সে কোন বনের হরিণ – কাসেম বিন আবুবাকার
বিশ্বসাহিত্য ভবন
৩৮/৪ বাংলাবাজর ঢাকা ১১০০
(১) “সৎ দ্বারা অসৎ দূর কর”, এই আয়াত সম্বন্ধে (হযরত মুহাম্মদ (দঃ)) বলিয়াছেন, “ক্রোধে ধৈর্য এবং অসদ্ব্যবহারের সময় ক্ষমা কর। যখন তাহারা ইহা অবলম্বন করে, আল্লাহ তাহাদিগকে রক্ষা করিবেন এবং তাহাদের শত্রুগণকে হেয় করিবেন, যেন তাহারা পরম সুহৃদ হয়।” –বর্ণনায় : হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বুখারী
(২) “হে নফস, কথা বলাটা রূপার মতো হলেও চুপ থাকাটা স্বর্ণের ন্যায়।”–হযরত আলি (রাঃ)
(৩) নীরবতা মঙ্গল না করতে পারে, কিন্তু ক্ষতি করে না।——জর্জ রিচার্ড
০১.
আপু তোর ফোন।
রূপা রাত দশটায় খেয়ে এসে পড়ছিল। ছোট বোন সায়মার কথা শুনে ঘড়ির দিকে তাকাল, কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে দশটা।
তাই দেখে সায়মা বলল, ছেলেটা রোজ রোজ তোকে ডিস্টার্ব করে, তুই কিছু বলিস নি কেন?
রূপা তার কথার জওয়াব না দিয়ে বলল, বলে দে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।
সায়মা অবাককণ্ঠে বলল, আমাকে মিথ্যে বলতে বলছ? তুমিই তো বলেছ কোনো কারণেই মিথ্যে বলা হারাম।
একটা পড়া তৈরি করছিলাম, তাই বেখেয়ালে বলে ফেলেছি। তারপর ড্রইংরুমে এসে রিসিভার তুলে বিরক্তকণ্ঠে বলল, কেন প্রতিদিন ঠিক এই সময়ে। ফোন করেন? কতদিন আপনাকে বলেছি, এ সময়ে পড়াশোনা করি।
অন্য সময়ে আপনাকে নিরিবিলি পাওয়া যায় না। তাই এই সময়ে করি। রূপা রাগের সঙ্গে বলল, কিন্তু এখন তো সবাই জেগে। তা ছাড়া ফোনটা তো আমার ঘরে নেই। ছোট বোন প্রতিদিন ফোন ধরে আমাকে ডেকে দেয়। আচ্ছা, কে আপনি?
আমি একজন মানুষ।
আমার তো মনে হয় অমানুষ।
তা হতে পারি। তবে অমানুষ হলেও খুব খারাপ অমানুষ নই।
আমার ধারণা, আপনি খুব খারাপ অমানুষই। নচেৎ প্রত্যেকদিন একজন ছাত্রীর পড়ার ডিস্টার্ব করতেন না।
আপনার কথা কতটা সত্য জানি না। তবে কী জানেন, আমাকে অনেক রাত পর্যন্ত পড়তে হয়। খেয়ে এসে এই সময়ে কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারি না। আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করার পর পড়ায় মন বসে। তাই একটু ডিস্টার্ব করি।
কিন্তু আপনার ফোন আসার পর আমি যে পড়ায় মন বসাতেপারি না। প্লীজ, আর কোনো দিন এ সময়ে ফোন করবেন না।
তা হলে বলুন, কখন ফোন করলে আপনার ডিস্টার্ব হবে না?
কোনো সময়েই ফোন না করলে খুশী হব।
কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা না বললে যে আমার পড়াশোনা একটুও হবে না। সারারাত একটু ঘুমও হবে না। পরীক্ষায় নির্ঘাৎ ডাব্বা মারব।
আপনি আমাকে চেনেন না, জানেন না। আমিও আপনাকে চিনি না, জানি না, তবু এরকম কথা বলছেন কেন?
আপনি আমাকে না চিনলেও, না জানলেও আমি আপনার সব কিছু জানি। কী জানেন বলুন তো?
আপনার ভালো নাম যাবিন তাসনিম। ডাক নাম রূপা। বাবা রোকন উদ্দিন সাহেব একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যবসায়ী। বর্তমানে মন্ত্রী। দেশের বাড়ি নীলফামারী জেলার পলাশবাড়ি। ঢাকায় দু’টা বাড়ি, দু’টা গাড়ি। একটা আপনার বাবার। অন্যটা আপনাদের দু’বোনের। গাড়ি নিয়ে দু’বোন মাঝে মধ্যে ঝগড়া করেন। আপনি ইডেনে বাংলায় অনার্স করছেন। ছোট বোন সায়মা ঐ কলেজেই ইন্টারে পড়ছেন। আপনারা দু’বোনই সুন্দরী। তবে আপনি একটু বেশি।
সবকিছু মিলে যাচ্ছে দেখে রূপা খুব অবাক হয়ে ভাবল, ছেলেটা আমাদের সবকিছু জানে। কে হতে পারে চিন্তা করে না পেয়ে অধৈর্য গলায় বলল, হয়েছে হয়েছে, আর বলতে হবে না। এবার আপনার পরিচয়টা বলুন।
বলা যাবে না।
কেন?
সময় হলে বলব।
আপনি শুধু অমানুষ নন, কাপুরুষও। এই কথা বলে রূপা রিসিভার ক্র্যাডেলে রেখে ফিরে এসে পড়তে বসল। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারল না। বই বন্ধ করে চিন্তা করতে লাগল, ছেলেটা কে হতে পারে? আমার পেছনেই বা লেগেছে কেন? ব্যাপারটা আব্বাকে জানালে কেমন হয়? আবার চিন্তা করল, ছেলেটার গলার আওয়াজ বেশ মিষ্টি। দেখতে কেমন কে জানে? অনেকের গলার আওয়াজ মিষ্টি হলেও দেখতে রোগা পেঁচকা, বেঁটে, চোখ ছোট ছোট, গায়ের রং মিশমিশে কালো। আবার কোনো গরিবের দেখতে শুনতে ভালো ছেলে নিজেকে বড়লোকের ছেলের পরিচয় দিয়ে ধন-সম্পত্তির লোভে বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করতে চায়। এই ছেলেটা সেরকম নয়তো? তা না হলে পরিচয় দিতে চায় না কেন? এদিকে তলে তলে আমাদের সব খবর জেনে নিয়েছে। আজ তিন মাস ধরে ছেলেটা পিছনে লেগেছে। যদি সত্যিই তার কোনো বদ মতলব থাকে, তা হলে আব্বাকে। বলে বাছাধনকে জেলের ভাত না খাইয়েছি তো আমার নাম রূপা নয়।
রূপা ও সায়মা রিডিংরুমে দুটো আলাদা টেবিলে পড়ে। দু’বোন একই বেডরুমে আলাদা খাটে ঘুমায়। সেখানেও পড়ার জন্য দু’টো চেয়ার টেবিল আছে। রাত দশটায় খাওয়ার পর দু’জনে বেডরুমে পড়ে। পড়তে পড়তে ঘুম পেলে সায়মা প্রায় প্রতিদিন চোখে মুখে পানি দিয়ে বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। তাই ড্রইংরুমে ফোন বাজলে সে-ই ধরে।
সায়মা এতক্ষণ একটা নোট করছিল। নোটটা শেষ করে রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, আপু, এই বন্ধ করে চুপচাপ কী ভাবছিস?
রূপা জানে কথা বললেই সায়মা ঐ ছেলেটাকে নিয়ে নানান কমেন্ট করবে। উপদেশ দিতেও ছাড়বে না। তাই তার কথার উত্তর না দিয়ে হাই তুলে বলল, আজ আর পড়তে ভালো লাগছে না, ঘুমাব বলে খাটে শুয়ে পড়ল।
সায়মা কিছু বলল না, শুধু তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। বাথরুমের কাজ সেরে এসে শোয়ার সময় বলল, আপু তুই কী ঘুমিয়ে পড়েছিস?
ঘুমাই নি, তবে ঘুম পাচ্ছে। তুই আর কোনো কথা বলবি না, চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়।
আচ্ছা আপু, ছেলেটা তোকে প্রতিদিন ফোন করে কেন বলবি?
রূপা রেগে উঠে বলল, তোকে কথা বলতে নিষেধ করলাম, তবু কথা বলছিস? বললাম না, আমার ঘুম পাচ্ছে?
প্লীজ আপু, আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে দে, আর একটাও কথা বলব না।
সায়মা, তুই কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছিস। আর যদি একটা কথা বলিস, রিডিংরুমে গিয়ে ঘুমাব।
সায়মা খুব ভীতু। একা ঘুমাতে ভয় পায়। রূপা যেদিন কোনো কারণে খুব রেগে যায়, সেদিন রিডিংরুমে ঘুমাতে চলে যায়। সায়মা তখন অন্যায় স্বীকার করে অনেক কাকুতি মিনতি করে তাকে এই রুমে নিয়ে আসে। তাই এখন তার কথা শুনে আর কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়ল।
রূপা কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারল না। চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে ছেলেটার পরিচয় পাওয়া যেতে পারে? হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসার পর ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে রূপা আব্বুকে বলল, আমাদের বেডরুমে একটা প্যারালাল ফোনের ব্যবস্থা করে দাও। পড়ার সময় ফোন এলে ড্রইংরুমে গিয়ে ফোন ধরতে খুব বিরক্ত লাগে। অনেক সময় ওখানে বাইরের লোকজন থাকে। অসুবিধে হয়।
রোকন উদ্দিন সাহেবের কোনো পুত্র সন্তান নেই। শুধু দু’টো মেয়ে। বড় মেয়ে রূপা মায়ের সবকিছু পেয়েছে। পুত্র সন্তান না থাকায় রোকন উদ্দিন সাহেব দুই মেয়েকেই ভীষণ ভালবাসেন। তবে রূপাকে একটু বেশি। তার কথা শুনে বললেন, প্যারালাল নয়, কয়েকদিনের মধ্যে আর একটা ফোন তোদের জন্য নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।
রূপা বলল, কয়েকদিন পরে যা করার করো, আজ প্যারালাল ফোনের ব্যবস্থা করে দাও।
রোকন উদ্দিন সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে, অফিসে গিয়ে একজন লোক পাঠিয়ে দেব। সে ব্যবস্থা করে দেবে।
আজ সন্ধ্যের পর থেকে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। রাত নটার পর বৃষ্টি একটু কমলেও দমকা দমকা ঝড় বইছে। দশটার সময় খেয়ে এসে রূপা সায়মাকে বলল, ঝড়-বৃষ্টির কারণে আজ হয়তো ছেলেটা ফোন করবে না। তবু যদি করে, তুই ফোন ধরবি। তারপর কি বলবে বুঝিয়ে বলল।
সায়মা বলল, আজ আবার মিথ্যে বলতে বলছ?
হ্যাঁ বলছি। বাজে ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যে বললে দোষ হয় না।
কিন্তু উনি তো আমার গলা চেনেন।
চিনুক, তবু যা বলতে বললাম বলবি।
ঠিক সাড়ে দশটায় ফোন বেজে উঠতে রূপা সায়মাকে রিসিভ করতে বলল।
সায়মা রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, রূপা বলছি।
অপর প্রান্ত থেকে অজানা ছেলেটা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি রূপা নন, সায়মা।
কী করে বুঝলেন? আমি তো রূপাই বলছি।
শুধু শুধু মিথ্যে বলে নিজেকে ছোট করছেন কেন?
আপনি যখন বিশ্বাসই করছেন না তখন ফোন রেখে দিচ্ছি।
প্লীজ রাখবেন না, দয়া করে আপনার আপুকে দিন।
আপনি তো বিশ্বাসই করছেন না, আমি রূপা। রেখে দেব না তো কী করব?
তা হলে বলুন, “আল্লাহর কসম আমি রূপা বলছি।”
সায়মা জানে আল্লাহর নামে মিথ্যে কসম খাওয়া কবীরা গুণাহ। তাই কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
কী হল? আল্লাহর কসম খেয়ে বললেন না যে?
সায়মা মাউথপীসে হাত চাপা দিয়ে রূপার দিকে তাকিয়ে কসম খাওয়ার কথা বলে বলল, এখন কী করব?
রূপা তার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বলল, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
ছেলেটা আহতস্বরে বলল, ছোট বোনকে দিয়ে এভাবে ফোন রিসিভ করতে বলা আপনার উচিত হয় নি। এটা আমার আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার কাছে সায়মা কত ছোট হয়ে গেল বলুন তো?
উচিত অনুচিতের কথা পরে, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন কী না বলুন?
একটা কেন, হাজারটা অনুরোধ রাখব। তবে ফোন করার ব্যাপারটা ছাড়া। তারপর বলল, বেডরুমে ফোন নিয়ে খুব ভালো করেছেন। পড়ার সময় আর ডিস্টার্ব করব না। কাল থেকে সাড়ে বারটার সময় যখন ঘুমাতে যাবেন তখন করব।
রূপা খুব অবাক হয়ে বলল, এ রুমে ফোন নিয়েছি আপনি জানলেন কিভাবে?
আল্লাহর ইচ্ছায় আমি অনেক কিছু জানতে পারি। শু
ধু আমাদের অনেক কিছু জানতে পারেন, না অন্যদেরও জানতে পারেন?
অন্যদের কোনো কিছু জানার ইচ্ছা কখন হয় নি। তাই সেকথা বলতে পারলাম না। তারপর বলল, কী যেন অনুরোধ করবেন বললেন?
তা আর করব না। তবে একটা প্রশ্ন করব, সঠিক উত্তর দেবেন তো?
উত্তর জানা থাকলে সঠিকই দেব। কারণ কোনো মুমীন মুসলমান মিথ্যে বলতে পারে না।
আপনি আমার পেছনে লেগেছেন কেন?
উত্তরটা আপনি জানেন, তবু জিজ্ঞেস করছেন কেন?
সিওর হওয়ার জন্য।
যা জেনেছেন সেটাই সত্যি।
আমি কি জেনেছি, তা আপনি বুঝলেন কী করে? কারো মনের কথা তো আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানতে পারে না। এটা কুরআন পাকের কথা।
আপনি ঠিক কথা বলেছেন। তবে আল্লাহ যাদেরকে পছন্দ করেন তাদেরকে মানুষের মনের খবর জানার জ্ঞান দান করেন।
তারা তো আল্লাহর খাস বান্দা। আপনিও কী নিজেকে তাই ভাবেন?
কখনই না। তাদের পায়ের ধূলোর সমান যোগ্যতাও আমার নেই।
তা হলে ঐ কথা বললেন কেন?
আল্লাহর মেহেরবাণীতে আমি হিকমতের দ্বারা শুধু আপনাদের সবকিছু জেনে নিই।
বুঝলাম না।
পরে এক সময় বুঝিয়ে দেব। অবশ্য আপনিও চেষ্টা করলে হিকমতের দ্বারা আমার সবকিছু জানতে পারেন।
হিকমত টিকমত বুঝিও না, আর জানিও না। আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন। কিনা বলুন?
বললাম তো, উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয় দেব।
আপনার নাম বলুন।
আব্দুস সাত্তার।
বাবার নাম?
বলা যাবে না।
ঠিকানা?
তাও বলা যাবে না।
কেন?
বললাম বলা যাবে না, তবু জিজ্ঞেস করছেন কেন?
আপনি কী করেন?
দু’তিন মাস পরে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স দেব।
আপনার বাবা কী করেন?
একটা বেসরকারী কলেজে অধ্যাপনা করেন।
আপনি যখন ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স করছেন তখন ধর্ম সম্পর্কে নিশ্চয় অনেক জ্ঞান রাখেন?
তাতো কিছু রাখি।
তা হলে প্রতি রাতে একজন গায়ের মহররম মেয়েকে ফোন করা যে ইসলামের পরিপন্থী, তা তো জানার কথা। তবু করেন কেন?
আপনাকে প্রায় দু’বছর আগে থেকে ভালবাসি এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিয়ে। করব। জীবন সাথী পছন্দ করা ইসলামের পরিপন্থী নয়।
এই আইন শুধু ছেলেদের বেলায়, না মেয়েদের বেলায়ও।
উভয়েরই।
আমি তো আপনাকে দেখি নি, চিনি নি, আপনাকে যদি আমার পছন্দ না হয়?
ছেলেরা যেসব কারণে মেয়েদের পছন্দ করে, সে সব আপনার মধ্যে আছে। তাই আমি যেমন আপনাকে পছন্দ করেছি, তেমনি মেয়েরা যেসব কারণে ছেলেদের পছন্দ করে, সেসব আমার মধ্যে আছে। তাই আমি হান্ড্রেডপার্সেন্ট সিওর, আমাকে দেখলে আপনি অপছন্দ করবেন না।
আপনার কথা সত্য হলেও সবক্ষেত্রে নয়। যেমন অনেক সুন্দরী মেয়ে অসুন্দর ছেলেকে পছন্দ করে। আবার অনেক সুন্দর ছেলে অসুন্দর মেয়েকে পছন্দ করে।
আপনার কথা অস্বীকার করব না। আমি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেছি। আর আপনি যা বললেন, তা ব্যতিক্রম।
আপনি আমাকে দেখে শুনে ও আমাদের সবকিছু জেনে পছন্দ করেছেন এবং বিয়ে করার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন বললেন। আমারও কী উচিত নয়, আপনাকে দেখে।
ও আপনাদের সবকিছু জেনে পছন্দ করা?
অফকোর্স।
তা হলে বলুন, কবে-কখন ও কোথায় আপনার সঙ্গে আলাপ করব।
কাল বলব, আজ অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ন, নচেৎ ফজরের নামায কাযা হয়ে যাবে। তারপর রূপা কিছু বলার আগেই সালাম দিয়ে লাইন কেটে দিল।
রূপা সালামের উত্তর দিয়ে রিসিভার রেখে দিল।
সায়মা এতক্ষণ নিজের খাটে বসেছিল। ছেলেটার কথা শুনতে না পেলেও আপুর কথায় বুঝতে পারল, সে আপুকে ভালবাসে ও বিয়ে করতে চায়। তাই রিসিভার রেখে দেওয়ার পর জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা পরিচয় বলেছে?
শুধু নাম বলেছে আব্দুস সাত্তার। বাবার নাম ও বাসার ঠিকানা বলে নি।
তুই দেখা করার কথা বলতে কী বলল?
কাল বলবে বলেছে?
আর কী করেন জিজ্ঞেস করতে?
ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স দেবে।
নাম ছাড়া অন্য কিছুই যখন বলে নি, মনে হয় ছেলেটা ফ্রড। একা একা তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া তোর ঠিক হবে না।
তোকে অত পাকামী করতে হবে না। নে এবার শুয়ে পড় বলে রূপা বাথরুম থেকে এসে শুয়ে পড়ল।
০২.
প্রায় চার মাস হতে চলল, আব্দুস সাত্তারের ফোন না পেয়ে রূপা চিন্তা করল, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। নচেৎ যে নাকি তিন মাস প্রতি রাতে ফোন করত, সে এতদিন ফোন না করে আছে কি করে? যাকগে, ভালই হল, কোথাকার কে না কে? ফোন করা বন্ধ করতে দুশ্চিন্তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। এইসব ভাবলেও প্রতিদিন রাত সাড়ে বারটার সময় ফোনের সেটের দিকে পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই দৃষ্টি চলে যায়। তার মনে হয়, এক্ষুনি বুঝি রিং বেজে উঠবে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিরাশ হয়ে আবার পড়ায় মন দেয়। আব্দুস সাত্তার যখন ফোন করত তখন রূপা বিরক্ত হলেও মনের মধ্যে এক ধরণের রোমাঞ্চ অনুভব করত। ফোন না আসায় সেই রোমাঞ্চ থেকে বঞ্চিত হয়ে ব্যথা অনুভব করে।
আপুর হাবভাব সায়মার চোখ এড়াল না। একদিন সাড়ে বারটার সময় তাকে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, কী রে আপু, সেটের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? আব্দুস সাত্তার ফোন করে নি বলে তুই কী কিছু ফিল করছিস?
রূপা বড় বড় চোখে তার দিকে তাকাল।
আহ হা, তুই ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আমার মনে হচ্ছে, ছেলেটা সত্যিই ফ্রড। তুই দেখা করার কথা বলতে কেটে পড়ল। তা না হলে এতদিন ফোন না করার কারণ কী?
তার কথা শুনে রূপার মনে হল, সায়মা ঠিক কথাই বলেছে। দৃষ্টি সংযত করে বলল, তোকে লেকচার দিতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দে বলে পড়ায় মন দিল।
এরপর কয়েকদিন রূপা সাড়ে বারটার সময় ফোনের সেটের দিকে তাকাল না আব্দুস সাত্তারের কথা ভুলে যাওয়ার জন্য। আজ হঠাৎ অজান্তে ঐ সময়ে সেটের দিকে তাকিয়ে ভাবল, সত্যিই কি আব্দুস সাত্তার আর কোনোদিন ফোন করবে না? সে কি সত্যিই ফ্রড? তার মন বলে উঠল, না-না, আব্দুস সাত্তার কোনোদিন ফ্রড হতে পারে না।
আজও ব্যাপারটা সায়মার চোখ এড়াল না। বলল, আব্দুস সাত্তারের ফোন না করার দুটো কারণ থাকতে পারে।
রূপা তার দিকে তাকিয়ে একটু রাগের সঙ্গে বলল, তোকে আমার ব্যাপারে নাক গলাতে নিষেধ করেছি না?
রাগ করছিস কেন আপু? কথাটা হঠাৎ মনে হল তাই বলছি। প্রথমটা হল, তার মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষার পর গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। দ্বিতীয়টা হল, হয়তো কোনো কঠিন অসুখ হয়ে মারা গেছে।
গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে শুনে রূপা একটু কষ্ট অনুভব করলেও মারা যাওয়ার কথা শুনে খুব রেগে গেল। বলল, তুই একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে একজনের সম্পর্কে মারা যাওয়ার কথা বলতে বিবেকে বাধল না? জানিস না, কারো মৃত্যু কামনা করতে নেই? খবরদার ওরকম কথা আর মুখে আনবি না।
সরি আপু, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও বলব না।
আরো একমাস পর রূপার পরীক্ষা শুরু হল। শেষ হতে প্রায় দু’মাস সময় লাগল। যেদিন শেষ হল সেদিন রাতে দশটার সময় খেয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ল। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য দৈনিক প্রায় চৌদ্দ পনের ঘণ্টা পড়াশোনা করেছে। তাই বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে।
সায়মার দু’মাস পরে পরীক্ষা। তাই সে রাত দেড়টা দুটো পর্যন্ত পড়ে। আজও পড়ছিল। হঠাৎ এতদিন পর ফোন বেজে উঠতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সাড়ে। বারটা। ভাবল, নিশ্চয় আব্দুস সাত্তার ফোন করেছে। সেটটা রূপার খাটের মাথার দিকের টেবিলের উপর। ফোন বাজার শব্দে আপুর ঘুম ভাঙার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। পাঁচ ছ’বার রিং হওয়ার পরও যখন তার ঘুম ভাঙল না তখন উঠে এসে রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো, কে বলছেন?
আমি আব্দুস সাত্তার। তারপর সালাম দিয়ে বলল, আপনি সায়মা তাই না?
সালামের উত্তর দিয়ে সায়মা বলল, হ্যাঁ।
আপনার আপুকে একটু দিন তো?
এতদিন কোথায় ছিলেন বিদ্রুপকণ্ঠে বলতে গিয়েও সায়মা সামলে নিল। বলল, আপু ঘুমাচ্ছে, ডাকা যাবে না।
কেন?
পরীক্ষা চলছিল, দিন রাত পড়াশোনা করেছে। আজ শেষ পরীক্ষা ছিল। তাই দশটায় খেয়ে এসে ঘুমিয়েছে। কাল সকালে না হয় ফোন করুন। আমি আপুকে আপনার ফোন করার কথা বলে রাখব।
ঠিক আছে, তাই করব। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনারা নিশ্চয় ভালো আছেন?
হ্যাঁ ভালো।
আপনার তো সামনে পরীক্ষা, পড়ছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ তাই।
সকালে ক’টার সময় ফোন করলে আপনার আপুকে পাব?
সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। পরে হয়তো আপু কোথাও বেরিয়ে যেতে পারে।
এবার রাখছি তা হলে, বলে আব্দুস সাত্তার সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
সায়মা যত রাত জেগে পড়ুক না কেন? ফজরের নামাযের সময় ঘুম ভাঙবেই। নামায পড়ে ও কুরআন তেলাওয়াত করে ঘণ্টাখানেক ঘুমাবে। তারপর উঠে নাস্ত। খেয়ে পড়তে বসবে। এটাই তার প্রতিদিনের রুটিন।
সূর্য ওঠার আধঘণ্টা আগে ওঠা রূপার বরাবরের অভ্যাস। ফজরের নামায পড়ে পনের মিনিট কুরআন তেলাওয়াত করবে। তারপর আধঘণ্টা বাগানে হাঁটবে। কিন্তু আজ ফজরের নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করার সময় ঘুমে চোখ বুজে আসছিল বলে তেলাওয়াত বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফোন বাজার শব্দে জেগে গেল। হাত বাড়িয়ে রিসিভার কানের কাছে নিয়ে ঘুম জড়ান কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলল, হ্যালো, কাকে চান?
সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, যাকে চাই তিনিই ফোন ধরেছেন। মনে হচ্ছে, আজ বাগানে হাঁটতে না গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙিয়ে নিশ্চয় অন্যায় করে ফেললাম। সেজন্য ক্ষমা চাইছি।
আব্দুস সাত্তারের গলা বুঝতে পেরে রূপার ঘুমের ভাবটা দ্রুত কেটে গেল। তখন তার তনুমনে আনন্দের শিহরণ বইতে শুরু করল। ধড়ফড় করে উঠে বসে। কিছু বলতে গিয়েও পারল না। অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
কী হল? ক্ষমা চাইলাম, তবু চুপ করে আছেন যে?
কাল ফোন করার কথা বলে ছ’মাস ডুব মেরে ছিলেন কেন?
সেজন্যও ক্ষমা চাইছি।
ডুব মারার কারণ আগে বলুন। তারপর ক্ষমা করার কথা চিন্তা করব।
প্রথম কারণ, ঐদিন ফোনে যা কিছু বলেছি, আম্মু সব শুনে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটা কে? বললাম, ঐ মেয়েকে আমি ভালবাসি। আম্মু পরীক্ষার আগে আপনাকে ফোন না করার ওয়াদা করিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কারণ, আমার ও আপনার পরীক্ষার ব্যাপার ছিল। তৃতীয় কারণ, পরীক্ষার পরের দিন আমাকে নিয়ে আম্মু তার বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানে ফোন নেই। এমন কি আট দশ মাইলের মধ্যেও নেই। গতকাল ফিরে রাতে ফোন করেছিলাম। সায়মা ফোন ধরে বললেন, “আপনি ঘুমাচ্ছেন, জাগান যাবে না। আগামীকাল সকালে ফোন করবেন। আমি আপাকে আপনার কথা বলে রাখব?” তিনি কি বলেন নি?
না। হয়তো জানাতে ভুলে গেছে অথবা সময় পাই নি।
উনি এখন কোথায়?
ঘুমাচ্ছ।
এবার তা হলে বলুন ক্ষমা করেছেন?
আপনি দু’টা ব্যাপারে ক্ষমা চেয়েছেন। প্রথমটা ক্ষমা করলাম। দ্বিতীয়টার ব্যাপারে সামনা-সামনি না হলে ক্ষমা করব না। বলুন, কখন আমাদের সাক্ষাৎ হচ্ছে?
তা বলব, তবে তার আগে বলতে হবে, “আমাকে ভালবাসেন।”
বোকার মতো কথা বলছেন কেন? আপনি এতকিছু জানেন, আর একথা জানেন, ভালবাসা মনের ব্যাপার? আপনাকে কখনও দেখি নি। দেখার পর যদি মনে ভালবাসা জন্মায় অথবা আপনার আচার-আচরণ ভালো মনে হয়, তখন না হয় বলতে পারি? তা ছাড়া শুধু মুখে ভালবাসি বললে তো আর সত্যিকার ভালবাসা হয় না।
আপনি ঠিক কথা বলেছেন। তবে কী জানেন? আমার খুব ভয় হয়, আমাকে দেখে যদি আপনার মনে ভালবাসা না জন্মায়? তখন হয়তো নিজেকে সামলাতে পারব না। কিছু অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারি।
তার কথা শুনে রূপা একটু ঘাবড়ে গিয়ে চিন্তা করল, বড় লোকের বখে যাওয়া ছেলে নয়তো? যদি সত্যিই তাই হয় তা হলে তার সামনে যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। কি করা উচিত বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করতে লাগল।
কী ব্যাপার, চুপ করে আছেন কেন? আমার কথা শুনে খুব ভয় পেয়েছেন, তাই?
রূপা আমতা আমতা করে বলল, না, মানে, ভয় পাব কেন? ||||||
|||| আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, আমি সিওর, আমার কথা শুনে আপনি ভয় পেয়েছেন। শুনুন, আমাকে দেখার পর আপনার মনে ভালবাসা জন্মান অথবা না জন্মান আল্লাহ পাকের মর্জি। এতে আপনার কোনো দোষ হবে কেন? অঘটন ঘটার কথা যে বললাম, তা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে বিশ্বাস রাখতে পারেন, আপনার এতটুকু ক্ষতি করব না। একটা কথা জেনে রাখুন, কেউ কাউকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবাসলে একবিন্দু পরিমাণ ক্ষতি তার করতে পারে না। যে করে, সে ভালবাসার মর্ম বোঝে না অথবা সত্যিকার ভালবাসা কাকে বলে জানে না। ঠিক আছে, আপাততঃ সামনা-সামনি হওয়ার দরকার নেই। আরো কিছুদিন যাক। তারপর আপনার মন যখন চাইবে তখন সামনা-সামনি হওয়া যাবে। তবে ইচ্ছা করলে এখন আমাকে দূর থেকে দেখতে পারেন। কাছে গিয়ে আলাপ করার প্রয়োজন নেই।
কথাটা রূপার মনে ধরল। বলল, তা হলে বলুন, কিভাবে আপনাকে দেখব?
আজ পাঁচটার সময় সংসদ ভবন চত্বরে একটা লাইট পোস্ট সামনে রেখে আমি আসরের নামায পড়ব। সে সময় আমাকে দেখতে পারেন। যদি আপনার। বায়নোকুলার থাকে, তা হলে কাছে না গিয়ে দূর থেকে খুব ভালোভাবে দেখতে পাবেন।
ঠিক আছে, তাই হবে। এবার রাখি তা হলে?
তার আগে বলুন, কেমন আছেন?
আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
তা জানার দরকার নেই।
কেন?
লোকে আপনজনের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। আমি তো আপনার তেমন কেউ নই।
কথাটা ঠিক বলেন নি। আপনজন না হলেও এমনি আলাপ পরিচয় থাকলে সবাই-ই ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। আর এটা করাও ভদ্রতা। যেমন আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
আপনি অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। তবে আপনাকে আমি আপনজন ভাবি। তাই জিজ্ঞেস করেছি। যাই হোক, পাঁচটার সময় সংসদ ভবন চত্বরে নিশ্চয় আসছেন?
ইনশাআল্লাহ আসব। এবার রাখছি বলে রূপা সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
ফোন বাজার সাথে সাথে সায়মারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘড়ি দেখে বুঝতে পারে আব্দুস সাত্তার ফোন করেছে। আপুর ঘুম ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করে। তারপর তাকে ফোন ধরে কথা বলতে দেখে এতক্ষণ ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিল। লাইন কেটে দিতে জিজ্ঞেস করল, আব্দুস সাত্তার ফোন করেছিল, তাই না?
রূপা বলল, হ্যাঁ।
ইনশা আল্লাহ আসব বললি, নিশ্চয় তার সঙ্গে দেখা করতে যাবি?
হ্যাঁ যাব।
কখন? কোথায়?
আজ পঁচটার সময় সংসদ ভবন চত্বরে।
আমিও তোর সঙ্গে যাব।
কেন?
কেন আবার? সেদিন বললাম না, ছেলেটা ফ্রড হতে পারে? একা পেয়ে তোর ক্ষতি করতে পারে? তাই বলছিলাম কি, ওমর ভাইকেও আমাদের সঙ্গে নিলে ভালো হয়।
তুই যেতে চাচ্ছিস যাবি। ওমর ভাইকে টানছিস কেন? জানিস তো, তাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না।
ওমর ওদের মামাতো ভাই। তার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো। ধানমণ্ডিতে বাড়ি করেছেন। গাড়িও আছে। ওমর পল সাইন্সে মাষ্টার্স করেছে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। দেখতেও খুব সুন্দর। কলেজ লাইফ থেকে কমিউনিষ্ট পার্টি করে। মাষ্টার্স করার পর পুরোপুরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। আত্মিয়তার সুবাদে রূপাও সায়মার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা করে। রূপা যে বছর অনার্সে ভর্তি হয়, সে। সময় ওমর একদিন তাকে বলল, তোকে আমার ভীষন পছন্দ। পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করব। তুই যেন এর মধ্যে আবার কারো প্রেমে-ট্রেমে পড়ে যাস নি।
ওমর ভাই যে কোনো অংশে তার অনুপযুক্ত নয়, তা রূপা জানে। শুধু সে রাজনীতি করে বলে তাকে অপছন্দ করে। তাই বলল, কারো প্রেমে-ট্রেমে পড়ব। কিনা জানি না; তবে তুমি যে কথা বললে, তা কখনই সম্ভব নয়।
ওমর বলল, কেন?
কোনো মুসলমান মেয়ে কমিউনিষ্ট ছেলেকে বিয়ে করতে পারে না। কমিউনিষ্টরা কুরআন-হাদিস বিশ্বাস করে না। তারা ধর্মকে অফিসের সঙ্গে তুলনা। করে। এক কথায় কমিউনিষ্টরা ইসলামের দুশমন।
তোর কথা ঠিক নয়। পৃথিবীর অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে কমিউনিষ্ট পার্টি আছে।
দেখ ওমর ভাই, তুমি আমার থেকে অনেক জ্ঞানী। তোমার সঙ্গে যুক্তি তর্কে পারব না। তবু একটা কথা না বলে পারছি না। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব মতবাদ আছে। আর তা একের সঙ্গে অন্যের মিলে না। ফলে যে যার মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ ও হানা-হানিতে জড়িয়ে পড়ছে। এর কারণ কোনো মানুষের মতবাদ যত ভালো হোক না কেন, তা তার যুগের জন্য প্রযোজ্য হলেও সর্বযুগের জন্য হতে পারে না। কারণ মানুষ যত বড় জ্ঞানীই হোক, তার জ্ঞান সসীম। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ। রাব্দুল আল-আমিন অসীম জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর সৃষ্টিকূলের মঙ্গলের জন্য যে মতবাদ আমাদের নবী (দঃ) এর মারফত জানিয়েছেন, তা সর্বযুগের ও সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। যারা প্রকৃত মুসলমান, তারা তাঁর সেই মতবাদ ছাড়া মানুষের মতবাদ গ্রহণ করতে পারে না। যারা করে তারা মুসলমান নামের অযোগ্য। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছ, কেন আমি তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয় বললাম?
ওমর বলল, ধর্ম মানুষকে অলস ও অকর্মণ্য করে দেয়, সভ্যতাকে বাধা দেয়, সম্মুখে অগ্রসর হতে দেয় না, অন্ধকার যুগের দিকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায়। তাই কমিউনিষ্টরা ধর্মকে স্বীকার করে না।
চুপ কর ওমর ভাই, চুপ কর। তাই যদি হত, তা হলে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) যখন ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন তখন সমগ্র আরব অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবেছিল। মানুষ অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার-ব্যভিচার, মদ-জুয়া, হিংসা-বিদ্বেষ ও হানা-হানিতে লিপ্ত ছিল। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তারা কি আরো অসভ্য ও বর্বর হয়েছিল? না সত্য জ্ঞানের আলোতে সভ্যতার চরম শিখরে উঠেছিল? তুমি বোধহয় ইসলামের ইতিহাস পড় নি অথবা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মণিষীদের উক্তিও পড় নি। যদি ঐ সব পড়তে ও জানতে, আরবের মরুভূমিতে যে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা আল্লাহ পাক বপন করেছিলেন, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। সেই আলো সারা পৃথিবীর অন্ধকার দূর করে আলোয় আলোকিত করেছে। জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এর বেশি কিছু তোমাকে বলতে পারলাম না। আমার কথা শুনে তুমি আবার মনে করো না, আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তবে তোমার পার্টির মতবাদকে ঘৃণা করি।
এরপরও ওমর মাকে দিয়ে ফুফু-ফুফার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। তারা জানতেন, রূপা কমিউনিষ্ট ছেলেকে বিয়ে করবে না। তাই না করে দেন।
ওমর ভাই আপুকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করতে চায়, সায়মা জানে; কিন্তু আপু যে কেন তাকে পছন্দ করে না, তা জানে না। তাই রূপা যখন বলল, “ওমর ভাইকে টানছিস কেন? জানিস তো তাকে আমি ঘৃণা করি” তখন বলল, কেন যে। তুই তাকে সহ্য করতে পারিস না, তা বুঝি না। ওমর ভাইয়ের মতো হ্যান্ডসাম ও ভালো ছেলে আজকাল দেখাই যায় না।
রূপা বলল, তুই যে দেখছি কলেজে ঢুকতে না ঢুকতেই পেকে খয়ের হয়ে। গেছিস। ভার্সিটিতে ঢুকে কী হবি আল্লাহই জানে।
পেকে খয়ের হওয়া কি জিনিস জানি না। আমার যা মনে হয়েছে বলেছি।
ওমর ভাইকে যদি তোর এতই পছন্দ, তা হলে বল, আম্মুকে বলে এনগেজমেন্ট করে রাখতে বলি।
কথাটা মন্দ বলনি। তবে মাঝ পথে তিনটে বাধা। প্রথম বাধা হল, ওমর ভাই তোমাকে পছন্দ করে। দ্বিতীয় বাধা, সে আমাকে কিছুতেই বিয়ে করবে না। আর। তৃতীয় বাধা, যে তোমাকে পছন্দ করে তাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব। নয়। এসব কথা রেখে আমাকে সঙ্গে নেবে কিনা বল?
তোকে নিতে পারি। তারপর আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করার পদ্ধতিটা বলে। বলল, তোর বায়নোকুলারটা নিবি।
সায়মা বলল, বায়নোকুলার নেওয়ার দরকার কী? নামায পড়া হয়ে গেলে আমরা কাছে গিয়ে আলাপ করব। নামায পড়ে যখন, ফ্রড হতে পারে না। তা ছাড়া ঐ সময় ওখানে অনেক লোকজন বেড়াতে আসে। কিছু ক্ষতি করার সম্ভাবনা নেই।
তবু তুই নিবি।
ঠিক আছে, নেব।
.
প্রতিদিন বিকেলে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংসদ ভবন চত্বরে লোকজন বেড়াতে আসে। তাদের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকা বেশি। আবার অনেকে স্বপরিবারেও বেড়াতে আসে। গ্রামদেশ থেকেও অনেকে সংসদ ভবন দেখার জন্য আসে।
রূপা ও সায়মা বেশ কয়েকবার বেড়াতে এসেছে। আজ দু’বোন পৌঁনে পাঁচটায় এল। গাড়ি থেকে নেমে রূপা ড্রাইভারকে বলল, আমাদের সঙ্গে আসতে হবে না, গাড়িতেই থাকুন। তারপর তারা হেঁটে এসে সংসদ ভবনের সিঁড়িতে বসল।
এমন সময় তিনটে ছেলে তাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একজন দেখ দেখ, কি খাসা দু’টা মাল বলে দাঁড়িয়ে অন্য দু’জনকে ইশারা করে দেখাল।
অন্য দু’জন রূপা ও সায়মার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলল, সত্যি দোস্ত, এরকম মাল জীবনে দেখি নি।
তাদের কথা শুনে দু’বোনই বিব্রত বোধ করল। সায়মা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রূপা বলে উঠল, এই যে দ্র ঘরের ছেলেরা, মাল শব্দটার লটা বাদ দিলে কি হয়?
এরকম প্রশ্ন শুনে দু’জন লজ্জা পেলেও যে ছেলেটা প্রথমে মাল বলে ইশারা করেছিল, সে পেল না। বরং হাসিমুখে বলল, আমরা বাদ দিলে কী হবে? বাবারা তো ছাড়বে না।
এবার রূপা কিছু বলার আগে সায়মা রাগের সঙ্গে বলল, আপনাদের ঘরে কী মা বোন নেই?
ঘরে তো সবারই মা বোন আছে। বাইরের মেয়েদের মা বোন ভাবলে বিয়ে করব কাকে?
এই কথার উত্তর দিতে না পেরে দু’বোন যেমন অপমান বোধ করল, তেমনি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল।
তাই দেখে ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠল। তাদের মধ্যে সেই ছেলেটা বলল, এই যে ম্যাডামদ্বয়, ঢিল ছুঁড়লে যে পাটকেল খেতে হয়। তা বুঝি জানা ছিল না?
রূপা ও সায়মা আসার আগে আব্দুস সাত্তার এসে কিছুটা দূরে বসে ছিল। ওদেরকে আসতে দেখে। কাছাকাছি এসে এতক্ষণ ঘটনাটা দেখছিল। রূপা ও সায়মার অবস্থা বুঝতে পেরে ছেলেগুলোর কাছে এসে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, বাইরের মেয়েদের মা বোনের মতো মনে না করলেও তাদেরকে সম্মানের চোখে দেখতে হয়।
ছেলেগুলো ভার্সিটির ছাত্র। নাম আজিজ, মহসিন ও ইউসুফ। তিন জনেই ধনী ও ভদ্র ঘরের ছেলে। চান্স পেয়ে একটু মজা করছিল। আজিজ ও ইউসুফ এক পার্টির সমর্থক হলেও পার্টির কাজ করে না। কিন্তু মহসীন করে। সে একই পার্টির। নেতার সহকারী। তাই তার কাছে সব সময় পিস্তল থাকে। বেশ একটু রাগী ধরণের ছেলে। দু’টো সুন্দরী ললনাকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে বেশ আনন্দ উপভোগ করছিল। বাধা পড়তে রেগে গিয়ে আব্দুস সাত্তারের দিকে কটমট করে তাকিয়ে। বলল, আপনি আবার কোথা থেকে এলেন? ভালো চান তো কেটে পড়ন।
আজিজ ও ইউসুফের দিকে তাকিয়ে আব্দুস সাত্তার হাসিমুখে বলল, আপনারাই বলুন তো ভাই, আমি কী কোনো খারাপ কথা বলেছি?
তার কথার উত্তর না দিয়ে আজিজ মহসিনের একটা হাত ধরে বলল, বাদ দে দোস্ত, গ্যাঞ্জাম করে লাভ নেই, চল যাই।
ইউসুফ জানে মহসিন সামান্য কারণে রেগে যায় এবং প্রায় সময়ই কোনো না কোনো ঘটনা ঘটিয়ে বসে। তাই তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ছেলেটা হয়তো ওদের কাজিন। প্লীজ, কোনো সীন ক্রীয়েট করিস না। চারদিকে লোকজন রয়েছে, সমস্যা হয়ে যাবে।
মহসিন তাদের কথায় কান না দিয়ে আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা কী আপনার কাজিন? না ওদের কাছে নিজেকে হীরো প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন?
আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, আপনার দু’টো অনুমানই ভুল। আপনাদের মতো আমিও এখানে বেড়াতে এসেছি।
তা হলে আর কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়ন।
আব্দুস সাত্তার মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল, আপনারা প্রথম, তারপর আমি।
রূপা দাঁড়িয়ে বলল, প্লীজ, আপনারা চুপ করুন, আমরাই চলে যাচ্ছি।
আব্দুস সাত্তার বলল, না, আপনারা বসুন। তারপর মহসিনের দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন, আমরা একসঙ্গে যাই।
মহসিন বলল, না, আপনি চলে যান। আমরা যাব, কিনা যাব সেটা আমাদের ব্যাপার।
তা হলে কথা দিন, ওঁদেরকে আর অপমান করবেন না?
মহসিন এতক্ষণ রাগ সামলে রাখতে পারলেও এখন আর পারল না। বলল, আর একটা কথা বললে তোর নায়কগিরি ছাড়িয়ে দেব।
আব্দুস সাত্তার বলল, ভার্সিটির ছাত্র হয়েও ভদ্রতা শেখেন নি?
তবে রে ভদ্রতা শেখাচ্ছি বলে মহসিন তার গালে একটা চড় মেরে বলল, যা শালা, ভাগ।
চড়ের আঘাতে আব্দুস সাত্তারের ফর্সা গালটা লাল হয়ে গেল। গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ভার্সিটিতে পড়লে কি হবে, আপনার বংশ বোধহয় ভালো নয়।
কী? বংশ তুলে কথা বলছিস? এত বড় সাহস বলে মহসিন এবার তার মুখে। ঘুষি মারতে গেল।
আব্দুস সাত্তার হাতটা এক হাতে ধরে অন্য হাত দিয়ে তার গালে একটা চড় মেরে বলল, একটু আগে বললেন না, “ইট ছুঁড়লে পাটকেল খেতে হয়?” পাটকেল। আর ছুঁড়লাম না, আপনার ইটটাই ফিরিয়ে দিলাম। তবে এরপর যদি আবার কিছু ছুঁড়তে চান, তা হলে আপনার কথাটা বাস্তবে ঘটবে। আর শুনুন, কথায় আছে, “জন্ম হউক যথা তথা, কর্ম হউক ভালো।” কথাটা মনে রাখবেন। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, লেখাপড়া যখন করছেন তখন ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করুন।
মহসিন রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাতে দাতে চেপে বলল, শালা শুয়োরের বাচ্চা, দাঁড়া, মজা দেখাচ্ছি বলে পকেট থেকে পিস্তল বের করে তার দিকে তাক করল।
আব্দুস সাত্তার পিস্তল দেখেও নির্ভয় কণ্ঠে বলল, আপনাদের মতো গুটিকয়েক ছেলের জন্য ভার্সিটির এত দুর্নাম। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত।
মহসিন কর্কশ কণ্ঠে বলল, খুব যে বড় বড় বুলি ছাড়ছিস, আমাকে চিনিস?
তা আর চিনি না, আপনি হলেন…..পার্টির সহকারী নেতা।
তোকে এক্ষুনি শেষ করে দিতে পারি, তা বোধহয় জানিস না?
আব্দুস সাত্তার চড় মেরে হাত ছেড়ে দেওয়ার পর খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে মহসিন পিস্তল বের করে তার দিকে তাক করে রয়েছে।
শেষ করে দেওয়ার কথা শুনে আব্দুস সাত্তার তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, শেষ করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। তবে আপনার হাতে আমার মৃত্যু লেখা থাকলে মরব। নচেৎ……।
তাকে থাটা শেষ করতে না দিয়ে মহসিন গর্জে উঠল, দাঁড়া বলছি। আর একপা এগোলে গুলি খাবি।
আজিজ ও ইউসুফ মহসিনকে জাপটে ধরে বলল, এ কী করছিস? তারপর আব্দুস সাত্তারকে বলল, আপনি চলে যান তো ভাই।
তোরা আমাকে ছেড়ে দে বলে আজিজ গুলি করল।
ধস্তাধস্তির ফলে গুলিটা আব্দুস সাত্তারের বুকে না লেগে বাম কাঁধের কিছু মাংস নিয়ে বেরিয়ে গেল।
আব্দুস সাত্তার তা গ্রাহ্য না করে মহসিনের হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিয়ে বলল, এবার আমি যদি আপনাকে গুলি করে শেষ করে দিই, তা হলে কী অন্যায় হবে? তারপর মৃদু হেসে বলল, ভয় নেই, গুলি করব না। আমি আপনাদের চিনি। আর কোনো সীন ক্রিয়েট না করে চলে যান। পিস্তলটা কাল আপনার পার্টির নেতার কাছ থেকে নেবেন।
আজিজ ও ইউসুফ মহসিনকে ধরে জোর করে বেশ কিছুটা দূরে নিয়ে আসার পর আজিজ বিরক্ত কণ্ঠে বলল, তুই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এমন কাণ্ড করিস, যা। মোটেই উচিত নয়।
আজিজ থেমে যেতে ইউসুফ বলল, এত ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে মাথা গরম করা তোর উচিত হয় নি। ছেলেটা তোকে চিনে বলল, নেতার কাছে নালিশ করতে পারে। নেতা অবশ্য তোকে কিছু বলবে না। তা জেনে ছেলেটা এ্যাকসান নিতে পারে।
মহসিন সরকারী পক্ষের এক এমপির ছেলে। তাই তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, আরে দূর, ও আবার কি এ্যাকসান নেবে? এ্যাকসান নিতে এসে শেষে জানটাই হারাবে।
ইউসুফ বলল, তুই নেতার সহকারী, তোকে ধৈর্যশীল হতে হবে।
হয়েছে হয়েছে, তোদেরকে আর উপদেশ দিতে হবে না। ঐ দিকটায় চল, বসে আড্ডা দিই।
গুলির শব্দ শুনে দূরের অনেকে তাদের দিকে তাকিয়েছিল। যারা কাছে ছিল, তারা দূরে সরে গিয়ে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করছিল। কেউ এগিয়ে আসার সাহস করে নি।
রূপা ও সায়মা আব্দুস সাত্তারের কার্যকলাপে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়েছিল।
ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর হঠাৎ রূপার লক্ষ্য পড়ল, সাহায্যকারী ছেলেটার ক্ষত থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে। এসে নিজের গায়ের ওড়না ছিঁড়ে বেঁধে দিয়ে বলল, শীঘ্রই সরওয়ার্দিতে চলুন।
আব্দুস সাত্তার যন্ত্রণা ভুলে একদৃষ্টে রূপার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বাধার পর রূপা যখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে সরওয়ার্দিতে যাওয়ার কথা বলল তখন। চোখে চোখ পড়ল। কয়েক সেকেন্ড কারো চোখের পলক পড়ল না।
প্রথমে রূপাই বলে উঠল, কই চলুন। বাঁধলেও রক্ত বন্ধ হয়নি। তারপর সায়মাকে দেখিয়ে বলল, আমার বোন। আমরা গাড়ি নিয়ে এসেছি, চলুন আমাদের সঙ্গে।
আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, ধন্যবাদ। আপনাদেরকে যেতে হবে না, আমি একাই যেতে পারব। তারপর সালাম দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
রূপা সায়মাকে আসতে বলে তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমাদের জন্য আপনার এই অবস্থা। আপনাকে সাহায্য করা কী উচিত নয়?
বাম হাতটা ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে ছিঁড়ে পড়ে যাবে। দাঁতে দাঁত চেপে আব্দুস সাত্তার সহ্য করছে। তাই কিছু বলতে পারল না।
রূপা ও সায়মার সঙ্গে একজন রক্তাক্ত ছেলেকে আসতে দেখে ড্রাইভার তাড়াতাড়ি গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিল। আব্দুস সাত্তার দু’বোনকে উদ্দেশ্য। করে বলল, দেখুন, আমি একটা রিক্সা…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রূপা বলল, আপনার কোনো কথাই শুনব।, গাড়িতে উঠুন। এই অবস্থায় আপনি একা রিকসায় যেতে পারবেন না।
সরওয়ার্দি হাসপাতাল থেকে ড্রেসিং ও ব্যান্ডিজ করিয়ে বাইরে এসে রূপা বলল, চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই।
আব্দুস সাত্তার বলল, আমার জন্য আপনারা অনেক করেছেন। সে জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আগের থেকে অনেক সুস্থ বোধ করছি, একা যেতে কোনো অসুবিধে হবে না। তারপর আসি বলে সালাম বিনিময় করে একা স্কুটারে উঠে চলে গেল।
দুই বোন হাঁ করে স্কুটারের দিকে তাকিয়ে রইল। অদৃশ্য হয়ে যেতে সায়মা বলল, আপু, ছেলেটা কিন্তু দারুণ।
রূপা বলল, দারুণ মানে?
মানে ছেলেটা যেমন দেখতে তেমনি সাহসী।
হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। চল বাসায় যাই।
সে কী? সংসদ ভবনে যাবে না? আব্দুস সাত্তার সাহেব হয়তো নামায পড়ে লাইট পোষ্টে হেলান দিয়ে তোর অপেক্ষায় তসবীহ পড়ছেন।
রূপা চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, তুই দিন দিন খুব ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। কেউ শুনে ফেললে কী মনে করত বলত?
সায়মা হেসে উঠে বলল, চারপাশে কেউ নেই দেখেই বলেছি। এখন কোথায় যাবি বল।
রূপা ঘড়ি দেখে বলল, সোয়া ছ’টা বাজে। এখন আর সংসদ ভবনে যেতে ইচ্ছা করছে না।
সায়মা হেসে উঠল।
কীরে হাসছিস যে?
হাসি পেল তাই হাসলাম।
শুধু শুধু কারো হাসি পায় না। কেন হাসি পেল বলবি তো?
সায়মা হাসি থামিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা পৌণে পাঁচটায় পৌঁছে পাঁচটা পঁচিশ পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। আমার ধারণা, এর মধ্যে আব্দুস সাত্তার সাহেব। নিশ্চয় কোনো একটা লাইট পোষ্টের কাছে নামায পড়েছেন এবং পুরো ঘটনাটা ও ছেলেটাকে নিয়ে ওখান থেকে চলে আসতে দেখেছেন। আমার গলায় বাইনোকুলার। ঝুলতে দেখে হয়তো ভেবেছেন, আমরা তাকে দেখেছি। কিন্তু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যে তার কথা একদম ভুলে গেছি, সে কথা জানতে পারেন নি। কথা শেষ করে সায়মা আবার হেসে উঠল।
রূপা ধমকের স্বরে বলল, এতে হাসবার কী হল?
সায়মা হাসি মুখেই বলল, বারে, এটা হাসির ব্যাপার নয় তো কী? তুই গেলি তোর প্রেমিককে দেখতে, তাকে দেখার কথা ভুলে নিজের গায়ের ওড়না ছিঁড়ে অন্য আর একজনের হাত বেঁধে দিলি। তারপর তাকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলি। এসব দেখে তোর বেচারা প্রেমিক নিশ্চয় ভাববেন, ছেলেটা তোর লাভার। অবশ্য কাজিনও ভাবতে পারেন।
রূপা রেগে উঠে বলল, তুই সময় সময় এমন আজে বাজে কথা বলিস, যা শুনে গা জ্বালা করে।
গা জ্বালা করুক আর অন্য কিছু করুক, রাতে ফোন এলেই বুঝতে পারবি। তোর বন্ধ কর তো, কান ঝালাপালা হয়ে গেল।
আমি কিছু বললেই বকবকানি হয়, আর নিজে যে পদে পদে ভুল করছিস, তা শুধরাবে কে?
রূপা একটু অবাক হয়ে বলল, আমি পদে পদে ভুল করছি মানে?
ছেলেটার নাম ঠিকানা নিয়েছিস? কেমন থাকেন না থাকেন জানার জন্য অন্ততঃ টেলিফোন নাম্বারটা নেওয়া উচিত ছিল নয় কী?
রূপা ভুলটা বুঝতে পারল। নরম স্বরে বলল, শুধু আমাকে দুষছিস কেন? তুই
তো জেনে নিতে পারতিস?
সবকিছুই জানতে আমার ইচ্ছা হয়েছিল; কিন্তু তুই কিছু মনে করতে পারিস ভেবে জিজ্ঞেস করি নি।
আমি আবার কী মনে করব?
যেভাবে ছেলেটার প্রতি দরদ দেখালি, ভাবলাম, তাকে তোর মনে ধরেছে, তুই তার পরিচয় নিবি। তাই তোকে ডিঙ্গিয়ে কিছু জানতে চাই নি।
রূপা হেসে উঠে বলল, এতদিন বলে এলি আমি আব্দুস সাত্তার সাহেবের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। একটু আগেও তাকে আমার প্রেমিক বলে উল্লেখ করলি। এখন বলছিস এই ছেলেটাকে পছন্দ করি। তোকে পাকা বলে ভুল করেছি। আসলে তোর বুদ্ধি একদম কাঁচা।
তা হলে আর একটা কাঁচা বুদ্ধির পরিচয় দিই, তাড়াতাড়ি আসরের নামায পড়ে নিই আয়, নচেৎ কাযা হয়ে যাবে। তারপর আপুকে কথা বলার সুযোগ না। দিয়ে অজু করার জন্য সায়মা বাথরুমে ঢুকল।
০৩.
আজ পনের দিন হয়ে গেল রূপা আব্দুস সাত্তারের ফোন পায় নি। প্রতিদিন রাত একটা পর্যন্ত ফোনের অপেক্ষায় থাকে।
সায়মা রাত বারটা একটা পর্যন্ত পড়ে। তার সঙ্গে রূপাও কোনো দিন গল্পের বই, আবার কোনো দিন কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ে। সায়মা ঘুমিয়ে পড়ার পরও আব্দুস সাত্তারের ফোনের আশায় একটার পর বিছানায় শুয়ে জেগে থাকে।
সায়মা ব্যাপারটা প্রথম দিকে জানতে পারে নি। জানার পর একদিন ঘুমাবার সময় জিজ্ঞেস করল, কিছু অনুমান করতে পারলি?
।সায়মা কী জানতে চাচ্ছে, রূপা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে বলল, কী অনুমান করব?
অত আর ন্যাকামী করিস না। তুই যে আব্দুস সাত্তারের ফোনের আশায় রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত জেগে থাকিস, তা আমার অজানা নেই।
রূপা চিন্তা করল, ও যখন জেনেই গেছে তখন আর মিথ্যে করে কিছু বলা ঠিক হবে না। তবু ছোট্ট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তুই কী আব্দুস সাত্তার সাহেবের কথা বলছিস?
তা নয় তো কী সেই গুলি খাওয়া ছেলেটার কথা বলছি?
আমার মনে হয়, ঐদিন কোনো কারণে আব্দুস সাত্তার সাহেব আসতে পারেন নি। তাই লজ্জায় হয়তো ফোন করেন নি।
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।
কী মনে হচ্ছে তা হলে বল।
সায়মার প্রায় মনে হয়, গুলি খাওয়া ছেলেটাই আব্দুস সাত্তার সাহেব। কথাটা আপু বিশ্বাস করবে না ভেবে বলবে কিনা চিন্তা করতে লাগল।
কী রে, চুপ করে আছিস কেন? বলবি তো তোর কী মনে হয়?
শুনে তো বলবি, “তোর বুদ্ধি একদম কাঁচা।”
ঠিক আছে, আর কোনো দিন বলব না। এবার বল।
গুলি খাওয়া ছেলেটাই আব্দুস সাত্তার সাহেব।
রূপা চমকে উঠে কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, হঠাৎ তোর এরকম মনে হল কেন?
হঠাৎ মনে হয় নি, ঐ দিনই হয়েছে। তুই বিশ্বাস করবি না বলে বলি নি।
ঐ দিনই বা তোর মনে হল কেন?
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আব্দুস সাত্তার সাহেবের কথা তোর মনে না থাকলেও আমার ছিল। তাই যতক্ষণ ওখানে ছিলাম কাছের ও দূরের সব লাইট পোষ্টের দিকে লক্ষ্য রেখেছিলাম। কাউকেই নামায পড়তে দেখি নি।
সায়মার কথা শুনে গুলি খাওয়া ছেলেটার সুন্দর বলিষ্ঠ শরীর, তার সৎ সাহস। ও ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ার পর চোখে চোখ পড়ার কথা রূপার মনে পড়ল। সেই সাথে সারা তনুমনে আনন্দের শিহরণ বয়ে গেল। চিন্তা করল, সায়মার কথা সত্য। হলে সে খুব ভাগ্যবতী। তার মতো ছেলে জীবনে দেখে নি। চওড়া কপাল, খাড়া নাক, কপালজোড়া কালো মিশমিশে যুগল, মাথায় কোঁকড়ান চুল, প্রায় ছ’ফুট শম্বা হলেও স্বাস্থ্য খুব সুন্দর, সংযত ও ভদ্র আচরণ, কি দুরন্ত সাহস। পিস্তল দেখেও এতটুকু ভীত হয় নি। কী অসীম ধৈর্য? অভদ্র ছেলেটা অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করলেও এতটুকু উত্তেজিত হন নি। বরং সংযত কণ্ঠে হাসিমুখে কথা বলেছেন।
তাকে চুপ থাকতে দেখে সায়মা বলল, আমার কথা কতটা সত্য বিচার করছিস তাই না?
রূপা এতক্ষণ যেন সংসদ ভবনে ছিল। সায়মার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, হ্যাঁ, তাই চিন্তা করছিলাম।
তা ফলাফলটা ইতিবাচক, না নেতিবাচক?
রূপা মনের ভাব গোপন করে বলল, নেতিবাচক। কারণ তিনি যদি আব্দুস সাত্তার সাহেব হতেন, নিশ্চয় ঐদিন রাতে ফোন করতেন। আমার মনে হয়, কোনো বিশেষ কারণে ঐদিন আসতে পারেন নি।
আসতে না পারার কারণটা কেন উনি ঐদিন ফোন করে জানালেন না, সে কথার উত্তরে কী বলবি?
ফোন না করারও কারণ থাকতে পারে।
এতদিনেও কী কারণটা শেষ হয় নি? আমি তোর যুক্তি মানতে পারলাম না। ঘুম পাচ্ছে বলে সায়মা পাশ ফিরে শুল।
রূপাও ঘুমাবার চেষ্টা করল; কিন্তু ঘুমাতে পারল না। চোখ বন্ধ করলেই আব্দুস সাত্তারে কথা মনে পড়তে লাগল। ভাবল, ঐদিন উনি এলেন না কেন? এতদিন ফোনও করেন নি কেন? তারপর সংসদ ভবনের ঘটনাটা মনের পর্দায়। ভেসে উঠল। গুলি খাওয়া ছেলেটা এতদিনে সুস্থ হয়েছে কিনা কে জানে। এইসব ভাবতে ভাবতে একটু তন্ত্ৰামতো এসেছিল, ফোন বেজে উঠতে ছুটে গেল। ভাবল, নিশ্চয় আব্দুস সাত্তারের ফোন। তাড়াতাড়ি উঠে রিসিভার তুলে মনের আবেগে সালাম দিয়ে ফেলল।
সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, আগে বলুন ক্ষমা করেছেন।
তার আগে বলুন, ঐদিন সংসদ ভবন চত্বরে আসেন নি কেন? আর এতদিন ফোন করেন নি কেন? জানেন না, ওয়াদা ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ?
জানি। সেই জন্য সেদিন গিয়েছিলাম। আপনাদের সামনে গুলি হতে দেখেছি। গুলি খাওয়া ছেলেটাকে আপনারা নিয়ে চলে গেলেন তাও দেখেছি।
আপনি তো বলেছিলেন, কোনো একটা লাইট পোষ্টের কাছে নামায পড়বেন; কিন্তু তা তো পড়েন নি।
না পড়ি নি। ঘটনা দেখতে দেখতে পাঁচটা পঁচিশ বেজে গেল। তাই আপনারা চলে যাওয়ার পর পড়েছি।
তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু ঐদিন রাতে ফোন করেন নি কেন?
ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিশেষ কারণে করতে পারি নি।
বিশেষ কারণটা এই পনের দিন পর্যন্ত বুঝি ছিল?
ঐদিন রাতে ফোন করলে পরের দিন রূপা তাকে দেখতে চাইতে পারে ভেবে আব্দুস সাত্তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করে নি। ভেবেছিল, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে করবে। আজ ডাক্তার ব্যান্ডিজ খুলে দিয়েছে। তাই ফোন করেছে। রূপার কথার উত্তরে। বলল, ঠিক কথাই বলেছেন।
রূপা রেগে উঠে বলল, বিশেষ কারণ না ছাই। আপনি আমাকে খেলাচ্ছেন। আমার তো মনে হচ্ছে, আপনি একটা ফ্রড।
আব্দুস সাত্তার মনে আঘাত পেয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
কী হল? ফ্রড বলতে চুপ হয়ে গেলেন যে?
আব্দুস সাত্তার আহতস্বরে বলল, তাই যদি ভেবে থাকেন, তা হলে আপনাকে আর কোনো দিন বিরক্ত করব না। কথা শেষ করে লাইন কেটে দিল।
তার কথাগুলো রূপার কানে খুব করুণ শোনাল। কয়েক বার হ্যালো হ্যালো করে বুঝতে পারল, লাইন কেটে দিয়েছে। রিসিভার ক্যাডেলে রেখে চিন্তা করল, ফ্রড বলায় নিশ্চয় মনে কষ্ট পেয়ে লাইন কেটে দিয়েছেন। হঠাৎ মনে হল, তিনি হয়তো কাটেন নি, এমনি কেটে গেছে। যদি তাই হয়, তা হলে আবার ফোন। করবেন ভেবে অপেক্ষা করতে লাগল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন ফোন এল না তখন নিশ্চিত হল, লাইন কেটেই দিয়েছেন। ভাবল, সত্যিই কী তিনি আর। কোনো দিন ফোন করবেন না? কথাটা ভেবে মনের গহীনে কাঁটা বিধার মতো ব্যথা অনুভব করল। মনকে বোঝাল, কোথাকার কে, যাকে কোনো দিন দেখে নি, যে। নাকি পরিচয় দেয় নি, সামনে আসার যার সৎ সাহস নেই, তার জন্য ব্যথা পাওয়া। উচিত নয়।
ঘুম পাচ্ছে বলে সায়মা পাশ ফিরে শুলেও ঘুমায় নি। সেও গুলি খাওয়া ছেলেটার কথা চিন্তা করছিল। ফোন বেজে উঠতে কান খাড়া করে এতক্ষণ ঘুমের ভান করে পড়েছিল। হ্যালো হ্যালো করে রূপা রিসিভার রেখে দিতে বুঝতে পারল, লাইন কেটে গেছে। আবার ফোন আসার অপেক্ষায় তাকে অনেকক্ষণ বসে থাকতে দেখে বলল, আজ হয়তো আর লাইন পাচ্ছেন না; কাল নিশ্চয় করবেন। এবার শুয়ে পড়।
রূপা বলল, উনি হয়তো আর কোনো দিন ফোন করবেন না।
খুব অবাক হয়ে সায়মা জিজ্ঞেস করল, কেন?
ঐদিন সংসদ ভবন চত্বরে আসেন নি ও এতদিন ফোন করেন নি কেন বলে তাকে ফ্রড বলেছি। তাই আর কোনো দিন বিরক্ত করবেন না বলে লাইন কেটে দিলেন।
যাক বাবা, এতদিনে তা হলে তুই একটা ফ্রড ছেলের উপদ্রব থেকে রেহাই পেলি।
তুই অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস, তবে কী জানিস, ফ্রড হোক আর যা কিছু হোক, আজ এক দেড় বছর ধরে যার সঙ্গে ফোনে আলাপ করে কি যেন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই স্মৃতি থেকে কী সহজে রেহাই পাব? তা ছাড়া ছেলেটা যে সত্যি সত্যি ফ্রড নয়, তা আমার মতো তুইও জানিস। কোনো ফ্রড ছেলে। এতদিন ধরে ভালবাসার কথা বলে ফোন করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
আমারও যে বিশ্বাস হচ্ছে না, তা নয়। প্রথম দিকে তাকে ফ্রড মনে হলেও পরে তা মনে হয় নি। একটা কথা জিজ্ঞেস করব, উত্তরটা সত্য বলবি তো?
আমি কী কোনো দিন তোকে মিথ্যে কিছু বলেছি?
তুই কী সত্যি সত্যি আব্দুস সাত্তার সাহেবকে ভালোবেসে ফেলেছিস?
রূপা কিছু না বলে চুপ করে রইল।
কয়েকদিন আগে একটা হাদিসে পড়লাম, “মৌনতা নারীদের সম্মতির লক্ষণ।”
আগে ওঁর কথা শুনে শুধু রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। সেই সাথে দেখার ইচ্ছা হত। আজ যখন করুণস্বরে আর কখনও বিরক্ত করবেন না বলে লাইন কেটে দিলেন তখন থেকে মনের মধ্যে যেন ব্যথা অনুভব করছি। এটা যদি ভালবাসা হয়, তা হলে তাই।
তাকে ফ্রড ভেবে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর। দেখবি, ব্যথা দূর হয়ে গেছে।
তোকে আর উপদেশ দিতে হবে না। এবার শুয়ে পড় বলে রূপা বালিশে মাথা রাখল।
.
আরো সপ্তাহখানেক পর একদিন সায়মা জুতো কেনার জন্য আপুকে নিয়ে নিউমার্কেটে এসে একটা জুতোর দোকানে ঢুকল। শোকেসে জুতা পছন্দ করে রূপা
একজন সেলসম্যানকে ডাকতে গিয়ে অবাক। সেই গুলি খাওয়া ছেলেটা একটা বোরখা পরা মেয়ের পাশে বসে আছে। মেয়েটা নতুন জুতো পায়ে দিয়ে দেখছে। তার হাতে পায়ে মোজা। চোখ দুটো ছাড়া সারা মুখ নেকাবে ঢাকা। কি দারুণ ডাগর ডাগর দু’টো মায়াবি চোখ। নাকের উপর থেকে কপালের অল্প অংশ দেখে বুঝতে পারল, মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। দুই বোন নির্বাক দৃষ্টিতে একবার মেয়েটির দিকে আর একবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
একজন সেলসম্যান তাদের কাছে এসে বলল, বলুন, কী জুতো দেখাব?
ততক্ষণে বোরখা পরা মেয়েটি অন্য একজন সেলসম্যানকে বলল, এটা পাল্টে আর এক সাইজ বড় দিন।
রূপা তার সেলসম্যানের কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে এসে মেয়েটির পাশে বসা ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিল।
আব্দুস সাত্তার ছোট বোন উম্মে কুলসুমকে নিয়ে তার জুতো কিনতে এসেছে। সে মনে করল, কোনো মেয়ে কাস্টোমার দোকানের কাউকে সালাম দিয়েছে। তাই সেদিকে খেয়াল করল না।
রূপা এবার তার সামনে এসে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, আমি আপনাকে সালাম দিয়েছি।
আব্দুস সাত্তার চিনতে পেরে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, সরি, আমি ঠিক বুঝতে পারি নি। তারপর সায়মাকে তার পাশে দেখে বলল, আজও দু’জনকে একসঙ্গে দেখছি। নিশ্চয় আপনারা দুই বোন?
রূপা মৃদু হেসে বলল, ঠিক বলেছেন।
সায়মা সালাম বিনিময় করে বলল, কেমন আছেন বলুন? সেদিন আমাদের চারণে আপনি গুলি খেয়েছিলেন। আল্লাহ আপনার হায়াত রেখেছেন, তাই বেঁচে গছেন। নচেৎ গুলিটা বুকে লাগলে বাঁচতেন কিনা সন্দেহ।
আব্দুস সাত্তার বলল, বাঁচা মরা আল্লাহ পাকের হাতে। ওসব নিয়ে আমি খনও ভাবি নি। দিন পনেরর মধ্যে সুস্থ হয়ে গেছি। তা আপনারা নিশ্চয়ই ভালো আছেন?
সায়মার আগে রূপা বলল, জ্বি ভালো। আপনার সঙ্গিনীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন না?
নিশ্চয়। আমার ছোট বোন উম্মে কুলসুম।
উম্মে কুলসুম তাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করল।
রূপা আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, সেদিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন। আপনার পরিচয় জানার সুযোগও দিলেন না। দিলে আপনার অসুস্থতার খোঁজখবর নিতে পারতাম।
আব্দুস সাত্তার বলল, এখানের কাজ শেষ করুন, বাইরে গিয়ে আলাপ করা। যাবে।
দোকান থেকে বেরিয়ে রূপা বলল, আপত্তি না থাকলে আমাদের বাসায় চলুন; আলাপ করা যাবে।
আব্দুস সাত্তার বলল, আজ যেতে পারব না। আরো কিছু কেনাকাটা আছে। অন্য একদিন যাব। সামনে একটা চাইনিজ রেষ্টুরেণ্ট আছে। চলুন ওখানে বসে কিছু খাওয়াও যাবে আর সেই সাথে আলাপও করা যাবে।
বেশ, তাই চলুন।
নাস্তা খাওয়ার পর কফির অর্ডার দিয়ে আব্দুস সাত্তার নাম পাল্টে বলল, আমার নাম আসিফ। তারপর রূপাকে বলল, আমরা অন্য টেবিলে বসে কফি খেতে খেতে আলাপটা সেরে নিই। ওরা দুজন এখানেই বসুক।
অন্য টেবিলে বসে বেয়ারা কফি না দেওয়া পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না। বেয়ারা কফি দিয়ে চলে যাওয়ার পর রূপা কিছু বলার আগে আসিফ জিজ্ঞেস করল, আপনি আব্দুস সাত্তার নামে কোনো ছেলেকে নিশ্চয় চেনেন?
নাম শুনে রূপা চমকে উঠে বলল, আপনার কথার উত্তর পরে দেব। তার আগে বলুন, ওঁর সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?
ও আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড।
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমাকে চেনেন?
হ্যাঁ, ওর কাছেই আপনাদের সম্পর্কের কথা শুনেছি। খোলাখুলি বলছি শুনুন, আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে কলেজ লাইফ থেকে বন্ধুত্ব। ও যেমন পার্সোনাল সব কথা আমাকে বলে, আমিও তাকে আমার পার্সোনাল সব কিছু বলি। ঐদিন সংসদ ভবন চত্বরে নিয়ে এসে আপনাদেরকে দেখিয়ে বলল, ওদের দুজনের মধ্যে যিনি বেশি সুন্দরী তিনি রূপা, আর অন্যজন সায়মা। ওঁরা দু’বোন। আপনারা যে ওকে দেখতে এসেছেন এবং কিভাবে দেখবেন তাও বলল। আমরা আপনাদের কাছ থেকে অল্প। দূরে ছিলাম। তিনটে ছেলে আপনাদেরকে টিজ করতে দেখে আমাকে বলল, ওঁদেরকে ছেলে তিনটের হাত থেকে রক্ষা কর। তারপরের ঘটনা তো আপনারা জানেন।
রূপা কি বলবে চুপ করে ভাবতে লাগল।
আসিফ একটু অপেক্ষা করে বলল, আব্দুস সাত্তার প্রায় প্রতিদিন আমাদের বাসায় আসে। সপ্তাহখানেক আগে এসেছিল। তার মন খারাপ দেখে বললাম, কী রে, কী হয়েছে? বলল, আপনি নাকি ওকে ফ্রড ভাবেন। তাই মনে খুব আঘাত পেয়েছে। আমি ব্যাপারটা জানতে চাইলে আপনার সঙ্গে ফোনে যা কিছু আলাপ হয়েছিল বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জীবনে আর কোনো মেয়ের কথা চিন্তা করতে পারব না। বললাম, দোষ তোর। তুই কেন আজ দেড় বছর তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিস? তা ছাড়া তুই মাঝে মাঝে অনেকদিন তার সঙ্গে যোগাযোগও রাখিস না। মেয়েটি নিশ্চয় খুব ভালো, তাই তোর সঙ্গে ফোনে কথা বলে। ঠিকানা দে, আমি তোদের ভুল ভাঙ্গিয়ে দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেব। ও অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কারো কথায় রূপা আমাকে ভালবাসবে, তা মেনে নিতে পারব না। এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলবি না। বললে এতদিনের বন্ধুত্ব হারাবি।” তার কথা শুনে আমি আর কিছু বলি নি।
আপনি নিশ্চয় ওঁর ঠিকানা জানেন?
হ্যাঁ, জানি।
ফোন নাম্বার?
তাও জানি।
রূপা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে বলল, লিখে দিন তো?
মাফ করবেন, ঠিকানা বা ফোন নাম্বার কোনোটাই দিতে পারব না।
রূপা খুব অবাক হয়ে বলল, কেন?
আপনাদের সম্পর্কের কথা প্রথম যখন বলে তখন ওয়াদা করিয়ে নিয়েছিল, আমি যেন কাউকে তার ঠিকানা বা ফোন নাম্বার না জানাই।
ওঁর পুরো বায়োডাটা বলুন তো?
মাফ করবেন, তাও বলতে পারব না, নিষেধ আছে।
রূপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে আপনি আমার কোনো উপকার করতে পারবেন না?
বিশ্বাস করুন, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পারছি না। তারপর একটু চিন্তা করে একটা ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে বলল, ও প্রতিদিন তিনটের দিকে আমাদের বাসায় আসে বললাম না? সে সময় ফোন করে কথা বলতে পারেন।
রূপা খুশী হয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ। তারপর কাগজটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে বলল, বোনেরা আমাদেরকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবতে পারে। চলুন ওঠা যাক বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আসিফও দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলল, ভাবাটাই তো স্বাভাবিক। ওরাও তো বড় হয়েছে।
.
আসিফ ও রূপা অন্য টেবিলে চলে যাওয়ার পর সায়মা উম্মে কুলসুমকে জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চয় পড়াশোনা করছেন?
হ্যাঁ, কামিল ফার্স্ট ইয়ারে।
আপনাদের হোম ডিস্ট্রিক্ট কোথায়?
উম্মে কুলসুম চিন্তা করল, ভাইয়া যখন নাম পাল্টে বলেছে তখন নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। তাই সেও হোমডিস্ট্রিক্ট পাল্টে বলল, দিনাজপুর।
ঢাকায় কোথায় থাকেন?
এটাও পাল্টে বলল, রাজারবাগ।
নিজেদের বাড়ি?
হ্যাঁ।
আপনারা কয় ভাই বোন?
তিন বোন ও দুই ভাই। বড় ভাই দু’বছর আগে মারা গেছেন। আমি সবার ছোট। তারপর উম্মে কুলসুম মৃদু হেসে বলল, আপনি তো আমার সবকিছু জানলেন, এবার আপনাদেরটা বলুন।
সায়মা তাদের সবকিছু বলে বলল, আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগল। ফোন নাম্বারটা দিন, মাঝেমাঝে আলাপ করব।
ফোন নাম্বার দেওয়াটা ঠিক হবে কিনা উম্মে কুলসুম চিন্তা করতে লাগল।
কী ব্যাপার? আপনাদের ফোন নেই? না আমাকে আপনার ভালো লাগে নি?
না-না, তা কেন? আপনাকে আমারও ভালো লেগেছে। তারপর একটা কাগজে ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে বলল, আপনাদেরটা দেবেন না?
নিশ্চয় বলে সায়মা আব্বার একটা কার্ড দিল।
কার্ডের ওপর চোখ বুলিয়ে উম্মে কুলসুম হর্ষোৎফুল্লা কণ্ঠে বলল, ওমা, আপনারা মন্ত্রীর মেয়ে?
এমন সময় রূপা ও আসিফ ফিরে এলে উম্মে কুলসুম ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, জান ভাইয়া, ইনারা মন্ত্রীর মেয়ে।
আসিফ বলল, আমি জানি। এবার চল, তোর তো অনেক কিছু কেনার রয়েছে।
.
ফেরার পথে সায়মা আপুকে বলল, আসিফ সাহেব কী এমন আলাপ করলেন। যা আমাদের সামনে করা গেল না?
যা কিছু আলাপ হয়েছে বলে রূপা বলল, তুই তো আসিফ সাহেবকেই আব্দুস সাত্তার বলেছিলি।
আজও তাই বলব। রূপা হেসে উঠে বলল, সাধে কি আর বলি তোর বুদ্ধি একদম কাঁচা।
ঠিক আছে, কাঁচা বুদ্ধি নিয়েই বেড ধরেছি, ।আসিফ সাহেব যদি আব্দুস সাত্তার না হন, তা হলে তোকে আমি পাঁচশ টাকা দেব। আর যদি হন, তা হলে তুই কী দিবি বল?
বেড ধরা ইসলামে নিষেধ। তাই ওসব বাদ দিয়ে বল, কেন তুই এত জোর দিয়ে কথাটা বলছিস? কোনো প্রমাণ পেয়েছিস?
প্রমাণ যা পেয়েছি, তা বললে তুই আমার বুদ্ধিকে কাঁচা বলবি। যেদিন পাকা প্রমাণ পাব, সেদিন বলব।
তা হলে অনুমান করে বলেছিস?
হ্যাঁ।
যাদের বুদ্ধি কাঁচা, তাদের অনুমানও কাঁচা।
সায়মা রেগে উঠে বলল, বারবার কাঁচা বুদ্ধি কাঁচা বুদ্ধি বলে রাগাবি না বলছি। যেদিন প্রমাণ করব আসিফ সাহেব ও আব্দুস সাত্তার একই মানুষ, সেদিন বুঝিয়ে দেব কার বুদ্ধি কাঁচা আর কার বুদ্ধি পাকা।
রূপা হাসতে হাসতে বলল, ঠিক আছে, তাই বোঝাস।
সায়মা তাকে হাসতে দেখে আরো রেগে গিয়ে বলল, অত হাসিস না, বেশি হাসতে হাদিসে নিষেধ, সে কথা ভুলে গেছিস বুঝি?
ততক্ষণে গাড়ি বাসায় পৌঁছে গেল। রুমে এসে সায়মা বলল, আসিফ সাহেবের ফোন নাম্বারটা দে তো।
রূপা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করে দিল।
উম্মে কুলসুম সায়মাকে যে নাম্বার দিয়েছিল সেটা বের করে মিলিয়ে দেখল একই। বলল, বাসার ঠিকানা নিস নি?
রূপা বলল, না।
এটা কিন্তু তোর পাকা বুদ্ধির পরিচয় হয় নি। আমি কিন্তু ওঁর বোনের কাছ থেকে দুটোই নিয়েছি। যদিও মনে হচ্ছে, ফোন নাম্বার ঠিক দিলেও বাসার ঠিকানা ঠিক দেয় নি।
তোর যেমন কথা, ফোন নাম্বার ঠিক দিলে বাসার ঠিকানা ঠিক দেবে না কেন?
তোর তো পাকা বুদ্ধি, তাই ধরতে পারছিস না। আমার কাঁচা বুদ্ধিতে আমি ঠিক ধরেছি।
কী ধরেছিস বলতো?
আজ বলব না, কাল বলব।
আজ বলবি না কেন?
তুই বিশ্বাস করবি না। বলবি, এটা তোর কাঁচা বুদ্ধির প্রমাণ। মনে রাখিস, পাকা বুদ্ধিমতী হয়েও যে তুই পদে পদে ভুল করছিস, তা দু’একদিনের মধ্যে প্রমাণ করেই ছাড়ব। তারপর তার কাগজটা ফেরত দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
আড়াই বছরের ছোট বোন সায়মাকে রূপা ভীষণ ভালবাসে। তবে চান্স পেলে ছোট খাট ব্যাপার নিয়ে রাগায়। সায়মা বেশি রেগে গেলে কেঁদে ফেলে। তার ক্রন্দসী মুখটা দেখতে রূপার খুব ভালো লাগে, তাই মাঝে মাঝে রাগায়। যেদিন। রাগে কেঁদে ফেলবে, সেদিন সায়মা সারাদিন মুখ গোমড়া করে থাকবে; কারো সঙ্গে কথা বলবে না। রাতে ঘুমাবার সময় রূপা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে রাগ মানাবে। সেই ছোটবেলা থেকে আজও তার পরিবর্তন হয় নি। ফোন নাম্বারের কাগজটা ফেরত দিয়ে চলে যাওয়ার পর রূপা ভাবল, আর একটু হলে কেঁদে ফেলত, তাই তাড়াতাড়ি চলে গেল।
.
মার্কেটিং করে বাসায় ফিরে উম্মে কুলসুম আব্দুস সাত্তারকে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঐ মেয়ে দুটোর কাছে তোমার নাম আসিফ বললে কেন?
আব্দুস সাত্তার বলল, শোন, তোকে একদিন বলেছিলাম না, আমি একটা মেয়েকে ভালবাসি এবং তার সঙ্গে প্রতিদিন রাতে ফোনে কথা বলি? ঐ দুটো মেয়ের বড়টাকে, মানে রূপা হল সেই মেয়ে।
উম্মে কুলসুম খুব অবাক হয়ে বলল, কিন্তু ওঁর কথা শুনে তো মনে হল, তোমাকে চেনেন না। এমনকি তোমার নামও জানেন না। অথচ তুমি আমাকে এক বছর কি আরো দু’তিন মাস আগে কথাটা বলেছিলে। আজ আবার ওঁদেরকে নিজের নাম না বলে অন্য নাম বললে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
আব্দুস সাত্তার ও উম্মে কুলসুম কোলে-পিঠের ভাই বোন। ওদের বয়সের তফাৎ তিন বছর। দু’জনের মধ্যে খুব সদ্ভাব থাকলেও উম্মে কুলসুম ছোট ভাইয়ার। উপর খবরদারি করে। আব্দুস সাত্তার তা পছন্দ না করলেও ছোট বোনকে কিছু বলে না। উম্মে কুলসুম গ্রামের মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করার পর আব্দুস সাত্তারের বন্ধু সদ্য পাশ করা ডাক্তার আব্দুল মজিদের সঙ্গে আকদ হয়। আব্দুল মজিদের বাড়ি ওদের বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল দূরে। তার বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। তার মামাদের অবস্থা খুব ভালো। তারাই ভাগ্নাকে ঢাকায় রেখে ডাক্তারী পড়িয়েছেন। আব্দুস সাত্তারের বাবা আব্দুল হামিদ প্রথমে রাজি হন নি। বলেছিলেন, ডাক্তারের চরিত্র ভালো না। তা ছাড়া ওর বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ। উম্মে কুলসুম কষ্ট পাবে। আব্দুস সাত্তার বন্ধুর উন্নত আখলাক, ধর্মভীরুতা ও তাদের বাড়ির ধর্মীয় পরিবেশের কথা বলে রাজি করিয়েছে।
আব্দুস সাত্তারের কথার সততা জেনে আব্দুল হামিদ খুশী হয়েছেন এবং জামাইয়ের কিডনীর উপর উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানতে পেরে তাকে খরচ দিয়ে আমেরিকায় পাঠিয়েছেন। আব্দুল মজিদ যাওয়ার আগে বন্ধুকে বলেছিল, উম্মে কুলসুম যদি আরো পড়াশোনা করতে চায়, তা হলে ঢাকায় তোমার কাছে। রেখে আলিয়ায় ভর্তি করে দিও। তার কথামতো আব্দুস সাত্তার উম্মে কুলসুমকে ঢাকায় এনে ফাজিলে ভর্তি করে। এ বছর পাশ করে কামিল পড়ছে।
এখন তার কথা শুনে বলল, পরে তোকে সব কিছু বুঝিয়ে বলব। এখন শুধু এতটুকু শুনে রাখ, আমি রূপার সবকিছু জানলেও সে আমার নাম ছাড়া কিছুই। জানে না। এমনকি আমাকে একবারও দেখে নি।
উম্মে কুলসুম আরো অবাক হয়ে বলল, উনি তোমাকে দেখতে চান নি?
তা আবার চায় নি, বহুবার চেয়েছে, আমি ইচ্ছা করে দেখা দিই নি।
কারণটা বল।
পরে শুনিস। এখন যা বলছি শোন, তারপর সংসদ ভবন চত্বরের ঘটনা ও আজ চাইনিজ রেষ্টুরেণ্টে যেসব আলাপ হয়েছে, সে সব বলে বলল, দু’একদিনের মধ্যে ফোন করবে। তুই রিসিভ করলে আমাকে ডেকে দিবি। আমি ফুফু আম্মাকে বলে দেব, কেউ যদি ফোনে আসিফকে খোঁজে, তা হলে যেন আমাকে ডেকে দেয়।
উম্মে কুলকুম বলল, ওঁর বোন সায়মা আমার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়েছে। বাসা কোথায় জিজ্ঞেস করতে বলেছি, রাজারবাগ।
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, রাজারবাগ বললি কেন?
তোমাকে নাম পাল্টে বলতে শুনে ভেবেছিলাম, নিশ্চয় এর ভিতর কোনো কারণ আছে। তাই আমিও বাসার ঠিকানা পাল্টে বলেছি।
বলে অবশ্য আপাততঃ ভালই করেছিস; কিন্তু ওরা যখন জানতে পারবে তখন তোকে কী ভাববে বল তো?
আর তুমিও যে নিজের নাম না বলে অন্য নাম বললে, সেকথা জানলে তোমাকে কী ভাববে?
যখন জানবে তখন বুদ্ধি করে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করা যাবে কী বলিস?
হ্যাঁ, তাই করো। তারপর বলল, তুমি যে পরে সবকিছু বলবে বললে, তা এখন বলো না।
আব্দুস সাত্তারের এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। রূপার অনিন্দ্য সুন্দর মুখটা বার বার মনে পড়ছে। তাই তাকে ভাগাবার জন্য বলল, তোর ডাক্তারের চিঠি টিঠি পেয়েছিস? প্রায় চার বছর হয়ে গেল, কবে ফিরবে-টিরবে কিছু জানায় নি? আমার বন্ধু কিন্তু আমাকে চিঠি দিয়েছে। সে তার বৌ এর জন্য কতটা। পাগল হয়ে আছে জানতে চাইলে চিঠিটা দিচ্ছি পড়ে দেখ। এই কথা বলে টেবিলের ড্রয়ার টেনে চিঠি বের করার ভান করল।
উম্মে কুলসুম লজ্জায় লাল হয়ে বলল, বড় ভাই হয়ে ছোট বোনকে এসব কথা বলতে বিবেকে বাধল না?
আব্দুস সাত্তার হাসি চেপে রেখে একটু গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলল, তা হলে ছোট বোন হয়ে তুই কী করে বড় ভাইয়ের প্রেম কাহিনী শুনতে চাচ্ছিস?
ঠিক আছে, আমিও আলু আম্মুকে চিঠি দিয়ে জানাব, ছোট ভাইয়া একটা। আপটুডেট মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কথা শেষ করে উম্মে কুলসুম ছুটে পালিয়ে গেল।
০৪.
আপুর কথায় সায়মা রেগে ড্রইংরুমে এসে তখনই উম্মে কুলসুমের বাসায় ফোন করল।
উম্মে কুলসুমের ফুফু রাইসা বেগম ফোন ধরে বললেন, হ্যালো, কে বলছেন?
ভারী গলা শুনে সায়মা মনে করল, নিশ্চয় উম্মে কুলসুমের মা। সালাম দিয়ে বলল, খালাআম্মা, আমি উম্মে কুলসুমের বান্ধবী। ওকে একটু দিন তো?
রাইসা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ও তো বাসায় নেই। আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে মার্কেটিং করতে গেছে।
আব্দুস সাত্তার কে?
ওমা, তাও জান না? আব্দুস সাত্তার ওর ছোট ভাইয়া।
শুনে সায়মার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভাবল, তার অনুমানই ঠিক হল। জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
আমি ওদের ফুফু।
ওর সঙ্গে আমার জরুরী দরকার ছিল। আপনাদের বাসার নাম্বারটা ভুলে গেছি। দয়া করে একটু বলুন না।
তুমি কেমন মেয়ে, বান্ধবীর বাসার নাম্বার ভুলে যাও? এখানে কোনো দিন আস নি?
না ফুফুআম্মা, উম্মে কুলসুম অনেকবার যেতে বলেছে, যাব যাব করেও যাওয়া হয় নি। কত নাম্বার রাজারবাগ যেন বলেছিল?
তুমি তো খুব ভুলো মেয়ে দেখছি। বললে আবার ভুলে যাবে। কাগজ কলম নাও, বলছি।
একটু ধরুন বলে সায়মা কাগজ কলম এনে বলল, বলুন।
…..নাম্বার রায়ের বাজার।
লিখে নিয়ে সায়মা বলল, এবার রাখি ফুফুআম্মা?
রাখ বলে রাইসা বেগম রিসিভার রেখে দিলেন। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে উম্মে কুলসুমকে আব্দুস সাত্তারের রুমের দিক থেকে দৌড়ে আসতে দেখে বললেন, দৌড়াচ্ছিস কেন? দাঁড়া বলে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা কখন ফিরলি?
এই তো কিছুক্ষণ আগে।
সায়মা নামে তোর এক বান্ধবী এক্ষুনি ফোন করেছিল। ফিরেছিস জানলে ডেকে দিতাম।
উম্মে কুলসুম আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন ফোন করেছিল কিছু বলেছে?
সায়মা যেসব কথা বলেছে, রাইসা বেগম বললেন।
উম্মে কুলসুম তাড়াতাড়ি ছোট ভাইয়ার কাছে এসে সে কথা জানাল।
আব্দুস সাত্তার ভেবেছিল, তাদের সম্পর্ক গভীর হওয়ার পর নিজেকে রূপার কাছে প্রকাশ করবে। আজ ফোন নাম্বার দেওয়ার সময় মনে হয়েছিল, আর বোধ হয়। বেশি দিন আড়াল হয়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু আজই ওরা জেনে যাবে ভাবে নি।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে উম্মে কুলসুম বলল, কী ভাবছ ছোট ভাইয়া?
ভাবছি, ধরা যখন পড়েই গেলাম তখন আর লুকোচুরি করা ঠিক হবে না।
হ্যাঁ, সেটাই ভালো। আচ্ছা ছোট ভাইয়া, রূপা আপা তোমাকে ভালবাসে কিনা বুঝতে পেরেছ?
পেরেছি, তবে কতটা ভালবাসে বুঝতে পারি নি। বলতো, রূপাকে তোর কেমন মনে হয়?
শুধু ভালো নয়, খুব ভালো। ওঁর মতো মেয়ে দেখেছি বলে মনে হয় না। আব্বু আম্মু দেখলে পছন্দ করবেই।
আব্দুস সাত্তার ছোট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তা আমিও জানি। কিন্তু রূপার আব্বা কিছুতেই আমাকে পছন্দ করবেন না।
কেন?
সে অনেক কথা। পরে শুনিস।
উম্মে কুলসুম একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি রূপা আপার আব্বাকে চেন তা হলে?
হ্যাঁ চিনি।
পরে নয়, এখনই বল, আমি শুনব।
রূপার আব্বার নাম রোকন উদ্দিন। রোকন উদ্দিনের আব্বা সালাউদ্দিনের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তোর শ্বশুরবাড়ির পাশের গ্রামে বাড়ি। সালাউদ্দিনের বাস্তুভিটে ছাড়া সামান্য ফসলী জমি ও একটা আম, কাঁঠাল ও সুপারির বাগান ছিল। রোকন উদ্দিনই তার একমাত্র সন্তান। তার উপর খুব ভালো ছাত্র। তাই ছেলেকে লেখাপড়া করাবার জন্য উনি ফসলী জমি ও বাগান দাদাজীর কাছে দশ বছরের জন্য সাফকওলা দিয়ে সেই টাকায় ছেলেকে লেখাপড়া করান। সে সব আর ছাড়িয়ে নিতে পারেন নি। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দাদাজী তাকে ডাকিয়ে এনে বললেন, তুমি তো টাকা ফেরত দিয়ে জমি ও বাগান ফিরিয়ে নিতে পারলে না, দলিল মোতাবেক ওগুলো এখন আমার। তখন উনি করুণ মুখে বললেন, তাতো বটেই। এখন থেকে আপনি ভোগ দখল করবেন, আমি আপত্তি করব কেন? হাইস্কুলে ভর্তির দিন থেকে রোকন উদ্দিনের সঙ্গে আব্বর গভীর বন্ধুত্ব। দু’জনেই তখন ইন্টার পড়তেন। যখন দাদাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে ঐসব। কথা বলছিলেন তখন আব্বুও সেখানে ছিলেন। তিনি জানতেন, ঐ জমির ফসল ও বাগানের আয়ে ওঁদের সংসার চলে। ওগুলো দাদাজী ভোগ দখল করলে ওঁদের সংসার কিভাবে চলবে ভেবে শিউরে উঠলেন। আব্বু সে কথা দাদাজীকে বলে বললেন, আপনি আরো কয়েক বছর ওঁকে সময় দিন। ওঁর ছেলে লেখাপড়া শেষ করে যখন রোজগার করবে তখন টাকা শোধ করে দেবেন। অথবা দলিলটা এখনই ফেরত দিয়ে বলুন, তোমাকে টাকাটা কর্জে হাসানা দিয়েছিলাম। যখন সামর্থ হবে তখন শোধ করে দিও। আর যদি কোনো দিন সামর্থ না হয়, তা হলে শোধ করতে। হবে না। আপনার সম্পত্তি আপনারই থাকবে। কর্জে হাসানা কি জিনিস, আপনি একদিন আমাকে বলেছিলেন, তাই বললাম। এতে যদি আমার বেয়াদবী বা অন্যায় হয়ে থাকে মাফ করে দিন।
আব্বুর কথা শুনে দাদাজীর চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, “আল্লাহ তোকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের মধ্যে সামিল করুক।” তারপর সালাউদ্দিনকে দলিটা ফেরত দিয়ে বললেন, তোমার ছেলের বন্ধুর কথা তো শুনলে, ওকে দোয়া করো। আর যে টাকা তোমাকে দিয়েছি, তা কর্জে হাসানা দিয়েছি আজ থেকে মনে করবে।
সালাউদ্দিন যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেল। তবু খুব অপমান বোধ করে মাথা নিচের দিকে করে। রইলেন।
দাদাজী তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, তুমি যখন জমি ও বাগান। সাফ কওলা দিয়ে টাকা নিতে এসেছিলে তখন কর্জে হাসানার মর্তবার কথা জানা থাকা সত্ত্বেও শয়তান সম্পত্তির লোভ মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এখন আব্দুল হামিদের কথা শুনে আল্লাহ আমার জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়েছেন। সে জন্যে তার পাক দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছি। কুরআন পাকে আছে, “মুমিনগণ একে অপরের ভাই” তুমি আমার মুমীন ভাই। অভাব বা বিপদের সুযোগ নিয়ে এক ভাই অন্য ভাইয়ের সম্পত্তি গ্রাস করা কোনো মুমীনের কাজ নয়। বরং অভাব বা বিপদের সময় তাকে সাহায্য করাই প্রত্যেক মুমীনের কর্তব্য। আর ভাইয়ের সাহায্য নেওয়া কোনো অপমানের কাজ নয়।
সালাউদ্দিন আপুত কণ্ঠে বললেন, আপনি আল্লাহর খাটি বান্দা। দোয়া করুন, “আল্লাহ যেন টাকাটা পরিশোধ করার তওফিক দেন।”
তারপর থেকে এম.এ. পাশ করা পর্যন্ত আব্ব, বন্ধু রোকন উদ্দিনকে টাকা দিয়ে অনেক সাহায্য করেছেন। এম.এ. পাশ করার পর আব্ব কলেজে শিক্ষকতা করতে ঢুকলেন; আর রোকন উদ্দিন ঢাকায় এসে ভাগ্যগুণে একটা বড় চাকরিতে ঢুকলেন। চার পাঁচ বছরের মধ্যে দাদাজীর টাকা পরিশোধ করে দেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতে উনি স্বপরিবারে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। ভারতে যাওয়ার সময় আল্লুকেও যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আবু যান নি। বরং পাক হানাদারদের সাহায্য করেছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছু করেন নি। এমন কি যদি উনি জানতে পারতেন, অমুক দিন অমুক গ্রামে পাক সৈন্যরা হামলা করবে। সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্রামে লোক পাঠিয়ে গ্রাম ছেড়ে লোকজনদের চলে যেতে বলেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রোকন উদ্দিন যখন দেশে ফিরলেন তখন আমাদের ও আশপাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা আব্বুকে রাজাকার বলে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। রোকন উদ্দিন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। তাঁরই হস্তক্ষেপের ফলে আবু বেঁচে গেলেন। কিন্তু সবাই রাজাকার বলত। সে সময়। আব্ব অনেকদিন বাড়ির বাইরে কোথাও যেতেন না। শুধু কলেজে যেতেন, আর লোকজনের দ্বারা চাষ-বাসের কাজ করাতেন। একদিন রোকন উদ্দিন আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আব্বু আগেই জেনেছিলেন, ওঁর জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা তাকে। কিছু বলে নি। তার দু’হাত ধরে আলু ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং নাস্তাপানি খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু উনি একগ্লাস পানিও খান নি। দাদাজী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ছ’মাস আগে ইন্তেকাল করেন। দাদি বেঁচে ছিলেন। তিনি রোকন উদ্দিনকে বললেন, তোমাকে আমি আব্দুল হামিদের মতো দেখি। ওকে মাফ করে দিয়ে কিছু খাও। নচেৎ আমি দুঃখ পাব।
রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, আমিও আপনাকে মায়ের মতো জানি। আপনার কথায় ওকে মাফ করে দিলাম। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাজাকারের বাড়িতে কিছুতেই খেতে পারব না। সেজন্য আপনার কাছে মাফ চাইছি। তারপর ফিরে আসার সময় বাইরে এসে আব্বকে বলেছিলেন, তুমি জীবনে আর কখনও আমাকে বন্ধু ভাববে না। আমাদের বাড়িতে যেন তোমার পা পড়ে।
সেদিন ওঁর কথায় আব্বু ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। সে সময় আমার বয়স পাঁচ আর তোর দুই কি আড়াই বছর হবে। বড় হয়ে যখন কলেজে পড়ি তখন একদিন আম্মুর মুখে এসব শুনেছিলাম। এখন তুই-ই বল, সেই রোকন উদ্দিন সাহেব কি আমাকে জামাই করবেন?
উম্মে কুলসুম একটু রেগে উঠে বলল, তুমি জেনেশুনে কেন তার মেয়ের প্রেমে পড়লে?
আব্দুস সাত্তার বলল, কেন পড়েছি বলছি শোন, প্রায় তিন বছর আগে গ্রীন সুপার মার্কেটে একদিন রূপাকে দেখে মুগ্ধ হই। তখন থেকে ওর কথা এক মুহূর্তও ভুলতে পারি নি। এর ছ’মাস পর পাবলিক লাইব্রেরীতে দেখি। সেদিন ওর সঙ্গে আমার এক ক্লাসমেটের বোন ছিল। পরে ঐ ক্লাসমেটের বোনের কাছ থেকে ওর বায়োডাটা জেনে মন খুব খারাপ হয়ে যায়। ওকে পাওয়া দুরাশা ভেবে মন থেকে ওর স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারলাম না। এভাবে আরো ছ’মাস কেটে গেল। একদিন রাতে ওর কথা মনে পড়তে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। হঠাৎ মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল, কোনো রকমে যদি রূপার মন। জয় করতে পারি, তা হলে বিয়ের মাধ্যমে হয়তো আব্বুর সঙ্গে ওর আব্বার সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে, তা আবার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। পরের দিন ঐ। ক্লাসমেটের বোনের মাধ্যমে রূপাদের ফোন নাম্বার জেনে আজ দেড় বছর ওর সঙ্গে ফোনে আলাপ করছি। আলাপ করে ওর মন জয় করতে পেরেছি বলে মনে হয়। কিন্তু কতটা পেরেছি তা জানি না।
কিন্তু উনি যখন তোমার আসল পরিচয় জানতে পারবেন তখন তো তোমাকে ঘৃণা করবেন।
তা করতে পারে, আবার নাও পারে। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত শত্রুর ছেলে মেয়ের মধ্যে অনেক প্রেমের ঘটনা ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে যেমন শত্রুতা আরো বেড়েছে, তেমনি শক্রতার অবসানও হয়েছে।
তোমার ক্ষেত্রে যদি প্রথমটা হয়?
তা হতে পারে। তবে চেষ্টা করতে দোষ কি? তকদিরে থাকলে সাকসেসফুল হতে পারি। আব্বুর কাছ থেকে বাধা এলেও আম্মুকে দিয়ে তাকে ম্যানেজ করতে পারব। কিন্তু রূপার আব্বা পাহাড়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়াবেন।
ওটাতো গার্জেনদের ব্যাপার; রূপা আপা যদি তোমাকে ঘৃণা করে, তা হলে কী করবে ভেবেছ?
আব্দুস সাত্তার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ভাবি নি যে, তা নয়। তাই তো তাকে পরিচয় ও দেখা না দিয়ে প্রেমের বীজ বপন করেছি এবং চারাও যে গজিয়েছে তাও বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সেই চারা এতদিনে কত বড় হয়েছে, তা না জানা পর্যন্ত দেখা দিলেও আসল পরিচয় দেব না ভেবেছি।
একটা মহৎ উদ্দেশ্যের কথা বললে বলে বাধা দিলাম না। নচেৎ শুধু রূপের মোহে যদি তুমি তাকে ভালবাসতে, তা হলে নিশ্চয় কঠিন বাধা দিতাম। কারণ আমার ধারণা, রূপা আপা তোমাকে যতই ভালবাসুক না কেন, তিনি যখন জানবেন, তুমি রাজাকারের ছেলে এবং সেই কারণে তার ও আমাদের আব্বুর সঙ্গে শত্রুতা তখন তোমাকে ঘৃণা করবেই। তাই তোমার জন্য আমার খুব ভয় হয়। বড় ভাইয়াকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন। এখন তুমিই আমাদের একমাত্র ভাই, রূপা আপার কারণে তোমার কিছু হলে আম্মু, আব্ব, আমরা কেউ-ই সহ্য করতে পারব না। আমি মনে করি, সে রকম পরিস্থিতি আসার আগেই রূপা। আপাকে তোমার পরিচয় দেওয়া উচিত।
আব্দুস সাত্তার বলল, ঠিক আছে, তুই এখন যা। ভেবে দেখি কী করা যায়।
.
আব্দুস সাত্তারের ফুফুর সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর সায়মা চিন্তা করল, এখন। আপুকে বললে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। তার চেয়ে কাল সকালে তাকে নিয়ে ওদের বাসায় গিয়ে চাক্ষুস প্রমাণ দেখাবে।
সন্ধ্যের পর থেকে সায়মার মাথা ব্যথা করছিল। তাই দশটায় খাওয়ার পর একটা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে পড়ল।
।রূপা আজ বান্ধবী আসমার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। তার রুমের টেবিলে নসিম হেযাজীর “কায়সার ও কিসরা” নামে একটা বেশ বড় বই দেখে কয়েক পাতা উল্টে বুঝতে পারল, ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই ধরণের বই পড়তে তার খুব ভালো লাগে। ফেরার সময় আসমার কাছ থেকে বইটা এনেছিল। সন্ধ্যে থেকে প্রায়। অর্ধেক পড়ে ফেলেছে। খেয়ে এসে সায়মাকে ঘুমাতে দেখে কিছু বলল না। আগেই। তার মাথা ব্যথার কথা শুনেছে। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বইটা নিয়ে বসল।
ইসলামকে দুনিয়া থেকে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য খৃষ্টান, ইয়াহুদী ও নজুসীদের রাজ্য জয়ের লোভ, যুদ্ধের হানাহানি ও তিন চার জোড়া নায়ক-নায়িকা নিয়ে সুখ-শান্তি, দুঃখ-বেদনা ও বিরহ-মিলনের অদ্ভুত কাহিনী। একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়া ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা কারো হবে না।
রূপা পড়ার মধ্যে ডুবে গিয়ে সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ফোন বেজে উঠতে চমকে উঠে ঘড়ি দেখল, সাড়ে বারটা। সঙ্গে সঙ্গে হার্টবিট বেড়ে গেল। সামলাবার জন্য কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল। তারপর রিসিভার তুলে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুস সাত্তার খুব নরম সুরে বলল, সেদিন আর কখনও বিরক্ত করব না বলা সত্ত্বেও করলাম। সেজন্য ক্ষমা চাইছি।
রূপা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
বুঝতে পারছি, আপনি আমার উপর খুব রেগে আছেন; কিন্তু কী করব বলুন, আপনার সঙ্গে কথা না বললে আজও সারা রাত জেগে কাটাতে হত। গত সাত আট দিন একফোঁটা ঘুমাতে পারি নি। প্লীজ, কথা বলুন।
আপনি যে ফ্রড নন, প্রমাণ করতে পারবেন?
ইনশাআল্লাহ পারব। কী প্রমাণ চান বলুন।
কাল আপনার মুখোমুখি হতে চাই।
আব্দুস সাত্তার বুঝতে পারল, সায়মা ঘটনাটা তাকে এখনও বলে নি। বলল, বেশ তো কোথায় কখন হতে চান বলুন।
সকাল আটটায় টি.এস.সির মোড়ে থাকবেন, আমি আসব।
ঠিক আছে, থাকব।
আপনাকে চিনব কী করে?
আপনাকে চিনতে হবে না, আমিই এগিয়ে এসে কথা বলব। এবার একটা। কথা বলব, কিছু মাইন্ড করবেন না বলুন?
মাইন্ড করার মতো কথা বললে, মাইন্ড করাই তো স্বাভাবিক।
না, মানে বলছিলাম কী, আপনি একা আসবেন।
ও এই কথা? আপনি না বললেও আমি একাই আসতাম।
এখনও জেগে ছিলেন মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, একটা বই পড়ছিলাম।
কী বই?
নসিম হেযাজীর কায়সার ও কিসরা।
আমি নসিম হেযাজীর সব বই পড়েছি। ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। আপনি কী ওঁর সব বই পড়েছেন?
না, এটাই প্রথম।
ওঁর লেখা সব বই আমার কালেকসানে আছে। নিয়ে পড়তে পারেন।
নেব কী করে? আপনি তো ধরাই দেন না।
ইনশাআল্লাহ কাল তো ধরা দিচ্ছি।
এখন তো পড়াশোনা নেই, তবু এতরাত জেগে রয়েছেন কেন?
একটু আগে কী বললাম ভুলে গেলেন?
না, ভুলি নি।
তবু জিজ্ঞেস করলেন কেন?
মানে জেগে জেগে কী করছিলেন, তা জানার জন্য।
আপনাকে ফোন করব বলে।
আমারও তো এখন পড়াশোনা নেই, আরো আগে করতে পারতেন।
তা পারতাম, নিরিবিলিতে অনেকক্ষণ আলাপ করা যাবে না ভেবে করি নি। তা। ছাড়া সায়মা যা চালাক, জেগে থাকলে আপনি কী এতক্ষণ আলাপ করতে পারতেন?
সায়মা খুব চালাক, আর আমি বুঝি খুব বোকা?
না, তা নয়। আপনি আমার মতো।
আপনার মতো মানে?
মানে, আমি বোকাও নই, চালাকও নই। আপনিও তাই।
আমার তো মনে হয় আপনি ভীষণ চালাক।
কী করে বুঝলেন?
ভীষণ চালাক না হলে আজ দেড় দু’বছর আমাকে নাকানি চুবানি খাওয়াতে পারতেন না।
ছি ছি, এ আপনি কী বলছেন? বরং আমিই কুলুর বলদের মত দেড় দু’বছর আপনার পিছনে ঘুরছি।
আর কতদিন ঘুরে আমাকে নাকানী চুবানি খাওয়াবেন?
বার বার একই কথা বলে নিজেকে ছোট করছেন কেন? আপনি কী, তা আমার জানতে বাকি নেই। অন্য কোনো মেয়ে হলে আমার বারটা বাজিয়ে ছাড়ত।
শুনুন, সেদিন আপনাকে ফ্রড বলে ভুল করেছি, সেজন্য ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। আমি আপনার সঙ্গে দীর্ঘদিন যা করেছি, তা অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে করলে শুধু ফ্রড নয়, ইতর, ছোটলোক ও লোফার বলত।
তবু বলুন; ক্ষমা করেছেন?
কাল আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর যদি সত্যি সত্যি ফ্রড বলে মনে হয়, তখন কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার জন্য অনুশোচনা হবে।
সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে। এখন ক্ষমা করেছেন কিনা বলুন।
আমিও কিন্তু প্রথমে ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন, ফ্রড নই প্রমাণ দেখাতে পারলে ক্ষমা করবেন। কথাটা উইথড্র করলেও ক্ষমা করেছেন কিনা বলেন নি।
আপনাকে খুব চালক ভেবেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে তা নন। এটাও বুঝতে পারেন নি, ক্ষমা না করলে রিসিভার তুলেই রেখে দিতাম?
আপনার কথা বোধহয় ঠিক। উম্মে কুলসুমও মাঝে মাঝে আমাকে বলে, আমার নাকি বুদ্ধি কম। আপনারও বোঝা উচিত ছিল, ঐদিন অপমানিত হয়েও কেন আজ ফোন করলাম।
ঠিক আছে, কালই প্রমাণ হবে, কে চালাক আর কে বোকা। এবার রাখি, সায়মা নড়াচড়া করছে। মনে হয় বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘুম পাতলা হয়ে আসছে। তা ছাড়া রাত কত হয়েছে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখুন।
দেড়টা বেজে গেছে দেখে আব্দুস সাত্তার সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
রূপা রিসিভার রেখে পড়ায় মন দিল। বইটা শেষ হতে কয়েক পৃষ্ঠা বাকি থাকতেই ফজরের আজান হল। তাড়াতাড়ি শেষ করে নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করতে বসল। কিন্ত ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কুরআন তুলে রেখে ভাবল, এখন ঘুমালে আটটা নটার আগে ঘুম ভাঙবে না। আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করার জন্য, সময় মতো যেতে পারবে না। তাই ঘুমাবার চিন্তা বাদ দিয়ে বাগানে হাঁটার মনস্থ করল।
সায়মা নামায পড়ে তার চোখ মুখ দেখে বলল, মনে হচ্ছে সারারাত পড়ে বইটা শেষ করেছিস?
রূপা মৃদু হেসে বলল, বইটা শেষ না করে কিছুতেই ঘুমাতে পারলাম না। দারুণ ভালো বই। তুইও পড়িস। ভাবছি, এই লেখকের সব বই কিনে নিয়ে আসব।
তাই কিনে আনিস। আমি নসিম হেযাজীর খুব নাম শুনেছি। বইগুলো আমিও পড়ব।
আপাততঃ এটা পড়িস।
কিনেছিস?
না, এক বান্ধবীর কাছ থেকে এনেছি।
ঠিক আছে, পড়ব। তারপর তাকে বেরোতে দেখে বলল, কোথায় যাচ্ছিস? নটা পর্যন্ত ঠেসে একটা ঘুম দে, দেখবি শরীর ঝরঝরে হয়ে গেছে।
আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করার কথা তাকে জানাতে চায় না। তাই কিছু না বলে রূপা বেরিয়ে গেল। বাগানে এসে ভোরের ঠাণ্ডা মুক্ত বাতাস গায়ে লাগতে প্রাণ। জুড়িয়ে গেল। হাঁটার সময় দীর্ঘ দেড় বছর ধরে শুধু ফোনে কথা বলে যাকে ভালবেসে ফেলেছে, তাকে আজ সামনা-সামনি দেখবে ভেবে রোমাঞ্চিত হতে লাগল। সায়মার কথামতো আসিফ সাহেবই যদি আব্দুস সাত্তার হন, তা হলে সত্যিই সে ভাগ্যবতী। তার মতো সুপুরুষ খুব কম দেখেছে। আর তা যদি না হয়ে আব্দুস সাত্তার অন্য কেউ হন? তিনি যদি কুশ্রী বেঁটে অথবা খুব রোগা হন, তা হলে কি করবে ভাবতে লাগল। প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর ফেরার সময় একটা ফুটন্ত। গোলাপ দেখতে পেল। ফুলটা আজ রাতে শেষ প্রহরে ফুটেছে, রূপা বুঝতে পারল। ফুলটা তুলতে গেলে হাতে কাটা বিধে গেল। উহ করে উঠে হাতটা টেনে নিল। তখন একটা কবিতা মনে পড়ল;
কাঁটা হেরী ক্ষ্যান্ত কেন কমল তুলিতে,
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?
ফুলটা তুলে রুমে এসে টেবিলের ড্রয়ারে রাখল। তারপর গোসল করার জন্য বাথরুমে ঢুকল। সাওয়ার ছেড়ে দিয়ে সাবান মাখার সময় গুনগুনিয়ে উঠল—
তুমি অমাবস্যার রাতের মতো কালো হও,
কিংবা তুমি চাদ হও অথবা সূরয হও,
যা কিছু হও না কেন, তুমিই আমার জীবন মরণ,
বিধাতার বিধান ভেবে তোমারেই করিব বরণ।
গোসল সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আলমারী খুলে অনেকগুলোর মধ্য থেকে। ফিরোজা কালারের সালওয়ার কামিজ ও ওড়না বের করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এল। তারপর সেজেগুজে মায়ের কাছে এসে বলল, নাস্তা দাও।
দু’জন কাজের মেয়ে থাকা সত্ত্বেও মুমীনা বেগম রান্না নিজের হাতে করেন এবং স্বামী ও মেয়েদের খাওয়ান। প্রথম দিকে রোকন উদ্দিন সাহেব স্ত্রীকে অনেকবার বলেছেন, সংসারের সবকিছু করার জন্য দু’জন বুয়া রাখা হয়েছে, তবু তুমি কিচেনে যাও কেন? তা ছাড়া একসঙ্গে খেতেও বস না। টেবিলে সবকিছু থাকে, প্রয়োজন মতো সবাই নিয়ে খাব। মুমীনা বেগম মৃদু হেসে বলেছেন, নিজের হাতে রান্না করে স্বামী-সন্তানদের খাইয়ে যে কত সুখ, কত শান্তি, তা তুমি পুরুষ। হয়ে বুঝবে না। পরে রূপা ও সায়মা বাবার মতো বলেছে। তাদেরকেও মুমীনা বেগম একই কথা বলেছেন।
ওরা সবাই আটটায় একসঙ্গে নাস্তা করে। এখন সাতটা। তাই রূপা এখন নাস্তা খেতে চাইলে মুমীনা বেগম তার দিকে না তাকিয়েই বললেন, এত সকালে নাস্তা খেতে চাচ্ছিস কেন? কোথাও যাবি নাকি?
রূপা বলল, হ্যাঁ আম্মু। একজনের সঙ্গে আটটায় এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
মুমীনা বেগম এবার তার দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন। এভাবে সেজেগুজে সায়মাকে বাইরে যেতে দেখলেও রূপাকে কখনও দেখেন নি। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
টি.এস.সিতে।
দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কড়াইয়ের ভাজি নাড়তে নাড়তে বললেন, ভাজি হতে দেরি আছে। ডাইনিং টেবিলে যা, রুটি পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফ্রিজে মিস্টি আছে, বুয়াকে দিতে বলিস।
নাস্তা খেয়ে রুমে এসে গোলাপ ফুলটা ভ্যানিটি ব্যাগে নিয়ে বেরোবার সময় সায়মার সামনে পড়ে গেল। সে এতক্ষণ রিডিংরুমে পড়ছিল। বেডরুমে একটা খাতার জন্য আসছিল। আপুকে দেখে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, যে আপুকে শতবার বলা সত্ত্বেও সেজেগুজে বাইরে বেরোয় না। তাকে আজ এ কী দেখছে?
সায়মার গায়ের রং রূপার চেয়ে একটু চাপা। সে বাবার রং পেয়েছে। আর রূপা মায়ের। সায়মা সুন্দরী। রূপা তার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী। রং একটু চাপা বলে সায়মা হয়তো সাজগোজ পছন্দ করে। আর রূপা খুব সুন্দরী বলে হয়তো সাজগোজ মোটেই পছন্দ করে না। সায়মা সাজগোজ করেও রূপার সৌন্দর্য্যের ধারে কাছে যেতে পারে না। তবে এ নিয়ে তার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। আপুকে ভীষণ ভালবাসে। তাই বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় সাজগোজ করার জন্য প্রায় চাপ দেয়। রূপা হেসে এড়িয়ে যায়। সেই আপুকে আজ সাজগোজ করে বেরোতে দেখে এত অবাক হল যে, কিছুক্ষণ কথা বলতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
রূপা এগিয়ে এসে তার গাল টিপে দিয়ে মুচকি হেসে বলল, কীরে, অমন করে তাকিয়ে কী দেখছিস?
তোকে দেখছি।
তোর হিংসা হচ্ছে বুঝি?
আপু তুই একথা বলতে পারলি বলে সায়মা তাকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, হিংসা হবে কেন? বরং ভীষণ খুশী হয়েছি। হাদিসে পড়েছি, হিংসা এমন জিনিস, যা নেকীকে লাকড়ীর মতো আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তাই তোর। রূপ দেখে হিংসা না করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছিলাম। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে কান্নামুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কোথায় এবং কেন যাচ্ছিস জানি না। তবে কোনো ছেলের সঙ্গে যদি দেখা করতে যাস, তা হলে নিশ্চিত করে বলতে পারি, সে তোকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাবে।
রূপা বলল, হিংসা করার কথাটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তবু আমার ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে এরকম ভুল আর হবে না। চলি, দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে এগোল।
সায়মা তার পথ আগলে বলল, আমাকে সঙ্গে না নিয়ে তুই কখনও কোথাও যাস না, আজ একা যাচ্ছিস যে?
একা কেন যাচ্ছি ফিরে এসে বলব।
কিন্তু নাস্তা খেয়ে আমি তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব ভেবেছিলাম।
বিকেলে নিয়ে যাস বলে রূপা বেরিয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে বসল।
ড্রাইভার আগেই ইনফরমেসান পেয়ে গাড়ি বের করে রেডি হয়েছিল। রূপাকে আসতে দেখে পিছনের দরজা খুলে দিল। ড্রাইভিং সিটে বসতে দরজা লাগিয়ে সরে দাঁড়াল।
টি.এস.সির মোড়ে এসে রূপা সরওয়ার্দি উদ্যানের গেটের দিকে রাস্তায় এক পাশে গাড়ি পার্ক করল। তারপর গাড়ি লক করে নেমে পার্কের গেটের কাছে। আসিফকে দেখে মনে হোঁচট খেল। ভাবল, তা হলে কি সায়মার কথাই ঠিক? যদি তাই হয়, তা হলে তো উনি এগিয়ে এসে কথা বলবেন। এই ভেবে তাকে না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
আসিফ ওরফে আব্দুস সাত্তার দশ মিনিট আগে এসে এতক্ষণ চিন্তা করছিল, আজ সকালে সায়মা যদি ঘটনাটা রূপার কাছে ফাঁস করে দেয়, তা হলে নিশ্চয় ফ্রড ভাববে, আর এখানে নাও আসতে পারে। আবার ভাবল, সায়মা ফাস না করলেও আসার পর যখন জানতে পারবে আসিফই আব্দুস সাত্তার তখন কী করবে? যদি ফ্রড ভেবে রাগ করে চলে যায়, তা হলে কি করবে? রাস্তার দিকে তাকিয়ে এইসব চিন্তা করছিল। রূপাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ধীরে ধীরে তার সামনে এসে সালাম দিল।
রূপা অবাক হওয়ার ভান করে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি এখানে?
হ্যাঁ, বন্ধু আব্দুস সাত্তার পাঠিয়েছে।
তার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রূপার পা থেকে মাথা পর্যন্ত আব্দুস সাত্তারের প্রতি ঘৃণায় রিরি করে উঠল। সেই সাথে প্রচণ্ড রেগে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে রাগ সামলাল। তারপর বিদ্রুপ কণ্ঠে বলল, আপনি তো বন্ধুর খুব গুণগান করেন, কিন্তু সে যে একটা জঘন্য ধরনের ফ্রড, তা জানেন না বোধহয়?
আব্দুস সাত্তার কিছু না বলে করুণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অল্পক্ষণের মধ্যে তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠতে মুখ নিচু করে নিল।
রূপা তার চোখে পানি দেখে ফেলেছে। বিদ্রুপ কণ্ঠেই বলল, বন্ধুকে ফ্রড বলেছি বলে খুব দুঃখ পেয়েছেন তাই না?
পানিভরা চোখে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, যদি বলি আমিই আব্দুস সাত্তার। বিশেষ কারণে সেদিন পরিচয় গোপন করে বন্ধু আসিফের নামে পরিচয় দিয়েছিলাম। তারপর আবার মুখ নিচু করে নিল।
রূপা হতভম্ব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। তখন তার সমস্ত তনুমনে আনন্দের বান ছুটল।
আব্দুস সাত্তার ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে তার মুখের দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ল। দেখল, সেখানে ঘৃণা বিদ্রুপ বা রাগের লেশমাত্র নেই। যা আছে, তা দেখে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
কতক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল রূপা জানতে পারল না। যখন চোখ দুটো পানিতে ঝাপসা হয়ে এল তখন বুঝতে পেরে দৃষ্টি নিচের দিকে করে নিল। কোনো কথা বলতে পারল না।
ততক্ষণে আব্দুস সাত্তারও বাস্তবে ফিরে এল। বলল, চলুন পার্কের ভিতরে গিয়ে বসি। রাস্তার লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছে।
ওড়নার খুঁটে চোখ মুছে যেতে যেতে রূপা বলল, অনেক ভুগিয়েছেন। নিজে অপমানিত হয়েছেন, আমাকেও অপমান করেছেন; কড়া মাশুল দিতে হবে।
আব্দুস সাত্তার তার পাশে হাটতে হাটতে বলল, আপনাকে খুশী করার জন্য হাসিমুখে প্রাণটাও উৎসর্গ করতে পারি। এর থেকেও কী আরো বড় মাশুল দিতে হবে?।
রূপা থমকে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ বের করে বলল, সাবধান করে দিচ্ছি, ভবিষ্যতে যদি এরকম কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেন, সেদিন আমার মরা মুখ। দেখবেন।
আব্দুস সাত্তার তার মনের খবর জানতে পেরে চমকে উঠে বলল, আমি না হয় ভুল করে কথাটা বলে ফেলেছি, তাই বলে এতবড় কথা বলে প্রতিশোধ নেবেন?
আপনি ভুল করতে পারলে আমি পারি না বুঝি? আপনি যা করেছেন, আমি তার পুনরাবৃত্তি করেছি মাত্র। তবু ক্ষমা চাইছি, আর ওয়াদা করছি, আর কখনও এমন কথা উচ্চারণ করব না।
ভুল আমি প্রথমে করেছি। আমারই ক্ষমা চাওয়া ও ওয়াদা করা উচিত।
ঠিক আছে, ভুল যখন দু’জনেই করেছি তখন দু’জনরেই দু’জনকে ক্ষমা করা উচিত এবং দু’জনকেই ওয়াদাও করা উচিত।এবার এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আসুন এখানে বসা যাক বলে রূপা ছায়া ঢাকা ও ঘাসেভরা জায়গায় বসে পড়ল।
আব্দুস সাত্তার তার সামনে বসে অপলক নয়নে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফিরোজা কালারের পোশাক রূপাকে ভীষণ মানিয়েছে। সুন্দরী রূপাকে আরো সৌন্দৰ্য্যময়ী করে তুলেছে। সেদিকে আব্দুস সাত্তারের কোনো খেয়াল নেই। সে তার চোখের তারার দিকে তাকিয়ে আছে।
রূপাও তার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, চোখের দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন?
একই প্রশ্ন যদি আমিও করি?
আপনি আগে বলুন, তারপর আমি।
“তোমার কাজল কালো চোখের দু’টো নীল পাথরের গভীরতায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে।” এবার তোমারটা বল।
রূপা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে গোলাপ ফুলটা বের কের তার হাতে দেওয়ার সময় মৃদু হেসে বলল, “আমার কাজল কালো চোখে হয়তো খুঁজে পাবে তোমার প্রিয় মরুদ্যান।”
মারহাবা মারহাবা বলে আব্দুস সাত্তার ফুলটা একবার শুকে নিয়ে পকেট থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে তার হাতে দিল।
শুকরিয়া বলে রূপা একবার শুকে বলল, আমারটা আমাদের বাগানের। তোমারটা আমারটার চেয়ে খুব সুন্দর।
আব্দুস সাত্তার বলল, দেশের বাড়িতে বেশ বড় ফুলের বাগান আছে, এখানে নেই। তাই ছাদটাকে ফুলের বাগান বানিয়েছি। এটা সেই বাগানের। তারপর বলল, জান, গত রাতে তোমাকে ফোন করার পর থেকে খুব টেনসানে ছিলাম। সারারাত ঘুমাতে পারি নি। কেবলই মনে হয়েছে, আমাকে দেখার পর যদি ফ্রড ভেবে রাগ করে চলে যাও, তা হলে…..।
থেমে গেলে কেন? তা হলে কী?
তা হলে লজ্জায় ও অপমানে হয়তো মরেই যেতাম। আর তা না হলে নিজের প্রতি খুব ঘৃণা তো হতই, এমনকি নিজের প্রতি বিশ্বাসও হারিয়ে ফেলতাম। সারাজীবন কোনো মেয়েকে গ্রহণ করা তো দূরের কথা, কোনো মেয়ের দিকে মুখ তুলে তাকাতেও পারতাম না। আল্লাহ পাকের অপার করুণা, তিনি আমাকে নিরাশ করেন নি। সেজন্য তার পাক দরবারে শতকোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি।
রূপা মৃদু হেসে বলল, প্রথম দিকে যখন ফোন করতে তখন তোমাকে বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে ভেবে রেগে যেতাম, কিছুটা ঘৃণাও করতাম। আব্বকে জানিয়ে শায়েস্তা করতেও চেয়েছিলাম; কিন্তু তোমার গলার স্বরে যেমন মধু ছিল তেমনি তোমার কথাতেও যাদু ছিল। তাই আল্লুকে জানাতে পারি নি। তারপর দিনের পর দিন তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। অনেক সময় মনে হয়েছে, অনেক কুশ্রী ও চরিত্রহীন ছেলেদের কণ্ঠস্বর মধুর হয়, কথাতেও যাদু থাকে। যখন সামনা-সামনি হতে চাইলে না, এমন কি ফোনেও নাম ছাড়া কিছুই জানালে না। তখন মন খুব বিগড়ে যায়। ভাবলাম, খুব গরিব ঘরের ছেলে আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পিছে লেগেছে। সায়মা ও আমি কোলেপিঠে। ও সব কিছু জানে। একদিন বলল, ছেলেটা ফ্রড। আব্বকে জানিয়ে জব্ধ করে দে। আমি বললাম, ছেলেটা যাই। হোক, তাকে সম্পূর্ণ না জানা পর্যন্ত আল্লুকে জানান ঠিক হবে না। ও কিন্তু সংসদ ভবন চত্বরের ঘটনার দিন বলেছে, গুলি খাওয়া ছেলেটাই তুমি। গতকাল জুতো কিনতে গিয়ে বাসায় ফিরেও ঐ কথা বলেছে।
আব্দুস সাত্তার জিজ্ঞেস করল, তোমার কিছু মনে হয় নি?
হয়েছে, তবে তেমন জোরাল নয়।
সায়মা সত্যিই খুব চালাক। গতকাল আমরা বাসায় পৌঁছাবার আগেই ফোন করেছিল। ফুফুআম্মা ফোন ধরেছিলেন। খুব চালাকির সঙ্গে তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু জেনে নিয়েছে।
ওমা, তাই নাকী? এখন বুঝতে পারছি, এখানে আসার সময় কেন বলেছিল, তোকে নিয়ে এক জায়গায় যাব। আমি বলেছি বিকেলে নিয়ে যাস। মনে হচ্ছে, তোমাদের বাসাতেই নিয়ে যেত। জান, ওর কাছে হেরে গেলাম।
হেরে গেলে বুঝলাম না।
বললাম না, ও বলেছিল, আসিফ সাহেবই তুমি?
হেরে গিয়ে দুঃখ হচ্ছে বুঝি?
তোমার কী তাই মনে হচ্ছে?
না, তবে তোমার মুখে শুনতে চাই।
দুঃখের বিপরীত শব্দটা হচ্ছে।
সায়মার কথা কেন বিশ্বাস কর নি বলবে?
দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তুমি মিথ্যে অভিনয় করতে পার না।
এখনও কী সে বিশ্বাস আছে?
আছে?
মিথ্যে অভিনয় করলাম, তবু আছে?
শুধু আছে নয়, বরং এখন সেই বিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে।
বুঝলাম না।
তোমাকে সামনাসামনি দেখে ও তোমার কথা শুনে যা জানতে পারলাম, তা চন্দ্র সূর্যের মতো সত্য। অতটুকু মিথ্যে অভিনয় না করলে তা জানতে পারতাম না।
আনন্দে আপ্লুত হয়ে আব্দুস সাত্তার কয়েক সেকেন্ড কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল। তারপর বলল, তুমি বোধহয় না খেয়ে বেরিয়েছ, চল, কোনো রেষ্টুরেণ্টে যাই।
আমি নাস্তা খেয়েই বেরিয়েছি। আমার তো মনে হচ্ছে, তুমিই না খেয়ে বেরিয়েছ।
তোমার অনুমান ঠিক। আল্লাহ যেন আমাকে অপমানিত না করেন, সেজন্য আজ নফল রোযা রেখেছি।
তার কথা শুনে রূপাও আনন্দে কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না। তারপর ছলছল চোখে বলল, তুমি আমাকে এত ভালবাস?
তোমাকে আমি কতটা ভালবাসি, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কথা দাও, কোনো কারণেই আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে না?
দিলাম। এবার তুমিও দাও।
আমিও দিলাম।
এতদিন কেন আড়াল হয়েছিলে, সরি ছিলেন বলবেন?
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, সরি বলার আর দরকার নেই। প্রথম দিকে অল্পক্ষণ আপনি করে বললেও এতক্ষণ দুজনেই তুমি করেই বলেছি।
রূপা লজ্জারাঙা হয়ে বলল, ওমা, তাই নাকী?
তাই আর হবে না? প্রায় দু’বছর যে স্রোত বইছিল আজ মিলিত হয়ে একাকার হয়ে গেছে। তাই মনের অজান্তে দু’জনেই তুমি হয়ে গেছি। আর এটাই চিরাচরিত নিয়ম, তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন? আচ্ছা, তোমার ভালো নাম যাবিন তাসনিম, তাই না?
রূপা মৃদু হেসে বলল, জেনেও জিজ্ঞেস করছ কেন?
অন্যের মুখে দু’বছর আগে জেনেছিলাম, মনে আছে কিনা ঝালাই করে নিলাম।
তোমার মেমোরি খুব প্রখর। সঠিক মনে রেখেছ। অনার্সে নিশ্চয়ই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলে?
তোমার অনুমান ঠিক।
মাস্টার্সের রেজাল্টও নিশ্চয়ই তাই হবে?
আশা তো করি, বাকি আল্লাহর মর্জি। এবার তোমারটা বল।
আমার মেমোরি তোমার মতো অত প্রখর নয়। আল্লাহ রাজি থাকলে সেকেন্ড ক্লাস পেতে পারি। তা হঠাৎ নাম জিজ্ঞেস করলে কেন?
নামের অর্থ জান?
হ্যাঁ, বেহেস্তের সোনালী ঝরণা।
রূপা নাম কে রেখেছেন?
আব্বু।
আর আসল নাম?
আম্মুর কাছে শুনেছি, গ্রামে আব্বুর এক বন্ধু ছিলেন, তিনি রেখেছেন। অবশ্য উনি বলার আগে আম্মুও ঐ নামটা সিলেক্ট করেছিলেন।
আব্দুস সাত্তার বুঝতে পারল, তার আব্বই নামটা রেখেছিলেন। বলল, তোমার আম্মু মনে হয়, ধর্ম সম্বন্ধে অনেক জ্ঞানী এবং ধর্মের বিধি নিষেধ মেনে চলেন?
হ্যাঁ, আব্বুও কিছু কিছু মেনে চলেন।
সোনা, রূপা, ধাতুর নাম। তোমার আব্ব ধার্মিক হয়েও কেন যে তোমার ডাক। নাম রূপা রাখলেন বুঝতে পারছি না। তোমার গায়ের রং সোনালী। সোনা রাখলেও না হয় কিছু সামঞ্জস্য হত। যাক গে, আমি তোমাকে তাসনিম বলে ডাকব।
রূপা হাসিমুখে বলল, বেশ তো তাই ডাকবে। এবার আমি একটা কথা বলি?
বল।
তোমাকে আমি শুধু সাত্তার বলে ডাকব।
না, তা ডাকবে না।
কেন?
সাত্তার শব্দের অর্থ জান?
না।
গোপনকারী। আর এটা আল্লাহর গুণবাচক একটা নাম। আল্লাহর এরকম গুণবাচক নাম নিরানব্বইটা অথবা তার চেয়ে বেশি আছে। শুধু আল্লাহর গুণবাচক নাম ধরে ডাকা অথবা রাখা উচিত নয়। রাখলে শেরেকের তুল্য গোনাহ হবে। তাই ঐসব নামের আগে আব্দুল বা আব্দুস শব্দ যোগ করে নাম রাখতে হবে। যেমন—আব্দুস সুবহান, আব্দুল গফুর, আব্বুর রউফ ইত্যাদি। আর নাম রাখার ব্যাপারে মুসলমানের খুব হুশিয়ার হতে হবে। হাদিসে আছে, “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, তোমাদের নামের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা উত্তম নাম আব্বুল্লাহ, আব্বুর রহমান। (দু’টো নামেরই অর্থ আল্লাহর দাস)।”(১)
ইসলামী নামসমূহের আংশিক নামে ডাকাও মারাত্মক অন্যায় ও গুনাহর কাজ। যেমন কোনো লোকের নাম আব্বুর রহমান (অর্থাৎ আল্লাহর দাস), তাকে যদি শুধু। “রহমান” নামে ডাকা হয়, তা হলে তাকে আল্লাহ সম্বোধনেই ডাকা হল। আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ সম্বোধনে ডাকা কত জঘন্য অপরাধ ও নাফরমানী, তা চিন্তা করে। দেখ। এরূপ আংশিক নামে যে অন্যকে ডাকবে এবং সে যদি ঐ ডাকে সাড়া দেয়, তা হলে উভয়েই সমান গুনাহগার হবে। বর্তমান যুগে মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই চরম বিভ্রান্তি ও গোমরাহীতে নিক্ষিপ্ত হয়ে অধর্ম ও অনাচারে লিপ্ত হয়ে, আধুনিকতার অন্ধমোহে, জেনে না জেনে শিক্ষিত সমাজে ইসলামী, আকীদা ও সাংস্কৃতিকে দুমড়ে মুচড়ে ছেলেমেয়েদের ইসলামী নামের বিপরীতে ডাক নাম রাখতে শুরু করেছে। তাদের দেখাদেখি সর্বস্তরে একরম ডাক নাম রাখা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ছেলেমেয়েদেরকে কেউ আর আসল নামে ডাকে না। সবাই ডাক নামেই ডাকে। আর ছেলেমেয়েদেরকে কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে, তারা ডাক নামটাই বলে। এটা যে বিদেশী ও বিধর্মীদের চক্রান্ত, তাতে কোনো সন্দেহ। নেই। কিছু কিছু নামের উদাহরণ দিচ্ছি, যেমন—রফিকুল ইসলাম (হিমেল), আব্বুর রহমান (বুলেট), আব্দুল মতিন (রাসেল), আবিদা সুলতানা (চকলেট), নূর মোহাম্মদ (নুরু), ওমর ফারুক (ডালিম), মেহের নিগার (নিপা), ফাহিম ফায়সাল (তারা), রওসনারা বেগম (বেদানা), ফরহাদ আহম্মদ (তনু), তোমার নামটাই দেখ না, যাবিন তাসনিম (রূপা)। আবার অনেক পিতামাতা ভালো নামের সঙ্গে ডাক নাম রাখেন, মন্টু, ঝন্টু, রিন্টু, বিল্লী, বিজলী, উর্মি, সোমা, সাগর, সৈকত, অন্তরা, পলাশ, গোলাপ, জবা, যুঁই, চামেলী, চাঁদ, সূর্য, তারা, তোতা, ময়না, টুটুল, সুন্দরী, তুলি, বুলি, উষা, হাসি, মেঘনা, যমুনা ইত্যাদি। বিবেক সম্পন্ন লোক একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, এসব পশু, পাখি, নদ, নদী, ফল ও ফুলের নাম। মুসলমান নর-নারীর ভালো অর্থবহ ও ফযিলতপূর্ণ ইসলামী নামের স্থলে বা বিপরীতে এরকম ডাক নাম রাখা শুধু খারাপ নয়, গুনাহও। কারণ মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। সেই আশরাফুল মাখলুকাতের নাম পশু-পাখি, ফল-ফুল, নদ-নদী ও অস্ত্র ইত্যাদির নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখলে এবং সে নামে ডাকলে নিশ্চয় আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। তাই মুসলমানদের ফজিলতপূর্ণ ইসলামী নামের বিপরীতে ঐসব নাম রাখা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটা বর্জন করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য।
অনেকে অজ্ঞতার কারণে ভালো ইসলামী নাম বিকৃত করে ডাকে। যেমন—কামাল হোসেনকে তার মা বাবা বা আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা “কামাইল্ল্যা,” মুহাম্মদ আলিকে “মুহাম্মাইদ্যা,” আব্দুল কাদিরকে “কাদিররা,: আবুল বাশারকে “বাশাইররা” ফাতিমা খাতুনকে “ফাতি” এবং নূরজাহান বেগমকে “নূরী” বলে ডাকে। এরূপ বিকৃত নামে ডাকা যে কত বড় অন্যায় ও গুনাহের কাজ, তা কেউ চিন্তা করে দেখে না। আবার অনেক মা-বাবা এমন নাম রাখেন, যা আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) এর নামের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। যেমন—লাল মিয়া, চান মিয়া, রাজীব চৌধুরী, মদন গাজী, কালু ফকির, অঞ্জলি বেগম, শেফালি বেগম ইত্যাদি। কতকগুলো ভালো নাম ও তার অর্থ বলছি। শোন—আব্দুল আলিম (মহা জ্ঞানীর বান্দা), আব্দুল আজিজ (মহাজ্ঞানীর সেবক), আব্বুর রহিম (করুণাময়ের সেবক), হাবিবুর রহমান (আল্লাহর প্রিয় বান্দা), আতকিয়া ফাওজিয়া (ধার্মিক সফল), আফিয়া আবিদা (পুণ্যবতী এবাদতকারিণী)।
এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমাকে শুধু সাত্তার নামে কেন ডাকতে নিষেধ করলাম? এবং তোমাকে কেন তাসনিম বলে ডাকব বললাম? তুমি কিন্তু তোমাদের বাসায় সবাইকে বলে দেবে, তোমাকে রূপা নামে না ডেকে তাসনিম বলে যেন ডাকে। তারপর বলল, নামের ব্যাপারে বলতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করলাম, বিরক্ত হও নি তো?
তাসনিম মৃদু হেসে বলল, না। বরং ইসলামের অনেক কিছু না জানা বিষয় জানতে পেরে খুশী হয়েছি।
একটা কথা বলব, মাইন্ড করবে না তো?
মাইন্ড করার প্রশ্নই আসে না।
তোমার কথায় বুঝতে পারলাম, তোমার আব্বু আম্মু নামায পড়েন, তোমরা দু’বোন পড়?
আম্মু আব্বর থেকে বেশি ধার্মিক। তিনি আমাদেরকে ছোটবেলাতেই নামায শিখিয়ে ধরিয়েছেন, কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে শিখিয়েছেন এবং ইসলামের অন্যান্য অনেক কিছু শিখিয়েছেন। আজও আমরা সে সব মেনে চলি।
তোমরা ধর্মীয় বই পুস্তক, মানে কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা, বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় বইপত্র পড়?
এসব বই পুস্তক আম্মু প্রচুর পড়েন। আমরাও অবসর সময়ে অল্প কিছু কিছু পড়ি। ইদানিং আমি কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে শুরু করেছি। সায়মা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। তবু মাঝে মধ্যে আমার পাশে এসে বসে।
মেয়েদের পর্দা সম্বন্ধে কিছু পড় নি অথবা জান নি?
এখনও পড়ি নি। তবে একদম যে জানি না, তা নয়। এস.এস.সি. পর্যন্ত আম্মু স্কুল ড্রেসের সঙ্গে আলাদা রুমাল দিয়ে চুলসহ মাথা ঢেকে দিতেন এবং আলাদা একটা চাদর জড়িয়ে দিতেন। কলেজে ঢোকার পর প্রথম প্রথম ঐভাবে যেতাম। পরে ক্লাসমেটদের হাসি ঠাট্টা সহ্য করতে না পেরে কলেজে ঢোকার আগে মাথার। রুমাল খুলে ফেলতাম। অনার্স পড়ার সময় থেকে আর মাথায় রুমাল দিই না। এজন্য আম্মু খুব রাগারাগি করতেন, এখনও করেন। আবু অবশ্য কখনও কিছু বলেন নি।
কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যা যখন পড়ছ, তখন অচিরেই জানতে পারবে, কেন তোমার আম্মু এ ব্যাপারে রাগারাগি করেন। আমি শুধু এতটুকু বলব, মেয়েদের। জন্য পর্দা করা ফরয। অর্থাৎ পর্দা করে মেয়েদের বাইরে বেরোন আল্লাহর হুকুম। আচ্ছা, মেয়েদের কি কি দেখে ছেলেরা প্রলুব্ধ হয় জান?
তাসনিম হেসে ফেলে বলল, জানি। তবু তোমার মুখে শুনতে চাই।
মুখ, বুক ও নিতম্ব। তুমি যেভাবে ওড়না গায়ে দিয়েছ, তাতে বুক ঢাকা পড়লেও মুখ ও নিতম্ব ঢাকা পড়ে নি। তাই ইসলাম বোরখা পরার নির্দেশ দিয়েছে। তবে বড় চাদর বা মোটা কাপড়ে ওড়না দিয়ে মুখ, বুক ও নিতম্ব ঢেকে রাখলে, তাতে কোনো দোষ নেই। এক কথায় পর্দা নারীদের ইজ্জত রক্ষা করে, সম্মান বৃদ্ধি করে, দুষ্ট লোকের নজর থেকে বাঁচায়। যারা বলে পর্দা নারী প্রগতির অন্তরায়, পর্দার কথা বলে তাদেরকে অন্তঃপুরে বাদী দাসী করে রাখতে চায়, তারা মুসলমান নামের অযোগ্য। নারীদের পর্দা করার জন্য আল্লাহ কুরআন পাকে বলিয়াছেন, “তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতা পুত্র, ভগ্নিপুত্র, সেবিকা যারা তাদের অধিকারভুক্ত অনুগত, যৌন কামনা রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকটে তাদের আবরণ প্রকাশ না করে এবং তারা যেন তাদের গোপন আবরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে।”(২)
যারা প্রগতির কথা বলে মেয়েদেরকে পর্দা ভাঙতে বলে, তারা নারীদের সৌন্দর্য ও রূপ যৌবন উপভোগ করার জন্য বলে। যারা আল্লাহর কুরআনের বিরোধীতা করে তারা ফাসেক। “আর ফাসেকদের স্থান জাহান্নাম।” এটাও কুরআন পাকের কথা। পর্দা করে মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারবে, প্রয়োজনে চাকরিও করতে পারবে। আগের যুগে এমন অনেক মহিয়সী নারী ছিলেন, তারা পর্দা করে সবকিছু করেছেন। বর্তমান যুগেও এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। এ ব্যাপারে আর বেশি কিছু বলব না। জ্ঞানীরা বলেছেন, “বুদ্ধিমানদের জন্য অল্পই যথেষ্ট।”
তাসনিম বলল, তোমার কথাগুলো খুব ভালো লাগল। আমার মনে হয়, প্রত্যেক বাবা মা যদি মেয়েদের এভাবে বোঝাতেন, তা হলে কোনো মেয়েই বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করত না।
তুমিও খুব ভালো কথা বলেছ; কিন্তু দুঃখের ব্যাপার কী জান? আজকাল মা-বাবারাই মেয়েদের বেপর্দায় চলার ইন্ধন যোগাচ্ছে। মেয়েরা বেপর্দায় চলার ও নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে প্রতিদিন কত হাজার হাজার মেয়ে লাঞ্ছিতা ও ধর্ষিতা হচ্ছে। তবু ঐসব মা-বাবারা জেনেও আল্লাহর হুকুম মানছে না। এবার এসব কথা থাক বলে আব্দুস সাত্তার চুপ করে গেল।
তাসনিম বলল, তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি।
আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, কেন নিজেকে তোমার কাছ থেকে দু’বছর আড়াল করে রেখেছিলাম, তাই জানতে চাচ্ছ, তাই না?
তাসনিমও মৃদু হেসে বলল, জ্বি।
এর দু’টো কারণ। প্রথম কারণ হল, প্রায় তিন বছর আগে তোমাকে প্রথম গ্রীন সুপার মার্কেটে দেখে মুগ্ধ হই। তারপর কিভাবে দ্বিতীয়বার দেখা হল, কিভাবে তার বায়োডাটা ও ফোন নাম্বার জোগাড় করল, বায়োডাটা জানার পর তার মনের অবস্থা এবং কিভাবে তার সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তার মন জয় করল, সবকিছু বলল।
আমার বায়োডাটা জেনে তুমি হতাশ হয়েছিলে কেন? আমি কী এতই দুর্লভ।
আসল কারণটা না বলে আব্দুস সাত্তার বলল, আমি এক অখ্যাত গ্রামের ছেলে। একজন মন্ত্রীর মেয়েকে পাওয়া কুঁড়ে ঘরে ছেড়া কাঁথায় শুয়ে স্বপ্নে রাজকন্যাকে বিয়ে করার মতো নয় কী?
তোমার কথা অবশ্য ঠিক; কিন্তু এটা বোধহয় জান না, এমন অনেক রাজকন্যা ছিল এবং এখনও অনেক ধনীর দুলালী আছে, যারা দীন হীন ছেলেকে ভালবেসে রাজপ্রাসাদ ছাড়তে এতটুকু দ্বিধা করে নি। তাদের মধ্যে যারা রাজপ্রাসাদ ছাড়ার সুযোগ পাই নি, তারা ভালবাসার পাত্রকে না পাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।
তোমার কথাও ঠিক; কিন্তু তারা দুজন দুজনকে গভীরভাবে ভালবাসত। আমার ক্ষেত্রে তো তাদের মতো ছিল না। আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসলেও তুমি গ্রাম্য একটা নগণ্য ছেলেকে ভালবাসবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহের ব্যাপার নয় কী? তাই তোমার বায়োডাটা জানার পর খুব মুষড়ে পড়লাম। দিন দিন। আমার শরীর ভাঙতে লাগল। ফুফু আম্মা আমার অবস্থা দেখে একদিন বললেন, রাত জেগে পড়ে পড়ে তোর শরীর ভেঙে যাচ্ছে। কয়েকদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে আয়। আমিও ভাবলাম, গ্রামের পরিবেশ হয়তো আমাকে কিছুটা শান্তি দিতে। পারবে এবং তোমার স্মৃতিও ভুলিয়ে দিতে পারবে। যদি তাই হয়, তা হলে আর ঢাকায় ফিরব না। এইসব ভেবে বাড়িতে গেলাম। আমাকে দেখে আম্মা বললেন, তোর অবস্থা একি হয়েছে? নিশ্চয় কোনো কঠিন অসুখ বাধিয়েছিস? বললাম, রাত জেগে পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি। কয়েকদিন তোমার আদর পেলে ঠিক হয়ে যাব। বেশ কিছুদিন থাকলাম। শরীরের কিছু উন্নতি হলেও তোমার স্মৃতি অক্টোপাসের মতো আমার মনকে জড়িয়েই রইল। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য মন পাগল হয়ে। উঠল। ঢাকায় ফিরে এসে বন্ধু আসিফকে সবকিছু বললাম, ও তোমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য জোরালো যুক্তি দেখাল। ওর যুক্তিগুলো ভালো ছিল। তাই প্রতিবাদ করি নি। কিন্তু মন কিছুতেই বাগ মানল না। এক মুহূর্তের জন্য তোমাকে ভুলতে পারলাম না। একদিন রাত দশটার সময় তোমার কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ তোমাকে ফোন করার প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করলাম। আসিফ এর বোনের কাছ। থেকে তোমার বায়োডাটা জানার সময় ফোন নাম্বারও জেনেছিলাম। অনেক আগে জেনে থাকলেও মেধার কারণে মনে ছিল। তোমার আব্ব ফোন ধরলে কি বলবে ভেবে বেশ ভয় ভয় করলেও তখনই ফোন করি। আজও করে চলেছি। কবে যে শেষ হবে অথবা আদৌ শেষ হবে কিনা তা আল্লাহ জানেন। তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, একতরফা ভালবাসার যে কি যন্ত্রণা, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না।
তার কথা শুনতে শুনতে তাসনিমার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠেছিল। শেষের দিকে কথা ও দীর্ঘনিশ্বাস তাসনিমার কলজেটাকে কেউ যেন ছুরি দিয়ে চিরে। দিল। চোখ মুছে করুণকণ্ঠে বলল, প্লীজ, আমার জন্যে আর এতটুকু দুশ্চিন্তা করো না। একটু আগে কথা দিয়েছি, কোনো কারণেই তোমাকে দূরে ঠেলে দেব না। এখন আবার বলছি, তোমার জন্য সবকিছু ত্যাগ করব, তবু তোমাকে ত্যাগ করব না। শুধু মন্ত্রীর মেয়ে নয়, যদি প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে অথবা কোনো রাজা বাদশার মেয়েও হতাম, তবু এই কথা বলতাম।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আব্দুস সাত্তার বলল, তোমার কথা শুনে এত শান্তি পেলাম, যা তিন বছরের দুঃখ ও যন্ত্রণা সর্ষে পরিমাণ মনে হচ্ছে। আর কী মনে হচ্ছে জান, সারা পৃথিবীর বাদশাহী পেয়েও বুঝি এত সুখ অনুভব করতাম না। তারপর বলল, কেউ কাউকে আনন্দের বা সুখের খবর শোনালে তাকে পুরস্কার দেয়। এখন আমারও তোমাকে কিছু দিতে মন চাইছে। চল মার্কেটে যাই।
তাসনিম আনন্দ বিহ্বল কণ্ঠে বলল, কাল দিলে হয় না?
না তাসনিম না, আজই কিছু না দিলে মনে শান্তি পাব না। এমন সময় সংসদ ভবন চত্বরে যে ছেলে তিনটি রূপা ও সায়মাকে টিজ করেছিল, তাদের আসতে দেখে তাসনিম ভয়ার্ত গলায় বলল, সেদিনের মতো আজ আবার কিছু করবে না তো?
আব্দুস সাত্তার বলল, মনে হচ্ছে তুমি ভয় পেয়েছ? ওদের লীডারকে আমি চিনি। মনে হয় কিছু করবে না। তবু যদি করে, তা হলে উপযুক্ত জওয়াব পাবে। চল ওঠা যাক বলে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাসনিম দাঁড়াবার পর দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে গেটের দিকে আসতে লাগল।
ওদের সামনা-সামনি এসে আব্দুস সাত্তার সালাম দিয়ে বলল, আপনারা ভালো আছেন ভাই?
সবার আগে মহসিন সালামের উত্তর দিয়ে বলল, জ্বি, ভালো। তারপর বলল, সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি খুব লজ্জিত ও দুঃখিত। প্লীজ, মাফ করে দিন।
আব্দুস সাত্তার তাদের সবার সঙ্গে হাত মুসাফাহা করে বলল, মাফ চাওয়ার দরকার নেই। আপনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন জেনে খুব খুশী হয়েছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভুল বোঝার ও সঠিক পথে চলার তওফিক দিক।
আর একটু দাঁড়ান সাত্তার ভাই, ওঁর কাছেও মাফ চাইব। সেদিন যদি ওঁর পরিচয় জানতাম তা হলে…….। কথাটা আর শেষ করতে না পেরে মুখ নিচু করে। নিল।
তাসনিম বুঝতে পারল, সে যে মন্ত্রীর মেয়ে ছেলেটা জেনে গেছে। বলল, আমাদের দু’বোনের সঙ্গে যা কিছু করেছেন, তাতে কিছু মনে করি নি। আব্দুস সাত্তার সাহেবকে গুলি করার পর আপনাকে খুব খারাপ ছেলে ভেবেছিলাম। এখন আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগল। আমিও দোয়া করছি, “আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তওফিক দিক।” তারপর আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, চল।
আব্দুস সাত্তার মহসীনকে জিজ্ঞেস করল, আপনি আমার পুরো নাম জানেন?
জানি, আব্দুস সাত্তার।
ভবিষ্যতে পুরো নাম ধরে বলবেন। তারপর কারণটা বুঝিয়ে দিয়ে সালাম বিনিময় করে তাসনিমকে বলল, চল।
গাড়ির কাছে এসে তাসনিম বলল, তুমি গাড়ি নিয়ে আস নি?
না, তুমি ফিরিয়ে দিলে নির্ঘাত এ্যাকসিডেন্ট করতাম, তাই গাড়ি নিয়ে আসি নি।
রোযা রাখার কথা শুনে তাসনিম তার প্রতি আব্দুস সাত্তারের ভালবাসার গভীরতা যতটা না অনুভব করেছিল, এখন গাড়ি নিয়ে না আসার কারণ শুনে আরো বেশি অনুভব করল। কোনো কথা বলতে পারল না। ছলছল চোখে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আব্দুস সাত্তার বলল, তুমি জান না তাসনিম, আমি তোমাকে কত ভালবাসি। তারপর নাও এবার গাড়িতে ওঠ দেখি বলে বলল, আমি কিন্তু ড্রাইভিং করব।
তাসনিম কিছু বলল না। চোখ মুছে গাড়ির চাবি তার হাতে দিল।
গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর বলল, পার্কের ঘটনাটা আমাকে খুব অবাক করেছে।
আব্দুস সাত্তার বলল, ছেলেটা হয়তো লীডারের কাছে তোমার পরিচয় পেয়েছে। আর আমাকে তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে দেখে ভেবেছে, আমি হয়তো তোমাদের কাছাকাছি একজন।
তাসনিম আব্দুস সাত্তারের ভালবাসার গভীরতার কথা চিন্তা করছিল। তাই আব্দুস সাত্তার যে নিজের পরিচয় এড়িয়ে গেল, তা বুঝতে পারল না।
বায়তুল মোকাররমে এসে আব্দুস সাত্তার গাড়ি পার্ক করে তাসনিমকে নিয়ে আমিন জুয়েলার্সে ঢুকল।
আব্দুস সাত্তারের ফুফা ও ফুফু আমিন জুয়েলার্সের বড় খদ্দের। স্বামী মারা। যাওয়ার পর রাইসা বেগম আব্দুস সাত্তারকে নিয়ে আসেন। তাই আব্দুস সাত্তারকে ম্যানেজার ও দোকানের অন্যান্য সবাই চেনে। একজন অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে ঢুকতে দেখে ম্যানেজার সালাম দিয়ে বলল, আসুন আসুন, অনেকদিন পরে এলেন, কেমন আছেন? আপনার ফুফুআম্মা ভালো আছেন?
আব্দুস সাত্তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে আমরা ভালো আছি। তা আপনারা কেমন আছেন?
জ্বি ভালো, বলে ম্যানেজার হাসিমুখে বললেন, সঙ্গে নিশ্চয় ভাবি? বিয়ের দাওয়াত না পেলেও আশা করি, অলিমার দাওয়াত পাব?
ম্যানেজারের কথা শুনে তাসনিমের মুখে কেউ যেন কয়েক মুঠো আবির মাখিয়ে দিল। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল।
তার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, আন্দাজে ঢিল ছোড়া উচিত নয় ভাই। ঢিলটা বেজায়গায় লেগে গেলে কী হত বলুন তো? অবশ্য কাছাকাছি পৌঁছেছে। শুনুন, আমি আপনাদের না জানিয়ে বিয়ে করব এটা ভাবলেন কী করে? আন্দাজে ঢিল মেরে শুধু শুধু এই বেচারীকে লজ্জা দিচ্ছেন। ওসব কথা বাদ দিয়ে ইনার বাম হাতের মধ্যমার মাপের একটা হীরের আংটি দিন। তৈরি না থাকলে আঙ্গুলের মাপটা নিন। দু’একদিনের মধ্যে তৈরি করে দেবেন।
ম্যানেজার বললেন, কয়েকটা তৈরি আছে দেখাচ্ছি, মাপ মতো হয় কিনা দেখুন। আশা করি পছন্দ হবে।
আংটি পছন্দ করে আব্দুস সাত্তার চেকে পেমেন্ট দিল।
ততক্ষণে কেক ও কো-কো এসে গেল। ম্যানেজার বললেন, নিন ভাই।
আব্দুস সাত্তার ইশারা করে তাসনিমকে খেতে বলল, সে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল।
আব্দুস সাত্তার ম্যানেজারকে বলল, মাফ করবেন, আমরা আজ কিছুই খেতে পারব না। অন্য দিন খাব বলে তাসনিমকে নিয়ে বেরিয়ে এল।
তাসনিম বুঝতে পারল, অখ্যাত পাড়াগাঁয়ের ছেলে বলে পরিচয় দিলেও আব্দুস সাত্তার খুব ধনী ঘরের ছেলে।
দোকান থেকে বেরিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, চল, তোমাকে কিছু খাওয়াই। সেই কোন সকালে নাস্তা খেয়েছিলে, নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। দোকানেও কিছু খেলে না?
তুমি রোযা রেখে রয়েছ, আর তোমার সামনে আমি খাব, এটা ভাবলে কী করে? যতই খিদে পাক, তোমার সঙ্গে থাকলে সারাদিন না খেয়ে থাকতে পারব। অন্য দিন আপত্তি করব না। আজ চল, ফেরা যাক। তারপর গাড়িতে উঠে বলল, এত দামি উপহার না দিলে কী হত না?
পার্কে কি বলেছিলাম মনে নেই বুঝি? তারপরও বলছি, আমি যদি সারা পৃথিবীর বাদশাহ হতাম, তা হলে এমন খুশীর দিনে বাদশাহীটাই তোমাকে উপহার দিয়ে দিতাম। তোমার বাম হাতটা দাও পরিয়ে দিই।
আব্দুস সাত্তার আংটি পরিয়ে দেওয়ার পর তাসনিম বলল, তোমার এই উপহার আমার কাছে বাদশাহী তক্তের চেয়ে লক্ষগুণ শ্রেষ্ঠ। আমারও মন চাচ্ছে, এই মুহূর্তে তোমাকে কিছু দেওয়ার; কিন্তু আমার কাছে যে কিছুই নেই। তারপর তার দু’টো। হাত ধরে চুমো খেয়ে গালে চেপে রেখে মুখের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল।
আব্দুস সাত্তার আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলল, তুমি যা দিলে, তার তুলনায় আমারটা অতি নগণ্য। তোমার প্রেমের এই প্রথম উপহার আমার কাছে লক্ষ কোটি টাকার উপহারের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। তারপর হাত দুটো টেনে। স্টিয়ারিং-এ হুইল ধরে বলল, চল, তোমাকে পৌঁছে দিই।
বাসার কিছুটা দূরে এসে গাড়ি থামাতে দেখে তাসনিম বলল, বাসা চেন মনে হচ্ছে, এখানে থামলে কেন?
আব্দুস সাত্তার গাড়ি থেকে নেমে বলল, এবার তুমি যাও।
তাসনিম অবাক হয়ে বলল, সে কী? আমাদের বাসায় যাবে না?
আজ নয়, অন্য দিন।
কেন? আজ গেলে কী হয়?
কিছু হয় না, তবু যেতে পারছি না। প্লীজ, জিদ করো না। তোমার কথা রাখতে পারলে খুব কষ্ট পাব।
না গেলে আমিও যে খুব কষ্ট পাব, সে কথা মনে হচ্ছে না?
হচ্ছে। তবু যেতে পারছি না। বললাম না, অন্য দিন যাব?
আজ না যাওয়ার কারণ নিশ্চয় আছে?
আছে বলেই তো যেতে পারছি না।
কারণটা বল।
এখন কারণটাও বলতে পারব না।
ভালো হবে না বলছি।
খারাপ হলেও আমি নিরুপায়।
তাসনিম আহত স্বরে বলল, ঠিক আছে, তুমি স্বেচ্ছায় না আসা পর্যন্ত আর কখনও আসার জন্য তোমাকে বলব না। এই কথা বলে গাড়ি ছেড়ে দিল।
আব্দুস সাত্তার তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। অদৃশ্য হয়ে যেতে একটা স্কুটার নিয়ে বাসায় ফিরল।
————–
(১) বর্ণনায় : হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) মিশকাত
(২) সূরা-নূর, ৩১নং আয়াত, পারা-১৮
০৫.
বাসায় ঢুকে তাসনিম চিন্তা করল, আংটিটা খুলে লুকিয়ে রাখাই ভালো। সায়মা দেখতে পেলে হাজার প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলবে।
সায়মা কলেজে গিয়েছিল। আড়াইটায় ফিরে তাসনিমকে বলল, এবার বল, কোথায় গিয়েছিলি।
এক বান্ধবীর বাসায় বলতে গিয়েও থেমে গেল। ভাবল, একটা মিথ্যে বললে, তাকে সাতটা মিথ্যে দিয়েও কভার দেওয়া যায় না। বলল, একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
সেই একজনটা কে? অত সকালে তার সঙ্গে দেখা করতেই বা গেলি কেন?
ওসব আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, বলা যাবে না।
কিন্তু তোর অনেক কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার আমাকে বলিস, এটাই বা বলবি না। কেন?
অনেক কিছু বললেও এটা বলা যাবে না।
সায়মা ক্রমশঃ রেগে যাচ্ছিল। তবু সংযত হয়ে বলল, কিন্তু যাওয়ার সময় তো বলেছিলি, ফিরে এসে বলবি?
হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
বেশি রেগে গেলে সায়মা কেঁদে ফেলে। এখনও তার কান্না পেল। বলল, ঠিক আছে, তোর কোনো ব্যাপারেই আমি আর কোনো দিন নাক গলাব না। কথা শেষ করে চলে যেতে লাগল।
তাসনিম তাকে কাঁদাবার জন্য এতক্ষণ ঘটনাটা বলে নি। কান্নাভেজা কণ্ঠ শুনে বলল, রাগ করে চলে যাচ্ছিস কেন? শোন।
সায়মা দাঁড়িয়ে পড়লেও ঘুরল না। বলল, কী বলবি বল।
বিকেলে কোথায় যেন নিয়ে যাবি বলেছিলি, নিয়ে যাবি তো? না আমার উপর রাগ করে নিয়ে যাবি না?
আপুর উপর রাগের চেয়ে অভিমানই বেশি হয়েছিল সায়মার। অভিমানের চোটে কান্না পাচ্ছিল। কিছু বলতে গেলে কেঁদে ফেলবে। তাই চুপ করে রইল।
রূপা তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, যেখানে নিয়ে যাবি বলেছিলি সেখানে যাওয়ার আর দরকার নেই। আমি সকালে আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তোকে বললে কলেজ কামাই করে যেতে চাইতিস। তাই বলি। নি। তোর অনুমান ঠিক, আসিফ সাহেবই আব্দুস সাত্তার। তোর কাছে হেরে গেলাম। একটু আগে যা বললাম, তোকে রাগাবার জন্য বলেছি।
সায়মা দ্রুত ঘুরে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি বলছিস আপু? ততক্ষণে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
তাসনিম তাকে পাশে বসিয়ে চোখ মুছে দিতে দিতে বলল, হারে সত্যি। এত সামান্য ব্যাপারে আমার উপর রাগ অভিমান করে কেঁদে ফেললি, বিয়ের পর যখন আমি শ্বশুরবাড়ি চলে যাব তখন কার উপর রাগ অভিমান করবি?
সেজেগুজে বেরোতে দেখেই বুঝেছিলাম, তুই আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস। আজ তোদের প্রথম সাক্ষাৎ, যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে জিদ করি নি। নচেৎ তোর নিষেধ অমান্য করে যেতাম। জিজ্ঞেস করল, ওঁকে নিশ্চয় তোর পছন্দ হয়েছে?
তোর কী মনে হয়?
একশ পার্সেন্ট হয়েছে। তারপর হেসে উঠে বলল, এই আপু বল না, তোর কত পার্সেন্ট হয়েছে?
আমারও একশ পার্সেন্ট হয়েছে বলে তাসনিম লজ্জা পেয়ে বলল, যা ভাগ। বড় বোনের এসব কথা জিজ্ঞেস করতে তোর লজ্জা করল না?
আহা আমার বড় রে? দু’আড়াই বছরের বড় আবার বড়? তা ছাড়া বড় বোন। হয়ে ছোট বোনের কাছে এসব কথা বলতে তোর যখন লজ্জা করে নি তখন আমার করবে কেন?
তুই দিন দিন বড় ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। খেয়েছিস? নামায পড়েছিস? না ওসব না করেই আমার সঙ্গে ফাজলামী করতে এসেছিস?
ওসব সেরেই তোমার কাছে এসেছি। এই আপু, আসিফ সাহেব নিজেই আব্দুস সাত্তার হয়ে ধরা দিলেন? না তুই কথার প্যাচে ফেলে ধরা দিতে বাধ্য করেছিস?
ও নিজেই ধরা দিল।
ওরে বাবা, প্রথম সাক্ষাতেই তুমি?
তাসনিম হেসে উঠে বলল, সাক্ষাৎ প্রথম হলেও সম্পর্কটা তো প্রায় দু’বছরের।
তা কি সব কথাবার্তা হল, একটু বল না শুনি।
আমার ডাক নাম রূপা বাদ দিতে বলেছে। তার বদলে তাসনিম দিয়েছে এবং আজ থেকে বাসার সবাই যেন তাসনিম নামে ডাকে, সে কথাও বলেছে।
ওমা, তাই নাকি? আর কি কি বলেছেন, বল না আপু?
দেব এক থাপ্পড়, যা এখান থেকে।
সায়মা একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি কি সব শুনতে চাচ্ছি? একটু আধটু বললে কী হয়? ভবিষ্যতে আমারও কাজে লাগতে পারে।
তবে রে দাঁড়া তোর ফাজলামী বের করছি বলে তাকে তাসনিম হাত বাড়িয়ে। ধরতে গেল।
সায়মা ছুটে পালাবার সময় বলল, আবার যেদিন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবি, সেদিন না নিয়ে গেলে আব্রু আম্মুকে বলব, তুই একটা বাজে ছেলের প্রেমে পড়েছিস।
তাসনিম তার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগল।
.
রাত বারটার সময় সায়মা ঘুমাতে এসে আপুকে বই পড়তে দেখে জিজ্ঞেস করল, ঘুমাবি, না আরো পড়বি?
তাসনিম টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বলল, তুই বড় লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়, বইটা শেষ করে ঘুমাব।
সায়মা জানে আপু আব্দুস সাত্তারের ফোনের অপেক্ষায় প্রতিদিন রাত সাড়ে বারটা একটা পর্যন্ত জেগে বই পড়ে। সে কথা বললে বকা খেতে হবে ভেবে শুধু একটু মৃদু হেসে ঘুমিয়ে পড়ল।
পড়তে পড়তে হঠাৎ তাসনিমের মনে হল, রিং বাজলে সায়মা জেগে যেতে পারে। তাই বারটা বিশে সে আব্দুস সাত্তারকে ফোন করল।
আব্দুস সাত্তার আজ সাড়ে দশটার সময় ফোন করতে চেয়েছিল, সায়মা জেগে আছে ভেবে করে নি। সাড়ে বারটা বাজার অপেক্ষায় সেও একটা বই পড়ছিল। ফোন বেজে উঠতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল, এ সময় আবার কে ফোন করল? বিরক্ত হয়ে রিসিভার তুলে সালাম দেওয়ার আগেই তাসনিমকে সালাম দিতে শুনে বিরক্ত ভাবটা কেটে গেল। উৎফুল্ল কণ্ঠে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কী ব্যাপার? আজ সময়ের আগেই তুমি ফোন করলে যে? আমি তো মনে করেছিলাম, তোমাদের বাসায় যাই নি বলে রাগ করে আমার ফোন রিসিভ করবে না।
রাগ অবশ্য ঠিকই করেছিলাম, তোমার প্রেম পানি ঢেলে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে।
শুনে খুশী হলাম।
আমিও খুশী হয়েছি।
তোমার খুশীর কারণটা তো বুঝলাম না।
বারে, তোমার খুশীতে আমি খুশী হব না?
সত্যি, তোমার কোনো জওয়াব নেই।
তোমারও কোনো জওয়াব নেই।
লা জওয়াবের মতো আমি কিছু করেছি কী?
একটা গ্রাম্য ছেলে হয়ে একজন মন্ত্রীর মেয়েকে প্রেমের বানে ঘায়েল করা কম কৃতিত্বের কথা নয়।
এই কথার উত্তর দিতে না পেরে আব্দুস সাত্তার চুপ করে রইল।
কিছু বলছ না যে?
প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য আব্দুস সাত্তার বলল, আমার আগেই তুমি ফোন করলে কেন বলবে না?
কিছুক্ষণ আগে সায়মা ঘুমিয়েছে। ভাবলাম, রিং হলে জেগে যাবে। তাই করলাম। কী করছিলে?
একসঙ্গে দু’টো কাজ করছিলাম।
তাসনিম হেসে উঠে বলল, একসঙ্গে আবার দু’টো কাজ করা যায় বুঝি?
তা জানি না। তবে আমি বই পড়ছিলাম আর তোমাকে ফোন করব বলে মাঝে মাঝে ঘড়িতে সময় দেখছিলাম।
তাসনিম হাসতে হাসতেই বলল, এটা আবার দু’টো কাজ হল বুঝি? বোকার মতো কথা বলছ কেন?
প্রেমে পড়লে সবারই বুদ্ধি লোপ পায়, তাই বোকামী করে। তুমিও কর।
ওমা, আমি আবার কি বোকামী করলাম?
আমি তোমার প্রেমে পড়ে তোমাদের সব খবর নিয়েছি। কিন্তু তুমি আমার কিছুই নাও নি। বুদ্ধিমতী মেয়েরা প্রেমিকের সঙ্গে প্রথম আলাপের সময়েই তার সবকিছু জেনে নেয়।
কথাটা ঠিক বল নি। অনেক আগেই জানতে চেয়েছি, তুমি বল নি। আজ অবশ্য বাসা থেকে বেরোবার সময় তোমার সবকিছু জানার কথা ভেবেছিলাম, তোমার কথা শুনতে শুনতে ভুলে গেছি। আর এজন্য দায়ী তোমার প্রেম। এখন তাড়াতাড়ি পূর্ণ বায়োডাটা বলে ফেল।
তাড়াতাড়ি কেন?
শুধু তোমার প্রেমে নয়, কথাতেও যাদু আছে। ফট করে এমন কথা বলবে, যা শুনে আমি আবার ভুলে যাব।
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, তাই নাকি?
জ্বি তাই। ফোনে তোমার কথার যাদুতেই তো প্রেমে পড়ে গেলাম।
আব্দুস সাত্তার হাসতে হাসতেই বলল, যাদু কি জিনিস জান?
দেখেছ? বায়োডাটা না বলে কেমন অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছ? যাদু সম্পর্কে কিছু জানি আর না জানি, তোমার জানার দরকার নেই। যা জানতে চেয়েছি বল।
আমি গ্রামের ছেলে তা তো আগেই বলেছি, আমার আব্বা গ্রামের বেসরকারী কলেজে শিক্ষকতা করেন। জমি-জায়গা, আগান-বাগান ও পুকুর ডোবা কিছু আছে। মোটামুটি স্বচ্ছল অবস্থা। আমরা তিন বোন, দুই ভাই। দু’বোন সবার বড়। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর একভাই। তিনি বিয়ে করার আগে মারা গেছেন। ঐ ভায়ের পরে আমি। আমার পরে উম্মে কুলসুম। ওর আকদ হয়েছে। আমার এখনো বিয়ে হয় নি। এতেই হবে? না আরো কিছু লাগবে?
তাসনিম হেসে উঠে বলল, বাবার নাম, গ্রামের নাম ও জেলার নাম লাগবে।
ওগুলো পরে বলব।
ওগুলো না হলে বায়োডাটা সম্পূর্ণ হয় না। আব্বকে জানাব কী করে?
যখন জানাবে তখন বলব।
তাসনিম আবার হেসে উঠে বলল, তুমি তো আচ্ছা পাগল। তখন তোমাকে পাব কোথায়?
কী বললে? আমি পাগল?
কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ বলে ফেলেছি। তাই বলে সত্যি সত্যি তুমি তো আর পাগল না।
তা হলে কথা প্রসঙ্গে আমিও তোমাকে পাগলি বলব?
আপত্তি নেই।
সায়মা নিশ্চিত ছিল, আব্দুস সাত্তার আজও ফোন করবেন। তাই আপু তার সঙ্গে কি কথা বলে শোনার জন্য এতক্ষণ ঘুমের ভান করে জেগে ছিল। এবার খাট থেকে নেমে নিঃশব্দে পিছন থেকে এসে তাসনিম বুঝে উঠার আগেই চিলের মতো ছোঁ মেরে তার হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে বলল, এই যে পাগল সাহেব, রাত কত হয়েছে খেয়াল করেছেন? পাগল পাগলির পাগলামীর কারণে অন্য একজনের যে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে, তাও খেয়াল নেই বুঝি? আর কোনো দিন এতক্ষণ ধরে পাগলামী করবেন না। মানুষে ঠিকই বলে, “পাগলরাই প্রেম করে।” রিসিভার রেখে দিন। নচেৎ আল্লুকে বলে প্রেম করার মজা বুঝিয়ে দেব।
সরি, তোমার, সরি আপনার ঘুম পাতলা জানলে এত দেরি করতাম না। ক্ষমা করে দিন।
বার বার সরি বলার দরকার নেই। আমাকে তুমি করেই বলবেন। রিসিভার রেখে দিন, তারপর ক্ষমা করার কথা চিন্তা করব।
রিসিভার রেখে দিলে তো তোমার আপু কষ্ট পাবে। তুমি বরং রিসিভারটা ওকে দাও। ও রাখতে বললে রেখে দেব।
মাত্র একবার দেখেই আপুর জন্য দরদ যে উথলে উঠছে দেখছি। বিয়ের কিছুদিন পর তো স্বামীরা বৌ এর সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে?
পুরুষরা কোমর বেঁধে ঝগড়া করে না, করে মেয়েরা। আমার মরহুম দাদাজী বলতেন, “বিয়ের প্রথম বছর স্বামী কথা বলে স্ত্রী শোনে। দ্বিতীয় বছর স্ত্রী বলে স্বামী। শোনে। আর তৃতীয় বছর থেকে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বলে পাড়া-পড়শী শোনে।” আমার মনে হয় দাদাজী ঠিক কথাই বলেছেন। কারণ এক হাতে তালি বাজে না।
আপনার দাদাজীর বচন শোনার ধৈর্য আপুর থাকলেও আমার নেই।
তা হলে আর কষ্ট করছ কেন? রিসিভারটা তোমার আপুকে দিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।
আচ্ছা বাচাল ছেলে তো? আপনার কী ভদ্ৰতা জ্ঞান নেই?
যথেষ্ট ছিল, তুমিই সব খরচ করে দিচ্ছ।
সামনে পেলে বাচালতা ছাড়িয়ে দিতাম।
ঠিকানা তো জান, ড্রাইভারকে বল, পৌঁছে দিতে।
সায়মা বুঝতে পারল, কথায় ওঁকে হারাতে পারবে না। বলল, বকমবাজরাই বেশি কথা বলে।
তুমি কিন্তু আমার চেয়ে বেশি কথা বলছ।
উঁহ, কী সাংঘাতিক ছেলে রে বাবা, বলে তাসনিমার হাতে রিসিভার দিয়ে বলল, তোর পাগলকে তুই সামলা। আমার ঘুম পাচ্ছে। তারপর বেড়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
গভীর নিঝুম রাত। তাই আব্দুস সাত্তারের কথাগুলোও তাসনিম শুনতে পেয়েছে। রিসিভার কানের কাছে নিয়ে বলল, সায়মার কথায় কিছু মনে কর নি তো? ও কিন্তু তোমার সঙ্গে দুষ্টুমী করেছে। আমার সঙ্গেও প্রায়ই করে।
আব্দুস সাত্তার বলল, তা কি আর আমি বুঝি না। শোন, আর দেরি করা উচিত হচ্ছে না। এবার রাখি কেমন?
কাল ফোন করবে তো?
তাতো করবই।
ঠিক আছে রাখছি বলে তাসনিম সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
সায়মা বলল, কোনো জিনিস বাড়াবাড়ি ভালো না। তোরা কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছিস।
হয়েছে, তোকে আর পাকামী করতে হবে না, ঘুমিয়ে পড়।
.
পরের দিন ফোনের অপেক্ষায় তাসনিম রাত দুটো পর্যন্ত জেগে রইল। সাড়ে বারটায় ফোন না আসায় দশ মিনিট অপেক্ষা করে বেশ কয়েকবার সে ফোন করেছে। রিং বাজার শব্দ না হয়ে শুধু ঘড় ঘড় শব্দ হয়েছে। তাতেই বুঝেছে ফোন খারাপ। তবু দু’টো পর্যন্ত জেগে থেকে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে নাস্তা খেয়ে তাসনিম আবার ফোন করল আব্দুস সাত্তারের বাসায়। রাতের মতো একই শব্দ শুনে। নিশ্চিত হল ফোন খারাপ। ভাবল, আজ নিশ্চয় ফোন সারাবার ব্যবস্থা করবে অথবা অন্য কোথাও থেকে ফোন করবে। কিন্তু তিন চার দিন পার হয়ে যেতেও যখন ফোন এল না তখন বেশ চিন্তিত হল।
এই ক’দিন সায়মা আপুর অস্থিরতা লক্ষ্য করেও কিছু বলে নি। আজ কলেজ থেকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আপু, তোর মন খারাপ কেন বলবি?
তাসনিম বলল, মানুষের মন সব সময় ভালো থাকে না, মাঝে মাঝে খারাপও থাকে।
তা আমিও জানি। আর মন খারাপের পিছনে যে কারণ থাকে, তাও জানি। তোর মন খারাপের কারণটা জানতে চাচ্ছি। আব্দুস সাত্তার সাহেবের সঙ্গে কিছু। হয়েছে নাকি?
কী আবার হবে? এমনিই মন খারাপ।
আমি তোর মুখ দেখে বুঝতে পারছি কিছু হয়েছে। কি হয়েছে বল, সম্ভব হলে সমাধান করে দেব।
তাসনিম জানে, সায়মার হাত থেকে সহজে নিস্তার পাওয়া যাবে না। বলল, প্রত্যেক দিন ফোন করার কথা থাকলেও আজ চার পাঁচ দিন করে নি।
সায়মা হেসে উঠে বলল, ও এই কথা। কোনো কারণে হয়তো করতে পারে নি। এতে মন খারাপের কী হল?
ও তুই বুঝবি না।
তা ফোন না করার কারণ কিছু বুঝতে পারলি?
না।
তুই ফোন করিস নি?
করেছি, রিং হয় নি। মনে হয় ফোন খারাপ।
ওর বাসায় গিয়ে খোঁজ নিতে পারতিস?
বাসার ঠিকানা জানি না।
আমি জানি।
সত্যি বলছিস?
হ্যাঁ সত্যি।
কীভাবে জানলি?
কিভাবে জেনেছিল সায়মা বলল।
ওমা, তাই নাকি? তুই তো খুব চাপা?
জানার পরের দিন তোকে ওঁদের বাসায় নিয়ে গিয়ে আসিফ সাহেবই যে আব্দুস সাত্তার প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। তুই তো সকালে তার সঙ্গে দেখা করে এলি। তাই কথাটা বলি নি।
তৈরি হয়ে নে, এক্ষুনি যাব।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ, এসময় কেউ কারো বাসায় যায়? আসরের নামায পড়ে যাব।
.
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তাসনিম ও সায়মা ঠিকানা মতো একটা বেশ বড় গেটের কাছে এল। গেট বন্ধ দেখে তাসনিম ড্রাইভারকে হর্ণ বাজাতে বলল।
একটু পরে একজন খাকী পোশাক পরা যুবক গেট খুলে দিলে ড্রাইভার গাড়ি ভিতরে ঢুকিয়ে একসাইডে পার্ক করল।
তাসনিম ও সায়মা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি দেখে অবাক। এ্যাপার্টমেন্ট আকারে সাততলা বাড়ি। নিচতলাটা প্রায় সবটাই গ্যারেজ। বেশ কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা। গেট থেকে ঢুকে অনেকখানি প্রশস্ত জায়গা। এক পাশে ছোটখাট একটা মসজিদ। মসজিদের দক্ষিণ দিকে দুটো পাকা রুম। উত্তর দিকে ছোট একটা। দোতলা বাড়ি।
খাকি পোশাক পরা যুবকটা এগিয়ে এসে বলল, আপনারা কোন ফ্লাটে যাবেন?
তাসনিম বলল, আপনি নিশ্চয় দারোয়ান?
জ্বি, টয়লেটে গিয়েছিলাম। গেট খুলতে তাই একটু দেরি হয়ে গেছে।
ঠিক আছে, আমরা আব্দুস সাত্তার সাহেবের কাছে এসেছি। উনি কোন ফ্লাটে থাকেন বলেন নি।
দারোয়ান চিন্তিত মুখে বলল, এখানে তিনজন আব্দুস সাত্তার আছেন, কার কাছে এসেছেন বুঝব কী করে? এই বাড়ির মালিকের নামও আব্দুস সাত্তার।
আমরা বাড়ির মালিকের কাছে এসেছি। কোন ফ্লাটে থাকেন বলুন।
ওরা ফ্লাটে থাকেন না। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ যে মসজিদের উত্তর দিকে দোতলা বাড়িটা দেখছেন, ওখানে থাকেন? কিন্তু ওঁরা তো কেউ বাসায় নেই।
কোথায় গেছেন?
দারোয়ান মনে মনে হিসাব করে বলল, চারদিন হল সবাই দেশের বাড়িতে গেছেন। শুধু একজন কাজের বুয়া আছে।
তাসনিম বুঝতে পারল, যেদিন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার পরের দিন গেছেন। জিজ্ঞেস করল, কবে ফিরবেন জানেন?
না। তবে কাজের বুয়া হয়তো জানতে পারে। আসুন আমার সঙ্গে।
সাদামাটা অর্ডিনারী বাড়ি। নিচতলা ও উপরের তলায় গ্রীল দিয়ে ঘেরা বেশ। চওড়া বারান্দা। গ্রীলের ভিতরে চিক ফেলা।
গেটের কাছে এসে দারোয়ান কলিংবেলের বোতামে চাপ দিল।
একটু পরে একজন বয়স্কা মহিলা চিক সরিয়ে বলল, কে?
দারোয়ান ওদেরকে দেখিয়ে বলল, ইনারা সাহেবের কাছে এসেছেন। সবাই দেশে গেছেন শুনে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
জমিলা গেট খুলে দিয়ে ওদেরকে ভিতরে আসতে বলল। তারপর তাদেরকে ড্রইংরুমে নিয়ে এসে বসতে বলে বেরিয়ে গেল।
তাসনিম ও সায়মা রুমের পরিবেশ দেখে খুব অবাক হল। সব আসবাবপত্র অর্ডিনারী। মেঝের কার্পেট, দরজা জানালার পর্দাও তাই। একপাশে বই ভর্তি একটা আলমারী। কোনো কিছুতে এতটুকু আভিজাত্যের ছাপ নেই।
তাসনিম চিন্তা করতে লাগল, যে এতবড় এ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির মালিক, যে প্রথম সাক্ষাতের দিন প্রেমিকাকে হীরের আংটি উপহার দিতে পারে, তার বাড়ির পরিবেশ এত সাধারণ, প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্বাস হত না।
সায়মাও যেন বিশ্বাস করতে পারল না। বলল, এই আপু, কিছু অনুমান করতে পারছিস?
তাসনিম বলল, কী অনুমান করব?
এমন সময় জমিলা ট্রেতে করে কেক, বিস্কুট ও দু’কাপ কফি নিয়ে এসে বলল, সাহেবদের কেউ নেই, যা ছিল নিয়ে এসেছি।
তাসনিম বলল, এসব আনতে গেলেন কেন? আমরা দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করেই চলে যাব।
তাতে কী হয়েছে? মেহমানকে যত্ন করা সওয়াবের কাজ।
দু’বোন কেক বিস্কুট না খেয়ে শুধু কফি খেল। তারপর তাসনিম জিজ্ঞেস করল, সাহেবরা কবে ফিরবেন জানেন?
জমিলা বলল, না।
তা হঠাৎ সবাই দেশে গেলেন কেন?
হঠাৎ হবে কেন? অনেক আগে সাহেবের আকদ হয়েছিল, এবার বৌ ওঠাবে। তাই সবাই দেশে গেছে।
দু’বোন চমকে উঠে একে অপরের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাসনিমের মনে হল, কেউ যেন তাকে হিমালয়ের চূড়া থেকে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
জমিলা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সাহেবের বিয়ের কথা শুনে খুশী হয় নি। বলল, এই দেখুন, আসল কথাটাই ভুলে গেছি, আপনাদের পরিচয় নেওয়া হয় নি। কেন এসেছেন তাও জানা হয় নি।
তাসনিম বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে সায়মার দিকে তখনও তাকিয়েছিল। তার কানে জমিলার কথা গেল না।
সায়মা তা বুঝতে পেরে জমিলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা দু’বোন। আমি ছোট। আপনাদের সাহেবের সঙ্গে খুব জানাশোনা। উনি আসতে বলেছিলেন। আচ্ছা, সাহেবের দেশের বাড়ি কোথায়?
নিলফামারী।
সায়মাদের দেশের বাড়িও নিলফামারী। তাই বেশ অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ওঁর আব্বার নাম জানেন?
তা আর জানব না। আমার বাড়িও তো ওখানে। হাজী আব্দুল হামিদকে গেরামের সবাই চেনে। আশপাশের গেরামের লোকেরাও চেনে। ওনার মতো বড়লোক দশ পাঁচটা গেরামে কেউ নেই। কত যে জমি-জায়গা তা কেউ বলতে পারে না। খুব ভালো মানুষ। গরিবের মা বাপ, গেরামের উন্নতির জন্য মাদ্রাসা, স্কুল, হাসপাতাল নিজের টাকায় করে দিয়েছেন।
আব্দুস সাত্তারের বাবার সুখ্যাতি শুনে সায়মা বিরক্ত বোধ করে বলল, তা বাসায় কেউ যখন নেই, এবার আমরা আসি। তারপর তাসনিমের দিকে তাকিয়ে বলল, আপু চল।
তাসনিম মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে এখনও স্তব্ধ হয়ে মুক ও বধিরের মতো বসেছিল। সায়মার কথাও তার কানে গেল না।
সায়মা তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে উঠে আপুর একটা হাত ধরে টান দিয়ে বলল, এই আপু, বাসায় চল।
তাসনিম এবার সম্বিত ফিরে পেয়ে ধীরে ধীরে তার সঙ্গে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল।
সায়মা ড্রাইভারকে বলল, বাসায় চলুন।
পথে কেউ কোনো কথা বলল না। বাসায় পৌঁছে সায়মা গাড়ি থেকে নামল; কিন্তু তাসনিম বসে রইল।
সায়মা বলল, এই আপু, নামবি তো।
তাসনিমের কোনো সাড়া নেই, বসেই রইল।
সায়মা তার একটা হাত ধরে টেনে নামিয়ে রুমে নিয়ে এসে বসিয়ে দিল।
তাসনিম তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
সায়মার মনে হল, আব্দুস সাত্তার সাহেবের বিয়ের কথা শুনে আপু এবনরম্যাল হয়ে পড়েছে। আতঙ্কিত স্বরে বলল, আপু তুই ওভাবে আমার দিকে। তাকিয়ে আছিস কেন? কোনো কথাই বা বলছিস না কেন?
তাসনিমের ঠোঁট দুটো শুধু একটু কেঁপে উঠল আর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
সায়মার ধারণা হল, মনে আঘাত পেয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আপু, তুই চুপ করে আছিস কেন? কথা বলবি তো? একটু পরে তাকে ফুলে ফুলে কাঁদতে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেয়ে বলল, একটা কাজের বুয়া কি বলতে কি বলেছে, আর তাতেই তুই আব্দুস সাত্তার সাহেবকে অবিশ্বাস করে ফেললি? তুই-ই তো বলেছিলি, “হাদিসে আছে, প্রমাণ না নিয়ে শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই,” আরো জোরে ফুলে ফুলে কাঁদতে দেখে চুপ করে গেল। কাদলে মানুষের অনেকটা হালকা হয়। তাই সায়মা তাকে কিছুক্ষণ সময় দিল। তারপর যখন বুঝতে পারল, কান্নার বেগ কমেছে তখন। তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তুই আমার থেকে বেশি কুরআন হাদিস পড়িস, আর এটা জানিস না, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) মানুষকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন? আমার মন বলছে, আব্দুস সাত্তার সাহেব তোর সঙ্গে কিছুতেই বেঈমানী করতে পারেন না। বিয়ের ব্যাপারটা আমি একদম বিশ্বাস করতে পারছি না। তুই। বোধহয় ওদের কাজের বুয়ার সব কথা শুনিস নি। আমি তার কাছ থেকে জেনেছি, দেশের বাড়ি নিলফামারী, ওর বাবার নাম হাজী আব্দুল হামিদ। তিনি খুব ধনী লোক। আশপাশের গ্রামের সবাই তাকে চেনে। আমাদের দেশের বাড়িও নিলফামারী। আলু নিশ্চয় ওদেরকে চেনে। আব্বুকে সবকিছু জানালে কেমন হয়?
তাসনিম চোখ মুখ মুছতে মুছতে বলল, আব্বকে কোন মুখে এসব কথা জানাব? হাদিসে পড়েছি, “আল্লাহ যার সঙ্গে জোড়া করে পয়দা করেছেন, তার সঙ্গে বিয়ে হয়।” কাজের বুয়ার কথা সত্য হোক, আর মিথ্যে হোক, আমি হাদিসের বাণী মোতাবেক ধৈর্য ধরব। দেখব, আল্লাহ কার সঙ্গে আমাকে জোড়া করে পয়দা করেছেন।
সায়মা খুশী হয়ে বলল, দোয়া করি, আল্লাহ তোকে ধৈর্য ধরার তওফিক দিক।
০৬.
সায়মা ফাইন্যাল পরীক্ষা নিয়ে দু’মাস ব্যস্ত রইল। এরমধ্যে একদিনও আপুকে আব্দুস সাত্তারের ব্যাপারে কোনো কথা বলে নি। গতকাল পরীক্ষা শেষ হলেও রাতে তাকে কিছু বলে নি। আজ সকালে নাস্তা খাওয়ার পর বলল, তুই কী আব্দুস সাত্তার সাহেবের কোনো খোঁজ টোজ নিয়েছিলি?
তাসনিম খুব রাগের সঙ্গে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, না।
তুই রেগে যাচ্ছিস কেন আপু? সত্যিই তিনি বিয়ে করেছেন কিনা জানা উচিত ছিল তোর।
দেখ ওর সম্পর্কে আর একটা কথা বলবি না।
তুই ভুল করছিস আপু, বাসার কাজের বুয়ার কথাকে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা তোর ঠিক হয় নি।
তাসনিম আরো রেগে উঠে বলল, কথাটা যদি সত্য না হবে, তা হলে ওই বা এতদিন ফোন করে নি কেন?
ফোন না করার হয়তো কারণ থাকতে পারে।
তাসনিম বিদ্রুপকণ্ঠে বলল, ফোন না করার যে কারণ থাকতে পারে, তা তো। জানি না। আগে তুই তাকে ফ্রড বলতিস, এখন তার ফরে কেন কথা বলছিস বুঝতে পারছি না। আমার তো মনে হচ্ছে, সে সত্যিই একটা ফ্রড। বড়লোকের ছেলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। আমার মতো কতো মেয়ের সঙ্গে যে প্রেম করে। বেড়ায়, তার কোনো ঠিক আছে? ওদের মতো ছেলে অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলেও বিয়ে করে মা বাবার পছন্দ মতো মেয়েকে।
সায়মা চিন্তা করল, বেশি কিছু বললে, আপু আরো রেগে যাবে। তার চেয়ে সে গোপনে আব্দুস সাত্তারের খোঁজ খবর নেবে।
দুপুরে খেয়ে এসে রেষ্ট নেওয়ার সময় সায়মা ভাবল, আপু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ড্রইংরুম থেকে আব্দুস সাত্তারের বাসায় ফোন করবে। তাই ঘুমের ভান করে। অনেকক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর আপু ঘুমিয়ে গেছে বুঝতে পেরে খাট থেকে নেমে। দরজার বাইরে এসেছে, এমন সময় ফোন বেজে উঠতে ফিরে আসতে লাগল।
সায়মা আসার আগেই তাসনিমের ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়িয়ে রিসিভার কানের কাছে নিতে আব্দুস সাত্তারের গলা শুনতে পেল “আসসালামু আলায়কুম।”
তাসনিম ধড়ফড় করে উঠে বসল। তখন তার হার্টবিট অনেক বেড়ে গেল। সালামের উত্তর দিতে পারল না; রাগে ফুলতে লাগল।
কী হল তাসনিম? চুপ করে আছ কেন? জান না, হাদিসে আছে, “সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজীব?” না দিলে গুনাহ হবে। তা ছাড়া তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য পাগল হয়ে আছি। প্লীজ, কথা বল।
তাসনিম কর্কশ কণ্ঠে বলল, একজন প্রতারক, ছোটলোক, ইতরের মুখে হাদিসের পবিত্র বাণী শুনতে চাই না।
আব্দুস সাত্তার খুব আশ্চর্য হয়ে আহতকণ্ঠে বলল, এ তুমি কী বলছ তাসনিমঃ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
একজন ফ্রড ও বেঈমানের মুখে আমার নামও শুনতে চাই না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি বলে রিসিভার রেখে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
সায়মা এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়েছিল। বুঝতে পারল, আবদুস সাত্তার ফোন করেছেন। আপুর কথা শুনে সেও খুব আশ্চর্য হল। তাড়াড়াড়ি রিসিভার তুলে কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে যখন কোনো সাড়া পেল না তখন রিসিভার রেখে বলল, তার সম্পর্কে কিছু না জেনেই এসব কথা বলা তোর মোটেই উচিত হয়। নি।
কাঁদার জন্য তাসনিম কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তারপর সামলে নিয়ে ভিজে গলায় বলল, তুই আমার মনের অবস্থা যদি জানতিস, তা হলে উচিত অনুচিতের কথা বলতিস না। তুই এখান থেকে যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
সায়মা চুপচাপ বেরিয়ে এসে ড্রইংরুম থেকে আব্দুস সাত্তারের বাসায় ফোন করল। কিন্তু তাদের ফোন খারাপ, তাই রিং বাজল না। হঠাৎ সায়মার মাথায়। একটা বুদ্ধি এল। ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে তাকে কিছু ইনস্ট্রাকসান দিয়ে গাড়ি নিয়ে আব্দুস সাত্তারের বাসায় পাঠাল।
প্রায় এক ঘণ্টা পর ড্রাইভার ফিরে এসে বলল, তাকে দারোয়ান গেটের ভিতরে ঢুকতে দিলেও বাসায় যেতে দেয় নি। তার কাছে জেনেছে, প্রায় দু’মাস আগে সাহেব এ্যাকসিডেন্ট করে দেশের হাসপাতালে ছিলেন। একটা পা ভেঙে গেছে। সেখানে প্লাস্টার করে দিয়েছিল। ইনফেকসান হয়ে গেছে। তাই কাল ঢাকায় নিয়ে এসে ইবনেসিনা ক্লিনিকে কাল রাতেই অপারেশন করে আবার প্লস্টার করে দিয়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন, আর দু’চার দিন দেরি হলে পুরো পাটা কেটে বাদ দিতে হত। আজ দুপুরের দিকে জ্ঞান ফিরেছে। বাসার সবাই সেখানে আছে। তাই দারোয়ান বাসায় যেতে দেয় নি।
সায়মা বলল, সাহেব বিয়ে করেছেন কিনা জিজ্ঞেস করেন নি?
সাহেবের সম্পর্কে এইসব জানার পর বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না ভেবে করি নি।
সায়মা চিন্তা করল, বিয়ে করলে আব্দুস সাত্তার কিছুতেই আপুকে ফোন করতেন না। তার এ্যাকসিডেন্টের কথা আপুকে বললে বিশ্বাস তো করবেই না, বরং উল্টো পাল্টা অনেক প্রশ্ন করবে। তার চেয়ে তাকে নিয়ে ক্লিনিকে গেলেই সবকিছু জানা যাবে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ড্রাইভার বলল, আমি এবার যাই?
আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন। তারপর আসছি বলে সায়মা রুমে এসে দেখল, আপু আসরের নামায পড়ছে। সেও অজু করে এসে নামায পড়ল। তারপর তাসনিমকে বলল, তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে নে।
তাসনিম বলল, আমার মন খারাপ। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না, তুই যা।
বাসায় থাকলে আরো খারাপ লাগবে। বাইরে গেলে মন ভালো হয়ে যাবে। একা যেতে আমার ইচ্ছা করছে না। প্লীজ আপু, চল।
কোথায় যাবি?
আহা চল না। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে গেলেই তোর মন যে ভালো হয়ে যাবে, তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল, না গেলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব।
ঠিক আছে ছাড়, কাপড় পাল্টে নিই। তুইও পাল্টে নে।
.
গাড়ি ইবনেসিনা ক্লিনিকে ঢুকতে দেখে তাসনিম বলল, এখানে এলি কেন? রুগী দেখে তো মন আরো খারাপ হয়ে যাবে?
এমন অনেক রুগী থাকে, যাকে দেখলে খারাপ মন ভালো হয়ে যায়।
গাড়ি থামার পর সায়মা বলল, তুই নেমে একটু দাঁড়া, আমি এসে তোকে নিয়ে যাব। তারপর ইনকোয়ারী কাউন্টারে গিয়ে আব্দুস সাত্তারের কেবিন নম্বার জেনে ফিরে এসে বলল, চল।
গতকাল ঢাকায় এসেই আব্দুস সাত্তার তাসনিমকে ফোন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ডাক্তারদের পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যস্ততায় ও অপারেশনের কারণে তা সম্ভব হয়। নি। আজ দুপুরের দিকে জ্ঞান ফেরার পর উম্মে কুলসুমকে বলল, তুই তাসনিমদের বাসায় ডায়েল করে রিসিভারটা আমাকে দে।
এ্যাকসিডেন্ট করে জ্বরের ঘোরে আব্দুস সাত্তার যখন তাসনিমের নাম বলত তখন তার মা-বাবা ফুফু বুঝতে না পারলেও উম্মে কুলসুম বুঝেছিল। আজও। সবাই রয়েছেন। উম্মে কুলসুমকে তাসনিমদের বাসায় ফোন করার কথা বলতে সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
উম্মে কুলসুম না দেখার ভান করে ডায়েল করে রিসিভার ছোট ভাইয়ার হাতে দিল। তারপর কথা বলতে বলতে তার মুখ বিবর্ণ হতে ও হাত থেকে রিসিভার পড়ে যেতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলল, কী হল ছোট ভাইয়া? ততক্ষণে আব্দুস সাত্তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। উম্মে কুলসুম হাত ধরে নাড়া দিতে লাগল। তারপর সাড়া না পেয়ে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্যে ছুটল।
ডাক্তার এসে পালস ও হার্ট পরীক্ষা করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। কোনো কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে। জ্ঞান ফেরার পর আপনারা রুগীর সঙ্গে কথা বলবেন না। আর রুগীকেও কথা বলতে দেবেন না।
প্রায় আধঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে এলে আব্দুস সাত্তার মা ও ফুফুকে বলল, তোমরা আমার বুকে একটু হাত বুলিয়ে দাও তো।
উম্মে হাফসা ছেলের বুকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কাকে ফোন করেছিলি?
আব্দুস সাত্তার কিছু বলার আগে উম্মে কুলসুম বলল, আহ আম্মু, ডাক্তার। সবাইকে কথা বলতে নিষেধ করে গেলেন না? তোমাদেরকে আমি পরে বলব।
.
কেবিনের কাছে এসে সায়মা দাঁড়িয়ে পড়ল।
তাসনিম বলল, কী রে? দাঁড়ালি কেন?
সায়মা বলল, যাকে দেখতে এসেছি, তার সম্পর্কে তোর জানা দরকার। তারপর কিভাবে ড্রাইভারকে আব্দুস সাত্তারের বাসায় পাঠিয়ে তার এ্যাকসিডেন্টের কথা ও গতকাল ঢাকায় আসার পর অপারেশনের কথা জেনেছে, সে সব বলে বলল, ভিতরে হয়তো ওর সব আত্মীয়রা আছেন। প্লীজ আপু, অশোভনীয় কোনো সীন ক্রিয়েট করবি না।
তাসনিম খুব অবাক হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সায়মা একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে ভিতরে ঢুকল।
সবাইর অবাক দৃষ্টি তাদের উপর পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উম্মে কুলসুম সামলে নিয়ে এগিয়ে এল।
সায়মা সালাম দিল।
উম্মে কুলসুম সালামের উত্তর দিয়ে তাসনিমের একটা হাত ধরে বেডের কাছে নিয়ে এল।
তাসনিম সবাইর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে নিল।
উম্মে হাফসা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কে মা তোমরা তোমাদেরকে তো চিনতে পারছি না।
উম্মে কুলসুম বলল, আমরা ডাক্তারের সাবধান বাণী কেউ মানছি না। ইনারা ছোট ভাইয়ার পরিচিত। খবর পেয়ে দেখতে এসেছেন।
তাসনিম আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে দেখল, অনেক রোগা হয়ে গেছে। মুখটা খুব মলিন। চোখে চোখ পড়তে অপলক দৃষ্টিতে দু’জনেই তাকিয়ে রইল।
চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে আব্দুস সাত্তার মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর সামলে নিয়ে উম্মে কুলসুমকে বলল, ওদেরকে চলে যেতে বল।
উম্মে কুলসুম ওদেরকে কেবিনের বাইরে নিয়ে এসে তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় ছোট ভাইয়া অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছেন, তার কথা বলা একদম নিষেধ। প্লীজ, আপনারা এখন চলে। যান। ছোট ভাইয়া সুস্থ হওয়ার পর আমি ফোন করে জানাব, তখন আসবেন।
আব্দুস সাত্তারের অবস্থা দেখে তাসনিমের দুঃখ হলেও বিয়ের ব্যাপারটা জানতে পারে নি বলে রাগটা এখনো রয়েছে। তাই রাগের সঙ্গে বলল, বিয়ের পরে নিশ্চয় এ্যাকসিডেন্টটা হয়েছে? তা আপনার ভাবিকে দেখলাম না যে?
তার কথা শুনে উম্মে কুলসুম প্রথমে হকচকিয়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ছোট ভাইয়া বিয়ে করেছে, কে বলেছে আপনাকে?
তাসনিম রাগের সঙ্গেই বলল, যেই বলুক, কথাটা সত্য কিনা বলুন?
উম্মে কুলসুম এবার রেগে উঠে বলল, না বলব না। যে প্রেমের মূল্য জানে না, কদর জানে না। প্রেমিককে বিশ্বাস করে না, তার কথার উত্তর দেব না। যান চলে। যান, আর কোনো দিন আসবেন না। ছোট ভাইয়াকেও বলে দেব, সে যেন। আপনাকে আর কোনো দিন বিরক্ত না করে। কথা শেষ করে কেবিনে ঢুকে গেল।
আপুর কথায় সায়মা রেগে গিয়েছিল। উম্মে কুলসুম কেবিনে ঢুকে যাওয়ার পর রাগের সঙ্গে বলল, বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করা তোর উচিত হয় নি।
উম্মে কুলসুমের কথা শুনে তাসনিম বুঝতে পেরেছে, বিয়ের কথাটা সত্য নয়। অনুতপ্ত কণ্ঠে বলল, আব্দুস সাত্তার আমাদেরকে চলে যেতে বলায় আমার মাথা। গরম হয়ে গিয়েছিল।
কেন উনি চলে যেতে বলেছেন, ভেবে দেখেছিস? ফোনে ওকে কি কি বলে অপমান করেছিস মনে নেই?
ছলছল চোখে তাসনিম বলল, এখন কি করব বলতে পারিস?
এখন বাসায় চল, ভেবে চিন্তে যা করার করা যাবে।
.
উম্মে কুলসুম ঢুকতেই উম্মে হাফসা আতঙ্কিত স্বরে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আব্দুস সাত্তার আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে।
সেকি বলে উম্মে কুলসুম ডাক্তারকে খবর দিতে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
তখনও দু’বোন কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তাকে তন্তদন্ত হয়ে বেরোতে দেখে সায়মা জিজ্ঞেস করল, এভাবে কোথায় যাচ্ছেন?
উম্মে কুলসুম যেতে যেতে বলল, ছোট ভাইয়া আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে, ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।
সায়মা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোর কারণেই উনি বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহ না করুক, যদি কিছু হয়ে যায়, সেজন্য তুই-ই দায়ী হবি। ওঁর মা-বাবা ও আত্মীয়রা ব্যাপারটা জানেন না, তারা তোকে দায়ী করবেন না ঠিক; কিন্তু উম্মে কুলসুম তোকে দায়ী করবেই। আর তুইও কী নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি?
তাসনিম ভুল বুঝতে পেরে মুখ নিচু করে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগল; কিছু বলতে পারল না।
উম্মে কুলসুম ডাক্তার ডাকতে যাওয়ার সময় দোতলার বারান্দা থেকে স্বামীকে আসতে দেখে তরতর করে সিড়ি বেয়ে নেমে এসে সালাম দিল।
আব্দুল মজিদ বিদেশ থেকে ফিরে এসে মাসখানেক হল পি.জি.তে প্রফেসার হিসাবে জয়েন করেছে। সেই-ই আব্দুস সাত্তারকে ঢাকায় নিয়ে এসে ইবনেসিনায় ভর্তি করেছে। ডিউটি সেরে ক্লিনিকে এসেছে। স্ত্রীর সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কী ব্যাপার? তোমাকে খুব পেরেশান মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চল। দুপুরের দিকে ছোট ভাইয়ার জ্ঞান ফিরে। কিছুক্ষণ পর ফোনে তাসনিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যায়। আধঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে আসে। একটু আগে তাসনিম ও সায়মা এসেছিলেন তাদেরকে চলে যাওয়ার কথা বলে আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি ডাক্তারকে খবর দিতে যাচ্ছিলাম, তোমাকে দেখতে পেয়ে নেমে এলাম।
আব্দুল মজিদ স্ত্রীর কাছে বন্ধুর প্রেম কাহিনী শুনেছে। হাঁটতে শুরু করে বলল, ওঁরা চলে গেছেন।
না, কেবিনের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর ওদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির ব্যাপারটা বলল।
এটা তুমি ঠিক করো নি। ওর মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করা তোমার উচিত ছিল। উনি নিশ্চয় কারো কাছে আব্দুস সাত্তার ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনেছেন। ভেবে দেখ, আমি ফেরার আগে তুমি যদি খবর পেতে আমি সেখানে একটা বিয়ে করেছি, তা হলে তোমার মানসিক অবস্থা কী হত? যাক গে, যা হওয়ার হয়েছে। ওর ভুল ভাঙিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিও। ততক্ষণে তারা দোতলায় উঠে। কেবিনের কাছে চলে এল।
সায়মা উম্মে কুলসুমকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার ছোট ভাইয়ার জ্ঞান ফেরার পর একটু বাইরে আসবেন।
উম্মে কুলসুম কিছু বলল না।
আব্দুল মজিদ এক নজর দু’বোনের দিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে বলল, ওঁরাই না কী?
হ্যাঁ, তারপর স্বামীকে নিয়ে কেবিনে ঢুকল।
ওরা ঢোকার একটু আগে আব্দুস সাত্তারের জ্ঞান ফিরেছে।
আব্দুল মজিদ বেডের কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, এখন কেমন লাগছে?
আব্দুস সাত্তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর উম্মে কুলসুমকে বলল, তুই কোথায় গিয়েছিলি?
তুমি অজ্ঞান হয়ে যেতে ডাক্তারকে খবর দিতে যাচ্ছিলাম, ওকে আসতে দেখে বলে লজ্জা পেয়ে থেমে গেল।
আব্দুল মজিদ স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, আব্বাকে দেখছি না যে? বাসায় গেছেন।
না, দুপুরে ছোট ভাইয়ার জ্ঞান ফেরার পর ড্রাইভারকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। আব্বার কলেজে এবারও ইন্টারের পরীক্ষা কেন্দ্র হয়েছে। কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। তারপর একটু আসছি বলে বেরিয়ে এসে তাসনিম ও সায়মাকে বলল, ছোট ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে। এবার আপনারা বাসায় যান। পরে আপনাদের সঙ্গে ফোনে আলাপ করব।
সায়মা বলল, প্লীজ, একটু সময় দেবেন? কয়েকটা কথা বলব।
উম্মে কুলসুম স্বামীর কথাগুলো চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, চলুন রিসেপসনে বসি।
রিসেপসন রুমে লোকজন বসার জন্য সোফা সেট ও বেশ কয়েকটা চেয়ার রয়েছে। ওরা এক সাইডে বসল। বসার পর সায়মা বলল, দেখুন, আপুর কথায় আপনি মনে কিছু নেবেন না। আপনারা দেশে যাওয়ার তিন চার দিন পর আমরা আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। আপনাদের কাজের বুয়া বলল, আপনার ছোট। ভাই এর বিয়ে। তাই সবাই দেশে গেছেন। কথাটা শুনে আপু এ্যাবনরম্যাল হয়ে পড়েছিল। তারপর এই দীর্ঘ দু’আড়াই মাস হয়ে গেল আপনার ছোট ভাইয়া যোগাযোগ করেন নি। এ্যাকসিডেন্টের কথা কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আমরা জানতাম না। তাই উনি যখন আজ দুপুরের দিকে ফোন করেন তখন আপু কয়েকটা অশোভন কথা বলেছে। তারপর কিভাবে এ্যাকসিডেন্টের কথা জেনে আপুকে নিয়ে সে এসেছে বলে বলল, এবার আপনিই বলুন, আপুর কতটা দোষ?
সায়মা থেমে যেতে তাসনিম করুণস্বরে বলল, আমার মাথা ঠিক ছিল না। তাই কিছুক্ষণ আগে আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। দয়া করে মাফ করে দিন।
উম্মে কুলসুম বলল, আপনি উচ্চ ডিগ্রী নিচ্ছেন, অথচ এটা জানেন না, শোনা কথা যাচাই না করে বিশ্বাস করতে নেই? যাই হোক, মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আমিও না জেনে আপনাকে অনেক কিছু বলে ভুল করেছি। আপনিও আমাকে মাফ করে দিন।
তাসনিম বলল, আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুক। এখন আমি কী আপনার ছোট ভাইয়ার কাছে যেতে পারি।
এখন যাওয়া ঠিক হবে না। আপনাকে দেখে ছোট ভাইয়া হয়তো আবার জ্ঞান হারাবে। আমি বলি কী, আপনারা বাসায় চলে যান। আমি ছোট ভাইয়াকে। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। পরিস্থিতি বুঝে কাল সকালে ফোন করে আপনাদের আনাব। ফোনে কী বলেছিলেন জানি না, ছোট ভাইয়ার মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল, হাত থেকে রিসিভার পড়ে গিয়েছিল। তারপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। আপনাকে ছোট ভাইয়া যে কত ভালবাসে, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?
ছলছল চোখে তাসনিম বলল, জানি ভাই জানি। খবরটা যাচাই না করে যে কত বড় ভুল করেছি, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
উম্মে কুলসুম বলল, আমাদের কাজের বুয়ার মাথায় একটু গোলমাল আছে। কি বলতে কি বলে, কি শুনতে কি শুনে তার কোনো ঠিক নেই। ওর একমাত্র ও ছয় বছরের ছেলে ও স্বামীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনারা মেরে ফেলে ওকে ক্যাম্পে নিয়ে চলে গিয়েছিল। ও আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। আব্ব জানতে পেরে অনেক টাকার বিনিময়ে ওকে নিয়ে আসে। তারপর থেকে ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। আব্ব চিকিৎসা করিয়ে ভালো করে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভালো হয় নি। মাঝে মাঝে ভুল বকে, আর উল্টো পাল্টা কথা বলে। আপনাদেরকেও ঐরকম কিছু বলেছে। আসল ঘটনা হল, পাঁচ বছর আগে আমার আকদ হয়েছিল। একটু আগে আমার সঙ্গে যে ডাক্তার কেবিনে গেলেন, উনি আমার স্বামী। আকদ হওয়ার এক বছর পর উনি উচ্চ ডিগ্রী নিতে বিদেশে গিয়েছিলেন। যেদিন ফিরলেন, সেদিনই আমরা সবাই এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার কয়েকদিন পর আমার বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানের দিন পাশের গ্রাম থেকে। রাজনৈতিক পার্টির কিছু ছেলে এসে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। ছোট ভাইয়া দিতে অস্বীকার করে। ফলে তারা ভাইয়াকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা করে। গ্রামের ছেলেরা জানতে পেরে বাধা দিলে দুই দলে মারপিট শুরু হয়। ওরা নানারকম অস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে এসেছিল। আমাদের গ্রামের ছেলেদের সেসব ছিল না। লাঠিসোটা, বল্লম, দা, হেঁসো বের করতে দেরি হয়। ততক্ষণে আমাদের অনেকে জখম হয়। শেষে গ্রামশুদ্ধ লোক যখন তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল তখন তারা পালাতে বাধ্য হল। অবশ্য তাদেরও কয়েকজন আহত হয়েছিল। তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ছোট ভাইয়া গুরুতর জখম হয়েছিল। তার ডান পায়ের হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তারপরের ঘটনা তো আপনারা দারোয়ানের কাছে থেকে জেনেছেন। আর সময় দিতে পারছি না। ছোট ভাইয়া আমাকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। এতক্ষণে হয়তো আমার স্বামীকে খুঁজতে পাঠিয়েছে। তারপর আসি বলে উম্মে কুলসুম তাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে কেবিনে ফিরে এল।
তাকে দেখে উম্মে হাফসা একটু রাগের সঙ্গে বললেন, এতক্ষণ কোথায় গিয়েছিলি? আব্দুস সাত্তার তোকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছে। একটু আগে আব্দুল মজিদ তোকে খুঁজতে গেল। আব্দুল মজিদ ফিরে এলে তোর ফুফুকে নিয়ে তার সাথে বাসায় যা।
উম্মে কুলসুম বলল, আমি আজ রাতে এখানে থাকব। তুমি ও ফুফুআম্মা তোমাদের জামাইয়ের সাথে চলে যাও। ড্রাইভারকে দিয়ে আমাদের রাতের খাবার পাঠিয়ে দিও।
এমন সময় স্বামীকে ফিরতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আম্মু ও ফুফুআম্মাকে নিয়ে বাসায় যাও। মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে আসছে, বাসায় গিয়ে নামায পড়বে।
.
রাতে খাওয়ার পর উম্মে কুলসুম ছোট ভাইয়ার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, একটা কথা বলব, রেগে যাবে না অথবা টেনসান করবে না বল?
আব্দুস সাত্তার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তুই যা বলতে চাচ্ছিস, আমি বুঝতে পেরেছি। ওর কথা না বলাই ভালো।
ঠিক আছে, ওর কথা না হয় নাই বললাম; কিন্তু তুমি কী ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবে?
বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে।
তাতো অবশ্যই। হায়াত যতদিন আছে বাঁচবেই। কিন্তু সেরকম বেঁচে থাকার যে কি যন্ত্রণা তা তুমি ভালোভাবেই জান। এখনও কী কম যন্ত্রণা ভোগ করছ?
আচ্ছা বল, কী বলতে চাচ্ছিস।
তাসনিম কেন ছোট ভাইয়ার সাথে এত রূঢ় ব্যবহার করল, সে সব বলে বলল, যত নষ্টের গোড়া আমাদের কাজের বুয়া জমিলা খালা।
শুনে আব্দুস সাত্তার এত খুশী হল যে, মনে হল তার বুকের উপর থেকে হাজার মণ ওজনের পাথর কেউ সরিয়ে দিল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে চুপ। করে রইল।
কী হল ছোট ভাইয়া? কিছু বলছ না কেন?
একটা কথা ভেবে খুব আশ্চর্য হচ্ছি, তাসনিমের মতো উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে সত্য মিথ্যা যাচাই না করে কথাটা বিশ্বাস করল কি করে?
আমিও সে কথা ওকে বলেছিলাম। ওর বোন সায়মা বলল, বিয়ের কথা শুনে তাসনিম আপা এ্যাবনরম্যাল হয়ে পড়েছিলেন। তাই সত্য মিথ্যা যাচাই করার কথা মাথায় আসে নি।
তুই এসব জানলি কেমন করে?
তোমার বন্ধুকে নিয়ে যখন এলাম তখনও ওরা কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর কিভাবে জানল বলে বলল; তাসনিম আপা খুবই অনুতপ্ত। আমার কাছে সবকিছু শোনার সময় চোখ থেকে পানি পড়ছিল। তখনই ক্ষমা চাওয়ার জন্য তোমার কাছে আসতে চেয়েছিলেন। তাকে দেখে তুমি যদি আবার অজ্ঞান হয়ে যাও? তাই বলেছি, আমি ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাব এবং কাল সকালে তাকে ফোন করে জানাব।
প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য আব্দুস সাত্তার বলল, তুই যে আমার কাছে সব সময়। রয়েছিস, আমার বন্ধুর অসুবিধার কথা ভাবছিস না কেন?
উম্মে কুলসুম লজ্জা পেয়ে বলল, তা আবার ভাবি নি। তাকে খুশী রাখার জন্যই তো তোমার কাছে সব সময় রয়েছি। আমাদের কথা বাদ দাও, তাসনিম আপার ব্যাপারে কিছু বললে না তো? কাল সকালে কী তাকে আসতে বলব?
সে কথা কাল বলব। এখন যা ঘুমিয়ে পড়। রাত জেগে জেগে তুই অনেক রোগা হয়ে গেছিস।
উম্মে কুলসুম ঘুমিয়ে পড়ার পর সাড়ে বারটার সময় আব্দুস সাত্তার তাসনিমকে ফোন করল।
রাতে খাওয়ার পর সায়মা আপুকে বলল, মনে হয়, উম্মে কুলসুম আজই তার ছোট ভাইয়াকে সবকিছু বলবে এবং কাল সকালে আমাদেরকে ফোন করে জানাবে।
তাসনিম বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। তারপর তাকে শুতে দেখে বলল, কী রে? এক্ষুনি ঘুমাবি? আজ হাদিসের একটা বই পড়বি বলেছিলি না?
আজ ঘুম পাচ্ছে, কাল পড়ব বলে পাশ ফিরে শুল।
তাসনিম বড় লাইট অফ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে একটা বই নিয়ে বসল। কিন্তু পড়ায় মন দিতে পারল না। কেবল আব্দুস সাত্তারের মলিন মুখটা বই এর পাতায় ভেসে উঠতে লাগল। ভাবল, উম্মে কুলসুমের কাছে সবকিছু শোনার পর। কী তার মনের পরিবর্তন হবে? আমাকে কী ক্ষমা করবে? আবার ভাবল, উম্মে কুলসুম যদি ফোন করে যেতে বলে, তা হলে কোন মুখে তার সামনে গিয়ে। দাঁড়াব? সত্য মিথ্যা যাচাই না করে তাকে কি জঘন্য ভাষায় অপমান করেছি। তারপরও কী সে আমাকে ক্ষমা করতে পারবে? ক্ষমা করলেও কী আগের মতো ভালবাসবে? আমিও কি আগের মতো তার কাছে ফ্রি হতে পারব? এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে সাড়ে বারটা বেজে গেল টের পেল না। ফোন বেজে উঠতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল, নিশ্চয় ও ফোন করেছে। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে কানের কাছে নিতে আব্দুস সাত্তারের সালাম শুনে চোখে পানি এসে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামলে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে ভিজে গলায় বলল, তোমার এই নাদান তাসনিম ক্ষমাপ্রার্থী। বল ক্ষমা করে দিয়েছ?
কথাগুলো আব্দুস সাত্তারের কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, ক্ষমা চাইছ কেন? তুমি যে ভুল করেছ, এতদিন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে তার থেকে কম ভুল আমিও করি নি। তা হলে তো তোমার কাছে আমারও ক্ষমা চাওয়া উচিত। অবশ্য কাউকে দিয়ে চিঠি বা টেলিগ্রাম করে জানাতে পারতাম, তুমি। দুশ্চিন্তা করবে ভেবে জানাই নি। আর যাওয়ার দিন আমার যাওয়ার কথা ছিল না, পরের দিন ছিল। এয়ারপোর্টে সবাইকে যখন গাড়িতে তুলে দিলাম তখন ছোট বোনের স্বামী কিছুতেই ছাড়ল না। ও আবার আমার ছেলেবেলার বন্ধু। তাই তোমাকে ফোন করে জানাবারও সুযোগ পাই নি। ভেবেছিলাম, উম্মে কুলসুমের বিয়ের অনুষ্ঠানের পরের দিন চলে আসব। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তা ছিল না। তাই এত কিছু ঘটে গেল।
তাসনিম কান্নাজড়িত স্বরে বলল, এতকিছু বলার দরকার ছিল না। আমি জানি, তুমি এতটুকু ভুল বা অন্যায় করতে পার না। তবু যে কেন তোমার বিয়ের কথা শুনে আমি এ্যাবনরম্যাল হয়ে পড়লাম, তা আল্লাহ জানেন। কাল ফোনে তোমাকে যেভাবে অপমান করেছি, সে কথা মনে পড়লে মরে যেতে ইচ্ছা করছে। তুমি ক্ষমা না করলে, আমাকে সেই পথ বেছে নিতে হবে।
এ তুমি কী বলছ তাসনিমঃ বেহেস্তের সোনালী ঝরণা নাম নিয়ে তুমি জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে চাচ্ছ? এক্ষুনি তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও বলছি। নচেৎ …….কথাটা শেষ করতে পারল না। কান্নায় তার গলা বুজে এল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সামলে নিয়ে আবার বলল, বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, কাল তোমার কথা শুনে খুব আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম ঠিক, কিন্তু তোমার প্রতি ভালবাসা এক বিন্দু কমে নি। এরপরও যদি তুমি ক্ষমা করার কথা শুনতে চাও, তা হলে তোমাকেই আগে বলতে হবে, আমাকে ক্ষমা করেছ।
তাসনিম এতক্ষণ মনে মনে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তার কথা শুনছিল। আব্দুস সাত্তার থেমে যেতে বলল, আল্লাহ আমাদের দু’জনকেই ক্ষমা করুন। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার কাছে কে আছেন?
উম্মে কুলসুম।
তোমাকে কখন একা পাব বলবে?
আম্মু আটটার সময় আসতে পারেন, তুমি তার আগে এস। তোমাকে দেখলে উম্মে কুলসুম কেবিন থেকে বেরিয়ে যাবে।
ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ আসব। উম্মে কুলসুমের কাছে শুনেছি, ডাক্তার তোমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। অনেক কথা বলেছ। আর নয়, এবার। ঘুমিয়ে পড়।
কথা না হয় নাই বললাম; কিন্তু ঘুম কি আসবে? তোমাকে না দেখা পর্যন্ত ঘুম আসবে না। সারারাত হয়তো জেগে কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকব তোমার আসার অপেক্ষায়। কাল তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে যে কষ্ট পাচ্ছি, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
এই কথা শুনে তাসনিমের চোখে আবার পানি চলে এল। ভিজে গলায় বলল, প্লীজ, আর এসব কথা বলো না, আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি। বাকি রাতটুকু আমাকেও জেগে কাটাতে হবে তোমার কাছে যাওয়ার সময়ের প্রতিক্ষায়।
০৮.
পরের দিন সকালে উম্মে কুলসুম ছোট ভাইয়াকে বলল, তাসনিম আপা খুব টেনসান নিয়ে ফোনের অপেক্ষায় আছেন। ফোন করে আসতে বলি?
আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, তার আর দরকার নেই। এক্ষুনি হয়তো এসে পড়বে।
উম্মে কুলসুমও মৃদু হেসে বলল, তা হলে রাতেই তোমাদের মিটমাট হয়ে গেছে?
তোর কী মনে হয়?
যা মনে হয় তাইতো বললাম।
সামান্য ভুলের জন্য বেচারী অনেক দুঃখ পেয়েছে তাই রাতে ফোন করে মিটমাট করে ফেললাম।
এমন সময় তাসনিম কেবিনে ঢুকে সালাম দিল।
উম্মে কুলসুম সালামের উত্তর দিয়ে হাসি মুখে বলল, এক্ষুনি আপনাকে ফোন করার জন্য ছোট ভাইয়ার কাছে পারমিশান চাচ্ছিলাম। তারপর জিজ্ঞেস করল, সায়মা আসেন নি?
ও আসতে চেয়েছিল, না করে দিয়েছি।
আপনি ছোট ভাইয়ার সাথে কথা বলুন, তারপর আসছি বলে উম্মে কুলসুম বেরিয়ে বারান্দার রেলিং এর কাছে এসে গেটের দিকে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরে তাদের গাড়ি গেটের কাছে দাঁড়াতে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এল। ততক্ষণে আব্দুল মজিদ ও উম্মে হাফসা নেমে দাঁড়িয়েছেন। উম্মে কুলসুম সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুল মজিদ জিজ্ঞেস করল, ছোট ভাইয়া কেমন আছে?
আল্লাহর রহমতে ভালো। তারপর স্বামীকে চোখ টিপে বলল, তুমি ডিউটিতে যাও, ফেরার সময় আসবে। আমি আম্মুকে নিয়ে যাচ্ছি।
আব্দুল মজিদ বুঝতে পারল, তাকে এখন যেতে নিষেধ করছে। বলল, ঠিক আছে; তা হলে আসি। তারপর গাড়িতে উঠে বলল, গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি বাসায় গিয়ে গোসল করে খেয়ে ফুফুআম্মাকে নিয়ে এসে আম্মুকে পাঠিয়ে দিও।
গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর উম্মে কুলসুম উম্মে হাফসাকে বলল, আম্মু চল। বারান্দায় এসে বলল, আমরা কিছুক্ষণ রিসেপসন রুমে বসি। ভাইয়ার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।
রিসেপসন রূমে বসার পর উম্মে হাফসা জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছে চিনিস?
হ্যাঁ চিনি। কাল বিকেলে যে দুটো মেয়ে এসেছিল, তাদের বড় জন। নাম তাসনিম। জান আম্মু, ও না এক মন্ত্রীর মেয়ে।
উম্মে হাফসা অবাক হয়ে বললেন, তাই না কী?
হ্যাঁ আম্মু। ওর বাবার নাম বললে তুমিও চিনবে। আমাদের পাশের গ্রামের রোকন উদ্দিন।
উম্মে হাফসা চমকে উঠে গম্ভীর হয়ে বললেন, তার মেয়ের সঙ্গে আব্দুস সাত্তারের কি এমন সম্পর্ক যে, সাত সকালে দেখা করতে এসেছে?
ছোট ভাইয়া ওকে ভালবাসে। ও-ও ছোট ভাইয়াকে ভালবাসে।
উম্মে হাফসা আবার চমকে উঠে বললেন, কী বললি?
আম্মুর দু’বার চমকে উঠার কারণ উম্মে কুলসুম জানে। তাই দেখেও না দেখার ভান করে বলল, তুমি তো কাল তাসনিমকে ভালো করে দেখ নি, তার। সাথে আলাপও কর নি। আজ দেখলে ও আলাপ করলে বুঝতে পারবে, মেয়েটা কি দারুণ সুন্দরী আর ব্যবহারও কত সুন্দর। মন্ত্রীর মেয়ে হলেও এতটুকু অহঙ্কার। নেই। একদম সহজ সরল। ওকে তোমার পছন্দ হবেই।
উম্মে হাফসা রেগে উঠে বললেন, চুপ কর। মন্ত্রীর মেয়ে হোক, আর যতই রূপবতী-গুণবতী হোক, তোর আব্ব কিছুতেই বৌ করবে না। আর মেয়ের। আব্বাও আব্দুস সাত্তারকে জামাই করবেন না। বরং ওদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে মেয়েকে কি করবেন জানি না, আব্দুস সাত্তারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করবেন। ভেবে খুব আশ্চর্য হচ্ছি, সবকিছু জেনেও আব্দুস সাত্তার ঐ পথে পা বাড়াল কেন?
আমিও সবকিছু জানি আম্মু।
কার কাছে জেনেছিস?
ছোট ভাইয়ার কাছে।
তবু তুই মেয়েটার গুণগান করছিস? আব্দুস সাত্তারকে বাধা দিস নি কেন?
বাধা দিয়েছি, কাজ হয় নি। বলল, সে নিজেও তাসনিমকে ভুলে যেতে চেষ্টা করেও সফল হয় নি।
আব্দুস সাত্তার জেনে শুনে একি আগুন নিয়ে খেলছে? মেয়ের বাবা ওদের সম্পর্কের কথা জানেন?
না।
জানলে যে কি হবে আল্লাহই জানে। আচ্ছা, মেয়েটা কি তোদের আব্বুর পরিচয় জানে?
ছোট ভাইয়া তাকে এখনও পরিচয় বলে নি।
আমার খুব ভয় করছে। আল্লাহ বড় ছেলেকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন। আব্দুস সাত্তার কত বড় বিপদ থেকে মরতে মরতে বাঁচল। এখন আবার আর এক বিপদের কথা শোনালি। আল্লাহ তকদিরে কি রেখেছেন কি জানি। কথা শেষ করে আঁচলে চোখ মুছলেন।
তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না তো আম্মু। মেয়ে যদি ভাইয়াকে সাপোর্ট করে, তা হলে মন্ত্রী হোক আর যেই হোক, ছোট ভাইয়ার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না। ছোট ভাইয়াকে অত কাঁচা ছেলে মনে করো না, সে জেনে শুনেই এই পথে পা বাড়িয়েছে। আমি যখন ঐসব বলে বাধা দিয়েছিলাম তখন বলল, তাসনিমকে বিয়ে করে আব্বুর সঙ্গে ওর আব্বুর পুরানো বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনবে।
উম্মে হাফসা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তা যদি করতে পারে, তা হলে তোর আব্বুর থেকে আর কেউ বেশি খুশী হবে না। দোয়া করি, “আল্লাহ যেন ওর মনের উদ্দেশ্য পূরণ করেন। তারপর বললেন, চলতো দেখি মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করি।”
কেবিনের দরজার কাছে এসে পর্দার বাইরে থেকে উম্মে কুলসুম বলল, ছোট ভাইয়া, আম্মু এসেছে।
তাসনিম তখন বেডে বসে আব্দুস সাত্তারের বুকে হাত রেখে বলছিল, আল্লাহ কবে এখানে মাথা রাখার সুযোগ দেবেন, তা তিনিই জানেন। উম্মে কুলসুমের গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আব্দুস সাত্তার বলল, বাইরে রয়েছিস কেন? আম্মুকে নিয়ে ভিতরে আসবি
ওরা ঢুকতেই তাসনিম সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে উম্মে হাফসাকে কদমবুসি করল।
উম্মে হাফসা থাক মা থাক বলে তার মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক, হায়াতে তৈয়েবা দিক।” তারপর চিবুক ধরে কয়েক সেকেন্ড মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে সুবহান আল্লাহ, মাশাআল্লাহ বলে বললেন, বাহ! কী সুন্দর চেহারা? যেমন চোখ মুখ, তেমনি নাক। গায়ের রংও দুধে আলতা। যে বাড়ির বৌ হয়ে যাবে, তারা খুব ভাগ্যবান। দাঁড়িয়ে আছ কেন মা, বস। তারপর ছেলের বেডের কাছে এসে বললেন, কেমন আছিস বাবা?
আব্দুস সাত্তার বলল, আল্লাহর রহমতে ও তোমার দোয়ার বরকতে গতকালের চেয়ে অনেকটা ভালো। একটু আগে ডাক্তার এসেছিলেন। বললেন, আর কোনো ভয় নেই।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে উম্মে হাফসা বললেন, মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে নিয়ে বসে একটু আলাপ করি। এত সুন্দর মেয়েকে কাল আসতে না আসতেই তুই তাড়িয়ে দিয়ে ভালো করিস নি। তারপর তাসনিমের একটা হাত ধরে বললেন, এস মা, আমরা আলাপ করি। বসার পর তাসনিমকে বললেন, তুমি মন্ত্রীর মেয়ে উম্মে কুলসুম বলেছে। নিশ্চয় লেখাপড়া করছ?
উম্মে হাফসা যখন চিবুক ধরে রূপের প্রশংসা করছিলেন তখন থেকে তাসনিম লজ্জায় মুখ নিচু করেছিল। এখন লজ্জা একটু কমেছে। মুখ তুলে তার দিকে। তাকিয়ে বলল, জি, বাংলায় অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি।
আল্লাহ তোমাকে রূপের সাথে গুণও দিয়েছেন।
ততক্ষণে উম্মে কুলসুম আম্মুর সঙ্গে তাসনিমের ব্যাপারে যা আলাপ হয়েছিল, তার সারমর্ম সটকাটে ছোট ভাইয়াকে ফিস ফিস করে বলছিল। মায়ের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে যদি তোমার এতই পছন্দ তখন বৌ করে ঘরে নিলেই পার।
তাসনিম লজ্জা পেয়ে আবার মুখ নিচু করে নিল।
অত ভাগ্য কী আমাদের হবে?
ভাগ্যে কি আছে না আছে, তা আল্লাহ জানেন। মেয়ে যখন পাশে বসে আছে, মতামত নিতেও তো পার?
উম্মে হাফসা তাসনিমকে বললেন, তুমি তো আমার মেয়ের কথা শুনলে মা, আব্দুস সাত্তার সুস্থ হওয়ার পর একদিন বাসায় এস।
তাসনিম আরো বেশি লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করেই বলল, জুি আসব। তারপর দাঁড়িয়ে বলল, এবার আসি খালা আম্মা।
আর একটু বস। মনে হচ্ছে, তুমি নাস্তা না খেয়ে এসেছ। আমি নাস্তা নিয়ে এসেছি, ওদের সঙ্গে নাস্তা খেয়ে তারপর যাবে।
আজ নয় খালা আম্মা, অন্য দিন খাব অনেকক্ষণ এসেছি, আব্বু নাস্তার টেবিলে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।
তা হলে তো আর জোর করব না। শোন, আব্দুস সাত্তার সুস্থ হওয়ার পর বাসায় আসতে বলেছি বলে যেন আবার মনে করো না, এখানে আসতে নিষেধ করেছি। কী? এখানে আসবে না?
তাসনিম মৃদু হেসে জ্বি আসব বলে সালাম বিনিময় করে বেরিয়ে এল।
.
রোকন উদ্দিন সাহেব প্রতিদিন সকাল আটটায় স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে নাস্তা করেন। আজ এসে বড় মেয়েকে দেখতে না পেয়ে ছোট মেয়েকে বললেন, রূপাকে দেখছি না কেন?
সায়মা বলল, আপু ভোর সাড়ে ছ’টায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করতে বলল, এসে বলবে। বললাম, আব্ব তো তোকে নাস্তার। টেবিলে খুঁজবে, কী বলব? বলল, তার আগেই ফিরব। সঙ্গে যেতে চাইলাম নিল না।
তাই না কী? তা হলে তো এতক্ষণ ফিরে আসার কথা। এখন তো রাস্তায় যানজট নেই, তবু দেরি হচ্ছে কেন? কোনো অসুবিধায় পড়ল না তো? আচ্ছা, ড্রাইভারকে নিয়েছে?
না নেয় নি।
তা হলে তো খুব চিন্তার কথা। অত সকালে ড্রাইভারকে না নিয়ে একা বেরোন উচিত হয়নি।
এমন সময় তাসনিম এসে আব্বর শেষের কথা শুনতে পেয়ে বলল, কাছেই গিয়েছিলাম, তাই ড্রাইভারকে নিই নি।
রোকন উদ্দিন সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, আর কোনো দিন অত সকালে ড্রাইভার ছাড়া একা বেরোবি না। তা কোথায় গিয়েছিলি বল তো?
ইবনেসিনা ক্লিনিকে একজন রুগীকে দেখতে।
খেতে শুরু করে রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, নিশ্চয় রুগী তোর প্রিয় কেউ?
কী করে বুঝলে?
তা না হলে নাস্তা না খেয়ে অত সকালে কেউ কাউকে দেখতে যায়?
ঠিক বলেছ। জান আব্বু, ছেলেটার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসীরা চাদা নিতে এসেছিল। ছেলেটা প্রতিবাদ করে। যা হওয়ার তাই হল। সন্ত্রাসীরা ওকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যেতে চাইলে লোকজন প্রতিরোধ করতে গেলে দু’দলে যুদ্ধ হল! উভয়পক্ষের কয়েকজন করে আহত হল। ছেলেটার একটা পা ভেঙ্গে গেছে। ইবনেসিনায় চিকিৎসা চলছে।
ছেলেটা খুব সাহসী বল?
হ্যাঁ আব্ব, শুধু সাহসী নয়, শক্তিশালীও। কয়েক মাস আগে একদিন আমি ও সায়মা সংসদ ভবন চত্বরে গিয়েছিলাম। তিন চারটে বাজে ছেলে আমাদেরকে টিজ করছিল। ছেলেটা তখন আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রথমে তাদেরকে দ্রভাবে চলে যেতে বলল। ছেলেগুলো তর্ক করতে করতে এক পর্যায়ে তাদের একজন পিস্তল বের করে গুলি করল। ছেলেটা তড়িৎগতিতে সরে গেলেও গুলিটা কাঁধের কিছু মাংস নিয়ে বেরিয়ে গেল। তবু ছেলেটা ভয় পেল না। পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে তাদেরকে ভাগিয়ে দিল। আশেপাশের অনেকে ঘটনাটা দেখলেও কেউ ছেলেটাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি। আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। তারপর বাজে ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর যা কিছু হয়েছে বলে বলল, আমরা ছেলেটার কার্যকলাপে খুব অবাক হলাম। সব থেকে বড় কথা, তখন তাকে আমরা চিনতাম না।
রোকন উদ্দিন সাহেব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, বাহ, ছেলেটা সত্যিই খুব বাহাদুর। তা হারে, পরে ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হল কী করে?
ঐ ঘটনার কয়েকদিন পর সায়মার জুতো কেনার জন্য নিউমার্কেটে গিয়ে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ছেলেটাও তার বোনকে নিয়ে জুতো কিনতে এসেছিল। তখন থেকে পরিচয়।
মেয়ের কথাবার্তায় রোকন উদ্দিন সাহেব বুঝতে পারলেন, সে ছেলেটার প্রতি বেশ দুর্বল। বললেন, এতকিছু বললি, দেখতে কেমন, কতদূর লেখাপড়া করেছে উপার্জন-টুপার্জন করে কিনা, বাবা কি করেন, দেশের বাড়ি কোথায়, সেসব তো কিছুই বললি না?
প্রায় দু’আড়াই মাস মানসিক যন্ত্রণায় ভোগার পর আজ আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করে সেই যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেয়েছে। তাই তার মন আনন্দে আপ্লুত হয়েছিল। আব্বুর কথার ইঙ্গিত তাসনিম বুঝতে পারল না। স্বতস্ফূর্ত কণ্ঠে বলল, দেশের বাড়ি কোথায় জানি না। আর দেখতে দারুণ। ফর্সা টকটকে দোহারা গড়ন, প্রায় ছ’ফুট লম্বা। এ বছর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে। দেখলে তোমারও ভালো লাগবে।
রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়ের মনের খবর এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলেন।
ছোট মেয়ের মনের খবর জানার জন্য তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, কীরে মা, তুই চুপ করে আছিস কেন? ছেলেটার সম্পর্কে তোর মতামতটা বলতো শুনি।
আপুর উচ্ছাসের বোকামী দেখে সায়মা মনে মনে হাসছিল। বলল, হ্যাঁ আব্বু, ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো। আপু যা বলল, একবর্ণ মিথ্যে নয়।
কি নাম ছেলেটার?
আব্দুস সাত্তার। জান আব্ব, উনি আপুর ডাক নাম রূপা বাদ দিতে বলে তাসনিম রেখেছেন এবং বাসার সবাইকে সেকথা জানাতে বলেছেন।
তাই নাকি?
তাসনিম ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে, আব্দুস সাত্তারের ব্যাপারে আব্বুর সামনে এত উচ্ছাস প্রকাশ করা বোকামী হয়েছে। তাই এবার সায়মা কিছু বলার আগে বলল, হ্যাঁ আব্বু; উনি একদিন আমার ডাক নাম রূপা শুনে আসল নাম জানতে চাইলেন। আমি বললাম, যাবিন তাসনিম। তারপর নামের ব্যাপারে আব্বুর সাত্তার যা কিছু বলেছে সব বলে বলল, খুব ধার্মিক ছেলে বলে মনে হয়, তাই না আব্বু?
তোদের কথা শুনে তাই তো মনে হচ্ছে। তারপর বললেন, ছেলেটাকে একদিন নিয়ে আসিস, আলাপ করব।
তাসনিম বলল, সুস্থ হওয়ার পর নিয়ে আসব।
.
আব্দুস সাত্তার একমাস ক্লিনিকে থেকে বাসায় ফিরে এলেও সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরো একমাস সময় লাগল। তাসনিম দু’একদিন পরপর তাকে ক্লিনিকে দেখতে গেলেও বাসায় সপ্তাহে একবার করে যায়। আর প্রতিদিন রাতে দীর্ঘ সময় ফোনে। আলাপ করে। উম্মে হাফসা তাকে মতামত জিজ্ঞেস করেন নি। তবে তাদের গভীর সম্পর্কের কথা বুঝতে পেরেছেন। ক্লিনিক থেকে বাসায় আসার পর একদিন ছেলেকে বললেন, উম্মে কুলসুম তোর ও তাসনিমের সম্পর্ক ও তোর উদ্দেশ্যের কথা আমাকে বলেছে। কিন্তু কাজটা কত কঠিন ভেবে দেখেছিস?
আব্দুস সাত্তার বলল, যত কঠিনই হোক, আমি আমার সংকল্প থেকে বিচ্যুত হব না। তুমি মা, তোমার কাছে কিছু লুকাব না। আমি তাসনিমকে ভীষণ ভালবাসি। তাসনিমও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। ওকে ছাড়া আমি যেমন বাঁচব না, আমাকে ছাড়া তাসনিমও হয়তো বাঁচবে না। অবশ্য বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে। হায়াত থাকলে বাচব ঠিক; কিন্তু সে বাচার থেকে না বাচাই ভালো। ওকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব কিনা জানি না, তবে একথা ঠিক, অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না। তা ছাড়া আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই বিয়ের মাধ্যমে ওর আব্বুর সঙ্গে আমার আব্বুর পূর্ব সম্পর্ক ফিরিয়ে আনবই। তুমি সবকিছু বলে আব্বুকে রাজি করাবে। আন্ধু তোমার কথা না রেখে পারবে না। আমি জানি আব্ব তোমাকে কত ভালবাসে।
এই বয়সেও সেই প্রথম জীবনের মতো স্বামী যে তাকে পাগলের মতো ভালবাসে, তা উম্মে হাফসা জানেন। তাই ছেলের মুখে সেই কথা শুনে লজ্জা পেলেও অন্তর জুড়িয়ে গেল। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে মৃদু হেসে বললেন, খুব সেয়ানা হয়ে গেছিস না?
বারে সেয়ানা হব না? কত বয়স হল, মা হয়ে তাতো ভালো করেই জান।
প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তোর আব্বর সঙ্গে তাসনিমের আব্বার আগের ও এখনকার সম্পর্কের কথা তুই কী ওকে বলেছিস?
না বলি নি। ভাবছি, কয়েকদিনের মধ্যে জানাব।
আমি না-হয় তোর আব্বকে রাজি করাব; কিন্তু তাসনিম যখন জানবে তুই রাজাকারের ছেলে তখন যদি তোকে ঘৃণা করে সরে যায় তখন কী করবি?
একথা যে ভাবিনি, তা নয়। এ ব্যাপারটা আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি। তিনি ভাগ্যে যা রেখেছেন, মুসলমান হিসাবে তা মেনে নিতেই হবে। তবু বান্দারা আল্লাহর কাছে মনের কামনা বাসনা জানায়। আমিও জানাচ্ছি। তুমি দোয়া করো আম্মু, আল্লাহ যেন আমার কামনা বাসনা পূরণ করেন।
উম্মে কুলসুমের মুখে তোর উদ্দেশ্যের কথা শোনার পর থেকেই প্রতি ওয়াক্ত নামাযের পর দোয়া করি। তারপর উম্মে কুলসুমের কাছে তাসনিমের বাবার কাছ থেকে যে বিপদ আসার কথা বলেছিলেন তা বললেন।
তুমি যে বিপদ আসার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছ, তা আমিও ভেবেছি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাসনিম আমার পরিচয় পাওয়ার পরেও দূরে সরে যাবে না। তারপর যখন আমার উদ্দেশ্যের কথা জানবে তখন আমাকে সাহায্য করবে। আর আমার অনুমান যদি সত্য না হয়, তা হলে ভাগ্যকে মেনে নেব। তুমি এসব নিয়ে এতটুকু দুশ্চিন্তা করো না।
.
আব্দুস সাত্তার সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার কয়েকদিন পর আজ দেশের বাড়িতে চলে যাওয়ার সময় উম্মে হাফসা ছেলেকে বললেন, তাসনিমকে সবকিছু জানাবার পর কি হয় না হয়, চিঠি দিয়ে জানাবি। কাল রাতে যে তুই বললি, বাড়ি চলে যাওয়ার কথা শুনে তাসনিম আজ আসবে। কই, এখনও তো এল না?
আব্দুস সাত্তার বলল, হয়তো কোনো কারণে লেট হচ্ছে।
এমন সময় তাসনিম পর্দা ঠেলে ঢুকে সালাম দিল।
উম্মে হাফসা সালামের উত্তর দিয়ে হাসিমুখে বললেন, এসেছো না? তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নচেৎ অনেক আগেই রওয়ানা হয়ে যেতাম। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, সবকিছু গাড়িতে তোলা হয়েছে?
এমন সময় রাইসা বেগম এসে বললেন, কখন রওয়ানা হবে? আরো দেরি করলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে তো?
উম্মে হাফসা বললেন, এই তো এক্ষুনি রওয়ানা হব।
তাসনিম এগিয়ে এসে উম্মে হাফসাকে কদমবুসি করে রাইসা বেগমকেও করল।
দু’জনেই মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করলেন। তারপর উম্মে হাফসা তার হাত ধরে নিচে এসে গাড়িতে উঠার সময় ছেলের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এই দুরন্ত ছেলেটা কারো কথা শোনে না, তুমি একটু শাসন করে দিওতো মা।
সবার অলক্ষ্যে আব্দুস সাত্তার ও তাসনিম একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
০৯.
আব্দুল হামিদ ও রাইসা বেগম ছাড়া তাদের আর কোনো ভাই বোন নেই। রাইসা বেগমের বিয়ে হয়েছিল একই জেলার খোকসাবাড়ীর বড় লোকের একমাত্র ছেলে আলি আশরাফের সঙ্গে। বিয়ের কয়েক বছর পর তার মা-বাবা মারা যান। আলি আশরাফ মা-বাবা মারা যাওয়ার পর জ্ঞাতী শত্রুর ষড়যন্ত্রের স্বীকার হন। ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অর্ধেক সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। তখন ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলে আলি হোসেনকে নিয়ে থাকতেন। চার পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যবসায় উন্নতি করে রায়ের বাজারে জায়গা কিনে এই এ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির কাজ শুরু করেন। টাকার প্রয়োজনে দেশের বাকি সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। বাড়ি কমপ্লিট হওয়ার পর একমাত্র সন্তান আলি হোসেন মারা যায়। ছেলের শোকে রাইসা বেগম পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। পুরো পাগল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ডাক্তারের পরামর্শ মতো আব্দুল হামিদ ও উম্মে হাফসা ছোট ছেলে আব্দুস সাত্তারকে দিয়ে দেন। তখন আব্দুস সাত্তারের বয়স দশ বছর। বড় হয়ে তাদেরকে ছেড়ে মা-বাবার কাছে চলে না যায়, সেজন্য স্ত্রীর কথামতো আলি আশরাফ ব্যবসা ও এই বাড়ি আব্দুস সাত্তারের নামে উইল করে দেন। আলি আশরাফ ব্যবসার প্রয়োজনে বিদেশে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে প্লেন এ্যাকসিডেন্টে মারা যান। তারপর থেকে রাইসা বেগম ম্যানেজারকে দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।
আব্দুস সাত্তার মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে ফুফুআম্মার জিদে ব্যবসা দেখাশোনা করছে। ছোট বোনের বিয়ে ও পা ভেঙে যাওয়ার কারণে প্রায় পাঁচ মাস অফিসে যেতে পারে নি। তাই মা দেশের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর নিয়মিত অফিস করছে। এতদিন অফিস না করায় প্রচুর কাজের চাপে তাসনিমকে দিনে সময় দিতে পারে নি। তবে রাতে ফোনে আলাপ করে।
একদিন আলাপ করার সময় তাসনিম বলল, তোমার কথা আব্বুকে বলেছি। আলাপ করার জন্য নিয়ে আসতে বলেছে। কবে আসবে বল।
আমি কবে যাব বললে তো হবে না। তোমার আব্ব ব্যস্ত মানুষ। যখন যাব। তখন যদি উনি বাসায় না থাকেন? তা ছাড়া একটা অজানা অচেনা ছেলেকে। দারোয়ান ঢুকতে দেবে কী?
তাসনিম হেসে উঠে বলল, দারোয়ানের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। শোন, পরশু শুক্রবার। ঐদিন তোমার আসার কথা বলে আব্বকে বাসায় থাকতে বলব। কি বলে না বলে কাল রাতে জানাব।
তা জানিও। তবে শুক্রবার উনি যেতে বলুন আর নাই বলুন, তুমি কিন্তু কাল সকালে আসবে। কিছু আলাপ করব। এবার রাখি খুব টায়ার্ড লাগছে, ঘুমাব।
কী ব্যাপার বলতো? কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছি, ফোন করতে না করতে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়?
এই কয়েকদিন যে খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
তাসনিম অবাক হয়ে বলল, খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছে মানে?
বারে, এত পড়াশোনা করলাম বসে থাকার জন্য নাকী? তুমি চী চাও না, তোমার স্বামী বেকার না থেকে কিছু কাজকর্ম করুক?
আমি সে কথা জানতে চাই নি। জানতে চাচ্ছি; সারাদিন এমন কী কাজ কর, যে জন্য রাতে এত টায়ার্ড হয়ে পড়?
কাল সকালে এস, সারাদিন কি কাজ করি বলব।
ঠিক আছে, আসব।
আব্দুস সাত্তারের খুব ঘুম পাচ্ছিল। হাই তুলে “লা হাউলা ওয়া কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” পড়ে বলল, এবার রাখি তা হলে?
তাসনিম বুঝতে পারল, সত্যিই ও খুব টায়ার্ড। বলল, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। তারপর সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
.
আজ সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় রোকন উদ্দিন সাহেব বড় মেয়েকে বললেন, কই রে মা, অল রাউন্ডার ছেলেটাকে নিয়ে এলি না যে? এখনও সুস্থ হয় নি?
আব্বুর কথা শুনে সায়মা হেসে উঠল।
কি রে মা, তুই আবার হাসছিস কেন?
হাসি থামিয়ে সায়মা বলল, তুমি আব্দুস সাত্তারকে অলরাউন্ডার বললে কেন? ক্রিকেট প্লেয়ারদের মধ্যে যারা ভালো ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং করতে পারে, তাদেরকে তো অল রাউন্ডার বলে।
তুই বুঝি খুব ক্রিকেট খেলা দেখিস?
শুধু আমি নই, আপুও।
তা কোন দেশের টিম তোদের ফেভারিট?
আমার দক্ষিণ আফ্রিকা। আপুর পাকিস্তান। তবে এ বছর পেপসি কাপে পাকিস্তানের খেলা দেখে পাকিস্তান টিম আমারও ফেভারিট হয়ে গেছে। শোয়েব আখতারের বোলিং ও অলরাউন্ডার ওয়াসিম আকরামের জন্য পাকিস্তান মনে হয় এবারের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ান হবে।
রোকন উদ্দিন সাহেব এবার বড় মেয়েকে বললেন, তুই কী বলিস? এ বছর বিশ্বকাপে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ান হতে পারবে?
তাসনিম বলল, আমি সাত আট বছর ক্রিকেট খেলা দেখছি। আমার ধারণা, এই খেলাটা সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার। কখন কোন টিম জিতবে আর কখন হারবে, বলা খুব কঠিন। তবে এ বছর বিশ্বকাপের ব্যাপারে সায়মার সাথে আমি একমত।
তোরা নিজের দেশের টিমের ব্যাপারে কিছু বললি না যে?
আমরা নিজের দেশের টিমকে খুব ভালবাসি। এ বছর বিশ্বকাপে খেলতে গেছে জেনে গর্ববোধ করছি। যখন ভালে খেলবে এবং চ্যাম্পিয়ান হবে তখন শুধু নিজের দেশের টিমই ফেভারিট হবে।
ছেলেটার নাম আব্দুস সাত্তার বললি না?
হ্যাঁ।
আব্দুস সাত্তার ক্রিকেট খেলে না?
তা জানি না। তবে খেললে নিশ্চয় কোনো না কোনো টিমে খেলতে দেখতাম।
যাক গে, এখন তার খবর বল।
উনি সুস্থ হয়েছে। তুমি যদি শুক্রবার বাসায় থাক, তা হলে ওকে নিয়ে আসব।
রোকন উদ্দিন সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, সকালের দিকে নিয়ে আসিস। বিকেলে বেরোব।
রিডিং রুমে সায়মা পড়ছিল। তাসনিম সেজেগুজে এসে জিজ্ঞেস করল, তোর আজ ক্লাস আছে?
না, কোথাও যাবি মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
সায়মা মিটি মিটি হাসতে লাগল।
কী রে, হাসছিস যে?
সাদা পোশাকে তোকে বেহেস্তের হুরের মতো লাগছে। আব্দুস সাত্তার সাহেবের মাথা না ঘুরে যায়।
তাসনিম মেকী রাগ দেখিয়ে বলল, বেহেস্তের হুর কখনও দেখেছিস? তার সঙ্গে তুলনা করলি যে?
দুনিয়ার কোনো মানুষই দেখে নি, আমি দেখব কী করে? বেহেস্তের হুরের বর্ণনা দাদির কাছে শুনেছিলেন। কিছুদিন আগে সুরা আর রহমানের ব্যাখ্যা পড়ে তুইও তো শোনালি।
তারপর বলল, কাল তাকে নিয়ে আসবি। আজ আবার যাচ্ছিস কেন? ফোন করে দিলেই তো পারিস?
তাই করতাম, গত রাতে ফোনে আজ সকালে যেতে বলেছে।
তা হলে অভিসারে যাচ্ছিস? যা যা, কাল আব্বর ইন্টারভিউতে যেন পাশ করতে পারে, শিখিয়ে পড়িয়ে আয়।
তোকে আর পাকামী করতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দে বলে তাসনিম বেরিয়ে এল।
.
আব্দুস সাত্তার নাস্তা না খেয়ে তাসনিমের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাইসা বেগম দু’বার তাগিদ দিয়েছেন। আব্দুস সাত্তার বলেছে, একটু পরে খাবে। তৃতীয়বার এলে বলল, ফুফুআম্মা বস, একটু আলাপ করি।
রাইসা বেগম বললেন, ক’টা বেজেছে দেখেছিস? নাস্তা খেয়ে নে, তারপর আলাপ করবি।
একদিন দেরিতে খেলে কিছু হবে না; তুমি বসতো বলে একটা হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিল।
কী পাগল ছেলে? আরো দেরি করলে তো সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে?
যাক ঠাণ্ডা হয়ে। জমিলা খালা গরম করে দেবে। আলাপটা সেরে নিই। আচ্ছা ফুফুআম্মা, তুমি কী তাসনিমের ব্যাপারে কিছু জান?
জানব না কেন? সব কিছু দেখছি, শুনছি। তোর মায়ের কাছেও সব কিছু জেনেছি।
ওকে তোমার পছন্দ হয়?
ওমা, পছন্দ হবে না কেন? ওর মতো সুন্দর মেয়ে আর কখনও দেখি নি।
ও যে আব্বুর বাল্যবন্ধু রোকন উদ্দিন সাহেবের মেয়ে, তা জান?
হ্যাঁ, তোর মা বলেছে। শোনার পর থেকে আমিও খুব দুশ্চিন্তায় আছি। তোর আব্বা রাজি হলেও তাসনিমের আব্বা কিছুতেই রাজি হবেন না।
তাসনিম ওর আব্বাকে রাজি করাবে। তুমি দুশ্চিন্তা করো না। আল্লাহ যা করবেন তাই হবে। ও আব্বুর পরিচয় জানে না। আজ জানাব বলে আসতে বলেছি। এখনও আসছে কেন বুঝতে পারছি না। ওকে নিয়ে নাস্তা খাব বলে অপেক্ষা করছি। এমন সময় কলিংবেলের শব্দ শুনে বলল, তুমি জমিলা খালাকে সবকিছু গরম করতে বল। আমি ওকে নিয়ে আসি। তারপর নিচে এসে গেট খুলে। সালাম বিনিময় করে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বলল, কেমন আছ?
তাসনিম বলল, ভালো। তুমি?
ভালো না, মন খারাপ।
মন খারাপের আবার কী কারণ ঘটল?
এখনও ঘটে নি, একটু পরে ঘটবে। সেকথা ভেবেই মন খারাপ।
হেঁয়ালী করছ কেন? আমি তো বুঝতে পারছি না।
ততক্ষণে তারা ডাইনিংরুমে এসে গেল। আব্দুস সাত্তার বলল, আগে নাস্তা খেয়ে নিই এস, তারপর বুঝিয়ে বলব। একসঙ্গে খাব বলে এখনও খাই নি।
সে কী? সেকথা তো তুমি কাল বল নি।
ভেবেছিলাম, সকালে যখন আসতে বলেছি, তুমি বুঝবে। যাক গে, আমারই ভুল হয়েছে। চা বা কফি তো চলবে?
তা চলবে।
জমিলার হাতে নাস্তার ট্রেসহ রাইসা বেগমকে ঢুকতে দেখে তাসনিম সালাম বিনিময় করে বলল, ফুফুআম্মা কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে ভালো আছি মা। তুমি ভালো আছ?
জ্বি ভালো।
তুমি এত দেরি করলে কেন? নাও নাস্তা খাও।
আমি নাস্তা খেয়ে এসেছি, শুধু কফি খাব।
রাইসা বেগম অবাক কণ্ঠে আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই যে বললি, তাসনিম এখানে এসে নাস্তা করবে? তারপর তাসনিমকে বললেন, জান মা, সেই আটটা থেকে নাস্তা খেতে বলছি। বললেই বলে, তুমি এলে একসঙ্গে খাবে।
আব্দুস সাত্তার বলল, আমি ওকে শুধু আসতে বলেছিলাম। নাস্তা খাওয়ার কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
রাইসা বেগম তাসনিমকে বললেন, তুমি দুপুরে এখানে খাবে। দরকার মনে করলে বাসায় ফোন করে দাও।
ঠিক আছে ফুফুআম্মা, তাই খাব।
নাস্তা খাওয়ার পর আব্দুস সাত্তার তাসনিমকে নিয়ে বেডরুমে এসে দু’জন দু’টো সোফায় বসল।
তাসনিম বলল, উম্মে কুলসুমকে দেখছি না যে?
ওরা একটা ফ্লাটে ভাড়া নিয়ে দুদিন আগে চলে গেছে।
আজ নাস্তার টেবিলে আব্ব বললেন, তোর সেই অলরাউন্ডার ছেলেটাকে একদিন নিয়ে আসতে বলেছিলাম, আনলি না যে?
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, উনি আমাকে অলরাউন্ডার বললেন কেন?
যেদিন আল্লুকে তোমার কথা বলেছিলাম, সেদিন অনেকরকম গুণের কথাও বলেছিলাম। তাই বলেছেন।
কি কি গুণের কথা বলেছিলে বলতে শুনি।
তাসনিম আব্বুকে যা কিছু বলেছিল, সে সব বলে বলল, এত গুণের কথা শুনেই তোমাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছিলেন। আজ বেরোবার আগে তোমাকে কাল নিয়ে আসব বলতে থাকবেন বলেছেন। এবার মন খারাপের ব্যাপারটা বল।
তার আগে দু’একটা প্রশ্ন করব।
বেশ তো কর।
তুমি আমাকে কতটা ভালবাস বলতে পার?
তাসনিম আহত স্বরে বলল, তা কী তুমি জান না?
জানি, তবু তোমার মুখে শুনতে চাই।
ভালবাসার পরিমাণ বা পরিমাপ নেই, সেকথা তুমিও জান। তবু যখন শুনতে চাচ্ছ তখন বলব, সারা পৃথিবীর সাত সমুদ্রের জল রাশির যত পরিমাণ ও পরিমাপ তার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসি।
তুমি কী জান, “লাভ অলওয়েজ টিয়ার্স?”
জানি।
কোনো কারণে তোমার আব্ব যদি আমাকে ঘৃণা করেন অথবা আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে না চান, তাহলে কী করবে?
জানি না, এরকম প্রশ্ন কেন করছ। তবু বলব, ঐ সাত সমুদ্রের জলরাশিতে আজীবন সঁতার কেটে তীরে উঠার চেষ্টা করব।
তাসনিমের ভালবাসার গভীরতা জেনে আনন্দে ও আতঙ্কে আব্দুস সাত্তারের চোখে পানি আসার উপক্রম হল। সামলে নিয়ে বলল, শোন তা হলে, তোমার। আব্ব আমার আব্বুর বাল্যবন্ধু ছিলেন। তোমাদের দেশের বাড়ির পাশের গ্রামে। আমাদের বাড়ি। ক্লাস সিক্স থেকে এম.এ. পাশ করার পরও সেই বন্ধুত্ব ছিল। তারপর কিভাবে তাদের শত্রুতা হল সেসব বলে বলল, আব্ব কয়েকবার মিলমিশ করার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু উনি প্রতিবারেই অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমি এক রাজাকারের ছেলে। রাজাকারের ছেলের সঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বিয়ে দেবেন কি? নিশ্চয় দেবেন না। কথা শেষ করে তার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় কিনা জানার জন্য মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
তাসনিমও তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। একসময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল এবং অল্পক্ষণের মধ্যে তা গাল বেয়ে টপটপ করে পড়তে লাগল।
আব্দুস সাত্তার বলল, জানতাম, একথা জানার পর তুমি প্রচণ্ড আঘাত পাবে এবং কাল যখন তোমার আব্ব আমার পরিচয় জানার পর তোমাকে জানিয়ে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলবেন তখন তুমি আমাকে ভুল বুঝতে। তাই এখন জানান উচিত ভেবে জানালাম। তোমাকে কয়েকদিন সময় দিলাম, চিন্তা ভাবনা করে জানাবে। আর এরপরও যদি কাল তোমাদের বাসায় নিতে চাও, তা হলে এস, যাব।
তাসনিম চোখ মুখ মুছে বলল, তুমি রাজাকারের ছেলে জেনে প্রচণ্ড আঘাত পাই নি। পেয়েছি, এতদিন কথাটা জানাও নি বলে। আর চোখের পানি ফেলেছি, তুমি আমার ভালবাসাকে খুব হালকাভাবে নিয়েছ বলে। একটা কথা মনে রেখ, তুমি আব্বুর শত্রুর ছেলে হও আর রাজাকারের ছেলে হও, তাতে আমার ভালবাসা একবিন্দু কমবে না। আমার ভালবাসাকে বিশ্বাস করতে পার নি জেনে খুব কষ্ট পাচ্ছি। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
বিশ্বাস কর তাসনিম, তোমার ভালবাসার এতটুকু অবিশ্বাস করি নি। শুধু জানান উচিত ভেবে বলেছি। আর তোমাকে চিন্তা করার ও তোমাদের বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে যা বলেছি; তা সাত সমুদ্রের জলরাশির গভীরতা পরীক্ষা করার জন্য একটু দুষ্টুমী করেছি। এতে যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তা হলে ক্ষমাপ্রার্থী। প্লীজ তাসনিম, ক্ষমা করে দাও। আর তা না হলে, যা ইচ্ছা বলে আমারও পরীক্ষা নাও।
তাসনিম সামলে নিয়ে বলল, আমার ভালবাসার পরিধি ও গভীরতার চেয়ে তোমার যে কয়েক সহস্রগুণ বেশি, তা অনেক আগেই জেনেছি। পরীক্ষা করলে আমিই ঠকে যাব। আর ক্ষমা করার কথা যে বললে, তার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তুমি যে আমার ভালবাসাকে পরীক্ষা করেছ, তা বোঝা আমারই উচিত ছিল। এবার আমি দু’একটা প্রশ্ন করি?
আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, অফকোর্স।
তুমি সারাদিন কি এত কাজ কর যে, রাতে খুব টায়ার্ড ফিল কর? প্রশ্নটা অবশ্য কাল রাতেই করেছিলাম।
সুস্থ হওয়ার পর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত অফিসের কাজ করতে হয়।
তাসনিম খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি চাকরি কর?
না।
তা হলে?
নিজের অফিস।
কোনো ব্যবসা শুরু করেছ?
না।
তা হলে খোলাখুলি বলছ না কেন?
বললে রাগ করবে না বল?
না করব না।
সবকিছু বলতে গেলে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। তুমি কিন্তু এখনও বাসায় ফোন কর নি।
টেবিলের উপর টেলিফোন সেট দেখে তাসনিম বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিল, “দুপুরে এক বন্ধুর বাসায় খাবে। বিকেলে ফিরবে।” তারপর রিসিভার রেখে। বলল, এবার বল।
আব্বুর নাম আব্দুল হামিদ ছাড়া আমার পুরো বায়োডাটা তোমাকে আগে বলেছি। তারপর ফুফা-ফুফুর সম্পর্ক ও কিভাবে সে এখানে, এল এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হল, সবকিছু বলে বলল, পরীক্ষার পর অফিস করছিলাম। দুর্ঘটনার কারণে প্রায় পাঁচ মাস অফিস করতে পারি নি। সুস্থ হওয়ার পর অফিসে গিয়ে দেখি প্রচুর কাজ পড়ে আছে। তা ছাড়া ম্যানেজার চাচা আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বলেছেন, এবার আমাকেই অফিস চালাতে হবে।
তাসনিম জিজ্ঞেস করল, এতবড় এ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির তত্ত্বাবধান কে করে?
গেটের পাশে দু’টো রুম দেখেছ না? ওটা একটা অফিস। তিনজন লোক কাজ করে। ওদের উপরেই দায়িত্ব দেওয়া আছে। আগে ফুফা শুধু হিসাব চেক করতেন। এখন আমি করি।
তুমি তো জানতে আব্ব কিছুতেই রাজাকারের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন না, তবু কেন আমাকে ভালবাসলে?
তুমি জান কিনা জানি না, সত্যিকার প্রেম ভালবাসা আল্লাহর ইশারাতেই হয়। অবশ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই তারই ইশারাতে হয়। আমাদের ব্যাপারটাও তাই। তা না হলে ছ’মাসের ব্যবধানে মাত্র দু’বার দেখে তোমার প্রতি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়লাম কেন? তারপর বায়োডাটা জেনে এত হতাশ হয়ে পড়লাম যে, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম হারাম হতে বসেছিল। তোমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য ছ’মাস আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। শরীর ও মন খুব ভেঙ্গে পড়ল। আল্লাহর ইশারায় হঠাৎ একদিন একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ব্যাস, তারপর থেকে ফোন করতে শুরু করে এই পর্যন্ত এলাম। কথা শেষ করে আব্দুস সাত্তার মৃদু হাসল।
তাসনিমও মৃদু হেসে বলল, তা না হয় বুঝলাম, বুদ্ধিটা তো ব্যাখ্যা করলে না?
আমি মনে করেছি, বুদ্ধিটা বুঝতে পেরেছ। বলছি শোন, তোমার আমার বন্ধনের দ্বারা উভয়ের আব্বুর দুশমনির বাঁধ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে পুনরায় বন্ধুত্বের বাঁধ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে দুশমনির অর্ধেক পথ ভেঙ্গেছি। আশা করি, তারই দয়ায় বাকি অর্ধেক ভেঙ্গে পুনরায় তাদের পুরোনো বন্ধুত্বের নতুন বাঁধ তৈরি করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
সুবহান আল্লাহ বলে তাসনিম বলল, তোমার এই মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে একমত হয়ে দোয়া করছি, “আল্লাহ আমাদের দু’জনকে কবুল করে এই মহৎ উদ্দেশ্য যেন সফল করান।” তারপর বলল, আচ্ছা, আব্বু পরিচয় জানার পর যদি তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন?
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, তাতো দেবেনই।
তাকে হাসতে দেখে তাসনিম অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
খুব অবাক হয়েছ না? ভাবছ, অপমান হওয়ার কথা শুনে হাসছি কেন? হ্যাঁ, তাই ভাবছি।
তুমি এত বোকা কেন? এটা তো সবাই জানে আগুনে হাত দিলে পুড়বেই। আমি জেনেশুনে হাত দিয়েছি। পুড়লে দোষ তো আগুনের না। পোড়ার কষ্ট তো আমাকে সহ্য করতেই হবে। রাজাকারের ছেলে হয়ে জেনেশুনে মুক্তিযোদ্ধার মেয়েকে ভালবেসেছি। তিনি তো অপমান করবেনই। আর সেই অপমান আমাকে সহ্য করতেই হবে। দুঃখ কষ্ট বা অপমান যখন পেতেই হবে তখন হাসিমুখে বরণ করাই তো পৌরুষ। আমি নিজের জন্য কিছু ভাবছি না, ভাবছি তোমার জন্য। উনি চেষ্টা করবেন আগুনে পানি ঢেলে ঠাণ্ডা করার। ঠাণ্ডা করার আরো অনেক। পদ্ধতি আছে। তুমি সেসব সহ্য করতে পারবে কি না ভেবে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। তাই মন খারাপের কথা বলেছিলাম।
আমার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করো না। আন্ধু আমাকে ভীষণ ভালবাসেন। আমার কথা না রেখে পারবেন না।
দোয়া করি আল্লাহ যেন তাই করেন। তবে কী জান, অধিকাংশ মা বাবা তাদের পছন্দমতো ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চান। ছেলেমেয়েরা নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করবে, এটা তারা পছন্দ করেন না। তার উপর যদি ছেলে বা মেয়ে শত্রুপক্ষের হয় অথবা তাদের মনের মতো না হয়। আমার তো মনে হচ্ছে, তুমি যত সহজ ভাবছ, ততটা সহজ নয়।
সহজ কঠিন যাই হোক না কেন, আব্বুকে যদি একান্ত রাজি করাতে না পারি, আম্মুকে পারবই। আর কাউকেই যদি না পারি, তোমার কাছে চলে আসব।
ওটা নিকৃষ্ট পথ। যারা কাপুরুষ তারাই ঐ পথ বেছে নেয়। ঐসব কাপুরুষের মধ্যে এমনও অনেকে আছে, যারা নাকি প্রেমাস্পদকে না পেয়ে আত্মহত্যা করে। ইসলাম এই পথ পরিহার করতে শিখিয়েছে। মা-বাবার মনে কষ্ট দিতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) নিষেধ করেছেন। আমরা মুসলমান হয়ে মা-বাবার মনে কষ্ট দিয়ে কিছু করব না। আমরা আধুনিক শিক্ষার যেমন শিক্ষিত, তেমন কুরআন-হাদিসের জ্ঞানও আমাদের আছে। সেইসব জ্ঞানের দ্বারা যুক্তির মাধ্যমে আমাদের মা-বাবাকে রাজি করাব। তারপর কি কি যুক্তি দেখাবে তা আলোচনা করে আব্দুস সাত্তার মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী? পারবে না?
তাসনিমও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ইনশাআল্লাহ পারব।
এমন সময় রাইসা বেগম দু’টো আইসক্রীম নিয়ে এসে বললেন, খুব গরম পড়েছে, খাও। আধঘণ্টা পরে কফি দেব। তারপর তাসনিমকে জিজ্ঞেস করলেন, বাসায় ফোন করেছ মা?
জ্বি, করেছি।
তোমরা গল্প কর, যাই দেখি, জমিলা আবার আরেক করতে এক করে বসবে।
রাইসা বেগম চলে যাওয়ার পর তাসনিম বলল, তোমার আম্মুর ও ফুফুআম্মার মনের ইচ্ছা আমি বুঝতে পেরেছি।
আব্দুস সাত্তার বলল, ওরাও প্রথমে রাজি ছিলেন না। যখন বললাম, তাসনিম আমার দীলের ধড়কন। দীলের ধড়কন থেমে গেলে যেমন মানুষ বাঁচে না। তেমনি ওকে না পেলে আমার দীলের ধড়কনও বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যাস, এই কথা শুনে রাজি হয়ে গেলেন। অবশ্য সেইসাথে তোমার আমার আব্বুর পূর্ব সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্তটাও বলেছি। তুমিও আমার পদ্ধতিটা টুকলিফাই করে তোমার আম্মুকে রাজি করাতে পার। তারপর আব্বুকে রাজি করাবার পদ্ধতি প্রয়োগ করবে।
তাসনিম হেসে উঠে বলল, টুকলিফাই শেখানোর জন্য ধন্যবাদ।
বিকেলে তাসনিমকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময় আব্দুস সাত্তার বলল, তোমাকে কাল আসতে হবে না। আমি সকাল নটায় যাব।
১০.
সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় রোকন উদ্দিন সাহেব বড় মেয়েকে বললেন, ছেলেটাকে আজ নিয়ে আসবি বলেছিলি না?
তাসনিম বলল, কাল ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, নিজেই আসবে বলেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো এসে পড়বেন।
নাস্তা খেয়ে তাসনিম দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রায় দশ মিনিট পর আব্দুস সাত্তারের গাড়ি এসে গেটের কাছে দাঁড়াতে দেখে নেমে এল।
তাসনিম আগেই দারোয়ানকে আব্দুস সাত্তারের নাম ও গাড়ির নাম্বার বলে গেট খুলে দিতে বলেছিল। আব্দুস সাত্তার গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকল।
রোকন উদ্দিন সাহেব ড্রইংরুমে পেপার পড়ছিলেন। তাসনিম আব্দুস সাত্তারকে নিয়ে এসে বলল, আব্ব, উনি এসেছেন।
রোকন উদ্দিন মুখ তুলে তাকাতে আব্দুস সাত্তার সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে রোকন উদ্দিন সাহেব বসতে বললেন।
তাসনিম আব্বুকে বলল, তুমি ওর সঙ্গে কথা বল, আসছি।
আব্দুস সাত্তারের সুঠাম দেহ ও চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব খুশী হলেন। বললেন, আমার মেয়েরা তোমার অনেক গুণগান। করে। ওদেরকে একদিন বাজে ছেলেদের খপ্পর থেকে রক্ষা করতে গিয়ে গুলি খেয়েছ, তাও বলেছে। তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করনি তো?
জ্বি না, এটাই তো স্বাভাবিক।
তোমার নাম তো আব্দুস সাত্তার?
জ্বি।
নামের অর্থ জান।
জ্বি, গোপনকারীর বান্দা বা দাস।
রেজাল্ট বেরোবার পর কী করবে কিছু ভেবেছ?
আমাদের একটা ব্যবসা আছে। পরীক্ষার পর থেকে সেটাই দেখাশোনা করছি। ভবিষ্যতে……।
তোমার বাবার ব্যবসা নিশ্চয়?
জ্বি না। উনি গ্রামের এক কলেজে আছেন।
তাসনিমের সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?
তা প্রায় আড়াই বছর।
হোম ডিস্ট্রিক্ট কোথায়?
নিলফামারী।
রোকন উদ্দিন সাহেব কুচকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবার নাম?
আব্দুল হামিদ।
রোকন উদ্দিন-চমকে উঠে গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন।
তাসনিম ড্রইংরুম থেকে ভিতরে এসে মাকে আব্দুস সাত্তারের আসার কথা জানিয়ে নাস্তা পাঠাবার কথা বলল। তারপর ফিরে এসে এতক্ষণ দরজার পর্দা ফাঁক করে সবকিছু শুনছিল ও দেখছিল। আব্ব দরজার বাইরে এলে জানা সত্ত্বেও বলল, চলে এলে যে?
রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়ের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ওকে চলে যেতে বলে আমার কাছে আয়। তারপর হনহন করে চলে গেলেন।
তাসনিম ভিতরে এসে ছলছল চোখে আব্দুস সাত্তারের দিকে তাকিয়ে রইল।
আব্দুস সাত্তার এগিয়ে এসে বলল, এত সামান্য ঝড় সহ্য করতে পারছ না? সবে তো শুরু, তারপর যখন দেড়শ দু’শ মাইল বেগে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হবে তখন কী করবে? রাতে ফোন করব, এখন আসি। তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে। চলে গেল।
তাসনিম কিছুক্ষণ স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলল; তারপর চোখ মুছে আব্বর রুমে গিয়ে দেখল, আম্মু ও সায়মা রয়েছে। তিনজনেরই মুখ খুব গম্ভীর।
রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, ওর সঙ্গে আর কোনো দিন মেলামেশা করবি।
কেন আব্বু?
তুই ওর পরিচয় জানিস?
জানি।
কী জানিস বলতো?
তাসনিম আব্দুস সাত্তারের সবকিছু বলল।
কিন্তু ওর বাবা যে রাজাকার ছিল, তা তো জানিস না?
তাতে কী হয়েছে? ওর বাবা রাজাকার ছিলেন, উনি তো ছিলেন না?
রোকন উদ্দিন সাহেব রেগে গিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনেছ তোমার মেয়ের কথা? তারপর তাসনিমকে বললেন, মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হয়ে একজন রাজাকারের ছেলের হয়ে কথা বলতে তোর লজ্জা করল না?
ওকে আমি ভালবাসি আব্বু।
রোকন উদ্দিন সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, চুপ, আর একটা কথা বলবি না। তোর সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে চাবকে। পিঠের ছাল তুলে নিতাম। তারপর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওকে বুঝিয়ে বলে দিও, এরকম দুঃসাহস যেন আর কখনও না দেখায়। এই কথা বলে বেরিয়ে গেলেন।
মুমীনা বেগম তাসনিমকে বললেন, তোর আব্বুর কথা শুনলি তো? ঐ ছেলেকে তুই ভুলে যা মা।
আব্বুর কথা শুনে তাসনিম মনে খুব ব্যথা পেল। চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। কিছু না বলে নিজের রুমে ফিরে এল।
সায়মা তার পিছু পিছু এসে বলল, আপু, উনি যে রাজাকারের ছেলে, কই, তুই তো আমাকে বলিস নি? বললে অনেক আগেই বাছাধনকে প্রেম করা বের। করে দিতাম। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুই কী আগে জানতিস?
না, কাল বলেছে।
দেখলি তো, উনি কত বড় ফ্রড? তোকে প্রেমের সাগরে ভাসাবার পর জানালেন। তুই ঘৃণা করবি ভেবে আগে জানাই নি। আমি হলে কাল জানার পর। মুখে থুথু ছিটিয়ে চলে আসতাম। আর তুই কী না ওকে এখনও ভালবাসিস। লজ্জায় মাথা খেয়ে আবুকেও আবার সে কথা বললি। ছিছি আপু, কোন মুখে। আব্বুকে কথাটা বলতে পারলি?
তার কথা শুনে তাসনিম প্রচণ্ড রেগে গেল। ইচ্ছা করল, তার গালে কষে একটা চড় মারতে। ইচ্ছাটা দমন করার জন্য উপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে রাগ সামলাবার চেষ্টা করল। রাগের চোটে চোখে পানি চলে এল।
তার চোখে পানি দেখে সায়মা বলল, একটা ফ্রড ছেলের জন্য কাঁদা তোর উচিত হচ্ছে না?
তাসনিম গর্জে উঠল, ওকে বার বার ফ্রড বলবি না। বললে চড়িয়ে গাল লাল করে দেব বলে হাত উঠাল। পরক্ষণে নামিয়ে নিয়ে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, সবকিছু না জেনে কারো বিরুদ্ধে কমেন্ট করা মুর্খতা। এতদিন পরিচয় না বলার মধ্যে যে কত বড় মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, তা যদি জানতিস, তা হলে ফ্রড বলতে পারতিস না। এতদিন আমার চেয়ে তুই-ই তার বেশি প্রশংসা করেছিস। রাজাকারের ছেলে জেনে এখন তাকে ঘৃণা করছিস। এটা ভাবছিস না কেন, রাজাকার ছিল তার বাবা, সে নয়। সব থেকে বড় কথা, সে যেই হোক না কেন, তাকে আমি আমার জীবনের সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালবাসি। কথাটা তুইও জানিস। একটা কথা জেনে রাখ, ও যদি চোর, ডাকাত, খুনীও হত, তবু ওকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করতে পারতাম না। ওর জন্য চিরকুমারী যদি থাকতে হয়, তাও থাকব। তোকে সাবধান করে দিচ্ছি, আমাকে তুই যা কিছু ভাবতে পারিস, কিন্তু ওর সম্পর্কে আমার কাছে কোনো খারাপ কমেন্ট করবি না।
আব্দুস সাত্তার রাজাকারের ছেলে জেনে তার ও তাসনিমের উপর সায়মার যে ঘৃণা ও রাগ জন্মেছিল, আপুর কথা শুনে তা দূর হয়ে গেল। তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে মাফ করে দে আপু। ওর সম্পর্কে সবকিছু না জেনে খারাপ কমেন্ট করে অন্যায় করেছি। বল, মাফ করে দিয়েছিস?
সায়মার কথাগুলো তাসনিমের কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করুক। এবার ছাড়।
সায়মা ছেড়ে দিয়ে বলল, আব্দুস সাত্তারের মহৎ উদ্দেশ্যের কথা বল না আপু, শুনব।
আম্মু ওদের সম্পর্কে অনেক কিছু নিশ্চয় জানে। ডেকে নিয়ে আয়, তার সামনে বলব। তা হলে সত্য মিথ্যা জানতে পারবি।
সায়মা মুমীনা বেগমকে ডেকে নিয়ে আসার পর তাসনিম বলল, বস আম্মু, আমি কয়েকটা কথা বলব। তোমরা আমাকে দু’টুকরো করে কেটে মাটিতে পুঁতে ফেল আর নদীতে ভাসিয়ে দাও, তবু আমি আব্দুস সাত্তারকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আর আল্লুকে বলে দিও, সে যদি আব্দুস সাত্তারের কোনো। ক্ষতি করে, তা হলে আমারও মরা মুখ দেখবে তোমরা। তারপর আব্দুস সাত্তারের আব্ব ও তার আব্বুর সম্পর্ক ও কি কারণে সম্পর্ক ছিন্ন হল সেসব বলে বলল, আব্দুস সাত্তার চায়, সেই পুরানো সম্পর্ক আবার প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই জন্যে সে এতদিন তার পরিচয় দেয় নি। আমিও তাই চাই।
সায়মা মাকে জিজ্ঞেস করল, এসব কী সত্যি আম্মু?
মুমীনা বেগম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সত্যি তো বটেই। বরং আরো এমন সত্য ঘটনা আছে। যা আব্দুস সাত্তার হয়তো জানে না বলে বলে নি।
সায়মা বলল, সেই ঘটনাগুলো বল না আম্মু শুনি।
মুমীনা বেগম বললেন, আব্দুস সাত্তারের বাবা আব্দুল হামিদ ভাই খুব উঁচু মনের মানুষ। ওদের আর্থিক অবস্থা অনেক আগের থেকে খুব ভালো। তোর। আব্বুর সঙ্গে আব্দুল হামিদ ভাইয়ের এত গভীর বন্ধুত্ব ছিল যে, যা তোরা কল্পনা করতে পারবি না। আব্দুস সাত্তারের দাদা দাদিও খুব উঁচু মনের মানুষ ছিলেন। তারা তোদের আন্ধুকে নিজের ছেলের মতো মনে করতেন। তোদের দাদার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। আব্দুল হামিদ ভাইয়ের বাবার সাহায্যে তোদের আব্ব এত লেখাপড়া করেছে। তোদের আলু অনেকবার আমাকে ওদের বাড়িতে। নিয়ে গেছে। আব্দুস সাত্তারের মাও খুব ভালো মহিলা। অত বিত্তশালী ঘরের বৌ হলেও এতটুকু অহঙ্কার নেই। আমার সঙ্গে সই পাতিয়েছিলেন। তারপর কি করে সম্পর্ক ছিন্ন হল, তা তো তোরা জেনেছিস। আমি তোদের আব্বকে অনেকবার বলেছি, মিলমিশ করার জন্য, কিন্তু ওর একটাই কথা, “যে ইচ্ছা করে মুক্তিযুদ্ধ। করে নি এবং পাকিস্তান সৈন্যদের সাহায্য করেছে, সে রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে একজন রাজাকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমাদের সম্পর্কের কথা লোকজন যখন জানবে তখন তাদের কাছে মুখ দেখাব কি করে?” তোদের আব্বুর কথা শুনে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমি কিছুই। বলতে পারি নি।
তাসনিম বলল, তুমি দেখে নিও আম্মু। তুমি যা পার নি, ইনশাআল্লাহ আমি তা করেই ছাড়ব।
মুমীনা বেগম আবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, দোয়া করি, “আল্লাহ যেন তোর মনের আশা পূরণ করেন। তারপর আমি যাই, রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে বলে চলে গেলেন।
সায়মা বলল, আব্লু বুঝি আব্দুস সাত্তার সাহেবকে খুব অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে?
তাসনিম বলল, না, তা করে নি। হাজার হোক এককালের বন্ধুর ছেলে তো। পরিচয় জানার পর চুপচাপ ড্রইংরুম থেকে চলে এসেছে। আমি দরজার বাইরে ছিলাম। দেখে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “ওকে চলে যেতে বল। ওর সঙ্গে তুই আর কখন মেলামেশা করবি না।”
এখন কী করবি ভেবেছিস?
ও চলে যাওয়ার সময় রাতে ফোন করবে বলেছে। কি বলে শুনি, তারপর চিন্তা করব।
.
রাত সাড়ে বারটায় আব্দুস সাত্তার ফোন করতে তাসনিম সালাম বিনিময় করে আব্ব যা কিছু বলেছে এবং সে কি বলেছে বলল।
সায়মা সবকিছু জেনেছে?
হ্যাঁ।
সে কিছু বলে নি?
প্রথমে তোমাকে ফ্রড বলেছিল এবং আমাকেও যা তা করে বলে তোমাকে ভুলে যেতে বলেছিল। তারপর যখন তোমার মহৎ উদ্দেশ্যের কথা বললাম তখন মাফ চেয়ে নিয়েছে।
তোমার আম্মু কিছু বলেন নি?
আম্মুও সায়মার মতো বলেছিল। পরে আমি যখন তোমার আমার গভীর সম্পর্কের কথাও আমাদের উদ্দেশ্যের কথা বললাম তখন শুধু রাজি হননি, দোয়াও করেছেন।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আব্দুস সাত্তার বলল, আম্মুর অসুখ, কাল সকালে দেশের বাড়িতে যাচ্ছি। কবে ফিরব আল্লাহকে মালুম। তুমি কোনো চিন্তা করো না। আব্বুকে রাজি করিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরব। দোয়া করো, “আল্লাহ যেন আমার মনের বাসনা পূরণ করেন।”
তাতো করবই। তুমি কিন্তু প্রতিদিন ফোন করে খালাআম্মার খবর জানাবে।
আম্মু নানির বাড়িতে গিয়ে অসুখে পড়েছে। ওখানে ফোন নেই। তবু খবর দেওয়ার চেষ্টা করব।
ফুফুআম্মা উম্মে কুলসুমও কী যাচ্ছেন?
ফুফুআম্মা আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। উম্মে কুলসুমের স্বামী আব্দুল মজিদ এখন রাজশাহী মেডিকেলে আছে। ওরা ওখান থেকে যাবে।
মনে হচ্ছে, খালাআম্মার অবস্থা সিরিয়াস। নিলফামারী সদর হাসপাতালে বা ঢাকায় নিয়ে এসে চিকিৎসা করালে হয় না?
সে রকম বুঝলে নিশ্চয় তাই করব। এবার রাখি, খুব ভোরেই রওয়ানা দেব। কিছু কাজ বাকি আছে।
ঠিক আছে, রাখ বলে তাসনিম সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
ফোনে আব্দুস সাত্তার কি বলে জানার জন্য সায়মা আজ জেগেছিল। তাসনিম রিসিভার রাখার পর বলল, খালাআম্মার চিকিৎসার ব্যাপারে কী যেন বললি?
হ্যাঁ, ওর আম্মুর খুব অসুখ। কাল ফুফুআম্মাকে নিয়ে দেশে যাচ্ছে। নে এবার শুয়ে পড়, একটা বাজে।
১১.
প্রায় পনের ষোল দিন হয়ে গেল আব্দুস সাত্তারের কোনো খোঁজ নেই। তাসনিম প্রতিদিন তার বাসায় ফোন করে। কিন্তু কাজের বুয়া জমিলা কিছু বলতে পারে না। আজ মাগরিবের নামাযের পর নসিম হেযাজীর “খুন রাঙা পথ” পড়ছিল।
কাজের বুয়া এসে বলল, আপা, আপনারে সাহেব বোলাইছেন।
তাসনিম বলল, তুমি যাও, আসছি। তারপর বইটা বন্ধ করে যাওয়ার সময় সায়মাকে আব্বর রুমের দিকে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল,কী রে, তোকেও ডেকেছে না কী?
তাসনিম বেডরুমে পড়ছিল, আর সায়মা রিডিংরুমে। কাজের বুয়ার মুখে আবু ডাকছে শুনে সায়মাও যাচ্ছিল। আপুর কথা শুনে বুঝতে পারল, তাকেও ডেকেছে। বলল, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করল, কেন ডেকেছে কিছু বুঝতে পারলি?
তাসনিম যেতে যেতে বলল, দু’জনকে একসঙ্গে যখন ডেকেছে তখন নিশ্চয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে।
সায়মা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। তারপর আব্বর রুমে ঢুকে দেখল, আম্মুও আছে।
তাদের দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, আয় বস। বসার পর তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ভেবেছিলাম, তোকে ওমরের হাতে তুলে দেব। তোর মায়ের মুখে শুনলাম, তুই তাকে পছন্দ করিস না। তাই একটা ভালো ছেলের খোঁজে ছিলাম। আল্লাহ মিলিয়ে দিয়েছেন। ছেলের মা বাবা আমেরিকায়। সেটেল্ড। সেখানে তাদের বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা আছে। সবাই ওখানকার নাগরিক। তাদের একমাত্র ছেলে আবু সাঈদ ডাক্তারী পাশ করে ওখানকার হাসপাতালে জয়েন করেছে। ওরা সবাই ধার্মিক। এরকম ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে তুই সুখী হবি। এখানে তাদের বাড়ি মাগুরা। দিন দশেক হল মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে দেশে এসেছেন, ধার্মিক বাংলাদেশী মেয়ে বৌ করে নিয়ে যাবেন বলে। আমার এক বন্ধুর বাড়ি মাগুরায় ওদের গ্রামে। সে সম্বন্ধটা এনেছে। ছেলে ও তার মা বাবা কাল সকালে তোকে দেখতে আসবেন। পছন্দ হলে দু’চার দিনের মধ্যে ছেলের বিয়ে দেবেন। মাসখানেক পর বৌ নিয়ে আমেরিকায় চলে যাবেন। কাল তোরা কোথাও যাবি না, বাসায় থাকবি।
মুমীনা বেগম বললেন, অন্যের কথায় বিশ্বাস করে কিছু করা উচিত নয়। বিশেষ করে বিয়ে শাদীর ব্যাপারে। তুমি ভালো করে খোঁজ খবর নিয়েছ?
তা আর নিই নি? আমার চাচাত ভাই আব্দুস সামাদকে তো তুমি চেন। বছর দুই হল সে আমেরিকা গেছে। ওদের কাছাকাছি থাকে। বন্ধু বলার পর তাকে ফোন করেছিলাম। যা বলল, বন্ধুর কথার সঙ্গে সব মিলে গেছে। আরো বলল, আজকালের যুগে এত ভালো ঘর ও ভালো ছেলে লাখে একটা আছে কিনা সন্দেহ। তুমি দেখো তাসনিমের মা, আমাদের তাসনিম সুখে থাকবে।
আব্বু থেমে যেতে তাসনিম বলল, কিন্তু আমি তো এখন বিয়ে করব না। আব্দুস সামাদ চাচা যখন ছেলে ও ছেলের মা বাবার সম্পর্কে ভালো সার্টিফিকেট দিয়েছেন তখন সায়মার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও। ওর তো দু’মাস পরে পরীক্ষা। পরীক্ষার পর স্বামীর কাছে চলে যাবে।
রোকন উদ্দিন সাহেব রেগে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, সায়মার ব্যাপারে তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই এখন বিয়ে করবি না কেন?
আমি যাকে ভালবাসি, তাকে ছাড়া বিয়ে করব না।
রোকন উদ্দিন সাহেব উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, তুই কী সেই রাজাকারের ছেলের কথা বলছিস?
হ্যাঁ আব্বু, তাকে যদি তোমাদের পছন্দ না হয়, চিরকুমারী থাকব।
রোকন উদ্দিন সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আরো উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, শুনেছ তোমার বড় মেয়ের কথা? ও সেই রাজাকারের ছেলেকে ছাড়া বিয়ে করবে না? তারপর তাসনিমকে বললেন, আমাদের কোনো পুত্র সন্তান নেই। তাই তোদের সব আবদার পূরণ করি। তাই বলে রাজাকারের ছেলের হাতে তোকে দেব, এটা ভাবলি কী করে? দুনিয়া এদিক ওদিক হয়ে গেলেও তা সম্ভব নয়। তারপর স্বর নামিয়ে বললেন, তুই একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হয়ে বাবার মান সম্মানের দিকে একটু খেয়াল করবি না? ওকে ভুলে যা মা, ভুলে যা। ওর হাতে কিছুতেই তোকে তুলে দিতে পারব না।
আব্বুকে নরম হতে দেখে তাসনিমের সাহস বেড়ে গেল। বলল, কেন পারবে আব্বু? রাজাকার ছিলেন তোমার বন্ধু। দোষ করলে তোমার বন্ধু করেছেন। তার ছেলে তো করে নি। তা ছাড়া আমরা যাদেরকে রাজাকার বলে জানি, তিনি। তা ছিলেন না। আমার এক বান্ধবী আছে, তার বাবাকেও গ্রামের লোক রাজাকার বলত। তিনি গ্রামে টিকতে না পেরে সবকিছু বিক্রি করে ঢাকায় এসে বসবাস করছেন। তার মুখে শুনেছি, তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিলেও নিজের ও আশপাশের গ্রামের লোকজনদের পাক বাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। তবু তাকে সবাই রাজাকার বলত। জেনেছি, তোমার বন্ধুও তাই করেছেন। এরকম ধরনের রাজাকার অনেক আছেন। যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন যে দল সরকার হয়েছে, সেসব দলে ভীড়ে বড়বড় পদে কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন। একটা জিনিস ভাবছ না কেন? প্রত্যেক সরকারের কমবেশি জনগোষ্ঠী সমর্থক থাকে। যারা সব সময় সরকারের পক্ষে কাজ করে। পাকিস্তান সরকারেরও ছিল। তারা পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন দেশের সরকারের আনুগত্য মেনে। নিয়েছে। একথা জানতে পেরে অথবা বুঝতে পেরে তকালীন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক ক্ষমা পেয়েছে, যারা নাকি স্বাধীনতাি যুদ্ধের বিরোধী ভূমিকা করেছে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতে সহায়তা করেছে এবং এখনও তারা স্বাধীনতা বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এরাই সত্যিকার রাজাকার, এরাই দেশের চিরশত্রু। এদেরকে ধরে ফাঁসিতে ঝোলান উচিত। আর তাদেরকেও ফাঁসিতে ঝোলান উচিত, যারা মুসলমান হয়েও বারকোটি মুসলমানের দেশ থেকে ইসলাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
তোমার বন্ধু মুক্তিযুদ্ধ করেন নি, এটাই তার অপরাধ; কিন্তু তিনি তো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেন নি। বরং যতটা সম্ভব লোকজনদের জান, মাল ও ইজ্জত বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন। সেজন্য তার হাজার হাজার টাকা খরচও হয়েছে। সে সব খবর কেন নাও নি? তিনি কী তোমার শত্রু ছিলেন? জেনেছি, স্কুল জীবন থেকে তোমাদের মধ্যে গভীর বন্ধুতু ছিল। তোমার উচ্চ ডিগ্রী নেওয়ার পেছনে তার ও তার বাবার অবদান কম ছিল না। সে সব কথা ভুলে গিয়ে ও তার। কর্মকাণ্ডের খোঁজ খবর না নিয়ে কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন নি বলে এত বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। বন্ধুত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি সবকিছু জানিয়ে ক্ষমা চাইতে তোমার কাছে রাতের অন্ধকারে কয়েকবার এসেছিলেন; কিন্তু তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অপমান করে প্রতিবারেই তাড়িয়ে দিয়েছ। এটা উচিত না অনুচিত হয়েছে, ভেবে দেখেছ কোনো দিন?
তুমি জান কিনা জানি না, হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “তিন দিনের অতিরিক্ত কোনো মুসলমানের পক্ষে তাহার ভ্রাতাকে পরিত্যাগ সে কোন বনের হরিণ ৭ করিয়া থাকা হালাল নহে। যে তিন দিবসের অতিরিক্ত তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে অতঃপর তাহার মৃত্যু হয়, সে দোযখে যাইবে(১)।”
আল্লাহ কুরআনে বলিয়াছেন, “মুমিনগণ তো সকলেই (পরস্পর) ভাই, সুতরাং তোমাদের ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে সন্ধি করাইয়া দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর, যেন তোমাদের প্রতি দয়া বর্ষিত হয়(২)।”
সে হিসাবে আব্দুস সাত্তারের বাবা তোমার ভাই। তার উপর তিনি তোমার বন্ধু ছিলেন। বন্ধু আত্মীয়ের সমান। আত্মীয়তা ছিন্ন করাও কবিরা গুনাহ। হাদিসে আছে, নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “বিদ্রোহ ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ব্যতীত আর অন্য কোনো গুনাহ নাই, যাহার জন্য আখিরাতে শান্তি অবধারিত থাকা সত্ত্বেও এই পৃথিবীতে তাহার শাস্তি হয়(৩)।”
আমি তোমাদের মেয়ে। কথা না শুনলে আমাকে তোমরা যা ইচ্ছা তাই শাস্তি দিতে পার। তবু বলব, আব্দুস সাত্তারকে ভাল না বাসলেও তোমার ও তার আব্বার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কথা জানার পর যেমন করে হোক সেই সম্পর্ক জোড়া দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম এবং এখনও তাই করব। আমার শেষ কথা তোমরা শুনে নাও, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে আমাকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আরা একটা কথা না বলে পারছি না, ছোটবেলায় আমরা যে আলুকে দেখেছি, বড় হয়ে সেই আন্ধুকে আবছা আবছা দেখতাম। মন্ত্রী হওয়ার পর তাও দেখতে পাচ্ছি না। তোমার মুখের উপর অনেক কিছু বলে খুব বড় বেয়াদবি করে ফেললাম। সেজন্য মাফ চাইছি। তারপর সেখানে থেকে নিজের রুমে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়ের কথা শুনে এত অভিভূত হলেন যে, কোনো কথা বলতে পারলেন না। তাসনিমের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সায়মা আবু আম্মুর দিকে ভয়ে ভয়ে একবার তাকিয়ে রিডিংরুমে এসে পড়তে বসল। কিন্তু পড়ায় মনোযোগ দিতে পারল না। ভোলা বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আপুর কথাগুলো চিন্তা করতে লাগল। একসময় ভাবল, আপু এত সাহস পেল কোথায়? মনে হয় প্রেমে পড়লে সাহস বেড়ে যায়। কথাটা ভেবে নিজে নিজে হেসে উঠল।
তাসনিমের কথা শুনে রোকন উদ্দিন সাহেবের রাগ পড়ে গেল। সেই সাথে কুরআন-হাদিসের বাণী শুনেও নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। কোনো কথা বলতে না পেরে তার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। দুই মেয়েকে চলে যেতে দেখেও কিছু বললেন না।
মুমীনা বেগম বড় মেয়ের কথা শুনে খুব খুশী হয়েছেন। স্বামীর মনের অবস্থা অনুমান করতে পেরে বললেন, আমার তো মনে হচ্ছে, তাসনিম খুব ভালো কথা বলেছে। বিয়ের ব্যাপারে এখন আর ওকে কিছু বলল না। তোমার বন্ধু যে। ছেলেটার কথা বলেছেন, কাল তারা এলে সায়মাকে দেখাও, তারা যদি ওকে পছন্দ করে, তা হলে তাসনিম যা বলল, সেই ব্যবস্থা করাই আমি ভালো মনে করি।
রোকন উদ্দিন সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তাসনিম যে এত কুরআন-হাদিসের জ্ঞান রাখে, তা জানতাম না। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, আব্দুল হামিদের সঙ্গে যা কিছু করেছি তা সত্যিই আমি ভুল করেছি। তাসনিম মস্তবড় গুনাহর থেকে বাঁচার পথ দেখাল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আব্দুল হামিদের। কাছে ক্ষমা চাইব।
মুমীনা বেগম খুব আনন্দিত হয়ে বললেন ও অনেক আগে থেকে। কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও ধর্মীয় নানারকম বইপত্র পড়ে, জানবে না কেন? ওতো বেশ কিছুদিন আগে থেকে বোরখা পরে বাইরে যায়।
যারা ধর্মীয় বইপত্র পড়ে, তারা বোরখা পরতে বাধ্য হবে। এখন ওসব কথা থাক। ভাবছি, ওরা কাল এলে সায়মাকেই দেখাব।
আমিও তো তাই বললাম। তবে তার আগে সায়মার মতামত নিতে হবে।
কেন? ও আবার কাউকে ভালবাসে নাকী?
তা জানি না। আজ খাওয়ার পর তাসনিমকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। সে রকম কিছু হলে তাসনিম জানবেই।
.
খাওয়ার টেবিলে তাসনিম নেই দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব বুঝতে পারলেন, রাগ করেছে। সায়মাকে বললেন, তাসনিমকে ডেকে নিয়ে আয়। না আসতে চাইলে বলবি, না এলে আমিও খাব না।
তাসনিম এশার নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সায়মা এসে জাগিয়ে বলল, আপু, ভাত খাবি চল।
তাসনিম বলল, খেতে ইচ্ছা করছে না। তোরা সবাই খেয়ে নে।
খাওয়ার টেবিল থেকে আলু তোকে ডাকতে পাঠাল।
গিয়ে বল, আমি খাব না।
তুই না খেলে আব্বুও খাবে না বলল।
তাসনিম জানে, সে না খেলে আব্বুও খায় না। তাই বলল, যাচ্ছি, তুই যা। তারপর উঠে বাথরুমে থেকে এসে খাওয়ার টেবিলে এল।
রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, কীরে মা, ছেলেকে বকা দিয়ে নিজেই রাগ করলি?
তাসনিম কিছু না বলে খেতে শুরু করল।
অল্প খেয়ে উঠতে দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, কিছুই খেলি না যে? বুড়ো ছেলের উপর এখনও রেগে রয়েছিস তা হলে?
তাসনিমের কান্না পাচ্ছিল আব্বুর কথা শুনে। তাই কিছু না বলে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে চলে যাচ্ছিল। আব্বুর গলা শুনতে পেল, একটু পরে আমার কাছে আসবি।
তাসনিম রুমে এসে চিন্তা করল, আব্বুর সুর অন্য রকম মনে হল। তা হলে আল্লাহ কী তার দোয়া কবুল করেছেন? আবার ভাবল, এটা একটা চাল নয় তো? যদি তাই হয়, তা হলে কি বলবে চিন্তা করতে লাগল।
এমন সময় সায়মা এসে বলল, তুই যখন আব্বকে ঐসব কথা বলছিলি তখন যেমন খুব ভয় পেয়েছিলাম, তেমনি তোর সাহস দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। আমি হলে তো লজ্জায় ও ভয়ে কোনো কথাই বলতে পারতাম না। তবে কথাগুলো বলে খুব ভালো করেছিস। মনে হচ্ছে আব্বুর মন চেঞ্জ হয়েছে।
কী করে বুঝলি?
আলুর কথা শুনে তুই কিছু বুঝতে পারিস নি?
আমাকে বোঝবার জন্য একটা চাল হতে পারে?
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। সত্যিই আব্বুর মন চেঞ্জ হয়েছে।
তোর এরকম হওয়ার কারণ?
তুই চলে আসার পর আব্ব ও আর খেল না। মুখ হাত দুয়ে চলে গেল। আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কাউকে পছন্দ করি কিনা?
তাসনিম কপাল কুঁচকে বলল, তুই কী বললি?
আমি আবার কী বলব? বললাম নেই।
আম্মু আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি?
জিজ্ঞেস করে নি, তবে বলল, “তোর আপু যখন এখন বিয়ে করবে না বলছে তখন কাল যারা আসবেন, তাদেরকে তোকে দেখাব।”
তাসনিম চমকে উঠে বলল, সত্যি বলছিস?
সত্যি না মিথ্যে আব্ব তো তোকে তার রুমে যেতে বলেছে, গেলেই জানতে পারবি।
তুই আম্মুকে কিছু বলিস নি?
আপাততঃ এই বিপদ থেকে তুই রক্ষা পাবি ভেবে বলেছি, “আমার কোনো আপত্তি নেই।”
তাসনিম তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তুই আমাকে এত ভালবাসিস? দোয়া করছি, “আল্লাহ তোকে সুখী করুক।” তারপর। তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে বলল, যাই, আব্ব কেন ডেকেছে শুনে আসি।
তাসনিমকে দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, আমার কাছে এসে বস। বসার পর তার মাথায় একটা হাত রেখে বললেন, এত কুরআন হাদিস জানিস, আর এটা জানিস না, মা-বাবার মনে কষ্ট দেওয়া বড় গুনাহ?
তাসনিম বলল, তা জানব না কেন? জানি বলেই তো এত কিছু বলে বোঝালাম। নচেৎ তোমাদেরকে না জানিয়ে এতদিনে আমরা বিয়ে করে ফেলতাম।
রোকন উদ্দিন সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তখন যে সব কথা বললি, তা শুনে আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। আমি আব্দুল হামিদের সঙ্গে খুব শিঘ্রী দেখা করে মাফ চাইব।
তাসনিম আলুর দুটো হাত ধরে আপ্লুতকণ্ঠে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আল্লাহ চাহে তো এবার আমরা আমাদের আব্বকে ছোটবেলার মতো দেখতে পাব। এমন সময় মাকে আসতে দেখে বলল, আম্মু, আব্ব কি বলল। শুনেছ?
মুমীনা বেগম হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ শুনেছি। তোর আব্ব আমাকে আগেই বলেছে। আব্দুস সাত্তারকে কালকেই নিয়ে আসবি। সেদিন কিছু না খেয়ে চলে গেছে।
এত তাড়াতাড়ি ও এত সহজে আব্বুর মন পাল্টে যাবে তাসনিম কল্পনাও করে নি। মনে মনে আবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে গিয়ে তার চোখে পানি এসে গেল। সেই অবস্থায় আব্বুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
রোকন উদ্দিন সাহেবের হাত তখনও তাসনিমের মাথায় ছিল। নাড়া দিয়ে। বললেন, হ্যাঁরে মা, তোর আম্মু ঠিক কতা বলেছে।
তাসনিম চোখ মুছে বলল, ও তো এখন ঢাকায় নেই। পনের ষোল দিন হল দেশের বাড়িতে গেছে। ওর আম্মুর খুব কঠিন অসুখ।
রোকন উদ্দিন সাহেব আতঙ্কিত স্বরে বলরেন, তাই নাকী? তা হলে তো দু’একদিনের মধ্যে আমাকে যেতে হবে। ওঁর কাছেও আমি অনেক ঋণী, মাফ চাইতে হবে।
স্বামী থেমে যেতে মুমীনা বেগম বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। উনি আমাকে মায়ের পেটের বোনের মতো মনে করতেন। তুমি দু’একদিনের মধ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।
রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, এর মধ্যে তুই কোনো খবর পাস নি?
না।
ঢাকার বাসায় ফোন করে জানিস নি?
ফোন করেছি, কিন্তু বাসায় কেউ নেই। শুধু কাজের বুয়া জমিলা আছে। সে কিছু বলতে পারে না।
ঠিক আছে, তুই এখন যা। ভেবে দেখি, কবে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
তাসনিম ফিরে এসে সায়মাকে বসে থাকতে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর কথাই ঠিক। আব্ব পাল্টে গেছে। তারপর সব কথা বলল।
সায়মা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আমার আপু আল্লাহর খাটি বান্দি। তাই, তিনি তার দোয়া কবুল করেছেন। কাল আমাকে দেখতে আসবে, তারা যদি পছন্দ করে ফেলে, তা হলে তো দু’চার দিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে। ছেলেটা কেমন হবে ভেবে খুব ভয় পাচ্ছি। তুই একটু দোয়া করে দে, যেন ছেলেটা ভালো হয়। তোর দোয়া নিশ্চয় আল্লাহ কবুল করবেন।
তাসনিম তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তোর সবটাতে দুষ্টমী। ঠিক আছে, দোয়া করছি, শুধু ছেলেটা নয়, তার মা-বাবাও যেন ভালো হয়। তারপর হেসে ফেলে বলল, হলো তো?
এমন সময় ফোন বেজে উঠতে দু’জনেই ঘড়ি দেখল, এগারটা।
সায়মা বলল, নিশ্চয় আব্দুস সাত্তার ভাই? কোনো কারণে সময়ের আগেই ফোন করেছেন।
তাসনিম হেসে উঠে বলল, সাহেব না বলে ভাই বললি যে?
সায়মাও হেসে উঠে বলল, বলব না? কয়েকদিন পরে শুধু ভাই নয় দুলাভাই বলতে হবে তো? তাই এখন থেকে অভ্যাস করছি।
তাসনিম হাসি থামিয়ে ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, তাসনিম বলছি?
আব্দুস সাত্তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেমন আছ?
আনন্দে তাসনিমের বুকের রক্ত ছলকে উঠল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সামলাবার চেষ্টা করল।
কী হল? কথা বলছ না কেন? এতদিন যোগাযোগ করি নি বলে খুব রাগ হয়েছে? না অভিমান হয়েছে? যাই হোক না কেন ক্ষমা চাইছি।
তাসনিম বলল, তোমার জান এত শক্ত কেন? আমার উপর ঝড় বইতে শুরু করেছে জেনেও এতদিন একটুও খোঁজ খবর নিলে না।
সে কথা পরে বলব, আগে বল, ঝড়ের বেগ কমেছে, না বেড়েছে?
তার আগে বল খালাআম্মা কেমন আছেন?
আম্মু একটু ভালো; কিন্তু দাদিআম্মা ভালো না। তিনি তার একমাত্র নাতির বৌ দেখে মরতে চান। তাই তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। ঝড়ের খবর বল।
আজ মাগরিবের নামাযের পর দু’শ মাইল বেগে বয়ে গেছে।
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, বাজে কথা।
কী? আমি বাজে কথা বলছি?
আহা, চটছ কেন? বাজে কথা মানে ঝড়ের বেগ যা বললে তা ঠিক নয়। বিশ পঁচিশ মাইল হতে পারে, সেই কথা বোঝাতে চেয়েছি।
কী করে বুঝলে?
তোমার গলার স্বরই বলে দিচ্ছে।
তাই যদি হয়, কাল সকালে আসতে পারবে?
কেন পারব না? তা ছাড়া তোমাকে যখন নিয়ে যেতে এসেছি তখন পাঁচশ মাইল বেগে ঝড় বইলেও কাল তোমাদের বাসায় যেতে হবেই। কাল তোমাকে নিয়ে কাজী অফিসে কাবিন করব। পরশু দেশের বাড়ি রওয়ানা দেব। কাল আরো কিছু কাজ সারতে হবে।
তার কথা শুনে আনন্দে তাসনিমের বুকের রক্ত আবার ছলকে উঠল। সামলাবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
আব্দুস সাত্তার অধৈর্য গলায় বলল, চুপ করে আছ কেন? আমার সঙ্গে যাবে না?
তোমার কী মনে হয়?
একশ পার্সেন্ট সিওর, তুমি যাবে।
তা হলে জিজ্ঞেস করছ কেন?
বিয়ের ব্যাপারে ছেলেকে প্রথমে মেয়ের কাছে প্রস্তাব দিতে হয় বলে।
তার আগে তো মেয়ের গার্জেনদের কাছে প্রস্তাব পাঠাতে হয়?
কাল সকালে গিয়ে তোমার গার্জেনদের কাছে প্রস্তাব দেব। তোমার মতামত নিয়ে দিলে তো ওরা অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দেবেন?
গার্জেনরা যদি প্রস্তাব নাচক করে দেন?
তুমি আমার ফরে থাকলে নাচক করে দিলেও রাজি করার জন্য কূটনৈতিক চাল চালব। আশা করি, ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হব।
নিজের প্রতি এতই তোমার বিশ্বাস?
নিজের প্রতি যা আছে, আল্লাহর উপর তার চেয়ে লক্ষগুণ বেশি আছে।
ঝড়ের রেজাল্ট শুনবে না?
না বললে শুনব কী করে?
ঝড় বিশ পঁচিশ মাইল বেগে বইতে শুরু করলে, তোমার শেখান কথাগুলো বলতে ঝড় থেমে গিয়ে বৃষ্টি হয়েছে।
বুঝলাম না।
তা হলে তুমিও মাঝে মাঝে কম বোঝ?
তোমার ধারণা ভুল।
কেন? এক্ষুনি তো আমার কথা বুঝতে পার নি বললে?
আমার অনুমান সত্য কিনা জানার জন্য বলেছি।
তা হলে বল, কী বুঝেছ?
আমার শেখান কথাগুলো শুনে তোমার আব্ব মত পাল্টেছেন।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাসনিম অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না।
কী হল? আমার অনুমান সত্য কিনা বললে না যে?
সত্য। কিন্তু খবু অবাক হচ্ছি, তুমি বুঝলে কী করে?
এতে অবাক হওয়ার কী আছে? ঝড় অর্থ দুর্যোগ, আর বৃষ্টি অর্থ শান্তি। আর বলা লাগবে?
না।
তা হলে এবার ঝড় বৃষ্টির ঘটনাটা বল।
তাসনিম আমেরিকার ছেলেটার কথা থেকে শুরু করে আব্বুর মত পাল্টান ও তারপর যা কিছু বলেছে বলে বলল, খালাআম্মার অসুখের খবর শুনে আব্বু তোমার আব্ব আম্মুর কাছে মাফ চাইতে দু’একদিনের মধ্যে দেশের বাড়িতে যাবে বলল। আর আম্মু কালকেই তোমাকে বাসায় নিয়ে আসতে বলল।
আব্দুস সাত্তার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এতক্ষণ কথাটা না বলে যে অন্যায় করেছ, তার শাস্তির জন্য প্রস্তুত থেক।
শাস্তি দেওয়ার সময়টা না বললে প্রস্তুত থাকব কী করে? বাসর রাতে।
দুষ্ট।
কী? আমি দুষ্টু? নিজে অন্যায় করে আমাকে দুষ্ট বলা হচ্ছে?
শুধু দুষ্টু নয়, অসভ্যও।
অন্যায়টা বেশি হয়ে যাচ্ছে। মনে রেখ, শাস্তির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু।
শাস্তির ভয় অত দেখিও না। যে নাকি একটা মেয়েকে ভালবেসে দু’বছর মুখোমুখি হতে ভয় পায়, সে কত বড় বীরপুরুষ জানা হয়ে গেছে।
বীরপুরুষ কিনা বাসর রাতে টের পাবে।
আমিও টের পাওয়াব।
তুমি আবার কী টের পাওয়াবে?
বাসর রাতে দাদি আম্মার সেবা শুশ্রুষা করে কাটাব।
তা হলে আমাকে ভীতু বললে কেন? তুমিই তো আমার থেকে আরো বেশি ভীতু?
ঠিক আছে, কে ভীতু আরা কে বীরপুরুষ, বাসর রাতেই বোঝা যাবে।
এমন সময় সায়মা খপ করে তাসনিমের হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে বলল, এই যে মিস্টার হবু দুলাভাই, এই রুমে যে আপনার একজন ম্যাচিওর অবিবাহিতা হবু শালীও থাকে, তা জেনেও বাসর রাতের গোপন কথাবার্তা বলতে বিবেকে বাধছে না? না বাসর রাতের স্বপ্নে মশগুল হয়ে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন?
স্বপ্নগুলো বাসর রাতের জন্য রিজার্ভ রেখে যা বলছি শুনুন, কাল সকাল আটটায় আসবেন। সবার সঙ্গে নাস্তা খাবেন। আলু আম্মু আসতে বলেছেন। এখন। সুবোধ ছেলের মতো ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ুন। তারপর আব্দুস সাত্তারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিসিভার ক্যাডেলে রেখে তাসনিমকে জড়িয়ে ধরে বলল, “থ্রি চিয়ার্স ফর তাসনিম আপু, হীপ হপ হুর-রে।”
———–
(১) বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-আহমদ, আবু দাউদ
(২) সূরা হুজুরাত, আয়াত-১০, পারা-২৬
(৩) বর্ণনায় : হযরত আবু বাকরাহ (রাঃ)-আবু দাউদ
Leave a Reply