কুয়াশা ৯ : প্রাচীন নকশা (ভলিউম ৩)
এক
হোটেল শাহরিয়ার।
শহরের সর্বাধুনিক এগারোতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল হোটেল। হোটেলের কাফে শপ-‘কাফে লালো।’
স্বপ্ন দেখা রঙধনুর মতো সাত রঙ মাখানো পরিবেশ। অভিজাত ও বিলালী নগরীর নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। মোহনীয় পরিবেশ উচ্ছল নারী ও পুরু। দেশী-বিদেশী নর-নারী লোভনীয় পারিপার্শ্বিকতায় উপস্থিত। স্বচ্ছলতার অপূর্ব সমাবেশ। এখানে মদ আর উষ্ণ নারী দেহই সবচাইতে লোভনীয়। এ জায়গার মোহময় পরিবেশে বলে অনেকেই নিজেদের আখের গুছি নেয়।
কাফে লালা’র উত্তর কোণের থামের আড়ালে যে ছোট্ট টেবিলটা, শহীদ সেখানে বসে পর্যবেক্ষণ করছিল। এ জায়গাটা শহীদের অত্যন্ত প্রিয়। সময় পেলেই একবার তার আসা চাই। ইদানীং সে গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে যে সর্ব ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েছিল, তার অনেক ব্যাপারের সমাধান সে এখানে বসেই করত।
তার দৃষ্টি গিয়ে পামলা মাথার উপরে। হলের মাঝখানে বিরাট ঝাড়বাতিটা অসংখ্য হীরের টুকরোর মতো দ্যুতি বেরুচ্ছে, কত দাম হবে ওটার? শুনেছে, খাস মার্কিন মুল্লুক থেকে আমদানী করা হয়েছে এটা হাজার পঁচিশেক খরচ করে। সেন্ট্রাল এয়ার কণ্ডিশন করা হলে মনে মনে ভাবছিল শহীদ খান।
আলোর নিচেই অন্ধকার।
আজীবন এই আলো-আঁধারির খেলা দেখে আসছে শহীদ তার কর্মময় জীবনের প্রতি পদক্ষেপে। কত প্রতিভার ভিতর পোকার মতো কিলবিল করতে দেখেছে জঘন্য মনোবৃত্তি। এখানে বসেও এই উচ্ছল জীবনের চলমান গতিতে দেখতে পায় বহু অপরাধ প্রবণতার ছাপ। আরও অনেক কিছু চোখে পড়ে, তা মেনে নিতে কুণ্ঠিত হয়ে পড়ে মন।
এমনি নানান কথা চিন্তা করছিল শহীদ খান। এমন সময় হলের ইনচার্জ মি. উইভিং স্বয়ং হন্তদন্ত হয় ছুটে এলো শহীদ খানের কাছে, ছোট্ট ১২
রূপার ট্রে’তে একখানা ভিজিটিং কার্ড নিয়ে।
‘গুড ইভনিং স্যার।’
‘গুড ইভনিং!’ শহীদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হেড ওয়েটারের দিকে তাকায়।
‘বিখ্যাত বিজনেস ম্যাগনেট ও ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট মি. রশিদ আহমদ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান, স্যার।’
কণ্ঠে খানিকটা সম্ভ্রম ঢেলে কথা বলে হেড ওয়েটার মি‘ উইভিং। শহীদের এবার বিস্মিত হবার পালা।
‘তিনি আমার সাথে দেখা করতে চান। কিন্তু কেন? আর আমি এখানে আছি, তিনি জানলেনই বা কিভাবে?’
‘সে কথাও তিনি আমাকে বলেছেন। অত্যন্ত জরুরী ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দেখা করা একান্তই দরকার। সে জন্যে আপনার বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে খবর পেয়ে সোজা চলে এসেছেন এখানে। এখন এন্ট্রান্স করিডরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।’ শহীদের দৃষ্টি চলে গেল এন্ট্রান্স করিডরের দিকে। বিরাট আয়না বসানো দরজার ভিতরের দিকে এসে দাঁড়িয়েছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। পরনে তার নিখুঁত সান্ধ্য পোশাক। সঙ্গে রয়েছে এক তিলোত্তমা। অপরূপ সুন্দরী, ঠিক যেন ভেনাসের প্রতিমূর্তি।
‘যদি আপনি অনুমতি দেন স্যার, তাহলে…।’
‘নিশ্চয়ই। আপনি ওদের নিয়ে আসুন আমার টেবিলে।’
কিন্তু শহীদের বিরক্তিভাব অপ্রকাশিত থাকলো না। রূপালী ট্রে থেকে দামী ভিজিটরস কার্ডখানা হাতে তুলে নিলো শহীদ, দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলো কার্ডটার উপর। লেখা আছে শুধু, “রশিদ আহমেদ”। গোল্ডেন এমব প্রিন্টিং-এ নামটা জ্বলজ্বল করছে।
পরিচয়ের পালা শেষ করে, তিলোত্তমার পরিচয় করিয়ে দিলেন রশিদ আহমেদ। ‘মিসেস রুনা আহমেদ, আমার স্ত্রী।’
তিলোত্তমা হাত বাড়িয়ে দিলো। পরিচ্ছন্ন আঙুলগুলো অনেক যত্নে ম্যানিকিউর করা। ‘আপনার কথা অনেক শুনেছি। পরিচিত হয়ে খুবই খুশি হলাম।’
মোলায়েম এক টুকরো হাসি উপহার দিলো তিলোত্তমা।
‘বসুন।’ শহীদ খান তাঁদের অভ্যর্থনা জানালো। ছোট্ট টেবিলটা ঘিরে বসে পড়লো সবাই।
শহীদ এবার ভালো করে লক্ষ্য করলো রশিদ আহমেদকে। ভদ্রলোকের চোখে মুখে এমন একটা কঠোর ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটে উঠেছে যেন কর্তৃত্ব করাই তাঁর সহজাত অভ্যাস। এক কথায় বলা যেতে পারে ‘গ্র্যানিট হার্টেড’। কিন্তু মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ছিল তাঁর চেহারায়।
কয়েকটি মুহূর্ত কেটে গেল এমনি নীরবতায়। এবার শহীদ খান মুখ খুললে। ‘কি করতে পারি আপনাদের জন্যে?’
ভদ্রলোক অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ‘ইদানীং একটা সমস্যায় পড়ে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছি। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। তবে বলাটা সময় সাপেক্ষ, যদিও ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী। কখন আপনার সময় হবে জানতে পারলে সে সময় আপনার বাসায় গিয়ে দেখা করতাম।’
শহীদ খান দ্রুত চিন্তা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, যতো শিগগির এদের কথা শুনে বিদায় দেয়া যায় ততই মঙ্গল। তার এই সুন্দর সন্ধ্যাটা এরা এমনি করে মাটি করে দিলো।’
‘আপনার কথা সচ্ছন্দে এখানেই বলতে পারেন।’
ভদ্রলোক একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিলেন। তারপর চেয়ারটা আরেকটু টেনে নিয়ে ঘন হয়ে বসলেন। মিসেস আহমেদ তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন। শহীদ খানের বিরক্তি এর মধ্যেই চরমে উঠেছে।
‘দেখুন আমি বিপদে পড়ে…’
‘আপনার বিপদটা কি তাই তো এখনও জানতে পারলাম না।’
‘সে কথাই তো বলতে যাচ্ছি।’ ভদ্রলোক অপ্রস্তুত হয়ে দারুণ লজ্জা পেলেন।
‘তাহলে গোড়া থেকেই শুরু করি শুনুন। সে আজ অনেকদিন আগের কথা। বাবা তখন বেঁচে আছেন। নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিলো তাঁর ব্যবসা। কর্ম উপলক্ষে প্রায়ই তাঁকে লামডিং থাকতে হতো। সেখানে দু’টো কোলিয়ারীর মালিক ছিলেন তিনি। একবার কাছাকাছি জায়গায় তিনি আরও একটি কয়লা খনির সন্ধান পান, এক বিজন বনের ভিতরে। তিনি জায়গাটা জরিপ করার জন্যে তাঁর নিজস্ব সার্ভেয়ার পার্টি নিয়ে সেই বনে গিয়ে তাঁবু গাড়েন। এদিকে আবার শিকারে শখ ছিলো খুবই। জরিপ করার কাজে লোকজন লাগিয়ে দিয়ে, তিনি বন্দুক নিয়ে বেরোতেন প্রায়ই। এমনি একদিন বেরোলেন। শিকারের আশায় আরও গভীর বনে গিয়ে ঢুকলেন! পথ চলতে চলতে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, হঠাৎ এক জায়গায় বনের ভিতর বেশ কিছুটা ফাঁকা মনে হলো। তিনি সামনের দিকে চাইলেন। তাঁর সম্মুখে ভেসে উঠলো পুরনো ধরনের এক বৌদ্ধ মন্দির। ভয়ানক কৌতূহল হলো তাঁর। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন। ভয় বলে কোনো বস্তু তার জানা ছিলো না। কিন্তু এই বিজন বনে এমন মন্দির দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। একটা প্রবল আকর্ষণ তাঁকে মন্দিরের দিকে টেনে নিয়ে গেল। মন্দিরের সামনে খানিকটা পথ গুহার মতো। নিচে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। দরজার দু’পাশে দুটো সিংহমূর্তি ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। ভিতরটা অন্ধকার।
প্রথমে কিছুই ঠাহর করা যায় না। কিন্তু বাবা অকুতোভয়ে ঢুকে পড়লেন ভিতরে। এবার ধীরে ধীরে তিনি অন্ধকারে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন। আরও ভিতরে এগিয়ে গেলেন তিনি। গলিপথটার শেষে একটা কুঠুরী দেখতে পেলেন। ঢুকবেন কি ঢুকবেন না চিন্তা করছিলেন, হঠাৎ অস্পষ্ট একটা আর্তনাদ শুনতে পেলেন ভিতর থেকে। বুঝলেন কোনো মানুষ রয়েছে ভিতর। তিনি উঁকি মেরে দেখতে পেলেন, অপরিসর একখানা ঘর। একপাশে কয়েকটা মাটির হাঁড়িপাতিল পড়ে রয়েছে। কিছুদূরে একটা মাটির কলস। অদূরে ছোট্ট একটা তাক, তার উপর একটা মৃনয় বর্তিকা জ্বলছে, কিন্তু তাতে ঘরের অন্ধকার দূর হচ্ছে না। মাঝখানে মেঝেয় একটা মাদুর বিছানো। তার উপর অস্থি মজ্জায় কঙ্কালসার এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী শুয়ে ইষ্টনাম জপ করছে। মুমূর্ষ বৃদ্ধের অন্তিম অবস্থা।
তাকে দেখে সন্ন্যাসী কাছে ডাকলেন। অনেক কিছু বলতে লাগলেন বাবাকে কিন্তু বাবা তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারলেন না। হাতের ইশারায় বার বার ঘরের একটা কোণের দিকে ইঙ্গিত করতে লাগলেন। বাবা সন্ন্যাসীর নির্দেশ মতো সেই কোণটায় গেলেন। অনেক আবর্জনা ছড়ানো রয়েছে সেখানে। সেই আবর্জনার মাঝখানে হাতির দাঁতের কাজ করা একটা জড়োয়া রাক্স রয়েছে, দেখতে পেলেন বাবা।’
রশিদ সাহেব একটু থামলেন। টেবিলে দেয়া আমানটিলাডো ওয়াইনে একটু চুমুক দিয়ে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে আবার শুরু করলেন।
‘বাক্সটা তিনি হাতে তুলে নিলেন। সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যেতে ইশারায় সেটা বাবাকে খুলতে বললেন। সেটা খুলতেই চোখে পড়লো, ভিতরে রয়েছে মণি-মাণিক্য খচিত একটা সুদৃশ্য ছোরা। ছোরার বাঁটে আঁকা ভীষণ চেহারার দুটো সাপের যুগল মূর্তি। বাবা চমকে উঠলেন। বাক্সের ভিতর আরেকটা জিনিস দেখতে পেলেন তিনি। পার্চমেন্ট পেপারে আঁকা একখানি ম্যাপের মতো কাগজ। একটা অজানা রহস্যে তাঁর মন ভরে উঠলো। সন্ন্যাসী ইঙ্গিতে বাক্সটা নিয়ে চলে যাবার জন্যে আদেশ দিলেন। কিন্তু তবুও সন্ন্যাসীকে মুমূর্ষ অবস্থায় ফেলে যেতে বাবার মন সরছিল না। তিনি আমতা আমতা করে রয়ে গেলেন।
হঠাৎ এক ভয়ঙ্কর গোঙানীর শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে বুঝতে পারলেন না। এবার সত্যি বক্সটা নিয়ে পালিয়ে এলেন। আর পিছন দিকে ফিরেও তাকালেন না। সেই থেকে বাক্সটা তাঁর কাছেই ছিলো। ভিতরের কাগজটার কোনো অর্থ তিনি অনেক চেষ্টা করেও বের করতে পারেননি। সে জন্যে বাক্সটা সিন্দুকে তুলে রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হতো বাবা রাতে আতঙ্কে ঘুমোতে পারতেন না। সব সময় কেমন চমকে উঠতেন। বাবা মারা যাবার পর আমি ওই অভিশপ্ত বাক্সটা যেমন ভাবে সিন্দুকে ছিলো ঠিক তেমনি ভাবে রেখে দিয়েছি।
কিন্তু এরপর থেকে বাবার সেই আতঙ্ক আমায় পেয়ে বসলো। আমি বুঝতে পারলাম. বাবা কেন রাতে ঘুমোতে পারতেন না। কেমন যেন পরিবেশটা ঘোলাটে হয় উঠলা। লক্ষ্য করলাম, কে বা কারা সব সময় ছায়ার মতো আমাদের বাড়ির চারদিকে ঘুর বেড়ায়। একটা বিষণ্ণ কান্নায় গভীর রাতে অনেক সময় আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আতঙ্কে আমরা শিউরে উঠি।’
বলতে বলতে রশিদ সাহেব সত্যিই শিউরে উঠলেন। ওয়াইন কাপটা তুলে নিয়ে বাকিটুকু এক চুমুকে শেষ করে দিলেন। ‘গতকাল রাতে আরেকটা ঘটনায় অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠেছি। তখন রাত প্রায় দুটো। হঠাৎ একটা শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। পায়ের কাছে কাঁচের জানালাটা বন্ধ। কিন্তু তার বাইরে বারান্দা থেকে একটা ভীষণ কুৎসিত মুখ জানালা দিয়ে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।
ভয়ে আমি চিৎকার করে উঠি। সেই চিৎকারে পাশের ঘরে আমার স্ত্রীর ঘুমও ভেঙে গেল। আবার একটা শব্দ হলো। সেই সঙ্গে ঝনঝন করে জানালার একটা কাঁচ ভেঙে ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো। ভীষণ মুখখানা হঠাৎ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। লোকজন উঠে এলো সব। কিন্তু খুঁজে আর কিছুই পাওয়া গেল না। এখন বলুন মি. শহীদ, আমি কি করবো?’
‘এ ব্যাপারে আমি কি করতে পারি বলুন?’
‘অনেক আশা নিয়ে আমরা আপনার কাছে ছুটে এসেছি। আপনি হয়তো এর একটা প্রতিকার করতে পারবেন।’
‘দেখুন, এসব ব্যাপারে আমি আজকাল বড় একটা জড়াই না নিজেকে। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় আমাকে। তাছাড়া গোয়েন্দাগিরি একরকম ছেড়েই দিয়েছি।’ শহীদ জবাব দিলো। ‘আর তাছাড়া ইদানীং একটা বড় লট পাট কিনেছি রেলী ব্রাদার্সের কাছ থেকে। রেলগুলোর এক্সপোর্ট নিয়ে অনেক ঝামেলায় আছি। আপনি এক কাজ করুন না! বরঞ্চ পুলিসের সাহায্য নিন, ওরা আপনাকে অনেক বেশি সাহায্য করতে পারবে।’
মি. আহমেদ একটু দমে গেলেন। তারপর বললেন, ‘আমাকে আপনি নিরাশ করবেন না, মি. শহীদ। আপনি আমায় সাহায্য করুন, আমি আপনার সমস্ত পাট কিনে নেবো ডাণ্ডি মার্কেট রেটে। আর এক্সপোর্টের সমস্ত ঝামেলাও আমার ফার্ম নিয়ে নেবে। ওখানকার সি এ এফ ভ্যালুতে, আপনার সমস্ত টাকা পকিস্তানে আমার ডাণ্ডি এজেন্ট ট্রান্সফার করে দেবে। আর তাছাড়া এ ব্যাপারে ইনভেষ্টিগেট করতে যা লাগে, সমস্ত ব্যয়ভার আমি বহন করবো।’
‘দেখুন, মি. রশিদ, আপনার ব্যাপারটা আমাকে ভেবে দেখতে হবে। আর তাছাড়া শখে আমি শার্লক হোমস হয়েছি। গোয়েন্দাগিরি করে আমি টাকা নিই না কারও কাছ থেকে। প্রয়োজনের তুলনায় টাকা আমার যথেষ্ট আছে।’
এবার তিলোত্তমা মুখ খুললো। কড়া মেকআপ আর রঞ্জিত অধর সত্ত্বেও, মুখখানা তার করুণ দেখাচ্ছিল। কণ্ঠস্বর তার অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনা গেল।
‘প্লীজ, মিস্টার শহীদ, আরেকটু ভেবে দেখুন। ওই অলক্ষুণে বাক্সটা ঘরে রেখে ও নিজেও পাগল হচ্ছে, আমাকেও পাগল বানাচ্ছে।’
নারীর কমনীয় আহ্বানে শহীদের মতো কঠিন লোকের চিত্তবৈকল্য হলো না। শুধু বললো, ‘এর আগে আমায় একটু ভেবে দেখতে দিন, মিসেস আহমেদ। আমি দু’এক দিনের মধ্যেই আপনাদের জানাবো কি করতে পারবো আমি।’
তবুও কৃতজ্ঞতায় মি. আহমেদ গলে গেলেন। মনে হলো, একটা গুরুতার তার বুক থেকে নেমে গেছে। স্টুয়ার্ড এনে ওদের ফুট ককটেল ও মুলিগানী সুপ দিয়ে গেল। পাশ্চাত্যের উষ্ণ মিউজিক বেজে উঠলো স্টেরিওফোনিক রেকর্ড প্লেয়ার থেকে। ওয়ালজ-এর তালে তালে এগিয়ে এলো অনেকে জোড়ায় জোড়ায় মাঝখানের ফ্লোরে। হলের উজ্জ্বল বাতিগুলো ধীরে ধীরে নিবু নিবু হয়ে পাঁচ ওয়াটস-এ স্থির হয়ে দাঁড়ালো।
দুই
এখন যেখানে পার্ক রো, এককালে সেখানে ছিলো নওয়াবদের ঘোড়ার আস্তাবল। ডি. আই.টি’র উন্নয়ন পরিকল্পনায় সেগুলো ঢাকার ম্যাপ থেকে চিরকালের মতো মুছে। গেছে। শুধু রয়ে গেছে চুনু মিয়ার মাটকোঠা বাড়িটা। এককালে বারোটা ঘোড়া গাড়ির মালিক ছিলো চুনু মিয়া। তারই স্মরণ চিহ্ন হিসেবে ছেঁড়া একটা জিলাগাম এখনও দেয়ালের গায়ে ঝুলছে। ডি.আই.টি’র নোটিস পেয়েছে সে কবেই, কখন যে উঠে যেতে হবে তাকে সেই কথার জাবর কাটে চুনু মিয়া মোড়ের উপর দু’খানা টিনের ছাপড়া দেয়া চায়ের দোকানটায়। তার খানদানী রক্ত টগবগিয়ে ওঠে এ-সব অনাচারের কথা স্মরণ করে। তার কথায় অনেকেই সার্কাসের সঙ-এর মতো ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
কিন্তু পাড়াটার চেহারা, যা খুলেছে, তা মনে রাখার মতো। চুনু মিয়ার বাড়ির চারধারে প্রাসাদোপম বাড়িগুলো সুন্দর করে সেজেগুজে আছে, ঠিক যেন তার যৌবনের গুলাবজান বিবির মতো।
বর্তমানে অভিজাত পল্লী এই পার্ক রো।
২৭২ নম্বর বাড়িটা অন্যান্য বাড়ির চেয়ে একটু স্বতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী মি. রশিদ আহমেদ করেছেন এ বাড়িটা। পূর্ব-দীঘল বাড়ি মনের মত সাজিয়েছেন তিনি আগাগোড়া ইটালিয়ান হোয়াইট মার্বেলে। ঝকঝকে বাড়িটা দেখলে মনে হয় যেন এই মাত্র শেষ হয়েছে এ বাড়ির কাজ।
*
ঝিরঝির বৃষ্টির অবিশ্রান্ত বর্ষণে চুনু মিয়া অনেকক্ষণ রাজা-উজীর মেরে অবশেষে বিরক্ত হলো। রাস্তার লাইটগুলো বৃষ্টির ঝাঁপটায় কেমন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, কিছুদূরের লোক মালুম হয় না। চুনু মিয়া ভাঙা ছাতিটা মাথায় দিয়ে ঘরমুখো হলো।
বিদ্যুৎ চমকে দেখা গেল বর্ষাতি গায়ে একটা ছায়ামূর্তি সেন্ট্রাল পার্কের দিক থেকে পার্ক রো-র ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসছে। ফেন্ট ক্যাপটা মাথার উপর, চোখের নিচে পর্যন্ত নামানো। বর্ষাতির কলারটা উপরের দিকে উঠানো। চুনু মিয়া চকিতে একবার তাকালো ছায়ামূর্তির দিকে। দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহ। কোনদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে চলেছে হন হন করে। আগের বাঁকে গিয়ে ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল, আর তাকে দেখা গেল না।
চুনু মিয়া নিজের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো। নাহ্। মাটির দেয়ালগুলো অনেক জায়গায় ধসে পড়েছে। জীর্ণ তাদের চেহারা। কিন্তু এককালে তো এমন ছিলো না। তার গুলাবীর তখনকার চেহারা মনে করতে চেষ্টা করে চুনু মিয়া। দরজার কড়াটা সজোরে নাড়া দেয় সে। অনেকক্ষণ পরে বৃদ্ধা গুলাবজান বিবি সদ্য ঘুমজড়িত চোখে উঠে এসে দরজাটা খুলে দেয়। চুনু মিয়া ভাঙা ছাতাটা বন্ধ করে তার দৌলতখানায় ঢুকে পড়লো।
মিসেস রুনা আহমেদ। মি. রশিদ আহমেদের দ্বিতীয় পক্ষের সুন্দরী স্ত্রী। এককালে কলেজে পড়া সবচেয়ে স্মার্ট ও সেরা সুন্দরী রুনা।
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মিসেস আহমেদ মানুষজোড়া ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে। মেকআপবিহীন মুখে স্পষ্ট একটা ক্লান্তির ছাপ। চোখের কোণে গাঢ় কালিমা। কোমর পর্যন্ত ছড়ানো এলোচুলে দু’এক জায়গায় পাক ধরেছে। কতদিন আর সতেজ বাঁধনে বেঁধে রাখবে দেহটাকে। অজানিতে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক ঠেলে।
রশিদ সাহেব এখনও ক্লাব থেকে ফেরেননি। ঘরে কড়া টিউব লাইটের আলোয় পরিবেশটা বড় জ্বালাময় মনে হলো তার। পাশে রাখা সাইড টেবিল থেকে কাটগ্লাসে ঢালা নির্জলা হুইস্কিটুকু এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিলো মিসেস আহমেদ। গ্লাসটা একবার চোখের সামনে ধরলো। সেখানে তার চেহারাটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। তিক্ত হাসি হাসলো মিসেস আহমেদ।
এ জীবনের দেনা-পাওনায় সে দেউলে হয়ে গেছে। কি পেলো আর কি দিলো। তার হিসেব করতে গিয়ে, জমার খাতায় শুধু নাই পড়লো। রশিদ সাহেবের ভালবাসা সে পায়নি।
কখন যেন চোখের কোণে দু’ফোঁটা পানি টলমল করে উঠলো। উঠে গিয়ে কাঁচের জানালাটা খুলে দিলো। এক মুঠো ঝিরঝিরে হাওয়া তার চোখে মুখে এসে লাগলো। চেয়ে রইলো ওই আকাশের দিকে, যেখান থেকে বৃষ্টির অক্লান্ত বর্ষণে ধরণী শীতল হয়ে গেছে।
ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো ২৭২ নম্বর পার্ক রো-র পিছন দিকটায়। একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিক দেখে নিলো। তারপর কাঁচের টুকরো বসানো দেয়ালের উপর উঠে গেল অবলীলাক্রমে। লাফিয়ে পড়লো ভিতরে কামিনী ঝোঁপটার পাশে। এক মুহূর্ত দাঁড়ালো সেখানে। তারপর এগিয়ে চললো সিঁড়ির দিকে।
রুনা আহমেদের রুমটা দেখা যাচ্ছে বায়ের দিকে। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আগন্তুক। কি যেন ভালো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে, তারপর ধীরে ধীরে ঘরের ভিতর ঢুকলো।
হাতটা জানালার বাইরে বাড়িয়ে দিলো রুনা আহমেদ। বাইরে বৃষ্টির ঝাঁপটা অনেকটা কমে এসেছে। চেয়ে দেখলো সামনের নিম গাছটায় শিরশিরে হাওয়া লাগছে, আর আন্দোলিত ডালপালা থেকে দু’চার কোটা পানি ঝরে পড়ছে নিচে।
হঠাৎ একটা ছায়া এসে পড়লো তার কাঁধের উপর দিয়ে সামনের দেয়ালে। চমকে ফিরে তাকাবার আগেই একটা রেশমি ফাঁস এসে তার গলায় এটে বসলো। দু’হাত দিয়ে নিজের গলাটাই চেপে ধরলো রুনা। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ধীরে ধীরে রুনা আহমেদের চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। এই পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ আর কোনদিন চাইবে না রুনা আহমেদ। মেঝের উপর ঢলে পড়লো সে।
গলার ফাঁসটা একবার দেখে নিয়ে আগন্তুক নিশ্চিন্ত হলো। তাকালো রুনা আহমেদের মৃতদেহের দিকে। তারপর এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলটার পাশে। ডুয়ার ধরে টান দিয়ে দেখলো চাবির গোছাটা যথাস্থানেই আছে। নির্দিষ্ট দুটো চাবি বেছে নিয়ে দেয়ালে গাঁথা আয়রন সেফের ডালাটা খুলে ফেললো সে। মনে হলো তালার, কমবিনেশনটা বহু আগেই জানা।
ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বের করে আনলো ছোট্ট হাতির দাঁতের কাজ করা জােয়া বাক্সটা। বোতামে টিপ দিতেই উপরের ডালাটা খুলে গেল। এবার নিশ্চিন্ত হলো সে। তার পর বাক্স বন্ধ করে রেইন কোটের ডান পকেটের ভিতর ঢুকিয়ে দিলো সেটা।
কাজ শেষ হয়েছে ছায়ামূর্তির। এবার একটা সস্তা দামের সিগারেট বের কর ধরালো নিশ্চিন্ত মনে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো, জ্বলন্ত সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে। দেয়াল টপকে পার হয়ে পিছনের রাস্তাটায় এসে দাঁড়ালো। একটু অপেক্ষা করলো। তারপর চলতে আরম্ভ করলো।
একটু পরেই রশিদ সাহেবের গাড়িখানা এসে থামলো সামনের গাড়ি বারান্দায়। ক্লাব থেকে ফিরছেন তিনি। টলতে টলতে উপরে উঠতে লাগলেন সিঁড়ি বেয়ে। দূর কোনো গাছে কর্কশ স্বরে একটা পেচা ডেকে উঠলো রাতের নীরবতা ভঙ্গ করে, নেহায়েৎ দুঃস্বপ্নের মতো।
সেই পেঁচার ডাক শুনে চুনু মিয়া চমকে উঠলো তার মাটকোঠা বাড়িটায়। জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালো। বৃষ্টিটা এখন একটু ধরে এসেছে, কিন্তু আকাশের মুখ ভার। আবার চমকে উঠলো চুনু মিয়া। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখলো, সেই আগের দেখা ছায়ামূর্তিটা পার্কের দিকে চলে যাচ্ছে অত্যন্ত সন্দেহজনক ভাবে! একটা অমঙ্গল আশঙ্কায় চুনু মিয়ার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।
তিন
সকাল বেলায় ব্রেকফাস্ট সেরে শহীদ খান চায়ের পেয়ালাটা পাশের পিক টেবিলে রেখে, একখানা দৈনিক ইংরেজি কাগজের উপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো।
‘শোন।’ মহুয়া এসে ঘরে ঢুকলো। সদ্যস্নাত এলোচুলে লাল ডুরে শাড়িটায় ওকে মানিয়েছে বেশ। শহীদ হাতের কাগজখানা পাশে রেখে দিয়ে এক দৃষ্টিতে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘কি দেখছো?’
‘তোমাকে। যা সুন্দর মানিয়েছে তোমায় আটপৌরে শাড়িটা!’ লজ্জায় আরক্তিম হয়ে ওঠে মহুয়া।
‘ভালো হবে না বলছি। অমন হ্যাংলাপনায় আমার লজ্জা করে না বুঝি? বলছিলাম কি, তোমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না কিছুদিন থেকে। সবাই মিলে কক্সবাজার ঘুরে এলে কেমন হয়?’
‘তোমার ইচ্ছায় তো কোনদিন বাধা দিইনি মুহু।’
মহুয়ার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সামনের দেয়ালের পর। সেই ৮ টা টাঙানো রয়েছে সেখানে। হঠাৎ দৃষ্টিটা কেমন ঝাপসা হয়ে এলো মহুয়ার। একটি মাত্র ভাই, কিন্তু কোনদিন কাছে পেলো না আপন করে। কুয়াশার মতো চিরদিন আড়ালেই রয়ে গেল।
গফুর এসে বারান্দায় কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করলো। ‘কি রে, গফুর, তোর আবার কি চাই রে?’
‘কিছু না দাদামণি। পুলিসের হক সাহেব এসে বসে আছেন। খুব নাকি জরুরী দরকার।’
‘তাঁর জন্যে কিছু ব্রেকফাস্ট আর চা নিয়ে আয়। আমি এখুনি যাচ্ছি।’
শহীদ ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখলো, হক সাহেব তখনও বসেননি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন।
‘কি খবর হক সাহেব? দাঁড়িয়ে যে–বসুন না।’
মোজাম্মেল হক এবার ধপাশ করে বসে পড়লেন বড় সোফাটায়। ককিয়ে উঠলো সোফাটা এতবড় গুরুভারের পীড়নে।
গফুর ব্রেকফাস্টের প্লেটটা এনে হক সাহেবের সামনে রেখে দিলো। মোজাম্মেল হক মনে মনে অত্যন্ত প্রীত হলেন। পকেট থেকে বিরাট আকারের একটা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিলেন। ইদানীং হক সাহেবের পেটের পরিধি আগের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি বেড়ে গেছে। সেই অনুপাতে খাবার বহরটাও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ভদ্রলোকের এহেন বিরাট বপু নিয়ে চলাফেরা করতে বেশ কসরত করতে হয়।
হক সাহেব কিছু বলতে উদ্যত হলে শহীদ সরবে প্রতিবাদ করে উঠলো। ‘আগে এগুলোর সদগতি করুন, তারপর শুনবো আপনার কথা।’
খুশি হয়ে হক সাহেব যুগপৎ সবগুলো খাবারের উপর এক সাথে আক্রমণ চালালেন। তাঁর ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে দেখে গফুর কিচেন থেকে বাড়তি আরেকটা প্রেট এনে ধরে দিলো হক সাহেবের সামনে। হক সাহেব তখন একসাথে হাত ও মুখ চালা চ্ছেন। ব্রেকফাস্ট শেষ করে পুরো তিন গ্লাস পানি খেয়ে প্রকাণ্ড একটা ঢেকুর তুললেন মোজাম্মেল হক। এইবার চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে শহীদের মুখোমুখি হলেন তিনি।
‘শহীদ সাহেব, আপনি নিশ্চয়ই বিখ্যাত মিলেনিয়ার রশিদ আহমেদকে চেনেন। তাঁর পার্ক রো’র বাড়িতে কাল রাতে কে বা কারা হানা দিয়ে মিসেস আহমেদকে হত্যা করেছে, অদ্ভুত উপায়ে খুন করা হয়েছে তাকে। আততায়ী সেই আগের দিনের ঠগীদের মতে রেশমী ফাঁস পরিয়ে তাকে হত্যা করেছে। সেই সঙ্গে উধাও হয়েছে সিন্দুক থেকে হাতির দাঁতের কাজ করা একটা বাক্স। ওতে নাকি কোনো গুপ্তধনের নক্সা ছিলো। টাকা পয়সা খোয়া যায়নি।’
‘বলেন কি, হক সাহেব।’
এবার শহীদের বিস্মিত হবার পালা। সে সোজা হয়ে বসলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলা সেদিন ‘কাফে লায়লা’য় দেখা মিসেস আহমেদের মুখখানি। কেমন একটা মোহময় আকর্ষণ ছিলো ভদ্রমহিলার। খানিকটা অনুশোচনায় তার মন ভারি হয়ে উঠলো।
‘মি. সিম্পসন রওনা হয়ে গেছেন অকুস্থলে। আমাকে অনুরোধ করেছেন যাবার পথে আপনাকে খবর দিতে। আপনি গেলে আমরা সবাই খুব খুশি হবো।’
শহীদ উঠ দাঁড়ালো। সে যাবে বলে মন স্থির করেছে। ‘একটু বসুন, হক সাহেব। আমি কাপড়টা বদলে আসি।’
শহীদও রওনা দেয়।
২৭২ নম্বর পার্ক রো। শহীদের ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেনটা মৃদু গুঞ্জন তুলে রশিদ আহমেদের বাড়ির ডাইভওয়ে দিয়ে ঠিক পোর্চের নিচে এসে থামলো। ডিউটিতে যে সেন্ট্রি ছিলো, ওদের দেখে ঠাস করে দু’পা একসঙ্গে এনে কড়া একটা স্যালুট দিলো। বিনয়ের সঙ্গে জানালো, মি. সিম্পসন দোতলায় মিসেস আহমেদের রুমে রয়েছেন। ওরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলো। বাঁদিকের রুমে মি. সিম্পসনকে পাওয়া গেল।
ঘরে ঢুকতেই মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, ‘আরে এসো, শহীদ। তুমি আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। কেসটা খুব ইন্টারেস্টিং। খুন খারাবির সাথে গুপ্তধনের নক্সা, পর্যন্ত আছে।’
‘তাই নাকি।’ শহীদ ছোট্ট একটা উত্তর দেয়।
‘হ্যাঁ। ঠগীদের মতো রেশমী ফাঁস দিয়ে মিসেস আহমেদকে হত্যা করা হয়েছে। শ্বাস রোধ হওয়াতেই ভদ্রমহিলা মারা গেছেন। আমি ইনকোয়েরী যা করার ইতিমধ্যেই করে ফেলেছি। ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট এসে সিন্দুকের গা থেকে কিছু ছাপ নিয়ে গেছে। তার রিপোের্ট আমরা পরে পাবো। তোমার যা দেখা দরকার, শহীদ, দেখে নাও। পরে আমরা এ নিয়ে আলোচনা করবো।’
শহীদ একবার ভালো করে রুমটার চারদিকে তাকিয়ে দেখলো। ভিতর দিকে একখানা পুরু গদীওয়ালা খাট। সুন্দর ম্যাচ করা বেড কভারে ঢাকা। একপাশে একই কালারের দামী সোফাসেট। উল্টোদিকে জানালার কাছে একটা বড় ড্রেসিং টেবিল। জানালার অপরদিকে উঁচু স্ট্যাণ্ডের উপর মাঝারি সাইজের পেতলের টব। ওতে কতক গুলো রজনীগন্ধার ঝাড়। ফুলের আবছা একটা মিষ্টি গন্ধ থেকে থেকে নাকে এসে লাগছে।
মিসেস আহমেদের মৃতদেহটা জানালাটার পাশেই লাল কার্পেটের উপর পড়ে। আছে। অদূরে দাঁড়িয়ে আছেন মি. আহমেদ। অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত মনে হচ্ছিলো তাঁকে।
শহীদ মৃতদেহর দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে ভালো করে পরীক্ষা করতে লাগলো।
গলার যে জায়গায় ফাঁস এটে বসেছিল, সরু একটা নীল দাপ সে জায়গাটা বেষ্টন করে আছে। চোখে মুখে একটা দারুণ আতঙ্কের ছাপ। দু’চোখের কোণে পানির একটা ক্ষীণ রেখা শুকিয়ে আছে। শহীদ পরীক্ষা শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে নিচে নেমে কামিনী ঝোঁপের পাশে গেল। এক জোড়া গাভীর পায়ের ছাপ দেখতে পেলো সেখানে। ছাপের গভীরতা থেকে আততায়ীর চেহারার খানিকটা হদিস পেলো সে।
গেট দিয়ে বের হয়ে বাড়ির পিছনটা একবার ঘুরে এলো। তারপর চনু মিয়ার মাটকোঠা বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা পায়ের ছাপ চলে গেছে বাড়িটার। সামনে দিয়ে বড় রাস্তাটার দিকে। ঢাকার মাটি। শুকোলে পাথর, ভিজলে চিনে জোঁকের মতো জুতোর সাথে লেগে থাকে।
চুনু মিয়া বাজারের থলি হাতে সেই মুহূর্তে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালো। সম্মুখে শহীদকে দেখতে পেয়ে লম্বা সালাম ঠুকলো।
‘সালাম, হজুর। মাটির দিক চাইয়া চাইয়া কি খুঁজবার লাগছেন?’
শহীদ এবার চোখ তুলে তাকালো চুনু মিয়ার দিকে। তাকে কাছে ডাকলো। ‘এটাই বুঝি তোমার বাড়ি? বেশ, বেশ। তোমার নামটা কিহে?’
‘বাপে আমার নাম রাখছিল, মিয়া চুনু, মাইনষে আমারে চুনু মিয়া কয়। বেবাক নাদানের দল।’
‘জানো, মিয়া চুনু, কাল রাতে তোমার পাশের বাড়ির রশিদ সাহেবের বিবি খুন হয়েছেন।’
চুনু মিয়ার চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে। ‘কন কি সাব, এক্কেরে খুন? তাও আবার জানানা মানু। তা হইবার বি পরে। বড় লোকের বাড়ির খবর আমরা রাখুম কেমনে।’
তারপর গলার স্বর খানিকটা নিচু করে বললো, ‘হুজুর, কাইল রাইতে আমার ভি সন্দো হইছিল।
‘সেটা কেমন মিয়া চুনু?’ শহীদ জিজ্ঞেস করলো।
‘আপনে বুঝি পুলিসের লোক, এতো কত জিগাইবার লাগছেন?”
‘নাহে, আমি রশিদ সাহেবের বন্ধু লোক।’
‘তাইলে আপনের কাছে কইবার পারি। কাল রাইতে বৃষ্টি যখন ধইরা আইলো, আমি চায়ের দোকান থেইকা বাড়িত আইবার লাগছি, দেহি এক জোয়ান মর্দ বর্ষাতি পইরা টুপি দিয়া মাথা ঢাইকা এই পথ দিয়া চইল্যা গেল, সাবের বাড়ির দি। পরে বাড়িত ফিইরা যখন বৃষ্টি থামছে কিনা জানালা দিয়া দেখবার লাগছি, দেহি হেই বেডা, দৌড়াইয়া পার্কের দিক যাইবার লাগছে। কেমন জানি তহনই আমার সন্দো লাগছিল।’
‘ঠিক আছে, মিয়া চুনু, যদি দরকার পড়ে তবে তোমায় ডাকবো।”
‘হ হুজুর, আপনের খেদমতের লাইগ্যাই এই চুনু বাইচ্যা আছে। আমার গুলাবী হেই দিন কইছিল।’ চুনু মিয়া তাকিয়ে দেখে শহীদ ততক্ষণ অনেকদূর চলে গেছে। খানিকটা বিরক্ত হলো চুনু মিয়া। তারপর থলি হাতে বাজারের দিকে চলে গেল।
শহীদ আবার মিসেস আহমেদের রুমে প্রবেশ করে রশিদ সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো।
‘আচ্ছা মি. রশিদ, কাল রাতে আপনি কখন বাসায় ফিরেছিলেন?’
‘আমি যখন ক্লাব থেকে ফিরে আসি, তখন রাত প্রায় পৌনে একটা।’
‘তখন কোনো লোককে যেতে দেখেছিলেন রাস্তা দিয়ে?’
‘জি না।’
‘তারপর?’
‘রুনার রুমের পাশেই আমার রুম। এতো রাতে তার ঘরে বাতি জ্বলছে দেখতে পেয়ে দরজার সামনে দাঁড়াই। দরজা খোলাই ছিলো। কিন্তু রুনাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। হঠাৎ কার্পেটের দিকে নজর পড়তেই দেখলাম রুনা পড়ে আছে, ঠিক আপনারা যেমনটি দেখছেন তেমনি। সিন্দুকের ডালাটা খোলা। তখন আমার বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না, ব্যাপারটা কি হয়েছে। হতভাগা বাক্সটার জন্যেই রুনাকে খুন করেছে।’
শহীদ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। মি. সিম্পসন শহীদকে বললেন, ‘এবার লাশ মর্গে পাঠিয়ে দিই, কি বলো?’
‘অবশ্যই। আর দেখার কিছু নেই।’
‘তোমার কি মনে হয় শহীদ?’
‘এখনও পুরোপুরি ভেবে দেখিনি। সময়ে আমি আপনাকে জানাবো। আচ্ছা এবার তাহলে চলি। গুড় বাই মি. সিম্পসন।’
‘গুড বাই মাই বয়।’ মি. সিম্পসন হাত নাড়লেন।
শহীদের গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো কামালের গাড়ি বারান্দায়। এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে ডুয়িংরুমের দরজার ভারি পর্দাটা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো শহীদ।
‘কামাল কইরে?’ শহীদ এবার হায়দারী হাঁক ছাড়লো।
কামাল সোফাটায় বসে এক প্যাকেট তাস নিয়ে পেশেন্স খেলছিল। শহীদকে দেখেই হাতের তাস মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উল্লাস ধ্বনি করে উঠলো।
‘কিরে শার্লক হোমস, খবর কি তোর? এই অধম ওয়াটসন বেচারা তো কাপ্লচা আলুর মতো গুদামজাত হয়ে আছে।’
‘খবর সাংঘাতিক রে, সেই খবরই তোকে দিতে এলাম। মিসেস রুনা আহমেদ বলে এক ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন গতকাল রাতে। সেদিন হোটেল থেকে ফিরে যে জড়োয়া বাক্সটার গল্প করেছিলাম, সেই ভদ্রলোক মি. রশীদ। রুনা আহমেদ তার স্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গে জড়োয়া বাক্সটাও আততায়ী নিয়ে গেছে। ঘটনাটা দেখলে মনে হয়, এটা নেবার জন্যেই আততায়ী মিসেস আহমেদকে খুন করেছে।’
‘কিন্তু, শহীদ, একটা কথা পরিষ্কার হচ্ছে না। যদি বাক্সটাই শুধু আততায়ীর লক্ষ্য হতো তাহলে তো সে অন্য কায়দায়ও ওটা নিতে পারতো, সে খুন করবে কেন?’
‘ধীরে, বন্ধু ধীরে! সহজ দৃষ্টিতে হয়তো সেই কথাটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যারা খুনী তাদের একটা সহজাত সংস্কার আছে। তারা সহজ সরল পথটাই বেছে নেয়। সে হয়তো বহুদিন থেকে লক্ষ্য করে আসছে, সিন্দুকের চাবিটা কার কাছে থাকে, কোথায় থাকে। কম্বিনেশনের নম্বরগুলো কতো, রশিদ সাহেব কখন ক্লাব থেকে ফেরেন, খুনীর এ খবরগুলো নখদর্পণে। খুনের যে পাগল সে খুনকে আশ্রয় করেই অপরাধ করে বসে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, খুনী কে? তাকে খুঁজে বের করতে হবে।’
‘তা না হয় হলো, কিন্তু তুই কি সত্যিই বিশ্বাস করিস ওই পার্চমেন্ট পেপারে গুপ্তধনের নক্সা ছিলো?’
‘ছিলো নয়, সেটাই এক অজানা দেশের গুপ্তধনের নক্সা। অফুরন্ত ধনভাণ্ডার পাবার চাবিকাঠি।’
‘কিন্তু শহীদ, ঘরের খবর কিছু রাখিস? মহুয়াদি কক্সবাজার যাবার জন্যে আমায় ভীষণ ভাবে ধরেছে। তুই কি ঠিক করলি। যাওয়া হবে তো আমাদের?’
শহীদ মাথা নাড়লো।
‘এবার আর যাওয়া হচ্ছে কই? অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্যাপারটা যেভাবে আমার হাতে এসে গেল, এর একটা সুরাহা না করে কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। তা না হলে ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যই থেকে যাবে।’
‘থ্রি চিয়ার্স ফর শহীদ খান, হিপ-হিপ-হুঁররে। ওয়াটসন বেচারাও এবার হোমসের সঙ্গে ঝুলে পড়বে। দোস্ত তোর সঙ্গে যে আমি দোজখেও যেতে রাজি। দাঁড়া, এই খুশিতে তোকে আমি টিকিয়া খাইয়ে ছাড়বো।’
ঠিক সেই সময়েই গরম গরম টিকিয়া নিয়ে বুয়া ড্রয়িংরুমে ঢুকলো। শহীদের হাঁকডাক শুনেই কামালের মা টিকিয়া ভাজতে চলে গিয়েছিলেন। কারণ এ খাবার যে তাঁর দুই ছেলেরই খুব প্রিয়।
‘হাত চালা, দোস্ত।’
কামালের আর তর সইছিল না। সে হাত লাগিয়ে দিলো টিকিয়ার প্লেটে। শহীদও বন্ধুর হস্তাঙ্ক অনুসরণ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হলো না। ততক্ষণে মা এসে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে দুই বন্ধুর কীর্তিকলাপগুলো সন্তোষের সাথে লক্ষ্য করছিলেন।
চার
রাত্রি অন্ধকার।
কোনো অশরীরী অশান্ত প্রেতাত্মা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকার রজনীতে। পেচকের অশুভ ডাক যেন প্রহর ঘোষণা করলো।
শফির চোখে ঘুম নেই। নুরবক্সকে সে ঠকিয়েছিল। অমরত্বের অর্ধেকটুকু থিসিস তার কাছে ছিলো। আজেবাজে জিনিস দিয়ে তাকে সে বুঝিয়ে দেয়। তার চালাকি নুরবক্স ধরে ফেলে তাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। কিন্তু কুয়াশা আরও অনেকের সাথে তাকেও রক্ষা করে শয়তান নুরবক্সের হাত থেকে। শয়তানকে আজও খুঁজে বের করা। সম্ভব হয়নি। কিন্তু শফি জানে নুরবক্স আবার ফিরে আসবে বাকি থিসিসটুকুর জন্যে। তার আগেই উদ্ধার করতে হবে চুরি যাওয়া থিসিস। কুয়াশা আসছে। এবার নুরবক্স তার বিশ্বাসঘাতকতা ও স্পর্ধার সমুচিত জবাব পাবে।
এমনি ভাবতে ভাবতে গভীর রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো শফি, নিজেও টের পেলো।
পুবদিকের জানালা দিয়ে যখন কড়া রোদ এসে শফির শরীরে লাগলো, ঘুম ভাঙলো তার। ধড়মড় করে উঠে ঘড়িতে দেখলো নটা বেজে পাঁচ। বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে। সর্বনাশ! এখুনি ছুটতে হবে এয়ার পোর্টে। নেপালের যুবরাজ চন্দ্র আউধ সিং আসছেন, এগারোটা দশের প্লেনে। রিসিভ করতে হয় তাকে।
কোনরকমে শাওয়ার সেরে নি, দামী ট্রপিক্যাল অ্যান্টিক্রিজ স্যুটটা পর নিলো শফি। গাড়ি বের করে ছুটলো এয়ার পোর্টের দিকে। ব্রেকফাস্ট করা আর হয়ে উঠলো।
কাটমুণ্ডু থেকে যাত্রী নিয়ে পি. আই. এর ফকার ফ্রেণ্ড শীপ প্লেন এয়ার পোর্টের উপর দু’বার চক্কর খেয়ে শেষবারে নেমে পড়লো রানওয়েতে। টেক্সিইং পথ বেয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালো।
শফি অধীর আগ্রহে তাকালো প্লেনটার দিকে। স্টারবোর্ড ইঞ্জিনটার শেষ গর্জন তখন থেমে গেছে। আণ্ডার ক্যারেজ এর চাকায় জ্যাম দিয়ে দিলো গ্রাউন্ড মেকানিক। কুলীর ঠেলে নিয়ে সুদৃশ্য গ্যাংওয়েগুলো প্লেনের গায়ে লাগিয়ে দিলো।
দরজাটা খুলে এয়ার হোস্টেস গ্যাংওয়ে বেয়ে নিচে এসে দাঁড়ালো। একে একে যাত্রীরা সব নামতে শুরু করেছে। নিপারের সানগ্লাস চোখে এক সুন্দর যুবক প্রথম শ্রেণীর গ্যাংওয়েতে এসে দাঁড়ালেন। নেপালের যুবরাজ চন্দ্র আউধ সিং। প্রেস ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরাগুলো। ক্লিক্ ক্লিক করে সক্রিয় হয়ে উঠলো।
সব রকমের প্রটোকল ফরমালিটিজ-এর দায় থেকে মুক্ত হবার পর যুবরাজ শফিকে দেখতে পেলেন।
‘হ্যালো, শফি! কেমন আছো তুমি?’
শফি গলার স্বরটা একটু নিচু করে বললো,’ও. কে. ভাইয়া।’
যুবরাজ শফির সাথে করমর্দন করে হাতে মৃদু চাপ দিলো। এরপর ওরা গাড়িতে উঠে বসলো। মিলন অ্যাভিনিউ পার হয়ে গাড়ি এসে ঢুকলো ঢাকার সবচাইতে অভিজাত হোটেল-শাহরিয়ারে। বিচিত্র কায়দা এই বিদেশী হোটেলটার।
কার অ্যাটেন্ট এসে দরজা খুলে ধরলো। ওরা নেমে মেইন এনট্রান্স পেরুবার সময় বিচিত্র বর্ণের জমকালো পোশাকে সজ্জিত ডোরম্যান মুঘলাই কায়দায় কুর্নিশ করে দরজা খুলে দিলো। বেল বয় লাগেজ নিয়ে চলতে আরম্ভ করলো পিছন পিছন।
চাঁদনী বার পার হয়ে পুল টেরাস্। ডাইনে ঢাকার একমাত্র ক্যাবারে ‘রুকসানা হল’। আরেকটু এগোলেই সম্মুখে কাফে লায়লা। হোটেলের এসেম্বলী হল ‘মিতালী’র পাশ কাটিয়ে লিফটে গিয়ে উঠলো ওরা।
সুইট নাম্বার ৯০০-১।ভি, আই. পি. সুইট। ভেতরে বাঁদিকে বেডরুম। একটা কনেটিং ডোর দিয়ে সামনে এগোলেই বিরাট ডুয়িং রুম। ডান ধারে ছোট অথচ আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো ইলেকট্রিক কিচেন।
ড্রয়িং রুমে ঢুকে যুবরাজ দেখলেন একটা রুপার টেতে সাজানো ফুট বাস্কেট। ছোট্ট একটা কার্ড রয়েছে, সাজানো ফলগুলোর মাঝখানে। ওতে লেখা, ‘ওয়েলকাম! উইশ ইউ হ্যাপি স্টে অ্যাট ঢাকা,’ ফুট বাস্কেটটা হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার মি. বার্লোজ-এর আন্তরিক উপহার। একটু হাসলো যুবরাজ। একবার তাকালো রুমটার চারদিকে। সুদৃশ্য বিচিত্র বর্ণের রকমারি পর্দা সরিয়ে দিলো যুবরাজ। বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায় বাইরে। মতিঝিলের সুউচ্চ বাড়িগুলো ছাড়িয়ে আরও দূরে শ্যামল আর সবুজের সমারোহ। দৃষ্টি চলে যায় আরও দূরে, একেবারে নদীর পাড় পর্যন্ত। মুগ্ধ হলো যুবরাজ। বুক ভরে একটা আরামের নিঃশ্বাস টেনে নিলো।
‘চমৎকার! বুঝলে, শফি, আপাততঃ এটাই হবে আমাদের হেডকোয়ার্টার। ডিনার, ডান্স, ভ্রমণ সব নিয়ে জমবে ভালো। মনে রেখো আমি এখন নেপালের যুবরাজ চন্দ্র আউধ সিং।’
শফি হেসে এবার কুয়াশার দিকে এক নজর ভালো করে তাকালো। নাহ! স্বয়ং সিম্পসন সাহেবও এ ছদ্মবেশ ধরতে পারবে না।
শফি সকালে ব্রেকফাস্ট করেনি, এবার ভয়ানক ক্ষুধা অনুভব করলো। কুয়াশা শফির মনের ভাব বুঝে নিলো। তার নিজেরও অত্যন্ত ক্ষুধা লেগেছে।
‘এসো একেবারে লাঞ্চটাই সেরে নেয়া যাক, শফি। কুয়াশা রূম সার্ভিসে টেলিফোন করে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলো। ‘Please Bring Two Shrimp Cocktail, Two Double Consomme (soup), Two Mushroom Omlette, Two Veal Oscar with Maionaise Sauce, Two Apple Tart Two Coffee.’
অর্ডারের এহেন বিরাট বহর দেখে শফি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। ঠিক দশ মিনিটেই খাবার এসে হাজির হলো।
‘এ যে, ভাইয়া, একেবারে দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। এতো খাবার খাবে কে?’
কুয়াশা এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলে, ‘জানো শফি! একটা কথা আছে, “এনজয় দ্য মীল অ্যান্ড এলিভেট দ্য মাইন্ড” যে পরিমাণ ক্ষুধা লেগেছে, ও খাবার তো একেবারে নস্যি।’
এবার উভয়েই এক সঙ্গে হেসে উঠলো।
রুকসানা হল।
দেবরাজ ইন্দ্রের-প্রমোদপুরীও বোধহয় এমন অপরূপ বেশে সাজতে পারে না। ক্যাবারে চলছে। সুন্দরী, ইরানী নর্তকী হোমায়রার নাচে মোহনীয় ছন্দ। হলের মাঝখানে বেশ খানিকটা কাঠের ফ্লোর। মেহগিনি কাঠের উপর মোম পালিশ দিয়ে গ্রেজ করা। লাইটের আলো পড়ে চক্ চক্ করছে। চারদিক ঘিরে ছোট ছোট টেবিল পাতা। গদি আঁটা কুন চেয়ার পাতা তার চারদিকে। প্রত্যেক টেবিলের উপর একটি করে ক্যাণ্ডে লামা অর্থাৎ মোমবাতিদান। তাতে মোমবাতি জ্বলছে। এর উপরে বাস এর জাফরী কাটা আচ্ছাদন। মোমবাতির আলো সেই জাফরীর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে মায়াময় আলো আধারি পরিবেশ সৃষ্টি করছে। ইরানী সুন্দরী নর্তকী হোমায়রার প্রতি পদক্ষেপে রম্বা শম্বার ছন্দ।
মাঝখানের দুটো টেবিলে দেশী-বিদেশী পার্টির মধ্যমণি হয়ে মি. সিম্পসনকে বসে থাকতে দেখে মৃদুহাস্যে কুয়াশার সারা মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। সিম্পসন শ্যাম্পেনের বারো ইঞ্চি লম্বা নলের মতো গ্লাস হাতে নিয়ে, একেবারে রাঙা হয়ে উঠেছেন। তাঁর চোখে তখন রঙিন স্বপ্ন।
নাহ্! তার ছদ্মবেশ ধরা পড়েনি। এবার নিশ্চিন্ত হলো কুয়াশা।
হোটেল কামরায় তার বর্তমান হেডকোয়ার্টার্সে একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে কুয়াশা উত্তেজনায় হঠাৎ একটা ঘুরপাক খেলো। চুরুটের ছাইটা সবেগে ঝাড়লো সামনের কনসিল্ড অ্যাশট্রেটায়, খানিকটা ছাই ছিটকে পড়ে অনেকদূর ছড়িয়ে পড়লো। তারপর অস্থির পদচারণায় জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
শফি চিন্তাক্লিষ্ট ভাবে অদূরে বসেছিল। কুয়াশা ঘুরে দাঁড়ালো। যখন রেগে যায় কুয়াশা, এমনি ভঙ্গিতে দাঁড়ায় সে। দাঁতে দাঁত চেপে আত্মগত ভাবে বললো, ‘নুরবক্স! এবার তোমার রেহাই নেই। তুমি আমার সাধনার ধন ছিনিয়ে নিয়েছে। তোমার একমাত্র দণ্ড –মৃত্যু। সেই মৃত্যুই আমি তোমাকে দেবো, চরম ভাবে। যে কেউ দেখবে, শিউরে উঠবে সে কথা স্মরণ করে।’
ক্ষুধার্ত শাদুলের মতো কয়েকবার পদচারণা করলো কুয়াশা। শফির কাছে এসে দাঁড়ালো। একটা হাত রাখলো তার কাঁধের উপর। ‘শোনো, শফি! নুরবক্সের খবর আমি পেয়েছি। আজ সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় তুমি রমনা গ্রীনের যে ধারটায় রমনা রেস্টুরেন্ট, তার বাঁ দিকের গেট দিয়ে ঢুকে আস্তে আস্তে লেকের দিকে চলে যাবে। ডান দিকের প্রথম বেঞ্চটায় যে লোকটা বসে থাকবে, তাকে তুমি ফলো করবে দূর থেকে। মূহুর্তের জন্যও তে চোখের আড়াল না হয়। সে যেখানে যাবে, তুমিও তার পিছু নেবে। এরপর তুমি নিজেই বুঝতে পারবে কি করতে হবে। আমার জন্যে ভেবো না। সবকিছুর উপরেই আমি নজর রাখবো।’
শফি কোনো কথা না বলে এবার নীরবে হোটেল ত্যাগ করলো। কুয়াশার চোখে মুখে চূড়ান্ত সঙ্কল্পের ছাপ। একটা বিজাতীয় হাসি তার মুখে ঢেউ খেলে গেল। ডিকেন্টারে রাখা হোয়াইট হর্স-এর বোতল থেকে খানিকটা’র হুইস্কি টেলে নিয়ে কয়েকটা লম্বা চুমুক দিলো কুয়াশা।
ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো কুয়াশা। সরোদখানা পেড়ে নিয়ে রাগ ভৈরো বাজাতে শুরু করলো সে। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়লো অপূর্ব সুরের মূৰ্ছনা।
পাঁচ
নারায়ণগঞ্জের যে সীমান্তে নিষিদ্ধ পল্লী, সেই গলির মুখে একটা বিরাট বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে বিগত যৌবনা এক দেহপশারিণী ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে পানবিড়ির দোকান ফেঁদে বসেছে। বৃদ্ধ বয়সেও পলিত কেশে পাতা কেটে, দোক্তা খাওয়া মিশকালো দাঁত বের করে হেসে পান বিক্রির আসর জমিয়ে রেখেছে। এক শ্রেণীর লোক সব সময় সেখানে ভিড় জমিয়ে রাখে। পান খায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢিমে, তেতলায়।
অনেক সুযোগ সন্ধানী, অনেক বারোয়ারী খবরের হদিস এই মুক্তকেশী পানওয়ালীর কাছে থাকে। অপরাধ জগতের বিস্তর খবর তার নখদর্পণে। এসব খবর চালাচালি করে বিস্তর পয়সাও কামায় সে।
তবে বিশ্বাসঘাতকতা করে না মুক্তকেশী। বোমা মারলেও তার পেটের সিন্দুক থেকে বেফাজিল একটা কথাও আরেকজনের কানে ঢুকবে না।
এজন্যেই মুক্তকেশীর উপর অনেকের আস্থা রয়েছে। সেজন্যে এক শ্রেণীর লোক আসে তার কাছে হরহামেশাই। বিভিন্ন জেলার দাগি, খুনী আসামী, ফেরারী লোক, যাদের গোপন আশ্রয়ের দরকার, তারা মুক্তকেশীর গোপন আড্ডায় লুকিয়ে থাকতে পারে। পুলিসের সাধ্য নেই যে ওদের খুঁজে বের করতে পারে।
সবাই মুক্তকেশীকে তোয়াজ করে সেজন্যে।
সন্ধ্যার পল্লী।
বেলারানীর ঘর থেকে কুৎসিত দর্শন একটা লোক দরজার উপর দাঁড়ালো। বেলা ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘আজকে এতো সকাল সকাল চললি?’
লোকটা একটা জঘন্য হাসি হেসে বললো, ‘তুই ঘুম যা, বেলা, আমার আসতে একটু দেরি হবেক বটে।’
বেলারানী আর কিছু বললো না। লোকটা রোয়াক ছেড়ে রাস্তায় এসে পড়লো। খানিক পরেই মুক্তকেশীর পানের দোকান থেকে একটা পানকিনলো।
মুক্তকেশী চারদিক দেখে নিয়ে গলাটা খাটো করে বললো, ‘রামু! নুরবক্সকে হুশিয়ার থাকতে বলিস। কুয়াশা আর পুলিস দু’জনাই তার পেছনে লেগেছে। রকম সকম আমার ভালো লাগছে না।’
রামু মুক্তকেশীর আরও কাছে সরে এলো। ‘তুই কিছু চিন্তা করিস না, মুক্তা। কর্তার কাজ প্রায় শেষ। এবার বাসা ভাঙা হবে।’ মুক্তকেশী মিশি দেয়া কালো দাঁত বের করে হাসে।
‘ওস্তাদকে বলবি আমায় মোটা বকশিশ দিতে, না হয় ভালো হবে না- তা বাপু আগে থেকেই বলে দিচ্ছি।’
‘সে আমি বলব’খন কর্তাকে। তুর চিন্তা নাই।’
রামু আর একনজর চারদিকে দেখে সোজা এগিয়ে গেল, গুলিস্তানের বাসটা যেখানে এসে দাঁড়ায়, সেখানে।
সাতটা বেজে পনেরো মিনিট। রামু রমনা লেকের ধারে বসে আছে একটা বেঞ্চে কর্তার অপেক্ষায়। নুরবক্স আসবে ঠিক সাড়ে সাতটায়। নিয়ে যাবে রামুকে তার গোপন আড্ডায়।
শফির টয়োটা করোনা রমনা গ্রীনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণটায় এসে থামলো। গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে লেকের পাশে রমনা রেষ্টুরেন্টে বৈকালিক চায়ের অর্ডার দিয়ে শফি লক্ষ্য করলো লেকের পাড়ের নির্দিষ্ট বেঞ্চটার দিকে।
হঠাৎ দেখতে পেলো রামুকে। রামু কুয়াশার অতীত দিনের একজন সহচর। তাকে চিনতে শফির একটুও ভুল হলো না। উত্তেজনায় শফি অধীর হয়ে একটু নড়েচড়ে বসলো। নাটকীয় একটা কিছু ঘটবার অপেক্ষায় সে উদগ্রীব হয়ে রইলো। | ঠিক সাতটা বেজে তিরিশ মিনিট। একটা দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো বেঞ্চটার দিকে। নুরবক্সের ছদ্মবেশ থাকা সত্ত্বেও শফি তাকে চিনতে পারলো।
শফি চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে, দ্রুতপদে বেরিয়ে এলো ব্রেস্টুরেন্ট থেকে। কাছা কাছি একটা গাছের ছায়ায় আড়াল হয়ে দাঁড়ালো, যেন ওদের কথোপকথন শুনতে পাওয়া যায়। উত্তেজনায় তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠলো।
নুরবক্সকে দেখে রামু উঠে দাঁড়ালো। ‘শোন, রামু!’ নুরবক্সের কণ্ঠে যেন এক বিজাতীয় উল্লাস।
‘আমাদের কাজ এখানে প্রায় শেষ। কিন্তু কুয়াশাকে যদি শেষ করে দেয়া যেতো তাহলে নিশ্চিন্ত হয়ে গুপ্তধনের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে পারতাম। যেখানে গুপ্তধনের খোঁজে আমাদের যেতে হবে, সে বড় দুর্গম পথ। তিব্বত মালভূমির অপর প্রান্তে লাসা। সেখান থেকে অনেক পশ্চিমে খামজং লেকের ধারে বার্তক। সেখানে যেতে হবে আমাদের।’
‘কিন্তুক, কর্তা, এতবড় বিপদের ঝুঁকি না নিলে হতেক।’
ধ্বক করে জ্বলে ওঠে নুরবক্সের চোখ দুটো।
‘সাবধান, রামু! খবরদার! এমন নেমকহারামী কথা আর বলবি না, বললে জিব টেনে ছিঁড়ে দেবো। নুরবক্স ভয় কাকে বলে জানে না। সে গুপ্তধন আমার চাই-ই। সাত রাজার ধন ছেড়ে দেবো, এমন মূর্খ তুই আমায় ভেবেছিস?’
রামু ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বললো, ‘আমি তা বলি নাইক, কর্তা। যাবেক যদি, রামু আপনার সাথেই থাকবে। আপনি যেমনটি বলবে, আমি তেমনটি করবেক।’
‘হ্যা! তাই যেন হয়, রামু। নেমকহারাম আর নিষ্কর্মা লোককে আমি চরম শাস্তি দিয়ে থাকি।’
‘জো হুকুম, কর্তা।’
এর পরের কথাবার্তাগুলো এতো নিচু গলায় হলো যে শফি বুঝতে পারলো না।
ধীরে ধীরে ওরা রেসকোর্সের দিকে এগুতে লাগলো। শফি ওদের ফলো করলো। রেসকোর্সের ফেন্সিং এর ধারে একখানা Contessa-de-luxe গাড়ি রাখা ছিলো। নুরবক্স রামুকে নিয়ে সেটায় চড়ে বসলো। গাড়ি চললো ময়মনসিংহ রোডের দিকে। শফিও তার টমোটা করোনাতে গিয়ে বসে স্টার্ট দিলো। গাড়ি ওদের পিছন পিছন ছুটলো। কিন্তু ওরা কেউ লক্ষ্য করলো না, তৃতীয় আরেকখানা গাড়ি ছুটে চলেছে ওদের পিছু পিছু বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে।
টঙ্গি ব্রীজ পার হয়ে হনুফানগর। সেটাকে বাঁয়ে রেখে সোনাভানের গড়। গড়খাইয়ের উপর থেকে চলে গেছে একটা জঙ্গল অনেকদূর পর্যন্ত। কিছুদূর গিয়ে নুরবক্সের গাড়িটা সাঁ করে ডাইনে ঘুরে জংলা পথে ঢুকে গেল।
শফি বুঝলো, পথের এবার শেষ হয়েছে। সে গাড়ি পার্ক করলো বড় রাস্তার বাঁ। ধারে, বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে। গাড়িটা লক করে চলতে লাগলো সেই পথে, যে পথে নুরবক্সের গাড়িটা ঢুকেছিল।
গাঢ় অন্ধকার রাত; শফির গা ছমছম করছে। সম্মুখে ভয়ানক শত্রু, অথচ সে একা। পকেটে হাত দিয়ে একবার অনুভব করে নিলো পিস্তলটা। তারপর আবার চলতে লাগলো।
খানিকদূর গিয়ে দেখতে পেলো নুরবক্সের গাড়িটা, দাঁড়ানো। কিন্তু ধারে কাছে কাউকে দেখতে পেলো না।
নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সে গাড়িটার পাশ কাটিয়ে খানিকদূর এগিয়ে গেল। সম্মুখে পথ বন্ধ। যাওয়ার রাস্তা হঠাৎ এখানে এসেই শেষ হয়ে গেছে। সে ঘুরে দাঁড়ালো। এক মুহূর্ত চিন্তা করলো, এবার কোন দিকে যাওয়া যায়। ডান দিকে যাবার জন্যে পা বাড়ালো শফি।
‘হ্যাণ্ডস্ আপ, শফি!’
নুরবক্সের কঠিন গলায় চমকে উঠে শফি উপরে হাত তুললো, কিন্তু অন্ধকারে তাকে দেখতে পেলো না।
‘বাঘের গুহায় পা দিয়েছিস, শয়তান, এবার তোর আর নিস্তার নেই। কুকুরের মতো গুলি করে মারবো তোকে।’
নুরবক্সের গলায় প্রচণ্ড উল্লাস! এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে শফির সামনে দাঁড়ালো সে।
‘বড় আশা ছিলো, যে জাল পেতেছিলাম, তাতে কুয়াশা ধরা পড়বে। কিন্তু তোর মতো ছারপোকা মেরে হাত গন্ধ করতে হবে ভেবে ভয়ানক আপসোস হচ্ছে। একবার আমার হাত থেকে বেঁচে গেছিস, কিন্তু এবার সুদে আসলে তার মাশুল গুণে দিতে হবে।’
শফি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল; এবার দপ করে বারুদের মতো জ্বলে উঠলো। দেখলো নুরবক্সের হাতে ধরা পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের পিস্তলটা তার দু’চোখের মাঝখানে ধরা। কিন্তু সে বিন্দুমাত্র সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলো না।
‘তুই আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস, কিন্তু তোর সাধ্য নেই যে আমার কেশাগ্র স্পর্শ করিস।’
‘এতদূর স্পর্ধা!’
সক্রোধে ভীষণভাবে সে শফিকে দু’গালে কয়েকটা চপেটাঘাত করলো। তাতে টাল সামলাতে না পেরে শফি মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নুরবক্সের দু’পা জড়িয়ে এমন কৌশলে এক প্যাঁচ কষলো যে, নুরবক্স লাটুর মতো ঘুরে, শফির পাশেই ধপাস করে পড়ে গেল। হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে পড়লো দূরে।
নুরবক্সের শরীরে মত্ত হাতীর বল। শফির ব্যায়াম করা পুষ্ট শরীরটাকে সে নিজের আয়ত্তে আনতে চেষ্টা করলো। কিন্তু শফি বাম মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
ততক্ষণে নুরবক্সও উঠে দাঁড়িয়েছে। উভয়ের চোখে হত্যার নেশা। নুরবক্স আর্তনাদ করে বসে পড়লো। তার বাঁ হাতটা মুচড়ে গেছে শফির জুজুৎসুর এক প্যাঁচে। এবার শফি লাপিয়ে পড়লো নুরবক্সের উপর। নুরবক্সের ডান হাতটা পিঠের নিচে পড়ে গিয়েছিল। শফি ওর বুকের উপর হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে সাঁড়াশির মতো গলা চেপে, ধরলো। নুরবক্স প্রাণপণ চেষ্টা করে তার ডান হাতটা ধীরে ধীরে বের করে কোমরের কাছে নিয়ে লুকানো ছোরাটা বের করে ফেললো। কিন্তু শফি বুটসুদ্ধ বাঁ পা দিয়ে ছোরাসহ ডান হাতের কব্দিটা মাড়িয়ে ধরলো। নুরবক্সের তখন শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
এমন সময় শফির মনে হলো ভারি একটা কিছু পিছন দিক থেকে সজোরে আঘাত করলো তার মাথায়। জ্ঞান হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। | নুরবক্স বসে বসে তখনও হাঁপাচ্ছে। রামুকে হুকুম দিল, ‘কুত্তাটাকে টেনে নিচে নিয়ে যা। পরে যা হয় করা যাবে।’
রামু দু’হাত দিয়ে একটা বিরাট পাথর খানিকটা সরিয়ে দিলো। একটা সুড়ঙ্গ পথ নিচের দিকে নেমে গেছে। টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চললো শফিকে সেই পথে।
মাটির নিচে গুহার মতো ঘর। ঘরটি বেশ বড়, অনেকটা হল ঘরের মতো। সেখান থেকে দু’দিকে দুটো পথ চলে গেছে, উপরের দিকে।
ঘরের এককোণে খানিকটা জায়গা চৌকো করে কাটা। সেখানে একটা বিরাট আগুনের কুণ্ড জ্বালা হয়েছে। রামু ঘরের এককোণে রাখা কতগুলো অস্ত্রের মাঝখান থেকে দুটো মোটা শিক বের করে আনলো। শিকগুলোর একটা দিক খুব সূচালো। ওই ধারটা রামু আগুনের মধ্যে ঢুকিয়ে শিকগুলো গরম করতে লাগলো। শিক দুটো আগুনে ঝলসে লাল হয়ে উঠেছে।
‘হতচ্ছাড়াটার চোখ দুটো আগে গেলে দিবি রামু ওই শিক দুটো দিয়ে। তারপর গলাটা ফুড়ে শিক দুটো চালিয়ে দিবি-একেবারে কলিজায়। বাছাধনের কলিজা চিরদিনের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’
নুরবক্স সক্রোধে বন্ধনরত শফির পাঁজরে এক লাথি মারলো। শফি ককিয়ে উঠলো।
রামু লোহার শিক দুটো পরীক্ষা করে নিলো। উজ্জ্বল লাল, উত্তপ্ত লোহার শিক দু’টো থেকে সূর্য কিরণের মতো আভা বেরুচ্ছে। ভয়ানক উত্তপ্ত। দু’টো কাপড় দিয়ে রামু শিক দু’টোর অন্য ধার ধরেছে। নুরবক্স দুহাত দিয়ে শফির মাথাটা তার হাঁটুর সঙ্গে চেপে ধরলো, যাতে শফি নড়াচড়া করতে না পারে। ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। রামু ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো উত্তপ্ত শিক দুটো নিয়ে। শফি চোখ বুজলো। এবার আর রেহাই নেই।
হঠাৎ রামু দু’হাত তুলে গগন বিদারী আর্তনাদ করে উঠলো। গরম শিক দু’টো ছিটকে পড়লো হাত থেকে। বুলেটটা ঠিক তার দুচোখের মাঝ দিয়ে চলে গেছে। তার দেহটা দুলে উঠলো। তারপর পিছনের অগ্নিকুণ্ড টার মধ্যে পড়ে গেল রামু। কাঁচা চামড়া পোড়ার গন্ধ মুহূর্তের মধ্যে চারদিক ছেয়ে গেল।
হতভম্ব নুরবক্স চকিতে শফিকে ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। কুয়াশার কোর্ট অটোমেটিকটা তার দিকে চেয়ে আছে। হাত দুটো তার এমনিতেই উপরে উঠে গেল।
এতক্ষণ কুয়াশা একটি কথাও বলেনি। এবার গর্জন করে উঠলো।
‘নেমকহারাম, কুকুর। যে বিশ্বাসঘাতকতা তুই করেছিস, তোকে হত্যা করে কুকুরের পেটে দিলেও তার প্রায়শ্চিত্ত হবে না। আমার থিসিস কোথায় রেখেছিস বল।’
‘সে তুমি খুঁজেও পাবে না। আমার জান নিয়ে নাও তুমি, তবুও আমি ওটা তোমায় দেবো না।’
‘তুই মনে করেছিস সেটা কোথায় রেখেছিস তা আমার অজানা?”
নুরবক্স কিছু বুঝার আগেই, চকিতে ওর বাঁ চোখটা এক ঝটকায় খুলে নিলো কুয়াশা। কাঁচের চোখ। বাঁ চোখের লাল গর্তটা ভয়ানক দেখা যেতে লাগলো। নুরবক্স একচোখে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলো।
ওই আগুনের কুণ্ড টার পাশে গিয়ে দাঁড়া শয়তান, যেখানে তোর কুকর্মের সহচর . রামুর মৃতদেহটা অঙ্গার হচ্ছে।
নুরবক্স একবার কুয়াশার হাতের কোল্ট অটোমেটিকটা, আরেকবার তার কঠিন মুখখানি দেখে সুবোধ বালকের মতো আগুনের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। তাপে মনে হলো তার শরীরটা ঝলসে যাচ্ছে।
‘নুরবক্স! এবার ভোের রক্ষা নেই। তোকেও তোর সঙ্গীর কাছে পাঠিয়ে দেবো।’
‘সে চেষ্টা আর করো না, কুয়াশা, ওরফে যুবরাজ চন্দ্র আউধ সিং। পিছনে মি. সিম্পসনের গলা শুনে কুয়াশা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। কোল্টের অব্যর্থ লক্ষ্যটা তখনও নুরবক্সের দিকে তাক করা।
কিন্তু কি যেন চিন্তা করে কুয়াশার সারা মুখ মৃদু হাস্যে ভরে গেল। ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো, কয়েকজন সেন্টি, তাদের ঘিরে রেখেছে। রাইফেলগুলো সব এদিকে তাক করা।
‘তারপর, কুয়াশা? এবার আশা করি তোমার খেলা সাঙ্গ হলো। নুরবক্স চেয়েছিল তোমাকে জালে ফেলে এখানে টেনে আনতে। শুধু এটুকু তোমার জানা ছিলো না, সব খবর আমরাও জানতাম। তুমি শফিকে কাজে লাগালে। আমরাও চোখ কান খোলা রেখেছিলাম। শফির উপর নজর আমাদের বরাবরই ছিলো। কিন্তু সত্যিই তোমায় ধন্যবাদ জানাতে হয়, কুয়াশা। তোমার এমন নিখুঁত ছদ্মবেশ প্রথমে ধরতেই পারিনি।’
এবার কুয়াশা মি. সিম্পসনের কাছে এগিয়ে এলো। তাঁর হাতে নিজের কোল্ট অটোমেটিকটা তুলে দিলো। হাসিমুখে বললো, ‘আমি আত্মসমর্পণ করছি, মি. সিম্পসন। আমি নিজে ধরা না দিলে, কিছুতেই আপনি আমাকে ধরতে পারতেন না। কিন্তু শয়তান নুরবক্স শফির যে অবস্থা করেছে, তাতে তাকে ফেলে আমি যেতে পারি না।’
‘ব্রাভো, কুয়াশা! তোমার মহত্ত্বের জন্য তারিফ না করে পারা যায় না। তুমি শফির হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দাও। নুরবক্স, তোমাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম অনেকদিন ধরে। এখন দয়া করে এদিকে এসে দাঁড়াও। আমরা যে প্রমাণ সংগ্রহ করেছি, তাতে তোমাকে রুনা আহমেদের হত্যার অপরাধে গ্রেপ্তার করলাম।’
কুয়াশা শফির হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতে আরম্ভ করলো। হঠাৎ সবার অলক্ষ্যে হাতের শিতের ভিতর থেকে একটা গোলাকার বস্তু বের করে আনলো। তারপর চুড়ে মারলো মি. সিম্পসনের দিকে। শফিকে বললো, ‘দম বন্ধ করে রাখো শফি।’
মি. সিম্পসন লাফ দিয়ে একদিকে সরে গেলেন, কিন্তু তার আগেই স্মোক বোম্বটা সশব্দে ফেটে গিয়ে একরাশ ধূম্রজালের সৃষ্টি করলো। সমস্ত ঘর অন্ধকার হয়ে গেল এক মুহূর্তেই। রাইফেল চালাবার কোন সুযোগই পেলো না সেন্টিরা।
এই গোলমালের মধ্যে কুয়াশা আর নুরবক্সকে খুঁজে পেলো না। নুরবক্স তাহলে পালিয়েছে। কুয়াশা শফিকে তুলে নিঃশব্দে ওখান থেকে বের হয়ে গেল।
আধঘন্টা পরে মি. সিম্পসনের যখন জ্ঞান ফিরে এলো তিনি দেখলেন সেন্টিরা তখন উঠে বসার চেষ্টা করছে। কুয়াশা, নুরবক্স বা শফি কেউ নেই। শুধু রামুর দেহটা পুড়ে ততক্ষণে অঙ্গার হয়ে গেছে। বিশ্রী একটা চিমশে গন্ধ সারা ঘর ছেয়ে রয়েছে।
ছয়
মি. সিম্পসন আই. বি. হেড কোয়ার্টার্সে বসে আছেন। পরাজয় মেনে নিতে নিতে তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন। কুয়াশার সাথে বুদ্ধির খেলায় কখনও এঁটে উঠতে পারলেন না তিনি। বার বার হাতের মুঠোর মধ্যে এসেও ফসকে বেরিয়ে গেল।
শহীদ খান মিসেস আহমেদের হত্যার ব্যাপারে খুনী কে বের করার জন্যে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। সে যে লাইনে তদন্ত করেছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে মিসেস আহমেদের হত্যাকারী নুরবক্স। গুপ্তধনের নক্সাটা বের করার জন্যে সে মিসেস আহমেদকে খুন করেছিল। সমস্ত প্রমাণ শহীদ খান সংগ্রহ করে তার হাতে তুলে দিয়েছিল। তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও শুধু নিজের হঠকারিতায় সে ফসকে পালিয়ে গেল। তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলেন কই? উপরওয়ালার কাছে তাঁর এ ব্যর্থতার কি কৈফিয়ৎ দেবেন তিনি?
এমন সময় শহীদ খান তাঁর ঘরে ঢুকলো। ‘হ্যালো, শহীদ! কেমন আছো?’
মি. সিম্পসন তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন শহীদ খানের দিকে। এমনিতেই কারো সাথে আলাপ করবার জন্যে তিনি মুখিয়ে ছিলেন। শহীদকে কাছে পেয়ে তাঁর মন অনেকটা প্রফুল্ল হলো।
শহীদ খানের হাতে ছোট্ট একটা চিঠি। মি. সিম্পসনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে চিঠিটা হাত বাড়িয়ে তাঁকে দিলো।
সিম্পসন চিঠিটা নিলেন। কুয়াশার চিঠি‚ শহীদ খানকে লেখা। সিম্পসন পড়তে আরম্ভ করলেন চিঠিটা।
প্রিয় শহীদ,
মি. সিম্পসনের হাতে আমি নুরবক্সকে তুলে দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে ধরতে গিয়ে নুরবক্সকেও হারালেন। তাকে আমিও ধরতে পারিনি। আমার মোক বোষ এর ধোঁয়ার সুযোগে সে-ও পালিয়ে গেছে। কিন্তু যে গুপ্তধনের নক্সাটা ওর কাছে ছিলো। সেটা আমি পেয়েছি। আমি আগেই জানতাম, তার বাঁ চোখটা ছিলো কাঁচের। সুতরাং সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু সে সেখানে Micro-Film করে রেখে দিতে পারে। সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে ওর চোখটা খুলে নেই আমি। কিন্তু থিসিটা ছিলো না সেখানে। ছিলো গুপ্তধনের নক্সা।
নুরবক্সের কাছে হয়তো আরও কোন কপি আছে, সুতরাং তার আগেই কোটি কোটি টাকার গুপ্তধন উদ্ধার করতে হবে আমাকে।
চললাম। হয়তো নুরবক্সের সাথে, আবার দেখা হবে। সে সময় পর্যন্ত হতভাগার জন্য কঠিন শাস্তি তোলা রইলো।
যদি নুরবক্সকে ধরার মতলব থাকে, তবে সিম্পসনকে নিয়ে সোজা চলে এসো বার্তক, তিব্বতের মালভূমিতে। কিন্তু সাবধান!
ইতি —
কুয়াশা।
মি. সিম্পসন চিঠিটা ভাঁজ করে শহীদ খানের হাতে ফিরিয়ে দিলেন। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে।
‘A great personality-কুয়াশা। কিন্তু Dr.Jackyl আর Mr. Hyde-এর দ্বৈত মানসিকতায় জর্জরিত। নইলে এতো বড় বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞা যার, তার পিছনে আমাদের পুলিসি অভিযান চালাতে হয়?’
শহীদ খান অপেক্ষা করে পরবর্তী ভাবধারার। মি. সিম্পসন বলতে লাগলেন, ‘মিসেস আহমেদের হত্যাকারীকে পেয়েও আমি ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তাকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। সেজন্য তিব্বত তো ঘরের কাছে দক্ষিণ মেরুতেও অভিযান চালাতে রাজি।’
কথাটা বলে সিম্পসন একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার মতোই। শহীদ একথার কোনো উত্তর দিলো না। এতক্ষণ সে নির্বাক দর্শকের মতোই মি. সিম্পসনের একতরফা বক্তব্য শুনে যাচ্ছিলো। তিনি আবার আরম্ভ করলেন। ‘সেদিন তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাইনি ইচ্ছে করেই। ভেবেছিলাম কুয়াশার ব্যাপারে তুমি নিষ্ক্রিয় থাকবে। আর তাছাড়া দু’জনকে এক সঙ্গে গ্রেপ্তার করবার লোভটাও সামলাতে পারিনি।’
শহীদ এবার মুখ খুললো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা, মি. সিম্পসন-গুড বাই। নুরবক্স আমার চোখের আড়াল হতে পারবে না। খবর পেলে আপনাকে জানাবো।’
‘গুড বাই।’
মি. সিম্পসন আন্তরিক ভাবে করমর্দন করলেন শহীদ খানের সঙ্গে। যে ভাবের বিনিময় হলো তাদের, উভয়েই নীরবে সেটুকু বুঝে নিলো।
শহীদ খান যখন তার ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলো, অনেক বিস্ময় তার জন্যে অপেক্ষা করছিল।
দেয়ালে টাঙানো সেই সরোদখানা পেড়ে নিয়ে কুয়াশা মারওয়া ঠোটে সোহিনী রাগের আলাপ করছিল একমনে। সুরের মায়াজাল অপূর্ব সুর লহরী তুলে যেন চারদিকের পারিপার্শ্বিকতার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
আর মহুয়া কুয়াশার পায়ের কাছে কার্পেটে বসে তন্ময় হয়ে সে মায়াজালে ধরা পড়ে হরিণ শিশুটির মতো বিস্ফারিত নেত্রে মুগ্ধ হচ্ছিলো। গাল বেয়ে মহুয়ার দু’ফোঁটা চোখের জল যে রেখা সৃষ্টি করলো তাতে মনের ফাটল মিশে গিয়ে ভাই-বোনের মাঝে অলক্ষ্যে মায়ার এক অপূর্ব সেতু রচনা হলো।
শহীদ খান চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ওদের ধ্যান আর ভাঙালো না। তৃপ্ত হলো মনে মনে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
সুরের মূৰ্ছন শেষ হয়ে গেল। কুয়াশা পাথুরের মূর্তির মতো বসে আছে। মহুয়ার আবেগ এতটুকুও কমেনি। গলার কাছে কি যেন একটা ওঠানামা করছিল।
‘ভাইয়া!’
হঠাৎ একটা আর্তনাদ করে মহুয়া জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো কুয়াশার পদতলে। ঝড়ের বেগে শহীদ খান ঘরে ঢুকে মহুয়ার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলো। নাড়ি ধরে দেখলো, পালস বিট অনেকটা কমে গেছে।
‘Don’t be nervous. my friend? তোমার ঘরে Atropine-dia hydro-sulphate বলে কোনো মেডিসিন আছে নাকি?’
‘হয়তো থাকতে পারে। ওই রুমে। ড্রেসিং টেবিলটার নিচের তাকে। সব রকম মেডিসিন আছে ওখানে। খোঁজ করে দেখো।’
কুয়াশা তড়িৎ গতিতে উঠে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। এক মিনিট পরেই নির্দিষ্ট অ্যামপিউল নিয়ে এলো কুয়াশা। অ্যামপিউলটার মাথা ভেঙে, দুফোঁটা তরল পদার্থ মহুয়ার মুখের ভিতর ঢেলে দিলো। তারপর আবার ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে বসলো।
‘চিন্তা করো না শহীদ, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওর জ্ঞান ফিরে আসবে।’
মিনিট পাঁচেক পর জ্ঞান ফিরলো মহুয়ার। শহীদ এক মনে তাকিয়ে ছিলো তার মুখের দিকে। এবার চোখ মেলে চাইলো মহুয়া। মুখে একটা পরিতৃপ্তির ছাপ।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো শহীদ খান। মহুয়াকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
ড্রয়িংরুমে শহীদ কিছুক্ষণ পর আবার যখন ঢুকলো, কুয়াশা তখন তন্ময় হয়ে বসে আছে। দীর্ঘ চেহারা, প্রশস্ত ললাট আর উন্নত নাশায় এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ। ভাস্বর এক জ্যোতি ফুটে বেরুচ্ছে তার দিব্যকান্তি থেকে।
শহীদ ওর কাছের সোফাটায় এসে বসলো। এবার ধ্যান ভাঙলো কুয়াশার। ‘খুব অবাক হয়ে গেছে শহীদ, তাই না? অনেক মানসিক আঘাত দিয়েছি তোমাকে। এবার তার পুরস্কারও কিছুটা দিতে চাই। যাবে তুমি আমার সাথে গুপ্তধন আবিষ্কারে? তাহলে নুরবক্সকে তুলে দেবো তোমার হাতে। মি. সিম্পসনও খুশি হবেন। অন্ততঃ ভাববেন, কুয়াশা অকৃতজ্ঞ নয়।’
এক মুহূর্ত নীরব থেকে ডিটেকটিভ শহীদ খান বললো, ‘তোমার সাথে না গেলেও সেখানে আমায় যেতে হবে। কারণ মুরবক্সের এমন ক্ষমতা হয়নি, শহীদ খানের-চোখে ধুলো দিয়ে আড়াল হতে পারবে। ওকে আমি ধরবই।’
কুয়াশা উঠে দাঁড়ালো।
‘Good luck to you. Shahid. so long…’ একলাফে কুয়াশা ঘরের বাইরে গিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।
শহীদ বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। গেটের বাইরে একটা গাড়ির গর্জন উঠে ক্রমে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিলো। পিছনে টেইল লাইট দু’টো ছোটো হয়ে এসে এক সময়ে তা শেষ বিন্দুতে মিলিয়ে গেল।
হঠাৎ কার মৃদু করস্পর্শে শহীদ পিছন ফিরে তাকালো। মহুয়া এসে কখন তার পাশে দাঁড়িয়েছে সে টের পায়নি। ‘চলো, ঘরে চলো।’
শহীদ মহুয়ার একখানা হাত ধরে ভারি কার্টেনটা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।
কয়েকদিন পর।
শহীদের ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেনটা এসে মি. সিম্পসনের অফিস গেটে ঢুকলো।
অফিস রুমে বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে বসেছিলেন মি. সিম্পসন। শহীদ রুমে ঢুকতেই তিনি উঠে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
‘তোমাকে টেলিফোন করেছিলাম, শহীদ। আমরা দু’চার দিনের মধ্যেই রওনা হচ্ছি। সেই মর্মে চীন সরকারকে এক টেলিগ্রামে আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করানো হয়েছে। Are you ready, shahid?’
‘Yes, Mr. Simpson.’
‘সাথে কামালকে নিচ্ছো তো?’
‘কামাল এবার আমাদের সঙ্গে যেতে পারছে না। ওকে একটা ছোট্ট অপারেশন করাতে হচ্ছে। ওর জন্যে সত্যি আপসোস হচ্ছে।’
মি. সিম্পসন টেলিফোনটা তুলে নিলেন। ডাকলেন তাঁর সহকারীকে। ‘হ্যালো, তারিক! প্লেনের টিকিট বুক করা হয়ে গেছে? হয়নি–তাহলে আরও দু’খানা টিকিট বুক করে ফেলো একই সঙ্গে। ও. কে।’ টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে মৃদু হাসলেন মি. সিম্পসন। একটা কি যেন কৌতুকে চোখ দু’টো তাঁর নাচতে লাগলো।
শহীদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো মি, সিম্পসনের দিকে।
সাত
ক্যান্টনগামী একখানা প্লেনে মি. সিম্পসন ও শহীদ খান ist Class-এর ডান দিকের প্রথম সিটটায় বসেছিল। মাইক্রোফোনে পাইলটের স্বর ভেসে এলো, ‘Fasten your seat belts. please. The plane is going to take off.
একজন দীর্ঘকায় ফ্লাইট স্টুয়ার্ড এসে সকলের বেল্ট বাঁধা হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে গেল। মি. সিম্পসনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো, ‘Anything I can do for you, Sir?’
‘No thanks.’
মি. সিম্পসন স্টুয়ার্ডের দিকে ফিরে না তাকিয়েই বললেন। স্টুয়ার্ডের মুখে সূক্ষ্ম একটা বিদ্রুপের রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
প্লেন তখন অনেক উপরে উঠে গেছে। শহীদ খান ভেলভেটের কোঁচান গাঢ় লাল রঙয়ের পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে চাইলো।
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের ভিতর দিয়ে প্লেন চলেছে। মনে হলো, জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই মেঘকে ছোঁয়া যায়। শহীদ তার কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো রূপকথার রাজপুত্রের মতো। সে-ও যেন ঠিক তেমনি চলেছে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে রাক্ষসের দেশে, অসুরকুল নিধন করতে।
শহীদ নিচের দিকে তাকায়। নদীগুলো কতো ছোট মনে হচ্ছে। পাহাড়গুলো যেন কতকগুলো পাথরের টিবি। একলাফেই পার হওয়া যায়।
মাঝে মাঝে দুচারটে বাড়ি খেলাঘরের মতো সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে, ঠিক যেন কোনো শিল্পীর আকা নিখুঁত ছবি।
আসবার সময় মহুয়া অনেক কেঁদেছিল। তার এক কথা, দূর দেশে গিয়ে এতবড় বিপদের বুকিটা তার নিজের কাঁধে না নিলেই ভালো হতো। কিন্তু যেখানে. কর্তব্যের বাঁধন তাকে ঘিরে রেখেছে, সেখানে দুয়িতার ডাক তাকে পিছু টানবে কেন? তবুও মনের কোণে একটা কাঁটা খচ খচ করে ওঠে।
কামালের অপারেশনটা সাকসেসফুল ভাবেই হয়েছে, কিন্তু তার বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নেয়া দরকার। তার জন্য শহীদের মনটা কেমন যেন লাগছে। ওকে আনতে পারলে অ্যাডভেঞ্চারটা জমতো ভালো। কামাল যা ভালো জমাতে পারে!
ক্লিন্তু যখন গফুর এসে সামনে দাঁড়ালো তার মনোভাব বুঝতে শহীদ খানের একটুও কষ্ট হয়নি। শহীদ খান যখন ঘরে ছিলো না, মি. সিম্পসনের টেলিফোনটা এসেছিল ঠিক সেই সময়ে। গফুর ধরেছিল ফোনটা। তাদের মধ্যে কি কথা হয়, শহীদ তা জানে না। কিন্তু সেদিন মি. সিম্পসনের অফিসে তার রহস্যময় হাসির অর্থ পরে খুঁজে পেয়েছিল সে।
এদিকে শহীদ খান যতদিন ফিরে না আসবে কামাল থাকবে শহীদের বাড়িতে, আর তার মহুয়ার দেখাশুনা করবে।
সেই কারণে গফুর সবদিক দিয়েই একেবারে নিশ্চিন্ত। তার গাম্ভীর্য দেখে শহীদের মনে হয়েছিল পাষাণকে টলানো যেতে পারে কিন্তু গফুরকে টলানো যাবে না। তার দাদামণিকে একেলা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সেই কোন্ বাহারের দেশে যেতে হবে, আর সে খাঁচার মুরগীর মতো বাড়িতে বসে ছটফট করবে, সে কিছুতেই সহ্য হচ্ছিলো না গফুরের।
মিরপুরের দরগায় পাঁচশিকে মানতি দিয়ে অবশেষে একরাশ মালপত্র লাগেজে বুক করে যখন গফুর তার দাদামণির পিছন পিছন এসে টুরিস্ট ক্লাসে ঢুকলো, দেখে তার সীটটা দরজার পাশেই পড়েছে। সে খুশি হয়ে উঠলো। কিন্তু যখন পাশের সীটটায় একটি চাইনীজ মেয়ে হাসিমুখে এসে বসলো, গফুর মনে মনে ভয়ানক অপ্রসন্ন হয়ে উঠলো। গফুরের চীন সম্বন্ধে ভয়ানক একটা ভীতি আছে। এবং সেই ভীতি এখন কুসংস্কারে দাঁড়িয়ে গেছে। গফুরেরও একটা নিজস্ব মতামত আছে ‘যাহা চীন তাহা সযত্নে পরিহার করিও।’ মেয়েটিকে প্রথম থেকেই সে সুনজরে দেখেনি।
কিন্তু সেই লম্বা লোকটির সাথে ফ্লোইট স্টুয়ার্ড তার বেশ ভাব হয়ে গেল। যখন, তাকে খাবারের ডবল প্যাকেট দিয়ে গেল, গফুর ভাবলো লোকটা নেহায়েৎ মন্দ নয়।
ক্যান্টনে তাদের জন্য চীন সরকারের বিশেষ হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছিল তাদের পিকিং নিয়ে যাওয়ার জন্য। পিকিং-এ গুপ্ত পুলিস হেড কোয়ার্টার্সের সুপ্রীম কমাণ্ডার মি. চ্যাং ফুঁ তাঁর বিশেষ দূত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ক্যান্টনে তাদের যথোচিত:মর্যাদার সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য।
স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের ট্রেনিংপ্রাপ্ত খ্যাতনামা ডিটেকটিভ মি. সিম্পসন ও শখের গোয়েন্দা শহীদ খান মি. চ্যাং ফু’র অফিস কক্ষে ঢুকে অপেক্ষা করছিল। অল্পক্ষণ পরেই মি. চ্যাং ফুঁ অন্য দরজা দিয়ে সে ঘরে প্রবেশ করলেন।
অত্যন্ত সাদর অভ্যর্থনা জানালেন তিনি তাঁর বিদেশী কাউন্টারপার্টদের। শহীদ খানের সাথে করমর্দন করে বললেন, ‘আপনার সুখ্যাতি অনেক শুনেছি, মি. শহীদ। আপনার প্রতিটি সাফল্যের সাথে আমরা পরিচিত। এদিকে আপনাদের জরুরী cable পেয়ে আমাদের সরকারের সম্মতিক্রমে বিশেষ ছাড়পত্র তৈরি করে রাখা হয়েছে আপনাদের নামে। মনে রাখবেন চীন সরকারের সামগ্রিক শক্তি আপনাদের পিছনে রয়েছে। সেজন্যে আপনারা বিন্দুমাত্র চিন্তা করবেন না।’
মি. চ্যাং ফুঁ তার ড্রয়ার খুলে বিশেষ ছাড়পত্রখানা বের করে মি. সিম্পসনের হাতে দিলেন।
‘আমাদের জনসাধারণ ও সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের এ সহযোগিতার জন্য অজস্র ধন্যবাদ,’ মি. সিম্পসন যথাসম্ভব কণ্ঠ মোলায়েম করে, চূড়ান্ত ভদ্রতা বজায় রাখতে চেষ্টা করলেন।
মি. চ্যাং ফুঁ Intercom-এর বোম টিপে কি যেন হুকুম দিলেন তাঁর দেশীয় ভাষায়। মিনিট দুই পরেই দেখা গেল তাদের টেবিলের উপর এসে গেছে রকমারি চীন দেশীয় খাবার। ওরা মি. চ্যাং ফুঁর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে গেল।
অনেক ধন্যবাদ বিনিময়ের পর যখন বেরিয়ে এলো, শহীদ দেখতে পেলো একজন ঢ্যাঙা মতন চীনাম্যান চকিতে দেয়ালের আড়ালে সরে গেল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। মনে হলো লোকটাকে এর আগেও যেন কোথায় দেখেছে, কিন্তু মনে করতে পারলো না।
শুধু এটুকু বুঝতে পারলো, তাদের গতিবিধি অন্য পক্ষের হয়ত অজানা নেই। একটা নির্দিষ্ট ক্যাবে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো ওদের পিপলস্ হোটেলে। সেখানে চীন সরকার তাদের জন্যে রাজকীয় ব্যবস্থা করে রেখেছে।
সন্ধ্যা অনেকক্ষণ হলো উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। দু’জন চীনাম্যান শতপুষ্পের সিঁড়ি নামীয় রাস্তা দিয়ে ‘দেবদূত’ রোডে এসে পড়লো। কিছুদূর চলার পর বাজারের ঘিঞ্জি এলাকায়। গিয়ে ঢুকলো ওরা। রাস্তার একপাশে পুরানো জিনিসপত্রের দোকান (Curio Shop)। তারা দাঁড়িয়ে সামনের ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সূর্যমুখীর বিচি কিনে খেলো।
ওরা দোকানে ঢুকতেই দোকানী তাদের দেখে অভিবাদন জানালো। একজন চীনাম্যান পকেট থেকে একখানা কার্ড বের করে দোকানীর চোখের সামনে ধরলো।
ছোট্ট একটা গলি। দুজন একসঙ্গে পার হওয়া যায় না। দোকানী ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। কিছুদূর গিয়েই ডানদিকে একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা অন্ধকার। দোকানী সেই সিঁড়ি দিয়ে অন্ধকারে উপরের দিকে মিলিয়ে গেল।
আগন্তুক চীনাম্যান দু’জন অন্ধকার হাতড়ে উপরে উঠতে লাগলো। কিছুদূর ওঠার পর ওরা দেখলো অন্ধকার একটু তরল হয়ে এসেছে। দোকানী বাঁ দিকের একটা বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা কাগজের লণ্ঠন দরজার উপরে ঝুলছে, মৃদু আলো অন্ধকার দূর করবার ব্যর্থ চেষ্টা।
দরজায় তিনবার টোকা মারলো দোকানী। ভিতর থেকেও তেমনি তিনটে টোকার শব্দ পাওয়া গেল। তারপর নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে একজন বৃদ্ধ চীনাম্যান।
আগন্তুকদ্বয় বৃদ্ধকে নীরবে অভিবাদন জানিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ছোট্ট অপরিসর কক্ষ। একটা ভাঙা তক্তপোষ একপাশে রাখা। দু’টো পুরানো চেয়ার আর তার পাশে ছোট্ট একটা টেবিল। টেবিলের উপরে রঙ-বেরঙ কাগজের একটা চাইনীজ লণ্ঠন ঝুলছে। আগন্তুকদ্বয় যখন ভিতরে ঢুকলো, দোকানী দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।
বৃদ্ধ চীনাম্যান আগন্তুকদ্বয়কে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন।
‘ব্রাভো মি. সিম্পসন, ব্রাভো মি. শহীদ। এ যে একেবারে আস্ত চীনাম্যান হয়ে গেছেন দেখছি। কে বলবে আপনারা চীনা বাপ-মায়ের ঘরে জন্ম নেননি। একেবারে চমৎকার হয়েছে ছদ্মবেশ।
‘সে তো আপনাদেরই বদৌলতে,’ শহীদ ফোড়ন কাটলো।
ছদ্মবেশী পুলিস চীফ মি. চ্যাং ফুঁ চারপায়াটার উপর গিয়ে বসলেন। ওরাও চেয়ার দুটো দখল করে নিলো।
‘এবার আমরা নিশ্চিন্ত মনে যাত্রা করতে পারবো।’
মি. চ্যাং ফুঁ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন। একটা রুট ম্যাপে পরিচ্ছন্ন ভাবে যাত্রার বিশেষ বর্ণনা দেয়া রয়েছে। মি. সিম্পসন ও শহীদ খান ম্যাপটার উপর ঝুঁকে পড়লো।
মি. চ্যাং ফুঁ এবার একটু কেশে বলতে আরম্ভ করলেন, ‘আমরা যাত্রীবাহী রেগুলার কনভয়ে, সাধারণ নাগরিক হিসাবে চীন সীমান্ত পার হয়ে যাবে। তারপর আরম্ভ হবে আমাদের দুর্গম পথ। সেই পথ ধরে আমাদের যেতে হবে লাসা।
আমাদের আগামীকাল রওনা হতে হবে। পিকিং থেকে কনভয়ে আমরা প্রথমে যাবো ইয়ান, সেখান থেকে চেং টু। তারপর কানটিং হয়ে বাটাং। ওখানে আমরা কনভয় ছেড়ে দেবো। মিটার গজ টেনে আমরা যাবো চাণ্ডে। চাণ্ডার খানিক পরেই সীমান্ত। মাঝখানে পড়বে সালোঘিন নদী। প্রচণ্ড স্রোত সে নদীতে। ওখানে আমাদের একদিন বিশ্রাম নিতে হবে।
যে জায়গায় আমরা যাচ্ছি সেটা হলো ভারত সীমান্ত থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে। বিখ্যাত মানস সরোবরের ধার ঘেঁষে এক গিরিবর্ত সোজা চলে গেছে উত্তর দিকে। যেখানে গিয়ে শেষ হলো, জায়গাটার নাম বার্তক। সেখানেই সব রহস্য ঘনীভূত হয়ে আছে।
কিন্তু একটা জিনিস আপনাদের সাবধান করে দিতে চাই। বার্তক-এর লোক এক শ্রেণীর হিংস্র পাহাড়িয়া। ভয়ঙ্কর সে সব লোক। তাউ সম্প্রদায় হলো ওদের দীক্ষাগুরু। চীন সরকারকে ওরা স্বীকার করে নেয়নি। অনেক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা ওদের কাবু করতে পারিনি। সুতরাং আমরা চাই ওদের কিছু শিক্ষা দিতে। সে জন্যে আপনাদের যতদূর সাহায্যের প্রয়োজন সেটা আমরা দিতে কুণ্ঠিত। হবে না। যে গুপ্তধনের নক্সা নুরবক্স বা কুয়াশার কাছে আছে, সেটা ওই জায়গারই। কোথায়ও হবে। কিংবদন্তী আছে, সেখানে তাউয়ের মন্দিরের নিচে কোনো বিশেষ। জায়গায় এতো ধনরত্ন লুক্কায়িত আছে যেটা ওরা বংশ পরম্পরায় রক্ষা করে আসছে। যুগ যুগ ধরে ওরা দস্যুবৃত্তি করেছে, হত্যা, লুণ্ঠন করেছে একাদিক্রমে। কতো জনপদ ওরা ধ্বংস করে দিয়েছে, ইতিহাসের পাতায় তার সাক্ষী নেই। জায়গাটা এতোই সুরক্ষিত যে সহজে কেউ সেখানে ঢুকতে পারে না। কোনো অজানা লোক বা কোনো বিদেশী কাউকে দেখতে পেলে ওরা নির্মমভাবে হত্যা করে।
এখন কথা হচ্ছে নুরবক্স বা কুয়াশাকে ধরতে হলে, শুধু তাদের বিরুদ্ধে নয় গোটা তাউ সম্প্রদায়ের সঙ্গেই বুদ্ধির লড়াই করতে হবে। না হলে সেখানে গিয়ে পৌঁছুতে পারা একেবারে অসম্ভব ব্যাপার।
আর একটা স্ট্র্যাটেজি আমাদের নিতে হবে। লাসায় তাউ সম্প্রদায়ের বহু লোক ছড়িয়ে আছে। এরাই খবর আদান প্রদান করে বাইরের জগতের সাথে। কোনো লোক বার্তকের দিকে চলতে আরম্ভ করলেই সমস্ত পথে বার্তাটা তড়িৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে।
সে লোক শেষ পর্যন্ত হয়তো বার্তকে পৌঁছতে পারে না। রাস্তায়ই শেষ হয়ে যায়।’
মি. চ্যাং ফুঁ এবার একটু থামলেন। কুজো থেকে খানিকটা পানি ঢেলে নিয়ে ঢক্ ঢক করে খেয়ে নিলেন। তারপর চীন দেশের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সিগারেট বের করে ওদের অফার করলেন, নিজেও একটা ধরালেন। বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করে আবার বলতে আরম্ভ করলেন, ‘স্ট্র্যাটেজিটা হলো, লাসায় আমাদের জন্যে একটা হেলিকপ্টার থাকবে। আমরা সোজা বার্তকের দিকে না গিয়ে এমন ভাব দেখাবো যেন আমরা ফিরে যাচ্ছি পিকিং-এ। কিন্তু আমরা ঘোরা পথে নেপাল সীমান্তের ধার ঘেঁষে মানস সরোবরের কাছে নামবো। তারপর আরম্ভ হবে আমাদের সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চার।
‘Let us hope for the best, Mr. Cheng Fu.,’ fl. fasthan 019 দিকে তাকিয়ে বললেন।
‘I do hope so,’ অপর পক্ষের উত্তর এলো।
এরপর ওদের শলাপরামর্শ চললো অনেকক্ষণ ধরে। রাত তখন গম্ভীর হয়ে এসেছে, হঠাৎ দোকানী দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো। কয়েকটা ক্যারিয়ারে তাদের জন্যে রকমারি খাবার নিয়ে এসেছে। নৈশ ভোজের বিপুল আয়োজন দেখে ওরা এবার সেদিকে মনোযোগ দিলো।
আট
মানস সরোবর।
গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের মাতৃ জঠর।
হিন্দু পুরাণে কথিত আছে, এই জায়গায় আছে স্বর্গের সিঁড়ি। যেখান থেকে গঙ্গা নেমেছে তার বাহনে চড়ে, ভগীরথের আকুল আহবানে। দুকূল প্লাবিত করে ভারতবর্ষকে করেছে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা। ওদিকে ব্রহ্মপুত্র শতনামে, গরীয়ান হয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে বহু জনপদ বিধৌত করে।
ভারত সীমান্ত পার হয়ে নেপাল। যেখানে নেপালের শেষ সেখানে তিব্বতের আরম্ভ। ঠিক পঞ্চাশ মাইল উত্তরে এই সরোবর। পাহাড়ের দেশে সমতল জলাভূমি। বিশাল সরোবরের স্নিগ্ধ পানি টলমল করছে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ সে পানি। সুউচ্চ পর্বত চুড়া দিয়ে ঘেরা সমতল প্রদেশ। দুরে নিচে অরণ্যরাজি বিরাট বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কতো রকম রঙ-বেরঙ-এর পাখিরা জলকেলী করছে হ্রদের বুকে। কোথাও লাল, কোথাও নীল আবার কোথাও সবুজের মেলা সুদূর বিস্তৃত এই সরোবরে। আকাশের নীলের প্রতিচ্ছবি সেই স্বচ্ছ পানিতে। সুন্দর একটা নীলাভ পরিবেশ গড়ে উঠেছে চারপাশে, যেন ধ্যানমগ্ন কোনো যোগী স্তব্ধ হয়ে বসে আছে যুগ-যুগান্ত ধরে।
পড়ন্ত রোদের অপরাহ্নিক আসর জমে উঠেছে হ্রদের চারদিকে। ক্ষীণ একটা কুয়াশার প্রলেপ মেখে, বিচ্ছুরিত সূর্যের আলোকে, নব বধূর মতো অবগুণ্ঠন তুলে দিয়ে বসে আছে মানস-প্রতিমা। চারদিকের তুষারমাখা পর্বতে একটা শুভ্র শুচিতার পরশ। যেন স্বয়ম্বর সভায় রাজকুমারীকে মাঝে বসিয়ে অনেক দেশের রাজপুত্তর করছে কানাকানি।
হঠাৎ মৌমাছির মতো একটা গুঞ্জন ধ্বনি ভেসে এলো দূর থেকে। কলুষিত করলো মানসের অখণ্ড নীরবতাকে।
ছোট্ট একটা ফোর-সিটার হেলিকপ্টার দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে এগিয়ে আসতে লাগলো দ্রুত লেকের উপর দিয়ে। কয়েকবার চক্কোর খেলো কপ্টারটা, তারপর ভালো দেখে একটা জায়গা বেছে নিয়ে ধীরে ধীরে নেমে পড়লো লেকের পাড়ে। কপ্টারে আরোহী চারজন।
রোটর বন্ধ করে দিয়ে শহীদ খান ককপিট থেকে নেমে পড়লো। ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একে একে মি. সিম্পসন, মি. চ্যাং ফুঁ ও গফুর।
দীর্ঘ পথশ্রমের ক্লান্তি ওদের চোখে মুখে। ওরা হাত পা ছড়িয়ে লেকের ধারে মাটিতে বসে পড়লো। ওদের চোখের সামনে এক অপূর্ব সৌন্দর্য দিগন্ত উদ্ভাসিত করে আছে। মুগ্ধ হলো ওরা।
‘যাক, বাঁচা গেল।’
মি. সিম্পসন পিঠের দাঁড়া সোজা করে বসলেন। শহীদ চেয়ে ছিলো একদৃষ্টে গভীর হ্রদের পানির দিকে। মি. চ্যাং ফুঁ তার শরীর থেকে কিটস ব্যাগ ইত্যাদি খুলে নামিয়ে রাখলো। গফুর হেলিকপ্টার থেকে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রগুলো নিয়ে এলো। একটা প্লেটে অনেকগুলো চিকেন স্যাণ্ডউইচ সাজিয়ে দিয়ে সবার সামনে রেখে দিলো। এরপর বড় থারমোফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে সবাইকে পরিবেশন করলো।
‘তাহলে আজকের মতো এখানেই যাত্রা বিরতি করা যাক,’ শহীদ মি, চ্যাং ফুর মতামত জিজ্ঞেস করলো।
‘হ্যাঁ! এখানেই আমাদের রাতটা কাটাতে হবে। কাল ভোরে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে অজানার উদ্দেশে। কোথায় কি বিপদ লুকিয়ে আছে, কে বলতে পারে। গফুর, জিনিসপত্রগুলো সামনের ওই গুহাটার কাছে নিয়ে যেতে হবে।’
সবাই মিলে ওরা গুহাটার ভিতর গিয়ে ঢুকলো। আজ রাতটা এখানেই থাকবে ওরা। গুহার ভিতর আড়ালে ওরা ক্যাম্পফায়ার করলো। নৈশকালীন ভোজ শেষ করে রাতে শোবার বিছানা করে নিলো। দীর্ঘ পথের ক্লান্তিতে সবার ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। চারদিকে অদ্ভুত নীরবতা। গুহার বাইরে দেখা যায় এক টুকরো আকাশ। একটা ম্লান আলো চারদিকে ঘিরে রয়েছে। এক সময় মনের অজান্তেই ওদের ক্লান্তদেহ গভীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো। শুধু সপ্তর্ষিটা হ্রদের পূর্ব দিগন্তে এক চোখে হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
গভীর রাতে কেন যেন শহীদের ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো কি যেন একটা থপ্ থপ শব্দে এগিয়ে আসছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকালো। হঠাৎ তার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।
একি স্বপ্ন, না সত্যি?
জীবনে এমনি অনেক ঘটনা সে বহুবার শুনেছে, কিন্তু বিশ্বাস করেনি। প্রকাণ্ড একটা মানুষ, দেহটা দীর্ঘ লোমশ আবরণে ঢাকা, আজানুলম্বিত, বাহু, অতি সন্তর্পণে। হ্রদের দিক থেকে হেলিকপ্টারের কাছে এগিয়ে আসছে। | সে দু’হাতে চোখ দুটো ভালো করে রগড়ে নিলো। নাহ! স্বপ্ন নয়, সত্যি। যে হিমালয়ের তুষার মানবের কথা এতদিন শুনে আসছিল, সেই ‘ইয়েতি’ ওর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে। তার নির্ভীক হৃদয়েও হৃৎকম্প উপস্থিত হলো।
শহীদ দু’হাতে মুখ ঢাকলো। মনে তখন তার অনেক কথার ঝড় বইছে। সে কোনদিনই বিশ্বাস করতো না, তুষার মানব বলে কিছু থাকতে পারে। ১৯৫৫ সালে একজন ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘ইয়েতি’ কথাটা তিব্বতের ‘লাল ভালুক’ কথাটার অপভ্রংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ওরা মানুষের মতো দু পায়ে ভর করে চলাফেরা করে।
আবার অনেকের মতে ‘ইয়েতি’ দীর্ঘ লোমশ মানুষের মতো এক অদ্ভুত জীব। ওরা হিমালয়ের ‘ইয়তের’ মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করে, আর তা না পেলে মানুষ ধরে খায়।
অনেকেই নাকি এই তুষার মানবকে দেখেছে। পর্বতে আরোহণকারী শেরপাদের অনেকেই এদের গল্প করে। আর এদের পায়ের ছাপও পাওয়া গেছে বহু জায়গায়।
১৯৫১ সনে পর্বতারোহী মি. এরিক শিষ্টিন পায়ের রেখা ধরে এক মাইল ধাওয়া করেছিলেন ‘ইয়েতির’ পিছনে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্র্যাক হারিয়ে ফেলেন মেনলুং-সি পর্বতের এক জায়গায়।’
বিশেষ কথা কি, এভারেস্ট বিজয়ী স্যার এডমাণ্ড হিলারীও বিশ্বাস করেন যে ‘ইয়েতি’ আছে। এভারেস্ট বিজয়ী অন্যতম বীর শেরপা তেনজিং এক গল্পে বলেছিলেন,
তাঁর বাবা সত্যি সত্যি একবার এই তুষার মানবের খপ্পড়ে পড়ে লড়াই করেছিলেন।
‘১৯৫৮ সনে রাশিয়ান বৈজ্ঞানিক ড, আলেকজাণ্ডার জি. প্ৰনিন তো বলেই বসলেন, পামির মালভূমিতে তিনি এই তুষার মানব দেখেছেন।
এইসব তথ্য জানা থাকা সত্ত্বেও শহীদ তুষার মানবকে গাঁজাখুরি বলে একদম উড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু আজ সে নিজের চোখে যা দেখছে তাকে কি করে অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দেয়?
একটা বাঁশির মতো তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে শহীদ চোখের উপর থেকে হাত নামালো। মনে হলো ভূমিকম্পের মতো সমস্ত জায়গাটা কাঁপছে। আরেকটি ‘ইয়েতি’ প্রথমটির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর আরেকটি…। প্রায় দশ-বারোটি হিমালয় মানব কপ্টারটার চারপাশে ঘিরে দাঁড়ালো। ওদের চোখে বিস্ময়। ওরা এটা সেটা নাড়াচাড়া করে দেখতে আরম্ভ করেছে। শহীদ মনে মনে প্রমাদ গুণলো।
শহীদের সাথে সাথেই বাকি সবাই কখন যে উঠে বসেছে, তা সে টের পায়নি। মি. সিম্পসন স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছেন। মি, চ্যাং ফুঁ দু’হাত একসঙ্গে জোড় করে, অর্ধ নির্মীলিত চোখে ইষ্ট নাম জপ করছেন। আর বেচারা গফুর তখন ভয়ে ঠক্ ঠক করে কাঁপছে।
হঠাৎ শহীদ দেখতে পেল, গফুরের চোখ দুটো ভয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে মুখ খুলছে চিৎকার দেবার জন্যে, কিন্তু সেটা বুঝতে পেরেই শহীদ দু’হাতে গফুরের মুখ চেপে ধরলো। একটা অস্পষ্ট গোঙানী উঠেই মিলিয়ে গেল।
শহীদ ফিসফিসিয়ে বললো।
‘খবরদার, গফুর। চিৎকার করলে মরতে হবে। ওরা যদি একবার টের পায়, তবে কোনো অস্ত্রই আর আমাদের বাঁচাতে পারবে না।’
‘দাদামণি!’
‘কি?’
কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে গফুর গোঁ গোঁ করতে করতে গুহার ভিতরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
শহীদ সেদিকে আর ভ্রূক্ষেপ করলো না। মি. সিম্পসন উঠে গিয়ে ফ্লাস্ক থেকে পানি নিয়ে গফুরের চোখে মুখে ছিটাতে লাগলেন।
এরপর শহীদ যা দেখলো, প্রথমে তার রোমাঞ্চ হলো, পরে সে রোমাঞ্চ হতাশায় পরিণত হলো।
তুষার মানবগুলো কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে হেলিকপ্টারের চারদিকে ঘোরাফেরা করলো। মনের আনন্দে কেউ কেউ হাততালি দিলো। আবার কলকণ্ঠে কেউবা বাঁশির মতো কণ্ঠস্বরে হেসে উঠলো।
হঠাৎ একটি তুষার মানবের ক্রুদ্ধ গর্জনে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। সে শব্দ ক্রমে দূর, বহুদূর থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতে লাগলো। ওর চোখে ফুটে উঠেছে। তখন সাপের মতো ঠাণ্ডা আর তীক্ষ্ণ দৃতি।
ক্রমাগত সে হেলিকপ্টারটার উপর লাথি চালালো। তারপর সবাই মিলে সগর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওটার উপর।
মুহূর্তে তাণ্ডবলীলা আরম্ভ হয়ে গেল। দুতিন মিনিটের মধ্যে ‘কপ্টারটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেললো ওরা। তারপর দূরে হ্রদের পানিতে টুকরোগুলো সক্রোধে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। পাঁচ মিনিট পরে তার শেষ টুকরো পর্যন্ত আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
এবার ধীরে ধীরে ওরা শান্ত হয়ে এলো। আবার থপ্ থপ্ করে ভারি পা ফেলে চললো দল বেঁধে, দূরের ঐ পাহাড়টার দিকে। যেখান থেকে জায়গাটা ঢালু হয়ে নিচের দিকে চলে গেছে দূর বনানী পর্যন্ত। এক সময় সবাই মিলিয়ে গেল সেই পাহাড়ের অন্তরালে। বাঁশির মতো হাসির তীক্ষ্ণ শব্দটা তখনও থেকে থেকে শোনা যেতে লাগলো।
কিন্তু শহীদের তখন বাহ্যজ্ঞান প্রায় বিলুপ্তির পথে।
শহীদ যখন সংবিত ফিরে পেলো, সে দেখলো, মি. সিম্পসন ও মি. চ্যাং ফু’র অবস্থাও তার চাইতে ভালো নয়।
ধীরে ধীরে সে গুহার বাইরে এসে দাঁড়ালো। মৃদুমন্দ বাতাস হ্রদের পানিতে একটা হিল্লোল তুলে বয়ে যাচ্ছে। আচ্ছন্ন কুয়াশার ভাবটা কেটে গিয়ে সেখানে জ্যোছনার স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়েছে পানির বুক জুড়ে। আকাশে চাঁদটা তাকিয়ে আছে মুখখানি বাঁকা করে। আর সে আলো ভেঙে ভেঙে লুটিয়ে পড়েছে শতধা হয়ে।
শহীদ এসে আবার ঢুকলো গুহার ভিতরে।
এবার সে গফুরের দিকে মনোযোগ দিলো। গফুর এতক্ষণে চোখ মেলে তাকালো। তার প্রথম কথাই হলো, ‘দাদামণি, এমন অলুক্ষণে জায়গায় মানুষ আসে?’
সভয়ে গফুর উঠে বসে। বাইরে তাকিয়ে দেখে, কপ্টারটি এখানে নেই। তার বুঝতে একটুও বিলম্ব হলো না ওটার ভাগ্যে কি ঘটেছে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে গফুরের বুক থেকে।
‘ওরা আমাদের ফেরবার পথটুকুও বন্ধ করে দিলো, দাদামণি। আর গিয়ে কাজ নেই। চলো আমরা যে ভাবেই হোক ফিরে চলে যাই।’
শহীদের মুখটা কঠিন আকার ধারণ করে।
‘গফুর!’ গফুর চমকে ওঠে। মাথা আপনা থেকেই নত হয়ে যায়। ‘আমার ভুল হয়ে গেছে, দাদামণি। মাফ করে দাও।’
‘শোন, গফুর। যে জন্যে এতো বিপদ তুচ্ছ করে এখানে এলাম, সে কাজ শেষ না করে একপাও নড়ছি না।’
এতক্ষণ মি. সিম্পসন ও মি. চ্যাং ফুঁ একটিও কথা বলেননি। এবার মি. সিম্পসন মুখ খুললেন।
‘মি. চ্যাং ফু, এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। এখনই যাত্রার আয়োজন করুন। যে বিভীষিকা দেখলাম তা কোনদিন ভুলবার নয়।’
মি, চ্যাং ফু’র মুখে একটা করুণ হাসি ফুটে উঠলো।
‘দেখুন এরা অতিমানব। সহজে কারও কোনো ক্ষতি করে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি এদের ক্ষতি না করেন। সে যা হোক, আমাদের এবার যাত্রা করা দরকার। ওহে গফুর, চলো এবার বেরিয়ে পড়া যাক।’
যে জিনিসপত্র ওরা কপ্টার থেকে নামিয়ে রেখেছিল, সেগুলো তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিলো।
নয়
মুকুলেশ্বর বান্দাসী।
পাহাড়ের ধারে ছায়াঘেরা নিবিড় বনানী। সুদীর্ঘ পাইন আর দেবদারুর ঘন বন। দু’টো দীর্ঘকায় মূর্তি এগিয়ে চলেছে মাঝখানের একটা সরু পথ ধরে। কাঁটায় কাঁটায় সমস্ত পথ আচ্ছন্ন। ফার্ন ও অন্যান্য গুল্মলতায় সমস্ত পথ ছেয়ে আছে। আর ভয়ানক পিচ্ছিল। দীর্ঘ পথশ্রমে ওরা তখন ভয়ানক ক্লান্ত।
‘ভাইয়া, আর যে চলতে পারছি না।’
‘হ্যাঁ! এসো এবারে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়া যাক।’ ওরা পথের পাশে একটা বড় গাছের নিচে গিয়ে বসলো।
‘শোনো, মান্নান। আমার অনুমান যদি সত্য হয় তাহলে নুরবক্স মানস সরোবরের ধার ঘেঁষে গুহাপথ দিয়ে এগুচ্ছে। সে বড় ভয়ঙ্কর পথ। কতদিন সে পথে কোনো মানুষ চলাফেরা করেনি তা কে জানে। তাছাড়া কত বিপদ ওর ভিতর এখানে সেখানে ওঁৎ পেতে বসে আছে। বিশেষ করে এক ধরনের বিষাক্ত সবুজ সাপ, সব সময় চারদিকে কিলবিল করে। যার এক ছোবল মুহূর্তে মানুষের মৃত্যু হয়।’
‘কি ভয়ানক, ভাইয়া!’
‘হ্যাঁ! আমাদের প্ল্যান হচ্ছে এই নিখুঁত ছদ্মবেশে আমরা বার্তকের উপকণ্ঠে ঢুকবো।’
‘কিন্তু সেটা তো আরও বিপজ্জনক।’
‘দেখো, মান্নান, বিপদকে যতো ভয় করবে বিপদ ততো ভোমার ঘাড়ে চড়বে। আর কুয়াশা কোনদিন কোনো বিপদকে ভয় করে না।’
গাছের উপর কতকগুলো বানর কিচিরমিচির করছিল। দূরে কোথাও একটা বন মোরগ ডেকে উঠলো। কুয়াশা মুখ তুলে তাকালো উপর দিকে। বানরগুলো ভয়ানক লাফাচ্ছে। আর সামনের দিকে ছোটো ছোটো ডাল ছুঁড়ে মারছে। এবার হঠাৎ কুয়াশা পিছনের দিকে তাকিয়ে চমকে গেল। তার হাত দশেকের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে চলন্ত মৃত্যু।
ভয়াল দর্শন এক শ্বেত ভাল্লুক দু’পায়ের উপর ভর করে এগিয়ে আসছে। এতবড় ভাল্লুক কুয়াশা জীবনে কখনও দেখেনি। নিজের অজান্তেই মান্নান এক পা দু পা করে পিছু হটে গেল।
এক মুহূর্ত মনস্থির করে নিলো কুয়াশা। লড়তে হবে। এবং খালি হাতে। গুলি ছুঁড়লেই সতর্ক হয়ে যাবে নুরবক্স, টের পেয়ে যাবে ওদের অবস্থান। আর যাই হোক, ফল তার শুভ হবে না-ছলে বলে কৌশলে চেষ্টা করবে সে ওদের হত্যা করত। কত লোক আছে ওর সঙ্গে কে জানে?
উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা। পিছিয়ে গিয়ে রাইফেল তুলছিল মান্নান, হাতের ইশারায় বারণ করলো ওকে। অবাক হয়ে দেখল মান্নান, পিঠর উপর থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছে কুয়াশা। মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি ভাইয়ার! খালি হাতে ঐ প্রকাণ্ড ভাল্লুকের সঙ্গে যুদ্ধ করবে নাকি নে? ভয়ঙ্কর সব বিপদের মুখে অকুতোভয়। কুয়াশাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছে সে জাবনে অনেকবার। সে জানে কুয়াশার বুকের মধ্যে বাস করে এক দুর্দান্ত সিংহ, মাঝে মাঝে ত্রিভুবন কাঁপিয়ে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। ভেঙে চুরে তোলপাড় করে দিতে চায় এই বিশ্বব্রহ্মান্ড–কিন্তু তাই বলে…
আর ভাবতে পারলো না মান্নান। কুয়াশার হাত তিনেকের মধ্যে এসে গেছে ভয়ঙ্কর ভালুকটা। কুয়াশার অপরাজেয় উদ্ধত ভাব দেখ ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়লো সে একটা। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বীর বিক্রমে। ঝট করে সরে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড এক রদ্দা মারলো কুয়াশা ভাল্লুকটার ঘাড়ে। নিজের হাতেই ব্যথা পেলো সে, জন্তুটার কিছু হলো না। ঘুরে দাঁড়িয়েছে সে আবার। নাকের উপর দমাদম দু’টা ঘুসি খেয়ে এক পা পিছিয়ে গেল জন্তুটা। আরও খেপে গেছে সে। দু’ হাত সামনে বাড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করছে সে ঐ বেয়াড়া দু’পেয়ে, জন্তুটাকে। মান্নান জানে একবার ঐ শক্তিশালী বাহুর মধ্যে যদি জড়িয়ে ধরতে পারে তাহলে আর ছুটবার ক্ষমতা থাকবে না কুয়াশার।
হঠাৎ মান্নান দেখতে পেলো ভাল্লুকটার অতর্কিত এক থাবায় চিৎ হয়ে পড়ে গেল কুয়াশা মাটিতে। মুহূর্তে উঠে দাঁড়ালো কুয়াশা কিন্তু পিছন থেকে জাপ্টে ধরেছে জন্তুট। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে রাইফেল তুললো মান্নান। কিন্তু মারবে কোথায়? এখান থেকে গুলি ছুঁড়লে গুলি সোজা গিয়ে লাগবে কুয়াশার বুকে। এমনি সময় ভোজবাজির মতো কাণ্ড ঘটলো একটা। যতো বড় শক্তিশালীই হোক জুজুৎসুর জ্ঞান ছিলো না ভাল্লুকটার। শূন্যের উপর এক ডিগবাজি খেয়ে দশ হাত তফাতে গিয়ে পড়লো বেচারা–মান্নানের তিন হাতের মধ্যে।
‘ও বাবা গো!” বলে চোঁ চাঁ দৌড় দিলো মান্নান। কিন্তু জন্তুটির মনযোগ তখন কুয়াশার উপর। লক্ষ্যও করলো না সে এতবড় ভারি বারটা নিয়ে পাথরের উপর আছড়ে পড়ায় ডান পায়ের উরুর বাইরের দিকটায় ছয় বর্গ পরিমাণ চামড়া ছিঁড়ে নেমে গেছে নিচে। প্রথমে সাদা পরে লাল হয়ে গেল ক্ষতটা। থপ থপ করে এগিয়ে গেল সে কুয়াশার দিকে। কোঁশ ফোঁশ নিঃশ্বাস পড়ছে ওর, ঘড়র ঘডু করে একটা শব্দ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে, ভয়ঙ্কর জিঘাংসায় বেরিয়ে পড়ছে চকচকে ধারালো দাঁত।
শেষ বারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো দু’জন পরস্পরের উপর। জড়াজড়ি করে পড়ে | মাটিতে। গড়িয়ে চলে গেল ওরা বেশ খানিকটা দূরে।
আবার সাহস সঞ্চয় করে ফিরে এসেছে মান্নান। আবার সেই দ্বন্দ্বে পড়েছে। এমন ভাব লুটোপুটি খাচ্ছে ওরা মাটিতে পড়ে যে গুলি করবার উপায় নেই।
হঠাৎ একটা আর্তনাদ শুনতে পেলো মান্নান। কার মুখ থেকে এই আর্তনাদ বেরোলো ঠিক ঠাহর করতে পারলো না সে। কুয়াশার বুকের উপর তখন জন্তুটা তারও মুখই দেখতে পাচ্ছে না ও। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো লুকটা, কুয়াশাও উঠলো সাথে সাথে। মান্নান শুধু বুঝলো অদ্ভুত এক কৌশলে বেকায়দা মতে মুচড়ে ধরে আছে। কুয়াশা ভাল্লুকটার একটা হাত। ব্যথায় বেঁকে গেছে জন্তুটার দেহ-বিকৃত হয়ে গেছে কুৎসিত চেহারাটা। ঘাম ঝরছে কুয়াশার কপাল থেকে, সেই সাথে মিশেছে রক্তের ধার। পরমুহূর্তেই মট করে একটা শব্দ শুনতে পেলা মান্নান। ককিয়ে উঠলো ভাল্লুকটা অবর্ণনীয় ব্যথায়। বেকায়দা মতো এক চাপ দিয়ে ভেঙে দিয়েছে কুয়াশা ওর হাত এবার ছেড়ে দিলো সে জন্তুটিকে। দেখা গেল কাব থেকে আলগা ভাব ঝুলছে ওর হাতটা।
একমুহূর্ত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ভাল্লুকটা। তারপর পিছিয়ে গেল কয়েক পা। ভীতি ফুটে উঠেছে ওর ছোটো ছোটো চোখ দু’টায়। ওর কাছে পরাজয় মানেই মৃত্যু এক্ষুণি হয়তো আবার আক্রমণ করবে ওর চেয়ে শক্তিশালী ঐ অদ্ভুত লোমহীন ভাল্লুকটা। তিন পায়ে ভর দিয়ে প্রাণভয়ে চুলা সে এবার। বিশ গজ গিয়ে থামলো একবার, ফিরে তাকালো কুশার দিকে। একবার চাইলে নিজের রক্তাক্ত উরুর দিকে, তারপর দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল দূরের কয়েকটা পাথরের আড়ালে। কুয়াশার দৃষ্টি সর্বক্ষণ অনুসরণ করছিল জন্তুটার গতিগপর দিকে। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। দস্তুরমত হাঁপাচ্ছে সে।
মান্নান এক দৌড়ে কুয়াশার কাছে ছুটে এলো। অপসৃয়মান জন্তুটার উদ্দেশে খানিকক্ষণ হাতপায়ের কসরত দেখালো।
‘ঠিক হয়েছে, আবার লাগতে আসবি ভাইয়ার সাথে?’
তারপর কুয়াশার শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘কী অদ্ভুত শক্তি আপনার গায়ে, ভাইয়া! আপনি ভাল্লুকের বাবা।’
‘কি বললি? পাজী, হতচ্ছাড়া! তার মানে আমিও ভাল্লুক?’
মান্নান তাড়াতাড়ি জিব কেট বললো, ‘না, ভাইয়া! আমি কি তাই বললাম নাকি! হু। তবে ফের দি লাগতে আসে তবে পাজীটাকে এমন একহাত দেখিয়ে দেবো যে, বাপধন মজাটা টের পেয়ে যাবে।’
মান্নান এবার গাছের গুঁড়িটার উপর এসে বসলো। কুয়াশাও মান্নানের পাশে বসলো, ‘মান্নান! আমাদের সামনে হয়তো আরও বড় বিপদ থাকতে পারে, বীরত্বটা সে সময়ের জন্যে তুলে রেখে দাও।’
এবার মৃদু মৃদু হাসছে কুয়াশা। হঠাৎ পিছন থেকে কি যেন একটা আওয়াজ শুনতে পেলো মান্নান। চমকে পেছন ফিরে চাইলো।
ও ভাইয়া। এযে দেখছি দু’টো ভাল্লুকের বাচ্চা।
কুয়াশা তাকিয়ে দেখলো, পিছনে একটা গুহার মতো। ওর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে দুটো ভাল্লুক ছানা।
‘এতক্ষণে বুঝলাম, জন্তুটা হঠাৎ এতো খেপে গেল কেন? এমনিতে ওরা কাউকে আক্রমণ করে না। পিছনে ওর বাচ্চারা রয়েছে বলে রাগ সামলাতে পারেনি।’
‘দেখ না, ভাইয়া, কেমন কুতকুতে চোখে তাকাচ্ছে পাজীর ছানাগুলো।’
এবার দুজনেই খুব একচোট হেসে নিলো। যে সব জায়গায় ছড়ে গিয়েছিল, রক্ত মুছে একটা মলম লাগিয়ে নিলো কুয়াশা। মান্নান হ্যাঁভার স্যা থেকে খাবার বের করে তার ভাইয়াকে খাবার দিয়ে নিজেও খেতে লাগলো।
কুয়াশা দু’টুকরো রুটি ছুঁড়ে দিলো ভালুক ছানা দু’টোর দিকে। ওরা রুটি কুড়িয়ে নিয়ে খেতে আরম্ভ করলো মনের আনন্দে।
আবার দীর্ঘ পথ চলা।
এক জায়গায় একটা পাথর দেখা গেল। উপরটা অনেকখানি মানুষের মূর্তির মতো। এটা কি মানুষের হাতে গড়া না প্রকৃতির নিছক খেয়াল বলা সম্ভব নয়। কুয়াশা পাথরটার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো।
বুকের কাছে শার্টের পকেট থেকে একটা ম্যাপ বের করে আনলো। তারপর কি যেন মিলিয়ে দেখতে লাগলো।
কুয়াশা নিশ্চিন্ত হলো। ঠিক জায়গায় এসে পড়েছে। যদি এ পাথরটা একটুখানি ১৫৪
সরাতে পারে, তবে এর নিচে একটা সুড়ঙ্গ পথ পাওয়া যাবে। সুড়ঙ্গ পথে ঢুকতে পারলেই, মন্দিরের নিচে যাবার একটা রাস্তা পাবে।
বহুদূরে, প্রায় মাইল দুয়েক চড়াই উতরাই শেষে বার্তকের তাউ মন্দিরের লোনা বাঁধানো চূড়া দেখা যাচ্ছে। সে এক নয়ন মুগ্ধকর দৃশ্য।
‘মান্নান, আমাদের এখান দিয়েই নিচে নামতে হবে।’
‘কিন্তু যাবো কি করে, ভাইয়া? পথ কোথায়?’ কুয়াশা পাথরটা দেখিয়ে দেয়। এটা সরাতে হবে।
মান্নানের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ‘কি করে সম্ভব বিশ-পঁচিশ মণ ওজনের পাথরটা সরানো?’
কুয়াশা পাথরটার সরু কোণের দিকে গিয়ে জোরে এক চাপ দিলো, কিন্তু পাথর যেমনটি ছিলো ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে রইলো।
‘আসুন ভাইয়া, দু’জনে মিলে দেখা যাক।’
অনেক চেষ্টা করেও কিছু হলো না। মান্নান কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করলো, তারপর উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো।
পেয়েছি, ভাইয়া! পেয়েছি।’
‘কি পেয়েছো, মান্নান?’
‘হদিস পেয়ে গেছি। আসুন ডিনামাইট দিয়ে পাথরটা উড়িয়ে দিই।’
‘চমৎকার! এ না হলে বুদ্ধি ডিনামাইট দিয়ে পাথরটা উড়িয়ে দেবে। আর সেই শব্দে সমস্ত বনানীতে খবর হয়ে যাবে তোমার কীর্তিকলাপের। যে যেখানে থাকবে ছুটে আসবে, আর তোমায় চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাবে জামাই আদর করতে করতে। তখন ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে, মান্নান?’
মান্নানের এতবড় প্ল্যানটা মাঠে মারা গেল দেখে সে একেবারে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গোল। ঘর্মাক্ত কলেবরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুয়াশা পাথর সরাবার পথ খুজছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়লো, খানিকটা পাথর একটা লিভারের মতো বেরিয়ে আছে। কুয়াশা কি যেন দ্রুত চিন্তা করলো, তারপর একলাফে উপরের দিকে উঠে গেল।
কি আশ্চর্য, এই সম্ভাবনাটা আমার মনে একবারের জন্যেও উদয় হানি!
কুয়াশা পাথরটা ধরে ঝুলে পড়লো। পাথরটা ধীরে ধীরে খানিক নিচে নেমে এলো। পাথরের গোড়ায় খানিক জায়গা দরজার মতো ফাঁক হয়ে গেল। ভিতরে একটা সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। কুয়াশা লাফিয়ে পড়লো নিচে। | কুয়াশা মান্নানের মুখের দিকে তালে একবার। তারপর ঢুকে গেল ভিতরে। মান্নানও তার পিছন পিছন চলল। পাথরটা এবার উল্টোদিকে ঘুরে নিজের জায়গায় গিয়ে থামলো। বন্ধ হয়ে গেল পিছনের দরজাটা।
এক অজানা উত্তেজনায় তখন মান্নানের সর্ব শরীর শিউরে উঠছিল। খানিকটা এগিয়ে গেলে একটা হিমেল বাতাস ওদের শরীরে এসে লাগলো। ‘সম্মুখে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। কুয়াশা তার হাতের নিওন টর্চটা অন করে দিলো। এক ঝলক, আলো অন্ধকার ভেদ করে আগে আগে ছুটে চললো।
এই নিয়ন টর্চটা তৈরি করতে কুয়াশার অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। ছোট্ট একটা সেল এ মাইক্রো জেনারেটর ফিট করে একটা সূক্ষ্ম তার উপরের দিকে একটা নিয়ন গ্যাস ভর্তি টিউবের সঙ্গে সংযোগ করে দেয়া হয়। একটা ছোট্ট বোতাম টিপলেই মাইক্রো জেনারেটর চালু হয়ে যায় কিন্তু রিডাকসন গিয়ার থাকাতে কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। ইলেকট্রিক এনার্জী গ্যাসে ককটেড হলেই একটা সুন্দর নীলাভ আলো রে হয়ে আসে।
ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে তারা নিচে নামতে লাগলো। তাদের মনে হলো বহুদিন ফেন এ পথে কেউ চলাফেরা করেনি।
কেমন একটা গ্যাসের গন্ধ তাদের নাকে এসে লাগলো।
‘গ্যাস মাস্কটা পড়ে নাও মান্নান, হয়তো আমরা কার্বন মনোক্সাইড় বা সালফিউরেটেড় হাইড্রোজেন গ্যাসে trapped হয়ে যেতে পারি।’
ওরা গ্যাস মাস্ক দুটো বের কর পর নিলো। আর পিঠ দু’টো করে মাঝারি আকারের ডিউরেলিমিনে’র সলিড় অক্সিজেন ভর্তি বোতল পরে নিলো। এখানে ব্যাপার হচ্ছে, ‘ডিউরলিমিন’ লোহার চেয়ে বহুগুণ হালকা, তাই অক্সিজেন নেয়ার জন্যে কুয়াশা এই উপায় আবিষ্কার করেছে, যাতে সহজভাবে চলাফেরা করা যায়।– এমনি করে ওর এগিয়ে চলল আঁকাবাঁকা সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে।
দশ
একটি বিদেশী পর্বত আরোহী দল কাটমুণ্ড থেকে সেদিন নেপালের ছাড়পত্র নিয়ে এগিয়ে চলল ধবল গিরিপর্বতর দিকে, ২৬৮১০ ফিট উঁচু শৃঙ্গ জয় করার মানলে, সেদিন দু’জন পরিচিত শেরা যোগ দিয়েছিল এ দলটিতে। কেউ অবশ্য তাদের চিনতো না, কিন্তু নিজেদের ফটোসহ নেপাল গভর্নমেন্টের শেরপা হিসেবে বিশেষ অনুমতিপত্র তাদের ছিলো।
কিন্তু ধবলগিরির base স্টেশন যেদিন দলটি পৌঁছুলো, তারপর থেকে তাদের আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
ততক্ষণে অপরিচিত শেরপা দু’জন দুর্গম পথ বেয়ে ‘মুক্তিনাথে’র উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। মুক্তিনাথ থেকে একটা ছোটো গিরিপথ চলে গেছে তিব্বতের দিকে। এই ‘গয়া গিরিপথ বেয়েই নেপাল থেকে তিব্বত প্রবেশ করা যায়। কিন্তু ভয়ানক বন্ধুর সে পথ। শেরপা দু’জন এগিয়ে চলেছে সেই পথ বেয়ে। বহু দুর্গম পথ হেঁটে অবশেষে তারা মাতসাং (ব্রহ্মপুত্র) এর পাড়ে এসে হাজির হলো। সেখানে গাছের ভেলা বেঁধে ওরা মাতসাং পার হয়ে জিদামে এসে পৌঁছুলো। সেখান থেকে নদীর উৎস লক্ষ্য করে চলতে আরম্ভ করলো। অবশেষে এক সময় ওরা মানস সরোবরের পাড়ে এসে পৌঁছুলো। তখন তাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। এগিয়ে চলার মতো জীবনী শক্তিও ওদের তখন ফুরিয়ে গেছে।
‘হুজুর, এবার আমাদের যাত্রা করা দরকার।’
‘হ্যাঁ ভুলুয়া, এবার আমরা যাত্রা করবো।’
উহ! মুক্তিনাথের সেই সন্ন্যাসীর পাল্লায় যেভাবে পড়েছিলাম। আরেকটু হলে আর আসতে হতো না।’
‘নাহে! সত্যিকারের বিপদ সবে আরম্ভ হয়েছে। যদি তাই মন্দিরের পুরোহিতরা, একটুও টের পায়, তবে আর ফিরে যেতে হবে না। প্রত্যেক মাসে পূর্ণিমায় ওরা বার্তক থেকে মানস সরোবরে আসে। শুধু এই তাউ পুরোহিতদের সংখ্যাই হলো প্রায় দুহাজার। এদের কথায় তিব্বতের যে কোনো লোক জান দিয়ে দেবে। তাতে একটুও কুণ্ঠা বোধ করবে না।’
‘তাহলে উপায়?’
‘উপায় আছে বৈকি। কুয়াশা যে নক্সাটা আমার চোখের কোটর থেকে চুরি করেছে, তার duplicate আমার কাছে আছে। ওতে একটা সুড়ঙ্গের কথা উল্লেখ রয়েছে। ওই যে উত্তর-পূর্ব কোণে যে চূড়াটা দেখছো, ওর নিচে রয়েছে একটা গুহা। সেই গুহার ভিতর দিয়েই সুড়ঙ্গ পথটা চলে গেছে বার্তকে ঠিক তাউ মন্দিরের নিচে। সেখান থেকেই গুপ্ত ভাণ্ডারে যাবার সংযোগ রয়েছে কোনো পাথর। সেটা খুঁজে নিতে হবে। এই যে যুগল সাপের মূর্তি আঁকা ছোরাটা দেখছো, এটা হচ্ছে সেই গুপ্তকক্ষে প্রবেশ করবার চাবিকাঠি। এই ছোরাটা আসলে গুপ্তকর দরজার চাবি।’
‘কিন্তু হুজুর, ব্যাটা কুয়াশা যে আমাদের পেছনে লেগে নেই তাকে বলতে পারে?’ এবার নুরবক্সের চোখে ধ্বক করে আগুন জ্বলে উঠলো। সে আগুন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।
‘কুয়াশা! কুয়াশা!! তাকে একবার এখানে দেখতে চাই। আমার অনেক আয়ান সে পণ্ড করে দিয়েছে। এবার হাতের মুঠোয় পেলে আমি তার উচিত প্রতিশোধ নেবে। তারপর-গুপ্তধন নিয়ে দেশে ফিরে যাবো। সেখানে নিশ্চিন্তে অমরত্বের সাধনা করবো। শয়তান! থিসিস মনে করে নক্সাটা নিয়ে গেছে। থিসিসটা পায়নি।’
নুরবক্স ভয়ঙ্কর ভাবে হেসে ওঠে। সেই নির্জন জায়গায় শব্দটা অনেকগুলো প্রতি ধ্বনি হয়ে তাদের কাছে আবার ফিরে আসে। সেই শব্দে কতকগুলো অচেনা পাখি লেকের এদিক থেকে উড়ে গিয়ে খানিকটা দূরে বসলো।
‘আসুন, হুজুর, কিছু খেয়ে নেয়া যাক।’
‘আমি প্রথমে দু’একটা পাখি মেরে নিয়ে আসি। ঝলসে খাওয়া যাবে।’
নুরবক্স তার উইনচেস্টার রাইফেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সরোবরের শান্ত পরি বেশে অশান্তির রক্তস্রোত বইয়ে দিতে।
নুরবক্স যখন ফিরে এলো, তার এক হাতে রাইফেল, আরেক হাতে দুটো সাইবেরিয়ান গিজ। ভুলু হাঁস দটো দেখে আনন্দে উদ্বাহু নৃত্য আরম্ভ করলো।
‘উহ্! কতদিন এরকম মাংস চোখে দেখিনি। আজকে বেশ মজা করে খাওয়া যাবে।’ মুখ দিয়ে তার লালা ঝরতে লাগলো।
বেলা গড়িয়ে সূর্য যখন পশ্চিমের আকাশে অস্ত যাবার উদ্যোগ করছে, ওরা পাহাড়টার নিচে এসে দাঁড়ালো। সম্মুখে উল্লিখিত গুহাপথটা বিরাট মুখব্যাদান করে আছে। ভিতরটা গাঢ় অন্ধকার, যেন কেউ একপোচ কালি মাখিয়ে দিয়েছে তার অন্তরটায়। ভুলুয়ার মনটা ভীষণ দমে যায়। সভয়ে তাকায় নুরবক্সের দিকে।
‘একটা কথা বলবো হুজুর?’
‘কি, ভুলুয়া?’
‘এখনও সময় আছে হুজুর। চলুন আমরা ফিরে যাই।’
‘ভুলুয়া!’
চমকে উঠলো ভুলুয়া। নুরবক্সের তীব্র কঠিন চিৎকারে ভয়ে কেঁপে উঠলো। সে চেয়ে দেখলো, নরবক্সের উদ্যত উইনচেস্টারটা তার বুকের দিকে তাক করা। তাকে সাপের মতো ভয়ানক ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল। ভুলুয়ার মাথা আপনাতেই নত হয়ে এলো।
‘তাই হোক, হুজুর। আপনার সঙ্গে আমি জীবন দিতেও রাজি।’
‘শোন, ভুলুয়া। যে জন্যে এতো বিপদ এতো কষ্ট সহা করে এতদূর এলাম, সেই গুপ্তধন উদ্ধার না করে আর ফিরে যাবো না। তাছাড়া কুয়াশার সাথে আমার হিসাব নিকাশ এখনও বাকিই রয়ে গেছে। যদি দুনিয়ার তামাম লোককে খুন করতে হয়’ আমি তাতে রাজি, কিন্তু পিছু হটা চলবে না।
নুরবক্স একবার চারদিকে তাকালো। অপরাহ্নের ম্লান আলোটা গুহার সামনে এসে পড়েছে। সেদিকে শেষবারের মতো চেয়ে দেখলো সে। আবার পৃথিবীর আলো কবে দেখবে কে জানে?
ওরা ভিতরে ঢুকে পড়লো। একটা গাঢ় অন্ধকার যেন গ্রাস করে নিলো ওদের।
*
কুয়াশার বুক থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। বহু দুঃসাহসিক অভিযান সে করেছে। বহু বিপদে সে পড়েছে। সাফল্যের সুবর্ণ পরশ সব সময়ই তাকে ছুঁয়ে গেছে। কন্তু এবার কেন যেন তার উৎসাহ ঝিমিয়ে আসছে, কোথায় যেন একটা নৈরাশ্য তাকে শুধু পিছু টেনে ধরছে। তবে কিসে এতদূর সঠিক পথে এসেও শেষ রক্ষা করতে পারবে না? যতো বিপদের ঝুঁকিই তাকে নিতে হোক না কেন এগিয়ে তাকে যেতেই হবে। আজ পর্যন্ত কোনদিন সে পরাজয় বরণ করেনি। ভবিষ্যতেও করবে না।
কাঁধে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে আবার নামতে শুরু করলো নিচের দিকে। মান্নান তার পিছু পিছু চলেছে সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে। কিছুদূর নামার পর তারা একটা মতল গলি পেয়ে গেল। গলিটা ধরে খানিকটা এগিয়েই দেখতে পেলো মুক্ত প্রাঙ্গণের মতো জায়গা। মাথার উপরে অনেক উঁচুতে ছাদ। টর্চের আলো ফেলে কুয়াশা ছাদ দেখতে পেলো না। সেখানে গভীর অন্ধকার।
ঝির ঝির একটা শব্দ কানে আসতে লাগলো। একটা হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে তখন। দেখলো একটা ওর ধারা বয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় পানিটা জড়ো হয়ে খানিকটা চৌবাচ্চার মতো দেখাচ্ছে। দু’চারটা পাথর পড়ে আছে আনাচে কানাচে।
পিপাসায় মান্নানের ছাতি ফেটে যাচ্ছিলো। সে দৌড়ে গিয়ে আঁজলা ভরে পানি তুলে নিলো খাবার জন্যে। কিন্তু কুয়াশা তাড়াতাড়ি তার হাত থেকে সে পানি ফেলে দিলো।
‘সর্বনাশ! আরেকটু হলেই হয়েছিল আর কি! এ যে খুব বিষাক্ত পানি, মান্নান। এই রকম ঘোলা পানিতে থাকে সবুজ রঙের বিষাক্ত সাপ। যার ছোবলে মানুষ এক মুহূর্ত বাঁচতে পারে না। এ পানি খেয়েছে কি মরেছে।’
‘বাপরে বাপ! এক শত্রুর মোকাবেলা করতে এসে দেখছি এখন বহু শত্রুর মোকাবেলা করতে হচ্ছে।’
‘বিষের বাঁশুরী বাজিয়েই তোমাকে অমৃত তুলতে হবে, মান্নান। ঘাবড়ালে চলবে কেন?’
কুয়াশা তার water carrier খুলে মান্নানকে পানি খেতে দিলো। আসার কিছুদূর যাবার পরে দুটো রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। কুয়াশা জায়গাটা পরীক্ষা করবার জন্যে চারদিকে টর্চের আলো ফেললো। অনেকগুলো বাদুড় উপর থেকে ঝলছিল, আলো দেখে ভয় পেয়ে ছুটাছুটি করতে লাগলো।
কুয়াশা মান্নানকে সাবধান করে দিলো। ‘ওই যে ওদের রক্ত-মুখ দেখছো, ওগুলো Vampire Bats, রক্ত শোষক বাদুড়। ঘুচিয়েছ কি রক্ষা নেই। একেবারে সাবড়ে দেবে। তোমায় আর তাহলে দেখতে হবে না। এদের এলাকার বাইরে গিয়ে আমাদের বিশ্রাম করতে হবে।’ কুয়াশা অনেকক্ষণ চিন্তা করলো, তারপর বাঁদিকের গলিটা ধরে এগোতে লাগলো। যেতে যেতে এমন জায়গায় গিয়ে পড়লো, সামনে কোনো পথ নেই। সম্মুখে খাড়া দল পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
থমকে দাঁড়ালো ওরা। আবার বুঝি অন্যপথে যেতে হবে তাদের। কিন্তু এবার বিশ্রামের প্রয়োজন। ওরা ওখানেই আস্তানা গাড়লো কিছু সময়ের জন্য। খুঁজে বের করতে হবে রাস্তাটা কোনদিকে গেছে। মান্নান ঘুমিয়ে পড়েছে। কুয়াশা শুধু জেগে আছে। চারদিকে বদ্ধ দেয়াল, কিন্তু মনের রুদ্ধ দেয়াল খুলে গেল। মনে পড়লো বোন মহুয়াকে। যে স্নেহ থেকে সে চিরকাল বঞ্চিত, সে স্নেহের দান পেয়েছে বোনটির কাছে। জীবনের অনেক অপূর্ণতা ক্ষণিকের মাঝে ভরিয়ে দিয়েছে। চিরদিন সে স্মৃতি জাগরুক হয়ে থাকবে তার জীবনে ধ্রুবতারার মতো। সে যেন হাসি-কান্নার, সুখ-দুঃখে ভরা সহজ মানুষ হয়ে গেছে।
এমনি অনেক কিছু কুয়াশা ভাবছিল কিন্তু সে জানতেও পারলো না, তাদের ডানপাশে কোন এক গলি দিয়ে নুরবক্স এগিয়ে চলেছে। হয়তো নুরবক্সও ধারণা করতে পারেনি, তার ভীষণতম প্রতিদ্বন্দ্বী কুয়াশা তার এতো কাছে, শুধু খানিকটা দেয়ালের ব্যবধান তাদের মাঝে।
কিন্তু সেই মুহূর্তে ওরা একে অপরকে ভাবছিল। কখন তাদের নাটকীয়ভাবে দেখা হয়ে যাবে তারই প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তারা মনে মনে।
উপরে তাদের শক্ত মাটি। সে মাটির বুক থেকে আকাশের দিকে উঠে গেছে দীর্ঘ পাইন আর দেবদারুর সারি। আকাশটা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে লম্বা গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে। সেখানে অনেক চেনা অচেনা তারার মেলা, এলোমেলো হয়ে ফুটে রয়েছে।
এগারো
নেপালের গিরিপথ বেয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে মানস সরোবর হয়ে বার্তক, তারপর পূর্ব দিকে চলেছে লাসার দিকে সে পথ অতি দুর্গম, বন্ধুর পথ।
ছদ্মবেশী মি. সিম্পসন, মি. চ্যাং ফু, শহীদ আর গফুর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে সেই পথ বেয়ে, যেন কোন পাহাড়িয়া কাঠুরের দল চলেছে কাঠ কাটতে।
গফুর চলেছে সবার পিছনে। বেশ ভারি একটা বোঝা তার পিঠে। কিন্তু আসুরিক শক্তি তার গায়ে। অবলীলাক্রমে এগিয়ে চলেছে সে পাহাড়িয়াদের মতো পা টেনে টেনে।
খাম্বাজং লেকের ধারে তারা পৌঁছে গেছে। চোখের সামনেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে পুণাক্ষর পাদপীঠ। আরও দূরে বার্তকের তাউ মন্দিরের হাজার স্বর্ণ-চূড়া সম্মুখে নয়নগোচর হয়ে আপন মহিমায় ঝলমল করছে। মাঝখানে আর দু’একটা চড়াই উৎরাই মাত্র। এবার ওরা গিয়ে পৌঁছুতে পারবে বার্তকে আর ঘন্টা চারেকের মধ্যেই। . তবে ভয়ানক পরিশ্রান্ত ওরা। আর মানস সরোবরের দুঃস্বপ্ন এখনও মন থেকে মুছে যায়নি।
ধীর পদে চলেছে ওরা। চলতে চলতে এক সময় চ্যাং ফুপুর কান সজাগ হয়ে উঠলো। হাত তুলে ইশারা করতেই সমস্ত দলটা থেমে গেল।
মি. সিম্পসন তাই দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। চাপা গলায় জিজ্ঞাস করলেন, ‘ব্যাপার কি, মি. চ্যাং ফু? হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন কেন?’ মি. চ্যাং ফুঁ মুখে আঙুল দিয়ে ইশারা করলেন কোনো রকম শব্দ না করার জন্যে। তারপর গিয়ে হাজির হলেন জঙ্গলের আরও গভীরে। বাকি সবাইও তাঁর পিছন পিছন গিয়ে দাঁড়ালো তাঁর পাশে।
মি. সিম্পসনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘Bamboo Telegraph (বাঁশের খবর)। বাঁশে বাঁশে আওয়াজ তুলে ওরা ওদের ভাষায় সংকেতে খবর পাঠায়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। ওরা হয়তো টের পেয়ে থাকবে। দেখাই যাক না কি হয়। আপাততঃ আমাদের এখানে চুপ করে সময় কাটানো ছাড়া কোনো পথ দেখছি না।’
প্রত্যেকটি মূহর্ত এক এক যুগ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু গফুর চুপ করে থাকতে পারলো না। মশার ভীষণ উৎপাত এ জঙ্গলটায়। ছিনে জোকের মতো লেপটে ধরেছে গফুরের গায়ে। সে চটাস চটাস শব্দে মশা মারতে থাকে। শহীদ তার এই বেয়াড়াপনায় ধমকে উঠলো চাপাস্বরে।
কিছুক্ষণ এই অস্বস্তিকর পরিবেশে ওরা নীরবে সময় কাটালো। হঠাৎ শহীদের মনে হলো বনটা কেমন যেন সজীব হয়ে উঠলো। যেন বহু চোখ একদৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে আছে। ভয়ানক অস্বস্তি লাগলো তার।
এমন সময় একটা তীব্র বাঁশির আওয়াজ ভেসে এলো। তারপর তাদের সামনে যেন আকাশ কুঁড়ে বেরিয়ে এলো অনেক লোক। বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত এই লোকজনের চেহারা দেখে মনে হলো লোকগুলো ভয়ানক হিংস্র। মারাত্মক রকম সব অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওরা এগুতে লাগলো।
ডাইনে তাকালো ওরা, সেখানেও বহু পাহাডিয়া জড়ো হয়ে রয়েছে। বাঁয়ে দেখলো সেদিকেও ফাঁক নেই। গফুর এবার পিছনের দিকে তাকিয়েই হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললো। পিছনেও বহু লোক জমায়েত হয়ে রয়েছে। কোনো দিকেই আর তাদের পালাবার পথ নেই।
গফুরের আক্ষেপ হলো দিদিমণিকে বোধহয় আর দেখতে পাবে না। চোখের পানি আর বাধা মানলো না।
এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব জেনেও ওরা যেদিকে ভিড়টা একটু কম সেদিকে ছুটে গেল। এবার অনেকগুলো বল্লম ছুটে এসে ওদের চারদিকে ছিটকে পড়লো। অল্পের জন্য ওদের গায়ে লাগলো না। শত শত লোক ছুটে আসছে তাদের দিকে, আর বুঝি রেহাই নেই।
এর মধ্যে অগ্রগামী একটা দলের সাথে ওদের সংঘর্ষ বাধলো। ওরা একটা ঝোঁপের কাছে সরে এলো। শহীদ তার রিভলভারটা বের করে পর পর দু’টো গুলি ছুড়লো। দু’জন শত্রু ধরাশায়ী হলো। এবার সবাই হাত চালাতে লাগলো। ওদের গুলির মুখে তারা খানিকটা পিছু হেঁটে যেতে বাধ্য হলো। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন পাহাড়িয়া ঘায়েল হয়ে গেছে ওদের রিভলভারের গুলিতে।
গফুরও বসে নেই। তার দাদামণির পাশে দাঁড়িয়ে সেও গুলি ছুড়ছে। অদ্ভুত লক্ষ্যভেদ তার। কিন্তু আধঘন্টার মধ্যেই সব গুলি তাদের ফুরিয়ে গেল। রাগে দুঃখে মি. সিম্পসন হাতের রিভলভারটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
ওরা এগিয়ে এলো কাছে, আরও কাছে তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উপর। “যুঝবার কোনো উপায় নেই। একে একে ওরা হলো বন্দী। জয়ের উল্লাসে পাহাড়িয়া
লোকগুলো চিৎকার করতে লাগলো। ঢাকগুলো বেজে উঠলো খ্রিম খ্রিম করে। ওদের বেঁধে চ্যাংদোলা করে নিয়ে রওনা দিলো বার্তকের পথে। লম্বা লাইনে ধীর পদে চলতে লাগলো ওরা প্রসেশন করে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সকলের সামনে একজন তাউ গুরু মশাল হাতে এগিয়ে চলেছে উচ্চস্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে। ভয়ানক হিংস্র সে মুখ। প্রতিশোধের চরম প্রতিচ্ছবি সেখানে।
বার্তকের রাজপথে যখন ওরা ঢুকলো মন্দিরের সবগুলো ঘন্টা একসঙ্গে বেজে উঠলো। হট্টগোল করতে করতে অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু ছুটে এসে রাস্তার দু’ধারে ভিড় জমিয়েছে ওদের প্রসেশন দেখতে।
ভয়ানক উত্তেজিত ওরা। ওদের আন্দোলিত হাত পায়ের ভঙ্গিতে শহীদ এটুকু বুঝতে পারছে যে, ওরা তাদের মৃত্যু কামনা করছে।
*
মন্দিরের সিংহদ্বার থেকে রাস্তাটা ক্রমশ ঢালু হয়ে ভিতরের দিকে চলে গেছে। দরজার দু’পাশে দু’টো ড্রাগনের মূর্তি। শহীদ একবার উপরের দিকে চাইলো। সুউচ্চ মন্দির চূড়া। সোনার কলসীগুলো তারার আলোতে স্নিগ্ধ হয়ে আছে।
ওদের যেখানে নিয়ে এলো, সেটা মাটির একশো ফুট নিচে একটা বিরাট হলঘর। প্রায় চার হাজার লোকের জায়গা হতে পারে, এমনি বিরাট সে জায়গা। দেয়ালে দেয়ালে মশাল জ্বলছে। সম্মুখে একটা উঁচু বেদী। বেদীর মাঝখানে বিরাট অগ্নিকুণ্ড। মন্দির তৈরির পর থেকে এই আগুন জ্বলছে, কোনদিন নেভেনি। ওদের নিয়ে যাওয়া হলো ওই বেদীর সম্মুখে। সেখানে কয়েকটা থাম মাটিতে পোঁতা রয়েছে। ওদের প্রত্যেককে একেকটা থামের সাথে বেঁধে ফেলা হলো। বেদীর পিছনে বহু জায়গা, কিন্তু সেখানে কেমন একটা আবছা অন্ধকার জমাট বেধে আছে। অস্বাভাবিক পরিবেশ চতুর্দিকে। শুধু হৈ চৈ আর ঢাকের ড্রিম খ্রিম শব্দ।
একজন ভীষণ দর্শন তাই পুরোহিত বেদীর উপর উঠে এলো। সকলের উপরেও একমাথা উঁচু সে। মাথাটা পরিষ্কার করে কামানো। কুলার মতো কান দুটো এতবড় যে চেহারার সাথে একেবারে বেমানান। দুটো বড় বড় সোনার বালা সে কানের শোভা বর্ধন করছে। গায়ে লম্বা আলখেল্লা।
ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এসে ডান হাত উঁচু করে প্রলো সে। সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ একদম চুপ হয়ে গেল। একটা উঁচ পড়লেও মনে হয় সে শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে। সে হাত পা নেড়ে অনবরত বহু কথা জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলে যাচ্ছে, কিন্তু তার বিন্দুবিসর্গ শহীদ বুঝতে পারলো না। শুধু এটুকু বুঝলো যে মৃত্যু তাদের অনিবার্য। এদিকে পুরোহিত বলে চলেছে নিজ ভাষায়।
‘বার্তকের নাগরিকবৃন্দ!’ ভীষণ গর্জনের মতো তার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো।
‘যুগ যুগ ধরে আমাদের পিতা-প্রপিতামহের অমর আত্মারা তিল তিল করে তাদের বুকের রক্ত ক্ষয় করে যে ধনরত্ন আহরণ করে গেছেন, সেগুলো আমরা আমাদের জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে রক্ষা করছি। কিন্তু আপনাদের জানা উচিত সেগুলো কিছু বিদেশী তস্কর অপহরণ করার চেষ্টা করছে। তার প্রমাণ আপনার সম্মুখে রয়েছে।
‘এই যে চারজন তস্কর আপনাদের সম্মুখে বন্দী অবস্থায় রয়েছে, এরা সেই সুযোগই নেবার জন্যে এসেছিল। কিন্তু আমারে দেবতার কৃপা আমাদের উগ্র আছে যার জন্যে এখানে পৌঁছবার আগেই এরা ধরা পড়েছে। এদের গুলি চালনায় আমরা বহু বান্ধব হারিয়েছি। এখন এদের বিচার করা হবে।
‘আপনারা এদের বিচার করে রায় দিন কি শান্তি এদের দেয়া হবে?’
সমবেত জনতা চিৎকার করে উঠলো। ‘মৃত্যু! মৃত্যু! এদের ড্রাগনের কূপে ফেলে দিন। দেবতা তুষ্ট হবে।’
পুরোহিত দু’হাত তুললেন। ‘হ্যাঁ! ড্রাগনের কূপেই ওদের উৎসর্গ করা হবে। কিন্তু তার আগে আরও ভয়ানক শাস্তি এদের দিতে হবে। তিলে তিলে হবে ওদের মৃত্যু। এতো ভয়ঙ্কর সে মৃত্যু যে লোকে শুনলে শিউরে উঠবে। আগামীকাল ওদের উৎসর্গ করা হবে ড্রাগন দেবতার পাদমূলে।’
এরপর ধীরে ধীরে পুরোহিত অগ্নিকুণ্ডের কাছ থেকে একটা অগুরু চন্দনের বাটি নিয়ে ওদের সবার কপাল চর্চিত করে দিলো। একটা ধূপদানে খানিকটা ধূপ দিয়ে আগুনটা একটু খুচিয়ে দিলো। ধূপের ধোঁয়ায় আর গন্ধে জায়গাটা আমোদিত হয়ে উঠলো। এবার পুরোহিত ধ্যানে বসলো অগ্নিকুণ্ড টার সম্মুখে।
আবার ঢাক বেজে উঠলো। অটোয়োলে চতুর্দিকে কান পাতা ভার। জায়গাটায় তিল ধারণের স্থান নেই।
*
কুয়াশা যে জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলো, সেখানে একটা খাড়া দেয়াল পথ বন্ধ করে উপরে উঠে গেছে। একমাত্র ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু কুয়াশার অভিধানে ‘পরাজয়’ শব্দটা ছিলো না বোধহয় ছাপার ভুলে।
সে চারদিকে দেখতে লাগলো। দেয়ালে দেয়ালে টোকা দিয়ে পরীক্ষা করলো। কিন্তু সব জায়গাই মনে হলো দুর্ভেদ্য। হঠাৎ কেমন যেনো সন্দেহ হওয়ায় সে কান পেতে নিচের দিকে কি যেন একটা আওয়াজ শুনতে চেষ্টা করলো।
মনে হলো পাথরের নিচে কুলু কুলু রবে যেন একটা ঝর্না বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতো অস্পষ্ট সে আওয়াজ যে শোনা যায় না একেবারেই।
কুয়াশা হতাশ হয়ে গেল। ভাবতে লাগলো কি করে পাথর ভেঙে রাস্তা করা যায়। মান্নান একটা বড় ভাঙা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে জোরে জোরে পায়ের নিচের পাথরে আঘাত করতে লাগলো।
এবার কুয়াশা চেষ্টা করলো। পাথরটা নিয়ে বিপুল বিক্রমে নিচের পাথরটায় জোরে মারতে লাগলো। কিছু একটা শব্দ হলো। খানিকটা জায়গা ফেটে গেছে। অবশেষে সে জায়গাটুকু ভেঙে ফেললো। কুয়াশা ভাঙা পাথরটুকু তুলে নিলো।
এবার পানির স্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেলো কুয়াশা। সে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পাথরটাকে টানতে লাগলো। বেশ বড় একটা পাথর দেয়ালের অন্য দিক থেকে চলে এলো। নিচে একটা বুর্নার পানি ভীষণ বেগে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে ছুটে চলেছে।
অত্যন্ত স্বচ্ছ সে পানি। কুয়াশা সেই পানিতে হাত দিলো। হিম শীতল পানি, কিন্তু অত্যন্ত পরিষ্কার। আঁজলা ভরে সেই পানি বেশ খানিকটা খেয়ে নিলো।
এবার নিচের দিকে মুখ দিয়ে দেয়ালের অপর দিকটা দেখে নিলো সে। রাস্তাটা চলে গেছে আবার ঠিক ভাবেই। এবার পানি মাপলো, খুব বেশি গভীর নয়, হাঁটু পানি মাত্র। ওরা সেই পানিতে নেমে খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে দেয়ালের ওপারে গিয়ে উঠলো।
নিয়ন টর্চটা জ্বাললো কুয়াশা। সম্মুখে ভীষণ অন্ধকার, কিন্তু উঁচু আর চওড়া রাস্তাটা অনেক প্রশস্ত হয়ে গেছে।
আরও খানিকদূর এগিয়ে গেল ওরা। এবার ঢাকঢোলের আওয়াজ শুনতে পেলো। ক্রমে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো সে আওয়াজ। দূরে একটা মৃদু আলোর রেখা ফুটে উঠলো। ওরা এবার অতি সন্তর্পণে এগোতে লাগলো। কুয়াশা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ালো, যেখান থেকে খানিকটা নিচে দেখতে পেলো একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। তার সম্মুখে বসে এক ভীষণ দর্শন পুরোহিত ধ্যানে সমাহিত। আগুনের আভায় সে মুখ আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।
একি! ওখামে বাঁধা রয়েছে কারা? মি. সিম্পসন যে! ওদিকে শহীদ ও গফুরও রয়েছে। আর মাঝখানে ওই চীনাম্যানটা কে? এইবার মনে পড়ছে। পিকিং-এ দেখেছে তাকে। গুপ্ত পুলিসের বড় সাহেব মি. চ্যাং ফু। এতক্ষণে তাহলে ব্যাপারটা বোঝা গেল। শেষ রক্ষা করতে পারেনি ওরা। ধরা পড়ে গেছে পাহাড়িয়াদের হাতে।
কুয়াশা ও মান্নান এগিয়ে এসে বেদীর পিছনে একটা অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়েছে। কিছু নিচে বিরাট হলঘরে কয়েক হাজার লোক উৎসব মুখরিত।
এরা এসেছিল কুয়াশাকে বন্দী করতে, কিন্তু ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, নিজেরাই ধরা পড়ে গেল।
কিন্তু কুয়াশা তো চুপ করে বসে থাকতে পারে না। বিবেকের দংশনে সে জর্জরিত হবে তাহলে। যেমন করে হোক ওদের বাঁচাতেই হবে। তারপর দেখা যাবে মি. সিম্পসনের শক্তি কতখানি। সে মোটেও পরোয়া করে না ওই আই. বি-র জাঁদরেল বড় সাহেবটাকে।
কুয়াশা এক সময় ভেন্ট্রিলুকুইজম শিখেছিল অত্যন্ত যত্নের সাথে। শহীদের মনে হলো কে যেন তার কানের কাছে মুখ রেখে কথা বলছে। ‘শহীদ, Don’t lose your heart, my friend! আমি তোমার কাছেই আছি।’
শহীদ চমকে ফিরে তাকালো, এ যে কুয়াশার কণ্ঠস্বর! সত্যি কুয়াশা তাদের কাছে আছে?
এবার মনে পড়লো তার পিকিং-এর কথা। মি. চ্যাং ফু’র অফিস থেকে বেরোবার সময় একজন চীনাম্যান চকিতে সরে গিয়েছিল। চেনা চেনা মনে হলেও সে মুখ চিনতে পারেনি। এবার মনে পড়লো, সে মুখ কুয়াশার।
একটা আরামের নিঃশ্বাস তার বক্ষ ভেদ করে উপরের দিকে উঠে এলো। সে চাপাস্বরে সিম্পসনকে খবরটা জানালো। গম্ভীর হয়ে গেলেন সিম্পসন। শহীদ আর কিছু বললো না। কিন্তু কি জানি কেন, মি. সিম্পসন খবরটা শুনে হঠাৎ উৎসব মুখরিত পাহাড়িয়াদের মাথার উপর দিয়ে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বারো
জীবনের এমন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে কুয়াশা, যেখান থেকে মোড় ঘুরবার আর কোনো পথ নেই। অর্থাৎ তার মিশনের সবে মাত্র আরম্ভ। যে উদ্দেশ্যে তার এতদূর আসা, এখন তার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। একদিকে শহীদ খান প্রমুখরা বন্দী, অন্য দিকে বিরাট তাই সম্প্রদায় তার পথে দুর্জয় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নুরবক্স এখন কোথায় কে জানে। হয়তো আশেপাতাই ওৎ পেতে বসে আছে। কিন্তু নুরবক্স এখন থাক। আগে শহীদদের মুক্ত করতে হবে।
বেদীর পিছন দিকটায় কিছুটা জায়গা কার্নিশের মতো বেরিয়ে রয়েছে। ওখানটায় জমাট অন্ধকার। কুয়াশা মান্নানকে সাথে নিয়ে সেই কার্নিশটায় এসে দাঁড়ালো।
উৎসব শেষ হয়ে গেছে। সমস্ত লোকজন চলে গেছে যে যার জায়গায়। সমস্ত হলঘরটা খালি। শুধু নিবু নিবু মশাল থেকে কিছুটা আলো অন্ধকার দূর করবার চেষ্টা করছে। বেদীর উপর পুরোহিত তেমনি ধ্যানে সমাসীন। ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসী এবার চোখ খুললো। চোখ দুটো অঙ্গারের মতো জ্বলছে। রোষ কষায়িত নয়নে একবার দেখে নিলো শহীদদের।
তারপর উঠে দাঁড়ালো। কোমর থেকে দীর্ঘ একটা ছোরা বের করে প্রথমে সে এগিয়ে গেল শহীদের কাছে। সভয়ে শহীদ চোখ বুজলো। আর বুঝি রক্ষা নেই।
সেই মুহূর্তে কুয়াশা লাফিয়ে পড়ল বেদীটার উপরে। পুরোহিত এবার দেখতে পেলো কুয়াশাকে। সে শহীদকে ছেড়ে কুয়াশার দিকে অগ্রসর হলো।
পরস্পর পরস্পরকে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিলো। এতদিনে বোধহয় ওরা যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছে।
‘তাহলে তুমিই হচ্ছো পালের গোদা। তোমার জন্যই আমাদের এ অবস্থা। তবে মরো হতভাগা।
কুয়াশা কথাগুলো বুঝলো না কিন্তু ভাবার্থ সে ঠিকই বুঝে নিলো।
পুরোহিত সাঁই করে তার হাতের ছোরাটা ছুঁড়ে মারলো কুয়াশার দিকে। সেই মুহূর্তে যদি কুয়াশা একটু সরে না দাঁড়াতো তবে ছোরাটা আমূল বিদ্ধ হতো তার বুকে। কিন্তু ছোরাটা গিয়ে লাগলো মি. সিম্পসনের মাথার উপরে থামটার গায়ে।
নিরস্ত্র পুরোহিতের সামনে এগিয়ে এলো কুয়াশা। হাতের মুঠোয় ধরা রিভলভারটা পকেটে রেখে দিলো।
কুয়াশার প্রচণ্ড এক মুষ্টাঘাতে পুরোহিত পিছন দিকে ঢলে পড়লো। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যে। আহত বাঘের মতো আবার সে ঝাঁপিয়ে পড়লে কুয়াশার উপর।
কুয়াশা এবার তার তলপেটে বাঁ হাতের আর একটা প্রচণ্ড মুষ্টাঘাত যোগ করলো। পুরোহিত বেদনায় নীল হয়ে মাটিতে বসে পড়লো। কুয়াশা তার ঘাড়ে দু’হাতের এক বিরাশী সিক্কার রদ্দা ঝাড়লো। পুরোহিতের তখন চোখে শর্ষে ফুল দেখার মতো অবস্থা। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কুয়াশার পায়ের উপর। সে পুরোহিতকে টেনে তুলে দাঁড় করাবার চেষ্টা করলো কিন্তু দাঁড়াতে পারলো না সে। কুয়াশা দুহাতে তাকে অবলীলাক্রমে শূন্যে তুলে নিলো। এক মুহূর্ত চিন্তা করলো, তারপর তাকে সেই বিরাট অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আবহমানকাল থেকে যে আগুন জ্বলছে, সে গ্রাস করলো কুল পুরোহিতকে।
এবার মান্নান এসে কুয়াশার পাশে দাঁড়ালো।
‘মান্নান, তুমি তাড়াতাড়ি গফুরের হাত-পায়ের বাঁধন কেটে দাও। দেরি করলে যে কেউ চলে আসতে পারে। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তারপর, শহীদ, তোমাদের খবর কি? হ্যাল্লো, মি. সিম্পসন–আমার ভয়ানক দুঃখ হচ্ছে আপনাদের জন্যে। এতো চালাক মানুষ হয়ে এতো বোকামি করতে পারেন তা ভাবতেই পারিনি।’
মি. সিম্পসন সে কথার কোনো জবাব দিলেন না।
‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। গফুরকে মান্নান মুক্ত করে দিয়েছে। আমরা চলে গেলে সে তোমাদের বাঁধন খুলে দেবে। শহীদ, এই রুট ম্যাপটা রেখে দাও, ঐ গুপ্ত দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে, তারপর এই ম্যাপ অনুযায়ী রাস্তা খুঁজে নিও। তা হলে নিরাপদে দেশে ফিরতে পারবে। হ্যালো, মি, চ্যাং ফু। আপনার জন্যে রইলো অভিনন্দন। তবে একটা কথা হচ্ছে, কুয়াশাকে কোনদিন under-estimate করবেন না। আশা করি সে কথাটা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন? OK Good bye to everybody. গফুর তুমি সাহেবদের বাঁধন খুলে দাও চট করে।
অসহায় মি. সিম্পসনের চোখের সামনে কুয়াশা মান্নানকে নিয়ে চলে গেল গুপ্ত পথ ধরে। সিম্পসন বিরক্ত হয়ে গফুরকে বললেন, ‘একটু তাড়াতাড়ি বাঁধনগুলো খুলে দাও।’
কিন্তু শহীদের বিস্ময় বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে এক কৃতজ্ঞতা বোধ। এভাবে বিপদের সময় কুয়াশা তাকে কয়েকবারই রক্ষা করলো।
মি. চ্যাং ফুঁ মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন এতক্ষণ ধরে এই অসীম বলশালী মহৎ লোকটিকে। শ্রদ্ধায় তাঁর সমস্ত অন্তর ছেয়ে গেল। নিজের বিপদকে তুচ্ছ করে, যে শত্রুকে এভাবে বাঁচাতে পারে সে সত্যিই মহৎ। তিনি কুয়াশার উদ্দেশ্যে তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। ‘ধন্য কুয়াশা!’
*
‘দেখ মান্নান, পেছনে শত্রু সম্মুখেও শত্রু রয়েছে, সুতরাং সাবধানে আমাদের এগোতে হবে। নুরবক্সকে যে ভাবে হোক আমাদের ধরতে হবে। কারণ ওর কাছে রয়েছে গুপ্তধনের চাবিকাঠি। যে যুগল সাপ আঁকা ছোরাটা রয়েছে তার কাছে ওটা আমাদের হাত করতে হবে।’
‘কিন্তু সে শয়তানকে আমরা খুঁজে পাবো কোথায়?’
‘ধীরে, বন্ধু ধীরে। নুরবক্স আর যেখানেই থাক আমাদের ধারে কাছেই রয়েছে। সে চায় গুপ্তধন। সুতরাং গতি তার নির্দিষ্ট পথেই। তাকে পেতে আমাদের বেশি বেগ পেতে হবে না।’
ওরা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলে সুড়ঙ্গ পথে। যে জায়গাটায় দুটো পথ দু’ ধারে চলে গেছে, কুয়াশা বেছে নিয়েছিল ডান দিকের পথটা। এবার ওরা বাঁ দিকে চলতে আরম্ভ করলো। অতি সন্তর্পণে ওরা এগিয়ে চলেছে। এক জায়গায় গলি পথটা ছোট হয়ে এলো অনেকখানি। হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হবে এ পথে। ওরা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল সেই জায়গাটায়। দু ধারে অনেক পাথর কাঁটার মতো বেরিয়ে আছে। হাত-পা ছড়ে, গেল তাদের অনেক জায়গায়, তবুও ভ্রূক্ষেপ নেই। কুয়াশী মনে মনে হিসেব করে দেখলো একটা কিছু। আর এক ফার্লং মাত্র। তারপরই তারা আজীবন সঞ্চিত ধনভাণ্ডারের সম্মুখে গিয়ে পৌঁছুবে। একথা মনে করে তাদের সমস্ত ক্লান্তি আর অবসাদ এক মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল।
আরেক মোড় ঘুরতেই গলিটা আবার বড়ো হয়ে এলো। কুয়াশা দেখতে পেলো দুটো ছায়ামূর্তি স্থির হয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। সে হাতের ইশারায় মান্নানকে থামিয়ে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে কুয়াশা সেখানে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো তার অতীতের সহচর নুরবক্স ও ভুলুয়ার কীর্তিকলাপগুলো।
ইচ্ছা করলে কুয়াশা এক মুহূর্তেই শেষ করে দিতে পারে ওদের, কিন্তু তা সে করবে না। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তলতে হবে। অপো এবে। দেখবে নূরক্সের দৌড় কতখানি! তারপর এমন শিক্ষা দেবে তাকে, যা আমরণ সবার মনে থাকবে।
নুরবক্স হঠাৎ উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো।
‘পেয়েছি, ভুলুয়া, পেয়েছি! চেয়ে দেখ আমাদের সামনে সেই গুপ্তকক্ষের দ্বার। একবার এর ভেতরে ঢুকতে পারলেই–ব্যাস্! তারপর সারা জীবন পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে খেতে পারবি। হাঃ হাঃ হাঃ!’
নুরবক্স পাগলের মতো হাসতে আরম্ভ করলো।
‘কুয়াশা তুমি এখন কোথায়? তোমায় কাঁচকলা দেখিয়ে এতসব ধনরত্ন আমিই ভোগ করবো। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!’
হঠাৎ ভুলুয়ার আর্তচিৎকারে নুরবক্স সংবিৎ ফিরে পেলো। অনেক বিস্ময় তখন তার জন্যে জমা হয়েছিল। এক জোড়া সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সম্মুখে। তাদের গায়ের রঙ সবুজ। চোখ দুটো কাঁচের মতো স্বচ্ছ অথচ ক্রুর। সেই চোখে তাদের দিকে চেয়ে দেখছে, আর ভয়ানক রাগে ফুঁসছে। যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত ওদের সামনে। দাঁড়িয়ে। ওদের প্রতি নিঃশ্বাস যেন আগুনের ঝলক। একটা মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন জীবন্ত হয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাপ যে এতবড় হতে পারে সেটা কল্পনার বাইরে। ওরা যেন বংশ পরম্পরায় এখানে বাস করছে এমনি যুগলভাবে, যুগ যুগ ধরে।
এ মুহূর্তে নুরবক্স মন স্থির করে ফেললো। রাইফেলটা তুলে নিলো হাতে, অব্যর্থ লক্ষ্য। কিন্তু তখন বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে।
বিকট গর্জনে একটা সাপ এগিয়ে আসতে লাগলো ওদের দিকে। রাইফেল ছুঁড়তে পারলো না নুরবক্স।
হঠাৎ একটা ভয়ানক ঝাঁপটা এসে লাগলো ওদের গায়ে। মুহূর্তে যেন প্রলয় হয়ে গেল। গাঢ় অন্ধকার। কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল নুরবক্স বুঝতেই পারলো না। আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে।
ভুলুয়া তখনও দাঁড়িয়ে। ভয়ে সে কাঁপছে। কিন্তু ক্ষমাহীন কয়েকটা ছোবল এসে পড়লো তার বুকে। একটা আর্তচিৎকার করে উঠলো ভুলুয়া। তার মৃতদেহটা লুটিয়ে পড়লো নুরবক্সের পাশে।
কুয়াশার চোখের সামনেই ঘটে গেল সবকিছু। এবার সে তুলে নিলো তার রাইফেলটা। পর পর দুটো গুলি ছুড়লো। গুলি দুটো তার লক্ষ্যে পৌঁছুতে পেরেছে। সাপ দুটো লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। কয়েকবার ওরা মাথা তুলবার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।
‘অদ্ভুত! আশ্চর্য! চোখে দেখেও যে বিশ্বাস করা যায় না। এরা এভাবে যক্ষের মতো জায়গাটা আগলে বসে ছিলো এতদিন! মান্নান তার বিস্ময় চাপতে না পেরে বলে উঠলো।
কুয়াশার স্বর গাঢ় হয়ে আছে। ‘ঠিক তাই, মান্নান। অনেক কল্পনা আমরা অলীক বলে হেসে উড়িয়ে দিই, কিন্তু একদিন হয়তো সে সত্য হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। সে জন্যে কিছুই এক কথায় উড়িয়ে দেয়া উচিত নয়।’
কুয়াশা এগিয়ে গেল। নুরবক্সের কোমরে সে সাপের যুগল মূর্তি আঁকা ছোরাটা দেখতে পেলো। ভয়ানক দেখাচ্ছে ছোরাটা। মাটিতে যে সাপ দুটো মরে পড়ে আছে, ছোরাটায় যেন তারই প্রতিচ্ছবি। ছোরাটা হাতে নিয়ে কুয়াশা এগিয়ে যায় দরজাটার কাছে। মান্নানের হাতে জ্বলছে নিয়ন টর্চটা। দরজার উপরে খোদাই করা রয়েছে যুগল সাপের একটা মূর্তি। অদ্ভুত ভাবে কুয়াশা তাকিয়ে থাকে পাথরে খোদাই করা গাঢ় লাল রঙয়ের মূর্তিটার দিকে। ঠিক যেন তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মূর্তিটার সমস্ত গা বেয়ে।
একটা আতঙ্ক শিহরণ ঢেউ খেলে গেল মান্নানের সর্বশরীরে।
চাবির গর্তটা খুঁজে পেতে দেরি হলো না কুয়াশার। সে হাতের ছোরাটা ঢুকিয়ে দিলো সেই গর্তটার ভিতর। সামান্য একটু চাপ দিতেই দরজার মাঝখানে একটু ফাঁক হয়ে গেল। কুয়াশা সেই জায়গায় দু’দিকে দু’হাতে চাপ দিলো। মনে হলো দরজাটা যেন কতগুলো চাকার উপর গড়িয়ে চলতে আরম্ভ করেছে। আর একটু চাপ দিতেই সুন্দর ভাবে দু’দিকের দেয়ালে দরজাটা দু’ভাগ হয়ে মিলিয়ে গেল।
এক নয়নাভিরাম দৃশ্য অপেক্ষা করছিল তাদের জন্যে। বেশ বড় রকমের চৌকোণা একটা ঘর। ঘরের চতুর্দিকে ঘনো দ্যুতি ফুটে বেরুচ্ছে।
বহু বছরের সঞ্চিত মণিমুক্তা চারদিকে থরে থরে সাজানো, অন্ধকারেও তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। কুয়াশা ধীর পদক্ষেপে কক্ষের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো। মান্নান পাগলের মতো মুঠো মুঠো হীরা ছড়াতে লাগলো চারদিকে।
কুয়াশার মনে পড়লো নীল নদের কথা। সম্ভ্রান্ত বংশের নষ্টা মেয়ে জেবা ফারাহর বোন দীবা ফারাহর কথা। ম্যান ট্রাপের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়েছিল এই দীবা ফারাহ।
রাজা অ্যামন হোটাপের শয়ন মন্দিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে তার প্রেতাত্মা। কুবেরের ঐশ্বর্য ছিলো মিশরের সেই পিরামিডের নিচে। সমস্ত ধনরত্নই পেয়েছিল কুয়াশা। গোগীর কথা মনে হলো তার। নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে হয়েছে গোষ্ঠীকে তার নিজের হাতে। গোগী অবাক বিস্ময়ে চেয়েছিল তার দিকে।
কিন্তু এখানে যে প্রচুর ঐশ্বর্যের সন্ধান সে পেলো, রাজা অ্যামন হোটাপের ধনরত্ন সে তুলনায় কিছু নয়। অতুলনীয় এ ধনভাণ্ডার। এ রকম দামী মণি-মুক্তা কুয়াশা জীবনে কখনও চোখে দেখেনি।
কতক্ষণ ওরা সেখানে দাঁড়িয়েছিল বলা যায় না। হঠাৎ একটা বিষণ কান্না গুমরে উঠতে লাগলো চারদিকে। কুয়াশা একমনে দাঁড়িয়ে শুনলে কান্নাটা, যেন চারদিকের দেয়াল গুমড়ে মরছে, ‘আমাদের মুক্তি দাও। মুক্তি দাও অভিশপ্ত বন্দীশালা থেকে।’
কুয়াশা বিরাটকায় চারটে ব্যাগ বের করলো তার হাভারস্যা থেকে। ধীরে ধীরে ওগুলো পূরণ করলো সাত কুবেরের ধন, মণিমুক্তা দিয়ে। ছোরাটা সে কোমরে রেখে দিলো। শেষবারের মতো চারদিকে চেয়ে দেখলো, তারপর বাইরে বেরিয়ে এলো মান্নানকে নিয়ে। একটু টান দিতেই দরজা আবার যথাস্থানে এসে বন্ধ হয়ে গেল।
ওরা এগিয়ে চললো। মৃত ভুলুয়ার কাছে পড়ে থাকা নরবক্সের অচেতন দেহটা একবার পরীক্ষা করে দেখলে কুয়াশা। শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে ধীরে ধীরে।
‘OK মান্নান, ও ঠিক হয়ে যাবে। ব্যাগ থেকে খানিকটা খাবার নুরবক্সের পাশে রেখে দিয়ে কুয়াশা যাত্রার উদ্যোগ করলো।
‘নুরবক্স। ভাগ্যের হাতে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি, তোমার অসহায় অবস্থার সুযোগে তোমায় আমি হত্যা কবো না। যদি কোনদিন আবার সুযোগ আসে সেদিন তোমায় দেখে নেবো।’
ধীর পদে ওরা এগিয়ে চললো একটা মূর্তিমান বিভীষিকা পিছনে ফেলে।
*
শহীদ খান ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছিল কামালের সাথে।
‘তাহলে কুয়াশা এবারও বাজিমাত করে দিল? আর তোরা তাই চেয়ে চেয়ে দেখলি। আর নীরবে সবটুকু অপমান হজম করে নিলি?’
‘নারে, পাগলা। এতে মান-অপমানের কি আছে? আর এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে যে একা সংগ্রাম করতে পারে তাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। কুয়াশা আমার চোখে এক নতুন রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে। তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।’
‘রেখে দে তোর কৃতজ্ঞতা, আমি গেলে খালি হাতে কখনও ফিরতাম না, কিছু, একটা করেই আসতাম।’
শহীদ এবার ফোঁড়ন কাটলো। ‘হে বীর পুঙ্গব! সেটা বার বার পরীক্ষিত হয়ে আছে।’
মহুয়া এসে ঘরে ঢুকলো। পিছনে গফুরের হাতে ট্রে। ওতে একগাদা খাবার নিজের হাতে তৈরি করে নিয়ে এসেছে মহুয়া।
‘কি পরীক্ষিত হয়ে আছে, কামাল ভাই?
‘সে আর তোমার শুনে কাজ নেই, মহুয়াদি। যে জিনিস সামনে এনে ধরেছে। সেটা পরীক্ষা করতেই এখন আমি বেশি সুক হয়ে পড়েছি। ’
১৭১
কামাল খাবারের উপর ঠিক আর্টিলারি কামানের মতোই আক্রমণ করে বসলো।
তোর ছোট দিদিমণিকে ডেকে দে, গফুর। মহুয়া গফুরের দিকে ফিরে বললো। সে নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর গফুর আবার যখন ঘরে ঢুকলো, তার হাতে একটা প্যাকেট আর তার সঙ্গে একটা চিঠি।
‘একটা লোক এসে দিয়ে গেল, দাদামণি, তোমাকে দেবার জন্যে।’
চিঠিটা শহীদ নিয়ে নীরবে পড়লো, তারপর কামালের হাতে দিলো। কামাল দেখলো কুয়াশার লেখা চিঠি।
প্রিয় শহীদ‚
যা চেয়েছিলাম, পেয়েছি। নুরবক্স বেঁচে আছে। সামান্য উপহারটুকু মহুয়ার জন্যে পাঠালাম, গ্রহণ করতে বলো।
ইতি
কুয়াশা
কামাল চিঠিটা ফেরত দিলো শহীদের হাতে। প্যাকেটটা খুলে ফেললো কামাল। সুদৃশ্য কারুকার্য করা ভেলভেটের একটা বাক্স বেরিয়ে এলো। | বোতামটায় একটু চাপ দিতেই বাক্সের ডালাটা খুলে গেল। একটা নিরুত্তাপ দ্যুতি ঠিকরে বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে।
শহীদ চেয়ে দেখলো, ভেতরে সুন্দর করে বসানো রয়েছে একটা বড় আকারের পদ্মরাগমণি।
Habib
I enjoyed the book very much though I have read all the books before but found there are plenty of spelling mistakes. Kindly rectify accordingly & thank you very much for your good work. Also, it would be highly appreciated if you could upload or add the balance books of the Kuasha & Masud Ran series as well.