চিকামার দেবরক্ষী
ফ্রান্সিস আর মারিয়া রাজবাড়ির গাড়ি চড়ে রেভকজাভিকের জাহাজঘাটায় এল। একটু পরেই ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা শস্যটানা গাড়িতে চেপে জাহাজঘাটায় এল। জাহাজে উঠে সবাই আনন্দে হৈ হৈ করতে লাগল। যে মণিমাণিক্যের জাহাজের খোঁজে ওরা এসেছিল তা উদ্ধার করা হয়েছে। ওদের আনন্দ ধরে না।
ফ্রান্সিস আর মারিয়া হাসিমুখে জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়ালো। সব বন্ধুরা ওদের ঘিরে দাঁড়ালো। বন্ধু ভাইকিংরা চীৎকার করে উঠলো–ও হো-হো-হো। ফ্রান্সিস হাসল। হাত তুলে ওদের থামতে ইঙ্গিত করল। চীৎকার হৈ-হল্লা বন্ধ হলো। ফ্রান্সিস বলল ভাইসব, রাজা ইনগলফ ও রাণী আমাদের আজ ভোজসভায় যোগ দিতে অনুরোধ করেছেন। আমরা ভোজসভায় অবশ্যই যাবো। তারপর ফিরে এসে জাহাজ ভাসাবো স্বদেশের উদ্দেশ্যে। সব ভাইকিংরা আনন্দে চীৎকার করে উঠল–ও-হো-হো। এবার সবাই ভোজসভায় যাবে বলে পোশাক পরে তৈরি হতে গেল।
ক ঘন্টা পরে ভাইকিংরা ভোজসভার শেষে জাহাজে ফিরে এল। ফ্রান্সিস ও মারিয়া রাজা ইনগলফের বিশেষ অতিথি হিসেবে গিয়েছিল। ওরাও রাজবাড়ির গাড়িতে ফিরে এল। ফ্রান্সিস জাহাজ ছাড়ার ইঙ্গিত করল। ঘরঘর শব্দে জাহাজের নোঙর তোলা হলো, বাতাসের তেমন জোর নেই। দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে চলে গেল। সমুদ্রের জলে দাঁড় চালাবার শব্দ উঠল, ছপ্ ছল্। সব কটা পাল খাটানো হলো। পালে হাওয়া লাগল। জাহাজটা আস্তে আস্তে রেভকজাভিক বন্দর ছেড়ে মহাসমুদ্রের দিকে চলল।
দিনকয়েক পরেই জাহাজ দিনরাতের অঞ্চলে চলে এল। শীতের তীব্রতা কমে গেল। সবাই বাড়তি পোশাক খুলে ফেলল। জাহাজ চলল ভাইকিংদের দেশের দিকে।
সেদিন দুপুরবেলা। জোর হাওয়ায় জাহাজের পালগুলো ফুলে উঠেছে। আকাশও পরিস্কার। দাঁড় টানার কাজ থেকে ছুটি। ভাইকিংরা বেশিরভাগই নিজেদের কেবিনে শুয়ে বসে বিশ্রাম করছে। অনেকে ঘুমিয়েও নিচ্ছে। জাহাজের ডেকের নিস্তেজ রোদে কয়েকজন ভাইকিং কম্বল পেতে শুয়ে আছে। ওদের মধ্যে বিস্কোও আছে। হঠাৎ মাস্তুলের মাথায়-বসা নজরদার নিচে ডেকের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল–একটা জাহাজ এইদিকে আসছে।
–কোন দেশের জাহাজ? শুয়ে থাকা বিস্কো চেঁচিয়ে বলল।
–মাস্তুলে একটা পতাকা উড়ছে-ঠিক ঠাহর করতে পারছি না কোন দেশের পতাকা। নজরদার বলল।
–মরুক গে, বিস্কো বলল–দেখো জলদস্যুদের জাহাজ যেন না হয়।
একটু সময় গেল। সেই জাহাজটা বেশ কাছে চলে এসেছে। নজরদার এতক্ষণে জাহাজটার পতাকা, ভালোভাবে দেখতে পেল। স্পেনদেশের পতাকা। নজরদার নিশ্চিত হলো। নজরদার চেঁচিয়ে বলল–স্পেন দেশের জাহাজ।
বিস্কো শুয়ে শুয়েই বলল–ঠিক আছে।
জাহাজটা তখন ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ের কাছে পাশে পাশেই চলেছে। হঠাৎ নজরদার দেখল সেই জাহাজের মাস্তুল থেকে স্পেনদেশের পতাকা নামিয়ে ফেলা হলো। সেখানে ওড়ানো হলো কালো কাপড়ে সাদা মড়ার মাথা আর চাঁড়া আকা জলদস্যুদের পতাকা। নজরদারের বুক কেঁপে উঠল–জলদস্যুদের জাহাজ। ও চিৎকার করে উঠল–জলদস্যু। কিন্তু ওর গলা তখন শুকিয়ে কাঠ। যেটুকু শব্দ গলা দিয়ে বেরুলো তা কারো কানেই গেল না। ততক্ষণে জলদস্যুদের জাহাজটা ভাইকিংদের জাহাজের গায়ে এসে লেগেছে। কোনোরকম শব্দ না করে জলদস্যুরা খোলা তলোয়ার উঁচিয়ে এই জাহাজে উঠতে লাগল। প্রথমে উঠল জলদস্যুদের দলপতি। ছুঁচোলো গোঁফ দাড়ি মুখে। মাথায় বাঁকা কালো টুপি। গায়ে জমকালো পোশাক। পায়ে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা বুট। জলদস্যুদের ইয়া গোঁফ, গাল পর্যন্ত জুলপি, মাথায় ঝকরা চুলে লাল কাপড়ের ফেট্টি, গায়ে ডোরাকাটা গেঞ্জি।
নজরদার দ্রুত মাস্তুলের গায়ে লাগানো দড়ির সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগল–জলদস্যু-সাবধান। ও কথাটা একবারই বলতে পারল। জলদস্যুর দলপতি কোমরের বেল্টে গোঁজা লম্বা ছুরিটা বের করে ছুঁড়ল নজরদারের দিকে। ছুরিটা পাক খেয়ে ছুটে গিয়ে নজরদারের বুকে বিঁধে গেল। ও দড়ির সিঁড়ি থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিঁধে যাওয়া ছুরিটা ধরে টানতে গেল। ছুরিটা বুক থেকে বের করতে পারল না। ছিটকে পড়ল জাহাজের রেলিং-এর ওপর। তারপর পাক খেয়ে সমুদ্রের জলে।
ততক্ষণে যে চারজন ভাইকিং ডেকে কম্বল পেতে শুয়ে ছিল তাদের দুজনের বুকেও জলদস্যুরা তরোয়াল বিধিয়ে দিয়েছে। ওরা টু শব্দটিও করতে পারল না। বিপদ আঁচ করে বিস্কো দ্রুত উঠে পড়ল। দেখল উদ্যত তলোয়ার হাতে জলদস্যুরা ওদের ঘিরে ধরেছে। জলদস্যুদের দলপতি এগিয়ে এসে হাতের তরবারির ডগাটা বিস্কোর বুকে ঠেকিয়ে স্পেনীয় ভাষায় বলল–কোনোরকম শব্দ করবে না। চলো তোমাদের অস্ত্রঘরটা দেখিয়ে দাও। ততক্ষণে অন্য ভাইকিংটির মাথায় একজন জলদস্যু তলোয়ারের বাঁট দিয়ে ঘা মেরেছে। ভাইকিংটি দুহাতে মাথা চেপে ডেকের ওপর গড়িয়ে পড়ে গেল।
এবার বিস্কোর পিঠে জলদস্যুদের দলপতি তলোয়ারের ডগা ঠেকিয়ে বলল–চলো।
বিস্কো দাঁড়িয়েই রইল। ও তখন ভাবছে কী করে ফ্রান্সিস ও হ্যারিকে ওই বিপদের কথা জানাবে। ওর পিঠে তলোয়ারের চাপ বাড়িয়ে দস্যু দলপতি বলল–চলো, নাহলে তলোয়ার বিধিয়ে দেব। বিস্কো বুঝল এখন এদের কথামতো চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। রুখে দাঁড়ালে ওকে ঠিক হত্যা করবে। বিস্কো আস্তে আস্তে চলল। সিঁড়ি বেয়ে ওরা নামতে যাবে দলপতি চাপাস্বরে বলল–কোনো শব্দ যেন na হয়।
বিস্কো সামনে, পেছনে দস্যু দলপতি ও অন্য দস্যুরা নামতে লাগল। বিস্কো ওদের অস্ত্রঘরের সামনে নিয়ে এল। আঙুল দেখিয়ে বলল–অস্ত্রঘর। দলপতির নির্দেশে দুজন জলদস্যু খোলা তলোয়ার হাতে ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। জলদস্যুদের দলপতি বলল–তোমাদের ক্যাপ্টেন কে? তার কাছে আমাকে নিয়ে চলো। বিস্কো চিন্তায় পড়ল। যে করেই হোক সে ফ্রান্সিসকে মুক্ত রাখতে চাইল। যদি ফ্রান্সিস ধরা না পড়ে তাহলে ফ্রান্সিস বৃদ্ধি খাঁটিয়ে নিশ্চয়ই বিপদ থেকে সকলকে উদ্ধার করতে পারবে। জলদস্যু নেতা ওর পিঠে তলোয়ারের চাপ বাড়াল। গম্ভীর গলায় বলল–চলো। কোনোরকম চালাকি করেছ কি মুণ্ডু উড়িয়ে দেব।
বিস্কো চলল। পেছনে পেছনে জলদস্যু নেতা। ওর পেছনে চারজন খোলা তলোয়ার হাতে জলদস্যু। ঠিক তখনই একটা কেবিন ঘরের দরজা খুলে একজন ভাইকিং বেরিয়ে এল। পড়ল একেবারে বিস্কো আর জলদস্যুদের সামনে। বিস্কো বলে উঠল–এই আমাদের ক্যাপ্টেন।
জলদস্যু নেতা একলাফে সামনে গিয়ে ভাইকিংটির গলায় তলোয়ার ঠেকিয়ে বলল–তুমিই এই জাহাজের ক্যাপ্টেন? ভাইকিংটির মুখ তখন ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। দুহাত ওপরে তুলে ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল–না-না, আমি না। ফ্রান্সিস। বিস্কো চোখের ইঙ্গিতে ভাইকিং বন্ধুটিকে বোঝাল যেন ও বলে যে, ওই ক্যাপ্টেন। কিন্তু বন্ধুটি ত সেটা বুঝল না উল্টে ফ্রান্সিসের নাম বলে দিল।
জলদস্যু নেতা এবার রাগত দৃষ্টিতে বিস্কোর দিকে তাকাল। বলল–আমাকে ধোঁকা দিচ্ছিলে। একজন জলস্যর দিকে তাকিয়ে বলল–একে ডেকে নিয়ে যাও। বন্দী কর। এবার দলনেতা ভাইকিংটির দিকে তাকাল। বলল–আমাকে ফ্রান্সিসের কাছে নিয়ে চলো। কোনোরকম চালাকি করবে না। ভাইকিংটিকে সামনে রেখে জলদস্যু চলল।
সবাই ফ্রান্সিস ও মারিয়ার কেবিন ঘরের সামনে দাঁড়াল। ভাইকিংটি আঙুল দিয়ে দরজাটা দেখাল। দসুনেতা গলা নামিয়ে বলল–ফ্রান্সিসকে ডাকো। ভাইকিংটি দরজায় টোকা দিল। ডাকল-ফ্রান্সিস-ফ্রান্সিস।
ফ্রান্সিস তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম করছিল। মারিয়া বিছানায় বসে রুমালে এমব্রডারি করছিল। ডাক শুনে মারিয়া এসে দরজা খুলে দিল। জলদস্যু নেতা উদ্যত তরবারি হাতে এক ধাক্কায় দরজার সবটা খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকল। ফ্রান্সিস একলাফে বিছানা থেকে নেমে কাঠের দেয়ালে ঝোলানো তরোয়ালটার দিকে ছুটল। কিন্তু তরোয়াল হাতে নেবার আগেই দুজন জলদস্যু দুদিক থেকে ফ্রান্সিসকে জাপটে ধরল। ফ্রান্সিস শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করল। পারল না। জলদস্যু দুজনের তরোয়ালের খোঁচা লেগে ফ্রান্সিসের বুক পিঠ হাত কেটে গেল। রক্ত পড়তে লাগল। মারিয়া বুঝল ওরা সকলেই বিপদে পড়েছে। কিন্তু মারিয়া ভয় পেল না!। দৃপ্তকণ্ঠে জিঞ্জেস করল–আপনি কে? জলদস্যু-দলপতি একটু মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানিয়ে হেসে বলল–আমার নাম আলবার্তো।
-তুমি জলদস্যু। মারিয়া চেঁচিয়ে বলল।
হ্যাঁ, আলবার্তো বলল-মাদ্রিদ নগরে পাঁচ একর জমি কিনেছি। বাড়ি হচ্ছে। সোনা, রুপো, হীরে,অলঙ্কার এসব খুব প্রয়োজন। তাই জাহাজ লুঠ করি। আর একটা কাজও করতে হয়। ক্রীতদাস সংগ্রহ ও বিক্রি।
-ঠিক আছে, মারিয়া বলল–আমাদের যা সোনা রুপো অলঙ্কার আছে দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের জাহাজ থেকে দূর হও তোমরা।
-খুব ভালো কথা। আপনি সেসব একত্র করুন। কিন্তু আপনাদের কাউকে তো ছাড়া হবে না। কাছাকাছি ডাঙ্গায় যেখানে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট পাবো সেখানেই আপনাদের বিক্রী করে দেব। সাদা চামড়ার ক্রীতদাস, অনেক দাম পাওয়া যাবে।
ফ্রান্সিসকে ততক্ষণে দুজন জলদস্যু দুহাত, বুক ঘাড় দড়ি জড়িয়ে বেঁধে ফেলেছে। ফ্রান্সিস বাধা দেয়নি। ও বুঝতে পেরেছে এখন লড়াই অসম্ভব। খালি হাতে এখন লড়াই চলবে না। সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে। আলবার্তো জলদস্যু দুজনকে ইঙ্গিত করল। ওরা ফ্রান্সিসকে ধরে নিয়ে চলল। পেছনে মারিয়া। মারিয়ার দুটো হাত ততক্ষণে বাঁধা হয়ে গেছে। সামনে আলবার্তো, পেছনে ফ্রান্সিসরা। সবাই চলল ডেকে ওঠার সিঁড়ির দিকে।
ওদিকে জলদস্যুরা চেষ্টা করল যাতে নিঃশব্দে সব কাজ সারা যায়, কিন্তু পারল না। ওদের দ্রুত চলাফেরায় কাঠের পাটাতনে শব্দ হলো বেশ। দুচারজন ভাইকিং কেবিন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। জলদস্যুদের দেখল। অস্ত্রঘরের সামনে খোলা তরোয়াল হাতে জলদস্যুরা পাহারা দিচ্ছে। ওরা হতাশ হলো। জলদস্যুরা ওদের ঘিরে ফেলল। ওদের হাত বেঁধে নিয়ে চলল ডেকে ওঠার সিঁড়ির দিকে।
ফ্রান্সিস মারিয়া হ্যারি আর সব ভাইকিংদের জাহাজের ডেকে জলদস্যুরা জড়ো করল। আলবার্তো সকলের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমরা সবাই বন্দী। শুধু আঙুল দিয়ে মারিয়াকে দেখিয়ে বলল-ইনি স্ত্রী লোক। ইনি থাকবেন একটি কেবিন ঘরে। সেই ঘরের দরজার সামনে অবশ্যই পাহারাদার থাকবে। একটা কাজ তাঁকে করতে হবে। এই জাহাজে সোনা-মুক্তো-হীরে যা কিছু দামী জিনিস আর অলঙ্কার আছে সব একত্র করে আমাকে দিতে-হবে।
-যদি না দিই। মারিয়া ক্রুদ্ধস্বরে বলল।
-তাহলে আপনি এবং এই জাহাজের কেউ বেঁচে থাকবেন না। সবাইকে মেরে হাঙরের মুখে ছুঁড়ে ফেলা হবে। আলবার্তো বেশ জোরের সঙ্গে বলল। ফ্রান্সিস একটু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল-মারিয়া-কোনো কথা বলো না। ভাইকিংরা সবাই তখন রাগে ফুঁসছে। বিনা যুদ্ধে এভাবে হার স্বীকার করা ওদের সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু উপায় নেই। এ অবস্থায় খালি হাতে লড়া যাবে না। ওরা চুপ করে রইল।
আলবার্তো মারিয়ার সামনে এল! মারিয়ার বাঁধা হাত খুলে দিল। বলল–যান এই জাহাজে যা কিছু সোনা দানা, হীরে, মুক্তো আছে সব নিয়ে আসুন। একজন জলদস্যুর দিকে তাকিয়ে আলবার্তো বলল-এর সঙ্গে যা! সব যোগাড় হলে এঁকে আমাদের ক্যারাভালে-এ নিয়ে যাবি। পাঁচ নম্বর কেবিন ঘরে বন্দী করে রাখবি। পাহারা দিবি।
জলদুস্যটি খোলা তরে!! হতে মারিয়ার কাছে এসে দাঁড়াল। মারিয়া তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আলবার্তে গলা চড়িয়ে হুকুমের স্বরে বলল–যান।
ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল-মারিয়া কথার অবাধ্য হয়ো না। মারিয়া একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর নিচে নামবার সিঁড়ির দিকে এগোলো।
আলবার্তোর হুকুমে সব জলদস্যু খোলা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। তারপর ওদের ঠেলে নিয়ে চলল জাহাজের ডেকের পাশে কাছের রেলিঙের দিকে। দুটো জাহাজই তখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিসদের একে একে জলদস্যুদের ক্যারাভেল জাহাজে নিয়ে আসা হলো। সিঁড়ি দিয়ে নিচে জাহাজের খোলে নামানো হলো। একটা লোহার শিক লাগানো দরজার সামনে ওদের আনা হলো। একজন পাহারাদার জলদস্যু দরজাটার তালা খুলল। দেখা গেল এই দিনের বেলায়ও প্রায় অন্ধকার কয়েদ ঘর। ফ্রান্সিসদের প্রত্যেকের সেই ঘরে ঢোকানো হলো। তিনজন কয়েদ ঘরের পাহারাদার জলদস্যু ফ্রান্সিসদের প্রত্যেকের হাতে দড়ি বেঁধে দিল। তারপর লোহার মোটা শিকওয়ালা দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করল। তালা লাগাল। তারপর দরজার সামনে খোলা তরোয়াল। হাতে পাহারা দিতে লাগল।
ভাইকিংরা কেউ কেউ কাঠের মেঝেয় শুয়ে পড়ল, কেউ কেউ বসে পড়ল। কেউ কেউ পায়চারি করতে লাগল। ফ্রান্সিস কাঠের দেয়ালে পিঠ চেপে বসল। পাশে বসল হ্যারি আর বিস্কো। হ্যারি মৃদুস্বরে বলল-আমাদের সাবধান থাকা উচিত ছিল। বিস্কো বলল-ই-নজরদার যদি একটু আগে বলতো
–ওসব ভেবোনা আর-ফ্রান্সিস বলল। একটু থেমে বলল-চারদিক ভালো করে দেখেছি। দরজা ছাড়া আর কোথা দিয়েও পালাবার উপায় নেই। তবে পা খোলা আছে আর শাঙ্কো বলেছে ওর বড় ছুরিটা ও জামার ভেতর লুকিয়ে রেখেছে। কটা দিন থাক। ওদের পাহারা দেবার নিয়ম, খাবার দেবার নিয়ম এসব দেখি। তারপর মুক্তির ফন্দী অটবো। আর কেউ কোনো কথা বলল না। লোহার গরাদ দেওয়া ওপারে তখন আলোর ভাব কমে এসেছে। বাইরে বোধহয় বিকেল হলো।
চার পাঁচ দিন কেটে গেল। মারিয়া ওর গয়নাগাঁটি স্বর্ণমুদ্রা যা ছিল সবই আলবার্তোকে দিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে আলবার্তো মারিয়া যে ভাইকিং রাজার মেয়ে: এটা জেনেছে। ও ঠিক করেছে-কোনো বন্দরের ক্রীতদাস কেনা বেচার হাটে ভাইকিংদের বিক্রি করে দেবে। তারপর ভাইকিংদের দেশের বন্দরে যাবে। মারিয়ার মুক্তিপণ হিসেবে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা, ভাইকিং রাজার কাছে দাবি করবে।
জাহাজ চলল। দিনের পর দিন। ফ্রান্সিসদের একঘেয়ে জীবন কাটতে লাগল কয়েদ ঘরে।
ওদিকে পাঁচ নম্বর কেবিনে মারিয়ারও একঘেয়ে বন্দিনী জীবন কাটছে! মারিয়ার বেশি চিন্তা ফ্রান্সিসদের জন্য। ওতো তবু আকাশ আলো সমুদ্র দেখতে পায়। ফ্রান্সিসরা তো অন্ধকারে পড়ে আছে। আলবার্তো মারিয়াকে মাত্র একবার ফ্রান্সিসদের সঙ্গে দেখা করবার অনুমতি দিয়েছে। আধঘন্টার জন্য।
মারিয়া আসে। লোহার দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর মুখ বিয়ঃ। ফ্রান্সিসের সঙ্গে কথা হয়। সামান্য কথাবার্ত। দু: করও কিছুই তো বলবার নেই। যা কিছু কথা এই বন্দ জান নিয়েই। মারিয়ার কাছেই ফ্রান্সিস জেনেছিল যে আলবার্তে ওর ক্যারাভেল জাহাজের পেছনে ফ্রান্সিসদের জাহাজটাও বেঁধে নিয়ে চলেছে। মারিয়া তখন!ও ফিসফিস করে বলে-ফ্রান্সিস-এই বন্দীদশা থেকে কি আমাদের মুক্তি নেই?
ফ্রান্সিসও চাপাস্বরে বলে–আছে। নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেই মুক্তি পেতে হবে আমাদের কারও জীবন বিপন্ন না করে আর সুযোগ বুঝে। ওরা এসব কথা খুব আস্তে বলে, যাতে পাহারাদারের কানে না যায়। মারিয়া এভাবে প্রতিদিনই আসে। কথা বলে। চলে যায়।
এর মধ্যে ফ্রান্সিসদের চারজন ভাইকিং বন্ধু নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে ঠিক করল পালাবে। কথাটা ওরা আর কাউকেই বলল না।
সেদিন রাতে তিনজন জলদস্যু পাহারাদার লোহার শিকের দরজা খুলে খাবার নিয়ে ঢুকল। সেই চারজন ভাইকিং পাহারাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজন পাহারাদারকে কাবু করল। কিন্তু হাত বাঁধা অবস্থায় কি লড়াই করা চলে? বাকি দুজন পাহারাদার তরোয়াল নিয়ে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাইকিং চারজন তরোয়ালের মার ঠেকাবে কী করে? চারজনই তরোয়ালের ঘায়ে আহত হয়ে মেঝেয় পড়ে গেল। তাদের মধ্যে একজন গুরুতর আহত হলো। রক্তাক্ত দেহে ওরা গোঙাতে লাগল। ফ্রান্সিসরা যে ওদের সেবা-শুশ্রূষা করবে তারও উপায় নেই। সবারই হাত বাঁধা। পাহারাদাররা দরজা বন্ধ করে পাহারা দিতে লাগল।
ফ্রান্সিস একজন পাহারাদারকে ডাক। সে দরজার কাছে মুখ বাড়াল। ফ্রান্সিস বলল-আমার বন্ধুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।
-ক্যাপ্টেন আলবার্তোর হুকুম না হলে হবে না। পাহারাদার বলল।
ফ্রান্সিস ভীষণ রেগে গেল। বলল-এক্ষুণি আলবার্তোকে আসতে বলে?
–ক্যাপ্টেন এখন বিশ্রাম করছেন। পাহারাদার বলল।
ফ্রান্সিস লোহার দরজায় প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে উঠল–আমার আহত বন্ধুরা যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে উনি বিশ্রাম করছেন? ফ্রান্সিসের চিৎকার করে বলা কথাগুলো শুনে সব ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে লোহার দরজার কাছে এল। সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল-ও-হো-হো। পাহারাদার এই চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘাবড়ে গেল। ওর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলল–যাও শিগগির। পাহারাদারটি কী ভাবল কে জানে। ও চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে আলবার্তে লোহার গারদ-আঁটা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস . বলল–আমাদের চারজন বন্ধু অাহত। ওদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।
তালতো হেসে বলল-ওরা আমার রক্ষীদের আক্রমণ করেছিল। ফল যা হবার তাই হয়েছে।
-কিন্তু ওরা আহত-ওদের চিকিৎসা।
আলবার্তো চেঁচিয়ে বলে উঠল-ওসব হবে ন!। মরুক ওরা। ফ্রান্সিসও গলা চড়াল যদি বিনা চিকিৎসায় ওরা কেউ মারা যায় তোমাকে ঠামি ছাড়বো না আলবার্তো। তোমাকে যেখানে যে অবস্থায় পাবো তামি ই কবে! আলবার্তো হো হো করে হেসে উঠল। বলল-ঐ স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তোমার জীবন এই কয়েদ ঘরে শেষ হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস আগুন-ঝরা চোখে আলবার্তোর দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলল না। আলবার্তো চলে গেল।
ফ্রান্সিসরা ফিরে এসে নিজেদের জায়গায় বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। কয়েকজন ভাইকিংতখন জলের পাত্র করে জল এনে আহতদের শরীরে ক্ষতস্থান বেঁধে দিল। রক্ত পড়া বন্ধ হলো।
কিছুক্ষণ পরে মারিয়া এল। লোহার গরাদ দেওয়া দরজায় এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস উঠে একটু দ্রুত পায়েই দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল এক্ষুনি আমাদের জাহাজে চলে যাও। বৈদ্য যে কটা ওষুধের বোয়াম আনতে বলে নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস মুখ ফিরিয়ে ওদের ভাইকিং বৈদ্যকে ডাকল। বৈদ্য আড়মোড়া ভেঙে উঠল। ফ্রান্সিসের কাছে এল। ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে বলল-মারিয়া আমাদের জাহাজে যাচ্ছে। কী কী ওষুধের বোয়াম আনবে বলে দাও। বৈদ্যও নিচুস্বরে বলল–রাজকুমারী, আমার কেবিনঘরের তাকে দেখবেন কালো, হলুদ আর নীল রঙের তিনটে বোয়াম আছে। আপনি হলুদ বোয়ামটা থেকে একমুঠো গুড়ো একটা কাগজের ঠোঙায় ঢেলে আনবেন।
–আমি বোয়ামটাই নিয়ে আসতে পারি। মারিয়া বলল।
–তা পারেন। কিন্তু এই কয়েদুঘরের দরজায় লোহার শিক লাগানো। এইটুকু ফাঁক দিয়ে বোয়াম ঢুকবে না। আপনাকে প্রত্যেক দিন ঠোঙায় করে লুকিয়ে ওই গুঁড়ো আনতে হবে। বৈদ্য বলল।
-মারিয়া দেরি করো না-শিগগির যাও। ফ্রান্সিস তাগাদা দিল। মারিয়া পাহারাদারদের দিকে তাকিয়ে বলল-ওদের পোশাক ভীষণ ময়লা হয়ে গেছে। আমি আমাদের জাহাজ থেকে কিছু পোশাক আনতে যাচ্ছি। পাহারাদার দুজন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মুখে কিছু বলল না।
মারিয়া ডেকে উঠে এল দ্রুতপায়ে। একজন জলদস্যুকে দেখল মাস্তুলে ঠেসান দিয়ে ঝিমুচ্ছে। মারিয়া ডাকল-শুনছো? লোকটা চোখ মেলল। মারিয়াকে দেখেই একলাফে উঠে দাঁড়াল। তরোয়ালের হাতলে হাত রাখল। মারিয়া হেসে বলল-লড়াই করতে আসিনি। তুমি তোমাদের দড়ির মইটা ধরো। আমি আমাদের জাহাজে যাবো।
-কেন? জলদস্যু বলল।
–আমার স্বামী আর বন্ধুরা তো কয়েদ ঘরে বন্দী হয়ে আছে। ওদের পোশক নোংরা হয়ে গেছে। কিছু পোশাক আনবো।
-কিন্তু ক্যাপ্টেনের হুকুম ছাড়া–
–আরে আমি তো পালাচ্ছি না। ক্যাপ্টেনকে পরে আমি বলবো খন। মারিয়া বলল।
জলসুটি! তা কিছু বলল না। জাহাজের পেছন দিকে চলল। জাহাজের পেছনের কাঠের রেলিংয়ের গায়ে একটা দড়ির মই আটকানো। মইটার মাঝে মাঝে কাঠের ফালি বাঁধা। মইটা বাঁধা রয়েছে ফ্রান্সিসদের জাহাজের সঙ্গে। দুটো জাহাজ একটা মোটা কাছিতে বাঁক। জলদসটি মইয়ের এক : কষ্টে নিয়ে কাছিটা ধরে ঝুলে ঝুলে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠল। তারপর কাছিটা একটা হুক-এর সঙ্গে আটকে টেনে ধরে রইল। মারিয়া মইয়ের কাঠের ফালিগুলোর ওপর পা রেখে ফ্রান্সিসদের জাহাজে উঠে এল। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে মারিয়াকে আসতে হলো। দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বৈদ্যর কেবিন ঘরে ঢুকল। তাকের দিকে তাকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে হলুদ বোয়ামটা পেল। বোয়ামটা নিয়ে মারিয়া নিজের কেবিনঘরে চলে এল। নিজের আর ফ্রান্সিসের কিছু পোশাক নিল। অন্য কেবিনঘরগুলোতে ঢুকে অন্য ভাইকিং বন্ধুদের পোশাক নিল। সব পোশাক পেঁচিয়ে বাঁধবার আগে হলুদ বোয়াম ভেতরে রেখে দিল। পেঁচিয়ে বাঁধা পোশাকের বোঁচকার মধ্যে রইল বোয়ামটা।
পোশাকের বোঁচকা দেখে জলদস্যুটি কিছু বলল না। মারিয়া মই বেয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ক্যারাভেল জাহাজে ফিরে এল। নিজের কেবিনে ঢুকল। কাপড়ের বোঁচকার মধ্যে থেকে হলুদ বোয়াম বের করল। একটা রুমালে হলুদ গুঁড়ো একমুঠো ঢালল। বোয়ামটা কাঠের তাকে লুকিয়ে রাখল। তারপর কাপড়ের বোঁচকার মধ্যে ওষুধ রুমালটা রেখে কয়েদঘরের সামনে এল। চারজন ভাইকিং পালাবার চেষ্টা করছিল বলে এখন নিয়মে কড়াকড়ি করা হয়েছে। সব ভাইকিংদের হাত খুলে দেওয়া হয়েছে। খাবারদাবার দরজার নিচের একটা ফোকর দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আলবার্তোর হুকুম কোনো কারণেই যেন দরজা খোলা না হয়। মারিয়া কাপড়ের পুটলি খুলে একটা করে পোশাক গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস টেনে নিতে লাগল। হলুদ ওষুধ জড়ানো পোশাকটা দেবার সময় মারিয়া বেশ জোরে বলল-এই পোশাকটা এক্ষুনি পর। ফ্রান্সিস বুঝল। মৃদু হেসে বলল–আচ্ছা। তারপর পোশাকটা নিয়ে বৈদ্যর কাছে এল। পোশাকের ভাঁজ খুলে ওযুধটা মেঝেয় ঢালল। বলল–জল-। একজন ভাইকিং নারকেলের মালায় করে জল নিয়ে এল। বৈদ্যর নির্দেশমতো হলুদের গুড়োর মধ্যে অল্প করে জল ঢালতে লাগল। বৈদ্য গুড়োটা মাখতে লাগল। একটু পরেই আঠার মতো দেখতে হলো। বৈদ্য ওষুধ নিয়ে আহত ভাইকিং কজনের ক্ষতে লাগিয়ে দিল। একটু জ্বালা করে উঠেই একটা ঠান্ডাভাব লাগল!ওদের ব্যথা অনেক কমে গেল।
পরের দিনই মারিয়া একটা করে পোশাক আনল আর হলুদ গুঁড়ো ওষুধ দিয়ে গেল। তিনজন আহত ভাইকিং মোটামুটি সুস্থ হলো। কিন্তু একজন আহত ভাইকিং ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওষুধ লাগানো চলল। কিন্তু ওর বুকের ক্ষতস্থান ফুলে পেকে উঠল। একদিন দুপুরে বাড়াবাড়ি অবস্থা হলো। প্রচন্ড জুরে ওর গা পুড়ে যেতে লাগল। ভাইকিংটি প্রলাপ বকতে লাগল। সন্ধ্যের সময় তজ্ঞান হয়ে গেল। একটু রাত বাড়তে ভাইকিংটি হঠাৎ চোখ বড় বড় করে চারদিকে তাকাতে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করল। শেষবারের মতো ওর শরীরটা নড়ে উঠে স্থির হয়ে গেল। ফ্রান্সিস মৃত বন্ধুর কাঁধে হাত রাখল। ওর চোখ ফেটে জল এল! দুহাতে মুখ চেপে ও কেঁদে উঠল। হ্যারি এগিয়ে এসে ওর পিঠে হাত রাখল। সব ভাইকিং বন্ধুরা মুখ নিচু করে বসে রইল। তানোকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফ্রান্সিস চোখ মুছে হ্যারিকে বলল-হ্যারি-ও নিজের জীবন দিয়ে আমাদের মুক্তির উপায় করে দিয়ে গেল। হ্যারি কোনো কথা বলল না।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গেল। রক্ষীদের বলল-আমাদের এক বন্ধু মারা গেছে। আলবার্তোকে খবর দাও। একজন রক্ষা চলে গেল। একটু পরেই কাঠের মেঝেয় জুতোর শব্দ তুলে আলবার্তো এল। পেছনে জলদস্যুদের বৈদ্য। রোগ। পাকা দাড়ি। কয়েদ ঘরের দরজা খোলা হলো। শুধু বৈদ্য ঢুকল। মৃত ভাইকিংটির বুকে কান পাতল। আঙুল দিয়ে চোখ খুলে দেখল। হাতের পায়ের নাড়ি টিপে দেখল। তারপর মাথা নেড়ে মৃদুস্বরে বলল-মারা গেছে। কয়েদঘরের বাইরে গিয়ে আলবার্তোকে বলল সে কথা। আলবার্তো ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বলল-এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করলে এই অবস্থাই হবে। মড়া কালকে সমুদ্রে ফেলা হবে।
ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠল। চিৎকার করে বলল,–না আজকে রাতেই মড়া এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে।
-কেন? আলবার্তো বেশ আশ্চর্য হয়েই বলল?
–আমরা একটা মড়ার সঙ্গে রাত কাটাতে পারবো না।
আলবার্তো ঠাট্টা করে হেসে বলল–কিছুক্ষণ আগেও তো ও তোমাদের বন্ধু ছিল?
–সে ছিল ছিল। এখন তো একটা মড়া। বিদায় করো এটাকে। ফ্রান্সিস বলল?
–তাই হবে। আলবার্তো পাহারাওয়ালাদের সে কথা বলল। তারপর চলে গেল।
ফ্রান্সিসের এ ধরনের কথাবার্তায় ভাইকিং বন্ধুরা অবাক হয়ে গেল। ফ্রান্সিসের এ কী কথাবার্তা! এ কী ব্যবহার! বন্ধুদের জন্যে যে ফ্রান্সিস নিজের জীবন দিতে তৈরী থাকে, সে একমৃতবন্ধু সম্পর্কে এরকম কথা বলছে। হ্যারির সহ্য হলো না, ও ফ্রান্সিসের মুখোমুখি দাঁড়াল। দৃঢ়স্বরে বলল-ফ্রান্সিস সাবধান, মৃতবন্ধু সম্পর্কে এরকম কথা যদি আর একটা বল, তোমাকে আমরা ছেড়ে দেব না।
ফ্রান্সিস শুধু ফিসফিস করে বলল-রাত্রি চাই-অন্ধকার চাই। তারপর ফ্রান্সিস দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে একজন পাহারাদারকে ডাকল। বলল-আচ্ছা। ভাই, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-কী কথা? একজন পাহারাদার এগিয়ে এসে বলল?
–আমার দৃঢ় বিশ্বাস জাহাজটা থেমে আছে অথবা খুব আস্তে চলছে।
–আরে-ঠিক বলছো। দুদিন যাবতহাওয়া পড়ে গেছে। জাহাজ প্রায় চলছেই না। কিন্তু তুমি কী করে বললে?
-আমরা ভাইকিং-সমুদ্র জাহাজ এসবের মতিগতি আমরা সহজেই ধরতে পারি। ফ্রান্সিস তারপর বলল–তা ভাই দেরি করছে কেন। মড়াটা তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও।
–তোমাদের রাতে খাওয়া হলেই নিয়ে যাবো। পাহারাদার জলদসূটি বলল?
–জলদি কর, জলদি কর। ফ্রান্সিস কথাটা বলে দরজার কাছ থেকে চলে এল।
ফ্রান্সিস দু-একজন ভাইকিং বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু এক হ্যারি ছাড়া আর সবাই মুখ ফিরিয়ে রইল। মৃত বন্ধু সম্পর্কে ফ্রান্সিস যা কিছুক্ষণ আগে বলেছে সেটা বন্ধুরা ভুলতে পারেনি। ছিঃ এত নোংরা মন ফ্রান্সিসের। একটু পরেই পাহারাদাররা রাতের খাবার দিয়ে গেল। প্রায় কেউই বিশেষ খেল না। ফ্রান্সিস কিন্তু পেট পুরে খেল। সব বন্ধুরা দেখল সেট। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল তারপর। একটু পরে একজন পাহারাদার জল একটা মোটা কাপড়ের বস্তা গরাদের মধ্য দিয়ে ভাঁজ করে গলিয়ে দিল। সঙ্গে একটা দড়ি। পাহারাদার বলল-মড়াটা বস্তায় পরে মুখ বেঁধে দরজার কাছে রেখে সবাই সরে যাও। আমরা ঢুকে মড়া নিয়ে আসবো। তখন কাছে আসবে না।
শাঙ্কো বস্তা দড়ি নিয়ে এল। এবার মৃতদেহ এই বস্তায় ভরতে হবে। ফ্রান্সিস ফিসফিস করে ডাকলে-শাঙ্কো। শাঙ্কো ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল ফ্রান্সিস হাত বাড়িয়ে বলল-শিগগির ছোরাটা দাও। শাঙ্কো ঢোলা জামার নিচ থেকে ছোরা বার করে ফ্রান্সিসের হাতে দিল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঢোলা জামায় ছোরাটা ভরে রাখল। সকলের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমরা সব দরজার কাছে গিয়ে ভিড় করে আঁড়াও যাতে পাহারাদাররা দেখতে না পায় এখানে কী হচ্ছে! সবাই এবার বুঝল ফ্রান্সিস নিশ্চয়ই কোনো ফন্দী এঁটেছে। সবাই দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভিড় হয়ে গেল দরজার সামনে। ফ্রান্সিস দ্রুত বস্তাটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। বলল–শাঙ্কো, বস্তার মুখ বেঁধে দাও। শাঙ্কো তাড়াতাড়ি বস্তার মুখ বাঁধল। ফ্রান্সিস বস্তা বন্দী হলো। হ্যারি বলে উঠলো-সাবাস ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস বস্তার মধ্যে থেকে বলল–আস্তে।
বিস্কো শাঙ্কো আর কয়েকজন ভাইকিং বস্তাটা কাঁধে নিয়ে দরজার কাছে এল। একজন পাহারাদার বলল-মড়া আবার কাঁধে করে নিয়ে আসছে। টেনে হিঁচড়ে আনো।
–না আমাদের বন্ধু তো-হ্যারি বলল–তা ভাই তোমরাও কাঁধে করে নিয়ে যেও?
–কাঁধে করে পারবো না। তবে ঝুলিয়ে নিয়ে যাবো। পাহারাদার বলল।
দরজা খুলে ওরা বস্তাটা ধরল। ঝুলিয়ে নিয়ে চলল। ততক্ষণে একজন পাহারাদার দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে।
বস্তা বন্দী ফ্রান্সিসকে চার পাঁচজন জলদস্যু ঝুলিয়ে নিয়ে চলল। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। ডেকে এসে আর ঝুলিয়ে নিল না। ডেকের কাঠের মেঝের ওপর দিয়ে হিড়হিড় করে হিঁচড়ে নিয়ে চলল। ঘা লেগে ফ্রান্সিসের মাথার পেছনে পিঠে জ্বালা করতে লাগল। ফ্রান্সিস দাঁত চেপে সহ্য করতে লাগল। মুখে কোনো শব্দ করল না। ডেকের রেলিঙের কাছে এসে দুজন জল বস্তা বন্দী ফ্রান্সিসকে দোলাতে লাগল। তারপর ছুঁড়ে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল।
জলে পড়েই বস্তা সুদ্ধ ফ্রান্সিস লে ডুবে যেতে লাগল, ফ্রান্সিস তৈরিই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে জামার তলা থেকে ছোরাটা বার করে মোটা কাপড়ের বস্তায় ঢুকিয়ে দিয়েই জোরে হ্যাঁচকা টান দিল। বস্তা লম্বালম্বি কেটে গেল। ফ্রান্সিস বস্তার ভেতরে থেকে বেরিয়ে এল। জলের মধ্যে এইজন্যে ওকে বেশ কিছুক্ষণ দম আটকে থাকতে হলো। মজোর সমুদ্র থেকে মুক্তো আনার জন্য ফ্রান্সিস মুক্তো শিকারীদের সঙ্গে থেকে দম বেশিক্ষণ রাখার অভ্যেস করেছিল। এখন সেটা কাজে লেগে গেল। হাত পায়ে জলের মধ্যে কয়েকটা ধাক্কা দিয়েই ওজলের ওপরে ভেসে উঠল। হাঁপাতে লাগল। ওর ভাগ্যও ভালো। দেখল ক্যারাভেল জাহাজ তার ওদের জাহাজ খুব আস্তে আস্তে যাচ্ছে। মৃদু জোৎস্না পড়েছে সমুদ্রের জলে, জাহাজে। বাতাস তেমন জোরে বইছে না। তাই ঢেউও কম।
ফ্রান্সিস ওদের জাহাজটা লক্ষ্য করে সাঁতরাতে লাগল। একটু পরেই ওদের জাহাজের পিছন দিকের জলে ডোবা হাট ধরল। হালের কাঠের খাঁজে খাঁজে পা রেখে একটু উঠল। তখন বেশ হাঁপাচে। একটু জিরো। হাঁপানো একটু কমল। দেখা হাতের কাছে একটা মোটা কাছি ঝুলছে। ফ্রান্সিস কাছিট! বেয়ে বেয়ে আস্তে আস্তে উঠতে লাগল। এক সময় হালের গায়ে পা রেখে জাহাজের ডেকে নামল। দেখল ওদের জাহাজের কোথাও আলো জ্বলছে না। ওর গায়ের পোশাক ভিজে সপ সপ করছে। সিঁড়ি দিয়ে নাম অন্ধকারে। দ্রুত পায়ে নিজের কেবিন। ঘরে ঢুকল দ্রুত হাতে ভেজা পোশাক ছেড়ে পোশাক পরে নিল। দেয়াল থেকে তরোয়ালটা নিয়ে কোমরে জল। তারপর একটা কাঁচ ঢাকা লণ্ঠন জ্বালল। সেটা নিয়ে চলল অস্ত্রঘরের দিকে। অস্ত্রঘর খুলল। বিস্কোর জন্যে তার একটা তরোয়াল কোমরে খুঁজে নিল। এবার শাঙ্কোর ধনকটা নিল কাঁধে, বুকে ছিলাটা চেপে রাখল। কাঁধে ঝোলাল তীর ভর্তি তুণীরটা। আলোটা নিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ির কাছে এল। আলোটা নিভিয়ে ফেলল। আলো জলদস্যুর নজরে পড়লে বিপদে পড়তে হবে। কাঁচ ঢাকা লণ্ঠনটা রেখে দিল। ডেকে উঠে এল। দেখল জলদস্যুদের ক্যারাভেলের ডেকে কয়েকটা আলো জ্বলছে। গভীর রাত। জলদস্যুরা নিজেদের কেবিনে ঘুমিয়ে আছে। মাস্তুলের আড়ালে দাঁড়াল ফ্রান্সিস। কিছুক্ষণ লক্ষ্য রেখে দেখল চার পাঁচজন জলদস্যু ডেকে জাহাজ পাহারা দিচ্ছে। দুজনের হাতে খোলা তরোয়াল। বাকিরা তরোয়াল পাশে রেখে ডেকে বসে আছে।
ফ্রান্সিস ওদের জাহাজের সামনের দিকে এল। চাঁদের আলো খুবই অস্পষ্ট!তবু যদি জলদস্যুরা দেখে ফেলে তাই ও হামাগুড়ি দিয়ে এল। কাঠের ফালি বাঁধা দড়ির মইটা তখনও দুটো জাহাজের মধ্যে লাগানো ছিল। মারিয়া ঐ দড়ির মই দিয়েই দু জাহাজে পারাপার করছিল। ফ্রান্সিস হামাগুড়ি দিয়ে দড়ির মইয়ের ওপর দিয়ে এল। নামল জলদস্যুদের ক্যারাভেল-এর ডেকে। একটু অপেক্ষা করল! না জলদস্যুরা পাহারাদাররা ওর আসা বুঝতে পারেনি।
ফ্রান্সিস এবার দড়ির মইয়ের হুকট। খুলে দিয়েই জাহাজের অন্ধকার কোণাটায় সরে এল। কাঠ বাঁধা মইটা জাহাজের গায়ে গিয়ে লাগল। বেশ জোরে শব্দ, উঠল-খট–
দস্যু ছুটে এল। জাহাজের হালের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে লাগল শব্দটা কিসের। ফ্রান্সিস এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। এক লাফে নিঃশব্দে এগিয়ে এসে জলদস্যুটার ঘাড়ে তরোয়ালের বাঁট দিয়ে এক ঘা মেরেই নিজের জায়গায় এলো। জলদস্যুটি মুখে কোনো শব্দও করতে পারল না। অজ্ঞান হয়ে রেলিঙের মুখ জুড়ে পড়ে রইল। অন্য পাহারাদার জলদস্যুটি দু একবার ওর অজ্ঞান বন্ধুকে ডাকাডাকি করল। তারপর খোলা তরোয়াল হাতে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বুঝল এর সঙ্গে তরোয়াল নিয়ে লড়তে গেলে তরোয়ালের ঠোকাঠুকির শব্দ হবে। ডেকে বসে থাকা জলদস্যুরা শব্দ শুনে ছুটে আসবে। কাজেই কোনোরকম শব্দ করা চলবে না। নিঃশব্দে কাজ সারতে হবে। ও অন্ধকার থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। জামার তলা থেকে ছোরাটা বের করল। তারপর পেছন থেকে জলদস্যুটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে তার মুখ চেপে ধলে যাতে কোনো শব্দ না করতে পারে। তারপর ছোরাটা আমূল ওর পিঠে বসিয়ে দিল। জলদস্যুটা কয়েকবার নড়ে উঠেই স্থির হয়ে গেল। ফ্রান্সিস ওকে ধরে আস্তে আস্তে ডেক-এর ওপর শুইয়ে দিল, যাতে কোনো শব্দ না হয়।
এবার ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল অন্য পাহারাদাররা মৃদুস্বরে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে এত কান্ড হলো ওরা কিছুই বুঝতে পারল না।
সিডির ঘর হাত বারোর মধ্যে। ফ্রান্সিস ডেকের মেঝেয় বক পেতে শুয়ে পড়ল। তারপর বুক দিয়ে হিঁচড়ে হিঁচড়ে চলল। তারপর নিচে নামার সিঁড়ির ওপর গড়িয়ে পড়ল। তখন ফ্রান্সিস শুনল ডেকের জলদস্যুরা ওদের বন্ধু দুজনকে ডাকাডাকি করছে। ফ্রান্সিস বুঝল–আর দেরি করা চলবে না। কাঁচ ঢাকা আলোয় ও দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। কয়েদঘরের সামনে যখন এল তখন ও হাঁপাচ্ছে। দেখল দুজন জলদস্যু খোলা তরোয়াল হাতে কয়েদঘর পাহারা দিচ্ছে। ফ্রান্সিস ভাবল এদের হত্যা না করে যাতে কয়েদ ঘরের চাবিটা নেওয়া যায় ও সেই চেষ্টাই করবে। কয়েদঘরের দরজার কাছে একটা কাঁচ ঢাকা বাতি ঝুলছিল। ফ্রান্সিস কোমর থেকে তরোয়াল বের করে আস্তে আস্তে পাহারাদার দুজনের সামনে এসে দাঁড়াল। পাহারাদার দুজন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। এ কী? এ কীকরে গারদ ঘরের বাইরে এল। তাও হাতে তরোয়াল নিয়ে। পরক্ষণেই ওরা লড়াইয়ের জন্য তরোয়াল উঁচিয়ে ধরল। ফ্রান্সিস গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল–যদি প্রাণে বাঁচতে চাও আমার সঙ্গে লড়াই করতে এসে না। আমি ফ্রান্সিস। তোমাদের মতো দশজনের সঙ্গে লড়াই করা আমার কাছে কিছুই না। গারদ ঘরটা খুলে দাও। বন্ধুদের মুক্তি দাও। আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করব না।
পাহারাদার দুজন একটু থমকে দাঁড়াল। ওদের মধ্যে একজন তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস একপাক ঘুরে তরোয়াল চালাল বিদ্যুৎবেগে। ওর মাথায় তরোয়ালের কোপ বসে গেল। জলদস্যুটা তরোয়াল ফেলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। অন্য পাহারাদারটির মুখ মৃত্যুভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ফ্রান্সিস গম্ভীর গলায় বলল–দরজা খুলে দাও। লোকটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোমরে গোঁজা চাবির তাড়া বের করল। কয়েদ ঘরের তালা খুলতে লাগল।
ওদিকে হ্যারি সারারাত ঘামতে পারেনি। ওর এক চিন্তা-ফ্রান্সিস বস্তা কেটে বেরতে পারল কিনা, হয়তো পারেনি। এসব বিপদের কথা ভাবছিল। তখনই ও কয়েদ ঘরের দরজার কাছে ফ্রান্সিসের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। ও আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বিস্কোশাঙ্কো অন্য বন্ধুদের ধাক্কা দিতে দিতে চাপা স্বরে বলতে লাগল-ওঠ-ওঠ-ফ্রান্সিস এসেছে। দুজন একজন করে সকলেরই ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দাঁড়াতে লাগল সবাই। হ্যারি চাপা স্বরে বলল-কোনরকম শব্দ করো না। তখনই কয়েদঘরের দরজা খুলে গেল। ফ্রান্সিস এক লাফে ঢুকল। কয়েদঘরে ঢুকেই ফ্রান্সিস ঠোঁটে আঙুল রাখল। সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল।
ফ্রান্সিসের নির্দেশে সবাই চুপ করে রইল। হ্যারি ছুটে গিয়ে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ওর চোখে জল এসে গেল।
ফ্রান্সিস বলল–পাগালামি করো না! এখন বড় লড়াই সামনে। ফ্রান্সিস বিস্কোকে তরোয়াল খুলে দিল। শাঙ্কোকে দিল তীর ধনুক। বলল-ভাইসব, এবার চূড়ান্ত লড়াই। সবাই জলদস্যুদের অস্ত্রাগারে চলে যাও। অস্ত্র নিয়ে প্রত্যেক কেবিনঘরে ঢুকে জলদস্যুদের বন্দী কর। তারপর সবাইকে বন্দী করে ডেকে নিয়ে এসো। জলদি। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করো না।
ওদিকে ডেকের ওপরে যে পাহারাদার তিনজন ছিল তার। মৃত ও আহত বন্ধু দুজনকে দেখে বুঝল কিছু একটা হয়েছে। ওরা সিঁড়ির দিকে ছুটল কেবিনঘরে ঘুমন্ত বন্ধুদের ডাকতে। কিন্তু সিঁড়ির কাছে আসতে দেখল খোলা তরোয়াল নিয়ে ভাইকিংরা দলে দলে উঠে আসছে। ওরা বুঝল এখন লড়াই করতে যাওয়া বোকামি। তবু ও এলো হাতে রুখে দাঁড়াল। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই আহত হয়ে গড়িয়ে পড়ল। গোঙাতে লাগল কেবিন থেকে নিরস্ত্র জলদস্যুদের বন্দী করে এনে ডেকে জড়ো করা হলো।
এদিকে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো খুঁজে খুঁজে মারিয়াকে যে কেবিনঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে সে ঘরটা পেল। দেখল বাইরে তরোয়াল হাতে একজন পাহারাদার দাঁড়িয়ে। পাহারাদারটি কিছু বোঝার আগেই ফ্রান্সিস ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁ হাতে গলা চেপে ধরল। লোকটা বেরিয়ে আসা চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। শাঙ্কো পাহারাদারটির হাত থেকে তরোয়ালটা কেড়ে নিল। ফ্রান্সিস বলল-–যাও ডেকে যাও। তারপর ওর গলা ছেড়ে দিল। ফ্রান্সিস তখন বেশ হাঁপাচ্ছে। ও এগিয়ে এসে দরজায় টোকা দিল। একবার, দুবার। মারিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। বলল–তুমি,–মানে আমি কী বলবো। ফ্রান্সিস হেসে বলল–কিছু বলতে হবে না। শিগগির ডেকে চলে যাও। ওখানে সবাই আছে।
–কিন্তু তোমরা?
–আলবার্তোর সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে যাচ্ছি। তুমি যাও মারিয়া আর কথা বাড়াল না। সিঁড়ির দিকে ছুটল।
ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো আলবার্তোর ঘরের সামনে এল। দেখল দরজা খোলা। একজন জলদস্যু ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় আলবার্তোকে লড়াইয়ের খবরটা দিতে এসেছে। জলদস্যু ওদের দেখেই চিৎকার করে উঠল–ক্যাপ্টেন–ঐ যে। আলবার্তো দ্রুত এগিয়ে এল। দেখল তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে। পেছনে তীর ধনুক হাতে শাঙ্কো। আলবার্তো নিজেও তখন যুদ্ধসাজে তৈরি। সোনা দিয়ে বাঁধানো
ওর তরোয়ালের হাতল। ও হাতল চেপে এক টানে তরবারি কোষমুক্ত করল। ফ্রান্সিস হেসে বলল তাহলে আলবার্তো। তুমি লড়াই চাও? আলবার্তো কোন কথা না বলে তরোয়াল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হলো। ফ্রান্সিস বলল–তোমার জাহাজ এখন আমাদের কজায়। সব জলদস বন্দী। এরপরেও তুমি লড়াই করতে চাও। আলবার্তো ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল-হা, হিম্মৎ থাকে তো লড়ো।
–বেশ। এখানে এই ছোট ঘরে লড়াই করা অসুবিধে। ডেকে চলো। ফ্রান্সিস বলল।
আলবার্তোকে আর জলকে সামনে রেখে ফ্রান্সিসরা সিঁড়ি বেয়ে ডেকে উঠে এল। দেখল–ভোর হয়েছে। নরম রোদ ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে, সমুদ্রের জলে, জাহাজে, একটু পরেই আলবার্তোর সঙ্গে তরোয়ালের লড়াইয়ে নামতে হবে। এই সুন্দর রোদে উজ্জ্বল নীল আকাশ-কতদূর ছড়িয়ে আছে। শান্ত সমুদ্রের জলে রোদের নাচন ফ্রান্সিসের মনটা কেমন যেন করে উঠল। এ তাপূর্ব সুন্দর পরিবেশে লড়াই–রক্তপাতহত্যা? ওর মন মানল না। শেষবার চেষ্টা করতে হবে যাতে এই অমানবিক রক্তপাত হত্যা এড়ানো যায়।
কিন্তু আলবার্তো নির্বিকার। ডেকে দাঁড়িয়ে ও তারোয়াল ওঠাল। ওর মুখ কঠিন। চোখে হত্যার নেশা। মুখ বেঁকিয়ে হেসে বলল-ফ্রান্সিস কী হলো? তৈরি হও। ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। তরোয়াল নামিয়ে রাখল।
–কী হল ভাইকিং? ভয় পেয়ে গেলে? আলবার্তো বলল। ফ্রান্সিসের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। কিন্তু মনকে শান্ত করল। বলল-আলবার্তো, আমি জানি তুমি নরঘাতক। অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে। ঐতিদাসের হাটে বিক্রি করার জন্য নিরীহ মানুষদের কয়েদঘরে জানোয়ারের মতো দীর্ঘদিন বন্দী করে রেখেছে। সেই তোমাকে আমার অনুরোধ-যে জীবন তুমি কাটিয়েছো,সেই জীবনের কথা ভুলে যাও। নতুন করে সৎ মানুষের মতো বাকি জীবনটা কাটাও। মানুষকে হত্যা নয়-মানুষকে ভালোবাসতে শেখ। মানুষের সেবা কর, দুঃখী-অভাবী মানুষের দুঃখ দূর কর, অভাব দূর কর। তোমার ধনসম্পত্তি কম নয়।
আলবার্তো হো হো করে হাসল। বলল-ফ্রান্সিস তুমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেছো।
ফ্রান্সিস মৃদু হাসল। বলল,আলবার্তো তোমাকে আমি বাঁচার সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি বুঝলে না। তোমার মতো নরপশুরা জীবনের উজ্জ্বল দিক কোনো দিন দেখতে পায় না। যাকগে-তুমিই আমাকে লড়াইয়ে নামালে। আমার কোন দায়িত্ব রইল না।
ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতে না হতেই আলবার্তো তরোয়াল উঁচিয়ে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস দ্রুত হাতে আলবার্তোর তরোয়ালের মার ঠেকাল। শুরু হল দুজনের তরোয়ালের লড়াই। ডেকের একপাশে বসে আছে নিরস্ত্র জলদস্যুর দল। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র ভাইকিংরা আর মারিয়া। মারিয়া শুনেছে তরোয়াল চালনায় ফ্রান্সিস সবার সেরা। কিন্তু কোনোদিন ফ্রান্সিসের তরোয়াল লড়াই দেখে নি। আজকে সেই সুযোগ এল। মারিয়া এমনিতে খুব শক্ত মনের মেয়ে। কিন্তু আজকে ও একটু আশঙ্কাই বোধ করল। কারণ ও ঠিক বুঝল যে আলবার্তো সুযোগ পেলে ফ্রান্সিসকে হত্যা করতে পিছপা হবে না। আলবার্তো বার বার আক্রমণ করতে লাগল। ও তরোয়ালের মার ঠেকাতে লাগল। ও চাইছিল যাতে আলবার্তো অল্পক্ষণের মধ্যেই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। আলবার্তো সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল। আলবার্তোর একটা তরোয়ালের মার ঠেকাতে গিয়ে ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াতে গেল। তখনই আলবার্তো তরোয়াল ঘুরিয়ে নিয়ে অন্য দিক থেকে তরোয়াল চালাল। তরোয়ালের চকচকে ফলাটা ফ্রান্সিসের বাঁ বাহু ঘেঁসে বেরিয়ে গেল। পোশাকটা কেটে তরোয়াল বসে গেল। রক্তের ধারা বইল। মারিয়া চিৎকার করে উঠল। ফ্রান্সিস একবার ক্ষতস্থানের দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল আলবার্তোর ওপর। এবার আর আত্মরক্ষা নয়। ফ্রান্সিস আক্রমণ করল। ফ্রান্সিসের তরোয়ালের মার ঠেকাতে ঠেকাতে আলবার্তো ভাল করেই বুঝতে পারল এ বড় কঠিন ঠাই। মারিয়া ফ্রান্সিসের নিপুণ তরোয়াল চালানো দেখে অবাক হয়ে গেল। কী অনায়াস ভঙ্গীতে ফ্রান্সিস তরোয়াল চালাচ্ছে। বিদ্যুৎগতিতে স্থান পরিবর্তন করছে। কিন্তু পিছোচ্ছে না। এইভাবে আক্রমণের চাপ রাখছে।
অল্প সময়ের মধ্যেই ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে আলবার্তোর হাত অবশ হয়ে এল। তরোয়াল আর হাতের বশে রইল না। ! ও এলোমেলো তরোয়াল চালাতে লাগল। ফ্রান্সিস এই সুযোগ ছাড়ল না। এক পাক দ্রুত ঘুরেই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তরোয়ালের এক মারল আলবার্তোর তরোয়ালে। আলবার্তোর হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে গিয়ে মাস্তুলের কাঠে বিঁধে গেল। বেঁধা অবস্থায় তরোয়ালটা দুলতে লাগল। ওর চোখে মুখে মৃত্যু ভয় ফুটে উঠল। ফ্রান্সিস শেষ আঘাতের জন্য তরোয়াল তুলল। ফ্রান্সিসও হাঁপাচ্ছে তখন। কিন্তু তরোয়াল চালাল না। আস্তে আস্তে তরোয়াল নামাল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তোমার জাহাজ আর তোমার দলবল নিয়ে যাও–এক্ষুনি এই তল্লাট ছেড়ে পালাও। ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। কেউ লক্ষ্য করেনি যে আলবার্তোর কোমরে বেল্ট-এ একটা ছোরা গোঁজা আছে। এইবার আলবার্তো দ্রুত হাতে ছোরাটা টেনে বের করল। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিসকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। শাঙ্কো আলবার্তোকে কোমরে হাত দিতে দেখেই বুঝেছিল ওর উদ্দেশ্য কি। আলবার্তো ছোরা ছুঁড়ে মারার সঙ্গে সঙ্গেই শাঙ্কো ফ্রান্সিসের পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল! দুজনে জড়াজড়ি করে ডেকের ওপর পড়ে গেল। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। তখনই মাস্তলের ওপর বসে থাকা নজরদার চেঁচিয়ে উঠল–ডাঙা দেখা যাচ্ছে, ডাঙা।
সকলেই হৈ হৈ করে উঠে জাহাজের রেলিঙের কাছে জড়ো হলো। সত্যি দূরে বিস্তীর্ণ বালির তটরেখা দেখা যাচ্ছে। এই হৈচৈ-র মধ্যে আলবার্তো জাহাজের রেলিঙে দ্রুত উঠে পড়ল। উদ্দেশ্য সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়া। কারণ কাছেই সমুদ্রতীর। সাঁতরে পালাতে পারবে। কিন্তু আলবার্তো শাঙ্কোর নজর এড়াতে পারেনি। শাঙ্কো অতি দ্রুত ধনুকে তীর পরিয়েই তীর ছুঁড়ল। একেবারে নিখুঁত নিশানা শাঙ্কোর। তীর আলবার্তোর পিঠে বিধে গেল। আলবার্তো দুহাত উপরে তুলে ছিটকে সমুদ্রের জলে পড়ে গেল। ডেক থেকে ভাইংকির ও জলদস্যুর দল দেখল যে আলবার্তো আর ভেসে উঠল না। জলে যেখানে আলবার্তো পড়েছিল সেখানের জলটায় একটু লাল রঙ লাগল। হ্যারি আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল–ফ্রান্সিস, আমাদের এক বন্ধুর মৃতদেহ এখনো কয়েদঘরে পড়ে আছে। ফ্রান্সিস দ্রুত বলে উঠল–সত্যিই তো। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়নি। কথাটা বিস্কোর কানে গেল, বলল,–আমরা কয়েকজন যাচ্ছি।
একটু পরেই বিস্কোর কয়েদঘর থেকে বন্ধুর মৃতদেহ ডেকে শুইয়ে দিল। সবাই চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়াল। ভাইকিংদের মধ্যে যে ধর্মযাজকের কাজ করে সে এগিয়ে এল। তার গলায় ঝুলছে একটা ভাঁজ করা চাদরের মতো। হাতে একটা চামড়ার ছেঁড়াখোঁড়া বাইবেল। ওটার পাতাগুলো সব ভোলা। ভাইকিং যাজক তাই থেকে একটা পাতা খুলে বিড়বিড় করে কি পড়ল। সবশেষে বলল,–আমেন। তখন মৃতদেহটা একটা মোটা কাপড়ের থলেতে ঢোকানো হলো। মাথার দিকে বেঁধে দেওয়া হলো। দুজন ভাইকিং মৃতদেহটি নিয়ে জাহাজের রেলিঙের কাছে গেল। মৃতদেহটি দোলাতে দোলাতে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল। সকলেরই মন খারাপ হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
নিরস্ত্র জলদস্যুর দল থেকে একজন যুবক জলদস্যু ফ্রান্সিসের সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল–আমাদের ক্যাপ্টেন মারা গেছে। এখন আমরা কি করবো?
ফ্রান্সিস হ্যারিকে ডেকে বলল–এখন এই জলদস্যুদের নিয়ে কি করবে?
-ওদের মুক্তি দেব-ওদের কারাভেল জাহাজ নিয়ে ওরা চলে যাবে। কিন্তু একটি প্রতিজ্ঞা ওদের করতে হবে বাকি জীবন ওরা আর জলদস্যুতা করবে না। দেশে ফিরে সৎ জীবনযাপন করবে।
ফ্রান্সিস যুবকটির দিকে তাকাল, বলল—কী, এই শর্তে তোমরা রাজী?
–হ্যাঁ আমরা রাজী। যুবকটি বলল।
–কিন্তু একটা সমস্যার সমাধান এখনই করতে হবে। হ্যারি বলল।
–দেখ–আলবার্তোর কেবিন ঘরে নিশ্চয়ই লুণ্ঠিত ধনসম্পদ রয়েছে। এখন আলবার্তো মারা গেছে ঐ লুঠ করা সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে এবার এই জলদস্যুদের নিজেদের মধ্যে মারামারি খুনোখুনি শুরু হয়ে যাবে।
ফ্রান্সিস একটু ভাবল। বলল–কথাটা সত্যি। এই ধনসম্পত্তি কি হবে?
শাঙ্কো বলল–ওগুলো আমরা দেখে নিয়ে গিয়ে রাজার জাদুঘরে রাখবো।
–না শাঙ্কো, ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল–অনেক নিরীহ মানুষের রক্তে ভেজা ঐ অভিশপ্ত ধনসম্পদ আমরা কোনমতেই নেবো না। হ্যারিকে দায়িত্ব দিচ্ছি–হ্যারিই ঐ ধনসম্পদ জলদস্যুদের মধ্যে যতটা সম্ভব সমান ভাগে ভাগ করে দেবে।
–বেশ! হ্যারি রাজি হলো। জলদস্যু যুবকটিকে হ্যারি বলল,–চলো–তোমাদের সঙ্গে কথা আছে। যেখানে জলদস্যুরা বসে আছে। যুবকটিকে নিয়ে হ্যারি সেদিকে গেল।
মারিয়া এগিয়ে এল ফ্রান্সিসের কাছে। বলল, তুমি আহত। কাটা জায়গা থেকে এখনো রক্ত পড়ছে। তুমি কেবিনে চলো। তোমার বিশ্রামও দরকার।
–হ্যাঁ চলে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বিক্ষোকে বলল–আমাদের জাহাজ চালককে বলো আমাদের জাহাজটা যতটা সম্ভব তীরের কাছে যেন নিয়ে যায়।
দুপুরে খাওয়ার পর হ্যারি ফিরে এলো। ফ্রান্সিসকে বলল–ভাগবাঁটোয়ারা করে এসেছি এবার কি করবে?
–ওদের কারাভেল জাহাজের সঙ্গে আমাদের জাহাজটি যে দড়ি দিয়ে বাঁধা সেটা শাঙ্কোকে কেটে দিতে বলো। জলদস্যুরা ওদের জাহাজ করে দেশে ফিরে যাক।
তাই করা হলো। জলদস্যুদের মুক্তি দেওয়া হলো। ওরা ওদের কারাভেল জাহাজে তাড়াতাড়ি পাল খাটাল। হাওয়ার তোড়ে পাল ফুলে উঠল। ওদের জাহাজ গভীর সমুদ্রের দিকে চলল। ডেকে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস তা দেখল।
কিছুক্ষণ পরে রসুইঘর আর ভাঁড়ার ঘরের দায়িত্ব যে তিনজন ভাইকিং-এর হাত ছিল তারা ফ্রান্সিস আর হ্যারির কাছে এল। একজন বলল—এবার কি দেশে ফিরবে?
–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল। অন্য ভাইকিংটি বলল—কিন্তু আমরা জানিনা আমরা কোথায় এসেছি। তীরের যে বালিয়াড়ি দেখছি তাতে বুঝতে পারছি না এটা কোনো দেশ না দ্বীপ। দিক ঠিক করে দেশে ফিরতে আমাদের কতদিন লাগবে জানি না।
–তা তো ঠিকই, হ্যারি বলল।
অন্য ভাইকিংটি বলল–ভাঁড়ার ঘরে যা ময়দা চিনি খাবার দাবার আছে তাতে তবু কিছুদিন চলবে। কিন্তু খাবার জলের পরিমান অনেক কমে গেছে। কিছু খাবার জল না জোগাড় করতে পারলে সাংঘাতিক সমস্যায় পড়ে যাবে।
ফ্রান্সিস হ্যারি দুজনেই ভাবল কিছুক্ষণ। হ্যারি প্রথমে বলল-ফ্রান্সিস, যে ভাঙাটা দেখা যাচ্ছে ওখান থেকেই খুঁজে পেতে খাবার জল জোগাড় করতে হবে। তারপর দিক ঠিক করে দেশের দিকে পাড়ি দেবো।
–ঠিক বলেছো তোমরা-ফ্রান্সিস বলল–তাইলে কালকেই আমরা তীরে নামবো। দ্বীপ হোক আর দেশ হোক খাবার জল খুঁজে বার করতেই হবে।
পরদিন সকালের খাবার খেয়েই ফ্রান্সিস বিস্কো আর শাঙ্কোকে তৈরি হয়ে আসতে বলল। বিস্কো তরোয়াল নিয়ে এল আর শাঙ্কো তীর ধনুক নিয়ে এল। মারিয়ার যাওয়ার ব্যাপারে ফ্রান্সিস দুএকবার আপত্তি জানাল। কিন্তু মারিয়া জেদ ধরল ও ওদের সঙ্গে যাবেই। অগত্যা ফ্রান্সিস আর আপত্তি করল না।
জাহাজের গায়ে ঝোলান একটা শক্তপোক্ত নৌকা জলে নামানো হলো। দড়ি বেয়ে বেয়ে ফ্রান্সিসরা জাহাজ থেকে নৌকায় নেমে এল। মারিয়াকে নামানো হলো দড়ির জালে দাঁড় করিয়ে। খাবার দাবার, খাওয়ার জল এসব প্রয়োজনীয় জিনিস আগে থেকে নৌকায় রাখা হয়েছিল আর দুটো জল রাখবার খালি পিঁপে। মারিয়া নেমে আসতেই বিস্কো নৌকো ছেড়ে দিল। বিস্কো আর শাঙ্কো নৌকো বাইতে লাগল তীরভূমি লক্ষ্য করে।
আধ ঘন্টার মধ্যে নৌকো তীরে ভিড়ল। ফ্রান্সিসরা নামল। মারিয়া কিন্তু কারো সাহায্য ছাড়াই নৌকো থেকে লাফিয়ে নামল। সবাই বিস্তীর্ণ বেলাভূমির বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল।
অনেকটা হাঁটার পর ওরা থামল। দেখল যতদূর চোখ যায় শুধু ধু ধু বালির প্রান্তর। ওরা আবার হাঁটতে শুরু করল।
সাদা-ধূসর রঙের বালি। কোনদিকে সবুজের চিহ্ন নেই। দুএকটা পাখি মাঝে মাঝে বালিতে ছায়া ফেলে উড়ে যাচ্ছে। তীব্র বোদ-বালিতে প্রতিফলিত হয়ে চোখে এসে লাগছে। ধাঁধিয়ে যাচ্ছে চোখ। গরম হাওয়া বইছে।
কিছুক্ষণ চলার পর ওদের নজরে পড়ল ক্ষয়িত শিলার তালচে পাহাড়। বেশি উঁচু নয়। তার ওপাশে কিছু সবুজ গাছগুলির মাথা দেখা গেল। ফ্রান্সিস আশ্বস্ত হলো-যাক মরুভূমির মত জায়গাটা খুব দূরবিস্তৃত নয়।
টানা পাহাড়ের কাছে ওরা এল। পাথরে পা রেখে ওরা পাহাড়টায় উঠল। দেখল ওপাশে একটু দূর থেকে বনভূমি শুরু হয়েছে। খুব ঘন ঘন বন নয়। ছাড়া ছাড়া। দূরে কিছু ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। ছাইগাদা দিয়ে গেথে গেৰ্থে তৈরি বাড়িঘর। ছাদ পেইকো ঘাসের। ফ্রান্সিস বলল-মানুষের বসতি আছে দেখছি। চলো ওখানেই জলের খোঁজ করা যাক। ওরা পাথরের চাঁইয়ে পা রেখে রেখে নামতে লাগল। ফ্রান্সিস অবশ্য মারিয়াকে হাত ধরে সাহায্য করতে লাগল। মারিয়া প্রায় নেমেই এসেছিল, হঠাৎ একটা পাথরের টুকরোয় রাখতেই টুকরোটা সরে গেল। মারিয়া তাল সামলাতে পারল না। পাথরের চাইয়ের মাথা থেকে নিচে পড়ে গেল একটা বড় গহ্বরের মধ্যে। ভাগ্য ভালো–নিচে ছিল বালি। বালির ওপর মারিয়ার পা পড়ল। ওর হাতটা একটু ছড়ে গেল। পাথরের চাঁইয়ের ধারে এসে ফ্রান্সিসরা হাঁটু গেড়ে বসে নিচে তাকাল। গহুরটা একটু অন্ধকারই, তবু দেখল মারিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সিস ডেকে বলল-তোমার কি খুব লেগেছে?
মারিয়া হেসে বলল–কিছছু না।
-এবার ফ্রান্সিস অন্যদের দিকে তাকাল। বলল-এখন মারিয়াকে তোলা যায় কী করে?
-জাহাজ থেকে দড়ি আনতে হবে। বিস্কো বলল
ওদিকে মারিয়া গহুরটার চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। একটু অন্ধকার হলেও পাথুরে দেয়াল, খোঁদল এসব দেখতে পাচ্ছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা গুহার মুখ। মুখটা বেশ বড়। একজন মানুষ মাথা উঁচু করে ঢুকতে পারবে। মারিয়া আস্তে আস্তে গুহাটার মূখে এসে দাঁড়াল। দেখল কাঠের ফালি দিয়ে তৈরি একটা দরজা গুহার মুখটায়। তার মানে এই গুহায় নিশ্চয়ই মানুষ থাকে। তাহলে এই গহ্বর থেকে বেরোবার পথও নিশ্চয়ই আছে। মারিয়া চারিদিকে ঘুরে ঘুরে পথ খুঁজতে লাগল। কিন্তু পথ কোথায়? চারিদিকেই পাথরের অমসৃণ গা। হঠাৎ এক জায়গায় দেখল যেন ওখানে অন্ধকারটা কম। মারিয়া দ্রুত পায়ে সেখানে এল। দেখল দুটো পাথরের মাঝখানে একটা পাথরের ফাটল। মারিয়া বালির ওপর হাঁটু মুড়ে বসল। তারপর বালির ওপর হামাগুড়ি দিয়ে ফাটলের মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তার মানে এই গুহায় যে বা যারা থাকে তারা এই পথেই যাতায়াত করে। লুকিয়ে থাকার পক্ষে ভালো জায়গা।
মারিয়া বাইরে পাথরের চাঁইয়ের নিচে এসে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে ডাকল-ফ্রান্সিস। বিস্কো তখন জলের খালি পিঁপে রেখে জাহাজ থেকে দড়ি আনতে যাবে বলে তৈরি হচ্ছে। তখন মারিয়ার ভাক ওদের কানে গেল। ওরা তাড়াতাড়ি পাথরের চাই থেকে নেমে এল। দেখল মাবিয় দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়া বলল-এই গহ্বরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার পথ আছে।
–ভালই হলো, ফ্রান্সিস বলল–আমরা তোমাকে দড়ি দিয়ে তুলব ভাবছিলাম।
–ফ্রান্সিস–এর ভেতর একটা গুহা আছে। গুহার মুখের কাঠের দরজ! আছে। মনে হয় মানুষ বাস করে।
-বলো কি। ফ্রান্সিস একটু আশ্চর্য হলো।
বিস্কো বলল–চলে! ফ্রান্সিস দেখা যাক।
সবাই হামাগুড়ি দিয়ে ফাটল পেরোল। গুহার মুখে এসে দাঁড়াল। ফালি কাঠের দরজাটা একটুকরো দড়ি বাঁধা ছিল। ফ্রান্সিস খুলল দড়িটা। তারপর একে একে সবাই গুহাটায় ঢুকল। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। চোখে ভাবটা সয়ে আসতে ওর দেখল–গুহার একপাশে শুকনো ঘাসের বিছানা। তার ওপর মোটা কাপড়ের কম্বল মতো পাতা। অন্য পাশে পোড়া হাঁড়ি কুড়ি, পাথরের টুকরো পেতে উনুন। একপাশে এলগারোরো গাছের বাঁকা কান্ড কুঁদে কুঁদে তৈরি বিচিত্র সব মূর্তি। এসব
কী মূর্তি ফ্রান্সিসরা বুঝল না। আবার মা-ছেলে, বিয়ের বর-কনে, এসবের মূর্তিও আছে। ওরা বুঝল এখানে একজনই মানুষই থাকে। বিছানায় একটা মাত্র ঢিলাঢালা পোশাক পঞ্চো পড়ে আছে। সব দেখেটেখে ফ্রান্সিস বলল–চলো, আর কিছু দেখার নেই। তবে লোকটাকে পেলে এখানে জলের সন্ধান পাওয়া যেত।
ওরা গুহর বাইরে আসতেই একজন মধ্যবয়স্ক লোকের মুখোমুখি পড়ল। লোকটা ভীষণভাবে চমকে উঠল। ও বোধহয় ওর গোপন আস্তানা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ছিল। লোকটা দ্রুত পেছন ফিরল। পালাবার ধান্ধা। বিস্কো জোরে ছুটে গিয়ে লোকটার ঢিলেঢালা পোশাক পঞ্চোটা পেছন থেকে চেপে ধরল। লোকটার পালানো হলো না। বিস্কে লোকটাকে ধরে ফ্রান্সিসের কাছে নিয়েএল। লোকটা বেশ ভয় পেয়ে গেছে বোঝা গেল। লোকটার কাছে আসতে ফ্রান্সিস হেসে হাত তুলে ওকে ভয় না পেতে ইঙ্গিত করল। লোকটা যেন একটু নিশ্চিন্ত হলো। ফ্রান্সিস কথা বলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ল। কী ভাষা বুঝবে লোকটা? ফ্রান্সিস প্রথমে পর্তুগীজ ভাষায় জিজ্ঞেস করল–তোমার নাম কী? লোকটা বুঝল না। তাকিয়ে রইল। এবার ফ্রান্সিস প্যানিশ ভাষায় বলল–তোমার ভয় নেই। তোমার নাম বলো। লোকটার চোখমুখ উজ্জ্বল হলো। বোঝা গেল ও ফ্রান্সিসের কথা বুঝছে। লোকটা ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় বলল,–আমি মেস্তিজো–চিকিমাদের দেবতার পূজারী।
ফ্রান্সিস এবার ভালোভাবে মেস্তিজোকে দেখল। মেস্তিজোর মাথায় লম্বা লম্বা চুল। মুখের দুপাশের আধখানায় হলুদ রঙ মাখা। দুকানের লতিতে সোনার কাঠি বেঁধানো। পরনে ঢিলেঢাল; পঞ্চে পোশাক। ওর একহাতে একটা ঘাসের তৈরি ঝুড়ি। তাতে ক্যারোপ বীন এর বেশ কয়েকটা রুটি। অন্য হাতে একটা চীনেমাটির কুঁজো মতো। বোঝা গেল খাবার জল তাতে। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হলো যে মেস্তিজোর হাতে অস্ত্র নেই। তার মানে সে যোদ্ধা নয়। ফ্রান্সিস বলল–মেস্তিজো, তোমার কোন ক্ষতি আমরা করবো না। আমাদের জাহাজ সমুদ্রতীরে রয়েছে। আমরা পানীয় জল নিতে এসেছি। তুমি পানীয় জলের জায়গাটা দেখিয়ে দাও। ফ্রান্সিস কথাগুলো থেমে থেমে বলল, যাতে মেস্তিজো সহজে বুঝতে পারে।
মেস্তিজো মাথার লম্বা লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে বলল–লো জলের জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছি ফ্রান্সিস বিস্কে তার শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল–তাহলে তোমরা ওর সঙ্গে যাও। জল নিয়ে এসো।
মেস্তিজো হাতের খাবারের ঝড়ি জলের কুঁজো ওর গুহাঘরে রেখে এল। তারপর জলের জায়গা দেখাতে চলল। পেছনে পিঁপে নিয়ে বিস্কো ও শাঙ্কে চলল। ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া–চলো আমরা গুহাঘরে গিয়ে বসি। দুজনে এসে ফালি কাঠের দরজা খুলে গুহায় ঢুকল। খড়ের বিছানায় গিয়ে বসল দুজনে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিস্কোরা পিঁপে ভর্তি জল নিয়ে ফিরে এল। এদিকে বেশ বেলা হয়ে গেছে সকলেরই খিদে পেয়েছে। জাহাজ থেকে খাবার দাবার আনা হয়েছিলো। মারিয়া সে সব খাবার সবাইকে ভাগ করে দিল। মেস্তিজোকেও দেওয়া হলে। মোস্তিজে খুব খুশি। ফ্রান্সিস বলল–মেস্তিজো–আমি তোমার খাবার খাবো। তুমি আমাদের খাবার খাও।
মারিয়া মেস্তিজোর খাবার খেতে চাইল। মেস্তিজো ঘাসে তৈরি ঝুড়ি থেকে রুটি, সামুদ্রিক মাছ, বন, লঙ্কামেশানো আলুর তরকারি বের করে দিল। ফ্রান্সিস মারিয়া খেতে লাগল। নতুন ধরনের খাবার। দুজনের ভালো লাগলো।
খাওয়াদাওয়ার পর মেস্তিজো বিছানায় পাতা কাপড় তুলে খড়গুলো গুহার মেঝেয় আরও জায়গায় ছড়িয়ে দিল। তারপর দুটো কম্বল মতো মোটা কাপড় পেতে দিল। ফ্রান্সিসরা সবাই বসল তাতে। শাঙ্কো শুয়ে পড়ল, বিস্কো আধশোয়া হলো। ফ্রান্সিস, মারিয়া আর মেস্তিজো বসে রইল। এতক্ষণ ফ্রান্সিস ভাবছিল–মেস্তিজোর কথা। স্পেনীয় ভাষায় কথা বলে অথচ আচার আচরণ মোটেই স্পেনীয়দের মতো নয়। ওর আসল পরিচয়টা কী? এই গোপন গুহাঘরে লুকিয়ে থাকে কেন? ফ্রান্সিস ডাকল–মেস্তিজো?
–বলুন?
–দেখ তোমার ভাষা শুনে বুঝেছি তুমি স্পেনীয়। অবশ্য তোমার কথা কিছুটা ভাঙা ভাঙা তবু ভাষাটা তো স্পেনীয়। তাছাড়া তুমি আমার স্পেনীয় ভাষাও বুঝতে পারছে। অথচ তোমার এখনকার চেহারা মোটেই স্পেনীয়দের মতো নয়। কী ব্যাপার বলো তো? ফ্রান্সিস বলল।
মেস্তিজো আস্তে আস্তে ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলতে লাগল–সে অনেকদিন আগের কথা। আমার বয়স তখন ছয় সাত। স্পেনের ডিমেলো শহরে বাবা-মার সঙ্গে থাকতাম। এটুকু আমার মনে আছে। বাবা মালবাহী জাহাজে কাজ করতেন। তখন একবার বাবা-মার সঙ্গে আমিও সমুদ্রযাত্রায় বেরোলাম। মাস চার পাঁচ জাহাজেই কাটল। ঝড় ঝাঁপটায় আমাদের জাহাজ বার কয়েক প্রায় ডুবে যাচ্ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে আমরা বেঁচে থেকেছি। জাহাজ ডোবেনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
একদিন আকাশে ঘন মেঘ করে সন্ধ্যের পরেই ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। তবু বাবা আর জাহাজের নাবিকেরা ঝড়ের মোকাবিলা করবার জন্য তৈরি হল। চলল ঝড়ের সঙ্গে লড়াই। বড় বড় পাল সব নামিয়ে ফেলা হল। ঝড়ের ঝাঁপটায় প্রচণ্ড বেগে জাহাজ দুলতে লাগল। এই জাহাজটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে যাচ্ছে পরক্ষণেই ঢেউয়ের ফাটলে নেমে আসছে। জাহাজের প্রচণ্ড দুলুনিতে আমরা কেবিন ঘরের এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়ছি। অনেকের মাথা ফাটল, হাত পা ভাঙল। আমি ডেক যেতে সাহস পেলাম না।
আকাশ মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাজ পড়ছে। হঠাৎ জাহাজটা ভীষণ জোরে দুলে উঠল। ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে কানে এল মড়মড় শব্দ। জাহাজটা কাত হতে লাগল। একটু পরেই অনেকটা কাত হয়ে গেল। কেবিন ধরে আমি একা, বাবা আর তার বন্ধুরা ডেকে গেছে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করতে। হঠাৎ নাবিকদের চিৎকার-জাহাজ ডুবছে। সাবধান। তখনই দেখি পায়ের কাছে জল ঢুকতে লাগল। তমি বুঝলাম আর এখানে থাকা চলবে না। জাহাজ ডুবছে। দ্রুত ছুটলাম সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি দিয়ে কি উঠতে পারি? সিঁড়ি হদোলামত দুলছে। কোনরকমে শরীর পা ঠিক রেখে ডেকএ উঠে এলাম। ততক্ষণে কেবিনঘরগুলো ডুবিয়ে দিয়ে সমুদ্রের জল ডেকএ উঠে এসেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। তারই আলোতে বাবাকে খুঁজতে লাগলাম। ওদিকে নাবিকেরা একে একে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমি বুঝলাম বাবাকে এই অবস্থায় খুঁজতে গেলে আমি আর বাঁচব না। তখন আমি হালের কাছে এসেছি। দেখি দড়ি বাঁধা একটা কাঠের থাম মত। আমি মাথাটা গড়িয়ে নিয়ে চললাম। ডেক-এর রেলিঙের ধারে নিয়ে এলাম। তারপর নিজের শরীরটা দড়ি দিয়ে থামটার সঙ্গে বাঁধলাম। ঠিক তখনই বোধহয় জাহাজটা ডুবে গেল। কয়েকজন নাবিকের চিৎকার কোলাহল শুনলাম। বিরাট এক ঢেউয়ের ধাক্কায় থামসুন্ধু আমি ছিটকে পড়লাম ঝড়োন্মত্ত সমুদ্রে। প্রাণপণে থামটা জড়িয়ে ধরলাম। ঢেউয়ের ধাক্কায় বিদ্যুতের আলো ঝলসে ওঠা সমুদ্রের ওপর দিয়ে আমি ভেসে চললাম। কতক্ষণ জানি না। আমার আর কিছু মনে নেই।
যখন চোখ খুললাম দেখি ভোর হয়েছে। সমুদ্রের ধারে ভেজা বালির মধ্যে থাম জড়িয়ে ধরে আমি পড়ে আছি। নুনে বালিতে চোখ বুঝে গেছে। খুলতে কষ্ট হচ্ছিল। কিছুক্ষণ শুয়ে রইলাম। হাওয়ার শব্দ। সমুদ্রের মৃদু গর্জন শুনতে লাগলাম। তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। রোদের তেজ বাড়তে লাগল। শরীরটা গরম হল। আস্তে আস্তে থামে বাঁধা দড়িটা খুললাম। তারপর বালিয়াড়িতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। মাথাটা ঘুরে উঠল। টাল সামলে সোজা হলাম। চারদিকে তাকালাম। একদিকে সমুদ্র। অন্যদিকে ধূধূ বালি। সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। এখানে পড়ে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। কাজেই কোথাও লোকজন বাড়িঘর আছে কিনা খুঁজে বের করতে হবে। সেই বালির মরুভূমির ওপর দিয়ে হেঁটে চললাম আমি।
আস্তে আস্তে সূর্য পশ্চিমদিকে অনেকটা নেমে এল। গত সন্ধ্যেয় পেটে কিছু পড়েনি। গলা শুকিয়ে কাঠ। ক্ষুধা তৃষ্ণায় মৃত প্রায় আমি টলতে টলতে হেঁটে চললাম।
হঠাৎ দেখি একটু দূরেই কিছু বাড়িঘর। ঠিক দেখছি তো? দুচোখ কচলে নিলাম। হা-থাম দেওয়া পাথরের বাড়িঘর। আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠতে গেলাম। গলা দিয়ে কোন শব্দই বেরোলো না। হাঁটতে লাগলাম। এখানে বালি গরম নয়। বালি মাটি মেশানো শক্ত জমি। আমি তখন আর হাঁটতে পারছি না। সেই জমির ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চললাম।
প্রথম যে বাড়িটা পেলাম সেটার দরজার ওপর আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কাঠের ফালি কেটে তৈরি দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল। সেই শব্দটাই আমি শেষ শুনেছিলাম। তারপরই আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আর কিছুই মনে নেই।
আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরে এল। অস্পষ্ট কাদের কথাবাতা কানে আসতে লাগল। সেই শব্দ আস্তে আস্তে আমার কানে স্পষ্ট হল। কিন্তু সেই কথাবাতার কিছুই আমি বুঝতে পারছিলাম না। বেশ কষ্ট করে চোখ খুললাম। আমার গলায় গোঙানির শব্দ উঠল। কথাবার্তা থেমে গেল। কে একজন একটু দ্রুতই আমার মাথার কাছে এল। কপালে হাত রাখল। আমি দেখলাম মুখের দুপাশে রঙমাখা একটা মুখ। লোকটা আমার চোখ খোলা দেখে হাসল। আমি অনেক কষ্ট করে বললাম জল। লোকটি কিছুই বুজল না। তাকিয়ে রইল। আমি আস্তে আস্তে ডানহাতট তুলে জল খাওয়ার ভঙ্গি করলাম। লোকটা বুঝল। গলা চড়িয়ে কী বলল। সামুদ্রিক মাছের তেলের আলো জ্বলছিল ঘরটাতে। সেই আলোয় দেখলাম একজন স্ত্রীলোক চিনেমাটির বাটিতে জল নিয়ে ছুটে এল। স্ত্রীলোকটির মুখে কোনো রঙ লাগানো নেই। আমি মুখ হাঁ করলাম। স্ত্রীলোকটি আস্তে আস্তে মুখে জল ঢেলে দিতে লাগল। আমি থেমে থেমে অনেকটা জল খেলাম। মুখ গলা নাকের শুকনো ভাবটা কেটে গেল। অনেকটা স্বাভাবিক হলাম আমি। স্ত্রীলোকটি হাসল। আমার মুখের কাছে মুখ এনে কী বলল। কিছুই বুঝলাম না। স্ত্রীলোকটি এবার হাত তুলে মুখে চুঁইয়ে খাওয়ার ইঙ্গিত করল। আমি আস্তে আস্তে মাথা কাত করে সম্মতি জানালাম। স্ত্রীলোকটি চলে গেল। এবার লোকটি এগিয়ে এল। হেসে আমার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কী যে ভাল লাগল। রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। এত ক্লান্ত যে কথা বলতে পারছিলাম না। লোকটি ও স্ত্রীলোকটি আমায় অনেক কথা জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু ওদের ভাষা আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় কী? একটু থেমে মেস্তিজো আবার বলতে লাগল দিন চার পাঁচেক কাটল। আমি তখন অনেকটা সুস্থ। জানলাম যেখানে আমি আশ্রয় পেয়েছি সেটা একটা ছোট শহর। নাম চিল্লাই। লোকটির নাম জামিলি। সমুদ্রে মাছ ধরাই তার কাজ। চিল্লাই শহরের অধিকাংশ লোকই সমুদ্রে মাছ ধরেই সংসার চালায়। মেস্তিজো থামল, ফ্রান্সিস বলল তারপর? মেস্তিজো বলতে লাগল।
জামিলির আশ্রমে আমার দিন কাটতে লাগল। জামিলিরা যে ভাষায় কথা বলে তার নাম উনকা। জামিলির পরিবারের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমি তাড়াতাড়ি উনকা ভাষা শিখে গেলাম। মাছ ধরার কাজে জামিলিকে আমি সাহায্য করতাম। এইভাবে আমি ঐ পরিবারেরই একজন হয়ে গেলাম। জামিলির স্ত্রী মায়ের মত স্নেহে যত্নে আমাকে মানুষ করতে লাগল। মেস্তিজো এই পর্যন্ত বলে থামল। ফ্রান্সিস বেশ আগ্রহের সঙ্গে মেস্তিজোর জীবনের কাহিনী শুনছিল। মেস্তিজোকে একটু দম নিতে সময় দিল। তারপর বলল-মেস্তিজো তারপর কী হল বলো। মেস্তিজো আবার বলতে শুরু করলো-এবার চিকামা উপত্যকার কথা বলি। চিল্লাই থেকে বেশ কিছুটা উত্তরে চিকামা উপত্যকা। এই উপত্যকা ঘিরে গড়ে উঠেছিল মোচিকা রাজ্য। চিকামা উপত্যকাতেই রাজধানী চিকম। অনেক মানুষের বাস সেখানে। সবাই উনকা ভাষায় কথা বলে। তাই এদের বলা হয় উনকা। এই উনকাদের রাজা ছিল কোলা। খুব উদার হৃদয়ের মানুষ। এই মোচিক রাজ্যের উত্তরে চিরজা। সেই রাজ্যের রাজার নাম লুপাকা। একটু থেমে মেস্তিজো বলতে লাগল-দুই রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘদিনের শত্রুতা। তখন আমি যুবক। নানা প্রয়োজনে আমাদের চিকাম যেতে হত। জামিলির সঙ্গে একদিন চিকামার উদ্দেশ্যে বেরোলাম। চিকামায় খুব ভালো মাছ ধরা জালের সূত্রে পাওয়া যায়। তা ছাড়া সংসারেরও কিছু জিনিসপত্র কেনাকাটা করার ছিল। আমরা যখন চিকামা পোঁছলাম তখন সন্ধে হয় হয়। এক সরাইখায় দুজনে আশ্রয় নিলাম। রাতে খেতে বসেছি তখনই সরাইখানার লোকজনের মুখে শুনলাম অবস্থা ভালো নয়। চিমুদের রাজা লুপাকা চিকিমার উত্তর সীমান্তে সৈন্য সাজিয়ে অপেক্ষা করছে। যে কোন মুহূর্তে মোচিকা রাজ্য আক্রমণ করতে পারে। জামিলি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। খেয়ে উঠে শুতে এলাম দুজনে। ঠিক করেছিলাম সেদিন রাতটা বিশ্রাম নিয়ে পরদিন কেনাকাটা করবো। জামিলি বলল-কেনাকাটা দরকার নেই। কাল ভোরেই চিল্লাই রওনা হবো। এই চিকিমায় আর থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। ভোরে উঠতে হবে। শুয়ে শুয়ে জামিলির মুখে উনকা আর চিমুদের শত্রুতার নানা গল্প শুনেছিলাম। জামিলি সে সব বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। একটু থেমে মেস্তিজো বলতে লাগল-গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। চারপাশের বাড়িতে ও সরাইখানায় লোকজনের চিৎকার হৈ হল্লা চলছে তখন। জামিলি আর আমি দুজনেই ছুটে বাইরে এলাম। দেখলাম উনকা সৈন্যরা মশাল আর লোহার ছুঁচালো মুখ বর্শা হাতে রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই রাজবাড়ি থেকে রাজা কালো ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে এল। পেছনে ঘোড়ায় চড়ে এল রাজার দেহরক্ষী সৈন্যরা। রাজা কোলার মাথায় লাল রঙের মোটা কাপড়ের ফেট্টি। তাতে লাল হলুদ বিচিত্র সব পাখির পালক গোঁজা। গায়ে কাঁচের টুকরো বসানো পঞ্চো। বিচিত্র রঙের সুতোর কাজ করা পঞ্চোটায়। জামিলি বলল এটাই নাকি রাজা কোলার যুদ্ধযাত্রার পোশাক। রাজা উত্তর দিকে ঘোড়া ছোটাল। পেছনে অশ্বারোহী দেহরক্ষীরা। তারপরে পদাতিক সৈন্যরা। চারদিকে ভিড় করে দাঁড়ালো। চিকিমার অধিবাসীরা চিৎকার করে রাজা কোলার জয়ধ্বনি দিল। সৈন্যরা উত্তর মুখে চলল। একটা নিচু পাহাড়ের আড়ালে পড়ে গেল রাজা কোলা আর তার সৈন্যরা। মেস্তিজো থামল। তারপর আবার বলতে লাগল কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম অন্ধকারে মশাল হাতে উত্তর দিক থেকে লোকজন ছুটে আসছে। খবর পাওয়া গেল চিমুদের রাজা লুপাকার সঙ্গে রাজা কোলার যুদ্ধ বেধে গেছে। শুরু হল লোকজনের চিৎকার চাচামেচি ছোটাছুটি। আমরা আর সরাইখানায় ঢুকলাম না। যুদ্ধের খবরের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। উত্তর দিক থেকে আবার কিছু লোকজন ছুটতে ছুটতে এল। তাদের কাছে খবর পাওয়া গেল প্রচণ্ড লড়াই চলেছে। কে জিতবে কে হারবে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। একটু থেমে মেস্তিজো বলতে লাগল-বাকি রাতটা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েই কাটল। ভোর হল তখনও লড়াই চলছে। জামিলি আর আমি সরাইখানায় কলাম। নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে এলাম। তখনও রাস্তাঘাটে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। আমরা আর অপেক্ষা করলাম না। চিল্লাইয়ের উদ্দেশ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটতে শুরু করলাম। দুপুর নাগাদ চিল্লাই এসে পৌঁছলাম। ক্লান্ত তৃষার্ত সারা শরীর ধূলিধূসরিত। চিক্লাইয়ের লোকজন আমাদের দেখে লড়াইয়ের খবর জানার জন্যে ছুটে এল। আমরা আর কথা বলতে পারছি না। তবু সংক্ষেপে বললাম সব। লড়াই চলছে। কে হারে কে জেতে বলা শক্ত।
বিকেলের একটু আগে। পরিশ্রান্ত আমি আর জামিলি ঘরে শুয়ে বসে বিশ্রাম করছি এমন সময় কে যেন খবর দিয়ে গেল রাজা লুপাকা তার পরাজিত সৈন্যদের নিয়ে উত্তরে চিম্ রাজ্যে পালিয়ে যাচ্ছে। রাজা কোলা তাঁর সৈন্যদের নিয়ে চিকিমায় ফিরে এসেছেন। বিজয় উৎসব চলছে চিকিমায়। চিল্লাই শহরের লোকজন আনন্দে চিৎকার করতে করতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগল আর রাজা কোলার জয়ধ্বনি দিতে লাগল।
তখন সন্ধ্যে হয় হয়। আমি শহরের পথে পথে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে হৈ হল্লা শুনে ফিরে এসে ঘরে বিশ্রাম করছি। জামিলি আনন্দ উৎসব শেষ করে ফেরেনি। হঠাৎ শুনলাম কাঠের দরজায় হাত দিয়ে চাপড়াবার শব্দ। তেমন জোরে চাপড়ানো হয়নি। তবু আমি মৃদু শব্দ পেলাম। তাড়াতাড়ি উঠে গেলাম। দরজা খুলে দিলাম। দেখি একজন মধ্য বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে। মুখের একপাশে হলুদ রং। মাথায় ফেট্টি। পালক গোঁজা তাতে। লোকটির গায়ে চাদরের মত একটা হলদে কাপড় জড়ানো। লোকটি এতক্ষণ মুখ নিচু করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছিলো। এবার মুখ তুলে তাকাতেই চমকে উঠলাম-আরে এ যে রাজ পুরোহিত গ্লাম। চিকামার হুয়াকা দেবতার পুরোহিত। আমি তাড়াতাড়ি ল্লামাকে দুহাতে তুলে মাথা নুইয়ে প্রণাম জানালাম। তারপর তাকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে এলাম। ল্লামা তখন এত ক্লান্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সারা গায়ে ধুলো বালি। স্ত্রীলোকেরা ল্লামাকে খুব যত্ন করে হাত মুখ ধুইয়ে খেতে দিল বীনের রুটি তরকারি। খেয়ে দেয়ে ল্লামা বিছানায় শুয়ে পড়ল। এতক্ষণে যেন শরীরে মনে একটু জোর পেল। জামিলি আমাকে চিকামা নিয়ে যেতো। হুয়াকা দেবতার পূজায় উৎসবেও গেছি। তখন ল্লামাকে দেখেছি। হুয়াকা দেবতার বেদী থেকে সমবেত ভক্তদের দিকে প্রসাদী ফুল ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে।
জামিলি তখনই বাড়ি ফিরল। ল্লামাকে দেখে সেও অবাক। জামিলি ল্লামারে মাথা নুইয়ে হাত বাড়িয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে জিজ্ঞেস করল-আপনার এ রকম অবস্থা হল কী করে? ল্লামা ক্লান্তস্বরে বলল-তার আগে বলো–যুদ্ধের সংবাদ কী?
রাজা কোলা জয়লাভ করেছে। লুপাকা তার সৈন্যদের নিয়ে চিন্ রাজ্যে পালিয়ে গেছে। ল্লামা খুশিতে প্রায় চিৎকার করে উঠল-রাজা কোলা দীর্ঘজীবী হোন। হুয়াকা দেবতার জয় হোক। এবার মা আস্তে আস্তে গায়ের লাল কাপড়টা বাঁদিকে সরাল। দেখা গেল কাঁধের কাছে বশর ক্ষত। গাছের লতাপাতা দিয়ে বাঁধা। রক্ত পড়ছে না। ল্লামা বলল-লুপাকার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়েছে জামতাম। দুপুরের দিকে তিতিকাকা হদের থেকে পূজের জল আনতে যাচ্ছি হঠাৎ পাঁচ ছজন সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে একেবারে আমার সামনে এসে হাজির। ওরা বোধহয় দলছুট সৈন্য ছিল। আমি তে! ছুটতে লাগলাম তিতিকাক বনের দিকে। ওরাও পিছু নিল। একজন বশ ছুঁড়ল। লাগল না আমার গায়ে। কিন্তু পরের বর্শাটি কাঁধ ছুঁয়ে গেল। কাটা জায়গা থেকে রক্ত ছুটল। আমি দাঁড়ালাম না। ঐ অবস্থায়ই ছুটে জঙ্গলে ঢুকে গেলাম। চি সৈন্যরা তিতিকাক বনের কিছুই চেনে না। আমাদের কাছে ঐ বনের সবই চেনা! তাল্পক্ষণের মধ্যেই আত্মগোপন করলাম গভীর বনের মধ্যে। কিন্তু বর্শার ঘায়ে কাধ থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি তখনও। কিছু বুনো লতাপাতা আমি চিনতা। সে সব পাতা থেঁতলে লাগালাম গায়ে। রক্ত পড়! বন্ধ হল। জ্বাল যন্ত্রণাও কমল। তারপর ঝোঁপ জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে হাঁটতে হাঁটতে চাল। মরুভূমিতে এলাম। উত্তর দিক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই চিল্লাই এসে পৌঁছলাম। জানি তোমাদের সেবা শুশ্রয়ার কয়েক দিনের মধ্যে সুস্থ হবো। মেস্তিজো থামল। ফ্রান্সিস মেস্তিজোর জীবন কাহিনী বেশ মন দিয়ে শুনছিল। বলল-তারপর?
মেস্তিজো বলতে লাগল-দুতিন রাত জেগে খুব কষ্ট করে রাজ পুরোহিত ল্লামার সেবা শুশ্রূষা করলাম। ল্লামা দিন সাতেকের মাথায় একেবারে সুস্থ হয়ে গেল। এবার চিকিমা চলে যেতে হবে। আবার হুয়াকা তোর পূজো শুরু করতে হবে। রাজা কোলা যুদ্ধে জিতেছেন। কাজেই এবারের পূজোয় খুব ধূমধাম হবে।
গ্লামা যাবে পরদিন। তার আগের দিন রাতের বেলা জামিলিকে ডেকে বলল দেখ মেস্তিজোর প্রাণপণ সেবা শুশ্রূষাতেই আমি এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হলাম। মেস্তিজো ছেলেটি খুবই সৎ পরিশ্রম আর দয়াবান। যদি তুমি আপত্তি না কর তবে মেস্তিজোকে আমি চিকামা নিয়ে যাবো। ওকে রাজপুরোহিতের সব ক্রিয়াকর্ম পদ্ধতি শেখাবো। আমার অবর্তমানে মেস্তিজোই হবে রাজপুরোহিত। জামিলি চুপ করে রইল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। ওদিকে আমার মন তখন আনন্দে নেচে উঠেছে। জামিলি আমার দিকে তাকাল। বলল-তোর কী ইচ্ছে বল।
–আমি ল্লামার সঙ্গে যাবো। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম।
–বেশ। জামিলি আর কোন আপত্তি করল ন!। মুস্কিল হল জমিলির স্ত্রীকে নিয়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কান্না আর থামে না। সত্যি উনি আমাকে মার মত রেহ যত্নে মানুষ করেছিলেন। আমিও তাঁকে মা বলেই মেনে নিয়েছিলাম। যা হোক মাঝে মাঝে আসবে। এই কথা দিয়ে ছাড়া পেলাম। পরদিন ভোরেই ল্লামার সঙ্গে চললাম চিকাম। দুপুর নাগাদ চিকাম পৌঁছলাম। এর আগেও চিকামা। এসেছি। হপ্তাতে জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে। এখন এসেছি থাকতে। চিকামা শহরে থাকবো ঐ স্বপ্ন আমার অনেক দিনের। আজকে সেই স্বপ্ন সার্থক হল।
মেস্তিজো গল্প থামিয়ে ফ্রান্সিসকে বলল আপনি তো চিকাম যাননি। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। মেস্তিজো বলতে লাগল বড় সুন্দর জায়গা চিকাম। এখানে এক উঁচু পাথরের স্তূপের ওপর উনকাদের দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত। নিখাদ সোনায় তৈরি সেই দেবমূর্তি কতদিন আগে তৈরি হয়েছিল কেউ জানে না। এই দেবমূর্তিকেই উনকার বলে হুয়াক। প্রতিদিন ল্লামা হুয়াকার পুজো করে। আমি ল্লামাকে নানাভাবে পুজোর ব্যাপারে সাহায্য করি। থাকি দেবমূর্তির পাথরের বেদীর কাছেই একটা পাথরের ঘরে ল্লামার সঙ্গে। এই ভয়াকা দেবতা মন্দিরের প্রাঙ্গনে মাঝে মাঝে উৎসব হয়। সারা চিকামার লোক দল বেঁধে আসে সেই উৎসব দেখতে পূজো দিতে ও আনন্দে অংশগ্রহণ করতে।
–সেই দেবতার স্বর্ণমূর্তি দেখতে কেমন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল। মেস্তিজো আঙুল দিয়ে গুহার প্রায় অন্ধকারে কোণায় রাখা একটা কাঠের মূর্তি দেখল। ফ্রান্সিসরা সেইদিকে তাকাল। দেখল কাঠের মূর্তি কয়েকটা। দেখতে এ রকম
–আসল মূর্তিটা কত উঁচু? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–হাত আড়াই তিনেক। রাজপুরোহিতল্লামা শুধু পূজোআর্চা করত না। পাথর, এলগারোর গাছের আঁকাবাঁকা কাণ্ড কুঁদেমূর্তি বানাতো। আমিও তার কাছে থেকে তার সঙ্গে কাজ করে এসব বানানো শিখে ছিলাম। ঐ মূর্তিগুলো আমারই তৈরি। মেস্তিজো থামল। ফ্রান্সিস বেশ মনোযোগ দিয়েই মেস্তিজোর গল্প শুনছিল। তবে উৎসাহিত হবার কোন তথ্য পাচ্ছিল না।
–এবার তোমার সম্পর্কে বলো, ফ্রান্সিস বলল–তুমি চিকামা থেকে পালিয়ে এসে এখানে আত্মগোপন করে আছো?
–চিম রাজ্যের রাজা লুপাকা এবার রাজা কোলার মোচিকা রাজ্য আক্রমণ করার জন্যে সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলতে লাগল। উত্তরের পাহাড়ী এলাকার উপজাতিদের নিয়ে লুপাকা এক দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল। মাস তিনেক আগে লুপাকা সেই দুর্ধর্ষ সেনাদের নিয়ে মোচিকা রাজ্য আক্রমণ করেছিল। রাজা কোলা এই আক্রমণের সম্ভাবনার কথা গুপ্তচরের মারফৎ যখন শুনলেন তখন আর সৈন্য সাজিয়ে নতুন সেনা জোগাড় করে সেই আক্রমণের মোকাবিলা করার সময় নেই। তবু রাজা কোলা সৈন্যবাহিনী নিয়ে উত্তর সীমান্তের দিকে চললেন। কিন্তু সীমান্ত পর্যন্ত যাবার আগেই চিমু সেন্যরা আক্রমণ করল। সেই পাহাড়া বন্য হিং চিন সেনাদের সামনে রাজা কোলার সৈন্যবাহিনী দাঁড়াতেই পারল না। ধুলোর মত উড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে রাজা কোলা মৃত্যুবরণ করলেন। মোচিকা সৈন্যরা পিছু হটে এল। পরে চিমদের পদাতিক বাহিনীও এল। শুরু হল অগ্নিসংযোগ আর অবাধ লুণ্ঠন। রাজা লুপাকা চিকামার রাজ সিংহাসনে বসল। তারপর অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দিল।
–লুপাকা এসে এখানে উনকাদের কাছে যত সোনা অলঙ্কার দামি পাথর পেল সব কেড়ে নিল। মাস দুয়েক কাটল। একদিন লুপাকা হুয়াকা স্বর্ণমূর্তি নিজের চিমু রাজ্যে নিয়ে যেতে চাইল। হুয়াকাভক্ত উনকাদের কোনো আপত্তিই সে গ্রাহ্য করল না। সৈন্যরা স্বর্ণমূর্তি নামিয়ে আনতে গেল। তখনই ধরা পড়ল যে, যে মূর্তিটা রাখা আছে সেটা সোনার নয় কাঠের। এত সুন্দর রঙ মিশিয়ে তৈরি যে কারো বোঝবার উপায় ছিল না। রাজা লুপাকা ভীষণ ক্ষেপে গেল। আসল স্বর্ণমূর্তি তাহলে কে সরিয়েছে? কে লুকিয়ে রেখেছে সেই স্বর্ণমূর্তি? রাজা লুপাকার যত রাগ গিয়ে পড়ল রাজপুরোহিত ল্লামার ওপর। ল্লামার সঙ্গে তার শিষ্য আমাকেও বন্দী করা হলো। ভাষণ অত্যাচার চলল ল্লামার ওপর। ল্লামা বলল-রাজা কোলার নির্দেশেই সে আসল স্বর্ণমূতির মতো একটি কাঠের মূর্তি তৈরি করেছিলো। সেটা নিয়ে রাজা কোলা কী করেছেন তা সে জানে না।
রাজা লুপাকার রক্ষীদের নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে রাজপুরোহিতল্লামা কয়েদঘরেই মারা গেল আমার কোলে মাথা রেখে। মস্তিজো থামল।
ফ্রান্সিস এতক্ষণে আধশোয়া হয়ে মেস্তিজোর কথা শুনছিলো। স্বর্ণমূর্তির রহস্যের কথা শুনেই ও সোজা হয়ে বসল-বোঝা যাচ্ছে রাজা কোলা আশঙ্কা করেছিলেন যে রাজা লুপাকা তার দেশ আক্রমণ করতে পারে। তার পরাজয় হতে পারে। যুদ্ধে জিতেও যাতে রাজা লুপাকা স্বর্ণমৃতি নিয়ে নিজের দেশে যেতে না পারে তার জন্যে তিনি নকল হুবুহু একরকম দেখতে একটা কাঠের মূর্তি ল্লামাকে দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন।
— ঠিক বলেছেন। মেস্তিজো বলল।
-–এখন প্রশ্ন হলো রাজা কোলা সেই আসল মূর্তি কো লুকিয়ে রেখেছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।
–তাদের হদিস কেউ জানে না। মেস্তিজো বলল—রাকা লুপাকা এখন হন্যে হয়ে সেই আসল স্বর্ণমূর্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে। ফ্রান্সিস কিছু নিচু করে তারপর ঘাসের বিছানা থেকে উঠে নকল কাঠের মূর্তিটার কাছে গেল। ভাল করে দেখল। বলল–মেস্তিজো, রাজপুরোহিত কি এ ব্যপারে কোনো ইঙ্গিত তোমাকে দিয়ে যেতে পারেনি?
-না, স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। তবে রাজা কোলাকে সে জিজ্ঞেস করেছিল–এই নকল কাঠের মূর্তি তিনি কেন এত করছেন? মেস্তিজো বলল।
–তার উত্তরে রাজা কোলা কী বলছিলেন? ফ্রান্সন্সি জানতে চাইল।
-শুধু হেসে বলেছিলেন-সবই কপালের লিখন। মেস্তিজো বলল।
-সবই কপালের লিখন–কথাটা ফ্রান্সিস বার কয়েক বিড়বিড় করে বলল। অর্থ কথাটার? ফ্রান্সিস গুহার পাথুরে মেঝেয় কয়েকবার পায়চারি করল। বিষ্কে বলল–ফ্রান্সিস, ব্যাপারটা কি তোমার কাছে রহস্যময় লাগছে?
–অবশ্যই-ফ্রান্সিস পায়চারি থামিয়ে বলল-আর আমি স্থির করে ফেলেছি ঐ স্বর্ণমূর্তি খুঁজে বের করতে আমি চিকামা উপত্যকায় যাবো।
-পারবে খুঁজে বের করতে? মারিয়া বলল।
আগে নকল মুর্তিটা দেখি। চারপাশ ভালো করে দেখি, তবেই বুঝতে পারবো মূর্তি উদ্ধার করতে পারবো কিনা। ফ্রান্সিস বলল। এবার ফ্রান্সিস মেস্তিজোর দিকে তাকিয়ে বলল-তুমি এই গুহাঘরে লুকিয়ে আছ কেন?
গুরুদেব ল্লামা মারা যাওয়ার পর রাজা পাকা আমার ওপর অত্যাচার শুরু করে-মেস্তিজো বলল–কোনোরকমে পালিয়ে এসে এখানে লুকিয়ে আছি।
–তুমি রাজা লুপাকাকে কী বলেছ? ফ্রান্সিস জানতে চাইল?
–ঐ যে কথাটা রাজা ল্লামাকে বলেছিলেন-সবই কপালের লিখন।
-হুঁ। ফ্রান্সিস কপাল কুঁচকে ভাবল একটুক্ষণ। বলল-রাজা লুপাকা বোধহয় কিছুই বোঝেনি।
–না। এই জন্যেই তো আমার উপর রাগ। এখানে লুকিয়ে থাকি। আমি তো রাজপুরোহিত ল্লামার সহকারী ছিলাম। তাই উনকারা আমাকে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। আমার খাবার লুকিয়ে পাঠিয়ে দেয়। কখনো আমিও খাবার আনতে যাই। মেস্তিজো বলল।
-তুমি তাহলে উনকা ভাষা জানো। ফ্রান্সিস বলল।
অনলি বলতে পারি। মেস্তিজো বলল। ফ্রান্সিস বিস্কোদের দিকে তাকাল। বলল–বিস্কো, শাঙ্কো-বিকেল হয়ে গেছে। তোমরা অস্ত্রশস্ত্র এখানে রেখে জল নিয়ে জাহাজে চলে যাও। বন্ধুদের গিয়ে বল-আমরা চিকামা যাবো। স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করবো। ওরা যেন দিন দশ পনেরো আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে। ততদিন আমরা না ফিরলে ওরা যেন সশস্ত্র হয়ে চিকামায় যায়। সব বলে তোমরা দুজনে ফিরে এসো।
–বেশ–বিস্কো বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শাঙ্কো উঠল। ফ্রান্সিস বলল-মারিয়া তুমি ওদের জাহাজে ফিরে যাও।
মারিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–না, আমিও তোমাদের সঙ্গে চিকামা যাবে।
–বেশ, চলো–ফ্রান্সিস বলল-আমরা কিন্তু বেড়াতে যাচ্ছি না। যে কোনো মুহূর্তে বিপদে পড়তে পারি।
–আমি ভয় পাই না। মারিয়া দৃঢ়স্বরে বলল।
বিস্কো আর শাঙ্কে। সন্ধ্যের আগেই জলের পিঁপে নিয়ে জাহাজে চলে গেল। গুহাঘরটা একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার হয়ে গেল। মেস্তিজো চকমকি ঠুকে পাথরের খাঁজে রাখা একটা মশাল জ্বালাল। মশালটা সামুদ্রিক মাছের তেলে ভেজানে! ছিল। মেণ্ডিজে! ফ্রান্সিসকে তার মারিয়াকে শোনাচিছল ওর চিকায় কাটানো জীবনের কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনছিল। ওর এর মনোযোগ দিয়ে শোনার উদ্দেশ্য যদি স্বর্ণমূর্তি উদ্ধারের কোনো সূত্র পাওয়া যায়।
একটু রাতে বিস্কো আর শাঙ্কো ফিরে এল। বলল-বন্ধুরা সবাই ফ্রান্সিসের কথা মন দিয়ে শুনেছে। ওরা খুসি হয়েছে ফ্রান্সিস আর এক অভিযানে যাচ্ছে শুনে। ওরা জাহাজ থেকে খাবার এনেছিল। রাতের খাওয়ার পর ওরা শুকনো ঘাস ছড়ানো বিছানায় শুয়ে পড়ল।
গভীর রাত তখন। দূরের সমুদ্রের মৃদু গর্জন শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ কিসের শব্দে মারিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল ও আর কোনো শব্দ হয় কি না শোনার জন্যে কান পেতে রইল। আবার শব্দ হলো। দু-চারটে পাথরের টুকরো বাইরে চাই পাথরের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। ও ফ্রান্সিসকে ফিসফিস করে ডাকল-ফ্রান্সিস, ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–শুনেছি। আসার পথে ধূসর রঙের শেয়াল দেখেছিলাম। বোধহয় শেয়ালের পাল, খাবারের ধাক্কায় এসেছে।
ঠিক তখনই কাঠের ফালিতে তৈরি গুহাঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। স্পষ্ট শব্দ। ফ্রান্সিস বিপদ আঁচ করল। একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে তরোয়ালটা নিয়ে চাপাস্বরে ডাকল-বিস্কো-শাঙ্কো।
বিস্কো শাস্কো তখনও ঘুমে অচেতন। মারিয়া ওদের জোরে ধাক্কা দিল। দুজনেই দ্রুত উঠে বসল। ততক্ষণে কয়েকজন লোক এসে গুহাঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে। মশালের আলোয় দেখা গেল-লোহার ছুঁচালো মুখওয়ালা বর্শা। সকলের হাতেই বর্শা। বশ ছোঁড়ার জন্যে উঁচিয়ে ধরল ওরা। লোকগুলো বেঁটে। শক্ত-সমর্থ। গায়ের রঙ হালকা তামাটে। মাথায় লম্বা চুল। কপালে লাল কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা। তাতে পাখির পালক গোঁজা। পরনে ঢিলেঢালা পোশাক-পঞ্চো। মুখের দুপাশে লাল রং মাখা। শাঙ্কো দ্রুত তীর ধনুকের দিকে হাত বাড়াল। ফ্রান্সিস বলে উঠল-শাঙ্কো, আগেই লড়াই নয়। ফ্রান্সিস তরোয়াল ফেলে দিল। মেস্তিজোর দিকে তাকিয়ে দেখল ভয়ে মেস্তিজোর মুখ সাদা হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল-মেস্তিজো এরা কারা?
–রাজা লুপাকার সৈন্য। আমাকে ধরলে মেরে ফেলবে। সৈন্য ক জন কিন্তু ফ্রান্সিসদের আর মারিয়াকে দেখে অবাক। সৈন্যদের মধ্যে সবচেয়ে বলশালী লোকটা ভারী গলায় কী বলে উঠল। ফ্রান্সিস বলল-মেস্তিজো-এরা যা বলবে আমাকে তা বলো।
-–ও দলনেতা। বলছে–তোমরা কে? মেস্তিজো বলল।
–বলো, আমরা ভাইকিং। রাজা কোলার লুকোনো স্বর্ণমূর্তি আমরা খুঁজে বের করতে এসেছি। আমরা লড়াই চাই না। ফ্রান্সিস বলল। মেস্তিজো উনকা ভাষায় কথাগুলোকে দলনেতাকে বলল। দলনেতা কিছুক্ষন মাথা নিচু করে কী ভাবল। তারপর মাথা তুলে কী বলল। মেস্তিজো বলল-দলনেতা বলছে, ওরা আমার খোঁজে এসেছিলে। কিন্তু আপনারা বিদেশী। আপনাদেরও ওরা বন্দী করবে। রাজা লুপাকার কাছে নিয়ে যাবে। তারপর রাজা লুপাকা যা করবার করবে।
–খুব ভাল কথা। কিন্তু মেস্তিজো, ওকে বলো আমাদের কারো যেন কোনো ক্ষতি না হয়। ফ্রান্সিস বলল। মেস্তিজো কথাটা দলনেতাকে বলল। দলনেতা মাথাটা দুপাশে নাড়ল। বোধহয় কথাটা মেনে নিল। দলনেতার ইঙ্গিতে একজন সৈন্য নিজের কোমরে জড়ানো কালো রঙের লম্বা দড়ি বের করল। সেই দড়ি দিয়ে প্রথম মেস্তিজো তারপর মারিয়ার হাত বাঁধা হলো। তারপর ফ্রান্সিসদের বাঁধা হলো। আর একজন সৈন্য ফ্রান্সিসদের তরোয়াল শাঙ্কোর তীর ধনুক নিল। শাঙ্কো ওদের চোখের আড়ালে বড় ছোরাটা ঢোলা জামার মধ্যে লুকিয়ে রাখল।
গুহাঘর থেকে সবাই বাইরে এল। দুজন সৈন্য মশাল হাতে সামনের দিকে চলল। পেছনে দলনেতা, অন্য সৈন্য আর ফ্রান্সিসরা চলল।
পাহাড়ী এলাকা পেরোতেই পুব আকাশ লাল হলো। একটু পরেই সূর্য উঠল। দেখা গেল এদিকটায় বালির চিহ্নমাত্র নেই। চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি। বীন, তুলো আলুর ক্ষেত। মাঝে মাঝে দুচারটে পাথরগাঁথা বাড়ি। পেইকো ঘাসের ছাউনি। সেসব বাড়ি থেকে পুরুষ স্ত্রীলোক বাচ্চাকাচ্চারা বেরিয়ে এল।
অবাক হয়ে ফ্রান্সিসদের দেখতে লাগল। বিশেষ করে হলদে গাউন পরা মারিয়াকে। ওদের পরনে মোটা সুতোর হাতে তৈরি ঢোলা পোশাক। পোশাকে নানা রঙের সুতোর কাজ।
ধুলোটে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই চিকামা পৌঁছাল। দেখা দেখা গেল সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের উপত্যকায় চিকামা নগর। এখানে জনবসতি বেশি। পাথরের বাড়িঘরও অনেক। চিকামার অধিবাসীরাও অবাক চোখে ফ্রান্সিসদের দেখতে লাগল। মারিয়ার পোশাক দেখে ওরা আশ্চর্য হলো বেশি।
একটা পথরের লম্বাটে ঘরের সামনে এসে দলনেতা দাঁড়ালো। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন সৈন্য গিয়ে ঘরটায় কাঠের দরজায় লাগানো একটা বড় হুক টেনে খুলল। দলনেতা ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢোকার জন্য ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা ঘরটায় ঢুকল। ঘরে ঢুকেই ফ্রান্সিস বুঝল এটা কয়েদঘর। হাত বাঁধা অবস্থায় প্রায় আটদশজন লোক ঘরটায় শুয়ে বসে আছে।
ফ্রান্সিস মেস্তিজোকে সঙ্গে সঙ্গে বলল-দলনেতাকে বলল, আমাদের কেন। কয়েদঘরে রাখা হচ্ছে?
মেস্তিজো ভয়ে সেকথা দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দলনেতাকে বলল! দলনেতার উত্তরটা মেস্তিজো ফ্রান্সিসকে বলল-দলনেতা বলছে, ও রাজাকে সব বলবে। তারপর আপনাদের ব্রাজসভায় রাজার সামনে উপস্থিত করবে। রাজা যা করার করবেন। ততক্ষণ কয়েদঘরেই থাকতে হবে।
অগত্যা ফ্রান্সিসদের এই বন্দী জীবন মেনে নিতেই হলো।
দুপুরের দিকে কয়েদঘরের রক্ষীরা বড় বড় পাতা পেতে ফ্রান্সিসদের খেতে দিল। হাত খুলে দিল। ওরা খেতে লাগল। ফ্রান্সিসরা বন্দীদশায় যেমন বরাবর বলে তেমনি বলল-পেট ভরে খাও। খেতে ভালো না লাগলেও খাও। শরীরটা ঠিক রাখো। মেস্তিজোর গুহাঘরে যে খাবার ফ্রান্সিস আর মারিয়া খেয়েছিল তেমনি খাবার। খুব সুস্বাদু হলেও খাবার অন্যরকম বলেই ভালো লাগলো। ফ্রান্সিস চেটেপুটে খেল। খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই সৈন্যদের দলনেতা সেই, বেঁটে বলশালী লোকটা এল। মেস্তিজোর সঙ্গে কী কথা হলো।
মেস্তিজো বলল-ফ্রান্সিস, চলো. রাজা আমাদের ডেকেছেন। রাজসভায় যেতে হবে।
হাত বাঁধা অবস্থাতেই ওরা দলনেতার পেছনে পেছনে চলল। রাস্তার দু–ধারের লোকজন বেশ ঔৎসুক্যের সঙ্গে ওদের দেখতে লাগল। রাস্তার পাশ থেকে হঠাৎ একজন পুরুষ ও একজন নারী ছুটে এসে মেস্তিজোকে মাথা নিচু করে দুহাত বুকে রেখে বোধহয় শ্রদ্ধা জানালো। সৈন্যরা ঐ দুজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ফ্রান্সিস বুঝল, মেস্তিজো রাজপুরোহিতের শিষ্য ছিল। ওকে উনকারা এখনও শ্রদ্ধা করে। কিন্তু রাজা লুপাকার সৈন্যদের ভয়ে এগিয়ে এসে শ্রদ্ধা জানাতে সাহস পাচ্ছে না।
রাজবাড়িটা বেশ উচ, বড় ও পাথরের তৈরি। পাথরের ছাদ। ওরা রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকল। একটু অন্ধকার মতো ভেতরটা। দিনের বেলায়ও পাথুরে দেয়ালে মশাল জ্বলছে। রক্ষীরা লোহার ছুঁচালোমুখ বশা হাতে পাহারা দিচ্ছে।
একটু এগোতেই ফ্রান্সিসরা দেখল রাজসভা চলছে। একটা পাথরের সিংহাসনে রাজা লুপাকা বসে আছে। দুপাশে আরো কয়েকটা পাথরের ছোট আসনে বোধহয় মন্ত্রী গণ্য মান্যরা বসে আছে। রাজা বেঁটে। বয়েস হয়েছে। তবু বেশ শক্তসমর্থ চেহারা। মাথায় লম্বা চুল। কপালে চকচকে কাপড়ের হলুদ রঙের ফেট্টি। তাতে সুন্দর লম্বা লম্বা পালক গোঁজা। দুকানের লতিতে সোনার কাঠি গাঁথা। গায়ে পঞ্চো। তবে পঞ্চোর কাপড় মোটা নয়। পাতলা। মুখের অর্ধেক অংশে লাল রঙ মাখা।
ফ্রান্সিসরা যখন পৌঁছল তখন একটা বিচার চলছিল বোধহয়। রাজা বোধহয় রায় দিল। বিচারপ্রার্থীরা মাথা নুইয়ে বুকে দুহাত রেখে সম্মান জানিয়ে চলে গেল। দলনেতা মাথা নুইয়ে দুহাত বুকে রেখে সম্মান জানিয়ে কী বলে গেল। রাজা ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল।
ফ্রান্সিস রাজার কঠিন মুখ দেখে আর ধূর্ত চাউনি দেখে বেশ চিন্তায় পড়ল। একে কি বোঝানো যাবে? তবে সোনা মণিমাণিক্যের লোভ বড় সাংঘাতিক। সেই লোভেই রাজা হয়তো ওদের কোনো বিপদে ফেলবে না।
এবার রাজা আর ফ্রান্সিসের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হলো। মেস্তিজো দোভাষীর কাজ করতে লাগলো।
রাজা-তোমরা ভাইকিং?
ফ্রান্সিস-হ্যাঁ।
রাজা মারিয়াকে দেখিয়ে বললো–এ কে?
ফ্রান্সিস-রাজকুমারী মারিয়া। আমার স্ত্রী।
রাজা-তোমাদের সব কথা শুনলাম। পারবে গুপ্ত স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করতে?
ফ্রান্সিস-সবকিছু দেখবো আগে, যতটা সম্ভব খবর সংগ্রহ করবো তারপর বলতে পারবো।
রাজা-বেশ, দ্যাখো চেষ্টা করে।
ফ্রান্সিস-এর জন্যে আমাদের মুক্তি দিতে হবে। সব জায়গায় অবাধে ঘুরতে দিতে হবে।
রাজা-বেশ, কিন্তু মারিয়াকে রাজপ্রাসাদে রাখা হবে। কথাটা বলে রাজা মৃদু হাসল। ফ্রান্সিস বুঝল ওরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে তাই মারিয়াকে নজরবন্দী রাখা হবে।
ফ্রান্সিস বলল–বেশ।
এবার রাজা মেস্তিজোর দিকে তাকাল। রাগে রাজার চোখমুখ লাল হয়ে গেল। ভয়ে মেস্তিজো বেশ কাঁপতে লাগল। চিৎকার করে রাজা কী বলে উঠল। একজন রক্ষী ছুটে এসে মেস্তিজোকে ধরল। ভয়ে মেস্তিজো কাঁদতে লাগল। মেস্তিজোকে টেনে হিঁচড়ে রাজার সামনে দাঁড় করানো হলো। আর একজন রক্ষী লম্বা চাবুক হাতে এগিয়ে এল। কোনো সামুদ্রিক মাছের সরু লেজ দিয়ে তৈরি চাবুকটা। চাবুকটার গায়ে ছোট ছোট কাটা। নির্মম হাতে চাবুক চালাল মেস্তিজোর গায়ে। মেস্তিজো যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। দেখা গেল পিঠে যেখানে চাবুকের ঘা পড়েছে সে জায়গা থেকে পঞ্চোতে রক্ত ফুটে উঠেছে। রাজা আবার চিৎকার করে কী বলে উঠল। মেস্তিজো বারবার মাথা নোয়াতে লাগল আর মুখে কী বলতে লাগল। ফ্রান্সিস বুঝল রাজা মেস্তিজোর কাছে গুপ্ত স্বর্ণমূর্তির হদিস জানতে চাইছে। আবার চাবুক আছড়ে পড়ার আগেই ফ্রান্সিস ডান হাত তুলে মেস্তিজোর কাছে দাঁড়াল।
আবার রাজা আর ফ্রান্সিসের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হলো।
মেস্তিজো কাঁপা কাঁপা গলায় দোভাষীর কাজ করতে লাগল।
ফ্রান্সিস-মেস্তিজোকে মুক্তি দিতে হবে।
রাজা-না, ও স্বর্ণমূর্তির খোঁজ জানে।
ফ্রান্সিস-না, ও জানে না। ও যা জানে সব আপনাকে বলেছে।
রাজা–না, ওকে মুক্তি দেওয়া হবে না।
ফ্রান্সিস-তাহলে স্বর্ণমূর্তির সন্ধান আমরা করবো না। আমরা জাহাজে ফিরে যাবো।
রাজা ভুরু কুঁচকে কী ভাবল। তারপর বলল-যদি মেস্তিজো পালিয়ে যায়?
ফ্রান্সিস-ওর দায়িত্ব আমাদের। ও পালিয়ে গেলে আমরা যে কোনো শাস্তি মেনে নেব।
রাজা লুপাকা ভেবে দেখলে যে ল্লামা মরে গেল, মেস্তিজো এত অত্যাচারেও কিছুই বলতে পারছে না, নিজের অনেক চেষ্টা করেও স্বর্ণমূর্তির হদিস করতে পারেনি-এখন যদি এই ভাইকিংরা হদিস বার করতে পারে তবে করুক না। বিদেশী বিধর্মী এরা। কাজ ফুরুলে মেরে ফেলাও যাবে।
–বেশ। রাজা বলল।
–মেস্তিজো সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকবে। ওর সাহায্য খুবই প্রয়োজন। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা মাথা দুপাশে নাড়ল। তার মানে সম্মতি দিল।
–আর একটা কথা। ফ্রান্সিস বলল।
রাজা ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল।
–আমাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলো ফেরৎ দিতে হবে। মারিয়া তো রাজপ্রাসাদে নজরবন্দী থাকবে। কাজেই আমরা তো আর ওকে ফেলে পালাতে পারবো না। ফ্রান্সিস বলল। রাজা সম্মতির ভঙ্গি করল।
ফ্রান্সিস আবার বলল-সারাদিনে মারিয়াকে একবার আমাদের সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে। অবশ্য মারিয়ার সঙ্গে আপনার প্রাসাদরক্ষীরাও থাকবে।
রাজা সম্মতির ভঙ্গি করল। ফ্রান্সিসদের হাতের বাঁধন একজন খুলে দিল। রাজসভা থেকে ফ্রান্সিসরা চলে এল। মেস্তিজোর পিঠের দিকটা তখনও রক্তে ভেজা। বাইরে এসে ফ্রান্সিস মেস্তিজোকে ওর কাঁধে ভর দিতে বলল। মেস্তিজো তখনও ভালো করে হাঁটতে পারছে না। ফ্রান্সিস বলল-মেস্তিজো, দলনেতাকে বলল যেন তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। দলনেতা ওদের সামনে সামনে যাচিছল। মেস্তুিজো ওকে কাঁপা কাঁপা গলায় সে কথা বলল। দলনেতা কিছু বলল না।
রাজবাড়ির পেছনদিকে ওরা কিছুদূর এল। একটা পাথরের বাড়ির সামনে দলনেতা দাঁড়াল। দরজা খুলে ফ্রান্সিসদের ইশারায় ঢুকতে বলল। ফ্রান্সিসরা বাড়িটায় ঢুকল। সামনের ঘরটা বেশ খোলামেলা। একপাশে শুকনো ঘাস বিছানো। দলনেতা হাততালি দিল। বাড়ির ভেতর থেকে দুজন লোক এঘরে ঢুকল। দলনেতা তাদের কী বলল।
মেস্তিজো ফ্রান্সিসকে বলল-এই দুজন আমাদের দেখাশুনা করবে।
লোক দুজনে বাড়ির মধ্যে গেল। একটু পরেই ফিরে এল। হাতে মোটা কাপড়ের কম্বলমতো। সেটা শুকনো ঘাসের গাদার ওপর পেতে দিল। মেস্তিজো বোধহয় জল চাইল। লোক দুজন চীনে মাটির বড় কুঁজোর মতো নিয়ে এল। ফ্রান্সিসরা প্রায় সকলেই জল খেল। ওরা বিছানায় বসল। মেস্তিজো শুয়ে পড়ল।
এবার দলনেতা মারিয়ার দিকে তাকিয়ে কী বলল। মেস্তিজো বলল-মারিয়া, দলনেতা আপনাকে রাজবাড়ির অন্দরমহলে রেখে আসবে। এখন যেতে বলছে। মারিয়া বিছানা থেকে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ওর চোখ জলে ভিজে উঠল। মারিয়া বেশ শক্ত মনের মেয়ে। কিন্তু ফ্রান্সিসদের জন্যে ওর মন বেশ খারাপ হয়ে গেল। তাই দেখে ফ্রান্সিস হেসে বলল-মারিয়া, আমরা ভাইকিং। আমরা শুধু কব্জির জোরে লড়াই করি না, বুদ্ধির জোরেও লড়াই করি। আমাদের মন খারাপ করো না, যাও। দিনে একবার তো দেখা হবেই।
মারিয়া কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে বোধহয় ফ্রান্সিসদের কথা ভাবতে ভাবতেই আস্তে আস্তে দলনেতার পেছনে পেছনে চলে গেল। ফ্রান্সিসদেরও মনটা খারাপ হয়ে গেল।
বিস্কো বলল-চলো ফ্রান্সিস, জাহাজে ফিরে যাই।
অসম্ভব, ফ্রান্সিস দৃঢ়স্বরে বলল–বিস্কো তুমি আমাকে ভালো করেই জানে। তোমরা সবাই চলে গেলেও আমি একা এখানে থাকবো। স্বর্ণমূর্তি খুঁজবো, উদ্ধার করবো। তারপর ফিরবো।
-না-না ফ্রান্সিস, তোমাকে ছেড়ে যাবো না। বিস্কো দ্রুত বলে উঠল। শাঙ্কোও বলল-আমরা তোমার সঙ্গেই থাকবো।
ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় আধশোয়া হলো। ভাবতে লাগল স্বর্ণমূর্তির কথা। কোথায় কীভাবে রাখা হতো সেই মূর্তিটা তা দেখতে হবে। মেস্তিজো শুয়ে আছে। তখনওঁ অল্প অল্প গোঙাচ্ছে।
একটু পরেই একটা রোগা বেঁটেমতো লোক ঘরে ঢুকলো। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফ। মাথায় হলুদ কাপড়ের পাগড়ি মতো। গলায় নানারঙের পাথরের মালা। লোকটার হাতে একটা চীনেমাটির বোয়াম। বোঝা গেল লোকটা বৈদ্য। বৈদ্য মেস্তিজোর কাছে গেল। পিঠের দিকে পঞ্চো সরিয়ে চাবুকের ক্ষত দেখল। তখনও ক্ষত থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। বৈদ্য বোয়াম থেকে থেকে সবুজ রঙের আঠা আঠা মতো একটা ওষুধ বের করল। আঙুল দিয়ে ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিল। মেস্তিজো একটু কঁকিয়ে উঠল। তারপর শান্ত হলো। বোধ হয় ব্যাথা জ্বালা একটু কমল। একটা ছোট ন্যাকড়ার পুটলি করে চারটে কালো বড়ি বাঁধল। মেস্তিজোকে কী বলল। তারপর চলে গেল।
দুদিন কেটে গেল। ফ্রান্সিসরা শুয়ে বসে সময় কাটাতে লাগল। মেস্তিজো সুস্থ না হলে কিছুই করার নেই। সেই দুদিনই মারিয়া এসে ওদের দেখে গেল। সেদিন ফ্রান্সিস মেস্তিজোকে বলল-এখন তোমার শরীর কেমন?
–অনেকটা ভালো। মেস্তিজো বলল।
–আমাদের নিয়ে চিকামায় একটু ঘোরাঘুরি করতে পারবে? ফ্রান্সিস বলল।
–পারবো।
–তাহলে আজই চলো। ফ্রান্সিস বলল। বিকেল নাগাদ ফ্রান্সিসরা মেস্তিজোকে সঙ্গে নিয়ে চিকামা দেখতে বেরুল। প্রথমে রাজ বাড়ির সামনে এল। রাজবাড়ি ওরা আগেই দেখেছে।
মেস্তিজোকে ফ্রান্সিস বলল–রক্ষীদের বলো, মারিয়াকে নিয়ে আসতে। মারিয়াও আমাদের সঙ্গে যাবে। মেস্তিজো একজন দ্বাররক্ষীকে বলল সে কথা। একথাও বলল যে, এটা রাজার হুকুম। রক্ষীটি রাজবাড়ির মধ্যে ঢুকল। একটু পরেই মারিয়া বেরিয়ে এল। ওদের সঙ্গে চলল। পেছনে দুজন রক্ষীও চলল।
পথে বেশ ভিড়। কিছুদুর আসার পর ডানদিকে একটা উঁচু বেদীমতো দেখা গেল। বেদীটি কাটা। বেদীর ওপরে একটা মূর্তি প্রায় ঢেকে গেছে। বেদীর সামনে এসে ফ্রান্সিস দেখল-মেস্তিজোর গুহাঘরে দেখা সেই কাঠের মূর্তির মতোই এই মূর্তিটা। তবে মেস্তিজোর মূর্তিটা ছিল ছোট। এটা একটু বড়। প্রায় আড়াই তিন ফুট।
মেস্তিজো বলল–এই আমাদের দেবতা হুয়াকার মূর্তি। তবে এটা আসল সোনার মূর্তি নয়, কাঠের।
–মেস্তিজো, মূর্তিটা থেকে ফুলপাতা সরিয়ে দাও। ফ্রান্সিস বলল। ভালো করে দেখি।
মেস্তিজো বেদীর মসৃণ সিঁড়ি বেয়ে উঠল। মূর্তিটা থেকে ফুলপাতা সরাল। সিঁড়িতেও ছড়িয়ে আছে ফুলপাতা ফ্রান্সিস মূর্তিটা ভালো করে দেখল। সত্যি, এত সুন্দর রঙ ব্যবহার করা হয়েছে যে মনে হচ্ছে সোনার মূর্তি। সিঁড়িতে বেদীতে পাথর কুঁদে কুঁদে ফুল লতাপাতার কাজ করা হয়েছে।
ফ্রান্সিস বলল-মেস্তিজো, এখানকার কারুকাজ কি তোমরা করেছে?
–না, রাজা কোলা নিজেই এই কারুকাজ করেছেন। রাজা কোলার আর একটা পাথরের কাজ দেখ। মেস্তিজো সামনে আঙুল তুলে দেখাল। দেখা গেল একটা বিরাট পাথরের মাথা। একটা ছোটখাটো আস্ত পাহাড় কেটে খুঁদে কুঁদে ঐ মাথাটা তৈরি করা হয়েছে।
মেস্তিজো বলল-এই মাথাটা পাথর কেটে আমরা তৈরি করেছি-রাজা কোলা, গুরুদেবল্লামা আর আমি।
–দেবরক্ষীর মাথা। মেস্তিজো বলল।
ফ্রান্সিস বলল–দেবরক্ষীরও পুজো হয় নাকি?
-–হ্যাঁ, হুয়াকা দেবতার সঙ্গে দেবরক্ষীরও পুজো হয়। মেস্তিজো বলল?
–অত উঁচুতে লোক ওঠে কি করে? ফ্রান্সিস বলল?
–অনেক উঁচু একটা কাঠের মই আছে।
সেটা কেয়ে সবাই ওঠে। ফুলপাতা দিয়ে পুজো করে। আমরাও পাথর কেটে তৈরি করার সময় ঐ মইটা ব্যবহার করতাম। মেস্তিজো বলল। ফ্রান্সিসরা স্বর্ণমূর্তির পাথরের বেদীতে ফুল-লতাপাতা, পাখির কাজ, দেবরক্ষীর মাথা সব দেখতে লাগল। সত্যি দুটোই দেখতে খুব সুন্দর। রাজা কোলা যে একজন দক্ষ ভাস্কর ছিলেন এসব দেখে সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল। সব দেখেশুনে ফ্রান্সিসরা নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল। মারিয়াকে নিয়ে রাজবাড়িতে চলে গেল।
দিন সাতেক কাটল। প্রায় প্রত্যেকদিনই ফ্রান্সিস মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে হুয়াকা দেবতার স্বর্ণমূর্তি দেবরক্ষীর মাথা দেখতে যায়। ঘুরে ফিরে দেখে। কিন্তু আসল স্বর্ণমূর্তি উদ্ধারের কোনো সূত্র পায় না। শাঙ্কোর কাছে এসব একঘেয়ে লাগে। ও তাই দুপুরের খাওয়া সেরেই তীরধনুক নিয়ে পাখি খরগোশ শোল শিকার করতে বেরিয়ে যায়। ডানদিকের সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের ওপারেই বনজঙ্গল শুরু হয়েছে। খুব গভীর বন নয়। তবে গাছপালা প্রচুর। ঐ বনজঙ্গলেই শাঙ্কো শিকার করতে যায়।
এর মধ্যে রাজা লুপাকা ফ্রান্সিসকে ডেকে পাঠিয়েছিল। স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করতে পারবে কি না। পারলে কবে নাগাদ পারবে এসব জিজ্ঞেস করেছিল। মেস্তিজোর মারফৎ ফ্রান্সিস বলেছে–খোঁজ খবর করছি। কোনো সূত্র এখনও পাইনি। তবে
বেশিদিন লাগবে না।
সেদিনও শাঙ্কো তীরধনুক নিয়ে শিকারে বেরিয়েছিল দুপুরে খেয়ে দেয়ে। বিকেল হয়ে গেল তখনও ফিরল না। ফ্রান্সিস আর বিস্কো ভাবল শাঙ্কো বোধহয় বেশি শিকার পেয়েছে তাই আসতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু সন্ধ্যে হলো। রাত হলো শাঙ্কো ফিরল না। এবার ফ্রান্সিস আর বিস্কো চিন্তায় পরল।
ফ্রান্সিস মেস্তিজোকে বলল-শাঙ্কো এখনও শিকার থেকে ফিরল না, কী ব্যাপার বলো তো?
-ঐ তিতিকাকা জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী নেই। তবে বিষধর সাপ আছে। শাঙ্কোকে কি সাপেই কামড়াল নাকি, ঠিক বুঝতে পারছি না। মেস্তিজো বলল।
ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিল। ভাবল, এভাবে অপেক্ষা করে দুশ্চিন্তাই বাড়বে শুধু। ঐ বনে-জঙ্গলে গিয়েই শাঙ্কোর খোঁজ করা ভাল। ও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। ডাকল-বিস্কো অস্ত্র নাও। শাঙ্কোর খোঁজে যাবো। বিস্কো দেয়ালের খাঁজে রাখা তরোয়ালটা নিল। ফ্রান্সিস বিছানার তলা থেকে নিজেদের তরোয়াল বার করল। বলল-মেস্তিজো, তুমি আমাদের সবার সামনে চলো।
তিনজন ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের দিকে চলল। মেস্তিজো সবার সামনে চলল। হাতে জ্বলন্ত মশাল। পাহাড় পেরিয়ে ওপাশে নামল। জঙ্গলে ঢুকল। খুব নিবিড় বন নয়। গাছপালা লতাগাছ এসব বেশ ছাড়া ছাড়া। ওরা মশালের আলোয় গাছপালার মধ্যে গিয়ে চলল বনে পথ বলে কিছু নেই। বেশ কিছুটা এল। কিন্তু ফ্রান্সিস ভেবে পেল না এই রাতের বেলা বন-জঙ্গলের মধ্যে কোথায় শাঙ্কোকে খুঁজবে। তবু দুহাতে তালু মুখের সামনে গোল করে চিৎকার করে ডাকল–শাঙ্কো-শাঙ্কো। কিন্তু নির্জন বনভূমিতে কোনো উত্তর ভেসে এল না। শুধু একটা পাখির দল কিচমিচ করে উঠল। রাতজাগা পাখিরা ডানা ঝাঁপটাল। বিস্কোও একইভাবে চিৎকার করে বলল–শাঙ্কো, আমরা এসেছি। তোমার কোনো ভয় নেই। শাঙ্কো-ও। কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না। ওরা এগোতে লাগল।
হঠাৎ ফ্রান্সিসের কানে এল শুকনো ডাল ভাঙার শব্দ। ও থমকে দাঁড়াল। তরোয়ালের হাতলে হাত রাখল-বিস্কো, সাবধান। ফ্রান্সিসের কথা শেষ হতে না হতেই ওদের চারদিকে শুকনো পাতা ভেঙে কারা ছুটে এল। ওদের চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল একদল যোদ্ধা। তাদের হাতে উদ্যত বশা। মেস্তিজো যযাদ্ধাদের মশালের আলোতে দেখেই চিৎকার করে কী বলে উঠল উনকা ভাষায়। সঙ্গে সঙ্গে যোদ্ধারা বর্শা নামাল। সবাই মাথা নিচু করে মেস্তিজোকে সম্মান জানাল। মেস্তিজো বলল ফ্রান্সিস, আপনারা যুদ্ধ করবেন না। এরা আমাদের বন্ধু। এরা উনকা সৈন্য। রাজা কোলার সৈন্যবাহিনীর সৈন্য। যুদ্ধে পরাজয়ের পর এরা এই তিতিকাকা জঙ্গলে আত্মগোপন করে আছে।
ফ্রান্সিস আর বিস্কো তরোয়াল খুলল না আর। যোদ্ধাদের মাথায় কালো কাপড়ের ফেট্টি। তাতে পাখির পালক গোঁজা। মুখের দুপাশে লাল রঙ লাগানো। ওদের দলনেতা এগিয়ে এল মেস্তিজোর সামনে। মেস্তিজোর সঙ্গে দলনেতা কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল। তারপর মেস্তিজো ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল-শাঙ্কোকে এর রাজা লুপাকার গুপ্তচর ভেবে বন্দী করে রেখেছে। তবে ভয়ের কিছু নেই। শাঙ্কো ভালো আছে।
শাঙ্কোকে ওরা যেখানে রেখেছে সেখানে আমাদের নিয়ে যেতে বলল। ফ্রান্সিস বলল। মেস্তিজো দলনেতাকে বলল সে কথা। দলনেতা মাথা ঝাঁকাল। কী বলল। তারপর গাছপালার মধ্যে দিয়ে চলল। মেস্তিজো বলল-চলুন ওদের পিছনে পিছনে। একটু পরে মশালের আলোয় দেখা গেল বনভূমির গাছপালা পাতলা হয়ে এসেছে। সামনে গাছপালার আড়ালে একটা লম্বাটে বাড়ি দেখা গেল। পেইকো ঘাসের ছাউনি। কাঠ পাথর মিলিয়ে বাড়িটা নতুন তৈরি হয়েছে। বাড়িটার পরেই একটা বড় হ্রদ বেশ বড়। হ্রদের জলে মৃদু ঢেউ।
সবাই বাড়িটার সামনে এল। বশ হাতে চারজন উনকা যোদ্ধা এগিয়ে এল। মেস্তিজোকে দেখে তারাও মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানাল। ফ্রান্সিস বুঝল উনকা রাজপুরোহিতের শিষ্য বলে মেস্তিজোকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। দলনেতা রক্ষী যোদ্ধাদের কী বলল। ওরা চলে গেল। দলনেতার সঙ্গে ফ্রান্সিসরা এসে বাড়িটার সামনে উঠোনে দাঁড়াল। দলনেতা একটা লম্বা ঘর দেখিয়ে মেস্তিজোকে কি বলল। মেস্তিজো ফ্রান্সিসকে বলল–আপনাদের এই ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ফ্রান্সিসরা ঘরটায় ঢুকল। লম্বাটে ঘর। কাঠ আর পাথরের দেয়াল। ঘরের দুপাশের দেয়ালে দুটো বাতি জ্বলছে। তার আলোয় দেখা গেল সারা ঘর জুড়ে শুকনো ঘাসের বিছানা। তাতে মোটা কম্বলমতো পাতা। প্রায় আট-দশজন উনকা যোদ্ধা তাতে শুয়ে বসে আছে। ফ্রান্সিসরা এতটা হেঁটে তখন বেশ ক্লান্ত ওরাও বিছানায় বসল। ঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে অনেকগুলো বশী।
একটু পরেই শাঙ্কো হাসিমুখে ঘরে ঢুকল। ওর কাঁধে তীর ধনুক। ও ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। শাঙ্কোকে সুস্থ দেহে দেখে বন্ধুরা খুশি হলো।
–এখানে তোমার ওপর কোনো অত্যাচার করা হয়নি তো? ফ্রান্সিস বলল?
–না-না। এরা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে। কারণ ধরা পড়ার পর আমি বারবার মেস্তিজোর নামটা বলেছি। তাতেই দেখলাম ওরা আমাকে বিশ্বাস করল। শাঙ্কো তীর ধনুক রেখে বিছানায় এসে বসল। ওরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে লাগল।
বিস্কো বলল-ফ্রান্সিস, স্বর্ণমূর্তি-বেদী,–দেবরক্ষীর মাথা সব তো দেখলে। আসল স্বর্ণমূর্তির কোনো হদিস করতে পারলে?
–এখনই কিছু বলতে পারছি না। সব বার বার ভালভাবে দেখতে হবে। সূত্র একটা পাবোই। ফ্রান্সিস বলল। ওরা কথাবার্তা বলছে। তখনই মেস্তিজো ঢুকল। ফ্রান্সিসের পাশে এসে বসল। বলল–ফ্রান্সিস-এরা তোমাদের আজকে রাতে এখানে অতিথি হিসেবে থাকতে অনুরোধ করেছে। ফ্রান্সিস বিস্কোর দিকে তাকাল। বিস্কো বলল–রাতে তো আমাদের কোনো কাজ নেই। থাকি না এখানে। একটা রাতই তো। ফ্রান্সিস মেস্তিজোর দিকে তাকিয়ে বলল–বেশ। বন্ধুরা যখন বলছে।
–উনকা যোদ্ধারা খুব খুশি হবে। যাক ওদের কথাটা বলে আসি। মেস্তিজো চলে গেল।
রাত বাড়ল। একসময় একজন উনকা যোদ্ধা এসে ইঙ্গিতে ফ্রান্সিসদের রাতের খাওয়া খেতে ডাকল। ফ্রান্সিসরা ঘরের বাইরে এল। লম্বাটে ঘরের সামনে উঠোনে দেখল তিনকোণা পাতা পেতে দেওয়া হয়েছে। যোদ্ধারা খেতে বসছে পাতার সামনে। ওরাও খেতে বসল। ফ্রান্সিস দেখল উনকা সৈন্যরা সংখ্যায় একশরও বেশি। খেতে দেওয়া হলো সেই বীন আলুর তরকারি। ক্যারোপটা বীনের গুড়ো দিয়ে তৈরি রুটি, সামুদ্রিক মাছের ঘন ঝোলমতো। ওরা খেতে লাগল। খিদেও পেয়েছিল বেশ।
সবারই খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। ফ্রান্সিসরা আগের ঘরে এসে বিছানায় বসল। অন্য যোদ্ধারাও এসে বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। ওরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে লাগল। ফ্রান্সিসরা এই উনকা ভাষার বিন্দুবিসর্গ বুঝল না। তবে মাঝে মাঝে ওদের কথাবার্তার মধ্যে লুপাকার নাম ওরা শুনছিল।
কিছুক্ষণ পরে মেস্তিজো এল। পেছনে সেই দলনেতা ওরা দুজনে ফ্রান্সিসের কাছে এসে বসল। মেস্তিজো দলনেতাকে দেখিয়ে ফ্রান্সিসকে বলল,–ওরা বলছিল তোমরা কী বলতে চাইছে। ফ্রান্সিস, মেস্তিাজো বলল–তোমরা ভাইকিং। তোমাদের শৌর্যবীর্যের কথা খুব ছেলেবেলায় আমি শুনেছি। তাই আমিও চাই তোমরা এদের সাহায্য কর। তোমাদের সাহায্য পেলে ওদের সাফল্য সুনিশ্চিত।
কীভাবে সাহায্য পেলে ওদের সাফল্য সুনিশ্চিত।
কীভাবে সাহায্য করবে সেটা সেটা বলো৷ ফ্রান্সিস বলল।
এই উনকা যোদ্ধাদের এই তিতিকাকা বনে আশ্রয় নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে। সব উনকা যুবকদের একত্রিত করছে। শক্তি সংগ্রহ করে ওরা কিছুদিন পরেই রাজা লুপাকার সৈন্যবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। যে করেই হোক, ওরা উনকাদের রাজ্য থেকে সৈন্যসহ রাজা লুপাকাকে তাড়াবে। এটাই ওদের প্রতিজ্ঞা। দেশ ও জাতিকে যে করেই হোক শত্রুর হাত থেকে বাঁচাবে। সেইজন্য ওরা তোমাদের সাহায্য চায়। মেস্তিজো বলল।
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ ভাবল ব্যাপারটা। হ্যারি থাকলে ভালো হতো। ওর পরামর্শ নেওয়া যেত। ফ্রান্সিসকে একাই ভাবতে হলো সব! ভেবে নিয়ে ও বলল–তার মানে ওরা চাইছে আমরা যেন ওদের দলে যোগ দিই, রাজা লুপাকার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে নামি।
–হ্যাঁ, তোমাদের সাহায্যে উনকাদের রাজ্য জয় করতে পারলে ওরা তোমাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। মেস্তিজো বলল।
ফ্রান্সিস বলল–কিন্তু মেস্তিজো–রাজা লুপাকা তো কখনও আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি। অবশ্য গুপ্ত স্বর্ণমূর্তি উদ্ধারের পর রাজা লুপাকা অন্য চেহারা নিতে পারে। এমনকি আমাদের হত্যাও করতে পারে। আমি সেটা ভালো করেই জানি। রাজা
পাকা অসৎ ও লোভী। তবুএখনও তোও আমাদের বিপদে ফেলেনি। কাজেই আমরা কেন রাজা লুপাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে যাবো। এসব তোমাদের ব্যাপার। তোমরা মিটিয়ে নাও।
–তাহলে তোমরা এদের সাহায্য করবেনা? মেস্তিজো বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলল।
–না, এই অবস্থায় পারবো না। তাছাড়া ভেবে দেখ, মারিয়া এখন রাজা লুপাকার হাতের মুঠোয়। মারিয়া বন্দিনী। আমরা যুদ্ধে উনকাদের সাহায্য করছি, এ সংবাদ রাজা লুপাকা পাবেই। তখন মারিয়ার জীবন বিপন্ন হতে পারে। সবদিক ভেবে বলছি এখন, আমাদের এসব ব্যাপারে না জড়ানোই ভালো। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল।
মেস্তিজো ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল–আজ হোক, কাল হোক–লড়াই হবেই।
মেস্তিজোর এই দৃঢ় সংকল্পের কথা শুনে খুশি হল। যে কোন কাজে দৃঢ় মনোবল বজায় রাখা বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে লড়াই করে জেতার মনোভাব এটা ফ্রান্সিস খুবই পছন্দ করে, ঘাসের বিছানায় শুতে শুতে ফ্রান্সিস বলল-মেস্তিজো তোমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন আছে কিন্তু ভাবছি এত অল্প সৈন্য নিয়ে চিমু সেনাবাহিনীর সঙ্গে তোমরা কতদিন লড়াই চালাতে পারবে? মেস্তিজো বলল-ফ্রান্সিস তোমাকে একটা কথা এখনও জানাইনি। কথাটা খুবই গোপনীয়। তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই বলছি–রাজা কোলার যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেলেন। তাঁর একমাত্র পুত্র পিসকোজকে যুদ্ধক্ষেত্রেই পিতার মৃত্যুসংবাদ জানানো হল। পিসকোজ বুঝল, এখন পশ্চাদপসরণ আর আত্মরক্ষা ছাড়া উপায় নেই। পরাজয় সুনিশ্চিত কয়েকজন বিশ্বস্ত সহরক্ষীকে নিয়ে পিসকোজ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালালো চাঙিনের দিকে। বেশ কিছুদিন রাজপুত্রের কোন সংবাদ কেউ জানতো না। মাত্র মাসখানেক আগে রাজপুত্র পিসকোজ এই তিতিকাকা আস্তানায় খবর পাঠিয়েছে সে সুস্থ আছে। চাঙিনের জঙ্গলে আত্নগোপন করে ঐ পাহাড়ি এলাকার উপজাতিদের একত্র করছে। সেখানে অস্ত্র তৈরি করে উপজাতিদের সুশিক্ষিত সৈন্য হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানেও সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে। রাজপুত্র পিসকোজ এখানে সংবাদ পাঠিয়েছে সে যখন রাজা লুপাকার সৈন্যবাহিনীকে আক্রমণ করতে বলবে তখনই আক্রমণ শুরু করতে হবে। তার আগে সবাইকে আত্মগোপন করে থাকতে হবে তিতিকাকার জঙ্গলে, চাঙিনের জঙ্গলে। রাজা লুপাকার গুপ্তচররা যেন তাদের হদিশও না পায়। একটু থেমে মেস্তিজো বলল-বুঝলে ফ্রান্সিস চিকামার মানুষেরা পিসকোজকেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা ভক্তি করে নিরুদ্দিষ্ট রাজপুত্র যদি উনকা সৈন্যদের সামনে এসে আত্মপ্রকাশ করে তবে তাদের মনোবল হাজারগুণ বেড়ে যাবে। সেই শেষ লড়াইয়ে আমরা জিতবোই। রাজা লুপাকাকে এ দেশ ছেড়ে পালাতেই হবে।
–মেস্তিজো আমিও চাই-তোমরা স্বাধীনতা ফিরে পাও। ফ্রান্সিস বলল।
রাত বাড়ল। ফান্সিসরা ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। শুধু ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। ও তখন ভাবছে–গুপ্ত স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করা যাবে কি? কোনো সূত্ৰই তো পাচ্ছি না। এখানে বেশিদিন থাকাও চলবে না। দেরি দেখে হয়তো বন্ধুরা এসে হাজির হবে। আবার স্বর্ণমূর্তির সন্ধান করতে ওরা ব্যর্থ হলে লোভী রাজা লুপাকা কি চেহারা ধরে কে জানে? হয়তো ওদেরও মারিয়ার মতো বন্দী করে রাখতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে ফ্রান্সিস ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালেই ওরা চিকামায় নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল। আসার সময় দলনেতা ফ্রান্সিসকে বেশ সুন্দর ফুল-পাতার কাজ করা একটা পঞ্চো উপহার দিল। ফ্রান্সিস খুব খুশি হলো। বারবার বলল-ধন্যবাদ। মেস্তিজো কথাটা বুঝিয়ে বলল দলনেতাকে। দলনেতা হাসল।
বিকেলে মারিয়া একা। সঙ্গে সেই দুজন চিমু পাহারাদার সৈন্য। মেস্তিজো সারা দুপুর টানা ঘুমিয়ে তখনই উঠল। আড়মুড়ি ভাঙতে ভাঙতে বলল-যাবে নাকিহুয়াকার উৎসবে?
–কোথায় হবে? বিস্কো জানতে চাইল।
–ঐ হুয়াকা দেবতার স্বর্ণমূর্তির বেদীর সামনে। নাচ গান হবে। রাজা লুপাকা ও রানী দুজনেই নাকি আসবে। রাজা সুপাকা এখন চেষ্টা করছে উনকাদের মন জয় করতে। যাবে তোমরা? ·
মারিয়া খুশির চোটে হাততালি দিল। বলল–ফ্রান্সিস, চলো না?
–যাবে তো! কিন্তু লুপাকা কি তোমাকে ওখানে যাবার অনুমতি দেবে? ফ্রান্সিস বলল?
–কেন দেবেনা? আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। মারিয়া বলল।
–ঠিক আছে। মেস্তিজো কখন আরম্ভ হবে উৎসব? ফ্রান্সিস বলল।
–একটু রাতে। আমরা খেয়ে-দেয়ে যাবো। উৎসব বেশ কিছুক্ষণ চলবে। মেস্তিজো বলল
–তাহলে এক কাজ করো মেস্তিজো। তুমি মারিয়াকে নিয়ে রাজা লুপাকার কাছে যাও। রাজাকে বললো যেন মারিয়াকে উৎসবে যেতে অনুমতি দেয়। অবশ্য সঙ্গে পাহরাদার থাকবে। ফ্রান্সিস বলল।
–দেখি বলে। মেস্তিজো ঘাসের বিছানা ছেড়ে উঠল। মারিয়াকে নিয়ে রাজবাড়িতে গেল।
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই মেস্তিজো ফিরে এল মারিয়াকে নিয়ে। সঙ্গে সেই দুজন চিমু পাহারাদার। হেসে বলল–রাজা লুপাকার মেজাজ এখন খুব ভালো। চিকামার গন্যমান্য উনকারা নাকি দল বেঁধে রাজারানীকে উৎসবে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করে গেছে। কাজেই অনুমতি বলার সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া গেছে।
রাতের খাওয়া-দাওয়া সারল ফ্রান্সিসরা। মারিয়া পাহারাদার সৈন্য দুজনও ওদের সঙ্গে খেল।
একটু রাত হতেই সবাই চলল উৎসবের প্রাঙ্গণের দিকে। ফ্রান্সিস উপহার পাওয়া পঞ্চো পরল। মারিয়া তাই দেখে হাসতে লাগল।
হুয়াকা দেবতার স্বর্ণমুর্তির বেদীর সামনের প্রাঙ্গনে উৎসবের আয়োজন হয়েছে। দেবতার পূজো দুপুরবেলাই হয়ে গেছে। স্বর্ণমূর্তির অর্থাৎ কাঠের মূর্তি ফুলে পাতায় প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। বেদীতেও ফুলপাতার স্তূপ। প্রাঙ্গনের চারিদিকে মশাল জ্বলছে। উৎসব প্রাঙ্গন আলোয় আলোময়। প্রাঙ্গনের চারপাশ বহু নারী-পুরুষ শিশুরা জড়ো হয়েছে। গাছের গুঁড়ি কুরে তার মুখে ভেড়ার চামড়া আটকে বাজনা তৈরি করা হয়েছে। সেটাই একজন দমাদম বাজাচ্ছে। কচ্ছপের নাড়ি দিয়ে তৈরী বাজনা আর একজন বাজাচ্ছে। টানা টানা সুরের বাজনা।
একটু পরেই দুটো পাহাড়ী ঘোড়ায় চেপে রাজা লুপাকা আর রানী এল। সামনে পেছনে রাজার দেহরক্ষীরা। দুজনেই বেশ সেজেগুজে এসেছে। রাজার মাথায় মোটা করে হলুদ ফেট্টি বাঁধা। তাতে একটা ধবধবে সাদা পাখির লম্বা পালক। রানীর ঢিলেঢালা পোশাকে কাঁচের চুকরো বসানো। মশালের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে সেসব। উপস্থিত উনকারা কেউ কিন্তু রাজারানীর জয়ধ্বনি করল না। শুধু তাকিয়ে দেখল। শুধু উপস্থিত চিমু সৈন্যরা হাতের বর্শা আকাশের দিকে তুলে কী বলল সমস্বরে চিৎকার করে। বোধহয় রাজা লুপাকা ও রানীর জয় ঘোষণা করল।
দেবরক্ষী মূর্তি সেই মাথাটার নিচেই পাথরের আসন। রাজারানী ঘোড়া থেকে নেমে এই আসনে বসল। শুরু হলো বাজনা। খুব সেজেগুজে একদল উনকা মেয়ে প্রাঙ্গ নে ঢুকল। তাদের গায়ে উজ্জ্বল সুতোর নক্সা আঁকা ঢিলেঢালা পঞ্চো। মাথার বিনুনিতে নানা রঙের ফুল গোঁজা। মাথায় কপালে লাল মোটা ফেট্টি বাঁধা। তাতে নানা রঙের পাখির পালক। বাজনার তালে তালে শুরু হলো মেয়েদের নাচ। নাচের সঙ্গে বেশ চড়া সুরে মেয়েরা গানও গাইতে লাগল। ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। দর্শকরা চিৎকার করে তাদের উৎসাহিত করতে লাগল।
নাচগান থামল। রানী হাত তুলে আবার নাচিয়েদের নাচগান করতে নির্দেশ দিল। আবার বাজনা বেজে উঠল। শুরু হলো নাচ আর সেইসঙ্গে গান। সেই গান উনকা ভাষার গান
ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝলনা। মেস্তিজো ফ্রান্সিসকে বলল–এটা হচ্ছে হুয়াকা দেবতাকে বন্দনার গান। নাচগান চলল কিছুক্ষণ। দর্শকরা নাচিয়েদের দিকে ফুল ছুঁড়ে দিতে লাগল। চিৎকার করে উনকা ভাষায় কী বলতে লাগল। বোধহয় নাচিয়েদের বাহবা দিতে লাগল।
নাচ গান শেষ হলো। বাজনা বন্ধ হলো। গোলমাল থামতে হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি তরুণ নাচিয়ে মেয়েদের সামনে এসে দাঁড়াল। দর্শকরা অবাক। তরুণটির মুখ মশালের আলোয় উজ্জ্বল। উত্তেজনায় তরুণটির ঠোঁটদুটো কাঁপছে। তরুণটি মুখের কাছে হাতের চেটো গোল করে চিৎকার করে কী বলে উঠল। মেস্তিজো ফ্রান্সিসকে বলল–সর্বনাশ। ছেলেটি রাজা কোলার জয়ধ্বনি দিচ্ছে। ও বিপদে পড়বে। তারপরেই তরুণটি তীক্ষ্ণস্বরে একটা গান ধরল। মুহূর্তে দর্শকদের মধ্যে ভীষণ চাঞ্চল্য জাগল। মেস্তিজো ফ্রান্সিসকে বলল ছেলেটি রাজা কোলার গুণকীর্তন করে গান গাইছে উনকারা সবাই এই গান জানে। সত্যিই দেখা গেল সব দর্শকরা-বেশির ভাগই উনকা উঠে দাঁড়িয়েছে। তরুণটির গানের সঙ্গেততক্ষণে গলা মিলিয়েছেনাচিয়ে উনকা মেয়েরাও। আস্তে আস্তে উপস্থিত প্রায় সব দর্শকরা সেই গানের সঙ্গে গলা মেলাল।
ওদিকে রাজা লুপাকা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, রানীও। রাগে রাজা লুপাকার মুখ লাল হয়ে গেছে। তার চিরশত্রুরাজা কোলার গুনগান গাইছে তারই সামনে। রাজা চিৎকার করে কী বলে উঠল। চিমু সৈন্যরা বর্শা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল উনকাদের ওপর। উনকাদের মুখের গান বন্ধ হয়ে গেল। গান থামিয়ে নাচিয়ে মেয়েরাও প্রাঙ্গণ থেকে পালাল। দর্শকদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু হলো। শুধু সেই তরুণটি একা তখনও গান গেয়ে চলেছে। রাজা লুপাকা তার দেহরক্ষীর একজনকে ইঙ্গিত করল। রক্ষীটি ছুটে এসে তরুণটির বুকে বর্শা বিধিয়ে দিল। তরুণটি উবু হয়ে উৎসব প্রাঙ্গণে পড়ে গেল। গান বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকবার নড়ে ওর দেহটা স্থির হয়ে গেল।
শাঙ্কো অসহিষ্ণু স্বরে বলে উঠল-ইস, সঙ্গে যদি তীর ধনুকটা থাকতো ঐ দেহরক্ষীটাকে এক্ষুনি নিকেশ করতাম। ওদিকে লোকজন সব ছোটাছুটি করে এদিক ওদিক পালাতে শুরু করেছে। চিমু সৈন্যদের বর্শার ঘায়ে কিছু লোক জখও হয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যে সেই প্রাঙ্গণ জনশূন্য হয়ে গেল। আহত লোকদের র্ত চিৎকার শোনা যেতে লাগল।
ফ্রান্সিস মেস্তিজোকে বলল-শিগগির তোমাদের কোনো বৈদ্যকে ডেকে নিয়ে এসো। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। ফ্রান্সিস, বিস্কো আর শাঙ্কো আহত লোকজনদের ধরাধরি করে প্রাঙ্গণের একধারে এনে শুইয়ে দিল। মারিয়া নিজেদের ঢোলা পোশাক থেকে কাপড় ছিঁড়ে আহতদের ক্ষতস্থান বেঁধে দিতে লাগল। তাতে কারো ক্ষতস্থান থেকে রক্তঝরা বন্ধ হলো। একটু পরেই মেস্তিজো একজন বৈদ্যকে নিয়ে এল। সে তার ঝোলা থেকে ওষুধ বের করে আহতদের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস ডেকে বলল-মারিয়া, এবার চলল আমাদের আর কিছু করার নেই।
ফ্রান্সিসরা ফিরে এল। মেস্তিজো আহতদের দেখাশুনো করার জন্যে থেকে গেল। বিশেষ করে মৃত তরুণটির সৎকারের জন্যেই মেস্তিজোকে ফ্রান্সিস থাকতে বলল। ফেরার পথে ফ্রান্সিসের বারবার সেই উদ্দীপ্তমুখ গাইয়ে তরুণটির কথা মনে পড়তে লাগল। ওর মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল।
তারপর কয়েকদিন কাটল। ওদিকে জাহাজে ফেরার তাগিদ রয়েছে। ফ্রান্সিসদের ফিরতে দেরি হলে হয়তো বন্ধুরা এসে হাজির হবে।
সেদিন বিকেলের দিকে মারিয়া ফ্রান্সিসদের আস্তানায় এল। সঙ্গে দুজন রক্ষীও এল। মারিয়া বলল-ফ্রান্সিস, চলো বেড়িয়ে আসি। বিস্কো আর শাঙ্কো বলল-চলো আমরাও যাবো। মেস্তিজোও ওদের সঙ্গী হলো। চিকামার রাস্তা দিয়ে চলল ওরা আর দুজন চিমু সৈন্যরা, চিকামার অধিবাসীরা ওদের চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। এই ভিনদেশি মানুষগুলো বিশেষ করে ঐ মেয়েটি অর্থাৎ মারিয়া যে কেন এখানে এসেছে, কেন এখনো আছে তাই ওরা ভেবে পেল না।
হুয়াকা দেবতার সেই কাঠের নকল মর্তি বেদীর কাছে ওরা পৌঁছল তখন বিকেল হয়ে গেছে। ওরা দেখল নকল মূর্তির তেমনি ফুলপাতায় প্রায় চাপা পড়ে গেছে। চিকামার উনকা. লোকেরা আসছে ফুলপাতা হাতে। পুজো দিচ্ছে। ফুলপাতা দিচ্ছে মূর্তিতে। বেদীও ঢেকে গেছে ফুলপাতায়। কিছু লোক আবার বিরাট উঁচু কাঠের মই বেয়ে উঠে দেবরক্ষীর মাথায় গলায় ফুলপাতা ছুঁড়ে দিচ্ছে। অত উঁচু মইটা বোধহয় পূজো দেবার সুবিধের জন্যেই এখন লাগানো হয়েছে।
ফ্রান্সিস ভাবল–হুঁয়াকার মুর্তিটা তো কাছে থেকে দেখছি কিন্তু দেবরক্ষীর মূর্তিটা ভালো করে দেখা হয়নি। কারণ তখন মইটা ছিল না। ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া তোমরা অপেক্ষা কর। দেবরক্ষীর মাথাটা কাছে থেকে দেখে আসছি।
ফ্রান্সিস কাঠের সেই অনেক উঁচু মইটার কাছে গেল। তারপর ওপর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মইটা বেয়ে উঠতে লাগল। উঠতে উঠতেমূর্তিরমুখের কাছে এল। মোটা ঠোঁট দাঁত পেরলো। নাক ছাড়লো। চোখ দুটো পুরো গোল নয়। কেমন চৌকো মতো। চোখ দুটো পার হলো। কপাল পার হলো। উঠেএল মার্থার উষ্ণীষের কাছে। এতক্ষণ গলা মুখ চোখ নাক চোখ সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এসেছে। কিন্তু মনোযোগ আকর্ষণ করে এমন কিছুই দেখতে পেল না। দেবরক্ষীর উষ্ণীষের ওপর নামল ফ্রান্সিস। চারদিকে তাকিয়ে দেখল। বিকেলের নরম আলোয় অনেকদূর দেখা যাচ্ছে। চিকামার রাজবাড়ি বাড়িঘর রাস্তা তিতিকাকা বন দূরে সমুদ্রের দিকে পাহাড়ের সারি সব দেখা গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে হুয়াকার মূর্তি বেদী পূজার্থী ও মারিয়াদের দেখল। ফ্রান্সিস মনে মনে রাজা কোলার প্রশংসা করল। একটা ছোট পাহাড় কেটে এইরকম মুর্তির মাথা তৈরি করা শুধু পরিশ্রমের কাজই নয় সেইসঙ্গে শিল্পবোধও থাকা চাই।
এবার ফ্রান্সিস নামবার জন্যে মইয়ে পা রাখল। তারপর আস্তে আস্তে নামতে লাগল। উষ্ণীষ পার হলো। যখন মুর্তিটার কপালের কাছে এল তখনই মুর্তিটার কপালের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস থমকে দাঁড়াল। কপালে কী যেন কুঁদে আঁকা। ও প্রথমে ভাবল হয়তো কপালের কোনো অলঙ্কার। ভালো করে দেখলো। সন্দেহ হলো। অলঙ্কার নয়-কী যেন পাথর কুঁদে লেখা। বিদ্যুৎচমকের মতো হঠাৎ ওর মনে পড়ল রাজপুরোহিতল্লামার শেষ কথাটা-রাজা কোলা যে কথাটা বলেছিলেন-সবই ললাটের লিখন। তাহলে তো এই মূর্তিটার কপালে নিশ্চয়ই কিছু লেখা আছে। এই লেখাটা তো তাহলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী লেখা আছে কপালে?
ফ্রান্সিস দ্রুত নেমে এল মই বেয়ে। ফ্রান্সিসকে এভাবে দ্রুত নেমে আসতে দেখে মারিয়া সবাই বেশ আশ্চর্য হলো। কী হলো ফ্রান্সিসের? নিশ্চয়ই একটা কিছু ঘটেছে।
ফ্রান্সিস মই থেকে নেমে মেস্তিজোর কাছে ছুটে এল। বলল–মেস্তিজো, রাজা কোলা বলেছিলেন সবই ললাটের লিখন। তাই কিনা?
–হ্যাঁ। মেস্তিজো বলল। কিন্তু ফ্রান্সিস এই কথাটা বলেছে কেন ও ঠিক বুঝল না। কথাটার এত গুরুত্বই বা দিচ্ছে কেন।
–তোমার গুরুদেব রাজপুরোহিতও এই কথাটাই বলেছিল সবই ললাটের লিখন। তাই কিনা?
— হ্যাঁ।
চলো মই বেয়ে উঠতে হবে। এসো তাড়াতাড়ি। ফ্রান্সিস বলল, মেস্তিজো ফ্রান্সিসের এই পাগলামির কারণ বুঝল না। তবু ফ্রান্সিসের কথামতো মইয়ের কাছে এল। দুজনে মই বেয়ে উঠতে লাগল। ফ্রান্সিস উঠতে উঠতে বলল-মেস্তিজো, তুমি, তোমার গুরুদেব রাজপুরোহিত আর রাজা কোলা মিলে এই মূর্তিটা বানিয়েছিলে। পাথর কুঁদে।
-হ্যাঁ। মেস্তিজো বলল-তবে বলতে পারো রাজা কোলার কৃতিত্বই বেশি। সমস্ত পরিকল্পনাটাই রাজা কোলার। উনিই পাথর কেটেছেন কুঁদেছেন আমরা শুধু পাথর মসৃণ করেছি।
দেবরক্ষীর কপালের কাছে এসেফ্রান্সিস বলল–ললাটের লিখন মানে কপালের লেখা। এবার মূর্তির কপালের সেই লেখাগুলো দেখাল। বলো তো ওগুলো কী লেখা? মেস্তিজো লেখাগুলো দেখল। লেখাগুলো দেখতে এমনি–
মেস্তিজো মনোযোগ দিয়ে লেখাগুলো দেখে বলল-এগুলো কোনো লেখা নয়। পর পর কয়েকটা উনকা ভাযায় অঙ্কের সংখ্যা কুঁদে লেখা। আমার মনে হয় রাজা কোলা এগুলো পরে কুঁদে লিখেছিলেন।
–বলো তো সংখ্যাগুলো কী?ফ্রান্সিস বলল।
মেস্তিজো পড়ে পড়ে বলল-০ ৪ ৮ ১২ ১৬। ফ্রান্সিস আশা করেছিল লুকানো স্বর্ণমূতির সম্বন্ধে কোনো সাঙ্কেতিক লেখা। এখন বুঝল এগুলো অঙ্ক। একটু হতাশই হলো। তবু অঙ্কগুলো মনে মনে মুখস্থ করল। বলল–আর কিছু লেখা নেই?
–না। কিন্তু এই অঙ্কগুলো দিয়ে তোমার কী হবে? মেস্তিজো বলল।
–হবে হবে। তবে অনেক ভাবতে হবে এই অঙ্কগুলো নিয়ে। তবেই রহস্য ভেদ করা যাবে। রাজা কোলা যখন নিজে এই অঙ্কগুলো কুঁদে লিখেছিলেন তখন নিশ্চয়ই এই অঙ্কগুলোর গুরুত্ব আছে। তাছাড়া ললাটের লিখনকথাটা ভুলে যেও না। ফ্রান্সিস বলল।
এবার ফ্রান্সিস নামতে লাগল। ও তখনও অংকের সংখ্যাগুলো নিয়ে ভেবে চলেছে। সঙ্গে মেস্তিজোও নামতে লাগল। মূর্তিটার মুখের কাছে এসে মুখটা দেখতে লাগল। মোটা ঠোঁট মূর্তিটার। প্রায় চৌকোনো। দাঁতগুলো পর পর সাজানো। ফ্রান্সিস কিছুটা অন্যমনস্ক ভঙ্গীতেই দাঁতগুলো দেখতে লাগল। হঠাৎ ওর মনে হলো-অঙ্কের ব্যাপার যখন, তখন দাঁতগুলো সংখ্যায় কটা দেখতে হয়। ও গুনলো। মোট ১৬টা দাঁত। এবার মুর্তিটার কপালের দিকে তাকাল। ঐ তো ওখানে শেষ সংখ্যা-১৬। আশ্চর্য! তাহলে তো সংখ্যাগুলোর সঙ্গে ষোলোটা দাঁতের একটা সম্পর্ক রয়েছে। কী সেই সম্পর্ক?
মই বেয়ে দুজনে নেমে এল। মারিয়া বিস্কো শাঙ্কো এগিয়ে এল। মারিয়া বলল কী ব্যাপার ফ্রান্সিস? তোমাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে।
একটু হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস বলল-হ্যাঁ মারিয়া স্বর্ণমূর্তির রহস্যের সমাধান প্রায় হাতের মুঠোয়। তবে ভাবনাচিন্তা করতে হবে।
বিস্কো, শাঙ্কো জানে ফ্রান্সিস ওসব ব্যাপারে কখনও বাজে কথা বলে না। ও নিশ্চয়ই মূর্তি উদ্ধারের হদিস পেয়েছে।
ওদের মধ্যে আর কোনো কথা হলো না। মারিয়া এই ব্যাপারে ফ্রান্সিসকে কোনো প্রশ্ন করল না। সময় হলে ফ্রান্সিস সব বলবে। ফ্রান্সিসরা নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল। মারিয়াকে নিয়ে রক্ষী দুজন রাজবাড়ি চলে গেল।
ফ্রান্সিস ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ ঘাসের বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে রইল। মেস্তিজোর মনে তখনও সংশয়। ফ্রান্সিস কি পারবে? দেবরক্ষী মূর্তির কপালে কয়েকটা অঙ্কের সংখ্যা লেখা আছে। তা থেকে কি স্বর্ণমুর্তি কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা বের করা যাবে?
ফ্রান্সিস উঠে বসল। বলল-মেস্তিজো তুমি দুটো কাজ কর। লেখবার জন্যে একটা সাদা চামড়া আর কালি কলম নিয়ে এসো। আর তামার হাতুড়ি ছেনি কোথায় আছে?
–ও দুটোও নিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।
মেস্তিজো চলে গেল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে এল। হাতে সাদা চামড়া আর পালকের কলম দোয়াতদান। হাতুড়ি ছেনিও সঙ্গে এনেছে।
ফ্রান্সিস নিল সে সব। মেস্তিজো বিস্কো শাঙ্কো সাগ্রহে এগিয়ে এল। দেখা যাক ফ্রান্সিস কী করে এসব নিয়ে। ফ্রান্সিস ভেড়ার চামড়ায় কালি কলমে লিখল–
০ ৪ ৮ ১২ ১৬
সংখ্যাগুলো লিখে ও ভাবতে লাগল এবং সংখ্যাগুলো নিশ্চয়ই কোনো একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার দিকে ইঙ্গিত করছে। সে সংখ্যাটা কত? ফ্রান্সিস ভাবতে লাগল। এই সংখ্যাগুলো দিয়ে কী হবে তা ওরা বুঝতেই পারল না। সংখ্যগুলো মুখে আওড়াতে আওড়াতে ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল সব সংখ্যার মধ্যে ব্যবধান রয়েছে চার অঙ্কের। তাহলে ৪ই সেই নির্দিষ্ট সংখ্যাগুলো ইঙ্গিত করছে।
ফ্রান্সিস খুশির হাসি হাসল। উৎসাহের কারণ কী? ফ্রান্সিস বলল-মেস্তিজো চলো দেবরক্ষীর মূর্তিতে উঠবো।
–কেন? মেস্তিজো বলল।
–তুমি হাতুড়ি ছেনি দিয়ে দেবরক্ষীর চার নম্বর দাঁতটা তুলবে। ফ্রান্সিস বলল।
মেস্তিজো অবাক। বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হলো?
–সেটা পরে বুঝবে? চলো। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই দেবরক্ষীর মূর্তির সামনে এ। তখন রাত হয়েছে। বেদ প্রাঙ্গণ জনশূন্য। বেদীর সামনে প্রাঙ্গনের ধারে মশা জ্বলছে। চারপাশ মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস মইটার সামনে এল। মেস্তিজোকে ইঙ্গিতে মই বেয়ে উঠতে বলল। দুজনে মই বেয়ে উঠতে লাগল। মেস্তিজোর হাতে হাতুড়ি ছেনি। বিস্কো শাঙ্কে। নিচে দাঁড়িয়ে রইল।
মই বেয়ে উঠতে উঠতে দুজনে মুর্তিটার মুখের কাছে এল! ফ্রান্সিস বলল মূর্তির পথরটা কি খুব শক্ত?
–না-না। এটা বোসেটা পাথর কেটে তৈরি। বোসেট। পাথর সাধারণ, থরের চেয়ে নরম।
–তাহলে চার সংখ্যায় দাঁতটা ছেনি দিয়ে কেটে তোলো। ফ্রান্সিস বলল। মেস্তিজো হাতুড়ি ছেনি হাতে চার নম্বর দাঁতটার কাছে মইয়ে পা রেখে দাঁড়াল। এই মূর্তি তৈরির সময় ও পাথর কাটার কাজ করেছে। ওর অভ্যেস আছে এই ভাস্করের কাজে। ও চার সংখ্যার তটায় হাতুড়ি ছেনি চালাতে চালাতে হেসে বলল-তোমার ধারণা এই দাঁতের খোঁদলে স্বর্ণমূর্তি আছে?
–ধারণা নয়, বিশ্বাস। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল। ও একটা মশাল নিয়ে এসেছিল। সেটা মেস্তিজোর সামনে ধরে রইল। উত্তেজনায় ওর হাত কাঁপছে। নির্জনে মন্দির প্রাঙ্গণে হাতুটি হেনির ঠক্ ঠক্ শব্দ উঠছে। মেস্তিজো পাথর-দাঁত ভাঙতে লাগল। সত্যি বোর্সেটা পাথর তেমন শক্ত নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দাঁত অনেকটা ভেঙে খোঁদল দেখা গেল। কিন্তু খোদ শুন্য, কিছু নেই তাতে। মেস্তিজো একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-পেলে কিছু?
–হিসেব মেলেনি। আবার ভাবতে হবে। চলো নামি। ফ্রান্সিস মই বেয়ে নামতে লাগল। পেছনে মেস্তিজো। বিষ্কো শাঙ্গো তখন নিচে দাঁড়িয়ে ভাবছে ফ্রান্সিস কি সত্যিই লুকোনো স্বর্ণমূর্তি খুঁজে পেল? ফ্রান্সিস আর মেস্তিজোকে আস্তে আস্তে নামতে দেখে ওরা বুঝল ফ্রান্সিস ব্যর্থ। স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করতে পারেনি।
ফ্রান্সিস। আস্তানায় ফিরে এল। পথে কেউ কোনো কথা বলল না। ঘাসের বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফ্রান্সিস তাঙ্কের সমাধান ভাবতে লাগল।
পরিদিন সকালে ফ্রান্সিসের স্বর্ণমর্তি উদ্ধারের কথা চিকামায় ছড়িয়ে পড়ল। লোকজ বের সামনে এসে ভিড় করল। দেখল দেবরক্ষীর দাঁত ভাঙা হলো কেন।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিসর বিশ্রাম করছে। রাজবাড়ি থেকে রাজার একজন দেহরী এল। ফ্রান্সিসকে কী বলল। সি কিছুই বুঝল না। মেস্তিজোর দিকে তাকাল। মেস্তিজো বলল-রজ পাল তোমাকে ডেকেছে।
–ও। ঠিক আছে; তুমি আমার সঙ্গে লে! তাইলে কেউ কারো কথা বুকবে না। ফ্রান্সিস বলল।
মেস্তিজোও ফ্রান্সিসের সঙ্গে গাড়ি চলল।
রাজা লুপাকা পাথরের সিংহাসনে বসেছিল। ফ্রান্সিস ও মেস্তিজো সামনে এসে দাঁড়াল। মেস্তিজো মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। ফ্রান্সিস মাথা নোয়াল না। এই লুপাকার আদেশেই সেদিন গায়ক তরুণটি প্রাণ হারিয়েছিল। এই বেদনা ফ্রান্সিস ভুলতে পারেনি। দুজনের কথাবার্তার মধ্যে মেস্তিজো দোভাষীর কাজ করল। রাজা ও ফ্রান্সিসের মধ্যে কথাবার্তা হলো এই রকম–
রাজা-স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করতে পারবে?
ফ্রান্সিস-হ্যাঁ।
রাজা-[হেসে) কোনোদিনই পারবে না।
ফ্রান্সিস-দেখা যাক। অপেক্ষা করুন।
রাজা-না, আমি আর অপেক্ষা করবো না। দুদিন সময় দিলাম। হয় স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করো, নইলে আমার রাজত্ব থেকে বিদেয় হও।
ফ্রান্সিস-দুদিন অনেক সময়।
রাজা-আর একটা কথা। শুনলাম তুমি সোনার মর্তি খুঁজতে গিয়ে দেবরক্ষীর মূর্তির ক্ষতি করেছে। ঐ মূর্তির আর ক্ষতি করা চলবে না।
ফ্রান্সিস-কিন্তু ঐ মূর্তি তো আপনার চিরশত্রু রাজা কোলার হাতে তৈরি।
রাজা-ঐ মূর্তির নিচে আমি আমার নাম ভাস্কর হিসেবে খোদাই করে দেবো। ওটা আমার তৈরি বলে সবাই জানবে।
ফ্রান্সিস-বেশ। তবে একটা কথা। ঐ মূর্তির আর একটু ক্ষতি আমি করবো, কারণ প্রথমবারে আমার হিসেব মেলেনি। এটুকু আপনাকে মেনে নিতে হবে।
রাজা যদি স্বর্ণমুর্তি পাই তবে এটুকু মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই। ফ্রান্সিসের সঙ্গে আর কোনো কথা হলো না। ওরা দুজন আস্তানায় ফিরে এল।
একটু সকাল সকাল খেয়ে নিল শাঙ্কো। বরাবরের মত তীর ধনুক নিয়ে শিকারে বেরিয়ে পড়ল। চলল তিতিকাকা বনের দিকে। বনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সারা দুপুর শিকার করল–দুটো খরগোস আর চারটে বুনো মুরগি। বিকেলের দিকে ফিরে আসছে তখন আত্মগোপনকারী তিনজন উনকা সৈন্যর সঙ্গে দেখা। ওরা শাঙ্কোর সঙ্গে সঙ্গে তিতিকাকা বনের প্রান্ত পর্যন্ত এল। এখানে ঘাসে ছাওয়া প্রান্তরের ওপর দিয়ে চিকামা যাওয়ার ধূলোটে পথ। ওরাও পথের কাছাকাছি এসেছে, দেখল দুজন চিম সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে এলাকাটা পাহারা দিচ্ছে। উনকা তিনজন ওদের দেখা মাত্র বনের দিকে ছুটল। চিমু ঘোড়সওয়ার সৈন্যরাও পিছু ধাওয়া করল। একজন বর্শা ছুঁড়ল। একজন উনকা সৈন্যের পিঠে গেঁথে গেল বশাটা। সে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। বাকি দুজনের একজনের একজন ঘুরে দাঁড়িয়ে বর্শা ছুঁড়ল। বর্শা বিঁধল চিমুসৈন্যের একজনের ঘোড়ার পেটে। ঘোড়াটা জোরে লাফিয়ে উঠল। তারপর আরোহী সৈন্যটিকে নিয়ে ঘাসের প্রান্তরে পড়ে গেল। অন্য জন ছুটে এল। উনকা সৈন্য দুজন ততক্ষণে বনের আড়ালে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। শাঙ্কো চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার চিমু সৈন্য দুজন শাঙ্কোর কাছে এল। দুজন ঘোড়া থেকে নেমে এল। একজন শাঙ্কোর তীর ধনুক কেড়ে নিল। অন্যজন শাঙ্কোর দুহাত দড়ি দিয়ে বাঁধল। বাঁধা দড়িটা ধরে ঘোড়ায় উঠল অন্যজনও তীর ধনুক নিয়ে ঘোড়ায় উঠল। দুজন আস্তে আস্তে চালাল। শাঙ্কোর হাতে বাঁধা দড়ি একজন ধরে নিয়ে চলল। শাঙ্কোও কোন প্রতিবাদ না করে চলল ওদের পেছনে পেছনে। সৈন্য দুজন মুখ ফিরিয়ে শাঙ্কোকে নানা কথা জিজ্ঞেস করছে। শাঙ্কো ওদের কোন কথাই বুঝতে পারে নি। চুপ করে থেকেছে।
তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে একটা লম্বাটে পাথরের ঘরের সামনে এসে সৈন্য দুজন ঘোড়া থেকে নামল। শাঙ্কো যেসব খরগোস, বুনন মুরগি শিকার করেছিল সেসব সেই সৈন্যটি নিয়ে গেলো। অন্য সৈন্যটি ঘরটার দরজার কাছে গেলো, দরজার দুপাশে মশালের আলোয় দেখা গেল দুজন সৈন্য বর্শা হাতে পাহারা দিচ্ছে। শাঙ্কো বুঝল এটা কয়েদঘর; সৈন্যটি এবার শাঙ্কোর কাছে এল। হাত বাঁধা শাঙ্কোকে নিয়ে ঘরটার দরজার কাছে এলো ততক্ষণে দরজাটা খোলা হয়েছে, কয়েদঘরের পাহারাদার সৈন্যটি শাঙ্কোকে ঘরের মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে। দিল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল। শাঙ্কো এবার চারপাশে তাকিয়ে ঘরটা দেখল। লম্বাটে ঘর। পাথুরে দেওয়ালে দুপাশে দুটে মশাল জ্বলছে। তার আলোয় দেখল মেঝেতে লম্বা লম্বা শুকনো ঘাস বিছানা। তার ওপর হাত বাঁধা অবস্থায় শুয়ে বসে আছে কয়েকজন উনকা সেন্য। শাঙ্কো প্রথমে শুকনো ঘাসের ওপর বসল। তারপর শুয়ে পড়ল।
ওদিকে যত রাত বাড়তে লাগল ফ্রান্সিসের ও বিস্কোর উদ্বেগ ততই বাড়তে লাগল। শাঙ্কো এখনো ফিরে এলো না-কী হল ওর? ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। আরো রাত বাড়লো। শাঙ্কো তখনও ফিরে এলো না, ফ্রান্সিস অধৈর্য হয়ে বলল–
–বিস্কো তৈরি হয়ে চলো, তিতিকাকা বনে যাবো। বিস্কো উঠে দাঁড়ালো, কোমরে তরোয়াল গুলো। ফ্রান্সিসও কোমরে তরোয়াল গুঁজে নিলো। মেস্তিজোর দিকে তাকিয়ে দেখল মেস্তিজো ঘুমিয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিস ওর দিকে এগিয়ে গেলো। কাঁধে ঠেলা দিয়ে ডাকল-মেস্তিজো, মেস্তিজো?
–মেস্তিজো বন্ধ চোখ খুলে তাকালো।
ফ্রান্সিস বলল-শাঙ্কো এখনো ফেরেনি। চল ওকে খুজতে যাবো।
মেস্তিজো তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলল-সে কী? শাঙ্কোর আবার কী হলো?
ফ্রান্সিস বলল-কিছুই বুঝতে পারছি না। চলো দেখি।
তিনজনে বাড়ির বাইরে এসে রাস্তায় দাঁড়াল, রাত তখন গভীর। দেখল রাস্তা জনশূন্য, এখানে ওখানে দু-একটা মশাল জ্বলছে। তিনজনে চলল তিতিকাকা বনের দিকে। বনের কাছাকাছি এসে দেখল ঘাসের প্রান্তরে জ্যোৎস্না পড়েছে, তিতিকাকা বনের গাছ গাছালির মাথায়ও জ্যোৎস্নার ছড়াছড়ি। ওরা বনের মধ্যে ঢুকলো। এগিয়ে চলল। দেখল ডালপালার ফঁকফোকর দিয়ে এখানে ওখানে ভাঙা জ্যোৎস্না। পড়ছে। ওরা আত্মগোপনকারী উনকা সৈন্যদের আস্তানার উদেশ্যে চলল। ফ্রান্সিস ও বিস্কো মাঝে মাঝেই গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগলো–
–শাঙ্কে-ও শাঙ্কো—ও–
কিন্তু উনকা সৈন্যদের আস্তানার কাছাকাছি আসতেই কয়েকজন উনকা সৈন্য উদাত বা হাতে ছুটে এলো।
মেস্তিজো চিৎকার করে বলল। আমরা বন্ধু। আমি মেস্তিজো। সেরা সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাঙা জ্যোৎস্নায় ভালোর মস্তিজোকে চিনতে পারলে। মাথা নুইয়ে তাকে সম্মান জানালো। ফ্রান্সিস ও বিস্কোকেও চিনতে পার। ঘরটার কাছাকাছি আসতেই সৈন্যদের দলপতি ছুটে এলো ফ্রান্সিসদের দেখে। চিৎকার করে কী বলে উঠল। মেস্তিজো সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলে উঠল–সর্বনাশ শাঙ্কোকে চিম সৈন্যরা বন্দী করে নিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস চমকে উঠে বলল। সে কী? কখন?
এবার দলপতি এগিয়ে এসে মেস্তিজোকে কী বলল। মেস্তিজো ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–আজকে বিকেলের দিকে বনের বাইরে চিকামা যাবার রাস্তার বারে শাঙ্কোকে ওরা বন্দী করেছে তারপর চিকামায় নিয়ে গেছে। বোধহয় কয়েদখানায় বন্দী করে রেখেছে।
ফ্রান্সিস বলে উঠল–বিস্কো চলো চিকামায় ফিরি। এসময় দলপতি মেস্তিজোকে কী সব বলল, মেস্তিজো বলল।
–ফ্রান্সিস রাজপুত্র পিসকোজ এই আস্তানায় এসেছেন। উনি তোমাদের কথা শুনেছেন। তোমরা যদি ওর সঙ্গে কথা বলো তাহলে খুবই ভালো হয়।
ফ্রান্সিস একটু ভেবে নিয়ে বলল–বেশ, কিন্তু বেশি সময় দিতে পারবো না। আমাদের এক্ষুনি চিকামায় ফিরে যেতে হবে আর শাঙ্কোর মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে হবে।
–ঠিক আছে। চলো। মেস্তিজো বলল।
মেস্তিজো আর দলপতি আগে আগে চলল। পেছনে অন্য সৈন্যরা আর ফ্রান্সিস ও বিস্কো। একটু এগোতেই সেই লম্বাটে বাড়িটার সামনে এল ওরা। এবার দলপতি ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। সেই বাড়িটার বড় উঠোন মত জায়গায় এল ওরা। দলপতি পূর্ব কোণার একটা ঘরের দিকে চলল। ঘরের কাছে এসে দেখা গেল ঘরের দরজা খোলা। দলপতি দরজার সামনে দাঁড়াল। দুহাত বুকে রেখে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে কী বলল। ঘরের ভেতর থেকে ভরাট গলায় কার কথা ভেসে এল। দলপতি ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। প্রথমে মেস্তিজো ঢুকলো। পেছনে ফ্রান্সিস আর বিস্কো। ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস দেখল মোটা কাপড় পাতা ঘাসের বিছানায় একজন শক্ত সমর্থ যুরক বসে আছে। মাথায় লাল কাপড়ের ফেট্টি। কিন্তু কোনো পাখির পালক নেই! মেস্তিজো মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফ্রান্সিসকে গলা উঁচিয়ে বলল—রাজা কোলার ছেলে রাজপুত্র পিসকোজ। ফ্রান্সিস আর বিস্কো অল্প মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানাল। রাজপুত্র পিসকেজে হেসে বিছানা থেকে উঠল। ফ্রান্সিসের ডানহাতটা ধরে ভাঙা ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলল—তুমি ফ্রান্সিস–বীর নাম শুনেছি–বসো। রাজপুত্র পিসরোজ নিজে বিছানায় বসল। ফ্রান্সিসের হাত ধরে বসাল। বিস্কো বসল। রাজপুত্র বলল–মেস্তিজো-অল্প স্পেনীয় ভাষা-শিখেছি। গুছিয়ে বলতে পারবো না। রাজা লুপাকা-চিকামা দখল–অত্যাচার-হত্যা-বন্দী-তাড়াবো। লুপাকাকে-চিকামা-স্বাধীন-আপনাদের সাহায্য। ফ্রান্সিস প্রথমে বুঝে উঠতে পারলো না কী বলবে। একটু ভেবে নিল। বলল এব্যাপারে আপনার এখানকার দলপতিকে আমি সব বলেছি। মেস্তিজোও জানে। আমরা এক্ষুণি আপনাদের সাহায্য করতে পারবো না। কারণ রাজকুমারী মারিয়া এখন রাজ প্রাসাদে প্রায় বন্দিনী। আর এই অবস্থায় রাজা লুপাকার সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চাই না। আমার বক্তব্য মেস্তিজো আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে। মেস্তিজো মৃদুস্বরে কিছুক্ষণ রাজপূত্রকে কী বলল। রাজপুত্র চুপ করে সব শুনে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। বলল-আপনার বন্ধু-বন্দী–লুপাক! হৃদয়হীন–নৃশংস-বন্ধু জীবন বিপন্ন। ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠল। ফ্রান্সিস বলল–রাজা লুপাকা যদি আমার বন্ধুকে আমার অনুরোধে মুক্ত দেয়-ভালো কথা। কিন্তু যদি আমার বন্ধুর ওপর অত্যাচার করে তবে বন্ধুর মুক্তির জন্যে, মারিয়ার মুক্তির জন্যে আমাদের অস্ত্র ধরতেই হবে। তখন আপনাদের পাশে আমাদের পাবেন। রাজপুত্র হেসে হাত তুলে বলে উঠল–দুঃসাহসী ফ্রান্সিস তোমাদের সামান্য সাহায্য-অনেক। ধন্যবাদ। ফ্রান্সিসরা আবার মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘরের বাইরে চলে এল। মেস্তিজোও বাইরে এল। বলল-চলো আমিও তোমাদের সঙ্গে যাবো। তিনজন চলল চিকামার দিকে। পথে মেস্তিজো বলল–ফ্রান্সিস আমাদের খাওয়া দাওয়া কিন্তু কিছুই হয়নি। চলো আস্তানায় গিয়ে কিছু খেয়ে নি, ফ্রান্সিস বলল।–শাঙ্কোকে সুস্থ না দেখা পর্যন্ত আমার মুখে খাওয়া রুচবে না। পথে আসতে আসতে সূর্য উঠল, ভোর হল। ওরা যখন রাজবাড়ির পাশেই সেই লম্বা ঘরওয়ালা কায়েদঘরের সামনে এসে পেঁছিল তখন সকাল হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস কয়েঘরের দরজার গিকে এগিয়ে গেল। এই কয়েঘরে ওদের আগে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। দেখল চারজন চিম সৈন্য বর্শা হাতে কয়েদঘর পাহারা দিচ্ছে। ফ্রান্সিস মেস্তিজোকে কাছে ডাকল, বলল –
–মেস্তিজো ওদের জিজ্ঞাসা করো যে শাঙ্কোকে এখানে বন্দী করা হয়েছে কী না? আর শাঙ্কো সুস্থ আছে কী না!!
মেস্তিজো পাহারাদারদের এসব কথা জিজ্ঞেস করল। উত্তরে পাহারাদাররা কী সব বলল। মেস্তিজো ফ্রান্সিসের দিকে ফিরে বলল।
–হ্যাঁ, শাঙ্কোকে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছে আর শাঙ্কো সুস্থ তাছে।
–শাঙ্কোকে কেন বন্দী করা হয়েছে জিজ্ঞাস কর।
–চিম পাহারাদার মেস্তিজোকে কী বলল। মেস্তিজো বলল–
–ওরা সন্দেহের বশে শাঙ্কোকে বন্দী করেছে। ওদের সন্দেহ তিতিকাকা বনে যেসব উনকা সৈন্যরা আত্মগোপন করে তাদের সঙ্গে শাঙ্কোর যোগ আছে। শাঙ্কো গুপ্তচর। একটু পরেই রাজসভার কাজ শুরু হবে। তখন রাজার সামনে শাঙ্কোকে হাজির করা হবে। রাজা বিচার করে শাস্তি দেবেন সেই শাস্তিই শাঙ্কোকে পেতে হবে। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ভেবে দেখল এক্ষুনি চিমু পাহারাদারদের সঙ্গে লড়াইতে নামা উচিত হবে না। সময় ও সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ওরা ফিরে এসে রাজবাড়ির সিংহদ্বারে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস, বিস্কো সারারাত কিছু খেতেও পারেনি, ঘুমুতেও পারেনি। মেস্তিজোরও একই অবস্থা তিনজন তখন প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত। সদর দেউড়ির পাশে একটা লম্বাটে পাথরের ওপর ওরা বসে পড়ল।
বেলা বাড়তে লাগলো। একসময় রাজবাড়ির সদর দেউড়ি খুলে গেলো। লোকজন রাজসভার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ফ্রান্সিসরাও গেলো। একসময় রাজা লুপাকা এলো। পাথরের সিংহাসনে বসল। ততক্ষণে পাহারাদার সৈন্যরা হাত বাঁধা শাঙ্কোকে রাজার সামনে এনে উপস্থিত করেছে। একজন পাহারাদার শাঙ্কোকে দেখিয়ে গড়গড় করে কী সব বলে গেলো। রাগে রাজা লুপাকার মুখ লাল হয়ে উঠল। চিৎকার করে রাজা কী বলে উঠল। মেস্তিজো চাপা গলায় বলে উঠল–
ফ্রান্সিস, পাঁচ ঘা বেত মারার হুকুম হয়েছে। তখন লম্বা, কালো বেত হাতে একজন সৈন্য এগিয়ে এলো। প্রচণ্ড জোরে চাবুক চালালো শাঙ্কোর গায়ে। শাঙ্কোর সমস্ত শরীর নড়ে উঠল। ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। বসে পড়ল, ফ্রান্সিস বুঝল চাবুকের পাঁচটা ঘা শাঙ্কো সহ্য করতে পারবে না, অজ্ঞান হয়ে যাবে। ও মেস্তিজোকে বলল–
শিগগির রাজাকে বলো চাবুক মারা বন্ধ করতে। আমি রাজার সঙ্গে কথা বলব। মেস্তিজো চিৎকার করে দুহাত ওপরে তুলে লুপাকাকে সে কথা বলল। এবার মেস্তিজো মারফৎ রাজা লুপাকা ও ফ্রান্সিসের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হলো।
ফ্রান্সিস-শাঙ্কো আমার বন্ধু। তাকে চাবুক মারা হচ্ছে কেন?
রাজা–ও গুপ্তচর।
ফ্রান্সিস–আপনি তার কোন প্রমাণ পেয়েছেন?
রাজা–আমার সৈন্যরা তার প্রমাণ পেয়েছে।
ফ্রান্সিস–মিথ্যে কথা, যদি এ মিথ্যে অভিযোগে আমার বন্ধুকে শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে গুপ্ত স্বর্ণমূর্তি আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব না।
রাজা–কিন্তু তোমাদের তো সেই জন্যই এখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে।
ফ্রান্সিস–আমার বন্ধুকে যদি মুক্তি দেওয়া না হয় তাহলে আমি স্বর্ণমূর্তি খুঁজবো না!।
রাজা–তাহলে তোমাদের দুজনকেও বন্দী করা হবে।
ফ্রান্সিস–বেশ তাই করুণ। কিন্তু আমার বন্ধুকে আর একটাও চাবুক মারা চলবে না।
রাজা–ওর আরো চারটে চাবুকের ঘা পাওনা আছে।
ফ্রান্সিস চিৎকার করে উঠল–না-না।
রাজা লুপাকা আঙুল নেড়ে পাহারাদারদের ইঙ্গিত করল, ওরা পাঁচজন ছুটে এসে ফ্রান্সিস ও বিস্কোর হাত বেঁধে ফেলল। তারপর ওদের কোমর থেকে তরোয়াল খুলে নিল। আবার চাবুকের ঘা পড়ল শাঙ্কোর পিঠে, তারপর আবার। শাঙ্কো পাথুরে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চাবুকের ঘায়ে আহত শাঙ্কোর দিকে। ফ্রান্সিসের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। বিস্কোর চোখেও জল। ওরা অসহায় বন্দী, কিছুই করার নেই।
পাহারাদাররা ফ্রান্সিস ও বিস্কোকে নিয়ে হাঁটতে লাগল কয়েদঘরের দিকে। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগল। ওর মাথায় অনেক চিন্তা। শাঙ্কোর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মারিয়ারও যাতে কোন বিপদ না হয় সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। ওদের দুজনকে কয়েদঘরে ঢোকানো হল। একটু পরেই পাহারাদাররা আহত শাঙ্কোকে কয়েদঘরে রেখে গেলো। ফ্রান্সিস ও বিস্কো আহত শাঙ্কোর ওপর ঝুঁকে পড়ল। বাঁধা দুটো হাত দিয়ে ফ্রান্সিস শাঙ্কোর মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। এমন সময় কয়েদঘরের দরজায় টং করে শব্দ হলো। ফ্রান্সিস দেখল মেস্তিজো লোহার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সিস তাকাতেই ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে লোহার দরজার কাছে দাঁড়াল। মেস্তিজো বলল–ফ্রান্সিস, অনেক কায়দা করে রাজা লুপাকাকে হাত করেছি। বলেছি ফ্রান্সিসদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখব এবং এইভাবে রাজপুত্র পিসকোজ ও আত্মগোপনকারী উনকা সৈন্যদের সব খবরাখবর জোগাড় করব এবং তা রাজা লুপাকাকে জানাবো। রাজা খুব খুশি, আমাকে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে। ফ্রান্সিস বলল–মেস্তিজো-তুমি যে করেই হোক শাঙ্কোর চিকিৎসার ব্যবস্থা কর।
দেখছি, একথা বলে মেস্তিজো চলে গেলো। ফ্রান্সিস এবার শাঙ্কোর পাশে ভাল করে বসল। শাঙ্কোর মাথা নিজের কোলে তুলে নিল। শাঙ্কো ব্যথায় একটু কঁকিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস ডাকলো–শাঙ্কো?
–উঁ?
–খুব কষ্ট হচ্ছে?
–না। শাঙ্কো মৃদু হাসল। বলল–বুঝলে ফ্রান্সিস–আমি খুব আহত হবার ভান করেছি যাতে আরো চাবুক খেতে না হয়। তবে পিঠটা ভীষণ জ্বালা করছে। দেখতো কতটা কাটল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে শাঙ্কোর জামাটা খুলতে লাগল। বিস্কোও সাহায্য করল। জামা খোল হলে মশালের আলোয় ওরা দেখল তিন চারটে লম্বাটে কালশিটের দাগ শঙ্কোর পিঠে। একটা দাগ একেবারে পিঠের চামড়া কেটে বসেছে। টুইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে কাটা জায়গা থেকে! ফ্রান্সিস বুঝল–শাঙ্কোর চিকিৎসা প্রয়োজন। নইলে কাটা জায়গাটা পেকে যেতে পারে। ফ্রান্সিস বলল–বিঙ্কে চিনেমাটির হাঁড়িট! জল নিয়ে এসো। বিজে উঠল। রের কোনায় রাখ হাঁড়িটা থেকে চিনেমাটির বাটিতে করে জল নিয়ে এল। ফ্রান্সিস নিজের কোমরের ফেট্টি থেকে কিছুটা কাপড় ছিঁড়ল। কাপড়ের টুকরোটা জলে চুবিয়ে শাঙ্কের পিঠের কালসিটে দাগে, কটা জায়গায় আস্তে আস্তে জল বুলিয়ে দিল। শাঙ্কো একবার নড়ে উঠল। জল লাগায় বেশ জ্বালা করে উঠল। পারে একটু ঠাণ্ডা লাগায় ভাল লাগল।
তখনই কয়েরের দরজায় শব্দ হল। দেখা গেল দরজা খোলা হচ্ছে। দুজন পাহারাদার বান্দাদের জন্যে চীনামাটির বড় গোল পাত্রে খাবার নিয়ে ঢুকল। ওরা বন্দীদের হাতের বাঁধন খুলে দিল। তিনকোণা পাতা বন্দীদের সামনে ঘাসের ওপর বিছিয়ে দিল। খাবার ঢেলে দিল। গতরাত থেকে খাওয়া নেই, ঘুম নেই ফ্রান্সিসর। যেন ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে গেছে। ফ্রান্সিস খাবার খেতে খেতে বলল–কিছুই ফেলো না–পেট পুরে খাও। মুখে ভালো না লাগলেও খাও। বন্দীদশায় ফ্রান্সিস সব সময় একথা বলে। শঙ্কেও উঠে বসে খেতে লাগল। সেই রানের রুটি, বুনো আলু আর সামুদ্রিক মাছের ঝোল। মেডিজের তাত্তিায় তিতিক বনের আস্তানায় এমনি খাবারই ওরা খেয়েছে। খেয়ে অভ্যস্ত হয়েছে। পেট পুরে খেল তিনজনে। তারপর অনেকটা জল খেল। পাহারাদাররা এঁটো পাতা নিয়ে চলে গেল। ফ্রান্সিসরা দ্বাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
কয়েক ঘণ্টা কটল। খেয়ে দেয়ে ফ্রান্সিস গায়ে বেশ জোর ফিরে পেল। লোহার দরজায় আবার শব্দ উঠল-ঢ ঢং ঢং ঘর র র। ওরা দেখল মেস্তিজো একটা লম্বা মত বুড়ো লোককে নিয়ে ঢুকছে। লোকটার মুখে পাকা দাঁড়ি গোঁফ। মাথায় কালো কাপড়ের কেটি বাঁধ। মাথায় পাকা চুল পেছনে বেণীর মত পাকানো। গলায় নানা রঙের পাথরের টুকরের মালা, হাতে একটা বোঁচকা। ফ্রান্সিস বুঝল লোকটা বদ্যি। বদি শাঙ্কোর কাছে এসে বসল। ওর পিঠের কালসিটে দাগ, চাবুকের ঘা এসব ভালো করে দেখল। তারপর ঝোলা থেকে চীনামাটির বোয়াম বের করল। একটা গাছের পাতা বের করল, তারপর সেই পাতার বোয়াম থেকে হলুদ রঙের কিছু গুড়ো ঢালতে ঢালতে মেস্তিজোকে জল নিয়ে আসতে বলল।
–মেস্তিজো জল নিয়ে এলো, যদি সেই জল গুড়োটার ওপর ফোঁটা ফোঁটা ঢেলে আঠার মতে করল। তারপর শাঙ্কোর পিঠে আস্তে আস্তে লাগিয়ে দিল। প্রথমে শাঙ্কো এ চেঁচিয়ে উঠল, বোধহয় জায়গাগুলো জ্বালা করে উঠল। তারপর শঙ্কো শান্ত হলো। বোধহয় জ্বালা যন্ত্রণা একটু কমল। ওষুধ লাগিয়ে বদ্যি মেস্তিজোকে কী বলল, মস্তিজো পাতাটায় ওষুধ কিছুটা রেখে দিল। তারপর চলে গেল, মেস্তিজো ফ্রান্সিসকে বলল–ওষুধ রইল। কাল সকালে লাগিয়ে দিও। সেদিন কাটল। মেস্তিজো পরের দিনও ওষুধ এনে দিলো।
দিন চারেক কাটল, শাঙ্কো এখন অনেকটা সুস্থ। সেদিন ফ্রান্সিস মেস্তিজোকে বলল–
–দেখো, রাজা লুপাকা শাঙ্কোকে যেভাবে বিনা কারণে শাস্তি দিলো, তাতে রাজার বিরুদ্ধে আমি রুখে দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু মারিয়ার কথা ভেবে আমি নিজেকে সংযত করেছি।
–ফ্রান্সিস। মেস্তিজো বলল–
–তোমাকে বলিনি কিন্তু এখন তো বলতেই হয়। মারিয়াকে একটা ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাকে বাইরে বেরুতে দেওয়া হচ্ছে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না।
ফ্রান্সিস বলল?
–এটা হবে আমি জানতাম। কিন্তু এখন যে করেই হোক মারিয়াকে উদ্ধার করতে হবে, মেস্তিজো তুমি কী একা পারবে।
–নিশ্চয়ই পিরবো। মেস্তিজো বলল–আমি সেসব ছকে রেখেছি। কিন্তু আমার ভয় হলো পরে রাজা লুপাকা এসব জানতে পারলে আমার জীবন বিপন্ন হবে।
–তোমার কোনো ভয় নেই। তোমাকে দুটো কাজ কতে হবে। মারিয়াকে মুক্ত করতে হবে আর আমাদের জাহাজে আমার বন্ধুদের বিপদের সংবাদ পৌঁছে দিতে হবে। ভাবছিলাম রাজা পাকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামব না। কিন্তু আর লড়াইয়ে না নেমে উপায় নেই। তুমি আমার বন্ধুদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসে সোজা তিতিকাকা বনে গিয়ে রাজপুত্র পিসকোজের কাছে নিয়ে যাবে। পিসকোজ যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকামা আমাণ করে। আমি এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করব কিন্তু দি পালাতে না-ও পারি আমার বন্ধুরা এসে ঠিক আমাদের উদ্ধার করবে। মেস্তিজো বলল–
–ঠিক আছে আমি যাচ্ছি, দেখি কতদূর কী করতে পারি। মেস্তিজো সেদিন সন্ধ্যেবেলা রাজা লুপাকার সঙ্গে দেখা করল। বলল
–মহারাজ আমি গোপন সূত্রে সংবাদ পেয়েছি যে রাজপুত্র পিসকোজ আগামী। পূর্ণিমার দিন চিকমা আক্রমণ করবে।
–পূর্ণিমা কবে? রাজা জিজ্ঞাসা করলেন?
–আর সাতদিন পরে। তারপর মেত্তিজো বলল।
–কালকে দেবরক্ষীর পূজো। সেই উৎসবে আপনি ও মহারাণী আসবেন। রাজকুমারী মারিয়াকেও আসার অনুমতি দেবেন এই আমার অনুরোধ। রাজা কিছুক্ষণ ভাবলেন তারপর বললেন।
–বেশ তাই হবে, কিন্তু রাজকুমার মারিয়ার সঙ্গে পাহারাদার সৈন্য যাবে?
–বেশ। মস্তিজো বলল।
পরদিন দুপুর থেকেই দেবীর পূজের উৎসব শুরু হল। চিকামার অধিবাসারা দলে দলে পুজোর আঙ্গিনায় আসতে লাগল। মই বেয়ে উঠে দেবরক্ষীর গলায় মালা পরাতে লাগল। দেবরক্ষীর মূর্তির বেদীতে ফুল পাতা ছড়িয়ে দিতে লাগল। বুনো গাছের শুকনো কষ জড়ো করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিল। সুগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল পূজাঙ্গনে। মেস্তিজো সারাদিন পুজো নিয়ে ব্যস্ত রইল। উৎসব জমে উঠল সন্ধ্যাবেলা। সমস্ত পূজাঙ্গন ঘিরে অনেক মশাল জুলল। শুরু হল নাচ গান। দলে দলে মেয়েরা সুর করা নাচের আসরে নাচগান করতে লাগল।
সন্ধ্যের পরেই ঘোড়ায় চড়ে রাজা লুপাকা ও রানী এল উৎসব প্রাঙ্গনে। বসল দেবরক্ষীর মূর্তির বেদীতে। রাজা রানী দুজনেই বেশ সেজেগুজে এসেছে। শুধু চারদিকে দাঁড়ানো চি সৈন্যরা রাজারানীর জয়ধ্বনি দিল। চিকামার অধিবাসীরা কোন জয়ধ্বনি দিল না।
একটু পরেই দুজন পাহারাদার সৈন্যের পাহারায় মারিয়া এল। মারিয়া চিন্তাগ্রস্ত। ফ্রান্সিস, বিস্কো, শাঙ্কো বন্দী। কয়েদঘরে কী কষ্টে না জানি ওদের দিন কাটছে মারিয়ার এই উৎসবে আসার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু মেস্তিজো ওর সঙ্গে দেখা করে বারবার অনুরোধ করেছে-এই উৎসবে আপনি অবশ্যই আসবেন। আপনার মন ভালো নেই। তবু আসবেন। তাই মারিয়াকে আসতে হলো। মারিয়া বেদীতে বসে উৎসব দেখতে লাগলো। এই সময় মেস্তিজো ওর কাছে এলো। বলল–
–আপনি আমার সঙ্গে আসুন। দেবরক্ষীর পূজা করুন তাহলে আপনার মঙ্গল হবে। মারিয়া উঠে মেস্তিজোর পেছনে পেছনে আসতে লাগল। মারিয়ার পাহারাদার দুজন চিমু সৈন্য ওকে অনুসরণ করল। ওরা সকলে এসে মেস্তিজোর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল, মেস্তিজো ইঙ্গিতে পাহারাদার দুজনকে বাইরে দাঁড়াতে বলল। তারপর মারিয়াকে নিয়ে ঘরে তুলল, ঘরে ঢুকে মেস্তিজো ওর পুরোহিতের পোশাক নানান রঙের সুতোর কাজ করা গায়ের চাদরটা ফেলে দিল। একটা পঞ্চো গায়ে পরে নিল। তারপর পেছন দিকটার দরজাটা খুলে মারিয়াকে চাপা-স্বরে ডাকল–রাজকুমারী তাড়াতাড়ি চলে আসুন! দুজনে দরজার বাইরে এল। তারপর মেস্তিজো দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো। পেছনে মারিয়া। মারিয়ার পাহারাদার দুজন সৈন্য তখনো বর্ষা হাতে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে মেস্তিজো ও মারিয়া যতটা দ্রুত সম্ভব যেতে লাগলো। সব লোকজন তখন উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা। ওদের লক্ষ্যই করল না। মেস্তিজো ও মারিয়া রাস্তায় এসে নামল। রাস্তা জনশূন্য। সবাই উৎসূবের প্রাঙ্গনে গিয়ে জড়ো হয়েছে। এক সময় ওরা চিকামা শহর থেকে বেরিয়ে এলো। আকাশে খণ্ড চাঁদ। তার আলোয় মেস্তিজো দেখল ধারে কাছে লোকজন নেই। এবার মেস্তিজোও দাঁড়িয়ে পড়ল। মারিয়াও দাঁড়িয়ে পড়ল। দুজনেই বেশ হাঁপাচ্ছে তখন। মেস্তিজো বলল
–রাজকুমারী–ফ্রান্সিস আমাকে দুটো দায়িত্ব দিয়েছে। এক, আপনাকে মুক্ত করার সেটা করলাম। দুই, জাহাজে গিয়ে ফ্রান্সিসের বন্ধুদের সব কথা জানানো। এইবার আমাকে সেই কাজটা করতে হবে। আপনি জাহাজে ফিরে যাবেন তো।
মারিয়া বলল–না আপনি চিকামাতেই কোথাও আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিন। ফ্রান্সিস্রা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি চিকামা ছেড়ে যাবো না।
–কিন্তু চিকামায় থাকা আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়। থাকলে আপনি যে কোন সময় বিপদে পড়তে পারেন।
–তাহলে চিকামার বাইরে আমার অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিন। মেস্তিজো বেশ চিন্তায় পড়ল। ও ভাবতে লাগলো মারিয়াকে চিকামার বাইরে কোথায় রাখা যায়। তখন হঠাৎ মনে পড়ল তিতিকাকা বনের সেই আস্তানার কথা। বলল–
তিতিকাকা বনের মধ্যে আত্মগোপনকারী উনকা সৈন্যরা এক আস্তানা তৈরি করেছে। সেখানে মৃত রাজা কোলার পুত্র পিসকোজ আছে। আপনি ঐ আস্তানায় নিরাপদে থাকতে পারবেন।
-তাহলে খুবই ভালো হয়। মারি। বলল।
মেস্তিজো মারিয়ারে তিতিকাকা বনের দিকে নিয়ে চলল।
তিতিকাকা বনের মধ্যে যখন ওরা ঢুকল তখন রাত গভীর! বনের ওপার নিচে অন্ধকার; প বলে কিছু নেই। বনের এখানে ওখানে চাঁদের ভাঙা অস্পষ্ট আলোয় মেস্তিজো দ্রুত এগিয়ে চলল পেছনে মারিয়া। এক সময় ওরা সেই কাঠের বাড়ির কাছে এলো। হঠাৎ তিন চার জন আত্মগোপনকারী উনকা সৈন্য ওদের ঘিরে এল। মেস্তিগো চিৎকার করে বলে উঠল। উনকা সৈন্যরা ওকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো। তারপর ওদের বাড়িটার মধ্যে নিয়ে গেলো। ঘরে ঢুকে মারিয়া মশালের আলোয় দেখা লম্বাটে ঘরটায় অনেক লোকজন ঘাসের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। এক কোনায় রাজপুত্র পিসকোজ ঘুমিয়ে ছিল। মেস্তিজো কাছে বলে কী বলে ডাকলো। পিসকেজের ঘুম ভঙে গেলো। সে উঠে বসল। মারিয়াকে দেখে বেশ অবাকই হলো! মেস্তিজো রাজপুত্রকে এক নাগাড়ে কী বলে গেলো। রাজপুত্র কী বলল। তখন মেস্তিজো মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল–আমি রাজপত্রের কাছে আপনার পরিচয় দিয়েছি। রাজপুত্র আপনাকে এখানেই থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মেয়েরা যে ঘরে থাকে সেই ঘরে। এবার মেস্তিজো মারিয়াকে নিয়ে ঘরের বাইরে এলো। একটা বড় উঠোন পেরিয়ে পূর্ব কোণায় একা ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল। মেস্তিজো ঘরের দরজায় আস্তে ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। মেস্তিজো কী বলল। দরজা খুলে একজন বয়স্ক উনকা স্ত্রীলোক বেরিয়ে এল। মেস্তিজো তাকে কী বলল। স্ত্রীলোকাট মারিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে কী বলল। তারপর দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। মেস্তিজো মারিয়াকে বল–রাজকুমারী আপনি এখানে থাকবেন। এরাই আপনার দেখাশুনো করবে। আমি সমুদ্রতীরে যাচ্ছি। ফ্রান্সিসের বন্ধুদের খবর দিতে। মারিয়া ঘরটায় ঢুকল! দেখল ঘরে দুটো মশাল জ্বলছে। মেঝেয় ঘাসের বিছানায় মোটা কাপড়ের চাদর পাতা। কিছু স্ত্রীলোক শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভেঙে দুএকজন মারিয়াকে দেখল। মধ্যবয়স্কা স্ত্রীলোকটি মারিয়াকে বিছানা দেখাল। হেসে কী বলল। বোধহয় মারিয়াতে শুতে বলল।
মেস্তিজো উঠোন মত জায়গায় নামল। তারপর ঐ আস্তানা থেকে বেরিয়ে এল। চলল মরুভূমির মত সেই ঢালা সমুদ্রতারের উদ্দেশ্য। দুএকটা টিলার মত পাহাড়ী এলাকা পার হয়ে মেস্তিজো সেই মরুভূমির মত এলাকায় এল। তখন চাঁদ পশ্চিমদিগন্তে হেলে পড়েছে! মৃদু-জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে মরুভূমি এলাকার জোরে হাওয়া আসছে। সমুদ্রের দিক থেকে বালি উড়ছে। মেস্তিজো চলল সমুদ্রের দিকে।
ভোর হল। মেস্তিজো দূর থেকে সমুদ্রের তীরে নোঙর কর ফ্রান্সিসদের জাহাজটা দেখল। ও জাহাজটার কাছে যখন পৌঁছল তখন সকাল। সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে মেস্তিজো ভাইকিংদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চিৎকার করে ডাকাডাকি শুরু করল। দুজন পাহারাদার ভাইকিং জাহাজের রেলিং-ধরে কাছে এলো, ঝুঁকে পড়ে মেস্তিজোকে দেখলো। মেস্তিজো চিৎকার করে বলল–
–খুব জরুরি খবর আছে। আমাকে জাহাজে উঠতে দাও। ততক্ষণে আরো কিছু ভাইকিং ডেকের রেলিং এর কাছে হাজির হয়েছে! ওরা তখন একটি কাঠের পাটাতন নামিয়ে দিল তীর পর্যন্ত। মেস্তিজো কাঠের পাটাতনের ওপর হেঁটে গিয়ে জাহাজে উঠল। ভাইকিংরা ওকে ঘিরে ধলে। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল–
–কী সংবাদ?
মেস্তিজো বলল–
–সব বলছি। আগে আমাকে কিছু খেতে দিন। ভাইকিংর একে খাবার ঘরে নিয়ে গেলো। মাংস, রুটি খেতে দিলো। মেস্তিজো খাচ্ছে তখনি হ্যারি এলো। হ্যারি জিজ্ঞাসা করল–
আপনি কে? কী খবর এনেছেন? মেস্তিজো তখন আস্তে আস্তে নিজের পরিচয় ফ্রান্সিসদের বন্দী দশা আর তিতিকাকা বনে মারিয়া আশ্রয় লাভের কথা বলল। তারপর ফ্রান্সিসের নির্দেশও জানলো।
হ্যারি বলল–আমরা সকালের খাবার খেয়েই চিকামা রওনা হবো। আপনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ভাইকিংরা স্নান খাওয়া সেরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জাহাজের ডেক-এ এসে জমায়েত হল। প্রথমে মেস্তিজো পাটাতন দিয়ে হেঁটে জাহাজ থেকে নামলো। ওরা আকাশের দিক তরোয়াল দিয়ে চিংকার করে উঠল—ও-হো-হো-হো মরুভূমির ওপর দিয়ে শুরু হলো। মরুভূমির বালি এর মধ্যেই তেতে উঠেছে। সমুদ্রের দিক থেকে হাওয়া ছুটছে জোরে! সুর্যের তেজও বেশ, এর মধ্য দিয়েই ভাইকিংবা চলল। দুপুর নাগাদ চিক্লাই শহরে এসে পৌঁছল। সেখান থেকে হেঁটে চিকামায় এসে যখন পৌঁছল তখন বিকেল। মেস্তিজোরা চিকামা শহরে ঢুকল না। কয়েকটি পাহাড়ি টিলা পেরিয়ে তিতিকাকা বনে ঢুকলো। যখন তিতিকাকা বনের আস্তানায় এসে পৌঁছল তখন সন্ধ্যে হয় হয়। মেস্তিজো হ্যারিকে রাজপুত্র পিসকোজের কাছে নিয়ে গেলো। পিসকোজ সমাদরে হ্যারিকে ঘাসের বিছানায় বসালো। তারপর ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় ফ্রান্সিসের বিপদের কথা বলল—
–এই অবস্থায় আমাদের আর অপেক্ষা করা উচিত নয়। মেস্তিজো রাজা লুপাকাকে বলেছে যে, আপনারা পূর্ণিমার দিন আক্রমণ করবেন। পূর্ণিমার এখনো দুদিন বাকি। রাজা লুপাকা এই কটা দিন নিশ্চিত থাকবে। সেইজন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আক্রমণ করতে হবে। আপনার আপত্তি না থাকলেও আমরা কালকেই চিকামা আক্রমণ করতে পারবো। পিসকোজ মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বলল
রাজা পাকাকে তৈরি হবার সময় দেবো না। কালকে রাতেই আমরা আক্রমণ করবো। আমি আজকেই সব আস্তানায় খবর পাঠাচ্ছি কাল বিকেলে সব সৈন্যরা এখানে-জড়ো হবে। এই সময় মারিয়া ঘরে ঢুকল। হ্যারি মারিয়াকে মুক্ত ও সুস্থ দেখে খুশি হলো। উঠে দাঁড়িয়ে তাকে মাথা নিচু করে সম্মান জানালো। বলল–
রাজকুমারী কালকে যুদ্ধ শুরু হবে। এ অবস্থায় আপনার এখানে না থাকাই ভালো, আপনি রাজী হলে আপনাকে জাহাজে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি। মারিয়া দৃঢ় স্বরে বলল না। আমি এখানেই থাকবো।
-কিন্তু এই লড়াই হাঙ্গামার মধ্যে আপনার কিছু হলে–
–আমার কিছু হবে না?
–বেশ। হ্যারি আর কিছু বলল না। রাজকুমার পিসকোজ বলল–এই লড়াইয়ে আমাদের সাহায্য করুন আমরা চাই।
–নিশ্চয়ই। তবে আপনারা আপনাদের যে রকম যুদ্ধ নীতি সেভাবে লড়াই ছালাবেন। আমরা আমাদের নীতি অনুযায়ী লড়বো। হ্যারি বলল।
–বেশ। পিসকোজ বলল। এবার হ্যারি মেস্তিজোকে বলল-আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। আপনাকে চিকামায় যেতে হবে।
–সে কী করে হয়। রাজকুমারী মারিয়াকে আমি পালাতে সাহায্য করেছি একথা এতক্ষণে রাজা পাকা জেনে গেছে। আমি চিকামায় ঢুকলেই চিমু সৈন্যরা আমাকে বন্দী করবে। রাজা পাকার কাছে নিয়ে যাবে। কী সাংঘাতিক শাস্তি–
–দাঁড়ান দাঁড়ান, শাস্তি এড়ানোর উপায় বার করছি। হ্যারি বলল। তারপর পাথরের মেঝেয় দুএকবার পায়চারি করল। ভাবতে লাগল। একসময় মেস্তিজোকে বলল-আচ্ছা আপনি তো রাজপুরোহিত। পুজো করতে আপনার করতে কী কী লাগে?
–ফুল লতাপাতা তিতিকার হ্রদের পবিত্র জল–ধোঁয়ার জন্যে গাছের শুকনো কয় এ সব!
-তিতিকাকা হদ্রের জল তো শুধু আপনিই আনেন? হ্যারি বলল–
-তাহলে ধরা পড়লে রাজা পাকাকে বলবেন–রাজকুমারী মারিয়া পুজো করতে চেয়েছিলো। তাই তাকে সঙ্গে নিয়ে আপনি তিতিকাকা হ্রদে পবিত্র জল আনতে যাচ্ছিলেন। তখনই আত্মগোপনকারী উনকা সৈন্যরা আমাদের বন্দী করে তাদের আস্তানায় নিয়ে গিয়েছিল। আপনি অনেক কষ্টে পালিয়ে চিকামায় চলে এসেছেন। পারবেন না এসব বলতে?
মেস্তিজো একটু চিন্তা করে বলল–হ্যাঁ তা পারবো।
-এইবার রাজাকে আপনি বলবেন যে দিন কয়েকের মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হবে। সেই যুদ্ধে যাতে রাজা লুপাকা জয়লাভ করতে পারেন তার জন্য আপনি কালকে সন্ধ্যেবেলা পূজার আয়োজন করেছেন। সব চিকামাবাসীরা যেন সেই পূজা উৎসবে অংশগ্রহণ করে। মেস্তিজো হ্যারির পরামর্শটা ভাবতে লাগল। রাজপুত্র পিসকোজ বলল-আপনি পুজোর কথা বলছেন কেন?
হ্যারি বলল–রাজপুত্র কালকে সন্ধ্যেবেলা পুজোর আয়োজন হলে চিকামার অনেক লোক সেই পুজোর উৎসবে অংশ নিতে যাবে। চিমু সৈন্যরাও যাবে। রাজবাড়িতে থাকবে কিছু প্রহরী সৈন্য। আমরা সহজেই তাদের পরাস্ত করতে পারবো। রাজা রানীকে বন্দী করতে পারবো। রাজা রানীকে বন্দী করতে পারলে চিম্ সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যাবে। তারা সহজেই বশ্যতা স্বীকার করবে। চিকামার মানুষজন পুজোর অঙ্গনে থাকবে। অযথা নিরীহ মানুষও এই লড়াইয়ের সময় মারা পড়বে না।
হ্যারির কথাগুলো রাজপুত্র পিসকোজ কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর হেসে ডান হাত বাড়িয়ে বলল–আপনি সত্যই বুদ্ধিমান! হ্যারি হেসে পিসকোজের হাত ধরল।
–তাহলে কাল সকালে আমি চিকামা নগরে যাবো। মেস্তিজো বলল।
পরদিন সকালের খাবার খেয়েই মেস্তিজো চিকামা নগরের দিকে চলল। পথে নিজের গায়ের পঞ্চোর এখানে ওখানে ছিঁড়ে ফেলল। মাথার চুল দাড়ি এলোমেলো করল। ও যা ভয় পেয়েছিল তাই হল। চিমু সৈন্যরা ওকে বন্দী করল। হাত বেঁধে নিয়ে চলল রাজা লুপাকার কাছে। লুপাকা ওকে দেখে তো আগুন। মেস্তিজো
হ্যারির শেখানো মতো সব বলল। দেখা গেল এতে কাজ হয়েছে। রাজা লুপাকা। শুনল সব। এবার মেস্তিজো রাজার যুদ্ধ জয়ের জন্য বিশেষ পুজোর কথা বলল। রাজা লুপাকা খুশি হল। মেস্তিজোকে মুক্তি দিল। মেস্তিজো মুক্তি হল।
মেস্তিজো সারা শহর ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যেবেলা বিশেষ পুজো ও আনন্দোৎসবের কথা ঘোষণা করে বেড়াল।
দেখা গেল সত্যই ঘোষণায় কাজ হয়েছে। সন্ধ্যে হতেই পুজোর প্রাঙ্গনে ভিড় জমে গেল। রাত হতে ভিড় বাড়ল। নাচগান চলল। চিমু সৈন্যরাও দল বেঁধে এল। আনন্দ উৎসবে মেতে গেল।
ওদিকে সন্ধের পরেই তিতিকাকার আস্তানায় লড়াইয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। আত্মগোপনকারী উনকা সৈন্যরা আস্তানার উঠোনে সারি বেধে দাঁড়াল। আস্তানার বাইরে খোলা জায়গায় সশস্ত্র জড়ো হলো। সবার সাখে দাঁড়ালে রাজপুত্র পিসকোজ তার সঙ্গে হ্যারি। রাজপুত্র যাত্রা শুরু করার ইঙ্গিত দিলো। ভাইকিং ও উনকা সৈন্যরা চলল চিকাম নগরীর দিকে। আকাশে মস্ত চাঁদ। তারই ভাঙা ভাঙা আলো পড়েছে তিতিকাকা বনের এখানে ওখানে তাতে অন্ধকার কাটেনি। তারই মধ্যে দিয়ে ভাইকিংরা ও উকা সৈন্যরা চলল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তারা চিকামা নগরীর রাস্তায় এসে উঠল। দেখা গেল পথ জনশূন্য। দোকানপাট বন্ধ। বাড়ির ঘরের আলো নেভানো। প্রায় সকলেই চলে গেছে পুজোর প্রাঙ্গণে। রাজবাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখা গেল চারজন চিম্ সৈন্য উৎসব থেকে ফিরে আসছে। ওরা কাছাকাছি এসে রাজপুত্র পিসকোজ উনকা ও ভাইকিংদের দেখে হকচকিয়ে গেলো। পিছু ফিরে পালাবার চেষ্টা করতেই উনকা সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়লো। চারজনই হার স্বীকার করল। উনকা সৈন্যদের দলপতি ওদের হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাস্তার পাশে রাখলো। এবার পিসকোজের নেতৃত্বে উনকা সৈন্যরা ছুটল রাজবাড়ির দিকে। হ্যারি তাদের একজনকে থামালো। আকারে ইঙ্গিতে জানতে চাইলো কয়েদঘরটা কোথায়? সৈন্যটি ডান হাত তুলে একটা লম্বাটে পাথরের তৈরি ঘর দেখলো। তারপর ছুটল রাজবাড়ির দিকে। হ্যারি তার বন্ধুদের নিয়ে চলল। কয়েদঘরের দিকে। কয়েদঘরের সামনে এসে দেখলো দরজার দুপাশে মশাল জ্বলছে। পাঁচজন চিম্ সৈন্য কয়েঘর পাহারা দিচ্ছে। দরজার কড়ায় একটা বড় তালা ঝুলছে। হ্যারি ভাইকিংরা পাহাদারদের ঘিরে ফেলল। পাহারাদাররা তো হতবাক। ওরা বুঝতেই পারলো না এরা কারা? কোত্থেকে এল? হ্যারি ইঙ্গিতে ওদের অস্ত্র ত্যাগ করতে বলল। ভয়ে ওদের তখন মুখ শুকিয়ে গেছে। ওরা তাড়াতাড়ি হাতের বশা ফেলে দিল। দড়ি দিয়ে ওদের হাত বাঁধা হলো। তারপর দরজার বাইরে বসিয়ে রাখা হলো। পাহারাদার একজনের কোমরে চাবির গোছা ঝুলছিল। হ্যারি এগিয়ে গিয়ে তার গলায় তরোয়ালের ধারালো মাথাটা ঠেকালো। ইঙ্গিতে বলল দরজা খুলে দিতে লোকটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলে একপাশে সরে এলো। হ্যারি কয়েদঘরের মধ্যে ঢুকল চাপাস্বরে ডাকল
ফ্রান্সিস–বিস্কো–শাঙ্কো। ফ্রান্সিস দরজা খোলার শব্দে ভেবেছিল খারার লোকেরা বোধহয় এসেছে। হ্যারি আরেকবার ডাকল ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠল এতে হ্যারির গলা। বিস্কো ঘুমুচ্ছিল, ওর-ও ঘুম ভেঙে গেলো। শাঙ্কোও হ্যারির গলা শুনে চাপাস্বরে বলে উঠলো–
হ্যারি আমরা এখানে, মশালের আলোয় হ্যারি ফ্রান্সিসদের দেখতে পেলো। শুকনো ঘাস ছড়ানো মেঝের ওপর দিয়ে ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। তারপর হ্যারি তরোয়াল দিয়ে হাতের দড়ি কেটে দিলো। বিস্কো আর শাঙ্কোর হাতের দড়িও কেটে দিলো। ফ্রান্সিস বলল-তোমরা তাহলে খবর পেয়েছিলে?
–হ্যাঁ, আমরা তিতিকাকা বনে এসেছিলাম। রাজপুত্র পিসকোজ তার উনকা সৈন্যবাহিনী নিয়ে রাজবাড়ি আক্রমণ করেছে, ওখানে বোধহয় লড়াই চলছে।
–আর সব বন্ধুর? ফ্রান্সিস বলল।
–সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। চলো।
–তার আগে এই কয়েদঘরে যে উনকা সৈন্যরা বন্দী রয়েছে ওদের মুক্ত করতে হবে। ফ্রান্সিস অন্য বন্দীদের দিকে তাকিয়ে বলল। শাঙ্কো নিজের ঢোলা জামার মধ্যে থেকে বড় ছুরিটা বের করল। দ্রুত গিয়ে অন্য বন্দীদের হাত বাঁধা দড়ি কেটে দিল। যুদ্ধ বন্দীরা ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো।
ফ্রান্সিসরা কয়েদঘরের বাইরে এল। পেছনে অন্য সদ্যমুক্ত উনকা সৈন্যরা। ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে এসে ঘিরে দাঁড়াল। মেস্তিজো হেসে এগিয়ে এল। ফ্রান্সিসের হাত ধরল।
–মেস্তিজো-আমাদের তরোয়াল তীর ধনুক কোথায় রাখা হয়েছে? মেস্তিজো বাঁ পাশে একটু দূরে ছোট ঘর দেখিয়ে বলল-ঐ যে অস্ত্রঘর। নিশ্চয়ই ওখানে রেখেছো ফ্রান্সিসরা অস্ত্রঘরের সামনে এল। ঘরটার দরজার সামনে মশাল জ্বলছে। দুজন পাহারাদার বর্শা হাতে অস্ত্রঘর পাহারা দিচ্ছে। অন্ধকার কুঁড়ে খোলা তরোয়াল হাতে ফ্রান্সিসদের আসতে দেখে ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মেস্তিজো একটু দূর থেকে বলল অস্ত্র ত্যাগ কর নইলে মরবে। ওরা দুজন বশা ছুঁড়ে ফেলে অন্ধকার মধ্য দিয়ে পালিয়ে গেল। বিস্কো একটা বশ তুলে দরজার তালা লাগানো লোহার আংটায় বশার মুখ ঢুকিয়ে প্রাণপণ চাড় দিল। কয়েকবার চাড় দিতেই একটা তালাটা খসে পড়ল। দরজা খুলে গেল। ফ্রান্সিস ঢুকল। ঘরটায় মশাল জুলছিল। মশালের আলোয় দেখল একপাশে ওর আর বিস্কোর তরোয়াল দুটো রাখা। পাশে শাঙ্কোর তীর ধনুক। ফ্রান্সিস, বিস্কো ও শাঙ্কো নিজেদের অস্ত্র নিল। সদ্য মুক্তি পাওয়া উনকা সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা বশাগুলোর ওপর। সবাই হাতে হাতে বশ নিল।
বাইরে এল সবাই। হ্যারি বলল-ফ্রান্সিস রাজপুত্র পিসকোজ উনকা সৈন্যদের নিয়ে রাজবাড়ি আক্রমণ করেছে। জানি না এখনো ওখানে লড়াই চলছে কি না।
চলো আমরা রাজবাড়ি যাই। আমরা রাজপুত্র পিসকোজের হয়ে লড়াই করবো। লুপাকা শাঙ্কোকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। একটি তরুণ উনকাকে রাজার আদেশে আমি করুণভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখছি। মেস্তিজোর কাছে শুনেছি রাজা পাকা হত্যা, অত্যাচার, লুণ্ঠন এখানে কীভাবে চালিয়েছিল। কাজেই রাজা লুপাকাকে এসবের শাস্তি পেতে হবে। চলো-প্রয়োজনে আমরা লড়াই করবো। ফ্রান্সিস বন্ধুদের তাকিয়ে এসব কথা বললো। ভাইকিং একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলো–ও-হো-হো। সবাই রাজবাড়ির দিকে চলল।
রাজবাড়ির কাছে পৌঁছে দেখল উনকা সৈন্যরা রাজবাড়ি ঘিরে ফেলেছে। সবাই বশ হাতে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে।
ফ্রান্সিস মেস্তিজো বলল-তুমি রাজবাড়ির মধ্যে যাও কী ঘটেছে বুঝতে পারছি না। সব জেনে এস। আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।
মেস্তিজো দ্রুতপায়ে রাজবাড়িতে ঢুকে পড়ল। সৈন্যরা পথ ছেড়ে দিল। ফ্রান্সিসরা খোলা তরোয়াল হাতে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে মেস্তিজো ছুটতে ছুটতে এল। চিৎকার করে বলতে লাগল-ফ্রান্সিস আমাদের জয় হয়েছে। রাজা লুপাকা ও রানী রাজবাড়ির অন্দরবাড়ির বন্দী। রাজপুত্র পিসকোজ তোমাদের রাজবাড়ির ভেতরে আসতে অনুরোধ করেছে। ফ্রান্সিস ডাকল-হ্যারি?
-বলল।
–কী করবে এখন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল। রাজপুত্র যেতে অনুরোধ করেছে। চলো। হ্যারি বলল।
-বেশ।
মেস্তিজো ওদের পথ দেখিয়ে রাজসভায় নিয়ে এল। ফ্রান্সিসরা দেখল সিংহাসন শূন্য। একটা সাধারণ পাথরের আসনে রাজপুত্র পিসকোজ বসে আছে। ফ্রান্সিসরা কাছে আসতে পিসকোজ ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে এল। হেসে ফ্রান্সিসের ডান হাত জড়িয়ে ধরল। আমার বিপদে আপনারা সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। আমার পক্ষে যথেষ্ট। লড়াই শেষ হয়নি। পুজোর প্রাঙ্গনে-নগরে নানা জায়গায় চিমু সৈন্যরা ছড়িয়ে আছে। আমরা রাজবাড়ি দখল করেছি। রাজারানী। বন্দী এই সব সংবাদ ওরা ওখানে এখনো পায়নি। আমি আশঙ্কা করছি ওরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সংবাদ পাবে। তখন নিশ্চই রাজারানীকে মুক্ত করতে এখানে আসবে।
তখন লড়াই হবেই রাজপুত্রের কথা শেষ হতে না হতেই উনকা সৈন্যদের দলপতি ছুটে রাজপুত্রের সামনে এসে দাঁড়াল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে গড় গড় করে কী বলে গেল। রাজপুত্র মাথা নিচু করে একটু ভাবল। তারপর দলপতিকে কী যেন আদেশ দিল। মেস্তিজো ফ্রান্সিসকে বলল–ফ্রান্সিস রাজপুত্র যা আশঙ্কা করেছিল তাই হয়েছে। পূজা প্রাঙ্গনে রাজবাড়ি দখল ও রাজারানী বন্দী এ সংবাদ পৌঁছে গেছে। চিমু সৈন্যরা সবাই সেখানে জড়ো হয়েছে ওরা রাজবাড়ির দিকে আসছে। লড়াই হবেই। ওদিকে ফ্রান্সিসরা যখনই মুক্ত হল মেস্তিজো তখনই দুজন উনকা সৈন্যকে পাঠিয়েছিল তিতিকাবনে। ওরা দুটো পাহাড়ী ঘোড়ায় চড়ে গিয়েছিল। তিতিকায় বনের আস্তানায় পৌঁছল ওরা। স্ত্রীলোকদের যে ঘরে মারিয়া থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সেখানে গেল ওরা। মারিয়াকে উনকা ভাষায় ফ্রান্সিসদের মুক্তিলাভের কথা বলল। কিন্তু মারিয়া ওদের উনকা ভাষা কিছুই বুঝল না। স্পেনীয় ভাষা বলতে পারে এমন কেউ সেখানে নেই। তবে সৈন্য দুজন হেসে কথাগুলো বলেছিল। তাতে মারিয়া বুঝল যে সংবাদ শুভ। সৈন্য দুজনের নির্দেশমত মারিয়া একটা ঘোড়ায় উঠল। অন্য ঘোড়াটায় একজন সৈন্য উঠল। সে পথ দেখিয়ে মারিয়াকে মেস্তিজোর নির্দেশমত রাজবাড়িতে নিয়ে এল।
মারিয়া রাজবাড়ির সামনে এসে দেখল চিকামার অধিবাসীদের ভীষণ ভিড় রাজবাড়ির সামনে। সবাই আনন্দে চিৎকার হৈ হল্লা করছে। ঘোড়ায়চড়া মারিয়াকে দেখে ওরা যাওয়ার পথ করে দিল। রাজবাড়ির সদর দেউড়িতে মারিয়া ঘোড়া থেকে নামল। সঙ্গী সৈন্যটি মারিয়াকে রাজসভাগৃহে নিয়ে এল। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা মারিয়াকে দেখে চিৎকার করে উঠল। ও-হো-হো। ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল। মারিয়া ফ্রান্সিসকে দেখল। হাসতে হাসতে ছুটে এসে ফ্রান্সিসের বাঁ হাতটা জড়িয়ে ধরল। সুস্থ মারিয়াকে দেখে ফ্রান্সিসও খুশি। বলল-মারিয়া-লড়াই কিন্তু এখনও শেষ হয় নি। চিমু সৈন্যরা রাজবাড়ি আক্রমণ করতে আসছে। তুমি অন্তঃপুরে যাও। মারিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল-না-অমি তোমাদের সঙ্গেই থাকবো।
–বেশ তবে আমার বন্ধুদের পাশে থাকবে। অন্য কোথাও যাবে না?
–আচ্ছা মারিয়া বলল।
ওরা কথা বলছে তখনই বাইরে থেকে হৈ হল্লা শোনা গেল। পিসকোজ গলা চড়িয়ে বলে উঠল মেস্তিজো নিশ্চয়ই চিমু সৈন্যরা এসে গেছে। আমাদের সৈন্যরা তৈরি তো?
হ্যাঁ-আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। মেস্তিজো বলল-মেস্তিজো রাজপুত্রের সঙ্গে ওর যা কথা হল তা ফ্রান্সিসকে বলল। ফ্রান্সিস এবার রাজপুত্রকে বলল যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলে আমি কয়েকটা কথা বলবো।
–বেশ বলুন?
–দেখুন চিমু সৈন্যরা এসে গেছে। যে কোন মুহূর্তে ওরা আক্রমণ করতে পারে। যাতে আরো মানুষেব মৃত্যু না হয়, রক্তপাত না হয় তার জন্য আমি একবার চেষ্টা করতে চাই। আশা করি আপনি আমাকে সেই সুযোগ দেবেন। রাজপুত্র ভাবল। বলল–কী ভাবে?
–রাজা লুপাকা ও রানীকে তাহলে মুক্তি দিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল?
–অসম্ভব। রাজপুত্র বলল। আমি বলি সম্ভব। আজকে সুযোগ এসেছে চিমু রাজ্য আর মোচিকা রাজ্যের এতদিনের শত্রুতা দূর করার। ফ্রান্সিস বলল।
-কী ভাবে? রাজপুত্র বলল।
অপার মহানুভবতা দিয়ে। শুধু আপনি এইটুকু মহানুভবতা দেখান যে যাকে আপনি অনায়াসে হত্যা করতে পারবেন সেই রাজা লুপাকাকে মুক্তি দিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
কিন্তু এতে কি লড়াই এড়ানো যাবে-দুরাজ্যের শত্রুতা দূর হবে? রাজপুত্র বলল।
সে ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। আপনি শুধু রাজা লুপাকা আর রানীকে মুক্তি দিতে সম্মত হোন। ফ্রান্সিস বলল।
রাজপুত্র একবার মেস্তিজোর দিকে তাকাল। ফ্রান্সিসের কথাগুলো মেস্তিজোর খুব ভালো লাগল। সত্যিই তো। শুধু লড়াই হত্যা রক্তপাত কখনও মানুষের ভালো করতে পারে না। মেস্তিজো উনকা ভাষায় বলল-রাজপুত্র আপনি ফ্রান্সিসকে একটা সুযোগ দিন। হয়তো এতে আমাদের ভালোই হবে। রাজপুত্র ফ্রান্সিসকে বলল-বেশ-রাজা লুপাকা আর রানীকে মুক্তি দেব। কিন্তু সৈন্যরা যদি তারপরেও লড়াই করতে চায়?
তাহলে লড়াই হবে। রাজা লুপাকা আর রানীকে যাবজ্জীবন এখানে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। ফ্রান্সিস বলল বেশ দেখুন চেষ্টা করে। রাজপুত্র বলল।
ওদিকে রাজবাড়ির সামনে তখন চিম্ সৈন্যরা এসে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে। চিৎকার করে বলছে রাজা রানীকে মুক্তি দাও। নইলে চিকামার সবাইকে আমরা মেরে ফেলবো।
ফ্রান্সিস মেস্তিজোকে ডাকল। বলল-তুমি আমার সঙ্গে বাইরে চলো। মেস্তিজো একটু ভয় পেল। ফ্রান্সিস হেসে বলল-ভয় নেই চলে।
ওরা দুজনে বাইরে রাজবাড়ির সদর দেউড়ির কাছে এল। মশালের আলোয় দেখল চিমু সৈন্যরা বশা হাতে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দলপতি হুকুম দিলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ফ্রান্সিস এদিক ওদিক তাকাল। দেখল দেউড়ির পাশে একটা উঁচু পাথরের চৌকোনো চাঁই। ফ্রান্সিস বলল-মেস্তিজো তুমি এই পাথরের চাঁইয়ে উঠে দাঁড়াও। ফ্রান্সিস মেস্তিজোকে পাথরের চাইতে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। মেস্তিজো চিৎকার করে বলল-সবাই শান্ত হও। আমার কথা শোন। চিৎকার চ্যাঁচামেচি বন্ধ হল। এবার নিচে থেকে ফ্রান্সিস যা বলতে লাগল মেস্তিজো উনকা ভাষায় তা চিৎকার করে বলতে লাগল-চিকামার অধিবাসী ভাই বোনেরা একটা লড়াইয়ের মুখোমুখি আমরা এসে দাঁড়িয়েছি। একদিকে চিমু সৈন্যরা তৈরি হয়েছে রাজবাড়ি আক্রমণ করে রাজা লুপাকা ও রানীকে মুক্ত করার জন্যে, অন্যদিকে উনকা সৈন্য আর আমার বীর ভাইকিং বন্ধুরা প্রস্তুত তাদের সঙ্গে লড়াই করবার জন্যে। এই পরিস্থিতিতে আমি চিকামার ভাই বোনদের অনুরোধ করছি তোমরা এখান থেকে যে যার বাড়ি যাও। আমরা চাই না যে নিরীহ চিকামাবাসীরা এই লড়াইয়ের সময় মারা যাক বা আহত হোক মেস্তিজো থামল। চিকামাবাসীদের মধ্যে চাঞ্চল্য জাগল। তারা আস্তে আস্তে সেই জায়গা থেকে চলে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল সাধারণ লোকজন খুব সামান্য রয়েছে। এবার বর্শা উঁচিয়ে দাঁড়ানো সারিবদ্ধ চিমু সৈন্যদের স্পষ্টই দেখা গেল। ফ্রান্সিসের কথা মেস্তিজো আবার চিৎকার করে বলতে লাগল আমার চিমু ভাইয়েরা আমরা এখানে বিদেশী। তবু আমরা চাই যে এই শান্তি পূর্ণ চিকামা নগরে যেন আর লড়াই না হয়। আমি রাজপুত্র পিসকোজকে অনুরোধ করেছি উনি যেন রাজা লুপাকা আর রানীকে মুক্তি দেন। তিনি সম্মত হয়েছেন। রাজা রানী একটু পরেই রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবেন। চিমু সৈন্য ভাইদের অনুরোধ করছি মুক্ত রাজা রানীকে নিয়ে তারা যেন নিজেদের চিমু রাজ্যে ফিরে যায়। অযথা রক্তপাত আমরা চাই না। মেস্তিজো ফ্রান্সিসকে বলল–ওরা বলছে ওরা লড়াই করে রাজা রানীকে মুক্ত করবে। ফ্রান্সিস আবার মেস্তিজো মারফৎ বলতে লাগল–যদি চিমু সৈন্য ভাইয়েরা আমার এই অনুবোধ না রাখো যদি তোমরা লড়াই করতে নামো তাহলে তোমরা কেউ জীবিত অবস্থায় চিমুরাজ্যে ফিরে যেতে পারবে না। আমরা ভাইকিং। লড়াইয়ে যে আমরা হার স্বীকার করতে শিখিনি। এখন ভেবে দেখ তোমরা মৃত্যু চাও না জীবিত অবস্থায় রাজা রানীকে নিয়ে নিজেদের রাজ্যে ফিরে যেতে চাও? মেস্তিজো থামল। চিমু সৈন্যরা এবার চুপ করে রইল। দেখা গেল ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ফ্রান্সিসের কথা আবার মেস্তিজো বলতে লাগল। রাজা লুপাকার আদেশে তোমরা চিকিমাবাসীদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছিলে তা তোমরা ভালো করেই জানো। রাজা লুপাকা নির্মম হৃদয়হীন। তবু রাজপুত্র পিসকোজ তাঁর অন্তরের মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সম্মত হয়েছেন রাজা লুপাকাকে ও রানীকে মুক্তি দিতে। এর পরেও তোমরা কি শান্ত সংযত হবে না? চিমু সৈন্যরা আস্তে আস্তে উদ্যত বর্শা নামাল। ওরা বুঝল এই অবস্থায় লড়াই করতে গেলে ওদের জীবন বিপন্ন হবে। মুক্ত রানীকে নিয়ে ফিরে যাওয়াই এখন বুদ্ধিমানের কাজ। ওদের মনোভাব ফ্রান্সিস বুঝতে পারল। মেস্তিজোকে বলল-অন্দরে যাও। রাজপুত্রকে বলল রাজা লুপাকা আর রানীকে মুক্তি দিতে। মুক্ত রাজা রানীকে নিয়ে চিমু সৈন্যরা নিজেদের রাজ্যে চলে যাক। মেস্তিজো দ্রুতপায়ে রাজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করল। কিছুক্ষণ পরে দুটো ছোট ঘোড়া রাজবাড়ির দেউড়িতে এনে রাখা হল। রাজবাড়ি থেকে প্রথমে রাজপুত্র পিসকোজ বেরিয়ে এল। পেছনে রাজা লুপাকা ও রানী দুজনে এসে ঘোড়া দুটোর সামনে দাঁড়াল। রাজপুত্র তাদের ঘোড়ায় উঠে বসতে সাহায্য করল। রাজারানীকে নিয়ে ঘোড়া দুটো চিমু সৈন্যদের দিকে চলল। তখন ফ্রান্সিস মেস্তিজোর মারফৎ বলল রাজা লুপাকা রাজপুত্র পিসকোজ আপনাদের মুক্তি দিয়ে যে মহানুভবতা দেখালেন আশা করি আপনি তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্মরণে রাখবেন। ভবিষ্যতে আর কোনদিন মোচিকা, রাজ্য আক্রমণ করতে আসবেন না। আপনাদের দুই রাজ্যের মধ্যে শত্রুতা চিরদিনের জন্য দূর হোক-আমরা এই কামনা করছি। রাজা লুপাকা একবার শুধু ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর যেমন মাথা নিচু করে রাজবাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সেভাবেই মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে ঘোড়া চালাতে লাগল। চিমা সৈন্যরা রাজা লুপাকার জয়ধ্বনি দিল। তবে সেই জয়ধ্বনি খুব জোরালো শোনাল না। চিম্ সৈন্যরা দুধারে সার দিয়ে দাঁড়ালো। মাঝখানে রইল ঘোড়ায় চড়া রাজা লুপাকা ও রানী। ওরা আস্তে আস্তে উত্তর মুখো চিমু রাজ্যের দিকে যাত্রা শুরু করল। কিছুক্ষণ উপস্থিত সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইল। রাজা রানীকে নিয়ে চিমু সৈন্যরা কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল।
রাতে রাজবাড়ির অন্দরমহলে খাবার ঘরে ফ্রান্সিসরা খেতে বসল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে স্বর্ণমূর্তির সব কথা বলল। একবার চেষ্টা করে খোঁজ পায়নি তাও বলল। তারপর খেতে খেতে বন্ধুদের উদ্দেশে বলল-ভাইসব-হুঁয়াকা দেবতার স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করতে আমি, বিস্কো আর শাঙ্কো এখানে এসেছিলাম। সেই স্বর্ণমূর্তি এখনও উদ্ধার করতে পারিনি। হিসেবে একটু গরমিল হচ্ছে তাই। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস কয়েকদিনের মধ্যেই আমি সেই স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করতে পারবো। তাই বলছিলাম তোমরা কাল সকালে জাহাজে ফিরে যাও। এখানে আমি হ্যারি আর বিস্কো থাকবো। আমরা কয়েকদিনের মধ্যে কাজ সেরে জাহাজে ফিরে যাবো। ফ্রান্সিস আসতে মারিয়া বলে উঠল-আমিও থাকবো। ফ্রান্সিস হেসে বলল-বেশ তুমিও থাকবে। এমনিতেই ভাইকিং বন্ধুদের মন খারাপ। একটা লড়াই হতে হতে হল না। ওরা আর এখানে থাকতে চাইছিল না। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল-সমুদ্রতীরে আমাদের জাহাজটা অরক্ষিত অবস্থায় আছে। কোন জলদস্যু এসে যদি জাহাজে চুরি করে নিয়ে যায় তাহলে আমরা এই বিদেশে ভীষণ বিপদে পড়বো। কাজেই কাল সকালেই তোমরা জাহাজে ফিরে যাও। ভাইকিং বন্ধুরা কেউ আর কোন আপত্তি করল না। ওরা নিঃশব্দে খেতে লাগল।
সেই রাতে সবাই রাজবাড়িতে অতিথি সমাদরে রইল।
পরদিন সকালে ফ্রান্সিসরা বাদে আর সব ভাইকিংরা সমুদ্রতীরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
ফ্রান্সিস, হ্যারি, মারিয়া, বিস্কো, শাঙ্কোকে নিয়ে পুরোনো আস্তানায় চলে এল। মেস্তিজো ঐ আস্তানাতেই ছিল।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ফ্রান্সিস ভেড়ার চামড়ায় কালি কলম নিয়ে অঙ্ক কষতে বসল। অঙ্ক করে আর কাটাকাটি করে।
মারিয়া ফ্রান্সিসের সেই ভেড়ার চামড়ায় লেখা অঙ্কের সংখ্যা দেখে বলল কী ব্যাপার তুমি কি পড়াশোনা শুরু করলে এই বুড়ো বয়সে? ফ্রান্সিস হেসে বলল-মারিয়া তুমি তো জানো-পড়াশুনার সময়টা কেটেছে আমার বিচিত্র সব অভিযানে।
–কী যে বল ফ্রান্সিস? তোমাদের মতো মানুষ একটা জাতির গর্ব। পড়াশুনো তোমার না হয় নাই হলো। মারিয়া বলল।
–আজকে কিন্তু একটু দুঃখই হচ্ছে। এই দেখ একটা সাধারণ হিসেব মেলাতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে আমাকে দাও। আমি মিলিয়ে দিচ্ছি। মারিয়া বলল।
তখন ফ্রান্সিস মূর্তির কপালে উৎকীর্ণ অঙ্কের সংখ্যা, দাঁতের সংখ্যা, চার-এর পার্থক্য ধরে চার নম্বর দাঁত ভাঙা এবং কিছুই না পাওয়া সমস্ত ব্যাপারটাই বলল। মারিয়া মন দিয়ে শুনল। তারপর চামড়ায় লেখা অঙ্কের সংখ্যাগুলো দেখে বলল–ফ্রান্সিস, তুমি একভাবে হিসেব করেছে। হিসেবটা অন্যভাবেও হয়। তুমি পার্থক্য ধরেছো চার-এর। কিন্তু তিন-এর পার্থক্যটাই বোধ হয় ঠিক।
–তাহলে তিন সংখ্যার দাঁত?
–না। কারণ চার নম্বর দাঁতে নিশ্চয়ই খোঁদল পেয়েছো?
–হ্যাঁ পেয়েছি।
–তাহলে সেই সঙ্গে তিন সংখ্যার দাঁতের খোঁদলটাও কাছাকাছি রয়েছে। তিন সংখ্যার দাঁতে মূর্তি লুকানো থাকলেও নিশ্চয়ই তার সামান্য অংশ হলেও দেখতে পেতে। ফ্রান্সিস তিন সংখ্যা নয়।
–তাহলে? ফ্রান্সিস বেশ সমস্যায় পড়ল?
–আচ্ছা, মুর্তির কপালে আর কোন চিহ্ন ছিল? মারিয়া বলল?
–না।
-কিন্তু আমার মনে হয় অঙ্কের সংখ্যাগুলোর কী ভাবে হিসেব হবে, মানে যোগ হবে না বিয়োগ হবে এরকম কোন ইঙ্গিত ওখানে নিশ্চয়ই আছে। রাজা কোলা নিশ্চয়ই কিছু চিহ্ন রেখেছেন। মারিয়া বলল।
–সেটা তাহলে আর একবার দেখতে হয়। তুমিও চলো। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই চলল হুয়াকার বেদীর উদ্দেশ্যে সেখানে পৌঁছে মেস্তিজো মই বেয়ে উঠতে লাগল। ওর মনে তখনও সংশয়। ভালো করে দেখতে লাগল। অঙ্কগুলো ছাড়িয়ে একটু দেখা গেল অস্পষ্ট একটা চিহ্ন। এই চিহ্নটা উনাদের ভাষায় যোগচিহ্ন। মেস্তিজো অবাক হলো। ও মনে মনে মারিয়ার বুদ্ধির প্রশংসা করল। মই বেয়ে দ্রুতই নেমে এল। ফ্রান্সিসরা সবাই এসে ওকে ঘিরে ধরল। মেস্তিজো মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-রাজকুমারী মারিয়া, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। অঙ্কগুলোর পরে একটা অস্পষ্ট যোগচিহ্ন আছে। মারিয়া খুশির চোটে লাফিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস বলল–কিন্তু মারিয়া এখন করবে কি করে। চামড়া কালি কলম তো আনিনি।
–এই সামান্য হিসেবের জন্যে ওসবের প্রয়োজন নেই। মারিয়া বলল। তারপর হুয়াকা দেবতার বেদীর সিঁড়িতে বসল। একটা লাল পাথরের টুকরো নিল। সব সংখ্যাগুলো লিখল। ফ্রান্সিসরা ওকে ঘিরে দাঁড়াল। মারিয়া সংখ্যাগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল-সব সংখ্যা যোগ করলে হয় চল্লিশ। কিন্তু দাঁতের সংখ্যা ষোল। হবে না। যে সংখ্যার দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে তা ষোলোর কম কোনো সংখ্যা। তারপর মারিয়া সংখ্যাগুলোর দিকে তাকিয়ে নানাভাবে হিসেব করতে লাগল। কিন্তু নিচের সংখ্যা পেল না। ও ভাবল-আচ্ছা যদি প্রত্যেকটি পার্থক্যের সংখ্যাকে যোগ করি। ও বেদীর সিঁড়িতে এইবাবে লিখল
০ – ৪ = ৩
৪ – ৮ = ৩
৮ – ১২ = ৩
১২ – ১৬ = ৩
নিচে টান দিয়ে লিখল–১২
ফ্রান্সিস বলল–তিন সংখ্যা কিভাবে পেলে।
মারিয়া বলল-শূন্য থেকে প্রত্যেকটি সংখ্যা বাদ দিলে পার্থক্য হয় ৩ অঙ্কের। যেমন শূন্য বাদ ১ ২ ৩ = ৩ সংখ্যা তেমনি ৪ বাদ ৫ ৬ ৭ ৩ সংখ্যা। এভাবে পার্থক্যগুলো যোগ করেই পাই–১২ সংখ্যা।
মারিয়া আনন্দে হাততালি দিয়ে ফেলল। চেঁচিয়ে বলল ফ্রান্সিস, বারো সংখ্যার দাঁত।
ফ্রান্সিস ডাকল–মেস্তিজো, হাতুড়ি ছেনি নিয়ে চলো।
দুজনে মই বেয়ে উঠতে লাগল। মূর্তির মুখের কাছে এসে দুজনে দাঁড়াল। বিকেলের সূর্যের লালচে আলো পড়েছে মূর্তিটায়। ওদিকে নিচের প্রাঙ্গণে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। অবাক চোখে দেখছে ফ্রান্সিসদের কাণ্ড। নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করছে। হয়তো মূর্তিটা এভাবে নষ্ট করছে ভিনদেশিরা ওদের পছন্দ নয়।
মেস্তিজো দাঁতের ওপরের পাটি থেকে গুনে বারো সংখ্যার হাতুড়ি ছেনি চালাল। বার কয়েক হাতুড়ি ঠুকে ছেনি চালাতেই দাঁতের সামনের পাথরের আস্তরণ খুলে এল। দেখা গেল। হুয়াকা দেবতার সেই আসল স্বর্ণমূর্তি। খোঁদলে বসানো। অস্তগামী সূর্যের আলো পড়েছে সেই মূর্তির চোখে মুখে গায়ে। ঝিকিয়ে উঠছে মূর্তির গা, দুছোখে নীলকান্ত মণি, মাথায় কারুকাজ করা মুকুট, গায়ে অলঙ্কার। ফ্রান্সিস অবাক হয়ে দেখতে লাগল মূর্তিটা। একটু পরে ফন্সিস বলল মেস্তিজো, আমি বিধর্মী। তোমাদের দেবমূর্তির গায়ে হাত দেব না। তুমি একা মূর্তিটা নিয়ে নামতে পারবে?
–পারবো। কাঁধে নিয়ে নামবো। কথাটা বলে মেস্তিজো প্রথমে স্বর্ণমূর্তির সামনে কিছুক্ষণ মাথা নত করে রইল। মুখে বিড়বিড় করে কী বলল। তারপর মূর্তিটা খোঁদল থেকে বের করে কাঁধে তুলে নিল। এবার নিচে দাঁড়ানো চিকামার অধিবাসীরা মূর্তিটা দেখতে পেল। সবাই নিঃশব্দে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর মাথা নুইয়ে রইল। চারিদিকে এত লোক। কোনো শব্দ নেই কারো মুখে।
প্রথমে ফ্রান্সিস মই থেকে নেমে এল। বিস্কো আর শাঙ্কো ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিস হেসে বলল-কৃতিত্ব আমার নয়,মারিয়ার। ওর অঙ্কের হিসেব ছিল নির্ভুল। মারিয়াও হেসে বলল-কিন্তু সন্ধানের সূত্র তুমিই দিয়েছিলে। সব কৃতিত্ব তোমার। ফ্রান্সিস হাসল। কোনো কথা বলল না।
মেস্তিজো স্বর্ণমূর্তি কাঁধে নিয়ে মই থেকে নামল। ফ্রান্সিসকে বলল-এই মূর্তি নিয়ে কী করবো এখন?
–তোমাদের দেবতা, সেটা তোমাদের ব্যাপার। আমার কাজ ছিল মূর্তি উদ্ধার, তা আমি করে দিয়েছি। এখন আমরা জাহাজে ফিরে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।
স্বর্ণমূর্তিটা তোমরাই নিয়ে যাও না। রাজা লুপাকার হাতে পড়লে ও হয় মূর্তিটা গলিয়ে ফেলবে নয় তো নিজেদের রাজ্যে নিয়ে যাবে। মেস্তিজো বলল।
ফ্রান্সিস হেসে মাথা নেড়ে বলল-স্বর্ণমূর্তির ওপর আমাদের কোনো লোভ নেই। তোমাদের উপাস্য দেবতার মূর্তি। তোমাদেরই থাকবে। এদিকে আসল স্বর্ণমূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে এই সংবাদ যুবরাজ পসকোজের কাছে পৌঁছল। যুবরাজ ঘোড়ায় চেপে এল। আসল স্বর্ণমূর্তি দেখে যুবরাজ খুশিতে ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। বারবার বলতে লাগল আপনার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ রইলাম।
–ও কথা বলবেন না ফ্রান্সিস বলল-মানুষ হিসেবে আমি আমার কর্তব্য করেছি মাত্র।
যুবরাজ এবার আমাদের যাবার অনুমতি দিন। আমরা দেশে ফিরবো?
–সে কী করে হয় ফ্রান্সিস। আগামী পূর্ণিমা পাঁচদিন পরে। সেদিন আমার রাজ্যাভিষেক হবে। সেই আনন্দ উৎসবে আপনারা থাকবেন না তা কি হয়?
রাজপুত্র বলল।
উপায় নেই যুবরাজ, আমরা অনেকদিন দেশ ছাড়া। আমরা কালকেই দেশের দিকে যাত্রা করবো। রাজপুত্র চুপ করে রইল। কী বলবে আর।
ফ্রান্সিস এবার মেস্তিজোর দিতে তাকাল। বলল–মেস্তিজো, মূর্তি বেদীতে রেখে তুমি চলো আমাদের পথ দেখিয়ে সমুদ্রতীরে নিয়ে যাবে।
মেস্তিজো স্বর্ণমূর্তিটা কাঁধে নিয়ে বেদীতে উঠল। কাঠের মূর্তির পাশে রাখল। মাথা নুইয়ে ভক্তি জানিয়ে নেমে এল। ততক্ষণে মন্দির প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া উনকারা আনন্দে নাচানাচি শুরু করেছে। রাজা লুপাকাও খুশি।
সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল মেত্তিজো। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ফ্রান্সিসরা দেখল চিকামাবাসীরা দলে দলে হুয়াকা দেবতার মন্দির প্রাঙ্গণের দিকে চলেছে। হাতে তাদের ফুলপাতা। আনন্দে হাসছে ওরা। এতদিন পরে আসল স্বর্ণমূর্তি পাওয়া গেছে। ফ্রান্সিস এই ভেবে খুশি হলো এতগুলো মানুষের মুখে ও হাসি ফোঁটাতে পেরেছে।
মরুভূমির পথ নয়। অন্য পাহাড়ী পথে মেস্তিজো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওদের সমুদ্র তীরে পৌঁছে দিল। জাহাজে উঠতে উঠতে ফ্রান্সিস ডাকল–মারিয়া।
–বলো?
–এবারও আমাদের হাত শূন্য। ফ্রান্সিস বলল?
–তা হোক। এজন্য আমার মনে কোনো দুঃখ নেই, মারিয়া বলল।
-সমাপ্ত-
Leave a Reply