স্তালিন : মিথ্যাচার এবং প্রাসঙ্গিকতা / মনজুরুল হক
প্রকাশক : ঐতিহ্য, রুমী মার্কেট ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড
বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০
প্রকাশকাল মাঘ ১৪২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
STALIN : Miththachar Abong Prasangikota by Monjurul Haque
Published by Oitijjhya / Date of Publication : February 2017
.
উৎসর্গ
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী তত্ত্বে সজ্জিত পার্টি গঠনে এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জীবন দিয়েছেন যারা সেই বীরদের…।
.
ভূমিকা
সর্বহারার মহান শিক্ষক কার্ল মার্কস, পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থপতি তথা বিশ্বের সর্বহারা শেণির মহান নেতা ভ. ই. লেনিন, ফেডারিক এঙ্গেলস, চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুঙকে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় যত লেখালিখি হয়েছে সে তুলনায় জোসেফ স্তালিনকে নিয়ে হয়নি। যতটুকু হয়েছে তা অনেকটাই আত্মজীবনীধাঁচের। স্তালিনকে নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক কুৎসা এবং বছরের পর বছর ধরে যে অপপ্রচার তার বিরুদ্ধে কার্যত কোনো শক্তিশালী প্রত্যুত্তর ছিল না।
অনেক দিন থেকেই স্তালিনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সমালোচনা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ এবং সত্য খুঁজে বের করার তাগিদ অনুভব করছিলাম। কাজটা সহজ ছিল না। প্রয়োজনীয় সাহায্যকারী বইপত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। বিশেষ করে অনলাইনে ক্রমাগত তাঁকে নিয়ে নানা মনগড়া কাহিনী, সমালোচনা দেখেও হাতের কাছে যোগ্য প্রত্যুত্তর না থাকায় বইটি লেখার তাগিদ প্রবল হয়।
২০০৭ সালের দিকে ইন্টারনেটে স্তালিনের পক্ষে-বিপক্ষে বিপুল তথ্যভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া গেল। তারপরও নানাবিধ কারণে কাজটা এগোয়নি। অবশেষে ২০১৩ সালে লেখাটা সম্পূর্ণ করব মনস্থির করি। এরপর শত শত ওয়েব পেজ সংগ্রহ করে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যায়।
‘স্তালিন সোসাইটি’, ‘স্তালিন আর্কাইভ’ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়েছি। বিশেষ করে সুইডিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মারিও সোনোর গবেষণা অনেকাংশে সাহায্য করেছে। অনেক তথ্য নেয়া হয়েছে হীরেন মুখার্জীর লেখা ‘স্তালিন উত্তরাধিকার’ বই থেকে। প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য এর কর্ণধার আরিফুর রহমান নাইম ব্যবসায়ীক দৃষ্টিকোণ ছাপিয়ে দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে বারে বারে তাগাদা নিয়ে কাজটি শেষ করিয়েছেন। এদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘন ঘন ফুটনোট, টীকা, নির্দেশিকা সাবলীল পঠনে বিরক্তি ঘটায় ভেবে প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে গ্রন্থপঞ্জি যুক্ত করা হয়েছে। লেখার ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব নির্মোহ থাকার চেষ্টা করেছি, তার পরও চূড়ান্ত বিচারে যদি লেখাটি ‘স্তালিনের পক্ষাবলম্বন’ মনে হয় তাতে কোনো গ্লানিবোধ নেই, বরং মহান নেতা জোসেফ স্তালিনকে। এদেশের পাঠক, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারায় একধরণের তৃপ্তিবোধ আছে।
মনজুরুল হক
ঢাকা
নভেম্বর, ২০১৬
.
প্রাককথন।
রুশ বিপ্লবের অন্যতম প্রধান রূপকার কমরেড লেনিন বলেছেন : কোনো ব্যক্তি, বিষয়, আন্দোলন অথবা কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন পর্যালোচনা করতে হলে তৎকালীন বাস্তব পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অবস্থা, শ্রমিকশ্রেণির অবস্থান, শোষকশ্রেণি ও শোষিত শ্রেণিগুলোর পারস্পরিক শক্তির অবস্থা এবং সর্বহারা শ্রেণির চরম লক্ষ্য ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বিষয়ের তৎকালীন আশু কর্মসূচির বিশ্লেষণ করতে হবে। এই ধরনের বিচারেই সঠিক মার্কসবাদী মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা বেরিয়ে আসে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক কতগুলো
ঘটনার যোগ ও বিয়োগ ফলের দ্বারা তা হয় না। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে একটা সামগ্রিক, সার্বিক ও অখণ্ড চিন্তা বেরিয়ে আসবে, নতুবা খণ্ডিত বা আংশিক বিচার হয়ে যায়।
কমরেড লেনিনের এই শিক্ষার আলোতেই তাঁর সুযোগ্য সহকারী কমরেড স্তালিনের বিপ্লবী জীবনের শিক্ষাগুলোকে আয়ত্ত করতে হবে। এবং শ্রেণি আন্দোলন ও গণ-আন্দোলন বিকাশের ক্ষেত্রে তার সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে হবে!
রাশিয়ার বুকে জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলশেভিক পার্টি গড়ে তোলা, শোষিত শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করে তুলবার জন্য সংগ্রাম, ট্রটস্কিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আদর্শগত সংগ্রাম, বিপ্লবোর পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখবার সগ্রাম, কমরেড লেনিনের জীবনাবসানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখবার সংগ্রাম এবং সর্বোপরি হিংস্র উন্মত্ত ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মানবজাতিকে রক্ষার সংগ্রামে ব্যাপৃত ছিল কমরেড স্ত লিনের সমগ্র জীবন। শুধু তাই নয়, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অটুট রাখতে তিনি পুঁজিবাদী ও ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
কমরেড স্তালিনই সর্বপ্রথম কমরেড লেনিনের শিক্ষা ও তত্ত্বগুলোকে সূত্রবদ্ধ করে সৃষ্টি করেন লেনিনবাদ! এর সংজ্ঞা নির্ধারিত করে তিনি বলেছিলেন : লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রমিক-বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, লেনিনবাদ হলো সাধারণভাবে শ্রমিক-বিপ্লবের মতবাদ ও রণকৌশল এবং বিশেষভাবে এ হলো শ্রমিকশ্রেণির মতবাদ ও রণকৌশল।
মার্কসবাদ-এর তত্ত্বকে বিকশিত করে তুলেছিলেন কমরেড স্তালিন। তিনিই লেনিনবাদের প্রবক্তা। ১৯২৪-এ প্রকাশিত কমরেড স্তালিনের ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’ এবং ১৯২৬-এ ‘লেনিনবাদের সমস্যা’ পুস্তক দুটিতে লেনিনবাদের আরও ব্যাপক বিস্তৃত আদর্শগত ব্যাখ্যা রয়েছে।
যোসেফ স্তালিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। কমিউনিজমের চিরশত্রু পুঁজিবাদী বিশ্ব তো বটেই, এমনকি সোস্যাল ডেমোক্রাট, নির্বাচনপন্থী কমিউনিস্ট আর শ্রেণি সচেতন শ্রেণি সংগ্রামী কমিউনিস্টরাও স্তালিনের বিরুদ্ধে এক ফর্মা বলতে পারলে স্বস্তি বোধ করেন। তাদের মনে হয় তারা গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচারের এক মহান ব্রত পালন করলেন! স্তালিনের বিরুদ্ধে বলতে পারাকে (তা সে প্রমাণ থাকুক বা না থাকুক) কেউ কেউ মনে করেন ইতিহাসের কাঠগড়ায় নৈর্ব্যক্তিক থাকা।
তিনি তাঁর এককালের সাথিদেরও নাকি ছাড়েননি এমনটাই শোনা যায়! তবে সেই সাথিরা সাত ধোয়া তুলসি পাতা ছিল কিনা সে নিয়ে অবিশ্যি কেউ ভুলেও আলোচনা করেন না।
তার উপর আরও অভিযোগ তিনি হিটলারের সাথে হাত মেলান, তিনি হিটলারের চেয়েও ‘রক্তপিপাসু’, ‘নরাধম’!
ক্রুশ্চেভ ভক্ত মেদভেদেভ লিখলেন; “আমার বইতে ৭০০ নিহত মানুষের নাম-ধাম দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ছাড়াও মারা পড়েছিলেন লক্ষ লক্ষ পার্টি সদস্য।
সাতশো মানুষ বললে ঠিক ব্যাপারটা ভালো দাঁড় করানো যায় না, তাই একেবারে লক্ষ লক্ষ! এই লক্ষ লক্ষ ফিগারটিকে চ্যালেঞ্জ করলে ধীরে ধীরে সংখ্যাটি কমতে থাকে। একটি পর্যায়ে এসে মাত্র কয়েক হাজারে দাঁড়ায়!
শিল্প সাহিত্যকে কতটা চোরকুঠুরিতে পাঠিয়েছিলেন তার হদিস মেলে না, তবে শলোকভের ধীরে বহে ডনের অনেক সমালোচনা করেও সেটাকে বাজার থেকে তুলে দেননি, মিকুলিনার এ্যুলেশন অব দি মাসেস গ্রন্থটি নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয় সোভিয়েতে, মনে করা হয়েছিল বইটি বাতিল করে দেয়া হবে, অথচ তিনি এই অভিযোগ হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেন, তাঁর মতে পুস্তিকাটি বাজার থেকে তুলে দিয়ে লেখক অথবা পাঠককে শাস্তি দেবার কোনো যুক্তিই নেই, বইটির আচ্ছারকম সমালোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু নিষিদ্ধকরণ কক্ষনো নয়!
কুৎসায় ছেয়ে গেলেও বিল বেলোতসারশ্লোভস্কিকে লেখা ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৯ এ লেখা চিঠিতে স্তালিন বলছেন “সমালোচনা করা এবং অপ্রলেতারীয় সাহিত্য নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা খুবই সহজ ব্যাপার। কিন্তু যা সহজ তাকে সর্বোত্তম মনে করা উচিত নয়।”
রাশিয়ায় স্তালিনের নেতৃত্বে যেসব ‘অত্যাচার’ ঘটেছিল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিচার করলে তৎকালীন অবস্থায় তাকে একান্তই স্বাভাবিক ও অনিবার্য বলে মনে হবে। উপরন্তু স্তালিনের মহত্ত্ব এখানেই যে, মানব সমাজের কল্যাণের জন্য যে বিপ্লবকে জয়ী করার জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাকে তিনি সুদৃঢ় ও দুর্জয় করে গিয়েছিলেন। বিশ্বের মানুষ আর কিছু না হোক, অন্তত এ কারণেই স্তালিনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
১৯৩৬ সালে সোভিয়েতের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ সর্বক্ষেত্রেই উন্নতির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই ব্যাপক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান-এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় ১৯২৪ সালে সোভিয়েত প্রণীত সংবিধানকে নতুন রূপ দেওয়া হয়। কমরেড স্ত লিনের সভাপতিত্বে মোট ৩১ জনের একটি বিশেষজ্ঞ দল ১৯৩৬ সালে রচনা করেন সোভিয়েতের নতুন সংবিধান। এই সংবিধানে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের তুলনায় আরও অনেক বেশি গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হলো। এই সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছিল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অজেয়। মনীষী রোমা রোলাঁ এই সংবিধানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন : ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ এতকাল ছিল মানুষের স্বপ্নের বস্তু মাত্র। এই সংবিধান থেকে তারা প্রাণ পেল।’ চীন থেকে সান ইয়াৎ সেনও অভিনন্দিত করেছিলেন এই সংবিধানকে! ইতিহাসে এই সংবিধান স্তালিন সংবিধান নামে পরিচিত হয়ে আছে।
১৯৩৮ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদনক্রমে কমরেড স্তালিন রচনা করেন ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-র ইতিহাস সংক্ষিপ্ত পাঠ’। ঐ একই বছরে তিনি লেখেন ‘দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ যা মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক বিশেষণের এক অমূল্য দলিল।
২২ জুন, ১৯৪১। হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করল। কমরেড স্তালিন ঘোষণা করলেন :… কেবল আমাদের দেশকেই মুক্ত করা নয়, ফ্যাসিস্ট প্রভুত্বে নিপীড়িত জনগণকেও আমরা মুক্ত হতে সাহায্য করব।… এ যুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির মুক্তি ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হবে।
১৯৪১ সালের বাইশে জুন ভোর রাত্রে যখন রুশিদের ঘুমও ভাঙেনি অতর্কিতে জার্মানদের অপ্রতিহত আক্রমণ! পিছু হটার সময়টুকুও ছিল না! সাধারণ অস্ত্র, অস্ত্রভাণ্ডার, সেতু, সচল রাস্তা, খনিজ তেল, খাদ্য গুদাম, এয়ার ফিল্ড, ট্যাঙ্ক, কামান বিমান বিপুল অংশ করায়ত্ত হলো নাজি বাহিনীর! মাটিতেই ২০০০ প্লেন হারাল স্তালিনের বাহিনী প্রথম দুদিনে!
পৃথিবীর যাবতীয় যুদ্ধেই দেখা যায় ক্ষয়ক্ষতি যতদূর নিজেদের কমিয়ে বলা হয়। যাতে সেনাদের মনোবল না ভাঙে, বাস্তবিকই ত্রিমুখী আক্রমণে নাজিরা সংখ্যাধিক্যে ছিল তিন থেকে পাঁচ গুণ! কামান ও মর্টারে তিনগুণ! আর ট্যাঙ্ক বিমানের বিপুল সংখ্যাধিক্য! তার উপর অতর্কিতে করা আক্রমণের ফলে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিপুল ক্ষয় ক্ষতির মুখে পড়ে রেড আর্মি। স্তালিন কিন্তু কোনো তথ্য গোপন করলেন না। তিনি খোলাখুলি বলেই দিলেন তারা কী হারিয়েছেন, শত্রু কোথায় কতটা মারাত্মক আঘাত হেনেছে সব। এবং সবার শেষে বললেন; “জয় আমাদের সুনিশ্চিত।”
১ মে, ১৯৪৫ কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লালফৌজ বার্লিনের রাইখ স্ট্যাগে রক্তপতাকা উড়িয়ে মানবজাতির চরমতম শত্রু ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘোষণা করেছিলেন।
ফ্যাসি-বিরোধী যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রথম স্থানে। এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন ২ কোটির বেশি সোভিয়েত জনগণ। যুদ্ধের সময় শিশুসহ ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে জার্মানিতে দাস শ্রমিক হিসেবে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েতে ৫৩ লক্ষ যুদ্ধবন্দির মধ্যে যুদ্ধের শেষে মাত্র ১০ লক্ষকে জীবিত পাওয়া গিয়েছিল। ফ্যাসিস্টদের আক্রমণে চরম ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল সোভিয়েতের ছোট-বড় মিলিয়ে ১ হাজারেরও বেশি শহরকে, ৭০ হাজার গ্রামকে, ৩২ হাজার শিল্প সংস্থাকে এবং ৯৮ হাজার যৌথ ও রাষ্ট্রীয় খামারকে। যুদ্ধ যখন চলছে, মিত্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েতকে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন রুজভেল্ট ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। রুজভেল্টে’র জীবনাবসানের পর টুম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েই সেই প্রতিশ্রুতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। অবশ্য কমরেড স্তালিন তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে সমস্ত যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমাণ করে দিয়েছিল তার সমাজতান্ত্রিক দৃঢ়তা। শুধু তাই নয়, পূর্ব ইয়োরোপের সদ্য মুক্ত হওয়া দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যেও সোভিয়েত তার সমগ্র শক্তিকে ব্যবহার করেছিল। এইভাবে যুদ্ধের বীভৎসতা কাটিয়ে কমরেড স্তালিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে দুনিয়ার তাবৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছিল।
এর পরের ইতিহাস পৃথিবীকে বারে বারে চমকে দেয়ার ইতিহাস। গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখল এক অকুতোভয় যোদ্ধা জাতি কী বিপুল বিক্রমে পৃথিবীকে রক্ষা করল। গোটা পৃথিবীকে এক রক্তপিপাসু জাতির দাসত্ব করা থেকে বাঁচাল রেড আর্মি, বিশেষত কমরেড স্তালিনের তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার বুদ্ধি, অকপট দেশপ্রেম আর জনগণের ওপর অগাধ বিশ্বাস।
জানা যায় যুদ্ধে তাঁর প্রিয় পুত্রকে বন্দী করে জার্মানরা। বন্দী বিনিময় করতে চায় তাদের ফিল্ড মার্শাল ফ্রেডরিখ পউলাসের সাথে।
তিনি রাজি হননি! এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে দেয় স্তালিনের কাছে দেশ আর নিজের সন্তানের মধ্যে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ? লাল ফৌজের সর্বাধিনায়ক স্তালিন বললেন; I will not trade a Marshal for a Lieutenant!
যারা গড় চিন্তাধারায় তার ‘স্বজনপোষণ’ নিয়ে কুৎসা করেন তারা অবশ্য কল্পনাও করতে পারেননি যে দেশের জন্য স্তালিন উৎসর্গ করে দেবেন নিজের ছেলেকেই!
অক্টোবর, ১৯৫২-তে সোভিয়েত বলশেভিক পার্টির ঊনবিংশতম কংগ্রেসের ভাষণে কমরেড স্তালিন বলেছিলেন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ও জাপানি ফ্যাসিস্ট বর্বরতাকে চূর্ণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইয়োরোপ এবং এশিয়ার জনগণকে ফ্যাসিস্ট দাসত্বের বিপদ থেকে মুক্ত করেছে। … যে সকল কমিউনিস্ট শ্রমিক-কৃষক ও গণতান্ত্রিক পার্টি আজও বুর্জোয়া শাসনের চাপে শোষিত ও বঞ্চিত, তাদের দিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।
এই পার্টি কংগ্রেস ভবিষ্যতে সোভিয়েতকে যেকোনো বিপদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ মোকাবিলার আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে তুলেছিল। এটাই ছিল কমরেড স্তালিনের জীবনের শেষ পার্টি কংগ্রেস। ৫ই মার্চ, ১৯৫৩ সোভিয়েত তথা সমগ্র দুনিয়ার শোষিত জনগণের মুক্তিকামী নেতা কমরেড স্তালিন চিরন্দ্রিামগ্ন হন।
দুনিয়ায় শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের সংগ্রাম যতদিন ধরে চলবে, নিপীড়িত হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনে অনুপ্রেরণার স্ফুলিঙ্গ হয়ে রইবেন কমরেড স্তালিন।
লেখক
নভেম্বর, ২০১৬
.
মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে?
সেগুলো কি আকাশ থেকে পড়ে?- না।
সেগুলো কি নিজের মনের মধ্যে সহজাত?- না।
মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কেবলমাত্র সামাজিক অনুশীলন থেকেই আসে,
সমাজের উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণি সংগ্রাম ও
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এই তিনটা অনুশীলন থেকেই আসে।
— মাও সে তুঙ
Leave a Reply