স্টিফেন ম্যানসন – রূপক সাহা
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২১
প্রচ্ছদ – ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য্য
প্রকাশক : শংকর মণ্ডল
.
উৎসর্গ
দমকল কর্মীদের উদ্দেশে
.
ভূমিকা
ছোটবেলা থেকেই আগুনে আমার ভীষণ ভয়। স্কুলের পাশের বাড়ির নীচে একটা মিষ্টির দোকানে একবার আগুন লেগেছিল। গলগল করে কালো ধোঁয়া ঢুকে গেছিল ক্লাসে। আমরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম তারাসুন্দরী পার্কে। সেই ভয়টা দ্বিতীয়বার পেয়েছিলাম, একবার কালীপুজোর আগে। পকেট কয়েকটা পটকা (তখন পাওয়া যেত) ছিল। আমার মনে নেই। লাফিয়ে বিছানায় শুতে গিয়ে হঠাৎ সেই পটকাগুলো ফেটে যায়। উরুতে বিরাট ফোস্কা, হাফপ্যান্টে বিরাট গর্ত। বাড়িতে মারধর খাওয়ার পর আগুন সম্পর্কে আমার ভীতি অনেক বেড়ে গেছিল। সেই ভয় এতদিনে গেল ‘স্টিফেন ম্যানসন’ লিখতে বসার পর। আমার এই নতুন উপন্যাসের বিষয় আগুন। গবেষণা করার সময় ক্রমেই বুঝতে পারলাম, আগুন ‘লাগানো’ হলে মারাত্মক ক্ষতিকারক। কিন্তু আগুন যখন ছোট, তখন মানুষের খুব উপকারে লাগে।
প্রতি বছর শহরে কোনও না কোনও বহুতল বা বস্তিতে আগুন লাগে। সেই দুর্ঘটনার খবর কাগজে আমরা বিস্তারিত দেখতে পাই। বইমেলায় আগুন নিজের চোখে দেখেছি। কয়েক বছর আগে পার্ক স্ট্রিটের এক বিশাল বাড়িতে আগুন লেগেছিল, এ কথা সম্ভবত কেউ এখনও ভোলেননি। তখন থেকেই ভাবছিলাম, অগ্নিকাণ্ডের একটা ঘটনাকে উপজীব্য করে কোনও উপন্যাস লিখব। বিদেশি লেখকরা লিখেছেন। তাঁদের লেখা নিয়ে হলিউডে অনেক সিনেমাও হয়েছে। কলেজে পড়ার সময় ‘দ্য বার্নিং ট্রেন’ বলে একটা হিন্দি ছবি দেখেছিলাম। ধর্মেন্দ্র আর হেমা মালিনী ছিলেন সেই সিনেমাতে। বাংলা ভাষায় এই অভিনব বিষয়টা নিয়ে কেউ কিছু লিখেছেন কি না আমার জানা নেই। কিন্তু লিখতে বসার পর আমার মনে হল, এর দরকার ছিল।
ছোটবেলায় পোস্তার যে অঞ্চলে আমরা থাকতাম, সেখানে দেখতাম, পাড়ার মোড়ে দুটো লাল বাক্স দাঁড় করানো থাকত। একটা চিঠিপত্তর ফেলার। অন্যটা দমকলে খবর দেওয়ার জন্য। কাচ ভেঙে ভিতরের কাঁটা ঘোরালেই দমকলের আপিসে খবর চলে যেত। সেই আপিসটা মনে হয়, ছিল সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে। হ্যারিসন রোডের মোড়ে। দমকলের লাল গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকত। তখন কলকাতার সবথেকে নামী দুর্গাপুজোটা হত ওই দমকলেই। অসাধারণ মূর্তি গড়তেন রমেশ পাল। আমরা ছোটরা দল বেঁধে দেখতে যেতাম সেই ঠাকুর। তখন রাস্তায় দমকলের ঘণ্টা বাজলেই বুক কেঁপে উঠত। হায় রে, কার সর্বনাশ হল কে জানে? এই বয়সে এখন অ্যাম্বুলেন্সের হুটার শুনলে যা মনে হয়।
স্মৃতিচারণ থাক, আগুনের কথা বলি। বৈদিক যুগ থেকেই আগুনের অপরিসীম গুরুত্ব। মুনি-ঋষিরা বলে গেছেন, অগ্নি হল পঞ্চভূতের অন্যতম। অগ্নিদেবের বিচরণক্ষেত্র সর্বত্র। স্থলে তিনি আগুন, শূন্যে বজ্র ও আকাশে সূর্য। এই তিনটি স্তরে তাঁর অস্তিত্বকে বেদে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যেন, তিনি দেবদেবী ও মানুষের মধ্যে বার্তাবাহক। বৈদিক যুগে হিন্দুরা অনেক উন্নতমানের ছিলেন। অগ্নিদেবকে তাঁরা মাথায় করে রেখেছিলেন। হিন্দুধর্মে কোনও আচরণবিধিই আগুন ছাড়া হয় না। বিয়ের সময় আগুনকে মাঝে রেখে সাত পাক দিতে হয়। নশ্বর দেহ দাহের জন্য চিতার আগুন প্রয়োজন। পুজো আচ্চাতে তো বটেই, উৎসবের সময়ও প্রদীপ জ্বালিয়ে অগ্নিদেবকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়।
আদিমানবরা আগুনকে প্রথম চাক্ষুষ করেন প্রাকৃতিক কারণে। বাজ পড়ার পর দাবানল দেখে। মাথা খাটিয়ে সেই আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনার, নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করার কাজটা প্রথম করেছিলেন তাঁরাই। ক্রমে ক্রমে ওঁরা বুঝেছিলেন, আগুন জ্বালালে বন্য পশুদের থাবা থেকে নিজেদের বাঁচানো যায়। আগুনের ধোঁয়া কীট পতঙ্গকে দূরে সরিয়ে রাখে। চরম ঠাণ্ডার হাত থেকে রক্ষা করে। আগুনে ঝলসে নেওয়া মাংস খেতে খুব সুস্বাদু লাগে। আগুনই এই পৃথিবীতে মানুষকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল বন্যপশুদের থেকে। অগ্নির গুরুত্ব এমনি এমনি বাড়েনি। আদিযুগে অগ্নিকে মানুষ তাই দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন। বেদ, উপনিষদ আর পুরাণে আমরা তারই প্রতিফলন দেখতে পাই।
আমার এই উপন্যাসে কেন্দ্রীয় দুটো চরিত্রে আছে দেবদূত ও মিলেনা। দেব একজন নামী বডি বিল্ডার এবং পার্ক স্ট্রিটের একটা জিমের চিফ ট্রেনার। তার প্রেমিকা মিলেনা যে বাড়িতে থাকে, পার্ক স্ট্রিটেই সেই স্টিফেন ম্যানসনের উপর নজর পড়েছে কুখ্যাত মাস্তান রুস্তমের। মিলেনাকে সে ফ্ল্যাট থেকে উৎখাত করতে চায়। সুপারি নিয়ে সে-ই স্টিফেন ম্যানসনে এমন একটা দিনে আগুন লাগিয়ে দেয়, যেদিন দেবদূতের ব্যাঙ্কক যাওয়ার কথা কম্পিটিশনে নামার জন্য। সে মিলেনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আগুন নেভাতে আসেন ফায়ার সার্ভিসের অফিসার শিখিন, যিনি অগ্নিদেবের ভীষণ ভক্ত। তিনি কি দেব-মিলেনাকে উদ্ধার করতে পারবেন? দেব কি শেষ পর্যন্ত যেতে পারবে ব্যাঙ্ককে? রুস্তমেরই বা পরিণতি কি হবে?
উপন্যাসটা লেখার সময়ই জানতে পারলাম, বড় আগুন লাগার আসল কারণগুলো কি? এর পিছনে রাজনীতিক-প্রোমোটার নেক্সাস কতটা সক্রিয়? দমকলে কত ধরনের দুর্নীতি হয়। আগুন মোকাবিলার জন্য কত নতুন ধরনের সরঞ্জাম বিদেশে ব্যবহার করা হয়। ড্রোন বা রোবট অবশ্য এ দেশেও চালু হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস পুলিশ বা আর্মির মতো ইউনিফর্ম সার্ভিস। বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স পড়ানো হচ্ছে। ইদানীং বহুতল বাড়ি, শপিং মল, মাল্টি প্লেক্সে কমপক্ষে একজন ফায়ার অফিসার নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। ফলে পাশ করে বেরনো ছেলেদের চাকরির অভাব হয় না। ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেটও পাওয়া সম্ভব পরীক্ষা দিয়ে।
Leave a Reply