হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো
বিশ্বজিত সাহা
উৎসর্গ
শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে আন্দোলনরত তরুণদের
.
‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ নামে বিশ্বজিত সাহা একটি বই লিখছে শুনে আমি খুশি হয়েছি। শুনেছি অনেকেই হুমায়ূনকে নিয়ে বই লিখছে। তবে আমার মনে হয় বিশ্বজিতের বইটা ভালো হবে কারণ সে তার চিকিৎসার শুরু থেকে শেষ দিনগুলো পর্যন্ত হুমায়ূনকে কাছ থেকে দেখেছে এবং সবসময়ই পাশে ছিলো। আমি তার বইটির জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আল্লাহ হুমায়ূনের আত্মার শান্তি দিন।
আয়েশা ফয়েজ
পল্লবী, ঢাকা।
.
‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো’ নিয়ে কিছু কথা
হুমায়ূন আহমেদ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ইতঃমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর নামে স্মারকগ্রন্থসহ প্রচুর বই। তাঁকে নিয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। যেহেতু এই নন্দিত কথাশিল্পীর জীবনাবসান ঘটেছে নিউইয়র্কে, তাই প্রবাস জীবনের শেষ দিনগুলোতে যারা তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন, দিবারাত্রির প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তাদের অনেকেই লিখেছেন প্রবন্ধ, নিবন্ধ কলাম ও স্মৃতিকথা। অনেকে বইও প্রকাশ করেছেন।
তাঁর জীবনের অন্তিম দিনগুলো কেটেছে নিউইয়র্ক শহরের বেলভ্যু হাসপাতালে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত এক বিছানায় নিথর নিস্তব্ধতায়। যন্ত্রপাতির কঠিন আবরণে ঢাকা পড়ে থাকে লেখকের যন্ত্রণাকাতর দেহটি। কখনো। ঘোরে, কখনো বা বেঘোরে।
গত দুদশক ধরে নিউইয়র্কে মুক্তধারা আয়োজিত বইমেলা বরেণ্য ও জনপ্রিয় এই লেখকের পদচারণায় মুখর হয়েছে। তার সাথে গড়ে উঠেছে এক নিগূঢ় সম্পর্ক। একইসাথে তিনি নিউইয়র্ক প্রবাসী হাজার বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় তৈরি করে নিয়েছেন এক স্থায়ী আসন।
দেশ-বিদেশের কোটি বাঙালির মনে এখনও তাঁর শেষ দিনগুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন। কী এমন ঘটেছিলো, কেন ঘটেছিলো- কী কারণ ছিলো এর পেছনে? এমন নানা প্রশ্নে বিদ্ধ বাঙালি পাঠক-হৃদয়। তারা চেষ্টা করেছেন উত্তর খুঁজে বের করার। নির্ভর করতে হয়েছে সংবাদপত্র এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের খবরাখবরের ওপর। অনেকে আস্থায় নিয়েছেন চিকিৎসাকালীন প্রবাসে বসবাসকারী তাঁর কাছের মানুষদের লেখালেখির তথ্য-উপাত্ত।
সিঙ্গাপুরের এলিজাবেথ সেন্টারে লেখকের কোলন ক্যান্সার নিশ্চিত করার পরপরই তিনি সপরিবারে ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চলে আসেন নিউইয়র্কে। সেই থেকে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ১টা ২৩ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত, এই সুদীর্ঘ ১০ মাস নিউইয়র্কে চলে তাঁর কোলন ক্যান্সার চিকিৎসা। চিকিৎসার এই লম্বা পথ পরিক্রমায় লেখকের চিকিৎসা পদ্ধতি, চিকিৎসক, হাসপাতাল, ওষুধপত্রসহ আনুসঙ্গিক বহু বিষয় নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন এবং এ সংক্রান্ত সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত ও দলিলপত্র প্রকাশের তাগিদ অনুভব করছিলাম বেশ কিছুদিন থেকে। সেই তাগিদ থেকেই আমার এ লেখার প্রয়াস। বইটিকে বিভিন্ন পরিচ্ছেদে ভাগ করে ১০ মাসের চিকিৎসা ও শেষ দিনগুলোর ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের এই জনপ্রিয় লেখক নিউইয়র্ক এসে জেএফকে বিমানবন্দর (JFK Airport) থেকে সোজা ওঠেন নিউইয়র্কের কুইন্সের এস্টোরিয়ায় সাউন্ড ভিউ ব্রডকাস্টিং-এর (এনটিভি ভবন) গেস্ট হাউসে। সেখান থেকে তার গন্তব্য জ্যামাইকা ও পরবর্তীতে ওজোনপার্ক। দুজায়গাতেই তিনি প্রাইভেট হাউসে অবস্থান করে। প্রথমদিকে বাড়ি থেকেই চলে তার ক্যান্সার চিকিৎসা। ম্যানহাটানের (Manhattan) বিশ্বখ্যাত মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং সেন্টার (Memorial Sloan-Kettering Cancer Center, MSKCC) 9789910TC OTO চিকিৎসা শুরু হয়। সেখান থেকেই তিনি ৫টি কেমোথেরাপি নেন। কেমোথেরাপি শরীরে প্রবেশ করানোর জন্য মেডিপোর্টসহ তারা লেখককে বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। এর দুদিন পর ওষুধ শেষ হলে আবার হাসপাতালে গিয়ে ক্যানিস্টার বিচ্ছিন্ন করতে হয়।
কিন্তু এই চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় এবং তাঁর পক্ষে তা দীর্ঘদিন একপর্যায়ে চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। একই পদ্ধতির চিকিৎসা, সুযোগ সুবিধা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক বেশি হওয়ায় হুমায়ূন আহমেদকে ম্যানহাটানের বেলভ্যু হাসপাতালে (Bellevu Hospital, Manhattan) স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে তাকে আরো ৭টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়।
প্রচণ্ড মানসিক শক্তির অধিকারী হুমায়ূন আহমেদকে ক্যান্সার পরাস্ত করতে পারেনি। প্রচণ্ড ঠাট্টা তামাশার মাঝে তার অসুস্থতা, কেমোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নিউইয়র্কের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে টুপি খুলে চুল পড়ে যাওয়া দেখানো, শরীরের চামড়া পড়ে যাওয়ায় ‘সর্পরাজ’ বলে রসিকতাসহ নিজের মৃত্যুর আগে দাওয়াত করে কুলখানি খাওয়ানোর মতো বিভিন্ন রসিকতা করেছেন অবলীলায়। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও লেখালেখিতে তার ভাটা পড়েনি। অবিরাম লিখে গেছেন ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ কলামে। কেমোথেরাপির ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই যেতেন হাডসন রিভারে (Hudson River) এবং বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বেশ কয়েকবার আটলান্টিক সিটি, মেরিল্যান্ড, ডেনভারের রকি মাউন্টেনে। চিকিৎসার ফাঁকে ফাঁকে এমনকি বাড়িতে কেমো নেওয়ার সময়ে পরম আনন্দে এঁকে গেছেন চিত্রকর্ম। বাংলার নৈসর্গিক দৃশ্যের প্রতিফলন ছিলো তাঁর আঁকা ছবিতে। ২০১২ সালে উত্তর আমেরিকা বইমেলায় তাঁর ২০টি ছবির প্রদর্শনী হয়। কথা ছিলো তার এবং মেহের আফরোজ শাওনের বইমেলায় ‘হাজার বছরের বাংলা গান’ নামের একটি অনুষ্ঠান করার। বইমেলা কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া সম্মাননা নেওয়ারও কথা ছিলো হুমায়ূন আহমদের। কিন্তু মৃত্যুর সাথে লড়তে গিয়ে তাঁর বইমেলায় আসা হয়নি।
চিকিৎসকদের বিশেষ অনুমতি নিয়ে ৩ সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়েছিলেন। বাংলার জল, মাটি, প্রকৃতি সর্বোপরি তাঁর বানানো নন্দনকানন নুহাশ পল্লীতে শ্বাস নেওয়ার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন প্রাণপ্রিয় মাকে দেখার জন্য।
বেঁচে থাকার বুকভরা আশা নিয়ে ছুটে এসেছিলেন নিউইয়র্কে। ভর্তি হয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত মেমোরিয়াল স্লোয়েন-কেটারিং সেন্টারে সুচিৎসা লাভে। হাসপাতাল পরিবর্তন হওয়ার পরও সবকিছুই ঠিকমতো চলছিলো। ১২ জুন বেলভ্যু হাসপাতালে হলো সফল অস্ত্রোপচার। ৭ দিন পর সুস্থ হয়ে ১৯ জুন বাড়ি ফিরলেন। জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দে মেতে উঠলেন উৎসবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, পরদিন চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো। অস্ত্রোপচারের সেলাই খুলে প্রচণ্ড ব্যথায় তিনি যন্ত্রনাকাতর। যেতে হলো ইমার্জেন্সিতে। সেই যাওয়াই হলো তাঁর জীবনের শেষ যাওয়া।
হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণের পর তাঁকে নিয়ে যে সব নাটকীয় ঘটনার অবতারণা ঘটানো হয়েছে, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদও সম্ভবত তার কাছে পরাজিত। কিন্তু ইতিহাসের প্রয়োজনে আজ অপ্রিয় হলেও কিছু সত্য কথা বলার জন্যই লিখতে হলো ‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলো। হয়তো অনেকেই অপ্রিয় বিষয়গুলোকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেকে হয়তো বাহবা দেবেন। কিন্তু আমি জানি, তাঁর কথা লিখে নিন্দা বা প্রশংসা কুড়ানোর। কোনো যোগ্যতা আমার নেই। চিরদিন আমি তাঁর গুণমুগ্ধ হয়েই থাকতে চাই। এই গ্রন্থটি লেখায় যাদের সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছি তাদের কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য প্রকাশককে বিশেষ। ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বিশ্বজিত সাহা
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
দিনপঞ্জী
Leave a Reply