হাদীস সংকলনের ইতিহাস – মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ)
সৌজন্যে: ইসলামিক ইপাব ও মোবি ক্রিয়েটর টিম
.
পূর্বকথা
ইসলামী জীবন বিধান তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে দুইটি মৌল বুনিয়াদের উপর স্থাপিতঃ একটি পবিত্র কুরআন, অপরটি রাসূলের হাদীস। পবিত্র কুরআন ইসলামের একটি মৌল কাঠামো উপস্থাপন করিয়েছে আর রাসূলের হাদীস সেই কাঠামোর উপর একটি পূর্ণাঙ্গ ইমারত গড়েয়া তুলিয়াছে। তাই ইসলামী জীবন বিধানে পবিত্র কুরআনের পরই রাসূলের হাদীসকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে। হাদীসেই ইসলামী জীবন-বিধানের বিস্তৃত রূপরেখার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই কারণে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও মর্ম উপলদ্ধি এবং তদনুসারে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ গঠনের জন্য হাদীসের বিকল্প আর কিছুই হইতে পারে না।
পবিত্র কুরআনের শিক্ষানুসারে রাসুলে আকরাম (ﷺ)- এর জীবন ও কর্মধারা মুসলমানদের জন্য ‘উসয়ায়ে হাসানাহ’ বা সর্বোত্তম আদর্শ। মুসলমানদের জীবন. সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির সকল অঙ্গনেই এই আদর্শের পরিধি বিস্তৃত। এই আদর্শের সঠিক ও নির্ভূল বিবরণ সংরক্ষিত রহিয়াছে হাদীসের বিশাল ভাণ্ডারে। কাজেই প্রকৃত মুসলিম রূপে জীবন যাপন ও সর্বতোভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য হাদীসের ব্যাপকতর অধ্যয়ন এবং ইহার বিশুদ্ধতা ও প্রমাণিকতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানার্জন করা একান্তই আবশ্যক। হাদীস সম্পর্কে জ্ঞানার্জন না করা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকারই নামান্তর।
দুঃখের বিষয় যে, মুসলমানদের জীবনকে রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর জীবন ও কর্মধারা হইতে বিচ্ছিন্ন করা এবং ইসলামকে একটি নিস্প্রাণ ও স্থবির ধর্মে পরিণত করার লক্ষ্যে হাদীসের প্রামাণিকতা ও বিশুদ্ধতা এবং ইহার সঙ্কলন ও সংরক্ষণ সম্পর্কে একটা সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টির অপচেষ্টা চলিয়া আসিতেছে সুদীর্ঘকাল হইতে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সোনালী যুগের অবসানের পর ম’তাজেলা সম্প্রদায়ের উত্থানের মধ্য দিয়েই এই অপচেষ্টা শুরু হইয়াছে এবং পরবর্তীকালে ‘কুরআনপন্হী’র মুখোশ পরিয়া হাদীস-অবিশ্বাসীদের একটি গোষ্ঠি বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের মধ্যে সুকৌশলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির এই হীন প্রয়াস চালাইয়াছে।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই উপমহাদেশেও অনুরূপ একটি চক্রান্তকারী মহল হাদীস বিরোধী এক প্রচণ্ড অভিযান শুরু করিয়াছিল। তাহারা হাদীসের সংকলন, লিপিবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে নানা অবান্তর প্রশ্ন তুলিয়া ইহার প্রামাণিকতা ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুসলিম জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াইতে চাহিয়াছিল। দুঃখের বিষয় যে, তৎকালীন পাকিস্তানের দায়িত্বশীল ও প্রশাসনিক পর্যায়ের কিছু সংখ্যক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিও সরকারী ক্ষমতার পক্ষপুটে থাকিয়া এই ষড়যন্ত্রকে ইন্ধন যোগাইয়াছিল।
এই সর্বনাশা চক্রান্তের মুকাবিলার লক্ষ্যেই এই ভূখণ্ডের বিশিষ্ট হাদীস-বিশেষজ্ঞ শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা মুহাম্মদ আবদুর রহীম ষাটের দশকের প্রথমভাগে ‘হাদীস সংকলনের ইতিহাস ‘ শীর্ষক এই বিশাল গ্রন্হখানি প্রণয়ন করিয়াছেন।
প্রায় অর্ধ যুগের ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষনার ফসল এই মূল্যবান গ্রন্হে হাদীসের সংকলন, লিপিবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ এবং হাদীস শাস্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে হাদীস-বিরোধীদের সকল কূট প্রশ্নেরই তিনি বিস্তৃত ও পুংখানুপুংখ জওয়াব দিয়াছেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সহিত এতৎসম্পর্কিত যাবতীয় শোবাহ-সন্দেহের অপনোদন করিয়াছেন। আল্লাহর অশেষ শোকর যে, গ্রন্হটি ইতিমধ্যেই বাংলা ভাষায় হাদীস চর্চার ক্ষেত্রে অপরিহার্য পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদা লাভ করিয়াছে।
বিগত ২৬ বৎসরে এই অনন্য গ্রন্হটির পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। ইহার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছিল জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী হইতে-১৯৭০ সনে। বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর ১৯৮০ হইতে ১৯৯২ সন পর্যন্ত ইহার তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর সৌজন্যে। প্রকাশনার এই ধারাবাহিকতা হইতে নিঃসন্দেহে গ্রন্হটির অসাধারণ জনপ্রিয়তাই প্রতিভাত হইয়াছে। এক্ষণে মওলানা আবদুর রহীম রচনাবলী প্রকাশনার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘খায়রুন প্রকাশনী’ গ্রন্হটির সুষ্ঠ প্রকাশনা ও বাজারজাতকরণের সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত ইহার পূর্বোকার সংস্করণের মুদ্রণ-প্রমাদগুলি সংশোধনের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, গ্রন্হের এই সংস্করণটি বিদগ্ধ পাঠক সমাজে অধিকতর সমাদর লাভ করিবে।
মহান আল্লাহ এই অনন্য দ্বীনী খেদমতের জন্যে গ্রন্হকারকে জান্নাতুল ফিরদৌস নসীব করুন, ইহাই আমাদের সানুনয় প্রার্থনা।
মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
চেয়ারম্যান
মওলানা আবদুর রহীম ফাউন্ডেশন
ঢাকাঃ আগস্ট, ১৯৯৭
.
ভূমিকা
মানব প্রকৃতির স্বভাবতই দুইটি পরস্পর-বিরোধী ভাবাধারা বিদ্যমান। একটি অপরের আনুগত্য স্বীকার করা আর দ্বিতীয়টি অন্য লোককে নিজের অনুগত বানাইয়া লওয়া।
[Instincts of submission and gregariousness] অন্য কথায়, আনুগত্য স্বীকার ও আধিপত্য বিস্তার এই দুইটি গুণই মানুষের স্বভাবগত এবং এই গুণ দুইটি মানুষের মধ্যে সাধারণত প্রায় সমান মাত্রায় বিদ্যমান। মানুষের প্রকৃতি এক দিকে যেমন তাহাকে অপর লোকের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য উদ্যোগী করিয়া তোলে, অপর দিকে ঠিক অনুরূপভাবেই তাহাকে অপর শক্তির নিকট আনুগত্যের মস্তক অবনমিত করিতে বাধ্য করে। যে লোক দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া আছে, তাহাকেই দেখা যাইবে অপর কোন উচ্চতর বৃহত্তর শক্তির সম্মুখে অবনমিত মস্তকে। প্রভাব বিস্তার ও আনুগত্য স্বীকার এই উভয়বিধ ভাবধারাই মানুষের প্রকৃতি নিহিত বলিয়া মানুষ সমাজ জীবন যাপন করিতে ও বহু মানুষের সহিত মিলিত হইয়া সামাজিক দায়িত্ব পালন করিতে সক্ষম। এই ভাবধারা না থাকিল না সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারিত, না সমাজের উপর মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারিত কোন রাষ্ট্রের প্রাসাদ।
মানব-প্রকৃতি ও মনস্তত্ত্বের গভীরতর অনুশীলনের ফলেই এই তত্ত্বের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব। মানব-প্রকৃতি নিহিত এই দুই বিপরীতমূখী ভাবধারা যেমন অপ্রয়োজনীয় নয়, তেমনি নয় কোন দূষনীয়। সকল প্রকার স্বাভাবিক ভাবধারা, প্রবণতা ও আবেগ-উচ্ছাসের একটি স্বভাবসম্মত সীমা নির্দিষ্ট রহিয়াছে এবং সেই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকিলেই তাহা মানূষের জন্য কল্যাণকর হইতে পারে।
আনুগত্য ও প্রভাব বিস্তারের এই ভাবধারা কালভিত্তিক ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে বহুর সঙ্গে এক-এর সম্পর্কে-সম্বন্ধ ও যোগাযোগ সৃষ্টি করে। এই ভাবধারার প্রবাহ শুষ্ক ও স্তব্ধ হইয়া গেলে সভ্যতার অগ্রগতি ব্যাহত হইতে এবং জীবন-যন্ত্র বিকল হইয়া পড়িতে বাধ্য। দুনিয়ার কোন মতাদর্শ ও চিন্তাধারাই এই কারণে সম্পূর্ণ অভিনব ও অপূর্ব হইতে পারে না, বাহ্য দৃষ্টিতে তাহা যতই ‘আনকোরা’ ও ‘নতুন’ বলিয়া মনে হউক না কেন। বরং একটৃ সন্ধনী দৃষ্টিতে বিচার করিলেই উহার প্রত্যেকটির মূল শিকড় অতীতের গভীর তলদেশে খুজিঁয়া পাওয়া যাইবে। গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রতিভা সূক্ষ্ম ও ব্যাপক হইলে অতীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্তে প্রবাহমান এক চিরন্তন জীবন ঝর্ণার ফল্গুধারা লক্ষ্য করা কিছুমাত্র কঠিন নহে। বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারই এমন নহে, যাহার বীজ পূর্ববর্তী কোন আবিষ্কার-উদ্ভাবনীর ক্ষেত্রে হইতে সঞ্চারিত নয়। সভ্যতা সংষ্কৃতি এই উত্তুংগ প্রাসাদ আদিম প্রাচীনত্বের ধ্বংসস্তূপের উপরই দণ্ডায়ামন, তাহাতে সন্দেহ নাই।
এই কারণে দুনিয়ার কোন সংস্কৃতিবান জাতিই স্বীয় অতীতের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া দীর্ঘকাল বাচিঁয়া থাকিতে পারে না। অতীতকাল জাতিকে একটি দৃঢ় ভিত্তিই দেয় না, ভবিষ্যতের চলার পথে দান করে বহুবিধ বাস্তব অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত জ্ঞান-পাথেয়। অতীতের ভূল-ভ্রান্তি, পদস্থলন ও ঘাত –প্রতিঘান তাহাকে অধিকতর সতর্ক করিয়া তোলে। কিন্তু সেই জন্য জাতির মধ্যে নিরপেক্ষ ও উদার মননশীলতা এবং উপদেশ গ্রহণের অনুকূল মানবিক অবস্থা বর্তমান থাকা একান্তই আবশ্যক। ইতিহাস অধ্যয়নের গুরুত্ব এই দৃষ্টিতেই অনুধাবনীয়। ইহার সাহায্যে অতীতকে বর্তমানের পাশাপাশি স্হাপন করিয়া পারস্পরিক যাচাই ও তুলনা করা এবং উহা হইতে অর্জিত জ্ঞান-আলোকে অজ্ঞাত ভবিষ্যতের তিমিরাচ্ছন্ন দিগন্তকে উদ্ভাসিত করিয়া তোলা প্রত্যেক জাতির পক্ষেই সহজ।
উপরন্তু একটি জাতির ইতিহাস কেবল সেই জাতির জন্য। নয়, দুনিয়ার সকল মানব জাতির জন্যই তাহা অমূল্য সম্পদ। এই কারণে কুরআন মজীদ সংক্ষিপ্তভাবে হইলেও বহু প্রাচীন জাতির ইতিহাস উল্লেখ করে এবং সেইসব জাতির উত্থান-পতন ও কল্যাণ-অকল্যাণের মর্মস্পশী কাহিনী হইতে এক নির্ভুল ইতিহাস-দর্শন গড়িয়া তোলে। ফলে কুরআন সকল যুগের মানুষের জন্য কল্যাণ পথের দিশারী। কিন্তু ইহার কার্যকারিতা নির্ভর করে ঘটনার যথার্থতা, সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার উপর। এই গুণাবলী সঠিকভাবে অর্জিত হইলে আজিকার মানুষও তাহা হইতে যেমন সঠিক পথের নির্দেশ লাভ করিতে পারে, তেমনি পারে ভবিষ্যতের দুর্গম পথে চলিবার বিপুল উদ্যম ও প্রেরণা লাভ করিতে।
মানুষের কল্যাণকামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন শ্রেণী রহিয়াছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বাধিক উন্নতমানের কল্যাণকামী লোক হইতেছেন আল্লাহর প্রেরিত আম্বিয়ায়ে কিরাম। তারাই বিশ্বমানবতার উজ্জ্বলম আদর্শ। তাহারা সকল প্রকার পাপ-ক্রটি ও গুনাহ-নাফরমানীর কলুষতা হইতে চিরমুক্ত। তাঁহাদের চিন্তাধারা, দৃষ্টিকোণ, কথা ও কাজ-সবকিছুই সরাসরিভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। অতএব তারা সাধারণ মানুষের নিকট কেবল ভক্তি-শ্রদ্ধা পাওয়ারই যোগ্য পাত্র নহেন, আকীদা ও বিশ্বাস হইতে শুরু করিয়া জীবনের সকল পর্যায়ের সকল প্রকার কাজে ও কর্মে বাস্তবভাবে অনুসৃত হইবার যোগ্য।
সকল নবীই একই নূরানী কাফেলার অগ্রপথিক, একই মূলনীতি ও আদর্শভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থার উদগাতা এবং প্রচারক; একই দ্বীনের প্রবর্তন। মানব-প্রকৃতিও চিরন্তনভাবে অভিন্ন ও অপরিবর্তনীয়। এই কারণে মানুষের প্রয়োজনীয় পথ-নির্দেশ এবং উহার মৌলিক ভাবধারা ও চূড়ান্ত আদর্শও অভিন্ন, চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়। এই মৌলিক শাশ্বত আদর্শের নাম ‘দ্বীন’। আর দ্বীন-ইসলাম এই কারণেই বিম্ভমানবের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রবর্তিত এক অখণ্ড জীবন বিধান। হযরত আদম (আ) হইতে শেষ নবী মুহাম্মদ (ﷺ) পর্যন্ত সকল নবীই দ্বীন ইসলামের বাহক প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাকামী। নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) সর্বশেষ পর্যায়। আল্লাহ তাঁহাকে যেমন সকলের শেষে প্রেরণ করিয়াছেন, তেমনি তাহাকে ধারণাতীতভাবে সামগ্রিক পূর্ণত্বও দান করিয়াছেন। মানবীয় গুণের দিক দিয়া যেমন, নবুওয়্যাতের যোগ্যতায়ও তিনি ছিলেন তেমনই এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তাহাকে উত্তরকালে সকল স্তরের ও সকল দিক ও ক্ষেত্রের জন্য উজ্জ্বলতর নিদর্শনরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। তাঁহার প্রতি অবতীর্ণ শরীয়াত চিরকালের, সমগ্র মানুষের এবং ইহকাল-পরকাল উভয় ক্ষেত্রের সার্বিক কল্যাণ লাভের একমাত্র নিয়ামক। সময় ও স্থানের পরিধি বা আবর্তন-বিবর্তন উহাকে স্পর্শ করিতে অক্ষম। এই কারণে নবুয়্যাত তাহাতেই চূড়ান্তভাবে পরিণতি লাভ করিয়াছে। আর এই কারণেই তিনি ‘খাতামুন-নাবিয়্যীন, ‘রাহমাতুললিল আলামীন’।
পূর্বেই বলিয়াছি রাসূলে করীম (ﷺ) মানব জাতির জন্য এক পরিপূর্ণ আদর্শ। মানব জীবনের কোন একটি দিক বা একটি কাজ এমন নাই- হইতে পারে না- যে সম্পর্কে রাসূলে করীমের নিকট হইতে পথ-নির্দেশ লাভ করা যায় না। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন, পারস্পররিক লেন-দেন, সম্পর্ক সম্বন্ধ স্থাপন, আত্মীয়তা-শক্রতা, শিক্ষাদীক্ষা, দেশ শাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক- যুদ্ধ ও সন্ধি- সবকিছু সম্পর্কেই সুস্পষ্ট আদর্শ বিদ্যমান রহিয়াছে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর জীবনে।
রাসূলে করীম (ﷺ) ইসলামী আদর্শ প্রচার ও উহার প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। এইজন্য তাহাকে পরিচালনা করিতে হইয়াছে এক সর্বাত্মক সাধনা, এক ক্ষমাহীন অভিযান। ইহা কোন সহজসাধ্য কাজ নহে। ইহা যদি কেবল চিন্তার সূক্ষ্ম জাল রচনা কিংবা বাণীর যাদুমন্ত্র সৃষ্টির দ্বারাই স্মভব হইত, তাহা হইলে চিন্তা ও কল্পনার নির্লিপ্ত প্রশান্তির আসনে অধরূঢ় দার্শনিকদের দ্বারাই মন ও জীবনে অনুরূপ বিপ্লব সৃষ্টি সম্ভব হইত, সম্ভব হইত মৃত জাতির পুনর্গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার দুরূহ কাজ। এই কাজ প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ ও পথ-নির্দেশের মাধ্যমেই অতিবাহিত হয় একজন নবীর জীবন। আর ‘নবুওয়্যাত’ কোন উপার্জনযোগ্য বস্তু নহে, উত্তরাধিকারসূত্রে লভ্য কোন সম্পদও ইহা নয়। ইহা একান্তভাবে আল্লাহর দান। ইহাকে যাহারা সম্পূর্ণত কিংবা আংশিক উপার্জনযোগ্য বলিয়া মনে করে, তাহারা কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণার বিপরীত ধারণা পোষণ করে। আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেনঃ
اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ আল্লাহ মানুষ ও ফেরেশতাদের মধ্য হইতে নিজেই রাসূল বাছাই ও মনোনীত করেন। (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াতঃ ৭৫)
اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ
আল্লাহ তাহার নবুওয়্যাত ও রিসালাত কোথায় কাহার প্রতি সংস্থাপন করিবেন, তাহা ততিন সকলের অপেক্ষা অধিক জানেন। (সূরা আন’আম, আয়াতঃ ১২৩)
এই কারণে নবী- আর আমাদের জন্য সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-ই চিরন্তন ও পরিপূর্ণ আদর্শ। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই অনুসরণীয়। তাহার মাধ্যমে যে মহান পবিত্র কিতাব-কুরআন মজীদ- আমরা লাভ করিয়াছি, তাহাও যেমন আমাদের জন্য এক অক্ষয় আদর্শ, তেমনি তাহার কথা, কাজ ও সমর্থনের সমন্বয়ে গঠিত সুন্নাতও এক চির উজ্জ্বল দীপ-শিখা। আর ইহাই হইতেছে হাদীসের দার্শনিক ভিত্তি। ইহার উপর রচিত হয় ইসলামী জীবন বিধানের সর্বকালীন প্রাসাদ।
আজ হইতে চৌদ্ধশথ বৎসর পূর্বে আরবের সরজমীনে যে সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল, উহাতে সার্বভৌমত্যের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন আল্লাহ তা’য়ালা এবং উহার নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ছিলেন সর্বষশষ নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)। কিন্তু এই সভ্যতা যেহেতু কেবল একচি দেশ ও একটি যুগের জন্যই ছিল না, উুহা ছিল বিশ্বের সকল দেশ, সকল সমাজ ও জাতি এবং সকল যুগের নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্য স্থায়ী ও কল্যাণকর, এই কারণে সভ্যতার মূল ভিত্তিদ্বয়-আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও রাসূলের নেতৃত্বকে চিরন্তন সব্যরূপে শাশ্বত ও চিরন্তন করিয়া রাখার উদ্দেশ্যে বিশ্ব মানবতার নিকট দুইটি বিকল্প ব্যবস্থা সংরক্ষিত করা হয়। এই দুইটি ব্যবস্থঅ হইতেছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতীক কুরআন মজীদ এবং রাসূলের একচ্ছত্র নেতৃত্বের বাস্তব রূপ ‘সুন্নাত’। এই দু্ইটির মাধ্যমে আল্লাহর বিধান রাসূলের আদর্শ তথা ইসলাম মানব সমাজে চিরন্তন সত্য ও চিরন্তন ব্যবস্থা হইয়া থাকিতে পারে, পারে দেশের সকল কালের জাতির মানুষ এই দুইটি স্থায়ী বুনিয়াদের ভিত্তিতে নতুন নতুন সমাজ ও সভ্যতা গড়িয়ে তুলিতে। এই কারণেই কুরআন মজীদ যেমন আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে অক্ষুণ্ন ও অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে এবং বর্তমানেও মজুদ রহিয়াছে, ঠিক অনুরূপভাবে ধ্বংস ও বিলুপ্তির করাল গ্রাস হইতে রক্ষা করিয়া রাখা হইয়াছে রাসূলে করীমের আদর্শকে-সুন্নত বা হাদীসকে।
বস্তুত দেড় সহস্র বৎসরকালীন মুসলিম জাতি ইসলামের ভিত্তি হিসাবে কুরআন মজীদের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসকেও স্বীকার করিয়া লইয়াছে এবং এই ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে অতীতকাল হইতে কোনরূপ মতভেদ সৃষ্টি হওয়া তো দূরের কথা, কোন কালের কোন মুসলমান একবিন্দু সন্দেহ কখনো পোষণ করন নাই। উপরন্তু কোন লোক যদি এই দুইটি ভিত্তিকে এক সঙ্গে স্বীকার করিতে ও মানিয়া লইতে অসম্মতি প্রদান
করিয়াছেন, মুসলিম সমাজে তাহাকে একবিন্দু স্বীকৃতি দিতেও কান মুসলমান প্রস্তুত হন নাই।
কিন্তু বর্তমানকালে মুসলমানদের মধ্যে এমন এক শ্রেণীর মুষ্টিমেয় লোক যত্রতত্র পরিদৃষ্ট হইতেছে, যাহারা কুরআন মজীদের সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের সুন্নাতকে ইসলামের উৎস হিসাবে মানিয়া লইতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিতেছে। আবার এমন কিছু লোকেরও অস্তিত্ব দেখা যাইতেছে, যাহারা হাদীস যথাসময়ে ও যথাযথভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিতেছে আর এই বিষয়ে পশ্চিমা পণ্ডিতদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় প্রভাবান্বিত হইয়া পড়িতেছে। ইহার ফলে মুসলিম সমাজে ইসলামী আদর্শের নিভুলতা, বিশ্বস্ততা, চিরন্তনতা সম্পর্কে কাহারো-কাহারো মনে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়াই ছিল অস্বাভাবিক ব্যাপার। অথচ মুসলিম সমাজের ই পুনরুক্থান ও পনর্জাগরণ পর্যায়ে ইসলামী আদর্শের ভিত্তি সম্পকের্ক এইরূপ সন্দেহ বা অবিশ্বাস গোটা জাতির পক্ষেই মারাত্মক হইয়া দেখা দিতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘হাদীস সংকলনের ইতিহাস’ সম্পর্কে ঐতিহসিক বিচার বিশ্লেষণ এবং ইহার স্বপক্ষে প্রামাণিক যুক্তি ও দলিলাদির ভিত্তিতে নিরপেক্ষ গবেষণা পরিচালনা একান্তই অপরিহার্য ছিল।
আরবী এবং উর্দু সাহিত্যে এই পর্যায়ে যথেষ্ট গবেষণা করা হইয়াছে বলা চলে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ইহার অভাব ইসলামী সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাংলাভাষীদের বিশেষ দৈন্যের প্রমাণ। এই অভাব মোচন ও দীনতা বিদূলণ করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি ও উন্নয় ন এবং হাদীস সম্পর্কে যাবতীয় সন্দেহ অপনোদনের উদ্দেশ্যে আমি বিগত চার বৎসরকাল ধরিয়া এই বিষয়ে ব্যাপক অধ্যাপনা ও গভীর গবেষণা চালাইয়া যে ফসল লাভ করিয়াছি, তাহাই অত্র গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়া বিদগ্ধ পঠকদের সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়াছি। ইহা আমার কোন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ কিনা তাহা চিন্তাশীল পাঠকদেরই বিচার্য। বাংলা একাডেমীর আনুকূল্য এই বিরাট গ্রন্হ প্রথমবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইতেছে দেখিয়াআল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করিতেছি।
মুহাম্মদ আবদুর রহীম
১৭৩, নাখালপাড়া
মুস্তফা মনজিল
…………..১৯৬৫
نضر الله امرء سمع منا شىا
আল্লাহ ধন্য করিবেন সেই ব্যক্তিকে, যে আমার নিকট হইতে কোন কিছু শুনিল এবং উহা যেভাবে শুনিল সেই ভাবেই অপরের নিকট পৌঁছাইয়াদিল। কেননা শ্রোতার অপেক্ষা উহা যাহার নিকট পৌছায় সে-ই উহার অধিক সংরক্ষণকারী হইয়া থাকে। (তিরমিযী)
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عليه وَسَلَّم نَضَر اللهُ عَبْدًا سَمِعَ مقَالتىْ فَحَفَظَهَا اوْوَ عَاهَا وَاَدَّها وَرَدَّهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهِ اَلَى مَنْ هُوَ اَفْقَهٌ مِنْهُ- (ابو داؤد)
নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ আল্লাহ তা’য়ালা সেই লোকের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল উদ্ভাসিত করিবেন, চিরসবুজ, চিরতাজা করিয়ারাখিবেন, যে আমার কথা শুনিয়া মুখস্থ করিয়া রাখিবে কিংবা স্মৃতিপটে সংরক্ষিত রাখিবে এবং অপর লোকের নিকট তাহা পৌঁছাইবে। জ্ঞানের বহু ধারকই প্রকৃত জ্ঞানী নহে। তবে জ্ঞানের বহু ধারক উহা এমন ব্যক্তির নিকট পৌঁছায়, যে তাহার অপেক্ষা অধিক সমঝদার।
(আবূ দাউদ)
Leave a Reply