স্বপ্নবাসবদত্তা – ভাস
অনুবাদ – শ্রী মুরারিমোহন সেন
ভূমিকা
নাট্যকার ভাস
দীর্ঘকাল যাবৎ সংস্কৃত সাহিত্যের প্রখ্যাত নাট্যকার ভাস কেবল আভাসরূপেই বিরাজিত ছিলেন, তবে সে-আভাষ খুবই স্পষ্ট, প্রদীপ্ত এবং ব্যক্তিত্বের মহিমায় উজ্জ্বল। শুধু ব্যক্তিটিকেই চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না!
‘মালাবিকাগ্নিমিত্র’ নাটকে স্বয়ং কবি কালিদাসের সশ্রদ্ধ উক্তি—‘প্রথিতযশসাং ভাস-সৌমিল্ল-কবিপুত্রাদীনাং প্রবন্ধান্ অতিক্রম্য বর্তমানকবেঃ কালিদাসস্য কৃতৌ কিং কৃতো বহুমানঃ’? ‘প্রথিতযশসাং’ বিশেষণটি তুচ্ছ করা চলে না। সপ্তমশতকে বাণভট্ট তাঁর হর্ষচরিতে লিখেছেন—
‘সূত্রধারকৃতারম্ভৈ র্নাটকৈ র্বহুভূমিকৈঃ।
সপতাকৈ যশো লেভে ভাসঃ দেবকুলৈরিব।।’
অর্থাৎ ভাস-রচিত নাটকগুলোর লক্ষণ এই—সূত্রধারের প্রবেশের সঙ্গে এইসব নাটকের সূচনা, এগুলোতে আছে বিভিন্ন শ্রেণির বহু চরিত্রের সমাবেশ আর রয়েছে আখ্যানের বৈচিত্র্য। এ-যেন পতাকা শোভিত বহুতলসম্পন্ন সুদৃশ্য মন্দিরের বিন্যাস। এইসব নাটকের গুণেই ভাস খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অষ্টম শতকে বাক্পতিরাজ তাঁর ‘গৌড়বহো’ কাব্যে ভাসকে বর্ণনা করেছেন অগ্নির মিত্ররূপে (‘ভাসে জ্বলনমিত্রে’)। দশম শতকে রাজশেখর তার ‘সূক্তিরত্নাবলী’তে বলেছেন—
‘ভাসনাটকচক্রহপি ছেকৈঃ ক্ষিপ্তে পরীক্ষিতুম্।
স্বপ্নবাসবদত্তস্য দাহকোহভূন্নপাবকঃ।।’
ভাস-রচিত ‘স্বপ্ন-বাসবদত্তম্’ নাটক সমালোচনার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এই শ্লোকে রাজশেখর দুটি মূল্যবান মন্তব্য করেছেন, ভাস-রচিত ‘নাটকচক্রের’ অস্তিত্ব ছিল এবং ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দশম-একাদশ শতকের আলঙ্কারিক অভিনবগুপ্ত তাঁর টীকার বহুস্থলে ভাসের উল্লেখ করেছেন-
(ক) ক্বচিৎ ক্রীড়া। যথা স্বপ্নবাসবদত্তায়াম্… (স্বপ্নবাসবদত্তা নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে এই কন্দুকক্রীড়ার কথা আছে)
(খ) মহাকবিনা ভাসেনাপি স্বপ্রবন্ধে উক্তম্―(‘অভিনবভারতী’–রৌদ্ররসের ব্যাখ্যায়)।
দ্বাদশ শতকে শারদা-তনয় তাঁর ‘ভাবপ্রকাশ’ গ্রন্থে প্রশান্ত নাটকের উদাহরণ দিতে গিয়ে স্বপ্নবাসবদত্তার প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং ওই নাটকের ষষ্ঠ অঙ্ক থেকে একটি শ্লোকও উদ্ধৃত করেছেন—
‘চিরপ্রসুপ্তঃকামো মে বীণয়া প্রতিবোধিতঃ।
তাং তু দেবীং ন পশ্যামি যস্যা ঘোষবতী প্রিয়া! (স্বপ্ন—ষষ্ঠ অ)
দ্বাদশ শতকে জয়দেবের একটি বিখ্যাত উক্তিও এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। ‘যস্যা ভাসো হাসঃ কবিকুলগুরুঃ কালিদাসো বিলাসঃ’। এখানে বলা হয়েছে ভাস হলেন কাব্যলক্ষ্মীর হাসি আর কালিদাস তাঁর বিলাসকথা।
বিস্তরেণালম্। বিখ্যাত কবি, নাট্যকার ও আলঙ্কারিকগণের উক্তি ছাড়াও বিভিন্ন শ্লোকসংগ্রহে ও অলঙ্কার শাস্ত্রে ভাসের রচনা উদ্ধৃত হয়েছে, ভাসের সংপ্রশংস উল্লেখ রয়েছে, যাতে এটুকু অন্তত স্পষ্ট হয় যে কালিদাসের পূর্বে ভাস নামে একজন সুবিখ্যাত নাট্যকার বর্তমান ছিলেন এবং তিনি একাধিক নাটক (নাটকচক্র) রচনা করেছিলেন
ভাস নাটকচক্র
ভাস নাটকচক্রের কথা প্রথম উল্লেখ করেছিলেন রাজশেখর দশম শতকে। কিন্তু বহুকাল পর্যন্ত একটিও নাটক আমাদের হস্তগত হয়নি। প্রায় হাজার বছর পরে সংস্কৃত সাহিত্যের এক অজ্ঞাত রহস্য-জগতের দ্বার উন্মোচন করলেন মহামহোপাধ্যায় গণপতি শাস্ত্রী। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবাঙ্কুর রাজ্য-সরকার গণপতি শাস্ত্রীর পরিচালনায় সংস্কৃত-সাহিত্যের অপ্রকাশিত রচনা প্রকাশনার জন্য একটি বিভাগ স্থাপন করেন। পুঁথির সন্ধানে ব্যাপৃত থাকাকালে পণ্ডিত গণপতি শাস্ত্রী পদ্মনাভপুরের কাছে ‘মনলিক্কর মঠম্’ নামক স্থানে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। একটি তালপাতার পুঁথি, মালয়ালম হরফে লেখা। এই পুঁথিতে যে সম্পূর্ণ নাটকগুলো পাওয়া গেল তাদের নাম—স্বপ্নবাসবদত্তম্, প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণম্, পঞ্চরাত্রম, চারুদত্তম্, দূতঘটোৎকচম্, অবিমারকম্, বালচরিতম্, মধ্যমব্যায়োগম্, কর্ণভারম্ ও উরুভঙ্গম্।
এই দশটি ছাড়াও আরও একটি অসম্পূর্ণ নাটক পুঁথিতে ছিল। পরে আরও দুটি নাটক আবিষ্কৃত হল। এইভাবে মোট নাটকের সংখ্যা দাঁড়াল তেরোটি। পরবর্তী তিনটি নাটকের নাম—প্রতিমানাটকম্, অভিষেকনাটকম্ ও দূতবাক্যম্।
এই তেরোটি নাটকের মধ্যে চারটি শ্রেণি লক্ষ করা যেতে পারে :
(ক) রামায়ণের কাহিনী নিয়ে রচিত—প্রতিমা, অভিষেক।
(খ) মহাভারতের কাহিনী নিয়ে রচিত একাঙ্ক নাটক—মধ্যমব্যায়োগ, দূতবাক্য, দূতঘটোৎকচ, কর্ণভার, ঊরুভঙ্গ এবং তিন অঙ্কের নাটক—পঞ্চরাত্র।
(গ) হরিবংশের কাহিনী নিয়ে রচিত চারুদত্ত। (মহাভারতের অন্তর্গত) কৃষ্ণ-উপাখ্যান নিয়ে রচিত—বালচরিত।
(ঘ) কল্পিত বা প্রাচীন কাহিনী থেকে উপাদান নিয়ে রচিত—স্বপ্নবাসবদত্তা, প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ, অবিমারক, চারুদত্ত।
এই তেরোটি নাটক যে এই লেখকের লেখা তা অধিকাংশ সমালোচক মেনে নিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি এই :
১. নাট্যারম্ভে সবগুলো নাটকেরই একইরকম মঞ্চ নির্দেশ—‘নান্দ্যন্তে ততঃ প্রবেশতি সূত্রধারঃ’ অন্যান্য সংস্কৃত নাটকের সূচনায় থাকে নান্দী—তারপর থাকে এই নির্দেশনা—‘নান্দ্যতে সূত্রধারঃ
২. সর্ব নাটকেই ‘প্রস্তাবনা’র পরিবর্তে ‘স্থাপনা’ শব্দটির প্রয়োগ।
৩. কোনো নাটকেই নাট্যকারের নাম নেই—অন্যান্য সংস্কৃত নাটকে নাট্যকারের
নাম ও পরিচয় থাকে।
৪. প্রারম্ভিক শ্লোকে প্রধান পাত্রপাত্রীদের নাম উল্লেখ।
৫. নাটকগুলোতে প্রায় একইরকম (সামান্য পরিবর্তন ছাড়া) ভরতবাক্যের প্রয়োগ—ইমামপি মহীং কৃৎস্নাং রাজসিংহঃ প্ৰশাস্তু নঃ।
৬. নাটকগুলোতে ভাষা ও রচনারীতির সাদৃশ্য। এই রূপকল্প, একই ধরনের শব্দগুচ্ছের বা বাক্যের পুনরাবৃত্তি।
৭. সব নাটকেই আর্যপ্রয়োগ সগৌরবে বিরাজমান।
৮. নাট্যশাস্ত্রের নির্দেশ—মঞ্চে মৃত্যু বা যুদ্ধ দেখান চলবে না, আলোচ্য নাটকগুলো এ বিধি সম্পর্কে উদাসীন।
বিদগ্ধ সমালোচকের দৃষ্টিতে হয়তো আরও কিছু সাদৃশ্য ধরা পড়বে, যাতে এই সিদ্ধান্তই অনিবার্য হয়ে উঠবে যে নাটকগুলো একই নাট্যকারের লেখনী-নিঃসৃত।
কিন্তু কে সেই প্রতিভাবান নাট্যকার?
বহু যুক্তিতর্কের দ্বারা পণ্ডিত গণপতি শাস্ত্রী প্রমাণ করেছেন ভাসই এই নাটকগুলোর রচয়িতা। তাঁর সিদ্ধান্তের প্রধান ভিত্তি অবশ্য বাণভট্টের এবং রাজশেখরের উক্তি। এই উক্তির আলোচনা আমরা আগেই করেছি।
ভাস সমস্যা নিয়ে একদিন সাহিত্য-মহলে তর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। একদল ভাসের কর্তৃত্ব মানেননি আর একদল সূক্ষ্ম বিচার ও গবেষণার পর ভাসকেই রচয়িতা বলে স্বীকার করেছেন। দুই শিবিরেই লব্ধপ্রতিষ্ঠ মনীষীগণ যোগদান করেছিলেন। কোন সংখ্যা ভারি ছিল সে বিচারের প্রয়োজন নেই, কেননা ভোটের জোরে সত্যের প্রতিষ্ঠা হয় না, সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তির বলে।
কতকগুলো প্রথম শ্রেণির নাটক আমাদের হাতে এসেছে। রচনায় ঐশ্বর্য সম্পর্কে দ্বিমত নেই, থাকতেও পারে না। এটুকু অন্তত বলা যেতে পারে যদি এই নাটকগুলোর রচয়িতা ভাস না-ও হন তাহলে যথার্থ ভাস যে গৌরবের অধিকারী ছিলেন আলোচ্য নাটকগুলোর রচয়িতাকে সেই ভাসেরই মর্যাদা দানে কোনো বাধা থাকতে পারে না। যুক্তিকে তুচ্ছ করে ভাস নামক একজন নাট্যকার হয়তো ছিলেন শুধু এই সম্ভাব্যতাটুকু নিয়ে ঘর করা কঠিন। এতদিন ভাসের নাটক পাইনি, পেয়েছি তাঁর নাটক থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি; এবং আবিষ্কৃত নাটকগুলোতেও সেই উদ্ধৃতির মিল আমরা উপেক্ষা করব কোন যুক্তিতে? Dr. Ke।th-এর মন্তব্য এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন—‘To ।gnore these co।nc।dences and to leave us w।th an anonymus dramat।st of h।ghest ।nd।an rank ।s to demand to much from probab।l।ty.’
নাটকগুলোর ভাষা, গঠনপ্রকৃতি, পরিবেশনা সবকিছু খুঁটিয়ে দেখলে একথা সহজেই মেনে নেওয়া যায় যে এগুলো একই লেখনীপ্ৰসূত। কোথাও নাট্যকারের নাম নেই একথা সত্য, কিন্তু ভাস-রচিত স্বপ্নবাসবদত্তম্ দশম শতকের রাজশেখরের নিকটে অজ্ঞাত ছিল না। কোনো-কোনো আলঙ্কারিক এবং শ্লোক সংগ্রাহকও এই নাটকের কথা জানতেন। অভিনবগুপ্ত, ভোজদেব, শারদা-তনয়, সাগরনন্দী প্রভৃতি উল্লিখিত নাটকে কয়েকটি পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন, অবশ্য ভাসের নাম তাঁরা বলেননি। রামচন্দ্র এবং গুণচন্দ্রের (দ্বাদশ শতক) সাক্ষ্যও কি উপেক্ষার যোগ্য? তাঁরা তাঁদের ‘নাট্যদর্পণ’ গ্রন্থে বলেছেন ‘যথা ভাসকৃতে স্বপ্নবাসবদত্তে শেফালিকা শিবাতনমবলোক্য বৎসরাজঃ’…! এখানে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে ভাসের নাম।
প্রাচীন সংগ্রহ গ্রন্থগুলোতে ভাস-রচিত পনেরটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। কারো কারো মতে শ্লোকের সংখ্যা তেরো। তেরো সংখ্যাটিই কি অশুভ? অভিযোগ এই শ্লোকগুলো আবিষ্কৃত নাটকগুলোতে নেই। কিন্তু এই না-থাকাটা নানা কারণেই সম্ভব হতে পারে : (১) ভাস হয়তো আরো অনেক নাটক লিখেছিলেন। শ্লোকগুলো হয়তো এই অনাবিষ্কৃত নাটকগুলোর অন্তর্গত। (২) শ্লোকগুলি হয়তো তাঁর বিক্ষিপ্ত রচনা। (৩) শ্লোকগুলো হয়তো আবিষ্কৃত নাটকগুলোরই অন্য কোনো সংস্করণে গৃহীত হয়ে থাকবে। (৪) শ্লোক সংগ্রাহকগণই হয়তো ভুল করে শ্লোকগুলো ভাস-রচিত বলে ঘোষণা করেছেন। এইজাতীয় ভুল শ্লোক সংগ্রাহকগণ সাধারণত করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে—সপ্তম শতকের লেখক মহেন্দ্র বিক্রমবর্মার রচিত ‘মত্তবিলাস’ নামক প্রহসনের একটি শ্লোক ভাস রচিত বলে ঘোষিত হয়েছে। (৫) এই সকল সংগ্রহগ্রন্থে দেখা যায় কোনো কোনো শ্লোক হয়তো কালিদাস বা অশ্বঘোষের রচিত বলে ঘোষিত হয়েছে, কিন্তু সেইসব শ্লোক তাঁদের প্রচলিত গ্রন্থগুলোতে দুর্লভ। তাতে কি কালিদাস বা অশ্বঘোষের প্রচলিত রচনাগুলোকে ‘ভেজাল’ বলে নিগৃহীত করা সম্ভব?
ভাসের কাল
ভাসের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। রচনার মধ্যে তিনি নিজের সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব। কিন্তু তাঁর আবির্ভাবকাল সম্পর্কে মোটামুটি একটা আলোচনা চলতে পারে।
অবশ্য ভাসের কাল নিয়ে পণ্ডিতবর্গের বিতর্ক ও কুতর্কের অভাব নেই। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত লেখক এ সম্পর্কে মত প্রকাশ করেছেন; সে-মতামত এত অস্থির যে দীর্ঘপথ অতিক্রমেও সঙ্কুচিত নয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় একাদশ শতক!—প্রায় দেড় হাজার বছরেরও অধিককালের মধ্যে যে কোনো সময়ে ভাসের আবির্ভাব ঘটেছে এইটেই ধরে নিতে হয়। এদের আলোচনা পড়লে যে কোনো নিরপেক্ষ এবং নির্দলীয় পাঠকের মনে হবে, এরা নিজেদের পাণ্ডিত্যের অহমিকাকেই অনুসরণ করেছেন, যুক্তিকে আমল দেননি। সাল-তারিখ নিয়ে পণ্ডিতেরা বিবাদ করেন করুন, কল্পনার এই যথেচ্ছ বিহারকে কোনোক্রমেই সমর্থন করা চলে না। কালিদাস ভাসের সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছেন। সুতরাং ভাস কালিদাসের পূর্ববর্তী এ সম্পর্কে সন্দেহ থাকতে পারে না। কালিদাসকে যদি চতুর্থ শতকের কবি (উজ্জয়িনীর কালিদাস সমিতি বলেন, কবির আবির্ভাব খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে) বলে ধরে নিতে হয় তবে অন্তত এক শতাব্দী আগেই ভাস সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন এটা মেনে নিতেও অসুবিধে হয় না। সুতরাং ভাস খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের লেখক। স্টেন কোনো, জলি, এ, বি, কিথ, ভাণ্ডারকর প্রভৃতি এই মতের পোষক। ভাস Ep।c Style-এ লিখেছেন। তাঁর রচনাশৈলীতে ভাষার স্বচ্ছন্দ প্রবাহ মহাকাব্যোচিত স্নিগ্ধ প্রসাদগুণে পূর্ণ, এই যুক্তিতেই তাঁকে টেনে মহাকাব্যের যুগে নিয়ে যেতে হবে এর কোনো অর্থ নেই। তাঁর ভাষা স্থানে স্থানে পাণিনি ব্যাকরণ সূত্র লঙ্ঘন করেছে। এর জন্যেই বলতে হবে পাণিনির আগে তিনি জন্মেছিলেন? পাণিনির পরবর্তীকালেও বহু লেখকের রচনায় অপাণিনীয় প্রয়োগ রয়েছে। ভাস ভারতের নাট্যশাস্ত্রের বিধি লঙ্ঘন করেছেন। এ থেকেও তাঁর জন্মকাল সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। তিনি হয়তো অন্য কোনো ‘নাট্যশাস্ত্র’ অনুসরণ করেছেন। তাঁর লেখাও নাকি একটি ‘নাট্যশাস্ত্র’ ছিল বিদগ্ধমহল এই মত স্বীকার করে নিয়েছেন। সুতরাং তিনি নিজেকেই নিজে অনুসরণ করেছেন, এমন সিদ্ধান্তে বাধা নেই। কিংবা পাণিনিতে যে ‘নটসূত্রে’র উল্লেখ রয়েছে তাকেই তিনি আদর্শ করেছিলেন। উদয়ন, প্রদ্যোত, দর্শক এঁরা ঐতিহাসিক চরিত্র এবং এঁদের কেউ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পরবর্তী নন। সুতরাং লেখক ভাসকেও সেই ষষ্ঠ শতকেই নিয়ে যেতে হবে, যেহেতু তিনি এইসব চরিত্র নিয়ে নাটক লিখেছেন?
এঁদের ভাসভক্তি এত প্রগাঢ় যে তাকে ধূসর অতীতের অস্পষ্ট আলোয় রেখে তার একটা রোমান্টিক ভাবমূর্তি গড়ে তোলাটাই এঁদের বিলাস, যুক্তিবিচারের কথা এখানে ওঠে না।
অবশ্য যতদিন না নতুন তথ্যের আবিষ্কার হয় ততদিন ভাসের কাল-প্রশ্নটি ভাবীকালের হাতেই তোলা রইল। আপাতত খ্রিস্টীয় ‘দ্বিতীয় শতক’ নিয়ে কাজ চলতে পারে।
ভাসকে যাঁরা খ্রিস্টপূর্ব শতকে নিয়ে যেতে আগ্রহী, আগ্রহের বশেই হয়তো একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁরা উদাসীন হয়ে থাকেন। এঁদের মধ্যে স্বয়ং মহামহোপাধ্যায় গণপতি শাস্ত্রী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ভিদে দীক্ষিতকর, পুশলকর, পরাঞ্জপে প্রভৃতি প্রধান। ভাসের ভাষা সম্পর্কে এঁদের প্রধান বক্তব্য—পতঞ্জলির সময়ে পাণিনির সংস্কৃত আর কথ্যভাষা ছিল না! কিন্তু ভাসের সংস্কৃত কথ্য ভাষাগন্ধী; সুতরাং যখন সংস্কৃত কথ্যভাষা ছিল, ভাস সেই সময়কার লেখক। অর্থাৎ তিনি পতঞ্জলির পূর্বে এমনকি কাত্যায়ন, পাণিনির পূর্বে জীবিত ছিলেন।
আমাদের বক্তব্য—পাণিনির সংস্কৃত খ্রিস্টীয় শতকগুলোতেও কথ্যভাষা ছিল, অন্তত সমাজের অভিজাতমহলে। পরবর্তী অলঙ্কার শাস্ত্রগুলোতে নাটকের বিভিন্ন পাত্রপাত্রীর মধ্যে ভাষা বিভাগের কথা বলা হয়েছে, কারা সংস্কৃত বলবেন তাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া কালিদাস প্রভৃতি বৈদভী রীতির লেখকদের রচনাতেও সহজ সংস্কৃতের মধ্যে কথ্যভাষার বাগভঙ্গি ধরা পড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, কবে সংস্কৃত ভাষা কথ্যভাষা হিসেবে ‘অচল’ হয়ে গেল, সেই সম্পর্কে শেষকথা বলবার অধিকারী কে? প্রশ্নটি এখনও বিতর্কমূলক।
আর একটি কথা। ভাসের ব্যবহৃত প্রাকৃত নিঃসন্দেহে খ্রিস্টীয় শতকের। খ্রিস্টীয় শতকের কিছু আগে স্বরমধ্যবর্তী অঘোষ ব্যঞ্জনের ‘ঘোষীভবন’ শুরু হয়েছিল (জানাতি>জাণাদি, পীড়িতঃ>পীড়িদো; উপরতা>উবরদা)—ঘোষীভূত ব্যঞ্জন লুপ্ত হতে শুরু করেছে খ্রিস্টীয় শতকের গোড়ার দিকে। (ওষ্ঠগতম্? ওট্ঠগঅং; লাবাণক> লাবাণঅ।) আশা করি এ ব্যাপারে আচার্য সুনীতিকুমারের সাক্ষ্যের প্রয়োজন হবে না। ভাসের প্রাকৃত সংলাপে ঘোষবর্ণের লোপ, অ-লোপ দুই-ই আছে। সুতরাং ভাস দ্বিতীয় শতকের লেখক এ অনুমান যুক্তিসহ। ভাস কালিদাসের সময়ে লব্ধপ্রতিষ্ঠ; কালিদাস গুপ্তযুগের কবি, চতুর্থ শতকের কবি, এ সম্পর্কে যুক্তিবিন্যাস করার অবকাশ এখানে নেই।
পরবর্তী নাট্যসাহিত্যে ভাসের প্রভাব
পরবর্তী নাট্যকার কালিদাস, ভবভূতি ও শূদ্রক এই তিনজনের ওপরেই ভাস অল্পাধিক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। কালিদাস যে ভাসের প্রতিভা স্বীকার করতেন তা তাঁর ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটকের সশ্রদ্ধ উল্লেখ থেকেই বুঝতে পারা যায়। খুবই স্বাভাবিক যে তিনি তাঁর রচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
ভাসের অবিমারক নাটকে ‘চন্দ্রভার্গবা’র অভিশাপের প্রসঙ্গ আছে। শকুন্তলা নাটকের দুর্বাসার অভিশাপ কি এর দ্বারা প্রভাবিত? অবশ্য এটা হতে পারে নাটকে কোনো অভিশাপকে কাজে লাগাবার তথ্যটুকু হয়তো কালিদাস ভাসের নাটক থেকেই পেয়েছিলেন, কিন্তু দুর্বাসার অভিশাপের নাটকীয় এবং নৈতিক তাৎপর্য এত গভীর যে স্বীকার করতেই হবে কালিদাস ঋণী হয়েও একান্তভাবে মৌলিক। শাপের অবসানে প্রেমিক-প্রেমিকার পুনর্মিলন ভাসের নাটকেও আছে। তবু ভাসের প্রেমভাবনা কালিদাসীয় শীর্ষে উঠতে পারেনি।
প্রতিমা নাটকে সীতা কৌতুকের ছলেই বল্কলের পোশাক পরেছেন—সখি অবদাতিকা তাকে দেখে বলে উঠলেন, ‘সর্বশোভনীয়ং সুরূপং নাম’ অর্থাঃ সৌন্দর্য সবকিছুকেই শোভনীয় করে তোলে। শকুন্তলাকে বল্কলসজ্জায় দেখে দুষ্মন্তের উক্তি ‘কিমিব হি মধুরাণাং মণ্ডনং নাকৃতীনাম!’ নিশ্চয়ই মনে পড়বে।
ভাস ও কালিদাসের কয়েকটি উক্তি পাশাপাশি রেখে তাদের সাদৃশ্য উপভোগ করা যেতে পারে :
ভাস | কালিদাস |
১. পদ্মাবতী—অনেন বহুমানবচনেন অনুগৃহীতাস্মি। (স্বপ্ন—১) | রাজা—ভবতীনাং সুনৃতয়েব গিরা কৃতমাতিথাম্। (শকুন্তলা-১) |
২. রাজা—(লব্ধাং বীণাং প্রতি) শ্রুতিসুখনিনদে কথং নু দেব্যা স্তনযুগলে জঘনস্থলে চ সুপ্তা। বিহগগণরজো বিকীর্ণদণ্ডা প্রতিভয়মধ্যুষিতাস্যরণ্যবাসম্ ॥ (স্বপ্ন—৬) | রাজা—(অঙ্গুরীয়কং প্রতি) কথংনু বন্ধুর কোমলাঙ্গুলিং করং বিহায়াসি নিমগ্নমন্তসি অচেতনং না গুণং ন লক্ষয়েন্ ময়ৈব কস্মাদবধীরিতা প্রিয়া। (শকুন্তলা—৬) |
৩.বিবাহো নাম বহুশঃ পরীক্ষা কর্তব্যা ভবন্তি (অবিমারক—১) | অতঃ পরীক্ষা কর্তব্যং বিশেষাৎ সঙ্গতং রহঃ (শকুন্তলা—৫) |
৪. অহো ভবিতব্যস্য প্রভাবঃ! (অবিমারক) | অথবা ভবিতব্যানাং দ্বারাণি ভবন্তি সর্বত্র! (শকুন্তলা—১) |
৫. দ্রুমা ধাবন্তীব দ্রুতরথগতিক্ষীণবিষয়া নদীবোদ্ধৃত্বাম্বু নিপতিত মহী নেমিবিরে! (প্রতিমা —৩) | যদালোকে সূক্ষ্মং ব্ৰজতি সহসা তদ্বিপুলতাম যদদ্ধাবিচ্ছিন্নং ভবিত কৃতসন্ধানমিব তৎ। (শকুন্তলা—১) |
৬.আপৃচ্ছ পুত্রকৃতকান্ হরিণান্ দ্রুমাংশ্চ (প্রতিমা —৫) | সোহয়ং ন পুত্রকৃতকঃ পদবীং মৃগস্তে (শকুন্তলা —৪) |
৭. যোহস্যা করঃ শাম্যতি দর্পণেহপি স নৈতি খেদং কলশং বহন্ত্যাঃ। কষ্টং বনং স্ত্রীজনসৌকুমার্য্যম্ সমং লতাভিঃ কঠিনীকরোতি (প্রতিমা —৫ ) | ইদং কিলাব্যাজমনোহরং বপু স্তপক্ষমং সাধয়িতুং য ইচ্ছতি। ধ্রুবং স নীলোৎপলপত্রধারয়া শমীলতাং ছেতুষিব্যবস্যতি। (শকুন্তলা—১) |
এই ধরনের ‘ভাসাভাস’ ভবভূতির নাটক ‘উত্তরচরিতে’ও মিলবে। ‘উত্তরচরিত’ নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের ‘আত্রেয়ী সংবাদ’ স্বপ্ন নাটকের প্রথম অঙ্কস্থ ‘ব্রহ্মচারী সংবাদ’-এর আদর্শে লেখা বলে মনে হতে পারে। ‘উত্তরচরিত’ প্রথম অঙ্কের বিদ্যাধরবার্তার সঙ্গে অভিষেক নাটকের ষষ্ঠ অঙ্কের বিদ্যাধর বার্তা, এই দুইয়ের সাদৃশ্যও চিন্তনীয়।
নাট্যকার শূদ্রক ভাস-রচিত ‘চারুদত্ত’ নাটকের কয়েকটি শ্লোক অপরিবর্তিতরূপে গ্রহণ করেছেন। ‘লিম্পতীব তমোহঙ্গানি, সর্বং শূন্যাং দরিদ্রস্য’ প্রভৃতি শ্লোক এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। “চারুদত্ত’ নাটকের সঙ্গে শূদ্রক-রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’-এর সাদৃশ্য এত অধিক যে বহু বিদগ্ধ পণ্ডিত মনে করেন, ‘চারুদত্ত’ ‘মৃচ্ছকটিকে’রই সংক্ষিপ্ত রূপ। অবশ্য এই প্রশ্নের এখনও মীমাংসা হয়নি।
পরবর্তীকালের সাহিত্যে ভাসের প্রভাব স্থায়ী হতে পারেনি। কেননা, কালিদাস যদিও ভাসের মতোই বৈদভী রীতির কবি ছিলেন, তবু কালিদাসের পরে এই রীতি আর অনুসৃত হয়নি। ভবভূতি ছিলেন গৌড়ীয় রীতির লেখক, প্রকৃতপক্ষে, কালিদাসের পর থেকেই নানা কারণে (প্রধানত অলঙ্কার শাস্ত্রের উৎপীড়নে সংস্কৃত-সাহিত্য-কৃত্রিম হয়ে পড়ে। পরবর্তী কবিরা ভাষার সহজ লাবণ্যকে বা ভাবের সরল প্রকাশকে কাব্যের আদর্শরূপে গ্রহণ করতে পারেননি। ভাবে ও রূপে ভাস তো ‘সহজিয়া’ তাঁর কথা লোকে সহজেই ভুলে গিয়েছিল। তবে যারা ‘ঘটত্বাৎ—পটত্বাৎ’ নিয়ে মেতে উঠেছিলেন তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ তাঁকে স্মরণ করেছেন—কখনো বাণভট্ট, কখনো অভিনবগুপ্ত, কখনো রাজশেখর!
ভাসের রচনারীতি
বিষয়বস্তুগত বৈচিত্র্যের শিল্পী হিসেবে ভাস সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে একক। এত অধিক সংখ্যক এবং এত বিচিত্র বস্তু বিষয়ে নাটক আর কেউ রচনা করেননি। তাঁর ভাষা সরল ও স্নিগ্ধ, প্রকাশভঙ্গিও স্বাভাবিক। চরিত্র চিত্রণে বা কাহিনীর বিন্যাসে তিনি কোথাও বাস্তবতাকে ক্ষুণ্ণ করেননি। অলঙ্করণের বাহুল্য থেকে মুক্ত বলেই তাঁর ভাষা সহজ, স্পষ্ট এবং মধুর। শব্দ নির্বাচনে তিনি অত্যন্ত সতর্ক। রচনায় কোথাও দীর্ঘ সমাসের ফাঁস বা অযথা অলঙ্কারের কৃত্রিমতা নেই। কোথাও কোথাও হয়তো তিনি অনুপ্রাস বা যমকের মোহে বিভ্রান্ত হয়েছেন কিন্তু তাঁর প্রধান অবলম্বন উপমা আর উৎপ্রেক্ষা।
সমালোচক বলবেন, ভাসের রচনার একটি উল্লেখযোগ্য ত্রুটি—ভাষা সংহত হওয়ার জন্য কোথাও কোথাও অর্থবোধ ক্ষুণ্ন হয়েছে; বাক্যে কোনো শব্দ বাদ রেখে যাওয়ার জন্যই হয়তো দুর্বোধ্যতা দেখা দিয়েছে। পরবর্তীকালে প্রচলিত থাকেনি এমন শব্দও তিনি কোথাও কোথাও প্রয়োগ করেছেন। অবশ্য এই অপরাধের জন্য লেখককে দায়ী করা কঠিন।
কিন্তু ব্রণসন্ধানের জন্য মক্ষিকার অভাব নেই। গুণের কথা বলি। ভাস রচিত নাটকের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে এখানে শ্লোকগুলোকেও নাট্যকার কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যই রচনা করেছেন, শুধু আখ্যান-বিযুক্ত বর্ণনা এদের লক্ষ্য নয়। এরা যেন সংলাপেরই অংশ। অন্যান্য সংস্কৃত নাট্যকারদের মধ্যে এই গুণটি দুর্লভ। নাট্যকার হিসেবে ভাস আর একটি বিশেষ শক্তিরও অধিকারী, সেটি হল ‘পতাকাস্থানে’র সার্থক প্রয়োগ। ইংরেজিতে যাকে Dramat।c ।rony বলে ‘পতাকাস্থান’ বললে তাই বুঝতে হবে। বিস্ময় সৃষ্টি এর লক্ষ্য। ‘প্রতিজ্ঞা যৌগন্ধরায়ণ’ থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে বাসবদত্তার পিতা মহিষীর সঙ্গে কন্যার প্রার্থীদের যোগ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আলোচনার শেষে রাজা প্রশ্ন করলেন রানিকে, এদের মধ্যে কাকে তোমার কন্যার যোগ্য মনে হয়?
ঠিক এই মুহূর্তেই কঞ্চুকী এসে বলল, “বৎসরাজ’! সে সংবাদ এনেছে, বৎসরাজ উদয়নকে বন্দি করা হয়েছে। আনন্দের উচ্ছ্বাসে সে ‘বৎসরাজ’ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেনি।
ভাস রচনারীতিতে Ep।c style-কেই অনুসরণ করেছেন, কিন্তু Ep।c-এর ত্রুটি থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত। পরিমিতির অভাব Ep।c-এর সেই ত্রুটি। নিজের রচনায় সর্বত্র ভাস সেই ত্রুটি পরিহার করে চলেছেন, কোথাও কোনো আতিশয্য নেই।
ভাসের নাটক
ভাস রচিত তেরোটি নাটকের সাধারণ পরিচয় এখানে দেওয়া যেতে পারে।
১. দূতবাক্য—একাঙ্ক নাটক; কাহিনীর উৎস মহাভারত। এখানে দুই বিবদমান পক্ষ, কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সন্ধি ঘটাবার জন্য শান্তির দূতরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। উদ্ধত দুর্যোধন নানাভাবে তাঁকে অপমানিত করে ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ধৃতরাষ্ট্র শ্রীকৃষ্ণের কাছে নতিস্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
২. কর্ণভার—এটি একাঙ্ক নাটক। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কর্ণের দায়িতৃভারের কথা মনে রেখেই নাটকের এই নামকরণ। ইন্দ্র কর্তৃক কর্ণের কবচকুণ্ডল হরণ এই নাটকের মূল কাহিনী।
৩ . দূতঘটোৎকচ—এই নাটকে হিড়িম্বাপুত্র ঘটোৎকচ শ্রীকৃষ্ণের দূত হয়ে এসেছেন কৌরব শিবিরে। অর্জুন-তনয় অভিমন্যুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন জয়দ্রথ। পুত্রশোকে অধীর অর্জুন এই হত্যার প্রতিশোধের শপথ গ্রহণ করেছেন। দূত ঘটোৎকচ এসেছেন কৌরবদের যে সর্বনাশ এসেছে সেই কথা জানাতে। ‘দূতঘটোৎকচ’ও এক অঙ্কের নাটক।
৪. মধ্যমব্যায়োগ—এই এক অঙ্কের নাটকে আছে দুই মধ্যমের কাহিনী—একজন মধ্যমপাণ্ডব ভীম আর একজন এক ব্রাহ্মণের মধ্যম পুত্র! হিড়িম্বার পুত্র ঘটোৎকচ এলেন এক ব্রাহ্মণের কাছে। তার মাতা হিড়িম্বার মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য একজন মানুষ চাই। ব্রাহ্মণের তিন পুত্র, মধ্যম পুত্ৰ আত্মবিসর্জনে সম্মত হলেন। পথে পিপাসার্ত মধ্যম পুত্র একটি সরোবরে গেলেন জলপান করতে। ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে ঘটোৎকচ ডাকলেন মধ্যম, শীগির চলে এস। মধ্যম পাণ্ডব ভীম কাছেই ব্যায়ামে রত ছিলেন, ডাক শুনে তিনি চলে এলেন। ব্রাহ্মণ-পুত্রও এলেন। ব্রাহ্মণ তার পুত্রের জীবন রক্ষার জন্য ভীমকে অনুরোধ জানালেন। কিন্তু ঘটোৎকচ ব্রাহ্মণ-পুত্রকে ছাড়তে রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ঘটোৎকচ ব্রাহ্মণ-পুত্রের পরিবর্তে ভীমকেই নিয়ে গেলেন মা’র কাছে। তারপর হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের মিলন আর পুত্র ঘটোৎকচের সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে নাটকের সমাপ্তি।
৫. ঊরুভঙ্গ—এক অঙ্কের রচিত ঊরুভঙ্গের অবলম্বন ভীম ও দুর্যোধনের যুদ্ধ এবং শেষ পর্যন্ত ভীমের গদাঘাতে দুর্যোধনের ‘ঊরু-বিপর্যয়’! দৃশ্যটি অত্যন্ত করুণ, যেখানে দুর্যোধনের তরুণ পুত্র পিতার ভগ্ন ঊরুর উপরে উঠে বসার চেষ্টা করছে সেখানে করুণরস আরও ঘনীভূত হয়েছে। অনুতপ্ত বীর দুর্যোধন বিরোধের অবসানের জন্যই পুত্রকে উপদেশ দিয়েছেন। ‘উরুভঙ্গ’ নাটক সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যে একমাত্র ট্র্যাজেডি।
৬. পঞ্চরাত্র—তিন অঙ্কের নাটক। দুর্যোধন যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন। এই উপলক্ষে উদারভাবে প্রার্থীদের দান করা হচ্ছে। অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যকে তিনি দক্ষিণা দিতে ইচ্ছুক। দ্রোণ চাইলেন পাণ্ডবদের জন্য অর্ধেক রাজত্ব। শকুনি একটি শর্ত আরোপ করলেন, দ্রোণকে পাঁচ রাত্রির মধ্যে পাণ্ডবদের সংবাদ এনে দিতে হবে। এই সময়ে সংবাদ এল, যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানে বিরাটরাজ উপস্থিত হতে পারেননি, কেননা তাঁর আত্মীয় একশত কীচকে কেবলমাত্র বাহুর আঘাতেই কোনো এক অজ্ঞাত যোদ্ধা বধ করেছে—ভীষ্ম বুঝলেন এ যোদ্ধা আর কেউ নয় স্বয়ং ভীম! শকুনির শর্তে দ্রোণাচার্য সম্মত হলেন। এদিকে বিরাট রাজার গোধন অপহরণের জন্য ভীষ্মের পরামর্শে এক অভিযান প্রেরিত হল—রাজকুমার উত্তর এগিয়ে এলেন যুদ্ধে, তাঁর সারথি হলেন বৃহন্নলাবেশী অর্জুন। যুদ্ধে কৌরবদল পরাজিত হলেন, দ্রৌপদীপুত্র অভিমন্যু বন্দি হলেন বিরাট রাজার পাচকবেশী ভীমের হাতে। নাটকে শেষ পর্যন্ত দেখান হয়েছে অভিমন্যুর সঙ্গে রাজকুমারী উত্তরার বিবাহ হল; দুর্যোধন তার শপথ পালন করলেন!
৭. বালচরিত—পাঁচ অঙ্কের নাটক। নাট্যবস্তু কংসবধ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণের বাল্যজীবনের কাহিনী। নাটকে হত্যাকাণ্ডের প্রাচুর্য দেখা যায়।
৮. অভিষেক—কাহিনীর উৎস রামায়ণ। ছয় অঙ্কে সমাপ্ত এই নাটকে আছে তিনটি অভিষেকের কাহিনী। বালি ও সুগ্রীবের অভিষেক থেকে কাহিনীর শুরু আর সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও রামের অভিষেকে সমাপ্ত।
৯. প্রতিমা নাটক—ভাস-রচিত রামায়ণ অবলম্বনে নাটকগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাটক ‘প্রতিমা’। রচনা সর্বত্র নাটকীয়গুণে সমৃদ্ধ। রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের আয়োজন চলছে। সহসা সব বন্ধ হয়ে গেল। সংবাদ এল বৃদ্ধ রাজা দশরথ মূর্ছিত হয়ে পড়েছেন! এই বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে কৈকেয়ীর দাবি। তাঁর দাবি—রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসী হতে হবে, আর ভরতকে অভিষিক্ত করতে হবে রাজসিংহাসনে।
রামচন্দ্র বনে যাত্রা করলেন, তাঁর অনুগামী হলেন লক্ষ্মণ ও সীতা। ভরত তখন মাতুলালয়ে ছিলেন, কিছুই জানতেন না। তিনি ফিরে এসে প্রতিমাগৃহে দেখতে পেলেন দশরথের মূর্তি; এই গৃহে মৃত রাজাদেরই মূর্তি রক্ষিত হত। ভরত সব কথা জানতে পারলেন; এটুকু জানতে বাকি রইল যে তাঁর মা এই সর্বনাশের মূলে। ভরত রামকে ফিরিয়ে আনার জন্যে বনে যাত্রা করলেন। কিন্তু রাম ফিরলেন না, পিতৃসত্য তাঁকে পালন করতে হবে; তখন রামচন্দ্রের পাদুকা নিয়ে ভরত ফিরে গেলেন অযোধ্যায়, পাদুকার প্রতিনিধি হয়েই তিনি রাজকার্য চালাবেন।
এইভাবেই কাহিনী অগ্রসর হয়েছে—সীতা উদ্ধারের পর রামচন্দ্রের অযোধ্যায় ফিরে আসা পর্যন্ত। নাটকটি সাত অঙ্কে সমাপ্ত।
১০. স্বপ্নবাসবদত্তা—ভাস-রচিত নাটকগুলোর মধ্যে স্বপ্নবাসবদত্তা শ্রেষ্ঠ স্থান দাবি করতে পারে। এই নাটক ছয় অঙ্কে রচিত। নাটকটি স্বপ্ন-নাটক নামেও পরিচিত। নাটকের উৎস ‘বৃহৎকথা’।
১১. প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ—এই নাটকেরও উৎস ‘বৃহৎকথা’। নাটকটি যেন স্বপ্নবাসবদত্তার ভূমিকা। চার অঙ্কের এই নাটকে আছে—যৌগন্ধরায়ণ উজ্জয়িনীতে এসেছেন, উদয়ন প্রদ্যোত মহাসেন কৃতক বন্দি; বাসবদত্তার সঙ্গে উদয়নের পলায়নব্যবস্থা সুসম্পূর্ণ করতে। শেষ পর্যন্ত সুদক্ষ মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণের সাহায্যে বাসবদত্তাকে নিয়ে উদয়ন পালিয়ে গেলেন কিন্তু যৌগন্ধরায়ণ বন্দি হলেন মহাসেনের হাতে। পরে উদয়নের সঙ্গে বাসবদত্তার বিবাহ স্থির হল, যৌগন্ধরায়ণ মুক্তি পেলেন! নাটকটি চার অঙ্কে সমাপ্ত। এই নাটক স্বপ্নবাসবদত্তার পূর্ববর্তী কাহিনীর ভিত্তিতে রচিত।
১২. অবিমারক—ছয় অঙ্কের নাটক। এর আখ্যানবস্তু কুমার বিষ্ণুসেনের (অবিমারক) সঙ্গে রাজা কুন্তীভোজের কন্যা কুরঙ্গীর মিলন। কাহিনীর উৎস—বৃহৎকথা। নাটকটি অতি নাটকীয় এবং ভাবাবেগপ্রধান।
১৩. চারুদত্ত–চার অঙ্কের এক অসম্পূর্ণ নাটক। বিদগ্ধ মহলের মতে পরবর্তীকালে শূদ্রক ‘চারুদত্ত’কে অবলম্বন করেই মৃচ্ছকটিক’ রচনা করেছিলেন। নাটকের আখ্যানবস্তু ব্রাহ্মণ চারুদত্ত ও নটী বসন্তসেনার প্রেম, সে যুগের এক জনপ্ৰিয় কাহিনী।
স্বপ্ন নাটকের কথা
স্বপ্ন নাটককে অর্ধ-ঐতিহাসিক নাটক বলা যেতে পারে। ‘কথাসরিৎসাগরে’ যে উদয়কথা বর্ণিত হয়েছে তা ঐতিহাসিক হলেও নাট্যকার প্রয়োজনমতো নিজের কল্পনার সাহায্য নিয়েছেন।
নাটক সম্পর্কে আলঙ্কারিক যেসব বিধান দিয়েছেন, ভাস সেইসব সম্পর্কে খানিকটা উদাসীন বলেই মনে হয়।
আলঙ্কারিক বিধি নির্দেশ করলেন, নাটক রচনায় মঞ্চে কোনো যুদ্ধ, মৃত্যু বা শোকাবহ দৃশ্য কিংবা বধ প্রভৃতি দেখান চলবে না, ভাস ‘ঊরুভঙ্গ’ লিখে বিধিভঙ্গের দুঃসাহস দেখালেন।
সংস্কৃত নাটক নান্দীশ্লোক (শুভেচ্ছা বা আশীর্বাণী সূচক) দিয়ে শুরু হয়। নান্দীপাঠের পর মঞ্চ নির্দেশ থাকে ‘নান্দ্যন্তে সূত্রধারঃ’ অর্থাৎ নান্দীপাঠের পর সূত্রধার প্রবেশ করবেন। কিন্তু ভাস-রচিত নাটকে দেখা যাচ্ছে এই শুভেচ্ছা শ্লোকের আগেই মঞ্চ নির্দেশ থাকে—‘নান্দ্যন্তে ততঃ প্রবিশতি সূত্রধারঃ’। তার অর্থ এই—নান্দী হয়ে গেছে নেপথ্যে, হবার পর সূত্রধার মঞ্চে প্রবেশ করে একটি শ্লোক পাঠ করেন। কিন্তু সেই শ্লোকটিকে কি আর নান্দী বলে চিহ্নিত করা যাবে?
স্বপ্ন নাটকেও তাই। ভাসের যুগে নিশ্চয়ই আলঙ্কারিকের নিয়ম তেমন বাধ্যতামূলক ছিল না অথবা সেই যুগে প্রচলিত অন্য কোনো নাট্যশাস্ত্রের বিধান তিনি পালন করেছেন। নইলে ‘প্রস্তাবনার’ পরিবর্তে ‘স্থাপনা’ তিনি পেলেন কোথা থেকে?
পঞ্চসন্ধি
সূচনা থেকে পরিসমাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র নাটকীয় অ্যাখ্যানকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করে দিতে হয়, এই হল অলঙ্কার শাস্ত্রের নির্দেশ। এই পাঁচটি ভাগের এক-একটিকে বলা হয় সন্ধি। স্বপ্ন নাটকে এই পঞ্চসন্ধির ব্যাপারটি বেশ স্পস্ট। সন্ধিগুলোর নাম—মুখ, প্রতিমুখ, গর্ভ, বিমর্শ ও উপসংহৃতি। স্বপ্ন নাটকে প্রথম অঙ্কে মুখসন্ধির সূচনা, যেখানে মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ পদ্মাবতীকে বললেন—‘ভোঃ অহম্ প্রার্থী’। মুখসন্ধির এই বীজ বিকশিত হতে-হতে ক্রমশ অভিপ্রেত ফলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, তার নাম প্রতিমুখসন্ধি। স্বপ্ন নাটকের দ্বিতীয়, তৃতীয় আর চতুর্থ অঙ্কে বর্ণিত ঘটনা প্রতিমুখসন্ধির অন্তর্গত। এই অংশে বাসবদত্তা পদ্মাবতীর সহচরী, ঘটনাগুলোও এমনভাবে ঘটে যাচ্ছে যাতে নায়ক ও নায়িকার মিলন হতে পারে।
এরপর গর্ভসন্ধি। এই অংশে কতকগুলো অনুকূল ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে নাটকের মূল উদ্দেশ্য সার্থকতার পথে অগ্রসর হয় : স্বপ্ন নাটকে দেখা যায়—পঞ্চম অঙ্কে নায়ক-নায়িকার সঙ্গে সমুদ্রগৃহে সামান্য সময়ের জন্য হলেও মিলিত হয়েছেন। উদয়ন যেখানে বাসবদত্তার স্পর্শে জেগে উঠেই আর্তনাদ করে উঠেছেন—“তিষ্ঠ! তিষ্ঠ!’—সেইখানেই গর্ভসন্ধির সমাপ্তি। গর্ভসন্ধির পর বিমর্শসন্ধি। আখ্যানের এই অংশে নায়ক-নায়িকার বিরহের বর্ণনা থাকে। ষষ্ঠ অঙ্কের যেখানে বাসবদত্তার ছবি উদয়নের হাতে তুলে দেওয়া হল (এসা চিত্তফলআ তব সআসং পেসিদা) সেই পর্যন্ত বিমর্শসন্ধি বিস্তৃত। উপসংহৃতি অর্থাৎ উপসংহার। ষষ্ঠ অঙ্কে যেখানে পদ্মাবতী চিত্রের দিকে তাকিয়ে উদয়নকে বলছেন—তার সঙ্গিনী আবন্তিকার (বাসবদত্তা) সঙ্গে প্রতিকৃতির সাদৃশ্যের কথা, সেখানে থেকেই নির্বহণ সন্ধির (উপসংহারের) সূচনা। এই অংশে ধীরে-ধীরে মিলনের বাধাগুলো অপসারিত হচ্ছে এবং শেষপর্যন্ত নায়ক-নায়িকার মিলনের মধ্যে আখ্যান সম্পূর্ণ হয়েছে। নির্বহণ সন্ধিতে থাকে বাধা অপসারণ আর ফলপ্রাপ্তির কথা।
নাটকের নাম
নাটকের নাম প্রসঙ্গে খুব বিচলিত হবার দরকার নেই, কেননা প্রাচীন যুগের লেখকগোষ্ঠী খুব সোজাসুজি নাম রাখারই পক্ষপাতী ছিলেন। যাতে নামের মধ্যে বিষয়বস্তুটা ধরা পড়ে সেইদিকেই তাঁদের যত্ন ছিল। রচনার নাম বেশ ইঙ্গিতবহ হবে এ বাতিকটা আধুনিক কালের।
ভাস-রচিত একটি নাটকের নাম ঊরুভঙ্গম্’ ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর একটি নাটক দূতঘটোৎকচম্’—দূতরূপী ঘটোৎকচের কাহিনী; অন্য একটি নাটকের নাম ‘অভিষেক নাটকম্’—এর মধ্যেও দুর্বোধ্য কিছু নেই। তবে ‘প্রতিমা নাটকম্’ বা ‘পঞ্চরাত্রম্’– এইজাতীয় নামকরণের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। স্বপ্নবাসবদত্তম, নাটকটিও এই পর্যায়ের। ‘বাসবদত্তা’র সঙ্গে ‘স্বপ্ন’ যুক্ত হওয়ার ফলেই একটা কৌতূহল জাগে,—নামকরণের মধ্যে এই উৎকণ্ঠা সৃষ্টি রীতিমতো নাটকীয়।
স্বপ্নবাসবদত্তম্ নামটি তিনভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে—
১. ‘বাসবদত্তামধিকৃত্য কৃতং নাটকম্’—‘বাসবদত্তম্’ বাসবদত্তাকে নিয়ে লেখা নাটক। ‘স্বপ্ন প্রধানম্ বাসবদত্তম্’—অর্থাৎ বাসবদত্তাকে নিয়ে লিখিত যে নাটকে ‘স্বপ্নই’ প্রাধান্য পেয়েছে।
২. স্বপ্ন দৃষ্টা বাসবদত্তা—স্বপ্নবাসবদত্তা; স্বপ্নবাসবদত্তাম্ অধিকৃত্য কৃতং নাটকম।
৩. স্বপ্নদৃষ্টা বাসবদত্তা যস্মিন (বহুব্রীহি) তৎ (নাটকম্)।
কাহিনী
মগধের রাজধানী রাজগৃহের একপ্রান্তে তপোবন। সেই তপোবনের পথে এসে দাঁড়ালেন এক পরিব্রাজক আর তারই সঙ্গে এক রমণী।
সঙ্গে সঙ্গে নেপথ্যে এক কোলাহল শোনা গেল। পরিব্রাজক জানতে পারলেন মগধরাজ দর্শকের ভগিনী পদ্মাবতী তপোবনে এসেছেন তাঁর মাকে দেখতে, রাতটা তপোবনেই কাটাবেন, পরে ফিরে যাবেন রাজগৃহে।
পদ্মাবতী এলেন। এসে ঘোষণা করলেন—যাঁর যেমন ইচ্ছে প্রার্থনা করুন, আমি দান করব। কারও প্রার্থনা অপূর্ণ থাকবে না।
পরিব্রাজক এগিয়ে এলেন! পদ্মাবতীকে প্রণাম জানিয়ে বললেন, আমি প্রার্থী। সঙ্গে আমার ভগিনী আছেন। এঁকে আপনার কাছে কিছুকালের জন্য রেখে যেতে চাই, কেননা এর স্বামী আছেন প্রবাসে।
পদ্মাবতী সম্মত হলেন।
এমন সময় এক ব্রহ্মচারী এলেন আশ্রমে। তিনি লাবাণক থেকে এসেছেন। লাবাণক বৎসরাজ্যেরই একটি অঞ্চল। ব্রহ্মচারীর মুখে শোনা গেল—লাবাণকে সম্প্রতি একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সেখানে ছিলেন বৎসরাজ উদয়ন আর তাঁর স্ত্রী বাসবদত্তা। একদিন উদয়ন মৃগয়ায় গেলেন, শুরু হল অগ্নিকাণ্ড, বাসবদত্তা সেই আগুনে পুড়ে মরলেন; উদয়নের মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ রানিকে রক্ষা করতে গিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিলেন কিন্তু তাঁরও মৃত্যু হল। উদয়ন ফিরে এসে সব শুনলেন। তাঁর অবস্থা আর চোখে দেখা যায় না, দিনরাত করুণ বিলাপের মধ্যে তাঁর দিন কাটছে।
কাহিনী শুনে পরিব্রাজকের ভগিনীরূপে পরিচিতা সেই রমণীর চোখে জলের ধারা নামল!
এ কি পরদুঃখকাতরতা? না অন্য কিছু?
ভগিনীকে পদ্মাবতীর আশ্রয়ে রেখে পরিব্রাজক চলে গেলেন।
পদ্মাবতীর আশ্রিতা সেই রমণীর নাম ‘আবন্তিকা’।
রাজভবনে সুখের অভাব নেই। মগধরাজ দর্শকের ভগিনী পদ্মাবতী, তিনি তাঁর সহচরী। পদ্মাবতীর যত্নে, তাঁর সঙ্গে আলাপে ও বিহারে আবন্তিকার বেশ আনন্দেই দিন কাটছিল।
রাজবাড়িতে এসে পদ্মাবতীর এক দাসীর মুখেই আবন্তিকা শুনলেন, উজ্জয়িনীর রাজা প্রদ্যোত মহাসেনের ছেলের সঙ্গে পদ্মাবতীর বিয়ের প্রস্তাব চলেছে। কিন্তু পদ্মাবতীর ইচ্ছে নয়, ওখানে বিয়ে হোক। পদ্মাবতী নাকি বৎসরাজ উদয়নকেই স্বামীরূপে পেতে ইচ্ছুক।
তারপর দ্রুত কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল।
উদয়নের সঙ্গেই পদ্মাবতীর বিবাহ স্থির হল। একদিন উৎসব ও আড়ম্বরের মধ্যে উদয়ন-পদ্মাবতীর বিবাহ হয়ে গেল।
কিন্তু এই আনন্দোৎসবের উচ্ছলতায় আবন্তিকাকে যেন ঠিক মানায় না, যেন সে এক সর্বসুখবঞ্চিতা দুঃখিনীর প্রতিমূর্তি!
পদ্মাবতীকে পেয়েও উদয়ন বাসবদত্তাকে ভুলতে পারেননি। একদিন বয়স্যের কাছে তিনি মনের কথা বলেই ফেললেন—রূপে, শীলে আর মাধুর্যে পদ্মাবতী আমার আদরের পাত্রী কিন্তু বাসবদত্তায় আবদ্ধ আমার মনটিকে তিনি হরণ করতে পারেননি।
কখনও-বা উদয়ন কথাপ্রসঙ্গে বাসবদত্তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে ফেলেন- ভুলে যান যে তিনি আর জীবিত নেই।
এমনি করেই দিন যাচ্ছিল।
একদিন পদ্মাবতীর ভয়ানক মাথার যন্ত্রণা, সমুদ্রগৃহে তার শয্যা রচিত হয়েছে। দাসীর মুখে খবর পেয়ে আবন্তিকা এগিয়ে গেলেন সমুদ্রগৃহের দিকে। বিদূষক গেলেন উদয়নকে সংবাদ দিতে, দাসী ছুটে গেল মাথার প্রলেপ আনতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদূষকের সঙ্গে উদয়ন এসে দাঁড়ালেন সমুদ্রগৃহের সামনে।
ঘরে ঢুকে দেখলেন বিছানায় পদ্মাবতী নেই।
বিদূষক বললেন, বোধহয় এসে চলে গেছেন।
উদয়ন একটু দেখে বললেন, না আসাই সম্ভব। বিছানায় কেউ শুয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমার ঘুম আসছে বয়স্য!
বিদূষকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে উদয়ন ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁকে ঘুমন্ত দেখে বিদূষক ছুটে গেলেন রাজার গায়ের চাদর আনতে।
বিদূষক চলে যেতেই ঘরে ঢুকলেন বাসবদত্তা—দাসীকে নিয়ে। দাসী চলে গেল মাথার প্রলেপের খোঁজে। আবন্তিকা বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন।
পদ্মাবতীকে খুশি করবার জন্যেই আবন্তিকা বিছানার কাছে বসলেন, তারপর পাশে শুয়ে পড়লেন।
ওদিকে স্বপ্নের মধ্যে উদয়ন বলে উঠেছেন, হায় বাসবদত্তা!
আবন্তিকা চমকে উঠলেন, পদ্মাবতী তো নয়! সর্বনাশ! দেখে ফেলেছেন নাকি?
স্বপ্নের ঘোরেই উদয়ন বললেন, প্রিয়ে! আমার কথার উত্তর দাও!
আবন্তিকা বললেন, আমি তো বলছি!
রাজা বললেন, তুমি কি রাগ করেছ?
আবন্তিকা জবাব দিলেন, না, না, রাগ কিসের? তবে আমার বড় দুঃখ!
রাজা বললেন, তুমি কি বিরচিকার কথা ভাবছ?
আবন্তিকা উত্তর দিলেন, আঃ যাও! এখানেও বিরচিকা? রাজা তখনও স্বপ্নের ঘোরে। তিনি বললেন, আমি তোমাকে প্রসন্ন দেখতে চাই, এস কাছে এস। হাত বাড়ালেন ঘুমন্ত উদয়ন।
আবন্তিকা সরে গেলেন! অনেকক্ষণ আছেন, কেউ হয়তো দেখে ফেলতে পারে। তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল উদয়নের। বিদূষক ঘরে এসে ঢুকতেই উদয়ন বলে উঠলেন, একটি সুসংবাদ বয়স্য, বাসবদত্তা জীবিত আছেন।
বিদূষক বোঝাতে চাইলেন, এ স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়, অত্যধিক তদ্গতচিন্তার ফলমাত্র!
উদয়ন বুঝতে চাইলেন না।
এদিকে সংবাদ এল বৎসরাজ্য নিষ্কণ্টক, উদয়নের মন্ত্রী রুমন্বান সৈন্যবল নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন, রাজা দর্শকের সৈন্যবাহিনীও প্রস্তুত।
উদয়ন তাঁর পরম শত্রু আরুণির বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য প্রস্তুত হলেন।
বৎসরাজ্যের রাজধানী কৌশাম্বী–
উদয়নের রাজপ্রাসাদ!
এরই মধ্যে একদিন একটি বীণা উদয়নের হাতে এল, একটা লোক বীণাটিকে খুঁজে পেয়েছিল নর্মদার তীরে কুরচি লতার ঝোপের মধ্যে।
বহু অতীত সুখের স্মৃতি উদয়নের কাছে বহন করে এনেছে সেই বীণা। বীণার নাম ‘ঘোষবতী’ বাসবদত্তা বাজাতেন।
ঘোষবতী বীণা নতুন তারে বাঁধিয়ে নিয়ে আসা হল।
উদয়নের শোক যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল।
সেদিন রাজসভায় বসে আছেন উদয়ন, খবর এল প্রদ্যোত মহাসেনের কাছ থেকে বাসবদত্তার ধাত্রী এসেছেন। বাসবদত্তার পিতা মহাসেন। তিনি পিতার কাছ থেকে কন্যাকে হরণ করে এনেছিলেন কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারেননি। উদয়ন ভীত হয়ে উঠলেন। মহাসেন তাঁর হাতে বাসবদত্তাকে তুলে দেবার জন্যেই উজ্জয়িনীতে এনেছিলেন। তিনি বাসবদত্তাকে বীণা শেখাতেন—অনঙ্গদেবের লীলা! বিবাহ পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই তিনি কন্যাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন।
ধাত্রীর মুখে শোনা গেল আর এক ইতিহাস। তিনি চলে আসার পর নাকি দুজনের ছবি একত্র করে, সামাজিক বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাসবদত্তার মাতা সেই দম্পতির ছবি ধাত্রীর হাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন, উদয়ন পত্নীবিরহে সান্ত্বনা পাবেন এই আশায়!
পদ্মাবতী সেই ছবি দেখেই চমকে উঠলেন, এ যে আবন্তিকা! তাঁর সহচরীর ছবি!
পদ্মাবতী উদয়নকে বললেন, এক পরিব্রাজক ব্রাহ্মণ তাঁর ভগিনীকে আমার কাছে গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলেন, এর স্বামী প্রবাসে আছেন, তাই তিনি পরপুরুষ দর্শন করেন না। উদয়ন বললেন, রূপের সাদৃশ্য কি থাকে না? যাইহোক, আবন্তিকাকে ডেকে পাঠাও।
পদ্মাবতী চলে গেলেন আবন্তিকাকে খবর দিতে। এমন সময় দ্বারপালের সঙ্গে ঘরে এলেন এক পরিব্রাজক। তিনি বললেন, আমার ভগিনীকে মহিষীর কাছে রেখে গিয়েছিলাম। তাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি।
উদয়ন চমকে উঠল, এ স্বর তাঁর পরিচিত!
পদ্মাবতীর সঙ্গে অবগুণ্ঠনবতী আবন্তিকা এসে দাঁড়ালেন। ধাত্রী দেখেই বলে উঠলেন, এ যে রাজকন্যা বাসবদত্তা!
বিস্মিত উদয়ন বলে উঠলেন, একি! এ যে মহাসেনপুত্রী! দেবি! তুমি পদ্মাবতীর সঙ্গে অন্তপুরে—
বাধা দিয়ে পরিব্রাজক বললেন, না, না, ওঁর ভিতরে যাওয়া চলবে না। উনি আমার ভগিনী!
অবগুণ্ঠন মোচন করা হল।
উদয়ন দেখলেন বাসবদত্তাকে, চিনতে পারলেন পরিব্রাজকবেশী মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণকে।
যৌগন্ধরায়ণ বললেন, দেবীকে আমি আপনার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম! আমি অপরাধী, আমাকে ক্ষমা করুন। কিন্তু এসবই আপনার কল্যাণের জন্য—মহারাজ দর্শকের ভগিনীর সঙ্গে বিবাহ না হলে আপনার শত্রু আরুণিকে পরাজিত করা সম্ভব হত না! সুখময় মিলনপর্বের পরে ঠিক হল উদয়ন সকলকে নিয়ে মহাসেনের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন।
চরিত্রলিপি
উদয়ন
উদয়ন বৎস রাজ্যের রাজা, তাঁর রাজধানী কৌশাম্বী। কিন্তু আলোচ্য নাটকে রাজা হিসেবে তাঁর কোনো পরিচয় নেই। নাটকের চতুর্থ অঙ্কে তাঁর প্রথম আবির্ভাব কিন্তু সে আবির্ভাব প্রেমিকরূপে। অবশ্য, বাসবদত্তার প্রতি তাঁর গভীর প্রেমই যে তাঁর চরিত্রকে মহিমান্বিত করেছে তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। পদ্মাবতীকে বিবাহ করার পরেও তিনি মুহূর্তের জন্য বাসবদত্তাকে বিস্তৃত হতে পারেননি। নাটকে উদয়ন চরিত্রের অন্যান্য অনেক গুণের কথাই আমরা শুনেছি, কিন্তু তাঁর প্রেমিকসত্তাই প্রাধান্য পেয়েছে। নাটকের যুদ্ধ যা কিছু সব নেপথ্যেই ঘটেছে, তবু এটুকু বলতে হবে যে যুদ্ধের আহ্বানে তিনি বীরের মতো সাড়া দিয়েছেন। পঞ্চম অঙ্কের শেষে স্বপ্নে দৃষ্টা বাসবদত্তার স্মৃতিতে মুহ্যমান থেকেও তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন আরুণির বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য। তার উক্তি—‘তমারুণিং দারুণকর্মদক্ষং মহানবাভে যুধি নাশয়ামি’। অর্থাৎ সাগরতুল্য মহাসংগ্রামে নির্মম সেই আরুণিকে আমি বধ করব।
উদয়নের চরিত্র শালীনতামণ্ডিত। মহাসেনের কাছে তিনি যে অপরাধ করেছেন তার জন্য তিনি অনুতপ্ত। ষষ্ঠ অঙ্কে ধাত্রী বসুন্ধরা এবং কঞ্চুকীর প্রতি বাক্যালাপে বাসবদত্তার পিতামাতার প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধার ভাব ব্যক্ত হয়েছে।
উদয়ন আদর্শ প্রেমিক। পঞ্চম অঙ্কে স্বপ্নের মধ্যে তিনি বিরচিকার প্রসঙ্গ তুলে ফেলেছেন, নইলে আমাদের জানবার কোনো অবকাশ হত না। কালিদাসের দুষ্যন্ত নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন ‘সকৃৎকৃতপ্রণয়োহয়ং জনঃ’—আমরা শুধু একবার প্রণয় করে ছেড়ে দিই। উদয়নকে সে পর্যায়ে ফেলা চলবে না। বিরচিকার জন্য তিনি অনুতপ্ত, তার জন্য বাসবদত্তার নিকটে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।
মোটকথা উদয়ন ধীরোদাত্ত শ্রেণির নায়ক, প্রজাপ্রিয়, হৃদয় ও মস্তিষ্কের বিচিত্র গুণে মণ্ডিত।
বাসবদত্তা
কেবল উদয়নের প্রিয়তমা মহিষী, এইটুকুই বাসবদত্তার পরিচয় নয়। এই চরিত্রে ভারতীয় নারীত্বের বহুবিচিত্র গুণের সমাবেশ ঘটেছে। পতিপ্রেমের জন্য, রাজ্যের কল্যাণের জন্য তিনি জীবনের সর্বসুখ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন, স্বেচ্ছায় বিরহ বরণ করেছেন। স্বপ্ন-নাটকের নায়িকা বাসবদত্তা এক অপরিসীম মমতায় ভরা কারুণ্যের প্রতিমূর্তি! দুর্লভ আত্মত্যাগের জন্য তিনি সকল সময় দর্শকহৃদয় আকর্ষণ করে রাখেন। তিনি দেহের মাধুর্যে সুন্দর, কিন্তু অন্তরের ঐশ্বর্যে সুন্দরতম। পদ্মাবতীকে স্বামীর হাতে সঁপে দেবার পরেও তিনি তার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র ঈর্ষাবোধ করেননি! পদ্মাবতীর প্রতি তাঁর অসীম মমতা, আশ্চর্য দাক্ষিণ্য! ধৈর্য ও ক্ষমার তিনি মূর্ত বিগ্রহ! পতির জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত; কখনো-বা তিনি ভাবের আবেগে কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছেন কিন্তু আশ্চর্য সংযমশক্তির গুণে মুহূর্তেই নিজেকে সংযত করে নিয়েছেন। গোপনে তিনি যে-অশ্রু বিসর্জন করেছেন, দর্শকগণ তা দেখে তার প্রতি সমবেদনা বোধ করবেন। বাসবদত্তার প্রেম ত্যাগের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেছেন, ‘বিরহপর্যুৎসুকস্য আর্যপুত্রস্য বিশ্রামস্থানভূতা ইয়মপি অস্বস্থা জাতা’। স্বামী আমার বিরহে কাতর, এখন পদ্মাবতীর কাছে এসেই তিনি সান্ত্বনা পাবেন= পদ্মাবতীও অসুস্থ হয়ে পড়ল।
স্বপ্ন নাটকের নায়িকা বাসবদত্তা, আদর্শ প্রেমিকা। নাটকে তাঁকে মাতৃত্বের অধিকারিণীরূপে দেখান হয়নি একথা সত্য, তবু আমরা অনুভব করি বাসবদত্তার প্রেম মাতৃভূভাবমণ্ডিত। অনুগত সকলের প্রতিই তিনি মাতৃরূপা, পঞ্চম অঙ্কের স্বপ্নদৃশ্যে যেখানে তিনি চলে আসবার সময় নিদ্রিত উদয়নের হাত শয্যায় যথাযথভাবে বিন্যস্ত করে এলেন তা এক কথায় অপূর্ব! ঠিক মা যেমন করে সন্তানকে ঠিকমতো শুইয়ে রেখে চলে আসেন তেমনি।
যৌগন্ধরায়ণ
নাটকের প্রথম অঙ্কে আর শেষ অঙ্কে দুইবার মাত্র মঞ্চে এই চরিত্রটির আবির্ভাব, দুইবারই ছদ্মবেশে। সমস্ত নাটকীয় ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উদয়নের মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ। নেপথ্যে থেকেও তিনি দর্শকের মন জুড়ে থাকেন। রাজনৈতিক পরিকল্পনার এমন সুনিপুণ গঠনশক্তি, এমন নিখুঁৎ বয়নবিদ্যা ভারতীয় সাহিত্যে তো বটেই, পাশ্চাত্যেও সুলভ নয়। মনে হয় রাজ্যের শাসনযন্ত্রের পরিচালক তিনিই, উদয়ন নামেমাত্র রাজা।
ভাসের ‘প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ’ও এই শ্রেণির রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক নাটক। ভাসের অঙ্কিত যৌগন্ধরায়ণ চরিত্রটির সঙ্গে বিশাখদত্ত রচিত ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকের চাণক্য চরিত্রটির তুলনা চলতে পারে। সেখানেও কূটনীতিবিদ্ চাণক্য অপূর্ব কৌশলে নন্দরাজার উচ্ছেদ সাধন করেছেন এবং তার মন্ত্রী রাক্ষসকে স্বপক্ষে এনেছেন।
স্বপ্ন-নাটকে যৌগন্ধরায়ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য লাবাণকের অগ্নিদাহে নিজের ও বাসবদত্তার মৃত্যুর কাহিনী প্রচারিত করেছিলেন। বাসবদত্তাকে ভগিনী পরিচয়ে পদ্মাবতীর কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন, উদ্দেশ্য—সফলতার দিন পর্যন্ত প্রতীক্ষমানা বাসবদত্তার চরিত্র সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না ওঠে। তারপর পদ্মাবতীর সঙ্গে উদয়নের বিবাহ, পদ্মাবতী মগধরাজ দর্শকের ভগিনী, এরপর মগধের রাজশক্তিকে উদয়নের শত্রু আরুণির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার আর কোনো বাধা রইল না।
এসবই যৌগন্ধরায়ণ করেছেন প্রভুর কল্যাণের জন্য, স্বামীর কল্যাণের জন্য বাসবদত্তাও তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে দিলেন। রাজভক্ত বীর যৌগন্ধরায়ণের পরিকল্পনা যখন সফল হল তখনও তিনি উদয়নের নিকটে ক্ষমাপ্রার্থী। অভিভূত উদয়ন শুধু বলেছিলেন, ‘ভবদ্ যত্নৈঃ খলু বয়ং মজ্জমানাঃ সমুদ্ধতাঃ’। আমরা বিপদ সাগরে ডুবে গিয়েছিলাম, তোমার যত্নেই আমাদের উদ্ধার সম্ভব হয়েছে!
এইখানেই যৌগন্ধরায়ণের মহত্ত্ব যে শাসনযন্ত্রের পরিচালক হয়েও তিনি রাজা উদয়নের দীনতম সেবক।
পদ্মাবতী
স্বপ্ন নাটকের এই নারীচরিত্রটি সর্বাংশে অপরূপ স্নিগ্ধতায় ও লাবণ্যে ভরা। তিনি মগধের রাজা দর্শকের ভগিনী, সংস্কৃতিগত শুচিতা তাঁর চরিত্রে থাকবে। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এর সঙ্গে ছিল তাঁর স্বভাবগত ধর্মবোধ আলাপে ও আচরণে, নাটকের সর্বত্র তাঁর এ মহিমান্বিত রূপটিই ফুটে উঠেছে।
বিবাহের পরেও স্বামী বাসবদত্তাকে ভুলতে পারেননি একথা জেনেও তিনি বাসবদত্তার প্রতি ঈর্ষান্বিতা নন। এমনকি উদয়ন যখন বিদূষককে বললেন, “বাসবদত্তাবন্ধং নতু তভাবন্ মে মনো হরতি’। অর্থাৎ ‘বাসবদত্তায় আবদ্ধ আমার মন পদ্মাবতী হরণ করতে পারেননি’, তখনও পদ্মাবতী অবিচলিত; তিনি বলছেন, আর্যপুত্রের হৃদয় কেমন অনুকম্পায় ভরা, এখনো তিনি বাসবদত্তার গুণ ভুলতে পারছেন না।
এইদিক দিয়ে পদ্মাবতী চরিত্র দর্শকের হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসন অধিকার করবে। মহাসেনের কাছ থেকে বাসবদত্তার চিত্র যখন উদয়নের হাতে এল, তখন পদ্মাবতী বললেন, চিত্রগতং গুরুজনং দৃষ্ট্বা অভিবাদয়িতুমিচ্ছামি, অর্থাৎ চিত্রে গুরুজনকে দেখে আমি প্রণাম করব! আর যখন পদ্মাবতী জানতে পারলেন, আবন্তিকা প্রকৃতপক্ষে বাসবদত্তা, তখন তিনি বললেন, এতদিন সখীজনের মতো দেখেছি, আপনি তো গুরুজন, কোথাও ত্রুটি ঘটে থাকলে ক্ষমা করুন।
নাটকে উদয়ন-বাসবদত্তার কাহিনী প্রধান হলেও পদ্মাবতী কোনোক্রমেই অপ্রধান নন। চরিত্রের মহিমায় তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শকের মন অধিকার করে থাকেন।
বসন্তক (বিদূষক)
সংস্কৃত নাটকে বিদূষকের বিশেষ কোনো কাজ নেই, হাস্যপরিহাসে রাজার মন সরল রাখা আর উদরভর্তি করে ভোজনপর্ব সমাধা করা, এর বাইরে বিদূষকের দৃষ্টি দেবার দরকার নেই। বসন্তকও ভোজনবিলাসী ছিল সন্দেহ নেই। উদয়ন একবার প্রশ্ন করেছিলেন, বয়স্য, কে তোমার প্রিয়—বাসবদত্তা না পদ্মাবতী? বিদূষক তার জবাবে বলেছিলেন, পদ্মাবতীর সবই ভালো, কিন্তু বাসবদত্তার মতো তিনি ভোজ্যদ্রব্য হাতে নিয়ে আমার খোঁজ করে বেড়ান না! উদয়ন-পদ্মাবতীর বিবাহের পরে আমরা বিদূষকের আক্ষেপ শুনেছি, ‘আহার্য দ্রব্যের তেমন পরিপাক হচ্ছে না।’
বসন্তক ঔদরিক; কিন্তু শুধু এদিক দিয়ে দেখলে অবিচার করা হবে। কতকগুলো গুণেরও তিনি অধিকারী। বাসবদত্তার শোকে অভিভূত রাজাকে তিনি সান্ত্বনা দিয়েছেন—গল্প বলে সখাকে ভুলিয়েছেন। পঞ্চম অঙ্কে বিদূষকের সেই গল্পটি খুবই উপভোগ্য; সেই যে ‘এক নগর—নাম ব্রহ্মদত্ত। সেখানে এক রাজ্য—নাম কাম্পিল্য!’ উপস্থিত বুদ্ধিও তার কম নেই! বাসবদত্তার কথায় রাজার চোখে জল এল, বিদূষক গেলেন জল আনতে; আনবার পথে পদ্মাবতীর সঙ্গে দেখা।—পদ্মাবতী জানতে চাইলেন, ও জল কিসের? একটু আমতা-আমতা করেই তিনি জবাব দিলেন, কাশফুলের রেণু রাজার চোখে লেগেছে তাই!
স্বপ্ন-নাটকের বিদূষকের একটি স্বতন্ত্র রূপ আছে, শুধু ভোজনসর্বস্ব নয়। শকুন্তলার ‘মাধবের’ সঙ্গে তুলনা করলেই এই স্বাতন্ত্র্য বুঝতে পারা যাবে।
নাট্যালোক
প্রেক্ষাগৃহে বসেই নাটকটিকে একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে!
প্রথম অঙ্কের ঘটনাপুঞ্জ সুপরিকল্পিত—মূল ঘটনা, একজন পরিব্রাজক এসে এক রমণীকে তার ভগিনীর পরিচয়ে পদ্মাবতীর কাছে রেখে চলে গেলেন।
দ্বিতীয় অঙ্কের গতি অত্যন্ত দ্রুত। পদ্মাবতী তাঁর আশ্রিতা বাসবদত্তার সঙ্গে একদিন খেলায় মত্ত। সেদিন দাসীর মুখে বাসবদত্তা শুনলেন পদ্মাবতীর বিবাহ উদয়নের সঙ্গে স্থির হয়ে গেছে—আর একজন দাসী এসে জানিয়ে গেল শুভদিন, বিবাহ সেইদিনই অনুষ্ঠিত হবে।
হোক, আপত্তি নেই, কিন্তু সবই যেন বড় দ্রুত ঘটে যাচ্ছে, মনে হয়।
পঞ্চম অঙ্কে বর্ণিত স্বপ্নদৃশ্যটি চমৎকার কিন্তু দিাগ হয়তো মাথা উঁচু করে বলে বসবেন—নিদ্রিত মানুষের স্বপ্নে কি জাগ্রত কারো সঙ্গে বার্তালাপ সম্ভব? উদয়ন স্বপ্নে কথা বলছেন বাসবদত্তার সঙ্গে, অথচ বাসবদত্তা জাগ্রত। তিনি যা বলছেন উদয়ন তা শুনছেন, শুনে নতুন প্রশ্ন করছেন। জাগ্রত বাসবদত্তার কণ্ঠস্বর তিনি শুনছেন অথচ তিনি নিদ্রিত। এই দৃশ্যের পরিকল্পনায় মনে হয় ভাস সম্ভাব্যতার সীমা একটু লঙ্ঘন করে গেছেন।
আর একটি প্রশ্ন দর্শকের মনে জাগবে, পঞ্চম অঙ্কের স্বপ্নদৃশ্যে পদ্মাবতী কোথায়? সমুদ্রগৃহে তিনি মাথার যন্ত্রণায় শুয়ে আছেন তাই সেখানে থাকবার শিরঃপীড়া তো তারই! সকলের মুখেই শোনা গেল তিনি সমুদ্রগৃহে, কিন্তু উদয়ন তাঁকে পাননি, বাসবদত্তা এসে তাঁকে পাননি। না-থাকার একটা কৈফিয়ত থাকলে সঙ্গত হত। হয়তো এই ‘Comedy of errors’ লিখতে গিয়ে ভাসেরও সামান্য ‘error’ হয়ে গেছে।
বিদূষক স্বপ্ন নাটকের উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ।
উদয়ন ও বাসবদত্তার মিলনের পথে তাঁর যেটুকু করণীয় তিনি তা করেছেন। কিন্তু নাটক দেখার পর দর্শকের মনে একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই জাগবে—এত দুঃখের পর পতি-পত্নীর মিলন-দৃশ্যে বিদূষক নেই কেন? থাকলে ভালো হত একথা বলব না—বলব এই চরিত্র না থাকায় এই মিলন-দৃশ্য অসম্পূর্ণ থেকে গেছে, উৎসবের আনন্দদীপ্তিও ম্লান মনে হয়েছে। ভাস ভুলেছেন বিদূষককে কিন্তু দর্শক মনে রেখেছেন। ষষ্ঠ অঙ্কের শেষে উদয়ন বলেছেন—
দেবী পদ্মাবতীকে নিয়ে আমরা সবাই যাব মহাসেনের কাছে। যৌগন্ধরায়ণ বললেন—আপনার যেমন ইচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে বিদূষক বসন্তক প্রবেশ করলে নাটকের কোনো ক্ষতি হতো না—প্রবেশ করে তিনি অনায়াসে বলে উঠতে পারতেন—‘কহং! দুযে বি ভট্টিদারিত্র! অহুনা দাব কিম্পি ভোজং ণ শক্কং সিণিদ্ধং ভোঅণং বজ্জিঅ!’—কী আশ্চর্য! এ যে দুজন ভদারিকাই একসঙ্গে! তাহলে এখন প্রথমে স্নিগ্ধ ভোজনপর্ব বাদ দিয়ে অন্য কিছুই হতে পারবে না!
সূক্তি রত্নাবলী
ভাসের রচনায় বহু স্থানেই এমন বাক্য রয়েছে যা প্রবাদ-বাক্যের মতোই জ্ঞানগর্ভ, সংক্ষিপ্ত হলেও তাৎপর্যময়। স্বপ্ন-নাটক থেকে এমনি কয়েকটি অংশ উল্লেখ করা যেতে পারে :
১. চক্রার পঙ্ক্তিরিব গচ্ছতি ভাগ্যপঙ্ক্তিঃ। (প্ৰথম অঙ্ক
চক্রনেমির মতোই মানুষের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়।
২. প্রদ্বেষো বহুমানো বা সঙ্কল্পাদ্ উপজায়তে! (প্রথম অঙ্ক) বিদ্বেষ বা ভালোবাসার মূল—মানুষের বাসনা।
৩. দুঃখং ন্যাসস্য রক্ষণম্। (প্রথম অঙ্ক
গচ্ছিত বস্তুর রক্ষা খুবই কঠিন।
৪. তথা পরিশ্রমঃ পরিখেদং নোৎপাদয়তি যথায়ং পবিভবঃ—(প্রথম অঙ্ক)
শ্রমে দুঃখ নেই, দুঃখ পরাজয়ে।
৫. নহি সিদ্ধাবাক্যানক্রম্য গচ্ছতি বিধিঃ সুপরীক্ষিতানি—(প্রথম অঙ্ক) স্মৃতির মধ্যেই দুঃখ।
৬. স্বত্বা স্বত্বা যাতি দুঃখং নবতৄম্―(চতুর্থ অঙ্ক)
স্মৃতির মধ্যেই দুঃখ।
৭. স্ত্রী স্বভাবস্ত কাতরঃ—(চতুর্থ অঙ্ক)
স্ত্রীলোক স্বভাবতই অধীর।
৮. কর্তারঃ সুলভা লোকে বিজ্ঞাতারস্তু দুর্লভাঃ—(চতুর্থ অঙ্ক)
কাজ করবার লোক মিলে কিন্তু যিনি সব জানেন এমন লোক দুর্লভ।
৯. পরম্পরতা লোকে দৃশ্যতে রূপতুল্যতা
পরস্পর রূপের সাদৃশ্য সংসারে দেখা যায়।
১০. রজ্জুচ্ছেদে কে ঘটং ধাবয়ন্তি—(৬ষ্ঠ শ্লোক)
রজ্জু যদি ছিন্ন হয় তবে ঘট ধরে রাখবে কে?
শ্রী মুরারিমোহন সেন
.
কুশীলব
পুরুষ চরিত্র
সূত্রধার—নাট্যপরিচালক
রাজা—বৎসরাজ্যের অধিপতি উদয়ন
যৌগন্ধরায়ণ—উদয়নের মন্ত্রী
বিদূষক—(বসন্তক) রাজা উদয়নের বন্ধু
ব্রহ্মচারী—লাবাণকের অধিবাসী জনৈক ছাত্র
কঞ্চুকী—অন্তঃপুরচারী বৃদ্ধ
সম্ভাষক, ভট–পদ্মাবতীর ভৃত্যদ্বয়
স্ত্রী চরিত্র
বাসবদত্তা—উদয়নের প্রথমা স্ত্রী (আবন্তিকাবেশধারিণী)
পদ্মাবতী—মগধরাজ দর্শকের ভগিনী উদয়নের দ্বিতীয়া স্ত্রী
তাপসী, চেটী–পরিচারিকা
মধুকরিকা, পদ্মিনিকা–পদ্মাবতীর দুই সহচরী
ধাত্রী—পদ্মাবতীর প্রতিপালিকা
বিজয়া—রাজপ্রাসাদের দ্বারপালিকা
ধাত্রী—বাসবদত্তার প্রতিপালিকা
Leave a Reply