কুয়াশা ৪ (ভলিউম ২)
০১.
মৃদু গর্জন করে শহীদের ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেনটা কামালের গাড়ি বারান্দায় এসে থামলো। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো শহীদ একতলার ড্রইংরূমের সামনে, তারপর প্রচণ্ড এক হুঙ্কার ছাড়লো, কামাল।
ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, ঘেউ!
অবাক হয়ে যায় শহীদ। ব্যাপার কি? কামালের ঘরে কুকুর! ও আবার কবে থেকে কুকুর পুষতে আরম্ভ করলো? দামী ভেলভেটের পর্দা একটু ফাঁক করে দেখলো একটা সোফায় বসে টেবিলের ওপর দুই পা তুলে দিয়ে চোখ বুজে সিগারেট টানছে কামাল। ঘরের মেঝেতে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত গোটা কতক সস্তা দরের ইংরেজি রহস্যোপন্যাস, মিকি স্পিলেন, লেসলি চার্টেরিস, আগাথা ক্রিষ্টী, আয়ান ফ্লেমিং, স্টেনাল গার্ডনার, কনান ডয়েল; আর বিভিন্ন ধরনের পত্র-পত্রিকা, রিডার্স ডাইজেস্ট, গানস এণ্ড গেম, আউট ডোর লাইফ, পপুলার সায়ান্স, ফিল্ড এণ্ড স্টীম, লাইফ, টাইম, নিউজ উইক–সব একসাথে মিলেমিশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঘরে ঢুকে এক নজর চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে শহীদ বললো, ব্যাপার কি কামাল? ঘরের এই অবস্থা কেন? তোর বাড়িতে কুকুর এলো কোত্থেকে?
ঘেউ। কামালের মুখে সেই একই উত্তর।
হেসে ফেলে শহীদ বললো, তোর আবার এই রূপান্তর ঘটলে কবে? আর কিছু হতে পারলি না, শেষ পর্যন্ত কুকুর হয়ে গেলি!
শুধু কুকুর নয়, একেবারে ক্ষ্যাপা কুকুর। ঘেউ ঘেউ ঘেউ!!
ওরে বাপরে, তবেই সেরেছে! একটু দূরেই বলি? ধপাস করে কামালের পাশে। বসে পড়লো শহীদ।
আর কতদিন, শহীদ? এভাবে শুয়ে বসে শরীরে যে ঘুণ ধরে গেল। তুই তো পণ করেছিস গোয়েন্দাগিরি করবি না–কিন্তু আমার দিন কাটে কি করে বল তো?
তুই কীরে? স্নেহের সুরে বললো শহীদ, এখনো পাগলাই রয়ে গেলি। চিরকাল কি আর ঐ চোর-পুলিস খেলা ভালো লাগে? চলে আয় আমার সাথে, নেমে পড় ব্যবসায়। এটাও একটা অ্যাডভেঞ্চার, কামাল।
কদিন ধরে দিনরাত কেবল ভাবছি। সেই যে দুমাস আগে কুয়াশা ওর গরিলাটা নিয়ে প্লেনে করে চলে গেল মিশরের পথে-তারপর মি. সিম্পসন কিছুদিন ঘুর ঘুর করেছেন আশেপাশে। ছোটোখাট এক আধটা কেসে একসাথে কাজও করেছি। কিন্তু কিছু ভাল্লাগলো না। তোকে পাশে না পেলে কোনও কাজেই আমার আনন্দ লাগে না। সেই ছোটকাল থেকে উপগ্রহের মতো কেবল তোর চারপাশে অনবরত ঘুরে মরছি– তোর মধ্যে কি যে যাদু আছে বুঝি না। তোকে ছাড়া কিছু করতে গেলে অসম্পূর্ণ লাগে সব কাজ, মনে হয় শরীরের অর্ধেকটা যে অবশ হয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বুঝে নিয়েছি এ বাঁধন থেকে আমার মুক্তি নেই।
অন্যমনস্ক ভাবে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো কামাল। কেন জানি বড় করুণ শোনালো ওর কথাগুলো। শীতকালের রাত আটটাকে অনেক রাত মনে হচ্ছিলো। বাইরের প্রশস্ত রাস্তাটা হেড-লাইটের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করে দিয়ে এক একটা গাড়ি চলে যাচ্ছিলো মৃদু গুঞ্জন তুলে। তারপর আবার ল্যাম্প পোস্টের হলদে মলিন আলোয় চওড়া পীচ ঢালা রাস্তাটাতে নেমে আসছিল যেন শূনা মঞ্চের রোমাঞ্চ।
হঠাৎ একটু হেসে কামাল গুনগুন করে ওর একটা প্রিয় গানের কলি ধরলো:
আটক রইয়াছি বন্ধু তোমার
পাগলা ফাটকে।
ভাবছি, তোর সাথে ব্যবসাতেই নেমে পড়বো। তুই আমাকে যাদু করেছিস, শহীদ। কেন আমাকে খোদা এমন দুর্বল আর স্পর্শকাতর করে তৈরি করেছেন বলতে পারিস?
কিন্তু কোথায় শহীদ? জবাব না পেয়ে কামাল ঘড়ি ফিরিয়ে দেখলো কখন অলক্ষ্যে বেরিয়ে গেছে সে ঘর থেকে। নিশ্চয়ই টিকিয়ার গন্ধে রান্নাঘরের দিকে ছুটেছে ব্যাটা। কামালের মায়ের হাতের টিকিয়া সেই ছেলেবেলা থেকেই অর্ধেক শহীদের জন্য রিজার্ভ করা থাকে। সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো কামাল। এবং ঠিক সেই সময় ঘটলো ঘটনাটা। শূন্য মঞ্চে কখন যে নাটক শুরু হয়ে গিয়েছে টের পায়নি কামাল।
কামাল শুধু জানালা দিয়ে এক ঝলক দেখতে পেলো একজন লোক প্রাণপণে ছুটে আসছে এ বাড়ির দিকে, আর তার দশ গজ পেছনে ছুটছে ছুরি হাতে দুজন মুখোশধারী লোক।
এক তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার কানে এলো। বাইরের দরজার দিকে ছুটলো কামাল। কিন্তু বাড়ির ভেতর দিকের একটা দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলো শহীদ।
খবরদার কামাল! বাইরে বেরোবি না। দরজার সামনে থেকে জলদি সরে যা।কথাটা বলতে বলতে একহাতের ধাক্কায় হতভম্ব কামালকে সরিয়ে দিলো শহীদ দরজার সামনে থেকে। এতক্ষণে কামাল লক্ষ্য করলো শহীদের ডানহাতে ওর প্রিয় কোন্ট-পুলিস স্পেশাল রিভলভারটা ধরা। দুর-দুর করে উঠলো কামালের বুকের ভেতরটা অজানা এক আশঙ্কায়।
দরজার বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপরই হুড়মুড় করে চৌকাঠের সামনে ভারি কিছু পতনের শব্দ হলো। সেই সাথে অদ্ভুত একটা বিজাতীয় গোঙানির শব্দ।
এক ঝটকায় পর্দাটা সরিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো শহীদ। দেখলো উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝের ওপর একজন লোক। এক মাথা ঘন কালো কোঁকড়া চুল ছাড়া চেহারার আর কোনো কিছু দেখা গেল না। পিঠের ওপর আমুল বিঁধে আছে একটা ছইঞ্চি ব্লেডের ছোরা। সাদা শার্টটা লাল হয়ে উঠছে একটু একটু করে।
মাত্র কয়েক গজ দূরে রিভলভার হাতে হঠাৎ শহীদকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল লোক দুজন, কিন্তু এক মুহূর্তে সামলে নিয়ে দুই লাফে শহীদের ফোক্সওয়াগেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। তারপর এক ঝটকায় দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসলো।
খবরদার! একটু নড়াচড়া করলেই গুলি করবো। গর্জে উঠলো শহীদ।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। গাড়ির এঞ্জিন ততক্ষণে স্টার্ট হয়ে গেছে। নিজের গাড়ির ওপর গুলি ছুঁড়তে এক সেকেণ্ডের জন্যে একটু দ্বিধা হলো শহীদের। আর সেই সুযোগে চোখের সামনে দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় পড়লো শহীদের গাড়িটা এবং পরমুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল দৃষ্টিপথ থেকে। পাঁচ সেকেণ্ডে চল্লিশ মাইল স্পীড উঠে গেল।
ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেল যে মনে মনে এদের অনায়াস দক্ষতা এবং পেশাদারী ক্ষিপ্রতার প্রশংসা না করে পারলো না শহীদ।
এবার ফিরে চাইলো শহীদ আহত লোকটার দিকে। কামালও ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ছুরিটা পিঠের ওপর থেকে টেনে বের করতেই কল কল করে তাজা রক্ত বেরিয়ে এলো। সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে সেঁটে গেল গায়ের সঙ্গে। শহীদ বুঝলো, এ লোক বাঁচবার নয়।
দেহটা ঘুরিয়ে লোকটার চেহারা দেখে একসাথে চমকে উঠলো শহীদ আর কামাল। অস্ফুট উত্তেজিত কণ্ঠে শহীদ বললো, আরে এ যে কাফ্রী খোদাবক্স?
সেই মিশরীয় নর্তকী জেবা ফারাহ-র দেহরক্ষী না?
হ্যাঁ! ধরো তো আমার সঙ্গে, ঘরের ভেতরে নিয়ে যাই।
খোদাবক্সের দুই কশা বেয়ে তখন ফেনা বেরোচ্ছে। একটা অস্বাভাবিক ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে ওর গলা দিয়ে। ঘরের মধ্যে আনা হলে হঠাৎ জ্ঞান ফিরে এলো ওর। সমস্ত মুখটা বিকৃত হয়ে গেল কিসের এক আতঙ্কে। ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে মার্বেলের মতো চোখ দুটো। দুই হাত শূন্যে তুলে কি যেন ঠেকাবার চেষ্টা করছে সে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে শিরা বের করা দুহাত। পালিয়ে বাঁচবার জন্যে একবার হামাগুড়ি দেবার চেষ্টা করে আবার পড়ে গেল সে মেঝেতে। এক হাতে পুরু কার্পেটের একটা অংশ খামচে ধরলো খোদাবক্স। মিশরীয় ভাষায় অস্পষ্ট ভাবে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে। তারপরই একবার হিক্কা তুলে স্তব্ধ হয়ে গেল চিরতরে।
.
০২.
হ্যালো! কে, শহীদ বলছে? মি. সিম্পসনের বিস্মিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
হ্যাঁ। কামালের বাসা থেকে আপনাকে রিং করছি। এক্ষুণি একটু আসতে পারবেন এখানে?
ব্যাপার কি?
এসেই না হয় শুনবেন! কি জানো, প্রেসিডেন্টের দেশ সফর নিয়ে সারা অফিসে মহা হট্টগোল চলছে। আমি এই মুহূর্তে বেরোতে পারবো না কিছুতেই। তোমার প্রয়োজনের একটু আভাস যদি দিতে পারো তবে উপযুক্ত লোক পাঠাবার।
বুঝতে পেরেছি। তবে প্রয়োজনটা আমার নয়, আপনাদেরই। সেটা হচ্ছে এই যে, জেবা ফারাহ-র কাফ্রী দেহরক্ষী খোদাবক্সের মৃতদেহ আমরা আগলে বসে আছি এখন, কামালের ড্রইরূমে। আর আধ ঘন্টা রাখতে পারবো। উপযুক্ত লোক পাঠালে এর মধ্যেই পাঠান।
বলো কি শহীদ! খোদাবক্সকে খুন করলো কে? আর তার কারণই বা কি?
কে করেছে তা আমি জানি না, জানতে চাই-ও না। তবে কারণটা হচ্ছে, আমার যতদূর বিশ্বাস, ওর কোমরে বাঁধা একটা রূপোর কবচ।
হেঁয়ালি রেখে একটু পরিষ্কার করে বলবে?
অতো সময় নেই। আর টেলিফোনে সব কথা জানানো সম্ভবও নয়। খুব তাড়াতাড়ি লোক পাঠান, আমাদেরও প্রাণ সংশয় আছে।
ঠিক আছে, আমি এক্ষুণি লোক পাঠাচ্ছি। আর আজ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে এদিকে কাজ সামলে আমি তোমার বাসায় গিয়ে সব শুনবো। কেমন? সি ইয়ু!
শহীদ উত্তরে সি ইয়ু বলবার আগেই রিসিভার ছেড়ে দিলেন সরকারী গোয়েন্দা বিভাগের পদস্থ কর্মচারী মি. সিম্পসন। দুএকটা কথাতেই সবটা বুঝে নিয়েছেন, তিনি। শহীদও নিশ্চিন্ত মনে এবার একটা টেল ল্যাম্পের নিচে মেলে ধরলো খোদবক্সের কোমরে বাঁধা কবচের মধ্যে থেকে বের করা এক টুকরো ট্রেসিং পেপার। বিচিত্র আঁক-ফোক দেয়া আছে কাগজটার উপর। চট করে শহীদের মাথায় খেলে গেল, এটা নিশ্চয়ই গুপ্তধনের নক্সা। আসল নক্সা থেকে এই ট্রেসিং পেপারের ওপর নকল তুলে নিয়ে আসলটা বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। তবে কি কুয়াশা নেসার আহমেদের কাছ থেকে যে নক্সাটা ছিনিয়ে নিয়ে মিশরের পথে উধাও হয়ে গেল সেটা সেই ভুল আঁক দেয়া নক্সা ব্যাপার কি খোদাবক্সই বা আজ সন্ধ্যার পর এদিকে আসছিল কি করতে পেছনে লোক লেগেছে টের পেয়েই কি খোদাবক্স আসছিল শহীদ বা কামালের সাহায্য গ্রহণ করতে।–যারা একে খুন করলো তারা কি নেসারের সোক
থাক, এতো মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। য়ে জীবন থেকে সরে এসেছে সে আর সেপথে পা বাড়াবার কোনও দরকার নেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নক্সাটা আবার উজ করে রূপোর চৌকোণা মাদুলির ভিতরে ভরে রাখলো শহীদ।
কামাল গিয়েছিল বাড়ির ভিতরটা সামলাতে। ফিরে এসে আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে রাখলো অন্দর মহলের-তারপর সোফার ওপর বসলো, সন্তর্পণে যেন গম্ভীর চিন্তামগ্ন শহীদের ধ্যান ভঙ্গ না হয়।
খট করে একটা শব্দ হতেই চমকে ফিরে কামাল দেখলো শহীদের রনসন ভ্যারামে গ্যাস লাইটারের ক্ষুদ্র চোয়ালটা হাঁ হয়ে গেছে-আর তার থেকে অগ্নি পান করছে কিং সাইজের একখানা পলমল সিগারেট। খোদবক্সের নিষ্প্রাণ মুখটা পালিশ করা আবশ কাঠের মূর্তির মতো মনে হচ্ছে।
.
আপন মনে গজর গজর করতে করতে স্টার্ট দেয়া অবস্থায় দাঁড়ানো উইলিজ জীপের কাছে এসে দাঁড়ালো ইন্সপেক্টর আলম। উঃ, মাতবুরি মারার জায়গা আর পায় না! শালা অ্যাংলো কুত্তার বাচ্চা! যাও, কোনও কথা শুনতে চাই না-এক্ষুণি রওনা হও! উ…উ…ই। তুই আমাকে হুকুম করবার কেরে শালা তোর কেনা গোলাম আমি? তোকে কে পরোয়া করে দাঁড়াও এমন ফাশান ফাশাবো যে বাপের নাম ভুলে যাবে। নিষ্ফল আক্রোশে ফেঁশ ফোঁশ করতে করতে বিপুল বপু মনিরুল আলম জীপের ফুট বোর্ডে এক পা রাখলো। সাথে সাথেই গাড়িটা বাঁ দিকে খানিকটা হেলে পড়লো।
নাও, চালাও, ড্রাইভার হুঙ্কার ছাড়ে মনিরুল আলম।
ড্রাইভার কথা না বলে হুকুম তামিল করলো। কাঁচা পেট্রোলের গন্ধ ছড়িয়ে গাড়ি ছুটে চললো। স্টিয়ারিং হুইল ধরে নিঃশব্দে বসে রইলো ড্রাইভার এজিদ শেখ। তার পাকানো গোঁফের প্রান্তদেশে সূক্ষ্ম একটু হাসি উঠেই মিলিয়ে গেল।
লাথি মারো অমন চাকরির মুখে…
মনিরুল আলম গজর গজর করতে লাগলো, সময় নেই, অসময় নেই “ইয়ে আর কি গাড়ি তখন জনাকীর্ণ জিন্না এ্যাভিনিউ ধরে ছুটে চলেছে। চারপাশে ব্যস্ত লোকের চলাচল। গাড়ি ঘোড়ার ভিড়। ভিড় বাঁচিয়ে নিপুণ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে এজিদ শেখ। মোড়ে এসে বললো, কোনদিকে যাবো, স্যার…
সোজা ধানমণ্ডি।
রাইট, স্যার।
এজিদ শেখ পাকা লোক। সে নরম গলায় উত্তর দিলো।
গাড়ি স্টেডিয়াম ছাড়ালো। মনিরুল আলম লক্ষ্য করলো না যে রেলওয়ে ক্রসিং এর কাছ থেকে একটি লাল রঙের ফোক্সওয়াগন ওদের পিছু পিছু সতর্ক ভাবে এগিয়ে আসছে। একটু লক্ষ্য করলে বুঝতে পারতো গাড়িতে বসা লোক তিনটির তীক্ষ্ম চোখের দৃষ্টি সোজা তাদের গাড়িটার দিকে থকে আছে। এসব কিছু লক্ষ্য করার উপায়ও অবশ্য তেমন ছিলো না। একে তো বিপুলকায় তুড়ি, ও ভারি রকমের রাত্রিকালীন ভোজনের আলস্যে মনিরুল আলম নির্জীব, তার উপর তার মেজাজ বড় সাহেব সিম্পসনের উপর দারুণ খাপ্পী। গাড়িতে বসে সে বরং চোখ বুজে ঢুলুনির আরাম খাওয়াটাই লাভজনক। মনে করলো। নতুন চাকরিতে বহাল হওয়া এজিদ শেখের পাকানো গোঁফের প্রান্তে সূক্ষ্ম হাসির অর্থ সে একবারও সন্দেহ করলো না। গাড়ি নিউ মার্কেট পার হয়ে কিছুদূর। গিয়েই জনবিরল গ্রীন রোডে প্রবেশ করলো পেট্রোল পাম্পের পাশ দিয়ে। ইন্সপেক্টর মনিরুল আলম চোখ বুজে ঢুলতে ঢুলতে হঠাৎ একবার সজোরে হ্যাঁচ্চো দিলো। গাড়ির দরজা জানালা কেঁপে উঠলো। একবার হাসলো এজিদ শেখ। তারপর গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা ঢুকে গেল লাল ইটের দেয়াল ঘেরা একটি বাড়ির প্রশস্ত অঙ্গনে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ একটি লোক। এজিদ শেখ ততক্ষণে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দরজা খুলেছে।
কি হলো, এসে গেছি নাকি? মনিরুল আলম বিরক্ত হয়ে চোখ খোলে। আড়মোড়া ভেঙে গোটা দুই হাই তোলে। তারপর কোমরে হাত দিয়ে রিভলবারটা মনের অজান্তেই আছে কিনা একবার পরীক্ষা করে। দেখে যথাস্থানে জিনিসটা নেই। ঘুমের ঘোরটা দ্রুত কেটে আসতে থাকে তার।
ওটা পরীক্ষা করতে হবে না..দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ লোকটি প্রচণ্ড থাবায় মনিরুল আলমের কবজি চেপে ধরে। বলে, যদি গোলমাল করো, তাহলে ঐ দেখো পেছনে পিস্তল নিয়ে তোমার আজরাইল দাঁড়িয়ে আছে, একদম খুন হয়ে যাবে।
প্রবলভাবে চমকে ওঠে মনিরুল আলম। চোখ দুটি ভয়ে ও বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে নিঃশব্দে আদেশ পালন করলো অর্থাৎ বসে রইলো। তার চোখের সামনে এজিদ শেখকেও বাঁধা হলো। হাত পা বেঁধে মনিরুল আলমকে নিয়ে যাওয়া হলো একটা পাঁচ বাই তিন হাত কুঠরীতে। ঘরে ভ্যাপসা গরম। চারদিকে বড় বড় মশা ভন্ ভন্ করছে। প্রথম নে নিঃসাড় হয়ে হাত বাঁধা অবস্থার কথা একবার ভাবলো। চুলকান যাচ্ছে না। একবার একটু ফুঁপিয়ে উঠেই ত্যা করে কেঁদে ফেললো সে।
বলিষ্ঠ লোকটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। সে হুকুমের সুরে বললো, এই তাজা গর্দভটা এখানে থাক। বেশি গোলমাল করে তো ওষুধ দিয়ে গেলাম, টাইট করে রাখিস। নে, চল, একজনকে সে হুকুম করলো।
শহীদ ঘরের এক কোণ থেকে আর এক কোণ অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। ক্রমাগত ঘড়ি দেখছিল। সিম্পসন সাহেবকে অন্ততঃ পৌনে এক ঘন্টা আগে সে টেলিফোন করেছে। এখনও কোনও সাড়া নেই। সে অস্থির ভাবে টেলিফোনের কাছে গোল।
কামাল একটু দূরে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিল। তারও মুখ গম্ভীর। ঘরের মাঝখানে পড়ে রয়েছে হতভাগ্য খোদাবস্ত্রের লাশ। সেদিকে তাকিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা সে মনে মনে তলিয়ে দেখছিল। শহীদকে টেলিফোনের কাছে যেতে দেখে সে বললো, এই নিয়ে বোধহয় তিনবার হলো না?
শহীদ কোনো জবাব দিলো না। নম্বর ঘোরাতে লাগলো। কামাল বিড়বিড় করে কি বললো।
এই সময় বারান্দায় বুটের শব্দ হলো। তিনজন ইউনিফর্ম পরা গোয়েন্দা পুলিসের লোক ঘরের পর্দা পার হয়ে ভেতরে ঢুকলো। ঢুকেই আদাব দিলো।
সিম্পসন সাহেব তখন টেলিফোন ধরেছেন। শহীদ ততক্ষণে একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলেছে। সিম্পসন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, হাউ স্ট্রেঞ্জ! আমি তো অনেকক্ষণ আগে ওদের পাঠিয়েছি। ওরা এখনো পৌঁছোয়নি
শহীদ বললো, এইমাত্র ঘরে ঢুকলো। অনেক ধন্যবাদ,সিম্পসন সাহেব। আমি মৃতদেহ এদের হাতে তুলে দিচ্ছি।
ও কে…
সিম্পসন সাহেবের নির্লিপ্ত গলার স্বর শোনা গেল।
ইন্সপেক্টরের পোশাক পরা লোকটি সামনে এগিয়ে এলো। বিনীত কণ্ঠে বললো, সিম্পসন সাহেব আমাদের পাঠিয়েছেন স্যার। আমার নাম আলী আহমেদ।
কামাল বিরক্তি চেপে রাখতে না পেরে বললো, আপনারা কি পায়ে হেঁটে এখানে, এসেছেন, ইন্সপেক্টর সাহেব?
আই. বি. ইন্সপেক্টর মৃদু হাসলো। বললো, আর বলবেন না স্যার। অর্ডার পেয়েই, যখন তখন আমরা রওনা হয়েছিলাম। কিন্তু রেল গেটে এসে পাক্কা পনেরো মিনিট দেরি করতে হয়েছে।
আপনি মৃতদেহ গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করুন। শহীদ গম্ভীর হয়ে বললো, ঘটনাটা আমি খুলে বলছি।
এক মুহূর্ত ভাবতে হলো শহীদকে। কামালের বাড়িতে সে এসেছিল সন্ধ্যা কাটাবার জন্যে। কিন্তু সময়ের রঙ্গমঞ্চে কখন যে কি ঘটে বলা মুস্কিল।
সে ঘটনাটি খুলে বললো। বিস্ময়ে, উত্তেজনায় ইন্সপেক্টর আলী জ্বল জ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো। শহীদ বলা শেষ করলে সে রুদ্ধশ্বাসে বললো, বীভৎস কাণ্ড, স্যার।
সে মৃতদেহটি উল্টে পাল্টে পরীক্ষা করলো। ডায়রীতে কয়টা কথা তুলে নিলো। এক সময় শহীদকে বললো, স্যার, যদি অপরাধ না নেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করি–
স্বচ্ছন্দে…
এই হত্যাকাণ্ডটি সম্পর্কে আপনার কি ধারণা স্যার?
শহীদ এক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গোয়েন্দা ইন্সপেক্টরের দিকে তাকালো। তারপর বললো, এ সম্পর্কে আমার যা ধারণা তা যথাসময় সিম্পসন সাহেবকে আমি জানিয়ে দেববা ইন্সপেক্টর। আমি এখন মনের দিক দিয়ে স্থির নই। আশা করি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না বলে কিছু মনে করেন নি আপনি
না, না…স্যার…
পুলিস ইন্সপেক্টর বিনীতভাবে হাসে। একটা সূক্ষ্ম বিদ্রুপের রেখা তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেই পরক্ষণে মিলিয়ে যায়। বললো, আপনি কিনা গোয়েন্দা বিভাগের আদর্শ পুরুষ..আপনার তো স্যার চোখের নজরই আলাদা। তাই বলছিলাম আর কি
কামালের মনে হলো ইন্সপেক্টর যেন শহীদকে ঠাট্টা করলো। একটু অবাক না হয়ে সে পারলো না। ততক্ষণে মৃতদেহ গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে। পুলিস দুজন আবার ফিরে এলো ঘরে।
স্যার…
ইন্সপেক্টর আলী বিনীত হেসে বললো, স্যার, সিম্পসন সাহেব বলেছিলেন খোদাবক্সের কোমরে একটা রূপোর তাবিজ আছে। তাবিজটা দেখছি না।
শহীদ চোখ তুলে তাকালো। সূক্ষ্ম হাসির একটা ক্ষীণ রেখা ওর ওষ্ঠ প্রান্তে উঠেই মিলিয়ে গেল। হাসিটা কেমন যেন বেদনা রাঙানো আর নিষ্পহ। শহীদ দেখলো দুদরজার গোড়ায় দুজন গোয়েন্দা পুলিস রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে গেছে। ইন্সপেক্টর আলীর ডান হাতটা রিভলবারের একান্ত কাছে। ইন্সপেক্টর আলীর দিকে চেয়ে দেখে লোকটাকে শহীদ নির্ভুল ভাবে চিনলো। লোকটা খুনী। স্তিমিত, আধ ভেজা দৃষ্টিতে জান্তব নিষ্ঠুরতা স্থির হয়ে জ্বলছে।
ইন্সপেক্টর আলী আগের মতোই হাসতে হাসতে বললো, তাবিজটা কোথায়, স্যার?
শহীদ মৃদু হেসে বলে, ডুয়ারে।
ইন্সপেক্টর আলী স্থির নেত্রে চারদিকে তাকায়। শহীদ বলে, সিম্পসন সাহেবকে আমার শুভেচ্ছা দেবেন।
নিশ্চয়ই।
নম্র গলায় বলার চেষ্টা করে ইন্সপেক্টর। এগিয়ে দুয়ার খোলে। হঠাৎ সাত রাজার ধন পেয়ে গেলে যেমন আনন্দে ফেটে পড়ে মানুষ, তাবিজটা পেয়ে ঠিক তেমনি উল্লাসে চঞ্চল হয়ে পড়ে ইন্সপেক্টর আলী। এক মুহূর্ত তাবিজটা খাঁটি কিনা তা তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করলো, তারপর দ্রুত হাতে সেটা রেখে দিলো পকেটে।
কাজে সহযোগিতা করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, স্যার। সারা গোয়েন্দা বিভাগ আপনার কাছে আর একবার ঋণী হয়ে রইলো।
ইন্সপেক্টর আলী দ্রুত কথা সারে। দুজন সঙ্গী গোয়েন্দা পুলিস চকিতে ঘর পেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। কামালের দৃষ্টি এতক্ষণে ভরে যায় বিস্ময়ে। সে দেখলো শহীদ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইন্সপেক্টর আলী তার সঙ্গীদের মতোই প্রায় লাফিয়ে ঘর থেকে নামলো। তড়িৎ পায়ে গাড়িতে উঠলো। মুহূর্তে গর্জে উঠলো এঞ্জিন। একরাশ কাঁচা পেট্রোলের গন্ধ জায়গাটা ভরিয়ে দিয়ে গাড়িটা তীব্র বেগে ছুটে বেরিয়ে গেল।
শহীদ। কামাল বন্ধুকে ডাকলো। তার চোখে-মুখে দুর্ভাবনার চিহ্ন।
কি রে? শহীদ সাড়া দেয়।
আমার সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে। এরা গোয়েন্দা বিভাগের লোক নয়। এরা খোদাবক্সের হত্যাকারী নেসার আহমেদের লোক!
সে আমি জানি…
শহীদ ম্লান হাসলো। বললো, সিম্পসন সাহেবের ফোন ছেড়ে দিয়ে ওদের মুখোমুখি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু তখন কিছু করার উপায় ছিলো না।
কামাল উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠলো। শহীদ একটু হাসলো। আস্তে আস্তে বললো, যে জীবন থেকে বিদায় নিয়েছি সেই জীবনে ফিরে যাবার আর একটুকু ইচ্ছে নেই, তুই তো জানিস কামাল। এতক্ষণে যা ঘটলো তার ভেতর আমার নিজের কোনো ভূমিকা ছিলো না। আমি, তুই দুজনেই নির্বাক দর্শক। শুধু দুঃখ লাগছে হতভাগ্য খোদাবক্সের জন্যে। যাহোক, চল ওঘরে। না, দাঁড়া
শহীদ ঘুরে দাঁড়ায়। বলে, শেষ কর্তব্যটা সেরে নিই।
সে টেলিফোনের কাছে যায়। সিম্পসন সাহেবকে সব কথা খুলে বলে।
সিম্পসন সাহেব সব শুনে আঁতকে ওঠেন, হাউ স্ট্রেঞ্জ।
শহীদ কেবল হাসলো।
.
০৩.
তখন রাত ভোর হয়নি। উন্মুক্ত নীল আকাশে ফুলকির মতো অজস্র তারা জ্বলছে। আবছা কুয়াশায় চারদিক ঢাকা। বিস্তীর্ণ মরুভূমির এখানে ওখানে প্রেতাত্মার মতো দাঁড়িয়ে আছে পিরামিডগুলো। কোথাও অনুচ্চ পাহাড় বা টিলার ভূপ। উত্তর সীমানা থেকে জোরে হাওয়া বইলো। সেই হওয়ায় ধোঁয়া ধোয়া হয়ে উড়ে গেল সামনের কুয়াশা। হাওয়ায় কেপে উঠলো অদূরবর্তী খেজুর গাছের পাতা। চারদিক নির্জন নিস্তব্ধ।
খুট করে একটা শব্দ উঠলো নিকটবতী পিরামিডের পাদদেশে। ভারি পাথরের দরজা ঠেলে কেউ যেন বেরিয়ে এলো মৃত্যু শীতল গহ্বর থেকে। একটা দীর্ঘকায় মানুষের ছায়া। আপাদমস্তক ভারি কাপড়ে আবৃত। হাতের আঙুলে সিগারেট জ্বলছে। চোখে মুখে পরিশ্রমজনিত স্বেদ-বিন্দু। বাইরে এসে লোকটি বুক ভরে মুক্ত বাতাস গ্রহণ করলো। ডারি ওভারকোটটা খুলে ভাঁজ করে হাতে রাখলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝলো রাত ভোর হতে বেশি বাকি নেই। দূরের পুব-আকাশ একটু একটু করে স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। উপরের আকাশ থেকে একটা একটা তারা নিভে যাচ্ছে। হাওয়ার বেগ বাড়ছে আস্তে আস্তে। একটু পরেই মরুভূমির বেদুইনের কণ্ঠে শোনা যাবে আজান।
লোকটি পিছন ফিরে তাকালো। গোগী আসছে না কেন? সে হাতের তালুতে বার তিনেক সাঙ্কেতিক শব্দ বাজালো। দেখতে দেখতে গুহার মুখ হতে উপরে উঠলো একটা বিপুলকায় ছায়া। লোকটা ফিসফিস করে কি যেন বললো। মুহূর্তেই গোগী হেলেদুলে কাছে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেল। হাতের সিগারেট ততক্ষণে নিঃশেষিত। সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লোকটা ধীর পদক্ষেপে সামনে এগোলে।
মরুভূমির পথ। এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে অজস্র খেজুর গাছ। খেজুর গাছের সারি ঘণ হয়েছে নদীর বাঁকের কাছে। চারপাশে চোখ তুলে তাকালে বালির পাহাড়, পিরামিড আর শীর্ণকায় খেজুর গাছ ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না সেখানে। বিধাতার আশির্বাদের মতো কুলুকুলু বেগে বয়ে চলেছে নীল নদ।
নদীর তীরে এসে দাঁড়ালো লোকটা। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলো। চারপাশে আবছা অন্ধকার। ফিকে কুয়াশা। হাওয়ার শব্দ। লোকটি সিগারেট টানছে। দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ দেহ। তীক্ষ্ণ, খাড়া নাক। চোখ- জোড়া উজ্জ্বল তারার বিন্দুতে জ্বলছে। অপূর্ব সুন্দর একটি পুরুষ… দেখে মনে হয় যেন গ্রীক-স্থপতির তৈরি একটা জীবন্ত অস্কর মূর্তি। বড় ক্লান্ত সে। লোকটি চুপচাপ বালির ওপর বসলো। গত তেরো রাত ধরে তার ঘুম নেই। সকাল বেলা আবশ্যকীয় কাজ-কর্ম সেরে নির্দিষ্ট গুহায় ঢোকে। সারাদিন সারারাত কাজ করে। যখন কিছুতেই পারা যায় না তখন সে গুহার পাথরেই মাথা রেখে চোখ বোজে। জিরিয়ে নেয়। এভাবে কতদিন যাবে কে জানে? ধরতে গেলে আসল কাজের কিছুই হয়নি। এখনো যেন গুহার গোলক ধাঁধায় ঘুরে মরছে। মনে হচ্ছে মৃত্যুর হাতছানি যেন তাকে ক্রমেই জটিলতার গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মৃত্যুর হাতছানিই হোক আর মৃত্যুই হোক, যে কাজে একবার সে হাত দিয়েছে কাজ শেষ না করে তো সে কিছুতেই সরে যেতে পারে না। এ তার স্বভাব বিরুদ্ধ। এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। অতীতের দিকে চাইলো সে ফিরে। মনে পড়লো আফ্রিকার সেই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা। শহীদ, কামালের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। কই, বিপদ, মৃত্যু ভয় কিছুই তো তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। এবারেই কি সে ব্যর্থ হবে? না অসম্ভব। মউত কবুল কিন্তু পরাজয় নয়।
সে উঠে দাঁড়াতে গেল। ঠিক এই সময় মোটরের হেড লাইটের তীব্র আলোর ঝলকানি এসে লাগলো তার গায়ে। মুহূর্তে সে আত্মগোপন করলো একটা ঢিবির পাশে।
গাড়িটা নদীর ঠিক বাঁকটার পাশে গিয়ে থামলো! এঞ্জিনের শব্দটা স্তব্ধ হলো। কৌতূহলী চোখ মেলে লোকটা দেখলো সেই গাড়ির আরোহী এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা। ধীর পায়ে সে গাড়ি থেকে নামলো। নিকটবর্তী হলো নদীর। কি ভেবে দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁড়িয়ে উপরে চোখ তুলে আকাশ দেখতে লাগলো। বাতাসে তার ওড়না উড়ছে, মাথায় এলোমেলো কুন্তল উড়ছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
আশ্চর্য তো! টিবির ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো লোকটি! এই শেষ রাতের ভয়াবহ নির্জনতায় এই পুরবাসী মহিলা এখানে কেন? দয়িতের সন্ধানে? হবে হয়তো। কারো কারো মনে প্রেম এনে দেয় অস্থিরতা। এনে দেয় ঘর ছাড়ার বার্তা। হয়তো প্রেমের অস্থিরতাই এই যুবতী মহিলাকে ভোর রাতের বিভীষিকাময় নীল নদের তীরে ডেকে এনেছে। কিংবা কে জানে কি রহস্য জড়িয়ে আছে এই যুবতীটির জীবনে। লোকটি সন্তর্পণে এগিয়ে গেল। কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে দেখলো মহিলার দুই চোখ উদভ্রান্ত। শেষ রাতের ফিকে আলোয় অদ্ভুত রহস্যময়ী বলে মনে হচ্ছে যুবতাঁকে। বুকের ওড়না উড়ে গিয়ে আটকে গেছে দুই বাহুতে। শরীরের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট। শরীর বেয়ে যৌবন যেন উপচে পড়ছে।
মানুষ আলোর রহস্য দেখে যে চোখ দিয়ে, মুক্তির রূপ দেখে যে চোখ দিয়ে, সেই চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো লোকটি। কিন্তু ওকি। সহসা সেই নারী দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো। বাহুর বাঁধন ছেড়ে বাতাসে উড়ে গেল ওড়না। সাপের ফণার মতো উথলে উঠলো চুলের স্তবক। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই যুবতীর। দুই হাতে মুখ ঢেকে সে ফোঁপাতে লাগলো। বেদনা সজল শুকতারাটি তখন মাথার ওপর জ্বল জ্বল করছে। বহু দূরবর্তী ডোঙার মাঝি ভোরের আজান দিচ্ছে উচ্চকণ্ঠে।
যুবতীটি কান পেতে সেই ভোরের আজান শুনলো। কি ভেবে যেন শিউরে উঠলো। মাথা ঝাঁকালো বার কয়েক। তারপর উন্মত্তের মতো ছুটে গেল নদীর দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে লোকটি বুঝলো, আর কিছু নয় যুবতী আত্মহত্যা করতে চলেছে। একটুও দেরি না করে সে ছুটে এগিয়ে গেল। নদীর বিশাল বুক তার জন্যে অপেক্ষা করছে। সেখানে অতল শান্তি। অসীম মুক্তি। যুবতীটি ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। কিন্তু পারলো না। কিসে যেন আটকা পড়েছে। সে আর কিছু ভাবতে পারছিল না। ক্রমাগত কেপাচ্ছিল। কাঁদছিল। দূরের দিগন্ত রেখায় রক্তিম বর্ণে আকাশ রাঙিয়ে সূর্য উঠছিল, লোকটির বাহুতে হেলান দিয়ে রোরুদ্যমানা যুবতী সেই দিকে তাকিয়ে রইলো। এক, মুহূর্তের এদিক ওদিক হলে সে তলিয়ে যেতো নদীর অতল জলে। ভাগ্যের চক্রান্তে অপরিচিত এই লোকটি তাকে রক্ষা করেছে। কিন্তু একে কি রক্ষা বলে? এ যে যন্ত্রণার অধিক যন্ত্রণা। আবার তাকে সেই কুট চক্রের শিকার হতে হবে ভেবে যুবতী কাঁদতে লাগলো।
কিন্তু এবার সেই লোকটির বিস্মিত হবার পালা। যুবতীর দিকে তাকিয়ে তার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। ঢাকার অভিজাত হোটেল কক্ষে যার মৃতদেহ নিজের চোখে সে দেখেছে সেই জেবা ফারাহর জীবন্ত মূর্তি তার চোখের সামনে। না, কোনো ভুল নয়। এ সেই জেবা ফারাহ। সেই আপেল-রাঙানো মুখ। মায়াবী নীল চোখ। তীক্ষ্ণ চিবুকের উপর পুরুষ্টু রঙিন ঠোঁট। জেবা ফারাহ্। আশ্চর্য…যাকে নেসার আহমেদ নিজের হাতে খুন করেছিল সেই জেবা ফারাহ্ তারই বাহুবন্ধনে! তারই নিঃশ্বাসের একান্তে নিঃশ্বাস ফেলেছে!
মেয়েটি আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আত্মহত্যার সমস্ত প্রবণতা, ও উত্তেজনা কাটিয়ে তার চোখ মুখ, শরীর এখন বিমর্ষ ক্লান্ত। লোকটি ইংরেজিতে বললো, তুমি জেবা ফারাহ্
জেবা ফারাহ্
মেয়েটি মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠলো। পরিষ্কার ইংরেজিতে উত্তর দিলো, তুমি জেবা ফারাহকে চেনো?
হ্যাঁ, চিনি। ঢাকার এক হোটেলে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তুমি কি তার বোন।
হ্যাঁ, আমরা দুবোন যমজ। আমার নাম দিবা ফারাহ্। মেয়েটি আস্তে আস্তে শ্বাস টানলো। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর কান্নার গলায় বললো, কিন্তু তুমি কে? কেন তুমি আমাকে বাঁচালে?
লোকটি একটু হাসলো। ততক্ষণে তার মন থেকে সমস্ত অলীক ভয় আর দুর্ভাবনা কেটে গেছে। ভোরের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়েছিল দুজনের গায়ে। সেই আলোয় পরস্পরকে তারা দেখলো।
লোকটি বললো, তুমি মরতে চাইছে কেন?
বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই, তাই। তুমি বিদেশী। তুমি কায়রোর অভিজাত বংশের নষ্ট হয়ে যাওয়া মেয়ে জেবা ফারাহর বোন দীবা ফারাহর দুঃখ বুঝবে না।
তা বটে।
লোকটি সহজ গলায় হাসলো। বললো, কিন্তু জানেনা, ইচ্ছে করলেই সহজ ও স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকা যায়। তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো তাহলে আমাকে তোমার সব কথা খুলে বলো। আমি তোমাকে সাহায্য করবে।
মেয়েটি বিদ্রূপ ভরে হেসে উঠলো। বললো, তোমার সাহস আছে বটে। যুবতী নারীর বিপদে নির্ভয়ে এগিয়ে আসার মনও আছে। কিন্তু শোনো বিদেশী, আমাকে দুনিয়ার কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমার মরার একটুও ইচ্ছে ছিলো না…
গলাটা ভেঙে এলো তার, বিশ্বাস করো আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু চাইলে কি হবে? মৃত্যু আমার অনিবার্য। মরতে আমাকে হবেই।
লোকটি তার কথায় প্রতিবাদ করলো না। শুধু বললো, তুমি তো এমনিই মরতে যাচ্ছিলে। আমি বাধা না দিলে এতক্ষণে তুমি মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে থাকতে।
হ্যাঁ, থাকতাম। কিন্তু তুমি কে? কেন তুমি… :
একটু হেসে সে আবার বললো, বর্তমানে আমার একটা নামই প্রচলিত। আর সব নাম, পরিচয় ঢাকা পড়েছে। আমার নাম কুয়াশা। তোমাকে বাঁচান যায় কিনা একবার আমাকে চেষ্টা করতে দাও।
কুয়াশা? দীবা ফারাহ স্তব্ধ হয়ে রইলো অনেকক্ষণ। সে তাকিয়ে রইলো কুয়াশার বলিষ্ঠ দেহ আর সুন্দর সুঠাম মুখের দিকে। কুয়াশার নাম সে জানে। জেবা ফারাহ, তার বোন, কুয়াশাকে নম্বর ওয়ান শক্ত বলে গণ্য করতো। জেবা দুনিয়ার কাউকে ভয় করতো না। কিন্তু কুয়াশার নামে সে কম্পিত হতো। বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর লোকটি, সেই কুখ্যাত কুয়াশা তারই চোখের সামনে দাঁড়িয়ে, দীবা যেন কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
কুয়াশা হাসলো। বললো, দীবা, যে মরতে চায় তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না। কিন্তু যে বাঁচতে চায় তার জন্য জীবনের কোনো না কোনো পথ খোলা থাকেই। ভোর হয়ে গেছে। আর দেরি করতে পারি না। চলো।
কোথায়?
কাছেই আমার লঞ্চ। সেখানে চলো।
দীবা একবার তাকালো কুয়াশার দিকে। অবিশ্বাসের কিছু ছিলো না। কুয়াশার চোখের স্পষ্ট সরল চাহনী, তার হাসি দিবার মন থেকে সব দুর্ভাবনা দূর করে দিলো। তার মন বললো এই লোকটার যতো কুখ্যাতি থাক, নিষ্ঠুরতার যতো দুর্নামই থাক, এ কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। নির্ভয়ে একে আশ্রয় করা যায়।
সে বললো, একটা কথা।
বলো।
আমাকে তুমি আশ্রয় দিচ্ছো। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছো। তোমাকে এজন্যে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। হয় তো…
সশব্দে হেসে উঠলো কুয়াশা। পথ দেখিয়ে বললো, চলো। আর দেরি নয়।
তখন ভোর হয়ে গেছে। সূর্যের আলোয় মরুভূমি উদ্ভাসিত। খেজুর গাছের সারি দুই পাশে রেখে নীল-নদ বয়ে চলেছে কুলকুল বেগে। দিনটা ভারি সুন্দর।
.
০৪.
কায়রোর পুলিস সুপার মি. গামাল হাসানের মুখোমুখি বসেছিলেন মি. সিম্পসন। খোদাবক্স হত্যা ঘটনার তদন্তে জড়িত হয়ে তিনি সুদূর মিশরে এসেছেন। স্কটল্যাও ইয়ার্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত এই গোয়েন্দাটির কার্যকলাপ সর্বত্র উচ্চ প্রশংসিত ছিলো। মি. গামাল হাসানও এর সম্পর্কে যথেষ্ট শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করেন। কিন্তু খোদাবক্স হত্যা ঘটনার বিবৃতি দিতে গিয়ে মি. সিম্পসনের চোখে ব্যর্থতা ও ক্লান্তির যে ছায়া ফুটে উঠলো তা দেখে গামাল হাসান একটু অবাক না হয়ে পারলেন না। মি. সিম্পসন বলেছিলেন, আমি জীবনে অনেক রহস্যময় ঘটনা ও চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত হয়েছি মিঃ হাসান এবং শক্তি আমার যতটুকু থাক, আমি কখনো আত্মবিশ্বাস হারাইনি। কিন্তু এই ব্যাপারটা…
মি. সিম্পসন একটু হাসলেন। তাকালেন মিঃ গামাল হাসানের দিকে। বললেন, বুদ্ধি, সাহস, আত্মবিশ্বাস সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে।
মি. হাসান ডয়ার থেকে সুদৃশ্য সিগারেট কেস বের করলেন। কেসে পর পর কুড়িটি ফিল্টার্ড রথম্যান সিগারেট সাজানো আছে। কেসটি খুলে মি. হাসান সেটি বিনয়ের সঙ্গে বাড়িয়ে দিলেন মিঃ সিম্পসনের দিকে। ধন্যবাদ দিয়ে সিম্পসন একটি গ্রহণ করলেন। পুলিস সুপারের এয়ার কণ্ডিশন্ড ঘরের বাতাস চক্রাকার নীল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। দুজনই কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ধূমপান করলেন। নীরবতা ভঙ্গ করলেন মি. হাসান। বললেন, আমার সরকারের পক্ষ থেকে সদাশয় বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসাবে আপনাকে আগেই স্বাগতম জানিয়েছি মি. সিম্পসন। তারপর শুধু এইটুকু বলতে পারি এই ব্যাপারে আমাদের তরফ থেকে যে কোনো সাহায্য, যে কোনো। প্রতিশ্রুতি দিতে বললে আমরা প্রস্তুত।
সিম্পসন ধন্যবাদ জানালেন।
মি. হাসান বললেন, জেবা ফারাহ সম্পর্কে ইতিমধ্যে যে ফাইলটি করা হয়েছে। সেটি আপনাকে দেবার নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের মহামান্য সরকার। ফাইলটি এখুনি আপনাকে দেবার ব্যবস্থা করছি। আমার বিশ্বাস জেবা ফারাহ্ ও তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষী খোদাবক্সের হত্যা সম্পর্কে আপনি অনেক নতুন সূত্র ও তথ্য এতে পাবেন।
সিম্পসন বললেন, আপনাকে ধন্যবাদ দেবার ভাষা আমার নেই। আমার ও আমার সরকারের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। এই দুই বন্ধু রাষ্ট্রের ভেতর প্রীতি ও সৌহার্দ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক এই কমনা করি।
ইতিমধ্যে কফি প্রস্তুত হয়েছে। মি. সিম্পসনকে নিয়ে মি. হাসান প্রশস্ত বরান্দার অঙ্গনে গিয়ে বসলেন। বাইরে তীব্র উজ্জ্বল রোদ। কায়রো নগরের সুউচ্চ অট্টালিকারাজি চারদিকে দণ্ডায়মান। একটা বাতাস লুর তপ্ত হল্কা ছড়াতে ছড়াতে ছুটে এলো। মি. সিম্পসন অভ্যাসবশতঃ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে নিলেন। হঠাৎ অদূরবর্তী রাজপথের একদিকে চোখ পড়াতে তাঁর দৃষ্টি থমকে গেল। চমকে উঠলেন মি. সিম্পসন। লোকটিকে ঢাকায় তিনি দেখেছেন। লোকটি কৃষ্ণকায়। দীর্ঘ, বলিষ্ঠ দেহ। মাথার কুঞ্চিত চুল ফুলে ফেঁপে ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছেছে। চ্যাপ্টা নাকের নীচে পুরু ঠোঁট। দুটি হাত পেছনে নিয়ে লোকটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে এদিকে? হঠাৎ সিম্পসন সাহেবের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়াতে লোকটা যেন কিছু হয়নি এভাবে চট করে এক পাশে ঘুরে গেল। ঘুরে গিয়ে চলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তাকে দেখা গেল না।
মি. হাসান উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেন, এনিথিং রঙ মি. সিম্পসন?
নাথিং সো সিরিয়াস।
মি. সিম্পসন একটু হাসেন। তাকান মি. হাসানের দিকে। বলেন, যদি অসুবিধে না হয় তাহলে আমি আজই মহামান্য রাজকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
মি. হাসান বিনীতভাবে আশ্বাস দিলেন-মহামান্যা রাজকুমারীকে আগেই সংবাদ পাঠিয়েছিলাম। তিনি সানন্দে আপনার সঙ্গে আজ বিকেল চারটায় দেখা করতে রাজি হয়েছেন।
আপনার কাছে আমি চির বাধিত মি. হাসান।
মি. হাসান হেসে বললেন, আমাদের আতিথেয়তার ত্রুটি হয়তো থাকবে মি. সিম্পসন, কিন্তু অকপট বন্ধুত্বের হৃদয় আপনাকে উপহার দিতে পারবো।
.
মহামান্যা রাজকুমারী আয়িদা বানুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষ করে মি. সিম্পসন পথে নামলেন। কায়রোর রাজপথ অতি সুদৃশ্য। সুউচ্চ অট্টালিকাসমূহের উপর মিনার শোভা পাচ্ছে। রাস্তার এখানে সেখানে উটের গলায় ঘন্টা ধ্বনি। রাস্তায় নেমে ভাড়া করা ট্যাক্সি নিলেন মি. সিম্পসন। হোটেলের নাম ঠিকানা বলতেই ট্যাক্সি চালকের চোখে মুখে সম্মান ও বিনয়ের ভাব ফুটে উঠলো।
সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ ধূমপান করছিলেন মি. সিম্পসন আর চিন্তাকীর্ণ মনে আগাগোড়া সবটা ব্যাপার তলিয়ে দেখছিলেন। মিশর দেশীয় সুলতানদের একটা নক্সা যে এমন একটা রক্তক্ষয়ী, রহস্যময় ঘটনার জন্ম দেবে তা কে জানতো? নক্সাটি, সম্ভবতঃ ছিলো মিশরের শেষ শক্তিশালী ফারাউন প্রথম আখৃতানুনের। আমন দেবতার পূজো বর্জন করে মিশর দেশে তিনি সূৰ্য্য দেবতার পূজো চালু করেছিলেন। ফলে তাকে আমন দলীয় শক্তিশালী পুরোহিতদের কোপ দৃষ্টিতে পড়তে হয়েছিল। আখতানুন তাতে ভয় পাননি। তিনি রাজধানী সরিয়ে নিলেন কায়রো থেকে। কথিত আছে রাজধানী সরিয়ে নেবার সময় রাজকোষের বিপুল অর্থরাজি তিনি তাঁর পিতামহের সমাধি মন্দিরে প্রোথিত করে যান। প্রয়োজনের সময় যাতে এই অর্থ তিনি উদ্ধার করতে পারেন তার ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। সমাধি মন্দিরের গুপ্তকক্ষের চিহ্ন ও পথ তিনি একটি নক্সায় টুকে রাখেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আমন দলীয় পুরোহিতদের হাতে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। ঘটনাচক্রে এই নক্সা গিয়ে পড়ে দয়ালু রাজা আখতানুনের জ্ঞানী চিকিৎসকের হাতে। এই চিকিৎসকটি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবৎ জানতেন যে তিনি এক সাধারণ মজুরের পুত্র। কিন্তু কালক্রমে বৃদ্ধ দশায় উপনীত হয়ে তিনি জানতে পারলেন তার দেহে আছে রাজ রক্ত। শুধু তাই নয় পূর্ববর্তী ফেরাউনের উইল অনুযায়ী আখতানেরও পূর্বে সিংহাসনের উপর ছিলো তাঁর অধিকার। জ্ঞানী চিকিৎসক ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হলেন। কিন্তু তিনি নির্বোধ ছিলেন না। সিংহাসনের অধিকা জানাতে গেলে তাঁকে যে বহু রক্ত ও লোক ক্ষয় করতে হবে তা তিনি জানতেন। তিনি নিঃশব্দে সিংহাসন ও রাজ দরবারের কুটিল পরিবেশ ত্যাগ করে গ্রামান্তরে চলে যান। তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ আত্মজীবনীতে এই নক্সার উল্লেখ করেছেন। চিকিৎসকের মৃত্যুর পর এই নক্সার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি দীর্ঘ তিন হাজার বছর। সেই চিকিৎসক এবং আখতানুনের নক্সাটির কথা ততদিন ইতিহাস পাতায় বিস্মৃত হয়েছে। ১৯৪২ সালে একদল ফরাসী ভূতত্ত্ববিদ দুশো ফিট মাটির নিচ থেকে আকস্মিকভাবে এই নক্সা এবং চিকিৎসকের আত্মজীবনীটি উদ্ধার করেন। আশ্চর্যের বিষয় এই নক্সা এবং গ্রন্থটি এমনভাবে সংরক্ষিত ছিলো যাতে কালের এতটুকু অবক্ষয়ের চিহ্ন তাতে পড়েনি। এই নক্সার স্বত্ব নিয়ে ফরাসী সরকার ও মিশরের রাজ পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। মিশরের রাজ পরিবার স্বাভাবিক ভাবেই এই নক্সার স্বত্ব দাবি করতে পারেন। কিন্তু গোলযোগ বাধিয়েছিল আত্মজীবনীতে লিখিত জ্ঞানী চিকিৎসকের কয়েকটি পংক্তি। তিনি এই নক্সা সম্পর্কে বলেছেন, আইনতঃ এই নক্সার মালিকানা আমার। ইচ্ছে করলে এই নক্সায় নির্দেশিত ধন সম্পত্তি উদ্ধার করে তা আমি ভোগ করতে পারতাম। কিন্তু তা আমি করনি। করিনি কারণ আমি জানি ঈশ্বরের ইচ্ছে তা নয়। এই সম্পত্তি ভোগ করার মালিকানা ফিরাউন বা রাজবংশীয় লোকদের কি তাদের অধীনস্থ সাধারণ মানুষের এই প্রশ্ন আমার মনে বারবার দেখা দিয়েছে। মহাকালের হাতে এর বিচারের ভার ছেড়ে দিলাম।
জ্ঞানী চিকিৎসকের এই উক্তি এই নক্সার প্রকৃত মালিকানা কার তা কিছু নির্দেশিত করে না, ফলে ফরাসী সরকার ও মিশরীয় সুলতানের মধ্যে এই নক্সাটির স্বত্ব নিয়ে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘকাল বিবাদের পর আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে এই নক্সার উপর মিশরীয় সুলতানদের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। সেই থেকে নক্সাটি রাজ পরিবারের গুপ্ত কক্ষে রক্ষিত ছিলো। স্বয়ং সুলতান ছাড়া এই নক্সটি, অবস্থান সম্পর্কে অবহিত ছিলেন সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধীকারিণী রাজকুমারী আয়িদা বানু। সম্ভ্রান্ত বংশীয়া মিশরীয় নর্তকী জেবা ফারাহ্ ছিলো তারই ঘনিষ্ঠতম সহচরী। রাজকুমারীর সঙ্গে সম্পর্ক সূত্রে রাজপ্রসাদে তার ছিলো অবাধ যাতায়াত। একটু আগের সাক্ষাৎকারে রাজকুমারী আয়িদা বানু মি. সিম্পসনকে বলছিলেন, অর্থের উপর জেবার ছিলো দারুণ লোভ। অনেক গুণে সে গুণান্বিত ছিলো। কিন্তু এই লোভ তার সমস্ত গুণাবলী এবং প্রতিভা নষ্ট করে দিয়েছে। জেবাই এই নক্সা রাজপ্রসাদ থেকে চুরি করেছিল মি. সিম্পসন।
মি. সিম্পসন তা জানতেন। তিনি রাজকুমারীর দিকে, সন্ধানী চোখে তাকিয়েছিলেন। দেখেছিলেন রাজকুমারীর অনিন্দ সুন্দর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ক্ষোভ ও রাগের চিহ্ন। রাজকুমারী আরও বলেছিলেন, মিশর রাজ পরিবারের রোষবহ্নি থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যেই নর্তকীর বেশে মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান ভ্রমণ করে ফিরছিল জেবা। আমরা জানতাম একদিন না একদিন তাকে মিশরে ফিরতেই হবে। সরকার থেকে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে যে কোনো ছদ্মবেশ ধরে জে মিশরে প্রবেশ করুক, পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেবাকে গ্রেফতার করা হতো। কিন্তু রাক্ষুসীর হত্যার সঙ্গে সঙ্গে নক্সা ফিরে পাওয়ার সমস্ত আশা লুপ্ত হয়েছে।
মি, সিম্পসন সব কথাই জানতেন। তিনি দেখলেন রাজকুমারীর চোখেমুখে ফুটে উঠেছে দারুণ হতাশা। আশ্বাস দিয়ে রাজকুমারীকে তিনি বলেছেন, হতাশ হবেন না হামান্যা রাজকুমারী। জেবার মৃত্যু হয়েছে বটে। কিন্তু নক্সাটি এখনো সম্পূর্ণ অটুট অবস্থায় রয়েছে। এমন কি…
তিনি একটু হাসলেন। বললেন, যার হাতে নক্সাটি রয়েছে সে এখন মিশরেই অবস্থান করছে।
কোথায়?
রাজকুমারী দারুণ উত্তেজনায় আসন ছেড়ে প্রায় উঠে পড়েছিলেন।
মৃদু হাসলেন মি. সিম্পসন। চার হাজার বছরের পুরাতন এই নক্সা এমন রহস্যময় ও বিপজ্জনক ঘটনার সৃষ্টি করবে তা কি জ্ঞানী চিকিৎসক জানতেন?
ভাড়াটে ট্যাক্সি সজোরে ছুটে চলেছে। হাতের সিগারেটটি নিঃশেষিত প্রায়। রাজকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষে মি. সিম্পসন ফিরে চলেছেন হোটলের দিকে বিশ্রাম গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু বিশ্রাম কথার কথা মাত্র। মি. সিম্পসন এক মুহূর্তের জন্যেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। হাতের সিগারেটটি তিনি বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কেন যেন খোদবিক্সের মৃত, নিশ্চল চোখ জোড়া তার মনে পড়ে গেল। মনে পড়লো গুপ্তকক্ষে নেসার আহমেদ ও কুয়াশার সঙ্গে শেষ দেখার কথা। জেবা ফারাহ্র কাছ থেকে নক্সাটি উদ্ধার করার চেষ্টা করছিল নেসার আহমেদ ও কুয়াশা দুজনেই। কার চেষ্টা সফল হয়েছে কে জানে? তবে সম্ভবতঃ নক্সাটি বর্তমান নেসারের অধিকারে আছে। দুর্দান্ত প্রকৃতির দস্যু নেবার তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে নক্সা নির্দেশিত গুপ্তধন উদ্ধারের কাজ। লুক্কায়িত আছে হাজার হাজার বছর ধরে সঞ্চিত সাত রাজার ধন। সেই ধনের জন্য কতো খোদাবক্সকে রক্ত দিতে হবে তা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারে।
ভাড়াটে ট্যাক্সি হোটেলের লনে এসে ঢুকলো। মি. সিম্পসন ড্রাইভারকে আশাতিরিক্ত বকশিস দিলেন। ডাইভার মিগ্রীয় কায়দায় মাথা নিচু করে হাত আন্দোলিত করে সালাম জানিয়ে চলে গেল।
মি. সিম্পসন যখন নিজের ঘরে ঢুকলেন তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কাছেই একটা মসজিদের দক্ষিণ দিকে মুখ করে নামাজ পড়ছে কয়েকজন মুসল্লি।
.
০৫.
নীল নদের অনতিদূরে গিজে নামক এলাকায় হাজার হাজার বছরের পুরাতন পিরামিডগুলো দণ্ডায়মান। বিশালাকায় প্রস্তর নির্মিত সমাধি মন্দিরগুলো সর্বকালের মানুষের জন্যে বিস্ময়ের বস্তু। বহু ভ্রমণকারী প্রতিদিন এই পিরামিড দর্শনে যায়। আমরা যে তারিখটি উল্লেখ করছি সে তারিখটি ছিলো মিশর সরকারের নির্ধারিত ছুটির দিন। পিরামিড এলাকা সেদিন প্রায় জনশূন্য। সন্ধ্যা অনুমান সাতটায় একজন দীর্ঘকায় পুরুষ মাইকে-রিনোস পিরামিডের দ্বারদেশে উপস্থিত ছিলো। অভ্যাস মতো চারদিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে সম্মুখস্থ এক গুহার ভেতর ঢুকলো। সঙ্গে সঙ্গে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। সেই দীর্ঘকায় লোকটি আর কেউ নয়, কুয়াশা। তীব্র টর্চ লাইটের আলোয় পথ চিনে নিতে কষ্ট হলো না। অনতিবিলম্বে কুয়াশা পিরামিডের ভেতর প্রবেশ করলো। চারদিক ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। দুই পাশে খাড়া প্রাচীর। এখানে ওখানে প্রস্তর নির্মিত নানা জীবজন্তুর মূর্তি। কুয়াশা দ্বিতীয় প্রাচীর পার হয়ে একটি স্তম্ভ ঘেরা অলিন্দে এসে ঢুকলো। ভেতরে ছোটো একটি কুঠুরী। কুঠুরীর ভেতর বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। এই কুঠুরীর ভেতর বসেই কুয়াশা দিনের পর দিন কাজ করে চলেছে। আখতানের নক্সার পাঠোদ্ধার করে একটু একটু সে এগিয়ে চলেছে পিরামিডের সেই স্থানটিতে যেখানে সাত রাজার ধন হাজার হাজার বছর ধরে লুকনো আছে। গতকাল সে পিরামিডের সপ্তম প্রাচীর ভেদ করেছে। যদি নক্সার কথা সত্যি হয় তাহলে আর একটি প্রাচীর উত্তীর্ণ হলেই তার কাজ উদ্ধার হবে। আশা ও আশঙ্কায় বুক দুলছে। সে কুঠুরীতে ঢুকে দেখলো জেনারেটরের এক পাশে গোগী দাঁড়িয়ে আছে। স্থির চোখে সে বিদ্যুতের তীব্র আলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কুয়াশাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্যে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। পরক্ষণেই তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো বিশ্বাস ও আনন্দের হাসি।
চিয়ার আপ গোগী।
কুয়াশা একটু হেসে আস্তে গলায় আদর জানালো গোগীকে। ইশারা করতেই গোগী থপ থপ পায়ে এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ দিকের একটা প্রাচীর-মুখ খুলে দিলো। খুলে দিতেই এক ঝলক বিদ্যুৎ গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো অন্ধকারে। প্রাচীর পথ অস্পষ্ট আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। অন্ধকার দেয়াল পথে ঝাঁপ দেয়ার মুখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চাইলে কুয়াশা। গলা ততক্ষণে ধূমপানের জন্যে তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। পকেটে হাত দিতেই সিগারেটের প্যাকেটের সঙ্গে উঠে এলো ছোটো একটি চিরকুট। চিরকুটে কায়রো নগরের জনৈক অভিজাত যুবকের নাম ও ঠিকানা লেখা। সব ঘটনা মনে। পড়লো কুয়াশার। সেদিন ভোর বেলা দীবা ফারাহকে উদ্ধার করে সে লঞ্চে ফিরে গিয়েছিল। দুপুর পর্যন্ত দীবাকে সে কোনো কথা বলতে দেয়নি। বলেছে, আগে বিশ্রাম করো। পানি তৈরি আছে, স্নান সেরে নাও। লাঞ্চের পর কথাবার্তা হবে।
দীবা কথা বলার জন্য উদগ্রীব ছিলো। কিন্তু কুয়াশার কথা নিঃশব্দে সে পালন করেছিল। দুপুরের খাওয়ার পর দুজন দুটি চেয়ারে কেবিনের বারান্দায় বসেছিল। দীবা তার সংঘাত ও বেদনাজর্জরিত জীবনের সব কাহিনী খুলে বলেছিল।
জেবা ও দীবার পরিবার কায়রো নগরের অত্যন্ত অভিজাত এক পরিবার। জেবা রাজকুমারী আয়িদার অন্তরঙ্গ সখী রূপে গণ্য হবার পর এই পরিবারের সম্মান আরো বেড়ে গেল। কিন্তু সুখ, সম্মান প্রতিপত্তি সবই বুঝি নীল নদের জোয়ার ভাটার মতো। সাময়িক। এই আছে, এই নেই। শীঘ্রই জেবা ও দীবাদের পরিবারে দুর্যোগ ঘনিয়ে এলো। জেবা ছিলো উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তার উচ্চাকাঙ্খা পরিণত হলে লোতে এবং লাভের বশবর্তী হয়ে সে রাজকুমারী আয়িদার নক্সা চুরি করে মিশর ত্যাগ করলো। জেবাকে অনুসন্ধান ও গ্রেপ্তারের জন্য রাজ পরিবার থেকে বিশেষ এক শ্রেণীর গোয়েন্দা পুলিস নিয়োজিত হলো। দেশে বিদেশে চললো তৎপরতা। কেবল তাই নয়। দীবা ও তার বৃদ্ধ পিতার উপরও অমানুষিক অত্যাচার, নির্যাতন শুরু হলো। কৌশলে বৃদ্ধ পিতার জমিদারী ও খেতাব বাজেয়াপ্ত করা হলো। বৃদ্ধ পিতা ভগ্ন মনোরথ হয়ে আত্মহত্যা করলেন। দীবাও পিতার সঙ্গেই আত্মহত্যা করতো। করেনি একটি মাত্র আশা ও বিশ্বাসে। সেই আশা ও বিশ্বাসের নাম মুজাদ্দিদ করীম, কায়রো নগরীর এক অভিজাত যুবক।
দীবা তার কাহিনী বলতে বলতে থেমে গিয়েছিল। বলেছিল, গ্রীক দেবতা এপোলোর মূর্তি দেখেছো তুমি?
কুয়াশা বলেছিল, দেখেছি।
তাহলে আর করীমের রূপ বর্ণনা করার প্রয়োজন হয় না। করীম গ্রীক দেবতা এপোলোর মতোই সুন্দর। সে আমাকে ভালবাসত আমি তাকে ভালবাসতাম। আমরা দূজন সুখের নীড় বাঁধবার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু
বলতে বলতে দীবার গলার স্বর কান্নায় ভারি হয়ে এসেছিল, সেই নক্সা চুরির পর করামও আমাকে ত্যাগ করলো। সে জানিয়েছে তার বাবা-মা একটি নিঃস্ব পরিবারের মেয়েকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। শুনেছি কোটিপতি আল গাফরানের মেয়ে নাঈমা বর্তমানে তার বাগদত্তা।
এজন্যেই তুমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ। বেঁচে থেকে আমার কি লাভ বলো? আমার অর্থ নেই, পারিবারিক সম্মান নেই…ভালবাসার মানুষটি পর্যন্ত আমাকে পরিত্যাগ করলো।
কুয়াশা কথা বলেনি। শুধু দীবাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। অপূর্ব সুন্দরী এক যুবতী। তার নিটোল, লাবণ্যমাখা মুখখানি বেদনায় বিষণ্ণ। যৌবন প্রাচুর্যে ভরা তম্বী দেহলতা হতাশায় ক্লান্ত।
দীবা বললো, আমাকে বাঁচিয়ে কোনো উপকার করোনি তুমি আমাকে একদিন একদিন মরতেই হবে। কুয়াশা একটু হেসেছিল। বলেছিল, যদি করীম তোমাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়।
অসম্ভব।
ধরো সেই অসম্ভব সম্ভব হলো, তখন?
এক মুহূর্ত দ্বিধা করেছিল দীবা। তারপর আবেগ তপ্ত গলায় বলেছিল, তুমি তো। জানো আমি বাঁচতে চাই। করীম যদি আমাকে গ্রহণ করতে রাজি হয় তাহলে আমি কি করবো তা বলার দরকার পড়ে না।
চিরকুটটা পকেটে চালান দিলো কুয়াশা। মনে মনে একটু হাসলো, মেয়েদের হৃদয় কি কোমল আর স্নেহ মায়া মমতায় ভরা! এক অসতর্ক টোকায় সরোদের সব কটা তার যেন এক সঙ্গে বেজে উঠলো। টন্ টন করে উঠলো বুকের ভেতরটা। মনে পড়লো। মহুয়ার কথা। মহুয়াই ছিলো তার একমাত্র মেহের বন্ধন। সেই বন্ধন বহুদিন সে ছিন্ন করতে পারেনি। বন্ধন ছিন্ন করতে গেলে হৃদয়ের কোথায় যেন বাজতো। আজ অবশ্য অন্য কথা। আজ সে বেরিয়ে এসেছে অতীত জীবনটা পেছনে ফেলে। বিজ্ঞান গবেষণায় তার প্রচুর অর্থের প্রয়োজন মেটাতেই হবে। যে করে থোক মেটাতে হবে। দীর্ঘ দুমাস এই নক্সার পেছনে অর্থ ও পরিশ্রম ব্যয় করেছে। এখন উদগ্রচিত্তে সে ফল লাভের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু ফল লাভ করার আর কতো দেরি?
হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো কুয়াশা। ডাকলো, গোগী,
গোগী প্রভুর এই ডাকের অর্থ বোঝে। সে যন্ত্রচালিতের ন্যায় ভারি একটা ব্যাগ পিঠে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। উত্তেজনায় তার গলা দিয়ে ঘড়র ঘড়র শব্দ বেরোচ্ছে।
কুয়াশা কুঠুরী থেকে অন্ধকার দেয়াল পথে নামার আগে টর্চ লাইট ও ডিটেক্টর যন্ত্রটি হাতে নিলো। ঠিক এই সময় কুঠুরির বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। শত্রু নয় তো? কুয়াশা একটু হাসলো।
এই যন্ত্রটির বিদ্যুৎ অগ্নি মুহূর্তে যে কোনো ইস্পাতকে গলিয়ে ভস্ম করে দিতে সক্ষম। কোনো মানুষের উপর প্রয়োগ করার জন্য এই যন্ত্রটি কুয়াশা তৈরি করেনি। কিন্তু প্রয়োজন বোধে, উপায় কি, প্রয়োগ করতেই হবে। সে সতর্ক ভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। নিঃশব্দে কুঠুরী থেকে বেরিয়ে দেয়াল ঘেঁষা টানা বারান্দায় টর্চের আলো ফেললো। না, কেউ নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হলো একটি ছায়া চকিতে দেয়ালের সঙ্গে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল। দৃষ্টি বিভ্রম নয় তো?
আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কুয়াশা নিঃসন্দেহ হলো। না, কেউ নেই। এই অন্ধকার মাইকেরিনোস পিরামিডে কারো থাকার কথাও নয়। এই পিরামিডে অতীতে কার পদচিহ্ন পড়েছে কুয়াশা জানে না। হয়তো পদচিহ্ন পড়েছে, ফারাওদের, তাঁদের অনুচরবর্গের ভাস্কর বা প্রত্নতত্ত্ববিদের। কিন্তু এই বিষয়ে কুয়াশা নিশ্চিত যে এই দুই মাসের ভেতর এই পিরামিডের অভ্যন্তরে গোগী ছাড়া তৃতীয় কোনো প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেনি। দৃষ্টিবিভ্রম নিশ্চয়ই। কুয়াশা আর কালক্ষেপ না করে সোজা দেয়ালের অন্ধকার পথে নেমে গেল। এটি তৃতীয় প্রাচীরের শেষ সীমান্ত। আর চারটি প্রাচীর অতিক্রম করলেই ফারাওদের মূল সমাধি মন্দির পাওয়া যাবে। নক্সার নির্দেশ মতে সমাধিস্থ ফারাওর শিয়রের দশ হাত মাটির নিচে আখতানের সেই ধন-রত্ন প্রোথিত।
সম্মোহিতের ন্যায় এগিয়ে চললো কুয়াশী। বিশেষ ভাবে তৈরি ইলেকট্রিক টর্চ লাইটের আলায় হাজার হাজার বছরের জমাট বাঁধা অন্ধকার এক একবার যেন চমকে উঠছে। এতক্ষণে তার হাতে রাখা ডিটেক্টর যন্ত্রটি সে চালু করেছে। এই যন্ত্রটি সে পিরামিডের রহস্য উদ্ধার করার জন্যে উদ্ভাবন করেছে। সেই সুদূর পঞ্চদশ শতক থেকে
শুরু করে এই পর্যন্ত প্রতিটি প্রত্নতত্ত্ববিদের গবেষণা কুয়াশার নখদর্পণে। সে জানে। ১৮৩৭ সালে বৃটেনের প্রত্নতাত্ত্বিক গোষ্ঠি চিপস পিরামিডের রহস্য ও গোপন কক্ষ সমূহ আবিষ্কারের চেষ্টা করে কতকটা সফলতা লাভ করেছিলেন। তাঁরা পিরামিডের অভ্যন্তর ভাগে প্রবেশ করেন। যেখানেই তাঁরা দ্বার রুদ্ধ দেখেছেন সেখানেই তাঁরা গোলা বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পথ তৈরি করেছেন। কিন্তু এভাবে পিরামিডে প্রবেশের পথ করা যায়, পিরামিডের রহস্য উদ্ধার অসম্ভব। অনেক গবেষণার পর কুয়াশা এই ডিটেক্টর যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছে। এই যন্ত্রটির সাহায্যে তীব্র শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মি পিরামিডের দেয়ালে প্রেরণ করা যায়। এই মহাজাগতিক রশি রঞ্জন রশ্মি অপেক্ষাও শক্তিশালী। এই রশ্মি ৩০০০ মিটারেরও বেশি ঘনত্ব ভেদ করে চলে যেতে পারে। এই রশ্মি পাঠিয়ে কুয়াশা ষষ্ঠ প্রাচীর পর্যন্ত মাইকেরেনোস পিরামিডের অভ্যন্তরস্থ সব রহস্য অবগত হয়েছে। বাকি আছে সপ্তম ও শেষ প্রাচীর। কিছুক্ষণের মধ্যে সব রহস্য কুয়াশার জ্ঞাত হবে।
অন্ধকার প্রাচীর পথের একস্থানে এসে কুয়াশাকে থামতে হলো। টর্চ লাইটের আলো ফেলে দেখলো, সামনের পথ রুদ্ধ। নতুন একটি দেয়াল উঠেছে। তবে কি এটিই সপ্তম দেয়াল? কুয়াশা উগ্র চিত্রে নক্সার নির্দেশ অনুযায়ী বাঁ দিকে দশ পদক্ষেপ এগিয়ে গেল। একটি পাথরের স্তম্ভের উপর ভীষণকায় এক সাপের মূর্তি। মনে হয় যেন ফণা দোলাচ্ছে। কিন্তু আসলে এটি আর কিছু নয়, পাথরের গড়া মূর্তি। সাপের চোখে টিপ দিতেই একটি গুহা মুখের মতো দরজা খুলে গেল। কিন্তু ভেতরে এক পা দিতেই প্রচণ্ড এক আর্তনাদ করে কুয়াশাকে পিছিয়ে আসতে হলো।
.
০৬.
কায়রোর বিখ্যাত কসমোপলিটান হোটেলের লনে এক বৃদ্ধ ইহুদী অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন তাঁর মাথার চুল সাদা। নাকে ফ্রেম হীন চশমা। তীক্ষ্ণ নাকের ওপর দুটি ঘোলাটে চোখ। ভদ্রলোক ঘড়ি দেখছিলেন আর দরজার দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন।
কিছুক্ষণ পর আর একজন বৃদ্ধ ইহুদী কাঁধে ট্যুরিষ্ট ব্যাগ ঝুলিয়ে আস্তে পায়ে লনে ঢুকলেন। প্রথমোক্ত ইহুদী সচকিত হয়ে তাকালেন।
হ্যালো জন।
জন এগিয়ে এসে এক গাল হাসলো। ইংরেজিতে বললো, ঘন্টা খানেকের ভেতর না গেলে কিন্তু…
আমার সব ব্যবস্থা ঠিক আছে। তুমি বরং এক কাজ করে। এই ফোন নাম্বার নিয়ে সুপার সাহেবকে জানিয়ে দাও
রাইট স্যার।
আমি রিসেপশনের দিকে যাচ্ছি। বিলটা মিটিয়ে সোজা ছুটবো।
তখন অনুমান সকাল নটা। আরবী পোশাকে সজ্জিত একদল সামুদ্রিক জাহাজী ডাম বাজিয়ে হল্লা করতে করতে যাচ্ছিলো।
রাস্তার লোকজন অবাক হয়ে ওদের দেখছিল। কিন্তু সেদিকে ওদের দৃকপাত নেই। বণিক দলটি দুইদিন আগে সুমাত্রা থেকে জাহাজ বোঝাই নানাপ্রকার মসলা ও ফলল নিয়ে কায়রো ফিরেছে। সমুদ্রে ভেসে ভেসে ওরা জীবন কাটায়। ওদের জীবনের ভরসা কি? বাধা বিপদের মুখে যে কোনো সময় ওরা আক্রান্ত হতে পারে। মৃত্যুবরণ করতে পারে। তাই সুযোগ পেলেই আমোদ প্রমোদে এরা সময় কাটায়। দলটি দুইদিন হলো এসেছে। এসে নানা ভাগে ভাগ হয়ে নগরের এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। আলোচ্য দলটি কসমোপলিটান হোটেল থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে চলেছে। কায়রোর দক্ষিণ প্রান্তে গানের জলসা বসে রোজ দুপুরে। উন্মুক্ত ময়দানে খেজুর গাছের ছায়ার নিচে যাযাবর রমণীরা মিশরীয় বেদুইনের হাতের ম্যাণ্ডোলিনের বাজনার তালে তালে নৃত্য করে। যাযাবর রমণীদের চোখের কটাক্ষ মদির। লাল ঘাগড়ার ঢেউয়ে আরব সাগরের বাতাস নাচে।
ড্রাম বাজিয়ে বাজিয়ে ওরা চলেছে। হঠাৎ এক অভিজাত অট্টালিকার কাছে এসে দলটি মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। ওরা কেউ লক্ষ্য করলো না অট্টালিকার দ্বিতল জানালায় বাইনোকুলার চোখে যে লোকটি দাঁড়িয়েছিল সে হঠাৎ উচ্চকণ্ঠ হেসে উঠলো।
লোকটি যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। পরনে দামি পোশাক। চোখে গগলস আঁটা। সে হঠাৎ হাসতে শুরু করলো। হাসি আর থামতে চায় না। দরজা দিয়ে তড়িৎ পায়ে ছুটে এলো দীর্ঘকায়, কুৎসিত একটি লোক। অস্থির গলায় বললো, ওস্তাদ ওরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।
সে তো দুদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলে, ভয় কেন?
না, ভয়ের কি আছে?
কুৎসিত লোকটি একটু হাসলো। বললো, কোরবান আলী শুধু ভয় কর ওস্তাদকে। ব্যস, আর কাউকে না।
যা বলেছিলাম তা করেছো?
জরুরী।
তাহলে সবাইকে ওয়ার্নিং দিয়ে সরে যেতে বলো।
বেশক।
শোনো কোরবান।
ওস্তাদ নামধারী হাসলো, হারামজাদাকে একটু শিক্ষা দিয়ে যেতে চাই। ওরা সবাই যাক। তুমি যেয়ো না আমার সঙ্গে থাকো…
কিন্তু।
বলে বোধহয় ইতস্ততঃ করছিল কোরবান। আর সাহস পেলো না। নিঃশব্দে সেলাম জানিয়ে আদেশ পালন করবার জন্যে সে কক্ষান্তরে চলে গেল।
ততক্ষণে হত্নাকারী দলটা বাড়ির সর্বত্র ঢুকে পড়েছে। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ভাবে ওরা নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে বাড়িটা ঘেরাও করে রইলো। প্রত্যেকের হাতে রিভলভার। এর ভেতর কখন যেন পূর্ব বর্ণিত দুজন বৃদ্ধ ইহুদী ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছেছেন। তারা কাল ব্যয় না করে দ্রুত পায়ে উপরে উঠলেন। প্রতি মুহূর্তে নেসার আহমেদের দলের লোকদের আক্রমণের আশঙ্কা করছেন তাঁরা। কিন্তু আশ্চর্য এক নারবতা বিরাজ করছে।বাড়িটিতে। তবে কি এতদিনকার অনুসন্ধান ভুল পথে চলেছিল? তাই বা কি করে হয়?
হঠাৎ জানালা পথে এক যুবকের মুখ দেখা গেল। যুবকটি অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বললো, একজন ভদ্রলোকের বাড়িতে এভাবে চড়াও হওয়ার কি অর্থ জানতে পারি জনাব?
অতি শীঘ্র তা জানতে পারবেন। প্রথমোক্ত বৃদ্ধ ইহুদী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দিলেন। তাঁর বুকের রক্ত উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছিল। আর কোনো সন্দেহ। নেই, এটি সঠিক আচ্ছা। স্বয়ং নেসার আহমেদ ভদ্র যুবকের ছদ্মবেশে কথা বলছে।
অ্যাভাস। প্রথমোক্ত ইহুদী নিচের দলকে আদেশ দিলেন। হাতে উদ্যত রিভলভার। যুবকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, একটুও নড়াচড়ার চেষ্টা করো না নেসার। মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো।
বলেন কি সায়েব। নেসার যেন মাথার খুলি উড়ে যাবার ভাবনায় চম্কে উঠলো। তারপর হাসতে হাসতে বললো, মি সিম্পসন, আপনি একটা তৃতীয় শ্রেণীর গাধা?
দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে ইহুদীবেশী মি. সিম্পসন বললেন, আমি কি সেটা এক্ষুণি জানতে পারবে বাছাধন।
মি. সিম্পসন ও তাঁর সঙ্গীর রিভলভারের রেঞ্জের ভেতর অনায়াস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো নেসার। তার মুখে মৃদু মৃদু হাসি। বললো, আহা, টিকটিকি সাহেব, রাগ করছো কেন? আমাকে ধরেছে, না হয় আমি তোমার বন্দী। কিন্তু দুটো রসালাপও করতে দেবে না, তুমি লোকটা কি হে?
ইতিমধ্যে নিচের দলটি মি. সিম্পসনের আদেশে উপরে উঠে এসেছে। নেসারকে সর্বক্ষণ রিভলভারের মুখে দাঁড় করিয়ে রেখে মি. সিম্পসন নিজে ঘরের ভেতর ঢুকলেন। না, কেউ নেই। দেয়াল ও থামের ওধারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন। কোথাও কেউ নেই। দুহাত ওপরে তুলে সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর দ নেসার আহমেদ।
পেছন থেকে দুজন ও সামনে থেকে মি. সিম্পসন এগিয়ে যাচ্ছিলেন নেসার আহমেদের দিকে। নেসার আহমেদ গলা কাশি দিয়ে বললো, যা করার করে ফেলুন। টিকটিকি সাহেব। উর্ধ বাহু হয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না।
মুহূর্তে আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লেন মি. সিম্পসন ও তার দুজন সঙ্গী। নেসার আহমেদের চোখ মুখ কঠোর হয়ে উঠলো। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় বললো, নিচের সব কটাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দে। এই হারামজাদা থাক। এর ব্যবস্থা পরে হবে।
নেসার আহমেদের সঙ্কেতে দেয়াল দুফীক হয়ে গৰ্তমুখ দেখা গেল। বেরিয়ে এলো কোরবান। হাসিমুখে বললো, যা হুকুম দিয়েছিলেন ওস্তাদ তাই করেছি। মাত্র তিনটে গ্যাস বোম ছুঁড়েছিলাম ওস্তাদ। তাতেই দেখছি শালারা সব হাঁটু ভেঙে পড়ে গেছে।
আর দেরি করো না।
নেসার আহমেদ চিন্তাকীর্ণ গলায় বললো, এক্ষুণি এই আড্ডা পুড়িয়ে দিতে হবে। আমি মিনিট দুয়েকের মধ্যে এক নম্বর আড্ডায় ফিরে যাচ্ছি। তুমি সুড়ঙ্গ পথটা ঠিক রেখে বাকি সব মিসমার করে দিয়ে এসো। সিম্পসনকে পাথর ঘরে পাঠিয়ে দাও। অলরাইট?
ঠিক হ্যায় ওস্তাদ কোরবান সালাম দিয়ে বললো।
দেয়ালের গর্ভমুখ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথে সোজা মাটির নিচে নেমে গেল নেসার আহমেদ। সুড়ঙ্গটি গিয়ে পৌঁছেছে গিজেহ এলাকার মরুভূমিতে। এখানে ওখানে অনুচ্চ পাহাড়, টিলা, খেজুর গাছ ও ঝোঁপঝাড়।
কয়েক মিনিট নীরবতা বিরাজ করলো পূর্বোক্ত হানাবাড়িতে। তারপর বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণে অগ্নৎপাত ঘটতে লাগলো। মুহূর্তে ধোঁয়া ও আর্তনাদের শব্দে আকাশ বাতাস ভরে উঠলো।
সেই আর্তনাদের সঙ্গে তাল রেখেই যেন একটি পিশাচ কণ্ঠ গিজেহ এলাকার মরুভূমির নিচে এক সুরক্ষিত গুপ্তকক্ষে দাঁড়িয়ে প্রবল ভাবে অট্টহাস্য করে উঠলো। সামনে দাঁড়িয়েছিল কোরবান ও মোতিয়া। যুবতী মোতিয়া নেসারের পানপাত্র ভরে দিচ্ছিলো নতমুখে।
নেসার আহমেদ হাসতে হাসতে বললো, তাহলে সব ঠিক আছে কোরবান?
সব ঠিক আছে ওস্তাদ। সিম্পসন কুত্তাটাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাথর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর তিন নম্বর আড়াটা এতক্ষণে বোধহয় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
অল ক্লিয়ার। শোনো কোরবান, আমরা দিন তিনেকের ভেতর এই দেশ ত্যাগ করবো। তুমি যাবার ব্যবস্থা ঠিক করে রাখো। মোতিয়া
মোতিয়া ভীত চোখে নিঃশব্দে পানপাত্র ভরে দিলো। গ্লাসে চুমুক দিয়ে নেসার আহমেদ বললো, আজ সারাদিন আমি বিশ্রাম করবো। রাত্রি বেলা শুরু করবো কাজ। আমার সঙ্গে তুমি ছাড়া থাকবে কালু আর মদন।
ঠিক হ্যায় ওস্তাদ!
পথ পেয়ে গেছি। রাস্তা বিলকুল সাফ। এখন শুধু মণিমুক্তা বোঝাই করে পাচার করা! হাঃ হাঃ হাঃ
নেসার আহমেদ হাসলো। জেবাকে মেরেছিল। বড় কায়দা করে। বিছানায় শুয়ে, গায়ে আদর করতে করতে..কোরবান…
জি ওস্তাদ…
সিম্পসন কুত্তাটা কিন্তু তাদোড়। সাবধান…
ওস্তাদ যা বলেছেন তাই হবে, আমরা সাবধানে থাকবো।
হু, সাবধানে থেকো।
নেসার আহমেদ খলিত পায়ে মোতিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। মোতিয়া ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। সে বুঝলো, পানপাত্র ভরে দেবার কাজ ফুরিয়েছে। এখন নিজেকেই পানপাত্র করে তুলে ধরতে হবে নেসার আহমেদের কাছে। কোরবান হাসলো। কানা চোখটা আরও কুৎসিত দেখালো। প্রভু ও মোতিয়ার দিকে তাকিয়ে চকিতে সে কক্ষান্তরে সরে এলো।
.
০৭.
পেছনে দাঁড়িয়ে গোগী ক্রুদ্ধ হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। আঘাতটা সামলাতে বেশ কিছুক্ষণ লাগলো কুয়াশার। গোগীর দিকে তাকিয়ে আস্তে গলায় বললো, কোয়ায়েট গোগী।
গোগীর গর্জন থেমে গেল। সে বোবা দৃষ্টি মেলে প্রভুর দিকে তাকিয়ে রইলো। কুয়াশা বুঝলো, আর কিছু নয়, গোগী বিচলিত হয়েছে তার আর্তনাদ শুনে। সপ্তম প্রাচীরে পা দিতে গিয়ে ডান দিকে ঘুরেছিল কুয়াশা। অমনি প্রবল এক বিষনিঃশ্বাসের ঝাঁপটা এসে লাগলো তার চোখে মুখে। মুহূর্তে মনে হয়েছিল তার মৃত্যু হচ্ছে। দম টানতে পারছে না। আমি মরছি এই ভাবনার ভেতর প্রবল এক প্রতিরোধকারী শক্তির প্রতিক্রিয়া থাকে। সেই শক্তির বলেই হয়তো সে ছিটকে পেছনে সরে আসতে পেরেছিল। নতুবা তার প্রাণহীন দেহ পিরামিডের পাথরে এতক্ষণ নিশ্চল পড়ে থাকতো। এক সময় প্রাণায়ামের অভ্যাস ছিলো কুয়াশার। সেই অভ্যাসের বলে সে অচিরে বিষ কষ্ট থেকে নিঃশ্বাস মুক্ত করলো। ডিটেক্টর যন্ত্রটি বন্ধ করে সে একটি পাথরে আসন নিয়ে বিশ্রাম করতে লাগলো।
মনে পড়লো দীবার কথা। সে যখন বেরিয়ে আসে তখন দীবা দাঁড়িয়েছিল কেবিনের বারান্দায়। ঢিলে কোর্তা ও পাজামা পরনে, পিঙ্গল কেশরাশি পিঠে ছড়ানো। বিষণ্ণ ও নিশ্চল দীবাকে অন্ধকারে মোমবাতির শিখার মতো সুন্দর ও আরক্তিম দেখাচ্ছিল। সে দীবাকে শুভ প্রভাত জানিয়েছিল। দীবা বলেছিল, তুমি আমাকে সঙ্গে নেবে?
বলো কি?
কুয়াশা একটু হেসেছিল, আমি যাবো মাটির নিচে কবর খুঁড়তে। সেখানে গিয়ে তুমি কি করবে?
না, আমি যাবে। আমি নানাভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।
না, তুমি এখানেই থাকো।
কুয়াশা হেসে বলেছিল, তুমি চিন্তা করো না। তোমার মামলা প্রায় খতম করে এনেছি। মুজাদ্দিদ করীমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথাবার্তাও হয়েছে।
দীবা সাগ্রহে কথাগুলো শুনলো। হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, এইবার সোজা হলো। বললো, সত্যি?
কুয়াশা একটু হেসেছিল। বলেছিল, আমি চলি
দীবা পুনর্বার অধীর হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, তুমি যেখানে যাচ্ছো, সে জায়গা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই কুয়াশা। আমার কথা রাখো, আমাকে সঙ্গে নাও।
কুয়াশা বিরক্ত হয়েছিল। বলেছিল, তুমি এখানেই থাকবে। চলি, অনেক দেরি হয়ে গেল! ..
দীবা আসতে চেয়েছিল, দীবাকে সে আনেনি।
আনা সঙ্গত হতো না তাই আনেনি। কিন্তু দীবা ঠিক কথাই বলেছিল। এই পিরামিডের সপ্তম প্রাচীর সম্পর্কে তার প্রায় কোনো ধারণাই নেই।
হঠাৎ গোগী হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। সবিস্ময়ে তার দিকে তাকালে কুয়াশা। দেখলো, গোগী পেছনের দিকে তাকিয়ে আছে আর অনবরত ক্রুদ্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ছে।
কুয়াশা জানে ইতর জন্তুর ঘ্রাণ ও শ্রবণ শক্তি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষতঃ গোগীর এই ব্যাপারে কখনো ভুল হয় না। ব্যাপার কি দেখার জন্যে সে উঠে দাঁড়ালো। মনে পড়লো পদশব্দ শোনার কথা। দেয়ালের সাথে মিশে যাওয়া ছায়ামূর্তির কথা। সে এগিয়ে গেল। সতর্ক পায়ে এদিক ওদিক খুঁজলো। অপেক্ষা করলো। না, কোথাও কেউ নেই।
সে দৃষ্টি দিয়ে আদর করলো গোগীকে। তার একমাত্র বন্ধু। আফ্রিকার লিম্পোপো নদীর সহস্র কুমীর তাকে আক্রমণ করেছিল। আত্মরক্ষা সে করতে পেরেছিল ঠিকই। কিন্তু গহিন অরণ্যে বিপদ আপদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল তাকে একাকী। সেইসব অসহায় দিনে গোগী তাকে বাঁচিয়েছিল। এখন পর্যন্ত তীব্র ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে গোগীকে বশে রাখতে হয় বটে, কিন্তু এতদিনে গোগী তার জীবনের সঙ্গে মিশে একাত্ম হয়ে গেছে। তার দুঃখে গোগী দুঃখ পায়। তার আনন্দে গোগীর জান্তব চোখে অবোধ বন্য খুশি ফুটে ওঠে।
সে গোগীকে আদর জানালো। গোগীর গলায় খুশির ঘড়র-ঘড় শব্দ বেরোতে লাগলো। খুব সমঝদারের মতো সে ডাইনে বাঁয়ে মাথা দোলাতে লাগলো। কুয়াশা বুঝলো গোগী তার আদরটুকু গ্রহণ করেছে।
বিশ্রামের মুহূর্ত শেষ। এইবার এগিয়ে যাওয়ার পালা। কুয়াশা উঠে দাঁড়ালো। সম্ভবতঃ ভুল তারই। নক্সায় চিহ্নিত পথটির অবস্থান বাঁদিকে। ডানদিকে এগিয়েছিল বলেই হয়তো এই বিভ্রাট। দেখা যাক। বাঁদিকে পা বাড়ালো সে। তীব্র টর্চের আলো ফেলে দেখলো। না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অন্যান্য প্রাচীর পথের মতোই স্বাভাবিক পথ। তবে অন্যগুলোর তুলনায় সঙ্কীর্ণ। সতর্ক পায়ে সে এগিয়ে চললো। এক জায়গায় টর্চের আলো পড়তেই সে চমকে উঠলো। একটা নরকঙ্কাল দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে। সে স্থির হয়ে দীড়িয়ে রইলো একমিনিট। তারপর দেয়ালের গা ধরে যেই এগোতে গেল সামনে অমনি পেছনে তীক্ষ্ণ সতর্কবাণী শোনা গেল ওয়াচ আউট! কুয়াশা লাফিয়ে পেছনে হটে এলো। মুহূর্তে দেয়াল থেকে দুটি পাথরের হাত বেরিয়ে এসে, আবার আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে দেয়ালে মিশে গেল।
কুয়াশার বিস্ময়ের সীমা নেই। দেখলো সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে আর কেউ নয়, দীবা।
সে তখনও হাঁপাচ্ছে। বললো, ম্যান-ট্রাপের ভেতরে পড়তে গিয়েছিলে তুমি। আমি জানতাম এমনি কিছু ঘটতে পারে।
কুয়াশা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো দীবার দিকে। গুপ্তধনের এই নক্সার সঙ্গে জেবা ফারাহর বোন দীবা ফারাহর সম্পর্ক থাকা অন্ততঃ অস্বাভাবিক নয়। কিংবদন্তী ও প্রবাদ সূত্রে দীবা পিরামিডের রহস্য সম্পর্কে হয়তো অনেক কথাই জেনেছে। কে জানে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে অযাচিত ভাবে কুয়াশাকে রক্ষা করার পেছনে পিরামিডের রহস্যের চাইতেও বড় ও জটিল রহস্য আছে কিনা।
প্রশ্ন করার প্রয়োজন ছিলো না! তবু কুয়াশা বললো, তুমি এলে কি করে?
বলছি…। দাবা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো। পেছন দিকে তাকিয়ে হাসলো। বললো, তোমার ঐ গোগীর হাত থেকে আপাততঃ আমাকে বাঁচাও। সর্বক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর মুখ বেজার করে ভোঁ ভোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে।
কুয়াশা হেসে ফেললো। বুঝলো, গোগীর ঈর্ষা হয়েছে। কুয়াশাকে কেউ পছন্দ করুক, কুয়াশা কাউকে পছন্দ করুক এ বোধহয় শ্রীমান গোগী চায় না। তার কাছে এসব খুব খারাপ লাগে। প্রথম প্রথম তো দীবাকে একদম সহ্য করতে পারতো না। কুয়াশা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে দেখলে হুঙ্কার ছাড়তো। কে জানে ছাড়া থাকলে হয়তো মেরেই বসতো দীবাকে। এখন ততটা আক্রোশ নেই। সে বুঝেছে তার প্রভু দীবাকে পছন্দ করেন। তাদের দুজনের ভেতর ভাব রয়েছে। দীবার ক্ষতি করলে তার প্রভু ব্যথা পাবেন, রাগ করবেন এটা জানার পর গোগী আর আগের মতো দীবার প্রতি প্রকাশ্যে হিংসা প্রদর্শন করে না। তবে দীবাকে দেখলেই সে ভয়ানক গম্ভীর হয়ে যায়। ভ্রূকুটির সঙ্গে দীর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ভেংচি মারতেও ছাড়ে না।
কোয়ায়েট গোগী…
কুয়াশা গোগীর দিকে তাকায়।
গোগী হাঁ করে তাকায়। ভাবটা, বাঃ, আমি আবার কি করলাম। পরে প্রভুর আদেশ বুঝতে পেরে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
কুয়াশার ডিটেক্টর যন্ত্রটি নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। পাশে বসে সে ও দী। দীবার চোখ-মুখ উজ্জ্বল, আরক্তিম। মুজাদ্দিদ করীমের সঙ্গে আবার মিলিত হতে পারছে, হয়তো এই ভাবনায় সে সুখী। কুয়াশা মহুয়ার কথা মুহূর্তের জন্যে ভাবলো। মনে মনে হাসলো।
চলো এবার। কোথায়? কোথায় আবার, লঞ্চে।
কুয়াশা প্রথমেই জবাব দিলো না। সে দীবার সুন্দর মুখখানি দেখতে লাগলো। দীবা আবার বললো, কি হলো…
তুমি যাও দীবা। আমি যাবো না।
কেন?
যে কাজের জন্য বেরিয়ে এসেছি সে কাজ উদ্ধার না করা পর্যন্ত আমার বিশ্রামের প্রশ্ন ওঠে না। তুমি বরং যাও।
দীবা প্রতিবাদ করলো না। কিছুদিনের ভেতর এই লোকটির স্বভাব সে জেনে ফেলেছে। চারদিকে সে তাকালো। আবছা আবছা অন্ধকার। ভ্যাপসা গরম। সামনে সপ্তম প্রাচীরের ছায়া ছায়া অলিন্দ দেখা যায়। সঙ্কীর্ণ পথের এখানে ওখানে কি ভাবে মৃত্যু ওঁৎ পেতে আছে কে জানে?
ওরা এগোলো। কুয়াশা একটা গভীর গর্তের মুখে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। পিরামিডের নানা স্থানে এইসব গভীর গর্ত লুকিয়ে আছে। কতো অসংখ্য লোক এই ধরনের গর্তে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।
কিছুদূর এগিয়ে সামনে পড়লো একটি ভগ্ন দেয়াল। দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে বিরাটকায় এক বিড়ালের মূর্তি। ফারাহদের যুগে মিশরের লোকেরা বিড়াল পূজা করতো। তাদের কাছে বিড়াল ভাগ্যদেবী। সাধারণতঃ পিরামিড এইসব বিড়ালের মূর্তি রাখা হয় মৃত রাজা বা রাণীর শিয়রের কাছাকাছি একটা স্থানে। বিড়ালের মূর্তি : দেখে কুয়াশা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বললো, আমরা তাহলে সমাধি মন্দিরের কাছে এসে পৌঁছেছি।
দীবা জবাব দিলো না। কুয়াশার সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকেই একটা সন্দেহ তার মনে দেখা দিয়েছিল। বলি বলি করেও সেই সন্দেহের কথা কুয়াশাকে সে খুলে বলেনি। বিড়ালের মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিলো কুয়াশা কোথাও ভুল করেছে।
ঠিক এই সময় একটা হাতুড়ি-ঠোকার ক্ষীণ শব্দ দেয়ালে দেয়ালে ঘা খেয়ে ভেসে এলো। চমকে উঠলো দুজনেই। কুয়াশা কান পাতলো। তার চোখ দুটি বিস্ময়ে ঝিকিমিকিতে ভরে গেল। শব্দটা ক্রমে স্পষ্ট ও স্থায়ী হলো। মনে হলো কাছেই কোথাও শব্দটা বেজে চলেছে।
গোগী তখন ভয়ানক অস্থির হয়ে উঠেছে। শব্দটা তারও কানে এসেছে। তার ভাষায় এই শব্দের অর্থ যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীকে আহ্বান। টুক টুক টুক ঠাক। শব্দটা মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। আবার জেগে ওঠে। গোগী দুই হাতে বুক চাপড়াতে লাগলো। তার চোখ মুখ অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর অপেক্ষায় কঠোর ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
কুয়াশা বললো, গোগী!
গোগী বুঝলো তার প্রভু বলছেন এ তোমার শত্রু নয়, চোগী। তুমি শান্ত হও।
সে হাঁ করে প্রভুর দিকে তাকালো। তারপর দীর দিকে। শান্ত হয়ে গেল।
নিশ্চল, নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল কুয়াশা। তাকে পেছনে রেখে হঠাৎ এগিয়ে গেল দীবা। যেন ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইলো। কুয়াশা প্রথমে বিস্মিত হলো। তারপর বুঝলে পিরামিডের গোলক ধাঁধার রহস্যে অস্থির হয়ে উঠেছে দীবা। হয়তো সে এই অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে মুক্ত আলোর দেশে যেতে চায়। হু হু হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিতে চায়।
সে-ও ছুটতে ছুটতে দীবাকে অনুসরণ করলো। ডাকলো, দীবা, দীবা..
দীবা মানা শুনলো না। উন্মাদিনীর মতো সে ছুটতে লাগলো।. পিরামিডের রহস্য উদ্ধারের নেশা বড় ভয়ানক। গুপ্তধনের লোভ বড় প্রচণ্ড। সেই লোভে পড়ে প্রাণ দিয়েছে হতভাগিনী জেবা। পিরামিডের অতল রহস্যের হাতছানি হয়তো দীবাকেও টানছে।
দীবা, শোনো।
কুয়াশা প্রাণপণে চিৎকার করলো। অন্ধকার গুহায় সেই শব্দ প্রতিধ্বনির পর প্রতিধ্বনি ঢেউ তুলে সর্বত্র গমগম করতে লাগলো।
কুয়াশা ছুটছে। আর এক মুহূর্তের অপেক্ষা। তারপরই দীবাকে সে ধরতে পারবে।
হঠাৎ প্রবল শব্দে বসে পড়লো একটি প্রকাও পাথর। দীবা আর্তনাদ করে উঠলো। ততক্ষণে সে কুয়াশার বাহুবন্ধনে। এক চুল এদিক ওদিক হলে প্রকাণ্ড সেই পাথরটি তার উপর এসে পড়তো। তারপর কি হতে ভাবতে গিয়ে চোখ বুজলো দীবা। প্রাণপণে সে আঁকড়ে ধরলো কুয়াশার গলা। তার বুকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে লাগলো।
কুয়াশা দীবার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। কিন্তু সম্মুখের দিকে তাকিয়ে তার সমগ্র সত্তা স্থির হয়ে গেল। পথটা চলে গেছে দক্ষিণে। এই পথটি সপ্তম প্রাচার অতিক্রম করে অন্য কোথাও চলে গেছে। তবে কি নক্সা বর্ণিত সপ্তম প্রাচীর শেষ স্থান: নয়? কিন্তু তাই বা কি করে হয়?
অনেকক্ষণ পর দীবা সংবিৎ ফিরে পেলো। আস্তে আস্তে সে কুয়াশার বাহু-বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। সে বুঝলো তার আতঙ্কের কারণ ছিলো যা সেই শব্দটা আর কোথাও নেই। কিন্তু স্বলিত সেই পাথরের ওপাশ দিয়ে একটি গুহা মুখ বেরিয়ে পড়েছে। যেন মুখব্যাদান করে প্রচণ্ড এক মৃত্যু তাদের আহ্বান জানাচ্ছে। সে দেখলো। তার মতো কুয়াশীও নির্বাক দৃষ্টিতে সেই নতুন পথটির দিকে তাকিয়ে আছে।
এই হচ্ছে সঠিক পথ…
দীবা ফিসফিস করে বললো, এই পথ ধরে গেলে আখতানুনের ধন-রত্নের সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু আমি ধনরত্ন চাই না। আমি বাঁচতে চাই। আমি জানি, যে ঐ পথে একবার ঢুকেছে, সে আর কখনো পৃথিবীতে ফিরে যায়নি। কখনো যায়নি…
স্থির হও, দীবা…
কুয়াশা যেন তিরস্কার করলো। বললো, ভেবে দেখো তুমি ইচ্ছে করেই এখানে এসেছে। তুমি ভয় পাবে জেনেই তোমাকে আনতে চাইনি। কিন্তু যখন এসেই পড়েছে, দয়া করে গোলমাল করো না। আমি না আসা পর্যন্ত এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। গোগী…
গোগী কাছে এসে দাঁড়ালো। বুঝলো তার প্রভু বলছেন এই দুর্বল মানুষটিকে তোর জিম্মায় রেখে গেলাম রে গোগী। কেউ যেন ওর অনিষ্ট করে দেখিস বাবা!
সে ভারি খুশি হয়ে দীর দিকে তাকালো। ক্রমাগত মাথা নাড়তে লাগলো। প্রভু এই মানুষটিকে বিশ্বাস করেন, পছন্দ করেন সুতরাং এ নিশ্চয়ই শত্রু নয়, বন্ধু। গোগীর ভয়াল হাসিতে যেন কৃতজ্ঞতা ও স্নেহ ঝরতে লাগলো।
দীবাকে পেছনে রেখে কুয়াশা স্থির অবিচল ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল! কেন যেন তার মনে হচ্ছিলো এই পথে কারো কারো যাতায়াত হয়েছে। তার এই ধারণা বদ্ধমূল হলো কিছুদূর এগোতেই। দেখলো একটি কম্পমান ছায়া পথের শেষ প্রান্তে টর্চের আলো ফেলে এদিকে আসছে।
মুহূর্তে কুয়াশা থামের আড়ালে আত্মগোপন করলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলো। সেই কম্পমান ছায়া ক্রমে আরো কাছে এগিয়ে এলো। একেবারে কুয়াশার কাছাকাছি, তিন হাতের ভেতর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কুয়াশা চিনলো লোকটিকে। নেসার আহমেদ। চিরকালের এই ভয়ঙ্কর শত্রুকে চিনতে আর ভুল হবার কথা নয়। উত্তেজিত হয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হচ্ছিলো আর দেরি না করে এই মুহূর্তে জীবনের চরম শত্ৰু এই নেসার আহমেদকে রিভলভারের একটি গুলিতে শেষ করে দেয়। বহু কষ্টে সে উত্তেজনা দমন করলো। এখনো নেসারের সঙ্গে বোঝাপড়া করার সময় আসেনি। সময় আসুক নেসার আহমেদের মুখোমুখি সে নিশ্চয় হবে। দম বন্ধ করে নেসার আহমেদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগলো সে।
নেসার আহমেদ থমকে দড়িয়েছে। কি ভেবে সে চারপাশে তাকাতে লাগলো। সম্ভবতঃ সে ধরে নিলো কেউ কোথাও নেই। তাকে নিশ্চিন্ত মনে হলো। দেয়ালের গায়ে একটা পাথরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখতে দেখতে দেয়ালটা ফাঁক হয়ে গেল। দেখা দিলো একটা আবছা সিঁড়ি পথ। সেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল নেসার। মুহূর্তে বন্ধ। হয়ে গেল দেয়ালের ফাঁকটুকু।
অনেকক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কুয়াশা। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সম্মুখে। সঙ্কীর্ণ পথের বাঁক ঘুরতেই অপূর্ব এক সুরম্য মন্দির চোখে পড়লো। ক্ষুদ্রকায় এই মন্দিরটির সামনে প্রশস্ত অঙ্গন। মন্দিরের চূড়ায় চূড়ায় অলিন্দে অলিন্দে দামি পাথরের কারুকার্য। বড় বড় থাম। কুয়াশা বুঝলো এটিই সমাধি মন্দির। উত্তেজনা তার সর্ব সত্তা জ্বলছিল। সে মন্দিরের ভেতর ঢুকলো।
হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কুয়াশা। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। দেখলো শয়ন মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে, চূড়ায়, উঠোনের মর্মর মূর্তিতে বসানো রয়েছে ঝলকিত হীরা-মুক্তা-মাণিক্য। বড় বড় হীরা মুক্তা মাণিক্যের পাথর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে দ্যুতি। সেই দুতির আলোয় শয়ন মন্দিরের সময় প্রাঙ্গণ আলোকিত। আলোকিত হয়তো নয়। এক রকম লাল-নীল-সবুজ আলোর কোমলতায় চতুর্দিক আচ্ছন্ন।
কুয়াশা বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো জানে না। তার হাতের কাছেই কুবেরের ঐশ্বর্য। রাজা আখতানুনের ধন-রত্নরাজি, যা নাকি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল জ্ঞানী চিকিৎসকের কাছে, যার জন্য জেবা ফারাহ্ প্রাণ দিয়েছে। না, এ সেই লুকায়িত ধন-রত্ন নয়। এইসব হীরা-মুক্তা-মাণিক্য শুধু সেই বিপুল ধন-রাজির একটা সামান্য আভাস মাত্র। শয়ন মন্দিরের মাটি খুঁড়তে হবে। কুড়ি ফুট মাটির নিচে রয়েছে সেই ঐশ্বর্য। আখতানুনের ঐশ্বর্য।
কুয়াশা এখনো পরিশ্রম ও সাধনার ফল পায়নি।
সে এগোলো। এক মুহূর্ত বুঝি কি ভাবলো। ডেকে আনবে নাকি দীবাকে, জেবা ফারাহর বোন দীবা ফারাহকে? দীবা দাঁড়িয়ে আছে সপ্তম দেয়ালের বাইরে। চকিতে আর একটা কথা ভাবলো কুয়াশা। তীক্ষ্ণ বাণের মতো কথাটা বিদ্ধ হয়ে আছে এতক্ষণ। না , দীবাকে সে সন্দেহ করে না। সে ভাবছে নক্সাটার কথা। যে নক্সা তার অধিকারে আছে, যে নক্সার নির্দেশানুযায়ী এতদিন কাজ করেছে, কই সে নক্সার পথ ধরে ঈপ্সিত এই শয়ন মন্দিরে আসার পথ তো সে পায়নি। দুর্ঘটনা কিংবা আকস্মিকতা তাকে এই গুপ্ত পথটির সন্ধান দিয়েছে। সে কৌতূহলী হয়েছিল বলেই এখানে আসতে পেরেছে। ৩ গ্য তার প্রতি সদয় বলেই এই শয়ন মন্দিরের গুপ্ত কক্ষে সে পদার্পণ করতে পেরেছে। কিন্তু যদি আকস্মিক এই ঘটনা না ঘটতো?
দাঁতে দাঁত ঘষলো কুয়াশা। তার কপালে ঘামের চিহ্ন ফুটে উঠলো। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠলো। নেসার আহমেদ, তুমি যতো বড় ধুরন্ধরই হও না কেন–আমার হতে তোমার রক্ষা নাই। ফিস ফিস করে কুয়াশা যেন নিজের সঙ্গেই কথা বললো। তার নিজের নক্সাটা ভূল, আর তার প্রতিপক্ষ নেসার আহমেদ ঠিক নক্সা ধরে ঠিক পথে এগিয়ে এসেছে ভাবতে গিয়ে কুয়াশা ঘৃণায়, ক্রোধে আর হিংসায় ভেতরে ভেতরে আচ্ছন্ন, উন্মত্ত হয়ে উঠলো।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো শয়ন মন্দিরের দিকে। না দীবাকে সে ডাকবে না। এখনকার প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। গুরুত্বপূর্ণ। নেসার আহমেদ ও তার দলবল সন্ধান জেনেছে এই গুহার, এই ধন-রাজির। একটু ভুল করলে রক্ষা নেই। রাজা আখতানের পিতামহের সঙ্গে মৃত্যুর রাজত্বে কাটাতে হবে তাকে।
সে হাসলো। তার অস্তিত্বের চারদিকে হাজার হাজার বছরের স্মৃতি। আচ্ছন্ন। অলো। আলো। প্রেতাত্মা ও নেসার আহমেদের জিঘাংসার ভ্রূকুটি।
এবারে আর ভুল করলো না কুয়াশা। পিরামিড-তত্ত্ব সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান। সে প্রতিটি পাথরের ইতিহাস বলতে পারে। প্রতিটি স্তম্ভের নির্মাণ রহস্য জানে। ফেরাউনদের শক্তিমত্ত মনটির পরিচয় তার কাছে পরিস্ফুট। প্রথমে সে শন মন্দিরের দিক নির্ণয় করলো দিকদর্শন যন্ত্রটি দিয়ে। চিরকাল মিশরের সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য নীল নদ। নীল-নদ এই দেশের পবিত্র মাতৃ জঠর। আবহমান কাল থেকে নীল-নদের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ দিগন্ত মিশরবাসীদের কাছে পূজ্য। শয়ন মন্দিরের দক্ষিণ প্রান্ত বেছে নিলে৷ কুয়াশা। দক্ষিণ প্রান্তের দেয়ালের বিশেষত্ব সহজেই চোখে পড়ে। অনেক কটা বিচিত্র পাথর একত্রিত করে সেই দেয়াল নির্মিত। এক একটি পাথরের এক এক রকম রঙ। দে!লের মাঝখানে একটি প্রশস্ত ও মসৃণ মেজেন্টা রঙের পাথর। একটার পর একটা পাথর পরীক্ষা করলো কুয়াশা। মেজেন্টা রঙের পাথরে হাত দিতেই পাথরটি বড়ির পেণ্ডুলামের মতো দুলতে লাগলো। কিন্তু খুব ধীর গতিতে। একটু একটু পাথরটি সরতে লাগলো। ভেতর থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটি গুহা মুখ। পাথরটি স্থানচ্যুত করার অনুরূপ ব্যবস্থা দেয়ালের ভেতর দিকেও রয়েছে। কুয়াশা পাথরটির গতির ভারসাম্য রক্ষা করে দেয়ালের ভেতর দিয়ে গুহা মুখে পৌঁছলো। গুহা ধরে নেমে গেল নিচে।
নিচে নেমেই ভয়ে, উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলো কুয়াশা। সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছেন একপাশে রাজা এ্যামন হোটাপ। স্থির, অবিচল, নিষ্ঠুর মূর্তি।
.
০৮.
মি. সিম্পসন বন্দী অবস্থায় নেসার আহমেদের দুই নম্বর আড্ডায় দিন কাটাচ্ছিলেন। নেসার আহমেদের দুই নম্বর আড্ডা মরুভূমির নিচে, একটা শিলাময় পাথুরে গুহার ভেতর। তাঁকে রাখা হয়েছিল ছোটো একটা ঘরে। কোরবান আলীর হুকুম ছিলো তাকে সর্বদাই হাত পা বেঁধে রাখার। তিন দিনের ভেতর এক মুহূর্তের জন্যে এই হুকুমের এদিক ওদিক হয়নি। মি. সিম্পসন বন্দী হওয়াতে যতো না বিমর্ষ হয়েছিলেন, অপমানের জ্বালায় তার চেয়ে বেশি হয়েছিলেন যন্ত্রণাহত। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত স্বনামধন্য গোয়েন্দা সিম্পসন মৃত্যুকে ভয় পায় না। কিন্তু চালের সামান্য একটা ভুলে তাকে বন্দী হতে হলো, আর বন্দী হয়ে এমন অসহায় অপমানকর জীবন যাপন করতে হচ্ছে-এই যন্ত্রণা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক আর গ্লানিকর। মি. সিম্পসনের চেহারায় এই কদিন বিপুল পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তাঁর প্রশস্ত ললাটে অসংখ্য বলি রেখা ফুটে উঠেছে। চোখ দুটি উন্মাদের মতো সর্বদা জ্বলছে। হাত পা শৃঙ্খলাবদ্ধ। সিম্পসন সর্বক্ষণ একটা কোনো উপায় খুঁজছেন এই বন্দীশালা থেকে মুক্ত হবার। একটা কোনো সূত্র খুঁজছেন জেবা ফারাহর হত্যাকারী নেসার আহমেদকে সমুচিত শিক্ষা দানের। কিন্তু, তার সব চেষ্টা নিষ্ফল। সব চিন্তা অসহায়।
মি. সিম্পসন নিষ্ফল আক্রোশে গুহার আবছা অন্ধকার ও অসহায় বন্দীত্ব সহ্য করেন। তাঁর ঘরের সামনে রাখা হয়েছে কোরবান আলীর জনৈক বিশ্বস্ত চেলাকে। সে প্রতিক্ষণ সজাগ হয়ে প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে থাকে। দুএকবার মি. সিম্পসন, আকারে ইঙ্গিতে তাকে প্রলোভন দেখিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রহরীটা শুধু হেসেছে আর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছে মি. সিম্পসনের দিকে। মি. সিম্পসন বলছেন, তুমি তাকিয়ে কি দেখছো?
আপনাকে দেখছি। আপনি বাঁচতে চান, না?
আমি নেসার আহমেদকে ধরতে চাই। সে একটা খুনে ডাকাত। তুমি আমাকে সাহায্য করা। আমার সরকার তোমাকে অনেক টাকা দেবেন।
নেসার আহমেদ যদি খুনে ডাকাত হয় তাহলে আমি আর সাধু হলাম কিসে সাহেব?
প্রহরীটা হাসে। বলে, ওসব লোভ দেখাবেন না আমাকে। লাভ হবে না কিছু।
মি. সিম্পসন মনে মনে অশিক্ষিত, ভয়ঙ্করদর্শন প্রহরীর প্রশংসা না করে পারেন না। ন্যায়ের পথ আছে ডাকাতেরও আছে ধর্ম। এই প্রহরী তার স্বধর্ম রক্ষা করছে। নেসার আহমেদ লোকটা ভাগ্যবান।
তিনি আর কিছু বলেন না। প্রহরী নিঃশব্দে দরজার দিকে চলে যায়। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সিম্পসনের ঘুম ভাঙে, সময় কাটে। বন্দী দশায় কদিন গেল এই হিসাবও তার মনে নেই। একদিন দরজার গোড়ায় উচ্চকণ্ঠে হাসি শোনা গেল। সচকিত হলেন মি. সিম্পসন। ভেতরে ঢুকলো নেসার আহমেদ! মদে চুর। একটি যুবতী মেয়ের কোমরে হাত দিয়ে টলতে টলতে ঢুকলো। পেছনে কোরবান।
মি. সিম্পসনের চোখ দুটি মুহূর্তের জন্যে জ্বলে উঠলো।
ব্রাদার সিম্পসন!
মদে চুর নেসার আহমেদ উদারতায় বিগলিত। তোমার প্রতি যে নির্দয় ব্যবহার আমরা করছি তার জন্য আমরা খুবই দুঃখিত। কি বলো কোরবান?
কোরবান আলী সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানায়।
সুতরাং আমরা ঠিক করেছি বেশিদিন তোমরা আমাকে, কি বলে, আমরা তোমাকে এভাবে কষ্ট দেব না। হাঁ কষ্ট দেবো না।
নেসার আহমেদ মমতায় বিগলিত হয়ে যুবতী মেয়েটিকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে আরো কাছে আকর্ষণ করলো। অত্যন্ত চটুল দেখতে মেয়েটা প্রথমে ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো। পরে নেসার আহমেদের নির্দয় আলিঙ্গনের ভেতর খসখসে চাপা গলায় হেসে উঠলো।
তুমি এখন পাশের ঘরে যাও চম্পা। নেসার আহমেদ: আলিঙ্গন থেকে মেয়েটিকে মুক্ত করে দিয়ে বিড়বিড় করলো। বললো, আমি এখন ব্রাদার সিম্পসনের সঙ্গে কথা বলবা।
চম্পা নামধারী মেয়েটা চলে গেল।
নাউ ব্রাদার সিম্পসন।
নেসার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ালো সিম্পসনের। বললো, আমি ঠিক করেছি তোমাকে আর দুদিন বাদে মুক্তি দেবো।
মি. সিম্পসন এই কথার অর্থ ভালো করেই জানেন। তিনি শুধু বললেন, তুমি যাই করো নেসার, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
নেসার হো হো করে হেসে উঠলো। বললো, তুমি লোকটা বেশ বুদ্ধিমান সিম্পসন। তবে ঐদিন আমাকে ধরতে গিয়ে যে বোকামী করেছে তার তুলনা হয় না। তোমার গাধামি আর বুদ্ধি দেখে আমি চমৎকৃত হয়েছি। আমি ঠিক করেছি যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।
মি. সিম্পসন শুধু তাকিয়ে রইলেন। নেসার আহমেদ হাসতে লাগলো। বললো, মর্যাদার সঙ্গে কেন বললাম জানো? সাধারণ মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে তোমারটা তফাৎ থাকবে। তোমাকে প্রথম ছেড়ে দেয়া হবে আমার শিকারী কুকুরগুলোর ভেতর। কুকুরগুলোকে ট্রেনিং দেয়া আছে। ইশারা করলেই তারা তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তোমার পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হবে। হাতের বাঁধন অবশ্য ঠিকই থাকবে। তবে তোমার কোনো অমর্যাদা হবে না। আমি কথা দিচ্ছি শিকারী কুকুরগুলো তোমাকে টেনে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবার আগেই তোমাকে সরিয়ে ফেলা হবে। এরপর তোমাকে এক জালা লবণাক্ত গরম পানির ভেতর রাখা হবে। তারপর …
নেসার আহমেদ হাসতে লাগলো। বললো, খুবই দুঃখের বিষয় যে, তোমার মুক্তি দুদিন পিছিয়ে দিতে হবে। এর কারণ কি জানো? কারণ হচ্ছে আমার প্রভুভক্ত শিষ্য কোরবান আলীর প্রার্থনা। দুদিন পর আমার জন্মদিন। কোরবান আলী প্রার্থনা জানিয়েছে ঐদিন যেন তোমাকে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
একটা ঢেকুর উঠলো নেসার আহমেদের। পাশ ফিরে হাঁটতে হাঁটতে বললো, সিম্পসন সাহেব, আমার এখানকার কাজ প্রায় শেষ। আর সপ্তাহ খানেকের ভেতর আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি। দুঃখ রইলো দেশে ফিরে গিয়ে তোমার মতো বন্ধুর দেখা পাবো না। হাঃ হাঃ।
সিম্পসন সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, তোমারও দিন ফুরিয়েছে!
কোরবান আলী উত্তেজিত হয়ে চাবুকে হাত দিলো। তার একটা মাত্র চোখ ধিকি ধিকি আগুনে জ্বলছে। নেসার আহমেদ তাকে বাধা দিলো। বললো, যেতে দাও কোরবান। সাহেব গোসা হয়েছেন। কিন্তু সাহেব, এই কথাটা বুঝলেন না যে তিনি আমাদের ধরতে পারলে আমাদেরও সোজা শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন!
নেসার আহমেদ হাসতে লাগলো।
*
দীবা হাতের রিস্টওয়াচ দেখলো। কুয়াশা গেছে আড়াই ঘন্টারও ওপর। আর অপেক্ষা করা ঠিক না। সে গোগীর দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব জানার চেষ্টা করলো। গোগী উঁচু একটা পাথরের উপর গম্ভীর হয়ে বসেছে। ভাঁটার মতো চোখ জোড়া নিরতিশয় চিন্তিত।
দীবা ডাকলো। গোগী।
গোগী অভ্যাস বশে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু পরক্ষণেই আবার বসে পড়লো। ভাবখানা, তুমি ডাকাডাকি করছো কেন? আমি তোমার চাকর? এই আমি বসলাম। সাহেব না আসা পর্যন্ত উঠবো না। যা খুশি মনে করতে পারো।
দীবা আবার ডাকলো, গোগী।
এইবারও প্রথমটায় গোগী চঞ্চল হয়ে উঠলো। দীবার ডাকের ভেতর আদেশের সুর ছিলো। সেই সঙ্গে ছিলো স্নেহ ও আদরের স্পর্শ। সে আদেশ প্রতিপালন করার জন্যে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো সেই গম্ভীর, সমোহনকারী আদেশ তো এ নয়। গোগী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
দীবা হাত দিয়ে পথ দেখিয়ে দিলো। ইঙ্গিত করলো। একটু ইতস্ততঃ কর গোগী দীবার বশ মানলো। সে দেখেছে সাহেব দীবার বন্ধু তোক। তার সঙ্গে কথা বলার সময় সাহেব কখনো গুলি ছোঁড়াছুড়ি করেন না। কখনো রাগ হয়ে হাত পা ছোঁড়েন না। বরং হাসি মুখে কথা বলেন। গোগী ইঙ্গিত পেয়ে এগিয়ে গেল।
অন্ধকার সুড়ঙ্গে পথ চলতে গিয়ে বার বার হোঁচোট খেলো দীব। সঙ্কীর্ণ দেয়ালের নিচে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলে মাথা ঠুকে যায়। দেয়ালের কন্দরে কন্দরে লুকিয়ে আছে জিঘাংসার নানা অভিসন্ধি। কিন্তু কিছুই তাকে টেনে রাখতে পারছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে পথ চলছিল। জেবা ফারাহর লোভের ধিকিধিকি আগুন যেন দাবার মনেও সংক্রামিত হয়েছে। অন্ধকার মৃত্যুগহ্বরে হাজার হাজার বছরের সঞ্চিত ধন-রত্ব যেন দীবারও চাই। পিরামিডের নিচে এসে সব সে ভুলে গেছে। একটা মাত্র উদ্দেশ্য তাকে টেনে নিয়ে চলেছে। মমি, রাজার ধন। নর্তকী জেবা ফারাহ্র রক্ত যেন দীবার শিরায় শিরায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।
অবশেষে সুড়ঙ্গ পথ এসে একটা প্রাচীরে শেষ হয়ে গেল। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দীবা। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না।
কতক্ষণ এভাবে গেল সে জানে না। এক সময় দেখলো, পিছনে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোগী। দীবা সচকিত হয়। সামনে এগিয়ে যায়। হঠাৎ কান পেতে শুনলো প্রাচীরের পাথরে পাথরে একটা ক্ষীণ শব্দের তরঙ্গ বেজে উঠছে। শিউরে উঠলো দীবা। অপেক্ষা করলো একটা ভয়ানক কিছুর জন্য। কিন্তু কিছুতেই ঘটলো না ভয়ঙ্কর কিছু। শব্দ তরঙ্গ থেমে গেল একটু পরেই। অন্ধকার পিরামিডের তলায় দীবা দাঁড়িয়ে রইলো কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে।
গোগী…
দীবা যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য অসহায় ভাবে গোগীর সহযোগিতা কামনা করলো। কিন্তু ডাক শুনে তোগী একটু চঞ্চল হলো মাত্র। তার ভাঁটার মতো দুটি জ্বলন্ত চোখে উত্তেজনা ফুটলো। তারপর সময় তেমনি কাটতে লাগলো। পিরামিডের পাথর অচল অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
দীবা পাথরে হাত রাখলো। মাথা রাখলো। যেন এই ভয়ঙ্কর, অচল প্রাচীরের কাছে সে আত্মসমর্পণ করলো। কতক্ষণ সে চোখ বুজে এইভাবে ছিলো জানে না। এক সময় ক্লান্ত চোখ নিয়ে তাকালো। পাশ ফিরলো। হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠলো। কিন্তু মুহূর্তেই সামলে নিলো নিজকে। দেখলো বাঁ পাশে একটি সোনালি রঙের সিংহ মূর্তি। সেই মূর্তির পেছন দিকে রয়েছে ভেতরে যাবার সঙ্কীর্ণ পথ। যেন মুহূর্তে হারানো জীবন ফিরে পেলো দীবা। এগিয়ে গেল সে। সঙ্কীর্ণ পথে পা দিলো। হঠাৎ কি হলো সে জানে না। প্রথমে হোঁচট খেলো, পরে গড়িয়ে পড়লো সিঁড়ি বেয়ে। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় একটা অসহ্য ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। পিরামিডের গভীর অন্ধকার তার চারদিকে ঘনিয়ে উঠলো। দীবা মূৰ্জিত হয়ে পড়লো।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজের চোখকে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলো না। দেখলো পরম বন্ধুর মতো তার শিয়রে বসে আছে কুয়াশা। সে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো। কুয়াশা তাড়াতাড়ি তার মুখে হাত চাপা দিলো। ইঙ্গিতে নিষেধ করলো। হাত দিয়ে পাশের একটি অলিন্দ দেখিয়ে কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করলো। দীবা সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা অনুভব করছিল। কিন্তু শারীরিক পীড়ার কথা তার এই মুহূর্তে মনে রইলো না। সে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো।
রকমারি রঙিন আলোর ছটা এসে পড়েছে একটু দূরে। চারদিকে পাথর, উঁচু স্তম্ভ ও দেয়াল। মাঝখানটা ফাঁকা। রঙিন আলোর ছটায় সেই স্থানটা স্বল্পালোকিত। দীবা দেখলো সেই স্বল্লালোকিত স্থানে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ। কাঁধে একটা বিড়াল। রাজ পোশাক পরিহিত সেই লোকটার নাসিকা তীক্ষ্ণ। চোয়ালের গঠন নিষ্ঠুর স্বভাবের পরিচয় বহন করে। লোকটার অভিব্যক্তিতে একটা অতিকায় হিংস্র হাসি ফুটে আছে।
কুয়াশা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিলো বুঝি সুমুখের স্বল্পালোকিত স্থানে এখনই কোনো নাটকীয় ঘটনা ঘটবে। হলোও তাই। বিপরীত মুখের অন্ধকার প্রাচীর থেকে মশাল হাতে একটা লোক বেরিয়ে এলো। লোকটা দীর্ঘ বলিষ্ঠ। এগিয়ে এসে রাজ পোশাক পরিহিত লোকটার সামনে দাঁড়ালো। মশালটা উঁচিয়ে ধরলো মুখের সামনে। তারপর প্রচণ্ড অট্টহাস্য করে উঠলো।
বললো, রাজা অ্যামন হেটাপ! মরে গিয়েও তোমার স্বস্তি নেই। যক্ষ হয়ে রাজ কোষ পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু এবারে আমি তোমাকে মুক্তি দেবো দোস্ত। আর মাত্র তিন দিন অপেক্ষা করো।
একটা প্রমোট নির্জনতা থমথ করে উঠলো। মশালের লাল ছায়া দেয়ালে দেয়ালে। সাপের জিহ্বার মতো লক লক করে উঠলো। লোকটা মশাল নামিয়ে এক মুহূর্ত কি ভাবলো। তারপর পাশের আর একটা অন্ধকার প্রাচারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটলো। দীবা তাকালো কুয়াশার দিকে। কুয়াশা দীবার মাথায় হাত রাখলো। একটু হাসলো। বললো, দীবা, তুমি আমি দুজনেই দৈব দুর্বিপাকে এখানে এসে পড়েছি। সামনে মন্দিরটি দেখছো? রাজা অ্যামন হোটাপের মন্দির। তোমার বোন জেবাহ ফারাহ্ যে ধন-রত্নের জন্য আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছে, সেই ধন-রত্ন পোঁতা রয়েছে ঐ মন্দিরে।
একটু থামলো কুয়াশা। বললো, ঐ যে স্তব্ধ রাজমূর্তিকে দেখছো, সেই রাজমূর্তি রাজা আখতানের পিতামহ রাজা অ্যামন হোটাপের। মন্দির থেকে এই গুহায় ঢুকে আমি ঐ নিষ্ঠুর অবিচল মূর্তিটা দেখে বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম।
একটু হাসলো কুয়াশা। বললো, অল্পের জন্য আমরা বেঁচে গেছি দীবা। আমি উন্মাদের মতো ধন-রত্ন কুড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ একটা ভারি বস্তু ওপর থেকে নিচে এসে পড়লো। আমি চেতনা ফিরে পেলাম। কাছে গিয়ে দেখি তুমি। তোমাকে ধরে তুলতেই আবার বিপদ সঙ্কেত। দেখলাম গুহার প্রবেশ মুখের পাথর ধীরে ধীরে নড়ছে। বুঝলাম বিপদ আসন্ন। তাড়াতাড়ি সরে এসেছি প্রাচীরের এই প্রান্তে।
দীবা আস্তে আস্তে বললো, ঐ লোকটি কে? রাজা অ্যামন হোটাপের প্রেতাত্মা?
সশব্দে হেসে উঠলো কুয়াশা। বললো, না, জেবা ফারাহ্র হত্যাকারী নেসার আহমেদ। বর্তমানে কুয়াশার এক নম্বরের শত্রু। দীবা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। জেবার হত্যাকারীর প্রতি তার যে প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিদ্বেষ এতকাল মনে চাপা ছিলো সেই ঘৃণা ও বিদ্বেষ তার চোখে মুখে হিংস্র হয়ে উঠলো। সে উঠে দাঁড়াতে চাইলো। কুয়াশা বুঝলো সবই। সে শুধু সন্দেহে দীবাকে ধরে রাখলো। হাঁপাতে হাঁপাতে দীবা বললো, ঐ খুনে শয়তানকে আমিও এতকাল খুঁজেছি কুয়াশা। আমার হাতে ওর নিস্তার নেই।
কুয়াশা বললো, তুমি বিশ্রাম করা দীবা। তুমি অসুস্থ। জেবার হত্যাকারী নেসার আহমেদের সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য কুয়াশাই যথেষ্ট। তুমি
বলতে বলতে কুয়াশার চোখ-মুখ স্নিগ্ধ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। সে বললো, তুমি এ কাজের উপযুক্ত নও। তোমাকে আমি মুজাদ্দিদ করীমের জীবনে ফিরিয়ে দিয়ে আসবো।
দীবা তাকিয়ে রইলো কুয়াশার দিকে। কুয়াশা আর কথা বললো না। সস্নেহে দীবার মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। ক্লান্ত কণ্ঠে দীবা বললো, আমরা ফিরে যেতে পারবো?
কুয়াশা হাসলো, বললো, পারবো। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তুমি এখানে বিশ্রাম করো। আমি গোগীর খোঁজ করছি।
কিন্তু…
কুয়াশা বললো, ভয় নেই দীবা। পিরামিডের রহস্য এখন আমার হাতের মুঠোয়।
সে হাসলো, বললো, আমি পিরামিডের অতল রহস্যের সঙ্গে আরো কিছু রহস্য যোগ করবো। নেসার আহমেদ অন্ততঃ জানবে রাজা আমন হোটাপ য হলেও প্রতিশোধ নিতে জানেন। তুমি আমাকে সাহায্য করবে না দীবা?
দীবা চুপ করে রইলো। কুয়াশা এক মুহূর্তে তার দিকে তাকিয়ে আস্তে পা বাড়ালো। গোগীকে এই শিলা গুহার অন্ধকার থেকে উদ্ধার করতে হবে। আপাততঃ এই তার প্রধান কর্তব্য।
.
তখন অনেক রাত। দেয়ালে হেলান দিয়ে মি. সিম্পসন কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ একটা কোমল স্পর্শে তিনি জেগে উঠলেন। তাঁর বিয়ের অন্ত রইলো না। দেখলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেসার আহমেদের বিলাস সঙ্গিনী চম্পা। মি. সিম্পসন চোখ খুলতেই সে ঠোঁটের উপর তর্জনী রেখে কথা বলতে নিষেধ করলো। সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে সে মি. সিম্পসনের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলো। একখণ্ড কাগজ তাঁর চোখের সামনে তুলে ধরলো। সবিস্ময়ে দেখলেন কাগজটি মিশর সরকারের রাজকীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয় পত্র। লেখা আছে মিস নাফিসা আইভরি, গামাল হোসেনের প্রয়োদশ সহকারী। মি. সিম্পসন সম্মান সূচক মাথা নোয়ালেন। নাফিসা আইভরি চাপা গলায় পরিষ্কার ইংরেজিতে বললো, এই চোরা কুঠুরীর একটি মাত্র লোক বাদে সবাই মাতাল হয়ে আছে। আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। আপনি পালান।
মি. সিম্পসন বললেন, লোকটি কে, কোরবান আলী?
না। নাফিসা আইভরি কানের কাছে মুখ আনলো। বললো, আপনার ঘরের দরজায় যাকে রাখা হয়েছে সেই প্রহরী। আমি চোরা পথে লুকিয়ে এখানে এসেছি। কিন্তু এই গুহা থেকে বেরোতে হলে সমুখের পথ দিয়ে যেতে হবে। আর ঐ পথের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আপনার প্রহরী।
নাফিসা আইভরি একটা ছোট্ট এ্যাসট্টা পয়েন্ট টু ফাইভ পিস্তল গুঁজে দিলো মি. সিম্পসনের হাতে। বললো, পুরো ছটা বুলেট ভরে রেখেছি। আর দেরি করবেন না। পালান।
তুমি?
আমি?
নাফিসা আইভরি একটু হাসলো, নেসার আহমেদের কাজ শেষ হয়নি। আমার কর্তব্যও বাকি আছে যদি বেঁচে থাকি যথাসময় আমাদের দেখা হবে।
মি. সিম্পসন কৃতজ্ঞতাভরা চোখে তাকান আইভরির দিকে। আইভরি তার হাত বাড়িয়ে দিলো। মি. সিম্পসন করমর্দন করলেন। চাপা গলায় আইভরি বললো, আমাকে অনুসরণ করুন।
মি. সিম্পসন অন্ধকার ঘর থেকে আইভরির পিছু পিছু বাইরে এলেন। দেখলেন বারান্দায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে প্রহরী আদিল শেখ। মোড় ফেরার উপক্রম করতেই আইভরির ইঙ্গিতে মি. সিম্পসন দেয়ালের পাশে আত্মগোপন করলেন। কিন্তু ততক্ষণে প্রহরী আদিল শেখ আইভরিকে দেখতে পেয়েছে।
আদিল শেখ রাইফেল উঁচিয়ে এগিয়ে এলো। কাছে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। অবাক হয়ে বললো, তুমি এখানে কেন?
নাফিসা বললো, মাঝ রাতে সবাই মাতাল। তাই আমি বেরিয়ে এসেছি।
বেরিয়ে এসেছো কেন?
তোমার কাছে। আমি জানি মদ তোমাকে মাতাল করতে পারে না। আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার কাছে আমি ধরা দেবার জন্য এসেছি আদিল শেখ।
আদিল সন্দেহপূর্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো। বললো, তোমাকে আমি এই মুহূর্তে হত্যা করতে পারি নাফিসা। তোমার আসল মতলব কি খুলে বলো।
তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমার কাছে এসেছি। কাতর গলায় নাফিসা বলে।
হেসে ওঠে আদিল। বলে, কিন্তু তুমি যাই বলো, তোমাকে আমি এতটুকু বিশ্বাস করি না। আমার প্রভু নেসার আহমেদ যখন উপভোগের জন্য তোমাকে কায়রোর হাটেল থেকে সংগ্রহ করেন তখনই আমার মন বলছিল প্রভু একটা ভুল করেছেন। আমার সন্দেহ যে সত্যি তাতে আর ভুল নেই। নড়াচড়া করবার চেষ্টা করো নানাফিসা। আমি তোমাকে বন্দী করলাম।
আদিল এগিয়ে গেল নাফিসার দিকে। হঠাৎ বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে এসে আদিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন সিম্পসন। আদিলের কণ্ঠনালী সজোরে চেপে ধরলেন। দারুণ বিস্ময়ের ঝোঁক কাটাবার আগেই অন্ধকার হয়ে এলো আদিলের পৃথিবী। তার প্রাণহীন দেহ মেঝেয় পড়ে গেল।
মি. সিম্পসন শুধু এক মুহূর্তে নেসার আহমেদের বিশ্বাসী ভৃত্য হতভাগ্য আদিলের দিকে ফিরে তাকালেন। তাঁর দুঃখ লাগছিল। কিন্তু ভাবালুতায় সময় নষ্ট করবার বিপদ তিনি জানেন। আর দেরি না করে তিনি এগিয়ে যান। নাফিসাকে অনুসরণ করে তিনি গুহামুখে এলেন। নাফিসা বললো, তাহলে বিদায়, সিম্পসন।
গুডবাই কাইণ্ড লেডি!
মি. সিম্পসন মাথা নোয়ালেন।
অতর্কিতে একটি অট্টহাসি ছড়িয়ে পড়লো। কোরবান আলীর নিষ্ঠুর মূর্তি দেখা গেল দ্বারপ্রান্তে। চকিতে একটা তীক্ষ্ণ একফলা ছুরি গিয়ে বিধলো নাফিসার বুকে। তীব্র চিৎকারে লুটিয়ে পড়লো নাফিসা। মি. সিম্পসন ঝট করে এক পাশে সরে গিয়ে কোরবান আলীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন।
গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। ভয়ঙ্কর অট্টহাসি শোনা গেল কোরবান আলীর।
ইতর টিকটিকি, আমার হাতে আজ তোর রক্ষা নেই।
নাফিসা কাতর কণ্ঠে বললো, মি. সিম্পসন, এই মুহূর্তে আপনি বেরিয়ে যান। এখনো সময় আছে মি. সিম্পসন-প্লিজ, প্লিজ।
কিন্তু মি. সিম্পসন নাফিসার মৃতদেহ পেছনে রেখে কিছুতেই যাবেন না। তার চোখ-মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। দেয়ালের এপাশে সরে এসে তিনি পর পর দুটো গুলি ছুড়লেন। ভেতর থেকে কাতর কণ্ঠ শোনা গেল। কেউ আহত হয়েছে। সোরগোল পড়ে গেছে গুহায়। বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠলো। আর দেরি করলেন না মি. সিম্পসন। নাফিসার দেহ কাঁধে তুলে অন্ধ বেগে ছুটে গেলেন গুহামুখে। গুহামুখ বন্ধ। দুজন প্রহরী ছুটে আসছে। মি. সিম্পসন আবার গুলি ছুড়লেন। গুলি খেয়ে একজন প্রহরী মেঝেয় লুটিয়ে পড়লো। আর একজন দেয়ালের খাঁজে আত্মগোপন করলো।
প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসছে আরও কয়েকজন লোক। মি. সিম্পসন বুঝলেন আর যুদ্ধ করে ফল নেই। মৃত্যু এবারে অবধারিত। তার হাতের পিস্তলে আর মাত্র একটি গুলি আছে। রুদ্ধ গুহামুখে এক মুহূর্তের জন্য তিনি দাঁড়ালেন। তার কাঁধের উপর ছুরিকাবিদ্ধ মুমূর্ষ নাফিসা। রক্তে মি. সিম্পসনের জামা-কাপড় রঞ্জিত। শেষ চেষ্টায় তিনি গুহামুখের বিশালকায় পাথরে সর্বশক্তিতে ঠেলা দেন। গুহা মুখ তেমনি অচল, অনড় হয়ে রইলো!
অস্পষ্ট, জড়ানো গলায় নাফিসা বললো, দেয়ালের ঐ বোতামে টিপ দিন মি. সিম্পসন। প্লিজ, দেরি করবেন না।
মি. সিম্পসন তাই করলেন। অবশেষে মুক্তির পথ উন্মুক্ত হলো সামনে। পেছনে। ছুটে আসছে নিষ্ঠুর আততায়ীরা। মি. সিম্পসন গুহামুখ থেকে বেরিয়ে মরুভূমির ভেতর ছুটতে লাগলেন। অন্ধকার থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন আলোর পৃথিবীতে, মৃত্যু পার হয়ে এসেছেন জীবনে। আর ভয় নেই।
তিনি ছুটতে লাগলেন। আবছা অন্ধকার রাত্রিতে তিনি হারিয়ে গেলেন রহস্যময় মরুভূমির বুকে।
.
০৯.
দীবা দাঁড়িয়েছিল কেবিনের বারান্দায়। নীল নদে ভাসমান লঞ্চটি সন্ধ্যার বাতাসে একটু একটু দুলছে। বহুদূরে দেখা যায় বালিয়াড়ির দিগন্ত। আকাশের দিকে তাকায় দীবা। আকাশটা যেন কোনো খেয়ালী শিল্পীর ক্যানভাস। নানা রঙে রঞ্জিত। দীবার মন চিন্তাকীর্ণ। সারাদিন সে শুয়ে শুয়ে কাটিয়েছে, তার শরীর দুর্বল, অবসন্ন। কুয়াশা সেই যে ভোরবেলা বেরিয়েছে, এখনো ফেরেনি। রোগীকেও নিয়ে যায়নি। শুধু তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা কাগজে গোটা কতক সই করিয়ে নিয়ে গেছে দীবাকে দিয়ে। পিরামিডের গোলক ধাঁধা থেকে মুক্তি পাবার পর কুয়াশা কিছুতেই আগের মতো সহজ, স্বাভাবিক হয়নি। সর্বদাই তার চোখ দুটি জ্বলন্ত। মুখে উত্তেজনার রক্তিম রঙ। ভোর সকালে বেরোবার সময় দীবা দাঁড়িয়েছিল খোলা ডেকে। সে জিজ্ঞেস করছিল, কোথায়। যাচ্ছো?
কুয়াশার চোখ দুটি কৌতুকে ভরে উঠেছিল। বলেছিল, বর খুজতে।
কার জন্যে?
কুয়াশা এই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। একটু হেসে বলেছিল, যা তা বর নয় দীবা। দামী বর। নাম শুনবে? মুজাদ্দিদ করীম। দীবা কি একটা বলতে চেয়েছিল। বলতে পারেনি। কুয়াশা একটা দামি সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ টানছিল। আকাশের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। কুয়াশার এই রূপটি ভারি সুন্দর। দীবা দেখেছে সরোদ বাজাবার সময় কুয়াশার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে শিল্পীর গভীর তন্ময়তা। একটা আলোময় দ্যুতি খেলা করে মুখমণ্ডলে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে এই লোকটাই হিংস্র ডাকাত, ভয়ঙ্কর নর হত্যাকারী। জেবা ফারাহ্ সুদূর মিশরে বসেই বাংলাদেশের এই লেকিটিকে এক নম্বরের শত্রু জ্ঞান করতো। খুনে ডাকাত নেসার আহমেদ এরই ভয়ে কম্পিত। একই মানুষের দুটো চেহারা ভাবতে অবাক লাগে।
চুপচাপ, সিগারেট টানছিল কুয়াশা আর আকাশের দিকে তাকিয়ে তনয় হয়ে গিয়েছিল। দীবা আস্তে আস্তে বলছিল, মুজাদ্দিদ করীমের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে?
হয়েছে। লোকটা অদ্ভুত সুন্দর। আমার লোভ হয়-আমি যদি অমনি সুন্দর হতে পারতাম!
কুয়াশা আর কিছু বলেনি। একবার তাকিয়েছিল দীবার দিকে। তখন আফ্রিকার ভয়ঙ্কর সুন্দর সূর্য পূর্ব আকাশে রক্তিম হয়ে উঠছে। বুনো পাখির দল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে। ডোঙ্গার মাঝি নীল নদে নৌকা ভাসিয়ে দিন আরম্ভ করেছে।
দীবার চোখের সামনে কুয়াশার দীর্ঘ, বলিষ্ঠ মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ খোলা ডেকে বসে দীবা ফিরে গিয়েছিল নিজের কেবিনে। তার শরীর দুর্বল, মন অবসন্ন। পিরামিডের রহস্যময় গোলক ধাঁধায় সে মৃত্যুর চেহারা স্পষ্ট দেখে এসেছে। উপলব্ধি করেছে সে যেন পুনর্জীবন নিয়ে ফিরে এলো। কিন্তু এই জীবন আবার কোন পথে মোড় নিতে যাচ্ছে?
দীবা সারাদিন কেবিনে শুয়ে বসে কাটিয়েছে। একবার শুধু গোগীকে দেখতে গিয়েছিল। গোগী ডেকের নিচে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় ছিলো। গোগীকে দেখে মনে হচ্ছিলো শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ার জন্যে সে খুব অপমানিত বোধ করছে। দীবাকে দেখে তার চোখ মুখ অভিমানে রীতিমত ভারি হয়ে উঠলো। সে একবার মাত্র দীবার দিকে চোখ তুলে তাকালো। ভাবখানা, দেখলে মেম সাহেব, আমাদের সাহেবের কাণ্ড টা? লোহার শিকল দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছেন, যেন আমি ছাড়া থাকলে পালিয়ে যেতাম! আরে, পালিয়ে যাবার ইচ্ছে থাকলে এই গোগীকে কেউ ফেরাতে পারতো? তেমন শক্তি কারো আছে?
দীবা গোগীকে দেখলো। ভয়ঙ্কর দর্শন গরিলা। কিন্তু কুয়াশার সম্মোহনে তার বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। গোগীর ঝুলানো ঠোঁটে আর ঝিমানো চোখে অভিমানের ছায়া দেখে দীবা একটু না হেসে পারলো না। গোগী অমনি সচকিত হয়ে তাকালো। দীবার মনে হলো গোগী যেন বলতে চায়, দোহাই মেম সাহেব, সাহেবকে যেন সব কথা বলো না। আমার কথা ছেড়ে দাও। মুখ্য সুখ্য জীব। কি না কি বলছি ঠিক আছে? তাহলে মেম, সাহেব, বলো না কিন্তু, হ্যাঁ? সাহেব রেগে গেলে আমার সঙ্গে যা মেজাজ দেখান, ভয়ে আমি বাঁচি না। না বাপু, আমি বরং এই রকম আর করবো না।
গোগীকে আদর জানিয়ে দীবা আবার কেবিনে ফিরে এসেছে। বলতে গেলে সারাদিন সে কিছু করেনি। অবচেতন মনে কুয়াশার জন্যে অপেক্ষা করছে। দুপুর তেল, বিকেল গেল, সন্ধ্যাও যায় যায়। কোথায় কুয়াশা?
কুয়াশা ফিরলো গভীর রাতে। ক্লান্ত দীবা তখন জানালার পাশে বসে নির্জন রাত দেখছে। নীল-নদের হাওয়ার শব্দ শুনছে। কুয়াশা হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়ালো। এ সেই কুয়াশা যে সরোদ বাজায়, যে ভোর সকালের উদ্ভাস দেখে তন্ময় হয়ে যায়।
দীবা বললো, এতক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হলো বুঝি?-বলেই বুঝলো কথাটা বেমানান হয়েছে।
কুয়াশা প্রথমটায় বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সপ্রতিভ হলো পরমুহূর্তে। বললো, আমি জানতাম না তুমি রাত জেগে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। নিশ্চয়ই কষ্ট দিয়েছি খুব।
দীবা কথা বললো না। কিন্তু মুজাদ্দিদ করীমের সংবাদ জানার জন্যে ভেতরে ভেতরে উদগ্রীব হয়ে উঠলো।
কুয়াশা বললো, আজ আমার আনন্দের দিন দী। আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে সাহায্য করবো। আমার চেষ্টা সফল হয়েছে। মুজাদ্দিদ করীম কোটিপতি ধনী আল গাফরানের কন্যা নাঈমার সঙ্গে বাগদত্তা ছিলেন। সব কথা বুঝিয়ে বলার পর তিনি আবার তোমাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন। মুজাদ্দিদ করীম এখন জানেন তুমি আর নিঃস্ব দীবা ফারাহ নও। এখন তোমার অনেক অর্থ। অনেক সম্মান ও প্রতিপত্তি। তিনি আনন্দের সঙ্গেই তোমাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন।
দীবা প্ৰথমটায় আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো। পর মুহূর্তে একটা আশঙ্কার খোঁচায় বিমূঢ় হলো। তাকিয়ে রইলো কুয়াশার দিকে। বললো, কিন্তু আমার অর্থ আছে, সম্মান আর প্রতিপত্তি আছে এসব তো মিথ্যে! তুমি মুজাদ্দিদ করীমকে যা সত্য নয় তা দিয়ে ভোলাতে গেলে কেন কুয়াশা?
মিথ্যে আমি বলিনি দীবা। এই নাও ব্যাঙ্কের চেক ও পাবুক। তোমার নামে ব্যাঙ্ক অফ ইজিপ্টে তিরিশ কোটি টাকা জমা হয়েছে। তুমি যাতে পিরামিডের অর্থ অপহরণের দায়ে না পড়ে তার ব্যবস্থাও আমি করে দিয়েছি। টাকাটা আমার হয়ে তোমাকে দিয়েছেন আমার এক মিশরীয় বন্ধু শেখ বোরহান।
দীবার চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। বুকের ভেতর উথলে উঠলো নাম না জানা এক আবেগ। সে বলতে চাইলো, না, না এ টাকা আমি চাই না। মিথ্যে পরিচয়ে আমি সুখী হতে পারবো না। কিন্তু কিছুতেই সে কোন কথা বলতে পারলো না। অপলক নেত্রে সে তাকিয়ে রইলো কুয়াশার দিকে। এতবড় দান কেন করতে গেল কুয়াশা। এতদিনে তার মনে হয় কুয়াশা নিষ্ঠুর কুয়াশা বিপজ্জনক।
কুয়াশা দীবার মনের ভাব টের পেলো না। সে পকেট থেকে একটা খাম বের করলো। বললো, আমাকে তোমার পুরস্কৃত করা উচিত দীবা। আমি মজাদ্দিদ করীমের কাছ থেকে তোমার চিঠি বয়ে নিয়ে এসেছি। এই নাও।
দীবা চিঠি হাতে নিলো। কুয়াশা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। বললো, ভোর রাতে তোমার যাবার ব্যবস্থা ঠিক হয়েছে। সকাল সাতটার ভেতর মুজাদ্দিদ করীম কায়রোর ইম্পিরিয়াল হোটেলে তোমার জন্য অপেক্ষা করবেন। আশা করি তুমি প্রস্তুত।
মাথা নাড়লো দীবা। বললো, হ্যাঁ আমি তৈরি।
কুয়াশা এরপর কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
খামটা নিয়ে অনেক্ষণ দীবা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। খোলা বাতাসে তার মাথার চুল কাঁপছিল। অন্ধকার ও আলোর ছায়া কাঁপছিল চোখে মুখে। তার মনে পড়ছিল মুজাদ্দিদ করীমের সুন্দর মুখচ্ছবি। প্রথম যৌবন থেকে এই সুন্দর মুখচ্ছবি দীবার জীবনের স্বপ্ন। জেবা-ফারাহ যদি রাজকুমারী আয়িদার নক্সা চুরি না করতো তাহলে তার বাবা আত্মহত্যা করতেন না। তাদের জমিদারী ও প্রাসাদ বাজেয়াপ্ত হতো না। হয়তো এতদিন মুজাদ্দিদ করীমের সঙ্গে তার সম্পর্ক মিলনের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছতো। সেই স্বপ্ন এতকাল ছিলো দুঃস্বপ্ন। এতকাল বিরহের আগুনে দীবা দগ্ধ হয়েছে। জীবনে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে গিয়েছিল। এসবই ছিলো মুজাদ্দিদ করীমের জন্য। সুন্দর স্বপ্নের মতো সেই মুজাদ্দিদ আবার ফিরে এসেছে দীবার জীবনে। দীবার চেয়ে সুখী আর ভাগ্যবতী কে আছে?
দীবা খামটা খুললো। পরিচিত সুন্দর হস্তাক্ষরে মিশরীয় ভাষায় মুজাদ্দিদ করীম লিখেছেঃ
প্রিয়তমা,
নানা কারণে তোমার কাছ থেকে আমি দূরে সরে গিয়েছিলাম। আমাকে ভুল বুঝো না লক্ষ্মী মেয়ে। বিশ্বাস করো তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে বিরহের দাবানলে দগ্ধ হয়েছি। এখন আমাদের মিলনের আর কোনো বাধা নেই। আমি সাগ্রহে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। তোমার অভিভাবক শ্রেণীর বাংলাদেশী ভদ্রলোকটি আগামীকল্য আমাদের বিবাহ উৎসবের আয়োজন করেছেন। ইম্পিরিয়াল হোটেলে বাঙালী ভদ্রলোকটির হয়ে তোমাকে আমার কাছে সম্প্রদান করবেন কায়রোর বিখ্যাত ধনপতি শেখ বোরহান সাহেব। শেখ বোরহানের সঙ্গে এ ব্যাপারে সব কথা আলোচিত হয়েছে। আমরা দুজনেই শেষ পর্যন্ত সুখী হতে যাচ্ছি, আল্লাহর কাছে হাজারো শোকর। দুঃখের বিষয় বাঙালী ভদ্রলোকটি আমাদের বিয়েতে নাকি থাকবেন না। যা-ই হোক ব্যবস্থা অনুযায়ী তুমি নিশ্চয়ই আগামীকল্য সকাল সাতটার আগে ইম্পিরিয়াল হোটেলে এসে পৌঁছবে। শেখ বোরহান-এর স্ত্রী কন্যাগণ সামাজিক উৎসবে যা যা করণীয় তা করার জন্যে এবং তোমাকে গ্রহণ করার জন্যে আমার সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থাকবেন।
আমার গভীর ভালবাসা জেনো।
ইতি–
তোমারই একান্তভাবে
মুজাদ্দিদ করীম।
দীবা কেবিনের জানালার পাশে বসে রইলো। ঘটনাচক্রে সে একজন অদ্ভুত স্বভাবের লোকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। কাল থেকে সেই লোকটির সঙ্গে তার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে ভাবলো তার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে কুয়াশা নিশ্চয়ই খুশি। হ্যাঁ, খুশি হবারই কথা। দীবা কুয়াশার জীবনে এসেছিল কর্তব্যের বোঝা হয়ে। ঘটনাচক্রের দায় হয়ে। কাল থেকে কুয়াশা কর্তব্য ও দায় থেকে মুক্ত। এবারে সে নিশ্চিন্তে নেমে যাবে তার কাজে। পিরামিডের অতল রহস্যের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কুয়াশার বুকে জ্বলবে হত্যাকারীর জিঘাংসা। হাতের মুঠোয় থাকবে নিষ্ঠুর আক্রমণ। আর দুচোখ মেলে দেখবে সে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান সাধনার স্বপ্ন।
আশ্চর্য, দীবা ভাবলো। লোকটা কি অদ্ভুত। গুপ্তধনের লোভে সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসেছে রহস্য নগরী কায়রোতে। কিন্তু কুয়াশার লোভ কি শুধু ধন-রত্নেই? শুধু মণি-মানিক? একটি সুন্দরী নারীর সান্নিধ্য কি তাকে এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি? প্রেম, ভালবাসার কণামাত্র অনুভূতি হৃদয়ে জাগিয়ে দিতে পারেনি?
সম্ভবতঃ পারেনি। দীবার চোখ ভুল করে না। কুয়াশাকে সে চিনেছে। কুয়াশা সেই প্রকৃতির পুরুষ, যার ভালবাসা গভীর সমুদ্রের মতো। যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নির্জন, শান্ত। যখন জেগে ওঠে তখন প্রলয়ের মতো ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় ভয়ঙ্কর। যুগে যুগে নারীদের কাছে এই ভালবাসাই আকাঙিক্ষত হয়ে এসেছে। কিন্তু দীর দুর্ভাগ্য যে সে কুয়াশার সাগর মনে এতটুকু দোলা জাগাতে পারলো না।
টপ টপ করে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দীবার চোখ থেকে। দীবা সচকিত হলো। চোখ মুছে হাসলো। আশ্চর্য, সে কি তবে এতদিন কুয়াশার ভালবাসার জন্য উন্মুখ ছিলো? কারো জন্যে বেদনার অনুভব, কাউকে জীবন দিয়ে সুখী করার অন্তর, সুখ ও আনন্দ বিসর্জন দিয়ে কাউকে চাওয়ার নামই কি ভালবাসা? আশ্চর্য! দীবা ভাবলো। এতদিন এই বেদনা, এই সুখ, এই মর্মমথিত দীর্ঘশ্বাস কোথায় ছিলো।
দীবা নিঃশব্দে বাইরে এলো। আকাশে অসংখ্য তারা। বাতাস বইছে। ঘুমন্ত পৃথিবী।
হঠাৎ রাতের নির্জনতা ভরে উঠলো সরোদের কান্নায়। কুয়াশা সরোদ বাজাচ্ছে। দীবা সঙ্গীতের ধর্ম বোঝে না। কিন্তু সরোদের বাজনা শুনে তার মনে হলো যে কথা বলার উপায় নেই, যে কথা কথা দিয়ে প্রকাশ করা যায় তা সঙ্গীতের ভাষা।
তার ইচ্ছে করলো কুয়াশার কাছে গিয়ে বসে। বসে কুয়াশার তন্ময়, সুন্দর চোখ দুটি দেখে। কিন্তু ইচ্ছে সে দমন করলো। সম্পর্কের সূত্র বাড়িয়ে লাভ নেই। রাত পোহালেই দাবা চলে যাবে বহুদুরে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে একটি নতুন জীবন।
সে ভাবলো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেবে। ঘুমোবার জন্য সে ঘরে গেল। বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে ঘুমোতে চেষ্টা করলো কিন্তু ঘুম এলো না। রাত ভরে গেছে সরোদের কান্নায়। সময় এগিয়ে আসছে বিদায় নেবার। সে আবার বাইরে এলো। দাঁড়িয়ে রইলো কেবিনের রেলিং ধরে।
একটা একটা করে আকাশের তারাগুলো নিভে আসছে! একটু একটু করে হাওয়ার বেগ বাড়ছে। দূরের মরুভূমি, পাহাড় আর কায়রো নগরীর আলোকোজ্জ্বল দিগন্ত হারিয়ে যাওয়া কোনো অতীতের মত লাগছে। দীবা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষের মন কি নির্দয় প্রতারক। এতকাল যার জন্যে দীবাস্বপ্ন দেখলো, কতক্ষণ আগেও কি দীবা জানতো সে একটা অর্থলোভী সুযোগ সন্ধানী বই কিছু না? অর্থের লিপ্সায় দীবার সঙ্গে সে বাগদত্তা হয়েছিল অর্থই তাকে আবার তার কাছে ফিরিয়ে এনেছে। না, দীবা নিজের প্রায়শ্চিত্ত নিজে করতে তীতা নয়। সে মুজাদ্দিদ করীমের কাছেই ফিরে যাবে। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে সারা জীবন দিয়ে। এছাড়া করার তার আর কি রইলো?
ধীরে ধীরে রাত্রি প্রভাত হলো। কখন যেন কুয়াশার, সরোদ থেমে গেছে। দীব কেবিনে গিয়ে প্রস্তুত হয়ে ফিরে এলো। চারদিকে আবছা, কোমল আলো। ঝির ঝির ঠাণ্ডা বাতাস। নদীর বুকে ঢেউ উঠেছে। ঢেউয়ের মাথায় চকিত শুভ্রতা। দীবা আকাশের দিকে তাকালো। একটি মাত্র তারা এখন আকাশে জ্বলছে। শুকতারা। কিছুক্ষণ বাদে এই তারাটিও দিনের প্রথম তাপে নিভে যাবে। হাতঘড়ি দেখলো সে। সাতটার দেরি কতো?
কুয়াশা বেরিয়ে এলো নিজের কেবিন থেকে। ছোট একটা হ্যান্ড ব্যাগ সে তুলে দিলো দীবার হাতে। বললো, এতে প্রয়োজনীয় সব কিছু ভরে দিলাম।
দীবা বললো, যাই এখন।
কুয়াশা বললো, ঐ বাঁকটা ঘরই দেখবে তোমার জন্য আমার গাড়ি অপেক্ষা করছে। তোমাকে কিছু করতে হবে না। ডাইভারকে সব নির্দেশ দেয়া আছে। সে তোমাকে সোজা ইম্পিরিয়াল হোটেলে নিয়ে যাবে।
দীবা বললো, চলি।
কুয়াশা বললো, এসো।
দীবার হাতে হ্যাণ্ড ব্যাগ। পরনে কুয়াশার উপহার দেয়া অত্যন্ত মূল্যবান পরিচ্ছদ। অল্প দোমটা উঠেছে মাথার ওড়নার। ফর্সা মুখে একটা ক্লান্ত অরুণাভা ফুটেছে। দীবাকে বিষণ্ণ অথচ সুন্দর দেখাচ্ছে।
দীবা আস্তে আস্তে চলে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো কুয়াশা। যতক্ষণ দীবাকে দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। আশ্চর্য, দীবা একবারও পেছন ফিরলো না। নদীর তীর ধরে নতমুখে হেঁটে চলেছে। কিছুক্ষণ পর সে অদৃশ্য হয়ে গেল। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে কুয়াশা আবার নিজের কেবিনে এলো। গতকাল থেকে কেন যেন একটা শুন্যতা অনুভব করছিল সে। মহুয়ার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় যেমন লেগেছিল মেনি। যাক, তাহলে দীবাও গেল। কুয়াশা এখন মুক্ত। কর্তব্য থেকে মুক্ত, দায় থেকে মুক্ত।
কুয়াশা সিগারেট ধরালো। অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। সত্যি কি মুক্ত? বুকের ভিতর ফাঁকা শূন্যতাটুকু তবে কি?
এই প্রশ্নের উত্তর কুয়াশা জানে না। জানার চেষ্টাও সে করলো না। কিন্তু কেন। জানি নিজের অজান্তেই দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ এক সময় চোখ তুলে তাকিয়ে সে দারুণ অবাক হয়ে গেল। বললো, তুমি?
হ্যাণ্ড ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দীবা কান্নায় দুই হাতে মুখ ঢাকলো। বললো, আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না। কিছুতেই যাবো না। আমি ফিরে এসেছি।
কুয়াশার চোখ দুটি সুন্দর এক নতুন পৃথিবী দেখলে।
.
১০.
তখন রাত দশটা! কায়রোর একটা নিষিদ্ধ অঞ্চলে লোক চলাচল শুরু হয়েছে। একজন দীর্ঘকায় মিশরী এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে জনৈকা রূপ জীবনীর দরজায় করাঘাত করলো। অনেকক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দিলো এক বিগত যৌবনা রমণী। কর্কশ কণ্ঠে বললো। কি চাই?
লোকটি হো হো করে হাসলো। বললো, যা সবাই চায়। তোমার ঘরে আসতে চাই।
এখন হবে না। ঘরে লোক আছে। বলে রমণী লোকটি মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজা বন্ধ করে সে অনেকক্ষণ এক ঠায়ে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটা কেমন। যেন চেনা চেনা লাগছে না? ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠলো। সে তার সহচরীকে ডেকে কানে কানে কি বললো। সহচরী মাথা নেড়ে বললো, আমি পারবো না বাপ। পারো তো তুমি গিয়ে বলো।
আহা, না পারলে চলবে কেন? যদি তোর মানুষের বিপদ হয়, তখন?
সহচরী কতক্ষণ কি ভাবলো। আস্তে আস্তে সে পা বাড়ালো ভেতরের দিকে। ভেতরের একটা ঘরে শুয়ে আছে আবদুল্লাহ হারুণ, তার প্রেমিক। আবদুল্লাহ হারুণ ভয়ানক মেজাজী মানুষ। মিশর সরকারের অধীনে সে কি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। কাজের সূত্রেই আবদুল্লাহর সঙ্গে তার পরিচয়। সেই পরিচয় প্রেমে পৌঁছেছে। কিন্তু পরিচয় যত গভীরই হোক, আবদুল্লাহ হারুণ তার কাছে প্রথম পরিচয়ের মতোই রহস্যময় থেকে গেছে। নিজের সত্যিকার পরিচয় সে কিছুতেই খুলে বলে না। প্রায়ই সে বলে তার পিছনে আততায়ী ঘুরছে! সাধারণতঃ এই রকম দুঃসময়ে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেবার জন্য তার ঘরে সে আশ্রয় নেয়। আজও হয়তো বাইরের বিপদ থেকে গা বাঁচাবার জন্যই এখানে সে এসেছে।
সহচরী, নাম কুলসুম, আবদুল্লাহ হারুণের ঘরে ঢুকলো। তাকে সাবধান করে দেয়া দরকার। কিন্তু ঘরে ঢুকেই সে বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। কোথায় আবদুল্লাহ হারুণ? পেছনের জানালা ভাঙা। বিছানা তছনছ।
কুলসুম ভয়ে চিৎকার করে উঠলো।
.
আবদুল্লাহ হারুণও তখন চিৎকার করছিল। ভয়ে নয় উত্তেজনায়। তার হাত পা বাঁধা। সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেসার আহমেদ ও কোরবান আলী। কোরবান আলীর হাতে একটা চাবুক।
আবদুল্লাহ হারুণ বলছিল, তোমরা যাই করো, শয়তান; ভেবো না আমাদের হাত থেকে তোমাদের নিস্তার আছে।
কোরবান আলী চাবুকটা বাগিয়ে ধরে সক্রোধে বললো, চুপ বেতমিজ
শান্ত গলায় নেসার আহমেদ বললো, ওকে বলতে দাও কোরবান। ও হলো বেশ্যার দালাল, আর সেই সঙ্গে মিশর সরকারের টিকটিকি। ও যা বলতে চায় বলতে দাও…
আবদুল্লাহ হারুণ বললো, তোমাদের সব আড্ডার হদিশ আমরা জেনেছি নেসার। আমাকে বন্দী করেছে, কিন্তু জেনে রেখো তোমাদের দিনও ফুরিয়েছে।
নেসার আহমেদ কোরবানের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি যা যা বলেছিলাম সব তৈরি আছে কোরবান?
জ্বি হুজুর।
কজন লোক সাথে নিচ্ছো?
দশজন।
অস্ত্রশস্ত্র?
সব ঠিক আছে হুজুর।
প্লেন?
তা-ও তৈরি।
অলরাইট।
নেসার খুশি হয়ে কোরবানের পিঠ চাপড়ে দিলো। বললো আমরা আবদুল্লাহ হারুণের বিচারটা শেষ করেই গুহায় নেমে যাবো। সব কাজ আজ রাতের ভেতরে সেরে পরশুর মধ্যেই দেশে ফিরে যাবো।
আবদুল্লাহ হারুণ উর্দু কথা বুঝছিল না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। এবারে তার দিকে মনযোগ দিলো নেসার। শান্ত গলায় ইংরেজিতে বললো, আবদুল্লাহ হারুণ, তুমি আমার দারুণ ক্ষতি করেছে। তুমি আমার হাতে নাফিসা আইভরি ওরফে চম্পাকে বিক্রয় করেছিলে পীসার জন্য। আমি জানতাম না তোমরা দুজনেই ঘৃণ্য কুকুরের দলের। নাফিসা আইভরির রূপ যৌবন দেখে আমি উন্মাদ হয়েছিলাম। তার মাশুল আমাকে শোধ করতে হয়েছে অনেক মূল্য দিয়ে। প্রথমতঃ আমার অতি বিশ্বস্ত প্রহরী আদিল শেখকে হারিয়েছি। দ্বিতীয়তঃ সেই শয়তান টিকটিকি সিম্পসনকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারলাম না। আবদুল্লাহ, স্বীকার করি তুমি বুদ্ধিমান…আমার দুর্বলতার সুযোগ তুমি ঠিক মতোই নিয়েছিলে।
আবদুল্লাহ হারুণ বললো, আরো কিছু মূল্য তোমাকে দিতে হবে নেসার। ঠিক জেনো, তোমাকে এবং তোমার দলবলকে আমাদের হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
নেসার আহমেদ হাসলো। কোমরের খাপ থেকে তীক্ষ্ণ একফলা একটা ছোরা বের করে আবদুল্লাহ হারুণের মুখোমুখি হলো। প্রথমে ছোরার খোঁচায় আবদুল্লাহর ডান চোখটা উপড়ে ফেললো নেসার। তীব্র গগন ভেদী আর্তনাদে ঘরটা ভরে উঠলো। নেসার হাসলো শুধু। কাছে গিয়ে বাম হাতটা কেটে নামিয়ে দিলো। ছুরির রক্তটুকু আবদুল্লাহর পরনের জামায় মুছতে মুছতে নেসার বললো, আশা করি, এতে তোমার রাগ কিছু কমবে। চিন্তা করো না। তোমাকে অতো সহজে মারা হবে না। কোরবান।
জ্বি
ওর কাটা চোখ আর হাতে লবণ মাখিয়ে দিতে বলো। রাত্রিবেলা এসে অন্য ব্যবস্থা করবো।
আবুদল্লাহ হারুণ তীব্র ব্যথায় গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো। নেসার শুধু হাসলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পিরামিডের দিকে।
রাত নিঝুম হয়ে এসেছে। কয়েকজন নিশাচর নিঃশব্দে পিরামিডের গুপ্ত গুহার পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। দলের সম্মুখ ভাগে আছে নেসার আহমেদ ও কোরবান আলী। নেসার আহমেদ স্থির ও গম্ভীর। কোরবান আলীর একটা মাত্র চোখ হিংস্র নেকড়ের চোখের মতো জ্বলছে। দলের সম্মুখ ভাগে দুজন মশালধারী প্রহরী পথ দেখিয়ে চলেছে। চারদিকে থম থম করছে ভৌতিক নির্জনতা। বহুদুরে এসে একটা প্রাচীরের সামনে নেসার আহমেদ হঠাৎ দাঁড়ালো। কোরবান আলীর ইঙ্গিতে অন্যান্যরাও দাঁড়িয়ে পড়লো।
তোমাদের কাছে এই পথ অচেনা নয়…
নেসার আহমেদ গম্ভীর গলায় বলতে লাগলো, বহুবার তোমরা আমার সঙ্গে এই পথে আসা যাওয়া করেছে। কিন্তু সবচেয়ে দুর্গম যে পথটি আছে, সে পথে তোমরা কেউ কখনো যাওনি। সে পথে কি ভাবে যেতে হবে তার সব নির্দেশ কোরবান আলীর কাছ থেকে তোমরা পাবে। আমি এখানে তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো আমি সর্বদাই ছায়ার মতো তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবো।
নেসার আহমেদ হেসে উঠলো, সাবধান, কেউ আমাকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করো।। ঈমান নিয়ে কাজ করো। কাজ শেষ হলে তোমাদের সকলকে বহুত ইনাম দেয়া হবে।
দলের লোকজন সসম্ভ্রমে সর্দারের সম্মুখে মাথা নোয়ালো। নেসার আহমেদ ইঙ্গিতে কোরবান আলীকে কাছে আসতে বললো।
কোরবান আলী কাছে এলে চাপা গলায় বললো, আমি যা যা বলেছি, সব মনে আছে?
আছে হুজুর।
শোনো, আর একবার কথাগুলো বলছি। পিরামিড থেকে মাল বোঝাই গাড়িগুলো সোজা পাঠিয়ে দেবে পাঁচ নম্বর আড্ডায়। মাল পাঠাতে যতক্ষণ লাগে ততক্ষণে তোমার কাজ হবে গর্দভগুলোর সাথে মোটামুটি তাল মিলিয়ে চলা। কাজ হয়ে গেলে… বুঝেছো?
বেশক…
কোরবান আলী হাসলো, কাজ হয়ে গেলেই সব শেষ করে দেবো।
হ্যাঁ। মনে রেখো মনি-মাণিকের লোভ প্রচণ্ড লোভ। বুদ্ধিমান কখনো পেছনে শত্রু রেখে যায় না।
বুঝেছি হুজুর
নেসার আহমেদ বললো, তুমি গুহা মুখের কাছে থাকবে। আমি ভেতরে ঢুকবো। আমি নিজের হাতে মাল খালাস করতে চাই। অল-রাইট?
জি হুজুর।
কোরবান আলী মাথা নোয়ালো। নেসার আহমেদ এক মুহূর্ত স্থির তীক্ষ্ণ চোখে দশজন লোকের দলটাকে পরখ করলো। তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো ভয়ানক এক ধূর্ত হাসি। কোরবান আলীর দিকে এবারে ফিরে তাকিয়ে বললো, আমি চললাম কোরবান। সঙ্কেতমত কাজ করো।
মশালের রক্তিম আলোয় গুহার ভেতরটা লাল লাল ছায়ায় ভরে উঠেছে। নেসার আহমেদ সেই ছায়া পার হয়ে অন্ধকারে ডুব দিলো। তার পদধ্বনি মিলিয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই।
.
জানো, আমার হাসি পাচ্ছে, দীবা বলছিল।
কুয়াশাও হাসলো। বললো, অভিনয় অভিনয়ই। এতে হাসির কিছু নেই দীবা। দীবা বললো, হাসি পাচ্ছে অন্য কারণে। আজ আমার বাসররাত ছিলো।
কুয়াশা বললো, বাসর ঘর তো সঙ্গেই আছে। বলো তো শ্রীমান গোগীকে নৃত্য করতে আদেশ দিই। বাসর শয্যার আগে একটু আমোদ উৎসব হোক।
সবতাতেই তোমার ঠাট্টা…
দীবাও হাসলো। বললো, গোগীকে বললে মন্দ হয় না। কাপড় চোপড় পরাই আছে। এখন শুধু আদেশের অপেক্ষা।
গোগী কিভাবে যেন টের পেয়েছে তার সম্পর্কে কথাবার্তা হচ্ছে। সে খুব গম্ভীর চালে সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখ জোড়া পিট পিট করতে লাগলো।
কুয়াশা সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। আলোচনার প্রসঙ্গ তার মনঃপুত হচ্ছিলো না। সে নিঃশব্দে অন্ধকার গুহা ছেড়ে দেয়ালের সন্নিকটে এসে দাঁড়ালো। চারদিকে পিরামিডের সঞ্চিত হাজার হাজার বছরের নির্জন স্তব্ধতা। এই অন্ধকার গুহায় আজ সংঘটিত হতে যাচ্ছে তার জীবনের সবচাইতে ভয়ঙ্কর নাটক। সে ভাবলো যদি হেরে যায়? তার চোখ মুখ উত্তেজনায় রক্তিম হয়ে উঠলো। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠলো। নির্নিমেষ চোখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কুয়াশা অপেক্ষা করতে লাগলো।
কুয়াশা ঠিকই বলেছিল। পিরামিডের নিচে আজ জেন ভয়ঙ্কর এক নাটক অভিনীত হতে চলেছে। শয়ন-মন্দিরের মমিগুলো যখন নিশ্চল প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছে অন্ধকারচারী প্রেতাত্মাদের জন্য, তখন পিরামিডের তৃতীয় গুহাপথে ঢুকলো নতুন আর একদল নিশাচর। তারা সকলেই সশস্ত্র। দলের নেতা সহকারীকে বললো, ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাইর ব্যবস্থা ঠিক মতোই আছে তো মি. শরীফ?
আছে। আপনি আদেশ দেয়া মাত্র পিরামিডের অন্ধকার, গুহা আলোময় হয়ে উঠবে।
দলের নেতা হাসলো। বললো, আজ আমার হাতে কারো নিস্তার নেই। আজ আমি পরাজয় আর অপমানের প্রতিশোধ নেবোই।
মি. শরীফ বললো, আপনি স্যার কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা সকলেই যে কোনো এনকাউন্টারের জন্য প্রস্তুত। বাইরে আমাদের জন্য একটা পুরো ব্যাটেলিয়ান রিজার্ভ রয়েছে।
ফিস ফিস করে দলের নেতা বললো, আমি সবচেয়ে কাকে ভয় করি জানেন মিঃ শরীফ?
কাকে স্যার?
দলের নেতা একটু হাসলো। বললো, ভয়, শ্রদ্ধা দুই-ই করি। তার নাম কুয়াশা।
কুয়াশা?
মিঃ শরীফ বিস্ময়ে বিমূঢ় হলেন, আপনি স্যার কুখ্যাত বাঙালী দস্যু কুয়াশার কথা বলছেন?
অবিকল তাই। কুয়াশা কখনো হারেনি। তার হাতে বার বার আমিই পরাজিত হয়েছি। কিন্তু আজ কুয়াশা, নেসার কারো নিস্তার নেই।
দলের নেতা হুকুম দেয়।
হঠাৎ কি একটা শব্দে সকলে চমকে উঠে। দলের নেতা দীর্ঘকায় লোকটিও প্রথমে থমকে যায়। তার হাত চকিতে গিয়ে স্থির হয় কোমরের রিভলভারের বটে। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে তার দেরি লাগলো না। এ একটা আকস্মিক ঘটনা মাত্র। শত্রু পক্ষের আক্রমণ নয়, আসলে পিরামিডের পুরনো দেয়ালের একটা পাথর কালের অবক্ষয়ে ধসে পড়েছে।
দলের নেতা হাসলো।
নেসার আহমেদও হাসছিল। প্রচণ্ড অট্টহাসি। সে দাঁড়িয়ে ছিলো রাজু অ্যামন হোটাপের মর্মর মূর্তির সামনে। রাজা অ্যামন হোটাপ নিষ্ঠুর হাসি হাসছেন। সেই হাসিকে ব্যঙ্গ করে নেসার আহমেদ অট্টহাস্য করে উঠলো। বললো, দোস্ত, আমি কিছু একটা রাজা বাদশা নই। কিন্তু তোমার চেয়ে আমি অনেক শক্তিশালী। ঘন্টা দুই অপেক্ষা করো। তোমার মহামূল্যবান রাজ পোশাক আর চোখের মণি জোড়া নিয়ে তোমাকে সুখী করবো!
হঠাৎ অলৌকিক বিস্ময়ের মতো সেই আচ্ছন্ন আলোময় স্থানে মৃদু টুং টাং ঘন্টা ধ্বনি শোনা গেল। সেই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের ফিস ফিস কথাবার্তা ও গুঞ্জন। নেসার আহমেদ চমকে ফিরে তাকালো। সতর্ক হয়ে কান পাতলো। শব্দটা ক্রমেই স্পষ্টর হচ্ছে। এ যেন রাজা আমন হোটাপ সপরিষদ দরবারে প্রবেশ করছেন। নেসার আহমেদ সভয়ে ফিরে তাকালো রাজা আমন হোটাপের মর্মর মূর্তির দিকে। দেখলো রাজা অ্যামিন হোটাপ নিঃশব্দে হাসছেন। হঠাৎ দারুণ এসে ছুটতে আরম্ভ করলো নেসার আহমেদ। রাজা অ্যামন হোটাপের শয়ন মন্দির পার হয়ে যেমনি গুহা মুখের উপর উঠতে গেল অমনি নারী কণ্ঠের উন্মাদ খিল খিল হাসি শোনা গেল। সভয়ে পেছন ফিরে তাকালো নেসার। দেখলো নর্তকী জেবা ফারাহ্ দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। খিল খিল করে হাসছে। জেবা ফারাহ জেবা ফারাহ্ এখানে কেন? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না নেসার। জেবা ফারাহকে সে নিজের হাতে গলা টিপে খুন করেছে। একি তবে জেবা ফারাহর প্রেতাত্মা…
নেসার স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো জেবা ফারাহর দিকে। জেবা ফারাহ্ হাসতে হাসতে বললো, নেসার আহমেদ এখন জেবা ফারাহর হাত থেকে তোমাকে কে, বাঁচায়?
নেসার আহমেদ ভয়ে উত্তেজনায় পিস্তল বের করলো। উন্মাদের মতো গুলি করলো জেবা ফারাহ্র মূর্তির দিকে। আশ্চর্য। ভোজবাজির মতো সেই মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গোল। সারা গুহাময় শুধু কাঁপতে লাগলো জেবা ফারাহয় ভৌতিক হাসি।
নেসার আহমেদ গুহা মুখের পাথর ধরলো। আবার সেই নিঝুম ঘন্টাধ্বনি। হাজার হাজার মানুষের পদচারণার শব্দ, ফিস ফিস গুঞ্জনের স্বর। শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
নেসার আহমেদ আর কালবিলম্ব না করে পালাতে চাইলো। পিরামিডের প্রেতাত্মারা যেন ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে। মৃত রাজা অ্যামন হেটাপের নির্দেশে প্রতিটি পাথর যেন জিঘাংসায় হিংস্র হয়ে উঠেছে। আর দেরি নয়। অনতিবিলম্বে এই স্থান ত্যাগ করতে হবে।
হঠাৎ কি একটা প্রচণ্ড আর্তনাদ শোনা গেল। কোনো মানুষের গলায় এই আর্তনাদ সম্ভব নয়। নেসার সভয়ে পেছনে ফিরলো। দেখলো একটা কফিনের ডালা খুলে গেছে। আর তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে বিপুলকায় এক মমি কোনো যাদুমন্ত্র বলে প্রাণ ফিরে পেয়ে। মাটিতে যেন পা চেড়ে গেল নেসারের। এও কি সম্ভব?
বিপুলকায় মমিটা এবারে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মমিটার আপাদমস্তক সাদা কাপড়ের ব্যাণ্ডে জে জড়ানো। হাত দুটি আক্রমণের ভঙ্গিতে সামনে বাড়ানো। বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল নেসারের-ভয়ে কণ্ঠতালু গেল শুকিয়ে। হঠাৎ পাগলের মতো পর পর দুটো গুলি করলো সে মমিটা লক্ষ্য করে। কয়েক মুহূর্তে যেন পাথর হয়ে গেল মমিটা। পরে প্রচণ্ড, গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো। দারুণ ক্রোধে থপ থপ পা ফেলে এগোতে লাগলো নেসারের দিকে; নেসার ততক্ষণে পাথর ধরে ফেলেছে। প্রাণপণ চেষ্টায় সে উপরে উঠে গেল। তারপর সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারে ছুটতে লাগলো। এক লাফে পাথর টপকে তার পেছনে পেছনে অন্ধের মতো ছুটলো মমিটা। যেন পিরামিডের ক্ষুধার্ত প্রেতাত্মা আজ কিছুতেই নেসারকে ক্ষমা করবে না।
কোনও ক্ষমা নেই নেসারের।
.
দীবা নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। কুয়াশা নেমে গেছে সুড়ঙ্গ পথে। পিরামিডের সঞ্চিত অর্থ আজ তার আয়ত্তে। অদ্ভুত ক্ষমতাশালী এই কুয়াশা। দীবা আর গোগীকে দিয়ে ভয় দেখিয়ে হটিয়ে দিয়েছে নেসার আহমেদকে। আর সেই সুযোগে গোগীর পিঠে করে সমস্ত গুপ্তধন নতুন আবিষ্কৃত এক সুড়ঙ্গ পথে লঞ্চে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। নেসারের গুলিতে গোগীর একটা পা ভয়ানক যখম হয়েছে। দরদর করে রক্ত পড়ছিল জখম থেকে-কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে কুয়াশার সব আদেশ পালন করছে গোগী। পিরামিডের অজস্র ধন-রত্ন, হীরা-মুক্তা, মাণিক্য সাত রাজার ধন এখন কুয়াশার হস্তগত। নেসার আহমেদের মুখের গ্রাস অপরূপ উপায়ে কেড়ে নিয়েছে। কুয়াশা। আশ্চর্য এই লোকটি। দীবা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ভাবলো। পরনে তার নর্তকী জেবা ফারাহর পোশাক। কিন্তু এই পোশাক তার সত্যিকার পরিচয় বহন করে না। দীবার মনে জেবা ফারাহর কোনো দুর্বলতা নেই। দীবার মনে আছে পিরামিডের রহস্যের চেয়ে রহস্যময় ভালবাসা। এই ভালবাসার আবেগ অস্থির হয়ে উঠছে দীবার মনে। কুয়াশার জন্য অপেক্ষা করছে সে। কাল ভোরেই মিশর ত্যাগ করবে তারা। বাংলাদেশে ফিরে যাবে। বাংলাদেশটা নাকি সুন্দর। কতো সুন্দর? কুয়াশার চোখের মতো সুন্দর?
কুয়াশা! আশ্চর্য লোকটি! দীবা উন্মুখ হয়ে আছে তার একটি ডাকের জন্য, একটু আদরের জন্য, প্রীতিময় স্পর্শের জন্য। কুয়াশা নির্লিপ্ত। কোনো সাধারণ দুর্বলতা তার নেই। সে অপেক্ষা করছে বিপদমুক্ত দিনের জন্য।
পিরামিডের অন্ধকার কবরে দাঁড়িয়ে দীবা ভাবলো বিপদমুক্ত দিন কি সত্যি তার জীবনে আসবে?
পদশব্দে সে চমকে ফিরে তাকালো। কুয়াশা। দীবা হেসে উঠলো। দৌড়ে কাছে গেল। কুয়াশার একটা হাত তুলে নিলো নিজের হাতে। আঙুল উঁচিয়ে চুপ করবার ইঙ্গিত করলো দীবাকে কুয়াশা। কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললো, চুপ, কথা বলো না। আমার সব কাজ শেষ। এবার ফিরে যাওয়ার পালা। চলো…
কিন্তু গোগী?
কুয়াশা চারদিকে তাকালো। গোগী নেই। বললো, ভয়ানক জখম হয়েছে বেচারা-বোধহয় কোথাও বিশ্রাম নিচ্ছে। চল, এগোই। সতর্ক হয়ে ওরা রাজা আকতানুনের শয়ন মন্দির থেকে বাইরে এলো। দুপাশে সঙ্কীর্ণ খড়ি দেয়াল। দেয়ালের কোণে কোণে খাপ পেতে আছে শত্রু। ম্যান-ট্র্যাপের ভয়। কুয়াশা সাবধানে টর্চটা ব্যবহার করলো। সপ্তম প্রাচীর পর্যন্ত বিনা বাধায়ই এলো। যষ্ঠ প্রাচীরে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা। চকিতে দীবাকে ঠেলে নিয়ে এক পাশে সরে গেল। একটা অট্টহাসি শোনা গেল কাছেই। দেখতে পেয়েছে ওদেরকে নেসার। কুয়াশা অস্থির হয়ে উঠলো। প্রতিহিংসার আগুনে তার চোখ জ্বলছিল। সে নিঃশব্দে দীবাকে কাছে। টানলো। ম মুহূর্ত যদি আর না আসে। পর মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়লো অন্ধকারে।
অন্ধকারে দুটি দুধর্ষ শক্তিশালী মানুষের হিংস্র যুদ্ধ তুমুল হয়ে উঠলো। প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নয়, নেসার আহমেদ। সে অট্টহাস্য করছিল। বলছিল, আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল যে এসব ভৌতিক কাজ আর কারো নয়, কুয়াশার। আজ তোকে হাতে পেয়েছি কুয়াশা। তোর বুকের রক্ত শুষে খাবো আমি। আমার হাতে তোর নিস্তার নেই আজ।
প্রত্যুত্তরে কুয়াশার হিংস্র গর্জন শোনা গেল।
দীবা স্থির, অচল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভেসে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো কুয়াশা। তার সারা শরীর রক্তে প্লবিত। বললো, নেসার পালিয়েছে দীবা। তুমি এই পথে সোজা লঞ্চে চলে যাও, আমি আসছি।
হঠাৎ সারা পিরামিড যাদু-মন্ত্রের মতো আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। আর সেই আলোয় পালিয়ে বেড়াতে থাকলো গুপ্তধন লোভী নিশাচরের দল। চারদিকে গুলি গোলার আওয়াজ আর ধোঁয়ার ঝাপ্টা।
পাগলের মতো কুয়াশা খুঁজছে নেসারকে। মাথায় খুন চেপে গেছে তার। অলিন্দ দিয়ে ছুটলো সে নেসারের পিছু পিছু। হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই কুয়াশা দেখতে পেলো নেসারের পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে গোগী। সে-ও বুঝি খুঁজে ফিরছিল নেসারকে।
এক-পা এক-পা করে পিছিয়ে আসছিল নেসার আহমেদ। আর খোঁড়াতে খোঁড়াতে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে এগিয়ে আসছিল সেই ভয়ঙ্কর গরিলা হিংস্র গর্জন করতে করতে। সারা অঙ্গে তার ব্যাণ্ডে জ জড়ানো মমির ছদ্মবেশ। বাঁ পায়ের উরুর কাছে ব্যাণ্ডেজ লাল হয়ে ভিজে গেছে রক্তে। বীভৎস দেখাচ্ছিল ওকে।
হঠাৎ শোল্ডার হোলস্টার থেকে টান দিয়ে পিস্তলটা বের করলো নেসার। উদ্যত ছুরি হাতে পিছন থেকে ছুটে এলো কুয়াশা। কিন্তু ততক্ষণে দুটো গুলি বেরিয়ে গেছে পিস্তল থেকে। পিস্তল দেখেই লাফিয়ে উঠেছিল গোগী। প্রথম গুলিটা লাগলো না তার গায়ে-কিন্তু দ্বিতীয়টা লাগলো গিয়ে ডান পায়ের ঠিক হাঁটুর নিচে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল গোগী মাটিতে।
সাথে সাথেই হুমড়ি খেয়ে তার পাশে পড়লো নেসার আহমেদ। পিঠের উপর তার আমুল বিঁধে আছে কুয়াশার হাতের ছুরিটা। প্রাণটা তখনও বেরোয়নি। আহ! এক অপার্থিব চিৎকার বেরিয়ে এলো ওর মুখ দিয়ে।
হাতের কাছে পেয়ে ক্রোধমত্ত গোগী নেসারের হাঁ করা মুখের দুই পাটি দাঁত দুই হাতে ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলো। গলগল করে বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত। নেসারের সেই চেহারার দিকে আর তাকাতে পারলো না কুয়াশা-শিউরে উঠে দৃষ্টি ফেরালো সে অন্যদিকে।
কাম গোগী। কুয়াশা ডেকেই পিছন ফিরলো। এখন পালাতে হবে এখান থেকে। একদল লোক দ্রুত এগিয়ে আসছে। তাদের কথাবার্তার শব্দ ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে। কুয়াশা চিনলো সিম্পসনের গলা। নিশ্চয়ই সশস্ত্র বাহিনী আছে সঙ্গে। আর দেরি নয়।
আরে, একী! গোগী আবার পড়ে গেল কেন? কুয়াশার আদেশ পাওয়া মাত্রই অভ্যাস বসে একঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছিল গোগী। কিন্তু দুই পা এগিয়েই হাঁটু ভাঁজ হয়ে সামনের দিকে পড়ে গেল সে। আর চলতে পারছে না।
বিস্মিত কুয়াশা দেখলো দুই পায়েই মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে গোগী। সম্পূর্ণ ভাবে চলৎশক্তি হারিয়েছে সে। কিন্তু সময় নেই–আর তো অপেক্ষা করা চলে না। আর পনেরো সেকেণ্ড অপেক্ষা করলেই ধরা পড়ে যাবে সিম্পসনের হাতে। পালাতে হবে এখান থেকে এই মুহূর্তে। উপায় নেই, গোগীকে পিছনে ফেলেই যেতে হবে।
মনটাকে শক্ত করে ঘুরে দাঁড়ালো কুয়াশা। তারপর এগিয়ে গেল তার একমাত্র বিশ্বস্ত এবং প্রিয় সাথীকে পিছনে ফেলে। জীবনে একটিবারও যে ধোঁকা দেয়নি কখনও এমন বন্ধুকে এই অসহায় অবস্থায় ফেলে পালাতে হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিলো কুয়াশার। কয়েক পা এগিয়ে থামলো কুয়াশা। আবার পিছন ফিরে চাইলো। দেখলো গোগীর চোখে করুণ মিনতি–আমাকে বাঁচাও প্রভু, আমাকে ফেলে চলে যেয়ো না।
কি যেন ভাবলো কুয়াশা। তারপর ফিরে এলো গোগীর কাছে। আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় জ্বল জ্বল করে উঠলো গোগীর ছোটো ছোটো চোখ দুটো। একান্ত বিশ্বাসে, পরম নির্ভরতায় তার গলা দিয়ে খুশির অভিব্যক্তি রেরিয়ে এলো ঘর ঘর।
মাটি থেকে নেসারের পিস্তলটা তুলে নিলো কুয়াশী। তারপর নিষ্ঠুরভাবে পর পর দুবার গুলি করলো সে গোগীর হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। সিম্পসনের হাতে মরার চেয়ে এই-ই ভালো।
চমকে উঠলো গেী। অবাক হয়ে গেল সে। কোনও শব্দ বেরোলো না তার মুখ দিয়ে। স্তব্ধ বিস্ময়ে কুয়াশার চোখে চোখে তাকিয়ে রইলো। এই অসম্ভব ব্যাপার সে বিশ্বাস করবে কি করে?
চলে গেল কুয়াশা। পিছনে আহত, মুমূর্ষ গোগী বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো প্রভুর যাত্রা পথের দিকে।
Leave a Reply