হ্যালো আইনস্টাইন : চেনা নাম অচেনা গল্প – মণি ভৌমিক
অনুলিখন: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০১৪
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: তাতিয়ানা
.
আমার পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, ভুবনবিখ্যাত সর্বশ্রেষ্ঠ
বাঙালি পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসুর স্মৃতির উদ্দেশে—
যাঁর নাম স্বয়ং আইনস্টাইনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে
থাকবে চিরকাল
.
ভূমিকা
বিংশ শতক— বিজ্ঞানের হিরণ্ময় যুগ!
কিন্তু এই শতকের প্রথমদিকে আমরা জানতামও না, পরমাণু ঠিক কেমন দেখতে।
আরও একটি প্রশ্ন— এই মহাবিশ্ব কত বড়? তা কি আমাদের মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা পেরিয়েও বিস্তৃত? এ-প্রশ্নেরও উত্তর জানতাম না আমরা।
এখন অবশ্য আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ও মহাবিশ্বতত্ত্বের অবিশ্বাস্য উন্নতি হয়েছে। ফলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধিও বেড়েছে অনেক। মহাবিশ্ব সম্পর্কে যেমন জানি, জানি অণুবিশ্ব সম্পর্কেও। পরমাণু থেকে নামতে নামতে আমাদের গবেষণা ও জ্ঞান চলে গেছে একেবারে অস্তিত্বের ভিত পর্যন্ত। আবার এই যে মহাবিশ্ব, যার মধ্যে রয়েছে অযুত ছায়াপথ— তারও প্রান্ত পর্যন্ত ধাবিত আমাদের ধারণা, ভাবনা, জ্ঞান।
আমাদের এই ক্রমবিস্তৃত জ্ঞানের পিছনে রয়েছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান।
পদার্থবিদ্যার এই অগ্রগমন সম্ভব হয়েছে মূলত দুটি স্তম্ভের উপর নির্ভর করে— রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব।
থিওরি অফ রিলেটিভিটির বিকাশ ও ক্রমপরিণতির সমস্ত কৃতিত্ব একা আইনস্টাইনের। এছাড়া, কোয়ান্টাম ফিজিক্সের প্রাথমিক অবস্থাতেও তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মহাশূন্য ও সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণায় আইনস্টাইনই নিয়ে এলেন নতুন আলো, যা আমাদের বিশ্ববোধকে সার্বিকভাবে বদলে দিল। বস্তু ও শক্তি সম্পর্কেও আমাদের ভাবনায় নিয়ে এলেন বিপ্লব।
এই দুই পরিবর্তনই বৈপ্লবিক।
ফলে, আমরা নতুনভাবে প্রকৃতিকে বুঝলাম। বুঝলাম তার মধ্যে নিহিত ঐক্যকে।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেক কিছুর উপরেই ঘটল আইনস্টাইনের প্রজ্ঞা ও প্রতিভার আলোকপাত।
তাঁরই অবদানের ফলে মহাবিশ্বের আকার ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে সম্ভব হয়েছে আমাদের তত্ত্বভিত্তিক অনুমান।
সাধে কি আর বলা হয়, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী!
অথচ তাঁর জীবনের শুরুটা ছিল অনিশ্চিত। নানা বাধায় কণ্টকিত। সেই বাধাপ্রাপ্ত জীবন ও তাঁর কঠোর প্রচেষ্টার কথা ভেবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যহীন অমেধাবীরাও ভরসা পেতে পারে।
চার বছর বয়েস পর্যন্ত আইনস্টাইন কথা বলতে শেখেননি!
তিনি ছিলেন হাইস্কুলের ‘ড্রপ-আউট’। অর্থাৎ লেখাপড়া শেষ করার আগেই বিদ্যালয় থেকে বিদায়। আমাদের রবীন্দ্রনাথের মতো।
এক মাস্টারমশাই তো আইনস্টাইনের বাবাকে বলেই দিলেন, আপনার ছেলে একটি অপদার্থ, জীবনে বিশেষ কিছু করতে পারবে না।
কলেজের প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা— ফেল করল আইনস্টাইন! পাশ করবে কী করে? তুমি তো একটি অলস সারমেয়! বললেন আইনস্টাইনের এক শিক্ষক।
শেষ পর্যন্ত গ্র্যাজুয়েট হল আইনস্টাইন-‘লাস্ট ইন দ্য ক্লাস’, সবচেয়ে নীচে তার নাম।
পরীক্ষার ফল এত খারাপ হলে চাকরি পাওয়া যায়? দু’বছর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও চাকরি পেল না আইনস্টাইন। ওর সতীর্থরা কিন্তু সবাই চাকরি পেয়ে গেল।
অবশেষে হতাশ আইনস্টাইন ভাসতে চেষ্টা করল ডুবন্ত মানুষের মতো খড়কুটো ধরে— সেই খড়কুটো হল বার্নের এক সুইস পেটেন্ট অফিসে তৃতীয় শ্রেণির পেটেন্ট-পরীক্ষকের এক নগণ্য চাকরি। ১৯০২ সালে সেই চাকরি পেল আইনস্টাইন। দিনে আট ঘণ্টা খাটুনি। সপ্তায় ছ’দিন। টানা সাত বছর!
তবে চাকরি পাওয়ার পরেই বিয়েটা সেরে ফেলল অ্যালবার্ট। বাগদত্তা মেয়েটির সঙ্গেই বিয়ে। ১৯০৪ সালে একটি ছেলেও হল।
সামান্য চাকরি। বউ, বাচ্চা, সংসারের দায়িত্ব। এই অবস্থার মধ্যে অন্য কোনও সুবিধেও নেই। সারস্বত কেন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আইনস্টাইন। বিখ্যাত অধ্যাপকদের সঙ্গেও কোনওরকম যোগাযোগ নেই। অর্থাৎ লেখাপড়ার কোনও পরিবেশই নেই চারপাশে। ক’জন পদার্থবিজ্ঞানী এই অবস্থায় গবেষণার কথা ভাবতে পারেন?
এই অতি সাধারণ, প্রতিকূল অবস্থা থেকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী— সে এক অকল্পনীয় উত্তরণের রূপকথা!
সেই কাহিনিই অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আশ্চর্য জীবন!
১৯০৫ সাল।
জ্বলে উঠল অবিস্মরণীয় প্রতিভার বিস্ময়-প্রদীপ!
ঘটল অসামান্য, অনন্য আত্মপ্রকাশ।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন প্রকাশ করলেন পাঁচটি গবেষণাপত্র। সবক’টিই নোবেল পুরস্কারের যোগ্য!
দীর্ঘ হতাশা আর ক্লান্তিহীন সংগ্রামের পর ফুটল সৌভাগ্যের আলো।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হলেন মহিমার পথযাত্রী।
যাঁরা ডুবে আছেন হতাশায়, মনে করছেন জীবন বুঝি শুধুই ব্যর্থ সংগ্রাম— আইনস্টাইনের জীবনযুদ্ধ ও আরোহণ তাঁদের প্রাণিত করবে নিঃসন্দেহে।
সবাই আমরা পরিচিত আইনস্টাইনের নাম ও খ্যাতির সঙ্গে। কিন্তু এই মানুষটির জীবনের অনেক ঘটনাই আমরা জানি না যা হতে পারে আমাদের সবার প্রেরণার উত্স।
এই বই যেন দূর করে হতাশার তমসা।
যেন জ্বেলে দেয় আলো।
যেন ফিরিয়ে দেয় উদ্যম।
যেন জাগিয়ে তোলে আত্মপ্রত্যয়।
যেন নিয়ে আসে নতুন প্রাণন।
এই উদ্দেশ্যেই নিবেদিত আমার বিনম্র প্রয়াস— অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের এক জীবনকথা।
অবস্থা যতই খারাপ, জীবন যত সংগ্রাম আর হতাশারই হোক, হাল ছাড়বেন না।
এই সোনালি বার্তাটুকু পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এই বই।
আরও এক উদ্দেশ্য— এই বইয়ে আছে এমন এক মানুষী উপাখ্যান, যা না বললেই নয়।
সেই উপাখ্যানের নায়ক অবশ্যই আইনস্টাইন। ভয়ংকর দুরবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ।
কিন্তু কঠিন সংগ্রামে নষ্ট হচ্ছে না তাঁর স্বভাবের লাবণ্য।
তাঁর হৃদয় হয়ে উঠছে না কঠিন।
হারিয়ে যাচ্ছে না তাঁর অমায়িকতা।
সাফল্যের শীর্ষেও তিনি কখনই নন অহংকারী।
তিনি সর্বদাই সৎ, সাদাসিধে, সুভদ্র, সদালাপী।
তিনি মেধায়, খ্যাতিতে আলোকবর্ষ দূরের জ্যোতিষ্ক।
তবু কত কাছের মানুষ তিনি!
এক আত্মভোলা ভুবনখ্যাত মগ্ন বিজ্ঞানী!
কাছে গেলে অনুভব করা যায় যাঁর আন্তরিকতার সন্দীপন। এখানে একটি উদাহরণ দিচ্ছি আইনস্টাইনের সততার, তাঁর সুষমামণ্ডিত ব্যবহারের।
বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম কে না জানে?
কিন্তু আইনস্টাইন এবং তাঁকে নিয়ে একটি সত্য কাহিনির কথা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না।
অধ্যাপক সত্যেন বসু তখন তরুণ বিজ্ঞানী। কেউ তাঁকে বিশেষ চেনে না। তিনি তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য পাঠালেন ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটিতে। গবেষণাপত্রটি বাতিল করল রয়্যাল সোসাইটি। সত্যেন বসু সেই প্রত্যাখ্যাত গবেষণাপত্রটি পাঠালেন আইনস্টাইনের কাছে।
প্রায় কিছু না আশা করেই পাঠালেন। বলা যায়, একটা ‘চান্স’ নিলেন।
এক অচেনা-অজানা বাঙালি বিজ্ঞানীর খারিজ-হয়ে-যাওয়া গবেষণাপত্রটি মন দিয়ে পড়লেন আইনস্টাইন। সেটিকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করলেন। শুধু অনুবাদই করলেন না, প্রকাশ করলেন— সত্যেন বসুর নামেই। কতদিন নিলেন এই কাজটি করতে?
গবেষণাপত্রটি হাতে পাওয়ার পর মাত্র একটি সপ্তাহ!
কারণ? দেখামাত্রই আইনস্টাইন বুঝেছিলেন বোসের আবিষ্কারের গুরুত্ব। বোসের গবেষণাটি বাড়িয়ে সঙ্গে নিজের নামেও আর একটি পত্র প্রকাশ করলেন।
অন্য এক গল্প মনে পড়ছে এবার।
নিউটন জানতে পারলেন লিবনিত্স্-এর স্বতন্ত্র, মৌলিক আবিষ্কার ‘ক্যালকুলাস’ সম্পর্কে। কী করলেন তিনি?
বহু কুটিল, প্যাঁচানো পদ্ধতিতে সেটিকে চেপে দিতে চেষ্টা করলেন। আর সেটিকে শুধুই নিজের বলে চালাবার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন।
সত্যেন বসুর গবেষণাপত্রটি যদি পড়ত নিউটনের হাতে? ভাগ্যিস!
আইনস্টাইন আর সত্যেন বসুকে নিয়ে আরও এক সত্যি গল্প না বলে পারছি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খালি হল পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের পদ। সেই চাকরি পেলেন না সত্যেন বসু তাঁর ‘পিএইচ ডি’ নেই বলে। তাঁকে সুপারিশ করলেন স্বয়ং আইনস্টাইন একটি পোস্টকার্ড লিখে।
সেই পোস্টকার্ড এল আর সঙ্গে সঙ্গে চাকরিটা পেয়ে গেলেন সত্যেন বসু।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন আমার অধ্যাপক। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর নাম হয়ে থাকবে চিরকালীন— বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স-এর পরিচয়ে।
এই বইয়ের উত্সর্গপত্রে তাই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আর সত্যেন বসুকে একসূত্রে জানালাম আমার হৃদয়ের শ্রদ্ধা।
দু’জনেই আমার প্রেরণা। সারাজীবন।
মণি ভৌমিক
Leave a Reply