স্রষ্টার জন্যে লড়াই : মৌলবাদের ইতিহাস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং
অনুবাদ: শওকত হোসেন
প্ৰথম প্ৰকাশ – একুশে বইমেলা ২০১১
অনুবাদকের কথা
বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় মৌলবাদ প্রসঙ্গটি ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ৯/১১ পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মকে নির্বিচারে মৌলবাদ অ্যাখ্যা দিয়ে খোদ ধর্মের বিরুদ্ধে সকল শক্তি প্রয়োগের একটি প্রবণতা গোটা বিশ্বজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর তিনটিতেই মৌলবাদের প্রবল উপস্থিতি থাকলেও এবং খৃস্ট ও ইহুদি ধর্মের মৌলবাদের ভয়ঙ্কর চেহারা সত্ত্বেও বিশ্ব-মিডিয়ার একপেশে প্রচারণার ফলে বর্তমানে কেবল ইসলাম ধর্মই মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন যেন ইসলাম ছাড়া আর কোনও ধর্মের অস্তিত্ব নেই; যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্যে ইসলামী সন্ত্রাসবাদই দায়ী। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে যেন ধার্মিকতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদের আর কোনও পার্থক্য নেই।
কিন্তু আসল ব্যাপার যে তা নয়, মৌলবাদ যে ধর্মের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিব্যক্তি, আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার প্রতি ধার্মিকদের বিশেষ সাড়া হিসাবে যার জন্ম, বর্তমান বিশ্বের ধর্ম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ স্বনামখ্যাত ব্রিটিশ গবেষক-লেখক ক্যারেন আর্মস্ট্রং সেটাই তুলে ধরেছেন বর্তমান গ্রন্থে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, মৌলবাদ কোনওভাবেই নতুন ঘটনা নয় বা কেবল ইসলামই মৌলবাদের আসরে আক্রান্ত নয়। বিগত প্রায় কয়েকশো বছর ধরে, আধুনিকায়নের সূচনাকাল হতে, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের আবির্ভাবে অস্তিত্ব বিনাশের আশঙ্কায় ধর্মের টিকে থাকার সংগ্রাম থেকেই জন্ম হয়েছিল মৌলবাদের। পৃথিবীর সকল দেশের, সকল ধর্মের মানুষই, অন্তত কিছু সংখ্যক মানুষ, ধর্মের অখণ্ডতা রক্ষার নামে আধুনিকতার সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে। আবার যুগে যুগে রাষ্ট্রও উপর হতে আধুনিকতা চাপিয়ে দিতে গিয়ে প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করছে ধর্মকে, মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পশ্চাদপদতার সমার্থক বিচার করে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, ব্যতিক্রম নেই কোথাও। মৌলবাদ যেন আধুনিক মানুষেরই অপরিহার্য সঙ্গী। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একে নির্মূল করার প্রয়াস বিজ্ঞান সম্মত নয় বলেই মনে হয়। মৌলবাদকে প্রতিহত বা নির্মূল করা নয়, প্রয়োজন একে সংশোধন করা। এর জন্যে মৌলবাদের চেহারা, তার আদিরূপ বা ইতিহাসটুকু জানা জরুরি। ইতিহাসের দীর্ঘ সময় জুড়ে মৌলবাদের উৎপত্তি হতে শুরু করে পর্যায়ক্রমে এর বিকাশ জানতে পারলে ধর্মের এই অসুস্থ অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে সংশোধন প্রয়াস সহজতর হবে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের পাঠকদের মৌলবাদের ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিশ্বের মৌলবাদ সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকদের কৌতূহল মেটাতে ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের সুবিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ ব্যাটল ফর গড: আ হিস্ট্রি অভ ফান্ডামেন্টালিজম-এর বাংলা অনুবাদ স্রষ্টার জন্যে লড়াই: মৌলবাদের ইতিহাস পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি আনন্দিত।
উল্লেখ্য, মূলগ্রন্থে বহু দার্শনিক, ধর্মীয় ও কারিগরি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। পাঠকদের সুবিধার জন্যে আমি যথাসম্ভব বাংলা পরিভাষা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। ধর্মগ্রন্থের, বিশেষ করে পবিত্র কোরানের আয়াতের নির্ভুল অনুবাদের খাতিরে মুহম্মদ হাবীবুর রহমানের কোরান শরীফ: সরল বঙ্গানুবাদ-এর সাহায্য নিয়েছি।
মূলগ্রন্থে ব্যবহৃত না হলেও পয়গম্বর মুহাম্মদ-এর নামের শেষ (স) চিহ্ন ব্যবহার করেছি। পাঠকদের কাছে পয়গম্বর ও নবীগণের নামের শেষে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যথাযথ বাণী ব্যবহারের অনুরোধ থাকল।
পাঠকদের একটি বিশ্বস্ত মূলানুগ ও সাবলীল অনুবাদ উপহার দেওয়ার চেষ্টা ছিল আমার। জানি না কতটুকু সফল হয়েছি। পাঠক সামান্য উপকৃত হলেও নিজের শ্রম স্বার্থক জানব। যে কোনও রকম ভুল-ত্রুটি আমাদের গোচরে আনলে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধনের প্রয়াস নেওয়া হবে।
বইটি আরও আগে বের হওয়ার কথা ছিল। দেরি হবার কারণ প্রসঙ্গে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। এই বইটিসহ আমার অনূদিত আরও কিছু বই বের হওয়ার কথা ছিল আজিজ সুপার মার্কেটের সন্দেশ নামক প্রকাশনা সংস্থা থেকে। পাণ্ডুলিপিও জমা দিয়েছিলাম। এমনি এক সময় সহসা সুপ্রিয় অনুবাদক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অনুবাদক জনাব জি.এইচ. হাবীরের কাছে জানতে পারি সন্দেশে’ স্বত্বাধিকারী লুৎফর রহমান চৌধুরীর অপকর্মের ফিরিস্তি। জনাব লুৎফর রহমান অনুবাদকদের প্রতারিত করে বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা থেকে অনূদিত গ্রন্থের বিপরীতে অনুবাদকদের নামে বরাদ্দ ও প্রেরিত প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এ খবর জানতে পেরে আমি নরওয়ের নরলা, কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর ট্রান্সলেশন, ডাচ ফাউন্ডেশন ফর ট্রান্সলেশন, ইত্যাদি বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে জনাব লুৎফর রহমানের অপকর্মের জ্বলন্ত প্রমাণ যোগাড় করি। তাতে জানা যায় এই তথাকথিত সাহিত্যসেবী আসলে একজন নিম্নশ্রেণীর তস্কর ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি বিভিন্ন বিদেশী প্রকাশনা সংস্থা ও লেখকদের এজেন্টদের সাথে নামী-অনামী লেখকদের বাংলাদেশের পাঠকদের সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার নামে খুবই সামান্য অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স (স্বত্ব নয়) হাতিয়ে নেন। তারপর অনুবাদকদের সাথে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট বইটি অনুবাদ করানোর জন্যে নামকাওয়াস্তে চুক্তি সম্পাদন করেন। কিন্তু সেই চুক্তির কথা গোপন করে তিনি উল্লেখিত বিদেশী সাহিত্য সংস্থাগুলোর কাছে অনুবাদকের সত্যিমিথ্যার মিশেল জীবনবৃত্তান্ত ও জাল স্বাক্ষরসহ সম্পূর্ণ ভিন্ন মিথ্যা চুক্তিপত্রের অনুলিপি জমা দিয়ে অনূদিত গ্রন্থের বিনিময়ে অনুবাদকের নামে বরাদ্দ অর্থের জন্যে আবেদন করেন এবং অনুবাদককে কিছুই না জানিয়ে সেই অর্থ বেমালুম তছরুপ করেন। এভাবে এপর্যন্ত তিনি বহু লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই ঘৃণ্য কাজ করে আসছেন। তাঁর এমনি প্রতারণার ফাঁদ থেকে বাংলাদেশের কোনও অনুবাদক রেহাই পাননি। নদে উপন্যাসের অনুবাদক আনিস পারভেজ, সোফির জগৎ ও শত বর্ষের নিঃসঙ্গতার নন্দিত অনুবাদক জি.এইচ. হাবীব, একটি অপহরণ সংবাদ ও বাগদাদে একশ দিন- এর অনুবাদক সিলেট মেট্রপলিটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুরেশ রঞ্জন বসাক, লাইফ অভ পাই ও টিন রঙা শাড়ীর অনুবাদক শীব্রত বর্মণ, তাশ রহস্য-এর অনুবাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মণ, ক্যালি গ্যাংয়ের আসল ইতিহাসের অনুবাদক সালেহা চৌধুরীসহ কেউই বাদ যাননি। অথচ প্রকাশ্যে নিজেকে তিনি সাহিত্যসেবী হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, ভান করেন সাহিত্যের সেবা করতে গিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া, ভারতীয় পূর্বপ্রকাশিত বিভিন্ন অনুবাদও তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়দের নামে প্রকাশ করে বর্ণিত সংস্থাগুলো থেকে অনুদানের অর্থ আদায় করে নিয়েছেন। সম্পূর্ণ বিষয়টি অনুবাদকদের মাঝে জানাজানি হওয়ার পরও এবং প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও (বর্ণিত সংস্থাসমূহের ওয়েব সাইটে অনুসন্ধান করলেই এই অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মিলবে) তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে গেছেন। অনেক চেষ্টা করেও আমি ও অন্য অনুবাদকগণ প্রাপ্য অনুদানের টাকা তো বটেই অন্যান্য অনূদিত গ্রন্থের বিনিময়ে চুক্তিমাফিক প্রতিশ্রুত অর্থও পাইনি। তিনি চুক্তিভঙ্গ ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন বলে পূর্বপ্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ প্রত্যাহারের কথা লিখিতভাবে জানানো সত্ত্বেও তিনি সেগুলোর বিপনন অব্যাহত রেখেছেন এবং দাখিল করা পাণ্ডুলিপি ফেরত চাইলেও ফেরত দেননি; যে কারণে অত্যন্ত পরিশ্রম সপেক্ষ হলেও এ বইটি দ্বিতীয়বার অনুবাদ করতে হয়েছে। আমার আরও কয়েকটি অনূদিত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি এখনও অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছেন, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তাতে কান দেননি। বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখা এবং প্রতারণা থেকে দেশের অনুবাদকদের বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন এটাই কাম্য। আমি আন্তরিকভাবে আশাবাদী যে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা যথা-ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশের সাহিত্য জগৎকে লুৎফর রহমান চৌধুরীর মতো নিম্নশ্রেণীর তস্করের কবল থেকে উদ্ধার করে নিবেদিতপ্রাণ লেখক ও অনুবাদকদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসবেন। পাঠক, লেখক ও অনুবাদকগণকে এই প্ৰকাশককে সামাজিকভাবে বর্জন করার আহ্বান জানাই। পাঠকদের একটি অন্যায় সম্পর্কে অবহিত করার জন্যেই এখানে এত কথা বলতে হলো। কারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটার কারণ হলে আমি সেজন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। প্রসঙ্গত, এই বক্তব্যের জন্যে রোদেলার প্রকাশক দায়বদ্ধ নন।
ধন্যবাদ সবাইকে
শওকত হোসেন
মালিবাগ, ঢাকা
নতুন ভূমিকা
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখটি বিশ্বকে চিরতরে পাল্টে দেওয়া দিন হিসাবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে। এই দিনই মুসলিম সন্ত্রাসীরা বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগনের একটি অংশ ধ্বংস করে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল। স্পষ্টতই টেলিভিশনে প্রচারের উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিত কাজ ছিল এটা। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের জ্বলন্ত টাওয়ারজোড়া এবং পরবর্তী দর্শনীয় ধস সম্ভবত একবিংশ শতাব্দীর আইকনে পরিণত হবে। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কোনও বিদেশী শক্তির হাতে আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু কোনও জাতি রাষ্ট্র নয়, বা পারমানবিক মিসাইলও নয়, বরং স্রেফ পেননাইফ আর বক্স কাটার হাঁকানো ধর্মীয় চরমপন্থীদের হাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত হামলা হলেও প্রথম বিশ্বে আমাদের সবার উদ্দেশ্যেই সতর্কবাণী ছিল এটা। এক নতুন ধরনের নগ্নতা, আক্রম্যতা বোধে আক্রান্ত হয়েছি আমরা, নিষ্ঠুরতার মাত্র এক মাসের কিছু বেশি সময় পর যখন আমি লিখছি, এখনও এটা স্পষ্ট নয় যে কীভাবে এই ঘটনাটি আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করবে। পরিবর্তিত এই বিশ্বে একটা ব্যাপার ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। সেপ্টেম্বর ১১-এর আগে যেসব অগ্রাধিকার ও উদ্বেগ আমাদের ব্যস্ত রেখেছিল সেগুলোকে এখন অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। আমরা ভীতিকর অস্বস্তিকর এক পরিবর্তনের মুখে পড়েছি।
অবশ্য মৌলবাদের গতিশীলতায় পরিবর্তন আসেনি। আক্রমণের ব্যাপকতা সম্পর্কে কারও পক্ষেই পূর্বধারণা করা সম্ভব ছিল না, কারণ তা ছিল ধারণাতীত। তবে এটা ছিল মৌলবাদীদের ঈশ্বরের পক্ষে তাদের চলমান যুদ্ধে নতুনতম ও সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণ। এই পৃষ্ঠাগুলোতে আমি যেমন তুলে ধরার প্রয়াস পাবো, প্রায় শতবছর ধরে ক্রিশ্চান, ইহুদি ও মুসলিমরা এক উগ্র ধরনের ধার্মিকতা গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত ছিল যার লক্ষ্য আধুনিক সেক্যুলার সংস্কৃতিতে অবনমিত ঈশ্বর ও ধর্মকে প্রান্তরেখা থেকে আবার মধ্যমঞ্চে ফিরিয়ে আনা। এইসব ‘মৌলবাদী’, যেমন তাদের আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে, ধর্মের প্রতি উৎসগতভাবে বৈরী এক বিশ্বে বিশ্বাসের পক্ষে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সেক্যুলার আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা; এই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সাধারণভাবে পণ্ডিত ও ধারাভাষ্যকারগণ ধরে নিয়েছিলেন যে সেক্যুলারিজমই আগামীর আদর্শ এবং ধর্ম আর কখনওই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিতে পরিণত হতে পারবে না। কিন্তু মৌলবাদ এই প্রবণতাকে উল্টে দিয়েছে, ক্রমশঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম বিশ্বের উভয় ক্ষেত্রেই ধর্ম এমন এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যাকে প্রতিটি সরকার গুরুত্বের সাথে নিতে বাধ্য হয়েছে।
সেপ্টেম্বর ১১-এর প্রলয়কাণ্ডকে এই গ্রন্থে বর্ণিত মৌলবাদের ইতিহাসের যৌক্তিক পরিণাম হিসাবে দেখা যেতে পারে। প্রায়শঃই লোকে যেমনটা ভেবে থাকে, মৌলবাদ কোনও সচেতন পশ্চাদপদতা নয়। এটা অতীতে ফিরে যাওয়া নয়। এইসব মৌলবাদ আবিশ্যকভাবেই আধুনিক আন্দোলন এবং নিজ সময় ছাড়া অন্য কোনও কালেই শেকড় গাড়তে পারবে না। এটা ছিল সেক্যুলার আধুনিকতার বিরুদ্ধে পরিচালিত সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী অক্রমণ, এরচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষ্য আর বেছে নিতে পারত না সন্ত্রাসীরা। সেপ্টেম্বর ১১-র চেয়ে আর কখনওই মৌলবাদীরা মিডিয়ার এমন দক্ষ সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। প্রথম বিমানের ধ্বংসে সচেতন হয়ে ওঠা লক্ষ লক্ষ মানুষ ততক্ষণে যার যার টিভি সেটের সামনে বসে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের দাক্ষিণ টাওয়ারে দ্বিতীয় প্লেনের হামলে পড়া দেখতে হাজির হয়ে গিয়েছিল। মৌলবাদীরা আধুনিক বাবেল মনে হওয়া প্রকৃতির বিরোধিতা করে গড়ে তোলা অসাধারণ ভবন ধ্বংস করার লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েছে। মৌলবাদীদের কাছে এই ধরনের কাঠামো ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঠেকতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগন ধর্মীয় অভিশাপের মুখে তাসের ঘরের মতো জমিনে লুটিয়ে পড়েছে। মারাত্মক আঘাত ছিল এটা। কেবল হাজার মানুষ প্রাণই হারায়নি, বরং আমেরিকার গর্বিত স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও আস্থা টাওয়ারগুলোর সাথে সাথে ধসে পড়েছে। মানুষ আর কোনওদিনই সেপ্টেম্বর ১০-এর মতো নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারবে না। দশকের পর দশক এয়ারপ্লেনগুলো মানুষকে এক ধরনের অতিমানবীয় মুক্তির বোধ যুগিয়েছে, তাদের মেঘের অনেক উপরে বসে থাকতে সক্ষম করে তুলেছে, প্রাচীনকালের দেবতাদের মতোই ক্ষিপ্র বেগে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে পেরেছে তারা। কিন্তু এখন তাদের অনেকেই আকাশে উড়তে ভয় পাচ্ছে। ওদের মাটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে, নিয়ে আসা হয়েছে আসল রূপে, ওদের সেক্যুলার ডানা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে এবং ভয়ঙ্করভাবে ফুটো করে দেওয়া হয়েছে আত্মবিশ্বাস।
প্রধান সন্দেহভাজন ওসামা বিন লাদেন মৌলিক চিন্তাবিদ নন। তাঁর ধ্যানধারণা সম্পূর্ণই মিশরিয় মৌলবাদী সৈয়দ কুতবের ধারণা ভিত্তিক। এই গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে তাঁর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কুতবের পরিভাষা ব্যবহার করে বিন লাদেন ঘোষণা করেছেন যে, সেপ্টেম্বর ১১-র ঘটনাপ্রবাহ বিশ্ব দুটি শিবিরে বিভক্ত থাকার বিষয়টিই তুলে ধরেছে: একটি ঈশ্বরের পক্ষে, অন্যটি তাঁর বিপক্ষে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ব দুটি ভিন্ন শিবিরে ভাগ হয়ে আছে, সেটা বিন লাদেনের বর্ণনা মোতাবেক না হয়ে থাকলেও। অনেক দশক ধরে আধুনিকতার সুযোগ সুবিধা উপভোগ ও সমর্থন করে আসছে যারা আর আধুনিক সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া মৌলবাদীরা পরস্পরে প্রতি চরম বিতৃষ্ণার সাথে দুর্বোধ্যতার মহাগহ্বরের উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে। সেপ্টেম্বর ১১-র নিষ্ঠুরতা কেবল ভুল বোঝাবুঝির মাত্রাটুকু কতটা গভীর এবং ভিত্তি কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে সেটাই তুলে ধরে। এটা সভ্যতার সংঘাত নয়, মৌলবাদ সব সময়ই আন্তসমাজ বিরোধ। যেন এই বিষয়টিকে জোরাল করে তুলতেই আমেরিকান ক্রিশ্চান মৌলবাদী জেরি ফলওয়েল ও প্যাট রবার্টসন প্রায় সাথে সাথেই ঘোষণা করেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্যুলার মানবতাবাদীদের পাপের জন্যে ওই ট্র্যাজিডি ছিল ঈশ্বরেরই বিচার-এমনি দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম ছিনতাইকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব একটা ভিন্ন কিছু নয়।
এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে আমি তুলে ধরেছি যে মৌলবাদ বিদায় নিচ্ছে না, বরং এটা আধুনিক দৃশ্যপটেরই অংশ, এবং এমন এক বাস্তবতা যার মোকাবিলা করা আমাদের শিখতে হবে। মৌলবাদের ইতিহাস দেখায় যে, এই উগ্র ধার্মিকতা আমরা অগ্রাহ্য করলেই মিলিয়ে যায় না। মৌলবাদের হুমকির অস্তিত্ব নেই ভান করা বা মুষ্টিমেয় উন্মাদ লোকের বদ্ধমূল ধারণা হিসাবে মৌলবাদকে সেক্যুলার বিতৃষ্ণার সাথে নাকচ করে দেওয়া মোটেই ঠিক নয়। ইতিহাস আরও দেখায় যে, মৌলবাদকে দমন করার প্রয়াস স্রেফ তাকে আরও চরম রূপ দেয়। এটা পরিষ্কার, সকল ধর্মবিশ্বাসের মৌলবাদীরা কী প্রকাশ করতে চাইছে উপলব্ধি করার জন্যে আমাদের মৌলবাদী ইমেজারিসমূহকে বোধগম্য করে তুলতে হয়েছে। কারণ এইসব আন্দোলন এক ধরনের উদ্বেগ ও অসন্তোষ তুলে ধরে যা কোনও সমাজই উপেক্ষা করে থাকতে পারে না। সেপ্টেম্বর ১১-র পর থেকে বিশ্বের বহু স্থানে ক্রমেই চরম রূপ ধারণ করতে চলা মৌলবাদী আন্দোলনসমূহকে উপলব্ধি করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিশ্চান রাইটের সদস্যরা ১৯৭০ দশকের মৌলবাদের সীমা অতিক্রম করে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে আমি জেরি ফলওয়েল ও মরাল মেজরিটিকে অনেক পিছে ফেলে যাওয়া রিকন্সট্রাকশনিজম ও ক্রিশ্চান আইডেন্টিটি আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করেছি। এগুলো উত্তর-মৌলবাদের একটি ধরন, যা ঢের বেশি ভীতিকর, অনমনীয় ও চরম। একইভাবে ছিনতাইকারীরা যেন ইসলামি মৌলবাদের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের ভয়ঙ্কর পরিবর্তন তুলে ধরেছে বলে মনে হয়। বিন লাদেন সৈয়দ কুতবের প্রচলিত মৌলবাদী পরিভাষায় কথা বললেও ছিনতাইকারীরা, বিন লাদেনের যাদের কুতবিয় পরিভাষায় ‘ভ্যানগার্ড’ আখ্যায়িত করেছেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মৌলবাদের আবির্ভাব ঘটাতে পারত, এমন কিছু অতীতে যা আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। প্রথম বিমানের চালক মিশরিয় ছিনতাইকারী মুহাম্মদ আতা ছিল প্রায়-মদ্যপ ধরনের, বিমানে আরোহনের আগেও ভদকা খাচ্ছিল সে। পেনসিলভেনিয়ায় ক্র্যাশ করা বিমানের অভিযুক্ত লেবানিজ পাইলট জিয়াদ জাররাহিও মদ্যপ ছিল, হামবুর্গে নিয়মিত নাইটক্লাবে যাতায়াত করত সে। ছিনতাইকারীরা লাস ভেগাসের বিভিন্ন ক্লাব ও নারীসঙ্গও উপভোগ করত।
এইসব তথ্য বের হয়ে আসার সাথে সাথে খুব অদ্ভুত কিছু ব্যাপার ঘটছে বলে আমি সজাগ হয়ে উঠেছিলাম। মুসলিমদের পক্ষে ধর্মীয়ভাবে অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ। একজন মুসলিম শহীদ পেট ভর্তি ভদকা নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে, এমন ধারণা ১৯৯৪ সালে হেবরনের গ্রেট মস্কে হামলা চালিয়ে উনত্রিশজন মুসলিমকে হত্যা করার আগে শূকরের মাংস ও ডিম দিয়ে নাশতা সারা বারুচ গোল্ডম্যানের মতো ইহুদি মৌলবাদীর আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মতোই অচিন্তনীয়। কোনও ধার্মিক মুসলিম বা ইহুদিই এই ধরনের আচরণে নিজেকে জড়িত করার কথা ভাবতে পারে না। বেশির ভাগ মৌলবাদীই অর্থডক্স জীবন অনুসরণ করে, অ্যালকোহল, নাইটক্লাব আর শিথিল রমনী হচ্ছে জাহিলিয়াহর বৈশিষ্ট্য, অজ্ঞ, ঈশ্বরবিহীন বর্বরতা মুসলিম মৌলবাদীরা সৈয়দ কুতবের নির্দেশ অনুসরণ করে যাকে কেবল বর্জনেরই শপথ গ্রহণ করেনি, বরং নিশ্চিহ্ন করারও শপথ নিয়েছে। ছিনতাইকারীরা যেন কেবল ধর্মের যেসব মৌল বিধানকে রক্ষা করার শপথ নিয়েছিল সেগুলোকেই অমান্য করার পথে যায়নি, বরং প্রচলিত মৌলবাদীদের অনুপ্রাণিতকারী নীতিমালাকেও পদদলিত করেছে।
পরের পাতাগুলোয় আমি বহু উন্মলতাবাদী আন্দোলনের বর্ণনা দিয়েছি যেখানে জনগণ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রবল উদ্বেগ ও পরিবর্তনের পর্যায়ে পবিত্রতম রীতিনীতি লঙ্ঘন করে গেছে। এখানে সপ্তদশ শতকের মেসায়াহ চরিত্র শাব্বেতাই যেভি, তাঁর শিষ্য জ্যাকব ফ্রাংক ও ‘পবিত্র পাপের’ পক্ষে বক্তব্যদানকারী সপ্তম শতকের ইংল্যান্ডের বিপ্লবী পয়গম্বরগণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। সময় এতটাই মরিয়া ছিল যে, সম্পূর্ণ নতুন কিছুর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। প্রাচীন মূল্যবোধসমূহ আর কাজে লাগছিল না; কেবল প্রাচীন রীতিনীতির পাইকারী লঙ্ঘনের ভেতর দিয়েই অর্জনযোগ্য নতুন বিধান ও নতুন স্বাধীনতা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
আমি আরও দেখিয়েছি যে, মৌলবাদের অধিকতর চরম রূপে এক ধরনের অন্তস্থঃ ধ্বংসাত্মক প্রবণতা রয়েছে। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের সবকটাতেই মৌলবাদীরা ধ্বংস ও নিশ্চিহ্নকরণের কল্পনা লালন করেছে। অনেক সময়, যেমন দশম অধ্যায়ে আমি দেখিয়েছি, পরিকল্পিতভাবেই স্বয়ং-ধ্বংসাত্মক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বাধ্য করা হয়ে থাকে তাদের। ১৯৭৯ সালে ডোম অভ রক উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে জুইশ আন্ডারগ্রাউন্ডের পরিকল্পনা এর জ্বলন্ত নজীর। এই ঘটনার ফলে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিনাশ ঘটতে পারত। এই ইহুদি মৌলবাদীরা এক পৌরাণিক বিশ্বাসে চালিত হয়েছে। এই পৃথিবীর বুকে তারা প্রলয় ঘটাতে পারলে ঈশ্বর তখন মহাকাশ থেকে নিষ্কৃতি অবতরণ করাতে ‘বাধ্য’ হবেন। আবার, মুসলিম আত্মঘাতী বোমারুদের চেয়ে ব্যাপক ধ্বংসবাদী কর্মকাণ্ড কল্পনা করা কঠিন। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক স্তরে ১৯৮০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টেলিভিশন কেলেঙ্কারীর সৃষ্টিকারী জিম ও ট্যামি ফেয় বেকার এবং জিমি সোয়াগনের বিচিত্র অ্যান্টিকসমূহ জেরি ফলওয়েলের অধিকতর সুবোধ মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঢের চরম ধ্বংসবাদী বিদ্রোহ তুলে ধরে। এটাও উত্তর-মৌলবাদের একটা রূপ ছিল যা ‘পবিত্র পাপে’র উন্মুলতার অন্বেষণ তুলে ধরে। সেপ্টেম্বর ১১-র ছিনতাইকারীরাও সম্ভবত এমন একটা অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল যেখানেও তারাও মুসলিম উন্মুলতা- উত্তর-মৌলবাদের একটি ধরন গড়ে তুলছিল, কোনও কিছুকেই আর পবিত্র ভাবতে পারছিল না ওরা। একবার এই পর্যায়ে পৌঁছে গেলে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও অশুভ আচরণকেও ইতিবাচক শুভ কাজ হিসাবে দেখা হতে পারে।
সে যাই হোক, সেপ্টেম্বরের ভয়ঙ্কর হামলা দেখায় যে, লোকে যখন ঘৃণা ও হত্যাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করতে ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করে, সকল মহান বিশ্ব ধর্মের সহানুভূতিময় নৈতিকতাকে বিসর্জন দেয়, তখন তারা এমন এক পথে যাত্রা করে যেখানে বিশ্বাসের পরাজয় ফুটে ওঠে। এই আগ্রাসী ধার্মিকতা এর আরও অধিকতর চরম উপাদানকে নৈতিকতার অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে যা আমাদের সবাইকেই বিপদাপন্ন করে তোলে। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের মৌলবাদীরা যদি আরও রেডিক্যাল ও ধ্বংসাত্মক বিশ্বাস আলিঙ্গন করতে শুরু করে থাকে, সেটা সত্যিই ভীতিকর একটা পরিবর্তন হবে। সুতরাং, এই গভীর হতাশার পেছনে কী লুকিয়ে আছে ও কোন জিনিসটা মৌলবাদীদের তাদের কর্মকাণ্ডে বাধ্য করে, সেটা বুঝতে পারাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখনও এটা ঠিক যে মৌলবাদীদের কেবল একটা সামান্য অংশই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়, বাকি সবাই তাদের চোখে বিশ্বাসের প্রতি পরিহাসময় মনে হওয়া এক পৃথিবীতে ধর্মীয় জীবন যাপন করার প্রয়াস পাচ্ছে। আমাদের অব্যাহত অজ্ঞতা ও বিতৃষ্ণা যদি আরও বিপূল সংখ্যক মৌলবাদীকে সহিংসতার পথে ঠেলে দেয়, সেটা হবে খুবই দুঃখজনক। আসুন আমরা এই ভীতিকর সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্যে যা কিছু সম্ভব করার প্রয়াস পাই।
সূচনা
বিগত বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের অন্যতম চমকপ্রদ পরিবর্তন ছিল প্রতিটি প্রধান ধর্মীয় ঐতিহ্যেই জনপ্রিয়ভাবে ‘মৌলবাদ’ নামে পরিচিত এক ধরনের উগ্র ধার্মিকতা। অনেক সময় এর প্রকাশ মারাত্মক হতে দেখা যায়। মৌলবাদীরা মসজিদে প্রার্থনাকারীদের গুলি করে হত্যা করেছে, অ্যাবরশন ক্লিনিকে কর্মরত ডাক্তার ও নার্সদের খুন করেছে, নিজেদের প্রেসিডেন্টদের গুলি করে মেরেছে, এমনকি শক্তিশালী সরকারেরও পতন ঘটিয়েছে। মৌলবাদীদের খুব অল্প সংখ্যার সংখ্যালঘু অংশই এইসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, কিন্তু সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ও নিয়মনিষ্ঠরাও যেন বিভ্রান্ত বোধ করছে, কারণ তাদের যেন আধুনিক সমাজের অধিকাংশ মূল্যবোধের সাথেই চরমভাবে বিরোধিতায় মত্ত মনে হয়। গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, শান্তিরক্ষা, বাক-স্বাধীনতা কিংবা গির্জা ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারে মৌলবাদীদের কোনও অবকাশ নেই। ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন আবিষ্কারকে প্রত্যাখ্যান করে, জোর দিয়ে বলে বুক অভ জেনেসিসই সবদিক থেকে বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ভুল। অনেকেই অতীতের শৃঙ্খল ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে যখন, এমন একটা সময়ে ইহুদি মৌলবাদীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোরভাবে প্রত্যাদিষ্ট বিধান পালন করে চলেছে, মুসলিম নারীরা পশ্চিমা নারীদের স্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করে বোরখা ও চাদরে নিজেদের আবৃত্ত করছে। মুসলিম ও ইহুদি মৌলবাদীরা উভয়ই প্রবলভাবে সেক্যুলারিস্ট হিসাবে সূচিত আরব-ইসরায়েল বিরোধকে চরমভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করে। তাছাড়া, মৌলবাদ কেবল মহান একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। বুদ্ধ, হিন্দু, ও এমনকি কনফুসীয় মৌলবাদীও রয়েছে। উদার সংস্কৃতির বহু কষ্টে আহরিত অন্তর্দৃষ্টি যাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, যা ধর্মের নামে যুদ্ধ ও হত্যা করে এবং রাজনীতি ও জাতীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রে পবিত্রকে টেনে আনার সংগ্রাম করে।
এই ধর্মীয় পুনর্জাগরণ বহু পর্যবেক্ষককে হতবাক করে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী বছরগুলোতে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, সেক্যুলারিজম অপরিবর্তনযোগ্য প্রবণতা, ধর্মবিশ্বাস আর কোনওদিনই বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে না। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, মানবজাতি আরও যৌক্তিক হয়ে উঠবে, তাদের আর ধর্মের প্রয়োজনই হবে না বা একে জীবনের একেবারেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত রেখেই সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে মৌলবাদীরা সেক্যুলার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ধর্মকে প্রান্তিক অবস্থান থেকে একেবারে মধ্যমঞ্চে তুলে নিয়ে আসে। অন্ততপক্ষে এই দিক থেকে তারা লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ধর্ম আবারও এমন এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যাকে কোনও সরকারের পক্ষেই আর নিরাপত্তার সাথে উপেক্ষা করে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মৌলবাদ পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে বটে, কিন্তু কোনওভাবেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। এটা এখন আধুনিক দৃশ্যপটের অত্যাবশ্যক অংশে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বলয়ে নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকাই পালন করবে। সুতরাং, এই ধরনের ধার্মিকতার মানে কী, কীভাবে এবং কোন কারণে এর বিকাশ ঘটল, আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের তা কী জানাতে পারে এবং কেমন করে সবচেয়ে ভালোভাবে এর মোকাবিলা করা যেতে পারে সেটা বোঝার চেষ্টা করা খুবই জরুরি।
কিন্তু সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে বহুল-সমালোচিত খোদ ‘মৌলবাদ’ কথাটির দিকে আমাদের একটু সংক্ষিপ্ত নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকগুলোতে আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরাই সবচেয়ে প্রথম এই পরিভাষাটি ব্যবহার করে, তাদের কেউ কেউ নিজেদের অন্য অধিকতর ‘উদার’ প্রটেস্ট্যান্টদের থেকে ভিন্ন হিসাবে তুলে ধরার জন্যে ‘মৌলবাদী’ আখ্যায়িত করতে শুরু করেছিল। তাদের মতে উদারবাদীরা ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাসকে বিকৃত করছিল। মৌলবাদীরা মৌলবিশ্বাসে ফিরে যেতে চেয়েছে ও ক্রিশ্চান ঐতিহ্যের ‘মৌল বিষয়’গুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। একে তারা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও বিশেষ কিছু বিশ্বাসকে মেনে নেওয়ার সাথে একীভূত করে নিয়েছিল। ‘মৌলবাদ’ পরিভাষাটি তখন থেকেই অন্য বিশ্ব ধর্মের সংস্কারবাদী আন্দোলনসমূহকে এমনভাবে বর্ণনা করার কাজে ব্যবহার করা হয়ে আসছে যা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এটা যেন বোঝাতে চায় মৌলবাদী এর সব ধরনের প্রকাশে সম্পূর্ণই একরৈখিক। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। প্রতিটি ‘মৌলবাদ’ নিজেই একটি আইন এবং এর নিজস্ব গতিশীলতা রয়েছে। পরিভাষাটি এমন ধারণাও দেয় যে, মৌলবাদীরা উৎসগতভাবে রক্ষণশীল, অতীতচারী; কিন্তু তাদের ধারণাসমূহ আবিশ্যিকভাবেই আধুনিক ও দারুণভাবে উদ্ভাবনী ধরনের। আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরা তাদের ‘মৌলবিশ্বাসে’ ফিরে যেতে চেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তারা করেছে লক্ষণীয়ভাবে আধুনিক কায়দায়। এমনও যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, এই ক্রিশ্চান পরিভাষাটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অগ্রাধিকার বিশিষ্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ, মুসলিম ও ইহুদি মৌলবাদ মূলতঃ মতবাদ নিয়ে তেমন একটা সচেতন নয়, এটা আবিশ্যিকভাবেই ক্রিশ্চান সংশ্লিষ্ট বিষয়। ‘মৌলবাদে’র আক্ষরিক অনুবাদ থেকে আমরা উসুলিয়াহ শব্দ পাই, যার মানে দাঁড়ায় ইসলামি আইনের বিভিন্ন বিধান ও নীতিমালার উৎস নিয়ে গবেষণা। পশ্চিমে ‘মৌলবাদী’ হিসাবে তকমা পাওয়া বেশিরভাগ অ্যাক্টিভিস্টই ইসলামি বিদ্যাচর্চায় নিয়োজিত নয়, তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। সুতরাং ‘মৌলবাদ’ কথাটির ব্যবহার ভ্রান্তিকর।
অন্যরা অবশ্য এই বলে যুক্তি তুলে ধরেন যে, কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, ‘মৌলবাদ’ কথাটি টিকে থাকতেই এসেছে। আমি পরিভাষাটি যে সঠিক নয় তার সাথে একমত পোষণ করেছি, তবে আন্দোলনসমূহকে শনাক্ত করতে এটা কাজে লাগে, এবং তাদের ভেতরকার পার্থক্য সত্ত্বেও জোরাল পারিবারিক সাদৃশ্য রয়েছে। মার্টিন এ. মার্টি ও আর. স্কট অ্যাপলবী তাঁদের বিশালাকার ছয় খণ্ডের গ্রন্থ ফান্ডামেন্টালিস্ট প্রজেক্টের ভূমিকায় যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, সকল ‘মৌলবাদ’ নির্দিষ্ট কিছু প্যাটার্ন অনুসরণ করে চলে। আধ্যাত্মিকতার যুদ্ধংদেহী ধরন এগুলো, অনুমিত সঙ্কটের প্রতি সাড়া হিসাবে এদের উদ্ভব ঘটেছে। তারা এমন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত যাদের সেক্যুলারিস্ট বিশ্বাসসমূহ খোদ ধর্মের প্রতি বৈরী বলে বোধ হয়। মৌলবাদীরা এই যুদ্ধকে প্রচলিত রাজনৈতিক সংগ্রাম মনে করে না, বরং একে মহাজাগতিক শুভ ও অশুভ শক্তির ভেতরকার লড়াই হিসাবে কল্পনা করে। এরা নিশ্চিহ্নতার ভয়ে ভীত; তাই অতীতের নির্দিষ্ট কিছু মতবাদ ও অনুশীলনের নির্বাচিত পুনর্জাগরণের মাধ্যমে নিজেদের আসন-ছাড়া পরিচয়কে সংহত করার প্রয়াস পায়। দূষণ এড়াতে তারা প্রায়ই প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমাজের মূলধারা হতে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, কিন্তু মৌলবাদীরা বাস্তবতা বর্জিত স্বাপ্নিক নয়। তারা আধুনিকতার বাস্তবভিত্তিক যুক্তিবাদকে আত্মস্থ করে নিয়েছে, ক্যারিশম্যাটিক নেতার নির্দেশনায় তারা এইসব ‘মৌলবিশ্বাসকে’ পরিমার্জিত করে যাতে বিশ্বাসীদের কর্মপরিকল্পনার যোগান দেওয়ার মতো একটি আদর্শ নির্মাণ করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত পাল্টা লড়াই করে তারা, ক্রমবর্ধমান সংশয়বাদী এক বিশ্বকে আবার পবিত্র করে তোলার প্রয়াস পায়।
আধুনিক সংস্কৃতির প্রতি এই বৈশ্বিক সাড়ার নিগূঢ়ার্থ অনুসন্ধানের জন্যে তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বাস ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম ও ইসলামে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অল্প কয়েকটি মৌলবাদী আন্দোলনের প্রতি দৃষ্টি দিতে চাই আমি। এদের একটির থেকে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা আলাদাভাবে পর্যালোচনা না করে আমি এসবের বিকাশকে সময়ানুক্রমিকভাবে পাশাপাশি অনুসন্ধান করতে চাই, যাতে এগুলো কতটা গভীরভাবে একই রকম সেটা বুঝতে পারি। আমি বিষয়টিকে আরও বেশি গভীরতায় পরীক্ষা করার আশা করি, যাতে অধিকতর সাধারণ সামগ্রিক জরিপে তুলনায় অনেক বেশি ফল মিলবে। আমি যেসব আন্দোলন বেছে নিয়েছি সেগুলো হলো, আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদ, ইসরায়েলের ইহুদি মৌলবাদ এবং সুন্নী মুসলিম অধ্যুষিত মিশর ও শিয়া ইরানের মুসলিম মৌলবাদ। আমি এটা দাবি করছি না যে আমার আবিষ্কারসমূহ আবিশ্যিকভাবে মৌলবাদের অন্যান্য ধরনের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রভাবশালী এই বিশেষ আন্দোলনগুলো কীভাবে সাধারণ ভীতি, উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হয়েছে সেটা তুলে ধরার আশা করছি, যা আধুনিক সেক্যুলার বিশ্বের অদ্ভুত কঠিন জীবনের বিশেষ কিছু সমস্যার প্রতি সাড়া হিসাবে অস্বাভাবিক মনে হয় না।
সব যুগ ও ঐতিহ্যে সব সময়ই এমন লোক থাকে যারা তাদের সময়ে আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু আমাদের আলোচ্য মৌলবাদ আবিশ্যিকভাবেই বিংশ শতাব্দীর আন্দোলন। পশ্চিমে প্রথম আবির্ভূত বৈজ্ঞানিক ও সেক্যুলার সংস্কৃতির বিপক্ষে এটি একটি প্রতিক্রিয়া। পাশ্চাত্য সম্পূর্ণ নজীরবিহীন ও একেবারেই ভিন্ন ধরনের সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে, তবে তখন থেকেই তা বিশ্বের অন্যান্য এলাকায়ও শেকড় গেড়েছে। সুতরাং, এর প্রতি ধর্মের সাড়াও অনন্য ছিল। আমাদের নিজস্ব কালে বিকশিত মৌলবাদী আন্দোলনসমূহের আধুনিকতার সাথে একটি প্রতীকী সম্পর্ক রয়েছে। এগুলো পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, কিন্তু একে বাদ দিতে পারে না। পশ্চিমা সভ্যতা জগৎ পাল্টে দিয়েছে। ধর্মসহ কোনও কিছুই আর আগের মতো হয়ে উঠতে পারবে না। সারাবিশ্ব জুড়ে মানুষ এই নতুন অবস্থার সাথে যুঝে চলেছে, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক সমাজের জন্যে পরিকল্পিত ধর্মীয় ঐতিহ্যকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়েছে তারা।
প্রাচীন বিশ্বে একই ধরনের ক্রান্তিকাল গেছে, যার মেয়াদ ছিল মোটামুটিভাবে ৭০০ থেকে ২০০ বিসিই পর্যন্ত; ইতিহাসবিদগণ একে অ্যাক্সিয়াল যুগ বলেন, কারণ মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই সময়টি। খোদ সময় পর্বটি ছিল হাজার হাজার বছরের অর্থনৈতিক ও সেই সুবাদে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ফল ও সংশ্লেষ। বর্তমান ইরাকের সুমের ও প্রাচীন মিশরে এর সূচনা ঘটেছিল। বিসিই চতুর্থ ও তৃতীয় সহস্রাব্দের জনগণ তাদের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ফসল ফলানোর বদলে কৃষিতে উদ্বৃত্ত ফলানোয় সক্ষম হয়ে উঠেছিল। এর সাহায্যে তারা বাণিজ্য পরিচালনা করে আরও আয় অর্জন করতে পারত। এই বিষয়টিই তাদের প্রথম সভ্যতা গড়ে তুলতে, শিল্পকলার বিকাশ ও ক্রমবর্ধমানহারে শক্তিশালী রাজনীতির বিকাশে সক্ষম করে তুলেছিল: নগর, নগর- রাষ্ট্র ও শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্য। কৃষিভিত্তিক সমাজে ক্ষমতা আর স্থানীয় রাজা বা পুরোহিতদের করায়ত্ত ছিল না; এর কেন্দ্রবিন্দু অন্তত আংশিকভাবে হলেও প্রতিটি সংস্কৃতির সম্পদের উৎস বাজার এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। এমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষ শেষতক আবিষ্কার করতে শুরু করে যে তাদের পূর্বপুরুষদের দারুণভাবে উপকারে আসা প্রাচীন প্যাগান মতবাদ এখন আর তাদের অবস্থার সাথে খাপ খাচ্ছে না।
অ্যাক্সিয়াল যুগের নগর ও সাম্রাজ্যে সাধারণ জনগণ প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিস্তৃত দিগন্তের অধিকারী হয়ে উঠছিল, ফলে স্থানীয় কাল্টসমূহকে সীমিত ও সংকীর্ণ মনে হতে শুরু করেছিল। ঈশ্বরকে কিছু সংখ্যক দেবতার মাঝে সীমিত ভাববার বদলে মানুষ ক্রমবর্ধমানহারে একজন মাত্র বিশ্বজনীন দুর্ভেয় সত্তা ও পবিত্রতার উৎসের উপাসনা শুরু করেছিল। তাদের হাতে প্রচুর অবসর ছিল বলে আরও সমৃদ্ধ অন্তস্থঃ জীবন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়ে উঠেছিল; সেই অনুযায়ী তারা এমন এক আধ্যাত্মিকার আকাঙ্ক্ষা করতে শুরু করে যা কেবল বাইরের উপাদানের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল থাকবে না। সবচেয়ে সংবেদনশীলরা কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রতীয়মান হওয়া সামাজিক অবিচারের কারণে অস্বস্তিতে ভুগছিল; সাধারণ কৃষকদের উপর নির্ভরশীল ছিল সেটা যারা উঁচু সংস্কৃতি থেকে কোনওভাবেই কোনও রকম সুবিধা পেত না। পরিণামে পয়গম্বর ও সংস্কারকদের আবির্ভাব ঘটে, এঁরা আধ্যাত্মিক জীবনে সহানুভূতির গুণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জোর দিতে শুরু করেন: প্রতিটি মানুষের মাঝে পবিত্রতা প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা ও সমাজের অধিকতর নাজুক সদস্যদের বাস্তবভিত্তিক সেবা প্রদানের সদিচ্ছা প্রকৃত ধার্মিকতার পরীক্ষায় পরিণত হয়। এইভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগে মানবজাতিকে পথনির্দেশনা দিয়ে চলা মহান কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাসসমূহ সভ্য সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভারতে বুদ্ধধর্মমত ও হিন্দুধর্ম, দূরপ্রাচ্যে কনফুসিয় মতবাদ ও তাওবাদ। এগুলোর প্রধান পার্থক্য সত্ত্বেও অ্যাক্সিয়াল যুগের এইসব ধর্মের ভেতর অনেক সাধারণ মিল ছিল: একক সর্বজনীন দুয়ে ধারণার বিকাশ ঘটাতে এগুলো সবই প্রাচীন ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে, এক ধরনের অন্তস্থঃ আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেছে এবং বাস্তবভিত্তিক সহানুভূতির প্রতি জোর দিয়েছে।
আজকের দিনে, যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা একই ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। আধুনিক কালের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এর শেকড় প্রোথিত, যখন পশ্চিম ইউরোপের মানুষ ভিন্ন ধরনের সমাজের বিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছিল। কৃষি উদ্বৃত্তের উপর নির্ভরশীল নয়, এই সমাজ সম্পদকে সীমাহীনভাবে পুনরুৎপাদনে সক্ষম করে তোলা প্রযুক্তির নির্ভর ছিল। সত্যের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন জ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী ধর্মীয় পরিবর্তনের ফলে এর আগের চারশত বছরের বিপুল সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের সাথে অর্থনৈতিক পরিবর্তনসমূহ অগ্রসর হয়েছে। এবং আরও একবার ধর্মীয় পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিল। সারা বিশ্বে জনগণ জানতে পারছিল যে তাদের নাটকীয়ভাবে বদলে যাওয়া পরিবেশে বিশ্বাসের প্রাচীন ধরন আর কাজ করছে না। মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় আলোকন ও সান্ত্বনার যোগান দিতে পারছে না এগুলো। ফলে নারী- পুরুষ অ্যাক্সিয়াল যুগের সংস্কারক ও পয়গম্বরদের মতো ধার্মিক হয়ে ওঠার, অতীতের দর্শনের উপর ভিত্তি করে এমনভাবে নিজেদের গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে যা মানবজাতিকে নিজেদের জন্যে নির্মিত এক নতুন বিশ্বে নিয়ে যাবে। এইসব আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্যতম-আপাত তাকে যতই পরস্পরবিরোধী মনে হোক ন কেন—মৌলবাদ।
আমরা ধারণা করে নিতে চাই যে, অতীতের মানুষ (মোটামুটিভাবে) আমাদের মতোই ছিল; কিন্তু আসলে তাদের আধ্যাত্মিক জীবন অনেক ভিন্ন ছিল। বিশেষ করে ভাবনা, কথোপকথন ও জ্ঞান অর্জনের দ্বিমুখী ধারা গড়ে তুলেছিল তারা, পণ্ডিতরা যার নাম দিয়েছেন মিথোস ও লোগাস। দুটোই ছিল আবশ্যক: সত্যি অর্জনের ক্ষেত্রে উভয়কেই সম্পূরক মনে করা হত, দুটোরই তাদের ক্ষমতার বিশেষ অঞ্চল ছিল। মিথকে মৌল বিষয় মনে করা হত; আমাদের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সময়হীন ও ধ্রুব মনে করা বিষয়সমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল তা। জীবনের উৎস, সংস্কৃতির ভিত্তি ও মানব মনের গভীরতর স্তরে দৃষ্টি দিত তা। বাস্তব বিষয়আশয়ের সাথে মিথের কোনও সম্পর্ক ছিল না, ছিল অর্থের সাথে। আমাদের জীবনের এক ধরনের তাৎপর্য খুঁজে না পেলে, আমরা মরণশীল নারী-পুরুষ অনায়াসে হতাশায় ডুবে মরি। সমাজের মিথোস মানুষকে এক প্রেক্ষিতের যোগান দেয় যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অর্থ তুলে ধরে। এটা চিরন্তন ও সর্বজনীনের প্রতি তাদের মনোযোগ চালিত করে। আমরা যাকে অবচেতন মন বলব, এটা তাতেও প্রোথিত ছিল। আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হবে বলে মনে করা হয়নি এমন সব বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ছিল মনস্তত্ত্বের প্রাচীন ধরন। মানুষ পাতালে অবতরণ করে গোলকধাঁধায় সংগ্রামরত বা দানবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত বীরদের কাহিনী বর্ণনার সময় অবচেতন বলয়ের অস্পষ্ট এলাকাসমূহকে আলোয় তুলে নিয়ে আসত, একেবারেই যোক্তিক মনের অনুসন্ধানে যা বোধগম্য ছিল না; তবে আমাদের অভিজ্ঞতা ও আচরণের উপর যার গভীর প্রভাব ছিল। আমাদের আধুনিক সমাজে মিথের মৃত্যুর ফলে আমাদের অন্তস্থঃ জগতের মোকাবিলা করতে সাইকোঅ্যানালিসিসের বিজ্ঞানের উদ্ভাবন করতে হয়েছে।
যৌক্তিক প্রমাণ দিয়ে মিথকে তুলে ধরা সম্ভব নয়; এর আন্তর্দৃষ্টিসমূহ অধিকতর স্বজ্ঞাপ্রসূত: শিল্পকলা, সঙ্গীত, কবিতা বা ভাস্কর্যের মতো। কেবল কাল্ট, আচার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ধারণ করা হলেই মিথ বাস্তবে পরিণত হয়, উপাসকদের উপর নান্দনিকতার ভিত্তিতে কাজ করে, তাদের ভেতর পবিত্র তাৎপর্যের বোধ জাগিয়ে তোলে ও অস্তিত্বের গভীরতর প্রবাহ উপলব্ধিতে সক্ষম করে তোলে। মিথ ও কাল্ট পরস্পরের সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে কোনটার আবির্ভাব আগে ঘটেছে সেটা পণ্ডিতি বিতর্কের বিষয় হতে পারে: পৌরাণিক বিবরণ নাকি এর সাথে সংশ্লিষ্ট আচার।o মিথ আবার অতীন্দ্রিয়বাদের সাথেও সম্পর্কিত ছিল: স্বজ্ঞাপ্রসূত অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সকল সংস্কৃতিতে বিকশিত মনোসংযোগ ও একাগ্রতার ধাপবিশিষ্ট অনুশীলনের মাধ্যমে মনের গভীরে অবতরণ। কাল্ট বা মরমী চর্চা ছাড়া ধর্মের মিথসমূহ বিমূর্ত রয়ে যায় ও অবিশ্বাস্য ঠেকে, ঠিক যেমন আমাদের বেশিরভাগের কাছেই সঙ্গীতের সুর অস্পষ্ট রয়ে যায় ও এর সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্যে বিভিন্ন যান্ত্রিক অনুষঙ্গ দিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে।
প্রাক-আধুনিক বিশ্বে ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তারা আসলে কী ঘটেছিল তা নিয়ে আমাদের চেয়ে কম আগ্রহী ছিল। তারা বরং ঘটনার নিগূঢ় অর্থের ব্যাপারেই বেশি সংশ্লিষ্ট ছিল। ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহকে সময়ের দূরবর্তী প্রান্তের অনন্য সাধারণ ব্যাপার হিসাবে দেখা হত না, বরং একে অটল, সময়হীন বাস্তবতার প্রকাশ মনে করা হত। এই কারণে ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করার প্রবণতা দেখাত, কারণ সূর্যের নিচে কোনও কিছুই নতুন ছিল না। ঐতিহাসিক বিবরণসমূহ চিরন্তন মাত্রাকে বের করে আনার প্রয়াস পেত। এভাবে প্রাচীন ইসরায়েলিরা মিশর থেকে পালিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করার সময় আসলে কী ঘটেছিল সেটা আর আমরা জানতে পারি না। পরিকল্পিতভাবেই এই কাহিনীকে মিথ হিসাবে লেখা হয়েছে, এবং একে যাত্রার অন্যান্য কাহিনী, গভীরে প্লাবিত হওয়া ও এক নতুন বাস্তবতা সৃষ্টির জন্যে দেবতাগণের সাগর দুই ভাগ করার কাহিনীর সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর পাসওভার সেদারের আচারে ইহুদিরা এই মিথের অভিজ্ঞতা লাভ করে, এই উৎসব ওদের জীবনে কাহিনীটিকে নতুন করে ফিরিয়ে এনে একে তাদের নিজেদের কাহিনীতে পরিণত করতে সাহায্য করে। কেউ বলতে পারেন ঐতিহাসিক ঘটনাকে এইভাবে মিথে পরিণত করা না হলে, এবং অনুপ্রেরণাসৃষ্টিকারী কাল্টে রূপান্তরিত না করলে তা ধর্মীয় হতে পারবে না। ঠিক বাইবেলে যেভাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, মিশর থেকে এক্সোডাস সেভাবেই ঘটেছিল কিনা, এই প্রশ্ন উত্থাপন বা একে সত্যি প্রমাণ করার জন্যে বৈজ্ঞানিক বা ও ঐতিহাসিক প্রমাণ দাবি করা গল্পের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যকে ভুলভাবে গ্রহণ করার শামিল হবে। এটা হবে মিথোস-কে লোগোসে-র সাথে গুলিয়ে ফেলার মতো।
লোগোসও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লোগোস হচ্ছে এই বিশ্বে নারী- পুরুষকে কর্মক্ষম রাখার যৌক্তিক, বাস্তবভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা। আজকের দিনে পশ্চিমে আমরা হয়তো মিথোসের বোধ হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু লোগোসের সাথে আমরা বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। এটাই আমাদের সমাজের ভিত্তি। মিথের বিপরীতে লোগোস-কে অবশ্যই বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত হতে হবে ও বাইরের বাস্তবতার সাথে মিলতে হবে, যদি একে কার্যকর হতে হয়। জাগতিক বিশ্বে একে দক্ষতার সাথে ক্রিয়াশীল থাকতে হবে। আমরা যখন কোনও কিছু করতে যাই, কোনও কাজ সম্পাদন করতে চাই বা অন্য লোককে বিশেষ কোনও কাজে সম্মত করাতে চেষ্টা করি তখনই এই যৌক্তিক, আলোচনামূলক যুক্তি প্রয়োগ করে থাকি। লোগোস বাস্তবভিত্তিক। সূচনা ও ভিত্তির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপকারী মিথের বিপরীতে লোগোস দৃঢ়তার সাথে সামনে অগ্রসর হয় ও প্রাচীন দর্শনকে ব্যাখ্যা করার লক্ষ্য নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করে, পরিবেশের উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে, ও আনকোরা কিছু আবিষ্কার করে এবং নতুন কিছু উদ্ভাবন করে।
প্রাক আধুনিক বিশ্বে মিথোস ও লোগোস উভয়কেই অপহিার্য মনে করা হত। একটি ছাড়া অন্যটি অচল হয়ে পড়ত। কিন্তু তারপরেও এদুটো ছিল আবিশ্যিকভাবেই ভিন্ন; পৌরাণিক ও যৌক্তিক আলোচনাকে গুলিয়ে ফেলা বিপজ্জনক মনে করা হত। ভিন্ন ভিন্ন ছিল তাদের কাজ। মিথ যৌক্তিক ছিল না; এর বর্ণনা প্রায়োগিকভাবে তুলে ধরা যাবে বলে মনে হত না। এটা অর্থের একটা পরিপ্রেক্ষিত যোগাত যা আমাদের কর্মকাণ্ডকে মূল্যবান করে তুলত। মিথোসকে বাস্তবভিত্তিক কোনও নীতির ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করবেন আপনি, এমনটা ভাবা হত না। সেটা করে থাকলে ফলাফল ভয়াবহ রকম মারাত্মক হয়ে উঠতে পারত; কারণ মনের অন্তস্থঃ বিশ্বে যা চমৎকারভাবে কাজ করে সেটা চট করে বাইরের কর্মকাণ্ডে প্রয়োগ সম্ভব ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ, পোপ দ্বিতীয় আরবান যখন ১০৯৫ সালে প্রথম ক্রুসেডের ডাক দেন, তার পরিকল্পনা ছিল লোগোসের বলয়ের। তিনি চেয়েছিলেন ইউরোপের নাইটরা যেন পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘাত বন্ধ করে ও পাশ্চাত্য ক্রিশ্চান বিশ্বের ভিত্তি বিনষ্ট না করে চলে। এবং সেই শক্তিটুকু যেন তারা মধ্যপ্রাচ্যে ব্যয় করে তাঁর চার্চের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু এই সামরিক অভিযান লোক মিথলজি, বাইবেলিয় উপকথা ও প্রলয়বাদী ফ্যান্টাসির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে গেলে বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায় তার পরিণতি; বাস্তবক্ষেত্রে, সামরিক দিক থেকে ও নৈতিকভাবেও। দীর্ঘ ক্রুসেডিয় কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ সময় জুড়ে ব্যাপারটা এমন ছিল যে যখনই লোগোস আধিপত্য বজায় রেখেছে তখনই ক্রুসেডাররা সাফল্যের মুখ দেখেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে চমৎকার তৎপরতা দেখিয়েছে তারা, মধ্যপ্রাচ্যে উপযোগি কলোনী প্রতিষ্ঠা করেছে এবং স্থানীয় জনগণের সাথে অনেক বেশি ইতিবাচকভাবে মিশতে শিখেছে। তবে যখনই ক্রুসেডাররা তাদের নীতির ভিত্তিতে পৌরাণিক বা নিগূঢ় দর্শন তৈরি করতে গেছে, সাধারণত তারা পরাস্ত হয়েছে ও ভয়ানক সব নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে।
লোগোসের নিজস্ব সীমাবদ্ধতাও ছিল বৈকি। মানুষের বেদনা বা বিষাদের প্রশমন ঘটাতে পারত না এটা। যৌক্তিক যুক্তি-তর্ক ট্র্যাজিডির কোনও অর্থ করতে পারত না। লোগোস মানব জীবনের পরম মূল্য সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর যোগাতে পারেনি। একজন বিজ্ঞানী বিভিন্ন বস্তুকে আরও কার্যকরভাবে ক্রিয়াশীল করে তুলতে পারতেন, ভৌত বিশ্ব সম্পর্কে আবিষ্কার করতে পারতেন অসাধারণ সব নতুন তথ্য, কিন্তু তিনি জীবনের অর্থ ব্যাখ্যা করতে পারতেন না।” এটাই ছিল মিথ আর কাল্টের রাজত্ব।
তবে অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এমন বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে যে তারা ভাবতে শুরু করেছিল যে লোগোসই সত্যি জানার একমাত্র উপায়, মিথোসকে তারা মিথ্যা ও কুসংস্কার বলে নাকচ করে দিতে শুরু করে। এটাও ঠিক যে যে নতুন বিশ্ব নির্মাণ করতে যাচ্ছিল তারা সেটা প্রাচীন পৌরাণিক আধ্যাত্মিকতার গতিশীলতার সাথে বিরোধমূলক হয়ে উঠেছিল। আধুনিক বিশ্বে আমাদের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বদলে গেছে, ক্রমবর্ধমান হারে মানুষ বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকেই কেবল সত্যি হিসাবে দেখতে শুরু করায় তারা তাদের ধর্মবিশ্বাসের মিথোসকে প্রায়শঃই লোগোসে পরিণত করার প্রয়াস পেয়েছে। মৌলবাদীরাও একই প্রয়াস পেয়েছে। এই বিভ্রান্তি আরও বেশি করে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
আমাদের বিশ্ব কীভাবে বদলে গেছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। সুতরাং, এই বইয়ের প্রথম অংশ পঞ্চদশ শতকের শেষে ও সপ্তম শতকের গোড়ায় ফিরে যাবে, যখন পশ্চিম ইউরোপের জনগণ তাদের নতুন বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ঘটাতে যাচ্ছিল। ধর্মবিশ্বাসের প্রাচীন ধরনগুলো কীভাবে কাজ করত বোঝার জন্যে আমরা প্রাক আধুনিক কৃষিভিত্তিক সমাজের পৌরাণিক ধর্মানুরাগও পর্যালোচনা করব। সাহসী নতুন বিশ্বে প্রচলিত ধারায় ধার্মিক থাকা ক্রমবর্ধমানহারে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। আধুনিকায়ন সব সময়ই একটা বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া ছিল। সমাজের মৌলিক পবির্তন যখন বিশ্বকে অচেনা ও শনাক্তের অতীত করে তোলে মানুষ তখন বিচ্ছিন্ন ও দিশাহারা বোধ করতে শুরু করে। আমরা ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রিশ্চান, ইহুদি জনগণ ও মিশর ও ইরানের মুসলিমদের উপর আধুনিকতার প্রভাব অনুসন্ধানের চেষ্টা করব। তাহলেই আমরা উনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে মৌলবাদীরা ধর্মবিশ্বাসের এই নতুন ধরন সৃষ্টি করতে যাওয়ার সময় তারা আসলে কী করার চেষ্টা করছিল জানার মতো একটা অবস্থানে পৌঁছাতে পারব আমরা।
মৌলবাদীরা মনে করে তারা বুঝি তাদের পবিত্রতম মূল্যবোধকে আক্রান্তকারী শক্তির বিরুদ্ধে লাড়াই করছে। যুদ্ধের সময় সংঘাতে লিপ্ত থাকে যারা তাদের পক্ষে একে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করা দারুণ কঠিন হয়। আমরা দেখব যে, আধুনিকায়ন সমাজের মেরুকরণের দিকে চালিত করেছে, তবে অনেক সময় বিরোধের অবনতি ঠেকাতে আমাদের অবশ্যই অন্যপক্ষের বেদনা ও দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার প্রয়াস পেতে হবে। আমাদের ভেতর যারা- আমিসহ আধুনিকতার স্বাধীনতা ও সাফল্য ভোগ করে থাকি তাদের পক্ষে ধর্মীয় মৌলবাদীদের ক্ষেত্রে সেসবের কারণে সৃষ্ট দুর্গতি বোঝা কঠিন। তবু আধুনিকায়ন প্রায়শঃই মুক্তি নয় বরং আক্রমণাত্মক হামলা হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আধুনিক বিশ্বে ইহুদি জাতির তুলনায় খুব কমসংখ্যকই ভোগান্তির স্বীকার হয়েছে; সুতরাং, পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে আধুনিকায়নবাদী পাশ্চাত্য সমাজের সাথে তাদের বেদনাদায়ক সাক্ষাতের ঘটনা দিয়ে শুরু করাই সবচেয়ে মানানসই হবে, যা কোনও কোনও ইহুদিকে পরে নতুন বিশ্বে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হবে এমন নানা ধরনের রণকৌশল, অবস্থান ও নীতিমালার উদ্ভাবনের পথে চালিত করেছিল।
Leave a Reply