হিন্দুআইন (দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা) – বিভূতিভূষণ মিত্র
ভূমিকা
হিন্দুআইন (দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা)
ফৌজদারী কাৰ্য্যবিধি আইন, দণ্ডবিধি আইন, আইন ও আদালত, ইউনিয়ন বোর্ড আইন, সাক্ষ্যবিষয়ক আইন, মুসলমান আইন প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা
শ্রীবিভূতিভূষণ মিত্র, বি, এল
দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৩৫
প্রকাশক-শ্রীইন্দুভূষণ মিত্র
২৯ নং হুজুরীমল লেন,
কলিকাতা
নিবেদন
হিন্দু আইন সম্বন্ধে বাঙ্গালী ভাষায় একখানিও পুস্তক নাই। আমার স্বৰ্গীয় পিতৃদেব প্রণীত”সাধারণের জ্ঞাতব্য আইন” নামক পুস্তকে হিন্দু আইনের সারমর্মগুলি সংক্ষিপ্তভাবে লিখিত হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে কোনও জটিল প্রশ্নের আলোচনা নাই। এতদ্ভিন্ন, বাঙ্গালী ভাষায় আরও কতকগুলি পুস্তকে আরও সংক্ষিপ্তভাবে হিন্দু আইনের কতকগুলি তথ্য লিখিত আছে বটে, কিন্তু তাহাতে হিন্দু আইন সম্বন্ধে সাধারণের মোটামুটি একটু জ্ঞান জন্মায় মাত্র, কোন কঠিন প্রশ্নের মীমাংসা করিতে হইলে উক্ত পুস্তকগুলিতে কোনও সাহায্য পাওয়া যায় না।
ইংরেজী ভাষায় হিন্দু আইন সম্বন্ধে অনেকগুলি পুস্তক রচিত হইয়াছে বটে, কিন্তু সেগুলি এত দুর্ম্মূল্য যে সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে তাহা ক্রয় করা অসম্ভব, তাহার উপর আইনের নানা জটিল কথা থাকায় এবং সাধারণের দুৰ্ব্বোধ্য কূটভাষা ব্যবহৃত হওয়ায় একমাত্র আইনজ্ঞ ব্যক্তিগণ ব্যতীত অন্য কেহ তাহা বুঝিতে সক্ষম হইবেন না। যাহারা ইংরাজী ভাষা জানেন না তাহাদের পক্ষে সে পুস্তকগুলি কোনও কাজেই আসিবে না। সুতরাং হিন্দু আইন সম্বন্ধে সাধারণ গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে ব্যবহার্য্য বিশদভাবে লিখিত কোনও পুস্তক বাঙ্গালা ভাষায় এপর্যন্ত ছিল না।
এই অভাব দূর করিবার জন্য আমি বর্তমান পুস্তকখানি প্রণয়ন করিতে সাহসী হইয়াছি। আইনের কুটভাষা যতদূর সম্ভব পরিত্যাগ করিয়া এবং অতিরিক্ত, ও অনাবশ্বক জটিল প্রশ্নের আলোচনা যথাসম্ভব বাদ দিয়া পুস্তকখানিকে সাধারণ গৃহস্থের বোধগম্য করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছি। যেখানেই কোনও জটিল প্রশ্নের আলোচনা করিতে এবং তজ্জন্য আইনের সামান্য সামান্য কুটভাষা ব্যবহার করিতে হইয়াছে, সেইখানে উদাহরন দ্বারা তাহা বুঝাইয়া দিয়াছি। যেস্থলে প্রাচীন হিন্দু আইনের বিধানগুলি এখনও অবিকলভাবে প্রচলিত আছে, সে স্থলে স্মৃতিশাস্ত্র ও টীকাকারগণের গ্রন্থ হইতে সংস্কৃত সূত্রগুলি উদ্ভূত করিয়া দেখাইয়াছি, এবং প্রাচীন শাস্ত্রের নিয়মগুলি বর্তমানে নজীর দ্বারা স্থানে স্থানে কিরূপ পরিবর্তিত হইয়াছে তাহাও নির্দেশ করিয়া দিয়াছি।
এই পুস্তকে কলিকাতা হাইকোর্টের ও প্রিভিকৌন্সিলের সমস্ত প্রয়োজনীয় নজীরগুলি দিয়াছি, এবং ষে স্থলে অন্যান্য প্রদেশের আইনের। সহিত বঙ্গদেশের আইনের কোনও পার্থক্য নাই সেস্থলে অন্যান্য হাইকোর্টের নজীরগুলিও উদ্ধত করিয়াছি।
আশা করি, আমার অন্যান্য পুস্তকগুলির ন্যায় এই পুস্তকখানিও সাধারণের উপকারজনক ও আদরণীয় হইবে।
শ্রীবিভূতিভূষণ মিত্র
ভাদ্র, ১৩৩২
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে মিতাক্ষরা সম্বন্ধে কোন কথাই আমি লিপিবদ্ধ করি নাই, তাহার কারণ বঙ্গবাসীদিগের মধ্যে মিতাক্ষরাশাসিত খুব কম লোকই আছেন। কিন্তু তাহারা সংখ্যায় কম হইলেও তাহাদের আইনটী একেবারে বাদ দেওয়া উচিত নহে, এই বিবেচনায় এবং বহু স্থান হইতে মিতাক্ষরা আইনটা লিখিবার জন্য অনুরোধপত্র পাওয়ায় এই সংস্করণে মিতাক্ষরার বিধানগুলি পরিশিষ্টে সংযোজিত করিলাম।
শ্রীবিভূতিভূষণ মিত্র
২২শে আশ্বিন, ১৩৩৫
উপক্রমণিকা – হিন্দু আইনের উৎপত্তি ও উপকরণ
হিন্দু আইনের মূল ভিত্তি সম্বন্ধে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। হিন্দু মনীষীগণের মতে স্বয়ং ভগবানই হিন্দু আইনের সৃষ্টিকৰ্ত্ত; ভগবানের মুখ হইতে যে আদেশ বাক্য নিঃস্থত হইয়াছিল, ব্ৰহ্মা তাহা শ্রবণ করিয়াছিলেন শ্রীতি], এবং তিনি শ্রবণ করিয়া উচ্চা তাহার পৌত্র মনুকে বলিয়াছিলেন; মন্ত্র ঐ সকল বাক্য স্মরণ করিয়া রাখিয়া স্থিতি পরিশেষে তাহার মরীচি প্রভৃতি পুত্ৰগণের নিকট বিবৃত করিয়াছিলেন। ঐ শ্রুতি ও স্মৃতি হইতেই হিন্দু আইনের উৎপত্তি হইয়াছে, ইহাই প্রাচ্য পণ্ডিতগণের মত। কিন্তু পাশ্চাত্য আইনবিশারদগণ বলিয়া থাকেন যে, আর্য্যগণ ভারতবযে আসিবারও পূৰ্ব্বে এদেশে যে সমস্ত প্রথা বৰ্ত্তমান ছিল, তাহাই হিন্দু আইনের মূল ভিত্তি। মাৰ্য্যগণ এদেশে আসিয়া অনাৰ্য্যগণের সেই সমস্ত প্রথাগুলির মধ্যে কতকগুলি গ্রহণ করিলেন, কতকগুলি নীতিবিরুদ্ধ বা রুচিবিগর্হিত বলিয়া পরিত্যাগ করিলেন; এইরূপে আর্য ও অনাৰ্য্যগণের প্রথাগুলি সংমিশ্রিত হইয়া গেল। পরে আর্য্যগণ সেই সমস্ত প্রথা লিপিবদ্ধ করিলেন, উহাই তাহাদের ধৰ্ম্মশাস্ত্রে পরিণত হইল। ইহাই পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মত।
হিন্দু আইনের মূল ভিত্তি সম্বন্ধে যতই মতভেদ থাকুক না কেন, উহার উপকরণ সম্বন্ধে কোন মতভেদ নাই। নিম্নলিখিত বিষয়গুলি হইতে হিন্দু আইনের উপকরণ গৃহীত হইয়াছে –
(১) শ্রুতি; অর্থাৎ চারি বেদ, ছয় বেদাঙ্গ এবং অষ্টাদশ উপনিষদ। যদিও শ্রুতি হিন্দু আইনের একটী উপকরণ বলিয়া কথিত আছে, তথাপি আমরা আইন বলিতে যাহা বুঝি, তাহা শ্ৰুতিতে নাই বলিলেই হয়, এবং আইনঘটিত কোনও বিষয়ের মীমাংসায় কখনও বেদ-বেদাঙ্গ প্রভৃতির আলোচনা করিবার প্রয়োজন হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না।
(২) স্মৃতি; অর্থাৎ, মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ, বৃহস্পতি, দেবল, কাত্যায়ণ, ব্যাস প্রভৃতি ঋষিগণ প্রণীত স্মৃতিশাস্ত্রসমূহ; এবং গৌতম, বৌধায়ণ, বশিষ্ঠ, পরাশর প্রভৃতি ঋষি প্রণীত ধৰ্ম্মসূত্রসমূহ। এইগুলি হিন্দু আইনের প্রধান উপকরণ বটে।
স্মৃতি সম্বন্ধে জৈমিনী লিখিয়াছেন—যদি স্মৃতির কোন বিধানের সহিত শ্রুতির বিরোধ দৃষ্ট হয়, তবে সে স্থলে স্মৃতির বিধান অগ্রাহ্য হইবে। আরও, যদি এরূপ বুঝিতে পারা যায় যে পুরোহিতগণ তাঁহাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোন বিধান প্রণয়ন করিয়া গিয়াছেন, তবে সে স্থলেও স্মৃতির সেই বিধান গ্রাহ্য করা হইবে না। (পূৰ্ব্বমীমাংসা, ১। ৩। ৩৪)
(৩) পুরাণ। এইগুলিতে দেবদেবীগণের উপাখ্যান, সৃষ্টিতত্ত্ব, দেবাসুরের যুদ্ধ, দশাবতারের বিবরণ প্রভৃতি লিপিবদ্ধ হইয়াছে। আইনের উপকরণ হিসাবে পুরাণের মূল্য অতি সামান্য।
(৪) নিবন্ধ বা উপরোক্ত স্মৃতিশাস্ত্র ও, ধৰ্ম্মসূত্র সমুহের টীকা। যদিও এইগুলি স্মৃতিশাস্ত্রসমূহের টীকা বা ব্যাখ্যারূপে লিখিত হইয়াছে, তথাপি নিবন্ধকারগণ স্থানে স্থানে মূল স্মৃতিশাস্ত্রের অনেক পরিবর্তন করিয়া দিয়াছেন। স্থানে স্থানে অনেক নুতন কথাও সংযোগ করিয়াছেন। স্মৃতিসমূহ যে সময়ে লিখিত হইয়াছিল, তাহার বহু শতাব্দী পরে নিবন্ধকারগণ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, এই সময়ের মধ্যে প্রাচীন রীতিনীতির অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছিল। বোধ হয়, সেই কারণে নিবন্ধকারগণ তাহাদের সমসাময়িক সামাজিক রীতিনীতির প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া উক্ত সমাজের মতানুযায়ী করিবার নিমিত্তই প্রাচীন শাস্ত্রসমূহের ঐরূপ পরিবর্তন এবং স্থানে স্থানে নূতন বিষয় সংযোজনা করিয়াছেন। এই নিবন্ধগুলিই হিন্দু আইনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপকরণ এবং আইন হিসাবে স্মৃতিসমূহ অপেক্ষাও ঐগুলি অধিক মূল্যবান। যদি কোনও বিষয়ে স্মৃতি এবং নিবন্ধের মধ্যে মতভেদ লক্ষিত হয়, তাহা হইলে নিবন্ধের মতই গৃহীত হইবে।
নিবন্ধ বহুসংখ্যক আছে, তন্মধ্যে কতকগুলির নাম উল্লেখযোগ্য, যথা—জীমূতবাহন প্রণীত”দায়ভাগ”; বিজ্ঞানেশ্বর প্রণীত”মিতাক্ষর”; রঘুনন্দন প্রণীত”দায়তত্ব”; শ্ৰীকৃষ্ণ প্রণীত”দায়ক্রম-সংগ্রহ”; বাচস্পতি মিশ্র প্রণীত”বিবাদ-চিন্তামণি”; দেবানন্দ ভট্ট প্রণীত”স্মৃতি-চন্দ্রিকা”; চণ্ডেশ্বর প্রণীত”বিবাদ-রত্নাকর”; মিত্রমিশ্র প্রণীত”বীরমিত্রোদয়” প্রভৃতি। এই সমস্ত গ্রন্থগুলি সকল দেশ সমানভাবে প্রচলিত নহে; কোনটী বঙ্গদেশে প্রচলিত, কোনটী বা মিথিলায় প্রচলিত, এইরূপ। বঙ্গদেশে দায়ভাগ, দায়তত্ত্ব, দায়ক্রমসংগ্রহ এবং বীরমিত্রোদয় এই চারিট গ্রন্থ প্রচলিত; তন্মধ্যে দায়ভাগই সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ। যদি কোনও বিষয়ে এই চারিটী গ্রন্থের মধ্যে মতভেদ দৃষ্ট হয়, তাহা হইলে দায়ভাগের মতই গৃহীত হইবে। একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমে, অর্থাৎ আট শত বৎসর পূৰ্ব্বে জীমূতবাহন কর্তৃক দায়ভাগ রচিত হইয়াছিল। ইহা প্রধানতঃ মনুসংহিতার টীকা বিশেষ। রঘুনন্দন তাহার”দায়তত্ব” গ্রন্থে স্থানে স্থানে দায়ভাগের ব্যাখ্যা এবং অনুসরণ করিয়াছেন। শ্ৰীকৃষ্ণ প্রণীত”দায়ক্রমসংগ্রহ” গ্রন্থখানি দায়ভাগেরই একটী ব্যাখ্যা।
মিতাক্ষরা গ্রন্থ দায়ভাগের বহু পূৰ্ব্বে পণ্ডিত বিজ্ঞানেশ্বর কর্তৃক রচিত হইয়াছিল। ইহা যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির টীকা বিশেষ। মিতাক্ষরা গ্রন্থখানিতে হিন্দু আইনের সকল বিষয়গুলিই (উত্তরাধিকার, দত্তকগ্রহণ, বিবাহ, ভরণপোষণ) লিপিবদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু দায়ভাগ গ্রন্থখানি বঙ্গদেশে উত্তরাধিকার সম্বন্ধে বিশেষ বিধি প্রচলিত করিবার জন্য রচিত হইয়াছে। সুতরাং বঙ্গদেশে উত্তরাধিকার ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে মিতাক্ষরার বিধি গ্রাহ হইবে। যাঁহারা দায়ভাগশাসিত, তাহাদের প্রতি উত্তরাধিকার সম্বন্ধে মিতাক্ষরা অপেক্ষা দায়ভাগই প্রবল হইবে। বঙ্গদেশের কোন কোন স্থানে অনেক বাঙ্গালী বাস করেন, তাহারা মিতাক্ষরা কর্তৃক অনুশাসিত, তাহারা সম্পত্তি বিভাগ ও উত্তরাধিকার বিষয়ে দায়ভাগ অপেক্ষা মিতাক্ষরার বিধিই মানিয়া চলিবেন। (এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট মিতাক্ষরার বিধিগুলি লিপিবদ্ধ হইয়াছে)।
(৫) রাজকীয় আইল সমূহ। পূৰ্ব্বোক্ত স্মৃতি ও নিবন্ধগুলি হইতে আমরা যে আইনব্যবস্থা প্রাপ্ত হই, তাহা স্থানে স্থানে রাজকীয় আইনসমূহ কর্তৃক পরিবৰ্ত্তিত হইয়াছে। যথা, কোনও ব্যক্তি ধৰ্ম্মাস্তুর গ্রহণ করিলে সে তাহার পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হইতে পারিতনা; ইহাই স্মৃতিশাস্ত্রোক্ত প্রাচীন হিন্দু আইন ছিল; কিন্তু ১৮৫০ সালের ২১ আইনের বিধানমতে এখন আর কেহ ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণ করিলে উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত হয় না। এইরূপে যে যে স্থানে রাজকীয় আইন কর্তৃক প্রাচীন হিন্দু আইন পরিবৰ্ত্তিত হইয়াছে, তাহা এই পুস্তকের যথাস্থানে লিখিত হইয়াছে।”
(৬) নজীর। নজীরগুলি দ্বারাও প্রাচীন হিন্দু আইনের অনেক অংশ পরিবর্তিত হইয়াছে। যথা, যে বালক তাহার পিতামাতার একমাত্র পুত্র, তাহাকে দত্তকরূপে গ্রহণ করা শাস্ত্রোক্ত হিন্দু আইনে নিষিদ্ধ; কিন্তু প্রিভিকৌন্সিল কর্তৃক ঐরূপ দত্তকগ্রহণ সিদ্ধ বলিয়া প্রতিপন্ন হইল (২২ মাদ্রাজ ৩৯৮; ২১ এলাহাবাদ ৪৬০; ২৪ বোম্বাই ৩৬৭)।
(৭) প্রথা। প্রাচীন হিন্দু আইনকত্ত্বগণ হইতে আরম্ভ করিয়া বর্তমান কালে আদালতের বিচারপতিগণ পৰ্য্যন্ত সকলেই সামাজিক প্রথার খুব উচ্চ স্থান দিয়াছেন। প্রিভি কৌন্সিল একটি মোকদ্দমায় স্পষ্টই বলিয়াছেন যে যদি কোনও লিখিত আইন এবং সামাজিক প্রথা পরস্পরবিরোধী হয়, তাহা হইলে লিখিত আইন অপেক্ষা প্রথই বলবত্তর বলিয়া গণ্য হইবে (মাদুরাব কালেক্টর ব: মুথু রামলিঙ্গ, ১২ মুর্স্ ইণ্ডিয়ান আপীল্স্ ৩৯৭)। সকলেই জানেন যে রাজ-এষ্ট্রেটগুলি (যথা বৰ্দ্ধমান রাজ এষ্টেট, দ্বারবঙ্গ রাজ এষ্টেট) বিভাগ করা যায় না, এবং উহা কেবলমাত্র জ্যেষ্ঠ পুত্ৰই পাইয়া থাকেন; ইহাই প্রথার একটী প্রকৃষ্ট উদাহরণ; সাধারণ হিন্দু আইনের বিভাগ ও উত্তরাধিকার বিষয়ক কোনও বিধান এস্থলে প্রযোজ্য হইবে না, প্রথাই প্রবল থাকিবে।
তবে সকল প্রথাই যে এইরূপ প্রবল বলিয়া গণ্য হইবে তাহা নহে। যে প্রথা বহুদিন ধরিয়া (অন্ততঃ একশত বৎসর ধরিয়া) চলিয়া আসিতেছে, যাহার কোনও পরিবর্তন হয় নাই এবং যাহা সামাজিক নীতিবিরুদ্ধ নহে, এইরূপ প্রথাই আদালত কর্তৃক গৃহীত হইবে (রামলক্ষ্মী বঃ শিবানন্দ, ১৪ মুর্স্ ইণ্ডিয়ান আপীলস ৫৮৫)। যাহা অল্পদিন মাত্র হইয়াছে, ৩ মাদ্রাজ ল জার্ণল ১০০; ১৩ বেঙ্গল ল রিপোট ১৬৫), যাহা পরিবর্তনশীল, এবং যাহা ধৰ্ম্মনীতি-বিরুদ্ধ (২১ মাদ্রাজ ২২৯) এরূপ প্রথা কোনও মত্ত্বেই প্রবল বলিয়া বিবেচিত হইবে না।
এই সাতটী উপকরণের সংমিশ্রণে বর্তমান হিন্দু আইন গঠিত হইয়াছে। ইহা হইতেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, যে শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ ও নিবন্ধগুলি হইতে আমরা যে প্রাচীন বিশুদ্ধ হিন্দু আইন প্রাপ্ত হই, তাহা পরে রাজকীয় আইন ও নজীর দ্বারা বহু পরিবর্তিত হইয়া বর্তমান সময়ে এক মিশ্রিত আকার ধারণ করিয়াছে। শুধু তাহাই নহে, হিন্দু আইনের কতকগুলি বিষয় ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক একেবারেই পরিত্যক্ত হইয়াছে। দণ্ডবিধি, চুক্তি, সম্পত্তি হস্তান্তর, আদালতের কার্য্যবিধি প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রাচীন হিন্দু আইনে যে সমস্ত বিধান ছিল, তাহা ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট এদেশে হিন্দু আইন প্রচলিত করিবার সময়ে গ্রহণ করেন নাই। কেবলমাত্র বিবাহ, দত্তকগ্রহণ, উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ, এজমালী পরিবার, বিভাগ প্রভৃতি বিষয়ে হিন্দু আইনের বিধানগুলি গবৰ্ণমেণ্ট কর্তৃক এদেশের জন্য গৃহীত ও প্রচলিত হইয়াছে, এবং হিন্দু আইন বলিতে গেলে এখন আমরা ঐ বিষয়গুলিই বুঝিয়া থাকি। ঐ বিষয়গুলিই আমরা একে একে এই পুস্তকে লিপিবদ্ধ করিব।
এইস্থলে আরও একটী কথা জানিয়া রাখা আবশ্যক—কোন কোন ব্যক্তির প্রতি হিন্দু আইন প্রযোজ্য? প্রথমতঃ, যাহারা হিন্দু ধৰ্ম্মাবলম্বী তাঁহাদের প্রতি ইহা প্রয়োজ্য; যদিও তাহারা হিন্দু আচার ব্যবহার পরিত্যাগ করিয়া থাকেন, তাহা হইলেও তাহারা হিন্দু আইন কর্তৃক শাসিত হইবেন। যথা, যদি কেহ বিলাতে গিয়া সাহেবী আচার-ব্যবহার অবলম্বন করেন, তাহা হইলেও যতদিন তিনি হিন্দু ‘ধৰ্ম্ম’ পরিত্যাগ না করিবেন ততদিন তিনি হিন্দু আইনের অধীনে থাকিবেন।
দ্বিতীয়তঃ, শিখ ও জৈনগণের প্রতি হিন্দু আইন প্রযোজ্য হইবে; তবে হিন্দু আইনের যে যে বিধানের সহিত হিন্দু-ধর্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, সেই সেই বিধানগুলি শিখ ও জৈনগণের প্রতি প্রয়োজ্য হইবে না; যথা, হিন্দু আইন অনুসারে পিতৃপুরুষের পিণ্ডলোপ নিবারণ করিবার জন্য দত্তকগ্রহণের ব্যবস্থা আছে, অর্থাৎ দত্তকগ্রহণের সহিত হিন্দুধর্ম্মের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রহিয়াছে, সুতরাং দত্তকগ্রহণ সম্বন্ধে হিন্দু আইনের বিধানগুলি শিখ ও জৈনগণের প্রতি প্রয়োজ্য হইবে না!
তৃতীয়তঃ, কতিপয় শ্রেণীর লোক হিন্দু না হইলেও তাহদের প্রতি হিন্দু আইনের উত্তরাধিকারের নিয়মগুলি প্রয়োজ্য হয়; যথা, বোম্বাই দেশের খোজা এবং মেমনগণ; গুজরাটের সুন্নি বোরাগণ; রাজপুতানার গিরাসিয়াগণ। উত্তরাধিকার ব্যতীত হিন্দু আইনের আর কোনও বিধান ইহাদের প্রতি প্রয়োজ্য হয় না। আসামের কোচগণের প্রতিও হিন্দু আইন প্রয়োজ্য হইবে (দীননাথ বঃ চণ্ডী কোচ, ১৬ কলিকাতা ল জার্ণাল, ১৪; আইতি কোচুনি বঃ আইদেও কোচুনি, ২৪ কলিকাতা উইক্লি নোটস্, ১৭৩)।
চতুর্থতঃ, কোন হিন্দু ব্যক্তি মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্রহণ করিবার পরেও যদি হিন্দু আচার ব্যবহার পরিত্যাগ না করেন, তাহা হইলে তিনি হিন্দু আইন কর্তৃক শাসিত হইতে থাকিবেন।
পঞ্চমতঃ, কোন হিন্দু ব্যক্তি যদি খৃষ্টানধৰ্ম্ম গ্রহণ করেন, তাহা হইলে যে যে বিষয়ের সহিত খৃষ্টান ধৰ্ম্মের কোনও সংশ্রব নাই, সেই সেই বিষয়ে হিন্দু আইন তাহার প্রতি প্রয়োজ্য হইবে।
ষষ্ঠতঃ, ব্রাহ্মগণ হিন্দু বলিয়া গণ্য এবং তাঁহার হিন্দু আইন দ্বার শাসিত হইবেন।
Leave a Reply