কুয়াশা ৩ (ভলিউম ১)
০১.
গাঢ় হয়ে এসেছে বর্ষার সন্ধ্যা। বাইরে ঝমঝম অবিরাম বৃষ্টি, আর সেই সাথে প্রচণ্ড ঝড়। মাঝে মাঝে কাঁচের শার্শি দিয়ে বিদ্যুতের তীব্র ঝলসানি ঘরের সবাইকে সচকিত করে দিচ্ছে, পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ছে দূরে কোথাও। হু হু করে দমকা হাওয়া ছুটে এসে জানালার কবাট ধরে ঝাঁকাচ্ছে। ভিতরে আসবার জন্যে চেষ্টা করছে যেন ভয়ঙ্কর প্রেতলোকের কোনও অতৃপ্ত আত্ম। মহা তাণ্ডবলীলা চলছে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে।
শহীদের ছোটো একতলা বাড়ির ড্রইংরুমে মুখোমুখি বসে শহীদ, কামাল আর মহুয়া গল্প করছে। কামালের কি একটা হাসির কথায় কপট রাগ করে মহুয়া কামালকে মারতে যাবে–হঠাৎ কি দেখে যেন উঃ করে আর্তনাদ করে উঠলো ভয়ে। সবাই ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে চাইলো। আঙুল দিয়ে দরজার দিকে কি একটা দেখিয়ে মহুয়া শুধু বললো ভূত! তারপরই অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো সোফার ওপর। সবাই একসাথে চাইলো দরজার দিকে। একটা ভয়ঙ্কর দর্শন প্রকাণ্ড গরিলা দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মধ্যে।
শহীদ একবার চোখ কচলালো, স্বপ্ন না সত্যি? আফ্রিকা জঙ্গলের এই ভীষণ হিংস্র জন্তু, কি করে এলো তার ঘরে? ঝর ঝর করে তার গা বেয়ে বৃষ্টির জল ঝরে কার্পেটের ওপর, পড়ছে। কিন্তু এক সেকেও মাত্র। তারপরই এক ঝটকায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। শহীদ উঠে দাঁড়াতেই এক পা এগিয়ে এলো গরিলাটা। শহীদের সাথে রিভলভার নেই। শোবার ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে আছে সেটা। দমাদম করে দুবার নিজের বুকের ওপর চাপড় বসালো গরিলাটা। যুদ্ধ ঘোষণার ইঙ্গিত। এক মুহূর্তে প্রস্তুত হয়ে নিলো শহীদ। একটা কাঠের চেয়ার তুলে নিলো ওকে প্রতিরোধ করবার জন্যে।
এমন সময় গফুর এসে ঢুকলো চা নিয়ে। ঘরের মধ্যে জলজ্যান্ত ভয়ঙ্কর গরিলা দেখে সে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল-হাত থেকে ট্রে-টা মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে কাপ তস্তরী ভেঙে গেল সব। প্রথমে সে পালাবার জন্যে দুপা পিছিয়ে গেল, কিন্তু কি ভেবে থেমে পড়লো আবার। তারপর ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো জন্তুটার ওপর। গরিলাটা এক পা-ও নড়লো না। শুধু বাঁ হাতটা দিয়ে অবলীলাক্রমে গফুরকে ঝেড়ে ফেলে দিলো শরীরের ওপর থেকে। গফুরের প্রকাণ্ড দেহ ছিটকে গিয়ে পড়লো দেয়ালের গা ঘেঁষে রাখা শো-কেসের কাঁচের ওপর, তারপর সটান মাটিতে।
এবার, একলাফে জন্তুটা চলে গেল গফুরের পাশে। কামালও একলাফে সোফা, টপকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। শহীদ এগিয়ে গেল কাঠের চেয়ারটা মাথার ওপর তুলে গরিলাটার দিকে। ঠিক সেই সময় ঘরের বাইরে থেকে বহু গম্ভীর কণ্ঠে কে যেন ডাকলো জন্তুটাকে, গোগী, কাম হিয়ার।
তারপর পর্দাটা তুলে ঘরে এসে ঢুকলো কালো আলখাল্লা পরা একজন লোক। খোঁড়া লোকটা। দুই বগলে দুটো ক্যাচের ওপর ভর করে এগিয়ে এলো লোকটা ঘরের মধ্যে। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে জন্তুটাকে আবার বললো–গেট আউট, গোগী! নিতান্ত অনুগত নৃত্যের মতো সেই ভয়ঙ্কর জন্তুটা থপ থপ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আমাকে চিনতে পারছে না শহীদ? লোকটা বললো শহীদের দিকে ফিরে!
কুয়াশা! কামালের মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে গেল কথাটা।
শহীদও বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ কুয়াশার মুখের দিকে। তারপর বললো, তুমি! তুমি বেঁচে আছে!
যে লোককে আফ্রিকার লিপোপো নদীতে ডুবে যেতে দেখেছে এক বছর আগে, যাকে ঘিরে সেই ভয়ঙ্কর নদীর কুমীরগুলোকে কিলবিল করে উঠতে দেখেছে নিজ চোখে, সে বেঁচে আছে কি করে বিশ্বাস করা যায়?
নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো কুয়াশা, হ্যা! বেঁচে আছি! এবং আজ দুটো সত্যি কথা শুনিয়ে যাবার জন্যেই আমার আসা। একটা কথা হচ্ছে, তুমি কাপুরুষ এবং দ্বিতীয় কথা, তুমি বিশ্বাসঘাতক, কৃতঘ্ন বেঈমান। তোমাকে সাহায্য করবার জন্যে আমি কি না করেছি। কতো বড় বিপদ মাথায় নিয়ে আফ্রিকা গিয়েছি তোমার পিছন পিছন, নিজের জীবন বিপন্ন করে কতবার তোমার জীবন রক্ষা করেছি। ছি ছি ছি ছি, শহীদ, সেই তুমি আমাকে কুমীরের মুখে ফেলে পালিয়ে এলে লঞ্চ ছেড়ে দিয়ে! বিষাক্ত ওষুধ ছড়িয়ে কুমীরের হাত থেকে জীবনটা রক্ষা করতে পেরেছি, কিন্তু পা-টা রক্ষা করতে পারিনি। কাটা পা নিয়ে বহু কষ্টে যখন নদীর অপর পারে উঠেছি, তখনও তোমরা আমার চোখের আড়ালে যাওনি। অসহায় আমি চিৎকার করে ডেকেছি তোমাকে, গায়ের জামা খুলে নিয়ে উড়িয়েছি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, তুমি বলতে চাও আমায় দেখতে পাওনি, কিংবা আমার ডাক শোননি? আমি হলপ করে বলতে পারি, তুমি, দেখেছো আমাকে, কিন্তু জংলীদের ভয়ে এগিয়ে আসতে সাহস পাওনি। একবার লঞ্চ থামিয়েও আবার না দেখতে পাওয়ার ভান করে পালিয়ে গিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করেছে।
শহীদ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো, কিন্তু সত্যি বলছি বিশ্বাস করো আমাকে
তোমাকে বিশ্বাস করবো আবার? বগম্ভীর কণ্ঠে শহীদকে বাধা দিয়ে বললো কুয়াশা, আর অভিনয় করবার চেষ্টা করো না শহীদ। ছি, ছি তোমার লজ্জা করে না? আর বেশি কথার প্রয়োজন নেই, মহুয়া বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমি চললাম, আর যাওয়ার আগে আরেকবার বলে যাচ্ছি, তুমি কাপুরুষ, বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক এবং নেমকহারাম।
কুয়াশার গম্ভীর কণ্ঠস্বর সমস্ত ঘরটা গম গম্ করতে থাকলো। ক্র্যাচের ওপর ভর দিয়ে একটা পা টেনে টেনে বেরিয়ে গেল কুয়াশা। বেদনায় শহীদের মুখটা কালো হয়ে গিয়েছে। সম্বিত ফিরে পেয়ে সে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে কুয়াশার পেছন পেছন।
কুয়াশা ততক্ষণে চকচকে কালো একটা শেভ্রোলে গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসে সশব্দে
দরজা বন্ধ করেছে। ছুটে গিয়ে শহীদ বললো, আমার একটা কথা শুনে যাবে না?
না না। কোনও কথা শুনতে চাই না আমি! বেঈমান!
কালো ধোঁয়া ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল গাড়িটা। পেছনের সীটে বসে আছে সেই প্রকাও ভয়ঙ্কর কুৎসিত গরিলা।
.
০২.
সেই সন্ধ্যারই আর একটি ঘটনা। ঢাকার শাহবাগ অঞ্চলে বিশিষ্ট এক হোটেলের তেতলায় একখানা ডবলসিটেড কামরা। মিশরের নাম করা নৃত্যশিল্পী জেবা ফারাহ্ এসে এখানে উঠেছে চার পাঁচ দিন হলো। লাহোর, করাচী, রাওয়ালপিণ্ডিতে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়ে এসেছে এই নর্তকী গত তিন মাস ধরে। টিকেট বিক্রির হার কমে না গিয়ে বরঞ্চ বেড়েই গিয়েছে দিনের পর দিন। নাচের আসরে তার গায়ে কাপড় চোপড়ের বালাই কমই থাকে। প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় নির্লজ্জভাবে সে নেচে যায় একের পর এক জিপসী ড্যান্স, বেলী ড্যান্স, স্নেক ড্যান্স আরও কত কি! তার সুন্দর সুঠাম অর্ধনগ্ন দেহ দর্শকদের লোভাতুর করে তোলে। দলে দলে লোক ভিড় করে দাঁড়ায় গেটের কাছে শো ভাঙার পর এই লাস্যময়ী কামিনীকে একবার কাছে থেকে দেখবে বলে। য়ে ব্যবসায়িক তাকে। প্রতিরাতের জন্য তাকে হাজার টাকা দিয়েও তারা হাজার হাজার টাকা করে নিয়েছে। কিন্তু কেন যেন জেবা ফারাহ কোথাও বেশিদিন থাকেনি। কি এক অজ্ঞাত শঙ্কায় যেন সে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে অন্য কোথাও পালিয়ে যাবার জন্যে। আজ পাঁচ দিন হলো সে করাচী থেকে ঢাকায় চলে এসেছে। আজ সন্ধ্যায় প্রসাধন সমাপ্ত করে সে যেই রওনা হবে ভাবছে অমনি টেলিফোন এলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যে আজকের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। রিসিভার নামিয়ে রেখে ড্রেসিং টেবিলের লম্বা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো জেবা। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে আপন। মনেই হাসলো সে।
ধবধবে সাদা দামী একটা আলখাল্লায় ওর কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত ঢাকা। কাপড়টার সামনের দিকটা আগাগোড়াই চেরা। কটীতে শুধু একটা কালো রেশমী বেন্ট বাঁধা। কোমরের দড়িটা খুলে আলগোছে গা থেকে কাপড়টা ছেড়ে দিলো জেবী। কার্পেটের ওপর আলুথালু হয়ে খসে পড়ে গেল সাদা নাইলনের আলখাল্লাটা। ড্রেসিং টেবিলের লম্বা আয়নায় এবার ফুটে উঠলে এক সুন্দরী নারী দেহের ছায়া। পরনে তার বহুমূল্য সাদা পাথর বসানো কালো বক্ষাবরণ। ঝিকমিক করে উঠলো সেটা ঘরের উজ্জ্বল আলোতে। আর কোমরে জড়ানো জরীর কাজ করা ছোটো একটা মিশরীয় পরিচ্ছেদ। সেটাও কালো। অপলক দৃষ্টিত সে কিছুক্ষণ নিজ তনুশোভা নিজেই উপভোগ করলো। তারপর আবার হেসে উঠলো আপন মনে।
এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলে জেবার কাফ্রী দেহরক্ষী খোদা বক্স। মিশরীয় ভাষায় বললো, কালকের সেই ভদ্রলোক আবার আজ এসেছে। ভিতরে আনবো?
নিয়ে এসো।
ভিতরে এলো একজন ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়সের যুবক। দামী কাপড় চোপড় দেখে এক নজরেই বোঝা যায় ধনীর দুলাল। অতিমাত্রায় মদাসক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে চোখের কোণে। তার আধ বোজা চোখ এবং এলোমেলো পা ফেলা দেখে হেসে ফেললো জেবা। তারপর বললো, এসেছে বাবুজী। কথার ঠিক আছে দেখছি। আমার জন্যে কি আনলে দেখি? শুধু টাকায় চলবে না, আজ আমাকে কিছু উপহার দিতে হবে, কাল বলেছি না!
এনেছি গো এনেছি তোমার জন্য উপহার এনেছি, এই যে আমার উত্তপ্ত প্রেমিক হৃদয়, এ হৃদয় তোমাকে উপহার দিলাম।
যাও ঠাট্টা করো না। কি এনেছো দেখি?
যুবক কোটের পকেট থেকে বের করলো হীরে বসানো একটা মহামূল্যবান জড়োয়া সেট। বিস্মিত জেবা এগিয়ে গিয়ে হাতে নিলো হারটা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে উল্লসিত হয়ে বললো, তুমি মস্ত বড় শেঠ, বাবুজী?
গর্বের হাসি ফুটে উঠলো যুবকের ঠোঁটে। জেবাকে কাছে টেনে নিয়ে নিজ হাতে পরিয়ে দিলো হারটা তার গলায়। তারপর তার সারা দেহের ওপর একবার লোভাতুর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে গেল। চট করে সরে গিয়ে জেবা বললো, ধীরে বুজী, ধীরে। দরজাটা খোলা আছে সে খেয়াল নেই বুঝি?
দরজাটা ভালো করে লক্ আপ করে উজ্জ্বল বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে একটা হালকা সবুজ আলো জ্বেলে দিলো জেবা। গুন গুন করে একটা মিশরীয় সুর ভাঁজতে ভাজতে সহজ সচ্ছলভাবে আলগোছে একটা বোতল থেকে দুটো গ্লাস ভর্তি করে শ্যাম্পেন ঢেলে নিয়ে বিছানার পাশে টিপয়ের ওপর রাখলো।
জেবার দুই কাঁধে দুহাত রাখলো যুক। আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপর এক সময় ক্ষীণ কণ্ঠে বললো, তোমার হাতটা গলা থেকে একটু সরাও বাবুজী, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু হাত দুটো সরলো না। কিছুক্ষণ ছটফট করলো জেবা, তারপর প্রাণপণে হাত দুটো সরাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই সে হাত দুটো সরলে না-সাঁড়াশীর মতো চেপে বসলো আরও ওর কণ্ঠনালীর ওপর। ধাক্কা দিয়ে যুবককে সরিয়ে দিতে চাইলো জেবা, কিন্তু নড়াতে পারলো না। হাতের ধাক্কায় একজোড়া গোঁফ খসে পড়লো যুবকের ঠোঁটের ওপর থেকে। মুহূর্তে চিনতে পারলো সে। শিউরে উঠে বহু কষ্টে উচ্চারণ করলো জেবা–
নেসার আহমেদ!
ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখে দেখতে পেলো জেবা যুবকের ঠোঁটে একটা তীক্ষ্ণ বক্র হাসি।
ক্রমে নিঃসাড় হয়ে গেল জেবার নগ্ন দেহ।
.
০৩.
পরদিন সকাল আটটার দিকে শহীদের ড্রইংরুমে এসে ঢুকলেন মি. সিম্পসন। এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান এই ভদ্রলোক সরকারী গোয়েন্দা বিভাগের পদস্থ কর্মচারী। সরকারী বৃত্তি পেয়ে স্কটল্যাওইয়ার্ডে তিন বছর বিশেষ শিক্ষা কোর্স কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করে সম্প্রতি মাসখানেক হলো ঢাকায় ফিরেছেন।
তীক্ষ্ণ প্রতিভাবান এই ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। লম্বা দোহারা গড়ন–মাথায় কাঁচা পাকা চুল। শহীদকে ইনি অত্যন্ত স্নেহ করেন এবং সেই সাথে করেন সমীহ। প্রায়ই তিনি জটিল কেস নিয়ে আসেন শহীদের সাথে আলাপ করতে। বিদেশ যাওয়ার আগে শহীদের সাথে কয়েকটা কেস নিয়ে তিনি একসঙ্গে কাজ করেছেন, সেই থেকেই পরিচয় এবং বন্ধুত্ব।
মহা সমাদরে মি. সিম্পসনকে বসতে বললো শহীদ। কিন্তু তিনি না বসে বললেন, শহীদ, তোমাকে আমার সাথে একটু যেতে হবে শাহবাগে। ওখানে একটা অদ্ভুত খুন হয়েছে-very interesting. আমি সেই spot থেকে সোজা তোমার এখানে চলে এসেছি-এক্ষুণি রেডি হয়ে নাও।
আচ্ছা আমি এক্ষুণি আসছি।
পাঁচ মিনিটে শহীদ বেরিয়ে এলো প্রস্তুত হয়ে। ড্রইংরুমে ফিরে এসেই দেখলো মি. সিম্পসন কার্পেটের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে গভীর মনোযোগর সাথে কি যেন নিরীক্ষণ করছেন। ঘাড় ফিরিয়ে শহীদকে জিজ্ঞেস করলেন, কাল রাতে তোমার ঘরে কোনো বানর জাজয় জন্তু এসেছিল?
না তো! কেন?
নিশ্চয়ই এসেছিল। কারো সাথে এই ঘরে তার ধস্তাধস্তিও হয়েছে। এই দেখ তার গায়ের লোম, একটা সাদা রুমালের ওপর সযত্নে কুড়িয়ে তোলা কিছু লোম দেখালেন মি. সিম্পসন।
ও আমার অ্যালসেশিয়ান কুকুরের লোম।শহীদ হেসে বললো।
অসম্ভব। বাইরে এসে দ্যাখো। এই পায়ের ছাপ কি তুমি কুকুরের বলতে চাও? বারান্দায় বেরিয়ে শহীদ দেখলো কাদামাখা অনেকগুলো থ্যাবড়া পায়ের চিহ্ন স্পষ্ট ছাপ রেখে গেছে তার বারান্দার ওপর।
তাই তো, strange!
কেবল তাই নয়, সেই জন্তুটার সাথে একজন খোঁড়া লোকও এসেছিল এই ঘরে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তারা এসেছিল গাড়িতে চড়ে। এবং এই একই পায়ের চিহ্ন পাবে তুমি শাহবাগের হোটেলে। চলো, let us start.
পথে যেতে যেতে ঘটনার বিবরণ ভেঙে বললেন মি. সিম্পসন। জেবা ফারাহ নামী এক মিশরীয় নৃত্যশিল্পীকে কে যেন তার কামরায় গলা টিপে হত্যা করে গেছে গত রাতে। হোটেল কর্তৃপক্ষের টেলিফোন পেয়ে কাল রাতেই পুলিশ এসে ঘরের দরজা ভেঙে প্রবেশ করে–এবং বিছানার ওপর জেবার সম্পূর্ণ নগ্ন মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে ।
.
খোদা বক্স জানায় যে রাত আটটার দিকে একজন লোক জেবার কক্ষে প্রবেশ করে জেবার অনুমতিক্রমেই। তারপর ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণতঃ যারা এই ঘরে ঢোকে ঘন্টাখানেক পরই তারা বেরিয়ে যায়। কিন্তু, রাত এগারোটা বেজে গেলেও যখন সেই লোকটা বেরোলো না, তখন সে দরজায় করাঘাত করে। ভেতর থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। বারবার করাঘাত করেও যখন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না, তখন সে নিচে গিয়ে রিসেপশন রুম থেকে জেবার কামরায় বারবার টেলিফোন করে।
ঘরে মৃতদেহ ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি? শহীদ জিজ্ঞেস করলো।
না। তবে কতগুলো অদ্ভুত পরস্পর বিরোধী পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। এবং তাতে ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।বলতে বলতে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেল।
.
পুলিশ প্রহরী দাঁড়িয়ে রয়েছে কামরার সামনে। মিঃ সিম্পসনকে দেখেই সেলাম ঠুকে পথ ছেড়ে দিলো। সাদা কাপড়ে ঢাকা মৃতদেহটার ওপর একবার দূর থেকে চোখ বুলিয়েই শহীদ চলে গেল ঘরের পেছন দিককার ব্যালকনিতে। দেখলো, তার বাড়ির বারান্দায় যে দুটো পায়ের ছাপ মি, সিম্পসন তাকে দেখিয়েছেন ঠিক সেই চিহ্ন। ভ্রূকুঞ্চিত হয়ে গেল শহীদের, ব্যাপার কি! এ তো কুয়াশা এবং তার গরিলার পদচিহ্ন! তবে কি কুয়াশাই এই কাজ করলো?
.
খোদা বক্সকে ডেকে পাঠালো শহীদ। সেলাম জানিয়ে এসে দাঁড়ালো নিকষ কালো জোয়ান কাফ্রী খোদা বক্স। ক্ষণে ক্ষণে জলে ভিজে উঠেছে চোখ দুটো, বারবার রুমাল দিয়ে মুছে মুছে লাল করে ফেলেছে। ওকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে শহীদ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো, কতদিন ধরে তুমি মিস জেবার কাছে কাজ নিয়েছো?
পাঁচ বছর।
কাল যে লোকটা এই কামরায় ঢুকেছিল, তার সাথে কোনও জন্তু জানোয়ার ছিলো?
জ্বী না।
লোকটার একটা পা কি খোঁড়া ছিলো?
স্ত্রী না।
তার হাতে কোনও লাঠি ছিলো। পরনে কালো আলখাল্লা ছিলো?
না। খয়েরী রঙের দামী স্যুট ছিলো পরনে। হাতে কোনও লাঠি-সোঁটা ছিলো না।
ভ্রু কুচকে বাইরের দিকে চেয়ে শহীদ কিছুক্ষণ কি যেন ভালো। তারপর বললো, পুলিশ যখন দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে তখনও কি ঘরটা ভেতর থেকেই বন্ধ ছিলো?
জ্বী হাঁ।
আচ্ছা তুমি যাও।
খোদা বক্স চলে যাচ্ছিলো, কিন্তু মি, সিম্পসন ওকে ডাকলেন। বললেন, খোদা বক্স এদিকে এসো। কাল যে লোকটা এখানে এসেছিল তার চেহারাটা. আমি বানিয়ে দিচ্ছি, আমার ভুল তুমি শুধরে দিবে বুঝলে?
একটা ছোটো বাক্স খুললেন মি. সিম্পসন। তার মধ্যে থরে থরে সাজানো প্লাস্টিকের নাক, কান, চোখ, ভুরু, গোঁফ, চুল বিভিন্ন রকমের। তার থেকে কয়েকটা জোড়া দিয়ে মোটামুটি একটা মানুষের মুখ তৈরি করলেন এক মিনিটের মধ্যেই। প্রায় শেষ হয়ে আসতেই খোদা বক্স বললো, মোচ জোড়া আরও বড় ছিলো।
এই রকম? আরেকটা টুকরো লাগালেন মি. সিম্পসন।
অনেকটা হয়েছে, কিন্তু আগাটা ওপর দিকে তোলা ছিলো।
এই রকম?
হ্যাঁ। আর মাথার চুলটা উল্টোদিকে আঁচড়ানো ছিলো। সিথি ছিলো না।
এই রকম?
হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক।
এইভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মানুষের মুখ তৈরি হয়ে গেল। খোদা বক্সই বলে দিলো কোন অংশটা কেমন ছিলো। কিন্তু মূর্তিটা যখন তৈরি হয়ে গেল তখন ও পরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললো, হুজুর, আজব কাণ্ড, আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, এই লোকটাই কাল রাতে এসেছিল!
মি. সিম্পসন তাঁর ইলেকট্রনিক ফ্ল্যাশ গান কিট করা লাইকা ক্যামেরা দিয়ে মূর্তিটার দুটো স্ন্যাপ নিয়ে আবার মূর্তিটাকে খুলে বাক্সে ভরে ফেললেন। তারপর শহীদকে বললেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে এনেছি এটা। এই বাক্সটাকে কি বলে জানো? একে বলে
Identi-kit.
বুদ্ধিমান ছেলে! তুমি জানলে কি করে? আবাক হলো মি. সিম্পসন।
আমেরিকায় ম্যাকডোনান্ড সাহেবের আবিষ্কার তো? পাশ্চাত্যের সমস্ত পুলিস মহলে একটা যুগান্তর এনে ফেললো এই নতুন আবিষ্কার, তার খবর রাখা এমন কি আর আশ্চর্যের হলো?
এই লোকটার চেহারা পেলাম, এর আঙ্গুলের এবং পায়ের ছাপও পেয়েছি। এবার চলো। এখানে আর আমাদের কোনো কাজ নেই। প্ররেম হচ্ছে,দরজা বন্ধ অবস্থায় চারজন ছিলো এ ঘরে। একজন মৃত। বাকি তিনজন গেল কোথায়
আমি মৃতদেহটা একবার দেখবো। শহীদ বাধা দিয়ে বললো।
ওতে দেখার কিছু নেই। ছেলেমানুষ শুধু শুধু লজ্জা পাবে। দেহটা সম্পূর্ণ নগ্ন।
উত্তর না দিয়ে শহীদ এগিয়ে গেল বিছানাটার দিকে। মি. সিম্পসন নিজের কাঁধটা একটা বিশেষ বিদেশী কায়দায় ঝাঁকিয়ে নিয়ে মৃদু হেসে ব্যালকনিতে চলে গেলেন।
বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো শহীদ। মৃতদেহের ওপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে ফেললো। চোখ দুটো খোলা-এবং তাতে ফুটে রয়েছে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কি যেন দেখছে সে এখনও। আলতোভাবে শহীদ লাশটাকে ডান দিকে পাশ ফিরিয়ে দিলো। ওমনি বিছানার ওপর ছোট্ট একটা জিনিসের ওপর দৃষ্টি পড়লো তার। নিঃশব্দে সেটা তুলে পকেটে ফেললো সে। লাশটার আপাদমস্তকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে সেটাকে ঢেকে রেখে ঘরটা একবার পরীক্ষা করে দেখলো শহীদ, তারপর ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। মি. সিম্পসন বললেন, এই যে পাম গাছটা দেখছো-ওটা এই বারান্দা থেকে কয় ফিট হবে আন্দাজ করো তো।
তা, পনেরো ফিটের কম হবে না।
কোনও মানুষের পক্ষে এখান থেকে লাফিয়ে ওখানে যাওয়া বা ওখান থেকে লাফিয়ে এখানে আসা সম্ভব?
উহুঁ। অসম্ভব।
ঠিক মানুষের পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু শিম্পাঞ্জী, ওরাংওটাং বা গরিলা জাতীয় কোনও জন্তুর পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই না? আমার কোনই সন্দেহ নেই যে একজন। খোঁড়া লোক এই ধরনের কোনও জন্তুর পিঠে চড়ে এই ঘরে এসেছিল কাল রাতে এবং সেই জন্তুটাই তাকে আবার পিঠে করে নিয়ে অনায়েসে লাফিয়ে গিয়ে ঐ গাছ ধরে নেমে গেছে।
প্রমাণ?
প্রথম প্রমাণ, ঐ গাছটার তলায় তাদের পায়ের চিহ্ন আছে। দ্বিতীয় প্রমাণ, এই ঘরেও তাদের পায়ের চিহ্ন পেয়েছি। আর তৃতীয় প্রমাণ, সদর দরজা বন্ধ থাকা অবস্থায় ঐ গাছটা ছাড়া ঘরে ঢুকবার বা এ ঘর থেকে বেরোবার অন্য কোনও উপায় নেই।
গাছের তলায় কি তিনজনেরই পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে?
না। রহস্যটা এখানেই। তৃতীয় ব্যক্তিটা যে কি করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল বোঝাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ভোজবাজীর মতো সে অদৃশ্য হয়ে গেছে হাওয়ায়।
আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন মি. সিম্পসন, তা ছাড়া কেনই বা এই নর্তকীকে খুন করা হলো? তৃতীয় ব্যক্তির সাথে খোঁড়া লোকটার কি সম্পর্ক? মনে হচ্ছে এর পেছনে আছে একটা বিরাট দল-বিশেষ কোনও কারণে হয়তো
শহীদ মাঝপথে বাধা দিয়ে বললো, মি. সিম্পসন, আমি এখন বাড়ি ফিরবো, আপনি কি এখানেই থাকবেন?
না। আমিও একটু অফিসে যাবো। এই পায়ের চিহ্ন, আঙ্গলের ছাপ খুনীর ফটোগ্রাফ সব কিছু আজই ডেভেলপ করে ফেলতে হবে বারোটার মধ্যে। চলো তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাই।
চিন্তিতমুখে শহীদ ফিরে এলো তার ড্রইংরুমে। একটা সোফায় আধ ঘন্টা সে চোখ বন্ধ করে একটার পর একটা সিগারেট পোড়ালো। তারপর তার মুখে মৃদু হাসির চিহ্ন ফুটে উঠলো। চোখ খুলেই গলা ছেড়ে হাঁক দিলো, গফুর।
ডাকছো দাদামণি?
চা নিয়ে আয়–আর তোর কামাল ভাইকে একটু ফোন করে দে এক্ষুণি যেন চলে, আসে এখানে। যা, তাড়াতাড়ি কর।
.
০৪.
ঢাকার ইন্দ্রপুরীতে একটা বহুকালের জীর্ণ দুইতলা জামিদার বাড়িতে দুর্ধর্ষ দস্যু নেসার আহমেদ গুপ্ত আস্তানা গড়েছে বছর পাঁচেক হলো। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সব শহরেই এর একটা করে আড্ডা আছে। কয়েক বছর ধরে এই দস্যুর পেছনে আঠার মতো লেগে থেকেও একে ধরতে পারেনি পুলিস আজও। তিন তিন বার পুলিস প্রায় ধরেই ফেলেছিল ওকে, কিন্তু প্রতিবারেই সে অভাবিত কৌশলে পিছলে বেরিয়ে গেছে; ধরা পড়েনি।
সেদিনও সারা আকাশ জুড়ে মেঘভার। বৃষ্টিটা ছাড়ছে না কিছুতেই। সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায় না একবারও। মাঝে মাঝে আকাশটা পরিষ্কার হয় একটু অক্ষণের জন্য বৃষ্টি থামে। তারপর আবার কালো হয়ে আসে আকাশ, ঝর ঝর করে আবার আরম্ভ হয় সেই এক ঘেয়ে অক্লান্ত বরিষণ।
নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলো নেসার আহমেদ। পরনে ওয়াটারপ্রুফ। আর পায়ে গামবুট। হাতে সদ্য প্রকাশিত ইংরেজি একটা দৈনিক সান্ধ্য পত্রিকা। দোতলায় একফালি লম্বা বারান্দা হারিকেনের মৃদু আলোয় আলোকিত। কুৎসিত দর্শন একজন প্রহরী সালাম ঠুকে সরে দাঁড়ালো। কোনও প্রত্যুত্তর না করে নেসার আহমেদ ডানধারের একটা ঘরে মৃদু করাঘাত করলো। একজন সুদর্শনা ভৃত্যশ্ৰেণীয় যুবতী দরজা খুলে দিলো। অত্যন্ত সুসজ্জিত এই কক্ষে একটা হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। ওয়াটারপ্রুফ ও গামবুট খুলে দিলো যুবতী। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বর্মা চুরুট ধরালো নেসার আহমেদ, তারপর বললো, মোতিয়া, কোরবান আলী ফিরেছে?
জ্বী।
ডেকে নিয়ে আয় এ ঘরে।
একটা ভেজানো দরজা খুলে পাশের ঘরে চলে গেল মোতিয়া। অল্পক্ষণ পরেই ঘরে এসে ঢুকলো কোরবান আলী। সেলাম করে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে সে। কিছুক্ষণ নিবিষ্টচিত্তে চুরুট টানবার পর নেসার আহমেদ বললো, বিছানার ওপর থেকে কাগজটা নিয়ে এসো।
হুজুর, এ তো আপনার ছবি! আশ্চর্য হয়ে কোরবান আলী পত্রিকাটা তুলে নিলো বিছানার ওপর থেকে। সান্ধ্য পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি বেরিয়েছে নেসার আহমেদের। নেসার বললো, এবং ছবিটির নিচে লেখা আছে এই লোকটি একজন খুনী আসামী। যে একে ধরে দিতে পারবে, অথবা এর সম্পর্কে পুলিশে খবর দিতে পারবে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হবে।
কিন্তু আপনার ছবি পেলো কোথায় ওরা?
সে কথাই তো ভাবছি। যাক, এতে ভয় পাবার কিছুই নেই। কালই আমার ভোল সম্পূর্ণ পালটে যাবে। পুলিশের কেউ আমার টিকিও স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছে সেই ল্যাংড়া লোকটাকে নিয়ে। দুই দুই বার আমার সাথে ওর টক্কর লেগেছে এই একমাসের মধ্যে এবং প্রতিবারই ছলে বলে কৌশলে সে আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। অদ্ভুত ধূর্ত এবং কৌশলী এই লোকটা। একে শায়েস্তা করা এখন আমার প্রথম কাজ।
আমাদের একজন লোককে লাগিয়ে রেখেছি ওর পেছনে হুজুর। ছায়ার মতো সে অনুসরণ করছে তাকে।
, কার কথা বলছে, শুকুর? সে এখন হাসপাতালে, বাঁচে কি মরে ঠিক নেই। ধানমণ্ডি লেকের ধারে ঝোঁপের পাশে কাল সারারাত পড়েছিল অজ্ঞান হয়ে। ভোরে লোকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস, ল্যাংড়া লোকটাই ওর এ অবস্থা করেছে।
কাল থেকেই অন্য লোক লাগিয়ে দেবো হুজুর।
তা দিও। কেবল ওর আস্তানাটা বের করতে পারলেই বাকি কাজ শেষ করতে সময় লাগেবে না। মনে রেখ, যে তিনটে কাজ হাতে নিয়ে আমরা ঢাকায় এসেছি, তার প্রথমটা সমাপ্ত হয়েছে। বাকি দুটোও অল্পদিনেই হয়ে যাবে। এখন চতুর্থ কাভ হচ্ছে এই ল্যাংড়াকে শায়েস্তা করে মিশরের দিকে রওনা হওয়া।
মিশরে কেন?
পরে জানতে পারবে। এখন আজকের রাতের জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও।
.
ধানমণ্ডি লেকের ধারে প্রতিদিন বিকেল বেলায় দুটি যুবক যুবতী এসে বসে, হাত ধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে পুল পর্যন্ত চলে যায়–তারপর সন্ধ্যার আগেই মেয়েটি ফিরে যায় বাড়িতে। অত্যন্ত দামি পোশাক পরিচ্ছদ মেয়েটির পরনে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে বোঝা যায় স্পষ্ট। ছেলেটি সাদাসিধে পাঞ্জাবী পাজামা পরে আসে। গল্পে হাসিতে বিভোর হয়ে যায় ওরা। আশেপাশে আর কেউ থাকতে পারে, এবং তাদের চালচলন লক্ষ্য করতে পারে, সে খেয়ালই যেন নেই ওদের। ।
কিন্তু কিছুদিন ধরে একজন খোঁড়া লোকের দিকে লক্ষ্য না দিয়ে পারেনি ওরা। লোকটা যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। রোজই মস্ত একটা কালো গাড়িতে করে আসে ক্র্যাচের ওপরে ভর দিয়ে। দামি নীল স্যুট পরিহিত এই ভদ্রলোক ওরা, যেখানটায় বসে তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে লেকের পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখে। ওরা তার দিকে চাইলেই মিষ্টি করে হেসে মাথাটা একটু নত করে, তারপর নিজের জায়গায় গিয়ে বসে থাকে গোধূলি আকাশের সব রঙ মুছে না যাওয়া পর্যন্ত।
কদিন ধরে মেয়েটি আর আসে না। ছেলেটি রোজ অপেক্ষা করে ওর জন্যে সন্ধ্যে পর্যন্ত। তারপর সাঁঝের মতোই আঁধার হয়ে আসে যুবকের মুখ, উঠে চলে যায় সে।
সেদিনও বিকেল বেলা একা বসে তন্ময় হয়ে কি যেন ভাবছে যুবক, এমন সময় চমকে উঠলো ঘাড়ের ওপর কার মৃদু স্পর্শে। চেয়ে দেখলো পাশে এসে বসেছে সেই প্রকাণ্ড দেহী খোঁড়া লোকটা। কোনও ভূমিকা না করেই বললো সে লোক, কি হয়েছে। কলিম, তোমার বান্ধবী আসে না কেন?
প্রথমে অপরিচিত লোকের মুখে নিজের নাম শুনে বিস্কিত হলো যুবক, তারপর ভাবলো ওর হৃদয়ের গভীরতমবেদনার কথা হঠাৎ একজন অপরিচিতের কাছে বলবেই বা কেন সে? কিন্তু ভদ্রলোকের সাহনুভূতিশীল মুখের দিকে চেয়ে কলিমের উগ্রতাবটা মুহূর্তেই কোমল হয়ে এলো, এই লোকের কাছে মনের সব কথা বলা যায়। কোনো ভূমিকা না করে সহজ ভাবেই সে বললো, ওর বাবা আসতে বারণ করে দিয়েছেন।
কেন?
আমি যে চাষার ছেলে।
তুমি যে একজন কৃতী ছাত্র, এবার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে, পাস করেছে, সে খবর নিশ্চয়ই ওর বাবা জানে না?
জানেন। আমার বাবার মুখের ওপর চৌধুরী সাহেব বলে দিয়েছেন, চাষার ছেলের সাথে ওঁর মেয়ের বিয়ে হতে পারে না।
তিনি জানেন না যে এতে তীর মেয়ের সম্মতি আছে?
জানেন এবং তা শুনে বলেছেন, এমন মেয়েকে নিজ হাতে রের মতো গুলি করে মারবেন, কিন্তু চাষার ঘরে যেতে দেবেন না।
কি ঠিক করলে তুমি?
সহ্য করবো, করুণ হয়ে আসে যুবকের মুখ।
ছি, ছি। এ কি বলছো? এ অন্যায় সহ্য করে নেবে? রীনা কি বলে?
আজ এক টুকরো চিঠি পেয়েছি। লিখেছে, আব্বাজানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া। আমার পক্ষে অসম্ভব। সেটা আমাদের কারো পক্ষেই মঙ্গলকর হবে না। তুমি তো জানোই কেমন ভয়ঙ্কর একরোখা মানুষ উনি। কথার নড়চড় হয় না কখনও। আমার যা হবার তা হবেই, তুমি আমাকে ক্ষমা করো, গলাটা ভেঙে আসে যুবকের।
কলিমের দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে প্রবল একটা ঝাঁকুনি দিলো খোঁড়া লোকটা, তারপর চোখে চোখ রেখে ধীরে অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বললো, একটা কথা মনে রেখো কলিম,তুমি পুরুষ মানুষ। ভেঙে পড়া তোমার সাজে না। কাম্য বস্তু আদায় করে নেয়াই তোমার ধর্ম। ভদ্রভাবে না পারো, ছিনিয়ে নেবে।
উঠে গেল খোঁড়া লোকটা ক্র্যাচের ওপর ভর করে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে–ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল মূর্তিটা দূরের অন্ধকারে। আর কলিমের কানের মধ্যে মগজের ভেতর কে যেন উচ্চারণ করে চললো, মনে রেখো, তুমি পুরুষ মানুষ। ভদ্রভাবে না পারো, ছিনিয়ে নেবে। ছিনিয়ে নেবে।
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো যুবক।
.
শহীদ আর কামালকে ঢুকতে দেখেই মি. সিম্পসন উঠে দাঁড়িয়ে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন।
এসো, এসো। তোমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি। বসো। কয়েকটা ব্যাপারে আলাপ করার জন্যে তোমাকে ডেকেছি শহীদ।
বলুন, কি সাহায্য করতে পারি।-বসতে বসতে বললো শহীদ, জিজ্ঞাসু নেত্রে চেয়ে রইলো মি. সিম্পসনের দিকে।
এক মিনিট চুপ করে থেকে মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিলেন মি. সিম্পসন। তারপর ডয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে টেবিলের ওপর রেখে ফিতে খুলতে খুলতে বললেন, করাচী পুলিস জানিয়েছে, আমি যে আঙ্গুলের ছাপ এবং ছবি পাঠিয়েছিলাম সেগুলো নেসার আহমেদ নামে এক ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ দস্যুর। বাড়ি ওর পাঞ্জাবে। সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানে বছর সাতেক হলো সে একটার পর একটা ডাকাতি এবং খুন খারাবী করে চলেছে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও তাকে ধরা যাচ্ছে না। সুসংবদ্ধ একটা দল গঠন করে সে এখন পশ্চিম পাকিস্তানের ধনীত্রাস দস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া নারীঘটিত বহু কুকীর্তির সাথেও সে জড়িত। আরও লিখেছে গোঁফ জোড়া নকল, তাছাড়া আর সবই তার চেহারার সাথে মিলছে। একটা স্পেশাল নোটে করাচী পুলিশ সুপার আমাকে লিখেছেন, সাবধান, যে কাজে হাত দিয়েছে সেটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।
বেশ। এতে বোঝা গেল নেসার আহমেদের দস্যু দল এখন ঢাকার বুকে তাদের আস্তানা গেড়েছে।
হ্যাঁ। আরও বোঝা গেল নর্তকী জেবা ফারাহের হত্যাকারী নেসার আহমেদই। কেবল তাই নয় সেদিনকার সেই বন্দুকের দোকান লুট এবং জুয়েলারীর দোকানে ডাকাতিও ওরই দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে।
খোঁড়া লোকটা এবং তার সাথে একটা জন্তু তাহলে নেসারেরই দলের লোক?
উঁহু। গোলমালটা এখানেই, জুওলজিস্টকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে দেখিয়েছি জন্তুটা একটা গরিলা। আফ্রিকার এই ভয়ঙ্কর জন্তু পোষ মানে না কখনও। কিন্তু এ একটা অদ্ভুত ব্যতিক্রম! যাক গে, সে ব্যাপার নিয়ে জুওলজিস্টরা মাথা ঘামাক গিয়ে। আমি মনে করেছিলাম খোঁড়া লোকটা নেসারের অনুচর, কারণ জেবার গলায় নেসারের আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেলেও সে ঘরে গরিলার পায়ের ছাপও রয়েছে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম এরা সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী দুটো দল। সেদিন জুয়েলারীতে ডাকাতি করে এক রতি সোনাও নেসার নিয়ে যেতে পারেনি। কুয়াশা, নামে সেই অদ্ভুত ধূর্ত এবং কৌশলী খোঁড়া লোকটা ছিনিয়ে নিয়েছে সব কিছু।
বুঝলাম, দুটো দল আছে–কিন্তু কোন পথে এগোবেন ঠিক করেছেন কিছু?
আমি কোনও রাস্তাই পাচ্ছি না শহীদ। সেজন্যেই তোমাকে ডেকেছি। তোমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই। তুমি কি ভাবলে এ কয়দিন?
আস্তানা বের করে ফেলেছি।
কি বললে?
হ্যাঁ। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দুর্গের মতো করে ফেলেছে সে তার আস্তানাকে।
এক্ষুণি চলো। দরকার মনে করলে আমরা মিলিটারী রেজিমেন্টের সাহায্য গ্রহণ করবো।
ধীরে, মি. সিম্পসন ধীরে। তাড়াহুড়োর কি আছে? রেজিমেন্ট নিয়ে গেলে ওখানে কাউকে পাবেন না। গুপ্ত পথে সবাই সরে পড়বে। ওদের ধরবার একটা চমৎকার প্ল্যান : ঠিক করেছি। কিন্তু তার আগে
কথা শেষ হবার আগেই ঝড়ের বেগে ঘরের ভেতর ঢুকলো একজন লোক। প্রৌঢ় ভদ্রলোকের মাথার চুল কাঁচাপাকা, দামী বিলিতি কাটের স্যুট পরনে। ঢুকেই বললো, মাফ করবেন, মি.সিম্পসন। অনুমতির অপেক্ষা না করেই অনধিকার প্রবেশ করলাম।
সিম্পসন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আরে মি. চৌধুরী যে! হঠাৎ? ব্যাপার কি? বসুন।
এইমাত্র আমি শহীদ খানের বাড়ি থেকে আসছি। ওখানে জানতে পেলাম উনি আপনার অফিসে আছেন। ইনিই কি..
জ্বী, হ্যাঁ। আমারই নাম শহীদ খান।
একটা বিপদে পড়ে আপনার ওখানে গিয়েছিলাম, মি. শহীদ। আমার নাম আনিস চৌধুরী। আমি
ব্যাস। আর পরিচয় দরকার হবে না। এখন বলুন তো এমন হন্তদন্ত হয়ে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কেন?
দেখুন, কাল রাতে একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় আমি অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছি। ব্যাপারটা খুলে বলতে চাই আপনাদের, কিন্তু
কামালের দিকে চেয়ে একটু ইতস্ততঃ করলেন বিখ্যাত বনেদী জমিদার আনিস চৌধুরী। শহীদ বললো, ও হচ্ছে কামাল আহমেদ, আমার বন্ধু এবং সহকর্মী। ওর সামনে আপনি সব কথা বলতে পারেন।
সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে খুলে বলছি-একটু ধৈর্য ধরে শুনুন দয়া করে।
কাল মাঝরাতে আমার ঘরের মধ্যে কোনও অপরিচিত মানুষের চলাফেরার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। চেয়ে দেখলাম ছায়ার মতো কে একজন আমার ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বালিশের তলায় হাত দিয়ে আমার রিভলভারটা পেলাম না। ভাবছি চিৎকার করে লোক ডাকবো কিনা। এমন সময় মূর্তিটা আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো এবং মৃদুস্বরে বললো, খবরদার, কোনও রকম চিৎকারের চেষ্টা করবেন না। আপনার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক এবং তার রিভলভারের নল আপনার দিকেই । চেয়ে আছে। এতে সাইলেন্সর লাগানো আছে নিঃশব্দে আপনাকে পরপারে চলে যেতে হবে একটু নড়াচড়া বা চিৎকার করলে।
টুঁ শব্দটি না করে বিছানায় পড়ে থাকলাম। মূর্তিটা একটা টর্চ জ্বালিয়ে সারা ঘরের দেয়ালে তন্ন তন্ন করে কিছুক্ষণ ধরে কি যেন খুঁজলো। ঘরের মধ্যে যে গুপ্ত দেয়াল সিন্দুকটা আছে পরিবারের দু একজন ছাড়া বাইরের আর কারও পক্ষে সেটার অবস্থান জানবার উপায় নেই-আশ্চর্য হয়ে দেখলাম লোকটা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এবং যেন রোজই ব্যবহার করছে এমনি অভ্যস্ত হাতে আমার স্ত্রীর মস্ত বড় অয়েল পেন্টিং ছবিটা দেয়াল থেকে সরিয়ে সিন্দুকের ডালা খুলে ফেললো একটা চাবি লাগিয়ে। গতকাল সকালেই সব টাকা সরিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের বাড়ির একটা গুপ্ত কক্ষে। মাত্র হাজার পাঁচেক ছিলো ওখানে তোড়া বাঁধা অবস্থায়। টাকা কটা পকেটে ফেলে অনেকক্ষণ ধরে সিন্দুকের সমস্ত জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলো লোকটা। তারপর, বিছানার পাশে এসে বললো, কই চাবিটা তো দেখছি না! ওটা কোথায়?
কিসের চাবি? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ন্যাকামী রাখুন, মি .চৌধুরী। আপনি স্পষ্ট জানেন আমি কোন চাবির কথা বলছি। এই বাড়ির গুপ্ত ঘরের চাবিটা ভালোয় ভালোয় বের করে দিন।
পুরুষানুক্রমে আমরা এই জমিদার বাড়িতে বাস করছি। বাবার মুখে শুনেছি আমাদের কোনও পূর্বপুরুষ সমস্ত ধনরত্ন নিরাপদে রাখবার জন্যে এ বাড়িতে একটা গুপ্তঘর তৈরি করিয়েছিলেন অতি গোপনে সে কালের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ কারিগরকে দিয়ে। এবং যেদিন ঘরটা তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল সেদিন সব কজন কারিগরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন তিনি। সেই ঘরের চাবিটা এমন বিচিত্রভাবে তৈরি এবং সেটা খুলবার কায়দা এমন বিশেষ রকমের যে গুপ্তঘরটা সম্পূর্ণ নিরাপদ রইলো। কেবলমাত্র বংশের বড় ছেলের অধিকার রইলো ঐ চাবিটা পাবার এবং ঘরটা খোলার কৌশল জানবার। অবাক হয়ে গেলাম। এতো রাতে আমার ঘরে ঢুকে অপরিচিত এক লোক ঐ চাবিটা দাবি করছে কেন? বললাম, চাবিটা আমার কাছে নেই।
নিশ্চয়ই আছে।
বংশের বড় ছেলে আপনি। এ চাবি আপনার কাছেই আছে।
আমার কাছে ছিলো, কিন্তু সেদিন গোয়ালন্দ থেকে ফেরবার পথে নারায়ণগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাসায় নেমেও ছিলাম কদিন থাকবো বলে, কিন্তু ঢাকা থেকে জরুরী টেলিফোন পেয়ে চলে এসেছি স্যুটকেস ওখানে রেখেই। চাবিটা সেই স্যুটকেসের মধ্যে আছে।
আপনার কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করলাম না, চৌধুরী সাহেব। কিন্তু তবু আপনাকে একটু ভেবে দেখার সময় দিচ্ছি। আগামী শুক্রবার রাত আটটায় রেসকোর্সের মধ্যেকার কালীমন্দিরে আপনি নিজে গিয়ে সে চাবি দিয়ে আসবেন। যদি অন্যথা হয়, আর যদি পুলিশের সাহায্য নেবার চেষ্টা করেন তবে মনে রাখবেন আপনার গচ্ছিত সমস্ত ধনরত্নের চাইতে যা আপনি বেশি মূল্যবান মনে করেন আপনার সেই বংশের ইজ্জত আমি নষ্ট করে দেবো। টর্চের আলোটা নিভে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকবার পর আমি বললাম, আমার একটা কথা জিজ্ঞেস করবার আছে।
কোনও সাড়াশব্দ নেই। বেড সুইচটা টিপে ঘরের আলো জ্বেলে দেখলাম ঘরে কেউ নেই।
সবাই চুপ করে আগাগোড়া ঘটনাটা শুনে গেল। মিঃ সিম্পসন বললেন, আপনি বংশের ইজ্জতের ভয় করেন না? পুলিসের কাছে এলেন কেন?
বংশের ইজ্জতকে আমি সবচাইতে বড় বলে মনে করি, মি. সিম্পসন। আমি ক্ষুদ্র হতে পারি কিন্তু আমার বংশ মস্ত বড়–সেটাকে আমার সব সময় সকলের চেয়ে উপরে স্থান দিতে হবে। কিন্তু এই বিংশ শতাব্দীতে একজন ডাকাতের হুমকিতে যদি ভয়ে আমি জড়সড় হয়ে যাই এবং ধনরত্ন তার হাতে তুলে দিই তবে আমি নিজের কাছে একেবারে ছোটো হয়ে যাবো। কাল সারারাত ধরে ভেবেছি, কি করবো। একবার মনে হয়েছে, চাবিটা দিয়েই দিই-পরক্ষণেই আবার নিজের ভেতর থেকে কে যেন গর্জন করে বলেছে,
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।
ভালই করেছেন, চৌধুরী সাহেব। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে, আপনার বংশের ইজ্জত কি করে নষ্ট হতে পারে তার কোনো ইঙ্গিত পেয়েছেন কি?
সরাসরি কোনো ইঙ্গিত পাইনি। তবে মনে হয় সে আমার একমাত্র কন্যা রীণার প্রতিই ইঙ্গিত করেছে। এবং সেটাই আমাকে সবচাইতে বেশি অস্থির করে তুলেছে। আমার অবিবাহিতা এই যুবতী কন্যাকে যদি সে কোনও সুযোগে কোনো রকম অপমান করে তবে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।
আপনি নিশ্চিত থাকুন, মি. চৌধুরী। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে আমরা আপনাকে প্রোটেকশন দেবো।
শহীদ বললো, আপনার ঘরে আমাদের এখনই একবার নিয়ে যেতে হবে, মি. চৌধুরী।
নিশ্চয়ই। চলুন, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
সবাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আনিস চৌধুরী ড্রাইভিং সীটের দরজাটা খুলেই
কি ব্যাপার, কি হলো?সবাই অবাক হয়ে এগিয়ে গেল।
সাপ। সীটের ওপর সাপ।
সবাই কাছে গিয়ে দেখলো একটা গোখরা সাপ ফণা তুলে বসে আছে। লক লক করে তার জিভটা এক একবার বেরিয়ে আসছে। লাল সূতা দিয়ে ওটার ফণার কাছে একটা ভাঁজ করা কাগজ বাঁধা। কাগজটা সরিয়ে ফেলতে পারছে না বলে সাপটা উত্তরোত্তর উত্তেজিত হয়ে উঠছে।
রিভলভারটা বের করে গুলি করলো শহীদ। বিষধর গোখরার ফণাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ততক্ষণে একজন সেপাই এসে উপস্থিত হয়েছে। লাঠি দিয়ে সে মরা সাপটা বের করে রাস্তায় ফেললো। ভাঁজ করা কাগজটা খুলে দেখা গেল একটা চিঠি। তাতে লেখাঃ
চৌধুরী সাহেব,
আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা নেই দেখছি। আমি বিষধর গোক্ষুর। আমি করতে পারি না এমন কাজ নেই! আপনি আমার আদেশ অমান্য করে পুলিসের সাহায্য গ্রহণ করতে চলেছেন। এজন্যে আপনার জন্যে সামান্য শাস্তির আয়োজন করছি। দুএক দিনেই সেটা হাতে নাতে টের পাবেন। কিন্তু তবু আপনাকে আরেকবার সুযোগ দেবো ভাবছি। এবং সেটাই শেষ সুযোগ। তারপরও যদি আপনি পুলিস বা শহীদ খানের মতো চুনোপুটি টিকটিকির সাহায্য গ্রহণ করেন তবে আপনার কন্যার ইজ্জত নষ্ট করতে দ্বিধামাত্র করবো না। এই আমার শেষ কথা।
নেসার
চিঠিটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে অসহায় দৃষ্টিতে সবার মুখের দিকে একবার চাইলেন চৌধুরী সাহেব। তারপর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মনের উদ্বেগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তাঁর চোখে–মুখে।
শহীদ তাড়া দিলো,কই, চলুন মি. চৌধুরী!
ও, শ্যা, এই যে চলুন।
.
০৫.
রাত দশটার সময় মিঃ চৌধুরীর ড্রইংরূমে দুটো ক্রাচের ওপর ভর দিয়ে একজন খোঁড়া লোক এসে দাঁড়ালো। তার দীর্ঘ-ছায়া গিয়ে পড়লো মিঃ চৌধুরীর কোলে খুলে রাখা একটা ইংরেজী বই-এর উপর।
আসুন মি. শহীদ, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। বলে বইটা বন্ধ করে আগন্তুকের মুখের দিকে চেয়েই চমকে উঠলেন চৌধুরী সাহেব। আতঙ্কিত হয়ে বললেন, আপনি কে? কি চান?
পরিচয় দিচ্ছি। তার আগে বসতে বলুন।
সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে চৌধুরী সাহেব বললেন, বসুন।
আমাকে দেখে ভয় পাবার কিছুই নেই, মি. চৌধুরী।
আমি আপনার গুপ্তকক্ষের চাবি দাবি করতে আসিনি। কারণ আমি জানি আপনার বাবা সে চাবি আপনাকে দিয়ে যাননি। আমি বোকা নেসার নই। আমাকে দেখে আতঙ্কিত হবেন না; দেখতেই পাচ্ছেন, ল্যাংড়া মানুষ, কতটুকুই বা আমার ক্ষমতা। আপনার কোনও ক্ষতিই আমি করতে আসিনি। আপনি নিশ্চিত হয়ে আমার বক্তব্য শুনতে পারেন।
সব খবরই রাখেন দেখছি। যাক, আপনার বক্তব্যটা শুনি?
আমার সময় কম। সংক্ষেপে সব কথা সেরে সরে পড়তে চাই। কলিমের সাথে আপনার মেয়ে রীণার বিয়েতে আপনার অমত কেন?
তার আগে আমি জানতে পারি কি আপনি প্রশ্ন করবার কে?
আমার পরিচয় শুনলে আঁতকে উঠবেন-তাই পরিচয়টা গোপন রাখছি। আপনার ভালোর জন্যেই বলছি। এ বিয়েতে অমত করে ঠিক করেননি।
ভালো মন্দ বুঝবার ক্ষমতা আমার আছে। চাষার ছেলের সাথে চৌধুরী বংশের
এ বিয়েতে আপনার বংশের সম্মান কমে যাবে, আর নেসার আহমেদ যদি আপনার মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় তাহলে সম্মান বাড়বে, এই বলতে চান?
আমি আপনাকে কিছুই বলতে চাই না, আপনি এখন যেতে পারেন।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো খোঁড়া লোকটা উত্তেজিত হয়ে, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, বংশের ইজ্জত! ছিঃ লজ্জা করে না খোলশ মুখে পরে সমাজে বংশের বড়াই করে বেড়াতে? আপনার কাপুরুষ পিতা বংশের ইজ্জতের ভয়ে সমস্ত ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন পুরুষত্বহীন। প্রজনন ক্ষমতা তাঁর ছিলো না। জানতে পারি কি, তবু আপনার জন্ম সম্ভব হয়েছিল কি করে? একজন সাধারণ চাষাভুষো চাকরের ঔরসে নয় কি?
খবরদার! মুখ সামলে কথা বলো!–চিৎকার করে উঠলেন চৌধুরী সাহেব।
সত্যি কথা মুখের ওপর বলে যাচ্ছি। আপনার নিজের জন্ম ইতিহাস আপনার অজানা নেই। তবু সমাজের মাথায় বসে মিথ্যা বংশ গরিমার অহমিকায় বেলুনের মতো ফুলে থেকে যদি নিজে সুখী হতে চান আমার আপত্তির কিছুই ছিলো না। কিন্তু দুটি জীবন নষ্ট করে দেবার কোনও অধিকার আপনার নেই।
get out! বেরিয়ে যাও তুমি এখান থেকে।
যাচ্ছি। তার আগে আর একটা কথা বলে যাচ্ছি, এ বিয়ে হতেই হবে-কেউ ঠেকাতে পারবে না। আপনার এই মিথ্যে বংশ গরিমার চাইতে অনেক বড় অনেক মহান হচ্ছে দুটি তরুণ তরুণীর নিষ্পাপ প্রেম। এই প্রেমকে সফল করতে আমি আমার প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দেবো প্রয়োজন হলে।
দুই কান দুহাতে চেপে ধরলেন চৌধুরী সাহেব। থর থর করে সর্বশরীর কাঁপছে তীর। চোখের সামনে দেখলেন দুটো ক্র্যাচের ওপর ভর দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অকুতোভয় খোঁড়া লোকটা।
.
আবছা চাঁদের আলোয় রাতটা বড় সুন্দর। সেই সাথে দমকা পুবের হাওয়া মস্ত বড় বড় সাদা মেঘের টুকরোগুলোকে অনায়াসে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে কোন নিরুদ্দেশে। মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছে মেঘে পূর্ণিমার চাঁদ। আবার হঠাৎ ফিক করে হেসে উঠছে। রাত সাড়ে দশটা। এমন সময়, কে? চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো রীণা।
আমি, কলিম।
তুমি! এতো রাতে এই দোতলার ছাতে এলে কি করে?
পাইপ বেয়ে উঠেছি।
পাইপ বেয়ে! পড়ে গেলে কি দশা হতো ভেবেছো একবার?
এখন আমি মরতে ভয় পাই না রীণা।
বুঝলাম মস্ত বীর পুরুষ তুমি। এখন আবার আমাকে নিয়ে ছাতের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়তে চাইবে না তো?
ঠাট্টা নয় রীণা। আমি তোমার শেষ কথা শুনতে এসেছি। চলো, আমরা এখন থেকে পালিয়ে যাই। দূরে, কোনও দূর দেশে গিয়ে ঘর বাঁধবো আমরা।
রীণার একটা কোমল হাত তুলে নেয় কলিম তার হাতে।
আব্বাজানকে তো তুমি জানো। এরপরেও তুমি এ কথা কি করে বলছে কলিম আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। যদি তুমি আমার মৃত্যু কামনা করো, বলো আমি ফিরে যাচ্ছি, আর কখনও আসবো না।
ছিঃ! এ কথা বলো না। তুমি কৃতী ছাত্র, বিলেত যাচ্ছো, ফিরে এসে নিশ্চয়ই কোনও সুন্দরীকে বিয়ে করে সুখী হবে তুমি। ততদিনে আমার স্মৃতি মুছে যাবে তোমার মন থেকে। ভুলে যাবে তুমি রীণা চৌধুরী একদিন তোমায় ভালবেলেছিল–সমস্ত হৃদয় উজাড় করে দিয়ে। এ কয়দিন অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আত্মহত্যা করবার সাহস আমার নেই, পারিনি। এই বন্দীশালার দেয়ালে দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে আমি পাগল হয়ে যাবো কলিম!
গলাটা ভেঙে এলো রীণার। টপটপ করে কয়েক কোঁটা তপ্ত অশ্রু ঝরে পড়লো কলিমের হাতের ওপর।
কেঁদো না লক্ষ্মী! এখনো সময় আছে। চলো এ অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে আমাদের প্রেমের অপমান হবে রীণা।
কিন্তু আমি যে দুর্বল। অবিবাহিতা তরুণীর সমস্ত দ্বিধা, সমস্ত দ্বন্দ্ব যে আমার পা জড়িয়ে ধরেছে।
আমি কথা দিচ্ছি রীণা, কালই আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করে ফেলবো ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিসে গিয়ে, এবং তার আগে পর্যন্ত তোমাকে আমি স্পর্শ করবো না। আমাকে বিশ্বাস করো রীণা।
বেশ, প্রতিজ্ঞার মর্যাদা রক্ষার ভার তোমার ওপরেই থাকলো। আমি এই সুন্দর চাঁদ আর ঐ মাতাল হাওয়াকে সাক্ষী রেখে তোমার হাতে নিজকে সমর্পণ করলাম।
পা টিপে টিপে দুজনে এসে দাঁড়ালো বিরাট জমিদার বাড়িটার পেছনের দিককার পাঁচিলের সামনে। ওপারে জংলা মতো একটা মাঠ আছে আবর্জনায় ভর্তি। সেটা পেরোলেই নিরাপদে রাস্তায় এসে পড়তে সুবিধে হয় না।
ঝুপ করে পাঁচিলের ওপর থেকে দুজনে একসাথে লাফিয়ে পড়লো মাটিতে। অমনি ভোজবাজীর মতো জনা ছয়েক ঘণ্ডামার্কা লোক ঘিরে ধরলো ওদের। প্রস্তুত হওয়ার আগেই প্রচণ্ড মুষ্টাঘাত এসে পড়লো কলিমের নাকের ওপর। চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো কলিম। আরও কয়েকটা আঘাত এসে পড়লো ওর মাথায়, ঘাড়ে পিঠে। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে।
এদিকে অপর একজন রীণার মুখ চেপে ধরলো একটা রুমাল দিয়ে। কেমন একটা মিষ্টি গন্ধে মাথাটা ঝিমিয়ে এলো রীণার। অল্প কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে অজ্ঞান হয়ে পড়লো সে-ও।
দুজনে পাঁজাকোলা করে রীণার সংজ্ঞাহীন দেহটা নিয়ে একটা গাড়িতে তুললো। দুমিনিটের মধ্যেই আশেপাশে আর কারো চিহ্নমাত্র থাকলো না। কলিম কেবল পড়ে রইলো ঝোঁপঝাড়ের পাশে অজ্ঞান অবস্থায়।
.
০৬.
পরদিন একমাথা উস্কোখুস্কো চুল আর শুকনো মুখে চৌধুরী সাহেব এসে উপস্থিত হলেন শহীদের বাসায়।
আমাকে বাঁচান মি. শহীদ।
কি হলো? নতুন কোনও খবর আছে?
রীণাকে পাওয়া যাচ্ছে না কাল রাত থেকে। আজ একটু আগে একটা চিঠি পেলাম। এই দেখুন।
হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলো শহীদ। তাতে লেখা:
মি. চৌধুরী,
যে সামান্য শাস্তির কথা গত চিঠিতে লিখেছিলাম,
আজ নিশ্চয়ই তা টের পেয়েছেন। রীণাকে নিয়ে গেলাম।
আজ রাত এগারোটায় চাবিটা নিয়ে রেস কোর্সে আসবেন। সেখানে আমার লোক আপনার জন্যে অপেক্ষা করবে।
চাবিটা হাতে পেলে রীণাকে অক্ষত অবস্থায় আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেবো। কিন্তু যদি আবার পুলিসের কাছে যান তাহলে আপনার বংশ গৌরব আমি ধুলোয় মিশিয়ে দেবো। ধর্ষিতা রীণার উলঙ্গ দেহ পড়ে থাকবে রাস্তার ধারে। পত্রিকা মারফত এ খবর পৌঁছবে প্রতিটি ঘরে প্রতিটি লোকের কানে। আমার কথার নড়চড় হবে না, তার প্রমাণ পেয়েছেন। এই কথারও নড়চড় হবে না। অতএব সাবধান!
নেসার
চিঠিটা পড়ে বিস্মিত শহীদ জিজ্ঞেস করলো, এ চিঠিটা পাওয়ার পরও আমার কাছে এসেছেন! ধন্য আপনার সাহস!
ব্যাপারটা আসলে অন্যরকম, তাই আপনার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছি মি. শহীদ। এতো সাহস আমার নেই, আমি বড় দুর্বল। সেদিন অতো লোকের মধ্যে কথাটা আপনাকে বলতে পারিনি। যে চাবির জন্যে এতো কিছু, সে চাবি আমার কাছে নেই।
নারায়ণগঞ্জে আছে তো…
না। সেখানেও নেই। বাবা আমাকে সে চাবি দিয়ে যাননি।
আশ্চর্য তো! যাহোক, সে কথা পরিষ্কার করে জানাননি কেন প্রথম রাতেই!
জানাতে পারিনি। আত্মসম্মানে লেগেছে। মিথ্যা অহমিকার মোহজালে আবদ্ধ ছিলাম আমি। গত রাত্রে আমার সে ভুল ভেঙেছে। তার আগেই আমি আমার সর্বনাশ করে বসেছি।
আপনার বাবা সে চাবি আপনাকে দেননি কেন? তাঁর একমাত্র সন্তান হিসেবে ওটা তো আপনারই পাবার কথা?
কেন যে দেননি তা কারো কাছে ভেঙে বলা যাবে না মি. শহীদ। ও প্রশ্ন থাক।
তাহলে ব্যাপার দাঁড়ালো এই যে, চাবিটা আপনার কাছে নেই, অথচ সে চাবি আজ রাত এগারোটার মধ্যে আপনি নেসার আহমেদকে না দিলে আপনার মেয়ের সর্বনাশ করবে সে।
তাই যদি সে করে তবে আমার আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না মি. শহীদ। যে করে থোক আমাকে বাঁচান আপনি। এই দুশ্চিন্তায় আমি পাগল হয়ে
আপনি উতলা হবেন না চৌধুরী সাহেব। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। আজই রাত আটটার মধ্যে সদলবলে ধরা পড়বে নেসার আহমেদ। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
আপনাদের এই অভিযানে আমিও যোগ দিতে চাই মি. শহীদ।
তাতে আমাদের সুবিধার চাইতে অসুবিধাই হবে বেশি। আমরা ছদ্মবেশে আগে ওদের আড্ডায় কয়েকজন ঢুকে পড়বো। ওদের পালাবার সব পথ বন্ধ করে দেয়ার পর পুলিশ বাহিনী প্রবেশ করবে ভেতরে। অনেক বিপদ-আপদ ঘটতে পারে। আপনার যাওয়া ঠিক হবে না সেখানে।
আমার যেতেই হবে মি. শহীদ। ওদিকে আমার মেয়ের কপালে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা জানতে না পেরে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় আমি ছটফট করতে করতে হার্টফেলই করবো। হাই রাডপ্রেশার আমার, যে কোনও সময় কোলাপ করতে পারি। আপনার কোনও অসুবিধার সৃষ্টি করবো না আমি। দয়া করে আমাকে সাথে নিন মি. শহীদ।
বেশ, যখন এতো করে অনুরোধ করছেন, নেয়া যাবে আপনাকে। আপনি সন্ধ্যার সময় আমার এখানে চলে আসবেন। ছদ্মবেশ পরিয়ে আপনার চেহারা পাল্টে নিতে হবে রওনা হবার আগে।
আমি ঠিক সাতটায় পৌঁছবো এখানে।
.
অন্ধকার একটা ঘরে ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এলো রীণার। প্রথমে সে মনে করলো নিজের ঘরেই বুঝি শুয়ে আছে। তারপর হঠাৎ কলিমের কথা মনে পড়লো। এবং সাথে সাথে রাতের সমস্ত ঘটনা একসঙ্গে মনে পড়ে যেতেই চমকে উঠলো রীণা। কোথায় সে? উঠে বসতেই একটা নারীকণ্ঠে প্রশ্ন এলো, ঘুম ভাঙলো?
অবাক হয়ে চারপাশে চাইলো রীণা। অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে আসতেই দেখলো মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা স্ত্রীলোকের মূর্তি।
কে তুমি।
আমি? আমার পরিচয় নাই বা জানলে। মনে করে নাও আমিও তোমার মতোই একজন হতভাগিনী। ধরে নাও আমার নাম মোতিয়া।
মোতিয়া? আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে ওরা?
যেখানে আমাকেও একদিন এনেছিল এমনি করে বাবা-মা, ভাই-বোন, সমাজ-সংসার থেকে ছিন্ন করে।
কেন? আমাকে ধরে আনলো কেন?
তোমার বাবার কাছ থেকে তোমাদের জমিদার বাড়ির গুপ্ত কক্ষের চাবি আদায় করবার জন্যে।
চাবি পেলেই আমাকে ছেড়ে দেবে তো?
অসম্ভব। এরা তাকে একবার আনে, সে আর সমাজে ফিরে যেতে পারে না বোন! আমিও ভদ্রঘরের ভদ্র মেয়ে ছিলাম। একদিন এমনি করে মুখ চেপে ধরে নিয়ে এলো ওরা আমাকে। আজ আমি কলুষিত। কোথাও আমার স্থান নেই আর। প্রতিরাতে ওদের লালসার শিকার হওয়ার জন্যেই আমি বেঁচে আছি।
এখান থেকে পালাবার কোনও পথ নেই?
না। বিশ ফুট মাটির তলায় এই ঘর। ওপরে ওঠার পথই তুমি পাবে না।
এখন রাত কতো?
রাত কোথায়? দুপুর দুটো বাজে। আমি যাই, এখনই সর্দার ফিরবে। আমাকে এ ঘরে দেখলে চাবকে পিঠের চামড়া তুলে নেবে।
ত্রস্তপদে সোজা একটা দেয়ালের দিকে চলে গেল মোতিয়া, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে রীণা একবার চোখ কচলালো, স্বপ্ন না সত্যি। উঠে দেয়ালের কাছে গিয়ে দেখলো কোনও দরজা নেই সেখানে। এবার ভয় পেয়ে গেল রীণা, ভূত নয় তো!
এমনি সময় ঘরের মধ্যে এক ঝলক তীব্র আলো এসে পড়লো। রীণা চেয়ে দেখলো অপর একটা দেয়ালে দরজার মতো একটা ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে। পাশের ঘর থেকে উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে এই ঘরে।
ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো কোরবান আলী।
ঘুম ভেঙেছে সুন্দরী? বাহ, এই তো বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
দেয়ালটা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল। খশ করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে একটা মোমবাতি ধরালো কোরবান। তারপর নিঃসঙ্কোচে বিছানার ওপর বসে পড়ে বললো, যখনই তোমাকে দেখেছি তখনই তোমার প্রেমে পড়ে গেছি সুন্দরী। সারারাত কাল ছটফট করেছি, কলিজাটা শুকিয়ে একেবারে মরুভূমি হয়ে গেছে। তাই এলাম। যদি কিছু অধর সুধা পাই তবে এই অধমের প্রাণটা রক্ষা হয়। এদিকে এসো সুন্দরী, কাছে এসো, দূরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো রীণা। ভয়ে কণ্ঠতালু পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে ওর। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোরবান আলী নিজেই উঠে এলো ওর কাছে। ওর হাত ধরে মৃদু টান দিয়ে বললো, অবাধ্য হয়ো না সুন্দরী! তাতে কোনও লাভ আছে? স্বেচ্ছায় না আসো তোমাকে কাছে আনবার শক্তি আমার দেহে আছে। এসো।
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ালো রীণা। বললো, খবরদার। আমার গায়ে হাত দেবে না বলছি।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! হাসলে মাইরী। আমার ঘরে আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। গায়ে হাত দেবো না?
আবার এগিয়ে আসে কোরবান আলী। টেবিলের ওপর থেকে অলক্ষ্যে একটা কাঁচের ফুলদানি তুলে নিলো রীণা। কোরবান কয়েক পা এগোতেই সেটা ছুঁড়ে মারলো ওর মাথায়। কপালে লেগে মাটিতে পড়ে সশব্দে ভেঙে গেল কাঁচের ফুলদানি। ফিকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়লো কপাল থেকে। প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেল কোরবান আলী। তারপর বাঘের মতো লাফিয়ে পড়লো রীণার ওপর। ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে শূন্যে উঠিয়ে ফেললো, তারপর বিছানার পাশে যেতে যেতে এক হাতের কয়েকটা ক্ষিপ্ত টানে শাড়িটা খুলে ফেললো রীণার দেহ থেকে। তারপর ঝপাৎ করে ফেললো ওকে বিছানার ওপর। ব্লাউজের বোতাম খোলার চেষ্টা করছে কোরবান আলী। ছটফট করতে থাকলো রীণা ওর হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে। কিন্তু অসুরের মতো শক্তিশালী কোরবানের সাথে পারবে কেন সে?
এমনি সময় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো মোতিয়া। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে ডাকলো, কোরবান!
ঠিক স্প্রিং-এর মতো তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো কোরবান আলী।
এক্ষুণি বেরোও ঘর থেকে, নাহলে আমি সর্দারকে ডাকবো।
তীব্র জ্বালাময় দৃষ্টিতে একবার মোতিয়ার দিকে চাইলো কোরবান আলী, তারপর মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যাবার সময় চাপাস্বরে বলে গেল, এর প্রতিশোধ নেবো আমি। প্রস্তুত থেকো।
বিছানা থেকে উঠে রীণা মাটি থেকে কাপড়টা তুলে পরে নিলো। তারপর বললো, তুমি আমাকে বাঁচালে ভাই।
তাই মনে হচ্ছে আপাততঃ, কিন্তু রাত দশটার সময় তোমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সর্দারের শয়নকক্ষে দিয়ে আসতে হবে এই আমাকেই। তিনি আগে তোমাকে ধন্য করবেন তারপর তাঁর চেলা-চামুণ্ডারা।
.
চলে গেল মোতিয়া। বিছানার ওপর বসে পড়লো রীণা। বড় অসহায় লাগলো নিজেকে তার। মেয়েমানুষের জীবনটা কী? এই একটু আগেই একজন তার সর্বনাশ করতে বসেছিল, তাকে ঠেকাবার কোনও শক্তি ছিলো না তার। এ বিপদ কেটে গেল ঠিকই। কিন্তু রাতে? এক দস্যুর অঙ্গশায়িনী হতে হবে তাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। হঠাৎ কান্না পেলো রীণার। বিছানার ওপর লুটিয়ে পড়ে হু হু করে কেঁদে ফেললো সে। মনে পড়লো কলিমকে। এই বুঝি তাদের স্বপ্নের সুখের সংসার? কোথায় তুমি কলিম? তোমার কাছে প্রাণ মন সঁপে একসাথে বেরিয়েছিলাম ঘর থেকে। আমাকে একলা এই বিপদে ফেলে কোথায় রইলে তুমি এখন। বাঁচাও আমাকে কলিম! এই সর্বনাশ থেকে বাঁচাও!
.
জ্ঞান ফিরে এলো কলিমের ঠিক দুঘন্টা পর। কে যেন তার চোখে মুখে জল ছিটাচ্ছে। উঠে বসতেই চাঁদের আলোয় দেখতে পেলো ধানমণ্ডি লেকের ধারের সেই খোঁড়া ভদ্রলোককে।
আপনি? আপনি এখানে!
রীণা কোথায় কলিম? এলো না? তোমাকে এমন করে মারলেই বা কে? পড়ে গিয়েছিলে?
এ প্রশ্নে লিমের ঘোর কেটে গেল। সব কথা মনে পড়তেই একবার চারদিকে চাইলো সে, তারর সটান উঠে দাঁড়ালো।
কোথায় চললে?
পাঁচিল টপকে দুজন নেমেছিলাম এই মাঠে কিছু আগে। হঠাৎ কয়েকজন লোক আমাকে আক্রমণ করলো। বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আঘাত খেয়ে। আর কিছু মনে নেই আমার। কিন্তু রীণা? রীণা কোথায় গেল?
যা ভেবেছিলাম, তাই হয়েছে দেখছি। আমার পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে নেসার তার কাজ হাসিল করে নিয়েছে।
আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
চলো তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবো। এই মাঠে রীণাকে খুজলে পাবে না। তাছাড়া তোমার এখন চিকিৎসার দরকার। তোমার মাথা থেকে এখনও রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি। চলো দেরি করো না।
অদ্ভুত স্নেহশীল এই কণ্ঠ। যেন কতদিনের বন্ধু, এমনি দাবি এর কথায়। তাই উপেক্ষা করা যায় না এর নুরোধ। খোঁড়া লোকটার পিছন পিছন গিয়ে একটা কালো গাড়িতে উঠলো কলিম।
ভোর রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল কলিমের। মিষ্টি একটা বাজনার শব্দ এলো কানে। পাশের ঘর থেকে আসছে শব্দটা। নিজের অজান্তেই উঠে পড়লো কলিম বিছানা থেকে। ভৈরো রাগে সুগম্ভীর আলাপ করছে কে যেন সরোদে। অপূর্ব সুরমূর্ঘনায় অভিভূত হয়ে পড়লো কলিম। এগিয়ে গিয়ে পাশের ঘরের ভারী পর্দাটা সরিয়ে ভিতরে তাকাতেই কিছু একটা দেখে আঁতকে উঠলো কলিম। ভয়ে মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠলো ওর। শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে একটা শিরশিরে আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেল।…
আবছা আলো অন্ধকারে একটা বাঘের চামড়ার ওপর ধ্যানাসনে বসে সরোদ বাজাচ্ছে খোঁড়া লোকটা–আর তার সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাটিতে বসে আছেবিকট দর্শন প্রকাও একটা গরিলা।
সন্তর্পণে নিজের বিছানায় ফিরে এলো কলিম।
বাকি রাতটুকু আর ঘুম এলো না তার চোখে। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত মিষ্টি বাজনাটা বেজেই চললো।
.
০৭.
রাত আটটা। নতুন ঢাকার নির্জন মালিবাগ অঞ্চলের ইন্দ্রপুরী এলাকায় যেন লোক চলাচল একটু অস্বাভাবিক রকমের বেশি বলে মনে হচ্ছে। হরেক রকম লোক বিভিন্ন পোশাক পরিচ্ছদ পরে যাতায়াত করছে একটা মস্ত পুরোনো জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে।
আর সেই জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে স্বল্পালোকিত একটা মাঝারি আকারের ঘরে চলেছে ফ্লাশের আড়া। ঝনঝন আধুলি পড়ছে বোর্ড ফী; তারপর তাস বাটা হলে
আওয়াজ আসছে, এক রুপেয়া।
পাশ।
এক।
এক।
দো!
দো রুপেয়া।
পাঁচ।
পাশ।
বিশ রুপেয়া?
লে লো বিশ!
শো?
ছে সাত আঠ কা রান।
ছোডড়া বেটা, ইয়ে লো রানিং ফ্লাশ! হাহাহা…। আবার ঝনঝন পড়ছে বোর্ড।
দলের একজন নতুন স্যাঙাৎ জিতে নিয়ে যাচ্ছে প্রায় বেশির ভাগ বোর্ডই। সুদর্শন এই নবনিযুক্ত যুবকের পেছনে চেলাচামুণ্ডা জুটে গেছে ইতিমধ্যেই; হৈ হৈ করছে তাকে ঘিরে। এমন ভাগ্যবান সচরাচর মেলে না। ভালো বিলাতি বোতল নিশ্চয়ই মিলবে আজ এর পিছনে থাকলে।
এই নতুন লোকটি আমাদের শহীদ ছাড়া আর কেউ নয়। মি. সিম্পসন, চৌধুরী সাহেব আর কামালও আছে ছদ্মবেশে এই জুয়োর আড্ডায় অন্য সবার সাথে মিশে।
খোলোয়াড়দের মধ্যে মাতব্বর গোছের একজন অতিরিক্ত চটে গেছে নতুন মক্কেলের উপর। এ কেমন বেয়াদবী? নতুন ঢুকেই পুরোনোদের হারিয়ে দিচ্ছে। কেমন ধারা শরাফতী এটা? সে বলেই বসলো, বহোত চালু মালুম হোতে হো ভাইয়া। যারা সোঁচ সামাকে চ্যলন।
নতুন স্যাঙাৎ খাশ ঢাকাই ভাষায় বললো, আরে চুপ কইরা থাক। তেরীবেরী করিছ না। হারবার আইছত হাইরা বাইত্ যাগা।
রাগে গজ গজ করে পরাজিত জুয়াড়ীরা। কিছুক্ষণ পর আরও কয়েকজন এসে যোগ দিলো খেলায়। বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়া আর মদের বোতলের টুংটাং শব্দের সাথে মাতাল জুয়াড়ীদের মত্ত কোলাহল একটা নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ঘরটায়। পরস্পর পরস্পরের প্রতি অবাধে ম-কার ব-কার এবং শ-কার তুলে অশ্লীল মন্তব্য এবং গালাগালি চলেছে। ভদ্রতা সৌজন্যের প্রশ্ন এখানে বাতুলতা মাত্র।
এ সময় মোতিয়া ঢুকলো ঘরে। হৈ হৈ করে উঠলো সবাই। কেউ বললো, আও মেরী জান! কেউবা–জানে জিগ্যর, আও ইধার পেয়ারী।
কারও কথায় কর্ণপাত না করে গভীরভাবে মোতিয়া বললো, সর্দার মেহমানদের ওপরে তলব করেছেন।
কথাটা শেষ হবার সাথে সাথেই কয়েকজন লোক বাঘের মতন লাফিয়ে পড়লো শহীদ, কামাল, সিম্পসন আর চৌধুরী সাহেবের ওপর। প্রস্তুত হবার জন্যে এক মুহূর্ত সময় পেলো না ওরা। শহীদ প্রথম আক্রমণকারীর প্রায় নাকের ওপর একটা ঘুষি নিয়ে এসেছিল, কিন্তু পেছন থেকে অপর একজন সাপটে ধরে ফেললো ওকে এবং এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিয়ে পকেট থেকে রিভলবার বের করে নিলো। বাকি দুজন এগিয়ে এসে হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো ওর। ততক্ষণে বাকি তিনজনেরও একই অবস্থা হয়েছে।
শহীদ বুঝতে পারলো এতক্ষণ এ ঘরের সব কটা লোক তাদের না চিনতে পারার ভান করেছিল মাত্র। তাদের পরিচয় কারো কাছেই অজানা ছিলো না। সবাই কেবল সর্দারের হুকুমের অপেক্ষা করছিল। তবে যে দুদিন আগে জুম্মান মিস্ত্রি ওকে এই দলে ভর্তি করিয়ে দিলো সেটাও কি এদের অভিনয়? আজ ওকে দেখা গেল না কেন? সেও কি এদের হাতে বন্দী হয়েছে?
দোতলার একটা ঘরে নিয়ে আসা হলো বন্দীদের।
একটা ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে চুরুট টানছিল নেসার আহমেদ চোখ বন্ধ করে। পায়ের আওয়াজ শুনে ধীরে চোখ মেললো সে। মৃদু হেসে বললো, আসুন, আসুন, স্বাগতম। নেসার আহমেদকে বন্দী করতে এসেছিলেন, কিন্তু ভাগ্যের কি বিপরীত লিখন–উল্টো আপনারাই তার হাতে হলেন বন্দী। নিজেদের ছেলেমানুষী বুদ্ধিতে আমাকেও কচি খোকা ঠাউরে আপনারা মস্ত ভুল করেছেন, মি. সিম্পসন।
ততক্ষণে একটা মোটা রশি দিয়ে চারজনকেই শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। একটা মস্ত দরজার লোহার কড়ার সাথে।
আমাদের নিয়ে কী করতে চাও তুমি বদমাশ? মি. সিম্পসন রাগতঃ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
মুখের ভাষাটাকে আর একটু মার্জিত করতে শিখুন, মি. সিম্পসন। সৌজন্য প্রকাশ করতে পয়সা লাগে না। যাকগে, আপনাদের তিনজন, অর্থাৎ আপনি, মি. শহীদ এবং মি. কামালকে আমি এই প্রথম বারের মতো মৃদু শাস্তি দিয়েই ছেড়ে দেবো, মানে ভবিষ্যতে আমার পেছনে লাগবার দুঃসাহস আর যেন না হয়। আপনাদের গোটা শরীর থেকে মাত্র আধ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা আমি কেটে বাদ দিয়ে দেবো। যাতে খাওয়া দাওয়ার কোনো রকম অসুবিধা না হয় সেজন্যে ভাবছি বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুল থেকে কথা আমার মাথায় আসছে না।
এ ধরনের হুমকি আমি বহুবার, বহু চোর ছাচোরের মুখে শুনেছি নেসার। ওতে আমাকে কাবু করতে পারবে না। তুমি জানো, আমাদের কেশাগ্র স্পর্শ করলে তোমার
কচু হবে। একগাদা ভীতু পুলিস নিয়ে এসে বাড়ি ঘেরাও করেই মনে করেছেন নেসার আহমেদ ধরা পড়ে গেল। যাকগে, বৃথা বাক্যব্যয়ের সময় আমার নেই। আমার যে কথা সেই কাজ। তার প্রমাণ পাবেন অল্পক্ষণ পরেই। তবে আপনাদের মধ্যে থেকে যদি কেউ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবে আমি বিনা শাস্তিতে তাকে এই প্রথম বারের জন্যে মুক্তি দেবো। বলুন আপনাদের কারও কিছু বলবার আছে?
চৌধুরী সাহেব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, নেসার আহমেদ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আপনার কোনও কথা আমি শুনতে চাই না, দুবার আপনাকে সুযোগ দিয়েছি, তৃতীয় বারে আপনার ক্ষমা নেই। আমি শহীদ, কামাল আর সিম্পসনকে জিজ্ঞেস করছি, কারও কিছু বলবার আছে?
কেউ কোনও উত্তর দিলো না। এবার এক এক করে নাম ধরে ডাকলো নেসার, মি. সিম্পসন?
তিনি কোনও উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলেন, যেন শুনতেই পাচ্ছেন না কিছু।
মি. শহীদ?
আমি তোমাকে ঘৃণা করি। অতি নীচ পাষণ্ড তুমি। তোমাকে এছাড়া আর কিছুই বলবার নেই।
মি. কামাল?
কামাল কোনও উত্তর দিলো না, কেবল কটমট করে নেসারের দিকে চেয়ে রইলো।
বেশ। একটা ঝামেলা গেল। এবার বলুন, মি. চৌধুরী, চাবিটা এনেছেন?
চাবিটা আমার কাছে নেই। বাবা আমাকে ঐ চাবি দিয়ে যাননি।
বিশ্বাস করলাম না আপনার কথা। তাহলে চাবি আপনি দিচ্ছেন না?
নেই তো সেটা আমার কাছে।
ভাল কথা। আমার দ্বিতীয় চিঠিতে কি লেখা ছিলো নিশ্চয়ই পরিষ্কার মনে আছে আপনার। আমার আদেশ উপেক্ষা করে এর পরেও আপনি পুলিসের সাহায্য নিয়েছেন; এমন কি আজ আমার আস্তানায় উপস্থিত হয়েছেন আমাকে গ্রেপ্তার করে মেয়েকে উদ্ধার করবেন বলে।
আমি সেজন্যে মাফ চাইছি নেসার আহমেদ।
আপনি সে সীমা লঙ্ঘন করে গেছেন অনেক আগেই মি. চৌধুরী। এখন বৃথা মাফ চেয়ে নিজেকে ছোট করবেন না। আমার কথার নড়চড় হবে না। আপনার স্পর্ধার শাস্তি হিসেবে অল্পক্ষণ পরেই আপনার চোখের সামনে আপনার কন্যার সর্বনাশ করা হবে। ঐখানে বাঁধা অবস্থায় ছটফট করবেন আপনি, তাছাড়া আর কিছুই করবার উপায় থাকবে না আপনার।
নিভে যাওয়া চুরুটটা জ্বালিয়ে নিয়ে নেসার আহমেদ কয়েকবার পায়চারি করলো ঘরের মধ্যে। তারপর পাঞ্জাবী ভাষায় অনুচরদের কি যেন বললো। তার মধ্যে কোরবান আলী কথাটা ছাড়া আর কিছুই বোঝা গেল না। সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অল্পক্ষণ পরই নেসার আহমেদের প্রধান অনুচর কোরবান আলী এসে ঢুকলো ঘরে। লম্বা প্রায় সাড়ে ছফুট হবে, এবং সেই তুলনায় প্রস্থও প্রকাণ্ড। পেটা শরীরে পেশীগুলো স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল এবং কপালের নিচে দুটো জ্বলজ্বলে লাল চোখ। ঘরে ঢুকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো কোরবান।
কিছুক্ষণ পায়চারি করবার পর চৌধুরী সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো নেসার আহমেদ, তারপর বললো, আমার এই অনুচরটি আপনার কন্যার প্রতি অত্যন্ত আসক্তি হয়ে পড়েছে। আজ দুপুরে একবার ঢুকে পড়েছিল ওর ঘরে প্রেম নিবেদন করতে বহুকষ্টে ওকে ঠেকানো হয়েছে। আমার প্রিয় করেদের নজর দেয়া জিনিস আমি ভোগ করতে চাই না, তাই ওকেই ডেকে পাঠালাম।
কোরবান আলীর গোটা কতক নোংরা দাঁত বেরিয়ে পড়লো খুশিতে। কোনও মতে সেগুলোকে চেপে সবিনয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সে।
পর্দাটা সরিয়ে ফেলে।
সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখলো। নেসারের পিছনে যেটা এতক্ষণ দেয়াল মনে হয়েছিল সেটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল বা ধারের দেয়ালের ভেতর। সামনের বেশ কিছুটা জায়গা খোলা। এবং ঘরটার অপর প্রান্তে ঠিক শহীদদের মতো হাত দুটো পিছমোড়া করে দরজার কড়ার সাথে বাঁধা রয়েছে রীণা চৌধুরী। বাবার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো রীণা। বোঝা গেল কোনও কথাই ওর আগোচরে নেই। একটা অসহায় মেয়ের ওপর এতো বড় একটা পাশবিক কাণ্ড ঘটতে চলেছে তার পিতার চোখের সামনে; শহীদের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সমস্ত শক্তি দিয়ে সে চেষ্টা করলো কয়েকবার হাতের বাঁধনটা ছিঁড়ে ফেলতে। তাতে ফল কিছুই হলো না, বাঁধন আরও শক্ত হয়ে বসলো। ওর ব্যর্থ প্রয়াস নেসার চেয়ে দেখলো, তারপর মৃদু হেসে কোরবান আলীকে বললো, কোরবান তোমার কাজ তুমি কর।
লোভাতুর কুকুরের মতো ছুটে গেল কোরবান আলী রীণার পাশে। শাড়ির আঁচলটা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়ে একটানে রাউজটা ছিঁড়ে দুটুকরা করে ফেললো।
রীণার দেহ থেকে শাড়িটা খুলে মাটিতে ফেলে দিলো কোরবান আলী। রইলো কেবল বক্ষাবরণ আর পেটিকোটটা। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস পড়ছে উন্মত্ত কোরবানের।
রাগে দুঃখে চৌধুরী সাহেবের চোখে জল এলো। বিড় বিড় করে কেবল উচ্চারণ করলেন, আল্লা! তুমি আমার মেয়েকে বাঁচাও?
ঠিক সেই মুহূর্তে ঝড়ের বেগে ঘরে প্রবেশ করলো কলিম। বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো সে কোরবান আলীর ওপর। পেছন দিকে ফিরে ছিলো কোরবান আলী। অপ্রস্তুত কোরবান আলীর ঝাঁকড়া চুলের মুঠি ধরে এক টানে তাকে চিৎ করে মাটিতে শুইয়ে ফেললো কলিম। তারপর জুতো পায়ে দমাদম ওর নাকে মুখে লাথি মারতে থাকলো। কয়েকটা লাথি খাবার পর উপুড় হয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকবার চেষ্টা করলো কোরবান আলী, তখন নিষ্ঠুরভাবে কলিম ওর শরীরের যেখানে সেখানে লাথি মারতে থাকলো।
হঠাৎ কলিমের একটা পা ধরে হেচকা টান মারলো কোরবান আলী। পাকা মেঝের ওপর পড়ে কলিমের মাথাটা ভয়ানকভাবে ঠুকে গেল। দরদর করে রক্ত বেরিয়ে পড়লো আগের ক্ষত জায়গাটা থেকে। ততক্ষণে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে কোরবান। দেখা গেল, নির্মম লাথির চোটে একটা চোখ গলে বেরিয়ে পড়েছে কোটর থেকে। সে ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে নেসার আহমেদ ছাড়া বাকি সবাই শিউরে উঠলো। অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে হুড়মুড় করে পড়ে গেল কোরবান আলী রীণার পায়ের কাছে।
ঘটনাটা ঘটে যেতে দশ সেকেণ্ডের বেশি সময় লাগলো না। নেসার আহমেদ ততক্ষণে রিভলভার তুলে নিয়েছে হাতে। গর্জন করে উঠলো উত্তেজিত নেসার, কুকুরের মতো গুলি করে মারবো তোকে শয়তান! মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে নে।
কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা লাঠির আঘাতে নেসারের হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল দূরে। চমকে ফিরে চাইলো নেসার। দেখলো ডান ধারের খোলা জানালা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছে কুয়াশা। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মিশমিশে কালো প্রকাণ্ড এক গরিলা!
প্যান্টের সাথে ঝোলানো একটা খাপ থেকে একটানে একটা ঝকঝকে ছোরা বের করলো নেসার।
এতদিনে তোমায় সামনে পেয়েছি কুয়াশা! আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন।
ছোরা হাতে লাফিয়ে পড়লো নেসার কুয়াশার ওপর।
বিদ্যুৎ গতিতে সরে গেল কুয়াশা একপাশে। আর নেসার আহমেদ সোজা গিয়ে পড়লো গোগীর কবলে। লম্বা হাত দিয়ে প্রথমেই নেসারের নাক মুখের ওপর একটা প্রচণ্ড থাবড়া বসালো গরিলাটা। পড়ে যাচ্ছিলো নেসার আহমেদ, কিন্তু চট করে ধরে তাকে মাথার ওপর তুলে নিলো অসীম শক্তিশালী গোগী, তারপর ছুঁড়ে মারলো দূরের দেয়াল টার দিকে। দড়াম করে দেয়ালের সাত ফুট উঁচুতে একটা কাঁচের ফ্রেমে আঁটা ছবির ওপর গিয়ে পড়লো নেসারের দেহটা প্রবল বেগে, তারপর ভাঙা কাঁচের সাথে একই সঙ্গে পড়লো একেবারে সটান মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে। আর উঠলো না।
ওয়েল ডান্ গোগী! ওয়েল ডান! এখন ভালো মানুষের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো তো!
বলতে বলতে কুয়াশা এসে দাঁড়ালো হাত বাঁধা অবস্থায় শহীদ, কামাল, মি. চৌধুরী আর মি. সিম্পসনের সামনে।
ছিঃ ছিঃ? এতগুলো বুদ্ধিমান লোক ছাগলের মতো করে বাঁধা কেন? শহীদ খান, তুমিও যে এমন বোকামী করবে, এ আমি ভাবতেও পারিনি। যাক, বেশি কথার সময় নেই, অনেক কাজ পড়ে রয়েছে, আমি চলে গেলে কলিম তোমাদের বাঁধন খুলে দেবে। ততক্ষণ একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো।
নেসারের সংজ্ঞাহীন দেহটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা। তারপর নেসার আহমেদের গলায় বাঁধা একটা চারকোণা তাবিজ এক টানে ছিঁড়ে নিলো।
এদিকে কলিম ততক্ষণে ধীরে ধীরে উঠে বসেছে। অর্থহীন দৃষ্টিতে একবার চারদিকে চেয়ে দেখলো, তারপর নেসারের ছুরিটা দিয়ে রীণার বাঁধন কেটে দিলো। মাটি থেকে কুড়িয়ে রীণার শাড়িটা ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে এলো শহীদের দিকে।
মি. সিম্পসন উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, এই যে ভদ্রলোক, আমার হাতের বাঁধনটা কেটে দিন তো একটু তাড়াতাড়ি করুন।
কুয়াশা ততক্ষণ এসে দাঁড়িয়েছে মি. সিম্পসনের সামনে।
কেন, এতো তাড়া কিসের? এই বুঝি উপকারের যোগ্য প্রতিদান সিম্পসন? ভেবেছো কেবল হুইসলটায় তিনটে ফুঁ দিলেই কুয়াশা নেসার দুজনকেই একসাথে ধরে ফেলবে? একসাথে দুজনকে গ্রেপ্তার করা এবার আর তোমার কপালে নেই। তোমার সাথে বোঝাপড়া আমার বাকিই থাকলো।
খোলা জানালার ধারে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো কুয়াশা গরিলাটাকে। তাকে পিঠে নিয়ে জানালার বাইরে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়লো গোগী।
.
০৮.
ধানমণ্ডি এলাকায় ঈদগাহের কাছে একটা ছোটো ঘর ভাড়া করে থাকে কলিম। মি. চৌধুরীর নীল মরিস মিনিমাইনরটা এসে থামলো সে বাড়ির সামনে। রীণার পেছনে পেছনে কলিমের ঘরে এসে ঢুকলেন মি. চৌধুরী। একটা চৌকির ওপর কাত হয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আকাশ পাতাল ভাবছিল কলিম। হঠাৎ চৌধুরী সাহেবকে ঘরে ঢুকতে দেখে যতখানি না আশ্চর্য হলো তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠলো কোথায় বসতে দেবে ভেবে। ওকে বিছানা থেকে উঠবার চেষ্টা করতে দেখে চৌধুরী সাহেব একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠলেন।
শুয়ে থাকো, শুয়ে থাকো কলিম। উঠো না। এই যে আমি এখানে বসছি।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন মি. চৌধুরী।
এখন কেমন বোধ করছে কলিম? ওষুধগুলো খাচ্ছো তো? কই, ঐ তো ভরা শিশি রয়েছে, একদাগও খাওয়া হয়নি। মাথায় আইস ব্যাগের ব্যবস্থা হয়নি! না কলিম! এখানে তোমার থাকা হবে না।
কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর রয়েছে গায়ে। এবার মাথা নেড়ে বললেন, অসম্ভব। এই অবস্থায় তোমার একা থাকা চলবে না। এক্ষুণি আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে আমার বাসায়। ওখানে রীণা সব সময়ই দেখাশোনা করতে পারবে।
এতক্ষণ চুপ করেই ছিলো কলিম। এবার গভীরভাবে বললো, চাষার ছেলের জন্যে এই ঘরই যথেষ্ট। আমি এখানেই থাকবো।
পাগল ছেলে! এখনও বুঝি অভিমনি যায়নি? সে জন্যে আমি ক্ষমা চাচ্ছি কলিম। আমার সব ভুল ভেঙে দিয়েছে সেই খোঁড়া লোকটা। আমার সেই বংশের মিথ্যা গৌরব ঘুচে গেছে চিরকালের মতো। তুমি তোমার জীবন বিপন্ন করে আমার মেয়েকে রক্ষা করতে পারো; আর আমি এই সামান্য কাজটুকু করার অধিকার পাবো না? আমি কোনো কথাই শুনবো না কলিম, আমি গাড়িটা ঘুরিয়ে রাখছি, তোমরা দুজন জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও জলদি।
গটগট করে বেরিয়ে গেলেন মি. চৌধুরী। এবার রীণা এসে বসলো কলিমের মাথার কাছে। কপালে একটা কোমল হাত রেখে বললো, চলো কলিম! আব্বাজান ঠিকই বলেছেন, এভাবে একা থাকা ঠিক হবে না। নেসার আহমেদ পাগলের মতো তোমাকে আর সেই খোঁড়া লোকটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাদের বাড়ি দশজন পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ওখানে চলো, তোমার এই অসুস্থ অবস্থায় তোমাকে চোখে চোখে রাখতে পারবো এই আমার সবচেয়ে বড় লাভ।
নেসার আহমেদ? কেন, সে ধরা পড়েনি?
পুলিসের গাড়ি থেকেই কাল রাতে কৌশলে হাতকড়া খুলে উধাও হয়ে গিয়েছে। সে। থানা পর্যন্ত আর নিতে পারেনি ওকে। সেই জন্যেই তো তয়, তুমি চলো আমাদের সাথে।
কিন্তু…
আর কোনও কিন্তু নয় কলিম। চলো লক্ষ্মী! আব্বাজন একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। আজই সকালে তোমার আব্বাকে টেলিগ্রাম করেছেন, সেই সাথে মাফ চেয়ে লম্বা এক চিঠি দিয়েছেন। দশ তারিখে যে আমাদের বিয়ে!
সত্যিই! লাফিয়ে উঠে বসে কলিম। কি করে এটা সম্ভব হলো?
সত্যি নয় তো কি? কুয়াশা আব্বাজানের এই পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আচ্ছা কলিম, লোকটা কে?
জানি না। তবে এইটুকু বুঝেছি অদ্ভুত বুদ্ধিমান এবং দুর্দান্ত সাহসী এই লোকটার মধ্যে আগুন আছে। এই মহান আগুনের কাছে এলে সবার কালিমা ঘুচে যায়। এমন মানুষ আর দেখিনি আমি।
.
আনিস চৌধুরীর বাড়িতে বিকেল বেলায় চায়ের আসর বসেছে। শহীদ, কামাল, মি. সিম্পসন, রীণা সবাই গোল হয়ে বসেছে সামনের লাউঞ্জে। সবুজ ঘাসের ওপর পরিপাটি করে খানকয়েক চেয়ার আর ছোটো ছোটো তেপায়া সাজানো।
আনিস চৌধুরী এসে বসলেন একটা খালি চেয়ারে। শহীদকে লক্ষ্য করে বললেন, মনে হচ্ছে এই কয়টা দিন যেন একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে উঠলাম। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে বিশ্বাসই হতে চায় না সব কিছু।
সত্যি বলেছেন। ঠিক যেন একটা দুঃস্বপ্ন!
কামাল শহীদের দিকে চেয়ে বললো, কয়েকটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না কিছুতেই। এ কদিন ব্যস্ততার মধ্যে জিজ্ঞেস করবার সময়ই পাইনি। একটু বুঝিয়ে দে ভাই।
জিজ্ঞেস কর, আমি যতটা বুঝেছি বলবো।
মিশরীয় নর্তকীকে খুন করা হলো কেন?
তার কাছে মিশরের পিরামিডের নিচের একটা গুপ্তধনের নক্সা ছিলো, তাই।
গুপ্তধনের নক্সা! পিরামিডের নিচে…
হ্যাঁ, এই নর্তকী ছিলো মিশর রাজকুমারীর বাল্য-সখী। রাজ-অন্তঃপুরে ছিলো তার অবাধ যাতায়াত। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এই জেবা ফারাহ সুযোগ বুঝে একদিন রাজবাড়ি থেকে নক্সাটা চুরি করলো। মহামূল্যবান ধন-রত্ন মণি-মাণিক্য সেই পিরামিডের তলায় রক্ষিত আছে কয়েক হাজার বছর ধরে, রাজ্যের দুর্দিনে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে। নক্সা চুরির কথা জানাজানি হলে পরে খুব.চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো রাজ অন্তঃপুরে। যে কয়েকজনকে সন্দেহ করে নজরবন্দী রাখা হলো জেবাও তাদের মধ্যে একজন। মিশর সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠলো এদের বিরুদ্ধে। রাজরোষ এড়াবার জন্যে নানান ছলে জেবাকে পালিয়ে আসতে হয় তুরস্কে। সেখানেও শান্তি নেই, মনের মধ্যে সন্দেহ-মিশরীয় গুপ্তচর নিশ্চয়ই লেগে আছে পেছনে। তাই সারা মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া, ইরান, ইরাক, টার্কি আজ এখানে কাল ওখানে নাচ দেখিয়ে বেড়াতে লাগলো জেবা ফারাহ। সেই সূত্রেই লাহোরে এসে উপস্থিত হলো একদিন সে। এবং সেখানেই পড়লো নেসারের খপ্পরে।
অনেক রকম প্রলোভন এবং ভয় প্রদর্শনেও যখন জেবা কিছুতেই দিলো না নক্সাটা, বারবারই পিছলে বেরিয়ে গেল ওর হাতের মুঠি থেকে তখন তাকে হত্যা করে নক্সাটা ছিনিয়ে নেবার সঙ্কল্প নিয়েই সে এসেছিল ঢাকায়–এবং তাই সে করেছে।
গল্পটা মন্দ লাগলো না শুনতে। কিন্তু এ গল্প পেলে কোথায় তুমি শহীদ? মৃদু হেসে মি. সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন।
কিছুটা আমার কল্পনা, কিছুটা কাফ্রী দেহরক্ষী খোদা বক্সের কাছ থেকে নানান কথার ছলে বের করে নেয়া আর বাকিটুকু বাস্তব প্রমাণ পেয়েছি। নেসারের আজ্ঞায় কুয়াশা যে তাবিজটা ওর গলা থেকে টান দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে গেল, তারই মধ্যে রয়েছে সেই নক্সাটা। এই তাবিজেরই কিছুটা মোম পেয়েছিলাম আমি জেবার বিছানার ওপর। নেসার আহমেদ তাবিজের মুখে আটকানো এই মোম খুলে পরীক্ষা করে নিয়েছিল সত্যি সত্যিই নক্সাটা আছে কিনা তাবিজের মধ্যে।
তাহলে তুমি বলতে চাও কুয়াশাও জানতো এই নক্সার কথা?
নিশ্চয়ই। সেও গিয়েছিল জেবার ঘরে এরই জন্যে। কিন্তু কিছুটা দেরি করে ফেলেছিল।
যদি স্বীকার করে নিই এরই জন্যে কুয়াশাও গিয়েছিল সেখানে, তবে সে নেসারের কাছ থেকে সেটা কেড়ে নিলো না কেন?
কুয়াশা যখন সে ঘরে উপস্থিত হলো, ততক্ষণে নেসার সরে পড়েছে।
কোন্ পথে? নেসার আহমেদ অদৃশ্য হলো কোন পথে?
একটু হেসে শহীদ বললো, কেন, সদর দরজা দিয়ে। এটা তো সাধারণ কথা। একটু কল্পনার আশ্রয় নিলেই বোঝা যায়। জেবা ফারাহকে হত্যা করে নেসার নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছে সেই কামরায়। খোদা বক্স যখন দরজায় করাঘাত করে তখনও সে চুপচাপ বসে আছে সে ঘরে। তারপর যখন মুহূর্মুহূ টেলিফোন বাজতে আরম্ভ করলো তখন নিশ্চিন্ত মনে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে সে।
এটা হতেই পারে না। পুলিস এসে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ পেয়েছে। সিম্পসন আপত্তি তুললেন।
তাতো পাবেই। দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ পাবেই। নেসারের অন্তর্ধানের অল্পক্ষণ পরেই কুয়াশা এসে উপস্থিত হয়েছে পাম গাছটা বেয়ে। দরজাটা খোলা দেখে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে নক্সাটা খুঁজেছে তন্ন তন্ন করে, তারপর না পেয়ে আবার গাছ বেয়ে নেমে গেছে গরিলার সাহায্যে।
I see! এতক্ষণে বুঝলাম! এই সাধারণ কথাটা আমার মাথায় খেলেনি শহীদ। সেই সেদিন থেকে ভেবে মরছি তৃতীয় লোকটা অদৃশ্য হলো কোন পথে। যাক আর একটা কথা। সেদিন কুয়াশার জেবার ওখানে যেতে দেরি হয়ে যেতো না, যদি সে তোমার বাসায় সময় নষ্ট না করতো। সে তোমার বাসায় গিয়েছিল একথা আমি যেমন জানি, তুমিও জানো; কিন্তু আমার কাছে অস্বীকার করলে কেন?
এখনও অস্বীকার করছি। যদি সে গিয়ে থাকে, গিয়েছে আমার অজান্তে।
তোমারই বৈঠকখানায় একটা জ্যান্ত গরিলা কারও সাথে ধস্তাধস্তি করে গেল, ঝনঝন করে একটা আলমারির কাঁচ ভেঙে গেল, আর তুমি সে সম্বন্ধে কিছুই জানো না? কুয়াশার প্রতি তোমার এই দুর্বলতার কারণ কি? তোমরা কুয়াশাকে সব সময় আড়াল করে রাখছো কেন? এর কি জবাব দেবে তোমরা শহীদ! তোমাদের সাথে কুয়াশার কি সম্পর্ক? একটা হীন দস্যুর সাথে তোমাদের কি ধরনের যোগাযোগ থাকতে পারে? তোমরা …
কলিম বাধা দিয়ে বললো, কুয়াশাকে হীন দস্যু বলেছেন কেন মি. সিম্পসন। সে তো কোথাও চুরি বা ডাকাতি করেনি। বরং আমাদের সবাইকে নিজের জীবন বিপন্ন করেও এক সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করেছে।
দেখুন মি. কলিম, সরাসরি কোনও ডাকাতি কুয়াশা করেনি ঠিকই, কিন্তু চোরাই মাল তার কাছে আছে। নেসার আহমেদ ডাকাতি করেছে আর কুয়াশা নিয়েছে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে। আইনের চোখে যে চুরি করে আর যে চোরের উপর বাটপারি করে, দুজনেই সমান অপরাধী।
তা অবশ্য ঠিকই। তবে…
আর কোনও তবে নেই এর মধ্যে, মি. কলিম। আমার দুই একটা প্রশ্নের সঠিক এবং সত্য উত্তর দিতে হবে আপনাকে। এখন একমাত্র আপনিই ভরসা। আপনার কাছ থেকে সঠিক উত্তর পেলে আজই রাতে আমি কুয়াশাকে গ্রেপ্তার করতে পারবো।
বলুন কি প্রশ্ন আপনার।
সেদিন রাতে কি আপনাকে সাহায্য করতেই কুয়াশা নেসারের আজ্ঞায় গিয়েছিল?
হ্যাঁ।
আপনাকে সে-ই চিনিয়ে দিয়েছিল সে আচ্ছা?
হ্যাঁ।
আপনার সাথে তার পরিচয় কতদিনের?
পাঁচ ছয় দিনের।
সে আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো কী স্বার্থে?
কোনও স্বার্থেই নয়। তিনি স্বার্থপরতার ঊর্ধে।
ওর বাড়িতে গিয়েছেন কখনও?
গিয়েছি।
এখন চিনতে পারবেন সে বাড়িটা?
খুব চিনতে পারবো। কিন্তু প্রাণ গেলেও আপনাকে চিনিয়ে দেবো না। এ নিয়ে দয়া করে বৃথা তর্ক করবেন না। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে আপনার?
কোনও উত্তর না দিয়ে মি. সিম্পসন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। চৌধুরী সাহেবের প্রতি সামান্য একটু মাথা ঝাঁকিয়ে পা বাড়ালেন গেটের দিকে, তারপর কি ভেবে থেমে শহীদের দিকে ফিরে বললেন, শহীদ, এই পার্টিটা সেরেই চলে এসো আমার অফিসে। খুব জরুরী ব্যাপার আছে। ভুলো না কিন্তু।
চলে গেলেন মি. সিম্পসন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। কালো হয়ে মেঘ করেছে আকাশে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে অল্পক্ষণ হলো। প্রচণ্ড দুর্যোগের পূর্বাভাস।
অতিথিদের নিয়ে মি. চৌধুরী চলে গেলেন ড্রইংরুমে। পাশাপাশি বসে রইলো কলিম আর রীণা। রীণার একটা হাত কলিমের হাতে। কলিম মৃদু স্বরে ডাকলো, রিণি!
কি?
কিছু না।
ডাকলে যে?
এমনি তোমাকে ডাকতে ইচ্ছে করছে।
দুজনেই হাসলো। তারপর চুপ করে বোধহয় একই সাথে ভাবতে লাগলো আগামী দশ তারিখের কথা।
এমন সময় কাছেই একটা পায়ের শব্দে দুজনেই চমকে উঠলো। তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কুয়াশা। কলিমের কাঁধে একটা হাত রেখে কুয়াশা বললো, আমি আজ চলে যাচ্ছি এদেশ ছেড়ে। ভাবলাম যাবার আগে তোমাদের বলে যাই। তোমাদের বিয়েতে উপহার দেবার মতো কিছুই নেই আমার। অনেক টাকা উপার্জন করেছি আমি, কিন্তু সে সবই চুরি ডাকাতির টাকা– সে টাকায় কেনা কোনও উপহার দিয়ে তোমাদের আগামী দিনের পবিত্র সুন্দর সূচনাকে আমি অশুত করবো না। তাই বিদায় কালে আমি শুধু মুখেই তোমাদের আর্শীবাদ করে যাচ্ছি, চির সুখী হও। কল্যাণময় হোক তোমাদের জীবন! উজ্জ্বলতর হোক তোমাদের প্রেম!
অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কুয়াশার ছায়ামূর্তিটা।
.
০৯.
চৌধুরী বাড়ির গেট ছাড়িয়েই হঠাৎ কামাল শহীদকে বললো, কথাগুলো কিন্তু অন্যায় বলেননি মি. সিম্পসন। আমিও এ নিয়ে কদিন ধরে অনেক মাথা ঘামাচ্ছি। কুয়াশার প্রতি আমাদের এই অহেতুক দুর্বলতা কেন? একটা দস্যুর সাথে আমাদের কিসের এতো দহরম-মহরম? এক সময় হয়তো সে বন্ধু ছিলো–তা আমরা ওকে চিনতাম না বলে তাই বলে কি ও যা খুশি অন্যায় কাজ করে যাবে, আমরা কিছুই বলবো না? এই কি আমাদের ব্রত–এই কি আমাদের ন্যায়-নীতি? এর কি জবাব দিবি তুই, বল?
শহীদের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। মাথাটা সামনের দিকে একটু নিচু করে কী যেন ভাবতে লাগলো সে–কোনও উত্তর দিতে পারলো না। সত্যিই তো, এর কি জবাব দেবে সে? অন্যায়কে সে প্রশ্রয় দিচ্ছে। নিজের বিবেককে সে কোন ব্যাখ্যা দিয়ে শান্ত করবে? এ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। সমস্ত মায়া-মোহ-দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে যদি ন্যায়ের পথে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে না-ই পড়তে পারলো, তবে কেন মিছেমিছি ভড়ং করছে সে? কুয়াশার পক্ষে বা বিপক্ষে, কোনও দিকেই কিছু কাজ করতে পারছে না সে। কেউ যেন দুহাত বেঁধে নিরুপায় করে রেখেছে ওকে। ছি ছি, এ কী অবস্থায় পড়লো সে?
গোয়েন্দাগিরি আমি ছেড়ে দেবো কামাল।
কেন? বিস্মিত কামাল ভ্রূ কুঁচকে চাইলো শহীদের দিকে।
দিনের পর দিন নিজের কাছে নিজে ছোটো হয়ে যাচ্ছি।
সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সোজা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবি না?
না।
এই তোর মনের বল? এই তোর চরিত্রের দৃঢ়তা? এই তোর কর্তব্যনিষ্ঠা? তুই কী রে?
কোনও উত্তর নেই শহীদের মুখে। বেদনায় বুঝি কণ্ঠ গোল রুদ্ধ হয়ে। একটা মোড় ঘুরতেই কামাল বললো, আমাকে নামিয়ে দে এখানে, একটু কাজ আছে।
.
প্রচণ্ড ঝড় এবং সেই সাথে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে শহীদের মরিস মাইনর গাড়িটা এসে থামলো মি. সিম্পসনের অফিসের সামনে। সিম্পসন প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, খাওয়া দাওয়া শেষ করে এসেছো তো?
না। আমি চৌধুরী সাহেবের বাসা থেকে সোজা আসছি।
বেশ করেছে। এখন আমার সাথে কিছু খেয়ে নাও তো, আজ সারারাত হয়তো জাগতে হতে পারে বনে-জঙ্গলে।
আপনি খান, আমার ক্ষিধে নেই। কিন্তু ব্যাপারটা কি? হঠাৎ শিকারের ঝোঁক নাকি?
শিকার? তা কিছুটা শিকার তো বটেই। গরিলা শিকার। আজ আমার শেষ চেষ্টা। আজও যদি বিফল হই তবে আর কুয়াশাকে ধরতে পারবো না কোনদিন।
আমাকে আর এর মধ্যে টানছেন কেন, মি. সিম্পসন। অবিশ্বাসের পাত্র হয়েও আপনার সাথে একসঙ্গে আমি কাজ করতে পারবো না। আমাকে ডেকে ভুল করেছেন।
ঠিকই করেছি শহীদ। তুমি তো কুয়াশাকে সাহায্য করছে না, আমাকেও বাধা দিচ্ছে না। কেবল ওর ব্যাপারটা আমার কাছে সম্পূর্ণ চেপে যাচ্ছে। এতে অবিশ্বাসের কিছু নেই। আমি বুঝতে পারছি তোমার নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা আছে। আমার সাথে চলো শহীদ। তুমি সাথে থাকলে অনেক লাভ আছে।
মাফ করবেন, মি. সিম্পসন, আমি কচি খোকা নই কিম্বা খেলার পুতুলও নই। আপনি মনে করেছেন, আমি সাথে থাকলে আপনি নিরাপদে আমার আড়ালে থেকে কাজ উদ্ধার করতে পারবেন। আমাকে কুয়াশা কিছুই বলবে না, সেই সুযোগে আপনিও ওর আড্ডায় হানা দেবার বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন। কেন? আপনার সাহস নেই? একটা খোঁড়া লোককে এতো ভয় পাবার কি আছে? আপনি একাই যান, মি. সিম্পসন, এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না।
শহীদ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বিলাতী কায়দায় একবার কাঁধটা ঝাঁকিয়ে নিলেন মি. সিম্পসন, তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন মুচকি হেসে।
.
তুমুল বর্ষণ চলছে বাইরে। রাত নটা সাড়ে-নটা হবে। কুয়াশা তার ল্যাবরেটরীতে বসে নিবিষ্টচিত্তে কি যেন পরীক্ষা করছে। শান্ত সৌম্য চেহারা তার।
ঘরের এক কোণে মোটা শিকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে গোগী। বাড়ি থেকে এদিকে ওদিকে বেরিয়ে গিয়ে কি বিপদ বাধিয়ে বসবে সেজন্যে এই ব্যবস্থা।
কিছুক্ষণ ধরে একটু বেশি চঞ্চল হয়ে উঠেছে গোগী। ছটফট করছে, আর শিকলটা ছিড়বার চেষ্টা করছে। কুয়াশা একবার ওর দিকে চেয়ে বললো, Quite Gogi! চুপচাপ বসে থাকো, কাজ করছি এখন।
কিন্তু আরো চঞ্চল হয়ে উঠলো গোগী। কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছে কিন্তু বোঝাতে পারছে না।
ঠুং ঠাং শিকলের শব্দে বিরক্ত হয়ে কুয়াশা আবার ফিরে চাইলো গোগীর দিকে। একমুহূর্ত গোগীর মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলো কি যেন। তারপর বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে দাঁড়ালো দরজার দিকে।
এবার? এবার কোথায় যাবে কুয়াশা?
খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেসার আহমেদ। হাতে উদ্যত রিভলভার।
কোনও রকম চালাকীর চেষ্টা করো না। ভালোয় ভালোয় নক্সাটা বের করে দাও। বললো নেসার।
এবার কোমরে বাঁধা শিকলটা ছিড়বার জন্যে পাগলের মতো টানাটানি আরম্ভ করলো গোগী। চিনতে পেরেছে সে নেসারকে। ওর দিকে চাইতেই জ্বলে উঠলো নেসার আহমেদের হিংস্র দুটো চোখ। রিভলভারের মুখটা ঘুরে গেল গোগীর দিকে।
তুমিও আজ মজা টের পাবে বাছাধ। আজ শিকলে বাঁধা আছে। তোমার নাগালের বাইরে আজ আমি।
গুড়ুম করে গুলি ছুঁড়লো নেসার। কিন্তু পিছন থেকে কে যেন ওর হাতে একটা ধাক্কা দিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিলো ওকে। চমকে ঘুরে দাঁড়ালো নেসার। দেখলো একজন লোক দাঁড়িয়ে আসে ওর সামনে। মুখে একটা কালো মুখোশ পরা। প্রায় ছফুট লম্বা সবল সুঠাম দেহের অধিকারী এই আগন্তুক। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে চুপচুপে হয়ে গেছে।
নেসারের কব্জিতে একটা বিশেষ কায়দায় চাপ দিতেই ঠিক শিশুর হাতের খেলনার মতোই রিভলভারটা পড়ে গেল মাটিতে। পা দিয়ে একটা লাথি মেরে রিভলভারটা ঘরের এক কোণে সরিয়ে দিলো মুখোশধারী। নেসার আহমেদ ততক্ষণে এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছে। অসুরের মতো শক্তিশালী নেসার এবার খালি হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটার ওপর। এলোপাতাড়ি কয়েকটা ঘুসি খেয়ে আগন্তুক পিছিয়ে গেল কিছুটা। আবার বাঁপিয়ে পড়লো নেসার আহমেদ প্রবল বিক্রমে। এবার কিন্তু ফল হলো উল্টো। অদ্ভুত কায়দায় লোকটা অল্প একটু সরে গিয়ে নেসারের একটা হাত ধরে ফেললো। তারপর যুযুৎসুর এক প্যাঁচে আছড়ে ফেললো মাটিতে। নেসারও কম যায় না। মাটিতে পড়লো বটে কিন্তু মুখোশধারীকে নিয়েই পড়লো। আগন্তুকের বুকের ওপর উঠে বসে তার গলা টিপে ধরলো নেসার।
এদিকে কুয়াশা পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে একটা চাবি-গোগীর শিকল খুলবার চাবিটা পাওয়া যাচ্ছে না।
লোকটা। তখন পা দুটো ভাঁজ করে এনে নেসারের গলায় বাধিয়ে জোরে একটা লাথি মারলো সে। ডিগবাজী খেয়ে নেসার ছিটকে পড়লো দূরে। জোরে দেয়ালে ঠুকে গেল তার মাথাটা। এগিয়ে গিয়ে আগন্তুক বুশ শার্টের কলার ধরে টেনে তুললো নেসারকে, তারপর দেয়ালের সাথে ঠুকতে থাকলো ওর মাথাটা প্রবল বেগে যতক্ষণ না সে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো।
ড্রয়ার থেকে একটা শক্ত দড়ি বের করে ছুঁড়ে দিলো কুয়াশা মুখোশধারীর দিকে। বললো, তোমাকে চিনতে পারলাম না ভাই, কে তুমি, এমন ভাবে আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করে চিরঋণী করে রাখছো?
কোনও জবাব না দিয়ে মুখোশধারী নেসারের হাত পা ভালো করে বেঁধে ফেললো। এমন সময় কাছেই কয়েকটা রাইফেলের গুলির আওয়াজ হতেই কুয়াশা ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে উঠলো। আগন্তুককেও একটু বিচলিত মনে হলো।
একটা বোতল থেকে কিছু এসিড ঢেলে দিলো কুয়াশা গোগীর কোমরে বাঁধা লোহার শিকলের ওপর। গলে গেল লোহা। মুক্তি পেয়েই গোগী নেসারের দিকে চললো।
ঠিক এমনি সময়ে সামনের খোলা দরজা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন মি, সিম্পসন, সাথে তিনজন রাইফেলধারী সেপাই। ঢুকেই বগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, হ্যাণ্ড স আপ। যে যেখানে আছে দাঁড়িয়ে থাকো–কেউ এক পা নড়াচড়া করবে না।
গোগী থমকে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনলো, তারপর এগিয়ে গেল থপ থপ করে মি. সিম্পসনের দিকে। সেপাইগুলো এই ভয়ঙ্কর গরিলা মূর্তি দেখে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। এক মুহূর্তে মনস্থির করে গুলি করলেন মি. সিম্পসন। বাঁ হাতের কনুইয়ের একটু ওপরে লাগলো গুলিটা। যন্ত্রণায় কুঁচকে গেল বিকট গরিলার ভয়ঙ্কর মুখ। ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখলো রক্ত পড়ছে ক্ষত জায়গাটা থেকে। এবার সোজা হয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ালো গোগী। এক লাফে মি. সিম্পসনের পাশে গিয়ে উপস্থিত হলো। রাইফেলটা রি-লোড করবার আর অবসর হলো না। গোগীর ডান হাতের এক প্রচণ্ড চাপড়ে ধরাশায়ী হলেন মি. সিম্পসন। পেছনের সিপাইগুলো ততক্ষণে উধাও হয়েছে। ঠিক সেই সময় টমিগান হাতে দশ বারোজন মিলিটারীকে পেছনে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন কমাণ্ডার শেখ।
ঠুং করে একটা শব্দ হলো, যেন কোনও শিশি মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল। এক মুহূর্তে ঘরটা পুরো ধোঁয়ায় ভরে গেল, আর সেই সাথে তীব্র বিষাক্ত গন্ধ। ঘরের মধ্যে কাউকে দেখতে পেলেন না কমাণ্ডার শেখ। শুধু শুনলেন, কে যেন মৃদুস্বরে বলছে, গোগী, কাম টু মি!
ধোঁয়া যখন একটু হাল্কা হলো, তখন ঘরের মধ্যে হাত-পা বাঁধা নেসার আর অজ্ঞান মি. সিম্পসন ছাড়া আর কাউকে পাওয়া গেল না।
.
আধঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে পেলেন মি. সিম্পসন। উঠেই বললেন, কুয়াশা কোথায়?
পালিয়ে গেছে। কে যেন পাশ থেকে বললো।
উঠে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন।
এক্ষুণি যেতে হবে এয়ারপোর্টে। ডাইভার, জলদি গাড়ি স্টার্ট করো।
ধানমণ্ডি থেকে একটা জীপ দ্রুত চলে গেল এয়ারপোর্টের দিকে। এবং তার পিছন পিছন চললো বড় একটা মিলিটারী ট্রাক।
মি. সিম্পসন যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলেন তখন একটা অস্টার প্লেন রানওয়ের ওপর এঞ্জিন স্টার্ট দেয়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে। ছুটে গেলেন তিনি প্লেনটার কাছে। কিন্তু বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে চলতে আরম্ভ করলো প্লেনটা।
পাইলটের পাশের সীটের জানালা দিয়ে একটা ভয়ঙ্কর গরিলার মুখ বেরিয়ে এলো বাইরে। মি. সিম্পসন আর তার বাহিনীকে দেখে মুখ বিকৃত করে ভেংচি কাটলো গরিলাটা।
এক মিনিটের মধ্যেই আকাশে উঠে গেল প্লেনটা। একবার মাথার ওপর পাক খেয়েই চলে গেল সোজা মিশরের পথে।
মি. সিম্পসন চিন্তিতভাবে নিজের মনেই বিড় বিড় করে বললেন, কিন্তু, মুখোশধারী লোকটা কে?
– শেষ –
Leave a Reply