রূপোর নদী
রাজকুমারী মারিয়ার সঙ্গে বিয়ে হলো ফ্রান্সিসের। ভাইকিং দেশের অধিবাসীরা সাত দিন ধরে আনন্দ উৎসব করল। সকলের প্রিয় ফ্রান্সিস। তার বিয়ে। কনে রাজকুমারী মারিয়া। কাজেই দেশের লোকের আনন্দ আর ধরে না।
বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে বিয়ের পর ফ্রান্সিস আর মারিয়া এল ফ্রান্সিসদের বাড়ি। সামনে ঘোড়সওয়ারের সারি। রূপোর ঝালর ঝুলছে ঘোড়াগুলোর মুখে-পিঠে। ঘোড়সওয়ারদের পরনে সবুজ-হলুদ পোশাক। টুপি থেকে ঝুলছে সোনালী ঝালর। ঘোড়সওয়ারদের সারির পরে একটা কালো ওক কাঠের গাড়িতে বরকনের সাজে ফ্রান্সিস আর মারিয়া। গাড়িটা খোলা গাড়ি। গাড়ির গায়ে সোনালী কাজ করা লতাপাতা। গাড়ি চলছে মন্থর গতিতে। দুপাশের রাস্তার ধার থেকে, বাড়িগুলো থেকে লোকজন ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে ফ্রান্সিসদের গাড়িতে। ওদের দুজনের গাড়ির পর কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের গাড়ি। তার মধ্যে ফ্রান্সিসের বাবার গাড়িও আছে।
শোভাযাত্রা এসে শেষ হলো ফ্রান্সিসদের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে বরকনে পাশাপাশি হেঁটে ঢুকল বাড়িতে। এত আনন্দ হৈ-হল্লার মধ্যেও বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে ফ্রান্সিসের বুকটা হাহাকার করে উঠল। বারবার মার কথা মনে পড়তে লাগল। মা বেঁচে থাকলে কত খুশি হতো। ফ্রান্সিসের চোখে জল এল। মারিয়া পাশে-পাশে যাচ্ছিল। ও ফ্রান্সিসের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারল। মৃদুস্বরে সান্ত্বনা দিল, মার কথা ভেবে মন খারাপ করো না। কারণ মা তো চিরদিন থাকেন না।
ফ্রান্সিস পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছল। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে দুজনে বাড়িতে ঢুকল।
ফ্রান্সিসের নতুন সংসার শুরু হলো। মারিয়া রাজকুমারী হলে কী হবে, খুব কাজের মেয়ে। কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ির দুটো ঝিকে সঙ্গে নিয়ে খেটেখুটে ঘরদোরের চেহারাই পাল্টে ফেলল। ফ্রান্সিসের মা মারা যাবার পর ঘরদোর তেমন যত্ন করে আর কে সাজাবে গুছোবে। মারিয়া আবার ঘরদোরের আগের চেহারা ফিরিয়ে দিল। ফ্রান্সিস এতে খুব খুশি হলো।
আনন্দে কাটতে লাগল দুজনের জীবন। আজকে প্রিয় বন্ধু হ্যারির বাড়িতে নিমন্ত্রণ। কালকে আর এক বন্ধু বিস্কোর বাড়িতে। এভাবে প্রায় প্রতিদিন এ বাড়ি-ও বাড়ি নিমন্ত্রণ লেগে রইল। এর ওপর রয়েছে এখানে-ওখানে সন্ধ্যায় নাচের আসর। সবাই চায় ফ্রান্সিস আর মারিয়াকে। আনন্দের স্রোতে ভেসে চলল দিনগুলো।
কোনো-কোনো দিন বিকেলে দুজনে গাড়ি চড়ে বেরোয়। রাস্তায় ময়দানে, সমুদ্রের ধারে ধারে ঘুরে বেড়ায়। পথে লোকজন ওদের অভিবাদন জানায়। কেউ-কেউ এগিয়ে এসে করমর্দন করে। বেশ আনন্দে কাটতে লাগল দুজনের দিন।
বন্ধুরা ফ্রান্সিসের বাড়ি আসে। আগের মতোই আড্ডা বসে। সোনার ঘন্টা আনা, হীরেমুক্তো আনার সেই কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা বলাবলি করে ওরা। কেউ কেউ উৎসাহে বলে ওঠে–চলো ফ্রান্সিস, আবার জাহাজ নিয়ে ভাসি।
দিন কাটে। মাঝে-মাঝে ফ্রান্সিস হাঁপিয়ে ওঠে। এত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বেকার জীবন ওর ভাল লাগে না। মারিয়া পাছে মনে ব্যথা পায়, তাই ফ্রান্সিস মুখ ফুটে কিছু বলে না। কিন্তু মাঝে-মাঝে একা বেরিয়ে পড়ে। ঘুরতে ঘুরতে সমুদ্রের ধারে চলে আসে। বন্দরে দেশ-বিদেশ থেকে এসে নোঙর করা জাহাজগুলো দেখে। কত রকমের পতাকা উড়ছে সেসব জাহাজগুলোতে। নাবিকদের সঙ্গে গল্পটল্প করে। কোত্থেকে আসছে, কোথায় যাবে, এসব কথা হয়।
একদিন এমনি একা-একা বেড়াচ্ছিল ফ্রান্সিস। রাত হয়েছে তখন। বন্দরের ধারে পরপর কয়েকটা সরাইখানা। তারই একটাতে ঢুকল ফ্রান্সিস। দোকানটায় আলো জ্বলছে, বিরাট উনুনে রুটি সেঁকা হচ্ছে। কাঠের টানা টেবিলে বেঞ্চিতে লোকজন খাচ্ছে। ফ্রান্সিসও ওদের সঙ্গে বসল। যে ছেলেগুলো খাবার দিচ্ছিল, তাদের একজনকে ডাকল। ছেলেটি কাছে এলে বলল–চারটে ফুলকো রুটি আর মাংস নিয়ে এসো।
ছেলেটি চলে গেল। দোকানদার এক পেটমোটা ইহুদি। ইয়া গোঁফ মুখে। তার সামনে একটা কালো কাঠের বাক্স। দাম নিচ্ছে, ভাঙানি ফেরত দিচ্ছে। খুব ব্যস্ত সে।
ফ্রান্সিস চারিদিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছে। বেশীরভাগই বিদেশী নাবিক। এইরকম দুটো নাবিকের দল খেয়েটেয়ে বেরিয়ে যেতেই সরাইখানাটায় ভিড় কমে গেল। ফ্রান্সিস খাচ্ছে। তখনই দোকানদারের হঠাৎ নজর পড়ল ফ্রান্সিসের দিকে। এ কী? ফ্রান্সিস আমার দোকানে? সে তাড়াতাড়ি বাক্সে তালা লাগিয়ে ছুটে এল ফ্রান্সিসের সামনে। হাত নেড়ে দ্রুত বলতে লাগল আপনি-মানে আমার দোকানে মানে আপনাকে কি বলবো মানে,ফ্রান্সিস আমার দোকানে।
আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। নিজের কাজ করুন গে। ফ্রান্সিস বলল।
দোকানদার তবু কিছু বলতে গেল। ফ্রান্সিস তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল–উঁহু কোন কথা নয়, নিজের কাজে যান।
দোকানদার ফিরে গিয়ে কাঠের বাক্সের সামনে বসল। খদ্দেরদের কাছ থেকে দাম নিতে লাগল। ভাঙানি ফেরত দিতে লাগল। ফ্রান্সিসের খাওয়াও প্রায় হয়ে এসেছে। তখনই শুনল টেবিলের ওপাশ থেকে কে বলল–আপনিই ফ্রান্সিস?
বেশ মোটা ভারী গলা লোকটার! ফ্রান্সিস তাকাল লোকটার দিকে। লোকটা মধ্যবয়সী। মুখে কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ। মাথায় কাঁচাপাকা বাবরি চুল, বেশ বলিষ্ঠ চেহারা। পরনে নাবিকদের ঢিলে হাতাঅলা পোশাক। ফ্রান্সিস দেখল লোকটা খাওয়া বন্ধ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও হ্যাঁ বলল তারপর আবার খেতে লাগল।
লোকটা বলল–আপনার কথা আমরা অনেক শুনেছি। পাত্রীদের সোনার ঘন্টা এনেছেন, হীরে, মুক্তো এনেছেন। আপনি তো এই দেশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ।
ফ্রান্সিস খেতে-খেতেই হাসল। কোনো কথা বলল না। লোকটা চুপ করে থেকে বলল–রূপোর নদীর কথা শুনেছেন?
ফ্রান্সিস চমকে উঠল কথাটা শুনে। খাওয়া থামিয়ে লোকটার দিকে তাকাল। কাঁচাপাকা ভুরুর নীচে লোকটার চোখ দুটো কেমন রহস্যময়। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল–না।
তারপর একটু থেমে বলল–আপনি জানেন রূপোর নদী কী? কোথায় আছে তো?
হ্যাঁ জানি। রূপোর নদী আছে কঙ্কাল দ্বীপে।
আপনি দেখেছেন সেই নদী?
লোকটা মাথা নাড়ল বলল–না, তারপর তার পাশে বসা আরো দুজন নাবিককে দেখিয়ে বলল–আমরা সবাই মিলে দীর্ঘ ছমাস ঐ দ্বীপে ছিলাম। তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু খুঁজে পাই নি।
কঙ্কাল দ্বীপ কোথায়? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
ডাইনির দ্বীপ চেনেন?
হ্যাঁ।
তার পাঁচশ মাইল পশ্চিমে।
দ্বীপটা কি জনহীন?
না। ইকাবো নামে এক জাতীয় লোক ওখানে বাস করে। তাদের গায়ের রঙ তামাটে। চোখ নীল। মাথায় লম্বা চুল। ওরা মাথার চুল বেণী পাকিয়ে রাখে। এদের রাজা আছে।
ফ্রান্সিস বেশ মনোযোগ দিয়ে নাবিকদের কথা শুনছিল। এবার বলল–আচ্ছা, ইকাবোরা আপনাদের এতদিন কঙ্কাল দ্বীপে থাকতে দিয়েছিল কেন?
লোকটা দাড়ির ফাঁকে হাসল। বলল-ওদের বাগে আনতে হয়েছিল কী করে জানেন? আয়না, চিরুনি, টুপি, চকচকে পুঁতির মালা এসব রাজাকে দিয়েছিলাম। রূপোর মদীর কথা ইকাবোদর মুখেই শুনেছিলাম। কিন্তু কোথায় সেই নদী, অনেক খুঁজেও আমরা তার হদিস পাই নি।
কিন্তু রূপোর নদী যে আছেই, এ বিষয়ে নিশ্চিত হলেন কী করে?
কঙ্কাল দ্বীপের পাহাড়ের নীচে আছে ওদের দেবমন্দির। সেই মন্দিরের থাম রূপোর তৈরী। সামনে নিরেট রূপোর থাম পোঁতা আছে। এত রূপো ওরা পেল কোথায়? একথা জিজ্ঞেস করলে রাজা বলেছিল ওদের পূর্বপুরুষরা এই রূপো পেয়েছিল রূপোর নদী থেকে।
আচ্ছা ঐ দ্বীপে নদী আছে?
হ্যাঁ, একটাই নদী। পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে এসেছে। ওরা বলে কুনহা নদী। ওদের ভাষায় কুনহা অর্থ রূপে।
কুনহা নদীর জলের রং কেমন? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
কালচে জল। লোকটা বলল।
নাবিকদের আর তার সঙ্গীদের তখন খাওয়া হয়ে গেছে। রাতও বাড়ছে। দোকানে এরা ছাড়া আর কোনো খদ্দের নেই। সরাইখানার মালিক দোকান বন্ধ করে দিত। কিন্তু ফান্সিসকে নাবিকদের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত দেখে দোকান বন্ধ করতে বলেনি।
ফ্রান্সিসেরও খাওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ও উঠে দাঁড়ালো। নাবিকটির দিকে হাত বাড়াল। নাবিকও ওর হাত ধরল। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–আপনার নাম কি?
পাঞ্চো। আমার দেশ স্পেনে।
আমরা কাল দ্বীপে যাবে। রূপোর নদী খুঁজে বের করবো।
পাঞ্চো দাড়িগোঁফের ফাঁকে হাসল–দেখবেন চেষ্টা করে।
তারপর ফ্রান্সিস ওদের আর নিজের রুটি মাংসের দাম দিতে গেল দোকানদারকে। দোকানদার কিছুতেই দাম নেবে না; বারবার বলতে লাগল–আপনি আমার দোকানে এসেছেন। কত সৌভাগ্য আমার।
ফ্রান্সিস বুঝল লোকটা কিছুতেই দাম নেবে না।
একটা খালি ঘোড়ার গাড়ি আসছিল। গাড়ি থামিয়ে ফ্রান্সিস গাড়িতে উঠে বসল। বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হলো। মারিয়া তখনও জেগে ছিল। ফ্রান্সিস মারিয়াকে বলল–বাইরে খেয়ে এসেছি। আর খাবো না।
আমি তো খাবো। খাবার টেবিলে বসবে এসো।
ওরা খাবার টেবিলে বসল। মারিয়া খাচ্ছে তখনই ফ্রান্সিস ওকে পাঞ্চোর কথা, কঙ্কাল দ্বীপ, ইকাবোদের কথা আর রূপোর নদীর কথা বলতে লাগল। মারিয়া খেতে খেতে সব শুনল। তারপর বলল–কী ভাবছো, যাবে।
নিশ্চয়ই। ফ্রান্সিস উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল।
কিন্তু পাঞ্চোরা ছমাস খুঁজেও যার হদিস পায়নি, তোমরা তা পারবে?
ফ্রান্সিস বলল–সেটা ঐ দ্বীপে না পৌঁছে বলতে পারবো না। ওখানে গিয়ে সব খবরাখবর নিয়ে তবেই বুঝবো রূপোর নদী আসলে ছিল না, সবটাই মন ভোলানো গপ্পো।
কিন্তু–
মারিয়া–তুমি ভালো করেই জানো–এই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বেকার জীবন আমার কাছে অসহ্য। আবার জাহাজ নিয়ে ভেসে পড়ব, সে কথা ভাবতে ভাবতে আমি বোধহয় আজ রাতে ঘুমোতে পারবো না।
আমার কোনো আপত্তি নেই। মারিয়া খেতে–খেতে বলল।
এই তো চাই মারিয়া। ফ্রান্সিস খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠল। বলল–আমি জানতাম তুমি আপত্তি করবে না।
মারিয়া হাসল। বলল–তোমার মন আমি বুঝি ফ্রান্সিস। তুমি ভালোবাসো দুরন্ত জীবন।
ফ্রান্সিস বলল–তা ঠিক।
কিন্তু তোমার বাবাকে রাজী করাতে পারবে এবার?
দেখি বলে কয়ে। না পারলে আবার পালাতে হবে।
বরং আমিই তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। মনে হয় আমি বললে উনি আপত্তি করবেন না।
পরদিনই ফ্রান্সিস সব বন্ধুদের খবর পাঠালো বিস্কোকে দিয়ে। বিস্কো সবাইকে খবর দিয়ে এল রাতে সেই পোড়ো বাড়িটায় আসতে।
একটু রাত হতেই ফ্রান্সিস তৈরী হলো সেই পোড়ো বাড়িতে যাবার জন্যে। মারিয়াও চলল ওর সঙ্গে। ওরা যখন পোড়ো বাড়িতে পৌঁছল, তখন ফ্রান্সিসের অনেক বন্ধুরাই এসে গেছে। ফ্রান্সিসের সঙ্গে মারিয়াকে দেখে সবাই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিসের সব বন্ধুরা এসে হাজির হলো। গল্পগুজব আনন্দ উল্লাসের শব্দে বাড়িটা গম গম করতে লাগল। একসময় ফ্রান্সিস দুহাত তুলে গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব। আমরা আবার সমুদ্রযাত্রায় বেরুবো।
সবাই একসঙ্গে আওয়াজ তুলল–ও হো-হো।
ফ্রান্সিস বলতে লাগল–ডাইনির দ্বীপের পশ্চিমে একটা দ্বীপ আছে। কঙ্কাল দ্বীপ। জানি না কেন দ্বীপটার নাম কঙ্কাল দ্বীপ। সেখানে ছিল রূপোর নদী। কিন্তু আজ কেউ সেটার খোঁজ জানে না। পাঞ্চো নামে একজন স্পেনীয় লোক ঐ দ্বীপে ছমাস রূপোর নদীর সন্ধানে কাটিয়েছে। কিন্তু কোনো হদিস পায়নি। এবার আমরা যাবো সেই রূপোর নদীর সন্ধানে। ফ্রান্সিস থামল।
একজন ভাইকিং বলল–রাজা কি এই অভিযানের জন্যে জাহাজ দেবেন?
ফ্রান্সিস তার দিকে তাকিয়ে বলল–যদি দেন ভালো, না দিলে আবার চুরি করবো।
সবাই চেঁচিয়ে উঠলো–ও হো-হো।
এবার হ্যারি এগিয়ে এল। বলল–কিন্তু সত্যিই কি রূপোর নদীর অস্তিত্ব আছে।
ফ্রান্সিস বলল–ইকাবো নামে এক উপজাতি বাস করে ওখানে। ওদের পূর্বপুরুষরা পাহাড়ের ধারে তৈরী করেছে রূপোর থামওলা একটা মন্দির। ওদের উপাস্য দেবতার মন্দির। এত রূপো তারা পেল কোথায়? নিশ্চয়ই রূপোর নদী থেকে। রূপোর থামও আছে মন্দিরের সামনে।
ঐ দ্বীপে কি কোনো নদী আছে? একজন ভাইকিং জিজ্ঞাসা করল।
ফ্রান্সিস বলল–ঐ দ্বীপে মাত্র একটা নদী–কুনহা। ইকাবোদের ভাষায় কুনহা শব্দের অর্থ রূপো।
ওদের কথাবার্তা ভাইকিংরা নিবিষ্ট মনে শুনল। ফ্রান্সিস এবার চেঁচিয়ে বলল–ভাইসব তোমরা কি এই অভিযানে বেরোতে রাজী?
সবাই চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো।
ফ্রান্সিস বলল–আজকের মত সভা এখানেই শেষ। আমি আর হ্যারি এর মধ্যে সব পরিকল্পনা করবো। কারা যাবে, তার তালিকা তৈরী করবো। তারপর আর একটি সভা ডাকা হবে এবং শেষ সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
সভা ভেঙে গেল। ভাইকিং বন্ধুরা একে-একে চলে গেল। ফ্রান্সিস আর মারিয়াও ফিরে চলল।
***
কয়েকদিন পরে এক রাতে ফ্রান্সিস আর ওর বাবা খেতে বসেছে। মারিয়া পরিবেশন করছে। রাঁধুনি রয়েছে। তারই পরিবেশন করার কথা। কিন্তু এ কাজটা মারিয়া নিজেই করে। দুবেলা ফ্রান্সিস আর মন্ত্রীমশাই খেতে বসলে মারিয়াই খাবার পরিবেশন করে। খেতে-খেতে ফ্রান্সিস ডাকল–বাবা।
মন্ত্রীমশাই মুখে শব্দ করলেন–হুঁ।
ফ্রান্সিস বলল–যদি অভয় দাও,তাহলে একটা কথা বলি।
বলো।
আমি সমুদ্রযাত্রায় বেরোতে চাই।
আবার? বাবা কড়া চোখে ওর দিকে তাকালেন!
কঙ্কাল দ্বীপে আছে রূপোর নদী। আমি তারই সন্ধানে বেরোতে চাই।
বাবা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–মাকে তো অনেক কষ্ট দিয়েছ। এবার মারিয়াকেও দুশ্চিন্তা কষ্টের মধ্যে ফেলতে চাও?
মারিয়ার কোনো আপত্তি নেই। ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিসের বাবা মারিয়ার দিকে তাকালেন। মারিয়া মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলল–বাবা, ও গেলে আমার কোনো দুশ্চিন্তা বা কষ্ট হবে না।
ঠিক আছে। মারিয়া, তুমি যদি সব মেনে নিতে পারো তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।
খুশিতে ফ্রান্সিসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এত সহজে বাবার সম্মতি পাওয়া যাবে, তা ও ভাবতে পারেনি। ও মারিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। মারিয়াও হাসল। ফ্রান্সিস একটু তাড়াতাড়ি খেতে লাগল; খেয়েই ছুটতে হবে হ্যারিদের বাড়ির দিকে। সব বলতে হবে ওকে। বাবা গলা খাঁকারি দিলেন–আস্তে খাও।
রাজামশাইও শুনলেন কথাটা। মারিয়াও বাবাকে সব বুঝিয়ে বলল। রানীও শুনলেন। দুজনেই আপত্তি তুললেন। বিয়ে-টিয়ে করে ফ্রান্সিস এখন সংসার পেতেছে। এখন আর ওসব পাগলামি কেন? মারিয়া বলল মা, তোমরা আপত্তি করো না।
পাগল হয়েছিস। কোথায় কঙ্কাল দ্বীপ, কোথায় রূপোর নদী, কী পরিবেশ, ওখানে কোন অসভ্য জাতির বাস–কোন সাংঘাতিক বিপদ কখন ঘটে তার কিছু ঠিক আছে? রাজা বললেন।
কিন্তু আগে তো তুমিই ফ্রান্সিসকে উৎসাহ দিতে।
তখনকার কথা আলাদা। এখন ওর জীবনের সঙ্গে তুইও তো জড়িয়ে গেছিস। এখন আর ও একা নয়।
ওকে এমনি যেতে না দিলে ও জাহাজ চুরি করে পালাবে।
ঠিক আছে–আমরা কথা বলবো ওর সঙ্গে। রাত্রে তোদের নিমন্ত্রণ রইলো। তোর হাতেই একটা চিঠি দিচ্ছি ফ্রান্সিসকে। ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি।
মারিয়া রাজপ্রাসাদ থেকে ফিরে এসে ফ্রান্সিসকে সব বলল। রাজার চিঠি দিল। ফ্রান্সিস বলল–বেশ চলল।
রাত্রে ফ্রান্সিস আর মারিয়া এল নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। অনেক কটা সুসজ্জিত ঘর পেরিয়ে ওরা অন্দরমহলে ঢুকল। রাতের খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। একটা লম্বাটে ঘরে। ঝাড়লণ্ঠনের নীচে ঝকঝকে টেবিল-কাঠের সবুজ গদিমোড়া চেয়ার, বাসনপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুস্বাদু খাবার থরেথরে সাজানো।
রাজা-রানী ফ্রান্সিসদের অপেক্ষায় বসেছিলেন। ওরা আসতেই রাজা বললেন–বসে পড় তোমরা। খেতে-খেতেই কথা হবে। পরিচারকরা খাবার-দাবার এগিয়ে দিল।
ফ্রান্সিস ও মারিয়া চেয়ারে বসল। খাওয়া শুরু করেছে, তখনই রানী হেসে ডাকলেন–ফ্রান্সিস!
বলুন। ফ্রান্সিস রানীর দিকে তাকাল। তুমি নাকি আবার সমুদ্রযাত্রায় যাবে? হ্যাঁ। কোথায় যাবে? |||||||||| –কঙ্কাল দ্বীপে রূপোর নদীর খোঁজে।
রাজা একটু কেশে বললেন–ফ্রান্সিস–এখন তুমি সংসারী হয়েছে। সোনার ঘন্টা থেকে শুরু করে অনেক কিছু এনেছো। তোমার বীরত্ব নিয়ে চারণ কবিরা গান বেঁধেছে। সারা রাজ্যে সেই গান গেয়ে বেড়ায়। আর কেন। এবার সংসারে মন দাও।
ফ্রান্সিস একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল–আমার এই অভিযানে বাবার মত আছে, মারিয়ারও কোনো আপত্তি নেই। শুধু আপনারাই আপত্তি করছেন।
তুমি রাগ করলে ফ্রান্সিস? রানী জিজ্ঞেস করলেন। না। তবে আপনারা আমাকে নিরুৎসাহ করবেন, এটা কখনো ভাবিনি।
রাজা বললেন–মারিয়া ছেলেমানুষ–ও কী বোঝে। তোমার বাবাও সম্মতি দিয়েছেন মারিয়া রাজী হয়েছে বলেই। যাক গে–এ খেয়াল ছাড়ে।
ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। মাথা গুঁজে খেতে লাগল। বুঝল রাজা-রাণী কিছুতেই সম্মতি দেবেন না। অগত্যা সেই পুরনো রাস্তাই ধরতে হবে। জাহাজ চুরি করতে হবে। ফ্রান্সিসের অভিযান নিয়ে আর কোনো কথা হলো না। রাজা-রানী অন্য বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন।
খাওয়া শেষ করে রাজারানীর থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে বাড়ি ফিরে এল।
পালকের বিছানায় অনেক রাত অবধি জেগে রইল ফ্রান্সিস। নানা চিন্তা মাথায়। তারপর বিছানা থেকে উঠে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। হঠাৎ মারিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। ও একটু অবাক হলো, ফ্রান্সিসকে পায়চারি করতে দেখে। বলল তুমি ঘুমুবে না?
হ্যাঁ। তারপর এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মারিয়া বলল–কী ঠিক করলে? ফ্রান্সিস হেসে বলল–সব ছক ভাবা হয়ে গেছে। আমি যাবোই। ঠিক আছে। এখন ঘুমোও। মারিয়া বলল।
পরদিন ফ্রান্সিস বিস্কোর কাছে গেল। ওকে দিয়ে সবাইকে খবর পাঠাল রাত্রে সেই পোড়ো বাড়িটায় সভা হবে। সবাই যেন আসে।
রাত্রে ফ্রান্সিস পোড়ো বাড়িটায় যখন এল, তখন প্রায় সবাই এসেছে। আজকে মারিয়া এল না। ফ্রান্সিস সবাইকে ডেকে বলল–ভাইসব, এইবারের সমুদ্রযাত্রায় আমরা আবার অসুবিধেয় পড়েছি। রাজামশাই-এর মত নেই। তাই উনি জাহাজ দেবেন না। এখন একটাই পথ খোলা জাহাজ চুরি।
সবাই চেঁচিয়ে উঠল-ও-হো-হো।
ফ্রান্সিস বলতে লাগল–কাল রাত্রে আমরা যাত্রা শুরু করবো। যারা-যারা যাবে, তাদের নাম পড়ছি।
ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে হাত বাড়াল। হ্যারি তালিকার কাগজটা ওকে দিল। ফ্রান্সিস সব নাম পড়ে গেল। মোট তিরিশ জন। যাদের নাম নেই, তারা গুঞ্জন তুলল। ফ্রান্সিস বলল-ভাইসব–যাদের নাম বাদ গেল তারা দুঃখ করো না। অন্য কোনো অভিযানে তাদের পরে নেওয়া হবে।
একটু থামল ফ্রান্সিস। পরে বলতে লাগল–এবার যারা যাবে তাদের বলছি, কাল রাত্রে অস্ত্রশস্ত্র পোশাক নিয়ে জাহাজঘাটায় উপস্থিত থাকবে নিশানঘরের কাছে। জাহাজ চুরির সেই আগের পদ্ধতি আমরা নেব।
থামল ফ্রান্সিস। তারপর আবার বলতে লাগল–ভাইসব জেনে রেখো অনিশ্চিতের পথেই আমাদের যাত্রা। আদৌ কঙ্কাল দ্বীপ বলে কোনো দ্বীপ আছে কিনা জানি না। থাকলেও সেখানে রূপোর নদী ছিল কি ছিল না তাও জানি না। শুধু জানি ডাইনি দ্বীপের পশ্চিমে এই কঙ্কাল দ্বীপ আছে। কত দিন যাবে এই দ্বীপ খুঁজে বের করতে জানি না। কাজেই আমাদের ধৈর্য ধরে খুঁজতে হবে। ততদিন আমাদের অধৈর্য হলে চলবে না। হয়তো খাদ্য ফুরিয়ে যাবে, হয়তো খাবার জলও ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের অধৈর্য হলে চলবে না। তোমাদের কোনো ওজর আপত্তি শোনা হবে না। আমার আর হ্যারির কথাই হবে শেষ কথা। সেই কথা শুনেই তোমাদের চলতে হবে।
ফ্রান্সিস থামলো। বন্ধুরা সব একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল-ও-হো-হো।
সভা শেষ হলো। সবাই চলে গেল। সবশেষে বেরিয়ে এল ফ্রান্সিস আর হ্যারি। পথে আসতে-আসতে হরি বলল–রূপোর নদীর গল্পটা ছেলেভুলোনো গপপো কিনা কে জানে।
ফ্রান্সিস বলল–যদি কঙ্কাল দ্বীপের খোঁজ পাই, তাহলে বুঝবো রূপোর নদী আছে, মানে ছিল।
আমারও তাই মনে হয়। হ্যারি বলল।
বাড়ি ফিরে খেতে বসে ফ্রান্সিস ওদের পরিকল্পনার কথা মারিয়াকে বলল। মারিয়া বলল–বাবা রাগ করবে না তো?
ফ্রান্সিস হেসে বলল–যখন তাল-তাল রূপো নিয়ে ফিরবো, তখন তোমার বাবা খুশিই হবেন।
ঠিক আছে–তোমরা নির্বিঘ্নে ফিরে এসো এখন আমার একমাত্র কামনা মারিয়া বলল।
পরদিন সারা সকাল বিকেল ফ্রান্সিস আর বাড়ি থেকে বেরোল না। চুপচাপ শুয়ে বসে সময় কাটাল।
সন্ধ্যে হতেই খেয়ে নিল। পোশাক-তলোয়ার সব গুছিয়ে তৈরী হলো। বাবাকে কিছু বলল না। বাবা আর রাজামশাই-এর অজান্তেই জাহাজ চুরি করতে হবে।
একটু রাত হতেই ফ্রান্সিস মারিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিল। মারিয়ার দুচোখ ছল ছল করে উঠল। ফ্রান্সিস হেসে বলল–অত ভীতু হলে চলবে না।
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ফ্রান্সিস একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল। টক টক টকা গাড়ি চলল পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে। গাড়ি কিছুটা চলতে ফ্রান্সিস জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পেছনের দিকে তাকাল। দেখল, দেউড়ির আলোর নীচে মারিয়া তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস একটু উন্মনা হয়ে পড়ল। কিছু পরক্ষণেই দুর্বল হয়ে পড়া মনকে শক্ত করল। এসব কি ভাবছে সে? মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ও গলা চড়িয়ে বলল… ভাই, একটু তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাও।
গাড়ি চলার বেগ বাড়ল। গাড়ি বন্দরের জেটির কাছে এসে থামল। ফ্রান্সিস গাড়ি থেকে নেমে এল। ভাড়া চুকিয়ে দ্রুত পায়ে নিশানঘরের সামনে এল। দেখল, প্রায় সবাই এসে গেছে। একটু অপেক্ষা করতেই বাকিরা এসে পড়ল।
ফ্রান্সিস সবাইকে অপেক্ষা করতে বলল। তারপর নিজে নিশান ঘরের আড়াল থেকে জেটিতে এল। কিছুক্ষণ এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াল। অন্ধকারে জাহাজগুলো ভাসছে কোনো জাহাজে আলো আছে, কোনো জাহাজে নেই। একটা জিনিষ লক্ষ্য করল যে আজকে অনেক পাহারাদার সৈন্য জাহাজঘাটা পাহারা দিচ্ছে, সাধারণত এত পাহারাদার সেনা জাহাজঘাটায় থাকেন। ফ্রান্সিস বুঝল-পাহারা এত কড়াকড়ি করা হয়েছে রাজার আদেশে।
রাজা জানেন যে ফ্রান্সিস যদি জাহাজ চুরি করে পালাবে এটা স্থির করে থাকে তবে সেটা করবেই। কাজেই রাজা সাবধান হয়েছেন।
ফ্রান্সিস একটু চিন্তায় পড়ল। পাহারাদার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই না করে, রক্তপাত ঘটিয়ে কী করে জাহাজ চুরি করা যায়। নিশানঘরের আড়ালে ও যখন এল তখন বন্ধুরা ওকে ঘিরে ধরল। জিজ্ঞেস করতে লাগল এখন কী করবে ওরা। ফ্রান্সিস আস্তে-আস্তে বলল–রাজা টের পেয়েছেন যে আমরা জাহাজ চুরি করবো। তাই বন্দরের পাহারায় অনেক সৈন্য মোতায়েন করেছেন।
তারপর হ্যারিকে বলল–হ্যারি–একটা কিছু উপায় বার করো। কোন খুনখারাপির মধ্যে আমরা যাবো না।
হ্যারি হেসে বলল–তোমার বুদ্ধি আমার চেয়ে কিছু কম নয়। তুমিই একটা উপায় বার কর।
ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকাল–না–মাথাটা কেমন হালকা লাগছে। কিছু ভাবতেই পারছি না।
বিস্কো এগিয়ে এল। বলল–খড়, কেরোসিন বাক্সে আগুন লাগিয়ে দিই। এর আগে তো এভাবেই পালিয়েছি।
ফ্রান্সিস হেসে বলল–রাজামশাই অত বোকা ভেবো না। সারা জাহাজঘাটা সাফ। খড়, কেরোসিন, কাঠের বাক্স কিছু নেই।
কথাটা শুনে সকলেই বেশ চিন্তায় পড়ল। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। ওদিকে রাতও বাড়ছে। অনেকেই নিশানঘরের সিঁড়িতে বসে পড়ল।
হঠাৎ হ্যারি উঠে দাঁড়াল। বলল–সৈন্যরা আমাকে চিনে ফেলবে। তাই বিস্কোকে নিয়ে আমি যাচ্ছি। বিস্কো সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেবে কোন জাহাজটায় আটা, ময়দা, চিনি এসব খাবার ভালো মজুত আছে, জল আছে। সেই অনুযায়ী আমরা একটা জাহাজ বেছে নেব। তারপর জাহাজ নিয়ে পালাবার উপায় ভাববো।
হ্যারি আর বিস্কো চলে গেল। জাহাজঘাটায় এখানে ওখানে মশাল জ্বলছে। জলে কাঁপছে সেই আলো। একটা পাথুরে দেওয়ালের পেছনে হ্যারি দাঁড়াল। বিস্কো গেল সৈন্যদের সঙ্গে গল্প জমাতে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে বিস্কো ফিরে এল। বলল–সব খবর পেয়েছি প্রথম তিনটে জাহাজের পরে চার নম্বর জাহাজটায় সব খাবার-দাবার জল রাখা আছে, ওটা কাল সকালে লিসবনের দিকে রওনা হবে। জাহাজটা নতুন, খুব মজবুত।
কোন্ জাহাজটা নিয়ে পালাতে হবে সেটা ঠিক হলো। কিন্তু পালাবার উপায়? হ্যারি জাহাজঘাটার জ্বলন্ত মশালগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। জাহাজগুলোও দেখতে লাগল। তখনই দেখল দুনম্বর জাহাজটা থেকে শীল মাছের তেলের পিঁপে খালাস করা হচ্ছে। জাহাজটার ডেকে অনেকগুলো তেলের পিঁপে সাজিয়ে রাখা। জাহাজ থেকে ঘাট পর্যন্ত একটা কাঠের পাটাতন পাতা। জাহাজের খালাসীরা পিঁপেগুলো পাটাতনের ওপর দিয়ে ঘাটে এনে জড়ো করছে। হ্যারি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। হঠাৎ একটা চিন্তা ওর মাথায় খেলে গেল। পিঁপেগুলোতে আগুন লাগালে কেমন হয়? খুব সহজেই তেলের পিঁপেগুলোতে আগুন ধরে যাবে। হ্যারি দ্রুত বলে উঠল–বিস্কো–চলো।
ওরা দুজনে নিশানঘরের নিচে এল। বন্ধুরা বসে ছিল, তারা উঠে এল। হ্যারি
চাপাস্বরে ডাকল শাঙ্কো-শাঙ্কো কোথায়।
শাঙ্কো এগিয়ে এল–তীর ধনুক এনেছো তো? হ্যারি জিজ্ঞেস করল। শাকো মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে বলল–নিশ্চয়ই।
তাহলে এক কাজ কর। অন্ধকারে কোনো জাহাজ থেকে তেলেভেজা মশালের পলতে নিয়ে এসো। শীগগির।
শাঙ্কো খুব দক্ষ তীরন্দাজ, অনেক প্রতিযোগিতায় ও তীর ছোঁড়ায় প্রথম হয়েছে। শাঙ্কো তীরধনুকটা বিস্কোকে দিল। তারপর অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
সবাই অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরেই শাঙ্কো ফিরে এল। হাতে মশালের তেলেভেজা পলতে। হ্যারি বিস্কোর হাত থেকে একটা তীর নিল। তেলে ভেজা পলতেটা তীরটায় জড়াল। শাঙ্কোর হাতে তীরটা দিয়ে বলল…মশালের আগুন থেকে তীরটায় আগুন জ্বালাও। তারপর অন্ধকার জাহাজঘাটায় গিয়ে দাঁড়াও। দেখবে দুনম্বর জাহাজটা থেকে তেলের পিঁপে নামানো হচ্ছে। একটা পিঁপেয় জ্বলন্ত তীর ছোঁড়ো। শীল মাছের তেল খুব দাহ্য পদার্থ। সঙ্গে সঙ্গে কাঠের পিঁপেটায় আগুন লেগে যাবে। সেই আগুন ছড়াতেও সময় নেবে না। শীগগির যাও।
শাঙ্কো জ্বলন্ত তীর-ধনুক নিয়ে চলে গেল। একটু এগোতেই দেখল দুনম্বর জাহাজের পিল খালাস হচ্ছে। ও হাতের কাছের মশালটা থেকে তীরটায় আগুন লাগাল। দেখল খালাসীরা পাটতনের ওপর দিয়ে একটা তেলের পিঁপে গড়িয়ে নিয়ে আসছে। সেই পিঁপেটা লক্ষ্য করে ও জ্বলন্ত তীর ছুঁড়ল। তীরটা গিয়ে কাঠের পিঁপেটায় বিঁধে গেল। মুহূর্তের মধ্যে পিঁপেটায় আগুন লেগে গেল। যে দুজন খালাসী ওটা গড়িয়ে নিয়ে আসছিল, তারা জ্বলন্ত পিঁপেটা ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে সরে গেল। জ্বলন্ত পিঁপেটা গড়াতে-গড়াতে পাটাতন থেকে সরে সমুদ্রের জলে পড়ে গেল। নিভে গেল আগুন। শাঙ্কো নিজের কপালে চাপড় দিয়ে…ইস্ ফস্কে গেল।
শাঙ্কো হ্যারির কাছে ফিরে এল। আর একটা পলতে নিল। তীরে জড়াল। আবার মশালের আলো থেকে তীরটায় আগুন জ্বালল। ততক্ষণে খালাসিরা আবার পিঁপেগুলো পাটাতনের ওপর দিয়ে গড়িয়ে-গড়িয়ে তুলতে শুরু করেছিল। লক্ষ্য স্থির করে শাঙ্কো জ্বলন্ত তীরটা ছুঁড়ল। পিঁপেটায় জ্বলন্ত তীর ঢুকে গেল। পিঁপেটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। খালাসি দুজন পিঁপে ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। জ্বলন্ত পিঁপেটা ঢালু পাটাতন দিয়ে গড়াতে-গড়াতে জাহাজের ডেক-এর দিকে চলল। ডেক-এর সাজিয়ে রাখা পিঁপেগুলোয় গিয়ে পড়ল জ্বলন্ত পিঁপেটা। মুহূর্তের মধ্যে আর একটা পিঁপেতে আগুন ধরে গেল। দেখতে দেখতে আরো কটা পিঁপেয়। প্রচণ্ড শব্দে প্রথম পিঁপেটা ফাটল এবার। চারিদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। তারপরই ফাটল আর একটা পিঁপে। চোখের পলকে জাহাজটার ডেকে আগুন লেগে গেল। আগুনের ফুলকি ছিটকোতে লাগল অনেক দূর পর্যন্ত।
সৈন্যরা প্রথমে হকচকিয়ে গেল। ওরা বুঝতেই পারল না জাহাজে আগুন লাগল কী করে। তারপরেই ওরা সবাই জ্বলন্ত জাহাজটার সামনে এসে হৈচৈ শুরু করল। কিন্তু পিঁপেগুলো যে প্রচণ্ড শব্দে ফাটছে, তাই ওরা কাছে যেতে সাহস পেল না। দূর থেকে বালতি করে জল ছুঁড়ে দিতে লাগল। কিন্তু আগুন তাতে নিভল না। আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ল।
ওদিকে হ্যারি চাপাস্বরে বলে উঠল–সব ছোটো–চার নম্বর জাহাজটায় গিয়ে উঠবে। কোনো শব্দ করবো।
ততক্ষণে শাঙ্কোও এসেছে। সবাই দ্রুত পায়ে ছুটল চার নম্বর জাহাজটার দিকে। #হাতে পাটাতন পেতে সব নিঃশব্দে জাহাজটায় উঠে পড়ল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল সবাইকে–নোঙর তোল–নিঃশব্দে। দাঁড়ঘরে চলে যাও কিছু। কোনো শব্দ না করে দাঁড় বাইতে থাকো।
ফ্রান্সিসের কথামতো সবাই কাজে লেগে পড়ল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই নোঙর তোলা হলো–দাঁড় বাওয়া শুরু হলো। জাহাজটা আস্তে আস্তে ভেসে চলল গভীর সমুদ্রের দিকে।
ওদিকে সৈন্যরা জাহাজের আগুন নেভাতে ব্যস্ত। কিন্তু একটু পরেই বুঝল যে আগুন নেভানো অসম্ভব। আগুন তখন সমস্ত জাহাজটায় ছড়িয়ে পড়েছে। মাঝে-মাঝে প্রচণ্ড শব্দে পিঁপেও ফাটছে। কাছে যেতে সাহস হচ্ছে না কারো।
এদিকে আগুন আর হৈ-চৈয়ের মধ্যে সৈন্যরা দেখল, একটা জাহাজ গভীর সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। সৈন্যরা ভেবে উঠতে পারল না কী করবে ওরা। জাহাজটা ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে। সৈন্যরা হাল ছেড়ে দিল। ঐ জাহাজ আর ফেরানো সম্ভব নয়। এদিকে অন্য জাহাজগুলোতেও যাতে আগুন না লেগে যায়, তার জন্যে ওরা জ্বলন্ত জাহাজটার নোঙর তুলল। জ্বলন্ত জাহাজটা ঠেলে দিল গভীর সমুদ্রের দিকে। অন্য জাহাজগুলোতে আর আগুন লাগল না। জ্বলন্ত জাহাজটা ভেসে চলল।
ফ্রান্সিসদের জাহাজটা বন্দর থেকে অনেকদূরে এসে পড়েছে তখন। ভাইকিংরা খুশীতে চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো-। দাঁড়ীদের ঘর থেকে দাঁড়ীরাও চীৎকার করে উঠল ও-হো-হো-। ঘড়ঘড় শব্দে পালগুলো তোলা হলো। সব পাল হাওয়ার তোড়ে ফুলে উঠল। একটা পাক খেয়ে জাহাজটা যেন জল কেটে উড়ে চলল। জাহাজ চলল দক্ষিণমুখো।
জাহাজ চলেছে। ওপরে নির্মেঘ আকাশ। নীচে শান্ত সমুদ্র বাতাসও বেগবান। পালগুলো ফুলে উঠেছে বাতাসে। বেশ জোরেই চলল জাহাজ। ভাইকিংদের আর দাঁড় বাইতে হচ্ছে না। শুধু জাহাজের ডেক মোছা, পালের দড়িদড়া ঠিক রাখা আর রান্নাবান্না এ ছাড়া কোনো কাজ নেই।
রাত হলে ওরা ডেক-এ জড় হয়। ছক্কা-পাঞ্জা খেলে। নাচে, গান গায়। ফ্রান্সিস আর হ্যারিও নাচগানের আসরে বসে কখনো। নাচগানের আসর ভেঙে যায় আর একটু রাত হলেই। ফ্রান্সিস তখন ডেক-এ একা-একা পায়চারি করে বেড়ায়। হ্যারি কোনো দিন ওর সঙ্গে থাকে। দুজনে কথাবার্তা হয়–রাত বাড়ে। দুজনে কেবিন ঘরে ফিরে
আসে। শুয়ে পড়ে।
এর মধ্যে একদিন বিকেলে অন্ধকার করে মেঘ জমল। ঘন-ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। বিদ্যুতের জ্বলন্ত রেখা আঁকাবাঁকা জলের মতো কালো আকাশটায় ফুটে উঠতে লাগল। সেই সঙ্গে বজ্রপাতের প্রচণ্ড গভীর শব্দ।
দেখতে-দেখতে প্রচণ্ড গতি নিয়ে বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল জাহাজটার ওপর। ভাইকিংরা অভিজ্ঞ নাবিক। ওরা আগেই দড়িদড় কেটে পাল নামিয়ে ফেলেছিল। এবার জাহাজের হুইলের সামনে দাঁড়াল কয়েকজন। বাকীরা দাঁড়ীঘর থেকে উঠে এল ডেক-এ। তৈরী হলো ঝড়ের মোকাবিলা করবার জন্যে।
শুরু হলো ঝড়ের তাণ্ডব। বিরাট-বিরাট ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল জাহাজের ডেক-এ। জাহাজ একবার ঢেউয়ের ধাক্কায় অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছে। আবার আছাড় খেয়ে নেমে আসছে ঢেউয়ের ফাটলের মধ্যে। আবার উঠছে। আবার পড়ছে। জাহাজের প্রচণ্ড দুলুনিতে কেউ স্থির হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ডেক-এর ওপর এদিকে-ওদিকে ছিটকে পড়ছে। ওরই মধ্যে ভাইকিংরা হইল ঘুরিয়ে চলল! দড়িদড়া আঁকড়ে ধরে টাল সামলাতে লাগল। জলে ভিজে সবাই যেন মন করে উঠল।
প্রচণ্ড ঝড় চলল প্রায় আধঘন্টা। হঠাৎ ঝড়ের দাপট কমে গেল। বাতাসের বেগ কমে এল। কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি থেমে গেল। বাতাসের বেগ স্বাভাবিক হলো। মেঘ উড়ে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। তারা ফুটল আকাশে। ঝড়ের প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে
লড়াই করে ক্লান্ত ভাইকিংরা যে যেখানে পারল কেউ বসে পড়ল, কেউ শুয়ে পড়ল।
ঠিক করেছিল প্রথমে ডাইনীর দ্বীপে যাবে। দ্বীপে নামবে না। ঐ দ্বীপ থেকে দিক নির্ণয় করে পশ্চিম দিক লক্ষ্য করে জাহাজ চালাবে। তবেই পৌঁছুতে পারবে কঙ্কাল দ্বীপে। পাঞ্চো সে রকমই বলেছিল।
জাহাজ চলছে। এর মধ্যে আর ঝড়ের পাল্লায় পড়তে হয়নি। বেশ দ্রুতই চলছে জাহাজ। অনেকদিন হয়ে গেল। ভাইকিংদের মধ্যে একটু গুঞ্জন শুরু হলো। এখনও ডাইনীর দ্বীপে পৌঁছোতে পারলাম না। সেখান থেকে আবার কঙ্কাল দ্বীপ। তার দূরত্ব কত কে জানে? হ্যারি শুনল এসব কথা। কিন্তু ফ্রান্সিসকে কিছু বলল না।
একদিন ভোর-ভোর সময়ে দূর থেকে দেখা গেল ডাইনীর দ্বীপ। স্পষ্ট দেখা গেল না। কারণ একটা কুয়াশার আস্তরণ দ্বীপটাকে ঘিরে ছিল। মাস্তুলের ওপর যে নজরদারি করছিল সেই প্রথম দেখল ডাইনী দ্বীপ। ও চীৎকার করে বলে উঠল–ফ্রান্সিস, ডাইনীর দ্বীপ।
ওর চীৎকার চেঁচামেচিতে অনেকেরই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ফ্রান্সিসের ঘুম খুব পাতলা। ও প্রথম ডাকেই উঠে পড়ল। ডেক-এর ওপর উঠে এল। ভোরের কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সবাই ডাইনীর দ্বীপ দেখল।
একটু বেলা হতেই কুয়াশার আবরণ সরে গেল। স্পষ্ট দেখা গেল ডাইনীর দ্বীপ। সবুজ পাহাড়, সবুজ গাছগাছালি।
ফ্রান্সিস ডেক-এ দাঁড়িয়ে দ্বীপটা দেখল। তারপর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল জাহাজের মুখ পশ্চিমদিকে ঘোরাও। সোজা পশ্চিম দিকে যেতে হবে আমাদের। তাহলেই কঙ্কাল দ্বীপে পৌঁছবো আমরা।
জাহাজের মুখ ঘোরান হলো পশ্চিমদিকে। জাহাজ চলল জল কেটে। লক্ষ্য কঙ্কাল দ্বীপ।
জাহাজ চলল। কয়েকদিন পরে এক রাতে ফ্রান্সিস ডেক-এ পায়চারি করছে। হ্যারি এল। ফ্রান্সিস বলল হ্যারি এই জাহাজে কাঠ কত আছে?
কাঠের তক্তাগুলো গুণে দেখি নি। তবে কাঠের স্তূপটা ছোট নয়।
তুমি কালকেই ভাল করে দেখ–কেন কাঠ আছে।
কী করবে কাঠ দিয়ে?
সেই কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরী করতে হবে। যে কটা নৌকা হয় বানাতে হবে। কঙ্কাল দ্বীপে যেতে লাগবে। জাহাজ থেকে সরাসরি দ্বীপে নামা যাবে না।
রূপোর নদী
বেশ–ফার্নান্দো ওস্তাদ কাঠের মিস্ত্রী। ওকেই বলবে কয়েকজনকে নিয়ে কাজ শুরু করতে।
ফার্নান্দোকে বলতে ও পরদিনই নৌকা তৈরীর কাজে হাত লাগাল।
***
জাহাজ চলেছে। এর মধ্যে দুবার ঝড়ের মুখে পড়েছিল জাহাজটা। তবে ঝড় তেমন প্রচণ্ড ছিল না। দুতিনটে পাল ঘেঁসে গিয়েছিল শুধু। সেগুলো মেরামত করে জাহাজ পূর্ণ গতিতেই চলল।
মাঝখানে দিন চারেক হাওয়া পড়ে গিয়েছিল। পালে কাজ হয়নি। ক্রমাগত দাঁড় বাইতে হয়েছিল ভাইকিংদের।
দিন কুড়ি কেটে গেল। কিন্তু কঙ্কাল দ্বীপের দেখা নেই। এবার বেশ জোরে গুঞ্জন উঠল ভাইকিংদের মধ্যে। হ্যারীর কানে গেল সে কথা। ও বুঝল এই অসন্তোষকে বাড়তে দিলে যে কোনো মুহূর্তে ভাইকিংরা ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। ও ফ্রান্সিসকে বলল সব কথা। ফ্রান্সিস সেইদিন সন্ধ্যেবেলাই ডেক-এ সভা ডাকল।
সন্ধ্যে হতেই ভাইকিংরা ডেক-এ এসে জড়ো হলো। একটু পরেই ফ্রান্সিস হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে কেবিন ঘর থেকে ডেক-এ উঠে এল। সব ভাইকিং বন্ধুদের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ফ্রান্সিস বলতে লাগল–ভাইসব–এই অভিযানে বেরোবার আগেই আমি বলেছিলাম আমাদের পথ ভুল হতে পারে, খাদ্যজল ফুরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমাদের অধৈর্য হলে চলবে না। সোনার ঘন্টা আনতে গিয়েও এরকম সমস্যায় আমাদের পড়তে হয়েছিল। সেদিন বন্ধুরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আমার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে বলেই বলছি কেউ যদি হতাশ হয়ে পড়ে তাহলে বলো, সামনে কোনো বন্দর পেলে তাকে নামিয়ে দেবো। সে অন্য জাহাজ ধরে দেশে ফিরে যাবে। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল-বলল তোমরা কে-কে ফিরে যেতে চাও।
ভাইকিংরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কোনো কথা বলল না। ফ্রান্সিস সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। তারপর তাহলে সবাই হাত লাগাও। বাতাস পড়ে গেছে। দাঁড়ীরা দাঁড়ঘরে যাও। যত দ্রুত সম্ভব জাহাজ চালাও। কঙ্কাল দ্বীপে আমাদের যেতেই হবে।
ভাইকিংরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো-। তারপর যে যার কাজে লেগে পড়ল। জাহাজের গতি বাড়ল অল্পক্ষণের মধ্যেই।
আরো দুদিন কাটল। বাতাসের বেগ বাড়ল। পাল ফুলে উঠল। দাঁড় বাওয়াও চলল। জাহাজ চলল দ্রুত গতিতে। ভাইকিংরা আবার আগের মতো প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওরা ফ্রান্সিসকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে।
***
পরের দিন। সূর্য পশ্চিমদিকে ঢলে পড়েছে। তখনও অস্ত যায়নি। মাস্তুলের মাথায় পালা করে ওরা থাকে।
চারদিক নজর রাখে। সেই বিকেলে মাস্তুলের নজরদার চিৎকার করে উঠল–ডাঙা দেখা যাচ্ছে–ডাঙা। ফ্রান্সিসকে খবর দেওয়া হলো। ও দ্রুতপায়ে ডেক-এ উঠে এল। হ্যারিও এল।
ফ্রান্সিস নজরদারকে চীৎকার করে বলল–কী দেখছো?
মনে হচ্ছে একটা দ্বীপ। একটা পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে। নজরদার বলল।
জাহাজ ঠিক ঐ দ্বীপের দিকে যাচ্ছে? ফ্রান্সিস বলল।
না। আমাদের একটু উত্তরের দিকে সরে যেতে হবে।
ফ্রান্সিস জাহাজ চালকের কাছে এল। বলল–একটু উত্তর দিক ঘেঁষে চালাও।
জাহাজ একটু উত্তরমুখো হলো।
একটু পরেই অস্তগামী সূর্যের আলোয় দ্বীপটা দেখা গেল। লাল আকাশের নীচে কালো পাহাড়ের মাথাটা দেখা গেল। মানুষের মাথার খুলির মতো। জাহাজ থেকে সবাই দেখছিল পাহাড়টা। ফ্রান্সিস আর হ্যারি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। ফ্রান্সিস বলল–হারি এটাই কি কঙ্কাল দ্বীপ?
আমার বিশ্বাস এটাই কঙ্কাল দ্বীপ, দেখছো না পাহাড়টা দেখতে করোটির মতো।
হ্যাঁ-মানুষের মাথার খুলির মতো। ফ্রান্সিস বলল। একটু পরেই পশ্চিমের লাল আলো আকাশ থেকে মুছে গেল। অন্ধকার নেমে এল।
ফ্রান্সিস জাহাজের চালককে বলল–জাহাজ থামাও।
তারপর সবাইকে বলল–পাল নামাও। দাঁড় বাওয়া বন্ধ কর। কাল দিনের বেলা দ্বীপের দিকে যাব আমরা।
একটু পরেই জাহাজ থেমে গেল।
পুব আকাশের আধভাঙা চাঁদটা আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হলো। মেটে জ্যোৎস্না ছড়াল সমুদ্রের ওপর। আবছা দেখা গেল দূরের কঙ্কাল দ্বীপ।
পরদিন সকালে কারো কোনো কাজ নেই। সকালের খাবার খেয়ে সকলেই ডেকে এসে জড়ো হলো। দেখতে লাগল কঙ্কাল দ্বীপ। পাহাড়ের চুড়োটা ন্যাড়া। কিন্তু পাহাড়ের নীচ থেকে শুরু করে চারদিকে প্রচুর গাছপালা। তীরের কাছে জঙ্গল অত ঘন নয়। অতদূর থেকে মানুষ জন্তু বা পাখি দেখা গেল না। হঠাৎ একজনের নজর পড়ল–গভীর সমুদ্রের দিকে দূরে একটা ভেলামত কী যেন ঢেউয়ের মাথায় উঠছে পড়ছে। সে সঙ্গীদের ডাকল–দ্যাখ তো ওটা কী?প্রায় সকলেরই দৃষ্টি পড়ল ওদিকে। কিন্তু অতদুর থেকে ওরা বুঝতে পারল না জিনিসটা কি?
দুজন ছুটে গিয়ে ফ্রান্সিসকে খবর দিল। ফ্রান্সিস ডেকে-এ উঠে এল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ভেলাটার দিকে। তারপর ফিরে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল–ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এক কাজ কর–জাহাজ চালু কর। ঐদিকে জাহাজ নিয়ে চল।
কথামত সবাই কাজে লেগে পড়ল। জাহাজটা একবার নড়ে উঠে গভীর সমুদ্রের দিকে চলতে লাগল। জাহাজটা যত কাছে যেতে লাগল ভেলাটা ততই স্পষ্ট হতে লাগল।
কাছে আসতে দেখা গেল-কতকগুলো গাছের কাণ্ড দিয়ে, বুনো লতা দিয়ে বাঁধা একটা ভেলা। তার ওপর দুজন মানুষ। একজন বৃদ্ধ, অন্যজন যুবক। দুজনের হাত পা ভেলাটার সঙ্গে জংলী লতা দিয়ে বাঁধা। বৃদ্ধটির গায়ে বিচিত্র রঙের ডোরাকাটা আলখাল্লার মতো কী একটা। যুবকটির গা খালি। দুজনেরই পরনে ঘাসের তৈরী ঘাগরামতো। বৃদ্ধটির মাথায় লাল কাপড়ের ফেটি। তাতে কয়েকটা লম্বা পাখির পালক গোঁজা।
ফ্রান্সিস ডেক থেকে দেখল সব। কিন্তু বুঝে উঠতে পারল না মানুষ দুটো বেঁচে আছে কিনা। ফ্রান্সিসের কথামতো এর মধ্যেই পাঁচটা নৌকো তৈরী হয়েছিল। তারই একটা জলে নামানো হলো। বিস্কো একটা বৈঠা হাতে জাহাজের ঝোলানো দড়ি বেয়ে বেয়ে নৌকোটায় নামল, তারপর নৌকা বেয়ে চলল ভেলাটার দিকে। কাছে আসতে ও নৌকো থেকে ভেলাটায় উঠল। প্রথমে লতা দিয়ে বাঁধা যুবকটির বুকে নিজের কান চেপে ধরল। তারপর নাকের কাছে হাত রাখল। উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে জাহাজের বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল-শাস পড়ছে–বেঁচে আছে। এবার বৃদ্ধটিকে পরীক্ষা করল। উঠেদাঁড়িয়ে বলল–দুজনেই বেঁচে আছে।
তারপর বিস্কো কোমরে গোঁজা ছোরাটা বের করল। লতার বাঁধন কাটল। প্রথমে যুবকটি আস্তে আস্তে উঠে বসল। বৃদ্ধটি শুয়েই রইল। বিস্কো যুবকটিকে বলল…নৌকোয় চড়তে পারবে?
যুবকটি ওর ভাষা বুঝল না। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল।
বিস্কো এবার পর্তুগীজ ভাষায় বলল। যুবকটি বুঝল না। মাথা নাড়ল। তখন বিষ্ণো স্প্যানিশ ভাষায় বলল। যুবকটি এবার চোখ খুলে ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় বলল আমার নড়বার শক্তি নেই। বিস্কো বুঝল ওদের নৌকোয় ভোলা যাবে না। ও নিজের নৌকোয় ফিরে এল। নৌকো থেকে কাছি নিয়ে কাঠের ভেলাটার সঙ্গে বাঁধল। তারপর ভেলাটাকে টেনে নিয়ে এল জাহাজের কাছে। জাহাজ থেকে ভাইকিংরা একটা দড়িতে ফাস পরিয়ে ঝুলিয়ে দিল। বিস্কো যুবকটিকে তুলে ধরে ফাঁসটায় বসিয়ে দিল। জাহাজ থেকে ভাইকিংরা টেনে টেনে যুবকটিকে জাহাজে তুলে নিল। আবার দড়ির ফাঁস নামিয়ে দিল। বিস্কো অনেক কষ্টে বৃদ্ধকে তুলে ফাঁসে বসিয়ে দিল। বৃদ্ধের দেহটি ফাঁসে ঝুলতে লাগল। ভাইকিংরা দড়ি টেনে টেনে বৃদ্ধটিকে জাহাজে তুলে নিল। বিস্কোও নৌকোটা জাহাজের গায়ে বেঁধে দড়ি ধরে জাহাজে উঠে এল।
ততক্ষণে কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে বৃদ্ধ ও যুবকটিকে একটা কেবিনঘরে নিয়ে শুইয়ে দিয়েছে। ওদের গায়ে কম্বল ঢাকা দিয়েছে। যুবকটি তবু চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু বৃদ্ধটি মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলছিল।
ফ্রান্সিস যুবকটির কাছে এসে বসল। বিস্কো ফ্রান্সিসকে বলল যুবকটি স্প্যানিস ভাষা বোঝে। ফ্রান্সিস যুবকটিকে জিজ্ঞেস করল–তেমরা কারা? যুবকটির খুব দুর্বল কণ্ঠে বলল-ইকাবো। ফ্রান্সিস পাঞ্চোরকাছে শুনেছিল কঙ্কাল দ্বীপের অধিবাসীরাইকাবো জাতি।
তোমরা কঙ্কাল দ্বীপের অধিবাসী?
হ্যাঁ।
আমরা যে দ্বীপটিকে এখান থেকে দেখছি সেটাই কি কঙ্কাল দ্বীপ?
হ্যাঁ? |||||||||| – তারপর যুবকটি ভীষণ ক্লান্তস্বরে বলল–আমার কথা বলতে–কষ্ট। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। বলল–মাপ করো ভাই–এসময় আমার কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত হয়নি। ও বিস্কোর দিকে তাকাল। বলল–বিস্কো, ওদের আগে জল খেতে দাও, তারপর গরম মাংস রুটি।
বিস্কো অল্পক্ষণের মধ্যে সব ব্যবস্থা করল। প্রথমে যুবকটিকে ধরাধরি করে বিছানায় বসানো হলো। তারপর জল খাওয়ানো হলো। জল খেয়ে যুবকটি একটু সুস্থ হলো যেন। ওর হাতে মাংস রুটির থালা দেওয়া হলো। যুবকটি বৃদ্ধটির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বিস্কোকে জিজ্ঞেস করল–আমার বাবা বেঁচে আছেন? বিস্কো বুঝল বৃদ্ধটি ওর বাবা। বলল–হ্যাঁ–বেঁচে আছেন। তুমি নিশ্চিন্ত মনে খাও। যুবকটি আস্তে আস্তে খেতে লাগল।
কয়েকজন ধরাধরি করে বৃদ্ধটিকে উঠিয়ে বসাল। জল খাওয়াল। তারপর মাংস রুটির থালাটা ওঁর হাতে দিল। বৃদ্ধটি কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে রইল। তারপর চোখ খুলে ছেলের দিকে তাকিয়ে ইকাবো ভাষায় কী বলল। ছেলেটিও মৃদুস্বরে কী উত্তর দিল। বৃদ্ধটি আস্তে আস্তে খেতে লাগল।
রাত্রে ফ্রান্সিস একা একা ডেক-এ পায়চারি করছিল। কী করবেএখন তাই ভাবছিল। হ্যারি এসে ওর কাছে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস পায়চারী থামিয়ে বলল–ওরা কি সুস্থ এখন।
না, এখনও ওদের দুর্বলতা কাটেনি।
এখন কী করবো বলো তো?
এখন কঙ্কাল দ্বীপে যাবে কি না ভাবছো?
হ্যাঁ।
আমার মনে হয় কয়েকদিন অপেক্ষা করা ভাল।
ও কথা বলছো কেন?
দেখ–এরা ইকাবো। কী এরা অপরাধ করেছে যে ভেলায় বেঁধে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে? অথবা কঙ্কাল দ্বীপে এমন কিছু ঘটেছে যে জন্যে এদের ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত ব্যাপারটা না জেনে এখন কঙ্কাল দ্বীপে যাওয়াটা উচিত হবে না। হ্যারি বলল।
ঠিকই বলেছো। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল–এদের কাছে আগে সমস্ত ব্যাপারটা শুনি তারপর সিদ্ধান্ত নেবো।
কয়েকদিনের মধ্যেই যুবকটি আর তার বাবা অনেকটা সুস্থ হলো। ফ্রান্সিস দুবেলাই ওদের খোঁজখবর নিতে যেতো।
আজকেই বিকেলের দিকে ওদের কেবিনঘরে এল। দেখল যুবকটি বিছানায় বসে আছে। বৃদ্ধটি শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস হেসে বলল-ভাই-এখন কেমন আছো? ভালো। যুবকটি মাথা নেড়ে হাসল। বলল–আপনারা আমাদের বাঁচিয়েছেন। আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
ফ্রান্সিস হেসে ওর পিঠ চাপড়াল–মানুষ হিসেবেআমাদের যা কর্তব্য তাইকরেছি। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল–তোমার এখন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে না তো?
ন্নাঃ।
তাহলে তোমাদের ব্যাপারটা একটু বল। আসল কথা তোমাদের ব্যাপারটা না জানা পর্যন্ত আমরা কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না।
যুবকটি ফ্রান্সিসের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইল। পাশেই ছিল হ্যারি হ্যারি বলল তোমার বলতে কোন আপত্তি আছে?
ন্নাঃ তা কেন? তারপর আস্তে আস্তে যুবকটি বলতে লাগল–আমার বাবা হচ্ছেন ইকাবোদের রাজা। আমি রাজপুত্র! আমার নাম মোকা। একটু থেমে মোক বলতে লাগল–কঙ্কাল দ্বীপের দক্ষিণে বেশ দূরে ত্রিস্তানদের একটা দ্বীপ আছে। ওরা আমাদেরচিরশত্রু। এর আগেও অনেকবার আমাদের দ্বীপ আক্রমণ করেছে। কিন্তু আমাদের হারাতে পারে নি। মোকা থামল। একটু দম নিল। তারপর বলতে লাগল–কিন্তু আমাদের দুভাগ্য। কিছুদিন আগেদ্বীপে ভীষণভূমিকম্প হয়েছিল। অনেকইকাবো তাতে মারা যায়। কমসংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে এবার ত্রিস্তানদের আক্রমণ রোধ করতে পারলাম না। আমরা হেরে গেলাম। আমাদের যোদ্ধারা বনে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। আমি আর বাবা ধরা পড়লাম ত্ৰিস্তানদের হাতে। ওরা আমাদেব প্রাণে মারল না। ভেলায় বেঁধে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিল।
কতদিন আগে? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
তা বলতে পারবো না। দিন সাতেকের কথা মনে আছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
তাহলে কঙ্কাল দ্বীপ এখন ত্ৰিস্তানদের দখলে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল। হ্যাঁ। এখন তোমরা কী করবে? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
মোক একটু চুপ করে থেকে বলল–আমরা প্রাণে বাঁচবো এটা তো স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন আপনাদের দয়ায় আমরা বেঁচে গেছি। এবার নতুন করে ভাবতে হবে এখন আমরা কী করবো?
মোকার কথা শেষ হলে বৃদ্ধ রাজা মোকাকেইকাবোদের ভাষায় কী জিজ্ঞেস করল। দুজনে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। ওদের কথা শেষ হলে ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল–তোমার বাবা মানে রাজামশাই কী বললেন?
বাবা বলছেন–পলাতক যোদ্ধাদের একত্র করে তিনি আবার ত্রিস্তানদের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। তাতে তাঁর মৃত্যু হলে তিনি মৃত্যুই মেনে নেবেন।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি চুপ করে রইল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। হঠাৎফ্রান্সিসের মনে পড়ল রুপোর নদীর কথা। ও জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা তোমাদের দ্বীপে কি রূপোর : নদী আছে?
মোকা যেন একটু চমকাল। বলল–রূপোর নদীর কথা আপনি কি করে শুনলেন?
পাঞ্চো নামে একজন স্প্যানিশ নাবিক বলেছিল। আমাদের দেশে একসরাইখানায় পাঞ্চোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।
পাঞ্চো। মোকা হাসল। বলল–পাঞ্চো কিছুদিন আমাদের দ্বীপেছিল। ওর কাছেই আমি স্প্যানিশ ভাষা শিখেছি। ও রূপোর নদীর খোঁজে এসেছিল। এর আগেও দুতিনজন এসেছে। কিন্তু রূপোরনদীর খোঁজ কেউ পায়নি। ত্রিস্তানরা যে আমাদের দ্বীপদখল করেছে, ওদেরও লোভ রূপোর নদীর দিকে। একটু থেমে মোক বলল–কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ রূপোর নদী খুঁজে পায়নি।
তোমরা নিজেরা খুঁজেছো? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। অনেকভাবে চেষ্টা করেছি–খুঁজেছি, পাইনি।
তোমার বাবাও জানেন না বোধহয়? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
না বাবাও জানেন না।
তোমরা কী মনে করো? হরি বলল–সত্যিই রূপোর নদী ছিল, না সবটাই। একটা ছেলে-ভুলানো গপপো?
না–গপপো নয়। বাবা বলেন রূপোর নদীর কথা তিনি আমার ঠাকুরদার মুখে শুনেছেন। তা ছাড়া আমাদের দ্বীপের দেবতা–গিয়ানি। তার মন্দিরমত একটা পুজোর স্থান আছে। সমস্ত মন্দিরটা তাল তাল রূপোর থাম দিয়ে তৈরী। সামনে আছে রূপোর থাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা এত রূপো পেল কোত্থেকে?
ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল-হারি, এবার বুঝতে পারছো?
হুঁ। কিন্তু রূপোর নদী গেল কোথায়? হ্যারি বলল।
আচ্ছা মোকা–ফ্রান্সিস বলল–তোমাদের দ্বীপে তো একটাই নদী?
হ্যাঁ।
সেটার নাম কুনহা?
হ্যাঁ।
তোমাদের ভাষায় কুনহা-র অর্থ রূপো–তাই কিনা?
হ্যাঁ, আপনি এতসব জানলেন কী করে?
পাঞ্চো বলেছে।
পাঞ্চো–চোর। ঠকবাজ। মোকা কেশ রেগে বলল–জানেন ও গিয়ানির মন্দিরের একটা থাম চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।
ফ্রান্সিস একটু আশ্চর্য হলো। বলল–আমি অতশত জানি না। পাঞ্চো আমার বন্ধু নয়, এক রাত্রের আলাপ। ঠিক আছে, ফ্রান্সিস মোকার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল তোমরা বিশ্রাম করা। পরে কথা হবে।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে এল।
রাত্রে ফ্রান্সিস একা একা জাহাজের ডেক-এ পায়চারি করছিল। গভীরভাবে ভাবছিল কী করবে এখন? হ্যারি এল। ওর মাথায়ও এক চিন্তা। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে দুজনে কথাবার্তা বলছে, তখনই বিষ্ণো এল। একটা দুঃসংবাদই নিয়ে এল ও। বলল–
ফ্রান্সিস, জাহাজে খাবার জল ফুরিয়ে এসেছে। কী করবে?
কঙ্কাল দ্বীপ থেকেই জল আনতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।
কিন্তু দিনের বেলা যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
না, রাত্রে যেতে হবে।
তাহলে আজ রাত্রেই যেতে হয়।
ঠিক আছে। দুটো পিঁপে নিয়ে তোমরা চারজন যাও কিন্তু তার আগে মোকার সঙ্গে কথা বলতে হবে। কঙ্কাল দ্বীপে কোথায় পানীয় জল পাওয়া যাবে তার হদিস একমাত্র ও-ই দিতে পারবে। ফ্রান্সিস বলল। তারপরারির দিকে তাকিয়ে বলল চলো তো হ্যারি–মোকার সঙ্গে কথা বলে আসি।
ওরা দুজনে মোকা যে কেবিনঘরে ছিল সেই ঘরে এল। দেখল রাজামশাই মোকা দুজনেই ঘুমিয়ে আছেন।
ফ্রান্সিস মোকাকে আস্তে আস্তে ঠেলল। ঘুম ভেঙে মোকা বসল। এত রাত্রে ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে দেখে ও অবাকই হলো। ফ্রান্সিস বলল-মোক-আমাদের জাহাজে জল ফুরিয়ে এসেছে। তোমাদের দ্বীপে কোথায় পানীয় জল পাওয়া যাবে?
পাহাড়ের নীচে উত্তর দিকে একটা ঝর্ণা আছে। আমরা আছি দ্বীপের দক্ষিণ দিকে। যারা যাবে তাদের উত্তর দিক থেকে দ্বীপে নামতে হবে।
যে বেলাভূমি আমরা এদিক থেকে দেখছি সেখানে নেমেও তো উত্তর দিকে যাওয়া যায়।
যে বেলাভূমিটা এদিক থেকে দেখছেন তাকে মৃতের বেলাভূমি বলা হয়।
কেন?
এই বেলাভূমির কাছে সমুদ্রের নীচে যে বালি আছে তা অত্যন্ত হালকা। পা দিয়ে দাঁড়ালে বালি দ্রুত পায়ের নীচে সরে যায়। এখান দিয়ে তীরে উঠতে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। তাই এইদিকের বেলাভূমির ধারে কেউ আসে না। দেখবেন এই দিকের বেলাভূমির ধারে ত্ৰিস্তানদের একটাও ক্যানো নৌকা বাঁধা নেই। সব উত্তরের খাঁড়িগুলোতে বাঁধা আছে। মোকা বলল।
ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল–হ্যারি–আমি এই দিক দিয়েই দ্বীপেনামবো ভেবেছিলাম। ভীষণ বিপদে পড়তাম তাহলে।
মোক বলল–উত্তর দিকে পাহাড় পর্যন্ত একটা রাস্তা আছে। কিন্তু সেই রাস্তাটা নিশ্চয়ই ত্ৰিস্তান যোদ্ধারা পাহারা দিচ্ছে। যারা জল আনতে যাবে তাদের যেতে হবে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।
ঠিকআছে। ফ্রান্সিস বলল-ওদের উত্তরের জঙ্গলেরমধ্যে দিয়েই যেতে বলবো।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি ডেক-এ উঠে এল। বিস্কো আর তিনজন ভাইকিংকে নিয়ে তৈরী হয়ে ফ্রান্সিসের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ফ্রান্সিস বলল-বিস্কো-দুটো জলের পিঁপে নিয়ে যাও। কিন্তু এদিকের সমুদ্রের তীরে নামা চলবে না। তোমাদের যেতে হবে উত্তর দিকে। সেখানে খাঁড়ি আছে। সেখানে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের দিকে যাবে। পাহাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে ঝর্ণা পাবে। রাস্তামত নাকি আছে ওখানে। কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে যাবে না। ত্রিস্তান যোদ্ধারা পাহারা দিচ্ছে সেই রাস্তা।
ঠিক আছে। আমরা নৌকা নিয়ে উত্তর দিক থেকে দ্বীপে যাবো।
বিস্কোরা চলে গেল। একটু পরেইদুটো নৌকায় ওরা দুটো জলের পিঁপে নামাল। তারপর নৌকো চলল কঙ্কাল দ্বীপের দিকে। আকাশে ভাঙা চাঁদ। স্নান জোৎস্নায় ওরা নিঃশব্দে নৌকো বেয়ে চলল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি জাহাজ থেকে তাকিয়ে রইল ওদের নৌকোর দিকে। একটু পরে আর নৌকো দেখা গেল না। পাতলা কুয়াশায় আড়াল পড়ে গেল। ওরা নিজেদের কেবিনে এসে শুয়ে পড়ল।
ভোরহলো। বেলা বাড়ল। কিন্তু বিস্কোদের নৌকোর দেখা নেই। হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এল। বেশ চিন্তিত স্বরে বলল-ওরা ফিরলো না। কী ব্যাপার বলল তো?
চিন্তার কথা। দেখি আজকের দিনটা। হরি বলল।
সারাদিনই ফ্রান্সিসের চিন্তায় চিন্তায় কাটল। বিষ্ণোদের নৌকোর দেখা নেই।
সন্ধ্যে হলো। রাত বাড়তে লাগল! সবাই ডেক-এ এসে জড়ো হলো। তাকিয়ে রইল কঙ্কাল দ্বীপের দিকে। বিস্কোদের নৌকোর কোনো পাত্তাই নেই। কয়েকজন ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল ওরা বিস্কোর খোঁজে দ্বীপে যাবে। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। বলল–না আমি একা যাবো। হ্যারি আপত্তি করল। ফ্রান্সিস বুঝিয়ে বলল–বিস্কোরা নিশ্চয়ই ত্রিস্তানদের হাতে ধরা পড়েছে। আমি একা বোকার মতো ওদের সঙ্গে লড়তে যাবো না। শুধু কী ঘটেছে সেটা জেনে আসবে। তারপর সবাই মিলে যাবো। লড়াই যদি করতে হয় তখনি করবো।
রাত একটু গম্ভীর হলে ফ্রান্সিস পোশাক পরে নিল। কোমরে তরোয়াল গুঁজল। তারপর দড়ি বেয়ে জাহাজ থেকে নৌকোয় নেমে এল। আজকের চাঁদ আরো উজ্জ্বল। জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে ঢেউয়ের মাথা।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বৈঠা বাইতে লাগল। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে নৌকো এগিয়ে চলল কঙ্কাল দ্বীপের দিকে।
উত্তর দিক থেকে ঘুরে যেতে হলো বলে একটু দেরীই হলো কঙ্কাল দ্বীপে পৌঁছতে। উত্তর দিকের দ্বীপের খাঁড়িগুলোতে দেখল অনেক ক্যানো নৌকো বাঁধা। ফ্রান্সিস নৌকা নিয়ে তীরের জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে চলল। তখনি আবছা জ্যোৎস্নায় দেখল ওদের দুটো নৌকো একটা খাঁড়িতে বাঁধা। ফ্রান্সিস বুঝল–এখানেই বিস্কোরা নেমেছে। ফ্রান্সিসও নৌকোটা ভেড়াল ওখানে। একটু নীচ কেপড়া গাছের ডালে নৌকোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে ও মাটিতে নামল। বনের মধ্যে দিয়ে চলল পাহাড়টার দিকে।
বনের নীচে অন্ধকার গভীর। যেখানে গাছগাছালি একটু কম সেখানে ভাঙা জ্যোৎস্না পড়েছে ঘাসে ঝোপে। বিচিত্র সব শব্দ শোনা যাচ্ছে। কয়েকটা নিশাচর পাখি ডানা ঝাঁপটাল। এক গাছ থেকে উঠে অন্য গাছে গিয়ে বসল।
ফ্রান্সিস কোমর থেকে খুলে তরোয়ালটা হাতে নিল। তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে চলল।
হঠাৎ ভাঙ্গা জোৎস্নার আলোয় দেখল দুটো জলের পিঁপে পড়ে আছে। একটা কাত হয়ে পড়ে আছে, অন্যটা সোজা বসানো। সেটার ভিতর হাত দিয়ে দেখল জল ভরা। বুঝল বিস্কোরা এখানেই ধরা পড়েছে।
তাহলে ঝর্ণাটা কাছেই। কিন্তু সেদিকে গিয়ে লাভ নেই। বরং ত্ৰিস্তানদের আস্তানা কোন দিকে দেখতে হয়। বিস্কোদের বন্দী করে নিশ্চয়ই ওদিকে কোথাও রাখা হয়েছে।
ফ্রান্সিস ডানদিকে ঘুরল। বন থেকে বেরোতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে ত্রিস্তানদের আস্তানা। ও এগিয়ে চলল।
হঠাৎ পায়ের কাছে কী যেন কিলবিল করে উঠল। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা শক্ত বুনো লতা ওর পায়ে ফঁস হয়ে লেগে গেল। চোখের নিমেষে লতার বাঁধনটা এক হ্যাঁচকা টানে সামনের গাছের মাঝামাঝি টেনে তুলল ওকে। হাত থেকে তরোয়ালটা ছিটকে গেল। ডাল থেকে ঝোলানো লতার ফাঁদ ওর বাঁ পাটা বাঁধা। ওর মাথা নীচের দিকে। ও ঝুলতে লাগল। বুঝল ত্রিস্তানরা বনের মধ্যে ফাঁদে পেতে রেখেছে। সেই ফাঁদেই ও ধরা পড়েছে।
মাথা নীচের দিকে। পা ওপরে। ফ্রান্সিস ঝুলতে লাগল। শব্দ করে কয়েকটা পাখি গাছটা থেকে উড়ে গেল। হাতে তরোয়ালটাও নেই যে বুনো লতার ফাঁসটা কাটবে। ও ঝুলতে লাগল। গায়ের ঢোলা জামাটা মুখের ওপর আটকে গেল। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ও। জামাটা দু হাত দিয়ে খুলে নীচে ছুঁড়ে ফেলল।
বেশ কিছু সময় কাটল। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। ও বুঝল ঐভাবে আর কিছুক্ষণ ঝুললে মাথায় রক্ত উঠে অজ্ঞান হয়ে যাবে। ও শরীরটা বাঁকাতে লাগল। কয়েকটা ঝুল খেয়ে হঠাৎ শরীরটা বাঁকিয়ে পায়ের ওপরের লতাটা ধরে ফেলল। কিছুক্ষণ রইল ওভাবে। তারপর প্রাণপণ শক্তিতে লতাটা দুহাতে ধরে আস্তে আস্তে একটু সোজা হলো। পায়ের লতার বাঁধনটায় ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। হাঁপাতে লাগল। পায়ের বাঁধনটা প্রায় হাঁটুর কাছে উঠে এল। বুনো লতাটা যেন কেটে বসল পায়ে। ঘষা লেগে লেগে অনেকটা জায়গা ছড়ে গেল। ভীষণ জ্বালা করতে লাগল। যে ডাল থেকে ফাঁদের লতাটা ঝুলছে সেই ডালটা বেশ উঁচুতে। নাগাল পাওয়া অসম্ভব।
বেশ কিছুক্ষণ কাটল। মাঝে মাঝে তামত এল। কিন্তু পায়ের অসহ্য জ্বালায় তন্দ্রা ভেঙ্গে যেতে লাগল।
কতক্ষণ এভাবে ফ্রান্সিস ঝুলে রইল ও জানে না। চারপাশের বনে জঙ্গলে পাখি ডাকতে লাগল। বিচিত্র ডাক পাখিগুলোর।
ওপরে গাছের পাতার ফাঁকগুলো দিয়ে ফ্রান্সিস দেখল আকাশ আর কালো নয়। তাহলে ভোর হয়েছে। গাছের নীচের অন্ধকার তখনও কাটেনি। ও নিরুপায়। কিছুই করার নেই ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া। হাতে তরোয়ালটা থাকলে তবু কিছু করতে পারত। কিন্তু এখন একেবারেই অসহায, অসহ্য ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে পড়ছে যেন।
ফ্রান্সিস আর ওভাবে বেশীক্ষণ থাকতে পারল না। বুনো লতাটা থেকে হাত ছেড়ে দিল। আবার মাথা নিচু পা ওপরে করে ঝুলতে লাগল।
কতক্ষণ এভাবে ঝুলে রইল তা ও হিসেব করতে পারল না। হঠাৎ বনের মধ্যে কাদের কথাবার্তা ভেসে আসতে লাগল। তখন বনের নীচে কিছুদুর পর্যন্ত বেশ দেখা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস দেখল পাঁচজন লোক কথা বলতে বলতে আসছে। দুর্বোধ্য সেই ভাষা। হাতে ওদের কাঠের লম্বা বশী। মাথাটা ছুঁচলো। ওদের পরনে তাসক ঘাসের ঘাগরা। গায়ে কিছু নেই। কপালে গালে বুকে লাল সাদা রঙের দাগ। ফ্রান্সিস বুঝল–এরা ত্ৰিস্তান যোদ্ধা। ফাঁদে কেউ ধরা পড়ল কিনা খুজতে এসেছে। ওরা এসব ফাঁদ পেতেছে নিশ্চয়ই পলাতক ইকাবোদের ধরবার জন্যে।
ওরা একটু দূর থেকেই ফ্রান্সিসকে ঝুলতে দেখল। সবাই একসঙ্গে দুর্বোধ্য ভাষায় কী বলে চিৎকার করে উঠল। ছুটে ওরা সিডার গাছটার নীচে এল। একজন টিকটিকির মতো গাছের কাণ্ড বেয়ে ওপরে উঠে গেল। তরতর করে ডাল ধরে ধরে ফ্রান্সিস যে ডাল থেকে ঝুলছিল সেইটার কাছে এল। কোমর থেকে একটা ধারালো লোহার টুকরো বের করল। সেটা দিয়ে ফাঁদের তলাটা কাটতে লাগল। ফ্রান্সিস বুঝল মাথা সোজা করে মাটিতে পড়লে ও ভীষণভাবে আহত হবে। তাই শরীরটা বেঁকিয়ে ও তৈরী হলো। লতাটা কাটা হতেই পিঠ দিয়ে একটা ঝোঁপের ওপর পড়ল। ঘাড়ে লাগল তবু। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পারল না। আবার শুয়ে পড়ল। ত্ৰিস্তান যোদ্ধারা বর্শা উঁচিয়ে ছুটে এল। ফ্রান্সিসকে তুলে ধরল। ও একবার ভাবল ছিটকে যাওয়া তরোয়ালটা খুঁজে বের করবে। পরক্ষণেই ভাবল তরোয়ালের কথা বললে হয়তো ত্ৰিস্তানরা ক্ষেপে যাবে। বিপদ বাড়বেই তাতে। বরং চুপচাপ থাকা যাক। দেখা যাক ওকে ত্রিস্তানরা কী করে।
ত্রিস্তান যোদ্ধারা নিজেদের ভাষায় কী বলাবলি করল। তারপর ফ্রান্সিসকে ধাক্কা দিয়ে চলবার ইঙ্গিত করল। ধাক্কা খেয়ে ফ্রান্সিস রাগে জ্বলে উঠল। কিন্তু কোনো কথা বলল না। ওদের নির্দেশমত হাঁটতে লাগল। ছড়ে-যাওয়া পাটা অসম্ভব জ্বালা করছে। কিন্তু উপায় নেই। ওদের অবাধ্য হলে হয়তো প্রাণ বিপন্ন হতে পারে।
ফ্রান্সিসকে সামনে রেখে ত্ৰিস্তান যোদ্ধারা পেছনে চলল।
কিছুক্ষণ বনের মধ্যে দিয়ে চলার পর বনের বাইরে এল ওরা। ঘাস, বুনো ঝোপে ঢাকা প্রান্তর উঠে গেছে পাহাড়ের দিকে। উজ্জ্বল রোদে দেখা গেল পাহাড়ের ন্যাড়া মাথাটা। সবুজের চিহ্ন নেই ওখানে। নিরেট কালচে পাথরের প্রায় গোল মাথাটা। ফ্রান্সিস দুর থেকে দেখেছিল পাহাড়ের মাথাটা। এবার কাছ থেকে উজ্জ্বল রোদে দেখল। ঠিক মানুষের মাথার করোটির মতো দেখতে। চোখের ফুটোর মতো বড় একটা গর্তও দেখা যাচ্ছে। অন্য গর্তটা আধ-ভাঙা। দ্বীপের উত্তর দিকটাই বসতি এলাকা। সেখানে যখন পৌঁছল তখন বেশ বেলা হয়েছে। একটু দূরে দূরে তাসক ঘাসের ছাউনি দেওয়া পাথর দিয়ে তৈরী ইকাবোদের বাড়ি দেখা গেল। পাথর সাজিয়ে বেশ শক্ত করেই বাড়িগুলো তৈরী।
ফ্রান্সিসকে সামনে রেখে ত্ৰিস্তানরা হেঁটে আসছিল। বাড়িগুলো থেকে ত্রিস্তান যোদ্ধারা বেরিয়ে এল। দেখতে লাগল বন্দী ফ্রান্সিসকে, পেছনের যযাদ্ধার দলকে। সবই ইকবোদের বাড়ি। হয়তো ইকাবোরা পালিয়েছে, নয়তো ওদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটা বাড়ি ঘর ছাড়া বাকিগুলো যোদ্ধারা দখল করে নিয়েছে।
পাহাড়ের মাথার নীচে যেখান থেকে ঘাস-ঢাকা জমি শুরু হয়ে নীচে নেমে এসেছে সেখানেই ছাড়া ছাড়ি বাড়ি নিয়ে বসতি এলাকা। যে কিছু ইকাবো বৃদ্ধ আর মেয়েরা ও শিশুরা ছিল তারা ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। পাথরের বাড়িঘর ছাড়িয়ে পাহাড়ের মাথার কাছাকাছি আসতে দেখা গেল একটা বড় ঘর। কাঠ আর পাথরের। চালাটা তাসক ঘাসের হলেও ভালোভাবে তৈরী। ফ্রান্সিস আন্দাজে বুঝল এটা নিশ্চয়ই রাজার বাড়ি। ইকাবোদের রাজা তো এখন জাহাজে। ত্ৰিস্তানদের রাজা নিশ্চয়ই এখানে আস্তানা গেড়েছে।
অনেক ত্রিস্তান যোদ্ধা ওদের পিছনে পিছনে রাজবাড়ির দিকে আসতে লাগল। রাজবাড়ির বাইরে একটা পরিচ্ছন্ন প্রাঙ্গণ। তার দুপাশে পাথরের আসন মতো সাজানো।
প্রাঙ্গণের মাঝখানে ফ্রান্সিসকে দাঁড় করানো হলো। দুজন ঢুকল রাজার ঘরের মধ্যে। এর মধ্যে পাঁচ ছজন ত্রিস্তানপ্রাঙ্গণের দুপাশে রাখা পাথরগুলোতে বসল। ওরা সবাই বয়স্ক, বৃদ্ধ। বোঝা গেল ওরা যোদ্ধা নয়। রাজার পরামর্শদাতা, পারিষদবর্গ।
একটু পরেই ঘরটা থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন তিনি খুব বলিষ্ঠ দেহী ত্রিস্তান। মুখে বুকে উঁকি আঁকা। নাক টিকালো, মাথার লম্বা চুল পিছনের দিকে ঝুঁটি করে বাঁধা। ফ্রান্সিস ধরে নিল ইনিই ত্ৰিস্তানদের দলনেতা। তিনি বেরিয়ে আসতে পাথরের ওপর বসে থাকা বৃদ্ধরা উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে একটা কাঠের সিংহাসন মতো এনে বাইরে রাখা হলো। সিংহাসনে বসার জায়গায় পাখির পালকের গদি। বলিষ্ঠদেহী লোকটি একবার চারদিকে চেয়ে নিয়ে কাঠের সিংহাসনে বসলেন।
একজন ত্রিস্তান দলনেতার সামনে এসে দাঁড়াল। উবুহয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে দলনেতাকে সম্মান জানাল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ত্রিস্তান ভাষায় গঙ্গাড় করে কী বলে গেল। ফ্রান্সিস তার বিন্দুবিসর্গও বুঝল না। দলনেতা তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। যোদ্ধাটি উত্তর দিল। এবার দলনেতা একজন পারিষদের দিকে তাকিয়ে কী বললেন। সেই পারিষদটি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিসকে আস্তে আস্তে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্প্যানিশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল–তুমি কে? ফ্রান্সিস আশ্বস্ত হলো যে যাহোক একজনকে পাওয়া গেল যে ওর কথা কিছু বুঝবে। ফ্রান্সিস বলল–আমরা জাতিতে ভাইকিং।
তুমি এসেছো কেন? বৃদ্ধটি জিজ্ঞেস করল।
জাহাজে জল ফুরিয়ে গেছে, জল নিতে এই দ্বীপে এসেছিলাম। থেমে থেমে বৃদ্ধটি বলল-যুদ্ধ হয়েছে–আমরা জিতেছি–রাজা মরেছে। বনে আমাদের পাতা ফাঁদে তুমি ধরা পড়েছে। এসময় দলনেতা বৃদ্ধটিকে কী বললেন। বৃদ্ধ বলল–সেনাপতি বলছেন–তুমি গুপ্তচর ত্রিস্তানদের ক্ষতি করতে তুমি এখানে এসেছে। ফ্রান্সিস এবার সেনাপতির দিকে তাকালো। বলল–আপনি ভুল করছেন। আমার আগে আরো চারজন ভাইকিং এই দ্বীপে এসেছে–জল নিতে। তারা জল নিয়ে ফিরতে পারেনি। তাই তাদের খোঁজে আমি এসেছিলাম। বৃদ্ধটি সেনাপতিকেত্ৰিস্তান ভাষায় সব বলল। সেনাপতি উত্তরে কী বললেন। বৃদ্ধটি বলল–সেনাপতি বলছেন–সেই চারজনও ধরা পড়েছে। তোমরা গুপ্তচর।
ফ্রান্সিস চমকে উঠল। তাহলে বিস্কোরাও ধরা পড়েছে। ও চিৎকার করে বলল আমরা কোন অপরাধ করিনি। যুদ্ধেও অংশ নিইনি। দ্বীপের দক্ষিণে আমাদের জাহাজ রয়েছে। জল নিয়ে জাহাজে যাবো। তারপর জাহাজ ছেড়ে দেব।
বৃদ্ধটি সেনাপতিকে বলল সে কথা। সেনাপতি মাথা ঝাঁকিয়ে কী বলে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বৃদ্ধটি বলল-সেনাপতি বলছেন–প্রাণদণ্ড।
ফ্রান্সিস বুঝল–এই সেনাপতি নির্মম। নরহত্যা তার কাছে কিছু না। সেনাপতি ঘরে ফিরে গেলেন।
কয়েকজন ত্ৰিস্তান যোদ্ধা এসে ফ্রান্সিসকে ধাক্কা দিয়ে হাঁটবার ইঙ্গিত করল।
ওখান থেকে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে উপত্যকার মতো একটা জায়গায়। উপত্যকার কাছাকাছি আসতেই ফ্রান্সিস দেখতে পেল ইকাবোদের রূপোর মন্দিরটা। প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু মন্দিরটা। চারকোণা। থামগুলো নিরেট রূপোর। সামনেও অর্ধবৃত্তাকারে কয়েকটা রূপোর থাম। মোটা মোটা থাম। মন্দিরের মধ্যে গিয়ানি দেবতার মূর্তি। চৌকোণা একটা কাঠের থাম কুঁদে কুঁদে তৈরী হয়েছে গিয়ানির মূর্তি। মন্দিরের মাথার ছাউনি তাসাক ঘাস আর নারকেল পাতায় শক্ত করে বোনা। থামগুলোতেও কুঁদে কুঁদে নানা কারুকাজ করা প্রচুর কাঁচা রূপো না পেলে এত বড় মন্দির তৈরী করা যায় না। রূপোর নদী ছেলে ভুলানো গপপো নয়। সত্যি এরকম কিছু ছিল। যেখান থেকে মোকার পুর্বপুরুষরা প্রচুর রূপো পেয়েছিল। ফ্রান্সিস উপত্যকা দিয়ে একটা ছোট নদী বয়ে যেতে দেখল। এটাই তাহলে কুনহা নদী।
উপত্যকা পার হয়ে ওরা এবার ওপরের দিকে উঠতে লাগল। বেশ কিছুটা ওঠবার পর ওরা একটা গুহার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার ফ্রান্সিস ফিরে দাঁড়াল। দেখল প্রায় কুড়ি পঁচিশজন ত্ৰিস্তান যোদ্ধা এসেছে। কারণটা একটু পরেই বুঝল যখন সবাই মিলে গুহার মুখের পাথরটা ঠেলতে লাগল। কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলির পর গুহার মুখের পাথরটা কিছুটা সরে গেল। সেই ফাঁক দিয়ে ত্রিস্তান যোদ্ধারা ফ্রান্সিসকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। তারপর পাথর ঠেলে গুহার মুখ বন্ধ করতে লাগল।
গুহার ভেতরটা প্রায় অন্ধকার। প্রথমে ফ্রান্সিস কিছুই দেখতে পেল না। একটা ভ্যাপসা গরম অনুভব করল। পাথুরে দেয়ালের খাঁজে একটা মশাল জ্বলছে। সেই মশালের নীচে এসে ও দাঁড়াল। পাথুরে মেঝেতে কয়েকজনকে শুয়ে থাকতে দেখল। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজন লোক এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। বিস্কো? ফার্নান্ডো? ফ্রান্সিস খুশিতে চিৎকার করে উঠল–তোমরা বেঁচে আছো? কিন্তু আর দুজন কোথায়?
বলছি। বিস্কো বিষণ্ণ স্বরে বলল–বসো।
ততক্ষণে অন্ধকারে ফ্রান্সিসের চোখ অনেকটা সয়ে এসেছে। দেখল আরো চারজন মেঝেতে শুয়ে আছে। ওরা ইকাবো। কিন্তু বন্ধু দুজন কোথায়?
ফ্রান্সিস মেঝেতে বসল। বিস্কো ফার্নান্দো বসল। ফ্রান্সিস বলল–কী হয়েছিল বলো তো?
আমরা পিঁপে ভর্তি করে জল নিয়ে ফেরার পথে গর্ত-ফাঁদে আটকে পড়ে গিয়েছিলাম। ত্রিস্তানরা আমাদের বন্দী করে ওদের রাজার কাছে নিয়ে আসে। বিস্কো বলল।
রাজা নয়, ও সেনাপতি। লোকটা সাপের মতো ধূর্ত আর বাঘের মত হিংস্র।
একজন বৃদ্ধ ভাঙা ভাঙ স্প্যানিশ ভাষায় আমাদের জানাল আমাদের নাকিপ্রাণদণ্ড হয়েছে। তারপর এই গুহায় এনে বন্দী করল।
তারপর?
তারপর কয়েকজন বন্দী ইকাবোর সঙ্গে আমাদের দুই বন্ধুকে ধরে নিয়ে গেল। ওরা কেউ আর ফেরেনি। বিস্কো আস্তে আস্তে বলল।
বন্ধুদের এই মৃত্যুসংবাদে ফ্রান্সিস প্রথমে চমকে উঠল। তারপর গভীর দুঃখে ওর বুক ভেঙে যেতে লাগল। ও কথা বলতে পারল না। ওর শরীরটা থর থর করে কেঁপে উঠল। একটু ফুঁপিয়ে উঠল ও। বিস্কো ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রেখে চাপ দিল। মৃদুস্বরে। বলল–ফ্রান্সিস আমরা এখনো মুক্ত নই। ভেঙে পড়লে চলবে না।
ফ্রান্সিস স্থির হলো। চোখ মুছে বলল-পালাতে হবে।
কিন্তু কী করে?
ত্রিস্তানরা কীভাবে আমাদের খেতে দেয় কীভাবে পাহারা দেয় সেটা খুঁটিয়ে দেখি–তারপরই পালাবার পরিকল্পনা করবো। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–আচ্ছা গুহাটার চারধার ভালো করে দেখেছো?
হ্যাঁ দেখেছি–নিরেট পাথর চারদিকে।
কিন্তু কোথাও না কোথাও ফাঁকফোকর নিশ্চয়ই আছে। নইলে এই বদ্ধ গুহায় তোমরা মরে যেতে।
হ্যাঁ, একটা বড় ফোকর আছে ওপরে দিকে। ঐ দেখ। বিস্কো আঙুল দিয়ে দেখাল। ফ্রান্সিস দেখল গুহাটার হাতের দিকে একটা বড় পাথুরে ফোকর। দুজন মানুষ একসঙ্গে বেরোতে পারে এরকম ফোকর। কিন্তু এত উঁচুতে ওঠা? অসম্ভব। গুহার মুখের পাথরটাও এমন চেপে বসে আছে যে সামান্যতম ফাঁকও নেই। তাছাড়া ওটা সরানো পাঁচ ছয়জনের পক্ষে সম্ভব নয়। বিস্কো বলল–ঐ ফোকরটা দেখেই আমরা রাত-দিনের পার্থক্য বুঝতে পারি। ওখানে দিনের বেলা আলো থাকে।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল! ভীষণ ক্লান্ত লাগছে শরীর। ছড়ে যাওয়া পায়ের জ্বালাটাও কমে নি। কিন্তু এখন বিশ্রামের সময় কোথায়। ও পাথুরে মেঝের ওপর এদিক ওদিক পায়চারি করল কিছুক্ষণ। তারপর পাথরের খাঁজ থেকে মশালটা তুলে নিয়ে সমস্ত গুহাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। চারদিকেই নিরেট পাথর। গুহার শেষ মাথায় দেয়ালের মতো সমান কিছুটা জায়গা। এখানে ওখানে পাথুরের বড় বড় টুকরো ছড়ানো। ফিরে এসে গুহাটার মাঝামাঝি দাঁড়ালো। ওপরদিকে বড় ফোঁকরটা দেখল। তারপর বিস্কোকে ডাকল। বিস্কো কাছে এলে ওর হাতে মশালটা দিয়ে পাথুরে দেয়ালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে ঐ ফোকরটার দিকে উঠতে লাগল। কিছুটা উঠল। কিন্তু ফোকরটা তখনও বেশ দূরে। আর এগোতে পারল না। পাথুরে দেয়ালের খাঁজে শরীরের ভারসাম্য রাখা যাচ্ছেনা। ও পাথুরে খাঁজে খাঁজে পা রেখে নেমে এল।
যে চারজন ইকাবো মেঝেয় শুয়েছিল তারা এবার উঠে বসল। ফ্রান্সিসের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস পাথুরে দেয়াল থেকে নেমে বসল। হাঁপাতে লাগল।
এমন সময় গুহার মুখের পাথরটা সরে যেতে লাগল। বিস্কো ফ্রান্সিসকে ফিসফিস করে বলল–খাবার দিতে যে লোকটা ঢুকবে তাকে খতম করে তো আমরা পালাতে পারি।
ফ্রান্সিস হাসল–পাগল হয়েছে। এই পাথর সরাতে অন্তত কুড়িজন ত্রিস্তান ওর সঙ্গে আসে। আমরা তো মোট সাতজন। তাও নিরস্ত্র।
দুজন ত্রিস্তান গুহায় ঢুকল। হাতে হাতে করে কয়েকটা মাটির পাত্রে খাবার ওদের সামনে রাখল। ম্যাকরেল মাছসেদ্ধ, বুনো কলা আর বুনো আলুসেদ্ধ। বিস্কো চিৎকার করে বলে উঠল–নিয়ে যা এসব। আমার বন্ধুদের হত্যা করেছিস তোরা, তোদের দেয়া খাবার থু-থু। বিস্কো থুতু ফেলল। লোক দুটো বেশ রেগে গেছে মুখ দেখেই বোঝা গেল। বিস্কো বলল–কাল রাত্রেও ওদের দেওয়া খাবার আমরা খাইনি। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল আহাম্মকের কাজ করেছে। না খেলে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়বে–পালানোর কোন আশা থাকবে না। বরং বেশী বেশী করে খাবে। শরীরে জোর রাখবে তবে না পালাতে পারবে। খেয়ে নাও।
বিস্কো আর আপত্তি করল না। ওদের দেখাদেখি ইকাবো বন্দীরাও খেতে লাগল। খাওয়া শেষ করে ফ্রান্সিস ইঙ্গিতে আরো খাবার চাইল। ওরা খাওয়া নিয়ে ঝামেলা পাকাচ্ছে না দেখে ত্ৰিস্তান যোদ্ধা দুটি খুশি হলো। একটা বড় মাটির পাত্র নিয়ে এল। বোধ হয় ওদেরও খাবার আছে ওর মধ্যে। ফ্রান্সিস তাই চেয়ে চেয়ে খেল। বিস্কোরাও বেশী করে খেল। আর কেউ বেশী চাইল না। ত্ৰিস্তান দুজন এঁটো পাত্র নিয়ে চলে গেল। একটু পরে বড় কাঠের পাত্রে জল নিয়ে এল। নারকেলের মালা চুবিয়ে জল নিয়ে ফ্রান্সিসরা খেল। পেট ভরে জল খেল ফ্রান্সিস, এত জলতেষ্টা পেয়েছিল ও বুঝতেই পারেনি।
ত্রিস্তান দুজন চলে গেল। গুহার মুখে পাথরটার চাপা দিয়ে গেল। ফ্রান্সিস উঠে পাথরটা কাছে গেল। দেখল মুখেমুখে চেপে বসে গেছে। জলও গলবেনা এমন নিরেটভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
ফ্রান্সিস ফিরে এসে পাথুরে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। বিশ্রাম নিল কিছুক্ষণ। পাশ ফিরে ইকাবো বন্দীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু ওরা ফ্রান্সিসের কোনো কথাই বুঝতে পারল না। হাল ছেড়ে দিয়ে ফ্রান্সিস চোখ বুজে বিশ্রাম করতে লাগল।
একটু তন্দ্রাও এসেছিল। কিন্তু পায়ের ছড়ে যাওয়া জায়গাটায় জ্বালা করে উঠল। তন্দ্রা ভেঙে গেল। হঠাৎই মনে পড়ল দেশের কথা। বাবার কথা। মারিয়ার কথা। কোথায় বাড়ির ধপধপে সাদা পালকের নরম বিছানা আর কোথায় ও শুয়ে আছে। এবড়ো খেবড়ো পাথুরে মেঝে। পিঠের হাড়ে খোঁচা দিচ্ছে। মৃদু হাসি ফুটলো ফ্রান্সিসের মুখে। যাও সব। ও এক ঝটকায় উঠে পড়ল।
আবার মশালটা নিয়ে গুহার পাথুরে দেওয়ালগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। আবার এল গুহার শেষে। সেই একটু সমতল একটা পাথরের স্তর। ও সমতল স্তরটায় একটা পাথর দিয়ে ঠুকতে লাগল। আশ্চর্য! নিরেট পাথরের আওয়াজ পাতলা? ফ্রান্সিস দেওয়ালের মতো জায়গাটায় কান চেপে ধরল। খুব মৃদু শব্দ। প্রায় ধরাই যায় না। জলের শব্দ।
ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে বিস্কোকে ডাকল। ওর চড়া গলায় ডাকের শব্দটা গুহার মধ্যে গমগম করতে লাগল। বিস্কো ছুটে ওর কাছে এল। বলল-কি ব্যাপার?
এই জায়গাটায় কান পেতে শোনো তো কোন শব্দ শুনতে পাও কিনা দেখতো? বিস্কো ঐ জায়গাটায় কান চেপে পাতল। একটু পরেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। চেঁচিয়ে বলে উঠল-ফ্রান্সিস, জলের শব্দ। ফ্রান্সিস বলল–এখানটায় পাথুরে আস্তরণটা বেশী মোটা নয়। মনে আছে মোক বলেছিল, কিছুদিন আগে এই দ্বীপে ভূমিকম্প হয়ে গেছে। কাজেই পাথর মাটির স্তরে কিছু পরিবর্তন ঘটা আশ্চর্য নয়। ফ্রান্সিস তারপর চেঁচিয়ে ফার্নান্দোকে ডাকল-ফার্নান্দো, আমরা প্রায় মুক্তির দোরগোরায়। ফার্নান্দোও ছুটে এল। কান পাতল, ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। ইকাবো বন্দীরা অবাক চোখে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখল। ওরা বুঝে উঠতে পারল না এত খুশি হবার কী কারণ ঘটল।
ফ্রান্সিস ওদের ইশারায় কাছে ডাকল। এরা উঠে ফ্রন্সিসের কাছে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস একটা ছুঁচোলো মুখ পাথর তুলে নিল। দেওয়ালের মত পাথুরে স্তরে একটা জায়গায় গোলমত দাগ দিল। ওদেরও পাথর তুলতে বলল। বড় বড় পাথরের টুকরো ওখানে এখানে পড়েছিল। ফ্রান্সিস ঐ কিছুটা সমতল দাগ দেওয়া জায়গায় পাথরের ছুঁচালো মুখ খন্ডটা দিয়ে ঘা মারতে লাগল। ওদেরও তাই করতে ইঙ্গিত করল। ওরা এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল দ্রুত হাতে পাথর তুলে নিল। তারপর এলোপাথাড়ি ঘা মারতে লাগল। ফ্রান্সিস ওদের থামিয়ে দিল। দেখিয়ে দিল নির্দিষ্ট জায়গায় কী করে একজন করে পরপর ঘা মারবে। ওরা সেইভাবে ঘা মারতে লাগল। গুহাটায় সেই শব্দ প্রচন্ড জোরে প্রতিধ্বনি হতে লাগল।
ফ্রান্সিস বিস্কোকে বলল–আগেওরা ঘা মারতে থাকুক। ওরা পরিশ্রান্ত হলে আমরা আরম্ভ করবো। চলল ঐ নির্দিষ্ট জায়গাটায় পাথর দিয়ে ঘা মারা। গুহাটায় শব্দ উঠতে লাগল-দুম-দুড়ুম-।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ইকাবো বন্দীরা ঘা মারল। এবার ওরা হাঁপাতে লাগল। দুজন বসে পড়ল। ফ্রান্সিস ওদের সরে যেতে বলল। ওরা বিশ্রাম করতে লাগল।
ফ্রান্সিস কাছে গিয়ে ভালো করে জায়গাটা দেখল। ঘাগুলো ঠিক এক জায়গায় পড়ে নি দুএকটা জায়গায় সামান্য গর্তত হয়েছে। ওর মধ্যে যে জায়গাটা বেশি গর্তমত হয়েছেও সে জায়গাটা বেছে নিল। বিস্কো আর ফার্নান্দোকে জায়গাটা দেখিয়ে বলল–ঠিক এ জায়গাটায় ঘা মারো।
ওরা তিনজন এবার ঘা মারতে লাগল। গুহাটায় দুম দুম শব্দপ্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
বেশ কিছুক্ষণ একটানা ঘা মেরে ওরা ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল। ঘা মারা থামিয়ে ওরা বসে পড়ল। হাঁপাতে লাগল।
ফ্রান্সিস ওপরে ফোকরটার দিকে তাকাল। দেখল ওখানে আলো কমে এসেছে। তার মানে বিকেল হয়েছে। ভাবল, আজ রাতের মধ্যেই ঐ আস্তরণটা ভাঙতে হবে। তারপর রাতের অন্ধকারে পালানো। ও এবার ইকাবোদের ইঙ্গিত করল। দেখিয়ে দিল কী করে একই জায়গায় পরপর ঘা মেরে যেতে হবে।
আবার ঘা মারা চলল। কিন্তু ঐ জায়গাটায় ফাটল দেখা দিল না।
এবার ফ্রান্সিসরা ঘা মারতে লাগল। চলল ঘা মারা। ফ্রান্সিস ফোকরটার দিকে তাকাল। অন্ধকার হয়ে গেছে। তাহলে বাইরে এখন রাত।
পাথরের ঘা মারা চলল। দুম দুম শব্দও উঠতে লাগল।
হঠাৎ ফার্নান্দোর হাতের পাথর আস্তরণ ভেঙে ঢুকে গেল। জল ছিটকে ঢুকল। ফুটো থেকে পাথরটা খুলে নিয়ে আসতেই ফোয়ারার মতো জল ঢুকতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল,-ঘা মারা থামিও না। ফাটল বড় করতে হবে।
ওরা ঘা মেরে চলল। ফাটল আর একটু বড় হলো। কিন্তু মানুষের শরীর বেরোবার মতো বড় হলো না।
ফ্রান্সিস বুঝল-বৃথা চেষ্টা। এর বেশি ফটল বড় হবে না। বাকীটুকু নিরেট। ওদিকে গুহায় জল ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
বিস্কো শঙ্কিত স্বরে ডাকল? |||||||||| -ফ্রান্সিস?
বলো।
গুহায় জল জমছে। আমরা কী করবো?
এই সম্ভাবনাটা আমি আগেই ভেবে রেখেছি। ফ্রান্সিস বলল।
কী ভেবেছ তুমি?
জল বাড়বে। ডুব জল হলে আমরা ভেসে থাকবো। জল উঁচুতে উঠতে থাকবে! আমরাও উঁচুতে উঠতে থাকবে। তারপর ঐ ফোকরে পৌঁছে যাব।
বিস্কো আর ফার্নান্দো একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল-ও হো হো। বিস্কোদুহাতেফ্রান্সিসকে জড়িয়ে বলে উঠল-সাবাস ফ্রান্সিস।
ওদিকে ইকাবো বন্দীরা শঙ্কিতভাবে দেখতে লাগল যে গুহায় জল জমেছে। ওরা ভয়ে পাথুরে দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু খাড়া দেয়াল। উঠবে কি করে?
ফ্রান্সিস ওদের সাঁতারের ভঙ্গি দেখাল। ওরা মাথা ঝাঁকাল। অর্থাৎ সাঁতার জানে। ওরা দ্বীপবাসী। সাঁতারে ওস্তাদ। ফ্রান্সিস তারপর আঙুল দিয়ে ওদের ওপরের ফোকরটা দেখাল। এতক্ষণে ওরা ফ্রান্সিসের পরিকল্পনাটা বুঝতে পারল। হাসি ফুটল ওদের মুখে।
গুহাটায় আস্তে-আস্তে জল বাড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁটু অব্দি জল উঠল। ওদিকে ফুটো দিয়ে প্রচণ্ড বেগে জল ঢুকছে। জলও বাড়ছে। গুহার মুখের পাথরটা এমন এঁটে বসে গেছে যে ওখান দিয়ে এক ফোঁটা জলও বেরোতে পারছে না।
সময় কাটতে লাগল। জল বাড়তে লাগল। আস্তে আস্তে কোমর অব্দি জল উঠল। বাড়তে লাগল জল। আস্তে-আস্তে কাঁধ পর্যন্ত জল উঠল। ওরা হাতে পায়ে জল ঠেলতে ঠেলতে ভেসে রইল।
আরো বাড়ল জল। ওরা একই ভাবে ভেসে রইল।
আস্তে আস্তে জলের স্তর গুহার মাথার কাছে চলে এল। মশালটা নিভে গেছে ততক্ষণে। চারিদিক অন্ধকার। শুধু ফোকরটা দিয়ে একটু আলোর আভাস।
ফ্রান্সিস ফোকরটার কাছে এসে পায়ে ধাক্কা দিয়ে লাফিয়ে ফোকরের পাথুরে খাঁজটা ধরে ফেলল। তারপর শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ফোকরের ওপর উঠে এল। পরিশ্রমে ও হাঁপাতে লাগল। চারদিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই বুঝল না। ভাবল বেরোনোর পথ পরে খোঁজা যাবে, আগে ওদের সবাইকে টেনে তুলি।
ও ফোকরটার দুপাশে পায়ের ভর রেখে মাথা নিচু করে ডাকল–বিস্কো এই দিকে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্সিসের গলারশব্দ লক্ষ্য করে বিস্কো সাঁতরাতে সাঁতরাতে এগিয়ে এল। হাত বাড়াল। ফ্রান্সিস ওর বাড়ানো হাতটা ধরে একহ্যাঁচকা টানে ওকে ওপরে তুলে নিল। বিস্কো বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস এবার চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকতে লাগল। ওর কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে সবাই অন্ধকারে সাঁতরাতে সাঁতরাতে ওর কাছে এল। ও একে-একে সবাইকে তুলে নিল।
এবার বেরোবার পথ খোঁজা। ওরা সকলেই তখন ভীষণ পরিশ্রান্ত। কিন্তু ফ্রান্সিস ওদের বিশ্রাম করতে দিল না। চেঁচিয়ে বলল–এক মুহূর্তও আর দেরি করা চলবে না। রাত থাকতে থাকতেই আমাদের পালাতে হবে।
ফ্রান্সিস সবার আগে–আগে পায়ে-পায়ে এগোল। দেখল এ জায়গাটাও একটা গুহা মতো। কিছুটা এগোতেই সামনে দেখল যেন একটা অর্ধগোলাকার পর্দা ঝুলছে। তাতে তারা জ্বলছে। আকাশ! ফ্রান্সিস চাপা স্বরে বলল–আমার পেছনে-পেছনে এসো। সামনেই গুহার মুখ।
একটু পরেই গুহাটার মুখে এসে দাঁড়াল সবাই। সামনেই দূরবিস্তৃত আকাশ। বেশ উজ্জ্বল চাঁদ। নরম জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে চারদিকে–উপত্যকায়, বসতিতে, বনে।
ফ্রান্সিস ইকাবো বন্দীদের আঙ্গুল দিয়ে দূরের বন দেখাল। ইঙ্গিত করল–ওখান দিয়ে আমরা পালাব। বন্দীরা মাথা ঝাঁকাল। মানে-বুঝেছে।
পাহাড়ের মাথা থেকে নীচে ঢালু জমি। ফ্রান্সিস দক্ষিণ দিকে চলল। ম্লান জ্যোৎস্না পড়েছে উপত্যকায়, ঘাসের ঢালু জমিতে, পাথরে। সেই অলোয় ওরা দ্রুত ছুটতে লাগল বনের দিকে।
ওরা দূর থেকে দেখল বনের ধারে আগুন জ্বলছে। আগুন ঘিরে ত্রিস্তান যোদ্ধারা বসে হৈ হল্লা করছে।
দূর থেকে ফ্রান্সিস দেখে আশ্চর্য হলো দ্বীপের বিচিত্র সব পাখি সেই আগুনের কাছে উড়ে উড়ে আসছে। ত্রিস্তান যোদ্ধারা গাছের ডাল দিয়ে গিয়ে পাখি মারছে আর আগুনে পুড়িয়ে খাচ্ছে। আশ্চর্য! মৃত্যু জেনেও পাখির ঝাঁক উড়ে–উড়ে আসছে। ঐ দলের পেছনে বিরাট একটা পাথরের চাঁই। সেটার আড়ালে আড়ালে এগিয়ে গিয়ে ওরা বনে ঢুকে পড়ল।
আর চাঁদের আলো নেই। অন্ধকারেই ছুটতে হচ্ছে ওদের। বনের নীচে ভাঙা–ভাঙা জ্যোৎস্না পড়েছে কোথাও কোথাও। ফ্রান্সিস হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। ও সবার আগে আগে যাচ্ছিল। ওকে থামতে দেখে সবাই থেমে পড়ল। ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো, আমরা সামনে যাবে না। ইকাবোদের আগে-আগে ছুটতে দাও। ওরা সহজেই পাতা ফাঁদ দেখে বুঝতে পারবে। তখন সকলেই সাবধান হতে পারব। বিস্কো বলল,–ঠিক বলেছো। ও ইকাবোদের কাছে কাছে ডাকল। তারপর ইঙ্গিতে অঙ্গভঙ্গী করেফাঁদের ব্যাপারটা বোঝাল। বিস্কো কী বলছে সেটা ওরা বুঝল। ওদের মধ্যে একজন বুকে আঙ্গুল ঠুকে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে ধরল। তার মানে ওরা আগ্যোবে।
এবার ইকাবোরা আগে আগে চলল। চলার গতি কমিয়ে চারদিকে তাকাতে তাকাতে ওরা চলল। ফ্রান্সিসরা ওদের পেছনে পেছনে যেতে লাগল।
হঠাৎ নিস্তব্ধ বনে একসঙ্গে কয়েকটা পাখি বিচিত্র সুরে শিস দিয়ে ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ইকাবোরা দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসরাও দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন ইকাবো মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়ল। তারপর পাখির মতো শিস দিল। শিসের শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। হঠাৎ বনের অন্ধকার থেকে তিনজন ইকাবো ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।
কাবোরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল। মৃদুস্বরে কথা বলতে লাগল। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস ওদের কাছে গিয়ে ছোটার ইঙ্গিত করল। যারা বনের আড়াল থেকে বেরিয়েছিল তারা আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ফ্রান্সিস বুঝল ইকাবোরা পাখির মতো শিস দিয়ে পরস্পরকে সঙ্কেত দিতে পারে।
আবার ওরা চলতে লাগল। এত সাবধানতা সত্ত্বেও একজন ইকাবো লতার ফাঁদে আঁটকে গেল। এক ঝটকায় সে উঠে গেল ওপরে। মাথা নীচে ঝুলতে লাগল। আর একজন ইকাবো দ্রুত গাছের কাণ্ড বেয়ে উঠে গেল। যে ডাল থেকেফাঁদটা ঝুলছিল সেই ডালটা ধরে ঝুঁকে ঝুলন্ত লতাটা কামড়াতে লাগল। একটু পরেই লতাটা ছিঁড়ে গেল। ফঁদে আটকানো ইকাবোটিও মাটিতে পড়ে গেল।
আবার চলা শুরু হলো। কিছুদুর যেতেই একটা ঝর্ণার কাছে এল ওরা। ফ্রান্সিস সবাইকে থামতে ইঙ্গিত করল। আঁজলায় জল ভরে ও জল খেতে লাগল। একে একে সবাই জল খেল। বিস্কো বলল-এই ঝর্ণা থেকেই জল নিয়ে ফিরছিলাম আমরা।
তাহলে কাছেই জলের পিঁপে দুটো আছে। ও দুটো পেলে আমরা জল ভরে নিয়ে যাব।
ওরা চলল। কিছুটা এগোতেই জ্যোৎস্নার ভাঙা আলোয় দেখল পিঁপে দুটো পড়ে আছে। একটায় জলভরা আছে। অন্যটা কাত হয়ে পড়ে আছে। ফ্রান্সিস, বিস্কো আর ফার্নান্দো পিঁপেটা নিয়ে ঝর্ণার দিকে ফিরে গেল। একটু পরেই জলভর্তি পিঁপেটা নিয়ে ফিরল। ওরা একটা পিঁপে আর ইকাবোরা অন্য পিঁপেটা নিয়ে চলতে শুরু করল। ফ্রান্সিস এদিক-ওদিক নজর রেখে চলল–যদি হারানো তরোয়ালটা পাওয়া যায়। কিন্তু নজরে পড়লো না। মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর।
বনের মধ্যে ত্ৰিস্তানদের ফাঁদ এড়িয়ে ওরা যখন সমুদ্রের ধারে পৌঁছল তখন রাত শেষ হয়ে এসেছে। ওদের ভাগ্য ভাল দেখল তিনটি নৌকাই গাছের ডালের সঙ্গে বাঁধা আছে। গাছের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল বলেই নৌকাগুলো ত্ৰিস্তানদের নজরে পড়েনি। নৌকায় কাঠের বৈঠাও রয়েছে। ওরা ধরাধরি করে পিঁপে দুটো একটা নৌকায় তুলল। সেটাতে রইল বিস্কো। ফ্রান্সিস এবার ইকাবোদের ইঙ্গিত করল ওদের সঙ্গে যাবার জন্য। কিন্তু ওরা মাথা ঝাঁকাল। আঙুল দিয়ে বনটা দেখাল। অর্থাৎ ওরা বনে ফিরে যাবে। ফ্রান্সিস ওদের সঙ্গে হাত মেলাল। তারপর একটা নৌকায় গিয়ে উঠল। অন্যটায় উঠল ফার্ণান্দো। নৌকা ছেড়ে দিল। একটা পাক খেয়ে নৌকো ঢেউয়ের ওপর নাচতে-নাচতে চলল। ফ্রান্সিস পেছনে তাকিয়ে আরইকাবোদের দেখতে পেল না। ওরা বনের মধ্যে চলে গেছে।
ফ্রান্সিসরা যখন জাহাজের গায়ে এসে নৌকা লাগাল তখন ভোর হয়ে এসেছে। জাহাজের রেলিং থেকে ঝুঁকে হ্যারি ডাকল ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস উত্তর দিল হ্যারি। তখনই জাহাজে হ্যারির ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি সুরু হয়ে। গেল। অনেকেই ঘুম থেকে উঠে রেলিঙ দিয়ে ঝুঁকেফ্রান্সিসদের দিকে দড়ি ছুঁড়ে দিল। ফ্রান্সিসরা দড়ি চেপে ধরে রইল। ভাইকিংরা ওদের টেনে টেনে তুলল। একটু পরে কয়েকজন নেমে এসে জলের পিঁপেদুটোও দড়ি বেঁধে জাহাজে তুলল।
নিজের কেবিনঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখে হাত চাপা দিল। হ্যারি বলল-তুমি খুব পরিশ্রান্ত। বিশ্রাম কর–পরে আসবো।
ফ্রান্সিস চোখ থেকে হাত সরাল। আস্তে-আস্তে বলল–আমরা ফিরেছি কিন্তু বাকী দুজনের কোনো খোঁজ পাইনি? |||||||||| –
ওদের কি হত্যা করা হয়েছে?
ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে ত্ৰিস্তান সেনাপতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর লোক। হয়ত মেরেই ফেলেছে ওদের।
হ্যারি কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। তারপর যখন কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন ফ্রান্সিস বলল–বৈদ্যকে একটু পাঠিয়ে দাও তো। বা পা’টা ছড়ে গেছে। সমুদ্রের নোনা জল লেগে জ্বালাটা বেড়ে গেছে। ঘুমোতে পারব না।
পাঠিয়ে দিচ্ছি, ঘুমাবার চেষ্টা কর। পরে সব শুনবো। হ্যারি চলে গেল।
হ্যারির মুখেই ভাইকিংরা ওদের দুই বন্ধুর নিখোঁজ হয়ে যাবার খবর পেল। বন্ধু দুজনের জন্যে ওদের ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। ওরা ধরেই নিল বন্ধু দুজন বেঁচে নেই।
সেদিন ফ্রান্সিস আর কেবিনঘর থেকে বেরোলো না। সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিল। পরের দিন বাইরে এল। ডেক-এ ঘুরে বেড়াল। সবসময়ই ভাবতে লাগল এরপর কী করবো?
একদিন পরে। সেদিন রাতে ফ্রান্সিস ডেক-এ পায়চারী করছিল। হ্যারি এল। ফ্রান্সিস বিস্কোদের নিয়ে পালাবার কাহিনী হ্যারি শুনছিল। ও কাছে আসতে ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি একটা বুদ্ধি দাও।
কী ব্যাপার? হ্যারি জানতে চাইল।
এখন কি করবো?
মনে হয় রাজপুত্র মোকার সঙ্গে আগে কথা বল। ও কী বলে শোনা যাক।
তখন দুজন ভাইকিং হালের কাছে শুয়ে ছিল। হ্যারি তাদেরই একজনকে পাঠাল মোকাকে নিয়ে আসতে।
একটু পরেই মোকা এল। ফ্রান্সিসের কাছে এসে দাঁড়াল। ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ফ্রান্সিস বলল–মোকা কঙ্কাল দ্বীপে আমাদের বন্দী হওয়া, পালানো সব কথাই তোমাকে বলেছি। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল-সত্যি কথা বলি এবার। মোকা–আমরা এবার রূপোর নদী খুঁজে বের করতেই এখানে এসেছি।
মোকা চুপ করে কোনো কথা না বলে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস বলল-কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কাল দ্বীপ এখন ত্রিস্তানদের দখলে। কাজেই রূপোর নদীর খোঁজ করা এখন অসম্ভব।
মোকা বলল–ত্ৰিস্তানরা ভীষণ হিংস্র। আমাদের ওপর চরম অত্যাচার করেছে। যদি আপনারা আমাদের সাহায্য করেন তবে আমরা কঙ্কাল দ্বীপ থেকে তাদের তাড়িয়ে দিতে পারব।
আচ্ছা যদি আমরা নদী খুঁজে বের করতে পারি নিশ্চয়ই অনেক রূপো পাবো। সেসব কি আমরা নিয়ে যেতে পারবো?
মোকা কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে ভাবতে লাগল। তারপর মাথা তুলে বলল–এসব নির্ভর করছে কতটা রূপো আপনারা পাবেন তার ওপর। আপনারা বাবার আর আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। এতেই আমরা আপনাদের কাছে ঋণী। এরপরে যদি ত্রিপ্তানদের পরাজিত করতে আমাদের সাহায্য করেন তাহলে আমাদের কৃতজ্ঞতা আরো বাড়বে। তখন আপনারা যদি রূপো চান মানে যতটা পারেন ততটাই চান তাহলেও আমরা তো না করতে পারবো না।
না মোকা। তোমাদের অসন্তুষ্ট করে আমরা কিছু নেব না।
বেশ। মোকা বলল।
দেখ মোকা–ত্রিস্তানরা আমাদের দুজন বন্ধুকে বন্দী করেছে। তারা বেঁচে আছে, কি তাদের মেরে ফেলা হয়েছে এখনও জানি না। যদি ত্ৰিস্তানরা ওদের মেরে থাকে তা হলে একজন ত্ৰিস্তানকে আমরা ফিরে যেতে দেব না। যদি না মেরে থাকে এবং ওদের জাহাজে ফিরে আসতে দেয় তাহলে তো অন্যায়ভাবে ত্ৰিস্তানদের কোন ক্ষতি আমরা করবো না। তোমাদের সমস্যা তোমরাই মেটাবে।
মোকা মাথা নীচু করে কি ভাবল। তারপর বলল-আমি নিশ্চিত যে ত্ৰিস্তানরা ওদের মেরে ফেলেছে। যদি না মেরে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সেনাপতি কোন চাল চেলেছে। তবে এটা সত্যি, ওদের বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই।
আমারাও সেই কথাই ভাবছি। ফ্রান্সিস বলল।
এখন কী করবেন ভাবছেন? মোকা জানতে চাইল।
দুএকটা দিন যাক। এরমধ্যে ওরা না ফিরলে ওদের মুক্ত করবে মরা ত্রিস্তানদের আক্রমণ করবো।
বেশ। মোকা আর কিছু বলল না। চলে গেল।
পরদিন রাত্রে ফ্রান্সিস ডেক-এ পায়চারি করছে। একা। হ্যারি আসেনি তখনও।
হঠাৎ কঙ্কাল দ্বীপের দিকে চোখ পড়তে ফ্রান্সিস চমকেউঠল। কঙ্কাল দ্বীপের বনে আগুনের লাল আভা। বোঝা যাচ্ছে সে আগুন ছড়াচ্ছে। আকাশে চাঁদ অনেকটা উজ্জ্বল। সেই বন থেকে জ্যোৎস্নায় আলোকিত আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। ফ্রান্সিস দ্রুত কেবিন ঘরের দিকে ছুটল। হ্যারিকে ডেকে নিয়ে এল। হ্যারি সেই আগুনের দিকে তাকিয়ে বলল–এ আগুন হঠাৎ লাগেনি। ত্রিস্তানরা লাগিয়েছে। তুমি বলেছিলে বনে আত্মগোপনকারী কয়েকজন ইকাবোকে তুমি দেখেছো। আরো অনেকইকাবো নিশ্চয়ই ঐ বনে আত্মগোপন করে আছে। এই আগুন লাগানোর উদ্দেশ্য হলো ওদের পুড়িয়ে মারা।
ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে ছুটোছুটি করতে দেখে ডেকের ওপর শুয়ে থাকা কয়েকজন ভাইকিং-এর ঘুম ভেঙে গেল। ওরা উঠে এসে ফ্রান্সিসের কাছে দাঁড়াল। আগুন দেখল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ভাইকিংরা জানতে পারল কঙ্কাল দ্বীপে আগুন লেগেছে। সবাই ডেক-এ এসে জড়ো হলো। রাজপুত্র মোকাও এল। আগুন দেখে ও পাগলের মত ছুটে এল ফ্রান্সিসের কাছে। ফ্রান্সিসের হাত দুটি ধরে কঁদো কাঁদো স্বরে ও বলে উঠল আপনারা ইকাবোদের বাঁচান
ফ্রান্সিস একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–দেখ মোকা-ওরা যদি সাঁতরে এসে জাহাজে আশ্রয় নেয় আমরা ওদের আশ্রয় দেব, খাদ্য দেব। কিন্তু ওদের জন্য এগিয়ে গেলে আমরা ত্ৰিস্তানদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যাবো। এটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।
কি বলছে ফ্রান্সিস–হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল–চোখের সামনে লোকগুলো পুড়ে মরবে আর আমরা বসে থাকবো?
ভুলে যেও না হ্যারি আমাদের দুজন বন্ধু এখনও ত্রিস্তানদের হাতে বন্দী।
ঠিক। কিন্তু তুমি এখন জানো না ওরা বেঁচে আছে না হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু–
কোনো কিন্তু নয় ফ্রান্সিস। ভালো করে তাকিয়ে দেখ, জ্বলন্ত বনের আগুনের আলোয় দেখ–ত্রিস্তানদের ক্যানো নৌকাগুলো ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইকবোরা সাঁতরে এসেও প্রাণ বাঁচাতে পারবে না।
ফ্রান্সিস কঙ্কাল দ্বীপের দিকে তাকাল। আগুনের আভায় আর উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় দেখল কয়েকটা ক্যানো নৌকা ঐ বনের কাছে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফ্রান্সিস সব ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকাল। চেঁচিয়ে বলল-একদল দাঁড়ঘরে চলে যাও। জাহাজ দ্বীপের দিকে নিয়ে চল। আর একদল অস্ত্র নিয়ে তৈরী হয়ে এস। পাঁচটা নৌকাই জলে ভাসাও। একটু থেমে ডাকলো–শাঙ্কো।
শাঙ্কো এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল-তুমি তীর ধনুক নিয়ে আমার নৌকোয় চলো। মোক এগিয়ে এল। বলল-আমিও আপনার সঙ্গে যাবে!
বেশ-ফ্রান্সিস বলল। দাঁড় বাওয়া শুরু হলো। জাহাজ আস্তে আস্তে এগিয়ে চলল কঙ্কাল দ্বীপের দিকে।
দ্বীপের কাছাকাছি এসে জাহাজ থামানো হলো। হ্যারির অনুমানই ঠিক। যেসব ইকবোরা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে পালাতে চাইছে, ত্রিস্তানরা ক্যানো নৌকো থেকে তাদের বুকে পিঠে কাঠের বশ বিধিয়ে দিচ্ছে।
পাঁচটা নৌকোইজলেনামানোহলো৷ তরোয়োল, বল্লম হাতে ভাইকিংরা ত্ৰিস্তানদের ক্যানোগুলো লক্ষ্য করে এগোতে লাগল।
একেবারে সামনের নৌকোটায় ফ্রান্সিস, মোল আরশাঙ্কো। ক্যানোগুলোর কাছাকাছি এসে ফ্রান্সিস বলল–শাকো–বশী হাতে ক্যানোয় দাঁড়ানো ত্রিস্তানদের মারো। নৌকো দুলছে। নিখুঁত নিশানা নিয়ে মারবে। তীর যেন বাজে খরচ না হয়। নৌকোগুলো এগিয়ে চলল।
তখনই মোকা নৌকোয় উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত গোল করে মুখের কাছে এনে তীক্ষ্ণ সুরে শিস দিতে লাগল। ও থামলেই বনের দিক থেকেও অমনি শিসের শব্দ ভেসে এল। বেশ কয়েকবার মোকা শিস দিল। বনের দিক থেকেও শিসের শব্দ ভেসে এল। মোকা নৌকোয় বসে পড়ল। বলল–ফ্রান্সিস আমার সঙ্কেত ওরা পেয়েছে। সঙ্কেতে বলেছি আমি আর বাবা বেঁচে আছি। ওরা যেন সাঁতরে জাহাজে আশ্রয় নেয় জাহাজের লোকেরা আমাদের বন্ধু।
ওদিকে ভাইকিংরা তরোয়াল বল্লম হাতে ত্রিস্তানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। নৌকো আর ক্যানোর ওপর লড়াই শুরু হলো ত্ৰিস্তানদের সঙ্গে।
শাঙ্কো ফ্রান্সিসের নির্দেশে ত্রিস্তানদের লক্ষ্য করে নিখুঁত নিশানায় তীর ছুঁড়তে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ কিছু ত্রিস্তান যোদ্ধা মারা পড়ল। আরোহীহীন ত্রিস্তানদের ক্যানোগুলো এখানে-ওখানে ঢেউয়ে দোল খেতে লাগল। সেগুলোতে সাঁতরে এসেইকাৰবোরা উঠতে লাগল।
বেগতিক বুঝে ত্রিস্তানরা ক্যানো নিয়ে পালাতে লাগল। আধঘন্টার মধ্যে ত্রিস্তানরা বেশ কিছু মরল, বাকিরা প্রাণভয়ে পালাল ক্যানোয় চড়ে।
মোকা নৌকোয় উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ইকাবোদের ভাষায় কী বলতে লাগল। ইকবোরা সাঁতরে চলল জাহাজে। কেউ-কেউ ভাইকিংদের নৌকোয় উঠে পড়ল। মোকা একবারে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন আহত ইকাবোকে নৌকোয় নিয়ে এল।
ফ্রান্সিস দেখল বনের আগুন অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। তবে আকাশে এখনো কালো ধোঁয়া উঠছে। ও নৌকোয় উঠে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল–ভাইসব-জাহাজে ফিরে চল।
সব ভাইকিংরা চেঁচিয়ে উঠল–ও-হো-হো। জাহাজেও শোনা গেল প্রতিধ্বনির মতো–ও-হো–হো।
আস্তে-আস্তে নৌকোগুলো জাহাজের দিকে ফিরে যেতে লাগল।
সব ইকাবোদের জাহাজে আশ্রয় দেওয়া হলো। অনেক ইকাবোদের গা-হাত-পা পুড়ে গিয়েছিল। ভাইকিংরা কয়েকজন আহত হয়েছিল। জাহাজের বৈদ্য তাদের চিকিৎসার ভার নিল।
এসব তদারকি করতে হলো হ্যারিকে। ফ্রান্সিস নিজের কেবিনে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ও।
একটু বেলায় ওর ঘুম ভাঙল। সকালের খাবার খেয়ে ও ডেক-এ উঠে এল। দেখল আহতরা এখানে-ওখানে শুয়ে আছে কম্বল পেতে। হ্যারি সব দেখাশুনো করছে।
একপাশে দেখল মোকা বসে আছে। ওর পেছনে রেলিঙে রোদে শুকোচ্ছে রাজার সেই গায়ের কাপড়টা। মোকা চড়া রোদের মধ্যে বসে আছে। ফ্রান্সিস বলল–মোকা, তুমি ছায়ায় গিয়ে বসো।
মোকা রাজার গায়ের কাপড়টা আঙুল দিয়ে দেখাল।
ওটা তো তোমার বাবার গায়ে থাকে। ভিজল কী করে?
কাল রাত্রে ৪টা গায়ে দিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলাম। একজন আহত ইকাবোকে বাঁচাতে জলে নেমেছিলাম। তাই ভিজে গিয়েছিল। এই কাপড়ের নাম কোহালহো।
ঠিক আছে, ওটা শুকোক–তুমি ছায়ায় গিয়ে বসো। মোকা মাথা নাড়ল। বলল–ঐ কোহালহো গিয়ানির মন্ত্রপূত। আমাদের রাজবংশে বহুকাল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কোনোমতেই ঐ কোহালহো আমরা কাছছাড়া করি না। আমাকে এ রোদেই বসে থাকতে হবে।
ফ্রান্সিস কাপড়টাকে একটা সাধারণ গায়ে দেবার কাপড় ভেবেছিল। বলল–কাল রাতে তুমি ওটা গায়ে দিয়েছিলে কেন?
আমাদের নিয়ম রাজবংশের যে যুদ্ধে যাবে তাকেই এই পবিত্র কোহালহো গায়ে দিয়ে যেতে হবে। কালকে আমি গিয়েছিলাম, তাই যুদ্ধে জয় হয়েছে।
ফ্রান্সিস হাসল। বলল–তাহলে ত্রিপ্তানদের সঙ্গেযুদ্ধে তোমরা হেরে গেলে কেন?
ওরা হঠাৎ আক্রমণ করেছিল। বাবা পবিত্র কোহালহো গায়ে দিয়ে বেরোবার আগেই বন্দী হন।
হুঁ।
ফ্রান্সিস একটু কৌতূহলী হলো। রেলিঙে মেলে দেওয়া কোহালহোটা দেখতে লাগল। নারকেলের আঁশ থেকেতৈরী মোটা কাপড়। তাতে ছবির মতো কিছুনা আঁকা। রাজামশাই কোহালহো ভাঁজ করে গায়ে দেয়। তাইনল্লা বোঝা যায়নি। এখন ভাঁজ খুলে মেলে দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সিস কাছে গিয়ে ভালো করে দেখল কাপড়টা। ওটাতে কিছু ছবির মতো নক্সা আঁকা। তিনটি রঙ তাতে। সাদা, গেরুয়া আর সবুজ।
নক্সা ছবিটা দেখতে একরকম–
ফ্রান্সিস নক্সা ছবিটা দেখল। অতীতের কঙ্কাল দ্বীপের কোনো আদিবাসী ইকাবো এঁকেছে। আনাড়ির হাতে আঁকা নক্সা। বোঝাই যাচ্ছে কাপড়টাই বহুদিনের। পুরোনো। রঙ নক্সা সবই অস্পষ্ট। যেদিকে ওটা ভাঁজ করা থাকে সেদিকের রঙ অনেকটা স্পষ্ট।
একটু বেলা হয়েছে তখন। হঠাৎ বিস্কো ছুটতে ছুটতে ফ্রান্সিসের কেবিন ঘরে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–ফ্রান্সিস, শিগগির এসো৷ ত্ৰিস্তানরা আমাদের আক্রমণ করতে আসছে।
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ছুটল ডেক-এর সিঁড়ির দিকে। ছুটে ডেক-এর রেলিঙে এসে দাঁড়াল। দেখল, কঙ্কাল দ্বীপ থেকে অনেকগুলো ক্যানো নৌকো ওদের জাহাজের দিকে আসছে। দুদিক দুসার ক্যানো নৌকো। মাঝখানে দুটো নৌকো একটা কাঠের পাটাতন দিয়ে বাঁধা। তার ওপর কাঠের সিংহাসনটা পাতা সেনাপতি বসে আছে। সেনাপতির হাতে তরোয়াল। তার পেছনে দুটি ত্ৰিস্তান যোদ্ধার হাতেও তরোয়াল। ফ্রান্সিস বুঝল ওদের ফেলে-আসা তরোয়াল ওরা পেয়েছে।
সেনাপতির নৌকো দুটোর পেছনে একটা ক্যানো নৌকো। এখানে ভাইকিং এর পোষাক পরা কারা দুজন বসে আছে? ফ্রান্সিস চমকে উঠল–একি! ওদেরই দুজন বন্ধু। একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল দুজনেরই হাত-পা বাঁধা। দুই বন্ধুকে দেখে জাহাজের ভাইকিংরা চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো। দূর থেকে বোঝা গেল দুই বন্দী বন্ধু মান হাসল। খুব দূর্বল হয়ে পড়েছে ওরা। যাক, বেঁচে আছে। ফ্রান্সিস এতেই খুশী হলো। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারল না–সেনাপতির মতলবটা কী?
জাহাজের কাছাকাছি এসে সব ক্যানো নৌকো থেমে গেল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাকল-হারি। হ্যারি এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল–ওদের মতলবটা ঠিক বুঝছি না। সবাইকে বলো তৈরী হতে। অস্ত্রঘর থেকে অস্ত্রশস্ত্র এনে ডেক-এ রাখো। কিন্তু ওরা যেন টের না পায়।
ফ্রান্সিসের নির্দেশমত সবাই তৈরী হলো। ডেক-এ রাখা হলো অস্ত্রশস্ত্র।
একটা ক্যানো নৌকো এগিয়ে এল। দেখা গেল তাতে দাঁড়িয়ে আছে অল্প অল্প স্প্যানিশ ভাষা বলতে পারে সেই বৃদ্ধটি। ক্যানো নৌকোটা জাহাজের খুব কাছে এল। বৃদ্ধটি চেঁচিয়ে বলল–যুদ্ধ নয়–বিনিময়–এসেছি।
কীসের বিনিময়? ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল।
সংবাদ–রাজা, রাজপুত্র মোকাজীবিত-জাহাজে।
কী করে বুঝলেন?
কাল রাত্রে–মোকাদ্ধ–শিস দিয়ে নির্দেশ–তাহলে রাজাও জীবিত জাহাজে।
বিস্কো চেঁচিয়ে বলল–রাজা, রাজপুত্র কেউ আমাদের জাহাজে নেই।
বৃদ্ধ দোভাষীটি সেনাপতিকে সে কথা বলল বোধহয়। সেনাপতি কী বলল। বৃদ্ধটি চেঁচিয়ে বলল-সেনাপতি বলেছেন-মিথ্যে বললে–চোখের সামনে বন্দী দুজন হত্যা।
ফ্রান্সিস এবার বিনিময় কথাটার অর্থ বুঝল। বলল-বেশ–রাজা আর রাজপুত্র জীবিত। আমাদের জাহাজে আছে।
তা হলে–বৃদ্ধ দোভাষী বলল–রাজা-রাজপুত্রকে দিন-দুজন বন্দী নিয়ে যান।
ফ্রান্সিস দ্রুত ভাবতে লাগল-এই সুযোগ। জীবিত অবস্থায় বন্ধু দুটিকে ফিরে পেতে গেলে বুদ্ধি খাটাতে হবে। বলল–বেশ আমরা রাজি। কিন্তু কথা দিন রাজা ও রাজপুত্রকে আপনারা প্রাণে মারবেন না।
কথাটা বৃদ্ধ সেনাপতিকে বলল। সেনাপতি উত্তরে কী বলল। বৃদ্ধ বলল– সেনাপতি বলেছেন–আমাদের ব্যাপার আপনারা বিদেশী কোনো কথা নেই।
বেশ–রাজপুত্রের সঙ্গে কথা বলি। তারপর বলছি। আসলে ফ্রান্সিস ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাটা ভাবছিল। একটু সময় চাই যার জন্যে।
ফ্রান্সিস ভাবতে ভাবতে মাথা নীচু করে কয়েকবার পায়চারি করল ডেক-এর ওপর। হ্যারি কাছেই ছিল। পায়চারি থামিয়ে বলল–হ্যারি উপায় বাতলাও।
রাজা আর রাজপুত্রকে পেলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলবে।
এ তো জলের মতো পরিষ্কার।
ওদের হাত থেকে বন্ধুদের উদ্ধার করতে হবে আবার রাজা-রাজপুত্রকেও বাঁচাতে
কিন্তু কী করে।
আমি একটা উপায় ভেবেছি।
হুঁ। বলো।
পরিকল্পনাটা এরকম–জাহাজ থেকে দুটো দড়ি ঝুলবে।
বেশ।
একটা দড়ি বেয়ে আমাদের এক বন্ধু জাহাজে উঠে আসবে। অন্য দড়িতে রাজাকে নামিয়ে দেওয়া হবে। তারপর অন্য বন্ধু আর রাজপুত্র।
বুঝলাম। তারপর?
রাজা আর রাজপুত্র নৌকায় নেমে ওরা কিছু বোঝার আগেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কাছেই জাহাজ, ডুব সাঁতার দিয়ে জাহাজ পেরিয়ে ওপাশে ভেসে উঠবে। ওরা রাজা আর রাজপুত্রকে আক্রমণ করার আগেই আমরা ওদের জাহাজে তুলে নেব? |||||||||| –
সাবাস হ্যারি। ফ্রান্সিস হেসে হ্যারির কাঁধে এক চাপড় মারল। তারপর দুজনে চলল রাজা আর রাজপুত্রের কেবিনের দিকে। কেবিনে ঢুকে দেখল রাজা মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে আছে। রাজপুত্র শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল ওদের দিকে। চোখে মুখে মৃত্যুভীতি। ফ্রান্সিস ওর কাঁধে হাত রাখল। বলল-বিপদের সময় সাহস হারাতে নেই। তারপর আস্তে আস্তে সমস্ত পরিকল্পনাটা বলল। মোকার মুখচোখ উজ্জ্বল হলো। ফ্রান্সিস বলল–কিছছু ভয় পেও না। আমরা আছি। এছাড়া আমাদের বন্ধুদের বাঁচাবার অন্য কোনো পথ নেই। এখন তোমার বাবাকে সব বুঝিয়ে বলো। ডুবসাঁতার দিয়ে জাহাজ পেরোতে পারবেন বিনা বলে দেখ।
মোকা রাজামশাইকে সব বুঝিয়ে বলল। রাজামশাই সব শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে কি সব বলে গেল। মোকা বলল–বাবা বলছেন–আপনাদের পরিকল্পনা খুব সুন্দর হয়েছে। উনি ডুব সাঁতার দিয়ে জাহাজ পেরোতে পারবেন।
এ সময় রাজামশাই মোকাকে কিছুক্ষণ ধরে কী বললেন। মোকা বলল–বাবা বলছেন ভবিষ্যৎকী ঘটবেজানা নেই–কাজেই উনি আমাকে কোহালহো পরিয়ে অভিষেক করতে চান। জাহাজে তো অনেক ইকাবো আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সামনেই তিনি এই অনুষ্ঠান করবেন।
বেশ–
ফ্রান্সিস বলল-তোমার বাবাকে ডেক-এ নিয়ে চলো।
ওরা সবাই ডেকে এসে দাঁড়াল।
যে সব আহত, আগুনে-পোড়া এবং সুস্থ ইকাবোরা জাহাজে আশ্রয় নিয়েছিল তারা রাজাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। দুহাত সোজা ওপরে তুলে মাথা নীচু করে রাজাকে অভিনন্দন জানাল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল।
রাজা সকলের দিকে একবার তাকিয়ে ইকাবোদের ভাষায় কিছুক্ষণ বলে গেলেন। তারপর নিজের গায়ের কোহালহো মোকার গায়ে পরিয়ে দিলেন। গলায় নারকেলের দড়িটা ফিতের মতো বেঁধে দিলেন।
মোকা রাজপদে অভিষিক্ত হলেন। উপস্থিত ইকাবোরা খুশিতে হৈ-হৈ করে উঠল। জাহাজের রেলিঙে ঝুঁকে একজন ইকাবো কিছুক্ষণ ধরে নানা সুরে শিস দিল। বোধহয় সাঙ্কেতিক শিস দিয়ে ও কঙ্কাল দ্বীপের ইকাবোদের এই সংবাদ জানাল।
ওদিকে সেনাপতি অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। ফ্রান্সিস এত দেরি করছে কেন? ফ্রান্সিস সেটা বুঝতে পারল। এবার ও রেলিঙের ধারে এগিয়ে এল। ও দোভাষী বৃদ্ধকে কীভাবে কেমন করে বন্দীদের জাহাজে তোলা হবে–রাজা আর রাজপুত্রকে নামানো হবে, সব বুঝিয়ে বলতে লাগল।
আর হ্যারি ওদিকে জাহাজের ওপাশে শক্ত কাছি ঝুলিয়ে দিল। সবাইকে তৈরী থাকতে বলল।
ফ্রান্সিসের কথা দোভাষী সেনাপতিকে বুঝিয়ে বলল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সেনাপতি। ফ্রান্সিস সেনাপতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেনাপতির সম্মতির ওপর সব নির্ভর করছে। একটু পরে সেনাপতি কী যেন বললেন। দোভাষী বলল-সেনাপতি রাজী হয়েছেন। তবে ওঠা-নামার দড়ি থাকবে পাশাপাশি।
বেশ। ফ্রান্সিস বলল। ওদিকে সেনাপতির একজন দেহরক্ষী হাতের তরোয়াল দিয়ে ভাইকিং বন্দীদের হাত-পায়ের বাঁধন কেটে দিল।
ফ্রান্সিস তখনই শাঙ্কোকে ইশারায় ডাকল। ও কাছে আসতে ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–আমার কাছে থাকো। আমার কথামত তীর ছুঁড়বে। নিশানা যেন নিখুঁত হয়।
শাঙ্কো তীর-ধনুক নিয়ে ফ্রান্সিসের আড়ালে এসে দাঁড়াল।
বন্দী দুজন ভাইকিংদের নিয়ে ক্যানো নৌকোটা একজন ত্রিস্তান যোদ্ধা জাহাজের গায়ে এসে লাগল।
কাছিতে ফাঁসমত পরিয়ে, তাতে রাজাকে বসিয়ে নামিয়ে দেওয়া হলো আস্তে আস্তে ক্যানো নৌকোর ওপর। অন্য কাছি ধরে বন্দী ভাইকিংটি জাহাজেউঠে এল। জাহাজে নামতেই কয়েকজন ভাইকিং ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল।
এবার রাজপুত্র মোকা। দ্বিতীয় ভাইকিং বন্ধুটিকে তোলা হতে লাগল জাহাজে। ও জাহাজে উঠল। সবাই ওকে ঘিরে ধরল।
মোকা নামতে লাগল। ফ্রান্সিস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেনাপতির দিকে। সে কোনো ইঙ্গিত করে কিনা। দেখল, সেনাপতি চুপ করেই বসে আছে। রাজা ও রাজপুত্র দুজনেই তো এখন তার হাতের মুঠোয়।
মোকা ক্যানো নৌকোতে নেমেই চাপাস্বরে বোধহয় বাবাকে কিছু বলেই পাক, খেয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজাও ঝাঁপ দিতে গেলেন। কিন্তু একটু দেরি হলো। ততক্ষণে ক্যানো নৌকোয় বসা ত্ৰিস্তান যোদ্ধাটি কাঠের কশা তুলে ছুঁড়ে মেরেছে রাজার বুক লক্ষ্য করে। ফ্রান্সিস চীৎকার করে উঠল-শাকো। শাকো সঙ্গে সঙ্গে তীর ছুঁড়ল। তীর গিয়ে লাগল ত্ৰিস্তান যোদ্ধার ডান কাঁধে। কিন্তু ততক্ষণে বশ ছোঁড়া হয়ে গেছে। কশা বিঁধেছে রাজার বুকে। ক্যানো নৌকো থেকে গড়িয়ে জলে পড়ে গেলেন। ওখানকার জল লাল হয়ে উঠল। ত্ৰিস্তান যোদ্ধাটি বাঁ হাতে কাঁধ চেপে নৌকোয় বসে পড়ল। ওদিকে তিন-চারটি ক্যানো নৌকো মোকাকে খুঁজতে লাগল বশা উচিয়ে। কিন্তু মোকা আর ভেসে উঠল না। মোকা তখন ডুবসাঁতার দিয়ে জাহাজ পেরিয়ে জাহাজের ওপারে ঝোলানো কাছি ধরে উঠছে। সাত-আটজন ভাইকিং দ্রুত হাতে কাছি টেনে মোকাকে জাহাজে তুলে নিল।
চোখের পলকে এত ঘটনা ঘটে গেল। সেনাপতি কাঠের সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে কী বলে উঠল। সব ত্ৰিস্তান যোদ্ধারা বর্শা উচিয়ে চিৎকার করে উঠল। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল–শাকো, সেনাপতিকে। সঙ্গে সঙ্গে শাকোর তীর ছুটল। একেবারে সেনাপতির বুকে গিয়ে বিধল। নিখুঁত নিশানা। সেনাপতি দুহাত তুলে উল্টে পড়ল কাঠের পাটাতনের ওপর। তারপর কাতরাতে লাগল।
এরকম কিছু ঘটবে ত্রিস্তানরা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি। ওরা হকচকিয়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। তখনই দোভাষী বৃদ্ধটি চিৎকার করেকী বলে উঠল। তারপর তার ক্যানো নৌকোটা কালদ্বীপের দিকে চালাতে লাগল।
আর ক্যানো নৌকোগুলোও ওটার পেছনে-পেছনে চলল কঙ্কাল দ্বীপের দিকে। মারাত্মক আহত সেনাপতিকে নিয়ে ত্ৰিস্তান যোদ্ধারা ফিরে গেল কঙ্কালদ্বীপে।
***
সেদিনটা কাটল। ফ্রান্সিসরা সারাদিনই সজাগ রইল যদি ত্ৰিস্তানরা ফিরে আক্রমণ করে তার মোকাবিলা করার জন্যে। কিন্তু ত্ৰিস্তানরা আর এমুখো হলো না।
বাবার মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত রাজপুত্র মোকা চুপ করে বসে রইল আর মাঝে-মাঝেই ওর চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। ফ্রান্সিসরা ওকে সান্ত্বনা দিল। বলল–অল্পের জন্যে তোমার বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না। যাকগে তোমাদের দ্বীপ ত্ৰিস্তানরা দখল করে আছে। আগে ওদের তাড়াতে হবে। এখন ভেঙে পড়লে চলবে না।
মোকা ওদের কথায় একটু শান্ত হলো।
সন্ধেবেলা ফ্রান্সিস সব ভাইকিংদের ডেক-এ জমায়েত হতে বলল।
সন্ধ্যেবেলা সবাই এসে ডেক-এ বসল। ফ্রান্সিস বলতে লাগল-ভাইসব-আজ রাত্রেই আমরা কঙ্কালদ্বীপে যাবো। ত্রিস্তানরা আমাদের দুই বন্ধুর সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করেছে। ওরা ত্রিস্তান সেনাপতিকে রূপোর নদীর হদিস বলে দেবে এই ভাঁওতা দিয়ে কোনো রকমে নিজেদের জীবন বাঁচিয়েছে। যা হোক–ত্ৰিস্তানরা ওদের প্রাণে মারেনি। কাজেই ত্ৰিস্তানরা আমাদের শত্রু নয়। আমরা ওদের ভয় দেখিয়ে কশ্যতা স্বীকার করাবো। আমরা আগ বাড়িয়ে ওদের হত্যা করবো না। আক্রান্ত হলে তবেই যুদ্ধ করবো। ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলল–এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে বিশ্রাম করে নাও। গভীর রাত্রে আমাদের যাত্রা শুরু হবে।
সবাই চলে গেল। ফ্রান্সিসের কথামত খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম করতে লাগল।
গভীর রাত্রে নৌকোয় করে যাত্রা শুরু হলো। প্রথম নৌকোটায় গেল ফ্রান্সিস, হ্যারি, বিস্কো আর তীর ধনুক নিয়ে শাঙ্কো। বনের মধ্যে নেমে ওরা অন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সে রাত্রে চাঁদ অনেক উজ্জ্বল। সমুদ্রে, বনের মাথায় জ্যোৎস্নার ছড়াছড়ি। বোধহয় পূর্ণিমার কাছাকাছি সময়।
পাঁচটা নৌকোয় দফায় দফায় ভাইকিংরা আর সুস্থ ইকাবো যোদ্ধারা বনের আড়ালে তীরে নামল। ইকাবোদের হাতে কাঠের বশী। ভাইকিংরা তরোয়াল, বশ নিল। সবাই যখন এল খন ফ্রান্সিস মোকাকে বলল–এই বনে অনেক ইকাবো আত্মগোপন করে আছে। তুমি শিস দিয়ে জানিয়ে দাও যে আমরা ওদের বন্ধু শত্রু নই।
বনের মধ্যে কিছুটা গিয়ে মোকা উবু হয়ে বসে শিস দিতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ নানা সুরে শিস দিল।
একটু পরেই দেখা গেল অন্ধকারে বনের আড়াল থেকে একজন দুজন করে কাঠের বর্শা, গাছের ভাঙা ডাল দিয়ে তৈরি লাঠি নিয়ে ইকাবোরা বেরিয়ে আসছে। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজনইকাবো এসে ওদের দলে যোগ দিল। সকলেই রোগার্ত। কতদিন না খেয়ে আছে কে জানে।
ফ্রান্সিস সবাইকে লক্ষ্য করে চাপাস্বরে বলল–আমরা বনের মধ্যে দিয়ে যাবো না। ওখানে ত্ৰিস্তানরা অনেক ফাঁদ পেতে রেখেছে। আমরা চড়াইয়ের ঢাল বেয়ে উঠবে। আমি না বললে কেউ আক্রমণ করবে না। ফ্রান্সিস মোকাকে বলল-ইকাবাদের কথাটা বলে দাও। মোকা ওদের ভাষায় কথাগুলো বলে দিল। ইকাবো যোদ্ধারা মাথা এপাশ ওপাশ করল। অর্থাৎ ওরা বুঝেছে।
বন ছেড়ে সবাই চড়াইয়ের ঘাসে ঢাকা ঢাল বেয়ে উঠতে লাগল। বেশ দূর পর্যন্ত জ্যোৎস্নায় দেখা যাচ্ছে।
কিছুটা এগোতে বাঁ দিকে বনের ধারে আগুন জ্বলছে দেখা গেল ত্রিস্তান যোদ্ধারা ওখানে দল বেঁধে বসে আছে। দ্বীপের বিচিত্র সব পাখি উড়ে-উড়ে আগুনের কাছে আসছে। ওরা সেসব মেরে পুড়িয়ে খাচ্ছে।
ফ্রান্সিসের নির্দেশমতসবাই হামাগুড়ি দিয়ে ওদের কাছাকাছি গেল। তারপর ওদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল।
ফ্রান্সিস মোকাকে বলল–চেঁচিয়ে ওদের বলো যে ওদেব আমরা ঘিরে ফেলেছি। বাঁচতে হলে ওরা যেন অস্ত্রত্যাগ করে।
ফ্রান্সিসের নির্দেশে হঠাৎ সবাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। ত্ৰিস্তানরা পাখি মারতে মারতে হঠাৎ দেখলকারা ওদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। তখনই মোকা ত্ৰিস্তানদের ভাষায় বলতে লাগল-তোমরা শোন। শুধু আমরা, ইকাবোরা নই, আমাদের দলে আছে ভাইকিংরা। এরা দুর্ধর্ষ জাতি। এদের হাতে তরোয়াল থাকলে এদের সঙ্গে যুদ্ধে কেউ পারে না। আমরা মিছিমিছি রক্তপাত চাই না। তোমরা অস্ত্রত্যাগ কর। আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না।
ওদের মধ্যে কয়েকজন বর্শা উঁচিয়ে ধরেছিল। কিন্তু চারদিক লুকিয়ে ভাইকিং আর ইকাবো যোদ্ধাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দেখে বর্শা নামাল। নিজেদের মধ্যে কী কথাবার্তা বলল। তারপর হাতের বাগুলো মাটিতে ফেলে দিতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সবাই অস্ত্রত্যাগ করল।
ফ্রান্সিস বিস্কোকে বলল-যাও-বর্শাগুলো নিয়ে এসো। পাহাড়ের কোনো গুহায় গিয়ে রেখে এসো।
বিস্কো আর কয়েকজন মিলে বর্শাগুলো আনতে গেল।
হঠাৎ ফ্রান্সিসদের পেছনে একটা বিরাট পাথরের চায়ের আড়াল থেকে আট দশজন ত্ৰিস্তান যোদ্ধা বর্শা হাতে ছুটে এল। ফ্রান্সিসরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল-লড়াই। ভাইকিংরা কেউ কেউ হঠাৎ এই আক্রমণে আহত হলো। আক্রমণের প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে ওরা ঘুরে আক্রমণ করল। ত্রিস্তানরা হাতে বশা ছুঁড়ে মারছে। পরক্ষণেই নিরস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়ছে। ভাইকিংরা সহজেই ওদের ঘায়েল করতে লাগল তরোয়াল ও বশা দিয়ে।
লড়াই অল্পক্ষণেই মিটে গেল। কয়েকজন ইকাবো বন থেকে লতাগাছ নিয়ে এল। তাই দিয়ে ত্রিস্তানদের পিছমোড়া করে হাত বাঁধা হলো।
ফ্রান্সিসরা এবার চলল রাজবাড়ি লক্ষ্য করে। চড়াই দিয়ে হেঁটে ওরা ওপরের দিকে চলল। বসতি এলাকা শুরু হলো। ভাইকিং আর ইকাবো যোদ্ধারা ঘরে ঘরে ঢুকতে লাগল। ত্ৰিস্তানদের বন্দী করে আনতে লাগল। ত্ৰিস্তানরা বোধহয় ভাবেনি এত তাড়াতাড়ি ওরা আক্রান্ত হবে। ফ্রান্সিস আগেই বলেছিল যেন বেশি গোলমাল না হয়। কিন্তু গোলমাল হৈ চৈ চিৎকার কিছু হলো। তাতেই রাজবাড়ির পাহারাদার ত্রিস্তানরা সাবধান হয়ে গেল। ওরা গাছ-পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিল।
ফ্রান্সিসরা রাজবাড়িতে পৌঁছে দেখল রাজবাড়ি অরক্ষিত পড়ে আছে। জ্যোৎস্নার আলোতে রাজবাড়ির চারপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল ত্রিস্তানরা নিশ্চয়ই এখানেই আত্মগোপন করে আছে। তোমরা রাজবাড়ির সামনে জড়ো হও আর চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখো। খবরদার–অস্ত্র হাত থেকে নামাবে না। মোকাও এই কথাগুলো ইকাবো যোদ্ধাদের বলল।
রাজবাড়ির সামনে সবাই জড়ো হলো। তৈরী হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
মোকা, ফ্রান্সিস আর হ্যারি বাড়ির ভেতর ঢুকল। একটা ঘরে দেখল ম্যাকরেল মাছের তেলের একটা প্রদীপ জ্বলছে। তাসক ঘাসের একটা বিছানা। তাতে গাছের নরম ছাল বিছানো। কে একজন শুয়ে আছে।
ফ্রান্সিস দ্রুত ছুটে গিয়ে লোকটার গলায় তরোয়াল চেপে ধরল। দেখল–আহত সেনাপতি। সেনাপতি ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। ফ্রান্সিস তরোয়াল সরিয়ে নিল। মোকাকে বলল-সেনাপতিকে বলল-ওর দলের প্রায় সবাই বন্দী। আমরা রক্তপাত চাইনা। ওরা এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যাক। মোকা সেনাপতিকে ত্ৰিস্তান ভাষায় সে কথা বলল। সেনাপতি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। বিড়বিড় করে বললো–আমরা চলে যাবো।
ঘরের আর এক কোণায় অন্ধকার আর একটা বিছানা ছিল। সেখানে শুয়েছিল দোভাষী বৃদ্ধটি। সে এবার উঠে আলোর কাছে এল। ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে বলল সেনাপতি অসুস্থ–গুরুতর। আমাদের সৈন্যদের হত্যা করবেন না। কাল এই দ্বীপ ছেড়ে যাব।
ফ্রান্সিস বলল–আক্রান্ত না হলে আমরা কাউকে আক্রমণ করি না। ত্রিস্তান যোদ্ধারা কিছু আহত হয়েছে কিন্তু কাউকে আমরা মারিনি। শুধু বন্দী করেছি।
ঠিক তখনি বাইরে জোর চিৎকার হৈ চৈ শোনা গেল। লুকিয়ে থাকা ত্ৰিস্তানরা আক্রমণ করেছে। জোর লড়াই চলল বাইরে বেশ কিছুক্ষণ। আবার চারিদিক নিঃশব্দ। শুধু আহতদের আর্তনাদ মাঝে মাঝে শোনা যেতে লাগল।
ফ্রান্সিসদের নির্দেশে সব ত্রিস্তানদের হাত বেধে একটা গুহায় রাখা হল। পূর্বদিকের আকাশ তখন লাল হয়ে উঠেছে। আহত ভাইকিং আর ইকাবোদের নৌকা করে জাহাজে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
সকাল হলো। দোভাষী বৃদ্ধটি ফ্রান্সিসকে এসে বলল–চিকিৎসক-সেনাপতির চিকিৎসা।
ফ্রান্সিস তখনই ফার্নান্দোকে জাহাজে পাঠাল। কিছুক্ষণ পরে জাহাজের বৈদ্য এল। সেনাপতির বুকের ক্ষত পরীক্ষা করল। ওষুধ দিয়ে পট্টি বেঁধে দিল। দোভাষী বৃদ্ধ ফ্রান্সিসকে বারবার ধন্যবাদ জানাল।
একটু বেলা হতে সেনাপতি বৃদ্ধ দোভাষীকে ডেকে কী বলল। বৃদ্ধ ফ্রান্সিসকে এসে বলল সেনাপতি সুস্থ বোধ করছেন। ত্রিস্থান বন্দীদের ছেড়ে দিন। আমরা রওনা হব।
ত্রিস্তান বন্দীদের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো। ওরা সবাই সমুদ্রের ধারে এসে জড়ো হলো। সারি সারি ক্যানো নৌকা রাখা হলো। প্রথমে আহতদের নৌকোয় তোলা হল। আহত সেনাপতিকে কয়েকজন কাঁধে করে নিয়ে এল। জোড়াবাঁধা দুটো ক্যানো নৌকায় পাটাতনে সেনাপতিকে শুইয়ে রাখা হল। সঙ্গে রইল বৃদ্ধ দোভাষীটি। তারপর সবাই একে একেক্যানো নৌকায় উঠতে লাগল। সবাই উঠলে সারি বেঁধে সব নৌকা চলল দক্ষিণমুখো ত্ৰিস্তানদের দ্বীপের উদ্দেশ্যে।
দু একদিনের মধ্যেই কঙ্কালদ্বীপে জীবন ফিরে এল। যারা বনে লুকিয়েছিল তারা সবাই এল। ইকাবোদের ঘরে ঘরে আবার শান্তি ফিরে এল।
কঙ্কালদ্বীপে রইল শুধু ফ্রান্সিস আর হ্যারি। সব ভাইকিংরা জাহাজে ফিরে গেল।
সেদিন শেষরাত। ফ্রান্সিস আর হ্যারি দুজনে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎকয়েকজন ইকাবো এসে ওদের ঘরের সামনে চিৎকার করে কী বলতে লাগলো। ওদের হাতে মশাল। ফ্রান্সিস আর হারির ঘুম ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস উঠেই শিয়র থেকে একটা তরোয়াল নিল। গাছের ডাল কেটে তৈরী দরজার দিকে এগোল। হ্যারিও একটা তরোয়াল নিল। চলল ফ্রান্সিসের পেছনে পেছনে।
বুনো লতায় বাঁধা দরজাটা খুলে ফ্রান্সিস বাইরে এল। বলল কী ব্যাপার? যে কজন ইকাবো এসেছে তাদের দেখেই ফ্রান্সিস চিনল এরা রাজবাড়ির পাহারাদার। ওরা ফ্রান্সিসকে হাত পা নেড়ে কী বোঝাতে লাগল। ফ্রান্সিস ওদের একটা কথা বুঝল–বন্দী। আর বুঝল ওরা বারবার রাজা মোকার নাম করছে। ওরা রাজবাড়ির দিকে ইঙ্গিত করতে লাগল। ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল–হ্যারি মনে হচ্ছে মোকা কোনোভাবে বন্দী হয়েছে। রাজবাড়িতে চলল।
দুজনে রাজবাড়ির দিকে চলল। জ্যোৎস্না বেশী উজ্জ্বল নয়। চারিদিকে নিস্তব্ধ। দুজনে আগে আগে চলল। পেছনে চলল রাজবাড়ির পাহারাদার।
ওরা রাজবাড়িতে পৌঁছল। ভেতরে রাজা মোকার ঘরে ঢুকে দেখল পাথরের ওপর বিছানো তাসক ঘাসের বিছানা ছত্রাখান হয়ে আছে। মোকা নেই। ফ্রান্সিস মৃদু আলোয় চারদিকে দেখল। ঘর শূন্য। একপাশে পাথরের ওপর ছড়ানো রয়ছে মোকার গায়ের সেই কোহালহোটা।
তখনই পাহারাদারদের মধ্যে কয়েকজন দুজন পাহারাদারকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। দুজনইআহত। তারমধ্যে একজনের আঘাত সাংঘাতিক। তখনই একজন পাহারাদার বারবার ত্রিস্তান এই কথাটা বলতে লাগল। এবার ফ্রান্সিস ব্যাপারটা বুঝতে পারল। রাতে ত্ৰিস্তানরা এসে মোকাকে ধরে নিয়ে গেছে। ত্ৰিস্তানরা আবার আসতে পারে। একথা ওরা ভাবতেই পারেনি। কিন্তু তাই ঘটল। পাহারাদারটি এবার সমুদ্র তীরের দিকেইঙ্গিত করতে লাগল। ফ্রান্সিস বুঝল ক্যানো নৌকা চালিয়ে ত্ৰিস্তানরা এসেছিল। কতক্ষণ আগে ধরে নিয়ে গেছে সেটা পাহারাদারদের বারবার জিজ্ঞেস করেও জানতে পারল না। বলল–হ্যারি-কিছুই বুঝতে পারছি না। কখন ধরে নিয়ে গেল? ওদের দলেই বা কতজন ছিল? যাগগে, চলো সমুদ্রের ধারে যাওয়া যাক। যদি ওদের ধরা যায়।
দুজনে রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তারপর দ্রুত ছুটল সমুদ্রতীরের দিকে। সমুদ্রতীরে যেখানে ত্ৰিস্তানরা কানো নৌকা নিয়ে এসেছিল, পাহারাদাররা সেখানে ওদের দুজনকে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস তাকাল সমুদ্রের দিকে। ত্রিস্তানদের ক্যানো নৌকার চিহ্নমাত্র
নেই। অল্প জ্যোৎস্নায় দেখা যাচ্ছে দূরে সমুদ্রের বুকে পাতলা কুয়াশার আস্তরণ। তার মানে ধরে নিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে।
ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি কী করা যায় বলো তো?
মোকাকে ত্ৰিস্তানদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে।
তার মানে যুদ্ধ।
হ্যাঁ প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে হবে।
আমি যুদ্ধে রক্তপাত এসব এড়াতে চাইছি।
বেশ, সে চেষ্টা করা যাক। ত্রিস্তানরা মোকাকে বন্দী করল কেন কী ওদের উদ্দেশ্য তা তো আমরা জানি না।
ভাবছি, কালকেই জাহাজে নিয়ে ত্ৰিস্তানদের দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হব।
দু একজন ইকাবোকে সঙ্গে নিতে হবে। ওরা ঠিকনিশানা রেখে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে।
ওরা নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল যখন রাত শেষ হয়ে এসেছে। হ্যারি আবার শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমলো না। কী করে মোকাকে উদ্ধার করবে তারই পরিকল্পনা করতে লাগলো। পাখির ডাক শোনা গেল। ভোর হলো।
ফ্রান্সিস বিছানা থেকে উঠল। হাত-মুখ ধুয়ে একটা বুনো আনারস খেল। তারপর চলল রাজবাড়ির দিকে। সেখানে পৌঁছে দেখল অনেক ইকাবো মেয়েপুরুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। কেউ কেউ কাঁদছে। ফ্রান্সিস বুঝল-ওরা সত্যিই মোকাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। ফ্রান্সিসকে দেখে কয়েকজন ইকাবো মেয়েপুরুষ ছুটে এল। ফ্রান্সিসের হাত ধরে কী বলেতে লাগল। ওদের মুখে বারবার রাজা মোকা কথাটা শুনে ফ্রান্সিস বুঝল ওরা কি বলতে চায়? ফ্রান্সিস রাজবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে সবাইকে শান্ত হবার ইঙ্গিত করল। সকলে চুপ করল। ফ্রান্সিস তখন অঙ্গভঙ্গী করে ত্রিস্তানদের দ্বীপ থেকে কী করে মোকাকে মুক্ত করে আনবে সেটা বোঝাল। ও বারবার মোকা ত্রিস্তানআর মুক্তি এই কথা কটার ওপর জোর দিয়ে বলল। ইকাবোরা বুঝতে পারলো ফ্রান্সিস মোকার মুক্তির কথাই বলছে। ওরা আনন্দে হৈ হৈ করে উঠল। হাসতে লাগল। ফ্রান্সিসও হাসল। খুশীইহলো–যাক, ইকাবোরা ওর কথা বুঝতে পেরেছে।
ও তখন পাহারাদারদের সর্দারকে ইঙ্গিতে ডাকল। সর্দার কাছে এল। ফ্রান্সিস ওকেইঙ্গিতে বোঝাল ওরা জাহাজ চালিয়ে ত্ৰিস্তানদের দ্বীপে যাবে। সর্দার ওদের নিয়ে যেতে পারবে কিনা। কয়েকবার মুক্তি ত্রিস্তান কথাগুলো শুনে সদার মাথা ঝাঁকাল। তারপরে নিজের বুকে বারবার ছুঁইয়ে ও বোঝাল ও ওদের নিয়ে যেতে পারবে।
সেদিন দুপুরেই ফ্রান্সিস হ্যারি আর পাহারাদারদের নিয়ে সমুদ্রতীরের দিকে রওনা হলো। নৌকো চালিয়ে ওরা ওদের জাহাজে এসে উঠল। সকলেই ওদের ঘিরে ধরল। ঠিক বুঝল না ফ্রান্সিস হঠাৎ এল কেন? ফ্রান্সিস সকলের দিকে তাকিয়ে বলল ভাইসব–কাল রাত্রে ত্ৰিস্তানরা লুকিয়ে কঙ্কাল দ্বীপে এসেছিল। মোকাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। জানি না ওদের উদ্দেশ্য কি? যা হোক আমরা আজকেই রাহাজ। নিয়ে যাচ্ছি যাত্রা করণে, ত্ৰিস্তান দ্বীপ লক্ষ্য করে। একজন ইকাবো সর্দারকে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের ঠিক পথে নিয়ে যাবার জন্য। এখন সবাই বিশ্রাম করো। রাত হলেই আমরা যাত্রা করব। মোকাকে মুক্ত করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
সব ভাইকিংরা চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো। তারপর সবাই যে যার কাজে চলে গেল।
রাতের খাওয়া–দাওয়া শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। ফ্রান্সিস আর হ্যারি ইকাবো সর্দারকে নিয়ে জাহাজের ডেক-এ এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল-নোঙর তোল। পাল খাটাও। বাতাস পড়ে গেছে। দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে যাও। মুহূর্তে জাহাজে কর্মব্যস্ততা শুরু হলো। ঘড়ঘড় শব্দে নোঙর তোলা হলো। কয়েকজন মাস্তুল বেয়ে উঠে গেল ওপরে। পাল খুলে দিল। ইকাবো সর্দারের নির্দেশমতো জাহাজ চলল দক্ষিণ-পশ্চিম মুখো। আজ জ্যোৎস্না তেমন উজ্জ্বল নয়। আবছা আলোয় পাতলা কুয়াশা ঢাকা সমুদ্রের ওপর দিয়ে, জাহাজ চলল ঢেউ ভেঙে।
সারারাত জাহাজ চলল। পরের দিন ভোর ভোর সময়ে মাস্তুলের ওপর নজরদার ভাইকিংটি চেঁচিয়ে বলল–ত্রিস্তান দ্বীপ দেখা যাচ্ছে।
সকালে সমুদ্রের বুকে কুয়াশার পাতলা আবরণ কেটে গেল। দেখা গেল ত্ৰিস্তান দ্বীপ। দ্বীপে দুটো পাহাড়ের পাথুরে চূড়া দেখা গেল। পাহাড় দুটো একেবারে ন্যাড়া, সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। শুধুই নীচের দিকে গাছগাছালির ভীড়। ফ্রান্সিসের পাশেই দাঁড়িয়েছিল হ্যারি। বলল–একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছে?
কী? ফ্রান্সিস ওর দিকে তাকাল।
ডানদিকের চুড়োটার মাথা ভাঙা।
হ্যাঁ, কেমন চ্যাপ্টা মতো।
ওটা আগ্নেয়গিরির মুখ। হ্যারি বলল।
এখন বোধহয় মৃত। ফ্রান্সিস বলল।
হতে পারে। তবে সেটা কাছে না গিয়ে বলা যাবে না।
ফ্রান্সিসের নির্দেশে জাহাজের পাল নামিয়ে ফেলা হলো। দাঁড়িরা দাঁড় বাওয়া বন্ধ। করল। ঘরঘর শব্দে নোঙর ফেলা হলো।
সবাইকে ডেক-এ আসতে নির্দেশ দিল ফ্রান্সিস। সবাই ডেক-এ এল। ফ্রান্সিস বলল–ভাইসব শুধু আমি আর বিস্কো ত্ৰিস্তান দ্বীপে যাবো। তোমরা সবাই জাহাজে থাকবে। দুচারজন আপত্তি তুলল। বলল–তোমরা মাত্র দুজন যাবে। এটা বিপজ্জনক। ফ্রান্সিস বলল–তা ঠিক। তবে আমি প্রথমে যুদ্ধে জড়াতে চাইছি না। আমরা দুজনেই ওদের হাতে ধরা দেব। ওরা নিশ্চয়ই আমাদের রাজার কাছে নিয়ে যাবে। তখনই জানতে পরবো ওদের উদ্দেশ্য কি? তাছাড়া যাকে মুক্ত করতে যাচ্ছি সেই মোকা কোথায় আছে সেটা জানতে পারবো। এ ছাড়া অন্য কোন পথ নেই।
ফ্রান্সিস থামলে হ্যারি বলল–যদি তোমাদের কাউকে ওরা মুক্তি না দেয়?
তখন তোমরা আমাদের মুক্ত করতে মারে। তিন দিনের মধ্যে আমরা যদি না ফিরি তখন তোমরা আক্রমণ করবে। ফ্রান্সিস থামল। আর কেউ কোনো কথা বলল না। বোঝা গেল, সকলেই ফ্রান্সিসের পরিকল্পনা মেনে নিল।
কিছুক্ষণ পরে ফ্রান্সিস আর বিস্কো তৈরী হয়ে এল। কিছু খাবার আর তরোয়াল নিল সঙ্গে। জাহাজ থেকে ঝোলানো পঁড়ি বেয়ে বেয়ে দুজনে একটা নৌকায় নেমে এল। দড়ি খুলে নৌকা ছেড়ে দিল। বিস্কো বৈঠা তুলে নিল। নৌকো বাইতে লাগল ত্রিস্তান দ্বীপের উদ্দেশ্য। ঢেউয়ের ঘায়ে নৌকা ওঠা-পড়া চলল। পরিষ্কার নীল আকাশ। আকাশ সমুদ্র জুড়ে ঝকঝকে রোদ।
ত্ৰিস্তান দ্বীপে যেখানে পৌঁছল সে দিকটায় বড় বড় গাছের জঙ্গল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে একটা ফাঁকা জায়গায় ওরা নৌকা ভেড়াল।
তীরে নেমে একটা বড় পাথরের সঙ্গে নৌকার দড়িটা বাঁধল। তারপর দুজনে এগিয়ে চলল। কয়েক পা এগিয়েছে তখনই জঙ্গল থেকে একদল ত্ৰিস্তান যোদ্ধা কাঠের বর্শা হাতে ওদের দিকে ছুটে এল। দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। যোদ্ধারা ওদের ঘিরেদাঁড়াল। ওদের মধ্যে সর্দার গোছের একজন ত্ৰিস্তান ভাষায় কী যেন জিজ্ঞেস করল। ফ্রান্সিসরাও কিছুই বুঝল না। ফ্রান্সিস কোমর থেকে তরোয়াল খুলে সামনের ঘাসে-ঢাকা জমিতে ফেলে দিল। বিস্কোও ফ্রান্সিসের দেখাদেখি তরোয়াল ফেলে দিল। তখন সদার গোছের একটা একজনকে কী বলল। সে ছুটে গিয়ে বনের মধ্যে থেকে একটা লতাগাছনিয়ে এল। পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে লতা দিয়ে ফ্রান্সিস আর বিস্কোর হাত বাঁধল। তারপর সর্দার চলার ইঙ্গিত করল। ওরা দুজন সদারের নির্দেশমতো হাঁটতে লাগল। একজন এদের তরোয়াল দুটো তুলে নিয়ে চলল।
কিছুটা এগোতেই বসতি এলাকা শুরু হলো। বাড়িগুলো সব কাঠ পাথর আর তাসক ঘাসের তৈরি। বাড়িগুলো থেকে ত্রিস্তান স্ত্রী-পুরুষ বা ছেলে-মেয়েরা বেরিয়ে এল। দেখতে লাগল বন্দী দুজনকে।
একটু পরেই চারিদিকে পাথরের দেয়াল-ঘেরা একটা বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। বাড়িটা বড় আর মজবুত। বোঝা গেল এটা রাজার বাড়ি।
পাথরের দেয়ালের মাঝখানে একটা উঠোন মতো। সেখানেই ফ্রান্সিস আর বিস্কোকে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। সামনেই গাছের ডাল ফালি করে তৈরী একটা সিংহাসন মতো। তাসক ঘাস আর পাখির বিচিত্র পালক দিয়ে তৈরী একটা বসবার আসন।
একটু পরেই দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় মতো একজন লোক বেরিয়ে এল। উপস্থিত ত্ৰিস্তানরা সকলেই মাথা নোয়াল। বোঝা গেল ইনিই রাজা। মোকার মতো এই রাজার গায়েও একটা কোহালহো। গলায় একটা বিনুনির মতো বাঁধা। কপালে গালে শরীরে উল্কি আঁকা। হাতে একটা সাপের মতো আঁকাবাঁকা লাঠি।
রাজার পেছনে পেছনে যে বৃদ্ধলোকটি বেরিয়ে এল তাকে দেখে ফ্রান্সিস অনেকটা নিশ্চিত হলো। বৃদ্ধটি সেই দোভাষী। অল্প অল্প স্পেনীয় ভাষা বুঝতে পারে বলতেও পারে। সে। একপাশের একটা পাথরেবসল। রাজা সিংহাসনে কসলে উপস্থিত সবত্ৰিস্তানরা বসল। রাজাহাতের বাঁ লাঠিটা ফ্রান্সিসদের দিকেইঙ্গিত করেতীরে কী বলে উঠলেন। রাজার শরীরের তুলনায় কণ্ঠস্বর ভীষণ সরু। ফ্রান্সিস সেই দোভাষী বৃদ্ধের দিকে তাকাল। বৃদ্ধটি এবার উঠে দাঁড়াল। রাজার দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে নিয়ে কী বলল। রাজাও কী বললেন। বৃদ্ধটি এবার ফ্রান্সিসদের দিকে তাকাল। বলল–মহামান্য রাজা-তোমরা-কেন?ফ্রান্সিসফলল-আপনারা অন্যায়ভাবে কঙ্কালদ্বীপের রাজাকে বন্দী করে এনেছেন। আমরা রাজা মোকার মুক্তির জন্যে এসেছি। বৃদ্ধটি বলল–রাজা–গিয়ানির মন্দির-যত রূপোর থাম-চাই-বিনিময়ে রাজা মোকা-। ফ্রান্সিস বুঝল রূপোর থামগুলোর ওপরই রাজার লোভ। বলল
ঠিক আছে-রাজা মোকার সঙ্গে আমাদের এই নিয়ে কথা বলতে দিন। মোকাকে রাজী করবার চেষ্টা করব।
বৃদ্ধটি রাজাকে তাই বলল। রাজা কী বলল যেন। কয়েকজন ত্ৰিস্তান যোদ্ধা এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস আর বিস্কোকে ধাক্কা দিয়ে চলবার নির্দেশ দিল। দুজনে নির্দেশমত চলল। ওদিকে রাজসভায় বিচারপ্রার্থী একজনকেরাজা কি যেন বলতে লাগল।
উত্রাই বেয়ে ফ্রান্সিসরা উঠতে লাগল। একবারে ন্যাড়া পাহাড়। শুধু পাথর আর ধুলো। ঘাসও জন্মায়নি সেখানে।
একটি বাড়ির সামনে এসে ত্ৰিস্তান যোদ্ধারা থামল। পাথয় আর তাসক ঘাসের ছাউনির ঘর। খণ্ড খণ্ড ডাল দিয়ে তৈরী দরজা। বুনো লতা দিয়ে বাঁধা। সেই বাঁধন খুলে একজন দরজা খুলল। ফ্রান্সিসদের ভেতরে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। ওরা দুজন ভেতরে ঢুকল। ত্রিস্তান কয়েকজনও ঢুকল।
বাইরের আলো থেকে ঘরে ঢুকে অন্ধকার লাগল। কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না ওরা। অন্ধকার চোখে একটু সয়ে এলে দেখল ঘরের মেঝেয় তিনি চারটে কাঠের খুঁটি পোঁতা। ত্রিস্তানরা ফ্রান্সিস আর বিস্কোকে দুটি খুঁটির কাছে নিয়ে গেল। তারপর বুনো লতা দিয়ে খুটির সঙ্গে হাত বেঁধে দিল। তারপর দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
ফ্রান্সিস এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরটা ভাল করে দেখছিল, তখনই নজর পড়ল একটা খাটের নীচে বন্দী একজন পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে আছে। ফ্রান্সিস চোখ কুঁচকে তাকাল বন্দীটির দিকে। চমকেউঠল–আরে মোকা। মোকাও তখন ফ্রান্সিসের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। এবার ফ্রান্সিসকে চিনতে পেরে হাসল। মোকার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। বেশ খারাপ হয়ে গেছে চেহারা; ফ্রান্সিস ডাকল-মোকা?
বলুন। মোকার কণ্ঠস্বরে হতাশা।
তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে।
মোকা কোন কথা না বলে ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল।
ত্রিস্তানদের রাজার সঙ্গে কথা হলো। রাজা বলছে তোমাদের গিয়ানির মন্দিরের রূপোর থামগুলো ওকে দিয়ে দিলেই ওরা তোমাকে মুক্তি দেবে।
জানি।
তুমি রূপোর থামগুলো দিয়ে দিও না।
মোক একটু ক্ষণ মাথা নীচু করে রইল। তারপর মুখ তুলল। ফ্রান্সিস সেই স্বল্প আলোয় দেখল মোকার চোখে জল। মোকা ভারী গলায় আস্তে আস্তে বলল–গিয়ানির পবিত্র মন্দিরের থাম–অসম্ভব। ওগুলো ত্ৰিস্তানদের দেবার আগে আমার যেন মৃত্যু হয়।
ফ্রান্সিস ও রকম উত্তর আশা করেনি। ও বুঝল গিয়ানি দেবতা আর তার মন্দিরের ওপর ইকাবোদের শ্রদ্ধাভক্তি কত গভীর। বলল–আমাকে মাফ কর মোকা। আমি ঠিক বুঝিনি। একটু থেমে বলল–কিন্তু এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কথাটাও তো ভাববে?
মোকা ম্লান হাসল। বলল-আমি নিজে না হয় এই বন্দীদশাতেই মারা গেলা। আমার প্রজারা তো বাঁচবে–গিয়ানির পবিত্র মন্দিরও থাকবে।
ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। বুঝলমুক্তির অন্য কোনো উপায় ভাবতে হবে।
ফ্রান্সিসদের বন্দীদশার দুদিন কাটল। ত্ৰিস্তানরা ওদের সারাদিনে দুবার খাবার দিয়ে যায়। বুনো ফলের তরকারী মতো আর সামুদ্রিক মাছ সেদ্ধ। খিদের জ্বালায় তাই খেয়েছে ওরা। তারপর নারকেলের মালায় চক চক করে জল খেয়েছে।
সেদিন বিকেলে সেই দোভাষী বৃদ্ধ ত্রিস্তানটি এল। রাজাইনাকি পাঠিয়েছে ফ্রান্সিসদের সিদ্ধান্ত জানতে। ফ্রান্সিস স্পষ্ট বলল–গিয়ানির দেবতার মন্দিরের থামের বিনিময়ে মোকা বাঁচতে চায় না। বৃদ্ধটি কথা শুনে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। ফ্রান্সিস বলল–রাজাকে গিয়ে বলুন–বিনা শর্তে আমাদের সবাইকে যেন মুক্তি দেন। নইলে আমাদের জাহাজ কাছে আছে। আমার বন্ধুরা তৈরী! কালকের মধ্যে আমাদের মুক্তি না দিলে আমার বন্ধুরা এই দ্বীপ আক্রমণ করবে। তখন আপনারা কেউ বাঁচবেন না। আমরা ভাইকিং। একমাত্র মৃত্যু হলেই আমরা অস্ত্র ত্যাগ করি তার আগে নয়। রাজাকেবলুন–আমরা অযথা রক্তপাত চাইনা।
বৃদ্ধটি ফ্রান্সিসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে চলে গেল।
বেশ রাত তখন। ঘরের কোণায় ম্যাকরে মাছের তেলের প্রদীপ জ্বলছে খুঁটিতে হাত বাঁধা অবস্থাতেই ফ্রান্সিসরা শুয়ে আছে মাটিতে। বিস্কো আর মোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজার বাইরে একটা পাথরের উপর একজন ত্ৰিস্তান পাহারাদার বসে আছে। ও ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। ফ্রান্সিস দেখল ওদেরই একটা তরোয়াল পাহারাদার কোলের ওপর রেখেছে। ও তরোয়ালটার দিকে তাকিয়ে রইল। ঈস্ একবার খোলা হাতে তোয়ালটা পেলে হঠাৎ একটা কানফাটা শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক লাল আলো ঝলসে উঠল বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে মাটি দুলে উঠল। ঘরটা একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল। দরজাসুন্ধু বাইরের পাথরের দেয়ালটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল পাহারাদারের ওপর। ওর কোল থেকে তরোয়ালটা ছিটকে গেল। মোকা আর বিস্কো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভীষণ দুলে দুলে উঠছে ঘরটা ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলল–আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে।
বিস্কো চেঁচিয়ে বলল–ফ্রান্সিস, আমার খুঁটিটা উপড়ে গেছে।
তাহলে শীগগির ভাঙা দরজার কাছে যাও। আলো এখনও নেভেনি। তরোয়ালটা খুঁজে বের কর। আমাদের বাঁধন কাটো তাড়াতাড়ি। ফ্রান্সিস দ্রুত বলে গেল।
আবার আলোর ঝলকানি। সেইসঙ্গে গুড় গুড় একটানা শব্দ। আবার মাটি দুলে উঠল। বিস্কো খুঁটিটা থেকে হাতটা খুলে নিল। কোনরকমে টাল সামলাতে সামলাতে ভাঙা দরজার কাছে গেল। প্রদীপের স্নান আলোয় দেখল পাথরের নীচে তরোয়ালের হাতলটা বেরিয়ে আছে। ও হাতলটা ধরে এক হ্যাঁচকা টানে তরোয়ালটা বের করে আনল। তারপর ছুটে এল ফ্রান্সিসদের কাছে। ওদের দুজনের হাতের বাঁধন কেটে দিল। নিজেরটাও কাটল। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলল বাইরে চলো শীগগির।
ওরা দ্রুত ছুটতে যাবেতখনই ঘরের একপাশের পাথুরে দেওয়াল শব্দ তুলে ভেঙে পড়ল। ঐ দেয়ালের দিকে ছিল মোকা। মোকা সরে আসতে আসতেও শেষ রক্ষা হলো না। একটা বড় পাথর গড়িয়ে মোকার ডানপায়ে এসে পড়ল। মোকা আর্তনাদ করে উঠল। তারপর বসে পড়ল। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলল–বিস্কো মোকার পায়ের দিকে ধরো।
বিস্কো ছুটে গিয়ে মোকার পায়ের দিকে ধরল। ফ্রান্সিস ধরল ওর মাথার দিক। তারপর সন্তপর্ণে ভাঙা দেয়ালের পাথর ডিঙিয়ে ওরা বাইরে চলে এল। ঠিক তখনই সমস্ত ঘরটা শব্দ তুলে ভেঙে পড়ল।
ওরা দুজনে মোকাকে কাঁধে নিয়ে ছুটল সমুদ্রতীরের দিকে। একবার পেছন ফিরে দেখল–সেই চ্যাপ্টা মাথা পাহাড়টারমাথা থেকে লক্ষ লক্ষ ফুলকির মতো আগুনের ফণা থেকে থেকে ছিটকে উঠছে আকাশের দিকে। সেই আলায় ত্রিস্তান দ্বীপ আলোকিত। বহুদূর পর্যন্ত সমুদ্রও দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। পাহাড়ের মাথা থেকে কালো ঘন ধোঁয়া বেরোচ্ছে গল গল করে! আকাশে অনেক দূর উঠে গেছে সেই ধোঁয়া।
পায়ের নীচে ধুলো পাথরভর্তিজমি দুলে দুলে উঠছে। হঠাৎ সামনেই একটা ফাটল দেখা গেল। ফাটল থেকে তোড়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ওরা ফাটল এড়িয়ে অন্যদিকে ছুটল।
আগ্নেয়গিরির মাথায় আগুনে-আলোর তীব্রতা কখনও বাড়ছে কখনও কমছে। ওরা বসতির কাছে এল। দেখল ত্ৰিস্তানদের অনেক বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। চিৎকার কান্নাকাটি শোনা গেল। কিছু ত্ৰিস্তান বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে দেখা গেল। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে আগ্নেয়গিরির দিকে মুখ করে। একবার দুহাত তুলছে। উবু হয়ে মাটিতে দুহাত রাখছে। আবার উঠে বসছে।
নেমে আসার পথে এখানে ওখানে ত্রিস্তান যোদ্ধাদের মুখোমুখি পড়ল ওরা। কিন্তু ত্রিস্তান যোদ্ধারা তখন নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত। ওদের দিকে চাইবার সময় কোথায়
আবার একটা ছোট ফাটল পড়ল। ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ওরা লাফিয়ে পার হলো। কাঁধে আহত মোকা। খুব জোরে ছুটতে পারছিল না ওরা।
ফ্রান্সিস আর বিস্কো সমুদ্রতীরে পৌঁছুল। কিন্তু নৌকো কোথায়? তীর ধরে খুঁজতে খুঁজতে জঙ্গলের আড়ালে একটা ক্যানো পেল। সেটাতেই উঠল ওরা। মোকাকে সাবধানে গলুইতে শুইয়ে দিল। আগ্নেয়গিরির মাথায় কখনও কখনও আগুনের আলোর তীব্রতা ঝলসে উঠছে। সেই আলোয় ফ্রান্সিস দেখল মোকার ডান পাটা বেশ জখম হয়েছে। রক্ত পড়ছে। সমুদ্রের জল হাত দিয়ে তুলে ক্ষতের জায়গাটা ধুয়ে দিল। ক্ষতে নোনা জল লাগাতে বোধহয় জ্বালা করে উঠল। মোকাও কঁকিয়ে উঠল। কোনো কথা বলল না।
এবার ফ্রান্সিস সমুদ্রের দিকে তাকাল। আগ্নেয়গিরির আলোয় যতদূর দেখা যাচ্ছে ওদের জাহাজ কোথাও নেই। ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো, আমরা দক্ষিণ ঘেঁষে এসেছি। দ্বীপের ধার ধার দিয়ে এবার উত্তর ঘেঁষে যাবো।
ফ্রান্সিস নৌকোর গলুইতে বৈঠা খুঁজল। পেল না। তখন নৌকোর ওপর বুক লাগিয়ে শুয়ে হাত দিয়ে জল ঠেলতে লাগল। সমুদ্রে তখন বাতাসের তেজ নেই। শান্ত সমুদ্র। ঢেউও ছোট ছোট। হাত দিয়ে জল ঠেলে নৌকো চালাতে লাগল ফ্রান্সিস। নৌকো দ্বীপ ঘুরে চলল। ফ্রান্সিস ডাকল–বিস্কোও তুমিও হাত লাগাও- বিস্কো ওর মত শুয়ে পড়ে হাত দিয়ে ঠেলতে লাগল। নৌকো চলল। কোথাও কোথাও সমুদ্রের জল ভুস ভুস করে উঠছে। ওরা সেগুলো পাশ কাটিয়ে চলল।
ফ্রান্সিস আগ্নেয়গিরির দিকে তাকাল। দেখল–এবার পাহাড়ের মাথা থেকে গলিত লাভার স্রোত নেমে আসছে। লাল হলুদ ধোঁয়া উঠছে গলিত লাভা থেকে।
ত্রিস্তান দ্বীপের পশ্চিমদিকের বাঁকটা পেরোতেই ওরা অস্পষ্ট দেখল দূরে ওদের জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। হাত দিয়ে জল ঠেলে ঠেলে ওরা জাহাজের দিকে নৌকো নিয়ে চলল।
ক্যানো নৌকো ঢেউ ভেঙে খুব আস্তে আস্তে চলছে। বিস্কো একবার চিৎকার করে উঠল-ও-হো-হো-। কিন্তু সেই চিৎকার জাহাজে গিয়ে পৌঁছল না।
হঠাৎ আগ্নেয়গিরিতে আর একবার অগ্নদগার ঘটল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে গায়ের জামাটা খুলে উঠে দাঁড়াল। জামাটা হাতে দিয়ে ঘোরাতে লাগল। এবার সমুদ্রে অনেকদূরে পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা গেল। জাহাজে ভাইকিংরা সবাই ডেক-এ এসে দাঁড়িয়ে আছে তখন। হ্যারিকে সবাই জিজ্ঞেস করছিল–আমরা কী করবো এখন?
হ্যারি দুহাত তুলে বলল–ফ্রান্সিস তিন দিন অপেক্ষা করতে বলেছিল। আমাকে ভাবতে দাও আর কেউ কোনো কথা বলল না।
হ্যারি ভুরু কুঁচকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ত্রিস্তান দ্বীপের দিকে। তখনই আগ্নেয়গিরিতে অগ্নদাগার হলো। সেই আলোয় হ্যারি নজরে পড়ল ক্যানো নৌকোটা। নৌকোয় দাঁড়িয়ে কে কাপড় নাড়ছে। হ্যারি চীৎকার করে বলল–ভাই সব, ফ্রান্সিসরা আনছে। ঐ দেখ ক্যানো নৌকো।
ততক্ষণে অনেকেরই নজরে পড়েছে ক্যানো নৌকোটায়। ওরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল-ও-হো-হো-।
ফ্রান্সিস আর বিস্কোও নৌকো থেকে চিৎকার করল–ও হো-হো-ওদের চিৎকার জাহাজ থেকে শোনা গেল না।
নৌকোর আসার গতি দেখে হ্যারির মনে সন্দেহ হলো। এত আস্তে আসছে কেন নৌকোটা? ও কয়েকজন ভাইকিংকে ডাকল। বলল–নৌকো নামাও। ওদের নৌকো নিয়ে এসো।
তখনই কয়েকজন ভাইকিং দড়ি বেয়ে নেমে এল নৌকোর ওপর। তারপর দুটো নৌকো চলল ফ্রান্সিসদের নৌকো লক্ষ্য করে।
ভাইকিংরা ফ্রান্সিসদের নৌকোটা ওদের একটা নৌকোর সঙ্গে বাঁধল। তারপর দ্রুত চলল জাহাজের দিকে।
ফ্রান্সিসরা যখন জাহাজের ডেক-এ উঠল তখন বন্ধুদের মধ্যে আনন্দের বান ডাক যেন। ফ্রান্সিস বিস্কো অক্ষত দেহেই ফেরেনি শুধু মোকাকেও মুক্ত করে এনেছে।
মোকাকে ধরাধরি করে কেবিন ঘরে শুইয়ে দেওয়া হলো। জাহাজের বৈদ্য কাঁচের বোয়ামে ওষুধপত্র নিয়ে এল। মোকার ক্ষত পরীক্ষা করে ওষুধ দিল। মোকা ঘুমিয়ে পড়ল। জাহাজ আবার রওনা হল কঙ্কালদ্বীপের উদ্দেশ্যে।
এবার শুরু হলো ফ্রান্সিসের রূপোর নদী খোঁজা। অনেক অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু রূপোর নদীর হদিস পায়নি। সেই নদী খুঁজে বের করতে হবে।
কঙ্কালদ্বীপে ফ্রান্সিস আর হ্যারি ইকাবোদের দেওয়া একটা ঘরে আস্তানা নিয়েছে। প্রায় সারাদিনই ওরা দ্বীপটা ঘুরে বেড়ায় যদি রূপোর নদীর কোনো হদিস মেলে। দ্বীপটা নেহাৎ ছোট নয়। কাজেই চার-পাঁচ দিন লেগে গেল সমস্ত দ্বীপ ঘুরে ফিরে দেখতে।
বসতি এলাকায় ওরা যখন ঘুরে বেড়ায় ইকাবোরা মাথা নুইয়ে ওদের শ্রদ্ধা জানায়। ফ্রান্সিস আর হ্যারি ইকাবোদের বাচ্চা ছেলেমেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করে। ইকাবোরা খুব খুশী হয়।
সেদিন ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–চলো গিয়ানির মন্দিরটা দেখে আসি। ওটা ভালো করে দেখা হয়নি।
দুজনেই বেরোল মন্দিরটার উদ্দেশ্যে।
কঙ্কাল পাহাড়ের মাথার নীচেইদক্ষিণ দিকে সেই মন্দিরটা। এদিকটায় ইকাবোদের বসতি কম। ওরা ঘুরে ঘুরে মন্দিরটা দেখতে লাগল। মন্দিরটা চারকোণা। গাছের ডাল, তাসক ঘাস আর নারকেল পাতা দিয়ে বোনা ছউনি মন্দিরের চারটে চৌকোণা থাম রূপোর। বেশ মোটা রূপোর থামগুলো।
তাছাড়া মন্দিরের সামনে অর্ধগোলাকারভাবে সাজানো ছটা রূপোর থাম। হাত দিয়ে দেখল, বেশ মোটা নিরেট রূপোর তৈরী থামগুলো। তাতে লতাপাতা আঁকা নানা
কারুকার্য। ওখানে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস মুখ উঁচু করে পেছনে তাকাল। দেখল কঙ্কালের মাথার পেছনটা। এবার দক্ষিণমুখে তাকাল। দেখল বাঁ দিকে একটা নদী বয়ে চলেছে। জলের রঙ। হলুদ। ফ্রান্সিসের মনে পড়ল বন্দীদশা থেকে পালানোর সেই ঘটনা। সেদিন ওরাই পাথরের পাতলা আস্তরণ ভেঙে এই নদীটাকে মুক্তি দিয়েছিল। নদীটা সেই গুহা থেকে বেরিয়েছে।
ডানদিকে শুধু বনজঙ্গল। বনজঙ্গল খুব ঘন নয়। ছাড়া ছাড়া।
মন্দিরের ভেতরে অন্ধকারে দেখল কাঠের খোদাই করা গিয়ানি দেবতার মূর্তি। অনেক ইকাবো এসেছে বুনো ফুল ফল দিয়ে গিয়ানির পূজো দিতে।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখল। তারপর নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল।
সন্ধ্যেবেলা বিস্কো এল। বলল–ফ্রান্সিস, একবার জাহাজে এস।
কেন? কী হলো?
বন্ধুদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
হুঁ।
ওরা আর এখানে থাকতে চাইছে না। অনেকদিন হয়ে গেল–দেশে ফিরে যেতে চাইছে।
রাত্রে আমি জাহাজে যাবো। সবাইকে ডেক-এ থাকতে বলবে।
বেশ। বিস্কো চলে গেল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি চলল রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। পথেইকাবোদের সঙ্গে দেখা হলে তারা মাথা নুইয়ে ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে সম্মান জানাতে লাগল।
রাজবাড়ির ভেতরের ঘরে ঢুকে ওরা দেখল মোকা প্রদীপের আলোয় কী করছে। ওরা কাছে যেতে মোকা হেসে বলল–আসুন।
পা কেমন আছে?
ভাল। মোকা বলল।
ওরা দেখল মোকা ওর গায়ের কোহালহোর মতো একটা কাপড়ে কী আঁকছিল। গাছের ডাল থেঁতো করে তুলির মতো বানিয়েছে। ওরা যে পাথর গুঁড়ো করে রঙ বানায় শরীরে মুখে উল্কি আঁকার জন্য, তেমনি রঙ একটা চ্যাপ্টা পাথরে রাখা। হ্যারি জিজ্ঞেস করল–ছবি আঁকছো?
হ্যাঁ, বলতে পারেন ছবিই। জানেন তো আমাদের মুখের ভাষা আছে কিন্তু আপনাদের মতো কোনো অক্ষর নেই। আপনাদের জাহাজে থাকার সময় কিছু চামড়ার বই আমি দেখেছি। তখনই ভেবেছি আমাদের ভাষায় লিখিত অক্ষর তৈরী করবো। সেইসব অক্ষর তৈরী করছি।
হ্যারি আর ফ্রান্সিস কথাটা শুনে খুশী হলো। হ্যারি মোকার কাঁধেই চাপড় দিয়ে বলল-এই তো কাজের মতো কাজ। আমি আসবো। এই ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করবো।
তাহলে তো খুবই ভালো হয়। মোকা হেসে বলল।
হ্যারি বলল–অক্ষরগুলো তৈরী করতে খুব কল্পনার আশ্রয় নিও না। তোমরা মুখে গায়ে যে উল্কি আঁকো সেই রূপগুলো দিয়ে অক্ষর তৈরী করো। ইকাবোদের কাছে সেসব সহজবোধ্য হবে। পরিচিত উল্কির রূপ দেখে ওরা তাড়াতাড়ি অক্ষর চিনতে পারবে।
ভালো কথা বলেছেন। মোক বলল–আমি এদিকটা আগে ভাবিনি।
মোকা আর হ্যারি অক্ষর তৈরীর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে লাগল। ফ্রান্সিস চুপ করে কিছুক্ষণ ওদের কথা শুনল। তারপর একসময় বলল–হ্যারি,এখন ওসব আলোচনা রাখো। মোকার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
বেশ বলো।
ফ্রান্সিস মোকাকে বলল–দেখ মোকা, আমরা সারা কঙ্কাল দ্বীপ যথাসাধ্য ঘুরে ঘুরে দেখেছি। কিন্তু রূপোর নদীর কোন হদিস করতে পারছি না।
অনেকেই চেষ্টা করেছে। বাবাও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি। মোকা বলল।
আচ্ছা–রূপোর নদীর সম্বন্ধে তোমার বাবা কী বলতেন? সত্যিই কি রূপোর নদী ছিল?
বাবা বিশ্বাস করতেন যে রূপোর নদী ছিল। বাবা আমাকে একদিন বলেছিলেন যে তিনি নাকি ঠাকদার মুখে শুনেছেন–রূপোর নদী বেরিয়েছে কঙ্কালের জটা থেকে।
ফ্রান্সিস চমকে উঠলো। কঙ্কালের জটা মানে কঙ্কালের মাথার পেছন দিক। সেদিকে একটা নদী তো ওরাই গুহা থেকে বের করে দিয়েছিল। কিন্তু সে নদীর জলতে হলদেটে। সেটায় কি রূপোর গুঁড়ো আছে? দেখতে হয় তাহলে।
আর কিছু বলতেন তোমার বাবা?
না। শুধু ঐ কথাই একদিন বলেছিলেন।
তোমার কী মনে হয়?
দেখুন, ঐ নিয়ে আমি ভাবি না। রূপ তত খাদ্য নয় যে ইকাবোরা খাবে। উত্তরের বন অনেকখানি পুড়ে গেছে। জন্তু-জানোয়ার, পাখি মারা গেছে। কিছু দিনের মধ্যে আমার প্রজাদের খাদ্যাভাব দেখা দেবে। আমি ঐ নিয়েই ভাবছি এখন।
কথাটা শুনে ফ্রান্সিস খুব খুশী হলো। একজন দায়িত্ববোধসম্পন্ন রাজার মতোই মোকার চিন্তা। ফ্রান্সিস বলল–তোমাকে আর বিরক্ত করবো না। চলি।
দুজনে ফিরে এল।
একটু রাতহতে ফ্রান্সিস আর হ্যারি নৌকো বেয়ে চলল জাহাজের দিকে। আজকে জ্যোৎস্না আরও উজ্জ্বল। সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় জ্যোত্সা চিকচিক করছে। শান্ত হাওয়া বইছে।
ওরা যখন জাহাজের ডেক-এ উঠল–দেখল সবভাইকিংরা উপস্থিত। বসে দাঁড়িয়ে সবাই ফ্রান্সিসের জন্যে অপেক্ষা করছে।
ফ্রান্সিস একবার সকলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগল–ভাইসব–যাত্রা শুরু করবার আগেই আমি বলেছিলাম অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করবার জন্যে আমাদের তৈরী থাকতে হবে। আমরা এখানে চড়ইভাতি করতে আসিনি। রূপোর নদী খুঁজে বের করবার সংকল্প নিয়ে এসেছি। অবশ্য কষ্ট লড়াইয়ের দিন শেষ হয়েছে। এখন বুদ্ধির জোরে এগোতে হবে। তার জন্যে তোত প্রয়োজন পড়বে হয়তো। কিন্তু সেটা পরে। এখন তো তোমাদের আনন্দেই দিন কাছে। তবে অধৈর্য হয়ে উঠছো কেন? ফ্রান্সিস থামল। কেউ কোনা কথা বলল না। ফ্রান্সিস আবার বলতে লাগল–যা হোক আমাদের বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না। রূপোর নদীর হদিস পেতে আর দেরী নেই। কব্জির লড়াইয়ের দিন শেষ। এখন বুদ্ধির লড়াই চলছে। এ সময়ে তোমরা দেশে যাবো এই বলে ঝামেলা বাড়িও না। এভাবে আমার মনের একাগ্রতা নষ্ট করো না। এটা আমার আদেশ নয়–অনুরোধ। ব্যা–আর আমার কিছু বলবার নেই। ফ্রান্সিস থামল কেউ কোনো কথা বলল না।
হ্যারি বলল–যদি কারো কিছু বলার থাকে বলো। পরে যেন বাড়ি ফেরার বায়না তুলে ঘোঁট পাকিও না।
একজন ভাইকিং বলল ফ্রান্সিস একটা কথা তুমি কি বিশ্বাস করো রূপোর নদী বলে কিছু আছে?
অবশ্যই। ফ্রান্সিস বলল যেমন তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। কথা বলছো এটা সত্য, তেমনি রূপোর নদী আছে এটা সত্য।
কবে নাগাদ এই রহস্য ভেদ করতে পারবে?আর একজন ভাইকিং বলল।
সেটা নির্ভর করছে রহস্যের সূত্রগুলোর ওপর। তবে যতদুর মনে হয় সপ্তাহখানেকের মধ্যেই এই রহস্যের একটা সমাধানে পৌঁছুতে পারবো।
আর কেউ কোনো কথা বলল না। সভা ভেঙে গেল।
পরদিন সকালে ফ্রান্সিস হ্যারিকে ডেকে বলল–চলো আজকে কঙ্কাল পাহাড়টা ভালো করে দেখবো। ওটার মাথায় ওঠা যায় কিনা সে চেষ্টা করবো। অবশ্য প্রথমে দেখবো হলুদ জলের নদীটা।
দুজনে বেরোল। সকালের ঝকমকে রোদে-ছাওয়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরের দিকে চলল। হলুদ জলের নদীটার কাছে এল। ফ্রান্সিস নদীটা ভালো করে দেখতে লাগল। নদীর দুধারে হলুদ রঙের স্তর জমে গেছে। ও কোমরের ফেট্টি থেকে একটুকরো বড় ন্যাকড়া বের করল। নদীর জল একটা নারকেলের মালা দিয়ে তুলে ন্যাকড়ায় ছাঁকল। বেশ কয়েকবার। দেখা গেল ন্যাকড়ায় হলুদ স্তর জমে আছে। ফ্রান্সিস সেই স্তর আঙুল দিয়ে ঘেঁটে দেখে হতাশার ভঙ্গীতে ঘাড় নাড়ল। ও রূপোর গুঁড়ো আশা করেছিল। দেখল–অেন কোনোকিছুর চিহ্নমাত্র নেই।
এবার দুজনে চলল কঙ্কাল পাহাড়ের দিকে। চড়াই হয়ে উঠতে লাগল দুজনে। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল। পাহাড়টার মাথাটা নরকঙ্কালের মাথার মতো। চোখের একটা বড় গর্তও তাতে। আর একটা গর্ত অর্ধেকটা আছে। বাকীটা ভেঙে ধসে গেছে। হ্যারি সব দেখতে দেখতে বলল–জানো, আমার কেমন সন্দেহ, এই মাথার পুরোটাই প্রকৃতির খেয়াল নয়। মোকাদের পূর্বপুরুষরা এই মাথার চোখ দুটো পাহাড় কুঁদে করেছে।
ফ্রান্সিস ভালো করে দেখল চোখ দুটো। সত্যি সমান দূরত্বে দুটো গহ্বর। প্রকৃতির খেয়াল নাও হতে পারে।
ফ্রান্সিস মাথাটার দিকে তাকাল। তিন দিকই ঢালু। ওঠার উপায় নেই। একমাত্র যে চোখের গর্তটা ধসে গেছে সেখান দিয়েই ওঠা যেতে পারে। সেদিকে পরপর ভাঙা পাথর ছড়ানো। বোধহয় ভূমিকম্পেই এটা হয়েছে।
ফ্রান্সিস পশ্চিম দিকের ঐ ধসা জায়গাটায় এল। ভালো করে ছড়ানো পাথরগুলো দেখল। একটা দুটো করে পাথরে পা রেখে ওপরে উঠতে লাগল। চোখের গর্ত ছাড়িয়ে কপালের কাছে উঠে এল। আর ওঠার উপার নেই। ও লক্ষ্য করল কয়েকটা খোঁদল রয়েছে মাথার দিকে। সেগুলোতে পা রেখে রেখে একসময়ে ফ্রান্সিস বুক দিয়ে ঘষটে ঘষটে পাহাড়ের মাথায় পৌঁছল। পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছে। উত্তর দিকেইকাবোদের বসতি কুনহা নদী, বনজঙ্গল সমুদ্র। দূরে ওদের জাহাজ।
এবার বুক চেপে আস্তে আস্তে দক্ষিণমুখো হলো। ঠিক নীচেই গিয়ানির মন্দির। ছটা রূপোর থাম। বাঁদিকে হলুদ জলের নদী বয়ে যাচ্ছে। বনজঙ্গল। তার পরেই সমুদ্র।
হঠাৎ এই দৃশ্যটা ওকে নাড়া দিল। ও চমকে ভালো করে তাকাল। ঠিক এমনি একটা ছবি ও কোথায় দেখছে। বাঁদিকে হলুদ নদী। সবুজ গাছের নক্সা। সারি সারি। ডানদিকে কী যেন একটা? হ্যাঁ সাদা রঙের নদী। কিন্তু এখানে সেটা নেই। কোথায় দেখেছি–এমনি নক্সা ছবি? কোথায়? হ্যাঁ হ্যাঁ-রাজা মোকার গায়ের কাপড়টা–কোহালহো, জাহাজে রোদ্দুরে শুকোচ্ছিল। ফ্রান্সিস চীৎকার করে উঠল–কোহালহো।
হ্যারি নীচ থেকে বলল–কী হয়েছে?
ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলল–রূপোরনদীর রহস্য–ভেদ করেছি। চলো মোকার কাছে।
ফ্রান্সিস দ্রুত পাহাড়ের মাথা থেকে নামতে লাগল। হঠাৎ খোঁদল থেকে পা পিছলে গেল। পড়তে পড়তেও টাল সামলাল। উত্তেজনায় ওর সারা শরীর তখন কাঁপছে। ও সাবধান হলো মাথা ঠাণ্ডা করে আস্তে আস্তে নামতে লাগল।
নীচে নেমেই ডাকল–হ্যারি, শিগগির এসো বলে ছুটল রাজবাড়ির দিকে। পেছনে হ্যারিও ছুটল।
রাজবাড়ির সামনের চত্বরে তখন বিচারসভা বসেছে। মোকা কোহালহো গায়ে দিয়ে কাঠের সিংহাসনে বসে আছে। সামনে একদল ইকাবো দাঁড়িয়ে আছে।
ফ্রান্সিস ছুটে গিয়ে মোকার সামনে দাঁড়াল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–মোকা এখন তোমার বিচারসভা বন্ধ কর। জরুরি কথা আছে।
কী ব্যাপার ফ্রান্সিস? মোকা বেশ আশ্চর্য হলো।
বলছি। তুমি ইকাববাদের যেতে বল।
মোকা ওদের ভাষায় কিছু বলল। ইকাবোরা মোকাকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে চলে গেল।
ফ্রান্সিস বলল–মোকা, মনে হচ্ছে রূপোর নদীর হদিস পেয়েছি।
মোকার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
মোকা জিজ্ঞাসা করলো,–কোথায় তার হদিস পেলে? যা আমাদের পূর্বপুরুষরা খোঁজ করে পায়নি।
ফ্রান্সিস বলল,-সবচাইতে আশ্চর্যের জিনিস কি জানো? রূপোর নদীর হদিশের নক্সা তোমরা বংশপরম্পরায় বহন করে চলেছে।
ফ্রান্সিস আবার বলল–মোকা–তোমার গায়ের কোহালহোটা সিংহাসনের ওপর মেলে দাও। ভাঁজ খুলে।
মোকা আরো আশ্চর্য হলো। তবু ফ্রান্সিস বলছে। কাজেই কোনো কথা না বলে গলায় নারকেলের দড়ি দিয়ে বাঁধা কোহালহোটা খুলে সিংহাসনের উপর মেলে দিল। সেই নক্সার ছবিটা। কঙ্কাল পাহাড়ের মাথা থেকে ফ্রান্সিস ঠিক এই ছবিটাই দেখেছে। শুধু দুটি জিনিষ নেই। গিয়ানির মন্দিরের একটা থাম আর ডানদিকে নদীর ধারাটা। একটা থাম পাঞ্চোরা চুরি করে নিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল–দেখ তোমরা, আমি ছবির নক্সাগুলোর নাম দিচ্ছি। তাহলেই বুঝতে পারবে।
ফ্রান্সিস একে একে ছবিগুলোর নাম দিতে থাকল। তারপর একসময় নাম দেওয়া শেষ হলো;
ফ্রান্সিসের দেওয়া নাম দিয়ে ছবির নক্সাটা দাঁড়াল এরকম :
হ্যারি আর মোকা ঝুঁকে পড়ে নক্সা-ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখল। হ্যারি বলল–কিন্তু রূপোর নদী কোথায়?
ফ্রান্সিস হাসল। বলল–ডানদিকে যে নদীটা চলে গেছে দেখ ওটা সাদা রঙের আঁকা। ওটাই রূপোর নদী।
কিন্তু কোনো নদীই তো ওদিকে নেই।
অতীতে ছিল। ভূমিকম্পে বা প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয়ে সেই নদীর উৎসমুখ বন্ধ হয়ে গেছে।
এখন কী করবে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
সেই উৎসমুখটা খুলে দিতে হবে। তার জন্যে সকলের সাহায্য চাই। আমরা আর ইকাবোরা মিলে সেই উৎসমুখ খুলে দেব।
মোকা বলল–কিন্তু সেই নদী থেকে কি রূপো পাওয়া যাবে?
নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর হ্যারির দিকে ফিরে বলল–হারি চলো৷ কঙ্কালের বাঁ চোখের কাছে পশ্চিমদিকে যে ধস দেখা যায় সেদিকটা আমায় খুঁটিয়ে দেখতে হবে। রূপোর নদীর উৎস ওখানেই চাপা পড়েছে।
দুজনে উঠল। মোক বলল-চলুন, আমিও যাবো।
ওরা চড়াই পেরিয়ে কঙ্কাল পাহাড়ের মাথার কাছে পৌঁছল। দেখল কঙ্কালের বাঁ চোখের কাছ থেকে পাথরের ধস নেমেছে। ফ্রান্সিস ভাঙা পাথর ধুলোবালির স্তূপ ভালো করে দেখতে লাগল। হঠাৎ নজরে পড়ল নীচে একটা খুব সরু জলধারা নেমে গেছে। ও বলে উঠল–দেখ তোমরা–এখানে কোথাও নিশ্চয়ই জমা জলের স্তর আছে। নইলে ঐ সরু ঝর্ণা থাকত না।
ঐ সরু ঝর্ণাই অনেকদিন থেকে দেখছি আমরা। তবে মাঝে মাঝে ওটা শুকিয়ে যায়। বলল মোকা।
হতে পারে। ফ্রান্সিস বলল–তবু এই জায়গাই আমাদের খুঁড়তে হবে। হ্যারি কাল সকাল থেকেই আমরা খোঁড়ার কাজ শুরু করবো। তুমি জাহাজে বন্ধুদের খবর দিয়ে এসো। মোকা–তুমি ইকাবোদের বলে তারা যেন আমাদের সাহায্য করে।
মোকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
ফ্রান্সিস ও জায়গাটায় দাঁড়িয়ে হ্যারি আর মোকাকে কাছে ডাকল। বলল–ঠিক আমার দৃষ্টি বরাবর নীচের দিকে তাকিয়ে দেখ। কল্পনা কর ঐ নক্সা-ছবির মতো একটা নদী বয়ে গেছে। স্পষ্ট সেই ধারার গতিপথটা দেখতে পাবে। লক্ষ্য করে দেখ সেই গতিপথে শধু ধুলোবালি আর পাথর। কোন গাছ জন্মায় নি।
গাছ জন্মায়নি কেন? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই ওখানে রূপোর স্তর জমেছিল। রূপোর স্তরে গাছ জন্মাবে কী করে? ওপরের মাটিতে কিছু ঘাস জন্মেছে শুধু।
ওরা ফিরে এল।
সেইদিনই খবরটা রটে গেল–রূপোর নদীর হদিস পাওয়া গেছে। খুঁজে বের করা হবে নদী।
সকাল থেকেই দলে দলে ইকাবো মেয়ে পুরুষ বাচ্চা ছেলেমেয়েরা জড়ো হলো সেখানে। কিছু পরে হ্যারি ভাইকিংদের জাহাজ থেকে নেমে এল। সঙ্গে আনল গাঁইতি, কুড়ুল, কাছি আর হাতুড়ি।
ফ্রান্সিস, আর মোকা এসে পড়েছে তখন। ফ্রান্সিস জায়গা নির্দিষ্ট করে দিল।
শুরু হলো পাথরের স্তূপ সরানোর কাজ। ইকাবোরাও হাত লাগাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাথরের স্তূপসরাতে দেখা গেল একটা গুহার মুখ। গুহার নীচের দিকটার পাথরের স্তর ভেজা। ফ্রান্সিস বুঝল কাছেই কোথাও জল আছে। সেই জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে জায়গাটা ভিজিয়ে দিয়েছে।
গুহায় ঢুকল ফ্রান্সিস। সঙ্গে বিস্কো আর হ্যারি। বাইরের আলো অল্পই আসছে। বেশ অন্ধকার অন্ধকার ভাব।
একটু এগোতেই ফ্রান্সিস দেখল–একটা বড় গহুর নেমে গেছে। ফ্রান্সিস পেছনে দাঁড়ানো বিস্কোকে বলল–কাছি আর একটা জ্বলন্ত মশাল আনন। কাছিটা ঝুলিয়ে দাও।
বিস্কো নিয়ে এল সেসব। ফ্রান্সিস মশালটা হাতে নিয়ে ঝোলানো কাছি ধরে ধরে নামতে লাগল। এক মানুষসমান নামতেই পায়ে ঠেকল একটা পাথরের চাই। ও দেখল এই পাথরের চাঁইটা গহ্বরের মুখটা বুজিয়ে দিয়েছে। হয়তো ওপর থেকে পড়েছিল। পাথরের চাঁইটা ভেজাভেজা। তার মানে নীচে জল আছে।
ফ্রান্সিস মুখ তুলে বলল–বিস্কো, কয়েকজনকে নামতে বলল। এই পাথরের চাঁইটা ভাঙতে হবে।
মশালটা পোঁতা হলো পাথরের খাঁজে। ফ্রান্সিস একটা চুনা পাথরের টুকরো দিয়ে চাঁইটার মাঝবরাবর দাগ দিল। সবাইকে বলল–এই দাগ বরাবর ঘা মারো, যত জোরে পারো।
পাঁচ ছজন কাছি ধরে নামলো। শুরু হলো পাথরের চাইটার ওপর গাঁইতি, কুড়ুল আর বড় বড় হাতুড়ি চালানো। গাঁইতি কুড়ুলের ঘা পড়তে লাগল পাথরের ওপর। আগুনের ফুলকি ছিটকোতে লাগল।
একদল পরিশ্রান্ত হলে অন্য দল নামছে। এইভাবে ঘা মারা চলল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল ঘা মারা।
হঠাৎ পাথরের চাঁইটা ফেটে গেল। যারা হাঁতুড়ি গাঁইতি চালাচ্ছিল ওটার ওপর দাঁড়িয়ে তারা কিছু বোঝার আগে পাথরের চাঁইয়ের একটা অংশ ভেঙে পরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তোড়ে জল উঠতে লাগল। মুহূর্তে গহুরটা জলে ভরে গেল। যারা গাঁইতি, হাতুড়ি চালাচ্ছিল তারা কাছি ধরে একে একে উঠে এল। জল গুহার মুখ দিয়ে ছুটল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে, আশ্চর্য! জল সাদাটে। পরিষ্কার। গুহা থেকে জল বেরোতে দেখে বাইরে দাঁড়ানো সবাই উল্লাসে চিৎকার করে উঠল।
মশাল নিভে গেছে। ফ্রান্সিস প্রায় অন্ধকারে জলভরা গহ্বরটায় নামল কাছি ধরে। এক ডুব দিয়ে দেখল পাথরের চাঁইয়ের একটা অংশ ভেঙে উল্টেযাওয়াতে অন্য পাথরের চাইটাও আলগা হয়ে গেছে। ও জল থেকে মুখ তুলল। কিছুক্ষণ শ্বাস নিল। তারপর দম বন্ধ করে আবার ডুব দিল। হাতের কাছিটা সেই আলগা চাঁইটার চারিদিকে বাঁধল। এটা করতে তিন-চারবার ওকেডুব দিতে হলো জলে। মুক্তোর সমুদ্রে যাবার আগেও অনেকক্ষণ জলে ডুবে থাকার অভ্যাস করেছিল। সেটা কাজে লাগাল। এবার উঠে এল। সবাইকে বলল-চলো সব গুহার বাইরে। ওখান থেকে আমরা কাছি ধরে টানবো। চাইটা তাহলেই কাত হয়ে যাবে, আরো জল উঠবে তখন। সেই জলের তোড়ের সামনে আমরা হয়তো ভেসে যেতে পারি।
সবাই গুহার বাইরে এল। শুরু হল কাছি টানা। একটু পরেই পাথরের চাঁইটা কাত হয়ে গেল। বেশ জোরে গুহার মুখ থেকে জলের ধারা বেরিয়ে এল। বাইরে নুড়ি পাথরের ধুলোবালি সব ভাসিয়ে নিয়ে চলল। এবার জলধারা একটা নদীর চেহারা নিল। সবাই গুহার মুখ থেকে সরে দাঁড়াল।
জলে ভেজা কাপড়-চোপড় নিয়ে ফ্রান্সিস একটা পাথরের ওপর বসল। কিন্তু এত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে যে বসে থাকতে পারল না। শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল। যারা এতক্ষণ গাঁইতি কুড়ল চালাচ্ছিল তারাও এখানে ওখানে বসে পড়ল, কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। ইকাবোরা তখনও আনন্দে হৈ হৈ করছে।
ওদিকে রূপোর নদীর ধারা বয়ে চলেছে সমুদ্রের দিকে। নুড়ি পাথর ধুলোবালির মধ্যে দিয়ে।
একসময় ফ্রান্সিস হ্যারিকে ডাকল। হ্যারি এল। ফ্রান্সিস বলল–নদীটার জলের রঙ দেখেছো?
হ্যাঁ সাদাই।
একটা ন্যাকড়ার জল নিয়ে হেঁকে দেখ তো কিছু তলানি পড়ে কিনা।
কিছুক্ষণ পরে হ্যারি ফিরে এল। হেসে বলল সাবাস ফ্রান্সিস। তোমার অনুমানই ঠিক। ন্যাকড়ায় গুড়ো গুঁড়ো রূপোর আস্তরন পড়েছে। অবশ্য খুব অল্প।
হতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল দীর্ঘদিন ধরে নদীর নীচে এই স্তর পুরু হয়ে জমত। তাই থেকেই ইকাবোরা রূপো তুলতে।
সন্ধ্যে হয়ে গেল। ভাইকিংরা জাহাজে ফিরে গেল। ইকাবোরা নিজেদের বসতিতে। ফ্রান্সিস ও ব্যারি নিজেদের আস্তানায়।
পরদিন। একটু বেলা হয়েছে তখন। ফ্রান্সিসের সবে ঘুম ভেঙেছে। হ্যারি উঠে পড়েছে। মুখ ধুচ্ছে।
হঠাৎ মোকা ছুটতে ছুটতে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,শিগগির দেখবেন আসুন।
কী হয়েছে ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।
রূপোর স্তর পাওয়া গেছে।
সত্যি? হ্যারি চমকে উঠল।
ফ্রান্সিস হাসল-ঐ নদীই আসল রূপোর নদী। কুনহা নয়। ওরা আর দেরী করল না দ্রুত পায়ে চলল নদীর দিকে।
সত্যিই রূপোর স্তর। নদীর জল ওপরের ছোট পাথর ধুলো-বালি মাটি সরিয়ে দিয়েছে। বড় বড় কিছু পাথর পড়ে আছে। সেসবের আড়ালে নীচে রুপোর স্তর দেখা যাচ্ছে। গুহা সামনেই সেই স্তরটা স্পষ্ট দেখা গেল। প্রায় এক হাত পুরু নিরেট রূপোর আস্তরণ দেখা গেল। তারপর থেকে পাথর জমা। ওগুলোর নীচটা এখনও পরিষ্কার হয়নি।
এত রূপো? এ যে কল্পনাতীত। মোকা চীৎকার করে বলে উঠল।
মোকা–নইলে মন্দিরের অতগুলো থাম নিরেট রূপোর তৈরি হলো কি করে? ফ্রান্সিস বলল।
–তবে একটা কথা। তোমাদের কুনহা নদীটা শুকিয়ে যাবে।
–বলেন কি? মোকা আশ্চর্য হল।
–হ্যাঁ। কারণ আমার যতদূর মনে হয় অতীতে কোন সময় কঙ্কাল দ্বীপে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়েছিল। তাতে রূপোর নদী আর হলুদ জলের নদীর উৎস গলিত লাভা পাথরের ধ্বংসের নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। তখনই সৃষ্টি হয়েছিল কুনহা নদী। অন্য এক উৎস থেকে। এখন রূপোর নদী আর হলুদ জলের নদী মুক্ত হয়েছে। তার ফলে অতীতের কঙ্কাল দ্বীপের ভৌগোলিক বিন্যাস আবার অতীতের রূপ নিয়েছে। কুনহা নদী আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে। থাকবে শুধু রূপোর নদী আর হলুদ জলের নদী। অবশ্য এগুলো নামেই নদী। আসলে একটা বড় আকারের ঝর্ণা।
–আচ্ছা হলুদ নদীতে রুপোর গুঁড়া নেই কেন? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
–তার কারণ দুটো নদীরই উৎস এক হলেও রূপোর নদী রূপোর গুঁড়ো মেশানো পাথরের স্তরের মধ্যে দিয়ে এসেছে। কিন্তু হলুদ জ্বলের নদী এসেছে গন্ধকের স্তরের মধ্য দিয়ে। তাই নদী দুটোর জলের রংএও পার্থক্য রয়েছে।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি নিজেদের আস্তানায় ফিরে চলল। ইকাবোরা তখনও রূপোর নদীর দুধারে দাঁড়িয়ে চীৎকার করছে।
জাহাজ থেকে ভাইকিংরা আনন্দে হৈ হৈ করে এল। রুপোর নিরেট আস্তরণ দেখে হতবাক। মাঝে মাঝেই ওরা চিৎকার করে উঠতে লাগল–ও হো-হো।
রাত তখন গভীর। নিজেদের আস্তানা তাসক ঘাস বিছানো বিছানায় ফ্রান্সিস আর হ্যারি ঘুমিয়ে আছে। ঘরটায় ম্যাকরেল মাছের তেলের আলো জ্বলছে।
হঠাৎ কার ডাক শুনে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। কান পাতল। ওর বাম ধারে আবার কে ডাকল। বুঝল–মোক ডাকছে। উঠে বসল। হ্যারি বলল-মোক ডাকছে মনে হচ্ছে।
-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে পাথুরে মেঝেয় দাঁড়াল।
–এত রাতে ডাকাডাকি করছে। কী ব্যাপার?
–দেখি। ফ্রান্সিস বলল।
–তরোয়াল নিয়ে যাও। হ্যারি বলল।
–না-না বিপদের কিছু নেই।
সিডার গাছের কাঠের তৈরী দরজার পাল্লাটা খুলল ফ্রান্সিস। দরজাটা তখনও সম্পূর্ণ খোলা হয় নি। দুতিন জন তোক এক ধাক্কায় দরজার সবটা খুলে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হঠাৎ এই ধাক্কায় ফ্রান্সিস মেঝের ওপর পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দু তিনজন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। উঠে দাঁড় করাল। তারপর হাতদুটো টেনে নিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। ওদিকে আরো কয়েকজন ছুটে গিয়ে হ্যারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হ্যারি কিছু বোঝার আগেই ওর দুহাত পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলল।
এবার দরজা দিয়ে মোকা ঢুকল। ঘরের মৃদু আলোতে ফ্রান্সিস দেখল মোকার মুখ ভ কাতর। মোকার পিঠে তরোয়াল ঠেকিয়ে আর একজন লোক ঢুকল। তার মাথায় কাঁচা পাকা বাবড়ি চুল! মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি গোঁফ। লোকটার কাঁচাপাকা ভুরুর নীচে চোখদুটো কেমন রহস্যময়। হাসল লোকটা। মোটা গলায় বলল–ভাইকিং দেশের শ্রেষ্ঠ বীর ফ্রান্সিস আমাকে চিন্তে পারো? তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল লোকটার মুখের দিকে। চিনতে দেরী হল না। লোকটা পাঞ্চো। সেই নিজের দেশে সমুদ্রের ধারের এক সরাইখানায় এই পাঞ্চোর সঙ্গে ওর পরিচয় হয়েছিল। এই পাঞ্চোর মুখেই ও প্রথম শুনেছিল-রূপোর নদীর কথা। ফ্রান্সিস বলল–হ্যাঁ চিনেছি। তুমি পাঞ্চো। পাঞ্চো হাসল। বলল–তোমরা সেই বন্দর থেকে জাহাজ চুরি করে পালালে। আমরাও একটা ছোট জাহাজে চড়ে তোমাদের পিছু নিলাম। তোমরা কঙ্কাল দ্বীপে এলে। আমরাও পশ্চিমদিকের জঙ্গলের আড়ালে জাহাজ লুকিয়ে প্রতীক্ষায় রইলাম। ত্রিস্তানদের সঙ্গে যুদ্ধ হল। ত্রিস্তানরা যুদ্ধে হেরে গেল। নিজেদের দ্বীপে চলে গেল। সবই দেখেছি আমরা। পাঞ্চো থামল। তারপর বলতে লাগল ঠিক জানতাম নদীর হদিশও তুমিই বের করবে যা আমরা কখনই পারবো না। তাই তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের একজন তোক ইকাবোদের পোশাক পরে সব সময় থাকতো। তারপর জানলাম–তুমি রূপোর নদী আবিষ্কার করেছে। ফ্রান্সিস আমি জানতাম একমাত্র তুমিই এই ধাঁধার সমাধান করতে পারবে।
-এখন কী চাও? ফ্রান্সিস ক্ষুব্ধস্বরে বলল।
–এই ঘরে তোমাদের বন্দী করে রাখবো। তোমাদের জাহাজের বন্ধুরা এ কথা জানতেও পারবে না। মোকাকে বন্দী করবনা। ওকে সব সময় আমাদের সঙ্গে রাখবো। ইকাবোরা তাদের রাজাকে মুক্তই দেখবে। ওদের মনে কোন সন্দেহ হবে না।
-তারপর? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
-তারপর আসল কাজ। গিয়ানি মন্দিরের সবকটা রূপোর থাম আমাদের জাহাজে নিয়ে যাবো। রূপোর নদী থেকে যতটা রূপো সম্ভব কেটে নেব। ইকাবোদের মনে কোন সন্দেহ হবে না। ওরা ভাববে রাজাই এসব আমাদের দিচ্ছে। কেউ বাধা দেবে না। ওদিকে তোমাদের জাহাজের বন্ধুরা কিছু বোঝার আগেই আমরা জাহাজ ছেড়ে দেব। দেশে ফিরে তালতাল রূপা বিক্রি করে আমি রাজার হালে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেব! পাঞ্চো হা হা করে হেসে উঠল।
–অত সহজে সব কাজ হাসিল করতে পারবে না পাঞ্চো?
–তুমি বাধা দেবে?
-আমি তো বন্দী। কিন্তু জাহাজে আমার বন্ধুরা রয়েছে। দুতিন দিন আমাদের কোন খবর না পেলেই খোঁজ করতে এখানে আসবে। তখন? তোমরা তো দশ বারো অন। আমরা তিরিশ। পারবে মোকাবিলা করতে?
-তার আগেই আমরা কাজ হাসিল করবো। দাড়ি গোঁফের ফাঁকে পাঞ্চো হাসল।
ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। কী ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল
–কিন্তু পাঞ্চো–রূপোর চেয়েও অনেক দামী জিনিস রয়েছে এই দ্বীপে। পাঞ্চো স্পষ্ট চমকে উঠল। বলল–কী জিনিস?
-সোনা।
–সোনা? পাঞ্চো লাফিয়ে উঠল। বলল–তুমি তার খোঁজ জানো?
–না।
পাঞ্চো একত্সাফে ফ্রান্সিসের সামনে এসে দাঁড়াল। তরোয়ালের ডগাটা ফ্রান্সিসের কণ্ঠনালীতে চেপে ধরল। দাঁতচাপা স্বরে বলল-তুমি নিশ্চয়ই জানো। বলো সেই সোনা কোথায়? ফ্রান্সিস নির্বিকার ভঙ্গীতে বলল-দেখ পাঞ্চো আমি যদি সেই সোনার হদিস জানতাম তাহলে তোমাকে আগ বাড়িয়ে বলতে যেতাম না।
–হু। পাঞ্চো তরোয়াল সরিয়ে নিল? |||||||||| –কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত যে এখানে সোনা আছে।
-হ্যাঁ-রূপোর স্তরের মত সোনার স্তর।
–বলো কি?
–হ্যাঁ। তবে সেই ধাঁধার সমাধান মাথা খাঁটিয়ে বের করতে হবে।
–কোথায় রয়েছে সেই ধাঁধার সমাধান?
–ঐ যে–মোকার গায়ে জড়ানো কোহালহোর মধ্যে। পাঞ্চো মোকার গায়ের কোহালহোর দিকে তাকাল। কিছুই বুঝল না। অস্পষ্ট হয়ে আসা কিছুনক্সা আঁকা ওটাতে।
–ওটা পেলে তুমি সোনার হদিশ করতে পারবে?
–চেষ্টা করতে পারি।
পাঞ্চো মোকার দিকে তাকাল। বলল–মোকা তোমার গায়ের ঐ কাপড়টা খুলে দাও।
–না। মোকা ঘাড় নাড়ল। বলল–এটা গিয়ানির মন্ত্রপূত কোহালহো। এটা খুলতে পারবো না। পাঞ্চো রুখে উঠল। তরোয়াল উঁচিয়ে মোকাকে বলল-এক্ষুণি ওটা খুলে দে। নইলে তোর মাথা কেটে ফেলে ওটা নেব। পাঞ্চোর চোখ দুটো জ্বলতে লাগল। ফ্রান্সিস বুঝল-ওটা না পেলে পাঞ্চো নির্ঘাত মোকাকে হত্যা করবে। ফ্রান্সিস ডাক মোকা?
-কী? মোকা ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল।
-কোহালহোটা এর আগেও আমাকে দিয়েছে। এবারও দাও আমি কোহালহোর পবিত্রতা নষ্ট হতে দেব না।
-কিন্তু–
-আমি জানি মোকা। কোহালহো তোমরা কখনও হাতছাড়া করো না। সেদিন জাহাজে কোহালহো রোদে শুকাতে দিয়ে তুমি প্রচণ্ড রোদের মধ্যে সারাদিন কোহালহোর সামনে বসে ছিলে। তবু আমার অনুরোধ আজকে রাতের মত কোহালহোটো আমার কাছে দাও। দেখি ধাঁধার, সমাধান করতে পারি কিনা। পারি বা না পারি-কালকেই তোমার কোহালহো ফিরিয়ে দেব। মোকা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর গা থেকে কেহালহোটা খুলতে খুলতে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল–ফ্রান্সিস আপনি আমাদের প্রাণে বাঁচিয়েছেন। আপনার কাছে আমি অশেষ ঋণী। শুধু আপনি চাইলেন–তাই এই কোহালহো আপনাকে দিলাম।
-তুমি নিশ্চিত থাকো মোকা–এর পবিত্রতা রক্ষা করবো। ফ্রান্সিস বলল।
পাঞ্চো এবার সঙ্গীদের হুকুম করল-এই দুজনকেই দুটো খুঁটির সঙ্গে বাঁধো। ওর সঙ্গীরা এগিয়ে এল। ফ্রান্সিস এবার মোকাকে বলল–মোকা তোমার কোহালহোটা আমার সামনে মেঝেতে পেতে দাও। আমি ধাঁধার সমাধানটা বের করবো।
মোকা গা থেকে কোহালহোটা খুলে ফ্রান্সিসের সামনে রাখলো।
হঠাৎ মোকা উবু হয়ে শিস দিয়ে উঠল। পাঞ্চো দ্রুত ছুটে এসে মোকার মাথার ওপর তরোয়াল উচিয়ে চিৎকার করে উঠল–শিস দেওয়া বন্ধ কর-নইলে; মোকা শিস দেওয়া বন্ধ করল। পাঞ্চো বলল–তোমাদের শিস দিয়ে খবর পাঠানোর ব্যাপারটা আমি জানি। সাবধান-আর শিস দেবে না। তারপর পাঞ্চো দলের সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল-মোকাকে শিস দিতে দেখলেই মেরে ফেলবে। পাঞ্চোর এই হুকুমের অর্থটা সঙ্গীরা বুঝল না। তবে মাথা ঝাঁকিয়ে ওরা বোঝার ইঙ্গিত করল।
মোকা বলল-ফ্রান্সিস-আপনাদের বাঁচাবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু হল না। আমাকে ক্ষমা করুন।
-তুমি এই নিয়ে মন খারাপ করো না মোকা–ফ্রান্সিস বলল।
পাঞ্চো বলল–ফ্রান্সিস তুমি ধাঁধার সমাধান করবার চেষ্টা কর। সোনা আমার চাই।
–চেষ্টা করবো সমাধান বের করতে।
-তোমাকে একদিন সময় দিলাম। যদি না পারো–তোমাদের দুজনকে খতম করে জাহাজে উঠব গিয়ে! তারপর দেশের দিকে পাড়ি জমাবো। জলদি–সময় নেই।
পাঞ্চো তার সঙ্গীদের আর মোকাকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে থেকে ঘরের দরজা ভালো করে বন্ধ করে দিল। ঘরের বাইরে বারন্দায় পাঞ্চোর এক সঙ্গী তরোয়াল হাতে পাহারা দিতে লাগল।
পাঞ্চো ওরা চলে যেতে চারিদিক নিস্তব্দ হয়ে গেল।
এবার হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল-তুমি ঠিক জানো আর একটা সোনার স্তর আছে এই দ্বীপে?
-পাগল হয়েছে। আর কিছু নেই এই দ্বীপে।
–তাহলে তুমি সোনার স্তরের কথা বললে কেন?
–এবার সেটা বুঝবে।
এই বলে ফ্রান্সিস খুঁটির সঙ্গে বাঁধা শরীরটা উঁচু করে তুলে বসল। বলল। হ্যারি এবার আলোটা আমার বাঁধা হাত দুটোর কাছে তোমার পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে এস।
হ্যারি পা বাড়িয়ে ঠেলে ঠেলে আলোটা ফ্রান্সিসের বাঁধা হাত দুটোর দিকে এগিয়ে আনতে লাগল। আলোটা একটা মাটির পাত্র। তাতে তেল ভরা। পলতে করা হয়েছে গাছের পাতলা আঁশ দিয়ে।
ফ্রান্সিস বলল-হ্যারি-যদি পাঞ্চোকে বলতাম আলোটা আমার কাছে এনে দাও তাহলে ওর সন্দেহ হত। ও কিছুতেই আলোটা কাছে রাখতে দিত না। কিন্তু ঐ ধাপ্পাটা দিতেই ও কোন আপত্তি করল না। এবার দেখ।
ফ্রান্সিস এবার ঈড়ি বাঁধা হাত দুটো আলোর শিখার ওপর রাখল। বাঁধা দড়িটা পুড়তে লাগল। সেইসঙ্গে ফ্রান্সিসের হাতের কব্জিও। কিন্তু ফ্রান্সিস দাঁত চেপে কব্জি পোড়ার অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগলো। আস্তে আস্তে দড়িটা পুড়ে যেতে লাগল। বেশ কিছুটা পুড়ে যেতেই ফ্রান্সিস দুহাতে হ্যাঁচকা টান দিল। পোড়া দড়ি ছিঁড়ে গেল। ফ্রান্সিস এক লাফে উঠে দাঁড়াল। দুহাতের কব্জি তখন পুড়ে কালো হয়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগল। ছুটে গেল বিছানার কাছে। শিয়রের কাছে রাখা তরোয়ালটা নিল। তরোয়ালটা নিয়ে এল হ্যারির কাছে। দ্রুত হাতে তরোয়াল ঘষে হ্যারির হাতের বাঁধন খুলে ফেলল। হ্যারিও লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিছানায় শিয়রের পাশ থেকে ওর তরোয়াটা তুলে নিল।
ফ্রান্সিস চিৎকার করতে লাগল-পাহারাদার শিগগির এসো–ঘরে আগুন লেগেছে। আগুন-আগুন। পাহারাদার তাড়াতাড়ি ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকল। দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়েছিল ফ্রান্সিস ও ডান পাটা বাড়িয়ে দিল। ফ্রান্সিসের পায়ে হোঁচট খেয়ে পাহারাদার উবু হয়ে ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস ওর তরোয়ালের বাঁট দিয়ে পাহারাদারের ঘাড়েমারল। লোকটা আর মেঝে থেকে উঠল না। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলে উঠল-হ্যারি শিগগির–ছোটো। বলেই ফ্রান্সিস লাফিয়ে ঘরটার বাইরে চলে গেল। পেছনে হ্যারিও এল। দুজন ছুটল সমুদ্রতীরের দিকে।
অন্ধকার রাত। আকাশে অজস্র তারা। সমুদ্রের দিক থেকে জোরালো হাওয়া বইছে।
ফ্রান্সিস ধ্রুবতারাটা দেখে নিল। তারপর দিকটা ঠিক রেখে ছুটল উত্তর-পূর্ব মুখে সমুদ্রের ধার ঘেঁসে গাছগাছালির গায়ে ওদের নৌকো বাঁধা আছে। নৌকা খুঁজে বের করে নৌকো চড়ে জাহাজে উঠবে গিয়ে।
দুজনে অন্ধকার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ছুটল।
সমুদ্রের ধারে বনজঙ্গলের কাছে যেসময় পৌঁছল তখন পুব আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। সূর্য উঠতে বেশী দেরী আর নেই।
ফ্রান্সিস সমুদ্রের ধারের জংলা এলাকাটায় ওদের নৌকা দুটো খুঁজতে লাগল। আশ্চর্য! একটা নৌকোও নেই। ফ্রান্সিস বুঝল–এসব পাঞ্চোর কাজ। নৌকাগুলো লুকিয়ে রেখেছে কোথাও যাতে ফ্রান্সিসরা ওদের জাহাজের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখতে না পারে।
ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল-হ্যারি পাঞ্চো নিশ্চয় সব নৌকা লুকিয়ে রেখেছে। আমাকে সাঁতার কেটে জাহাজে যেতে হবে। তুমি পারবে না অত কষ্ট করতে। তুমি বনের আড়ালে লুকিয়ে থাকো। আমি বন্ধুদের নিয়ে আসছি।
-বেশ তো। হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিল। আগুনে পোড়া দুহাতের কব্জিতে সমুদ্রের নোনা জল লাগতে অসহ্য জ্বালা করে উঠল। ওর মুখ দিয়ে চাপা আর্তস্বর বেরিয়ে এল। তবু ফ্রান্সিস দুহাতে জলকেটে সাঁতরে চলল জাহাজের দিকে।
আকাশটা অনেক পরিষ্কার হয়ে এসেছে। দূরে জাহাজটা দেখা যাচ্ছে।
ফ্রান্সিস সাঁতরে চলল। তখনই সূর্য উঠল পূর্ব আকাশে। খুবই পরিচিত দৃশ্য। তবুও আজকে বড়ভাল লাগল সূর্য ওঠা দেখতে। বন্দীজীবন থেকে মুক্তি, বন্ধুদের কাছে যাচ্ছে এসবের জন্যও ওর মন খুশী আজকে।
সাঁতরে চলল ফ্রান্সিস। সকালের রোদ ছড়িয়ে পড়ল সমুদ্রের জলে। জাহাজ আর বেশী দূরে নয়। অনেকখানি সাঁতরে আসতে হলো ওকে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে শরীর। হাতের কব্জি জ্বলছে। সমুদ্রের নোনা জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
একসময় জাহাজের কাছে এসে পৌঁছল। ঝোলানো দড়ি দড়া ধরে উঠতে গেল। কিন্তু শরীর আর বইছে না। হাতে জোর পাচ্ছে না যে দড়ি ধরে উঠবে।
ফ্রান্সিস দড়ি ধরে হাঁপাতে লাগল। বিশ্রাম নিল কিছুক্ষণ। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে চিৎকার করে ডাকাল–বিস্কো। কিন্তু কেউ শুনতে পেরেছে বলে মনে হল না। আবার পর পর দুবার ডাকল বিস্কো বিস্কো।
এবার রেলিং ধরে কে মুখ বাড়িয়ে দেখল। ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলে উঠল–দড়ির মই নামাও। ভাইকিংটি এবার ফ্রান্সিসকে চিনতে পারলো। ও ছুটল। সবাইকে খবর দিতে। একটু পরেই সবাই এসে জড়ো হল রেলিঙের ধারে। তাড়াতাড়ি দড়ির মই নামিয়ে দিল। ফ্রান্সিস দড়ির মই বেয়ে বেয়ে জাহাজে উঠে এল।
সবাই এসে ফ্রান্সিসকে ঘিরে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস তখনও হাঁপাচ্ছে। বিস্কো বলল–ফ্রান্সিস কী হয়েছে? সব শুনে বিস্কো বলল-হ্যারির কোন বিপদ হবে নাতো?
–না। ওকে বনের আড়ালে রেখে এসেছি?
–তাহলে এখন কী করবে?
–লড়াই-পাঞ্চোর দলের সঙ্গে।
সবাই চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো-হো
জাহাজের বদ্যিকে খবর পাঠানো হল। বদ্যি এল। ফ্রান্সিসের আগুনে পোড়া দুহাতের কব্জিতে ওষুধ লাগিয়ে দিল। জ্বালা যন্ত্রণা কমল।
ফ্রান্সিস সবাইকে বলল-আমি ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নেব। এর মধ্যে সবাই তৈরী হয়ে নাও।
ঘন্টাখানেক কাটল। সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরী হয়ে এল। ফ্রান্সিসও খেয়ে দেয়ে তৈরী তখন।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল নৌকো নিয়ে। মাত্র দুটো নৌকো রয়েছে। বাকী তিনটে নৌকো তো কঙ্কাল দ্বীপে রয়েছে। পাঞ্চো লুকিয়ে রেখেছে সেগুলো।
ফ্রান্সিস বলল-দুটো নৌকোতেই আমরা দফায় দফায় দ্বীপে যাবো। বিস্কোকে বলল-বিস্কো–হ্যারির জন্যে খাবার নিয়ে যেও।
প্রথম দফায় ফ্রান্সিস বিস্কো আর শাঙ্কোকে সঙ্গে নিয়ে গেল।
ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে সবাই কঙ্কালদ্বীপের সমুদ্রতীরের বনের মধ্যে জড়ো হল। হ্যারি এর মধ্যেই খেয়ে নিল।
বিস্কো বলল-এখন আমরা কোথায় যাবো?গিয়ানির মন্দির। পাঞ্চো ওর দল নিয়ে নিশ্চয়ই এখানে আছে। রূপোর থামগুলো চুরীর মতলব ওর। ফ্রান্সিস বলল।
ওরা পাহাড়ের সবুজ ঘাসে-ভরা ঢাল দিয়ে উঠতে লাগল।
এক সময় কঙ্কালের মাথার কাছে এসে পৌঁছল সবাই। ফ্রান্সিস নীচে তাকিয়ে দেখল ওর অনুমানই ঠিক বেশ কিছু শক্ত সমর্থ ইকাবোকে দিয়ে পাঞ্চো রুপোর থাম ভোলাচ্ছে। দুটো থাম ভোলা হয়েছে। পাথুরে মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে থাম দুটো। বাকীগুলো তোলবার চেষ্টা চলছে।
ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল দুভাগে ভাগ হয়ে সবাই নীচে নামো। ওদের কাছাকাছি গিয়ে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে। আমি না বললে কেউ আক্রমণ করবে না।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেয়ে দুদল ভাইকিং দুপাশ থেকে নামল। তারপর গিয়ানি মন্দিরের পেছনের দিকে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
তখনই একটা পাথরের চাঁইয়ের আড়াল থেকে ফ্রান্সিস দেখল একটু দূরে মোক একটা পাথরের ওপর বসে আছে। অসহায় মোক দেখছে. ওর চোখের সামনে পাঞ্চোর দল রূপোর থামগুলো তুলছে।
ফ্রান্সিস মোকাকে ডাকতে গিয়ে সাপান হল। মোকার ঠিক পেছনেই তলোয়ার হাতে পাঞ্চোর দলের একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।
ফ্রান্সিস তখন একটা পাথরের নুড়ি হাত দিয়ে কুড়িয়ে নিল। তারপর ছুঁড়ল মোকার দিকে। মোকার গায়ে নুড়িটা লাগতেই মোকা এদিকে ফিরে তাকাল। দেখল-ফ্রান্সিস পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। মুক্ত ফ্রান্সিসকে দেখে ওর চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হল। পাহারাদারটা দেখল সেটা। সে-ও ওদিকে তাকাল। ফ্রান্সিস পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়বার আগেই পাহারাদার ওকে দেখল। তলোয়ার হাতে ছুটে এল পাহারাদারটা। কাছাকাছি আসতেই বিস্কো ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুজনে জড়াজড়ি করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে অনেকটা নীচে নেমে এল। বিস্কোই আগে উঠে দাঁড়াল। পাহারাদারটা উঠে দাঁড়াতে গেল।
তার আগেই বিস্কো তরোয়াল চালাল ওর ডান হাত লক্ষ্য করে। তরোয়ালের ঘা লাগল ওর ডান কাঁধে। তরোয়াল ফেলে লোকটা কাটা কাঁধ বাঁ হাতে চেপে ধরল। তারপর শুয়ে পড়ে গোঙাতে লাগল।
এবার ফ্রান্সিস হাতের তরোয়াল উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল সবাই নেমে চলে–গিয়ানির মন্দিরের দিকে।
ভাইকিংরা দ্রুতপায়ে পাহাড়ের ঢাল থেকে নেমে আসতে লাগল। এবার পাঞ্চোর নজরে পড়ল ফ্রান্সিসরা। ইকবোরা থাম তোলার কাজ বন্ধ রেখে তাকিয়ে রইল সেই দিকে। পাঞ্চো আর তার সঙ্গীরা তরোয়াল উঁচিয়ে লড়াইয়ের জন্য তৈরী হয়ে গেল।
মন্দিরের কাছাকাছি এসে ফ্রান্সিস দুহাত তুলে নির্দেশ দিল থামো।
ভাইকিংরা পাঞ্চোর দলের মুখোমুখি দাঁড়ালো।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ডাকল। শাঙ্কো তীরধনুক হাতে ফ্রান্সিসের পাশে এসে দাঁড়াল।
ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–পাঞ্চো তুমি ভাইকিংদের বীরত্বের কথা জানো। আমরা তোমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছি। সংখ্যায় আমরা তোমাদের দ্বিগুণ। যদি প্রাণের মায়া থাকে-তাহলে এক্ষুনি অস্ত্র ত্যাগ কর।
-না-সবগুলো রূপোর থাম আমার চাই।
-পাঞ্চো-ভালো করে ভেবে দেখো একবার সড়াইতে নামলে তোমরা কেউ প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না।
-আমরা পরোয়া করি না?
–বেশ-তাহলে তুমিই আমাদের লড়াইয়ে নামতে বাধ্য করলে। ফ্রান্সিস বলল।
ঠিক তখনই গিয়ানি মন্দিরের পুরোহিত পাগলের মত ছুটতে ছুটতে গিয়ে একটা রূপোর থাম জড়িয়ে ধরল। পাগলের মত চিৎকার করে কী বলতে লাগল ও কাঁদতে লাগল। পাঞ্চো ছুটে গিয়ে পুরোহিতের মাথার বেণী ধরে একহ্যাঁচকা টান দিল। পুরোহিত থাম ছেড়ে পাথুরে মাটিতে ছিটকে পড়ল। পাঞ্চো পুরোহিতের মাথার ওপর তরোয়াল উচিয়ে ধরল?
–পাঝে? ফ্রান্সিস চিৎকার করে ডাকল। পাঞ্চে ফ্রান্সিসের দিকে রক্তচক্ষু মেলে একবার তাকাল শুধু। পুরোহিত এই ফাঁকে মাটি থেকে উঠে পালাতে গেল। পাঞ্চো আবার ওর মাথার বেণী টেনে ধরল। ফ্রান্সিস বলে উঠল-শাঙ্কো-চালাও তীর। ওর পাশে দাঁড়িয়ে শাঙ্কো তৈরীই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্চোর বুক লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ল। নিখুঁত নিশানা। তীরটি ঠিক পাঞ্চোর বুকে গিয়ে বিঁধল। পাঞ্চে ঠিক তখনই তরোয়াল চালাল। কিন্তু তরোয়ালের কোপ লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল। পুরোহিতের মাথায় কোপ লাগল না। শুধু ওর মাথার বেণীটা কেটে গেল। পাঞ্চো তরোয়াল ফেলে দিল
গেল। পাঞ্চো তরোয়াল ফেলে দিল। দুহাত বুকে চেপে ধরে তীরটা টেনে ধরল এক হ্যাঁচকা টানে তীরটা টেনে খুলে ফেলল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। পাঞ্চো টলতে টলতে পাথুরে মাটিতে গড়িয়ে গেল। দেহটা নড়াচড়া করল কয়েকবার। তারপর স্থির হয়ে গেল।
দলের সর্দারের ঐ মৃত্যু দেখে দলের বাকী সঙ্গীরা ভয়ার্ত চোখে চারিদিকে তাকাতে লাগল। তারপর এক পা করে পিছোতে পিছোতে ছুটতে শুরু করল পেছনের দিকে। ওরা ছুটল দ্বীপের উত্তরদিককার সমুদ্রতীরের দিকে। ফ্রান্সিস বলে উঠল–বিস্কো–শিগগির ছুটে যাও। ফেরাও ওদের। ওদিকে বালিয়ারিতে মৃত্যুর ফাঁদ পাতা। ওদিক দিয়ে সমুদ্র নামলে কেউ বাঁচবে না ওরা।
বিস্কো ছুটল পাঞ্চোর সঙ্গীদের পেছনে পেছনে। চীৎকার করে বলতে লাগল–ওদিকে যেওনা। ফিরে এসো। কোন ভয় নেই। কিন্তু কে কার কথা শোনে। ওরা ছুটে চলল মৃত্যু–সৈকতের দিকে।
এত কাণ্ড ঘটে গেল। ইকবোরা সবাই অবাক হয়ে সব ঘটনা দেখল।
মোকা ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। ও কাঁদতে লাগল। ফ্রান্সিস হেসে বলল–কান্না থামাও। তোমার প্রজাদের সাহস দাও। এখন কান্নার সময় নয়। মোকা শান্ত হল। তারপর ইকাবোদের দিকে তাকিয়ে ওদের ভাষায় কী বলে গেল। ইকাবোরা একে একে ফ্রান্সিসের সামনে এসে মাথা নীচু করে সম্মান জানিয়ে গেল।
ঘরে ঢুকে ফ্রান্সিস মেঝেয় বিছানো কোহালহোটা তুলে নিয়ে মোকার গায়ে পরিয়ে দিল। মোক বলল :
–আপনি যে বললেন সোনার স্তর আছে–কোহালহোর নক্সা থেকে তা খুঁজে বের করবেন।
ফ্রান্সিসহেসেবলল–এসব গপপো কেঁদেছিলাম পালাবার ফন্দী করতে। তোমাদের জীপে আর দামী কিছু নেই। তুমি হতাশ হলে তাই না?
–না ফ্রান্সিস, আমি খুব খুশী হলাম। যদি রূপো সোনা আরো থাকত তবে সব লুঠে নিতে কত জলদস্যু খুনী ডাকাত আসত এই দ্বীপে। আমার প্রজাদের জীবনে অশান্তি নেমে আসত। খুন জখম রক্তপাতে দ্বীপ কলুষিত হত। তার চেয়ে এই ভাল। রূপো যা পাব তাই দিয়ে শুধু গিয়ানি মন্দিরের থাম বসিয়ে যাব। সবই উৎসর্গ করবো দেবতার উদ্দেশ্যে।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল-সত্যি মোকা তোমার মত আমি খুব কমই দেখেছি। একজন আদর্শ রাজা তুমি। একটু চুপ করে থেকে বলল-সভ্যজগৎ থেকে কতদূরে এই কঙ্কাল দ্বীপ। অথচ কত প্রগতিশীল তোমার মন, তোমার চিন্তা। ভাবলে অবাক হতে হয়। মোকা কথা বলল না। মৃদু হাসল শুধু। তারপর ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
-তোমার হাত কেমন আছে? হ্যারি জিজ্ঞেস করল?
–এখন একটু ভালো বিছানায় বসতে বসতে ফ্রান্সিস বলল?
–তবে ফেরা যাক কী বলে? হ্যারি বলল।
–হ্যাঁ তবে আর একটা কাজ রয়েছে?
–আবার কি কাজ?
–আমাদের নৌকা তিনটে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। তাছাড়া পশ্চিম সমুদ্রতীরের দিকে একবার যেতে হবে।
-কেন?
–পাঞ্চো ওর দলবল নিয়ে একটা ছোট জাহাজে চড়ে এসেছিল। ওদিকেই পাঞ্চোর জাহাজটা কোথাও লুকানো আছে। সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
–পাঞ্চোর সঙ্গীরা বাধা দিতে পারে।
–হ্যারি, ওঁরা কেউ বেচে নেই।
–বলো কি?
-হ্যাঁ উত্তর সমুদ্র তীরের দিকে পালিয়েছিল ওরা। ওখানে সমুদ্রে কেউ বেঁচে ফেরে না। জাহাজটা এখন খালি। হয়তো দু একজন পাহারাদার থাকলেও থাকতে পারে।
-জাহাজ নিয়ে কি করবে তুমি? হ্যারি জানতে চাইল?
–মোকাকে দেব। তাহলে ত্রিস্তানদের সঙ্গে লড়াই করতে পারবে?
–এখনই বেরুবে?
–হ্যাঁ। চলো–বেলা থাকতে থাকতে জাহাজটা খুঁজে বের করতে হবে?
–চলো।
দুজনে ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরুলো। চলল পশ্চিমমুখে। সমুদ্রতীরের দিকে। ঘন জঙ্গল ওদিকটায়। ফ্রান্সিস একটা বিরাট উঁচু সীডার গাছের মাথায় উঠল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ নজরে পড়ল একটা গাছের ডালপাতার ফাঁকে একটা কাঠের মাস্তুলের মত। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে এল।
নীচে মাটিতে নামতে হ্যারি বলল–কী? কিছু হদিশ পেলে?
–হ্যাঁ, চলো।
দিক ঠিক করে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলল দুজনে। গভীর জঙ্গল। পচা পাতার স্তূপ জমে আছে গাছগুলোর নীচে। পা ফেললে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে। গাছের নীচে অন্ধকার। মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও রোদের ভাঙা ভাঙা টুকরো যেন। ওর মধ্যে দিয়েই চলল দুজনে। ফ্রান্সিস নিশানা ঠিক করে চলছিল।
কিছুক্ষণ পরেই দেখল একটা সামুদ্রিক খাঁড়ি দ্বীপের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সেই খাঁড়িতে একটা ছোট্ট জাহাজ নোঙর করা। জাহাজটার কাছাকাছি আসতে দেখল ওদের নৌকো তিনটে দড়ি দিয়ে জাহাজটার সঙ্গে বাঁধা।
জাহাজে ওঠার জন্যে একটা কাঠের পাটাতন ফেলা ছিল। পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে ওরা জাহাজটায় উঠল। জাহাজের ডেক, কেবিনঘর, দাঁড়ঘর, রসুইঘর সবে ঘুরে বেড়াল ওরা। কেউ নেই জাহাজটায়। ছোট জাহাজ। তবে খুব মজবুত।
ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি এসো নোঙর খুলতে হবে।
দুজনে মিলে নোঙর খুলল। হ্যারি দাঁড় ঘরে চলে গেল। দাঁড় টানতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল গাছপালার এলাকা ছাড়াতে না পারলে পাল খাটানো যাবে না। তাই ও দাঁড়ঘরে গেল। দুজনে মিলে দাঁড় বাইতে লাগল। একটু পরেই জাহাজটা চলতে শুরু করল। যেতে যেতে খাড়ি ছেড়ে সমুদ্রে এসে পড়ল।
ফ্রান্সিস ও হ্যারি ডেক-এ উঠে এল। ফ্রান্সিস নিপুণ হাতে দড়ি দড়া ঠিক করে পাল খাঁটিয়ে দিল। পালে হাওয়া লাগতেই পাল ফুলে উঠল। জাহাজ দ্রুত ছুটল।
ওদের জাহাজ যেদিকে ছিল নতুন পাওয়া জাহাজটা সেই দিকে নিয়ে এল। তারপর দ্বীপের ধারে নিয়ে এল। তারপর জাহাজটার নোঙর ফেলল।
তখন বিকেল। ফ্রান্সিস ও হ্যারি জাহাজ থেকে পাটাতন ফেলল। তারপর দ্বীপে নামল। চলল রাজবাড়ির দিকে।
রাজবাড়িতে মোকার সঙ্গে দেখা হল। ফ্রান্সিস বলল–মোকা আমাদের সঙ্গে চলো। একটা জিনিস দেব তোমাকে।
–কী? মোকা বেশ অবাক হল কথাটা শুনে?
–চলোই না। ফ্রান্সিস তাগাদা দিল।
–বেশ চলুন।
সমুদ্রের ধারে এসে ছোট্ট জাহাজটা দেখে মোকা কিছুই বুঝতে পারল না। এই জাহাজ তো ওরা আগে দেখেনি। কোত্থেকে এল এই জাহাজ। ফ্রান্সিস মোকার মনের অবস্থা বুঝল। বলল–মোকা এই জাহাজটা তোমাকে দিলাম।
মোকা নির্বাক। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস তখন ওকে সমস্ত ঘটনাটা বলল। এবার মোকা বুঝল পাঞ্চোরা এই জাহাজে চড়েই এসেছিল। আজ ওরা কেউ বেঁচে নেই।
মোকা জাহাজটায় উঠল ও কেবিন ঘর, দাঁড়ঘর সব ঘুরে ঘুরে দেখল। আনন্দে ওর চোখে জল এসে গেল। বলল-ফ্রান্সিস আপনি আবার আমাদের বাঁচালেন। আর ব্রিস্তানদের ভয় করি না। ওরা যদি আবার আক্রমণ করে এই জাহাজই সেই আক্রমণের মোকাবিলা করতে পারবে। আপনার কাছে আমরা চিরঋণী হয়ে রইলাম। ও আবেগে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি মোকাকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের আস্তানায় যখন ফিরে এল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
পরদিন দুপুরে খেতে বসে ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি-জাহাজে খবর পাঠাও। বিদায় কঙ্কাল দ্বীপ। এবার দেশে ফেরা।
কিছু রূপো নিয়ে যাবো না? হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
নাঃ। ফ্রান্সিস বলল–রাজাকে অনেককিছু এনে দিয়েছি। এবার আর নাই বা কিছু নিয়ে গেলাম।
বিকালে মোকা এল। জিজ্ঞেস করল–আপনারা কি আজই যাচ্ছেন?
না, কালকে জাহাজ ছাড়বো। ফ্রান্সিস বলল।
একটা অনুরোধ ছিল আমার।
বলো।
আপনাদের ঋণ কেনোভাবেই শোধ করতে পারবো না, তাই বলছিলাম–মন্দিরের দুটো রূপোর থাম যদি আপনারা গ্রহণ করেন।
কী বলছো মোকা? তোমাদের দেবতার পবিত্র থাম।
আমি সদারদের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই সম্মতি দিয়েছে। পুরোহিতও বলেছে এতে কোনো পাপ হবে না। পরে দুটো থাম তৈরী করে দিলেই হবে।
ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বুঝে উঠতে পারল না কী বলবে। হ্যারি বলল নাও ফ্রান্সিস। মোক এত করে বলছে। তাছাড়া এই থাম দুটো হবে ইকাবোদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের নিদর্শন;
–বেশ–ফ্রান্সিস বলল।
পাঞ্চো যে দুটো থাম খুঁড়ে তুলেছিল–সে দুটো পাশাপাশি রাখা হল।
জল দিয়ে থামের তলায় লেগে থাকা মাটি বোয়া হলো। নারকেল ছোবড়া দিয়ে ঘষে উজ্জ্বল করা হলে থাম দুটো। লতাপাতা পশুপাখি খোদাই করা থাম দুটো সুন্দর লাগল দেখতে।
ফ্রান্সিস আর হ্যারি দাঁড়িয়ে এসব দেখছিল। মোকাকে পুরোহিত কী বলল। মোকা ফ্রান্সিসকে বলল-পুরোহিত বলছে–এগুলো পবিত্র থাম। এই দুটোতে যেন কারো পা না লাগে। এগুলো কোনো কারণেই গলাবেন না বা বিক্রি করবেন না।
ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল-নিশ্চিন্ত থাক। এই থামের পবিত্রতা আমরা রক্ষা করবো।
বেশ ভারী থাম। দুদল ইকাবো কাঁধে করে দুটো নিয়ে চলল সমুদ্রতীরের দিকে। ফ্রান্সিস আর হ্যারিও চলল সেই সঙ্গে। সবার সামনে পুরোহিত বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে পড়তে চলল।
সমুদ্রতীরে থাম দুটো নামানো হলো। একটু সমস্যা দেখা দিল। কী করে থাম দুটো জাহাজে তোলা যায়।
ফ্রান্সিস হ্যারিকে পাঠাল জাহাজের গায়ে বাঁধা সবগুলো নৌকো নিয়ে আসতে। হ্যারি একটা নৌকো চালিয়ে জাহাজে গেল। কয়েকজন ভাইকিং নৌকোগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ পরেই এল।
ফ্রান্সিস নৌকোগুলো পরপর সাজাল। মোটা কাছি দিয়ে নৌকোগুলো পরস্পর বাঁধলো। তারপর ইকাবো আর ভাইকিংরা মিলে থাম দুটো সেই নৌকোয় বাঁধা সারির ওপর আস্তে আস্তে রাখল। খুব ভারী থাম দুটোর ভারে নৌকোগুলোর অনেকটা জলে ডুবে গেল। থাম দুটো এবার নৌকোগুলোর সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। থাম দুটোর আর গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রইল না।
ভাইকিংরা বৈঠা হাতে নৌকোয় উঠল। এবার ফ্রান্সিসের বিদায় নেবার পালা। মোকা ফ্রান্সিসকেবুকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ ঐভাবেই রইল। আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে ফ্রান্সিস এবার জড়ো হওয়া ইকাবো নারীপুরুষ শিশুদের দিকে তাকাল। সবাই নির্বাক তাকিয়ে আছে ফ্রান্সিসের দিকে। দুএকজন চোখ মুছছি। ফ্রান্সিসেরও মনটা খারাপ হয়ে গেল। ম্লান হেসে ও হাত নেড়ে বলল-বিদায় ভাই বোনেরা ইকাবোরা কোনো কথা বলল না। একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
ফ্রান্সিস নৌকোয় গিয়ে উঠল। হাতে বৈঠা তুলে নিল। দড়িবাঁধা নৌকোর বহর চলল জাহাজের দিকে। নৌকোর ওপর থাম দুটো।
জাহাজের কাছে পোঁছে ও পেছন ফিরে তাকাল। দেখল ইকাবোরা তেমনি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জাহাজে উঠল সবাই। দড়ি বেঁধে থাম দুটো তোলা হলো জাহাজে। নৌকোগুলো বাঁধা হলো জাহাজের সঙ্গে।
ডেকে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল–নোঙর তোল। পাল তুলে দাও। দাঁড়িরা দাঁড়ঘরে যাও বাতাসের তেমন জোর নেই।
সব ভাইকিংরা চীৎকার করে উঠল একসঙ্গে–ওহহহহ। তারপর সবাই যে যার কাজে লাগল।
ঘড় ঘড় শব্দে নোঙর উঠল। পাল খাটানো হলো। জলে দাঁড় পড়তে লাগল—ছপ–ছপ।
একটা পাক খেয়ে জাহাজ চলল। সরে সরে যেতে লাগল কঙ্কাল দ্বীপ। কিছুক্ষণ পরেই আর দেখা গেল না কঙ্কাল দ্বীপ। এখন চারিদিকে শুধু অথৈ জল।
জাহাজের ডেক-এ দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিস তখনও কঙ্কাল দ্বীপের দিকে তাকিয়ে আছে। তখনও ওর মন বিষণ্ণ।
– সমাপ্ত –
Leave a Reply