া সৃষ্টি করল। ফ্রান্সিস হ্যারি মারিয়া তন্ময় হয়ে গেল। হঠাৎফ্রান্সিসের মাথায় একটা চিন্তা বিদ্যুৎ-চমকের মতো খেলে গেল—এই গানগুলোর মধ্যেই আছে কাউন্ট রজারের গুপ্তধনের চাবিকাঠি। থাকতেই হবে। এ ছাড়া আর কোনো সূত্র নেই।
ফ্রান্সিস খুব মনোযোগের সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরের মেঝের মোজেকের কাজগুলো দেখল। এখানেই লেখা আছে গানটা। কিন্তু গুপ্তধনের সঙ্গে এই গানের কী সম্পর্ক বুঝে উঠতে পারল না। হতাশায় মাথা নেড়ে বলল, চলুন বড়ো গীর্জাটায় যাবো।
গাড়ি চলল। আবার বড়ো গীর্জাটায় ঢুকল সবাই। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। দুজন ধর্মযাজক মোমবাতি জ্বেলে দিচ্ছেন। গীর্জাঘর মোমবাতির স্নিগ্ধ আলোয় ভরে উঠল। সেই আলোয় মেঝের মোজেকের কারুকাজ বুঝতে অসুবিধা হলো না। ফ্রান্সিস বলল, সাভোনা, এখানকার গানটি মুখে বলুন।
সাভোনা আস্তে আস্তে বলল,
নীরবে সহ যন্ত্রণা
কর যীশুর বন্দনা
ভুলে যাও সব মন্ত্রণা
হৃদয় পাবে সান্ত্বনা
ফ্রান্সিস গানটা কয়েকবার মুখে মুখে আওড়াল। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। এ তো ভক্তিগীতিই। এছাড়া কিছু নয়। তবে গানগুলির গুরুত্ব আছে এইজন্যে যে এগুলি কাউন্ট রজারের রচনা।
ম্যামিয়েস দুর্গে ফিরে আসতে একটু রাতই হলো। রাতের খাওয়াদাওয়ার পর সবাই শুয়ে পড়ল। হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস, কিছু হদিস করতে পারলে?
না। তবে এখানকার গীর্জাটা কালকে ভালো করে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
মারিয়া বলল, আমার মনে হয় গানগুলোর মধ্যেই কোনো সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে।
হ্যারি বলল, আচ্ছা সাভোনা, কাউন্ট রজারের এরকম আরো গান আছে?
হ্যাঁ, আছে, তবে সেসবের এখন খুব বেশি চল নেই। গীর্জার মেঝেয় লেখা গানগুলোরই চল বেশি। প্রায় একশো বছর ধরে সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়।
ফ্রান্সিস বলল, এই গানই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গান দুটোই সকলে জানে। গীর্জার মেঝেতেও লেখা রয়েছে। ম্যামিয়ে দুর্গের গীর্জায় তো আগে সকলেই যেতে পারতো।
আর সবই ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস তখন জেগে। নানা চিন্তা মাথায়। তার ওপর কাউন্ট রজারের গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য ও জীবনটাই বাজি ধরেছে। ভাবতে ভাবতেই একসময় ওর দুচোখে ঘুম জড়িয়ে এলো।
গভীর রাতে হঠাৎ ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফ্রান্সিস উঠে বসল। ঘরে মশাল জ্বলছে। তার আলোয় দেখল হ্যারি শুয়ে চোখে দুহাত চাপা দিয়ে ফোঁপাচ্ছে। ফ্রান্সিস হ্যারির গায়ে হাত রাখল। আস্তে ডাকল, হ্যারি হ্যারির ফোঁপানি বন্ধ হলো ফ্রান্সিস বলল, কী হয়েছে?
হ্যারি কান্নাভেজা গলায় বলল, তুমি এভাবে নিজের জীবনটাকে বাজি ধরলে? একবার কারো কথা ভাবলে না? তোমার বাবা, মারিয়া, আমরা—কারো কথা না?
ওদের কথাবার্তায় মারিয়ারও ঘুম ভেঙে গেল। মারিয়া বলে উঠল, হ্যারি, কেঁদো না তোমাকে কাঁদতে দেখলে ফ্রান্সিসের মন দুর্বল হয়ে পড়বে। দেখো আমি তো কাঁদছিনা।
সাভোনার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ওদের কথাবার্তা শুনে সাভোনা আস্তে আস্তে বলল, সত্যি তোমাদের মধ্যে এমন ভালোবাসা কমই দেখা যায়। একটু থেমে বলল, মানুষকে ভালোবাসা মানেই ঈশ্বরকে ভালোবাসা।
ফ্রান্সিস হেসে বলল, সাভোনা, কাউন্ট রজারের গানটা শোনান না!
এত রাত্রে গান? সাভোনা হেসে বলল।
করুন না। হ্যারি বলল। সাভোনা শুয়েই আস্তে আস্তে গাইতে লাগল—
লোভ হিংসায় কাতর
হলুদ লাল পাথর
দূর কর এই দোসর
হৃদয় শ্বেতপাথর
যেমন যীশুর ঘর।
গান শেষ হলো। হঠাৎ ফ্রান্সিস বলল, আচ্ছা সাভোনা, লক্ষ্য করেছেন আর দুটো গানের পঙক্তি চারটে। শুধু এই গানটা মানে যেটা এখানকার গীর্জার মেঝেতে লেখা সেই গানটার কিন্তু পঙক্তি পাঁচটা।
সাভোনা একটু হিসেব করল। হেসে বলল, ঠিক বলছো। আমি তো কোনোদিন খেয়াল করিনি। ওদের মধ্যে আর কথাবার্তা হলো না। ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।
মোরাবিত চুপ করে শুয়ে এতক্ষণ সাভোনার গান শুনছিল। ওর মন একেই ভালো নেই। তার ওপর এই গানটা শুনে ওর মন আরো খারাপ হয়ে গেল। কত কাজ এখন। লিপারি দ্বীপে লড়াইয়ে হেরে গেছে ওরা। বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী বন্ধু লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছে। ও নিজেও রাজা ফ্রেডারিকের সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছিল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সাভোনা ওকে জোর করে লড়াই থেকে নিরস্ত করেছিল। ভীষণভাবে আহত ওকে অনেক কষ্টে সাভোনা প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরে লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিল। মোরাবিত বার বার নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেছে। বলেছে-সাভোনা বন্ধুদের এভাবে ফেলে রেখে আমি পালাবো না। সাভোনা বলেছে—মোরাবিত—তোমাকে বেঁচে থাকেতই হবে। এই লড়াই আমরা হেরে গেছি। তুমি প্রাণ দিলেও এই লড়াইয়ে আমরা জিতবো না। কিন্তু তুমি বেঁচে থাকলে আবার আমরা বিদ্রোহ চালিয়ে যেতে পরবো। আরো দেশবাসীকে একত্র করতে পারবো। সময় সুযোগ বুঝে আমরা আরো শক্তি সংগ্রহ করে রাজা ফ্রেডারিককে বিদেশি নর্মানদের অত্যাচারী ভূস্বামীদের সিসিলি থেকে তাড়াতে পারবো। কিন্তু তুমি মরে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। সাভোনা অনেক কষ্টে ওকে সমুদ্রতীরে নিয়ে আসতে পেরেছিল। তারপর নৌকোয় লুকিয়ে। পালাতে পেরেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য ধরা পড়তেই হল।
মোরাবিত ঘাসের বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব সাত-পাঁচ ভাবছিল। ওর ঘুম আসছিল না। ঘরের জ্বলন্ত মশালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই মোরাবিত সিদ্ধান্ত নিল—পালাতে হবে। সিমেতো নদীর ওপারের জঙ্গলে বিদ্রোহীদের পুরানো আস্তানায় যাবে। আবার সব বিদ্রোহী সঙ্গীসাথীদের একত্র করবে। এলাকার আরো লোক একত্র করবে। অস্ত্র তৈরি করবে।
সবাইকে তালিম দিয়ে রাজা ফ্রেডারিকের সৈন্যদের চেয়েও শক্তিশালী নিপুণ যোদ্ধা তৈরি করবে। তারপর আক্রমণ করবে ম্যামিয়েস দুর্গ। অনেক কাজ—অনেক কাজ—মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মোরাবিত মনে মনে বার বার বলল কথাটা।
রাত বাড়তে লাগল। মোরাবিরে চোখে ঘুম নেই। ও দুচোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে রইল।
শেষ রাতের দিকে মোরাবিতের একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। হঠাৎ তন্দ্রা ছুটে গেল। মোরাবিত বিছানায় উঠে বসল। দেখল—সাভোনা ফ্রান্সিসরা গভীর ঘুমে। একবার ভাবল-সাভোনাকে পালাবার কথা বলি। পরক্ষণেই সাবধান হল। নাসাভোনাকে কিছু বলা চলবে না। সাভোনা কিছুতেই ওকে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিতে দেবে না।
মোরাবিত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। পা টিপে টিবে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পাথরের বারন্দায় মশালের আলোয় দেখল একজন সৈন্য পাথরের দেয়ালে পিঠ রেখে ঝিমুচ্ছে। মোরাবিত নিঃশব্দে দেয়ালে পিঠ ঘষে ঘষে মশালের আলোর এলাকা থেকে বাইরে
অন্ধকারে নেমে এলো। সদর দেউড়ির দিকে লুকিয়ে দেখল চার-পাঁচজন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। এ ম্যামিয়েস দুর্গে এখন রাজা ফ্রেডারিক আছেন। কাজেই জোর পাহারার ব্যবস্থা এখন। পাহারাদারদের নজর এড়িয়ে দেউড়ি দিয়ে পালানো অসম্ভব। মোরাবিত চারদিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখতে লাগল। পাথরের উঁচু ঘেরা দেয়ালের প্রায় সব জায়গাতেই মশাল জ্বলছে। দেখতে দেখতে লক্ষ্য করল দক্ষিণ কোণায় দুটো মশাল নিবু নিবু। জায়গাটা বেশ অন্ধকার। নীচে কুয়াশাও ছড়িয়ে আছে ওদিকে।
মোরাবিত অন্ধকারে পাথর বাঁধানো রেবুকে পেতে শুয়ে পড়ল। তারপর শরীর টেনে টেনে চলল ঐ দক্ষিণ কোণায় দেয়ালের দিকে। হাঁটুর বুকের ঘা তখনও সম্পূর্ণ সারে নি। একটা কোণা উঁচু পাথরে হাঁটুটা ঘষটে গেল। মোরাবিত প্রচণ্ড বুকের যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতে গিয়ে মুখে জোরে হাতচাপা দিল। একটু থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগল। একটু পরে যন্ত্রণা একটু করল। প্রায় অন্ধকারে ডান হাঁটুর দিকে তাকিয়ে বুঝল রক্ত পড়ছে। ও মুখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে আবার বুক হিঁচড়ে চলল।
দেয়ালের কাছে এসে একটু বিশ্রাম নিল। ভীষণ হাঁপাচ্ছে তখন। একটু পরে হাঁপ ধরা ভাবটা কমল।
মোরাবিত উঠে দাঁড়াল। তারপর বেশ অন্ধকারে দেয়ালের পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে বেশ কষ্ট করে দেয়ালের ওপরে উঠেই ঘুরে দেয়ালের ওপাশে পাথুরে রাস্তায় লফিয়ে নামল। দ্রুত নামতে গিয়ে ও লক্ষ্যই করে নি যে দেয়ালের বাইরেও কাছাকাছি তিন-চারজন পাহারাদার খোলা তলোয়ার হাতে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। রাজা ফ্রেডারিক আছেন দুর্গে। কাজেই কড়া পাহারা চলছে।
পাথুরে রাস্তায় লাফিয়ে পড়তেইশব্দ হল। দুজন পাহারাদার সেই শব্দ শুনল। একজন চিৎকার করে উঠল কে? দুজনেই অল্প অন্ধকারে খোল তলোয়ার হাতে ছুটে আসতে লাগল মোরাবিতের দিকে।
মোরাবিতের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা পেরিয়ে পড়িমরি ছুটল সামনের অন্ধকার গলিটা লক্ষ্য করে। পাহারাদার দুজন ততক্ষণে চিৎকার করে অন্য পাহারাদারদের ডাকতে ডাকতে ছুটে আসছে। তারা কাছাকাছি আসার আগেই মোরাবিত গলির অন্ধকারে মিশে গেল। ছুটল প্রাণপণে। আস্তে আস্তে পাহারাদারদের ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকির শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল।
হঠাৎ হ্যারি উত্তেজিত স্বরে ডাকাডাকিতে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ও দ্রুত বিছানায় উঠে বসল। হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস—সর্বনাশ হয়েছে। মোরাবিত পালিয়ে গেছে।
-বলো কি। ফ্রান্সিস মোরাবিতের শোবার জায়গাটার দিকে তাকাল। দেখল ফাঁকা। পাশেই সাভোনা মাথা নিচু করে বসে আছে। সাভোনা চুপ করে আছে। তখনই মারিয়ারও ঘুম ভেঙে গেল। মশালের আলোয় মারিয়া এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল—ঢালা বিছানার কোথাও মোরাবিত নেই। মারিয়া বেশ ঘাবড়ে গেল। মোরাবিত পালিয়ে গিয়ে ওদের ভীষণ বিপদে ফেলে গেল।
ফ্রান্সিস কদিন যাবই লক্ষ্য করছিল মোরাবিত চুপ চাপ শুয়ে বসে থাকে। কে জানে কী ভাবে। কোনো কথাও বলতো না। সাভোনার সঙ্গেও কথা বলতো না। ওরা বাইরে বেরুতো। মেরাবিতও ওদের সঙ্গে প্রথমদিন বেরিয়েছিল। পালাবার চেষ্টা করেছিল। ফ্রান্সিসের তৎপরতায় পারেনি। তারপর থেকেই মোরাবিত কেমন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। ওদের সঙ্গে বাইরেও বেরুতো না।
ফ্রান্সিস ডাকল—সাভোনা। সাভোনা মুখ তুলে ওর দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল মোরাবিত কেন পালালো বলতে পারবে। সাভোনা মাথা এপাশ-ওপাশ করল।
—মোরাবিত তো আমাদের ভীষণ সমস্যায় ফেলে গেল। হ্যাঁর বলল।
ফ্রান্সিস বলল—উপায় নেইমোরাবিকে ধরে নিয়ে আসতে হবে।
—কিন্তু মোরাবিত কোথায় গেছে তার হদিশ পাবে কী করে? মারিয়া বলল।
ফ্রান্সিস বলল—সাভোনা বলুন তো মোরাবিত পালিয়ে কোথায় যেতে পারে?
সাভোনা আস্তে আস্তে বলল—ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে লিপারি দ্বীপে যায় নি। ওখানকার ঘাঁটি এলাইমো নিশ্চয়ই এতদিন ভেঙে দিয়েছে।
—ঐ দ্বীপ ছাড়া আর কোথায় মোরাবিত আত্মগোপন করেছে বলে আপনার মনে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
—এখান থেকে মাইল দশেক দক্ষিণে আছে সিমমাতো নদী। নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে আমরা প্রথমে ঘাঁটি গেড়েছিলাম। পরে এলইমোর সৈন্যদের তাড়া খেয়ে আমরা লিপারি দ্বীপে ঘাঁটি সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। লিপারিতে আমরা যুদ্ধ হেরে গেছি। তাড়া খেয়ে বিদ্রোহবন্ধুরা নিশ্চয়ই পুরোনো আস্তানায় ফিরে এসেছে। মোরাবিত নিশ্চয়ই ঐ আস্তানায় আত্মগোপন করেছে। ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল—ঐ সিমেতো পেরিয়ে জঙ্গলের আস্তানায় যেতে হবে। পাথরের জানালা দিয়ে ফ্রান্সিস বাইরে তাকাল। দেখল—বাইরেটায় আর অন্ধকার তেমন নেই। তার মানে রাত শেষ হয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস ঘরের পাথরের মেঝেয় পায়চারি করতে লাগল।
ভোর হল। বেলা একটু বাড়ল। দুজন সৈন্য ওদের সকালের খাবার নিয়ে এলো। কাঠের থালায় গোল করে রুটি আর নানা সজিমেশানো ঝোলমতো। ফ্রান্সিসরা বিছানায় বসে খেয়ে নিল।
এঁটো থালা নিয়ে সৈন্যরা চলে গেল। ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি—চললা সিমেতো নদীর ওপারে জঙ্গলে যাবো। মোরাবিতকে খুঁজে বের করতেই হবে। হ্যারি উঠে দাঁড়াল। কোমরবন্ধনী ভালো করে এঁটে যাবার জন্যে তৈরি হল।
মারিয়া বলল—আমিও যাবো।
ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল–না মারিয়া। যদি আমরা দুজন বিপদে পড়ি তুমি অন্ততঃ জাহাজে বন্ধুদের সে খবরটা দিতে পারবে। তুমিও আমাদের সঙ্গে গেলে সে উপায় আর থাকবেনা।
সাভোনা বলল—চলো-আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই।
না সাভোনা—ফ্রান্সিস বলল—শুধু মারিয়া একা এখানে থাকলে রাজার মনে সন্দেহ হতে পারে। মোরাবিত পালিয়েছে এটা যেন এখানে কেউ না জানে। তুমি থাকলে কারো মনে সন্দেহ জাগবেনা। তুমি আর মারিয়া থাকো।
ফ্রান্সিস বলল—মারিয়া—যদি দেখো আমরা কাল পরশুর মধ্যে ফিরে এলাম না তাহলে জাহাজে বন্ধুদের খবর দিও। সাভোনাকে নিয়ে আমাদের খুঁজতে যেও।
গত কয়েকদিনের মতো নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে ফ্রান্সিস আর হ্যারি দুর্গের সদর দেউড়ির দিকে চলল। ওরা এসময় বাইরে বেরোয় এটা পাহারাদারদের দেখেছে। ওরা কোনো সন্দেহ করল না। ওদের দেখাশুনো করার জন্যে ওদের কাজে সাহায্য করার জন্যে রাজা ফ্রেডারিক যে দুজন সৈন্যকে রেখেছিলেন তারা এগিয়ে এলো ফ্রান্সিসদের দিকে। হ্যারি বলল—ভাই—আজকে আর তোমাদের দরকার নেই। আজ আমরা নিজেরাই সব খোঁজ খবর করবো। গাড়িরও দরকার নেই। সৈন্য দুজন ফিরে গেল।
দুর্গের বাইরে এসে ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল—হ্যারি—জোরে পা চালাও। দুজনে দ্রুতপায়ে দক্ষিণমুখো রাস্তাটা ধরে হাঁটতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বসতি এলাকা ছেড়ে ওরা একটা পাহাড়ি এলাকায় এলো। উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ ধরে চলল।
দুপুর হল। সূর্য মাথার ওপরে। বেশ রোদের তেজ। হেঁটে চলল ওরা।
কিছু পরেই একটা পাহাড়ি গ্রাম পেল। পাথরের বাড়িঘর। ঘাসের ছাউনি। মাত্র কয়েকটা ঘরবাড়ি। একটা বাড়ির ঘরের সামনে চোট গাছের নীচে একজন বয়স্ক লোক পাথরের ওপর বসেছিল। ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি—জিজ্ঞেস করো তো—সিমেতো নদী কতদূরে?
হ্যারি লোকটির কাছে গেল। বলল—আচ্ছা সিমেতো নদী এখান থেকে কতদূর?
লোকটি একটু পাহাড়ি টানের ভাষায় বলল—আর বেশি দূরে না কাছেই। তারপর ফ্রান্সিসদের পোশাক দেখে বলল—মনে হচ্ছে আপনার বিদেশি।
—হ্যাঁ আমরা ভাইকিং জাতি। হ্যারি বলল।
—এত বেলা হয়েছে—বিদেশি আপনারা নিশ্চয়ই খিদে পেযেছে লোকটি বলল। হ্যারি বলল—ফ্রান্সিস—বলছে আমরা ক্ষুধার্ত কিনা।
ফ্রান্সিস হেসে বলল—বলো যে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। হ্যারি হেসে বলল সেকথা। লোকটি পাথরের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। ঘর থেকে বৌঝিরা বেরিয়ে এলো। লোকটি তাদের কী বলল। তারপর ফ্রান্সিসদের বসতে ইঙ্গিত করল।
ক্লান্ত হ্যারি চেস্টনাট গাছের ছায়ায় লম্যাটে পাথরটায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির মেয়েরা বড়ো পাতায় রুটি পাখির মাংসের ঝোল নিয়ে এলো। ফ্রান্সিস হ্যারি হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদ জানাল। যা খিদে পেয়েছিল। হাপুস হুপুস করে খেয়ে নিল।
খেয়েদেয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে ওরা চলল সিমেতে নদীর উদ্দেশ্যে। হাঁটতে হাঁটতে ফ্রান্সিস বলল হ্যারি—দেখো এই যে বিদেশ বিভুইয়ে আমরা আতিথ্য পেলাম ক্ষুধার মুখে খাদ্য পেলাম—অচেনা অজানা মানুষের ভালোবাসা পেলাম আপনার জীবনে এর মূল্য কি কম?
হ্যারি হেসে বলল—মোটেইনা।
প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ওরা সিমেতো নদীর ধারে পৌঁছল। নদীটা খুব বড়ো নয়। পাহাড়ি নদী। খুব স্রোত। এদিকটায় প্রচুর গাছপালা। নদীর ওপারেও ঘন বন জঙ্গল। তবে গাছপালা খুব দীর্ঘ নয়। গাছগাছালির নীচে বুনো ঘাস। লম্ফা লম্ফা।
এবার সমস্যা এই খরস্রোতা নদী পার হওয়া যাবে কী করে। তখনই ওরা দেখল নদীটার এপারের একটা গাছে মোটা কাছি বাঁধা। কাছিটা টেনে নিয়ে ওপারের একটা গাছে বাঁধা হয়েছে। কাছি নদীর জলের কিছু ওপরে ঝুলছে। ওরা বুঝল এই কছি ধরে ধরেই এখানকার লোকেরা নদীটি পারাপার করে। যে প্রচণ্ড স্রোত তাতে পা ঠিক রাখা অসম্ভব। দড়ি ধরেই এই স্রোতকে ঠেকাতে হয়।
ফ্রান্সিস হ্যারি—দুহাতে দড়ি ধরে নদীর জলে নামল। নদীর জল বেশ ঠাণ্ডা। আস্তে আস্তে দড়ি ধরে ধরে নদীর স্রোতধারার মধ্যে দিয়ে পেছল পাথরগুলিতে পা রেখে রেখে বেশ কসরৎ করে নদী পার হল দুজনে। দড়ি না ধরে পার হওয়া অসম্ভব। প্রচণ্ড স্রোতের ধাক্কায় কোথায় ছিটকে যাবে তার ঠিক নেই।
ওপরে পৌঁছে কিছুক্ষণ পরিশ্রান্ত দুজনে বিশ্রাম করল। তারপর বনের মধে ঢুকল। বনের গাছপালর নীচে লম্ফা লজ্জ্বা ঘাস। তার মধ্যে দিয়ে ওরা চলল।
আসার সময় সাভোনা বলে দিয়েছিল ডানদিকে ছাড়া ছাড়া তিনটে উঁচু টিলামতো পড়বে। একেবারে তৃণশূন্য টিলাটার নীচেই বিদ্রোহীদের পুরানো আস্তানা।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি চলল। কিছুই যেতেই ডানদিকে দেখল উঁচু টিলা একটা। টিলাটা সবুজ ঘাসে ঢাকা। এই টিলাটা নয়।
আবার চলল দুজনে। বেশ কিছুটা ঘাসের জঙ্গল ঠেলে যাবার পর দেখল ডানদিকে বেশ কিছুটা দূরে আর একটা উঁচু টিলা। আশ্চর্য! টিলাটা একেবারে তৃণশূন্য। শুধু ছাই রঙা পাথরের। বিকেলের নরম আলো টিলাটার মাথায় পড়েছে। এটার নীচেই কোথাও আছে বিদ্রোহীদের আস্তানা।
ওরা টিলাটি লক্ষ্য করে চলল। বিকেল হয়ে গেছে। গাছগাছালির নীচে এর মধ্যেই অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। ওরা ঠাহর করে করে চলল।
হঠাৎ চারপাশের ঘাসের বনে ছড় ছড় শব্দ উঠল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল—ওদের চারপাশে ঘাসের জঙ্গলের আড়াল থেকে আট দশজন যোদ্ধা খোলা তলোয়ার বর্শা হাতে উঠে দাঁড়াল। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল—লড়াইনয়। আমরা সাভোনা মোরাবিতের বন্ধু। একটু থেমে আবার বলল কথাটা। ফ্রান্সিস ভেবে আশ্বস্ত হল যে সঙ্গে হ্যারিকে এনে বুদ্ধির কাজই করেছে। ও একা লে ল্যাতিন ভাষা বলতে পারতো না। কাজেই প্রাণ সংশয় হত।
যোদ্ধারা অস্ত্রনামাল। ওদেরমধ্যে বয়স্ক একজন এগিয়ে এলো। বলল-তোমরা কারা?
—আমরা ভাইকিং। আমরা মেরাবিতের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। হ্যারি বলল।
—কেন? যোদ্দটি বলল।
—সেটা মোরাবিতকেই বলবো। হ্যারি বলল।
—হুঁ—এসো। যোদ্ধাটি পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। অন্য যোদ্ধারাও চলল। পেছনে চলল ফ্র্যান্সিস আর হ্যারি
ন্যাড়া উঁচু টিলারের নীচেই ওরা দেখল প্রায় আট-দশটা ঘর। শুকনো ঘাসের ছাউনি। দেয়াল শুকনো ঘাস গেঁথে গেঁথে তৈরি করা হয়েছে। ওরা ঘরগুলোর কাছে এলো। বয়স্ক যোদ্ধাটি একটা ঘরে ঢুকে পড়ল। একটু পরেই বেরিয়ে এসে বলল—এই ঘরে এসো।
ফ্রান্সিস ও হ্যারি মাথা নিচু করে ঘরটায় ঢুকল। ঘরটায় আলো জ্বালা হয় নি। অন্ধকারে ওরা আন্দাজেই বুঝল মোটা কাপড় পাতা বিছানায় কে বসে আছে। হ্যারি ডাকল—মোরাবিত। মোরাবিত বিছানা ছেড়ে উঠল। একটু খুঁড়িয়ে কয়েক পা এসে হাত বাড়িয়ে ফ্রান্সিসের ডান হাতটা ধরল। ফ্রান্সিস হেসে ওর হাতে চাপা দিল। মোরাবিত এবার হ্যারির হাতও ধরল। হাতে চাপ দিল। হ্যারি বলল—তোমার হাঁটুর ঘাটা শুকোয় নি?
— শুকিয়ে এসেছিল পালাতে গিয়ে পাথরে ঘষটানি লেগে হাঁটতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। মোরাবিত বলল।
—তুমি বিছানায় বসো। হ্যারি বলল।
—আপনারাও বসুন। মোরাবিত বসল। মোরাবিত বলল—আপনাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করি।
—না—না—হ্যারি বলল—আমরা আসার পথে খেয়ে নিয়েছি।
ফ্রান্সিস বলল—হ্যারি-মোরাবিকে বলো ও পালিয়ে এলো কেন?
হ্যারি সেটা মোরাবিতকে বলল।
মোরাবিত একটু চুপ করে থেকে বলল—আমার বিদ্রোহী বন্ধুরা এখানে লিপারি দ্বীপ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কী কষ্টের জীবন কাটাচ্ছে ওরা। এইসব জেনে বুঝেও আমি রাজার দুর্গে পেটপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটাবো—অসম্ভব। তাই আমি পালিয়ে এসেছি। আবার সব বিদ্রোহীকে একত্র করবো। অস্ত্র সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাবো। তারপর চুড়ান্ত যুদ্ধে নামবো ঐ ভিনদেশি রাজা ফ্রেডারিকের বিরুদ্ধে। হ্যারি মোরাবিতের কথাগুলো ফ্রান্সিসকে বলল।
একটু চুপ করে থেকে ফ্রান্সিস বলল—আমি যা বলছি তা মোরাবিকে বুঝিয়ে দাও। ফ্রান্সিস বলতে লাগল—মোরাবিত তুমি সাভোনা খাঁটি দেশপ্রমিক এসম্বন্ধে আমার মনে বিন্ধুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি বলবো-তুমি এভাবে পালিয়ে এসে ভালো করো নি।
কথাটা শুনে মোরাবিতের মুখ গম্ভীর হল। একটু তিক্তকণ্ঠে ও বলল—তার মানে আমি পালিয়ে আসায় আপনারা বিপদে পড়েছেন। কথাটা বুঝে নিল ফ্রান্সিস কথাটা ফ্রান্সিসের মনে খুব লাগল। দুঃখার্তরে ও বলল শুধু আমাদের বিপদ হলে কিছু বলতাম না। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন তোমাদেরই সাভোনা-সাভোনাকেও আমরা মুক্ত করে নিয়ে আসবো। মোরাবিত বলল। কথাটা বুঝে নিয়ে ফ্রান্সিস এবার বলল—মোরাবিত রাজা ফ্রেডারিককে আমি কী বলেছিলাম সেটা আমার ভাষা জানোনা বলেই তুমি বোঝে নি। কী বলেছিলেন আপনি? মোরাবিত বলল।
-রাজাকে বলেছিলাম যদি কাউন্ট রজারের গুপ্তধন আবিষ্কার করতে না পারি তাহলে তোমাদের দুজনের সঙ্গে আমিও ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুবরণ করবো। মোরাবিকে ফ্রান্সিসের এই সঙ্কল্পের কথা সাভোনা বলেছিলেন। কিন্তু মোরাবিত তখন বেশ অসুস্থ। সব কথা বোঝবার মতো মনের অবস্থা ওর ছিল না। মোরাবিত ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকাল। ঘরটায় তখনও আলো জ্বালা হয় নি। ফ্রান্সিসের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল না। মোরাবিত কোনো কথা বলল না। চুপ করে ফ্রান্সিসের এই সঙ্কল্পের কথা ভাবতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল—দেখো মোরাবিত—তোমাদের দেশের সমস্যা তোমরা যেভাবে পারো মেটাও আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু আমরা এখানে রয়েছি কাউন্ট রজারের নিখোঁজ গুপ্তধন উদ্ধারের জন্যে। এখন তোমরা দুজনে পালিয়ে এলে রাজা ফ্রেডারিক আমাদের বন্দি করবেন। কারণ তোমাদের সব দায়িত্ব আমি নিয়েছি। তাহলেই বুঝতে পারছো যে কাজের জন্যে আমরা দেশে ফিরলাম না সেই কাজটাই তো ভণ্ডুল হয়ে যাবে। মাঝখান থেকে আমার বন্ধুরা আমাদের মুক্ত করতে লড়াইয়ে নামবে অযথা রক্তপাত মৃত্যু। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল—একটু ভেবে দেখো মোরাবিত এখন অন্ততঃ আমাকে সুযোগ দাও যাতে আমি নিশ্চিন্ত মনে গুপ্তধনের খোঁজ বের করতে পারি। গুপ্তধন খুঁজে বের করতে পারলে রাজা ফ্রেডারিক তোমাদের মুক্তি দিতে বাধ্য। এই শর্ত আমি রাজাকে দিয়ে আগেই করিয়ে নিয়েছি। হ্যারি ফ্রান্সিসের কথাগুলো বুঝিয়ে বলতে মোরাবিত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল—ঠিক আছে—”আমি দুর্গে ফিরে যাবো। সাভোনা যা বলবেন আমি তাই করবো।
—বেশ তোমাকে আজই ফিরে যেতে হবে। এক্ষুণি। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি কথাটা বুঝিয়ে বলতেই মোরাবিত বলে উঠল-বলেন কি! আমি এখনও ভালো করে হাঁটতে পারছি না। কয়েকদিন ওষুধ বিশ্রাম। কথাটা বুঝে নিয়ে ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল—না—তোমাকে এক্ষুণি আমাদের সঙ্গে ম্যামিয়াস দুর্গে ফিরে যেতে হবে।
—আপনি আমাকে এক্ষুণি যেতে বলেছেন কেন? মোরাবিত জানতে চাইল।
—কারণ—ফ্রান্সিস বলল—তুমি পালিয়ে গেছো এটা জানাজানি হয়ে গেল রাজা ফ্রেডারিক সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কয়েদ ঘরে বন্দি করে রাখবেন। তখন সাভোনাকেও তোমরা মুক্ত করতে পারবেনা। আমাদের মুক্তির আশা না হয় ছেড়েই দিলাম। মোরাবিত একটুক্ষণ ভাবল। বলল—পিরবো এতটা পথ হেঁটে যেতে?
—আমাদের দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে তুমি যাবে। পথে ঘোড়ার টানা শস্যের গাড়ি জোগাড় করবো হয়তো একটা ঘোড়া বা খচ্চর। কোনো কষ্ট হবে না তোমার। ফ্রান্সিস বুঝিয়ে বলল। মোরাবিত আর কোনো কথা বলল না। বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তখনই একজন বৃদ্ধ একটা জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে ছোট্ট ঘরটায় ঢুকল। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় পোঁতা লোহার চোঙে জ্বলন্ত মোমবাতিটা বসিয়ে দিল। মোরাবিত মৃদুকণ্ঠে বৃদ্ধকে কী বলল। বৃদ্ধ মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল। মোরাবিত ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল-চলুন।
ওরা ছোট্ট ঘরটার বাইরে এসে দাঁড়াল। দেখল-মোরাবিতের বিদ্রোহী বন্ধুরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মোরাবিত সবাইকে লক্ষ্য করে কী বলতে লাগল। হ্যারি বলল—মোরাবিত ওর বন্ধুদের বলছে ওরা যেন মনোবল না হারায়। ও সাভোনাকে সঙ্গে নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। আবার রাজা ফ্রেডারিকের সঙ্গে যুদ্ধ করবে ওরা। ওদের জয় হবেই। মোরাবিতের বিদ্রোহী বন্ধুরা খোলা তলোয়ার বর্শা উঁচু করে হৈ হৈ করে উঠল।
এবার ফ্রান্সিস হ্যারি আর মোরাবিত হাঁটতে শুরু করল। মোরাবিত বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো ওকে সাহায্য করতে। মোরাবিত হেসে বলল—যতটা পারি হাঁটি। না পারলে তবেই আপনাদের সাহায্য নেবো। ফ্রোন্সিস হেসে মোরাবিতের কাঁধে আস্তে আস্তে চাপড় দিয়ে বলল—এই তো বীরপুরুষের মতো কথা।
সিমেতো নদীতে বাঁধা কাছি ধরে ধরে পার হ’তে মোরাবিতেরর বেশ কষ্টেই হ’ল। ফ্রান্সিস পেছন থেকে সর্বক্ষণ ওকে ধরে থেকে সাহায্য করল।
সিমেতো নদীর ওপারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ওদের আবার যাত্রা শুরু হল।
একটা পাহাড়ি গ্রাম ছাড়তেই উত্তর পুব কোণায় চাঁদ উঠল। আধাভাঙা চাঁদ। মোটামুটি উজ্জ্বল। জ্যোৎস্না ছড়াল পাহাড়ি এলাকায় রাস্তায় দু’পাশের ফিকাস ওক গাছের মাথায়। মোরাবিত ভীষণ হাঁপাচ্ছে তখন। ফ্রান্সিস পিছিয়ে এসে মোরাবিতের বাঁ হাতটা কাঁধে তুলে নিল।
মোরাবিত হেসে বলল—সবটা যেতে পারলাম না। ফ্রান্সিস ও হেসে বলল—বন্ধু লড়াইটাই বড়ো কথা। জেতা হারাটা বড়ো কথা নয়। চলো-।
রাত বড়ল। চাঁদটা মাথার ওপার চলে এলো। এত রাতে পথে গাড়ি ঘোড়া কিছুই পেল না ওরা। হেঁটেই আসতে হল সারাটা পথ।
ম্যামিয়াস দুর্গে যখন ওরা পৌঁছল তখন শেষ রাত।
গই ছিল। ফ্রান্সিসরা ঘরে ঢুকতেই মারিয়া ছুটে এলো। ফ্রান্সিস বলল—পাহারাদার সৈন্যরা কোনো সন্দেহ করে নি তো?
—না। আমি দুপুরে খাওয়ার সময় বলেছি তোমরা কাতানিয়া গেছে। কাল সকালে ফিরবে। পাহারাদররা আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি। মারিয়া বলল।
ফ্রান্সিস ক্লান্তমুখে একটু হাসল—মারিয়া—তোমায় উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করছি।
ওদের কথাবার্তায় সাভোনার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। সাভোনা বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাড়াঁল। মোরাবিত প্রায় ছুটে এসে সাভোনাকে জড়িয়ে ধরল। সাভোনাও ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। মশালের আলোয় ফ্রান্সিসরা দেখল সাভোনার দুগাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। নিঃশব্দে কাঁদছে সাভোনা। মারিয়া মৃদুস্বরে–বলল-ফ্রান্সিস বোধহয় একেই বলে স্বর্গীয় দৃশ্য।
কথাটা হ্যারির কানে গেল। অভিভূত হ্যারি বলল ঠিক বলেছেন রাজকুমারী। ফ্রান্সিস কোনো কথাই বলতে পারল না।
পরদিন সকালের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস বলল, সাভোনা চলুন গীর্জাটা দেখতে যাবো।
সবাই গীর্জার সামনে এলো। গীর্জার সিঁড়ি দিয়ে উঠল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ফ্রান্সিস বলল, গানটা কোথায় লেখা আছে?
সাভোনা আঙুল দিয়ে মেঝেটা দেখিয়ে বলল, ফুল লতা-পাতা নকশা দিয়ে এখানেই জড়িয়ে জড়িয়ে লেখা, লোভ হিংসায় কাতর—
পড়ুন তো। ফ্রান্সিস বলল। সাভোনা পড়তে লাগল। চার পঙক্তি পড়ে বলল, আরে পাঁচের পঙক্তিটা তো এখানেই লেখা নেই!
ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বলল, ভালো করে দেখুন মেঝের কোথাও লেখা আছে কিনা!
সাভোনা মেঝের চারপাশে খুঁটিয়ে দেখল। বলল, উঁহু, এখানে তো লেখা নেই।
নিশ্চয়ই কোথাও লেখা আছে। বাইরের ছোটো বারন্দায়ও তো মোজেকের কাজ আছে। চলুন তো। ফ্রান্সিস বলল।
গীর্জাঘরের দরজার বাইরে ছোটো একটু বারান্দা। মেঝেয় মোজেকের কাজ। তবে খুব খুশি লতাপাতা ফুল জড়ানো নয়। এখানে দাঁড়িয়ে সাভোনা হাসল, এই এখানে লেখা—যেমন যীশুর ঘর-শেষ পঙক্তিটা।
ফ্রান্সিস ভাবল, যীশুর ঘর-তার মানে গীর্জা।
ফ্রান্সিস মেঝের উপর উবু হয়ে বসল। ফুল লতাপাতায় লেখাগুলো দেখতে লাগল। ও গভীরভাবে ভাবতে লাগল, বেশি পঙক্তিটা আলাদাভাবে এখানে লেখা কেন?ভাবতে ভাবতে যখন মেঝের এদিক-ওদিক দেখছে তখনই হঠাৎ দেখল লেখাটার ঠিক ওপরেই দুটো লম্বাটে পাথর বসানো, আর ঐ দুটো পাথরকে কেন্দ্র করেই ফুল-লতাপাতার নকশা আঁকা হয়েছে। পাথর দুটো রঙিন। রঙ কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। ভালো করে দেখতেই দেখল, একটা পাথরের রঙ হলুদ, অন্যটার লাল। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিসের গানের দুটো পংক্তি মনে পড়ল—
হলুদ লাল পাথর
দূর কর এই দোসর
ফ্রান্সিস দ্রুত চিন্তা করতে লাগল—এই গানটার পঙক্তির পাঁচ এবং শেষেরটা আলাদা লেখা। অন্য কোনো গানে পাথরের কথা নেই। তবে এই পাথর দুটো তো হলুদ আর লাল রঙের। তবে কত দিন আগের। রঙ অনেক ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ওপরে ছাত আছে। তাই জল ঝড়ে রঙটা একেবারে মুছে যায় নি। ফ্রান্সিস আনন্দে চিৎকার করে উঠতে গেল। কিন্তু নিজেকে সংযত করল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। হলুদ লাল পাথর দুটো দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যারি, কাউন্ট রজারের গুপ্তধন পোঁতা আছে এই হলুদ লাল পাথর দুটোর নীচে।
বলো কি! হ্যারি পাথর দুটোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। মারিয়া আর সাভোনা দুজনেই পাথর দুটোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছুই বুঝতে পারল না।
ফ্রান্সিস বলল, সাভোনা, রাজা ফ্রেডারিককে খবর দিন। এই পাথর দুটো তুলে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
কী করে বুঝলে যে-সাভোনা বলতে গেল। ফ্রান্সিস বলে উঠল, ভুলে যাবেন না এই গীর্জার ওপরটাই রাজা ফ্রেডারিক পুননির্মাণ করিয়েছিলেন। মেঝেটা তৈরি করিয়েছিলেন কাউন্ট রজার। এটা কিন্তু আজও অক্ষত আছে।
সাভোনা আর কোনো কথা না বলে ছুটল দুর্গের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজন অমাত্যকে সঙ্গে নিয়ে রাজা ফ্রেডারিক এলেন। ফ্রান্সিসকে বললেন, আপনি কি নিশ্চিত এই লাল হলুদ পাথরের নীচেই আছে কাউন্ট রজারের গুপ্তধন?
হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল, আর শুধু একটা কথার ধাঁধা। হৃদয় শ্বেতপাথর। এই দুটো পাথর খুলে তুললে যদি একটা শ্বেতপাথর পাওয়া যায় তাহলে সব ধাঁধার সমাধান হয়ে যাবে। গানে আছে, দূর কর এই দোসর। হৃদয় শ্বেত পাথর। . রাজা ফ্রেডারিকের নির্দেশে মোজেকের কয়েকজন কারিগরকে নিয়ে আসা হলো। ওরা বাঁকানো লোহার দু-তিনরকম যন্ত্র বের করে পাথর দুটো অল্পক্ষণের মধ্যেই আলগা করে ফেলল। যখন সবাই মিলে টেনে পাথর দুটো তুলে ফেলল, দেখা গেল একটা লম্ফা শ্বেতপাথরবসানো। মারিয়া খুশিতেহাততালি দিয়ে ফেলল। ফ্রান্সিস হেসে—বলল,হ্যারি, সাফল্য।
এবার শ্বেতপাথরটা কারিগর কয়েকজন বেশ কসরৎ করে তুলে ফেলল। দেখা গেল একটা লম্ফাটে ওক কাঠের বা’। তাতে সোনারুপোর লতাপাতার কাজ। এবার বা’টা তোলা হলো। ভারী বাটা রাখা হলো মেঝেয়। রাজা ফ্রেডারিক এগিয়ে এলেন। ওপরের কাঠের ঢাকনাটা আস্তে আস্তে তুললেন। দেখা গেল অনেক সোনার ছোটো ছোটো চাকতি সারা বাটায় ছড়ানো। সেগুলো রাজা ফ্রেডারিক কিছুটা সরাতেই দেখা গেল কতরকম দামী পাথর বসানো মিনেকরা অলঙ্কার। সোনা দিয়ে বাঁধানো আয়না। সোনার চিরুনি। সকালের রোদ পড়েছে ঐ সোনার চাকতি অলঙ্কারগুলোর ওপর। ঝিকিয়ে উঠছে সব। আয়না চিরুনি। রাজা অমাত্যরা কারিগররা সাভোনা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ঐ মহামূল্যবান গুপ্ত সম্পদের দিকে। শুধু হ্যারি ফ্রান্সিস মারিয়া খুব একটা অবাক হলো না। ফ্রান্সিসের উদ্ধার করা গুপধন ওরা তো আগেও দেখেছে। তবে মারিয়া তো মেয়ে। অলঙ্কারগুলো দেখতে লাগল। কী সুন্দর গড়ন অলঙ্কারগুলোর! ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। উদগত কান্নায় ওর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। ফ্রান্সিস হেসে বলল, হ্যারি এখনও কিন্তু আমাদের কিছু কাজ বাকি।
হ্যারির আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফ্রান্সিসরাজা ফ্রেডরিকের সামনে এলো। বলল মহামান্য রাজা, আমি আমার কর্তব্য করেছি। এবার আপনি আপনার প্রতিশ্রুতিরাখুন।
রাজা ফ্রেডারিক সে কথার জবাব দিলেন না। আশ্চর্য হয়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার এত আত্মবিশ্বাস!
ফ্রান্সিস হাসল। তারপর বলল,এবার তাহলে মোরাবিত আর সাভোনাকে মুক্তি দিন। রাজা আস্তেআস্তে বললেন, নিশ্চয়ই কিন্তু তোমরা এইগুপ্তধন উদ্ধার করেছো, তোমাদেরও তো কিছু প্রাপ্য আছে। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে হাসল। বলল,এই গুপ্তধন আপনাদের দেশের, আপনাদের। আমরা কিছু নেব না। এখানকার আদিম বাসিন্দা সারাসেন জাতি, মানে মোরাবিরা, তাদের কল্যাণের জন্যে আমাদের প্রাপ্য সব দিলাম। আমার অনুরোধ, আপনি ওদের ওপর সদয় হোন ওদের ভালোবাসুন। ওদের কল্যাণে আমাদের প্রাপ্য অংশ ব্যয় করুন। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল, এবার আমরা আমাদের জাহাজে ফিরে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস মারিয়া ও হ্যারির দিকে তাকাল।
তিনজনে চলল দুর্গের দিকে। পেছন ফিরে ফ্রান্সিস দেখল সাভোনা ছুটতে ছুটতে আসছে। ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে পড়ল। সাভোনা ছুটে এসে ফ্রান্সিসের দু হাত জড়িয়ে ধরল। ওর চোখে জল সাভোনা কান্নাভেজা লগায় বলল, তুমি আমার সন্তানতুল্য। সেই তোমাকে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তোমার মতো মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।
ফ্রান্সিস হেসে বলল, অনেক আছে সাভোনা। আমরা জানি না তাই। আচ্ছা চলি—মোরাবিতের সঙ্গে দেখা হলো না। ওকে আমার অন্তরের স্নেহ জানাবেন।
ওদিকে সমস্তনগরে কাউন্ট রজারের গুপ্তধন আবিষ্কারের কথা ততক্ষণে রটে গেছে। যে কারিগররা পাথর তুলেছিল, তারাই বাইরে এসে বলেছে।
তিনজন দুর্গের বাইরে আসতে দেখে হাজার হাজার নগরবাসী ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরাও খবর শুনে ছুটে এসেছে। ফ্রান্সিসরা দুর্গ থেকে বেরোতেই বন্ধুরা ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। আনন্দে ধ্বনি দিল—ও হো হো।
উপস্থিত নগরবাসীরা ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। ওরা বুঝতে পারল না একজনকে নিয়ে এত লোক মাতামাতি করছে কেন?
Leave a Reply