কুয়াশা ৫ (ভলিউম ২)
[আগের কথা]
০১.
সন্ধ্যা আট ঘটিকা। অভিজাত নানা ক্লাবের হলঘরে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। সারি সারি চেয়ারে বসে আছেন নিমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ। ক্লাবের সেক্রেটারী মি. মাহতাব পেছনের গ্রীন রুমে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে সময় দেখছেন আর বিরক্ত মুখে বিড়বিড় করে বলছেন, হঠাৎ বড়লোকদের কাণ্ডই আলাদা। আটটা বাজতে চললো কোনো পাত্তাই নেই!
গ্রীন রুমের পাশে ছোটো একটা ঘরে ক্লাবের কজন মেম্বার দরজা ভেজিয়ে তাস খেলছিল। সেই ঘরের এক পাশে খবরের কাগজ পড়ছে সখের গোয়েন্দা শহীদ খান আর উল্টোদিকে বসে আপন মনে কথা বলে যাচ্ছে রিটায়ার্ড মেজর বদরুদ্দিন।
বুঝলে শহীদ, লোকটা একেবারে কাগু জ্ঞানহীন। বুদ্ধও বলতে পারো। আমি যখন আর্মিত ছিলাম সে হলো গিয়ে ১৯৪৩ সালের কথা, তখন চৌধুরী আলী নকীব একটা সাধারণ তৃতীয় শ্রেণীর কন্ট্রাক্টর ছিলো। ওকে আমরা, মানে কমিশন্ড
অফিসাররা পাত্তাই দিতাম না। কী হে শুনুছ তো?
বুড়ো মেজর গল্প থামিয়ে আচমকা প্রশ্ন করে বসে শহীদকে। শহীদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, তা শুনছি বৈকি। তারপর কি হলো বলুন।
আসলে শহীদ মেজরের কথায় একটুও কান দিচ্ছিলো না। সর্বক্ষণ এটা ওটা নিয়ে বক বক করা বুড়োর একটা রোগ। তার কথার শুরু আছে, শেষ নেই। বকবকানি শোনার তয় সহজে কেউ কাছে ঘেঁষে না বুড়োর। বুড়ো এজন্যে সারা দুনিয়ার উপর চটা। তার ধারণা দুনিয়া থেকে ভালো মানুষ খোদা সরিয়ে নিচ্ছেন। এখন দুনিয়ায় কিলবিল করছে যতো জুয়াড়ী আর মাতাল। শহীদকে বুড়ো বেশ পছন্দ করে। তার মতে সারা ক্লাবে দুজন ভদ্রলোকই আছে। একজন শহীদ খান, অপরজন সে নিজে। সন্ধ্যার পর থেকে মেজর বদরুদ্দিন ক্লাবে এসে বসেছে, কথা বলার মতো কাউকে পাচ্ছে না। শহীদকে দেখে বুড়ো তাকে আশ্রয় করেছে। কড়া লিকারের চা খাচ্ছে, আর শহীদকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথা বলছে।
তারপরের কথা কি বলব? সবই তো জানো। শালা চৌধুরী কন্ট্রাক্টরী করে কপাল ফিরিয়ে নিলো। বছর না ঘুরতেই থার্ড ক্লাস কেটাগরি থেকে একদম ফার্স্ট ক্লাসে প্রমোশন। ভাগ্য আর কাকে বলে!
তা বটে, শহীদ মেজরের কথা সমর্থন করে, এখন তো চৌধুরী আলী নকীব কোটিপতি।
কিন্তু শালার স্বভাব একটুও বদলায়নি।
মেজর বদরুদ্দিন অভ্যাস বসে চোখ টিপে বলে, কথায় বলে স্বভাব না যায় মলে। বয়স হয়েছে ষাটের উপর, তাও এতটুকু কাণ্ড জ্ঞান নেই। বিয়ে করে বসেছে সুলতানা পারভিনকে। হুঁ,…
মেজর অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বলে, বিয়ের পর আলী নকীব চৌধুরী একদম বদলে গোল। বোতল বোতল মদ খাওয়া ধরেছে, বাড়িটাকে বানিয়ে তুলেছে একটা শরাবখানা!
এই সময় হল ঘর থেকে একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল। মাইকে সেক্রেটারী মি. মাহতাবের গলার স্বর ভেসে এলো, ভদ্রমহিলা, ভদ্রমহোদয়গণ, …আমাদের প্রধান অতিথি চৌধুরী ও বেগম আলী নকীব পৌঁছে গেছেন। আপনারা আশা করি অবগত আছেন যে, আমরা মি. ও মিসেস চৌধুরীর সম্মানেই আজকের এই ক্ষুদ্র অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছি। আপনাদের ধৈর্য ও সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু করছি।
যারা তাস খেলছিল তাদের মধ্যে কে একজন বললো, এখন খেলা বন্ধ করে দিই, কি বলো?
কেন, খেলা বন্ধ করার কি দরকার হে? ইচ্ছে হলে তুমি কেটে পড়ো, যাও, সুলতানা পারভিনের চন্দ্র বুদন দেখা গে! আমরা খেলব, কি বলিস, মকবুল?
নিশ্চয়ই!
মকবুল সায় দেয়, আমরা দুনিয়াতে এসেছি কাজ করার জন্য, বক্তৃতা শোনার জন্য নয়। নাও, লিড় দাও।
তাস খেলা পুরোদমে চললো। শহীদ খবরের কাগজ নিয়ে বসে রইলো। মেজর বদরুদ্দিন বকবক করতে লাগলো আপন মনে।
চৌধুরী আলী নকীবকে চীফ গেস্ট কেন করা হয়েছে জানো শহীদ? মানি ..অল ফর মানিন সেক। চৌধুরী নাকি ক্লাবের, সুইমিং পুলটা করে দেবে, সেজন্যে তাকে অনার দেয়া হচ্ছে। এসব খবর আমি চারদিন আগেই জানি।
শহীদ নাভানা ক্লাবের একজন পুরানো মেম্বার। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট ধনপতি চৌধুরী আলী নকীবকে ক্লাবের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হচ্ছে এটা সে ক্লাবে এসে আজই প্রথম শুনলো। সেক্রেটারী মি. মাহতাব শহীদকে অভ্যর্থনা সভায় যোগ দেয়ার জন্যে অনুরোধ করেছে। জবাবে শহীদ একটু হেসেছে, কিছু বলেনি। এতক্ষণ সে সান্ধ্য দৈনিকগুলোর পাতা উল্টিয়েছে, আর বুড়ো মেজর বদরুদ্দিনের বকবকানি শুনেছে। সে উঠে গিয়ে হল ঘরে বসবে কিনা ভাবছে, এই সময় ভেজানো দরজার এক চিলতে আলো ভরা কাঁকটুকু ভরে গেল অন্ধকার। শহীদ বুঝলো কেউ একজন দরজার ফাঁক দিয়ে তাদের দেখছে। শহীদ ফিরে তাকাতেই লোকটা সরে গেল।
ভেজানো দরজার এক চিলতে আলো তরা কাঁকটুকু আবার দৃষ্টি গ্রাহ্য হয়। শহীদ বুঝলো হল ঘরের সভা শুরু হয়ে গেছে। উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর কে একজন বহুত দিচ্ছে গদগদ কণ্ঠে, আলী নকীব আমাদের দেশের গৌরব। তাঁর জীবন আমাদের কাছে আদর্শ স্বরূপ। তিনি অদ্বিতীয় কর্মবীর, সামান্য অবস্থা থেকে তিনি যে অবস্থায় উঠেছেন তাতে কবির ভাষায় বলতে হয়, তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ।
বক্তৃতা ভেসে আসছিল গ্রীন রুমের পাশের ঘরটিতে, শহীদ শুনছিল। মেজর বদরুদ্দিন ফিসফিস করে বললো, যে বক্তৃতা দিচ্ছে, তার নাম হলো আলী তরফদার। প্রোফেশনাল বক্তা। দশটা টাকা ফেললেই যেমন খুশি বস্তুত চাও তেমন বক্তৃতা দেবে তরফদার। ওকে মি. মাহতাব তাড়া করে এনেছে।
মেজর বদরুদ্দিন মাথা নাড়, দুনিয়া একটা চিড়িয়াখানা হয়ে উঠেছে দিন দিন। এই যে সুলতানা পারভিন স্টেজ আলো করে বসে আছে, চৌধুরী আলী নকীবের বেগম, কদিন আগে সে কি ছিলো জানো? এ্যাকট্রেসলাহোর এ্যাকটিং করতা সুলতানা পারভিন..তার মানে বেগম সাহেবার চরিত্রখানা কি রকম ছিলো বুঝতেই পারছো! স্বভাব-চরিত্র এখনো বদলেছে কিনা কে জানে! কথায় বলে কাদা ধুলেও কাদা! হুঁ, …সুলতানা পারভিন এখন কোটিপতির স্ত্রী, তার কতা শান-শওকত, কতো বাহানা। অথচ দশ এগারো বছর আগে তার যখন বিয়ে হয় তৈমূর মীর্ধার সাথে তখন পাকাটির মতো দেখতে ছিলো মেয়েটা, সাত চড়ে রা বেরোতো না মুখ দিয়ে। তৈমুর মীর্ধা ছিলো আমার বন্ধু মানুষ, এক গোলাসের ইয়ার। আমি তখন লাহোর আছি মেজর হয়ে আর তৈমুর মর্ধা এয়ার ফোর্সের স্কোয়াড্রন লীডার। আমি বলেছিলাম–তৈমুর, পাখিকে উড়াল তো শেখালে, দেখো এখন না আবার পালিয়ে যায়। তৈমুর হো হো করে হেসেছিল। শালা একটা স্কাউণ্ডেল ছিলো যাই বলো শহীদ। দুবছর আড়াই বছর যেতে না যেতেই কোথায় যে গা ঢাকা দিলো শালা সবাই বললো মারা গেছে, ডেথ সার্টিফিকেট পর্যন্ত ইস্যু করা হলো, কিন্তু আমি জানি তৈমুর মীর্ধা মরেনি। ও হলো উঁচু জাতের জুয়াড়ী। কোনো একটা তালে পড়েছিল হয়তো…
শহীদ উঠে দাঁড়ায়। এই সময়। বুড়ো মেজর বদরুদ্দিন বলে, ওকি কোথায় যাচ্ছো?।
হল ঘরে গিয়ে একটু বলি। আপনি যাবেন তো চলুন।
একটু ইতস্ততঃ করলো মেজর। তারপর বললো, চলো। চৌধুরী আলী নকীব কি বলে শুনেই আসি। কিসমত যখন দিয়েছে তখন কে জানে মাহমুদও হয়তো বক্তৃতা দেবে। ওর বক্তৃতাও শুনবো। কথায় বল পড়েছি বানর, যত খানা খেতে হবে সাথে!
ছোটা ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে ওরা তখন হলঘরে ঢুকেছে। শহীদ বললো, মাহমুদ কে?
চেনো না? ঐ দেখা স্টেজে বসে আছে সুলতানার ডান পাশে। ভাবখানা যেন ভাজা মাছটা উন্ট খেতে জানে না। ব্যাটা ডাকাত, পাঁচ বছর আগেও জেলের ঘানি টেনেছে আর আজ পোজ নিয়েছে একখানা যেন মহাপুরুষ!
ছোটা স্টেজের উপর বিচিত্র রং-এর আলো জ্বলছে। ডায়াসের উপর বসে আছে। সভাপতি জনৈক সম্মানিত নাগরিক, চৌধুরী আলী নকীব, সুলতানা পারভিন, তার ভাই মাহমুদ আর ক্লাবের সেক্রেটারী মি. মাহতাব। একজন বক্তা বক্তৃতা করছিল উদাত্ত কণ্ঠে। হঠাৎ শহীদের চোখ পড়লো ডানদিকের প্রবেশ দরজার দিকে। একজন দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ লোক পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে দরজার আড়াল ঘেষে। মুখটা দেখা যায় না। শহীদের মনে হলো লোকটাকে যেন লে চান। কিন্তু কে হতে পারে কিছুতেই মনে করতে পারলো না।
একে একে সকলের বক্তৃতা শেষ হলো। সবশেষে সভাপতির অনুরোধে বক্তৃতা দেবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন চৌধুরী আলী নকীব। বয়সে প্রৌঢ়। কিন্তু অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী। প্রশান্ত হাসি। মোটা রাট গলার স্বর। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কোটিপতি আলী নকীব বললেন, আমার মতো নগণ্য একজনকে আপনারা যে সম্মান উপহার দিলেন
হল ঘরে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। সকলেই পূর্ব পাকিস্তান তথা সারা পাকিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী চৌধুরী আলী নকীবের বক্তৃতা শুনছে তন্ময় হয়।
আলী নকীব বললেন, ভদ্রমহিলা, ভদ্রমহোদয়গণ, আমি সত্যই অভিভূত হয়ে পড়েছি। আমি বৃদ্ধ হয়েছি, হয়তো বেশি দিন বাঁচবো না কিন্তু
হঠাৎ দপ করে ঘরের সব কটা আলো নিতে গেল। পর মুহূর্তেই প্রচণ্ড একটা শব্দের সাথে সাথে হৃদয়বিদারক আর্তনাদে ভরে গেল হল ঘর। চারদিকে ভয়ার্ত চিৎকার শোনা গেল।
শহীদ হতবাক হয়ে পড়েছিল ঘটনার আকস্মিকতায়। চেতনা ফিরতেই সে ছুটে বেরিয়ে এলো হল ঘর থেকে এপাশের স্টাডিকর্নারে। তার অনুমান মিথ্যে নয়। দেখলো একটা ছায়া মূর্তি লাফিয়ে এসে পড়েছে ছোটো ঘরটায়। শহীদ পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো লোকটাকে কিন্তু পর মুহূর্তেই একটা প্রচণ্ড আঘাত পড়লো, তার তলপেট ঘেঁষে বাঁ উরুর উপর। সে ছিটকে পড়লো দূরে। পকেট থেকে ততক্ষণে পিস্তল বের করেছে। শহীদ। ঠিক এই সময় আলো জ্বলে উঠলো। ছায়া মূর্তি ফিরে তাকালো। শহীদ চমকে উঠলো।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। কঠোর মুখে একটা তীব্র অভিব্যক্তি।
কুয়াশা, তুমি!
কুয়াশা একটু হাসলো। বললো, হ্যাঁ আমি
কি একটা আবেগ শহীদ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠতে তার সময় লাগলো না। দয়া, মায়া, মমতায় ভুললে চলবে না। মায়া-মমতার চেয়ে কর্তব্য অনেক বড়। কুয়াশা দুষ্কৃতকারী; কুয়াশা দ্য-কুয়াশাকে ছেড়ে দিলে চলবে না।
শহীদ উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু ততক্ষণে কুয়াশা দরজা ঠেলে বাইরে চলে গেছে। বাইরে থেকে শেকল তুলে দিয়ে গেছে দরজায়। শহীদ বার বার দরজার কপাট ধরে নাড়া দিলো। কিন্তু সবই নিষ্ফল।
হাতের ঘড়িতে সময় দেখলো শহীদ। এতক্ষণে নিশ্চয়ই কুয়াশা নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে।
শহীদ গম্ভীর মুখে ফিরে এলো হল ঘরে। তার অনুমান মিথ্যে নয়। চৌধুরী আলী নককেই খুন করা হয়েছে। চৌধুরী আলী নকীব পড়ে আছেন মঞ্চের উপর রক্তাক্ত দেহ। গুলিটা লেগেছে ঠিক হৃৎপিণ্ডে। কিছু বলার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। সুলতানা পারভিন উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। মাহমুদ বিমর্ষ, গম্ভীর।
শহাদকে দেখে ক্লাবের সেক্রেটারী মি. মাহতাব এগিয়ে আসেন। ব্যাকুল কণ্ঠ বলেন, দেখুন দিকি মি. শহীদ, কি বিপদেই পড়লাম।
শহীদ শুধু ম্লান হাসলো। বললো, চিন্তা করবেন না মি. মাহতাব। আমি এদিকটা দেখছিঃ আপনি পুলিশে খবর দিন।
.
০২.
সকাল দশটায় লাইব্রেরী ঘরে বসে শহীদ একটা চিঠি ভ্রাট করছিল প্রাদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের ডি. আই. জি. মি. কবীরের কাছে। চিঠিখানা এই রকমঃ
জনাব, আপনাদের কন্ট্রাক্ট আমি গ্রহণ করলাম। চৌধুরী আলী নকীবের হত্যাকাণ্ডে আমার ব্যক্তিগত কিছু দায়িত্বও রয়েছে, কারণ নিজে আমি সে রাতে নাভানা ক্লাবে উপস্থিত ছিলাম। যাহোক, আমি যথাশীঘ্র তদন্ত শুরু করবো।
চিঠিখানা এনভেলাপে ভর চিঠির উপর ডি. আই. জি, অফিসের ঠিকানা লিখলো শহীদ। সে তার কাজে তনায় ছিলো। হঠাৎ একফলা একটা ছুরি তীব্র বেগে ছুটে এসে বিদ্ধ হলো ক্যালেন্ডারের উপর.. লাল কালিতে লেখা রোববারের তারিখটায়। পেছনে মোটা কর্কশ গলায় কে যেন বলে উঠলো, এক পা নড়েছে। কি মরেছো! সাবধান!
শহীদ সবই বুঝলো কিন্তু কোনো উত্তজনা প্রকাশ করলো না। মাস্টারি ভঙ্গিতে শুধু বললো, ছুরি ছোঁড়াটা ঠিকই হয়েছে, কিন্তু গলা কাঁপছে কেন কামাল? বলে সে পেছন ফিরলো।
কামাল বললো, গলা কাঁপবে না তো ঠ্যাং কাঁপবে? মাত্র মাসখানেক হলো ছুরির এই খেলাটা প্র্যাকটিশ করছি–সেই তুলনায় যথেষ্ট ভালো করিনি বলতে চাস?
শহীদ হাসলো।
কামাল বললো, এক মহিলা ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। তোর সঙ্গে দেখা করতে চান।
দয়া করে বলে দিলেই পারতিস আমি ব্যস্ত আছি, দেখা হবে না।
বলেছিলাম। লাভ হয়নি কিছু। মহিলা ড্রয়িংরুমে জাকিয়ে বসেছেন। খুব নাকি জরুরী দরকার।
বটে?
হ্যাঁ, আমাকে বলে দিলেন মি. শহীদের সঙ্গে দেখা না করে কিছুতেই যাবেন না। দরকার হলে ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করবেন।
শহীদ হাতের আম বন্ধ করলো। বললো, চল তো দেখি।
মহিলা একাকী ডুয়িংরুমে বসে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাচ্ছিল। শহীদ ও কামাল ঘরে ঢুকতেই নড়েচড়ে বনে। একটু হেসে বলে, আপনি নিশ্চয়ই মি. শহীদ। আমার নাম বেগম রশিদ। আমি আপনার বন্ধু এ্যাডভোকট মি. শফির কাছ থেকে একখানা চিঠি নিয়ে এসেছি।
মেপে মেপে কথাগুলি বললো বেগম রশিদ। যেন এই কথাগুলি বলার জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত হয়েছিল। ব্যাগ খুলে বের করলো একটা খামে আটা চিঠি। তারপর হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে দিলো শহীদের হাতে।
শহীদ চিঠিখানা পড়তে লাগলো। বেগম রশিদ তাকালো কামালের দিকে। বললো, মি. শহীদ বুঝি আপনার বন্ধু?
জ্বি।
এই দেখুন, আমি ঠিক অনুমান করেছিলাম। বেগম রশিদ সগর্বে হাসলো।
বেগম রশিদ মধ্যবয়স্কা মহিলা। দেখতে শুনতে অপূর্ব সুন্দরী। চিকন করে টানা দুটি কাজল ভ্রূর নিচে ডাগর আঁখি। থুতনীর নিচে সামান্য একটু খাঁজ। সোজা সিঁথির দু পাশে কুঞ্চিত অলকরাশি ঘাড়ের পেছনে এলো খোঁপায় বাঁধা। বয়স হলেও বেগম রশিদের যৌবন এখনো তার তনী শরীরে অটুট বন্দী হয়ে আছে। গায়ের রংটা অদ্ভুত ফর্সা…রক্তাভ।
চিঠিখানা পড়লো শহীদ। বললো, বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
বলছি।
বেগম রশিদ একটু ইতস্ততঃ করলো, তেষ্টা পেয়েছে, এক গ্লাস পানি আনতে বলুন দয়া করে।
গফুরকে ডেকে পানি আনতে বললো শহীদ। বেগম রশিদ শহীদের দিকে তাকিয়ে হাসলো। বললো, এতো বড়ো বাড়িটায় আপনি থাকেন?
জ্বি।
আপনাকেই মানায়।
বেগম রশিদের সুবিন্যস্ত দাঁতগুলি মিষ্টি হাসিতে ঝকঝক করে উঠলো। ভাবে ভঙ্গিতে একটু ঘরোয়া ও অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করলো।
গরুর টেবিলের ওপর এক গ্লাস পানি এনে রাখলো। বেগম রশিদ ঢক ঢক করে পানি খেলো। আলতো করে ঠোঁট মুছলো হাতের পাতলা রুমাল দিয়ে। আগের চেয়ে অনেক সপ্রতিভ দেখাচ্ছিল তাকে।
শহীদ তাকিয়েছিল বেগম রশিদের হাতের দিকে। মহিলার হাতের আঙুলগুলির অদ্ভুত একটা বৈশিষ্ট্য আছে। আঙুলগুলি কেমন যেন রোগা আর কুকরে যাওয়া। কুৎসিৎ। অমন সুন্দর শরীরে আঙুলগুলো বেমানান লাগে।
হাসলো বেগম রশিদ। বললো, বেশ হোলি লাগছে আপনার এখানে বসে। তা অমন করে কি দেখছেন আপনি, রুমালটা?
রুমালটা খুলে দেখায় বেগম রশিদ। গর্বে তার চোখমুখ ভরে ওঠে, এই যে ফাইন সুতোর কাজ দেখছেন সব আমার হাতে করা। কি, পছন্দ হচ্ছে আপনার?
মৃদু হেসে শহীদ বললো, আপনি এখানে কেন এসেছেন খুলে বলুন বেগম রশিদ।
দপ করে যেন নিভে যায় বেগম রশিদের উৎসাহ। অস্ফুট গলায় বলে, বলছি…।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেগম রশিদ। তারপর বলতে শুরু করেঃ
ব্যাপারটা একান্ত ভাবে আমাদের পারিবারিক। আমার এক বড়জা মানে ভাসুরের স্ত্রীর হয়ে আপনার কাছে এসেছি আমি। বড়জা হলে কি হবে–বয়সে আমার চেয়ে ঢের ছোটো। বেচারী বড় হতভাগী। দুদুবার বিয়ে হয়েছে। দুবারই কপালের দোষে স্বামী হারিয়েছে।
কামাল এতক্ষণ পত্রিকা পড়ছিল। পত্রিকা নামিয়ে এইবার সে জুত হয়ে বসে। বেগম রশিদের কথায় কেমন একটা গাম্ভীর্য প্রকাশ পায়।
আমার বড়জার প্রথম বিয়ে হয় আজ থেকে এগারো বছর আগে। স্বামী ছিলো এয়ারকোর্সের বড় চাকুরে। থাকতো লাহোরে। সেখানেই সুখ স্বাচ্ছন্দে দিন কেটে যাচ্ছিলো আমার বড়জা সুলতানার। কিন্তু সুখ কপালে সইলো না। বিয়ের বছর দুই পরেই হঠাৎ তার স্বামী নিখোঁজ হয়ে যায়। কিছুদিন পর জানা গেছে অপঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। এই সংবাদে খুব দুঃখ পায় সুলতানা। কিন্তু দুঃখ পেলেই কি করবে? কপালের উপর তো কারো হাত নেই।
দম নেয় বেগম রশিদ। তারপর বলে, সুলতানা বাঙালী হলেও বরাবর লাহোর থাকতো। গতবছর আমার ভাসুর লাহোরে গিয়েছিলেন ব্যবসার কাজে। আমার ভাসুরের বয়স হয়েছিল ধরুন ষাটের মতো। গত পনেরো বছর যাবৎ তিনি বিপত্নীক। আমরা কতো তাঁকে বলেছি বিয়ে করার জন্য। কিছুতেই তিনি বিয়ে করেননি। কিন্তু আশ্চর্য, গত বছর লাহোরে গিয়ে কি যে হলো তাঁর আল্লা মালুম। সুলতানাকে তিনি প্রথম দেখেন একটা সিনেমায়। সুলতানা তখন আবার সিনেমায় অভিনয় করতো। সুলতানাকে বিয়ে করার জন্যে আমার ভাসুর লোক লাগালেন। প্রচুর টাকা খরচ করলেন, তারপর বিয়ে হয়ে গেল।
শহীদ এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। ভেতরে ভেতরে কৌতূহল উদয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে সংযত হলো। চৌধুরী নকীবের হত্যাকাণ্ডের রহস্য ভেদে পুলিস তাকে নিযুক্ত করেছে, বেগম রশিদ নিশ্চয়ই তা জানে না। দেখা যাক, বেগম রশিদ কি বলেন। সে মনযোগী ভাব নিয়ে গল্প শুনে যেতে লাগলো। কামাল বললো, একজন বুড়োকে বিয়ে করলেন আপনার বড়জা?
হ্যাঁ করলেন। সুলতানা তখন সিনেমা লাইনে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিল। আমাকে সে বলেছে, বিয়ে করার ইচ্ছে একদম তার ছিলো না। প্রথম স্বামীকে সে খুব ভালবাসত। তার স্মৃতি নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে বলে সে ভেবেছিল। কিন্তু বোঝেন তো, তার বয়স কম, লাইনটা আবার খারাপ, এদিকে দেখতে সে অদ্ভুত সুন্দরী। প্রথম স্বামীর স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে চাইলেই সে পারবে কেন? নানারকম মানুষ অহরহ তাকে উৎপাত করতে শুরু করলো। এইসব উৎপাত থেকে বাঁচবার জন্যেই সুলতানা আমার ভাসুরকে বিয়ে করে। বিয়ের পর সুলতানা আমার ভাসুরের সঙ্গে লাহোর ছেড়ে মানিকপুর চলে আসে, আচ্ছা আপনারা কেউ মানিকপুর গিয়েছেন?
কামাল মাথা নাড়লো, হ্যাঁ গিয়েছি।
চমৎকার জায়গা, তাই না? থানা আছে, হাসপাতাল আছে, কাপড়ের কল আছে, সুন্দর সুন্দর রাস্তা-ঘাট, গাড়ি ঘোড়া সব আছে। মানিকপুরেই আমাদের বাড়ি। আমার ভাসুরের দোতলা বাড়িটার নাম চৌধুরী কুটির। মোজাইক করা দেয়াল আর পাথরের মেঝে। এই বাড়িতেই বিয়ের পর বৌ নিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন আমার ভাসুর।
কিন্তু ভাগ্যের লেখা খণ্ডায় কার সাধ্য বলুন? বিয়ের পর দুমাসও কাটলো না, আমার ভাসুর প্রাণ দিলেন আততায়ীর হাতে। আজ পর্যন্ত সেই খুনের কোনরকম সুরাহা হয়নি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেগম রশিদ বলে, বেচারী সুলতানা। এই বয়সেই দু-দুবার কপাল ভাঙলো ওর?
শহীদ নিবিষ্ট মনে শুনে যাচ্ছিলো। বললো, তারপর…?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না বেগম রশিদের কাছ থেকে। বেগম রশিদ অনেকটা আপন মনে বলে, আমার ভাসুরের ষাট বছর বয়স হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এমন সুন্দর স্বাস্থ্য ছিলো যে দেখে চল্লিশ বছরের বেশি কিছুতেই মনে হতো না। আর বেচারী সুলতানা। স্বামীর মৃত্যুতে সে অবশ্য বার্ষিক ছাপ্পান্ন লক্ষ টাকা আয়ের বিপুল এক সম্পত্তির মালিক হয়েছে। কিন্তু মানুষের অভাব কি টাকা দিয়ে পূরণ হয়, বলুন? যার স্বামী নেই, তার সাধ আহ্লাদও নেই। সে টাকা দিয়ে কি করবে?
অত্যন্ত মূল্যবান কথা, …
একটা সূক্ষ্ম হাসি শহীদের ঠোঁটে ফুটেই মিলিয়ে যায়, তা আপনার বড়জা সুলতানা কি বিবাগী হয়ে সংসার ছেড়ে দিচ্ছেন?
অসম্ভব কি?
বেগম রশিদ চোখ বড় বড় করে তাকায় শহীদের দিকে।
চিন্তা করুন খুব শান্ত আর নরম স্বভাবের একটা মেয়ের কথা। দুদুবার সে হোঁচট খেয়েছে জীবনের কাছে। আত্মবিশ্বাস, আনন্দ সব গেছে তার। মন তার উড় উড়ু। এই অবস্থায় এই মেয়ে যদি সংসার ত্যাগ করতে চায়, আশ্চর্য কি?
না, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
বড় কষ্টে আছে বেচারী সুলতানা। তার দুঃখ দেখে আমাদের প্রাণ ফেটে যায়। সম্পর্কে বড় হলে কি হবে সে আমাকে দেখে ঠিক তার বড় বোনের মতো। শহীদ সাহেব, …
বলুন।
আমি সুলতানার জন্য কিছু করতে চাই। আপনি যদি সাহায্য করতে পারেন
যেমন?
খবর পেয়েছি।
বেগম রশিদের বড় বড় চোখ দুটি তীক্ষ্ণতায় ছোটো হয়ে আসে। বলে, বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছি সুলতানার আগের স্বামী অপঘাতে মরেনি। এখনো জীবিত আছে। তাকে উদ্ধার করে আনার ভার আপনার উপর দিতে চাই। মি. শফির কাছে গিয়েছিলাম, তিনি আপনার কথা বলে দিয়েছেন। এখন দয়া করে যদি ভার গ্রহণ করেন।
শহীদ কথা বললো না। চুপ করে রইলো। কামালের চোখে মুখে মৃদু উত্তেজনা ফুটে উঠলো। কি বলতে গিয়ে সে থেমে গেল। সারা ঘর নিস্তব্ধ। শুধু দেয়াল ঘড়ি টিক টিক করছে।
একটু ভাবুন বেচারী সুলতানার কথা। প্রথম স্বামীর প্রতি তার ভালবাসা চিরদিনই অটুট ছিলো। এই অবস্থায় সে যদি তার স্বামীকে ফিরে পায়, কি পরিমাণ আনন্দ সে পাবে চিন্তা করুন!
সে অবস্থায় সুলতানার চেয়ে আপনিই বোধহয় বেশি আনন্দ পাবেন, তাই না। বেগম রশিদ!
আপনি ঠিক ধরেছেন। সুলতানাকে আমি বড় ভালবাসি। চিরদুঃখিনী সুলতানা যদি তার স্বামীকে ফিরে পায় তাহলে আমার মতো সুখী আর কেউ হবে না। আপনি যদি সুলতানার স্বামীকে উদ্ধার করে আনার ভার গ্রহণ করেন, তাহলে মানিকপুরের চৌধুরী পরিবার আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে।
একটু থেমে বেগম রশিদ বলে, ভালো একটা source থেকেই সুলতানার প্রথম স্বামীর জীবিত থাকার সংবাদটা পেয়েছি। সে নাকি এখন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ছদ্মবেশে আছে। আমি অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছি। মি. শহীদ।
এবং অনেক দুঃখ নিয়ে আপনাকে ফিরে যেতে হবে বেগম রশিদ।
শহীদ বললো, আমি নিজেও দুঃখিত। আপনার এই কেস গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়
শহীদের কথায় খিলখিল করে হেসে ওঠে বেগম রশিদ। বলে, আপনি পাকা লোক মি. শহীদ। আমারই ভুল হয়েছে। কেসটা দেয়ার আগে আপনার ফি-র কথাটা আলোচনা করা উচিত ছিলো। তা দেখুন, আমি নিজে গরীব মানুষ। আপনার মতো স্বনামধন্য লোকের কি জোগাতে পারবো এমন সামর্থ্য আল্লা আমাকে দেননি। তবে…
বেগম রশিদ অল্প একটু হাসলো, সুলতানার প্রথম স্বামীকে যদি উদ্ধার করতে পারেন, তাহলে…
আপনি অতি মহিয়সী মহিলা বেগম রশিদ। বড়জার দুঃখে কাতর হয়ে টাকা খরচ করা আপনাকেই সাজে। কিন্তু আমি এবারও দুঃখ প্রকাশ করছি।
এবার সত্যি সত্যি দুঃখিত হলা বেগম রশিদ। বললো, হু, বুঝতে পারছি দরে পোষাবে না বলে ভয় করছেন আপনি। কি জানেন? কোটিপতি চৌধুরী আলী নকীবের ভাইয়ের বৌ-এর পক্ষে আপনার দাবি মেটানো অসম্ভব হতো না কিন্তু কি বলবো? সবই কপালের ফের।
চৌধুরী আলী নকীব!
শহীদ যেন অতিশয় অবাক হয়েছে এমন ভাব দেখায়। বলে, চৌধুরী আলী নকীব আপনার ভাসুর?
চেনেন দেখছি। হ্যাঁ, উনিই আমার ভাসুর। সুলতানা বর্তমানে ওই বিধবা স্ত্রী। মাস খানেক আগে চৌধুরী সাহেবের হত্যার খবর পত্রিকায় নিশ্চয়ই দেখেছেন?
দেখেছি! সুলতানা তাহলে সুলতানা পারভিন? আর তার প্রথম স্বামীর নাম তাইমুর মীর্ধা?
ঠিক তাই।
বেগম রশিদ মাথা নাড়ে, তাইমুর মীর্ধাকেও আপনি চেনেন দেখছি।
শহীদ সে কথায় কান দিলো না। সে শুধু চৌধুরী আলী নকীবের হতাকাণ্ডের সঙ্গে বেগম রশিদের বলা কাহিনীর সম্পর্ক কি হতে পারে, তা-ই চিন্তা করলো।
ওদিকে বেগম রশিদ বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। দুঃখের গলায় বলে, মি. শহীদ, অনেক আশা করে আপনার কাছে এসেছিলাম। এভাবে ফিরিয়ে দেবেন, সত্যি বলতে কি কখনো আশা করিনি। যাক গে, এখন তাহলে ওঠা যাক…
শহীদ বললো, চলুন, আপনাকে আমরা গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছি।
বেগম রশিদ উঠলো। দীর্ঘ সুঠাম শরীর। অপূর্ব সুন্দর দুটি ভাবাময় চোখ। শহীদ কামাল দুজনে তাকে গেটের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।
যেতে যেতে শহীদ বললো, চৌধুরী সাহেবের সম্পত্তির বার্ষিক আয় কতত বললেন?
ছাপান্ন লক্ষ টাকার মতো।
চৌধুরী সাহেব আপনার আপন তাসুর?
আপনই বলতে পারেন। চৌধুরী আলী নকীব সাহেবের সহোদর ভাই কেউ নেই। আমার স্বামী তাঁর আপন চাচাতো ভাই।
চৌধুরী আলী নকীব বিয়ের পরে সুলতানা পারভিনের নামে সবটা সম্পত্তি উইল করে দিয়েছিলেন, তাই না?
জ্বি হাঁ। অল্প বয়সে বেচারী মেলা টাকার মালিক হয়েছে বটে, কিন্তু টাকায় কি সুখ আসে মি. শহীদ?
আপনার তো টাকাতেই সুখ বেগম রশিদ
মানে, অস্ফুট আর্তনাদ করে থেমে যায় বেগম রশিদ। তার চোখ মুখে ভয়ের ভাবনা ফুটে উঠেছে।
শহীদ একথার জবাব দিলো না। শক্ত গলায় শুধু প্রশ্ন করলো, আপনি এখানে কার স্বার্থে এসেছিলেন বেগম রশিদ?
কার স্বার্থে! কি বলছেন আপনি?
বেগম রশিদ যেন অবাক হয়। বলে, আমি কেন এসেছি সে কথা আগেই আপনাকে বলা হয়েছে। আমি বড়জা সুলতানার জন্যে, সুলতানার স্বার্থে এসেছিলাম..
মিথ্যে কথা। আপনি আপনার নিজের স্বার্থে এখানে এসেছিলেন।
বেগম রশিদ থতমত খেয়ে যায়। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠে। শহীদ একটু হেসে বলে, সে যাই হোক বেগম রশিদ, আমরা আপনার কেস গ্রহণ করলাম।
বেগম রশিদ আনন্দিত হয়ে উঠলো। শহীদের দিকে তাকিয়ে বললো, কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো বুঝতে পারছি না। তাইমুর মীর্ধাকে যদি উদ্ধার করে দিতে পারেন তাহলে আমরা সকলে আপনাদের কেনা হয়ে থাকবো।দাঁড়ান, আমি
আমার ঠিকানাটা দিয়ে রাখি।
বেগম রশিদ ব্যাগ থেকে হাত দিয়ে এক টুকরো কাগজ বের করলো। ব্যাগের উপর কাগজটা রেখে ঠিকানা লিখতে লাগলো। ইতিমধ্যে শহীদ ও কামালের দৃষ্টি বিনিময় হলো বার দুই। কামাল হাসলো।
এই যে আমার ঠিকানা নিন।
বেগম রশিদ ঠিকানাটা শহীদকে দিলো। শহীদ সংযত গলায় বললো, কাজ করার আগে আপনাকে জানাবো বেগম রশিদ। দরকার হলে আপনার সঙ্গে দেখা করতেও যাবো।
বেগম রশিদ উচ্ছ্বসিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে লাগলো। কামাল ও শহীদের প্রশস্তি গাইতে লাগলো। তারপর চলে গেল বিদায় নিয়ে।
শহীদের মনে পড়ছিল কুয়াশার শান্ত কঠিন মুখের ছবিটা। যে কুয়াশাকে সে এতো ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, ঘটনাচক্রে আবার তার সঙ্গেই বাধলো সংঘর্ষ। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস।
শহীদ সেই রাতের ঘটনা স্মরণ করলো একবার আর কঠিন হয়ে উঠলো তার ইচ্ছা। না, হত্যাকারী যে-ই হোক না কেন, তার সঙ্গে আপোস নেই। শাস্তি তাকে দিতেই হবে। সেই ভালবাসার চাইতেও কর্তব্যের আহ্বান অনেক বেশি মূল্যবান। সে কথা ভুললে তো চলবে না।
শহীদ ও কামাল ফিরে এলো ডুয়িংরুমে। ঘরে এসেই কামাল একটা সোফায় বসে গাম্ভীর্য অবলম্বন করলো। শহীদ মৃদু হেসে বললো, রহসা ভেদ করতে চাইছিলি না? নে জুটিয়ে দিলাম।
“আহ্ ডিসটার্ব করিস না।
কামাল খুব মাতব্বর গোছের একজন ডিটেকটিভ মতো মুখভঙ্গি করে। বলে, আমি এখন কেসটার কথা ভাবছি।
বাপরে..
শহীদ হাসে, এমে দেখছি গরু কেনার আগেই দুইয়ের হিসাব।
সে আর কিছু বলে না। বেগম রশিদের লেখা ঠিকানাটার উপর চোখ বুলায়। সুন্দর মেয়েলী অক্ষরে লেখা আছে, বেগম আফিয়া রশিদ, পাতা বাহার রোড, মানিকপুর।
.
(পরের কথা)
০১.
মানিকপুর জায়গাটা ছরিব মতো সুন্দর।
জেলা শহর থেকে দশ মাইল উত্তরে পীরগঞ্জের উঁচু-নীচু টিলা। টিলা থেকে বেরিয়েছে একটা ছোটো আঁকাবাঁকা নদী। একটা প্ৰকাণ্ড চাল মাঠ দক্ষিণে রেখে নদী ঢুকেছে শাল-মহুয়ার জঙ্গলে। জঙ্গলের গা ঘেঁষে সবুজ গাছপালার ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে সরকারী হাসপাতাল। এখান থেকে মানিকপুরের শুরু। এখানে ওখানে সবুজ গাছপালার দ্বীপের ভেতর রয়েছে বাজার, থানা, পোস্টাসি, ট্যুরিস্ট হোটেল আর দি মানিকপুর কটন মিস নামে বিরাট এক কাপড়ের কল। কাপড়ের কল কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কলোনী। এর নাম চৌধুরী কলোনী।।
মানিকপুর শহর না হলেও নিদেন পক্ষে উপশহর। জেলা শহর থেকে চমৎকার পীচ ঢালা রাজপথ চলে এসেছে চৌধুরী কমোনী বরাবর। সেখান থেকে নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে রাজপথটি ছড়িয়ে আছে মানিকপুরের সর্বত্র। মানিকপুরে একটা হাই স্কুল আছে। একটা মুন্সেফ কোর্ট আছে আর আছে মহকুমা রেজিস্ট্রারী অফিস। মানিকপুর ট্যুরিস্ট এবং স্বাস্থ্য-লোভীদের পক্ষে আকর্ষণীয় জায়গা। এছাড়া বহু পুরানো আমলের নবাবদের তৈরি একটা ভাঙা দুর্গ আছে। এছাড়া আছে পীরগঞ্জের টিলায় হারিয়ে যাওয়া প্রকাও রাজা সাহেবের মাঠ ও শাল-মহুয়ার অরণ্য। জায়গাটার জলবায় অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর বলে দূর দূরান্ত থেকে প্রতি বছর বহু লোক এখানে চঞ্জে আসে। হেমন্তের শুরু থেকেই মানিকপুরে টুরিস্ট এবং স্বাস্থ্য লোভীদের আগমন শুরু হয়ে যায়। তাছাড়া প্রতিদিন বাইরে থেকে বহু লোক এখানে বেড়াতে এসে থাকে। কেউ রাজা সাহেবের মাঠে বা পীরগঞ্জের টিলায় বেড়াতে যায়। কেউ দেখতে যায় নবাবদের ভাঙা দুর্গ।
মানিকপুরের সবচেয়ে সুন্দর পথটির নাম পাতাবাহার রোড। এই রোড শুরু হয়েছে কলোনী থেকে, কিছুদূর গিয়ে সোজা পৌঁছেছে হাসপাতালে! সেখান থেকে শাল-মহুয়ার অরণ্য দক্ষিণ পাশে রেখে চলে গেছে। হোটেল তাজ-এ। হোটল তাজ রাজা সাহেবের মাঠের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ শাল-মহুয়ার ছায়া, পুবে ধূ ধূ মাঠের দিগন্ত।
জায়গাটা সত্যি সুন্দর। ছবির মতো সাজানো আর ঝকঝকে। মনে হয় কোনো এক শিল্পীর মনের একটি স্বপ্ন যেন শাল-মহুয়ার অরণ্যের পাশে, রাজা সাহেবের মাঠের কিনারায় ছবির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
পাতাবাহার রোডের ডান পাশে একটি পুরানো বাড়ির বাগানের সামনে দাঁড়িয়েছিল তেইশ চব্বিশ বছরের এক স্বাস্থ্যবতী শ্যামলা মেয়ে। নাম শাহেলি। দুপুর বারোটায় তখন পাতাবাহার রোড রীতিমত কর্মব্যস্ত। গাড়ি-ঘোড়া এবং লোকজনের চলাফেরায় সরগরম। রাস্তার কেউ কেউ চোখ তুলে এই স্বাস্থ্যবতী সুন্দর শ্যামলী মেয়েটিকে দেখে যাচ্ছিলো। কিন্তু শাহেলির কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে অপলক চোখে তাকিয়েছিল উত্তর প্রান্তের একটা লাল রঙের সুন্দর দোতলা বাড়ির দিকে। গাছপালার নিবিড়তার ফাঁকে বাড়িটার ওপরের একাংশ মাত্র দেখা যাচ্ছিলো। শাহেলি তাকিয়েছিল সেদিকেই।
মানিকপুরের সবচে বিখ্যাত লোকের বাড়ি ওটা, নাম চৌধুরী কুটীর। মানিকপুরে শাহেলি ফিরে এসেছে একমাসেরও আগে। কিন্তু ফিরে এসে অবদি একবারও ঐ বাড়িতে যায়নি। অথচ ধরতে গেলে ঐ বাড়িতেই সে মানুষ। দুবছর আগে শাহেলি যখন পড়াশোনার জন্য শান্তিনিকেতন যায় তখন জানতো ফিরে এসে প্রকৃতপক্ষে ঐ বাড়ির মালিক হবে রবিউল্লা আর সে-ই। কপালের ফেরে এখন সব উল্টে গেছে। এখন মালিকানার দাবি দূরে থাক, ঐ বাড়ির ত্রি-সীমানায় যাওয়ার অধিকারও শাহেলির কিছুমাত্র নেই। ঐ, বাড়ির মালিক এখন এককালের অভিনেত্রী সুলতানা পারভিন ও তার অভিভাবক বড় ভাই আশিক মাহমুদ। মাঝে মাঝে ঐ বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে শাহেলির। অধিকার না-ই থাক। অধিকার ছাড়া কি বাইরের মানুষের মতো একবার যাওয়া যায় না ঐ বাড়িতে? শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি ভরা ঐ লাল রঙের সুন্দর দোতলা বাড়িটা অজানা এক আকর্ষণে টানে শাহেলিকে। শাহেলি যেতে চায়। কিন্তু মা মানা করেন। শাহেলির বড় চাচা চৌধুরী সাহেব বেঁচে নেই, শাহেলি আর কেন যাবে ঐ বাড়িতে? মায়ের এইসব কথার অর্থ বোঝে না শাহেলি। একদিন সে চৌধুরী কুটীরে যাওয়ার জন্য জিদ ধরেছিল। মা বলেছিলেন, কি বেয়াদব মেয়ে রে বাবা। একশোবার মানা করছি। একটু যদি কথাবার্তা শোনে!
শাহেলি বলেছিল, কেন মা, একদিন গেলে কি হয়? রোজ রোজ তো যাচ্ছি না। একদিন গিয়ে শুধু বাড়িটা দেখবো আর নতুন চাচীর সঙ্গে গল্প করে আসবো।
ইস; নতুন চাচী। কথা শুনে আনন্দে আর বাঁচি না। বলি যেতে যে চাচ্ছিস ও একটা মানুষ না শয়তান? জানিস তোর বড় চাচাকে ঐ মাগীই খুন করেছে?
চমকে উঠেছিল শাহেলি।
মা বলেছিল, বুড়োকে মেরে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হয়েছে ঐ শয়তান মেয়েলোকটা, বুঝিস না কিছু?
বড় চাচার স্নেহময় হাসি মাখা মুখটা মনে পড়ে শাহেলির। বড় চাচার বুক ভরা ছিলো স্নেহ-মমতা। চৌধুরী বংশের প্রতিটি লোক তাঁর কাছে ঋণী। শাহেলিকে তিনিই শান্তিনিকেতন পাঠিয়েছিলেন। বি. এ. পাস করার পর রবিউল্লাহকে তিনিই চাকরি নিতে দেননি। তারই সাহায্য এবং নির্দেশে ছোটো একটুকরো জমি নিয়ে ফার্ম শুরু করেছিল রবিউল্লাহ। এখন সেই ফার্ম বিরাট বড় হয়েছে। সারা জেলার সেটা গর্বের কন্তু এখন। শুধু যে রবিউল্লাহ এবং শাহেলিকে তিনি সাহায্য করেছেন তা নয়। ডাক্তার চাচা, রশিদ চাচা থেকে শুরু করে চৌধুরী বংশের প্রতিটি মানুষকে নানাভাবে নিয়মিত সাহায্য করছেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনের জন্য অর্থ ব্যয়ে কোনদিন তাঁর কার্পণ্য ছিলো না। কেউ তাঁকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে এলে তিনি হাসতেন। বলতেন, খোদা আমাকে প্রচুর দিয়েছেন। এখনো দিচ্ছেন। ছেলেপুলে নেই, একলা একটা মানুষ… এতো ধনদৌলতে আমার হবেটা কি?
আরো বলতেন, আমার বংশের কেউ যদি লেখাপড়া না শিখে মূর্ষ হয়, অসম্মানটা কার? আমার পরিবারের কেউ যদি দুর্দশায় পড়ে, অপমানটা কার হয় শুনি?
এমন ফেরেশতার মতো মানুষ হঠাৎ রাতারাতি যেন বদলে গেলেন। লাহোরে ব্যবসার কাজে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বেড়াতে গিয়ে বিয়ে করে বসলেন লাহোর সিনেমা জগতের সুলতানা পারভিনকে। সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিলেন তার নামে। বিয়ের পর কমাসও কাটলো না। অপঘাতে মৃত্যু হলো তাঁর।
শাহেলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লাল রঙের দোতলা বাড়িটির দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকায়।
মা খুজতে খুজতে আসেন বাইরে। এসে ঋতু বধিত বাগানের কামিনী গাছের নিচে ভরা দিনের আলোয় খোলা চুলে শাহেলিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আঁৎকে ওঠেন।
ও কিরে শাহেলি। দাঁড়াবার কি নমুনা বাপু! রাস্তা দিয়ে কতো লোকজন যাচ্ছে, একটু যদি লজ্জা শরম থাকে। নে চল।
শাহেলির প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা হয়। দুবছর অন্য পরিবেশে মন তার বেড়ে উঠেছে স্বাধীন ভাবে। এসব বাধা নিষেধ ভালো লাগে না। মায়ের কথায় প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা হয় তার। কি ভেবে চেপে যায় সে। শুধু বলে, কারা কারা এসেছেন মা? বুলু চাচীমা এসেছেন?
হ্যাঁ, ওঁরা দুজনেই এসেছেন। রবিউল্লাহ আর তোর ডাক্তার চাচা এখনো আসেননি। ওরাও এখুনি এসে পড়বেন। চলতোর বুলু চাচীমা একটু আগেই খুঁজেছিলেন।
শাহেলি মায়ের পিছু পিছু ঘরে আসে। আজ শাহেলির মা মর্জিনা বানু চৌধুরী পরিবারের প্রায় সবাইকে দুপুর বেলা খেতে ডেকেছেন। শাহেলি আর রবিউল্লাহর বিয়ের ব্যাপারে সকলের মতামত শেষ বারের মতো জানার জন্যেই চৌধুরী পরিবারের সকলকে ডেকেছেন। কিন্তু, চৌধুরী আলী নকীবের বিধবা স্ত্রী সুলতানা পারভিন ও তার বড় ভাই মাহমুদকে ডাকেননি তিনি।
বেগম রশিদ বলে, যাই বলো মেজো আপা। সুলতানা না এলে ঠিক জমতে চায় না। ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
খোঁচা খেয়ে মর্জিনা বানু বলেন, কথাটা ঠিকই বলেছো ছোটো বৌ। কিন্তু বেগম সাহেবাকে যে খেতে বললো, তার উপায় আছে কিছু দেখছো তো আমার অবস্থাটা?
না, না…ওকে দাওয়াত না করে ভালো করছো ভাবী।
রশিদ সাহেব বললেন, সুলতানা ভাবী সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু ওই যে একটা পাজী আছে সঙ্গে মাহমুদ, ওকে আমি দুচোখে দেখতে পারি না।
আঃ, তুমি থামবে?
বেগম রশিদ রেগে মেগে তাকায় রশিদ সাহেবের দিকে। রশিদ সাহেব স্ত্রীর ধমক শুনে বুঝতে পারেন মাহমুদ সম্পর্কে অমন খোলামেলা মন্তব্যটা করা তার উচিত হয়নি। দেয়ালেরও কান আছে আর এ তো রীতিমত গুলজার আসর। কাঁচুমাচু হয়ে যান রশিদ সাহেব। নিচের দিকে চোখ নামিয়ে পা নাচাতে লাগলেন তিনি।
চৌধুরী আলী নকীব মানিকপুরের চৌধুরী পরিবারের ছেলে। নিজের চেষ্টায় তিনি বড়লোক হয়েছিলেন। সারা পাকিস্তানে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে আছে। পাকিস্তানের সবচেয়ে চালু ও জনপ্রিয় প্রাইভেট ব্যাঙ্ক, পিপলস ব্যাঙ্কের তিনি একমাত্র স্বত্বাধিকারী। তাছাড়া নানান জায়গায় রয়েছে তার চিনির কল, কাপড় ও সুতা তৈরির কল, তেল কোম্পানি ইত্যাদি। কোটিপতি আলী নকীব চৌধুরীর সহোদর কোনো ভাই বোন নেই। চৌধুরী আকবর হোসেন, ডাঃ চৌধুরী, চৌধুরী মমতাজ হোসেন ও চৌধুরী রশিদ আহমেদ,-এই চারজন তার আপন চাচাতো ভাই। দুর্ভাগ্যক্রমে ডাঃ চৌধুরী ও চৌধুরী রশিদ আহমদের কোনো ছেলে মেয়ে নেই। চৌধুরী আকবর হোসেন ও চৌধুরী মমতাজ হোসেন একটি মাত্র মেয়ে ও একটি মাত্র ছেলে রেখে মারা যান। চৌধুরী আকবরের মেয়ের নাম শাহেলি ও চৌধুরী মমতাজের একমাত্র ছেলের নাম রবিউল্লাহ। চৌধুরী আলী নকীব শাহেলি ও রবিউল্লাহকে আপন ছেলে-মেয়ের মতো ভালবাসতেন। বিপত্নীক আলী নকীব পরিণত বয়সে এদের বিয়ে দেবার কথাও ভেবেছিলেন। শাহেলিকে পাঠিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বাইরে। রবিউল্লাহকে একটা কৃষি ফার্ম করে দিয়েছিলেন। কথা ছিলো শাহেলি ফিরে এলেই আলী নকীব নিজের হাতে রবিউল্লাহর সঙ্গে তার বিয়ে দেবেন। তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি উইল করে রেখেছিলেন। সেই উইলে সম্পত্তির শতকরা পঞ্চাশ ভাগ দেয়া হয়েছিল শাহেলি আর রবিউল্লাহকে, পঁচিশ ভাগ রির্জাভ করা হয়েছিল হাসপাতাল, স্কুল ইত্যাদি জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক ব্যয়ের জন্য। বাকি পঁচিশ ভাগ সমান ভাবে দেয়া হয়েছিল ডা. চৌধুরী ও রশিদ আহমেদকে। কিন্তু হঠাৎ সাজানো দাবার ছকটা কে যেন উল্টে দিলো। গোলমাল হয়ে গেল সবকিছু। বুড়ো আলী নকীব হঠাৎ বিয়ে করে বসলেন। রাতারাতি উইল বদলে সম্পত্তি লিখে দিলেন যুবতী স্ত্রীর নামে।
এতদিনের সব আশায় ছাই ঢেলে দিলো কোথাকার একটা নষ্ট মেয়েমানুষ এসে।
রশিদ সাহেবের চোখ মুখ উত্তেজনায় ভুগতে থাকে। বর্তমান উইল যে জাল। প্রমাণিত করবেন তারও উপায় নেই। উইল সাক্ষী হিসাবে নাম এবং টিপসই আছে। তার এবং ডা. চৌধুরী দুজনেরই। উকিলের কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে বহু পরামর্শ নিয়েছেন রশিদ সাহেব। কোনো আশা পাওয়া যায়নি আইনজ্ঞদের কাছ থেকে। তারা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন উইল জাল প্রমাণিত করার কোনো উপায় নেই। চৌধুরী আলী নকীবকে হত্যার অপরাধে মাহমুদকে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টাও করছেন রশিদ সাহেব, শুধু চেষ্টা নয়, এর পিছনে তিনি সর্বস্ব ব্যয় করে চলেছেন। কিন্তু তার পক্ষের উকিল এ বিষয়েও কোনো নিশ্চিত আশ্বাস দেননি। মামলায় জেতা প্রায় অসম্ভব, এটা বুঝতে বাকি নেই কারো, রশিদ সাহেবের তো নয়ই।
রশিদ সাহেব উত্তেজিত নিঃশ্বাস ফেলছিলেন। এই সময় ঘরে ঢুকলেন ডা. চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী রাবেয়া সৈয়দ ও রবিউল্লাহ। নানারকম বিষয় নিয়ে গল্প জমে উঠলো। শাহেলির দিকে তাকিয়ে ডা. চৌধুরী বলেন, মানিকপুর কেমন লাগছে মা?
শাহেলি হেসে ফেললো, বাঃ, কেমন লাগবে আবার, তালো। নিজের জায়গা কারো কাছে খারাপ লাগে?
রবিউল্লাহ শান্তশিষ্ট, ধীর-স্থির মানুষ। সে একটু ঠাট্টা করে বলে, সারাদিন মুখ চুন করে বাড়িতে বসে থাকার নাম বুঝি তোমার ভালো থাকার লক্ষণ?
শাহেলি বলে, বাড়িতে থাকবো না তো কি ঐ চাষাদের কাজ দেখতে যাবো দুপুরের রোদ ভেঙে?
রবিউল্লাহ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বেগম রশিদকে বলে, দেখলেন বুলু চাচী মা বেগম রশিদের ডাক নাম), শাহেলি, ধরুন গিয়ে আমাকেই চাষা বলছে।
ডা. চৌধুরী হো হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, সম্পর্ক আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে তো। তাই শাহেলি মা গালিগালাজটা এখন থেকেই রিহার্সেল দিয়ে রপ্ত করে, নিচ্ছে।
শাহেলি লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে।
মর্জিনা বানু এসে বলেন, চলো তোমরা, খানা তৈরি।
ভেতরের বারান্দায় টেবিল পাতা হয়েছে। ডা. চৌধুরী, রশিদ সাহেব ও রবিউল্লা টেবিলে গিয়ে বসে। ব্রাবেয়া সৈয়দ আর বেগম রশিদ মর্জিনা বানুর জন্য অপেক্ষা করেন।
আপনিও চলুন আপা…
তোমরা গিয়ে বসো না ভাই। শাহেলি তোমাদের সঙ্গে বসুক। আমি তদারক করি
রাবেয়া সৈয়দ বলেন, শাহেলি তো বসছেই। আপনিও চলুন।
রাবেয়া সৈয়দ এই পরিবারের সবচে মানী আর বিদুষী মহিলা। সম্পর্কে ছোটো ভাই-এর বৌ হলেও স্বয়ং মরহুম আলী নকীব চৌধুরী পর্যন্ত একে অত্যন্ত সম্মান করতেন। রাবেয়া সৈয়দের কথায় দীর্ঘশ্বাস পড়ে মর্জিনা বানুর। বলেন, আর তাই আমাদের খাওয়া-দাওয়া। এখন মরতে পারলে বাঁচি। বড় কর্তা কি বাঁচার হাল কর রেখে গেছেন আমাদের!
কথাটা চৌধুরী পরিবারের সকলেরই মনের কথা। রাবেয়া সৈয়দ চুপ করে রইলেন। বেগম রশিদ জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
মর্জিনা বানু এইবার ফিসফিস করে বলেন, খবর শুনেছো ভাই?
কি?
এদিক ওদিক তাকান মর্জিনা বানু। তারপর তেমনি কিসফিসে গলায় বলেন, এই যে সুলতানার ভাইটা মাহমুদ, ও নাকি সুলতানার আপন ভাই না।
বলেন কি মেজো আপা। বেগম রশিদ আসমান থেকে পড়ে। বলে, না…না…এ হতেই পারে না।
তিক্ত অথচ তীক্ষ্ণ গলায় মর্জিনা বানু বলে, কেন হতে পারে না শুনি? সুলতানার সঙ্গে আমাদের পরিচয় তো মোটে ছসাত মাসের। তার কে আছে না আছে সে খবর তুমি আমি কতটুকু জানি বলো? পেয়ারের নাগরকে নিজের কাছে রাখার জন্য তাকে ভাই বলে জাহির করা, এটা কি এতোই অসম্ভব?
রাবেয়া সৈয়দ কিছু বললেন না।
বেগম রশিদ চোখ বড় বড় করে বললো, কার মনে কি আছে আল্লাহ্ জানেন? শুনেছি প্রথম স্বামী মারা যাবার পর সুলতানা নাকি লাহোরে লিনমায় অভিনয় করতো।
তাহলেই বোঝে। একটা রাণ্ডী মেয়েমানুষের পক্ষে কিছুই অসম্ভব না। এমন
মর্জিনা বানু আবার চারদিকে তাকায়। তার চোখ দুটি লাল আর ধোঁয়াটে হয় উঠেছে। বলেন, আমার মনে হয় বড়কর্তাকে সুলতানাই গুণ্ডা দিয়ে মারিয়েছে…
ইয়াল্লা!
বেগম রশিদ প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, মেজো আপা, আপনি এসব কি বলছেন! শুনে যে রীতিমত আমার গা কাঁপছে
এটা কিন্তু ঠিক হলা না ভাই মেজো আপা।
রাবেয়া সৈয়দ শান্ত কণ্ঠে এবার বলেন, চৌধুরী সাহেবকে শত শত লোকের মাঝখানে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারী যে-ই হোক তার উদ্দেশ্য একটা নিশ্চয়ই ছিলো। কিন্তু সেটা না জানা পর্যন্ত এভাবে বিনা প্রমাণে দায়িত্বহীন ভাবে কাউকে হত্যাকারী বলা অত্যন্ত অন্যায় কাজ।
রাবেয়া সৈয়দ মৃদু গলায় বলে চলেন, লোক তো শুনি এই খুনের ব্যাপারে চৌধুরী পরিবারের মানুষের কথাও বলে? কার কথা সত্য বলবে বলো?
কই গো, তোমরা সব চল এসো। অদূরর বারান্দায় টেবিল থেকে ডাক্তার চৌধুরীর আর্তনাদ শোনা গেল, কতক্ষণ এভাবে কই মাছের ভাজা সামনে রেখে আকাকে কষ্ট দেবো?
সব কথা কাউকে বলবেন না আপা …
রাবেয়া সৈয়দ শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, কপালর দোয়ে আমরা সবাই এখন গরীব। আমরা যদি সুলতানা পারভিন আর তার ভাইয়ের নামে এসব রটিয়ে বেড়াই
তো সবাই বলবে আমরা হিংসে করে এসব বলছি। তাই না?
মর্জিনা বানু একটু থতমত খেয়ে যান। রাবেয়া সৈয়দ মিষ্টি হেসে বলেন, চলুন, কর্তারা ডাকছেন। আর দেরি করা ঠিক না।
খাবার টেবিলে কর্তারাও কিন্তু প্রায় একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। রশিদ। সাহেব বলছিলেন, আগের উইলটার কথা মনে আছে ছোটো ভাই?
ডাক্তার চৌধুরী বললেন, হু।
রশিদ সাহেব বললেন, আগের উইলটা করার সময় বড় কর্তাকে আমি অনেক নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম আপনি আপনার সম্পত্তি এভাবে আমাদের মধ্যে ভাগ করে দেবেন না। ভবিষ্যতে কি হয় কে জানে? আপনার স্বাস্থ্য ভালো, বয়সও এমন কিছু একটা হয়নি। এমনও হতে পারে আপনি আর একবার বিয়ে করবেন, ছেলেপুলে হবে। বড় কর্তা হা হা করে হেসে উঠেছিলেন। তোদর কথাবার্তার ধরনই আমি বুঝি না রশিদ। আমার ছেলেমেয়ে নেই বলতে চাস? শাহেলি, রবিউল্লা এরা আমার ছেলেমেয়ে নয়?
মর্জিনা এক বাটি কোর্মা এগিয়ে দেন ডাক্তার চৌধুরীর দিকে। বলেন, তোমাকে দিই ডাক্তার সাহেব।
সামান্য দাও। হয়েছে, হয়েছে আর না…
রশিদ সাহেব তাতে ঝোল মাখতে মাখতে বলেন, কি মানুষ ছিলো বড় কর্তা। আর হঠাৎ রাতারাতি কি হয়ে গেল।
সবই কপাল…
রশিদ সাহেব বলেন, এখন বড় কর্তার সমস্ত সম্পত্তির মালিক ঐ সুলতানা পারভিন আর তার বেয়াদব ভাইটা। কোনদিন যা করিনি এখন তাই করতে হবে। নিজেদের সামান্য যা কিছু আছে তারই উপর নির্ভর করতে হবে।
আর নির্ভর…
ডা. চৌধুরী আস্তে আস্তে অনেকটা আপন মনে বলার মতো বলেন, আমার প্র্যাকটিশ তো কোনদিনই ভালো ছিলো না তোমরা জানো! এদ্দিন সংসার চলছিল কাঠের গুদামটা দিয়ে। এবার সেটাও গেল। দশটা জাহাজী নৌকায় প্রায় চল্লিশ হাজার টাকার কাঠ চালান যাচ্ছিলো চালনা বন্দর। সাইক্লোনে দশটা জাহাজই রূপসা নদীতে দুবেছে। এক ধাক্কায়ই আমি শেষ।
এই দুর্ঘটনার কথা সবাই জানে। সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। মর্জিনা বান বলে, তোমার তো তবু শেষ সঙ্গতী রইলো ডাক্তার সাহেব। আমার? বাড়ি ভাড়া থেকে যে দেড়শোটি টাকা মাসে মাসে পাই ব্লক সেই আমার সম্বল।
রবিউল্লা এই আলোচনায় যেন বিব্রত বোধ করছিল। সে বললো, সবই ধরুন গিয়ে আমাদের কপালের কের। এসব বলে কি হবে।
রশিদ সাহেব বলেন, না অভাবের কথা আর বলবো না। রবিউল্লাহ ঠিকই বলেছে। এসব বলে কি লাভ? তার চেয়ে যদি পারি তাহলে ঐ সুলতানা পারভিন আর তার ভাই মাহমুদকে একটু ভালো রকম শিক্ষা দিয়ে গায়ের ঝালটা মেটাবো…
হঠাৎ ঘর বজ্র পতন। ভেতরের দরজা দিয়ে বারান্দায় আসে সুলতানা পারভিন ও মাহমুদ। সবাই মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে যায়। কেউ কথা বলতে পারে না।
বাঃ এ যে দেখছি রীতিমত ভোজের ব্যাপার। এক সুলতানা বাদে চৌধুরী পরিবারের সবাই উপস্থিত …
মাহমুদ হাসতে থাকে। তার পাশে অপ্রতিত হয়ে দাঁড়িয়ে সুলতানা।
মর্জিনা বানু হঠাৎ অভ্যর্থনায় মুখর হয়ে ওঠেন। বলেন, দয়া করে যদি তোমরা এলেই তাই তাহলে দাঁড়িয়ে কেন? বসো। আমাদের সঙ্গে চাট্ট ডাল ভাত যা হোক
সুলতানা বলে, আপনি ব্যস্ত হবেন না আপা। আমরা এই একটু আগে খেয়েছি।
একটু থেমে বলে, খুব অসময়ে এসে পড়েছি দেখছি।
না, না। সে কি।
মর্জিনা বানু রিনয়ে একেবারে বিগলিত, সময় অসময়ের কথা কি বলছে ভাই। এ হলো গিয়ে তোমার নিজের বাড়ি। নিজের বাড়িতে আসবে তার আবার সময় অসময় কি?
তা তো বটেই।
মাহমুদ মাথা নাড়ে, বলে, সুলতানা এসেছে আপনার শান্তি নিকেতন ফেরত মের সঙ্গে আলাপ করতে। বোধহয় নিয়ম মতো আপনার মেয়েরই যাওয়া উচিত ছিলো। তা মোহাম্মদ যদি পর্বতের কাছে না যায় তো পর্বতকেই মোহাম্মদের কাছে। আসতে হয়। কি বলেন?
রাবেয়া সৈয়দ বলেন, তা দাঁড়িয়ে কোনো ভাই মাহাদ? তোমরা বসো।
সুলতানা বললো, আপনারা খান। আমরা ততক্ষণ পাশের ঘরে বসছি।
শাহলির খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে বললে, চলুন চাচীমা আমরা ওই ঘরে গিয়ে বসি।
খাওয়ার পর সবাই বসবার ঘরে ঢোকে। একথা ওকথা নিয়ে গল্প জমে উঠে। রশিদ সাহেব তাকিয়েছিলেন সুলতানা পারভিনের দিকে। মনে মনে বলছিলেন, সুলতানা পারভিন, তুমি সত্যি একজন পাক অভিনেত্রী। অসময়ে এই বাড়িতে এসে ঢুকেছে। নিশ্চয়ই কোনো মতলবে, অথচ ভাবখানা দেখাচ্ছে তোমার মতো সরল আর নিরীহ মেয়ে হয় না! হুঁ।
মর্জিনা বানু পানের বাটা আনলেন। পান মুখে দিয়ে মেয়েরা ছেলেরা কখন অজান্তেই দুদলে ভাগ হয়ে গেলেন। পুরুষেরা বসেছেন সোফা ও কোচে ছড়িয়ে, মেরা বলেছেন এক কোণে দূরে। কিভাবে কিভাবে যেন শিকারের গল্প উঠলো। মাহমুদ বললো, যাই বলেন মানিকপুরের শাল মহুয়ার জঙ্গলে একদম কিচ্ছু মেলে না। দুদিন শিকার করতে গিয়েছি, দুদিনই কাক্কা। মেরেছিলাম গোটাকতক হরিয়াল আর ঘুঘু। হ্যাঁ, মানিকপুর ঘুঘু আছে বটে। প্রচুর ঘুঘু। তা ঘুঘু মারতে মন্দ লাগে না
রশিদ সাহেব বলেন, শিকার খুব ওস্তাদ বুঝি আপনি? অপেক্ষা করুন, পীরগঞ্জের টিলা থেকে মাঝে মাঝে চিতা বাঘ আসে। একদিন ঠিক মিলে যাবে দেখবেন।
তাহলে তো ভালোই হয়। ঘুঘু মেরে মেরে বিরক্ত হয়ে গেছি।
রশিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসে মাহমুদ, চিতা বাঘের খবরটা দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
হঠাৎ রবিউল্লাহকে সে প্রশ্ন করে, আপনি শিকার টিকার করেন না?
জ্বি না …
বলেন কি?
মাহমুদ অবাক হবার ভান করে। বলে। শিখবেন?
রবিউল্লাহ কোনমতে বিরক্তি চেপে বলে, তা শিখলে নেহায়েত মন্দ হতো না। কিন্তু কাজকর্ম কেলে শিকার করার সময় কোথায় বলুন?
স্ট্রেঞ্জ!
মাহমুদ হো হো করে হেসে ওঠে।
এ পাশে গল্প চলছিল মেয়েদের। বেগম রশিদ সুলতানাকে বলছিল, শুনলাম তুমি নাকি ঢাকা চলে যাবে?
না! কে বলেছে।
সুলতানা অপ্রতিভ হাসলো, বেশ তো আছি মানিকপুরে। রাবেয়া সৈয়দ একমনে দেখছিলেন সুলতানাকে। হঠাৎ তিনি বলেন, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরী আলাপ আছে সুলতানা। তুমি কি কাল দুপুরবেলা বাড়ি থাকবে?
হাঁ থাকবো।
তাহলে একবার যেতে পারি।
আসবেন। আমি বাড়ি থেকে বেরোই কালে ভদ্রে।
এদিকে ডাক্তার চৌধুরী জমিয়ে তুলেছিলেন মাহমুদের সঙ্গে। বলছিলেন, কবে ছিলে বলছে, পঞ্চাশে?
হ্যাঁ, ফিফটি থেকে ফিফটি-ফাইভের মধ্যে। রবার্ট হেনরী নামে এক ইংরেজ এই দলটা গঠন করেছিলেন। প্রথম ঐ দলে আমি একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। পরে আমার সাহস ও কার্য-কুশলতা দেখে হেনরী আমাকে ঐ দলের ডেপুটি চীফ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি দল ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম।
দলটা যেন কিসের বললে?
ডাকাতির। বুঝলেন না? আমরা আফ্রিকার স্বর্ণ উপকূলে ডাকাতি করে বেড়াতাম। রাহাজানি, খুন, জখম এসব ছেলেখেলা ছিলো আমাদের কাছে।
সবাই স্তব্ধ হয়ে মাহমুদের নির্লিপ্ত মুখের দিকে তাকিয়েছিল। লোকটা বলে কি?
ডাক্তার চৌধুরী যথেষ্ট মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি বললেন, তা এসব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে খুব ভালো করেছো ভাই।
ছেড়েছি বটে, কিন্তু একেবারে ছেড়ে দিয়েছি তা আপনাকে কে বললো। দরকার হলেই আবার ধরবো।
মাহমুদের কথাবার্তার ভেতর কেমন একটা রহস্য-রহস্য ভাব। আর লোকটার ভেতর ভদ্রতা বলতে কিছু যদি থাকতো! দেখতেও অসম্ভব রকমের জটিল চেহারা। গায়ের ফর্সা রংটা পুড়ে গিয়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দুটি ভয়ঙ্কর। খুনীর চোখের মতো সর্বদাই ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে।
এপাশে তখন মেয়েদের মধ্যে সুলতানাকে ঘিরে প্রশংসা ও তোষামোদের ঝড় উঠেছে। বেগম রশিদ বলছিল, আমি ভাই একমুহূর্ত তোমার কথা ভুলতে পারি না। আহা, এই তো বয়স। এই বয়সেই…
মর্জিনা বানু প্রায় হাহাকার করে বলেন, কতো যে আল্লার কাছে মোনাজাত করি সুলতানার জন্যে। এমন রাণীর মতো চেহারা, আহা রে…
সুলতানা অপ্রতিভ হয়ে বসে থাকে। কি করবে বুঝতে পারে না।
দিক থেকে মাহমুদের গলা ভেসে এলো, সুলতানা, এবারে চলো বেরাই অনেক তো গল্প হলো…
আর একটু বলব না ভাই?
মর্জিনা বানু মিনতি করেন।
সুলতানা বসতে চায় বসতে পারে…আমার কাজ আছে। আমাকে উঠতে হবে।
সুলতানার মুখ শুকিয়ে যায়। সে পুতুলের মতো উঠে দাঁড়ায়! বলে, আমি যাই, আর একদিন আসবো। শাহেলি, সময় করে এসো আমার ওখানে। গল্প করবো, কেমন?
মাহমুদের পেছনে পেছনে সুলতানা চলে যায়। সকলেই বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেইদিকে। সারা-ঘর নীরব, নিস্তব্ধ। হঠাৎ একটা ফিসফিস শব্দ শুনে শাহেলি ফিরে তাকালো। দেখলো বেগম রশিদ সাহেবের কানে কানে কি যেন বলছে আর রশিদ সাহেব মাথা নাড়ছেন।
হঠাৎ বেগম রশিদ বলে, আমরা এখন উঠছি মেজা আপা।
এখনই? বলো কি ছোটো বৌ?
হ্যাঁ, উঠতে হবে। কাজ আছে।
আমরাও উঠছি
মিষ্টি হাসলেন রাবেয়া সৈয়দ। বললেন, শাহেলিকে নিয়ে আমার এখানে আসবেন আপা। কই গো; তুমি উঠছে না যে?
হ্যাঁ, এই তো…চলো।
ডাক্তার চৌধুরী সাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ান। চৌধুরী পরিবারের দুই জোড়া মানুষ নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বাইরে আসে। গেট পেরোয়। শাহেলি লক্ষ্য করে রাস্তায় নেমেই দুদল দুদিকে চলে গেলেন। বেগম রশিদ ও রশিদ সাহেব গেলেন সুলতানারা যে পথে গিয়েছে সেই পথে।
মর্জিনা বানু কেমন একটা হিংস্র দৃষ্টিতে পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যে উদ্দেশ্যে দুপুর বেলা চৌধুরী পরিবারের সকলকে বাড়িতে জড়ো করেছিলেন, শাহেলিকে দেখতে আসার নামে সুলতানা ও তার ভাই মাহমুদ সেই উদ্দেশ্যটা মাটি করে দিয়ে গেল।
মর্জিনা বানু আপন মনে গজরাতে থাকেন। শাহেলি দাঁড়িয়েছিল একটু দূর। হঠাৎ তার চোখ গেল রাস্তার দিকে আর রীতিমত চমকে উঠলো সে। দেখলো রাস্তার পেছনে একটা লাল মাটির উঁচু টিলার উপর একটা কালো আলখাল্লধারী লোক তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে তাদের বাড়ির দিকে চেয়ে। লোকটা যেমন দীর্ঘ তেমনি বলিষ্ঠ। শাহেলি তার দিকে তাকাতেই সে রাস্তার ছায়ায় মিশ চাল।
শাহেলি এই আলখাল্লাধারী মূর্তিটিকে আগেও দুএকদিন দেখেছে। লোকটা ছায়াবাজির মতো, এই আছে এই নেই। শাহেলি অনুভব করলা একটা ভয়ঙ্কর রহস্য আস্তে আস্তে ধূমায়িত হয়ে উঠছে মানিকপুর।
.
০২.
পরদিন সকালবেলা বসবার ঘরে সুলতানার সামনে বসে বার বার থতমত খাচ্ছিলেন মর্জিনা বানু। কথাটা কির্তাবে ওঠাবেন বুঝতে পারছিলেন না। শেষে মরিয়া হয়ে বলেই ফেললেন।
তোমার কাছে এসেছি কিছু টাকার জন্যে। আমার অবস্থা তো জানো। দুটো ভাঙাচোরা বাড়ি আছে, ভাড়া দিয়ে মাসে মাসে দেড়শোটি টাকা পাই। কিন্তু এই চড়া বাজারে দেড়শো টাকা দিয়ে কি হয় বলো তো তাই?
সুলতানা শুধু অবাক হয়ে বললো, টাকা?
হ্যাঁ অল্প কয়েকটা টাকা, ধরা হাজার পাঁচেক। টাকাটা তোমার পক্ষে সামান্যই।
মর্জিনা বানু কাকুতি-মিনতি করেন, বাজারে আমার দেনার অন্ত নেই সুলতানা। তোমার কাছ থেকে টাকাটা পেলে দেনার কিছুটা শোধ করে দিতাম। আমার ইজ্জত বাঁচতে। বুঝলে তো কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে তিন মাসের কড়ালে টাকা কর্জ করেছিলাম। টাকা শোধ করতে পারিনি। শুনছি, কাবুলিওয়ালা নাকি বেইজ্জত করবে বলে বেড়াচ্ছে…
সুলতানা কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইলা।
তুমি তো জানো ভাই, বড় কর্তার আমলে আমার সংসারের অর্ধেক খরচ বরারই উনি দিতেন। চাইতে হতো না, না চাইতে দিতেন। বড় কর্তা নেই। কিন্তু তুমি তো আছো? এই বিপদে আর কোথায় যাই বলো?
সুলতানা বললো, কিন্তু টাকা …
মেয়েটা শান্তিনিকেতনে পড়ছিল। বড় কর্তার কত সাধ ছিলো তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। কিন্তু পোড়া কিসমতের জন্যে কিছুই হলো না। মেয়েটাকে পরীক্ষার আগেই ফিরিয়ে আনতে হলো।
মর্জিনা বানুর গলার স্বর ভারি হয়ে আসে। আপন মনে বলেন, আজ বড় কর্তা যদি বেঁচে থাকতেন …
সুলতানা ছটফট করে উঠলো। এসব টাকার বেড়াজালে পড়ে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। সে অস্থির চোখে তাকালো মর্জিনা বানুর দিকে। বললো, কিন্তু আমি তো বড় কার। মতো মাসে মাসে আপনাকে টাকা জোগাতে পারবো না। বড় জোর এবারের মতো কিছু টাকা..ধরুন হাজার দুই টাকা আপনাকে দিতে পারি। নেবেন?
দুহাজার…
ভাবে-ভঙ্গিত মনে হলো মর্জিনা বানু যেন হতাশ হয়েছেন। কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে তিনি খুশি। কিছু যে পাওয়া যাচ্ছে এই যথেষ্ট। সুলতানা টাকা না দিলে কি করতে পারেন তিনি? সত্যি বলতে কি টাকা পাওয়ার এক বিন্দু আশাও তিনি করেননি। মাহাদকেই তার ভয় ছিলো। মাহমুদ বাড়িতে নেই জেনেই সুলতানার কাছে টাকার কথাটা পেড়েছেন। এখন যা পাওয়া যায় তা নিয়ে মানে মানে সরে পড়াই ভালো।
ভেতরে ভেতরে মর্জিনা বানু খুব খুশি। কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করবেন না। একটু হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, ঠিক আছে ভাই বড় বৌ। তা-ই না হয় দাও। কি কপাল নিয়েই যে এসেছিলাম। তোমাদের এক বিন্দু উপকারে লাগলাম না। মাঝখান। থেকে তোমাদের শুধু ঝামেলায় ফেলছি।
আপনি বসুন। আমি এক্ষুণি আসছি।
সুলতানা অস্থির পায়ে উঠে নিজের ঘরে যায়। ফিরে আসে একটা নোটের বাণ্ডিল নিয়ে। একশো টাকার কুড়িখানা নোট। মর্জিনা বানুর হাতে টাকাটা দিয়ে বলে, এই নিন। টাকার কথাটা দয়া করে আর কাউকে বলবেন না। আর, আর, টাকার জন্য কখনো আসবেন না।
মনে মনে হাসেন মর্জিনা বানু। পরের কথা পরে। এখন তো ওঠা যাক। মুখে বলেন, কিছু মনে করো না ভাই বড় বৌ। ভিক্ষার কপাল নিয়ে এসেছি। তোমাদের বিরক্ত করা ছাড়া উপায় কি?
সুলতানা কিছু বললো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তাহলে এখন আসি। মেয়েটা বাড়িতে একলা আছে।
আসুন। আবার আসবেন।
নিশ্চয়ই আসবো। এ হলো গিয়ে বড় কর্তার বাড়ি।
মর্জিনা বানু এক গাল হাসলেন, নিজের বাড়ির ভাড়া। নিশ্চয়ই আসবো।
বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বেরোলেন। গেটের কাছে এসে দেখা হলো মাহমুদের সঙ্গ। মাহমুদের হাতে একটা দোনলা বন্দুক। মর্জিনা বানুকে দেখেই ভ্রু কুঞ্চিত হয়। ঠোঁট জোড়া শক্ত হয়ে উঠে।
এই যে মাহমুদ! কেমন আছো ভাই! শরীর-টরীর ভালো তো?, মর্জিনা বানু যেন ভ্ৰাত বিগলিত হয়ে পড়েন। মাহমুদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মর্জিনা বেগমের দিকে তাকায়। দেখেই চেনা যায় বুড়ি একটা পাকা ঘুঘু। সে বলে, কেমন আছি জিজ্ঞেস করছেন তো? ভালো নেই। এই দেখুন না। শিকারে বেরিয়েছিলাম। একটা কিছুও মেলেনি। গুলি ভর্তি বন্দুক যেমন ছিলো তেমনই আছে। এখন ভাবছি গুলি দুটো খরচ করি কোথায়? আমার হাতটা নিসপিস করছে
আমি যাই এখন…
মর্জিনা বেগমের গলার স্বর কাঁপতে থাকে, আমার অনেক কাজ আছে ভাই..আমি গেলাম।
পেছনে দাঁড়িয়ে হো হো করে হেসে ওঠে মাহমুদ। বুড়ী আচ্ছা ভয় পেয়েছে যা হোক। এবার সে গেট পার হয়ে ভেতরে ঢোকে। আস্তে আস্তে তার চোখ-মুখ গম্ভার হয়ে ওঠে।
বন্দুক যথাস্থানে রেখে সে সুলতানার ঘরে ঢোকে।
সুলতানা মুখে হাসি টেনে এনে বলে, এসো শিকার-টিকার মিললো কিছু?
না। মানিকপুরে অনেক মানুষ শিকার আছে। কিন্তু মেরে আনন্দ পাওয়া যায় এমন পাখি একটাও নেই। পীরগঞ্জের টিলা থেকে কখন চিতাবাঘ বেরোয় তার অপেক্ষায় আছি।
মৃদু হাসলো মাহমুদ। একটা কোচের উপর বসলো। বসে পা নাচাতে লাগলো একদৃষ্টে সুলতানার দিকে তাকিয়ে। ভয়ে ফ্যাকাসে দেখায় সুলতানার মুখ।
সুলতানা।
বল।
এই বুড়ি তোমার কাছে কেন এসেছিল, টাকা চাইতে না?
হ্যাঁ।
এবং দয়ার শরীর তোমার, টাকা চাইতেই দিয়ে ফেলেছো, তাই না?
খুব কাকুতি মিনতি করছিল আমার কাছে। বলছিল টাকা না দিলে নাকি ইজ্জত যায়।
ইজ্জত যায়? চমৎকার! মানিকপুরের চৌধুরী বংশের মান ইজ্জত রাখার ভার তো তোমারই উপর হু! তা কতো টাকা দিয়েছে।
সুলতানা ভয়ে ভয়ে বললো, দুহাজার।
ভালো।
মাহমুদ তীক্ষ্ণ গলায় মন্তব্য করে, ভবিষ্যতে তোমার কি হবে জান সুলতানা? চৌধুরী পরিবারের লোকেরা দল বেঁধে তোমার কাছে আসব টাকা চাইতে। টাকা দাও ভালো। না দিলে ডাকাতি করবে। তোমাকে খুন করব টাকার জন্য।
সুলতানা আর্তনাদ করে উঠলো। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হা হা করে হেসে উঠলো মাহমুদ। বললো, ওদের কিছু দোয় নেই। সুযাগ পেলে সবাই তা-ই কর। আমিও এ-ই করতাম।
একটু থেমে সে বলে, তোমাকে চিরতরে সরিয়ে দিতে পারলে চৌধুরী পরিবারের লাভটা কি দেখেছো? তোমাকে সরিয়ে দিতে পারলেই তারা রাতারাতি বার্ষিক ছাপ্পান্ন। লক্ষ টাকা আয়ের সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়…
সুলতানা পাথরের মতো অনড় ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাহমুদ শান্ত গলায় বলে, সুতরাং আমি যা বলি বিনা বাক্যব্যয়ে তা পালন করাই কি তোমার উচিত না সুলতানা?
অস্ফুট গলায় সুলতানা বলে, তুমি যা বলবে আমি তাই করবো, কিন্তু দোহাই তোমার, ওসব ভয়ানক কথা আমাকে আর শুনিয়া না।
বেশ, শোনাবো না।
মাহমুদ হাসলো মৃদু। বললো, মনে রেখো আমি ছাড়া এই দুনিয়ার সবাই তোমার শত্রু। কাউকে দয়া করতে যেয়ো না। বিশ্বাস করতে যেয়ো না।
আমি তা-ই করবো, বিশ্বাস করো তাই করবো। কথা বলতে বলতে মাহমুদের নিকটবর্তী হয় সুলতানা। বলে, এখন তো আমাদের অনেক টাকা। চলো না কোথাও বেরিয়ে পড়ি।
কোথায় যেতে চাও?
যাহোক কোথাও। এই মানিকপুরে থেকে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চক্রান্ত ছাড়া আর কোনো খবর নেই এখানে। চলো আমরা অনেক দূরে কোথাও চলে যাই।
যাব সুলতানা। চারদিকে যড়যন্ত্রের জাল। জালটা একটু গুটিয়ে আনতে পারলেই চলে যাব মানিকপুর থেকে।
সুলতানা বলে, চৌধুরীরা ষড়যন্ত্র করছে তা কি বুঝি না ভেবেছো, সব বুঝি! চৗধুরীদের প্রত্যেকটা লোক ভয়ঙ্কর।
মাহমুদ বলে, মানিকপুরের চৌধুরীদের কুটিল বুদ্ধি যথেষ্ট আছে তা আমি স্বীকার করি সুলতানা। কিন্তু ওদের আমি থোড়াই কেয়ার করি আমি যাকে ভয় করি সুলতানা, তার নাম কুয়াশা। চমকে উঠো না…কুয়াশা মানিকপুরে আছে, আমার সব দুর্বলতা ওর জানাকুয়াশার সাথে আমার লড়াই চলছে সুলতানা
মাহমুদ কোচ থেকে উঠে দাঁড়ায়। বলে, লড়াই ফেলে আমি কখনো পালিয়ে যাই সুলতানা। তুমি তো জান এ আমার স্বভাব নয়। মানিকপুরে কিছুদিন আমাদের থাকতেই হবে।
সুলতানা বলে, কিন্তু কদ্দিন?
তা আমি নিজেই জানি না, তোমাকে বলবো কি করে? মাহমুদ হাসে। এগিয়ে এসে সুলতানার কাঁধে হাত রাখে। স্নেহের সুরে বলে, তুমি ভয় পেয়ো না লক্ষ্মীটি। যতক্ষণ আমি তোমার পাশে আছি ততক্ষণ কারো সাধ্য নেই তোমার একটুকু ক্ষতি করে। তুমি নিশ্চিন্ত থেকে।
দরজার কাছে পদশব্দ শোনা গেল।
বড় বৌ, আছে নাকি?
সুলতানা মাহমুদের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়।
মাহমুদ বলে, কে?
এক মুখ মিষ্টি হাসি নিয়ে ঘরে ঢোকেন রাবেয়া সৈয়দ। বললেন, ভাই-বোন দুজনেই আছো দেখছি। বিরক্ত করলাম না তো?
অজান্তেই বিনীত হয়ে ওঠে সুলতানার চোখ-মুখ। সারা মানিকপুরে রাবেয়া সৈয়দের মতো মনী-গুণী মহিলা একটিও নেই। প্রথম দেখায়ই কেমন একটা সম্ভ্রম বোধ জাগে মহিলাকে দেখে। সুলতানা এগিয়ে আসে, বলে, না, না, কিসের বিরক্ত করলেন। ভাইয়ার সঙ্গে গল্প করছিলাম। আপনি বসুন আপা…
মাহমুদ কথা বলে না। সে গিয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণের জানালা ঘেঁষে। হেমন্তকাল মাত্র শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে গাছ-গাছালির সবুজ রং-ধূসর হয়ে উঠছে একটু একটু।
রাবেয়া সৈয়দ বসলেন। দেখেই বোঝা যায় এই মহিলা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। আর দৃঢ় স্বভাবের।
ভূমিকা ছাড়াই রাবেয়া সৈয়দ শুরু করলেন, আমার কারবারের লোকসানের কথা নিশ্চয়ই শুনেছো সুলতানা? ছোট কারবার, পুজি পাটা যা ছিলো সব নৌকাডুবিতে শেষ। এখন তুমি যদি কিছু টাকা ধার দাও তাহলে কারবারটা আবার শুরু করতে পারি।
মাহমুদ এদিকে ফিরে তাকায়। শান্ত গলায় আস্তে আস্তে বলে, same old story. টাকা চাইতে এসেছেন?
চাইতে নয়, ধার করতে।
একই কথা।
মাহমুদ এগিয়ে এসে কোচের উপর রাবেয়া সৈয়দের মুখোমুখি বসলো। বললো, এসব ব্যাপারে সুলতানার কিছু বলার নেই। আমি তার গার্জিয়ান। যা বলার আমাকে বলুন।
বেশ তো, তোমাকেই বলছি। তুমি আমাদের বাড়ি বন্ধকীর উপর হাজার পঞ্চাশেক টাকা ধার দাও।
পঞ্চাশ হাজার?
মাহমুদ ঠাট্টার দৃষ্টিতে রাবেয়া সৈয়দের দিকে তাকায়। বলে, আমাদের প্রচুর টাকা আছে সত্যি। কিন্তু টাকা থাকলেই টাকা আপনাকে দেবো এমন ভরসা আপনি। কোত্থেকে পেলেন?
রাবেয়া সৈয়দ মাহমুদের অভদ্র কণ্ঠস্বর প্রথম একটু যেন চমকে গেলেন। সেটা কাটিয়ে উঠতে তার দেরি হলো না। স্বভাব সিদ্ধ মিষ্টি হাসি হেসে বললেন, বাঃ, এ কেন কথা বলছো মাহমুদ! তোমার টাকা আছে, আমি তোমাদের গরীব আত্মীয়, ঠেকায় পড়ে তোমার কাছে টাকা চাইতে আসবা এতে অবাক হওয়ার কি আছে?
না, অবাক হইনি। কিন্তু শুনুন, আত্মীয় বলে অতো ভড়ং আর না-ই করলেন। আপনাদের আত্মীয় বলে আমি স্বীকার করি না
বটে!
এক ধরনের বিচিত্র হাসি ফুটে উঠলো রাবেয়া সৈয়দের চোখে মুখে। বললেন, যে আলী নকীবের টাকা পেয়ে অতো অহঙ্কার, তারই আত্মীয়কে আত্মীয় বলে স্বীকার
করতে এতো আপত্তি! বাঃ, এরই নাম বোধহয় কৃতজ্ঞতা!
হ্যাঁ। মনে করুন তাই।
মাহমুদের চোখমুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে। বলে, আলী নকীব তো বহুদিন এই কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করেছে। সবাই মিলে লুটেপুটে খেয়েছে বুড়োকে। বুড়ো অক্কা পেয়েছে, আগের জের আর এখন টেনে লাভ নেই মিসেস চৌধুরী। দাও দাও, খাই খাই ব্যবসা আলী নকীবের সঙ্গে সঙ্গেই খতম। এখন যে যার পথ দেখলেই ভালো হয়।
অপমানে লাল হয়ে ওঠে রাবেয়া সৈয়দের মুখ। ভয় কাঠ হয়ে পঁড়িয়ে থাকে সুলতানা। কিন্তু কোনদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই মাহমুদের। নিষ্ঠুর ভাবে রাবেয়া সৈয়দকে বলে, আপনার ব্যবসা চলুক না চলুক তা নিয়ে সুলতানার এতটুকু মাথা ব্যথা নেই মিসেস চৌধুরী। সুলতানার টাকা আপনাদের মত লোভীদের পেট ভরার জন্যে নয়।
রাবেয়া সৈয়দ বলেন, অনেকে বলতো বটে তুমি বেয়াদব। কিন্তু এতোটা তা ভাবিনি।
ও, আমি বেয়াদব? তা আমাকে কি রকম আশা করেছিলেন শুনি? টাকা চাইছেন শুনে ধন্য হয়ে যাবো, বিনয়ে গলে গিয়ে চেয়ার এগিয়ে দেবো, এই ভেবেছিলেন?
রাবেয়া সৈয়দ উঠে দাঁড়ালেন। স্থির ও শান্ত গলায় বললেন। মাহমুদ, আমি টাকা ধার করতে এসেছিলাম। ভদ্রভাবেও সেটা না করতে পারতে।
ভদ্রভাবে,। নাম মাত্র পরিচয় নিয়ে যারা টাকা চাইতে আসে তাদের সঙ্গে আবার ভদ্রতা। এই তো কিছুক্ষণ আগে মর্জিনা বানু এসে সুলতানাকে ধাপ্পা দিয়ে দুহাজার টাকা নিয়ে গেছে। আপনি তো সোজা কথায় ডাকাতি করতে এসেছেন, আপনার সঙ্গে ভদ্রতা কি?
বিচিত্র এক ক্রোধ নীল হয়ে ফুটে উঠলো রাবেয়া সৈয়দের চোখে মুখে। সুলতানা দেখে শিউরে উঠলো। রাবেয়া সৈয়দ বললেন, এই অপমান আমি সহ্য করবো না মাহমুদ। মনে রেখো।
অস্ফুট স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে সুলতানা। বলে, ভাইয়া, ওকে ফিরতে বলো।
রাবেয়া সৈয়দ বললেন, যে কোনো ক্ষতির জন্যে প্রস্তুত থেকো। আজ পর্যন্ত কখনো কাউকে ক্ষমা করিনি আমি।
রাবেয়া সৈয়দ স্থির পায়ে ঘর থেকে চলে গেলেন। এক মুহূর্তকাল হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাহমুদ। তারও একটু একটু মনে হচ্ছিলো কাজটা তেমন ভালো হয়নি। সাপের মধ্যে বিষধর নাগিনী যে জাতের, মেয়ে মানুষের ভেতর রাবেয়া সৈয়দ সেই জাতের। রাগে ও উত্তেজনার মাথায় মাহমুদ আসলে কালনাগিনীর ছোবলটাকেই জাগিয়ে দিয়েছে। এখন সবরকমে প্রস্তুত থাকতে হবে। এতদিন ভদ্র ও মিষ্টি হাসিতে নিজেকে ঢেকে রেখেছিলেন রাবেয়া সৈয়দ। এখন ছদ্মবেশ খুলে বেরিয়ে পড়েছে তার আসল স্বভাব।
আমি প্রস্তুত। মাহমুদ যেন নিজেকে ভরসা দেবার জন্যেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মনে মনে কললল। রাবেয়া সৈয়দ, আপনি মাহমুদকে চেনেন না। আফ্রিকার দুর্ভেদ্য স্বর্ণ উপকূলে ডাকাতি করে বেড়িয়েছে সে। তাকে চোখ-রাঙালেই সে ভয় পাবে এমনটা আশা করা অন্যায়। বেশ তো, আসুন এক চক্কর হয়ে যাক।
সুলতানা এগিয়ে এসে তীব্রু গলায় বললো, একি করলে তুমি?
ঠিক করেছি।
জানো, আমার মনে হচ্ছে …
তোমার কি মনে হচ্ছে তা আমি জানি সুলতানা। তুমি আসলে ভয় পেয়েছে। কিন্তু অতো সহজে ভয় পেলে কি ছাপ্পান্ন লক্ষ টাকা আয়ের সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবে? লড়াই তো সবে মাত্র শুরু হলো।
মাহমুদ হাসে, অপেক্ষা করা। দেখো।
.
০৩.
রবিউল্লাহর কাৰ্ম দেখতে বেরিয়েছিল শাহলি।
দুধারে পাতাবাহার রোডের বিচিত্র বর্ণালী। রাস্তা পার হয়ে মাঠে নামলো ওরা। সুন্দর, উজ্জ্বল দিন। মিষ্টি বাতাস বইছে। শাহলির ভালো লাগছিল খুব।
রবিউল্লাহর পাশাপাশি হাঁটছিল সে। হঠাৎ দেখলো একটা লোক রাস্তার ঝাঁকালো কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শাহেলি তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই লোকটা এগিয়ে এলো সামনে। লোকটার বয়স চল্লিশের দিকে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বাঁ চোখের নিচে একটা গভীর কাটা দাগ। লোকটার পিঠে একটা ঝুলি, তে একটা তারের বেহালা।
চলছে না স্যার।
বুরুজ মিঞা আকর্ণ বিস্তীর্ণ হাসি হাসলো, গত পরশু ট্রাউনের বাজার থেকে মোট তিন টাকার মাল এনেছিলাম। তা বললে বিশ্বাস করবেন না স্যার, এই দেড় দিনে মাত্র
আট আনার বিজিনেস করেছি।
রবিউল্লাহ মাথা নাড়ে। বলে, আমি বলেছিলাম না মিঞা মানিকপুরে তোমার তারের বেহালা চলবে না? এখন দেখলে তো?
দেখলাম মানে? হাড়ে হাড়ে বুঝলাম স্যার। বললে বিশ্বাস করবেন না, কাল রাত থেকে উপোষ মারছি।
একটু হাসলো বুরুজ মিঞা। বললো, সবই কপালের দোষ বুঝলেন না? মানিকপুরে তারের বেহালা বিক্রি করতে এসে লোকসান তো লোকসান, এখন পুঁজি নিয়ে টানাটানি। দিন স্যার একটা সিগারেট দিন। বড় তেষ্টা লেগেছে।
রবিউল্লাহ পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা বুরুজ মিঞাকে দিলো। শাহেলির বিরক্তি লাগছিল একটা পথের লোকের সঙ্গে রবিউল্লাহকে আলাপে জমে উঠতে দেখে। অনেক কষ্টে সে বিরক্তি চেপে রেখেছিল।
বুরুজ মিঞা সেদিকে ক্ষেপই করলো না। সিগারেটটা লোলুপ নয়নে দেখতে দেখতে বলে, কই স্যার, দিন।
আবার কি দেবো বুরুজ মিঞা?
ঘোড়া দিলেন স্যার, চাবুক দেবেন না? ম্যাচটা দিন।
রবিউল্লাহ পকেট থেকে ম্যাচ বের করে বুরুজ মিঞাকে দিলো। সিগারেট ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বুরুজ মিঞা বলে, আপনাদের স্যার অনেক দেরি করিয়ে দিলাম। ঐ আমার এক দোষ স্যার, কথা কিছুতেই কমিয়ে বলতে পারি না। এজন্যে
আমার ওস্তাদ কি করেছেন জানেন? তাহলে ঘটনাটা স্যার খুলেই বলি।
না হে, রবিউল্লাহ বাধা দেয়, এখন ধরোগে তোমার গল্প শোনার ফুরসত নেই। ওঁকে নিয়ে যাচ্ছি ফার্ম দেখাতে। আরেক সময় তোমার গল্প শুনবো।
আচ্ছা স্যার, সেই ভালো। আমি বরং সন্ধ্যের দিকে আপনার ওখানে যাবো।
বুরুজ মিঞা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। তারপর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সিগারেট টানতে টানতে মাঠ ছেড়ে রাস্তার দিকে চলে যায়।
আবার হাঁটতে থাকে ওরা। রবিউল্লাহ বলে, লোকটা খুব গুণী বুঝলে তো? যেমন সুন্দর বেহালা বাজায়, তেমন সুন্দর স্বভাব। দোষের মধ্যে মাথায় একটু ছিট আছে।
শাহেলি কিছু বলে না। কিন্তু রবিউল্লাহর অস্বাভাবিক সৌজন্য বোধ দেখে মনে মনে একটু অবাক হয়। ছোট বেলা থেকেই রবিউল্লাহ ভীষণ হিসেবী ছেলে। ধীর স্থির স্বভাব, কথা বলে কম। আবেগের ছিটে ফোঁটা ওর মনে আছে কিনা সন্দেহ। নামহীন, গোত্রহীন বুরুজ মিঞার প্রতি এহেন রবিউল্লাহর ব্যবহার তাই তাকে বিস্মিত করে তোলে।
কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করে না। রবিউল্লাহর পাশে হাঁটতে থাকে।
প্ৰকাণ্ড মাঠ জুড়ে রবিউল্লাহর ফার্ম। দিগন্ত বিস্তৃত ধানী জমিতে সবুজ আমন ধানের শিষ বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে। ধানের কাঁচা জমিতে সবুজ রং দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। খামার বাড়ির পিছনে সজি ও কলা বাগান। কলা বাগানের ঠিক গা ঘেঁষে বিরাট এক দীঘি। দীঘির উঁচু পাড়ে আখ খেত।
এই আমার জমিদারী…
রবিউল্লাহ একটু গর্ব মিশ্রিত লজ্জার হাসি হাসে, চাকরি-বাকরি করার চেয়ে ধরোগে তোমার, এটা অনেক ভালো।
অনেক।
শাহেলি সায় দেয়, বলে, দোষের মধ্যে সবাই তোমাকে চাষা বলে ঠাওরাবে।
রবিউল্লাহ রাগ করে না। শাহেলির ঠাট্টা সহজ ভাবেই গ্রহণ করে। বলে, চাষা বলে বলুক না। তাতে ক্ষতিটা কি হচ্ছে। গায় তো আর ফোস্কা পড়ছে না।
রবিউল্লাহ বুদ্ধিমান বিচক্ষণ লোক। শাহেলি মনে মনে স্বীকার করে। মিথ্যে দুর্নাম ও সহজ প্রশংসার ধার ধারে না সে। নিজের লাইনে রবিউল্লাহ উন্নতি করবে এ একেবারে অবধারিত।
রবিউল্লাহ্ বলে, ধানী জমি দেখলে, এবারে চলে আখ-খেত দেখিয়ে আনি।
শাহেলি ইতিমধ্যে ক্লান্ত। বললো, না, এবারে বাড়ি ফিরবো।
বলো কি, এক্ষুণি? ঠিক আছে, চলো আমার খামার বাড়িতে বসবে কিছুক্ষণ।
খামার বাড়িতে ওরা কিছুক্ষণ বসলো। রবিউল্লাহর খামার বাড়ির কিষাণ আবদুল বাগানের পেঁপে কেটে খেতে দিলো শাহেলিকে। বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে এক কাঁদি সাগর কলা গাছ থেকে পেড়ে সামনে রাখলো।
রবিউল্লাহ তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা খুলে বলছিল শাহেলিকে। ভবিষ্যতে উত্তর চকের রাজা সাহেবের পুরো মাঠটাই ফার্মের জন্যে নেবে বলে আশা রাখে রবিউল্লাহ। মাটি যে রত্নগর্ভা তা সে ভালো করেই জেনেছে। এই মাটিতে সোনা ফলিয়েই আগামীতে সে চৌধুরী আলী নকীবের মতো বিত্তশালী হওয়ার আশা রাখে।
আশা করাটা খুব কি বোকামি? চৌধুরী আলী নকীবের মতো অতোটা না হোক, জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিতে পারে সেই পরিমাণ বিত্তও কি মাটি থেকে পারবে না অর্জন করতে?
রবিউল্লাহ প্রায় অনেকটা আপন মনেই কথা বলছিল। চিরদিনের হিসেবী ছেলেটা যেন হঠাৎ একটা ধাঁধায় পড়ে স্বপ্নের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। টাকা চাই। স্বাচ্ছন্দ্য চাই। সুখ ও শান্তি চাই। রত্নগর্ভা মাটি কি সেই অর্থ ও মোক্ষ দেবে না জীবনে?
রবিউল্লাহ কোন জবাবের আশা না করেই আপন মনে বলছিল। শাহেলি শুনছিল। কথাগুলি আর নিঃশব্দে হাঁটছিল। খামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তখন তারা মাঠে নেমেছে। পেছনে কলার কাঁদি নিয়ে আসছে কৃষাণ আবদুল। বেলা একটার কম নয়। মাথার উপর সূর্য জ্বলছে। খোলা মাঠে হাওয়া বিরঝির করছে।
এমন সময় পেছনে একটা যান্ত্রিক ঘড় ঘড় ঘড় আওয়াজ পাওয়া গেল। দূর থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসতে দেখা গেল একটা বৃহৎ মোটর বাইককে। আশ্চর্য, বাইকটা এসে থামলো শাহেলির ঠিক পাশে। আরো আশ্চর্য, ফাইভ হাওরেড সি. সি. মিলিটারী মডেলের ট্রায়াম্প বাইকটির মালিক মাহমুদ হাসছিল শাহেলির দিকে তাকিয়ে।
বেপরোয়া উচ্ছংখল হাসি। শাহেলি অবাক, রবিউল্লাহও। কিষাণ আবদুল কলার কাঁদি নামিয়ে রাখলো মাটিতে। এই সাহেবটা ভীষণ রগচটা আর খামখেয়ালী। মানিকপুরে এসেছে ছমাসও হয়নি, এরই মধ্যে তার স্বভাব জানতে কারো বাকি নেই। মোটর বাইক নিয়ে যখন পেছনে ধাওয়া করেছে তখন একটা না একটা মতলব আছে নিশ্চয়ই। আর সেটা যদি ভয়ঙ্কর কিছুও হয় তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সুতরাং কলার কাঁদি নামিয়ে অপেক্ষা করাই ভালো।
কিন্তু না, তেমন ভয়ঙ্কর কোন ইচ্ছা মাহমুদের আছে বলে মনে হলো না। সে তীক্ষ্ণ চোখে একবার শাহেলিকে দেখলো শুধু। তার চোখ দুটি শাহেলির শ্রী ও সৌন্দর্য দেখে যেন মুগ্ধ হয়ে গেল।
রবিউল্লাহ বিরক্ত হয়। অনেক কষ্টে সেটা চেপে রেখে সে বলে, এই যে, কি ব্যাপার? শিকারে বেরিয়েছেন বুঝি?
না, আজ বেরিয়েছিলাম এমনি এমনি। দূর থেকে দেখলাম কার লাল শাড়ি উড়েছে। কৌতূহল নিয়ে ছুটে এসেছিলাম।
মাহমুদ হাসলো। বললো, তারপর কাছে এসে দেখি (শাহেলির উদ্দেশ্যে) আপনি। আপনি ভালো আছেন?
ভালোই।
মাহমুদ বলে, আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেন না?
শাহেলি বলে, জিজ্ঞেস করতেই হবে?
মুহূর্তে যেন চেতনা ফিরে পায় মাহমুদ। তার দুচোখ ভরা মুগ্ধ দৃষ্টি নিমেষে উবে যায়। বদলে সেখানে ধিক ধিক করে জ্বলতে থাকে সাপের হিংসা। স্বভাবসিদ্ধ,নিষ্ঠুর নির্লিপ্ত ভাব ফিরে আসে চোখে-মুখে। একটু হেসে বলে, না না, তা কেন? সহজ ভদ্রতার ব্যাপার কিনা, তাই ভেবেছিলাম আমি কেমন আছি তা উন্টে জিজ্ঞেস করবেন।
ভদ্রতা জিনিসটা লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি পাওয়ার মতো কপালের গুণ না, বুঝলেন? ওটা শিখে অর্জন করতে হয়।
বাঃ, চমৎকার বক্তৃতা দিতে পারেন দেখছি। না, আমি ঠিকই অনুমান করেছিলাম। আপনি হলেন গিয়ে চৌধুরী পরিবারের সবচে ট্যালেন্টেড লোক।
মাহমুদের কথার সুরে একটু বা প্রশংসা ফোটে। বলে, আপনি একটুও আপনার মায়ের মতো হননি। একদম অন্যরকম হয়েছেন।
শাহেলি হতবাক। রাগে ও বিস্ময়ে সে ছটফট করে ওঠে। বলে, আমার মায়ের ব্যাপারে কি বলতে চান শুনি?
না, না বলাবলির কি আছে। বলছিলাম কি আপনার মা বেশ চালাক-চতুর। সেদিন সুলতানার কাছ থেকে একটা গল্প ফেঁদে দিব্যি দুহাজার টাকা ফোকটে মেরে নিয়ে এসেছেন। জানতেন আমার কাছে চাইলে পাবেন না, তাই আমি যখন বাড়ি নেই। সেই সময় তিনি সুলতানার কাছে গিয়ে হাজির।
আম্মা টাকা নিয়েছেন?
শাহেলি বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে পারে না।
আহা, তাতে কি হয়েছে? ব্যাপারটা অতো সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? মোটে তো দুহাজার টাকার মামলা…
মাহমুদ যেন দয়ার সাগর। বলে, ভদ্রমহিলা গিয়ে বললেন টাকা না দিলে ইজ্জত যায়, তাইতো সুলতানা টাকা দিয়ে দিলো। তা আপনার মা বেশ খোলাখুলি মানুষ কিন্তু। সোজা গিয়ে সুলতানাকে বললেন কিছু টাকা ভিক্ষা দিতে হবে।
শাহেলি অপমানে স্তব্ধ হয়ে থাকেমাহমুদ বলে, দুহাজার টাকা সুলতানার কাছে কিছুই না। এটা ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে না সে। তা যাক সেকথা..এদিকে এসেছিলেন কি মনে করে? ফার্ম দেখতে? হ্যাঁ, রবিউল্লাহ সাহেব কৃষিকাজ জানেন বটে। ভালো কৃষক। আচ্ছা চলি হয়তো শীঘ্রই আবার দেখা হবে।
মাহমুদ তার মোটর সাইকেলের সিটে বসেই পা নামিয়ে কথা বলছিল। এইবার সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। গর্জন করে ওঠে অতিকায় যন্ত্রটা মাহমুদের পায়ের এক লাথি খেয়ে! এঞ্জিনের প্রচণ্ড গর্জন আর-কম্পন শুনে মনে হচ্ছিলো ছিপছিপে মাহমুদের পক্ষে ওটা বুঝি কন্ট্রোল করা সম্ভব হবে না। কিন্তু দেখা গেল শক্ত হাতে অবলীলাক্রমে যাণ্ডেল চেপে ধরেছে মাহমুদ। ধোঁয়া আর গর্জন ছড়িয়ে গাড়িটা তীব্র গতিতে ছুটে গেল রাস্তার দিকে।
এতক্ষণে মুখ খোলে রবিউল্লাহ। বলে, লোকটা ধরো গে তোমার, একেবারে বাজে। আমাকে বললো, কিনা কৃষিকাজ করি…কৃষক। মুখে একটুও আটকাল না
বলতে। তা তুমি অমন চুপচাপ হয়ে গেলে কেন শাহেলি? এসব নিয়ে মন খারাপ করে লাভ আছে কিছু?
লাভ লোকসানের কথা না।
শাহেলির ঠোঁট জোড়া শক্ত দেখায়। বলে, আমি ভাবছি মান অপমানের কথা। রবি ভাই, দুহাজার টাকা যে করে থোক আমাকে জোগাড় করতে হবে। ঐ অভদ্র, ইতর লোকটার মুখের উপর ছুঁড়ে মারতে হবে টাকাটা। নইলে আমি স্বস্তি পাবো না। উঃ, আম্মা অমন সর্বনেশে মানুষ, কে জানতো? রবি ভাই,
কি বলছো?
তুমি আমাকে দুহাজার টাকা ধার দেবে?
দুহাজার টাকা সমান্য টাকা নারবিউল্লাহ আস্তে আস্তে বলে, জোগাড় করতে একটু সময় লাগবে বৈকি। তাছাড়া একটু চিন্তা ভাবনাও করা দরকার।
চিন্তা ভাবনা, সেটা আবার কি?
শাহেলি হাবেভাবে নির্মম হয়ে ওঠে।
তুমি রাগ করছো বুঝতে পারছি শাহেলি। তা এতে তোমার রাগের কি আছে? মাহমুদ সাহেব এখন এই তল্লাটের সবচে টাকাওয়ালা মানুষ। খারাপ মানুষের হাতে টাকা হলো গিয়ে চাবুকের মতো। যার হাতে এই চাবুকটা আছে, তাকে সবাই ভয় পায়।
তুমি মাহমুদকে ভয় পাও?
ভয়?
রবিউল্লাহ একটু অন্যমনস্ক হয়ে ভাবে। বলে, না ভয় ঠিক পাই না। আমি হলাম গিয়ে ঠাণ্ডা কিসিমের মানুষ। ভীতুই বলো আর দুর্বলই ভাবো ভালরকম ভেবেচিন্তে তবে আমি একটা কাজ করি। হাঙ্গামা ফ্যাসাদের ভেতর যেতে সহজে আমি চাই না। মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে লড়ালড়ি, ও একটা হাঙ্গামা। দেখছো না লোকটা ঝগড়া কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
শাহেলি অসহিষ্ণু হয়ে বলে, এ ইতরটার সঙ্গে ঝগড়া করতে কে যাচ্ছে শুনি? আমি চাইছি আম্মা যে টাকাটা নিয়েছেন সেটা শোধ দিতে…
টাকা…
রবিউল্লাহ চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবলো। বললো, আচ্ছা, টাকাটা তোমাকে দিতে পারবো কি না সেটা কাল বলতে পারবো।
শাহেলি বললো, বেশ, কালকেই বলো। তুমি টাকাটা ধার দিতে পারো ভালো, নতুবা যে করে হোক টাকা জোগাড় আমাকে করতেই হবে।
রবিউল্লাহ দেখলো শাহেলি উত্তেজিত। এখন তাকে কিছু বোঝাতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। সে-চেষ্টা সে করলো না। বললো, চলো, কিছুদূর তোমাকে এগিয়ে দিই…
নিঃশব্দে পাশাপাশি দুজন মাঠ পার হয়ে রাস্তায় উঠলো। দুপাশে পাতা বাহার রোডের গাছপালা ও বাড়িঘর। রাস্তা দিয়ে চলাচল করছিল গাড়ি ঘোড়া ও পথচারি। রবিউল্লাহ ভাবছিল শাহেলির কথাই। রূপে, গুণে, ব্যক্তিত্বে শাহেলি অনেক উঁচু শ্রেণীর মেয়ে। স্বাভাবিক হিসাবে তার সঙ্গে শাহেলির বিয়ের প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠতো না। বড়কর্তা চৌধুরী আলী নকীব তার সঙ্গে শাহেলির বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন বলেই আজ সে শাহেলির মতো মেয়েকে পাওয়ার কথা ভাবছে। হ্যাঁ, শাহেলির মতো মেয়েকে বিয়ে করা রবিউল্লার পক্ষে পরম সৌভাগ্য। শুধু আফসোস হয় অতো রূপ আর গুণ আছে শাহেলির, সঙ্গে যদি আরো খানিকটা বাস্তব বুদ্ধি থাকতো!
পাতাবাহার রোডের স্নিগ্ধ ছায়া হেমন্তের বাতাসে কাঁপছে। স্টেশন থেকে সুন্দর পীচ ঢালা এই পথটা মাঠ ঘুরে কলোনীর ভেতর দিয়ে গিয়ে ঢুকেছে শাল মহুয়ার জঙ্গলে। সেখান থেকে থানা ও হাসপাতাল হয়ে পৌঁছেছে একেবারে উত্তর সীমানায় রাজা সাহেবের মাঠে। মাঠের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিখ্যাত ট্যুরিস্ট হোটেল, হোটেল তাজ।
নিঃশব্দে হাঁটতে হাঁটতে একসময় শাহেলি বলে, তুমি কি আমাদের বাড়ি যাচ্ছো এখন?
না। কিছুদূর তোমাকে এগিয়ে দিচ্ছি।
আর এগিয়ে দেয়ার দরকার কি? এই তো বাড়ির কাছেই এসে গেছি।
রবিউল্লাহ বললো, ঠিক আছে, আমি তাহলে কাল তোমাদের ওখানে যাচ্ছি।
আচ্ছা।
শাহেলি চলে গেল। রবিউল্লাহ আর এই অবেলায় ফার্মের দিকে গেল না। কলোনীর শেখ সাহেবের কাছে একটু কাজ ছিলো। ভাবলৈ কলোনী হয়ে বাড়ি চলে যাবে।
রবিউল্লাহর বাড়ি স্টেশনের কাছাকাছি। পাতাবাহার রোডের সুনিবিড় ছায়া পার হয়ে সে পৌঁছলে কলোনীর কাছাকাছি। রাস্তা থেকে নেমে বাঁ দিকের গলিতে ঢুকবে এই সময় পেছন থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর কানে এলো, একটু শুনবে?
রবিউল্লাহ ফিরে তাকায়। সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপরিচিত এক ভদ্রলোক। কোট-প্যান্ট-টাই পরা। বিশাল কাঠামো শরীরের, কিন্তু সেই অনুপাতে শক্ত-সামর্থ্য নয়। কেমন যেন দুর্বল দেখাচ্ছে। ভদ্রলোকের নাকটা টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো। চোখ জোড়া ক্লান্ত।
রবিউল্লাহ বললো, কিছু বলছেন?
হ্যাঁ! হোটেল তাজের পথ কি এটাই?
জ্বি। সোজা এই পথ ধরে চলে যান। এই রাস্তাটার নাম পাতাবাহার রোড। কিছুদূর গিয়ে দেখবেন শাল-মহুয়া জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তাটা হোটেল তাজ-এ চলে গেছে।
আপনি দেখছি ভূগোল ইতিহাস বেবাক ঝেড়ে ফেলেছেন।
লোকটা মাথা নিচু করে মুচকি হাসে। বলে, মেলা চক্করের পথ নাকি, অ্যাঁ? কমাইল হবে এখান থেকে?
তা ধরুনগে দেড় মাইল তো হবেই। এইটুকু পথ রিকসা করেও যেতে পারেন। মানিকপুরে রিকসা ভাড়া আপনার খুব কম।
হুঁ।
লোকটা যেন কি ভাবে। রবিউল্লাহ বলে, আপনাকে মানিকপুরে নতুন দেখছি। চেঞ্জে এসেছেন বোধ করি।
লোকটা এই কথার জবাব দেয় না। মুখ উঁচু করে দূরে তাকিয়ে কি যেন দেখে। তারপর বলে, আচ্ছা, আপনি একটা খবর দিতে পারেন?
কি খবর?
চৌধুরী আলী নকীব সাহেবের বিধবা স্ত্রী সুলতানা পারভিন কি এখন মানিকপুরে আছেন না অন্যত্র চলে গেছেন?
না, তিনি এখনো মানিকপুরেই আছেন!
আচ্ছা…ওতেই হবে।
ব্যাগ হাতে লোকটা মাথা নিচু কর হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে। কিছুদূর গিয়ে একটা খালি রিকসায় চেপে বসে। হাঁ করে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রবিউল্লাহ। লোকটা রিকসায় চেপে বোধহয় হোটেল তাজ-এ, চললো। কিছুক্ষণ আপন মনে কি যেন ভাবলো রবিউল্লাহ। তারপর আর ইতস্ততঃ না করে সেও একটা খালি রিকসা ডেকে নিলো। রিকসাওয়ালাকে বললো, হোটেল তাজ-এ চলো।
রিকসা চলতে লাগলো।
প্ৰকাণ্ড রাজা সাহেবের মাঠের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে হোটল তাজ। দীর্ঘ, প্রশস্ত বারান্দার উপর টালির ছাত। ভেতরে যাবার সরু পথের দুপাশে মৌসুমী ফুলের বাগান। মানিকপুরে যারা টিলা পাহাড় দেখতে আসে, ঐতিহাসিক দুর্গ, রাজা সাহেবের মাঠ বা শাল মহুয়ার জঙ্গল দেখতে আসে, বা স্বাস্থ্য-উদ্ধারে চেঞ্জে আসে তারা সাধারণতঃ এই হোটেলে এসে আশ্রয় নেয়। হোটেল তাজ মানিকপুরের গর্ব। জেলা শহরেও অমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন হোটেল আছে কিনা সন্দেহ। প্রকাণ্ড ঢালু রাজা সাহেবের মাঠের কিনারায় ছবির মতন ছিমছাম ও সুগম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলটি।
হোটেলের ম্যানেজার আইনুল হক মাত্র একজন খদ্দের রিসিভ করে বারান্দায় এসেছে। এই সময় বাগানের ছোট পথটি ধরে ব্যস্ত ভাবে আসতে দেখা গেল রবিউল্লাহকে।
আরে রবিউল্লাহ! কি ব্যাপার? এই সময়ে তুমি?
একটা খবর জানতে এসেছি তোমার কাছে আইনুল।
খবর! ঠিক আছে, বসো। এই বারান্দায়ই বসো না হয়।
না হে, চলো একেবারে ঘরে। এই কিছুক্ষণ আগে যে লোকটি তোমাদের হোটেলে এসেছে ওর নামটা আমার জানা দরকার।
আইনুল হক রবিউল্লাহর ব্যক্তিগত বন্ধু। সে রবিউল্লার এই কৌতূহলে একটু অবাক না হয়ে পারে না। কিন্তু বিস্মিত ভাবটা চাপা দিয়ে সে রবিউল্লাহকে নিয়ে ঘরে আসে। রেজিষ্টার খুলে নাম বের করে। রবিউল্লাহ প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে নাম ও ঠিকানার উপর।
খাতায় লেখা আছে, হাসান মওলা, চব্বিশ, মেহগনি রোড, ময়মনসিংহ। পেশা ব্যবসা।
হাসান মওলা,
রবিউল্লাহ নামটা উচ্চারণ করে আর ভাবতে চেষ্টা করে এই ধরনের কাউকে সে চেনে কি না
আইনুল হক বলে, কি হে, ব্যাপার কি? লোকটা তোমার চেনা-জানা নাকি? …
না, না…চেনা-জানা কিছু না। লোকটা ধরোগে তোমার খুব অভদ্র। কি উদ্দেশ্যে মানিকপুরে এসেছে একটু জানা দরকার।
ঠিক আছে,চিন্তা করো না। আজ থেকেই আমি মুন্সিকে পেছনে লাগিয়ে দিচ্ছি। তুমি খবর নিয়ো। মুন্সি সব খোঁজ-খবর করে তোমাকে জানাবে। দাঁড়াও, মুন্সিকে ডেকে আমি এখনই বলে দিচ্ছি।
খবর দিতেই হোটেলের কেয়ার টেকার মুন্সি ভেতরের পথ দিয়ে ঘরে এলো। ধূর্ত চেহারা। বাড়ি সিলেট! লোকটা বেড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে হাঁটতে পারে।
আইনুল হক মুন্সিকে মোটামুটি কাজটা বুঝিয়ে দিলো। একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে ভেবে রবিউল্লাহ বললো, না হে আমার এমন একটা কিছু interest নেই, বুঝলে? লোকটাকে দেখে-শুনে কৌতূহল হয়েছে, তাই খোঁজ নিচ্ছি। এরকম ব্যস্তসমস্ত হওয়ার কিছু দরকার নেই এজন্যে।
মুন্সি বললো, ঠিক আছে স্যার। তেমন খবর থাকলেই জানাবো।
হ্যাঁ, তাই।
রবিউল্লাহ সায় দেয়। আইনুল হক বলে, মুন্সি, আমাদের জন্য দুপেয়ালা চায়ের কথা বলে এসো কিচেনে। কি হে, চায়ে আপত্তি নেই তো?
রবিউল্লাহ একটু ইতস্তঃ করে বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে।
মুন্সি চলে যায়। আইনুল হক বলে, তারপর তোমার বিয়ের গল্প বলো দোস্ত।
রবিউল্লাহ সে কথার জবাব দেয় না। সে হঠাৎ চমকে ফিরে তাকায় পাশের কাঁচের জানালার দিকে। আইনুল হকও দেখলো একটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে কাঁচের জানালার ওপাশে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। চেঁচিয়ে ওঠে আইনুল হক, কে, কে, ওখানে?
ধপাস করে একটা পতনের শব্দ হলো। কি একটা ভারি বস্তু যেন পড়ে গেল উপর থেকে নিচে। রবিউল্লাহ ও আইনুল হক দুজনেই তাড়াতাড়ি জানালার দিকে ছুটে যায়। জানালা খুলে নিচে ও, আশেপাশে তাকিয়ে দেখে। না কেউ নেই।
আশ্চর্য।
ম্যানেজার আইনুল হক বলে, চার বছর ধরে হোটেলে ম্যানেজারী করছি। কখনো এমনটি ঘটতে দেখিনি, আর হাসান মওলা লোকটা হোটেলে পা দিতে না দিতেই দিনে দুপুরে ভোজবাজি শুরু হয়ে গেল?
রবিউল্লাহ আইনুল হকের কথায় কর্ণপাত করে না। সে চারপাশে তাকিয়ে কি যেন খোঁজ করছিল। হঠাৎ দেখলো বেশ খানিকটা দূরে রাস্তায় বুরুজ আলী তারের বেহালা বাজাতে বাজাতে চলছে।
একটু হাসলো রবিউল্লাহ। বুরুজ আলীর বেহালার ব্যবসা তাহলে ভালোই চলছে।
.
০৪.
তখন বেলা দুটোর কম নয়।
চৌধুরী কুটীরের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে তারের বেহালা বাজাচ্ছিল বুরুজ আলী। চারপাশে জমে উঠেছিল পথচারী ও বাচ্চাদের ভিড়। চোখ বুজে একমনে বেহালা বাজাচ্ছিল বুরুজ আলী আর সুরের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছিল। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে বাজনা শুনছিল সুলতানা। বাজনা শুনে সে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল। লোকটা লোকপ্রিয় পরিচিত গানের গৎ বাজাচ্ছে। থেকে থেকে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে সুলতানার। পুরনো গানের সুরে পুরনো দিনগুলিও কি আশ্চর্য রকম মিশে থাকে। সুলতানা মুগ্ধ হয়ে বুরুজ আলীর বাজনা শুনছিল আর ভাবছিল লোকটাকে বাড়ির ভেতরে ডাকলে কেমন হয়।
সুলতানা অনেকটা তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছিল দোতলার রেলিং ধরে, তার চমক ভাঙলো মাহমুদের হাসির শব্দে। ঘর থেকে সেও এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়।
“কি হাসছো যে?
হাসছি তোমাকে দেখে। কি সরল আর সহজ তোমার মন সুলতানা যে সাধারণ তারের বেহালা বাজনা শুনে তুমি একেবারে তন্ময়।
এইটা বুঝি হাসির ব্যাপার হলো তোমার কাছে?
নিশ্চয়ই। যার কোটি কোটি টাকা আছে ব্যাঙ্কে সে রাস্তার একটা লোকের তারের বাজনা শুনে চেতনা হারিয়েছে ভাবতে হাসি পায় না?
সুলতানা বিস্মিত হয়ে বলে, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। বেহালার বাজনা শুনে মুগ্ধ হওয়ার সঙ্গে কোটি কোটি টাকার কি সম্পর্ক?
মাহমুদ এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টে জিজ্ঞেস করে, লোকটাকে বাড়ির ভেতরে ডেকে আনতে খুব ইচ্ছে করছে, তাই না?
তা করছে বৈকি।
লোকটাও তাই চায়।
মানে?
মাহমুদ গম্ভীর হয়ে বলে, কদিন ধরেই লক্ষ্য করছি এই বেহালা বাদক লোকটা আমাদের বাড়ির চারপাশে যখন তখন ঘুরঘুর করছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ছিঁচকে চোর টোর। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি নোকটা গভীর জলের মাছ।
সুলতানা কিছুক্ষণ কথা বলে না। তার চোখমুখে আরক্তিম হয়ে ওঠে একটা জমাট বেদনা। আস্তে আস্তে বলে, হয়তো তোমার কথাই সত্যি। আমি অতোটা তলিয়ে দেখিনি। বাজনা শুনেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এখন থেকে আমি সাবধান হলাম। কিন্তু এভাবে দম বন্ধ হয়ে কদ্দিন আর মানিকপুরে থাকতে হবে বলতে পারো?
বেশি না, আর মাস দুই তোমাকে মানিকপুরে থাকতে হবে সুলতানা। এর ভেতর সব ঠিক হয়ে যাবে।
মানিকপুরে এই দুমাস থাকার সত্যি কি কোনো প্রয়োজন আছে বলতে চাও?
হঠাৎ কপালের গুণে কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছো সুলতানা। তাই কোটি টাকার মলিক হওয়ার যে কি বিপদ তা বুঝতে পারছে না। যদি বুঝতে তাহলে এ প্রশ্ন আমাকে করতে না তুমি।
সুলতানা বললো, তুমি রাগ করো না। বিশ্বাস করো এখানে থেকে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। মানিকপুরের এই দুষিত পরিবেশ ছেড়ে আর কোথাও না গেলে আমি বোধহয় দম বন্ধ হয়েই মারা পড়বো। মাঝে মাঝে মনে হয় কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার চেয়ে আমার আগের জীবন অনেক সুখের ছিলো।
মাহমুদ একটু হাসলো। বললো, শাঁখের করাত আসতেও কাটে, যেতেও কাটে সুলতানা। এই অবস্থায় আগের কথা কারো কাছে প্রকাশ করেছে তো ধনে প্রাণে মরেছো। তুমি নির্বোধ নও। এসব ভাবনা মন থেকে একদম ঝেড়ে ফেলল। এখন তোমার একমাত্র পরিচয় ভুমি চৌধুরী আলী নকীবের বিধবা স্ত্রী। তোমার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আছে দেশে-বিদেশে। কিসমত ও দৌলতের তুলনায় তোমার শত্রুর। সংখ্যা নগণ্য। সুতরাং এ অবস্থায় হাল ছেড়ে দেয়া চরম বোকামির লক্ষণ।
সুলতানা বললো, মানিকপুরে পা দিয়ে অবধি শুনছি আমার শত্রুর অন্ত নেই। আমার এইসব শত্রু কারা একটু খুলে বলবে?
সুলতানা আর কথা বললো না। উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রেলিং ধরে। গেটের বাইরে বুরুজ আলী বেহালা বাজিয়ে অনেকক্ষণ বোধহয় চৌধুরী কুটিরের মালিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ দূরে থাক, গেটের দারোয়ান পর্যন্ত ভালো-মন্দ একটা কথা বললো না।
আর অপেক্ষায় না থেকে বুরুজ আলী একটা ভিড় পেছনে নিয়ে বেহালা বাজাতে বাজাতে দূরে পাতাবাহার রোডের সর্পিল বাঁকে হারিয়ে গেল।
মাহমুদ বলে, চলো, সুলতানা ঘরে চলো।
চলো।
সুলতানা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। মাহমুদ সস্নেহে একটা হাত ধরলো সুলতানার। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো হঠাৎ দেখলো একটা অপরিচিত লোক গোট পার হয়ে ভেতরে ঢুকছে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। পিয়ন কালু এসে সালাম দিলো। সুলতানার হাত আগেই ছেড়ে দিয়েছিল মাহমুদ। কালুর দিকে তাকিয়ে বললো,
কি খবর কালু?
হোটেল তাজের একজন কর্মচারী একটা চিঠি নিয়ে এসেছে স্যার।
যে লোকটা এসেছে তাকে তুই চিনিস, তাই না?
জ্বি স্যার। ওর নাম মতিন, হোটেল তাজের বেয়ারা।
সার।
কালু ভয়ে ইতস্ততঃ করতে লাগলো, মতিন বললো খোদ সাহেব ছাড়া কারো কাছে তার নাকি চিঠি দেয়ার হুকুম নেই। যদি বলেন তো স্যার মতিনকে উপরে আসতে বলি।
বেশ তাই কর।
কালু নিচে গিয়ে হোটেল তাজের বেয়ারা মতিনকে নিয়ে এলো। বিনীতভাবে মাহমুদকে বলে মতিন, কসুর মাফ করবেন হুজুর। যিনি আমাকে এই চিঠিখানা দিয়েছেন, আপনাকে ছাড়া আর কাউকে সেটি দিতে তিনি মানা করে দিয়েছিলেন। তাই…
ঠিক আছে, চিঠি দাও।
মতিন চিঠিখানা দিলো। সেলাম জানিয়ে কালু সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে গেল। চিঠি হাতে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠলো মাহমুদ। খামের উপর তারই ঠিকানা লেখা। অক্ষরের ছাঁদটা একটু বাঁকা বাঁকা, মেয়েলি ধরনের। খাম খুলতেই বেরোলো এক টুকরো কাগজ। চিঠিতে লেখা ছিলোঃ
প্রিয় মাহমুদ সাহেব,
আসলে আমার এই চিঠি লেখার কথা আপনার ছোট বোন সুলতানা পারভিনের কাছে। চিঠিখানা তাকেই লিখতাম। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানলাম বর্তমানে আপনি তার অভিভাবক, সুলতানা পারভিন ওরফে মিসেস চৌধুরীর সম্পত্তির পরিচালনা থেকে শুরু করে তার স্বাস্থ্য রক্ষার খুটিনাটি বিষয়গুলি পর্যন্ত নাকি আপনি দেখাশোনা করেন। ভালই হলো, মিসেস চৌধুরী হয়তো বা এই চিঠি পেয়ে শুধু শুধু মন খারাপ করতেন। আমার বিশ্বাস আপনি আমার কথাগুলি বুঝবেন। চিঠিতে বিস্তারিত কিছু জানালাম না। আপনি আজ বিকেল সাড়ে ছটার দিকে একবার হোটেল তাজে এলে আমার সাথে দেখা হতে পারে। আমি আট নম্বর কামরায় আছি। আপনার বোনের প্রথম স্বামী ফ্লাইট লেঃ তাইমুর মীর্ধা সম্পর্কে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ খবর আমার নিকট আছে। আশা করি আসবেন। আপনার বিশ্বস্ত —
হাসান মওলা।
মাহমুদ অস্ফুট গলায় চেঁচিয়ে উঠলো। এগিয়ে আসে সুলতানা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, কি হলো?
পড়ো।
মাহমুদ চিঠিখানা সুলতানার হাতে তুলে দেয়। সুলতানা আগাগোড়া চিঠিখানা। পড়ে। বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠে তার চোখে মুখে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি বুঝতে পারছি সুলতানা।
মাহমুদ ঠোঁট কামড়ে ধরে ঘৃণায়। বলে, ওটা হলো বড় রকমের একটা চাল। কবে মরে ভূত হয়ে গেছে তৈমুর মীর্ধা। আর আজ কে না কে হাসান মওলা, তিনি দেবেন তারই সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ খবর। বুঝলে না সুলতানা, ওটা চাল।
সুলতানা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ভয়ে ও ভাবনায় তার চোখ-মুখ ফ্যাকাসে দেখায়। আস্তে আস্তে সে বলে, আচ্ছা এমনও তো হতে পারে তৈমুর মীর্ধা…
মরেনি…এই তো?
মাহমুদ কথা কেড়ে নিয়ে বলে, কিন্তু তা বললে চলবে কেন সুলতানা? তৈমুর মীর্ধাকে মরতেই হবে। তৈমুর মীর্ধার জীবিত থাকার অর্থ আলী নকীবের বার্ষিক ছাপ্পান্ন লক্ষ টাকা আয়ের সম্পত্তিটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া, বুঝতে পারছো?
না।
সুলতানা হঠাৎ যেন ভেঙ্গে পড়লো-হতাশায়। ক্ষোভ-জনিত বিদ্রোহের সুর ফুটলো। তার কথায়। বললো, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বুঝতেও চাই না। এই বিশ্রি গোলক ধাঁধা থেকে আমাকে তুমি মুক্তি দাও মাহমুদ..আমি এখান থেকে চলে যাবো।
“ছিঃ লক্ষ্মীটি, অমন ভেঙ্গে পড়ো না।
মাহমুদ যেন মিনতি করে। বলে, তুমি তো জানো আলী নকীবের সম্পত্তির মালিক হওয়ার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত আঘাতের অপেক্ষা করেছি। কিন্তু আঘাতের ঝাঁপটা যে এদিক থেকে আসবে তা একবারও ভাবিনি। অন্য দিকে ব্যস্ত ছিলাম সুলতানা, তৈমুর মীর্ধার কথা মনে ছিলো না।
সুলতানা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাহমুদ তাকে অনেক আশ্বাস-বাণী শোনায়। কিন্তু সে সব আশ্বাস-বাণী সুলতানার কর্ণগোচর হয়েছে কিনা বোঝা গেল না।
মাহমুদ বললো, আমার উপর যখন ভরসা করতে পারছে না তখন তুমি এক কাজ . করতে পারো সুলতানা। সোজা পুলিসের কাছে গিয়ে বলতে পারো যে
চকিতে ফিরে তাকায় সুলতানা। মাহমুদের মুখে হাত চাপা দেয়। বলে, দোহাই লাগে তোমার। চুপ করো। ওসব কথা বলো না আমাকে।
মাহমুদ সুলতানার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, আমি কখনো এসব কথা তোমাকে বলতে চাই না। কিন্তু যখন দেখি তুমি আমার উপর আর আস্থা রাখতে পারছে না, তখন ইচ্ছে হয় আমিই গিয়ে পুলিসকে সব জানিয়ে দিই।
সুলতানা আস্তে আস্তে বলে, আমি খুব দুর্বল! আমার কথায় কিছু মনে করো না। আমার ভয়-ভাবনার কথা ছেড়ে দাও। এই চিঠির ব্যাপারে কি করবে ভেবেছো কিছু
হুঁ। হাসান মওলার সঙ্গে বিকেলে দেখা করবো। তারপর? সোজা ব্যাপার! অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবো।
মাহমুদের চোখ-মুখ ঘৃণায়, আক্রোশে ভয়ঙ্কর দেখায়। বলে, আমি তো সাধু পুরুষ কিছু নই সুলতানা। নর-হত্যা ইতিপূর্বে বহু করেছি-মাঝখানে ছেড়ে দিয়েছিলাম, প্রয়োজনে না হয় আরো দু একটা করবো।
দুপুরে খাওয়ার পর নিজের ঘরে মাহমুদ একাকী ছটফট করে বেড়ায়। চৌধুরীদের এতদিন মিথ্যেই প্রধান শত্রু বলে সন্দেহ করলো। এদিকে ঘোড়ার চাল দিয়ে রেখেছে অদৃশ্য আর একজন। কে সে? তৈমূর মীর্ধা? তৈমুর মীর্ধা তো শোনা গিয়েছিল অপঘাতে মারা পড়েছে। তবে কি সে মারা যায়নি?
বিকেল হতে না হতেই কাপড় পরলো সে। পকেটে পুরলো গুলি ভর্তি রিভলভারটা। সুলতানা নিজের ঘরে দাঁড়িয়েছিল তার অপেক্ষায়ঃ মাহমুদ যেতেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো, কখন ফিরছো?
আগে দেখি তো কেমন মক্কেল।
মাহমুদ একটু হার্সে। বলে, যদ্র মনে হচ্ছে তাড়াতাড়িই ফিরতে পারবো। তুমি খামোকা চিন্তা করো না সুলতানা। মনে রেখো শক্তি এবং বুদ্ধিতে আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন কেউ মানিকপুরে নেই।
সুলতানা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাহমুদ নেমে এলো নিচে। তখনো বিকেলের রাঙা রোদ গাছপালার পেছনে সোনার মতো ঝলমল করছে। অরণ্যের ছায়ায় ঢাকা মানিকপুরের আকাশে গোধূলি নামছে রক্তিম সমারোহে। চারদিকে পাখ-পাখালির কলরব। মাহমুদের মোটর বাইকটা বুনো মোষের মতো গর্জন করে রাস্তার ধূলো উড়িয়ে ছুটে চললো।
হোটেল তাজ-এ যখন পৌঁছুলো মাহমুদ তখন পাঁচটা বেজে আরো কয়েক মিনিট। সুমুখে বিশাল রাজা সাহেবের মাঠ গোধূলির উদাস আলোয় আচ্ছন্ন। দিগন্তে পীরগঞ্জের টিলার অসংখ্য ত্রিভুজ স্কেচের মত দাঁড়িয়ে আছে আকাশের গায়ে। এক ঝাঁক বুনো পায়রা আকাশ পাড়ি দিয়ে উড়ে যাচ্ছে শাল-মহুয়ার অরণ্যের দিকে।
হোটেলে পৌঁছে প্রথমেই দেখা হলো ম্যানেজার আইনুল হকের সঙ্গে। আইনুল হক সাদরে অভ্যর্থনা করে মাহমুদকে। আট নম্বর কেবিন চিনিয়ে দেবার জন্য মুন্সিকে ডেকে দিলো ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে।
আট নম্বর কেবিন উত্তর প্রান্তের একেবারে শেষ ঘর। ভেতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বর। ভেসে এলো, কে?
মুন্সিজী হাঁক দিয়ে বলে, “চৌধুরী বাড়ির মাহমুদ সাহেব স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
কয়েক সেকেণ্ড নীরবত, তারপরই খুট করে দরজা খুলে যায়। সেই আগের গম্ভীর কণ্ঠ বলে, মাহমুদ সাহেব? আসুন।
ভেতরে ঢোকে মাহমুদ। দুজন দুজনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। হাসান মওলা মৃদু হাসে। বলে, বসুন মাহমুদ সাহেব। আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আপনি নির্ধারিত সময়ের তিন মিনিট আগে এসেছেন। So kind of you. দয়া করে বসুন। চা আনতে বলি, কেমন?
বেশ বলুন।
চায়ের সঙ্গে আর কিছু?
হাসান মওলার প্রচণ্ড ভদ্রতাবোধ দেখে গা জ্বলে যায় মাহমুদের। মনে মনে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে সে। মুখে বলে, আমার জন্যে আর কিছুর দরকার নেই।
Excuse me for a moment. আমি চায়ের কথাটা বলে আসি।
হাসান মওলা বাইরে আসে। সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে শুকিয়ে কেউ আছে কি না। লক্ষ্য করে। তারপর একটা বয়কে ডেকে চায়ের অর্ডার দিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
এইবার সমঝোতার পালা। দুজনেই দুজনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ নীরবতা ভেঙে প্রায় কঠোর কণ্ঠে মাহমুদ বলে, এইবার কেন তলব করেছেন দয়া করে খুলে বলুন মওলা সাহেব।
বলছি। কিন্তু তার আগে নাহক তকলিক দেয়ার জন্যে প্রথমেই মাপ চাইছি।
আপনার ভদ্রতাবোধ অসাধারণ।
হাসান মওলা বলে, এভাবে চিঠি লিখে নিশ্চয়ই আপনাদের অবাক করে দিয়েছি?
হ্যাঁ। সে কৃতিত্বটুকু আপনি অনায়াসে দাবি করতে পারেন বটে। আমরা ভাই বোন দুজনই আপনার চিঠি পেয়ে খুব অবাক হয়েছি।
আমি এজন্যে খুবই দুঃখিত মাহমুদ সাহেব। কিন্তু কি করবো? এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না সামনে। যাক গে। এইবার কাজের কথায় আসি। আচ্ছা, বাই দি বাই, আপনি কি কখনো আপনার বোন মিসেস সুলতানা পারভিনের প্রথম স্বামী তৈমুর মীর্ধাকে দেখেছেন?
দেখবো না কেন? হাজার হোক একটা মাত্র বোন আমার। তার স্বামীকে দেখবো না?
হাসান মওলার চোখে-মুখে একটা তীব্র ঠাট্টার হাসি ফুটে উঠলো। বললো, মিথ্যে কথা বলবেন না মাহমুদ সাহেব। আপনি তৈমুর মীর্ধাকে কখনো দেখেননি। আপনার অভিনেত্রী বোন সুলতানা পারভিন যখন স্কোয়াড্রন লীডার তৈমুর মীর্ধাকে বিয়ে করেন তখন আপনি সুদূর আফ্রিকার গিনি উপকূলে ডাকাতি করে বেড়াতেন। ঠিক কি না? আপনার সঙ্গে সুলতানা পারভিনের দেখা হয় দীর্ঘ দশ বছর পরে। তখন সুলতানা, পারভিন লাহোর সিনেমা জগতের উজ্জ্বল নায়িকার জীবন যাপন করছেন। তৈমুর মীর্ধার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয়েছে তারও বেশ কবছর আগে।
চমৎকার নাটকীয় বর্ণনা। তারপর?
হ্যাঁ, তারপরের কথাও আমি জানি। আফ্রিকার গিনি উপকূল থেকে ফিরে আপনি অর্থোপার্জনের দাঁও খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। বুড়ো আলী নকীব এই সময় সুলতানা পারভিনের রূপে উৰ্ত্ত হয়ে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। সুলতানা পারভিন ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু আপনি
দেখতে দেখতে মাহমুদের মুখমণ্ডল হিংস্রতায় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সে তড়িতাহতের মতো উঠে দাঁড়ায়। চাপা গর্জন বেরিয়ে আসে উত্তেজিত কণ্ঠ থেকে, Sut up you rascal!
উত্তেজিত হবেন না মাহমুদ সাহেব। বসুন, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আমি এতক্ষণ শুধু ভূমিকাটুকু সারছিলাম। বসুন, দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
হাসান মওলা নিলিপ্ত ভঙ্গিতে হাসে, আমি সবই জানি মাহমুদ সাহেব। অপরাধ নেবেন না দয়া করে। আপনার কোনো ক্ষতি করা আমার ইচ্ছা নয়। আগে কথাগুলি শুনুন, তারপর আপনার যা ইচ্ছা হয় করবেন। রিভলভার বের করে লাভ কি বলুন? ইচ্ছে করলেও এই অবস্থায় খুন করা আপনার পক্ষে উচিত হবে না।
মাহমুদ পকেটে হাত দিয়ে রিভলভারের বাঁটটা সজোরে চেপে ধরেছিল। হাসান মওলার কথায় একটু বক্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসে। বলে, কোনটা উচিত কোনটা অনুচিত সেটা বিচার করার ভার আপনার উপর নয়। আমার সব কথাই যখন আপনি জানেন তখন আশা করি এটাও বলে দিতে হবে না যে দরকার পড়লে যে কোনো অবস্থায়ই খুন করতে আমি এতটুকু দ্বিধা করি না।
ভেজানো দরজা খুলে এই সময় চায়ের ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো বেয়ারা। ট্রে নামিয়ে নিঃশব্দে সে চলে গেল। হাসান মওলা অত্যন্ত ধীর স্থির ভাবে দুপেয়ালা চা তৈরি করে। এক পেয়ালা নিজে রেখে আর এক পেয়ালা বাড়িয়ে দেয় মাহমুদের দিকে। বলে, নিন শুরু করুন।
মাহমুদ চায়ে চুমুক দেয়। এই প্রথম সে অনুভব করে, যে লোকটা সামনে বসে আছে, শক্তি ও বুদ্ধিতে তার কাছে সে নিতান্ত অসহায় শিশু। হাসান মওলা আঁটঘাট বেঁধেই এই বৈকালিক সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছে। ব্যবস্থায় এতটুকু খুঁত নেই। পকেটের রিভলভারটা হোটেল তাজের এই গোধূলি সন্ধ্যায় নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।
মাহাবুদ সাহেব, হাসান মওলা আবার শুরু করে, এটা ঠিক যে তৈমুর মীর্ধাকে আপনি কখনো দেখেননি। আচ্ছা ধরুন, এখন যদি জানতে পারেন তৈমুর মীর্ধা জীবিত আছে, তাহলে?
মাহমুদ বলে, ধরাধরির কিছু নেই এতে। তৈমুর মীর্ধা মারা গেছে আজ থেকে প্রায় নবছর আগে।
হ্যাঁ, নবছর আগে এরকম একটা খবরই প্রচারিত হয়েছিল বটে। আর খবরটা প্রচারিত করেছিল স্বয়ং তৈমুর মীর্ধাই।…
মানে?
মানেটা খুবই সহজ। তৈমুর মীর্ধা আসলে মারা যায়নি। কোনো একটা বিশেষ কারণে তাকে মৃত্যু-সংবাদ প্রচার করতে হয়েছিল মাত্র।
মাহমুদ বললো, হ্যাঁ, আপনার মস্তিষ্ক যে উর্বর তা স্বীকার করতেই হয় মওলা সাহেব। তা এই গাঁজাখুরি খবরটা দিতেই কি আপনি মানিকপুরে এসেছিলেন?
দআপনার কাছে খবরটা গাঁজাখুরি হতে পারে কারণ সত্যি কথাটা চোখে আঙুল দিয়ে— বুঝালেও আপনি বুঝবেন না। কিন্তু ধরুন তৈমুর মীর্ধাকে যদি আমি চৌধুরী পরিবারের কারো কছে, ধরুন চৌধুরী রশিদের কাছে এনে হাজির করি, তখন আপনাদের অবস্থাটা কি দাঁড়াবে ভেবেছেন?
আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
না। আমি আপনাকে সত্যি কথাটা বোঝাতে চেষ্টা করছি মাত্র। জেনে রাখুন তৈমুর মীর্ধা এখনো জীবিত। আমি তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তার সব খবরই আমি রাখি। নবছর আগে ফ্রন্টিয়ারের কোন এয়ার পোর্টে একটা বড়ো রকমের স্মাগলিং কেসে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় তৈমুর শীৰ্বা হঠাৎ চাকরি ছেড়ে আফগান সীমান্তের ওপারে পালিয়ে যায়। যাবার আগে আমার মতো কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব ও সহকারী কর্মচারীদের সাহায্যে নিজেকে সে মৃত বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। নানা লোকের ছদ্মবেশে এতকাল তৈমুর শীধা আফগানিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় আত্ম গোপন করেছিল। তৈমুর মীর্ধা আবার স্বনামে আত্মপ্রকাশ করতে ইচ্ছুক।
বটে? তাহলে থোকাবাজির অপরাধটা বুঝি সরকার থেকে মওকুফ হয়ে গেছে?
না, তা হয়নি। এতকাল নাম ভাঁড়িয়ে বেড়াবার ও নিজেকে মৃত বলে জাহির করার অপরাধে তৈমুর মীর্ধাকে নিশ্চয়ই অভিযুক্ত হতে হবে। কিন্তু তাতে ধরুন, কি এমন শাস্তি হবে তৈমুর মীর্ধার? বড়জোর কয়েক হাজার টাকা ফাইন। তৈমুর মীর্ধা ইতিমধ্যে আইনজীবীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে দেখেছে এবং ঐ ফাইনের জন্যে মনে মনে প্রস্তুত সে।
হুঁ।
মাহমুদ নিবিষ্ট মনে তাকায় হাসান মওলার দিকে। বলে, আপনার উদ্দেশ্যটা এখন একটু একটু বুঝতে পারছি। তৈমুর মীর্ধার ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে এসেছেন।
ছিঃ, ছিঃ কথাটা এমন ভাবে বলছেন যে আমি রীতিমত লজ্জা পাচ্ছি মাহমুদ সাহেব। কদৰ্থ করলে ব্যাপারটা ব্ল্যাকমেলিংই দাঁড়ায় বটে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ভদ্রলোকের ছেলে, নেহাৎ অসুবিধায় পড়েই আপনার কাছে টাকা চাইতে এসেছি।
কত টাকা? তা ধরুন লাখ দেড়েক টাকা দিলেই আমার এবং তৈমুর মীর্ধার মুখ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। বিশ্বাস করবেন না জানি। ভাবছেন একবার টাকা পেলে আপনাকে একেবারে পেয়ে বসবো। বারবার আসবো টাকা চাইতে। কিন্তু ভদ্রলোকের এক কথা। বিশ্বাস করেন না করেন আপনার ইচ্ছা।
মাহমুদ বললো, তৈমুর মীর্ধাকে যদি আমার সামনে হাজির করতে পারেন তাহলে আমি টাকা দিতে পারি।
হো হো করে হাসলো হাসান মওলা। কিছুতেই তার হাসি থামে না। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে সে বলে, আপনি খুব মজার কথা বলতে পারেন মাইরি। তৈমুর মীর্ধাকে সামনে হাজির করে দিই, আর আপনি সুযোগ বুঝে আমাদের দুজনকেই যমের বাড়ি পাঠিয়ে নিষ্কন্টক হন!
আপনাদের যমের বাড়ি যাওয়ার সম্ভাবনা কি এখনই কিছু কম আছে মনে করেন?
তা মনে করি বৈকি। তৈমুর মীর্ধাকে আপনি কোথায় পাচ্ছেন যে মারবেন? আমাকে অবশ্য ইচ্ছে করলে এখানেই আজরাইলের হাতে সপে দিতে পারেন। কিন্তু আমি যেখানে তৈমুর মীর্ধার বন্ধু, আর তৈমুর মীর্ধা সশরীরে জীবিত, সেখানে আমাকে খুন করলে আপনার অবস্থাটা কি হবে চিন্তা করুন?
হাসান মওলা খুব হাসে। তার তীক্ষ্ম চাখজোড়া জ্বলজ্বল করতে থাকে। একটু থেমে সে বলে, ব্যাপারটা আশা করি আপনি বুঝেছেন। আমাকে ধরুন ঐ তৈমুর মাধাই পাঠিয়েছে আপনার কাছে। তার এখন ভীষণ অর্থাভাব। লোকটা খুব খেয়ালী, যা কিছু উপার্জন করেছিল সব বেমালুম উড়িয়ে বসে আছে। তা খেয়ালী হলে কি হবে তার মাথাটা একেবারে পাকা। খবরের কাগজে চৌধুরী আলী নকীবের মৃত্যু আর সেই সঙ্গে সুলতানা পারভিনের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি পাওয়ার সংবাদটা চোখে পড়েছে। ওমনি বুঝলেন কি না একটা প্ল্যান গজিয়ে উঠলো মাথায়। তৈমুর মীর্ধার কথাটা হলো তার জীবিতাবস্থায় সুলতানা পারভিন কি করে মিসেস চৌধুরী আলী নকীব হয়? কাবিন নামার শর্তে আছে স্বামী বারো বৎসর নিখোঁজ থাকার পর স্ত্রী ইচ্ছে করলে দ্বিতীয় বার নিকাহ করতে পারে। তা বারো বছর তো হয়নি, হয়েছে মোট নবছর, সাড়ে নবছর। সুতরাং চৌধুরী আলী নকীবের সঙ্গে সুলতানা পারভিনের বিয়েটাই অবৈধ। তা যদি হয়, অর্থাৎ বিয়েটাই যদি অবৈধ হয় তাহলে সুলতানা পারভিন আইনতঃ চৌধুরী আলী নকীবের সম্পত্তি পেতে পারে না। আর যদি পেতে হয় সামান্য দেড় লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে।
মাহমুদ বললো, একটা ধাপ্পাবাজিতে ভুলবার পাত্র আমি না। স্পষ্ট কথাই বল। ভালো। টাকা আমি দেবো না।
বেশ তো, না দিলেন। আমাকে তাহলে একবার চৌধুরীদের কাছ থেকে ঘুরে আসতে হয়। আমি জানি ওরা অনেক রকম ফন্দি-ফিকির করছে আলী নকীবের সম্পত্তিতে কামড় বসাবার জন্যে। কিছুতেই সুবিধা করতে পারছিল না। এইবার তৈমুর মীর্ধার বেঁচে থাকার খবরটা পেলে জিইয়ে উঠবে।
তুমি একটা স্টুপিড হাসান মওলা… দাঁতে দাঁত ঘষে বলে মাহমুদ।
আর আপনি একটা নাক-উঁচু শয়তান হাসান মওলা হাসে।
আমি কি সেটা যথাসময় বুঝতে পারবো। তা কতো টাকা চাইছিলে?
দেড় লাখ।
অসম্ভব। টাকাটা এক লাখে নামিয়ে আনতে পারো?
বেশ। কিন্তু চেক চলবে না। কারেশী নোট চাই।
দেবো। কিন্তু কদিন সময় দিতে হবে।
আটচল্লিশ ঘন্টা সময় দিলাম। এর ভেতর টাকাটা দিয়ে দিতে হবে।
এতো অল্প সময়ে শহরের ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এনে দেয়া সম্ভব নাও হতে, পারে।
তাহলে আগামী বিষাদবার?
“ঠিক আছে, মাহমুদ সায় দেয়। দম নিয়ে বলে, কিন্তু যদি ফের ব্ল্যাকমেলিং করতে আসে?
তা যে আসবো না তা আপনি জানেন মাহমুদ সাহেব। চোরেরও একটা ধর্ম আছে।
অলরাইট।
মাহমুদ উঠে দাঁড়ায়। বলে, বিষুদবার সন্ধ্যার পর আমি টাকা দিতে আসবো। আশা করি আমাদের এ আলাপটা আর কেউ জানবে না?
নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার ক্ষতি করবার উদ্দেশ্যে আমি মানিকপুরে আসিনি।
মাহমুদ দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।. হাসান মওলা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে থাকে। ধীরে ধীরে তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে শঠতার হাসি।
সেই হাসি দেখে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে মুন্সিজীর চোখ-মুখ। সাত-আট নম্বর কেবিনে লুকিয়ে হার্ড বোর্ডের ছোট একটা ছিদ্রে চোখ লাগিয়ে এতক্ষণ সে সবকিছু দেখছিল, শুনছিল। মাহমুদ চলে যাবার পর লুকানো জায়গা ছেড়ে সেও ছুটলো রবিউল্লাহর উদ্দেশ্যে। সাহেবকে খবরটা দিতে হবে।
.
০৫.
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মানিকপুর স্টেশনে একটা লোকাল ট্রেন এসে থামলো। মানিকপু ছোট স্টেশন। মাত্র জনাকয় যাত্রী গাড়িতে উঠলো। গাড়ি থেকে নামলো তারও কম সংখ্যক লোক। চিঠির ঝুলি কাঁধে নিয়ে নামলো একজন পিয়ন। স্বামী-স্ত্রী ও একটি শিশুকন্যা নিয়ে একটা পরিবার, বোধহয় মানিকপুরে চেঞ্জে অথবা বেড়াতে এসেছে তারা। আর নামলো কামাল। আরো একটি দীর্ঘাকায় লোক সকলের অগোচরে ট্রেন থেকে নামলো। পরনে কালো সার্জের স্যুট। মাথায় জিন্না ক্যাপ। ট্রেন থেকে নেমে লোকটা গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো লেবেল-ক্রসিং এর কাছে একটা কামিনী গাছের ঝাঁকালো ছায়ার নিচ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কারো জন্যে অপেক্ষা করলো। তারপর বিরক্ত হয়ে স্টেশনের উল্টা পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর যেতেই শেষ হয়ে গেল কাঁটা তারের বেড়া। লোকটা চারদিক তাকিয়ে রাস্তা পরখ করার চেষ্টা করলো। একটা কাঁটামেদির ঝোঁপ পার হয়ে রাস্তা। লোকটা সন্তর্পণে ঝোঁপ পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে উঠলো।
ট্রেন থেকে নেমে কামালও একজনের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সিটি বাজিয়ে স্টেশন ছেড়ে চলে গেল ট্রেন। পেছনে কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে রইলো মানিকপুর। স্টেশন ঘরের সামনে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। ঝি ঝি পোকা ডাকছে ঝোপে-ঝাড়ে। বেশ কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলে কামাল। তারপর ব্যাগ হাতে স্টেশন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলো বাইরে। রাস্তার এক পাশে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা রিকসা ও এক্কা গাড়ি। ফেরিওয়ালারা কোমরে কাঠের বাক্স ঝুলিয়ে বাক্সে কুপি বাতি বেধে পান-বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করছে। খানিকটা দূরে খোলা জায়গায় বাজার বসেছে। সারি সারি কুপি-বাতি বাতাসে দপদপ জ্বলছে। অল্প অল্প কলরব ভেসে আসছে বাজার থেকে। কামাল একটা এক্কা গাড়ি নিলো।
গাড়োয়ান বললো, কই যাইবেন স্যার?
হোটেল তাজ-এ।
একখান নোট কিন্তুক নিমু স্যার, হুঁ!
কামাল বুঝলো এক টাকা চাইছে গাড়োয়ান। সে হেসে বললো, ঠিক আছে চলো। গাড়োয়ান মাত্র চাবুকে হিস শব্দ তুলে ঘোড়া দুটোর উদ্দেশ্যে একটা আদরের গালি ঝেড়েছে, এই সময় ছুটতে ছুটতে এলো বুরুজ মিঞা? গাড়ির পা-দানীতে উঠে জানালায় মুখ বাড়িয়ে বললো, স্যার, দয়া করে আমাকেও যদি কলোনী পর্যন্ত নিয়ে যান।
প্রথমটায় কামাল একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। বুরুজ মিঞাকে দেখে আশ্বস্ত হয়। মজা করার জনা বলে, না হে পুরো একটা নোট দিয়ে ভাড়া করেছি গাড়ি। পারবো না। আধাআধি দিতে পারব?
সিকি ভাগ দেবো স্যার। তারের বেহালা বিক্রি করি, মুরোদ তো স্যার বোঝেন।
গাড়িতে নিবি তো বল তা নইলো দরজা ভেঙে ঢুকবো।
শেষের কথাটা আস্তে করে বললো বুরুজ মিঞা যাতে গাড়োয়ান শুনতে না পায়। কিন্তু কথাবার্তা শুনতে না পেলেও দেরি হওয়ায় গাড়োয়ান চটে গেছে। বললো, কি স্যার, ঝামেলা আছে না গেছে?
ততক্ষণে কামাল দরজা খুলে দিয়েছে। গাড়িতে উঠে বসেছে বুরুজ মিঞা। গাড়োয়ানের কথা শুনে একটু চেঁচিয়ে বলে, আমি বুরুজ মিঞা গো খাঁসাব। ঐ যে যার কাছ থেকে বেহালা কিনেছিলে।
খাঁসাব তাচ্ছিল্যের একটা শব্দ তুলে বলে, আমি বুরুজ মিঞা আর সুরুজ মিঞা বুঝি না। হুজুর যদি তোমারে জায়গা দ্যান তত বহো। হে না আইলে বাইর অইয়া যাও কইলাম! হ!
কামাল বুঝলো গাড়োয়ান খাসা একটু মেজাজী লোক। সে গাড়োয়ানের উদ্দেশ্যে বললো, তুমি গাড়ি চালাও। বুরুজ মিঞা আমার সঙ্গেই যাবে।
তাইলে আর কথা নাই হুজুর…
চাবুকের হিসহিস শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করলো গাড়িটা। উপরের আসন থেকে গাড়োয়ানের চড়া গলার স্বর শোনা গেল, এহন গিয়ে আমার গাড়ির মালিক অইলো হুজুর! হুজুর যা কইবেন তা-ই সই। আমি ঐ সব বুরুজ মিঞা সুরুজ মিঞার কি ধার ধারি?
শালা গাড়োয়ানের খালিত তো বড় খারাপ। বুরুজ মিঞা না বলে পারে না।
শালা শব্দটা বোধহয় শুনতে পেয়েছিল গাড়োয়ান। সে বললো, কি কাইলা গো বুরুজ মিঞা? আমারে নি গালি দিলা?
না খাঁসাব। বলছি, একটু জলদি করে চালাও।
হ! এইডা একশো বার কইতে পারো। কিন্তুক গালিগালাজ দিয়ো না সোনাভাই, হ! আমার মেজাজ বড় চড়া।
গাড়োয়ান হিসহিস চাবুক চালাতে চালাতে বললো, ছলিম ডাকাইতের নাম হুনো নাই বুরুজ মিঞা? দুই দুইবার লাগতে আইছিল আমার লগে। দুইবারই আমি ফাস্ট অইছি।
গাড়োয়ান উপরের সিটে বসে বিড় বিড় করতে লাগলো। সিটের গায়ে হেলান দিয়ে বুরুজ মিঞার মুখোমুখি বসলো কামাল। বুরুজ মিঞা বললো, আমার চিঠি পেয়েছিলি?
হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। কিছুতেই তৈমুর মীর্ধার রিপোর্ট তৈরি করতে পারছিলাম না। সামনে ধাঁধা আর ধাঁধা। হাসান মওলার খবর পেয়ে অকূলে কূল পেয়েছে শহীদ।
বুরুজ মিঞা ওরকে শহীদ একটু হাসে। বলে, আজ বিদবার না? কাল ভোর বেলা মানিকপুর ছেড়ে চলে যাবে হাসান মওলা। তা লাহোর থেকে কবে ফিরেছিস তুই?
দিন দুই আগে।
লাহোরে মোটমাট কদিন ছিলি?
তিন দিন। লাহোর থেকে গেলাম পেশোয়ার, সেখান থেকে লাণ্ডিকোটাল। তৈমুর মধা আমাকে খুব কদিন ভুগিয়েছে বলতে হবে।
কামাল একটু হাসে। বলে, আর এখন ভোগাচ্ছে শহীদ খান।
দুজনেই হাসলো।
গাড়ি ছুটে চলেছে হোটেল তাজর দিকে। শহীদ বললো, তুই সোজা গিয়ে হোটেলে উঠবি। আমি নেমে যাবো হাসপাতালের কাছে। যথাসময় তার সঙ্গে দেখা করঝে গিয়ে
কামাল বলে, খুনীর হদিস পেলি?
শহীদ হাসে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। সবই জানা গেছে মোটামুটি। এখন শুধু কুয়াশার পাত্তা নেয়া। সেও হয়ে যাবে…
দুই বন্ধু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। কুয়াশাকে দুজনেই ভালবাসে, শ্রদ্ধা কর, অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস কুয়াশার সঙ্গেই বার বার সংঘর্ষ বেধে উঠছে।
শহীদ বলে, তোর রিপোর্ট কি বলে? তৈমুর মীর্ধা মৃত?
আমার রিপোর্ট তো তাই বলে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারিনি নবছর আগের ব্যাপার তো প্রমাণ পত্র খুঁজে বের করা মুস্কিল। আর হাসান মওলা কি বলে?
হাসান মওলা বলে সে তৈমুর মীর্ধার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার মতে তৈমুর শীর্ধা এখনো জীবিত আছে।
তৈমুর মীর্ধার জীবিত থাকার সংবাদটা বুঝি মানিকপুরে জানাজানি হয়ে গেছে? আমার মনে হয় না। হোটেল তাজ-এর একজন কর্মচারী চৌধুরী বাড়ির রবিউল্লাহকে খবরটা দিয়ে কিছু টাকা কামাই করেছে। রবিউল্লা ও সেই কর্মচারীটি রাস্তার একটা অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। আমি ছিলাম একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে ওদের ঠিক পেছনে। সৌভাগ্যক্রমে ওদের সব কথাই আমার কানে এসেছে।
তুই তাহলে ইতিমধ্যে মানিকপুরে বেশ পরিচিত লোক?
হ্যাঁ, তা বলতে পারিস। বেহালা বাদক বুরুজ মিঞাকে চেনে না এমন লোক এ তল্লাটে আছে কি না সন্দেহ।
শহীদ একটু হাসলো। বললো, হাসান মওলার সঙ্গে দেখা তো করতে যাচ্ছি, কিন্তু খুব সাবধান। লোকটা যেমন ধূর্ত তেমনি নিষ্ঠুর।
গাড়ির ভেতর কামাল ও শহীদ কথা বলছিল মৃদু গলায়। বাইরে কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত। রাস্তা প্রায় নির্জন। ক্বচিৎ দু একটা রিক্সা বা এক্কা গাড়ি রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করছে। পাতাবাহার রোডের দুপাশে গাছপালার আড়াল থেকে বাড়ি ঘরের আলো উঁকি দিচ্ছে। ঝি ঝি ডাকছে দূরে কোথাও। খটাখট শব্দ তুলে খাঁসাবের এক্কাগাড়ি এগিয়ে চলেছে হোটেল তাজের দিকে। কলোনী পার হয়ে পড়লে শাল মহুয়ার জঙ্গল। অন্ধকার আরো নিবিড় হয়ে এলো চারপাশে।
কামাল বললো, তুই চিঠিতে মাহমুদ সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছিলি। কিন্তু সুলতানা পারভিনের কথা একবারও উল্লেখ করিসনি। ব্যাপার কি?
সুলতানা পারভিন বাড়ি থেকে বেরোয় কালে ভদ্রে। বেরোলেও বেরোয় গাড়ি কর। কতবার ফন্দি খুঁজলাম চৌধুরী কুটিরে ঢুকবার। কিন্তু মাহমুদ থেকে শুরু করে বাড়ির বয় বাবুর্চি দারোয়ান পর্যন্ত এক একটা চালাকের ধাড়ি। কিছুতেই চৌধুরী। কুটিরে ঢুকতে পারিনি। যদ্র মনে হয় সুলতানা পারভিন মনে মনে টের পেয়ে গেছে যে, তার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র তৈরি হচ্ছে মানিকপুরে। তাই সব সময় সতর্ক হয়ে আছে।
শাল মহুয়ার জঙ্গল পার হয়ে আবার ফাঁকা রাস্তায় পড়লো গাড়ি। কিছুদুর এগিয়েই থানা ও হাসপাতাল। শহীদ বললো, আমাকে এখানেই নামিয়ে দে কামাল। নামার কথা তো ছিলো অনেক আগেই। এক গাড়িতে তার সঙ্গে বসে এগোনো আর ঠিক হবে না।
কাল সকাল বেলা তাহলে আসছিস?
হ্যাঁ, বেহালা বাজিয়ে তোকে মুগ্ধ করে দেব। তুই একটা বেহালা নগদ চার আনা দিয়ে কিনবি এবং বাজনা শেখাবার জন্য রোজ বিকাল বেলা আমাকে আসতে আদেশ দিবি। বুঝলি তো?
জো হুকুম ওস্তাদ।
কামাল মৃদু হাসে, থানার চৌহদ্দি পেরির গাড়ি একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ে। কামাল হাঁক দিয়ে বলে, খাঁসাব, গাড়ি থামাও, এখানে বুরুজ মিঞা নামবে।
বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়ি থামার গাড়োয়ান খাঁসাব। বুরুজ মিঞা কামালকে ভারিক্কি রকমের একটা সেলাম ঠুকে গাড়ি থেকে নেমে যায়। গাড়োয়ান খাঁসাবকে খুশি করার জন্য বলল, ও খাঁসাব বিড়ি চলবো?
গম্ভীর কণ্ঠে জবাব এলো, চলবো!
তা নাও একটা বিড়ি। হুজুরকে ভালয় ভালয় পৌঁছে দিয়া হোটেলে।
বুরুজ মিঞার কাছ থেকে একটা বিড়ি নিয়ে টান দিচ্ছিলো খাঁসাব। এই কথায় সে অপমান বোধ করলো যেন। বললো, হে তোমার কওন লাগবো না, বাপু। আমার কাজ আমিই ভালা জানি। এ তোমার তারের সারেঙ্গী না যে হাত মোচোরা দিবা আর প্যাপো আওয়াজ উঠবো। ইডা অইলো খাঁসাবের গাড়ি। বুঝলা মিঞা?
বুরুজ মিঞা বুঝেছে বৈকি। সে আর কথা বাড়ায় না। পথের গভীর অন্ধকারে অদৃশ্য, হয়ে যায়।
ডানদিকের জানালার কপাটটা নিচে নামিয়ে দেয় কামাল। বাতাস বইছে হু হু করে। বাতাসে শীতের স্পর্শ। অল্প অল্প কুয়াশা চারদিকে। রহস্যময় অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আছে সারা মানিকপুর। রাত কিছুতেই সাড়ে সাতটার বেশি হবে না। এরই মধ্যে মাঝ-রাত্রির নির্জনতা নেমেছে মানিকপুরে।
গাড়ির ভিতর বসে অনেক কথাই ভাবছিল কামাল। এর আগে কতবারই তো মানিকপুরে এসেছে নে। একবার এসেছিল শহীদের বিয়ের পর শহীদ ও মহুয়ার সঙ্গে বেড়াতে। বার দুয়েক এসেছে পিকনিকে। বেগম রশিদের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। সত্যি ভারি সুন্দর জায়গা এই মানিকপুর। শহরের কল-কোলাহল থেকে মানিকপুরে এসে একটা অনুরূপ মুক্তির আনন্দ পাওয়া যায়। এখানে সীমাহীন মাঠ আছে, উদার আকাশ আছে, ছবির মতো সুন্দর টিলা, পাহাড় আছে, ছায়া সুনিবিড় অরণ্য ও অরণ্যের রং-বেরঙের পাখি আছে। প্রতিবারই মানিকপুরে এসে ভালো লেগেছে কামালের। কিন্তু, এবারে মানিকপুরে আসার সঙ্গে ভালো লাগা না লাগার সম্পর্ক নেই। আকস্মিক ভাবে মানিকপুর আসতে হয়েছে এবার। ঘটনাচক্রে শহীদ জড়িয়ে পড়লো মানিকপুর হত্যা রহস্যের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে পড়লো কামালও। বেগম রশিদের বিবৃতি, কতদূর সত্যি তা জানার জন্যে কামালকে যেতে হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান। তৈমুর মীর্ধা জীবিত কি মৃত তা জানার জন্যে সে লাহোর, পেশোয়ার, লাণ্ডিকোটাল ঘুরেছে। তদন্ত করার পর সে নিশ্চিত যে তৈমুর মীর্ধা মৃত। কিন্তু শহীদের চিঠি পাওয়ার পর সবটা ব্যাপারই দারুণ জটিল হয়ে দেখা দিয়েছে। ডেথ রিপোর্টে বলে তৈমুর মর্ধা মৃত। এদিকে তার বন্ধু হাসান মওলা এসে দাবি করছে তৈমুর মাধা জীবিত।
কোনটা সত্য, কে জানে?
গাড়োয়ান খাঁসাবের গাড়ি খট খট শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে। দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে আসছে ঠাণ্ডা বাতাস। গাড়ির ভেতর বসে ঘড়িতে সময় দেখলো কামাল। সাতটা বেজে কয়েক মিনিট। শহীদের খবর অনুযায়ী তাহলে হাসান মওলা এতক্ষণে লক্ষ টাকার মালিক। ব্যাগভর্তি ব্ল্যাকমেলিং-এর টাকা নিয়ে ভোরের জন্য নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে হাসান মওলা। কিন্তু ভোর হবার অনেক আগেই হাসান মওলাকে নতুন বিস্ময়ের সম্মুখীন হতে হবে। সুলতানা পারভিন ও তৈমুর মীর্ধার রহস্য ভেদের সবচে বড় দুলিল এই হাসান মওলা। একে কামাল কিছুতেই যেতে দিতে পারে না।
গাড়ির ভেতর নিজের ভাবনায় ডুবে বসে রইলো কামাল। এক্কাগাড়ি পাতাবাহার রোডের শেষ মাথায় গিয়ে পৌঁছলো। সামনে কয়েক সারি মেহগনি গাছের নিশ্চুপ ছায়া। ছায়া পার হতেই কয়েকবার উজ্জ্বল আলো অন্ধকার ধাঁধিয়ে লাফিয়ে উঠলো কামালের চোখে। সামনে হোটেল তাজ। তারও সামনে প্রাচীন স্মৃতির মতো করুণ ও উদাস হয় আবছায়ার উপর শুয়ে আছে প্রকাণ্ড রাজা সাহেবের মাঠ। উপরে তারা জ্বালা আকাশ।
হোটেলের সামনে গাড়ি থামালো খাঁসাব। গেটের কাছে দুটো রিকসা আর একটা এক্কাগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কামাল দশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলো, খাঁসাবের হাতে। বললো, তোমার গাড়ি বহুত আচ্ছা খাব। চড়ে খুব আনন্দ পেয়েছি।
খাঁসাব খুসিতে ডগমগ। বললো, হজুর যা দিছেন হেই আমার সাত রাজার ধন : আইজ ধরেন এ গরীবের ষাইট ট্যাকা রুজি অইয়া গেছে কিছুক্ষণের মধ্যে! আল্লায় দিলে, হুজুর, দিবার পারে।
ষাট টাকা রুজি।
হ হুজুর। যে টেনে আইলেন হেই টেনে একজন সায়েবরে তুইল্যা দিলাম, হে দিলো একটা পঞ্চাশ টাকার নুট। নাম কইলেই তারে চিনবেন হুজুর। নাম কইতে মানা কইরা গেছে তয় নামডা আর কইলাম না।
গাড়োয়ান খালাব খুশির চোটে হাসতে লাগলো। বললো, রুজি আমার কপালে আছে, হেইটা মারবে কে, কন, হুজুর?
কামাল ব্যাগটা নিলো। গাড়োয়ান লম্বা সালাম দেয়। হেসে কামাল গেট পার হয় হোটেলের ভেতরে ঢোকে। দু পাশে মৌসুমী ফুলের বাগান। সরু কাঁকর ঢালা পথটা গিয়ে উঠেছে বাংলা প্যাটার্নের বাড়ির মাঝদিকের বারান্দা বরাবর। বারান্দার ছাত টালি দিয়ে তৈরি। দুপাশে মাধবী লতার ঝাড়, মাঝখানে কার্নিশের উপর ইংরেজি ও বাংলা হরফে হোটেল তাজ কথাটা খোদাই করা।
হোটেলের বিভিন্ন ঘরে আলো জ্বলছে। কাঁচের জানালা দিয়ে সেই আলো এসে পড়েছে বাগানে। বারান্দা জনশূন্য রিসেপশানেও কেউ নেই। একটা বড় রেজিস্টার বুক-সমান উঁচু টেবিলের উপর খুলে রাখা। রিসেপশানে ঢুকে অবাক হয় কামাল। অনেকবার মানিকপুর এসেছে সে। প্রায় প্রতিবারই এখানে এসে উঠেছে হোটেল তাজে। হোটেল তাজের ব্যবস্থাপনার সুনাম বহু দিনের। কিন্তু এ কেমন ব্যবস্থাপনা যে রিসেপশান খালি রেখে ঘর থেকে কর্মচারী উধাও? সে রিসেপশানে ঢুকে ভাবছে কি করবে এমন সময় পাশের ঘর থেকে একটা উত্তেজ্জিত, গলার স্বর শোনা গেল। কে একজন বললো, না তোমাদের দিয়ে কিছু হবে না মুন্সি। আধ ঘন্টা আগে তোমাকে খবর দিতে বললাম আর তুমি কিনা এখন বলছো মতিনকে পাঠিয়েছ: কেন, তুমি নিজে গেলে কি ক্ষতি হতো শুনি?
না স্যার, ক্ষতি আর কি হতো। আমার পায়ে একটা ঘা হয়েছে, হাঁটতে পারি না ভালো করে, এজন্যে ওকে পাঠিয়েছিলাম। মতিন এতো দেরি করবে কে জানতা স্যার। ঠিক আছে আমিই যাচ্ছি।
হ্যাঁ, জলদি যাও। কপালে কি আছে আল্লা জানেন। চার বছর ধরে এই হোটেলে চাকরি করছি, এমন কাণ্ড কখনো দেখিনি বাবা!
দরজা খুলে যায়। রিসেপশানে ঢোকে ম্যানেজার আইনুল হক ও মুন্সিজী। কামালকে ওভাবে ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ম্যানেজার প্রায় চমকে ওঠে। বলে, কে?
তারপর কামালকে চিনতে পারে। ম্যানেজারের মুখটা ফ্যাকাসে দেখায়। কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, স্যার আপনি সাড়ে ছটার ট্রেনে এলেন বুঝি? তা জিনিসপত্র কোথায়, বাইরে গাড়িতে? দাঁড়ান স্যার…এক মিনিট, একটা বেয়ারা পাঠিয়ে দিচ্ছি। জিনিসপত্রগুলি নিয়ে আসুক।
বাধা দিয়ে কামাল বলে, ব্যস্ত হবেন না হক সাহেব। জিনিসপত্র যা কিছু আমার সঙ্গেই এই ব্যাগে আছে।
আইনুল হক হঠাৎ তীব্র দৃষ্টিতে তাকায় মুন্সিজীর দিকে।
কড়া গলায় বলে, তুমি আবার হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন মুন্সি? বলি বিপদটা কি আমার বলে ভাবছে নাকি, এ্যা?
মুন্সি খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যায়।
আর বলবেন না স্যার।
ম্যানেজার আইনুল হক বিষণ ভাবে মাথা নাড়ে, কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম। আজ!
কি ব্যাপার হক সাহেব? আপনাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে।
চিন্তিত?
হক সাহেব কথা কেড়ে নিয়ে বলে, শুধু চিন্তিত বলছেন স্যার। উপায় থাকলে ডাক ছেড়ে কাঁদতাম। আপনি স্যার দয়া করে একটু বিশ্রাম করুন—ব্যবস্থা করছি। আমি অন্যত্র ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। কিছু মনে করবেন না স্যার! এমন উড়ো ঝামেলা পড়িনি জীবনে!
মনে করার কিছু নেই হক সাহেব। কাজ আছে যখন সেখানেই যান। আমাকে শুধু একটা খবর দিতে হবে।
খবর? বলুন স্যার।
আমি হাসান মওলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। দয়া করে এক্ষুণি ব্যবস্থা করুন।
ম্যানেজার আইনুল হক স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলা কামালের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললো, হাসান মওলার কথা বলছেন? He is dead, sir. .murdered!
What do you say!
কামাল প্রায় লাফিয়ে উঠল, Murdered? কখন খুন হয়েছে?
অনুমান করি ঘন্টা দেড়েক আগে। আসুন স্যার দেখাচ্ছি।
ম্যানেজার আইনুল হক কামালকে হাসান মওলার ঘরের দিকে নিয়ে যায়।
.
০৬.
ভেতরের বারান্দার দুপাশে টানা দুই সারি ঘর। ম্যানেজার আইনুল হকের পেছনে পেছনে কামাল গিয়ে পৌঁছলো উত্তর প্রান্তে। ডান দিকের ঘরটা হাসান মওলার। সামনের বারান্দায় কয়েকজন লোক জটলা করছিল। কথাবার্তা বলছিল। ম্যানেজার আইনুল হকের সঙ্গে কামালকে আসতে দেখে ওদের কথাবার্তা থেমে যায়। একসঙ্গে অনেকগুলি দৃষ্টি কামালের উপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ম্যানেজার আইনুল হক সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র করলো না। কামালের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো, আসুন, এই ঘরই হাসান মওলার।
দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ঘর পাহারা দিচ্ছিলো হোটেলের নেপালী দারোয়ান। গুরুবন্ত সিং। ম্যানেজার বললো, সিংজী, খবর আছে?
জ্বি, আছে।
গুরুবন্ত সিং মাথা নাড়ে মুন্সিজী এই ঘরে ঢুকতে চাইলো। আমি দিলাম না তো হামাকে গালিগালাজ করলো।
ঠিক হ্যায়, মুন্সিজীকে দেখো লেঙ্গে।
আইনুল হক গম্ভীর গলায় বলে, থানার লোকজন না আসা পর্যন্ত এই ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয়া যাবে না। বুঝেছো?
ঠিক হুজুর।
গুরুবন্ত সিং সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বারান্দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মানুষগুলির দিকে একবার অপাঙ্গে দৃষ্টিপাত করে ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে আইনুল হক। পেছনে পেছনে কামাল। ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াতে হলো। ঘরের অপরিসর মেঝের উপর লম্বালম্বি হয়ে পড়ে আছে হাসান মওলার দেহ। মেঝে ভেসে গেছে রক্তে। নাক, ঠোঁট, জামার কলার, বুক রক্তে ভিজে জবজবে। হাসান মওলা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। চোখ দুটি বিস্ফারিত। সারা মুখে একটা দারুণ হতাশা ও ক্ষোভের চিহ্ন। বাঁ হাতের মুঠি বন্ধ করা। ডান হাতটা প্যান্টের পকেটে ঢুকানো। কপালের বাঁ পাশে একটা জায়গা ফুলে উঠেছে। বুঝতে কষ্ট হয় না এটা আঘাতের চিহ্ন।
আমরা মৃতদেহ যেরকম পেয়েছি সেরকম অবস্থায়ই রেখে দিয়েছি। থানায় খবর দিয়েছি বেশ কিছুক্ষণ আগে। দারোগা সাহেব এলেন বলে।
আইনুল হকের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঘরটা ঘুরে ফিরে দেখলো কামাল। ছোটো ঘর। ঘরের পশ্চিম কোণে সিঙ্গল খাট পাতা, ডান পাশে একটা বন্ধ দরজা। খাটের শিয়রে আলনা আর তেপায়া টেবিল একখানা। পূর্বদিকের জানালা ঘেঁষে একটা টেবিল। চারপাশে গোটাকয়েক সোকা। কামাল দেখলো জুতার কয়েকটা এবড়ো খেবড়ো ছাপ মৃতদেহ থেকে সোজা চলে গেছে পশ্চিম দিকের দরজার দিকে। দরজার কাছে গিয়ে সে দেখলো বাঁ পাশে একটা পার্টিশন, তারপর একটা কেবিন।
আপনারা সামনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিলেন, তাই না ম্যানেজার সাহেব…?
একটু থতমত খেয়ে যায় আইনুল হক। বলে, জ্বি। আপনি ঠিকই ধরেছেন। সামনের দরজা ভেঙেই আমরা ভেতরে ঢুকেছি। আসলে ব্যাপারটা কি হয়েছিল আপনাকে খুলেই বলছি। তার আগে হাসান মওলার কথা একটু বলে নিই। আইনুল হকের গলার স্বর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলে, সত্যি কথা বলতে কি হাসান মওলা লোকটা তেমন সুবিধের ছিলো না। মানিকপুরে এসেছে ধরুন আজ পাঁচদিন। এরই মধ্যে নানারকম কাণ্ড হয়ে গেছে হোটলে। প্রথম যেদিন এলো সেদিন রিসেপশানে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। বললে বিশ্বেস করবেন না একটা ছায়ামূর্তি জানালার কাছে ঘাপটি মেরে আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিল। আমরা টের পেয়ে যেতেই এক সেকেণ্ডর মধ্যে ছায়ামূর্তিটা কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল আল্লামালুম। রকম সকম দেখে আমি হোটেলে কেয়ার টেকার মুন্সিজীকে লোকটার পেছনে লাগিয়েছিলাম। তা অতো যে চালাক চতুর মুন্সিজী সে পর্যন্ত লোকটার সঠিক হদিস বের করতে পারলো না। শুধু এইটুকু জানা গিয়েছিল হাসান মওলা মানিকপুরে এসেছে, চৌধুরী বাড়ির মাহমুদ সাহেবের কাছে। কি একটা টাকার ব্যাপার ছিলো তার সঙ্গে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে লোকটা হোটেল থেকে চলে গেলে আমরা বাঁচি। দারুণ খলিফা লোক, দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। বেশি কথাবার্তা বলতো না, কিন্তু তাকাতো এমন কড়া নজরে যে মনে হতো সামনে থেকে পালাতে পারলে বাঁচোয়া। আমি তো সায়েব একদিন খাতির জমাতে গিয়েছিলাম। তা কি বললো শুনবেন?
আইনুল হকের চোখ মুখ রাগ আর অভিমানে ভারি দেখায়। বলে, বললো দরকার ছাড়া আমি কথা বলি না। দয়া করে ঘর থেকে বেরোন। আমি আর কথা বলি না কি? যা কিনা বদরাগি চোখ আর কড়া মেজাজ, আমি চুপ করে সেখান থেকে সরে পড়লাম। হাসান মওলার ঘরে আর যাইনি।
কামাল বললো, হাসান মওলা এখানে আসার পরে নানা রকম কাণ্ড ঘটে গেছে। বললেন না?
হ্যাঁ বলছি। হাসান মওলা এখানে আসার পরদিন রাতে এক মহিলাকে হাসান মওলার ঘর থেকে বেরোতে দেখেছিলাম। মহিলার আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা। হাসান মওলার ঘর থেকে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মহিলাটি মাঠে নামলো। মাঠ নেমে মহিলা যে কোনদিকে চলে গেল বুঝতে পারলাম না। শুধু কিছুক্ষণ পর রাজা সাহেবের মাঠে একটা মোটর গাড়ির গর্জন শুনলাম। উত্তর দিক থেকে। গর্জনটা পাতা বাহার রোডের দিকে চলে গেল। রাত তখন ধরুন দুটোর কম না। আর এক রাতের কথা বলি শুনুন। সে রাতেও হোটেলের হিসাবপত্র মেলাতে মেলাতে রাত একটা হয় গিয়েছিল। ঘুম আসছিল না বলে বাগানে চেয়ার নিয়ে বসেছিলাম। আকাশে ছিলো কৃষ্ণপক্ষের একাদশী চাঁদ। চাঁদের ম্লান আলোয় বীদিককার রাজা সাহেবের মাঠটা ভৌতিক দেখাচ্ছিল। চেয়ারে বলে ঢুলুনি আসছিল, তো ভাবলাম এই বেলা গিয়ে শুয়ে পড়ি। হঠাৎ দেখলাম কি জানেন?
কি?
অবাক কাণ্ড স্যার। দেখলাম রাজা সাহেবের মাঠের বহুদূরে একটা নীল আলো জ্বলে উঠলো তিনবার। আর হাসান মওলা পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মাঠে নেমে হনহন করে হাঁটতে শুরু করেছে। দেখে শুনে ভয় বাঁচি না স্যার।
কামাল একাগ্র মনে শুনছিল। বললো, তারপর?
হাসান মওলার কথা কতো বলবো স্যার। হোটেল তাজে এসে উঠেছে আজ নিয়ে পাঁচদিন। এরই মধ্যে কতো কাণ্ড ঘটে গেল। আজকের সন্ধ্যার কথাই ধরুন না কেন? সাড়ে পাঁচটার দিকে চা খেয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়েছে একেবারে ফুল বাবুটি হয়ে। পরনে দামী সুট, হাতে চুড়ি। তা খোশ মেজাজে ছিলো বোধহয়। গেটের কাছে বাগানে আমার সঙ্গে দেখা হতেই বললো, আমি কাল ভোর বেলা চলে যাচ্ছি হক সাহেব। রাত্রিবেলা আমার বিল পাঠিয়ে দেবেন।
আমি বললাম, তা পাঠিয়ে দেবো স্যার! মানিকপুরে বেড়ানো বুঝি হয়ে গেল?
কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠেছিল হাসান মওলা। বলেছিল, আমি তো, বেড়াতে আসিনি হক সাহেব, কাজে এসেছিলাম।
একটু থেমে চোখ-মুখ কুঁচকে বলেছিল, মানিকপুর নাকি একটা বেড়াবার জায়গা, ছোঃ! একটা মাঠ, কিছু জঙ্গল আর এইতো আপনার বাহারের হোটেল! এ আবার দেখতে আসে কেউ?
কথার রকম শুনলেন স্যার! মানিকপুর দেখবে বলে হাজার হাজার লোক প্রতি বছর আসে। আর তিনি ভারি একটা জাহাবাজ লোক তিনি মানিকপুরের নামে নাক সিটকালেন। কথা শুনে স্যার ইচ্ছে হয়েছিল দিই ব্যাটাকে ভাল-মন্দ কিছু শুনিয়ে। তা, বললে বিশ্বাস করবেন না স্যার, বছর পাঁচ ধরে হার্টের অবস্থাটা ভালো যাচ্ছে না। ধমক-টমক বাড়লেই হার্টটা ধ্বক ধ্বক করে ওঠে। তাই কথা বাড়ালাম না।
কামাল বুঝলো হক সাহেব আলাপী মানুষ। আলাপ শুরু করতে জানে, শেষ করতে জানে না। সে বললো, তারপরের কথা বলুন।
বলছি স্যার। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে হাসান মওলা তো গেলেন রাজা সাহেবের মাঠে বেড়াতে। সন্ধ্যা সাড়ে ছ টার দিকে তার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম। দরজার বাইরে থেকে তালা মারা। বিল নিয়ে গিয়েছিলাম, ওই কাজটা নিজেরা করলেই সায়েব-সুবো লোক খুশি হন, তাই তেমন খরিদ্দার হলে বিল নিয়ে আমিই যাই। তা ঘর তালা মারা দেখে ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে একটা কাতরানির শব্দ পেলাম। প্রথমটায় বিশ্বাস হয়নি। তাই ভালো করে কান পাতলাম। আর কোনো সন্দেহ রইলো না। ঘরের ভেতর থেকে একটা কাতরানিরই শব্দ আসছিল। তালা মারা দরজা টান দিয়ে যেটুকু ফাঁক হয় সে ফাঁকে যা দেখলাম তাতে চমকে উঠলাম স্যার। দেখলাম হাসান মওলা মেঝেয় পড়ে রক্তের বন্যার ভেতর শুয়ে কাত্রাচ্ছে। সবটা ব্যাপারই ভৌতিক মনে হলো। ঘর তালা মারা, এদিকে ঘরের ভেতর রক্তাক্ত দেহে শুয়ে আছে হাসান মওলা। আমার হাঁকডাকে লোকজন এসে জড়ো হলো। সবাই মিলে চিৎকার করে ডাকলাম হাসান মওলাকে। কিন্তু কোনো ফল হলো না। শেষে তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকে দেখলাম পশ্চিমের দরজা হাঁ করে খোলা, ঘরে আলো জ্বলছে, মেঝেয় অচেতন হয়ে রক্তাক্ত দেহে শুয়ে আছে হাসান মওলা। সৌভাগ্যক্রমে হোটেলে একজন ডাক্তার এসেছেন আজ দুদিন হয়। তাঁকে ডেকে পাঠানো হলো। তিনি নাড়ি দেখলেন। তারপর বললেন তাঁর কিছু করার নেই। He is dead.
আইনুল হক কথা বলতে বলতে থেমে যায়। হাত-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, এখন বাজে আটটা পাঁচ। ঘটনাটা ঘটেছে এখন থেকে ধরুন দেড় ঘন্টা আগে। ডাক্তার হাসান মওলাকে মৃত বলে ঘোষণা করার পরই আমি পশ্চিমের দরজা বন্ধ করে সব লোকজন বের করে দিয়ে পাহারা বসিয়েছি। থানায় আগেই লোক পাঠিয়েছিলাম। দারোগা সাহেবের আসতে দেরি দেখে মুন্সিজীকে আবার পাঠিয়েছি। খোদা একি বিপাকে ফেললেন এইসব ভাবছিলাম, তখন স্যার আপনি এলেন। এ বোধহয় খোদারই ইচ্ছা।
আইনুল হক হাত কচলিয়ে করুণ হাসলো, নিরীহ লোকদের বাঁচাতে বোধহয় খোদা এখানে আপনাকে পাঠিয়েছেন স্যার! আমাদের একটু দেখবেন স্যার…ছাপোষা নিরীহ ভদ্র সন্তান স্যার…পেটের দায়ে হোটেলে চাকরি করতে এসেছি। দেখুন দেখি কি বিপদেই না জড়িয়ে পড়লাম।
আইনুল হকের অবস্থা প্রায় কেঁদে ফেলার মতো। কামাল বলে, নির্দোষ লোকদের ভয় কি হক সাহেব। আপনি ব্যস্ত হবেন না। হাসান মওলার ব্যাপারে আমি নিজে জড়িত হয়ে পড়েছি। আমার পক্ষে যা করা সম্ভব আমি তা নিশ্চয়ই করবো।
ছল ছল চোখে দাঁড়িয়ে রইলো আইনুল হক। কামাল পশ্চিমের দরজার দিকে। এগিয়ে যায়। দরজার ঠিক নিচে থেকেই আরম্ভ হয়েছে বিশাল রাজা সাহেবের মাঠ। চারপাশে কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটি অন্ধকার। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে রাজা সাহেবের মাঠে।
একটা রহস্য যেন থমথম করছে চারদিকে। অভিজাত হোটেল তাজে আজকের সন্ধ্যা। এমন ভাবে নামবে কে জানতো? বাইরে অন্ধকার রাত্রি, ঘরের ভেতর আলোর নিচে রক্তাক্ত দেহে শুয়ে আছে অতি শক্তিশালা, অতি ধুরন্ধর হাসান মওলা।
কামাল ঘরের ভেতরটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো এমন সময় হুড়মুড় করে মোটা শরীর নিয়ে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে ভেতরে ঢুকলো দারোগা সমশের শিকদার। সঙ্গে দুজন পুলিস, একজন জমাদার। আইনুল হক যথারীতি তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সমুখে দণ্ডায়মান কামালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিলো, প্ৰকাণ্ড থাবা তুলে তাকে বাধা দিয়ে সমশের শিকদার সবিয়ে বললো, কামাল সাহেব না?
খুব অবাক হয়েছেন নিশ্চয় এখানে আমাকে দেখে?
স্বভাবসিদ্ধ প্রচণ্ড হুঙ্কার ছেড়ে শিকদার বললো, অবাক হবো না, বলেন কি সাহেব? এতদিন কাগজে-পত্রে শার্লক হোমসদের কথা পড়েছি এখন সেটা দেখছি বাস্তবে একেবারে চোখের সামনে, যাকে বলে যথারীতি ঘটনাস্থলে, অবাক হবো না!
কামাল হেসে ফেলে বলে, ঠাট্টা করছেন করুন! এখন আসুন এদিকে। দায়িত্ব বুঝে নিন।
তা তো বটেই, কথায় বলে পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। তবে যাই বলেন, এ ব্যাপারে আপনার হেল্প কিন্তু আগে থেকেই চেয়ে রাখলাম।
সমশের সিকদার এবার হাসান মওলাকে নিয়ে পড়ে। মৃতদেহ যথারীতি তদন্তের পর ঘর সার্চ করা হলো।
খাটের নিচে পাওয়া গেল একটা লাল টকটকে গোলাপ ফুল, বোধহয় ঘন্টা দুয়েকও হয়নি গাছ থেকে ছোঁড়া হয়েছে ফুলটা। এ ছাড়া পাওয়া গেল ইংরেজিতে এম খোদাই করা একটা কালো রঙের সিগারেট লাইটার। হাসান মওলার ডান হাত প্যান্টের পকেট : একটা লগার পিস্তল ধরে আছে। খুব সম্ভব আত্মরক্ষার জন্য প্যান্টের পকেট থেকে লুকানো পিস্তলটা বের করতে গিয়েছিল হাসান মওলা। কিন্তু তার আগেই আততায়ীর আঘাতে ধরাশায়ী হয়েছে সে। যদ্দর মনে হয় শত কোনো একটা হাতল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে কপালের পাশটায়। সম্ভবতঃ আঘাতটা নাকেও লেগেছিল। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে শরীর থেকে। মেঝে ভিজিয়ে রক্তের ধারা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের চারদিকে।
ঘর সার্চ করার পর যথারীতি ককজনের জবানবন্দী নেয়া হলো। প্রথমে সবটা ঘটনা খুলে বললো আইনুল হক। ঘটনার বিবরণ মোটামুটি এইরকম দাঁড়ালো, হাসান মওলা বিশেষ এক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে মানিকপুর এসেছিল। যেদিন সে মানিকপুর আসে সেদিনই সন্ধ্যায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে আশেক মাহমুদের। দুজনের ভেতর কথাবার্তায় ঠিক হয় হাসান মওলা বিশেষ একটা গোপনীয় ব্যাপার, চাপা দিয়ে রাখবে, বদলে হাসান মওলাকে এক লক্ষ টাকা উৎকোচ দেবে মাহমুদ হাসান মওলা লোকটা তেমন সুবিধের ছিলো না। তার চাল-চলন ও কথাবার্তা ছিলো সন্দেহজনক ও আপত্তিকর। আজ বিষাদবার সন্ধ্যা সাতটায় মাহমুদের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার কথা ছিলো তার। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় রাজা সাহেবের মাঠের দিকে সে বেড়াতে যায়। আইনুল হক হোটেলের বিল নিয়ে তার ঘরের সমুখে গিয়ে তালা মারা বন্ধ ঘর থেকে কারানির শব্দ শুনতে পায়। তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে হাসান মওলাকে রক্তাক্ত মুমূর্য অবস্থায় পাওয়া গেল। হোটেলে অবস্থানরত এক ডাক্তার তার চিকিৎসার ভার নেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই হাসান মওলার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর আগে হাসান মওলা কোনো কথা বলে যায়নি।
আইনুল হকের জবানবন্দী শুনে গম্ভীর হয়ে ওঠে সমশের শিকদারের চোখ-মুখ। সে বলে, এইবার যে ডাক্তার হাসান মওলাকে attend করেছিলেন তাকে ডাকুন।
ডাক্তারের নাম আবদুর রহিম তরফদার। বয়স ষাটের কাছাকাছি। সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর খানেক আগে। তাঁর বাড়ি যশোহরে। তবে বর্তমানে ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। মানিকপুরে সস্ত্রীক এসেছেন চেঞ্জে।
ডাক্তার সাহেব।
সমশের শিকদার জেরা করতে শুরু করে, হাসান মওলার মুমূর্ষ অবস্থায় আপনি তার চিকিৎসা করেছেন, তাই না?
হ্যাঁ, নাড়ী পরীক্ষার নাম যদি চিকিৎসা বলেন তাহলে তা করেছি। ডাক্তার স্নান হাসেন। বলেন, আমাকে কিছুই করতে হয়নি। খবর পেয়ে সাত তাড়াতাড়ি এসে দেখলাম হাসান মওলার তখনো একটু একটু নিশ্বাস পড়ছে। ভাবছি একটা কোরামিন ইনজেক্ট করবো, এই সময় হঠাৎ নাকের কাছটা জোরে একবার ফুলে উঠলো। এক ঝলক টাটকা রক্ত বেরিয়ে এলো নাক থেকে। নাড়ী ধরে বুঝলাম সব শেষ হয়ে গেছে।
কিসে হাসান মওলার মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করেন?
আপনাদের ক্রিমিনলজি টার্মে সেটা ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ধরতে গেলে এক নাড়ী টেপা ছাড়া আর কিছুই করিনি। সুতরাং টেকনিক্যালি কিছু বলতে যাওয়া এক্ষেত্রে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে বাইরে থেকে যর মনে হয় অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলেই হাসান মওলার মৃত্যু হয়েছে।
অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ, হুঁ!
সমশের শিকদার কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলো। তারপর কামালকে বললো, আপনি কোনো প্রশ্ন করবেন?
না। পরের জনকে ডাকুন।
পরের ব্যক্তি মতিন, হোটেল তাজের বেয়ারা। সে যা বলে তার মধ্যে বিশেষ কিছু নূতনত্ব নেই। শুধু এটুকু জানা গেল হাসান মওলার দেখাশুনার জন্যে তাকে হোটেল কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করেছিল। প্রাণপণে কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করেছে সে। তার মতে হাসান মওলা অবশ্য গোঁয়ার ধরনের লোক ছিলো। তবে মাঝে মাঝে বয় বেয়ারাদের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করতে না সে। এই তো যেদিন হোটেল তাজে এলো সেদিনই মতিনকে সে একটা খামে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছিল চৌধুরী বাড়িতে মাহমুদ সাহেবের কাছে। এই সামান্য কাজটুকু করে দেবার জন্য বকশিশ মিলেছিল দশ টাকা।
পরের ব্যক্তি হোটেল তাজের কেয়ার টেকার মুন্সিজী। রবিউল্লার সঙ্গে তার চুক্তি থেকে শুরু করে আড়ি পেতে মাহমুদ ও হাসান মওলার কথাবার্তার সব ব্যাপারই সে খুলে বললো। সমশের শিকদার বললো, এখন আর কথা কি? কেসটা একেবারে পানির মতো সহজ এখন। যাও মুন্সি, তুমি এখন যেতে পারো।
দাঁড়াও।
কামাল মুন্সির দিকে ফিরে তাকায়। বলে, মুন্সি, তোমার পায়ে কি হয়েছে?
মুন্সি অম্লান বদনে বললো, হোঁচোট খেয়েছিলাম স্যার, তাইতে ডান পাটা একটু মচকে গেছে।
এই অঘ্রাণ মাসে হোঁচোট! তুমি নিশ্চয়ই খুব অসাবধানী মানুষ মুন্সি। তা এই হুঁশ নিয়ে তুমি বেলগাঁয়ে ডাকাতি করতে গিয়েছিলে?
কি বললেন, ডাকাতি? ব্যাটা তাহলে ডাকাত! বলেন কি অ্যাঁ?
সমশের শিকদার হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মুন্সিজীর দিকে। দেখতে দেখতে ভয়ে, আশঙ্কায় কালো হয়ে ওঠে মুন্সিজীর চোখ মুখ।
কামাল বলে, আমি তোমাকে দেখেই চিনেছি মুন্সিজী। কি পুরোনো কথা মনে পড়ছে না?
মনে পড়বে না কেন হুজুর। কিন্তু দোহাই আল্লার, বিশ্বেস করুন, আমি ওসব হারাম ছেড়ে দিয়েছি। বেলগাঁয়ের ডাকাতির মামলায় সাত বছরের জেল হয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে মসজিদে গিয়ে তওবা করে ছেড়ে দিয়েছি ওসব লানতের কাজ। এখন। আমি হালাল রুজি করি, হালাল খাই।
তা বটে। তবে এখনো মাঝে মাঝে পূর্ব নোম রক্তের ভেতর চাঁড়া দিয়ে উঠে, তাই না? মিথ্যে কথা বলো না মুন্সি, সন্ধ্যা সাড়ে ছটা থেকে সাতটা পর্যন্ত তুমি কোথায় ছিলে বলে।
মুন্সি চট করে জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে গুম হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। মনে মনে কি যেন ভাবলো সে। দেখতে দেখতে তার চোখে মুখে ফুটলো দৃঢ়তার ছাপ। বললো, হুজুর আমার গুনাহর অন্ত নেই। মসজিদের মাটি ছুঁয়ে তওবা করেছিলাম গুনাহর কাজ আর করবো না। কিন্তু লোভে পড়ে আমি আবার খারাপ কাজ করতে যাচ্ছিলাম। ডাকাতির নেশায় আবার আমাকে পেয়ে বসেছিল হুজুর। বিশ্বেস করুন, আর আমি মিথ্যে বলবো না। খা, সন্ধ্যে ছটা থেকে সাত নম্বর কেবিনে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো ঠিক করেছিলাম। এক লক্ষ টাকা জীবনে দেখিনি হুজুর? সেই টাকা কে না কে হাসান মওলা মানিকপুর থেকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। ঠিক করেছিলাম, এটা হতে দেবো না। তা সাত নর কেবিনে পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল আমার। আমিও ঢুকলাম আর হাসান মওলাও পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে হমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
তুমিও আর তাল সামলাতে পারোনি, পাশ ফিরতে গিয়েছে অমনি গাদা করে রাখা একরাশ পুরোনো আসবাবপত্র থেকে একটা টেবিল এসে পড়লো তোমার ডান পায়ে, তাই না মুন্সি?
হুজুর সবই জানেন।
আচ্ছা মুন্সি, একটা লোক পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে ভেতরে এসেছিল, তারপর একই রাস্তা ধরে চলে গিয়েছিল, লোকটাকে তুমি দেখেছ?
দেখেছি হুজুর।
লোকটা কে?
মুন্সি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর বললো, হুজুর, আপনি তো সবই জানেন। লোকটা মাহমুদ সাহেব।
মাহমুদ সাহেব।
ঘরের মধ্যে সমবেত আর্তধ্বনি উঠেই মিলিয়ে গেল। বিরাজ করতে থাকলো একটা অসহ্য নীরবতা।
নীরবতা ভঙ্গ করলো কামাল। বললো, শিকদার সাহেব, এখন আমাদের দরকার আরো তিন ব্যক্তির জবানবন্দী। আপাততঃ একজনকে মানিকপুরে পাওয়া যাবে না। রবিউল্লাহ আর মাহমুদ সাহেবকে এত্তেলা দিন। ওদের জবানবন্দী নেয়া প্রয়োজন।
আরো জবানবন্দী নিতে চান নিন, আসল ব্যাপার কিন্তু বেরিয়ে গেছে…
শিকদার কৌতূহলী নেত্রে তাকায় কামালের দিকে, কি সায়েব বেরোয়নি?
কামাল একটু মজা করার জন্য বললো, আপনি নিজে যখন চেপে ধরেছেন তখন, বেরোবে না মানে?
প্রশংসায় যথেষ্ট আনন্দ পায় শিকদার। হাসিতে ঘর ফাটিয়ে দিয়ে তারপর একটু বিনয় করে বলে, না, না..এমন আর কি করলাম? করলেন তো সায়েব আপনি-ই। তবে হ্যাঁ, আমি ব্যাপারটা গোড়া থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। বলতে পারেন বটে যে এসব খুন-খারাপীর তদন্তে এসে আমার মাথা খুলে যায়। ছোটো বেলা থেকেই আমার ব্রেন যাকে বলে mathematical. মেট্রিক পরীক্ষায় তো সায়েব মাত্র সতেরো নম্বরের জন্য লেটার পেলাম না।
খুবই আফসোসের কথা! আসুন আমরা বাকি কাজটুকু সেরে ফেলি।
চলুন, চলুন।
সমশের শিকদার বিপুল বপুটি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরে পাহারা বসাবার ব্যবস্থা হয়। আইনুল হকের অনুরোধে ওরা সবাই গিয়ে বসে বসবার ঘরে। চা নিয়ে আসে বেয়ারা মতিন। চায়ে চুমুক দিয়ে সমশের শিকদার মাত্র সিগারেটটি ধরিয়েছে এমন সময় ঘরে এসে ঢেকে রবিউল্লাহ আর মাহমুদ।
আপনারা এসেছেন ভালই হয়েছে, বসুন।
সমশের শিকদার মাথা নাড়ে, আমি এক্ষুণি আপনাদের জন্যে লোক পাঠাতে যাচ্ছিলাম।
তার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। আমরা…
মাহমুদ তিক্ত হাসি হাসলো, আমি আর রবিউল্লাহ সাহেব খবরটা শুনে নিজেরাই এসেছি।
ভালো। আপনাদের কর্তব্য পরায়ণতায় আমাদের অসীম বিশ্বাস। তা মাহমুদ সাহেব, ইনি (কামালকে দেখিয়ে) আপনাকে কতগুলি প্রশ্ন করবেন। আশা করি যথাযথ জবাব দিতে আপত্তি নেই আপনার।
আগে তো প্রশ্নের ধরনটা শুনি, তারপর আপত্তি আছে কি নেই বোঝা যাবে।
মাহমুদ ও রবিউল্লাহ দুজনেই বসলো। কামালের চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে রবিউল্লাহর দিকে ফিরে তাকালো।
রবিউল্লাহ সাহেব।
বলুন …
আপনি হাসান মওলার পেছনে মুন্সিজীকে লাগিয়েছিলেন এটা কি সত্য?
হ্যাঁ, সত্য।
কেন জানতে পারি?
তা নিশ্চই পারেন। এ ব্যাপারে ধরুন লুকালুকির কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। হ্যাঁ, মুন্সিজীকে আমিই হাসান মওলার খবরাখবর নেয়ার জন্যে বলেছিলাম। হাসান মওলার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা রাস্তায়! উনি আমাকে হোটেল তাজের পথ কোনটা জিজ্ঞেস করলেন, আমি পথ বলে দিলাম। তারপর উনি মিসেস সুলতানা পারভিন কোথায় আছে, জিজ্ঞেস করলেন। ভদ্রলোক এমন ভঙ্গিতে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন যে তাতে ধরুন আমার একটু সন্দেহ হয়। আমি কৌতূহলী হয়ে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করি। কিন্তু লোকটা এমন অভদ্র যে আমার কথার জবাব পর্যন্ত দিলো না। আমার তখন ধারণা হয় লোকটা নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলৰে মানিকপুরে এসেছে। তখন আমি হোটেল তাজে আলি। ম্যানেজার আইনুল হক জানালেন লোকটার নাম হাসান মওলা, বাড়ি মেহগনি রোড, ময়মনসিংহ–পেশা ব্যবসা। আমি ম্যানেজারকে সন্দেহের কথা বলায় তিনিই ধরুন তো আপনার হাসান মওলার খোঁজ খবর নিতে মুন্সিজীকে পেছনে লাগিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, লাগিয়েছিলাম, আইনুল হক জবাব দেয়, হোটেলের চাকরিতে ব্যবসাগত কারণে ছোটখাট গোয়েন্দাগিরি আমাদের করতেই হয়। কিন্তু কেচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে যাবে কে জানতো স্যার?
কামাল আর প্রশ্ন করলো না রবিউল্লাহকে, শুধু জিজ্ঞেস করলো, আজ সন্ধ্যে ছটা থেকে এতক্ষণ নিশ্চয়ই বাড়িতে ছিলেন?
জ্বি না। আমি ফার্মের হিসাব পত্র দেখছিলাম এতক্ষণ। হাসান মওলার মৃত্যুর খবরটা রটে গেছে বাইরে। শুনে আর থাকতে পারিনি, চলে এসেছি।
কামাল মৃদু হাসলো। বললো, হাসান মওলার মৃত্যুর ঘটনা শুনে আপনিও নিশ্চয়ই স্থির থাকতে পারেননি মাহমুদ সাহেব, ছুটে এসেছেন দেখতে, তাই না?
ঠিক তাই! আপনারা যা খুশি ভাবুন, ইডিয়েটটা মরেছে শুনে আমি আনন্দিত হয়েছি।
ইডিয়েটটা কিন্তু মরেনি, তাকে মারা হয়েছে।
একটু বিষণ্ণ ভাব ধারণ করে মাহমুদ। বলে, হ্যাঁ, ঐ যা একটু দুঃখের ব্যাপার। তা ওকে মার1 কে?
আপনি মেরেছেন, মাহমুদের উদ্ধত ভঙ্গি দেখে রাগে আর থাকতে না পেরে হুঙ্কার ছাড়ে সশর শিকদার, ইট ইজ ইউ, আপনি!
কঠোর হাসি হাসে মাহমুদ। বলে, বুঝে শুনে কথা বলুন ইন্সপেক্টর। আমি হাসান মওলাকে মারতে যাবো কেন শুনি?
কামাল বলে, কেন মারতে যাবেন সে কথা এখন থাক। আচ্ছা মাহমুদ সাহেব, হাসান মওলা মানিকপুর কেন এসেছিলেন বলতে পারেন?
অন্তত একটা কারণ বলতে পারি। হাসান মওলা মনিকপুর এসেছিল তাও দিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিতে।
আপনি টাকা দিতে রাজি হয়েছিলেন?
হ্যাঁ, হয়েছিলাম। লোকটা ছিলো অতি ধুরন্ধর। সে আমাদের পারিবারিক সম্মান নষ্ট করার চেষ্টা করছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে সম্মান রক্ষার তাগিদে টাকা দেয়ার অঙ্গীকার আমাকে করতেই হলো।
তা টাকা আপনি দিয়েছেন?
না। এখন ভাবছি আমি ভাগ্যবান। টাকা দেবার আগেই ধুরন্ধর হাসান মওলার মৃত্যু হয়েছে।
কামাল একটু হাসলা মাহমুদের কথায়। বললো, সন্ধ্যার পর এতক্ষণ আপনি কোথায় ছিলেন জানতে পারি মাহমুদ সাহেব?
আমি বাড়িতেই ছিলাম, আবার কোথায় থাকবো?
বাড়ি থেকে এই সময়ের মধ্যে একবারও কেরাননি?
জ্বি না।
অস্বীকার করছেন? বেশ…
কামাল হঠাৎ বের করে দেখায় কালো রঙের সিগারেট লাইটারটা। বলে, এম মনোগ্রাম করা লাইটারটা কার মাহমুদ সাহেব, আপনার না?
আরে, আর…
মাহমুদ যেন ভয়ানক অবাক হয় লাইটারটা দেখে। বলে, এ দেখছি আমারই গাইটার। কোথায় পেয়েছেন?
কোথায় পেয়েছি তা যথাসময়ই আপনাকে বলা হবে। তাহলে মাহমুদ সাহেব, এটা আপনার জিনিস?
জ্বি দিন পাঁচেক আগে ওটা চুরি গিয়েছিল। কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আপনি খুব মনভুলো মানুষ দেখছি।
কামালের ঠাট্টায় চেঁচিয়ে ওঠে মাহমুদ, কি বললেন?
মাহমুদ সাহেব, মিথ্যেই আপনি লুকোবার চেষ্টা করছেন। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছটা থেকে লোয়া সাতটার মধ্যে আপনি হাসান মওলার ঘরে এসেছিলেন।
হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে মাহমুদ। বলে, আপনি দেখছি সিরিয়াস লোক সাহেব! আর হ্যাঁ, একটা কথা ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমি আজ সাড়ে ছটার সময় হাসান মওলার ঘরে গিয়েছিলাম বটে। কিন্তু বাইরে থেকে হাসান মওলার ঘর তালা বন্ধ ছিলো বলে কিছুক্ষণ অপেক্ষ করেই ফিরে এসেছিলাম।
সামনের দরজা তালা মারা দেখে বুঝি পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছিলেন?
এবারে একটু যেন চমকে ওঠে মাহমুদ, কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। তার চোখ মুখ কঠোর ভাব ধারণ করে। বলে, যা খুশি ভাবুন তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার যা বলার ছিলো বলেছি। কথা মতো টাকা দিতে গিয়েছিলাম হাসান মওলাকে। দরজায় তালা মারা দেখে ফিরে এসেছিলাম। ব্যাস, এর বেশি কিছু আমার বলার নেই।
মাহমুদের পরে আরো দুএকজনের জবানবন্দী নেয়া হলো। হোটেলের এখানে ওখানে তখন লোক জড়ো হতে শুরু করেছে। একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে চারদিকে। বারান্দার ভিড় ঠেলে মৃতদেহের কাছে এগোচ্ছিলো কামাল, সমশের শিকদার ও তার দলবল। হঠাৎ সামনে দেখা গেল অপরিচিত এক মূর্তি। পরনে কালো রঙের সার্জের স্যুট, হাতে ছড়ি, মাথায় জিন্নাহ টুপি। লোকটা লম্বা চওড়া। প্রকাণ্ড নাকের নিচে ছাঁটা পুরু গোফ। বয়েস ষাটের উপর হবে, কিন্তু শরীর বেশ শক্ত সমর্থ।
আমি আটটা লিশের গাড়িতে মানিকপুরে এসেছি। লোকটা কামাল ও সমশের শিকদারের উদ্দেশ্যে বললো, আমার জনৈক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্যই এসেছিলাম এখানে। আমার বহুকালের পুরোনো বন্ধু। বন্ধু চিঠিতে জানিয়েছিলেন তিনি মানিকপুর হোটেল তাজের আট নম্বর কেবিনে অবস্থান করছেন। হোটেলে এসে শুনছি আট নম্বর কেবিনে যিনি থাকতেন তিনি নাকি কিছুক্ষণ আগে রহস্যজনক ভাবে খুন হয়েছেন। আশা করি এ ব্যাপারে আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করবেন। আমি এসব কথার অর্থ কিছু বুঝতে পারছি না।
সমশের শিকদার বললো, আপনার বন্ধুকে দেখে আপনি চিনতে পারবেন?
নিশ্চয়ই পিরবো! একদিন দুদিনের বন্ধুত্ব তো নয় যে কিছুদিনের অদেখায় চেহারা ভুলে যাবো। ক্যাম্প জীবনের বন্ধুত্ব সে কি ভুলবার?
আসুন আমাদের সঙ্গে…
সমশের শিকদার আহ্বান জানায় অপরিচিত বৃদ্ধকে। ঘরের দরজায় পাহারা দিচ্ছে বন্দুকধারী দুজন সিপাই। ঘরের ভিতর ফ্যাকাসে আলো জ্বলছে। কালচে রক্তের উপর পড়ে আছে হাসান মওলার মৃতদেহ। মৃতদেহ দেখেই সভয়ে দুপা পিছিয়ে আসে বৃদ্ধ। গলা চিরে বেরিয়ে আসে একটা তীব্র আর্তনাদ, My God! এ যে দেখছি আমার সেই বন্ধু, তৈমুর মীর্ধা!
Leave a Reply