স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা : প্রয়াস ও পরিণতি – অমলেন্দু দে
স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা : প্রয়াস ও পরিণতি – অমলেন্দু দে
.
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ঢাকায় পাক সেনাবাহিনী কতৃক নৃশংসভাবে নিহত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ, প্রখ্যাত দার্শনিক
ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব
যিনি বাংলাদেশ বিভক্ত হওয়ার পরে পারিবারিক জীবনে পালিত মুসলিম পুত্র ও
মুসলিম কন্যাকে নিয়ে এক সুন্দর পরিবার গঠন করে বাঙালি জীবনে এক
নতুন আদর্শ স্থাপন করেন, এই গ্রন্থখানি সেই মহৎপ্রাণ, উচ্চ আদর্শের
অধিকারী শহিদের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হল।
.
ভূমিকা
স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা প্রয়াস ও পরিণতি গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নিহত হলে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। আবার পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় বামপন্থা ও কংগ্রেসের নিরন্তর সংঘাত এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। দুই বাংলার ওই অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে জনপ্রিয় ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে-র গ্রন্থটি যেন এক ঝলক মুক্ত বাতাস নিয়ে এসেছিল। আবার, বিগত শতাব্দীর আশির ও নব্বই-এর দশকে দেশভাগসংক্রান্ত গবেষণায় যখন জোয়ার এসেছিল, তখন গবেষকগণ ও চিন্তকগণ গ্রন্থটি সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহী হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তার কারণে এই গবেষণালব্ধ গ্রন্থটির সব কপি একে একে বিক্রি হয়ে গেলে ইতিহাস-সচেতন পাঠকগণ গ্রন্থটির অভাব বোধ করতে থাকেন। ব্যস্ততা ও নানান সমস্যার কারণে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ আর দেখে যেতে পারেননি। ২০১৪ সালের ১৬ মে দাবদাহের মধ্যে যখন নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়, তখন দীর্ঘ রোগভোগের পর অধ্যাপক দে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। গ্রন্থটির বিপুল চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিগ বুকসের পক্ষে শ্রীগৌরদাস সাহা ২০১৭ সালে যে দ্বিতীয় সংস্করণের উদ্যোগ নিলেন, তার জন্য অধ্যাপক-দের পরিবারের তরফ থেকে তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। গ্রন্থের ঐতিহাসিক মূল্যের কথা মনে রেখে প্রথম সংস্করণে লেখক যে ভূমিকা লিখেছিলেন তা অপরিবর্তিতভাবে দ্বিতীয় সংস্করণে সংযোজিত হল।
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পূর্বে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ারদি, আবুল হাশেম ও শরৎচন্দ্র বসু স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের যে পরিকল্পনা উত্থাপন করেন, তা কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক প্রজা পার্টিও এক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা নেয়নি। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ব্যবহার করে পরিশ্রমী ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে বাংলা তথা আধুনিক ভারতের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর অধ্যায় উপস্থাপনা করেছেন। নি:সন্দেহে মননশীল পাঠকের কাছে তা আদৃত হবে।
১৬ মে ২০১৭
ঐতিহাসিকের তৃতীয় প্রয়াণ দিবসে
অধ্যাপক ড. অমিত দে
ইতিহাস বিভাগ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
এই গ্রন্থে ১৯৪৬-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগের প্রাক্কালে অবিভক্ত বাংলার একটি বিশেষ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস থেকে ২০ জুন পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। এই সময়ে এক অবিভক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে শহিদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম ও শরৎচন্দ্র বসু আলোচনা শুরু করেন এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে তাঁরা একটি দলিল রচনা করে তাঁদের কল্পনাকে রূপদান করেন। স্বভাবতই এই পরিকল্পনা কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগ ইত্যাদি সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নেতৃত্বে এক গভীর আলোড়নের সৃষ্টি করে। কিন্তু কংগ্রেস ও লিগ নেতৃত্ব ভারত বিভাগের সঙ্গে পাঞ্জাব ও বাংলাদেশ বিভাগে সম্মত হওয়ায় স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের পরিবেশে যখন হিন্দু ও মুসলমান উভয়ে সন্দেহপ্রবণ হন এবং পরস্পরকে অবিশ্বাস করেন তখন স্বাধীন বঙ্গের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। একদিকে পাকিস্তান দাবিকে ভিত্তি করে ভারত বিভাগের দাবি ও তারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বঙ্গভঙ্গের আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জোরালো হয়। এই অবস্থায় ভারত বিভাগ মেনে নিয়ে স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠন করা সম্ভব ছিল কি না, এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠবে। আমি কোনো বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি কীভাবে বিষয়টির সম্মুখীন হন তার ওপরেই আলোচনা নিবদ্ধ রেখেছি। আশা করি, তা থেকে পাঠকবর্গ স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে পারবেন।
তা ছাড়া, আর একটি প্রশ্ন বারে বারে মনকে নাড়া দেয়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে শিক্ষিত হিন্দুসমাজ গর্জে ওঠেন, তাঁদেরই একটি অংশ অথবা উত্তরপুরুষেরা কী কারণে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে জনমত গঠন করেন? ইতিহাসের এই নির্মম ও করুণ পরিহাস নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর আত্মবিশ্লেষণ এখনও শুরু হয়নি। এই বিষয়ের প্রতি গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাও এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, সম্প্রতি ভারতবর্ষে ও বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে অথবা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে কোনো আলোচনা এইসব গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এই অভাব কিছুটা পূরণের উদ্দেশ্যেই আলোচ্য গ্রন্থখানি রচিত।
১৯৭০-১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে যখন ‘পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক’ সম্পর্কে লিখতে শুরু করি তার অনেক আগেই স্বাধীনবঙ্গ গঠনের বিষয়ের ওপর তথ্যসমূহ সংগ্রহ করি। তখনই এই বিষয়ে একখানি পুস্তিকা রচনার আগ্রহ ছিল। কিন্তু অন্য কাজের চাপে তা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ‘শেরে বাংলা স্মৃতি সংসদ’-এর সাধারণ সম্পাদক মোহম্মদ আবদুল খালেকের নিকট থেকে ‘শেরে বাংলা স্মারক সঙ্কলন গ্রন্থে’ একটি প্রবন্ধ দেওয়ার আমন্ত্রণপত্র পাই। জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. এ এফ সালাউদ্দিন আহমেদও আমাকে এই সংকলন গ্রন্থে একটি প্রবন্ধ পাঠাতে অনুরোধ করেন। এই গ্রন্থের জন্য আমি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠাই। প্রবন্ধটির নাম হল : ‘অবিভক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা ও তার পরিণতি’। এই প্রবন্ধটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত এই সংকলন গ্রন্থে মুদ্রিত হয়েছে। আলোচ্য গ্রন্থখানি এই প্রবন্ধের বর্ধিত রূপ। সুতরাং, এই গ্রন্থখানি মোহম্মদ আবদুল খালেকের ও ড. এ এফ সালাউদ্দিন আহমেদের আগ্রহের জন্যই রচিত হল, তা বলাই বাহুল্য। এই উপলক্ষ্যে তাঁদের আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ইউজিসি অধ্যাপক ড. জগদীশ নারায়ণ সরকার ও আমার বড়োমামা ডা. সতীশচন্দ্র দে আগ্রহ প্রকাশ করায় এই গ্রন্থ রচনায় উৎসাহিত হয়েছি। রত্না প্রকাশনের শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র দে খুব দ্রুত গ্রন্থখানি মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন। আর মুদ্রণ পারিপাট্যের কৃতিত্ব তুষার প্রিন্টিং ওয়ার্কস-এর। নির্দেশিকা তৈরি করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের গ্রন্থাগারিক শ্রীবিনয়ভূষণ রায়। প্রুফ দেখার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেন, চেতলা নিবাসী শ্রীমোহনলাল মন্ডল (টুলু)। আর প্রচ্ছদপট অঙ্কন করেন প্রখ্যাত শিল্পী শ্রীখালেদ চৌধুরী। তাঁদের প্রত্যেককে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
অমলেন্দু দে
Leave a Reply