কুয়াশা ৬ (ভলিউম ২)
০১.
মানিকপুরের বিখ্যাত ধনপতি চৌধুরী আলী নকীব রহস্যজনক ভাবে এক সংবর্ধনা সভায় অদৃশ্য আততায়ীর হাতে খুন হন। ঘটনাচক্রে শহীদ খান সেখানে উপস্থিত ছিলো। অন্ধকার কক্ষে চৌধুরী আলী নকীব যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় আর্ত চিৎকার করছিলেন তখন শহীদ একটা ছায়ামূর্তিকে ছুটে পালাতে দেখে। সে ছায়ামূর্তি আর কেউ নয়, কুয়াশা। শহীদ খান কুয়াশাকে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। কিন্তু খুনী কুয়াশার যতো প্রতিভাই থাকুক, তাকে সে ক্ষমা করতে পারে না। চৌধুরী আলী নকীবের হত্যা রহস্য ভেদ করার ভার পড়ে শহীদ খান ও কামালের উপর। শহীদের নির্দেশে সুলতানা পারভিনের প্রথম স্বামী তৈমুর মীর্ধার ব্যাপারে তদন্তের জন্য কামাল পশ্চিম পাকিস্তানে গেল। তদন্ত শেষে তার ডাক পড়লো মানিকপুরে। মানিকপুরে হাসান মওলা নামে কে একজন তৈমুর মীর্ধার বন্ধু বলে পরিচয় দিয়ে গোপনে টাকা বাগাতে চেষ্টা করছে সুলতানা পারভিনের ভাই মাহমুদের কাছ থেকে। কামাল বুঝলো হাসান মওলাই হচ্ছে মানিকপুর হত্যা রহস্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাকে ধরতে পারলেই সব রহস্যের সমাধান হয়। মানিকপুর এসে হোটেল তাজে উঠলো কামাল। হাসান মওলা হোটেল তাজেই আস্তানা গেড়েছে। হোটেল তাজে পৌঁছেই সে ম্যানেজার আইনুল হকের কাছে হাসান। মওলার খোঁজ করলো। আইনুল হক জানালো অল্প কিছুক্ষণ আগে হাসান মওলাকে তার। ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কামাল চমকে উঠলো। তার সব তরসা নিরর্থক মনে হলো। হাসান মওলার ঘরে থানার ও. সি. মি. শিকদারের সঙ্গে দেখা হলো। হাসান মওলার ঘর সার্চ করে, এম মনোগ্রাম করা একটা সিগারেট লাইটার ও একটা সদ্য ছেঁড়া গোলাপ ফুল পাওয়া গেল। সারা হোটেল ভয়ে, আশঙ্কায় থম থম্ করছে। ঠিক এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো এক আগন্তুক। প্রৌঢ় ব্যক্তি। মৃত হাসান মওলাকে দেখে সে ভয়ে, বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলো। বললো, আরে, এই যে দেখছি তৈমুর মীর্ধা!
কামাল অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে। পরনে কালো সার্জের স্যুট, মাথায় জিন্নাহ টুপি। বয়স ষাটের কম হবে না। শরীর স্থূলকায়। চোখ হিংস্র শ্বাপদের মতো জ্বলছে।
আমি বলছি এই লোকটা তৈমুর মীর্ধা। হাসান মওলা আপনারা কাকে বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।
দারোগা শমসের শিকদার বললো, যাকে আপনি তৈমুর মীর্ধা বলছেন তাকেই আমরা হাসান মওলা বলে চিনি। লোকটা নিজেই ঐ নামে এসে হোটেলে উঠেছে।
আগন্তুক বৃদ্ধ বললো, দেখুন, তা হতে পারে। বিশেষ কারণে হয়তো নাম পাল্টাবার দরকার পড়েছিল।
কামাল বললো, তৈমুর মীর্ধা আপনার কে হতো?
বন্ধু। আমরা এক সঙ্গে অনেকদিন এক জায়গায় ছিলাম। পরে তৈমুর মীর্ধা গেল নিরুদ্দেশ হয়ে, আর আমি…
লোকটা কথা শেষ না করে হাসলো। কামালের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার আবার হিস্ত্রী আছে। ধৈর্য ধরুন, আমি সব খুলে বলছি।
শমসের শিকদার বললো, হ্যাঁ, সব কথা তো বলতেই হবে। হিস্ত্রী বলার আগে আপনার নামটা বলুন।
আমার নাম বদরুদ্দিন হোসেন, মেজর বদরুদ্দিন হোসেন। ইণ্ডিয়ান আর্মির বি কোম্পানির মেজর ছিলাম আমি। বছর পাঁচ-ছয় হলো রিটায়ার করেছি। তৈমুর মীর্ধার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় লাহোরে, নাম শুনে কামাল বিস্মিত হলো। শহীদের কাছে নামটা ইতিপূর্বে সে শুনেছে। শহীদের বর্ণনা সত্যি হলে মেজর বদরুদ্দিন একজন ছাপোষা নিরীহ ভদ্রলোক। তার পেনসনের টাকা জুয়াচুরি করে মেরে দিয়েছিল পুরানো দোস্ত লেঃ কর্নেল আনসারী। এই নিয়ে মেজরের দুঃখ আর ক্ষোভের অন্ত নেই। প্রায়ই আনসারীকে মারধোর করার প্ল্যান আঁটে মেজর এবং শেষ পর্যন্ত তাকে মাপ করে দিয়ে ক্লাব থেকে বাড়ি ফেরে। এহেন মেজর বদরুদ্দিন হঠাৎ মানিকপুরে কেন?
শমসের শিকদার মেজর বদরুদ্দিনের জবানবন্দী নোট করে নিতে লাগলো আর কামাল ভাবতে লাগলো শহীদের কথা। হাসান মওলার মৃতদেহের কাছে মেজর বদরুদ্দিনের রহস্যময় উপস্থিতির কথা শহীদের জানা দরকার।
কিন্তু এই রাতে বুরুজ মিঞাকে কি খোঁজ করে পাওয়া যাবে? কামাল ঘড়ির দিকে তাকায়। তখন রাত আটটা। ঘরের মেঝেয় রক্তাক্ত দেহে পড়ে আছে হাসান মওলা। মাহমুদকে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করতে মানিকপুর এসেছিল হাসান মওলা। তার এই পরিণতি হবে কে জানতো? হাসান মওলাকে কে খুন করতে পারে? মাহমুদ? তাহলে কি আগন্তুক বৃদ্ধের কথাই সত্যি? হাসান মওলা তাহলে তৈমুর মীর্ধা? না, সবটা ব্যাপার গুলিয়ে যাচ্ছে। শহীদকে সব কথা বলা দরকার।।
.
০২.
ঘন্টা দুয়েক পরে হোটেল থেকে বেরোতে পারলো কামাল। শমসের শিকদার সকলের জবানবন্দী নিয়ে লাশসহ থানায় চলে গেছে। মেজর বদরুদ্দিনকে নতুন নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত হোটেল তাজে অবস্থান করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। মেজর বদরুদ্দিন সানন্দে রাজি হয়েছেন। কামালের ঘরের দক্ষিণহাতি বারান্দা পার হলেই মেজর বদরুদ্দিনের ঘর। জবানবন্দী নেয়ার ঝামেলা চুকে যাবার পর কামাল রাতের খাবার খেয়ে নিলো। ম্যানেজার আইনুল হককে ঘুম আসছে না একটু পায়চারি করে
আসি, বলে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। বুরুজ আলী ঠিক কোথায় থাকে তা সে জানে না। তবে শহীদ যা বর্ণনা দিয়েছিল তাতে জায়গাটা চিনতে হয়তো অসুবিধা। হবে না। দেখা যাক।
কামাল রাস্তায় নেমে হাসপাতালের দিকে হাঁটতে লাগলো।
রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। সন্ধ্যার দিকে বাতাস ছিলো মিষ্টি আর উষ্ণ। যতো রাত বাড়ছে ততো শীত নামছে বাতাসে। চারিদিক নির্জন, নিস্তব্ধ। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ী মাটির গন্ধ পেলো কামাল। জঙ্গলের ভিতর একটা তক্ষক সাপের ডাক শোনা গেল।
রাস্তায় লোকজন নেই। দুপাশে নিম বাড়িঘর। মাথার ওপর আকাশ। তারা মিট মিট করছে। বহুদূরে একটা আগুনের শিখা জ্বলছে লকলকে জিহ্বার মতো। কামাল বুঝলো বুনো পাহাড়ী লোকেরা আগুন দিয়ে জঙ্গল সাফ করছে।
কামাল একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ একপাশে তাকিয়ে তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। দেখলো একটা জটাধারী প্রকাণ্ড লোক দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। কামালের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
রিভলভারটা ট্রাউজারের পকেট থেকে বের করে আনতে এক মুহূর্ত লাগলো কামালের। সে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো উত্তেজনায়, কে ওখানে?
লোকটা হঠাৎ ঘুরেই দৌড় দিলো জঙ্গলের ভিতর। হতবাক কামাল না পারলে গুলি চালাতে, না পরলো লোকটার পিছু নিতে। সে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তক্ষক সাপটা আবার ডেকে উঠলো কাছেই কোনো গাছের গুঁড়ি থেকে।
মানিকপুরের রহস্যময় নাটকের নতুন অধ্যায় তাহলে শুরু হয়ে গেছে? কামাল সতর্কভাবে চারিদিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো, প্রথমে হল-ভর্তি অভ্যর্থনা সভায় অদ্ভুত ভাবে খুন করা হলো চৌধুরী আলী নকীবকে। এর কিছুদিন পর সুলতানা পারভিনের প্রথম স্বামী তৈমুর মীর্ধাকে খুঁজে দেবার কন্ট্রাক্ট নিয়ে শহীদের কাছে গেলেন বেগম রশিদ। নাটকের তৃতীয় অঙ্কে রহস্যজনক ভাবে মানিকপুরে আবির্ভাব ঘটলো হাসান মওলার। তাকে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করলো কে বা কারা, আর এই খুনের বিস্ময় কাটতে না কাটতে মঞ্চে উপস্থিত হলেন মেজর বদরুদ্দিন। তিনি জানালেন হাসান মওলা আর কেউ নয় স্বয়ং তৈমুর মীর্ধ। মানিকপুর হত্যারহস্যের নাটক এখন নতুন অঙ্কে প্রবেশ করেছে। এখন পদে পদে আততায়ীর ভয়। হত্যার আশঙ্কা। হুমকি।
কামাল রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ালো। বড় রাস্তা থেকে একটা ছোটো পথ ধরে। কিছুদূর এগোলেই হাসপাতাল। বুরুজ মিঞা এখানেই কিছুক্ষণ আগে নেমে গিয়েছিল। সে সরু পথটা ধরে এগোলো। এদিকে বাড়িঘর প্রায় নেই। চারদিকে শিশু, মহুয়া আর গজারী গাছ। হাওয়া ঢেউয়ের মতো কল কল করছে। চারপাশে ফিসফিস শব্দ। একটা কালো পেচা পাখা ঝাপ্টে হঠাৎ উড়ে গেল এক গাছ থেকে অন্য গাছে। জঙ্গলের ঘন ছায়ার ভিতর দিয়ে বহুদূরের একটা আলো দেখা গেল।
কামাল বুঝলো ওটাই হাসপাতাল। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে সে সামনে এগোতে লাগলো। জটাধারী লোকটা কে হতে পারে? সে ভাবলো। পাগল, না মানিকপুর রহস্যের কোনো একটা নতুন গুটি?।
আলো লক্ষ্য করে যাচ্ছিলো কামাল। কিছুদূর যাবার পর কোথাও আর আলোটা দেখা গেল না। চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। কামাল বুঝলো সামনের সারি সারি একতলা বাড়িগুলি হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টার। পার হলে একটা খেলার মাঠ আছে। সেই মাঠের অপর পারে হাসপাতাল। বুরুজ মিঞা স্টাফ কোয়ার্টারের কেরানী জহিরউদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। দিনের বেলায় মানিকপুর বাজারে তারের। বেহালা বিক্রি করে। রাতেরবেলা জহিউদ্দিনের বাড়িতে এসে ঘুমায়। জহিরউদ্দিনের বাসা কোনটা এখন জানা দরকার।
কামাল অন্ধকার শাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কি করবে ভাবছিল, এই সময় গাছের উপর কি একটা শব্দ হলো। কামাল বিদ্যুৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। গাছের উপর থেকে গম্ভীর গলায় শহীদ বললো, গুলি করিস না কামাল। মহুয়া বিধবা হয়ে যাবে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কামাল। পরিহাসের গলায় বলে, গাছের উপর কি করছিস শহীদ?
তারের বেহালা বিক্রি করছি। কেমন হলো? শহীদ নেমে আসে গাছের উপর থেকে। বলে, তোকে প্রথমটা চিনতে কষ্ট হচ্ছিলো। ঠ্যাং কাঁপছে দেখে বুঝলাম লোকটা তুই।
বাজে বকবি না বলে রাখলাম। ঠ্যাং কাঁপছে তুই অন্ধকারে বুঝলি কি করে?
কামাল রাগ দেখায়। শহীদ হেসে বলে, কপাল জোরে বেঁচে গেছিস। আমার হাতেও পিস্তল ছিলো। চিনতে ভুল করলেই হয়েছিল আর কি! যাক গে…আসল কথা বল্। রাতেরবেলা হোটেল ছেড়ে এসেছিস কেন?
কামাল হাসান মওলার খুন এবং মেজর বদরুদ্দিনের আবির্ভারের কথা খুলে বললো। শুনে গম্ভীর হয়ে গেল শহীদ। বললো, হু…
কামাল বলে, আমার মনে হয়, মেজর বদরুদ্দিনের কথাই ঠিক। লোকটা হাসান মওলা নয়, তৈমুর মীর্ধা।
শহীদ বলে, কিন্তু তুই যে বলছিলি তৈমুর মীর্ধা মৃত?
কামাল বলে, পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে তৈমুর মীর্ধার সম্পর্কে যে তদন্ত চালিয়ে ছিলাম তাতে তৈমুর মীর্ধাকে মৃত না বলে উপায় নেই। ডেথ রেজিস্টারে তৈমুর মীর্ধার মৃত্যুর কথা স্পষ্ট ভাবে লেখা আছে।
তাহলে?
আমার মনে হয় তৈমুর মীর্ধা নিজেকে মৃত বলে প্রমাণ করেছিল। নিজেকে মৃত বলে প্রমাণ করতে যাওয়ার পিছনে একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে এবং সেটাই আমাদের বের করতে হবে।
শহীদ কিছু বললো না। কয়েক মুহূর্ত শুধু নিগ্ন হয়ে রইলো। কামাল বললো, ব্যাপারটা তোকে জানাবার জরুরী প্রয়োজন বোধ করেছিলাম। তাই হোটেল থেকে বেরিয়ে এসেছি তোর খোঁজে। তুই গাছের উপর উ কি করছিলি?
শহীদ বলল, কুয়াশা।
কুয়াশা? কোথায়?
শহীদ হাসলো। বললো, আয় আমার সঙ্গে। কুয়াশা ঠিক কোথায় বাস করে তার হদিস আমি এখনো জানি না। শিগগিরই জানতে পারবো।
দুই বন্ধু নিঃশব্দে এগোতে লাগলো। শাল আর মহুয়ার স্বল্প পরিসর জঙ্গল পার হয়ে পড়লো রাস্তা। ঝোঁপের ভিতর থেকে শহীদ টেনে বের করলো একটা বাইসাইকেল। …
কামালকে বললো, তুই পেছনে উঠ।
পাতাবাহার রোড ধরে নির্জন রাস্তায় বাইকটা এগিয়ে চললো। সামনেই হোটেল তাজ। ওরা রাজা সাহেবের মাঠের দিকে একটা ছোটো পথ ধরলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই খোয়া ওঠা ইটের পথ ছেড়ে তারা পড়লো ঘাসে ছাওয়া বন্ধুর মাঠে। যতদূর চোখ যায়। আবছা অন্ধকার। মাঠের দিগন্তে নেমে এসেছে তারা জ্বলা আকাশ। বিরাট মাঠের বুকে থম থম করছে হাজার হাজার বছরের নির্জনতা। যতদূর চোখ যায় আবছা অন্ধকার। খোলা হাওয়া বইছে।
কামাল বললো, কোথায় যাচ্ছিস রে?
শহীদ হাসলো শুধু। জবাব দিলো না।
অনেকদূর যাওয়ার পর দেখা গেল একটা বুক সমান উঁচু মাটির টিলা। আশেপাশে হোগলা আর কাঁটামেদির জঙ্গল। ঝি ঝি পোকা ডাকছে। কোথাও জল পড়ার শব্দ শোনা গেল।
টিলার কাছে থামলো শহীদ। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। বেশ খানিকটা দূরে ভোজবাজির মতো জ্বলে উঠলো একটা আলো। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো একটা কালোছায়া। আলোর মশাল হাতে নিয়ে কালোছায়াটা এক পা দুপা করে এগোতে লাগলো পীরগঞ্জের দিকে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল কামালের। সে বিস্ফারিত চোখে অন্ধকারে ঢাকা কুয়াশার মুর্তিটা দেখতে লাগলো। তার চোখ সন্দেহে ভরে উঠলো। ফিসফিস করে বললো, শহীদ, এ কিছুতেই কুয়াশা হতে পারে না।
কেন?
কুয়াশার পা তো খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। আর এজন্যে আমরাই দায়ী। এই লোকটা দিব্যি সটান পায়ে হাঁটছে, এ কিছুতেই কুয়াশা হতে পারে না।
শহীদ বললো, প্রথমে আমারও তাই মনে হয়েছিল। আমার ভুল ভেঙে গেছে। সামনের ঐ মশালধারী মূর্তিটা যে কুয়াশা তা একটু পরে তুই-ও বুঝতে পারবি।
শহীদের ইঙ্গিত কিছুই বুঝলো না কামাল। সে বললো, আলো হাতে করে লোকটা কোথায় যায়?
জানি না।
রোজ রাতে এরকম হয়?
প্রায়ই হয়। আমি হাসপাতালের কাছে কড়ই গাছটার মগডালে এজন্যেই উঠেছিলাম কামাল। গাছের উপর থেকে ছায়ামূর্তিটা দেখা যায় না। আলোটা স্পষ্ট দেখা যায়। প্রায় রোজ রাতেই দেখি আলোটা সামনের ঐ ঢিবি থেকে মাটি ফুড়ে বেরোয় কিছুদূর পীরগঞ্জের টিলার দিকে এগোয়। কিছুদূর যাবার পর নিভে যায়। এ এক দারুণ রহস্য। হয়তো এই রহস্য উদ্ধার করতে পারলেই মানিকপুর হত্যারহস্য ভেদ করা যাবে।
কিন্তু লোকটা যে কুয়াশা তা কি করে জালি? এমনও তো হতে পারে….
কামালের কথা মাঝ পথে থাকতেই বাতিটা হঠাৎ নিভে গেল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাতের নির্জনতা ভেদ করে বাতাসে বেজে উঠলো সরোদের গম্ভীর সুর।
কামাল অস্কুট গলায় বললো, কুয়াশা।
শহীদ হাসলো শুধু। বললো, কুয়াশাই মানিকপুরে আমাকে টেনে এনেছে কামাল। কুয়াশার আইন-বিরোধী জীবন আমি খতম করতে চাই। কুয়াশাকে আমি ভালবাসি। শ্রদ্ধা করি। একটা প্রতিভা এইভাবে নষ্ট হচ্ছে দেখে দুঃখ পাই। কিন্তু, কামাল, কর্তব্যবোধ এই ভালবাসা আর শ্রদ্ধার অনেক ঊর্ধ্বে। কুয়াশাকে আমি ছাড়বো না।
কামালের হাত চলে গিয়েছিল পকেটে সুকানো রিভলভারটার দিকে। শহীদ বললো, কুয়াশাকে এভাবে ধরার চেষ্টা নিরেট বোকামী হবে কামাল। চল এবার ফিরি
কামাল বললো, কিন্তু…
শহীদ হাসলো। বললো, কাছে পেয়েও কুয়াশাকে ছেড়ে দিলাম কেন? এ ধারণার বশবর্তী হয়ে প্রথম রাতে আমিও কুয়াশার পিছনে ধাওয়া করেছিলাম। পিস্তল ছুঁড়েছিলাম। কুয়াশাকে ধরতে পারিনি। কুয়াশা ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গিয়েছিল।
সে ঘটনার কথা ভাবলে এখনো লজ্জা পাই।
সাইকেলটা রাজা সাহেবের মাঠ ধরে এগোতে লাগলো হোটেল তাজের দিকে। হোটেল তাজের কাছে এসে কামাল চলে গেল হোটেলের দিকে আর শহীদ এগিয়ে চললো সামনে।
তখন রাত দুটো।
.
০৩.
পরদিন সকাল দশটায় হোটেলে বুরুজ মিঞার আবির্ভাব ঘটলো। হোটেলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সে একটা পুরানো হিন্দী গানের গৎ বাজাচ্ছিল। এই সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো মতিন। বললো, বুরুজ মিঞা, আমাকে বাজনা শিখিয়ে দিতে পারবে?
আহা ঢং দেখে আর বাঁচি না ঘটনাস্থলে এসে হাজির হয় মুন্সিজী। সে একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে মতিনের উদ্দেশ্যে সে বলে, পেটে ভাত জোটে না শালা পিয়ন কাহেকা, তিনি বাজনা শিখবেন?
শিখবো।
মতিন গম্ভীর চালে বলে, আমার সখ হয়েছে আমি শিখবো। তোমার তাতে কি হে বাপ?
আমি ম্যানেজার সাহেবকে বলে দেবো।
ম্যানেজার সাহেবকে আমি নিজেই বলবো।
বটে?
দ্বিতীয় কিস্তি দাঁত খিঁচুনী লাগায় মুন্সি। চারদিক একবার ভালো করে তাকিয়ে বলে, বলি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া হচ্ছে? জানিস আমি তোর বস।
মতিন মাটিতে থুথু ফেলে। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে, এই শালা মুন্সি, তুই আমার কচু।
মুন্সি বুঝলো তার চালে একটু ভুল হয়ে গেছে। বস কথাটা বলা ঠিক হয়নি। নিজের পজিশন রাখার জন্যে সে তারিক্কিরকমের একটা গলাকাশি দিলো। বললো, তুই আমার কাছে মাপ চা কইলাম মতিন!
মতিন বেশ খেপে গেছে। সে বললো, তোমার পাছায় গুণে গুণে তিনটা লাথি লাগাবো শালা বেঈমান…
কি হচ্ছে শুনি?
বলতে বলতে আইনুল হক ও কামাল সেখানে উপস্থিত হয়। কথাটা আইনুল হকের। তাকে দেখে এবং তার কথা শুনে মতিন, মুন্সিজী দুজনেই পানি হয়ে যায়। মুন্সিজী বলে, ইয়ে স্যার, বুরুজ মিঞা…
আইনুল হক এদের ঝগড়া শুনেছিল। ধমক দিয়ে বললো, কোনো কথা শুনতে চাই না। তোমরা তোমাদের কাজে যাও।
মতিন, মুন্সিজী দুজনেই মাথা নিচু করে চলে যায়।
আইনুল হক বুরুজ মিঞার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কি চাও?
বেহালা বেচতে এসেছিলাম স্যার। আপনাদের বেয়ারা মতিন মিঞা বলছিল সে বেহালা কিনবে। তা মতিন মিঞা যখন কিনলো না তখন আমি চলি স্যার। আদাব স্যার
দাঁড়াও হে, কামাল কৌতূহলী ভাব দেখিয়ে বললো, আমি একটা বেহালা কিনবো। কতো দাম একটা বেহালার।
দাম তো স্যার লাখ টাকা। এক লক্ষ এক টাকা মাত্র।
বুরুজ মিঞা দাঁত বের করে হাসলো। বরুজ মিঞার কাছ থেকে নিলে দাম একটু কম পড়বে। আট আনা পিস।
তুমি দেখছি বেশ রসিক লোক।
কামাল হাসলো। বললো, ভালো দেখে একটা বেহালা দাও। এই যে পয়সা
পয়সা ট্যাকে গুঁজে রেখে একটা ৰেহালা বের করে কামালের হাতে দিলো বুরুজ মিঞা। বললো, খুব ভালো দেখেই দিলাম স্যার। মাথার দিকটা যুরালেই যন্ত্রটা টান হবে। আচ্ছা, আদাব স্যার, চলি।
বুরুজ মিঞা চলে গেল। বেহালা হাতে আইনুল হকের সাথে হোটেলের চারদিক ঘুরে বেড়ালো কামাল। ঘুরে ঘুরে কামালকে সব দেখালো আইনুল হক। বকবক করার দোষ তার আছে। কথা একবার শুরু করলে শেষ করার নাম নেই। অতি কষ্টে তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে ঘরে এলো কামাল। দরজা বন্ধ করে বেহালার মাথাটা খুললো। বেরিয়ে এলো দুটুকরো কাগজ। একটা কাগজে লেখাঃ শাহের বানু, মাতৃসদন, ঢাকা।
আর একটা কাগজের টুকরোয় শহীদ লিখেছে, আমি আজ রাতে ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। বুরুজ মিঞার কাজ শেষ। এইবার শহীদ খানের প্রবেশ লাভ ঘটবে মঞ্চে। চৌধুরী আলী নকিবের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমার যে ভুল ধারণা হয়েছিল তা এখন আর নেই। মানিকপুরে এসে সব রহসাই অবগত হয়েছি। শুধু কুয়াশা আর শাহের বানুর রহস্য ভেদ করতে পারলাম না। শাহের বানুর ঠিকানা লেখা এই কাগজটা আমি পেয়েছি চৌধুরী আলী নকিবের বাড়িতে, মাহমুদের দেরাজে। হ্যাঁ, রাতে চুরি করে মাহমুদের ঘরে ঢুকেছিলাম। যাহোক, আজ রাতে আমি চলে যাচ্ছি। কখন আবার মানিকপুরে ফিরছি তা যথাসময় জানতে পারবি। তুই মেজর বদরুদ্দিন আর মাহমুদের উপর লক্ষ্য রাখিস। এক কাজ করতে পারিস। বেগম রশিদকে দিয়ে একটা পাটির ব্যবস্থা কর তাঁর বাড়িতে। মেজর বদরুদ্দিন আর মাহমুদকে দাওয়াত দে। সামনাসামনি এরা একে অন্যের উপর কি ভাব পোষণ করে তা লক্ষ্য কর।
কামাল, কুয়াশা এখনো রহস্যময় হয়ে রইলো। কিন্তু শহীদ খান পরাজয় স্বীকার করেনি আজ পর্যন্ত। ওকে আমি ধরবই। তুই সাবধান থাকিস। শেষ বারের মতো বলছি। মেজর বদরুদ্দিনের উপর কড়া নজর দিস। মেজর বদরুদ্দিন এখন মানিকপুর হত্যা রহস্যের সবচে বড় গুটি।
ইতি
শহীদ
.
০৪.
বেগম রশিদের চিঠি পড়া মাত্র শেষ করছে কামাল, নাটকীয় ভাবে ঘরে ঢুকলো মেজর বদরুদ্দিন।
ডিসটার্ব করলাম বোধহয়। মেজর বদরুদ্দিন বিনীতভাবে বলে, নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছেন এখন।
না, না..এমন কিছু ব্যস্ত নয়। একটা চিঠি পড়ছিলাম। সন্ধ্যাবেলা রশিদ সাহেবের বাড়িতে চা পানের দাওয়াত।
আরে আমারও তো সেই ব্যাপার। একটু আগে লোক মারফত দাওয়াতের চিঠি পেয়েছি। আপনি নিশ্চয়ই ভদ্রলোককে চেনেন?
জ্বি হ্যাঁ।
আমি চিনি না।
হাঃ হাঃ করে হাসে মেজর বদরুদ্দিন, দাওয়াত পেয়ে আমি তো দারুণ অবাক হয়ে গেছি সায়েব। চিনি না, জানি না, দাওয়াত …একি কাণ্ড। তা আপনি কখন যাচ্ছেন?
পাঁচটার দিকে।
আমি ভাবছি আপনার সঙ্গে যাবো। অবশ্য আপনার যদি অসুবিধে না হয়…
কিছুমাত্র অসুবিধে নেই। চলুন, তাহলে একই সঙ্গে যাওয়া যাবে।
বিকেল পাঁচটায় হোটেল থেকে এক সঙ্গে বেরোলো কামাল আর মেজর বদরুদ্দিন। মেজর বদরুদ্দিনকে কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগছে। পরনে সার্জের স্যুট। মাথায় জিন্নাহ টুপি।
পথে নেমে মেজর বদরুদ্দিন কি একটা প্রসঙ্গ ধরে ক্যাম্প জীবনের গল্প বলতে শুরু করেছে। কথায় কথায় উঠলো তৈমুর মীর্ধার কথা। মেজর বদরুদ্দিন বলে, তৈমুরের মতো এমন দিল দরিয়া মানুষ আমি খুব কম দেখেছি কামাল সাহেব। দোষের মধ্যে একটু খেয়ালী ছিলো এই যা। ভালো কথা, তৈমুর মীধর পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট কি পাওয়া গেছে?
দু একদিনে মধ্যে পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে।
আরো দুএকদিন? বলেন কি?
মেজর বদরুদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে। আপন মনে বলে, আরো দু একদিন। তাহলে মানিকপুর থাকতে হচ্ছে আমাকে। হুঁ!
কামাল বলে, মানিকপুর বুঝি এই প্রথম এলেন আপনি?
এবং এই শেষ। এখন এই সান্দাদের রেহেশত থেকে বেরোতে পারলে বাঁচি।
মেজর বদরুদ্দিন আপন মনে বিড়বিড় করে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কামাল। মানিকপুরের নাটকীয় ঘটনায় মেজর বদরুদ্দিন অন্যতম রহস্যময় চরিত্র তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাসান মওলার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে আজ নিয়ে চারদিন আগে। এ কদিন বুড়ো মেজর বদরুদ্দিন মানিকপুরে আছে। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে হাসান মওলা নামে কথিত তৈমুর মীর্ধার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত বুড়ো মানিকপুরেই থাকবে। উদ্দেশ্য একটা নিশ্চয়ই আছে এবং সেটা কি ধরনের তা বুড়োর ভাবগতিক বা চলাফেরা থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। সারাদিন হোটেল থেকে এক পা বেরোবে না বুড়ো। হয় নিজের ঘরে না হয় রিসেপশনে বসে থাকবে। শুধু বসে থাকলে কথা ছিলো। বুড়ো সর্বক্ষণ বকর বকর করে চলেছে। সারাদিনের মধ্যে হোটেলের নাসিন্দারা বুড়োর কাছ থেকে রেহাই পায় বিকেল পাঁচটার দিকে। বুড়ো তখন তালি দেয়া সার্জের স্যুট পরে মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ চড়িয়ে হাতে চুড়ি নিয়ে কড়া সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বেড়াতে বেরোয়। রাজা সাহেবের মাঠে অথবা শাল বনে বেড়াতে যায়। একদিন গিয়েছিল কাপড়ের কল দেখতে। বেড়িয়ে বুড়ো ফেরে রাত আটটার দিকে। আবার শুরু হয় বুড়োর বকবকানি। হোটেলের লোকেরা এরই মধ্যে বিরক্ত হয়ে উঠেছে বুড়োর উপরে।
শহীদের চিঠির কথা মনে পড়লো কামালের। মেজর বদরুদ্দিনের উপর নজর রাখতে বিশেষ ভাবে বলে দিয়েছে শহীদ। কামাল অবশ্য গোড়া থেকেই মেজর বদরুদ্দিনের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। গতকাল বিকাল পাঁচটায় বেরিয়ে মেজর বদরুদ্দিন যে রাত এগারোটায় লুকিয়ে হোটেলে ফিরেছে সে খবরও সে জানে। মেজর বদরুদ্দিন মানিকপুর হত্যা রহস্যের অন্যতম গুটি, এতে সন্দেহ নেই। তার ভূমিকা কি সেটাই এখন জানা দরকার।
.
রশিদ সাহেবের বাড়িটা পাতাবাহার রোডের ডান ধরে। ছোটো একতলা বাড়ি। চারিদিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সামনে সবুজ ঘাসে ছাওয়া লন। লনে চেয়ার পেতে বসার জায়গা করা হয়েছে। কামাল যথারীতি সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো মেজর বদরুদ্দিনের।
রশিদ সাহেব বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম মেজর সাহেব। আপনার বন্ধু তৈমুর মীর্ধার মৃত্যুতে নিশ্চয়ই খুব আঘাত পেয়েছেন?
আঘাত পেয়েছি বৈকি। পুরোনো বন্ধুর মৃত্যুতে আঘাত পাওয়ার কথা কি আর বলতে হয়? কিন্তু হত্যাকারী যদি সমুচিত শাস্তি পায় তাহলে আঘাতের বেদনা কতকটা ভুলতে পারবো।
মেজর বদরুদ্দিন ও রশিদ সাহেব আলাপে আলাপে রীতিমত জমে গেলেন। কামাল সরে গেল বাঁ পাশে। লম্বা একটা টেবিলের এককোণে বসেছে রাবেয়া সৈয়দ, ডাঃ চৌধুরী আর ওদের একটু দূরে শাহেলি।
ডাঃ চৌধুরী কামালকে দেখে শুষ্ক হাসি হাসলেন। বললেন, এই যে আসুন।
বেগম রশিদ কোত্থেকে উদিত হলো এই সময়। পিছনে রবিউল্লাহ। প্রথাগত ভাবে সকলের সঙ্গে পরিচিতির পালা চুকিয়ে নিয়ে বললো, সামান্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করেছি মাত্র। এখুনি চা দেয়ার কথা বলতাম। কিন্তু কেউ কেউ আবার বড় বাড়ির মাহমুদ সাহেব আর সুলতানা পারভিনে জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা এলেই…
রাবেয়া সৈয়দ মৃদু কণ্ঠে বললেন, ওদের বুঝি বলা হয়েছে?
আপনার যেমন কথা,
বেগম রশিদ হাসে, সবাইকে ডেকেছি আর বড় বাড়ির গিন্নিকে ডাকবো না তা কি হয়? চা খাওয়া এমন আর কি, আসল কথা তো সকলের সঙ্গে…
বিনয়ে বিগলিত হয়ে হাসতে থাকে বেগম রশিদ। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো, রবিউল্লাহ। সে এইসব কথাবার্তা শুনছিল কিনা বলা মুস্কিল। সে তাকিয়েছিল শাহেলির দিকে। শাহেলিও সেটা বুঝতে পেরেছিল। সে একবার রবিউল্লাহর দিকে তাকিয়ে অপ্রতিভ হয়ে উঠলো।
রবিউল্লাহ শাহেলির পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো। শাহেলি মৃদু কণ্ঠে বললো, তুমি কি কিছু বলবে?
না, এমন কিছু না। আমি ভাবছিলাম টাকা দিইনি বলে তুমি নিশ্চয়ই আমার উপর রাগ করেছে?
শাহেলি একটু হাসলো। বললো, আমি রাগ করেছি তোমাকে কে বললো?
তা ধরোগে তোমার কে বলবে? আমি নিজেই অনুমান করছি।
তুমি একটা বুদ্ধ কি বললে??
রবিউল্লাহ প্রথমটা ধরতে না পেরে হকচকিয়ে গেল। শাহেলি লাল হয়ে উঠে বললো, কিছু বলিনি বাপু। সবাই চোরা চোখে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে, আমার লজ্জা লাগছে, তুমি এখান থেকে যাও…
রবিউল্লাহ বললো, তোমার কাছ থেকে সরে যেতে ধরোগে আমার খারাপ লাশছে। কিন্তু তুমি বলছো যখন অগত্যা যাই।
রবিউল্লাহ একটু হাসলো। উঠে কামালের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কামাল লক্ষ্য না করে পারলো না যে রাবেয়া সৈয়দের তীব্র ভ্রূকুটি হঠাৎ গিয়ে বিধলো রবিউল্লাহর উপর, আর সেই সঙ্গে কেমন যেন থমকে গেল রবিউল্লাহ।
হা, হা।
অদূরে গোল হয়ে বসা লোকগুলির ভিতর বসে প্রাণ খুলে হাসছিল মেজর বদরুদ্দিন, আমি কি বিশ্বেস করি জানেন? বললে তো ফাঁকা গালগল্প মনে করবেন। ভাববেন চান্স পেয়েছি আর অমনি বাণী ছাড়ছি। কিন্তু For Gods sake, বিশ্বেস করুন গালগল্প ছাড়ছি না। মিলিটারীতে ঢুকেছিলাম আর্লি টুয়েন্টিতে, রিটায়ার করেছি সেই কবে, এখন বয়স হতে চললো ষাটের উপর। এখনো আমার সেই এক কথা সায়েব। খান, দান, ফুর্তি করেন। আমার কাছে life is a tale told by an idiot, full of sound and fury, signifying nothing. কি বিশেস হচ্ছে না বুঝি? তাহলে শুনন লেঃ কর্নেল আনসারীর কথা। শালা ছিলো আমার দোস্ত মানুষ।
অম্লান বদনে বলে চলে মেজর বদরুদ্দিন, রিটায়ার করেছিলাম প্রায় একই সময়। এক টেবিলের ইয়ার তো, একদিন মওকা বুঝে বেসামাল অবস্থায় একটা দস্তখতের জোরে আমার পেনশানের বেবাক টাকা মেরে দিলো। তাকে খুন করা উচিত ছিলো আমার, কি বলেন? কিন্তু দোস্ত বহুত চালাক মানুষ, করেছে কি আমার মতো আরো কয়েকজনের টাকা মেরে দিয়ে একদম বার্মা মূল্পকে ভাগোলবা। প্ল্যান প্রোগ্রাম আগে থেকেই ঠিক করা ছিল বোধহয়।
আমি এদিকে আঙুল চুষি, বার্মা মুলুকে আমার দোস্ত লেঃ কর্নেল আনসারী enjoy করছে life. Drinking life to the lees. হা হা, কি মজা, তাই না…
প্রচণ্ড হয়ে ফেটে পড়ে মেজর বদরুদ্দিনের হাসি। হাসির ভিতর গেট দিয়ে লনের দিকে এগিয়ে আসে মাহমুদ। কিন্তু মেজর বদরুদ্দিন কোনদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র করে না। বলে, আমি কিন্তু টাকা হারিয়ে ভেঙে পড়িনি। সামান্য কটি টাকার জন্যে বুঝি হা পিত্যেস করে মরে যাবো! ছোঃ, মেজর বদরুদ্দিন সে ধাতের লোকই না। Chances are frequent, হাল ছেড়ে দেয় যে সে বোকা। আমি আর যা হই বোকা নই। Foolishness I hate most.
মাহমুদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো মেজর বদরুদ্দিনের দিকে। এই কথায় কেন যেন মুচকে হাসলো সে।
মেজর সাহেব,
রশিদ সাহেব মাহমুদকে দেখিয়ে বলেন, ইনি হলেন মিসেস চৌধুরী অর্থাৎ মিসেস সুলতানা পারভিনের বড় ভাই মি. মাহমুদ। আর মাহমুদ সাহেব, ইনি মেজর বদরুদ্দিন, আনডিভাইডেড ইণ্ডিয়ান আর্মির রিটায়ার্ড মেজর।
দুজনেই দুজনকে আদাব দেয়। গৎ বাঁধা বুলি দিয়ে কুশল বার্তা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কামালের মনে হলো মেজর বদরুদ্দিনের প্রসন্ন চোখ দুটি হঠাৎ ঘোলাটে হয়ে গেছে আর মাহমুদের ঠোঁটে ও চোখে অতি সূক্ষ্ম একটা ঠাট্টার হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
মেজর বদরুদ্দিন বলে, আমি আপনাকে দুদিন রাজা সাহেবের মাঠে গাড়ি করে বেড়াতে দেখেছি।
আমিও দেখেছি আপনাকে। আপনি বোধহয় হাসান মঞ্জুলা যেদিন মারা গেল সেদিনই মানিকপুরে এসেছিলেন?
জ্বি ই। আপনারা যাকে হাসান মওলা বলছেন তিনি আসলে স্কোয়াড্রন লীডার মি তৈমুর মীর্ধা। তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো ছিলেন। কিন্তু বয়সের অমিল সত্ত্বেও আমরা ছিলাম যাকে বলে অন্তরঙ্গ বন্ধু।
মেজর সাহেব, আপনার বক্তব্যে কিছু ত্রুটি আছে। হয় আপনার মাথায় ছি আছে, না হয় আপনি
এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করলো মাহমুদ। তারপর আগের চেয়েও তীব্র স্বরে বললো, মিথ্যে কথা বলছেন।
প্রায় লাফিয়ে উঠলেন মেজর, Shut up. ভদ্রলোকের মতো কথা বলতে শিখুন মাহমুদ সাহেব, হা-ভালো হবে না বলে দিচ্ছি
মাহমুদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো, Be ready for tye consequence Major. প্রতিফলের জন্যে প্রস্তুত থাকবেন!
পার্টির উপস্থিত সকলে এই নাটকীয় ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পড়ে। সবাই হাঁ করে থাকে কিছুক্ষণ। রশিদ সাহেব বলেন, আহ-দয়া করে উত্তেজিত হবেন না মাহমুদ সাহেব…
সবাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে বেগম রশিদ। অপ্রীতিকর ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্যে যেন অনুযোগের কণ্ঠে মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বলে, কই সুলতানাকে নিয়ে এলে না যে?
সুলতানা অসুস্থ।
অসুস্থ, বলো কি?
বেগম রশিদ খবরটাকে বেশি রকম মর্যাদা দিতে চেষ্টা করে। অদূরে মাথা নিচ করে বসেছিলেন ডা. চৌধুরী। তিনি মাথা তুলে বলেন, It was just a headache. আমি কালই ওষুধ দিয়ে এসেছিলাম। সুলতানা কি সেরে ওঠেনি?
মাহমুদ স্থির গলায় বলে, আপনারা যা ভাবছেন তা না। সুলতানার সামান্য একটু মাথা ধরেছে, ইচ্ছে করলেই সে আসতে পারতো। তা মাথা ধরাটা যদি বেড়ে যায়, এই ভয়ে সে আসেনি…
ওঃ, তাই বলো, আমি রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বেগম রশিদ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এতক্ষণে ভালো করে তাকায় সকলের দিকে। কামালকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কতকটা আনুষ্ঠানিক ভাবে বলে, আপনারা আমাদের এই সম্মানিত মেহমানকে আশা করি সবাই চেনেন। ইনি কামাল আহমেদ, বিখ্যাত গোয়েন্দা শহীদ খানের বন্ধু। এরই সম্মানে আজ এই সামান্য চায়ের আয়োজন করেছি।
ইতিমধ্যে টেবিলে নাস্তা দেয়া শুরু হয়েছে। রাবেয়া সৈয়দ গিয়ে বসেছেন বড় টেবিলটায় যেখানে মেজর বদরুদ্দিন ও রশিদ সাহেব বসেছেন। এপাশে আর একটা টেবিলে শাহেলির পাশে জায়গা করে নিয়েছে মাহমুদ, মাহমুদের পাশে বসেছেন গম্ভীর মুখ ডা. চৌধুরী। বেচারা রবিউল্লাহ কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মাহমুদ ও শাহেলির দিকে, তারপর কি ভেবে কিছুদূরে আলাদা একটা টেবিলে মুখ গোমরা করে গিয়ে বসলো।
রবিউল্লাহ, বেগম রশিদ হাঁক দেয়, তুমি বাবা এদিকটায় (শাহেলির বাম পার্শ্ব দেখিয়ে এসে বসলেই পারো।
তা ধরুন গে আপনার দরকার কি?
বিরক্তি চাপতে পারে না রবিউল্লাহ, বলে, দিব্যি আছি। কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।
আপনার কি কোনো অসুবিধে হচ্ছে? মাহমুদ কৌতুকের স্বরে জিজ্ঞেস করে শাহেলিকে।
হাঁ হচ্ছে, স্পষ্ট গলায় একটুও দ্বিধা না করে জবাব দেয় শাহেলি। বলে, কিন্তু, বলে লাভ কি? অসুবিধে হচ্ছে বললেই কি আপনি অন্যত্র সরে বসবেন?
তা বসবো না। আসলে ইচ্ছে করেই আপনার কাছে এসে বসেছি। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করি।
শাহেলি হতবাক হয়ে তাকায়। লোকটা যেমন ধূর্ত তেমনি শক্তিশালী। নিজেকে অসহায় মনে হতে লাগলো শাহেলির। একবার সে উঠে গিয়ে ডা. চৌধুরীর পাশে বসবে ভাবলো। কিন্তু তার হাত-পা অসাড় হয়ে রইলো। উঠতে পারলো না।
চায়ে চুমুক দেয় মাহমুদ। আস্তে আস্তে বলে, আপনি আমাকে ঘৃণা করেন তাই?
শাহেলি এই কথার জবাব দিলো না।
ভেবেছেন আমি একটা কপালগুণে বড়লোক মহিলার বর্বর বড় ভাই, তাই না?
মাহমুদ হাসে। বলে, আপনি ঠিকই ভেবেছেন। আমি করিনি এমন অন্যায় নেই, কিন্তু মজা কি জানেন? আমার অন্যায় ধরার মতো একটি লোকও আজ পর্যন্ত পাইনি। চিরকালই আমি বিজয়ী। বিশ্বেস হয় না বুঝি?
শাহেলি বললো, আমাকে এগুলো বলে লাভ?
লাভ আবার কি। তবে একটা উদ্দেশ্য হয়তো আছে। সেটা আশা করি আপনি বুঝেছেন!
না। উদ্দেশ্য আমি বুঝিনি, বুঝতে চাইও না। শাহেলি কেমন যেন একটু হাসলো। উঠে দাঁড়ালো সঙ্গে সঙ্গে। সোজা গিয়ে ইচ্ছে করেই বসলো রবিউল্লাহর টেবিলে তার পাশের চেয়ারে।
এই সবই লক্ষ্য করছিল কামাল। এতক্ষণ সে বেগম রশিদের সঙ্গে কিছুদূরের একটা টেবিলে বসেছিল। সে দেখলো শাহেলি উঠে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদের চোখ মুখ হিংসা ও রাগে ধ্বক ধ্বক করে উঠলো। মাহমুদ অত্যন্ত ধূর্ত ও কৌশলী। মুহূর্তেই সে চোখ মুখের অভিব্যক্তি চাপা দিয়ে এমন সহজ ভাবে একটু সরে গিয়ে ডা. চৌধুরীর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো যে কামাল মনে মনে তার শক্তির প্রশংসা না করে পারলো না।
পাশের টেবিল থেকে মেজর বদরুদ্দিনের গলার স্বর শোনা যাচ্ছিলো। বুড়ো হা হা করে হাসছিল আর বলছিল, কি জিজ্ঞেস করলেন মিসেস চৌধুরী (রাবেয়া সৈয়দ)। আমার বন্ধু মি. তৈমুর মীর্ধা কেন মানিকপুরে এসেছিল? খুর মজার প্রশ্ন করেছেন যাহোক। তৈমুর মীর্ধা ঠিক কেন মানিকপুরে এসেছিল তা অবশ্য আমার জানার কথা নয়, কারণ আমার সঙ্গে তৈমুর মীর্ধার দেখাই হয়নি। কিন্তু দেখা না হলেই কি? কেন তৈমুর মীর্ধা মানিকপুরে এসেছিল তা বোঝা কি অতোই অসম্ভব? শেক্সপিয়ারের সেই বিখ্যাত লাইনটা মনে নেই, To be or not to be that is the question
মেজর বদরুদ্দিন হা হা শব্দে হাসতে লাগলো।
.
০৫.
মাহমুদ ঘাড় বাঁকিয়ে হেসে উঠলো। হাতে তার মদের গ্লাস। টেবিলের উপর একটা শ্যাস্পেনের বোতল। বোতলের অর্ধেকটা খালি। পাশে বসে আছে সুলতানা পারভিন। তার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। সুলতানা পারভিন বললো, আর খেয়ো না মাহমুদ।
মাহমুদ মানা শুনলো না। এক ঢোকে গ্লাসটা খালি করে দিলো। চোখে মুখে ফুটে উঠলো অ্যালকোহলের প্রতিক্রিয়া। ঝাঁঝের সঙ্গে বললো, তুমি খামোখা চিন্তা করছে পারভিন। মদ খেলে আমার কিছু হয় না। ওসব কথা পাক। তুমি বরং গল্পটা শোনো…
পারভিন আস্তে আস্তে বললো, বেশ, বলো। মাহমুদ খুশি হয়ে একটা চাপড় লাগায় সুলতানা পারভিনের কাঁধে। বলে, গুড গার্ল। মন্তব্য শুনে সুলতানা পারভিনের কোনো ভাবান্তর হলো না। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা নিয়ে সে বসে রইলো মাহমুদের পাশে। সুলতানা পারভিনের পরনে বিচিত্র পোশাক। হাত কাটা ব্লাউজের উপর হালকা সুর্মা রঙের পাতলা জামদানী শাড়ি। নিচের অন্তর্বাস নেই। পাতলা শাড়ির আড়ালে তার সুপুষ্ট জঘানিতম্ব আর বক্ষদেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
মাহমুদ বললো, হাসান মওলাকে ভয় করেছিলাম। শালা হারামী ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে চেয়েছিল। শালা কুত্তার বাচ্চা খুন হয়েছে, ভালো হয়েছে।
মাহমুদ একচোট হাসলো, আমার সাথে যে লাগতে আসবে তারই এই দশা হবে। হাসান মওলা মরেছে, এখন পাল্লা দিতে এসেছে মেজর বদরুদ্দিন। এই শুয়োর যে। কোত্থেকে এলো বুঝতে পারছি না। এই শালাও আমাকে জ্বালাতে শুরু করেছে। শালাকে পাঁচদিনের মধ্যে আমি নিজের হাতে খুন করবো।
সুলতানা পারভিন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বসে রইলো। মাহমুদ তার দিকে তাকিয়ে বললো, এরপর ধরবো কুয়াশাকে। কুয়াশা ভেবেছে ভয় দেখিয়ে কেল্লাফতে করবে। তার ভুলও ভেঙে দেবো আমি
সুলতানা পারভিন বললো, কুয়াশা কে?
কুয়াশা কে তুমি জানো না? ভারি মজার কথা কিন্তু। মাহমুদ হাসতে লাগলো, কুয়াশার কথা তোমাকে এর আগেও বলেছি। কুয়াশা হলো একটা ভয়ঙ্কর ডাকাত … একটা হীন…
এই সময় একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটলো। ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো একটা দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তি, সারা গা ভারি ওভারকোটে ঢাকা। মাথায় ফেন্ট ক্যাপ। মাহমুদ লাফিয়ে উঠে পকেটের পিস্তলে হাত দিলো। লোকটা শান্তভাবে বললো, পিস্তল বের করার চেষ্টা করো না মাহমুদ। সেটা তোমার পক্ষে বোকামি হবে।
মাহমুদ দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ দমন করলো। খালি হাত বের করে আনলো পকেট থেকে। বললো, তুমি কি চাও? এতো রাতে আমার বাড়িতে এসেছো কেন?
কেন এসেছি তুমি ভালো করেই জানো। লোকটা স্থির গলায় বললো, তোমার পাপের শাস্তি দেয়ার জন্যে শহীদ খানই যথেষ্ট। সে ব্যাপারে আমার কোনো ভূমিকা নেই। আমি এসেছি টাকার জন্যে।
টাকা, কিসের টাকা, কার টাকা?
ছায়ামূর্তি গম্ভীর গলায় বললো, টাকার উপর কারো স্থায়ী অধিকারের ছাপ থাকে মাহমুদ। কাল যে টাকা চৌধুরী আলী নকীবের ছিলো আজ সে টাকা তোমার হাতের মুঠোয়। সেই টাকা এখন আমার হবে। চৌধুরী আলী নকীবের সব টাকা আমার চাই, মাহমুদ।
মাহমুদ তিক্ত হাসলো। বললো, তাহলে তোমাকে ব্যাঙ্ক লুট করতেই হবে কুয়াশা। আলী নকীবের সব টাকা ব্যাঙ্কে আছে।
কয়াশা বললো, আমি জানি। ব্যাঙ্ক লুট করার ঝামেলা আমি নিতে চাই না। আমি তোমার হাত দিয়ে সেই টাকাটা চাই। তুমি এক সপ্তাহের ভেতর সব টাকার কারেন্সী নোট নিয়ে আসবে।
মাহমুদ বললো, ভয় দেখিয়ে হাসান মওলাও আমার উপর ব্ল্যাকমেল করতে, চেয়েছিল। সে কথা ভুলে যেয়ো না কুয়াশা।
আমি ব্ল্যাকমেল করতে চাই না। আমি টাকা চাই এবং সেটা এক সপ্তাহের ভেতর। এর অন্যথা হলে মানিকপুরের লোকেরা শোবার ঘরে তোমার লাশ দেখতে পাবে এক সপ্তাহ পরেই।
কুয়াশা একটু থেমে বললো, আমার প্রচুর টাকা দরকার। আমি মানুষকে অমর করতে চাই। পৃথিবী থেকে দুঃখ আর জরা দূর করতে চাই। পিরামিডের কোটি কোটি টাকা পেয়েও টাকার প্রয়োজন আমার মেটেনি। আরো টাকা চাই। টাকার জন্যে দরকার হলে দুনিয়ার সব ধনীর ভাণ্ডার লুটতেও আমি প্রস্তুত।
সুলতানা পারভিন অবাক হয়ে দেখছিল কুয়াশাকে। দীর্ঘ, বলিষ্ঠ দেহ। তীক্ষ্ণ একজোড়া চোখে শাণিত আলো। মোটা ঢুরুর উপর আবছা সাদা রঙের ছোপ লেগেছে। কুয়াশার গলার স্বরে কেমন একটা খসখসে আবিষ্টতা।
মাহমুদ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো। কুয়াশা পিস্তল উদ্যত রেখে পিছু হটতে লাগলো। দরজা পর্যন্ত পৌঁছে কুয়াশা হাসলো। বললো, মাহমুদ, আমার হাতে যা দেখছো এটা একটা খেলনা পিস্তল। পিস্তলটা তোমাকে দিয়ে গেলাম। মিনাইট প্রেজেন্টেশান। এই নাও…
কুয়াশা পিস্তলটা ছুঁড়ে দিলো মাহমুদের দিকে। পর মুহূর্তে মাহমুদের হাতের পিস্তল গর্জে উঠলো কুয়াশার দিকে। একটা ভরাট, মিষ্টি হাসি কেঁপে কেঁপে উঠে হঠাৎ ভোজবাজির মতো যেন দেয়ালে মিশে গেল।
মাহমুদ অপমানে, ক্ষোভে, দুঃখে ফুঁসতে লাগলো।
.
০৬.
ঘরে বসে রিপোর্ট লিখছিল কামাল। মতিন এসে খবর দিলো থানার ও. সি, সমসের শিকদার তার অপেক্ষায় বসে আছেন রিসেপশান ঘরে। গল্প করছে ম্যানেজার আইনুল হকের সঙ্গে।
আপনি তো চা খেতে গেলেন বেগম রশিদের বাড়ি, সমসের শিকদার স্বভাবসিদ্ধ ভারিক্কি চালে বলে, এদিকে আমার অবস্থা ফাটো ফাটো। ভাবছি কালই হাসান মওলার খুনের চার্জশীট দাখিল করবো ওপরে।
বেশ তো করুন। আমি আপনাকে সাহায্য করবো।
তা তো করবেনই, করতেই হবে। কিন্তু এদিকে নতুন খবর। হেড অফিস থেকে লিখে পাঠিয়েছে আই. বি. ডিপার্টমেন্টের বড় কর্তা মি. সিম্পসন নাকি মানিকপুর আসছেন। আদেশ দেয়া হয়েছে তাঁকে যেন যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে অভ্যর্থনা করা হয়।
শিকদারকে ভরসা দিয়ে কামাল বলে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন শিকদার সাহেব। মি. সিম্পসন নিশ্চয়ই আমাদের উপকার বই অপকারে আসবেন না।
তা তো বটেই, তবে কি জানেন ওপরওয়ালাদের আবার high sensitive মেজাজ। পান থেকে চুন খসলে রক্ষা নেই সায়েব! ভাবছি শেষ রক্ষা করতে গিয়ে না বেইজ্জতী হই। যাকগে আপনার রিপোর্টের কর তাই বলুন।
আমার রিপোর্ট মোটামুটি তৈরি আছে। আগামীকাল রিপোর্টের একটা কপি আপনাকে দিতে পারব আশা করি।
বেশ তাই দেবেন। আমি সায়েব পষ্ট কথার মানুষ। হাসান মওলার খুনের ব্যাপারে আপনার ওপর ষোলোআনা ভরসা করে আছি। আপনি যা বলবেন তার ওপর ভিত্তি করেই ফাইনাল চার্জশীট দেবো। তা ব্যাপার কি কামাল সাহেব, শুনলাম বেগম রশিদ নাকি জবর একটা টি-পার্টি দিয়েছেন আপনার সম্মানে?
আমার সম্মানে দিয়েছেন বটে। তবে পার্টিটা উনি এক রকম আমার কথায়ই দিয়েছেন। মাহমুদ আর মেজর বদরুদ্দিনের মধ্যে একই পরিবেশে কি ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঘটে সেটা চাক্ষুস দেখাই ছিলো আমাদের উদ্দেশ্য।
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সবই তাহলে দেখেছেন বলুন? আপনাদের কথাই সায়েব আলাদা! আমরা situation tackle করি লাঠি দিয়ে, আর আপনারা করেন মস্তিষ্ক দিয়ে। না, না…বিনয় প্রকাশ করবেন না কামাল সাহেব। যা সত্যি আমি তা-ই বলছি। আমি সায়েব পৃষ্ট কথার মানুষ। আমার মধ্যে কোনো পাক-চক্কর পাবেন না, হ্যাঁ!
সমসের শিকদার তার বিপুল বপুটি নিয়ে নড়েচড়ে বসে। আইনুল হক এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেয়ে বলে, চা আসছে, স্যার। চা তাহলে এখানেই দিতে বলি…
না, না…এ আপনার ভারি অন্যায় হক সাহেব, সমসের শিকদার প্রায় হুঙ্কার ছাড়ে, যখনই আসি তখনই চা-টার ঝামেলা করবেন এ অন্যায় সহ্য করা যায় না। তবে হ্যাঁ, আপনার হোটেলের চায়ের নাম আছে বটে! আপনাদের কি বলে ঐ রসমালাইটা। আহা, যেমন মিঠেকড়া তেমনি নরম!
রসমালাই দিতে বলেছি, স্যার! আর ঘিয়ে ভেজে সিঙ্গাড়া বানিয়েছে হোটেলের বয়রা। ভিতরে দিয়েছে কুচি কুচি মাংসের কাবাব। সঙ্গে আলু আর মটরশুটি। চলবে তো, স্যার?
শুধু মুখে মুখে, আর বলবেন না সায়েব।
সমসের শিকদার প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে। বলে, মুখে বলবেন না, কাজে দেখান। বাঙালীর ঐ এক দোষ। শুধু কথা বলে।
হক সাহেব তাকায় কেয়ারটেকার মুন্সিজীর দিকে। মুন্সি বলে, আসছে, মতিন নিয়ে আসছে…
নিয়ে আসছে শুনে সোফায় জুৎ হয়ে বসে সমসের শিকদার। মুন্সিজীর দিকে এতক্ষণে নজর যায়। স্বভাবসিদ্ধ হুঙ্কার ছেড়ে বলে, তুমি সেই জেলখাটা ডাকাতির আসামী মুন্সি না? হুঁ… জেল থেকে বেরিয়ে নামের বাহার তো খুব খুলেছে! তা মুন্সি নামটা তোমাকে কে দিলো বাপু? Self-styled মুন্সি নাকি, অ্যাঁ? ব্যাটা দেখি কথাও বলে না!
জেল থেকে বেরিয়ে খুব নামাজ পড়তাম কিনা স্যার, নামাজে একেবারে মশগুল হয়ে থাকতামপ্তাই
মুন্সি কৈফিয়ত দেয়, সবাই সেই থেকে মুন্সি বলে ডাকতে শুরু করেছে…
হুঁ!
সমসের শিকদার দারুণ রকম গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, তা ভেক যা-ই ধরো না কেন বাপু, লাভ হবে না কিছু। আমি হলাম গিয়ে যাকে বলে এ লাইনের পাকা লোক। একটু এদিক-ওদিক করেছো তো রক্ষে নেই, একদম catch করে ফেলবো।
বেয়ারা মতিন ট্রেতে করে খাবার নিয়ে ঢোকে। দুটো প্লেট সাজিয়ে একটা কামালের সামনে আর একটা সমসের শিকদারের সামনে রাখে। লোলুপ দৃষ্টিতে প্লেটের দিকে তাকিয়ে সমসের শিকদার তাড়া দেয় কামালকে, কই সাহেব বিসমিল্লাহ করেন
হ্যাঁ, শুরু করুন।
কামাল সায় দেয়।
ম্যানেজার আইনুল হক বলে, আমি তাহলে সবাইকে বলে দিই স্যার যে চা টার পর আপনি সবার সঙ্গে মিট করছেন?
গোটা তিন রসমালাই চামচে করে গালে ফেলতে যাচ্ছিলো সমসের শিকদার, বাধা পেয়ে থমকে গেল, হুঙ্কার ছেড়ে বললো, আমি এখন একদম কথা বলতে পারবো না। আমার একটা principle আছে বুঝলেন? কাজের সময় কাজই করি। আর…
পরের কথাগুলো রসমালাইয়ের নরম ছানা আর রসে ভিজে অস্পষ্ট হয়ে মুখের ভিতর জড়িয়ে গেল। কিছু বোঝা গেল না।
খাওয়া-দাওয়ার পর সমসের শিকার দুই খিলি পানে আধ শিশি কড়া জর্দা মিশিয়ে গালে ফেললো। পান চিবুতে চিবুতে ঢেকুর উঠতে লাগলো তার। জানালার ধারে গিয়ে বার দুই পিক ফেলে পানটাকে মুখের ভিতর ধাতস্থ করলো শিকদার। কামালকে বললো, রাতে আর জবানবন্দীর হাঙ্গামা নিলাম না, কি বলেন!
ঠিক আছে।
হ্যাঁ সায়েব, খুব টায়ার্ড হয়ে আছি। তার ওপর সন্ধ্যেবেলা যখন শুনলাম, রশিদ সাহেব একটা জবর টি-পার্টি দিয়েছেন অথচ আমাকে ডাকেননি তখন মিথ্যে বলবো না সাহেব, তখন একেবারে আঁতে ঘা লেগেছিল। যাকগে, হক সাহেবের রসমালাই আর সিঙ্গাড়া দিয়ে শূন্যস্থান অনেকটা পূরণ করা গেল। কী বলেন হক সাহেব, অ্যাঁ?
সমসের শিকদার গলা খুলে হাসতে লাগলো আর হাসির বিকট আওয়াজে গমৃগ করে উঠলো ঘরের ভিতরটা। গোটা দুই ঢেকুর উঠলো শিকদারের। বিপুল ভুড়ি বাগিয়ে অতি কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে শিকদার বলে, তাহলে আজ উঠি। ভালো কথা, হক সাহেব, সেদিন আপনার হোটেলে যে সব লোকের জবানবন্দী নেয়া হলো, তাদের কাউকে আমার অর্ডার না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়বেন না
আমি সবাইকে ঘটনার রাতেই আপনার আদেশ জানিয়ে দিয়েছি, স্যার…
ঠিক হ্যায়, চলি, ইয়া মালেক …
সমসের শিকদার কামালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। রিসেপশান থেকে মাল নিজের ঘরে আসে। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছিল ঘরে। কামাল উত্তর দিকের জানালা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ প্রায় চমকে ওঠে। জানালার বাইরে রাজা সাহেবের ধূ ধূ করা মাঠ। চারিদিকে আচ্ছন্ন অন্ধকারে ঢাকা। উপরের নগ্ন আকাশে কোটি কোটি তারার আলোময় চোখ। তারার অস্পষ্ট আলোয় কামাল দেখলো হোটেলের অনতিদূরে রাজা সাহেবের মাঠে গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মূর্তি। একজনকে চিনলো কামাল-মেজর বদরুদ্দিন। আর একজনকে চিনতে পারলো না। গা ঢাকা দিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো। কথা বলতে বলতে ওরা কাছে এগিয়ে এলো। অচেনা। লোকটা বললো, যা বললাম তা না করলে বিপদ হবে ভাইজান।
অসহায়ের মতো মেজর বদরুদ্দিন বললো, কিন্তু…
চুপ করুন!
অচেনা লোকটা চাপা গলায় বলে উঠলো। গলাটা যেন চেনা চেনা লাগলো। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই ধরতে পারলো না কামাল।
লোকটা বললো, অনেকদূর এগিয়েছি। আর পিছন ফিরলে আপনিও মরবেন, আমিও মরবো। যান…আমি চলি।
লোকটা হন হন করে মাঠের দিকে চলে যায়। মাথার চুল ধরে উদভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে রইলো মেজর।
কিছুক্ষণ পর গা ঢাকা দিয়ে পিছনের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলো। রিসেপশানে বুড়োর হা হা হাসি আর কথাবার্তার শব্দ শোনা গেল একটু বাদেই।
রিসেপশানে যাবে বলে একবার ভাবলো কামাল। পরক্ষণেই মনে হলো মেজর বদরুদ্দিন যেমন ধূর্ত আর ধড়িবাজ তাতে সামনাসামনি কথাবার্তার ফাঁক ধরে কিছু আদায় করার চেষ্টা অপচেষ্টা বই কিছু নয়। কি করবে ভাবছে এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো আইনুল হক।
স্যার।
কি ব্যাপার হক সাহেব?
রিসেপশানে একবারটি আসুন, স্যার। মেজর সাহেব কেমন যেন পাগলামি। করছেন। তার কথাবার্তা আর হাসির ধরন আমার ভালো ঠেকছে না, স্যার।
চলুন দেখি…
রিসেপশানে এসে কামাল দেখলো জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসেছে মেজর বদরুদ্দিন। সামনের টেবিলে তার ছড়ি ও টুপি রাখা। অনর্গল কথা বলছে মেজর বদরুদ্দিন। ঘরে দুএকজন নতুন বোর্ডার ছাড়াও আছে বেয়ারা মতিন, মুন্সিজী ও ডাক্তার রহিম। আপন মনে কথা বলে চলেছে মেজর বদরুদ্দিন। কখনো হা হা করে
অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ছে, কখনো মেজাজ গরম করে চিৎকার ছাড়ছে।
আমি ভেবেছো ওকে ছেড়ে দেবো? কভি নেহি। কত্তি নেহি। ও আমার সর্বনাশ করেছে, আমাকে পথের ভিখারী করেছে। শালাকে আমি খুন করবো। দাঁড়াও, কালই আমি বার্মা যাবো। পাসপোর্ট নেই তো কি হয়েছে? ইণ্ডিয়ান আর্মির বি কোম্পানীর মেজর বদরুদ্দিনের পাসপোর্ট লাগে না। পাসপোর্ট ছাড়াই আমি বার্মা যাবো।
আইনুল হক কাছে গিয়ে বিনীত ভাবে বলে, মেজর সাহেব, আপনার ঘরে চলুন…
আমার ঘর, yon mean my room?
ক্রু কুঁচকে তাকায় মেজর বদরুদ্দিন। হা হা করে হাসে। বলে, আমার আবার ঘর কোথায় হে। ঘর নেই। NO roon, no shelter. তুমি বাপু কানের কাছে অমন গুনগুন করো না-ভালো হবে না কিন্তু।
বৃদ্ধ ডাক্তার রহিম এতক্ষণে বলে, মেজর সাহেব নিশ্চয় কোনো একটা Pressure এ ভুগছেন। আপনারা অনুমতি করেন তো একে আমি দেখতে পারি…
তাহলে তো স্যার ভালোই হয়।
ম্যানেজার আইনুল হক কৃতার্থ কণ্ঠে বলে, কী যে বিপদে পড়েছি স্যার। অ্যাদ্দিন ধরে হোটেলে চাকরি করছি, এমন বিপদে আর কখনো পড়িনি। এই সেদিন হাসান মওলা খুন হলো হোটেলে, তারই জের কাটেনি এখনো। আবার শুরু হয়েছে নতুন ঝামেলা!
আইনুল হক সাতিশয় বিরক্ত। তার চোখ পড়ে মুন্সিজী আর মতিনের দিকে। মতিন যেন মেজর সাহেবের কথাগুলো গিলছি।
আইনুল হক ধমক দিয়ে ওঠে। বলে, মতিন তুমি তোমার কাজে যাও। মুন্সি তুমিও যাও এখন। এগারো আর ঝরো নম্বরে একটা ফ্যামিলি এসে উঠেছে। ওদিকে নজর দাও গিয়ে।
মতিন আর মুন্সিজী তাড়াতাড়ি রিসেপশান থেকে রেরিয়ে যায়। মেজর বদরুদ্দিন খুব মনযোগ দিয়ে আইনুলের ধমক মেশানো কথাগুলো শুনলো। তার চোখ-মুখ আহত অপমানে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বলে, ইউ। মেজর বদরুদ্দিন থাকতে এই মাঠে কমাও দেবার তুমি কে? ভালো হবে না বলছি
কথাগুলি গায়ে মাখায় না ম্যানেজার আইনুল হক। কামালের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, দেখলেন সে। স্যার! একদম বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে। কই ডাক্তার সাহেব …একটু দেখবেন বলেছিলেন
ডাক্তার রহিম মেজর বদরুদ্দিনকে পরীক্ষা করার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে ওঠে মেজর বদরুদ্দিন, I say stop! Dont proceed.ভালো হবে না কিন্তু।
ডাক্তার রহিম চিৎকার শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সবাই থ।
এক ধমকে সবাই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে দেখে মেজর বদরুদ্দিন ভারি খুশি। উঠে দাঁড়িয়ে কমাণ্ড দেয়ার ভঙ্গিতে মিলিটারী কায়দায় বলে, স্ট্যাণ্ড অ্যাট ইজ!
আমি বলছিলাম কি স্যার।
ম্যানেজার আইনুল হক আবেদন করার ভঙ্গিতে বলতে যায় মেজর বদরুদ্দিনকে। মেজর বদরুদ্দিন হা হা করে হেসে বলে, তুমি বলছিলে? তুমি আবার কি বলবে হে? তুমি তো একটা লেন্স কর্পোরেল মাত্র। কোম্পানি এটেনশান।
মেজর বদরুদ্দিন হুকুম ছাড়ে। তার চোখ পড়ে ডাক্তার রহিমের দিকে। একটু এগিয়ে এসে উপরওয়ালার ভঙ্গিতে সৌজন্যের সঙ্গে বলে, You neednt worry my dear. আপনার ভয় কি? আপনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। এখন মেজর ডেজিগনেট। Be cheerful man!
ম্যানেজার আইনুল হক কি বলতে যাচ্ছিলো! মেজর বদরুদ্দিন খেপাটে গলায় opy 6731, You! Dont move.
আইনুল হক আর কথা বলতে সাহস করে না। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকায় কামালের দিকে। ভাবখানা, দেখলেন তো স্যার, কি ন্যাংটা পাগলের পাল্লায় পড়েছি।
কোম্পানি!
মেজর বদরুদ্দিন স্থিরভাবে সকলের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, আমি কাল ভোর বেলা বার্মা যাচ্ছি। লে. কর্নেল সিদ্দিকীকে আমি দেখে ছাড়বো। আমার অবর্তমানে Major designate রহিম কোম্পানির চার্জে থাকবে। অলরাইট?
কামাল বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সবটা ঘটনাই অবিশ্বাস্য ঠেকছে। এই তো বিকেল পাঁচটায় মেজর বদরুদ্দিন টি-পার্টিতে গেল বেগম রশিদের বাড়ি। দিব্যি সুস্থ সমর্থ মানুষ। একটু আগেও রাজা সাহেবের মাঠে কার সঙ্গে কথা বলছিল অন্ধকারে। মাঠ থেকে হোটেলে ফিরেই, অন্ধকার থেকে আলোতে এসেই হঠাৎ কেন ডোল পাল্টালো মেজর সাহেব?
এটা কি পাগলামি না পাগলামির অভিনয়? কিংবা নতুন কোনো রহস্যের সূচনা?
বিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে কামাল। মেজর বদরুদ্দিন উৎফুল্ল কণ্ঠে ঘোষণা করলো, ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দাও হে। আমি এখন বিশ্রাম করবো। I will take rest now, শুনেছো?
ম্যানেজার আইনুল হক কামালের মতোই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল কতক্ষণ। ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দাও হে বলেই মেজর সাহেব যখন রিসেপশানের এক ঘর লোকের সামনে আনন্দে উদ্বাহু নৃত্য করতে শুরু করলো তখন তার চেতনা ফিরলো।
গুরুবন্ত সিং ও মুন্সিজীর সহায়তায় মেজরকে তার নিজের ঘরে নিয়ে আসা হলো। প্রায় জোর করে খানিকটা দুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলো তাকে। দুধের সঙ্গে কামালের নির্দেশে পরিমিত ঘুমের ঔষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলেন ডাক্তার রহিম। কিছুক্ষণ বিছানায় দাপাদাপি করে, হোটেলের সকলকে কোর্ট মার্শালের ভয় দেখিয়ে মেজর বদরুদ্দিন কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো।
নিজের ঘরে এসে শ্রান্ত কামাল বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
হোটেলের পেটা ঘড়িতে রাত বারোটা বাজে।
.
০৭.
আরো একটা রাত কাটলো মানিকপুরে।
সকাল এগারোটায় হোটেল তাজে নিজের ঘরে বসে গত অসমাপ্ত ডায়েরীর শেষ কটা লাইন লিখছিল কামাল।
আমার কোনো সন্দেহ নেই হাসান মওলাকে মাহমুদ-ই হত্যা করেছে। যথাযোগ্য প্রমাণের অপেক্ষায় এতদিন তাকে গ্রেপ্তার করা থেকে বিরত ছিলাম। মেজর বদরুদ্দিনের আকস্মিক অপ্রকৃতিস্থতা দেখে বুঝতে পারছি মাহমুদকে বাইরে রাখার অর্থ নতুন বিপদ ডেকে আনা। তাকে শিগগির গ্রেপ্তার করাই সঙ্গত। হাসান মওলাকে খুন করার যে অভিযোগ মাহমুদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হচ্ছে সেই অভিযোগ প্রমাণের এক নম্বর সাক্ষী হোটেল তাজের কেয়ারটেকার মুন্সিজী। দ্বিতীয় প্রমাণ এম. মনোগ্রাম করা সিগারেট লাইটার, যা অকুস্থলে পাওয়া গেছে, মাহমুদ নিজেও যার মালিকানা নিজের মুখে স্বীকার করেছে। তৃতীয় প্রমাণ…
মনোযোগর সঙ্গে লিখছিল কামাল। হঠাৎ ভেজানো দরজা খুলে যে লোকটা হাসিমুখে ঘরে ঢুকলো তাকে দেখে লাফিয়ে উঠলো সে।
আরে শহীদ..What surprseকখন এসেছিস?
কখন এসেছি? শুনে তুই যে রাগ করবি। বলবো কিনা ভাবছি।
হেঁয়ালি রাখ। কখন এসেছিস তাই বল।
বলছি। কিন্তু তোর ভদ্রতা জ্ঞান দেখছি একেবারে লোপ পেয়েছে। বসতেও বললি না পর্যন্ত।
শহীদ মৃদু হেসে খাটের কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসলো। একটা সিগারেট ধরালো। এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে বললো, আমি মানিকপুরে এসে পৌঁছেছি সকাল সাতটা বিশের গাড়িতে। আর এতেই অবাক হচ্ছিস? শোন আগে। সাতটা বিশে মানিকপুরে এসে থানায় গিয়েছি প্রথম। মি. শিকদারের আইডেনটিটি কার্ড দেখাতেই ভদ্রলোক। ভুড়ি সামলে এমন একখানা স্যালুট ঝাড়লো যে দাপটে মনে হচ্ছিলো মা ধরিত্রী কেপে উঠলেন। তা মি. শিকদার তার প্রমোশনের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস বোবা গেল। আই. বি. ডিপার্টমেন্টের মি. সিম্পসনের বন্ধু জেনে খাতির-যত্নের চূড়ান্ত করলেন ভদ্রলোক। এই আধা শহর আধা গ্রাম মানিকপুরে তিনি আমাকে ব্রেকফাস্টের সঙ্গে ফাইন কোয়ালিটির কফি পর্যন্ত খাওয়ালেন। মি. শিকদারের প্রমোশন রুখে কে…
বাজে কথা রেখে ব্যাপারটা একটু খুলে বল তো!
আহা অস্থির হচ্ছিস কেন? মানিকপুরে এসে পৌঁছেছি সকাল সাড়ে সাতটায়। এই সময় তোর ঘুমই ভাঙে না সাধারণতঃ, তাই ভাবলাম তোকে ডিসটার্ব না করে মি. শিকদারের সঙ্গে বরং প্রাতঃভ্রমণটা সেরে নেয়া যাক।
প্রাতঃভ্রমণ?
প্রাতঃভ্রমণ অবশ্য তখন ঠিক বলা যায় না। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোতে বেরোতে সোয়া আটটা বেজে গেল। কিন্তু সময়টা শীতের শুরু তো। বেরিয়ে মোটামুটি Morning walk-এর আমেজই পাওয়া গেল। তা ঘুরতে ঘুরতে মানিকপুরের চৌধুরী পরিবারের লোকজনের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাতের পালাটা ঢুকিয়ে এলাম। মি. শিকদার ছিলেন সঙ্গে। তিনিই সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথম গেলাম সুলতানা পারভিনের ওখানে। সুলতানা পারভিন, মাহমুদ দুজনের সঙ্গেই দেখা হলো। তোর কথাই ঠিক দোস্ত। মাহমুদ লোকটা ভারি জটিল আর গোঁয়ার-গোবিন্দ। তবে লোক ভালো সুলতানা পারভিন। তোর জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি মহিলা আমার দিকে বার বার তাকিয়ে মিষ্টি হাসছিল। দেখতে মহিলা বেশ সুন্দরী।
কামাল আর থাকতে না পেরে অসহিষ্ণু হয়ে বলে, বাঁকা টানটা রেখে দয়, করে একটু সোজাসুজি কথা বলবি শহীদ? Sometimes you talk simply nonsensel।
এবং বুঝতে হবে তখনই আমি সিরিয়াসলি কথা বলছি
শহীদ এক মুখ ধোয়া ছাড়ে। বলে, সে যা-ই হোক। আজ সকাল সাড়ে আটটা, থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত মি. শিকদারের সঙ্গে একে একে সুলতানা পারভিন, মাহমুদ, মর্জিনা বানু, শাহেলি, রাবেয়া সৈয়দ, ডা. চৌধুরী ও রবিউল্লাহর সঙ্গে দেখা করেছি।
কামাল হাসে, তোর চেহারা দেখে কেউ সন্দেহ করেনি?
সন্দেহ করেছে। মানিকপুর থানার ও. সি. শিকদার সাহেব আমার ভাব-ভঙ্গি দেখে আমি সুস্থ কি না তা সন্দেহ করেছেন। মুখে কিছু বলেননি বটে, তবে আমি বুঝেছি।
দুজন খুব হাসলো। শহীদ বললো, বুরুজ মিঞাকে যে একমাত্র চিনতে পেরেছে সে হলো কুয়াশা। আর কেউ চেনেনি।
কামাল বললো, ভালো কথা, বেগম রশিদের সাথে দেখা করিসনি?
না প্রয়োজন বোধ করিনি।
মানিকপুরে নেমেই তদন্তের প্রথম পর্যায় তাহলে শেষ করে এসেছিস?
মোটেই না। আমি সবে তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছি। আমি কাদের ওপর তদন্ত করতে যাচ্ছি শুনবি?
কাদের ওপরে?
গুরুত্ব অনুযায়ী নামগুলো সাজিয়ে বলছি, শোন–এক হোটেল তাজের বেয়ারা মতিন, দুই কেয়ারটেকার মুন্সিজী, তিন এক্কা গাড়ির গাড়োয়ান খাঁসাব…তারপর একে একে রাবেয়া সৈয়দ, শাহেলী, মাহমুদ, সুলতানা পারভিন, রবিউল্লাহ, মেজর বদরুদ্দিন ও মি. রশিদ।
বলিস কিরে? আমার রিপোর্ট তাহলে স্থগিত রাখতে হয়?
তুই রিপোর্ট তৈরি করেছিস নাকি?
হ্যাঁ। এই দ্যাখ, পড়শেষটুকু অবশ্য তৈরি হয়নি। কিন্তু বুঝতে কিছুই অসুবিধে হবে না।
পড়ছি। ইতিমধ্যে এক পেয়ালা চায়ের হুকুম দিয়ে আয় দোস্ত। মি. শিকদার বোধহয় রিসেপশানে অপেক্ষা করছেন। তার চা-টা-ও পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর।
আমি দেখছি। তুই কাগজ কখানা দেখে ফ্যাল।
কামাল বেরিয়ে যায়। জানালার ফাঁক দিয়ে পুড়ে শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় শহীদ। টেবিলের উপর রাখা কাগজ ক খানা টেনে নেয়। হাসান মওলার খুনের তদন্তের উপর কামালের রিপোর্ট। মনোযোগ দিয়ে রিপোর্টটা পড়ে শহীদ। পড়তে পড়তে তার ক্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। কপালের বলিরেখায় ফুটে ওঠে চিন্তার ছাপ।
চায়ের কথা বলে এসে কামাল ঢোকে ঘরে। শহীদ তখন রিপোর্ট পড়া শেষ করে নতুন আর একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ টানছে।
দেখা শেষ?
হ্যাঁ। তোর রিপোর্ট আমার যথেষ্ট কাজে লাগবে।
আমার রিপোর্ট সম্বন্ধে তোর মন্তব্যটা আরো পরিষ্কার হলে ভালো হতো শহীদ।
শেষ মন্তব্যের সময় কি এসে গেছে কামালঃ আমার বিশ্বাস বাইরে থেকে যতটুকু দেখা যায় তাতে হাসান মওলার মৃত্যুর ব্যাপারে মাহমুদকে অভিযুক্ত না করে গত্যন্তর নেই এবং কার্যতঃ তুই তা-ই করেছিস।
অর্থাৎ মাহমুদ দোষী মনে হলেও আসলে সে তা নয়?
আমি কোনো মন্তব্যই করতে চাই না এখন। শুধু একটা কথা বলতে চাই, ব্যাপারটা আগাগোড়া ভুল দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা হয়েছে। ভালো কথা, মেজর বদরুদ্দিন এখনো হোটেলেই অবস্থান করছেন তো?
কামাল সবিস্তারে বেগম রশিদের পার্টিতে যোগ দেয়া থেকে শুরু করে রাজা সাহেবের মাঠে সন্ধ্যার পর অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তির সঙ্গে মেজর বদরুদ্দিনের রহস্যময় সাক্ষাৎ ও মাঠ থেকে ফিরে নাটকীয় ভাবে তার হঠাৎ পাগল হয়ে যাওয়ার কাহিনী খুলে বললো।
শহীদ সব শুনে চুপ করে রইলো। অনেকক্ষণ কথা বললো না। বহুক্ষণ পর বললো, আমি দেখা করতে চাই মেজর বদরুদ্দিনের সঙ্গে।
চা নিয়ে বেয়ারা ভিতরে ঢুকলো। শহীদ চায়ের পেয়ালা টেনে নিয়ে বললো, তোর রিপোর্ট তুলে রাখ কামাল। আমার সঙ্গে এক্ষুণি বেরোতে হবে। আর হাসান মওলার ছবি তুলে রেখেছিস লিখেছিলি। কই দেখি ছবিটা?
.
০৮.
চা খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে রিসেপশানে এলো শহীদ। থানার দারোগা মি. শিকদারের সঙ্গে দুএকটা দরকারি কথা সেরে তাকে বিদায় দিয়ে কামাল ও ম্যানেজার আইনুল হকসহ সে ঢুকলো মেজর বদরুদ্দিনের ঘরে।
কি, আমাকে চিনতে পারছেন?
চিনতে পারবো না মানে?
মেজর বদরুদ্দিনের চোখে ধমকের আগুন ফোটে। বলে, আপনি তো ক্যাপ্টেন হালিম। তা আমার কাছে এসেছেন কেন? রিপোর্ট করতে? অ্যাটেনশান প্লিজ। একমাস ছুটিতে গিয়ে দেখছি অফিশিয়েল কায়দা-কানুন সব ভুলে বসে আছেন।
শহীদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো মেজর বদরুদ্দিনের দিকে। হা হা করে হেসে উঠলো মেজর। বললো, কি হলো ক্যাপ্টেন হালিম, নিজের বসকে চিনতে পারছেন না? না, আপনার কপালে অনেক দুঃখ আছে দেখছি।
মেজর বদরুদ্দিন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা লম্বা করে বিছানায় বসে আছে। পরনে গত রাতের পোশাক। দাড়ি কামানো হয়নি দুদিন ধরে। উস্কোখুস্কো দেখাচ্ছে চেহারা।
শহীদ আবার বলে, আমাকে চিনতে পারছেন না মেজর সাহেব? আমি শহীদ। একটু ভালো রকম চিন্তা করে দেখুন তো কোথায় আমাদের দেখা হয়েছিল?
This is intolerble.
মেজর বদরুদ্দিন চেঁচিয়ে ওঠে রাগে, অভিমানে, subordinate হয়ে এ রকম কুৎসিত ব্যবহার করবে এ সহ্য করা একেবারে অসম্ভব। I say get out!
মৃদু হাসলো শহীদ। বললো, আপনি খুব চালাক মানুষ মেজর সাহেব। কিন্তু এযাত্রা খুব বোকামি করে বসেছেন। অলরাইট। বিশ্রাম করুন আপনি।
সে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। পিছনে কামাল ও ম্যানেজার আইনুল হক।
হক সাহেব, ম্যানেজারকে ডাক দেয় শহীদ।
“বলুন স্যার।
আপনার বেয়ারা মতিনকে বলুন এখানে একটু আসতে। আপনার হোটেলটা ভারি সুন্দর। হোটেলটা ঘুরে ফিরে দেখবো।
কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না আইনুল হক। বিনীত কণ্ঠে বলে, এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো শহীদ ও কামাল। তখন রোদের ঝিলিমিলি লেগেছে বাগানের কামরাঙা গাছের মাথায়। সুন্দর, উজ্জ্বল দিন।
কিছুক্ষণ বাদেই মতিন এলো। ছোটোখাটো, শক্ত-সমর্থ মানুষটা। কপালের বাঁ পাশে একটা লম্বা কাটা দাগ।
তোমার নাম মতিন?
জ্বি, হুজুর।
তোমাকে নিয়ে আমরা হোটেলটা ঘুরে ফিরে দেখতে যাচ্ছি।
চলুন হুজুর। হোটেল দেখতে অনেকেই আসেন। আপনার সঙ্গের এই হুজুর তো কামালকে দেখিয়ে অনেকবারই এসেছেন।
বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে হোটেলটা দেখে হঠাৎ কি যেন মনে পড়লো শহীদের। বললো,মতিন, কামাল সাহেবের ঘরে আমার হাতবাক্সটা আছে। হাতবাক্স খুলে আমার ক্যামেরাটা এনে দিতে পারবে? এই নাও চাবি।
কামালের ঘরের চাবি ইচ্ছা করেই শহীদ নিয়ে রেখেছিল নিজের হাতে। চাবিটা সে মতিনের হাতে দেয়। চাবি নিয়ে চলে যায় মতিন।
তোর কাণ্ড কারখানা কিছু বুঝতে পারছি না শহীদ।
বুঝতে ঠিক পারবি। চল এগোই। আচ্ছা কামাল, সামনের ঐ লোকটা কে বল্ তো, কেয়ারটেকার মুন্সিজী না?
ঠিক ধরেছিস! ডাকবো ওকে?
হ্যাঁ ডাক।
কামালের ডাকে কাছে এসে দাঁড়ায় মুন্সিজী। শহীদ বলে, এই দুপুর বারোটায় তুমি কোথায় গিয়েছিলে মুন্সিজী?
মাঠের দিক দেখিয়ে মুন্সি বলে, ওই দিকে হুজুর।
ওই দিকে যাওনি, তুমি গিয়েছিলে পাতাবাহার রোড পার হয়ে রবিউল্লাহ সাহেবের ফার্মে, তাই না?
না হুজুর, ওখানে আমি যাইনি। মুন্সি অস্বীকার করে।
মানুষের স্বভাব কখনো বদলায় না, জানিস কামাল? কামালের উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে বলে শহীদ। তাকায় মুন্সিজীর দিকে। বলে, আচ্ছা মুন্সি, রবিউল্লাহ সাহেব প্রায়ই হাসান মওলার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তাই না?
প্ৰায় কিনা জানি না হুজুর। তবে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন। মুন্সিজী এবারে অনেকটা ভয়ে ভয়ে বলে।
কখন এসেছিলেন?
তখন অনুমান রাত নটা।
হুঁ। ইদানীং মেজর সাহেবের সঙ্গে গোপনে তিনি দেখা সাক্ষাৎ করছেন, ঠিক?
মুন্সি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলে, হ্যাঁ, হুজুর।
কেন বলতে পারবে?
না হুজুর।
তুমি এসব কথা পুলিসের কাছে বলেনি কেন?
মুন্সিজী চুপ করে থাকে। ইতিমধ্যে ক্যামেরা নিয়ে ফিরে আসে মতিন। বলে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছি হুজুর।
ঠিক আছে।
ক্যামেরাটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেয় শহীদ। মুন্সিজীকে উদ্দেশ্য করে বলে, আচ্ছা, তুমি … এবারে যেতে পারো।
শহীদ ও কামালের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মুন্সিজী। বোধহয় কাকুতি-মিনতির সঙ্গে কিছু বলতেও যাচ্ছিলো। তার বলার আগেই শহীদ বলে উঠলো, তুমি যে নিরপরাধ তা আমি জানি মুন্সি। তোমার কোনো ভয় নেই। কিন্তু সাবধান, কাউকে বাঁচাতে গিয়ে মিথ্যে কথা বলতে যেয়ো না। তাহলে নিজেই শক্ত বিপদে পড়বে, বলে রাখলাম। মতিন, এখন আমরা একটু বেরোচ্ছি। তুমি যেতে পারো।
পাতাবাহার রোডের দিকে হাঁটতে লাগলো দুজনে। কামাল বললো, মনে হচ্ছে। ঘটনার সব রহস্যই তোর জানা
সে জন্যে সবচে বেশি প্রশংসার দাবি করতে পারে কে জানিস?
না।
এজন্যে প্রশংসার দাবিদার তুই। আর আমার কমনসেন্স।
শহীদ হাসে, তোর চোখ আর আমার মন দুটোই ঠিক ঠিক কাজে লেগেছে।
তাহলে তুই রহস্য উদ্ধার করেছিস?
হ্যাঁ, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা Hypothesis মাত্র, অনুমান। প্রমাণপত্র সংগ্রহের পর বলা যাবে আমি হাসান মওলার মৃত্যু রহস্য ভেদ করতে পেরেছি কিনা। মতিন ও মুন্সিজীর জবানবন্দী পেয়ে গেছি। এখন চল এক্কা গাড়ির গাড়োয়ান খাঁসাবের কাছে। আমি জানি কামাল, গাড়োয়ান খীসাবের কাছ থেকে যে জবানবন্দী পাবো তা শুনে চমকে উঠবি তুই।
বটে?
দেখিস।
একটা রিকশা করে স্টেশনে গেল ওরা। খাঁসাবকে খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হলো না। একটা জামগাছের তলায় গাড়ি রেখে ঘোড়াকে দানা খাওয়াচ্ছিল খাঁসাব। আর দুপুর একটা পয়ত্রিশের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছিল। কামাল ও শহীদকে দেখে মুখ তুলে তাকালো সে। তারপর বললো, কি স্যার, গাড়ি ভাগবো?
না গাড়ি লাগবে না। তোমার সঙ্গে একটু গল্প করতে এলাম খাঁসাব।
একটু অপ্রতিভ হয়ে খাঁসাব বলে, তা কন হুজুর, কি কইবেন।
আচ্ছা খাঁসাব, ধরো একটা মানুষ মারা পড়েছে তোমাদের মানিকপুরে। মানুষট কিসে মারা পড়লো সেটা বের করার ব্যাপারে যদি তোমার সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে,
তুমি সাহায্য করবে না?
করুম না মানে। একশোবার কম হুজুর। কন, কি লাগবো… কইয়া ফালান।
খাঁসাব উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বললো, কোন খুনের কথা কইতেছেন হুজুর? আমাগো মানিকপুরের হোটেলে যে খুনটা অইয়া গেছে হেই ঘটনার কথা কইতেছেন?
খাঁসাব তুমি ঠিক ধরেছো। হোটেল তাজে যে মানুষটা মরেছে বিষুদবার রাতে তার কথাই বলছি।
হ হুজুর। খুন রাইতে হইছে, আমরা গিয়ে শুনছি শুকুর বার বিয়ালে।
হ্যাঁ, শুক্রবার সকালে সেটা তুমি শুনেছো। আচ্ছা খাঁসাব, বিষুদবার সন্ধ্যা সোয়া সাতটার সময় একজন লোক তোমার গাড়িতে চড়ে এবং তোমাকে পঞ্চাশ টাকার একখানা নোট বকশিশ দিয়েছিল, মনে পড়ে তোমার?
খাঁসাব হাঁ করে থাকে কিছুক্ষণ। বোধহয় বিষ্যুদবার রাতের খুনের সঙ্গে এই ঘটনার সম্বন্ধ আছে ভেবে বিস্মিত হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলে, হুজুর, মাত্র তো সাত দিন আগের ঘটনা। মনে থাকবো না কেন?
যে লোকটা তোমার গাড়িতে চড়ে স্টেশনে এসেছিল তাকে চেনো তুমি?
গাড়োয়ান কথা বললো না। চুপ করে রইলো। শহীদ বললো, পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে সেই লোকটা কাউকে কিছু বলতে মানা করে গিয়েছিল তোমাকে। তাই না খাঁসাব?
হ হুজুর।
দেখো খাঁসাব, এটা খুন খারাপির ব্যাপার। তুমি যদি ঐ লোকটার নাম আমাদের বলো তাহলে কিছুতেই ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হয় না। তুমিও হয়তো হাঙ্গামায় পড়বে।
হাঙ্গামারে এই খাঁসাব ডরায় না হুজুর!
গাড়োয়ানের চোখ-মুখ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে থাকে, কিন্তু কথা অইলো আমি তোর নাম না কইলে আমার ধর্ম নষ্ট অইবো। হুজুর, ধর্ম নষ্ট করবার পারুম না আমি। যে লোকটা আমার গাড়িতে কইর্যা আইছিল তেনার নাম রশিদ সায়েব, চৌধুরী বাড়ির রশিদ সায়েব গো হুজুর।
রশিদ চৌধুরী?
কামালের মুখে আর কথা সরে না।
মৃদু হাসে শহীদ। বলে, খাঁসাব, এই কথা তুমি পুলিসের কাছে বলতে পারবে?
পারুম হুজুর। রশিদ সায়েবেরে মানি-গন্যি করি। তয় তেনি যদি খুন কইরা ছাপাইয়া ফাতে চান, তাইলে তারে ছাড়ুম ক্যান? খোদার রাজত্বে ইনসাফ কি উইঠ্যা যাইবো হুজুর? পুলিসের কাছে কমু হুজুর, দরকার অইলে হাকিমের কাছেও কমু।
গাড়োয়ান খীসাবের জবানবন্দী নিয়ে শহীদ ও কামাল আবার রিকশা নিলো। পাতাবাহার রোড ধরে রিশা এগিয়ে চললো কলোনি পার হয়ে সামনে। ডা. চৌধুরীর বাড়ির কাছে এসে রিকশা থেকে নামলো ওরা। কামাল বললো, এখানে নামলি যে?
চল গলাটা ভিজিয়ে নিই এই বাড়িতে। ডা. চৌধুরীর ডুয়িংরুমটাও ঘুরে যাবো এই অবসরে।
কামাল শহীদের চালচলন কিছু বুঝতে পারলো না। সে সজাগ কৌতূহলে অনুসরণ করলো তাকে।
একটা চাকর দেখতে পেয়ে ড্রয়িংরুমে এনে বসালো ওদের। তারপর বেগম সাহেবাকে খবর দিতে ভিতরে চলে গেল। একটা সোফায় আরাম করে বসে শহীদ বললো, সিগারেট চলবে?
দে।
একটা সিগারেট কামালকে দিয়ে নিজে আর একটা ধরালো। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললো, মানিকপুরের চৌধুরীরা খুব accomplished, কি বলিস? যে বাড়িতেই গিয়েছি, সেখানেই অভ্যর্থনার সাড়া পড়ে গেছে। দেখা যাক দ্বিতীয় কিস্তিতে রাবেয়া.. সৈয়দ কি রকম ব্যবহার করেন।
খবর পেয়ে রাবেয়া সৈয়দ এলেন স্বভাবসিদ্ধ স্থির শান্ত মুখে। দুধ সাদা শাড়ির উপর পাতলা খয়েরী রঙের চাদর জড়ানো। গায়ে কোনো অলঙ্কার নেই। নিরাভরণ দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারা। দেখলেই সম্ভ্রান্ত বলে চেনা যায়।
এবারে সত্যি সত্যি বিরক্ত করতে এলাম মিসেস চৌধুরী। সকালবেলা বলেছিলেন চা খেতে, খাইনি। তাই পুরো দেড় ঘন্টা মানিকপুরে ঘুরে ঘুরে আকণ্ঠ তৃষ্ণা জোগাড় করে নিয়ে এসেছি।
শহীদের কথায় মিষ্টি হাসলেন রাবেয়া সৈয়দ।
বললেন, আমি চায়ের কথা বলেই এসেছি।
অনেক ধন্যবাদ। ডা. চৌধুরী নিশ্চয়ই চেম্বারে?
জ্বি, হাঁ, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফিরবেন।
Excuse me,
শহীদ হঠাৎ এগিয়ে যায় দেয়ালের দিকে। দেয়ালে টাঙানো আছে পাশাপাশি দুটো অয়েল-পেন্টিং। একটা রাবেয়া সৈয়দের। কাছে গিয়ে দুটো ছবিই দেখে শহীদ। রাবেয়া সৈয়দের উদ্দেশ্যে বলে, এই ছবিটা আপনার, তাই না মিসেস চৌধুরী?
জ্বি, ছবিটা আমারই। ডা. চৌধুরীর এক বোন পো, নাম বললে হয়তো চিনবেন, কাওসার আহমদ, সে-ই আমার ছবিটা এঁকেছিল।
ছবিটা কতো বছর আগের?
অন্ততঃ দশ বছর আগের।
রাবেয়া সৈয়দ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন আর কেন যেন চোখ-মুখ শুকিয়ে আসছিল তাঁর।
শহীদ বললো, ছবিটা ভারি সুন্দর আঁকা হয়েছে। কিছু যদি মনে করেন তাহলে এই অয়েল-পেন্টিংটার একটা ফটো তুলে নিই।
না, এতে মনে করার কি আছে…
অস্ফুট গলায় বলেন রাবেয়া সৈয়দ। কামাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো দেখতে দেখতে রাবেয়া সৈয়দের চোখ-মুখ হতাশা আর ক্ষোভের ছায়ায় ভরে গেছে।
আমার হাতে যে ক্যামেরাটা দেখছেন, এর নাম M3 লাইকা। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ক্যামেরার মধ্যে এটা একটা। আপনার অয়েল-পেন্টিং-এর প্রতিটি রেখা এই ক্যামেরায় উঠে আসবে।
শহীদ ক্যামেরাটা হাতে নিতে নিতে বললো। কেন যেন একটু হাসলো। বললো, পাশের এই অয়েল-পেন্টিংটা নিশ্চয়ই আপনার বাবার?
জ্বি। কি করে বুঝলেন আপনি?
আপনার বাবার চেহারার সঙ্গে অদ্ভুত মিল আছে আপনার চেহারার। অবশ্য বংশগত ব্যাপারে এটা খুবই স্বাভাবিক। একই বংশের লোকদের চেহারায় কোনো না কোনো দিক দিয়ে মিল থাকেই। কি বলেন?
ফ্ল্যাশ-বালবের আলোটা জ্বলে ওঠে মুহূর্তে। শহীদ ছবি তুলে নেয়। রাবেয়া সৈয়দের মুখ থমথম করছে। কেউ কোনো কথা বলে না। চাকর এসে চা দিয়ে যায়। চায়ে চুমুক দিয়ে শহীদ বলে, চমৎকার চা। যেমন সুন্দর রং তেমনি গন্ধ।
রাবেয়া সৈয়দ কোনো জবাব দিলেন না।
শহীদ বললো, খুব একটা odd সময়ে এসে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত মিসেস চৌধুরী। এইবার একটা সাংসারিক ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
বসুন।
আমি শুনেছি আপনি একটা পুরানো জীপ গাড়ি বেচে নতুন গাড়ি কিনতে চান। আমি এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
ধন্যবাদ। সাহায্যের কোনো প্রয়োজন হবে না। একটা পুরানো জীপ গাড়ি অবশ্য আমার আছে। কিন্তু সেটা একেবারেই পুরানো, অচল। ওটা বিক্রি করার কথা কখনো ভাবিনি। বিক্রি করার ইচ্ছেও নেই।
তাহলে তো কথাই নেই।
শহীদ চুপ করে যায়। রাবেয়া সৈয়দ হঠাৎ বলেন, আপনি কদ্দিন মানিকপুরে আছেন?
সেটা নির্ভর করে আপনার উপর।
রাবেয়া সৈয়দ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন, মানে?
মানেটা খুব সহজ মিসেস চৌধুরী। সেটা বুঝিয়ে বলার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা এখন উঠছি। আপনি নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো একদিন আমার এখানে, মানে হোটেল তাজে আসছেন?
অসম্ভব। চুলোয় যাক আপনার শয়তানী। আমি কখনো যাবো না আপনার ওখানে।
সে যাওয়া না যাওয়া আপনার ইচ্ছে। তবে আমি আপনার জন্যে ঠিক অপেক্ষা করবো।
শহীদ উঠে দাঁড়ায়। দেয়ালে টাঙানো রাবেয়া সৈয়দ ও তার বাবার অয়েল টেন্টিংটার দিকে আর একবার চোখ তুলে তাকায়। তারপর আদাব জানিয়ে বের হয়ে আসে রাবেয়া সৈয়দের সুসজ্জিত ড্রয়িংরুম থেকে।
পথে নেমে কামাল বলে, এবার?
শহীদ হাসে। বলে, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি কামাল। আজ দুপুর বেলা মর্জিনা বানুর বাড়িতে আমাদের দুজনের দাওয়াত।
বলিস কি?
হ্যাঁ। শাহেলি মেয়েটা আচার ব্যবহারে এমন ভদ্র যে রবিউল্লাহর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে না থাকলে তোর জন্যে তাকে মনোনীত করতাম।
চুপ কর তো শহীদ। আসলে মতলবটা খুলে বল।
মতলব কিছুই না। শাহেলিকে নিজেই যেচে বলেছিলাম তোমাদের বাড়িতে আজ দুপুরবেলা চাষ্ট্রে ডাল-ভাত খাবো। তো মেয়েটা হেসে ফেললো। বললো ঠিক আছে আসবেন। খেতে হবে কিন্তু ডাল-ভাতই।
কামাল শহীদের দিকে তাকিয়ে কি যেন অনুসন্ধান করে। যে শহীদ তার অন্তরঙ্গ বন্ধু সে শহীদ মানিকপুর হত্যা রহস্য ভেদ করতে এসে কেমন যেন বদলে গেছে। তার চলাফেরা বিচিত্র হয়ে উঠেছে। মানিকপুরে দীর্ঘদিন বুরুজ মিঞার ছদ্মবেশে থাকতে থাকতে রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
শহীদ হাসে। কি দেখছিস অমন করে?
তোকে দেখছি। তুই বদলে গেছিস দোস্ত।
শহীদ বললো, তুল বললি কামাল। মানুষ কখনো বদলায় না। কুয়াশা বদলাবে না, না আমিও না, শাহেলিও না।
মানে?
মানেটা পরে বলছি। তার আগে একটা কথা বলে নিই। হাসান মওলা যে রাতে মারা যায় সে রাতে প্রায় একই উদ্দেশ্যে দুজন মানিকপুরে এসেছিল। তার মধ্যে একজন তুই।
তাহলে আর একজন কে?
মেজর বদরুদ্দিন। একই গাড়িতে করে তোরা মানিকপুর এসেছিলি। তুই বুরুজ মিঞার সন্ধানে গেলি, মেজর বদরুদ্দিন গেল স্টেশনের উত্তর দিকে কামিনী গাছের নিচে। সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বোধহয় অপেক্ষা করলো একজনের জন্যে। যে কোনো কারণেই হোক সেই লোকটা আসতে পারেনি। তখন মেজর বদরুদ্দিন নিজেই হোটেল তাজে চলে যায়। মেজর বদরুদ্দিন অত্যন্ত চতুর লোক। হোটেলে গিয়ে যখন শুনলেন হাসান মওলা আর নেই, মারা গেছে, তখন তিনি সেটাকে কাজে লাগিয়ে দিলেন।
মেজর বদরুদ্দিনের এ ব্যাপারে কি স্বার্থ থাকতে পারে?
সেটাই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি। শেষ সিদ্ধান্তে এখনো এসে পৌঁছইনি। তবে যদুর মনে হয় আলি নকিবের লক্ষ লক্ষ টাকাই এসব রহস্যের পিছনে কাজ করছে। অবশ্য শাহেলির কথা আলাদা…
মানে?
মানে যন্দুর মনে হয় একমাত্র শাহেলির সঙ্গেই চৌধুরী আলী নকীবের টাকার কোনো সম্পর্ক নেই।
মানিকপুর হত্যা রহস্যের পেছনে তাহলে সবটাই রূপের ঝলক
শহীদ বললো, বলা শক্ত। আরো কিছুদিন যাক। আমার বিশ্বাস এ ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ নতুন কিছু বলতে পারবো।
আমার কিন্তু ধারণা ব্যাপারটা একেবারেই সাদামাটা।
কামাল বললো, ঘটনা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টই বোঝা যায় মাহমুদই খুন করেছে হাসান মওলাকে।
চোখ নাচিয়ে কৌতুকের স্বরে শহীদ বলে, ভালো। তাহলে চৌধুরী আলী নকীবকে কে খুন করেছে?
কুয়াশা। হয়তো আলী নকীবের টাকার উপর লোভ পড়েছিল কুয়াশার
শহীদ গম্ভীর হয়ে পড়ে। বলে, কিন্তু টাকার জন্যে খুন করা কুয়াশার ধর্ম নয়। এই ব্যাপারটাই গোলমেলে লাগছে। যাকগেদেখা যাক কি দাঁড়ায় ব্যাপারটা।
শহীদ ম্লান হাসলো। সামনে মর্জিনা বানুর বাড়ি। বাড়ির সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল শাহেলি।
বোধহয় শহীদের জন্য অপেক্ষা করছিল সে।
.
০৯.
খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় পাতা চেয়ারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো শহীদ ও কামাল। মর্জিনা বানু ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেদের দুরবস্থার কথা বলতে লাগলেন। সেই সঙ্গে বড় কর্তা চৌধুরী আলী নকীব বেঁচে থাকাকালীন মানিকপুরে চৌধুরীদের কি শান–শওকত আর ইজ্জত ছিলো তারও জারী গাইলেন।
শহীদ রীতিমত মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। এক সময় সে বলে উঠলো, সুলতানা পারভিনই তাহলে আপনাদের সব দুর্দশার মূল কারণ, কি বলেন?
সে আর বলতে বাবা! রাক্ষুসী মানিকপুরে এসে মানিকপুরের চৌধুরীদের সাজানো সংসার যেন তছনছ করে দিলো।
আঃ আম্মা, কি যা-তা বকছো…
শাহেলি বিরক্ত হয়ে বাধা দেয়। বলে, এসব পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে কি লাভ।
মর্জিনা বানু বিড়বিড় করেন। বলেন, লাভ-লোকসানের তুই কি বুঝবি শাহেলি! তোর বয়স কম। রক্ত তাজা। ঐ রাক্ষুসী আমাদের কি সব সর্বনাশ করেছে তা তুই বুঝবি না মা!
শাহেলি আর কথা বাড়ায় না। কামাল লক্ষ্য করে সুলতানা পারভিনের কথায় মর্জিনা বানুর চোখ দুটি যেন হিংস্র বাঘিনীর মতো জ্বলে উঠলো।
শহীদ বললো, চৌধুরী আলী নকীবের খুনের ব্যাপারে আপনার কাকে সন্দেহ হয় মিসেস চৌধুরী।
মর্জিনা বানু বলেন, কাকে আবার? মাহমুদকে। ওটা একটা দাগী ডাকাত বাবা। ওর চোখ দুটি দেখে বুঝতে পারো না ও একটা খুনী?
শহীদ আর কথা বাড়ায় না। চৌধুরী পরিবারের সবাই সুলতানা পারভিন আর তার বড় ভাই মাহমুদের উপর দারুণ খেপে আছে। অবশ্য খেপে যাওয়া স্বাভাবিক। সুলতানাকে বিয়ে করে চৌধুরী আলী নকীব সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিলেন। বার্ষিক ছাপ্পান্ন লক্ষ টাকা আয়ের সম্পত্তি তিনি উইল করে দিয়েছেন সুলতানা পারভিনের নামে। এই ক্ষতি চৌধুরীদের পক্ষে দুর্বহ। সে কিছুক্ষণ এটা ওটা নিয়ে কথা বললো। তারপর উঠে পড়লো।
এবারে আমরা উঠি মিসেস চৌধুরী। অনেক দিন পরে তৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ রইলো।
তাহলেই দেখুন, শাহেলি হাসলো, ডাল-ভাতই খেতে চেয়েছিলেন, ডাল-ভাতের কি গুণ।
এবার তো ডাল-ভাতই খেয়ে গেলাম, আর কদিন পর পোলাও কোর্মা খেতে আসবো।
কামাল বেশ গম্ভীর চালে বলে, তারিখটা কিন্তু জানাতে ভুলবেন না।
শাহেলি বুঝলো কামাল তার আসন্ন বিয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটু লজ্জিত হেসে চুপ। করে রইলো।
হোটেলে ফিরে এলো শহীদ ও কামাল। ম্যানেজার আইনুল হক শহীদের নির্দেশ মতো কামালের ঘরেই আর একখানা খাট ফেলে শহীদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। ঘরে ঢুকেই প্রথমে কামাল জুতো জোড়া পা থেকে একরকম খামচিয়ে নামালো। তারপর নিজের বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে পড়লো। বললো, চুলোয় যাক হাসান মওলা আর রহস্য। Now I am the king of my sweet bed. শহীদ, আমি একটু চোখ বুজলাম।
শহীদ কোনো জবাব দিলো না। ঘরে ঢুকে প্রথমেই সে হাত-বাক্সটা খুলেছিল। হাত-বাক্সের ভেতরটা ভালরকম পরখ করে একটা গভীর আত্মবিশ্বাসের হাসি ফুটে উঠলো তার চোখে-মুখে। সে দেখলো হাত-বাক্সটার পাশেই টেবিলের উপর কয়েকখানা পাঁচ টাকা আর একটাকার নোট যেমন রেখে গিয়েছিল তেমনি আছে। একটা পয়সাও খোয়া যায়নি। একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শহীদ। কিছুক্ষণ চুপচাপ টানে।
তারপর সে কামালের দিকে তাকায়। কামালের তখন নাক ঢাকছে। একটু হাসলো শহীদ। কামালের স্বভাবটাই অমনি আয়েশী ধরনের। আগের তুলনায় এখন আরাম আয়েশ অনেক কমে এসেছে কামালের, তবে ভরপেট খাওয়ার পর নরম বিছানায় দিবা নিদ্রার অভ্যেসটা কামাল এখনো ছাড়তে পারেনি।
কামালকে না জাগিয়ে শহীদ তার নোটবুকে প্রয়োজনীয় দুএকটা কথা টুকে নিচ্ছিলো, এমন সময় কে যেন বাইরে থেকে দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দিলো। শহীদ লেখা বন্ধ করে ছোটো নোট খাতাটা পকেটে পুরলো। তারপর গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
বাইরে ভগ্নাদূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আইনুল হক। বললো, অসময়ে ডিসটার্ব করতে এলাম স্যার।
বলুন কি ব্যাপার?
সাঘাতিক ব্যাপার স্যার। মেজর সাহেবকে পাওয়া যাচ্ছে না।
শহীদ একটুও অবাক হলো না। বললো, কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?
লাঞ্চের আগে থেকে স্যার। তার ঘরের পিছনের দরজা খোলা। আমি এতক্ষণ রিসেপশানে ব্যস্ত ছিলাম। লাঞ্চের সময় খাবার দিতে গিয়ে জানা গেল মেজর সাহেব নেই।
শহীদ হাসলো, দিনে দুপুরে মানুষ ডাকাতি? কি আর করবেন? থানায় একটা রিপোর্ট দিয়ে রাখুন।
রাখবো স্যার। থানায় যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আগে আপনাদের পরামর্শ নিই তারপর যা করতে বলেন তাই করবো। স্যার, আর একটা খবর। রিসেপশানে মাহমুদ শাহেব আপনার জন্যে বসে আছেন।
বসতে বলুন, আমি আসছি।
আইনুল হক চলে যায়। শহীদ পরনের কাপড় ছেড়ে এক প্রস্থ নতুন কাপড় পরে নেয়। মানিকপুরের সব ঘটনাই এখন রহস্যের বৃত্তে একে একে দেখা দিচ্ছে। মেজর বদরুদ্দিন দিনে দুপুরে নিখোঁজ হলো, আর সেই খবর দিয়ে গেল কিনা ম্যানেজার আইনুল হক। লোকটা হোটেলের চাকরি করছে বটে কিন্তু চালকের হাঁড়ি। খবরটা দিতে এসে ভাব দেখালো যেন এই ব্যাপারে কিছুই সে জানতো না।
শহীদ মনে মনে হাসলো। সব অবস্থায়ই মানুষ একটা বন্ধন স্বীকার করে নেয়। কোথাকার কে এক বিদেশী আইনুল হক, মানিকপুরে এসে সে পর্যন্ত আবেগের বন্ধনে আটকা পড়লো। জড়িয়ে পড়লো মানিকপুর হত্যারহস্যের কেন্দ্রীয় ঘটনায়।
হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। চারটে বাজে। একটা কাগজে লিখলো, কামাল, তুই ঘুমোচ্ছিস দেখে একাই বেরোলাম। মানিকপুর চষে বেড়াবো যতোটা সন্ধ্যা পর্যন্ত সম্ভব। তুই সাড়ে সাতটায় থানায় আসবি। সাড়ে সাতটার মধ্যে আমি থানায় ফিরে আসবো। ইতি-শহীদ।
কাগজটা সে কামালের টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসের মধ্যে তার প্রিয় কোন্ট গভর্নমেন্ট অটোমেটিক .455 ক্যালিবার পিস্তলটা নিতে সে তুললো না।
রিসেপশানে এসে দেখলো মাহমুদ অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। তার চোখ-মুখ রাগে লাল। শহীদকে দেখে পায়চারি থামিয়ে সে থমকে দাঁড়ায়। বিনা ভূমিকায় বলে,
আপনার কাছে এসেছি মি. শহীদ, আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন।
শহীদ বললো, বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি।
আমার ছোটো বোন মিসেস সুলতানা পারভিন চৌধুরী: খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অনতিবিলম্বে তার ভালো চিকিৎসা করা, প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকে নিয়ে আমি আপাততঃ ঢাকা যেতে চাই। দরকার হলে টাকা থেকে ন্যত্র।
বেশ তো যান না। আপনাদের বাধা দিচ্ছে কে?
বাধা দিচ্ছে কে? তা বটে। বলেছেন ভালো, বাধা দিচ্ছে কে। বাইরে থেকে বলা সহজ বটে যে আমাদের কেউ বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু ধরুন এই মুহূর্তে আমরা যদি মানিকপুর ত্যাগ করি তাহলে হাসান মওলার খুনের ব্যাপারে সব সন্দেহই কি আমাদের উপর গিয়ে পড়বে না?
শহীদ বললো, সে সন্দেহ মানিকপুর থাকলেও আপনাদের ওপর পড়তে পারে। এবং সম্ভবতঃ পড়েছেও। কিন্তু লোকের সন্দেহের এতো পরোয়া কেন আপনার মাহমুদ সাহেব?
সে আপনি বুঝবেন না। গরীব ছিলাম, ডাকাতি করে বেড়াতাম আফ্রিকায়, সেই বোধহয় ছিলো ভালো। লক্ষ লক্ষ টাকা পেয়ে সুখ গেছে, শাস্তি গেছে, স্বস্তিটুকু পর্যন্ত নেই। মানিকপুরের ঐ সব mean minded চৌধুরীরা আর আপনাদের ঐ বোকার ধাড়ী পুলিসগুলো মিলে জীবন একেবারে বিষময় করে তুলেছে।
জীবন আবার সুখময় করে তুলুন না। আপনাকে বাধা দিচ্ছে কে?
আবার বলছেন বাধা দিচ্ছে কে? ধরুন যদি বলি বাধা দিচ্ছে আপনাদের ঐ বুদ্ধির টেকি পুলিসের দারোগা, বাধা দিচ্ছে ডা. চৌধুরী…
ডা. চৌধুরী?
চকিত হয় শহীদ। বলে, তিনি কিভাবে বাধা দিচ্ছেন?
কিছু না। তিনি আমার বোন সুলতানার চিকিৎসক হিসেবে আছেন কিছুদিন ধরে। প্রথম দিকে সুলতানার সর্দি মতো হয়েছিল, তা ধারে কাছে তেমন কেউ ছিলো না বলে ডাক্তার চৌধুরীকে কল দেয়া হয়। তিনি চিকিৎসার ভার নেয়ার পর সামান্য সর্দিটাই বেড়ে গিয়ে এমন স্টেজে পৌঁছেছে যে এখন সুলতানার অসুখটা রীতিমত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা সুলতানাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবার কথা সেদিন বললাম ডা. চৌধুরীকে। ডা. চৌধুরী সরাসরি কি মন্তব্য করলেন জানেন? বললেন রোগী এখন তাঁর হেফাজতে আছে। তার শক্তিতে যখন কুলোবে না তখন তিনি নিজেই চিকিৎসার জন্যে সুলতানাকে অন্যত্র পাঠাবার উপদেশ দেবেন।
অর্থাৎ ডা. চৌধুরী আপনার বোন মিসেস চৌধুরীকে অন্যত্র পাঠাবার অনুমতি দেননি?
না দেননি। এদিকে সুলতানার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাইরে থেকে ঠিক হয়তো বোঝা যাবে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে
তা বেশ, আপনার অবস্থা বুঝলাম। এখন আপনি আমার কাছে কোন ধরনের সাহায্য চান?
ডা. চৌধুরীকে আমি ঘোড়াই কেয়ার করি। ওঁর কথা বাদ দিন। আমি শুধু চাই পুলিসের অনুমতি। এ ব্যাপারে আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন মি. শহীদ।
আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন মাহমুদ সাহেব। আমি পুলিসের লোক নই। অনুমতি দেওয়ারও মালিক নই। পুলিসকে যতখানি influence করতে পারি তা আপনার কাজে আসবে না। আপনি বরং ডা. চৌধুরীর চিকিৎসার উপরেই আপনার বোনকে রাখুন।
আপনি বলছেন মি. শহীদ?
শহীদ একটু হেসে বললো, মনে হচ্ছে আমার কথার খুব মূল্য দেবেন আপনি?
Absolutely. বিশ্বেস করুন, আপনার একটা কথার দাম আমার কাছে অনেক।
বটে।
বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছা। আচ্ছা সুলতানাকে নিয়ে চিকিৎকার জন্যে অনত্র যাওয়া এখনকার মতো তাহলে স্থগিত রাখলাম মি. শহীদ। কিন্তু একটা কথা আপনাকে স্পষ্টই বলে যাই, I dont belive chowdhuries of manikpur–মানিকপুরের চৌধুরীদের আমি একবিন্দু বিশ্বাস করি না। ডা. চৌধুরীকে তো নয়-ই। ডা. চৌধুরী আর তার স্ত্রী রাবেয়া সৈয়দ শয়তানের ভিতর বাড়ী শয়তান, পাজীর ভিতর বড় পাজী। আচ্ছা আসি তাহলে…
আসুন।
দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় মাহমুদ। বলে, এ ব্যাপারে আপনার কাছেই কেন এসেছিলাম জানেন?
না।
মাহমুদ গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, কারণটা আমিও জানি না। বোধহয় মনে হয়েছিল যে আপনি আর দশটা লোক থেকে একটু পৃথক। আপনি নিশ্চয়ই আমার কথাগুলো বুঝবেন। তাই এসেছিলাম। আচ্ছা, আসি এখন।
মাহমুদ চলে যায়। বাইরে একটা মিলিটারী ট্রায়াম্প মোটর সাইকেলের বিকট গর্জন শোনা যায়। মোটর সাইকেলটা রাস্তায় নেমে ছুটতে থাকে পাতাবাহার রোড, ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা অদৃশ্য হয়ে যায় রাস্তার বাঁকে।
মাহমুদ চলে যাবার পর ঘরে ঢুকলো আইনুল হক। ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা। শহীদের দিকে তাকিয়ে বললো, মাহমুদ সাহেব চলে গেছেন স্যার?
মৃদু হেসে শহীদ বলে, ঐ লোকটাকে আপনারা সবাই খুব ভয় করেন, তাই না হক সাহেব?
করি স্যার, মিথ্যে বলবো না, করি। এই মাহমুদ সাহেব ছসাত মাস হয়েছে মানিকপুরে এসেছে, এরই মধ্যে চারদিকে হাহাকার পড়ে গেছে স্যার। লোকটা একেবারে যাকে বলে
বলেই আইনুল হক থেমে যায়। কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, থাক, স্যার বলবো না। দেয়ালেরও কান আছে। আমরা হলাম গরীব ছাপোষা লোক। পেটের দায়ে বিদেশ বিভুই-এ চাকরি করতে এসে শেষে কি প্রাণটা দেবো?
শহীদ কোনো কথা বলে না। রিসেপশান থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। ছোটো কীকর ঢালা একটা পথ বাগানের ভিতর দিয়ে গেট পর্যন্ত গেছে। বাঁদিকে শুরু হয়েছে প্রকাণ্ড রাজা সাহেবের মাঠ। ঢালু মাঠের দিগন্তে দেখা যাচ্ছে পীরগঞ্জের টিলা। গেটের ডান পাশে পাতাবাহার রোডের শুরু। রাস্তাটা থানা, হাসপাতাল, শাল মহুয়ার অরণ্য পার হয়ে চলে গেছে চৌধুরী কলোনীর দিকে। কলোনী থেকে রাস্তাটা স্টেশন পর্যন্ত বিস্তৃত। এই রাস্তার পাশেই পড়েছে মানিকপুরের বিখ্যাত চৌধুরীদের বাড়িগুলো। প্রথমে পড়ে চৌধুরী রশিদের বাড়ি। তারপর ডা. চৌধুরীর বাড়ি, তারপর মর্জিনা বানুর বাড়ি। মর্জিনা বানুর খুব নিকটেই রয়েছে চৌধুরী আলী নকীবের চৌধুরী কুটীর। রবিউল্লাহর বাড়ি পড়েছে সর্বদক্ষিণে।
শহীদ পাতাবাহার রোড থেকে নেমে একটা সরু গলির পথ ধরলো। দুপাশে কাঠের ও টিনের বাড়ি, শাল, কড়ুই ও বন্দিরাজ গাছ। মাঝে মাঝে দোকানপাট। রাস্তা ভর্তি লাল ধুলো উড়িয়ে দুএকটা রিকশা বা গরুর গাড়ি চলে যাচ্ছে। কিছুদূর যেতেই বাঁয়ে পড়লো হাসপাতাল। হাসপাতাল পার হয়ে পড়লো একটা ছোট ফাঁকা মাঠ। চারপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। মাঠের ওপারে ঘন-সন্নিবিষ্ট গাছপালার ফাঁকে একটা পাকা দালানের কিয়দংশ নজরে পড়লো। আসলে শহীদ হোটেল তাজ থেকে রবিউল্লাহর ফার্মের ভিতরকার সংক্ষিপ্ততম রাস্তাটা কি হতে পারে জানার জন্যে বেরিয়েছিল। হঠাৎ মাঠের ওপারে চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। একটা নতুন ঝকঝকে মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শহীদ গাড়িটা চিনতে পারলো। মাহমুদের গাড়ি। সে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল দালানটার দিকে।
দালানটা দেখে চিনলো শহীদ। সালু কাপড় দিয়ে ঘেরাও করা পাকা কবর দেখা যায় উঠানে। পাকা স্তম্ভের উপর অনেকগুলো লাল নিশান উড়ছে। এটা পীরের দরগা। পীরের দরগায় মাহমুদ কি করতে এসেছে ভাবছে শহীদ ঠিক এসময় দরগার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো সুলতানা পারভিন।
শহীদকে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হঠাৎ সে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
সঙ্গের ড্রাইভার সন্ত্রস্ত হয়ে বললো, কি হয়েছে মাঈজি
সুলতানা পারভিন কোনো জবাব দিলো না। সম্মোহিতের মতো সে এগিয়ে গেল শহীদের দিকে। ভয়ে তার চোখ কাঁপছে। ঠোঁট নীল। ফিসফিস করে বললো, আমি হজরত পীর বাবাজীর দোয়া পেয়ে গেছি। আর আমাকে কিছু করতে পারবে না।
শহীদ মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। স্থিরভাবে বললো, তার চেয়ে সব কথা আমাকে আপনি খুলে বলুন মিসেস চৌধুরী।
বোধহয় সেই ভালো হয়,
হঠাৎ সুলতানা পারভিনকে দারুণ ক্লান্ত মনে হলো। বললো, আমি আর কিছুতেই পারছি না। সব কথা আমার বুকে চেপে আছে। আমি এসব থেকে মুক্তি পেতে চাই। শুনবেন আপনি আমার কথাগুলো?
শহীদ বললো, আপনি যদি বলেন নিশ্চয়ই শুনবো।
হ্যাঁ বলবে। আপনাকেই বলবো। আপনি কাল আমার ওখানে আসুন। কিন্তু…
বলুন…
দুহাতে মুখ ঢাকলো সুলতানা পারভিন। ফুঁপিয়ে উঠলো। বললো, কিন্তু সব কথা শোনার পর আপনারা যদি আমাকে জেলে পাঠান? যদি শাস্তি দেন?
জেল থেকে বাঁচার ঐ একটাই উপায় এখনো ভোলা আছে মিসেস চৌধুরী। সব স্বীকার করলে আপনাকে বাঁচিয়ে দেয়া হবে। নতুবা সব ব্যাপার যখনই হোক আমরা জানবোই। তখন আপনাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
ড্রাইভার নিবিষ্ট মনে কি যেন শুনছিল। সে এবারে তাড়া দিয়ে বলে, গাড়িতে গিয়ে বসুন মাঈজি। সাঁঝ হয়ে আসছে।
শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুলতানা পারভিন।
শহীদ বললো, কাল নটার ভিতর আপনার ওখানে আমি যাবো মিসেস চৌধুরী।
আসুন।
ভাঙা গলায় বললো সুলতানা পারভিন। আস্তে আস্তে গাড়িতে গিয়ে বসলো। গাড়ি গর্জন তুলে স্টার্ট নিলো। মাঠের উপর দিয়ে দ্রুত গতিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেল মানিকপুর। শহীদ এগিয়ে চললো সামনে। কিছুদূর গিয়ে পড়লো একটা বাঁশবন। বাতাস হিস হিস শব্দ তুলছে বাঁশবনে পাতায় পাতায়। কি একটা রহস্য যেন থমথম করছে চারদিকে। শহীদ বুঝলো মানিকপুরের বসতি এখানেই শেষ হয়ে গেছে। বাঁশবন পেরোতেই পড়লো মাঠ। রবিউল্লাহর ফার্ম। মাঠের পুবধারে রবিউল্লাহর খামারবাড়িতে আলো জ্বলছে। শহীদ অনুমান করলো হোটেল তাজ থেকে হাঁটা পথে খামার বাড়ি পৌঁছতে পনেরো থেকে বিশ মিনিট সময় লাগবে।
খামারবাড়ির বাইরে উঠোনে পা দিয়েই ঘরের ভিতর দুজন মানুষের গলার স্বর গুনলো শহীদ। একজনকে সে চিনলো। রবিউল্লাহ। রবিউল্লাহ বলছিল, তোমাদের অতো চিন্তা ভাবনার দরকার কি বাপু? কাজ ধরো গে তোমরা..আমি করবো। তোমরা পায়রা সাহায্য করো, না পারো
আর একজন নিচু গলায় অনেকটা কাঁচুমাচু হয়ে বললো, আগে তো ভয় পাই নাই মামু। কিন্তু এখন
চুপ করো, কথা বলো নাতো সব উজবুক।
রবিউল্লাহ ধমক দিলো। ব্যাপারটা কদুর গড়ায় শোনার জন্যে উদগ্রীর ছিলো শহীদ। আবদুল তখন আখ খেত থেকে খামার বাড়িতে ফিরছিল।
কেডা গো, হ্যাঁ?
আবদুল চেঁচিয়ে উঠে, ঐহানে খাড়ায়ে আছে কেডা?
মুহূর্তেই ঘরের ভিতরকার কথাবার্তা থেমে যায়। কে একজন যেন চকিতে সরে গেল পিছনে।
আর লুকিয়ে থাকার অর্থ হয় না। শহীদ বললো, আমার নাম শহীদ খান, রবিউল্লাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্যে এসেছি।
মুহূর্তেই খুলে যায় ঘরের দরজা। এক ঝলক আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাইরের অন্ধকারে। রবিউল্লাহ বেরিয়ে এসে বলে, মি, শহীদ? কি আশ্চর্য, বাইরে কেন? দয়া করে যখন এসেছেন তখন ধরুন গে আপনার বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? আসুন, ভিতরে আসুন।
শহীদ ভিতরে ঢুকলো। ঘরের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে ষণ্ডামার্কা একটা জোয়ান লোক। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিলের চারপাশ ঘিরে কয়েকখানা কাঠের চেয়ার। বাঁদিকে মস্ত বড় দুটো খোল শেফ। একই সারিতে একটা আলমারী। ঘরের এক কোণে একটা তক্তপোষ। তক্তপোষের উপর নতুন এক প্রস্থ বিছানা পাতা।
শহীদ বলে, ডিসটার্ব করলাম না তো?
না, না ডিসটার্ব কিসের?
রবিউল্লাহ অমায়িক হাসলো, আমার এই লোকটাকে নিয়ে খুব মুস্কিলে পড়েছি। ভাবছি নতুন একটা ব্যবসায়ে হাত দেবো। ও খুব ভয় পেয়ে গেছে। বলছে সিজন নাকি খুব খারাপ যাচ্ছে এখন। তা যাকগে এসব। অসময়ে গরীবের এই ফার্মে হঠাৎ পদধূলি যে?
রাত্রিবেলা নিশ্চয় আপনার ফার্ম দেখতে আসিনি। শহীদ রহস্য করে বলে, এসেছিলাম একজন মানুষের খোঁজে।
মানুষের খোঁজে? আমার এখানে? বলেন কি?
ঠিকই বলছি। মানুষটা খুব খেল দেখাচ্ছে মানিকপুরে। যাকগে…ঐ লোকটার খোঁজ আমি আগেই পেয়ে গেছি রবিউল্লাহ সাহেব। আপনার এখানে এসেছিলাম just for a strolling. একটু ঘুরতে ফিরতে। তা আপনি বুঝি রাত্রিবেলা এখানেই আজকাল থাকতে শুরু করেছেন রবিউল্লাহ সাহেব? তক্তপোষে নতুন বিছানা পাতা দেখছি।
ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যায় রবিউল্লাহর মুখ। আমতা আমতা করে বলে, ফার্মের হিসাব-পত্র দেখতে দেখতে আজকাল অনেক রাত হয়ে যায়। তাই অনেক সময় এখানেই চাট্টি খেয়ে শুয়ে পড়ি।
তাই!
শহীদ একটু হাসে। কথা বাড়ায় না। রবিউল্লাহ কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। চায়ের অর্ডার দিয়ে সে রীতিমত আলাপ ফেঁদে বসলো শহীদের সঙ্গে। রবিউল্লাহ ব্যবসা বোঝে ও মানুষ চেনে। শহীদ মনে মনে তার সঙ্গে তুলনা করলো মাহমুদ, ডা. চৌধুরী ও রশিদ সাহেবের। না, রবিউল্লাহর সঙ্গে এদের কারো তুলনা চলতে পারে না। এক হিসাবে রবিউল্লাহ অদ্বিতীয়।
ঘড়ি দেখে উঠলো শহীদ। রবিউল্লাহ প্রায় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো তাকে। রাস্তায় উঠে শহীদ আবার একা। আকাশে লক্ষ তারার দীপালী। আশেপাশে দোকান পাটের আলো। এখানে ওখানে আলোছায়া।
আশ্চর্য এক সুন্দর অথচ রহস্যময় রাত নেমেছে মানিকপুরে। শহীদ থানায় ফিরলো কাঁটায় কাঁটায় সাতটায়। দেখলো কামাল আগেই ওখানে এসে পৌঁছেছে। মুখোমুখি চেয়ারে বসে গল্প করছে শিকদারের সঙ্গে।
শহীদকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় মি. শিকদার। শহীদ বলে, খানিকটা চক্কর মেরে এলাম আপনার এলাকায় মি. শিকদার।
আপনি বেরিয়েছেন তা শুনেছি স্যার। আমরা এখানে বসে আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।
শহীদ একটা চেয়ার টেনে বসে। শিকদারও আসন নেয়। শহীদ বলে, মানিকপুর বাসস্ট্যাণ্ড আর রেলওয়ে স্টেশনে আজ রাতেরবেলা কজন লোক রাখার ব্যবস্থা করতে হবে শিকদার সাহেব।
রাখবো স্যার।
অঙ্কন বিদ্যায় আমি খুব পারদর্শী নই। তবু কাজ চালাবার মতো একটা লোকের চেহারা এঁকে দিচ্ছি
শহীদ হাসে, এই লোকটার কতগুলি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে দিচ্ছি কাগজে। আপনি যাদের পাঠাবেন তাদের এই ছবিটা দেখাবেন। এই লোকটাকে ধরতে হবে। Please mind it, এই লোকটাকে ধরতে পারলেই আমাদের পঁচাত্তর ভাগ কাজ শেষ।
লোকটা বুঝি মানিকপুর থেকে আজ রাতে ভাগছে স্যার?
ঠিক তাই। দাঁড়ান ছবিটা একে দিচ্ছি
.
১০.
শহীদ, কামাল থানা থেকে যখন ফিরলো তখন রাত নটা। রিসেপশানে গম্ভীর মুখে বসেছিল ম্যানেজার আইনুল হক। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। শহীদ বললো, হক সাহেব নিশ্চয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন?
কি করে জানলেন স্যার…একটু বিস্ময়ের ভাব ফুটে ওঠে হক সাহেবের চেহারায়। বলে, সন্ধ্যার দিকে বড় বাড়ি থেকে কালু পিয়ন এসেছিল স্যার।
বড় বাড়ি মানে চৌধুরী আলী নকীবের বাড়ি। শহীদ বললো, কি ব্যাপার?
মাহমুদ সাহেব একটা চিঠি পাঠিয়েছেন আপনাদের কাছে। এই যে স্যার চিঠি।
একটা সাদা খাম শহীদের দিকে এগিয়ে দেয় হক সাহেব। চাপা গলায় বলে, কথায় বলে শয়তানকে নাকি আজরাইলও ভয় পায়। কি না কি আছে চিঠিতে, আমি তো ভয়ে কাবু হয়ে আছি সেই থেকে।
শহীদ হাসে একটুখানি। কামাল বলে, মেজর সাহেবের কোনো খোঁজ মিললো হক সাহেব?,
কপাল দেখায় হক সাহেব, না, স্যার। দুর্ভোগ আছে ললাটে, পোয়াতেই হবে। ভাবছি কদ্দিনে এই মানিকপুর ছেড়ে বেরোতে পারবো।
ঘরে এসে খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বের করে শহীদ। সংক্ষিপ্ত চিঠি। মাহমুদ লিখেছে? প্রিয় শহীদ সাহেব, কামাল সাহেবহীন দস্যু কুয়াশার কথা নতুন করে আপনাদের কাছে আশা করি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কুয়াশা আজ আমার বাড়ি লুট করতে আসবে। আমি উপযুক্ত পাহারার ব্যবস্থা করেছি বটে, নিজেও সবদিক দিয়ে সতর্ক হয়ে আছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি কিছুতেই ভরসা পাচ্ছি না। কুয়াশা আমাকে সাত দিনের সময় দিয়েছিল। আজ শেষ দিন। আমার বিশ্বাস কুয়াশা আজই তার কার্যসিদ্ধি করার চেষ্টা করবে। কুয়াশার কথা আর কাজে অমিল কখনো দেখিনি। আপনাদের কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করি। পুলিসের ওপর আমার আস্থা নেই। এ ব্যাপারে তাদের কিছুই জানাইনি। আশা করি এই সংকটে একটা হীন দস্যুর হাত থেকে আমাকে আপনারা রক্ষা করার জন্য দয়া করে এগিয়ে আসবেন।
ইতি বিনীত,
মাহমুদ।
চোরের ওপর বাটপার লেগেছে। কামাল হাসে।
শহীদ হাসে না। বলে, আমার কিন্তু অবাক লাগছে কুয়াশার কাণ্ডকারখানা দেখে।
কি রকম?
কুয়াশাকে আমরা দুজনেই চিনি। কুয়াশা ছিঁচকে ডাকাত নয়। এভাবে ওয়ার্নিং দিয়ে টাকা লুটের পরিকল্পনাও তার পক্ষে একটু অস্বাভাবিক। তাহলে ব্যাপারটা কি?
এমনও হতে পারে কুয়াশার সঙ্গে মানিকপুর হত্যা রহস্যের কোনো সম্পর্ক নেই।
কামাল বললো, হয়তো মানিকপুরে কুয়াশার অবস্থান একটা অ্যাকসিডেন্ট।
না, তা হতে পারে না। মানিকপুরকে কেন্দ্র করে কোনো একটা প্ল্যান কুয়াশার নিশ্চয় ছিলো। তোকে তো বলেছি চৌধুরী আলী নকীব যে রাতে খুন হন সে রাতে কুয়াশাকে আমি নাভানা ক্লাব থেকে পালিয়ে যেতে দেখেছিলাম। কুয়াশার একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। সে মানিকপুরের কোথাও আত্মগোপন করে আছে। রাজা সাহেবের মাঠের শেষ মাথায় পীরগঞ্জের টিলার কাছে রোজ রাতে মশালের আলো আর সরোদের বাজনার একটা অর্থ রয়েছে।
শহীদ গম্ভীর হয়ে ওঠে। কামাল বলে, কুয়াশা সত্যি রহস্যময়। A misguided genius.
শহীদ বলে, কিন্তু এই কথার পরেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না কামাল। কি করতে হবে আদেশ করুন গুরুদেব।
আপাততঃ ডিনার। তারপর…
খাবারের নামে অতি উৎসাহী কামাল বাধা দিয়ে বলে, আহা, পরের কথা পরে। আগে তো খাই। পরে দেখা যাবে কি করা দরকার। চল…
.
পীরগঞ্জের টিলার কাছে একটা আলোছায়া মূর্তি দাঁড়িয়েছিল। এখানে ওখানে ঘন কাঁটামেদি আর বাবলা গাছের ঝোঁপ, চারদিকে ঝিঁঝি ডাকছে। উপরের আকাশে অজস্র রূপালী তারা জ্বলছে। হাওয়ার গায়ে শীতের চাবুক। লোকটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। হাতের ঘড়ি দেখলো।
আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো একটা দীর্ঘদেহ আলখেল্লা ধারী লোক।
কে, মান্নান?
হুঁ।
কাজ হয়েছে?
হয়েছে।
বেশ। সবদিকে লক্ষ্য রেখো।
প্রথমোক্ত আবছায়া মূর্তিটা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। একটা ঝোঁপের কাছে এসে সে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কি একটা সঙ্কেত শোনার চেষ্টা করলো যেন। ইতিমধ্যে সেই লোকটা যার নাম মান্নান, উল্টোদিকের একটা পথ ধরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
স্থির কালো ছায়ামূর্তিটা কান পেতে রইলো কিছু একটা শব্দ শোনার জন্য।
.
একটা ঠুকঠুক ক্ষীণ শব্দ। কান খাড়া করলে মাহমুদ। শব্দটা বহুদিন সে শুনেছে। শব্দটা কিসের?
সে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো। চারদিকে দরজা জানালা বন্ধ। উপরের ভেন্টিলেটারের সামান্য আলোবাতাসের পথটাও বন্ধ করে দেয়া আছে। ঘরে শক্তিশালী বিজলি বাতি জ্বলছে। মাহমুদের হাতের মুঠোয় গুলি ভরা পিস্তল। আজকের প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান। অন্যমনস্ক হলে আজ চলবে না। কুয়াশা যদি কথামত আজ আসে তাহলে তার রক্ষা নেই। মাহমুদের হাতে তার নিস্তার নেই।
মাহমুদ পায়চারি করতে লাগলো ঘরময়। সে কি ভয় পেয়েছে? হা, ভয় পেয়েছে বৈ কি। কুয়াশাকে ভালো করেই সে জানে। ফাতু কথা বলার লোক কুয়াশা নয়, যা বলে তা করবেই।
উঃ, কি প্রচও লোভ লোকটার। মাহমুদ ক্ষোভে আর আক্রোশে দাঁতে দাঁত চাপলো। কুয়াশা তাকে পথের ভিখিরি করে দিতে চায়। বলিহারী লোকটার সতর্কদৃষ্টি। ব্যাঙ্ক থেকে সে যে টাকা তুলে এনে ঘরের সিন্দুকে রেখেছে তা কুয়াশা জানলো কি করে? লোকটা কি যাদুমন্ত্র জানে? আশ্চর্য
দুকোটি টাকা মূল্যের জিনিস ভয় দেখিয়ে ধমক দিয়ে ছিনিয়ে নিতে চায় কুয়াশা, ব্যাপারটা আশ্চর্য বৈ কি। মাহমুদ হাসলো। কুয়াশার লোভ প্রচণ্ড। লোভের খেসারত হয়তো আজই তাকে দিতে হবে। যে টাকা মাহমুদ সংগ্রহ করেছে অতো পরিকল্পনার পর সে টাকা এক বাজিতে লুট করে নিতে চায় কুয়াশা। ভেবেছে, মাহমুদ একটা ভীরুর হদ্দ টাকা চাইতেই দিয়ে দেবে। হাঃ হাঃ…
মাহমুদ হাসতে লাগলো। একটা আলমারীর তাক থেকে মদের বোতল বার করলো। নির্জলা মদ গলায় ঢেলে দিলো অসঙ্কোচে। বুক জ্বলে উঠলো। রক্তের ভিতর লাগলো আনন্দের উত্তেজনা। এবসার্ড, এবসার্ড। মাহমুদ পায়চারি করতে লাগলো। হাসতে লাগলো। সুলতানাকে এ সময় ডেকে আনলে কি রকম হয়?
টলতে টলতে দরজার দিকে এগোচ্ছিল মাহমুদ। ঠিক তখন শোনা গেল শব্দটা। দেয়ালের কোথাও টুক টুক শব্দ। পিস্তলটা আঁকড়ে ধরে সে ফিরে দাঁড়ায়। সারা ঘর উজ্জ্বল আলোয় প্লাবিত। কেউ নেই। সন্দেহ ব্যাপারটা ভারি জঘন্য। মাহমুদ হাসলো। আজকাল সে কি দুর্বল হয়ে পড়েছে? না, নাব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আসলে সংসারে বাঁচতে গেলে শুধু দৈহিক বল দিয়ে হয় না। এর সঙ্গে চাই বুদ্ধির প্যাঁচ। চাই কূটনীতি। দৈহিক বলের সঙ্গে কূটনীতি মেশালে একেবারে সোনায় সোহাগা। এই যেমন একটা জাল ফেলেছি মানিকপুরের চৌধুরী আলী নকীবের উপর। শুধু একটা পিস্তলের জোরে কি সব বাগানো যেতো? যেতো না। প্রয়োজন ছিলো বুদ্ধির। প্রয়োজন ছিলো বলেই অনেক সহ্য করেছে মাহমুদ। কুয়াশাকে সহ্য করেছে। সুলতানাকে সহ্য করেছে। সব কিছুর গোড়া হলো প্রয়োজন। যখন যা প্রয়োজন তখন তা করতে হবে, থামলে চলবে না। ভড়কে গেলে চলবে না। স্নেহ, মায়া, মমতা, মনুষ্যত্ব এসবের পরোয়া করলে চলবে না।
দরজার গোড়া থেকে ফিরে এলো মাহমুদ। সুলতানাকে এখন ডাকার দরকার নেই। সুলতানার কাছে যথাসময়ই সে যাবে। আপাততঃ কুয়াশার জন্যে অপেক্ষা করছে সে। কুয়াশা যদি তার কথা মত আসে তাহলে আজ তার রক্ষে নেই।
একটা ভবিষ্যত মনে মনে দেখলে মাহমুদ। খুশি হয়ে উঠলো। এতদিন টাকা ছিলো না। তাই ভোগ করতে পারেনি। এখন টাকা হয়েছে। আর চিন্তা কি? যে জাল ফেলেছি সেটা সাবধানে গুটিয়ে তুলেই সে পাড়ি দেবে বাইরে। আজ দিল্লী, কাল কায়রো, পরশু বাগদাদ, লণ্ডন, প্যারিস। পোশাক, আহার, মেয়েমানুষ–সবই আয়ত্তের ভিতর এসেছে। গুলি মারো কুয়াশাকে। স্নেহ-মমতা, বিবেককে।
মাহমুদ ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো। একবার সিন্দুকের কাছে গিয়ে গুছানো ব্যাগটা পরখ করবে বলে ভালো। ব্যাগটা বেশ ভারি। এমন জায়গায় ব্যাগটা রাখা হয়েছে যে কেউ বুঝবে না। ভাবলো আজ রাতে সটকে পড়লে কেমন হয়? না, তা হয় না। কিছু কাজ এখনো বাকি আছে। সেটুকু শেষ করে যাওয়া চলবে না। নাটকের শেষ অংশ এখনো বাকি।
সে পিস্তলটা চোখের সামনে ধরলো, ঠিক এই সময় আবার সেই ক্ষীণ টুক টুক শব্দটা উঠলে দেয়ালের কোথাও। মাহমুদের কানে সেটা পৌঁছলো না। মাহমুদ যখন পিস্তলটা দেখছে চোখের সামনে নিয়ে, তখন দেয়াল আলমারী থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো একটা কালো ছায়া। মাহমুদের পিঠে লাগলে একটা শীতল ধাতব স্পর্শ। পিছনে দাঁড়িয়ে লোকটা স্থির ভরাট গলায় বললো, নড়াচড়া করার চেষ্টা করো না মাহমুদ। খুন, হয়ে যাবে। পিস্তলটা ফেলে দাও। দিয়েছে? বেশ–এবার ফিরে দাঁড়াও। হ্যাঁ, আমি কুয়াশা।
মাহমুদ ফিরে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিল। কুয়াশা বললো, বুঝতেই পারছো আমি আমার কথা রক্ষা করেছি। না, তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। তোমার কোথায় কি আছে তা আমি জানি। আমি নিজেই তা বের করে নিতে পারবো।
কুয়াশা হাসলো, আমার সম্পর্কে তোমার একটা ভয় ছিলো মাহমুদ। কিন্তু আমার শক্তি সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই ছিলো না। ধারণা থাকলে আমার কথা অমান্য করার সাহস তোমার হতো না।
মাহমুদ বললো, কুয়াশা, আমাকে প্রাণে মেরো না। আমার যা আছে সব তোমাকে দিয়ে দেবো?
কুয়াশা এবারেও হাসলো। বললো, “তুমি দিয়ে দেবার কে হে বাপু? টাকা হলো আলী নকীবের। দয়া করে সে টাকা আমি নিয়ে যাচ্ছি।
কুয়াশা থামলো। বললো, একটা কথা তোমাকে বলি। আলী নকীবের ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের ওপর আমার লোভ ছিলো না বিন্দুমাত্র। আমি যা চেয়েছিলাম সে হলো একটা গুপ্তধনের নকশা। এই নকশাটা আলী নকীব কপাল গুণে পেয়ে গিয়েছিল এক বুড়ো জমিদারের কাছে। এই বাড়িটা আসলে সেই বুড়ো জমিদারেরই বাড়ি। আলী নকীব সেই বুড়োর নায়েব ছিলো। বুড়ো জমিদার হঠাৎ হার্টফেল করে। মারা যাওয়ার সময় এই নকশাটা সে দিয়ে যায় আলী নকীবকে। বুড়ো জমিদার বলে গিয়েছিল গুপ্তধনের টাকা যেন সৎকাজে দান করা হয়। কোম্পানী আমলের এই গুপ্তধন এতকাল লোক চক্ষুর অন্তরালে মৃত্তিকা গর্ভে প্রোর্থিত ছিলেবুড়ো জমিদার যখন এই নকশা পান তখন তার জীবন ফুরিয়ে এসেছে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই অর্থ মানব কল্যাণের জন্য ব্যয় করে যেতে পারেননি। আলী নকীব বুড়োকে কথা দিয়েছিল। বুঝতেই পারছো সে কথা রক্ষা করা হয়নি। আলী নকীব সেই গুপ্তধনের কিছু নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এই বাড়ির মাটির নিচে এতো কোটি কোটি টাকা মূল্যের মোহর পোঁতা ছিলো যে সে টাকা সম্পূর্ণ ব্যবহার করা আলী নকীবের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। বলতে গেলে গুপ্তধন প্রায় সবটাই অটুট ছিলো।
কুয়াশা থামলো। বললো, আমি আলী নকীরেব পিছু নিয়েছিলাম এই নকশাটার জন্যেই। নকশাটা, আমি জানতাম আলী নকীবের বুকের কাছে সর্বদা বাঁধা থাকে। যে রাতে আলী নকীব নাভানা ক্লাবে যায় সে রাতে আমিই আলো নিভিয়ে দিয়ে নকশাটা বের করে এনেছিলাম। কিন্তু আলী নকীবকে কে খুন করেছিল?
তুমি…
মাহমুদ প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, তুমিই চৌধুরী আলী নকীবকে খুন করেছিলে।
কুয়াশা শান্ত কণ্ঠে বললো, খুনের রহস্য যথাসময়ই তুমি জানবে মাহমুদ। গুপ্তধনের কথাটা বলি। আমি এই সাতদিনে এই বাড়ির সব সম্পদ সরিয়ে নিয়েছি আস্তে আস্তে। মোট কতো টাকা হবে জানতে নিশ্চয়ই ইচ্ছে করছে? সঠিক পরিমাণ এখনো বলতে পারবো না, তবে পঞ্চাশ কোটির কম হবে না।
পঞ্চাশ কোটি!
মাহমুদ প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে।
হ্যাঁ। সুখের বিষয় সব আমি সরিয়ে ফেলতে পেরেছি। আলী নকীবের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করবো। মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যয় করবো এই টাকা। আমি মানুষকে অমর করতে চাই মাহমুদ। আমার আরো বহু টাকার দরকার। ভয় নেই, তোমার সামান্য দুকোটি টাকাও আমি ফেলে যাবো না।
কুয়াশা পিস্তলের নিশানা ঠিক রেখে পিছু হটলো। সিন্দুকের কাছে গেল। ঠিক এ সময় জানালার কাছে দেখা গেল একটা পিস্তল ধরা হাত। চমকে উঠলো কুয়াশা। চট করে সরে দাঁড়াতেই এক ঝলক অগ্নিবৃষ্টি ছুটে গিয়ে বিধলো সামনের দেয়ালে। কুয়াশা পর মুহূর্তে বাঁ পাশের দেয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই দেয়ালটা দুফীক হয়ে গ্রাস করলো কুয়াশাকে।
মাহমুদ বিস্ময়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
কিছুক্ষণ পর শহীদ আর কামাল ঢুকলো ঘরে। শহীদ উত্তেজনায় তখনো রীতিমত হাঁপাচ্ছে। বললো, আর এক মুহূর্ত আগে এসে পৌঁছলেই কুয়াশাকে ধরতে পারতাম। আমারই দুর্ভাগ্য। কুয়াশা এবারও ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।
মাহমুদ বললো, আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই শহীদ সাহেব। আপনারা এসে আমাকে রক্ষা করলেন। আমার সর্বনাশের মূল কি জানেন? এই বাড়িটা! এই বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে যে এতো কারসাজি আছে তা কি জানতাম! উঃ, কি ভয়ানক কথা। পঞ্চাশ কোটি টাকা। আই গো ম্যাড মি. শহীদ! পঞ্চাশ কোটি টাকা! মাই গড গড…
উন্মাদের মতো হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো মাহমুদ।
.
১১.
পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে নটা বেজে যায় শহীদ ও কামালের। ব্রেকফাস্ট সেরে মাত্র তৃতীয় সিগারেটটা ধরিয়েছে, তখন ছুটতে ছুটতে এলো আইনুল হক।
স্যার…
বলুন!
সুলতানা পারভিন, মানে মিসেস আলী নকীব চৌধুরী স্যার…
কি হয়েছে?
খুন, খুন হয়েছে স্যার। চৌধুরী বাড়ির পিয়ন কালু খবর নিয়ে এসেছে এখানে। জলদি চলুন স্যার।
আইনুল হকের কাঁদতে বাকি আছে। বলে, সব ভুতুড়ে কাণ্ড স্যার। কথা নেই বার্তা নেই মার্ডার! ডেঞ্জারাস্ ব্যাপার স্যাপার চলছে
দ্রুত কাপড় পরে রিসেপশানে আসে ওরা। কালু ভগ্নদূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
কালু কেঁদে ফেলে, মেম সাহেব খুন হয়েছেন স্যার। সাহেব পাগলের মতো হয়ে গেছেন। আপনারা চলুন।
কালুর মুখেই ব্যাপারটা শোনা গেল। সন্ধ্যবেলা মেম সাহেব গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছিলেন। রাত নটায় তিনি বাড়ি ফিরে সামান্য খেয়ে শুতে যান। রাতের বেলায় কি সব কাণ্ড হলো বাড়িতে…সাহেব এক ফোঁটা ঘুমোননি। সকাল বেলা ঝি মেম সাহেবকে ডাকতে যায়। সাড়া না পেয়ে সাহেবকে খবর দেয়। সাহেব এসে দরজায় আঘাত করেন। কোনো ফল হয় না। শেষে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকা হলো। দেখা গেল মেঝেয় পড়ে আছেন মেম সাহেব। মুখ দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে। হাত-পা বরফের মতো ঠাণ্ডা।
থানায় একটা খবর দেয়া হলো। দারোগা শমসের শিকদার প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হয়।
চৌধুরী কুটিরে এসে যখন ওরা উপস্থিত হলো তখন সকাল সাড়ে দশটা। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। ইতিমধ্যেই সুলতানা পারভিনের মৃত্যু সংবাদ কিভাবে যেন রটে গেছে বাইরে। চৌধুরী বাড়ির সবাই এসে হাজির হতে শুরু করলো একে একে। শহীদ ও কামাল গিয়ে দেখলো খবর পেয়ে আগেই ডা. চৌধুরী ও রাবেয়া সৈয়দ হাজির হয়েছেন দোতলার বারান্দায়। যে ঘরে সুলতানা পারভিনের মৃতদেহ পড়েছিল সেটি তার শোবার ঘর। ঘরটা চমৎকার ভাবে সাজানো গুছানো। মেহগনি খাটের উপর পুরু গদির বিছানা। দেয়ালে ঝালর-কাটা পর্দা। কোণের একটা পাথরের স্ট্যাণ্ডে প্রেমের দেবী ভেনাসের নগ্ন মূর্তি শোভা পাচ্ছে।
ঘরের মেঝেয় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সুলতানা পারভিন। চোখের কোণ দুটি সজল। ঠোঁট দুটিতে তখনো বিষণ্ণ বেদনার রেখা অঙ্কিত হয়ে আছে। একটা হাত, মাথার দিকে লম্বালম্বিভাবে ছড়ানো।
She is dead.
ডা. চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্তব্য করলেন। শহীদ ও কামালকে দারোগা শমসের শিকদার হল ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি এতক্ষণে ঘরে ঢুকেছেন। তার পাশে পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাবেয়া সৈয়দ।
শহীদ ডা. চৌধুরীকে বললো, আপনি কতক্ষণ আগে এসেছেন?
আধ ঘন্টাখানেক হবে। প্রথমে ওরা মনে করেছিল সুলতানা বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। এই ভেবে কালু আগে আমাকে খবর দেয়। আমি এসে পরীক্ষা করে বুঝতে পারি আমার আসার আরো আধ ঘন্টা আগে ওর মৃত্যু হয়েছে। আমি সবাইকে কথাটা জানাই। জানিয়ে থানায় খবর দিতে বলি।
শহীদ ঘরের চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে। নজর পড়ে খাটের শিথান দিককার শেলফের দিকে। শেলফের উপরের তাকে পর পর সাজানো আছে তিন ফাইল ওষুধ ও শিশির ভিতর এক রকমের গুড়ো পাউডার। হাত না দিয়ে সাবধানে সে ওষুধ ও পাউডারের শিশি নিরীক্ষণ করে। পাউডারের শিশির কর্কের উপর কিছু গুড়ো ছিটিয়ে আছে। পাশেই রাখা আছে একটা শূন্য গ্লাস।
একে একে ঘরে ঢোকে রশিদ সাহেব ও বেগম রশিদ, মর্জিনা বানু, শাহেলি ও রবিউল্লাহ। সবাই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনো কথা না বলে।
হঠাৎ ঝড়ের মতো ঘরে ঢোকে মাহমুদ। একটা হিংস্র গর্জন ফেটে বেরোয় গলা থেকে, দেখলেন তো, শেষ পর্যন্ত সুলতানাকে সরিয়ে দিলো! খুন করলো আমার সরল, নিষ্পাপ বোনটাকে? আমি জানতাম মি. শহীদ, মানিকপুরের চৌধুরীরা যে সুলতানাকে সরিয়ে দেবে তা আমি আগে থেকেই জানতাম
আবেগের উত্তেজনায় বাষ্পচ্ছন্ন হয়ে আসে মাহমুদের গলার স্বর, সুলতানাকে আমি বাঁচাতে পারলাম না! এই ভয় আমি আগেই করেছিলাম…
আপনি দয়া করে থামুন মাহমুদ সাহেব,
শহীদ বাধা দেয়, এটা যে খুন তা আপনাকে কে বললো? এটা আত্মহত্যা হতে পারে।
আত্মহত্যা? অসম্ভব! সুলতানা আত্মহত্যা করতেই পারে না। আমি জানি এ কার কাজ!
মাহমুদ হিংস্র দৃষ্টিতে তাকায় ডা. চৌধুরীর দিকে। বলে, আমি আপনাকে এমনি ছেড়ে দেবো ভাববেন না ডাক্তার। প্রতিশোধ কি করে নিতে হয় তা আমি জানি। আমার হাত থেকে আপনার নিস্তার নেই
ভয়ে ফ্যাকাসে দেখায় ডাক্তার চৌধুরীর চোখ-মুখ। শহীদের দিকে তাকিয়ে বলে, lam in danger মি.শহীদ, আমি বিপদগ্রস্ত। দয়া করে আমার security-র ব্যবস্থা করুন! নতুবা that fellow…
মাহমুদকে দেখিয়ে বললেন ডা. চৌধুরী, He is a murderer. দেখেও চিনতে পারছেন না?
হ্যাঁ, খুন আমি অনেক করেছি বৈকি। আর একটা করবো। One more kill and mind that its youl
মাহমুদ উন্মত্তের মতো অট্টহাস্য করে ওঠে। শহীদের ইঙ্গিতে ডা. চৌধুরীকে সরিয়ে ফেলা হয় ঘর থেকে। মাহমুদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় সশস্ত্র একজন পুলিসের জমাদার।
মাহমুদ হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, Sultana is dead! হায় আল্লা, এও আমাকে দেখতে হলো! সুলতানা আমাকে মানিকপুর ছেড়ে চলে যেতে কতবার কাকুতি-মিনতি করেছে…আমি শুনিনি…
শহীদ মৃদু কণ্ঠে বলে, মি. শিকদার, আপনার প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষ করে লাশ ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দিতে পারেন।
আপনি সার?
আমার যা দেখার দেখেছি।
শহীদ অবজ্ঞার সঙ্গে বলে, এটা একেবারে যাকে বলে clear case of suicide. আত্মহত্যা।
একটা সূক্ষ্ম হাসি তার ঠোঁটে রেখায়িত হয়েই পরক্ষণে নিভে যায়।
হোটেলে ফিরতে সাড়ে বারোটা বেজে যায়। রিসেপশানে দেখা হয় আইনুল হকের সঙ্গে। চিন্তাকীর্ণ মুখ, তার বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে দিনে দিনেই। শহীদ ও কামালের খাবার তদারক করতে আসে নিজেই। হোটেলে স্পেশাল যত্ন-আত্যির ব্যবস্থা হয়েছে শহীদ ও কামালের জন্যে। কারণটা বুঝতে অবশ্য কষ্ট হয় না শহীদের।
ম্যানেজার আইনুল হক বলে, খাবার দাবার কেমন হচ্ছে স্যার?
খুবই ভালো, কামাল মন্তব্য করে।
যত্ন-আত্যির চেষ্টা তো সব সময়ই করি স্যার। ম্যানেজার হক সাহেব বিষণ্ণ মুখে মাথা নাড়ে, ভেবেছিলাম যদ্দিন বেঁচে আছি মানিকপুরের হোটেল তাজ ছেড়ে কোথাও যাবো না। এটাকে একটা প্রথম শ্রেণীর হোটেলে তৈরি করে যাবো। কিন্তু সবই হলো কপাল স্যার…
ওদের তখন খাওয়া শেষ হয়েছে। বেয়ারা টেবিল থেকে বাসনপত্র ওঠাচ্ছে। শহীদ বলে, কেন, কি হলো হক সাহেব?
মানিকপুরে যা শুরু হয়েছে তারপর কেউ এখানে থাকতে সাহস করে স্যার? এই তো মিসেস চৌধুরীর খুনের কথা শুনেই আমাদের পাঁচজন কর্মচারী রেজিগনেশান সাবমিট করেছে। ওরা আর ভূতুড়ে জায়গায় থাকতে সাহস পাচ্ছে না। ওদের শুধু দোষ দিয়ে লাভ কি স্যার? আমার নিজের অবস্থাও তো ওদেরই মতো। কোনরকমে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে এখান থেকে সরে পড়তে পারলে বাঁচি স্যার
ম্যানেজার হক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, কি সোনার জায়গা ছিলো মানিকপুর আর এই কদিনেই কি সব কাও হয়ে গেল স্যার! এখানে যা খুশি ঘটে যেতে পারে, কিছু বিশ্বাস নেই।
হক সাহেব চলে যায়। কামাল কেন যেন হাসে। শহীদ খাওয়ার পর প্রথম সিগারেটটা ধরিয়েছে। চুপচাপ সিগারেট টানছে আর কি যেন ভাবছে।
কামাল, শহীদ ডাক দেয়।
বল, তোর নাটকের অভিজ্ঞতা আছে?
একেবারে নেই বলা যায় না। সিরাজউদ্দৌলা নাটকে একবার আমাকে দৌবারিকের পার্ট দেয়ার কথা হয়েছিল। পরে অবশ্য চান্স পাইনি।
শহীদ হাসে, এইরকম আনকোরা নতুন মানুষই আমি চেয়েছিলাম। কামাল, মানিকপুরের এই নাটকের তোর রোল হলো পরিচালকের। আমি স্মারক, প্রম্পটার।
মানে?
মানে পরে বুঝিয়ে বলছি। এখন একটা নিমন্ত্রণপত্র ডাফট করে ফেল তো। লিখবি, তুই অর্থাৎ কামাল আহমেদ অমুক দিন বিকেল পাঁচটায় হোটেল তাজের হল ঘরে একটা টি-পার্টিতে অমুকের সহৃদয় উপস্থিতি প্রার্থনা করছিস।
টি-পার্টি দেয়ার উদ্দেশ্য?
সামাজিকতা করা। আসল উদ্দেশ্যের কথা না বললেও চলবে আশা করি। নিমন্ত্রণ যাদের যাদের দিবি তারা সবাই আমাদের পরিচিত। তারা হলেন মাহমুদ সাহেব, ডা. চৈৗধুরী, রাবেয়া সৈয়দ, মর্জিনা বানু, শাহেলী, রবিউল্লাহ, বেগম রশিদ, চৌধুরী রশিদ ও শিকদার সাহেব। দুর্ভাগ্যক্রমে সুলতানা পারভিন এখন আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে?
সুলতানা পারভিনের প্রসঙ্গে একটু আগের মর্মন্তুদ ঘটনাটাই ভেসে ওঠে কামালের মানস- চোখে। বেচারী সুলতানা পারভিন রূপ-যৌবন, প্রভূত ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যের হাতে মার খেয়েছে নিদারুণ ভাবে।
কামাল বললো, আচ্ছা, সুলতানা পারভিন কি আত্মহত্যা করেছে বলেই তোর ধারণা?
নিশ্চয়ই না। সুলতানা পারভিনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। She is murdered!
বলিস কি? তখন যে তুই বললি সুলতানা পারভিন আত্মহত্যা করেছে
বলার একটা কারণ ছিলো নিশ্চয়ই। কথাটা একজনকে ধোঁকা দেয়ার জন্যে বলেছিলাম।
সে তোর ধোঁকাবাজিতে পড়েছে?
হ্যাঁ, পড়েছে বলেই টি-পার্টির নাম করে একটা এক অঙ্কের নাটক জমাচ্ছি হোটেল তাজে। নতুবা আজ রাতে তাকে কিছুতেই ছেড়ে দেয়া যেতো না। কই, তুই নিমন্ত্রণপত্র ড্রাফট করেছিস?
এই তো করছি। তারিখটা করে দেবো?
শহীদ নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, পরে বলবো।
দুবন্ধুর মধ্যে বিশেষ আর কোনো কথা হয় না। ঘুমকাতুরে কামাল কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন চা খেয়ে দুজনেই গেল চৌধুরী কুটিরে। বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে যেন। মাহমুদ এসে অভ্যর্থনা জানায় দোরগোড়ায়। কিন্তু তার অভ্যর্থনায় কোনো প্রাণ নেই। মাহমুদের চোখ দুটি লাল। মুখে স্থির কাঠিন্য।
শহীদ বলে, আজ রাতেরবেলা ঘুমোননি মাহমুদ সাহেব?
বুঝতেই পারছেন, ম্লান হাসে মাহমুদ। তারপর অনেকটা সংযত ভাষায় বলে, কাল রাতেরবেলা উত্তেজনাবশতঃ কোনো অন্যায় ব্যবহার করে থাকলে তার জন্যে। দুঃখ প্রকাশ করছি মি. শহীদ।
অন্যায় ব্যবহার আপনি করেননি মাহমুদ সাহেব। যা করেছেন তা খানিকটা আবেগপ্রবণ হলেও আপনার পক্ষে অস্বাভাবিক ছিলো না। তা যাক গে, আপনার নেক্সট প্রোগ্রাম কি হচ্ছে, মাহমুদ সাহেব?
দেখি…
ম্লান হাসে মাহমুদ। কামাল অবাক হয়েছিল মাহমুদের ব্যবহারে। দুই রাতেই অমন জটিল স্বভাবের খেপাটে আর জেদী লোকটা কেমন যেন বদলে গেছে। কিন্তু সে আরো বেশি অবাক হয় শহীদের আচরণে। শহীদ পুরো দুদিন কাটিয়ে দিলো প্রায় বসে বসেই। দিনের বেলা হয় ঘুরে বেড়ায় নয় হোটেলের ম্যানেজার আইনুল হকের সঙ্গে গল্প করে। এর মধ্যে সে একবার বেগম রশিদের বাড়ি গিয়েছিল কামালকে সাথে নিয়ে। .
বেগম রশিদ রীতিমত ভয় পেয়ে গেছে। বলে, মানিকপুরের কাণ্ড–কারখানা দেখে শুনে সবাই ভড়কে গেছে কামাল সাহেব। হাসান মওলা খুন হলো, মেজর সাহেব নিখোঁজ, সুলতানা পারভিনও গেছে, এবারে কার পালা কে জানে?
মৃদু হেসে শহীদ বলে, ভড়কে যাওয়া স্বাভাবিক। মূল ঘটনার সঙ্গে তো আপনাদেরও সম্পর্ক আছে।
কি বললেন? আমাদেরও সম্পর্ক আছে?
আপনাদের মানে রশিদ সাহেবের। কি রশিদ সাহেব, সম্পর্ক নেই?
রশিদ সাহেব কুদ্ধস্বরে বলেন, আপনারা যা খুশি বলতে পারেন। আমি ভয় পাই না।
ভয় কে-ই বা পেয়েছে? কেউ কেউ ভান করেছে বটে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি কিছু। সবাই আসল ব্যাপার ঠিক, বোঝে।
মি, শহীদ, রশিদ সাহেব তিক্ত কণ্ঠে বলেন, আপনারা তো এ ব্যাপারে তদন্ত করছেন। আসল ব্যাপারটা কি হেয়ালী না করে বুঝিয়ে বলতে পারেন?
যথাসময়ই তা বলা হবে রশিদ সাহেব, এ ব্যাপারে আপনার ভূমিকাটুকু সুদ্ধচিন্তা করবেন না।
মাহমুদের ওখান থেকে ফেরার পথে কামাল বললো, আইনুল হক বা বেগম রশিদের কথাগুলি একেবারে উপেক্ষা করা যায় না শহীদ। হাসান মওলা ও সুলতানা পারভিনের হত্যারহস্য ক্রমেই জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে সকলের কাছে।
তা বটে, শহীদ স্বীকার করে। বলে, টি-পার্টির আয়োজন ঠিক আছে তোর?
বিলকুল ঠিক আছে। নিমন্ত্রণপত্র টাইপ করিয়ে রেখেছি। শুধু সেখানে তারিখটা বসাতে হবে।
কথা বলতে বলতে রিশা হোটেলের গেটে এসে থামে। কামাল গাড়িভাড়া মিটিয়ে দেয়। গেট পার হয়ে বাগানের সুরকি ঢালা পথ দিয়ে যেতে যেতে শহীদ বলে: “ আমি যে কারণে নিশ্চেষ্ট হয়ে অপেক্ষা করছিলাম তা মিটে গেছে কামাল। গতকাল সন্ধ্যার দিকে আমি ব্যাঙ্ক আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এবং সেই সাথে দুটো পার্সেল পেয়ে গেছি। তুই কাল বিকেল পাঁচটার দিকে টি-পার্টির আয়োজন কর। নাটকীয় আবেদনটুকু থাকতে, থাকতে নাটকটা শেষ হোক।
আগামীকাল বিকেল পাঁচটায়?
হ্যাঁ।
রিসেপশানে ঢুকলো ওরা। থমকে দাঁড়ালো দুজনেই। শহীদ একটু হাসলো। রিসেপশানে অপেক্ষা করছেন রাবেয়া সৈয়দ।
মি. শহীদ, আপনার সঙ্গে নির্জনে আমি দুএকটা কথা বলতে চাই।
আপনি জানেন মিসেস চৌধুরী আমি এজন্যে বহু আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিলাম।
পাশের গেস্ট রুমে রাবেয়া সৈয়দকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় শহীদ। কামাল বারান্দা পার হয়ে নিজের ঘরে আসে। উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে বাইরের উন্মুক্ত রাজা সাহেবের মাঠ দেখা যায়। বিশাল এই মাঠ ঢালু হয়ে হারিয়ে গেছে দিগন্তজোড়া আকাশের নীলে। দুএকটা সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশে। বহুদূরে ত্রিভুজের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পীরগঞ্জের টিলা।
বেশ কিছুক্ষণ পর কামালের ডাক আসে। গেস্টরুমে ঢুকে কামাল খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলো। রাবেয়া সৈয়দের কথা বোধহয় এখনও শেষ হয়নি। রাবেয়া সৈয়দ বলছিলেন, আপনি কর আমাকে বিশ্বাস করলেন জানি না মি. শহীদ কিন্তু দেখুন…
এখানে বিশ্বাসের প্রশ্ন একেবারেই অর্থহীন মিসেস চৌধুরী। যা সত্যি তা আপনিও যেমন জানেন আমিও তেমনি জানি। আমার কথা স্পষ্টই আপনাকে বলে দিয়েছি…
মিনতি ঝড়ে পড়লো রাবেয়া সৈয়দের কণ্ঠস্বরে, আমাকে বাঁচিয়ে দেবেন এই আশা নিয়েই এসেছিলাম মি. শহীদ। দোহাই আপনার, আর একবার ভেবে দেখুন।
তাতে কিছু লাভ নেই মিসেস চৌধুরী। কর্মফলের শাস্তি যেটুকু আপনার পাওনা তা আপনাকে ভোগ করতেই হবে। আমি বাঁচিয়ে দেবার কে? আচ্ছা, মিসেস চৌধুরী, কামাল সাহেব আপনার সঙ্গে একটু কথা বলবেন।
শহীদের ইঙ্গিত কামাল বুঝলো। সে বললো, আমার কথা যৎসামান্য। আমরা শিগগিরই মানিকপুর থেকে চলে যাবো। আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় হোটেল তাজ সামান্য চায়ের আয়োজন করেছি। আশা করি ডাক্তার চৌধুরী ও আপনি দুজনেই দয়া করে আসবেন।
নিশ্চয়ই আসবো।
পরিহাসের সুরে শহীদ বলে, আমাদের ব্যবস্থাপনা প্রায় নিখুঁত বলতে পারেন। মৌখিক দাওয়াত দেয়া হয়েছে, নিমন্ত্রণপত্রও পাঠানো হবে যথাসময়।
শুষ্ককণ্ঠে রাবেয়া সৈয়দ বলেন, ধন্যবাদ। তাহলে উঠি এখন।
আসুন। কালই আবার দেখা হচ্ছে আমাদের। বিদায় নিয়ে চলে যান রাবেয়া সৈয়দ। শহীদ কিছুক্ষণ তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। ম্লান হাসে।
ইনি তাহলে সব স্বীকার করছেন?
হ্যাঁ।
অর্থই তাহলে সকল অনর্থের মূল?
অর্থ এবং মিথ্য সম্মানবোধ।
কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় শহীদ। কামাল বলে, উঠছিস যে? কোথায় যাবি?
কামালের বৈঠকে দুজন মাননীয় অতিথি আসবে বলে কথা দিয়েছিলেন। তাঁদের টেলিফোনে কন্টাক্ট করতে যাচ্ছি।
মাননীয় অতিথি কে?
একজন এস, ডি, পি, ও মি. নুরুল আলম পি. এস. পি. আর একজন মি. সিম্পসন।
নাটকের অভিনয়ক্ষণ তাহলে প্রায় সমাগত?
কামাল মৃদু হাসে।
শহীদ বলে, হ্যাঁ, মনে রাখিস নাটকের ভূমিকা সারার পালা তোর। বেশ আঁট ঘাট বেঁধে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করো বন্ধু।
.
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ। এটা জনসভাও নয় বিচিত্রানুষ্ঠানও নয়। অথচ এই দেখুন সাধারণ ঘরোয়া পরিবেশে কথা বলতে গিয়েই ঘেমে উঠছি! কথা জড়িয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।
কামাল একটু হাসে। বলে, উপায় নেই। হাসান মওলার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে রহস্য দানা বেঁধে উঠেছে এবং মেজর বদরুদ্দিনের নিখোঁজ ও মিসেস সুলতানা পারভিনের হত্যাকাণ্ডের ভিতর দিয়ে যে রহস্য জটিলতর হয়েছে সেই রহস্য আমাকে খুলে বলতেই হবে।
মাহমুদ তিক্ত গলায় বলে, অথচ এটা ছিলো চায়ের দাওয়াত। ভূতের গল্প জমাবার আসর নয়
সাজানো হলঘরে সজ্জিত বেশে সবাই বসে আছে নিস্তব্ধ ভাবে। বাঁ দিকে বসেছে রবিউল্লাহ, আইনুল হক, শাহেলি ও মর্জিনা বানু। ডান পাশে আছেন ডা. চৌধুরী, রাবেয়া সৈয়দ ও মানিকপুরের বিশিষ্ট উকিল রামপ্রসাদ কুণ্ডু। মাঝামাঝি জায়গায় বসে আছেন বিশিষ্ট অতিথি মি. নুরুল আলম পি. এস. পি. তারই পাশের চেয়ারে বসেছে মাহমুদ। মাহমুদের পাশে বসেছে বেগম রশিদ ও চৌধুরী রশিদ। সুমুখের জায়গাটা মঞ্চ মতো করা হয়েছে। সেখানে পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বসে আছে শহীদ ও শমসের শিকদার। কামাল দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের কোণা ধরে। প্রথম দৃষ্টিতে লক্ষণীয় না হলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না যে হলঘরের দুটো দরজার মুখেই যথেষ্ট সংখ্যক পুলিস। পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে। পশ্চিম দিকের দরজার মুখে বেয়ারার পোশাক পরে দাঁড়িয়ে মুন্সিজী ও মতিন। মি. সিম্পসনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
মাহমুদের কথায় মৃদু হাসলো কামাল। বললো, চায়ের দাওয়াতে ডেকে এনে রহস্যোপন্যাস শুনতে হচ্ছে বলে আমি আন্তরিক দুঃখিত মি. মাহমুদ। কিন্তু আমার বন্ধু শহীদ খানের কাছ থেকে গল্পটা শুনুন। আশা করি খারাপ লাগবে না।
কামাল বসে পড়ে। উঠে দাঁড়ায় শহীদ। বলে, হাসান মওলার মৃত্যু থেকেই গল্পটা শুরু করা যাক। আগের কথা আপনারা আশা করি জানেন। নিঃসন্তান, বিপত্নীক বৃদ্ধ চৌধুরী আলী নকীব রূপ ও লালসার মোহে অন্ধ হয়ে হঠাৎ বিয়ে করে বসলেন লাহোরের খ্যাতনাম্নী বাঙালী অভিনেত্রী সুলতানা পারভিনকে। তার নামে লিখে দিলেন বার্ষিক ছাপান্ন লক্ষ টাকা আয়ের সম্পত্তি। ফলে চৌধুরী আলী নকীবের সম্পত্তির আগের ওয়ারিশানরা সম্পত্তির অধিকার হতে বঞ্চিত হয়। তারা অর্থাৎ আগের ওয়ারিশানরা নানাভাবে সম্পত্তির উপর তাদের অধিকার প্রমাণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু আইনতঃ তা গ্রাহ্য হবে না বুঝেই বুদ্ধিমানের মতো তারা সে চেষ্টা থেকে বিরত হলো। ইতিমধ্যে আততায়ীর হাতে চৌধুরী আলী নকীব খুন হলেন নাভানা ক্লাবে। মিসেস সুলতানা পারভিন ও তার বড় ভাই মাহমুদ যখন চৌধুরী আলী নকীবের সম্পত্তি অধিকার করে রীতিমত তা ভোগ করতে শুরু করেছে তখনই হাসান মওলা নামে একজনের আগমন। ঘটলো মানিকপুরে। হাসান মওলা এসে উঠলো এই হোটেল তাজে। যেদিন সে মানিকপুরে আসে সেদিনই বিকালবেলা মাহমুদ সাহেব একটা চিঠি পেলো হাসান মওলার কাছ থেকে। চিঠিতে হাসান মওলা দাবি করে সে মিসেস সুলতানা পারভিনের প্রথম স্বামী তৈমুর মীর্ধার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাহমুদের সঙ্গে দেখা হবার পর সে জানায় তৈমুর মীর্ধা.এখনো জীবিত আছে। বলতে গেলে সে-ই তাকে পাঠিয়েছে মিসেস সুলতানা পারভিনের কাছে। তৈমুর মীর্ধার জীবিত থাকা অবস্থায় চৌধুরী আলী নকীবের সঙ্গে সুলতানার বিয়ে কখনো বৈধ হতে পারে না। তা যদি না হয় তাহলে সুলতানা পারভিন চৌধুরী আলী নকীবের বার্ষিক ছাপ্পান্ন লক্ষ টাকার সম্পত্তির ওয়ারিশান হয় কিভাবে? আইনতঃ তা অসম্ভব। ধুরন্ধর হাসান মওলা জানালো বেআইনী ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চাইলে তারও উপায় আছে। সেটা হলো দেড় লাখ টাকা দিয়ে তার এবং তৈমুর মীর্ধার মুখ বন্ধ করে দেয়া। মাহমুদ প্রথমে হাসান মওলাকে অগ্রাহ্য করতে চাইলো, মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিলো তার কথা, শাস্তির ভয় দেখালো তাকে। কিন্তু হাসান মওলা গভীর পানির মাছ। মাহমুদ বুঝলো তাকে ভয় দেখিয়ে কোনো ফয়দা নেই। নিখোঁজ তৈমুর মীর্ধা অ্যাদ্দিনে সতিসত্যি ফিরে এলে কি হবে এই আশঙ্কা
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাহমুদ এক লক্ষ টাকা দিতে স্বীকার করলেন হাসান মওলাকে। কথা হলো টাকাটা নিয়ে তৈমুর মীর্ধা বা হাসানমওলা কেউ আর কোনদিন এ মুখো হবে না। বিষুদবার সন্ধ্যায় টাকা দেয়ার তারিখ ধার্য হলো।
শহীদ তাকায় মাহমুদের দিকে। বলে, ঠিক না মাহমুদ সাহেব?
হ্যাঁ, বর্ণে বর্ণে ঠিক।
সেই দিনের সন্ধ্যাবেলা। সময় অনুমান সোয়া সাতটায় এক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে হাসান মওলা খুন হয়েছে বলে সবাই জানতে পারলো।
শমসের শিকদার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, এস্থলে বোধহয় বলা দরকার যে থান থেকে এই খুনের ব্যাপারে যা তদন্ত হয়েছে তাতে আমরা…
বলুন, বলুন থামলেন কেন?
প্রবীণ উকিল রামপ্রাসাদ কুণ্ডু, আবেদন জানান।
আমরা, শমসের শিকদার বলতে শুরু করে, এই ব্যাপারে চৌধুরী আলী নকীবের সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী মিসেস সুলতানা পারভিনের ভাই মাহমুদকে অভিযুক্ত বলে মনে করি।
উপস্থিত সকলের মধ্যেই একটা গুঞ্জন শোনা গেল। মাহমুদের চোখ-মুখ রাগে উত্তেজনায় ভয়ঙ্কর দেখায়। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে শমসের শিকদার বলে যায়–এটা অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যাপার যে হাসান মওলাকে মাহমুদ সাহেবই খুন করেছেন। এক হতে পারে হাসান মওলাই সুলতানা পারভিনের প্রথম স্বামী তৈমুর মীর্ধা। তা যদি হয় তাহলে আলী নকীবের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য হাসান মওলাকে খুন করাই মাহমুদ সাহেবের পক্ষে স্বাভাবিক। আর এক হতে পারে হাসান মওলা ব্ল্যাকমেলিং করছিল মাহমুদ সাহেবকে। এক লক্ষ টাকা দেবার হাত থেকে বাঁচবার জন্য অথবা একটা ব্ল্যাকমেলার শত্রুকে চিরতরে সরিয়ে দেবার জন্যে হাসান মওলাকে মাহমুদ সাহেব খুন করেছেন
জঘন্য মিথ্যে কথা…
মাহমুদ চেঁচিয়ে ওঠে, আমি এদের বিরুদ্ধে মানহানির কেস করুবো। বিনা প্রমাণে…
বিনা প্রমাণে নয় মাহমুদ সাহেব। হোটেল তাজের কেয়ারটেকার মুন্সিজী সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আপনাকে হাসান মওলার ঘর থেকে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছে। আপনার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষী ইংরেজি এম খোদাই করা এই সিগারেট লাইটার। এটা মৃত হাসান মওলার ঘরেই পাওয়া গেছে। এটা যে আপনারই সিগারেট লাইটার তা আপনি নিজেই আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন।
রবিউল্লাহর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। মর্জিনা বানু তো আনন্দে প্রায় আটখানা। চৌধুরী পরিবারের সকলকেই আনন্দিত মনে হলো এক ডা. চৌধুরী ছাড়া। ডা. চৌধুরী গম্ভীর, বিষণ্ণ মুখে বসে আছেন।
এইভাবে এখানে আমাদের ডেকে এনে অপমান করার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে আপনাদের মি. কামাল?
দাঁড়িয়ে উঠে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানায় মাহমুদ।
কামাল বলে, আপনার আপত্তির কারণ অর্থহীন মাহমুদ সাহেব। দয়া করে মনে রাখবেন টি-পার্টিতে আসা না-আসা আপনাদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিলো না ভদ্রতা করে টি-পার্টির উপলক্ষ তৈরি হয়েছে বটে তবে আপনার জ্ঞাতার্থে বলে রাখি ক্ষমতার দিক দিয়ে এই পার্টিকে প্রথম শ্রেণীর আদালতের বিশেষ মর্যাদা দিতে পারেন। সুতরাং এই পার্টিকে দয়া করে ভূতের গল্পের আসর মনে না করলে সেটা আপনারই মঙ্গলের কারণ হবে।
মি. নুরুল আলম মৃদু হাসছিলেন। মাহমুদের কিার বন্ধ হয়ে গেল। অপরিচিত। এ আক্রোশে তার চোখ-মুখ জ্বলতে লাগলো।
শমসের শিকদার বলে, হাসান মওলাকে মাহমুদই খুন করেছে, এই হলো আমার ধারণা…
শহীদ উঠে দাঁড়ায়। সবারই দৃষ্টি পড়ে তার দিকে। শহীদের হাতে একটা চকচকে পিস্তল। সে পিস্তলটা বের করে টেবিলের উপর রাখে। মৃদু হেসে বলে, এটা ঠিক, যে একজন খুনী আমাদের মধ্যেই পরম নিশ্চিন্তে বসে আছে। আর মনে মনে আমাদের বোকা ঠাউরিয়ে পরম অবজ্ঞার হাসি হাসছে। এই পিস্তলটা তার প্রতিরোধের জন্য তোলা রইলো।
শহীদ দু পা সামনে সরে আসে। বলে, হাসান মওলার রহস্য সত্যি খুব জটিল। শমসের শিকদার এইমাত্র বলেছেন যে সন্ধ্যায় হাসান মওলার মৃত্যু হয় সেই সন্ধ্যায় হাসান মওলার ঘর থেকে মাহমুদ সাহেবকে বেরোতে দেখা গেছে। মাহমুদ সাহেব নিজেও তা স্বীকার করেছেন এবং এখনো করবেন তা আশা করি।
হ্যাঁ গিয়েছিলাম।
মাহমুদ অনেকটা শান্ত কণ্ঠে বলে, হাসান মওলার সঙ্গে কথা হয় বিষুদবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে তাকে টাকা দেবো। বিষুদবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সত্যিই আমি নিজে হোটেল তাজে গিয়েছিলাম। হাসান মওলার সঙ্গে আগেই কথা ছিলো পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকবো। তাই হোটেল তাজের রিসেপশান না হয়ে আমি হাসান মওলার ঘরে গেলাম রাজা সাহেবের মাঠ হয়ে তার ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে। গিয়ে দেখলাম হাসান মওলা রক্তাক্ত দেহে মেঝেয় পড়ে গোঁঙাচ্ছে। আমি অবস্থা দেখে দেরি করিনি, তাড়াতাড়ি সটকে পড়েছিলাম।
আমার মনে হয় আপনি ঠিক কথাই বলেছেন মাহমুদ সাহেব।
সকলকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিয়ে শহীদ বলে ওঠে, বিষুদবার সন্ধ্যায় পেছনের দরজা দিয়ে মাহমুদ সাহেব ছাড়াও আরো দুই ব্যক্তি হাসান মওলার ঘরে ঢুকেছিল। তাদেরকে আপনারা ভালো করে চেনেন। তাদের একজন হলে চৌধুরী রশিদ।
রশিদ সাহেব গভীর লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকেন।
আর একজন?
উদগ্র কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করেন প্রবীণ আইনজীবী রাম প্রসাদ কুণ্ড।
আমি শিগগিরই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো মি. কুণ্ডু, শহীদ হাসিমুখে বলে, উত্তর দেবার আগে আমি আমার একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আপনাদের একমিনিট বিরক্ত করবো। ব্যাপারটা আর কিছু না…সামান্য একটা চুরি।
সে ফিরে তাকায় পশ্চিমের দরজার দিকে, যেখানে মতিন, মুন্সিজী ও গাড়োয়ান খাঁসাব দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। শহীদ ডাকলো, মতিন।
মতিন বোধহয় আগেই ব্যাপারটা আচ করেছিল। শহীদের ডাক শুনেই সে হঠাৎ কি ভেবে ছুটে পালাতে গেল। দুজন পুলিস তকে ধরে নিয়ে এলো ঘরের মাঝখানে, শহীদের কাছে।
মতিন ফোঁপাচ্ছিল, খোদার দোহাই লাগে হুজুর, আমাকে ছেড়ে দেন, আমি আর এমন কাজ করবো না। যদি কন তো মানিকপুর ছেড়ে চলে যাই
শহীদ বললো, তোমার কোনো ভয় নেই মতিন। আগে বলে যে জিনিসটা নিয়েছিলে সেটা তোমার কাছে আছে না বিক্রি করে দিয়েছে…
আছে হুজুর, বলেন তো এখনই এনে দিই।
হ্যাঁ, তাই দাও…
মতিন ফোঁপাতে ফোঁপাতে দুজন পুলিসের পাহারাধীনে চলে যায়। শহীদ বলে, হাসান মওলার মৃত্যু রহস্য খুবই জটিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই জটিলতা সৃষ্টি করার পেছনে যে ব্যক্তিটি আছেন তার বুদ্ধিমত্তা এবং ব্যক্তিত্বের উপর সত্যি কথা বলতে কি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা জন্মেছে। তবে দুঃখ এই শেষরক্ষা তাকে দিয়ে সম্ভব হলো না।
সেই লোকটা কে মি. শহীদ?
মর্জিনা বানু রূদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করেন।
আমাদের মধ্যেই একজন।
শহীদ মৃদু হাসে। চাপা গুঞ্জনে ভরে যায় ঘর। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। ডা. চৌধুরী মুখ নামিয়ে রাবেয়া সৈয়দকে কি যেন বলেন। রাবেয়া সৈয়দের চোখ-মুখ ভয়ে রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে দেখায়। রবিউল্লাহর চোখেমুখে উত্তজনা পরিস্ফুট হয়। তার কপালের ডান পাশের শিরা দপদপ করতে থাকে। শাহেলি কেন যেন বারবার রশিদ সাহেবকে দেখছিল। রশিদ সাহেব সেই যে মাথা নিচু করেছেন আর মাথা তোলেন নি। বেগম রশিদ রীতিমত কাঁপছে ভয়ে ও আশঙ্কায়। আইনুল হক বারবার ঢোক গিলছে। শুধুমাত্র মাহমুদকে দেখা গেল স্থির ও শান্ত হয়ে বসে থাকতে।
শহীদ যেন মনে মনে উপস্থিত সকলের উপর তার কথার বিচিত্র প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল। এই সময় মতিন ফিরে এসে কাগজে জড়ানো কি একটা জিনিস দিলো শহীদের হাতে। কাগজের মোড়ক খুলে জিনিসটা সকলকে বের করে দেখায় সে। সবাই দেখে শহীদের হাতে চকচক করছে ছোটো একটা কালো রঙের সিগারেট লাইটার।
এটি আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
শহীদ বলতে থাকে, এটি হাত-বাক্সে রেখে মতিনকে ইচ্ছে করেই হাত-বাক্সে হাত দিতে দিয়েছিলাম। আমার ধারণা বিশেষ বিশেষ জিনিস চুরি করা কারো কারো বাতিকে দাঁড়িয়ে যায়। আমার চাকর গনি মিঞার এই রকম একটা বাতিক ছিলো নয়া পয়সা চুরি করার। মতিনের বাতিক হলো সিগারেট লাইটার চুরি করা। হাসান মওলা মতিনকে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছিল মাহমুদ সাহবের কাছে। চিঠি বিলি করার এক ফাঁকে মাহমুদ সাহেবের লাইটারটা সে সরিয়ে ফেলে। তাই না মতিন?
মতিন বলে, জ্বি হুজুর। এই লাইটারটা নিচের ড্রয়িংরুমের টি-পয়ে রাখা ছিলো। কালু যখন সাহেবকে খবর দিতে উপরে যায় তখন আমি সেটা লুকিয়ে ফেলি।
এবং সেটা যথাসময় একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে, তাই না?
মতিন অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে। শহীদ সকলের দিকে তাকিয়ে বলে, মতিনের জন্যে আমি দুঃখিত। মতিন ইচ্ছে করে এ কাজ করেনি। সিগারেট লাইটার চুরি প্রথমে ছিলো সখের ব্যাপার পরে সেটা অভ্যেস হয়ে দাঁড়ায়, এখন সেটা দাঁড়িয়েছে রাতিকে।
শহীদ কামালের দিকে তাকায়। কামাল তার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে উঠে দরজার কাছে চলে যায়। শহীদ বলে, মতিন যার কাছে এই সিগারেট লাইটার বিক্রি করে সেই লোকটাই হলো হাসান মওলার মৃত্যু রহস্যের সবচে বড় গুটি। সে-ই হাসান মওলার ঘরে প্রথম ঢুকেছিল, হাসান মওলার মুমূর্ষ দেহের পাশে সে-ই মাহমুদের এম খোদাই করা সিগারেট লাইটার ও একটা টকটকে লাল গোলাপ ফুল রেখে আসে। উদ্দেশ্য হাসান মওলার মৃত্যুর সন্দেহটা যাতে সরাসরি মাহমুদের উপর গিয়ে পড়ে। বেশ চমৎকার পরিকল্পনা, তাই না?
এহেন পরিস্থিতির জন্যে কেউ যেন প্রস্তুত ছিলো না। ডা. চৌধুরী বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। রাবেয়া সৈয়দের চোখ-মুখ ব্যথা-বেদনা ও অপমানে নীল হয়ে আছে। রবিউল্লাহ উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছে। শাহেলির মুখও বিবর্ণ।
শহীদ গম্ভীর গলায় বলতে থাকে, এই লোকটা আমাদের মধ্যেই বসে আছে। তার প্রতিটি অভিব্যক্তি এখান থেকে আমি লক্ষ্য করছি। He is the most talented man of Manikpur. মানিকপুর চৌধুরী পরিবারের সবচে প্ৰতিশীল লোক। লোকটা কে জানেন?
সবাই রুদ্ধনিঃশ্বাসে অপেক্ষা করে। শহীদ টেবিলের উপর থেকে পিস্তলটা উঠিয়ে হাতে নেয়। তারপর এগিয়ে যায় বাঁ সারির চেয়ারগুলির দিকে।
তার নাম রবিউল্লাহ। শহীদ রবিউল্লাহর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
বিস্ময়ের ধকল কাটতে না কাটতে কামালের ইঙ্গিতে একজন পুলিসের হেফাজতে ঘরে ঢোকে, মেজর বদরুদ্দিন। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে রবিউল্লাহ। ততক্ষণে হিংস্র উন্মত্ত হয়ে উঠেছে সে। কণ্ঠে আক্রোশের ঘৃণা ছড়িয়ে বলে, হ্যাঁ, আমিই হত্যা করেছি হাসান মওলাকে। ঐ খবর আর কারোর জানার কথা নয়। নিশ্চয়ই এটা মেজরের কাজ। আমি হাসান মওলকে খুন করেছি। আমি আর একটা খুন করবো। মেজরকে আমি নিজের হাতে খুন করবো। বিশ্বাসঘাতক, পাজী, শয়তান
দুজন পুলিস গিয়ে রবিউল্লাহর দুপাশে দাঁড়ায়। মেজর ম্লান হেসে বলে, আমি বিশ্বাসঘাতকতাই করেছি। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না রবিউল্লাহ। দুদিন আগে যে রাতে আমি পালিয়ে যাবে বলে স্টেশনে যাই সে রাতেই আমি পুলিসের হাতে ধরা পড়ি।
Shut up, you rascal!
রবিউল্লাহ রাগে কুদ্ধ বাঘের মতো গর্জে উঠে, তোমার সলাপরামর্শেই আজ আমার এই অবস্থা হয়েছে মেজর। খুনের দায় যদি আমাকে গ্রহণ করতে হয় তাহলে তুমিও রক্ষা পাবে বলে ভেবো না!
হ্যাঁ, আমিও দায়ী বৈকি!
মেজর আস্তে আস্তে বলে, আমার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় আমি কিছু টাকা পয়সা উপার্জনের উপায় খুঁজছিলাম। হঠাৎ একদিন শুনলাম মানিকপুরে কে এক হাসান মওলা এসে হাজির হয়েছে, সে নিজেকে তৈমুর মীর্ধার বন্ধু বলে জাহির করে মাহমুদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে।
আপনি কার কাছ থেকে একথা শুনেন মেজর সাহেব?
রবিউল্লাহর কাছেই। ঘটনা চক্রে রবিউল্লাহর সঙ্গে পরিচয় হয়। রবিউল্লাহ দূর সম্পর্কীয় হলেও আমার আত্মীয়। খবরটা শুনে আমিই রবিউল্লাহকে হাসান মওলার খোঁজ খবর নিতে পরামর্শ দেই।
পরেরটুকু আমি জানি মেজর সাহেব,
শহীদ বলে, আপনার কাছ থেকে পরামর্শ পেয়ে রবিউল্লাহ গিয়ে দেখা করে হাসান মওলার সাথে। রবিউল্লাহ হাসান মওলাকে একটা প্রস্তাবে বাধ্য করার চেষ্টা করে। ব্ল্যাকমেলারের উপর ব্ল্যাকমেলিং আর কি! প্রস্তাবটা হলো হাসান মওলা তৈমুর মীর্ধা বলে নিজেকে পরিচয় দেবে। আইনের দৃষ্টিতে তৈমুর মীর্ধা মৃত বটে তবে সেটা মিথ্যা বলে প্রমাণ করা মেজর বদরুদ্দিনের পক্ষে অসুবিধে হবে না। কথা হয় হাসান মওলা এই প্রস্তাবে রাজি হলে রবিউল্লাহ কোর্টে গিয়ে চৌধুরী আলী নকীবের সম্পত্তির উপর, সুলতানা পারভিনের মালিকানা চ্যালেঞ্জ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে হাসান মওলা তাতে রাজি হয়নি।
রবিউল্লাহ বুঝলো কোনো কথাই শহীদের অজানা নেই। সে ধীরে ধীরে বললো, আমার নিজের কথা আমাকেই বলতে দিন মি. শহীদ। ফাঁসিতে যেতে আমার এতটুকু দুঃখ নেই। উচ্চাকাঙ্খই ছিলো আমার জীবনের সবকিছু। সেই উচ্চাকাঙ্খার কোনো ভবিষ্যতই যখন রইলো না তখন চৌধুরী আলী নকীবের লক্ষ লক্ষ টাকার বদলে সামান্য এক টুকরো জমির মালিক হয়ে বেঁচে থেকে লাভ কি? আমি সব স্বীকার করছি। হাসান মওলা তৈমুর মীর্ধা সাজতে প্রথম অস্বীকার করে বটে, কিন্তু ঘটনার দিন অর্থাৎ বিষাদ বার দিন সন্ধ্যার আগে তার সঙ্গে যখন রাজা সাহেবের মাঠে আমার দেখা হয় সে তখন এই ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলাপ করতে রাজি হয় এবং আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে তার ঘরে নিয়ে যায়।
আপনি নিশ্চয়ই হাসান মওলাকে ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন তার প্রস্তাবে রাজি না হলে ব্যাপারটা পুলিসকে জানাবেন?
পুলিসের কথা বলিনি তবে ব্যাপারটা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়েছিলাম।
তারপর?
হাসান মওলা আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে তার ঘরে নিয়ে গেল এবং হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার তলপেট বরাবর প্রচও লাথি লাগালো। আমি সতর্ক হয়ে যাওয়াতেই লাথিটা মিস হলো। বুঝলাম হাসান মওলা আমাকে এই কারণেই ঘরে ডেকে এনেছে। রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম আমি। মুহূর্তেই আমার একটা ঘুসি গিয়ে পড়লো হাসান মওলার কপালে। ঘুসি খেয়ে হাসান মওলা দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ আশ্চর্য একটা কাণ্ড ঘটলো। হাসান মওলা থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। তার নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগলো। হাসান মওলা গোঁ গোঁ করে মাটিতে পড়ে গেল। তখন বুঝলাম এক ঘুসিতে অক্কা পেয়েছে হাসান মওলা। কি করবো ভাবছিলাম, হঠাৎ দুদিন আগে মতিনের কাছ থেকে কেনা সিগারেট লাইটারের কথা মনে পড়লো। লাইটারটা মাহমুদের তা আমি জানতাম। লাইটারটা তখন আমার পকেটে। আর দ্বিরক্তি না করে সেটা রেখে দিলাম হাসান মওলার রক্তাক্ত দেহের পাশে। হ্যাঁ, ফুলটাও আমারই। ওটা আমি রাখিনি। ধস্তাধস্তিতে নিশ্চয়ই ফুলটা কোটের বাটন হোল থেকে পড়ে গিয়েছিল।
হঠাৎ এক ফোঁটা গরম পানি গড়িয়ে পড়লো রবিউল্লাহর চোখ থেকে। বললো, ফুলটা সেদিন আমি একজনের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলাম। জানি, এখন তার কথা ভাবার কোনো মানে হয় না।
শহীদ মৃদু হাসে। বলে, রবিউল্লাহ সাহেব, যে আপনাকে ফুলটা উপহার দিয়েছিল তার মূল্য কি আপনার উচ্চাকাঙ্খার চেয়েও বেশি?
রবিউল্লাহ চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আপনি যা খুশি ঠাট্টা করতে পারেন মি. শহীদ। আমি এখন ফাঁসির আসামী। আমার রাগ বা চোখের পানি দু-ই সমান।
শাহেলি মাথা নিচু করে বসে আছে। ক্ষোভে দুঃখে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছেন মর্জিনা বানু। রবিউল্লাহ হাসান মওলাকে খুন করতে পারে এ তিনি কখনো ভাবতে পারেননি।
শহীদ রবিউল্লাহর কাছ থেকে সরে গিয়ে দাঁড়ায় রাবেয়া সৈয়দের সামনে। মৃদু কণ্ঠে বলে, মিসেস চৌধুরী
বেদনা গ্লানিতে কালো রাবেয়া সৈয়দ আস্তে আস্তে বলেন, হ্যাঁ, আমি শাস্তির জন্যে প্রস্তুত আছি শহীদ সাহেব।
শহীদ বলে, আপনার শান্তি অনেক আগেই হয়ে গেছে মিসেস চৌধুরী। এখন আমি আপনাকে মিথ্যে সম্মান আর অহমিকাবোধ থেকে মুক্তি দিতে চাই।
শহীদের গলার স্বর গম্ভীর হয়ে ওঠে। বলে, একটা কথা আমি ইচ্ছে করেই এতক্ষণ গোপন রেখেছি। শাহেলির জন্য নিশ্চয়ই এটা সুসংবাদ। কথাটা হলো রবিউল্লাহ হাসান মওলাকে খুন করেনি।
বিস্ময়ের প্রবল ঝাঁপটা বয়ে গেল ঘরে। রবিউল্লাহ বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শহীদের দিকে। মাহমুদ অস্ফুট গলায় বলে, My God! একি ভেল্কিবাজি শুরু হলো।
ভেল্কিবাজিই বটে।
শহীদ পিছনে সরে গিয়ে টেবিলের উপর রাখা দুটো পার্সেলের একটা টেনে নেয়। পার্সেল খুলে বের করে দুটো ছবি। ছবি দুটো সকলের চোখের সামনে তুলে ধরে বলে, এ দুটো ছবি আপনারা চিনতে পারেন?
খুব পারি, মাহমুদ জবাব দেয়, দুটো ছবির একটা হলো রাবেয়া সৈয়দের আর একটা হলো হাসান মওলার।
ঠিকই ধরেছেন আপনি, উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে শহীদ, দেখুন তো এ দুটো ছবির চেহারায় মিল আছে কি না
স্পষ্ট মিল আছে, মি. নুরুল আলম পি. এস. পির চোখে মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। তার সঙ্গী কোর্ট অফিসার মি. শরীফ দৃষ্টি বিনিময় করেন এস. ডি. পি.ও. নুরুল আলমের সঙ্গে।
রামপ্রসাদ কুণ্ডু, প্রায় চেঁচিয়ে বলেন, হ্যাঁ স্পষ্ট মিল আছে দুটো ছবির চেহারায়। দুজনেরই লম্বা, বাঁকানো নাক, চোয়াল শক্ত, চোখ ভাসা ভাসা-কি আশ্চর্য হাসান মওলা কি তাহলে
হ্যাঁ, মিল থাকা স্বাভাবিক। কারণ এরা একই বংশের ছেলে-মেয়ে, সম্পর্কে আপন চাচাতো ভাই বোন।
রাবেয়া সৈয়দ উঠে দাঁড়ান। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারেন না তিনি। বোধহয় অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করলেন! ভাঙা গলায় বললেন, আমার কলঙ্কের কথা আমি নিজেই স্বীকার করছি সকলের কাছে। ঘটনাচক্রে আমার দ্বারা যা হয়েছে তাতে অনেক বড় শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিলো। হ্যাঁ, হাসান মওলা আমারই ছোটো ভাই, চাচাতো ছোটো ভাই। ছোটোবেলা ও বাড়ি থেকে পালিয়ে নেপাল চলে যায়। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর সে ফিরে আসে দেশে। তাকে ভাই বলে পরিচয় দিতে লজ্জা হতো আমাদের। কারণ ও ছিলো একজন দাগী ঠকবাজ আর জুয়াড়ী। ঘটনাচক্রে তারই সাহায্য নিয়েছিলাম আমি। সেটুকুই আমার লজ্জা আর কলঙ্কের কাহিনী। আপনারা জানেন চৌধুরী আলী নকীব বেঁচে থাকাকালীন আমরা, মানিক ভাই, মোস্তাকের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম ঢাকায়। তার সঙ্গে সলাপরামর্শ করে ঠিক হলো সে হাসান মওলার ছদ্মবেশে মানিকপুর যাবে এবং তৈমুর মীর্ধার নামে ব্ল্যাকমেলিং করবে মাহমুদকে।
রাবেয়া সৈয়দ থামলেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন, মান-অপমানের চেয়েও আমার কাছে তখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল টাকা, প্রথম দিকে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। সুলতানা যদি তৈমুর মীর্ধা ভেবে মোস্তাক ওরফে হাসান মওলার সঙ্গে দেখা করতে আসে তাহলেই তো ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, হাসান মওলা ধরা তো পড়লোই না, বরং উল্টো মাহমুদ তার ফাঁদে আটকা পড়লো। ঠিক হলো বিষুদবার দিন সন্ধ্যার পর সে টাকা নিয়ে আসবে হোটেলে। সবই ঠিকঠাক ছিলো, কিন্তু গোল বাধালো রবিউল্লাহ আর মেজর বদরুদ্দিন।
শহীদ বললো, আপনি একদিন গভীর রাতে বোরকা পরে হাসান মওলার ঘরে গিয়েছিলেন, তাই না মিসেস চৌধুরী।
জ্বি।
আর রাজা সাহেবের মাঠে আপনাকে নেয়ার জন্যে জীপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ডা. চৌধুরী? রাজা সাহেবের মাঠ থেকে গভীর রাত্রে নীল আলোর সঙ্কেতও কি আপনারাই পাঠাতেন?
আমরাই। সঙ্কেত পেয়ে হাসান মওলা রূপী মোস্তাক আমাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতো।
হুঁ, তারপর?
বুধবার রাতে মোস্তাক রবিউল্লাহর কথা আমাদের জানায়। আমরা তার কোনো ঘোরপ্যাঁচে না গিয়ে বিষুদবার রাতে মাহমুদের কাছ থেকে ভালোয় ভালোয় টাকাটা নিয়ে তাকে সরে আসতেই উপদেশ দিই। তারপরের কথা আপনারা সকলেই জানেন।
শহীদ বলে, হ্যাঁ, তারপরের কথা আমরা সবাই জানি। রবিউল্লাহর ভাষায় বিষ্যদবার সন্ধ্যায় হাসান মওলা খুন হয় তার হাতে। এটা ভূল ব্যাপার। আমার বন্ধু
কামাল হয়তো লক্ষ্য করে থাকবে যে আমি হাসান মওলার ব্যাপারটা কখনো খুন বলে ধরিনি। একবার শুধু এক্কা গাড়ির গাড়োয়ান খাঁসাবের কাছে, বিশেষ উদ্দেশ্য বশতঃ ব্যাপারটা খুন-খারাপ বলে উল্লেখ করেছিলাম। আসলে ব্যাপারটা খুন-খারাপ নয়। গোড়া থেকে এটাকে ভুল দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা হয়েছে বলেই এই ভুল হলো। হাসান মওলা আসলে Aortic aneurism নামে একটা জটিল রোগে মারা গেছে। রোগটা pecular সন্দেহ নেই। যারা জবরদস্ত জোয়ান অথচ over exposure. আর under feeding এর ফলে ভিতরে ভিতরে দুর্বল, অনেক সময় তারা এই রোগে আক্রান্ত হয়। কোনো আঘাত ছাড়াই অনেক সময় অত্যধিক উত্তেজনা বশতঃ রোগীর নাক বা মুখ থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এইভাবে শরীরের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত ক্ষরিত হয়ে যায়। রবিউল্লাহর যে ঘুসিটা এসে পড়েছিল হাসান মওলার কপালে তাতে হাসান মওলা আঘাত পায় বটে, আঘাতটা সামলে নিয়ে প্রতিঘাত করতে উদ্যত হয়েছিল সে। কিন্তু তার আগেই এই রোগের যা লক্ষণ,প্রবল Heart throbbing শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নাক-মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে শুরু করে। এইভাবেই সে মারা যায়। আমার এই কথাগুলির প্রমাণ স্বরূপ আমি হাসান মওলার পোস্ট মর্টেম উদ্ধৃত করতে পারি।
শহীদ টেবিল থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বের করে দেখায়। রিপোর্টে শহীদের কথার সত্যতাই প্রমাণিত হলো।
রবিউল্লাহ এতক্ষণে যেন শহীদের একটু আগেকার ঠাট্টার মর্ম উপলব্ধি করতে পারে। পাহাড়-প্রমাণ কৃতজ্ঞতা বিমূঢ় করে রাখলো তাকে। সে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো শহীদের দিকে। মর্জিনা বানু বারবার বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছিলেন। বোধহয় সুরা পড়ছিলেন কৃতজ্ঞতায়। শাহেলির ঠোঁট কাঁপছিল আনন্দের আতিশয্যে। কিন্তু ডা. চৌধুরী তখনো গম্ভীর ও নিপ।
শহীদ একটু হাসে। বলে, নাটকের প্রথম অঙ্ক শেষ হলো। এবারে দ্বিতীয় অঙ্কে পালা। একটা কথা আশা করি বুঝেছেন যে মতিন, মুন্সিজী এবং আইনুল হক এরা সবাই রবিউল্লাহর দলের অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক। প্রাণ গেলেও এরা কখনো রবিউল্লাহর বিরুদ্ধে যেতে পারতো না। এজন্যেই বলছিলাম রবিউল্লাহ হচ্ছে মানিকপুরের সবচে ক্ষমতাশালী লোক। আইনুল হক তারই নির্দেশে মেজর বদরুদ্দিনকে হোটেল থেকে রবিউল্লাহর ফার্মে সরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু রবিউল্লাহর কথা থাক। এইবার মানিকপুর হত্যা রহস্যের প্রধান চরিত্র কে আসুন বের করা যাক।
শহীদের চোখ-মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সারা ঘরে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করে। মি. সিম্পসনকে হঠাৎ এই সময় দেখা যায় দরজার কাছে মুহূর্তের জন্য। রামপ্রসাদ কুণ্ডু, নড়েচড়ে বসেন। মি. নুরুল ইসলাম পি. এস. পি তার সঙ্গী কোর্ট অফিসার মি. শরীফের দিকে তাকালো। মি. শরীফ বসে বসে পা নাচাতে থাকেন। মাহমুদ ছটফট করে নিজের আসনে বসে।
শহীদ বলে, দ্বিতীয় অঙ্কের নাটকের শুরুতেই আমি প্রশ্ন করি, চৌধুরী আলী নকীবের হত্যাকারী কে? আচ্ছা থাক এ প্রশ্ন। আসুন আমরা সুলতানা পারভিনের ব্যাপারটা খতিয়ে দেখি। এই যে দেখুন আমার হাতে রয়েছে সুলতানা পারভিনের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।
শহীদ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাঠ করে শোনায়। রিপোর্ট থেকে জানা গেল অতিরিক্ত মরফিয়া সেবনে সুলতানার মৃত্যু হয়েছে।
এটা কি তাহলে আত্মহত্যা? মি. রামপ্রসাদ কুণ্ডু প্রশ্ন করেন।
না এটা একেবারে cold-blooded murder, ঠাণ্ডা মাথায় সুলতানা পারভিনকে খুন করা হয়েছে।
শহীদ ফিরে তাকায় ডা. চৌধুরীর দিকে। বলে, সুলতানা পারভিনকে ঘুমের জন্য মরফিয়া কে দিয়েছিল, আপনি?
না, আমি দেইনি। সুলতানার সর্দিকাশির উপসর্গ ছিলো। আমি এক ফাইল Corex প্রেসক্রাইব করেছিলাম।
মিথ্যে কথা। মাহমুদ বাধা দিয়ে বলে ওঠে, সুলতানাকে আপনি attend করতেন, মরফিয়া আপনারই দেয়া…
শহীদের হাতের চকচকে পিস্তলটা এইবার উদ্যত হয়ে ওঠে। সে মাহমুদের দিকে তাকিয়ে কঠোর গলায় বলে, দয়া করে হাতটা পকেট থেকে সরিয়ে আনুন মাহমুদ সাহেব। আপনি আমার পিস্তলটার লক্ষ্যস্থল একবারও বুঝতে পারেননি। পারলে ঠিক উপলব্ধি করতে পারতেন যে অনেকক্ষণ আগে থেকে পিস্তলটা আপনাকেই প্রতিরোধ করার জন্য উদ্যত করা হয়েছে, রবিউল্লাহকে নয়। মি. শিকদার, এই নিন আপনার আসামী। সুলতানা পারভিনের হত্যাকারী আশেক মাহমুদ।
ইঙ্গিত পেয়ে দারোগা শমসের শিকদার দুজন পুলিসসহ এগিয়ে এসে হাতকড়া পরিয়ে দেয় মাহমুদের হাতে। মাহমুদ রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে গর্জন করতে থাকে। অশ্লীল গালিগালাজ করতে থাকে শহীদ ও কামালকে।
শহীদ গা করে না এসব কথায়। নিজের মনেই সে বলে, বাট হুইজ দি মার্ডারার অভ চৌধুরী আলী নকীব আলী নকীবকে কে হত্যা করেছে!
ডা. চৌধুরী অনেকক্ষণ থেকে চুপ করে বসেছিলেন। তিনি বললেন, মাহমুদ তাহলে নিজের বোন সুলতানাকে খুন করেছে। আশ্চর্য।
শহীদ বলে, তার চেয়েও বড় আশ্চর্যের কথা ডা. চৌধুরী। সুলতানা পারভিন আজ থেকে তিন মাস আগে মারা গেছেন।
মারা গেছেন?
আশ্চর্য। দুদিন আগে যে মহিলা মারা গেলেন তিনি তাহলে কে?
অসম্ভব। এ অসম্ভব। সুলতানা পারভিন তিনমাস আগে মারা যেতে পারেন না।
যেতে পারেন। শহীদ মৃদু হাসে। বলে, আমি ঘটনাটা খুলে বলছি।
চৌধুরী আলী নকীবের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ঢাকার অভিনেত্রী সুলতানা পারভিনের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর প্রমাণ আমার কাছেই আছে। এটি আমি সংগ্রহ করেছি ডেথ-রেজিস্ট্রারী অফিসে গিয়ে। আমি আসলে গিয়েছিলাম তৈমুর মীর্ধার ডেথ-রিপোর্ট সংগ্রহ করার ব্যাপারে ঐ অফিসের সাহায্যের আশায়। রেজিস্ট্রারের কাছে করাচী হেড অফিসের কিছু কিছু ডেথ-রিপোর্টের নকল ছিলো। কিন্তু তৈমুর মীর্ধার ডেথ-রিপোর্ট সেখানে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল সুলতানা পারভিন, স্বামীর নাম চৌধুরী আলী নকীব, মানিকপুর, এর ডেথ-রিপোর্ট। অবাক হয়েছিলাম বলাই বাহুল্য। পরে ব্যাপারটা খোঁজ করে বের করেছি। এবং তারপর আর অবাক হইনি।
কি ব্যাপার ভেঙে বলুন।
ব্যাপার আর কিছু না, অ্যাক্সিডেন্ট। অক্সিডেন্ট?
ডা. চৌধুরী কিছুই বুঝতে পারেন না।
শহীদ বলে, হ্যাঁ। বলতে পারেন ঘটনাচক্রে। চৌধুরী আলী নকীবের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই বড় ভাই মাহমুদসহ সুলতানা পারভিন ঢাকা আসে এবং মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। মাহমুদ এই আকস্মিক মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে পড়ে। একে তো একমাত্র বোনের মৃত্যু, তার উপর লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তির মালিকানা নষ্ট। এই সময় আর একটা অ্যাক্সিডেন্ট তাকে রক্ষা করে।
অ্যাক্সিডেন্ট? ২০৬
মাতৃসদনের নার্স বিধবা শাহের বানুর সঙ্গে সুলতানা পারভিনের চেহারার হুবহু মিলকে অ্যাক্সিডেন্ট নয়তো কি বলবো? শাহের বানুর গায়ের রং শ্যামলা ছিলো, সুলতানার মতো ফর্সা ছিলো না। আর সুলতানার তুলনায় সে কিছুটা রোগ, ছিপছিপে ছিলো। কিন্তু কসমেটিকের কল্যাণে শ্যামা রঙকে ফর্সা করা আজকাল এমন কি আর কঠিন কাজ? মাহমুদ লোভ দেখিয়ে শাহের বানুকে রাজি করে ফেললো। মানিকপুর ফিরে এলো সে সপ্তাহ দুই পর। সবাই জানলো ঢাকা গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সুলতানা পারভিন। কেউ আসল রহস্য ধরতে পারলো না। এই রহস্য ভেদ করা কারো পক্ষে সম্ভব হতো না যদি মাহমুদ দুটো প্ৰকাণ্ড গলদ না রাখতো। প্রথম গলদ ডেথ রিপোর্টটা সে কোনরকমে বানচাল করে আসেনি। দ্বিতীয় গলদ শাহের বানু ওরফে সুলতানা পারভিনের চিঠিগুলি সে নৃষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। আমি তদন্ত করতে গিয়ে বুক শেলফের কাছে মাতৃসদনের জনৈকা নার্সের চিঠি পাই। তাতে সে সুলতানাকে শাহের বানু বলে উল্লেখ করেছে। কৌতূহলী হয়ে আমি মাতৃসদনের কর্ম কর্তাদের শাহের বানুর ফটো ও অন্যান্য তথ্যাদি পাঠাবার জন্য অনুরোধ করি। মাতু সদন কর্তৃপক্ষ ফটো ও অন্যান্য তথ্য পাঠিয়েছেন। চিঠি এবং সেগুলো আমার সঙ্গেই আছে।
শহীদ দ্বিতীয় পার্সেলটা বের করে দেখায়। বলে, এছাড়া আরো প্রমাণ আছে। মরফিয়া যে শিশিতে রাখা হয়েছিল সেই শিশি এবং গ্লাসে হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। সেই ছাপ মাহমুদের হাতের। যথাসময় সেটা জানা যাবে।
শহীদ, একটু হাসে। বলে, ইদানীং শাহের বানু ওরফে সুলতানা পারভিন মানিকপুরের ঘটনাবলী দেখে ভীষণ ভড়কে গিয়েছিল। মাহমুদের উপর সে আর আস্থা রাখতে পারছিল না। মাহমুদ ভয় করছিল শাহের বানুই হয়তো পুলিসের কাছে গিয়ে সব ফাঁস করে দেবে এবং এই ভয় একটুও অমূলক ছিলো না। শাহের বান আমাকে সব কথা বলবে বলে সময় নিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই মাহমুদ তাকে সরিয়ে দিলো পৃথিবী থেকে চিরজন্মের মতো।
তাহলে মাহমুদ চৌধুরী আলী নকীবের সম্পত্তির মালিকানার আশা ত্যাগ করে ইদানীং অন্য প্ল্যান করছিল?
হ্যাঁ, মানিকপুর থেকে ভেগে পড়ার সুযোগ খুঁজছিল সে। পাছে সুলতানার মৃত্যুর। পর চৌধুরী আলী নকীবের সম্পত্তির অধিকার ছুটে যায় এজন্যে ব্যাঙ্ক থেকে সে প্রচুর টাকা সরিয়ে রেখেছিল। আমার কাছে ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট আছে। ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায় এই পাঁচদিনে মাহমুদ ব্যাঙ্ক থেকে মোট দুকোটি টাকা উঠিয়ে রেখেছে।
শহীদ শান্ত গলায় বলে, মাহমুদ সবই প্ল্যান মাফিক করেছিল। শাহের বানুর খুনের দায় ডা. চৌধুরীর ঘাড়ে চাপিয়ে ভেবেছিল মানিকপুর থেকে সটকে পড়বে। একেই বলে তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়া।
বাট হু মার্ডারড চৌধুরী আলী নকীব?
প্রশ্ন করেন রামপ্রসাদ কুণ্ডু। শহীদ কি বলতে যাচ্ছিলো হঠাৎ এ সময় উঠে দাঁড়ায় কোর্ট অফিসার মি. শরীফ। বলে যদি অনুমতি করেন তবে আপনাদের এই নাটকের সাথে আরো কিছু নাটকীয় তথ্য যোগ করি। চৌধুরী আলী নকীবের খুনের তদন্তে পুলিসের স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে আমাকে গোপনে কয়েকটি তথ্য জানানো হয়েছে।
শহীদ বলে, দয়া করে বলুন মি. শরীফ!
নাভানা ক্লাবে সেদিন চৌধুরী আলী নকীবকে অনুসরণ করে দুব্যক্তি। একজনের নাম কুয়াশা। দ্বিতীয় ব্যক্তি চৌধুরী আলী নকীবের সঙ্গে সঙ্গেই ছিলো–মাহমুদ।
নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিলো ঘরের সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে। মি. শরীফ বলতে থাকে, কুয়াশা হঠাৎ বাতি নিভিয়ে দিয়ে চৌধুরী আলী নকিবের বুকপকেট থেকে একটা নকশা ছিনিয়ে নেয়। মাহমুদ ঠিক এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বসলো। তার পিস্তল থেকে এক ঝলক অগ্নি-বন্যা ছুটে গেল হতভম্ব চৌধুরী আলী নকীবের দিকে। পিস্তলটা মাহমুদ পাচার করে দিলো সুলতানা পারভিনের হাতে। অভিনেত্রী সুলতানা পারভিনের আচরণে কেউ এ ঘটনার বিন্দুমাত্র ছায়া দেখতে পায়নি। এসব কিছুর প্রমাণপত্র আমার কাছে রয়েছে।
আরো একটা কথা। মি. শরীফ বলে, কুয়াশা যখন নাভানা ক্লাব থেকে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিলো তখন ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে আজকের এই রহস্য ভেদের প্রধান নায়ক শহীদের সঙ্গে। তাই না শহীদ সাহেব?
জ্বি হ্যাঁ।
শহীদ হাসে। তাকায় দরজার প্রান্তে দাঁড়ানো মি. সিম্পসনের প্রায় অদৃশ্যমান মূর্তির দিকে। মি. নুরুল ইসলাম বলেন, এসবই আমাদের কাছে আশ্চর্য ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে মি. শরীফ
এই সময় ঘরে ঢোকে মি. সিম্পসন। মুখে সাফল্যের হাসি। বলে, ভদ্র মহিলা, ভদ্র মহোদয়গণ…সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, আপনারা যাকে বিখ্যাত দস্যু কুয়াশা বলে জানেন সেই কুয়াশা ছদ্মবেশে বসে আছে আপনাদেরই মধ্যে। কুয়াশা আর কেউ নয়, ছদ্মবেশধারী মি. নুরুল আলম কুয়াশা। আপ ফ্রেণ্ড…
মি. সিম্পসন উদ্যত পিস্তল হাতে হাসি মুখে এগোতে থাকেন নুরুল আলম রূপী কুয়াশার দিকে। মি. শরীফের মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। দরজার আশেপাশে তখন বেয়োনেটধারী পুলিস আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
কুয়াশা, তুমি আমাকে অনেক ভুগিয়েছ।
মি. সিম্পসন হাসতে হাসতে বললেন, একটা চালে ভুল করেছে বলে আজ তোমাকে আমাদের হাতে ধরা পড়তে হলো। এতদিনে তোমাকে পেয়েছি।
কুয়াশা কোনো কথা বললো না। ঘরে সবাই বিস্ময়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিখ্যাত দস্যু কুয়াশা, যার ভয়ে ধনীরা সন্ত্রস্ত, পাকিস্তান সরকার উত্যক্ত, সেই প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক দস্যু কুয়াশা এই ঘরেই নিরীহ ভদ্রলোকের মতো বসে আছে, এটা কেউ বিশ্বাস করতে চাইলো না।
শহীদ বলে, কুয়াশা…সেদিন রাতে তোমার অহঙ্কার ভেঙে দিয়েছিলাম। আশা করি আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার আর কোনো সন্দেহ নেই।
কুয়াশা কোনো কথা বললো না। মি. সিম্পসন এবারে হুইসল বাজিয়ে দরজার গোড়ায় দাঁড়ানো থানা থেকে আগত পুলিস ফোর্সকে ঘরে প্রবেশ করার নির্দেশ দেন। কুয়াশার মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। পুলিস ফোর্সের বারোজন পুলিস ভিতরে ঢোকে একে একে। কিছু বোঝার আগেই মি. সিম্পসন আর শহীদের হাতে ধরা পিস্তল ছিটকে পড়ে দূরে। দারোগা শমসের শিকদার, শহীদ, কামাল, আর সিম্পসনকে কর্ডন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সেপাইগুলো। হাতে তাদের উদ্যত রাইফেল।
কুয়াশী বললো, Dont move মি. সিম্পসন কুয়াশা সবকিছুর জন্যেই সর্বদা প্রস্তুত হয়ে আসে। তাকে আশা করি ভবিষ্যতে under-estimate করবেন না। শুনুন…থানার কজন হাত-পা বাঁধা সেপাই উলঙ্গ অবস্থায় হাজত ঘরের ভেতর পড়ে আছে। ওদের দয়া করে শাস্তি দেবেন না। ওদের ঐ দশার জন্যে মূলতঃ আমিই দায়ী।
মি. সিম্পসন অসহায় অবস্থায় পড়ে ক্ষোভে দুঃখে গজরাতে লাগলেন। কুয়াশা শহীদের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি আমাকে সেদিন মাহমুদের ঘরে পরাজিত করেছিলে। আজ তারই কিছু জবাব দিয়ে গেলাম শহীদ। কিছু পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করেছি তোমার জন্য।
কুয়াশা একটু হাসে। তার নির্দেশে মি. শরীফ একটা ছোটো কালো রঙের চামড়ার ব্যাগ টেবিলে রাখে। কুয়াশা বলে, চৌধুরী আলী নকীবের খুনী মাহমুদের বিরুদ্ধে সব প্রমাণপত্র এই ব্যাগে আছে। আরেকটা কথা আজ পরিষ্কার বলে যাই। লিষ্পেপোতে সেদিন কুমীরে আমার পা কেটে নিতে পারেনি। আমি এতদিন তোমাকে শাস্তি দিলাম। আমাকে একা ফেলে পালানোর জন্যে তোমাকে দিলাম নিষ্ঠুর মানসিক যন্ত্রণা। কিন্তু আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে।
সে এগিয়ে যায় মাহমুদের দিকে। তার পাশ থেকে উঠিয়ে নেয় একটা পোর্টফোলিও। বলে, নিশ্চয়ই এর ভেতর দুকোটি টাকা রয়েছে! ব্রাভো মাহমুদ তুমি অত্যন্ত চতুর। শেষ রক্ষা করতে পারলে না এই যা…
কুয়াশা দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বলে, আগামীতে আবার দেখা হবে মি. সিম্পসন। এবারে চলি।
পুলিস ছদ্মবেশধারী লোকগুলো কর্ডনটা সতর্ক ভাবে ছড়িয়ে দিতে থাকে। ঘরের সব লোক হতভম্ব। ম্যানেজার আইনুল হক বলি পাঁঠার মতো সকলের পিছনে বসে ঘামছে আর কাঁপছে। মি. শরীফ আর নুরুল আলম রূপী কুয়াশা বেরিয়ে যায় দক্ষিণের দরজা দিয়ে। ঘোর কাটতে না কাটতেই একটা এঞ্জিনের শব্দ শোনা যায় বাইরে।
মি. সিম্পসন অস্থিরভাবে হাত পা ছুঁড়ছেন। ঘরের বাইরে থেকে শেকল তুলে দিয়ে কুয়াশা চলে গেছে। হ্যাণ্ডকাফ পরা মাহমুদও গজরাচ্ছে।
শহীদ শুধু হাসলো। মনে মনে বললো, কুয়াশা তোমার তুলনা হয় না। ইউ আর গ্রেট। -: শেষ :-
Leave a Reply