সেয়ানে সেয়ানে – গোলাম মাওলা নঈম
প্রথম প্রকাশ: ২০০১
১. আস্তাবলের সামনে এসে
আস্তাবলের সামনে এসে সিগারেট ধরানোর পর জেমস মরগান খেয়াল করল দেয়াশলাইয়ে আর একটি কাঠিও অবশিষ্ট নেই। বিরক্ত হয়ে বাক্সটা প্রধান সড়কের লাগোয়া নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলল ও, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে আস্তাবলের দিকে এগোল। সামনের বেঞ্চিতে বসা জোয়ান একটা ছেলে দেখছে ওকে, ছোট ছোট চোখে একরাশ কৌতূহল। জেমস যখন স্যাডল ছেড়ে তার দিকে এগিয়ে গেল, ওর লম্বা সুঠাম শরীর আর উরুতে বাঁধা জোড়া পিস্তলের ওপর আটকে থাকল ছেলেটার চোখ।
ঘোড়ার লাগাম হস্তান্তরের পর তরুণ হসল্যারের ছেড়ে যাওয়া আসনে বসল মরগান। ঘণ্টাখানেক পর আসব। ভাল করে যত্ন কোরো, ছেলেটার উদ্দেশে বলল ও। একটা রূপোর ঈগল দেব তোমাকে।
মাথা ঝাঁকিয়ে ওকে আশ্বস্ত করল সে। অনেক দূর থেকে এসেছ, না?
ওয়াইওমিং।
সিগারেট শেষ করে আস্তাবল ছাড়ল মরগান। শূন্যপ্রায় রাস্তা ধরে দক্ষিণে এগোল। হাতের ডানে একটা সেলুন দেখে রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। অগোছাল তবে বারকিপারের আন্তরিক হাসি শেষ পর্যন্ত বেরুতে দিল না ওকে। বারের সামনে উঁচু টুলের সারির একটায় ক্লান্ত দেহ চাপিয়ে হুইস্কির ফরমাশ দিল ও। হুইস্কিতে চুমুক দেয়ার ফাঁকে দেখে নিল সেলুনের ভেতরটা। পাঁচ-ছয়জনের একটা দল আড্ডায় বসেছে এক টেবিলে, নিষ্কর্মা লোক। চেহারা-সুরৎ দেখে বোঝা যায় রকবাজ। দূরে, ও-মাথায় একটা টেবিলে বসেছে দু’জন পাঞ্চার, সামনে হুইস্কির ভরা গ্লাস। নীরব কৌতূহলী চোখে দেখছে ওকে।
কাজের ধান্ধায় থাকলে কিছু খবর দিতে পারি তোমাকে, নিচু কণ্ঠে বলল বারকিপ, মরগানের ঊরুতে ঝোলানো জোড়া পিস্তলের দিকে উদ্দেশ্যপূর্ণ চাহনি হানল ওগুলো যদি সত্যিই ভাল চালাতে জানো, যথেষ্ট খাতির পাবে এখানে।
রেঞ্জ ওঅর?
শেষতক ওরকম হতেও পারে। এখানকার একটা আউটফিট কঠিন কিছু লোক চায়।
তাড়া আছে আমার। অনেক দূর যেতে হবে।
দুদিন আগে মারা গেছে আমাদের মার্শাল, বারকিপারের উৎসাহ কমল না। গরু চুরির তদন্তে বেরিয়ে মারা পড়ল বেচারা। এদিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ার জন্যে মুখিয়ে আছে দুটো বাথান। আইনের বাধা নেই, কে যে কখন কাকে হামলা করে বলে! ইচ্ছে করলে সুযোগটা নিতে পারো। মনে হচ্ছে তোমাকে খাতির করবে ওরা।
আগ্রহ পাচ্ছি না, বন্ধু। ধন্যবাদ। পকেট থেকে খুচরো পয়সা বের করে বিল মেটাল মরগান। মাথায় হ্যাট চাপিয়ে নড় করল বারকিপের উদ্দেশে। প্রত্যুত্তরে ত্যাগ করল লোকটা, ন্যাকড়া দিয়ে বার মোছায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
বেরিয়ে এসে ফুটপাথ ধরে দক্ষিণে এগোল মরগান, হাতের ডানে নাপিতের দোকান পেয়ে ঢুকে পড়ল। সোরেলের যত্নের ফাঁকে সময়টা কাজে লাগানো যেতে পারে, ভাবল ও, টানা পথচলায় সবসময় সুযোগ হয়ে ওঠে না। মুখ ক্ষৌরি করিয়ে নিল। গোসল করার পর অনুভব করল ঝরঝরে লাগছে, দীর্ঘ পথচলার ক্লান্তি কেটে গেছে অনেকটাই।
নাপিতের দোকান থেকে বেরিয়ে ফিরতি পথে আস্তাবলের দিকে এগোল ও, কয়েকটা বাড়ি পর জেনারেল স্টোরের সামনে একটা চাক ওয়্যাগন চোখে পড়ল। চর্বিসর্ব শরীরের চল্লিশোর্ধ্ব এক বুড়ো কয়েকটা প্যাকেট তুলে রাখছে ওয়্যাগনে।
স্টোরে ঢুকল ও। দৈনন্দিন জিনিসপত্র সাধারণত অনেকগুলো একসাথেই কেনে মরগান। ভবঘুরে মানুষের ক্ষেত্রে যা হয়-ফুরিয়ে গেলেও কেনার সুযোগ সবসময় হয়ে ওঠে না। এক প্যাকেট দেয়াশলাই আর বুলেট কিনে দাম মিটিয়ে দিল।
বেরুনোর সময় পাশ ফিরতে দেখতে পেল মেয়েটাকে, ভেতরের কামরা থেকে বেরিয়ে এসেছে। আশ্চর্য কমনীয় মুখ, রুক্ষতার কোন চিহ্নই নেই অথচ তুকটা রোদপোড়া। দীর্ঘ শরীর আকর্ষণ করবে যে কোন পুরুষকে। ওকেই দেখছিল মেয়েটা, আড়চোখে ওর উরুতে বাঁধা জোড়া পিস্তলের দিকে তাকাল একবার, তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দোকানির সাথে কথা বলতে শুরু করল।
স্টোর থেকে বেরিয়ে আস্তাবলে চলে এল মরগান।
মিস বডম্যানের সাথে দেখা হয়েছে, না? সহাস্যে জানতে চাইল তরুণ হসল্যার, আগের মতই পোর্চে বসে আছে। স্টোরের উল্টোদিকে আস্তাবলের অবস্থান বলে সবকিছু দেখেছে।
কিছু বলল না মরগান, নির্বিকার।
এখানকার অনেকেই ওর প্রেমে পড়েছে, কেবল ও নিজে কারও প্রেমে পড়ে না।
তুমি খুব চালাক।
ধন্যবাদ। চলে যাচ্ছ?
উত্তর না দিয়ে স্যাডল ব্যাগে বুলেট আর দেয়াশলাইয়ের প্যাকেট ঢোকাল মরগান। হসল্যার সোরেলটাকে নিয়ে আসতে স্যাডলে চেপে মূল রাস্তা ধরে দক্ষিণে এগোল। একেবারে ঠাণ্ডা শহর, ভাবল ও। রাস্তায় লোকজন কম, সেলুনগুলোও ফাঁকা। আয়তন অনুযায়ী যেরকম হওয়ার কথা, তত লোক বাস করে না এখানে। ক্যাসল টাউনে আগেও এসেছে ও, বছর দুই আগে যেমন দেখেছিল তেমনি আছে শহরটা। খুব একটা বদলায়নি।
রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ দোকানের বেশিরভাগই বন্ধ। কাজ চলছে কিছু দোকানের। একেবারে দক্ষিণে আবাসিক এলাকা। জেনারেল স্টোর, হোটেল, ব্যাংক, ল-অফিস, গির্জা-সবই আছে। ক্যাসল টাউন বড় শহর ঠিকই, কিন্তু এর বড় অসঙ্গতি হচ্ছে দৈন্যদশা।
শহরের ওপাশে মিসৌরি যাওয়ার ট্রেইল, ক্যালট্রপ ক্যানিয়নের পশ্চিমে ওল্ডম্যান মাউন্টেনস হয়ে মিসৌরি নদীর কাছে শেষ হয়েছে। নদীর ওপারে মরগানের আপাত গন্তব্য। অবশ্য তার আগেও থামতে পারে। টেক্সাস থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে চায় ও, স্যাডল ব্যাগের টাকাগুলো কাজে লাগিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন শুরু করার ইচ্ছে।
বামে মোড় নিয়েছে রাস্তা, উল্টোদিকে একটা গলি। মোড় ঘুরে চওড়া রাস্তার ওপর চোখ পড়তে বিস্মিত হলো মরগান। স্পরের আলতো ছোঁয়ায় দাড়িয়ে পড়ল সোরেলটা।
পঞ্চাশ গজ দূরে কাত হয়ে পড়ে আছে চাক ওয়্যাগন, একটু আগে জেনারেল স্টোরের সামনে দেখে এসেছে যেটা। ধুলোর ওপর বসে ককাচ্ছে বুড়ো, আর রাস্তার ঠিক মাঝখানে মেয়েটাকে ঘিরে রেখেছে তিনজন। আশ্চর্য কঠোর হয়ে গেছে সুন্দর মুখটা, জেদ আর ক্ষোভে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে-এতদূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পেল মরগান। কয়েক কদম এগোল সোরেলটা, এখনও ওর উপস্থিতি টের পায়নি কেউ।
বলেছি তো, চড়া সুরে বলল মেয়েটি, অধৈর্য দেখাচ্ছে। যাব না আমি!
যাচ্ছ তুমি, ম্যাম, শরীরের তুলনায় ঘাড় মোটা এমন একজন বলল। পাঞ্চারের পোশাক পরনে, কোমরে সিক্সশূটার।
টেনিসনকে আমার কথা আগেই বলেছি! ঝঝ মেয়েটার কণ্ঠে।
জানতাম জোর করেই নিয়ে যেতে হবে, দুই কদম এগোল লোকটা।
পিছিয়ে গেল নীলনয়না, আতঙ্কিত। তোমরা সবাই কাপুরুষ, তোমাদের বস্-ও! একজন মহিলার সাথে জোর করতে বাধছে না তোমাদের?
খরখর শব্দে হাসল ঘাড়-মোটা। কেউ যখন অবাধ্য হয়, তখন তাকে জোর করতেই হয়, ম্যাম, হাত বাড়িয়ে মেয়েটার কজি চেপে ধরল সে, কিন্তু ঝাড়া মেরে ছড়িয়ে নিল নীলনয়না, রুখে দাঁড়াল এবার। দ্রুত হাত চালাল পাঞ্চার, চড়টা গলে পড়তে কাত হয়ে পড়ে গেল মিস বডম্যান।
সরে এসো, বাছা! লোকটা ফের এগোতে নিচু কণ্ঠে নির্দেশ দিল মরগান।
তপ্ত লোহার ছ্যাকা খেয়েছে যেন, থমকে দাড়াল পাঞ্চার, বিকৃত হয়ে গেছে মুখ। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল, কোমরের কাছে চলে গেছে ডান হাত। বিরক্তি আর ভর্ৎসনা দেখা গেল নীল চোখে। কোন্ নর্দমা থেকে উঠে এসেছ, হাঁদারাম? রাগে চেঁচাল সে।
ওয়াইওমিং যদি তাই হয়…’
তুমি একটা আস্ত বোকা! মরগানের কথা কেড়ে নিল সে। মরার শখ হয়েছে নাকি?
লেডির কাছ থেকে সরে এসো সবাই, ফের বলল ও, নির্লিপ্ত চাহনিতে দেখছে পিস্তলের কাছে চলে গেছে সবার হাত। একটা উপলক্ষ পেলে মুহূর্তে হাতে চলে আসবে, আগুন ঝরাবে।
সাহস আছে তোমার, স্ট্রেঞ্জার, নাকি মাথায় ঘিলু কম বুঝতে পারছি না, হালকা সুরে বলল আরেকজন। তিনজনের বিরুদ্ধে ডুয়েল লড়ার খায়েশ হয়েছে দেখছি! আড়চোখে সঙ্গীদের দিকে তাকাল সে, মুখে চাপা কৌতুকের হাসি। দেখেছ, পয়েট, উরুতে আবার জোড়া পিস্তল ঝুলিয়েছে? উঁহু, গায়ে পড়ে জ্ঞান দিতে আসা কোন মাস্টারবাবুকে কখনও পিস্তল ঝোলাতে দেখিনি আমি। তোমরা কখনও দেখেছ?
সস্তা তামাশায় ভ্রুক্ষেপ করল না মরগান, ভাবলেশহীন দেখাচ্ছে ওকে। সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছে লোকগুলোকে। হিসাবে ভুল করছে ওরা। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। দেখাচ্ছে তিনজনকে, সংখ্যায় বেশি বলে পরোয়া করছে না। মরগানের টান টান হয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গি, চোখের শ্যেনদৃষ্টি কিংবা শীতল নির্বিকার আচরণ মানেই সমূহ বিপদ-কিন্তু কোনটাই ধরতে পারছে না। ভুল করতে যাচ্ছে ওরা, করুণার সাথে ভাবল মরগান। এদের কেউই পিস্তলে চালু নয়, স্রেফ উদ্ধত পাঞ্চার কেবল।
মাফ চেয়ে চলে যাও, বাছা। পয়েট হয়তো ক্ষমা করতেও পারে! তাচ্ছিল্যের সাথে বলল দ্বিতীয়জন।
ওদের সাথে যেতে চাও, ম্যা’ম? মিস্ বডম্যানের উদ্দেশে জানতে চাইল মরগান।
না, স্পষ্ট সুরে বলল মেয়েটি, উঠে দাঁড়িয়েছে।
ব্যস, চুকে গেল ব্যাপারটা। নিজের চরকায় তেল দাও তোমরা।
পয়েট, ঘাড়-মোটাকে ডাকল তৃতীয়জন। সাহস দেখো ওর, কেমন চালবাজি করছে!
পিস্তলের গুলিতে উত্তর দিল ঘাড়-মোটা, ঝটিতি অস্ত্র তুলেই গুলি করল মরগানের পেছনে বাড়ির দেয়ালে চল্টা উঠাল গুলিটা, ওদিকে ধুলোর ওপর নিথর পড়ে থাকল তার দেহ। নিঃসাড় দাঁড়িয়ে আছে অন্যরা, সঙ্গীর পরিণতি দে আতঙ্কে সিটিয়ে গেছে। কখন অস্ত্র বের করে গুলি করেছে মরগান, টেরই পায়নি কেউ।
ভাগো সবাই! বিরক্ত স্বরে বলল মরগান, জানে লড়ার মুরোদ এদের কারও নেই। শুধু শুধু একটা বুলেট খরচ হলো।
তিন মিনিটের মধ্যে সঙ্গীর লাশসহ সরে পড়ল দুই বীরপুরুষ।
বিস্ময় আর ঘটনার আকস্মিকতা সামলে নিতে সময় নিল মেয়েটি। তারপর এগিয়ে এল মরগানের দিকে, মৃদু স্বরে ধন্যবাদ জানাল। ততক্ষণে বুড়োর। সাহায্যে চাক ওয়্যাগনটাকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে মরগান। সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল নীলনয়না, নিজের পরিচয় জানাল-মেলিসা বডম্যান। বুড়ো লোকটা বডম্যানদের কূক, ক্লীভ অ্যালেন।
মাথা থেকে হ্যাট সরিয়ে নড় করল মরগান, তারপর সোরেলের দিকে এগোল। পরিচিত হয়ে খুশি হালাম, ম্যাম।
কোথায় যাচ্ছ? অবাক হয়েছে মেয়েটি।
মিসৌরি।
কি কাণ্ড! আমাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগও দেবে না? অসন্তুষ্ট স্বরে বলল মেলিসা বডম্যান। নিদেনপক্ষে একসাথে পান করতে পারি আমরা। তারপর আমাদের বাথানে যাব…অবশ্য তোমার সময় হলে মি, মরগান।
ভাবতে হলো ওকে। শেষে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে না তো?
প্লীজ! অনুরোধ এল।
দ্বিমত করল না মরগান। সুন্দরী কোন মেয়েকে মুখের ওপর নিরাশ করেনি ও কখনও, মেলিসা বডম্যানের ক্ষেত্রে সাহসও হবে না বোধহয়। অস্বীকার করার উপায় নেই নীলনয়নার কাছাকাছি হওয়ার আগ্রহ জমাট বেঁধে আছে ওর ভেতরে।
যেতে যেতে ওর সম্পর্কে জানতে চাইল মেলিসা, কিন্তু কৌশলে এড়িয়ে গেল মরগান। শহরটা কিভাবে গড়ে ওঠা উচিত ছিল এ নিয়ে আলাপ শেষ করার আগেই একটা সেলুনের সামনে পৌঁছে গেল ওরা। নিরিবিলি ও পরিচ্ছন্ন পানশালা, ভাল লাগল মরগানের। মেলিসার বিপরীতে বসল ও। ওর জন্যে হুইস্কি আর নিজের জন্যে অরেঞ্জ জুসের ফরমাশ দিল মেয়েটি।
নিজের প্রসঙ্গ তো এড়িয়েই গেছ, এই ঝামেলাটা সম্পর্কেও জানতে চাওনি তুমি।
আমার মত মানুষদের অত কৌতূহল নেই।
খানিক তাকিয়ে থাকল মেলিসা, তারপর মৃদু হাসল। বাথানে যাচ্ছ তো?
নড করল মরগান, মেয়েটি নিজের কৌতূহল চেপে রাখায় কৃতজ্ঞ বোধ করছে। ও একটু ভিন্ন ধাতের মানুষ, নিজের সম্পর্কে আলোচনা ওর অপছন্দ। মেলিসা হয়তো তা বুঝতে পেরেছে, কিংবা হতে পারে ভুলও বুঝেছে। নিজের সম্পর্কে যে তোক কিছু জানাতে চায় না, তার জীবনে আপত্তিকর কিছু থাকবেই-এ ধরনের চিন্তা মেয়েটির মাথায় খেলে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। সেসব ভেবে মাথা ঘামাল না মরগান, ওর সম্পর্কে কে কি মনে করল তা নিয়ে চিন্তা করা ওর ধাতে নেই।
উঠল ওরা। পানীয়ের দাম পরিশোধ করেছে মেলিসা, এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে ভদ্রতা দেখাতে যায়নি মরগান। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ দিচ্ছে। ওয়্যাগনের কাছে এসে সোরেলে চাপল ও। চালকের আসনে বসে অপেক্ষা করছিল ক্লীভ অ্যালেন, তার পাশে উঠে বসল মেলিসা। শহর ছাড়িয়ে পুবের ট্রেইল ধরে এগোল ওয়্যাগন। ইতোমধ্যে বডম্যানদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে ফেলেছে মরগান। মেলিসার বাবা পঞ্চাশোর্ধ্ব এক বুড়ো যে মুক্ত সরল জীবন পছন্দ করে, টেনেসি ছেড়ে তাই এদিকে এসেছে বাপ-বেটি। অল্প সময়ের মধ্যে এখানে মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে। মিসেস বডম্যান মারা গেছে মেলিসার যখন এগারো চলছিল। বলতে গেলে কৃকের হাতেই বড় হয়েছে মেলিসা। বাপ-মেয়ে আর ক্লীভ, এ তিনজন মিলে ওদের পরিবার।
বামে মোড় নিয়েছে ট্রেইল, হাতের ডানে মাইল খানেক দূরে ক্যাকটাস হিলের ঝাঁপসা দেহ। চিরুনির মত খাঁজকাটা চূড়াগুলো চোখে পড়ছে। ধূলিধূসর পথের দু’পাশে অনাবাদী জমি। পাহাড়শ্রেণী পেরিয়ে আসার পর অবশ্য বদলে গেল পরিবেশ। ডানে বিস্তৃত তৃণভূমি চোখে পড়ল, বাতাসে দুলছে-বড়বড় ঘাস। বাথানের জন্যে আদর্শ জায়গা। মরগান ভেবে পেল না ওখানে কেন বসতি করেনি কেউ। একপাশে খানিকটা উঁচু জমি, লজপোল পাইনের বিশাল ঝাড়ের সামনেই। ওখানে র্যাঞ্চ-হাউস তৈরি করলে চমৎকার লাগবে। পেছনে ক্যাকটাস হিলের দৈত্যাকার অবয়ব জায়গাটার সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ফ্ল্যাগ-বি বাথানে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। বিশাল ফটকের পর বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, শেষে র্যাঞ্চ-হাউস। বাথানটা এখনও প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে বলে অগোছাল লাগছে। অভিজ্ঞ হাতের ছোঁয়া পেলে সেরা হয়ে উঠতে পারে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস পাহাড়ের কোলে র্যাঞ্চ-হাউসের অবস্থান, দূর থেকে চমৎকার লাগে।
সুদর্শন এক বুড়োকে দেখা গেল পোর্চে, মেলিসার সাথে চেহারার মিল আছে। কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে মাপছে মরগানকে, ক্ষীণ আগ্রহ প্রকাশ পেল চাহনিতে। ব্যক্তিত্ববান পুরুষ, প্রথম দর্শনে মনে হলো ওর কাছে।
এরপর দৌড়ে বারান্দায় উপস্থিত হলো ছোট্ট একটা ছেলে। মেলিসাকে দেখে স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত হলো মুখ। ছুটে এসে মেলিসার কোলে জায়গা করে নিল। প্রাণবন্ত আর সজীব লাগছে বাচ্চাটাকে। দেরি করেছ! অভিযোগ করল ছেলেটা
বডম্যান-কন্যা চুমু খেল তাকে। দুঃখিত, শ্যন। এরকম হবে না আর।
ঠিক তো?
বাধ্য মেয়ের মত মাথা ঝাঁকাল মেলিসা।
খুশি হয়ে মায়ের কোল ছাড়ল শ্যন, ছুটে ঢুকে গেল ভেতরে।
বারান্দায় উঠে এসে বাপের সামনে দাঁড়াল মেলিসা, সকালে শহরে ঘটে যাওয়া ঘটনা জানাল।
নির্বিকার মুখে শুনে গেল বাথান মালিক। মেলিসা থামার পর আপনমনে হাসল। ওর কাছে যাওয়াই ঠিক হত, শেষে মন্তব্য করল।
কি বলছ, বাবা! লোকটা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে বলেছে, আমি কি ফেরারী? ওর লোক আমার গায়ে হাত তুলেছে…হঠাৎ মরগানের ওপর চোখ পড়তে থেমে গেল মেলিসা। নিজেকে সামলে নিয়ে বাপের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল অতিথিকে।
সৌজন্যমূলক আলাপের ক্ষেত্রে যা হয়, বেশিদূর এগোল না। অতিথির মুখে মৃদু অস্বস্তির ছায়া হয়তো দেখে থাকবে মেলিসা, লাঞ্চের প্রসঙ্গ তুলে মরগানকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বাবা তোমাকে পছন্দ করেনি, অস্বস্তিভরা কণ্ঠে বলল ও। কিছু মনে করোনি তো?
না। এটাই স্বাভাবিক।
কি বলতে চেয়েও নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল মেয়েটি। শেষে শ্রাগ করে বলল: তবু আজকের ঘটনার জন্যে তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমরা।
পাশাপাশি এগোল মরগান। এসব ছোটখাট ব্যাপারে মাথা ঘামানো ওর ধাতে নেই। স্বয়ং ওর বাবাও মরগানের বাউণ্ডুলে জীবন পছন্দ করে না, তাই অনেক আগে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। ফেরে খুব কম, তা-ও জন্মদাত্রীর কারণে। শেষবার গিয়েছিল গত বড়দিনে।
একসাথে লাঞ্চ করল ওরা। কফি আসার পরপরই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল সেয়ানে সেয়ানে
ক্লীভ অ্যালেন। উদ্বেগে কুঁচকে গেছে বুড়োর চোখ-মুখ। মেলিসাকে ডেকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।
ঠিক দুই মিনিট পর ফিরে এল মেলিসা। ওর শুকনো মুখ আর উৎকণ্ঠা দেখে প্রমাদ গুণল মরগান। জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হলো না, জানে নিজ থেকেই বলবে। মেয়েটা।
ছেড়ে যাওয়া আসনে বসল মেলিসা। দ্বিধা ওর মুখে। এরকম হবে জানলে কিছুতেই এখানে আসতে জোর করতাম না তোমাকে, স্নান, অপরাধী কণ্ঠে বলল। ওরা আসছে, মি. মরগান.. হয়তো জানে এখানেই আছ তুমি।
কিছুটা বুঝতে পারল মরগান, বাকিটা আন্দাজ করে নিল। মেরুদণ্ডে শীতল একটা অনুভূতি হচ্ছে। কোন কারণ নেই, তবু বিপদের আগে ঠিক ঠিক টের পায় ও। আমি চাই না তোমাদের কোন ক্ষতি হোক, ম্যাম, শান্ত, নিষ্কম্প সুরে বলল ও। কারা ওরা?
আলফ্রেড টেনিসনের লোক, শহরে যারা আক্রমণ করেছিল আমাকে।
২. স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মরগান
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মরগান, চোখের পলক পড়ছে না। সেকেন্ড দুই, তিন…পাচ। ক’জন?’ শেষে জানতে চাইল ও। ফের শিহরণ উঠল মেরুদণ্ড বরাবর-বিপদ!
ছয়জন।
সদ্য ফেলে আসা অতীতে ফিরে গেল সে। আবার ঝামেলা! এ জিনিসটাকেই ভয় পেয়েছিল, অথচ শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ল বোধহয়, এবং খুব কম সময়ের মধ্যে। এরকম কিছু হতে পারে আশঙ্কা করেছিল, তবে ধারণা করতে পারেনি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পিছু নেবে আলফ্রেড টেনিসন। লোকটা সম্পর্কে ওর অতি স্বচ্ছ ধারণা-ভয়ঙ্কর লোক সে। পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে যে তোক নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেলে, এছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না তাকে। আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার, মেলিসা বডম্যান বা ফ্ল্যাগ-বি বাথানের সাথে তার বিরোধ চলছে। এদেরকে বেশ ভোগাবে লোকটা।
আধ-খাওয়া সিগারেট ছাইদানিতে গুঁজে উঠে দাঁড়াল মরগান।
ইচ্ছে করলে পেছন দিক দিয়ে চলে যেতে পারো তুমি, মি. মরগান, জানাল মেলিসা, ভয় আর আশঙ্কা দূর হয়ে গেছে মুখ থেকে। আত্মবিশ্বাস আর বুদ্ধিমত্তার ছটা চোখে। এখনও অনেক দূরে আছে ওরা। পাহাড়ের পাশ দিয়ে একটা ট্রেইল আছে, চিনি আমি। এখন রওনা দিলে ওরা পৌঁছানোর আগেই অনেক দূর চলে যেতে পারবে।
ধন্যবাদ, ম্যাম, তিক্ত সুরে বলল ও। আমার মনে হয় না লড়াই করার জন্যে আসছে ওরা। আমার ইচ্ছেও সেরকম, এখানে লড়তে যাওয়া মানে তোমাদের ওপর ঝামেলা চাপিয়ে দেওয়া। তাছাড়া আমি কোন অন্যায় করিনি, ডুয়েলটা ফেয়ার ছিল।
মাথা ঝাঁকাল বডম্যান-কন্যা। তবুও…তোমার বোধহয় ওদেরকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
ক্ষীণ হাসল মরগান। পিছিয়ে যাওয়া আমার খুব অপছন্দ, ম্যাম।
কিন্তু… বলতে গিয়েও থেমে গেল মেয়েটি, শ্রাগ করে মৃদু হাসল। তুমি ভীষণ একরোখা, মি. মরগান।
দৃঢ় পায়ে এগোল মরগান।
পিছু নিল মেলিসা। সহসা উল্টোদিকের কামরা থেকে বেরিয়ে এল বাড়ির সবচেয়ে ছোট্ট সদস্যটি। কিছু একটা বলতে চেয়েছিল সে, কিন্তু তার আগেই তাকে কোলে তুলে নিল মেলিসা। আমার ঘরে চলে যাও, শ্যন, ছেলের কপালে চুমো খেয়ে বলল ও। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত ওখানেই থেকো। বুঝেছ?
মাথা ঝাঁকাল ছেলেটা। তাড়াতাড়ি এসো। ঘুমোব আমি।
আমার শ্যন সোনা, লক্ষ্মী ছেলে! চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। খানিক এগিয়ে অতিথির উদ্দেশে পেছনে তাকাল মেলিসা, বারান্দায় চলে গেছে সে। দ্রুত পা চালাল ও, শ্যনকে পৌঁছে দিয়ে একগাদা খেলনা রাখল সামনে, প্রিয় খেলনাগুলোও-ঘোড়া, হান্টার, ইন্ডিয়ান। মেলিসা চায় না র্যাঞ্চ হাউসের সামনে চলে আসুক শ্যন। নিশ্চিন্ত হয়ে বারান্দায় এল ও।
ততক্ষণে অনেকটা কাছে চলে এসেছে টেনিসনের লোকেরা। পোর্চ থেকে বিশ হাত দূরে এসে থামল ওরা। ছয়জন। এদের দু’জনকে সকালে ক্যাসল টাউনে দেখেছে মরগান। যে লোকটা মেলিসাকে চড় মেরেছিল, সে নেই।
দুই কদম এগোল বাদামী রঙের একটা মাসট্যাঙ, মেলিসার চোখে সরাসরি তাকাল এর আরোহী। এতটা শীতল আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, মেলিসার মনে হলো লোকটা ওর চোখ ভেদ করে অন্তস্তল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে, পড়ে নিচ্ছে সব চিন্তা-ভাবনা। ছাইরঙা চোখগুলো যেন জ্বলন্ত অঙ্গার, অনুভব করে শিউরে উঠল ও, অজানা কারণে কেঁপে উঠল সারা শরীর।
লোকটা আলফ্রেড টেনিসন।
মাসট্যাঙের ওপর এমনভাবে বসেছে যাতে একইসাথে আত্মবিশ্বাস আর আভিজাত্য প্রকাশ পায়। একেবারেই সাধারণ বেশভূষা-নীল শার্ট, লেভাইসের প্যান্ট আর চামড়ার চ্যাপস। কাউহ্যান্ডদের সাধারণ হ্যাট তার মাথায়, গলায় সাদা ব্যানডানা। কোমরে কিংবা উরুতে হোলস্টার বা পিস্তলের খাপ নেই। হাসছে। টেনিসন। তার হাসি প্রাণবন্ত এবং আকৃষ্ট করার মত। খানিকটা বিস্মিত হয়েছে মরগান। ওর চিন্তায়-ধারণায় আলফ্রেড টেনিসনের থাকা উচিত উল্টো সাজে, উল্টো মেজাজে। স্বীকার করতেই হবে ওর বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে লোকটা। মরগান ভেবে পেল না শত্রু হিসেবে ঠিক কিভাবে নেবে তাকে। বাইরে থেকে একেবারে সাধারণ মানুষ মনে হচ্ছে। হয়তো পুরোটাই ভান, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারল না ও।
লিসা, ভরাট গলায় ডাকল টেনিসন। তোমাকে যেতে বলেছিলাম।
আমার গায়ে হাত তুলতে বলোনি নিশ্চই? রুক্ষ স্বরে বলল মেলিসা বডম্যান, অনেকটা সামলে নিয়েছে যদিও কণ্ঠের অস্বস্তি বা মানসিক অস্থিরতা তাতে ঢাকা পড়েনি।
ম্লান হলোনা টেনিসনের হাসি। হপ্তাখানেক বিছানা ছাড়তে পারবে না ও, চাকুরিও খুইয়েছে, আড়চোখে মরগানের দিকে তাকাল সে, চোখে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি। কারণ তোমার গায়ে হাত তুলেছে ও। আমার সম্পদের গায়ে কারও হাত পড়বে তা কিভাবে বরদাস্ত করি? করবও না।
কবে হলাম? বিদ্রূপ করল মেলিসা।
ভাল করেই জানো তুমি, একই সুরে জবাব দিল টেনিসন, মেলিসার উত্তরের অপেক্ষা করল না। সরাসরি মরগানের দিকে তাকাল সে এবার, শীতল হয়ে এল। ভরাট কণ্ঠ। মি. জেমস মরগান, ওয়াইওমিং থেকে এসেছ, যাবে মিসৌরি। আশা করছি আগামীকালের মধ্যে যাত্রা করবে তুমি। আমার এক ক্রুকে খুন করেছ, তবু একটা সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে।
এখুনি যেতে হবে, বললে না? শোনো, মিস্টার, সকালের ডুয়েলটা ফেয়ার। ছিল, হাসলেও, লোকটার বলা তথ্যগুলো ভাবাচ্ছে মরগানকে। আমার আগেই। পিস্তলে হাত দিয়েছিল তোমার লোক। খুঁটিনাটি তথ্যগুলো জানল কিভাবে? নিজের লোক, হসল্যার ছেলেটা…বারকিপ, তিনজনের সাথে আলাপ করে তা সম্ভব। কাজটা সে করেছে সংক্ষিপ্ত সময়ে। বোঝা যাচ্ছে চালু লোক। নাকি অন্য কোন ব্যাপার?
থেকে গেলে অবশ্য ভালই হবে, খেলাটা জমবে
কি যেন একটা আছে তার বলার সুরে, নাকি ভুল শুনেছি? কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল মরগান, পরিস্থিতিটা পছন্দ হচ্ছে না ওর। এখানে এসেছ কেন, আমাকে হুমকি দিতে?
টেনিসনের দৃষ্টি স্থির হলো ওর ওপর, দুর্বোধ্য হাসি ঝুলছে ঠোঁটের কোণে। নীরবে দেখল ওকে, তারপর অলস ভঙ্গিতে স্যাডলে নড়েচড়ে বসল। তুমি এসেছ কেন, মরগান? হেসে পাল্টা জানতে চাইল। ঘণ্টা দুয়েক আগে একটা খুন করে এসেছ। এখন গা ঢাকা দেয়াই উচিত তোমার। ডুয়েলটা হয়তো ফেয়ার ছিল, কিন্তু টার্নার, মানে যাকে খুন করলে, ওর বন্ধুরা যদি তোমাকে চ্যালেঞ্জ করে? প্রিয়জন হত্যার বদলা নেয়ার অধিকার সবারই আছে, তাই না?
পরামর্শ চাইনি।
কিন্তু এটাই আমার শেষ কথা! ঘোষণা করল টেনিসন, চাপা দম্ভ প্রকাশ পেল কণ্ঠে। তুমি চলে গেলে অযথা কিছু ঝামেলা এড়াতে পারব আমরা। আমার ধারণা সেরকম ইচ্ছে তোমারও আছে। এবার মেলিসার দিকে তাকাল সে, খানিকটা কোমল সুরে বলল: জায়গাটা আমাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত তোমার।
সন্দেহ আছে আমার।
মনে হলো তর্ক করবে টেনিসন, ক্ষণিকের জন্যে ক্ষোভ দেখা গেল চোখে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে হাসল সে। শ্যন কোথায়?
রক্ত সরে গেল মেলিসা বডম্যানের মুখ থেকে, আতঙ্ক ফুটে উঠল চোখে। না! ওর কাছে যেতে পারবে না তুমি!
কেন? হাসছে টেনিসন।
কোন অধিকারে যাবে?
কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল সে, ভাবল কিছু একটা। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে টুপির কিনারা ছুঁয়ে উইশ করল মেলিসাকে। শ্যন আর ওর নানাকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো। স্পারের মৃদু খোঁচায় ঘুরল মাসট্যাঙটা, এগোল ফিরতি পথে।
পেছনে সঙ্গীরা অনুসরণ করল তাকে।
মরগান খেয়াল করল চিন্তিত দেখাচ্ছে মেলিসাকে। তাকিয়ে আছে দলটার দিকে, চোখে জেদ। তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল ও। ধারণা করল টেনিসনের সায্যে কোন একটা সমস্যায় আছে মেয়েটা। কৌতূহল হলেও নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল। প্রয়োজন ছাড়া অন্যের ব্যাপারে কৌতূহল দেখায় বোকা আর অলসরা। যথেষ্ট তাড়া আছে ওর, অনেক দূর যেতে হবে।
নিশ্চয়ই আমার মত ভয় পাওনি তুমি? স্লান হাসি দেখা গেল মেলিসার মুখে, কণ্ঠে কৌতুক। স্বীকার করছি ওকে সত্যিই ভয় পাই আমি। আলফ্রেড টেনিসন একজন বেপরোয়া লোক, সপ্রতিভ ভাবটুকু ফিরে এসেছে মেয়েটির চেহারায়, উজ্জ্বল হলো চোখ। বাতিলের ভঙ্গিতে একটা হাত নাড়ল। এবং খারাপ লোক, অন্তত এখন।
আমাকে একটা সুযোগ দিয়েছে ও। ওটা নেব আমি
সোরেলের কাছে এসে দাঁড়াল মেলিসা বডম্যান, চোখে কৃতজ্ঞ দৃষ্টি। গুডলাক, মি. মরগান।
স্যাডলে চেপে ট্রেইলের পথ ধরল মরগান।
আলফ্রেড টেনিসন সাবধানী ও ধূর্ত। ওকে কি এভাবে ছেড়ে দেবে? ভাবছে মরগান, নাকি বুঝে গেছে গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া আছে ওর? এ ধরনের লোকদের ক্ষেত্রে যা হয়-কখনও পিছু ছাড়ে না। টেনিসন ঠিক ওরকম না হলেও, লোকটার মধ্যে মরগান এমন কিছু দেখেছে যাতে ওর ধারণা হয়েছে একটা সুযোগ সত্যি পেয়েছে। আদৌ কি তাই? হতে পারে ক্যাসল টাউন পেরুনোর আগেই চোরাগোপ্তা হামলায় প্রাণ হারাবে ও, কিংবা হয়তো অযথাই সন্দেহ করছে। আসলে লোকটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই ওর, মিনিট পাঁচেকের সাক্ষাতে তা পাওয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু অবচেতন মন থেকে একটা হামলা আশা করছে মরগান।
এবং তৈরিই আছে ও।
ফ্ল্যাগ-বি বাথানের সীমানা ছাড়িয়ে মাইল চারেক আসার পর রাশ টানল ও। সময় নিয়ে সিগারেট ধরাল। দৃষ্টি দু’শো গজ দূরের উঁচু উপত্যকায়। যাওয়ার সময়ও জায়গাটা ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চকিতে মনে হলো মিসৌরি কেন এখানেই থেমে যেতে পারে! সেটা কি উচিত হবে যেখানে রয়েছে আলফ্রেড টেনিসনের মত শক্র, যে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে শত্রু নিধনে বেরিয়ে পড়ে, তা-ও ক্ষুদ্র কারণে? মরগান কাপুরুষ নয়, ঝামেলা এড়াতে পারে না এটাই হচ্ছে ওর দোষ। গন্তব্যে পৌঁছতে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে ওকে। এ কদিনের যাত্রায় ক্লান্তি এসেছে, থামার আকুতি আছে ওর ভেতর, তবু উপায় নেই। ক্যাসল টাউন ওর জন্যে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। মরগানের মাথা-ব্যথা সেখানেই। শান্তিপূর্ণ একটা জায়গায় স্থির হতে চায় ও
আলতো পায়ে স্পার দাবাল জেমস মরগান। একশো গজের মত এগিয়ে বামের ট্রেইলে নেমে পড়ল ঘোড়াটা। আশপাশে প্রচুর ঘাস আর ছোট ছোট জুনিপার ঝোঁপ। উপত্যকাটা আরও সামনে। ধীরে, অলস ভঙ্গিতে ওখানে উঠে এল সোরেলটা, কিন্তু সওয়ারীর মধ্যেই আগ্রহ বেশি। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকল ও, বুক ভরে টেনে নিল পাইনের সুবাসমাখা বাতাস। চোখ খুলে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তৃণভূমির দিকে। পুরো জায়গাটা সবুজ ঘাসে ছাওয়া। দৃষ্টিসীমার একেবারে শেষ প্রান্তে লজপোল পাইনের বন, বাতাসে নাচছে ওগুলোর ছোট ছোট ডাল। ডানে দিগন্তজোড়া ক্যাকটাস হিল।
নিজ থেকে ঘাস ঠেলে এগোচ্ছে ঘোড়াটা।
হঠাৎ মেলিসা বডম্যানকে মনে পড়ল ওর। দারুণ মহিলা। সুন্দরী, মিশুক ও নিরহঙ্কারী। সচরাচর এমন মহিলা দেখা যায় না। শ্যনের বাবা, সৌভাগ্যবান লোকটি কে?
আচমকা সাহসী হয়ে উঠল ও, ভাবছে এখানেই বসতি করবে কি-না…স্যাডল ব্যাগের টাকাগুলো কাজে লাগিয়ে এ জমিটা কিনতে পারে। তারপর একটা বাথান…স্বপ্ন বটে! নিজেকে ধিক্কার দিল মরগান। একটা বাচ্চা ছেলের চেয়েও খারাপ হয়ে গেছে সে। নিজের মধ্যে দ্বিধা আবিষ্কার করে অবাক হলো। এরকম হবে ভাবাই যায় না, কারণ ওর সারা জীবনে সিদ্ধান্ত নিতে কখনও দেরি হয়নি। যারা ওকে চেনে, জানে ভেবে-চিন্তে এগোয় সে। অথচ এখন ভাবনাগুলো পর্যন্ত গুলিয়ে ফেলেছে।
তৃণভূমির অনেক গভীরে চলে এসেছে মরগান। ভাবনায় ব্যস্ত ছিল, নইলে ধাতব নলে সূর্যের আলোর প্রতিফলন ওর মত সাবধানী লোকের চোখ ফাঁকি দিতে পারত না। কানের পাশ দিয়ে কিছু একটা সুর তুলে চলে যাওয়ার মুহূর্তে রাইফেলের গর্জন শুনতে পেল। এতক্ষণের নীরবতা ওর অন্তস্তল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তা নষ্ট হওয়ায় ভেবে পেল না কি করবে, স্থবির বসে থাকল স্যাডলে। কিন্তু সোরেলটা ছুটতে শুরু করেছে-উল্কা বেগে, পাইনের বন বরাবর ছুটছে।
প্রথমবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও এবার আর হলো না, মরগানের ডান কাঁধে বিধল গুলিটা। সবে হুঁশ ফিরেছে ওর তখন, মাথা নিচু করে স্যাডলের সাথে শরীর মিশিয়ে ফেলেছে। গুলির তীব্র ধাক্কায় পেছনে হেলে পড়ল দেহ, আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও পড়ে গেল স্যাডল থেকে। রেকাবে আটকে রইল ডান পা, ওদিকে ছুটে চলেছে ঘোড়াটা।
হায় খোদা, প্রান্তরটা যদি ঘাসের না হত, এতক্ষণে দফারফা হয়ে যেত ওর! লোকটা যদি ফের লক্ষ্যভেদ করতে পারে তাহলেই সেরেছে। এবার লাগানো একেবারেই সহজ।
শূন্য প্রান্তরে আরেকবার রাইফেল গর্জে ওঠার আগেই রেকাব থেকে পা মুক্ত করে ঘাসের ওপর শরীর ছেড়ে দিল মরগান। দূরে সরে যাচ্ছে ঘোড়াটা। পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে সত্যি, কিন্তু এ-ও ঠিক আপাতত মুক্ত সে, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও। লম্বা ঘাসের আড়াল থাকায় ওর অবস্থান আঁচ করতে পারবে না লোকটা। পঞ্চাশ গজের মধ্যে আছে আততায়ী, ধারণা করল মরগান।
বুক ধড়ফড় আর পাগলা নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হতে চারপাশে শব্দ শোনার আশায় ইন্দ্রিয়গুলোকে অবাধ স্বাধীনতা দিল মরগান। ঠায় পড়ে আছে ও, কান খাড়া, চোখের পলক পর্যন্ত ফেলছে না। বাতাসে ঘাস নড়ার শা শা শব্দ ছাপিয়ে অন্য কিছু কানে এল না। অনেকক্ষণ পর নিশ্চিত হলো এগিয়ে আসছে না কেউ। এ ফুরসতে ক্ষতটার দিকে মনোযোগ দিল। এক খাবলা মাংস তুলে নিয়ে চলে গেছে সীসা, অনবরত রক্ত ঝরছে। মোটামুটি গুরুতর, তোগাবে কয়েকদিন। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করার প্রয়াস পাচ্ছে ও, ভয় হচ্ছে অত্যধিক ব্যথায় না শেষে ছটফট করতে শুরু করে, আর এ সুযোগে ওর অবস্থান জেনে ফেলবে লোকটা।
বাম হাতে হোলস্টার থেকে কোল্ট বের করে পাশে রাখল ও। সময় নিয়ে খুলল শার্টখানা। হাতা ছিড়ে, বগলের নিচ দিয়ে কাঁধ বেঁধে ফেলল। তেমন জুতসই হয়নি, তবে একহাতে এরচেয়ে ভাল কিছু সম্ভবও নয়। এটুকু করেই ক্লান্তি লাগছে। কান খাড়া করে পুরো বিশ মিনিট পড়ে থাকল ও। অধৈর্য লাগছে। ক্ষতের যন্ত্রণা বন্ধ হয়নি, মনে হচ্ছে বেড়েই চলেছে। ওদিকে অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে প্রতিপক্ষ। পেশাদার লোক, ভাবল মরগান, ঝুঁকি নিয়ে নিজের অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে নারাজ। নিজে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে গ্যাড়াকলে ফেলে দিয়েছে ওকে।
ইতোমধ্যে কয়েকবার রাইফেলে আলোর প্রতিফলন চোখে পড়েছে ওর। যে লোক এত সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারে, এরকম বোকামি করবে না সে; গৃঢ় কোন উদ্দেশ্য আছেই, এবং তা জানে মরগান। লোকটা চায় ঘাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসুক ও। সে-ইচ্ছে ওর আছে ঠিকই তবে সময়ে, সুযোগমত বেরুবে। হয়তো মাত্র একবারই গুলি করার সুযোগ পাবে, ওই একবারেই সফল। হতে হবে। আশার কথা বাম হাতেও সমান তালে অস্ত্র চালাতে পারে ও, সক্ষ্যভেদেও দারুণ।
ধীরে ধীরে একটা পরিকল্পনা দাঁড় করাল মরগান, সম্ভাবনা বিচার করল-ঝুঁকি বেশি, কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। ঘন্টার পর ঘণ্টা এখানে পড়ে থাকার মানে হয়। মত বদলে কাছে চলে আসতে পারে লোকটা। তাহলে কিছুই করার থাকবে না ওর, কাজ সারার জন্যে একটা সীসাই যথেষ্ট।
কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে সোরেলটা। চাপা, নিচু স্বরে শিস দিতে কান খাড়া করল, ক্ষণিকের জন্যে ইতস্তত করার পর ছুটতে শুরু করল। শেষবারের মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশ দেখে নিল মরগান, ইতিকর্তব্য স্থির করে নিল পুনরায়। ধরেই নিয়েছে ওর পরিকল্পনা আঁচ করে ফেলবে লোকটা। ঘোড়াটা কয়েক হাত দূরে চলে আসতে, ঝটিতি উঠে দাঁড়াল ও। ছুটতে শুরু করল সোরেলের পাশাপাশি, হাত বাড়িয়ে স্যাডল হন চেপে ধরে এক লাফে উঠে বসল স্যাডলে। পমেল আঁকড়ে ধরে স্যাডলের সাথে মিশিয়ে ফেলল শরীর। এক নাগাড়ে গুলি করে চলেছে প্রতিপক্ষ, কিন্তু লাগাতে পারছে না। এ অবস্থায় লক্ষ্যভেদ করা সহজও নয়। ওকে বেঁধানোর চেয়ে বরং ঘোড়াটাকে পেড়ে ফেলা অনেক সহজ, কিন্তু তাতে অবস্থার হেরফের হবে না খুব একটা।
অকস্মাৎ রাশ টানল মরগান, গতিপথ বদলে উল্টোদিকে ঘোড়া ছোটাল। হাতে চলে এসেছে কোল্টখানা। পাইন বনের কাছে, উঁচু জায়গাটায় চোখ পড়তে। দেখতে পেল আততায়ীকে। রাইফেল উচিয়ে গুলি করছে বিশালদেহী লোকটা। প্রতিপক্ষের মরিয়া অবস্থা আঁচ করতে পেরেছে, বুঝেছে নিজের সঙ্কটাপন্ন। অবস্থাযত কাছে যাবে মরগানের সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। কাজটা শেষ করার তাগিদে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সে।
নিশানা করে গুলি করল মরগান, হ্যামার টানার সময় তীব্র বেগে কিছু একটা আঘাত করল ওর ডান উরুতে। হোঁচট খেয়েছে যেন, সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল ও। হাত ফস্কে পড়ে যাচ্ছিল কোল্ট, শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে স্যাডলের সাথে মিশে থাকার চেষ্টা করল। ইতোমধ্যে শক্রর অনেক কাছে চলে এসেছে।
ফের নিশানা করছে লোকটা।
দূরত্বটুকু হিসাব করে কোমরের কাছ থেকে গুলি করল মরগান। ভেবেছিল ছুটে চলার ঝাঁকুনিতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে আগেরটার মত, কিন্তু লোকটাকে টলে উঠতে দেখে খুশি হলো। সোৎসাহে গুলি করল আবার। সটান পেছন দিকে আছাড় খেল বিশালদেহী, হাত থেকে রাইফেল খসে পড়ল। প্রায় সাথে সাথেই ওকে বিস্মিত করে দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু পড়ে গেল আবার। ওঠার চেষ্টায় ইস্তফা দিয়ে শুয়ে থেকে নিশানা করার প্রয়াস পেল। ধীর গতি, হাত চলছে না, এবং প্রয়োজনীয় শক্তিও যেন পাচ্ছে না। ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে মরগান, নির্দ্বিধায় শিকারীর কপাল ফুটো করল। শেষ মুহূর্তে চার চোখ এক হয়ে গিয়েছিল ওদের, অসহায়ত্ব আর বিরক্তি ফুটে উঠেছিল লোকটার চোখে; কিন্তু শুধু করুণাই বোধ করল মরগান।
অজান্তে শিউরে উঠল ওর দেহ। লোকটার শেষ গুলি চুলে সিঁথি কেটে চলে গেছে। স্বীকার করতেই হবে দুর্দান্ত হাত ছিল লোকটির। কিন্তু জয়-পরাজয় নির্ধারণে একটা পদক্ষেপই যথেষ্ট। আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে ভুল করেছে সে, মাসুল তো দিতেই হবে।
ঢাল বেয়ে উঁচু জায়গাটায় উঠে এল মরগান। লোকটাকে দেখল-কোমরের জোড়া হোলস্টারে বহুল ব্যবহৃত চকচকে বাটে সিক্স্যটার। চেহারার আদল চেনা চেনা লাগলেও স্মরণ করতে পারল না ও। হয়তো ভাড়াটে লোক। স্যাডল থেকে নামার ইচ্ছে হলো না ওর, নিশ্চিত জানে কোন চিহ্ন থাকবে না। পেশাদার লোক চিহ্ন রেখে যাওয়ার মত সামান্য ভুল করে না।
একটা গ্রুলা দাঁড়িয়ে ছিল অদূরে। ব্র্যান্ড নেই, এটাই স্বাভাবিক। মরগান যদি। আলফ্রেড টেনিসনের হয়ে কাজ করত, নিজের ঘোড়ই ব্যবহার করত। শুধু একটা। ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে, টেনিসনের সাথে ফ্ল্যাগ-বিতে যায়নি এ লোক।
সরে এসে প্রভুর পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল গ্রুলাটা। ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে খলিত পায়ে লজপোল পাইনের সারির দিকে এগোল এরপর। এ অবসরে হারিয়ে যাওয়া হ্যাটখানা খুঁজে নিয়েছে মরগান। ঘোড়াটার গন্তব্য নিয়ে তো ভাবছেই না, বরং গ্রুলার মালিকের মৃতদেহও ওর মাথা-ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। নিজেকে নিয়ে ভাবছে ও। শুশ্রূষা দরকার, ক্যাসল টাউনে যাবে? ওখানে নিশ্চয়ই কোন ডাক্তার আছে। নাকি ফ্ল্যাগ-বি বাথানে যাবে? চিন্তাটা মনে আসায় নিজের ওপর বিরক্তি বোধ করল। মেলিসা বড়ম্যানকে আরেকবার বিপদে। ফেলার মানে হয় না। তারচেয়ে, শেষে সিদ্ধান্ত নিল, আশপাশে কোথাও একটা আশ্রয় খুঁজে নিয়ে ক্ষতের পরিচর্যা করবে। পারলে এগিয়ে যাবে। চোট দুটো এমন গুরুতর নয় যে ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে। তা করলে-শহরে ওকে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাবে টেনিসন। হয়তো এ হামলার ব্যাপারে কিছুই জানে না সে, তবু ঝুঁকি নিতে রাজি নয় মরগান। কোনরকমে যদি একবার রেডরকে পৌঁছতে পারে, ওর নাগাল পাবে না টেনিসন। বিপজ্জনক ওই খনি শহরে আগ বাড়িয়ে ঝামেলা পাকাতে পারবে না সে, এখানকার মত ক্ষমতা থাকবে না রেডরকে। তাছাড়া লুকিয়ে থাকার জন্যে শহরটা আদর্শ।
স্পার দাবাতে এগোল ঘোড়াটা। সামনে লজপোল পাইনের বন, সারি সারি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। অস্বস্তি লাগছে ওর, গ্রুলার মালিককে চেনা জরুরী মনে হচ্ছে। কোন একটা ব্যাপার কাটার মত বিঁধে আছে মনের গভীরে, ভুলতে পারছে না। ক্ষতস্থানগুলো যন্ত্রণা করছে, বিশেষ করে উরুর চোটটা
অধৈর্য হয়ে পড়েছে মরগান, অস্থির দৃষ্টিতে চারপাশ জরিপ করল। বন পেরিয়ে যেতে হবে, এদিকে আশ্রয় নেয়ার মত জায়গা নেই, যেটা ওর জন্যে পুরোপুরি নিরাপদ হতে পারে। এগোতে চাইছে না সোরেলটা, আসলে যে-পথ ধরে এগোচ্ছে, আদতে কোন ট্রেইল নয় ওটা। পায়ের নিচে শুকনো পাতা মাড়ানোর মচমচ শব্দ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে ঘোড়াটাকে। উঁচু কোন শৃঙ্গে ওঠার চেষ্টা করা সোরেলটার জন্যে এরচেয়ে সহজ কাজ।
লজপোলের সারি শেষে ঘন ঝোঁপ আর বোল্ডারে ছাওয়া এক জায়গায় উপস্থিত হলো ওরা। সার বেঁধে পড়ে থাকা বোন্ডার পেরুনো সম্ভব নয়, ওগুলোর ফাঁক দিয়ে এগোনোর মত কোন পথও চোখে পড়ছে না। বিরক্তি গ্রাস করল মরগানের সারা শরীর। কপাল আর কাকে বলে! এত পথ আসার পর ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছে না। বাধ্য হয়ে বোন্ডারের সারির পাশ ঘেঁষে এগোতে থাকল ও। নাক ঝেড়ে অস্বস্তি প্রকাশ করল ঘোড়াটা, কিন্তু পাত্তা দিল না মরগান। অবচেতন মনে ক্ষীণ আশা, শিগগিরই একটা আশ্রয় খুঁজে পাবে। কিন্তু এদিকে আরও ঘন হয়েছে বোল্ডারের সারি, পেছনে ক্যাকটাস হিলও এগিয়ে এসেছে। এর মধ্যে মাথা গোঁজার ঠাই কোথায়?
মিনিট দশ পর সঙ্কীর্ণ একটা পথ দেখা গেল, বড়জোর একজন ঘোড়সওয়ার পার হতে পারবে। কোন দ্বিধা ছাড়াই এগোল ও, রুক্ষ প্রান্তর ধরে ধীর গতিতে চলছে ঘোড়াটা। খানিক বাদে মরগান লক্ষ করল বোল্ডারের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে, পায়ের তলায় এ্যানিটের তৈরি পাথুরে জমি। সামনের পাহাড়সারি দ্বিধান্বিত করে তুলেছে ওকে, মনে আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত হয়তো কোন আশ্রয় খুঁজে পাবে না। এদিকে ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে।
তেষ্টা পাওয়ায় স্যাডলের ওপর পড়ে থাকা ক্যান্টিন তুলে দুই ঢোক পান করল ও। কিছুটা সুস্থির বোধ করছে। ঘোড়াটা দ্রুত এগোচ্ছে এখন, সম্ভবত পানির কোন উৎসের কাছাকাছি এসে পড়েছে। ঠিক সামনেই ক্যাকটাস হিলের একটা শৈলশ্রেণী, আশপাশে ওঅটর হোল বা ঝর্না থাকা বিচিত্র নয়।
শেষ পর্যন্ত ওর ধারণাই সত্যি হলো। কিভাবে ওখানে পৌঁছল ঠিক বলতে পারবে না, কারণ শেষ দিকে ক্ষতের যন্ত্রণা আর ক্লান্তি এতটাই চরমে পৌঁছেছিল যে হাল ছেড়ে দিয়েছিল মরগান। অবশ্য ঘোড়াটার ওপর বরাবরই আস্থা আছে ওর। মাইলখানেক দূর থেকেও পানির গন্ধ পায় এ প্রাণীটি, হয়তো একসময় বুনন ছিল বলেই।
স্যাডল ছাড়তে কসরৎ করতে হলো ওকে। আসন্ন বিপদ বা ঠিক কোথায় আছে, এ নিয়ে ভাবছে না। অবসন্ন দেহে চলে এল কয়েক ফুট চওড়া স্বচ্ছ পানির প্রবাহের কাছে, হাটার সময় খেয়াল করল ডান উরুতে জোর পাচ্ছে না। প্রথমে প্রাণভরে পান করল, তারপর নিজের শুশ্রূষার দিকে মনোযোগ দিল। কোমরের খাপ থেকে বাডই ছুরি বের করে উরুর কাছে কেটে ফেলল প্যান্ট। দগদগে ঘা-র মত দেখাচ্ছে ক্ষতটা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভেতরে রয়ে গেছে বুলেট হাড় পর্যন্ত অবশ্য পৌঁছায়নি। সবার আগে সীসাটা বের করা দরকার।
কোন কালেই ভীতু প্রকৃতির লোক ছিল না জেমস মরগান। বুনো এই দেশে টিকে থাকতে অনেক বিপদের মোকাবিলা করতে হয়েছে ওকে, দিতে হয়েছে অসীম ধৈর্য আর সহনশক্তির পরীক্ষা। নিজের শরীর থেকে বুলেট বের করতে পারবে না অনেকেই, কিন্তু সে পারবে। মানসিক স্থৈর্যের দিক থেকে এটা কোন ফাস্টগানকে মোকাবিলা করার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে সীসার টুকরোটা বের করার পর ক্লান্ত শরীরে কিছুক্ষণ পড়ে থাকল মরগান। কাজটা করার সময় প্রচণ্ড যন্ত্রণা ভোগ করেছে, কিন্তু মুখ থেকে টু শব্দও বেরুয়নি। হুইস্কি থাকলে ভাল হত, অগত্যা পানি দিয়ে ক্ষতগুলো পরিষ্কার করল। রক্তপাত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আবার শুরু হয়েছে এখন। ব্যানডানা খুলে পানিতে ধুয়ে উরুর ক্ষতটা বঁধল ও। চারপাশে নজর বুলাল এরপর, কাছেই পাওয়া গেল গাছটা-ফুলে ছাওয়া ইন্ডিয়ান ঔষধি, ক্লিফ রোজ। এ ধরনের পরিবেশই গাছটার জন্যে অনুকূল। রঙিন ফুলসমেত কয়েকটা ডাল ভেঙে পানির উৎসের কাছে ফিরে এল ও
নিজের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই ওর। তবে আঁচ করছে ক্যাকটাস হিলের কোন উপত্যকায় এসে পড়েছে। অবশ্য এ নিয়ে খুব একটা চিন্তা করছে না, এ মুহূর্তে ওর প্রয়োজন নিরাপদ কোন জায়গায় পরিপূর্ণ বিশ্রাম, এবং অবশ্যই সবার আগে জখমের শুশ্রূষা।
উরু থেকে ব্যানডানার পট্টি সরিয়ে ফের ক্ষতটা পরিষ্কার করল মরগান, ক্লিফ রোজের ফুল আর কচি পাতা পিষে তার রস লাগাল; কাঁধের ক্ষতেও। ওটা অবশ্য তেমন মারাত্মক নয়, উত্তপ্ত সীসা আঁচড় কেটে যাওয়ার সময় একদলা মাংস তুলে নিয়ে গেছে। দুই জায়গায় ব্যান্ডেজ বেঁধে স্যাডলে চাপল ও। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পানির উৎস ধরে উপত্যকার আরও ভেতরে ঢুকে পড়বে। নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, যেখানে নিশ্চিন্তে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিতে পারবে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও পানিতে পা রাখল ঘোড়াটা। গোড়ালি সমান উঁচু পানির প্রবাহ ভেঙে এগোতে শুরু করল। পানির তলায় শক্ত মাটি থাকায় এগোতে অসুবিধে হচ্ছে না। এতক্ষণ যা-ও বা ট্রাক ফেলে এসেছিল, এখন আর তার নাম-গন্ধও থাকবে না, ভাবল মরগান। কেউ অনুসরণ করলেও পানির কাছে এসে দিশেহারা হয়ে পড়বে, এলাকাটা পরিচিত এবং খুব ধুরন্ধর লোক হলে অবশ্য ভিন্ন কথা-ঠিকই ওর গন্তব্য আঁচ করে নেবে।
উপত্যকার ঢালু জমির ওপর দিয়ে নেমে এসেছে পানির স্রোত। দু’পাশে প্রচুর ঘাস আর ঘন ঝোঁপের ছড়াছড়ি। কয়েকটা সিডারও রয়েছে। ছোট একটা মেসার পাশ ঘেঁষে পুবে চলে এল মরগান। তিন দিক থেকে পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকায় পৌঁছে যারপর নাই খুশি হলো ও। খোলা আকাশের নিচে এরচেয়ে চমৎকার আশ্রয় আর হতে পারে না। যেন খুব ছোট একটা বক্স ক্যানিয়ন। প্রবেশপথের উল্টোদিকে কিফের গা বেয়ে নেমে গেছে পানির স্রোত। লজপোল পাইনের বন থেকে অন্তত কয়েকশো ফুট ওপরে আছে, ধারণা করল ও। বোল্ডারের সারি পেরুনোর পর ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এসেছে, ক্লান্তির কারণে খেয়াল করেনি।
শুকনো জুনিপার ঝোঁপের কাছে এসে স্যাডল ছাড়ল ও, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ মাটির ওপর পড়ে থেকে শক্তি সঞ্চয় করল। উরু আর কাঁধের ক্ষতে নতুন পট্টি বেঁধে শুয়ে পড়ল কিছুক্ষণ পর। বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে রেখেছে রাইফেলটা। সূর্যের আঁচ থেকে রক্ষা পেতে মুখের ওপর হ্যাট চাপিয়ে দিয়েছে। চেষ্টা করতে হলো না, এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়ল।
টানা সাত ঘণ্টা ঘুমাল ও। প্রচণ্ড জ্বরে ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকেছে। জেগে উঠে প্রথমে বুঝতে পারল না ঠিক কোথায় আছে। ঘামে চটচট করছে সারা শরীর। চোখ বুজে পড়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর খিদে অনুভূত হতে উঠে বসল। স্যাডল ব্যাগ থেকে শুকনো মাংসের জার্কি আর সেদ্ধ সীম বের করে খাওয়া সেরে নিল। পেট ভরে পানি খেল এরপর। এ জিনিসটার কমতি নেই।
শুয়ে পড়ে তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকাল মরগান। সারাদিনের ঘটনাগুলো মনে পড়ল-মেলিসা বডম্যান, আলফ্রেড টেনিসন…অচেনা আততায়ী…। হিসেব মিলছে না, কোথাও একটা অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে। সরাসরি শত্রুতা ঘোষণা করেনি টেনিসন, আবার খুব সৌজন্যমূলক আচরণ করেছে তা-ও বলা যায় না। এক ধরনের চ্যালেঞ্জ প্রকাশ করেছে সে, এর মানে কি? লোকটার উদ্ধত আচরণের প্রভাব মেলিসা বডম্যানের ব্যক্তিগত জীবনেও পড়েছে, মেয়েটিকে নিজের সম্পদ বলে দাবি করেছে সে। এতটা সাহস দেখায় কি করে?
অচেনা ওই আততায়ী কিভাবে জানল তৃণভূমিতে যাবে মরগান? কে সে? হতে পারে টেনিসনের ভাড়া করা লোক, কিংবা…নাহ, কোন কিছুই পরিষ্কার নয়। লোকটার পরিচয় জানতে পারলে হয়তো কিছুটা দিশা পাবে।
মেলিসার ব্যাপারে আগ্রহ দেখানো ঠিক হয়নি, তাহলে এত কিছু ঘটত না। হয়তো আগামীকালই রেডরকে পৌঁছে যেত ও। অথচ এখন আহত তো হয়েছেই, অনেক ব্যাপারেই অনিশ্চয়তায় ভুগছে। আরও ঝামেলা পোহাতে হবে কি-না খোদা মালুম।
ফের ঘুমিয়ে পড়ল মরগান। ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে। টের পেল মুখ দিয়ে অনবরত ওর পাজরে গুতো মারছে সোরেলটা। মেরুদণ্ডে শিরশিরে অনুভূতি হলো ওর। ঝট করে উঠে বসে চারপাশে তাকাল-কোথাও কেউ নেই। শ্রবণশক্তিকে পুরো স্বাধীনতা দিতে ঘোড়ার পানি ঠেলে চলার শব্দ কানে এল। চকিতে রাইফেল তুলে নিল ও, লেভার টেনে উপত্যকার প্রবেশপথে নিশানা করল। বেডরোল ছেড়ে চলে এল জুনিপার ঝোঁপের আড়ালে। ওপাশে চলে গেছে ঘোড়াটা, নিজ দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছে।
এগিয়ে আসছে ওরা। একাধিক নোক, শব্দ শুনে বুঝতে পারল মরগান। কারা ওরা? আপাতত পরিচয় জানার উপায় নেই, হয়তো কোন বাথানের নিরীহ পাঞ্চার, কিন্তু কু গাইছে ওর মন। আশপাশে মাইলখানেকের মধ্যে কোন বাথান চোখে পড়েনি, তাছাড়া এত উঁচুতে পাঞ্চারদের কোন কাজ থাকার কথা নয়। অবচেতন মনের সতর্ক সঙ্কেত অগ্রাহ্য করতে পারছে না মরগান, কারণ এই জিনিসটিই এর আগে বহুবার সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্য করেছে ওকে।
৩. পানি ডিঙানোর আওয়াজ
পানি ডিঙানোর আওয়াজ জোরাল হচ্ছে ক্রমশ। অনড় পড়ে আছে জেমস মরগান, ভাবছে ক’জন হতে পারে। নিজের অবস্থান যাচাই করল, সন্তোষজনক। উপত্যকায় ঢোকার পর প্রথমে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা বেডরোল আর ক্যান্টিন চোখে পড়বে ওদের, কাছেই নিজ আহারে ব্যস্ত সোরেলটা। অস্বাভাবিক কিছু নেই। শূন্য বেডরোল প্রমাণ করে না এর মালিক হামলার আশঙ্কায় তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে আশপাশে। একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে অবশ্য বেডরোলের। পাশে রাইফেলটা রেখে আসা যায়, কিন্তু খুব বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাবে। নাজুক অবস্থায় নিজের প্রাণ নিয়ে খেলতে পছন্দ করে না মরগান। কেউই পছন্দ করবে না।
কত দূরে আছে ওরা, শব্দ শুনে আঁচ করার চেষ্টা করল ও। নীরব হয়ে আছে সারা উপত্যকা। মৃদু বাতাস, পানি গড়ানোর শব্দ ছাপিয়েও সোরেলটার ঘাস টানার আওয়াজ পাচ্ছে। কিন্তু এসব স্বাভাবিক। একবার মনে হলো অন্য একটা ঘোড়ার নাক টানার শব্দ পেয়েছে, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারল না। প্রতিপক্ষ বোধহয় থেমে পড়েছে। মরগানের ইচ্ছে করছে সামনে উপস্থিত হয়ে চমকে দেয় লোকগুলোকে। কিন্তু সন্দেহটা নিরসন করা দরকার আগে, হয়তো সত্যিই কোন বাথানের পাঞ্চার ওরা এবং ঘটনাচক্রে এখানে আসছে।
ঘুম ভাঙার পর এই প্রথম শরীর আর ক্ষতগুলোর দিকে নজর দেয়ার প্রয়াস পেল ও। এতক্ষণ অনায়াসে ডান বাহু নাড়াচাড়া করেছে, এ মুহূর্তে রাইফেল ধরে আছে, অথচ ভুলেই গিয়েছিল কাঁধে একটা ক্ষত আছে। বাম হাতে রাইফেল হস্তান্তর করল ও, তারপর ধীরে ধীরে নাড়ল ডান হাত, বিভিন্ন দিকে। ব্যথা পাচ্ছে তেমন। একদিনেই ভাল কাজ দেখিয়েছে ক্লিফ রোজ। উরুর দিকে নজর দিল এবার। ঠিকমত নড়াচড়া করতে না পারলেও হাঁটতে কিংবা ধীরে দৌড়াতেও পারবে, যদি ছোট ছোট পদক্ষেপ ফেলে। বেডরোল থেকে জুনিপার ঝোঁপ-দশ গজ দূরত্ব অনায়াসে হেঁটে এসেছে, টেরই পায়নি। অবশ্য অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণেও তা হতে পারে।
ঘোড়া ছেড়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে লোকগুলো, এজন্যেই কোন সাড়া নেই, ভাবল মরগান। এলাকাটা বোধহয় পরিচিত ওদের, তাই নিশ্চিন্তে অনুসরণ করতে পেরেছে ওকে এবং খুব সম্ভব এ জায়গার কথাও জানে। চমকে দিয়ে বাড়তি সুবিধা পাবে জানলেও ওদেরকে খাটো করে দেখছে না মরগান, বরং যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। সংখ্যা নিয়ে খানিকটা ভাবনা অবশ্য রয়ে গেছে। একা ক’জনকে সামাল দেবে? কিন্তু এ-ও ঠিক কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও কাউকে ছেড়ে কথা বলার মানুষ নয় মরগান। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। অন্তত দু’একজনকে সাথে না নিয়ে মরবে না।
প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হলো ওর চোয়ালের পেশী, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। চকিতে একটা সম্ভাবনা মাথায় আসতে সামনের পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকাল, কেউ ঘাপটি মেরে আছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। ফেলে আসা পথ স্মরণ করার চেষ্টা করল-পাহাড়ে ওঠার কোন পথ কি দেখেছে? উঁহু, চোখে পড়েনি, তবে অন্য কোন পথে হয়তো ওঠা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সময় একটা সমস্যা। তবু, নিজেকে বোঝাল মরগান, একটি চোখ সবসময় পাহাড়ের ওপর রেখো। উপত্যকার প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকবে ওরা, খোলা জায়গায় থাকবে, এ অবস্থায় ওকে কাবু করা সহজ হবে না। পাহাড়ের গায়ে অবস্থান নিতে না পারলে ওর জয়ের সম্ভাবনাই বেশি, যদি না শত্রুপক্ষ সংখ্যায় খুব বেশি হয়।
অগত্যা-অপেক্ষা।
ঠিক পাঁচ মিনিট পর একসঙ্গে উপত্যকায় ঢুকে পড়ল দু’জন। লম্বা তাগড়া শরীর ওদের, নোংরা কাপড় পরনে। হাতের রাইফেল বাগিয়ে ধরে আছে। চেনার চেষ্টা করল মরগান, হাটের কার্নিসের ছায়ায় ঢেকে আছে কপাল আর চোখ, তাছাড়া রয়েছে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শূন্য বেডরোল থেকে জুনিপার ঝোঁপ হয়ে ওর ওপর স্থির হলো প্রথমজনের দৃষ্টি, মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল। কিন্তু পরক্ষণে হাতের পেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠল, গুলি করতে যাচ্ছে। যেটুকু সন্দেহ ছিল, তা-ও। এক লহমায় দূর হয়ে গেল। সম্ভাষণ দূরে থাক, একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। ওরা, নিশ্চিত জানে কি করতে যাচ্ছে। কারও ক্যাম্পে প্রবেশ করতে হলে সাড়া দিয়ে অনুমতি নিতে হয়-এটাই পশ্চিমের রীতি। তা করেনি ওরা। সুতরাং ও-ইবা দ্বিধা করবে কেন! টিকে থাকার প্রশ্ন এখানে, ন্যায়-অন্যায়ের কোন ব্যাপার নেই। সামনের লোকটাকে গুলি করে অন্যজনের দিকে মনোযোগ দিল মরগান।
সব মিলিয়ে চারটা গুলি খরচ হলো।
বিতৃষ্ণার সাথে পড়ে থাকা লাশ দুটো দেখল মরগান, তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করার সময় মনোযোগ দিয়ে গুলির শব্দের প্রতিধ্বনি শুনল। আপাতত প্রথম পর্যায়ের লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে ও। সম্ভবত আরও লোক আছে। এবার নতুন ফন্দি আঁটবে ওরা। এ দু’জনের মত উপত্যকায় ঢুকে বেঘোরে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নেবে না। সুতরাং খানিকটা সময় পাওয়া গেল। ধূমপান শেষে ক্ষতের পরিচর্যা করল ও, হাত-মুখ ধুয়ে এরপর খাওয়া সেরে নিল।
আরও লোক আছে, একটু পরই নিশ্চিত হয়ে গেল মরগান, মাঝে মধ্যে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এবার বোধহয় সামনের পাহাড় থেকে হামলার চেষ্টা করবে, কিংবা একবারে সহজ কাজটি করতে পারে-উপত্যকা অবরোধ করে রাখলেই হলো। একসময় ওকে বেরিয়ে যেতেই হবে। পানির ঘাটতি নেই, কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে খাবার। সাথে যে পরিমাণ খাবার আছে, খুব বেশি হলে চার-পাঁচ দিন চলবে। এরপর?
অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা জেমস মরগানের দারুণ অপছন্দ। বরাবরই সময় থাকতে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয় ও, এবারও তাই করবে। নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা করেনি এখনও, তবে এ-নিয়ে খুব একটা ভাবছেও না। বরং সময়ে, মাথা থেকে কোন একটা উপায় বেরিয়ে আসবে এ আত্মবিশ্বাস আছে ওর। ঘাড়ের ওপর শরীরের ওই অংশটার ওপর মরগানের আস্থা সবচেয়ে বেশি। প্রখর বুদ্ধি, দূরদৃষ্টি আর বিচক্ষণতার জন্যেই এখনও বেঁচে আছে ও।
সহসা খুরের শব্দ শোনা যেতে সচকিত হলো মরগান, ভজ দেখা গেল ওর প্রশস্ত কপালে। প্রতিপক্ষের কৌশল বোঝার চেষ্টা করছে। সিক্সটার নিয়ে অপেক্ষায় থাকল, কাছাকাছি দূরত্বে রাইফেলের চেয়ে ওগুলোই কাজ দেয় বেশি-সহজে নাড়াচাড়া করা যায়, জরুরী মুহূর্তে নিশানা না করলেও চলে, তাছাড়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
একটু পর নিশ্চিত হলো মরগান। একসঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে। ওরা, ইন্ডিয়ান কৌশল। শুরুতে দু’একজন ঘায়েল হলেও ঠিকই সফল হবে বাকিরা। আপনমনে হাসল ও, বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বেঁকে গেল ঠোঁটের কোণ। চমক অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে। ইন্ডিয়ান এই কৌশলটির সাফল্য নির্ভর করে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দিয়ে তার সুযোগ নেয়ার ওপর, কিন্তু এটি কোন কাজে আসবে না যেহেতু তৈরিই আছে মরগান। বাড়তি পিস্তলটা লোড় করে পাশে রেখেছে ও, রাইফেল তো আছেই। দু’হাতে উদ্যত দুই পিস্তল নিয়ে অপেক্ষায় থাকল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আচমকা তীরবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে উপত্যকায় প্রবেশ করল তিন অশ্বারূঢ়। পানি ডিঙিয়ে আসছে ওরা, খুরের দাপটে এমনভাবে পানি ছিটকে পড়ছে যেন তিনটে দামাল ছেলে হুটোপুটি খাচ্ছে। সমানে গুলি করছে ওরা। সবার সামনে তাগড়া একটা কালো মাসট্যাঙ। ওটার আরোহীকে প্রথমে গুলি করল মরগান, পেছন দিকে ছিটকে পড়ল সে। ঝুপ করে পানিতে আছড়ে পড়ল লাশটা। পেছনের ঘোড়াগুলো মাড়িয়ে গেল তার দেহ, আর মাসট্যাঙটা তখনও ছুটছে।
বাম হাতের পিস্তল দিয়ে দ্বিতীয় লোকটাকে পরপর দুটো গুলি করল ও। রাইফেল তুলে নিশানা করছিল লোকটা, মুহূর্তে স্যাডলশূন্য হলো, তার পাঠানো গুলি মরগানের পাঁচ হাত দূর দিয়ে চলে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে চলার ওপর। গতিপথ বদল করার প্রয়াস পেল শেষজন, ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে। আরোহীর আচানক প্রয়াসে তাল সামলাতে পারল না ঘোড়াটা, হুড়মুড় করে পড়ে গেল। ঘাসের ওপর। বিপদ দেখে আগেই লাফ দিয়েছে লোকটা, মাটিতে পড়ার সাথে সাথে হোঁচট খেল। কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে ঝেড়ে দৌড় লাগাল ফিরতি পথে। পিস্তলের নল দিয়ে ব্যাটার শিরদাঁড়া অনুসরণ করল সেকেন্ড খানেক, শেষে মত বদলে পিস্তল নামিয়ে ফেলল। পলায়নপর কোন শত্রুকে পেছন থেকে গুলি করা ওর ধাতে নেই, যদিও জানে এ লোকটিই হয়তো সুযোগ পেলে ঠিক এভাবেই ওকে খুন করতে দ্বিধা করত না।
সন্তুষ্টচিত্তে পরিস্থিতি আর ভবিষ্যৎ চিন্তা করল মরগান। প্রতিপক্ষকে ভাল একটা নাড়া দেয়া গেছে। ওকে শিকার করা যে সহজ হবে না, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে লোকগুলো। এখন থেকে বুঝে-শুনে এগোবে, আগে নিশ্চিত হতে চাইবে, পতঙ্গের মত আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মত বোকামি আর করবে না। নিজেকে ওদের। জায়গায় কল্পনা করল মরগান, এ অবস্থায় কি করত? উপত্যকা অবরোধ করে অপেক্ষায় থাকত।
নিবিষ্ট মনে কিছুক্ষণ ভাবল ও, শেষে সাফল্যের সম্ভাবনা বিচার করে মনস্থির করল। ঝুঁকিপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা করতে চাইছে সম্ভব কি-না জানে না, তবে এছাড়া উপায়ও নেই। নিচু সুরে শিস বাজাল ও। ঘাস খাচ্ছিল সোরেলটা, প্রভুর সাড়া পেয়ে কান খাড়া করল প্রথমে, তারপর কাছে চলে এল। ল্যাসো খুলে কোমরের সাথে এক প্রান্ত বাধল মরগান, স্যাডলের ওপর আড়াআড়িভাবে বাঁধল অপর প্রান্ত। জড়িয়ে ধরে আদর করল ঘোড়াটাকে, তারপর পেছনে ক্লিফের কাছে চলে এল। পানির উৎসটি দুই ভাগ হয়ে গেছে এখানে। শুভ্র জলরাশি ক্লিফের খাড়া গা বেয়ে নেমে গেছে কয়েকশো ফুট। ওটা বেয়ে নেমে যেতে হবে ওকে।
ঝুঁকি আছে, কিন্তু উপত্যকায় অবরুদ্ধ হয়ে থাকার চেয়ে ঢের ভাল। প্রতিপক্ষের চারজন প্রাণ হারিয়েছে ওর কারণে, আর এরা যদি আলফ্রেড টেনিসনের লোক হয় তো পাঁচজন। একবার নাগালের মধ্যে ওকে পেলে শকুনের মত খুবলে খাবে। উপত্যকায় থাকলে সে-পথ সুগম করাই হবে। তারচেয়ে ঝুঁকিটা নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে, আধাআধি সম্ভাবনা আছে। ওর ভাগ্য সুপ্রসন্ন। বলতে হবে, উপত্যকা থেকে চলে যায়নি মৃত লোকগুলোর ঘোড়া, ওগুলোর স্যাডল থেকে ল্যাসো সংগ্রহ করেছে। চারটে মিলে একশো ফুটের মত দাঁড়িয়েছে। অতটুকু পথ নামতে পারলে পরেরটুকু নিয়ে ভাববে। আপাতত শত্রুপক্ষের চোখের আড়ালে থাকতে পারলেই হলো।
সোরেলটার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা ভাবছে না মরগান। দুর্গম বৈরী এ দেশে বাহন ও বিশ্বস্ত প্রাণী হিসেবে ঘোড়া অপরিহার্য। অহেতুক ঘোড়ার প্রাণ হরণ করে না কেউ, সে যত বর্বরই হোক। খুব জোর ঘোড়াটাকে দখল করতে পারে।
দাঁড়িয়ে থাক, বাছা, চাপা স্বরে ঘোড়াটাকে আদেশ করল মরগান। স্যাডল ব্যাগ থেকে একটা অতিরিক্ত শার্ট বের করে রাইফেল বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে দিল। কোমরের ওপর আড়াআড়ি বাধল স্যাডল ব্যাগটা। ল্যাসো ধরে নামতে শুরু করল এবার। ক্লিফের দেয়াল বরাবর ঝুলিয়ে দিয়েছে ল্যাসো। নিচে, একেবারে তলায় চলে গেল ওর দৃষ্টি-বোল্ডার আর বুনো ঝোপে ভরা রুক্ষ জায়গা। বোঝা যাচ্ছে এটা একটা গভীর ক্যানিয়ন। তৃণভূমি থেকে বেশ নিচুতে। ক্লিফের গা বেয়ে নেমে যাওয়া পানি জমা হয়েছে এক প্রান্তে, তারপর তীব্র স্রোতের আকারে উত্তরে চলে গেছে। সূর্যের আলো ঠিকমত পৌঁছতে পারেনি বলে ঘোলাটে দেখাচ্ছে পানির স্রোত।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঘাম আর ক্লিফের গা থেকে ছলকে পড়া পানিতে ভিজে গেল ওর শরীর। যতটা কঠিন হবে ভেবেছিল তারচেয়ে সহজেই নামতে পারছে। কাঁধের ক্ষতটা না থাকলে দ্রুত নামতে পারত। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মাঝে মধ্যেই ডান কাঁধে টান পড়ছে। দুটো ক্ষতেই যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ব্যান্ডেজ ভিজে থাকায় বুঝতে পারছে না রক্তপাত হচ্ছে কি-না। সোরেলটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে সব ধকল, ওর ওজনের পুরোটাই সামলাতে হচ্ছে। কিন্তু একচুল নড়বে না। ঘোড়াটা, জানে ও।
পানির স্রোত থেকে কিছুটা ডানে সরে আড়াআড়ি নামতে শুরু করল মরগান। খানিক নিচে চাতালের মত এ্যানিটের চাঙড় চোখে পড়তে ওখানে নেমে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবল। ওই বিশ ফুট নামতে অনেক সময় লাগল, ক্লান্তি আর দুর্বলতার কারণে গতি কমে গেছে।
চাতালে বসে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিল মরগান। ভাল করে জরিপ করল ক্লিফের নেমে যাওয়া শরীর, আশায় আছে কোন ফাটল বা সঙ্কীর্ণ পথের সন্ধান পাবে যেটা ধরে সামনের লজপোল পাইনের উপত্যকায় যেতে পারবে। তাহলে ক্যানিয়ন অবধি নামতে হবে না; অতিরিক্ত কষ্ট থেকে ঘোড়াটাকে মুক্তি দেয়া যাবে, উপরন্তু ল্যামসা শেষ হয়ে যাওয়ার পর অমানুষিক পরিশ্রমও করতে হবে না। ওকে। হাত-পা ব্যবহার করে ক্লিফের গা বেয়ে নামতে হবে ভাবতেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
ভাগ্যদেবী সহায় হলো মরগানের ওপর। ফুট: ত্রিশেক নামার পর সরু উপত্যকাটা চোখে পড়ল, বুনো জুনিপার আর ক্লিফ রোজে ভরাট হয়ে আছে। উপত্যকার অন্য প্রান্তে কি আছে না-ভেবেই শক্ত মাটিতে পা রাখল ও। কোমর। থেকে ল্যাসোর বাধন খুলে ঝুলিয়ে দিল। লম্বা বিশ্রামের পর ক্লিফ রোজ আর ক্যান্টিনের পানি দিয়ে ক্ষতের পরিচর্যা করল।
ঘন জুনিপার ঝোঁপ ঠেলে এগোল ও। পায়ের তলায় ঢালু পাথুরে পথ, পা হড়কে গেলে বিপদ হতে পারে। র্যাটলের ভয় চিন্তিত করল ওকে, এরকম পরিবেশে ওগুলোর দেখা না পেলে অবাকই হবে। হাতে বাউই ছুরি তুলে নিয়েছে, প্রয়োজনে যাতে ব্যবহার করতে পারে। গুলি করে প্রতিপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এত কষ্ট মাটি হয়ে যাবে।
একটু পর ওর ধারণাই সত্যি হলো। দু’হাত দূরে একসাথে দেখতে পেল দুটো র্যাটলকে, ফণা না তুললেও ওর দিকেই মনোযোগ ব্যাটাদের। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল মরগান, ছুরি নিয়ে প্রস্তুত। আরেকটু এগোলে প্রথমটাকে আঘাত করবে। দরকার হলে চোখের পলকে ড্র করবে।
তেমন কিছুর প্রয়োজন অবশ্য পড়ল না। পথ থেকে সরে গেল সাপ দুটো। খানিক অপেক্ষার পর এগোল ও, সতর্ক। র্যাটল হচ্ছে কয়োটের মত, বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। হয়তো কোন ঝোঁপের ফাঁকে ওঁৎ পেতে আছে, কাছে গেলে ছোবল মারবে। পিস্তল হাতে জায়গাটা পেরিয়ে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মরগান। সামনে ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাহাড়ী ট্রেইল। হাটতে শুরু করল ও, ভাবছে বামে গেলে গতকালের মত উপত্যকায় পৌঁছানোর পথটা হয়তো পেয়ে যাবে।
প্রথম যেখানে নালাটা খুঁজে পেয়েছিল, ঘণ্টাখানেক পর ঘুরে-ফিরে সেখানে এসে উপস্থিত হলো ও। অনেক হাঁটায় ক্লান্তি লাগছে, বিশ্রাম নেয়ার ফাঁকে খুঁটিয়ে দেখে নিল চারপাশ। যখন নিশ্চিত হলো, আশপাশে কেউ নেই, নালার কাছে চলে এসে পানি পান করে ক্যান্টিন ভরে নিল। স্রোত ঠেলে এগোতে শুরু করল এরপর।
হয়তো উপত্যকা অবরোধ করে রেখেছে প্রতিপক্ষ, কিংবা শিকার পালিয়েছে দেখে ফিরে আসছে এখন। তেমন হলে দেখা হয়ে যেতে পারে ওর সাথে। চোখ কান খোলা রেখে এগোচ্ছে মরগান, সজাগ এবং তৈরি।
দূর থেকে কথা-বার্তার শব্দ শুনতে পেয়ে দ্বিগুণ সতর্ক হয়ে এগোল এবার। সামনে এক বয়স্ক সিডারের গোড়ায় অ্যাসপেনের ঝড়। ঘুরে ওটার পেছনে চলে এল মরগান। খোলা জায়গায় চোখ পড়তে উপত্যকার দিকে মুখ করে বসে থাকা লোকগুলোকে দেখতে পেল। পাঁচজন। কফি তৈরি করে নিশ্চিন্তে গলাধঃকরণ করছে। তাজা কফির সুবাসে তীব্র তেষ্টা পেল ওর, সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকল আগুনের ওপর বসানো কেতলির দিকে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে সামিল হয় ওদের সাথে, গল্প করতে করতে কফি পান করে। মনে পড়ল আগের দিন ফ্ল্যাগ বি বাথানে ক্লীভ অ্যালেনের তৈরি সুস্বাদু কফি পান করার পর লালচে ওই জিনিস আর পেটে পড়েনি। কফির গুঁড়ো এবং কেতলি সাথে ছিল, কিন্তু আগুন জ্বালালে উত্মক কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে ভেবে তৈরি করেনি।
আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব? বিরক্তির সাথে বলল এক তরুণ। আমার ধারণা মহা আরামে ঘুমাচ্ছে শালা, আর এদিকে আমরা…
যাচ্ছ না কেন? বাধা দিল পাশের জন, কণ্ঠে শ্লেষ। তোমাকে আটকাবে না কেউ, উইলি। কাজটা সারতে পারলে পাচশো ডলার তো পাচ্ছোই।
তাহলে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে!
এতদূর থেকেও মরগান দেখতে পেল রক্ত সরে গেছে তরুণের মুখ থেকে। তবে বেশ দ্রুত নিজেকে সামলে নিল সে। তোমরা সাহায্য করলে ঠিকই পারব, আত্মবিশ্বাসের চেয়ে বরং জেদই প্রকাশ পেল তরুণের কন্ঠে। ভাল করেই জানো একা আমার পক্ষে ওকে সামলানো সম্ভব নয়।
একবার তো পালিয়ে এসেছ, সাথে আরও দু’জন ছিল তখন।
লোকটা একটা পিশাচ! এবার আতঙ্কিত গলায় বলল উইলি। ম্যাট আর পিটকে নিমেষে খুন করে ফেলল! এত দ্রুত কাউকে গুলি করতে দেখিনি আমি।
এ লোক বিখ্যাত কেউ না হলে কান কেটে ফেলব।
চুপ করে থাকো, উইলি! চাপা স্বরে ধমকে উঠল আরেকজন। পাঁচ হাত দূরে জুনিপার ঝোঁপের পাশে বসে আছে লোকটা, রাইফেলের চেম্বার পরিষ্কার। করছে। ঠোঁটে চুরুট। চোখ তুলে তাকায়নি সে, কিন্তু চুপসে গেল তরুণ। মিনমিন করে কি যেন বলে কেতলির দিকে এগোল।
মোক্ষম সময়, ভাবল জেমস মরগান। কফি পান করার লোভ সামলাতে পারছে না। এটা অবশ্য বাড়তি পাওনা। নিঃশব্দে, সবার অগোচরে ঝোঁপ ছেড়ে বেরিয়ে এল ও। দলটার কাছ থেকে দশ হাত দূরে এসে দাড়িয়েছে, হাতে উদ্যত সিক্সশটার। জানে এখানে একটা ডিনামাইট ফাটাতে যাচ্ছে, এবং পাচজনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে পাঁচ রকম। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে দো-আঁশলা ছোটখাট লোকটি, দূরে বসে এতক্ষণ নিস্পৃহ দৃষ্টিতে সঙ্গীদের বাদানুবাদ দেখছিল। উইলিও বিপজ্জনক, কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্রেফ রিফ্লেক্সের বশে ড্র করতে পারে। ছোকরার কোমরে জোড়া পিস্তল, চকচকে বাট। নিয়মিত অনুশীলন করে বোধহয়। কিন্তু ধৈর্য কম, অসহিষ্ণু পদক্ষেপ আর অস্থিরতায় বোঝা যাচ্ছে এ জিনিসটা এখনও আত্মস্থ করতে পারেনি। পশ্চিমে টিকে থাকার জন্যে প্রথম শর্ত ওটাই।
মর্নিং, বয়েজ! বোমা ফাটাল মরগান, মৃদু হাসছে। শিকারীরা এখন শিকার বনে গেছে। পাঁচজনের বিরুদ্ধে একা, এ অবস্থায় ও নিজেই ধরাশায়ী হয়ে যেতে পারে। আশার কথা, প্রতিপক্ষকে চমকে দেয়ায় বাড়তি একটা সুবিধে পাবে।
লোকগুলোর প্রতিক্রিয়া চুটিয়ে উপভোগ করছে মরগান। রাইফেল পরিষ্কার করছিল চুরুটঅলা, এতটা চমকে গেছে যে ঠোঁট থেকে চুরুটটা পড়ে গেল। নিঃসাড় হয়ে গেছে দু’হাত, রাইফেল ধরে রাখল শক্ত হাতে। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে উইলির চোখজোড়া, বিশ্বাস করতে পারছে না ওর উপস্থিতি। দো-আঁশলা লোকটা-মরগানের ধারণায় পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন মানুষ-শুধু চোখ তুলে তাকাল, শীতল কালো চোখে কিংবা মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। মরগান নিশ্চিত হলো সবার আগে সে-ই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, এরপর চুরুটঅলা। উইলির ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না এখন, একেবারে চুপসে গেছে যেন যমের সামনে উপস্থিত।
বোকার মত কিছু কোরো না কেউ, একটু পর বলল মরগান। থেমে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝার সময় দিল, ততক্ষণে অনেকটা সামলে নিয়েছে ওরা। উইলি, তোমার হোলস্টারগুলো খালি করো, দূরে অ্যাসপেন ঝোঁপের ভেতর ফেলবে খেলনা দুটো, যাতে কেউ লাফ দিয়েও নাগাল না পায়। হ্যাঁ, দারুণ দেখিয়েছ! তরুণ নির্দেশ তামিল করতে বলল ও। এবার চুরুটঅলার হাত আর কোমর খালি করো, ওর হাতে বরং চুরুটটা ধরিয়ে দাও।
একে একে সবাইকে নিরস্ত্র করল উইলি, কাজ শেষে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। বিপর্যস্ত অবস্থাটা নেই এখন, তবে ভয় লেগে রয়েছে চোখে।
খানিকটা পিছিয়ে এল মরগান। আমার দিকে মুখ করে বসো সবাই, আলাদা হয়ে দুহাত দূরে দূরে। উইলি, এক মগ কফি দাও আমাকে। সবাই বসতে সন্তষ্টির সাথে তাদেরকে দেখল ও, আড়চোখে তাকাল উইলির দিকে। সময় নিয়ে মগে কফি ঢালছে সে, ওর দিকে পিছন ফিরে। পলকের জন্যে তরুণের দিকে তাকাল দো-আঁশলা লোকটা, নির্বিকার মুখে মরগানের দিকে ফিরল এরপর। উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তার চোখের তারা।
কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝে ফেলল মরগান। কফির মগ হাতে ওর আর বন্ধুদের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে উইলি। সবাইকে না হলেও দু’জনকে আড়াল করতে পেরেছে। কিছু বলতে গিয়ে চেপে গেল ও, চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল। ঘাড়ের কাছে চলে যাচ্ছে দো-আঁশলার ডান হাত, লুকানো ছুরি বের করবে নিশ্চয়ই। চুরুটঅলা উঠে দাঁড়ানোর উপক্রম করেছে, হাতে ছোট্ট একটা ডেরিঞ্জার, কোত্থেকে বের করেছে আল্লা মালুম। আর গরম কফি ছুড়ে মারতে যাচ্ছে উইলি।
দিশেহারা বোধ করল মরগান। বুঝতে পারছে আবার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ও-শিকারী থেকে শিকার!
৪. কিছু কিছু মুহূর্ত আছে
কিছু কিছু মুহূর্ত আছে যখন খুব কম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তার ওপর বাঁচা-মরা নির্ভর করে। এ ধরনের মুহূর্তের সাথে পরিচিত জেমস মরগান। অবচেতন মন আর সহজাত প্রবৃত্তি সক্রিয় করল ওকে। পুরো ব্যাপারটা ঘটল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
নির্দ্বিধায় গুলি করল ও। ফলাফলের দিকে নজর দেয়ার ফুরসৎ নেই, গুলি করার পরপরই ঝাঁপ দিয়েছে। পড়ন্ত অবস্থায়, যখন উইলির শরীরের আড়াল থেকে ডান দিকে সরে এসেছে কেবল, ফের গুলি করল। নিশানা করার সুযোগ পেয়েছিল চুরুটঅলা, মরগানের পাঠানো গুলি ওর কপাল ফুটো করল। গুলির ধাক্কায় দু’হাত দূরে ছিটকে পড়ল শরীরটা। নিথর পড়ে থাকল।
শুয়ে থেকে অন্যদেরকে কাভার করল মরগান। ওর বাম হাতে চলে এসেছে অন্য সিক্সশটারটা। দো-আঁশলার চোখে কেবলই বিস্ময়। পিঠের ওপর থেকে দুরি সমেত হাত সরিয়ে আনল সে। অন্যরা যেমন ছিল তেমনি আছে, যদিও ওদের চোখে বিস্ময়ের বদলে আতঙ্ক ভর করেছে এখন।
উইলি, যে তাদেরকে সুযোগ করে দিয়েছিল, চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বুলেটটা ওর বুকে বিধেছে। যন্ত্রণাকাতর মুখ, বাতাসের জন্যে হাঁসফাঁস করছে। একনজর দেখে মরগান বুঝল খুব বেশি হলে কয়েক ঘণ্টা টিকবে। হ্যাঁ, কফির মগ এখনও ওর হাতে ধরা। এবার, ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল মগটা, কাত হয়ে পড়ে যেতে যেটুকু কফি ছিল মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
উঠে দাঁড়াল মরগান। টের পেল এটুকুতেই ঘেমে গেছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সুস্থির হতে কিছুটা সময় লাগল। তারপর তাকাল লোকগুলোর দিকে, ফ্যাকাসে তিনটা মুখ দেখে বিন্দুমাত্র করুণা হলো না ওর। জানে সুযোগ পেলে এখুনি ওকে খুন করবে এদের যে কেউ। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো সবাই! শীতল স্বরে নির্দেশ দিল ও। আরেকবার বলব না। তুমি, হলদে শেয়াল, দো-আঁশলার উদ্দেশে বলল। শোয়ার আগে ছুরিটা সামনের দিকে ছুঁড়ে দাও।
মরগানের নির্দেশমত দ্রুত উবু হলো লোকগুলো, হাত খালি করল দো আঁশলা।
কয়েক পা পেছনে সরে এল ও। শেয়ালটার দিকে সরে এসো অন্যরা, হ্যাঁ। এবার হলুদ শেয়াল, তোমার হাত দুটো ওদের পিঠে তুলে দাও। তোমরাও ওর। পিঠে হাত তুলে দাও। কেউ নই তো পাছায় গুলি করব। তোমরা জানেনা ওখানে একটা সীসা ঢুকলে কি হবে, একটা হপ্তা বসতে পারবে না।
লোকগুলো ওর নির্দেশ তামিল করতে চুরুটঅলার কাছে এল মরগান, ডেরিঞ্জারটা মুঠি থেকে খসিয়ে ক্রীকের দিকে ছুঁড়ে দিল। তারপর উইলির কাছে এল, তরুণকে ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে দেখে হেসে মগটা তুলে নিল ও। কেতলি থেকে কফি ভরে ফিরে এল আগের জায়গায়।
কাছেই ছিল ওদের ঘোড়াগুলো, ল্যাসো সংগ্রহ করে সবচেয়ে কাছের লোকটার দিকে ছুড়ে দিল মরগান। বাধো ওদের, আয়েশ করে কফিতে চুমুক দিল ও। আরও শক্ত করে, তাগাদা দেয়ার সময় আড়চোখে পড়ে থাকা উইলির দিকে তাকাল। রক্তে সয়লাব হয়ে গেছে ছেলেটার শরীরের ওপরের অংশ। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু বুক ফুটো হয়ে যাওয়ায় সব বাতাস আর রক্ত বেরিয়ে আসছে। নীল হয়ে গেছে মুখ। বেশি হলে আর কয়েক মিনিট টিকবে।
কফি শেষ করল মরগান। মগ ছুঁড়ে ফেলে মুক্ত লোকটার দিকে এগোল। ঘুরে দাঁড়াও! আদেশ করল ও, লোকটা নির্দেশ তামিল করতে তার কানের পেছনে নামিয়ে আনল পিস্তলের বাঁট। সশব্দে সঙ্গীদের পাশে আছড়ে পড়ল সে। দ্রুত অন্যদের সাথে তাকেও বাঁধল মরগান। কাজ শেষে উইলির কাছে ফিরে এল।
দয়া করে মেরে ফেলো আমাকে! থেমে থেমে কথাগুলো উচ্চারণ করল ছেলেটা, চোখে অনুনয়। এত কষ্ট
ধৈর্য ধরো, একটু পর তোমার আশা এমনিতেই পূরণ হবে।
হকিন্স খুন করবে তোমাকে!
এগোচ্ছিল মরগান, ঝট করে ফিরল উইলির দিকে। তাতে তোমার লাভটা কি হচ্ছে শুনি? নিস্পৃহ ভাব দেখালেও মনে মনে স্মৃতির পাতা হাতড়াচ্ছে-হকিন্সটা আবার কে?
উত্তর দিল না উইলি, আসলে উত্তর দেয়ার ক্ষমতাই হারিয়েছে।
ক্রীক ধরে এগোল ও, ইচ্ছে থাকলেও দ্রুত চলতে পারছে না। ক্লান্তি লাগছে, ধকল তো কম যায়নি। মন থেকে বিপদের আশঙ্কা তাড়াতে পারছে না, এ পাঁচজনের সাথে আরও লোক নেই তা কে বলবে। ভালয় ভালয় এখান থেকে কেটে পড়তে পারলে খুশি হয় মরগান।
প্রশ্নটা ভাবাচ্ছে ওকে। হকিন্স লোকটা কে? উইলির গলায় এমন কিছু ছিল যে হেলাফেলা করতে পারছে না। নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করল ও। কি অলক্ষুণেই না এখানে এসে পড়েছিল! এতক্ষণে অন্তত পঞ্চাশ মাইল সামনে থাকত, যদি না…উঁহু, মেলিসা বডম্যানের সাথে পরিচয় চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা। এমন মেয়ে পশ্চিমে খুব কম আছে। সমস্যাটা ও নিজেই সৃষ্টি করেছে। ট্রেইলের পাশে ওই ঘেসো প্রান্তরে ঢুকে পড়া মোটেও উচিত হয়নি। তাহলে এত কিছু ঘটত না। সহসাই মনে পড়ল নামটা-রডনি অ্যাশ, কুখ্যাত রেঞ্জার। দুশো মাইল পেছনে অ্যাবিলিনে দেখেছিল তাকে। পিছু নিয়ে এতদূর চলে এসেছে লোকটা, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু ঠিকই দেখা হয়ে গেল। যোগাযোগটা দৈবাৎ বলে মানতে পারছে না।
পুরো ব্যাপারটাই ধাঁধার মত লাগছে মরগানের কাছে। মরিয়া হয়ে ওর পিছু নিয়েছে কেন লোকগুলো? টেনিসন লেলিয়ে দিয়েছে? লোকগুলোর ঘোড়ার মার্কা দেখেছে ও, একটার সাথে আরেকটার মিল নেই। তাছাড়া স্রেফ কাউহ্যান্ড মনে হয়নি ওদেরকে। অনেক বন্ধুর, বেআইনী পথে এদের চলাফেরা। কয়েকজন সম্ভবত আউট-লই। টেনিসনের বাথান আউট-লদের আখড়া নাকি? ফ্ল্যাগ-বি বাথানে আসা লোকগুলোর বেশভূষা আর চালচলন মনে করার চেষ্টা করল মরগান। প্রায় সবাই ছিল সাধারণ পাঞ্চার, রাইফেল বা সিক্সটারের চেয়ে শ্যাসোই ওদের হাতে যেন বেশি মানায়। দুটো বাথানের মধ্যে রেঞ্জ ওঅর হলে এর কাউহ্যান্ডরাও অংশ নেয়। ওদেরকে দেখে তাই মনে হয়েছে মরগানের।
আরেকটা চিন্তা এল ওর মাথায়, কিন্তু তার ভিত্তি খুব দৃঢ় নয়। হতে পারে ওর স্যাডল ব্যাগের টাকাগুলোর কথা জেনে গেছে লোকগুলো, কিন্তু সম্ভাবনাটা একেবারে অসম্ভব হলেও উড়িয়ে দিতে পারছে না মরগান। টাকার ব্যাপারটা হয়তো আঁচ করেছিল রডনি অ্যাশ, এবং সেই ফ্রিসকো থেকে ওর পিছু নিয়েছিল। লোকটাকে শেষ দেখেছিল লারেডো হিলে-ক্যাসল টাউন থেকে চল্লিশ মাইল দূরে ছোট্ট এক কাউটাউনে। ওখান থেকে খুব দ্রুতই মরগানকে ধরে ফেলেছে সে। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, ঘেসো উপত্যকায় না ঢুকলেও ট্রেইলের কোথাও ঠিকই ওকে অ্যাম্বুশ করত অ্যাশ। উপত্যকায় ঢুকে তার কাজ সহজ করে দিয়েছিল মরগান। এদেরকে টাকার কথা জানিয়েছে অ্যাশ, মানতে নারাজ ও। কারণ রডনি একাই কাজ করতে পছন্দ করে। নিজের প্রাপ্য অংশ অন্যকে ভাগ দেয়ার লোক সে নয়।
তবে?
জানে না মরগান, জানার ইচ্ছেও নেই। নিরাপদে এখান থেকে সরে পড়তে পারলে খুশি ও। যত দ্রুত সম্ভব মিসৌরি পৌঁছানো দরকার।
উপত্যকায় চলে এসেছে ও। ভেতরে ঢুকতে এগিয়ে এল সোরেলটা। কাছে এসে মুখ দিয়ে ওর পেটে খোঁচা মারল, আনন্দ প্রকাশ করছে। দ্রুত কাজে নেমে পড়ল মরগান, ল্যামসা খুলে পেচিয়ে স্যাডল হর্নের সাথে ঝোলাল, বেডরোল শুটিয়ে জায়গামত রাখল। রাইফেল হাতে এরপর স্যাডলে চেপে ফিরতি পথ ধরল। মনে আশঙ্কা হয়তো দেখবে অন্য কেউ মুক্ত করে দিয়েছে লোকগুলোকে, আর সবাই মিলে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।
তেমন কিছু অবশ্য ঘটল না। যেমন দেখে গিয়েছিল তেমনই আছে সব। বাঁধা তিনজন অক্লান্ত চেষ্টা করছে নিজেদের মুক্ত করার, ওর সাড়া পেয়ে তাতে ইস্তফা দিয়ে ঠায় পড়ে থাকল। মনে মনে একচোট হাসল মরগান, বোঝা যাচ্ছে পশ্চাৎদেশে গুলি খাওয়ার ইচ্ছে কারও নেই। উইলির পানে তাকাল ও, তার জন্যে কারও করার কিছু নেই এখন।
ঘুমিয়ে পড়লে নাকি সবাই? একটা সিগারেট তৈরি করতে শুরু করল ও। উত্তর এল না, কেউ নড়লও না
অ, ঘুমিয়ে পড়েছ তাহলে। বাপু, তোমাদের তিনজনকে জাগানো তো, সহজ কাজ নয়। তারচেয়ে পাছায় একটা করে গুলি সেঁধিয়ে দেয়া যাক, বলে পিস্তলের হ্যামার টানল ও। সাথে সাথেই নড়ে উঠল তিনটে দেহ।
তোমরা তাহলেজেগেই আছ, এমনভাবে বলল মরগান যেন খোশ-গল্প করছে। যাক, অযথা তিনটে গুলি খরচ করতে হলো না। ধন্যবাদ। রোল করা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টান দিল ও। ঝেড়ে কাশো, ছেলেরা। খোদার কসম, তোমাদেরকে আজই প্রথম দেখলাম! অথচ তোমাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে জনম জনম ধরে আমাদের শত্রুতা। ব্যাপার কি বলো তো, কোন্ সুখে আমার পিছু লাগলে?
এবারও কোন উত্তর এল না।
বুঝলাম কথাগুলো তোমাদের কানে ঢুকছে না। কিন্তু এরচেয়ে জোরে বলাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারচেয়ে, গুলি করল, ও, ডানের লোকটার চুলে সিঁথি কেটে বেরিয়ে গেল তপ্ত সীসা। এই যে, তুমি, শুনতে পাচ্ছ?
পা-পাচ্ছি। এক্কেবারে পরিষ্কার! কাঁপা গলায় বলল লোকটা
আমার পিছু লাগলে কেন?
তুমিই তো আগে হামলা করেছ! গুলির শব্দ পেয়ে এখানে এসেছিলাম আমরা। চিহ্ন দেখে বুঝলাম উপত্যকায় গেছ। ওখানে গিয়ে তোমার তোপর মুখে পড়লাম।
আরেকটা গুলি করল মরগান। ঊরুর কাছে ট্রাউজার ফুটো করল এটা। থরথর করে কেঁপে উঠল লোকটার শরীর।
বদহজম হয়েছে তোমার, তাই বাজে বকছ। শোনো, এটাই শেষ সুযোগ, পরেরবার ঠিক মেরুদণ্ডে গুলি করব। সারা জীবন বিছানায় পড়ে থাকার ইচ্ছে থাকলে আবারও মিথ্যে বলতে পারো।
ওদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখো!
প্রমাদ গুণল মরগান। তোমাদের ব্যাপারটা কি? একসাথে এতজনই বা কেন?
হায় খোদা, এ লোকটা জানে না অথচ একটা রেঞ্জ ওঅরের মধ্যে নাক গলিয়েছে!
এবার মরগানের চমকে যাওয়ার পালা। পেট খালি করো, স্ট্রেঞ্জার।
এটা ম্যাকলয়ারীদের বাথানের অংশ, পাশের এলাকার দখল নিয়ে টেনিসনের সাথে লড়াই চলছে ওদের। তুমি তো টেনিসনেরই লোক।
ম্যাকলয়ারীদের মার্কা কি?
সার্কেল-এম।
তোমরা ওই মার্কা ব্যবহার করছ না।
আমরা ভাড়াটে। নিজেদের ঘোড়া ব্যবহার করছি।
সম্ভষ্ট হতে পারছে না মরগান। আমাকে টেনিসনের লোক মনে করেছ কেন?
গতকাল বিকেলে দলবল নিয়ে শহরে গিয়েছিল টেনিসন। ম্যাকলয়ারীদের এক ভাইকে পিটিয়েছে সে। আর হুমকি দিয়েছে দেশছাড়া করবে ওদেরকে। ফেরার পথে সার্কেল-এমের দুই কাউহ্যান্ডকে গুলি করে মেরেছে ওর ক্রুরা। টেনিসনের দলবল আক্রমণ করতে পারে ভেবে এদিকে অপেক্ষা করছিলাম আমরা।
বিরক্তি বোধ করছে মরগান, খাপে খাপে মিলছে না কিছুই। হতে পারে। মনের গভীরে পাগলাঘণ্টী বাজছে, এখান থেকে সরে পড়ার জন্যে তাগাদা দিচ্ছে। হকিন্স কে? ফের জানতে চাইল ও।
চিনি না ওকে।
আমার ধৈর্য কিন্তু কম, মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।
খোদার কসম, ওই নামে কাউকে চিনি না!
হলদে শেয়াল, তুমি চেনো?
না! একগুয়ে সুরে জবাব দিল লোকটা।
মরগানের একবার ইচ্ছে হলো গুলি করে লোকটাকে, কিন্তু তাতে অযথাই রক্তক্ষয় হবে। কিছু জানলেও সহজে বলবে না এ লোক। যথেষ্ট সময় পেলে। হয়তো সত্যটা বের করা সম্ভব, কিন্তু তা নেই এখন। দক্ষিণে বনভূমির দিক থেকে খুরের আবছা শব্দ কানে আসছে, নিশ্চিত হতে কান পাতল ও। যা ভয় পেয়েছিল, হয়তো এদেরই সঙ্গী হবে। মনে হচ্ছে কয়েকজন।
হোলস্টারে পিস্তল ফেরত পাঠিয়ে স্যাড়লে চেপে উত্তরে ঘোড়া ছোটাল ও। কোন ট্রেইল ছাড়াই, ঝোঁপ-ঝাড়ের ফাঁক গলে ছুটল সোরেলটা। পুরো একটা দিন পর ছুটতে পেরে যেন পাখা গজিয়েছে। বারবার গতি বাড়াতে চাইছে, কিন্তু লাগাম টেনে মাঝে মধ্যেই গতি কমাল ও। ঝোঁপের সাথে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্যে প্রায়ই এদিক-ওদিক সরে যেতে হচ্ছে। একটু পর কিছুটা ডানে সরে এসে লজপোল পাইনের বনে ঢুকে ইচ্ছেমত ছুটতে দিল ঘোড়াটাকে। সামনেই ক্যাসল টাউনের ট্রেইল পড়বে।
কয়েক মিনিট পর শেষ হয়ে গেল পাইনের বন। ক্রমশ ঢালু জমির শুরু হয়েছে। শহরের ট্রেইলে উঠে আসার পর খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল। থেমে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ও, আড়াআড়ি পশ্চিমে এগোচ্ছে কয়েক ঘোড়সওয়ার। ওর আগেই ক্যাসল টাউন থেকে মিসৌরি যাওয়ার ট্রেইলে পৌঁছে যাবে। সম্ভবত উপত্যকার লোকগুলোও যোগ দিয়েছে এদের সাথে, ভাবল মরগান, হাতের নাগালের মধ্যে ওকে পেলে খুন করতে দ্বিধা করবে না এরা।
উল্টোদিকে যেতে পারে, ভাবছে মরগান…ফ্ল্যাগ-বি বাথানে। চিন্তাটা মাথায় আসতে কষে নিজেকে গাল দিল।ওকে পেয়ে বসেছে মেলিসা বড়ম্যান, ঘুরে ফিরে তার কথাই মনে পড়ছে। ওখানে যাওয়া মানে ওদেরকেও বিপদে ফেলা। সে-অধিকার নেই ওর। সবচেয়ে বড় কথা, তিক্ত মনে ভাবল মরগান, নিজের লড়াই নিজেই করতে অভ্যস্ত ও
দ্রুত এগোচ্ছে ঘোড়াটা। ক্যাসল টাউনে পৌঁছতে সময় লাগবে। ট্রেইলটা যেহেতু ঘুরপথের, এছাড়া উপায়ও নেই। হয়তো আজকের রাতটা শহরে কাটাতে হবে, বিতৃষ্ণার সাথে ভাবল ও, কিংবা ফিরতি পথে পঞ্চাশ মাইল পিছিয়ে মিসৌরি যাওয়ার অন্য ট্রেইল ধরতে হবে।
মরগান যখন, শহরে পৌঁছল, দুপুর পেরিয়ে গেছে তখন। রাস্তায় লোজন কম, গনগনে সূর্যের নিচে অযথা সিদ্ধ হতে কে চায়! খুরের দাপটে ক্ষত-বিক্ষত রাস্তার ধুলো উড়ছে। হাটার গতিতে এগোচ্ছে ঘোড়াটা। প্রথম যে আস্তাবল চোখে পড়ল, ঢুকে পড়ল ও। টুলে বসে ঢুলছিল বুড়ো হসল্যার, ওকে দেখে চোখ মেলে তাকাল
হাউডি, স্ট্রেঞ্জার!
মৃদু নড করল মরগান। স্যাডল ছেড়ে লোকটার হাতে ঘোড়া হস্তান্তর করল। স্যাডল ছাড়িয়ো না, অনুরোধ করল ও, রাস্তায় থিতিয়ে আসা ধুলোর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে বুড়োর দিকে তাকাল, দেখল নির্বিকার মুখে ওর অদ্ভুত নির্দেশ শুনল লোকটা। রাতে এখানেই থাকব, জানাল মরগান।
সেজন্যে বাড়তি এক ডলার দিতে হবে।
মাথা ঝাঁকাল, মরগান। হসল্যার ঘোড়াটাকে ভেতরে নিয়ে যেতে আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল। ক্লান্তি লাগছে, তবে চেষ্টা করছে স্বাভাবিকভাবে হটতে। কারও মনোযোগ কাড়ার ইচ্ছে নেই। পঞ্চাশ গজের মত এগিয়ে ডানে একটা ক্যাফে চোখে পড়ল। খাওয়ার ব্যাপারে ভাল-মন্দের বাছ-বিচার করে না মরগান, এখন সে-সময়ও নেই। কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল।
দুটো কামরা নিয়ে ক্যাফেটা। বাইরের দিকে বড় ডাইনিংরূম, ভেতরে কিচেন। ডাইনিংরূমটা সাজানো-গোছানো। প্রায় খালিই, দু’জন খদ্দের খাওয়ায় ব্যস্ত। বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে খালি একটা টেবিল দখল করল মরগান। দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে বসল যাতে রাস্তা আর জানালার ওপর চোখ রাখতে পারে।
কিচেন থেকে মাঝবয়সী এক মহিলা বেরিয়ে এল। হট খুলে তাকে বাউ করল মরগান।
কি দেব তোমাকে?
তোমার ইচ্ছেমত দাও, ম্যাম কে আগেই জানিয়ে রাখি বেশি টাকা নেই আমার পকেটে
সীম, সুপ, রুটি, মাংস আর কফি। চলবে?
ধন্যবাদ। ওগুলোই গত কয়েকদিন পাইনি।
মিনিট তিন পর খাবার নিয়ে এল এক তরুণী। মহিলার নকল বলা যেতে পারে। খুব বেশি হলে বিশ হবে এর বয়েস, ধারণা করল ও। খাবার ভর্তি ট্রে টেবিলে নামিয়ে রেখে চলে গেল মেয়েটা।
খাবার দেখার পর খিদে চাগিয়ে উঠল মরগানের। মনে পড়ল সকালে শুধু শুকনো জার্কি আর সীম পেটে পড়েছিল। দ্রুত খাওয়া শেষ করল ও। খাবারটা ভাল, রান্না চমৎকার। কত হলো, ম্যাম? বিল দেয়ার সময় জানতে চাইল ও।
দুই ডলার পনেরো সেন্ট।
বেশ সস্তা, ভাবল ও। পাঁচ ডলারের একটা নোট এগিয়ে দিল মহিলার দিকে। তারপর দরজার দিকে এগোল
মিস্টার, তোমার টাকা? পেছন থেকে ডাকল মহিলা।
ঘুরে হাসল ও। খাবারটা ভাল, ম্যাম, পছন্দ হয়েছে আমার। রাতে আবার আসব। আগাম বিল হিসেবে রেখে দাও।
বেরিয়ে এসে, পোর্চে দাঁড়িয়ে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখে নিল মরগান, চিন্তিত হওয়ার মত কিছু নেই। ধৈর্য ধরার পক্ষপাতি ও, দেখতে চায় ওরখোঁজে সার্কেল এমের রাইডাররা শহরে আসে নাকি ট্রেইলে অপেক্ষা করবে। এ ফাঁকে বিশ্রাম হয়ে যাবে। অবশ্য, মিসৌরি পৌঁছা’নোর তাড়া ওর ঠিকই আছে। নিশ্চিত জানে শহর থেকে বেরুলে শত্রুপক্ষের সামনে পড়তে হবে। আগে শরীরটা ঝরঝরে থোক, তারপর দেখা যাবে কি করা যায়।
সিগারেট ধরিয়ে দিগন্তের শেষ সীমানায় ফুটে ওঠা ক্যাকটাস হিলের আবছা অবয়বের দিকে তাকাল ও। একেবারে ডান দিকে, পশ্চিমে মালভূমির আকারে। শেষ হয়েছে ওটা। ওদিকেই মিসৌরি যাওয়ার ট্রেইল। মরগান নিশ্চিত জানে। ওখানে ওঁৎ পেতে আছে প্রতিপক্ষ। অপেক্ষা করছে কখন বেরিয়ে আসবে ও। থাকুক ওরা। আজকের দিনটি এখানে শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেবে সে।
আগের মতই টুলে বসে আছে হসল্যার। দোতলায় চলে যাও, ওকে দেখে বলল। ডান দিকে কাঠের সিঁড়ি আছে। ভাড়া আগাম দিতে হবে।
মরগানের ছুঁড়ে দেওয়া রূপোর ঈগল দুটো লুফে নিল বুড়ো।
কিছু খবর দরকার আমার।
তুমি নিজেই তো একটা খবর।
খানিকটা বিস্মিত হলো ও, কতটুকু জানে লোকটা? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল। বুড়োকে, কিন্তু নির্বিকার দেখাচ্ছে তাকে। নীল চোখের গভীর চাহনিতে এমনকি স্বাভাবিক কৌতূহলও নেই। চাপা স্বভাবের মানুষ, শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছল ও, হসল্যারের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে বোধহয়। পরে এ নিয়ে আলাপ করবে ভেবে সিঁড়ির দিকে এগোল। আপাতত নিরবিচ্ছিন্ন একটা ঘুম চাই ওর।
.
খড়ের বিছানায় আড়মোড়া ভাঙল জেমস মরগান, আলসেমি লাগছে। চোখ বুজে আরও কয়েক মিনিট পড়ে থাকল। শেষে বিছানা ছেড়ে মাথার নিচ থেকে স্যাডল ব্যাগ তুলে নিল। এটা কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার, ভাবল ও। ব্যাগ খুলে ফিল্ড গ্লাস বের করে পকেটে ভরল
খড়ের গাদার পাশে গরাদহীন একটা জানালা আছে। মেঝের কাঠ দেয়াল ছাড়িয়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে কিছুটা। জানালা দিয়ে নিচু হয়ে কাঠের প্রান্তে ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখল মরগান। ইচ্ছে করলে যে কোন সময় আস্তাবলের পেছনে গেলে তুলে নিতে পারবে। আরেকটি সুবিধা, কেউ যদি এটার খোঁজে খড়ের গাদায় তল্লাশি চালায়, পাবে না।
নিশ্চিন্ত হয়ে নিচে নেমে এল ও। হসল্যারকে কোথাও দেখতে না পেয়ে পেছনে স্টলের সারির কাছে চলে এল, একটা স্টলে দেখতে পেল সোরেলটাকে। ওর সাড়া পেয়ে বিজাতীয় একটা শব্দ করল ঘোড়াটা। কাছে গিয়ে ওটার কেশরে হাত বুলাল মরগান, পিঠ চাপড়ে দিল।
এককোণে বড়সড় পাত্রে পানি রাখা। পাশে টিউবওয়েল। লণ্ঠনের আলো ওখানে কমই পৌঁছেছে, তবে কাজ সারতে অসুবিধা হলো না ওর। হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল আস্তাবল থেকে। দরজার একপাশে সরে দাঁড়াল ও। রাতের আঁধার তখন ভালভাবেই জাকিয়ে বসেছে ক্যাসল টাউনে, সেলুন আর ড্যান্স হল থেকে হৈ-হল্লা, বাদ্যের শব্দ কানে আসছে। সিগারেট রোল করার ফাঁকে আশপাশে নজর বুলাল মরগান। রাস্তায় লোকজন কম। চল্লিশ গজ দূরের একটা সেলুনে গুলির শব্দ হলো, তারপর ভাঙচুরের আওয়াজ। একটু পর ব্যাটউইং দরজা ঠেলে পোর্চের ওপর আছড়ে পড়ল একটা দেহ। হাঁচড়ে-পাচড়ে উঠে দাড়াল লোকটা, অকথ্য খিস্তি করে সটকে পড়ল পাশের গলির ভেতর।
পেছনে হসল্যারের পায়ের শব্দ পেল ও, দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে লোকটা। তোমাদের শহরটা দেখছি সন্ধের পরপরই গরম হয়ে ওঠে, হালকা সুরে মন্তব্য করল মরগান।
সুযোগ পেয়েছে ওরা। ল-অফিসটা এ মুহূর্তে খালি পড়ে আছে, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল হসল্যার।
এসব ঘটনা সামাল দেয়ার লোক নেই?
আপাতত নেই। মার্শালের কাজটা নেয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
এ কাজে ঝামেলা বেশি, পোর্চ ছেড়ে নেমে উত্তরে, এগোল ও। উদ্দেশ্যহীনভাবে হটিল কিছুক্ষণ, খিদে বাড়াচ্ছে। একেবারে উত্তরে গির্জার কাছে। চলে এল একসময়। ঘর-বাড়ি কম এদিকে। যা-ও বা কয়েকটা আছে, ভেতরে। জ্বালানো আলোর খুব কমই রাস্তায় এসে পড়েছে। সুবিধাই হলো মরগানের, দূর থেকে ওকে শনাক্ত করতে পারবে না কেউ। গির্জার লাগোয়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল, একেবারে ঘণ্টার কাছাকাছি। ঘণ্টা-ঘরটা ছোট, চারটা খিলানের ওপর ছাত, বড়সড় ঘণ্টা ঝুলছে মাঝখানে। একটা খিলানে হেলান দিয়ে দাঁড়াল ও। ফিল্ড গ্লাস চলে এসেছে হাতে। চোখে ঠেকাতে ক্যাকটাস হিলের পশ্চিম প্রান্ত আর মিসৌরি যাওয়ার ট্রেইল স্পষ্ট চোখে পড়ল।
যা খুঁজছিল, পেতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। নিজেদেরকে গোপন করার কোন চেষ্টাই করেনি ওরা। ট্রেইলের দু’পাশে দু’জন করে অবস্থান নিয়েছে। ঝোঁপের আড়ালে বসে অলসভাবে সময় কাটাচ্ছে একজন। শুয়ে আছে অন্যরা। একটু দূরে বিশ্রাম নিচ্ছে ঘোড়াগুলো, তবে ছোটার জন্যে তৈরি।
এবার উল্টোদিকে চলে এল মরগান। যে ট্রেইল ধরে গতকাল ক্যাসল টাউনে এসেছিল, তার ওপর নজর বুলাল। অনেকক্ষণ ধরে চোখ দেখেও কিছু দেখতে পেল না। তবে ও নিশ্চিত এদিকেও আছে কয়েকজন, আড়ালে থাকায় চোখে পড়ছে না।
ফ্ল্যাগ-বি বাথানের ট্রেইলটাও বাদ দিল না। ক্যাকটাস হিলের পাশে, লজপোল পাইনের বনেও দু’জন আছে। শক্ত আর অটুট একটা জাল পাতা হয়েছে, বেরিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। লোকগুলো চাইছে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক ও, তাতে সহজ হয়ে যায় ওদের কাজ। সম্ভবত শহরে এসে কিছু করার সাহস ওদের নেই, যদিও সেটাই সহজ হত। তবে বেরিয়ে সে যাবেই। তার আগে অপেক্ষা করে দেখা যাক ক্লান্তি আর বিরক্তির শিকার হয় কি-মা ওরা। সে সুযোগই নেবে ও। ওরা জানে না কার পিছু লেগেছে।
চিন্তিত মনে পাই-হাউসের দিকে এগোল মরগান। দূর থেকে ভেতরে ভিড় দেখে মত বদলে ফিরতি পথে এগোল। সেলুনে ঢুকে গলা ভেজাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোন সেলুন কিংবা পাই-হাউসের মত জমজমাট যে কোন ক্যাফে ওর জন্যে বিপজ্জনক জায়গা হয়ে উঠতে পারে। সার্কেল-এম রাইডারদের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। নিজের চেহারা যত কম দেখানো যায় তত মঙ্গল।
ডানের গলিতে ঢুকে পড়ল মরগান। বছর দুই আগে এক বাড়িতে ব্যবসাটা চলত, এখন ও থাকলে ওর সমস্যা মিটে যায়। বিশ গজের মত এগিয়ে বাড়িটা পেল ও। বন্ধ দরজায় নক করল।
সতর্কতার সাথে খুলে গেল দরজার কপাট, খানিকটা ফাঁক হতে এক মহিলার চর্বিবহুল মুখ দেখা গেল। কি চাই? নিস্পৃহ কণ্ঠে জানতে চাইল মহিলা, তীক্ষ্ণ নজর বুলাচ্ছে ওর শরীরে।
একটা মেয়ে দরকার আমার।
নোংরা হাসিতে উজ্জ্বল হলো মহিলার, মুখ, দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকল মরগান। দরজা আটকে ওকে অনুসরণ করতে বলে করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করল মহিলা। কতক্ষণ?
দুই ঘন্টা।
অকারণেই হাসল মহিলা। ভেতরে পার্লারের একপাশে চারটে মেয়েকে বসে থাকতে দেখল মরগান। চোখে নির্লজ্জ আমন্ত্রণ। বেছে নাও, উদার কণ্ঠে আহ্বান করল মহিলা। প্রতি ঘন্টার জন্যে দশ ডলার, আর আমাকে দিতে হবে দশ ডলার। হুইস্কির জন্যে পাঁচ ডলার, যদি লাগে তোমার।
লাগবে, চারজনের ওপর চোখ বুলাল মরগান। ডানের মেয়েটাকে পছন্দ হলো ওর, জানাল।
মারিয়া, তোমার কামরায় নিয়ে যাও ওকে। হুইস্কি পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি।
উঠে দাঁড়াল মেয়েটি। হাসল অযথাই, চাপা স্বরে বলল: আমার সাথে এসো
দোতলার একটা কামরায় এল ওরা। একটু পর হুইস্কি দিয়ে গেল আরেকটা মেয়ে। ছোট্ট কামরাটায় ডাবল-বেড, ছোট্ট একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার রয়েছে। দরজা বন্ধ করো, চেয়ারে বসে হুইস্কির বোতলের মুখ খোলার সময় বলল মরগান, দুটো গ্লাসে পানীয় ঢালল। দরজা বন্ধ করে মেয়েটা সামনে এসে দাঁড়াতে বসার ইঙ্গিত করল ও। শোনো, এখানে শুধু সময় কাটাতে এসেছি আমি, এবং কিছু তথ্য দরকার আমার। যদি দরকারী কিছু জানাতে পারো, বাড়তি কিছু টাকা রোজগার করতে পারবে।
মেয়েটার চোখে লোভের ছায়া, তবে প্রথমে অবাকই হলো। কি জানতে চাও?
আগে হুইস্কি নাও। ভেবে-চিন্তে বলবে, না জানলে বলার দরকার নেই কিন্তু মিথ্যে বা মনগড়া কিছু শুনতে চাই না।
মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা। গ্লাসে চুমুক দিয়ে ধন্যবাদ জানাল।
আলফ্রেড টেনিসনকে চেনো?
ভয় ফুটে উঠল মেয়েটার চোখে। সে তো এখানে আসে না!
মারিয়ার বোকামিতে বিরক্ত হলো মরগান। সে এখানে আসে কি-না জানতে চাইনি আমি, তুমি ওকে চেনেন কি-না তাই জানতে চাইছি। নিশ্চই বহু লোক আসে এখানে, অনেক কিছু জানতে পারো তোমরা, একটু থেমে সময় দিল মেয়েটাকে। এখানকার কয়েকজন সম্পর্কে জানতে চাই আমি, গ্লাস নামিয়ে রেখে সিগারেট ধরাল ও। হয়তো এদের কাউকেই দেখোনি, কিন্তু অনেক গল্প শুনেছ, এ ব্যাপারে নিশ্চিত আমি। ওদের অধীন লোকেরা আসে এখানে।
কে তুমি?
কেউ না।
কিন্তু আমার তা মনে হচ্ছে না। তুমি হয়তো টেনিসনকে খুন করতে এসেছ, কেউ ভাড়া করেছে তোমাকে। ডেভিড ম্যাকলয়ারী হতে পারে।
আমাকে দেখে খুনী মনে হয়?
তুমি টাফ লোক এটা তো ঠিক।
পাঁচ ডলারের একটা নোট টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল মরগান। বুঝেছি, অন্য মেয়েগুলোর সাথে কথা বলতে হবে। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো চারপাশের খোঁজ খবর রাখো, আর মুফতে কিছু টাকা রোজগার করতে চাইবে। দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল ও।
দাড়াও, মিস্টার! ব্যস্ত হয়ে উঠল মারিয়া, দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়াল। আমি যা জানি বলব, কতটুকু তোমার কাজে আসবে জানি না। কিন্তু কাউকে এসবের কিছুই বলতে পারবে না, এমনকি মিসেস টার্নারকেও নয়। তাহলে এতেও ভাগ বসাবে চর্বির দলাটা! খেদ প্রকাশ পেল মেয়েটার কণ্ঠে।
যথার্থ নাম, স্মিত হেসে ভাবল মরগান, ফিরে এসে চেয়ারে বসল।
আমি কোন ঝামেলায় পড়ব না তো?
নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, এরপর দেখাই হবে না আমাদের।
যা বলব, তার সবই শোনা। এর কতটুকু সত্যি, জানি না আমি। অবসরে ক্যাসল টাউন আর আশপাশের লোকজন নিয়ে আলোচনা করি আমরা। বেশি আলাপ হয় টেনিসনকে নিয়ে, কারণ সে-ই এখানকার সবচেয়ে সফল মানুষ।
মাত্র দুই বছর আগে এখানে এসেছে ও। আগে টেনেসিতে থাকত। এখানে এসে বাজে একটা জমি ক্লেইম করেছিল, ভালগুলো অবশ্য অনেক আগেই দখল হয়ে গিয়েছিল। বড় স্টক আর কিছু করিৎকর্মা পাঞ্চার ছিল ওর সঙ্গে। এ তল্লাটের সব বাথান ফ্রি রেঞ্জের অধীন: ওর জমিতে পর্যাপ্ত ঘাস না থাকলেও অসুবিধা হলো না। অবাধ রেঞ্জে ছড়িয়ে পড়ল সব গরু। ফ্রি রেঞ্জের সুবিধা নিয়ে লাভবান হলো টেনিসন। কৃতজ্ঞতাবশতই বোধহয়, বিনিময়ে সবাইকে রাউন্ড-আপ আর গরু বিক্রির সময় যথেষ্ট সাহায্য করে সে। কিন্তু যার যার বাথানের সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে ইদানীং। তেমন হলে টেনিসনই বেশি বিপদে পড়বে, এবং সবার আগে। সেজন্যেই ফ্ল্যাগ-বির দিকে হাত বাড়াতে চাইছে সে, ট্রেইলের ওপাশের জমিটার ওপর চোখ পড়েছে ওর। ক্যাকটাস:হিলের যে-অঞ্চল থেকে ঝর্নার শুরু, ওখান থেকে এঞ্জেলো রীভারের উৎপত্তি, শুকনো মরসুমের সময় পানির জন্য এটার ওপর নির্ভর করতে হয় প্রায় সবগুলো বাথানকে। তাছাড়া আছে–লজপোল পাইনের বিস্তীর্ণ সমভূমি, ছোটখাট সমৃদ্ধ একটা বাথান গড়ে তোলা সম্ভব ওখানে।
প্রথমে মেলিসা বডম্যানের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল টেনিসন, পাত্তা পায়নি। শেষে ওই জায়গাটা বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে। সাফ না করে দিয়েছে ফ্ল্যাগ-বি। তবু চাপ দিচ্ছে লোকটা ম্যাকলয়ারীদের শায়েস্তা করতে হলেও জায়গাটা দরকার তার, থেমে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিল মারিয়া, শ্রাতার মধ্যে আগ্রহ আছে কি-না বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু, চোখে বা মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই তার। সিগারেট টেনে চলেছে সে, দৃষ্টি জানালা পথে বাইরে চলে গেছে।
ম্যাকলয়ারীদের সম্পর্কে কতটুকু জানো?
তিন ভাই ওরা। টেমিসন সন্দেহ করে রাসলিং করছে ওরা, কিন্তু প্রমাণ করতে পারেনি। তবে এটা ঠিক, সবারই কিছু না কিছু গরু রাসলিং হচ্ছে। এদিকে লয়ারীরা, দোষ চাপিয়েছে টেনিসনেরই ঘাড়ে। ওর পাঞ্চাররা গরু। দাবড়ানোর পাশাপাশি অন্ত্রেও পারদর্শী। গত তিন দিনে তাই প্রমাণিত হয়েছে। গতকাল ম্যালিয়ারীদের ছোট ভাইকে পিটিয়েছে টেনিসন, পরে সার্কেল-এমের দুই পাঞ্চারকে খুন করেছে ওর ক্রুরা। শেষ পর্যন্ত কে যে টিকে থাকে, আগাম বলা মুশকিল। টেনিসন পণ করেছে ম্যাকলয়ারীদের দেশছাড়া করে ছাড়বে তিন ভাইও বসে থেকে মজা দেখবে না। অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে মার্শাল মারা যাওয়ায়। রাসলিঙের তদন্ত করতে ক্যাকটাস হিলের ওদিকে গিয়েছিল সে, পরের রাতে ট্রেইলে পাওয়া যায় ওঁর লাশ
ফ্ল্যাগ-বি?
তিন বছর আগে এখানে এসেছে ওরা, আগে টেনেসি থাকত। অনেকের ধারণা টেনিসন আর বড়ম্যানদের সাক্ষাৎ-এখানেই প্রথম ঘটেনি। র্যাঞ্চিং জিনিসটা ভালই বলঝে মহিলা। তবে একটা কথা ঠিক, মহিলা এ তল্লাটের সেরা সুন্দরী।
একটা ছেলে আছে জানার পরও অনেকেই ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছে ওর সাথে।
ওদের বাথান দেখে কিন্তু আমার মনে হয়নি মাত্র তিন বছর হলো।
বাথানটা অনেক পুরানো। আগে এক বুড়ো থাকত, ওর কাছ থেকে কিনে নিয়েছে বড়ম্যানরা।
হকিন্স নামে কাউকে চেনো?
মাথা নাড়ল মারিয়া। প্রথম শুনলাম নামটা। মেয়েটার চোখে দ্বিধা। বুঝতে পারছে না তথ্যগুলো কতটুকু কাজে এসেছে আগম্ভকের। হয়তো এর বিনিময়ে কোন টাকাই পাবে না, তবে এ-ও ঠিক এগুলো খুবই সাধারণ তথ্য, এখানকার যে কোন লোক এসব জানে
ফের গ্লাসে পানীয় ঢালল মরগান। ভাবছে। অনেকগুলো ব্যাপারে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এখানকার অবস্থা সম্পর্কে আবছা হলেও একটা ধারণা পেয়েছে। টেনিসনের বাথানটা কোথায়? জানতে চাইল ও।
ঠিক জানি না, তবে ফ্ল্যাগ-বি ছাড়িয়ে আরও পুবে। ক্যাকটাস হিলের লাগোয়া
সার্কেল-এম?
শহরের দক্ষিণে, ট্রেইলের পশ্চিমে।
বিষম খেল মরগান। উইলির সঙ্গী মিথ্যে বলেছে ওকে! ওরা দাবি করেছিল ওটা সার্কেল-এমের এলাকা। লোকগুলো টেনিসনের নয়তো? তবে আউট-ল বা রাসলারও হতে পারে। কিংবা আসলেই সার্কেল-এমের লোক। পুরো ব্যাপারটা একটা ধাঁধা।
এ ব্যাপারগুলো এ মেয়ে জানবে না, ওকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আনমনে গ্লাসে চুমুক দিল মরগান। নিজের ওপর কিছুটা বিরক্ত। ফালতু একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে সে। কে যে আসল শত্রু, সেটাই বুঝতে পারছে না। শুরু থেকেই ব্যাপারটা গোলমেলে, নইলে রডনি অ্যাশ ওকে এভাবে কোণঠাসা করার সুযোগ পায়?
আমি কি তোমার সাহায্যে আসতে পেরেছি? ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল মেয়েটা।
হ্যাঁ, ধন্যবাদ, হাসল মরগান, পকেট থেকে টাকা বের করে পঞ্চাশ ডলার এগিয়ে দিল। মারিয়ার বিস্মিত অভিব্যক্তি এড়িয়ে দরজার দিকে এগোল।
অদ্ভুত মানুষ তুমি! পেছন থেকে বলল মেয়েটা। তোমার কথা কখনও ভুলব না আমি।
ঘুরে তাকাল মরগান। বোকা মেয়ে, স্রেফ ভুলে যাও আমার কথা! মৃদু ভর্ৎসনার সুরে পরামর্শ দিল। ভুলে গেলেই ভাল করবে।
নিচে নেমে চর্বির দলার পাওনা মেটাল মরগান। তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে এল। রাস্তায় লোকজন নেই, প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। সেলুনগুলোর হৈ-হল্লা কমে এসেছে। নিভে গেছে অনেক বাড়ির বাতি। পাই হাউসের দিকে এগোল।
যা আশা করেছিল মরগান, মোটে তিনজন খদ্দের ক্যাফেতে! কোণের একটা টেবিল দখল করার পর ফরমাশ নিয়ে গেল তরুণী মেয়েটা। খাবারের জন্যে অপেক্ষা করছে এসময়ে দরজায় আলফ্রেড টেনিসনকে দেখতে পেল ও। চোখাচোখি হলো ওদের।
প্রথমে থমকে গেল টেনিসন, বিস্ময় দেখা গেল চোখে, স্বতঃস্ফূর্ত হাসিতে উজ্জ্বল হলো মুখ। হয়তো এর পুরোটাই ভান। সোজা ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। আরে, তুমি দেখছি যাওনি! সামনে এসে উল্টোদিকের চেয়ারে বসে পড়ল সে।
কিছু বলল না মরগান
কি দেব তোমাকে, মি. টেনিসন? মেয়েটা এসে জানতে চাইল
প্রথমে নড করল সে। কেমন আছ, জেনি? তোমার মাকে দেখছি না যে?
রান্নাঘরে।
ফরমাশ দিল টেনিসন।
জেনি নামের মেয়েটির মধ্যে অতিরিক্ত উৎসাহ খেয়াল করল মরগান। টেনিসন অবশ্য সে ধরনের লোকই। সুদর্শন, সুঠাম শরীর। মুখে গাম্ভীর্যের সাথে নিষ্ঠুর একটা ভাব আছে, অনেক মেয়েই সেটা পছন্দ করবে।
এদিকে থাকবে ঠিক করেছ নাকি? আলাপী সুরে জানতে চাইল টেনিসন।
প্রশ্নটার পেছনের অর্থ খোজার চেষ্টা করল মরগান। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কি বোঝাতে চাইছে লোকটা, নিখাদ কৌতূহল তার চোখে। আমি থাকলে তোমার বুঝি খুব অসুবিধা হয়?
হবে, যদি গরুচোরদের সাথে হাত মেলাও।
তোমাকেও তো অনেকেই গরুচোর হিসেবে সন্দেহ করে।
হাসল টেনিসন, চোখে কৌতুক। শুধু ম্যাকলয়ারীরা। খুব স্বাভাবিক নিজেদের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে ওরা।
এটা শুধু তুমিই বলছ।
হয়তো। আর কারও কথা জানি না, আমার গরুই বেশি ছাপ্পড় মারছে ওরা। ওদের আর আমার বাথানই ক্যাকটাস হিলের কাছাকাছি। অন্যদের গরু এত দূরে আসে না, তৃণভূমির আরও ভেতরে চলাফেরা করে।
ধরছ না কেন?
মার্শাল যখন নেই, ব্যাপারটাকে আমার নিজেরই সামলাতে হবে। তাছাড়া নিজের পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করি আমি। কোন গরুচোরকে এ তল্লাটে থাকতে দেব না।
মার্শালের জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার।
ঠিক কি বোঝাতে চাইছ? ওর মুখ জরিপ করছে টেনিসন।
কিছুই না। অন্যের সমস্যা মেটাতে গিয়ে মারা পড়ল বেচারা।
এটাই তার কাজ। ওর বেতনের বড়সড় একটা অংশ আমরা ক্যাটলম্যানরা দেই।
জেনি খাবার দিয়ে যেতে খাওয়া শুরু করল ওরা
মিস্টার টেনিসন ম্যাককার্থিদের নাচের আসরে যাচ্ছ তো? আগ্রহভরে জানতে চাইল জেনি।
উ..যাব হয়তো।
ধুরন্ধর এ লোকটিকে চিনতে পারেনি মেয়েটা। মেয়েটাকে নিয়ে ভাবার মত লোক টেনিসন নয়, তার চোখ ওর দিকে। জেনি কি তা জানে?
আমাদের সাথে বসো, জেনি। তোমার মাকেও ডাকো, প্রস্তার করল টেনিসন
অদ্ভুত এ লোকটি দ্বিধান্বিত করে তুলেছে ওকে। নিপাট ভদ্রলোকের মত এর আচরণ, ভেতরে গরল অথচ সহজে ধরার উপায় নেই। জীবনে দুর্বোদ্ধ চরিত্রের লোক অনেক দেখেছে মরগান, কিন্তু জানা লোকগুলোর সাথে টেনিসনকে মেলাতে পারছে না। লোকটা অহঙ্কারী, অথচ আচরণে বোঝা যায় না। কোমরে পিস্তল ঝোলায় না, কিন্তু হাতের বুড়ো আঙুলে হামার টানার দাগ? অস্ত্রে পারদর্শী সে, এবং লুকানো কোন অস্ত্রও বহন করছে না, বাজি ধরে বলতে পারবে মরগান। টেনিসনের চরিত্রে আরও কয়েকটা জিনিস চোখে পড়ার মত, আত্মবিশ্বাস আর সাহস। এ লোকটি শক্ত না হয়ে বন্ধু হলেই ভাল হত, তিক্ত মনে ভাবল ও।
একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল মরগানের জন্যে-শেষ খদ্দেরকে বিদায় করে মা-মেয়ে দুজনেই কফির মগ হাতে ওদের টেবিলে এসে বসল। আচরণে মনে হচ্ছে টেনিসনের আমন্ত্রণে নিজেদেরকে সম্মানিত বোধ করছে।
মিসেস উইলিয়ামস, সম্ভাষণ জানানোর পর বলল টেনিসন। এর সাথে কি পরিচয় হয়েছে তোমাদের? এ হচ্ছে জেমস মরগান। আর এরা মা-মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। মিসেস উইলিয়ামস আর ওঁর মেয়ে জেনিফার
নতুন করে নড করতে হলো মরগানকে। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত। স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওকে নিয়ে এক ধরনের মজা করছে টেনিসন। শক্রর সাথে সহজ আচরণ করে বুনো আমোদ পাচ্ছে সে, এবং হয়তো ভণ্ডুকে দিতে চাইছে ওকে।
বাপু, ভাবল মরগান, এত সহজে ভড়কে যাওয়ার মত লোক নই আমি।
যদি এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো, আমার আউটফিটে যোগ দিতে পারো, প্রস্তাব দিল টেনিসন। তাতে আমার কাজ সহজ হয়ে যাবে। ম্যাকলরীরা…’
অবাক হলো না মরগান; কপট লোকটার পক্ষে এমন একটা প্রস্তাব দেয়া খুবই স্বাভাবিক। কারও অধীনে কাজ করি না আমি, দ্রুত বাধা দিল ও। অন্তত যাকে আমার পছন্দ নয়।
সূক্ষ্ম রাগ দেখা গেল টেনিসনের মুখে, দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। হাসল, তবে হাসিটা চোখ স্পর্শ করল না। তাহলে সার্কেল-এমে যোগ দেবে? শীতল সুরে জানতে চাইল। যদ্দুর জানি তোমাকে পেলে কচুকাটা করে ফেলবে ওরা। তোমাকে নাকি তাড়া করছিল ওদের পাঞ্চাররা?
আসলেও কি তাই? ওদেরকে দেখে কিন্তু মোটেও পাঞ্চার মনে হয় আমার। ভাড়াটে কিছু গানহ্যান্ড। হয়তো ক্যাকটাস হিলের ওপাশের হাইড আউ থেকে এসেছে ওরা।
ফের অবাক হলো টেনিসন। মরগান ধরে নিল এটাও ভান। তাই নাকি? তারমানে…আউট-লদের সহায়তায় কাজটা করছে ওরা! সার্কেল-এম পাঞ্চারদের ওপর চোখ রেখেও কেন ধরতে পারিনি বোঝা গেল এবার।
একবিন্দুও বিশ্বাস করল না মরগান। তুমি একটা আস্ত মিথ্যুক! শীতল কণ্ঠে বলল ও, তাকিয়ে আছে টেনিসনের চোখে।
হতভম্ব দেখাল আলফ্রেড টেনিসনকে। বোধহয় ভাবতে পারেনি এভাবে তাকে অপদস্থ করবে মরগান। রাগে ভয়ঙ্কর, বীভৎস দেখাচ্ছে সুদর্শন মুখ। তারপর শীতল দৃষ্টিতে দেখল ওকে। খোদার কসম, আমার কাছে পিস্তল থাকলে আরেকবার কথাটা উচ্চারণ করতে বলতাম!
এতটুকু ম্লান হলো না মরগানের হাসি। কেন হাত দুটো তো আছে!
উই, রাত-দুপুরে তোমার সাথে মারামারি করব না আমি। অন্তত এখানে, দু’জন লেডির সামনে।
তোমার সুবিধামত? খোঁচা মারল মরগান, কিন্তু নিশ্চিত জানে ধাপ্পা দেয়নি লোকটা,পিস্তল থাকলে সত্যিই হয়তো ডুয়েল লড়ত। সে-সাহস আছে লোকটার।
উঠে দাঁড়াল টেনিসন। যখন ইচ্ছে, তোমার পছন্দ মত হবে, কেমন? শান্ত স্বরে বলল সে কথাগুলো, স্বাভাবিক হয়ে এসেছে আচরণ, একটু আগের রাগ বা। বিদ্বেষ নেই। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবটা চলে এসেছে আবার। আবার হয়তো দেখা হবে আমাদের, এগোল সে। যদি তুমি চাও।
হকিন্স কে, মি. টেনিসন? চেনো নাকি? পেছন থেকে জানতে চাইল মরগান, আন্দাজে ঢিল ছুড়েছে। ওর আশা ঠিকমতই লাগবে।
থেমে গিয়ে ঝট করে ঘুরল সে। ও নামে কাউকে চিনি না, চোখে চোখ রাখল টেনিসন, শীতল দৃষ্টি বিদ্ধ করল মরগানকে। মি. জেমস মরগান, তুমিও একটা মিথ্যুক! বলে আর দেরি করল না, দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল মরগানের মেরুদণ্ড বেয়ে। বুঝতে ভুল হয়নি তো ওর? লোকটা কি আসলেই তা বোঝাতে চেয়েছে? কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব?
৫. রাতে ঠিকমত ঘুম হয়নি
রাতে ঠিকমত ঘুম হয়নি মরগানের। অস্বীকার করতে পারবে না চাপা অস্বস্তি ঘিরে রেখেছে ওকে। কারণটা ধরতে পারল-ত্রু সম্পর্কে কিছুই জানা নেই, অথচ ওর সম্পর্কে সবই জানে শত্রু! এরকম খেলা মোটেও পছন্দ নয় মরগানের, শত্রুর চেয়ে এক ধাপ পিছিয়ে থাকা ওর ধাতে সয় না
সারাদিন শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিল ও আস্তাবল থেকে বেরিয়েছে কেবল দু’বার, নাস্তা আর লাঞ্চ করার জন্যে। ভাব জমানোর চেষ্টা করেছে বুড়ো হস্যারের সাথে। কথা বলে সময় কাটানোই সার হয়েছে, কাজের কিছু জানতে পারেনি। টেনিসন বা ম্যাকলয়ারীদের প্রসঙ্গে কোন মন্তব্য করেনি বুড়ো। শেষে বিরক্ত হয়ে ওপরে উঠে ক্ষতের ড্রেসিং বদলেছে মরগান। স্টকে যা ছিল তার সবই ঝাড়ল বুড়োর উদ্দেশ্যে। খেয়ালী এ লোকটার কাছ থেকে কিছুই বের করা যাবে না, যতক্ষণ না সে নিজে মুখ খোলে।
নিজের বেহাল অবস্থা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মরগান। অনায়াসে ওকে আটকে রেখেছে শত্রুপক্ষ। ক্যাসল টাউন থেকে বেরুতে গেলেই সদলে হামলে পড়বে। তবে এত সহজে সবকিছু ঘটতে দেবে না সে। কয়েকটাকে সাথে নিয়ে মরবে, হাড়ে হাড়ে টের পাবে ওরা। সিঁড়িতে পদশব্দ পেয়ে ভাবনার লাগাম। থামাল ও। শুয়ে থাকল একইভাবে, নড়ল না এতটুকু, শুধু ডান হাতে হোলস্টার থেকে তুলে নিয়েছে একটা সিক্সশূটার। পায়ের শব্দ দোতলায় উঠে আসতে তটস্থ পেশীতে ঢিল পড়ল। এ পায়ের শব্দ ওর চেনা, হসল্যার।
পাওনা নিতে এলাম, বরাবরের মত নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল বুড়ো। আমার ধারণা আজই চলে যাচ্ছ তুমি।
অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করল মরগানের মনে, কিন্তু কোনটাই জিজ্ঞেস করল। শুধু জরিপ করল লোকটাকে। অদ্ভুত মানুষ, তার পেশার লোকদের চেয়ে আলাদা সবকিছু আগে আগেই টের পায় সে। পাওনা মিটিয়ে দিল ও।
ঘোড়াটা তৈরি থাকবে।
বোসো। একা থাকতে বিরক্তি ধরে গেছে।
দাঁড়াল সে, তবে বসল না।
টাকা-পয়সার দরকার নেই নাকি তোমার? কিছু খবর দরকার আমার, আর সেগুলো জানো তুমি। আমাকে জানালে দুজনেই উপকৃত হতাম।
তোমাকে পছন্দ হচ্ছে না আমার
মোটেও অবাক হলোনা মরগান। পশ্চিমে এটাই স্বাভাবিক, এখানকার বেশিরভাগ লোক স্পষ্টভাষী এবং সাহসী। তাহলে টেনসনকেই তোমার পছন্দ? শ্লেষের সুরে জানতে চাইল ও, চাইছে লোকটা রেগে যাক, তাহলে বেস কিছু বলে ফেলতেও পারে।
না, তাকেও পছন্দ নয় আমার।
তাহলে নিশ্চই টেনিসনের কাছ থেকে পয়সা খেয়েছ?
হাসল বুড়ো, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বেঁকে গেল ঠোঁটের কোণ। তোমার ধারণায় কিছু যায়-আসে না আমার। হাটতে শুরু করেও ঘুরে দাড়াল। শিগগির এখান থেকে চলে গেলে ভাল করবে। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছে ওই লোকগুলো। ধৈর্যহারা হয়ে একসময় চলে আসবে ওরা, একা এত লোককে সামাল দিতে পারবে না।
পরামর্শ চাই না।
মাথা ঝাঁকাল সে, হাসল ফের
তুমি তো আমাকে পছন্দ করো না, তাহলে পরামর্শ দিচ্ছ কেন?
তোমাদের এ খেলাটা পছন্দ হচ্ছে না আমার।
মানে?
একজন লোককে এভাবে কোণঠাসা করা আমার ভাল লাগেনি।
পাশে এসে দাঁড়াবে তো না-ই, কিছু তথ্য দিয়েও সাহায্য করছ না আমাকে!
কারও ঝামেলায় নিজেকে জড়াই না আমি।
ইতোমধ্যে কমও জড়াওনি।
শ্রাগ করল লোকটা। ধরে নাও একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর প্রত্যাশা।
ধন্যবাদ।
নড করে চলে গেল বুড়ো।
জালটা হেঁড়ার কয়েকটা পরিকল্পনা করল মরগান, কিন্তু একটাও মনে ধরল। শেষে বিরক্ত হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল। শহরটা জেগে উঠেছে। পাই প্যালেসে এল ও। খদ্দেরে পরিপূর্ণ, কিন্তু আজ আর এ নিয়ে ভাবল না মরগান। লুকিয়ে থেকে লাভটা কি! ওরা জানে কোথায় আছে সে, সুতরাং রাখ-ঢাক করে লাভ নেই আর। আপাতত একটা কাজই করার আছে, চোখ-কান খোলা রাখছে যাতে অতি উৎসাহী কেউ আচমকা ওর অসতর্কতার সুযোগ নিতে না পারে।
মিসেস উইলিয়ামসের সাথে নতুন এক লোককে দেখা গেল, সম্ভবত কুক। সে-ই মরগানের ফরমাশ নিল। খাওয়ার সময় ওর সামনে এসে দাঁড়াল মহিলা। মি. মরগান, দেরি হওয়ার জন্যে দুঃখিত। জেনি নেই তো, সব সামাল দিতে…’
কিছু বলল না মরগান, স্মিত হেসে অভয় দিল তাকে।
মেয়েটা জেদ ধরল ম্যাককার্থিদের ওখানে যাবেই, বাধা দেই কি করে! এমন। একটা অনুষ্ঠান তো মাসে মাসে হয় না, থেমে সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। মি. মরগান, এবার নিচু হয়ে এল মহিলার কণ্ঠ। সকালে শহরে এসেছিল মেলিসা বডম্যান, তোমার সম্পর্কে জানতে চাইল।
বিষম খেল মরগান। দ্রুত নিজেকে সামলে নিল ও, গ্লাস তুলে পানিতে চুমুক দিল।
তোমাকে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেছে ও। তোমার ব্যাপারে বেশ চিন্তিত মনে হলো ওকে
ধন্যবাদ, ম্যাম।
কফি আসার পর সিগারেট ধরাল ও। পুলক অনুভব করছে, মেলিসা বডম্যান ওকে নিয়ে ভাবছে, এটা আশাতীত ব্যাপার। তবে এটাও ঠিক, এর সবটুকুই। কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। উপকারীর প্রতি শুভাকাঙক্ষা মাত্র। তার জায়গায় মরগান নিজে হলেও তাই করত।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার, শহরে ওর উপস্থিতি সম্পর্কে জানে সবাই। এত রাখ-ঢাক সময়টাকে মোটেই দীর্ঘায়িত করতে পারেনি। হসল্যার মুখ খোলেনি, নিশ্চিত জানে ও, তাহলে এর কারণ কি টেনিসনের সাথে ওর গতরাতের সাক্ষাৎ? সতর্কতা অনুভব করল মরগান, অবচেতন মনে টের পাচ্ছে জালটা ছোট করে আনছে ওরা। হয়তো আজ রাতেই আস্তাবলে হানা দেবে, কিংবা একটা সেলুনে ইচ্ছে করেই ঝগড়া বাধিয়ে কাজ সেরে ফেলতে চাইবে। তবে দ্বিতীয়টির সম্ভাবনা কম, কারণ এ পর্যন্ত শহর এড়িয়ে চলেছে লোকগুলো।
তবে আজ সেলুনে যাবে ও। সারাদিন বসে থেকে বিরক্তির চরমে পৌঁছে গেছে। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে থাকা ওর একেবারেই অপছন্দ। আসুক ওরা, বুলেট কখনও ভাল-খারাপের বাছ-বিচার করে না। আজই এখান থেকে বেরিয়ে যাবে, সিদ্ধান্ত নিল মরগান, নয়তো কখনোই নয়।
সিদ্ধান্ত নিতে পেরে সন্তুষ্ট হলো ও। পাই-প্যালেস থেকে বেরিয়ে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করল কিছুক্ষণ, তারপর আস্তাবলে ফিরে এসে স্যাডল ব্যাগটা আছে কি পরখ করল। সোরেলের কাছে গেল নামার পথে। বিশ্রাম পেয়ে তরতাজা হয়ে আছে ঘোড়াটা, ছোটার জন্যে উন্মুখ।
বাইরে থেকে সেলুনগুলোর ভেতরের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করল ও। তারপর আস্তাবলের সবচেয়ে কাছের সেলুনে ঢুকে পড়ল। সব মিলিয়ে দশ-বারোজন লোক। বারের কাছে এসে দাড়াল মরগান। বারটেন্ডারের হাসির জবাবে বিয়ারের ফরমাশ দিল। বিয়ারের ক্যান পেয়ে সরে এল পোকার টেবিলের কাছে। দাড়িয়ে খেলা দেখল মিনিট দুয়েক। দু’জন ব্যবসায়ী আর এক কাউহ্যান্ড খেলছে। ডিলার লোকটা পেশাদার জুয়াড়ী, একনজর দেখেই বুঝল ও।
খেলবে নাকি? একটু পর উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল কাউহ্যান্ড। ফতুর হয়ে গেছি আমি।
তার ছেড়ে দেওয়া চেয়ার দখল করল মরগান। দেয়ালের আয়নায় চোখ বুলাল একবার, সেলুনের প্রায় সবটাই চোখে পড়ছে।
তাস শাফল করছে ডিলার।
খেলা শুরুর দশ মিনিটের মধ্যেই মরগান টের পেল চুরি করছে লোকটা। তুমি বোধহয় বুঝতে পারোনি শুধু ভাগ্য আর নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে খেলর আমরা লোকটাকে বলল ও। রাজি না থাকলে উঠে যাও, অন্য কোথাও গিয়ে চেষ্টা করো। আমি যা জানি, এরা যদি তা শোনে, বিপদ হবে তোমার।
তোমাকে পাত্তা দিচ্ছে কে? তড়পে উঠল ডিলার, মরগানের শীতল দৃষ্টিকে গ্রাহ্য করল না।
খোদার কসম, আরেকটা কথা বললে তোমার কোট খুলব!
চেষ্টা করেই দেখো!
পেছনে চেয়ার ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল মরগান। প্রতিপক্ষের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। টেবিলের পাশ ঘেঁষে দু’পা এগোল জুয়াড়ীর দিকে, ইতোমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বন্ধুরা, এই লোকটাকে পছন্দ হচ্ছে না আমার, অন্যদের উদ্দেশে বলল ও। বাজে মতলবে আছে ও। ওর মাথা থেকে ভূতটা নামাতে হবে। নিমেষে হাত বাড়াল ও, জুয়াড়ীর কোটের কলার ধরে ঢ্যাঙা শরীর মেঝে থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে তুলে ফেলল। শুনেছ কি বলেছি আমি। সোজা বেরিয়ে যাও, নয়তো পিটিয়ে রাস্তায় ফেলব তোমাকে।
কি করেছি আমি! প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল জুয়াড়ী।
তেমন কিছু এখনও করোনি, তবে করতে পারো। সেজন্যে আগেই কেটে পড়তে বলছি। থাকতে পারো, বাজে মতলব বাদ দিতে হবে তাহলে।
থাকছি আমি, আপসের সুরে বলল সে, তোমাদের পছন্দমতই চলবে।
উল্টাপাল্টা কিছু করলে সোজা গুলি করব, ঠিক তাসগুলো যেখানে আছে ওসব জায়গায়, লোকটাকে ছেড়ে দেয়ার সময় চাপা স্বরে হুমকি দিল মরগান।খেয়াল করল মারামারি দেখার মজা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে নিরাশ হয়েছে সেলুনের খদ্দেররা। ওদের দিকে মনোযোগ দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল।
কোন জোচ্চোরের সাথে খেলব না আমি! উঠে দাঁড়াল একজন, চোখে ঘৃণা দেখা গেল। দুনিয়ায় এই পেশার লোকদের সহ্য হয় না আমার!
নতুন একজন বসার পর খেলা শুরু হলো। কাউহ্যান্ড বা ব্যবসায়ীরা কেউই পেশাদার নয়। অভিজ্ঞতা আর কৌশলের ঘাটতির কারণে কুলিয়ে উঠতে পারল না ওদের সাথে। জুয়াড়ী আর মরগানই জিতছে। ঘণ্টাখানেক পর নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীরা বসল। এরাও হারল।
মরগানের ইচ্ছে ছিল জুয়াড়ীর কিছু টাকা খসাবে। আজ রাতে যদিও ভাগ্য ওর অনুকূলে নেই বলা চলে। কিছুক্ষণ পর টের পেল ধীরে ধীরে হারতে শুরু করেছে, চুরি ছাড়াই জিতছে জুয়াড়ী! রাগ হলো ওর। মনোযোগ দিল খেলায়, নিজের টাকায় অন্য কেউ ফুর্তি করবে, সহ্য হবে না মরগানের। এমন ভাব করল যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে ও, ছোট কার্ডে ব্লাফ দিয়ে জিততে চাইছে। দু’বার ইচ্ছে করেই হারল, বেশ বড়সড় দান। মনে আশঙ্কা হয়তো বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে। জুয়াড়ীর পকেটে এখন ওর কয়েকশো ডলার রয়েছে।
নতুন করে তাস বাটা হলো। একনজর দেখে নামিয়ে রাখল মরগান। বিরক্ত হয়ে ড্রিঙ্ক চাইল। নিজের দানের সময় একটা কার্ড নিল, পরেরবার আরেকটা। তারপর শুরু করল আসল খেলা। ব্লাফ ভেবে দান বাড়াচ্ছে জুয়াড়ী : টেবিলে চিপসের তৃপ জমে গেছে। লাভে চকচক করছে জুয়াড়ীর দুই চোখ, আলতোভাবে টেবিলের ওপর রেখেছে হাত দুটো। টেবিলের মাঝখানে চিপস ঠেলে দেয়ার সময় কোনরকম জড়তা দেখা গেল না, হয়তো লাভের টাকায়। খেলছে বলেই। একটু পর অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেল যে ওই দান জেতা দু’জনের জন্যেই জেদের ব্যাপার হয়ে দাড়াল।
চারপাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে লোকজন। সিগারেট রোল করার ফাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বীকে জরিপ করল মরগান। শেষ চাল দিল এবার। ভাব দেখাল যেন শো করবে পরেরবার, নেহায়েত অনিচ্ছায় চিপস ফেলছে। ওর দ্বিধা দেখে টাকার অঙ্ক দ্বিগুণ করে দিল জুয়াড়ী। পরেরবারও একই কাণ্ড করল ও, নির্বিকার মুখে টাকা দিয়ে গেল লোকটা। তিন রাউন্ড এভাবে চলার পর হতাশ হয়ে পড়ল জুয়াড়ী, টের পেয়ে গেল সমূহ বিপদ, কিন্তু ফেরার উপায়ও নেই। শশা দিল সে।
চুরি করেছ তুমি! এটা কি করে সম্ভব? মরগান তাস উল্টে দেখানোর পর প্রায় আর্তনাদ করে উঠল সে, চোখে অবিশ্বাস।
তাই? ভুরু নাচিয়ে হেসে উঠল মরগান। তোমার তাসগুলো উল্টাও, ওখানে চারটে টেক্কা আছে। যার একটা অন্য সেটের। উল্টাও!
বাজে বকছ, বন্ধু, তাস উল্টানোর আগ্রহ দেখাল না জুয়াড়ী। পাচটা কার্ড একসাথে ভাজ করে রেখেছে টেবিলের ওপর। উঠে দল সে, কোমরের কছাকাছি চলে গেছে হাত।
সতর্কঘন্টা বাজল মরগানের ভেতর। স্থির দৃষ্টি সেঁটে আছে লোকটার ওপর। বব রবার্ট নামের পাশের প্রতিদ্বন্দ্বীর উদ্দেশে বলল ও। ওর কার্ডগুলো টেবিলের ওপর বিছিয়ে দাও তো।
কাউহ্যান্ড তাসের দিকে হাত বাড়াতে ছোঁ মারল নোকটা। একসঙ্গে দু’হাত চালাল। বাম হাতে টেবিল থেকে খাবলা মেরে তুলে নিল তাসগুলো, অন্য হাতে পিস্তল চলে এসেছে। পিস্তলের নলে কাভার করল সবাইকে। ঠিক আছে, আমরা দুজনেই জানি কি করেছি আমরা। ওই টাকার অর্ধেকের বেশি আমার, তো ওগুলো ফেলে যাই কিভাবে? তাসগুলো পকেটে ঢুকিয়ে চিপস নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল সে। বোকামি কোরো না, মরগান, গুলি করার সুযোগ দিয়ো না আমাকে।
প্রমাদ গুণল মরগান। কাউহ্যান্ড লোকটা বোকার মত দু’জনের মাঝখানে বাধা হয়ে না দাড়ালে ড্র করার সাহস করত না জুয়াড়ী। ছক পাল্টে গেছে বুঝতে পেরে আহাম্মকের মত জুয়াড়ীর দিকে তাকিয়ে আছে কাউহ্যান্ড। মৃদু কাঁপছে তাস নিতে বাড়ানো হাত। ধপ করে চেয়ারে বসে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল। দুঃখিত, মরগান, চাপা স্বরে বিড়বিড় করল সে। বুঝতেই পারিনি হারামজাদা এত চালাক।
চিপস্ ভাঙিয়ে টাকা দাও তো, বাপু, বারকিপের উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল জুয়াড়ী। জলদি!
নির্দেশ তামিল হতে সব টাকা পকেটে ভরল সে। হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে মরগানের দিকে তাকাল, তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে। তো ভালই খেলা হলো, না? বলতেই হয় তোমার ভাগ্য খারাপ, শ্রাগ করার ভঙ্গিতে কাঁধ উঁচু করল সে। এত টাকা, কি করে ফেলে যাই!
ঠিকই তোমাকে খুঁজে নেব আমি।
উঁহু, আবার আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ভাগ্যের ওপর নির্ভর করা হয়ে গেল না? ভাগ্যের প্রতি ভক্তি বা বিশ্বাস নেই তোমার
বিশ্বাস করি না বলেই নিশ্চিত জানি।
একটু পরেই আবার দেখা হবে আমাদের।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখল জুয়াড়ী। ঝেড়ে কাশো তো!
কিছুই না। টাকাগুলো হজম করতে পারবে না তুমি।
পরেরবার সুযোগ নেয়ার উপদেশ দিচ্ছি তোমাকে।
দ্রুত পিছিয়ে গেল সে, ব্যাটউইং দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল।
গুঞ্জন উঠল সেলুন জুড়ে। ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে মরগান, তুফান বেগে চিন্তা চলছে মাথায়। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ও। কয়েকগজ এগোতে একটা গলি চোখে পড়ল, সেটা ধরে মূল রাস্তার কাছে এসে থামল। উঁকি দিয়ে দেখল ফাঁকা রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে জুয়াড়ী। হাতে এখনও সিক্সশ্যটার। অপেক্ষা করছে কখন বেরিয়ে আসবে মরগান, ধারণা করেছে সামনের দরজা দিয়ে বেরুবে ও।
অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষায় থাকল সে; কিন্তু সেলুন থেকে কেউই বেরুল না দেখে শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে হোলস্টারে অস্ত্র ফেরত পাঠাল জুয়াড়ী। ফুটপাথ ধরে হাটতে শুরু করেছে, মরগানের দিকেই এগিয়ে আসছে। নিঃশব্দে মূল রাস্তায় উঠে এল মরগান, দালানের ছায়ায় দাঁড়াল, ঘুরেই যাতে ওকে দেখতে পেয়ে গুলি করতে না পারে লোকটা। তারপর ডাকল তাকে।
ঝটিতি আধ-পাক ঘুরল সে। ঘোরার সময় হোবল মারল হোলস্টারে, নিমেষে হাতে উঠে এল কোল্ট। আন্দাজের ওপর নির্ভর করে কোমরের কাছ থেকে গুলি করল। কিন্তু তাড়াহুড়োয় ফস্কে গেল, তাছাড়া ঠিকমত দেখেওনি ওকে। মরগানের। পাশে দেয়ালে চল্টা উঠাল গুলিটা। কামারের দোকানের জানালা দিয়ে আসা আলোয় জুয়াড়ীকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে মরগান, সময় নিয়ে নিশানা করে গুলি করল ও। হাঁটু মুড়ে পড়ে গেল লোকটা। তাকে শেষ চেষ্টা করতে দেখে এবার কপালে গুলি করল মরগান। ধুলোমাখা ফুটপাথের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল সে, মরার আগে উড়ন্ত ধুলোর মধ্যে নিজের হ্যাটটাকে ধীরে ধীরে নেমে আসতে দেখল।
খানিক অপেক্ষা করে এগোল মরগান। পোর্চে বেরিয়ে এসেছে সেলুনের লোকজন, বিভিন্ন মন্তব্য করছে। সেসবে আমল না দিয়ে লোকটার পকেট খালি করল ও, তারপর রাস্তা পেরিয়ে ফের সেলুনে ঢুকল। শেষ রাউন্ড পান করে আস্তাবলে ফিরবে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ঠিক বিশ মিনিট পর বেরিয়ে এল ও। কয়েকটা বাড়িতে আলো জ্বলছে এখনও, তারই কিছু রাস্তায় এসে পড়েছে। সিগারেট ফুকতে ফুকতে আস্তাবলের। দিকে এগোল মরগান। চিন্তিত। এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিল চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জালের ব্যাপারটা। যেভাবে হোক এটা ছিন্ন করতে হবে। আস্তাবলের ভেতরে ঢুকে পড়ল। বুড়ো বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে, সাড়া নেই। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যাবে, এসময় ওপরে কয়েকজনের পদশব্দ কানে এল ওর। কমপক্ষে তিনজন, ধারণা করল। নিমেষে হাতে চলে এল জোড়া পিস্তল। তারপর সহসা বাইরে আরও কয়েকজনের সাড়া পেল। টের পেল ফাঁদে আটকা পড়েছে, দুদিক থেকে ওকে ঘিরে ফেলেছে লোকগুলো।
.
ম্যাককার্থিরা এ তল্লাটে সবচেয়ে আমুদে পরিবার হিসেবে পরিচিত। পারিবারিক যে কোন একটা উপলক্ষ পেলেই নাচের আসর বসাবে ওরা, আমন্ত্রণ জানাবে আশপাশের বাথানের সবাইকে। আজ ওদের ছোট ছেলে ব্রায়ানের জন্মদিন।
আশপাশের সবগুলো বাথানের লোকজন এসেছে, বিশেষত মালিক পক্ষের পরিবারগুলো। ম্যাকলয়ারীরা দু’ভাইও এসেছে। অস্বস্তির সাথে আলফ্রেড : টেনিসনের উপস্থিতি লক্ষ করল মেলিসা বডম্যান। হলরুমে ঢোকার পথে দেখা হলো টেনিসনের সাথে। হাতে বিয়ারের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে, ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। সামনে এসে হ্যাট খুলে বাউ করল। কেমন আছ, লিসা?
ভাল, সংক্ষেপে জানাল ও, পাল্টা তার কুশল জানতে চাইল না। লোকটা কি ভাবে সে-নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কেটে পড়ল। একপাশে ব্রায়ানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ম্যাককার্থিরা, সেদিকে এগোল মেলিসা। উচ্ছ্বাসভরে ওকে জড়িয়ে ধরল ডরোথি ম্যাককার্থি, কুশল জানতে চাইল
টেনিসনকে কিছু বলেছ নাকি? একপাশে ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে চাপা স্বরে জানতে চাইল মহিলা। মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে ও।
নাহ্, কিছুই তো বলিনি।
তোমার ব্যাপারে আগ্রহের কমতি নেই ওর, অথচ মোটেই সুযোগ দিচ্ছ না। বেচারাকে। লিসা, এ তল্লাটে ওর চেয়ে ভাল কাউকে পাবে না তুমি।
ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি
টেনেসিতে, তাই না? হাসল ডরোথি। আমার ধারণা তোমার কারণেই এখানে এসেছে ও। যদূর শুনেছি ওখানে একটা বড়সড় বাথান ছিল ওর।
একটা বাজে মেয়েও ছিল, এটা শোনোনি?
কি বলছ! বিস্ফারিত হলো ডরোথির চোখ।
ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখো, ডোনা রাইস নামে কোন মেয়েকে চিনত কি না।
শ্যনকে আনলে না যে? প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল ডরোথি।
শরীর ভাল যাচ্ছে না ওর, বাবা নিষেধ করল। তাছাড়া ফিরতে তো রাত হবে। এত রাত করে ফেরা ওর জন্যে ঠিক হবে না।
এরপর ম্যাকলয়ারীদের সাথে কথা বলল মেলিসা। চমৎকার মানুষ মনে হলো দু’ভাইকে। আমুদে এবং মিশুক। প্রতিবেশী হিসেবে ফ্ল্যাগ-বির সাথে সবসময়ই ভাল আচরণ করেছে ওরা, যেটা টেনিসন করেনি।
আড়চোখে কামরার কোণে টেনিসনের দিকে তাকাল মেলিসা, জেনিফার উইলিয়ামসের সাথে গল্প করছে সে। আগ্রহ ঝরে পড়ছে মেয়েটার চোখে। টেনিসন অবশ্য পছন্দ করার মত লোক, মেয়ে-মহলে আলাদা একটা আকর্ষণ আছে তার। জেনি নিজেও সুন্দরী, ভাবল মেলিসা, ওরা হয়তো…
খেতে এসো সবাই, ম্যাককার্থির ডাকে ছিন্ন হয়ে গেল ওর চিন্তা। আনমনে মাথা ঝাঁকাল ও, টেবিলে এসে বসল। পাশেই ডেভিড ম্যাকলয়ারী। মেলিসা খেয়াল করল উল্টোদিকে, একটু দূরে জেনির পাশে বসেছে টেনিসন। চোখাচোখি হতে স্মিত হাসল ও। টের পেল ঠিকমতই লোকটার আঁতে ঘা দিতে পেরেছে। গম্ভীর হয়ে গেছে টেনিসনের মুখ, রোষের সাথে একবার তাকাল ডেভিড় ম্যাকলয়ারীর দিকে, তারপর জেনির দিকে মনোযোগ দিল। একটু পর খানিকটা চমকে দেবে তাকে, সিদ্ধান্ত নিল মেলিসা।
খাওয়ার পর নাচের পর্ব শুরু হলো। প্রথমেই ম্যাকলয়ারীদের সাথে নাচল ও, তারপর ম্যাককার্থির সাথে। বিরতি পড়তে একটা চেয়ারে বসে অরেঞ্জ জুসে চুমুক দিচ্ছিল, দেখল ওর দিকে এগিয়ে আসছে টেনিসন। পাশে এসে বসল।
নাচবে আমার সাথে? কোমল সুরে জানতে চাইল সে।
কেন, জেনির সাথে নেচে আনন্দ পাওনি? তোমার সঙ্গ পেলে খুশিই হবে ও।
মেলিসার কটাক্ষ গায়ে মাখল না টেনিসন, হেসে পাল্টা জানতে চাইল: তুমি হবে না?
না।
ম্লান হয়ে গেল লোকটির হাসি, ধীরে ধীরে গাম্ভীর্য জায়গা করে নিল সেখানে। পুরো হলুরূমের ওপর চোখ বুলাল, তারপর হঠাৎ ফিরল ওর দিকে। ম্যাকলয়ারীদের সাথে নেচেছ তুমি! চাপা অসন্তোষ প্রকাশ পেল কণ্ঠে।
তাতে তোমার কি?
ওই গরুচোরগুলোর সাথে কোন ভদ্রমহিলার নাচা উচিত নয়।
রেগে গেল মেলিসা, বিরক্তি বোধ করছে। কিন্তু কোন জোচ্চোরের সাথে নাচব না আমি! অসহিষ্ণু স্বরে ঘোষণা করল ও। ওদেরকে মোটেও গরুচোর মনে হচ্ছে না আমার। বরং তোমার সম্পর্কে একই দাবি করে ওরা। নিজের দোষ ঢাকতে ওদেরকে উচ্ছেদ করতে চাইছ, সেজন্যে আমার জমিটা দরকার তোমার, যাতে ঝর্নার মুখ বন্ধ করে ওদের পানির উৎস বন্ধ করতে পারো। মি. টেনিসন, তুমি কি চাও আমি সবাইকে বলি যে নিজের ঘরে সুন্দরী স্ত্রী রেখে একটা বাজে মেয়ের পেছনে ঘুরেছ তুমি?
রাগ দেখা গেল টেনিসনের মুখে। তারপর বিব্রত বোধ করল সে, করুণ হয়ে উঠল মুখ। সত্যিই ভুল করেছি আমি, এবং অনুশোচনাও কম করিনি।
নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছ?
ন-না। শুধু তুমি…’।
মরগানের পেছনে তুমিই লোক লাগিয়েছ, তাই না? প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল মেলিসা, অজান্তে কর্কশ হয়ে গেল কণ্ঠ। তোমার ওই ছা-পোষা লোকটা ফেয়ার ফাইটে মারা গিয়েছিল, অথচ একগাদা লোক ওর পেছনে লেলিয়ে দিয়েছ!
ওর প্রেমে পড়েছ নাকি? উমা প্রকাশ পেল টেনিসনের কণ্ঠে।
গা জ্বলে উঠল মেলিসার। পড়লেই তোমার কি! মি. টেনিসন, তোমার মত যার-তার প্রেমে পড়ি না আমি।
খুশি হালাম।
তোমার খুশি হওয়ার কিছু নেই। বরং জেনিকে পটানোর চেষ্টা করো। যদিও আমি চাই না তোমাদের মধ্যে কোন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থোক।
কেন?
মেয়েটা বোকা। ও জানে না কতটা খারাপ লোক তুমি।
তিন বছর আগে একটা মেয়ের সাথে কি করেছি তাতেই খারাপ হয়ে গেলাম?
তোমার নাড়ি-নক্ষত্র খুব ভাল করেই জানি আমি। নিজের স্ত্রীকে বঞ্চিত করেছ তুমি, প্রতারণা করেছ, ওকে অপমান করেছ। তোমার চরিত্র বুঝতে এগুলোই কি যথেষ্ট নয়?
কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল আলফ্রেড টেনিসন। অসহায়ভাবে কাঁধ উঁচাল। আমার মধ্যে কি ভাল কিছু নেই? প্রায় আপসের সুরে জানতে চাইল শেষে।
আছে। নিরপরাধ কারও পেছনে লাগতে পারো তুমি, জোর-জবরদস্তি করার মত মস্ত একটা গুণও তোমার আছে। আর হাঁ, তুমি অহরী, প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং সাহসী।
মাত্র একটা ভাল গুণ, তা-ই সই। ধন্যবাদ, লিসা। আমি ভালবাসতে পারি, সেটা বললে না?
খানিকটা বিব্ৰত বোধ করল মেলিসা। তুমি ভালবাসা বদল করতেও পারো।
তুমি পারো না, এবার হাসল আলফ্রেড টেনিসন। নিরীখ করছে মেলিসাকে। আমি জানি, এখনও স্বামীকে ভালবাসো তুমি।
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না মেলিসা, অজান্তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। গলার ভেতর কিছু একটা দলা পাকিয়ে আছে যেন। নিজেকে সামলে নিতে সময় লাগল ওর। সে একটা বাজে মানুষ! প্রায় আক্ষেপের সুরে স্বীকার করল শেষে।
মেলিসার সামনে এসে দাঁড়াল টেনিসন। এখানকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির সাথে নাচার সৌভাগ্য আমার হবে কি? সহাস্যে, চোখে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে ফের প্রস্তাব দিল সে।
তুমি একটা বেহায়া! আগেও বলেছি, তোমার সাথে নাচব না আমি। ফের জানতে চাইলে কেন? তোষামোদে গলে যাব ভেবেছ? শোনো, মি. টেনিসন, তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা কখনোই পাল্টাবে না।
উঠতে যাচ্ছিল মেলিসা, কিন্তু সামনে থেকে নড়ল না টেনিসন। তার ছাইরঙা চোখজোড়া বিদ্ধ করল ওকে। অজানা কারণে অস্বস্তি বোধ করল মেলিসা, অজান্তে দু’পা সরে এল। চেয়ারের সাথে পা বেধে পড়ে যাচ্ছিল, কোমর ধরে ওকে দাড় করিয়ে দিল টেনিসন। মেলিসার সারা শরীরে বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হলো, কেঁপে উঠল বুক। অজান্তে চোখ বুজে এল।
লিসা, ভরাট, আমুদে গলায় বলল টেনিসন। খুব শিগগিরই ধারণা পাল্টে যাবে তোমার, এইমাত্র নিশ্চিত হালাম আমি। হাসিতে উদ্ভাসিত হলো তার সুদর্শন মুখ, ঝকঝকে সাদা দাঁত দেখা গেল। তুমি এমন একটা মেয়ে যাকে সহজে পাওয়া যায় না, কেনাও যায় না। তোমাকে পাওয়ার বিনিময়ে নিজের সর্বস্ব হারাতে রাজি আমি, বিশ্বাস করো!
ধন্যবাদ, মি. টেনিসন! আন্তরিক কণ্ঠে বলল মেলিসা, সামলে নিয়েছে নিজেকে। লোকটা ওর বেসামাল অবস্থার সুযোগ নেয়নি বলে কৃতজ্ঞ বোধ করছে। চকিতে চারপাশে তাকাল ও, দেখল ওদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না কেউ। ছোট ছোট দল পাকিয়ে গল্পে মশগুল সবাই।
জায়গাটা আমাকে ছেড়ে দিচ্ছ তো?
না! টেনিসনের প্রতি ফের বিদ্বেষ অনুভব করল মেলিসা। বরং ক্যাটলম্যান এসোসিয়েশনকে একটা প্রস্তাব দিতে যাচ্ছি আমি। খুব শিগগিরই কাঁটাতার এনে আমার রেঞ্জে বেড়া দেব অন্যদেরকেও তাই করতে বলব। নিজের রেঞ্জে অন্যের হাজার হাজার গরু চরে বেড়াবে, এই উদারতা দেখানো আর পছন্দ হচ্ছে না আমার। তাছাড়া এতে রাসলিংও কমে যাবে।
টেনিসনের অবস্থা দেখে মনে হলো যেন তাকে লাথি মেরেছে মেলিসা। বিস্ময়ে ঝুলে পড়ল চওড়া পেশীবহুল কাঁধ, রাগে লাল হয়ে গেল ফর্সা মুখ। তুমি কি সত্যি তাই করবে? গলায় সন্দেহের সুর, অজান্তে কেঁপে উঠল কণ্ঠ। মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছে তেমন হলে এ তল্লাট ছাড়তে হবে ওকে, কারণ ওর রেঞ্জের জমিতে ঘাস নেই। একটা বছরও টিকবে না গরুগুলো। সত্যি কথা বলতে কি, ফ্রি রেঞ্জের সুবিধা আছে বলেই টিকে আছে এখানে।
নিশ্চিন্তে কয়েক হাজার ডলার বাজি ধরতে পারো, অনাবিল হাসি মেলিসার মুখে, টেনিসনের কোণঠাসা অবস্থা চুটিয়ে উপভোগ করছে। তোমার অসুবিধে কি, ম্যাকলয়ারীদেরকে তো দেশছাড়া করছই। ওদের ফেলে যাওয়া রেঞ্জ কিনে নিয়ে, গরু চরানোর জায়গা পেয়ে যাবে। তবে এরপর কিন্তু পানির উৎসটা বন্ধ করে দেব আমি। তোমাকে দেশছাড়া করার একটা সুযোগ আমারও আছে, তাই না?
বিশ্বাস করতে পারছি না…সত্যিই তাই করবে?
তুমি যদি ম্যাকলয়ারীদের ওপর জোর খাটাতে পারো, আমি কেন তোমার সাথে কৌশল বা জোর খাটাতে পারব না?
আমি তোমার কোন ক্ষতি করিনি!
তুমি একটা বেহায়া লোক এবং এ এলাকায় যদ্দিন থাকবে কেবল ঝামেলাই পাকাবে। তোমাকে উচ্ছেদ করতে পারলে আমার ওপর খবরদারি করার ঝুঁকিটা থাকে না, গরুচুরিও বোধহয় বন্ধ হয়।
আমাকে গরুচোর বলছ!? বিস্ফারিত হয়ে গেছে টেনিসনের চোখ, অজান্তে দৃঢ় হয়ে গেল মুঠি।
কখন বললাম! আকাশ থেকে পড়ার ভান করল মেলিসা। ম্যাকলয়ারীদেরকে তাড়াচ্ছ তুমি; পরে, তোমাকে তাড়াব আমি। সন্দেহজনক কোন আউটফিট এখানে থাকবে না আর। ব্যস, তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!
খোদার কসম, লিসা, কাঁটাতারের বেড়ার প্রচলন হলে সব গরু তোমার রেঞ্জে নিয়ে যাব আমি! জেনে-শুনে এরকম জঘন্য একটা কাজ করতে পারো না। তুমি। ফ্রি রেঞ্জ পশ্চিমের একটা স্বভাবসিদ্ধ ব্যাপার। তোমার প্রস্তাব মানবে না কেউ।
কিন্তু আমার ধারণা প্রস্তাবটা লুফে নেবেসবাই। কেউ না মানলেও নিজের এলাকায় বেড়া দেব আমি, সবকটা ঝর্না ফ্ল্যাগ-বির দিকে বইয়ে দেব। খরার। সময় পানি না পেলে আমার প্রস্তাব মানতে বাধ্য হবে ওরা। আর তুমি যদি আমার রেঞ্জে ঢোকার চেষ্টা করো, গুলি করার আগে সতর্ক করে দেব হয়তো, কিন্তু কথা শুনলে সত্যিই নিজের খারাবি ডেকে আনবে। নিজের এলাকায় উটকো ঝামেলা সহ্য হবে না আমার।
টেনিসন যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, বড়বড় হয়ে গেছে চোখ। তোমাকে এভাবে জানতাম না আমি! হতাশ, ম্লান কণ্ঠে বলল সে একসময়। আড়ষ্ট হয়ে গেছে শরীর, আত্মবিশ্বাসী ভাবটা নেই আর এখন।
সবার ওপর ছড়ি ঘুরানোর একটা মজা আছে, তাই না? তোমার মত ধুরন্ধর লোকের ওপর হলে তো কথাই নেই! খোদার কসম, মি. টেনিসন, ব্যাপারটা খুব মজাদার হবে, দারুণ উপভোগ করব আমি!
চড়া কণ্ঠে সবাইকে ডাকল মিসেস ম্যাককার্থি। তৃতীয় রাউন্ড শুরু হবে এখন।
নাচবে আমার সাথে? হেসে জানতে চাইল মেলিসা, চোখে কৌতুক। নাকি ইচ্ছে নেই আর?
এরচেয়ে জরুরী কাজ পড়ে আছে, উদাসীন সুরে বলল সে, হ্যাট খুলে বো করল, কিন্তু ভঙ্গিটার মধ্যে আন্তরিকতার বালাই থাকল না। ধন্যবাদ, লিসা, স্বীকার করছি আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছ, মনে করিয়ে দিয়েছ সত্যিই নাজুক অবস্থায় আছি আমি। এরকম একটা ধাক্কা তোমারও দরকার! মেলিসার চোখে চোখ রাখল টেনিসন, দৃঢ় হয়ে গেছে চোয়ালের পেশী। রাগে দপদপ করছে কপালের পাশের একটা শিরা। চোখে কঠিন; বরফের মত ঠাণ্ডা চাহনি। তোমাকে এসব করতে দেব না আমি, লিসা, যেভাবে পারি ঠেকাব। বিশ্বাস করো, কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার আগেই সব সামলে নেব! বলেই ঘুরে দাড়াল সে, দ্রুত বেরিয়ে গেল হলরুম থেকে।
ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠেছিল মেলিসার ঠোঁটের কোণে, ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। টেনিসনের পিঠের ওপর স্থির হয়ে থাকল ওর দৃষ্টি, যতক্ষণ দেখা গেল তাকে। অবচেতন মনে ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে, অজান্তে শিহরিত হলো ও। লোকটাকে ভাল করেই চেনে, জানে জেদ চাপলে টেনিসনের পক্ষে সবই সম্ভব। তবে ঝামেলায় যেতে চায় না মেলিসা, টেনিসন ওকে আর না ঘটালে কিছুই করবে না-সিদ্ধান্ত নিল। অস্বীকার করার উপায় নেই লোকটাকে দমানোর জন্যে দারুণ কয়েকটা অস্ত্র আছে ওর হাতে।
এই যে, লিসা, আরেক রাউন্ড হবে নাকি? রল ম্যাককার্থির ডাকে চৈতন্য হলো ওর, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
হেসে সায় জানাল মেলিসা। দেখো আবার, শেষে তোমার বউ হয়তো নাখোশ হবে আমার ওপর। ওকে খেপালে এরকম নাচের আসরে আর নিমন্ত্রণ জানাবে না।
বাদ্য বেজে ওঠার আগেই ঘোড়ার খুরের শব্দ পেল মেলিসা, দ্রুত উত্তরে ছুটে যাচ্ছে। অস্বস্তি ঘিরে ধরল ওকে, ভয় লাগছে। হঠাৎ করে টেনিসনের আসর ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ কি? ওর হুমকি ঠেকাতে কি পরিকল্পনা করবে কে জানে! জোর করে টেনিসনের ভাবনা মন থেকে তাড়িয়ে ম্যাককার্থির সাথে ফ্লোরে চলে এল মেলিসা। টের পেল প্রায়ই ভুল করছে, মনোযোগ রাখতে পারছে না।
কোন সমস্যা, লিসা? আন্তরিক কণ্ঠে জানতে চাইল ম্যাককার্থি। নাচে মন দিতে পারছ না। টেনিসন বোধহয় আগ্রহী করে তুলেছে তোমাকে?
ন-না…ওহ, ঠিকই ধরেছ।
তাহলে আমরা আশা করতে পারি, তোমরা…
না! বাধা দিল মেলিসা, অস্বস্তির সাথে হাসল। ওরকম কিছু নয়। আমার জন্যে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে।
সেজন্যে টেনিসনকে দোষ দিতে পারো না তুমি! হালকা সুরে মন্তব্য করল ম্যাককার্থি। সব পুরুষই সৌন্দর্যের পূজারী। তোমার মত সুন্দরী মহিলার সঙ্গ পাওয়ার জন্যে ও যদি খানিকটা বেপরোয়াও হয়ে যায়, বিরক্ত না হয়ে হয়তো শিই হওয়া উচিত তোমার। কারণ পরোক্ষভাবে হলেও তোমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করে এ।
তুমিও কি তাই?
অনেকটা। তবে ডরোথিকে নিয়ে সুখী আমি। একজন সুন্দরী লেডির সাথে নাচতে পারছি, তাতেই আনন্দিত এবং সন্তুষ্ট। ডরোথির সাথে নেচে বোধহয় একই আনন্দ পাবে অন্য কেউ।
হালকা কথা-বার্তা চালিয়ে গেল ওরা। পরের রাউন্ডে কারও আমন্ত্রণেই সাড়া দিল না মেলিসা, বসে থেকে নাচ দেখল। মিসেস ম্যাককার্থি এখন স্বামীর সাথে নাচছে। অতুলনীয় একটা জুটি। পুরো আসর ওরা দুজনেই মাতিয়ে রেখেছে।
ইচ্ছে করলেও আলফ্রেড টেনিসনকে ভুলতে পারছে না মেলিসা, লোকটার আঁতে ঘা দিয়ে বোধহয় ভুলই করেছে। এমনিতে একগুয়ে সে, জেদ চাপলে অন্যায় বা জোর করতেও দ্বিধা করবে না। ওর জীবনে অশান্তি বয়ে আনুক টেনিসন, চায় না মেলিসা, কারণ তাকে প্রতিরোধ বা দমন করার সামর্থ্য ওর নেই, এটা ওর চেয়ে আর কেউ ভাল জানে না। এমন বেপরোয়া লোক সত্যিই দেখেনি ও, আকাক্ষিত জিনিসটা আপসে না পেলে জোর করবে, সে, নিশ্চিত জানে মেলিসা এবং এখানেই ওর ভয়।
আসর শেষ হলো প্রায় মাঝরাতে, একে একে বিদায় নিতে লাগল অতিথিরা। বিদায় নেয়ার সময় পোর্চে ক্লীভ অ্যালেনকে দেখতে পেল, মেলিসা। বুড়োর মুখ থমথমে দেখে অজান্তে কেঁপে উঠল ওর বুক, কু গাইল মন। দ্রুত পোর্চে বেরিয়ে এল ও। কি হয়েছে, ক্লীভ?
কিছু না বলে একটা চিরকুট এগিয়ে দিল কূক।
কাগজটা নিয়ে পড়ল মেলিসা। মাত্র দুটো লাইন, কিন্তু সেগুলোই ওর ভিত কাপিয়ে দিল। ঘামতে শুরু করেছে, বুক ধড়ফড় করছে, গলা শুকিয়ে আসছে। কে দিয়েছে? কাঁপা স্বরে জানতে চাইল।
টেনিসনের এক পাঞ্চার। তোমাকে দিতে বলে চলে গেছে।
বাগিটা নিয়ে এসো।
বুড়ো চলে যেতে ফের চিরকুটটা পড়ল ও। বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু না করারও উপায় নেই। টেনিসনের হাতের লেখা চেনে ও।
শ্যন আমার এখানে আছে।
জলদি চলে এসো।
.
টেনিসনের পক্ষে এমন একটা নোংরা কাজ সম্ভব। নাচের আসর ছেড়ে আগেভাগে চলে যাওয়ার কারণ বোঝা গেল এবার। ভবিষ্যৎ অনুমান করতে ভয় লাগছে ওর। জানে টেনিসনের বার্থানে যেতে হবে, নিজের তাগিদেই। অনিবার্য একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সে, নোংরা কৌশল খাটিয়েছে ওর ওপর।
মেলিসা চড়ে বসতে বাগি ছেড়ে দিল বুড়ো। অখণ্ড নীরবতা ভাঙার চেষ্টা করল না কেউ। রুক্ষ ট্রেইলে খটখট শব্দে এগিয়ে চলেছে বাগি। ঘোড়াগুলোর ঘন, গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে মেলিসা। আশঙ্কা ওর মনে, বুক ঢিপঢিপ করছে, নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। চাঁদের মায়াবী আলোয় ভেসে যাচ্ছে প্রকৃতি, কিন্তু উপভোগ করার মানসিকতা নেই ওর, বরং শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল দূরের ক্যাকটাস হিলের আবছা অবয়বের দিকে। হালকা ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। অজান্তে কেঁপে উঠল মেলিসার দেহ, ঠাণ্ডা লাগছে না বরং ভয়ে-আশঙ্কায় ভেতরটা বরফের মত শীতল হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই শ্লথ হয়ে গেল বাগির গতি, ক্লীভ অ্যালেনের প্রশ্নে সংবিৎ ফিরল ওর, কিন্তু ধরতে পারল না প্রশ্নটা। দেখল মূল ট্রেইলে চলে এসেছে ওরা। ডানের ট্রেইল ধরে এগোলে ফ্ল্যাগ-বিতে পৌঁছে যাবে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে।
বক্স-টিতে যাচ্ছি আমরা, ক্লীভ, মৃদু স্বরে নিজের সিদ্ধান্ত জানাল মেলিসা।
সেটা কি ঠিক হবে, ম্যাম?
শ্যনকে নিয়ে বাথানে ফিরব আমি!
নড করল সে। দ্রুত ছুটল বাগি।
ম্যাককার্থিদের বাথান থেকে মাইল চার পরে টেনিসনের বাথানের সীমানা। ঘাসহীন রুক্ষ প্রান্তরের শুরু বক্স-টি সীমানার কথা জানান দেয়। আরও মাইল দুই যাওয়ায় র্যাঞ্চ-হাউসটা চোখে পড়ল। কয়েকটা কামরায় আলো জ্বলছে। দূর থেকে চাঁদের আলোয় স্বপ্নপুরীর মত মনে হচ্ছে র্যাঞ্চ-হাউসটাকে। বাস্তবের সাথে কল্পনার অমিল অনুধাবন করে ক্ষীণ তিক্ততার হাসি ফুটল মেলিসার ঠোঁটে। বরং দুঃস্বপ্নপুরী বলা উচিত ভাবল ও, আজকের রাতটা এখানে কিভাবে কাটবে জানা নেই, কিংবা আলফ্রেড টেনিসনের চাহিদাও কি হতে পারে বুঝতে পারছে না। ভাবতেও ভয় লাগছে।
পাহাড়ের কোলে বড়সড় দালানের পাশে বার্ন আর করাল। দুই সারি ওঅটর ট্রাফের মাঝখান দিয়ে বিশাল র্যাঞ্চ-হাউসের সামনে এসে থামল বাগি। পোর্চের খুঁটির সাথে ঝুলন্ত দুটো লণ্ঠন ম্লান আলো ছড়িয়ে দিয়েছে আঙিনায়। বাম দিকের একটা কামরা থেকে বেরিয়ে এল আলফ্রেড টেনিসন। হাসি লেগে আছে মুখে।
ঠায় বসে আছে মেলিসা, যেন নামার শক্তি পাচ্ছে না।
নেমে এসো, ক্লীভ। ড্রিঙ্ক করে যাও। শেষে আবার যেন বলতে না পারো, আমার এখানে এসে ড্রিঙ্কের অফার পাওনি। সস্তা রসিকতায় হেসে উঠল সে, অন্যরা কেউ যোগ দিল না। তবে তাতে অসন্তুষ্ট মনে হলো না বক্স-টি মালিককে। এগিয়ে এসে মেলিসাকে নামতে সাহায্য করল। দোতলায় চলে যাও, লিসা। আসছি আমি।
ছুটল মেলিসা। সিঁড়ি ভেঙে চলে এল ওপরে।
ক্লীভ অ্যালেনকে নিয়ে নিচের অফিসরূমে এল টেনিসন। নির্জলা হুইস্কি অফার করল।
এসব কি হচ্ছে, টেনিসন? চেষ্টাকৃত কোমল কণ্ঠে জানতে চাইল কূক।
কিছুই না। ওরা মা-ছেলে আজ আমার অতিথি, ব্যস। কাল সকালে ওদেরকে পৌঁছে দেব আমি।
আমাকে চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ।
যদি না যাই?
থাকতে পারো, একজন অতিথি বাড়লে বরং খুশিই হব, অমায়িক হেসে বলল টেনিসন। কিন্তু ওরা এখানে থাকছে আজ, খবরটা জানা উচিত মি. বডম্যানের।
আমি তোমার চাকুরি করি না! শীতল শোনল কুকের কণ্ঠ। বিদ্বেষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টেনিসনের দিকে।
হ্যাঁ, নিশ্চই। বুঝতে পেরেছি মালিক ছাড়া অন্য কারও কথা মনে ধরবে না তোমার। একটু অপেক্ষা করো, ক্লীভ। মেলিসা নিজেই তোমাকে একই কথা বলবে।
কিছুই বুঝতে পারছে না ক্লীভ অ্যালেন। টেনিসনের ঘাড় মটকে দিতে ইচ্ছে করছে। বিষদৃষ্টিতে বক্স-টি মালিকের দিকে তাকাল, ও, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করছে না সে। তার হাসি গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে ওর।
বোতল আর সময়ের সদ্ব্যবহার করো, ক্লীভ, উদার ভঙ্গিতে হেসে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল টেনিসন
তাই করল ফ্ল্যাগ-বি কুক। বোতলটির সদ্ব্যবহার করা ছাড়া এখানে করার কিছুই নেই ওর, তিক্ত মনে ভাবল।
একটু পরই এল মেলিসা। শুকনো দেখাচ্ছে মুখ, আশঙ্কা আর ভয় ঢেকে রাখার চেষ্টা করেও পারছে না। ক্লীভ, বাবাকে বোলো কাল সকালে ফিরব আমরা।
কি বলছ, ম্যাম!?
ভয়ের কিছু নেই, ম্লান হাসল মেলিসা, ওর চোখ দেখে মনে হলো নিজেও কথাটা বিশ্বাস করছে না। শ্যন ভাল আছে। আমার ধারণা…জমিটা বেচতে আমাকে বাধ্য করবে ও
তুমি অনুমতি দিলে ঘটনাটা সবাইকে জানাতে পারি আমি। ম্যাককার্থিদের নাচের আসরে এখনও কিছু লোক আছে বোধহয়। খবর পেলে টেনিসনকে লটকাতে আসবে ওরা। ওর সাধের এই বাথান জ্বালিয়ে ছারখার করে দেবে।
শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছ, ক্লীভ। আমি এখানে ভালই থাকব।
মি. বডম্যান হয়তো দুশ্চিন্তা করবে, ম্যাম।
তোমার ফিরতে দেরি হলে বাবা আরও বেশি দুশ্চিন্তা করবে।
হুইস্কির গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে বেরিয়ে গেল কুক। পিছু পিছু পোর্চ পর্যন্ত এল মেলিসা। বাগিটার অবয়ব দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল ও, তারপর দোতলায় উঠে এল।
ওপরে শুধু একটা কামরায় বাতি জ্বলছে, টেনিসনের বেডরূমে। বিছানার ওপর বসে সিগারেট ফুকছিল সে, দরজায় এসে দাঁড়াল মেলিসা। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভয়ে বেসামাল অবস্থা, প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস পাচেছ।
এসো, লিসা।
শ্যন কোথায়? তোমার কথা মত ক্লীভকে চলে যেতে বলেছি।
ঘুমোচ্ছে ও।
তোমার সাথে কথা বলার আগে ওকে দেখব আমি! একগুঁয়ে স্বরে দাবি করল মেলিসা।
অযথাই ভয় পাচ্ছ। এসো, বলে এগোল টেনিসন, পিছু নিল মেলিসা।
দুটো কামরা পেরিয়ে আরেকটায় ঢুকল সে, লণ্ঠন জ্বালাল। এটাও একটা বেডরূম, তবে ফাঁকা।
শ্যন কোথায়?
পাশের রূমে। জানালা দিয়ে দেখো।
ছুটে গেল ও, লণ্ঠনের ম্লান আলোয় পাশের কামরায় ঘুমন্ত শ্যনকে দেখতে পেল। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো ওর, শয়তানটা ওকে…। শ্যনের ছোট্ট বুক আর পেট নিয়মিতভাবে ওঠা-নামা করছে দেখে অজান্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শ্যনের কাছে যাব আমি, ঘুরে বলল মেলিসা।
কাল সকালের আগে নয়।
আসলে কি চাও তুমি?
সকালে এ নিয়ে আলাপ করব আমরা, ঠিক আছে? ক্লান্ত হয়ে আছ, সন্ধেয় অনেক নেচেছ, বিশেষ করে ম্যাকলয়ারীদের সাথে।
প্রত্যাখ্যানের শোধ তুলছ?
তোমার কামরাটা দেখিয়ে দেই। ঘুমোও, সকালে উঠে সব বিদ্বেষ ভুলে যাবে।
তোমার ধারণা এখানে শান্তিতে ঘুমাতে পারব আমি? শ্লেষের সুরে জানতে চাইল মেলিসা।
উত্তর দিল না টেনিসন, দরজার দিকে এগোচ্ছে। অগত্যা পিছু নিল মেলিসা। দরজার কাছে এসে সরে গিয়ে ওকে বেরুনোর সুযোগ দিল সে, ফের কামরায় ঢুকে বাতি নিভিয়ে দিল। তারপর পাশের কামরায় এল ওরা। বাতি জ্বালাতে মেলিসা দেখল আগেরগুলোর চাইতে অনেক বেশি আরামদায়ক এবং বিলাসবহুল এটা।
ড্রিঙ্ক দেব তোমাকে? টেনশন কাটবে। দরজা ভিড়িয়ে দিল সে।
কিছু না বলে বিছানার কিনারায় বসল মেলিসা। ভয় পাচ্ছে, টেনিসন আসলে কি চাইছে? কাঁপা হাতে হুইস্কির গ্লাস নিল ও, খানিক দ্বিধার পর চুমুক দিল। অভ্যাস নেই বলে জ্বালা ধরে গেল বুকে। অজান্তে দাঁত-মুখ কুঁচকে উঠল। একটু হালকা লাগল নিজেকে।
হুইস্কি যেমন সইছে না, একা থাকাও সইছে না তোমার, লিসা, হেসে মন্তব্য করল টেনিসন।
চমকে উঠল মেলিসা। কি বলতে চাইছ?
তুমি অনিন্দ্যসুন্দর একটা মেয়ে, লিসা। তোমার দরকার একজন বলিষ্ঠ পুরুষের সঙ্গ। তা দিতে পারি আমি, পারি না? তুমি জানো আজ তোমাকে কত সুন্দর লাগছে?
উঠে দাঁড়াল মেলিসা। বেরিয়ে যাও, প্লীজ! নইলে চেঁচাব আমি!
কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু’হাতে ওকে বেষ্টন করল টেনিসন। এই মেয়ে, আমাকে তোমার দরকার, তুমি স্বীকার না করলেও নিশ্চিত জানি আমি। ম্যাককার্থিদের বাড়িতে সন্ধ্যায়ই তা বুঝেছি। তুমি এখন না চাইলেও মানব না আমি। তুমি আমাকে পাগল করে তুলেছ, লিসা! দ্রুত মেলিসার পেলব ঠোঁটজোড়া দখল করল সে।
থরথর করে কেঁপে উঠল মেলিসার শরীর। দু’হাত টেনিসনের বুকে ঠেকিয়ে বাধা দিতে চাইছিল, খানিক পর শিথিল হয়ে এল সেগুলো। তারপর মৃণাল বাহু দিয়ে টেনিসনের গলা জড়িয়ে ধরল ও, নিজেকে আরও এগিয়ে দিল লোকটার আলিঙ্গনের মধ্যে।
৬. থমকে দাঁড়িয়েছে জেমস মরগান
থমকে দাঁড়িয়েছে জেমস মরগান। সিঁড়ির ধাপে একটা পা তুলে দিয়েছিল, ধীরে ধীরে নামিয়ে আনল। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পরিস্থিতি বোঝার প্রয়াস পেল। ওপরে। কোন সাড়া নেই, সম্ভবত ওর উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে লোকগুলো। অপেক্ষায় আছে কখন ওপরে উঠে যাবে মরগান। হয়তো আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করবে, তারপর অধৈর্য হয়ে নেমে আসবে। বাইরের লোকগুলো বোধহয় ব্যাক আপ টীমের সদস্য, মরগান আস্তাবল ছেড়ে বেরিয়ে গেলে হামলা করবে।
দ্রুত পেছনের কামরায় চলে এল ও। আলাদা আলাদা স্টলে তিনটে ঘোড়া বিশ্রাম নিচ্ছে। ওর সাড়া পেয়ে নড়েচড়ে, সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ল সোরেলটা। একপাশে দেয়ালের সাথে ঝোলানো স্যাডল নামিয়ে সাজ পরাল মরগান। তারপর স্যাডলে চেপে মৃদু স্পার দাবাল। বোধহয় পরিস্থিতির গুরুত্ব আর ওর প্রয়োজন আঁচ করতে পেরেছে ঘোড়াটা, প্রায় নিঃশব্দে সামনের কামরায় এসে দাঁড়াল।
নিজের শ্রবণশক্তির ওপর মরগানের আস্থা যোলো-আনা। মিনিট তিনেকের মধ্যে বাইরের লোকগুলোর অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়ে গেল। অধৈর্য হয়ে পড়েছে ওরা, নড়াচড়া করছে খুব। মরগান দোতলায় উঠে গেলে অনেক আগেই গোলাগুলি শুরু হয়ে যাওয়ার কথা, আর এ ফাঁকে নিজেরা ভেতরে ঢুকে পড়বে-পরিকল্পনামাফিক সবকিছু এগোচ্ছে না বলে হয়তো কিছুটা চিন্তিত। ওদের ধাত ভাল করেই জানে মরগান। ঝুঁকি নিয়ে সামনাসামনি বা একা কিছু করার ইচ্ছে নেই, তাই দল ভারী করে ওকে ধরাশায়ী করতে এসেছে। একজনের বিপক্ষে ছয়জন-সহজ সমীকরণ। তবে ওরা জানে না খেপে গেলে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে জেমস মরগান। জানে না সে অসাধারণ এক মানুষ, অন্তত যতক্ষণ ওর পিস্তলে বুলেট থাকবে।
মরগান ভেবেছিল স্যাড়লে চেপে আস্তাবল থেকে বেরুনোর চেষ্টা করবে, কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব ভেবে চিন্তাটা বাতিল করে দিল। একটা পরিকল্পনা এসেছে মাথায়। স্যাডল ছেড়ে ঘোড়ার সামনে চলে এল ও। সোরেলের ঘাড়ে হাত বুলানোর সময় ফিসফিস করে কথা বলল। আলতো করে মুখ দিয়ে ওর পেটে তো মারল সোরেলটা, মরগান টের পেল শক্ত হয়ে গেছে ওটার শরীর। তারপর সহসাই শিথিল হলো, ঠিক ছোটার আগে, আর মরগান সামনে থেকে সরে যাওয়ার পরপরই। বাইরের লোকগুলোকে হতচকিত করে দিয়ে নিমেষে বেরিয়ে গেল অন্ধকার রাস্তায়।
সোরেলের পেছনে খোলা পিস্তল হাতে বেরিয়ে এল ও। দরজা পেরিয়ে যখন দুই কদম এগিয়েছে, এসময় ভুল বুঝতে পারল লোকগুলো। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। সবচেয়ে কাছের লোকটা পাঁচ হাত দূরে ছিল, হাতে সিক্সশ্যটার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকে বুলেট নিয়ে আছড়ে পড়ল সঙ্গীর ওপর। তাকেও গুলি করেছিল মরগান; কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। উঠতে সময় লাগবে লোকটার-সামলে। নিয়ে, শুয়ে থেকেও যদি গুলি করে, কিছুটা সময় লাগবে-ভেবে অন্য দিকে নজর দিল মরগান। সহসা কানের পাশ দিয়ে সুর তুলে চলে গেল একটা বুলেট। তারপর আরও একটা। শিউরে উঠল ও। আধপাক ঘুরে নিশানা ছাড়াই বাম হাতের পিস্তল থেকে গুলি করল, ইচ্ছে লোকটাকে ব্যস্ত রাখা। পাশে সরে গেল এক পা। বিশ হাত দূরে দেখতে পেল বিশালদেহীকে, সমানে কমলা আগুন ওগরাচ্ছে তার পিস্তল। নিশানা করার কোন বালাই নেই, ওকে মুখোমুখি হতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে দুটো পিস্তল থেকে গুলি করল মরগান। পাশাপাশি দুটো গর্ত সৃষ্টি হলো কপালে, ধূলিময় রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ল। লোকটা।
এবার ডান দিকে নজর দিল ও। নিথর পড়ে আছে দু’জনেই। দ্বিতীয় লোকটা আহত হয়েছে, বুক চেপে ধরে ককাচ্ছে। খোলা পিস্তল হাতে রাস্তা ধরে ছুটল মরগান, দু’পাশে তীক্ষ্ণ নজর চালাল। একেবারে ফাঁকা রাস্তা। গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়র কাছে চলে এল ও। রেলের লাগাম ধরে হেঁটে সরে এল জায়গাটা থেকে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে মিশে গেল। বিশ্রামের ফাঁকে পিস্তল রিলোড করল, তারপর হোলস্টারে ফেরত পাঠাল বাম হাতের কোল্ট।
কয়েকটা বাড়ির জানালা খোলার শব্দ পেল মরগান, আলোর ক্ষীণ ধারা এসে পড়ল ধূলিধূসর রাস্তায়। ডান দিকে দোতলার জানালায় কৌতূহলী একটা মুখ দেখা গেল। রাস্তায় চোখ বুলাল মাঝবয়েসী লোকটা, কিছু বুঝতে না পেরে শেষে জানালা আটকে দিল। একটু পর লণ্ঠন হাতে আস্তাবলের দরজায় এসে দাঁড়াল বুড়ো হসল্যার, লাশগুলো দেখল। বিড়বিড় করে অদৃশ্য কাউকে গাল দেয়ার পর ভেতরে চলে গেল। মরগানের মনে পড়ল বুড়োর পাওনা মেটানো হয়নি। ঘোড়াটা দেখে হসল্যার হয়তো ভাববে পালিয়েছে ও। কয়েকটা গালও জুটতে পারে কপালে, সেইসাথে বিতৃষ্ণা। তবে, সুযোগ পেলে সকালে ফিরে এসে দেনা শোধ করবে, ভাবল ও।
ওপরের লোকগুলো নামছে না, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। সঙ্গীদের সাড়া না। পাওয়ায় ধরে নিয়েছে কাজ হয়নি। শিকার ধরতে এসে নিজেরাই আটকা পড়েছে এখন। ইচ্ছে করলে ওদেরকে আরও কিছুক্ষণ আটকে রাখতে পারে মরগান, অন্তত মিনিট বিশের আগে উকিও মারবে না কেউ। আস্তাবলের পেছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করবে ওরা, সেটাই স্বাভাবিক। ওখানে গিয়ে লোকগুলোর ওপর চড়াও হতে পারে, কিন্তু বাদ দিয়ে দিল সে-চিন্তা। অযথা ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই।
স্যাডলে চেপে গলি ধরে উল্টোদিকের বাড়িগুলোর পেছনের রাস্তায় চলে এল ও। ধীর গতিতে এগোল, অফুরন্ত সময় হাতে। ত্রিশ গজের মত এসে পাশের গলি ধরে মূল রাস্তার কাছে ফিরে এল। কোণের একটা বাড়ির অন্ধকার দেয়াল ঘেঁষে দাড়াল, সময় নিয়ে সিগারেট রোল করল। ধূমপানের ফাঁকে ইতিকর্তব্য স্থির করে। নিল। আস্তাবলের সামনের দিকটা চোখে পড়ছে, আগের মতই ফাঁকা।
গলি থেকে মূল রাস্তায় চলে এল ও। পেছনে ফাঁকা রাস্তা জরিপ করে নিশ্চিত হলো পিছু নিচ্ছে না কেউ। রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল উল্টোদিকের গলিতে। ঘোড়াটাকে হটিয়ে নিয়ে দক্ষিণে এগোল। আস্তাবলের পেছন দিকটা ওর গন্তব্য। পথে পড়ে থাকা আবর্জনা মাড়িয়ে চলতে হচ্ছে, পরোয়া করছে না মরগান। তাড়ার মধ্যে আছে।
আস্তাবলের পেছনে, বিশ গজ দূরে পতিত জমি, জুনিপার আর উইলোর ছড়াছড়ি। তারই একটার আড়ালে অবস্থান নিল ও। ঘোড়াকে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষায় থাকল। ভাবছে দেরি করে ফেলেছে কি-না। স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করল আগের মতই দেয়ালের কিনারায় ঝুলছে স্যাডল ব্যাগটা।
মরগান নিশ্চিত জানে পেছন দরজা দিয়ে বেরুবে লোকগুলো। এদিক দিয়ে আক্রমণের আশঙ্কা করবে না।
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় দেখা গেল ওদের। দু’জন অন্য লোকটির চেয়ে কিছুটা এগিয়ে আছে। চুপিসারে, নিঃশব্দে সরে পড়ার ইচ্ছে। ধরে নিয়েছে এদিক দিয়ে কোন বাধা পাবে না। কৌতুক বোধ করল মরগান। সেইসাথে রাগও হলো, এরা খুব বেশি বিরক্ত করছে ওকে। ক্যাসল টাউনে থাকার ইচ্ছে ছিল না, অথচ ওকে বাধ্য করেছে। দুটো রাত আর একটা দিন আটকে রেখেছে। এ খেলাটা একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না ওর। কোণঠাসা হয়ে লড়তে অভ্যস্ত নয় জেমস মরগান
তবে এখন আর অবস্থা নাজুক নয়। প্রতিপক্ষের বেশ কয়েকজন মারা পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পিঠটান দেবে লোকগুলো, টাকার চেয়ে জীবনের মায়াকে বড় করে দেখা শুরু করবে। তাই চাইছে মরগান। শুধু পেছনের লোকটাকে হাতের নাগালে পেতে চায় ও। ওর কাছে প্রচুর টাকা আছে, কেউই জানত না। বোঝা যাচ্ছে পেছনের নোকটা তা জানে এবং মূলোর লোভ দেখিয়েছে ওর পেছনে লেলিয়ে দেয়া লোকগুলোকে। কিংবা তথ্যটা এদের কাছে পাচার করেছে, আর ডলারের লোভে ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে লোকগুলো। মরগান জানে কে করেছে এ কাজ।
আলফ্রেড টেনিসনের প্রতি রাজ্যের ঘৃণা অনুভব করছে ও।
একে একে তিনজনই বেরিয়ে এল। বলা যায় মরগানই বেরুতে দিল। দশ কদম এগোনোর পর বুলেট বৃষ্টি শুরু হলো লোকগুলোর ওপর। আচমকা আক্রমণ পিলে চমকে দিল ওদের, হতচকিত অবস্থা সামলে নিয়ে পাল্টা হামলা করার সুযোগ পেল না কেউ। কাটা কলাগাছের মত পড়ে গেল একেকজন
মিনিট দুই অপেক্ষা করার পর আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল মরগান। ঝোঁপের সেয়ানে সেয়ানে পেছনে এসে অপেক্ষায় থাকল। জানে এবারও বেরিয়ে আসবে হসল্যার, বিরক্ত হয়ে লাশগুলো দেখবে, তারপর দুনিয়ার বিরক্তি নিয়ে যথারীতি শুয়ে পড়বে।
অশ্রাব্য খিস্তি করতে করতে বেরিয়ে এল হসল্যার। আলো উঁচিয়ে ধরে বাইরে উঁকি দিল, চারপাশে খুঁজল কি যেন। শ্রাগ করল এরপর। দয়া করে ঘুমাতে দাও, বাপু! কণ্ঠে তিরস্কার। তুমিও চলে এসো। বোধহয় আজ রাতে তোমাকে আর ঘটাবে না ওরা। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে কার সাথে লাগতে এসেছিল। আর হ্যাঁ, আমার পাওনা দিয়ে যেয়ো। কখন কি হয়!
নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল মরগানের মুখ। বুড়ো জানে এখানে আছে ও, যদিও দেখতে পায়নি। ঝোঁপ ছেড়ে বেরিয়ে এসে সোরেলটাকে হটিয়ে নিয়ে এগোল ও।
কেমন লোক তুমি, ঠিক বুঝতে পারছি না, চিন্তিত সুরে বলল সে, যদিও মুখটা নির্বিকার দেখাচ্ছে। হিসেব গরমিল করে দিতে ওস্তাদ। সাধারণ গানফাইটার ভাবতে পারছি না তোমাকে।
মাঝরাতের হিসাবে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক, হালকা সুরে বলল ও।
ওদের মত?
ভুলে যাও।
নৃশংস! কোন সুযোগই পায়নি ওরা।
তীক্ষ দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখল্প মরগান। একজনের বিরুদ্ধে ছয়জন, তা-ও সামনে-পেছনে দুটো দলে এসেছিল ওরা। এটা কি ফেয়ার?
ভুল বুঝেছ। ওরা কিছু করার সুযোগ পায়নি, তাই বোঝাতে চেয়েছি।
খেলাটা ওরাই শুরু করেছিল এবং অনেকগুলো ভুল করেছে।
এবং উচিত সাজা পেয়েছে।
ওরা কারা, চেনো নাকি?
থমকে গেল বুড়ো, চোখ ছোট করে দেখল ওকে। নিশ্চই ভাবছ ওরা টেনিসনের লোক? না হে, স্রেফ ধান্ধাবাজ এরা। ক্যাকটাস হিলের ওপাশের হাইড-আউটের বাসিন্দা, এবং সম্ভবত গরুচোর।
শুনেছি এখানকার গরুচুরির ব্যাপারে টেনিসনের সম্পর্ক খোঁজে কেউ কেউ।
হতে পারে, নিস্পৃহ সুরে মন্তব্য করল বুড়ো। আবার ম্যাকলয়ারীরাও জড়িত থাকতে পারে। টেনিসনের চেয়ে ওদের স্টক অনেক ছোট। তাতে কিছুই প্রমাণিত হয় না।
দেখো, মরগান, আমি কিন্তু কোন জুরী নই। কে কি করল তাতে কিছুই আসে-যায় না আমার। কারও কৃতকর্মের বৈধতা বিচার করার দায়িত্বও আমার নয়।
আমার একটা কাজ করে দাও, সহাস্যে প্রস্তাব দিল মরগান। পকেট হাতড়ে দশ ডলারের একটা নোট বের করে এগিয়ে দিল। কয়েকদিনের খাবার কিনে রাখতে পারবে? সকালে এসে নিয়ে যাব। এখানে, দরজার পাশে রেখো।
আমাকে বিশ্বাস করছ কেন? বেঈমানি করতে পারি আমি। তোমার জন্যে অভ্যর্থনা-পাটির ব্যবস্থা করতে পারি।
হাসল মরগান, বুড়োর রসিকতায় কৌতুক বোধ করছে। ইচ্ছে হলে করতে পারো, তৈরি থাকব আমি।
টাকাটা নিয়ে পকেটে ঢোকাল সে। আমার পাওনা দুই ডলার, আর খাবার কিনতে পাঁচ। হুঁ, মুফতে কামাই করতে ভালই লাগে, কি বলে?
যদি হজম করতে পারো।
ম্লান হলো না হসল্যারের হাসি। তোমার সমস্যা কি জানো, সবকিছুর মধ্যে শুধু সন্দেহ করো। কাউকে বিশ্বাস করো?
করি। একমাত্র নিজেকে।
ঠিক আছে, পেয়ে যাবে তোমার জিনিস। তবে এরচেয়ে বেশি কিছু চেয়ো। এমনিতে ঝামেলার অন্ত নেই আমার। নড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।
সিগারেট রোল করতে শুরু করল মরগান। ভাবছে রাতটা বাইরে কাটিয়ে দেবে। আস্তাবলের চেয়ে ভোলা প্রেয়ারি অনেক নিরাপদ। পরেরবার ওর ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন না-ও হতে পারে। অবশ্য আরেকটি উদ্দেশ্য আছে, শত্রুপক্ষের ওপর নজর রাখতে চায়, এবং সুযোগ পেলে জাল ছিড়ে বেরিয়ে যাবে।
সময় নিয়ে সিগারেট শেষ করল ও, তারপর পেছন দরজা দিয়ে আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এল। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ওর ঘোড়া, ওটাকে হটিয়ে নিয়ে কিছু দূরে উঁচু ঢিবির মত একটা জায়গায় চলে এল। বেশ কিছু ঝোঁপ রয়েছে, সেখানে এসে ফিল্ডগ্লাস বের করে খুঁটিয়ে দেখল পুরো এলাকা। এখনও পশ্চিমের ট্রেইলে রয়েছে দু’জন। বাজি ধরে বলতে পারবে উল্টোদিকেও কয়েকজন আছে। কোন্ দিকটা দুর্বল, মনে মনে ভাবল ও, কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না
আপাতত কিছুই করার নেই। ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে ঘাসের গালিচার ওপর বেডরোল বিছাল মরগান, এমন জায়গায় যাতে সহজে কারও চোখে না পড়ে। শুয়ে তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকাল ও। একটু পর মুখের ওপর হ্যাট চাপিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
মরগানের ঘুম ভাঙল ভোরে, সূর্য ওঠার আগে। বেডরোল গুটিয়ে স্যাডলে চাপল ও। চারপাশে নজর বুলাল, আগের জায়গায় আছে প্রতিপক্ষ। সম্ভবত লোক বদল হয়েছে। খানিক পর ঘুরে শহরের ভেতর চলে এল ও বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ। তবে পাইপ্যালেস খোলা পেয়ে খুশি হলো।
আরে, মি. মরগান যে! এত সকালে? রান্নাঘরের দরজায় দেখা গেল মিসেস উইলিয়ামসকে।
রাক্ষুসে খিদে ঘুম ভাঙিয়ে দিল, হেসে বলল ও
পাল্টা হাসল মহিলা। একটু অপেক্ষা করতে হবে। এখনও তৈরি হয়নি।
নড করে একটা টেবিলে বসল ও। মহিলা ভেতরে চলে যেতে বাইরে তাকাল, উল্টোদিকের জেনারেল স্টোরের ঝপ তুলছে দোকানি। ফাঁকা রাস্তা। দূরে স-মিলের সামনে দুটো মুরগীকে দেখে দাবড়ানি দিল ঘুমকাতুরে একটা নেড়ি কুকুর। পাশের বাড়ির ছায়ায় দাঁড়িয়ে শরীর টানটান করল ওটা, তারপর পাঁজরে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। টেরই পেল না ফিরে এসেছে মুরগী দুটো, মিলের সামনে রাখা কাঠের গুঁড়োর মধ্যে খাবার খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আধ-ঘণ্টা পর আস্তাবলে এল মরগান। কথামত দরজার একপাশে খাবারের পোটলা রেখেছে হসল্যার। ওটা নিয়ে এসে ফের স্যাডলে চাপল ও। শহর থেকে বেরিয়ে পুব দিকে ঘোড়া ছোটাল। ট্রেইলের ধারে-কাছেও গেল না, বিরান প্রান্তর দিয়ে এগিয়ে চলল। উঁচু-নিচু পথ, মাঝে মধ্যে শুকনো ডু-র আকারে নিচু হয়ে গেছে। দূরের অনুসন্ধানী চোখ এড়িয়ে যেতে নিচু জমি ধরে এগোল ও। মুখের ওপর সূর্যের আলো এসে পড়েছে, ক্রমশ তেতে উঠছে রোদ
মাইল খানেক পরে ক্ষীণ ধারার একটা ক্ৰীকের কাছে পৌঁছল ও। ওটা পেরিয়ে মাইল দশ রুক্ষ জমি পাড়ি দেয়ার পর ফ্ল্যাগ-বির সীমানা শুরু হলো। উঁচু ঘাস ঠেলে এগোচ্ছে ঘোড়াটা। দুপুর পর্যন্ত এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে কাটাল মরগান। খেয়াল করল বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে বাথানটা। তবে তুলনায় স্টকটা ছোট। আরও কয়েক হাজার গরু নির্বিঘ্নে চরতে পারবে এখানকার তৃণভূমিতে।
একটা ঝর্নার কাছে লাঞ্চ সেরে ফ্ল্যাগ-বি র্যাঞ্চ-হাউসের দিকে ঘোড়া ছোটাল মরগান। নিজের মধ্যে উত্তেজনা অনুভব করে অবাক হলো। এর কারণ কি মেলিসা বডম্যান? নিজেকে তিরস্কার করল ও। এ মেয়ে তার ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দূর থেকে খালি মনে হলেও মরগান যখন কাছে এল, দেখল বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে মেলিসা বডম্যান। নীল চোখে বিস্ময়। আরে, তুমি দেখছি এখনও যাওনি!
কফি খেতে এলাম, হেসে বলল মরগান।
এসো।
স্যাডল ছেড়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ল ও! আনমনে দাড়িতে হাত বুলাল। ক্ষৌরি করেনি বলে আফসোস হচ্ছে। হিচিং রেইলে ঘোড়া বেঁধে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
লাঞ্চ করেছ?
মাথা ঝাঁকিয়ে একটা চেয়ার দখল করল ও।
কিচেনে গিয়ে চুলোয় কফির পানি চড়িয়ে ফিরে এল মেলিসা। ক্যাসল টাউনেই আছ?
ঘুরছি। ইচ্ছে করছে এখানে থেকে যাই। কিন্তু আমার ঘোড়াটা পছন্দ করছে না।
ঘোড়ার পছন্দের দাম দেয় ক’জন! পাল্টা হালকা সুরে বলল মেলিসা। বরং ওরাই মালিকের ইচ্ছে মত চলে।
আমি স্বাধীন লোক। ঘুরে বেড়াতে আনন্দ পাই, আমার সাথে সাথে ঘোড়াটাও বাউণ্ডুলে হয়ে গেছে।
মি. মরগান, আমার কাছে অবাকই লাগছে, তোমার মত লোক কাজ ছাড়া এভাবে ঘোরাঘুরি করার কথা নয়। ফের কিচেনে চলে গেল মেয়েটা, আলাপে ছেদ পড়ল। দুটো মগে কফি নিয়ে ফিরে এল একটু পর।
আমার স্যাডল ব্যাগে কিছু টাকা আছে, কিছু লোক সেগুলো ছিনিয়ে নিতে চাইছে। চারপাশ থেকে আমার বেরুনোর পথ আটকে রেখেছে ওরা, এ জন্যেই যেতে পারছি না।
নিজের টাকার কথা সবাইকে বলে বেড়াও নাকি?
বললেও কেউ কেউ ঠিকই জেনে যায়। বিস্মিত দেখাল মেলিসাকে, আড়ষ্ট হয়ে গেছে কাঁধ দুটো। মরগানের মুখে স্থির হলো দৃষ্টি, কি যেন বোঝার চেষ্টা করল। মরগানের মনের ভাবনা ঠিকই পড়তে পারল মেলিসা, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারল না ও। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সামলে নিল, গম্ভীর হয়ে গেল মুখ। নিশ্চিত জানো তোমার টাকা ছিনিয়ে নিতে চাইছে টেনিসন?
দুঃখিত, ম্যাম। ঠিক তা বোঝাতে চাইনি আমি। না, টাকার ব্যাপারে আগ্রহ নেই ওর, কিন্তু আমার চামড়ার পেছনে লেগেছে ঠিকই। লোকের গোপন খবর পেতে সে ওস্তাদ।
ও তো কাল সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ম্যাককার্থিদের বাথানে ছিল। তারপর নিজের বাথানে গেছে, এসময়…’
নিজে কিছু করছে না টেনিসন। ওর ভাড়া করা লোক হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাকে।
ঝামেলাটা বোধহয় আমার কারণেই হলো, বিষণ্ণ দেখাল মেলিসাকে। আমি দুঃখিত, মি, মরগান। নিজের নয় এমন একটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেছ তুমি
উঁহু, আমি নিজেই জড়িয়েছি। অযথাই নিজেকে দোষী ভাবছ তুমি, ম্যাম।
কফিতে চুমুক দিল মেলিসা। ঠিক কি ঘটেছে বলবে?
জানাল মরগান।
কিন্তু ওটা তো আমার এলাকা! ফ্রি রেঞ্জ বলে সবাই ব্যবহার করতে পারে। অথচ জায়গাটাকে সার্কেল-এমের বলে দাবি করেছে লোকগুলো। এর মানে কি? ওরা ম্যাকলয়ারীদের লোক?
কাউকেই পাঞ্চারের মত মনে হয়নি আমার। খুব সম্ভব আউট-ল।
কিন্তু তোমার ওপর এভাবে হামলা করবে কেন? তোমাকে কিছু একটা বলে বুঝ দিতে হবে এ জন্যে নিজেদেরকে সার্কেল-এমের ক্রু বলে দাবি করবে, এটা মানতে পারছি না আমি। বোধহয় পরিকল্পনামাফিক করেছে কাজটা।
হতে পারে, হেসে সিগারেট ধরাল মরগান, নিরীখ করছে মেলিসাকে। চিন্তিত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। টেনিসন সম্পর্কে আমাকে জানাবে, ম্যাম? বোধহয় তুমিই ওর সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানো।
মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল মেলিসা। তেমন কিছু নয়, ক্ষীণ হেসে শেষে বলল, টেনেসিতে নিজের বাথান বেচে দিয়ে এখানে এসেছে।
এতবড় স্টক নিয়ে এল, এমন এক জমিতে বাথান করল যেখানে ঘাস বলতে কিছু নেই। একটু অস্বাভাবিক না?
বোধহয় না। ফ্রি রেঞ্জের সুবিধা পাবে জেনেই এসেছে সে। কাঁটাতারের বেড়ার প্রচলন হলে বিপদে পড়বে ও। বিকল্প একটা ব্যবস্থা করতে হবে, নয়তো…’
বিকল্প ব্যবস্থা কি সার্কেল-এম দখল?
শ্রাগ করল মেলিসা। হতে পারে। তবে টেনিসনই ভাল জানে সেটা।
তোমার সাথে ওর ঝামেলা বাধল কি নিয়ে?
লজপোল পাইনের ওই অংশটুকু চায় সে, অবশ্য ন্যায্য দামেই কিনতে চেয়েছে। আমি ওকে বলেছি শিগগিরই আমার সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দেব। অন্যরাও যদি একই কাজ করে তো বিপদে পড়তে হবে ওকে। ফ্রি রেঞ্জের সুবিধা থাকায় নিজস্ব তৃণভূমির দরকার হবে ওর, কিন্তু পর্যাপ্ত ঘাস নেই বক্স-টির জমিতে। সেজন্যেই লজপোল পাইনের ওই জমিটা চাইছে টেনিসন, তাছাড়া ঝর্নার গতিপথ আটকে ম্যাকলয়ারীদের জমিতে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিতে হলেও জায়গাটা দরকার ওর
তুমি ওর কাছে জায়গাটা বিক্রি করছ?
না। ফ্ল্যাগ-বির স্টক দিনদিন বাড়ছে। বাড়তি গরুর জন্য জায়গাটা আমার নিজেরই দরকার হবে।
এখানে তো আইন বলতে কিছু নেই। টেনিসন যদি জোর করে?
পারবে না।
এত নিশ্চিত হচ্ছ কি করে?
যদ্দূর জানি এরকম কিছু করবে না সে। ওকে গরুচোর হিসেবে সন্দেহ করে ম্যাকলয়ারীরা, আবার এটাও ঠিক তারা নিজেরাও এ সন্দেহের বাইরে নয়। বরং ওদের আউটফিটেই আজেবাজে লোক বেশি।
এমন হতে পারে ওরা দুজনেই কাজটা করছে?
আমি জানি না। অসহায় দেখাল মেলিসাকে, আনমনে একটা কাঁধ উঁচাল। গম্ভীর মুখ দেখে বোঝা গেল এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। মি. মরগান, তুমি আমাকে অবাক করেছ।
এসব জানতে চেয়ে?
নড করল মেয়েটা। তোমাকে নিজের চরকায় তেল দেয়ার মত লোক মনে হয়েছে আমার। প্রথম দিন এখানকার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাওনি তুমি
স্মিত হাসল মরগান, যদিও দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ দেখাল ওর চোয়াল। ঝামেলা পছন্দ করি না আমি, কিন্তু ঝামেলা এলে পিছিয়েও যাই না। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে ওরা। ওদের কাউকেই ছাড়ব না আমি।
টেনিসনকে অভিযুক্ত করতে হলে প্রমাণ করতে হবে।
সেসবের ধার ধারি না আমি! ও যদি কোন ঝামেলা করে সোজা ওর কপালে বুলেট ঢোকাব।
ওর অনেক লোক।
উঁহু, আমি ওকে আটকাব সুবিধামত, যাতে আমার সাথে একা লড়তে হয়।
মি. মরগান, কিছু মনে কোরো না। যদ্দর মনে হচ্ছে টেনিসন নিজে তোমার ওপর হামলা করেনি, এমনকি ওর কোন পাঞ্চারও নয়। অথচ ওকে শত্রু ভাবছ তুমি।
ছাইয়ের নিচে আগুন থাকে, পানি থাকে না, ম্যাম।
নীরবতা নেমে এল। আনমনে মগ নাড়াচাড়া করছে মেলিসা।
উঠে দাঁড়াল মরগান। দুঃখিত, ম্যাম। আমি বোধহয় তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম।
তোমাকে এখন ভিন্ন রকম মনে হচ্ছে, চিন্তিত সুরে বলল বডম্যান-কন্যা।
কি রকম?
টেনিসনের মতই একজন-সাহসী, জেদী এবং একরোখা।
কফির জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে বারান্দায় চলে এল মরগান। রেইল থেকে লাগাম খুলে রোয়ানে চড়ে বসল।
আবার কি দেখা হবে আমাদের?
হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে, হ্যাটের কিনারায় আঙুল তুলে নড় করল ও। হলে অবশ্য মন্দ হরে না। তোমার মত মহিলার দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
আভা ছড়াল মেলিসার মুখে। তুমি এলে খুশি হব, মি. মরগান।
শুধু কৃতজ্ঞতা?
বিচলিত দেখাল মেলিসাকে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
নিজেকে গাল দিল মরগান, এভাবে মেয়েটিকে বিব্ৰত করার জন্যে আফসোস হচ্ছে। আসলে সে এরকমই। ভদ্রমহিলাদের সাথে কি করে সদাচরণ করতে হয়, জানা নেই ওর। বিনীতভাবে ক্ষমা চাইল ও, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে এগোল। মেলিসা বডম্যানকে বিব্ৰত করা একেবারে অনুচিত হয়েছে, রুক্ষ ট্রেইল ধরে এগোনোর সময় ভাবল ও, আর দশটা সাধারণ মেয়ের মত আচরণ করেছে মেয়েটির সাথে। অথচ সে মোটেই তা নয়।
ক্যাসল টাউনের ট্রেইল ধরে এগোল মরগান। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। ওর বদ্ধমূল ধারণা এখানে আটকে থাকতে হবে আরও কয়েকদিন, নিদেনপক্ষে আগামীকাল পর্যন্ত। এ কদিনের উদ্বেগ আর ব্যস্ততায় গন্তব্যে পৌঁছার তাড়া প্রায় ভুলতে বসেছে। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় কেবল দুটো-মিসৌরির ট্রেইল ধরে যেতে পারে কিন্তু তাহলে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হবে, অথবা পশ্চিমের ট্রেইল ধরে মরুভূমি হয়ে ঘুরপথে রেডরকে যেতে পারে, কিন্তু চরম বোকামি হবে কাজটা। একে তো ট্রেইল চেনা নেই তারওপর পানির উৎসগুলো সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ওর। মরুভূমির সাথে লড়াই করার চেয়ে সশস্ত্র লোকের সাথে লড়ে জয়ের সম্ভাবনা বেশি ওর। তাছাড়া, সবচেয়ে বড় কথা, এসবের শেষ দেখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও।
ঘণ্টাখানেক পর লজপোল পাইনের বনের কাছে পৌঁছে গেল মরগান। জায়গাটা আসলেই চমৎকার, ভাবল ও, ঠিক তিনদিন আগে যেমন ভেবেছিল। সোরেলটাকে ট্রেইল থেকে সরিয়ে তৃণভূমিতে নেমে এল ও। হাঁটুসমান ঘাস ঠেলে লজপোল পাইনের বনের দিকে এগোল ঘোড়াটা। আপাতত এ তল্লাটে ওর জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বোধহয় একমুখী ওই উপত্যকাটা। নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারবে, চাই কি ভাগ্য ভাল হলে ক্যানিয়ন আর পর্বতশ্রেণী ডিঙিয়ে চলে যেতে পারবে ওপাশে।
বিশ মিনিটের মধ্যে উপত্যকায় পৌঁছে গেল মরগান। ঝর্নায় নেমে প্রথমে গোসল সেরে নিল, উরুর ক্ষত ভাল করে ধুয়ে পুনরায় পট্টি লাগাল। শুকিয়ে এসেছে ওটা। কয়েকদিন পর কেবল একটা দাগ থাকবে। ঘোড়ার যত্ন নিয়ে বিছানা করল ও, এমন জায়গায় যাতে কেউ এলে আগেভাগে জানতে পারে।
সিগারেট ধরিয়ে গত কয়েকদিনের ঘটনা ভাবতে শুরু করল মরগান। ছুটতে হচ্ছে না, তাই ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে পারছে এখন। এতগুলো লোক ওকে নিকেশ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অথচ এদের কাউকে চেনে না। সবচেয়ে বড় কথা, ওর কাছে টাকা আছে তা কারও জানার কথা নয়। কেউ জানিয়েছে এদেরকে, লোকটা কে?
ওকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে আলফ্রেড টেনিসন। সরাসরি হামলা করেনি লোকটা, অথচ মরগানের অভিজ্ঞতা আর অবচেতন মন সবকিছুর পেছনে ঠিকই তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। জানে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, ওর পেছনে লাগার মত যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই টেনিসনের। বরং ম্যাকলয়ারী আর মেলিসা বডম্যানকে নিয়েই ব্যস্ত সে।
স্যাডল ব্যাগের টাকাগুলো একটা কারণ হতে পারে।
টেনিসনের ব্যাপারে মেলিসার ধারণা কি জানে না মরগান, তবে মেয়েটা যে লোকটাকে ভয় পায় তা চোখে পড়েছে ওর। কারণ কি? মেলিসা বডম্যান কি আজ টেনিসনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেনি? আগে থেকে পরিচিত দু’জন, লোকটা সম্পর্কে জানার কারণে হয়তো টেনিসন সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে মেয়েটি, যেটা মরগান নিজে সহজেই পারছে। তবে এটা ঠিক টেনিসনের বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করা যাবে না। কেউ দেখাতে পারবে না সবকিছুর পেছনে সে-ই আছে।
ও কি অতি মাত্রায় সন্দেহপ্রবণ? রডনি অ্যাশ অনুসরণ করছিল ওকে, টাকার ব্যাপারটা জানত। হতে পারে রডনিই জানিয়েছে লোকগুলোকে? সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সবচেয়ে অস্বাভাবিক ব্যাপার, প্রতিপক্ষ ওকে ঘায়েল করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে, আর সেজন্যেই সন্দেহ হচ্ছে পেছনে কারও উপস্থিতি রয়েছে বোধহয়। কেউ পরিচালিত করছে ওদেরকে, নইলে অনেক আগেই রণেভঙ্গ দিত লোকগুলো।
ড্যানি ওকে মিথ্যে বলেনি, অন্তত হকিন্সের ব্যাপারে। হয়তো হকিন্স নামে সত্যিই আছে কেউ। তাকে চেনে টেনিসন। এটাই চিন্তার ব্যাপার। অবস্থা এমন যে মরগান নিজে এ লোককে চিনতে পারছে না। পশ্চিমে হকিন্স নামে লোকের। অভাব নেই, কিন্তু টেনিসন চেপে যাবে এমন লোকের কথা ও শোনেনি, অথচ ড্যানি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে নামটা উচ্চারণ করেছে। একটা নামের শুধুই শেষের অংশ, শুরুটা যদি জানত! নিজের ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট মরগান, বিরক্তও। হকিন্স নামটার একটা তাৎপর্য আছে, ওর অবচেতন মন বলছে, অথচ তা ধরতে পারছে না। হয়তো এটাই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে।
বেডরোল ছেড়ে কফির আয়োজন করল মরগান। মগভর্তি কফি নিয়ে আয়েশ করে বসল বিছানায়। সিদ্ধান্ত নিল আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেবে। হন্যে হয়ে ওকে খুঁজতে শুরু করবে প্রতিপক্ষ, ছড়িয়ে পড়বে ওরা, আর তাতে ভাগ হয়ে পড়বে দলটা। অধৈর্য হলে তো কথাই নেই। ঠিক এটাই চাইছে মরগান। এ সুযোগে আসল কাজ সারবে, এবং ঝামেলাটা শেষ করে তবেই এখান থেকে যাবে, মিসৌরি যাওয়ার চেয়ে এটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
এবং আলফ্রেড টেনিসনের সাথে আরেকবার মোলাকাত করবে।
৭. ভোরে জাগলেও সকাল পর্যন্ত বিছানায়
ভোরে জাগলেও সকাল পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিল মরগান। হস্যারের কিনে দেয়া খাবার আর কফি দিয়ে নাস্তা সেরেছে। সূর্য যখন মাথার ওপর, সোরেলে চেপে উপত্যকা থেকে বেরিয়ে এল। যা করতে যাচ্ছে তাতে ঝুঁকি আছে, তবে সাফল্যের সম্ভাবনা একেবারে কমও নয়, ওর অন্তত তাই ধারণা। হয়তো ঘুরে বেড়ানোই সার হবে। তবে বসে থাকার চেয়ে ভাল। তিন দিন আগে যে পথে ঝর্না দিয়ে নেমে উইলিদের ক্যাম্পে এসেছিল, সেটা ধরে এগোল। ঘোড়াটা ওর এরকম অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করতে পারছে না। ধীর গতিতে এগোচ্ছে, কিছুটা সন্ত্রস্ত। পাহাড়ী র্যাটলগুলোকে নিয়ে ওটার যত ভয়। তবে কোন অসুবিধে ছাড়াই ঝর্নার কাছে পৌঁছে গেল ও।
ষাট ফুট নিচে ক্যানিয়নের তলা আবছাভাবে চোখে পড়ছে। তলায় কি আছে বোঝার উপায় নেই। হয়তো বহুদিনের জমাট পানি কিংবা নরম মাটি, চোরাবালি থাকাও বিচিত্র নয়। কয়েক জাতের র্যাটলের আড়াও থাকতে পারে। তবে পরোয়া করছে না মরগান। স্টির্যাপের ওপর ভর দিয়ে শরীর উচিয়ে তাকাল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল চারপাশ-এমন কোন পথ থাকতে পারে যেটা ধরে নেমে যাওয়া সহজ হবে। পথটা ঢালু হলেও সোরেলের ওপর ভরসা করা যায়, এরকম পথ ধরে বহুবার নেমেছে বা উঠেছে ঘোড়াটা। আসল সমস্যা হবে ক্যানিয়নের তলদেশে নেমে যাওয়ার পর। ওখানকার মাটি নরম হলে বিপদে পড়তে হবে ওকে।
ঝোপে পূর্ণ ঢালু পথ ধরে এগোচ্ছে ঘোড়াটা। গ্যানিটের মত শক্ত পাথুরে মাটি থাকায় সহজে নেমে যেতে পারছে। অন্তত পা হড়কানোর কোন সুযোগ নেই। মাঝে মাঝে নরম জায়গাও আছে, এড়িয়ে চলছে মরগান। তবু ষাট ফুট জায়গা নামতে প্রচুর সময় লাগল। নিচে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, মাটির সোঁদা গন্ধ আর কিছুটা বদ্ধ বাতাস। মাঝে মধ্যে থমকে দাড়িয়ে নিজের অপছন্দের কথা জানাচ্ছে ঘোড়াটা, অবশ্য ওর নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে। আবছা আলোয় মাটির ওপর চোখ বুলাল, গোড়ালি সমান পানি জমেছে পাথুরে মাটির ওপর। স্পরের মৃদু খোঁচায় এগোল ঘোড়াটা, খুরের আঘাতে পানি ছিটানোর শব্দ প্রতিধ্বনি। তুলছে খাড়া ক্লিফের দেয়ালে। বোন্ডার আর পাথুরে চাঙড়ের ফাঁক গলে এগোতে হলো। ভয় হচ্ছে হয়তো বেরুতে পারবে না ক্যানিয়ন থেকে। তেমন হলে একই পথে ফিরে যাওয়া বেশ কঠিনই হবে, কারণ এমনিতেই যথেষ্ট ধকল গেছে সোরেলটার ওপর দিয়ে।
মাথার ওপর খোলা আকাশের দিকে তাকাল মরগান। অনেক উঁচুতে নীল আকাশকে অচেনা মনে হচ্ছে। আলো-আঁধারি পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করছে ও, কিছুক্ষণ পর দিক ও সময়জ্ঞান দুটোই হারিয়ে ফেলল। এমনকি কতটুকু এসেছে তা-ও নিশ্চিত বলতে পারবে না। তবু অনিশ্চিত পদক্ষেপে এগোচ্ছে ঘোড়াটা। ভরসার কথা ক্যানিয়নটা কানা নয়, যদ্র জানে মরগান, এবং এখান থেকে বেরুনোর অনেকগুলো পথ আছে।
কতক্ষণ পর বলতে পারবে না, ডান দিকে কিছুটা আলোকিত পথ দেখতে পেয়ে এগোল ও। টের পেল ঘোড়ার গতি বেড়ে গেছে। পথটার মুখে আসতে বাতাস লাগল গায়ে। দেখল সামনে ঢালু পথ বেশ উঁচুতে উঠে গেছে, ঝলমলে আকাশও দেখতে পাচ্ছে। লাগাম ঢিলে করে ইচ্ছেমত এগোতে দিল সোরেলকে। দ্রুত ছুটছে ওটা।
বিশ মিনিট পর ক্যানিয়নের বাইরে সিডার আর অ্যাসপেনের ঘন বনে এসে পড়ল ও। গাছের ফাঁক গলে নাক বরাবর এগোল। আসলে বলা উচিত নিজের ইচ্ছেমত এগোচ্ছে ঘোড়াটা। এসব ক্ষেত্রে ওর চেয়ে বোবা এ প্রাণীটির সহজাত প্রবৃত্তিই অনেক বেশি কাজে দেয়।
বন পেরিয়ে ট্রেইল চোখে পড়ল, মরগান ধারণা করল মিসৌরি যাওয়ার ট্রেইলের কাছাকাছি চলে এসেছে। কয়েক মাইল পর, ক্যাকটাস হিলের শেষ প্রান্তে ট্রেইলটার বাক, হয়তো ওখানেই আছে লোকগুলো। পেছন দিক দিয়ে উপস্থিত হয়ে ওদেরকে চমকে দিতে পারবে।
ট্রেইল ছেড়ে পাশের উঁচু জমিতে উঠে এল ও। ডানে একটা ছোট ঝর্না দেখতে পেয়েছে। একটা সিডারের ছায়ায় স্যাডল ছেড়ে কফির আয়োজন করল। তারপর, সবশেষে ঝর্নার পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে লাঞ্চ করতে বসল।
মিনিট বিশ বিশ্রাম নিয়ে ফের ট্রেইলে উঠে এল ও। দুই মাইল আসার পর ক্যাকটাস হিলের প্রান্ত চোখে পড়ল, ঢালু জমির আকারে দিগন্তে তৃণভূমির সাথে মিশে গেছে। এখানেও প্রচুর সিডার আর স রয়েছে। সুবিধাই হলো ওর, নিজেকে লুকিয়ে রেখে শক্রর ওপর নজর রাখতে পারবে।
কয়েকশো গজ এগিয়ে ট্রেইল ছেড়ে ঢালু জমিতে নেমে পড়ল মরগান। ঠিক যেখানে ক্যাকটাস হিল শেষ হয়েছে, তার একটু আগে। লুকিয়ে থাকার মত যথেষ্ট আড়াল আছে এদিকে। স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে স্যাডল ছাড়ল। সোরেলের ঘাড়ে চাপড় মারতে হেঁটে ঝোঁপের ভেতর ঢুকে পড়ল ওটা। নিঃশব্দে চিতার ক্ষিপ্রতায় এগোচ্ছে মরগান। জানে এখনও ফাস হয়নি ওর উপস্থিতি। শিগগিরই প্রতিপক্ষের দেখা পাবে। জুনিপার ঝোঁপ পাশে ফেলে উঁচু পাথুরে বোন্ডারের পাশে এসে দাঁড়াল ও। থেমে নজর চালাল সামনের দিকে। এখান থেকে বিস্তীর্ণ প্রান্তরের শুরু, আরও দূরে ক্যাসল টাউন চোখে পড়ছে। লোকগুলো রয়েছে ওর হাতের আরও বামে। নজর রাখতে হলে কিছুটা বামে সরতে হবে।
চুপিসারে এগোল ও, সময় নিয়ে কয়েকটা ঝোঁপ পেরুল। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাইন আর বার্চের আশপাশে গুল্ম জাতীয় কিছু গাছ জন্মেছে। ওগুলোর ওপর ভর করেছে কিছু লতানো গাছ। পঁচিশ হাত দূরের একটা অ্যাসপেন ঝোঁপ মনঃপূত হলো ওর। পাহাড়ের ঢালু শরীর বেয়ে নামতে শুরু করল মরগান, হাতে। কক করা রাইফেল। ঝোঁপের পেছনে পৌঁছতে মিনিট খানেকের বেশি লাগল না। প্রথমে জিরিয়ে নিল, তারপর কিছুটা পাশে সরে এসে দৃষ্টি রাখল সামনের খোলা জায়গায়। পঞ্চাশ গজ দূরে মাটির সাথে মিশে গেছে ক্যাকটাস হিল, পাশেই মিসৌরির ট্রেইল। আড়াআড়িভাবে ওটাকে চিরে গেছে সরু নদীটা, ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর ওপর কাঠের সেতু। সেতু পেরিয়ে এগিয়ে আসছে এক ঘোড়সওয়ার। অন্যদের খুঁজে বের করার আশায় চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখল মরগান। কষ্ট করতে হলো না, নিজেদের লুকিয়ে রাখার কোন চেষ্টা করেনি ওরা। দুজন, পাশাপাশি বসে আছে একটা সিডারের নিচে-গতরাতে শহর থেকে ফিল্ড গ্লাসের সাহায্যে যেমন দেখেছিল। পাশে বিশাল এক পাইনের গুড়িতে ঘোড়াগুলোর লাগাম বাঁধা।
এই, লেন্স, ওদিকের খবর কি? চেঁচিয়ে জানতে চাইল একজন।
পাত্তা নেই হারামজাদার, বিরক্তির সাথে বলল সেতু পেরিয়ে আসা লোকটা, লেন্স। অবশ্য ট্রেস করার চেষ্টা করছে ব্লু আই। গতকাল দুপুরের পর ফ্ল্যাগ-বিতে গিয়েছিল মরগান।
খোদার কসম, টেনিসন জানলে কিন্তু চিবিয়ে খাবে ওকে! শিস দিয়ে উঠল প্রথমজন। মেলিসা বডম্যানের নাম বলতে অজ্ঞান টেনিসন। মেয়েটা যত এড়ানোর চেষ্টা করে ওর আগ্রহ যেন ততই বাড়ে। আমার ধারণা কি জানো, খুব শিগগিরই ওই জমিটা কজা করবে সে।
গাধার মত কথা বোলো না, লসন! ক্যাসল টাউনের কেউ সেটা সহ্য করবে ভেবেছ?
তুমি তাহলে কিছুই জানো না, লেন্স। পরশু রাতে মেলিসা বডম্যান কোথায় ছিল, জানো?
কোথায়?
টেনিসনের বাথানে, ওর বিলাসবহুল র্যাঞ্চ-হাউসে।
প্রচণ্ড ধাক্কা খেল মরগান। মেলিসা বডম্যান, স্বেচ্ছায়?
ম্যাকলয়ারীদের খবর কি? জানতে চাইল লসন।
এবার বোধহয় ব্যবসা গোটাতেই হবে। ওরা নিজেরা তো ডুববেই, আমাদেরও ডোবাবে। টেনিসন এমন হারামজাদা যে সার্কেল-এমকে হটিয়ে দেয়ার পর আমাদের কথা ভাববে। দুই বাথান থেকে প্রতি মাসে একশোটা গরু, মন্দ চলছিল না, কি বলো? আমার তো দুঃখই হচ্ছে, মুফতে কামাই করার এমন সহজ উপায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তবে শেষ দাওটা দু’একদিনের মধ্যেই মারব। আগে মরগানকে কব্জা করে নিই।
ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না আমার, আলোচনায় যোগ দিল অন্যজন। মরগান যেন সাক্ষাৎ যম! এ পর্যন্ত প্রায় আট-ন’জনকে সাবাড় করে ফেলেছে, অথচ নিজে অক্ষতই রয়ে গেছে। খোঁজ-খবর নিয়ে দেখে হয়তো সেরাদের কেউ ও। লোকটার সঙ্গের টাকার কথা চিন্তা করলে কি তাই মনে হয়।
এবার আর পার পাবে না, সামনে-পেছনে দুদিকেই আছি আমরা। মরুভূমিতে মরতে না চাইলে আমাদের সামনে আসতেই হবে ওকে। একেবারে পানির মত সহজ কাজ। ট্রেইলে দেখতে পেলেই গুলি করব, ও জানে এখানে আছি আমরা, তবু কিছু করার থাকবে না ওর। ক্যাসল টাউন ছাড়তে হলে ওকে এই ট্রেইলে আসতেই হবে।
এত সহজ ভেব না, হালকা সুরে বলল লসন। যে সাত-আটজন মারা গেছে তোমার মতই ভেবেছিল ওরা। বুটহিলে শুয়ে ভুলটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন
ওর চামড়া তো লোহার তৈরি নয় যে বুলেট ঢুকবে না! উন্মা প্রকাশ পেল। লেন্সের কণ্ঠে। উঁহু, মরগানের চেয়ে আমাদের চান্স বেশি।
লেন্স, আমি এমন কিছু লোককে চিনি যারা শরীরে অন্তত তিন-চারটে বুলেট নিয়ে একাধিক শত্রুকে ধরাশায়ী করেছে, এবং বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে এখনও।
ওসব কেবল গল্পই, কখনও এমন ঘটনা শুনিনি আমি।
ডরেসের নাম শুনেছ? সনোরায় ওকে ঘেরাও করেছিল চারজন বাউন্টি হান্টার। সেলুনের বাইরে অপেক্ষা করছিল ওরা, ডরেস বেরিয়ে আসতে চড়াও হলো। জোড়া পিস্তল বের করে একটার পর একটা গুলি করল ডরেস, শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামেনি। লড়াই শেষ হতে দেখা গেল শরীরে চারটে বুলেট নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে, আর মরা কুকুরের মত রাস্তায় পড়ে আছে শিকারীরা।
আচ্ছা, এ লোক ডরেস নয় তো? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল তৃতীয়জন।
দূর, তা হতে যাবে কেন? গত দুই বছর ডরেসের কোন নাম-নিশানা নেই। আমার ধারণা, সনোরার ওই লড়াইয়ের পর শহর থেকে কেটে পড়তে পারলেও পরে ট্রেইলে কোথাও মারা গেছে সে। বেঁচে থাকলে ওর কথা শুনতে পেতাম।
শ্রাগ করল লসন। ডরেসের চেয়েও সরেস কেউ হতে পারে এ লোক। ওরকম না হলে অবশ্য খুশি হব আমি।
তোমার কথায় মনে হচ্ছে ও বিলি দ্য কিড় কিংবা হিকক।
খোদার কসম, লেন্স, ওর সামনে পড়লে ডুয়েলের সময় তাই মনে হবে। তোমার! কিন্তু দুঃখের কথা কি জানো, কাউকে কথাটা বলার সুযোগ পাবে না। তুমি।
তুমি একটা ভীতুর ডিম! স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করল লেন্স হারপার।
এসব লোককে ভয় পাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ কিছু নয়, অপ্রতিভ বা ব্ৰিত হলো না লসন, বরং হাসল। এবং ফলদায়কও। হয়তো আমি ভুল ভাবছি, কিন্তু তোমার ভাবে মনে হচ্ছে নিজেকে ওর কাতারে ভাবতে শুরু করেছ তুমি।
সন্দেহ আছে?
মুখ না দেখেও লসনের প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করতে পারল মরগান, কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েছে। ইতিবাচক উত্তর দিলে হয়তো তাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারে লেন্স, আর উল্টোটা বললে মিথ্যে বলা হবে, অন্তত লেন্স তাই মনে করবে। তাকে বাঁচিয়ে দিল অন্য লোকটা। কি শুরু করেছ তোমরা? বিরক্ত স্বরে বলল সে। ধারে-কাছে নেই এমন লোককে নিয়ে তর্ক করছ। তারচেয়ে নিজেদের কাজ করে যাও, মরগান কখন এসে পড়ে তার ঠিক আছে?
শোনো, টোলবার্ট, এই ব্যাটা ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, আমি শুধু…
হজম করে ফেলো, লেন্স! স্রেফ ভুলে যাও।
কিছু না বলে টোলবার্টের দিকে তাকিয়ে থাকল লেন্স হারপার। দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করার চেষ্টা করল তাকে, হাত নিশপিশ করছে। পা জোড়া ফাঁক করে দাড়িয়ে। সঙ্গীর চকচকে পিস্তলের বাটের দিকে চোখ পড়তে কলজে শুকিয়ে এল ওর। জানে সহজেই ওকে পেড়ে ফেলবে টোলবার্ট।
ভাল, খুশি হালাম, লেন্স হাল ছেড়ে দিতে নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল টোলবার্ট। হাসল সে, লসনের দিকে ফিরল। যাও তো, কফির আয়োজন করো।
হিসেব কষল মরগান, পরস্পরের কাছাকাছি আছে ওরা। সন্তর্পণে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এসে রাইফেল ক করল। চমকে উঠল তিনজনই। মরগান যা ভেবেছিল, তাই হলো একটু পর। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ্য করল হোলস্টারে হাত বাড়াচ্ছে লেন্স। বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে গুলি করল তাকে। ভারী বুলেটের ধাক্কায় পেছনে হেলে পড়ল লেন্স হারপারের দেহ, চোখে আফসোস এবং বাঁচার আকুতি। শিথিল হয়ে এল তার শরীর, পিস্তলসহ ডান হাত পড়ে থাকল দেহের পাশে।
অন্যদের দিকে তাকাল মরগান। চুপসে গেছে লসন, চোখে ভয়ার্ত চাহনি। দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। নিস্পৃহ দৃষ্টিতে লেন্সের লাশের দিকে তাকাল টোলবার্ট। জানতাম এভাবেই বোকামির মাসুল দেবে একদিন, বিড়বিড় করে বলল সে। হিসেবে বরাবরই কাঁচা ছিল ও।
লসন, তোমার কোমর খালি করো, গানবেল্টসহ, নির্দেশ দিল মরগান। এরপর টোলবার্টের পেছনে গিয়ে ওকেও নিরস্ত্র কোরো। কোন হেরফের হলে আগে তোমাকেই গুলি করব।
অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ পালন করল লোকটা, ভিজে বেড়ালের মত দাঁড়িয়ে থাকল এরপর। টোলবার্ট এমন ভাব করছে যেন কিছুই হয়নি। পকেট থেকে তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল। ধরিয়ে একমুখ ধোয়া ছাড়ল। এর আগে কোথাও দেখেছি তোমাকে, সন্দিগ্ধ স্বরে মন্তব্য করল সে। আমার ধারণা জেমস মরগান নামটা ভুয়া।
মনে করার চেষ্টা করতে থাকো, শ্রাগ করল মরগান। তবে ভূলেও বেয়াড়া কিছু করার চিন্তা কোরো না। তুমি নিরস্ত্র কি-না গুলি করার সময় একটুও চিন্তা করব না।
এটা তো খুন! নিচু স্বরে বলল লসন।
মোটেই সাধু মনে হচ্ছে না তোমাকে। ট্রেইল ধরে এখানে এলে কোন সুযোগ দেয়া ছাড়াই আমাকে খুন করতে তোমরা। তাহলে এরচেয়ে ফেয়ার কিছু আশা করো কিভাবে?
চুপ করে থাকল লসন।
আমাদের নিয়ে কি করবে? জানতে চাইল টোলবার্ট। খুব বেশি সময় পাবে তুমি। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে অন্যরা।
তাতে লাভ হবে না তোমার।
জাহান্নামে যাও!
উঁহু, শহরে যাচ্ছি আমরা। গরুচোরদের ধরার খুব ইচ্ছে ওদের, তোমাদেরকে পেলে খুশিই হবে। মার্শালকে তোমরাই খুন করেছ, তাই না?
টোলবার্ট! ঝটপট জানাল লসন।
তোমার জিভ,টেনে ছিড়ে ফেলব! হুমকি দিল টোলবার্ট।
নিজের কথা আগে ভাবছ না কেন? ওকে ছোঁয়ার সুযোগ তুমি পাবে, যদি আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকতে পারো, তবেই।
তোমার কি মনে হয়?
কিছুই মনে হয় না আমার, শিস বাজাল মরগান, দূরে সোরেলের খুরের হালকা শব্দ শুনতে পেল। ঘুরে দাঁড়াও, ট্রেইল ধরে হাঁটতে শুরু করো।
হেঁটে যাব!?
নয়তো কি? ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ চাও?
দু’জনের কেউই নড়ল না, ভাবছে কি যেন। টোলবার্টের পায়ের কাছে গুলি করল মরগান। তীব্র গাল বকে ঘুরে ক্যাসল টাউনের ট্রেইল ধরে এগোতে শুরু করল সে। পিছু নিল লসন।
সোরেলটা এসে গেছে। স্যাডলে চেপে দুই তস্করকে অনুসরণ করল মরগান। খেয়াল করল সমানে খিস্তি করছে টোলবার্ট। শোনো, বার্ট, তোমার গালাগাল থামাও, নইলে মুখে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেব, হুমকি দিল ও।
গোল্লায় যাও তুমি!
উত্তরে একটা বুলেট পাঠাল মরগান। টোলবার্টের চুলে সিঁথি কেটে চলে গেল ওটা। ঝট করে ঘুরল সে, শীতল দৃষ্টিতে তাকাল, তবে তার চোখে চাপা ভয়। ঠিকই দেখতে পেল মরগান। তোমার চোটপাট চলবে না এখানে, পরিষ্কার? হেসে বলল ও।
তবু নড়ল না সে, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল।
হাঁটুর ওপর আড়াআড়িভাবে রাইফেল রেখে সিগারেট ধরাল মরগান। বার্ট, তুমি দেখছি একটা বেয়াড়া ঘোড়ার চেয়েও খারাপ। নিজের ভাল বোঝো না। সুযোগ চাও নাকি? তাহলে এখুনি ফয়সালা হয়ে যাক। কষ্ট করে ক্যাসল টাউনে যাওয়ার দরকার নেই। তোমার বগলে একটা পিস্তল আছে, বের করো ওটা। হয়তো হারাতে পারবে আমাকে।
ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল টোলবার্ট। নিজের জীবন নিয়ে জুয়া খেলি আমি।
ভাল কথা বলেছ। এগোও এবার। লসন অনেকটা এগিয়ে গেছে। ধরে ফেলো ওকে।
সশব্দে একদলা থুথু ফেলল টোলবার্ট। তোমাকে বোধহয় চিনতে পেরেছি। টমস্টোনে দেখা হয়েছিল আমাদের।
হয়তো। তবে সন্দেহ আছে আমার। যদূর মনে হচ্ছে ওদিকে যাইনি কখনও।
বিব্রত দেখাল তাকে। অস্বীকার করছ?
আমি বলেছি দেখা হয়নি আমাদের। তুমি তা মানতে চাও না, এই তো? কিন্তু মেনে নিলেই ভাল করবে। কেউ যখন আমার সাথে তর্ক করে, লোকটাকে র্যাটলের মত বিষাক্ত লাগে; র্যাটলকে ফণা তোলার আগেই গুলি করা উচিত, পশ্চিমের এ প্রবাদটা শুনেছ নিশ্চয়ই?
নিকুচি করি তোমার প্রবাদের! ঘুরে হাঁটতে শুরু করল টোলবার্ট। সময় হলে ঠিকই তোমাকে বুঝিয়ে দেব পিস্তল উচিয়ে এরকম বাহাদুরি আমিও দেখাতে পারি!
আগে তো মার্শালের খুনের অভিযোগ থেকে রেহাই পাও।
আমাদেরকে ধরিয়ে দিয়ে নিজে সাধু সাজতে চাও?
উঁহু, পথের কাঁটা পরিষ্কার করছি। রাইফেল হাতে কেউ ট্রেইলে অপেক্ষায় থাকবে এটা আমার কাছে একাধারে অস্বস্তিকর এবং বিরক্তিকর।
তোমার কথা শহরের লোকজনকে জানাব আমি।
মরগান হাসল কেবল, কিছু বলল না।
শহরে পৌঁছার পরপরই কয়েকজনের একটা দল ঘিরে ধরল ওদেরকে। উৎসাহী দু’জন এসে বেঁধে ফেলল দুই রাসলারকে।
ওর কাছে একটা লুকানো পিস্তল আছে, টোলবার্টকে দেখিয়ে জানাল মরগান
তোমাকে খুন করব আমি, মরগান! রাগে কুৎসিত দেখাল টোলবার্টের মুখ, হাত বাঁধা না থাকলে হয়তো এখুনি পিস্তল বের করার চেষ্টা করত।
জাজের কাছে নিয়ে চলো এদের, পরামর্শ দিল একজন, এইমাত্র নিরস্ত্র করেছে টোলবার্টকে।
সোৎসাহে ওদেরকে নিয়ে গেল লোকজন। একপাশে সরে এল মরগান, ফিরতি পথে ডান দিকের একটা সেলুনে ঢুকে পড়ল। সময় নিয়ে হুইস্কি পান করল, তারপর পাই-প্যালেসে লাঞ্চ সেরে আস্তাবলে এল। টুলে বসে যথারীতি ঝিমাচ্ছে বুড়ো হসল্যার। মরগান সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চোখ খুলল, পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করল ওকে, দৃষ্টিতে ঘুমের রেশ নেই। ভালই আছ দেখছি, বিরস মুখে মন্তব্য করল। এবং চলেও যাওনি।
তাই আশা করেছিলে?
আমার আশা করা না-করায় কিছু যায়-আসে না তোমার। ভাবছি শেষ পর্যন্ত এখান থেকে বেরুতে পারবে কি-না।
সামনের পথ পরিষ্কার এখন।
এত সহজ ভেব না। কার্টারের দল তোমাকে সহজে ছাড়বে বলে মনে হয়। আচ্ছা, তোমার সাথে ওদের সম্পর্কটা কি? লোকগুলোর তাড়া দেখে মনে হচ্ছে একাই সবার পাছায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছ?
কার্টার কে?
আমার ধারণা এটা ওর নিজের দেয়া নাম। বছর দুই আগে ক্যাসল টাউনে। দুটো লোককে খুন করেছিল ও, তারপর ক্যাকটাস হিলের ওপাশে আস্তানা গেড়েছে। দুনিয়ার সব আউট-লরা যোগ দিতে লাগল ওর সাথে। টাকার বিনিময়ে নিরাপদ আশ্রয় আর খাবার সরবরাহ করে সে। তবে ওপারে যাই করুক ক্যাসল টাউনে এসে ঝামেলা করে না ওরা। নিজেদের আস্তানায় ছোটখাট একটা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে।
গরুচুরির পেছনে হাত আছে ওদের, সম্ভবত এখানকার একটা বাথানও জড়িত। তোমাদের মার্শালকে খুন করেছে এদেরই একজন, টোলবার্ট নামের লোকটা
ভাল কথা মনে করেছ, শিগগিরই হয়তো আবার দেখা পেয়ে যাবে ওদের।
বুঝল না মরগান, কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করল একরকম নিশ্চিত মনে হচ্ছে বুড়োকে।
এ জীবনে কম তো দেখিনি। গরুচোর ধরতে হয় হাতে-নাতে, মালসহ। তা করতে পারোনি তুমি, তাছাড়া শুধু তোমার কথায় চিড়ে ভিজবে না।
হকিন্স কে, তা-ও জানো নিশ্চয়ই?
মাথা নাড়ল হসল্যার। তোমার কাছ থেকে শুনলাম নামটা। শুধু হকিন্স নামে কয়েকজন লোক পাবে। একটু থামল সে, রাস্তা ধরে উত্তরে তাকিয়ে কি যেন দেখল। তবে বুঝতে পারছি লোকটা সাধারণ কেউ নয়। তোমার মত লোকের চিন্তায় ঘুরপাক খাওয়া চাট্টিখানি কথা?
তামাশা করছ?
তামাশা করব কেন! ফের মরগানের পেছনে নজর বুলাল সে। তোমাকে বোধহয় সাবধান করে দেয়া উচিত। এইমাত্র স্টোর থেকে বেরিয়েছে টোলবার্ট আর ওই লোকটা। সম্ভবত নতুন অস্ত্র পরখ করার সুযোগ খুঁজছে।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল মরগান, দেখল দু’জনকে। ষাট গজ দূরে পাশাপাশি এগিয়ে আসছে। তাড়াটা টোলবার্টের মধ্যে বেশি, সঙ্গীর চেয়ে এগিয়ে আছে। দুজনের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। কৌতুক বোধ করল মরগান, খুব সহজ পথ বেছে নিয়েছে ওরা। ওকে ফাঁদে ফেলে কাজ সারতে চাইছে। টোলবার্ট থাকবে সামনে, আর লসন থাকবে ডান পাশে-টার্গেটের সাথে সমকোণী ত্রিভুজ তৈরি করে। কে প্রলুব্ধ করবে ওকে, টোলবার্ট না লসন?
ভেতরে চলে যাও, বুড়ো খোকা, হালকা সুরে বলল মরগান। দু’পা ডানে সরল, নিরেট দেয়ালের দিকে পিঠ। ঠিক ওর সামনে টোলবার্ট, আর লসন কিছুটা ডানে। রাস্তায় কাছাকাছি যেসব লোক ছিল, দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল।
তারপর, মরগান, অবাক লাগছে না? হেসে জানতে চাইল টোলবার্ট।
কেন?
এই যে, জাজ লোকটা আমাদের আটকে রাখতে পারল না। আহা, কি কষ্টই করল! জাজ বলল, তোমরা রাসলার। উত্তরে আমি বললাম: তাহলে জাজ, তুমিও রাসলার, হাসছে সে, দু’কান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে হাসিটা। এবং তুমিও, মরগান। তো ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? কারও বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই।
যে লোকটা প্রমাণ করতে পারত, তাকে খুন করেছ তুমি।
আমি বলছি তুমিই মার্শালকে খুন করেছ, চাপা স্বরে বলল টোলবার্ট, লোকজনের দিকে তাকাল। তোমাদের মার্শালকে খুন করেছে এই লোক। আমি আর লসন এর সাক্ষী।
গুঞ্জন উঠল লোকজনের মধ্যে। মার্শাল খুন হওয়ার দু’দিন পর এখানে। এসেছে ও, ভিড়ের মধ্য থেকে মরগানের পক্ষে সাফাই গাইল একজন।
মার্শালকে খুন করার পর ঘুরে উত্তর দিকের ট্রেইল ধরে শহরে এসেছে ও, ব্যাখ্যা দিল টোলবার্ট, সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে। তো মরগান, অবস্থাটা কি দাঁড়াচ্ছে? মার্শালের খুনের দায়ে ফেঁসে যাচ্ছ তুমি।
উহুঁ, ভুল করছ। শহরে আসার দুদিন আগের অ্যালিবাই আছে আমার। টুকসনে এক রাত কাটিয়েছি, ওখানকার হোটেলের রেজিস্ট্রারে আমার নাম পাওয়া যাবে। নিজের পাপের বোঝা আমার ঘাড়ে চাপাতে চাইছ কেন? ভাল করেই জানো ফাসাতে পারবে না আমাকে, তুমি বললেই তো প্রমাণিত হলো না।
এত সহজ কি?
মরগান সহসাই টের পেল ভিত্তিহীন একটা অভিযোগ তুলে কেন খোশ-গল্প করছে টোলবার্ট। আসলে সময় কাটাচ্ছে সে। ওদের পরিকল্পনায় আরেকজন শরীকদার জুটেছে। ডানে দু’পা সরে আসার সময় উল্টোদিকে, একটু বামে সেলুনের ছাদে দেখতে পেল লোকটাকে। পজিশন নিয়েছে। আসল কাজ সে-ই সারবে।
কিছুটা বিচলিত বোধ করল ও। এখানে ওর জেতার আশা কম, তিনজনে মিলে প্রায় নিচ্ছিদ্র একটা ফাঁদ পেতেছে। তবে আশার কথা একটাই, তৃতীয় লোকটার উপস্থিতি টের পেয়েছে মরগান যা জানে না ওরা।
না, সহজ নয়, শীতল কণ্ঠে স্বীকার করল ও। বাম দিকে সরে এসেছে। দুটো ইচ্ছে ছিল ওর, উল্টো টোলবার্টকে প্রলুব্ধ করা এবং রাস্তার দু’জনকে। একইসাথে মোকাবিলা করার জন্যে সুবিধাজনক একটা অবস্থান নেয়া। অন্তত এখন বোঝা যাচ্ছে, কথা চালিয়ে গেল ও। আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে, আবার দেখা হয়ে গেল এখন। বলতেই হয় নাছোড়বান্দা লোক তোমরা। আমিও খুব ভয়ে আছি, শক্রর সামনে পিঠ দিয়ে সমোরা যাওয়া খুব সহজ হবে না। ঠিক হত যদি পেছন দিকেও দুটো চোখ থাকত আমার।
কি বলছ?
শোনো, টেনিসনের শালা, বলছিলাম তোমার দিকে পিঠ দেয়া বোফামি, হবে।
রেগে কাই হয়ে গেল টোলবার্ট, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ওখানেই দাঁড়াও, মরগান, নোভড়া না! চাপা স্বরে নির্দেশ দিল সে। নিজে ডানে মরে যেতে পা বাড়াল।
এ সুযোগটাই নিল মরগান। চোখের পলকে পিস্তল উঠে এল এর দু’হাতে। ভুলে গেল সামনের দু’জনকে, সেলুনের ছাদে চলে গেছে দৃষ্টি। আয়েশ করে রাইফেল বাগিয়ে ধরে আছে লোকটি, গুলি করার জন্যে তৈরি। কোমরের কাছ থেকে গুলি করল ও। লোকটাকে নড়ে উঠতে দেখে দৃষ্টি নেমে এল ওর, আগুন ঝরাল ডান হাতের কোল্ট। নিশানা ছাড়াই গুলি করেছে, স্রেফ টোলবার্টকে ব্যস্ত রাখার জন্যে। সেটাই দারুণ কাজে দিল। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ব্যবধানে বাম হাতের সিক্সশ্যটার থেকে গুলি করল ও। টোলবাটের বাম বুকে একটা ফুটো তৈরি। হলো, যখন ক্ষতটা থেকে রক্ত গড়াতে শুরু করল ততক্ষণে পাশে আরেকটা ফুটোর সৃষ্টি হয়েছে। পিস্তল হাতে নিয়েই মারা গেল টোলবাট, পড়ে যাওয়ার সময় একটা গুলি ছুঁড়েছিল, ওটা কোথায় গেল তা কেউই বলতে পারবে না।
ভেলকি দেখেই কাত জেফ লসন। মরগানকে মেরে ফেলার সুযোগ ওরই বেশি ছিল। পিস্তল বের করেছিল, কিন্তু গুলি করা হয়নি। কপালে ত্রিনয়নের সৃষ্টি হওয়ার পরও ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। অদ্ভুত এক কষ্ট, মায়া আচ্ছন্ন করল তাকে। মরার আগেও নিজের ভুল বুঝতে পারেনি।
বিস্ময় কখনও কখনও মানুষকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয়, ভাবল মরগান। নিজের ভুলে মরেছে জেফ লসন, দৃঢ়তা ছিল না লোকটার। ডুয়েলের সময় চমকে যেতে নেই, এ শিক্ষা রপ্ত করতে পারেনি সে।
সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ল মরগান। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে এ যাত্রা। পিস্তল রিলোড করে জট পাকিয়ে থাকা লোকজনের দিকে তাকাল, গুঞ্জন উঠছে ওদের মাঝে। পেছনে হসল্যারের পদশব্দেও ফিরল না ও। রাস্তা ধরে দু’দিকে যদ্র দৃষ্টি যায়, খুঁটিয়ে দেখল। সন্তুষ্ট হয়ে, আর কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরে বুড়োর দিকে ফিরল।
খোদার কসম, এরচেয়ে সংক্ষিপ্ত ডুয়েল আর দেখিনি!
কফি হবে? হসল্যারকে থামিয়ে দিল মরগান
ওদের আগেই পিস্তলে হাত দিয়েছ তুমি! ভিড়ের মাঝখান থেকে অভিযোগ করল একজন। একসাথে তিনটা খুন করেছ!
ঝট করে ফিরল মরগান, ভিড়ের মধ্যে লোকটাকে খুঁজল। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল, আহ্বান করল ও।
কেউ এল না, এমনকি টু শব্দও করল না।
সামনে এসে কথাটা বলার সাহস তোমরা রাখো না, অথচ আশা করছ। তিনজনের বিরুদ্ধে একা লড়াইয়ে ওদের পর পিস্তল বের করব আমি। জঘন্য ঘামাদের শহর এবং তোমরা! বলে আর দাঁড়াল না মরগান, সোরেলের লাগাম হাতে আস্তাবলে ঢুকে পড়ল।
ভেতরে, বুড়োর কামরায় এসে বসল ও। কোণের স্টোভে পানি চড়িয়ে দিয়েছে হসল্যার। না তাকিয়েও মরগান টের পেল ওকে দেখছে বুড়ো।
তোমার নাম জেমস মরগান নয়, নিশ্চিত আমি। ওরকম হলে অনেক আগেই নামটা শুনতাম। তোমার মত লোকেরা অন্যের গল্পের খোরাক না হয়ে পারে না।
নিরুত্ত থাকল মরগান।
বোধহয় চলে যাচ্ছ, না?
আজই নয়, দৃঢ় হলো ওর চোয়ালের পেশী। ব্যাপারটার শেষ না দেখে যাওয়ার ইচ্ছে মোটেও নেই। কার্টারের আর কত লোক আছে? এতগুলো প্রাণ তাকে দমানোর জন্যে যথেষ্ট নয় কি? খেলাটার আসল হোতা কে? কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে কুকুরের মত এক ডজন লোককে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে ওর পেছনে। অথচ টাকার কথা কাও জানার কথা নয়, কেবল একজন ছাড়া। তার পক্ষে আঁচ করা সম্ভব-মরগানের পরিচয়ের সাথে ওর স্যাডল ব্যাগের টাকাগুলোর। একটা যোগসূত্র আছে। আলফ্রেড টেনিসন।
চরম একটা সিদ্ধান্ত নিল ও। টেনিসনকে মোকাবিলা করা ছাড়া এখান থেকে এক পা-ও নড়বে না। তবে লোকটা অসম্ভব ধূর্ত। নিজের কাজ হাসিল করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট করতে হয়নি তাকে, বরং তারই ইঙ্গিতে ঘটছে সবকিছু। ডজন খানেক লোকের মৃত্যুর কারণ এই লোকটাই।
ও বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে কি করবে টেনিসন? জানার উপায় নেই। আর কত কূট-কৌশল তার মাথায় আছে খোদা মালুম। একসময় বেরিয়ে আসতেই হবে তাকে, আসতে বাধ্য করবে মরগান। তারপর মোকাবিলা করবে লোকটাকে। খুব সম্ভব সে নিজেই কাটার নামে ক্যাকটাস হিলের ওপাশে রাজত্ব। করছে, আর এপাশে আলফ্রেড টেনিসন নামে ধনী এক র্যাঞ্চার। দারুণ এক খেলা! লোকটার বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়।
তাহলে হকিন্স কে?
মরগান, কফি পরিবেশন করার পর সামনের চেয়ারে এসে বসল হসল্যার। বোধহয় চলে যাওয়াই উচিত তোমার। শনিবার আজ। সব বাথানের পাঞ্চারে ভরে যাবে শহর। ওই ফাঁকে কার্টারের লোকজনও অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারবে। তেমন হলে তোমাকে ওরা খুঁজে নেবেই।
আমাকে থাকতে দেবে না নাকি?
না, তা কেন! তুমি থাকলে ভাড়া পাব। কিন্তু আজ রাতে ঝামেলা হলে নিরীহ লোকও হতাহত হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, সার্কেল-এম আর টেনিসনের পাঞ্চারদের মধ্যে যে কোন সময়ে লড়াই বেধে যেতে পারে।
বুড়োকে নিরীখ করল মরগান। ভয়-ডর বলতে কিছু নেই মুখে। ঝামেলা ভয়। পাও?
না, শুধু তোমার নিরাপত্তার দিকটা ভাবছি আমি, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল সে, ফের মগে কফি ঢালল। আরেকটা কাজ অবশ্য করতে পারো-ভাল হবে যদি আস্তাবল ছেড়ে কোথাও না যাও।
উঠে দাঁড়াল ও। এখানেই থাকছি আমি। ঠিকমত ঘোড়ার যত্ন কোরো স্যাডল চাপিয়ে রাখার দরকার নেই। কফির জন্যে ধন্যবাদ। বেরিয়ে এল ফুটপাথ ধরে উত্তরে এগোল মরগান। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাঁটছে। পেছনে এল অশ্বারোহীর খুরের শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকাল, এইমাত্র শহরে প্রবেশ করছে জন। পাঞ্চারের একটা দল।
ডানে ব্যাংকের দিকে দৃষ্টি চলে গেল ওর। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মেলিসা। বডম্যান। বাইরে অপেক্ষারত চার পাঞ্চারের মুখে হাসি ফুটল, দ্রুতনজেদের পাওনা বুঝে নিয়ে সরে পড়ল ওরা। অপেক্ষা করার ফাঁকে এক সিগারেট রোল করল মরগান।
ওকে দেখতে পেয়ে হাসল মেলিসা। প্রত্যুত্তরে নড করল মরগান, এগোতে গিয়েও থেমে গেল। ব্যাংকের ভেতর থেকে বেরিয়ে মেলিসার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে আলফ্রেড টেনিসন। সহাস্যে মেলিসাকে কিছু জিজ্ঞেস করল সে, উত্তরে মৃদু মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা। মরগানের ওপর চোখ পড়তে থমকে দাঁড়াল টেনিসন, আড়ষ্ট হয়ে গেল কাঁধ দুটো। চটজলদি নিজেকে সামলে নিল সে, নির্বিকার হয়ে গেল মুখ। লিসা, পাই প্যালেসে গিয়ে বসো, বেশ জোরেসোরেই বলল সে, মরগানের ওপর থেকে চোখ সরায়নি। দেরি হবে না আমার। সেলুনে গিয়ে পাঞ্চারদের পাওনা মিটিয়েই চলে আসব। মেলিসার ডান হাত ধরে চাপ দিল সে, তারপর সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল।
কেমন আছ, মরগান? সামনে এসে সহাস্যে জানতে চাইল টেনিসন। আমাদের শহরটা বোধহয় ভাল লাগতে শুরু করেছে তোমার? নইলে এতদিন থাকতে না। যদ্র জানি যথেষ্ট তাড়া আছে তোমার।
নোংরা শহর, নিচু স্বরে বলল মরগান যাতে কেবল টেনিসনই শুনতে পায়। এবং এখানকার বেশিরভাগ মানুষই তোমার মত নোংরা ও কপট।
তুমি বোধহয় বলতে চাইছ…’ পেছনে মেলিসার উপস্থিতি টের পেয়ে থেমে গেল টেনিসন। শ্রাগ করে সরে গেল ওখান থেকে।
মেলিসা সামনে আসতে নড করল মরগান, সপ্রতিভ দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। পাল্টা ওর কুশল জানতে চাইল বডম্যান-কন্যা।
পাঞ্চারদের একটা দল পেরিয়ে গেল ওদের, ধুলো ওড়ায় কিছুটা দূরে সরে এল ওরা।
চলো, পাই-প্যালেসে যাই, প্রস্তাব দিল মেলিসা।
ওখানে কি আমার যাওয়ার কথা? একটু পর টেনিসন আসবে, হলফ করে বলতে পারি তোমার সাথে আমাকে দেখলে খেপে যাবে ও।
এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, নয় কি? রূঢ় স্বরে বলল মেলিসা, বিরক্তি চেপে রাখার চেষ্টা করছে না। আমি তোমার সাথে এক কাপ কফি খেলে ওর অসুবিধে কি? ওর পছন্দ-অপছন্দে কিছু যায়-আসে না আমার।
ওকে যথেষ্ট সমীহ করে চলো তুমি, সম্ভবত ভয়ও পাও।
ম্লান হলো না মেলিসা বড়ম্যানের হাসি। খুবই সত্যি কথা, কিন্তু এটা তো ঠিক আমাদেরকে একসঙ্গে কফি খেতে দেখলে আমাকে বা তোমাকে, কাউকেই খুন করবে না ও! হালকা সুরে কথাগুলো বলে এগোল মেলিসা।
, দ্বিধান্বিত পায়ে অনুসরণ করল মরগান। রহস্যময় লাগছে মেলিসাকে, টেনিসনকে ভয় পায় অথচ র্যাঞ্চারকে কেয়ার না করে ওর সাথে কফি খেতে চাইছে। পরস্পরবিরোধী আচরণ। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এ মেয়ে টেনিসনের বাথানে একটা রাত কাটিয়েছে বিশ্বাস করতে পারছে না মরগান; এবং দু’জনকে। পরস্পরের শত্রু বলা যাচ্ছে না এখন আর। ব্যাংকের সামনে টেনিসনের অপেক্ষায়। ছিল মেয়েটা, নিশ্চিত রিগান। যে লোককে ভয় পাওয়ার কথা তার সাথে এমন সহজ আচরণ করা অস্বাভাবিক।
মরগানের ধারণা যেভাবেই হোক মেয়েটাকে পটিয়ে ফেলেছে ধুরন্ধর লোকটা। সমালোচনার দৃষ্টিতে যাচাই করল দু’জনকে–মেলিসা বডম্যান যতটা ভাল, ততটাই খারাপ টেনিসন। লোকটির মধ্যে ভাল গুণ কেবল কয়েকটা-সাহসী, বুদ্ধিমান এবং সুদর্শন সে। মেলিসাও অকপটে স্বীকার করে এসব। ক্যাসল টাউনে প্রথম যেদিন এসেছিল মরগান, বক্স-টি ক্রুদের তোপের মুখে পড়েছিল মেলিসা, পরে ফ্ল্যাগ-বিতে গিয়ে হুমকি দিয়েছে টেনিসন। এসবের পরও কিভাবে তার সাথে সহজভাবে মিশছে মেয়েটি?
পাই প্যালেসে কোণের একটা টেবিলে বসল ওরা। কফির ফরমাশ দিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল মেলিসা। তোমার তো অনেক আগেই চলে যাওয়ার কথা।
পারছি না। তুমি যেমন টেনিসনকে এড়াতে পারছ না।
হোঁচট খেল যেন মেয়েটা, চোখ-মুখের ভাব দেখে তাই মনে হলো মরগানের। তবে দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। কিন্তু এটাও ঠিক, ওকে এত সহজে ছাড়ছি না আমি। ওর এখানে টিকে থাকা আমার ওপর নির্ভর করছে। লজপোল পাইনের জায়গাটা ছেড়ে দিলে নিশ্চিন্তে একটা সাম্রাজ্য গড়তে পারে ও।
সেজন্যেই কি তোমার সাথে সহজ হতে চাইছে?
উ…অনেকটা সেরকমই।
মিসেস উইলিয়ামস কফি পরিবেশন করার সময় আলাপে ছেদ পড়ল। নীরবে কফি পান করছে দু’জন, নীরবতা ভাঙছে না কেউ। দরজার দিকে মরগানের নজর। টেনিসন এখানে উপস্থিত হওয়ার আগেই চলে যেতে চায়।
তুমি তো টেনিসনকে চেনো, কিছুক্ষণ বাদে জানতে চাইল ও। টেনেসিতে ওর একটা বাথান ছিল, বেশ বড়সড়। অথচ ওটা ছেড়ে এসে মরুভূমির মত একটা জায়গা বেছে নিয়েছে এখানে। একটু অস্বাভাবিক না? বোধহয় কারণটা বলতে পারবে তুমি, ম্যাম। আমার ধারণা, টেনিসন শুধু একজন বাথান মালিকই ছিল না, অন্য কিছু
একই প্রশ্ন আবারও করলে, মি. মরগান, অসহিষ্ণু স্বরে বাধা দিল মেলিসা। এসব জানতে চাইছ কেন?
বিব্রত বোধ করল মরগান, মেলিসার কাছ থেকে এমন নির্লিপ্ত উত্তর আশা করেনি। ওর অতীত সম্পর্কে জানতে চাইছি।
সেটা কি খুব গুরুতুপূর্ণ?
অল্প সময়ের মধ্যে কোন লোককে বিচার করতে হলে তার অতীতটাই সবচেয়ে কাজের হয়ে দাঁড়ায়। এ দেশটা অনেক বড়, ম্যাম। এখানে ভালমানুষের পাশাপাশি খারাপ মানুষও আছে, নিজের অতীত ঢেকে রাখতে চায় কেবল খারাপ লোকেরাই।
কি যেন বলতে চেয়েছিল মেলিসা, মরগানের শেষ কথায় থেমে গেল। বিদ্রূপ আর কৌতুকভরা চাহনিতে দেখল ওকে। কথাটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। কারও কারও জন্যে অতীতটা একান্তই সমস্যার, শুধু তার নিজের জন্যে।
টেনিসন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম, ম্যাম।
দুঃখিত, সাহায্য করতে পারছি না। এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্যের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখি না আমি। তুমি যদি নাচার হও টেনেসিতে খোঁজ নিতে পারো। ওখানকার মার্শাল বোধহয় সাহায্য করতে পারবে তোমাকে। একটা তার করে দাও।
বিস্মিত হলো মরগান। টেনিসনের অতীত গোপন করতে চাইছে মেলিসা বডম্যান! ব্যাপারটা হজম করতে সময় লাগল ওর। টেবিলের ওপর থেকে হ্যাট তুলে নিয়ে উঠে দাড়াল ও, নড় করল। ধন্যবাদ, ম্যাম। তোমার পরামর্শ মনে থাকবে আমার।
মি, মরগান?
চলে আসছিল ও, থেমে ঘুরে তাকাল।
চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এল মেলিসা, কিছুটা বিচলিত এবং অনুতপ্ত দেখাচ্ছে। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি। যদি
শুধু ওর নামটা বলল, ম্যাম। আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই আমার।
যুগপৎ বিস্ময় আর অস্বস্তি দেখা গেল বডম্যান-কন্যার চোখে। এটাই তো ওর নাম!
স্মিত হাসল মরগান, নিজের ওপর বিরক্ত-কৃতজ্ঞতার সুযোগেও নরম করতে পারেনি মেয়েটিকে। কোন লাভই হলো না।
আমি শুধু জানি…এখানে আসার আগে খারাপ কিছু করেনি ও। টেনেসিতে খুব কমই থাকত সে, কেবল শেষের দুটো বছর ছাড়া। এর আগে বাউণ্ডুলের মত এখানে-সেখানে কাটিয়ে দিত।
হতাশ হলো মরগান। ত্যাগ করে হাঁটতে শুরু করল, একরকম নিশ্চিত টেনিসনের ভয়ে মুখ খুলছে না মেয়েটা। ও কি ভুল করছে? টেনিসন হয়তো আদপে দোষী নয়, অন্তত ও যেরকম ভাবছে সেরকম না হলে? আনমনে মাথা নাড়ল মরগান, নিজের বিশ্বাসের ওপর আস্থা আছে ওর। হাজার মানুষ দেখেছে জীবনে, এদের ধাত বুঝতে শিখেছে। সাচ্চা লোক হতে পারে না টেনিসন, নিজের জীবন বাজি রেখে বলতে পারবে ও। বৈরী এ দেশটিতে একটা মানুষকে দেখে বা দু’একটা কথা শুনে বা আচরণে তার সম্পর্কে ধারণা করে নিতে হয়, মাঝে মাঝে দেখা যায় ওই ধারণাই দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। চলার পথে যে কারও কাছ থেকে বিপদ আসতে পারে, মুহূর্তের ব্যবধানে বদলে যেতে পারে পরিস্থিতি। নিজের সম্পর্কে বলে বেড়ায় না কেউ, সুতরাং তার আচরণ আর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই লোকটিকে চিনে নিতে হয়; আগাম ধারণা করে নিতে হয়, লোকটি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। বছরের পর বছর হাজারো মানুষ সম্পর্কে এমন ধারণা করে অভ্য হয়ে গেছে মরগান, এবং তাতে যে ভুল হয় না এর বড় প্রমাণ এখনও ওর বেঁচে থাকা।
আলফ্রেড টেনিসনের মত লোকের অতীত পরিষ্কার হতে পারে না।
পাই প্যালেস থেকে বেরিয়ে একটা সেলুনে ঢুকল ও। তিন ঘণ্টা পোকার খেলার ফাঁকে নজর রাখল শোকজনের ওপর। সন্ধের পর ভিড় বাড়তে বেরিয়ে এসে আস্তাবলের দিকে এগোল মরগান। পোর্চে এসে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ, সিগারেট রোল করার ফাঁকে আশপাশে সতর্ক নজর চালাল। দুশ্চিন্তা করার মত কিছু নেই। আস্তাবলের ভেতর থেকেও কোন সাড়া আসছে না। সময় নিয়ে সিগারেট শেষ করল ও। মেলিসা বডম্যানের রহস্যময় আচরণ মনে পড়ছে বারবার, অনুমান আর বাস্তবের হিসাবের জের টানতে পারছে না বলে বিরক্তি লাগছে। অধৈর্য হয়ে হাল ছেড়ে দিল ও, আস্তাবলের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
ওপরে উঠতে যাচ্ছিল মরগান, পেছনে হালকা পায়ের শব্দে ঘুরে তাকাল। হল্যার। লোকটাকে দেখেই টের পেল কিছু একটা হয়েছে, নিদেনপক্ষে ওর জন্যে একটা খবর আছে।
পালাও, মরগান! তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে তিনজন লোক। এখানেও এসেছিল ওরা, মিথ্যে বলে বুঝ দিয়েছি ওদের।
কার্টারের দল, না টেনিসনের?
মনে হয় না। ওদের ঘোড়া দেখে মনে হলো অনেক দূর থেকে এসেছে। এদের অন্তত একজন বন্দুকবাজ। অন্যরা ওকে অ্যাবল বলে ডাকছিল।
পাগলাঘণ্টী বাজল মরগানের মনে। যা ভয় পেয়েছিল, তা-ই হয়েছে। কিন্তু কিভাবে ওর হদিস পেল ওরা?
৮. ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারছে না
ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারছে না মরগান। নিশ্চিত জানে কোন সূত্র রেখে আসেনি ও, তবু ঠিক ঠিক হাজির হয়েছে ওরা।
কি বলেছ ওদের? জানতে চাইল ও।
বলেছি বেরিয়ে গেছ তুমি। ওরা জানতে চেয়েছিল কোথায় যেতে পারো, এখানে থাকছ কেন। উত্তরগুলো শুনে সন্তুষ্ট হয়নি কেউ। কাউকে এখানে রাখার জন্যে পরামর্শ দিচ্ছিল একজন। অন্যরা প্রস্তাবটা মানেনি বলে রক্ষা, নয়তো। একেবারে পিস্তলের মুখে এসে পড়তে। সন্ত্রস্ত মনে হয়েছে লোকগুলোকে, বোধহয় আলাদাভাবে তোমার সামনে পড়ার ইচ্ছে নেই কারও।
কোন্ দিকে গেছে?
জেসন’স কর্নারে ঢুকতে দেখেছি। সম্ভবত ওখানেই আছে এখন, যদি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে না থাকে।
ঘোড়াটা?
তৈরি আছে। নিয়ে আসব?
উত্তর দিল না মরগান,, ভাবছে। পেছনের স্টল থেকে সোরেলটাকে নিয়ে আসতে পাওনা মিটিয়ে দিল ও।
ওরা কারা? মনে হচ্ছে চেনো তুমি। ওদের সাথে তোমার সম্পর্কটা কি?
পুরানো শক্রতা।
বাছা, তোমার দেখছি শত্রুর অভাব নেই। এভাবে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। এত শত্রু নিয়ে কি করে টিকে আছ, এটাই বেশি বিস্মিত করছে আমাকে। তুমি
কে, মরগান? উঁহু, চলনসই একটা উত্তরে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না।
ওটাই আমার নাম, নিস্পৃহ সুরে বলল মরগান
অনেকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বুড়ো। বোঝার চেষ্টা করল মরগান মিথ্যে বলেছে কি-না। কি বুঝল কেবল সে-ই জানে, ঘুরে চলে গেল নিজের কামরায়। অ্যাডিওস, মরগান। আশা করি আবার দেখা হবে।
কাঁধ উঁচিয়ে অসহায় ভঙ্গি করল মরগান, মাথায় হ্যাট চাপিয়ে বেরিয়ে এল। আস্তাবল থেকে। সেলুনের হৈ-হল্লা কানে আসছে। মূল রাস্তাটা প্রায় জনশূন্য। স্যাডলে চেপে উত্তরে এগোল ও। ডানের গলিতে ঢুকে দুতিনটে বাড়ি পেরিয়ে খোলা জায়গা হয়ে ফের ডানে মোড় নিয়ে আস্তাবলের পেছনে চলে এল। স্যাডল ছেড়ে ঘোড়ার ঘাড়ে হাত বুলাল। এখানেই থাকিস, বাছা, ফিসফিস করে বলল ও।
পেছনের দরজা খুলে গেল। আধো অন্ধকারে হসল্যারের ভীত চোখজোড়া দেখল ও।
সমস্যায় পড়েছ নাকি? দ্রুত জানতে চাইল বুড়ো।
ভেতরে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে দিল মরগান। পকেট থেকে পঞ্চাশ ডলারের একটা মোট বের করে এগিয়ে দিল। দয়া করে এই কাজটা করে দাও। ওদেরকে গিয়ে বলো এখানেই আছি আমি।
সেধে ধরা দিতে চাইছ?
তামাক-কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল ও। ভেবে দেখলাম ঝামেলা মিটিয়ে ফেলাই উচিত। তিনটে লোককে পেছন পেছন নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। সেক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে আমারই ওদের মুখোমুখি হওয়া উচিত। ওরা তো লড়াই চায়, তাই না? আর আমিও সহজে ধরা দেব না। যদি পারে শ্রাগ করল ও, জিভ সহযোগে কাগজের শুকনো আঠায় ভিজিয়ে সিগারেট তৈরি করল।
ভেবে বলছ?
এরকম ছোটাছুটি ভাল লাগছে না আর। নিশ্চিন্তে এই শহর থেকে বেরুব নয়তো এখানকার বুটহিলে একটা জায়গা নেব।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল হসল্যার। শ্রাগ করে বেরিয়ে গেল এরপর।
ওদের সাথে তুমি নিজে এসো না আবার। কিছুক্ষণ অন্য কোথাও কাটিয়ে দাও।
সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টানতে শুরু করল মরগান। নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে না। হাড়ে হাড়ে তিনটেকেই চেনে ও, মিসৌরির দিকে রওনা দিলেও আঠার মত পেছনে লেগে থাকবে ওরা, নরক পর্যন্ত ধাওয়া করবে। তারচেয়ে এখানে…একটু বাড়তি সুবিধে পাবে ও। ওরা জানে না তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে মরগান। ভয় কেবল অ্যাবল টেনারিকে নিয়ে, প্রথম সুযোগে লোকটাকে কুপোকাত করতে না পারলে খারাবি আছে ওর কপালে।
ঠিক বিশ মিনিট পর বাইরে লোকজনের সাড়া পেল ও। দ্রুত, নিঃশব্দে একপাশে সরে এল মরগান, পেছনের কামরার দরজার কাছে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়াল যাতে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, মূল দরজা এবং অফিসরুমটা কাভার করতে পারে। হাতে দুটো পিস্তলই বেরিয়ে এসেছে। জানে ওকে দেখামাত্র গুলি করবে প্রতিপক্ষ। অ্যাবল টেনারিকে ভাল করেই চেনে, কথা বলার আগে গুলি ছেড়ে এ ভাড়াটে গানম্যান।
একসাথে দু’জন ঢুকল, দ্রুত ও নিঃশব্দে। দশাসই শরীর দেখে চেনা গেল অ্যাবল টেনারিকে। চোখের পলকে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে, দরজার একপাশে দাড়িয়ে তাকে কাভার করছে অন্যজন। স্থির দাঁড়িয়ে থাকল টেনারি, ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ করে তুলেছে পুরোপুরি। মরগানও তাই করেছে, এবং নিঃশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে আছে। বুকে আশঙ্কা হয়তো ওর অবস্থান আঁচ করে ফেলবে টেনারি, আন্দাজের ওপর গুলি শুরু করবে। একসঙ্গে দুজনকে সামলানো কঠিন হবে, যদি একজনকে বেচাল করা যায়, কিংবা খানিকটা অমনোযোগী করা যায়…নিদেনপক্ষে লাইন অভ ফায়ার থেকে যদি সরিয়ে দেয়া যায়-ওর সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়ত। তিন নম্বরটা কোথায়? বাইরে রেখে এসেছে, না পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকার পায়তারা করছে ব্যাটা?
লণ্ঠনের আবছা আলোয় অশরীরীর মত মনে হচ্ছে বিশালদেহী টেনারিকে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এখনও। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল, সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে-ওপরের তলায় আছে মরগান। চোখে পড়ে না, সঙ্গীর উদ্দেশে আলতোভাবে হাত নেড়ে ইঙ্গিত করল সে, হোলস্টার থেকে একটা পিস্তল তুলে সিঁড়ির দিকে এগোল। মরগানের দিকে পিছন ফিরে আছে এখন।
তার ছোট্ট এ ভুলটাই বাঁচিয়ে দিল মরগানকে।
তৃতীয় লোকটির অস্তিত্বের কথা ভুলে গেল ও, আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। মোক্ষম সময়-টেনারির মনোযোগ এখন ওপরের তলায়, আর কাভার দেয়া লোকটার মনোযোগ সিঁড়ির আশপাশে। কোন কিছু বলার আগেই দরজায় দাঁড়ানো লোকটাকে গুলি করল মরগান, দুটো পিস্তল থেকে একসঙ্গে। গুলির। ধাক্কায় দেয়ালের সাথে মিশে গেল লোকটার দেহ। কমলা আগুন ওগরাল হাতের পিস্তল, ছাদে গিয়ে বিধল গুলিটা।
চরকির মত ঘুরল অ্যারল টেনারি। মাঝপথে তাকে গুলি করল মরগান, ঘূর্ণন কিছুটা শ্লথ হয়ে গেল। পড়ন্ত অবস্থায় তীব্র গাল বল গানম্যান; কিন্তু বিরতি নেই গুলি চালানোয়, নিশানা ছাড়াই সমানে গুলি করছে। মেঝেয় পড়ার পর শেষ চেষ্টা করল সে, নির্দ্বিধায় তার কপালে একটা সীসা পাঠিয়ে দিল মরগান।
চটজলদি পাশে সরে গেল মরগান। বাম হাতের পিস্তল কোমরে গুঁজে অন্য পিস্তলে টোটা ভরতে শুরু করল, দরজার ওপর চোখ। জানে আরও একজন আছে। পিস্তল রিলোড করেছে, এসময়ে দরজায় দেখা গেল তাকে। খানিকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় ওকে পেয়ে গেল লোকটা। শীর্ণ হাতে ভয়াল দর্শন কোল্টটাকে বেমানান লাগছে। সিঁড়ির দিকে তাক করা ছিল কোল্ট, ঘুরতে শুরু করেছে মরগানের দিকে। বিপদ বুঝে ডাইভ দিল মরগান, মেঝের সাথে শরীর মিশিয়ে দিল। শিকার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে তাড়াহুড়োয় গুলি করল তালপাতার সেপাই, ফস্কে গেল। তবে মরগানেরটা ফস্কাল না। ঝাঁপ দেয়ার সময় হ্যামার টেনেছে ও, উড়ন্ত অবস্থায় গুলি করল লোকটাকে। বাহুতে গিয়ে বিধল তপ্ত সীসা। গড়ান দিয়ে সরে গেল মরগান, শোয়া অবস্থায় পরের গুলি করল।
উঠে দাঁড়াতে যেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ও, ডান উরুর ভেতর যেন একটা গরম রড ঢুকে গেছে। ডান দিকে তাকাতে হুঁশ ফিরল। তালপাতার সেপাইকে নিয়ে এতক্ষণ ব্যস্ত থাকায় দরজার পাশের লোকটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে সে, ওই অবস্থায় গুলি করেছে। মরগান আছে বেকায়দা অবস্থায়, পড়ে যাওয়ার সময় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পিস্তল ধরা হাত চলে গেছে ডান পাশে। লোকটাকে গুলি করতে হলে হাতটা সামনে আনতে হবে। দেখল ফের গুলি করার চেষ্টা করছে লোকটা। অসহায় বোধ করল মরাগন, মরিয়া হয়ে উঠল। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা ভুলে গড়ান দিল বাম পাশে। ওর চুলে সিঁথি কেটে চলে গেল একটা গুলি, আরেকটা পাশ দিয়ে। পিস্তলধরা হাতে যখন লোকটাকে নিশানা করছে দেখল হাঁসফাস করছে ওর শিকার, ট্রিগার টানার মত শক্তিও পাচ্ছে না আর। আড়চোখে অ্যাবল টেনারি আর তালপাতার সেপাইয়ের দিকে তাকাল মরগান, নিথর পড়ে আছে ওরা।
লোকটার ওপর চোখ রেখে উঠে দাঁড়াল মরগান। পিস্তল ছেড়ে দিয়েছে সে। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ হাঁ করে বাতাস নিচ্ছে। ডান বুকের ফুটো থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। লোকটার দৃষ্টিতে কেবলই ঘৃণা; মৃত্যুর ভয়, বাঁচার আকুতি কিংবা অনুতাপ কোনটাই নেই।
হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেল, তাই না, কার্লি?
রক্তে ভরা একদলা থুথু মাটিতে ফেলল সে। জাহান্নামে যাও!
তুমি তো এ লাইনের লোক নও, কার্লি। ওই শুটকির সাথে ভিড়লে কোন লোভে? আমার স্যাডলব্যাগের টাকাগুলো, তাই না? বোধহয় জানতে না এখানেই দেখা পেয়ে যাবে, নয়তো ভেবেছ অ্যাবল টেনারি সাথে থাকলে কোন কাজই কঠিন নয়। মনে আছে, কার্লি, তিনটে বছর একসঙ্গে ছিলাম আমরা, সারা পশ্চিম চষে বেড়িয়েছি?
কার্লি টেইমসের চোখে অসহায় দৃষ্টি ফুটে উঠল এবার। হসল্যার বলেছে ওপরে আছ তুমি।
আমিই পাঠিয়েছি ওকে। আমার দুর্ভাগ্য সবার আগে তোমাকেই গুলি করতে হলো। এসবে না এলেও পারতে, কার্লি।
কি যেন বলতে চেষ্টা করল কার্লি, রক্ত বেরিয়ে এল মুখে। অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল মুখ, তারপর হঠাৎ করেই ক্লান্ত, ফ্যাকাসে দেখাল। এখানে আয়রন হক আছে… শেষ করতে পারল না সে।
আয়রন হক!
শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল মরগানের মেরুদণ্ড বরাবর, দিশেহারা বোধ করল ও। ইচ্ছে হলো এখুনি ঘোড়া ছোটায় মিসৌরির দিকে। এ কদিনের লাগাতার ছোটাছুটি আর মানসিক অস্থিরতায় নিজেকে ক্লান্ত, পর্যদস্ত মনে হচ্ছে। শরীরে একটা আঘাত নিয়ে আয়রন হকের মোকাবিলা করা সহজ হবে না।
মরে যাওয়ার আগে ওকে একটা ক্ষত দিয়ে গেছে কার্লি। উরুর মাংস ভেদ করে চলে গেছে বুলেট, অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বহুকষ্টে শরীর টেনে নিয়ে কলের কাছে চলে এল মরগান। মেঝেয় বসে ছুরি দিয়ে কেটে ফেলল প্যান্টের অংশ। ভাগ্য ভাল এক খাবলা মাংস তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেছে বুলেটটা, ভেতরে থাকলে বের করার ধকল এ মুহূর্তে সহ্য করতে পারত না বোধহয়। প্রচুর পানি দিয়ে ক্ষতটা পরিষ্কার করল ও, তারপর গলা থেকে ব্যানডানা খুলে পটি বাধল। এটুকু কাজ করতেই হাঁপিয়ে উঠেছে, টের পেল মরগান
নড়ার ইচ্ছে হলো না, চোখ বুজে পড়ে থাকল কিছুক্ষণ। সিগারেট রোল করল। এক লহমায় মনে পড়ে গেল অনেক কিছু-রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দুপুরে এখানে উপস্থিত হয়েছিল ও, ঘটনাচক্রে মেলিসা বডম্যানের সাথে পরিচয়…অসাধারণ সুন্দরী এক মহিলা, যাকে পাওয়ার লোভ মরগানেরও হয়েছিল; কপট আলফ্রেড টেনিসন, অদৃশ্য কার্টার আর বেপরোয়া কিছু লোক। হন্যে হয়ে ওকে খুন করতে চাইছে এরা, নাকি স্যাডলব্যাগের টাকাগুলো পেলেই বেশি খুশি হবে? এসবের মধ্যে আয়রন হকের ভূমিকা কি?
মিথ্যে বলেনি কার্লি, এ নিয়ে বাজি ধরতে রাজি মরগান। হারিয়ে যাওয়া আয়রন হকের অস্তিত্ব এখানে কে বহন করছে, কার্টার না টেনিসন? পশ্চিমে আয়রন হক একটা অতি পরিচিত নাম। নামটা এত বেশি উচ্চারিত হয়েছে যে লোকটার আসল নামই হারিয়ে গেছে। বহু আগে কলোরাডো, টেক্সাস আর মিসৌরির আশপাশে শোনা যেত ওর নাম। ডুয়েলে অনেক বিখ্যাত গানম্যানকে ধরাশায়ী করেছে সে-জেফরি লোগান, প্যাট সিমন্স, ইয়্যাট অ্যাপি, লো অ্যালেন…এদেরকে হটিয়ে দিয়েই তার পরিচিতি। একসময় বাউন্টি শিকারী। হিসেবে খুব নাম করেছিল, ওয়েলস ফারগোর স্টেজগার্ডের চাকুরি করেছে দুই বছর। কিন্তু ডাকাতিতে সাহায্য করার অজুহাতে চাকুরি হারায় সে। তারপর শেষবার, অ্যাবিলিনে ক্র্যাফটার আর ফ্ল্যাগানদের পারিবারিক যুদ্ধে দেখা যায় তাকে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই লাপাত্তা হয়ে যায় আয়রন হক। অনেকের ধারণা ওই যুদ্ধে মারা পড়েছিল কিংবদন্তীর এই বন্দুকবাজ।
অসাধারণ ক্ষিপ্রতা, নিখুঁত লক্ষ্যভেদ আর অপরিসীম ধৈর্য-এ তিনটি জিনিসের সমন্বয়ের নাম, আয়রন হক। তার সম্পর্কে অসংখ্য গল্প চালু ছিল একসময়, আসল লোকটা গায়েব হয়ে যাওয়ায় সেসব গল্পও পরে হারিয়ে গেছে। বরাবরই নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছে এ গানম্যান, এবং সফলও হয়েছে। ছয়-সাত বছর তার হদিশ পায়নি কেউ, এবং সে নিজেও আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেনি।
এখানে, ক্যাসল টাউনেও স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হবে না সে, জানে মরগান। সবকিছুর পেছনে রয়েছে ওই লোকটাই। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করতে হবে তাকে।
বুড়ো হসল্যারের হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসার শব্দে বাস্তবে ফিরে এল মরগান। ওকে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন। খোদার কসম, আমার ধারণাতেও আসেনি তোমাকে জীবিত দেখব! ওরা তিনজন… কথা শেষ না করে এগিয়ে এল সে, পরখ করল ওর জখম। ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। ওঠো, ওপরে পৌঁছে দেই তোমাকে। তারপর ডককে নিয়ে আসব এখানে।
বুড়োর সহায়তায় উঠে দাঁড়াল মরগান। পেছনের দরজায় পৌঁছে দাও আমাকে। স্যাডলে চাপব! অধৈর্য স্বরে বলল ও।
কি বলছ! এই অবস্থায় স্যাডিলে চাপার ধকল সইবে না তোমার। কথা না শুনলে জোর করে নিয়ে যাব। এখন বোধহয় আমার সাথে শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারবে না। সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিল সে। বুড়োর কাঁধে ভর করে সিঁড়ির দিকে এগোল মরগান। টের পেল আসলেই দুর্বল বোধ করছে। হসল্যারের সাহায্য ছাড়া বোধহয় দশ-কদমও এগোতে পারত না।
প্রথম যখন এখানে এসেছিল, পাঁচটা মিনিটও ক্যাসল টাউনে থাকার ইচ্ছে ছিল না ওর, কিন্তু অন্তত একটা সপ্তাহ বাধ্য হয়ে থাকতে হয়েছে। কার্লি টেইমসের ক্ষত তার সাথে আরও চার দিন যোগ করল, নিতান্ত অনিচ্ছায় শুয়ে বসে দিনগুলো কাটিয়ে দিল জেমস মরগান
একসময় বিরক্ত হয়ে পড়ল ও। একরাশ দুশ্চিন্তা আর আশঙ্কা নিয়ে এভাবে বসে থাকতে ভাল লাগছে না। কাজ ছাড়া অযথা পাচটা মিনিটও কখনও কোথাও বসে থাকেনি ও। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার কথাও নয় এখন। যে কোন মুহূর্তে এখানে উপস্থিত হতে পারে আরেকটা দল, এসব ক্ষেত্রে এমনই হয়-এক দলের ওপর ভরসা রাখে না কেউ। অন্তত জেমস মরগানের ক্ষেত্রে এটা ঠিক।
একেকটা দিন গড়ানোর সাথে সাথে মরগানের অস্থিরতা কেবল বাড়ছেই। নিজেকে অসহায়ও মনে হচ্ছে। এতদিনে মিসৌরি পৌঁছে যাওয়ার কথা ওর, তাহলে টেনারি বা তার মত কেউ নাগাল পেত না। অথচ বোকার মত জড়িয়ে পড়েছে এখানে, যেখানে বিন্দুমাত্র স্বার্থ নেই ওর, বরং প্রতি মুহূর্তে পৈত্রিক প্রাণের ঝুঁকি কেবল বাড়ছেই। বারবার ভাগ্যের সহায়তা পাবে না। সবচেয়ে বড় কথা অস্থির এ পশ্চিমে হাজারো বন্দুকবাজের মধ্যে ওর চেয়ে সেরা লোক নেই, কে বলতে পারে? বন্দুকবাজ সাধারণত বন্দুকের গুলিতেই মরে।
নিজের এ জীবনকে ঘৃণা করে মরগান। কিন্তু পালানোর বা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় জানা নেই ওর। অনেক ঘটনার ওপরই কারও হাত থাকে না। এখানে যেমন হয়েছে, ওর সহজাত প্রবৃত্তিই মেলিসা বডম্যানকে বখাটে লোকের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। তাতেই বিপত্তির শুরু। নইলে যে শান্তিপ্রিয় জীবনের হাতছানি দেখছিল ওর মন, মিসৌরি গিয়ে হয়তো এতদিনে তার প্রাথমিক কাজ শুরুও করতে পারত।
এ ঝামেলাটা অচিরেই শেষ করতে চায় মরগান। নির্জন প্রেয়ারির অনন্ত দিগন্ত হাতছানি দিচ্ছে ওকে, রুক্ষ ট্রেইল ধরে ছুটে যেতে চাইছে মন। কিন্তু জেদ আর পরিস্থিতি আটকে রাখছে ওকে। যার কারণে এতকিছু তাকে ছেড়ে দেয়ার মত মানুষ জেমস মরগান নয়। যারা ওকে চেনে, জানে ভাঙবে তবু মচকাবে না ও। একবার যা মনস্থির করে, সেটা করে ছাড়ে।
পঞ্চম দিন সকালে নিচে নেমে এল ও। কোন জড়তা নেই, কেবল খানিকটা আড়ষ্ট ভাব। জানে একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। হসল্যারের কামরায় চলে এল।
স্টোভে কফির পানি চড়িয়েছিল বুড়ো, পদশব্দেও ফিরে তাকাল না। মরগান, একটা সিগারেট তৈরি করে দাও তো, আমার তামাক শেষ হয়ে গেছে, অনুরোধ করল সে।
কফির বিনিময়ে দেয়া যেতে পারে, একটা চেয়ারে বসে সিগারেট রোল করা শুরু করল মরগান। অদ্ভুত ব্যাপার, এখনও তোমার নামই জানা হলো না, অথচ দুটো সপ্তাহ তোমার ওপর ভূতের মত চেপে আছি।
আমিও কি তোমার নাম জানি?
বিষম খেল মরগান, তবে দ্রুতই সামলে নিল। না জানলেই ভাল, খানিক ভেবে বলল ও। নামটা হয়তো ভাল লাগবে না তোমার। তারচেয়ে জেমস মরগান নামটা কি চলনসই নয়? কাজ চললেই হলো।
হ্যাঁ, কাজ অবশ্য কোন নাম ছাড়াও চলতে পারে। আমার বেলায় ঘটল যেমন, আমার নাম জানো না তুমি।
তোমার ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞেস করিনি আমি, তোমার কাছেও জানতে চাইনি।
আমিও জানাইনি, কফি পরিবেশন করার সময় বলল হসল্যার। ঘরের ওপাশ থেকে একটা চেয়ার এনে ওর সামনে বসল। হাঁপিয়ে উঠেছ?
উত্তর না দিয়ে কফিতে চুমুক দিল মরগান
এখানে কেন পড়ে আছ ঠিক বুঝতে পারছি না। চলে গেলেই বেশি মানাত তোমাকে, আর এত ঝামেলাও হত না। যদূর বুঝেছি অনেক দূর থেকে এসেছ তুমি এবং ওই লিকলিকে লোকটাসহ তিনজন তোমার গন্ধ শুকে শুকে এখানে হাজির হয়েছিল। মরগান, কিসের জন্যে, তোমার পিছু লেগেছে ওরা? আর সবাইকে নিজের চাদমুখ দেখানোর জন্যে তুমিও যেন পণ করে বসে আছ, অথচ ভেতরে ভেতরে গন্তব্যে পৌঁছা’নোর জন্যেও অস্থির।
আমার মতই শত্রুকে কখনও ক্ষমা করে না ওরা, কোন অবস্থাতেই না।
অন্য কারও জন্যে অপেক্ষা করছ?
তা নয়, আসলে বুঝতে পারছি না ঠিক কে আমাকে কোণঠাসা করতে চাইছে। হতে পারে কার্টার, কিংবা টেনিসন
কিন্তু এ পর্যন্ত যত লোক মারা গেছে; তাদের কেউই বক্স-টির ক্রু নয়, বরং কার্টারের আউটফিটের হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
টেনিসনের সব লোককে চেনো তুমি?
বেশিরভাগ
ওদের মধ্যে এমন কেউ আছে যাকে অন্তত গত এক সপ্তাহ দেখোনি?
ওরা তো মাত্র একদিন আসে শহরে, পে-ডেতে। গত শনিবারে ঠিকমত খেয়াল করিনি। আস্তাবলে ঘোড়া রাখে না ওরা, বেশিরভাগ ক্রু সেলুনের হিচিং রেইল ব্যবহার করে।
হতাশ হলো না মরগান, তেমন কিছু আশাও করেনি। আয়রন হকের নাম শুনেছ?
বোধহয় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হকিন্সের কথাই জানতে চাইছ?
শুধু হকিন্স, আর কিছু না? উত্তেজিত হয়ে পড়ল মরগান, নিজের ওপর রাগও হচ্ছে। আয়রন হক শুধুমাত্র একটা উপাধি, দৃঢ়তা আর জেদী স্বভাবের জন্যে এ নামে খ্যাতি পেয়েছে সে। আগেই বোঝা উচিত ছিল নামটা হকিন্স থেকে এসেছে, অথচ ঘুণাক্ষরেও সম্ভাবনাটা আসেনি ওর মাথায়।
দুঃখিত, মরগান, বাকিটুকু জানি না। কিন্তু ওর কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? সে তো বহু দিন নিখোঁজ। অনেকের ধারণা সত্যিই অ্যাবিলিনের যুদ্ধে মারা গেছে ও। আমার তো মনে হয় না নিজেকে আড়ালে রাখতে পেরেছে অসাধারণ এ লোকটা।
ক্যাসল টাউনের আশপাশেই আছে ওই লোক, হেসে বলল মরগান
লাফিয়ে উঠল বুড়ো, মেঝেয় পড়ে গেছে ঠোঁটের সিগারেট। কি বলছ! এখানে…এখানে আছে আয়রন হক!? কার পরিচয়ে?
যে কেউ হতে পারে। আমিও হতে পারি।
বোধহয় তামাশা করছ তুমি! বিহ্বল দেখাল বুড়োকে।
উঠে গিয়ে খালি মগ ভরে নিল মরগান। মোটেই ঠাট্টা করছি না। এখানে এমন এক পরিচয় ওর, যার সাথে আসলেই কোন সম্পর্ক নেই। কার্টার হতে পারে, আবার টেনিসনও হতে পারে। তবে কার্টারের সম্ভাবনাই বেশি।
কার্টারকে চিনি না আমি, কখনও দেখিওনি। আর টেনিসন কখনোই পিস্তল ঝোলায় না। ওকে দেখে বরং পাকা গরু ব্যবসায়ী মনে হয়। এখানে এসে তাই প্রমাণ করেছে ও। নিজের জমিতে ঘাস নেই, তবু ফ্রি রেঞ্জের সুবিধা নিয়ে সবচেয়ে বড় স্টক গড়ে তুলেছে। লোকটা জানে কি করে উন্নতি করতে হয়! মেঝেয় পড়ে যাওয়া সিগারেট নিভে গিয়েছিল, থেমে ফের ধরাল হসল্যার। অবশ্য ওর সম্পর্কে গুজব আছে, সে নাকি রাসলারদের নেতা। কিন্তু প্রমাণ করতে পারেনি কেউ। ম্যাকলয়ারীরা দোষারোপ করেছিল ওকে, দুদিন আগে ওদেরকে গুড়িয়ে দিয়ে দেশছাড়া করেছে টেনিসন। ডেভিড ম্যাকলয়ারী অবশ্য বেঁচে গেছে এ যাত্রা, পণ করেছে ফিরে আসবে সে, কড়ায়-গণ্ডায় শোধ নেবে।
গিয়ে দেখো ট্রেইলের কোথাও পড়ে আছে ওর লাশ। টেনিসন ওকে অ্যাম্বুশ করলে একটুও অবাক হব না।
তুমি শুধু ধারণাই করছ।
হয়তো দুদিন পর জানবে ধারণাটা মিথ্যে নয়। উঠে দাঁড়াল মরগান। কফির জন্যে ধন্যবাদ।
বেরুবে নাকি?
চারপাশে চক্কর দিয়ে আসি। বসে থেকে শরীরে খিল ধরে গেছে।
ফ্ল্যাগ-বিতে? হাসছে বুড়ো, চোখে কৌতুক।
শ্রাগ করে ঘোড়ার কাছে এল মরগান। একটু পর স্যাডলে চেপে রাস্তায় বেরিয়ে এল। কোথায় যারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, একবার ভাবল নির্জন। প্রেয়ারি ধরে ঘোড়া ঘোটায়। আবিষ্কার করল ফ্ল্যাগ-বি বাথানের ট্রেইল ধরে এগোচ্ছে। শহরের ট্রেইল এড়িয়ে কয়েকদিন আগে যেটা ধরে গিয়েছিল। বাথানটার উদ্দেশে আড়াআড়িভাবে ঘোড়া ছোটাল, কিছু সময় তো বাঁচবেই। তবে কাজটা সহজ হলো না, মরগানের কেবলই মনে হচ্ছিল হয়তো পথ ভুল করবে। একমাত্র দিক নির্দেশনা ছিল দিগন্তের কাছে ক্যালটুপ মাউন্টেনের আবছা অবয়ব। জানে এর কোলেই ফ্ল্যাগ-বি র্যাঞ্চ-হাউস। সোজাসুজি যেতে থাকলে একসময় পৌঁছে যাবে।
ঘণ্টাখানেক পর গন্তব্যে পৌঁছল ও। র্যাঞ্চ হাউসটা তখন প্রায় জনশূন্য। পাশের স্টেবল খালি, শুধু একটা গ্রুলা আছে। সব পাঞ্চাররা কাজে বেরিয়ে গেছে, ধারণা করল মরগান। বোধহয় মেলিসা বডম্যানও বেরিয়েছে।
বারান্দায় দাঁড়ানো ক্লীভ অ্যালেন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল ওকে। ভেতরে এসো, কফি খাবে।
মাথা নাড়ল মরগান। মিস বডম্যানের কাছে এসেছিলাম, বোধহয় নেই ও?
দু’মাইল পুবে নদীর কাছে পাবে ওকে। কয়েকটা গরু পানি খেতে গিয়ে কাদায় আটকে গেছে। ওগুলোকে তুলে আনার কাজ তদারক করতে গেছে মেলিসা
আরও বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দেয়ার আগে কফি হলে মন্দ হয় না-ভেবে স্যাডল ত্যাগ করল মরগান। কৃকের পিছু নিয়ে খাবার ঘরে এসে বসল। বোধহয় বডম্যানদের সাথে অনেকদিন আছ তুমি? টেনেসিতেও ছিলে, তাই না?
ওখানেই আমার জন্ম, গর্বভরে উত্তর দিল কুক।
টেনিসনকে তো চিনতে, কেমন মানুষ ও?
ভাল-মন্দে মেশাল, অন্তত এখন। যদিও ওকে পছন্দ হয় না আমার। কথাটা অবশ্য ওর সামনাসামনি বলার সাহস হবে না।
হাসল মরগান। ভয় পাও ওকে?
একসঙ্গে দু’জন লোককে পিটিয়ে প্রায় লাশ বানাতে দেখেছি ওকে। লোকটা। অসম্ভব জেদী, তাছাড়া…’
কুক থেমে যাওয়ায় চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল ও।
কিছু না বলে কফি পরিবেশন করল সে। চুমুক দিল মরগান। হকিন্স কে, জানো?
ওটা তো টেনিসনের নামের মাঝের অংশ।
কিছুটা বিস্মিত হলো মরগান। নামের মাঝের অংশ নিয়ে দেশজোড়া পরিচিতির ঘটনা বোধহয় একমাত্র এটাই। তা-ও পরিবর্তিত। আয়রন হক নামটার আড়াল থেকে টেনিসন এমনকি হকিন্সটুকু বের করাও দুঃসাধ্য। এটা সম্ভব হয়েছে পেশাগত কারণে লোকটার গোপনীয়তা রক্ষার কারণে। খ্যাতির চূড়ায় সে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু সেইসাথে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছে। মরগান ধারণা করল টেনিসন আর আয়রন হক যে একই ব্যক্তি তা হয়তো জানেই ফ্ল্যাগ-বি কুক
অনেকগুলো প্রশ্ন দোলা দিচ্ছে ওর মনে। ওকে মিথ্যে বলেছে মেলিসা! বলেছে হকিন্সকে চেনে না, টেনিসনের নির্দেশে করেছে কাজটা? লোকটাকে ভয় পায় মেয়েটি, অথচ টেনিসনের বাথানে একটা রাতও কাটিয়েছে। লোকটির সাথে ওর সম্পর্ক কি?
অজান্তে শ্রাগ করল মরগান। মেলিসা বডম্যানের ব্যাপারে কিছু আসে-যায় না ওর। এ মুহূর্তে টেনিসনের চেয়ে এ মেয়েটিকেই বেশি রহস্যময় মনে হচ্ছে।
কিছুটা নিরাশ হলো ও। মেলিসার সাথে শেষবারের মত কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আগ্রহ বোধ করছে না আর। তাছাড়া যা জানার দরকার ছিল, ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছে। এখন কেবল শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা। টেনিসনের টুটি চেপে ধরবে ও, হোক সে আয়রন হক। ওসবে পাত্তা দেয় না মরগান। নিজের ওপর যথেষ্ট আস্থা আছে ওর। দরকার হলে লোকটার বাথানে উপস্থিত হয়ে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করবে।
তবে কার্টারের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ ঘুচছে না। হয়তো টেনিসনই ক্যাকটাস হিলের হাইড-আউটে কার্টার নামে আউট-লদের একটা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। তেমন হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
ড্যানিকে চিনতে নাকি?
টেনিসনের ক্রুদের মধ্যে এই ছেলেটাই বেশি উদ্ধত। মাসখানেক আগে শহরে এক ভবঘুরেকে খুন করার পর থেকে মাটিতে পা ফেলছে না ছোকরা। দুই কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে ভাব করে যেন অসাধারণ এক বন্দুকবাজ হয়ে গেছে। টেনিসন ছাঁটাই করে দেয়ার পর আর দেখিনি।
হতে পারে পুরো ব্যাপারটাই সাজানো। ড্যানি হয়তো আসলে টেনিসনেরই লোক। নিজের ওপর থেকে সন্দেহ সরানোর জন্যে ড্যানিকে ছাটাই করেছে, ভিড়তে দিয়েছে কার্টারের দলে। আর টেনিসন স্বয়ং কার্টার হয়ে থাকলে তো কথাই নেই।
কফির জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে দাঁড়াল মরগান। বেরিয়ে এসে স্যাডলে চেপে শহরের ট্রেইল ধরল।
মি. মরগান? পেছন থেকে ডাকল ক্লীভ অ্যালেন।
পেছন ফিরে দেখল পোর্চে এসে দাঁড়িয়েছে কুক।
রাস্তা ভুল করছ। মেলিসার সাথে দেখা করতে হলে পুবে যেতে হবে।
পরে আরেকদিন আসব, হয়তো, কুকের বিস্মিত মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে। ট্রেইলের দিকে মনোযোগ দিল মরগান। মাথায় একটা পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে। কাটারের হাইড-আউটে গেলে কেমন হয়? গণ্ডায়-গণ্ডায় তোক লেলিয়ে দিয়েছে। সে, ওর গায়ের চামড়াকে খুব সস্তা ভেবেছিল এরা। ব্যাপারটা ভাল লাগেনি ওর। একবার ওখানে ঢুকতে পারলে কার্টারের সাথে মোলাকাত হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া লোকটার আসল পরিচয় খোঁচাচ্ছে ওকে
মরগানের ধারণা ক্যানিয়নের ওই ট্রেইল ধরে যাওয়া-আসা করে আউট-লরা। ঘুরপথে যাওয়ার চেয়ে এটাই সহজ হবে। ঝুঁকি আছে তবু ওটা ধরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ও।
সহসাই কোন কিছুতে আলোর প্রতিফলন চোখে পড়ল ওর। এসব পরিস্থিতিতে এই প্রথম পড়েনি, তাই জানে কি করতে হবে। সহজাত প্রবৃত্তি বশে তৎপর হয়ে উঠল ও। মাথা নিচু করে স্যাডলের সাথে মিশিয়ে দিল শরীর। সেইসাথে স্পার দাবাল। ওর দ্রুততম রিফ্লেক্সের কারণে বেঁচে গেল এ যাত্রা। সশব্দে পাশ দিয়ে ছুটে গেল তপ্ত সীসা।
পূর্ণগতিতে ছুটছে সোরেলটা। চোখ তুলে আততায়ীর অবস্থান আন্দাজ করার চেষ্টা করল ও। ট্রেইল ছেড়ে লজপোল পাইনের বনে চলে এসেছে, সম্ভবত কয়েকশো গজের মধ্যে আছে লোকটা। হয়তো ডান দিকে পাথরের চাঙড়ের আড়ালে অবস্থান নিয়েছে।
স্যাডল হর্ন থেকে রাইফেল তুলে নিল ও। এসময় আবারও চেষ্টা করল লোকটা, কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলো। হাসি পেল মরগানের, ছুটন্ত ঘোড়সওয়ারকে লাগানো সহজ ব্যাপার নয়। অথচ ঠিক তাই করতে চাইছে নোকটা। ভয় পেয়েছে সে, কাউকে অ্যাম্বুশ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে দুজনের সম্ভাবনা সমান-সমান হয়ে যায়। লোকটির ভয় যুক্তিসঙ্গত, কারণ পাল্টা আঘাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মরগান-সময় ও সুযোগমত।
কাছে-ধারে পায়ের শব্দ পেল ও, একটু পর ঘোড়ার খুরের শব্দ। বামে ওর সমান্তরালে ছুটছে একটা গ্রুলা, পাইনের ফাঁক দিয়ে এক ঝলকের জন্যে দেখতে পেল। সোরেলকে ফের তাগাদা দিল ও, জানে কোথায় যাবে লোকটা। আগেই সেখানে পৌঁছে যেতে চায়। একটা জুনিপার ঝোঁপ পেরিয়ে কোণাকুণিভাবে ঘোড়া ছোটাল মরগান। ঘোড়ায় চাপতে সময় লেগেছে লোকটির, এ সময়টুকু এগিয়ে থাকতে পারবে ও। ইতোমধ্যে আততায়ীর চেয়ে অন্তত বিশ গজ এগিয়ে গেছে।
আরও কিছুটা এগোল ও, তারপর ঘোড়ার ঘাড়ে আলতো চাপড় দিল। স্টির্যাপ থেকে পা আলগা করে ঝাঁপ দিল ডান দিকে, শক্ত মাটিতে পড়ল শরীর। দুই গড়ান দিয়ে অ্যাসপেন ঝোঁপের পেছনে সরে এল। তখনও একই গতিতে ছুটে চলেছে সোরেলটা।
রাইফেল হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মরগান, কান পাতল। নিঃশব্দ প্রকৃতির সাড়াই শোনা যাচ্ছে কেবল। খুরের শব্দ না পাওয়ায় ধারণা করল ঘোড়া ত্যাগ করেছে লোকটা, নয়তো হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে। চারপাশে কোথায় কি আছে মনে করার চেষ্টা করল ও, ধারণা করল ঝর্নার দিকে যাচ্ছে আততায়ী। লোকটার জায়গায় ও নিজে হলেও তাই করত। কার্টারের লোক হলে এ এলাকা ভাল করে চিনবে এবং ঝর্নার ওপরের ওই উপত্যকার কথাও জানবে নিশ্চয়ই। সেই পথ ধরে নেমে আসবে লোকটি, এবং ওর কাছাকাছি আসার চেষ্টা করবে। মরগানের মত সে-ও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ফেলেছে-এখন থেকে লড়াই হবে সেয়ানে সেয়ানে। একজন অন্যজনকে খুঁজবে, বাগে পেলে হত্যা করবে।
মাটির সাথে শরীর মিশিয়ে দিয়ে ক্রল করে এগোল ও। এগোনোর সময় দু’হাতের ওপর পুরো শরীরের ভার পড়ছে। কান দুটো সজাগ ওর, যে কোন অস্বাভাবিক শব্দ শোনার আশায় সজাগ-ঘাসের ওপর দিয়ে হাত-পা হেঁচড়ে নেয়ার কিংবা ছোট্ট একটা নুড়িপাথর গড়ানোর শব্দ-যাতে আততায়ীর অবস্থান জানা যাবে। উল্টোটা যাতে না ঘটে, পুরোমাত্রায় সচেতন ও। সারাটা বছর ট্রেইলে কাটে ওর, অনেক বিপদ আর বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অভিজ্ঞতার কারণে ভাল করেই জানে কি করে নিঃশব্দে চলতে হয়।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে উদ্বেগ বাড়ছে ওর, ঘামছে দরদর করে। জানে অবস্থাটা যে কোন দিকে গড়াতে পারে, হয়তো হঠাৎ করে মুখোমুখি হয়ে পড়বে দু’জন, নয়তো ঠিক ওর পেছনে গিয়ে পৌঁছতে পারে লোকটা। এরপর কি হবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসছে। মনে মনে নিজের ভাগ্যকে গাল দিল, কি অলক্ষুণেই না ক্যাসল টাউনে এসেছিল, থামার সিদ্ধান্ত নিয়ে কি চরম বোকামি করেছে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন। এরকম অস্বস্তিকর আর বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আর পড়েছে কি-না মনে করতে পারল না-একগাদা লোক হন্যে হয়ে খুঁজেছে ওকে অথচ এদের কাউকেই চেনে না। কেবল অন্ধের মত লড়াই করা, আগাম কিছু বোঝার উপায় নেই, যৎ কালে তৎ বিবেচনা। এরকম কোণঠাসা হয়ে লড়াই করা মোটেও সহজ নয়। পশ্চিমে টিকে থাকার জন্যে যোগ্যতমদের একজন বলে এখনও টিকে আছে মরগান।
এমন একটা জায়গায় এসে পড়েছে ও যেটা ঝর্নার একেবারে কাছেই। পাশে ঘন জুনিপার ঝোঁপ আর ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা অনেকগুলো বোল্ডার। লজপোল পাইনের গাছগুলো কেবল নিরবিচ্ছিন্ন ছায়াই দেয়নি, আবছা অন্ধকারময় পরিবেশও সৃষ্টি করেছে। কিছু ক্যাকটাস আর জুনিপার পেরিয়ে এল মরগান, ধারণা করল সামনে কোথাও খোলা জায়গা আছে। একটা বোল্ডারের আড়ালে এসে নজর বুলাল চারপাশে, দশ হাত দূরে নিরেট পাথরের সারি, ওখানে পৌঁছতে পারলে সুবিধে পাবে।
ধৈর্য ধরে পড়ে থাকল ও, বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করছে না। ধূমপান করার তীব্র ইচ্ছেটাকে গলা টিপে হত্যা করল। বারবার মনোযোগ সরে যেতে চাইছে ওর, কিন্তু জোর করে ধরে রেখেছে। ক্ষণিকের একটা ভুল চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। সেটা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। ওর কাছে কিছু টাকা আছে, এবং তা কাজে লাগিয়ে বাকি জীবন উপভোগ করতে চায় মরগান। অনর্থক বেখেয়ালে প্রাণ দিয়ে সুযোগটা হাতছাড়া করার কোন মানে হয় না।
সহসা ত্রিশ গজ দূরে এক ঝলকের জন্যে লোকটাকে দেখতে পেল মরগান। বাম দিকে একটা অ্যাসপেনের পাশে সরে পড়ছে, মুহূর্তের জন্যে, তাই ভাল করে বুঝতে পারল না ঠিক দেখেছে কি-না। নিঃসাড় পড়ে থাকল, ও, অ্যাসপেন ঝোঁপের ওপর থেকে দৃষ্টি সরাল না। মিনিট দশেক এভাবেই কাটল, তারপর একসময় বেরিয়ে এল লোকটা, অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় ওর ফেলে আসা পথের দিকে এগোল। আপনমনে হাসল মরগান, ও এতটুকু চলে এসেছে এখনও টের পায়নি। ব্যাটা। চকিতে একটা পরিকল্পনা দোলা দিল মাথায়। লোকটাকে হাতে-নাতে ধরতে হলে এরচেয়ে ভাল কিছু আর হয় না।
কোন উদ্বেগ ছাড়াই পরের আধ-ঘণ্টা কেটে গেল। লোকটার ওপর চোখ রেখেছে ও, তার প্রতিটি নড়াচড়া মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছে। যখন বুঝল সময় হয়েছে, নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। বিশ গজ দূরের একটা বোন্ডারের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে আছে লোকটা। ইচ্ছে করলে তার পিঠে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দিতে পারে মরগান। কিন্তু তা না করে রাইফেলের লেভার টানল ও। কোন চালাকি নয়, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াও। আদেশ করল ও।
শক্ত হয়ে গেল লোকটার ঘাড়ের পেশী, এতদূর থেকেও বুঝতে পারল। মরগান। কয়েক সেকেন্ড ঠায় পড়ে রইল সে। মরগানের আশঙ্কা হলো হয়তো হঠাৎ করে গড়িয়ে পাশে সরে কিংবা উঠে দাড়ানোর পর ঘুরে গুলি করার চেষ্টা করবে লোকটা। কিন্তু কোনটাই করল না সে, ওর দিকে পিছন ফিরে উঠে দাঁড়াল। যেভাবে আছ ওভাবে থেকে আগে রাইফেলটা ছুঁড়ে ফেলল। তারপর পিস্তল। বেচাল দেখলে…’ কথা শেষ না করে অপেক্ষায় থাকল ও, লোকটা নির্দেশ পালন করতে হাঁপ ছাড়ল। এবার ঘুরে মাটিতে বসে পড়ো। উঁহু, লাফ দিয়ে লাভ নেই, তোমার কাছ থেকে অন্তত দশ হাত দূরে আছি আমি।
ঘুরে দাঁড়াল লোকটা।
ব্লু আইকে দেখে বিস্মিত হলো মরগান। দো-আঁশলার চোখে যুগপৎ হতাশা আর ঘৃণা। ওর প্রতি লোকটির বিদ্বেষের কারণ বুঝতে পারল না। পা ছড়িয়ে বোসো, হলদে শেয়াল। চাপা স্বরে নির্দেশ দিল ও।
জ্বলে উঠল ব্লু আইয়ের চোখ, ঘৃণায় বিবর্ণ হয়ে আছে মুখ। তীব্র গাল বকে পায়ের কাছে একদলা থুথু ফেলল, তারপর পা ছড়িয়ে বসল। দুর্ভাগ্য, অল্পের জন্যে গুলিটা ফস্কে গেছে। এবার তো হলো না, পরের জন্মে ঠিকই খুন করব তোমাকে! তীব্র বিদ্বেষে কথাগুলো টানা বলে গেল সে।
হাসি পেল মরগানের। গাছের গুড়ির সাথে রাইফেল ঠেস দিয়ে রেখে পকেট থেকে তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট তৈরির আয়োজন করল। হয়তো, হয়তো বা না। যাকগে, এটুকু নিশ্চই বুঝেছ আমাকে খুন করা তোমার সাধ্যের বাইরে? এ নিয়ে দু’বার চেষ্টা করেছ, নাকি আরও বেশি? হাল ছেড়ে দাও, সবাই সবকিছু পারে না, ওই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মাওনি তুমি। এবার ভালয় ভালয় কিছু প্রশ্নের জবাব দাও, বেচাল কিছু করার চিন্তা কোরো না। তোমার মাথায় যদি খুনোখুনির ভূতটা এখনও থাকে তো লাফিয়ে কিংবা ছুটে এসে আমাকে আক্রমণ করতে পারো, আমার হাতে রাইফেল নেই এখন।
তাকিয়ে থাকল লোকটা। জানে বেচাল দেখলে নিমেষে তাকে ছাঁদা করে ফেলতে পারবে মরগান।
আর কেউ আছে তোমার সাথে?
কথা বলল না লোকটা।
দেশলাইয়ের কাঠি বের করে নখে ঘষে সিগারেট ধরাল মরগান। একমুখ ধোয়া ছেড়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল দো-আঁশলার দিকে। শোনো, হলদে শেয়াল, আমার ধৈর্য খুব কম। তোমাকে জানে মারব না তা ঠিক, ভাবছি দুউরুর মাঝখানে কিছু বুলেট পাঠাব। পরের জন্মে কিন্তু ওই জিনিসটা ছাড়াই চলতে হবে তোমাকে। তাই চাও তুমি, না কথা বলবে?
জাহান্নামে যাও তুমি!
আরেকবার জিজ্ঞেস করব না কিন্তু। সিগারেট শেষ করেই গুলি করব। যদি মুখ খোলো তাহলে ছেড়ে দেব, তবে ছোট্ট একটা কাজও দেব। একটা খবর পৌঁছে দিতে হবে একজনকে।
চিন্তিত দেখাল লোকটাকে।
দ্রুত সিগারেট ফুঁকছে মরগান। সিগারেট শেষ হয়ে যাচ্ছে, ব্লু আই! শীতল সুরে তাড়া দিল ও।
আছে, ছোট্ট করে উত্তর দিল সে।
ঠোঁটে সিগারেট রেখে হোলস্টার থেকে একটা পিস্তল তুলে আনল ও। কক করে দ্রুত গুলি করল, দো-আঁশলার দুই উরুর ফাঁকে মাটিতে গিয়ে বিঁধল গুলিটা। থরথর করে কেঁপে উঠল বু আইয়ের শরীর। ভয় ফুটে উঠল চোখে
ভাওতা দিচ্ছ তুমি, সহাস্যে বলল মরগান, হালকা সুরে বললেও লোকটি টের পেল এখন আর তামাশার পর্যায়ে নেই ব্যাপারটা। আর কেউ যে নেই নিশ্চিত জানি আমি, থাকলে এতক্ষণ গল্প করতে পারতাম না আমরা। যাকগে, আরেকটা মিথ্যে বললে সত্যিই খারাবি আছে তোমার কপালে।
মাথা ঝাঁকাল সে। নেই, দ্রুত উত্তর দিল।
কার্টারকে চেনো?
চিনি।
সে আর টেনিসন একই লোক?
না, তা হবে কেন! বরং ওকে পেলে খুন করবে টেনিসন।
রাসলিঙের জন্যে?
কার্টার রাসলারদের জায়গা দেয় সেজন্যে।
তুমি কার্টারের ক্রু?
মাথা নাড়ল ব্লু আই। কার্টারের ডেরায় থাকি আমি। টাকার বিনিময়ে সবকিছুর ব্যবস্থা করে সে, আমাদের নিরাপত্তার দিকটাও দেখে।
আমার পিছু নিয়েছ কেন তোমরা?
কার্টার আমাদের জানিয়েছিল অনেক টাকা আছে তোমার কাছে, কোনভাবে সাবাড় করতে পারলেই কেল্লাফতে। বলেছে তোমাকে ধরা সহজ হবে না, কিন্তু তুমি এতটা টাফ নোক বোধহয় ও নিজেই জানত না।
টাকার খবর কিভাবে জানল ও?
ড্যানি জানিয়েছে। আমার ধারণা টেনিসনই পাঠিয়েছিল ড্যানিকে, চালাকি করে কার্টারের কানে দিয়েছে খবরটা।
ড্যানিকে বলবে কেন সে?
টেনেসি থেকে একসঙ্গে এখানে এসেছিল ওরা। একসময় শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত ড্যানি, নিজের বাথানে ওকে কাজ দিয়েছিল টেনিসন। পুরো পাঁচ বছর কাজ করেছে ও। মামুলি কারণে হঠাৎ ওকে ছাঁটাই করেছে বক্স-টি। আসলে ইচ্ছে করেই কার্টারের কাছে ড্যানিকে পাঠিয়েছিল টেনসন। সে চায়নি কার্টার কোন সন্দেহ করুক। কার্টার অবশ্য টের পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু ড্যানি বিপজ্জনক নয় বলে আমল দেয়নি। তাছাড়া সবকিছু শেষ হওয়ার পর ছেলেটাকে ঠিকই শায়েস্তা করত।
মন দিয়ে শোনো, ব্লু আই। একটা সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে। যদি ঝামেলা না করো বেঁচে যাবে, থেমে লোকটাকে যাচাই করল মরগান। মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, তবে বাদামী চোখে কিছুটা হলেও প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। টেনিসনের বাথানে যাবে প্রথমে, ওকে জানাবে আগামীকাল ক্যাসল টাউন ছাড়ব আমি। পাই প্যালেস বা ঢোকার মুখে যে আস্তাবল আছে ওখানে থাকব। সন্ধের আগে যে কোন সময়ে আমাকে পেতে পারে সে-বোলো ওকে আশা করব আমি এবং যেতেও বলেছি।
ওর প্রতি এত বিদ্বেষ কেন তোমার?
এ লোকটিই আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে তোমাদের। এতগুলো লোক আমার হাতে মারা পড়ল যাদের সাথে আমার বিন্দুমাত্র শত্রুতা ছিল না, কাউকে এর আগে দেখিওনি। অথচ তোমাদের লোভ আর ওর চক্রান্ত সারাক্ষণ আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে ক’টা দিন।
আমাকে খুন করতে পারে টেনিসন।
যা বলছি তা না করলে আমিই করব, খোদার কসম! অধৈর্য হয়ে বলল মরগান। তোমার ওপর নজর রাখব আমি। যেখানেই যাও ধরে এনে ওখানটায় দুটো গুলি করব। বুঝেছ? এবার ঠিক করো আমার কথামত টেনিসনের বাথানে যাবে কি-না।
যাব।
তুমি রাসলার, জানে সে?
মনে হয় না।
তাহলে আর সমস্যা কি?
তবুও, খবরটা দেয়ার পর যদি রেগে গিয়ে…’
তা করবে না ও। তাছাড়া তুমি যাচ্ছ নিরস্ত্র অবস্থায়। তোমার প্রতি বিদ্বেষ নেই ওর। আসলে ঠাণ্ডা মাথার আস্ত একটা শয়তান ও। নিজের বাথানে নিরস্ত্র কাউকে খুন করে সম্মান নষ্ট করবে না। এখানে এই জিনিসটাই ওর একমাত্র সম্বল।
ও যদি না আসে?
তাহলে চলে যাব আমি, জানব আলফ্রেড টেনিসন আসলে একটা কাপুরুষ। নিজের সমস্যা নিজে মেটানোর মুরোদ নেই তার। তবে আসবেই সে, যে কোন কিছুর বিনিময়ে বাজি ধরতে রাজি আমি। বিশ্বাস হচ্ছে না? ইচ্ছে হলে আমার স্যাডল ব্যাগের টাকাগুলো বাজি ধরতে পারো।
আমার কাছে পাঁচটা ডলারও নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে ঠিকই বলছ তুমি।
রাইফেল তুলে নিল মরগান। ঘোড়া খুঁজে রওনা দাও, বু আই। আবারও বলছি, চালাকি কোরো না। সোজা বক্স-টিতে যাবে, টেনিসনকে খবরটা দিয়েই চলে আসবে। এখানে রইল তোমার অস্ত্রসস্ত্র, ফিরে এসে নিয়ে যাবে, তারপর এ তল্লাট ছাড়বে। তোমার ওপর নজর রাখব আমি।
মাথা ঝাঁকাল লোকটা, পাশের ঝোঁপ থেকে গ্রুলাটাকে বের করে আনল। ঠিক বুঝতে পারছি না লোক হিসেবে কেমন তুমি, মরগান, স্যাডলে চেপে বলল সে, কণ্ঠে দ্বিধার সুর। ইচ্ছে করলে খবরটা অন্য কাউকে দিয়ে পাঠাতে পারতে, কিংবা নিজেই বক্স-টিতে যেতে পারতে। যাকগে, একটা সুযোগ পেয়েছি আমি, ভাগ্য তোমার হাতে মারা পড়িনি। আর দ্বিধা করছি না, ব্যবসাটা ছেড়েই দেব। তবে এ তল্লাট ছাড়ার আগে তোমাদের ডুয়েলটা দেখে যাব ভাবছি। কাল শহরে থাকব আমি।
তোমার যা ইচ্ছে কোরো, কেবল খবরটা ওকে দাও, আর আমার সামনে এসো না। এলেও অস্ত্র থেকে হাত দূরে সরিয়ে রেখো।
ব্লু আইয়ের অবয়ব দিগন্তে মিলিয়ে যেতে ফিরে চলল মরগান। ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম চাইছে। ক্যাসল টাউনে ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নেবে সে, নিশ্চিত জানে ওর মুখোমুখি হতে আসবেই আলফ্রেড টেনিসন। কাল সকাল বা দুপুরে ক্যাসল টাউনের রাস্তায় দুর্ধর্ষ আয়রন হকের মোকাবিলা করতে যাচ্ছে ও, কিন্তু এ নিয়ে কোন উদ্বেগ নেই মরগানের। লোকটার প্রতি কেবল ঘৃণাই অনুভব করছে ও।
ছয় বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল আয়রন হক। আগামীকাল ক্যাসল টাউনে আবার জন্ম হবে তার, মরার জন্যে।
৯. সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে এ পর্যন্ত নিরুদ্বেগে কেটে গেছে জেমস মরগানের। ভবিষ্যতের কথা ভেবে রোদ ঝলমলে সকালটা মাটি করতে চায়নি। পাই প্যালেসে নাস্তা সেরে ঘুরে বেড়িয়েছে সারা শহরে। সেলুনে বসে পোকার খেলেছে, কয়েক পেগ হুইস্কি পান করেছে। দুপুরের জন্যে অপেক্ষা করছে ও। রোদ একটু জাকিয়ে বসতে ফিরে এল আস্তাবলে, সোরেলটাকে তৈরি রাখল। সময় কাটছে না ওর, অবশ্য অধৈর্যও লাগছে না। আলফ্রেড টেনিসন উপস্থিত হওয়ার পর আর অল্প কয়েকটি মুহূর্ত থাকতে হবে এখানে, জানে ও, তারপর হয় ওর নয়তো টেনিসনের ছুটি। দুজনের একজনকে মরতে হবে আজ। হয়তো দু’জনকেই, এমন ডুয়েল অনেক ঘটেছে-দু’জনের গুলিই পরস্পরের মরণ ডেকে। এনেছে। ভয় পাচ্ছে না মরগান। ফয়সালা শেষ করার তাড়া অনুভব করছে, তারপরই শহর ছাড়বে।
আলফ্রেড টেনিসন একটা আস্ত হারামি। লোকটাকে শেষ করতেই হবে। বারবার ওকে আঘাত করেছে সে, আত্মরক্ষা করে কূল পায়নি মরগান। এবার সুযোগ এসেছে-প্রতিঘাতের।
আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট রোল করল মরগান। ধরিয়ে বুক ভরে ধোয়া টেনে নিল। রাস্তাটা জনশূন্য, রোদের আঁচে তপ্ত হয়ে উঠেছে মাটি। পায়ের ভর বদল করে আরাম করে দাঁড়াল ও, হঠাৎ দেখতে পেল আলফ্রেড টেনিসনকে। ঠিক উল্টোদিকের সেলুন থেকে বেরিয়ে এসেছে। বরাবরের মত পরিপাটি পোশাক। পরনে, কোমরে হোলস্টারসহ পিস্তলটাই শুধু নতুন। চকচকে বাট ওর মনে বিপদসঙ্কেত বাজাল যদিও তার কিংবদন্তীর নামটাই যথেষ্ট। মরগান খেয়াল করল টেনিসনের হাতে খবরের কাগজের একটা তাড়া দেখা যাচেছ।
ওর উদ্দেশে মৃদু নড করল আয়রন হক ওরফে আলফ্রেড টেনিসন। হেসে আরও দু’পা এগিয়ে এল। দেরি করলাম নাকি, মরগান?
ভ্রূকুটি করল মরগান। ঠিক সময়েই এসেছ, এবং দেখতে পাচ্ছি, তৈরি হয়েই।
তৈরি তো সবসময়েই। তুমি যখন এখানে প্রথম এসেছ, তখন থেকেই।
সন্দেহ আছে আমার। কিছু বেপরোয়া লোকের সাহায্য নিয়েছ তুমি। আমাকে পেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল ওঁরা, পারেনি। তোমার নিয়মেই খেলতে হলো আমাকে। নিজে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সাহস দেখাতে যে চায় না, তাকে টেনে আনতেই হয়। তাছাড়া হারানো লোকটাকে খুঁজে বের করারও একটা তাগিদ ছিল। এখানকার লোকেরা জানবে আলফ্রেড টেনিসন আসলে কে, কেন সে এই বৈরী দেশে পিস্তল ছাড়া ঘুরে বেড়ায়। নিজের পরিচয় লুকিয়ে এখানে আর থাকতে পারছ না তুমি। এখন থেকে তোমার আসল পরিচয় জানবে সবাই।
মাথা ঝাঁকাল টেনিসন। সারা মুখে প্রচ্ছন্ন কৌতুক খেলা করছে, খানিকটা ব্যঙ্গাত্মক ভাবও আছে। যাই বলো না কেন, খেলাটা কিন্তু দারুণ জমেছিল। কার্টারের দলটাকে কানা করে দিলে তুমি, অবশ্যই আমার দেয়া চালে। আর তোমাকেও পেয়ে গেলাম আমি। এখানে কটা দিন আটকে রাখতে চেয়েছি। কেন জানো? হাতের কাগজের দিকে ইঙ্গিত করল সে। এগুলোয় কি আছে, ধারণা করতে পারছ?
অসহায় বোধ করল মরগান, সেকেন্ড কয়েক কিছুই বলতে পারল না। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল শেষ কশেরুকা পর্যন্ত। অস্বস্তি নিয়ে তাকাল প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে। পারছি, নিজের কণ্ঠ অচেনা মনে হলো ওর! আট মাস আগের পত্রিকা ওটা।
একটু ভুল হলো, দুটো পত্রিকা। আরেকটা পাঁচ দিন আগের। নভেম্বরে টুকসনের এক ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছিল, পাঁচ লাখ ডলার লুট হলো। ডাকাতদের পেছনে লাগল ওয়েলস ফারগো, কিন্তু কিছুই করতে পারল না। তবে ধারণা করল ডাকাতদের সংখ্যা চারজন। তারপর, সাত মাস…এর মধ্যে পুরো ব্যাপারটা ভুলতে বসেছে সবাই। তবে আশা ছাড়েনি ওয়েলস ফারগো। দশ দিন আগে মন্টানায় ধরা পড়েছে লুইফ বেক্সটার। তক্কে তক্কে ছিল ওরা, নোটগুলোর খবর পেতে গোপনে সেখানে চলে যায় এবং বেক্সটারকে খুঁজে পায়। চার দিন আগে ফাঁসি হয়ে গেছে বেক্সটারের, কিন্তু মরার আগে সঙ্গীদের নাম বলে গেছে সে। উইলিয়াস ডরেস ওরফে জেমস মরগান তাদেরই একজন।
মৃদু হাসল মরগান যদিও চরম হতাশা কাটাতে পারছে না। খেলাটা তুমি শুরু করলেও আমিই শেষ করব। তোমার সাধের ইচ্ছে আপাতত পূরণ হচ্ছে। লজপোল পাইনের ওই জায়গাটা পাচ্ছ না তুমি, মেলিসা বডম্যানকেও পাবে না।
হাসল টেনিসন, ঠিক পিশাচের মত। মেলিসা আমার কি হয়, জানো?
থমকে গেল মরগান। মেলিসা বডম্যানের সাথে কি সম্পর্ক থাকতে পারে শয়তানটার?
স্ত্রী। ভালবাসার পর বিয়ে করা স্ত্রী। এখনও আমাকে ভালবাসে ও, আমিও। আর শ্যন? …ও আমার ছেলে। পৃথিবীতে দু’জন মানুষের চোখ দেখবে ছাইরঙা-একজন আমি, আরেকজন শ্যন। আমার আর লিসার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিল একটা মেয়ে, ভুল বোঝাবুঝি এবং ছাড়াছাড়ির কারণ ওটাই। তবে লিসা আর আমি পুরো ব্যাপারটা খুব শিগগিরই মিটিয়ে ফেলব।
জেমস মরগান হতবাক। জীবনে এরচেয়ে বেশি কখনোই বিস্মিত হয়নি। মনে পড়ল মেলিসাকে টেনিসনের কাছে যেতে চাপ দিত মি. বডম্যান, টেনিসনের সামনে আসলে নিজেও দুর্বল বোধ করত মেলিসা, একটা রাতও কাটিয়েছে টেনিসনের সাথে। আর টেনিসন সম্পর্কে মিথ্যে বলেছে ওর কাছে। বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না মরগান, মাথা ধরে এল। এই একটি লোক, ওর জীবনে দেখা লোকগুলোর মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কোনভাবেই একে বুঝতে পারছে না মরগান। লোকটা একাধারে কপট, অহঙ্কারী এবং ধুরন্ধর। পেছনের অতীত সে জয় করেছে, এমনকি মেলিসা বডম্যানকেও যার সাথে তিক্ত একটা সম্পর্ক ছিল তার।
সহসা বিপুল সতর্কতা গ্রাস করল মরগানকে। টেনিসনের ছাইরঙা চোখের দিকে তাকাল, চ্যালেঞ্জ সেখানে। ধীরে ধীরে তীব্র ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে গেল ওর শরীর। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে সে হয়ে গেল উইলিয়াম ডরেস, দুধর্ষ এক আউট-ল যার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি বোকা বানিয়েছিল ওয়েলস ফারগোর তুখোড় গোয়েন্দাদের। কিন্তু ভজকট করেছে বেক্সটার শালা, তিক্ত মনে ভাবল মরগান, নইলে নির্বিঘ্নে মিসৌরি পৌঁছে যেতে পারতাম। পুরো ব্যাপারটা চাপাই থাকত, ডাকাতির আগে যেমন ভেবেছে। তবু, ক্যাসল টাউনে আটকে না থাকলে বোধহয় কিছুই আসত-যেত না। জনতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কিংবদন্তীর এই লোকটি যত নষ্টের গোড়া। এর প্রতি রোষের অন্ত নেই মরগানের। যেভাবেই হোক শেষ করতে হবে একে। টেনিসনের ছাইরঙা চোখে কাঁপন দেখতে পেল ও-তারমানে ড্র করতে যাচ্ছে শয়তানটা! বিদ্যুৎ খেলে গেল মরগানের হাতে।
ক্যাসল টাউনের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুতগতির আর ভয়ঙ্করতম ডুয়েল হলো ওটা।
.
সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, তখন ফ্ল্যাগ-বি বাথানে পৌঁছল সে। হিচিং রেইলে ঘোড়ার লাগাম বেঁধে গায়ের ধুলো ঝাড়ল প্রথমে, পোর্চ হয়ে বারান্দায় উঠে এল এরপর। ভেজানো দরজা ঠেলে র্যাঞ্চ–হাউসে ঢুকে পড়ল সে। ভেতরে কোন সাড়া নেই। মেলিসা বডম্যানের কামরার দিকে এগোল আগন্তুক।
সামনে এসে খানিক ইতস্তত করল সে, তারপর ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। কামরাটা পরিপাটি করে গোছানো। নরম কার্পেটের ওপর দিয়ে এগোল ও। ওপাশের জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেলিসা বডম্যান, জানালা গলে আসা বিকেলের রোদ মধুরঙা চুলগুলোকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে।
ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল সে। ডাকল মেয়েটিকে।
চমকে ঘুরে তাকাল মেলিসা। তুমি?
হ্যাঁ, আমি। পুরো ব্যাপারটা শেষ, হাতের কাগজ দুটো এগিয়ে দিল ও। পড়ো।
কি আছে এসবে?
আট মাস আগে জেমস মরগান
ওর ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই আমার, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল মেলিসা। লোক লাগিয়ে তুমিই হয়রানি করেছ ওকে, শেষে নিজেই বাকি কাজটুকু শেষ করেছ, তাই না? কিন্তু এত ঝামেলার কি দরকার ছিল? প্রথম দিনই শেষ করে দিতে পারতে ওকে, মাঝখানে এতগুলো লোক অযথা খুন হলো।
আমার দুটো উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে তাতে। উপরি হিসেবে কার্টারের দলটা পঙ্গু হয়ে গেল। তাছাড়া প্রথমে নিশ্চিত ছিলাম না যে ও-ই উইলিয়াম ডরেস।
মিথ্যে বোলো না। তোমার আরও উদ্দেশ্য ছিল-ম্যাকলয়ারীদের শিক্ষা দেয়া, আমার কাছ থেকে জমিটা কেড়ে নিতে চেয়েছ।
খোদার কসম, লিসা, তা চাইনি আমি!
নিজের কানকেও অবিশ্বাস করব? লজপোল পাইনের ওই জমিটা চাওনি তুমি?
চেয়েছি, কিন্তু কেড়ে নিতে চাইনি। ন্যায্য দামে কিনতে চেয়েছি।
আরেকটু হলে আমাকে বাধ্য করতে তুমি! এখনও কি তাই চাও?
জায়গাটা আমার দরকার, তোমার চেয়ে বেশিই দরকার। আমার জমিতে ঘাস নেই, অথচ এটা ব্যবহার করছ না তুমি। আবার বলেছ কাঁটাতারের বেড়া দেবে নিজের সীমানায়। তাহলে আমার এতবড় স্টক কোথায় চরবে?
সেটা আমি জানি? ঝাঝিয়ে উঠল মেলিসা।
কিন্তু ওই জমির প্রয়োজন হবে না, যদি ফ্রি রেঞ্জের সুবিধেটুকু আমি ভবিষ্যতেও পাই। তুমি এমন জেদী…অথচ দুটো বাথানকে একটাতেই রূপান্তরিত করতে পারি আমরা। আমাদের সম্পর্কটা তো ওরকমই।
নিরাসক্ত দৃষ্টিতে টেনিসনকে দেখল মেলিসা। এবার নিশ্চই সবাইকে বলা শুরু করবে?
টেনেসি থেকে যখন চলে এলে, সম্পর্ক গোপন রাখার কোন প্রতিশ্রুতি বিনিময় হয়নি আমাদের মধ্যে। এখানে এসে দেখলাম শ্যনের বাবার পরিচয় গোপন করেছ। খারাপ লাগলেও মুখ খুলিনি, কারণ আমি সবসময়ই সুখী করতে চেয়েছি তোমাকে। কেবল একটি ভুলই করেছি, স্বীকার করছি ওটা জঘন্য অপরাধ ছিল, ডোনা রাইস…।
ওই বেল্লিক মেয়েমানুষটার নাম আমার সামনে উচ্চারণ কোরো না! ঝামটে উঠে ফের টেনিসনকে থামিয়ে দিল মেলিসা।
অধৈর্য দেখাল বক্স-টি মালিককে। নড়েচড়ে শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে চাপাল। ঠিক আছে, তুমি যা চাও, তাই হবে। বাথানের সীমানায় তারের বেড়া দাও, ওই জায়গারও দরকার নেই আমার। কেবল তোমাকে পেলেই হলো, আর কিছু চাই না!
তুমি আমাকে এত অপমান করার পরও তোমার সাথে থাকতে বলছ?
তুমি আমার স্ত্রী।
প্রবলভাবে মাথা নাড়ল মেলিসা। আমাকে জোর করেছ তুমি! অস্বীকার করার পরও অধিকার চাপিয়ে দিচ্ছ। চালাকি করে তোমার বাথানে নিয়ে গেছ আমাকে, তারপর.. হায় খোদা, এর আগে আমাকে, আমার ভালবাসাকে অপমান করেছ তুমি আর সেদিন…আমি নিজেই তা আরও বাড়িয়ে দিলাম! পাগলের মত তোমাকে চেয়েছি আমি। নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে আমার!
টেনিসন অবাক হয়ে দেখল কাদছে মেলিসা। মেয়েটির আচমকা উপলব্ধি চমকে দিল ওকে। শ্যনের কি হবে ভেবে দেখেছ?
জানাব ওর বাবা…’
এখানেই আছে, নাম আলফ্রেড টেনিসন, মেলিসার মুখের কথা কেড় নিয়ে শেষ করল টেনিসন।
না, এ পরিচয় ওকে দেব না আমি! দৃঢ় স্বরে ঘোষণা করল বডম্যান-কন্যা।
কিন্তু সত্যটি জানার অধিকার আছে ওর।
আমার ছেলের ব্যাপারে আমিই সিদ্ধান্ত নেব, তুমি নও।
স্মিত হাসল টেনিসন; আশান্বিত, ওষুধে ধরছে। মেলিসাকে তার চেয়ে বেশি আর কে চিনবে! জানে অন্তরঙ্গ কথাবার্তা আর একটু সাহচর্য মেলিসাকে দুর্বল। করতে যথেষ্ট; পুরানো ক্ষতের ঘা আর নেই এখন, সেখানে দরকার মমতার প্রলেপ। ও কি তোমার একার ছেলে? এগিয়ে গিয়ে মেলিসার খুব কাছাকাছি দাড়াল, ভেজা নীল চোখের দিকে তাকাল। আমার সামনে একটিবার আনো। ওকে, আমি ওর চোখের দিকে তাকাই, তারপর দেখব তোমার একার অধিকার কতটুকু গ্রহণ করে ও।
ফ্রেড, প্লীজ! অসহায় দেখাল মেলিসাকে। চলে যাও তুমি। শ্যন জেগে গেলে আমার সর্বনাশ হবে। চলে যাও, ওই জায়গাটা ছেড়ে দেব আমি, এক শর্তে-কক্ষনো ওর অধিকার চাইবে না!
মেলিসার কোমর পেঁচিয়ে ধরল টেনিসন। লিসা, আমি কি ক্ষমা পেতে পারি?
তাকে দেখল মেলিসা, বোঝার চেষ্টা করছে। এখন তুমি একটা জোচ্চোরে পরিণত হয়েছ, অথচ আগে…
কিন্তু লিসা, আমি যাই হই না কেন, তোমাকে ছাড়া যে চলবে না আমার। শ্যনকে আজই নিয়ে যাব আমি, সাথে ওর মা-ও যাবে।
যাব না আমি!
আমাদের মধ্যে আর কোন ডোনা রাইস আসবে না।
এরকম প্রতিশ্রুতি কি একবার দাওনি?
আরও দশ মিনিট ধরে তর্ক করল ওরা। তারপর ক্ষুব্ধ মেজাজে পাশের কামরার দিকে এগোল টেনিসন, জানে ওখানেই শুয়ে আছে ছোট্ট ছেলেটা। দৌড়ে ওর সামনে এসে পথ রোধ করল মেলিসা।
ওর কাছে যেতে পারবে না তুমি!
একশোবার যাব! চেঁচাল টেনিসন। সরো!
না!
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা।
এরকম করছ কেন, লিসা? একটা ভুল করেছি বলে নিকৃষ্ট হয়ে গেছি? তোমাকে কথা দিয়েছি, কেবল একটা সুযোগ দাও! বুঝতে পারছি তোমার বিশ্বাস হারিয়ে গেছে। শুধু নিজের কথাই ভাবছ তুমি, শ্যন কি কষ্ট পাচ্ছে না? আমি কি পাই না? আমি তো জানি ওই একটা ভুলের কারণে কি হারিয়েছি! অস্বীকার করতে পারবে এখনও আমাকে ভালবাস না? নইলে তোমাকে কাছে পেতাম সেদিন? আমাকে সহ্য করতে না পারলে ডিভোর্স দিচ্ছ না কেন? সবাইকে বলে দিলেই হয় আমি তোমার বখে যাওয়া স্বামী, তারপর কারও সাথে ঝুলে পড়লেই হয়? তোমাকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে এ তল্লাটের যে কোন পুরুষ।
তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারি না আমি!
আবার আমাকে ক্ষমাও করতে পারছ না! টেনিসনের সারা মুখে হাসির দ্যুতি দেখা গেল। মেলিসা বাধা দেয়ার আগেই ওকে নিজের দিকে টেনে নিল। এই মেয়ে, দ্বিধা কোরো না আর, শেষবারের মত বিশ্বাস করো আমাকে। তোমার অবচেতন মন তাই চাইছে। কিন্তু মুখে কেবল না না করছ।
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল মেলিসা, কিন্তু পেরে উঠল না সুঠামদেহী লোকটির সাথে। একসময় আবিষ্কার করল টেনিসনের বাঁধনে আটকা পড়েছে পুরোপুরি। দেহের সাথে ওকে চেপে ধরেছে সে, এবং মুখটা নেমে আসছে। ছাইরঙা চোখ দুটোর দিকে তাকাল মেলিসা। হারানো বিশ্বাস খুঁজে পেল সেখানে, মুহূর্তে সব অতীত ভুলে গেল ও। আনন্দে জড়িয়ে ধরল টেনিসনের গলা। আমি এ জিনিসটাকেই ভয় পাই, ফ্রেড, রুদ্ধ স্বরে বলল মেলিসা। তোমার স্পর্শ আমাকে সব ভুলিয়ে দেয়। আর এ দুর্বলতার জন্যেই আমাকে ঠকিয়েছ তুমি। যদি আরেকবার ঠকাও, খোদার কসম, নিজেকেই খুন করব আমি! নিশ্চিন্ত থাকো, মিসেস টেনিসন, হেসে বলল টেনিসন, উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সারা মুখ। আমারও শিক্ষা হয়েছে, আর ভুল করছি না। মেলিসা বডম্যানের মত মেয়ের স্বামীরা জীবনে ওরকম ভুল একবারই করে!
darashiko dot com
আল্লাগো! কি বই পড়লাম এইটা!! কোন চ্যাপ্টার মিসিং হয় নাই তো? অদ্ভুত। লেখকের সাথে ডুয়েল লড়তে চাই আমি!