হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর – উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়
সম্পাদনা : অভীক চট্টোপাধ্যায়
সপ্তর্ষি প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০১৩
প্রচ্ছদ – সৌরীশ মিত্র
প্রকাশক – স্বাতী রায়চৌধুরী
.
উৎসর্গ
প্রকাশকের তরফ থেকে
উত্তমকুমার অনুরাগীদের
.
ভূমিকা
ছোটোবেলায় যখন থেকে বড়োদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়ার সুযোগ ঘটল, তখন সেই বয়সেই মনের মধ্যে একটা ইচ্ছে খচখচ করত। অবশ্যই, কারোর কাছে তা প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। আসলে, চলচ্চিচত্রের পর্দায় দেখতে ইচ্ছে হত, উত্তমকুমারকে। যেসব ছবি আমাকে দেখতে নিয়ে যাওয়া হত, তার কোনোটাতেই উত্তমকুমার থাকতেন না। অথচ, বাড়ির পিসি—কাকা—দাদাদের মুখে, বাড়ির বিভিন্ন ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সিনেমার পত্রিকার পাতায় পাতায়, দেওয়ালে দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে— সর্বত্রই দেখতাম একজনের প্রাধান্য— উত্তমকুমার! এই মানুষটিকে নড়াচড়া অবস্থায় পর্দায় দেখার ইচ্ছেটা প্রবল হওয়াই স্বাভাবিক। অবশেষে, ইচ্ছেপূরণ হল। মায়ের সঙ্গে দেখলাম ‘জয়জয়ন্তী’। ছবিটিতে ছোটোদের ভূমিকার একটা প্রাধান্য থাকার কারণেই বোধহয়, আমাকে তা দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু, আজ একথা অকপটে জানাতে দ্বিধা নেই, ওই বয়সেই ছবিতে থাকা বাচ্চচাদের পরিবর্তে উত্তমকুমার, অপর্ণা সেন এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানগুলি আমার মন কেড়েছিল। এ আমি আজও স্পষ্ট মনে করতে পারি। উত্তমকুমারকে প্রথম অভিনয়রত অবস্থায় দেখে, ঐ ছোটো বয়সেই ওঁর মতো হাঁটতে, চলতে, কথা বলতে ইচ্ছে জেগেছিল। পরবর্তীকালে, দেখলাম এই অসম্ভব আকর্ষণের নামই ‘উত্তমকুমার’। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম শিক্ষাদীক্ষা, পড়াশুনা, রাজনৈতিক—সামাজিক পরিবেশজাত প্রভাব থেকে সরল স্বাভাবিক ভাবনাগুলোর ওপরে যখন একধরনের সচেতন ধ্যান ধারণার আস্তরণ পড়তে লাগল, তার ফলে, সেই যুবকাবস্থায় নানারকম বিভাজনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হল। এরই ফলস্বরূপ, ‘মূলধারা’র সিনেমার রোম্যান্টিক ‘হিরো’ উত্তমকুমারের সম্বন্ধে বেশি ভাবনা—চিন্তা করার মতো কিছু নেই—এইরকম একপ্রকার মতের সমর্থক হয়ে উঠেছিলাম সেইসময়। ক্রমে, এইসব আরোপিত ঘোর যখন কাটতে শুরু করল এবং যথাযথভাবে আপন সত্তার দিকে তাকানোর অবকাশ মিলল, তখন চেতনার অনেকটাই মুক্তি ঘটার ফলে, অনেক বিষয়ের সঙ্গেই নতুন করে হৃদয়ের যোগ স্থাপিত হল, যেগুলি, এতদিন সচেতনভাবে দূরে সরিয়ে রাখা ছিল। এহেন অবস্থায় নতুন করে বুঝলাম, শক্তিশালী অভিনয় ও ‘স্টার’ অভিনেতার এক সম্পৃক্ত মিশ্রণের আদর্শ রূপ হলেন ‘উত্তমকুমার’। অনেক অর্থেই তিনি ব্যতিক্রমী। কেন? আসব সে কথায়, তবে তার আগে এই বইটার হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনি এবং গঠনপ্রণালী নিয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার।
উপরে এত ব্যক্তিগত কথা দিয়ে শুরু করার একটাই অর্থ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার মতো চল্লিশোর্ধ্ব বাঙালির জীবনে উত্তমকুমারের আগমনের ধরন, একটু হেরফের করে আমার ধাঁচেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটেছে। এবার আসি বইটার প্রসঙ্গে। আমার এক বন্ধু দেবাশিস গুপ্ত, যিনি আমার এলাকা চন্দননগরের বাসিন্দা, তিনিই নিজ উদ্যোগে তাঁর সংগ্রহে থাকা ১৩৬৭ সালের বৈশাখের প্রথম সংখ্যা নবকল্লোল পত্রিকা থেকে, একবছর ধরে পরপর সংখ্যায় বেরোনো উত্তমকুমারের ধারাবাহিকভাবে লেখা ‘হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর’ শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক রচনাটি সম্পূর্ণ ফোটোকপি করে আমার হাতে তুলে দেন। এই রচনাটি সম্বন্ধে কোনো ধারণাই আমার ছিল না। দীর্ঘদিন এটি দৃষ্টির অগোচরে ছিল। পুরোনো বই ও পত্রপত্রিকার সংগ্রাহক বন্ধু দেবাশিস গুপ্ত—র প্রতি এজন্য আমার কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই। তিনি এইভাবে নিজে এগিয়ে এসে, এই রচনাটি সম্বন্ধে আমায় অবহিত না করলে, বইটিই প্রকাশিত হতে পারত না। এই ফোটোকপি হাতে আসার পর, এটিকে বইয়ের আকার দেওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়। ‘সপ্তর্ষি প্রকাশন’ —এর সৌরভকে একবার বলাতেই, সে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল। এজন্য, তারও কৃতজ্ঞতা প্রাপ্য। কিন্তু, যতটুকু রচনা পাওয়া গিয়েছিল, তার পরে আরও ছিল। পুরোটা না পেলে তো, বই হবে না। লাইব্রেরির সাহায্য নেওয়া দরকার। বিশিষ্ট সাংবাদিক—প্রাবন্ধিক ও অনেক উচ্চচমানের গ্রন্থের সম্পাদক ভবেশ দাসের স্ত্রী রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের লাইব্রেরিয়ান শ্রীমতী এলা দাস, যাঁরা দুজনেই আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন, সেই বৌদি যোগাযোগ করিয়ে দিলেন ‘জাতীয় গ্রন্থাগার’—এ উচ্চচপদে কর্মরত জয়গোপাল সাহার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সঙ্গে। তিনি অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে সাহায্য করলেন। পেয়ে গেলাম রচনাটির বাকি অংশের (নবকল্লোল ১৩৬৮ ও ১৩৬৯’ বৈশাখ) ফোটোকপি। ব্যস, সম্পূর্ণ রচনা হাতে। এরপর, এল অনুমতির প্রশ্ন। উত্তমকুমারের পৈতৃক বাড়ি যে রাস্তার ওপরে, সেই গিরিশ মুখার্জি রোডেই ‘গিরিশ ভবন’—এ আমার এক ভাইঝির বিয়ে হয়েছে। ওদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ উত্তমকুমারের পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা। ভাইঝির শ্বশুরমশাই শ্রীতপন মুখোপাধ্যায়ের মারফত যোগাযোগ হল, উত্তমকুমারের পুত্রবধূ শ্রীমতী মহুয়া চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ভীষণ আন্তরিক ব্যবহারসহযোগে, তিনি এককথায় লিখিত অনুমতি দিয়ে দিলেন। উপরিল্লিখিত, প্রত্যেককে আমার অন্তরের সবটুকু কৃতজ্ঞতা নিবেদন করলাম। এছাড়া, তথ্য, ছবি ইত্যাদি অনেক বিষয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ, সমাজতাত্ত্বিক গবেষক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, রেকর্ড—সংগ্রাহক জয়দীপ চক্রবর্তী, উত্তমকুমারকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাতা স্বপন দাস, শ্রদ্ধেয় সংগীতব্যক্তিত্ব ডঃ দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বেতারের শ্রদ্ধেয় মিহির বন্দ্যোপাধ্যায়, কলেজ জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধু চলচ্চিচত্রপ্রেমী মানসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, চলচ্চিচত্র—গবেষক দেবীপ্রসাদ ঘোষেদের মতো ব্যক্তিরা। এঁদের প্রত্যেককে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম। প্রখ্যাত রেকর্ড—সংগ্রাহক সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায় একটি পত্রিকায় বেরোনো তাঁর লেখা উত্তমকুমারের রেকর্ড ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া গান সংক্রান্ত অভিনব দুষ্প্রাপ্য তথ্যবহুল রচনাটি এই বইতে পুনর্মুদ্রণের অনুমতি দিয়ে কৃতার্থ করেছেন। এজন্য, তাঁর প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ। অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানাই, আশিস পাঠককে যিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় সেপ্টেম্বর মাসে বইটি সম্পর্কে এক সুন্দর প্রতিবেদন লিখে, আগাম সবাইকে বইটি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। এদের প্রত্যেকের অবদান বইটিকে বাস্তব রূপ দিতে সহায়তা করেছে।
এবার, শেষে, উত্তমকুমার তাঁর এই বইতে কীভাবে উঠে এসেছেন, সে বিষয়ে কয়েকটি কথা বলে ভূমিকায় ইতি টানব। বাংলা সিনেমা সবাক হবার পর থেকে, বলা যায় আজ অবধি ঠিকঠাকভাবে যে তিনজন ‘স্টার’—এর দেখা মিলেছে, তাঁরা হলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া ও উত্তমকুমার। প্রথম দুজনের চেয়ে উত্তমকুমার জনপ্রিয়তা ও দীর্ঘপ্রভাবের দিক থেকে যে অনেক এগিয়ে, তা অনেকেই সম্ভবত মানবেন। তাছাড়া, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যে সময় বিরাজ করতেন, তা ছিল মূলত থিয়েটারের যুগ এবং তিনিও নিজে পছন্দ করতেন মঞ্চাভিনয়।
তখন সেই তিন—এর দশকে নির্বাক যুগ থেকে সবাক যুগে ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটছে চলচ্চিচত্রের—নিতান্তই এক শৈশবাবস্থা বলা যায়। ফলে, অভিনয় জগৎ শাসিত হত মঞ্চাভিনয়ের দ্বারা। আর, প্রমথেশ বড়ুয়া অবশ্যই একশো ভাগ চলচ্চিচত্রের মানুষ হলেও খতিয়ে দেখলে, একটা বিষয় সম্ভবত পরিষ্কার হয় যে, বড়ুয়াসাহেব প্রথমে একজন চিত্র—পরিচালক তারপরে অভিনেতা। প্রযোজনা ও পরিচালনার গুণে চলচ্চিচত্রকে সাবালক তৈরির ক্ষেত্রে, উজ্জ্বল ভূমিকা নিয়েছিলেন। এর সঙ্গে অবশ্যই ছিল প্রমথেশচন্দ্রের নায়ক ভূমিকায় অভিনয়। কিন্তু, উত্তমকুমার ছিলেন একজন আদ্যোপান্ত চলচ্চিচত্রাভিনেতা। অল্প কিছু ক্ষেত্রে, মঞ্চাভিনয় বা চলচ্চিচত্র—পরিচালনা করলেও, উত্তমকুমার সকলের মনে বিরাজ করছেন একজন স্বপ্নের নায়ক ও ‘স্টার’ অভিনেতা হিসেবে, একথা আশাকরি সকলেই মানবেন। এর বীজ নিয়েই যে তিনি জন্মেছিলেন, তার পরিষ্কার আভাস তাঁর লেখা এই বইতে আছে। এই রচনা যেখানে শেষ হচ্ছে তখন ১৯৬২ সালের এপ্রিল—মে মাস। সকলেই জানেন, এ সময়ে তিনি মধ্যগগনে। ফলে, তাঁর নিজেকে গড়ে তোলার জায়গাটি অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে উঠে এসেছে এই বইতে। মনে রাখতে হবে, দুর্গাদাস ও প্রমথেশচন্দ্র দুজনেই ছিলেন কিন্তু অভিজাত বংশোদ্ভুত। অন্যদিকে, উত্তমকুমার এক ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের কলমপেষা কেরানি ছিলেন। সেখান থেকে স্বপ্ন দেখতেন নায়ক হওয়ার। এ যেন, আমাদের মতো সাধারণের ভাবনায় ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমির হওয়ার স্বপ্ন দেখার মতো ব্যাপার। কিন্তু, যিনি আমিরত্বের সত্তা নিয়েই জন্মেছেন, ছেঁড়া—কাঁথা—টাথা তাঁর কাছে কিছু নয়। তিনি আমির হবেনই এবং হলেনও তা।
১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে শুরু করে, পরপর ৭ খানি ছবি ফ্লপ হওয়ার পরে, ১৯৫২ সালে ব্যতিক্রমী পরিচালক নির্মল দে— র ‘বসু পরিবার’ ছবিতে প্রথম সাফল্যের মুখ দেখলেন। এ থেকে স্পষ্ট হয়, কী পরিমাণ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে এই অন্ধকার সময়টি তিনি অতিক্রম করেছেন। কখনও লড়াই ছেড়ে তো যানই নি, উপরন্তু, প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে গেছেন তাঁর লক্ষ্যে। এইসময় একদিন একা গঙ্গার ধারে বসে থাকার সময়, হঠাৎ, এক সন্ন্যাসী কোথা থেকে উদয় হয়ে, উত্তমকুমারকে তাঁর পারিবারিক ও ছবির জীবনের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে এক অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী করে চলে যান, যা পরে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। একদিকে গৌরী দেবীকে জীবনে পাওয়ার ব্যাপারে চিন্তা, অন্যদিকে ছবির জগতে সাফল্য পাওয়া নিয়ে চরম উদ্বেগ। সব মিলিয়ে এক অন্য উত্তমকুমার উঠে আসেন, তাঁর নিজ রচনায়। নিজের ছবির জগতে সাফল্য পাওয়ার বিষয়ে কতখানি গভীর চিন্তা—ভাবনা তিনি করেছিলেন, একটু ভাবলেই আমাদের কাছে তা পরিষ্কার হয়। ‘বসু পরিবার’—এ সাফল্য আসার পর কয়েকটি ছবি পেরিয়ে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪) ছবিতে সম্পূর্ণ এক অন্য উত্তমকুমার জেগে ওঠেন যেন। ইনিই হন আমাদের চেনা ‘স্টার’। একইসঙ্গে, এই ছবি থেকে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁর রোম্যান্টিক রসায়নটিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এই বইতেই এক জায়গায় উত্তম তাঁর প্রিয় অভিনেতা হিসেবে প্রখ্যাত হলিউড ‘স্টার’ রোনাল্ড কোলম্যান—এর নাম করেছেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতেই প্রথম দেখা যায়, উত্তমকুমারের হাঁটাচলা, পোষাক নির্বাচন, চুলের বিন্যাস, তাকানো, ক্যামেরাকে ব্যবহার—সমস্ত পালটে যায়। একধরনের হলিউডি ‘স্টার’ ঘরানার সঙ্গে যার প্রভূত মিল চোখে পড়ে। এই জায়গা থেকেই তিনি সবাইকার থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলেন। শুধু তাই নয়, ক্যামেরাকে নতুন ভাবে ব্যবহার করাও দেখা গেল তাঁর মধ্যে থেকে। যেমন, উত্তমকুমারের ক্যামেরার দিকে পিছন করে, পাশে তাকিয়ে একধরনের বিশেষ স্টাইলকে অবলম্বন করে অভিনয়, আমাদের কাছে ভীষণ প্রিয়। এর আগে, এরকম বিদেশিয়ানার ছোঁয়া—লাগা ভঙ্গিমায়, অন্য কোনো নায়ককে দেখতে অভ্যস্ত ছিল না দর্শককুল। নিজে খুবই ভালো গান গাইতে পারতেন এবং কতখানি সংগীতবোধ তাঁর ছিল, তা তো ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবিতে উত্তমকুমারের সুরারোপিত গানগুলি শুনলেই বোঝা যায়। এর ফলে, গানের সঙ্গে ঠোঁট নাড়ার ক্ষেত্রে, তিনি উচ্চচতম মানে পৌঁছেছিলেন। কী অসম্ভব নিষ্ঠা অভিনয় সংক্রান্ত বিষয়ে সারাজীবন দেখাতে পারলে, তবেই এই উচ্চচতায় পৌঁছোনো সম্ভব, তা সহজেই অনুমেয়। একটি দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী মান্না দে বলেছিলেন যে, একবার তাঁর সঙ্গে মুম্বইয়ের রাস্তায় উত্তমকুমারের দেখা হয়েছিল। উত্তমবাবু হাতে একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে ঘুরছিলেন। মান্না দে জিজ্ঞাসা করাতে, উত্তমকুমার বলেছিলেন, তখন ‘অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি’ ছবির জন্য সদ্য রেকর্ড করা মান্না দে—র গাওয়া গানগুলি যখনই সময় পাচ্ছেন, বারবার শুনে ‘লিপিং’ প্র্যাকটিশ করছেন, যাতে স্যুটিং—এর সময়ে অভিনয়ে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। ভাবা যায়! অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার চরমতম নিদর্শন ছাড়া, একে আর কীইবা বলা যায়। এককথায়, ব্যক্তিগতভাবে যা মনে হয়, বাংলা ছবিতে হলিউডের ‘স্টার’ ঘরানাকে এক আদর্শ বাঙালির মোড়কে সফলতার সঙ্গে প্রথম এনেছিলেন উত্তমকুমার তাঁর অভিনয়শৈলীর মধ্য দিয়ে।
বিশ্ববন্দিত সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘নায়ক’ ছবির মধ্য দিয়ে যেন এই হলিউড স্টার উত্তমকুমারকেই অসাধারণভাবে তুলে ধরেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের মতো চিত্র পরিচালকেরা সাধারণত চিত্রনাট্য রচনা করে তার চরিত্রোপযোগী অভিনেতা—অভিনেত্রীদেরই নির্বাচন করে থাকেন। ‘নায়ক’ ছবির ক্ষেত্রে, কিন্তু উত্তমকুমারের সব কিছু বজায় রেখে সত্যজিৎ চরিত্রটি নির্মাণ করেন। একথা, তিনি নিজেই বলেছেন। এর ফলে, দুই অসামান্য সৃষ্টিশীল প্রতিভাধরের প্রতিভার এক অপূর্ব বিনিময় ঘটে যেন ছবিতে। একইরকম বিনিময় আমরা দেখি সত্যজিৎ রায়—ছবি বিশ্বাস (‘জলসাঘর’) বা সত্যজিৎ রায়—তুলসী চক্রবর্তী (‘পরশপাথর’)—র ক্ষেত্রে। বিশেষ করে, একজন অভিনেতার কাছে, এ যে কতখানি সম্মানের তা বলে বোঝানো যায় না। এখান থেকেই বোধহয় উত্তমকুমারদের মতো অভিনেতারা বহুর মধ্যে এক হয়ে ওঠেন। মৃত্যুর ৩৩ বছর পরও, এই কারণেই বোধহয় উত্তমকুমার আমাদের মধ্যে এতখানি জীবন্ত হয়ে থাকতে পারেন। এ হেন ঈশ্বরপ্রতিম অভিনেতার আত্মজীবনীর সম্পাদনার কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতে পেরে, সত্যিই নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে।
সবশেষে বলি, এই বইয়ের শেষে কিছু প্রাসঙ্গিক টীকাকরণ ও উত্তমকুমারের জীবনীপঞ্জি ও কর্মপঞ্জির একটি সাধ্যমতো বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সম্পাদক হিসেবে কখনওই দাবি করছি না, যা দেওয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, এটি কিন্তু উত্তমকুমারের আংশিক আত্মজীবনী (১৯৬২ সাল অবধি)। সম্পাদনার ক্ষেত্রে, যেসব ত্রুটি রয়ে গেল, তার জন্য পাঠকবর্গের কাছে আগাম মার্জনা চেয়ে রাখলাম। উত্তমকুমারের পরিবারবর্গ, প্রকাশক সহ বইটি নির্মাণে সমস্ত সাহায্যকারী ও উৎসাহদাতাদের উদ্দেশ্যে পুনরায় আমার কৃতজ্ঞতা জানালাম। সবশেষে, প্রণাম জানালাম চিরভাস্বর চিরনায়ক উত্তমকুমারকে।
অভীক চট্টোপাধ্যায়
১৮.১.২০১৩
Leave a Reply