হৃদয়ে আঁকা ছবি – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ – মার্চ ১৯৯৬
উৎসর্গ
মরহুম বিশ্বকবি আল্লামা ইকবাল (রঃ)
“আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তায়ালা তাহার জন্য মুক্তির পথ বাহির করিয়া দেন। আর তাহাকে এমন স্থান হইতে রিযক পৌঁছাইয়া থাকেন, যাহা তার ধারনাও হয় না, আর যে আল্লাহর উপর ভরসা করিবে, তবে আল্লাহ তাহার জন্য যথেষ্ঠ।”
–আল কোরআন-২৮ পারা- সুরা তালাকৃ-আয়াত-২,৩
ভূমিকা
“শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম দাতা ও দয়ালু”
প্রত্যেক মানব-মানবী জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মনের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। অনেকে পায়, অনেকে পায় না। যারা পায়, তাদের বেশির ভাগ বাস্তব জীবনে। প্রবেশ করে সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। কারণ স্বপ্ন আর বাস্তব দু’টোর ব্যবধান আকাশ আর পাতাল। তবু মানুষ স্বপ্ন দেখে। এটা জগতের নিয়ম। অনেকে মনের মতো জীবনসঙ্গী। খোঁজে বিয়ের বয়স পার করে দিচ্ছে। এটা ঠিক না বেঠিক, পাঠকবর্গের চিন্তার উপর ছেড়ে দিলাম। এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা স্বপ্নের মানুষ পেয়েছে। কিভাবে পেল, সেই ঘটনাপুঞ্জি নিয়ে এই কাহিনী। বাস্তব জীবনে তাদের স্বপ্ন কতটা সফল হল, তা লিখলে বইটা অনেক বড় হয়ে যাবে বিধায় লিখিনি। সে জন্যে পাঠকবর্গের কাছে ক্ষমাপ্রার্থি।
ওয়াস সালাম
কাসেম বিন আবু বাকার
২রা ফাল্গুন ১৪০২ বাংলা
২৪শে রমযান ১৪১৬ হিজরী
১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ ইংরেজী
এক
অগ্রহায়নের আধা-আধি। শীত পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। আগে যেমন কার্তিক মাস থেকে শীত পড়তে শুরু করত, এখন তা আর পড়ে না। আগের মত বর্ষাও হয় না এখন। আকাশ ও সমুদ্র গর্ভে পারমানবিক বোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে করে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বোমা যুদ্ধের ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ, পশু-পাখি ও মাছের নতুন নতুন নানা ধরনের রোগ হচ্ছে। সেদিকে বুদ্ধিজীবিদের মাথাব্যথা নেই। তাদের শুধু চিন্তা, কিভাবে আরো বেশি শক্তিশালী বোমা তৈরি করে অধিক সংখ্যক মানুষ খতম করা যায়। ভাবতে খুব আশ্চৰ্য্য লাগে, তারা কি চিন্তা করে দেখেননি, প্রতি বছর যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে, সন্ত্রাসীদের হাতে, নানারকম অসুখ-বিসুখে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি মুহূর্তে কত লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে? তার উপর জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তবুও কি মানুষ সফল হতে পারছে? পারছে না। কারন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাকের ইচ্ছাকে মানুষ বুদ্ধি খাঁটিয়ে রোধ করতে পারবে না। তিনি মহা শক্তিশালী। তাঁর শক্তির সাথে আকাশ-মণ্ডলী ও ভূ-মণ্ডলের কারো সঙ্গে তুলনা করা যায় না। শুধু তাই নয়, আকাশ মন্ডলী ও ভু-মণ্ডলে এবং এতদোভয়ের মধ্যে যত মানুষ, জ্বিন ও জন্ত–জানোয়ার আছে, তাদের সম্মিলিত শক্তি, আল্লাহর শক্তির কাছে, এক অনু পরমাণুর কোটি কোটি ভাগের এক ভাগও নয়। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। বুদ্ধিজীবিরা আরো বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ না করলে বিশ পঁচিশ বছর পরে পৃথিবীতে মানুষের বাসস্থানের যেমন অভাব হবে তেমনি খাদ্যের অভাবও হবে। তা হলে আমরা কি ভাববো, মহান শক্তিশালী আল্লাহ, তার সৃষ্টির সেরা জীবকে আহার ও বাসস্থান দেওয়ার শক্তি রাখেন না? অথচ আল্লাহ কোরআনে বর্ণনা করেছেন, আকাশ-মণ্ডল ও ভু-মণ্ডলে ও এতদোভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর আমিই সৃষ্টি কর্তা ও পালন কর্তা।” এখন আমরা বুদ্ধিজীবিদের কথা মানব, না আল্লাহর কথা মানব? পৃথিবীতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে, তা সমাধানের জন্য বুদ্ধিজীবিরা আল্লাহর আইন মোতাবেক সমাধান না করে নিজেরা বুদ্ধি খাঁটিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করছেন। ফলে এক সমস্যার-সমাধান হলেও তার বদলে অন্য সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। যেমন ধরুন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে ব্যবস্থা বুদ্ধিজীবিরা করেছেন, তাতে কিছুটা সাফল্য লাভ করলেও অবাধ যৌন মিলনের রাস্তা খুলে দিয়েছে। এইডস্ নামক মারাত্মক ব্যাধির প্রসার ঘটেছে। মানুষের নৈতিক চরিত্রের অবনতি যে হ্যাঁরে বেড়ে চলেছে, অচিরেই সারা বিশ্বে একজনও সৎ লোক ও সতী নারী থাকবে কিনা সন্দেহ। এখন বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ জারজ সন্তান জন্মাচ্ছে। সেইসব দেশের সরকারেরা তাদের লালন-পালন করছে। বুদ্ধিজীবিরা বিবাহের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে অবৈধ সন্তানের দ্বারা পৃথিবী ভরিয়ে ফেলতে চাইছেন। সে সব বুদ্ধিজীবিরা সভা-সমিতি ও পত্র-পত্রিকায় বক্তৃতা করেন, মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠজীব। সেই মানুষ আগে পাহাড়ে পর্বতে, বনে-জঙ্গলে অসভ্য জীবন-যাপন করত। বর্তমানে মানুষ জ্ঞানে-গুনে ও সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছেছে, তাই যদি হয়, তা হলে সারা পৃথিবীতে এত অশান্তি কেন? কেন কোটি কোটি টাকার মারনাস্ত্র উৎপাদন করছেন? কেন সামান্য সার্থের জন্য একে-অন্যের সঙ্গে বিবাদ লাগিয়ে দিয়ে যুদ্ধ করাচ্ছেন? সেইসব মারনাস্ত্র সাপ্লাই দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করছেন? কেন পারমানবিক বোমা ফাটিয়ে সারা পৃথিবীর আবহাওয়া দুষণ করছেন? সারা পৃথিবীতে আজ লক্ষ লক্ষ স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটি হয়েছে। প্রতি বছর কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রী ডিগ্রী নিয়ে বেরোচ্ছে। শিক্ষিতের হার যত বাড়ছে তত বেশি কেন চুরি-ডাকাতি-খুন রাহাজানী ধর্ষণ বাড়ছে? এগুলোই বুঝি জ্ঞানী-গুনী ও সভ্যতার চরম উন্নতির লক্ষণ?
আর পৃথিবীর মানুষ যদি সৃষ্টিকর্তার ও তার প্রেরিত পুরুষ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর নির্দেশিত পথ এবং জ্ঞান অর্জন করত এবং সেই সব মেনে চলত, তা হলে সারা পৃথিবীর মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারত। এটাই আল্লাহ ও রাসুল (সঃ) এর কথা। মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হয়ে সৃষ্টিকর্তার বিধিনিষেধ না মেনে, জ্ঞানী-গুনী হয়েও বন্য হিংস্র জীবের চেয়ে অধম হয়ে গেছে।
.
ফুয়াদ এক মনে লিখছে। উপন্যাসটা শেষের পথে। এইসময় লেখকদের কোন হুঁশ-জ্ঞান থাকেনা। ফুয়াদেরও নেই। আজ যে নটার সময় মাহবুব ভাইয়ের মামার সঙ্গে তাদের দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাবে বলেছে, সে কথাটা একদম ভুলে গেছে।
ফিরোজা বেগম ছেলের রুমের দরজার কাছে এসে বললেন, কিরে তুই এখনো লিখছিস, বান্দুরা যাবি না?
ফুয়াদের তখন মায়ের কথার উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। মা কি বলছেন ভালো করে শুনতেও পায়নি।
ফিরোজা বেগম ছেলের হাল হকিকত জানেন। রুমে ঢুকে তার কাছে এসে কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, এবার লেখা বন্ধ কর বাবা, প্রায় নটা বাজে।
মায়ের হাতের স্পর্শে ফুয়াদ বাস্তবে ফিরে এল। লেখা থামিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, কিছু বলছ আম্মা?
নটা বাজতে যায়, গোসল করে নাস্তা খাবি কখন? মাহবুবের মামা মুক্তার সঙ্গে তোর আজ নটার সময় বান্দুরা যাওয়ার কথা না?
তাই তো, সে কথা আমার একদম মনে নেই। তুমি যাও আমি লেখাটা শেষ করে আসছি।
ফিরোজা বেগম যেতে যেতে ভাবলেন, ফুয়াদ লেখা পড়া বন্ধ করে সংসারের হাল যদি না ধরতো, তা হলে কি হতো আল্লাহ মালুম। মনোয়ারাকে দেখতে পেয়ে বলল, যাতো মা, তোর ভাইয়ার কাপড়-চোপড় ব্রীফকেসে গুছিয়ে দে। আর তাকে তাড়াতাড়ি গোসল করে নাস্তা খেতে আসতে বল।
মনোয়ারা ফুয়াদের ছোট বোন। ওরা তিন ভাই এক বোন। ফুয়াদ বড়। ফুয়াদের পর সাত্তার। সে ইন্টারে পড়ে। ছোট সারোয়ার, ক্লাস টেনের ছাত্র। আর মনোয়ারা সবার ছোট এইটে পড়ে। সে যখন ভাইয়ার রুমে এল তখন ফুয়াদ লেখা শেষ করে খাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে বলল, তোকে আবার আম্মা তাড়া দিতে পাঠাল বুঝি?
মনোয়ারা বলল, হ্যাঁ। তারপর বলল, কি কি জামা কাপড় নেবে বল, আমি ব্রীফকেসে ভরে দিই।
ফুয়াদ বলল, তুই শুধু দুটো পাজামা-পাঞ্জাবী আর ফুল ওভারটা ভরে রাখ, বাকিটা আমি দেখব। তারপর গোসল করার জন্য বাথরুমের দিকে দৌড়ে গেল।
ফুয়াদ নাস্তা খেয়ে যখন রেডী হচ্ছিল তখন ফিরোজা বেগম এসে বললেন, কবে ফিরবি?
ভাবছি ওখানে একসপ্তাহ থেকে গ্রাম দেখব। সেই সাথে গ্রাম্য জীবনের উপর একটা উপন্যাস লিখব। সেজন্য আরো কয়েক দিন দেরী হতে পারে। মাহবুব ভাইয়া যদি চলে আসে, তা হলে নবাবগঞ্জে হোটেলে থেকে লেখাটা কমপ্লীট করে ফিরবো।
ফিরোজা বেগম বললেন, তা হলে পৌঁছে কি করবি তা জানিয়ে চিঠি দিস।
তাই দেব বলে ফুয়াদ মাকে কদমবুসি করল।
ফিরোজা বেগম মাথায় চুমো খেয়ে দোওয়া করে বললেন, আল্লাহ তোকে সহিসালামতে ফিরিয়ে আনুক।
মনোয়ারা মায়ের সাথেই এসেছিল। সে ভাইয়াকে কদমবুসি করে বলল, পাড়া-গাঁয়ে মশার খুব উপদ্রব। মশারী খাঁটিয়ে শোবে। তুমি তো লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়। ওখানেও সেরকম করোনা। তা না হলে নির্ঘাৎ অসুখ-বিসুখ বাধিয়ে বসবে।
ফুয়াদ বোনের মাথা ধরে নাড়া দিয়ে বলল, সব সময় গার্জেনী ফলানো চাই। ঠিক আছে, তোর কথা মনে রাখবো। তারপর সালাম বিনিময় করে মাহবুবের বাসায় রওয়ানা দিল।
ফুয়াদের বাবা জাহিদ সাহেব ভারতের পশ্চিম বাংলার লোক। একটা বেসরকারী অফিসে চাকরি করতেন। হিন্দুস্থান- পাকিস্তান হওয়ার সময় স্বপরিবারে এখানে চলে আসেন। আসার পর ঢাকায় আড়াই কাটা জায়গা কিনে নিজেদের থাকার জন্য ছোট ছোট চার কামরা পাকা রুম করেন। চাকরি করে ছেলে-মেয়েদের লেখা পড়া করিয়ে মানুষ করা অসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই পরে আরো সেমিপাকা চারটি কামরা করে সে গুলোতে নিজেরা থাকেন। আর পাকা রূমগুলো ভাড়া দিয়েছেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর থেকে জিনিস পত্রের দাম বাড়তে বাড়তে এখন যা অবস্থা হয়েছে, জাহিদ সাহেব নিজের বেতন এবং ভাড়ার টাকা দিয়ে সংসার চালাতে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছিলেন, তার উপর বড় মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণ করে ফেলেন। ঋণ শোধ করবেন, না সংসার চালাবেন দিশে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফুয়াদ ইন্টারে পড়ার সময় গল্প লিখে রেগুলার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দিত। কোনো কোনো পত্রিকার সম্পাদকরা ফুয়াদকে বলতেন, আপনার লেখাগুলো খুব ভালো। আপনি এক সময় খুব ভালো লেখক হতে পারবেন। তারা কিছু কিছু টাকা পয়সাও দিতেন। ফুয়াদ তাদের উৎসাহ পেয়ে “জোনাকির আলো” নামে একটা উপন্যাস লিখে এক সম্পাদককে পড়তে দেয়। তিনি পড়ে খুব আনন্দিত হয়ে বইটা নিজেই ছাপেন। বইটা বাজারে খুব নাম করে। সম্পাদক ফুয়াদকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে আরো উপন্যাস লিখতে বলেন। ফুয়াদ বি, এ, পাশ করা পর্যন্ত চারটে উপন্যাস লিখে। সবগুলো বইই নাম করে এবং ভালো টাকা পায়। তাই বি, এ, পাস করার পর সংসারের অভাব অনটনের কথা চিন্তা করে পড়া ক্ষ্যান্ত দিয়ে উপন্যাস লিখছে।
.
মীর শফি আলম ফুয়াদদের বাসায় প্রায় বার তের বছর ভাড়া ছিলেন। ওঁর দেশের বাড়ি কলাকোপা বান্দুরা। উনি বাংলাদেশ বিমানে চাকরি করতেন। ওঁর চার ছেলে তিন মেয়ে। প্রথম স্ত্রী রহিমা বেগম মারা যাওয়ার পর ঢাকায় রিজিয়া বেগমকে আবার বিয়ে করেন। তার গর্ভে কোনো সন্তানাদি হয়নি। সেই স্ত্রীকে নিয়ে ফুয়াদদের ঘরে ভাড়া ছিলেন। ওঁর বড় ছেলে রফিক ও মেজ ছেলে সেলিম দুবাইয়ে চাকুরি করে। বছর খানেক হল তারা ছোট ভাই হাসানকে দুবাইয়ে নিয়ে গিয়ে চাকুরি দিয়েছে। মেজ ছেলে মাহবুব বাবার সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানে চাকরি করে। সে বাবু বাজারে তার এক বোনের বাসায় থেকে চাকুরি করত। পরে বাবার কাছে থাকতে চাইলে শফি আলম জাহিদ সাহেবের বাসার কিছুটা দূরে দুইরুমের বাসা ভাড়া নেন। এর মধ্যে শফি আলম রিটায়ার্ড করেছিলেন। জাহিদ সাহেবের বাসা ছেড়ে দিলেও এতদিনের সম্পর্ক বজায় ছিল। দুই পরিবারের মধ্যে নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। মাস দুয়েক আগে শফি আলমের ছোট ছেলে হাসান দুবাইয়ে এ্যাকসিডেন্ট করে মারা যায়। অন্য দু’ভাই রফিক ও সেলিম ছোট ভাইয়ের লাশ দেশে নিয়ে এসে দাফন করে। রফিকের ছুটি না থাকায় সে সপ্তাহ খানেক থেকে চলে যায়। ছোট ছেলের মৃত্যুতে শফি আলম খুব মূষড়ে পড়েন। বিশ পঁচিশ দিন পর হার্ট এ্যাটাক হয়। হলি ফ্যামিলী রেড ক্রসেন্ট হাসপাতালে চার পাঁচ দিন থাকার পর তিনিও মারা যান।
শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও ফুয়াদ ওঁর দাফনে উপস্থিত হতে পারেনি। চার দিন পর হাসানের কুলখানিতে ফুয়াদ শফি আলমের শালা মুক্তারের সাথে বান্দুরা যাবার প্রস্তুতি নেয়।
ফুয়াদ মাহবুবদের বাসায় এসে তার সৎ মামা মুক্তার ও বন্ধু মালেকের সঙ্গে বান্দুরা রওয়ানা দিল।
রাস্তায় এসে ফুয়াদ মুক্তারকে জিজ্ঞেস করল, মামা, আমরা কিভাবে যাব?
মুক্তার বলল, এখন স্কুটারে করে সওয়ারী ঘাটে গিয়ে নৌকায় বুড়ি গঙ্গা নদী পার হব। বুড়িগঙ্গার ওপারের নাম জিঞ্জিরা। ওখান থেকে বাসে বান্দুরা যাব।
বাসে ভাড়া কত?
বত্রিশ টাকা।
তা হলে সময় তো অনেক লাগবে?
হ্যাঁ তা প্রায় তিন ঘন্টা লাগবে।
বড় রাস্তায় এসে ওরা স্কুটারে উঠল। ভাড়া ঠিক হল ত্রিশ টাকা। চকবাজার হয়ে সওয়ারী ঘাটে আসতে বেশ সময় লাগল। কারণ ঢাকায় যারা বাস করেন, তারা নিশ্চয় জানেন, এখানে এতো বেশি রিক্সা চলাচল করে যে, এটাকে রিক্সার শহর বললে ভুল হবে না। এই রিক্সার কারণে যখন তখন যেখানে সেখানে ট্রাফিক জাম হয়। ফুয়াদরাও। ট্রাফিক জামে পড়ল। তারপর চকবাজার থেকে সওয়ারী ঘাট যেতে যে চিপা রাস্তা, কোনো গাড়িরই ওভারটেক করার সুযোগ নেই। শেষ মেষ তারা যখন ঘাটে পৌঁছাল তখন বেলা এগারটা। তারপর খেয়া নৌকায় নদীর ওপারে জিঞ্জিরায় পৌঁছাল। ফুয়াদ এর আগে কখনো জিঞ্জিরায় আসেনি। তবে নোক মুখে ও কাগজে জিঞ্জিরার নাম খুব শুনেছে। এখানে নাকি বিদেশী জিনিসের দু’নাম্বার মাল তৈরীর কারখানা আছে। এমন কি ভেজাল দুধ ও নকল ঔষধের কারখানাও আছে। এটা কেরানীগঞ্জ থানার অন্তর্গত। কেরানীগঞ্জ এক দিকে যেমন বহু মহান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্ম স্থান, অপর দিকে তেমনি খুন- জখম- রাহাজানি, সন্ত্রাসিদেরও জন্মস্থান। ফুয়াদের অনেক দিনের ইচ্ছা, কিংবদন্তী জিঞ্জিরায় একদিন বেড়াতে যাবে। আজ দৈবচক্রে এলেও বেড়াবার সুযোগ নেই। রাস্তার দু’পাশে বাস লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর কনডাকটাররা চিৎকার করে গন্তব্য স্থানের নাম বলে প্যাসেঞ্জারদের ডাকছে। আগে যে বাসটা ছাড়বে তাতে সিট নেই দেখে ফুয়াদরা পরের বাসে উঠল। আগের বাসটা ছেড়ে যাওয়ার পনের মিনিট পর ওদের বাস ছাড়ল। প্রায় আধঘন্টা আসার পর একটা ছোট নদী পড়ল। বাস ফেরিতে করে নদী পার হবে।
ফুয়াদ মুক্তারকে জিজ্ঞেস করল, মামা এ নদীর নাম কি?
মুক্তার বলল, ধলেশ্বরী নদী।
বাস ফেরিতে উঠার সময় বাসের প্যাসেঞ্জারদের নেমে পড়ার আইন থাকলেও কেউ নামল না। ফুয়াদ একা নেমে ফেরিতে উঠল। ফেরির লোকজনদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, এই ঘাটের নাম তুলসিখালি। ফুয়াদ দেখল, নদীতে তেমন স্রোত নেই। এপার ওপারের দূরত্বও তেমন বেশী নয়। ভাবল, শীতকাল বলে হয়তো নদীর পানি কমে গেছে। ফেরি ওপারে ভীড়ার আগে মাহবুব ভাইয়ের বন্ধু মালেক বলল, ফুয়াদ ভাই, উঠে আসুন, ফেরি থেকে উঠার পর বাস থামবে না।
অনিচ্ছা সত্বেও ফুয়াদ বাসে উঠে মালেককে জিজ্ঞেস করল, আপনি এর আগে এই রাস্তায় যাতায়াত করেছেন?
মালেক বলল, মাত্র একবার, শফি চাচাকে দাফন করতে গিয়েছিলাম। তারা তিন সিটে বসেছিলেন। ফুয়াদ ছিল জানালার দিকে। আর কিছু না বলে জানালা দিয়ে গ্রামের দৃশ্য দেখতে লাগল।
বাস আরো আধঘন্টা চলার পর আবার একটা নদী পড়ল, ফুয়াদ মামাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, নদীর নাম ইছামতি। আর ঘাটের নাম মরিচাঘাট। ঘাট পার হয়ে পড়ল খারশূর হাইস্কুল। তারপর টিকার পুর বাজারে এসে বাস থামল। লোকালবাস কিছুক্ষন পর পর স্টপেজ। আরো কিছুটা যাওয়ার পর আগলা চৌকিঘাটা জনমঙ্গল উচ্চবিদ্যালয় তারপর কোমরগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। এখানে বাস বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। প্যাসেঞ্জারদের চিল্লা- চিল্লীতে ড্রাইভার বাস ছাড়ল। তারপর বকস নগর, বাগমারা হয়ে বাস নবাবগঞ্জ এসে থামল।
প্যাসেঞ্জারদেরকে তাড়াতাড়ি করে নামতে দেখে ফুয়াদ মুক্তারকে জিজ্ঞেস করল, মামা, এটাই কি লাস্ট স্টপেজ?
মুক্তার বলল, না, সামনের রাস্তা গেলবারের বন্যায় নদীতে ভেঙ্গে গেছে। এখনো ঠিক হয়নি। তাই বাস সরাসরি বান্দুরা যায় না। ভাঙ্গা রাস্তা হেঁটে পার হয়ে আবার অন্য বাসে উঠতে হবে।
মুক্তার ওদের দুজনকে নিয়ে বাস থেকে নেমে হেঁটে ভাঙ্গা রাস্তাটা পার হয়ে এসে অন্য বাসে উঠল।
প্রায় আধঘন্টা পর বান্দুরা এসে পৌঁছাল। বান্দুরা এসে ওরা দু’টো রিক্সা নিল। ফুয়াদ আর মুক্তার একটা রিক্সায়। আর মালেক একা অন্য রিক্সায়। যেতে যেতে মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে পাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা কয়েকটা বাগান ও তার মধ্যে টিনসেড সুন্দর সুন্দর বাড়ি দেখে ফুয়াদ মুক্তারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, এগুলো খৃষ্টানদের বাড়ী। মেইন রাস্তা ছেড়ে রিক্সা গ্রামের রাস্তায় ঢুকতে মুক্তার বলল, এই গ্রামের নাম ইকরাশী। রাস্তার দু’পাশে নানা রকমের ফলের গাছ আর বাশবন। ওরা যখন মাহবুবদের বাড়িতে পৌঁছাল তখন বেলা দু’টো।
মাহবুবের চাচার নাম মীর আবুল কাশেম। উনি ডাক্তার। কাঁচারীঘাট বাজারে ডিসপেন্সরী। ওঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে দুটো বড়। বড়র নাম মীর শামীম আহম্মেদ। ছোটর নাম মীর সাইদ আহম্মেদ। দু’জনেই আই, এ পাশ করে বাবার ডিসপেন্সরীতে থাকে। সবার ছোট রুমানা দোহার নবাবগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের আই, এ, দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
মাহবুব যোহরের নামায পড়ে খেয়ে দেয়ে চাচাতো বোন রুমানার সঙ্গে গল্প করছিল। শীতকাল বলে রুমানা খাটে গলা পর্যন্ত লেপ গায়ে দিয়ে রয়েছে। আর মাহবুব খাটের পাশে একটা চেয়ারে বসে তার সঙ্গে কথা বলছে।
মুক্তার ফুয়াদ ও মালেককে নিয়ে সেই রুমের কাছে এসে বন্ধ দরজায় নক করল।
এই রুমের দু’টো দরজা। একটা উঠানের দিকে আর একটা পিছনের দিকে। উঠানের দিকের দরজা খোলা রেখে পিছনের দরজা বন্ধ করে ওদের অপেক্ষায় বসে গল্প করছিল। দরজায় নক হওয়ার শব্দ শুনে মাহবুব উঠে এসে দরজা খুলে দিল।
মাহবুব ফুয়াদের আসার কথা শুনেছিল, কিন্তু সত্যিই যে আসবে তা ধারণা করেনি। মুক্তার মামা ও মালেক আজ আসবে এটাই সিওর ছিল। তাদের সঙ্গে ফুয়াদকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, সত্যি সত্যি তা হলে আমাদের মত এই গরিবদের বাড়িতে এলেন? আসুন, ভিতরে আসুন।
ফুয়াদ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, মাহবুব ভাই, আপনারাতো অনেক বছর আমাদের বাসায় ছিলেন, আমরা বড়লোক না গরিব লোক, তা নিশ্চয় জানেন; তবু এ। কথা বলছেন কেন?
মাহবুব ওদেরকে চেয়ারে বসতে বলল।
রুমানা এক পলক ওদের দিকে চেয়ে লেপ টেনে মুখ ঢেকে ফেলল।
ফুয়াদ রুমে ঢুকেই রুমানার মুখ দেখে ফেলেছে। তারপর তাকে মুখ ঢেকে ফেলতেও দেখেছে। মাহবুবের কথা শুনে বলল, এখন বসতে গেলে নামাযের সময় পার হয়ে যাবে। তাই আগে নামায পড়ব।
মাহবুবের বড় ভাই রফিকের ঘরে ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। সেই ঘরে নিয়ে এসে মাহবুব বলল, কাপড় পাল্টে নিন।
ফুয়াদ কাপড় পাল্টে বলল, মসজিদ কত দূরে?
মাহবুব কিছু বলার আগেই মালেক বলল, মসজিদ কাছেই। চলুন আমিও নামায পড়ব।
মুক্তার নামায পড়ে না। তাই সে বসে রইল। ফুয়াদ ও মালেক নামায পড়তে গেল।
ওরা চলে যাওয়ার পর রুমানা লেপ সরিয়ে উঠে বসেছিল। মাহবুব ফিরে এলে বলল, মেজ ভাই, মুক্তার মামা ও তোমার বন্ধু মালেক ভাইকে তো চিনি, কিন্তু অন্যজনকে তো চিনলাম না?
মাহবুব বলল, আব্বা- আম্মা ওদের বাসায় বার-তের বছর ভাড়া ছিলেন। উনি বাড়ি ওয়ালার বড় ছেলে। তিন চার বছর হল বি, এ, পাশ করেছেন। উপন্যাস লেখেন। ওঁর লেখা কয়েকটা বই তো তোকে দিয়েছি। আব্বা মারা যাওয়ার সময় উনি অসুস্থ ছিলেন। তাই আসতে পারেননি। তোর প্রিয় লেখক আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে জেনে তুই তো ওকে কয়েকবার নিয়ে আসতে বলেছিস?
আউট বই বা গল্প উপন্যাস পড়া রুমানার হবি। তাই সব ধরণের বই সে পড়ে। স্কুলে পড়ার সময় ভাইদেরকে বই জোগাড় করে দিতে বলত। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নিজেই নবাবগঞ্জের বিভিন্ন লাইব্রেরী থেকে বই কিনে পড়ে। মাহবুব একদিন ফুয়াদের লেখা “আমিও মানুষ” বই দিয়ে বলেছিল, তুই তো অনেক লেখকের বই পড়িস; এটা পড়লে অন্য লেখকের বই আর পড়তে ইচ্ছা করবে না।
রুমানা বইটা হাতে নিয়ে লেখকের নাম দেখে বলেছিল, কই এই লেখকের নামতো কোনোদিন শুনিনি? আজকাল কত আজে বাজে লেখকের বই বেরোচ্ছে।
মাহবুব বলল, শুনিসনি তো কি হয়েছে? পড়লেই বুঝতে পারবি ইনি আজে বাজে লেখক কিনা। আমিও আগে অন্যান্য লেখকের বই পড়তাম। যে দিন এই লেখকের বই পড়লাম, সে দিন থেকে তাদের বই আর পড়তে ইচ্ছা করে না। শুধু ওঁরই বই পড়ি।
রুমানা বলল, ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ পড়ব।
“আমিও মানুষ” বইটা পড়ে রুমানা এত আনন্দিত হয়েছিল যে, তার মনে হয়েছিল, জীবনে এতো ভালো উপন্যাস সে বুঝি আর পড়েনি। মাহবুব বাড়ীতে থাকা অবস্থায় বইটা পড়েনি। পড়ার পর তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে ছিল, ফুয়াদ হাসানের যত বই বেরিয়েছে, এবার আসার সময় যেন সে সবগুলো নিয়ে আসে।
মাহবুব চিঠির উত্তরে বলেছিল, আমি এখন আসতে পারব না। তুই নবাবগঞ্জ থেকে কিনে নিস।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত ফুয়াদের যত বই বেরিয়েছে, সব কিনে পড়েছে।
এখন মাহবুরের কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, কি বলছ মেজ ভাই, উনিই ফুয়াদ হাসান?
মাহবুব জানে রুমানার কাছে ফুয়াদ হাসান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসিক। এ ব্যাপার নিয়ে তার সঙ্গে অনেক তর্কও করেছে। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁরে, উনিই তোর সেই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ লেখক। যাকে দেখার জন্য তুই বারবার আমাকে নিয়ে আসতে বলিস। এখন যা; দাদিকে খাবার রেডী করতে বল, ওদের ফেরার সময় হয়ে গেছে।
রুমানা বলল, যাচ্ছি। তারপর বলল, উনি যে আসবেন, সে কথা তো বলনি?
মাহবুব বলল, বলিনি, কারণ তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব ভেবেছিলাম। তাছাড়া উনি যদি না আসতেন, তা হলে তোর কাছে মিথ্যাবাদি হয়ে যেতাম। এবার যা বললাম কর।
রুমানা ও মাহবুব যে রুমে গল্প করছিল সেটা বেশ বড়। এক পাশে ডাইনিং টেবিল। রুমানা দাদিকে মেহমান আসার কথা বলে ভাত-তরকারী বেড়ে দিতে বলল।
ফুয়াদ ও মালেক নামায পড়ে ফিরে এলে মাহবুব তাদেরকে ও মুক্তার মামাকে নিয়ে রুমানাদের রুমে এসে ডাইনিং টেবিলে বসাল। রুমানা আগেই সবকিছু রেডী করে রেখেছিল। মাহবুব বলল, আপনাদের আসতে দেরী দেখে আমি খেয়ে নিয়েছি, আপনারা শুরু করুন। তারপর রুমানাকে ডেকে বলল, তুই মেহমানদের সার্ভ কর।
রুমানার গায়ের রং ফর্সা। চোখ দুটো বেশ বড় বড়। লম্বায় পাঁচফুট। দোহারা। স্বাস্থ্য। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী না হলেও সুন্দরী। পাড়া-গাঁয়ের মেয়ে হলেও বেশ চতুর। তার উপর কলেজে পড়ছে। রুমানা লাল টকটকে রং এর সালওয়ার কামিজ পরে দু’কাঁধের উপর দিয়ে সরু উড়না বুকের উপর ঝুলিয়ে দিয়েছে। মাহবুবের কথা শুনে বলল, নতুন মেহমানের সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দিলে না?
মাহবুব মৃদু হেসে ফুয়াদকে উদ্দেশ্য করে রুমানাকে দেখিয়ে বলল, আমার চাচাতো বোন রুমানা। এবছর ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। তারপর রুমানাকে বলল, উনি হলেন স্বনাম ধন্য লেখক ফুয়াদ হাসান।
রুমানা ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে সালাম দিল।
ফুয়াদ সালামের উত্তর দিয়ে রুমানার দিকে তাকাতে গিয়ে চোখে চোখ পড়তে মনে হোঁচট খেল। ভাবল, এ কাকে দেখছে? এ যে তার হৃদয়ের আঁকা ছবি।
জ্ঞান হবার পর থেকে জীবন সাথী করবে বলে হৃদয়ে যে মেয়ের ছবি এঁকে রেখেছে। এতে তারই প্রতিচ্ছবি। লাল রং তারও খুব পছন্দ। ঐ পোষাকে রুমানাকে দেখে মুগ্ধ হল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
রুমানারও একই অবস্থা। ফুয়াদ হাসানের বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে মনে মনে যে ছবি কল্পনা করেছিল, বাস্তবেও তাকে সেই রকম দেখে একেবারে অভিভুত হয়ে এক দৃষ্টে তার মুখের দিকে চেয়েছিল। তাকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে দেখেও তার হুঁশ হল না। একই ভাবে চেয়ে রইল।
মাহবুব ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পেরে রুমানাকে বলল, কিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন?
রুমানা মাহবুবের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি সবার ভাত-তরকারী তুলে দিতে লাগল।
এক সময় মাহবুব ফুয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলল, জানেন, রুমানা আপনার বইয়ের দারুন ভক্ত। ওর মতে আপনার মতো ঔপন্যাসিক বাংলাদেশে আর নেই।
কথাটা শুনে ফুয়াদ খাওয়া বন্ধ করে রুমানার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই নাকি? তারপর তার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, লেখক ও পাঠকের বিভিন্ন শ্রেণী আছে। এক এক শ্রেণীর পাঠক পাঠিকা এক এক শ্রেণীর লেখক লেখিকাকে পছন্দ করেন। তাই বলে আমার মতো একজন অখ্যাত লেখককে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ লেখক বললে, বড় বড় লেখকদের অসম্মান করা হবে। কথা শেষ করে খেতে শুরু করল।
দুই
মাহবুবদের গ্রামের নাম ইকরাশী। এই গ্রামের উত্তরে বান্দুরা। এখানে ছেলেদের জন্য বান্দুরা হলিক্রস উচ্চবিদ্যালয় এবং মেয়েদের জন্য সেন্ট হলিফ্রেটিস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় নামে দু’টো হাই স্কুল আছে। একটির নাম বেগম আয়সা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। আর দক্ষিনে পুল পার হয়ে জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। পশ্চিমে ইলছামারি ও ইমাম নগর——। এ গুলো দোহার থানার অন্তর্গত।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ফুয়াদ যতবার রুমানার দিকে তাকিয়েছে, তত বারই চোখে চোখ পড়েছে। তখন দুজনেই মনের মধ্যে আনন্দের শিহরণ অনুভব করেছে।
খাওয়ার পর কিছুক্ষন রেষ্ট নিয়ে সবাই মসজিদে গিয়ে আসরের নামায পড়ল। তার পর মাহবুব তাদেরকে নিয়ে কাঁচারীঘাট বাজারে বেড়াতে এল। ইকরাশী গ্রামের পশ্চিম দিকে উত্তর দক্ষিণে ইছামতি নদীর একটা শাখা বয়ে গেছে। কাঁচারীঘাট বাজারটা এই শাখা নদীর তীরে। বাজারের বেশ কিছু অংশ গত বন্যায় নদীতে চলে গেছে। তখনো মাহবুরের চাচা আবুল কাসেমের সঙ্গে ফুয়াদের পরিচয় হয়নি। মাহবুব চাচার ডিসপেন্সারীতে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল।
আবুল কাসেম সবাইকে বসিয়ে চা- নাস্তা খাওয়ালেন।
ওদের বাস্তুর পর থেকে তাঁতিদের বসবাস। দিন রাত তাত চলার খটাখট শব্দ হয়। এখানকার তাঁতিরা শুধু লুংগী বুনে। রাস্তার দু’পাশে রং বেরং-এর সুতা শুকাচ্ছে। আবার অনেকে সুতায় রং করছে। মাহবুবের চাচার ডিসপেন্সারীতে চা- নাস্তা খেতে খেতে মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেল। ওখান থেকে বেরিয়ে ফেরার সময় ফুয়াদ দেখল, একটা বুড়োলোকের সঙ্গে একটা কিশোরী সুতায় রং লাগাচ্ছে। ফুয়াদের মনে হল কিশোরীটা নিশ্চয়ই বৌ, আর বুড়ো লোকটা শ্বশুর। এ যুগেও এত ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছে ভেবে ফুয়াদ বেশ অবাক হল। আসতে আসতে একই দৃশ্য কয়েকটা দেখে ফুয়াদ কৌতূহল চাপতে পারল না। কর্তব্যরত এক বুড়োর কাছে এগিয়ে এসে সালাম দিল।
বুড়োটা সালামের উত্তর দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে মাহবুবকে চিনতে পারলেন। বললেন, কি গো মিয়া বাড়ির ছেলে, কবে এলে?
মাহবুব সালাম বিনিময় করে বলল, তিন চারদিন হল, কেমন আছেন চাচা?
আর বাবা, আল্লাহ এক রকম রেখেছে। তা ইনাদেরকে তো চিনতে পারলাম না, ঢাকা থেকে এসেছে বুঝি?
মাহবুব বলল, হ্যাঁ চাচা। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনাদের ব্যবসা কেমন চলছে?
সে কথা আর বলনা বাবা। সুতা ও রং-এর দাম সে হ্যাঁরে বেড়েছে সেই হ্যাঁরে লুংগীর দাম বাড়াতে পারছি না। দাম বাড়ালে পাইকাররা মাল কিনতে চায় না।
বুড়ো ওদের সাথে কথা বললেও কিশোরীটা তার কাজ করেই চলেছে।
ফুয়াদ বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিছু মনে যদি না করেন, তা হলে দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।
বেশ তো বাবা বলুন না, কি জানতে চান।
এই যে মেয়েটি সুতায় রং দিচ্ছে, কে হয় আপনার?
ছেলের বৌ?
এত ছোট মেয়েকে বৌ করেছেন কেন? আর ওকে দিয়েই বা এই কাজ করাচ্ছেন কেন? আপনার ছেলে কোথায়?
বুড়ো হেসে উঠে বলল, আপনি বোধ হয় এখানে নতুন এসেছেন। ছেলে বাড়িতে কাজ করছে। আর ছোট মেয়েকে যে বৌ করার কথা বললেন। আমাদের তাঁতীদের এটাই নিয়ম। আমার ছেলেও ছোট। ছোট বউ আনলে এসব কাজে অভ্যস্থ হয়ে যাবে। বড় বেলায় আর কষ্ট অনুভব করবে না। তাঁতীদের বাড়ির ছোট বড় সবাইকে অনেক পরিশ্রম করতে হয় বাবা।
এমন সময় মাগরিবের আযান শুনে মাহবুব বলল, ফুয়াদ ভাই চলুন, আযান দিচ্ছে।
নামায পড়ে মাহবুবের বড় ভাই রফিকের ঘরে এসে বসার পর তার মেজ ভাই সেলিম চা নিয়ে এল। শফি আলম যখন ফুয়াদদের বাসায় থাকতেন তখন থেকেই সেলিমের সঙ্গে ফুয়াদের পরিচয়। চা খাওয়ার পর সেলিম ফুয়াদকে বলল, আপনারা বসুন, কালকের কাজের ব্যাপারে আমরা পাশের বাড়িতে কথা বার্তা বলব। তারপর মাহবুবকে নিয়ে চলে গেল।
এই রুমে একটা ডবল খাট, ড্রেসিং টেবিল, তিন সিটের সোফা ও টী- টেবিল রয়েছে। শহরের চেয়ে গ্রামে শীত বেশি। ফুয়াদ ব্রীফকেস খুলে পুলওভার গায়ে জড়িয়েছে, এমন সময় রুমানা তার বয়সি আরো দুটো মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
ফুয়াদ এক পলক রুমানার সলাজ মুখের দিকে চেয়ে নিয়ে সালাম দিল।
রুমানা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এরা আমার প্রতিবেশী ও বান্ধবী। আমরা এক সঙ্গে পড়ি। আপনার কথা শুনে দেখা করতে এসেছে। এরাও আপনার ভক্ত পাঠিকা।
ফুয়াদ পুলওভারের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, আপনারা বসুন। ওরা সোফায় বসার পর ফুয়াদ খাটে বসল। তারপর ব্রীফকেস থেকে কয়েক দিন আগে প্রকাশিত তিন কপি বই বের করে রুমানাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার আসল নামটা বলুন?
রুমানা শারমিন।
ফুয়াদ একটা বইয়ের কভার পেজে উল্টে লিখল, “রুমানা শারমিন, আপনার সব কিছু আপনার নামের মতই। “দোওয়া করি আল্লাহ যেন আপনার ইহকাল ও পরকালে তাই করেন। তারপর অটোগ্রাফ দিয়ে বইটা রুমানার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
রুমানা দাঁড়িয়ে বইটা নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে বসে পড়ল।
ফুয়াদ আর একটা বই নিয়ে রুমানার পাশের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম বলুন।
নিশাত উলফত।
ফুয়াদ লিখল, নিশাত উলফতের অর্থ হল, আনন্দ উপহার। দোয়া করি সারা জীবন সবাইকে আনন্দ ও উপহার বিতরন করার তওফিক যেন আল্লাহ আপনাকে দেন। তারপর বইটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
নিশাতও দাঁড়িয়ে বইটা নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে বসে পড়ল।
ফুয়াদ বই হাতে নিয়ে তিন নাম্বার মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি বলল, আমার নাম খালেদা খানম।
ফুয়াদ লিখল, খালেদা অর্থ অমর। চিরদিন আপনার নাম অমর থাকে সেই রকম কিছু কাজ করার তওফিক আল্লাহ যেন আপনাকে দেন সেই দোওয়া করি। তারপর বইটা খালেদার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
খালেদাও দাঁড়িয়ে বইটা নিয়ে ধন্যবাদ দিল। তারপর বসে তিন জনে একে অন্যের। বইয়ের লেখা পড়ল।
খালেদা রুমানার বইয়ের লেখাটা পড়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাদের নামের অর্থ লিখলেন, রুমানার লিখলেন না কেন?
ফুয়াদ বলল, রুমানা শব্দের অর্থ রোমান্টিক। আর শারমিন শব্দের অর্থ হল, সুন্দরী। খালেদা বলল, কিন্তু ওর বইয়ের মধ্যে অর্থটা লিখলেন না কেন বললেন না তো?
ফুয়াদ বলল, সব কেনর উত্তর সব সময় দেওয়া যায় না। তা ছাড়া আপনারা হয়। তো জানেন না, লেখকরা একটু খেয়ালী হয়। এটাও তাই ভাবতে পারেন।
নিশাত বলল, দুএকটা প্রশ্ন করতে পারি?
ফুয়াদ বলল, নিশ্চয়ই। লেখকদের কাছে কোনো রকম সংকোচ করা ঠিক নয়।
আপনি মেয়েদেরকে নিয়ে, মানে মেয়েদের চরিত্র নিয়ে বেশি লেখেন কেন?
ফুয়াদ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আপনি বোধ হয় আমার লেখা সব বই পড়েননি। পড়লে জানতে পারতেন, ছেলেদের চরিত্র নিয়েও অনেক বই আমি লিখেছি। তবে আপনার কথাও ঠিক। ছেলের চেয়ে মেয়েদের চরিত্র নিয়ে আমি বেশি লিখি। কারণ, দাম্পত্য জীবনে ও সংসারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করে শতকরা সত্তর থেকে আশি ভাগ মেয়েদের উপর। একটা কথা নিশ্চয় শুনেছেন। “সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে।” কথাটার মধ্যে মেয়ে বা নারী না বলে রমনী বলা হয়েছে। যদিও তিনটি শব্দের অর্থ একই; তবুও বলব, রমনী শব্দটার মধ্যে ভাষার একটা আভিজাত্য রয়েছে। আরো বলব, মেয়ে ও নারী শব্দ দুটো যেন রমনীতে এসে সার্থক হয়েছে। কোনো জিনিসের, সেটা কথাই হোক অথবা কাজই হোক, তার পরিনতিতে যদি সার্থকতা না থাকে, তা হলে সেই কথার বা কাজের যেমন কোনো মূল্য নেই; তেমনি মেয়ে বা নারীর পরিনতি যদি রমনী না হয়, তা হলে ঐ মেয়ে বা নারীরও কোনো মূল্য নেই। তাই আমি মেয়ে ও নারী যাতে রমনী হতে পারেন, লেখার মাধ্যমে সেই চেষ্টা করে চলেছি।
নিশাত বলল, রমনীর ডেফিনেশনটা বললে খুশি হতাম।
রমনী শব্দ রম বা রমন থেকে উৎপত্তি। রম শব্দ যখন বিশেষ্য পদে ব্যবহার হয় তখন তার অর্থ- স্বামী; পতি। আর বিশেষনে ব্যবহার হলে অর্থ হয়-রমনীয়; আনন্দদায়ক। রমন শব্দের অর্থ বিশেষ্য পদে দুই প্রকার- যেমন (১) ক্রীড়া, কেলি, প্রমোদ-বিহার, মৈথুন ইত্যাদি। (২) কন্দর্প; পতি। বিশেষন পদে- প্রিয়; সন্তোষ বিধায়ক। স্ত্রীলিঙ্গে রমনা। রমনীর অর্থ বিশেষ্য পদে- সুন্দরী নারী; পত্নী। আর বিশেষনে প্রিয়া, সন্তোষ বিধায়িত্রী। রমনী রত্ন শব্ধটা বাংলা ভাষায় যেমন অলঙ্কার তেমনি পরিবারের এবং সমাজেরও অলঙ্কার। রমনী- রত্ন শব্দের অর্থ-শ্রেষ্ঠ নারী। তাই ভারতের জনৈক মনিষি বলেছেন, “যে সমস্ত মেয়েরা সংসারের দ্বায়িত্ব পালনের জন্য ঘরে থাকে, তারা রমনী। আর যারা সেই দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যখন চাকরি বাকরি করে অথবা যাত্রা থিয়েটার করার জন্য রাস্তায় নামে তখন আর তারা রমনী থাকে না, নারীতে পরিনত হয়।”
পরিবারে, সমাজে অর্থাৎ সারা দেশে রমনী- রত্ন তৈরী করার জন্য আমি মেয়েদের চরিত্র নিয়ে বেশি লিখি।
খালেদা বলল, এ পর্যন্ত আপনার কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে?
হা—- তা প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। আ
পনার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা জানতে পেরেছেন?
কিছু কিছু পেরেছি।
কি ভাবে?
আপনাদের মতো অনেক পাঠক পাঠিকা পত্র দিয়ে জানায়, তারা আমার বই পড়ে নায়ক নায়িকাদের মতো চরিত্র গঠনে চেষ্টা করছেন।
আমাদের মতো বললেন কেন? আমরাও যে আপনার বইয়ের নায়ক নায়িকার মতো চরিত্র গঠন করার চেষ্টা করছি, সেটাই বা বুঝলেন কি করে?
ফুয়াদ মৃদু হেসে বলল, যারা আমার বই পড়ে নায়ক নায়িকাদের মতো চরিত্র গঠনে চেষ্টা করছে, তারা পত্রের দ্বারা আপনাদের মতো প্রশ্ন করেছেন। আর আপনারা যে সে রকম চরিত্র গঠনের চেষ্টা করছেন অথবা না করলেও প্রেরনা অনুভব করছেন, তা আপনাদের সঙ্গে আলাপ করেই বুঝতে পেরেছি।
আপনার অনুমান ভুলও হতে পারে?
তা পারে; তবে আমি নিশ্চিত, যে কেউ আমার একটা বই পড়লে, তার যেমন আমার অন্যান্য বই পড়ার আগ্রহ জাগবে, তেমনি নিজেকে সৎ করার প্রেরণাও অনুভব করবে।
এতটা সিওর হলেন কি করে? আমার ভাই তো আপনার বই পড়ে আপনাকে একাত্তরের দালালদের দলভুক্ত মনে করেন?
ফুয়াদ আবার মৃদু হেসে বলল, শুধু আপনার ভাই নয়, আরো অনেকে তাই মনে করেন। আপনিও কি তাই মনে করেন?
সে কথা পরে বলব, আগে আমার পশ্নের উত্তর দিন।
দেখুন, আমাদের দেশে একটা প্রবাদ বাক্য আছে,- “যাকে দেখতে না-রি, তার চলন বাঁকা।” বাকীটার অর্থ নিশ্চয় বোঝেন?
জ্বী বুঝি।
যারা আমাকে একাত্তরের দালাল মনে করেন, তারা হয় ইসলাম বিদ্বেষী, না হয় ইসলাম সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। আমি উপন্যাসের মাধ্যমেই মডার্ন ছেলে-মেয়ে, মানে যারা স্কুল কলেজে লেখা পড়া করলেও ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানেন না। অথবা কিছু জানলেও জানার মতো জানেন না এবং সেই সব মেনেও চলেন না, তাদেরকে ইসলামের মহত্ব ও অবদান জানাবার জন্য কোরআন হাদিসের অনেক রেফারেন্স টেনে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সেই জন্যেই ইসলাম অনভিজ্ঞ পাঠক পাঠিকারা আমাকে ঐ দলের মনে করেন। আমি প্রতিটা বইয়ের মধ্যে ইসলামিক জ্ঞান আহরনের জন্য তাগিদ দিয়েছি। আমার বিশ্বাস, বিধর্মী ও বিজাতীয়দের অসংখ্য জ্ঞাণী-গুণীজন যেমন কোরআন- হাদীস ও বিভিন্ন ইসলামীক বই পুস্তক পড়ে ইসলামকে জেনে ইসলাম গ্রহন করেছেন, তেমনি মুসলমান হয়েও যারা ইসলামকে জানেন না এবং ইসলামকে বাঁকা চোখে দেখেন, তারা আমার বই পড়ে একদিকে যেমন উপন্যাসের স্বাদ পাবেন, অপর দিকে ইসলামকে জানতে পেরে ইসলামের দিকেও ঝুঁকে পড়বেন। এবার আমার সম্পর্কে আপনার ধারণাটা বলবেন কি?
খালেদা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল, শুনে আপনি কি মনে করবেন জানি না, প্রথম দিকের বইগুলো পড়ে আমিও ভাইয়ার সঙ্গে একমত ছিলাম; কিন্তু পরবর্তি বইগুলো পড়ে সেই ধারণা আমার অল্প অল্প করে পাল্টাতে শুরু করে। তবে আমার জানামতে অনেকে মুখে অথবা লেখার মাধ্যমে ইসলামের মহত্ত্ব প্রচার করলেও তাদেরকে বাস্তবে সে সব মেনে চলতে দেখিনি। আপনাকেও তাই মনে করতাম। এই নিয়ে রুমানার সঙ্গে একদিন আলাপও করেছিলাম। রুমানা বলল, মাহবুব ভাই তাকে বলেছেন, আপনি যা বলেন বা লেখেন, সেসব বাস্তবে মেনেও চলেন। তারপর থেকে ধারনাটা সম্পূর্ন পাল্টে যায়। আজ আপনাকে দেখেও আপনার সঙ্গে আলাপ করে মনে হচ্ছে, বর্তমান সমাজ সংরক্ষণে আপনার দান অতুলনীয়। সত্যিই আপনি——–
ফুয়াদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, প্লীজ থামুন, কারো সামনে তার প্রশংসা করতে নেই। তারপর বলল, কথায় ও কাজে এক না হলে, সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। যারা তা নয় তাদেরকে ইসলামিক পরিভাষায় মুনাফিক বলে। আর মুনাফিকরা ইসলামের দুষমন এবং মুনাফিকের স্থান জাহান্নামে। জাহান্নাম বড় নিকৃষ্ট স্থান। এটা ক্বোরআন পাকের কথা। আমাদের মধ্যে অনেকে জেনে না জেনে আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর আদেশ নিষেধ মেনে চলছি না। অথচ আমরা মুসলমান বলে দাবী করছি। এটা ঠিক নয়। কারণ যারা নিজের ও মানুষের মতবাদ ত্যাগকরে আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর মতবাদে চলবে তারাই প্রকৃত মুসলমান আর এরাই হল সফলকাম। অনেককে বলতে শুনেছি, আমাদের দেশের শতকরা পঁচাশি থেকে নব্বই জন মুসলমান, এদেশে আবার ইসলাম প্রচারের দরকার কি? কথাটা অতি সত্য; কিন্তু তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, যদি তাই হয়, তা হলে এই দেশের পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে অনৈসলামীক কর্মকান্ড হচ্ছে কেন? কেন কোরআন-হাদিস মোতাবেক রাজনিতী করছেন না? একথার জওয়াব দিবে কে? আমি সমাজের দেশের তথা সারা বিশ্বের মুসলমানদের জানাতে চাই, মুসলমানরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) এর আইন মোতাবেক সব কিছু করবে, মানুষের তৈরী আইন মোতাবেক চলতে তারা পারে না। তবে হ্যাঁ, সেই সব আইন মেনে চলতে নিষেধ নেই, যেগুলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) এর আইনের পরিপন্থি নয়। জনসাধারণ ও রাজনৈতিক নেতাদের বেশির ভাগ আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা ও হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কে নবী রাসুল জানেন। কিন্তু তাঁদের আদেশ-নিষেধ যেমন জানেন না, তেমনি মেনেও চলেন না। যারা কিছু কিছু জানেন, তারা সার্থের জন্য ধর্মীয় বিধি-নিষেধ এড়িয়ে চলেন। মানুষ এখন ধর্মকে ঘরের গোপন কুঠরিতে রেখে দিয়ে দুনিয়ার ভোগ বিলাসের পিছনে ছুটছে। সেই মুসলমানরাই আবার প্রকৃত মুসলমানদেরকে মৌলবাদি অথবা একাত্তরের দালাল বলে গালাগালি করছে। এ সমস্ত বিষয় আমি আমার অনেক বইয়ে আলোচনা করেছি। জানেন, আমার মরহুমা আম্মাজান আমাকে ছোট বেলায় শিক্ষা দিতেন, “আপ ভালা তো দুনিয়া ভালা। অর্থাৎ “নিজে ভালো হলে দুনিয়ার সব কিছু নিজের কাছে ভালো মনে হবে।” অপর পক্ষে নিজে খারাপ হলে, সব কিছুই তার কাছে খারাপ মনে হবে। একটা কথা মনে রাখবেন, “মানুষ নিজের চরিত্র দিয়ে অন্যকে বিচার করে।”
এমন সময় মাহবুব এসে রুমানার দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে তোরা এখনো ওঁকে। বিরক্ত করছিস?
কেউ কিছু বলার আগে ফুয়াদ বলল, এরকম কথা বলছেন কেন? বিরক্ত হব কেন? বরং খুশি হয়েছি।
মাহবুব বলল, মসজিদের ইমাম সাহেব আপনার ভক্ত পাঠক। আমার কাছে। আপনার পরিচয় জেনে খুব খুশি। চলুন উনি আপনাকে ডাকছেন।
ফুয়াদ বলল, কালকের কাজের ব্যাপারে আপনাদের আলাপ শেষ হয়েছে?
মাহবুব বলল, হ্যাঁ হয়েছে। এখন কার উপর কি কাজের ভার পড়বে, সেইসব আলাপ হচ্ছে। চলুন মসজিদে যাই, ইমাম সাহেব অপেক্ষা করছেন।
মসজিদের বারান্দায় ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফুয়াদ জুতো খুলে বারান্দায়, উঠতেই এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে মোসাফা করলেন। তারপর বললেন, আসর মাগরিবের নামাযের সময় আপনাকে দেখেছি; কিন্তু আপনার পরিচয় জানতে পারিনি। একটু আগে মাহবুব ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম। আপনার লেখা অনেক বই পড়েছি। আল্লাহ আপনাকে আরো লেখার তওফিক দিক। বর্তমানে আপনার মতো লেখকের বড় প্রয়োজন। চলুন ভিতরে গিয়ে বসি। আজ বেশ ঠান্ডা পড়েছে।
ভিতরে আরো কয়েকজন ছোট-বড় মুসল্লী ছিলেন। ভিতরে ঢুকে ফুয়াদ তাদেরকে সালাম দিল।
তারা সালামের উত্তর দেওয়ার পর ইমাম সাহেব তাদের সঙ্গে ফুয়াদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
তাদের মধ্যে কয়েকটা ছেলে ফুয়াদের ভক্ত পাঠক। তারা ফুয়াদকে দেখে খুব আনন্দিত হয়ে একে একে হাত মোসাফা করে নিজেদের পরিচয় বলল।
মাহবুব ফুয়াদকে নিয়ে মসজিদে চলে যাওয়ার পর রুমানা খালেদাকে বলল, কিরে, লেখক সাহেবকে তোর কেমন মনে হল?
খালেদা বলল, কেমন আবার, ভালো। তবে তোর কাছে যতটা ভালো, অতটা নয়।
মানে।
মানেটা তো না বোঝবার কারণ নেই; তুই তো ফুয়াদ হাসান বলতে অজ্ঞান। তাকে দেখার জন্য এতদিন তোর মন পাগল ছিল। এখন নিশ্চয় শান্ত হয়েছে।
খালেদা ও নিশাত পাড়া সুবাদে রুমানার চাচাতো বোন। তাদের বাড়িও কাছাকাছি। রুমানার কাছ থেকে বই নিয়ে তারা ফুয়াদের ভক্ত হয়েছে। তারা জানে রুমানা ফুয়াদ হাসানের প্রতি খুব দুর্বল। তাই রুমানাকে ফুয়াদের কথা বলে রাগায়। প্রথম প্রথম রুমানা রেগে গেলেও মনে আনন্দ পেত। তবু তাদের উপর রাগ করত। আজ ফুয়াদকে দেখে রুমানার মনে আনন্দের বান ডেকেছে। তারই আভাস তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। এখন খালেদার কথা শুনে মেকি রাগের সঙ্গে বলল, ফুয়াদ হাসানের জন্য আমার মন পাগল ছিল, তোদেরকে কোনো দিন বলেছি?
নিশাত বলল, ঐ কথা না বললেও তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই ফুয়াদ সাহেবের প্রেমে পড়েছিস। তাকে দেখে তোর মন যে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে তা তোর চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
রুমানা কথাটার সত্যতা অনুভব করে লজ্জায় লাল হয়ে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে রইল।
কিরে, কিছু বলছিস না যে?
তোদের জেলাস হচ্ছে বুঝি?
ওমা, জেলাস হবে কেন? বরং আমাদেরও খুশি লাগছে। তারপর খালেদার দিকে চেয়ে বলল, কিরে ঠিক বলিনি?
খালেদা বলল, হ্যাঁ। তারপর বলল, এবার ফুয়াদ সাহেবের মনের খবরটা জানা দরকার কি বলিস?
নিশাত বলল, তুই জানতে না পারলেও আমি কিন্তু পেরেছি।
খালেদা বলল, কি করে জানলি বলতো?
কেন, তুই যখন রুমানার নামের অর্থ না লেখার কারণ জিজ্ঞেস করলি তখন কি বললেন শুনলি না, “সব কেনর উত্তর সব সময় দেওয়া যায় না?” এই কথাতেই ফুয়াদ সাহেবের মনের খবর স্পষ্ট জানা গেছে।
ফুয়াদের কথা শুনে রুমানাও তাই বুঝেছে এবং মনের মধ্যে আনন্দের শিহরণ অনুভব করেছে। এখন নিশাতের কথা শুনে সেই শিহরণ আবার অনুভব করল। নিজেকে সামলে নিয়ে একটু রাগের সঙ্গে বলল, তোরা কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছিস।
এমন সময় রুমানার বড় ভাই শামিম সেখানে এসে বোনকে বলল, তোকে মা ডাকছে। তারপর নামায পড়তে মসজিদে চলে গেল।
রুমানা ওদেরকে বলল, তোরা বসবি না চলে যাবি?
নিশাত ও খালেদা এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে বলল বসে আর কি করব, তারপর তিনজন রুম থেকে বেরিয়ে এল।
রুমানা মায়ের কাছে এসে বলল, ভাইয়া বলল, তুমি ডেকেছ।
মাসুদা বিবি বেশ রাগের সঙ্গে বললেন, মাহবুবের বন্ধুর সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কি এত আলাপ করছিলি? জানিস না, বেগানা ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন?
রুমানা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তা জানব না কেন? আমাকে কোনো দিন কোনো বেগানা ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখেছ?
তা হলে আজ এতক্ষন মাহবুবের বন্ধুর কাছে ছিলি কেন?
জান আম্মা, উনিই বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ফুয়াদ হাসান। তুমিত ওঁর অনেক বই পড়েছ।
মাসুদা বিবি খুব অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি?
হ্যাঁ আম্মা তাই। আমার সঙ্গে নিশাত ও খালেদা ছিল। খালেদার ভাইয়া ওঁর বই পড়ে ওঁকে রাজাকার ভাবে। সে কথা খালেদার মুখে শুনে ফুয়াদ যা কিছু বলেছিল, মাকে বলল।
মাসুদা বিবি বললেন, তা হলে উনি তো খুব ধার্মিক ছেলে। আমি জানতাম, ধর্ম নিয়ে উপন্যাস লেখা যায় না, ইনার বই পড়ে সেই ধারণা পাল্টে গেছে।
হ্যাঁ আম্মা, তোমার কথা ঠিক। ওঁর বই পড়ে আমি যা ধারণা করেছিলাম, বাস্তবেও ওঁকে তাই দেখলাম। এই দেখ না বলে বইটা খুলে বলল, এটা দেওয়ার সময় কত সুন্দর আশীষ বাণী লিখে দিয়েছেন।
মাসুদা-বিবি পড়ে বললেন, বাহ, খুব সুন্দর তো? তা তোর নামের অর্থ তুই কি জানিস?
না, তোমরাও জানাওনি। নিশাত, খালেদাকেও দু’টো বই দিয়েছেন। সেগুলোতে তাদের নামের অর্থ ও আশীষ বাণী লিখে দিয়েছেন।
তোর নামের অর্থ লিখে দিলেন না কেন?
তা আমি কি করে বলব। তবে খালেদা আমার নামের অর্থ জিজ্ঞেস করেছিল। বললেন, রুমানার অর্থ-রোমান্টিক, আর শারমিনের অর্থ সুন্দরী।
মেয়ের কথাবার্তা ও হাবভাব দেখে মাসুদা বিবি তার মনের খবর কিছুটা আঁচ করতে পারলেন। শঙ্কিত হয়ে বললেন, ঠিক আছে, এখন এশার নামায পড়ে নে। তোর আব্বা এসে পড়বে।
তিন
পরের দিন সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় ফুয়াদ মাহবুবকে বলল, কখনো গ্রাম দেখিনি। আপনার কি সময় হবে? আপনাদের গ্রামের আশ-পাশ ঘুরে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।
মাহবুব বলল, কেন হবে না। আমার কোনো কাজ নেই। নাস্তা খেয়ে বেরোন। যাবে।
রুমানা নাস্তা খাওয়াচ্ছিল। ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল, এত তাড়া কিসের? কয়েকদিন থাকেন, ঘুরে বেড়িয়ে মনের ইচ্ছা পূরণ করবেন।
ফুয়াদ মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে বলল, শুনলেন আপনার বোনের কথা, আমি তো এক সপ্তাহ থাকার প্রোগ্রাম করেই এসেছি।
মাহবুব হেসে উঠে বলল, আপনার প্রোগ্রামের কথা রুমানা জানবে কি করে? আপনি এক সপ্তাহ কেন, যতদিন ইচ্ছা থাকুন না, কেউ আপনাকে নিষেধ করবে না।
রুমানাও মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে বলল, মেজ ভাই তোমার বন্ধুকে বল, উনি থাকলে আমরা সবাই খুশি ছাড়া অখুশি হব না। থাকুক না যতদিন ইচ্ছা।
ফুয়াদ শুধু এক পলক রুমানার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল।
মাহবুব ফুয়াদকে বলল, রুমানার কথার উত্তর দিলেন না যে?
ফুয়াদ বলল, মানুষের সব ইচ্ছা কি পূরণ হয়? দেখি আল্লাহ কতদিন এখানে রেযেক রেখেছেন।
তারপর আর কেউ কোনো কথা বলল না। নাস্তা খাওয়া শেষ হতে মাহবুব ফুয়াদকে বলল, চলুন তা হলে আমরা বেড়িয়ে আসি। তারপর বন্ধু মালেককে বলল, আপনিও চলুন।
এমন সময় একটা বিশ-বাইশ বছরের হ্যান্ডসাম যুবক এসে সালাম দিল।
মাহবুব সালামের উত্তর দিয়ে বলল, সোহেল যে, কখন এসেছ?
সোহেল বলল, গতকাল রাত নটায়।
মাহবুব তাকে দেখিয়ে ফুয়াদকে বলল, আব্বার চাচাতো ভাই খালেক চাচার ছেলে। জগন্নাথ ইউনিভার্সিটিতে ম্যানেজম্যান্টে অনার্স করছে। সোহেল আপনার ভক্ত পাঠক। তারপর সোহেলকে বলল, ইনিই তোদের প্রিয় লেখক ফুয়াদ হাসান।
সোহেল সালাম দিয়ে হাত মোসাফা করে বলল, আপনার বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। মাহবুব ভাইয়ারা আপনাদের বাসায় থাকার সময় একবার আমি গিয়েছিলাম। তখন আপনাকে দেখেছিলাম। তবে আপনি যে লেখক তা জানতাম না।
মাহবুব তাকে বলল, আমরা বেড়াতে যাচ্ছি তুমি গেলে চল।
সোহেল বলল, একটু অপেক্ষা কর। কাপড়টা পাল্টে আসি।
সোহেল আসার পর মাহবুব ফুয়াদকে বলল, চলুন।
ওরা কাঁচারীঘাট বাজার ছাড়িয়ে বড় রাস্তা ধরে কিছুদূর আসার পর মাহবুব বলল, এই গ্রামের নাম পালামগঞ্জ। এটা আমাদের পোষ্ট অফিস। আরো কিছুটা এসে মাহবুব দু’টো রিক্সা নিল। একটাতে ফুয়াদ ও সোহেল উঠল। আর অন্যটাতে মাহবুব ও মালেক উঠল। মাহবুব রিক্সাওয়ালাকে বলল, থানা কমপ্লেক্সে চল।
রিক্সা এসে পৌঁছালে মাহবুব ফুয়াদকে বলল, এটাই দোহার থানা। পাশে স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ভিতরে চলুন দেখে আনন্দ পাবেন।
থানা কমপ্লেক্সটা বেশ অনেক খানি জায়গা নিয়ে। তার পাশেই স্বাস্থ্য কেন্দ্র। সব নতুন ঝকঝকে বিল্ডিং। থানা কমপ্লেক্সের মাঝখানে বেশ বড় একটা পুকুর। পুকুরের পানি স্বচ্ছ স্ফটিকের মত। পুকুরে অনেক লাল শালুক গাছ। লাল-লাল অনেক শালুক। ফুল ফুটে রয়েছে। ফুয়াদ দাঁড়িয়ে পড়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বলল, বাহ, খুব সুন্দর তো। ঢাকায় এরকম দৃশ্য দেখা যায় না।
এখান থেকে বেরিয়ে মাহবুব আবার দু’টো রিক্সা নিয়ে রিক্সা ওয়ালাকে জয়পাড়া যেতে বলে ফুয়াদকে বলল, এখানে ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা দুটো হাই স্কুল আছে।
জয়পাড়া জায়গাটাও ফুয়াদের খুব ভাল লাগল। স্কুল বিল্ডিং দু’টোও খুব সুন্দর। বাজারে এসে মাহবুব ফুয়াদকে বলল, জয়পাড়ার দই ও মিষ্টি খুব বিখ্যাত। তারপর একটা ময়রা দোকানে সবাইকে নিয়ে ঢুকল।
ময়রা দোকানের মালিক হিন্দু। নাম সুখেন হাজরা। মাহবুবকে ও সোহেলকে। চিনে। তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল, সঙ্গের দু’জনকে তো চিনতে পারছি না?
মাহবুব বলল, ইনারা তো ঢাকার লোক চিনবেন কি করে? তারপর ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল, জানেন ফুয়াদ ভাই, জয়পাড়া বাজারে যতগুলো ময়রা দোকান আছে সুখেনদার দোকানের দই-মিষ্টি সব থেকে সেরা। ইনার দোকানের মিষ্টি খেলে সারা জীবনেও ভুলতে পারবেন না।
ফুয়াদ বলল, তা হলে তো খেয়ে টেষ্ট কুরতে হয়।
মাহবুব বলল, খাওয়াবার জন্যই তো এখানে নিয়ে এলাম। তারপর সুখেনকে বলল, দিনতো দাদা চার প্লেট দই ও প্রতিপ্লেটে দু’টো করে রসগোল্লা।
খেতে খেতে মাহবুব ফুয়াদকে জিজ্ঞেস করল, কি ফুয়াদ ভাই, কিছু বলছেন না কেন?
ফুয়াদ বলার আগে মালেক বলল, এত ভালো দই ও মিষ্টি ঢাকায় পাওয়া যায় না।
ফুয়াদ কিছু বলছে না দেখে মাহবুব আবার তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার মতামতটা বলুন।
ফুয়াদ বলল, মালেক ভাই যা বললেন, আমিও তাই বলব। তবে আমরা তো আব্বার দেশের বাড়িতে মাঝে মধ্যে যাই। সেখানকার দই ও মিষ্টি এর থেকে আরো অনেক ভালো। এগুলো যতই ভালো হোক, দুধে বা ছানায় কিছু হলেও ভেজাল আছে। আব্বার দেশের খাঁটি দুধের দই ও ছানার রসগোল্লা খেলে আপনার দাদার নাম ভুলে যাবেন।
মাহবুব হেসে উঠে বলল, কথাটা আমিও আব্বার মুখে শুনেছি। উনি তো ইন্ডিয়াতে আর্মিতে বেশ কিছুদিন ছিলেন। ভাবছি, একবার আপনার সঙ্গে ইন্ডিয়ায় বেড়াতে যাব।
ফুয়াদ বলল, পাসপোর্ট করে রাখবেন। এবারে যাওয়ার সময় আপনাকে নিয়ে যাব।
সুখেন, ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার বাবার দেশ তাহলে ইন্ডিয়ায়?
ফুয়াদ বলল, হ্যাঁ, উনি হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হওয়ার সময় স্বপরিবারে প্রথমে এসে যশোরে কিছু দিন ছিলেন। তারপর ঢাকায় এসে সেটেল্ড হন।
ইন্ডিয়াতে কোথায় আপনাদের পৈত্রিক বাড়ি?
হাওড়া জেলায়। অবশ্য কলকাতায় বাবা-মার জন্মস্থান। সেখানে আমাদের পূর্ব পুরুষদের অনেক কিছু ছিল। দেশ ভাগ হওয়ার সময় কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের যে। রায়ওট হয়, সেই সময় সেসব হিন্দুরা দখল করে নেয়। তারপর থেকে সবাই গ্রামের বাড়িতে চলে যান।
সুখেন বলল, বহরমপুরে আমার বড়দা ফ্যামিলী নিয়ে থাকেন। উনি সিগারেট কোম্পানীতে চাকরি করেন। দু’একবছর পর পর আমি তার কাছে বেড়াতে যাই। আপনার কথা ঠিক, ওখানে খাঁটি দুধের ও ছানার দই-মিষ্টির সঙ্গে আমাদের এখানকার কোনো তুলনা হয় না।
ফুয়াদ বলল, তবে আপনার দোকানের দই মিষ্টির কথা আমার অনেকদিন মনে। থাকবে।
ওখান থেকে বেরিয়ে মাহবুব ফুয়াদকে বলল, এবার আমরা যে স্কুলে লেখা পড়া করেছি সেটা দেখে বাড়ি ফিরব। তারপর দুটো রিক্সা নিয়ে প্রথমে সেন্ট ইউফ্রেটিশ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় দেখে পরে বান্দুরা হলিক্রস উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলাম। দু’টো স্কুলই খৃষ্টান মিশনারীর আন্ডারে। সেদিন স্কুল বন্ধ থাকায় মাহবুব সবাইকে নিয়ে স্কুল এরিয়ার মধ্যে ঢুকল। দু’টো স্কুল পাশাপাশি বিরাট এলাকা নিয়ে স্কুলের কম্পাউন্ড। চারপাশে পাকা পাঁচিল। স্কুলের সামনে অনেক খানি ফাঁকা জায়গা। আলাদা আলাদা ভাবে ছেলে মেয়েদের খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে। অনেকটা জায়গা নিয়ে ফুলের বাগান। কম্পাউণ্ডের মধ্যে দূরের ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার জন্য আলাদা বিল্ডিং। বিল্ডিং এর সামনে অনেকখানি মাঠ। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা কফি, আলু ও টমাটোর চাষ করেছে। স্কুলের উত্তর পাশ ঘেঁষে ইছামতি নদী বয়ে গেছে। সবকিছু দেখে তারা যখন বাড়ির পথ ধরল তখন দুপুর সাড়ে বারটা।
ফেরার সময় সোহেল ফুয়াদকে বলল, আপনার বই পড়ে আমরা ইসলামের অনেক অজানা জিনিস জানতে পারছি এবং আরো বেশি করে জানার প্রেরণা পাচ্ছি। আচ্ছা, কি কি বই পড়লে ইসলামকে ভালোভাবে জানতে পারব, বলবেন?
ফুয়াদ মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আপনি কোরআনের ব্যাখ্যা। অথবা হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জীবনী পড়েছেন?
না।
প্রথমে গোলাম মোস্তফার “বিশ্বনবী” অথবা মৌলানা আকরাম খানের “মোস্তফা চরিত” অথবা সৈয়দ আমীর আলির “দি স্পিরিট অফ ইসলাম” ইংরেজি বা বাংলায় পড়তে পারেন। এটা পড়ার পর নিজেই বুঝতে পারবেন, তারপর কি পড়বেন, আর সময় সুযোগ পেলে বড় বড় আলেমদের ওয়াজ মাহফিলে যাবেন। কোরআনের ব্যাখ্যা বাংলায় বেরিয়েছে। অবসর সময়ে পড়বেন।
সোহেল বলল, তবলীগ জামায়াতের লোকেরা আমাকে একবার কাকরাইলে নিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন ছিলাম। সেখানেও বড় বড় আলেমরা ওয়াজ করেন। ওঁদের সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা।
ওঁদের কর্মকাণ্ড ও উদ্দেশ্য অতি মহৎ। তবে সবাই তো আর সংসার ধর্ম, চাকরি-বাকরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে ওখানে বেশি সময় দিতে পারে না। যাদের সময় সুযোগ ও সামর্থ আছে তাদের যাওয়া উচিত। যাদের সময়-সুযোগের অভাব, তাদের পড়া-শোনার মাধ্যমে ইসলামকে জানা ও সেইমত চলা উচিত। আপনি ঢাকায় থাকেন কোথায়?
প্রথমে হোস্টেলে থাকতাম। ওখানে নানান চরিত্রের ছেলেরা থাকে। ঠিকমতো পড়াশোনা করা যায় না। তাই বাবু বাজারে মাহবুব ভাইয়ের এক বোনের বাসায় · পেইংগেষ্ট হয়ে আছি।
সময় পেলে আপনি ইসলামী ফাউণ্ডেসনে গিয়ে কিছু সময় পড়াশোনা করতে পারেন। ওখানে সবার জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে।
সোহেল বলল, ইনশাআল্লাহ, যাব।
বাড়িতে পৌঁছাতে বেলা একটা বেজে গেল। জোহরের নামাযের পর মাহবুবদের বৈঠকখানার সামনে ছোলাপড়া শুরু হল। আগেই কয়েক খতম কোরআন পড়া হয়েছে। আসরের নামাযের পর মিলাদ পড়ে সওয়াব-রেশানী করা হবে।
মিলাদ ও সওয়াব রেশানী করার জন্য যে মৌলবীকে দাওয়াৎ দেওয়া হয়েছিল, অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারলেন না। সে কথা একজন লোকের দ্বারা জানিয়েছেন। আসরের নামাযের পর মসজিদের ঈমাম সাহেবকে মিলাদ পড়িয়ে দেওয়া করতে বলা হল।
ঈমাম সাহেব দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাদের মধ্যে এমন একজন মহান ব্যক্তি আছেন যিনি একদিকে যেমন কোরআন-হাদিসের জ্ঞান রাখেন, তেমনি অন্য দিকে একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক। এ পর্যন্ত ওর প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা বই প্রকাশিত হয়েছে। আপনাদের মধ্যে হয়তো অনেকে ফুয়াদ হাসানের বই পড়েছেন। কথা শেষ করে ফুয়াদকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ইনি সেই গুণীজন। ওঁর কাছ থেকে কোরআন-হাদিসের কথা কিছু শুনতে চাই। তারপর বসে পড়লেন।
ফুয়াদ এই পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তত ছিল না। এর আগে দু’চারটে সভা সমিতিতে বক্তব্য রেখেছে। কিন্তু এই রকম ধর্মীয় সভায় কোনো দিন বক্তব্য রাখেনি। নার্ভাস ফিল করলেও আল্লাহকে স্মরণ করে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সামলে নিল। তারপর আল্লাহর হামদ ও রসুল (সঃ) উপর নাত পড়ে বলল, উপস্থিত মুরুব্বিগণ, যুবক, বৃদ্ধ ও আমার ছোট-ছোট ভাই ও বোনেরা, আসোলামু আলাইকুম। সবাই সালামের উত্তর দেওয়ার পর বলল, আমি কোনো আলেম নই যে, আপনাদেরকে ওয়াজ করে শোনাব। তবে আল্লাহ পাক মেহেরবানী করে আমাকে যতটুকু এলেম দান করেছেন, তা থেকে দু’চার কথা বলব। সারা পৃথিবী যখন অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে ছিল অর্থাৎ হিংসা-বিদ্বেষ, চুরি-ডাকাতি, দলগত ও জাতিগত দ্বন্দ এবং নারীদেরকে পন্যদ্রব্যের মত বেচাকেনা করত, মেয়ে সন্তানদের হত্যা করত, এক কথায় মানুষ তার মানুষত্ব হারিয়ে ফেলেছিল এবং পশুতে পরিণত হয়েছিল তখন আল্লাহ পাক সেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে সূর্যের ন্যায় জ্ঞানের প্রদীপ করে এই ধরাধামে পাঠালেন। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) শুধু মুসলমানদের নবী নন; সারা পৃথিবীর মানুষের নবী। তাই তো তিনি বিশ্বনবী (সঃ) নামে খ্যাত। মানুষ পৃথিবীতে কিভাবে জীবন-যাপন করবে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার কি করনীয়, তার বিধানসহ সৃষ্টি কর্তা তার প্রেরিত পুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে পাঠিয়েছেন। ইহকালের সব রকমের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে এবং পরকালের অনন্তকাল সুখ-শান্তির উপকরণ তার হাবিবকে দিয়ে বিশ্ব-মানবকে জানিয়ে দিয়েছেন। সেই জন্য আল্লাহ তাঁকে (হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে) কোরআন পাকে রাহমাতুল্লিল আ’লামীন বলে আখ্যায়িত করিয়াছেন এবং সারা বিশ্বের মানুষকে আহবান করে বলিয়াছেন, “তোমরা আমার রসুলের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ কর নচেৎ ইহজগতে যেমন অশান্তি ভোগ করবে, তেমনি পরজগতেও অনন্তকাল অশান্তি ভোগ করবে।”
যারা আল্লাহর কোরআনের বিধান ও রসুলের বিধান অস্বীকার করেন, তাদের কথা এখন আমি আলোচনা করব না। আমরা যারা এইসব বিশ্বাস করি এবং মুসলমান বলে দাবি করি, তারা কি আল্লাহ ও তার রসুলের (সঃ) এর বিধান মেনে চলছি? চলছি না। তাইতো সারা পৃথিবীর মুসলমান আজ নিকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হয়েছে। মুসলমানরা আজ আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সঃ) এর বিধান অমান্য করে মরীচিৎকার ন্যায়, বিজাতীয় ও বিধর্মীদের তৈরী বিধানের দিকে ছুটে চলেছে। তারা জানে না, মরীচিকা কোনো দিন বাস্তব হয় না। এসব কথা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বলে শেষ করা যাবে না। তাই সামান্য কিছু বলে আমার বক্তব্য আমি শেষ করব। প্রত্যেক মুসলমানের তথা প্রত্যেক মানুষের উচিত, তার সৃষ্টিকর্তার পরিচয় জানা। আমাদের নবী (সঃ) বলিয়াছেন, “সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে হলে, প্রথমে নিজেকে চিনতে হবে।”
জ্ঞান অর্জন ছাড়া মানুষ যেমন ভালো-মন্দ চিনতে পারে না, তেমনি নিজেকে এবং সৃষ্টি কর্তাকেও চিনতে পারে না। আর সেই জ্ঞান হল ধর্মীয় জ্ঞান। তাই বলে আমি স্কুল কলেজের জ্ঞান অর্জন করতে নিষেধ করছি না। আর একটা কথা আমাদের সবাইকে। মনে রাখতে হবে, জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে সেইসব আমাদের মেনে চলতে হবে। যারা শুধু ডিগ্রী অর্জনের জন্য লেখাপড়া করেন তাদের উদ্দেশ্য ভালো না এবং ভালো হতে পারে না। লেখাপড়া করার মূল উদ্দেশ্য হল, চরিত্র গঠন। লেখাপড়া করে বড় ডিগ্রী নিলাম অথচ চরিত্র গঠন হল না, সে রকম লেখাপড়ার এক কানাকড়িও মূল্য নেই। যারা এই রকম লেখাপড়া করে, ইসলামী দৃষ্টি ভঙ্গিতে তারা শয়তানের চেলা। আল্লাহর রসুল (সঃ) যে জ্ঞানের আলো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা ছিল মানবতার জ্ঞান, চরিত্র গঠনের জ্ঞান। তাই তো তখনকার মুসলমানদের মানবতা ও চরিত্র দেখে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে। আর আজকের মুসলমানরা সেই জ্ঞানকে দূরে ঠেলে দিয়ে মানব রচিত জ্ঞান আহরণ করে সারা দুনিয়ার কাছে অপমানিত ও অত্যাচারিত হচ্ছে।
কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করতে ইসলাম নিষেধ করেনি। তবে যে শিক্ষা মানুষকে অমানুষ করে তুলে, চরিত্র গঠনে সহায়ক হয় না, সৃষ্টি কর্তার বিধানকে অস্বীকার করে, সে শিক্ষা গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে। আপনারা হয়তো বলবেন, কোনো শিক্ষাই মানুষকে অমানুষ করে না। তাই যদি হয়, তা হলে শিক্ষার হার যত বাড়ছে মানুষ তত অমানুষ হয়ে যাচ্ছে কেন? অপরপক্ষে যখন শিক্ষার হার নগন্য ছিল তখন তো মানুষের চরিত্রের এত অধঃপতন ছিল না। ছেলে মেয়েরা বড়দের সম্মান করত, একজনের বিপদে অন্যজন এগিয়ে আসত। কিছু কিছু জমিদার, মোড়ল অথবা বিত্তশালীরা গরিবদেরকে শোষণ করলেও সমাজের এত অবক্ষয় ছিল না।
সমাজের অবক্ষয়ের জন্য প্রশাসন বিভাগ যেমন দায়ী, তেমনি সমাজপতি ও সমাজের লোকেরাও দায়ি। একজনকে নিয়ে সমাজ হয় না। সমাজের লোকেরা যদি ভালো হয় তা হলে সমাজ ভালো হতে বাধ্য। ছেলে-মেয়েরা প্রথমে মা বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের দেখে এবং বড় হয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকের সঙ্গে পরিচিত হয়। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা যদি ছোট বেলায় ঘরের পরিবেশ ও বড় বেলায় সমাজের পরিবেশ ভালো দেখত, তা হলে তাদের চরিত্রের অবক্ষয় হতে পারত না। তাই সন্তানের পিতা-মাতার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ আপনারা কোরআন হাদিসের জ্ঞান অর্জন করে সেই ভাবে নিজেদেরকে পরিচালিত করুন। এবং ছেলে-মেয়েদেরকেও সেই ভাবে গড়ে তুলুন। অনেক ছেলে-মেয়ে আছে, তারা আল্লাহর বিধান মেনে চলে, অথচ তাদের মা-বাবা তাদের বিপরীত। জীবন-যাপন করার জন্য কোনো শিক্ষা বা কাজ কর্মে কোনো বাধা নেই। তবে আমরা যা কিছুই করি না কেন, তা কোরআন হাদিসের আইনের পরিপন্থি যেন না হয়। সেই জন্য আমাদের সবাইকে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আর এই জ্ঞান অর্জনকে আল্লাহ পাক প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয করেছেন। আমরা মেয়েদেরকে লেখাপড়ার ব্যাপারে ছেলেদের চেয়ে বেশি অবহেলা করি। এটা কোনো বাবা-মায়েরই উচিত নয়। ভুলে যাচ্ছেন কেন, আজকের ছোট ছোট মেয়েরাই একদিন মা হবে। শিক্ষিত মা না হলে সন্তানদের মানুষ করবে কি করে? তাই মেয়েদের শিক্ষার প্রতি মা-বাবার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বিয়ের আগে পর্যন্ত অন্তত তাদেরকে ধর্মীয়, পার্থিব ও গৃহস্থালীর এবং আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ বধূ ও আদর্শ মা হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। তা হলে তার পেটে যে ছেলে-মেয়ে জন্মাবে, তারাও আদর্শবান হবে। সবশেষে আপনাদেরকে একটা কথা না বলে পারছি না, আপনারা সভা করুণ, সমিতি করুন, রাজনীতি করুন আর যাই করুন না কেন, কোনো কিছুই ইসলামে নিষেধ নেই। তবে ঐসব করতে গিয়ে ইসলামকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। বরং ঐসব ইসলামিক নীতিতে করবেন। তা না করে মানুষের কথা মতো করলে ইসলামকে অমান্য করা হবে। এবং পরিশেষে আমাদের উপর আল্লাহর গজব নাযিল। হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সবকিছু জানার, বোঝার এবং তাঁর ও তাঁর প্রিয় নবী (সঃ) এর পথে চলার তওফিক এনায়েত করুন, এই দোয়া করে। এখানেই আমার বক্তব্য শেষ করছি। তারপর সালাম জানিয়ে বসে পড়ে ইমাম সাহেবকে বলল, এবার আপনি দরুদ ও সালাম পড়িয়ে দোয়া করুন।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রুমানার বাবা ফুয়াদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হুজুররা শুধু মিলাদ পড়ে দোয়া করে চলে যান। সেই সময় আপনার মতো কিছু বক্তব্য রাখলে ছোট-বড় সবাই অনেক ধর্মীয় জ্ঞান পেত। আপনি ধর্মের আসল কথাটাই বলেছেন। লেখাপড়া করে যদি ছেলে মেয়েরা আদর্শ চরিত্র গঠন করতে না পারে, তা হলে অমন লেখাপড়ার মূল্য কী? কেন এ রকম হচ্ছে বলতে পারেন?
ফুয়াদ বলল, এর কারণ অনেক। তার মধ্যে প্রথম কারণ হল, পিতা-মাতারা যেমন ধর্মের কিছু মেনে চলেন না, তেমনি তাদের নৈতিক চরিত্রও ভালো না। যারা তা নন, তারাও ছেলে-মেয়েদেরকে আদব-কায়দা শিক্ষা দিয়ে মানুষ করছেন না। দ্বিতীয় কারণ স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় জ্ঞানের ও চরিত্র গঠনের মতো তেমন কিছু নেই। তৃতীয় কারণ হল, কি স্কুলে কি মাদ্রাসায় আদর্শ শিক্ষকের খুব অভাব। চতুর্থ কারণ হল,সরকার শুধু মুখে আদর্শ নাগরিক হওয়ার বুলি আওড়ান। অথচ তারা নিজেরাই আদর্শ নাগরিক নন। দেশকে সুষ্ঠভাবে শাসন করার জন্য আইন আছে, কিন্তু বলিষ্ঠ ভাবে আইনের প্রয়োগ নেই। দুর্নিতী ও ঘুষ প্রশাসন বিভাগের মূলমন্ত্র। তাদের মধ্যে যারা অল্প সংখ্যক আদর্শ চরিত্রের লোক আছেন, তারা বহু সংখ্যকের কাছে বন্দি ও অসহায়। প্রশাসকরা সমাজ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তাই সমাজের সবাই না হলেও বেশির ভাগ যদি সৎ হতে পারেন, তা হলে প্রশাসন বিভাগেও বেশির ভাগ সৎ লোক হবেন। সমাজকে সৎ হতে হলে সমাজের লোকদেরকে প্রথমে সৎ হতে হবে। আর সমাজের লোকদের সৎ হতে হলে সমাজের প্রত্যেককেই ব্যক্তিগত ভাবে সৎ হতে হবে। আমরা ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের ইতিহাস পড়লে জানতে পারব, আল্লাহ তার হাবিব হযরত মুহম্মদ (সঃ) কে সর্বগুণে গুণান্বিত করে পাঠালেন। তিনি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে সেই সব বাস্তবে পরিণত করলেন। তারপর সমাজের লোকদের সেই ভাবে তৈরী করতে সচেষ্ট হলেন। এবং আল্লাহ পাকের ঈশারায় তাতে তিনি সফলকাম হলেন। তারপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর মিশন পাঠালেন।
রুমানার বাবা বললেন, আপনার কথাগুলো অতি সত্য। মুসলমানরা যদি এইসব অনুধাবন করে অনুসরণ করতে পারত, তা হলে সমাজ অবক্ষয়ের হাত থেকে রেহাই পেত।
পরের দিন নাস্তা খাওয়ার সময় মাহবুব বলল, ফুয়াদ ভাই, আমি ও মালেক চাকরি করি। আমাদের আজই ফিরে যেতে হবে। মুক্তার মামাও খেটে খাওয়া মানুষ। উনিও। যাবেন। আপনি কয়েক দিন থেকে যান। আবার কবে আসবেন না আসবেন তার ঠিক নেই? রুমানা আছে, সোহেলও কয়েক দিন থাকবে, কোনো ব্যাপারেই আপনার অসুবিধা হবে না।
ফুয়াদের থাকার ইচ্ছা থাকলেও চিন্তা করল, ব্যাপারটা বেশ অশোভন দেখাবে। বলল, তা কি করে হয়? আপনারা থাকলে না হয় থাকা যেত? আল্লাহর ঈশারা থাকলে আবার আসা যাবে। আমিও আপনাদের সঙ্গেই যাব।
রুমানা তাদেরকে নাস্তা খাওয়াচ্ছিল। বলল, উনি শহরের বড়লোকের ছেলে। পাড়া গাঁয়ের গরিবদের সঙ্গে বেশি দিন থাকতে অসুবিধা হবে।
ফুয়াদ তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার ধারনা ঠিক নয়। বড়লোক বলতে যা বোঝায় তা আমরা নই। তবে আল্লাপাকের মেহের বানীতে আমাদের যেমন কোনো অভাব অনটন নেই তেমনি ব্যাংকেও লাখ লাখ টাকা জমা নেই।
তা হলে থাকতে চাচ্ছেন না কেন?
যতটুকু বলেছি তার বেশি কিছু বলতে পারব না।
কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরী হয়ে সবাই যখন রওয়ানা হবে তখন ফুয়াদ বাথরুমে গেল। মাহবুব রুমানাকে বলল, রিক্সাওয়ালা অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে, আমরা এগোই, ফুয়াদ ভাইকে তুই এগিয়ে দিস।
ফুয়াদ বাথরুম থেকে এসে রুমানা ছাড়া কাউকে দেখতে না পেয়ে বলল, কি ব্যাপার, ওঁনারা কি সত্যি সত্যি আমাকে ফেলে চলে গেলেন?
পরশুদিন ফুয়াদের পরিচয় পেয়ে রুমানা বিশ্বাসই করতে পারেনি, তার মতো একজন বিখ্যাত লেখক তাদের বাড়িতে আসবেন। তারপর যখন ফুয়াদ বলল, এক সপ্তাহ থাকার প্রস্ততী নিয়ে এসেছে তখন থেকে তার মন মুক্ত বলাকার মতো আকাশে উড়ছিল। আজ চলে যাবেন শুনে তীর বিদ্ধ বলাকার মতো ছটফট করছে। ফুয়াদের কথা শুনে মাথা নিচু করে কোনো রকমে বলল, ওরা এগিয়ে গেছে। রাস্তায় অপেক্ষা করবে। মাহবুব ভাই আপনাকে এগিয়ে দিতে আমাকে বলে গেল।
ফুয়াদ তৈরী হয়ে বলল, চলুন।
রুমানা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
ওভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এগিয়ে দেবেন না?
রুমানা তবুও অনড়। তার চোখ দুটো তখন পানিতে ভরে উঠেছে। ফুয়াদ দেখতে পেলে লজ্জায় মরে যাবে। তাই এই অবস্থা।
ফুয়াদ এই দু’দিনে রুমানার চোখ মুখ দেখে তার মনের খবর যেন একটু আঁচ করতে পেরেছে। বলল, চিঠি দিলে উত্তর দেবেন?
রুমানা আকুল সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে যেন বাঁচার একটা অবলম্বন পেল। তবু মুখে কিছু বলতে পারল না। ঐ অবস্থাতেই মাথা নেড়ে সায় দিল।
শুকরিয়া বলে ফুয়াদ বলল, দু’দিন আপনাদের খুব বিরক্ত করলাম। চলি, আল্লাহ হাফেজ। তারপর ব্রীফকেস হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল। রুমানার চোখ থেকে ততক্ষণে পানি গড়িয়ে পড়েছে। কিছুতেই সামলাতে পারছে না। মাথা নিচু করে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে ফুয়াদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
রাস্তায় এসে ফুয়াদ রিক্সায় উঠল।
মাহবুব বলল, রুমানা আপনাকে এগিয়ে দিল না?
ফুয়াদ বলল, আমি কি ছোট না কি যে, কাউকে এগিয়ে দিতে হবে।
বান্দুরায় এসে ওরা বাসে উঠল। বাস চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরে ফুয়াদ মাহবুবকে বলল, আমি নবাবগঞ্জে নামব।
মাহবুব খুব অবাক হয়ে বলল, কেন?
কয়েক দিন হোটেলে থেকে আপনাদের গ্রাম নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব। আপনি বাসায় গিয়ে আম্মাকে খবরটা দেবেন।
মাহবুব বলল, তা না হয় দেব; কিন্তু নবাবগঞ্জে হোটেলে থাকবেন কেন? আমাদের বাড়িতেই তো থাকতে পারতেন?
ফুয়াদ বলল, আপনি থাকলে অবশ্যই থাকতাম। অপরিচিত পরিবেশে একলা একলা থাকতে যেমন মন চাইল না, তেমনি লেখাও আসত না।
মাহবুব বলল, কাজটা আপনি ভালো করলেন না।
মাহবুব ভাই, মনে কষ্ট নেবেন না। আপনি বোধ হয় জানেন না, লেখকরা একটু খামখেয়ালী হয়। কখন মনে কি উদয় হয়, লেখকরাই বুঝতে পারেন না; আপনাদের বাড়ির সবাই থাকতে বললেন অথচ তখন মন সাড়া দিল না। এখন আবার নবাবগঞ্জে থাকতে মন চাইছে।
মাহবুব বলল, লেখকদের খামখেয়ালীর কথা একটু আধটু শুনেছিলাম, আজ আপনার কথা শুনে তার প্রমাণ পেলাম। আপনার মা শুনলে কি ভাববেন বলুন তো?
আম্মা কিছুই ভাববেন না। উনি পেটে ধরা ছেলের মতি গতি জানেন।
বাস নবাবগঞ্জে বেশ কিছুক্ষণ থামে। ফুয়াদের সঙ্গে মাহবুবও নামল। এখানে দু’তিনটে আবাসিক হোটেল আছে। মাহবুব তাকে নবাবগঞ্জ হোটেলে নিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে ম্যানেজারকে বলল, এটাচবাথ সহ একটা সিঙ্গেল রুম দিন। ইনি লেখক মানুষ। কয়েকদিন থাকবেন। আপনার লোকদের একটু লক্ষ্য রাখতে বলবেন।
ফুয়াদ তাকে বলল, আপনি এবার যান, বাস ছেড়ে দেবে।
ম্যানেজারের বাড়ি পালামগঞ্জে। ইকরাশীর মিয়া বাড়ির অনেক সুনাম শুনেছেন। বললেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। উনি লেখক মানুষ,তার উপর মিয়া বাড়ির মেহমান, ওঁর সবকিছু আমি নিজেই লক্ষ্য রাখব।
চার
ফুয়াদ রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রুমানা তার যাত্রা পথের দিকে চেয়েছিল। গাছপালার আড়াল হয়ে যেতে তার পিছু নিল। তারপর দূর থেকে তাকে রিক্সায় উঠে চলে যেতে দেখে অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ফেরার সময় ভাবল, ফুয়াদ সাহেব
কী আমার মনের খবর বুঝতে পেরেছেন? তার মন বলে উঠল নিশ্চয় পেরেছেন। তা না। হলে চিঠি দেওয়ার কথা বললেন কেন? এই সব ভাবতে ভাবতে ঘরে এলো। তাকে দেখে মাসুদা বিবি বললেন। এতক্ষন কোথায় ছিলি?
রুমানা বলল, মাহবুব ভাইয়েরা চলে গেল, একটু এগিয়ে দিতে গিয়েছিলাম।
তারা তো অনেক্ষণ চলে গেছে। তারপর মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর কি হয়েছে, মনে হচ্ছে একটু আগে কেঁদেছিস।
রুমানা হেসে উঠে বলল, আম্মা, তুমি যে কি? আমার আবার কি হবে? কাঁদতেই বা যাব কেন?
কিছু না হলেই ভালো। তোর আব্বা গোসল করতে গেছে। এলে খেতে দিস। আমি কয়েকটা কাপড়ে সাবান দেব। একথা বলে তিনি কলতলার দিকে চলে গেলেন।
রুমানার কলেজ পনের দিন বন্ধ ছিল। চার পাঁচ দিন পর খুলবে। তারপর প্রীটেস্ট পরীক্ষা। পড়তে বসে রুমানা পড়ায় মন বসাতে পারল না। সব সময় ফুয়াদের কথা মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে ভাবে যাওয়ার সময় চিঠি দেওয়ার কথা বলে গেছেন। অতবড় লেখকের কি আর আমার কথা মনে থাকবে, না আমাকে চিঠি দেওয়ার কথা মনে থাকবে? তা ছাড়া লেখকদের চিঠি লেখার সময় কোথায়। তবু চিঠির প্রতীক্ষায় দিন। গুনতে থাকে।
আজ কলেজ খুলেছে। রুমানা একা কলেজে এসেছে। নিশাত কয়েক দিন আগে খালার বাড়ি বেড়াতে গেছে। আর খালেদাকে দেখতে আজ পাত্র পক্ষের লোকজন আসবে। কলেজ ছুটির পর রুমানা বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় জামসেদ তার কাছে এসে বলল, চল না একটু চা খাই।
জামসেদের বাড়ি নবাবগঞ্জেই। কলেজের প্রিন্সিপালের ছোট ছেলে। রুমানার সঙ্গে পড়ে। জামসেদ রুমানাকে ভালবাসে। সে কথা বেশ কয়েক মাস আগে তাকে। জানিয়েছিল। জামসেদের সঙ্গে রুমানার পরিচয় ফাস্টইয়ার পরীক্ষার পর। খালেদার সঙ্গে জামসেদের কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বেশ জানাশোনা। জামসেদের মেয়েলিপনা স্বভাব। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সঙ্গে থাকতে বেশি পছন্দ করে। তাই ক্লাসের সব মেয়েদের সঙ্গে তার জানাশোনা। মেয়েরা তাকে নিয়ে বেশ রসিকতা করে। জামসেদ তা বুঝেও না বোঝার ভান করে তাদের সঙ্গে মিশে। বড় জেদী ধরনের ছেলে। বেশ ইন্ট্যালিজেন্টও। ক্লাসের ফাষ্ট বয়। কোনো মেয়ে যদি তার সঙ্গে মিশতে না চায়, তা হলে সে খুব রেগে যায় এবং যেমন করে হোক মেয়েটাকে তার সঙ্গে মিশতে বাধ্য করাবে। খালেদাকেও একদিন ভালবাসার কথা বলেছিল। খালেদা বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলেছিল, জামসেদ ভাই, আমার কোনো ভাই নেই। আমি আপনাকে আপন ভাইয়ের। মত মনে করি। তা ছাড়া আমার খালাত ভাইয়ের সাথে বছর খানেক আগে আমার কাবীন হয়ে গেছে। শুনে কয়েক দিন মন খারাপ করে খালেদার ধারে কাছে যায় নি। তারপর থেকে রুমানার পিছনে লেগেছে। খালেদার ব্যাপারটা রুমানা জানত। খালেদাই রুমানা ও নিশাতকে বলেছিল। তাই জামসেদ যখন ভালবাসার কথা জানায় তখন রুমানা খালেদার মতই বলতে চেয়েছিল, কিন্তু মিথ্যা বলতে তার বিবেকে বেধে ছিল। তাই বলেছিল, দেখুন জামসেদ ভাই, ভালবাসা মুখের কথায় হয় না। ওটা হল মনের ব্যাপার। আমার মন যখন আপনাকে ভালবাসবে তখন আমি নিজেই সে কথা আপনাকে জানাব। জামসেদ বলেছিল, ঠিক আছে তাই বলো। সে দিনের পর থেকে জামসেদ মাঝে মাঝেই তার মনের কথা জিজ্ঞেস করে। জিজ্ঞেস করার আগে চা খাওয়ার কথা বলে হোটেলে নিয়ে গিয়ে জোর করে অনেক কিছু খাওয়াবেই। আজ যখন জামসেদ তাকে চা খাওয়ার কথা বলল তখন তার মতলব বুঝতে পেরে বলল, চা খাওয়াতে হবে না, এমনিই বলছি, “এখনো মনে আপনার জন্য ভালবাসা জন্মায়নি। বলেছি তো, যে দিন জন্মাবে, সে দিন আমি নিজেই আপনাকে জানাব। এখন যাই বাস ছেড়ে দেবে বলে রুমানা বাস ষ্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
দু’দিন মাহবুবদের বাড়িতে থেকে ফুয়াদ রুমানার মনের ভাব একটু যেন অনুমান করতে পেরেছিল। আসার সময় রুমানার অবস্থা দেখে সেই অনুমান আরো দৃঢ় হয়। বাসে উঠে ভাবল, মাকে তো বলে এসেছি নবাবগঞ্জ হোটেলে থেকে গ্রামভিত্তিক একটা। উপন্যাস লিখব। তাই করলে কেমন হয়? রুমানা কলেজে এলে তার সঙ্গে দেখা করাও যাবে। কথাটা চিন্তা করে মত পাল্টায়। এই কয়েকদিন বেশির ভাগ সময় হোটেলের রুমে বসে উপন্যাস লিখলেও আসরের নামাযের পর কিছুক্ষণ হাঁটতে বেরোয়। সারাদিন বসে বসে লেখে, তাই লেখার জগতে আসার পর প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে একঘন্টা। করে হাঁটে। এখানেও তাই করে। একদিন বিকেলে হাঁটার সময় বিভিন্ন লাইব্রেরী ঘুরে ফিরে দেখল। দু’তিনটে বইও কিনল। একদিন কলেজে গিয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে কলেজ খোলার দিন জেনে এসেছিল। তাই আজ জোহরের নামায পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে হোটেলে খেতে না গিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে রুমানার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। কাছে এলে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
রুমানা ফুয়াদকে দেখে চমকে উঠল। নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড অপলক নয়নে তার দিকে চেয়ে রইল। সালামের উত্তর দিতে পর্যন্ত ভুলে গেল।
ফুয়াদ বলল, সালামের উত্তর দিলেন না যে? কিছু হল! চিনতে পারছেন না?
রুমানা নিজেকে সামলে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, চিনতে পরব না কেন? তবে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি।
কেন?
কেনর উত্তর রুমানা দিতে পারল না। তখন তার মনে আনন্দের তুফান বইছে।
ফুয়াদ তার মনের অবস্থা যেন বুঝতে পারল। বলল, ঠিক আছে, আসুন আমার সঙ্গে।
রুমানা না করতে পারল না। যেতে যেতে বলল, আপনি এ সময় এখানে, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
ফুয়াদ মৃদু হেসে বলল, কেন? নিষেধ আছে নাকি?
তা থাকবে কেন? কিন্তু…….বলে থেমে গেল।
কিন্তু কি, না বলে থেমে গেলেন কেন?
এখানে কোথায় উঠেছেন?
হোটেলে।
হোটেলে?
হ্যাঁ হোটেলে।
কবে এসেছেন?
আসব কি, আপনাদের বাড়ি থেকে ফেরার দিন ঢাকা যাইনি।
রুমানা খুব অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর বলল, মানে, আজ একসপ্তাহ হোটেলে আছেন?
হ্যাঁ।
এখানে হোটেলে থাকতে পারলেন, আর আমাদের বাড়িতে থাকতে পারলেন না? আমরা কি আপনার সেবা যত্ন করতে পারতাম না? কথা বলতে বলতে কান্নায় রুমানার গলা ভারি হয়ে এল। চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে নিল।
ফুয়াদ তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, দেখুন, ব্যাপারটা আপনি যেভাবে নিচ্ছেন, আসলে তা নয়। পরে সব কথা বলব। এখন আসুন আমার সঙ্গে।
ফুয়াদ তাকে নিয়ে একটা রেষ্টুরেন্টে এসে কেবিনে বসল। তারপর বলল, কি খাবেন, ভাত না অন্য কিছু?
আপনি এখনো খান নি?
না। তা হলে আপনি খান, আমি বাড়িতে গিয়ে খাব।
বাহ, বেশ সুন্দর কথা বললেন। আমি আপনার জন্য খায়নি,আর আপনি বলছেন। কিনা বাড়িতে গিয়ে খাবেন।
ততক্ষণে বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছে। ফুয়াদ চিকেন বিরানীর অর্ডার দিল।
বেয়ারা চলে যেতে রুমানা বলল, আমি যে আজ কলেজে আসব, জানলেন কেমন করে?
এখানে আসার পরের দিন কলেজে গিয়ে দারোয়ানের কাছে জানতে পারলাম, আজ কলেজ খুলবে। আর আপনার আসার ব্যাপারটা মন বলেছে।
রুমানা কিছু বলতে যাচ্ছিল, বেয়ারাকে আসতে দেখে থেমে গেল। অর্ডার সার্ভ করে চলে যাওয়ার পর বলল,বাড়ি না গিয়ে এখানে এতদিন রয়েছেন কেন বলবেন?
বললে মাইন্ড করবেন না তো?
না, আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।
আগে খেয়ে নিন তারপর শুনবেন।
খেতে শুরু করে রুমানা বলল, খেতে খেতেই বলুন না।
সে দিন আপনাদের ওখান থেকে আসার সময় আপনি মাথা নিচু করেছিলেন এবং কোনো কথাও বলেন নি। কারনটা না জেনে ফিরে যেতে কিছুতেই মন চাইল না। তাই বাসে উঠে মত পাল্টে থাকার সিদ্বান্ত নিই।
ফুয়াদের কথা শুনে রুমানা খাওয়া বন্ধ করে প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইল। তখন তার হৃদয়ের স্পন্দন অনেকগুন বেড়ে গেছে।
ফুয়াদ বলল, কি হল খাচ্ছেন না যে? মাইন্ড করলেন নাকি? আপনি কিন্তু এক্ষুণী নিশ্চিন্তে বলতে বলেছেন।
রুমানা খেতে শুরু করে বলল, মাইন্ড করিনি, তবে….. বলে থেমে গেল।
থামলেন কেন? বলুন।
ছোট একটা ঘটনা বলছি, সেটার মধ্যে আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আছে। কাগজে পড়েছিলাম, কোনো এক রিক্সাওয়ালা লটারীর টিকেট কেটেছিল। যখন সে জানতে পারল, প্রথম পুরস্কার বিশ লক্ষ টাকা পাবে তখন শুনেই সে হার্টফেল করল। আপনাকে দেখে ও আপনার কথাবার্তা শুনে আমারও রিক্সাওয়ালার মতো না অবস্থা হয়? কথা শেষ করে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ফুয়াদের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
ফুয়াদ তার মনের খবর জানতে পেরে খুব আনন্দিত হল। মনে মনে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করে বলল, ভয় পাচ্ছেন কেন? আল্লাহর মর্জি ছাড়া কুল-মখলুতে কোনো কিছুই হয় না। আপনি তাঁর কাছে সবর করার দোওয়া চান। আমিও তাই করব। আপনার মতো আমিও আপনাকে দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছি। প্রাথমিক পর্যায়ে যা কিছু ঘটে গেল, তা যেমন আল্লাহর মর্জি-মোতাবেক, তেমনি তকদিরে থাকলে বাকিটাও তাঁরই মর্জি-মোতাবেক হবে। ওসব নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। নিন এবার খাওয়া শেষ করুন।
ফুয়াদের মনের কথা জানতে পেরে রুমানার ক্ষুৎপিপাসা মিটে গেছে। কোনো রকমে দু’এক লোকমা খেয়ে মুখ-হাত ধূয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।
কি হল, খেলেন না যে?
খেতে ইচ্ছা করছে না, আপনি খেয়ে নিন। তারপর বেসিন থেকে মুখ-হাত ধূয়ে এসে বসল।
ফুয়াদ খাওয়া শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বেয়ারাকে ডেকে বলল, টেবিল পরিস্কার করে দু’প্লেট দই-মিষ্টি দিন।
রুমানা বলল, না-না, আমি আর কিছু খাব না। একপ্লেট দিতে বলুন। ফুয়াদ বলল, আপনি তো কিছুই খান নি। দই-মিষ্টি পছন্দ না করেন অন্য কিছু খান।
পছন্দ-অপছন্দের কথা নয়, আমার কোনো কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।
দেখুন, খাওয়ার ব্যাপারে লজ্জা করবেন না। পেটে খিদে মুখে লাজ, আমি পছন্দ করি না। তারপর রুমানা কিছু বলার আগে বেয়ারাকে বলল, আপনি নিয়ে আসুন তো ভাই।
রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে রুমানাকে বাসে তুলে দিয়ে বলল, ইনশাআল্লাহ কাল আবার দেখা হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে হোটেলে ফিরে এল।
কলেজ থেকে বেরিয়ে রুমানা জামসেদের সঙ্গে কথা বলে যখন বাস ষ্ট্যান্ডের দিকে যেতে লাগল তখন জামসেদ তাকে ফলো করে আসছিল। রুমানাকে একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাস ছেড়ে দেওয়ার পরও তাদেরকে কথা বলতে দেখে যেমন অবাক হল তেমনি রুমানার উপর বেশ একটু রেগে গেল। ভাবল, ছেলেটা কে হতে পারে? আড়াল থেকে ছেলেটাকে চিনতেও পারল না। তারপর তাদেরকে রেষ্টুরেন্টে ঢুকতে দেখে কাছাকাছি এসে অপেক্ষা করতে লাগল। রুমানাকে বাসে তুলে দিয়ে অচেনা ছেলেটাকে ফলো করে বুঝতে পারল, ছেলেটা হোটেলে থাকে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে রিসেপসনে এসে ম্যানেজারকে বলল, একটু আগে একটা হ্যান্ডসাম ছেলেকে ঢুকতে দেখলাম। উনি কে বলুন তো?
ম্যানেজার জামসেদকে চেনেন। বললেন, ওঁকে চেনেন না? উনিই তো বিখ্যাৎ উপন্যাসিক ফুয়াদ হাসান।
জামসেদও ওঁর বই পড়েছে। বলল, তাই নাকি? তা ওঁর দেশ কোথায়?
ঢাকায়।
এখানে এসেছেন কেন?
গ্রামকে নিয়ে উপন্যাস লেখার জন্য।
কতদিন আছেন এখানে?
সাত আট দিন হবে।
আর কতদিন থাকবেন বলতে পারেন?
কি ব্যাপার জামসেদ ভাই, ওঁর সম্পকে এতকথা জানতে চাচ্ছেন কেন?
সে কথা পরে বলব, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
ম্যানেজার হেসে উঠে বলল, তা আমি বলব কি করে? আপনার আরো কিছু জানার থাকলে ওকে ডেকে দিই, নিজেই আলাপ করুন।
না তার আর দরকার নেই। আজ চলি, অন্যদিন আসব বলে জামসেদ সেখান থেকে চলে এল।
.
মেয়েকে দেরিতে ফিরতে দেখে মাসুদা বিবি জিজ্ঞেস করলেন, কিরে আজ এত দেরি হল যে? যা কাপড় পাল্টে তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধূয়ে খাবি আয়, খাবি। তোর জন্যে আমিও খাইনি।
মা যে তাকে ছাড়া খায়নি, তা রুমানা জানে। সে জন্য সব সময় কলেজ ছুটির পর একটুও দেরি না করে বাড়িতে চলে আসে। আজ ফুয়াদের সঙ্গে দেখা হয়ে সে কথা ভুলে গিয়েছিল। মায়ের কথা শুনে মিথ্যে করে বলল, এক বান্ধবী জোর করে তাদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। না খাইয়ে ছাড়ল না, তাই দেরি হয়ে গেল। তারপর রুমে এসে নিজেকে খুব অপরাধী মনে করল। চিন্তা করল, প্রতিদিন যদি ফুয়াদ দেরি করিয়ে দেয়, তা হলে মাকে কি বলব?
পরের দিন রুমানা বাস থেকে নেমে দেখল, অল্প দূরে ফুয়াদ বাসের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে এসে সালাম দিল।
ফুয়াদ সালামের প্রতি উত্তর দিয়ে বলল, একটা কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তারপর বলল, কাল নিশ্চয় মায়ের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাই বলছিলাম কি ছুটির পর আপনার দেরি করা ঠিক নয়। অফ পিরীয়ডে যদি আমাদের দেখা হয়, তা হলে কোনো সমস্যা হবে না।
রুমানা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, সেটাই ভালো। আজ আমাদের থার্ড পিরিয়ড অফ। কিন্তু কোথায় দেখা করব?
কেন, যেখানে কাল খাওয়া দাওয়া করলাম।
ঠিক আছে, দশটা পাঁচে আসব। এখন তা হলে আসি?
আসুন।
ঠিক দশটার সময় ফুয়াদ রেষ্টুরেন্টের কাছে এসে অপেক্ষা করতে লাগল।
রুমানা এল দশটা পাঁচে। তাকে নিয়ে কেবিনে বসে বলল, কি খাবেন বলুন?
বারে খেতে এলাম বুঝি?
তা কেন? তবে কিছু না খেলে এখানে বসা কি উচিত হবে?
তা হলে চায়ের অর্ডার দিন।
বেয়ারা এলে ফুয়াদ দু’টো প্লেটে দু’টো করে মিষ্টি, সিঙ্গাড়া ও দু’কাপ চা দিতে বলল।
রুমানা বেয়ারারকে বলল, ওসব লাগবে না, শুধু চা দিন।
ফুয়াদ বেয়ারারকে বলল, ওঁর কথা শুনবেন না, যা বললাম নিয়ে আসুন।
বেয়ারার চলে যেতে রুমানা বলল, আর কোনো দিন এখানে আসব না।
কেন?
প্রতিদিন তো আপনি খাওয়াবেন?
মাঝে মাঝে না হয় আপনিও খাওয়াবেন।
তা হলে আজ আমি পেমেন্ট করব।
করতে পারেন, তবে শুধু দুকাপ চায়ের। কারন আপনি শুধু চায়ের অর্ডার দিয়েছেন।
আপনি তো দারুন ছেলে।
আপনিও দারুন মেয়ে।
মানে?
মানে, আপ্যায়নে যারা বাধা দেন, তারা দারুনই হন।
তাই?
হ্যাঁ তাই। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনার বান্ধবীরা আসেন নি?
না। নিশাত খালার বাড়ি গেছে। আর খালেদা বোধ হয় আর পড়বে না। কাল তাকে পাত্র পক্ষের লোকেরা দেখে পছন্দ করে গেছে। আপনি আর কত দিন থাকবেন?
এখানে থেকে একটা উপন্যাস লিখছি। শেষ করে তারপর যাব। এমন সময় বেয়ারা নাস্তা নিয়ে এলে ফুয়াদ বলল, নিন শুরু করুন।
রুমানা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, শেষ করতে কতদিন সময় লাগবে?
ঠিক নেই-সাত-আটদিন অথবা দশ-বারো দিনও লাগতে পারে।
বাড়িতে চিন্তা করবে না?
চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি।
কে কে আছে আপনার?
বাবা নেই। তিন বছর হল মারা গেছেন। মা, দু’ভাই ও এক বোন। আমিই সবার বড়।
আপনি এখনো বিয়ে করেন নি?
না।
কেন?
যদি বলি মনের মতো মেয়ে পাইনি বলে?
ঢাকা শহরে মেয়ের অভাব আছে কি?
তা নেই; তবে আমি যে রকম মেয়ে চাই, সে রকম মেয়ের খোঁজ পাইনি।
শুনেছি লেখকদের অনেক ভক্ত পাঠিকা থাকে। তারা চিঠির মাধ্যমে লেখকের কাছে প্রেম নিবেদন করে। শুধু তাই নয়, বিয়ের প্রস্তাবও পাঠায়।
ফুয়াদ বেশ অবাক হয়ে বলল, আপনি লেখা-লেখি করেন নাকি?
না।
তা হলে এসব কথা জানলেন কি করে?
লেখকরা উপন্যাসের মধ্যে এরকম ঘটনা লিখে থাকেন, পড়ে জেনেছি। তা ছাড়া দেশে-বিদেশে অনেক মেয়ে আছে যারা বই পড়ে লেখকের প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করেছে, এ কথা নিশ্চয় জানেন?
হ্যাঁ জানি। আর আমারও যে সে রকম পাঠিকা নেই, তা নয়। তবে তাদের প্রেম নিবেদন আমার অন্তরে সাড়া জাগাতে পারেনি। অবশ্য ইদানিং একজন আমার মনকে বেশ নাড়া দিয়েছে।
তাই নাকি। তা মেয়েটি নিশ্চয় শহরের এবং ভক্ত পাঠিকা?
আপনার বাক্যের প্রথম অংশটা নিশ্চয় নয়, তবে শেষ অংশটা নিশ্চয়।
চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন?
না।
তা হলে?
সাক্ষাত পেয়েছি। তবে তার মনের খবর একটু একটু আন্দাজ করতে পারলেও পুরাটা পারিনি।
রুমানা বেশ দমে গেল। ভাবল, তা হলে কি তার স্বপ্নের জাল ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল? নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, মেয়েটি খুব ভাগ্যবতী।
কেন?
আপনাকে যিনি পাবেন, তিনি ভাগ্যবতী না হয়ে পারেন না।
মেয়েটির পরিচয় শুনবেন?
রুমানা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আজ সময় নেই, অন্য দিন শুনব।
ফুয়াদ বলল, হ্যাঁ চলুন। তারপর বিল দিয়ে এসে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরোবার সময় বলল, আপনার দু’কাপ চায়ের দামটাও দিয়ে এলাম। পাওনা রইল, কাল শোধ করবেন কিন্তু।
ফুয়াদ একটা মেয়েকে পছন্দ করে শোনার পর থেকে রুমানার মন দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে গেছে। চায়ের দাম দেওয়ার কথা শুনে লজ্জিত হয়ে ম্লান হেসে বলল, আপনি তো খুব হিসাবী? ঠিক আছে তাই হবে।
ততক্ষণে তারা রাস্তায় এসে গেছে। ফুয়াদ তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, তা হলে হিসাবের খাতাটা খুলে ধরি?
রুমানা কথাটা বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফুয়াদও দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমার এই ছাব্বিশ সাতাশ বছরের হিসাবের খাতায় একটুও কালির আচঁড় পড়েনি। বান্দুরায় এসে প্রথম পড়ল। সেই আচঁড়ের লেখাটা হল, রুমানা শারমিন। যার ছবি জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার হৃদয়ে আঁকা হয়ে আছে।
ফুয়াদের কথা শুনে রুমানার মনের মধ্যে যেমন আনন্দের তোলপাড় শুরু হল তেমনি লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেল। বেশিক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। মাথা নিচু করে নিল।
ফুয়াদ বলল, কি হল, রাগ করলেন?
রুমানা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে তার দিকে চেয়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসি-মুখে বলল, না, বরং বলে থেমে গেল।
থেমে গেলেন কেন বলুন।
আপনি উপন্যাসিক হয়েও জানেন না, মেয়েরা অনেক কিছু মুখে উচ্চারণ করতে পারে না? তারপর আসি বলে হনহন করে কলেজের দিকে চলে গেল।
ফুয়াদ হাসি-মুখে তার দিকে চেয়ে রইল।
ছুটির পর জামসেদ রুমানাকে জিজ্ঞেস করল, কাল বাস স্ট্যান্ডে কার সঙ্গে আলাপ করছিলে?
রুমানা বুঝতে পারল, জামসেদ তা হলে তাকে সব সময় ফলো করে। ভাবল, ফলো যখন করেছে তখন রেষ্টুরেন্টে কতক্ষন ছিলাম তাও বোধ হয় জানে। বলল, উনি উপন্যাসিক ফুয়াদ হাসান।
তার সঙ্গে তোমার পরিচয় হল কি করে?
আমার বড় চাচা-চাচী ওদের বাসায় বার-তের বছর ভাড়া ছিলেন। আমার চাচাতো ভাইয়ের কুলখানিতে এসেছিলেন। সে সময় পরিচয় হয়।
কথা বলতে বলতে ওরা বাস-স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছে গেল। বাস দাঁড়িয়েছিল, এবার আসি বলেই রুমানা বাসে উঠে পড়ল।
জামসেদ বাস ছাড়া পর্যন্ত সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বাসার দিকে রওয়ানা দিল। সে মনে করেছিল রুমানা ঐ ছেলেটাকে পছন্দ করে। তাই তাদের দু’জনের উপর যে আক্রোশ জম্মেছিল, তা দূর হল; কিন্তু সন্দেহ থেকে গেল।
রুমানা প্রতিদিন রেষ্টুরেন্টে চা-খাওয়ার সময় আগামী কালের অফ পিরিয়ডের কথা ফুয়াদকে জানিয়ে টাইমটা বলে দেয়। সেই টাইমে তারা রেষ্টুরেন্টে এসে চা-নাস্তা খায়, গল্প করে। এ ভাবে চার-পাঁচদিন পার হয়ে গেল।
কোবাদ বড় লোকের বখে যাওয়া ছেলে। দু’বার ইন্টার পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে না পেরে পড়া ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের যাতায়াতের পথে দাঁড়িয়ে থাকে, ছাত্রীদের লক্ষ্য করে শীষ দেয় অশ্লীল মন্ত্যব্য করে। অন্য সময়ে রেষ্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেয়। জামসেদকে চিনে। স্কুলে ও ইন্টারে দু’বছর এক সঙ্গে পড়েছে। সে যে রুমানাকে ভালবাসে তাও জানে। তিনচার দিন রুমানাকে একটা ছেলের সঙ্গে রেষ্টুরেন্টে চা-নাস্তা খেতে দেখে এবং তাদের হাবভাব দেখে তার সন্দেহ হল। এক দিন জামসেদকে বলল, কিরে, তোর রুমানার খবর কি? তার মন গলাতে পেরেছিস?
জামসেদ বলল, চার-পাঁচদিন আগে তার সঙ্গে কথা বললাম। সেই একই কথা বলল।
আমার তো মনে হয় রুমানা একটা ছেলেকে ভালবাসে। তাই তোকে ঐ কথা বলে ঘোরাচ্ছে।
তুই কোনো প্রমান পেয়েছিস?
প্রমান না পেয়ে কোবাদ কিছু বলে না।
বলতো শুনি।
রুমানা একটা সুন্দর ছেলের সঙ্গে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রেস্টুরেন্টে চা-নাস্তা খায়, গল্প করে।
জামসেদ প্রথম দিনের ঘটনার পর রুমানার কাছে ফুয়াদের পরিচয় পেয়ে এবং ছুটির পর সে রকম ঘটনা না দেখে মনে করেছিল, তাদের আর দেখা সাক্ষাত হয়নি। কোবাদের কথা শুনে চিন্তা করল, রুমানা তো কোনো ক্লাসেই এ্যাবসেন্ট থাকে না। তা হলে কি অফ পিরিয়ডে যায়। কপাল কুঁচকে বলল, তাই না কি? কই আমি তো তা জানি না। অবশ্য কয়েক দিন আগে ছুটির সময় একবার তাকে বাসষ্ট্যান্ডে একটা ছেলের সাথে কথা বলতে ও রেষ্টুরেন্টে যেতে দেখে রুমানাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, উনি উপন্যাসিক ফুয়াদ হাসান।
কি নাম বললি?
ফুয়াদ হাসান। খুব ভালো লেখেন। ওঁর অনেক বই পড়েছি।
আমিও তো পড়েছি। কিন্তু উনি এখানে আসবেন কেন? আর রুমানার সঙ্গেই বা পরিচয় হল কি করে?
জামসেদ ফুয়াদ হাসানের সম্পর্কে রুমানার কাছে যা শুনেছিল বলল।
তাই নাকি?
হারে তাই। আমি হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারের কাছে খোঁজ নিয়েছিলাম। উনি বললেন, কয়েকদিন আগে বান্দুরার মিয়া বাড়ির একটা ছেলে ওঁকে সঙ্গে করে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি আমার বন্ধু। কয়েকদিন এখানে থেকে একটা উপন্যাস লিখবেন, ওঁর কোনো রকম অসুবিধা না হয় যেন লক্ষ্য রাখি।
আমার কি মনে হচ্ছে জানিস?
কি?
ওরা দু’জনে প্রেমে পড়েছে।
কি করে বুঝলি?
তা না হলে প্রতিদিন রেষ্টুরেন্টে দেখা করে কেন? তুই না জানলেও আমি জানি, লেখকদের চরিত্র ভালো না। তারা মেয়েদের সঙ্গে যা-তা করে বেড়ায়।
তোর কথা সত্য হলেও ফুয়াদ হাসান সে রকম নন। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে জামাতে নামায পড়তে যেতে দেখেছি।
তুই তো দুনিয়াদারির খবর রাখিস না, আজকাল নামাযীরাই বেশি অপকর্ম করে।
তুই যাই বলিস, ফুয়াদ হাসানকে সে রকম বলে মনে হয় না। তা ছাড়া নামাযীদের কেউ কেউ এরকম থাকলেও সবাইকে এক পাল্লায় ফেলছিস কেন? আমি ছাড়া আমাদের বাড়ির সবাই নামায পড়ে। তারা তো কেউ ওরকম না। নামায পড়িনি বলে বাবা আমাকে কত বোঝায়, রাগ-রাগিও করে। একদিন বলল, মুসলমানরা যদি সবাই ঠিকমতো নামায পড়ত, তা হলে সমাজের এত অবক্ষয় হত না। আমি তোর কথাটাই বললাম। শুনে বাবা বলল, যে ভাবে নামায পড়া উচিত, তারা সে ভাবে পড়ে না। তাই তাদের চরিত্র সংশোধন হয়নি। আল্লাহ কোরআন পাকে বলিয়াছেন- “নামায সকল প্রকার অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সূরা আলকাবুত, ৪৫ আয়াতের মাঝখানের প্যারা-২০)
আচ্ছা তুই রশিদুলকে চিনিস?
হ্যাঁ চিনি সে তো ফুড ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে? শালা ঘুষখোর মাতাল। তিন-চার বছর চাকরিতে ঢুকে ঘুষ খেয়ে খেয়ে দু’তলা বাড়ি করে ফেলেছে। ইদানিং শালাকে আবার নামায পড়তেও দেখি।
রশিদুল আমার চেয়ে দুই-এক বছরের বড় হলেও আমার সঙ্গে খুব ভাব। সে কিন্তু এখন আর ঘুসও খায় না আর মদও খায় না।
বিশ্বাস করি না। যে শালা একবার ঘুস ও মদের গন্ধ শুঁকেছে, সে জীবনে তা ছাড়তে পারবে না। আর ছাড়তে চাইলেও ঘুষ ও মদ তাকে ছাড়বে না।
সত্যি বলছি সে ওসব ছেড়ে দিয়ে নামায ধরেছে।
তুই নিশ্চিত হলি কি করে?
রশিদুল আমাকে বলেছে। তবে এর পিছনে একটা ঘটনা আছে।
কি ঘটনা বল তো শুনি।
ও অফিসের একটা মেয়েকে ভালবাসে। মেয়েটা খুব ধার্মিক। ওর উপরের পোস্টে কাজ কর। রশিদুল বি.এ. পাশ আর মেয়েটা এম.এ. পাশ। তবে কেমন করে যেন তাদের মধ্যে ভালবাসা হয়েছে। রশিদুল তো দেখতে খুব সুন্দর, তাই হয়তো মেয়েটার নজরে পড়ে যায়। তারপর খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে রশিদুল ঘুষ খায়, মদ খায়। সেই মেয়েটিই ওর ঘুষ ও মদ ছাড়িয়েছে এবং নামায ধরিয়েছে।
ওদের বিয়ে হয়েছে নাকি?
না, এখনো হয়নি। রশিদুল রলল, মেয়েটি না কি বলেছে, এক বছর তাকে পরীক্ষা করবে। পরীক্ষায় পাশ করতে পারলে বিয়ে করবে।
দারুন ব্যাপার তো? মেয়েটা বোরখা পরে অফিস করে কি না জিজ্ঞেস করেছিস?
কি বলছিস তুই? ধার্মিক মেয়ে বোরখা আবার পরবে না। হাতের কজী থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত বোরখায় ঢাকা থাকে। নেকাব দিয়ে মুখও ঢাকা থাকে। চোখ ফাঁকা থাকলেও চশমা পরে।
কোবাদ বলল, রশিদুলের কথা বাদ দে, তোর ব্যাপারটা কি হবে বল। তুই কি রুমানাকে চাস না?
চাইবো না কেন? রুমানার দিকে যে নজর দেবে তার চোখ উপড়ে নেব না।
আর তোর প্রিয় লেখক ফুয়াদ হাসান যদি দেয়? তা ছাড়া রুমানা তো তোকে পছন্দ করে না।
এই কথার উত্তর জামসেদ দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
কোবাদ বলল, তুই আমার বন্ধু। তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। তুই যদি চাস, সাহায্য করতে পারি।
জামসেদ জানে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোবাদের যোগাযোগ আছে। বলল, তুই কি ফুয়াদ হাসানের কোনো ক্ষতি করতে চাস?
না, তা করব না। কারন তার সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও তার বই পড়তে আমারও খুব ভালো লাগে। তুই রাজি আছিস কি না বল, তারপর কি করি নিজেই দেখতে পাবি।
উপকার করতে চাইলে করতে পারিস, তবে ওদের দুজনের যেন এতটুকু ক্ষতি না হয়।
বাস, তোকে আর কিছু বলতে হবে না। শুধু দেখ, আমি কি করি। আর শোন, তুই এখন রুমানার সঙ্গে এ ব্যাপারে কিছু আলাপ করবি না।
ঠিক আছে, তাই হবে বলে জামসেদ বলল, এখন যাই, পড়তে বসব।
কোবাদ জামসেদের চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর এক সন্ত্রাসী বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলে ম্যানেজারের রুমে এল।
ম্যানেজার ওদেরকে চিনেন। বললেন, কি খবর কোবাদ ভাই?
কোবাদ বলল, আপনাদের হোটেলে নাকি লেখক ফুয়াদ হাসান থাকেন?
তিন চারদিন আগে যখন জামসেদ এসে লেখকের খোঁজ নেয় তখন ম্যানেজার কোনো সন্দেহ করেনি। আজ কোবাদ একা এলেও হয়তো করতেন না। তার সঙ্গী ছেলেটার হাবভাব দেখে সুবিধা মনে হল না। তাই সরাসরি স্বীকার না করে বলল, ওঁকে চেনেন নাকি?
লেখক মানুষকে কে না চেনে? তা উনি কত নাম্বার রুমে আছেন?
আপনারা বসুন, আমিই ডেকে পাঠাচ্ছি। কথা শেষ করে কলিং বেল বাজালেন।
কোবাদ বলল, না-না ডাকতে হবে না। আমরা ওঁর রুমে দেখা করব। রুম নাম্বারটা বলুন।
ম্যানেজার রুম নাম্বার বলল।
কোবাদ বিশ টাকা টেবিলের উপর রেখে বলল, ওঁর রুমে তিন কাপ চা ও বিস্কুট পাঠিয়ে দিন। তারপর সঙ্গিকে বলল, চলরে দুলাল।
কলিং বেলের শব্দ পেয়ে হোটেল বয় সাবু তিন তলা থেকে নেমে এল।
ম্যানেজার সাহেব টাকাটা তার হাতে দিয়ে বললেন, লেখক সাহেবের রুমে এক প্যাকেট ভালো বিস্কুট ও তিন কাপ চা দিয়ে আয়। আর শোন, ওগুলো দিয়ে রুমের বাইরে কান খাড়া করে থাকবি। খারাপ কিছু শুনলে আমাকে জানাবি।
সাবু বলল, ঠিক আছে স্যার, তাই হবে। তারপর কেতলী নিয়ে চলে গেল।
পাঁচ
ফুয়াদ গভীর মনোযোগ সহকারে লিখছিল। দরজার পর্দা ফাঁক করে কেউ যে ভিতরে আসার অনুমতি চাচ্ছে তা বুঝতে পারেনি।
কোবাদ দরজার কড়া নেড়ে বেশ জোরে বলল, এই যে স্যার শুনছেন?
কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে ফুয়াদ দরজার দিকে তাকিয়ে দু’জন যুবক ছেলেকে দেখতে পেয়ে বলল, কি ব্যাপার বলুন।
কোবাদ বলল, ভিতরে আসতে পারি?
আসুন।
কোবাদ দুলালকে নিয়ে ভিতরে এলে ফুয়াদ বলল, আপনারা খাটেই বসুন। বসার পর বলল, আপনাদের পরিচয়?
কোবাদ বলল, আমি কোবাদ আর ও দুলাল। আপনার বই আমরা পড়েছি। এখানে আছেন শুনে দেখা করতে এলাম।
ফুয়াদ ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, শুনে খুশি হলাম। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি এখনো পড়াশোনা করছেন।
কোবাদ বলল, না পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসা করছি।
ফুয়াদ বলল, চাকরির চেয়ে ব্যবসা অনেক ভালো। একটু বসুন, চা দিতে বলি।
আপনি ব্যস্ত হবেন না স্যার, আমরা সে ব্যবস্থা করেই এসেছি।
সে কি? আপনারা আমার কাছে এসেছেন, আমার মেহমান। আপ্যায়ন করাটা আমারই তো উচিত।
আপনি স্যার আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছেন। আপনি আমাদের এলাকার। মেহমান, আপনি আপ্যায়ন করতে যাবেন কেন?
এমন সময় সাবু একটা ট্রেতে করে চা বিস্কুট নিয়ে ঢুকল।
চা খেতে খেতে কোবাদ বলল, আপনি লিখছিলেন ডিষ্টার্ব করলাম। কিছু মনে করবেন না স্যার। আপনার বই পড়ে আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। সে ইচ্ছা আজ পুরণ হল। এবার আসি স্যার। তারপর সালাম বিনিময় করে দুলালকে নিয়ে বেরিয়ে এল।
ব্রা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার এসে বললেন, একটু আগে দু’টো ছেলে কেন এসেছিল?
ফুয়াদ বলল, ওরা আমার বইয়ের পাঠক। দেখা করতে এসেছিল।
ম্যানেজার বলল, আপনি একটু সাবধানে থাকবেন?
ফুয়াদ বেশ অবাক হয়ে বলল, কেন?
ঐ ছেলে দু’টো তেমন ভালো নয়।
কিন্তু ওদেরকে তো বেশ ভদ্র ঘরের শিক্ষিত ছেলে বলে মনে হয়।
যে ছেলেটা প্যান্টশার্ট পরেছিল, ওর নাম কোবাদ। ও ভদ্র ও শিক্ষিত ঘরের বখাটে ছেলে। ওকে তেমন ভয় নেই। তার সঙ্গের ছেলেটা, যে লুংগী পাঞ্জাবী পরে ছিল, ও সন্ত্রাসীদের একজন। তাই একটু সাবধানে থাকতে বললাম।
ফুয়াদ মৃদু হেসে বলল, তারা যাই হোক না কেন, আমার কি ক্ষতি করবে? আমি লেখক মানুষ। এখানে কারো ক্ষতি করতে তো আসিনি।
আপনার কথা ঠিক; তবু স্যার, সাবধানের মার নেই। হোটেলে কোন কিছু করার সাহস কারো নেই। আপনি বাইরে ঘোরা-ফেরা করার সময় একটু সাবধান থাকবেন।
ঠিক আছে, আপনার কথা মনে রাখব। তবে শুনে রাখুন, আমি আল্লাহকে ছাড়া দুনিয়ার কারো শাক্তিকে ভয় পাই না। আর মৃত্যু মানুষের জীবনে একবারই আসে এবং তা অনিবার্য। অতএব, মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর দুষ্ট লোকেরা যদি বিপদে ফেলার চেষ্টা করে, সেটাও তকদিরের ব্যাপার। তকদিরে থাকলে সাবধানে থাকলেও আসবে। আমার জন্য আপনি কোনো রকম দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আল্লাহর উপর পুর্ণ বিশ্বাস রাখি। বিপদ যদি আসে তার ইশারাতেই আসবে। আবার তিনিই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।
ম্যানেজার বললেন, ঠিক আছে, এখন আসি তা হলে?
আসুন।
ম্যানেজার চলে যাওয়ার পর ফুয়াদ লেখায় মন দিল।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে কোবাদ দুলালকে বলল, উনি প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে নদীর পাড়ে বেড়ান। তুই সামনে যাবি না, তোকে চিনে ফেলবে। দূর থেকে সামাদকে চিনিয়ে দিয়ে যা বলেছি বুঝিয়ে বলবি। আর শোন, উনি লেখক মানুষ, সামাদ যেন ওঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে। শুধু বলবি, ওঁকে বুঝিয়ে সুজিয়ে দু’এক দিনের মধ্যে এখান থেকে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। তাতে কাজ না হলে একটু-আধটু ভয় দেখাতে পারে। সাবধান করে দিস, মারধর যেন না করে। কাজটা যদি তোরা পারিস, তা হলে পাঁচশ টাকা পাবি।
দুলাল বলল, ঠিক আছে ওস্তাদ তাই হবে।
ঐ দিনই দুলাল সামাদকে ঘটনাটা জানিয়ে বলল, কিরে পারবি না?
সামাদ বলল, এটা তো মশা-মাছি মারার মতো কাজ। আজ চিনিয়ে দাও, কালকেই লেখক বেটাকে এখান থেকে বিদায় করে দেব।
প্রতিদিনের মত আজও আসরের নামায পড়ে ফুয়াদ নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘাটের জেটিতে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষনের মধ্যে একটা লঞ্চ এসে ভিড়ল। ফুয়াদ লোকজনের ওঠা-নামা দেখতে লাগল।
দুলাল সামাদকে নিয়ে নদীর পাড়ে ফুয়াদকে দেখতে না পেয়ে খুজঁতে খুঁজতে যখন জেটির কাছে এল তখন মাগরীবের আযান হচ্ছে।
ফুয়াদ নামায পড়ার জন্য জেটি থেকে নামছিল। দুলাল দেখতে পেয়ে সামাদকে ঈশারা করে দেখিয়ে দিয়ে সরে গেল। সামাদ ফুয়াদের আপাদ মস্তক ভালো করে দেখে নিল। তারপর তার পিছন পিছন মসজিদ পর্যন্ত এসে নিজের পথ ধরল।
ফুয়াদ প্রতিদিন ফযরের নামায পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে নদীর পাড় ধরে প্রায় দু’মাইল হেঁটে যায়, তারপর ফিরে আসে। আজ হাঁটার সময় মনে হল, পিছনে কেউ যেন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তারই মতো একটা ছেলে। পথিক মনে করে সামনের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে লাগল। আঘ ঘন্টা হাঁটার পর ফুয়াদ ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরল এবং লক্ষ্য করল ছেলেটাও তার পিছনে পিছনে ফিরছে। ভাবল, ছেলেটা তা হলে পথিক নয়, তারই মতো কেউ হাঁটতে বেরিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর পিছনের ছেলেটি বলল, এই যে ভাই শুনছেন?
শীতকাল বলে এত সকালে তেমন লোকজন নেই। ফুয়াদ বুঝতে পারল, ছেলেটা তাকেই ডাকছে। দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরল।
ছেলেটা কাছে এসে বলল, আপনিইতো লেখক ফুয়াদ হাসান?
ফুয়াদ ভাবল, নিশ্চয় ছেলেটা তার বইয়ের পাঠক। বলল, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
আপনার সঙ্গে কিছু আলাপ করতে চাই।
বেশ তো যেতে যেতেই আলাপ করুন।
আপনি আর কতদিন এখানে থাকবেন?
আপনার পরিচয়টা বললে খুশি হতাম।
আমি সামাদ। এখানেই বাড়ি। এবার বলুন কতদিন থাকবেন?
আলাপের শুরুটা ফুয়াদের কাছে সন্দেহ জনক মনে হল। বলল, তা জেনে আপনার লাভ?
লাভ-লোকসানের কথা জিজ্ঞেস করিনি, যা করেছি তার উত্তর দিন।
ফুয়াদের সন্দেহটা দৃঢ় হল। বলল, একটা উপন্যাস লেখার জন্য এখানে আছি। লেখাটা শেষ হলে চলে যাব।
তবু কতদিনে লেখাটা শেষ হবে বলে মনে হয়?
তার কোনো ঠিক নেই। এক সপ্তাহ লাগতে পারে আবার দু’সপ্তাহও লাগতে পারে।
আর আমি যদি বলি দু এক দিনের মধ্যে এখান থেকে আপনাকে চলে যেতে হবে?
এ রকম আপনি বলবেনই বা কেন? আর আমিই বা আপনার কথা শুনব কেন?
দেখুন, আপনি লেখক মানুষ, তাই বেশি কিছু বলব না। তবে শুধু এটুকু বলব, এটা আমাদের এরিয়া আমরা যা বলি এখানকার সবাই তা মেনে নেয়। আপনি ঢাকার লোক। আমাদেরকে চেনেন না। আমাদের কথা না মানলে আপনার বিপদ হবে।
ফুয়াদ দাঁড়িয়ে পড়ে তার দিকে চেয়ে বলল, আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?
দু’ একদিনের মধ্যে না গেলে, শুধু ভয় নয়, হাত-পা লুলা করে দেব।
আর এখন যদি আমি আপনার হাত পা লুলা করে দেই।
সামাদ খুব জঘন্য ধরনের সন্ত্রাসী। শুধু দুলাল ভালো ব্যবহার করতে বলেছিল বলে এতক্ষণ সংযত ছিল। এখন তা আর পারল না। হঠাৎ একশানে গেল। ফুয়াদের গর্দানে কারাতের চাপ মারল।
ফুয়াদ সতর্ক ছিল। শরীরকে কন্ট্রোলে রাখল। ফলে সামাদের চাপ স্বীং এর মতো লাফিয়ে উঠল।
সামাদ খুব অবাক হলেও সঙ্গে সঙ্গে প্রানপণ শক্তিতে মুখে থাবড়া মারল।
ফুয়াদ ক্ষীপ্র গতীতে সরে গিয়ে তার হাত ধরে ফেলে বলল, আপনি তো হাত-পা লুলা করে দেওয়ার কথা বললেন, তা না করে অন্য জায়গায় মারছেন কেন?
সামাদ হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করে সফল হতে না পেরে আরো বেশি রেগে গিয়ে ফুয়াদের তলপেট লক্ষ করে পা চালাল।
ফুয়াদ সতর্ক ছিল। পা দিয়ে আক্রমণ ঠেকিয়ে শান্ত গলায় বলল, আপনি শুধু শুধু হাত-পা ছোঁড়াছাড়ি করছেন। আমাকে ঘায়েল করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে কি? তারপর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি আপনাদের এখানে কয়েকদিন বেড়াতে এসেছি। এটাই কি আমার অপরাধ? আর তা না হলে কি অন্যায় করেছি বলবেন তো? তা না বলে এখান থেকে চলে যেতে বলছেন। এটা কি ঠিক, আপনিই বলুন না?
সামাদ কর্কশকণ্ঠে বলল, অতশত বুঝিনা, আমি টাকার বদলে কাজ করি। আপনাকে এখান থেকে সরাতে পারলে পাঁচ শশা টাকা পাব।
সেকথা তো আগেই বললে পারতেন। টাকাটা বুঝি আপনার খুব দরকার?
টাকা কার না দরকার?
ঠিক আছে, চলুন, যেতে যেতে কথা বলি। আচ্ছা, আপনি লেখাপড়া করেছেন?
করেছি।
কতটুকু?
ফাইভ পর্যন্ত।
মারপিট শিখলেন কার কাছে?
ওস্তাদের কাছে।
ওস্তাদ কতদুর লেখাপড়া করেছেন?
বি. এ. পাশ।
তাই নাকি?
শুধু তাই নয়, খুব বড় লোকের ছেলে। থানার আগের দারোগা ওনার ডানহাত ছিলেন। কয়েক মাস হল নতুন দারোগা এসেছেন। উনি খুব কড়া। ওস্তাদ ওনাকে এখনো কজা করতে পারছেন না।
ওস্তাদ বুঝি আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন?
না।
তা হলে কে পাঠিয়েছেন?
আমাদের দলেরই একজন।
আপনার কে কে আছে?
শুধু মা। তার খুব অসুখ। টাকার জন্য ডাক্তার দেখাতে পারছি না।
আমি আপনার মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দেব, আমার একটা কাজ করে দেবেন?
কেন করব না। টাকা পেলে যে কোনো কাজ করতে পারি।
আমার কাছে আপনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তাকে ও আপনাদের ওস্তাদকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলে আমার রুমে আসতে পারবেন?
পারব। কত টাকা দেবেন বলুন।
আমার কাছে বেশি টাকা নেই। দু’চারশো যা পারি দেব। আর শুনুন, এরকম খারাপ কাজ ছেড়ে দিন। অন্য কিছু করে রোজগার করার চেষ্টা করুন।
আমি যে সন্ত্রাসী এ কথা সবাই জানে। আমাকে কেউ কাজ দেয় না। তা ছাড়া কি কাজ করে টাকা রোজগার করব, বলতে পারেন? তাই তো ওস্তাদের দলে ভিড়েছি।
ঠিক আছে, আপনি আমার সঙ্গে হোটেলে চলুন, দেখি কি করা যায়।
হোটেলে এসে ফুয়াদ সামাদকে দুশো টাকা দিয়ে বলল, এটা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করান। যাদেরকে নিয়ে আসতে বললাম, নিয়ে আসুন, পরে আরো দুশো দেব।
সামাদ ফিরে আসার সময় চিন্তা করল, লেখক সাহেবও ওস্তাদের মত পাকা খেলোয়াড়। তা না হলে কারাতের চাপ হজম করতে পারত না। ওস্তাদের মতো গায়ে শক্তিও আছে। অত জোর খাঁটিয়েও হাতটা ছাড়াতে পারলাম না।
দুলাল ওর খোঁজেই আসছিল। পথে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করল, কাজ হল?
সামাদ বলল, কাজ খুব কঠিন। লেখক সাহেব সব দিক দিয়ে ওস্তাদের মতো।
দুলাল অবাক হয়ে বলল, কি বলছিস তুই?
হ্যাঁ দুলাল ভাই, যা বললাম সত্যি। তারপর টাকা দেওয়ার কথা চেপে গিয়ে সব কথা বলল।
দুলাল চিন্তা করল, কথাটা কোবাদ ভাইকে জানাতে হবে।
কি ভাবছ দুলাল ভাই? ওস্তাদের কাছে যাই চল।
ওদের ওস্তাদের নাম মুগিব। চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে। তারা তিন ভাই। বড় ও মেজ ঢাকায় চাকরি করে। বাড়ি গাড়ি করে ফ্যামিলী নিয়ে থাকে। মুগিব বড় ভাইয়ের কাছে থেকে বি. এ. পাশ করেছে। কলেজে পড়ার সময় পার্টি করত। সেই সময় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পাশ করার পর দেশে বাবার সঙ্গে থাকলেও সন্ত্রাসী ছাড়তে পারেনি। তার নিজস্ব একটা দল আছে। তাদেরকে দিয়েই সব কিছু করায়। নিজে কিছু করে না। একটা ক্লাব আছে, সেখানে সব সময় থাকে। ক্লাবের পাশের রুমটাই তাদের অফিস।
সামাদ দুলালকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাবে এসে ওস্তাদকে ঘটনাটা বলে বলল, লেখক সাহেব দুলাল ভাই ও আপনাকে হোটেলে তার রুমে নিয়ে যেতে বলেছেন।
মুগিব দুলালকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কে এই কাজের ভার দিয়েছে?
কোবাদ।
যাও কোবাদকে ডেকে নিয়ে এস।
দুলাল কোবাদকে ডাকতে চলে যাওয়ার পর মুগিব সামাদকে বলল, তুই লেখককে ঘায়েল করতে পারলি না কেন?
চেষ্টা করেছিলাম; কিন্তু লেখক সাহেবও আপনার মতো ওস্তাদ।
বলিস কি?
হ্যাঁ ওস্তাদ। তারপর ফাইটিং এর ঘটনাটা বলে বলল, জানেন ওস্তাদ, লেখক সাহেব আমাকে এই কাজ ছেড়ে দিতে বললেন, আমি বললাম তা হলে খাব কি? মায়ের চিকিৎসা করাব কি করে। আমাকে অন্য কাজ করতে বলে হোটেলে নিয়ে গিয়ে দুশো টাকা দিয়ে বললেন, দুলাল ভাই ও আপনাকে তার কাছে নিয়ে যেতে পারলে আরো দুশো টাকা দেবেন।
ঠিক আছে, তুই চুপ করে বস। দুলাল কোবাদকে নিয়ে ফিরে আসুক, তারপর যা করার করা যাবে।
প্রায় আধ ঘন্টা পর দুলাল কোবাদকে নিয়ে ফিরে এল।
কোবাদ সালাম দিয়ে বলল, কিরে ডেকেছিস কেন?
মুগিব সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে বলল, তুই দুলালের উপর যে কাজের ভার দিয়েছিলি, তার পিছনের রহস্যটা বলতো?
কোবাদ বলল, আমাদের কলেজের প্রিন্সীপালের ছেলে জামসেদকে তো চিনিস। ও। একটা মেয়েকে ভালবাসে। মেয়েটা ওকে পাত্তা দেয়নি। ইদানিং ফুয়াদ হাসান নামে এক লেখকের সঙ্গে মেয়েটা মেলামেশা করছে। ফুয়াদ হাসান আমাদের এখানে একটা হোটেলে কিছুদিন থেকে আছে। জামসেদের লাইন ক্লিয়ার করার জন্য ফুয়াদ হাসানকে এখান থেকে বিদায় করার জন্য দুলালকে বলেছিলাম। কেন দুলাল কি খারাপ কিছু করেছে?
মুগিব কপাল কুচঁকে বলল, কি নাম বললি?
কোবাদ বলল, ফুয়াদ হাসান। খুব ভালো উপন্যাসিক। আমি ওঁর অনেক বই পড়েছি।
মুগিব বলল, জামসেদের কথা বাদ দে, ওতো মেয়ে ল্যাকড়া। সব মেয়েকেই ওর পছন্দ। চান্স পেলেই ভালবাসার কথা বলবে। তার জন্য লাইন ক্লিয়ার করা লাগবে না। তা মেয়েটা কে?
বান্দুরার মিয়া বাড়ির মেয়ে। নাম রুমানা শারমিন।
মুগিব বলল, আমি এক শালা ফুয়াদ হাসানকে চিনি। তিনিও লেখক। তার বই দু’ একটা আমি পড়েছি। শালা মৌলবাদি। তার বই পড়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রী মৌলবাদীর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আমার ভাইজীরা ইণ্ডিয়ান গল্পের বই পড়ত। এবারে ঢাকায় গিয়ে। দেখি সেসব বই আর পড়ে না। ফুয়াদ হাসানের বইয়ের জন্য ওরা পাগল। বড় ভাইয়ার মেয়ে সামসুন জানে আমি বামপন্থি। আমাকে একটা বই দিয়ে বলল, ছোট চাচা আপনি তো কার্লমার্কসের বই পড়তে ভালবাসেন, ফুয়াদ হাসানের এই বইটা পড়ুন, দেখবেন আপনাদের কমিউনিজম, ইসলামী ইজমের থেকেই তৈরী। বইটা পড়ে বুঝতে পারলাম, শালা জামাতের লোক। তোরা শুনে রাখ, এই ফুয়াদই যদি সেই ফুয়াদ হয়, তা হলে এখান থেকে আর জ্যান্ত ঢাকায় ফিরে যেতে পারবে না। কিন্তু একটা জিনিস ঠিক বুঝতে পারছি না, সামাদ বলল উনি নাকি খুব ভালো ফাইটার। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামাদকে বলল, আজ বিকেলে ওঁকে আমাদের এখানে নিয়ে আসবি। বলবি ওস্তাদের হুকুম।
ঠিক আছে ওস্তাদ, তাই হবে। এখন আমি যাই, মায়ের জন্য ওষুধ কিনব।
মুগিব তাকে যেতে বলে সবাইকে বিকেলে আসতে বলল।
কোবাদ বলল, কাজটা কি ভালো হবে ওস্তাদ?
সেটা আমি বুঝব, তোদেরকে সে ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে না। এখন তোরা যা।
.
গতকাল নিশাত খালার বাড়ি থেকে ফিরেছে। আজ কলেজে আসার সময় রুমানা তাকে বলল, একটা কথা বলব, কাউকে বলবি না বল।
ঠিক আছে, বলব না।
ওয়াদা?
ওয়াদা।
ফুয়াদ হাসান সেদিন মাহবুব ভাইদের সঙ্গে ঢাকা যাননি। নবাবগঞ্জের হোটেলে থেকে একটা বই লিখছেন।
সত্যি বলছিস?
হ্যাঁরে সত্যি।
তুই কি করে জানলি?
আমার সঙ্গে দেখা করেছেন।
কতবার দেখা করেছেন?
প্রতিদিনই।
কোথায় কি ভাবে দেখা করেন?
প্রথম দেখা হয় কলেজ খোলার দিন ছুটির সময় বাস-স্ট্যাণ্ডে। তারপর প্রতিদিন অফ পিরিয়ডে একটা রেষ্টুরেন্টে দেখা হয়, সেই সঙ্গে কিছু খাওয়াও হয়।
এই কদিনে তোরা এতদূর এগিয়েছিস? আজও তা হলে যাবি?
যাব। তুইও যাবি। তোকে দেখলে খুশি হবেন।
বলছিস যখন যাব, তবে প্রতিদিন যাব না।
কেন?
তোদের ডিস্টার্ব হবে। তা হ্যাঁরে প্রতিদিন তিনি খাওয়ান, না তুইও খাওয়াস?
তিনিই খাওয়ান, আমাকে বিল দিতে দেন না। তুই ডিষ্টাব হওয়ার কথা বলছিস কেন? আমার একা একা কেমন ভয় ভয় করে। তুই থাকলে সাহস পাব।
প্রেমে পড়লে প্রথম প্রথম অমন ভয় ভয় করে। তা তুই ওঁর মনের খবর জানতে পেরেছিস?
রুমানা কিছু না বলে মিটি মিটি হাসতে লাগল।
কিছু বলছিস না যে?
তোর কি মনে হয়?
তোর রকম-সকম দেখে মনে হচ্ছে পেরেছিস। এই কদিন কি এত কথা হল বল না?
তেমন কিছু হয়নি। তবে বললেন, আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকায় যান নি?
সেটা তো বুঝতেই পরছি। ভালবাসা-বাসির কথা কিছু হয়নি?
ভালবাসা-বাসির কথা আবার আলাদা কিছু আছে কিনা জানি না, তবে এতটুকু শুধু বলেছেন, আমি নাকি তার হৃদয়ে আঁকা ছবি।”
দারুণ রোমান্টিক তো? তা হ্যাঁরে, শুনে তুই কিছু বলিস নি?
শুনে আমার হার্টবিট হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছিল। তখন কথা বলার শক্তিই ছিল না।
হারে, জামসেদ তোকে বিরক্ত করেনি?
করেনি আবার। কলেজ খোলার প্রথম দিন ছুটির পর চা খাওয়ার কথা বলে হোটেলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তারপর তার সঙ্গে যা কথা হয়েছিল সেগুলি বলে বলল, ঐ দিন আমাকে ফুয়াদ ভাইয়ের সঙ্গে বাস ষ্ট্যাণ্ডে আলাপ করতে দেখে। পরের দিন জিজ্ঞেস করল, গতকাল কার সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আমি ফুয়াদ ভাইয়ের পরিচয় দিয়ে বললাম, উনি আমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে এখানে হোটেলে থেকে একটা বই লিখছেন।
নিশাত হাসতে হাসতে বলল, জামসেদ তোর পিছু ছাড়বে না।
রুমানাও হাসতে হাসতে বলল, তাতে আমারই লাভ।
মানে?
মানে, জামসেদ আমার পিছনে লেগে আছে জানলে, কলেজের আর কোনো ছেলে পিছনে লাগতে সাহস করবে না।
এই কথায় দুজনে একসঙ্গে হেসে উঠল।
হাসি থামিয়ে নিশাত বলল, কিন্তু ওর হাত থেকে রেহাই পাবি কি করে?
পরীক্ষা পর্যন্ত ওকে ঠেকিয়ে রাখব, তারপর সবশেষ।
যদি তোর মা-বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়?
তখন খালেদার মতো করে বলতে মা-বাবাকে শিখিয়ে দেব।
নিশাত হাসতে হাসতে বলল, হায় রে বেচারা জামসেদ।
রুমানা বলল, ঐ মেয়ে-ল্যাকড়ার জন্য তোর দরদ যে উথলে উঠল দেখছি। আমার তো মনে হয়, জেনে শুনে কোনো মেয়েই ওকে পছন্দ করবে না।
ততক্ষণে তারা বাস ষ্টাণ্ডে পৌঁছে গেল। বাস দাঁড়িয়ে ছিল। নিশাত বলল, এবার চুপ কর। তারপর তারা বাসে উঠে বসল।
বাস থেকে নেমে নিশাত বলল, রোজ তো আর ক্লাস অফ থাকে না, অথবা একই টাইমে থাকে না, ফুয়াদ ভাই জানেন কেমন করে?
রুমানা বলল, আগের দিন আমি জানিয়ে দিই।
উনি কতোদিন থাকবেন, জিজ্ঞেস করেছিলি?
করেছিলাম। বললেন, দশ-পনের দিন থাকবেন।
আজতো ফোর্থ পিরিয়র্ড অফ তাই না?
হ্যাঁ।
ক্লাসে ঢোকার সময় নিশাত বলল, দেখব ফুয়াদ ভাই তোকে কতটা ভালবাসেন।
রুমানা তার পিঠে চিমটি কেটে বলল, এবার চুপ কর।
.
সামাদকে টাকা দিয়ে বিদায় করার পর ফুয়াদ চিন্তা করল, যারা আমাকে এখান থেকে তাড়াতে চাচ্ছে, তারা কারা? এর পিছনে কি এমন কারণ থাকতে পারে? তা হলে কি কোনো রহস্য আছে? কি রহস্য থাকতে পারে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রুমানার কথা মনে পড়ল। তা হলে কি রুমানা প্রতিদিন রেষ্টুরেন্টে আমার সঙ্গে নাস্তা খায়, গল্প করে, এটা কারো নজড়ে পড়েছে? কথাটা চিন্তা করে একটা চিঠি লিখল।
রুমানা,
সালামান্তে জানাই যে, বিশেষ কারণ বশতঃ রেষ্টুরেন্টে আসতে পারলাম না। ছুটির পর বাস ষ্ট্যাণ্ডে অপেক্ষা করব।
ইতি–
ফুয়াদ
চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রেখে হোটেল বয় সাবুকে দিয়ে নাস্তা আনিয়ে খেল। তারপর লিখতে বসল।
ঠিক সোয়া এগারটার সময় হোটেল বয় সাবুকে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় অপেক্ষা করতে লাগল।
তিনটে ক্লাসের পর রুমানা ও নিশাত প্রথমে কমনরুমে গেল, সেখানে বাথরুমের কাজ সেরে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য দুজনে বেরিয়ে এল। কিছুটা এসেছে এমন সময় সাবু তাদের দিকে এগিয়ে এসে রুমানার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলল, ফুয়াদ সাহেব দিয়েছেন। তারপর হন হন করে চলে গেল।
রুমানা একটু অবাক হয়ে চিঠিটা খুলে পড়ে নিশাতকে বলল, তোের আশা পুরন হল না। চল কমন রুমে যাই।
যেতে যেতে নিশাত বলল, চিঠিটা একটু দে না, পড়ি।
রুমানা চিঠিটা দিল।
পড়ে ফেরত দেওয়ার সময় রুমানার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে, মন খারাপ করছিস কেন? ছুটির পর তো দেখা হবেই।
তুই যাভাবছিস, সে জন্য মন খারাপ হয়নি। ভাবছি, যিনি এই কদিন আমাকে ছাড়া নাস্তা খান নি, আজ কি এমন বিশেষ কাজ থাকতে পারে?
হয়তো লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত আছেন। শুনেছি লেখকদের যখন লেখার খুব মুড থাকে তখন নাওয়া-খাওয়ার কথাও মনে থাকে না। তাই আগে থেকে চিঠি লিখে ঐ ছেলেটাকে দিয়ে বলে রেখেছিলেন।
রুমানা বলল, হয়তো তোর কথাই ঠিক।
.
জামসেদ কোবাদের কথা মত মিথ্যা যাচাই করার জন্য আজ থার্ড পিরিয়ড শেষ হওয়ার সাথে সাথে রেষ্টুরেন্টে এসে চা- নাস্তার অর্ডার দিয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করেও যখন ফুয়াদ বা রুমানা এল না তখন ক্লাস করার জন্য বেরিয়ে এল। ক্লাসে ঢুকার সময় দেখল, রুমানা ও নিশাত বসে বসে কথা বলছে। ভাবল, কোবাদ কি ধাপ্পা দিয়ে আমার কাছ থেকে পাঁচশো টাকা আদায় করল?
ছুটির পর জামসেদ রুমানা ও নিশাতকে ফলো করে বাস ষ্ট্যাণ্ডের কাছে এল। তাদেরকে বাসে উঠতে দেখে নিশ্চিত হয়ে ফিরে গেল।
ফুয়াদ দূর থেকে রুমানা ও নিশাতকে বাসে উঠতে দেখল এবং জামসেদ যে তাদের ফলো করে এসেছে তাও লক্ষ্য করল। তাকে ফিরে যেতে দেখে বাস ষ্ট্যাণ্ডের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বাস ছাড়ার সময় বাসে উঠল।
রুমানা ও নিশাত বাসে উঠে প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে ফুয়াদকে দেখতে পেল না। তারপর সিটে বসে নিশাত বলল, কই ফুয়াদ ভাইকে তো দেখছি না।
রুমানা বলল, আমিও তো দেখছি না। হয়তো কোনো কারণে আসতে পারেননি, তবে এখনো আসার সময় আছে।
ফুয়াদ বাসে উঠে ইঞ্জিনের বাঁদিকে লেডিস সিটে তাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, আসতে একটু দেরি করে ফেললাম।
ওরা দুজনেই সালামের উত্তর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
ফুয়াদ নিশাতকে উদ্দেশ্য করে বলল, কেমন আছেন? কলেজ কামাই করে খালার বাড়ি বেড়ান কি উচিত?
নিশাত বুঝতে পারল, কথাটা নিশ্চয় রুমানা বলেছে। লজ্জা পেয়ে বলল, মানুষকে অনেক সময় প্রয়োজনের তাগিদে অনুচিত কাজও করতে হয়।
তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। কথাটা বলা হয়তো আমার উচিত হয়নি। সে জন্য ক্ষমা চাইছি।
না-না তা কেন? আমিই হয়তো আপনার সঙ্গে বেয়াদবি করে ফেললাম। সেজন্য ক্ষমা চাইছি।
ফুয়াদ মৃদু হেসে বলল, আমরা কেউই অন্যায় করিনি। তারপর বলল, বান্দুরায় নেমে কথা বলা যাবে।
বারান্দায় নেমে ফুয়াদ ওদেরকে বলল, চলুন হোটেলে গিয়ে বসি। ডান হাতের কাজও হবে আর সেই সঙ্গে আলাপও হবে।
রুমানা ও নিশাত আপত্তি করে বলল, আমরা বাড়িতে গিয়ে খাব। এখানেই আলাপ করা যাক।
ফুয়াদ শুনল না, তাদেরকে নিয়ে একটা হোটেলে ঢুকে তিন প্লেট ভাতের অর্ডার দিল।
খেতে খেতে ফুয়াদ রুমানার দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, কলেজের বা নবাবগঞ্জের কোনো ছেলে কি আপনাকে ভালবাসে?
রুমানা বেশ অবাক হয়ে বলল, কেন বলুন, তো?
আমাকে এখানকার কয়েকজন ছেলে এখান থেকে চলে যেতে বলছে। না গেলে ক্ষতি করার ভয় দেখাচ্ছে।
রুমানা খুব আতঙ্কিত স্বরে বলল, তাই না কি?
হ্যাঁ তাই। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
প্রিন্সীপালের ছেলে জামসেদ একটু পাগলাটে ধরনের ছেলে। আমাদের সঙ্গেই পড়ে। সে প্রথমে খালেদাকে প্রেম নিবেদন করে। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে বলে খালেদা তাকে ডিনাই করে। তারপর আমাকে একদিন বলল, সে আমাকে ভালবাসে। আমি নানান অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে চলছি। ব্যাস, এর বেশি কিছু নয়।
ফুয়াদ বলল জামসেদ কি রকম ধরনের পাগলাটে?
রুমানা বলল, মানে একটু মেয়ে-ল্যাকড়া। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সঙ্গেই বেশি থাকে। তবে ছাত্র হিসাবে ভালো। তার উপর প্রিন্সীপালের ছেলে। তাই তাকে কেউ ঘাটায় না। মেয়েরা তাকে নিয়ে কৌতুক করে বেশ হাসাহাসিও করে।
ফুয়াদ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমার মনে হয় জামসেদই বন্ধুদের দ্বারা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। তবে আপনারা কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করি না। শুনুন, রেষ্টুরেন্টে আর আসবেন না, যে কয়দিন আছি, আজকের মতো দেখা করার চেষ্টা করব। যে দিন আসতে পারব না, চিন্তা করবেন না, পরের দিন ইনশা-আল্লাহ আসব। আর চার-পাঁচ দিন আমি এখানে থাকব। তারপর চলে যাব। অবশ্য যাওয়ার আগে আপনাদের সঙ্গে দেখা করব।
হোটেল থেকে বেরিয়ে ফুয়াদ একটা কাগজ রুমানার হাতে দিয়ে বলল, ঠিকানা দিলাম, চিঠি দিলে খুশি হব। তারপর তাদেরকে বিদায় দিয়ে বাসে উঠে বসল। নবাবগঞ্জে এসে বাস থেকে নেমে থানায় গেল।
ছয়
থানার দারোগা জামিল তিনমাস হল এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। সৎ ও ধার্মীক হিসাবে এরই মধ্যে বেশ নাম ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারী ও বেসরকারী অসৎ লোকেরা তাকে হাত করার চেষ্টা করে সফল হতে পারেনি। সন্ত্রাসীদের নেতা মুগিবও তাকে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে হাত করতে পারেনি। আগের দারোগার দুর্নিতীর জন্য তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সে কথা জামিল জানে।
ফুয়াদ যখন থানায় পৌঁছাল তখন জামিল তার চেয়ারেই ছিল। ফুয়াদ রুমে ঢুকে। সালাম দিল।
জামিল একটা ফাইল দেখছিল। সালামের উত্তর দিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আরে দোস্ত তুই?
জামিল ও ফুয়াদ মতিঝিল আইডিয়াল হাই স্কুল থেকে এস. এস. সি. এবং আবুজর গীফারী কলেজ থেকে একসঙ্গে বি,. এ পাশ করেছে। তারপর তাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ নেই। জামিলের বাবা বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার র্যাংকে চাকরি করেন। মতিঝিল ব্যাংক কলোনীতে বাসা। ফুয়াদের বাসা মান্ডা। স্কুল ও কলেজে তাদের দু’জনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। একে অপরের বাড়িতে অবাধে যাতায়াত করত। বি.এ. পাশ করার পর জামিল দেশ থেকে সন্ত্রাসী দূর করার জন্য পুলিশ লাইনে চলে গেল। আর ফুয়াদ সংসারের ঘানী টানার জন্য লেখার জগতে এল। ফলে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের পালা শুরু হল। জামিল পুলিশের চাকরি করতে করতে বি. সি. এস পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে দারোগা হয়েছে। ঢাকার মিরপুর থানায় প্রথম পোষ্টিং হয়। সেখানে একবছর থাকার পর মাস তিনেক হল বান্দুরায় বদলী হয়ে এসেছে। জামিল আসার পর কয়েকজন হাইজ্যাকারকে ধরে তিন দিন বাজারের রাস্তায় সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত দু’পা একত্রে বেঁধে দু’হাতে দু’কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। আর পাশে একটা বোর্ড টাঙ্গিয়ে লিখে দিয়েছিল, “হাইজ্যাকারের শাস্তি।” দু’জন পুলিশ সারা দিন ধরে পাহারা দিত। সন্ধ্যার পর তাদেরকে থানা হাজতে রাখা হত। গার্জেনরা টাকা দিয়ে ছাড়াতে এলেও ছাড়ত না। এক সপ্তাহ এভাবে শাস্তি দিয়ে এই রকম কাজ ভবিষ্যতে না করার জন্য বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ফলে এই এলাকায় হাইজ্যাকারের সংখ্যা কমে গেছে। কিন্তু সন্ত্রাসীরা জামিলের উপর খুব ক্ষ্যাপা। তারা তাকে দুনিয়া থেকে সরাবার জন্য সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছে। দু’তিন বার চেষ্টাও করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি। বরং উল্টো ফল হয়েছে। জামিল কয়েকজন সন্ত্রাসী ধরে কঠোর শাস্তি দিয়েছে।
ফুয়াদ প্রথমে জামিলকে দারোগার পোষাকে চিনতে পারেনি। তা ছাড়া পাঁচ ছ বছর ওদের দেখা সাক্ষাৎ নেই। তার কথা শুনে চিনতে পেরে বলল, তুই পুলিশে ঢুকেছিস শুনেছিলাম, কিন্তু দারোগা হয়েছিস জানতাম না। তা কেমন আছিস বল।
জামিল এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে গলা মিলল। তারপর বসতে বলে নিজেও বসল।
ফুয়াদ বলল, কেমন আছিস বললি না যে?
জামিল বলল, সব বলব দোস্ত সব বলব। আগে বল কি খাবি?
কি আর খাব, চা-টা আনতে বল।
জামিল একজন সেন্ট্রিকে চা-বিস্কুট আনতে বলে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তুই কেমন আছিস বল।
আমিও আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আমি কিন্তু একটা কাজে থানায় এসেছি।
সে কথা পরে শুনব। আগে বল আমি না হয় এখানে চাকরি করতে এসেছি, কিন্তু তুই এখানে কেন?
যে জন্য এসেছি, সে কথা শুনলেই তা জানতে পারবি।
বেশ বল তা হলে।
তুই তো আমাদের বাসায় অনেক বার গেছিস। বাংলাদেশ বিমানের একজন লোক আমাদের বাসায় বার তের বছর ভাড়া ছিলেন। তার কথা তোর মনে আছে?
হ্যাঁ আছে।
তার বাড়ি বান্দুরায়। মাস দেড়েক আগে উনি মারা গেছেন। আর ওঁর ছোট ছেলে দিন পনের আগে মারা গেছে। সেই ছেলের কুলখানিতে এসেছিলাম। সে সময় তার এক ভাইঝী রুমানাকে আমার পছন্দ হয়। তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বুঝতে পারলাম সেও আমাকে পছন্দ করে। ফেরার পথে নবাবগঞ্জ হোটেলে কয়েকদিন থেকে একটা বই লিখছি। রুমানা এখানকার কলেজে পড়ে। তার সঙ্গে একটা রেষ্টুরেন্টে প্রতিদিন নাস্তা খাওয়ার সময় আলাপ করি। জামসেদ নামে একটা ছেলে যে রুমানাকে ভালবাসে তা জানতাম না। আজ রুমানার মুখে জানলাম। ছেলেটা ছাত্র হিসাবে ভালো। তবে মেয়ে ল্যাকড়া ধরনের। মেয়েদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে। সে অনেক মেয়েকেই প্রেম নিবেদন করেছে। রুমানা তাকে নানান অজুহাতে এড়িয়ে চলে। আজ যখন নদীর পাড়ে মর্নিং ওয়াক করছিলাম তখন সামাদ নামে একটা ছেলে আমাকে এখান থেকে দু’ একদিনের মধ্যে চলে যেতে বলে। আমি প্রতিবাদ করতে আমাকে প্রথমে হুমকি দেয়। পরে আমাকে মারার জন্য আক্রমণ করে। আমি আক্রমণ ব্যর্থ করে তাকে কাবু করে ফেলি এবং তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, সে দলেরই একজনের হুকুমে আমার পিছনে লেগেছে। আমি তাকে দু’শো টাকা দিয়ে বলি, যে তাকে এই কাজে পাঠিয়েছে সেই লোককে ও তাদের নেতাকে নিয়ে আমার হোটেলে আসতে। যদি নিয়ে আসতে পারে, তা হলে আরো দুশো টাকা দেব বলেছি। আমার কি মনে হয় জানিস, রুমানার সঙ্গে মেলামেশা করছি বলে জামসেদ আমাকে এখান থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছে। তাই একটা জি. ডি. এন্ট্রি করাব বলে থানায় এলাম।
জামিল বলল, তোর অনুমান ঠিক। তা তুই আর কতদিন এখানে থাকবি!
ভেবেছিলাম, উপন্যাসটা শেষ করে তারপর যাব। আজকের ব্যাপারে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ভাবছি, দু’ একদিনের মধ্যে চলে যাব। তবে যাওয়ার আগে ওদের নেতাকে কিছু শিক্ষা দিয়ে যেতে চাই।
জামিল জানে ফুয়াদ খুব ভালো ফাইটার। হেসে উঠে বলল, উত্তম মাধ্যম দিয়ে শিক্ষা দিতে চাস না কি?
না, কোরআন হাদিসের আলোকে কিছু শিক্ষা দেব। তবে প্রয়োজন হলে উত্তম-মাধ্যমও দেব।
ঠিক আছে, তোর যা ইচ্ছা তাই করিস। আমি তোর পিছনে আছি। কোনো চিন্তা করিস না। আমিও সন্ত্রাসীদের খুজছি। তোর পিছনে লেগে থাকলে তাদের খোঁজ পাব। এমন সময় সেন্ট্রীকে চা-নাস্তা নিয়ে আসতে দেখে বলল, চা খেয়ে তুই হোটেলে গিয়ে নিজের কাজ কর। দেখ, সামাদ ওদেরকে নিয়ে আসে কিনা? আর শোন, ঢাকা যাওয়ার আগে অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করবি।
ফুয়াদ বলল, তাতো করবই। তারপর চা খেয়ে ফেরার সময় মসজিদ থেকে
আসরের নামায পড়ে হোটেলে এল।
একটু পরে হোটেলের বয় সাবু এসে বলল, সামাদ নামে একটা লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ম্যানেজার সাহেব তাকে অফিস রুমে বসিয়ে রেখেছেন।
ফুয়াদ বলল, তাকে এখানে নিয়ে এস।
কিছুক্ষণের মধ্যে সাবু সামাদকে নিয়ে ফুয়াদের রুমে এল।
ফুয়াদ সাবুকে বলল, তুমি যাও। সাবু চলে যাওয়ার পর সামাদকে জিজ্ঞেস করল, কি খবর বলুন।
সামাদ বলল, ওস্তাদ আপনাকে ক্লাবে নিয়ে যেতে বলেছেন। দুপুরেও এসেছিলাম। ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনি বাইরে গেছেন।
ফুয়াদ তাকে দুশো টাকা দেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, আপনার মায়ের ঔষধ কিনেছেন?
সামাদ বলল, হ্যাঁ কিনেছি। তারপর টাকা না নিয়ে বলল, আমাকে টাকা দিচ্ছেন কেন? আমি তো ওস্তাদকে নিয়ে আসতে পারিনি?
ফুয়াদ বলল, তা হোক তবু আপনি টাকাটা নিন। আপনি চেষ্টা করেছেন, ওস্তাদ না এলে তাকে তো জোর করে আনতে পারবেন না। এই টাকা আপনার মায়ের চিকিৎসার জন্য দিলাম। কথা শেষ করে তার বুক পকেটে টাকাটা গুঁজে দিয়ে বলল, চলুন যাওয়া যাক।
মুগিব ফুয়াদকে ডেকে আনার জন্য সামাদকে পাঠিয়ে দলবল নিয়ে ক্লাবে অপেক্ষা করছিল।
ফুয়াদ সামাদের সঙ্গে ক্লাবে ঢুকে সবার উদ্দেশে সালাম দিল।
কোবাদও সেখানে ছিল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল বসুন স্যার।
ফুয়াদ সবার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে একটা চেয়ারে বসল। তারপর রুমের চারিদিকে লক্ষ্য করল, এক পাশে একটা আলমারীতে বেশ কিছু বই রয়েছে। অন্য পাশে একটা চৌকি। আট দশটা চেয়ার ও একটা টেবিল।
কোবাদ সামাদকে বলল, ওস্তাদকে খবর দে।
সামাদ ভিতরের দরজা দিয়ে পাশের রুমে গেল। একটু পরে সামাদের সঙ্গে মুগিব এলে সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিল। ফুয়াদ বসে রইল। মুগিব তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিই তাহলে ফুয়াদ হাসান?
জ্বী, আর আপনি নিশ্চয় ওস্তাদ মুগিব পাটওয়ারী?
কয়েক সেকেণ্ড দু’জনে দু’জনের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে মেপে নিল।
প্রথমে মুগিব বলে উঠল, লেখক সাহেবকে চা খাওয়াবার ব্যবস্থা কর।
ফুয়াদ বলল, ধন্যবাদ, ওসব লাগবে না।
কেন?
যারা অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করে প্রকৃত মুসলমানরা তাদের কিছু খায় না এবং খাওয়া উচিতও নয়।
আজ কাল তো মোল্লা-মৌলবীরাও অসৎপথে টাকা উপার্জন করছে।
মোল্লা-মৌলবী হোক আর পীর সাহেব হোক, যতক্ষণ না অসৎ পথে উপার্জন পরিত্যাগ করবে, ততক্ষণ প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে না।
খুব তো বড় বড় বুলী ছাড়ছেন, মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করলে বুঝি প্রকৃত মুসলমান হওয়া যায়? আমি তো শুনেছি, প্রকৃত মুসলমানদের জন্য এরকম করা হারাম।
হ্যাঁ, আপনি ঠিক কথা বলেছেন।
তাই যদি হয়, তা হলে আপনি একটা মেয়ের সঙ্গে প্রতিদিন আড্ডা মারেন কেন?
সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাকে বলতে বাধ্য নই।
শালার মোল্লারা নিজের দোষকে দোষ মনে করে না। শুধু অন্যের জন্য ফতোয়া দিতে পারে। এরা দেশের ও দশের শত্রু। এসব মোল্লাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। কথা শেষ করে ফুয়াদের বুক লক্ষ করে লাথি চালাল।
ফুয়াদ সতর্ক না থাকলে চেয়ারসহ উল্টে পড়ে যেত। মুগিবের পাটা ধরে ফেলে টাল সামলাল। তারপর ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কোনো শিক্ষিত ছেলে কাউকে ডেকে এনে অপমান করতে পারে না। মনে হচ্ছে, মোল্লাদেরকে আপনি সহ্য করতে পারেন না। আর সত্যি সত্যি যদি আমাকে দুনিয়া থেকে সরাতে চান, তা হলে আমিও প্রস্তুত। তবে আল্লাহর ইচ্ছা যদি অন্য রকম হয়, তা হলে শুধু আপনি কেন, আপনার দলের সবাই অথবা দুনিয়াশুদ্ধ লোক চেষ্টা করলেও তা পারবেন না।
মুগিব কর্কশ কন্ঠে বলল, আপনার লেখা বই পড়ে ছেলে-মেয়েরা প্রগতির দিকে না এগিয়ে পিছিয়ে পড়ছে। আপনি ফতোয়াবাজ, পাকিস্তানের দালাল। আপনি দেশের দুষমন। এ দেশে আপনার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কথা শেষ করে আবার আক্রমন চালাল।
ফুয়াদ আক্রমন প্রতিরোধ করে পাল্টা আক্রমন করল। এভাবে প্রায় দশ পনের মিনিট লড়াই করার পর ফুয়াদ মুগিবকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বুকে চেপে বসে বলল, ইচ্ছা করলে আপনাকে আমি শেষ করে দিতে পারি, কিন্তু করব না। কারণ হাদিসে “এক মুসলমানের জান মাল অন্য মুসলমানের জন্য হারাম।”
মুগিব দলের লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, তোরা হ্যাঁ করে কি দেখছিস? শালাকে খতম করে দে।
জোবায়েরকে পিস্তল বার করতে দেখে কোবাদ তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, খবরদার, ওনাকে গুলি করবি না। উনি লেখক মানুষ। আমাদেরতো কোনো ক্ষতি করেননি। সামাদও বলে উঠল, উনি খুব ভালো মানুষ।
জোবায়ের তাদের কথা শুনল না। ফুয়াদকে লক্ষ করে গুলি করতে গেল।
সামাদ ছুটে এসে তার পিস্তল ধরা হাতটা চেপে ধরল। ততক্ষণে পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়ে ফুয়াদের ডান দিকে পিঠে লাগল।
কোবাদ ছুটে এসে জোবায়েরের মুখে ঘুসি মেরে পিস্তল কেড়ে নিল। এমন সময় বাইরে পুলিশের বাঁশি শুনে সবাই পালাবার চেষ্টা করল।
জামিল ফুয়াদকে বিদায় দেওয়ার পর সিভিল ড্রেসে তার হোটেলে আসে। তারপর ম্যানেজারকে পরিচয় দিয়ে জেনে নেয়, কারা ফুয়াদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ফুয়াদকে একজনের সঙ্গে বাইরে যেতে দেখে তাদেরকে ফলো করে ক্লাবে আসে। মুগিবের দুষ্কর্মের কথা অনেক আগেই জেনেছে। সে একদিন থানায় এসে তার সঙ্গে আলাপ করার সময় অনেক টাকা দিয়ে বন্ধুত্ব করার প্রস্তাব দেয়। জামিল রাজি হয়নি। তখন থেকে মুগিবের দিকে খুব লক্ষ্য রাখছে। ক্লাবটা যে মুগিব পরিচালনা করে তা জামিল জানে। তাই ক্লাবে ওদের ঢুকতে দেখে ফুয়াদের বিপদের গন্ধ পায়। তারপর ওয়ার্লেস করে থানায়, লোকেশন জানিয়ে সেকেন্ড অফিসারকে কয়েকজন পুলিশ নিয়ে আসার জন্য অর্ডার দেয়। তারপর রুমের বাইরে থেকে এতক্ষণ ভিতরের কথাবার্তা শুনছিল। পরে মুগিব ও ফুয়াদের মধ্যে যখন মারামারি শুরু হয় তখন দরজার কাছে। এসে দাঁড়িয়ে ভাবল, ফুয়াদের সঙ্গে মুগিব পেরে উঠবে না। গুলির শব্দ পেয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় পুলিশের জীপ এসে থামতে বাঁশি বাজিয়ে ভিতরে ঢুকে পিস্তল বাগিয়ে বলল, যে যেখানে যে অবস্থায় আছেন, সেই ভাবে থাকুন, নচেৎ গুলি করতে বাধ্য হব।
ততক্ষণে পুলিশরা ভিতরে ঢুকে পড়েছে। জামিল সবাইকে এ্যারেষ্ট করতে বলে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে দেখল, রক্তে তার জামা ভিজে জব জবে হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরে বলল, আয় আমার সঙ্গে।
ফুয়াদ গুলি খেয়েও উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, আল্লাহ চাহেতো একটা গুলিতে আমার কিছু হবে না। দোস্ত, আমার একটা অনুরোধ তোকে রাখতেই হবে।
জামিল বলল, তা না হয় রাখব, আগে হাসপাতালে চল।
ফুয়াদ বলল, তার আগে অনুরোধটা রাখতে হবে।
বল, তোর কি অনুরোধ?
এদের সবাইকে ছেড়ে দে।
কি বলছিস তুই?
যা বলেছি, তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিস?
কিন্তু এরা ক্রমিন্যাল, আইনের লোক হয়ে তো আমি তা করতে পারিনা।
তবু তোকে আমার অনুরোধটা রাখতেই হবে। ওরা আমাকে ভূল বুঝে এই কাজ করেছে। আমি ওদের ভুল ভাঙ্গিয়ে দিতে চাই। এ্যারেষ্ট হলে, সেই ভুল ওদের কখনো ভাঙ্গবে না।
এদের সবার ব্যাড রেকর্ড থানায় রয়েছে। প্রমাণের অভাবে এতদিন এ্যারেষ্ট করতে পারিনি। এরা দাগী আসামী। ছেড়ে দেওয়া অন্যায় হবে। না- না তোর এ অনুরোধ রাখতে পারব না দোস্ত, আমাকে মাফ কর।
তুই এদের সবাইকে চিনিস। আজকের মতো ছেড়ে দে। পরে যদি কিছু করে তখন এ্যারেষ্ট করিস। আমার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত এদেরকে অবসর দে দোস্ত। আমি সুস্থ হওয়ার পর আবার এখানে ওদের সঙ্গে আলাপ করতে আসব। আমার এ ইচ্ছাটা তোকে পুরণ করতেই হবে। দোস্ত হয়ে দোস্তের এই সামান্য ইচ্ছাটা পুরণ করতে পারবি না? যদি না পারিস, তা হলে এখানে মরব তবু হাসপাতালে যাব না।
জামিল কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে পুলিশদের বলল, ওদেরকে সার্চ করে অস্ত্র গুলো নিয়ে নিন। আর দু’টো রুম সার্চ করে ওদেরকে ছেড়ে দিন।
পুলিশরা অর্ডার মত কাজ করে সবাইকে ছেড়ে দিল।
জামিল ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারা দেশের একজন কৃতি সন্তানকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। আল্লাহ আপনাদের হেদায়েৎ দান করুন। তারপর ফুয়াদকে ধরে জীপে তুলে নিয়ে হাসপাতালে গেল।
ফুয়াদকে যখন অপারেশন রুমে নিয়ে যাচ্ছিল তখন জামিলকে বলল, ঘটনাটা কাগজে গেলেও ওদের নাম ধাম যেন না দেওয়া হয়। ডাক্তাররা ফুয়াদকে অজ্ঞান করে অপারেশন করে গুলি বার করলেন। তারপর ব্যাণ্ডেজ করে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলেন।
জামিল নার্সকে জিজ্ঞেস করল, পেসেন্টের জ্ঞান কখন ফিরবে?
নার্স বললেন, নির্দিষ্ট সময় বলা যাবে না, তবে ঘন্টা তিনেকের আগে তো নয়ই।
জামিল ফুয়াদের বেডের কাছে দু জন পুলিশ গার্ড রেখে যখন থানায় ফিরল তখন রাত আটটা। তারপর কাজ সেরে এশার নামায ও খাওয়া দাওয়া করে এগারটার সময় হাসপাতালে এসে দেখল তখনও ফুয়াদের জ্ঞান ফিরেনি। পুলিশ দু’জনকে থানায় যেতে বলে নিজে বেডের কাছে রইল।
ভোরের আযানের সময় ফুয়াদের জ্ঞান ফিরল। জামিল আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
আযান শেষ হতেই ফুয়াদ আযানের দোয়া পড়ে বলল, এটা কিসের আযান হল?
জামিল বলল ফযরের।
তুই সারারাত এখানে রয়েছিস?
হ্যাঁ। কেন তাতে কি হয়েছে?
না, কিছু হয়নি। তোর ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।
দেখ ফুয়াদ, ওসব সাহিত্যের বুলি ছাড়বি না, যা করছি নিজের সার্থেই করছি। যাই মসজিদ থেকে নামায পড়ে আসি।
তার আগে আমাকে ধর বাথরুমে যাব। মাগরিব ও এশার নামায কাযা হয়েছে, সে গুলো পড়ে ফযরের নামায পড়ব।
কিন্তু তোর এখন নড়াচড়া করা উচিত নয়। ডাক্তার রাগারাগী করবেন।
আরে রাখ তোর ডাক্তার। আগে আল্লাহর আইন, তারপর অন্য কথা। তুই বল না, একটা গুলি খেলে কিছু হয়?
জায়গা মতো লাগলে হয়।
এমন সময় একজন নার্স এসে ফুয়াদকে কথা বলতে দেখে বললেন, আপনি বেশী কথা বলবেন না।
জামিল বলল, কিন্তু ও তো বাথরুমে যেতে চাচ্ছে। তারপর নামায পড়বে বলছে?
নার্স বলল, ন- না, তা সম্ভব নয়। ওর নড়াচড়া করা একদম নিষেধ। ডাক্তার সাহেব জানতে পারলে আমার চাকরি চলে যাবে।
ফুয়াদ বলল, সে ব্যাপারে ডাক্তারের সঙ্গে আমি কথা বলব। তারপর জামিলকে বলল, তুই আমাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে চল।
জামিলের কাঁধে ভার দিয়ে বাথরুমে যাওয়ার সময় নার্সকে বলল, আপনি আমার বেডের চাদরটা পাল্টে দিন, বেডেই নামায পড়ব।
নার্স চাদর পাল্টে দাঁড়িয়ে রইল।
বাথরুম থেকে ফিরে এসে ফুয়াদ তাকে জিজ্ঞেস করল, বেডটা কি পূর্ব পশ্চিমে লম্বা?
হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
বালিশটা পায়ের দিকে দিন। আমি শুয়ে শুয়ে নামায পড়ব।
নার্স বালিশ পায়ের দিকে রেখে বলল, তা হলে তো পশ্চিম দিকে পা হয়ে যাবে?
শুয়ে নামায পড়ার সময় পশ্চিম দিকে, মানে কাবা শরীফের দিকে পা করে চোখের ঈশারায় নামায পড়তে হয়।
জামিল ও নার্স তাকে ধরে বেডে শুইয়ে দিল। তারপর নামায পড়ে আসছি বলে জামিল চলে গেল।
নার্স বেডের পাশে দাঁড়িয়ে ফুয়াদের নামায পড়া দেখতে লাগল।
নার্সের নাম হামিদা বানু। বয়স পঁয়তাল্লিশের মতো। বান্দুরার পাশের গ্রামের মেয়ে। মা-বাবা নেই। মামাদের কাছে মানুষ। কলেজে পড়ার সময় একই গ্রামের এরশাদ নামে একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করে মামা-মামীকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে। এরশাদের মা- বাবা বৌকে গ্রহন করলেও যৌতুকের জন্য চাপ দিতে থাকে। এরশাদ প্রথম দিকে কিছু বলেনি। বছর দেড়েকের মধ্যে একটা মেয়ে হওয়ার পর মা- বাবার কথায় মামাদের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে আসার জন্য চাপ দিতে থাকে।
হামিদার মামাদের অবস্থা ভাল। তাদের ইচ্ছা ছিল এতিম ভাগনীকে অন্তত বি. এ. পাশ করিয়ে উচ্চ ফ্যামিলিতে শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। কিন্তু ভাগনী অল্প বয়সে এরকম অপকর্ম করবে চিন্তা করেনি। তাই তারা দুঃখ পেয়ে তার খোঁজ খবর করেনি। হামিদা কোন মুখে মামাদের কাছে টাকার জন্য যাবে? প্রায় দু’বছর শ্বশুরবাড়ির সকলের অত্যাচার নীরবে সহ্য করেছে। মেয়েটা এক বছরের হতে এরশাদ মামাদের কাছ থেকে টাকা এনে দেওয়ার জন্য মারধর শুরু করল। তাতে কাজ না হতে একদিন শ্বশুর-শাশুড়ী ছেলেদের নিয়ে বৈঠক করে হামিদাকে বলল, তুমি যদি তোমার মামাদের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা এনে দিতে না পার, তাহলে তোমাকে তালাক দিয়ে এরশাদের আবার বিয়ে দেওয়া হবে।
হামিদা তবু মামাদের কাছে গেল না। এরপর তার উপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। তাতেও কাজ না হতে এক ঝড় বৃষ্টির রাতে মেরে ধরে তালাক দিয়ে এরশাদ তাকে বাড়ী থেকে বার করে দিল। মারধরের ফলে হামিদা খুব জখম হয়েছিল। দু’বছরের মেয়ে মাহমুদাকে নিয়ে কোনোরকমে অন্ধকার রাতে হাসপাতালের বারান্দায় এসে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। মেয়েটার কান্না শুনে ডিউটিরত একজন ডাক্তার বাইরে এসে তাদেরকে দেখে নার্সদের সাহায্যে ভিতরে নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরের দিন হামিদার জ্ঞান ফিরে। সুপারিন্টেন্ডেন্ড মোরসেদ সাহেব এখানকার সব থেকে বড় ডাক্তার। তিনি খুব সৎ ও ধার্মিক। বয়স প্রায় পঞ্চাশের উপর। হাসপাতাল কোয়ার্টারে ফ্যামিলী নিয়ে থাকেন। তার তিন ছেলে, বড় ছেলে সৌদি আরবে কিং ফাহাদ হাসপাতালে চাকরী করে। স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে নিয়ে সেখানে আছে। অন্য ছেলের একজন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রফেসার। আর ছোট ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ে। তিনচার দিন পর হামিদা সুস্থ হলে মোর্সেদ সাহেব তাকে নিজের অফিসে ডেকে বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভদ্র ঘরের বৌ। দুর্যোগের রাতে ঐ অবস্থায় এখানে আসার কারণটা বলতো মা শুনি। কারাই বা তোমাকে পশুর মতো মারধর করেছিল?
এই কদিন নার্স ও ডাক্তাররা তার পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন; কিন্তু হামিদা মুখ খুলেনি। আজ মোর্সেদ সাহেবের কথা শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
মোর্সেদ সাহেব কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, কাঁদছ কেন? সব কিছু খুলে না বললে বুঝব কি করে?
হামিদা সামলে নিয়ে চোখ মুখ মুছে বলল, ছোট বেলায় বাবা মাকে হারিয়ে মামাদের আশ্রয়ে মানুষ হয়েছি। তার পরের সব ঘটনা বলে আবার ফুঁপিয়ে উঠে বলল, এই মেয়েটা না থাকলে আত্মহত্যা করে ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতাম।
মোর্সেদ সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, ছি মা, আত্মহত্যা করতে নেই। আত্মহত্যা মহাপাপ। আল্লাহ পাক যেমন পরম দয়ালু তেমনি ন্যায় বিচারক। তাঁর ঈশারা ছাড়া এই দুনিয়ায় কোনো কিছুই হয় না। মানুষ ভুল করে। ভুলের সংশোধনও আছে। আল্লাহ পাক নিজে কারো উপরে বিপদ দেন না। মানুষ নিজেই অন্যায় করে বিপদ ডেকে আনে। এটা কোরআনের কথা। এখন কোথায় যাবে কি করবে, কিছু ভেবেছ?
হামিদার কোনো উত্তর জানা নেই। তাই চুপ করে রইল।
মোর্সেদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কতদুর লেখা পড়া করেছ?
জী আই. এ. পড়ার সময় আমাদের বিয়ে হয়।
মোর্সেদ সাহেব একটা চিঠি লিখে তার হাতে দিয়ে বললেন, হাসপাতাল বিল্ডিং এর পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়ে সোজা দক্ষিণে যাবে। শেষ মাথায় ডান দিকের বিল্ডিং এর দোতলায় গিয়ে দরজায় নক করবে। ওটা আমার কোয়ার্টার। আমার স্ত্রী ওখানে আছেন। তাকে এই চিঠিটা দিও। উনি তোমাকে আশ্রয় দেবেন।
হামিদা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে এই তিন চারদিন আকাশ পাতাল ভেবেছে কোথায় যাবে, কি করবে কিছু ঠিক করতে পারেনি। মোর্সেদ সাহেবের কথা শুনে চিঠিটা হাতে নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। চোখ মুছে কদম বুসি করে ভিজে গলায় বলল, আপনার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না চাচা। তারপরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, মেয়ে হয়ে যেন আপনাদের সেবা করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি, সেই দোয়া করবেন।
মোর্সেদ সাহেব বললেন, এতে কাঁদবার কি আছে? আর তুমি ঋণীইবা থাকবে কেন? বিপদগ্রস্থকে সাহায্য না করলে একদিকে যেমন মানবতাকে অপমান করা হয়, তেমনি সামর্থ থাকতে সাহায্য না করলে, কাল হাশরের মাঠে আল্লাহর কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হবে। তারই ওপর সব সময় ভরসা রাখবে। তিনি যেমন বিপদ দেন, তেমনি উদ্ধারও করেন। যাও মা এবার যা বললাম কর।
হামিদা মাহমুদাকে নিয়ে মোর্সেদ সাহেবের কোয়ার্টারে এসে দরজা নক করল।
একটু পরে একটা আট দশ বছরের মেয়ে দরজা খুলে বলল, কাকে চান?
হামিদা বলল হাসপাতালের বড় ডাক্তার মোর্সেদ সাহেব আমাকে ওনার স্ত্রীর কাছে। পাঠিয়েছেন।
মেয়েটির নাম সফুরা। হাসপাতালের এক আয়ার মেয়ে। মোর্সেদ সাহেব বাসার ফাঁই ফরমাস শোনার জন্য রেখেছেন। বলল, একটু দাঁড়ান আমি দাদিকে ডেকে দিচ্ছি। তারপর ভিতরে চলে গেল।
অল্পক্ষণের মধ্যে একজন সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান বয়স্কা মহিলা এলেন।
হামিদা সালাম দিয়ে তার হাতে চিঠিটা দিল।
মহিলা সালামের উত্তর দিয়ে চিঠিটা পড়লেন। তারপর কয়েক সেকেণ্ড হামিদার আপাদ মস্তক লক্ষ্য করে বললেন, এস আমার সঙ্গে।
সেই থেকে হামিদা মোর্সেদ সাহেবের কাছে রয়ে গেল। তার ও তার স্ত্রীর মধুর ব্যবহারে হামিদা তাদেরকে আম্মা ও আব্বা বলে ডাকে। তারাও তাকে মেয়ের মত গ্রহণ করলেন। মোর্সেদ সাহেব তাকে নার্সিং শিখিয়ে নিজের হাসপাতালে চাকরি দিয়েছেন। অবশ্য তার আগে তাকে বলেছিলেন, আমরা তোমার আবার বিয়ে দিতে চাই। আর তোমার মেয়েকে আমরা মানুষ করব। হামিদা বিয়েতে অমত করে বলেছিল, আপনি আমাকে হাসপাতালে একটা চাকরি দেন। আল্লাহ যত দিন আপনাদের দুনিয়াতে রাখবেন ততদিন আপনাদের সেবা করে মেয়েকে মানুষ করব। সে সব আজ বিশ বছর আগের ঘটনা। সেই থেকে হামিদা এই হাসপাতালে নার্সের চাকরী করছে। তার মেয়ে মাহমুদা এখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। মোর্সেদ সাহেব ও তার স্ত্রীর সংস্পর্শে এসে হামিদাও খুব ধার্মিক হয়ে গেছে। মাহমুদাকেও সেইভাবে মানুষ করেছে। সে মেডিকেলে পড়লেও সব সময় বোরখা পরে ক্লাস করে। মাহমুদা ফুয়াদ হাসানের ভক্ত পাঠিকা। ফুয়াদ হাসানের কথা মায়ের সঙ্গে অনেক আলাপ করে। তার লেখা বই নিজে যেমন পড়ে তেমনি মাকেও পড়তে দেয়। সন্ত্রাসীদের হাতে আহত রুগী ফুয়াদ হাসান জানার পর হামিদা প্রত্যেক ওয়াক্ত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে তাকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য দোওয়া করতে লাগল।
সাত
জামিল ফুয়াদকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর মুগিব ও তার দলের সবাই অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।
প্রথমে কোবাদ জোবায়েরকে বলল, তোকে গুলী করতে নিষেধ করলাম, তুই শুনলি না। দেখলি তো উনি কতো ভালো মানুষ।
জোবায়ের বলল, উনি যাই হোন না কেন, ওস্তাদের হুকুম তামিল করা আমাদের উচিত।
কোবাদ বলল, তা আমিও জানি, তবে সব ক্ষেত্রে নয়। ভালো লোককে ডেকে এনে শুধু শুধু মেরে ফেলার চেষ্টা করা কারুরই উচিত নয়। ওস্তাদ যে কেন অমন একজন গুণী লোককে মেরে ফেলতে চাচ্ছিলেন বুঝতে পারছি না।
মুগিব উচ্চ ফ্যামিলীর শিক্ষিত ছেলে, পার্টির কাজ করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের লীডার হয়ে এতদিন যে অন্যায় করেছে। আজ ফুয়াদের কথায় ও ব্যবহারে তা বুঝতে পারল। এ্যারেষ্ট করা সন্ত্রাসীদেরকে পুলিশের কাছ থেকে যে লোক মুক্ত করে দেয় তাও আবার যারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তাদের সঙ্গে আবার আলাপ করতে আসবে শুনে। ফুয়াদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হল। কোবাদ ও জোবায়েরকে ঝগড়া করতে শুনে বলল, তোমরা চুপ কর। কোবাদ ও সামাদ ওঁকে ঠিকই চিনেছে। আমি ওঁকে একাত্তরের দালালদের লোক মনে করে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। আসলে উনি খুব ধার্মিক। শোন, আজকের ঘটনায় আমার জ্ঞানের চোখ খুলে গেছে আমি ঠিক করেছি, আমরা সকালে হাসপাতালে গিয়ে ওঁর কাছে ক্ষমা চাইব।
কোবাদ ও সামাদ বলে উঠল, হ্যাঁ ওস্তাদ তাই করা আমাদের উচিত।
জোবায়ের বলল, কিন্তু আমাদেরকে এক সঙ্গে দেখলে পুলীশরা যদি এ্যারেষ্ট করে?
মুগিব বলল,এখন করেও যখন ছেড়ে দিল তখন অন্যায় না করলে আর করবে না।
কোবাদ বলল ওস্তাদ ঠিক কথা বলেছে। আমরা কাল গিয়ে ওঁর কাছে ক্ষমা চাইব।
মুগিব বলল, এখন তোমরা সব যাও। কাল সকালে এখানে এসো। সে সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তারপর তারা সেখান থেকে চলে গেল।
কোবাদ ওখান থেকে বেরিয়ে জামসেদের সঙ্গে দেখা করে ঘটনাটা জানিয়ে বলল, ওস্তাদ সবাইকে কাল ক্লাবে যেতে বলেছে। আমাদের কি করা উচিত, সিদ্ধান্ত নেওয়া। হবে। তোরও যাওয়া উচিত। কারন তোর জন্যই এত কিছু ঘটনা।
জামসেদ বেশ ঘাবড়ে গেল। ভাবল, বাবা জানতে পারলে আমার উপর খুব রেগে যাবেন। যাবে কিনা চিন্তা করতে লাগল।
কিরে যাবি না?
আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
কেন হবে না? তোর আর রুমানার ব্যাপারটা ওস্তাদ জেনে গেছে। একটা কথা বলি শোন, তোর তো পছন্দের মেয়ের অভাব নেই, তুই রুমানার পিছন ছেড়ে দে। আমার মনে হয় ওরা দুজন দুজনকে ভালবাসে। আর যদি তা না হয়, তা হলে রুমানা। তোরই থাকবে।
জামসেদ কিছুক্ষন চিন্তা করে বলল, তোর কথা চিন্তা করে দেখব।
কোবাদ বলল, সেটা তোর ইচ্ছা। তারপর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
পরের দিন কাগজে ছোট করে ঘটনাটা ছাপা হয়েছে, “স্বনাম ধন্য উপন্যাসিক ফুয়াদ হাসান সন্ত্রাসীদের কবলে পড়ে আহত হয়ে নবাবগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।”
নিশাতের বাবা হাই স্কুলের মাষ্টার। তিনি পেপার রাখেন। নিশাত কলেজে যাওয়ার আগে প্রতিদিন পেপারের হেডলাইনগুলো পড়ে। কলেজ থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে পুরোটা পড়ে। আজ কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে হেডলাইনগুলো পড়ার সময় ফুয়াদ হাসানের খবরটা পড়ে পেপারটা হাতে নিয়ে রুমানাদের বাসায় এসে তাকে বলল, জানিস, গতকাল বিকেলে ফুয়াদ ভাই সন্ত্রাসীদের হাতে আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন।
রুমানা চমকে উঠে আতঙ্কিত স্বরে বলল, কি বলছিস তুই?
নিশাত পেপারটা খুলে লেখাটা দেখিয়ে বলল, পড়ে দেখ।
রুমানার বাবা ডিসপেন্সারিতে পেপার রাখেন। দুপুরে বাড়ীতে খেতে আসার সময় নিয়ে আসেন। তাই রুমানা কলেজ থেকে ফিরে পেপার পড়ে। এখন নিশাতের হাত থেকে পেপারটা নিয়ে পড়ে কেঁদে ফেলল। চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমার জন্য ওঁর এই অবস্থা মনে হয়। জামসেদই এই কাজ করিয়েছে।
নিশাত বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি যাই চল। হাসপাতালে ওঁকে দেখে তারপর ক্লাসে যাব।
রুমানা বলল, বাড়ীর সবাইকে খবরটা জানালে হত না?
নিশাত বলল, তোর বাবা ও ভাইয়েরা ডিসপেন্সারীতে চলে গেছে। তারা পেপার পড়ে জানতে পারবেন। দুপুরে খেতে এসে তা বাড়ীর সবাইকে জানাবে। তারপর তারা যা করার করবে। আমরা এখন যাই চল।
রুমানা চিন্তা করল, সবার সঙ্গে গেলে ফুয়াদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তাই চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তাই চল।
যেতে যেতে নিশাত বলল, তুই কাঁদছিস কেন? আমার মনে হয় আহত হলেও গুরুতর কিছু হয়নি। হলে পেপারে লিখত।
আল্লাহ করে যেন তোর কথাই ঠিক হয়। কি জানিস, মন যে বোধ মানছে না। কেবলই মনে হচ্ছে আমার জন্য ওঁর ওরকম হল। তারপর সারা রাস্তা চোখ মুছতে মুছতে হাসপাতালে পৌঁছাল। ওরা প্রথমে অফিসে গিয়ে ফুয়াদের আত্মীয় বলে পরিচয় দিল। সেখানে নার্স হামিদা ছিল। বলল, আসুন আমার সঙ্গে। যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, উনি আপনাদের কি রকম আত্মীয়?
রুমানা বলল, আমার চাচা-চাচি ওঁদের বাসায় অনেক বছর ভাড়া ছিলেন। চাচাত ভাইয়ের কুলখানিতে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। ফেরার পথে একটা উপন্যাস লেখার জন্য দশ বারো দিন এখানকার হোটেলে আছেন। আমরা পেপারে আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন জেনে দেখতে এসেছি। উনি এখন কেমন আছেন?
হামিদা বলল, ডান দিকের পিঠে একটা গুলি লেগেছিল। অপারেশন করে বার করা হয়েছে। সারারাত অজ্ঞান ছিলেন। ভোরে জ্ঞান ফিরেছে। এখন কিছুটা সুস্থ আছেন।
ওয়ার্ডে ঢুকে হামিদা হাত উঁচিয়ে দেখাল, ঐ যে, উনি ও,সি,সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন। আপনারা যান। কথা শেষ করে হামিদা ফিরে গেল।
রুমানা ও নিশাত বেডের কাছে এসে সালাম দিল।
ফুয়াদ সালামের উত্তর দিয়ে তাদের দেখে অবাক কণ্ঠে বলল, আপনারা?
রুমানা কথা বলতে পারল না, ছলছল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
নিশাত বলল, পেপারে খবরটা পড়ে আপনাকে দেখতে এলাম।
জামিল সেই যে রাতে এসেছে এখনও যায়নি। থানায় গিয়ে দু’জন পুলিশকে পাহারা দেওয়ার জন্য পাঠাবার কথা যখন বলছিল তখন রুমানা ও নিশাত এল। ফুয়াদ সালাম বিনিময় করে রুমানাকে দেখিয়ে জামিলকে বলল, বান্দুরায় ওঁদের বাড়ীতেই গিয়েছিলাম। ওঁর নাম রুমানা। তারপর নিশাতকে দেখিয়ে তার নাম বলে বলল, ওঁর বান্ধবী। পাশাপাশি বাড়ী। দু’জনেই নবাবগঞ্জ কলেজের ছাত্রী। তারপর জামিলকে দেখিয়ে ওদেরকে বলল, আমার বন্ধু জামিল। নবাবগঞ্জ থানার ওসি।
ততক্ষনে রুমানার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। তাই সে কিছু বলতে না পেরে মাথা নিচু করে নিল।
নিশাত জামিলের দিকে তাকিয়ে সালাম দিল।
জামিল রুমানার দিকে তাকিয়ে তার মনের অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পারল। নিশাত সালাম দিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে প্রতি উত্তর দিয়ে বলল, আপনারা কথা বলুন, আমাকে এখন থানায় যেতে হবে তারপর ফুয়াদকে বলল, চলি, পরে আবার আসব। কথা শেষ করে যেতে উদ্যত হলে ফুয়াদ বলল, আর এক মিনিট দাঁড়া। তারপর বলল, পুলিশ পাঠাবার দরকার নেই। তুই সময় করে আসিস।
জামিল মৃদু হেসে বলল ঠিক আছে, তাই হবে বলে চলে গেল।
নিশাত ফুয়াদকে জিজ্ঞেস করল, কি ভাবে ঘটনাটা ঘটল বলবেন?
ফুয়াদ বলল, ঘটনা বলতে গেলে আপনাদের ক্লাশ মিস হবে। ছুটির পর আসবেন তখন বলব। তারপর রুমানাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি ব্যাপার? আশা অবদি আপনি মাথা নিচু করে আছেন কেন?
রুমানার হয়ে নিশাত বলল, আপনার এই পরিনতির জন্য ও নিজেকে দোষি ভাবছে। তাই খবরটা জানার পর থেকে চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছে।
রুমানা লজ্জা পেয়ে নিশাতকে চিমটি কেটে ফিস ফিস করে বলল, তোর একটুও কান্ডজ্ঞান নেই।
রুমানা কথাটা ফিস ফিস করে বললেও ফুয়াদ শুনতে পেয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার তো মনে হচ্ছে আপনারই কান্ড জ্ঞান নেই। আমার এই অবস্থার জন্য আপনি দায়ী হতে যাবেন কেন? যার তকদিরে যা আছে তা হবেই। সে জন্যে অন্যে দায়ী হতে পারে না। এটা কোরান হাদিসের কথা।
রুমানা কথাটা এড়াবার জন্য বলল, এখন কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে ভালো। তারপর বলল, বেডের নিচে টুল আছে, বের করে একজন বসুন, আর একজন বেডেই বসুন।
নিশাত বলল, বসতে গেলে প্রথম ক্লাশটা মিস হবে। এখন যাই ছুটির পর আবার, আসব।
রুমানা নিশাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল, তুই যা। আমি পরের ক্লাসে আসছি।
নিশাত মৃদু হেসে বলল, ঠিক আছে। তারপর ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে আসি বলে চলে গেল।
নিশাত চলে যেতে রুমানা টুলটা টেনে ফুয়াদের বুক বরাবর বসল। তারপর তার কপালে হাত রেখে বলল, বেশ জ্বর রয়েছে।
রুমানার নরম ও ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ফুয়াদ আরাম বোধ করল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তার হাতের উপর হাত রেখে বলল, একটা কথা বলব, মাইন্ড করবেন না তো?
ফুয়াদ তার হাতের উপর হাত রাখতে রুমানা একবার কেঁপে উঠে বলল, মনে করব কেন? বলুন কি বলবেন।
মাথাটা বেশ ব্যথা করছিল আপনি হাত রাখতে আরাম বোধ হচ্ছে। একটু টিপে দেবেন?
অবশ্যই দেব। আপনি হাত সরান।
ফুয়াদ হাত না সরিয়ে বলল, কলেজে যাবেন না?
না।
কারনটা বলবেন?
কারনটা বুঝতে পারেন নি?
পেরেছি।
তবু জিজ্ঞেস করছেন কেন?
অনুমানটা যাচাঁই করার জন্য।
যদি বলি অনুমানটা ঠিক?
আলহামদুলিল্লাহ বলে ফুয়াদ হাত সরিয়ে নিল।
রুমানা মাথা টিপে দিতে লাগল।
ফুয়াদ জিজ্ঞেস করল, আপনাদের বাড়ীর আর কেউ আমার খবর জেনেছেন?
না আমি নিশাতের কাছে শুনেই চলে এসেছি। তবে আব্বা দোকানে পেপার রাখেন। এতক্ষনে হয়তো সবাই জেনে গেছেন। আপনি বাড়ীতে খবর দিয়েছেন?
না।
ওসি, সাহেব আপনার বন্ধু, তাকে আপনার বাড়ীতে ফোন করে দিতে বলতে পারতেন।
সে কথা কিছুক্ষন আগে বন্ধুই বলেছিল। আমি না করে দিয়েছি।
কারনটা বলবেন?
ফুয়াদ মৃদু হেসে বলল, খবরটা শুনলে বাড়ীর সবাই এসে যাবে। আম্মাতো কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলবে। তা ছাড়া আল্লাহর রহমতে আমার গুরুতর কিছু হয়নি। দু’একদিনের মধ্যে ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাব। শুধু শুধু বাড়ীর সবার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কি?
এটা আপনি ঠিক করেন নি।
এমন সময় একজন ডাক্তার ও নার্সকে আসতে দেখে রুমানা মাথা টিপা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
তারা কাছে এলে ফুয়াদ সালাম দিল।
ডাঃ মোর্সেদ সালামের উত্তর দিয়ে রুমানার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ সময়ে এসেছেন কেন? তারপর নার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এত কেয়ারলেস? এ সময় রুগীকে ডিস্টার্ব করা যে ঠিক নয়, তা কি জান না?
নার্স হামিদা কিছু বলার আগে ফুয়াদ বলল, স্যার ওঁর কোনো দোষ নেই। ইনি আমার খুব নিয়ারেষ্ট কাজিন। পেপারে সংবাদটা পড়ে দেখতে এসেছিলেন। উনি চলে যাচ্ছিলেন, আমিই যেতে দিইনি।
ডাঃ মোর্সেদ ফুয়াদকে পরীক্ষা করে বললেন, বেশি নড়াচড়া বা কথা বার্তা বলবেন না। হামিদার কাছে শুনলাম, আপনি বাথরুমে গিয়েছিলেন। আর যাবেন না। তাইমুম করে নামায পড়বেন। তারপর হামিদার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি সে ব্যবস্থা করে দেবে। তারপর চার্টে কিছু লিখে দিয়ে পাশের বেডের রুগীকে দেখতে গেলেন। হামিদাও ডাক্তারের সঙ্গে চলে গেল।
ডাক্তার সব রুগীদের দেখে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর হামিদা এসে ফুয়াদকে ঔষধ খাইয়ে বলল, আপনি বেশি কথা বলবেন না।
তারপর রুমানাকে বলল, আপনি যাবেন, না থাকবেন?
জ্বী থাকব।
তা হলে ওঁকে বেশি কথা বলবেন না। তারপর চলে গেল।
রুমানা টুলে বসে বলল, আপনি ঘুমাবার চেষ্টা করুন আমি মাথা টিপে দিই।
ফুয়াদ কিছু না বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
বেশ কিছুক্ষন তাকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুমানা লজ্জা পেয়ে বলল, কি দেখছেন, ঘুমাবেন না?
ফুয়াদ বলল, ঘুম এলে ঘুমাব। যতক্ষন না আসছে ততক্ষন——–বলে থেমে গেল।
থেমে গেলেন কেন? ততক্ষন কি করবেন?
কি আর করব, যা করার তা তো করছিই।
আমার লজ্জা পায় না বুঝি?
লজ্জা আছে বলে পাচ্ছেন।
আশ পাশের বেডের রুগীরা দেখে কি ভাববে চিন্তা করেছেন?
তারা যা কিছু ভাবুক না কেন, তাতে আমার কি?
তবু ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে।
লেখকরা একটু অভদ্র হয়।
আপনার সঙ্গে তর্কে পারব না।
তা হলে করছেন কেন?
আর করব না, এবার ঘুমান। নার্স আপনাকে বেশি কথা বলতে নিষেধ করে গেলেন না?
ডাক্তাররা অমন বলেই। তারপর বলল, সুস্থ হয়ে আমি দু’চার দিনের মধ্যে চলে যাব। আবার কবে দেখা হবে না হবে ঠিক নেই। তাই একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে। আপনি অনুমতি দিলে বলতে পারি।
দিলাম। কোনো চিন্তা না করেই দিলেন? যদি ভদ্রতা ছাড়িয়ে কিছু জানতে চাই?
ভদ্ৰ অভদ্র বিচার করেই উত্তর দেব। তবে আমার বিশ্বাস, আপনি ভদ্রতা বজায় রেখেই প্রশ্ন করবেন।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জীবন সাথী করার জন্য এমন একটা মেয়ের ছবি হৃদয়ে এঁকে রেখেছি, যার সঙ্গে আপনার হুবহু মিল রয়েছে। আপনি কি আমার ডাকে সাড়া দেবেন?
কথাটা শুনে রুমানা আনন্দে শিহরীত হয়ে তার মাথা থেকে হাতটা তুলে নিল। সেই সঙ্গে ভীষন লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফুয়াদ বলল, কথাটা বলে খুব বেশি অভদ্রতা করে ফেললাম, তাই না?
রুমানা লজ্জা মিশ্রিত স্বরে বলল, আর আমিও যদি বলি আপনার বই পড়ার পর থেকে আমার মনের মধ্যে যে ছবি চব্বিশ ঘন্টা বিরাজ করছে, তার সঙ্গে আপনি হুবহু মিলে গেছেন, তা হলে সেটাও কি অভদ্রতা হবে? এখন আবার যদি আপনার নিকট প্রেম নিবেদন করি, তা হলে কি ফিরিয়ে দেবেন?
এই কয়েক দিনে ফুয়াদ রুমানার মনের খবর কিছুটা জানতে পারলেও এতটা পারেনি। তাই আজ তার কথা শুনে আনন্দে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রুমানা তার কপালে গাল ঠেকিয়ে ভিজে গলায় বলল, এত দিন ধরে যে স্বপ্ন দেখে এসেছি তা কি সত্য হতে পারে না?
ফুয়াদ বলল, আল্লাহ রাজি থাকলে নিশ্চয় হবে। আপনি সোজা হয়ে বসুন।
রুমানা লজ্জা পেয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, তা হলে এখনো আপনি করে বলছেন কেন?
একই প্রশ্ন আমিও তো করতে পারি?
তা পারেন, তবে এসব ব্যাপারে ছেলেরা অগ্রভুমিকা নেয়।
ঠিক আছে, এবার তুমি আমার মাথা টিপে দাও, আমার খুব ক্লান্তি লাগছে, ঘুমাব।
রুমানা মাথা টিপতে শুরু করলে ফুয়াদ কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।
কলেজ ছুটির পর নিশাত এসে দেখল, রুমানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করল, কিরে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
রুমানা বলল, তোর জন্য। শোন তুই বাড়ী যা। আম্মাকে ওঁর কথা বলে বলিস, আমি এখানে আছি, বিকেলে ফিরব।
নিশাত বলল, অবস্থা কি ভালো না।
না তা নয়, এখন নামায পড়ছে। আমাকে বাড়ী যেতে বলল।
কি ব্যাপার বলতো, ফুয়াদ ভাইকে তুমি করে বলছিস যে?
সেই পর্যায়ে আমরা এসে গেছি।
ওমা! তাই না কি?
রুমানা মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ তাই।
তা তুই খাওয়া দাওয়া করবি না?
রুটি কলা খাব ভাবছি। চল তোকে বাসে তুলে দিয়ে আসি। আমাদের কেউ এলে তাদের সাথে যাব।
ঠিক আছে, তোকে আর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে হবে না। তুই কিছু খেয়ে নে। আমি যাই বলে নিশাত চলে গেল।
রুমানা হাসপাতালের গেটের পাশের দোকান থেকে রুটি কলা কিনে এনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেল। তারপর ফুয়াদের বেডের কাছে এল।
ফুয়াদের ততক্ষনে নামায পড়া শেষ হয়েছে। তাকে দেখে বলল, তুমি যাওনি?
যেতে চেয়েছিলাম; কিন্তু পারলাম না। তাই কিছু খেয়ে ফিরে এলাম।
বাড়িতে চিন্তা করবে না?
নিশাত এসেছিল, তাকে বলে দিয়েছি সে যেন আম্মাকে বলে আমি এখানে আছি, বিকেলে ফিরব।
ফুয়াদ আর কিছু না বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
রুমানা টুলে বসে বলল, কি ভাবে এরকম হল বলবে?
কাল বলব, এখনো ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বুঝতে পারিনি।
.
ডাঃ কাসেম মীর ডিস্পেন্সারীতে এসে পেপারে ফুয়াদ সন্ত্রাসীদের হাতে আহত হয়ে নবাবগঞ্জ হাসপাতালে আছে পড়ে যেমন অবাক হলেন, তেমনি আতঙ্কিতও হলেন। খবরটা ছেলেদেরকে জানিয়ে বললেন, তোদের একজন বিকেলে গিয়ে দেখে আয়।
বড় ছেলে শামীম বলল, তাই নাকি? উনি মনে হয় কোনো কাজে নবাবগঞ্জে আবার এসেছিলেন।
তা হতে পারে। তুমি গিয়ে সবকিছু জেনে আসবে।
দুপুরে খেতে এসে কাসেম মীর স্ত্রীকে ফুয়াদের আহত হওয়ার কথা বলে বললেন, শামীমকে বিকেলে পাঠাব।
মাসুদা… বিবি আতঙ্কিত হলেন। বললেন, দিন দিন দেশের অবস্থা যা হচ্ছে, কিছুদিন পর মানুষ রাস্তায় বেরোতে পারবে না। “ছেলেটা খুব ভালো। তুমি মনে করে শামীমকে পাঠিও।
ডিস্পেন্সারীতে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, রুমানাকে দেখছি না কেন? এখনো ফেরেনি?
মাসুদা….. বিবি বললেন, কিছুক্ষন আগে নিশাত এসে বলে গেল, ওরা খবরটা জেনে ছুটির পর হাসপাতালে ফুয়াদকে দেখতে গিয়েছিল। রুমানা সেখানে আছে। ওর কাছে বলে দিয়েছে বিকেলে ফিরবে। ওয়ার্ড নাম্বার ও বেড নাম্বার দিয়ে গেছে।
কাসেম মীর কিছু না বলে চিন্তিত মুখে ডিস্পেন্সারীতে গিয়ে শামীমকে বললেন, তুমি বাসায় গিয়ে খেয়ে-দেয়ে নবাবগঞ্জ যাও, সেখানে রুমানা আছে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।
শামীম যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছাল তখন সাড়ে তিনটে। ওয়ার্ডে গিয়ে দেখল, ঘুমন্ত ফুয়াদের বেডের পাশে রুমানা একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, আর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। বোনের অবস্থা দেখে শামিম ভাবল, ওঁর অবস্থা হয়তো আশঙ্কাজনক। কাছে এসে একটা হাত তার কাঁধে রেখে বলল, কি রে কাঁদছিস কেন? অবস্থা কি খুব খারাপ?
রুমানা ফুয়াদের মনের কথা জানার পর থেকে একদিকে যেমন আনন্দ ধরে রাখতে পারছিল না,অপর দিকে তার জন্য ফুয়াদের এই অবস্থা হয়েছে ভেবে মন বেদনাতুর হয়ে উঠছে। আনন্দ ও বেদনাভরা অনুভূতি নিয়ে তার মুখের দিকে তন্ময় হয়ে চেয়েছিল। কখন যে চোখ থেকে পানি টপ-টপ করে পড়তে শুরু করেছে টের পাইনি। কেউ কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলছে শুনে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর শামীমকে দেখে চোখ মুছে বলল, ভাইয়া তুমি?
শামীম বলল, খবরটা জেনে আব্বা পাঠাল। তা হ্যাঁরে এখন ওর অবস্থা কেমন?
কিছুটা ভালো। চলো বারান্দায় গিয়ে কথা বলি। উনি দু’টোর দিকে ঘুমিয়েছেন। ডাক্তার বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছেন। তারপর বারান্দায় এসে বলল, উনি মাহবুব ভাইয়াদের সঙ্গে ঢাকা যাননি। এখানে নেমে গিয়েছিলেন। হোটেলে থেকে একটা বই লিখছেন।
শামীম বেশ অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? তোকে তা হলে সব বলেছেন?
হ্যাঁ।
তুই কাঁদছিলি কেন? তোর কান্না দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। মনে করেছিলাম, ওঁর অবস্থা খুব খারাপ।
রুমানা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, না তেমন কিছু না। চোখে মনে হয় কিছু পড়েছিল।
শামীম বোনের মনের খবর কিছুটা অনুমান করতে পারল। মাথায় আস্তে করে চাঁটি মেরে বলল, ভাইয়ার কাছে সত্য কথাটা বলতে পারছিস না কেন? তারপর তার লজ্জা কাটাবার জন্য বলল, চল ভিতরে যাই।
ওরা বেডের কাছে এসে দেখল, ফুয়াদ জেগে গেছে। শামীম সালাম দিল।
ফুয়াদ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, বসুন, কেমন আছেন?
শামীম বলল, ভালো। আপনি কেমন আছেন বলুন। পেপারে আপনার খবর জানতে পেরে আব্বা পাঠালেন। আপনি আমাদের বাড়িতে না থেকে এখানে থাকতে গেলেন কেন? দেখুন দেখি, কি রকম বিপদে পড়লেন।
ফুয়াদ বলল, সবকিছু আল্লাহ পাকের ঈশারা। তেমন কিছু হয়নি। আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। দু’তিন দিনের মধ্যে আল্লাহ চাহেতো সুস্থ হয়ে যাব।
রুমানা টুল দেখিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি বস।
শামীম কমলা ও আপেল নিয়ে এসেছিল। বসে রুমানাকে বলল,তুই এগুলো ছাড়িয়ে ওকে খেতে দে।
ফুয়াদ বলল, আপনি আবার ওসব আনতে গেলেন কেন?
রুমানা বলল, আপনার শরীর থেকে কত রক্ত গেছে, তা পূরণ করার জন্য প্রচুর ফল খেতে হবে। তারপর কমলা ও আপেল ছাড়িয়ে একটা প্লেটে দিল।
খাওয়া শেষ হতে আবার আসার কথা বলে শামীম রুমানাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
পরের দিন কলেজে আসার সময় নিশাত বলল, কিরে তোর প্রিয় লেখকের মনের কথা জানতে পারলি কি করে, বল না শুনি?
রুমানা হেসে উঠে বলল, কেন রে, তুইও কারো সঙ্গে প্রেম করতে চাস না কি?
নিশাতও হেসে উঠে বলল, এখনো চান্স পাইনি তবে পেলে পিছাব না।
রুমানা গতকাল তাদের দু’জনের মধ্যে যা কিছু কথা হয়েছিল, তা সব বলে বলল, এসব কথা এখন কাউকে বলবি না।
ঠিক আছে বলব না। এবার কি করবি ভেবেছিস?
বারে, আমি আবার কি ভাববো? যা করার ফুয়াদই করবে।
নিশাত বলল, আজ ফুয়াদ ভাইয়ের কথা আম্মাকে জানিয়ে বলে এসেছি, তাকে দেখতে যাব। ফিরতে দেরী হবে।
রুমানা বলল, আমিও তাই বলে এসেছি।
কলেজ ছুটির পর ওরা রেষ্টুরেন্ট থেকে খেয়ে হাসপাতালে ফুয়াদের কাছে গেল।
ফুয়াদ তাদেরকে দেখে সালাম দিয়ে নিশাতকে বলল, কাল এসে দেখা না করে চলে গেলেন কেন?
নিশাত সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি নামায পড়ছিলেন। তাই ডিস্টার্ব করিনি। আজ কেমন আছেন।
ফুয়াদ ভালো বলে তাদেরকে বসতে বলল।
.
ঘটনার পরের দিন মুগিব সাথিদের নিয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কাল ভিজিটিং আওয়ারে সবাই একসঙ্গে গিয়ে ফুয়াদের কাছে ক্ষমা চাইবে। আজ সবাই ক্লাবে এসে রওয়ানা দিল।
শীতকালে বেলা তিনটের সময় রূগীদের দেখার জন্য গেট খুলে দেওয়া হয়। মুগিব জামসেদ সহ তাদের দলের পাঁচ ছয়জন হাসপাতালে ফুয়াদের কাছে যখন এল তখন নিশাত ও রুমানার সঙ্গে ফুয়াদ কথা বলছিল। তাদেরকে ওয়ার্ডে ঢুকতে দেখে ফুয়াদ রুমানাকে বলল, দেখতো ওদের কাউকে চিনতে পার কিনা।
নিশাত ও রুমানা দরজার দিকে পিট করে বসে ছিল বলে তাদেরকে দেখতে পাইনি। ফুয়াদের কথা শুনে রুমানা ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের মধ্যে জামসেদকে দেখে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, সবাইকে চিনি না। শুধু যে ছেলেটা জিনসের প্যান্ট-সার্ট পরে আছে ও জামসেদ। ওর কথাই তোমাকে বলেছিলাম।
সকলের আগে মুগিব এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন ফুয়াদ ভাই?
ফুয়াদ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো। তারপর রুমানাকে বলল, আমাকে ধরে বসাও তো।
রুমানা বেডের হ্যাঁন্ডেলে বালিশ দিয়ে তাকে বসাল। সে বড় চাদর মাথায় ও গায়ে দিয়ে কলেজে আসে। ফুয়াদকে বসিয়ে মাথায় চাদর টেনে মুখটা ঢেকে ফুয়াদের বেডের পিছনে দাঁড়াল। নিশাত টুলে বসেছিল। ওদেরকে দেখে সে আগেই মাথার দিকে বেডের পিছনে দাঁড়িয়েছে।
নিশাত ও রুমানার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মুগিব ফুয়াদের দু’টো হাত ধরে বলল, আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরে কৃত অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমি সকলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইছি। আপনি গুণী ব্যক্তি। আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন। ‘
ফুয়াদ এরকমই অনুমান করেছিল। তাদেরকে হেদায়েৎ দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছে। আল্লাহ মেহেরবানী করে তার ফরিয়াদ কবুল করেছেন জেনে মনে মনে তাঁর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে বলল, যারা নিজেদের অন্যায় বুঝতে না পেরে অনুতপ্ত হয় এবং সে জন্য ক্ষমা চায়, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং ভালোবাসেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুণ। তারপর বলল, মুগিব ভাই, আপনারা যদি অনুমতি দেন, তা হলে দু’চারটে কথা বলতে চাই।
মুগিব বলল, বেশতো বলুন।
ফুয়াদ বলল, আপনারা না এলেও সুস্থ হয়ে আমিই আপনাদের কাছে যেতাম। জানেন, আল্লাহপাক তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে যেমন সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন তেমনি তাকে বিবেক এবং জ্ঞানও দিয়েছেন। যা অন্য কোন সৃষ্ঠিকে দেন নাই। মানুষ ও জ্বিন ছাড়া বাকি সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর আনুগত্য মেনে চলছে। আর মানুষ শ্রেষ্ট সৃষ্টি হয়েও অল্প কিছু সংখ্যক ছাড়া তাঁর আনুগত্য মেনে চলা তো দুরের কথা তাঁকে অস্বিকার করছে। এটা কি শ্রেষ্টত্বের পরিচয়? শ্রেষ্টত্ব বজায় রাখার জন্য তিনি মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন এবং সেই জ্ঞানকে পরিচালিত করার জন্য বিবেকও দিয়েছেন। কিন্তু আজ মানুষ জ্ঞানে বিজ্ঞানে চরম উন্নতি করলেও বিবেকের দ্বারা সেই জ্ঞানকে পরিচালিত করছে না। ফলে সারাদুনিয়াতে অশান্তীর আগুন জ্বলছে। আমার কথা হয়তো আপনারা সবাই বুঝতে পারছেন না। সহজ কথায় বলি যেমন ধরুন, আজকাল মানুষ জ্ঞানের দ্বারা ভালোকে ভালো বলে জানে; কিন্তু বিবেকের কথা না মেনে খারাপের দিকে ক্রমশঃ এগিয়ে চলেছে। এর কারণ, মানুষ আল্লাহর আদেশ নিষেধ অমান্য করে নিজের খেয়াল খুশি মত চলছে। তারা ধন-সম্পদ ও ভোগ-লিপ্সার পিছনে অন্ধের মত ছুটছে। তাদের বিবেক বার বার বলছে,ওটা মরীচিকা। মরীচিৎকার পিছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ যেমন এক সময় মৃত্যু বরন করে তেমনি ধন-সম্পদও ভোগ-লিপ্সার পিছনে ছুটে ছুটে মানুষ বিবেক হারিয়ে অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। দয়া-মায়া-মমতা হারিয়ে ফেলছে। সামান্য সার্থের জন্য ভাই ভাইকে খুন করছে। যৌতুকের জন্য স্ত্রীর উপর অত্যাচার করছে, তালাক দিচ্ছে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ছেলেরা মেয়েদের মুখে এ্যসিড মারছে। আবার কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে। অফিসের ছোট বড় সবাই ঘুষ খাচ্ছে। মহাজনরা সুদের ব্যবসা করে গরীবদের রক্ত চুষে আরো ধনী হচ্ছে। ছোটরা বড়দের। সম্মান করছে না। ফলে মুষ্টিমেয় যারা সত্যের পথিক, সমাজে তাদের স্থান নেই। তারা যদি আল্লাহর বিধি-নিষেধের কথা বলে মানুষকে সৎপথে আনার চেষ্টা করে, তা হলে তাদেরকে মৌলবাদি, সাম্প্রদায়িক বলে গালাগালি করছে। আপনারা যদি আসল ইসলামের ইতিহাস পড়তেন, তা হলে জানতে পারতেন, কোনো মুসলমান বাদশা বা শাসক বিধর্মী প্রজাদের উপর এতটুকু অত্যাচার করেন নি। এ রকম শিক্ষা ইসলাম তাদেরকে দেয় নাই। আর আজ আমরা মুসলমান হয়ে ইসলামকে ঘৃনা করছি। কেউ ইসলামের কথা বললে তাদেরকে সাম্প্রদায়িক বলছি। আমার একান্ত অনুরোধ, আপনারা ইসলামকে জানুন। ইসলামকে জানার জন্য ইসলামিক বই পড়ুন। আপনাদের নেতারা কলেজ-ভার্সিটির ডিগ্রী নিলেও ইসলাম সম্বন্ধে পড়াশোনা না করে রাজনীতি করছেন। আর সেই রাজনীতিতে আপনাদেরকে টেনে নিয়ে নিজেদের কাজ হাসিল করছেন। একটা জিনিস মনে রাখবেন, ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সারা বিশ্ব মানবের জন্য। একটা উদাহরণ দিলে কিছুটা বুঝতে পারবেন। এই ধরুন মুসলমানদের নাম রাখার ব্যাপারটা। বিশ্ব নবী (দঃ) শিশুদের সুন্দর নাম রাখতে বলেছেন। যেমন আপনার নাম মুগিব। যার অর্থ সাহায্য কারী। নামের সার্থকতার জন্য, দুস্থ মানুষের সাহায্য করা আপনার উচিত ছিল। আপনি নামের সার্থকতা রাখতে পেরেছেন কি? আপনাদের আর একজনের নাম আব্দুস সামাদ, যার অর্থ হল যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, তাঁর দাস। অর্থাৎ আল্লাহর দাস। কারন আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। দাসের কি উচিত নয় মনিবের হুকুম পালন করা? যার নাম সাহায্যকারী তার তো সাহায্য কারী হওয়াই উচিত। এ ভাবে ইসলামের খুঁটি-নাটি প্রতিটি হুকুম মানুষের মঙ্গলের জন্য। আমি আর বেশি কিছু বলে আপনাদের বিরক্ত করব না। আপনারা আমাকে এখান থেকে যে কারণে চলে যেতে বলেছেন, তার কারণ আমি রুমানার সঙ্গে মেলামেশা করি। কথাটা মুগিব ভাই সেদিন আমাকে বলেছিলেন। মেলামেশার কারণটা বলছি শুনুন। আমরা দুজন দু’জনকে পছন্দ করি এবং কিছু দিনের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব। আপনারা বোধ হয় লক্ষ্য করেছেন, আমরা কখনো গোপনে কোন অভিসার করিনি।
মুগিব তাড়াতাড়ি বলে উঠল, সে কথা আর বলবেন না। আমি না জেনে,না শুনে ঐকথা বলে ভীষন ভুল করেছি। সে জন্য আমি অনুতপ্ত হয়ে আবার ক্ষমা চাইছি। আপনার সে দিনের ব্যবহার আমাদের জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছে। সে সব কথা বলে আমাদেরকে আর লজ্জা দেবেন না।
এবার জামসেদ এগিয়ে এসে বলল, স্যার সমস্ত ঘটনার জন্য আমিই দায়ি। আমার কারণেই আজ আপনার এই অবস্থা। আমি আপনার বইয়ের একজন ভক্ত পাঠক। আমাকেও ক্ষমা করে দিন স্যার।
ফুয়াদ বলল, মানুষ মাত্রই ভুল বা অন্যায় করে। যারা প্রকৃত মানুষ তারা তার সংশোধনও করে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার এবং তাঁর বিধি নিষেধ জানার, বোঝার ও মানার তওফিক দিক।
এমন সময় নার্স হামিদা এসে বলল, ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। এবার আপনারা দয়া কর চলে যান।
ফুয়াদ ওদেরকে বলল, আপনারা যান, আমি সুস্থ হয়ে ইনশা আল্লাহ আপনাদের ক্লাবে একদিন আসব।
ওরা সবাই চলে যাওয়ার পর রুমানা ফুয়াদকে বলল, আমরাও এবার যাই। ইনশা আল্লাহ কাল আবার আসব।
ফুয়াদ বলল, কিছুক্ষণ পরে যাও।
নিশাত তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার এই অবস্থার কথা বাড়িতে জানান নি?
ফুয়াদ বলল, না। কারণ জানালে আম্মা ভীষণ কান্না-কাটি করবেন। ভাবছি দু’একদিনের মধ্যে আর একটু সুস্থ হয়ে চলে যাব। আরো কিছুক্ষন থেকে নিশাত ও রুমানা বাড়ি রওয়ানা হল।
আট
ফুয়াদের বোন মনোয়ারা একদিন মুড়ির ঠোঙ্গাতে ফুয়াদের দুর্ঘটনার কথা পড়ে তাড়াতাড়ি মাকে লেখাটা দেখাল।
ফিরোজা বেগম পড়ে খুব আতঙ্কিত হয়ে বললেন, হায় আল্লাহ, একি হল। কবে এ রকম হল জানব কি করে। তারপর বললেন, তোর মেজ ভাইকে ডাকতো।
ফুয়াদের ছোট সাত্তার কলেজে পড়ে। সে তখন পড়ছিল।
মনোয়ারা তার কাছে গিয়ে বলল মেজভাই, ভাইয়া সন্ত্রাসীদের হাতে আহত হয়ে নবাবগঞ্জ হাসপাতালে আছে। তাড়াতাড়ি চল,আম্মা ডাকছে।
সাত্তার সন্ত্রস্থ হয়ে আসতে আসতে বলল, কে খবর দিল?
কেউ দেয়নি, আমি মুড়ির ঠোঙায় খবরটা পড়ে আম্মাকে বললাম।
সাত্তার মায়ের কাছে এসে বলল, কই ঠোঙাটা দেখি।
ফিরোজা বেগম ঠোঙাটা তার হাতে দিয়ে বললেন, মাহবুব এখন অফিসে। তুই তার মায়ের কাছ থেকে কিভাবে নবাবগঞ্জ যাওয়া যাবে জেনে আয়। ততক্ষনে আমি তৈরী হয়ে নিই।
সাত্তার ঠোঙাটা মনোয়ারার হাতে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
ফিরোজা বেগম মনোয়ারাকে ও কাজের মেয়েকে বললেন, তোমরা রান্না করে সব দিক খেয়াল রাখবে। আমরা যদি ফিরতে না পারি চিন্তা করবে না। আল্লাহ রাজি থাকলে কাল ফুয়াদকে নিয়ে ফিরব। কথা শেষ করে তৈরী হওয়ার জন্য রুমে চলে গেলেন।
কিছুক্ষনের মধ্যে সাত্তার ফিরে এলে তাকে তৈরী হতে বলে ছোট ছেলে সারোয়ারকে বললেন, সব সময় বাসায় থাকবি।
সাত্তার বলল, আমার মনে হয়, ভাইয়া আহত হলেও তেমন গুরুতর কিছু হয়নি। হলে নিশ্চয় খবর দিত। তোমার যাওয়ার দরকার নেই, আমি একাই যাই।
ফিরোজা বেগম বললেন, আল্লাহর রহমতে তোর কথা যেন ঠিক হয়, তবু আমি যাব। তুই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে। তারা যখন রওয়ানা হল তখন বেলা এগারটা।
আজ কলেজ বন্ধ। রুমানা বাড়ির কাউকে সে কথা না জানিয়ে কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরী হল।
নাস্তা খাওয়ার সময় মাসুদা বিবি মেয়েকে বললেন, আজ তোর আব্বা ও আমি বিকেলে ফুয়াদকে দেখতে যাব।
রুমানা আনন্দিত হয়ে বলল, আমিও কলেজ ছুটির পর ওকে দেখতে যাব। তোমাদের সঙ্গে ফিরব।
দুপুরে খাবি কি?
হোটেলে যা হোক কিছু খেয়ে নেব।
রুমানা যখন হাসপাতালে এসে পৌছাঁল তখন বেলা আটটা, সালাম বিনিময়ের পর ফুয়াদ বলল, কলেজে যাবে না?
কলেজ বন্ধ। তারপর বলল, আজ আব্বা আম্মা তোমাকে দেখতে আসবেন।
তা হলে ওদেঁর সঙ্গে আসতে পারতে; এখন এলে কেন?
কেন! এখন আসাতে তুমি কি অসন্তুষ্ট হয়েছ?
অসন্তুষ্ট হব কেন? বরং খুশি হয়েছি।
তা হলে ঐ কথা বললে কেন?
সারাদিন থাকতে তোমার অসুবিধা হতে পারে ভেবে বলেছি।
আর তুমি যে আজ কয়েকদিন রয়েছ, অসুবিধা হয় নি?
ফুয়াদ মৃদু হেসে বলল, বোকার মত কথা বলছ কেন? আমি কি স্বইচ্ছায় রয়েছি?
তোমার সঙ্গে তর্কে পারব না। ঠিক আছে, তা হলে চলে যাই?
যেতে পারবে?
আসতে যখন পেরেছি তখন যেতেও পারব।
তা পারবে,তবে এক্ষুণী যেতে পারবে না।
এমন সময় নার্স হামিদা এসে ফুয়াদকে জিজ্ঞেস করল, আজ কেমন আছেন?
ফুয়াদ বলল, আল্লাহর রহমতে আগের থেকে ভালো, কবে ছাড়া পাব বলতে পারেন?
আজ ব্যান্ডেজ খোলা হবে। কোনো অসুবিধা না থাকলে কাল হয়তো ছাড়া পাবেন।
বেলা দশটার সময় ডঃ মোর্সেদ ফুয়াদের ব্যান্ডেজ খুলে দিয়ে বললেন, আর ব্যান্ডেজ করা লাগবে না। আল্লাহর রহমতে আপনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেছেন। আগামী কাল আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
ফুয়াদ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আপনার মত দক্ষ ডাক্তারের চিকিৎসায় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় যে কোনো রুগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়াই স্বাভাবিক।
দুপুরে খাবার দিয়ে যাওয়ার পর ফুয়াদ রুমানাকে বলল, এস দু’জনে ভাগ করে খাই।
রুমানা হেসে উঠে বলল, তা হলে তো কারুরই পেট ভরবেনা।
একবেলা না হয় আধপেটাই খেলাম।
তা খাবেই বা কেন? তুমি খাও, আমি বাইরে গিয়ে কিছু খেয়ে নেব। তারপর আপত্তি সত্বেও ফুয়াদকে জোর করে খাওয়াল।
খাওয়ার পর ফুয়াদ বলল, পেট ভরলেও মন ভরল না।
রুমানা বলল, তুমি বিশ্রাম নাও, আমি মন ভরার ব্যবস্থা করে আসি। কথা শেষ। করে হাসপাতালের বাইরে এসে কলা রুটি খেয়ে ফিরে এল।
ফুয়াদ বলল, কি খেলে?
কলা আর রুটি।
ভাত খেলে না কেন?
একা একা হোটেলে খেতে আমার খুব লজ্জা করে।
তাই বলে না খেয়ে থাকবে?
না খেয়ে কোথায়? কলা-রুটি তো খেয়েছি।
বাঙ্গালীদের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতের বদলে যা কিছুই খাওয়া হোক না কেন পেট মন কোনটাই ভরে না।
তোমার কথা ঠিক; তবে প্রয়োজনে যা হোক কিছু খেয়ে দিন কাটান যায়। তা ছাড়া মেয়েদের একবেলা না খেলেও কোন অসুবিধা হয় না।
তবু নিজেকে সেলফিস মনে হচ্ছে!
এমন সময় ফিরোজা বেগম ও সাত্তার সেখানে এসে পৌঁছালেন।
তাদেরকে দেখে ফুয়াদ সালাম দিয়ে বলল, আম্মা, তোমরা কেমন আছ?
ফিরোজা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে ভিজে গলায় বললেন, তোর এরকম.হল, একটা খবর দেওয়া দরকার মনে করলি না। এই জন্যেই বুঝি তোকে লেখাপড়া করিয়েছি। তারপর পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কেমন আছিস? কবে এরকম হল? তারপর চোখ মুছলেন।
ফুয়াদ বলল, সপ্তাহ খানেক আগে গুলি লেগে সামান্য আহত হয়েছিলাম। তাই জানাইনি। তুমি কাঁদছ কেন? তকদিরে যা আছে তা হবেই। আল্লাহর রহমতে ও তোমার দোওয়ার বরকতে ভালো হয়ে গেছি। ডাক্তার বললেন, কাল ছাড়া পাব। তার পর সাত্তারের দিকে চেয়ে বলল, কিরে পড়া শোনা ঠিকমতো করছিস তো?
সাত্তার বলল, তা করছি। কিন্তু ভাইয়া, খবরটা দেওয়া তোমার উচিত ছিল।
ফুয়াদ বলল, খবর পেলি কি করে?
আজ সকালে মনোয়ারা মুড়ির ঠোঙার কাগজে তোমার আহত হওয়ার খবর পড়ে আমাদেরকে জানায়। তারপর আমরা রওয়ানা দিই।
রুমানা এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়েছিল। এবার এগিয়ে এসে ফিরোজা বেগমকে সালাম দিয়ে কদমবুচি করল।
ফিরোজা বেগম প্রথমে রুমানাকে দেখলেও তেমন লক্ষ্য করেননি। মনে করেছিলেন হাসপাতালের অন্য কোন রূগীর আত্মীয় স্বজন হবে। এখন তাকে সালাম দিতে ও কদম বুসি করতে দেখে অবাক হলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আরো অবাক হলেন। বেশ সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে। জিজ্ঞেস করলেন, কে মা তুমি, তোমাকে তো চিনতে পারছি না?
রুমানা কিছু বলার আগে ফুয়াদ বলল, ও রুমানা। শফি চাচার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। এখানকার কলেজে পড়ে। প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসে।
ওমা তাই নাকি? তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বাড়ির সবাই কেমন আছেন?
রুমানা বলল, জ্বী ভালো আছেন।
আমি একটু আসছি বলে সাত্তার বাথরুমের ছোট কাজ সারতে চলে গেল।
ফুয়াদ চিন্তা করল, রুমানার মা-বাবা হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যে এসে পড়বেন। এই সুযোগে রুমানার ব্যাপারটা বলে ফেলাই ভালো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা চিন্তা করছিল।
তাই দেখে ফিরোজা বেগম বললেন। কিরে মনে হচ্ছে কিছু যেন বলতে চাস?
ফুয়াদ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল।
ফিরোজা বেগম ছেলেকে লজ্জা পেতে দেখে বললেন, লজ্জার কি আছে, কি বলবি বল না।
ফুয়াদ মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, রুমানাকে ভালো করে দেখতো, তোমার পছন্দ হয় কিনা।
ফিরোজা বেগম ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক দিন থেকে মেয়ে দেখছেন; কিন্তু ফুয়াদ রাজি হয় নি। বলে এত তাড়া কিসের। আজ নিজেই মেয়ে পছন্দের কথা বলতে খুব খুশি হলেন। রুমানাকে বললেন, আমার কাছে এসো তো মা। রুমানা কাছে এলে তার চিবুক ধরে বললেন, এমন মেয়েকে কে না পছন্দ করবে? তারপর রুমানাকে জড়িয়ে ধরে দু’গালে চুমো খেয়ে বললেন, আল্লাহ রাজি থাকলে তোমাকে ফুয়াদের বৌ করতে চাই, তুমি রাজি আছ তো মা?
রুমানা খুব লজ্জা পেয়ে কিছুক্ষন নিথর হয়ে রইল। তারপর নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে কদম বুসি করে বলল, আমি কি আপনাদের বৌ হওয়ার উপযুক্ত হব?
ফিরোজা বেগম রুমানার মনের ইচ্ছা বুঝতে পারলেন। বললেন, তা জানি না। তবে ফুয়াদ যখন তোমাকে পছন্দ করেছে তখন ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় তুমি উপযুক্ত।
ফুয়াদ বলল, জান মা, আজ ওর মা-বাবা আমাকে দেখতে আসবেন, তুমি প্রস্তাবটা দিও।
ফিরোজা বেগম বললেন, সে কথা তোকে বলে দিতে হবে না। এই জন্যেই বোধ হয় আল্লাহ আমাকে এখানে নিয়ে এলেন।
এমন সময় সাত্তার ফিরে এলে ফিরোজা বেগম তাকে বললেন, আমাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিবি চলতো।
তারা চলে যাওয়ার পর ফুয়াদ রুমানাকে বলল, দেখলে তো লেখকরা কেমন বেহায়া?
রুমানার তখনও লজ্জা কাটেনি। তবু বলল, কথাটা শুনেছিলাম; কিন্তু লেখকরা যে এতটা বেহায়া হয়, তা জানতাম না।
বেহায়া স্বামীর ঘর করতে পারবে তো?
মেয়েরা স্বামীর বেহায়াপনা ছাড়াতে জানে।
বিয়ের পর মেয়েরা কিন্তু স্বামীদের চেয়ে বেশি বেহায়া হয়?
রুমানা আরো বেশি লজ্জা পেয়ে বলল, বাজে কথা।
ফুয়াদ হেসে উঠে বলল, বাজে না সত্য বিয়ের পর দেখা যাবে।
তাই দেখ বলে মুখে কাপড় দিয়ে রুমানা হেসে উঠল।
এমন সময় মা-বাবাকে ওয়ার্ডে ঢুকতে দেখে রুমানা বলল, এই হাসি থামাও আম্মা-আব্বা আসছে।
ইবনুল আরাবী
বুঝলাম না! সমস্ত ঘটনা গুলো এই ভাবে কেন শেষ হয় আমি বুঝতে পারছি না!