হুতোমপ্যাঁচার নক্সা – কালীপ্রসন্ন সিংহ
ভূমিকা উপলক্ষে একটা কথা
আজকাল বাঙ্গালী ভাষা আমাদের মত মূৰ্ত্তিমান কবিদলের অনেকেরই উপজীব্য হয়েছে। বেওয়ারিশ লুচীর ময়দা বা তইরি কাদা পেলে যেমন নিষ্কৰ্ম্মা ছেলেমাত্রেই একটা না একটা পুতুল তইরি করে খ্যালা করে, তেমনি বেওয়ারিস বাঙ্গালী ভাষাতে অনেকে যা মনে যায় কচ্চেন; যদি এর কেউ ওয়ারিসান থাকৃত, তা হলে স্কুলবয় ও অসিদের মত গাধাদের দ্বারা নাস্তানাবুদ হতে পেতে না-তা হলে হয়ত এত দিন কত গ্রন্থকার ফাঁসী যেতেন, কেউ বা কয়েদ থাকতেন, সুতরাং এই নজিরেই আমাদের বাঙ্গালী ভাষা দখল করা হয়। কিন্তু এমন নতুন জিনিস নাই যে, আমরা তাতেই লাগি—সকলেই সকল রকম নিয়ে জুড়ে বসেছেন বেশীর ভাগ অ্যাকচেটে, কাজে কাজেই এই নক্সাই অবলম্বন হয়ে পড়লো। কথায় বলে, এক জন বড়মানুষ, তারে প্রত্যহ নতুন নতুন মঙ্করামে দ্যাখাবার জন্য, এক জন ভড় চাকর রেখেছিলেন; সে প্রত্যহ নতুন নতুন ভাঁড়ামো করে বড়মানুষ মহাশয়ের মনোরঞ্জন কত্তো, কিছু দিন যায়, অ্যাকদিন আর সে নতুন ভাঁড়ামো খুঁজে পায় না; শেষে ঠাউরে ঠাউরে এক ঝাঁকা-মুটে ভাড়া করে বড়মানুষ বাবুর কাছে উপস্থিত। বড়মানুষ বাবু তার ভাঁড়কে ঝাঁকা-মুটের ওপর বসে আসতে দ্যাখে কুলন,—“ভাড়, এ কি হে?” ভাঁড় বলে, “ধৰ্মাবতার। আজকের এই এক নতুন!” আমরাও এই নক্সাটি পাঠকদের উপহার দিয়ে ‘এই এক নতুন’ বলে দাঁড়ালেম-এখন আপনাদের স্বেচ্ছামত তিরস্কার বা পুরস্কার করুন।
কি অভিপ্রায়ে এই নক্সা প্রচারিত হলো, নক্সাখানির দু পাত দেখলেই সহৃদয়মাত্রেই তা অনুভব কতে সমর্থ হবেন; কারণ, আমি এই নক্সায় একটি কথাও অলীক বা অমূলক ব্যবহার করি নাই। সত্য বটে, অনেকে নক্সাখানিতে আপনারে আপনি দেখতে পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু বাস্তবিক সেটি যে তিনি নন, তা আমার বলা বাহুল্য। তবে কেবল এই মাত্র বলিতে পারি যে, আমি কারেও লক্ষ্য করি না, অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিচি। এখন কি, স্বয়ংও নক্সার মধ্যে থাকতে ভুলি নাই।।
নক্সাখানিকে আমি একদিন আরসি বলে পেস কল্পেও কত্তে পাত্তেম; কারণ পূর্ব্বে জানা ছিল যে, দর্পণে আপনার মুল কদর্য দেখে কোন বুদ্ধিমানই আরসিখানি ভেঙ্গে ফ্যালেন না, বরং যাতে কমে ভালো দেখায়, তারই তদ্বির করে থাকেন। কিন্তু নীলদর্পণের হাঙ্গামা দেখে শুনে—ভয়ানক জানোয়ারদের মুখের কাছে ভরসা বেঁধে আরসি ধত্তে সাহস হয় না; সুতরাং বুড়ো বয়সে সং সেজে রং কত্তে হলো—পূজনীয় পাঠকগণ বেয়াদবী মাপ করবেন।
আশমান।
১৭৮৪ শকাব্দ।
দ্বিতীয়বারের গৌরচন্দ্রিকা
পাঠক। হুতোমের নক্সার প্রথম ভাগ দ্বিতীয়বার মুদ্রিত ও প্রচারিত হলো। যে সময়ে এই বইখানি বাহির হয়, সে সময়ে লেখক একবার স্বপ্নেও প্রত্যাশা করেন নাই যে, এখানি বাঙ্গালী সমাজে সমাদৃত হবে ও দেশের প্রায় সমস্ত লোকে (কেউ লুকিয়ে কেউ প্রকাশ্যে) পড়বেন। যারা সহৃদয়, যারা সৰ্ব্বসময় দেশের প্রিয় কামনা করে থাকেন ও হতভাগ্য বাঙ্গালী-সমাজের উন্নতির নিমিত্ত কায়মনে কামনা করেন, তাহারা হুতোমের নক্সা আদর করে পড়েন, সৰ্ব্বদাই অবকাশ-রঞ্জন করেন। যেগুলো হতভাগা, হুতোমের লক্ষ্য, লক্ষ্মীর বরযাত্র, পাজীর টেক্কা ও বজ্জাতের বাদসা, তারা “দেখি হুতোম আমায় গাল দিয়েছে কি না?” কিংবা “কি গাল দিয়েছে বলেও অন্ততঃ লুকিয়ে পড়েছে; সুদু পড়া কি—অনেকে শুধরেচেন, সমাজের উন্নতি হয়েছে ও প্রকাশ্য বেলেল্লাগিরি, বদমাইসী, বজাতীর অনেক লাঘব হয়েছে। এ কথা বলতে আমাদের আপনা আপনি বড়াই করা হয় বটে, কিন্তু এটি সাধারণের ঘরকন্নার কথা।
পাঠক! কতকগুলি আনাড়ীতে রটান, “হুতোমের নক্সা অতি কদর্য বই; কেবল পরনিন্দা, পরচর্চ্চা, খেউড় ও পচালে পোরা! শুদ্ধ গায়ের জ্বালানিবরিণার্থে কতিপয় ভদ্রলোককে গাল দেওয়া হয়েছে।” এটি বাস্তবিক ঐ মহাপুরুষদের ভ্রম, একবার কেন, শতেক বার মুক্তকণ্ঠে বলবো–ভ্ৰম। হুতোমের তা উদ্দেশ্য নয়, তা অভিসন্ধি নয়, হুতোম ততদূর নীচে নন যে, দাদ তোলার কি গাল দেবার জন্য কলম ধরেন। জাদীশ্বরের প্রসাদে যে কলমে হুতোমের নক্সা প্রসব করেছে, সেই কলমই ভারতবষের নীতিপ্রধান ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের প্রধান উৎকৃষ্ট ইতিহাসের ও বিচিত্র বিচিত্র চিত্তাকর্ষ বিধায়ক, মুমুক্ষু, সংসারী, বিরাগী ও রাজার অনন্য অবলম্বনস্বরূপ গ্রন্থের অনুবাদক; সুতরাং এটা আপনি বিলক্ষণ জানবেন যে, অজাগর ক্ষুধিত হলে আরসুলা খায় না, ও গায়ে পিপড়ে কামড়ালে ডঙ্ক ধরে না। ভুতোমে বর্ণিত বদমাইস ও বাজে দলের সঙ্গে গ্রন্থকারেরও সেই সম্পর্ক।
তবে বলতে পারেন, কেনই বা কলকেতার কতিপয় বাবু হুতোমের লক্ষ্যান্তর্ব্বৰ্ত্তী হলেন; কি দোষে বাগাস্বরবাবুকে, প্যালানাথকে, পদ্মলোচনুকে মজলিসে আনা হলো; কেনই বা ছুঁচো শীল, প্যাঁচা মল্লিকের নাম কল্লে, কোন দোষে অঞ্জনারঞ্জন বাহাদুর ও * * * হুজুর আলী, আর পাঁচটা রাজা-রাজড়া থাকতে আসোরে এলেন? তার উত্তর এই যে, হুতোমের নক্সা বঙ্গসাহিত্যের নূতন গহনা ও সমাজের পক্ষে নূতন হেঁয়ালি। যদি ভাল করে চকে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া না হতো, তা হলে সাধারণে এর মর্ম্ম বহন কত্তে পাত্তেম না ও হুতোমের উদ্দেশ্য বিফল হতো। এমন কি, এত ঘরঘাসা হয়ে এসেও অনেকে আপনারে বা আপনার চিরপরিচিত বন্ধুরে নক্সায় চিনতে পারেন না; ও কি জন্য কোন্ গুণে তাঁদের মজলিসে আনা হলো, পাঠ করবার সময় তাদের সেই গুণ ও দোষগুলি বেমালুম বিস্তৃত হয়ে যান।
* * * মহারাজের মোক্তার মহারাজের জন্যে, মেছোবাজার হতে উৎকৃষ্ট জরীর লপেটা জুতো পাঠান। মহারাজ চিরকাল উড়ে জুতো পায়ে দিয়ে এসেছেন, লপেটা পেয়ে মনে কল্লেন, সেটি পাগড়ীর কলকা; জন্মতিথি দিন মহাসমারোহ করে ঐ লপেটা পাগড়ীর উপর বেঁধে মজলিসে বার দিলেন। সুতরাং পাছে স্বকপোলকল্পিত নায়ক হুতোমের পাঠকের নিতান্ত অপরিচিত হন, এই ভয়ে সমাজের আত্মীয়-অন্তরঙ্গ নিয়ে ও স্বয়ং সং সেজে মজলিসে হাজির হওয়া হয়। বিশেষতঃ “বিদেশে চণ্ডীর কৃপা দেশে কেন নাই!” বাঙ্গালীসমাজে, বিশেষতঃ সহরে যেমন কতকগুলি পাওয়া যায়, কল্পনার অনিয়ত সেবা করে সরস্বতীরও শক্তি নাই যে, তাদের হাতে উৎকৃষ্ট জীবের বর্ণনা করেন।
হুতোমের নক্সার অনুকরণ করে বটতলার ছাপাখানাওয়ালারা প্রায় দুই শত রকমারী চটী বই ছাপান। কেহ বা “হুতোমের উতোর” বলে আপনার মুখ আপনি দেখেন ও দেখান। হনুমান লঙ্কা দগ্ধ করে সাগরবারিতে আপনার মুখ আপনি দেখে জ্ঞাতিমাত্রেরই যাতে এরূপ হয়, তার প্রার্থনা করেছিলেন; উল্লিখিত গ্রন্থকারও সেই দশা ও দরের লোক। কিন্তু কতদূর সফল হলেন, তার ভার পাঠক! তোমার বিবেচনার উপর নির্ভর করে। তবে এটা বলা উচিত যে, পত্র দ্বারা ভিক্ষা করে পরপরীবাদ ও পরনিন্দা প্রকাশ করা ভদ্রলোকের কর্ত্তব্য নয়।
ফলে, “আপনার মুখ আপনি দেখ” গ্রন্থকার হুতোমের বমন অপহরণ করে বামনের চন্দ্রগ্রহণের ন্যায় হুতোমের নক্সার উত্তর দিতে উদ্যত হন ও বই ছাপিয়ে ঐ বই হুতোমের উতোর ব’লে, কতকগুলি ভদ্রলোকের চক্ষে ধূলি দিয়ে বেচেন কিন্তু দুঃখের বিষয় বহুদিন ঐ ব্যবসা চল্লো না; সাতপেয়ে গরু দরিয়াই ঘোড়া ও হোসেন খাঁর জিনির মত ধরা পল্লো, সহৃদয় সমাজ জানতে পাল্লেন যে, গ্রন্থকারের অভিসন্ধি কি? এমন কি, ঐ গ্রন্থকার খোদ হুতোমকেই, তারে সাহায্য কত্তে ও কিঞ্চিৎ ভিক্ষা দিতে প্রার্থনা করেন। সে পত্র এই–
জগদীশ্বরায় নমঃ
মহাশয়! “আপনার মুখ আপনি দেখ” পুস্তকের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত করিয়া, পাঠকসমাজে যে তাহা গ্রহণীয় এবং আদরণীয় হইবে, পূর্ব্বে এত ভরসা করি নাই। এক্ষণে জগদীশ্বরের কৃপায় অনেকানেক পাঠক মহাশয়েরা উক্ত পুস্তকখানি পাঠ করিয়া, “দেশীচার-সংশোধন-পক্ষে পুস্তকখানি উত্তম হইয়াছে” এমত বলিয়াছেন; তাহালেই শ্রম সফল এবং পরম ক্ষাভ বিবেচনা করা হইয়াছে।
প্রথম খণ্ডে “দ্বিতীয় খণ্ড আপনার মুখ আপনি দেখ” প্রকাশিত হইবেক, এমত লিখিত হওয়ায়, অনেকেই তদ্দর্শনে অভিলষিত হইয়াছে, তাহারা পাঠক এবং সাম্প্রদায়িক এই মাত্র। উপস্থিত সহকাৰ্য, পরিশ্রম, অর্থব্যয় এই দেশহিতৈষী পরহিতপরায়ণ মহাশয়-মহোদয়দিগের উৎসাহ এবং সাহায্যপ্রদান ব্যতীত কোন মতে সম্পাদিত হইতে পারে না। আপনার নিঃস্বভাব, ধনব্যয় করিবার ক্ষমতা নাই। এ কারণ, এই মহংকাৰ্য্য মহল্লোকের কৃপাবর্ত্মে না দণ্ডায়মান হইলে, কোন ক্রমেই এ বিষয় সমধি হইবেক না। আর সাধারণ লোকের আশ্রয় গ্রহণ না করিলে এ বিষয় সমাধান হইবার নহে। ধনী, ধীর, স্বদেশীয় ভাষার শবৃদ্ধিকারক এবং দেশের হিতেচ্ছুকই এই মহৎকার্যে উৎসাহদাতা; এ বিধায় মহাশয় ব্যতীত এ বিষয়ের সাহায্যদাতা আর কেহই হইতে পারেন না। আপনার দাতৃত্বতা, পরোপকারিতা ও কৃতজ্ঞতা প্রভৃতির সুযশ-সৌরভ গৌরবে ধরণী সৌরভিলী হইয়াছে; ভারত আপনার যশোরূপ যশ ধারণ করিয়াছে। দেশাচার সংশোধন-পক্ষে মহাশয় বাঙ্গালা ভাষার প্রথম গ্রন্থকৰ্ত্তা, বর্তমানে মহাশয়ের মতানুসারে সকলেরই গ্রস্থ লেখা কর্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া আপনার কৃপাবত্মে দণ্ডায়মান হইয়া নিবেদন করিলাম। মহাশয় কিঞ্চিৎ কৃপানেত্রে চাহিয়া সাহায্য প্রদান করিলে সত্ত্বরেই “দ্বিতীয় খণ্ড “আপনার মুখ আপনি দেখ” পুস্তক প্রকাশ করিতে পারি, নিবেদন ইতি, ১২৭৪ সাল, তারিখ ২৩এ জৈষ্ঠ—
দ্বিতীয়বারের গৌরচন্দ্রিকা
পুঃ–লিপিখানিতে ডাক ষ্ট্যাম্প প্রদান করা বিধেয় বিবেচনা করিলাম না। না দেওয়ায় অপরাধ মার্জনা করিবেন। দ্বিতীয়ত, অনুজ্ঞার আশাপথ নিরীক্ষণ করিয়া রহিলাম।
কৃপাবলোকনে, যেরূপ অনুজ্ঞ হইবেক, লিখিয়া বাধিত করিবেন—“কায়ারূপ কারাবাসে, কালে কালে আয়ু নাশে, ভোলা মন ভাবে না ভুলিয়ে। বলি তারে সুবচনে, চলিতে সুজন সনে হেলা করে খেলায় মাতিয়ে॥ সদা প্রমদেতে মত্ত, ত্যজিয়া প্রসঙ্গতত্ত্ব, নিত্য নাচে কুসঙ্গের সনে। তত্ত্ব রস পরিহরি, বৃথা রস পান করি, মনমথ অনুক্ষণ মনে॥ ভারতে তন্নতা করি, অভেদ ভিন্নতা হরি, দেখাইছে মুক্তির সোপান। মন যদি বসি তায়, ত্যজে পাপ-মসি হায়, মুনি মুনি-মুখো গুণ গান।। ভারত বেদের অংশ শ্রবণে কলুষ ধ্বংস, ভারতে ফুরিত পাপ হরে। হরিগুণ সদা কহ, ভারত লইয়া রহ, ভগবত কর আখ্যা নরে।।
হুতোমের চিরপরিচিত রীত্যনুসারে এই ভিক্ষুকের পত্রখানি অপ্রচারিত রাখা কর্ত্তব্য ছিল। কিন্তু কতকগুলি স্কুলবয় ও আনাড়ীতে বাস্তবিকই স্থির করে রেখেছেন যে, “আপনার মুখ আপনি দেখ” ইনি হুতোমের প্রকৃত উত্তর ও বটতলার পাইকারেরাও ঐ কথা বলে হুতোমের নক্সার সঙ্গে ঐ বিচিত্র বইখানি বিক্রী করেন বলেই, ঐ হতভাগ্য ভিক্ষুকের পত্রখানি অবিকল ছাপান গেল- এখন পাঠক! তুমিই ঐ পত্রখানি পাঠ করে জানতে পারবে, হুতোমের নক্সার সঙ্গে “আপনার মুখ আপনি দেখ” প্রকারের কিরূপ সম্পর্ক।
শ্রীতালা হূল ব্ল্যাক ইয়ার ইয়ার,
প্রকাশক
শত্রুঘ্নপুর
১লা এপ্রিল
Leave a Reply